#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৬৮
তিন মাস ভালো কেটেছে নয়নার। চৌধুরী বাড়িতে আর ফেরা হয়নি তার। মাঝেমাঝে নাজিম চৌধুরী আর মিতা বেগমের সাথে ফোনে কথা হয়। কলেজ, নিজের বাসা, আর সঙ্গে আছে মিস্টার ড্রাইভারের ভালোবাসা—সব মিলিয়ে বিন্দাস জীবন কাটছে নয়নার। তবে ইন্টারে সায়েন্স নেওয়াটা ঠিক হয়নি। সুখের জীবনে এই সায়েন্স যেন একটা বোঝা। কাউকে যদি সুখে থাকতে ভূতে কিলায়, সে ইন্টারে সায়েন্স নেয়। বাপরে! ফিজিক্স আর ম্যাথ—এই দুটো সাবজেক্ট যেন নয়নার শান্তি গিলে খায়।
বারান্দায় বসে দোলনায় পা দোলাচ্ছে নয়না। আকাশে অগণিত তারা মিটিমিটি জ্বলছে। চাঁদের আলো ক্ষীণ হলেও নয়নার মন বেশ ফুরফুরে। অবশেষে জিয়ানের আসার সময় হয়েছে। নয়না জিয়ানকে ভিডিও কল করল।
জিয়ান কল রিসিভ করতেই মুচকি হেসে বলল, “হেই রঙ্গনা, কী অবস্থা?”
নয়না জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে এই লুকে মারাত্মক হ্যান্ডসাম লাগছে।”
“দেখতে হবে না, শার্টটা কার পছন্দ করা!”
“কার জন্য কেনাকাটা করছেন, ডিয়ার হাসবেন্ড?”
“আমার একমাত্র প্রিয়তমা, অর্ধাঙ্গিনীর জন্য।”
“আপনি আসলেই আসবেন?”
“নাহ, নকল করে আসব।”
“শার্টের বাটন লাগান।”
“মাত্র দুটো খোলা, বেব।”
“একটা লাগান।”
জিয়ান হাতে থাকা ব্যাগটা রেখে একটা বাটন বন্ধ করে নিল। “এবার চলবে?”
“দৌড়াবে, মিস্টার ড্রাইভার।”
“আচ্ছা, কেনাকাটা শেষ করে তোমাকে কল করব।”
“অপেক্ষা করব, কিন্তু আমি।”
“এই জান, অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে কথা হবে।”
“উহু, আমার ইচ্ছে করছে প্রেম করতে। নরম প্রেম।”
“প্রেম বুঝি নরম-শক্ত আছে?”
“হুম, আছেই তো। আপনি বুঝবেন না, মিস্টার পাইলট।”
জিয়ান শপিংমল থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসে বলল, “সো, মিসেস চৌধুরী, আমি তোমার সাথে নরম প্রেম করতে চাই।”
নয়নার চুল বাতাসে উড়ছে, দোলনাটা দুলছে। হেসে বলল, “প্রেম করবে তুমি? প্রেম করার দায়িত্ব তো ছেলেদের। আমরা তোমাদের প্রেমে মত্ত হব, পাগল হব, লুটিয়ে পড়ব তোমাদের বুকে।”
“ওহ, আচ্ছা। কিন্তু আমি তো জানি না, নরম প্রেম আবার কী, গো?”
“কানে কানে বলি, শোন।”
জিয়ান ফোনের স্ক্রিনের কাছে এসে বলল, “বলো গো, সুন্দরী বৌ।”
“চোখ বন্ধ করো। গভীরভাবে অনুভব করো। আমাদের রুফটপে আমি তোমার কোলে বসে আছি। তুমি আমার কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছ। আমি তোমার গলা জড়িয়ে ধরেছি। শহরজুড়ে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির শীতল ফোঁটা আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। তুমি মৃদু স্বরে ডাকলে, ‘সুনয়না’। তোমার এই ডাকে আমি কেঁপে উঠলাম। তুমি আমার দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছ। আমার ভেজা ঠোঁট তোমাকে চুম্বকের মতো টানছে। ধীরে ধীরে তুমি তোমার ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে আনলে, তারপর আমার কাঁপতে থাকা ভেজা ঠোঁট দুটো দখল করে নিলে তোমার ঠোঁটের আড়ালে।”
জিয়ান হঠাৎ চোখ খুলে বলল, “ওরে, দুষ্ট বৌ! এই মধ্যরাতে আমাকে মাতাল করার ধান্দা? এটা কিন্তু ঠিক না।”
নয়না জিয়ানের দিকে একভাবে তাকিয়ে বলল, “আই নিড ইওর লিপস। এই মুহূর্তে তোমার ঠোঁটের স্পর্শ খুব মিস করছি। আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠছে।”
জিয়ান ডাকল, “সুনয়না, সুনয়না। শুনছ তুমি?”
নয়নার চোখের কোণে অশ্রু টলমল করছে।
“কী হলো তোমার? তুমি কী ভাবছ, বলো জান।”
“জানি না, আমার খুব করে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আমি কি মরে যাব?”
“জান, এসব কথা কখনো বলবে না। এই তো, আর এক সপ্তাহ, তারপর আমি সত্যি সত্যি তোমার কাছে থাকব, একদম কাছে। যতটা কাছাকাছি থাকলে তোমার নিশ্বাস আমার নিশ্বাসে মিলিত হয়। ঠিক ততটা কাছে।”
নয়নার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। জিয়ানকে বলল, “এবার আসলে আমাকে নিয়ে যাবে, কিন্তু।”
“এবার হবে না, জান। তবে পরবর্তীতে নিশ্চিত নিয়ে যাব। নাহিদকে দায়িত্ব দিয়ে আসব, ও কাগজপত্র সব রেডি করে রাখবে।”
🌿
জাহিন এই ক’দিন একদম গায়েব। মাঝেমাঝে জাহিন এমন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশে ট্রাভেল করে বেড়ায়। ধরতে গেলে তখন কারো সাথে যোগাযোগ করে না।
জাহিন বসে আছে মান্নাতের সাথে এক টেবিলে। মান্নাতের ঘৃণা হচ্ছে সামনে বসা মানুষটার দিকে তাকাতে। জাহিন কফি মগে চুমুক দিয়ে বলল, “মিস্টার জন, আপনার হবু স্ত্রীকে বলুন নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে। যারা চলে গেছে, তাদের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করতে মানা করুন।”
মাইকেল জন এরিক। জনের সাথে মান্নাতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তারা বিয়েও করবে। কিন্তু আজ যখন জাহিন তাকে তিক্ত সত্যগুলো বলল, ইচ্ছে করছে জাহিনকে খুন করে ফেলতে। কিন্তু এই মানুষটার জন্যই সে এখনো সুস্থভাবে বেঁচে আছে। জন বলল, “ঠিক আছে, মান্নাত আর বাংলাদেশের কারো সাথে যোগাযোগ করবে না।”
জাহিন কফি মগে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, “গুড বাই, মিস মান্নাত। মনে রাখবেন, জীবনের বেড়াজাল খুব কঠিন। জাল ছিঁড়তে গেলে আরো গভীর জালে আটকে পড়তে হয়। আমাকেই দেখুন, গোয়েন্দা হয়ে জাল কাটতে গিয়ে গভীর জালে আটকে পড়েছি। এখন আমি গভীর জলের মাছ। গুড বাই।”
জাহিন সোজা এয়ারপোর্টে চলে এল। তিন মাস পর সে বাড়ি ফিরবে। আজ তার ফ্লাইট।
🌿
অন্তর বসে আছে তুষির সাথে। এই তিন মাসে তাদের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা এগিয়েছে। অন্তর বলল, “জাহিনের সাথে আমি তিন মাসে কোনো রকম যোগাযোগ করতে পারিনি।”
“এটা কেমন কথা? টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক—সোশ্যাল সাইটেও কি যোগাযোগ করা যায় না?”
“জাহিন এমনই। মাঝেমাঝে সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ট্রাভেল লাভার। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে পছন্দ করে। ও নিজে থেকে যোগাযোগ না করলে আর কোনো ব্যবস্থা নেই।”
“তবে খুব শিগগির দেশে ফিরবে হয়তো। কারণ সামনে বড় একটা কেসের শুনানি।” অন্তর বেখেয়ালে কথাটা বলে ফেলল।
“কীসের কেস? কেসের সাথে কী সম্পর্ক ওনার?”
“আরে, ওর বিয়ে। বিয়ে তো জীবনের সবচেয়ে বড় কেস।”
“আচ্ছা, আপনি বিয়ে করবেন না?”
“জেনেবুঝে কেস খাব? আজীবন মেয়াদি হাজতবাস! এর চেয়ে সিঙ্গেল ভালো আছি।”
তুষি কিছু বলল না। চুপচাপ থেকে বলল, “আচ্ছা, আজ তাহলে আসি।”
“আপনি কি সত্যি সত্যি জাহিনকে ভালোবাসতেন? না, মানে, কোনোভাবে আপনার মনে ওর জন্য সফট কর্নার জন্মেছিল?”
তুষি অন্তরের দিকে তাকিয়ে বলল, “লোভ জন্মেছিল। এত এত চকোলেট আর গিফটের লোভ। তাই কোনো ফিলিংস জন্মাতে পারেনি। যার জন্য সব ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলাম, সেই তো ধোঁকা দিল। বাদ দিন সেসব কথা। এখন বাবা-মায়ের পছন্দে সোজা বিয়ে করব। আপনি দেখুন, যত দ্রুত সম্ভব জাহিনের কান পর্যন্ত কথাটা পৌঁছে দিন।”
“একটু ওয়েট করুন, বিল পরিশোধ করে আসছি। আপনাকে বাসা পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে আসি।”
তুষি বাইরে এসে দাঁড়াল। এই কয়েকদিন তুষির দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার ভুলের জন্য নয়নার জীবনে কী বিপদ অপেক্ষা করছে? এসব ভেবে ভেবে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। মানুষ ভুল করে একদিন, সাফার করে চিরদিন।
🌿
সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বেশ বেলা হয়ে গেল নয়নার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল, ওড়না জড়িয়ে নিল গায়ে। হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হল। মোবাইল হাতে নিয়ে অবাক হল নয়না—জিয়ানের নাম্বার থেকে বিশ প্লাস মিসড কল! সাথে সাথে কল ব্যাক করল। ফোন বন্ধ বলছে। নয়নার সুন্দর সকাল মুহূর্তে কালো মেঘে ঢেকে গেল। বারবার কল দিতে থাকল, কিন্তু বন্ধ ফোনে তো কল যায় না।
নয়না ছুটে এল ড্রয়িংরুমে। কিছু বলতে চায়, কিন্তু কাকে বলবে? নীলাঞ্জনা কাতরাচ্ছে সোফায়। নীলাঞ্জনা ইদানীং খুব অসুস্থ থাকে। তার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও এর থেকে মুক্তি পায়নি। নয়নার মাথা চক্কর দিচ্ছে। দুচোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে তার পুরো পৃথিবীটা ঘুরছে। কিছু বলতে চাইল, তার আগেই ঢলে পড়ল ফ্লোরে।
#চলবে
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৮
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৭
#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬৭
জিয়ান ফোনটা কেটেই রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “সাহস কী করে হয় আমার রুমে প্রবেশ করার?”
“স্যার, আমার একটা দরকার ছিল।”
“দরকার মাই ফুট! গেট লস্ট। জাস্ট লিভ।”
“স্যার, আমার কথাটা শুনুন।” মেয়েটি দু’কদম সামনে এগিয়ে এল।
জিয়ান তার সামনে থাকা আয়নায় ঘুষি মেরে বলল, “এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বের হোন। নির্লজ্জ, বেহায়া, ডার্টি মহিলা।” অন্য হাতে গার্ডকে কল করে বলল, “আপনাদের কেন কাজে রাখা হয়েছে, ঘাস কাটতে? এত রাতে আমার রুমে আসার সাহস কী করে কেউ পায়? আগামীকাল সকালে যেন এর মুখ আর না দেখি।”
সিকিউরিটি গার্ড আসার আগে মেয়েটি জিয়ানের কাছে এগিয়ে গেল। জিয়ান নিজের সামনে থাকা ফুলদানি হাতে তুলে নিল।
মেয়েটি দু’কদম পিছিয়ে বলল, “স্যার, আপনি কাজটা ভালো করলেন না। আমি প্রমোশনের জন্য আপনার মনোরঞ্জন করতে এসেছিলাম। আমরা একই দেশের মানুষ। ছেলে হিসেবে আপনার ফিজিক্যাল নিড আছে। আজ রাতে আপনার সেই নিড আমি পূরণ করার জন্য স্বেচ্ছায় ধরা দিতে চেয়েছিলাম, আর আপনি!”
সিকিউরিটি গার্ড আসতেই জিয়ান বলল, “এই অসভ্য মহিলার চেহারা যেন আর না দেখি। পাইলট রেজা চৌধুরী এত সস্তা নয়। কেউ যেন দ্বিতীয়বার এই দুঃসাহস না করে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।”
বেডের ওপর বসল জিয়ান। পাইলট আর কেবিন ক্রু-সহ সবার খাবার সার্ভ করে তিনজন মহিলা। তাদের মধ্যে একজন মিস রায়া। মেয়েটি এতটা নির্লজ্জ, জিয়ান সেটা কল্পনাও করেনি। লজ্জা ছাড়া মানুষ পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট। যার লজ্জা নেই, সে যা খুশি করতে পারে। দরজা বন্ধ করে বেডে বসল। মোবাইলটা হাতে নিল নয়নাকে কল করার জন্য। কিন্তু তার আগেই ওপাশ থেকে কল এল।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের রুমে মধ্যরাতে একটা মেয়ে কেন প্রবেশ করে? এর উত্তর অজানা নয় নয়নার। তবুও নিজের মনকে সে বোঝাচ্ছে। হয়তো কোনো প্রয়োজনে এসেছে, অথবা কোনো বিপদও হতে পারে। নয়না পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল। এই পাঁচ মিনিট তার কাছে পাঁচ হাজার বছরের মতো মনে হয়েছে। মোবাইল হাতে নিয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতে জিয়ানের নম্বরে ভিডিও কল করল। রিং হচ্ছে? না, যেন নয়নার হৃদয়ে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে!
জিয়ান সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করে বলল, “তর সইছে না, বউ?”
নয়না হকচকিয়ে গেল। জিয়ানের পেছনের আয়নাটা ভাঙা, হাতে রক্ত লেগে আছে, তবুও মুখে হাসি! নয়না শান্ত স্বরে বলল, “কোন সুনামি ঘটিয়েছেন? আপনি নিজের রাগ সংযত করতে পারেন না কেন?”
