Monday, June 16, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ



মরীচিকার সংসার পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0

#মরীচিকার_সংসার (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আমার মরীচিকার সংসার তার নিজ গতিতে চলছে। সেই একই নিয়ম। ঘরের সমস্ত কাজ করো। রাতে সবার অভিযোগ শোনো। স্বামীর মাঝে মাঝে গায়ে হাত তোলা সহ্য করো। সব মিলিয়ে মানিয়ে নিয়ে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কোনরকম টিকে আছি। আমি জানি এভাবে শত শত মেয়েরা মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। যাদের সন্তান আছে তারা তো ভুলেও সামনে পা বাড়ায় না। বাড়াতে চায় না।

অতঃপর এই মরীচিকার সংসারে আমার সাথে এমন একটি ঘটনা ঘটলো যে আমি বাধ্য হলাম নিজের কথা ভাবতে। সারাজীবন সংসার, পরিবার, সমাজ নিয়ে তো অনেক ভাবলাম। এবার আমাকে আমার কথা ভাবতে হবে। সেটা আমি বুঝে গেলাম। গত সাতদিন হলো আমার ননদ এই বাড়িতে এলো। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো। মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাকে কথা শোনানো, সমস্ত কাজে হুকুম করা। সব মিলিয়ে আমার জীবন যেমন ছিলো তেমনই। তবে একদিন বিকালবেলা ননদের কান্নার শব্দ পেয়ে অবাক হলাম। ঘটনাচক্রে সেদিন পলাশও বাড়িতে ছিলো। ননদের কান্না দেখে সবাই তার কাছে গেলাম। পলাশ বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,“তোর কি হয়েছে? কান্না করছিস কেন?”

“আর বলিস না বাবা। ওর কানের দুল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
শাশুড়ী মা ননদের হয়ে জবাব দিলো। পলাশ কিছুটা হতবাক হলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,“এই বাড়ি থেকে আর কত কানের দুল হারাবে।”

“এবার হারাইছে বলে তো আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় তোর বউ কিছু একটা করেছে।”
শাশুড়ীর এই কথায় পলাশ তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি বোকার মতো সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ননদ তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,“আগেরবার বলছিলো ওটা তার কানের দুল। আমার নয়। আমি নিশ্চিত তখনই তার আমার কানের দুলের উপর নজর পড়েছে। সেই সরিয়েছে।”

“তোমরা আমাকে চোর বলছো?”
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম। সেই মূহুর্তে শাশুড়ী তেলেবেগুনে জ্ব লে উঠলো। পলাশ থামিয়ে বলে,“রিমি তুমি যদি নিয়ে থাকো তাহলে দিয়ে দাও।”

পলাশের কথায় এবার আর আঘাত পেলাম না। এখন এসব সয়ে গেছে। এই মানুষটার একের পর এক ব্যবহার, বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে এই মানুষটি আমার আপন কেউ নয়। যাই হোক, কানের দুল নিয়ে ঘরে বিশাল হট্টগোল বেধে যায়। অতঃপর সেই কানের দুল আমার ঘরেই পাওয়া যায়। আমি বুঝতে পারলাম, এটা ননদের কাজ। আমাকে ছোট করার। কানের দুল আমাদের ঘরে পাওয়ার পর পলাশ আমাকে জিজ্ঞেস করে,“এসব কি রিমি? তুমি?”

“আমি এটা এখানে রাখিনি। আর আমি এটাও জানি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কাজটা যে তোমাদের।”
আমার কথাটি মাটিতে পড়তে পারলো না, তার মাঝে শাশুড়ী তেলেবেগুনে জ্ব লে উঠে। সে বলে,“মুখ সামলে কথা বল ছোটলোক। চো রের বাচ্চা চোর। সেদিন নিজের প্রমাণ করে দুলটা নিতে চাইছিলো আর আজ চুরি করে ফেললো।”

“খবরদার আম্মা। ভুলেও আমাকে চোরের বাচ্চা বলবেন না। আমার বাবা, মা যথেষ্ট সৎ মানুষ।”
আমি কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে পলাশ গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। আমার অপরাধ আমি চুরি করে আবার বড় গলায় কথা বলেছি। পুরো বিকাল জুড়ে তাদের আমার উপর অকথ্য গালা গালি, অপবাদ চললো। আবার আমার বাবাকে ডেকে বিচার বসাতে চাইলো। এবার আর আমি সহ্য করলাম না। কানের দুলগুলো কেড়ে নিয়ে বললাম,“আমার বাবাকে ডেকে পাঠাতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি। তোমাদের মতো নোংরা মানুষের সাথে যতই মানিয়ে নেই না কেন? কখনো একসঙ্গে থাকা হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি।”

“কি বললে তুমি?”
পলাশ রাগান্বিত গলায় বললো। এবার আমিও দুইটা গা লি দিয়ে বললাম,“যা শুনছিস তাই। ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। এভাবে প্রতিদিন কু কুরের মতো ব্যবহার করা। একটার পর একটা অপবাদ দেওয়া। সব মিলিয়ে তোমরা আমার জীবন নরক বানিয়ে ফেলেছো। এখন আমার বাবাকেও ছাড়ছো না। এভাবে চললে আমার বাবার এই বাড়িতে এসে আমার বিচার করতে করতে ম রতে হবে। আর আমাকে তো জীবিত অবস্থায় নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। অনেক হয়েছে আর নয়। সবকিছুর একটা সীমা থাকে। তোমরা আমাকে পুরোপুরি ছাড়তেও চাও না আবার ভালোভাবে বাঁচতেও দাও না। এতদিন তোমার মা তোমার হাতে মা র খাইয়ে মজা নিতো। আজ বোনের শখ হয়েছে তাই চুরির অপবাদ দিলো। এখন আমার বাবাকে ডেকে এনে যা নয় তাই বলে অপমান করবে তাই তো?”
একটু থেমে আবারও বললাম,“না। সেটা আর হচ্ছে না। অনেক হয়েছে। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে অনেক কাটিয়েছি তোমার বাড়ি। আর নয় তো। এবার আমার মুক্তি প্রয়োজন। এই নরক থেকে।”
এই পর্যায়ে কান্না করে দিয়ে বললাম,“যেদিন এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি সেদিন চোখে অনেক স্বপ্ন ছিলো। মা নেই, শাশুড়ীর মাঝে মাকে খুঁজে নিবো। ননদকে বোনের মতো ভালোবাসবো। কিন্তু পরিশেষে কি হলো? আসলে একপাক্ষিক কোনকিছু হয় না। তাছাড়া যদি এই বাড়ির একজন অন্তত আমার হয়ে লড়াই যদি করতো। তেমন কেউ নেই। যার হাত ধরে আমি এই বাড়িতে এসেছি, সেই তো আমাকে ভালোবাসে না, বিশ্বাস করে না। তার চোখে আমি অপরাধী, আমি শুধু তার প্রয়োজন। এমন এক অপ্রয়োজনীয় ঘরে কেন থাকবো? একটা যন্ত্রণাময় সংসারে।”

