বাড়ি প্রচ্ছদ



যতনে রাখিও পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#যতনে_রাখিও
#পর্ব_২ ( শেষ)
#ছনিয়া_তাবাচ্ছুম ( অনি)

স্নিগ্ধা সাজিমের জন্য কফি বানিয়ে দোতালায় গেল। সাজিম ওয়াশরুমে শাওয়ার নিচ্ছে। স্নিগ্ধা সাজিমের জন্য কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। একটু পর সাজিম ওয়াশরুম থেকে বের হলো। স্নিগ্ধা হাসি মুখে সাজিমের দিকে কফির কাপ বাড়িয়ে দিল। কিন্তু সাজিম যে এমন কিছু করবে স্নিগ্ধা কল্পনাও করেনি। সাজিম স্নিগ্ধার হাত থেকে কফির মগ নিয়ে সম্পূর্ন কফি টুকু ফ্লোরে ফেলে দেয়। স্নিগ্ধা ছলছল চোখে সাজিমের দিকে তাকাল। সাজিম রুক্ষ কন্ঠে বলল,

“- তোমাকে কে বলেছে আমার জন্য কফি আনতে? কেন আনতে গেলে এবার ফ্লোর থেকে কফি উঠাও। জায়গা টা একদম আগের মতো চকচক করে ফেলবে বুঝেছো।

স্নিগ্ধা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। সাজিম রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। স্নিগ্ধা ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসল। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে তো ভালো মনে করেই সাজিমের জন্য কফি এনেছিল। সে কি খুব বড়ো কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। তার তো তেমন টা মনে হয় না। তাহলে? কেন বারবার এমন করে সাজিম। তার কি সত্যি সাজিমের জীবন থেকে চলে যাওয়া উচিত। এভাবে বেহায়ার মতো তো কারোর জীবনে থাকা যায় না। এই কয়েক মাস সে সাজিম কে বুঝিয়েছে। কিন্তু সে ব্যর্থ। সাজিমের মুখ থেকে সে সবসময় এক কথায় শুনে এসেছে। তাকে সে ডিভোর্স দেবে। এখানে পরে থেকে নিজেকে ছোটো করার মানে হয় না। ভালোবাসলেই যে তাকে পেতে হবে এমন টা নয়।

স্নিগ্ধা ফ্লোর পরিষ্কার করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। তার হাতে থাকা ফোন টা অন করল। ফোন করল তার প্রিয় বান্ধবীর কাছে। দুবার রিং হতেই ফোন রিসিভ করল তিশা। সে বলল,

“- কেমন আছিস স্নিগ্ধা? জিজু কেমন আছে?

স্নিগ্ধা মলিন কন্ঠে বলল,

“- আছি কোনো রকম রে। আমি আর পারছি না।

“- আবার কি হলো..?

“- যা হয় তাই হয়েছে।

“- জিজু র কি সত্যি কেউ আছে স্নিগ্ধা।

“- হ্যাঁ রে। উনি আমাকে প্রথম থেকেই বলে এসেছেন। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু আমিও তো তাকে খুব ভালোবাসি তিশা। তাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকব বল। আর কতদিন এভাবে বেহায়ার মতো পরে থাকব বল। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সাজিম যা চাই তাই হবে। ভালোবাসলেই যে তাকে পেতে হবে এমন টা নয়। দুর থেকেও ভালোবাসা যায়। আমিও না হয় তাই করবো৷ দুর থেকে আমার প্রিয় মানুষ টা কে ভালোবাসব।

“- কি বলব সত্যি ভেবে পাচ্ছি না রে।

“- আচ্ছা রাখছি।

____________

খোলা মেলে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা সাজিম আর একটা মেয়ে। মেয়ে টা সাজিমের গার্লফ্রেন্ড। সাজিমের ভালোবাসার মানুষ। স্নিগ্ধা ই সাজিম কে জোর করে মেয়ে টার সাথে দেখা করতে এসেছে। সাজিম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা মেয়ে টার দিকে কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখল। স্নিগ্ধা র এভাবে তাকানো তে মেয়ে টার অস্বস্তি হয়। মেয়ে টা সংকোচ বোধ করে বলে,

“- আপু….

স্নিগ্ধার হুশ আসল। স্নিগ্ধা নিজেকে সামলে হালকা হেঁসে বলল,

“- আপনিই সেই মেয়ে যে কি না আমার স্বামীর সবটা জুড়ে আছেন। তাই না।

মেয়ে টা মুচকি হাসল। স্নিগ্ধা ফের বলল,

“- আপনি মাশাল্লাহ খুব সুন্দর আপু। যে কোনো ছেলে দেখলেই পাগল হয়ে যাবে। যেমন সাজিম আপনি বলতে পাগল। সাজিমের সবটা জুড়ে আপনার বসবাস। কেউ চাইলেও তার মন থেকে আপনাকে সরাতে পারবে না।

“- জ্বি….

“- বেশি কিছু বলব না আপু। শুধু একটা কথায় বলবো।

“- বলেন আপু!

“- আপনি সাজিম কে খুব ভালো রাখবেন! কখনো অবহেলা করবেন না। তাকে সবসময় আগলে রাখবেন। সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবেন। সাজিম যেমন ওর সবটা দিয়ে আপনাকে ভালোবাসে ঠিক তেমনি আপনি আপনার সবটা দিয়ে ওকে ভালোবাসবেন। আমার প্রিয় মানুষ টা কে #যতনে_রাখিও আপু। সে আমার ভালোবাসার এক টুকরো সুখ। সে ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি। তার সুখে আমার সুখ। তার অসুখে আমার অসুখ! তাকে আমি আমার সবটা দিয়ে ভালোবাসলেও সে আমার হবে না। কেন জানেন..?

“- কেন?

“- কারণ সে আপনাকে ভালোবাসে । আপনি ছাড়া তার জীবনে কোনো নারীর অস্তিত্ব নেই। এমনি তার বিবাহিত বউ ও না। আচ্ছা ভালো থাকবেন আপু।

স্নিগ্ধা এবার সাজিমের দিকে আগালো। সাজিম স্নিগ্ধার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে ছিল। স্নিগ্ধার প্রতিটি কথা সাজিমের বুকে গিয়ে লাগছে। স্নিগ্ধা হাসি মুখে বলল,

“- ডিভোর্স পেপার রেডি করে পাঠিয়ে দিবেন। আমি সাইন করে দিবো। কোনো টেনশন করবেন না। আমি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাব না। আপনার জন্য কিছু করতে পারি আর না পারি। ডিভোর্স দিয়ে আপনার ইচ্ছে তো পূরণ করতে পারব। ভালো থাকবেন। কাল থেকে আর আমাকে দেখতে হবে না। নিশ্চিতে থাকতে পারবেন।

সাজিম এখনো অবাক হয়ে চেয়ে আছে। অবাকতার রেশ নিয়ে বলল,

“- কোথায় যাবে তুমি? থাকবে কোথায়..?

“- আমার থাকা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি যেখানেই যাই না কেন? সেখানে ভালো থাকব। আর হ্যাঁ বাবা কে একটু বলে দিবেন। তিনি যেন কষ্ট না পান।

স্নিগ্ধা চলে গেল। সাজিম এখনো স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছে। তিশা এগিয়ে এসে বলল,

“- চলো বেবি।আজ আমরা পার্টি দেব। আর কিছু দিন পর ই আমরা বিয়ে করতে চলেছি। বলে সাজিম কে জড়িয়ে ধরল।

সাজিমের কোনো হেলদোল নেই। সাজিম মনে মনে ভাবছে। সে ভুল করল না তো। আবার ভাবে সে যা করেছে একদম ঠিক করেছে। সে যাকে ভালোবাসে তাকেই সে বিয়ে করবে।

স্নিগ্ধা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। আজ সব কিছু ফেলে চলে এসেছে। সে কারোর জীবনের বোঝা হতে চাই না। সে ভালোবাসে তাতে কি? দুর থেকেই ভালোবাসবে। জীবনের কষ্ট গুলো না হয় একাই সামলে নিবে। আজ থেকে নিজের জীবন নিয়ে ভাববে। হেসে খেলে চলবে। নিজেকে গড়ে তুলবে। এটাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ। ভালোবাসার থেকে নিজেকে গড়া বড্ড দরকার। আজ থেকে নতুন স্নিগ্ধা কে দেখবে। একটু একটু করে যতনে রাখবে সে। স্নিগ্ধা আজ বুঝল সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিছু ভালোবাসা অপূর্ণ রয়ে যায়। তার ভালোবাসার নাম টা না হয় অপূর্ণর খাতায় লেখা থাকুক।

সমাপ্ত

যতনে রাখিও পর্ব-০১

0

#যতনে_রাখিও
#সূচনা_পর্ব
#ছনিয়া_তাবাচ্ছুম ( অনি )

“আমাকে ডিভোর্স দিবেন না সাজিম! এখানে আমার তো কোনো দোষ নেই। আমি আপনার সব কথা শুনব! আপনার সব কাজ করে দেবো! আপনি যা বলবেন তাই করবো! কখনো আপনার কথার অবাধ্য হবো না! তবুও আমাকে ডিভোর্স দিবেন না। আপনার ঘরের এক কোণায় একটু থাকার জায়গা দিলেই হবে।”

সাজিমের হাত ধরে বললো স্নিগ্ধা। সাজিম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধা’র দিকে। স্নিগ্ধা কাঁদছে! স্নিগ্ধা’র চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে! স্নিগ্ধা র কান্না দেখেও মন গললো না সাজিমের। স্নিগ্ধার হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে বলল,

“- শোনো, আমি এখানে তোমার ন্যাকা কান্না দেখতে আসিনি। যা বলেছি কান খুলে শুনে নাও। আমি তোমাকে নিজের বউ হিসেবে মানি না। আর মানবো ও না। আমাদের বিয়ে টা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট এর মাধ্যমে হয়েছে। আমি তোমাকে সেই প্রথমেই বলেছি আমার থেকে কোনো আশা তুমি রেখো না। এখন যদি তুমি জেনে শুনে ভুল করে থাকো। তাহলে তো আমার কিছু করার নেই?

স্নিগ্ধা কান্না মাখা গলায় বলল,

“- আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি সাজিম!

সাজিম খানিকটা রাগ নিয়ে বলল,

“- আমি তোমাকে বলেছি আমাকে ভালোবাসো? কেন ভালোবাসলে? এখন যেহেতু ভালো বেসেছো সেহেতু কষ্ট টাও তোমাকে পেতে হবে স্নিগ্ধা!

সাজিমের কথায় স্নিগ্ধা কেঁপে উঠল! তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

“- আপনি চাইলে সব সম্ভব হবে । আমাকে কি ভালোবাসা যায় না সাজিম?

সাজিম স্নিগ্ধার দিকে তাকাল। স্নিগ্ধা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে তার অনেক আশা। কিন্তু তা কখনোই হয়তো পূরণ হবার নয়। সাজিম কাট গলায় বলল,

“- না তোমাকে ভালোবাসা যায় না! আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারবেো না।

“- কিন্তু কেন সাজিম? আমি কি দেখতে খুব খারাপ?

“- কারণ আমি অন্য একজন কে ভালোবাসি। তাকেই আমি বিয়ে করতে চাই। নিজের জীবনসঙ্গী করতে চাই। ক্লিয়ার।

“- আমাদের বিয়ে টা যেভাবেই হোক না কেন? বিয়ে টা তো হয়েছে। এখন আপনি সেটা অস্বীকার করতে পারেন না।

সাজিম রক্তচক্ষু চোখে তাকালে স্নিগ্ধার দিকে। স্নিগ্ধা ভয়ে চোখ নামিয়ে নিল। সাজিম গম্ভীর কণ্ঠে সুধালো,

“- আমি যা বলছি তাই হবে। আমার কথার কোনো নড়চড় হবে না। তোমাকে আমি কখনোই আমার বউ হিসেবে মেনে নেবো না। তুমি যদি ভেবে থাকে আমাকে তুমি পাবে তাহলে ভুল ভাবছো। এই জাইহান খান সাজিম কখনো তোমাকে তার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে না।

সাজিম গটগট শব্দ করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। সাজিম চলে যেতেই স্নিগ্ধা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার জীবন টা এমন কেন হলো? কত হাসি খুশি ই তো ছিল। হুট করে কেন তার জীবন টা এলোমেলো হয়ে গেলো। কেন বেচে বেচে তার সাথেই এমন টা হতে হলো? এমন একটা মানুষের সাথে তার বিয়ে হলো যে কি না তাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানে না। তার স্বামীর মনে অন্য কোনো নারী। যাকে কি না সে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাকে ছাড়া সে ভাবতে পারে না। তাহলে তার কি হবে? তার কপালে কি এই ছিল? খোদা কেন তাকে এমন একজনের সাথে জুড়ে দিল? যার হৃদয়ে অন্য নারীর বসবাস।।

সাজিমের রুমের এক কোণায় বসে ফুপিয়ে কাঁদছে স্নিগ্ধা! কান্না করার কারণে তার চোখ মুখ ফুলে উঠেছে! ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে!

★★★

রাত তখন গভীর৷ স্নিগ্ধা ফ্লোরে ঘুমিয়ে আছে। সাজিম বাসায় ফেরে রাত দুটোয়। রুমে ঢুকে স্নিগ্ধা কে ফ্লোরে শুয়ে থাকতে দেখে রেগে গেলো। কিন্তু কিছু বললো না। এই রাতে চিৎকার চেচামেচি করতে মোটেও তার ইচ্ছে করছে না। তাই চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার দুচোখে ঘুম। চাইলেও আর সেটা মেলে রাখতে পারছে না। তাই তো বিছানায় এলোপাতাড়ি শুয়ে পড়ল।

____________

ফজরের আজান কানে আসতেই ধড়ফড়িয়ে উঠল স্নিগ্ধা। চোখ ডলে তাকাল। রুম টা অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। স্নিগ্ধা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে সুইচ বোর্ডের কাছে গেল। অন্ধকারে হাতড়িয়ে লাল আলো জ্বালালো।। লাল আলোয় সাজিমে’র মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্নিগ্ধা সাজিমের দিকে এগিয়ে গেলো।। সাজিম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।। স্নিগ্ধা এক পা দু পা করে সাজিমের একদম কাছে চলে যায়। স্নিগ্ধা হাত বাড়িয়ে সাজিমের চুলে হাত বুলালো। সাজিম কিচ্ছু টের পেল না। পাবে কি করে সে তো ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। স্নিগ্ধা কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল স্বামীর দিকে। ঘুমন্ত সাজিম কে দেখতে খুব কিউট লাগছে। চেহারায় কিউট কিউট ভাব আছে । স্নিগ্ধা মুচকি হাসল। এই মানুষ টা তার বিয়ে করা বর। অথচ তাকে সে চাইলেও পাবে না। এই মানুষ টা যে তাকে চাই না। সে অন্য কাউকে চাই।

সাজিম একটু নড়ে উঠল। স্নিগ্ধা দ্রুত দুরে সরে দাঁড়ায়। যদি সাজিম তাকে তার এত কাছে দেখে তাহলে তাকে আস্ত রাখবে নানে। সাজিম নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেল। স্নিগ্ধা ঘড়ি তে দেখল পাঁচ টা পাঁচ বাজে। সময় নষ্ট না করে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে যায়। হাত মুখ ধুয়ে ওযু করে বের হয়। তারপর সাজিমের কাছে আসল। আস্তে করে বললো,

“- এই যে শুনছেন? উঠুন, উঠে নামাজ পড়ে নেন।

সাজিম কোনো সাড়া দেয় না। স্নিগ্ধা আবার ডাকল,

“- শুনছেন, নামাজের সময় হয়ে গেছে। উঠে নামাজ পড়ে আবার ঘুমাবেন দরকার হলে।

সাজিম বিরক্ত হয়ে বলল,

“- উফ ডিস্টার্ব করবে না তো। ঘুমোতে দাও।

“- আপনি নামাজ পড়ে আবার ঘুমাবেন। তবুও নামাজ কাজা দিয়েন না।

সাজিম লাফ দিয়ে উঠে রাগী কন্ঠে বলল,

“- তোমাকে না বলছি ডিস্টার্ব করবে না। তাহলে কেন ডিস্টার্ব করছো? কথা কানে যায় না তোমার? তোমার নামাজ তুমি পড়ো। আমি পড়ব না তাতে তোমার প্রবলেম কোথায়? ফারদার যদি ডাক দিছো তাহলে ভালো হবে না বলে দিলাম। বলে সাজিম আবার শুয়ে পড়ল।

সাজিমের কথায় স্নিগ্ধা র চোখ ছলছল করে ওঠে। লোক টা তাকে একটু সহ্য করতে পারে না। স্নিগ্ধা চোখের কার্নিশ থেকে চোখের জল মুছে নামাজ পড়তে বসে।

★★

সকাল আটটা। খান বাড়ির সবাই একে একে ঘুম থেকে উঠছে। স্নিগ্ধা সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠছে আর ঘুমোই নি। স্নিগ্ধা ফজরের নামাজ পড়ে আর ঘুমোই না। তার ঘুম আসে না। স্নিগ্ধা এখানে আসার পর থেকে দেখেছে। এই বাড়ির মানুষ গুলো অন্য রকম। কেউ ঠিক মতো নামাজ পড়ে না। শুধু সাজিমের দাদু আর বাবা ছাড়া। তারা দু’জন নিয়ম করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। আর রইল সাজিমের মা। তাকে দেখলে মনে হয়। অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। তার কথা বার্তার ধরনেই সেটা প্রকাশ পায়। তিনি স্নিগ্ধা কে একটুও দেখতে পারেন না।

ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছেন সাজিমের বাবা আফজাল খান আর দাদা মফিজ খান। স্নিগ্ধা দু’জনের জন্য চা করে আনে। আফজাল খান হাসি মুখে স্নিগ্ধার কাছ থেকে চায়ের কাপ নেয়। তিনি স্নিগ্ধা কে বড্ড স্নেহ করেন।

কাজের মহিলা চুলায় রান্না বসিয়েছে। সাজিমের মম রাশেদা খান এখনো ঘুম থেকে উঠেন নি। তাকে কেউ ডাক ও দেন নি। কারণ তাকে ডাকা নিষেধ আছে। তার যখন ইচ্ছে হবে তিনি তখনই উঠবেন। অন্য দিন সকাল করে উঠলেও আজ এখনো ওঠেন নি। কেন ওঠেন নি স্নিগ্ধা জানে না।

স্নিগ্ধা সাজিমের জন্য কফি বানিয়ে দোতালায় গেল। সাজিম ওয়াশরুমে শাওয়ার নিচ্ছে। স্নিগ্ধা সাজিমের জন্য কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। একটু পর সাজিম ওয়াশরুম থেকে বের হলো। স্নিগ্ধা হাসি মুখে সাজিমের দিকে কফির কাপ বাড়িয়ে দিল। কিন্তু সাজিম যে এমন কিছু করবে স্নিগ্ধা কল্পনাও করেনি।

চলবে~

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#অন্তিম_পর্ব

সাদিক মাকে আদ্দোপান্ত সকল ঘটনাই বলেছে। জানে, মা বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করেওনি। তার কাছে ভাতিজা ভাতিজির মূল্য অনেক। সাদিক বিশ্বাস করানোর চেষ্টাও করেনি। শেষে নাতির কথা শুনে বিষ্মিত হলো ফরিদা। তারপর যখন মোবাইলে মাহাদীর হাস্যজ্বল ছবি দেখালো তখন বিস্ফারিত চোখে শুধু ছবিটা দেখেই গেছে। হুবহু সাদিকের ছোটবেলার ছবি৷ ছবির পর সাদিক ব্যাগ থেকে মাহাদীর আর্টের খাতা বের করে সামনে ধরে বলল,
–দেখো মা, আমার ছেলেটা একদম তোমার মতো আর্ট করে। তুমি ওকে পছন্দ না করলেও তোমার গুন পেয়েছে।

ফরিদা বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না। শুধু নিজের ছেলেকে দেখতে লাগলো। কি মুগ্ধ চোখে নিজের ছেলের আঁকানো ছবি তাকে দেখাচ্ছে! কি প্রসন্নই না দেখাচ্ছে ওকে! ছেলের সুখ যে এখানে ছিলো, তা কি তিনি বুঝেছিলেন! এসব দেখে হঠাৎই তার নাতিকে দেখতে মন চাইলো। অনেক সাহস সঞ্চয় করে বলল,
–যাওয়ার সময় আমাকে সাথে নিয়ে যাস বাবা। তোর বাবা তো বাড়িতে নাই। নাতিটাকে একটু দেখে আসতাম। নিয়ে তো আর আসলি না। তোর বাবা থাকলে তাও তোর বাবার সাথে যেতে পারতাম।

সাদিক তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলল,
–অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ট্রাভেল করা সম্ভব না মা। আর তাছাড়া ওকে আমি আনতামও না।

মাহাদীর অসুস্থতার কথা শুনে চমকে উঠলো ফরিদা। অবাক হয়ে বলল,
–কি হয়েছে ওর?

সাদিক দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল,
–ব্লা’ড ক্যান্সার৷

ফরিদা কিছুক্ষণের জন্য কথাই বলতে পারলো না। বিষ্ময় কাটিয়ে মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে লাগলো। আর্তনাদ করে বলে উঠলো,
–আমাকে একবার নাতিটাকে দেখতে দে বাবা। অসুস্থ নাতিটাকে একবার দেখে আসি।

সাদিক থমথমে মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বলল,
–তুমি এমনভাবে বলছো যে মনে হচ্ছে আমার ছেলেটা ম’রে যাবে।

ফরিদা আঁতকে উঠলো,
–কিসব বলছিস তুই?

সাদিক উত্তর দিলো না। হালকা হেসে পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে মায়ের সামনে রেখে বলল,
–তুমি আমার ছেলেকে মারতে যে টাকা দিয়েছিলে, এটা সেই টাকা। আমার ছেলের সব ঋণ শোধ করলাম মা। দোষ তো আমি আর অহনা করেছি। বাচ্চাটা নির্দোষ। অসুস্থ বাচ্চাটার উপর আর রাগ রেখো না মা। আর পারলে আমাদের মাফ করে দিও।

ফরিদা ডুকরে কেঁদে উঠলো,
–ভুল হয়েছে বাবা, খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দে। নাতিটাকে একবার দেখাতে নিয়ে যা বাবা।

ফরিদা সত্যি সত্যি অনুতপ্ত নাকি বোঝা গেলো না। একসময় যেই বাচ্চার একমাত্র অপরাধ ছিলো, সে অহনার গর্ভে জন্মেছিল। আর আজ সেই বাচ্চার অসুস্থতার কথা শুনে এতো কষ্ট পাচ্ছে! এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য!

সাদিক মাথা নেড়ে বলল,
–তুমি ওকে দেখার অধিকার হারিয়েছো মা। আমার বাচ্চাটাকে জন্মের আগেই তুমি মে’রে ফেলতে চেয়েছিলে। একবারও তোমার নিজের ছেলের কথা ভাবোনি।

ফরিদা আহাজারি করে উঠলো। সাদিকের হাত চেপে বলল,
–ভুল তো আমি করেছি বাবা৷ আমার ভুলের শাস্তি আমাকে অন্যভাবে দে। এমন সম্পর্ক ছিন্ন করে শাস্তি দিস না।

–ভুল না মা, অন্যায় করেছো। অনেক বড় অপরাধ করেছো তুমি। বাবা মায়ের অন্যায়ের শাস্তি নাকি সন্তানরা পায়। তোমাদের অন্যায়ের শাস্তির জন্যই বোধহয় আমার ছেলেটার আজ এই অবস্থা। ওর মাধ্যমেই বোধহয় আমাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

ফরিদা আর কথা বলতে পারলো না। ছেলের হাতে কপাল রেখে অঝোর নয়নে কাঁদতে লাগলো। কান্নাকাটি যখন অসহ্য লাগলো সাদিকের কাছে, তখন উঠে ঘরে গেলো। তার সব জিনিসপত্র লাগেজে তুলে, অহনার পাসপোর্ট নিয়ে একেবারে বেড়িয়ে গেলো। মায়ের আর্তনাদ, আহাজারি কিছুই শুনলো না।

সাদিক ফিরতে ফিরতে মাহাদীর অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। রক্তে প্লেটলেট কমে যাওয়ায় আবার হিমোগ্লোবিন দেওয়া হচ্ছে। এবারে ভয় পাচ্ছে না মাহাদী। চুপচাপ শুয়ে মোবাইলে কার্টুন দেখছে। সাদিক যখন কেবিনে আসলো তখন অহনা সেখানে ছিলো না। দেখা হলো শুধু ছেলের সাথে। ক্লান্ত শরীরে ছেলেকে দেখে মূহুর্তেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। কাছে যেতেই বাবার চোখে চশমা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো মাহাদী। সাদিকের চোখের দিকে আঙুল তুলে নিজের মুখে হাত চেপে হাসতে হাসতে বলল,
–বাবা চশমা পরে, বাবা চোখে দেখে না!

সাদিকও হেসে ফেললো। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
–হ্যাঁ আব্বু, বাবার নজর খুব খারাপ। নাহলে কি আর মাহাদীকে আর মাহাদীর আম্মুকে খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়!

মাহাদী অতো কিছু না বুঝলেও বাবার আদর বুঝে গলা জড়িয়ে ধরলো এক হাত দিয়ে৷ আরেক হাতে প্লেটলেট দেওয়া হচ্ছে। এক হাতের বাঁধনে উঠতেই দিলো না বাবাকে। সাদিক বেডে ভালো করে বসে মাহাদীর পিঠের নিচে হাত দিয়ে তুলে বুকে জড়িয়ে আধশোয়া হয়ে রইল। অহনা খানিক পর আসলো। মুখ থমথমে। ভেতরে এসে সাদিককে দেখে গোমড়া মুখে বলল,
–বাইরে আপনার কাজিনরা এসেছে।

অহনার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে, তাদের আসা তার একদম পছন্দ হয়নি। সাদিক সবটা বুঝলো। তারপর দ্রুত পায়ে বাইরে চলে গেলো। সকলে দল বেঁধে এসেছে। নিশ্চয় সব জানতে পেরেছে আর তাই নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে চলে এসেছে। সাদিক মহা বিরক্ত হলো। রাগী গলায় বলল,
–কেনো এসেছিস?

সজীব আমতা-আমতা করে বলল,
–তোমার ছেলেকে দেখতে। ফুপি বলল, তোমার ছেলের নাকি ব্লা’ড ক্যান্সার হয়েছে?

ফরিদা আর খলিল সাহেব সম্পর্কে খালাতো ভাইবোন ছিলো। আত্মীয়ের উপর করা এই আত্মীয় বেশ জোড় পাকিয়েছে।
সাদিক কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। সবার চোখে মুখে কি দাপট! মনে হচ্ছে হাতে লাঠি থাকলে এক্ষুনি মা’রামা’রি শুরু করে দিতো। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ আমার চেষ্টা করে বলল,
–যদি খু’ন মাফ হতো তাহলে আই সয়্যার, তোরা কেউ আর বেঁচে থাকতি না। মাথা আর খারাপ করিস না আমার। চলে যা এখান থেকে।

সায়রা এগিয়ে আসলো। নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে বলল,
–সাদিক ভাই, আমরা তো আপনার আর মৌলির ভালোর জন্যই সব করেছি। এখন সব দোষ আমাদের দিচ্ছেন!

মৌলি তেঁতে উঠলো,
–আমার নাম নিচ্ছিস কেন? আমি কি তোদের এসব করতে বলেছিলাম?

সাদিক ক্রোধিত স্বরে বলল,
–আমার যথেষ্ট ভালো করেছিস তোরা৷ তোদের ভালোবাসায় আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা না দিয়ে বিদায় হ তাড়াতাড়ি।

মিরাজ রেগে বলল,
–তুমি ওই মেয়ের জন্য আমাদের অপমান করছো ভাই? তুমি জানো ও কি কি করেছে? চরিত্রহীন মেয়ে ও। নিজেকে না জানি কাকে কাকে..

কথা শেষ করার আগেই সাদিক রেগে মিরাজের কলার চেপে ধরলো। নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ক্রোধে জর্জরিত ভয়ংকর স্বরে বলল,
–আমার স্ত্রীর সম্পর্কে একটা বাজে কথা বলবি তো আস্তো বাড়ি ফিরতে পারবি না। আমি তোদেরও চিনি আর আমি আমার স্ত্রীকেও চিনি।

মিরাজও কম যায় না। রেগে একদম সাদিকের চোখে চোখ রেখে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অবস্থা বেগতিক দেখে সজীব মিরাজকে ছাড়িয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলো। রাগ কমাতে সেখানে কিছুক্ষণ পাইচারি করলো সাদিক। কিছুক্ষণ মাথার চুল আকড়ে, কিছুক্ষণ ঘাড় মালিশ করে আর শেষমেশ মুখ দুই হাতে ঢেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর কেবিনে গেলো। অহনা বোধহয় তারজন্যই অপেক্ষা করছিলো। সাদিক ঘুমন্ত মাহাদীর দিকে একপলক তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
–চলে গেছে ওরা।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো অহনা। চলে না গেলে ও মাহাদীকে নিয়ে চলে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলো। নিজের বাচ্চাকে কিছুতেই ওদের সামনে আনতো না। নাহলে ওরা ওকে দেখে না জানি কি না কি করে বসতো। সাদিক অহনার পাশে বসে হাত চেপে বলল,
–বাবা আসতে চাইছে। বলবো আসতে?

অহনা কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। খলিল সাহেব প্রথম দিকে তার খুব খেয়াল রাখলেও পরে তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে ওকে তার সামনে মে’রে ফেললেও তিনি কিছুই বলতো না। আর সেই ঘটনার পর কি করলো! দলবল নিয়ে প্রথমে ওর মামার বাড়ি আর তারপর মা আর বোনের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে নিজ দ্বায়িত্বে সব জানিয়ে এসেছিলো আর বেশ ভালোমতো গন্ডগোলও করেছিলো। সেসব সাদিককে বলা হয়নি। প্রথমবারের মতো চাপে না পরে নিজে থেকে আস্তে করে নির্ভয়ে সবটা বলল। সাদিক মর্মাহত হলো দারুন। তার যে বাবা কখনোই কোনো ঝামেলায় থাকেনি, সেই বাবাই না কি এইসব করে বেড়িয়েছে! সব দিক থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শক্ত করে অহনার কাঁধ চেপে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো সাদিক। বাবাকে মেনে নিলেও তাকে ফেলে বাবা মায়ের এই নিরালা আলাপ তার একদম পছন্দ হয়নি। তাই জেগে উঠেই হাত বাড়িয়ে মায়ের আঁচল টেনে ধরলো। অহনা চমকে উঠে পেছনে ফিরতেই মাহাদীকে জেগে থাকতে দেখে আদুরে হাতে ছেলের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।

এরপরের তিন চার সপ্তাহ মাহাদীর কেমোথেরাপির প্রথম সেশন চললো। এই কয়েকদিনের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করে মাহাদীর পাসপোর্টের কাজ আর তাদের দুজনে ভিসার কাজ সম্পূর্ণ করে ফেললো সাদিক। মাহাদীর কেমোথেরাপির প্রথম সেশন দেশে হলেও বাকি সেশন দেশে বাইরে হবে। কাজ শেষ হতে হতেই মাহাদীর প্রথম সেশন বেশ ভালোমতো শেষ হলো। হসপিটাল থেকে বাড়ি আনা হলো তার দুইদিন পরেই।
আগামী সপ্তাহে তাদের ফ্লাইট। অহনা গোছগাছে ভীষণ ব্যস্ত। সাদিকও ব্যস্ত ছিলো কিন্তু তার মাঝেই সময় করে মায়ের সাথে ভিডিওকলে কথা বলতে লাগল। হঠাৎ মাহাদী এসে পেছন থেকে সাদিকের কানে সুরসুরি দিতেই সাদিক তার হাত ধরে মাথা পেছন দিকে ঝুঁকিয়ে আদুরে গলায় বলল,
–মায়ের কাছে ভদ্র বাচ্চা আর বাবার কাছে আসলেই দুষ্টমি!

মাহাদী খিলখিল করে হেসে পেছন থেকে সাদিকের গলা জড়িয়ে ধরলো। সাদিক প্রসন্ন হেসে দুই হাত দিয়ে ছেলের ছোট দুই হাত ধরে মাথা ঘুরিয়ে তার মাথায় চুমু দিলো। মাহাদী থেমে না থেকে হাসতে হাসতেই দুষ্টমি করে বাবার কানে, ঘাড়ে ফুঁ দিয়ে বিরক্ত করতে লাগলো। সাদিক উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। সামনে ল্যাপটপের ভেতর থেকে ফরিদা ছেলের এমন প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বাসিত হাসি দেখে মুগ্ধ হলো। মাহাদী কিছুক্ষণ বাবার সাথে দুষ্টুমি করে আরেকটু ঝুঁকতেই ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। প্রথমটায় ভিডিওকল বুঝতে পারেনি। ভেবেছিলো ভিডিও চলছে। ভিডিওকল বুঝেই নিজেকে সাদিকের আড়ালে নিলো। কিছু মূহুর্ত পর বাবার পেছন থেকে অল্প মাথা বের করে ডাগর ডাগর চোখে ল্যাপটপ স্ক্রিনে তাকাতে লাগলো। ফরিদা তো কিছুই বলতে পারছে না। শুধু নাতিকে দেখছে দুচোখ ভরে। স্পর্শ করার অধিকার নিয়ে নিলেও দেখার অধিকার সাদিক নিলো না। বেশ কিছুক্ষণ এমন চলার পর মাহাদী বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে হাত দিয়ে ঠোঁট আড়াল করে ফিসফিস করে বলল,
–এটা তো দাদীমা? তাই না বাবা?

সাদিক মুচকি হেসে বলল,
–হ্যাঁ, কথা বলবে?

মাহাদী সজোরে মাথা নেড়ে এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো। এরপর ফরিদা কি বলবে সেটা সাদিক জানে। তাই তাকে কিছু বলতে না দিয়ে বলল,
–আগামী সপ্তাহে আমরা দেশ ছাড়ছি মা। যাওয়ার আগে দেখা করে যাবো। এইটুকুতে আপত্তি নেই আশা করি।

বলে কথা শেষ করে সাদিক কল কেঁটে দিতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো ফরিদা। অন্যপাশে সাদিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না মায়ের কষ্ট দেখতে পারবে আর না তাকে ক্ষমা করতে পারবে। কি দারুন এক যন্ত্রণা!

বিদেশের মাটিতে মানিয়ে নেওয়া সহ কেমো থেরাপির সেই সময়কালটা ভীষণ যন্ত্রণার ছিলো মাহাদীর জন্য আর অহনা, সাদিকের জন্যেও। বিশেষ করে কেমোর পরের অসুস্থতাটা মাহাদীকে বেশ ভুগিয়েছে। অহনা সাদিক দুই হাতে ছেলেকে আগলেছে। মাহাদী কখনও বুঝেছে আবার কখনও তারস্বরে কান্নাকাটি করেছে। বিশেষ করে মাঝের সময়টাতে মেজাজ ভীষণ খিটখিটে হয়ে গেছিলো তার। এরপর আস্তে আস্তে শরীর সব মেনে নেওয়ায় ক্যান্সার হার মানলো। মাহাদীর কেমোথেরাপির লাস্ট সেশন শেষে ডক্টর কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
–মাহাদী, তুমি তো সম্পূর্ণ সুস্থ। এখন কি করবে?

মাহাদী কিছুক্ষণ ভাবলো। স্কুলে যাচ্ছে দুইবছর হলো৷ সুতরাং মাথায় এখন ভ্যাকেশনের চিন্তা ঘুরছে। বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করার পর বলল,
–আমি, বাবা আর বেবি আপু মিলে ফুলবল ম্যাচ দেখতে যাবো।

ডাক্তার বাঙালি ছিলো। মাহাদীর সাথে তার কথোপকথন বাংলায় হচ্ছে। ডাক্তার হেসে উঠে বলল,
–তোমার মাকে নেবে না?

মাহাদী ডাক্তারের বোকামিতে কপাল চাপড়ে বলল,
–আম্মু না গেলে বেবি আপু যাবে কিভাবে? বেবি আপু তো এখনও আম্মুর টামিতেই আছে।

অহনা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো। যে কথাটা একমাত্র ছেলেকে ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কাউকে জানায়ইনি ,সেই কথাটা ছেলে কি নির্দ্বিধায় বলে দিলো। কতবার করে বুঝিয়েছিলো তাকে যাতে এখনই কাউকে কিছু না বলে। আর ফট করে এমন হাটের মাঝে কাঁঠাল ভেঙে দিলো! সাদিক রাগী দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকাতেই অহনা মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে সামলালো। সাদিক অহনার কানের কাছে মুখ নিয়ে রাগী গলায় ফিসফিস করে বলল,
–বউরা নাকি বরদের টাকা লুকিয়ে রাখে। আর তুমি এইসব লুকিয়ে রাখো! বাড়ি চলো, নিরিবিলিতে ভালো করে শুনবো আর কি কি লুকিয়ে রেখেছো।

অহনা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। এই লজ্জার জন্যই তো কথাটা এখনও বলতে পারেনি। ডাক্তার আর মাহাদীর খোশগল্প চলতেই থাকলো,
–আর কি কি করবে মাহাদী?

মাহাদী আরো ভাবলো। তারপর ফোঁকলা দাঁতে হেসে বলল,
–আমরা সামার ভ্যাকেশনে হলুদ বাড়িতে যাবো। আর সেখানে অনেকদিন থাকবো।

মাহাদীর বয়স এখন সাত। সামনের দাঁতগুলো তার নিজের অস্তিত্ব বিলিন করে নতুনের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। তাই বলা চলে মাহাদী এখন বড় হয়েছে। তবে বড় হলেও তার স্মৃতিতে সেই হলুদ বাড়ি এখনও জ্বলজ্বলে। এতোদিনে আরো অনেকভাবে সেই বাড়ির ডিজাইন সে বানিয়েছে। বর্তমানে সেই বাড়ি এখন দোতলা বাড়ির রুপ ধারন করেছে। যার সামনে রয়েছে বড় রাস্তা আর রাস্তায় ঢালাই করে ফেলে রাখা রঙ আর অনেক ক্যানভাস। গাছের মতো করে রঙের তুলি দাঁড়িয়ে আছে। মাহাদী স্বপ্নে দেখে, সেই হলুদ বাড়ির সামনে বসে গাছের মতো তুলি দিয়ে রাস্তা থেকে রঙ তুলে তুলে আর্ট করবে সে। কল্পনা করেও তার গায়ে কাটা দিয়ে দিয়ে ওঠে।

সমাপ্ত…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-১৩

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৩

ডক্টর অনিন্দর চেম্বারে বসে অপেক্ষা করার মিনিট দশেকের মধ্যেই সে আসলো। সাদিক উঠে দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করে আবার নিজের জায়গায় বসলো। সাদিকের মুখ বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিলো। তাকে আর চিন্তায় না ফেলে কোন ভণিতা ছাড়াই ডক্টর অনিন্দ বলল,
–মাহাদীর র’ক্তের প্লেটলেট যথেষ্ট কম। কেমো সেশনের আগে প্লেটলেট দিতে হবে।

সাদিকের মাথা বাজ পরলো বলে মনে হলো। অবিশ্বাস্য সুরে বলল,
–কেমো দিতে হবে কেন?

ডক্টর অনিন্দ মিনিটের মতো চুপ থাকলো। চেম্বারে তেমন শব্দ নেই। একসময় এসির পাওয়ার কমিয়ে পরিবেশ ঠান্ডা করে বলল,
–মাহাদী লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। সহজ ভাষায় বললে ব্লা’ড ক্যা’ন্সার।

সাদিকের পুরো পৃথিবী দুলে উঠলো৷ চেয়ারের হাতল ধরে দ্রুত নিজেকে সামলালো। অহনার কথা মনে পরলো তার। কথাটা শোনার পর নিজেকে কিভাবে সামলেছিলো সে? তার বাচ্চাটা, ছোট বাচ্চাটা ক্যান্সার নিয়ে ঘুরছে! ওইটুকু বাচ্চাটার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে!
নিঃশ্বাসের বেগ পেতেই নিজের চুল খামচে ধরলো সাদিক। পরিস্থিতি বুঝে বন্ধুকে সামলে নিতে সময় দিলো অনিন্দ। একসময় সাদিক আহাজারি করে উঠে বলল,
–অনি, আমার ছেলে! আমার ছেলেকে কি হারিয়ে ফেলবো রে? সবে কোলে নিয়েছি ওকে। কাল রাতেও গল্প পড়ে শোনালাম। শোবার সময় কিভাবে আমার গলা জড়িয়ে শুয়েছিলো। ও..ও কি আর..

কথা শেষ করতে পারলো না সাদিক। শ্বাস টানা শুরু হয়েছে তার। অনিন্দ উঠে এক গ্লাস পানি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে পাশের চেয়ারে বসে পরলো। সাদিকের বিবাহিত জীবন আর এর পরের জীবন সম্পর্কে মোটামুটি সবটাই জানে সে। তাই এটা নিয়ে আর প্রশ্ন তোলে না। সাদিক জানে ওর বন্ধু অনেক বড় ডাক্তার। তাও পাগলের মতো করতে লাগলো। অনিক ওকে শান্ত করতে বুঝিয়ে বলল,
–আগে তুই একটু শান্ত হ। আমি সব বুঝিয়ে বললে তখন এতো কঠিন লাগবে না। লিউকেমিয়া বাচ্চাদের একটা সাধারণ রোগ। সব বাচ্চাদের না হলেও যাদের হয় তাদের এই টাইপের লিউকেমিয়াই হয়। আর প্রায় নাইন্টি পারসেন্ট বাচ্চাই সুস্থ হয়ে যায়।

সাদিক বুঝলো না। আর্তনাদ করে বলল,
–তাই বলে আমার ছেলে…ও কত কষ্টই না পাচ্ছে! এটা..এটা কিভাবে হলো? কবে হলো এসব?