“তুমিই বলো, আমি রুমে ঢুকে দরজা নক করতে ভুলে গেছি, ড্রেস চেঞ্জ করে শুয়েছি। এই রাতে এই মেয়ের এত বড় সাহস, না বলে আমার রুমে ঢুকে পড়ে! মেয়েমানুষ, তার গায়ে তো হাত তোলা যাবে না। তাই এই হাল।”
নয়না জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “ফার্স্ট এইড বক্স কোথায়? বক্সটা নিন আর এখনই হাতে ব্যান্ডেজ করুন।”
“ সেরকম জখম হয়নি, জান।”
“যা বলেছি, তাই করুন।”
জিয়ান বক্স এনে হাতে অ্যান্টিসেপটিক লাগাল। নয়না মুগ্ধ নয়নে জিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা মানুষ আর কতভাবে তাকে মুগ্ধ করবে? কঠিন মানুষের ভালোবাসা আরও কঠিন। তাদের ভালোবাসায় কোনো ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ থাকে না।
“এভাবে কী দেখছ, বউ? এমনিতেই মেজাজ খারাপ, তোমার সঙ্গে দেহমন তোমাকে চাচ্ছে । তার ওপর এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো দিশেহারা হয়ে যাব।”
নয়না দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল, “এত সুন্দর আয়নাটা ভেঙে ফেললেন, দয়ামায়া নেই?”
“দয়া, মায়া, ভালোবাসা সব আছে, কিন্তু তা শুধু তোমার জন্য, বাটার মাশরুম। এই শুনছ…”
“বলুন।”
“তোমার চোখদুটো মারাত্মক। আমাকে হত্যা করার জন্য তোমার দুটি চোখই যথেষ্ট।”
“এ আবার কেমন কথা, মিস্টার ড্রাইভার?”
“এ হত্যা সে হত্যা নয়, গো রঙ্গনা। এ হলো হৃদয় হত্যা। তোমার দৃষ্টির সীমানার বাইরে আছি, তাই দৃষ্টির প্রখরতা আমাকে হত্যা করছে। ভালোবাসি তোমাকে, প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।”
“কবে আসবেন আপনি?”
“এই তো, খুব তাড়াতাড়ি। আমিও যে ব্যাকুল হয়ে আছি। উফ, কবে যে তোমার উষ্ণ আলিঙ্গনে হৃদয় সতেজ করব?”
নয়না মৃদু স্বরে বলল, “এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। আমিও ঘুমাই।”
“আমার রিপ্লাই কই, জান?”
“অপেক্ষা করুন, মিস্টার ড্রাইভার।”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভোর হতে বেশি বাকি নেই। নয়না বাইরে তাকিয়ে বলল, “আমার শহরে ভোরের আলো, তোমার শহর মধ্যরাতের নিকষকালো। এক আকাশের নিচে, তবুও হাজার মাইলের দূরত্ব।”
🌿
তুষি কয়েকবার শ্বাস নিল। চোখ বন্ধ করে বলল, “আমি যে ভুল মজার ছলে করেছি, আমি চাই না সে ভুলের মাশুল অন্য কেউ দিক।”
অন্তর বলল, “এত হেঁয়ালি না করে সোজাসাপটা বলুন।”
“জাহিন চৌধুরী নয়নাকে পছন্দ করে।”
অন্তর উত্তর দিল না। “তারপর?”
“তিন বছর আগে নয়নার সঙ্গে জাহিনের দেখা হয় শপিংমলে। হয়তো সেদিনই প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যায়। এরপর আমি আর নয়না স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন আরেকবার দেখা হয়। নয়না যদিও খেয়াল করেনি, আমি খেয়াল করেছি। জাহিন ছেলে হিসেবে সুদর্শন। একজন সুদর্শন ছেলে আমাদের পিছু নিচ্ছে, ব্যাপারটা জোস লাগল আমার। প্রেমের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট আগে থেকেই ছিল। নয়নার কাছে পড়াশোনা ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছুতেই ইন্টারেস্ট ছিল না।”
“জাহিন একদিন আমাদের স্কুলের দারোয়ানের কাছে অনেকগুলো চকোলেট পাঠায়—ক্যাডবেরি, কিটক্যাট। নয়নাকে দিতে বলে, কিন্তু নয়নাকে না পেয়ে দারোয়ান আমার হাতে দিয়ে যায়। সঙ্গে একটা কাগজে নম্বরও লেখা ছিল।”
“এরপর শুরু হয় ফোন আলাপ। বিভিন্ন সময়ে অনেক গিফট সে পাঠায়। আমাদের প্রেম হয় ফোনে ফোনে। আমি কিন্তু টাইমপাস করছিলাম—চকোলেট, গিফট আর এত অ্যাটেনশনের লোভে। আমার তখন প্রেমিক ছিল। এরপর এভাবে চলতে থাকে। কথা হতো মাঝেমধ্যে, খুব বেশি না হলেও নিয়মিত টুকটাক কথা হতো। একদিন আমার বয়ফ্রেন্ড বিষয়টা জেনে যায়। সমস্যা হয় আমাদের মাঝে। আমি কথা বলা বন্ধ করে দিই। কিন্তু ততদিনে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। নয়না এই বিষয়ে কিছুই জানে না। নয়না বারবার বলে, জাহিনের চাহনি ওর ভালো লাগে না। আমি বুঝি জাহিন নয়নাকে ভালোবাসে। মানুষ নিজের প্রথম প্রেম কখনো ভুলতে পারে না। জাহিনও পারছে না। জাহিনের মনে হচ্ছে নয়না জাহিনকে ঠকিয়ে জিয়ানকে বিয়ে করেছে। অথচ বিয়েটা হয়েছে কাকতালীয়ভাবে।”
অন্তরের রাগ হচ্ছে তুষির ওপর। তিন বছর আগে এই মেয়ে ছিল ক্লাস নাইনে বা এইটে। ওইটুকু বয়সে এত কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে! বিরক্ত লাগছে তুষিকে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে। নিজের রাগ সংযত করে বলল, “কতদিন কথা হয়েছে আপনাদের?”
“প্রায় দেড় বছর।”
“কেমন টাইপ কথা হতো?”
“খুবই সাধারণ কথা। তবে ‘লাভ ইউ জান’, ‘লাভ ইউ টু জান’, ‘মিস ইউ জান’, ‘মিস ইউ টু জান’—এই কথাগুলো আমাদের মধ্যে বেশি আদান-প্রদান হতো।”
“জাহিনের কাছে যান আর এসব স্বীকার করুন। নয়তো জানি না এর পরিণাম কী হবে।”
তুষি অন্তরের হাত আঁকড়ে ধরল। কান্নারত কণ্ঠে বলল, “আমি জানি আমি ভুল করেছিলাম। বিশ্বাস করুন, ওই বয়সে ওই দামি দামি চকোলেট আর গিফটের লোভে এসব করেছি। আমি খারাপ, আমি জানি, কিন্তু এতটাও খারাপ না। প্লিজ আমাকে হেল্প করুন। আমার জন্য আমার বোনের মতো বান্ধবীর জীবনে ঝড় আসুক, আমি চাই না।”
অন্তর কঠিন মানুষ, তবুও শান্ত স্বরে বলল, “এখন অনেক দূর গড়িয়ে গেছে জল। এই ঝড় কীভাবে সামলাবো, আমার জানা নেই। তবে আমি চেষ্টা করব।”
তুষি মনে মনে ভেঙে পড়েছে। না জানি কত বড় বিপদ সে ডেকে এনেছে নয়নার জীবনে।
🌿
মেহনুর মিতা বেগমকে বলল, “আম্মি, আমি জাহিনকে বিয়ে করতে রাজি।”
“হ্যাঁ, তুই তো বলেছিস আমাকে। কিন্তু জাহিনকে তো শোনাতে পারছি না। এই ছেলেটাকে আমি বুঝতে পারি না, কখন কী যে করে!”
“তোমার ছেলেরা আমাকে এত অপছন্দ করে কেন, আম্মি? আমি কি এতটাই খারাপ?”
“এসব কী বলছিস? অপছন্দ করবে কেন? আজকালের ছেলেমেয়েরা প্রেম-ট্রেম করে নিজেই পছন্দ করে রাখে। তাই এই সমস্যা হয়। তুই চিন্তা করিস না, তোর জন্য ভালো পাত্র খুঁজব।”
মেহনুর মিতা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই, আম্মি।”
🌿
জাহিন কোট হাতে নিয়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে টেবিলের ওপর পা তুলে বসে বলল, “মন্ত্রী সাহেব, সব হলো মানি পাওয়ার। মানি পাওয়ার না থাকলে মানুষের কোনো মূল্য নেই।”
#চলবে
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৬
#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬৬
জিয়ান টিভি বন্ধ করে বলল, “ধুর, এত হট আর সুইট বৌ থাকতে টিভি দেখব কেন? আমি তো লাইভ শো দেখব, বেবি। লেটস ড্যান্স, জানু।”
“ওয়ে, মিস্টার ড্রাইভার! আপনি বললেই আমি নাচব?”
“জানু, আজ রাত’কা সিন বানা দো।”
“ছিহ! কী সব কথা!”
“তোমার ডার্টি মাইন্ড। আমি ‘ছিহহ বলার মতো কি বললাম, জানু?”
“এই তো একটু আগেই বললেন।”
জিয়ান উঠে এসে নয়নার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের একেবারে কাছে টেনে এনে বলল, “কী বললাম?”
নয়না জিয়ানের শার্ট খামচে ধরে বলল, “ছাড়ুন।”
“ছাড়ব বলে তো ধরিনি, জানু।”
“আপনার মাথায় সব সময় এসব ঘুরতে থাকে!”
“কোন সব?”
“ওই যে, ওইসব।”
“সেটা আবার কী, জানু?”
“বুঝতে পেরেছি, জানুর গভীর আদর লাগবে।”
জিয়ান নয়নার ঠোঁটে চুমু দিয়ে তাকে কোলে তুলে বলল, “চলো, নাচব দুজন।”
নয়না মৃদু স্বরে বলল, “আমার এখন নাচতে ইচ্ছে করছে না।”
জিয়ান নয়নার কানের কাছে মুখ এনে বলল,
“বন্ধু, তোমার ভালোবাসায় থাকব মাটির পিঞ্জিরায়,
তুমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আর তো কোনো বন্ধু নাই।
মাথা রেখে আমার বুকে, ঘুমাও তুমি সুখে।
তোমায় দেখিয়া দেখিয়া নয়নও জুড়ায়,
তোমায় দেখিয়া, দেখিয়া, জীবনও ফুরায়।”
নয়না হঠাৎ খেয়াল করল, সে বিছানায় বসে আছে। তাহলে জিয়ানের কোলে ওই মেয়েটা কে? নয়না উঠে জিয়ানের সামনে দাঁড়াল। অশ্রু টলমল চোখে জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমার সঙ্গে এরকমটা করতে পারেন না, মিস্টার পাইলট রেজা চৌধুরী। আপনি শুধু আমার। আপনি আমার ব্যক্তিগত প্রিয় পুরুষ।”
নয়না ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। ঘর জুড়ে কেমন অন্ধকার। হাত দিয়ে বেডসাইড সুইচ অন করল। আশপাশে তাকিয়ে বুঝল, এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে! নয়না মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল, রাত সাড়ে তিনটা বাজে। দ্রুত ফোনে ডাটা অন করল। জিয়ান তাকে রিপ্লাই করেনি? এখন তো তার ফ্লাইট নেই। বিশ্রাম নেওয়ার সময়, তবুও কোনো রিপ্লাই নেই কেন! নয়না নিজেই কল করল। সোজা ভিডিও কল।
জিয়ান নিজের পোশাক খুলে সবে বাসার পোশাক পরেছে। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে আছে, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। কপাল কুঁচকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল বেডসাইড টেবিল থেকে। ‘রঙ্গনা’ নিকনেমটা দেখেই যেন জিয়ানের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে উঁকি দিল হাসির ঝলক। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কথা শুরু হল।
ফোন রিসিভ হতেই নয়না এক নাগাড়ে বলতে শুরু করল, “একদম ভালোবাসেন না আমাকে? দু’দিনেই ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে। পুরোনো হয়ে গেছি, তাই এখন আর ভালোবাসবেন কেন!”
জিয়ান চুপচাপ নয়নার দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছে।
নয়না আরও ক্ষেপে গেল। “আশ্চর্য! এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কথা বলার জন্য মুখ নেই নাকি?”
জিয়ান মৃদু হেসে বলল, “এই গভীর রাতে এমনভাবে সামনে এলে আর কিছু খেয়াল থাকে, রঙ্গনা?”
নয়না নিজের দিকে তাকাল। শর্ট টি-শার্ট, যার ফলে পেট থেকে নাভি পর্যন্ত উন্মুক্ত। প্লাজো উঠে এসেছে বেশ খানিকটা। নয়না দ্রুত চাদর টেনে নিল। রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “অসভ্য!”
জিয়ান বুকে হাত দিয়ে বলল, “আই নিড ইউ, ডিয়ার বাটার মাশরুম। উফ! আজ আর ঘুম আসবে না। কেন এত রাতে এমন মোহনীয় রূপে ধরা দিলে? এখন নিজেকে কন্ট্রোল করব কী করে, বেব?”
নয়নার রাগ হচ্ছে। লোকটার মাথায় কি সাধারণ কোনো বোধবুদ্ধি নেই? জিজ্ঞেস করছে না, আমি এত রাতে কেন কল করেছি?
জিয়ান নিরাশ গলায় বলল, “কী স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে, মিসেস চৌধুরী?”
“আপনি আমাকে সত্যি ভালোবাসেন?”
“সুনয়না, ফোনটা কাটো। এই মুহূর্তে এসব কথা বলার কোনো ইন্টারেস্ট আমার নেই।”
নয়না কল কাটার আগেই জিয়ান কল কেটে দিল। নয়না স্পষ্ট দেখতে পেল, জিয়ানের রুমে এক নারীমূর্তির ছায়া। কাঁধ পর্যন্ত চুল, জিন্স আর শার্ট পরা মেয়েটা। নয়নার হৃদয়ে মুহূর্তে শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল। পুরো পৃথিবীর সব সত্য তার কাছে মিথ্যে মনে হতে লাগল।
🌿
অন্তর কয়েকদিন ধরে জাহিনের ওপর নজর রেখেছে। সে খোলা মাঠের এক প্রান্তে বসে আছে। “আচ্ছা, সত্যি সত্যি কি জাহিন আমার বোনের খুনিদের সহযোগী? এটা কী করে সম্ভব? সেই ক্লাস থ্রি থেকে আজ পর্যন্ত আমরা কখনো একে অপরকে ছাড়া একটা চকোলেট পর্যন্ত খাইনি। আমাদের বন্ধুত্ব রক্তের সম্পর্কের চেয়েও গভীর। সেই বন্ধু কি এমন জঘন্য কাজ করতে পারে? নাকি আমার কোথাও ভুল হচ্ছে?” মাটির দিকে তাকিয়ে অন্তর বলল, “আমি চাই না এসব সত্যি হোক। আমি চাই, পৃথিবীর সব মিথ্যে হোক, তবুও তুই আমার বোনের খুনিদের সহযোগী না—এটা কখনো সত্যি হোক।”
অন্তর নিজের মনে বসে ছিল। এমন সময় কেউ তার কাঁধে হাত রাখল।
অন্তর পেছনে তাকিয়ে বলল, “আপনি?”
“আমার আপনার হেল্প দরকার। প্লিজ আমাকে হেল্প করুন।”
“কিসের হেল্প?”
“তার আগে বলুন, আপনার চোখ ভেজা কেন? পুরুষ মানুষের চোখে পানি তো সহজে আসে না! এত কঠিন কাজ?”