আমার কথার জবাবে পলাশ এবং তার মা চ্যাতে যায়। তারা অকথ্য ভাষায় আমার সাহস নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। আমিও তাদের জবাব দিয়ে দেই। সেই সাথে বলি,“এই কানের দুল আমার মায়ের। সেটা তোমরা চুরি করেছো। আজ আবার সেটা দিয়ে আমাকে চোর বানাতে চাচ্ছো। সমস্যা নাই। আমাকে চোর বানানোর প্রয়োজন নেই। এটা আমি তোমাদের চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এখন। এটা আমার মায়ের। এটা আমার। তোমাদের কারো না। তাই আমাকে বাধা দিও না। উল্টা চুরির দ্বায়ে জে লে যাবে। অনেকদিন সহ্য করেছি। আর নয়। আমার মায়ের জিনিস অনেক ভোগ করেছো। এবার বাদ দাও। মানুষের যখন সহ্যের সীমা পার হয়ে যায় তখন সে কি করতে পারে সেটাও তোমরাও দেখে নাও।”
এখানে অনেক তর্ক বিতর্ক চলে। অবশেষে তাদের সবাইকে সুন্দরমতো জবাব দিয়ে আমি ঘর থেকে বের হলাম। আমি বুঝে গিয়েছি, এই সংসারে আমি টিকতে পারবো না।আমি যতই চুপচাপ সব মেনে নিচ্ছি ততই তাদের অত্যাচারের পরিমান বাড়ছে। শারীরিক মানসিক সব অত্যাচার তারা করছে। এই অসুস্থ পরিবেশে আমি সারাজীবন কাটাতে চাই না। তাই আজ নিজেকে শক্ত করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
__
বাড়ির দরজায় আমাকে দেখে ভাবী মুখটা কালো করে ফেললো। তাকে পাত্তা না দিয়ে আমি ভেতরে আসলাম। বাবা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। ইতিমধ্যে পলাশ তাকে ফোন দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে আমার নামে বদনাম করে দিয়েছে। তাই বাবা সব জানে।এজন্যই ভাবী আমাকে দেখে খুশি হতে পারলো না। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে অসহয় গলায় বললাম,“বাবা আমি আমার সব দিয়ে ওখানে টিকে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজ আর পারছি না বাবা। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ঐ বাড়িতে আর মানিয়ে নিয়ে, মেনে নিয়ে থাকতে পারছি না বাবা।”

কথাগুলো বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। দিনের পর দিন কতটা যন্ত্রণা সহ্য করে ওখানে টিকে ছিলাম সেটা বললাম বাবাকে। এসব শুনে ভাবী বলে,“সংসার করবা না তো কি আমাদের ঘাড়ের উপর বসে খাবা? হায়রে আমার পোড়া কপাল, এক বুড়ার জন্য বাঁচি না এখন আবার মেয়ে এসে ঝুটছে।”

একটু থেমে পুনরায় বললেন,“আমার সংসারে এসব চলবে না। আসছো ভালো। একবেলা খেয়ে বিদায় হও।”
এবার প্রথমবারের মতো আমার বাবাও জবাব দিলেন। সে বললেন,“এটা তোমার বাড়ি নয় যে আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিবে। এখন অব্দি এই বাড়িটা আমার নামে। তাই তোমাদের অসুবিধা হলে তোমরা বাড়ি ছাড়তে পারো।”

“কি? বাবা এই কথা আপনি বললেন? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আপনি বললেন এটা? আচ্ছা তা এটা নাহয় আপনার বাড়ি কিন্তু গিলেন কার টাকায়? সেটা তো আমার স্বামীরই।”
এই কথা বলে ভাবী একের পর এক আমার বাবার খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিতে লাগলো। যা মেয়ে হিসাবে আমার শোনা কষ্টকর। আমিও বলে দিয়েছি, আর খাবে না। আমরা বাবা, মেয়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করবো। তাদের টাকায় কেনা খাবার খাবো না। আমরা আমাদেরটা ম্যানেজ করে নিতে পারবো। ভাবী এরপর আর কিছু বলতে পারলো না। চুপ করে নিজের ঘরে গেলেন।

পরিশেষে, আমি নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী ছোট একটি কাজ যোগাঢ় করে নিয়েছি। সেই সাথে আবার মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে নিয়েছি। আমার বাবা এবং আমি আমার টাকায় মোটামুটি ভাবে জীবন কাটাচ্ছি। ভাবী আমাদের সাথে তর্ক করে আলাদা হয়ে গেছেন৷ আমরাও তাদের আর বাধা দেইনি। অন্যদিকে পলাশ কয়েকবার নিতে আসছিলো কিন্তু যাইনি। আমি জানি পলাশের মতো মানুষ কখনো শুধরাবে না। তার পরিবারও ঠিক হবে না। এদের মতো পরিবারে যারা পড়ে সেই মেয়েরাই জানে জীবন কত কষ্টের। এদের কপালে সারাজীবনে কখনো সুখ জোটে না। তবে শেষ বয়সে যখন বিছানায় পড়ে তখন শাশুড়ীরা মা মা বলে কেঁদে ম রে। তখন যে অপমান, অপদস্ত করা বউরাই কাজে লাগে। পলাশরাও সেই যুগে শুধরে যায়। যখন একটা মেয়ের জীবনের সব রঙঢঙ করার সময় শেষ হয়ে যায়। তবে যুগের সাথে সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন হবে এই আশা নিয়েই আমি সমাজের মানুষের কটুক্তিগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। জীবনের রঙঢঙ উপভোগ করতে এগিয়ে যাচ্ছি সামনের পথে।

(সমাপ্ত)

মরীচিকার সংসার পর্ব-০৩

0

#মরীচিকার_সংসার (৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

গতরাতের পলাশের কর্মকান্ড আমাকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়। গত আট মাসের সংসার জীবনে শাশুড়ীর সব বিষয়ে দোষ ধরা। কটু কথা সবকিছুকে মানিয়ে নিয়ে সংসারটাকে আপন করেছিলাম। কখনো পলাশকে কোন কথা বলেনি। শাশুড়ীকে নিজের মায়ের মতো ভেবেছিলাম। কিন্তু কানের দুলটা আমার অনেক প্রিয় ছিলো। মায়ের শেষ স্মৃতি বলে কথা। সেজন্য পলাশকে না পেরে বললাম। পরিশেষে কপালে দূর্ভোগ ছাড়া কিছুই ঘটলো না। গতকালের ঘটনায় স্পষ্টভাবে আমি বুঝে গেলাম, পলাশকে তার মায়ের কটু কথা, বোনের ন্যাকামি নিয়ে বললে লাভ হতো না। দিনশেষে সে আমাকেই দোষ দিতো। যদিও মাঝে মাঝে আকারে ইঙ্গিতে পলাশকে তার খারাপ লাগা বোঝাতো। পলাশ সেসবে পাত্তা দিতো না। আমার মন খারাপ আছে জেনেও কাছে আসতো। সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও গতকালের ঘটনা আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারলাম না। তার উপর বাবার শুকনো মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম তার জীবনটা সুখের নয়। সব মিলিয়ে মনমরা হয়ে বসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আনমনে জীবন নিয়ে ভাবছিলাম যার ফলস্বরূপ দুধ উতলে পড়ে যায়। এটা দেখে হন্তদন্ত হয়ে বারান্দা থেকে ছুটে আসে শাশুড়ী মা। সে বলে,“এই নবাবের ঝি কোন দিকে তাকিয়ে দুধে ঝাল করছিস?”

শাশুড়ীর কর্কশ কন্ঠে হুঁশ ফিরে আমার। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। শাশুড়ী এসে দুধ উনুন থেকে নামিয়ে নিলো। সেই সাথে তার মুখও চলতাছে। কথায় কথায় এক কথা,“চোরের জাত আমাকে বলে চোর। এখন মন দিয়ে কার না কার কথা ভাবছিলো। আমার সংসারে আ গুন লাগানোর প্লান করছে। সংসারে অলক্ষী এনে ঘরে তুললে তো এটাই হবে।”
শাশুড়ী একা একা বলে যাচ্ছে। আমি কথা বললাম না। শাশুড়ীর চেঁচামেচি শুনে ননদ আসলো। সেও মায়ের কথায় সঙ্গ দিচ্ছে। আমি কথা না বাড়িয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাশুড়ী মা অবশিষ্ট দুধ দিয়ে চা বানিয়ে নিলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,“এখানে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে থালা-বাসন গুলো ধুঁয়ে আসো।”
আমি মাথা নাড়িয়ে সেই কাজে চলে গেলাম।
___
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে দরজা খুলে দেয় ভাবী। এতক্ষণ অব্দি দরজার বাহিরে বসে ঝিমুচ্ছিলো বাবা। ভাবী দরজা খুলে বাবাকে এমনভাবে দেখে অবাক হয় না। মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,“মেয়ের বাড়িতে রাতটুকু জায়গা হয় নাই?”