অনিন্দ চোখ বুজে শ্বাস ফেলে বলল,
–কিভাবে হলো আর কবে হলো সেসব তো বলা সম্ভব না। আমি তোকে সব বুঝিয়ে বলছি। শান্ত হয়ে শোন।

সাদিক চুপ রইলো কিন্তু শান্ত হলো নাকি বোঝা গেলো না। অনিন্দ বন্ধুর হাতে নিজের ভরসার হাত চেপে বলল,
–বোনম্যারোতে স্বাভাবিক অবস্থায় যতটা র’ক্তকণিকা তৈরি হয় লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হলে সেটার ব্যাঘাত ঘটে। আমাদের বডি স্বাভাবিকভাবে যতটা হোয়াইট ব্লা’ড সেল বানায়, তখন সেটা বেড়ে যায় আর তুলনামূলক রেড ব্লা’ড সেল কম হয়। আর এর ফলে হোয়াইট ব্লা’ড সেল অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে র’ক্তে জমে যায়। যেমন আমাদের শরীরে চর্বি জমে আমাদের মোটা করে তেমনই অস্থিমজ্জার ওই অংশ তখন ফুলে ওঠে। আর এটা ধীরে ধীরে পুরো বডিতে ছড়িয়ে যায়। লিউকেমিয়া ব্লা’ড ক্যান্সারের একটা প্রকার মাত্র। এর চিকিৎসা আছে আর প্রচুর মানুষ একদম সুস্থ হয়ে যায়। আর মেইনলি, বাচ্চাদের শরীর কেমো খুব ভালোভাবে অ্যাক্সেপ্ট করে।

অনিন্দ বুঝানোর শুরুটা রোগ দিয়েই করলো। রোগ কিভাবে হয় সেটা বুঝতে পারলে চিন্তা অনেকাংশেই দূর হয়। কারন তখন মনের মধ্যে থাকে, ওই অংশটুকু রিপেয়ার করলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। সাদিকের ক্ষেত্রও তাই হলো। নিজেকে অনেকটা স্বাভাবিক করে ফেললো। অনিন্দ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–দেখ সাদিক, ভাবি চিকিৎসার কোন কমতি রাখেনি৷ লাস্ট দশ বারোদিন হলো মাহাদীর সাপোর্টিভ মেডিসিন চলছে। লিউকেমিয়া ধরা পরার পর ওর ফুল বডি নতুন করে চেকাপ করানো হয়েছিলো। শরীর অত্যাধিক দুর্বল আর লিভারের প্রবলেম ধরা পরেছিলো। খুব বেশি না, সামান্য। এই অবস্থায় কেমো দেওয়া সম্ভব হয়নি৷ দ্যাটস হোয়াই, এই সাপোর্টিভ মেডিসিন চলছিলো৷ আর এই অবস্থায় একটা বাচ্চার তার বাবা আর মাকে খুব দরকার। বাচ্চারা মাকে বেশি ভালোবাসলেও ভরসা বেশি বাবাকেই পায়৷ একটা আস্থা তৈরি হয় বাবার উপর। এটা ন্যাচারাল। ব্যাতিক্রম অবশ্যই আছে তবে সেটা আলাদা কথা। যাই হোক, ভাবীর সাথে কথা বলে জেনেছি, তোরা সেপারেশনে আছিস৷ আমি সাজেস্ট করলাম, বাচ্চার মেন্টাল কন্ডিশনের জন্য হলেও অন্তত বাবাকে বাচ্চার কাছে রাখুন। অন্তত কেমোর প্রথম দুই তিন মাস। আর এরপরের ঘটনা আমার জানার কথা না, তোরা ভালো জানিস। এখন তোর কাজ শুরু, মাহাদীকে মেন্টালি স্ট্রং বানানোর। রিপোর্ট সব নরমাল এসেছে। লিভারের প্রবলেম দূর হয়েছে। শুধু ওর শরীরে প্লেটলেট যথেষ্ট কম। কেমো দিলে এমনিতেই প্লেটলেট কমে যায়। তাই আগে প্লেটলেট দিতে হবে আর এরপর কেমোর প্রথম সেশন শুরু হবে।

সাদিক সব শুনলো, বুঝলো। আহত পাখির মতো ছটফট করতে মন চাইলো তার। পারলো না কোনোভাবে। দুর্বল গলায় শুধু বলল,
–কবে দিবি?

অনিন্দ সামান্য হেসে বলল,
–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তত তাড়াতাড়ি। আমি তো আজকেই রোগীকে ভর্তি করার সাজেস্ট করবো। আজকে প্লেটলেট ট্রান্সফার করলে কাল সকালেই কেমো দিতে পারবো।

সাদিক হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে বলল,
–ঠিক আছে। আজকেই ভর্তি করাবো। আর কিছু কি লাগবে?

–না। ভর্তি করানোর পর বাকিটা আমরা দেখে নেবো। তুই স্বাভাবিক হয়েছিস দেখে ভালো লাগলো।

সাদিক উত্তর না দিয়ে মাথা নেড়ে চেম্বার থেকে বের হলো। ও ঠিক কতটা স্বাভাবিক আছে তা ওর থেকে ভালো আর কে জানে!
সারা রাস্তা মাহাদীকে বুকের সাথে আকড়ে ধরে এনেছে সাদিক। মনে পড়ে, একদিন অহনা বাজারে যাওয়ার আগে মাহাদীকে কোলে নিয়ে ওর কাছে এসেছিলো যাতে ও ছেলেকে একটু দেখে রাখে। সাদিক সেদিন ব্যাজার মুখে বলেছিলো,
–দুর্বলতার জন্য শুধু মেডিসিন খেলে হবে না। শাক, সবজি, ফলমূল সব খেতে হবে।
আজ মনে হচ্ছে, ওসব কেনো বলেছিলো? কেনো প্রথম দেখায় ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেনি? কেনো অহনা আর ফিরলো না? আর কেনোই বা সে ক্যারিয়ারের জন্য দেশের বাইরে চলে গেলো! অন্তত ছেলের কাছে আরো অনেকটা সময় কাটাতে পারতো। ছেলের শিশুকাল দেখতে পারতো। তিনমাস এতো কম সময়! অহনা আরো আগে কেনো গেলো না? ওর ছেলে অসুস্থ! সুস্থ ছেলেকে কি আদৌ দেখতে পারবে?

হসপিটালে নেওয়ার দুই ঘন্টার মধ্যে প্লেটলেট দেওয়ার কাজ শুরু হলো। অহনা ছেলের মাথার কাছে বসে ছোট ছোট কথা বলে সাহস জোগাচ্ছে। সাদিক বাড়ে বাড়ে ওকেই দেখে যাচ্ছে। মেয়েটা এতো শক্ত আছে কিভাবে! পরিস্থিতি কাউকে সত্যিই এতো শক্ত বানিয়ে দেয়! হাসপাতালের সেই সাদা বিছানায় তাদের কলিজার টুকরা ভয়ার্ত মুখে শুয়ে আছে। সাদিক ছেলের হাত শক্ত হাতে চেপে ধরতেই মাহাদী খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,
–আম্মু, বাবা ইজেকশনে ভয় পেলো।

সফেদ পোশাক পরা নার্সের হাতে ক্যানোলা ছিলো। মাহাদী সেটাকেই ই’ঞ্জেক’শন ভেবে নিয়েছে। আর তারপর বাবার ভয় দেখে সে নিজে আর ই’ঞ্জেক’শনে ভয় পেলো না। ছোট ছোট কথায় বাবাকে সাহস দিতে লাগলো। নার্স সেই ফাঁকে মাহাদীর হাতে ক্যানোলা ঢুকিয়ে সব সেট করে ফেললো। ক্যানোলা পরানোর সময় সামান্য আর্তনাদ করলো মাহাদী৷ সাদিক ওর ক্যানোলা লাগানো নাজুক হাত নিজের শক্তপোক্ত হাতে তুলে চুমু দিয়ে বলল,
–মাহাদীর আম্মুর মতোই মাহাদী ব্রেভ। ভয় একদম পাবে না, ঠিক আছে?

মাহাদী বাবার দিকে তাকিয়ে নিজেকে সাহসী প্রমাণ করতে ফ্যাকাসে মুখে মাথা হেলিয়ে সায় জানালো। সাদিক মৃদু হেসে অহনার রক্তশূণ্য মুখের দিকে তাকালো। কি নির্লিপ্ততা! নিজেকে পাথর করতে আর কিছুই বাকি রাখেনি মেয়েটা!
নার্স ধীরে ধীরে র’ক্তের ব্যাগের নল মাহাদীর হাতে সংযুক্ত করে দিলো। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্লেটলেট ট্রান্সফিউশান শুরু করলো। ডাক্তার পাশে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করছে মাহাদীকে। ওর শরীর ঠিক আছে কি না দেখছে।
মাহাদীর ছোট শরীরটা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো। সাদিক আর অহনা মিলে অনেক গল্প করলো তার সাথে৷ মাহাদী কিছু গল্পে মনোযোগ দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো আবার কিছু গল্পে মনোযোগ দিতে না পেরে ভয়ে বা মায়ের বুকে মুখ গুজতে চাইলো৷ পয়তাল্লিশ মিনিটের দীর্ঘ জার্নির পর প্লেটলেট দেওয়া শেষ হতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে মায়ের কোলে ঢুকে পরলো মাহাদী৷

সেদিন রাতটা হসপিটালেই কাটালো তারা। মাহাদীকে কেবিনে শুইয়ে বাইরে এসেছিলো অহনা। ক্লান্ত দেহে বাইরে রাখা চেয়ারে বসতেই সাদিক খাবার নিয়ে আসলো। পাউরুটি আর কলা এনেছে। অহনা পাউরুটি হাতে চুপচাপ বসে রইলো৷ পাশে সাদিকেরও একই হাল৷ দুজনের কারোরই খাওয়ায় আগ্রহ নেই। কিছুক্ষণ মৌন থেকে ভাঙা গলায় নিরবতা ভাঙলো অহনা। ভেজা গলায় বলল,
–আমার ছেলেটা জীবনে কাউকে পায়নি। বাবার সাথে থাকার ভীষণ ইচ্ছা ছিলো। একদম যখন ছোট ছিলো তখন বাবা বাবা বলে ডাকতো। তারপর আশেপাশের বাচ্চাদের দেখে ওর নিজের বাবার কথা জিজ্ঞাসা করতো। আরো বড় যখন হলো তখন আর কিছুই বলেনি। কিন্তু মনে মনে বাবাকে চাইতো। জ্বর হলে, কান্না করলে সারাক্ষণ বাবা বাবা ডাকতো। ডক্টর বলল, ওর মেন্টাল কন্ডিশন খুব খারাপ। এমন হলে ঔষধ কাজ করবে না। বাচ্চার বাবাকে আনুন। বাচ্চার বাবাকে আনলাম। এখনও কি আমার ছেলেটা ঠিক হবে না?

এই প্রথম অহনাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখলো সাদিক৷ অহনা আগ বাড়িয়ে কখনোই কিছুই বলেনি, কিন্তু নিজেকে প্রকাশও করেনি কোনোদিন। সাদিক আহত মনে জড়িয়ে ধরলো তাকে। মাথায় চুমু দিয়ে আস্তে করে বলল,
–আমাদের ছেলের কিছুই হবে না। কয়দিন পর একদম ফিট হয়ে ফুলবল খেলবে।

অহনা প্রতিউত্তর করলো না। ওভাবেই স্বামীর বুকে পরে রইলো। বোধহয় এইটুকু আশ্রয় তার খুব প্রয়োজন ছিলো।

মাহাদীর কেমোথেরাপির প্রথম সেশন শুরু হলো পরদিন সকাল এগারোটায়। তার আগে মাহাদীর সুন্দর চুলগুলো একদম ফেলা দেওয়া হলো। চিৎকার করে কান্না করছিলো সে৷ নিজের চুল তার ভীষণ পছন্দের৷ অহনা আড়ালে চোখ মুছে ছেলেকে বুঝালো অনেকক্ষণ। শেষপর্যন্ত বুঝলো চোখ টোখ ফুলিয়ে কান্নাকাটি করার পর। গাল ফুলিয়ে এরপর কেমোথেরাপি নিতে বসেছিলো৷
মাহাদীর চোখেমুখে ভীষণ ক্লান্তি দেখা যাচ্ছিলো। সাথে একটু ভয় আর কৌতুহলও ছিলো। কেমো ইউনিটের চারপাশে ড্রিপ, নল আর ডাক্তার নার্সদের ব্যস্ততা। মাহাদী টলটল চোখে সেই ব্যস্ততা দেখছিলো। হালকা শোয়ানো চেয়ারে বসে আছে সে। তার মাথার কাছে বসে আছে মা আর পায়ের কাছে বাবা। অহনা ওর মুখভঙ্গি দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
–ভয় করছে আব্বু?

মাহাদী মুখ ছোট করে মাথা নাড়লো। তার মতো সাহসী ছেলের ভয় পাওয়াটা খুবই লজ্জাজনক কিন্তু ভয়টাও যে অনেক বেশি। কিছুতেই লুকিয়ে রাখা গেলো না। সাদিক চুপচাপ মা ছেলেকে দেখছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, তারা মা ছেলে তাকে ছাড়া অনেক সুখী। ও এখানে এক্সট্রা পারসোন। ছেলে অসুস্থ না হলে কখনই তার দরকার ছিলো না অহনার। জীবনটা হঠাৎ কি জটিলই না হয়ে গেছে!
ডক্টর অনিন্দর পরনে এপ্রোন। বেশ আগ্রহ ভরে এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ দেখছিলো মাহাদী। এরমাঝে নার্স ওর হাতের শিরায় ছোট সুঁ’চ ঢুকালো। চোখ বড় বড় করে কেঁদে উঠলো মাহাদী। অহনা ভয় পেয়ে মাহাদীর চোখ হাত দিয়ে ঢেকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো৷ মায়ের কোলে থাকা ভয়ার্ত মাহাদীর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো। আইভি ড্রিপের মাধ্যমে মেডিসিন ধীরে ধীরে তার শরীরে ঢুকতে লাগলো। সাদিক ছেলের জুতা খুলে পা কোলে তুলে নিলো। এরপর আলতো হাতে পা ম্যাসাজ করে দিতে লাগলো। আরামে শারীরিক অস্বস্তি ভুলে চোখ বুজে পরে রইলো মাহাদী। ঘন্টাখানেক পর মাহাদীর শরীর কেমন নেতিয়ে পরলো। বেশ অসুস্থ লাগতে লাগলো তার। অনিন্দ আশ্বাস দিয়ে বলল,
–এটা ন্যাচারাল। মেডিসিনের জন্য বডি রিঅ্যাক্ট করছে৷

অহনার জায়গায় তখন সাদিক বসেছিলো। মাহাদীর ছোট শরীর ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে উঠে বাবার কাঁধে নেতিয়ে পরে রইলো। নার্স কিছুক্ষণ পরপরই ওর শ্বাসপ্রশ্বাস, তাপমাত্রা, রক্তচাপ পরীক্ষা করছিলো৷ দীর্ঘ দুই ঘন্টা পর এই মানসিক কষ্টদায়ক সেশন শেষ হওয়ার পর মাহাদী ঘুমিয়ে পরলো। বেশ কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ওঠার পর একদম সুস্থ দেখালো ওকে। আরো কিছুক্ষণ চেকাপ করিয়ে ছুটি দিলো ডক্টর। তার আগে অহনা আর সাদিককে সাবধান করে দিলো। কেমোথেরাপির সাইড ইফেক্ট সবসময় সাথে সাথে শুরু হয় না। আগামী কয়েকদিন ওরজন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেশি অসুস্থ হলে সাথে সাথেই যাতে হসপিটালে নিয়ে আসে।
এরপরের দুই তিনদিন মাহাদী একদম সুস্থ ছিলো। আগের মতো দুর্বলতাও ছিলো না। বাবার সাথে সাইকেল চালিয়েছে, হেঁটে হেঁটে বাজারে গেছে আবার হালকা দৌড়ে ফুটবলও খেলেছে। ওকে এমন সুস্থ দেখে সাদিক সিদ্ধান্ত নিলো, বাড়ি যাবে। দরকারী কিছু কাজ আছে তার। পরেরদিন দুপুরের পর বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলো সে আর সেইদিন রাত থেকেই মাহাদীর ধুম জ্বর। শেষরাতে শ্বাসকষ্টের সাথে বমি শুরু হলো। শেষে তো বমির সাথে রক্ত পরতে লাগলো। ভীষণ ভয় পেয়ে তক্ষুনি হসপিটালে নেওয়া হলো মাহাদীকে।

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-১২

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ১২

মাহাদীর ডক্টর সাদিকের বন্ধু। অনেকদিন পর দুইজনই দুজনকে অবাক, বিষ্মিত। ডক্টরের নাম অনিন্দ। সাদীকের কলেজ জীবনের বন্ধু৷ তবে বন্ধুর ছেলে জেনে কিছুটা চিন্তিত দেখালো তাকে। মাহাদীর চেকাপ করিয়ে কিছু টেস্ট লিখে দিলো। সব কিছু নিজ হাতে সামলালো সাদিক৷ ওর স্বাভাবিক ভাব দেখে ড. অনিন্দ একটু অবাক হলো। অহনার আড়ালে বলল,
–ভাবী তোকে কিছু বলেছে?

বন্ধুর বউ বলে আগের সম্মোধন তক্ষুনি বাতিল করে এখন ভাবী বসিয়েছে। সাদিক ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কি ব্যাপারে?

অনিন্দ খানিক ইতস্তত করে বলল,
–মাহাদীর অসুস্থতা নিয়ে?

কপালে চিন্তার ভাজ আরো গভীর হলো। উদ্বিগ্ন হলো বেশ। দুর্বল গলায় বলল,
–না বলেনি। আমার ছেলের কি হয়েছে?

অনিন্দ উত্তর দিলো না৷ সাদিকের উতলা ভাব দেখে কাধে হাত রেখে বলল,
–টেস্টের রিপোর্ট কাল দেবে। তুই কাল আসিস, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এখন মনে হয় না সিচুয়েশন সুইটেবল।

সাদিকের চোখে ভয় দেখা দিলো। অনিন্দ আশ্বাস দিয়ে বলল,
–চিন্তা করিস না, এমন অসুস্থ হয়নি যে চিকিৎসা সম্ভব না।

সাদিক দুর্বল গলায় বলতে চেষ্টা করল,
–তবুও..

অনিন্দ হালকা হেসে বলল,
–ডোন্ট ওয়ারি ডিয়ার। মোমেন্ট এঞ্জয় কর। ছেলের চিন্তা কাল করিস। আর ভাবীকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করিস না।

সাদিক মাথা হেলিয়ে সায় জানালো। অনিন্দ শুধুমাত্র অহনার সাথে কিছু কথা বলল। সাদিক তখন ছেলেকে নিয়ে বাইরে বসেছিলো। অহনা বের হলো ফ্যাকাসে মুখে৷ সাদিক দেখে আরো চিন্তিত হলো। এরপরের পুরোটা সময় দুইজনই চুপ ছিলো। একজনের বলার ইচ্ছা ছিলো না আর একজনের শোনার সাহস ছিলো না। মাহাদীর জ্বর যায় আসে করছে। সাথে ঠান্ডায় গলা বসে গেছে। সন্ধ্যার পর যখন সাদিক ছেলেকে কোলে বসিয়ে গল্পের বই পড়ে শোনাচ্ছিলো তখন হঠাৎই মাহাদী নিজের হাত সামনে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল,
–বাবা, র’ক্ত!

সাদিক থমকালো। ছেলের মুখ ভালো করে চেক করে বুঝলো, নাক দিয়ে র’ক্ত পড়ছে। আর্ত গলায় ছেলেকে সাহস দিয়ে বলল,
–সমস্যা নাই আব্বু। আমারও এমন হয়।

মাহাদী যাতে ভয় না পায় তাই এই মিথ্যেটা বলেছিলো সে। এতে মাহাদী বেশ মজা পেলো সাথে তার ভয়ও দূর হলো। আগ্রহ নিয়ে বলল,
–তোমার কান দিয়ে র’ক্ত পরে?

সাদিক চিন্তিত থাকলেও ছেলেকে বুঝতে দিলো না। হালকা হাসার চেষ্টা আরো উৎসাহ দিয়ে বলল,
–হ্যাঁ বাবা। অনেকের তো চোখ দিয়েও পরে।

–চোখ দিয়ে পরে?

দারুন বিষ্মিত হলো মাহাদী। সাদিক মাথা নেড়ে বলল,
–হ্যাঁ, ভ্যাম্পায়ারদের চোখ দিয়ে পড়ে।

মাহাদী বাবার দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে বলল,
–ভেমপায়ের কি?

সাদিক এবারে হেসেই ফেললো। তার ছেলের জন্য ভ্যাম্পায়ার উচ্চারণটা বেশ কঠিন হয়ে গেছে। উচ্চারণের সময় চোখ কুঁচকে অনেক কষ্ট করে উচ্চারণ করেছে। আদুরে ভঙ্গিতে ছেলের গালে চুমু দিয়ে বলল,
–ভ্যাম্পায়ার হলো যারা মানুষের র’ক্ত খায় তারা।

বাবার কথা বুঝে মাথা নাড়লো সে৷ বিজ্ঞ ভঙ্গিতে চিন্তাভাবনা করে বলল,
–তাহলে কি মশা ভেমপায়ের?

–না। ভ্যাম্পায়ার মানুষের মতো দেখতে হয়।

–তাহলে কি ডাক্তাররা ভেমপায়ের হয়? ওই ডাক্তার আংকেলটার ওখানে একটা ডাক্তার আন্টি ইজেকশন দিয়ে আমার র’ক্ত নিয়েছিলো। আমার র’ক্ত নিয়ে কি ওরা ভেমপায়েরকে দিয়েছিলো?

ইঞ্জেকশন উচ্চারণও একই ভাবে করলো মাহাদী। সাদিক বুঝলো, এমন কঠিন কঠিন উচ্চারণ তার ছেলের জন্য আসলেই কতটা কঠিন। মুখে আসতে চায় না তাও গাল ভরে উচ্চারণ করে। সাদিক মাহাদীর মাথায় চুমু দিয়ে বলল,
–না বাবা। ওটা টেস্টের জন্য নিয়েছিলো। তুমি অসুস্থ নাকি সেই টেস্ট করতে র’ক্ত নিয়েছে।

মাহাদী মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বলল,
–কি বোকা! আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়। আমার আম্মু সব জানে।

সাদিক মৃদু হাসলো। ছেলের মাথায় চুমু দিয়ে উদাস গলায় বলল,
–হ্যাঁ বাবা, তোমার আম্মু অলরাউন্ডার।

মাহাদী মাথা নেড়ে স্বীকার করলো, বাবা সব বোঝে। বই ছেড়ে টিভিতে কার্টুন চালালো মাহাদী। বাবার বুকে লেপ্টে কার্টুন দেখতে লাগলো। সাদিক চোখ মুদে ছেলের স্পর্শ অনুভব করতে লাগলো। এটাতে যে এতো শান্তি লুকিয়ে আছে! বাবাকে অমনোযোগী দেখে মাহাদী গাল ফুলিয়ে ছোট দুই হাত দিয়ে সাদিকের গাল ধরে বলল,
–বাবা, আমরা হলুদ বাড়িতে ঘুরতে যাবো। আজকে যেমন লাল বাড়িতে ঘুরতে গেছিলাম তেমন।

সাদিক হেসে উঠলো। তার কাছে থাকা প্রিয় মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে থাকলে তারও রাগ ওঠে। ছেলে এই বৈশিষ্ট্যও নিয়ে নিয়েছে৷ হেসে উঠে মাহদীর ছোট হাত নিজের বলিষ্ঠ হাতে নিয়ে তাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
–ঠিক আছে।

–আমার আর্টের বাড়ির মতো বাড়িতে।

বাবাকে হলুদ বাড়ির আসল দৃশ্য বুঝাতে চাইলো মাহাদী। যদিও আঁকানো এখনও সম্পূর্ণ হয়নি তার। খুব চেষ্টায় আছে শেষ করার কিন্তু আর পারেই না করতে। সাদিক হাসি চেপে ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
–আচ্ছা, ওইরকম ভাঙাচোরা হলুদ বাড়িতেই আমরা থাকবো।

মাহাদী গাল ফুলিয়ে বলল,
–না, ভালো বাড়ি। ওখানে আমরা অনেকদিন থাকবো।

সাদিক মাহাদীর ফুলা গালে টোকা দিয়ে বলল,
–ঠিক আছে। আমরা অনেকদিন থাকবো।

–আমি থাকবো, আম্মু থাকবে, তুমি থাকবে আর আপু থাকবে।

আপু বলতে মাহাদীর সেই নিশু আপুকে বুঝলো সাদিক। বেয়াদপ মেয়েটাকে কিছুতেই তাদের ফ্যামিলিতে আনবে না। তাই একটু রাগী গলায় বলল,
–তোমার নিশু আপুকে আমি নেবো না।

মাহাদী বাবার বোকামিতে কপাল চাপড়ে বলল,
–উফফ! নিশু আপু না তো, অন্য আপু। একদম বেবি আপু। সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকবে, এমন আপু।

মাহাদীর স্মৃতিতে বেবি আপুর স্মৃতি অনেক গভীর। তাদের এক প্রতিবেশির ছোট বাচ্চাকে দেখতে গেছিলো মাহাদী। মিষ্টি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দারুন খুশি হয়েছিলো। কিন্তু আফসোস, কিছুক্ষণ থেকেই চলে আসতে হয়েছিলো। সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিলো তার। মাকে কতবার বলেছিলো, অমন বেবি আপু তাদের নাই কেন? মা কোনো উত্তর দেয়নি। কিছুদিন পর নিজে থেকে চুপ হয়ে গেলেও মনে আশা রেখে দিয়েছে। অনেক ভাবার পর মাহাদীর বেবি আপুর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলেছে সাদিক। হাসতে হাসতে বলল,
–মাহাদীর তাহলে বোন চাই?

মাহাদী কি বুঝলো কে জানে, জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে বলল,
–হ্যাঁ, একদম বেবি আপুর মতো বেবি আপু চাই।

খানিকক্ষণের এই কথাবার্তায় মাহাদীর র’ক্তের ব্যাপারটা কখন ধামাচাপা পরে গেলো, কেউ বুঝতেই পারলো না। রাতে মাহাদীকে ঘুম পারানোর সময় অহনার নজরে র’ক্ত পরেছিলো। মাহাদীর নাক দিয়ে আবার র’ক্ত পড়ছিল। ভেজা চোখে আলগোছে আচল দিয়ে র’ক্ত মুছে দিয়েছিলো অহনা।

সাদিক অনেক রাত পর্যন্ত অফিসের কাজ করবে জন্য নিজের পুরোনো ঘরে গিয়েছিলো। কাজ শেষে ঘরে ফিরতেই অহনাকে না দেখে বাইরে এসে দেখে, অহনা বারান্দায় বসে আছে। সাদিক তেজি পা ফেলে অহনার ঠিক পাশ ঘেঁষে বসে। নীরবে কিছুটা সময় কাটা পর সাদিক হুট করে বলল,
–তোমার সমস্যাটা কি জানো অহনা?

বারান্দার টিমটিমে আলোতে সাদিকের দিকে তাকালো অহনা। চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। হঠাৎ তার আবার কি সমস্যা হতে যাবে! সাদিক সামনে দৃষ্টি রেখে বলল,
–তুমি নিজেকে এক্সপ্রেস করতে পারো না। না কখনও অভিযোগ করো আর না কখনো প্রতিবাদই করো। এসব কেনো করো না জানো?

অহনা জানতে কোনো প্রশ্ন করলো না। এই কথা এখন কোন দিকে যাবে তা ভালোই বুঝতে পারছে সে। সাদিক নিজ থেকেই বলল,
–কারন তুমি ভিক্টিম কার্ড প্লে করতে পছন্দ করো। নিজেই নিজের মতো কথা বানিয়ে নাও৷ সামনের মানুষটাকে ভাবার সুযোগই দাও না। সবসময় ভাবো, আমার সাথে এটা হবারই ছিলো। অথবা, আমি যদি কিছু বলি তাহলে কি হবে! বলে তো দেখো কি হয়?

অহনা চোখ সরিয়ে আস্তে করে বলল,
–আমি পারি না।

সাদিক রেগে ধমকে উঠলো,
–তুমি পারোনা না, তুমি চেষ্টাই করো না। নিজেই নিজের মতো কথা বানিয়ে নাও। ইউ আর আ সাইকো। সাইকোলজিক্যাল ডিসওর্ডার আছে তোমার। ডক্টর দেখানো উচিৎ। ট্রিটমেন্টের খুব জরুরি।

সাদিক বেশ উত্তেজিত হয়ে পরলো। অহনা কি বলবে ভেবে পেলো না। বলার মতো ভরসা তো কোনোদিন পায়ই-নি। তাহলে বলবে কিভাবে! যাদের এতোদিন হলো জানে, চেনে, বিশ্বাস করে তাদেরকে বিশ্বাস না করে, তাদের দেওয়া প্রমাণে বিশ্বাস না করে কি তাকে বিশ্বাস করতো!
প্রসঙ্গ পাল্টালো সে। মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করা প্রশ্নটা করতে বলল,
–সেদিন আপনার বিয়ে ছিলো না সেটা বলেননি কেন?

–বলে কি লাভ হতো?

অহনা ব্যথিত স্বরে বলল,
–সাদিক লেখা দেখে ভেবেছিলাম আপনার বিয়ে।

সাদিক মৃদু হেসে বলল,
–পৃথিবীতে কি আমার একার নামই সাদিক? মৌলি জেদ ধরেছিলো, সাদিক ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। ও মানুষ চায়নি, নাম চেয়েছে। তাই ওকে সাদিক নামটা এনে দিয়েছি।

দুপুরেও একই কথা বলেছিলো সাদিক। অহনা নীরব রইলো। সাদিক তর্জনি দিয়ে অহনার থুতনি ধরে মুখ তুলে বলল,
–মনের কথা মুখে না আনলে এমন কষ্টই পেতে হয়, সাইকো ওম্যান। মা হয়েছো, এখন ওম্যানই হতে হবে।

অহনার মনে পরলো, এর আগে অনেকবার এটা নিয়ে কথা শুনিয়েছিল সাদিক৷ কেনো নিজের মতো কথা ভেবে নেয়? কেনো কিছু প্রকাশ করে না? সরাসরি তো সাইকো গার্ল উপাধি দিয়ে দিয়েছিলো।
সাদিক অহনাকে ছেড়ে সামনে তাকিয়ে নিস্প্রভ স্বরে বলল,
–অহনা, আর সময় ছিলো মাত্র দুইমাস। তোমার ভিসার প্রসেসিং চলছিলো৷ এই দুইমাস কি অপেক্ষা করতে পারতে না?

অহনা মাথা নিচু করে ফেললো। কিভাবে বলবে, পরিস্থিতি ওকে সময় দেয়নি। সাদিক ওর নিরবতায় রেগে গেলো। ধমকে উঠে বলল,
–কিছু বলছো না কেন? কথা বলতে পারো না?

সাদিকের গর্জনে অহনা কেপে উঠলো। ঠোঁট নাড়িয়ে আস্তে করে বলল,
–কি বলবো?

–তুমি তো কিছুই বলো না। কেনো বলো না? কোথায় খুঁজিনি তোমাকে? পাহাড়, সমুদ্র, বস্তি, গ্রাম, কোথায় না খুঁজেছি! আর তুমি এসে পরে আছো এই মোহাম্মদপুরে! রিডিকিউলাস মোহাম্মাদপুরে! আমার কি জানার কথা ছিল তুমি এখানে এসে বসে আছো? আমি কিভাবে এক মাস ছুটি নিয়েছিলাম তা কেবল আমিই জানি। প্রতিবার তুমি কেনো ভেবে নাও আমি মৌলিকে বিয়ে করবো? ও আমার পাস্ট। যেদিন থেকে তোমাকে মেনে নিয়েছি সেদিক থেকে মৌলির চিন্তা বাদ দিয়েছি। কোন জাহান্নামের মধ্যে ছিলাম আমি, একবারও জানতে চেয়েছো? নাহ! নিজের মতো ভেবে নিয়েছো সবকিছু। চুপ করে আছো কেনো?

সব কথার পর এমন ধমকে না উঠলেই কি হয় না! অহনা ভয় পেয়ে চুপ রইলো। সাদিক অহনার হাত শক্ত হাতে চেপে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–তোমার নামে কি কি এসেছিলো আমার কাছে তা কল্পনাও করতে পারবে না। সব কিছুর পরেও আমি তোমার সাথে সরাসরি কথা বলতে চেয়েছি। কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনি, অহনা পালিয়েছে। হিউজ টাকা চুরি করে পালিয়েছে। অসাম!

সাদিকের স্বরে রাগ ছিলো, ব্যাথা ছিলো, আফসোস ছিলো। অহনা নিজেও ব্যথিত হলো। আমি পালাইনি! আমাকে পরিকল্পিত ভাবে বের করে দিয়েছিলো। আপনার জীবনে থাকতে দেয়নি। এগুলো তো অহনা বলতে পারতো৷ কিন্তু বরাবরের মতোই মুখে তালা লাগিয়ে রাখল।

–ছয় বছর কতটা লম্বা সময় জানো তুমি? কতটা ব্যস্ত দিনের আড়ালে চিন্তিত, ঘুম না হওয়া রাত আছে, জানো সেসব? দিনের কত ঘন্টা তোমাকে খুঁজতে ব্যয় করেছি, জানো? তোমাকে খুঁজতে কত টাকা নষ্ট করেছি, ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া! সব টাকা ফেরত দেবে। আমার অতো টাকাও হয়নি যে, এতোগুলো টাকা পানিতে ভাসিয়ে দেবো।

অহনার অনেক কিছু বলার ছিলো। সেসব না বলে ফট করে বলে বসলো,
–কত টাকা?

সাদিক আগুনের স্ফূলিঙ্গের মতো ধপ করে উঠলো। অহনার ঘাড় ধরে নিজের মুখোমুখি এনে বলল,
–টাকার গরম দেখাচ্ছো? ছয় বছরের সব সময় ফেরত দিতে পারবে? অশান্তি, অপমান, ডিপ্রেশন সব ফেরত নিতে পারবে?

চোখে চোখ রাখার মতো সাহস অহনার কোনকালেই ছিলো না। চট করে চোখ সরিয়ে ফেললো। সাদিক তাচ্ছিল্যের হেসে দূরে সরে বলল,
–ছয় বছর পর ফিরে এসে কি বললে, স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া নাকি দ্বিতীয় বিয়ে করা যায় না। স্বামী থাকতে পরকিয়া করা যায়, না? প্রমান দিতে পারবে, যেগুলো আমার কাছে এসেছে তার সব মিথ্যা?

কোনো প্রমান তার কাছে নেই। মুখের কথা কে কবে বিশ্বাস করেছে। এই বিষয়ে কিছুই বলতে চাইলো না সে। উঠে যেতে চাইলে সাদিক শক্ত হাতে হাত চেপে মুখোমুখি বসিয়ে রাগী গলায় বলল,
–তুমি আসলে দিতে চাওই না। যার যা ভাবার ভাবুক। তুমি নিজের মতো ভাবলেই হলো! কথায় যে অনেক কিছুর সমাধান হয় তা আর কবে শিখবে?

অহনা ঢোক গিলল। ওর কিছুই বলার নেই। সত্যিই কিছু বলার নেই। যেখানে বলে কোন লাভ নেই সেখানে বলবেই বা কেন! জীবনে শুধু নিজের বাবাকে মনের কথা বলেছে। বাবা শুনে সমাধান দিয়েছে না হলে মনোযোগ দিয়ে শুনে বিশ্বাস করেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মামা বাড়ির বাজে ব্যবহার মায়ের কাছে বলতে নিয়ে অনেক মার খেয়েছিলো সে। এরপর যে মুখে তালা লেগেছে, আজ অব্দি সেই তালা খোলেনি। অন্তত এইটুকু তো বুঝেছে, যেখানে তার মূল্য নেই সেখানে কথা বলা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। সেই ঘটনার পর যদি ও প্রতিবাদ করতো তাহলে জল আরো ঘোলা হতো। না জানি আর কি কি অভিযোগ আনতো। সেগুলো ভুল প্রমান করার কোন পদ্ধতি তো ওর জানা ছিলো না। মোবাইল তার ছিলো, নাম্বারটাও তারই ছিলো। এখন সেখানে কে কি করছে তা তো কেউ জানতে চাইবে না। অহনার নীরবতা দেখে প্রচন্ড রাগলো সাদিক৷ হাত ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
–আমার ছেলেকে নিয়ে আমি চলে যাবো। তারপর তুমি তোমার ভাবনা চিন্তা নিয়ে থেকো।

অহনা পিলারের গায়ে স্বশব্দে বাড়ি খেলো। বারান্দার সিঁড়ির ওখানেই বসে ছিলো তারা। ওর আর্তনাদের শব্দে সাদিক বিচলিত হতে জড়িয়ে ধরলো অহনাকে। কাঁধে হাত বুলিয়ে ধীর গলায় বলল,
–সত্যিটা বলো অহনা?

আবার সেই একই কথা! অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ছাড়িয়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো। সাদিক রেগে গেলো আবার,
–বলবে না তাইলে?

অহনা মাথা নিচু করে ফেললো। সত্যিই বলতে চায় না। সাদিক নিজের এক হাত দিয়ে অহনার এক হাত চেপে আরেক হাত দিয়ে ওর থুতনি চেপে হিসহিসিয়ে বলল,
–মাথা নিচু করছো কেন? কি বোঝাতে চাচ্ছো? তুমি অন্যায় করেছো? আমার কাছে সে ছবি ভিডিও স্ক্রিনশট এসেছে তার সবটাই সত্যি?

অহনা তবুও চুপ রইলো। ওর জেদ দেখে যা বোঝার বুঝলো সাদিক। চোয়াল ছেড়ে দিয়ে বলল,
–এভাবে বলবে না। সাইকো গার্ল তো তুমি। ভুলেই গেছিলাম।

বলেই হাত ধরে টানতে টানতে ঘুমন্ত মাহাদীর কাছে নিয়ে গেলো। ওর গায়ের উপর অহনার হাত রেখে বলল,
–ওর গায়ে হাত রেখে সত্যিটা বলো?

আঁতকে উঠলো অহনা। সাদিক ভীষণ সিরিয়াস। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন কাজ হলো না তখন মোক্ষম চাল দিয়েছে। অহনা অসহায় চোখে অসুস্থ ছেলের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো সবটাই বলবে। এর ফল যাই হোক, ও বলবেই। কাঁপা গলায় বলল,
–তাহলে কথা দেন, আমার কথা অবিশ্বাস করলেও বাকি এই আড়াইমাস আপনি আমার ছেলেকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না?

অহনার ভয় এই এক জায়গাতেই। সব জানার পর যদি বিশ্বাস না করে ওকে সাহায্য করতে না চায় তাহলে ওর ছেলের কি হবে! তিন মাসের মধ্যে তো দুই সপ্তাহও হয়নি। এখনও বাকি অনেকদিন! সাদিক অহনার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভরসা দিয়ে বলল,
–কথা দিলাম, কোনোদিন ছেড়ে যাবো না।

অহনা ভরসা পেলো নাকি জানা গেলো না। শুধু বলে গেলো নির্লিপ্তভাবে। এমন অনূভুতিহীন ছিলো যে মনে হলো, এটা নিয়ে ওর কোনো চিন্তাই নেই। আসলেই নেই। মাহাদীর জন্মের পর ওর অতীত নিয়ে আর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কে ওকে কি ভাবলো সেটা ওর কাছে ফিঁকে হয়ে এসেছে। এগুলো ওর সাথে ঘটা নিছক কোন ঘটনা ছাড়া আর এর আর কোনো মূল্য নেই। সাদিক সব শুনে অহনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। মনে হলো, হয়তো এক্ষুনি আবার কোনো ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে অহনাকে হাড়িয়ে ফেলবে। যাদের নিজের ভাইবোন ছাড়া কোনোদিন কিছু ভাবেনি তারা ওর এতো বড় সর্বনাশ করে ফেলবে তা কল্পনাতেও আসেনি। ওদের হয়তো শাস্তি দেওয়া উচিত তার। কিন্তু সাদিক সিদ্ধান্ত নিলো সে কিছুই করবে না। সৃষ্টিকর্তার ন্যায় বিচারের উপর ওর সম্পূর্ণ আস্থা আছে। তাই তার হাতেই সব ছেড়ে দিলো।

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-১১

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ১১

অহনা সাদিকের একসাথে সংসার করার বয়স দুই বছর ছিলো। যদিও সেটাকে সংসার না বলে একপাক্ষিক সমঝোতা বললেই বেশি ভালো হয়। সেই এক পাক্ষিক সমঝোতা ছিলো সাদিকের দিক থেকে৷ অহনার দিক থেকে সারাক্ষণ নির্লিপ্ততা আর নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। এই নির্লিপ্ততার কারন অনুসন্ধান করলে এক বিরাট কারন খুঁজে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় সাদিকের কাজিনদের এক বিরাট ভুমিকা।
শুরু শুরুতে সাদিক নিজেকে অহনার সাথে মানিয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে। ভালোবাসা হারিয়ে নতুন করে ভালোবাসতে চেয়েছে। পেরেছেও অনেকটা। অহনাও চেয়েছে, পেরেছেও পুরোপুরি কিন্তু নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি। সাদিকের অহনার দিকে এমন ঝুঁকে যাওয়াটা সাদিকের কাজিনরা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। বাইরের একটা মানুষ তাদের কাজিনকে কাঁদিয়ে তার ভালোবাসা জোর করে কেঁড়ে নেবে, সেটা তেজি মহলের কারোরই সহ্য হয়নি। তাই প্রায় সকলেই অহনাকে খারাপ প্রমান করতে উঠে পরে লেগেছিলো। ফরিদাকে কিছুতেই অহনার দিকে ঝুঁকতে দিতে চায়নি। যতবার ফরিদার মন নরম হয়েছে, ততবার কেউ না কেউ এসেছে কান ভাঙানি দিতে। সাদিক চলে যেতেই প্রায়ই কেউ না কেউ এসে সেখানে থেকেছে। একদিকে ফরিদার মনে বিষ ঢুকিয়েছে আর অন্যদিকে অহনাকে নিচু করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে৷ ততদিনে তারা জেনেছে, অহনাকে মে’রে কুচিকুচি করে ফেললেও টু শব্দটাও করবে না। বিশাল এই দুর্বলতাটা অনেক কাজে লেগেছিলো তাদের। সাদিকের যোগ্য না, জোড় করে এসে ঢুকেছে, সাদিক একমাত্র মৌলিকেই ভালোবাসে, তাকে কাজের লোক ভাবে, সে শুধু সাদিকের টাকা চাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি কথা অহনাকে বুঝানোই ছিলো ওদের একমাত্র কাজ৷

এতো কিছুর পরে যখন সাদিক ছুটিতে বাড়ি ফিরতো তখন মা আর স্ত্রীর মনোভাব বুঝে মাথা খারাপ হয়ে যেতো তার৷ একদিকে যেমন মা অহনাকে দেখতে পারতো না, অন্যদিকে অহনা নিজেকে কাজের মেয়ে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারতো না। এমনও হয়েছে, সাদিক রাতে ঘুম থেকে উঠে অহনাকে খুঁজতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখেছে, অহনা রাতের খাবার রান্নাঘরে বসে খাচ্ছে। তাও শুকনো ভাত আর বাসি ডাল। সাদিক রেগে যেতো খুব। মায়ের সাথে এ বিষয়ে কথা বললে মা আরো বিগড়ে যেতো। একসময় সাদিক আরো আবিষ্কার করলো, একমাত্র সে আসলেই অহনা তার ঘরে আসে। নাহলে ওর অবস্থান হয় সেই পুরোনো স্টোররুমে। অহনার এই দূরত্ব আর বারবার প্রশ্ন করাতেও কিছু না বলায় সাদিক কখনো রেগে যেতো আবার কখনো বুঝাতো। এরপর কিছুদিন সব ঠিক থাকলেও কদিন পর আবার সে কে সেই! অহনাকে কলেজে ভর্তিও করে দিয়েছিলো সাদিক। প্রথমে খুব খুশি থাকলেও কিছুদিন পর আর পড়তে চায়নি। তাকে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি। মোটামুটি এভাবেই সাদিকের সংসারজীবন চলছিলো।

কোনভাবেই আর কোনো উপায় না পেয়ে বিশ্বাস করে কাজিনদের সাথে শেয়ার করেছিলো সে। তারা বিশ্বাস লুফে নিয়ে আরো বেশি যাতায়াত শুরু করল। এর ফলে একটা জিনিস হলো। সাদিকের সামনে সব কিছু খুব সতর্কতার সাথে এড়িয়ে গেলো। সামনা-সামনি কিছু না হলেও সাদিকের আড়ালে চললো এই জঘন্য খেলা। যার গুটি হয়েছিলো অহনা, ফরিদা আর সাদিক। সেইসময় নিজের পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলো সে। সংসারের এসব কূটকাচারি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়টাও ছিলো না। বিশ্বাস মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়। সাদিকের বিশ্বাস ছিলো তার প্রিয় ভাই বোনদের উপর, ফরিদার বিশ্বাস ছিলো ভাতিজা ভাতিজির উপর, অহনার বিশ্বাস ছিলো নিজের ভাবনার উপর আর সাদিকের কাজিনদের বিশ্বাস ছিলো নিজেদের বুদ্ধির উপর। সাদিকের কাজিনরা চেয়েছিলো, অহনাকে সরিয়ে মৌলি আর সাদিকের মিল করাতে। এই করতে চেয়ে এতোগুলো জীবন এলোমেলো করে ফেলেছিলো!