অন্তর বলল,”মানুষের হৃদয়ে কিছু কষ্ট থাকে, যেগুলো ভাষা হয়ে বের হয় না কখনো। বলতে চাইলেও শব্দেরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। বেদনাগুলো কেবল বুকের গহীনে চাপা পড়ে থাকে, অপ্রকাশিত এক নিঃশব্দ আর্তি হয়ে। সে কষ্ট কোনোদিন প্রকাশ পায় না। শুধু জমে থাকে, জমে থাকা মেঘের মতো, অনুভবের আকাশে।
হৃদয় যখন আর সেই ভার সইতে পারে না, তখন মনে কালো মেঘ নামে, নীরবতা ঘনিয়ে আসে, আর চোখের কোণেই হয় যেন সেই বেদনার একমাত্র আশ্রয়স্থল। অশ্রুগুলো ঝরে পড়ে, ঠিক যেন নির্জন বর্ষায় একলা কোনো বৃক্ষ কাঁদে।
এই দুঃখের নেই কোনো সঙ্গী, নেই কোনো আশ্রয়। এ এক নিঃসঙ্গ পথচলা, অন্তরের অন্তরালে জমে থাকা এক অমলিন মৌনতা।”
তুষি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “জানেন, আমি কঠিন কথা বুঝি না। খুব সহজ একটা মানুষ আমি। তবে এমন এক কঠিন জালে আটকে পড়েছি, বুঝতে পারছি না এই জাল ছিঁড়ে কীভাবে বের হব।”
“আমি কী হেল্প করতে পারি, সেটা বলুন।”
🌿
সায়না আর অনিকেতের বিয়ে হয়ে গেল। রাতের আঁধারে চারজন মানুষকে সাক্ষী রেখে, আল্লাহ তা’আলার ওপর ভরসা করে সায়না হয়ে গেল অনিকেতের বৌ। সায়নার চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে।
অনিকেত কাজি সাহেবকে বিদায় দিয়ে সায়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “জীবনটা ছেলেখেলা নয়। আর বিয়ে মানে এক বিশাল জার্নি। আপনি বুঝদার হয়েও অবুঝের মতো কাজ করলেন, মিস সায়না।”
সায়না শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় তুলে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, ডিয়ার হাসবেন্ড। আমি আপনার ওয়াইফ। মিসেস অনিকেত মাহমুদ। সুতরাং নিজের সদ্য বিয়ে করা বৌকে ‘আপনি’ করে বলবেন না।”
নাহিদ হেসে বলল, “ভাবি, আপনার মতো মেয়েই দরকার ছিল অনিকেতের।”
“আমাদের জন্য আপনাকে কষ্ট করতে হলো?”
“কষ্ট কিসের? এত আনন্দের। আমার বন্ধুর বিয়ে বলে কথা, এত মহাখুশির কাজ।”
অনিকেত রাগ দেখিয়ে বলল, “এসব মজা মনে হচ্ছে তোর?”
“বিয়ে মানেই তো মজা, দোস্ত। তুই জানিস না? না জানলে সমস্যা নেই, ভাবিজি তোকে জানিয়ে দেবে।”
“চুপ কর, নাহিদ। আমার কিছু ভালো লাগছে না।”
নাহিদ অনিকেতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “বৌকে আদর-সোহাগ করলেই ভালো লাগা শুরু হয়ে যাবে। আজকের মতো টাটা।”
নাহিদ বের হওয়ার আগে সায়নাকে বলল, “ভাবি, বেশি কিছু করতে পারিনি। যতটুকু সম্ভব, এই রাতে ততটুকু সাজিয়ে দিলাম। বাকিটা কাল করব। শুভকামনা রইল, ভাবি।”
🌿
জিয়ান কল কেটে সামনে তাকাতেই রাগে তার কপালের রগ ফুলে উঠল। চোখ দুটো লাল হয়ে উঠছে। “আপনার সাহস কী করে হয় আমার রুমে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করার?”
#চলবে
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৫
#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬৫
জাহিন নয়নাকে ড্রপ করে দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো।
অন্তর বলল, “তোর মনে কী চলছে, বল তো?”
“আমার মনে কী চলবে?”
“তুই কি কোনোভাবে ভাবির প্রতি দুর্বল বোধ করছিস?”
জাহিন হার্ড ব্রেক করে গাড়ি থামিয়ে, রক্তচক্ষু নিয়ে অন্তরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর সাহস হয় কী করে এতো লেইম কথা বলার?”
“এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? তুই আজ যা করলি, এসব তো তোর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। আর আমার চিরচেনা জাহিনকে দিয়ে এসব কল্পনাও করা যায় না। দেখ, আমি খেয়াল করেছি, তুই বারবার ভাবিকে টিচ করার চেষ্টা করেছিস।”
জাহিন নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল, “আরে, ইয়ার, আমি জাস্ট ফান করছিলাম। নয়না আমাকে দেখলে কেমন উদ্ভট ব্যবহার করে। মনে হয় যেন আমি তাকে খেয়ে ফেলবো! তাই আমিও আজ সুযোগ পেয়ে ফান করলাম।”
“আচ্ছা, তুই যে শামসুল হক খান স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতি, ওই মেয়েটার কী খবর?”
“কোন মেয়ে? আর আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম? কী বলছিস এসব? মাথা ঠিক আছে তোর? জাহিন চৌধুরীর যোগ্য মেয়ে পেলে জাহিন চৌধুরী সোজা তুলে নিয়ে বিয়ে করে নিতো। এসব দাঁড়িয়ে থাকা, ইম্প্রেস করা—এসব জাহিন চৌধুরীর সঙ্গে যায় না।”
অন্তর আর কথা বাড়ালো না। তবে জাহিনের সূক্ষ্ম মিথ্যে কথা শুনে বেশ অবাক হলো। অন্তর সবটা জেনেই প্রশ্ন করেছিল। সত্যিটা জানার পর মিথ্যে গল্প শুনতে ভালোই লাগে।
জাহিন অন্তরকে নামিয়ে দিয়ে বলল, “তুই বাসায় যা, আমার একটু কাজ আছে। দু’দিন পর ফিরব।”
জাহিন নিজের সিক্রেট অ্যাপার্টমেন্টে এসে দরজা বন্ধ করে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। বাথটাবে শুয়ে গিজার অন করে দিল। উপর থেকে শাওয়ার ছেড়ে চোখ বন্ধ করে রাখল। আজকের ঘটনা একে একে মেলাতে লাগল। হঠাৎ চোখ খুলে বলল, “বি কেয়ারফুল, জাহিন। এমনভাবে এগোতে হবে যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে।”
প্রায় ঘণ্টাখানেক শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো। হাফপ্যান্ট পরে লাইটার হাতে নিয়ে সিগারেট ধরাল। আয়েশ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসল। দেওয়ালজুড়ে নয়নার শতসহস্র ছবি টাঙানো। উঠে এসে একটা ছবির ওপর হাত রেখে বলল, “তোমার তো শুধু আমার হওয়ার কথা ছিল। তাহলে তুমি আমার ভাইয়ের কী করে হলে? প্রেম করবে আমার সঙ্গে, আর বিয়ে করবে আমার ভাইকে! তা হবে না, সুইটহার্ট। জাহিন চৌধুরী এতটা ভদ্র নয়।”
নিজের মোবাইল নিয়ে একজনকে কল করল। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই জাহিন বলল, “কী, মন্ত্রী সাহেব, ডিসিশন ফাইনাল করলেন, নাকি আমি শাস্তি ফাইনাল করব? সব প্রমাণ কিন্তু আমার হাতে।”
“মিস্টার চৌধুরী, আপনি যা বলবেন, তাই হবে। আপনি আমার ফার্মহাউসে চলে আসুন আজ রাতে। আপনার জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে রেখেছি।”
“কোনো মেয়ে যেন না থাকে। আর কোনো ধরনের চালাকি করলে আমি কী কী করতে পারি, তা কল্পনাও করতে পারবেন না।”
“মিস্টার চৌধুরী, আপনি যেমনটা চাইবেন, ঠিক তেমনটাই হবে। ডোন্ট ওয়ারি। আপনি আমার স্পেশাল গেস্ট, আপনার যত্নে কোনো ত্রুটি হবে না।”
🌿
নয়না বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসল। তুষিও খাচ্ছিল। নয়নার মুড অফ। বাসায় এসে শুধু জাহানারা বেগমকে বলেছিল, “আমরা ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি খাবার রেডি করো তো, আম্মু। আর এখন কিছু জিজ্ঞেস করবে না। বাকি কথা রাতে বলব।”
নীলাঞ্জনা এসে নয়নার পাশের চেয়ারে বসল। এই মুহূর্তে নীলাঞ্জনাকে নয়নার সহ্য হচ্ছিল না। নীলাঞ্জনা এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। মানুষের দৃষ্টি দেখলেই নীলাঞ্জনা এখন সেখানে তার জন্য ঘৃণা দেখতে পায়। নীলাঞ্জনা নিজের পেটে হাত রেখে বলল, “আমি তো ঘৃণিত মানুষ, তুইও কি আমাকে ঘৃণা করবি? নাকি তুই এসে তোর মায়ের পৃথিবী ভালোবাসা দিয়ে রাঙিয়ে দিবি? তোকে নিয়ে না হয় অন্যরকম এক ভালোবাসার পৃথিবী গড়ে তুলব।”
নীলাঞ্জনার ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল, নম্বরটা অপরিচিত। ফোন বাজতে বাজতে কেটে গেল। আবার বেজে উঠল। নীলাঞ্জনা ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই লাবিব বলল, “বাইরে আয়, নয়তো তোমার বিবস্ত্র ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দেব।”
নীলাঞ্জনা বোরকা পরে, গায়ে একটা ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। লাবিব ইশারা করে নীলাঞ্জনাকে গাড়িতে উঠতে বলল। দুজনে পাশাপাশি বসল, অথচ মনের মধ্যে বিশাল ফারাক।
লাবিব বলল, “তোর এসব কিসের দেমাগ? চল আমার সঙ্গে।”
নীলাঞ্জনা শান্ত স্বরে বলল, “আপনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি আমার জন্য অপরিচিত।”
“তুই কি বুঝতে পারছিস, তুই লুজার। হেরে গেছিস পুরোপুরি। তোর এখন এক পয়সারও দাম নেই এই সমাজে।”
“আমি কিছুই হারাইনি। বরং আপনি এমন একজনকে হারিয়েছেন, যে আপনাকে ভালোবাসত। আমি তো এমন একজনকে হারিয়েছি, যে মানুষটা কোনোদিন আমাকে ভালোবাসেনি! এবার আপনিই বলুন, কে হেরে গেল, আর কে জিতে গেল?”
“আমি হারব কেন? হারবি তুই। এই বালের ভালোবাসা আবার কী?”
নীলাঞ্জনা আর কথা বাড়ালো না। এর মধ্যেই পুলিশ এসে রিকশা ঘিরে ধরল। লাবিব রক্তচক্ষু নিয়ে নীলাঞ্জনার দিকে তাকাল। নীলাঞ্জনা ততক্ষণে রিকশা থেকে নেমে গেছে। পুলিশ নীলাঞ্জনাকে ধন্যবাদ দিল।
লাবিবের হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। নীলাঞ্জনা বলল, “এক মিনিট, স্যার।” নীলাঞ্জনা লাবিবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, “আমি কিছু হারাইনি, জানো?
হয়তো হারিয়েছি একটি মাত্র মানুষ,
কিন্তু সে তো কখনো ছিলই না আমার।
ভালোবাসার নামে শুধু ছিল কিছু মিথ্যে শব্দ,
আর আমি সেগুলোকেই সত্যি ভেবেছিলাম!
হারিয়েছ তুমি,
একজন এমন মানুষকে, যে তোমাকে ভালোবাসত নিঃস্বার্থভাবে, যার হৃদয়টা ছিল কেবল তোমার জন্য। তুমি বুঝোনি… তখনও না, এখনও না। আমি তো শুধু হারিয়েছি একটি ছায়া, একটি মুখ, একটি অস্তিত্ব, যার মধ্যে আমার জন্য কোনো ভালোবাসা ছিল না। তোমার ক্ষতি গভীর, আমার নয়। কারণ আমি ভালোবাসতে পেরেছি। আর তুমি?
তুমি তো ভালোবাসা কী জিনিস, সেটাই অনুভব করোনি কখনো।কিতাহলে বলো, কে হেরে গেল? আর কে জিতে গেল?”
নীলাঞ্জনা রিকশায় উঠে বসল। লাবিব পুলিশের গাড়িতে। এই প্রথমবার কোনো কথা তার হৃদয়ে লাগল। এই সাধারণ কথাগুলো যেন লাবিবের হৃদয় ভীষণ ভারী করে তুলল!
🌿
নয়না খেয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। মোবাইল নিয়ে কল করল জিয়ানকে। কল যাচ্ছে না। নয়না টাইম দেখল। মনে পড়ল, আজ জিয়ানের ফ্লাইট আছে। এখন নিশ্চিতভাবে বিমানে।
নয়না জিয়ানের টেক্সট দেখতে লাগল।
“তুমি কখনো আমাবস্যা, তো কখনো পূর্ণচন্দ্র। তবে তুমি যেরূপেই ধরা দাও, সব রূপেই মোহনীয়। মিসেস চৌধুরী, মুড সুইং হলো কেন হঠাৎ? আপনার কি পি**ড ডেট কাছাকাছি চলে এসেছে নাকি? শুনুন, ম্যাডাম, মাথা ঠান্ডা করুন, দুটো চকোলেট খান। এরপর আমাকে নক দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবেন। মনে থাক যেন।”
লাস্ট টেক্সটে লেখা, “তুমি রেগে গেলে তোমাকে টুপ করে কামড় দিতে ইচ্ছে করে। তোমার ওই লাল টুকটুকে গালে, নাকের টোকায়। আমি না তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। তুমি আমার সবটা দখল করে নিয়েছ। ভালোবাসি তোমাকে। প্রিয় সুনয়না, তুমি শুধু ক্যাপ্টেন রেজা চৌধুরীর। আই লাভ ইউ সো মাচ, ডিয়ার ওয়াইফি।”
নয়না হাসছে। লোকটা একেবারে রসগোল্লার মতো কিউট। ইচ্ছে করে টুপ করে খেয়ে ফেলতে। “ইশ, আমার বরটা এত কিউট কেন! ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কতদিন তার উষ্ণ বক্ষে মাথা রাখিনি।”
পাশ থেকে তুষি বলল, “ভাই, একটু আস্তে বল পিরিতের কথা। ভুলে যাস না, তোর পাশে একটা সিঙ্গেল, অসহায় মেয়ে আছে। তার প্রতি একটু তো দয়ামায়া কর।”
#চলবে
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৪
#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৬৪
ঠোঁটের স্বাদ নিতে খুবই মজা, আর বিয়ের কথা আসলেই ভেজা বেড়াল! সায়নার কথা শুনে অনিকেত অসহায় দৃষ্টিতে সায়নার দিকে তাকিয়ে আছে।
সায়না চোখ পাকিয়ে বলল, “কিস যখন করেছেন, তাও নিজের ইচ্ছায়, সুতরাং এখনই কাজিকে কল করুন।”
অনিকেত ফোন নিয়ে নাহিদকে কল করল। সব শুনে নাহিদ জোরে জোরে হাসতে হাসতে বলল, “অবশেষে আমাদের পবিত্র ডাক্তার বাবু কিস করে কট খেয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে! ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ উইথ কট ম্যারেজ। অপেক্ষা করো চান্দু, আমি কাজি নিয়ে আসছি।”
নাহিদের বউয়ের সন্দেহ করার রোগ আছে। সে কটমট চোখে তাকিয়ে বলল, “এই রাতে বন্ধুর বাহানায় কোন মেয়ের কাছে যাচ্ছ?”