বাবা জবাব দিলো না। ভাবী আবারও বলে উঠলো,“তা আপনার মেয়ে কি কান্ড ঘটিয়েছে? নিশ্চয় শ্বশুড়বাড়িতে আমাদের মান-সম্মান ডুবিয়েছে? আমি জানতাম, রাতের বেলা আপনাকে জরুরিভাবে ডেকেছে মানেই কোন অঘটন ঘটিয়েছে। তাই তো আপনার ছেলেকে আপনার সাথে যেতে দেইনি।”
বাবা কোন কথার জবাব না দিয়ে আস্তে করে ভেতরে যায়। ভাবী এটা দেখে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,“যান যান। মেয়ে অপকর্ম ঘটিয়েছে না। এখন তো চুপচাপ যাবেনই। এগুলো আমি করলে ঠিকই সারা পাড়া করতেন।”
এই কথা শুনে বাবা চুপ করে থাকতে পারলেন না। সে শান্ত গলায় বলেন,“তুমি যা করো বৌমা সেসব নিয়ে কথা বললে প্রতি ঘন্টায় বিচারে বসতে হতো। আর হ্যাঁ আমার মেয়ে কিছু করেনি। তবুও তার আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে আমি আমার মেয়েকে ঐ বাড়িতে দাঁত কামড়ে যে পড়ে থাকতে বলেছি সেটাও তোমার জন্য বৌমা। নয়তো যে সামান্য কারণে তারা আমার মেয়েকে নিয়ে বিচার বসিয়েছে তাতে আমার বিবেক, আমার আত্মসম্মান আমাকে বারবার বলছিলো আমার মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে আসি। কিন্তু পারিনি।”
বাবার এই কথায় ভাবী তেলেবেগুনে জ্ব লে উঠে। সে অহংকারের সাথে নিজেকে এই সেই দাবি করে, শ্বশুরবাড়ির সবাইকে তুচ্ছ করে কথা বলে। এসব দেখে বাবা নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মাঝরাতে বাড়ি ফিরে দরজা ধাক্কালে নিজের গুনবতী বউয়ের মুখ দিয়ে কত যে বাজে কথা শুনতে হবে সেই ভয়ে বাহিরে ছিলো। এসব কারণেই বাবা নিজের মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে মাথানত করতে বাধ্য হয়েছেন। নয়তো মেয়েকে নিয়ে চলে আসতেন। কিন্তু এই বাড়িতে এখন আসলে যে জীবন আরও জাহান্নাম হয়ে উঠবে। সেজন্যই নিয়ে আসেননি। অনেকে বলে শাশুড়ী, ননদ খারাপ হয়। এরা জীবনে ভালো হয় না। কিন্তু বাস্তবতা এটা নয়। বাস্তব হলো যে মানুষ খারাপ সে সব সম্পর্কে খারাপ। কিন্তু সম্পর্কে ধরে মানুষ খারাপ হয় বিষয়টি ভুল। বাবা এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নেয়। বাহির থেকে ভাবীর মুখের কটুক্তির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

____
সকালের ঘটনাকে ভিন্নরূপে শাশুড়ী বাড়িয়ে পলাশের কাছে তুলে ধরে। এতদিন এসব করে বেড়ায়নি। কিন্তু গতকাল থেকে বুঝতে পেরেছে পলাশ কখনো বউয়ের হয়ে তর্ক করবে না। পলাশকে দিয়ে বউকে অকারণে শায়েস্তা করা যাবে। সেজন্য এখন এই কাজটিও করতে শুরু করেছে। আমি বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে পারলাম। হলোও তাই। পলাশ বিচার বিবেচনা ছাড়া আমাকে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,“এই ঘরে শান্তিতে থাকতে চাস না? যদি থাকতে চাস। তাহলে আমার মা যেভাবে বলে সেভাবে থাক। পরবর্তীতে জানো আমি এই বিষয়ে আর কোন কথা না শুনি।”
পলাশের মুখে এই কথা শুনে রাগে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। এই মানুষকে এখন আর কেন জানি সহ্য হচ্ছে না।

এটা তো সবে শুরু হলো। এতদিন কথার আঘাতে শাশুড়ী, ননদ জীবনটা তেজপাতা করে দিয়েছিলো। এখন শুরু করেছে নতুন নাটক। পলাশ তাদের দলের বুঝতে পেরে পলাশ আসার আগে ভারী কাজ নিয়ে বসে শাশুড়ী। পলাশকে দেখেই বলবে,“ও মা গো। কোমরের ব্যথায় টিকলাম না। এই দিন ছিলো আমার কপালে।”
শাশুড়ীর এই ন্যাকামি দেখে পলাশ কোন কথা ছাড়া এসে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। তার কথা হলো,“তুই থাকতে আমার মাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে হয় কেন?”

“বাড়ির কাজ সব আমিই করেছি। লোক দেখানো কাজ শেষ করছে। এখানে আমার কি করার?”
এই কথা বলতে দেরি পলাশের আমার পেটে লাথি মা রতে দেরি হয় না। কয়েকটা লাগিয়ে দিয়ে সে আমার উদ্দেশ্য বলে,“ভুল করে আবার মুখে মুখে তর্ক। উল্টাপাল্টা কথা বলিস। তোকে আমি…।”

“থাক বাবা ছাড়। ওর তো মা নেই। এসব শেখাবে কে? হয়তো বা ওর মায়ও এমন অজাতের ছিলো। তাকে দেখে শিখেছে।”
নিজের মাকে নিয়ে এমন কথা কোন সন্তান মে নে নিতে পারে। আমিও পারিনি। কড়া গলায় বললাম,“আমার মায়ের সম্পর্কে কোন বাজে কথা বলবেন না। একদম না। আমার মা আপনাদের মতো খারাপ ছিলো না।”

“তারমানে আমরা খারাপ?”
শুরু হলো শাশুড়ীর ন্যাকা কান্না। আহাজারি। তার ন্যাকা কান্নার শব্দের সাথে পলাশের গায়ে হাত তোলাও শুরু হলো। ইচ্ছামতো মে রে মুখ চেপে ধরে বলে,“তোর এই মুখ দিয়ে এমন কোন শব্দ বের করবি না যেটা আমার মাকে অসম্মান করে।”
আমি মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারলাম না। এতসব কান্ড সন্ধ্যাবেলা করে সেই পলাশ রাতে যখন কাছে আসে তখন নিজেকে মন চায় শেষ করে দেই। তার প্রতি কোন আগ্রহ জন্মায় না। না ভালোবাসা। শুধুমাত্র কোনমতে মরীচিকার এই সংসার করে যাই। এমন করেই পার হচ্ছে জীবন। দিনের পর দিন পলাশ এবং তার পরিবারের অত্যাচারও বাড়ছে। এমন এক পরিস্থিতির মাঝে পলাশ আবার চাচ্ছে বাচ্চা। সেদিন রাতে যখন পলাশ বললো,“চলো না বউ আমরা একটা বাচ্চা নেই।”