দেশে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলো সাদিক। সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশে স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে যাওয়ার সুযোগ হাত ছাড়া করেনি। তার উপর দেশের এমবিএ-র ডিগ্রি ওখানে চাকরি পেতেও খুব সাহায্য করেছে। মোটামুটি চাকরি আর স্কলারশিপ একসাথে পেয়ে আর সময় ব্যয় করেনি সে। যাওয়ার মাস তিনেক আগে অনেক দৌঁড়ঝাপ করে অহনার পাসপোর্টও বানিয়েছিলো। স্পাউস ভিসায় নেবে অহনাকে। ঘটনা শুনে সকলে রাগে ফেঁটে পরলো। কারন ফরিদার কান ভাঙাতে সাদিকের কাজিনদের সাথে সাথে তার আত্মীয়স্বজনরাও বিরাট ভুমিকা রেখেছিলো। তাদের কারোরই অহনাকে পছন্দ ছিলো না। তবে সব থেকে বেশি ক্ষেপছিলো সাদিকের সেই কাজিনরা। সাদিকের যাওয়ার দিনই সায়রা এসে থাকতে শুরু করলো। এরপর একপ্রকার ক্ষমতা খাঁটিয়ে অহনার ফোন নিজের কব্জায় রেখে দিলো। শুধু সাদিক কল দিলেই ফোনটা অহনাকে দিতো৷ এরপর দুই চার মিনিট কথা বলার পর আবার ফোন হস্তান্তর হয়ে যেতো৷ সবাই মিলে অহনাকে এতো পরিমাণে ভাঙুর করে ফেলেছিল যে কোনদিন প্রতিবাদ করার কথা কিংবা কারো সাথে শেয়ার করার কথা মাথাতেও আসেনি। সবসময় মনে হতো, তাকে দয়া করে যে থাকতে দিয়েছে এইতো অনেক।
অহনার ভিসার প্রসেসিং শেষেরদিকে ছিলো। ঠিক তক্ষুনি শেষ পেরেক ঠোকা হয়। সবাই মিলে হাজির হয় সাদিকের বাসায়। অভিযোগ তোলে অহনার চরিত্র নিয়ে। প্রমান করে, সে পরকিয়া করে বেড়ায়। মোবাইলে অনেক ছেলেদের সাথে রিলেশন করে বেড়ায়, আজেবাজে কথাবার্তা বলে। এর প্রমাণ তো মোবাইলেই আছে। অহনা তো মোবাইলের তেমন কিছুই জানে না। তাই এসব দেখে, শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো। ফরিদা কোমড় ব্যাথায় নিজের ঘর থেকে বেরই হয় না। তাই বাইরের খবর তার জানার কথা নয়৷ আর ভাতিজা ভাতিজির বদলে বাইরের কাউকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না। তার উপর সেই মেয়েটা তার মনে এক বিষাক্ত অবস্থানে আছে।

এসব সামনে আসার পর অহনার মাথা ঘুরে উঠলো। বিশ্বাসের আড়ালে থাকা সকলের মুখোশ খুলে গেলো এক লহমাঅ। অবশ্য খুলে গেলেই বা কি লাভ! কি-ই বা করতে পারবে সে! ফরিদা চূড়ান্ত ক্ষেপে গেলো। কাউকে কিছু না জানিয়ে ওখানে, ওই অবস্থাতেই বাড়ি থেকে বের করে দিলো অহনাকে। তবে তার আগে সায়রা অহনার হাতের আংটিটা খুলে নিতে ভোলেনি। ওটার উপর অনেকদিনের নজর তার।
অহনার মাথা পুরো আকাশ ভেঙে পড়ল। কান্নাকাটি করে, অনুরোধ করে, জোর গলায় সত্যিটা বলেও লাভ হলো না। সময়ের কাজ সময়ে না করলে লাভ হবে কিভাবে! বের করার ঠিক আগ মূহুর্তে সায়রা বেশ তাচ্ছিল্য নিয়ে বলেছিলো,
–পুলিশের কাছে গিয়ে লাভ কিন্তু হবে না। সব প্রমাণ তোমার বিরুদ্ধে। সুতরাং, পুলিশে গিয়ে ফেঁসে যাওয়ার থেকে নিজের বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরো।

অহনা স্তব্ধ হয়ে গেলো। এতো চালাক আর এতো প্যাঁচালো মানুষদের সাথে ওর পেরে ওঠার কথা না। এসবে মিরাজের সামান্য দয়া হলো অহনার উপর। নিজ দ্বায়িত্বে ওকে মামার বাড়ি দিয়ে গেলো। আর এবাড়ির সকলে জানলো, অহনা পালিয়েছে। সাদিক বিশ্বাস করেনি। ওমন চুপচাপ আর ভদ্র মেয়ে এমন করতেই পারে না। ওকে বিশ্বাস করাতে মোবাইলের মেসেজের স্ক্রিনরেকর্ড পাঠানো হলো। তাতেও বিশ্বাস করলো না সাদিক। যে মেয়েটাকে ফোনের সামান্য ফাংশনও দুইদিন আগে নিজে শিখিয়েছে সে এতো তাড়াতাড়ি এতো কিছু কিভাবে করতে পারবে!
অহনা বাড়িতে গিয়ে সেই বেদনাদায়ক ঘটনাটা জানলো। তার ভাই আর নেই। একসাথে এতোগুলো ব্যথা নিয়ে বেঁচে থাকা দুরহ হয়ে উঠলো ওর কাছে৷ আ’ত্মহ’ত্যা করার মতো সাহসী সে না। অন্যদিকে সাদিকের সাথে ভয়ে যোগাযোগ করছে না। অন্তত এই একটা মানুষের থেকে এসব শোনার সাহস তার নেই। অবশ্য যোগাযোগের কোন উপায়ও ছিলো না। আর তাছাড়া ভাই বোনদের বিশ্বাস না করে নিশ্চয় তাকে বিশ্বাস করবে না!
মামা বাড়িতে তার জায়গা হয়নি। ওর আশ্রয় মা বাতলে দিলো। নিজের কাছে রাখার ক্ষমতা তার নেই। তাই আশ্রয় হিসেবে বলল, তাদের আগের বাড়ির কথা। অহনার বাবা বেঁচে থাকতে মোহাম্মদপুর থাকতো তারা। একই এলাকায় এক বৃদ্ধা ছিলেন। কেক দাদী নাম দিয়েছিলো সব বাচ্চারা। ওনার কেকের বিজনেস ছিলো। অহনা তার কাছে কেক বানানো শিখেছিলো। অনেক আশা নিয়ে সেখানেই গেলো। দাদী তাকে অনেক ভালোবেসে দুই হাতে আগলে ধরলো। সেখানে থাকলেও সে ছিলো প্রাণহীন এক জীবের মতো। যার বাঁচার আর কোন কারন নেই! জীবন চালনার সব আশা যখন শেষ তখন আশার টিমটিমে জ্বলা আলো পূর্ণরূপে জ্বলে উঠলো সুখবর নিয়ে। অহনা মা হতে চলছে। নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য এক বুক আশা নিয়ে শেষবারের মতো শ্বশুরবাড়ির দরজায় আসলো। সেখানে আবারও খুব জঘন্যভাবে বিতারিত হলো। ফরিদা পাঁচশো টাকার চারটা নোট হাতে গুজে দিলো বাচ্চাকে মে’রে ফেলার জন্য। বাচ্চাটা যদি সাদিকেরও হয় তবুও এই নষ্টা মেয়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া কাউকে তার ছেলের সন্তান হিসেবে মেনে নেওয়া অসম্ভব ও চূড়ান্ত অসম্মানের। সব হারিয়ে গর্ভের সন্তান নিয়ে আবার দাদীর কাছে ফিরলো সে। শুরু করলো নতুন জীবন।
যাওয়ার সাথে সাথে সাদিকের আসা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই ইউনিভার্সিটির প্রথম সেমিস্টার শেষ হতেই অনেক কষ্টে এক মাসের ছুটিতে দেশে ফিরেছিলো। এরপর শুরু করেছিলো নিজের উদ্বোগে অহনাকে খুঁজে সত্যিটা জানা। পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করলো। ছেলের অবস্থা দেখে অসুস্থ হয়ে পড়লো ফরিদা। বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে বলল,
–তোর বউ পালিয়েছে৷ অন্য কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো। বিশ্বাস করছিস না কেন?

সাদিক মূহুর্তকাল চুপ থাকলো। অসুস্থ মায়ের বারংবার করা অনুরোধ ফেলতে পারলো না। মধ্যবিত্ত মানুষের নিজের আগে পরিবারের কথা চিন্তা করতে হয়। বিরহে থাকাটা তাদের মানায় না। বাবা মায়ের আশা ভরসায় আর আঘাত না করে বলল,
–অহনা কোথায় তা আমি জানি না মা৷ অনেক খুঁজেছি ওকে। ওর যাওয়ার কোন জায়গা নেই। তাও খুঁজেছি। আমি জানি মা তুমি অহনাকে পছন্দ করো না। তাই সব অভিযোগ বিশ্বাস করেছো। প্রমানগুলো এমন যে অবিশ্বাসের জায়গাও রাখে না। তাও আমি অহনার থেকে সত্যিটা জানতে চাই। ওর পয়েন্ট অফ ভিউ আমার জানা প্রয়োজন। এতো অপমান মেনেও যেখানে চুপ করে থেকেছে, সেখানে যখন এসব থেকে বের হওয়ার সময় আসলো তখন এসব হয়ে গেলো! মানা যায় না এগুলো। তবে তোমাকে কথা দিচ্ছি মা, যদি আর কখনও অহনা আমার কাছে আসে তাহলে ফিরিয়ে দেবো না। যখন, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, ওর সব কথা শুনবোই।

সাদিক অসুস্থ মায়ের হাত ধরে কথা দিলো ফিরে গেলো নিজের কাজে।

***
মাহাদীর ডক্টরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দুপুর দুইটায় আর সাদিক স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়েছে সকাল এগারোটায়। হাত ধরে ঘুরে ফিরে লাঞ্চ করতে গেলো হসপিটালের কাছেই এক রেস্টুরেন্টে। ওখানেই দেখা হলো মৌলির সাথে৷ তাও শুধুমাত্র অহনার সাথেই দেখা হলো। সাদিক ওদের টেবিলে বসিয়ে কী একটা কাজে বাইরে গেছে৷ মৌলি অহনাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসলো। তার সাথে একজন পুরুষ ছিলো। কাছাকাছি এসে সাথের মানুষটির সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিলো,
–আমার হাজবেন্ড। সাদিকুর রহমান সাদিক।

মৌলি কি জন্য পরিচয় করিয়ে দিলো তা জানে না অহনা। ওতো বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। সাদিক সাহেব মৃদু হেসে বলল,
–আপনাকে চিনি৷ আপনি তো অহনা। মৌলির কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি।

নেহায়েতই ফরমালিটি নাকি বোঝা গেলো না। না হলে মৌলি কারো কাছে নিশ্চয় ওর গল্প করবে না। অবশ্য করতেও পারে। তবে সেটা অবশ্যই অসম্মানজনকই হবে। মৌলি মাহাদীকে দেখে মৃদু হেসে বলল,
–এই পিচ্চি কি তোমার?

অহনা নীরবে মাথা নাড়লো। বলতে মন চাইলো,
–হ্যাঁ, আপনাদের ভাষ্যমতে আমার অবৈধ সন্তান।

কিন্তু বলল আর কই! সাদিক ওদের দেখে দ্রুত আসলো। খানিক খোশগল্পও চললো ওদের মাঝে। তারপর বিদায় নিতেই অহনা কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বলল,
–মৌলি আপুর বিয়ে হয়েছে?

সাদিক তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,
— কেনো? বিয়ে কি হওয়ার কথা ছিলো না?

অহনা মাথা নেড়ে বলল,
–ওইদিন আপনাদের এনগেজমেন্ট হলো না? তাহলে এখন অন্য কাউকে বিয়ে করলো কেনো?

সাদিক হো হো করে হেসে উঠলো। অহনা মজার কোনো কৌতুক বলেছে এমন করে হাসতে হাসতে বলল,
–এটা মৌলির পড়ানো আংটি ভেবেছিলে তাই না? জানতাম আমি। এইজন্যই ভুল ভাঙাইনি। এতো বছরে আংটির ডিজাইন কাহিনী তো ভুলেই গেছো।

বলেই আংটি খুলে আংটির পেছন দিকটা দেখালো সাদিক। স্পষ্ট অক্ষরে বাংলায় অহনা লেখা। এরপর পকেট থেকে অহনার আংটি বের করে সেটাও দেখালো। সেখানেও স্পষ্ট অক্ষরে সাদিক লেখা। সাদিক হাসি থামিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,
–আমি তোমাকে কখনো কাছ ছাড়া করিনি অহনা। অথচ তুমি এটা ফেলে রেখে চলে গেছিলে। অবশ্য, নিয়ে যাওয়াও তো পসিবল ছিলো না। তোমার ততকালীন বয়ফেন্ড জেলাসি ফিল করতো।

আংটি ফেলে রেখে যায়নি সে। হাত থেকে খুলে নিয়েছিলো। কত কথাই তো জমে আছে তার মনে। সেসব কি প্রকাশ করতে পারবে! সব কথা কি প্রকাশ করা যায়! মাহাদী আলোচনায় দারুন বিরক্ত হচ্ছিলো। দুর্বল শরীরে আবার জ্বর এসেছে। মায়ের কোলে শুয়ে বিরক্তিতে কাচুমাচু করে আবার ঘুমিয়ে পরলো। সাদিক আলগোছে অহনার হাত নিজের হাতে নিয়ে দ্বিতীয়বারে মতো আংটি পরিয়ে দিলো। অহনা হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
–তাহলে বাইরে সাদিক আর মৌলির বিয়ে লেখা ছিলো কেন?

সাদিক কাঁধ নাচিয়ে বলল,
–ও নিজের কাছে প্রমিস করেছিলো, সাদিককেই বিয়ে করবে৷ তাই ওর জন্য সাদিক খুঁজে বের করা হয়েছে।

অহনা চাপা গলায় বলল,
–তাহলে আপনাদের বাড়িতে অনুষ্ঠান হচ্ছিলো কেন?

অহনার প্রশ্নে সাদিক কপাল কুঁচকে বলল,
–এমন কৌতুহল আসল জায়গায় খাটানো যায় না? ওই জায়গাতে যে ফুপুরও ভাগ ছিলো সেটা কি ভুলে গেছো? এখন একটা ফ্ল্যাটে আমরা থাকি আর একটা ফ্ল্যাটে ফুপুরা থাকে।

অহনা চিন্তিত মুখে মাথা নাড়লো। পুরোটা বুঝলেও মাথায় ঢুকতে একটু সময় লাগলো। সাদিক অহনার কপালে টোকা দিয়ে বলল,
–একা একাই চিন্তা ভাবনা করে নিলে এমনই হয়। ছয় বছর আগেও যে কাজ করেছো, ছয় বছর পরও সেই একই কাজটাই করলে। কথা বললে যে অনেক কিছুর সমাধান হয় তা আর কবে বুঝবে? গর্দভ একটা!

বলেই খাবারের কথা বলতে উঠে গেলো৷ অহনা কপালের টোকা দেওয়া জায়গায় হাত ঘষে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে কিই বা বলতো আর! বলার মতো উপায় কি রেখেছিলো কেউ!

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-১০

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ১০

বিয়ের বেশ কিছু মাস পর সাদিকের দাদাবাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য হলো অহনার। গেলো, ফরিদা, খলিল সাহেব আর অহনা। সাদিকের যাওয়ার কথা দুইদিন পর। সবাই যাওয়ার একটাই কারণ, সাদিকের দাদী অসুস্থ। এই সময় নাতবৌকে দেখতে চেয়েছেন। নাহলে ফরিদা কখনোই অহনাকে নিয়ে যেতো না। অহনা এতোকিছু জানতো না। ওর ধারণা মতে সব এখন ঠিক। বিরাট এই ভুল ধারণা ভাঙলো গ্রামে পৌঁছানোর পর। সবাই বিরক্ত আর ব্যাজার মুখে গ্রহন করলো ওকে। বিশেষ করে সাদিকের কাজিনরা। ওকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে চলে গেলো। বেশ মন খারাপ হলো তার। চুপচাপ থাকার কারনে ওর নিজের কাজিনদের সাথেও তেমন ভালো সম্পর্ক না। সবাই আড্ডা দিলে ওকে সেখানে কখনও নিতেই চাইতো না। বলতো, অহনা গেলেই পরিবেশ ভারী হয়ে যায়। আবার ঘুরতেও নিয়ে যেতো না। নিজে কখনও এমন প্রাণখোলা হাসি হাসে না জন্য আড্ডার মাঝে সবার প্রাণখোলা হাসি দেখতে তার দারুন লাগে। সবাই কত মিল দিয়েই না থাকে!
এ বাড়ির সকলে ঠিক তেমনই প্রাণোচ্ছল, দূরন্ত। অহনা দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখে তাদের। সিদ্দিকার কথায় দুই তিনবার ওদের সাথে গিয়ে বসে ছিলো। আগ্রহ ছিলো মিশে যাওয়ার। কেউ এগিয়ে আসলে হয়তো চেষ্টা করতে পারতো কিন্তু ওরা কেউ ওকে সহ্যই করতে পারে না। অহনা ওদের সাথে বসতেই তাদের আলোচনায় ভাটা পরে। সবাই অস্বস্তি নিয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সব বুঝতে পারে অহনা। উঠে চলে যায় বড়দের কাছে আর নাহলে রান্নাবান্নায় সাহায্য করে।
ইয়াং জেনারেশনের সকলে ঘুরতে যাবে। বেশ ঘটা করে প্ল্যান করা হলো। ওদের যাওয়ার আসল কারনটা অহনা জেনেছে। মৌলির মন ভালো করতে যাবে সকলে। কারো মন খারাপের জন্য এতো মানুষ উদ্ধিগ্ন হয়ে যায় সেটা জানা ছিলো না তার। তাই যখন সিদ্দিকা ওদের সাথে যেতে বলল তখন বেশ আগ্রহ নিয়েই রাজী হলো। ইচ্ছা ছিলো, দেখার যে কিভাবে মন ভালো করে। তার সাথে যে এমন হবে না সেটা ও জানে। তাই দেখতে চাইলো মন দিয়ে৷ এই আগ্রহ যে চুপচাপ থাকা অহনার জন্য এক বিরাট শিক্ষা যে হয়ে যাবে তা তার কল্পনাতেও আসেনি।

অহনা সাথে যাওয়ায় সবাই মুখ ভাড় করে গেলো। বড়দের জন্য না চাইতেও যেতেই হলো। তবে ডেস্টিনেশন বদলালো। সিদ্ধান্ত হলো, এমনিতেই গাড়িতে ঘুরবে আর টি-স্টলে সবাই মিলে চা খাবে। একসময় অহনার বাবা খুব চা খেতেন। তার সাথে অহনাও খেতো। বাবা চলে যাওয়ায় এই শখটা বাদ দিতে হয়েছে। আজ চা খাওয়ার কথা শুনে মনে মনে খুব খুশি হলো। ইচ্ছে তো হচ্ছিলো দুই কাপ চা খাওয়ার। কিন্তু এদের সামনে বলতে লজ্জা করবে জন্য সিদ্ধান্ত নিলো, এক কাপই খাবে।
বড় গাড়িতে উঠে সবাই হইহই করতে করতে পুরো রাস্তা গেলো। অহনা নামক প্রাণীকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করাই ছিলো ওদের প্রধান উদ্দেশ্য। রাত হয়ে যাওয়ায় গাড়ি থামালো শুনশান এক চায়ের দোকানের সামনে। এক মহিলার দোকান সেটা। পাশেই এক বড় ছাউনি আছে। ওখানে বসেই চায়ের অর্ডার দেওয়া হলো। এদের মধ্যে সবার বড় নিধি। সবার মধ্যে একমাত্র নিধিই ছিলো নিষ্ক্রিয়। অহনার প্রতি না ভালো লাগা আছে আর না বিদ্বেষ আছে। সবার পছন্দের চা যখন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিলো তখন অহনাকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করে বলল,
–অহনা, চা খাবে?

নিধি সাদিকের সমবয়সী হওয়ায় অহনাকে নাম ধরেই ডাকলো। অহনা দুধ চা খুব পছন্দ করে৷ অনেকক্ষণ নিজের মনে মনে প্র‍্যাকটিস করে দুধ চা বলতে চেয়েছিলো, তার আগেই মৌলি মুখ বেঁকিয়ে বলল,
–ছেলেদের মাথা খেতে বলো আপু, খুব সুন্দর করে খেয়ে ফেলবে।

সবাই উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। সবার কাছে এটা বিরাট মজা ছিলো। অহনার মুখ তেঁতো হয়ে গেলো। চা খাওয়ার ইচ্ছা চিরজীবনের মতো বাতিল হলো বলেই মনে হলো। খাবে না বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই সায়রা টিটকারি দিয়ে বলল,
–তোরা সবাই সাবধানে থাকিস। বলা যায় না, সাদিক ভাইয়ের থেকে মন উঠে গেলে তোদের পিছে লাগতে পারে।

ছেলেদের উদ্দেশ্য ছিলো কথাগুলো। এবারেও একে অপরের গায়ে পরে হেসে উঠলো সকলে। লজ্জায় অপমানে মাটিতে মিশে যেতে মন চাইলো অহনার। নিধি ধমক দিয়ে বলল,
–তোরা চুপ করবি?

চাপা স্বরে হেসে উঠলো সকলে। অহনা একটু দূরে গিয়ে বসলো। এই ঘটনার পর না চা খেতে চাইলো আর না কেউ একবার জিজ্ঞাসা করলো। সময় গড়িয়ে যেতেই মৌলি হঠাৎ কেশে উঠলো। শ্বাস আটকে আটকে আসতে লাগলো তার। সবাই বিচলিত হলো খুব। অহনা ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর অবাক হয়ে দেখলো, সবাই ওকে ফেলেই গাড়িতে উঠে গেলো। কাছে যাওয়ার সময়টুকুও পেলো না, তার আগেই গাড়ি চালিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলো। অহনা শূণ্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। হাতে না আছে মোবাইল আর না আছে টাকা। চা দোকানের মহিলাটিও অবাক হয়ে গেলো। কৌতুহলী হয়ে অহনাকে বলল,
–তুমি ওগোর সাথে আসো নাই?

অহনা ছলছল চোখে মাথা উপরনিচ করে বলল,
–এখন আমি যাবো কিভাবে?

মহিলাটিকেও বেশ চিন্তিত দেখালো। আকাশের অবস্থা ভালো না। ছোট সমাধান দিয়ে বলল,
–গাড়ি দাঁড় করামু? যাইবা?

অহনা বারংবার ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
–আমি ঠিকানা জানি না।

মহিলাটি আফসোসে মাথা নেড়ে বলল,
–আহারে জালিম লোক! তুমি এইখানে থাকো। কারুর না কারুর তো তোমার কথা মনে পড়বোই। তখন খুঁজতে আসবিনে।

অহনা নীরবে ছাউনির নিচে বসলো। আকাশের অবস্থা হঠাৎই বিগড়ে গেলো। শো শো বাতাসে ধূলা উড়তে লাগলো। মহিলাটি দোকান বন্ধ করে এসে বলল,
–আমার বাড়ি দুইপা হাঁটলেই। আমার সাথে বাড়িত চলো।

অহনা মাথা নেড়ে বলল,
–কেউ এসে যদি আমাকে না পায় তাহলে আবার ফেলে চলে যাবে।

অহনার মুখে অসহায়ত্বের ছাপ দেখা যাচ্ছে। মহিলাটি আফসোস করে বলল,
–ঝড় হইবো রে। আমি আর থাকবার পারমু না। ওইযে আমার ঘর দেখা যায়। সমস্যা হইলে চইলা আইসো।

অহনা ভয় পেলেও কারো কষ্টের কারণ হতে চাইলো না।।ঘাড় কাত করে সায় জানিয়ে যেতে দিলো।
মৌলির অসুস্থতার খবর বাড়ির সবার কাছে পৌঁছে গেছে। সাদিক এসে পড়ায় ওর কাছেও এসেছিলো। অহনা ওদের সাথে যাওয়ায় এমনিতেও আসতে চেয়েছিলো তাই এখন মৌলির খবর শোনায় আর দেরি করলো না। চলে গেলো হসপিটালে। মৌলির সামান্য শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো। ডক্টর মেডিসিন দিতেই ঠিক হয়ে গেলো। সাদিক আসলো ঝড় আসার ঠিক আগে আগে৷ এসে পরিস্থিতি দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। হসপিটালে সবাই আছে কিন্তু অহনাকে কোথাও পাওয়া গেলো না। কপাল কুঁচকে গেলো সাদিকের। ভারিক্কি স্বরে বলল,
–অহনা কোথায়?

কথায় রাগ স্পষ্ট। সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। গাড়িতে ওঠার সময় অহনার কথা ওদের কারো মনে ছিলো না। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে পরলেও ফিরতে মন চায়নি কারোরই। হসপিটালে এসেও সকলে আলোচনা করেছে, কিভাবে বাড়িতে ম্যানেজ করবে। এখন সাদিকের সামনে মুখে জড়তা এসে গেলো।। সজীব সাহস করে বলল,
–ভাই, মৌলির শরীর খুব খারাপ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো।

সাদিক চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠল,
–আমি বলছি অহনা কোথায়? ও তো তোদের সাথেই এসেছিলো। কোথায় রেখে এসেছিস?

রিকু ভয়ে আমতা-আমতা করে বলল,
–ভাই, ভাবী বোধহয় ওখানেই আছে। মৌলির এতো শরীর খারাপ ছিলো যে অন্য কারো দিকে নজর দেওয়ার সময়ই হয়নি। ভাবীর তো উচিত ছিলো আমাদের সাথে আসা। আমাদের মনে ছিলো না জন্য কি নিজেরও একটু জ্ঞান থাকবে না!

সব দোষ অহনাকে দিয়ে দিলো। সাদিক ক্রোধে জর্জরিত ভয়ংকর স্বরে বলল,
–কোথায় গেছিলি তোরা?

সাদিকের গর্জে ওঠা স্বরে তোতলাতে তোতলাতে মিরাজ জায়গা সম্পর্কে বলল। সাদিক সাথে সাথে যেতে চাইলেই সায়রা বাঁধা দিয়ে বলল,
–বাইরের অবস্থা তো ভালো না ভাইয়া। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি একটু থামুক তারপর যেও।

সাদিক ভয়ংকর চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, অবস্থা খুব খারাপ। আর এই অবস্থায় তোরা ওকে ফেলে এসেছিস। দোহাই দিচ্ছিস, মনে নেই। আমি দুধের শিশু না যে বুঝবো না কিছু। এরপর থেকে আমার ওয়াইফের থেকে শত মাইল দূরে থাকবি।

স্পষ্ট ভাবে সতর্ক করে চলে গেলো সাদিক। এই নীরব, নির্জন হসপিটালের করিডরে বসে সবটাই দেখলো মৌলি। ভালোবাসা কি সত্যিই এতো তাড়াতাড়ি বদলায়!

সাদিক ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে রিক্সা নিয়ে ছুটলো অহনার কাছে। দূরত্ব বেশি না হলেও ঘটনার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। অতি দ্রুত যেতে হবে সেখানে। অহনা ওখানে ওভাবেই রয়েছে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। কি হবে যদি অন্য কোন লোক এসে যায় কিংবা খারাপ কেউ আসে? কি করবে তখন! নিজেকে প্রটেক্ট করবে কিভাবে! হতাশ হলো চরমভাবে। অন্ধকারে নিভৃতে বসে নিজের পরিনতি ভেবে শিউরে উঠলো। ও কি সত্যিই আবার ছাদ হারা হলো!

অহনার আশার প্রদীপ যখন নিভু নিভু তখন সাদিক আসলো পূর্ণ আলো নিয়ে। তাকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো অহনা। সাদিকের ভেজা শরীর আকড়ে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আগলে ধরে রাখলো সাদিক৷
ওখান থেকে আর গ্রামের বাড়ি ফিরলো না তারা। রিক্সা চেপে বাসস্ট্যান্ডে গেলো। এরপর রাত এগারোটার বাসে সোজা নিজের বাসা। বিয়ের প্রথম রাতের মতো আবার তারা পাশাপাশি বসা তবে অহনার পাশে মানুষটা এবার ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকেনি। তাকে দেখেছে, বোঝার চেষ্টা করেছে, ভালোবাসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু, এভাবে কি চেষ্টা করে ভালোবাসা হয়!

****
সাদিক গভীর মনোযোগে মাহাদীর ছোট থেকে এতো বড় হওয়ার ছবি ভিডিও দেখছে। অহনা যার কাছে থেকেছে সেই দাদী নাকি মাহাদীর জন্মের পর স্মার্টফোন কিনেছিলো শুধুমাত্র বাচ্চার ছবি, ভিডিও করবে বলে৷ এতো বয়সেও সুন্দরভাবে সব শিখে গেছিলো। মাহাদীর প্রতিটা পদক্ষেপের ছবি সেখানে আছে। কোনটাতে চোখ বুজে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে তো কোনটাতে হাত পা ছুড়ে খিলখিল করে হাসছে। একটাতে আবার চোখ মুখ ফুলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ছবিটা দেখে অহনা বলল, প্রথমবার ইঞ্জে’কশ’ন দেওয়ার পর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরেছিলো মাহাদী। এটা সেই সময়কার ছবি। ছবি দেখা শেষে ভিডিও দেখলো। খাওয়ার ভিডিও, গোসলের ভিডিও, বসা শেখার ভিডিও, হামাগুড়ি দেওয়ার ভিডিও দেখ প্রতিটা বাচ্চার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মোমেন্টের ভিডিওটা দেখলো৷ বাচ্চার প্রথম স্টেপ। কতশত স্মৃতি বানানো যায় এই মোমেন্টটা নিয়ে৷ এরপরের ভিডিও ছিলো মাহাদীর প্রথম বাবা বলার ভিডিও। ভিডিওর ওপাশ থেকে অহনার সেই দাদীর মুখ বেঁকিয়ে বলা,
–তোর বাপ হলো বজ্জাদের হাড্ডি। বল, বজ্জাত বাপ।

এতোক্ষণ দাদীকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলেও এইটা বলার জন্য রাগ এসে জুড়ে বসলো। মাহাদী সাদিকের বুকের উপর শুয়ে ল্যাপটপে ছবি দেখছিলো। বাবার এই বেজ্জতি দেখে খিলখিল করে হেসে ফেললো। রাগে এই ছবিগুলো নিজের ল্যাপটপে কপি করে পেনড্রাইভ ফেরত দিলো অহনাকে৷ এরপর ছেলেকে নিজের পরিবারের লোকজনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো। প্রথমে তাদের ফ্যামিলি ফটো বের করে খলিল সাহেবকে দেখিয়ে বলল,
–এটা তোমার দাদু। কোন ডাবওয়ালা তোমার দাদু না।

শেষটায় বেশ রাগ ছিলো। মাহাদী গম্ভীরমুখে মাথা নাড়লো৷ সাদিক এরপর ফরিদা আর তাকে দেখিয়ে বলল,
–এটা দাদীমা আর এটা তোমার আব্বু।

মাহাদী মাথা তুলে চিন্তিত গলায় বলল,
–আব্বু? আম্মুর আব্বু তো আমি। তাহলে আমার আব্বু কে?

–তোমার আব্বু আমি।

মাহাদী ঠোঁট উলটে বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
–তুমি তো আমার বাবা।

সাদিক হেসে ফেলে বলল,
–বাবা আর আব্বু একই।

মাহাদী বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো৷ অহনা বিছানার এক কোনে বসে মাহাদীর জামা কাপড় খুব যত্ন নিয়ে ভাজ করছিলো। ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ মাহাদী একটা ছবি দেখিয়ে বলল,
–এটা কে?

–এটা তোমার চাচ্চু। এটা সজীব চাচ্চু, এটা রিকু চাচ্চু আর এটা মিরাজ চাচ্চু। চাচ্চু মানে কাক্কু।

এতো চাচ্চুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর ছেলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, ছেলে চাচ্চু মানেই বোঝেনি। তাই মানে বুঝে দিলো। মাহাদী বিষ্মিয় হয়ে বলল,
–এতো কাকু!

–হুম। আর অনেক ফুপুও আছে। সায়রা ফুপু, নিধি ফুপু আর মৌলি ফুপু।

মৌলি নাম শুনেই তাকালো সাদিকের দিকে। সাদিক মনোযোগ দিয়ে ছেলেকে ফুপুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। অহনার কপাল কুঁচকে গেলো। সম্পর্ক শেখালে এমন ভুলভাল সম্পর্ক কেন শেখাচ্ছে? মৌলি ওর কোন জনমের ফুপু হলো?
হঠাৎ মাহাদী উত্তেজিত হয়ে বলল,
–তোমার হাতে এটা আছে। আম্মুর হাতে নেই কেনো?

ওর দৃষ্টি সাদিকের হাতের হীরার আংটির দিকে। সাদিক হালকা হেসে বলল,
–তোমার আম্মুর আমার দেওয়া জিনিস পছন্দ না। তাই ফেলে দিয়েছে।

মাহাদী অভিযোগ নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। বাবার দেওয়া জিনিস ফেলে দিয়েছে কেন? অহনা তাকালো সাদিকের হাতের দিকে। আর ঠিক তক্ষুনি কিছু মনে পরে গেলো। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে কাপল রিং উপহার দিয়েছিলো তাকে। এটা কি সেই রিং? ডিজাইন মনে পরছে না কেন! এটা কি তবে বাগদানের আংটি না? পিঠ বেঁকিয়ে ল্যাপটপে ছবিটা দেখতে চাইলো। সাদিক বুঝে ল্যাপটপ ওর দিকে সরিয়ে দিলো। ছবি দেখেই হকচকিয়ে গেলো সে। এটা তো সেই ছবিই। তার আর সাদিকের এই মূহুর্তের ছবি। তার আংটিটা তো ওই বাড়িতেই রয়ে এসেছে। তাহলে সাদিকের এনগেজমেন্ট রিং কোথায় গেলো! বিভ্রান্ত নিয়ে সাদিকের দিকে তাকায়েই ভ্রু নাচালো সে। এর মানে পরিষ্কার, নিজের মতো কথা ভেবে নিলে এমনই হয়! এই নিজের মতো কথা ভেবে নেওয়ার জন্য সাদিকের থেকে কত কথাই না শুনেছে সে। গর্দভ, ডাল, নির্বোধ আরো সুন্দর সুন্দর কথাবার্তা বলেছে তাকে। হকচকিয়ে মাহাদীকে কোলে বসিয়ে আস্তে করে বলল,
–আব্বু, ঔষধ খেতে হবে। খাবার আনবো?

মাহাদীর খেতে মন চাচ্ছে না। তাই ব্যাজার মুখে ঘাড় কাত করে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনি অল্প ফাঁকা করে বলল,
–এইটুকু। বেশি না।

অহনা মৃদু হেসে খাবার আনতে গেলো। মাহাদীর জন্য বানিয়েছে কর্ণ স্যুপ। ভুট্টা, মাখন, ময়দা, পানি, লবণ আর সামান্য মরিচ দিয়ে। একটুখানি মুখে দিতেই মাহাদী চিৎকার করে উঠলো,
–ঝাল, ঝাল!

অহনা বিচলিত হয়ে উঠলো,
–ঝাল তো অল্প দিয়েছি।

সাদিক কপাল কুঁচকে মাহাদীর মুখ চেক করে বলল,
–মুখ ছিলে গেছে মনে হচ্ছে।

অহনার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। তারপর মাহাদীকে কোলে বসিয়ে আস্তে করে বলল,
–দুধ আনি আব্বু? দুধ খেলে ঝাল লাগবে না।

মাহাদী মাথা নেড়ে বলল,
–খাবো না।

–একটু খাও?

–খাবো না।

বলতে বলতে কেঁদে ফেললো মাহাদী৷ অহনা সাদিক দুজনেই বিচলিত হলো। অহনা চিন্তিত স্বরে বলল,
–কি হয়েছে বাবা?

–আম্মু, ব্যাথা।

ব্যাথা অনেকক্ষন হলোই হচ্ছিলো তার। এতোক্ষণ সহ্য করলেও মায়ের আদর পেয়ে আর ঢেকে রাখতে পারলো না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে হাত পা দেখাতে লাগলো। অহনা মাহাদীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলো। সাদিক চিন্তিত স্বরে বলল,
–কি হয়েছে?

অহনা উত্তর না দিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
–ওকে একটু রাখবেন? আমি দুধ গরম করে আনছি।

সাদিক মাথা নেড়ে মাহাদীকে কোলে নিয়ে পুরো ঘর পাইচারি করলো। নানান কথা বলে ব্যাথা থেকে মন ঘুরানোর চেষ্টা করলো। অহনা দুধ নিয়ে এসে জোর করে খাওয়ালো ছেলেকে। এরপর মেডিসিন বের করলো খাওয়ানোর জন্য। ওর মেডিসিন দেখে বিষ্মিত হলো সাদিক,
–এতো মেডিসিন সব মাহাদীর?

অহনা উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলো। সাদিক চোয়াল শক্ত করে অহনার হাত চেপে রাগী গলায় বলল,
–কিছু বলছো না কেন? কি লুকাচ্ছো তুমি?

অহনা চোখ নিচু করে আস্তে করে বলল,
–কাল বলবো। আজ না।

অহনার চোখ মুখের অবস্থা দেখে অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠলো সাদিকের। আর প্রশ্ন করার সাহস করে উঠলো না। ঔষধ খাওয়ায় কিছুটা আরাম হলো মাহাদীর। আরাম হতেই বাবার কোলে ঘুমিয়ে পরলো। বিছানায় ওকে মাঝে শুইয়ে পাশে শুয়ে পরলো সাদিক। অহনা সরে যেতে চাইলে চোখ গরম করে শুতে ইশারা করে চোখ বুজলো। অহনা চুপচাপ শুয়ে পরলো। ঘুম তো তার এমনিতেও হবে না।

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০৯

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৯

অহনার জ্বর এসেছে। থার্মোমিটারে মাপলে বোধহয় একশো তিনয়ের ঘর ছাড়িয়ে যেতো। ঔষধ খেয়ে কিছুই হয়নি। দুইদিন জ্বরে অমনি কাতরালো। মেয়েটার জ্বরে তাপা মুখ দেখে মায়া হলো ফরিদার। এই অবস্থায়ও ঘরের সব কাজ নিজ হাতে করছে। কোমড় আর পিঠ ব্যথা সহ্য করে সে নিজেও কিছু করতে চেষ্টা করে। এরমাঝে সাদিক আসলো হুট করে। গম্ভীর, চিন্তিত মুখ। অহনার অবস্থা দেখে মুখ আরো শুকিয়ে গেলো। ফরিদার থেকে জানতে পারলো, জ্বর দুইদিন হলো। তড়িৎ হসপিটালে নিয়ে গেলো অহনাকে। অহনাকে বসিয়ে সিরিয়াল দিতে গেলো। অহনা চুপচাপ বসে রইলো। ওর থেকে একটু দূরে একটা মেয়ে বসে আছে চুপচাপ। দৃষ্টি অহনার দিকে স্থির। অহনার আচমকা দৃষ্টি ওইদিকে যেতেই সে থমকালো। সুন্দর, টানা টানা চোখের মেয়েটাকে ও চেনে। এই চেহারা ভুলবার নয়। মৌলি! এসেছিলো বাড়িতে। মুখে ছিলো অবজ্ঞার হাসি। দুইমিনিট ওকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে চলেও গেছিলো। সুন্দর দেখতে মেয়েটির সাথে সাদিককে খুব সুন্দর মানাতো। কেউ একবার দেখলে আর নজরই ফেরাতে পারতো না। অহনার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। কাচুমাচু হয়ে বসে চোখ সরিয়ে ফেললো। সামনের ওই মেয়েটির দিকে তাকালে নিজেকে এতো অপরাধী যে লাগে! সাদিক হাতে পানির বোতল নিয়ে এসে অহনার সামনে দিয়ে বলল,
–এক ঘন্টার পরের সিরিয়াল।। এতোক্ষণ কি এখানে থাকবে নাকি একটু বাইরে হাঁটবে?