নাহিদ বলল, “বউ, তুমি ভিডিও কল করো আমাকে। যতক্ষণ না ফিরে আসি, তুমি ঘুমাবে না। দুই চোখ মেলে তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে। আমার ফোনে ফুল চার্জ আছে, তোমার চার্জ না থাকলে চার্জে লাগিয়ে হলেও তাকিয়ে থাকো।” নাহিদ শার্ট-প্যান্ট পরে বেরিয়ে গেল।সায়না পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। গুনগুন করে গান গাইছে।
অনিকেত আড়চোখে সায়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “সুন্দরী মেয়েরা ভয়ংকর। এদের ছলনায় পড়া মানেই কট। নিজেই ঠোঁট বাড়িয়ে দিল, এত সুন্দর ঠোঁট কী করে উপেক্ষা করতাম! এই কিস করার অপরাধে বিয়ে করতে হবে!”
“এভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন? আমি জানি আমি সুন্দরী, এত দেখার কিছু নেই। সারাজীবন আপনিই দেখবেন।”
“তোমার পরিবারকে কী বলবে?”
“আচ্ছা, আমি কোন ক্লাসে পড়ি?”
“অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।”
“আমার বয়স কত?”
“ঊনিশ-কুড়ি তো হবেই।”
“তো মিস্টার অনিকেত মাহমুদ, একটা একুশ বছরের অ্যাডাল্ট মেয়ে নিজের ইচ্ছায় নিজের পছন্দে বিয়ে করতে পারে না?”
“কিন্তু আমার তো তোমাকে বিয়ে করার যোগ্যতা নেই!”
“বাংলাদেশের এত বড় একটা হাসপাতালের ডাক্তার আপনি, তাও যেমন-তেমন ডাক্তার নন, সুনামধন্য কার্ডিওলজিস্ট। আপনি নিজেকে অযোগ্য বলার আগে কচুগাছের সঙ্গে গলায় দড়ি দিলেন না কেন?”
“আমি এতিম। বাবা-মায়ের কোনো খোঁজ নেই। পরিবার-পরিজন বলতে দুই-তিনজন বন্ধু।”
“তো আমি কি সংসার আপনার দাদার সঙ্গে করতাম? নাকি আপনার চৌদ্দগুষ্টির সঙ্গে? আমি বিয়ে আপনাকে করব। সংসার আপনার সঙ্গে করব। সুতরাং এসব লেম এক্সকিউজ দেওয়া বন্ধ করুন। আর হ্যাঁ, সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরে আসুন। আচ্ছা, আপনার বাসায় কোনো আংটি বা চেইন আছে?”
অনিকেত সায়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই মেয়েকে বোঝানোর চেয়ে নিজের মাথায় বাড়ি দেওয়া ভালো।”
“কবুল বলে মাথায় বাড়িটাড়ি যা দেওয়ার দিন। কবুল বলার আগ পর্যন্ত সুস্থ থাকতে হবে আপনাকে।”
“ডেঞ্জারাস মেয়ে!”
“আপনার বউ ডেঞ্জারাস, ডাক্তার বাবু।”
🌿
নয়না চেয়ারে বসে আছে, মোবাইল হাতে নিয়ে জিয়ানকে নিজের তোলা ছবি পাঠাল। মেসেজ ডেলিভারি হয়েছে, কিন্তু রিপ্লাই আসল না। নয়না আরেকটা টেক্সট লিখল, “আপনি কি জানেন, আমি জিতে গেছি। ভেবেছিলাম হেরে যাব। অথচ আমি জিতে গেছি!” নয়না মোবাইল রেখে সামনের মঞ্চে মনোযোগ দিল। একদল ছেলে-মেয়ে নাচছে। সবাই হাততালি দিচ্ছে।
তুষি কনুই দিয়ে নয়নাকে গুঁতো দিয়ে বলল, “ওই যে বাঁ-পাশের ছেলেটাকে দেখ, কী হ্যান্ডসাম, তাই না?”
“তুষির বাচ্চা, এখানে প্রেম করতে এসেছিস?”
“শোন, সিঙ্গেল মানুষ একটু-আধটু ক্রাশ খেয়েই থাকে।”
“চুপচাপ বসে থাক।” নয়না নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সামনে তাকাতেই দেখল জাহিন গিটারে সুর তুলছে। নয়না উঠে যেতে চাইল। তুষি নয়নার হাত ধরে বলল, “বসে থাক, তুই ওভার রিয়্যাক্ট কেন করিস! মনে কর, সামনে তোর দেবর নয়, আমার হবু বর দাঁড়িয়ে আছে। তাও মনে করতে না চাইলে শুধু এই গানটায় ফোকাস কর। কী সুন্দর গান গাইছে!”
*Tera sang yeh raat
Khush rang bahara
Tu raat deewani
Main zart sitaraO karam khudaya hai
Tujhe mujhse milaya hai
Tujhpe mar ke hi toh
Mujhe jeena aaya haiOh tera sang yeh raat khush rang bahara
Tu raat deewani
Main zart sitaraKahin kisi bhi gali mein jaaun main
Tere khushbu se takraaun main
Har raat jo aata hai mujhko woh khwaab tuTera mera milna taqdeer hai
Tere hone se mujh mein noor hai
Main hoon soona sa ek aasman, mehtab tuO karam khudaya hai
Tujhe mujhse milaya hai
Tujhpe mar ke hi toh
Mujhe jeena aaya hai*
নয়না একবারও উপরের দিকে তাকাল না। অন্তর খেয়াল করল, জাহিনের দৃষ্টি ঘুরে-ফিরে নয়নার ওপর এসে পড়ছে! গান শেষ হতেই কড়া তালিতে মুখরিত হলো কলেজ প্রাঙ্গণ।
জাহিন স্টেজ থেকে নামার পর নয়না উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল, বাসায় চলে যাব।”
“তোর মাথা ঠিক আছে? এতক্ষণ থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট না নিয়ে চলে যাব?”
নয়না দাঁত কামড়ে বলল, “তুই বাইরে চল, তোকে বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছি।”
নয়না বাইরে এসে দেখল, গাড়ি তাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিল। নয়না আর তুষি উঠে বসল। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, এর মধ্যেই গাড়ি চলতে লাগল। নয়না তখনও সামনে খেয়াল করেনি। সে বলল, “আঙ্কেল, সুবর্ণ রেস্তোরায় যাব।” নয়না হঠাৎ সামনে তাকিয়ে বলল, “আপনি!”
“চমকে গেলে নাকি! আরে, আমি আর অন্তর বেরিয়ে দেখি আমাদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। ওটা ড্রাইভারের দায়িত্ব দিয়ে আসলাম। গন্তব্য যখন এক, তখন আর সমস্যা কী?”
অন্তর বলল, “আসসালামু আলাইকুম ভাবি। আমি অন্তর, আপনার ছোট ভাইয়ের মতো।”
নয়না উত্তর দেওয়ার আগেই তুষি বলল, “আপনি তো সেই বেয়াদব লোকটা! এসেছেন ভদ্র সাজতে।”
নয়না নিজেকে সামলে বলল, “ভাইয়া, আমাকে একটু তালুকদার ম্যানশনে নামিয়ে দিয়ে আসুন। মাত্র দেখলাম আম্মু টেক্সট করেছে, দ্রুত বাসায় যেতে বলেছে। আর হ্যাঁ, বাসায় গিয়ে আম্মাকে বলে দিয়েন আমি বাসায় এসেছি।”
অন্তর গভীরভাবে জাহিনকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। হঠাৎ তার পাশে বসা মানুষটাকে অপরিচিত লাগছে।
জাহিন শান্ত কণ্ঠে বলল, “রেস্তোরাঁ থেকে লাঞ্চ সেরে তারপর ড্রপ করে আসব।”
নয়না বলল, “না, আমাকে এখনই যেতে হবে। আপনার কাজ থাকলে আমাকে এখানে নামিয়ে দিন, তুষির সঙ্গে রিকশায় চলে যাব।”
🌿
নীলাঞ্জনার চার মাস চলছে। শরীর দুর্বল, রক্তশূন্যতা, আবার মস্তিষ্ক জুড়ে নানা ধরনের টেনশন। এই সমাজে সিঙ্গেল মাদার হওয়া তো সহজ কথা নয়। তার ওপর বিয়েটা করেছিল পালিয়ে। অনেকেই জানে না এই বিয়ের কথা। মানুষ বলে ভুল শুধরে নিতে, ভুল থেকে শিক্ষা নিতে। কিন্তু জীবনে এমন কিছু ভুল থাকে, যে ভুলের শাস্তি সারাজীবন পেতে হয়। তার ভুলের জন্য এই অনাগত সন্তান পিতৃহারা। তার ভুলের জন্য সমাজে বড় হয়েও এই সন্তান থাকবে কোণঠাসা। এসব আজকাল ভাবতে পারে না নীলাঞ্জনা। তার মাথা ধরে যায়। এই সময় মেয়েদের সবচেয়ে ভরসার স্থান তার মা। অথচ তার নিজের মা তার দিকে মুখ তুলেও তাকায় না। জাহানারা বেগম নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে নীলাঞ্জনার খেয়াল রাখেন। কিন্তু নীলাঞ্জনার মা নীলাঞ্জনার চারপাশে ঘেঁষে না। চোখের জল মুছে সামনে থাকা জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে পান করল। জুসের গ্লাস রেখে শুয়ে পড়ল বিছানায়। নিজের জীবন নিজের হাতে নষ্ট করেছে। অভিযোগ বা অভিমান করার মতো কোনো স্থান নেই।
🌿
জিয়ান রেডি হয়ে নয়নাকে কল করার জন্য মোবাইল হাতে নিল। নয়নার টেক্সট দেখে উত্তর লিখল, “তা ম্যাডাম, আপনি কী করে জিতে গেলেন?”
নয়নার তখন মেজাজ তুঙ্গে। নয়না রিপ্লাই করল, “ছাতার মাথা, জিতেছি।”
জিয়ান হাহা ইমোজি দিয়ে লিখল, “ব্যাঙের ছাতা?”
নয়না রাগী ইমোজি দিয়ে লিখল, “আপনার মাথা।”
“কী করল আমার মাথা?”
নয়না রিপ্লাই না করে ডাটা অফ করে দিল।জিয়ান মনে মনে হাসল। মেয়েদের মন বোঝার মতো কঠিন কাজ আর নেই।
#চলবে
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৩
#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬৩
“মিস ইউ জান, মিস ইউ ভেরি ব্যাডলি।”
নয়না মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে টেক্সট দেখে মুচকি হাসছে। সকাল সকাল উঠে প্রিয় পুরুষের টেক্সট দেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। নয়না রিপ্লাই করল না। সে জানে জিয়ান এখন ঘুমাচ্ছে। তাই উঠে নিজের মতো ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে রুমে এল।
তুষির দেওয়া লাল পারের সাদা শাড়ি পরে রেডি হলো নয়না। সাদা হিজাব পরেছে। হাতে লাল ও সাদা রেশমি চুড়ি। চোখে হালকা কাজল দেওয়া শেষ করে লিপস্টিক হাতে নিল। লিপস্টিকের বক্সটা হাতে নিতেই নয়না থমকে গেল। এই লিপস্টিক সেটটা জিয়ান তাকে গিফট করেছিল—Forever Dior-এর লিপস্টিক সেট। এখানে বারোটা কালার অ্যাভেইলেবল। নয়না ডিপ রোজউড টোন, স্মুদ শাইন শেডটা নিল। এটার কালার নয়নার সবচেয়ে বেশি পছন্দ। হালকা করে ঠোঁটে অ্যাপ্লাই করলেই অসাধারণ একটা কালার ফুটে ওঠে। নয়না নিজের লিপস্টিক সেট থেকে দুটো লিপস্টিক তুষির জন্য নিয়ে নিল। রুম থেকে বের হওয়ার সময় থমকে দাঁড়াল। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে স্বর্ণের একটা ব্রেসলেট বের করে হাতে পরে নিল। শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। নিজের রুম থেকে সোজা গেল মিতা বেগমের রুমে।
মিতা বেগম নয়নাকে দেখে বললেন, “মাশাআল্লাহ! মনে হচ্ছে আসমান থেকে পরী নেমে এসেছে জমিনে! কারো নজর না লাগুক।” বলেই দোয়া পড়ে নয়নার মাথায় ফুঁ দিয়ে দিলেন। “সাবধানে যাবি। ড্রাইভারের সাথে যাবি, আবার ঠিক সময় চলে আসবি।”
নয়না মৃদু স্বরে বলল, “ঠিক আছে আম্মু। আসি এখন।”
নয়না গেট দিয়ে বের হবে, ঠিক তখন কেউ ডেকে উঠল, “সুনয়না, শুনছো?”
নয়না থমকে দাঁড়াল। জিয়ান আসল কোথা থেকে! পেছনে ফিরতেই নয়নার চেহারায় রাগ ফুটে উঠল।“নিজের ভাবিকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়, এই শিক্ষা আপনার কি জানা নেই?”
“উপস! সরি, তুমি এত কথায় কথায় রেগে যাও কেন? আমার চেয়ে বয়সে ছোট, তাই তুমি করে বলি।”
“আপনার মুখ থেকে ‘তুমি’ ডাক শুনলে আমার শরীর ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। গা গুলিয়ে আসে।” বলেই সামনে পা বাড়াল।
জাহিন নয়নার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বলল, “আই লাইক ইয়োর অ্যাটিটিউড।”
জাহিনের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। জাহিন ফোন বের করে কল রিসিভ করে বলল, “অবশেষে মনে পড়ল আমাকে, মন্ত্রী মহাশয়? তা, আপনার অপরাধের লিস্ট তো বিশাল।”
ওপাশ থেকে শব্দ এল, “আমার বাগানবাড়িতে চলে আসুন, সামনাসামনি বসে কথা হবে।”
“কথার আর কী বাকি? জাহিন চৌধুরী যা বলে, সেটাই শেষ কথা। ওই কথা রাখতে পারলে তবেই দেখা পাবেন, মন্ত্রী মহাশয়।”
“আচ্ছা, আসুন, সিক্রেট গোয়েন্দা অফিসার জাহিন চৌধুরী।”
“ওকে।” জাহিন কল কেটে দিল। গান গাইতে গাইতে নিজের রুমে যাচ্ছে, “সাদা সাদা, কালা কালা, রঙ জমেছে সাদা-কালা।” সিস বাজাচ্ছে আর শাওয়ার নিচ্ছে। তার মনে আজ আনন্দ আর আনন্দ। অবশেষে একটা বিগ ডিল হতে যাচ্ছে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ব্ল্যাক জিন্স আর হোয়াইট শার্ট পরে নিল। হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ। চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে নিজের পছন্দের পারফিউম লাগিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।মেহনুর চুপিচুপি আড়ালে দাঁড়িয়ে জাহিনের কর্মকাণ্ডে নজর রেখেছে। মেহনুর একটা ব্ল্যাক চুরিদার পরেছে। ফর্সা শরীরে ব্ল্যাক চুরিদারে যেন মেহনুরের রূপ উপচে পড়ছে।
***
গাড়িতে উঠেই নয়না জিয়ানকে কল করল। কল করতেই সাথে সাথে রিসিভ।
জিয়ান হাই তুলতে তুলতে বলল, “এসব কী হু! বর নেই দেশে, বউ পরী সেজে কোথায় যাচ্ছে?”
“মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, আজ তো নবীনবরণ অনুষ্ঠান। শাড়িটা তুষি আমাকে গিফট করেছে।”
জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বলল, “বউটা দিন দিন আরো কিউট হয়ে যাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে জব-টব ছেড়ে দেশে গিয়ে রিকশা চালাব, তবুও বউয়ের আঁচলের তলায় থাকব সারাক্ষণ।”
“এই যে, হ্যালো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, এত কী ভাবছেন?”
“ভাবছি, জব ছেড়ে দিয়ে রিকশা চালাব। তবুও বউ ছেড়ে দূরে থাকব না।”
“আহাগো, শখ কত নাগরের?”
“বহুত শখ, বউ।”
“তো রিকশা চালককে তো সুনয়না তালুকদার মেনে নেবে না।”
“নিষ্ঠুর রমনী, আমার কাজ দেখছে, ভালোবাসা দেখছে না।”
“এই শোনো…”
“বলো, জান।”
“এই যে তোমার-আমার ভালোবাসার মাঝে সাময়িক দূরত্ব আসে, তুমি কি জানো, এই দূরত্ব আমাদের ভালোবাসার উন্মাদনা আরো বাড়িয়ে তোলে? এই যে তিন মাস পর মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য তোমাকে কাছে পাই, প্রতিবার তোমাকে নতুন লাগে। মনে হয় দীর্ঘ অপেক্ষার পর তৃষ্ণা নিবারণ হচ্ছে।”
জিয়ান অবাক চোখে চেয়ে আছে তার বাচ্চা বউটার দিকে। কে বলবে এই মেয়ে কেবল সতেরোয় পা দিয়েছে!“ওগো, শুনছো? এভাবে তাকিয়ে থেকো না। আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি না। আমি তোমার আছি, তোমারই থাকব, প্রিয়।”
জিয়ান ফিসফিস করে বলল, “এই ঠোঁট এগিয়ে আনো তো।”
“কেন?”
“তোমার গোলাপ রাঙা ঠোঁট দুটো আমাকে বড্ড টানছে। ইচ্ছে করছে এখনই তোমার উষ্ণ ঠোঁট দুটো আমার রুক্ষ ঠোঁট দিয়ে আড়াল করে ফেলতে।”
নয়না লজ্জা পাচ্ছে, তবুও নিজেকে সংযত করে বলল, “প্রেমিক পুরুষ, তুমি প্রেম জমিয়ে রাখো। আমি তৃষ্ণার্ত হতে থাকি তোমার স্পর্শের। এরপর এসে আমার তৃষ্ণা নিবারণ করবে।”
জিয়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কতকাল হয়ে গেল তোমাকে জড়িয়ে ধরিনি! মনে হচ্ছে শত যুগ পার হয়ে গেছে। আমার বক্ষপিঞ্জরের আদুরে পাখিটার উষ্ণ আলিঙ্গনের অভাবে বক্ষপিঞ্জর হাহাকার করছে।”
“চোখ বন্ধ করে অনুভব করো। আমি আছি খুব কাছে। তোমার সবটা জুড়ে তোমার সাথে। আমার অনুভবে যেমন তুমি জীবন্ত, তোমার অনুভবেও আমাকে জীবন্ত করে নাও, প্রিয়।”
“মিস ইউ, জান।”
“মিস ইউ সো সো মাচ। মিস্টার ড্রাইভার, আমি চলে এসেছি কলেজে। আপনি এবার আবার ঘুমিয়ে পড়ুন। ভালোবাসি, আমার ভালোবাসার প্রথম পুরুষ।” কন্টাক্ট বিচ্ছিন্ন হলো। জিয়ানের চোখে কি আর ঘুম নামবে! বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। এই মুহূর্তে ছুটে গিয়ে নয়নাকে জড়িয়ে ধরতে পারলে ভালো লাগত। ইশ, বউ, তুমি এত দূরে কেন!
🌿
অনিকেত কোনোমতে দরজা খুলতেই দেখল, শাড়ি পরিহিতা এক রমনীর চিন্তিত মুখশ্রী। সায়না অনিকেতকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ঠিক আছেন আপনি? কী হয়েছিল আপনার? কথা বলছেন না কেন?”
অনিকেত দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। সায়না সোফায় বসে আছে। রুম জুড়ে পিন ড্রপ নীরবতা। নীরবতা ভেঙে অনিকেত বলল, “আজ আপনার এনগেজমেন্ট ছিল, তাহলে এনগেজমেন্ট ছেড়ে চলে এসেছেন কেন?”
সায়না শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে অনিকেতের কলার ধরে বলল, “শালা ভাঙবে, তবু মচকাবে না! ভালো যখন বাসেন, স্বীকার করতে কিসের ভয়? মেয়েমানুষের ভয় থাকে, পুরুষমানুষ হয়ে ‘ভালোবাসি’ বলতে ভয়? আজ, এখনই কাজি ডেকে আমাকে বিয়ে না করলে পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে দেব আপনার নামে বদনাম।”
“এই, ছাড়ুন! এসব কী হচ্ছে? ডাকিনী নাকি আপনি?”
“ন্যাকা, কী হচ্ছে বোঝে না! মোবাইল বের করে কাজি ডাকুন, নয়তো পুরো এপার্টমেন্টের মানুষ জড়ো করব এখন।”
“কাজি ডাকুন বললেই হয়ে গেল! বিয়ে কি মামার বাড়ির মোয়া?”
“মামার বাড়ির মোয়া হোক আর না হোক, আজ আমি আপনাকে ‘কবুল’ বলে তবেই ছাড়ব। ভালোয় ভালোয় কাজি ডাকুন, নয়তো আগামীকাল সকালে সংবাদপত্রের হেডলাইন হবে—‘সুন্দরী প্রেমিকার হাতে বলদ ডাক্তার খুন। ভালোবাসা অস্বীকার করার অপরাধে খুন হলেন ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ।’”
“আপনি তো ডেঞ্জারাস!”
“আপনি ‘কবুল’ বললেই আমি হাওয়াই মিঠাই হয়ে যাব।”
অনিকেত আর কিছু বলার আগে সায়না অনিকেতের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল, “তোমাকে আমার চাই, সারাজীবনের জন্য শুধু তোমাকেই চাই। আমি তোমার পৃথিবীতে একমাত্র ভালোবাসা হতে চাই। আমি এ জন্মে তোমার পিছু ছাড়ব না। ভালোবাসি তোমাকে।”
অনিকেত প্রথমবারের মতো সায়নার সাথে রেসপন্স করতে লাগল। দু’জনে হারিয়ে যেতে লাগল দু’জনের ঠোঁটের মাদকতায়।
🌿
মান্নাতের সাথে আজ অনেক কথা বলেছে অন্তর। অন্তর নিজের বোনের শোকে ভুলেই গিয়েছিল মান্নাতের বাবা-মায়ের কথা।
আচ্ছা, এই সবকিছুর নেপথ্যে কে রয়েছে? জাহিন মান্নাতকে সেফ করার জন্য বাইরের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ও জানল কী করে মান্নাতের ক্ষতি হবেই? অন্তর কিছু ভাবতে পারছে না। সব গোলকধাঁধার মতো তার মাথায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। অন্তরের ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। রিসিভ করতেই জাহিনের কণ্ঠ কর্ণপাত হল, “কিরে, বের হবি কখন? আজ না আমাদের প্রোগ্রাম আছে কলেজে?”
অন্তর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল, “এই তো, বের হব। তুই এগো, আমি আসছি।”
#চলবে।
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬২
#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬২
জিয়ান নয়নাকে ভিডিও কল করেছে।
নয়নার চোখে-মুখে তখন রাজ্যের টেনশন।
“কী হলো তোমার? চেহারার অবস্থা এমন করে রেখেছ কেন? তুমি কি চাও আমি জব ছেড়ে চলে আসি?”
নয়না উত্তর দিল, “উঁহু, তা কেন চাইব? তুমি তো বললে আম্মুর সাথে রান্না করতে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
“এবার বলো, মন খারাপ কেন? এত কিউট চেহারায় আমাবস্যা মানায় না। এই চেহারা হলো বারোমাসি পূর্ণিমা। সব সময় ঝলমল করবে চাঁদের হাসি।”
নয়নার চোখের পাতা ভারি হয়ে এল। নিম্ন স্বরে বলল, “মিস ইউ। আমি তোমাকে ভীষণ মিস করছি।”
জিয়ান আদুরে স্বরে বলল, “এদিকে তাকাও জান। জান, আমি কি তোমাকে মিস করছি না?”
নয়না কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, “তুমি যখন পাশে ছিলে, পৃথিবীটা অন্যরকম ছিল। সব কিছুই তখন রঙিন লাগত। প্রতিদিন মনে হতো বসন্তের আগমন ঘটছে আমার জীবনে। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতাম। তুমি ছাড়া সব কিছু যেন অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ; সব যেন ফিকে মনে হচ্ছে। তোমার হাসি, তোমার স্পর্শ, তোমার নিঃশ্বাস যেন চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করতে পারি। প্রতিটি মুহূর্তে তোমার মধ্যে হারিয়ে যেতাম, মনে হতো সময় থেমে গেছে। তুমি ছাড়া আমি যেন কিছুই নই, আমার সব কিছু তোমার সাথে চলে গেছে। নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে।”
“জান, আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছ পাখি। কী হয়েছে তোমার?”
নয়না কথার প্রত্যুত্তর না করে নিজের মতো বলতে লাগল, “তোমার হাত ধরলে মনে হতো যেন সমস্ত পৃথিবী কেবল আমাদের জন্য থেমে গেছে। এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না। তোমার চোখে আমি আমার প্রতিটি স্বপ্ন দেখতাম, আর তোমার সাথে কথা বললেই সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হতো। কেন তুমি আমাকে ছেড়ে এত দূরে? তবে যখন তুমি চলে গেলে, তখন আমার অস্তিত্ব যেন মুছে যেতে থাকে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত তোমার অভাবে ভরা। পৃথিবীটা আজ আর আমার আর তোমার নয়। আমি জানি না, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলব। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। হয়তো আমি জানি না কীভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু তোমার প্রতি আমার অনুভূতি চাঁদ আর সূর্যের মতোই সত্য।”
জিয়ান ডাকল, “সুনয়না, শুনছ?”
নয়না জিয়ানের দিকে দৃষ্টি দিল।
কিছুক্ষণ কথা হলো চোখে চোখে।
“জান পাখি, আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি সারাদিন রুমে ছিলে, যাও, কিচেনে গিয়ে আম্মুর সাথে কাজ করো।”
নয়না জিয়ানের দিকে তাকাল।
“লাভ ইউ জান।”
নয়না মুচকি হেসে বলল, “লাভ ইউ মিস্টার প্লেন ড্রাইভার।”
নয়না নিচে এসে কিচেনে গিয়ে দেখে, মেহনুর আর মিতা বেগম দাঁড়িয়ে আছে।
“আম্মু, আমিও রান্না করব।”
“আয়, মাংসটা ধুয়ে বসিয়ে দে। আমি ততক্ষণে কলমি শাক ভাজিটা করি।”
“আম্মি, আমিও রান্না করব,” মেহনুর বলল।
“তুই বাঙালি রান্না করতে পারবি না। তুই বরং সন্ধ্যাবেলা সবার জন্য হোয়াইট সস পাস্তা রান্না করিস। বিকেলে সবাই তোর হাতের বানানো পাস্তা খেতে খেতে আড্ডা দেব।”
মিতা বেগম মেহনুরের সাথে কথা বলার মাঝে খেয়াল করলেন, নয়না সুন্দর করে মাংসটা বসিয়ে দিয়েছে। অবাক হয়ে ভাবলেন, মেয়েটা শুধু দেখতে সুন্দর নয়, যেমন রূপবতী তেমনি গুণবতী। মিতা বেগম নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “নয়না, আজ যেহেতু তোর প্রথম রান্না, এক কাজ কর, পায়েসও রান্না করিস।”
নয়না মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক সম্মতি দিল।
🌿
সায়নাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। সায়না নিজের ফোন থেকে অনিকেতকে কল করল।
সাথে সাথে ওপাশ থেকে রিসিভ হল।
“আপনি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন না, ডাক্তার সাহেব?”
অনিকেত কম্পিত কণ্ঠে বলল, “কে?”
সায়না বিচলিত কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে আপনার? আপনি ঠিক আছেন তো?”
ওপাশ থেকে আর কোনো উত্তর এল না।
সায়না দ্রুত উঠে ড্রয়ার থেকে সাইডব্যাগ নিয়ে বসার রুমে আসতে উদ্যত হল।
সায়নার মা এসে সায়নার হাত ধরে বললেন, “রঙতামাশা পরে করবি। তোর জন্য ওনারা সেই কখন থেকে বসে আছে। ব্যাগ রাখ আর চল আমার সাথে।”
সায়না ব্যাগ রেখে বসার রুমে এল।
পাত্রপক্ষের সায়নাকে পছন্দ হল। খুশি হয়ে সায়নার হাতে দুশো টাকার এক বান্ডিল নোট ধরিয়ে দিল।
সায়না আর কালবিলম্ব না করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার ফ্রেন্ডের দাদি মারা গেছে, আমাকে এখনই যেতে হবে।” বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল।
উপস্থিত সবাই সায়নার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল।
🌿
জিয়ানের আর ঘুম হলো না। উঠে বসল। নিজের ফোন থেকে জাহানারা বেগমকে কল করল।
ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই সালাম দিয়ে বলল, “কেমন আছেন আম্মু?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তুমি কেমন আছ বাবা?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আম্মু, আমি বলছিলাম, আপনি যদি সুনয়নাকে কয়েকটা দিনের জন্য আপনার বাসায় এনে রাখতেন। কিছু মনে করবেন না। সুনয়নার মন খারাপ দেখলাম, তাই বলছি আর কি।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি আজ বিকেলে গিয়েই নিয়ে আসব। তুমি চিন্তা করো না বাবা।”
“আম্মু, আরেকটা কথা। আমি যে বলেছি, এটা যেন ও না জানে।”
“চিন্তা করতে হবে না বাবা, ও জানবে না। খেয়েছ তুমি?”