তৎক্ষনাৎ আমি মুখের উপর বলে ফেললাম,“না। এমন এক সংসারে বাচ্চা নিয়ে কি তাকে শেখাবো দেখ, তোর মাকে তোর বাবা কত অসম্মান করে? কত নিচু চোখে দেখে? এসব? তাকে এমন অসুস্থ পরিবেশে রাখবো।”
আমি কথাটি বলে পলাশের দিকে তাকালাম। পলাশ কিছু বলতে নেয় তখন আমি বললাম,“জানি এখন তুমি গায়ে হাত তুলবে। অকথ্য ভাষায় কথা বলবে। সত্যি বলতে ঠিক এই কারণেই বাচ্চার কথা ভাবতে ভয় হয়।”
প্রথমবার খুব শান্ত গলায় পলাশকে বোঝালাম। নারীরা বিয়ের পর একটা সংসারে আসে নিজেকে নতুনভাবে গড়তে। নিজের একটা সংসার সুন্দরভাবে সাজাতে। যেই সংসারে তার ছোট ছোট অনেক ইচ্ছের মূল্য দেওয়া হবে। অনেক স্বপ্নের মূল্য দেওয়া হবে। তার চাওয়া পাওয়ার মূল্য দেওয়া হবে। তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তার শক্ত খুঁটি তার স্বামী রুখে দাঁড়াবে। কিন্তু আমার জীবনে এসবের কিছুই হয়নি। শুধু কি তাই? এখানে তো আমার স্বামীই আমার বিপক্ষে একটা কিছুর সুযোগ খুঁজে। যাতে সে আমার গায়ে হাত তুলতে পারে। এমন এক পরিবেশে নিষ্পাপ এক বাচ্চা নিয়ে এসে কি তার জীবন জাহান্নাম করে দিবো? এই কথার পরিপেক্ষীতে পলাশ কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আমি শুনলাম না। আমি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। পলাশ বোধহয় কিছুটা আহত হলো।


চলবে,

মরীচিকার সংসার পর্ব-০২

0

#মরীচিকার_সংসার (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

বাবা আমার শ্বশুড়বাড়িতে পা দিতে তাকে বসিয়ে আমার শ্বশুড়, শাশুড়ী, ননদ একের পর এক আমার দোষের গল্প বলতে শুরু করেছে। আমার শাশুড়ী মা বলছে,“আপনার মেয়েকে আমি কি দিয়ে জ্বা লাই? ভাতে জ্বা লাই নাকি কাপড়ে? সেই মেয়ে আমাকে আজ চোর অপবাদ দিচ্ছে। কাল তো আমাকে মে রে হাসপাতাল পাঠিয়ে দিবে।”

এই কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্বশুড় বলল,“আপনার মেয়ে আজ এই ঘটনা ঘটালো। কাল তো বড় কিছু ঘটাবে। বড় কোন দূর্ঘটনা ঘটার আগে আমি চাই আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে চলে যান।”
এসবের মাঝে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে বাবা। সে মাথানত করে সবার কথা শুনে যাচ্ছে। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। এক ঘন্টা যাবত বাবাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সবাই আমার দোষগুলো বললো।অতঃপর বাবা বলার সুযোগ পেয়ে নরম গলায় বললো,“আমার মেয়ের নাহয় একটা ভুল হয়ে গেছে। এই কারণে আপনারা তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিবেন। দেখুন ও ছোট মানুষ। ওর ভুল হয়ে গেছে। আপনারা ক্ষমা করে দিন।”

“সেই ক্ষমা ভাবী চেয়েছে? সে তো তখন থেকে আমাদের চোর বলে যাচ্ছে।”
আমার ননদের কর্কশ কন্ঠে বলা মিথ্যা কথাটি শুনে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। আমি বললাম,“আমি ক্ষমা চেয়েছি। বিনা কারণে ক্ষমা চাওয়ার পরও তোমরা আমার বাবাকে এই মাঝরাতে ডেকে পাঠালে। আবার মিথ্যা কথা বলছো। একের পর এক মিথ্যা দোষারোপ তো দিয়ে যাচ্ছো।”

“দেখেছেন আপনার মেয়ের স্বভাব। মুখে মুখে তর্ক করা অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনার বউ ম রার আগে তাকে কিছু শিখিয়ে যায়নি।”
আমার শাশুড়ী কথাটি বলে উঠলো। সেই সঙ্গে আমার স্বামী মহাশয় তাল মিলিয়ে বলে,“বড় ছোট কাউকে মানে না। আমার মায়ের মুখে মুখে অব্দি তর্ক করে বেড়ায় আপনার মেয়ে।”

পলাশ আজ আমাকে বারবার হতাশই করছে। আমার ভালোবাসা যে ভুল সেটা প্রমান করে দিচ্ছে। আচ্ছা স্বামী কি এমন হয়? কই। আমার বাবাকে তো দেখেছি সবসময় আমার মায়ের কথায় গুরুত্ব দিয়েছে। আমার মায়ের কোন ক্রুটি থাকলে সেটা সকলের সামনে গোপন করেছে। সংসার জীবনে আমার মায়ের শক্ত এক অবলম্বন হয়েছে। তাহলে পলাশ এমন কেন? এসব কথাবার্তা আমার বাবা বন্ধ করলেন। সে নরম গলায় বললেন,“আপনারা এবারের মতো রিমিকে মাফ করে দেন। সে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইবে। সেই সাথে আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, রিমির থেকে এমন কিছু আর হবে না।”

বাবার এই কথায় অবশ্য প্রথমে কেউ রাজি হতে চায়নি। তারা পারলে এখনই আমাকে এই বাড়ি থেকে তাড়ায়। তবুও বাবা অনেক অনুনয় বিনয় করে তাদের রাজি করালো। বাবার এই অসহায়ত্ব দেখে আমি খুব কষ্ট পেলাম। বাবাকে বাধা দিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু বাবা তার আর হতে দিলো না। আমাকে অনুরোধ করে বললো,“দয়া করে তুই এখানে আর কোন কথা বলিস না। যা বলছি তাই কর। সবার কাছে ক্ষমা চা। প্লীজ…।”

বাবার এই নরমস্বরে করা অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। বাবার কথামতো সবার কাছে ক্ষমা চাইলাম। সবাই অবশ্য এবার মেনে নিলো। সবার কথা শুনে মনে হচ্ছে, এই বাড়িতে তারা আমাকে দয়া করে থাকতে দিয়েছে। নয়তো আমার স্থান এখানে হওয়ার কথা ছিলো না।
__
বাবা চলে যাবার আগে আমার সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলেন। আমিও ঘরে আসলাম। বাবাকে আলাদা পেয়ে আমি বললাম,“বাবা এভাবে তুমি মাথানত করে তাদের সব অভিযোগ শুনলে? সত্যি মিথ্যা নিয়ে একটা কথা তুললে না? তাছাড়া আমাকে তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে বললে অথচ একবারও ঘটনা সত্যি কি-না তা জানতে চাইলে না? কেন বাবা?”