অহনা বোতল হাতে নিলো চুপচাপ। প্রশ্নের উত্তর আর দিলো না। টলটলে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আবার মৌলির দিকে তাকালো। সাদিকের কপাল কুঁচকে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে অহনার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেলো মায়াবী চেহারাটার দিকে। একসময় যার চোখের দিকে তাকালে আর চোখ ফেরাতে পারতো না, আজ সেই চোখের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে চোখ সরিয়ে ফেলল দ্রুত। মৌলির নজর অহনার দিক থেকে সরে সাদিকের দিকে গেছে। সাদিককে তার দিকে এক পলক তাকাতে দেখে স্মিত হেসে এগিয়ে আসলো। সাদিকের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
–সুন্দরী বউ পেয়ে কাজিনকে ভুলে গেলে সাদিক ভাই? দেখেও না দেখার ভাণ করছো যে?

সাদিক চোখ সরিয়ে মৃদু গলায় বলল,
–ভুলিনি। কেমন আছিস?

মৌলি এক গাল হেসে বলল,
–অনেক ভালো। একদম রিল্যাক্সে আছি। ইদানিং নিজেকে খুব হালকা হালকা লাগে। পাখি টাখি হলাম নাকি বুঝতে পারছি না।

অহনা ব্যথিত চোখে দুইজনকে দেখে চোখ সরিয়ে নিলো। পাশাপাশি দাঁড়ানোয় কি সুন্দর লাগছে! নিজেকে এদের মাঝে পরগাছা মনে হচ্ছে৷ শরীরে বল থাকলে এক্ষুনি এদের মাঝ থেকে সরে যেতো। মৌলির পরের কথা ওর কানে শিশার মতো ঢুকলো,
–তোমার অল্প বয়সী মেয়ে পছন্দ তা তো জানতাম না? আর কি কি পছন্দ বদলেছে বলোতো? আচ্ছা ভালো কথা। এখানে কি প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট করাতে এসেছো? এতো বড় খবর আমাদের থেকে লুকাচ্ছো তুমি? ভেরি স্যাড! আমাদের প্রথম ভাতিজা ভাতিজি। আর আমাদের থেকেই লুকাচ্ছো! সবাই শুনলে কত কষ্ট পাবে বলোতো?

কিসব কথাবার্তা বলছে! নিজেকে গুটিয়ে ফেলল অহনা। এখান থেকে সরার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে লাগলো। মৌলির কথায় সাদিকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। কথা ঘুরিয়ে শক্ত গলায় বলল,
–তুই কি একাই এসেছিস?

মৌলি হা হা করে হেসে উঠলো। বলল,
–কি যে বলো! একা আসবো না তো কার সাথে আসবো? আমার তো আর হাবি নেই। থাকলে দেখা যেতো।

সাদিকের ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যাওয়ার আগেই চলে যেতে চাইলো। অহনার তপ্ত হাত শক্ত হাতে চেপে বলল,
–চলো অহনা, পরে আসা যাবে। এতোক্ষণ এখানে থাকতে হবে না। আমার কাজ আছে একটু।

অহনা সাদিকের আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে ওর বাহুর আড়ালে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। মৌলি গালে হাত দিয়ে বিষ্মিত হওয়ার ভাণ করে বলল,
–আরে বাপরে! প্রেম দেখি উতলে উতলে পরছে! চিন্তা করো না সাদিক ভাই, তোমার বউকে আমি খেয়ে ফেলবো না। তুমি তোমার কাজ সেরে আসো৷ ততক্ষণ তোমার বউয়ের সাথে একটু আড্ডা দেই। ছেলে পটানোর টিপস নেই একটু।

সাদিক না কিছু বলতে পারছে আর না সইতে পারছে। অহনার হাত টান দিয়ে বলল,
–অহনা, লেটস গো।

অহনা একটু মৌলির সাথে কথা বলতে চায়। মৌলি সাদিকের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। ভুল বুঝছে তাকে। সত্যিটা জানাতে চাচ্ছে তাকে। সাদিকের হাত থেকে নিজের হাত টেনে বলল,
–আমি একটু থাকি।

সাদিক অহনার চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় বলল,
–থাকতে হবে না।

সিদ্দিকা আসলো দেখা। সাদিক আর অহনাকে দেখে অবাক হয়ে বলল,
–সাদিক, তোরা কখন আসলি?

মৌলি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ব্যঙ্গ করে বলল,
–তোমার ভাতিজা বউকে ছাড়া থাকতে পারে না মা। প্রতি সপ্তাহে ছুটতে ছুটতে চলে আসে।

সাদিক নিজের রাগ সামলাতে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। সিদ্দিকা চোখ গরম করে মৌলির দিকে তাকাতেই মৌলি হেসে বলল,
–সরি সরি! আমি এই থাকলাম ভাবীর কাছে৷ তোমরা ফুপু ভাতিজা কথা বলো। আমরা ননদ ভাবী কথা বলি।

বলেই অহনা যে চেয়ারে বসেছিলো, মৌলিও ঠিক সেই চেয়ারে বসে পরলো। সাদিক দুই পা পিছিয়ে গেলো। অহনা সাদিকের বাহু খামছে কান্না আটকালো। কান্না পাচ্ছে তার। এই অপরাধের বোঝে নিতে সে অপারগ। সাদিক ফুপুকে দেখে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বলল,
–ফুপু, আমার একটা কাজ আছে। আধ ঘন্টার মতো লাগবে। আপনি একটু অহনাকে দেখেবেন প্লিজ।

সিদ্দিকা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল,
–ঠিক আছে যা। চিন্তা করিস না।

সাদিক অহনাকে সিটে বসিয়ে চলে যেতেই গুটিয়ে বসলো অহনা। ভয়ে বুক কাঁপছে তার। সিদ্দিকা পাশে বসে টুকটাক কথাবার্তা বলল। খানিক পর মৌলির রিপোর্ট আসায় তাদের ছেড়ে রিপোর্ট আনতে গেল। আশেপাশে তেমন লোকজন নেই। অহনা চারপাশে নজর বুলিয়ে অনেক সাহস সঞ্চয় করে বিমর্ষ স্বরে বলল,
–মৌলি আপু, উনি আপনাকে খুব ভালোবাসে। আমি তো উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। ওনার সাথে এমন ব্যবহার করবেন না প্লিজ।

মৌলি মোবাইল রেখে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো। তারপর পরিহাস করে বলল,
–বাবা! এতো ভালোবাসা! তো উড়ে এসে জুড়ে যখন বসেছো তখন আবার উড়ে গেলেই তো পারো। থাকতে কে বলেছে?

অহনা চোখ নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো,
–ঘর ছাড়া পাখি আমি। কোথায় যাবো? আমার তো যাওয়ার জায়গাটাও নেই।

কিন্তু বলা হলো না৷ এমনিই কি দোষ কম নাকি যে আরো দোষ নেবে! তখন ভাববে, সহানুভূতি চাচ্ছে! আসলে তো তা না। ও তো সাধারণ মেয়ে। সাধারণ একটা জীবনই চায়। মৌলি বিদ্রুপ করে বলল,
–আসলে কি বলোতো, তোমাদের মতো বিলো এভারেজ মেয়েরা টাকা দেখলে আর ঠিক থাকতে পারে না। কামড়ে যখন ধরেছো তখন ধরেই থাকো। এমনিতেও, অন্য কারো জিনিসে আমার কোন আগ্রহ নাই।

অহনা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। সবাই এতো অপমান করে কেন! তাদের কথার মাঝেই সাদিক আসলো। মৌলিকে অহনার কাছে দেখে রেগে গেলো। দ্রুত এসে বলল,
–ফুপু কোথায়?

মৌলি ব্যাঙ্গ করে বলল,
–তোমার বউকে আমি খেয়ে ফেলিনি। উলটে তোমার বউ তোমাদের সংসার ভেঙে আমাকে ঢুকতে অফার করছে। বলছে, তুমি নাকি ওকে ভালোবাসো না। ও চলে গেলে আবার আমার কাছে ফিরে আসবে। অফার কি গ্রহণ করবো সাদিক ভাই?

অহনা আকাশ থেকে পড়লো। ও কি এসব বলেছে নাকি! ওর কথার মানে কি এটা ধরে নিয়েছে! সাদিককে কি বলবে, ও কি বলেছিলো? না থাক। ওর কথা বিশ্বাস তো করবে না। বিশ্বাস করার মতো কোন মানুষ না ও। তার থেকে চুপচাপ এই দায় স্বীকার করে নেওয়াই শ্রেয়।
সাদিক দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় বলল,
–নিজেকে এতোটাও নিচে নামাস না যাতে তোর নাম শুনলেও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেই।

বলেই অহনার হাত ধরে ডক্টরের চেম্বারের সামনে গিয়ে বসলো। সিদ্দিকা এসে অল্প কথাবার্তা বলে মৌলিকে নিয়ে চলে গেলো। নিয়ে যাওয়ার সময় ছলছল চোখের মেয়েটিকে দেখলো অহনা। বোধহয় অনেকক্ষণ নিজেকে শক্ত করে রাখলেও শেষ পর্যন্ত আর পারেনি। চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি পরে গেছিলো। অহনা ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামনে শুকনো মুখের স্বামীকে দেখলো। এসব কি কোন স্ত্রীর পক্ষে আদৌ সহ্য করা সম্ভব!
ডক্টর খুব ডিটেইলসে চেকাপ করল অহনার। রক্ত পরিক্ষা, ইসিজি, আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান, এক্সরে সব করলো। রিপোর্ট দিল বিকালে। বিকালে আর তার আসতে হলো না। সাদিকই রিপোর্ট নিয়ে ডক্টরের সাথে কথা বলে মেডিসিন আনলো। রিপোর্ট স্বাভাবিক পেয়ে শান্ত হলো সাদিক। রাতে আলতো ভাবে অহনাকে বুকের সাথে জড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কখনও কি মেয়েটাকে বলা হবে, ও হুট করে কেনো ছুটে আসলো? কখনও কি বলবে, ওর ভাই আর এই পৃথিবীতে নেই। ওর ভাইকে আনতে গিয়ে জেনেছে, এক সপ্তাহ আগে বাবার মতোই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে সে। চিকিৎসা করানোর মতো কেউ ছিলোই না! শুনলে কি আফসোস করবে অহনা? যেমন এখন সে করছে। এই ক্যান্সার অহনার শরীরেও বাসা বেঁধেছে নাকি ভেবে কত চিন্তিত ছিলো সে। আর আজ রিপোর্ট নরমাল দেখে যতটা শান্তি পেয়েছে, এইরকম শান্তি যে আগে পায়নি, সেসব কি বলবে? কিছু না বলাই ভালো। এই দুর্বল মনের মেয়েটি না জেনেই ভালো থাকুক। ভালো থাকুক, ভালো থাকুক।

****
সাদিক নিজেই মাহাদীকে তৈরি করে দিলো। গ্রে টিশার্ট, ব্লু জিনস প্যান্ট আর সাদা কেডস পরিয়ে ছেলের সাথে টুইনিং করে শপিং এ বের হলো। অহনা ভীষণ ব্যস্ত এখন। পুরোদমে কাজে মনোনিবেশ করেছে। মাহাদীকে সাদিকের সাথে মিশতে দেখে বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। অনেকটা চিন্তামুক্ত এখন।

সাদিকের গাড়ি এই বাড়িতে রাখার জায়গা হয়নি। পাশের বাড়িতে ছোট একটা গ্যারেজ আছে। সেখানেই রেখেছে। সাদিক সেখান থেকে গাড়ি বের করে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে ছেলেকে পাশের সিটে বসালো। মাহাদী আগ্রহভরে গাড়ি দেখতে লাগলো। গাড়ি চালু হতেই বিষ্ময়ে এটা ওটা প্রশ্ন করতে লাগলো। সাদিক সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলল,
–গাড়ি চালাবে?

মাহাদী মাথা নেড়ে মন খারাপ করে বলল,
–আমি পারি না। আমি এখন তো ছোট, বড় হলে চালাবো।

সাদিক মৃদু হেসে মাহাদীকে কোলে বসিয়ে ওর ছোট ছোট হাত স্টেয়ারিং এ রেখে হাতের উপর হাত রেখে গাড়ি চালাতে লাগলো। মাহাদী উচ্ছ্বসিত হলো দারুন। পুরো রাস্তা বাবার কোলে বসে গাড়ি চালিয়ে গেল। এরপর দুইজন খুব ঘোরাফেরা করলো আর খুব শপিং করলো। সব শেষে আবার বাবার কোলে বসে গাড়ি চালিয়ে ফিরলো। ফেরার পথে মাহাদীকে মোটরসাইকেলের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাতে দেখে সাদিক প্রশ্ন করলো,
–মোটরসাইকেলে উঠবে?

মাহাদী সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
–না, আরিফ কাক্কুর আছে৷ আমি ওই গাড়িতে অনেক উঠেছি।

সাদিকের কপাল কুঁচকে গেলো। বিরক্তি নিয়ে বলল,
–আরিফ কাক্কু কে?

মাহাদী মাথা ঘুরিয়ে চোখ পিটপিট করে সাদিকের দিকে তাকালো। আরিফ কাক্কুকে চেনে না! আরিফ কাক্কুকে তো সবাই চেনে আর ওর বাবা চেনে না! মাথা নেড়ে কপাল চাপড়ে বলল,
–আরিফ কাক্কুকে চেনো না? নিশু আপুর আব্বু।

সাদিক বিরক্তিকর শব্দ করে বলল,
–সম্পর্ক বানানোর জন্য দাদুবাড়ির সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু পাওনি? তোমার আম্মু কি নানু, নানী, মামা, মামী, এইসব সম্পর্ক শেখায়নি?

মাহাদী গাল ফুলিয়ে রইলো। সাদিক বুঝে তার গালে টপাটপ চুমু খেয়ে বসলো। গাল ফুলালে যে বাচ্চাটাকে এতো আদুরে লাগে!
গাড়ি পেছন দরজা দিয়ে বাড়ির পেছনের গ্যারেজে রাখতে হবে। তাই মাহাদীকে নামিয়ে সেদিকে গেলো সাদিক। গাড়ি থেকে নামতেই মাহাদী তার নিশু আপুকে দেখলো। উঠানে রোদে বসে পড়ছে। এক দৌঁড়ে ছুটে গিয়ে হাত দেখিয়ে বলল,
–নিশু আপু, দেখো?

মাহাদীর নিশু আপু তার ছোট হাতে স্পাইডারম্যানের ঘড়ি দেখে চমৎকৃত হয়ে বলল,
–কি সুন্দর ঘড়ি! কে কিনে দিলো মাহাদী? আম্মু?

মাহদী মাথা নেড়ে বলল,
–না, বাবা দিয়েছে।

–বাবা!

অবাক হলো সে। পড়াশোনার জন্য অন্য জায়গায় থাকে। ওর বাবার আসার কথা শুনেছিলো কিন্তু মনে ছিলো না। মনে পড়তেই বলল,
–তোমার বাবা কোথায়?

–আরিফ কাক্কুর ঘরে গাড়ি রাখতে গেছে।

বলেই বাড়ির পেছন সাইড দেখালো। তারপর বাবাকে আসতে দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
–ওই দেখো বাবা?

নিশা অবাক হয়ে দেখলো, মাহাদীর বাবাকে একদম মাহাদীর মতোই দেখা যায়। একই নাক, একই মুখ। হাঁটেও একইভাবে। মূহুর্তেই মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। মাহাদীর দিকে ঝুঁকে গাল টেনে বলল,
–তুমি আম্মুর কাছে যাও। আমি তোমার আব্বুর সাথে একটু কথা বলবো।

মাহাদী ঘাড় নেড়ে চলে যেতেই সাদিকের কাছে গেলো সে। পেছন থেকে আস্তে করে বলল,
–এক্সকিউজ মি!

সাদিক ঘুরলো। হাতে এক গাদা ব্যগ নিয়ে বিরক্ত মুখে ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
–ইয়েস?

–আমি নিশা। এখানে থাকি।

সাদিক মাথা নেড়ে বলল,
–ওকে

নিশা রাগলো। কিসের এতো অ্যাটিটিউড! চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
–আপনি কি ওদের নিয়ে যাবেন?

–জানি না।

নিশা রাগা শুরু করলো। শক্ত গলায় বলল,
–আপনার জানতে ইচ্ছা হয় না, আপনার বউ এতোদিন কি করেছে? কিভাবে সারভাইভ করেছে?

সাদিক কাঁধ নাচিয়ে বলল,
–নট ইন্টারেস্টেড। এটা ওর পারসোনাল ম্যাটার।

ব্যাটা বিয়ে করে বাচ্চা পয়দা করার সময় মনে হয় না এটা বউয়ের পারসোনাল ম্যাটার হতে পারে? যেই বাচ্চার দ্বায়িত্বের কথা বউয়ের দ্বায়িত্বের কথা আসে সেই হয়ে যায় পারসোনাল ম্যাটার! নিশু ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
–যে মানুষ প্রেগন্যান্ট ওয়াইফকে অ্যাবর্শন করার জন্য টাকা দেয় তার থেকে আসলে ভালো কিছু ডিজার্ভ করাই ভুল হয়েছে। আপনাদের মতো মানুষদের সমাজে থাকতে দেওয়াই ভুল। সমাজের কীট! যত্তোসব!

উল্টাপাল্টা কথায় রেগে গেলো সাদিক। রাগী গলায় বলল,
–এক্সকিউজ মি?

নিশা কোমড়ে হাত রেখে আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
–এক্সকিউজ ইউ! আমার সময় আর রুচি সাংঘাতিকভাবে নষ্ট হচ্ছে। তিনমাস চলে গেলে দয়া করে এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। এলাকা দুষিত হচ্ছে।

বলেই বাড়ির ভেতর গেল। এতো সুন্দর দিনটা নষ্ট করে দেওয়ায় সাংঘাতিক চটে গেলো সাদিক। হম্বিতম্বি করে অহনার কাছে গিয়ে বলল,
–কাদের সাথে থাকো তুমি? যেখানে বাচ্চার কথাই জানতাম না সেখানে আমাকে বলে, আমি নাকি অ্যাবর্শনের জন্য তোমাকে টাকা দিয়েছি! সার্কাস হচ্ছে আমার সাথে?

অহনা বিষ্মিত হয়ে মুখে হাত চেপে ধরলো। এই সাংঘাতিক খবর কে দিলো তাকে! প্রশ্ন করার সাহসটাও করতে পারলো না। মাহাদী এসে বাবাকে তার আর্ট দেখাতে টেনে নিয়ে গেল। অহনা দম ছেড়ে ফ্লোরে বসে পরলো।

সারাক্ষণ অহনা খুব ভয়ে ভয়ে ছিলো। না জানি সাদিক কখন ওকে চেপে ধরে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। মাঝরাতের দিকে সাংঘাতিক জ্বর আসলো মাহাদীর। উঠে মাথায় পানি ঢালতে হলো। শব্দ শুনে সাদিক ঘুমঘুম চোখে উঠে এসে এই অবস্থা দেখে চিন্তিত হলো। ভালোই তো ছিলো ছেলেটা, হঠাৎ করে জ্বর আসলো কেন! অহনা ব্যস্ত হয়ে বলল,
–আপনি একটু ওর পাশে বসুন। আমি মাহাদীর জন্য খাবার নিয়ে আসছি। ঔষধ খাওয়াতে হবে। পাশে কাউকে না পেলে কান্না করবে।

সাদিক বিচলিত হয়ে বলল,
–সবসময়ই কি এমন করে?

অহনা মাথা নেড়ে বলল,
–হ্যাঁ, অসুস্থ হলে একা থাকতে চায় না।

সাদিক ব্যথিত মনে ছেলের কাছে বসলো। ছেলের কত কিছুই সে জানে না। কত কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে! সন্তানের উত্তপ্ত মুখে হাত বুলিয়ে চোখের পানি আড়াল করলো। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে ঠোঁট ছোয়ালো। মাহাদী জ্বরের ঘোরে বাবা বাবা বলে ডাকছে। সাদিক ফিসফিস করে বলল,
–বাবা আছে তো আব্বু। এখানেই আছে।

ছেলের অসুস্থতায়ও অহনার ছুটি নেই। বারবার মাহাদীর কাছে ছুটে আসছে আর রান্নাঘরে যাচ্ছে। সাদিক দেখছে আর অবাক হচ্ছে। একটা মেয়ে, একা হাতে সব সামলাচ্ছে! এতোদিন একাই সামলেছে! কিভাবে! সাদিক অহনাকে শান্ত থাকতে বলে নিজেই ছেলের পাশে বসেছিলো। তাও মানেনি অহনা। কেক বানানো শেষে কাচুমাচু করে এসে বলল,
–আমার একটু বাইরে যেতে হবে। এক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবো।

সাদিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–আমি কোথাও যাচ্ছি না। নিশ্চিন্তে যাও।

অহনা নিশ্চিন্ত হলো না। সন্তান অসুস্থ হলো কোন মা-ই বা নিশ্চিন্ত থাকে। সাদিকের অফিসের কাজ আছে। মাহদীর পাশ থেকে উঠে নিজের ল্যাপটপ আনতে ঘরে গেলো। এক মিনিটের ব্যাপার ছিলো। এরমাঝেই মাহাদী চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ল্যাপটপ ফেলে দৌঁড়ে আসলো সাদিক। মাহাদী এক হাত মাথায় চেপে আরেক হাত সাদিকের দিকে বাড়িয়ে কাঁদছে,
–বাবা ব্যাথা, বাবা ব্যাথা!

সাদিক ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ছেলেকে। ছেলের ব্যাথা নিজের মধ্যে নেওয়ার উপায় থাকলে সেটাই করতো সে। ব্যাথা ছেলে কাঁদছে আর দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সাদিক মাহাদীকে কোলে বসিয়ে মাথা টিপে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর শান্ত হলো মাহাদী। ওর শরীরের উত্তাপে নিজের শরীর পুড়তে লাগলো। ব্যাথা কমতেই ঘুমিয়ে গেলো মাহাদী। সাদিক ঘুমন্ত ছেলের কপালে চুমু দিয়ে কেঁদে ফেলল। ছেলে প্রথমবারের মতো বাবা ডেকেছে বলে খুশিতে কাঁদলো নাকি জ্বরের যন্ত্রণার ছেলের কষ্ট হচ্ছে বলে কাঁদলো বুঝলো না। প্রথমবারের মতো বাবা অনূভুতি তাড়া করলো ওকে। এতো মিষ্টি অনুভূতির থেকে পাঁচ বছর বঞ্চিত ছিলো! ছেলেকে শোয়ানোর সাহসটুকুও হলো না। যদি জেগে আবার কান্না করে! তাই মাহাদীকে কোলে নিয়েই শুয়ে পরলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেও ঘুমিয়ে পরলো।

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০৮

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৮

সাদিক আবার আসলো মাস দুয়েক পর তাও মায়ের জোরাজুরিতে। অহনা সাদিকের ঘরেই থাকে এখন। সেদিন স্টোররুমে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু ফরিদা মুখ বেকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বলেছিলো,
–প্রতিদিনের ঢং ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখো। বাইরের লোকের সামনে অপমান করার দরকার নাই।

আসল কথা ছিলো অন্যকিছু। খলিল সাহেব বোনের কথায় এক বড়সড় তালা স্টোররুমে ঝুলিয়ে দিয়েছিলো। সাথে কথা শুনিয়েছিলো ফরিদাকে। তাই এই রাগ। অহনা বেশ বুঝেছিলো, তার ফুপু শাশুড়ির বেশ প্রভাব আছে এই বাড়িতে।
সেবার সাদিক আসলো সকাল সকাল। সারা সকাল ঘুমিয়ে বিকালে সেই যে বাইরে গেলো, ফিরলো গভীর রাতে। তারপর ড্রয়িংরুমে খেলা দেখার অযুহাতে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দেয়। একদিন, দুইদিন, তিনদিন এমনই গেলো। অহনার সাথে খারাপ ব্যবহার কি, কোন ব্যবহারই করে না। ডাকা তো দূর, নজর তুলে দেখে না পর্যন্ত। অহনা বেশ বোঝে, রাতে যতক্ষণ সে ঘরে থাকে ততক্ষণ তার স্বামী ফেলে না। ভোরবেলা সেও ঘর ছাড়ে আর সাদিকও ঘরে ঢোকে। অহনার আর কি! হয়ে গেছে আগাছা। শিকড় গভীর জন্য তুলে ফেলতেও পারছে না। তবে চতুর্থ দিনের দিন একটা ঘটনা ঘটে গেলো। ফরিদা সাদিকের এক গাদা কাপড় ওর হাতে তুলে দিলো। সবগুলো ধুতে হবে। অহনার কাপড় ধোয়ার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। ফরিদা অন্য কারো কাপড় ধোয়া পছন্দ করে না জন্য নিজের কাপড় নিজেই ধুয়ে ফেলে। আর খলিল সাহেব কোনদিনও ময়লা কাপড় বাড়ি আনেননি। তাই অন্য সব কাজে বেশ পটু হলেও এই কাজে সে আনাড়িই থেকে গেছে। আজ ফরিদার কোমড়ে আর পিঠে দারুন ব্যাথা হচ্ছিলো। বলা চলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই অহনার হাতে কাজটা তুলে দিলো। সাদিকের ফিরে যাওয়ার সময়ও হয়ে এসেছে।
অহনা ভয়ে ভয়ে সব ধুলেও সাংঘাতিক ভুল করে ফেললো। সাদা আর রঙিন টি-শার্ট একসাথে ভিজালো। আরেকদিকে একসাথে ভিজিয়েছে প্যান্ট আর শার্ট। সেখানে সাদিকের শখের সাদা প্যান্ট আর ফরমাল সাদা শার্ট ছিলো। আর ছিলো মৌলির নিজের হাতে ডিজাইন করে দেওয়া সাদা পাঞ্জাবি। সবগুলো সাদা কাপড়েরই বেহাল দশা হয়ে গেলো। কোনোটা নীল রঙের ছোপ দাগ পরলো তো কোনটায় লাল রঙের। আর মৌলির দেওয়া পাঞ্জাবিতে তো একেক জায়গায় একেক কালার বসে গেলো। অহনা অতোসব বুঝলো না। রঙ যে হতে পারে কিংবা ওগুলো যে প্লেন সাদা ছিলো সেটাও বুঝলো না। ও তো সরাসরি পানিতে ডিটার্জেন্ট গুলিয়ে ভিজিয়ে রেখেছিলো৷ ঘন্টাখানেক পর হালকা কেচে ধুয়ে ফেলেছিলো।
কড়া রোদে কড়কড়া শুকে যাওয়ার পর বিকালে তুলে আনলো৷ এরপর আয়রন করে বিছানায় সুন্দর করে ভাজ করে রেখে রাতের রান্না করতে গেলো। ফরিদার শরীর খারাপ জন্য আবারও রান্নার দ্বায়িত্ব পেয়েছে সে। না হলে সাদিক আসলে সে রান্নাঘরের কাজ থেকে ছুটি পেয়ে যায়।
সাদিক আসলো নয়টার দিকে। ফরিদা খাবার খেয়ে শুয়ে পরেছে। অহনা রান্নাঘর থেকে দেখলো, সাদিক হাতে পাঞ্জাবি নিয়ে বড় বড় পা ফেলে মায়ের ঘরের দিকে যাচ্ছে। মিনিটের মধ্যে আবার চলেও এলো। অহনার চোখ সরাতে না সরাতেই সাদিক রান্নাঘরে এসে হাজির। চোখ সেদিনের মতোই লাল হয়ে আছে। আবার কি সেদিনের মতো কিছু করবে! ঢোক গিললো অহনা। গতবারের মতো এবারেও ধারনা ভুল প্রমানিত হলো৷ সাদিক অহনার হাত মুচড়ে ক্রোধে জর্জরিত ভয়ংকর স্বরে বলল,
–যেটা পারো না সেটা করতে যাও কেনো? মানুষের ইমোশনের কোন মূল্য নেই? বিয়ে হয়েছে জন্য যা খুশি তাই? খবরদার যদি আর কোনদিন আমার আমার জিনিসে হাত দিয়েছো তাহলে হাত কেঁ’টে ফেলে দেবো।

অহনা চোখ খিঁচে বুজে রইলো। ব্যাথায় টু শব্দটাও করলো না। কথা শেষে সাদিক ওর মুখের উপর পাঞ্জাবি ছুড়ে চলে গেলো। কি হলো কিছুই বুঝলো না অহনা। মেঝে থেকে পাঞ্জাবি তুলে দেখতে লাগলো। কান্না আটকানোয় চোখ জ্বলছে। ফরিদা কাতরাতে কাতরাতে এসে বলল,
–সাদা জামা যে আলাদা ধোয়া লাগে তা জানো না? বাপের বাড়িতে কি খালি ছেলে ফাঁসানো শিখে এসেছো?

অহনা সাদিকের পাঞ্জাবি হাতে মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। সে রাতে সাদিক বাড়ি ফিরলো না। অহনা অনেকরাত পর্যন্ত পাঞ্জাবির রঙ উঠানোর চেষ্টা চালালো। কিন্তু কাজ হলো না। উলটে কাপড় পাতলা হয়ে গেলো।
সাদিক ফিরলো ভোরের দিকে। অহনা পাঞ্জাবি শুকাতে দিয়ে খাটে বসে বসেই ঘুমিয়ে গেছে৷ ইচ্ছা ছিলো, পাঞ্জাবি শুকানোর পর লেবু দিয়ে ঘষে আবার চেষ্টা করা। তার আগেই ঘুমিয়ে পরেছে। সাদিক ঘুমন্ত অহনার দিকে একপলক তাকালো শুধু৷ প্রথমবারের মতো, অন্য নজরে। না রাগ, না ক্ষোভ আর না কামনা। সেই দৃষ্টিতে পরিচিত হবার ভাব ছিলো। সারারাত যে কেমন ছটফট করে কাটিয়েছে তা একমাত্র সেই জানে৷ মৌলি! ওর জীবনে আসা প্রথম নারী, প্রথন ভালোবাসা৷ যখন ভালোবাসাটাই বুঝতো না তখন থেকেই টান অনুভব করতো। সময়ের সাথে সাথে সেই টান ভালো লাগা, এরপর ভালোবাসায় রুপ নিয়েছে৷ কোনদিন অন্য কাউকে জীবনে আশাও করেনি৷ অপরদিকেরও সেই হাল৷ তার বিয়ের কথা শুনে হসপিটালে ভর্তি ছিলো মৌলি। এরপর একদম চুপচাপ হয়ে গেছে৷ কাজিনদের মধ্যে আর কেউ-ই ওর সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। এই একটা মানুষের জন্য সে সব হারিয়েছে, সব! সারারাত মসজিদে কাটিয়েছে সাদিক। নামাজ পরে প্রার্থনা করেছে নিজের অশান্ত মনের শান্তির জন্য। এরপর ফরজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জীবন থেকে পুরোনো স্মৃতি সব মুছে ফেলবে। পাঞ্জাবিটাই হয়তো সুচনা ছিলো। নাহলে এতো বছর কাঁদার ছিটা পর্যন্ত যে পাঞ্জাবিতে লাগেনি সেই পাঞ্জাবি হুট করে ধুতেই বা কেন যাবে আর এই অবস্থাই বা কেন হবে! অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলো আগে থেকেই। এখন বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্ততি নিলো। বিছানায় বসে চুল খামছে অনেকক্ষণ ভাবলো। এরপর মৌলির দেওয়া সমস্ত জিনিস ছাদে নিয়ে পুড়িয়ে ফেললো। এরপরের শেষকাজ হিসেবে ঘরে ফিরে অহনাকে ডেকে তুললো। প্রথমবারের মতো নরম গলায় বলল,
–সরি…

অহনা ভয়ার্ত মুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। সাদিক ওর দিকে তাকাতে পারলো না। চোখ নিচের দিকে রেখে ছোট করে বলল,
–গতরাতের জন্য আর…

অহনা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো। সাদিক বার কয়েক পলক ফেলে বলল,
–বাকি সব কিছুর জন্য৷

বলেই আর থাকলো না। অহনা বুঝতে চেষ্টা করলো অনেক। ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইলো কি? কিন্তু কেনো? ও তো এসব চায় না। আসলে কি চায় তা ও নিজেই জানে না। শুধু চায় ঘুমাতে৷ হ্যাঁ, ঘুমাতে চায় অনেকক্ষণ। অনেকদিন হলো ঠিকমতো ঘুমায় না। ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে আবার ঘুমিয়ে পরলো। সাদিক আবার ডেকে তুললো। একদম রেডি হয়েই এসেছে। অহনা চোখ কচলে উঠে বসলো। ওর মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে। ঘুমের রেশ কিছুতেই কাটছে না৷ সাদিক মৃদু গলায় বলল,
–আমি চলে যাচ্ছি। মাকে বলে দিও। আর এটা তোমার হাত খরচের জন্য।

অহনার হাতে কিছু টাকা জুয়ে দিয়ে ভারী কদমের চাপ ফেলে চলে গেলো। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো সে। কখনও তো এটা কল্পনাই করেনি তাহলে এমন স্বপ্ন কেনো দেখছে! যদি স্বপ্ন না হয় তাহলে কি? রাতেই না মারতে আসলো। এখন আবার এতো ভালো করে কথা! জ্বীন ভুতের আছরও হতে পারে। অহনার জানার কথা নয়, সাদিক এই সম্পর্ক মানতে নিজেকে ঠিক কতবার ভেঙেছে আর এখনও ভেঙে চলেছে।

****
সারা সকাল টিভিতে আর্ট বিষয়ে ডকুমেন্টারি দেখেছে মাহাদী। সাদিক বাইরে ছিলো আর অহনা নিজের কাজে ডুবে ছিলো। ছেলের এতোক্ষণ ডকুমেন্টারি দেখার ফলাফল পেতে হতো ছেলের বাবাকে। নিজের প্রিয় টি-শার্টের বেহাল দশা দেখে সাদিক রাগ নিয়ে অহনার সামনে হাজির হলো৷ টি-শার্ট অহনার মুখের সামনে ধরে বলল,
–দেখো তোমার ছেলে কি করেছে?

হকচকিয়ে গেলো অহনা। টি-শার্ট হাতে নিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,
–মাহাদী তো দুষ্টু না। কোনদিন এমন করেনি।

–তো কি আমি মিথ্যে বলছি?

সাদিক চেঁচিয়ে উঠলো। অহনা থতমত খেয়ে গেলো। পুরো টি-শার্ট জুড়ে রঙের কাজ দেখা যাচ্ছে। বোধহয় কিছু আঁকানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো কিন্তু আঁকাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই টি-শার্ট হাতছাড়া হয়ে গেছে। অহনা আমতা-আমতা করে বলল,
–আচ্ছা, আমি এটার দাম দিয়ে দেবো।

ভয়ংকর রাগলো সাদিক। অহনার হাত মুচড়ে গর্জে উঠে বলল,
–আমাকে টাকার গরম দেখাচ্ছো?

অহনা ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠতেই কোথা থেকে মাহাদী ছুটে আসলো। কাঁদতে কাঁদতে সাদিকের পায়ে ছোট ছোট হাত দিয়ে মারতে মারতে বলতে লাগলো,
–আম্মুকে ছাড়ো, আম্মুকে ছাড়ো।

কান্নার বেগ বাড়তেই লাগলো। সাদিক বিষ্মিত হয়ে ছেড়ে দিতেই অহনা ছেলেকে কোলে তুলে কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। বিষ্মিত সাদিক এইটুকু ছেলের কাছে অপরাধী হয়ে জায়গা ত্যাগ করলো।

রাতে শোয়ার পর মাহাদী সাদিকের ঘরে আসলো। ছোট হাতের মুঠ খুলে দশ টাকার দুটো নোট বাড়িয়ে দিয়ে রাগী গলায় বলল,
–এই নাও লাল টাকা। তোমার জামার দাম। আম্মুকে যদি আবার ব্যাথা দিয়েছো তাহলে তোমাকে আবার মারবো।

সাদিক বিষ্ময়ে টাকা দুটো হাতে তুলতেই মাহাদী যেপথে এসেছিল সেই পথেই চলে গেল। তাকে আর কোন কথাই বলতে দিলো না।
পরেরদিন আবার সবুজ টাকা নিয়ে হাজির। সদ্য জেনেছে, লাল টাকার থেকে সবুজ টাকার মান বড়। সাদিকের সামনে সবুজ টাকা ধরে বলল,
–এই নাও টাকা। এবারে তোমার বড় জামা দাও। আমি টাইগার আঁকবো।

সাদিক চোখ ছোট ছোট করে বিশ টাকার নোট হাতে তুলে বলল,
–এই বিশ টাকায় আমার জামা কিনবে?

মাহাদী মাথা উপর নিচ করে সায় জানালো। সাদিক হেসে ফেলে নিজের প্লেন হোয়াইট টি-শার্ট ছেলের হাতে তুলে দিতেই নাচতে নাচতে মাহাদী চলে গেলো।

বিকালের দিকে টি-শার্টে টাইগার এঁকে সাদিকের সামনে হাজির। কাঁচা হাতের আঁকানো বাচ্চা টাইগারের টি-শার্ট ওর সামনে রেখে হাত পাতলো। ভ্রু বাঁকালো সাদিক। ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো আবার কি। মাহাদীও ওর মতো ইশারায় টিশার্ট দেখিয়ে বুঝালো, ওর আঁকানো টি-শার্টের মজুরি চাচ্ছে। সাদিক হাসি চেপে বলল,
–এটা তো তুমি কিনে নিলে।

মাহাদী উপর নিচ করে মাথা নাড়িয়ে বলল,
–হ্যাঁ। এখন তোমার কাছে সেল করবো।

সাদিক আগেই দেখেছে, বয়স কম হলেও মাহাদীর উচ্চারণ অনেক স্পষ্ট। আবার কথায় কথায় স্পষ্ট ভাষায় ইংরেজি উচ্চারণও বলে। সাদিক টিশার্ট খুলে ডিজাইন দেখে বলল,
–আমি এটা কিনবো না। পছন্দ হয়নি।

মাহাদীর মুখ অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। সাদিকের টি-শার্টে এর আগে রঙবেরঙের আর্ট দেখেছিলো। তাই এঁকে দিয়েছে। ভেবেছে পছন্দ করে কিনে নেবে। কিন্তু তা হলো না। সাদিকের হাত থেকে টি-শার্ট নিতে নিলেই সাদিক হাত সরিয়ে ফেলে বলল,
–এটা বিক্রি করবে কেন?

–আম্মুর জন্য টাকা ইনকাম করবো। যাতে আম্মুর আর কষ্ট না হয়।

মাহাদী ছোট কিন্তু অনেক বুঝদার। পুরো সকাল ডকুমেন্টারিতে আর্ট করে যে ইনকাম করা যায় তা দেখেছে। দেখেছে, বুঝেছে আবার কাজে করে দেখিয়েছে। বড় মানুষরাও যা বোঝে না, এই ছোট বাচ্চাটা তা বুঝে ফেলেছে অতি দ্রুত। এটা বলাই যায়, সব হারিয়েও অহনা একটা খাঁটি সোনা পেয়েছে।
সাদিক বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
–কত টাকায় বিক্রি করবে?

–নীল টাকায়।

উচ্ছ্বাসিত হলো মাহাদী। সাদিক ভ্রু বেঁকিয়ে বলল,
–বিশ টাকায় কিনে একশো টাকায় বিক্রি। ভালোই তো বিজনেস বোঝো।

বলেই পকেট থেকে একশ টাকার নোট বের করে ছেলের হাতে তুলে দিলো। মাহাদী খুশি মনে চলে গেলেও কিছুক্ষণ পর রেডি হয়ে আবার আসলো। সাদিকের হাত টেনে বলল,
–কালার কিনবো, চলো।

সাদিক হেসে ফেলে গেলো সাথে। একশো টাকা ইনকাম করলেও কালার কিনলো হাজার টাকার। অহনা ফিরে এসব দেখে মাহাদীকে কাছে টেনে কোলে বসিয়ে বলল,
–কারো থেকে কিছু নিতে হয় না বাবা। তোমাকে তো আম্মু কালার কিনে দেয়।

মাহাদী মাথা নেড়ে নেড়ে বুঝালো, ও একটা নীল টাকা ইনকাম করেছে। সেই টাকাতেই এসব কিনেছে। অহনা তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
–এগুলো কিনতে ওই নীল টাকা অনেকগুলো দরকার। তুমি আর নিও না। ঠিক আছে?

মাহাদী বুঝে মাথা নাড়লো। তারপর অহনা যেতেই কালার উঠিয়ে সাদিকের ঘরে গেলো। সাদিক দরকারী মিটিং করছিলো। মাহাদীকে দেখে বসতে বলে দ্রুত মিটিং শেষ হেসে বলল,
–কি ব্যাপার? কালার নিয়ে ঘুরছো কেন? আরো টি-শার্ট লাগবে?

মাহাদী মাথা নেড়ে বলল,
–তোমাকে কালার ফেরত দিয়ে দেব। আম্মু বলেছে, এগুলো কিনতে অনেক নীল টাকা লাগে। আমার অতো নাই। পরে নেবো তোমার থেকে।

সাদিকের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। চোয়াল শক্ত করে বলল,
–তোমার আম্মু মিথ্যে বলেছে। একটা নীল টাকা দিয়েই কেনা যায়।

মাহাদী সজোরে মাথা নাড়লো,
–না। আম্মু মিথ্যা বলে না।

বলেই কালার ফেলে এক দৌঁড়ে চলে গেলো। সাদিকের ইচ্ছে হলো সবগুলো রঙ বাইরে ফেলে দিক। কিন্তু রাগ সংবরণ করলো। দ্রুত পায়ে অহনার কাছে গিয়ে চাপা গলায় চোটপাট করলো অনেকক্ষণ। অহনা মাথা নিচু করে সব শুনলো চুপ করে। সাদিক চুপ থাকল না। অহনাকে টেনে নিয়ে তাকে দিয়েই মাহাদীর হাতে রঙ তুলে দেওয়ালো। মাহাদী খুব খুশি হয়ে কালার করতে বসে গেলো। পরেরদিন লোকাল বাজার থেকে অনেকগুলো কমদামী সাদা গেঞ্জি কিনে ছেলের হাতে তুলে দিলো সাদিক। এরপরের কয়েকদিন বাবা ছেলের টিশার্ট বিক্রির বিজনেস চললো। যেখানে ক্রেতা হলো বাবা আর বিক্রেতা হলো ছেলে।

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০৭

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৭

সাদিকের আসার খবরে সিদ্দিকা পরদিন সকালেই চলে আসলো। রিক্সার আধঘন্টার দূরত্বে থাকে সে। এসেই সাদিককে পাকড়াও করে ঘরে দরজা আটকে দিলো। ভাতিজার সাথে একান্ত গোপনে কথা সারবে। ফরিদার কান পাতার স্বভাব নেই। ছেলে অহনার হাতে খায় না বলে নিজেই রান্নার দ্বায়িত্ব নিলো। অহনা তাতে টুকটাক সাহায্য করতে লাগলো কেবল।
সিদ্দিকা সাদিকের শুকনো মলিন মুখের দিকে তাকাল। এমন শুকনোমুখ এর আগে কেবল অ্যাডমিশন এর রেজাল্টের দিন দেখেছিলো। পছন্দের ভার্সিটিতে যখন চান্স হয়নি তখন। সেই ক্ষোভে ইঞ্জিনিয়ারিংই পড়লো না। অন্য ভার্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ভর্তি হয়ে গেলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেদী ভাতিজার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
–অহনাকে পছন্দ হয় না?