“জি। আচ্ছা আম্মু, ভালো থাকবেন। রাখি।”
জিয়ান কল কেটে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বেডে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বলল, “তোমার কথাগুলো শুনে ইচ্ছে করছিল একছুটে তোমার কাছে গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরি বুকের মাঝে। মিস ইউ আমার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী। আমি তোমাকে অনেক বেশি মিস করছি। তোমার মন খারাপে তোমার মন ভালো করতেও পারছি না। জান, কী হলো তোমার মনের? কী করলে তোমার মনটা হেসে উঠবে? আমার মনেও মেঘ জমে তোমার মন খারাপে।”
🌿
এতিমখানায় এসে দোয়া পড়িয়ে এতিম বাচ্চাদের এক বেলা খাবার খাওয়াল জাহিন আর অন্তর। এতিমখানা থেকে বের হয়ে রমনা পার্কে এসে নিরিবিলিতে বসল দু’জনে। অন্তর চুপ করে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। এরপর বলল, “জাহিন, আমি জানি আমার বোনের হত্যাকারী কে।”
হঠাৎ কথাটা শুনে জাহিন ঘাবড়ে গেল। কপালে আঙুল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “তাই? তাহলে বল, কে সে?”
“তুই এত ঘামছিস কেন জাহিন?”
“প্রচণ্ড গরম পড়েছে আজ। এত জার্নি করলাম, তাই ঘামছি।”
“মন্ত্রীর ছেলে, তার ভাগ্নে, তার এক বন্ধু আর একজন।”
“আর একজন! কে সেই একজন?”
“জানি না। তার কাছে ঠিক ম্যারিনোর মতো বেড়াল ছিল। স্পটে যে বেড়ালটার লাশ পাওয়া গেল?”
“এভিডেন্স লাগবে। আমাদের কাছে যতটুকু আছে, তা এত জোরালো নয়।”
“আমি এভিডেন্স বের করে ফেলব। আচ্ছা, ম্যারিনোকে তোর সাথে আর দেখা যায় না কেন? আগে তো ম্যারিনোকে ছাড়া বের হতিস না।”
“ম্যারিনো অসুস্থ, তাই আর ম্যারিনোকে নিয়ে বের হই না।”
“আচ্ছা, বলতো, চারজন মানুষ ছিল, কিন্তু তিনজন মানুষ অপরাধী। বাকি একজন কী করছিল সেখানে?”
“একজনকে এনে উত্তম-মাধ্যম দিলেই জানা যাবে।”
অন্তরের হঠাৎ চোখ পড়ল একটা মেয়ে দুই-তিনটা পথশিশুকে আইসক্রিম কিনে দিচ্ছে। অন্তর বলল, “তুই বস, আমি আসছি।”
তুষির মা পিজি হাসপাতালে ভর্তি। তুষি বেরিয়েছিল মেডিসিন নিতে। হাসপাতালে মেডিসিনের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই একটু নিজেকে সতেজ করতে পার্কে ঢুকেছিল।
অন্তর তুষির হাত ধরে বলল, “আর একটু পর সূর্য ডুবে যাবে। এখানে কোনো ভদ্র মেয়ে এই সময় থাকে না।”
তুষি অবাক হয়ে বলল, “ধরুন আমি অভদ্র মেয়ে, তাতে আপনার কী?”
“নিজের ইজ্জতের ভয় নেই? নাকি রাস্তার মেয়ে?”
তুষি অন্তরের কলার চেপে বলল, “নিজের লিমিট ক্রস করবেন না। আপনার সাহস কত বড়, আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেন? লোক জড়ো করে গণধোলাই খাওয়াতে এক সেকেন্ড সময় লাগবে না।”
ইতিমধ্যে কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে গেছে।
তুষি কলার ছেড়ে অন্তরের হাত ধরে বলল, “আপনি একাই রাগতে পারেন? দেখলেন, আমিও নায়িকাদের মতো রাগ দেখাতে পারি।”
কয়েকজন বলল, “কী হচ্ছে এখানে?”
তুষি হেসে বলল, “কিছু না, আমার হ্যাসবেন্ডের সাথে একটু মজা করছিলাম।”
তুষি অন্তরের হাত ধরে পার্ক থেকে বের হয়ে সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “শুধুমাত্র রেজা জিজুর জন্য আপনাকে ধোলাই খাওয়ালাম না। চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখুন, আমার হাতে মেডিসিন। আমার আম্মুর এখানে হার্টের সার্জারি হয়েছে। কারো সম্পর্কে না জেনে কথা বলা কোনো ভদ্রতা নয়। ডিসগাস্টিং।”
“তুষির কোনো কথার উত্তর দিল না অন্তর। তুষি চলে যাচ্ছে, সে দাঁড়িয়ে দেখছে।
#চলবে
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬১
#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৬১
তুষির সাথে কলে কথা বলছিলো তখন টুং করে নোটিফিকেশন আসলো। মিস্টার প্লেন ড্রাইভার টেক্সট করেছে৷ এই লোকটা অদ্ভুত রকমের! কিজানি তার টেক্সট বা কল দেখলেই নয়নার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে অটোমেটিক। এটা কে নিশ্চয়ই ভালোবাসার জাদু বলে৷ যে জাদুর মোহে আটকে পরে নিজেকে বিলীন করা যায় আরেকজনের বক্ষে। নয়না কিছুক্ষণ চুপ রইলো৷
তুষি আবার বলল “সবই বুঝলাম কিন্তু সহ্য না হওয়ার থিওরি বুঝলাম না৷”
নয়না কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলে, ,”না বোঝার মত কি আছে তুষি! তুই বল তখন এই ছেলে কেন বললো না! ও যে জিয়ান না! জাহিন।”
“হয়ত ভাবির সাথে মজা করেছে।”
“কেমন অদ্ভুত মজা! আর জানিস উনি আমাকে ভাবি বলে না৷ আমি ওনার বড় ভাইয়ের বৌ আমাকে ভাবি ডাকে না কেন!”
“তোর বয়স কম তাই হয়তো। তুই সব কিছু নিয়ে একটু বেশি ভাবিস। এতো ওভার থিংকিং না করে রিলাক্স কর। এক সপ্তাহ পর কলেজে নবীন বরণ আমি কিন্তু লাল পাড় সাদা শাড়ি অর্ডার করেছি দুটো। আমরা দুজন সেম সেম পরবো৷ জানিস সেখানে একজন গায়ক আসবে। যদিও প্রফেশনাল গায়ক না তবুও সে নাকি খুবই ভালো গান গায় আর দেখতেও নাকি সুপার হ্যান্ডসাম।”
নয়না নিরাশ গলায় আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। এখন তার এসব শোনার ইচ্ছে হচ্ছে না৷ নয়না হতাশ, কি অদ্ভুত তার মনের ফিলিংস সে কাউকে বোঝাতে পারছে না! কেউ কেনো বুঝতে পারছে না জাহিনের সামনে যেতে তার কেমন যেনো লাগে। এই কেমন লাগাটা সে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। মেয়ে মানুষের অদ্ভুত এক শক্তি আছে, কোন পুরুষ তার দিকে তাকালে তারা চট করে বুঝে যায় সে দৃষ্টিতে কি আছে, মোহ, ভালোবাসা, নাকি কুদৃষ্টি। এই সেন্স বেশিরভাগ মেয়েদেরই প্রখর। নয়না বুঝতে পারছে না জাহিনের সাথে কিভাবে এক বাসায় দুজন থাকবে! জাহিনকে দেখলেই নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নয়নার। মনে হয় কোন খোলসে নিজেকে আড়াল করতে পারলে তার স্বস্তি লাগতো৷ আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে চোখ বুঝে এলো নয়নার৷ ঘুম যেনো নয়নার চিরসঙ্গী। গভীর দুঃখ, টেনশন যাহোক তার চোখ থেকে ঘুম কখনো উবে যায় না। এতে সুবিধা ও আছে। ঘুম থেকে উঠলে নিজেকে অনেকটা রিলাক্স লাগে৷ এই কারণেই হয়ত গভীর কোন দুঃখ নয়নাকে তেমন ভাবে আঘাত করতে পারে না৷ তবে একজন আছে তার ঘুমের শত্রু। সেই মানুষটার সাথে তার ঘুমের তুমুল শত্রুতা। সে মানুষটা রেজা চৌধুরী। রাতে নয়নার সাথে গল্প করতে করতে খেয়াল করে নয়না ঘুমিয়ে পরেছে৷ রেজা রেগে যায় একটা মানুষ এভাবে কি করে ঘুমাতে পারে! এদিকে মাঝে মাঝে নয়না টেক্সট দেখে রিপ্লাই করবে ওইটুকু সময়ের মধ্যে ও সে ঘুমিয়ে যায়। জিয়ান টেক্সটের রিপ্লাই পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মত অপেক্ষায় থাকে, এদিকে নয়না গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়! এই যে সে জিয়ানকে অপেক্ষায় রেখে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। ঘুমের অদ্ভুত রকমের শক্তি আছে,ঘুমালে মস্তিষ্ক সুখ, দুঃখ দুটোই মনে হয় ভুলে যায়। ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর দুঃখের ভার কমে যায়! পৃথিবীতে তারা’ই হয়তো সবচেয়ে সুখী মানুষ যারা ঘুমখোর। যাদের চোখে ঘুম সহজে আসে না, যারা দুঃখ পেলেই রাত জাগে তাদের মত দুঃখী মানুষ জগতে খুবই কম আছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের দুঃখ বাড়তে থাকে। রাতের গভীরতা আর অন্ধকারের সাথে তাদের দুঃখও প্রখর হতে থাকে। ঘুমিয়ে পরা মানুষ সে দুঃখ অনুভব করতে অক্ষম।
“নয়নার টেক্সটের রিপ্লাই না পেয়ে ঘুম নিয়ে গবেষণা করে ফেললো জিয়ান। সে জানে তার অর্ধাঙ্গিনী এখন হয়ত ঘুমাচ্ছে। ঘুমালে তাকে মায়াবী লাগে৷ তখন যেনো নয়নার মুখশ্রী জুড়ে সরলতা ছড়িয়ে থাকে!” জিয়ান তাকিয়ে আছে তার পাঠানো টেক্সটের দিকে। প্রেমে পরলে মানুষ কিছুটা কাব্যিক হয়ে উঠে। এই যে জিয়ান এতো সুন্দর টেক্সট লিখেছে….. “আমার একটা আকাশ হোক, সেই আকাশ জুড়ে তোমার ভালোবাসার চাঁদ জ্বলতে থাকুক৷
আমার একটা নদী হোক,
সে নদীতে তোমার ভালোবাসার ঢেউ হোক।
আমার একটা সন্ধ্যা হোক,সেই সন্ধ্যা জুড়ে তোমায় নিয়ে গল্প হোক৷”
নিজেই বার কয়েক নিজের লেখা টেক্সট পড়ে মুচকি হাসছে। এই মেয়েটা খুবই অদ্ভুত, পৃথিবীতে কত মেয়ের সাথে তার দেখা হয়েছে কই কাউকে তো এতো স্পেশাল মনে হয়নি?অথচ নয়না নামের হাঁটুর বয়সী মেয়েটি যেনো পৃথিবীর সব নারীর যেয়ে আলাদা। সে জেনো ভালোবাসায় মোড়ানো এক বাসন্তী ফুল৷ যার প্রতিটি পাপড়িতে নানা রঙের মুগ্ধতা জমা আছে৷ জিয়ান একটা জিনিস নোটিশ করেছে, নয়নাকে যে কেউ দেখলে বা নয়নার সাথে কয়েক মিনিট কথা বললেও তার প্রেমে পরতে বাধ্য। এমন এক মুগ্ধ রমনী তার বৌ। অথচ মেয়েটি জানেনা এমন মেয়েকে নিজের করে পাওয়া শত জনমের সাধনা থাকে পুরুষের। এমন এক নিষ্পাপ মেয়ে তাকে ভালোবাসে এই অনূভুতি যেনো জিয়ানকে পৃথিবীর সবচেয়ে লাকী পুরুষ সে এই অনুভূতি দেয়।
নয়নার ঘুম ভাঙ্গলো একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। কেউ জিয়ানকে কেড়ে নিচ্ছে তার থেকে৷ ধড়ফড় করে উঠে বসলো নয়না৷ জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। অসময়ে ঘুমালে এই এক অসুবিধা আজেবাজে স্বপ্ন আসে! নয়না দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে জিয়ানের শেষ টেক্সট সিন করা কিন্তু রিপ্লাই করা নেই। দ্রুত রিপ্লাই করলো, “আমি তোমাকে ভিষণ ভালোবাসি৷ তোমাকে হারালে আমার জীবনের সব রঙ হারিয়ে যাবে৷ মানুষ হয়ত নিজের প্রিয় মানুষকে ছাড়া বাঁচে তবে সেই বাঁচার মধ্যে প্রাণ থাকে না।”
জিয়ান অবাক দৃষ্টিতে নয়নার টেক্সটের দিকে তাকিয়ে আছে! হঠাৎ এমন টেক্সট দেখে সে বিচলিত হলো। এতো সুন্দর রোমান্টিক টেক্সটের রিপ্লাই এতো করুণ বিরহের কেন!
🌿
অন্তর রিতুর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে বসে আছে৷ তিনজন মানুষের সিমটম পাওয়া গেছে। জাহিন তদন্ত করছে এই কেসের। জাহিনের হাতে প্রমান এলেই অপরাধীরা শাস্তি পাবে। জাহিনের প্রতি ওর অগাধ বিশ্বাস আছে। অন্তর নিজের হাতমুষ্টি বদ্ধ করে বলে,আমি বেঁচে থাকতে তোর অপরাধীরা ছাড় পাবে না বোন৷ আমি তাদের শাস্তি দেবোই।
অন্তর নিজের ফোন থেকে জাহিনকে কল করলো। জাহিন রিসিভ করে বলে, “তুই এতো টেনশন করছিস কেন? আমার উপর ভরসা নেই নাকি! তোর বোন কি আমার নিজের বোনের থেকে কম!”
“আমি জানি তুই সর্বোচ্চ চেষ্টা করবি। তোর প্রতি আমার ভরসা আছে তবুও হাহাকার করে বুকটা। আমার বোনটা এই পৃথিবীতে নেই! যার হাসিতে যার চাঞ্চল্যে মেতে থাকতো পুরো বাড়ি আর সে বেঁচে নেই। আর কখনো বলবে না ভাইয়া আমার জন্য এটা আনো ওটা না৷ হুট করে কল করে টাকা চাইবে না কোনদিন আর কোন বায়না করবে না। আমি কি করে মেনে নেবো আমার ফুলের মত বোনটা আর কোনদিন আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে না। আমার মনে হয় এইতো হুট করেই আমাকে ডেকে উঠবে ভাইয়া বলে, অথচ এজন্মে আমাকে কেউ আর ওমন করে ভাই ডাকবে না। আর কেউ ওরমতো আবদার করবে না। ঠুনকো কথায় নাক টেনে কাঁদবে না। আমার বোন আর কোনদিন এই পৃথিবীর সূর্য উদয় দেখবে না। রাতের তারা ভরা চাঁদেে আলো উপভোগ করবে না। এই হাতে তাকে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত করে এসেছি। এই হাতেই মাটি চাপা দিয়ে রেখে এসেছি। আচ্ছা ওর কি ভয় হচ্ছে এখন ওতো অন্ধকারে ভয় পায় একা থাকতে পারে না।”
জাহিন শীতল কন্ঠে বলল, “একটু শান্ত হ। আল্লাহ তায়ালা রিতুকে জান্নাত বাসি করুক। এক কাজ কর কাল তুই আমি একটা এতিমখানায় দুপুরে খাবার খাওয়াবো রিতুর জন্য দোয়া পড়াবো।”
অন্তর কল কেটে দিলো। এই পৃথিবীতে বোন হারানোর বেদনা বোঝার মত কি কেউ নেই? এই যন্ত্রণার ভার তার হৃদয়ে পাহাড় চেপে আছে কি করে এই বেদনার পাহাড় সরাবে সে! এই পৃথিবীতে কি এ যন্ত্রনার নিরাময় আছে?