আমার এই কথার জবাবে বাবা অসহয় গলায় বলে,“ মা রে সংসার জীবন বড় কষ্টের। এখানে মানিয়ে নিতে না পারলে সব শেষ। সংসারে একসাথে থাকতে হলে এরকম সমস্যাগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। তাছাড়া মেয়ে মানুষের জন্য স্বামীর ঘরই সব। এখানে টিকে থাকতে না পারলে দিনশেষে সব দোষ মেয়েটারও হবে।”
বাবা একটু থেমে পুনরায় বলেন,“আমি জানি তুই সঠিক। তোর ননদের কানে আমি তোর মায়ের সেই চিরচেনা কানের দুল দেখেছি। কিন্তু এখানে আমার কিছু করার নেই মা। তোকে যদি আজ আমি ঝামেলা করে বাড়ি নিয়ে যাই তাহলে তোর কি হবে? আমি আজ আছি কাল নেই। তোর ভাই, ভাবী তোকে কতদিন দেখবে? এক মাস দুই মাস। তারপর যখন অতিষ্ট হয়ে পড়বে তখন তাদের তিক্ত কথাগুলো শুনে তোর মনে হবে এই সংসারটাই তোর জন্য ঠিক। অন্তত এখানে তোর নিজের সংসার। কেউ তোকে এটা বলতে পারবে না, অন্যের সংসারে বোঝা হয়ে আছিস। তাছাড়া এসব টুকটাক বিষয় এড়িয়ে যেতে হয়।”

“টুকটাক? আমার মায়ের কানের দুল?”
এই কথার জবাবে বাবা অসহয় মুখে আমার দিকে তাকিয়ে একটি হাসি দেয়। নরম গলায় বলে,“সংসারে থাকতে হলে বোবা এবং অন্ধ হয়ে চলতে হয়। এভাবে মানিয়ে নিয়ে, এড়িয়ে গিয়ে সংসার করে যা। তোর জন্য আমার এই পরামর্শই। আমি এখন আসি।”

“এই রাতের বেলা চলে যাবে? তাও শুকনো মুখে?”
এই কথার জবাবে বাবা মুচকি হাসলো। যে হাসির আড়ালে কষ্টগুলো লুকানো ছিলো। যেখানে বাবা হয়তো বলছে, তোর বাড়িতে আজ এত এত কথা গিলেছি যে পেটে জায়গার বড্ড অভাব। এই বাড়িতে রাতটা কাটালে যদি তোর তাতে দোষ হয়ে যায়, সেই ভয়ে রাত কাটালাম না। বাবার মনের এই কথাগুলো আমি বুঝতে পারলাম। তাই বাবাকে বাধা দিলাম না। তাকে যেতে দিলাম। শুধু আস্তে করে বললাম,“সাবধানে যেও বাবা।”


বাবাকে বিদায় দিয়ে শোবার ঘরে এসে বসলাম। পাশেই পলাশ শুয়ে আছে। আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে আমার দিকে ফিরে শুইলো। আমি তার দিকে তাকালাম না। যেই মানুষটা আমার নয় তার দিকে তাকিয়ে মায়া বাড়িয়ে লাভ আছে। পলাশ বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে,“তোমার বাবা দেখলে ঠিক বুঝলো। শেফার কানের দুলের সাথে তোমার কানের দুলের ডিজাইনটা কিছুটা মিলে তাই তুমি ভুল বুঝলে।”

আমি জবাব দিলাম না। পলাশ আবারও বলে উঠলে,“এটা তুমি আগে বুঝলেই হতো। তাহলে এত ঝামেলা হতো না।”
এই কথা শুনে আমি ম্লান হেসে বললাম,“তুমি এই কথাগুলো এই ঘরের বাহিরে না নিলেই হতো। তাহলে এতকিছু হতো না। এখানে দোষটা কার দিবো? কারোর না। দোষটা আমার কপালের।”
আমার এই কথায় পলাশ চুপ করে গেল। সে বিরক্ত হলো বোধহয়। তবে আমি কথা বাড়ালাম না। উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লাম। এতক্ষণ অব্দি নিজেকে সামলাতে পারলেও এবার পারলাম না। এবার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়তে থাকলো। আমি চেয়েও নিজের কান্না থামাতে পারছি না। এই সংসারে কাকে আপন ভাববো?ননদকে দোষ দিবো? শাশুড়ীকে দিবো? লাভ কি? যদি স্বামীই ঠিক না থাকে। এখানে তো আামর মহা শত্রু পলাশ। সে যদি আমার ভালোবাসা বুঝতো, আমাকে ভালোবাসতো তাহলে এসব কিছু হতোই না।

পলাশ আজ যা করলো তাতে আমার মনে তার জন্য থাকা ভালোবাসায় ভাঙন ধরে গিয়েছে। সেই ভাঙন আরও বেড়ে গেল তখন যখন আমি কান্না করছি বুঝতে পেরেও পলাশ আমার কাছাকাছি এলো। আমি বাধা দিতে চাইলে পলাশ বলে,“স্বামীকে না করতে নেই। এখন আমার ইচ্ছা করছে। আমাকে কষ্ট দিও না।”
যার জন্য আমি কষ্টে জর্জরিত। সেই মানুষটি আমাকে বলে তাকে জানো কষ্ট না দেই। নিজের বুকের কষ্টে বুকের ভেতর রেখে, নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পলাশের ইচ্ছে পূরণ করতে হলো। পলাশ জোর করে করলো। আমি যখন বললাম,“এখন না পলাশ।”

“চুপ। স্বামী হই তোর। যখন প্রয়োজন তখনই দিবি। বউ থাকতে আমি কি রাত পার করবো কষ্টে?”
এই কথা বলে কোন বাধা না শুনে পলাশ আমার সাথে মিলিত হলো। এটা তো শুরু ছিলো। এখান থেকেই সাংসারিক ঝামেলা, পলাশের গায়ে হাত তোলা, সব মিলিয়ে একটা ঝগড়া শেষে আবার সেই মানুষটিই রাতে কাছাকাছি চলে আসে। এমন এক জীবনের শুরু হয় আমার। বিবাহিত জীবনের আট মাসের মাঝেই এই তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম আমি। শুরু হলো সংসার নামক মরীচিকার খেলা। যাকে আমি আপন করতে চেয়েছিলাম। খুব আপন।

চলবে,

মরীচিকার সংসার পর্ব-০১

0

#মরীচিকার_সংসার (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আমার হারিয়ে যাওয়া কানের দুল ননদের কানে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দুই মাসের আগে শাশুড়ী মা আমার কানের দুল পড়ে এক অনুষ্ঠানে যায়। তারপর থেকে কানের দুল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজ সেই কানের দুল ননদের কানে দেখে ভীষণ অবাক হলাম। রাতে স্বামী বাড়ি ফিরলে। তার বুকে মুখ গুজে কান্না করে দিলাম। আমার কান্নার শব্দ পেয়ে আমার স্বামী নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,“কী হয়েছে? কান্না করছো কেন?”

“তুমি তো জানতে আমার কানের দুলগুলো আমার কত শখের ছিলো। আমার মায়ের শেষ স্মৃতি।”
এই কথা বলে আরও কান্নায় ভেঙে পড়লাম। স্বামী আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,“এখনো ঐ কানের দুলের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছো। দেখো যা হারিয়ে যায় তা যদি কান্না করলে ফেরত পাওয়া যাবে? মন খারাপ করো না।”

“তুমি জানো আজ আমি সেই কানের দুল তোমার বোনের কানে দেখেছি। হারিয়ে গেলে নাহয় মন খারাপ করতাম না। কিন্তু….।”
আমি কান্নায় কথাটি সমাপ্ত করতে পারলাম না। আমার স্বামী আমাকে পুরো ঘটনা খুলে বলতে বললো। অতঃপর আমি তাকে ভরসা করে সব বললাম। আমি নিশ্চিত আমার শাশুড়ী মা কানের দুল হারায়নি বরং সেটা তার মেয়েকে দিয়েছে। দুই মাসে আমি সব ভুলে গেছি ভেবে আজ ননদ সেটা পড়ে আমার সামনে অনায়েসে ঘুরলো। আমি কথাগুলো স্বামীকে খুব বিশ্বাস, ভরসা করে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম স্বামী আমার পাশে থাকবে। কিন্তু না। আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আমার স্বামী আমাকে তার বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে রাগান্বিত গলায় বলে,“তুই কি বলতে চাস? আমার মা, বোন চোর? তারা তোর ঐ দুই পয়সার কানের দুল চুরি করেছে?”