–ফুপু প্লিজ!

সাদিকের গলার স্বর কাতর শোনালো। সিদ্দিকা চাপা গলায় বলল,
–একটা মেয়ে নিজের সব কিছু ছেড়ে একা তোর হাত ধরে চলে এসেছে আর তুই এই ব্যবহার করছিস? ও কি এই ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য?

সাদিক ছোট করে বলল,
–ও কি ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য তা আমি কিভাবে জানবো?

সিদ্দিকা এর আগে ফোনেও সাদিককে অনেক বুঝিয়েছে। এখন ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে আগের সব বুঝানো বৃথা। যখন বুঝায় তখন বোঝে আর এরপর আবার সব আগেরমতোই। হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো করে বলল,
–জানিস না তো জানার চেষ্টা কর। কতদিন আর এভাবে চলবে? সব কিছুর একটা শেষ আছে।

সাদিক সব জানে, বোঝে কিন্তু মানতে পারে না। সিদ্দিকা মলিন হেসে বলল,
–তোর সাথে আমরা ভুল করতে যাচ্ছিলাম। উপরওয়ালা আমাদের ভুলটা হতে দিলেন না। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন আমরা কত বড় ভুল জুটির চিন্তা করছিলাম। তোদের জোর উপরওয়ালা বানিয়েছেন। এমন করলে তিনি নারাজ হবেন। এমন করিস না সাদিক, ভাগ্য মেনে নে।

সাদিক কিছুই বললো না। মনের মাঝে ঢুকে পড়া কাঁটাটা আরো গভীর ভাবে বিঁধে গেলো শুধু। ফুপু ডেকে উঠলো,
–সাদিক

–জ্বি ফুপু?

–মেয়েটার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করিস না। ওর ফ্যামিলির কথা শুনে খুব খারাপ লাগছে। বাবা, মা, ভাই, বোন সবাইকে হারিয়ে এখানে এসেছে তোর ভরসায়, তোর হাত ধরে। ওর মামা বাড়ির সবাই তোর সাথে খারাপ করলেও ওর তো কোন দোষ নেই।

মামা বাড়ির দোষ! এখানে তো সাদিক চরমভাবে ঠকেছে। বন্ধু হারিয়েছে, ভালোবাসা হারিয়েছে, সম্মান হারিয়েছে। বোনের বিয়ে বলে দাওয়াত দিতে বাড়ি নিয়ে গেছিলো অহনার মামাতো ভাই। আর এরপর বদনাম করে রটিয়েছে, সাদিকের খারাপ নজর অহনার দিকে আছে। জোরজবরদস্তি করতে চেয়েছিলো মেয়েটার সাথে। অথচ এই অহনাকে সে কোনকালেই দেখেনি। লজ্জায় অপমানে চলে আসতে চাইলে সবাই একপ্রকার ধরে বেঁধেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। হিংসা মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়। বন্ধু যে মনে মনে ওকে এতো হিংসা করত তা কি কোনদিন জেনেছিলো! জানলে কি আর বিশ্বাস করতো!

–আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না ফুপু।

সাদিক উদাস ভাবে উত্তর দিলো৷ সিদ্দিকা ধীর গলায় বলল,
–বিয়েটা মেনে নে।

–নিয়েছি। সব কিছুই মেনে নিয়েছি।

সাদিক সবটাই মেনে নিয়েছে। মেনে নিয়েছে তার বিয়ে হয়েছে। তার জীবনে মৌলির বদলে অন্য কেউ এসেছে। চিরজীবনের মতো ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে। সবটাই তো মেনেছে। আর কি বাকি আছে!

–আমাদের সাদিক বুদ্ধিমান ছেলে। কারো উপর অন্যায় করবে না বলেই বিশ্বাস।

সাদিক হালকা হাসলো। নিজের কষ্ট গোপন করে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিয়েছে। আজ তার উপর মোহর পরলো। ফুপু আরো অনেক কথা বললো। সাদিক শুধু হু হা তে জবাব দিয়ে কথা শেষ করলো। কথাবার্তা শেষ হলেও সিদ্দিকাকে ফরিদা যেতে দিলো না। দুপুরের খাবার তাদের সাথেই খেতে বলল। সিদ্দিকা আগ্রহভরে খেতে বসলো। সাথে টেনে নিলো সাদিককেও। অহনাকে ডেকে বলল,
–নতুন বউ খাবার পরিবেশন করে দাও। আজ তোমার হাতে খাবো।

অহনা ফরিদার দিকে একপলক তাকালো। ফরিদা অন্যদিকে তাকিয়ে রাগ চাপার চেষ্টা করছে। অহনা ঠোঁট কামড়ে সাহস সঞ্চয় করে কাঁপা হাতে পরিবেশন করতে যেতেই সাদিক উঠে দাঁড়ালো। সিদ্দিকা কিছু বলার আগেই বড় বড় পা ফেলে বাইরে চলে গেলো। ফরিদ্দা জ্বলন্ত চোখে অহনার দিকে তাকিয়ে বলল,
–তোমার এই সুন্দর মুখটা নিয়ে আমার ছেলের সামনে না আসলেই কি চলে না?

স্পষ্ট ঠেস দিয়ে কথা বলল। অহনা মুখ নিচু করে বারবার পলক ফেলে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালালো। আসতে তো চায়নি। টেনে আনা হয়েছে। সে কথা কে বলবে! সিদ্দিকা খাবার রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–আমি চলে যাচ্ছি। আপনার ছেলেকে বলবেন, যেদিন বউকে যথাযথ সম্মান দেবে সেইদিনই যেনো আমাকে ফুপু বলে মানে।

বলে আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না। ফরিদা অহনার উপর ফেঁটে পরলো। গর্জে উঠে বলল,
–খাও শান্তিতে। কারো শান্তিতে খাওয়া তো পছন্দ হয় না। অলক্ষী বাড়িতে এসে গেছে। শান্তি কি আর থাকবে!

বিড়বিড় করে বলে প্লেট ঠেলে উঠে ঘরে চলে গেলো। অহনা নিরবে খাবার ঢেকে রেখে স্টোররুমে গেলো।

বাইরে জোরে জোরে বাজ পরার শব্দে অহনার মনে পরলো, ছাদ জামাকাপড় মেলা আছে। সেগুলো আনতে হবে। এক দৌড়ে ছাদে গেলো সে। ফরিদার দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস। নাহলে ওকে জীবনেও বাইরে বের হতে দিতো না। বাড়ির মালিক বলে কেউ আগ্রহ দেখানোর সাহস না করলেও যদি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে তখন মুশকিল হয়ে যাবে। তাই ওকে বের হতে দেয় না।
ছাদ থেকে জামাকাপড় আনতে আনতে ভিজে গেলো অহনা। জামাকাপড় এনে ফরিদার ঘরে তার কাপড় রেখে সাদিকের ঘরে গেলো। সাদিক বাড়ি নেই দেখেই এই সাহস করলো। ইচ্ছে ছিলো জামাকাপড় রেখে চলে যাবে কিন্তু ভাজ করে না গেলে যদি আবার রাগে তখন! তাই দ্রুত হাতে ভাজ করতে লাগলো। তার নিজের শরীর ভিজে একাকার। শাড়ি ভিজে একদম শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। সেদিকে তার ধ্যান নেই। বর্তমানে বকা খাওয়ার হাত থেকে বাঁচাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য।
হঠাৎই দরজা লাগানোর শব্দে দরজার দিকে তাকাতেই ভয়ের শিহরণ খেলে গেলো শরীর জুড়ে। সাদিক কখন এসেছে জানা নেই। চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে৷ শরীর ঘামছে সমানে। অহনা ঢোক গিলে হাতের কাজ ফেলেই চলে যেতে চাইলো। হাত চেপে বাঁধা দিলো সাদিক। এরপর অনেক এগিয়ে আসলো। যতটা এগিয়ে আসলে নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে ঠিক ততটা। অহনা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সাদিকের চোখ টকটকে লাল। এতো রেগে আছে কেন? মনের মাঝে ভয় এসে আঁকিবুঁকি করতে লাগলো। এবারে মারবে নাকি? এটাই বা বাদ রাখবে কেন!

সাদিক মারলো না তবে এমন কিছু করলো যেটাতে অহনার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেলো। এটা তো মারার থেকেও অনেক বেশি! ঠোঁটের জ্বলন সহ্য করতে না করতেই মানুষটার অবাধ্য বিচরণ তাকে অদ্ভুত এক সুখানূভুতির শিখরে নিয়ে গেলো। শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে অদৃশ্য কাঁপন ছড়িয়ে পড়লো মূহুর্তেই। হৃদস্পন্দন থেমে থেমে যেতে লাগলো তাদের। মিলনের এই সন্ধিক্ষণে পরস্পরের নিঃশ্বাস এক হয়ে দুরত্ব ঘুচিয়ে ফেললো খুব শীগ্রই। অদৃশ্য এই আগুনে দুজনেই সমান তালে পুড়তে লাগলো।

বিকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে সাদিকের রুমে আবিষ্কার করলো। সাদিক ঘরে নেই দেখেও লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে গেলো সে। তাহলে কি অবশেষে স্বামী, সংসারের সুখ ওর কপালে জুটবে? আশায় বুক বেঁধে রাখলো। পূর্বের অসম্মান ভুলে টুলে রাতে স্বামীর জন্য মন ভরে রান্না করলো। কিন্তু সাদিক ফিরলো না। ফরিদাকেও চুপচাপ দেখলো। রাতে শোবার সময় সাদিকের ঘরে গিয়ে দেখলো তার ব্যাগও নেই। পালালো তবে! স্থির হলো সে। আর কত অপমান সইতে হবে! কি করে ভেবেছিলো, যাকে দেখলে ঘৃণা লাগে, যার হাতের ছোয়ায় বানানো খাবার ঘৃণা করে তার শরীরে বিচরণ করে নিজেকে অপবিত্র মনে করবে না! সবটাই তার কল্পনা, মোহ! সব কাটুক, কাটুক, কাটুক।

****
সাদিক বাইরে গেছিলো। ফিরে এলো বড় দুটো ফুলের বুকে নিয়ে। একটা অহনার হাতে দিয়ে আরেকটা মাহদীর হাতে দিয়ে বলল,
–এর মাঝের একটা ফুল আমাকে দাও। কাল কিন্তু দাও নি। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।

মাহাদী কি মনে করে ছোট ছোট হাত দিয়ে ফুল ছিড়ে সাদিকের হাতে তুলে দিতেই মিষ্টি করে হাসলো সাদিক। এরপর ছেলের কপালে চুমু দিয়ে ঘরে গেলো। মাহাদী নিজের মনে খেলছিলো। সাদিক ওকে পাশ কাঁটিয়ে অহনাকে খুঁজতে রান্নাঘরে যেতেই থমকে গেলো। অহনা বেকিং করছে৷ খুব মনোযোগ দিয়ে কেক বানাচ্ছে। সাদিক ভেতরে এসে ঘাড় কাত করে অনেকক্ষণ দেখে বলল,
–এতো কেক বানিয়ে কি করবে? দোকান দেবে নাকি?

–দোকানে দেবো।

অহনা ছোট করে উত্তর দিতেই সাদিক কপাল কুঁচকে বলল,
–মানে?

–আমার বানানো কেক হোটেলে যায়। ওরা এগুলো প্রসেস করে বিক্রি করে।

–আর এগুলো করেই সংসার চালাও, তাইতো?

অহনা নিরবে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। সাদিক কিচেন কেবিনের উপর উঠে বসে একটা কাপকেক হাতে নিয়ে বলল,
–তুমি পুরো লসে ডুবে আছো। আমার কাছে থাকলে এতোদিনে নিজের বেকারি খুলতে পারতে। কার হাত ধরে যে ঘর ছেড়েছো! পুরো লস প্রজেক্ট!

অহনার নজর সাদিকের হাতে ধরা কাপকেকের উপর। এসব উল্টাপাল্টা কথায় কান দেয়নি মোটেও। সাদিক গভীর দৃষ্টিতে কাপকেক উলটে পালটে, গন্ধ শুকে দেখছে। অহনা চাপা গলায় বলল,
–সব গোনা কেক। নষ্ট করবেন না প্লিজ। এক ঘন্টার মাঝে ডেলিভারি দিতে হবে।

সাদিক কাঁধ নাচিয়ে বলল,
—আগে দেখি কেমন কেক বানাও। নাহলে কাস্টমারের কাছে মান থাকবে না।

বলেই টুপ করে খেয়ে ফেললো। মাথা নেড়ে বলল,
–হুম, মজা আছে। সব কি একই ফ্লেভারের?

অহনা উত্তর দিলো না। এরপরের ঘটনা সে বুঝে গেছে। সাদিক খুঁজে খুঁজে আলাদা আলাদা ফ্লেভারের কয়েকপিস খেয়ে ফেলল। নিজে খেয়ে শান্তি না পেয়ে অহনার মুখেও ঢুকিয়ে দিলো। এরপর মাহাদীর জন্য গোটা তিনেক নিয়ে তবেই রান্নাঘর ছাড়লো।
অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর মাত্র আড়াইমাস!
অতিরিক্ত আরো কেক বানানোয় কাজ বেড়ে গেলো। ডিম না থাকায় ডিম কিনে আনতে হলো। এরপর দেখে ভ্যানিলা আর স্ট্রবেরি এসেন্স শেষ। আবার সেগুলো আনতে হলো৷ এসব করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো। এরপর কেক ডেলিভারি দিয়ে তবেই ছুটি। গতরাতের বৃষ্টিতে জমে যাওয়া কাঁদায় আচ্ছামতো খেলেছে মাহাদী। উষ্কানি দিয়েছে সাদিক৷ মাহাদীকে সেখান থেকে তুলে গোসলে নিয়ে গেলো। ছেলেকে গোসল করাতে করাতে নিজেও অর্ধেক ভিজে গেলো। গোসল শেষে অর্ধভেজা শরীরে ছেলের হাত ধরে বাইরে আসতেই সাদিকের দৃষ্টিতে পরে গেলো। সামনের মানুষটার বুনো দৃষ্টি তার ভেজা অঙ্গে বুঝে অস্বস্তিতে গাট হয়ে গেলো। ছেলের দিকে ঝুঁকে বলল,
–তুমি বারান্দায় রোদে গিয়ে বসো। মা চেঞ্জ করে আসবে এক্ষুনি।

মাহাদী মাথা নেড়ে সাদিকের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। দূরত্ব এখনও ঘোচেনি তাদের। অহনা দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে গেলো। ওয়্যারড্রবের ড্রয়ার খুলে জামা খুঁজতে খুঁজতেই পেছনে দরজা লাগালোর শব্দ পেলো। জমে গেলো সে। নড়ার আর ক্ষমতা রইলো না। এই পরিস্থিতি থেকে না আগে বাঁচতে পেরেছে আর না এখন বাঁচতে পারছে। প্রতিটি ভারী কদমের সাথে ওর বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ শব্দ আরো বাড়তে লাগলো। সাদিক পেছনে এসে দাঁড়িয়ে তার কোমর চেপে বুকের সাথে আটকে ধরলো। হাত কোমর ছাড়িয়ে পেট জড়িয়ে ধরতেই অহনা হাত খামচে ধরলো। সাদিকের গরম নিঃশ্বাস কাঁধে পরতেই কেঁপে উঠলো সে। নিঃশ্বাসের দ্রুত বেগ সামলাতে না পেরে একদময় নিজেকে সপে দিলো। সাদিক আগলে নিলো সম্পূর্ণভাবে। ঠিক যেমন ছয় বছর আগে আগলে নিতো ঠিক তেমন ভাবেই।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে বিরক্ত মাহাদীর সামনে হাজির হলো অহনা। সদ্য গোসল করায় চুল দিয়ে টপাটপ পানি পরছে তার। মাহাদী খিলখিল করে হেসে বলল,
–মাহাদীও গোসল করেছে, আম্মুও গোসল করেছে।

অহনা হেসে ছেলের মাথায় চুমু দিলো। পেছন পেছন আসলো সাদিক। ওরও চুল ভেজা। মুখ ব্যাজার করলো মাহাদী। লুকানোর জায়গা না পেয়ে মাকে জাপ্টে ধরলো। অহনা অবাক হলো না। অন্য সময় বাবা বাবা বলে মাথা খারাপ করে দেয় অথচ বাবাকে পেয়ে কাছে যাওয়ার নামও নিচ্ছে না। সাদিক ভ্রু বাঁকিয়ে ছেলের দিকে তাকালো। নতুন জিনিস অ্যাকসেপ্ট করতে পারতো না সে নিজেও। ছেলেটার সব অভ্যাস তার মতো হতে হবে কেন! মায়ের মতো সব মেনে নিলেই তো হয়।

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০৬

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৬

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

অহনার অবস্থাও ঠিক এমনই। শ্বশুরবাড়িতে মাস পেরোলেও নিজের অবস্থান ঠিক করতে পারেনি৷ এখনও সেই একই অবস্থান। শুধু থাকার ঘর বদলেছে। এছাড়া আর সব একই আছে। সকাল থেকে বাড়ির সমস্ত কাজ সাথে ফরিদার বাড়িয়ে দেওয়া কাজ আর কিছু হলেই কথা শুনানো। এগুলোই চক্রাকারে চলছে৷
আজকে নিজের মা ভাইয়ের খবর পেয়েছে অহনা। মায়ের মাথার স্থায়ী ছাদ এসেছে। দুদিন আগেই মামারা মায়েরও স্থায়ী এক ঠিকানা করে দিয়েছে। বিয়ে দিয়েছে মায়ের। অর্থাৎ, ভাইদের কাছে তাদের বোনও বোঝা হয়ে ছিলো। বোনের দ্বায়িত্বটাও নিতে পারলো না। আর তার ভাই! তার অবস্থান হয়েছে এতিমখানায়। এই খবর অহনা পেয়েছে শাশুড়ীর থেকে। তাচ্ছিল্যের হেসে খবর দিয়েছে সে। শুধু খবর দিয়েই ক্ষান্ত ছিলো না। আরো কত কথা যে শুনালো! অহনা মাথা নিচু করে শুনেছে সেসব। পুরোটা সময় শুধু এটাই মনে হয়েছে, যদি ওর অবস্থান একটু শক্ত হতো তাহলে ভাইকে এতিমখানায় থাকতে হতে হতো না। ও যদি একটু শক্ত হতো তাহলে মাকে এই অবস্থায় পরতে হতো না। মাকে চেনে ও। কোন পরিস্থিতির চাপে বিয়েটা করেছে সে না জেনেও ঠিক বুঝতে পারছে। তবে সাথে বোনের খবরটা পেলো একটু শান্তি পেতো। কে জানে, ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেমন নাকি সেও কোন বানের জলে ভেসে বেরাচ্ছে! তবে সব থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে ভাইটার জন্য। সর্বহারা পরিবারের সকলেরই একটা নড়বড়ে ঠিকানা হয়েছে, কিন্তু ভাইটা! আদরের ভাইটার শেষ ঠিকানা হলো এতিমখানায়! মামার বাড়ির সবাই তো বেশ অবস্থাপন্ন। তাও একটা মানুষের জায়গা হলো না! বুক ফেঁটে কান্না আসতে লাগলো অহনার। বিছানায় হাঁটুতে মুখ গুজে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো।
কিছু দরকারী কাগজের জন্য ভার্সিটি থেকে চলে আসতে হয়েছে সাদিকের৷ প্রায় সময়ই আসতে আসতে রাত হয়ে যায় জন্য এক্সট্রা চাবি নিজের কাছে রেখেছে সে। আজকেও সেভাবেই এসেছে। নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালাতেই বিছানায় ভুতের মতো কাউকে বসে থাকতে দেখলো। কপাল কুঁচকে গেলো তার। কে বসেছে দেখার জন্য দুই পা আগাতেই মাথা তুললো অহনা। চোখজোড়া জলে টইটম্বুর। ওকে দেখেই সাদিকের মাথায় আগুন ধরে গেলো। ভার্সিটিতে যথেষ্ট বদনাম হয়েছে ওর। অহনার কাজিন পুরো ভার্সিটিতে ওর নামে উল্টাপাল্টা কথা ছড়িয়ে বদনাম করেছে। সেই রাগ অহনাকে দেখে দ্বিগুণ, তিনগুণ হারে বৃদ্ধি পেলো। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসে অহনাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। তারপর চোয়াল শক্ত হাতে চেপে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–তোমার সাহস কি করে হল, আমার ঘরে আসার?

ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো অহনা। নিজেকে ছাড়াতে সাদিকের হাত ধরতেই এক ঝটকায় হাত সরিয়ে ফেললো সাদিক। দেখে মনে হলো কোন অপবিত্র জিনিস ওর হাতের উপর পরেছে। অহনার চোখ ফেঁটে পানি গড়িয়ে পরলো। সাদিক চুপ রইলো না একদম। অহনার হাত শক্তহাতে চেপে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলো। অহনা নিজের অপমান, অবহেলা সাইডে রেখে ওই অবস্থাতেই কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–আম-আমার ভাইকে এনে দেবেন?

কত মান, কত আশা নিয়ে কিছু চাইলো স্বামীর কাছে। কিন্তু স্বামীর মনে দয়ার সৃষ্টি হলো না। পৃথিবীর সর্বোচ্চ কঠোরতা নিয়ে বলল,
–আগে নিজের জায়গা গোছাও তারপর অন্যের কথা চিন্তা করো।

বলেই খট করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। শব্দে পলক ফেললো অহনা। সাথে সাথে চোখের পানি চোখ বেয়ে গালে গড়িয়ে পরলো। তার নিজের জায়গার ঠিক নেই, কথাটা সত্যি। বাইরে একা বাঁচার মতো করে বড় হয়নি, সেটাও সত্যি। কিন্তু বোনের মন যে মানে না। কোলে পিঠে করে বড় করা ভাইটার অবস্থা যে সহ্য হয় না! করুনা ভরে দরজায় কড়াঘাত করলো। আর্তনাদ করে বলল,
–যা বলবেন তাই করবো, শুধু আমার ভাইকে এনে দেন। জীবনেও আর কিছু চাইবো না।

দরজার ওপাশে কঠোরতা রাজ করছিলো। কঠিন মুখে দরজা খুলে চোখ গরম করে চাইলো অহনার দিকে। সাদিকের ভষ্ম করে দেওয়া দৃষ্টি দেখেও পিছু হাটলো না সে। হাত জোর করে হাঁটু গেড়ে বসে একই কথা বলতে লাগলো। বিরক্তির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে চিৎকার করে মাকে ডাকলো সাদিক,
–মা!

হুড়মুড় করে আসলো ফরিদা। সাদিককে এখন দেখে অবাক হয়ে বলল,
–তুই কখন আসলি?

আরো অবাক হলো সাদিকের পায়ের সামনে অহনাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে। বিষ্মিত স্বরে বলল,
–ওর কি হয়েছে?

সাদিক তপ্ত স্বরে বলল,
–এখন কি বাড়ি ফিরেও শান্তি পাবো না? ফিরলেই এই রঙঢঙ দেখতে হবে?

ফরিদা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
–তোর ফুপুর সাথে কথা বলিসনি?

–বলেছি। আর তাই বলে যে সবার সব আবদার সহ্য করতে হবে এর কোন মানে নেই। তুমি একে আমার চোখের সামনে থেকে সরাও। প্রচন্ড টায়ার্ড। যা বলার, যা করার সব সকালে দেখা যাবে।

বলেই আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা করলো না। আবার শব্দ করে দরজা বন্ধ করলো। ফরিদা বিরক্তি নিয়ে বলল,
–যাত্রাপালা শেষ হলে সবাইকে একটু শান্তি দিয়ে আগের ঘরে ফিরে যাও।

অহনা কান্না অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেলো। অপাত্রে দান ছিলো সবটা, বুঝে ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রাজ্যে ফিরে গেলো। নিজের জায়গা ঠিক করতে কি করতে হয় তা তো কেউ কোনদিন শেখায়নি। জীবন নাকি সব শিখায়। আঠারো বছরের জীবনের সতেরো বছর তো শক্ত ছায়াতলেই কাটিয়ে দিলো। এই মাঝের এক বছর অবশ্য অনেক ঝড় পাড় করে এসেছে। তাও তো শিখলো না। তাহলে শিখতে আর কত জীবন পার হয়ে আসতে হবে!

****
সাদিক দুই মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিলো। সেই ছুটি শেষের দিকে। আর ছুটি চাইলে বোধহয় চাকরি থাকবে না। তাই হোম অফিস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নিয়েই বসের সাথে মিটিং ছিলো। মিটিং শেষে ল্যাপটপে মাহাদীর হাস্যজ্বল ছবি দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এই কয়েকদিনে অজস্র ছবি তুলেছে ছেলের। খাওয়ার সময়, ঘুমানোর সময়, খেলার সময়, এমন কি যখন রেগে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে, তখনকার ছবিও আছে। একেকটা ছবি দেখে আর মন আদরে আদরে ভরে যায়। বাচ্চাটা যে এতো আদুরে হয়েছে! দেখলেই গাল, নাক টিপে দিতে ইচ্ছে করে। আর নাহলে ইচ্ছে করে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে গালে টাপুস টুপুস চুমু খেয়ে নিক। হঠাৎ করেই মাহাদীর বাচ্চাবেলা দেখতে মন চাইলো তার। অহনা বারান্দায় টেবিলে বসে দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। বড় বড় পা ফেলে সেখানে হাজির হলো। অন্য পাশের চেয়ার টেনে একদম অহনার গা ঘেঁষে বসে সিদ্ধ আলু হাতে নিয়ে ছিলতে ছিলতে বলল,
–অহনা, মাহাদীর ছোট বেলার ছবি আছে?

আড়চোখে সাদিকের কর্মকান্ড দেখছিলো অহনা। মনে মনে কিভাবে মানা করবে সেটা গোছাচ্ছিলো। সেটা বাদ রেখে ঘাড় কাত করে বলল,
–আছে। অনেক ভিডিও আছে। দাদী ওর ছোটবেলার সব মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করে রাখতো।

–দাদী কে?

সাদিক কৌতুহলী হলো। অহনা ছোট করে বলল,
–যিনি আমাকে থাকতে দিয়েছিলেন, তিনি।

সাদিক সামনে থেকে সিদ্ধ ডিম মুখে পুরে চিবাতে চিবাতে বলল,
–যার হাত ধরে পালিয়েছিলে, সে কি মাঝপথে রেখে পালিয়ে গেছিলো নাকি যে পাতানো দাদীর কাছে থাকতে হয়েছে?

অহনা চুপ করে রইলো। পাশের মানুষটা কি রিল্যাক্সে কথাটা বলল অথচ এর উত্তর ওর কাছে নেই। কিছু ব্যাখা করা বা প্রমান করারও কোন ইচ্ছাও নেই। সাদিক আরেকটা ডিম হাতে তুলে প্রসঙ্গ পালটালো। তার নিজেরও হয়তো এই টপিক পছন্দ হচ্ছে না। তাই বলল,
–তোমার দাদী এখন কোথায়?

অহনা এবারেও উত্তর দিতে চাইলো না। নিজেকে ইগনোর করা সাদিকের অপছন্দের কাজ। অহনার ঘাড় ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে ভ্রু নাচিয়ে উত্তর জানতে চাইলো। অহনা মুখে বিরক্তির আভা ফুটিয়ে বলল,
–দুই বছর আগে মারা গেছেন।

সাদিক উত্তর পেয়ে অহনাকে ছেড়ে দিয়ে হাতের ডিমটাও মুখে পুরে দিলো৷ দুইটা আলু ছেলার বদলে দুইটা ডিম গলধঃকরণ করে বলল,
–এটা ওনারই বাড়ি?

অহনা মাথা উপর নিচ করে সায় জানাতেই সাদিকের কপাল কুঁচকে গেলো। রাগী গলায় বলল,
–এখানে আর থাকবে না তুমি। উত্তরায় আমার ফ্ল্যাট আছে। সেখানেই থাকবে। আর সেখানে থাকতে না চাইলে অজস্র ফ্ল্যাট আছে এই শহরে। অন্য কারো বাড়িতে তোমাদের রাখতে চাই না।

অহনা সাদিকের আড়ালে তাচ্ছিল্যের হাসলো। একসময় ছিলো যখন মাথার উপর ছাদ পাওয়ার জন্য উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ছুটেছে। আর আজ অজস্র ছাদ দেখাচ্ছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–বাইরে কোথাও থাকার মতো টাকা আমার নেই।

সাদিক রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–তোমাকে কেউ টাকা দিতে বলেনি। তোমাদের দ্বায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে।

অহনা থমথমে মুখে বলল,
–আপনার টাকায় আমি থাকবো না আর আমার ছেলেও থাকবে না।

সাদিক আরো রাগলো। তেজি হাতে অহনার চোয়াল ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
–আমার ছেলেকে জন্ম দেওয়ার আগে কথাটা মাথায় রাখা উচিত ছিলো।

অহনার ইচ্ছে করলো বলুক,
–আপনার ছেলে তো দুই হাজারের বিনিময়ে গর্ভে আসার পরেই মারা গেছে। যার জন্ম হয়েছিলো সে শুধু আমার সন্তান।

বলা আর হলো না। মনের কথা মুখে এনেছিলোই বা কবে যে আজ আনবে! মাহাদী আসায় টপিক থেকে একপ্রকার ছুটিই পেলো সে। মাহাদী কয়েকদিন আগে একটা গোলাপি নয়নতারার চারা লাগিয়েছিলো। সেই গাছেই আজ প্রথম ফুল ফুটেছে। মায়ের জন্য সেই ফুল তুলে এনেছিলো সে। আর এসেই দেখে, মায়ের পাশ ঘেষে অন্য একজন বসে আছে। মায়ের সাথে কেউকে বসে থাকা দেখতে মাহাদীর কবেই বা ভালো লেগেছে যে আজ লাগবে। এক ছুটে মায়ের কাছে গিয়ে আছড়ে পাছড়ে কোলে উঠে বসলো। অহনা কাজ বাদ দিয়ে ছেলেকে আঁকড়ে ছেলের গালে চুমু দিয়ে বলল,
–মা কাজ করছে আব্বু। তুমি পরে কোলে বসো।

মাহাদী সজোরে মাথা নেড়ে জড়িয়ে ধরলো মাকে। ধরেই ক্ষান্ত হলো না। রাগী চোখে সাদিকের দিকে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলো, মা শুধুই তার। এদিকে যেনো নজর না দেয়। সাদিকই বা বাদ যাবে কেন? সে আরো ঘেষে বসে পেছন থেকে মা ছেলেকে একসাথে আঁকড়ে ধরলো। চমকে উঠে অস্বস্তিতে গাট হয়ে রইলো অহনার। ছেলেকে সরিয়ে জায়গা থেকে উঠতে চাইলেও বাবা ছেলের জন্য একদম পারলো না। দুজনেই তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। অন্যদিকে মাহাদী আর সাদিকের অলিখিত প্রতিযোগিতা চলছে। মাহাদী এবারে মায়ের গালে চুমু খেলো। অহনা হেসে ছেলেকে ফিরতি চুমু দেওয়ার আগেই সাদিক তার গলা জড়িয়ে মাথা নিজের কাছাকাছি এনে অহনার গালে এক গভীর চুমু খেলো। এরপর কানের লতি আর সর্বশেষে ঘাড়ে আর ঘাড় জড়িয়ে রাখা মাহাদীর হাতে একসাথে চুমু খেয়ে তবেই ছাড়লো। অহনা বিষ্মিত হয়ে সাদিকের দিকে তাকাতেই দেখে সাদিক মিটিমিটি হাসছে। অসহায় অবস্থায় পরে কান্না আসলো তার। মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। মাহাদী হারতে নারাজ। হাতের ফুল মায়ের হাতে তুলে সাদিকের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিলো। এর মানে একটাই। এখন তুমি ফুল পাবে কোথায়! ফুল তো আর নাই। তবে সাদিক সেদিকে আর গেলোই না। মাহাদীকে ফুল দিতে দেখে মন খারাপের ভাণ করে বলল,
–আমার ফুল কই?

মূহুর্তেই মাহাদীর মুখের হাসি উধাও হয়ে গেলো। ছোট মনে আঘাত লাগলো খুব। মূহুর্তেই বাবার জন্য ফুল আনতে দৌড় দিতেই সিঁড়িতে পায়ে পা বেজে ধারাম করে উঠানে পরে গেলো। অহনা দৌড়ে এসে ছেলেকে তুলতেই মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো মাহাদী। সাদিকও দৌড়ে আসলো। মাহাদী গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–বাবা যাবো, বাবা যাবো।

অহনা বিচলিত হয়ে সাদিকের দিকে ইশারা করে বলল,
–ওইতো বাবা, যাও।

মাহাদী ওদিকে তাকালোও না৷ সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
–না, না। বাবা যাবো।

সাদিক থমকে দাঁড়ালো। মাহাদীর স্পষ্ট কথা বলায় বরাবরই মুগ্ধ হয় সে। এবারে হলো না। মূহুর্তেই মনে হলো, ওকে ধাক্কা দিয়ে ওদের জীবন থেকে বের করে দেওয়া হলো। তার ছেলেটা ওকে বাবা হিসেবে মানতে নারাজ! আসার সময় অহনার ব্যাগে ওর প্রেগ্ন্যাসি জার্নির সম্পূর্ণ রিপোর্ট আর মাহাদীর বার্থ সার্টিফিকেট দেখেছিলো। আচানক এমন বাবা হওয়ার খবরে মাথা ঘুরে উঠেছিলো তার। ছেলেটা তার নিজের। এখনও সেই অনূভুতি সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু তাই বলে বাবা হিসেবে মানবে না! পা আগালেও দুই পা পেছালো। ঢোক গিলে মা ছেলের মাঝ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলল।

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০৫

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৫

শ্বশুরবাড়িতে অহনার থাকার পাঁচ সাতদিন হয়ে গেলো। এই কয়েকদিনে বদলায়নি কিছুই। বরং সাদিক চলে যাওয়াতে ফরিদা আরো ঝাড়াহাতপা হয়ে গেছে। বাড়ির সব কাজের ভার অহনার কাঁধে তুলে নিশ্চিন্তে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। অহনা কাজের ফাঁকে যখন খেতে বসে তখন ভাগে পড়ে বাসি রুটি কিংবা বাসি ভাতের সাথে মাছ ছাড়া মাছের সামান্য তরকারি অথবা দুইদিনের পুরোনো ভাজি। সেটাই খেয়ে ফেলে ক্ষিদের তাড়নায়। ওর আনন্দ তো হয় নিজের ঘরে ফিরে, যখন তার ঘর প্রাকৃতিক আলোতে সেজে ওঠে। দুপুরে ঘর আলো করে বসে বসে আকাশ দেখে সে৷ আর নয়তো সন্ধ্যার পর অন্ধকার আকাশে তারা ওঠা দেখে। দেখে আর চমৎকৃত হয়। তারাগুলো কি সুন্দর জ্বলজ্বল করে। দেখতে কি যে ভাল লাগে!
কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখতে গেলে অন্য কিছু দেখায়। তার ঘরে লাইটের ব্যবস্থা হয়নি। হয়নি ফ্যানের ব্যবস্থাও। সন্ধ্যা হলেই অন্ধকারে পুরো ঘর ডুবে যায়। আবার সূর্য মাথার উপর উঠলে অসহ্য গরমে টেকা দুষ্কর হয়ে উঠে। আবার জানালা খুললেই মশা এসে ভীড় করে। এতেও অহনা সুখ খুঁজে নিয়েছে৷ ভাগ্য তাকে এটা দিলে এটাই সই।
সেদিন দুপুরের রান্নায় ব্যস্ত ছিলো অহনা। ফরিদা বোধহয় ঘরে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। ওই মূহুর্তে কলিংবেল বেজে উঠলো। অহনা কি করবে ভেবে না পেয়ে গুটিগুটি হেঁটে দরজা খুলে দিলো। দরজার ওপাশে মাঝবয়েসী একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। অহনাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে কপাল কুঁচকে বলল,
–তুমি সাদিকের বউ?

অহনা ভয়ে ভয়ে মাথা উপর নিচ করে সায় জানাতেই সামনের মহিলাটি ওকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। দরজা খোলার শব্দে ফরিদা প্রায় দৌঁড়ে এসেছে। মেয়েটার উপর চোটপাট করার সমূহ ইচ্ছা সামনে ননদকে দেখে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেলো। মুখে প্রসন্ন মুখে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল,
–তুমি কখন আসলে সিদ্দিকা?

সিদ্দিকা ভেতরে সোফায় বসতেই অহনা রান্নাঘরে ফিরে গেলো। রান্নাঘর থেকে তাদের কথোপকথন স্পষ্ট কানে আসতে লাগলো তার। না চাইতেও সব কথা শুনতে লাগলো। সিদ্দিকা বেশ গম্ভীর গলায় বলল,
–এসব কি ভাবী? ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে বলে মেয়েটার এই অবস্থায় রাখবেন? বড় ভাই কল দিয়ে না বললে তো কিছুই জানতে পারতাম না। সাদিকও তো শুনলাম ভার্সিটি চলে গেছে।

ফরিদা মন মরা হয়ে বলল,
–সাদিকের পছন্দে বিয়ে হয়নি। মেয়ের পরিবার জোর করে বিয়ে দিয়েছে। সাদিক তো ওকে পছন্দই করে না। ও তো মৌলিকে..

বলেই থামলো ফরিদা। অর্ধসমাপ্ত কথাটা সিদ্দিকা বুঝতে পারলো। ফরিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–তালাকের কথা চিন্তা করছি। তালাক হয়ে গেলেই সাদিক আর মৌলির বিয়েটা দিয়ে দেবো। এতো ঝামেলা আর ভালো লাগে না। এখন এই মেয়ে এসেছে, দুইদিন পর আরেকটা আসবে।

সিদ্দিকা গম্ভীরমুখে বলল,
–সাদিক এখন বিবাহিত ভাবী৷ মৌলি আমার মেয়ে হলেও সাদিক আমার পর না। নিজের মেয়ের জন্য অন্য কারো সংসার ভাঙার কল্পনা করাও মহা পাপ ভাবী। বিয়ে হয়েছে, পরিস্থিতি মেনে নেন।

ফরিদা চুপচাপ শুনে উদাস হলো। তার পরপরই চমকে উঠে বলল,
–এই ব্যাপারে আর কে কে জানে?

–শুধু আমি আর মা জানে। মা সাদিকের বউ নিয়ে বাড়ি যেতে বলেছে।

ফরিদা হায় হায় করে উঠে বলল,
–বাড়ি! অসম্ভব! মেয়েটাকে তো সাদিক সহ্যই করতে পারে না। ওকে বাড়িতে নিয়ে গেলে তুলকালাম হয়ে যাবে। ওই দেখো, রান্নাঘরে কাজের বাহানায় আমাদের সব কথা শুনছে। কি শেয়ানা মেয়ে দেখেছো! যাও ঘরে যাও। বাবা মা ভদ্রতা শেখায়নি?

অহনা কোন একটা কাজে দরজার দিকে আসতেই ফরিদার নজরে পড়ে যায়। তক্ষুনি নিজের কথা রেখে গর্জে উঠলো ওর উপর। অহনা ভয়ে চমকে উঠে রান্না ফেলে চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে গেলো। ওকে স্টোররুমে যেতে দেখে সিদ্দিকা কপাল কুঁচকে বলল,
–ওটা তো স্টোররুম। মেয়েটাকে ওখানে থাকতে দিয়েছেন?

ফরিদা মুখ বেঁকিয়ে বলল,
–তো আর কোথায় থাকতে দেবো? সাদিক তো ওর ছায়াও সহ্য করে না। আমার ঘরে তো ঢুকতেই দেবো না আমি। আর গেস্টরুমে কত দামী দামী জিনিস আছে। যদি চুরি করে বিক্রি করে দেয়? এসব মেয়েদের তো হাত ভালো না। কোন পরিবার থেকে এসেছে কে জানে!

–আমি তো শুনলাম, ও সাদিকের বন্ধুর কাজিন। ওর বন্ধু যদি ভালো ফ্যামিলি থেকে আসে তাহলে ওরও ভালো ফ্যামিলি থেকেই আসার কথা।

–ওসব ভুয়া কথা! কার মনে কি আছে তা আমরা জানবো কীভাবে?

সিদ্দিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সামনের মানুষটার মনে কোন কথাই ঢুকছে না। তাই আর বুঝাতে চাইলো না। উঠে দাঁড়ালো সরাসরি অহনাকে থাকতে দেওয়া ঘরে গেলো। মেয়েটা উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয় নাকি সেই ভয়ে ফরিদাও পিছু নিলো। ঘরের জানালা খোলা থাকলেই মশা আসে জন্য দরজা বন্ধ না করে জানালা খোলে না অহনা। তবে আজকে দরজা বন্ধ করলেও জানালা খোলেনি। অন্ধকারে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো। সিদ্দিকা ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ভ্রু কুঁচকে বলল,
–ঘর এতো অন্ধকার করে রেখেছো কেন? লাইট জ্বালাও।

অহনা চমকে উঠলেও নিজেকে সামলালো। মিনমিন করে বলল,
–ঘরে লাইট নেই।

সিদ্দিকা ঠান্ডা চোখে ভাবীর দিকে তাকাতেই ফরিদা আমতা-আমতা করে বলল,
–লা-লাইটের লাইন নেই তো। কোথায় লাগাবো?