🌿
অনিকেত বারান্দায় বসে আছে মেঘে ঢাকা আকাশ। কোথাও একটা তারাও নেই বিস্তৃত আকাশ জুড়ে! কালো মেঘ যেনো আকাশকে গিলে নিয়েছে৷ খুব দ্রুত ধরনী কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টির পর আবার সব স্বাভাবিক হবে। আকাশে তারা জ্বলবে, চাঁদ আলো ছড়াবে। কিন্তু তার জীবনে কি আলো জ্বলে উঠবে? সে কি কখনো সায়না নামক চাঁদের নাগাল পাবে? তীব্র ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার যন্ত্রণা মৃত্যুর মত। তারচেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হতে দেখা। জগতে এরচেয়ে যন্ত্রনার হয়ত আর কিছু নেই। ভালোবাসা বিষয়টা মানুষকে শিশুতোষ করে দেয়, নির্বোধ করে দেয় শুধু একমাত্র একটা মানুষের কাছেই,যাকে সে ভালোবাসে। তার সাথে একটু থাকার আশায় তাকে হারানোর ভয়ে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েও পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে চায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অনিকেত বাহিরে তখন ঝুম বৃষ্টি, হাত বাড়িতে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিলো অনিকেত। বৃষ্টির ঝাপটা এসে তার চোখে মুখে পরছে৷ আড়াল করে দিচ্ছে তার অশ্রু। চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে, “মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করিনি কভু। তবে তোমাকে হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করছি, মনে হচ্ছে দেহ থেকে কেউ শ্বাস কেড়ে নিচ্ছে। এই দমবন্ধ কর যন্ত্রণা ব্যখ্যা করার ভাষা আমার জানা নেই প্রিয়তমা। তুমি অন্য কারো গল্পের পূর্নতা হয়ে ভালো থাকো৷ পৃথিবীর সব সুখ তোমার হোক।সব ভালোবাসা পূর্নতা পায় না। সব ভালোবাসা পূর্নতা পেলে পৃথিবীতে না পাওয়ার যন্ত্রণা যে মৃত্যুর সাক্ষাৎ করায় তা কেউ অনুভব করতে পারতো না।” অনিকেতের চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে, ঠোঁটের কোনে তবুও প্রেয়সীর সুখ প্রর্থনার হাসি!
#চলবে
আগন্তুক পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব
#আগন্তুক
#অন্তিম_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা
অন্তরার যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন দেখলো, আর্য তার পায়ের কাছে বসে আছে। হয়তো সারা রাত জেগে থাকার জন্য ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে গেছে, তাই চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায়, অন্তরার বেডে মাথা নামিয়ে রেখেছে। এখন কি ডাকা ঠিক হবে? না থাক একটু এইভাবেই চোখ বন্ধ করে থাকুক। কি যে হয়ে গিয়েছিল নিজেই মনে করতে পারছে না অন্তরা। হঠাৎই কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল, তারপর আর কিছু মনে নেই। বিশ্বজিৎ এর কাছে বাড়ির একটা চাবি থাকে, ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করে খবর নেয় ছেলেটা। হয়তো ফোনে না পেয়ে সোজা বাড়ি চলে এসেছিল। পেটে হাত দিয়ে কিছু অনুভব করতে চাইলো অন্তরা, বাচ্চাটা ঠিক আছে তো?
আর্যর ঘুমটা ভাঙতেই দেখলো, অন্তরার জ্ঞান ফিরে এসেছে। হাসিমুখে বললো, গুড মর্নিং।
অন্তরা বললো, সারারাত আমার জন্য কত ক ষ্ট হলো বলো? আর্য বললো, কই না তো, ক ষ্ট কেন হবে? আর তুই এত বেশি ভাবিস বলেই এমন হলো। বিপি এত হাই হলো কিভাবে? নিজের না হোক বাচ্চাটার কথা ভাব। এবার থেকে আমি যা বলবো তাই করবি। অনেক হয়েছে তোর।
অন্তরা মনে মনে হাসতে লাগলো। আজ যদি ও ম্যারেড হতো, সমাজে এই বাচ্চার বাবার পরিচয় থাকতো, কত মানুষ মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো, মা এটা করলে বাচ্চার ভালো হবে, এটা করো না, বাচ্চার ক্ষ তি হবে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বলার কেউ নেই। গুটিকয়েক বন্ধু ছাড়া, যদিও তারা বেশির ভাগই পুরুষ। সেদিন আর্য ঠিকই বলেছিল, সব পুরুষ এক নয়।
বিশ্বজিৎ চলে এসেছে খাবার নিয়ে, অন্তরাকে সুস্থ দেখে বললো, উফ কি ভ য় খাইয়ে দিয়েছিলে মাইরি! এখনও মনে পড়লে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস আর্য দার ফোন নাম্বারটা ছিল, নয়তো কি যে হতো। অন্তরা একবার মুচকি হাসি দিয়ে আর্যর দিকে তাকালো। তারপর বললো, আমার আর ভ য় নেই। আমি না থাকলেও আমার বাচ্চা অনেক মা পাবে।
কথাটা শোনা মাত্রই আর্য আর বিশ্বজিৎ একে অপরের দিকে তাকালো।
গাড়ি থেকে নামতেই, পাশের বাড়ির আন্টিরা সবাই দেখা করতে এলেন। অন্তরা বেশ অবাকই হলো। কেউ কেউ ধমকের সুরে বললেন, এই সময় কেউ এত স্ট্রেস নেই? কেউ কেউ বললেন, খাবার-দাবার কেমন খাচ্ছে কে জানে? ওনারাই অন্তরাকে ধরে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এই প্রথম অন্তরা যেন এত ভালোবাসা পেল। কা ন্না আসছে কিন্তু সেটা আড়াল করার চেষ্টা করছে। যদিও সেটা আর্য ভালো করেই বুঝতে পারছে।
এই কদিনে যেন আর্য মেয়েটার মায়ায় বেশি জড়িয়ে পড়েছে। আর্য দুনিয়ার সব খুশি অন্তরাকে এনে দিতে চায়। অন্তরার খুশিতে যেন তার ভালোলাগা জড়িয়ে আছে। সেই প্রথম দেখা থেকে আজ অব্দি অন্তরার প্রতি একটা অনুভূতি কাজ করছে। সেটা কি শুধুই বন্ধুত্ব নাকি অন্য কিছু। এই অবস্থায় নিজের কথাগুলো বললে, অন্তরা বুঝবে?
অন্তরার ডাকে সম্বিৎ ফিরলো, তারপর বললো, হুম বল।
অন্তরা হেসে বললো, কী ভাবছো?
আর্য বললো, কই কিছু না তো।
ফোনটা বেজে উঠলো, স্ক্রিনে ডক্টর অরুন্ধতীর নাম্বার। অন্তরার থেকে একটু সরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো আর্য। অরুন্ধতী বললেন, এখন কিছুতেই অন্তরাকে একা রাখা যাবে না। কিন্তু ২৪ ঘন্টা ওর দেখাশোনা করবে এমন মানুষই তো নেই। আর্য বললো, আমি সব ম্যানেজ করে নেব।
অন্তরার কাছ থেকে সবাই চলে যেতেই, আর্য বললো, ফ্রেশ হয়ে নে, আমি এখানেই আছি। তোর সব দরকারী জিনিস আমি প্যাকিং করছি। অন্তরা অবাক হয়ে বললো, আমি কোথায় যাবো? আর্য অন্তরার ওষুধ গুলো দেখতে দেখতে বললো, আমার বাড়িতে থাকবি।
অন্তরা বললো, তা হয় না আর্য। আমি আর তোমার উপর বোঝা হতে চাই না। তাছাড়া তোমারও একটা জীবন আছে। আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে গেলে সবাই নানারকম কথা বলবে। আমি চাই না, আমার জন্য তোমার কোনো ব’দনাম হোক।
আর্য এবার রা গী চোখে তাকিয়ে বললো, তোকে এত ভাবতে কে বলেছে? তোকে যা বলছি তুই শুধু তাই কর।
অন্তরাও উত্তেজিত হয়ে বললো, কিছুতেই না। আমি আর তোমার জীবনে বোঝা হতে চাই না। এইভাবে দুজনের কথা কা’টাকা’টিতে হঠাৎ করে অন্তরা থেমে গিয়ে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়লো। আর্য অন্তরার কাছে গিয়ে বললো, কী হয়েছে অন্তরা? তুই ঠিক আছিস তো? সরি সরি। আমার মাথার ঠিক ছিল না, তোর সাথে জোর গলায় কেমন কথা বলছিলাম, ভুলেই গিয়েছিলাম তোর শরীরটা ভালো নেই।
অন্তরা কিছু না বলে আর্যর হাতটা তার পেটের কাছে রাখতেই আর্য চমকে উঠলো। বাচ্চাটা নড়ছে। যেন বলতে চাইছে, তোমরা ঝ গ ড়া করছো কেন? আমি যে তোমাদের সাথে আছি, সেটা কি ভুলে গেছ?
এই অনুভূতিটা যে কত সুন্দর তা বলে বোঝানো যাবে না। যাঁরা এটা অনুভব করেছেন তাঁরাই শুধু জানেন। আর্যর চোখে জল, ধীরে ধীরে বললো, আমাকে বিয়ে করবি অন্তরা? আমি জানি তোর কাউকে দরকার নেই। কিন্তু আমার প্রয়োজন তোদেরকে। আমি এই অল্প সময়েই তোদের অনেক আপন করে নিয়েছি। আমাকে একটু অধিকার দে না, যাতে আমি জোর গলায় বলতে পারি, এই সন্তান আমারও।
অন্তরা কাঁ’দতে কাঁ’দতে বললো, আমাকে দয়ায় রেখো না। আমি দয়ার পাত্রী হয়ে থাকতে চাই না।
আর্য এবার অন্তরার গাল দুটো ধরে বললো, একদম দয়া করছি না আমি, আমি দয়া করার কে? আমি শুধু তোর মনে আমার একটা জায়গা করতে চাইছি। বাচ্চাটা যখন হাঁটতে শিখবে, আমি আমার আঙুলটা বাড়িয়ে দিতে চাইছি। তোর এই সুন্দর জার্নিটা থেকে শুরু করে, যতদিন প্রাণ থাকবে ততদিন সাথে রাখতে চাই। আমাকে ফিরিয়ে দিস না। আমি অনেক ভেবেছি, তারপর সিন্ধান্ত নিয়েছি। কোনো আবেগ বা দয়া করে নয়।
এক মাস পর,
রেজিস্ট্রি ম্যারেজ অফিসে হাজির আছে, অরুন্ধতী, বিশ্বজিৎ, আর কিছু অন্তরা আর আর্যর বন্ধু, আর অন্তরাকে যিনি বড়ো করেছেন, সেই ফাদার। সকলে যেন ভীষণ খুশি। আর্য অন্তরার হাত ধরে ঢুকলো অফিসে।
অরুন্ধতী, অন্তরাকে দেখেই বুঝতে পারছেন, মেয়েটা শরীর এবং মন দুদিক দিয়েই ভালো আছে। অন্তরার মুখের হাসি যেন ভেজালহীন। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়ে গেল।
আর্যর ফোনে একটা ফোন আসতেই, আর্য বললো, একটু পরেই যাচ্ছি।
অন্তরা জিজ্ঞাসা করলো কয়েকবার, আমরা কোথায় যাবো? আর্য ততবারই হেসে বললো, সারপ্রাইজ।
ফাদার অনেক আশীর্বাদ করলেন ওদের। আর্যকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি।
তারপর আর্য, অন্তরা, বিশ্বজিৎ আর ডক্টর অরুন্ধতী গেলেন অন্তরার বাড়িতে।
অন্তরা একটু অবাকই হলো, কারণ সে এই একমাস আর্যর বাড়িতে ছিল। হঠাৎ করে আবার ওর বাড়ি যাওয়ার কারণ সে জানে না।
গাড়ি এসে বাড়ির কাছে থামতেই, অন্তরার পাশের বাড়ির আন্টিরা উলুধ্বনি দিতে লাগলেন। সকলে অন্তরাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। অন্তরার এখন নয় মাস চলছে। তাই নিয়মানুযায়ী এই মাসেই অন্তরার সাধ। আন্টিরা নিজেদের মতো রান্নাবান্না করেছেন। অন্তরাকে বসিয়ে সব খাবার সাজিয়ে দিলেন। লাল শাড়িতে অন্তরাকে আরও যেন সুন্দর লাগছে। আর্য যেন এক মুহুর্তের জন্য চোখ সরাতে পারছে না। তার জীবনে এই প্রথম ভালোবাসার বসন্ত এসেছে। অরুন্ধতী বললেন, খুব গর্ব হচ্ছে আপনার জন্য ডক্টর আর্য। এত সুন্দর একটা সিন্ধান্ত নেওয়ার জন্য। আপনাদের ভালোবাসা সারাজীবন অটুট থাকুক।
… কী ভাবছিস?
… কিছু না তো।
… বললেই আমি শুনে নেব। বল কী ভাবছিস?
… একটা সম্পর্কের নাম থাকা খুবই আবশ্যক? দেখো আমার বাড়ির পাশের আন্টিদের ব্যবহার কেমন পালটে গেল। যে মানুষগুলো আমার মুখ দেখতে চাইতেন না, তাঁরাই আজ আমায় কত আশীর্বাদ করলেন।
… ব্যাপারটা ঠিক তেমন না। সমাজের কথা বাদই দিলাম, আমরা যতই নামহীন সম্পর্ক নিয়ে মাতামাতি করি না কেন, একটা সময় পর সব মানুষই অধিকার খোঁজে।
যেমন ধর, প্রথম প্রথম এমন একটা সম্পর্ক শুরু হলো, যেখানে বলা হলো, আমাদের সম্পর্ক মুক্ত, আমরা নিজেদের মতো স্বাধীন, আমরা যেমন চাইবো সেভাবে নিজেদের জীবন কা’টাবো। কিন্তু একটা সময় পর মানুষ অধিকার খুঁজে। সারাদিন কাজের পর কেউ অপেক্ষা করে না থাকলে, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। অপেক্ষা, অধিকার, বিশ্বাস, ভালোবাসা আর সম্মান এইগুলো যেকোনো সম্পর্কের একটা স্তম্ভ।
বিয়ে মানেই যে সেই সম্পর্ক পবিত্র হয়ে গেল তেমন না। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে সেটা বিয়েই না। আর রইলো সমাজ, সেটাও একদিন পালটে যাবে সময়ের সাথে সাথে। চল রাত হলো, ঘুমিয়ে পড়।
এতক্ষণ ধরে ডক্টর মেঘা, ডক্টর আর্যর প্রেমকাহিনী শুনছিল। এবার আর্য একটু থামলো। মেঘা বললো, তারপর কী হলো?