নিজের স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার স্বামী আবারও কঠিন গলায় বললো,“আমার মা, বোনকে তোর কি মনে হয়? তারা জীবনে সোনার জিনিস চোখে দেখেনি? যে তোর মনে হয় তারা তোর সোনার জিনিস চুরি করছে?”

“আমি সেটা বলতে চাইনি। আমি শুধু বলতে চেয়েছি….।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে আমার স্বামী অর্থাৎ পলাশ বলে,“আমি বেশ ভালোভাবে বুঝেছি তুই কি বলতে চাইছোস। দাঁড়া আমি আমার মা, বোনকে ডাকি। যা ফয়সালা হওয়ার তাদের সামনেই হোক।”
আমি পলাশকে থামাতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু পারেনি। সে এতজোরে চিৎকার, চেঁচামেচি করছিলো যে বাড়ির সবাই দরজার সামনে এসে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিলো। পলাশ দরজা খুলতে সামনে আমার শাশুড়ী এবং ননদ পড়লো। পিছনে শ্বশুড়ও দাঁড়ানো ছিলো। পলাশ সবার সামনে কোন ভণিতা ছাড়া জিজ্ঞেস করলো,“মা তুমি নাকি রিমির কানের দুল চুরি করে শেফাকে দিয়েছো?”

“কি?”
আমার শাশুড়ী মনে হলো আকাশ থেকে পড়লো। ননদ আরও এক ধাপ উপরে। সে সঙ্গে সঙ্গে কান্না করে দিলো। তারপর বলছে,“এমনিতে বাপের বাড়ি কম আসি। যাতে ভাবীর চোখের বিঁষ না হতে হয়। এখন দেখছি আসাই যাবে না। একেবারে সোজা চোর বানিয়ে দিলো আমাদের।”
ননদের সাথে তাল মিলিয়ে শাশুড়ী বললো,“এই দিন দেখার জন্য শখ করে ছেলের বউ নিয়ে আসছিলাম। আজ আমি কি-না চোর। শুনছো ওগো। আমি নাকি বৌমার কানের দুল চুরি করে শেফাকে দিয়েছি।”

শাশুড়ী এবং ননদ তাদের অভিনয় শুরু করে দিয়েছে। তারা নিজেদের ন্যাকা কান্না দিয়ে মূহুর্তে পরিবেশ অনেক জটিল করে তুলেছে। শাশুড়ী মা আমার কাছে এসে বলে,“বৌমা তোমার যদি শেফার কানের দুল পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে তুমি আমাকে বলতে পারতে। আমি তোমার দুল হারিয়েছি তার বিনিময় নাহয় শেফার দুলটা তোমায় দিতাম। তাই বলে এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিবা। আমাকে চোর বানিয়ে দিলে।”

“হ্যাঁ ভাবী। এই দুল যদি তোমার পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে তুমি রেখে দাও। তবুও আমাদের এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিও না।”
এই কথা শুনে পলাশ আমার দিকে রাগীচোখে তাকিয়ে বলে,“দেখলি তুই? এটা আমার মা, বোন। যাদের বিরুদ্ধে তুই অভিযোগ দিচ্ছিলো তারা তোকে এক কথায় দুল দিয়ে দিতে রাজি। আর তুই কি-না…।”
পলাশের এই কথার জবাব দেওয়ার মতো কোন শব্দ আমার কাছে ছিলো। থাকবে কিভাবে? যে মানুষটির হাত ধরে এই বাড়িতে এসেছি। সেই মানুষটির কাছেই আমার কথার গুরুত্ব নেই। আমি মিথ্যা বলছি মনে হচ্ছে। তখন তাকে কোন শব্দ বা বাক্য দিয়ে বললেও যে সে বুঝবে না এটাই স্বাভাবিক। আমি বুঝতে পেরে চুপ করে গেলাম। এটা দেখে শাশুড়ী মা বলে,“কি বৌমা এখন মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে কেন? মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার সময় তো চুপ ছিলে না। তা এখন চুপ কেন? কানের দুল পছন্দ হলে নিয়ে যাও। তাও দয়া করে চোর অপবাদ দিও না। আমরা চোর নই।”

“আম্মা আমার স্বামীই আমার কথা বিশ্বাস করছে না। সেখানে আমার কোন কথাই এখানে গুরুত্ব পাবে না। তবে আমিও জানি আপনিও জানেন ঐ কানের দুল আমার। আমার মাকে সারাজীবন আমি এই কানের দুল পড়ে থাকতে দেখেছি। আমার বিয়ের পর থেকে আমি পড়েছি। এই কানের দুল আমি চিনবো না সেটা হতেই পারে না।”
আমার এই কথা ঘরের মধ্যে বিস্ফোরকের মতো পড়লো। সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। এই কথা শুনে আমার শাশুড়ী মা শ্বশুড়কে উদ্দেশ্য করে বলে,“শুনলে বৌমার কথা? বৌমা আমাকে সরাসরি চোর বললো। আমি চোর?”

”বৌমা তুমি চাও কি? সংসারে কেন অশান্তি করছো? তোমার কানের দুল কেন শেফাকে দিবে তোমার শাশুড়ী? শেফার কি কম আছে?”
শ্বশুড় এই কথার বলার সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ী ফোঁড়ন কেটে বলে,“না তো। আমার মেয়েকে তো ভিখারি বাড়ি বিয়ে দিয়েছি। আমরা ভিখারি। একমাত্র তোমার বৌমা কোটিপতি। বাপের বাড়ি থেকে কোটি টাকার জিনিস নিয়ে আসছে। আমরা সেটা চুরি করেছি।”

“না আম্মা। আমার বাবার বাড়ি থেকে কোটি টাকার জিনিস হয়তো নিয়ে আসিনি। তবে অনেক মূল্যবান আমার মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে আসছিলাম। যেটা এখন শেফার কানে রয়েছে।”
এই কথা শুনে তৎক্ষনাৎ পলাশ একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয় আমার গালে। সবার সামনে পলাশ এভাবে আমার গায়ে হাত তোলায় কিছুটা হতভম্বই হলাম। পলাশ রাগান্বিত গলায় বলে,“তোর সমস্যা কি? আমার মা, বোন এই বাড়িতে না থাকুক সেটা চাস? সেজন্য তখন থেকে উল্টাপাল্টা কথা বলে যাচ্ছিস। তুই আমার মা, বোনকে চোর বলছিস?”

“তোর বউ তো এটাই চায়। আমি আমার মেয়ে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। তোর বউ একা রাজত্ব করুক। তাই বলে এভাবে চোর বললো। আমি কি চোরের জাত? তোর বউয়ের মতো চোরের জন্মা না আমি। যে চুরি করবো।”
আমি আর জবাব দিতে পারলাম না। শাশুড়ী এবং ননদের ন্যাকা কান্নার মাঝে আমার চোখের পানি সবার আড়ালেই রইলো। বিষয়টা এখানেই থামতে পারতো। তাদের ন্যাকা কান্না দেখে, পলাশের অবিশ্বাস দেখে আমিই বললাম,“আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দিন আপনারা। আমি হয়তো ভুল দেখেছি। হয়তো বা আমার মায়ের কানের দুলটা আজ আর আমি চিনতে পারছি না।”
এই কথার পর সব থামতে পারতো। কিন্তু থামলো না। আমার শাশুড়ী এবং ননদ বিষয়টিকে আরও বড় করলো। শাশুড়ী মা তো আমার জাত, পাত, বাবা, মা তুলে কথা বলতে শুরু করেছে। পলাশ নিরব দর্শকের মতো সব শুনছে। এক পর্যায়ে শ্বশুড় বললো,“বৌমার বাবাকে ফোন দাও পলাশ। সে এসে মেয়েকে নিয়ে যাক৷ নয়তো আজ চুরির অপবাদ কাল তো নির্যাতনের মামলা দিয়ে বাড়িতে পুলিশ ডাকবে। এই মেয়ের সাথে আমাদের একসাথে থাকা সম্ভব হবে না।”
আমার শ্বশুড়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে যখন পলাশ আমার বাবাকে ফোন দিলো আমার অনুরোধ উপেক্ষা করে তখনই আমি বুঝে গেছি, এই সংসারে আমার আপন বলতে কেউ নেই। আমার এই সংসারে আমার আমির অস্তিত্বই নেই। আমি বিষয়টিকে জটিল করতে না চেয়ে পলাশকে অনুরোধ করে বলেছিলাম,“না পলাশ। আমার বাবাকে ফোন দিও না। প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