সিদ্দিকা তপ্ত শ্বাস ফেলে এগিয়ে অহনার হাত ধরে টেনে বলল,
–আমার সাথে এসো।

অহনা মাথা নিচু করে চুপচাপ গেলো। সিদ্দিকা ওকে সাদিকের ঘরে নিয়ে আসলো। এর আগে এই ঘরে সে আসেনি। সিদ্দিকা অহনাকে খাটে বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো। এরপর নরম স্বরে বলল,
–তোমার নাম কি?

–মারিয়াম জান্নাত অহনা।

অহনা ছোট করে উত্তর দিলো। সিদ্দিকা মৃদু হেসে বলল,
–সুন্দর নাম। আমি সাদিকের ফুপু। সাদিক আমার কথা খুব মানে। তুমি কোন চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় সব ঠিক করে দেবে। বুঝেছো?

অহনা মাথা হেলিয়ে সায় জানাতেই সিদ্দিকা আবার বলল,
–তোমার সব জিনিসপত্র এখানে নিয়ে এসো। এখন থেকে তুমি সাদিকের ঘরেই থাকবে।

অহনা চমকে উঠলো। ও এখন সাদিকের ঘরে আছে! ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। এই মূহুর্তে পালিয়ে যেতে মন চাইলেও পারলো না। দুরুদুরু বুকে অল্প মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাতেই সামনে চেয়ার টেবিল দেখতে পেলো। চেয়ারে একটা তোয়ালে ছড়িয়ে রাখা। বোধহয় সাদিকেরই। মূহুর্তেই মন ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো। সিদ্দিকা ফরিদার অসন্তোষ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
–কাল ওকে সাথে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে জামাকাপড় কিনে দেবো। তোমার ছেড়া শাড়ি ওর গায়ে মানাচ্ছে না ভাবী।

ফরিদা কিছুই বললো না। সিদ্দিকা চলে যাওয়ার সময় ভেজা চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
–এতো ভালো মানুষি দেখিও না সিদ্দিকা। মেয়ের কথাটা চিন্তা করো একবার।

সিদ্দিকা মৃদু হেসে বলল,
–সবার উপর যে মায়া দেখাও তার এক অংশ মেয়েটার উপর দেখাও। বাকি আমার মেয়েকে আমি বুঝে নেবো।

*****
দুই তিনদিন পার হলেও সাদিক আর মাহাদীর সম্পর্কের কোন উন্নতি নেই। কিছুক্ষণ পরপর এটা ওটা নিয়ে সাদিক মাহাদীকে খোচাতেই থাকে। যেমন গতকালই অহনা রান্নাঘরে কাজ করছিলো আর মাহাদী বারান্দায় রাখা টেবিলে বসে ড্রয়িং করে বাইরে সাইকেল চালাচ্ছিলো। হুট করে সাদিক রান্নাঘরের দরজায় এসে বলল,
–তুমি জানো অহনা, আকাশ নীল হয় কেনো?

অহনা বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
–কেনো?

সাদিক কাঁধ নাচিয়ে বলল,
-ওর ইচ্ছা।

বলেই অহনাকে হতভম্ব করে হেলতে দুলতে চলে গেলো। ওকে টেবিলের কাছে দেখেই মাহাদী সাইকেল ফেলে ছুটে এসে দেখে, সাদিক ওর আর্টের দফারফা করে ফেলেছে। সানসেটের সুন্দর ছবি আঁকাচ্ছিলো সে। সেখানকার পুরো আকাশে সবুজ রঙ দিয়ে দিয়েছে। মাহাদী ঠোঁট ফুলিয়ে ভেজা চোখে মায়ের কাছে অভিযোগ জানালো। অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলো শুধু। ছেলের চোখ স্পষ্ট করে বলছিলো, এ তুমি কেমন বাবা এনেছো আম্মু? বদলে আনো তাড়াতাড়ি!

অহনা নিজের সিদ্ধান্তে বিভ্রান্ত। সাদিককে এনে ঠিক করেছে নাকি বুঝতে পারছে না। ওর এমন ব্যবহার তো কোনদিনও দেখেনি। এ কি নতুন রুপ!
কাজ আছে অহনার। বিকালের দিকে বড় ব্যাগ হাতে বেরোচ্ছিলো। সাদিক বাঁধ সাধলো। পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
–কোথায় যাচ্ছো?

অহনা ছোট করে বলল,
–আমার বাইরে একটু কাজ আছে।

–কখন আসবে?

–দুই এক ঘন্টা লাগতে পারে।

সময় শুনে তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে বলল,
–ততক্ষণ কি আমি একা থাকবো?

অহনা আমতা-আমতা করে বলল,
–মাহাদী আছে তো।

সাদিক মুখ ঘুরিয়ে রাগ দেখিয়ে বলল,
–তোমার ছেলে আমার সাথে কথা বলে না।

এবারে ছেলে সম্পর্কে বাবার অভিযোগ। অহনা হতাশ হয়ে ছেলের দিকে তাকালো। বাড়ির সামনের ছোট উঠানে নিজের খেলনা গাড়ি দিয়ে খেলছিলো মাহাদী। অহনা ছেলের পাশে বসে বলল,
–আব্বু, এমন করছো কেন? তুমি তো সারাক্ষণ বাবা বাবা করতে। এখন বাবার সাথে কথা বলো না কেনো? আমার মাহাদীর তো গুড আর তার বাবাও গুড।

মাহাদী সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
–নাহ। গুড মাহাদীর গুড আম্মু। বাবা গুড না।

সাদিক চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই অহনা ছেলেকে আড়াল করে বলল,
–ঠিক আছে৷ গুড মাহাদী বাবার সাথে গুড বাচ্চা হয়ে থাকুক। আম্মু কাজ শেষে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।

মাহাদী অনিচ্ছায় ঘাড় নাড়তেই অহনা সন্তোষজনক হেসে সাদিকের দিকে তাকালো। সাদিক কপাল কুঁচকে বিরক্তিকর স্বরে বলল,
–আমি তোমার ছেলের সাথে এতোক্ষণ বোর হবো নাকি? বাইরে যাবো আমি। তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করো, আমার সাথে যাবে নাকি?

অহনা মাহাদীর দিকে ফিরতেই সে সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
–না আম্মু, মাহাদী যাবে না।

সাদিক গরম গলায় বলল,
–কে যাবে না?

বলেই অহনাকে উপেক্ষা করে মাহাদীকে পাজাকোলা করে তুলে এদিক ওদিক ঘুরাতে ঘুরাতে হাঁটতে লাগলো। মাহাদী প্রথমে ভয়ে চিৎকার দিলেও পরক্ষণেই মজা পেয়ে হাসতে লাগলো। অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তালা দিয়ে পাশের বাড়িতে গেলো। দরজা নক করতেই সেদিনের সেই মহিলা এসে দরজা খুলল। অহনা তাকে দেখেই তাড়াহুড়ো করে বাড়ির চাবি দিয়ে বলল,
–মৌসুমি ভাবী, উনি মাহাদীকে নিয়ে একটু বাইরে গেছেন। ফিরলে একটু চাবি দিও।

মৌসুমি চাবি হাতে নিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,
–তোর বর এখন কেমন রে? আগের মতোই আছে নাকি বদলেছে?

অহনা মলিন হেসে বলল,
–ওনাকে তো আমার জন্য আনিনি। বদলালেও বা কি!

–বেশি করে সময় কাটা। পুরুষ মানুষ তো। সুখ পেলেই কাছে থাকবে।

–ওনার সুখ ফেলে এখানে এসেছে ভাবী। বিয়ের আসর থেকে টেনে তুলে এনেছি৷ এখন শুধু যাওয়ার দিন গুণছে।

মৌসুমি বিরক্ত হয়ে বলল,
–তুই এতো শক্ত কেন! বাচ্চা হওয়ার পর দাদী কতবার বরের কাছে যেতে বলল। গেলিই না। এখন ফিরেছে আর তুই গুরুত্বই দিচ্ছিস না। দাদী বেঁচে থাকলে এক ঘরে বন্ধ করে রাখতো তোদের।

অহনা কথা ঘুরিয়ে বলল,
–হোটেলের লোকেরা আসতে পারে৷ ওদের থেকে জিনিসগুলো নিয়ে তোমার কাছে রেখো। আমি এসে নেবো।

মৌসুমি বুঝে আরো বিরক্ত হয়ে বলল,
–আচ্ছা ঠিক আছে। আমার কথা তো শুনবি না। সবসময় নিজের মনমনানিই করবি।

বলেই বাড়ির ভেতর চলে গেলো। অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ জীবন ওর সাথে বাড়ে বাড়ে খেলে। এবারেও খেলছে। দেখা যাক, এই খেলা ওকে কতদূর নিয়ে যায়!

সাদিক মাহাদীর হাত ধরে আশেপাশে হাঁটতে লাগলো। কিছুদূর হাঁটার পর ডাবওয়ালাকে দেখা গেলো। ডাবওয়ালা বোধহয় মাহাদীর অতি পরিচিত। তাকে দেখেই আদুরে গলায় বলল,
–মাহাদী দাদু, ডাব খাবা?

মাহাদীও এক গাল হেসে ঘাড় কাত করে বলল,
–খাবো দাদু।

সাদিক মাহাদীর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
–দাদু বলছো কেন? তোমার দাদু অন্য কেউ। নানু বলো এনাকে।

ডাবওয়ালা ডাব কাটা রেখে সন্দেহী গলায় বলল,
–আপনি কেডা?

সাদিক থতমত খেয়ে গেল। আসলে কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে আস্তে করে বলল,
–আমি ওর মায়ের হাজবেন্ড।

ডাবওয়ালা কপাল যথাসম্ভব কুঁচকে বিরক্তি গলায় বলল,
–মানে ওর আব্বা?

সাদিক হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,
–হ্যাঁ, সেটাই।

এবারে বিরক্তির সাথে সাথে তার গলা দিয়ে রাগ ঝড়ে পরলো। তেঁতে উঠে বলল,
–ওহ! তো এতো বছর যাওয়ার পর বউ ছাওয়ালের কথা মনে পড়ছে? আমি মাসে দুইবার করে বাড়িত যাই। নাতিপুতিরা দাদু দাদু কইয়া কোলে ঝাপায়া আসে। আর এতো সুন্দর বাচ্চাডার কথা একবারও মনে পড়লো না। ছ্যাহ! এই নাও দাদু। টাকা লাগবে না। ফিরি দিলাম। তোমার বাপের টাকা আমি নিমু না।

মাহাদী ডাবের পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পানি খেতে শুরু করলো। সাদিক রেগে বলল,
–নানু বলে ডাকুন। ওর দাদু আছে।

ডাবওয়ালা ওকে পাত্তাই দিলো না। মাহাদী বাবার হাত ধরে তাদের কথা শুনছিলো আর ডাবের পানি খাচ্ছিলো। কথা শেষ হতেই একটা ডাবের দিকে আঙুল তুলে বলল,
–দাদু, এটা আমি নেই? আর্ট করবো।

ডাবওয়ালা পান খাওয়া দাঁত বের করে হেসে বলল,
–তুমি নিতে পারবা না দাদু। অনেক ভারী। আমি তোমার বাড়িতে দিয়ে আসবোনে। একটা না, অনেকগুলা দেবোনে।

মাহাদী খুশি হলেও সাদিকের রাগ হলো। কেউ তার কথা পাত্তাই দিচ্ছে না! পকেট থেকে একশো টাকার নোট বের করে ভ্যানের উপর শব্দ করে রেখে বলল,
–ওর বাবার ডাব খাওয়ানোর ক্ষমতা আছে। ফ্রীতে খাওয়াতে হবে না।

তারপর আর সেখানে দাঁড়ালো না। মাহাদীর হাত এক প্রকার টেনে অন্যদিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
–তোমাকে আর এখানে আনবো না। কিসব মানুষের মধ্যে যে বড় হচ্ছো!

সাদিক বড় বড় পা ফেলে হাঁটছিলো। ওর হাঁটার সাথে তাল মেলাতে মাহাদীকে দৌঁড়াতে হচ্ছিলো। খানিকটা পথ যাওয়ার পর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
–আমি হাঁটতে পারছি না। ব্যাথা করছে।

সাদিক দাঁড়িয়ে পরলো। কপাল কুঁচকে মাহাদীর অবস্থা দেখে কোলে তুলে নিয়ে বিরক্তিকর স্বরে বলল,
–কোলে কোলে মানুষ হয়েছো। পা তো ব্যাথা করবেই।

সাদিক কোলে তুলতেই মাহাদী ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। প্রশান্তি বয়ে গেলো সাদিকের হৃদয়জুরে। তারপর খেয়াল করলো মাহাদীর জোরে জোরে শ্বাস ফেলা কমছে না। সাদিক বিচলিত হয়ে মাহাদীর পিঠ ঘষে মৃদু গলায় বলল,
–কি হয়েছে? পানি খাবে?

মাহাদী মাথা নেড়ে না বুঝিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। সাদিকও শক্ত হাতে আগলে রাখলো। মাহাদী মিনিট খানেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যেতেই সাদিক আবার হাঁটা শুরু করে বলল,
–এতো পাতলা কেন তুমি? বাতাসের থেকেও হালকা।

মাহাদী কিছু বলল না। ওভাবেই বাবার সাথে লেপ্টে থাকলো। সাদিক হাঁটতে হাঁটতে মাঠে কাছে চলে আসলো। অসমাপ্ত এক বিল্ডিং এর সামনে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। বাচ্চারা সেটাকেই খেলার মাঠ বানিয়ে ফেলেছে। সেখানেই অনেকগুলো বাচ্চা ফুটবল খেলছে। সাদিক দেখেছিলো, মাহাদী প্রায় সময়ই ফুটবল পায়ে নিয়ে হাঁটে। তাই দাঁড়িয়ে পরে বলল,
–চলো ফুটবল খেলি।

মাহাদী মাথা নেড়ে বলল
–আমি দৌড়াতে পারি না। কষ্ট হয়।

–দৌড়াতে হবে না। তুমি আমার কাছেই থাকো।

বলেই ওকে কাঁধে তুলে নিলো। কাঁধের দুই পাশে পা দিয়ে বসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো মাহাদী। নিজেকে পাখির মতো লাগতে লাগলো তার। মনে হলো এখন উড়তে পারবে। কিছুক্ষণের মধ্যে উড়তেও লাগলো। সাদিক ওকে কাঁধে তুলে ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে শক্ত করে ধরে বাচ্চাদের সাথে দৌড়ে দৌড়ে ফুটবল খেলতে লাগলো। মাহাদী মহা আনন্দে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০৪

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৪

সকালে খলিল সাহেবের দয়ায় অহনার খাবার জুটলেও বেলা গড়াতেই নিজের রুপে ফিরলো ফরিদা। অহনা ঘর থেকে শুনলো, কাউকে গরম গলায় বলছে,
–তোর আর আসা লাগবে না। নতুন লোক পেয়েছি।

ওপাশের ধীর গলার স্বর তার কান পর্যন্ত না আসলেও ফরিদার আবার গলা শোনা গেল,
–না মানে না। জোর করে থাকলে কি বিনা বেতনে কাজ করবি? টাকার বেলায় তো এক চুল ছাড় নাই। তাহলে জোর করছিস কোন সাহসে?

তারপরই দরজা বন্ধ করার শব্দ শোনা গেল। এতো জোরে বন্ধ করা হয়েছে যে সেই আওয়াজে কেঁপে উঠলো অহনা। ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেললো। পরমুহূর্তেই তার ঘরের দরজা খুলে গেল। রণমুর্তি ধারণ করে ভেতরে আসলো ফরিদা। আগুন চোখে আগে পুরো ঘর দেখলো। সব ঝেড়ে পুছে বাসযোগ্য করা হয়েছে। অচল বাক্সগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখায় জায়গা অনেক বের হয়েছে। ভাঙা শোকেস পরিষ্কার করে তার দেওয়া কাপড় ভাজ করে গুছিয়ে রাখা। এসব দেখে আরো কপাল কুঁচকালো ফরিদা। অহনার দিকে ফিরে গর্জে উঠে বলল,
–এসব রঙঢঙ করতে মন চাইলে বাড়ির বাইরে গিয়ে করবে। এ বাড়িতে থাকতে হলে খেটে খেতে হবে। মাগনা খাবার দেই না আমি।

ফরিদার গর্জনে অহনার বুক ভয়ে ধুকপুক করতে লাগলো। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলল,
–কি করতে হবে?

ফরিদা মুখ বেঁকিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
–মহারানীর বাইরে পদার্পণ ঘটলে তবে না দেখতে পাবেন, কি কি করতে হবে?

অহনা সটান উঠে দাঁড়ালো। তক্ষুনি ফরিদার নজর খাটের পাশে জড়ো করে রাখা সকালের প্লেট আর গ্লাসের দিকে গেল। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল,
–ওগুলো কি বাপের বাড়িতে পাঠানোর ধান্দায় আছো? ফকিরের বংশ থেকে এসেছো নাকি চোরের বংশ থেকে?

অপমানে অহনার চোখে পানি চলে আসলো। কোনোমতে মাথা দুই পাশে নাড়িয়ে প্লেট গ্লাস হাতে তুলে নিলো। তার পরিবার যথেষ্ট ভালো, সচ্ছল আর শিক্ষিত ছিলো। বাবার ক্যান্সারের চিকিৎসায় সব চলে না গেলে আজ এইখানে থাকত না সে। হয়তো কলেজ পাশ করে কোন ভালো ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নিতো। তখন এখানে অপমানিত হতে হতো না। মন চাইলো এগুলো সামনের মানুষটাকে জানিয়ে দিক সে। কিন্তু জানাতে পারলো না। কবেই বা কাকে মনের কথা জানাতে পেরেছে সে! বাবা বলতো, “আমার মেয়েটার যে কি হবে!” কি হবে দেখার জন্য আজ বাবা নেই। আর নেই জন্যই বোধহয় কিছু হচ্ছে তার সাথে।

ঘরের কাজ করতে খুব কষ্ট হয়েছে তার। নিজের বাড়িতে রান্না ছাড়া আর কিছুই কোনদিন করতে হয়নি। রান্নাও শখের বশে করতো। বাবা মারা যাওয়ার পর নানাবাড়িতে তার ভাগে এই রান্নার দ্বায়িত্বটাই পরেছিলো কারন ভালো রান্নার সুখ্যাতি তার ঝুলিতে ছিল। তখন রান্নার চাপে অন্যদিকে নজর দেওয়ার সময়ই হয়নি। যৌথ ফ্যামিলির তিন বেলার কয়েক পদের রান্না। তার উপর সাহায্যেরও কেউ ছিলো না। এই কয়েকমাসে আর কিছু না হলেও রান্নায় পাকা হয়ে উঠেছে। কিন্তু ওইযে আর কিছু! আর কিছু করতে অনেক সময় লেগে গেলো। এক ঘর ঝাড় দেওয়ার পর একটু বিরতি দিয়ে আরেক ঘর ঝাড় দিলো। ভারী ঝাটা হাতে দিয়ে ঝাড় দিতে গিয়ে কবজি ব্যাথা হয়ে গেলো। সেই কাজ শেষ হলে রান্নাঘরের এঁটো থালাবাসন পরে রইল। সকালের থালাবাসন মাজতে মাজতে দুপুর প্রায় হয়েই এলো। ভেতর ঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো ফরিদা,
–ওইরকম খুটে খুটে কাজ করলে বাইরের দরজা খোলা আছে। যেতে পারেন আপনি।

ফরিদার কথার বাণে অহনার চোখের পানি থালা বাসন ধোয়ার নোংরা পানির সাথে মিশে চলে গেলো। দ্রুত হাতে বাসন মেজে সাজিয়ে রেখে রান্নার কাজে হাত লাগালো।বিয়ের পরের প্রথম রসুই অহনার। সে হোক, বিয়েটা কেউ মানেনি বা হোক, বউ হিসেবে রান্নার দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়নি৷ কিন্তু মনে প্রানে তো নিজেকে বাড়ির বউ বলে মেনে নিয়েছে নিজেকে। স্বামী তাকে না মানলেও সে তো মানে। বাঙালি রমনীদের বিয়ের সাথে সাথে স্বামীর প্রতি এক অবাধ্য টান অনুভব করে বলেই শুনেছে সে৷ এখন সেই টান সেও অনুভব করছে। মানুষটা তার হাতের রান্না খাবে ভেবেই উৎসাহ দ্বিগুণ তিনগুণ বেড়ে যাচ্ছে। মাছ কাঁটলো, সবজি কাটলো, মরিচ পেঁয়াজ সব কেঁটে চুলা ধরিয়ে চুলার আগুনে হাড়ি চড়লো। আর সেই আগুনেই গলতে লাগলো তার সব অভিমান।

সারাদিন বাইরে বাইরে থেকে বাড়ি ফিরে খেতে বসলো সাদিক। রুই মাছ ভুনা, লাল শাক, আলু ভাজি আর মিষ্টি কুমড়া ভর্তা। মেনু দেখেই কপাল কুঁচকালো সে। তার বাড়িতে আজ পর্যন্ত, আলু ভাজি আর মাছ একসাথে রান্না হয়নি। তাহলে আজ কেন! মাকে জিজ্ঞাসা করার আগেই অহনা ডালের বাটি নিয়ে ছুটে আসলো। সব গোছালেও ডাল দিতে ভুলে গেছে। ওকে দেখেই সাদিক ঠান্ডা স্বরে বলল,
–আজকের রান্না কে করেছে মা?

ফরিদা ব্যাজার মুখে বলল,
–কে আর করবে? তোর বউ করেছে। আমি কি অতো পারি…

কথা শেষ করার আগেই ভাঙচুর হয়ে গেল। টেবিলের কোনো খাবারই আর টেবিলে থাকলো না। তাদের অবস্থান হলো মেঝেতে গড়াগড়ি অবস্থায় । ফরিদা চমকে চেয়ার থেকে উঠে গেল। অহনা রান্নাঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলো। সাদিক গর্জে উঠে বলল,
–যাকে দেখলেই ঘিন্না লাগে তাকে রান্নাঘরে অ্যালাও করেছো কেন? ওর হাতের রান্না রাস্তার কুকুর বিড়ালও থুথু ফেলে চলে যাবে।

অহনা শক্ত হাতে দরজার কপাট চেপে নিজেকে সামলালো। ইচ্ছে হলো নিজের হাত দুটো কেটে শরীর থেকে আলাদা করে ফেলুক।

***
জার্নির ক্লান্তিতে এসেই ঘুমিয়ে পরেছিলো সাদিক৷ উঠলো রাত আটটায়। উঠে চোখ ডলতে ডলতে বাইরে এসে দেখে সকালের সেই পিচ্চি ছেলেটা পা ছড়িয়ে নিজের ছোট টেবিলের উপর খাতা রেখে ঝুঁকে কিছু করছে৷ আগ্রহ হলো তার। ধীর পায়ে হেঁটে কাছে গিয়ে ঝুঁকে দেখলো বাচ্চাটা আর্ট করছে। একটা হলুদ রঙের বাড়ি, সামনে পিচঢাকা রাস্তা আর একটা গাড়ি৷ ঠিক ওর গাড়ির মতোই গাড়ি। আঁকানো এখনও শেষ হয়নি। সাদিক মুগ্ধ হয়ে গেলো। বাচ্চাটা অনেক ভালো আর্ট করে। আগ্রহ বশত পিছন থেকেই বলে উঠলো,
–এই বাড়িতে কে থাকবে?

মাহাদী চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই সাদিকও চমকে উঠলো। ছেলেটা একদম ওর মতো দেখতে। চোখ, নাক, ঠোঁট সব কপি। সাদিক অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো। এমনকি মাহাদী মাথা ঘুরিয়ে নিলে ওর সামনে বসে ওকে দেখতে লাগলো। এমন ব্যবহারে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে নিজের রঙ পেন্সিল সব গোছাতে লাগলো মাহাদী। সাদিক বিষ্মিত স্বরে বলল,
–তুমি আমার নাক চুরি করেছো কেন?

মাহাদী গোছানো বাদ দিয়ে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। এই ছোট ছোট চোখের বারবার পলক ফেলা সাদিককে আরো বিভ্রান্ত করে ফেলল। সাদিকও ওর মতো পলক ফেলে নিজের চোখ দেখিয়ে বলল,
–এই দেখো, চোখও সেম।

মাহাদী বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে ঘরে চলে গেলো। সাদিক অবাক হয়ে দেখলো, ছেলেটা ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে একদম মুখের উপর খট করে দরজা বন্ধ করে দিলো। বিষ্মিত হয়ে দুইবার পলক ফেলে সত্যতা যাচাই করতে চাইলো। ঘটনা সত্য বুঝেই চোখ ছোট ছোট করে উঠে ঘরে চলে গেলো। অপমানটা বেশ বড়ই ছিলো। বলা চলে ডেকে এনে অপমান!

ঘর থেকে আবার বের হলো ঠিকঠিক মাহাদীর খাওয়ার সময়। খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে বসার ঘরের মেঝেতে। অহনা ছেলেকে পাশে বসিয়ে টিভি দেখাতে দেখাতে খাওয়াচ্ছ। সাদিক গিয়ে অহনার পাশ ঘেষে বসে পরলো। তাকে অহনার পাশে বসতে দেখে গাল ফুলালো মাহাদী। নিজের বসার জায়গা থেকে উঠে মায়ের কোলে জায়গা করে বসে পরলো। অহনা এক হাতে ধরতেই জড়িয়ে ধরলো মাকে। অহনা বিচলিত স্বরে বলল,
–এভাবে কোলে থাকলে কিভাবে খাইয়ে দেবো বাবা?

মাহাদী মাথা নেড়ে আরো জাপ্টে ধরলো। সাদিক ভ্রু বাঁকিয়ে দেখলো, হলুদ টিশার্ট পরা বাচ্চাটা পারলে একদম মায়ের সাথে মিশে যায়। খানিক বিরক্ত গলায় বলল,
–ছেলেকে এমন কোলে কোলে মানুষ করলে ভবিষ্যতে আর দেখতে হবে না।

সাদিকের কথার টোন মাহাদীর মোটেও ভালো লাগেনি। অহনা পাত্তা না দিলেও সে মায়ের বুকে মাথা রেখে মুখ ঘুড়িয়ে রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। সাদিকের ইচ্ছে হলো, তার মতো দেখতে এই বাচ্চাটার রাগী মুখের সুন্দর নাকটা টেনে দিক। লোভ সংবরণ করতে না পেরে সত্যি সত্যি নাক টেনে দিতেই তারকশ্বরে কেঁদে উঠলো মাহাদি। হকচকিয়ে গেলো সাদিক। অহনা চমকে উঠে বিচলিত স্বরে বলল,
–কি হয়েছে বাবা? কাঁদছো কেন?

মাহাদী কাঁদতে কাঁদতে একবার নিজের নাক আরেকবার সাদিককে আঙুলের ইশারায় দেখালো। অহনা কিছু না বুঝলেও সাদিক বুঝে কেঁশে উঠে প্রসঙ্গ পাল্টাতে সামনের খিচুড়ির বাটি দেখিয়ে বলল,
–খিচুড়ি ছাড়া আর কিছু নেই?

খিচুড়ি তার খুব একটা পছন্দের না। অহনা ছেলে জন্য আর তার জন্য পাতলা খিচুড়ি করেছে। তাই তাড়াহুড়ো করে বলল,
–এটা খাবেন না।

সাদিক কপাল কুঁচকে বলল,
–কেন? এটা কি খাবার না?

–এটা আমি রান্না করেছি। একটু অপেক্ষা করুন, ওকে আগে খাইয়ে নেই তারপর আপনার খাবার গরম করে আনছি।

একটু আস্তে করে উত্তর দিয়ে খাবার খাওয়াতে মনোযোগ দিলো সে। এমন ভাব করতে লাগলো যেন এই জগতে সে আর তার ছেলে ছাড়া আর কেউই নেই। সাদিকের রাগ হলো। তাকে ডেকে এনে মা ছেলে আচ্ছা মতো অপমান করা শুরু করেছে। রাগে জেদ দেখিয়ে বলল,
–না, আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি যাও।

অহনা চোখ বুজে শ্বাস ফেলে নরম গলায় ছেলেকে বলল,
–আব্বু, তুমি একটু বসো। আমি বাবার খাবার নিয়ে আসছি।

মাহাদী গাল ফুলিয়ে মাথা হেলিয়ে সায় জানালো। সাদিক ঘাড় বেঁকিয়ে অহনার যাওয়া দেখলো। ও যেতেই মাহাদীর দিকে ঘুরে বসে চোখ ছোট ছোট করে বলল,
–তুমি আমাকে পছন্দ করোনি কেন? আমি কি তোমাকে মেরেছি? আমাদের তো আগে দেখাই হয়নি। আর তখন আমার মুখের উপর দরজা কেন বন্ধ করলে?

সাদিক রীতিমতো জেরা শুরু করলো। মাহাদী উত্তর না দিয়ে নাক ফুলিয়ে, রাগ দেখিয়ে ছোট ছোট হাত দিয়ে চামচ ধরে নিজের পাতলা খিচুড়ি খেতে লাগলো। সাদিক কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ ওর কান্ড দেখে হাত থেকে চামচ কেড়ে নিয়ে বলল,
–দেখি তোমার মা কেমন রান্না করেছে?

বলেই দুই চামচ খিচুড়ি মুখে পুড়ে দিলো। মাহাদী কিছু বলতে না পেরে ঠোঁট উলটে কান্নার প্রস্তুতি নিতেই সাদিক আঙুল তুলে সতর্ক করে বলল,
–খবরদার কান্না করবে না। কান্না করলে নিশিভুত ধরে নিয়ে যাবে।

মাহাদী কান্না গিলে চোখ পিটপিট করে কৌতুহলী গলায় বলল,
–কেনো?

সাদিকের খুব ভালো লাগলো। এই আদুরে ছেলেটা প্রথমবারের মতো তার সাথে কথা বলছে। নিজেকে সামলে বলল,
–কারন যে বাচ্চারা কান্না করে সেই বাচ্চাদের নিশিভুত দেখতে পারে না। তুমি নিশিভুত দেখেছো?

মাহাদী মাথা নাড়লো। সাদিকের আবার খুব ভালো লাগলো। খুব আদুরে গলায় বলল,
–নিশিভুত দেখতে ইয়া বড়। ওর ইয়া বড় কান, ইয়া বড় নাক, ইয়া বড় চুল, ইয়া বড় দাঁত। যখন কথা বলে তখন মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়। খায় শুধু বাচ্চাদের হাড্ডিগুড্ডি।

–তাহলে কি তোমার মতো দেখতে?

মাহাদী চোখ পিটপিট করে নিরীহ গলায় প্রশ্ন করতেই সাদিকের আর ওকে আদুরে লাগল না। উত্তর না দিয়ে থমথমে মুখে খিচুড়ির প্লেট নিজের দিকে টেনে পুরো খিচুড়িই শেষ করে ফেলল। মাহাদী সেদিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। কান্না এখন শুধু মায়ের অপেক্ষায়। অহনা আসলো খানিক পরেই। ওকে দেখেই মাহাদী ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলল। সাদিক চোখ গরম করে কিছু বলার আগেই তারকশ্বরে কান্না শুরু হয়ে গেল। সাদিক কানে আঙুল গুজে ইশারায় নিজের খাওয়া হয়ে গেছে বুঝিয়ে ঘরে দিয়ে আগে দরজা বন্ধ করে কান্নার আওয়াজ কমালো। অহনা অসহায়ের মতো ছেলের কান্না বন্ধ করতে লাগলো আর খাবারের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলের খাবারে ভাগ বসানোর কি খুব দরকার ছিলো!

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০৩

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৩

শেষরাতের দিকে ক্ষিদের জ্বালায় ঘুম ভাঙে অহনার। সহ্য করতে না পেরে হাত পেটে চেপে দেয়াল ঘেষে বসে পরে। সেখানে দয়া দেখানোর কেউ ছিলো না। ভোরের দিকে খলিল সাহেবের ঘুম ভাঙে। তিনি মসজিদে যাওয়ার জন্য বের হতেই অহনাকে বসে থাকতে দেখেন। মেয়েটার অবস্থা দেখে আফসোস হয়। তিনি ভেবেছিলেন, অন্তত সাদিক নিজের ঘরে নিয়ে যাবে। সাদিকের ঘরের দরজা বন্ধ। অহনাকে সোফায় বসিয়ে কিছু খাবার এনে দিলেন। সামান্য ইতস্তত করে পুরো খাবারটাই শেষ করলো অহনা। ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করলেন খলিল সাহেব। খাওয়া শেষ হতেই সাদিকের ঘরে নক করলেন। ফুলো চোখে ঘর খুললো সাদিক৷ সামনে বাবাকে দেখে থমথমে মুখে বলল,
–কিছু বলবে বাবা?

খলিল সাহেব রুষ্ঠ গলায় বললেন,
–মেয়েটা সারারাত বাইরে ছিলো। সামান্য সেন্স নেই তোমার? বিয়ে যখন করেছো, দ্বায়িত্ব নিতেই হবে। ভুলে যেও না, তুমিই ওকে এই বাড়িতে এনেছো।

সাদিক ঠান্ডা চোখে শুনলো। তারপর হনহন করে হেঁটে অহনাকে টেনে তুলে একদম বাড়ির বাইরে বের করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। হতভম্ব হয়ে গেলেন খলিল সাহেব। এতো বড় ছেলের গায়ে হাতও তোলা যায় না। সাদিক বাবার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
–আমার দ্বায়িত্ব শেষ। এবার যে দরজা খুলে ওকে ভেতরে আনবে, তার উপরই ওর দ্বায়িত্ব থাকবে।

বলেই আর দাঁড়ালো না। ছেলের দুঃসাহসে ব্যথা পেলেন তিনি। কিছু না করেও অপরাধীর মতো অহনাকে ভেতরে আনলেন। লজ্জায়, ভয়ে অহনা মাটিতে মিশে যেতে লাগলো। চোখের পানিও বাঁধ মানছে না। একটু খাবার দিয়ে এতো অপমান! বাকি অপমানের জন্য ফরিদা ছিলো। ঘুম থেকে উঠেই আবার চেঁচামেচি শুরু হলো। খলিল সাহেব পরিস্থিতি সামলালেন। পুনরায় সাদিককে ডাকা হলো। বাবার সাথে খারাপ ব্যবহারে অপরাধবোধ কাজ করছিলো তার। তাই এক ডাকেই চলে এসেছে। তারপর যখন শুনলো অহনা তার ঘরেই থাকবে তখন সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। ফরিদা রাগী গলায় বলল,
–এই মেয়ের জন্য আমার ছেলেকে কি এখন বাড়ি ছাড়া করবো?

খলিল সাহেবের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। একদিকে সামলালে আরেকদিকে গন্ডগোল হচ্ছে। আবার নতুন আসা এই মেয়ের সামনে স্ত্রীকে ছোট করতেও চাইছেন না। খানিক নরম গলায় বললেন,
–তাহলে গেস্টরুম খুলে দাও। ওখানেই আপাতত থাকুক।

ফরিদা থমথমে গলায় বলল,
–আত্মীয়স্বজন এসে কোথায় থাকবে? তাছাড়া ওই ঘরের সব কিছুই দামী দামী। কোন কিছু নষ্ট করলে তখন?

–তাহলে তোমার কাছে থাকুক। এমনিতেই আমি চলে যাবো আজকে।

খলিল সাহেব বাইরে চাকরি করেন। মাসে কিংবা সপ্তাহে একবার বাড়ি ফেরেন। ফরিদা বিরক্ত হয়ে বলল,
–তাহলে তুমি এসে কোথায় থাকবে?

–আমি তো সারাজীবনের কথা বলছি না।

ফরিদা বিরক্ত হয়ে বলল,
–যা হয় হোক। যদি থাকারই হয় তাহলে স্টোররুম ফাঁকা আছে। ছোট একটা খাটও আছে। একটা টেবিল ফ্যান দিয়ে দিলেই হয়ে যাবে।

ফরিদার এক কথায় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল৷ এই ছোট ফ্ল্যাটে ছোট ছোট তিনটে ঘর আর বড় ড্রয়িংরুম। একটা ছোট কিচের আর তার সাথেই লাগোয়া ডাইনিং এরিয়া। আর একটা ঘর আছে। সব থেকে ছোট ঘর। সেটাকে স্টোররুম বানানো হয়েছে। অহনার থাকার জায়গা সেখানেই হলো। চুপচাপ সেখানে গেল সে। শান্ত আর বাধ্য মেয়ে বলেই পরিচিত সে। প্রতিবাদ করার ভাষা কোনকালেই তার নেই। মা বলেছে, মাথার উপর ছাদ না হারাতে। বউয়ের অধিকার না পেলো, মাথার উপর ছাদ থাকলেই হলো।
স্টোররুমের অবস্থা খুব খারাপ। চারপাশে ধুলোয় ঢাকা। জিনিসপত্রের মধ্যে আছে পুরোনো বাক্স, ভাঙা শোকেস, আর মরিচা ধরা একটা লোহার খাট। তার উপর অনাদরে অবহেলায় একটা ছেড়া চাদর পরে আছে। খাটের ঠিক পাশে একটা ছোট জানালা আছে। দীর্ঘদিন না খোলায় সেটাতেও মরিচা পরে আটকে আছে। বহু কষ্টে সেই জানালা খুলে আলোর ব্যবস্থা করলো সে। বিছানার চাদর পেতে বসেও পরলো। তার সবসময় নিজের ঘরের শখ ছিলো। তাদের ছোট সেই বাড়িতে বাবা মা আর ভাইয়ের আলাদা ঘর ছিলো। শুধু সে আর তার বোন নাফিজা একসাথে থাকতো। পুরো ঘরে বোনের জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই করা ছিলো। তার জিনিসপত্র শুধু একটা ঝুড়িয়ে রেখেছিলো। মনে মনে হাজারবার কল্পনা কর‍তো, যখন নিজের ঘর হবে তখন সেগুলো সুন্দর করে বাইরে সাজিয়ে রাখবে। নাফিজার দুপুরে ঘর অন্ধকার করে ঘুমানোর অভ্যাস ছিলো। অহনার ভালো লাগতো না মোটেও। তার শখ ছিলো, দুপুরে না ঘুমিয়ে পুরো ঘর আলোকিত করে রাখবে। আবার চাইলে সারারাত আলো জ্বালিয়ে একাজ সেকাজ করবে। কারন রাত এগারোটার পর নাফিজা আর এক মিনিটও আলো জ্বালিয়ে রাখতে দিতো না। ইচ্ছা হলেও কিছু করতে পার‍তো না সে। ইচ্ছা চাপা রাখলে নাকি হারাতে হয়। সে হারাতো সব। তবে আজ পেয়েছে। একদম কানায় কানায় পেয়েছে একটা ঘর। এখানে সে নিজের মতো থাকবে। তার সাথে কি ঘটেছে তা মূহুর্তের জন্য ভুলে গেলো। মনে পরলো যখন ফরিদা এসে দয়া করে তার কিছু পুরাতন শাড়ি ওর মুখের উপর ছুড়ে মারলো তখন। ধ্যান ভেঙে মিনমিন করে বলল,
–একটা ঝাটা লাগতো। ঘর পরিষ্কার করতে হবে।

ফরিদা খেঁকি দিয়ে উঠলো,
–তোমার তো সাহস কম না, তুমি আমাকে হুমুক করছো?

মাথা নিচু করে ফেলল অহনা। এবারেও দয়া করলো ফরিদা। দপাদপ পা ফেলে ঝাটা এনে সরাসরি অহনার মুখের উপর ছুড়ে মারলো।

****
অহনার জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলো। হাতে স্যালাইন চলছে। চোখ পিটপিট করে সম্পূর্ণ সজাগ হতেই দেখে সাদিক ঠিক ওর সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। মাঝে মাঝে হাতে আপেলে কামড় দিয়ে খাচ্ছে। দৃষ্টি সম্পূর্ণ ওর দিকেই স্থির। সেই দৃষ্টি সরানোর নাম গন্ধও ওর মাঝে নেই। অহনাই চোখ সরিয়ে নিলো। চোখ সরাতে দেখে মৃদু হাসলো সাদিক। মুখে থাকা আপেলের টুকরো গিলে বলল,
–তোমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা পাঁচটা আপেল দিয়ে গেছে। আর দুইটা বাকি আছে৷ ওই দুইটা খাবে নাকি খাবো?

অহনা চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। এতো নির্লজ্জ কোন মানুষ হয়! এখন কত ফ্রী হচ্ছে। অথচ আগে! মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–আমি খাবো না। খেয়ে ফেলুন।

–গুড।

বলেই বাকি দুটোও নিমেশে শেষ করে ফেলল। সরকারি হাসপাতালের কোন খরচ নেই। এটাতে একটু নিশ্চিত হলেও বাড়ি ফিরবে কিভাবে সেই টেনশনে পরে গেলো অহনা। ব্যাগে আছে মাত্র আড়াইশো টাকা। ট্রেনে পুরো পথ গেলে স্টেশন থেকে বাড়ি যেতে মাত্র পঞ্চাশ টাকা লাগতো। এখন তো হাজার টাকার ফাঁড়া। টেনশনে ঘেমে উঠলো। সাদিক বিরক্ত হয়ে বলল,
–কিডন্যাপ তো করিনি। তাহলে এতো টেনশন কিসের?

অহনা উত্তর না দিয়ে স্যালাইনের দিকে তাকালো। স্যালাইন শেষের দিকে। মিনিট দশেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। একবার ভাবলো, ফোন দিয়ে টাকা চাওয়া যাক। মাথা নেড়ে সেটাও বাতিল করে দিলো। সাদিকের থেকেও নেবে না। তবে যদি জোর করে তাহলে অন্য কথা। সে নাহয় ফিরে গিয়ে টাকা ফেরত দেবে।
সাদিক জোর করলো না। হসপিটাল থেকে বের হয়েই গাড়িতে চেপে বসলো৷ সাদিকের নিজস্ব গাড়ি৷ ড্রাইভারের সাথে যোগাযোগে ছিলো সাদিক। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ট্রেনের পিছু পিছুই এসেছিলো৷ অহনা হাত মুঠ করে নিজেকে শক্ত করে গাড়িতে চেপে বসলো৷ দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে মোহাম্মদপুরের সেই ছোট বাসায় আসতে আরো তিন সারে তিন ঘন্টা লেগে গেল।
মাকে দেখেই মাহাদী দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরলো। অহনা ছেলেকে কোলে নিতেই নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাকে। ঘাড়ে মুখ গুজে অভিযোগ করে বলল,
–এতো দেরি করছো কেন? আমি অনেকক্ষন ধরে বসে আছি।

অহনা মৃদু হেসে ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
–তুমি না বাবা বাবা করতে। তোমার বাবাকে এনেছি।

মাহাদী মাথা তুলে অবাক হয়ে মায়ের সাথে আসা লোকটাকে দেখলো৷ পরক্ষণেই আবার মায়ের কাঁধে মুখ গুজে দিলো৷ অহনা চিন্তিত স্বরে বলল,
–কি হলো? খারাপ লাগছে?