আর্য বললো, আমাদের জীবনে এল রাজকুমারী। আমার সন্তান।
উঠি এবার, ভোর হয়ে গেল। আবার রাউন্ডে যেতে হবে।
মেঘার মন তখনও ভরে নি। নিশ্চয় এর পরে আরও কিছু হয়েছিল, যেটা ডক্টর আর্য এড়িয়ে গেল। না, মেঘাকে জানতেই হবে।
দুপুরে কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুললো আর্য। সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেঘা। বেশ অবাক হয়ে বললো, আপনি আমার বাড়িতে?
মেঘা বললো, আসলে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনার অন্তরাকে একবার দেখে যায়।
আর্য হেসে বললো, ওহ এই ব্যাপার। আসুন ভিতরে।
আর্য জলের গ্লাসটা নামিয়ে ডাকলো অন্তরাকে।
রুম থেকে বেরিয়ে এল, একটি ৩ বছরের বাচ্চা মেয়ে, আদো আদো গলায় বললো, আমায় ডাকছো কেন?
আর্য বললো, এই আন্টিটা তোমায় দেখতে এসেছেন। আন্টিকে হ্যালো বলো।
বাচ্চা মেয়েটি তখন মিষ্টি গলায় বললো, হ্যালো আন্টি!
মেঘা অবাক হলেও, মুখে হাসি নিয়ে বললো, হ্যালো বেটা! কী নাম তোমার?
বাচ্চা মেয়েটি বললো, আমার নাম অন্তরা।
কথাটি বলেই কোলে থাকা পুতুলটিকে দেখিয়ে বললো, এবার আমি যাই, মিমিকে ঘুম পাড়াতে হবে।
মেঘা ঘাড় নাড়লো।
বাচ্চা মেয়েটি চলে যেতেই, আর্য বললো, আপনি যার খোঁজে এসেছেন, তাকে দেখতে পাবেন না। সে ছিল স্বাধীন পাখি। অনেক চেষ্টা করেছিলাম, তাকে আটকে রাখার, কিন্তু পারি নি। অন্তরাকে জন্ম দিয়ে ওই অন্তরা হারিয়ে গেল। বহু চেষ্টা করেছিলেন ডক্টর অরুন্ধতী এবং বাকি সব ডক্টর। কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো। সে ছিল ক্ষণিকের অতিথি। তবে সেই ছিল আমার ভালোবাসা।
অনেকক্ষণ আগেই মেঘা, আর্যর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। মনে মনে ভাবছে, এমনও মানুষ পৃথিবীতে আছে বলেই, এখনও পৃথিবী টিকে আছে।
সমাপ্ত
আগন্তুক পর্ব-০৩
#আগন্তুক
#তৃতীয়_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা
বিশ্বজিৎ-এর দেওয়া ঠিকানায় গাড়ি নিয়ে পৌঁছালো আর্য। আগে থেকেই বিশ্বজিৎ-এর কাছে জেনে নিয়েছে, এইসময় অন্তরা থাকবে কিনা।
গাড়ি এসে বাড়ির কাছে থামতেই সামনেই কিছু আন্টিরা বসে গল্প করছেন, গাড়ি দাঁড়াতে দেখেই চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন তাঁরা। আর্য মনে মনে ভাবলো, অন্তরার সাথে অন্তরার মতো করেই মিশতে হবে। এই তিনবার দেখাতেই আর্যর মনে হয়, সে অন্তরাকে পুরোটা চিনে নিয়েছে। এতটাও কঠিনও ছিল না যদিও। অন্তরার বাচ্চাদের মতো হাবভাব, কথাবার্তা। তবে পরোপকারীও, আবার কঠোর আর জেদি।
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ফোনটা বের করে অন্তরাকে ফোন করলো আর্য।
এদিকে আন্টিরা নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছিলেন।
ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিল অন্তরা। আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসতে একটু অবাকই হয়েছিল। যে পরিস্থিতিতে সে এখন আছে, তাতে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া আর কেউই খোঁজ রাখে না। তারমধ্যে চার্চের ফাদার আর কয়েকজন বন্ধুর রোজ ফোন আসে। কখনো সখনো কাস্টমার ফোন করে ফটোশুটের জন্য। তবে এখন বেশ ক ষ্ট হয় অন্তরার। সময়ের সাথে সাথে পেটও বেড়েছে, সন্তানের নড়াচড়া ভালোই অনুভব করতে পারে। অন্তরার এখন অনেক কাজ, সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর ভালো ভাবে বড় করতে হবে। তাকে মানুষের মতো মানুষ গড়ে তুলতে হবে। এখন আর মন খা’রাপ হয় না। সুমনের উপর কোনো রা গ নেই অন্তরার। সুমন হয়তো এইসবের জন্য প্রস্তুত নয়। তবে অন্তরা কিছুতেই এই বাচ্চা ন ষ্ট করতে পারবে না, তাই তো জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও, তাকে পৃথিবীর আলো দেখাবে বলে সিন্ধান্ত নিয়েছে। ফাদারকে বারবার বলেছে, আমি যদি না থাকি, তুমি আমার মতই আমার সন্তানকে বড় করবে।
আরও একবার ফোনটা বেজে উঠতেই সম্বিৎ ফিরলো অন্তরার। আবারও সেই আননোন নাম্বার থেকে ফোন। ফোন রিসিভ করতেই, ওই প্রান্ত থেকে একজন বললো, একবার ব্যালকনিতে আসতে পারবেন ম্যাডাম? একটু দরকার ছিল।
অন্তরা কিছু বলার আগেই ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। অন্তরা বেশ অবাক হল। ল্যাপটপটা বিছানায় রেখে, ব্যালকনিতে গেল অন্তরা। নীচে ডক্টর আর্যকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল। আর্য হাসি মুখে হাত নাড়লো। অন্তরার চোখ গেল এবার পাশে বসে থাকা আন্টিদের দিকে। এমনিতেই তাঁদের এখন হট টপিক অন্তরা। অন্তরার গর্ভে কার বাচ্চা আছে, এই নিয়ে তাঁদের চিন্তার শেষ নেই। এই অবস্থায় ডক্টর আর্যকে দেখে তাঁদের টপিকে আরও স্পাইসি মশলা এড করা যাবে। এই ভেবেই অন্তরা হেসে বললো, কী ব্যাপার ডক্টর আর্য, আপনি আমার প্রেমে পড়লেন নাকি? আজ একেবারে বাড়ি অব্দি চলে এলেন।
আর্য হেসে বললো, কী করবো বলুন, আপনাকে দেখার পর রাতের ঘুম উড়ে গেছে। দিনরাত শুধু আপনার কথা ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই রোগের ট্রিটমেন্ট এবার আপনাকেই করতে হবে।
অন্তরা হো হো করে হেসে বললো, কিন্তু ডক্টর তো আপনি।
আর্য বললো, ডক্টর নিজের ট্রিটমেন্ট নিজে করতে পারবে না।
দুজনে কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর আর্য বললো, দরজাটা খুলবেন, একটু কথা ছিল। অন্তরা হাসি মুখে বললো, আসুন।
আন্টিরা কিছুই বুঝতে পারলেন না। অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। এদিকে আর্য একবার তাঁদের দিকে তাকিয়ে চশমাটা খুলে অন্তরার বাড়ির দরজার কাছে গেল।
অন্তরা ধীরে ধীরে নীচে নামার সময় ভাবলো, ডক্টর আর্য কীভাবে তার ঠিকানা পেল? এতদূর যখন এসেছেন, নিশ্চয় তিনি অন্তরার ব্যাপারে সবটুকু জেনে গেছেন। কিন্তু উনি কেন এমন করছেন? কী উদ্দেশ্য ওনার?
অন্তরা দরজাটা খুলতেই আর্য বললো, দুকাপ চা বানা তাড়াতাড়ি।
অন্তরা অবাক হয়ে বললো, দু কাপ?
আর্য বললো, হ্যাঁ দু কাপ, তোর আর আমার। সেদিন আমাকে আসতে বলে নিজে বেপাত্তা। আচ্ছা চল ছাড়, আমি বানাচ্ছি। কিচেনটা কোন দিকে? অন্তরা তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আর্যর দিকে। আর্য আবারও বললো, কিচেনটা কোনদিকে? অন্তরা হাতের ইশারা করে বোঝালো, মুখে কিছু বললো না। আর্য বললো, ওকে তুই চুপ করে এখানে বস, আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। আর হ্যাঁ মুখটা বন্ধ কর, নয়তো মাছি ঢুকে যাবে।
আর্য চা বানাতে গেল। অন্তরা নিজেকে চিমটি কে টে দেখলো, এইসব সত্যি নাকি স্বপ্ন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আর্য চা বানিয়ে নিয়ে এসে বসলো অন্তরার কাছে। অন্তরাকে এক কাপ চা দিয়ে বললো, দেখ তো কেমন বানিয়েছি। চিনি দিই নি। এইসময় তোর চিনি খাওয়া ঠিক নয়।
অন্তরা আর্যর দিকে তাকিয়ে বললো, কেন করছেন এমন?
আর্য অন্তরার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো, কাল সকালের দিকে নিতে আসবো, ডক্টর অরুন্ধতীর কাছে নিয়ে যাব চেক আপের জন্য। পালাবার চেষ্টা করিস না, যেখানে যাবি, সেখান থেকে খুঁজে তোকে বের করবো।
অন্তরা হাউহাউ করে কেঁ দে উঠলো। আর্য, অন্তরার আরও একটু কাছে গিয়ে বসলো। তারপর বললো, আমি বিশ্বজিৎ-এর কাছে গিয়েছিলাম। ওখান থেকেই তোর ঠিকানা আর ফোন নাম্বার পেয়েছি। আমি ওর কাছে সবটা জেনেছি। আমি তোকে জাজ করছি না অন্তরা। তুই যে ডিসিশনটা নিয়েছিস, সেটা আমি রেসপেক্ট করছি। তবে তোকে বুঝতে হবে, সব পুরুষ এক নয়। তোর আর কোথাও পালাবার পথ নেই। আমি তোকে ছাড়ছি না। তোর এই জার্নিটাতে আমাকে সাথে নিবি? আমি জানি না, আমি কেন এমন করছি? এমন তো পাগলামি আমি কোনোদিন করিনি। এই যে হঠাৎ একজন অপরিচিতকে এতটাই কাছের মনে হচ্ছে যে, আমি সোজা আপনি থেকে তুই করে বলছি। আমি জানি তুই ভীষণ স্ট্রং, তোর কাউকে প্রয়োজন নেই। তবুও আমি তোর পাশে থাকতে চাই। তোর এই জার্নিটা আরও সুন্দর করে তুলতে চাই। আমাকে রাখবি প্লিজ?
অন্তরা কান্না ভেজা গলায় ধীরে ধীরে বললো, রাখবো। যে কোনো বাহানায়, এই ছেড়ে যাওয়ার যুগে, কেউ থাকতে চাইলে তাকে ফিরিয়ে দিতে নেই। এটা আমাকে ফাদার বলেছেন। দুজনেই হাসছে। এই সুন্দর মুহুর্ত দেখার মতো কেউ নেই। তবুও সাক্ষী থাকলো এই বিকেল, এই চায়ের কাপদুটো।
চা শেষ করেই আর্য বললো, চল রেডি হয়ে নে, একটু ঘুরে আসি।
এই প্রথম অন্তরা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না, আর্যর কাছে যেন নিজেকে মেলে ধরলো। আর্য কাপদুটো নিয়ে বেসিনে গিয়ে বললো, একদম আঁটোসাঁটো ড্রেস পরবি না, ঢিলেঢালা কিছু পরিস, যেটাতে তুই আর বাবু দুজনেই কম্ফোর্টেবল ফিল করবি।
অন্তরা রেডি হয়ে এসে বললো, চলো, আজ আমাকে ফুচকা খাওয়াবে? অনেকদিন খাই নি।
অন্তরার হাসিমুখটা দেখে কিছুক্ষণ আর্য তাকিয়ে থাকলো। যেন একটা গাছ বৃষ্টির জল পেয়ে সবুজ আর সতেজ হয়েছে। আর্য মনে মনে ভাবলো, এই মেয়েটা অনেক কিছু একা সামলেছে, এবার ওর দুনিয়ার সব আনন্দ, সুখ দেখার পালা। ওকে আর ক ষ্ট পেতে দেওয়া যাবে না।
অন্তরার হাতটা ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল আর্য। আন্টিদের নজর তখনও ওদের দিকে। আর্য সেদিকে আর না তাকিয়ে, গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে গেল। গাড়ির স্পিড একদম কম। অন্তরা সেটা বুঝতে পারলো। তারপর নীরবতা ভে ঙে অন্তরা বললো, তুমি তো আমার জন্য ব’দনাম হয়ে গেলে ওই আন্টিদের কাছে। আর্য হেসে বললো, তা হলে হবো। কি করি বল, তোর মতো বন্ধুর জন্য এইটুকু সহ্য আমি করে নেব।
কথাটা বলা মাত্রই দুজনে আবার হেসে উঠলো।
এইভাবেই কে টে গেল আরও কয়েকটা দিন। এই কটা দিনে আর্য আর অন্তরার বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে। অন্তরা এইটুকু বুঝতে পেরেছে, আর্য কোনো স্বার্থ ছাড়াই তার জীবনে এসেছে। ডক্টর অরুন্ধতী, অন্তরার চেক আপের পর আর্যকে জানালেন, বেবি ঠিক আছে। কিন্তু অন্তরার ওভারিতে যে টিউমার আছে, সেটা নিয়ে ভ য় থেকেই যায়।
আর্য বললো, সেরকম হলে ওভারি বাদও তো দেওয়া যাবে বেবি হওয়ার পর।
অরুন্ধতী বললেন, রিস্ক আছে, ব্লি ডিং এর পরিমাণ বেড়ে গেলে, তখন কিছু করা যাবে না।
আপাতত এখন ওকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। সব থেকে বড় কথা ওকে হাসিখুশি রাখতে হবে। কিন্তু ওর ব্যাপারে যেটুকু শুনলাম, তাতে ওকে একা থাকতে হয়। এইসময় মোটেই ওকে একা রাখা যাবে না। এতদিন সেভাবে ও কোনো চেক আপ বা ট্রিটমেন্টের মধ্যে ছিল না। যদি প্রথম থেকে ব্যাপারটা ধরা পড়তো, তবুও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম। এখন চান্স অনেকটাই কম। আমাদের ডক্টরদের অনেক ব’দনাম হয়, কিন্তু পেশেন্ট যদি প্রথম থেকে রোগের ট্রিটমেন্ট না করায়, তাহলে অনেক সময় আমাদের হাতে কিছুই করার থাকে না। তবে আমি সবরকম চেষ্টা করবো অন্তরার জন্য। আমি আরও সিনিয়র ডক্টরদের সাথেও কথা বলবো।
কিছুক্ষণ পর বিশ্বজিৎ-এর ফোন এল আর্যর ফোনে। ফোনে বিশ্বজিৎ-এর কথা শুনে ভ য় পেয়ে গেল। অরুন্ধতী শুধু এইটুকু বুঝতে পারলেন, অন্তরা বাথরুমে পড়ে গেছে।
পরের পর্বে সমাপ্ত…
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 🙏