“না। আজ তোমাকে ক্ষমা করে দিলে তুমি লাই পেয়ে যাবে। আজ চোর বানাচ্ছো কাল হয়তো বড়সড় কিছু করবে। তাই আজই এর বিচার হওয়া উচিত।”
সংসারে যে মানুষটির হওয়া উচিত ছিলো আমার শক্ত একটি খুঁটি। সেই মানুষটিই আমাকে নিয়ে বিচার বসাতে উঠে পড়ে লেগেছে। একটা মরীচিকার সংসারকে আপন করে, একজন ভুল মানুষকে ভালোবেসে এই সংসারে নিজের সবটুকু দিয়েছে আমি সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না আমার। আমার চোখের সামনে পলাশ আমার বাবাকে খুব কড়া ভাবে এই বাড়িতে আসতে বলে। এসে তার মেয়ের দোষগুলো শুনে যেতে বলছে।



চলবে,

ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0

#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_১০
#সমৃদ্ধি_রিধী

জুলাইয়ের দিনটা ছিলো শুক্রবার। বাইরে প্রচন্ড ঝড়। ঘর থেকে বাইরের দিকে তাকালে বুঝা যাবে না এখন দুপুর বারোটা। অহমি রান্নাঘরে মাত্র হাঁড়িতে ধুয়ে রাখা চাল-ডাল দিয়ে দিলো। খিচুড়ি রান্না করবে। অন্য চুলায় সামান্য তেল গরম করে ফিরোজা বেগমের রুমে গেল। বেশ কয়েকদিন যাবত ওনার পায়ে প্রচন্ড পরিমাণে ব্যাথা। ঔষধপত্র খেলেও লাভ হয় না। তেল মালিশ করে দিলে একটু স্বস্তি অনুভব করেন।

ফিরোজা বেগম ঘুমিয়েছিলেন। আগের মতো দাপট নেই। একা হাতেও সব কাজ সেরে ফেলতে পারেন না এখন। বিশেষ করে মাহিদের বাবা মারা যাওয়ার পর ভেঙে পেরেছিলো। মাহমুদ হুসাইন ছেড়ে গেলেও উনি তো ঠিকই ভালোবাসতেন। অহমি ওনার পায়ে হাত দিয়ে মালিশ করে দিতেই ফিরোজা বেগমের ঘুম ভেঙে গেলো।

“তোমার রান্না শেষ?”

“না, খিচুড়িটা করলেই শেষ। ”

ফিরোজা বেগম এমন মেয়ে পেয়ে মনে মনে খুবই সন্তুষ্ট। মেয়েটা শুরুতে কাজ-বাজ করতে না পারলেও এখন বেশ চটপটে হয়েছে।

“আম্মি আপনাকে ঘরেই খাবার দিয়ে দিবো?”

“নাহ, সপ্তাহে একটা দিন দুই ছেলের সাথে দুপুরের খাবার খেতে পারি। তুমি রেডি করে আমাকে ডাক দিয়ো, আমি তখন যাবো।”

“আচ্ছা।”

“মাহাব কোথায়?”

“আপনার ছেলের সাথে। চেপে ধরে হোমওয়ার্ক করতে বসিয়েছে।”

“পরে করালেই তো পারে। এই দুপুরে পড়াতে হবে না। আমার কাছে একটু পাঠাও তো। ”

অহমি ততক্ষণে পায়ে মালিশ করে দিয়েছে। ও ফিরোজা বেগমের রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে গিয়ে দেখে সেখানকার চিত্র ভিন্ন। মাহিদ বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে আছে। মাহাব মাহিদের পিঠের উপর উপুর শুয়ে দুইজন একসাথে কি যেন দেখছে।

“এই আপনাদের এই অবস্থা কেনো?”

মাহিদ মাহাবকে হাত দিয়ে ধরে সামনে এনে সোজা হয়ে বসে। মাহাব দৌঁড়ে মায়ের কাছে গিয়ে মাকে ঝাঁপটে ধরে। অহমি মাহাবের দু গালে চুমু খায়।

“কি বাবা? এতোক্ষণ আমার সাথে থেকে মাকে পেয়েই আমাকে ভুলে গেলে যে?”

“কারণ মা আমার ভীষণ প্রিয়।”

অহমি চমকে মাহিদের দিকে তাকায়। মাহিদও অহমির দিকে তাকিয়ে থাকে। অহমি মাহিদের তাকিয়ে বলে, “কি করছিলেন?”

“আমরা একসাথে কার্টুন দেখছিলাম।”

মাহাবও মাহিদকে নকল করে বলে, “আমরা একসাথে কার্টুন দেখছিলাম।”

অহমি মাহিদের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “ওর হোমওয়ার্কগুলো করিয়ে দিতে বলেছিলাম। ”

মাহাবও অহমিকে নকল করে বলে, “হোমওয়ার্ক করিয়ে দিতে বলেছিলাম।”

অহমি মাহাবের দিকে কড়া চোখে তাকাতেই ছেলেটা ভদ্র বাচ্চা হয়ে যায়। ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

মাহিদ হাসি হাসি মুখ করে বলে, “করবে আরকি। এই ‘ক’, ‘খ’ শিখতে এতো প্রেশার দেওয়ার কি আছে?”

মাহাব আবারও নকল করে বলে, “কি আছে?”

মাহিদ জোরে জোরে হেসে বলে, “তোমার ছেলের আমার বলা পুরো কথা মনে ছিলো না। তাই শেষের দুইটা কথা বলেছে খালি।”

এমন সময় মুগ্ধ ওদের রুমে আসে। এসেই মাহাবকে চিৎপটাং করে কোলে নিয়ে বলে, “এই আমার স্টেথোস্কোপ দে!”

মাহাব আর মুগ্ধ সবসময় ঝগড়া করে। মাহাব মুগ্ধর চুল টেনে বলে, “দিবো নাআআ। ওটা আমার। আমি ডাক্তার না?”

“তুই কিসের ডাক্তার?”

“আমি… আমি.. বাবা আমি কিসের ডাক্তার?”

অহমি হেসে উঠে ছেলের এমন কান্ডে। মাহিদ হাসতে হাসতে বলে, “ফাঁকিবাজির ডাক্তার।”

অহমি মুগ্ধ আবারও হেসে উঠে। এতে পাঁচবছরের মাহাবের খুব গায়ে লাগে। ও মুগ্ধর কোল থেকে জোর করে নেমে ফিরোজা বেগমের ঘরের দিকে দৌঁড়ে চলে যায়। মুগ্ধও পিছন থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়ে।

অহমিও রুম থেকে বের হবে এমন সময় মাহিদ ওর হাত ধরে আটকে দেয়। নিজের পাশে বসায়।

“তোমার ভাইয়া কল করেছিলো।”

অহমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কেনো?”

“তোমাকে যেতে বলেছে।”

“ওওহ! এখন কিভাবে যাবো? মাহাবের সামনেই পরীক্ষা। ”

“অহমিকা! তোমার কথা ঘুরানো আমি বুঝি।”

“আমার ভালো লাগে না ওই বাসায়। আমার স্বস্তি অনুভব হয় না। আমি কেনো যেখানে যাবো?”