মাহাদী মুখ না তুলেই ঘাড় নাড়লো৷ অহনা ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
–তাহলে বাবার কাছে যাও।

মাহাদী এবারে জোরে জোরে ঘাড় নাড়লো। বাবা তার পছন্দ হয়নি। অহনা ছেলেকে শক্ত হাতে চেপে সাদিকের দিকে ফিরলো। অসহায় স্বরে বলল,
–সবে দেখছে তো তাই লজ্জা পাচ্ছে। একটু পর দেখবেন কোলে উঠে বসে আছে।

সাদিক কাঁধ নাচালো। এতো বড় ছেলের বাবা হয়ে যাওয়া সহজ কথা তো না। ভালো করে মাহাদীকে দেখলোও না সে আর না মাহাদী মায়ের কাঁধ থেকে মুখ তুলল। দুজনেই দুদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলো। খুব ক্লান্ত লাগছে সাদিকের। ক্লান্ত গলায় বলল,
–আর কতক্ষণ লাগবে? খুব টায়ার্ড আমি।

অহনা সাদিকের নির্লিপ্ত ভাব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির ভেতর গেলো৷ দুই রুমের ছোট একটা বাসা। বড় বারান্দার এক পাশে বড় কিচেন আর সাথেই একটা ছোট খাবার টেবিল রাখা৷ ভেতরে ছোট একটা বসার ঘর আর দুই পাশে দুই দরজা দিয়ে দুই ঘরে যাওয়ার পথ। ভেতরে একজন ভদ্রমহিলা বসেছিলেন। অহনাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে রাগ দেখিয়ে বললেন,
–তোর ছেলেকে এরপর পিঠের সাথে বেঁধে নিয়ে যাস। আমি আর কোন দ্বায়িত্ব নেবো না।

অহনা মৃদু হাসলো৷ তার পেছনে সাদিককে দেখে তাড়াহুড়ো করে তিনি বললেন,
–ফ্রীজে সব খাবার রাখা আছে৷ একটু গরম করে নিস।

অহনা মাথা হেলিয়ে সায় জানাতেই ভদ্রমহিলা চলে গেলেন৷ সাদিকের দিকে ভুলেও তাকালেন না৷ অহনা সাদিকের জন্য ঠিক করা ঘরের দিকে ইশারা করে বলল,
–ওটা আপনার ঘর। আর এটা ওয়াশরুম।

বসার ঘরের কোনের একটা ছোট দরজার দিকে ইশারা করে কথা শেষ করল সে। সাদিক একপলক সেদিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো৷ খাট, আলনা আর টেবিলে সাজানো ঘরটা দেখে দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার৷ বহু বছর আগের কিছু স্মৃতি আবছা মনে পরলো৷ ধুলোমাখা ঘর, মরিচা ধরা খাট, ইদুর দেখে চিৎকার দিয়ে বেড়িয়ে আসা আর প্রথম চোখে চোখ পড়া। সবটাই কি ভীষন তেতো ছিলো!

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০২

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০২

দরজা খুলে দিলো সাদিকের মা ফরিদা। বউ বেশে ছেলের পাশে একজনকে দেখে প্রথমে হতভম্ব হলেন, পরে রেগে চিৎকার করে উঠলেন। সাদিক শুধু দরজা খোলার অপেক্ষায় ছিলো। দরজা খুলতেই পায়ের জুতা খুলে মাকে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। এক ফোটা শব্দও যেন সে শোনেনি। অন্যদিকে ফরিদার চিৎকারে ঘরের ভেতর থেকে খলিল সাহেব চলে আসলেন। স্ত্রীর চিৎকারে আর সামনের মেয়েটির বেশভূষায় কিছুক্ষণ বেক্কলের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। হতভম্ব স্বরে বললেন,
–কি হয়েছে ফরিদা? এই মেয়ে কে?

–তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করো? সেই তো নিয়ে এসেছে।

ফরিদা তিরিক্ষি স্বরে বলল। খলিল সাহেব অহনাকে ভেতরে ঢুকতে বলে আগে দরজা লাগালেন। প্রতিবেশীরা অলরেডি উঁকিঝুঁকি দেওয়া শুরু করেছে। এরপর সাদিকের ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে দরজা খুললে বললেন। খানিক ডাকাডাকির পর দরজা খুললো সে। মাথা সম্পূর্ণ ভেজা। বোধহয় গোসল করেছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে গোসল! সু কেবিনেটের পাশের দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে চোরা চোখে সাদিকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে চিন্তা করলো অহনা। ফরিদা সোফায় বসে রাগে গজগজ করছিলো। ছেলে বের হতেই হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। রক্তিম চোখে রাগ নিয়ে বলল,
–এসব কি নাটক হচ্ছে?

সাদিক একপলক বাবা মায়ের দিকে তাকালো। তারপর চোখ নিচু করে বলল,
–কয়েক ঘন্টা আগে আমার বিয়ে হয়েছে।

–বিয়ে হয়ে গেছে? কে করালো এই বিয়ে? তুই নিজে করেছিস? নাকি এই মেয়ে এসে গলায় ঝুলে পড়েছে?

ফারিদার বিষঢালা কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল। রেগে গেলেন খলিল সাহেব। স্ত্রীর উপর গর্জে উঠে বললেন,
–থামো তুমি। আগে কথা শুনতে দাও।

ফরিদা ফোঁপাতে ফোপাঁতে আবার সোফায় বসে পরলো। খলিল সাহেব ছেলের দিকে ফিরে শান্ত গলায় বললেন,
–হঠাৎ এই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারন? আমরা কি কিছুতে বাঁধা দিয়েছিলাম?

–আমার ইচ্ছেতে কিছু হয়নি।

সাদিক উঁচু গলায় বলল। খলিল সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,
–মানে? জোর করে বিয়ে দিয়েছে?

–অনেকটা সেরকমই।

–কেন? কি করেছিলে তুমি?

–সেটা ওর পরিবারের লোকের থেকেই জানো।

কাঠকাঠ গলায় বললো সাদিক। সাথে ঘর থেকে অহনার মামার নাম্বার এনে বাবার হাতে তুলে দিলো। বাইরে থেকে কথা বলে এলেন তিনি। কি কথা বললেন তা কাউকে বলল না। ঘরে এসে শুনলেন, ফরিদা মেয়েটির উপর চোটপাট করছে। মেয়েটি ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ফরিদা স্বামীকে দেখে তেজি গলায় বলল,
–আমি এই মেয়েকে রাখব না।

—ফরিদা, থামো। বিয়ে হয়ে গেছে মানে ও এখন এই বাড়ির বউ। বাড়ির বউয়ের অসম্মান করা ভালো না।

খলিল সাহেব শান্ত গলায় বললেন। ফরিদা ক্রোধে গর্জে উঠলেন,
–কিসের বউ? চেনো তুমি ওকে? ওর চরিত্র সম্পর্কে কিছু জানো? কোথাও বিয়ে দিতে পারেনি জন্য আমার ছেলের ঘারে চাপিয়ে দিয়েছে। আমার ছেলের জীবন নষ্ট করেছে।

খলিল সাহেব ধমক দিয়ে স্ত্রীকে থামিয়ে বললেন,
–ঘরে যাও তুমি।

ফরিদা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো,
–ওই মেয়ে যেন আমার সংসারে না ঢোকে।

সাদিক তো বাবাকে কাগজ দিয়ে আবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন ঘরে তিনি আর অহনা একা। মেয়েটিকে কি বলবেন ভেবে পেলেন না খলিল সাহেব। ওর মামার থেকে যথেষ্ট অপমানিত হয়েছেন তিনি। সম্পূর্ণ দোষ সাদিকের আর অহনার দিয়েছে ওরা। ওরা দুজন মিলে নাকি ওদের মুখ কালো করেছে। এক ঘরে পাওয়া গেছে ওদের। এর প্রেক্ষিতে আর কিছু বলার ক্ষমতা হয়নি তার। আর না এখন মেয়েটির সাথে কথা বলার ইচ্ছা হলো। সত্যি জানার আগ্রহ হলো না মোটেও। তিনিও চুপচাপ চলে গেলো। অহনা কি করবে বুঝতে না পেরে ওখানেই বসে পরলো। রাত বাড়লে মাথার ওড়না বিছিয়ে তার উপর শুয়ে পরলো।

*****
ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত শান্তি লাগছিলো অহনার। লড়াইয়ের প্রথম ধাপ শেষ। পরাজয়ের হিসাব অনেক বড় হলেও বর্তমানের জয়টাই সব। অবশেষে বাচ্চাকে তার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে। এই শান্তির তুলনা হয় না। মুখে এক গভীর প্রসন্নতার ছাপ রেখে চোখ বুজলো। পাশের সিটের মানুষটাকে না জানিয়েই কখন যে ঘুমিয়ে পরলো বুঝতেই পারলো না। গত কয়েকদিনের ক্লান্তি আর ঠিকমতো না খাওয়া তার শরীরকে একদম ভেঙে দিয়েছে। তবে ঘুম বেশিক্ষণ হলো না। কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর দুঃস্বপ্ন দেখে ধরফরিয়ে জেগে উঠলো। ঘুম ভেঙে কিছুকাল কিছু ঠাহর করতে পারলো না৷ তারপরই সব মনে পরায় তড়িৎ পাশে তাকালো। পাশের সিটে কেউ নেই। বুক ধক করে উঠলো অহনার। উতলা হয়ে উঠতে নিতেই দেখে সামনের সিটে সাদিক পায়ের উপর পা তুলে ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হকচকিয়ে গেলো সে। ওঠা বাদ দিয়ে নিজেকে ঠিকঠাক করে সোজা হয়ে বসে আশেপাশে তাকিয়ে ব্যাগ খুঁজলো। না পেয়েই আবার আত্মা কেঁপে উঠলো। ব্যাগ না পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরবে কিভাবে? সাদিক বুঝতে পেরে বিরক্ত হলো। হাতের ইশারায় ট্রেনের টেবিলের উপর নির্দেশ করে বলল,
–আছেই তো দুশো সত্তোর টাকা। এই সামান্য টাকার জন্য এতো উতলা!

অহনা ব্যাগ বুকে চেপে বিষ্মিত স্বরে বলল,
–আপনি আমার ব্যাগ চেক করেছেন?

–হ্যাঁ, করেছি।

একদম চোখে চোখ রেখে সত্যি বললো সাদিক। অহনা দ্বিতীয় দফায় হকচকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলল। দুঃস্বপ্নের তোরে বুক এখনও কাপছে। যদি সত্যি সত্যি সাদিক সাথে না আসতো তাহলে বাচ্চাটার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারতো না। পরমুহূর্তেই কিছু মনে হতেই ব্যাগটা আরো শক্ত হাতে বুকের সাথে চেপে ধরলো। তার মানে ছেলের বার্থ সার্টিফিকেট ও দেখেছে! সন্দেহ সত্যি করলো সাদিক৷ অবজ্ঞা ভরা স্বরে বলল,
–তোমার ছেলের নাম তাহলে মাহাদী?

নীরবে মাথা নেড়ে সায় জানালো অহনা। একবার ভাবলো ছেলের বাবার নামটা বলে দিক। যদিও বার্থ সার্টিফিকেটে বাবার নাম আছে। তবুও বিশ্বাস করার জন্য মায়ের মুখ থেকে শোনা বেশি ভালো৷ কিন্তু মুহূর্তেই মাথা ঝাঁকালো। না বলাটাই বেশি নিরাপদ। কিছু সত্য যত লুকানো থাকে, ততই মানুষকে বাঁচায়।

–তুমি কতদিন আমার সাথে থেকেছো?

সাদিক ফের প্রশ্ন করে। অহনা মাথা তোলে একবার। তাদের সিট চারজনের। সামনাসামনি চারজন করে মোট আটজনের সিট। বর্তমানে সেখানে তারা ছাড়া আর কেউ নেই। তাই কথা শোনার অস্বস্তি থেকে বেঁচে গেলো। থুতনি চিবুকের সাথে আটকে আস্তে করে বলল,
–দুই বছর।

হ্যাঁ, থেকেছিলো অনেকদিন। যেদিন কাছাকাছি টেনেছিলো ঠিক সেদিন থেকেই একই ঘরের একই বিছানায় স্থান হয়েছিলো তার। এই দুই বছরের প্রতিটা ঘটনা তার মনে আছে। বোধহয় শেষদিন পর্যন্ত মনে থাকবে।

–বাচ্চা হলে তো এই দুই বছরে হয়ে যাওয়ার কথা। তাই না?

সাদিক আরেকটা প্রশ্ন করল। কন্ঠ অস্বাভাবিক নিরব। এবারে অহনা নিরব থাকলো। এখন বাচ্চা কবে হবে সেটা ও কিভাবে বলবে!

সাদিক হুট করেই ঝুঁকে অহনার হাত চেপে ধরলো শক্ত হাতে। চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–কার বাচ্চা আমার ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছো?

দম আটকে আসলো অহনার। রাগও হলো, অপমানিতও হলো। কান্না আটকে শক্ত গলায় বলল,
–আমি তো সন্তানের বাবার দাবী নিয়ে আসিনি। শুধু একটু সময় কাটাতে বলছি।

সাদিক যেমন হুট ধরে হাত চেপে ধরেছিলো তেমনই হুট করেই হাত ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। আগের মতোই পায়ের উপর পা তুলে হাত টেবিলের উপর হাত রেখে বাঁকা হেসে বলল,
–সুন্দর কথা। কিন্তু আমার মূল্যবান সময় কোন জায়গায় ওয়েস্ট করবো সেটা বোধহয় আমার জানা প্রয়োজন।

–আপনার ডিভোর্স প্রয়োজন।

অহনার প্রতি উত্তর শুনে সাদিক হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। পারলে তো হাত তালি দিয়ে হাসতো। তা না পেরে কেশে গলা পরিষ্কার করে ব্যাঙ্গ করে বলল,
–তোমাকে এতোটা বোকা তো মনে হয় না। ডিভোর্স দরকার হলে বিয়ের আয়োজন করতাম কেন? আমি তো জানি তুমি বেঁচে আছো অ্যান্ড বহাল তবিয়তেই আছো।

–তাহলে বিয়ে ছেড়ে আসলেন কেন?

–তোমাকে আমি কৈফিয়ত দেবো না অ-হ-না। তোমার নাম তো অহনা, রাইট?

অহনা লজ্জায় সিটের সাথে একদম মিশে যেতে লাগলো! সময় তো এখনও তিন মাস আছে। এই তিন মাসে আর কতবার যে অপমানিত হতে হবে, কে জানে! অহনা এই অপমানে বদলা নিতে চাইলো। অন্তত একজনের তো মনে হোক, সে আর আগের অহনা নেই। মাথা তুললো। একদম চোখে চোখ রেখে চোয়াল শক্ত করে বলল,
–আপনার নাম তো সাদিক, তাই না?

–ভেরি ক্লেভার!

সাদিক সুন্দর করে হাসলো। এই হাসিটা ওর মুখে বরাবরই খুব সুন্দর লাগে। তারপরই হাসির বাঁক বদলে গেলো। সুন্দর হাসিমুখ কঠিন করে বলল,
–বাচ্চার বাবা হিসেবে কয়জনকে হাতে রেখেছিলে?

অহনা বিষ্ময়ে তাকাতেই সাদিক আবার বলল,
–আমি কয় নাম্বার ছিলাম?

আবার! ঘুরে ফিরে সেই একই কথা। অহনার একবার বলতে মন চাইল,
–আপনারা তাড়িয়ে দেওয়ার পর আমার তো চলতে হতো। সে হিসেবে প্রতি রাতে একজন হলেই সুন্দর ভাবে দিন চলে যেত।

বলতে চাইলো কিন্তু বললো না। অপমানে মাথা নুইয়ে রাখলো। ভুল ভেবেছে সে। প্রতিবাদের ভাষা তার তখনও ছিলো না আর এখনও নেই।

–বাচ্চার কথা আমাকে বলোনি কেন? যেদিন সিওর হলে তুমি কন্সিভ করেছো সেদিক তো আমাকে জানানো উচিৎ ছিলো।

আবার প্রশ্ন। অহনা বেদনায় জর্জরিত হয়ে কাতর গলায় বলল,
–আপনি নিজের কথায় ঠিক থাকুন প্লিজ। আমার আর আমার বাচ্চার জীবনে আপনার অবস্থান মাত্র তিন মাসের। তিম মাস পর আপনার সাথে আমার সম্পর্কেই ইতি ঘটে যাবে।

ট্রেন থামায় সাদিক আর কিছুই বলল না। সোজা গাড়ি থেকে নেমে গেল। অহনার বুক কেঁপে উঠলো৷ তার কোন কথায় কিছু মনে করে সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো না তো! ঢোক গিলে কিছু বলার আগেই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো সাদিক। জানালা দিয়ে খুঁজতেও পাওয়া গেলো কিছু দূরে এক খাবারের দোকানে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এলো কেক আর পাউরুটির প্যাকেট হাতে। আরেক হাতে পানির বোতল। এবারেও বসলো একদম অহনার সামনা-সামনি। কেকের প্যাকেট অহনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–নাও

চুপচাপ প্যাকেট কোলের উপর রেখে বাইরের ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম দেখতে লাগলো। সাদিক নিতে বলেছে, খেতে তো আর না। সুতরাং, কথা শোনা হলো। ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইলো সাদিক। অহনার সেদিকে তাকানোর সাহস নেই। মাথা নিচু করে হাত কচলাতে লাগলো। কাল থেকে পানি ছাড়া আর কিছুই খায়নি। মাথা তো ঘুরছিলো কিন্তু ছেলেকে না দেখে কিছুই খেতে পারবে না। প্যাকেট শক্ত হাতে চেপে সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুজলো।
ভোররাতে ঘটে গেলো দুর্ঘটনা। ক্লান্তি আর না খাওয়ায় প্রেসার ফল করে জ্ঞান হারালো অহনা।

চলবে…

অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০১

0

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#সুচনা_পর্ব

স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের ঠিক দুদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হলো অহনা। পাঁচ তলা বিল্ডিং এর বাইরে টাঙানো সাইনবোর্ডে বড় হরফে সুন্দর করে লেখা-

“সাদিক ও মৌলির শুভ বিবাহ।”

আজ এনগেজমেন্ট, কাল গায়ে হলুদ আর পরশু বিয়ে। ধুমধাম করে হচ্ছে সব অনুষ্ঠান। সবাই নিশ্চয় খুব খুশি। খুশি তো হবারই কথা। এতো বছরের অপেক্ষার অবসান হচ্ছে আজ।
ছয় বছর! ছয় বছর কম সময় তো না। ছয় বছরে কত কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। পাঁচ তলার সেই ছোট ফ্ল্যাট আর নেই। ভেঙে বিশাল বড় বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। ভেতরে ঢুকতে দারোয়ানের মুখোমুখি হতে হয়। আজকে নির্দ্বিধায় ঢুকতে দিয়েছে তাকে। কাজের মেয়ে ভেবেছিলো বোধহয়। ভাবলেও ভুল কিছু ভাবেনি। এই বাড়িতে যতদিন ছিলো ততদিন সে কাজের মেয়ের মতোই ছিলো৷ ঘরও ছিলো পরিত্যাক্ত আসবাব রাখার ঘর৷ দারোয়ানের থেকে সত্যটা জানা হয়নি। এই পোশাকের ভিখারিও আজকাল দেখা যায়। সেটাও ভাবতে পারে। তবে আজ ভিক্ষা নিতেই আজ এসেছে সে। মলিন, ধূসর শাড়ির আঁচল পেতে ভিক্ষা নেবে।

দূরে আতশবাজির শব্দ হলো। আলোর রেশ আকাশের বুকে নিজেকে মেলে ধরলো। দারুন এক দৃশ্য। ছোট ফুপুর বিয়ের দিন আতসবাজি ফুটানো দেখেছিলো। কেউ ধরতে দেয়নি তাকে। ছোট হওয়ার অযুহাতে দূরে ঘরে বন্ধ হয়ে ছিলো।
আজকের বাজিতে কারো বিধিনিষেধ নেই বোধহয়। আলোর ঝলকানির সাথে সাথে ছোট বড় সকলেই উল্লাসে মেতে উঠল। মেতে উঠলো না শুধু অহনা। এই সাজসজ্জার মাঝে একমাত্র মলিন কাপড় পরে ঝিকিমিকি আলোর ভেতর দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে লাগলো।

স্বামীর বিয়ের কষ্ট তার হচ্ছে না। মানুষটা কোনকালেই তার ছিলো না। তিন কবুল আর একটা সাইনেই যে কেউ কারো আপন হয় না, তার জ্বলন্ত প্রমান সে। রঙিন বাতির রঙিন আলো, বিয়ের গানের শব্দ, হাসি মজা, সবকিছুই তার কাছে ফিকে মলিন।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো অহনা। বুকের ভেতরটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে উঠলো। তবে চোখ ভিজলো না। কান্নার ক্ষমতা হারিয়েছে বহু আগেই৷ মনে পড়লো সেই রাতের কথা, যখন পরিস্থিতির চাপে পরে বিয়ে হয়েছিলো তাদের। বিয়েতে না ছিলো ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি আর না ছিলো সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি। তাহলে কেন এসেছে আজ! অনর্থক আসা কি! একবার মনে হলো ফিরে যাক। পা ফিরিয়েও নিয়েছিলো আর ঠিক তক্ষুনি নজরে পরলো সাদিককে। ব্যস্ত সাদিক অতিথিদের সাথে কথা বলছে আর হাসছে। মেরুন পাঞ্জাবিতে কি দারুন দেখাচ্ছে! তাদের বিয়ের সময় বড় কাকার দেওয়ার সোনালি পাঞ্জাবি পরেছিলো সে। সেটাতেও কি দারুন লেগেছিলো। তবে আজকে বেশি সুন্দর লাগছে। ভালো তো লাগতেই হবে। ভালোবাসার মানুষকে যে পাচ্ছে।
আর পা আগানোর সাহস পায়নি সে। দূর থেকেই মন ভরে দেখল। আগের মতো টগবগে যুবক আর নেই। মুখে এক ঠান্ডা অভিব্যক্তি এসেছে। চোখে উঠেছে রিমলেস চশমা। হঠাৎই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো৷ দাঁড়িয়ে থাকতে সে আসেনি। কাজ সেরে আবার ফিরতে হবে। শক্ত হাতে কাঁধের কালো রঙের টোট ব্যাগ মুঠো করে ধরলো। ব্যাগের ভেতর ছোট টাকার পার্স, ছাতা, পানির বোতল রেখেছে। আর রেখেছে রিপোর্ট ফাইল। প্রমাণের প্রয়োজন পরলে রিপোর্ট দেখাতে হতে পারে।

পা বাড়ানোর আগে চারপাশে তাকালো সে। আশেপাশের মানুষের হাসাহাসি, সাজসজ্জা সবকিছু অসহ্য লাগতে লাগলো। এই চাকচিক্যময় পৃথিবীতে তার জায়গা কখনও ছিলোই না। তবুও একসময় চেয়েছে। পাগলের মতো চেয়েছে নিজের জায়গা করে নিতে। কিন্তু পারেনি।

অহনার বেশি কষ্ট করতে হলো না। সেদিকে যাওয়ার আগেই কোন এক অনাত্মীয়ের নজরে পড়েছিলো। আত্মীয় তো সাদিকের। তার তো কিছুই না। তবুও যখন এক প্রকার টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেলো তখন চুপচাপ চলে গেলো সে। আজেবাজে চিন্তা করার মানসিক পরিস্থিতি তার নেই।
অনেক অনেকদিন আগে এক রাজপুত্রের বিয়ে হয়েছিলো চাকরানীর সাথে। আজ আবার সেই রাজপুত্রের বিয়ে হচ্ছে এক রাজকুমারীর সাথে। সেখানে কেউ কালো ছায়া কেন মানবে!
মূহূর্তেই পরিবারের লোকজন দিয়ে ঘর ভরে উঠলো। সাহসী অহনার সাহস দুর্বল হয়ে আসতে লাগলো। তবুও মাথা তুললো। গলা উঁচিয়ে বলল,
–প্রথম স্ত্রীর জীবিত থাকা অবস্থায়, তার অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে? দেশে আইন কানুন আছে।

–মরোনি তো এতো বছর কার সাথে থেকে এসেছো? ফষ্টিনষ্টি করে এখন আবার আমার ছেলের জীবন নষ্ট করার ধান্দায় এসেছো? শয়তান মেয়ে কোথাকার!

কথা শেষে সাদিকের মা তেড়ে গেলেন মারতে। আটকালো সবাই। গমগমে পরিস্থিতিতে ভারি কদমের চাপ ফেলে উপস্থিত হলো সাদিক। তীর্যক চোখে পর্যবেক্ষণ করলো অহনাকে। তারপর শীতল স্বরে বলল,
–কত টাকা চাচ্ছো তুমি?

–টাকা না, সময় চাই। তিনমাস সময় চাই আপনার।
দলা পাকানো স্বরে প্রতিউত্তর করলো অহনা। সাদিক কপাল কুঁচকে তাকালো। ভ্রু জোড়া সুন্দরভাবে বেঁকে গেলো তাতে। হাতের ইশারায় সবাইকে বাইরে যেতে বলে দরজা চাপালো। পা দিয়ে টুল ঠেলে অহনাকে বসতে দিয়ে নিজে বসলো খাটে। তারপর কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
–সময় বেচে কি কিনবে?

অহনা কপালের ঘাম মুছলো। আস্তে আস্তে যে সত্যিটা সামনে আনতে হবে তার সূচনা করল। সামান্য ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
–খুশি।

–কার?

পালটা প্রশ্ন আসতে সময় নিলো না। দম বন্ধ করে প্রশ্নের উত্তর দিলো অহনা,
–আমার ছেলের।

–বাবা কে?

এমন প্রশ্নের আশা সে করেনি। অবাক হয়ে সামনে তাকালো। দু’একবার কামনার টানে যে কাছে এসেছিলো, সেটা কি ভুলে গেছে? নাকি ভেবেছে, ও সব ছেলের বিছানায় শুয়ে পরার মতো মেয়ে! রাগ হলো ওর। শক্ত গলায় বলল,
–ডিএনএ টেস্ট করালে জানতে পারবো।

সাদিক শান্তু গলায় কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
–তাহলে আমি স্যাক্রিফাইস করবো কেন?

স্বাভাবিক কথা। অন্য কারো ছেলের জন্য ও কেনো স্যাক্রিফাইস করবে! অহনার শরীর ভেঙে আসলো। সামনের মানুষটা ওকে এতো নীচ ভাবে? ছেলেটা যে তারও হতে পারে, এর বিন্দুমাত্র ধারনাও করতে চাইছে না! সিদ্ধান্ত নিলো সে। ছেলের বাবার পরিচয় জানাবে না। যেমন আছে তেমন থাকুক। শান্ত হলো মূহুর্তেই। চোখে চোখ রেখে শীতল গলায় বলল,
–কারন আপনার ডিভোর্স চাই। তিনমাস পর ডিভোর্স দিয়ে দেবো। বাঁধা থাকবে না।

–তোমার কথার সত্যতা কি?

অহনা উকিলের তৈরি কাগজ বের করে সাদিকের হাতে দিলো। সাদিক পড়লো সবটা। প্রথম কাগজটা শর্তনামা আর দ্বিতীয় কাগজটা ডিভোর্স পেপার। প্রথমটায় সাইন হলেও দ্বিতীয়টায় সাইন হবে তিনমাস পর। কাগজ রাখলো বিছানায় নিজের পাশে। নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
–ঠিক আছে৷ তোমার শর্তে আমি রাজি। অনুষ্ঠান শেষ হলে যাবো।

–আমি ডিভোর্স না দেওয়া পর্যন্ত আপনি বিয়ে করতে পারবেন না।

স্পষ্ট ভাষায় নিজের কথা জানিয়ে দিলো অহনা। সাদিক তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
–শুধু এনগেজমেন্ট হবে।

অহনা চুপ রইলো। শান্ত স্বরে কিছুক্ষণ পর বলল,
–অনুষ্ঠান কবে?

–আজ রাতে।

–ঠিক আছে।

অহনা মাথা নেড়ে রাজি হলো। এখানে ইমোশোনের খেলা খেলতে এসেছিলো সে। খেলায় অংশগ্রহণই করতে পারলো না। কত শত প্ল্যান, কত শত চিন্তা করেছে এতোদিন! এতো সহজে যে সব হবে তা কল্পনার বাইরে ছিলো।
বাড়ির লোককে সাদিক কিভাবে ম্যানেজ করেছে তা জানে না সে। জানতে চায়ও না। তার কাজ হলেই হলো। বাড়িতে এসে প্রথমটায় ইমোশনাল হয়ে পরেছিলো। পুরোনো অহনায় ফেরত গিয়েছিলো। এখন ঠিক আছে৷ একদম সুস্থ স্বাভাবিক। টিকিট কাটা আছে। সময় বেশি নষ্ট করবে না। আজ রাতের ট্রেনেই ফিরে যাবে।

অতীত যখন আসে, তখন একজনের সাথে আরেকজনকে নিয়ে আসে। অহনার অতীত শুধু অহনার না, সাদিকেরও। অহনার বাবাকে দাফন করানোর পরই মা কেমন একটা হয়ে গেলো। মৃত্যুভয় তারা করতো সবসময়। ছোট ভাই আর বড় বোনকে নিয়ে নানিবাড়িতে ওঠার পরপরই বোনের বিয়ে হয়ে গেলো। অহনার তখন সতেরো চলছিলো আর বোনের উনিশ। স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে চলে গেলো শ্বশুরবাড়ি। একা রইলো অহনা। দুইদিন পর মামা তারজন্যেও পাত্র আনলো। বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিলো। নানান ঝামেলায় সেবার বিয়ে না হলেও পরের বছর ঠিকঠিক বিয়ে ফাইনাল হলো। পাত্র সাদিক ছিলো না। সে কীভাবে থাকবে! সাদিককে তো চিনতোই না কেউ। তারপরও কিভাবে কিভাবে যেনো ওই বিয়ে ভেঙে তার সাথে বিয়ে হয়ে গেলো৷ এতো আগ্রহ ছিলো না জন্য জানতে চায়নি। আর এখন চাইলেও সম্ভব না। খোলাখুলি কথা বলার মতো সম্পর্ক কোনদিনই হয়ে ওঠেনি। বিয়ে হলো সংগোপনে। মামার পুরোনো পাঞ্জাবি পরলো সাদিক আর সে পরলো মামির পুরোনো লাল শাড়ি। এলাকার ইমামের সাহায্যে কবুল পড়িয়ে বিবাহকার্য সম্পন্ন করে ফেললো দ্রুত। এরপর কোত্থেকে কাজিও আসলো, রেজিস্ট্রিও হলো। তড়িঘড়ি করে বিদায় দিয়ে বাড়ির দরজা তারজন্য চিরতরে বন্ধ করে ফেললো।
পুরো রাস্তা কান্না করেছিলো অহনা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিলো। বাসের এই জার্নিতে পাশের সিটের মানুষটা কাঠের পুতুলের মতো বসেছিলো শুধু। ধোঁয়া ধোঁয়া স্মৃতি সব। মা ভাই বোন সবাই খুব আপন থাকলেও মাথার উপর ছাদের খুব প্রয়োজন ছিলো। মা বলে দিয়েছিলো,
–অহনা, যাই হয়ে যাক, আশ্রয় হারাবি না।

অহনা মেনেছিলো সেই কথা। সেই মেনেই যে কত কি হয়ে গেলো। কত কি! সেসব মনে করেই উদাস হয়ে গেলো!

গাড়ির কথা উঠতেই সাফ সাফ মানা করে দিলো সে। কোন টাকা যে নেবে না। গাড়ি নেওয়া মানে সাদিকের খরচে যাওয়া। চোখ মুখ শক্ত করে টোট ব্যাগ থেকে দুটো টিকিট বের করে দেখালো। সাদিক মুখ গম্ভীর করে রিক্সা চেপে চলে গেলো রেলস্টেশনে। ট্রেন আসলো আরো এক ঘন্টা পর। ট্রেনের সিটে পাশাপাশি বসলো তারা। ঠিক বিয়ের দিনের মতো। এবারে সাদিকের বাম হাতের অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে হীরার আংটি। সদ্য বাগদানের সাক্ষী হয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। অহনা হাসলো মনে মনে। দুনিয়ায় জীবিত থাকতে হলে কত কিছুই যে দেখতে হয়!

চলবে…

অদৃশ্য দেয়াল পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- ছয়।(শেষ)
লেখা: সিহাব হোসেন।

নাহিদ যে আসলে কোনো সরকারি চাকরি করে না, এই সত্যটা জানার পর আরিশার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, এত বড় একটা প্রতারণা তার সাথে হতে পারে। সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাহিদকে জিজ্ঞেস করল,
– “কেন তোমরা আমাকে এভাবে ঠকালে?”
– “এখানে ঠকানোর কী আছে? চাকরি সরকারি হোক বা বেসরকারি, তোমাকে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য তো আমার আছে।”
– “তাই বলে এত বড় একটা মিথ্যা?”
– “মানুষ তো মিথ্যা বলতেই পারে। তোমাদের তো উচিত ছিল বিয়ের আগে সবকিছু ভালোভাবে যাচাই করা। তা না করে সরকারি চাকরির কথা শুনেই তোমাদের মতো লোভী পরিবারগুলো মেয়েদের ছেলের হাতে গছিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। আর এই লোভের কারণেই শেষ পর্যন্ত তোমাদের কপালে এমন মুলাই জোটে।”
নাহিদের কটু কথায় আরিশা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার বলার মতো আর কোনো ভাষা ছিল না।

ওদিকে, আফজাল সাহেব যেদিন এনজিও থেকে টাকা ফেরত পাওয়ার কথা, তার আগেই সংবাদপত্রে খবর এল যে, পুরো কোম্পানিটাই ছিল এক প্রতারক চক্র। তারা প্রথমে মানুষকে দ্বিগুণ টাকার লোভ দেখিয়ে বিশ্বাস অর্জন করত, আর পরে যখন মানুষ লোভে পড়ে বড় অঙ্কের টাকা রাখত, তখনই সব নিয়ে উধাও হয়ে যেত। এই খবরটা আফজাল সাহেবকে একেবারে ভেঙে দিল। এক মাস পরেই সমিতির টাকাগুলো মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে। জমানো গয়না আর গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে সব মিলিয়ে বড়জোর দশ-বারো লাখ টাকা জোগাড় হবে। এখন একমাত্র উপায় হলো বাড়ি বিক্রি করা, কিন্তু এত অল্প সময়ে ভালো দামে বাড়ি বিক্রি করাও প্রায় অসম্ভব।

এত বড় মানসিক চাপের মধ্যেও তার উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের কোনো সমস্যা হচ্ছে না দেখে তিনি নিজেই অবাক হচ্ছিলেন। হয়তো আল্লাহ তাকে তার কর্মফল ভোগ করানোর জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি তার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে টাকার জন্য ধরনা দিলেন, কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করতে রাজি হলো না। অবশেষে দোকানের মালপত্র সব বিক্রি করে কোনোমতে পনেরো লাখ টাকা জোগাড় হলো। কিন্তু এখনো অনেক টাকা বাকি। তিনি যখন বাড়ি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন সুযোগসন্ধানী ক্রেতারা এমন দাম বলতে লাগল যা শুনলে কান্না পায়। তিনি তার বড় মেয়ের স্বামীকে টাকার জন্য অনুরোধ করলেন, কিন্তু সে সাফ মানা করে দিল। নাহিদের বাবা-মায়ের সামর্থ্য থাকলেও তারা যে এক পয়সাও দেবেন না, তা তিনি ভালো করেই জানতেন।

এরই মধ্যে নাহিদ আরিশাকে বাবার বাড়ি থেকে টাকার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। আরিশা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল,
– “আব্বুর যে অবস্থা, এই মুহূর্তে তিনি এতগুলো টাকা কীভাবে দেবেন, বলো?”
– “টাকা দিতে পারবে না, তাহলে এত টাকা মোহরানা বেঁধেছিলে কেন? হয় টাকা দেবে, নয়তো মোহরানা পরিবর্তন করে আমি যা দিতে চেয়েছিলাম, সেটাই লিখবে। নইলে আমার বাড়ি বিক্রি করে হলেও তোমার মতো মেয়েকে আমি রাখব না। আর যদি মনে করো, টাকা পেয়ে নিজের রূপ-যৌবন দেখিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবে, তাহলে মনে রেখো, সেটা আর সম্ভব হবে না। কারণ সবাই ততদিনে জেনে যাবে তোমরা কেমন লোভী আর প্রতারক। তখন তোমাকে সবাই ভোগ করতে চাইবে, কিন্তু বিয়ে কেউ করবে না।”

নাহিদের কথায় আরিশা দুলে উঠল। সে কী করবে, কিছুই বুঝতে পারছিল না। অবশেষে সে বাধ্য হয়েই মোহরানা দুই লাখ টাকা নিতে রাজি হলো। নাহিদ তৎক্ষণাৎ সেই টাকা পরিশোধ করে দিল, কিন্তু এরপর থেকে আরিশার জীবনটা যেন ন*রকে পরিণত হলো। নাহিদ তাকে আর আগের মতো দেখতে পারে না, সামান্য ভুলেই অকথ্য ভাষায় গা*লিগা*লাজ করে, বাজে ব্যবহার করে। আরিশা তার সব দুঃখের কথা লিমার সাথে ভাগ করে নিল। সব শুনে লিমা শুধু বলল,
– “দেখলি তো, এজন্যই বলি, মানুষকে কখনো অবহেলা করতে নেই। কখন কার অবস্থা কেমন হয়, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।”

রিফাতের বিয়ের তারিখটা কিছু কারণে চার মাস পিছিয়ে গিয়েছিল। সেই বিয়ে উপলক্ষে লিমাকেও দাওয়াত করা হয়েছিল। সায়ন নিজেই তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে এল। রাবেয়া বেগম লিমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। সায়ন দুদিন আগেই তার বাবা-মাকে লিমার কথা সব খুলে বলেছে।

বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে লিমা সায়নের ঘরে এসে তার বিছানায় বসল। সায়নের বাবা-মা তখনো অনুষ্ঠানেই ছিলেন। এমন সময় সায়ন ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। এক মুহূর্তের জন্য লিমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। কিন্তু সায়ন তাকে অবাক করে দিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার কোলে মাথা রাখল। লিমা বেশ অবাক হয়ে গেল। সায়ন আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলতে লাগল,
– “আমি তোমাকে সেই স্কুলজীবন থেকেই পছন্দ করতাম, কিন্তু কখনো বলার সাহস হয়ে ওঠেনি। আমি সবসময় তোমাকে নিয়ে ভাবতাম। কিন্তু যখন আমার পড়াশোনাটা আর হলো না, তখন ধরে নিয়েছিলাম, তোমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখাটা আমার জন্য মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ তোমার মতো ধনী পরিবারের মেয়েকে আমার মতো ছেলের হাতে কেউ তুলে দেবে না। তাই তো মা-বাবা যার সাথেই বিয়ে ঠিক করতে চাইত, আমি রাজি হয়ে যেতাম। কিন্তু জানো, যেদিন আমি তোমাকে আবার দেখলাম, আর জানলাম যে তোমার জীবনে আজ পর্যন্ত কেউ আসেনি, সেদিন থেকে আমি আবার নতুন করে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। বিশ্বাস করো লিমা, আমি জানি, তোমার মতো করে আমাকে আর কেউ কোনোদিন বুঝবে না, ভরসা দিতে পারবে না। আজ আমি তোমাকে আমার সারাজীবনের জন্য চাইছি। প্লিজ, আমাকে ফিরিয়ে দিও না।”

সায়নের কথায় লিমার চোখ ছলছল করে উঠল। সে আলতো করে সায়নের মাথাটা কোল থেকে তুলে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। দুই হাতে সায়নের মুখটা ধরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক স্নিগ্ধ হাসি। যে হাসি তার না বলা সমস্ত কথাই যেন এক নিমিষে বলে দিল, ভালোবাসার এক নীরব, কিন্তু শক্তিশালী অঙ্গীকার।

সায়ন উঠে দাঁড়াল। লিমার হাত ধরে সে তাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তাদের ভাড়া বাড়ির সামনেই বিশাল এক জায়গা, উঁচু দেয়ালে ঘেরা। সায়ন সেই ঘেরা জায়গার দরজা খুলে লিমাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। লিমা ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখল, একপাশে ফুলে ফুলে ভরা এক মনোরম বাগান। গোলাপ, গাঁদা, জবা, সব ধরনের ফুলের গাছ সেখানে লাগানো। আর এক কোণে রয়েছে ছোট্ট এক বেলি ফুলের ঝাড়, যার মিষ্টি সুবাস বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

সায়ন স্নিগ্ধ গলায় বলতে লাগল,
– “যেদিন থেকে আমি জেনেছি তুমি ফুল অনেক ভালোবাসো, সেদিন থেকেই মনে মনে ঠিক করেছি, তোমাকে আমি এমন একটা ফুল বাগানের মালিক বানাব। কী, হবে আমার এই ফুল বাগানের মালিক?”
লিমা হেসে উঠে উত্তর দিল,
– “মালিক কেন, তুমি যদি আমাকে এই বাগানের মালিও বানাতে চাও, আমি তাতেই রাজি।”
– “আমার মহারানি কখনো মালি হতে পারে না।”
লিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “কিন্তু এই জায়গাটা কার?”
– “কেন, আমার।”

লিমা এবার পুরোপুরি বিস্মিত। যার নিজের বাড়ি নেই বলে এত অবহেলা, এত অপমান, সে কি না এত বড় একটা জায়গার মালিক! সায়ন তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
– “কী, বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, আল্লাহ চাইলে ফকিরকে বাদশাহ বানাতে এক মুহূর্তও সময় নেন না।”
– “হুম। কিন্তু এখন তোমার আরিশার বাবার পাশে দাঁড়ানো উচিত।”
– “হ্যাঁ, আমি দাঁড়াব, চিন্তা করো না। তুমি আজ বাসায় গিয়ে কথা বলো। আমি আর দেরি করতে চাই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে আমার বউ করে আনতে চাই।”
– “ভেবো না। আমার বাবা-মা তোমার কথা সবকিছুই জানেন।”

সায়ন তার কথা রেখেছিল। সে আফজাল সাহেবের পাশে এসে দাঁড়াল, তবে শর্ত হিসেবে তার পুরো বাড়িটা কিনে নিল। আফজাল সাহেব হতবাক হয়ে গেলেন। যে ছেলেকে তিনি বাড়ি নেই বলে এত অপমান করেছেন, আজ সে শুধু তার বাড়িই কিনে নিল না, এর চেয়েও বড় এক জায়গার মালিক সে, এই বাস্তবতা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। তিনি সেদিন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলেন, অহংকারের প*তন অনিবার্য আর কোনো মানুষকে ছোট করে দেখার পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

অনেক দিন পর। আরিশা রাতের বেলা বেলকনিতে একা বসে আছে। আজ সায়ন আর লিমার বিয়ে হয়েছে। নাহিদ নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর শান্ত গলায় বলল,
– “আজ ওদের বিয়েতে গিয়েছিলাম। লিমা অনেক ধনী আর সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। অথচ তোমরা একদিন বলতে, সায়নের কপালে কেউ জুটবে না। কিন্তু দেখো, ভাগ্যের কী পরিহাস! আজ ওর মনের মতো মানুষ, নিজের বাড়ি, সহায়-সম্পদ, সবই হয়েছে। আর তোমার, সবকিছু থেকেও যেন কিছুই নেই। সামান্য একটু টাকা-পয়সা হলেই আমরা অহংকারী হয়ে উঠি, সাধারণ মানুষের সাথে অদৃশ্য এক দেয়াল তুলে দিই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এই অহংকার একদিন ঠিকই শেষ হয়ে যায়।”

এই বলে নাহিদ সেখান থেকে চলে গেল। আরিশার মনে পড়ল, কয়েকদিন আগে সায়ন তাকে বলেছিল:
– “তোকে অনেক ধন্যবাদ। তুই সেদিন আমাকে প্রত্যাখ্যান না করলে হয়তো আমি কোনোদিন লিমাকে পেতাম না। আসলে, কিছু খারাপ ঘটনার পেছনেও অনেক ভালো কিছু লুকিয়ে থাকে। প্রয়োজন শুধু একটুখানি ধৈর্যের। আর ভালোবাসা কখনো শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ মানে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শিক্ষিত হওয়ার আগে একজন ভালো মানুষ হওয়া আর মনুষ্যত্ববোধ থাকাটা অনেক বেশি জরুরি।”

সায়নের কথাগুলো আরিশার কানে বাজতে লাগল। সে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে হয়তো জল ছিল না, কিন্তু বুকের ভেতরটা পুড়ছিল এক গভীর অনুশোচনার আগুনে। যে সুখ সে একদিন পায়ে ঠেলেছিল, আজ তা অন্যের হয়ে গেছে, আর সে রয়ে গেছে এক শূন্যতার মাঝে, যেখানে অহংকারের ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নেই।

(সমাপ্ত)

অদৃশ্য দেয়াল পর্ব-০৫

0

#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- পাঁচ।
লেখা: সিহাব হোসেন।

লিমা মুগ্ধ চোখে বেলি ফুলের মালাটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার খুব শখ ছিল এমন একটা মালা পরার, কিন্তু আশেপাশে কোথাও এই গাছ খুঁজে না পাওয়ায় সেই ইচ্ছাটা অপূর্ণই রয়ে গিয়েছিল। সে অবাক হয়ে সায়নকে জিজ্ঞেস করল,
– “বেলি ফুল যে আমার এত পছন্দ, এটা তুমি জানলে কীভাবে?”
– “তোমার কি স্কুলের সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে? স্কুলে যাওয়ার পথে একটা বাড়িতে বেলি ফুলের গাছ ছিল। একদিন তুমি সেখান থেকে ফুল পাড়তে গিয়েছিলে, কিন্তু বাড়িওয়ালা দেখে ফেলায় তোমাকে তাড়া করেছিল। ঠিক তার পরের দিনই তারা গাছটা কেটে ফেলে। আর সেদিন তুমি ক্লাসে বসে খুব কান্না করছিলে।”

সায়নের কথা শুনে লিমার চোখের সামনে যেন অতীতের সেই দৃশ্যটা ভেসে উঠল। সে বলল,
– “আর ঠিক তখন এক ছোট ভাই আমাকে অনেকগুলো বেলি ফুল এনে দিয়েছিল। সে বলেছিল, ফুলগুলো সে আনেনি, অন্য কেউ তাকে দিয়েছে, আর নাম বলতেও নিষেধ করেছে। আমি এখন নিশ্চিত, ওটা তুমিই ছিলে, তাই না?”

সায়ন লাজুকভাবে মাথা নাড়ল। লিমা খিলখিল করে হেসে ফেলল। তার হাসিতে যেন কফিশপের পুরো পরিবেশটা আরও স্নিগ্ধ হয়ে গেল।
– “তো, আজকের কাহিনিটা বলো। এই মালাটা পেলে কোথায়?”
– “আমাদের এলাকা থেকে বেশ দূরে একটা গাছ আছে। খুব ভোরে গিয়েছিলাম ফুল আনতে। কিন্তু গিয়ে দেখি, আমার আগেই একটা মেয়ে প্রায় সব ফুল কুড়িয়ে নিয়েছে।”
লিমা ভ্রু কুঁচকে বলল, “তাহলে তুমি পেলে কীভাবে?”
– “গাছে আরও অল্প কিছু ফুল ছিল। আমি যখন সেগুলো কুড়াচ্ছিলাম, তখন মেয়েটি আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া, এটা কি আপনি আপনার কোনো প্রিয় মানুষকে দেবেন?’ আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারছিলাম না। তখন সে মুচকি হেসে তার কুড়ানো সব ফুল আমাকে দিয়ে দিল। বাসায় ফিরে আমি নিজ হাতে এই মালাটা গেঁথেছি।”

লিমা কিছুক্ষণ চুপ করে মালাটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সায়নের দিকে মালাটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
– “নাও, এবার এটা আমার হাতে পরিয়ে দাও।”

লিমার কথায় সায়ন চমকে উঠল। তার হাত স্পর্শ করতে হবে, এই ভাবনাতেই তার ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। লিমা সায়নকে চুপ করে থাকতে দেখে দুষ্টুমি করে বলল,

– “কী হলো? আবার বাথরুম পেয়েছে নাকি?”
– “আরে না!”
– “তাহলে পরিয়ে দাও।”

সায়ন কাঁপা কাঁপা হাতে লিমার হাতটা ধরতেই তার সারা শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে পরম যত্নে মালাটা লিমার কোমল হাতে পরিয়ে দিল। লিমা তার দিকে তাকিয়ে এক মায়াবী হাসি দিল।
এরই মধ্যে কফি এসে গেল। তারা কফি শেষ করে বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু বৃষ্টির তেজ কমার কোনো লক্ষণই নেই। হঠাৎ লিমা বলে উঠল,
– “এই বৃষ্টি আজ আর থামবে না। চলো, আজ বৃষ্টিতে ভিজব।”
– “ভিজলে ঠান্ডা লাগবে তো।”
– “তুমি কি বাচ্চা নাকি যে বৃষ্টিতে ভিজলেই ঠান্ডা লাগবে? চলো তো।”

লিমার জেদের কাছে সায়নকে হার মানতেই হলো। তারা কফিশপ থেকে বেরিয়ে এল ঝুম বৃষ্টির মাঝে। ভিজতে ভিজতে তারা কলেজের বিশাল মাঠে চলে এল। লিমা তার দুই হাত মেলে আকাশের দিকে মুখ করে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটাকে যেন আলিঙ্গন করছিল। আর সায়ন মুগ্ধ হয়ে দেখছিল তার ভেতরের এই উচ্ছল মানুষটিকে।

হঠাৎ তাদের চোখ পড়ল মাঠের অন্য প্রান্তে। আরিশা আর নাহিদও বৃষ্টিতে ভিজছে। আরিশা, সায়ন আর লিমাকে একসাথে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। লিমা ওদের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সায়নকে নিয়ে সেখান থেকে সরে গেল।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগেই। সায়ন লিমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে বাসায় ফিরল। তার ভেজা শরীর দেখে রাবেয়া বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
– “তুই বৃষ্টিতে এভাবে ভিজেছিস কেন?”
– “ভিজতে ইচ্ছা করছিল, তাই ভিজলাম।”
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে সায়ন আজকের বিকেলটার কথাই ভাবতে লাগল। এমন একটা সুন্দর দিন যে তার জীবনে আসবে, তা সে কখনো কল্পনাও করেনি।

সায়নকে লিমার সাথে দেখার পর থেকেই আরিশার মনটা অস্থির হয়ে আছে। সে কিছুতেই এটা মানতে পারছিল না। তৎক্ষণাৎ লিমাকে ফোন করে সে বলল,
– ” তোর সাথে ওর সম্পর্কটা কী, বল তো?”
– “কেন রে?”
– “তুই ওর সাথে এভাবে মিশছিস কেন?”
– “মিশলে সমস্যাটা কী?”
– “ওই ফকিন্নিটার সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিজের সুন্দর জীবনটা নষ্ট করিস না। ওই অশিক্ষিত, মূর্খটা তোকে কোনোদিন সুখী করতে পারবে না। ওর তো কোনো ভবিষ্যৎই নেই।”
– “দেখ আরিশা, তুই ওকে কেন সহ্য করতে পারিস না, তা আমি জানি না। কিন্তু ওর মধ্যে আমি এমন কিছুই দেখিনি, যাতে ওকে অশিক্ষিত মনে হয়। আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার আমরা কেউ না। ওপরে একজন বসে আছেন, তিনিই সব ভাববেন।”
– “কিন্তু তাই বলে তুই ওর সাথে?”
– “তোরা সবাই তো বলিস যে ও জীবনে কিছুই করতে পারবে না, ওর মতো ছেলেকে বিয়েই বা কে করবে? আমি তোদের সবাইকে দেখিয়ে দেব, ও খুব তাড়াতাড়িই অনেক বড় কিছু করে দেখাবে। আমার কথাটা মনে রাখিস। আর এখনো সময় আছে, নিজের অহংকারটা ঝেড়ে ফেল। নয়তো পতন হতে বেশি সময় লাগবে না।”
– “তার মানে, তুই ওকে পছন্দ করিস?”
– “হুম। যে আমাকে এতটা ভালোবাসে, তাকে ভালোবাসতে আমার কোনো সমস্যা নেই। ওকে আমি অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতাম, শুধু ওর সরলতার কারণে।”

দিন যত যাচ্ছে, লিমা আর সায়নের সম্পর্কটা ততই গাঢ় হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কেউ কাউকে মুখে “ভালোবাসি” কথাটা বলেনি। কিন্তু তাদের একে অপরের প্রতি যে গভীর নির্ভরতা তৈরি হয়েছে, তা না বলা অনেক কথাই বলে দেয়। এখন তাদের জীবনে এমন কোনো ঘটনাই নেই, যা তারা একে অপরের সাথে ভাগ করে নেয় না।

কর্মফল বোধহয় একেই বলে। আফজাল মিয়ার সুদের ব্যবসার ওপর যেন হঠাৎ করেই কালো মেঘের ছায়া নেমে এসেছে। তার বিশ্বস্ত এক লোক চার লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে, কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না। এর কিছুদিন পরেই খবর এল, বাজারের আরেকজন, যাকে তিনি পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন, সে-ও অতিরিক্ত সুদের বোঝা বইতে না পেরে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। এরা দুজনই ছিল আফজাল মিয়ার খুব কাছের লোক, তাই তিনি কোনো কিছু বন্ধক না রেখেই সরল বিশ্বাসে টাকাগুলো দিয়েছিলেন। এখন এই নয় লাখ টাকা উদ্ধার করতে না পারলে তার নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে। সামনে আর মাত্র দুই মাস বাকি সমিতির টাকা পরিশোধ করার। এই বিশাল অঙ্কের টাকার চিন্তায় তার র*ক্তচাপ বেড়ে গেছে, রাতের ঘুম হা*রাম হয়ে গেছে।

নাহিদ আর আরিশার সংসারেও অশান্তির আগুন জ্বলছে। নাহিদ অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে দেখল, আরিশা বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছে। সে এসেছে, অথচ সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। নাহিদের মেজাজ বিগড়ে গেল।
– “সারাদিন এই ফোন টেপা ছাড়া তোমার আর কোনো কাজ নেই?”
– “সব কাজই তো করি। আর কী বাকি আছে?” আরিশার নির্বিকার উত্তর।
– “আমি অফিস থেকে ফিরলাম, আমার ফাইলপত্রগুলো একটু গুছিয়ে রাখবে, তা না করে নিজের মতো ফোন টিপছ! যত্তসব ফালতু কাজকর্ম।”

নাহিদের রাগে আরিশারও জেদ চেপে গেল, কিন্তু সে মুখে কিছু বলল না। রাতে নাহিদ যখন বিছানায় শুয়ে ছিল, আরিশা তার পাশে এসে বসল। নাহিদ ঠান্ডা গলায় বলল,
– “তোমার বাবা যে গয়না দিতে চেয়েছিলেন, সেটার আর প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে বরং সমপরিমাণ টাকা দিতে বোলো।”
– “টাকা দিয়ে কী করবে?”
– “টাকা দিয়ে মানুষ কী করে, তা তো জানোই। আর শোনো, ছয় মাস পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টাকাটা যেন দিয়ে দেয়। তোমার বাবা তো কারও কাছ থেকে এক টাকা পেলে একদিনও দেরি সহ্য করেন না, তাহলে আমার বেলায় এত দেরি করার কোনো মানে হয় না।”
নাহিদের কথায় আরিশার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে বলল,
– “আমার ওপর তোমার মোহরানা পরিশোধ করা ফরজ ছিল, কিন্তু তুমি তো আমাকে সেই সুযোগই দাওনি। অথচ নিজের বাবার যৌতুকের টাকার জন্য আমার ওপর এমন জুলুম করছ?”
– “আমার সামর্থ্য ছিল দুই লাখ টাকা মোহরানা দেওয়ার। কিন্তু তোমরা জোর করে সেটা পনেরো লাখ টাকা ধার্য করলে। এত টাকা আমি এখন কীভাবে দেব? অথচ বিয়ের আগে তো তোমরা দুই লাখেই রাজি ছিলে। তোমার সুদখোর বাবা এই বিয়েটাকেও একটা ব্যবসায় পরিণত করেছে।”

নাহিদের কথায় আরিশা মাথা নিচু করে রইল। পরদিন সে তার বাবাকে গিয়ে সবটা খুলে বলল। আফজাল সাহেব তখন টাকার চিন্তায় দিশেহারা। তিনি চিন্তিত মুখে বললেন,
– “ওদেরকে আর দুটো মাস অপেক্ষা করতে বল। আমি সব টাকা একসাথে দিয়ে দেব।”

নয় লাখ টাকার বিশাল লোকসানের চিন্তায় যখন আফজাল সাহেব অস্থির, ঠিক তখনই তিনি একটা খবরের সন্ধান পেলেন। শহরে নাকি নতুন এক এনজিও এসেছে, যেখানে যত টাকা রাখা হবে, ঠিক এক মাস পর তার দ্বিগুণ ফেরত পাওয়া যাবে। আফজাল সাহেব খোঁজ নিয়ে দেখলেন, বিষয়টা সত্যি। অনেকেই নাকি দ্বিগুণ টাকা ফেরত পেয়েছে। তার মাথায় সাথে সাথে এক নতুন বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, তার সমিতির যে পঁচিশ লাখ টাকা আছে, সেটা যদি এক মাসের জন্য এই এনজিওতে রাখা যায়, তাহলে তো মাস শেষে তা পঞ্চাশ লাখ হয়ে যাবে!

যেই ভাবা, সেই কাজ। তিনি সমিতির সব টাকা তুলে নিয়ে সেই এনজিওতে রাখলেন। প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রও সযত্নে নিজের কাছে রাখলেন। মনে তার তখন কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন।

কিন্তু বিপদ যখন আসে, তখন চারদিক থেকেই আসে। এই টাকার ঝামেলার মধ্যেই তিনি এক ভয়ংকর খবর পেলেন। তার মেয়ের জামাই নাহিদ আসলে কোনো সরকারি চাকরি পায়নি। সে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে, সেটাও নাকি যাওয়া-যাওয়া অবস্থায়। এই খবরটা যেন তার মাথায় ব*জ্রপা*তের মতো আ*ঘা*ত করল। যে সরকারি চাকরির লোভে তিনি সায়নকে অপমান করে নাহিদের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, সেই চাকরিটাই আসলে একটা মস্ত বড় ধোঁকা ছিল।

চলবে….!

অদৃশ্য দেয়াল পর্ব-০৪

0

#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- চার।
লেখা: সিহাব হোসেন।

আরিশার বাবা আফজাল হোসেন শুধু একজন বড় পাইকারি ব্যবসায়ীই নন, বাজারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিও বটে। কাঁচামালের বড় আড়তের পাশাপাশি তিনি একটি সমিতি চালান, যা তার অবৈধ সুদের ব্যবসার একটি মোক্ষম আবরণ। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সমিতির নামে টাকা সংগ্রহ করে বছর শেষে সামান্য কিছু লভ্যাংশ দেন, আর সেই জমানো মূলধনটাই তিনি চড়া সুদে খাটান। টাকা দেওয়ার আগে বন্ধক হিসেবে রাখেন সোনাদানা বা জমির দলিল। কয়েক সপ্তাহ দিতে দেরি হলেই শুরু হয় তার আসল রূপের প্রকাশ; তখন বন্ধকি সোনা বা জমি, কোনোটিই আর ফেরত পাওয়ার উপায় থাকে না। এভাবেই তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।

আজ তেমনই এক লোক তার বন্ধকি গয়না ফেরত নিতে এসেছেন। সব টাকা পরিশোধ করে তিনি যখন গয়না চাইলেন, আফজাল সাহেব অবজ্ঞার সুরে বললেন,
– “তোমাকে তো আর এসব ফেরত দেওয়া সম্ভব নয় বাপু। কারণ তোমার ডেট ওভার হয়ে গেছে।”
– “এসব কী বলছেন মিয়া ভাই! মাত্র চার সপ্তাহ লাভের টাকা দিতে পারিনি, আর তার জন্য আপনি আমার পুরো গয়নাটাই রেখে দেবেন?”

“তুমি জানো না? আমার এখানে চার সপ্তাহ পার হয়ে গেলে আমি আর কোনো মাল ফেরত দিই না।”
– “আমার দেড় লাখ টাকার জিনিসের বদলে আপনি মাত্র বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। চার সপ্তাহের সুদসহ আপনার মোট পাওনা হয় বত্রিশ হাজার টাকা। আপনি এই টাকাটা রেখে বাকিটা আমাকে দিয়ে দিন, ভাই।”
লোকটির অনুনয়ে আফজাল হোসেনের মেজাজ বি*গড়ে গেল। তিনি বসা থেকে হুংকার দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
– “সরে যা আমার চোখের সামনে থেকে! কিসের টাকা পাবি তুই? তোকে আগেই বলেছিলাম, চার সপ্তাহের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে না পারলে বন্ধকি জিনিস পুরোটাই আমার। তুই তো স্ট্যাম্পে সইও করেছিলি, ভুলে গেছিস?”

লোকটি আর কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি জানেন, পুলিশের কাছে গিয়েও কোনো লাভ হবে না, কারণ শহরের প্রভাবশালী মহলে আফজাল হোসেনের ভালোই জানাশোনা। তাই তিনি অসহায়ভাবে আকাশের দিকে মুখ তুলে বললেন,
– “আল্লাহ, তুমিই এই জু*লুমের বিচার একদিন করবে।”

আফজাল সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। মনে মনে বললেন, ‘আমি তো হজ করে এসেছি, আমার কিছুই হবে না। যদি কিছু হওয়ার থাকত, তাহলে তো কবেই হতো! কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, আমার সম্পদ তো শুধু বাড়ছেই। এর আগেও তো কত লোক কত অভিশাপ দিল, কই, কিছুই তো হলো না।’

ঠিক এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। দরজা খুলে তিনি দেখলেন, এলাকার কিছু যুবকসহ মসজিদ কমিটির একজন মুরুব্বি দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বিনীতভাবে বললেন,
– “ভাইসাব, আমরা মসজিদের জন্য একটা বার্ষিক দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছি। আপনি যদি আমাদের সাথে শরিক হতেন, তাহলে খুব ভালো হতো।”
– “কেন নয়, কেন নয়! আপনারা ভেতরে আসুন, আমি দিচ্ছি।”
এরপর তিনি ঘরের ভেতর থেকে কড়কড়ে দশটি এক হাজার টাকার নোট এনে তাদের হাতে তুলে দিলেন। লোকটি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
– “আপনি এভাবেই আল্লাহর রাস্তায় দান করেন বলেই তো দিন দিন আপনার সম্পদে এত বরকত। আল্লাহ আপনার সম্পদে আরও বরকত দান করুন।”

ওদিকে, সায়ন এখন তার অনলাইন কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছে। তাদের পারিবারিক ব্যবসার অবস্থাও দিন দিন ভালো হচ্ছে। একদিন রাবেয়া বেগম আফসোসের সুরে বললেন,
– “কী দরকার ছিল মেয়েটাকে রিফাতের সাথে বিয়ে দেওয়ার? যদি না দিতিস, তাহলে এতদিনে তোরও একটা বিয়ে হয়ে যেত।”
– “বিয়ের পর তাহলে ওর এখানে থেকে পরকীয়া করাটা আরও সহজ হতো, তাই না?”
রাবেয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,
– “পরকীয়া? সেটা আবার কী জিনিস?”

মায়ের সরল প্রশ্নে সায়ন মনে মনে হাসল। ভাবল, তার মায়ের প্রজন্মটা কতই না ভালো ছিল! এখনকার সমাজের এই ভাইরাসের কথা তখনকার বেশিরভাগ মানুষই জানত না। যা এখন ডালভাতের মতো সহজ, সেই সময়ে তা ছিল কল্পনাতীত।
– “কী হলো, বলছিস না কেন?”
সায়ন হাসতে হাসতে বলল,
– “এর মানে হলো, পরের বউয়ের উপকার করা।”
– “কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলিস!”
– “থাক বাদ দাও তো আম্মু, এসব তুমি বুঝবে না। এটা এই প্রজন্মের একটা বড় ভাইরাসের নাম, যা আমাদের সমাজটাকে ভেতর থেকে একেবারে দূষিত করে দিচ্ছে। কত সংসার যে এর জন্য শেষ হয়ে যাচ্ছে, বাবা-মা বেঁচে থেকেও সন্তানরা তাদের আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে!”
– “হুম, বুঝতে পেরেছি।”
রাবেয়া বেগমের কণ্ঠে গভীর উদ্বেগ। সায়ন বলতে লাগল,
– “তিশা মেয়ে হিসেবে হয়তো ভালো, কিন্তু ওর মধ্যে এখনো যথেষ্ট পরিপক্বতা আসেনি। ও রিফাতকে ভালোবাসত, তাই আমার সাথে বিয়ে হলে কখনো মন থেকে মানতে পারত না। আর এখন তো ভার্চুয়ালের যুগ, প্রাক্তনের সাথে যোগাযোগ করাটা কোনো ব্যাপারই না। তার সাথে কথা বলতে থাকলে আমাকে ও জীবনেও ভালোবাসতে পারত না। তুমি হয়তো বলবে, ফোন ব্যবহার করতে দিতাম না। কিন্তু তাতে ঝামেলা আরও বাড়ত, শেষে দিতে বাধ্যই হতাম। তোমাদের সময়, নানি-দাদির সময়ে তাদের যেখানে বিয়ে দেওয়া হতো, তারা ভাগ্যকে মেনে নিত। ধৈর্য ধরত, আর সে কারণেই স্বামীর সাথে অনায়াসে সুখী হতে পারত। কিন্তু এখনকার মেয়েরা প্রেমিকের সাথে বিয়ে না হলে দোষ দেয় তার স্বামীর। মনে করে, স্বামীর কারণেই সে তার প্রেমিককে হারিয়েছে। ধৈর্য কম, তাই না সে নিজে সুখী হতে পারে, আর না তার স্বামীকে সুখী করতে পারে।”

ছেলের কথাগুলো রাবেয়া বেগমকে গভীরভাবে নাড়া দিল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– “তুই ঠিকই বলেছিস বাবা। আমি এতটা গভীরে গিয়ে ভেবে দেখিনি। সময় যে কতটা বদলে গেছে, তা আমার মাথায়ই আসেনি। এই সাধারণ জিনিসটা হয়তো আমাদের মতো অনেক মায়ের মাথায় আসে না, আর তাই আমরা না বুঝেই সন্তানদের ভুল পথে ঠেলে দিই।”
– “হুম।”
সায়ন কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে কথা গুলো বলল।

সকাল থেকেই আকাশটা কালো হয়ে আছে। মেঘে ঢাকা আকাশে সূর্যের দেখা নেই, তার বদলে বইছে একরাশ ঠান্ডা বাতাস। এমন দিনে কলেজের পেছনের পুকুরপাড়ে লিমার পাশে বসে আছে সায়ন। কিন্তু এই মনোরম পরিবেশেও তার কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, আর পায়ের পাতায় অনুভূত হচ্ছে এক অদ্ভুত কাঁপুনি। সে প্রাণপণে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু তার ছটফটানি লিমার চোখ এড়াল না। লিমা তার এই অবস্থা দেখে মুচকি হেসে বলল,
– “তোমার সমস্যাটা কী, বলো তো? সেই প্রথম দিন থেকেই দেখছি, তুমি আমাকে দেখলেই থরথর করে কাঁপো। এর কারণটা কী, বলবে?”
– “তা তো আমি নিজেও জানি না।”
– “আজব ব্যাপার তো! যখন তুমি একা আমার পাশে থাকো, ঠিক তখনই এমন করো। অথচ অন্য সময় তো বেশ স্বাভাবিকই দেখি।”
– “যখন তোমায় নিয়ে ভাবি, তখন পা কাঁপে।” কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল সায়নের।
লিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “কী ভাবো শুনি?”
এই প্রশ্নে সায়ন আরও বেশি অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে সে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– “তুমি একটু বসো, আমি আসছি।”
– “কোথায় যাবে?”
– “এসে বলছি।”

বলেই সায়ন দ্রুত পায়ে পাবলিক টয়লেটের দিকে দৌড়াতে লাগল। লিমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে সে কেন ওদিকে যাচ্ছে। তার এই ছেলেমানুষি কাণ্ডে লিমা আপনমনেই হেসে ফেলল।

একটু পর যখন সায়ন ফিরে এল, তার চেহারায় তখন রাজ্যের প্রশান্তি। সে ধীর পায়ে এসে লিমার পাশে বসল। লিমা দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করল,
– “বাথরুমে গিয়েছিলে?”
– “হুম। বুঝতে পারি না, তোমার সামনে এলেই আমার পেটে এমন কামড় দেয় কেন! অবস্থা এতটাই বেগতিক হয় যে, বাথরুমে না যাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাই না।”
– “গায়ে হলুদের রাতেও তাহলে এই কারণেই পালিয়েছিলে, তাই তো?”
– “হুম। তুমি তো সায়েন্স নিয়ে পড়েছ, তো এই বিষয়ে তোমার বিজ্ঞান কী বলে?”
– “ইন্টারে কমার্স নিয়েছিলাম, তাই ঠিক বলতে পারছি না।”

এই বলে লিমা খিলখিল করে হেসে উঠল। তার হাসির শব্দে পুকুরপাড়ের শান্ত পরিবেশটা যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠল। সায়ন মুগ্ধ হয়ে তার হাসি দেখছিল। কিছুক্ষণ পর সে জিজ্ঞেস করল,

– “আচ্ছা, তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?”
লিমা একটু ভেবে বলল,
– “উমম… একদম না। “আমি চাই আমার জীবনে এমন একজন আসুক, যে আমার মতোই একটু অন্যরকম হবে। যে আমি ছাড়া আর অন্য কারো দিকে তাকাবে না। আর… আমাকে একটু ভয়ও পাবে।”
– “আমি তো জানতাম, তোমার মতো মেয়েরা, যারা সহজে ছেলেদের পাত্তা দেয় না, তারা অনেক বেশি অ্যাটিটিউডওয়ালা ছেলে পছন্দ করে। লোকে বলে, তোমরা সুন্দর বলে তোমাদের অহংকারও নাকি অনেক বেশি।”
– “অনেকে হয়তো তাই, কিন্তু আমি তো বললামই, আমি সবার থেকে আলাদা। আমার একজন নরম মনের মানুষ দরকার, যে আমাকে খুব খুব ভালোবাসবে। আচ্ছা, চলো তো, অনেক গল্প হলো। এবার একটু হাঁটা যাক।”
– “চলো।”

তারা পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই ঝুম করে বৃষ্টি নামল। দৌড়ে গিয়ে তারা কাছের একটা কফিশপে আশ্রয় নিল। সায়ন দুটি কফির অর্ডার করল। লিমা জানালার কাঁচের ওপর গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আনমনে দেখছিল। আর সায়ন মুগ্ধ হয়ে দেখছিল লিমাকে। বৃষ্টিভেজা বিকেলের আলো-আঁধারিতে লিমাকে যেন আরও মায়াবী লাগছিল।

এমন সময় সায়ন পকেট থেকে সযত্নে রাখা একগোছা বেলি ফুলের মালা বের করে লিমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। লিমা চমকে উঠল। তার প্রিয় ফুল বেলি, কিন্তু সায়ন এটা কীভাবে জানল? তার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে সায়নের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি, যা তার ভেতরের সব না বলা কথাগুলো যেন এক মুহূর্তেই প্রকাশ করে দিল।

চলবে….!

অদৃশ্য দেয়াল পর্ব-০৩

0

#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- তিন।
লেখা: সিহাব হোসেন।

গভীর রাত। গায়ে হলুদের কোলাহল কমে এলেও খাওয়ার আয়োজন তখনো চলছে। সায়ন একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কেউ তাকে খাওয়ার কথা বলছে না। অথচ তার অন্য কাজিনদের কী ভীষণ খাতিরযত্ন করে খাওয়ানো হচ্ছে! এই নির্লজ্জ অবহেলা তার আত্মসম্মানে বড় বেশি আ*ঘা*ত করল। সে সেখান থেকে উঠে স্টেজের কাছে এসে দাঁড়াল। লিমা তখনো সেখানেই বসে ছিল। হঠাৎ সায়নের মেজো খালা লিমাকে কী একটা কাজে ডেকে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় লিমা সায়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “খেয়েছ তুমি?”
– “না।”
– “তাহলে চলে এসো, একসাথে খাই।”
তাদের কথা কানে যেতেই আরিশার বড় বোন আফসানা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠল,
– “তুমি গিয়ে খেয়ে নাও তো। ওর সময় হলে ও নিজেই খেয়ে নেবে।”

লিমা আর কথা বাড়াল না। সায়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বাজে পৌনে দশটা। প্রায় সবারই খাওয়া শেষ, শুধু তার সময় হয়নি। এত অবহেলা আর সহ্য করা যায় না। সে নিঃশব্দে অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। কাছেই দাদির বাড়ি। সেখানে গিয়েই রাতের খাবারটা সারল এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, এই অপমান সহ্য করে আর ওদের কোনো অনুষ্ঠানে সে যাবে না।

পরদিন সকালে রাবেয়া বেগম যখন বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বললেন, সায়ন মুখের ওপর সাফ জানিয়ে দিল,
– “আমি যাব না।”
ছেলের কণ্ঠের দৃঢ়তা আর চোখের ভাষা দেখেই রাবেয়া বেগম বুঝে গিয়েছিলেন গত রাতের ঘটনা। তাই তিনি আর জোর করলেন না। সায়ন ঠিক করল, আজকের দিনটা সে নিজের মতো করে কাটাবে।

ওদিকে বিয়ের বাড়িতে তখন সাজসাজ রব। লিমা কনের ঘরে আরিশাকে সাজিয়ে দিচ্ছিল। রুমে তারা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। এই সুযোগে লিমা বলল,
– “তুই সায়ন সম্পর্কে আমাকে যা যা বলেছিস, তার একটাও তো সত্যি না। ওকে দেখে তো কোনোভাবেই টোকাই মনে হয় না। সে তো তোরই খালাতো ভাই, তার সম্পর্কে এমন নিচু কথা বলা কি তোর ঠিক হয়েছে?”
– “এছাড়া আর কী বলব?” আরিশার নির্লিপ্ত জবাব।
– “মানুষকে এভাবে ছোট করা একদমই ঠিক না। কাল রাতে আমি সবটাই দেখেছি, তোরা ওদের কতটা অবহেলা করিস। মনে রাখিস, মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হতে সময় লাগে না। আজ যে রাজা, কাল সে ফকির হতে পারে। আবার কালকের ফকির পরশু রাজা হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ কখন কার ভাগ্য কীভাবে ঘুরিয়ে দেন, তা কেউ জানে না।”
– “একটা কথা জানিস? এই দুনিয়ায় যার টাকা নেই, তার কোনো দামও নেই। ওদের সাহস কত বড়, আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়! কী যোগ্যতা আছে ওর? না আছে লেখাপড়া, না আছে ঠিকমতো আয় করে খাওয়ানোর মুরোদ। আর নাহিদকে দেখ, ও যা আয় করে, সায়ন তা দশ বছরেও করতে পারবে না।”
– “ঘুষ খায় না তো আবার?”

কথাটা শুনেই আরিশা দাঁত কটমট করে লিমার দিকে তাকাল। লিমা পরিস্থিতি হালকা করতে হেসে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল।
লিমা সেদিন পুরো অনুষ্ঠানে সায়নকে খুঁজেছিল, কিন্তু কোথাও তাকে পায়নি। তাই আরিশার কাছে তার ফোন নম্বর চাইল, কিন্তু সে দিল না। বাধ্য হয়ে সে তৌহিদের কাছে গেল।
– “আমি সায়নের বন্ধু। ওর নম্বরটা কি পাওয়া যাবে?”
তৌহিদ নম্বরটা দিতেই লিমা ফোন করল। না আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই সায়ন বলল,
– “এত অবহেলা আর সহ্য করা যায় না। তবে আজকের পর থেকে যে আমার সাথে যেমন ব্যবহার করবে, সে ঠিক তেমনটাই ফেরত পাবে।”
– “যাক, এতক্ষণে তাহলে বুঝেছ। কেউ অবহেলা করলে বা নিচু চোখে দেখলে এক মুহূর্তও তার কাছে থাকবে না। আর বিশেষ করে নিজের দুর্বলতা কখনো কাউকে বুঝতে দিও না।”
– “হুম।”

দুপুরে দাদির বাড়ি থেকে খেয়ে নিজের ভাড়া বাসায় ফিরতেই সায়ন দেখল, বাড়িওয়ালার ছেলে রিফাত সিঁড়িতে বসে কাঁদছে। রিফাত সায়নের চেয়ে দুই বছরের ছোট, অনার্সে পড়ে। বাসায় তখন আর কেউ ছিল না। সায়ন তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
রিফাত চোখ মুছে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
– “তিশা আর আমি একসাথে স্কুল-কলেজে পড়েছি। আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আজ রাবেয়া আন্টি (সায়নের মা) এসে বলে গেলেন, তিশার মা-বাবা নাকি তার সাথে তোমার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে।”
সায়ন কথাটা শুনে মুচকি হাসল। তিশা হলো তার সেই মামাতো বোন, যার সাথে গতরাতে তার মা বিয়ের কথা বলছিলেন। সায়ন তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
– “আরে ধুর! বিয়ে দিতে চাইলেই কি আর হয়ে যাবে নাকি?”
– “কিন্তু ভাইয়া, আমার মা-ও তো তিশাকে মেনে নিতে চায় না। কারণ আমরা সমবয়সী।”
সায়ন কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল,
– “আচ্ছা, আমি যদি তোমাদের বিয়েটা পড়িয়ে দিই, তাহলে কেমন হয়?”
রিফাতের চোখমুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! সে আমতা আমতা করে বলল,
– “কিন্তু মা যদি কিছু বলে…”
– “প্রথম প্রথম একটু ব*কাব*কি করবেই। তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকো। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে আর কিছুই বলবে না।”

এরই মধ্যে লিমার ফোন এল। সে উত্তেজিত হয়ে জানাল, বিয়ের আসরে মোহরানা নিয়ে বিশাল ঝামেলা শুরু হয়েছে। আরিশার বাবা পনেরো লাখ টাকা মোহরানা ধার্য করতে চান, কিন্তু নাহিদ পাঁচ লাখের বেশি দিতে রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত নাহিদ একটা শর্ত দিল,পনেরো লাখ মোহরানা সে দেবে, যদি আরিশার বাবা যৌতুক হিসেবে পাঁচ ভরি সোনা দেন। তার যুক্তি, বড় মেয়ের বিয়ের সময় যদি দিতে পারেন, তাহলে ছোট মেয়ের বেলায় সমস্যা কোথায়? অবশেষে অনেক দর-কষাকষির পর পনেরো লাখ টাকা মোহরানা আর ছয় মাস পর পাঁচ ভরি সোনা দেওয়ার শর্তে বিয়েটা সম্পন্ন হলো।
খবরটা শুনে সায়ন হাসতে লাগল। বিয়ে হতে না হতেই ঝামেলা শুরু! ভবিষ্যতেও যে আরও কত কী নাটকীয়তা অপেক্ষা করছে, তা ভেবেই তার হাসি পেল।

সায়ন আর রিফাত মিলে পরিকল্পনা করল, আগামী শনিবারেই তারা কাজটা সেরে ফেলবে। পরিকল্পনা মতোই শনিবার সকালে সায়ন, রিফাত আর তিশাকে নিয়ে কাজী অফিসে হাজির হলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল এক নতুন বিপত্তি। রিফাত আর তিশা একা, সাক্ষী হিসেবে এসেছে শুধু রিফাতের এক বন্ধু। বিয়ের জন্য অন্তত দুজন সাক্ষী দরকার। সায়ন রিফাতকে বলল,
– “রিফাত, তোমার আর কোনো বন্ধুকে ফোন দিয়ে ডাকো।”
– “আরে ভাই, এরা সব গা*দ্দার। ঝামেলার ভয়ে কেউ আসতে চাইছে না।” রিফাতের কণ্ঠে রাজ্যের হতাশা।

উপায়ন্তর না দেখে সায়নের হঠাৎ করেই লিমার কথা মনে পড়ল। কেন যেন তার মনে হলো, একমাত্র সেই-ই এই মুহূর্তে সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো না। ফোন করার কিছুক্ষণের মধ্যেই লিমা কাজী অফিসে এসে হাজির হলো। এরপর আর কোনো বাধা রইল না। কাজী সাহেব তাদের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন।
কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে লিমা সায়নকে জিজ্ঞেস করল,
– “আজ বা কাল একবার দেখা করতে পারবে?”
– “বাসার এই ঝামেলাটা আগে শেষ করি। তারপর না হয় দেখা করব।”
– “আচ্ছা। কী হয় না হয়, আমাকে কিন্তু অবশ্যই জানিও।”
এই বলে লিমা একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেল। রিফাত দুষ্টুমি করে হাসতে হাসতে বলল,
– “ভাই, আপনি চাইলেই তো আজ আপনারও শুভ কাজটা হয়ে যেত, তাই না?”
– “ধুর! ও আমার ভালো বন্ধু। এর বেশি কিছু না।”
তিশা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,
– “আমরাও তো একসময় ভালো বন্ধুই ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হলো, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।”

বাড়িতে ফিরে সায়ন সরাসরি রিফাতের মাকে সবটা খুলে বলল। সব শুনে রিফাতের মা তো রেগে আগুন। তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। অন্যদিকে, রিফাতের বাবা মুচকি মুচকি হাসছেন, কিন্তু স্ত্রীর ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। এদিকে রাবেয়া বেগমের অবস্থা আরও করুণ। তিনি হাসবেন না কাঁদবেন, সেটাই বুঝতে পারছেন না। নিজের ছেলের জন্য যে মেয়েটিকে তিনি এত শখ করে ঠিক করেছিলেন, সেই মেয়েকে কি না তার ছেলেই আরেকজনের সাথে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এল! সায়ন পরিস্থিতি সামাল দিতে রিফাতের মাকে বুঝিয়ে বলল,
– “আন্টি, ওরা একে অপরকে ভালোবাসে। আমি জানি, ওরা সমবয়সী বলে আপনি মানতে চাইছেন না। কিন্তু ওরা যদি নিজেদের ভালোটা বুঝতে পারে, তাহলে আপনি বা আমি কী করতে পারি? ধরুন, ওদের অন্য কারও সাথে বিয়ে হলো। তাতে কী হবে? শুধু আপনার ইচ্ছাটা পূরণ হবে। কিন্তু রিফাত তার স্ত্রীর হক ঠিকভাবে আদায় করতে পারবে না, আর তিশাও তার স্বামীর প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। কারণ তাদের মন তো এখানেই পড়ে থাকবে।”

সায়নের যুক্তির কাছে তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। চুপচাপ তিশার হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন এবং ফোন করে তিশার বাবা-মাকে সব জানালেন। তারাও খুব বেশি দেরি করলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে পাকা করে ফেললেন।

সবকিছু মিটে যাওয়ার পর রাবেয়া বেগম মুখ মলিন করে বসে রইলেন। সায়ন তার পাশে বসে হেসে বলল,
– “কী হলো তোমার? মন খারাপ?”
– “তোর জন্য যাকে ঠিক করলাম…”
– “আরে মা, এত অস্থির হচ্ছ কেন? যদি থাকে নসিবে, আপনা-আপনি কেউ না কেউ আসিবে। আর তাছাড়া, জীবনে এখনো অনেক পথ চলা বাকি, অনেক কিছু করা বাকি, অনেক কিছু দেখা বাকি। আগে সেই স্বপ্নগুলো পূরণ হোক, তারপর বাকিটা না হয় দেখা যাবে।”

অবশেষে ঠিক হলো, রিফাত আর তিশার আনুষ্ঠানিক বিয়ে হবে এক মাস পর। সন্ধ্যায় লিমা ফোন করে খুনসুটির সুরে বলল,
– “কী ব্যাপার? নিজের চেয়ে ছোটদেরও বিয়ে হয়ে গেল। তোমার বিয়ের ফুল কবে ফুটবে?”
– “ফুল ফোটার আগেই তো ছাগলে এসে খেয়ে যাচ্ছে। যেদিন সফলভাবে চারপাশে বেড়া দিতে পারব, সেদিনই ফুটে যাবে।”

সায়নের রসিকতায় লিমা ফোনের ওপাশ থেকে খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই হাসির শব্দে সায়নের মনেও যেন একরাশ ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়ল।

চলবে….!