“আম্মুর শরীর ভালো না।”

“ওনার ছেলে আছে না? আমাকে কি দরকার?” অহমি অভিমানী কণ্ঠে বলে।

“মাহাব যদি তোমার সাথে কথা না বলে তোমার কেমন লাগবে?”

“আমার আর মাহাবের বিষয় এক না।”

“আচ্ছা থাকতে হবে না। দেখা করে এসো। ”

“সময় পেলে যাবো।”

অহমি শক্ত মুখ করে বেরিয়ে যায়। মাহিদের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

__________________________________________

খাবার টেবিলে আরেক কাহিনি। মাহাবকে ফিরোজা বেগম খাইয়ে দিচ্ছেন। বাবা আর দাদুমণির কাছে খাবার খাওয়ার সময় মাহাব একদম শান্ত বাচ্চার মতো খায়। মায়ের কাছে খাবার খাওয়ার সময় ওর যত বাহানা।

মাহাবের মুখে এক টুকরা মাংস তুলে দিতেই মাহাব মাহিদের উদ্দেশ্যে বলে, “বাবা আপনাকে পানি দিবো?”

মাহিদ অতটা খেয়াল করেনি। স্বভাবতই না বলে।

ফিরোজা বেগম মাহাবের মুখে খিচুড়ি তুলে দিতে গেলে মাহাব বলে, “দাদুমণি আমাকে আবার মাংস দিন তো।”

উনি তাই করলো। মাহাব একটু পর মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলে, “চাচ্চু আমাকে বেগুন ভাজাটা দেন তো।”

“এই তুই এমন আপনি আপনি করছেন কেনো?”

“মাম্মাও তো বাবাকে আপনি বলে, দাদুমণিকে আপনি বলে। ফুপ্পিকে আপনি বলে। তাই আমিও বলবো।”

অহমি থতমত খেয়ে যায়। মাহিদ আড়চোখে অহমির দিকে তাকায়। অহমিও একবার মাহিদ আবার ফিরোজা বেগনের দিকে তাকায়। ফিরোজা বেগম হালকা হেসে যেন শাসিয়ে বললেন, “আমি আমার নাতির মুখে আপনি-আজ্ঞে শুনতে পারবো না। আমাকে আর মাহিদকে আর আপনি ডাকা যাবে না। ঠিক আছে?”

মাহাব মাথায় হাত দিয়ে বলে, “আয়হায় তাহলে কি আমি খালি ফুপ্পিকে মাম্মার মতো আপনি বলবো?”

সবাই আবারও হেসে উঠে। অহমি মাহিদের তিকে তাকিয়ে দেখে মাহিদ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। অহমি মাথা নিচু করে ফেলে। ঠোঁটের কিনারায় হাসি ফুটে উঠে।

__________________________________

অহমি নিজের একটা গল্প প্রকাশ করেছে। “অমাবস্যার ক্রিনিকোলাস।” মাহিদ ওকে গল্প লিখার জন্য একটা ছোট্ট টেবিল জানালার পাশে সেট করে দিয়েছে। অহমি রাত হলেই ওখানে বসে গল্প লিখে। অহমি কলম দিয়ে ডায়েরিটা বন্ধ করে বিছানার দিকে তাকালো। মাহিদ চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে। মাহাব বাবার বুকের উপর মুখ হা করে ঘুমিয়ে আছে। অহমি উঠে মাহাবকে ঠিক মতো শুইয়ে দিয়ে বাবা ছেলের গায়ে কাঁথা টেনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। খুব ঠান্ডা বাতাস বইছে।

চোখ বন্ধ করে বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিলো। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে ওর বাম পাশে মাহিদ। অহমি মাহিদের ডান হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখে।

“ঘুম আসছে না?”

“উহু।”

“কি করতে চাচ্ছো?”

“সারাজীবন এভাবে থাকতে চাই আতহার।”

“তোমাকে সেভাবে সময় দিতে পারছি না আগের মতো।”

“যেভাবে আছি ভালো আছি। এই একান্ত সময়টা খুব স্পেশাল।”

“আমরা এমন সময় কাটাতে পারছি কয়দিনই বা?”

অহমি উত্তর দেয় না। মাহিদ অহমিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাথার উপর মাথা রাখে। চুলের বাঁধন খুলে দিয়ে বলে, “মাহাবটা বড় হয়ে যাচ্ছে।”

“আমরাও বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।”

“হুম।”

“আপনার চুল..”

“অহমিকা!”

“ওওহ! তোমার চুল পেকে গেছে আতহার।”

“তুমিও খুব একটা ইয়াং নও আর। পাঁচ বছরের ছেলে আছে। সাইত্রিশ বছরের স্বামী আছে।”

” আমি আম্মির বয়সেও আপনার কাঁধে মাথা রাখতে চাই আতহার।”

“বেঁচে থাকলে অবশ্যই পারবে।”

অহমি মাহিদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মাহিদ বলে, “তুমি তো মাহাবের ভীষণ প্রিয়।”

“কারণ আমি তার বাবারও ভীষণ প্রিয়।”

“ভাগ্যিস একদিন আম্মিকে তোমার ভাইয়ের ফ্যামিলি ফটো দেখিয়েছিলাম।”

“ভাগ্যিস ভাইয়ার স্টুডেন্টকে বিয়ে করতে দ্বিমত করিনি।”

“তোমার সাথে থাকলে সময়টা ভালো কাটে। ”

“তোমার সাথে থাকলে দ্বিধা কাজ করে না। স্বস্তি অনুভব হয়।”

আরো কথা বলতে বলতে অহমি ও মাহিদ হেসে উঠে। অহমির কেনো কে জানে চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে! ওর খুব সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে।
_________________________________________

রাত তিনটা। পুরো রুম অন্ধকার। কেবল একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। রুম জুড়ে কেবল কলমের খসখস শব্দ। এই ডায়েরিতে কেবল অনেক কষ্টের, খারাপ লাগার দিনগুলোতে হাত দেওয়া হতো। তবে কেনো যেন আবার হাত দিতে ইচ্ছে হলো।

“আমি অহমিকা তাজরীন। মিসেস অহমিকা আতহার হুসাইন। জন্মের এক সপ্তাহ আগে বাবা মারা যাওয়ায় আমার তেইশ বছর পর্যন্ত তার মৃত্যুর দায়ভার আমার কাঁধে ছিলো। যার থেকে বিয়ের পর আমি মুক্তি পেয়েছিলাম। আমি ডায়েরিতে আমার মনের কথা লিখতাম। তখন শুনবার মতো কেউ ছিলো না। এখন আমার কাছে দুজন আছেন যারা আমার সব। ছেলেটা পুরোই বাবার মতো হয়েছে। আমি এতে খুব খুশি। আমি তাদের দুজনের ভীষণ প্রিয় একজন। আমাকে আর এখন গল্প ছাড়া অন্যকিছু ডায়েরিতে লিখতে হয় না। খারাপ লাগলেও একটা বুক থাকে আমাকে আগলে নেওয়ার জন্য। আরেকজন আছে যে আমাকে কাঁদতে দেখলে তার ছোট ছোট হাত দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেও ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে। আমি হাসলে ওরাও হাসে।

ভাইয়া, আম্মু আমাকে খালি ওই বাসায় যেতে বলে। আমার যেতে ইচ্ছে হয় না। কেমন যেন লাগে। ওদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও মন থেকে ক্ষমা করতে পারিমি বলেই হয়তো। আমি জন্মদাত্রী মা থেকেও আমার শ্বাশুড়ির সাথে বেশি ক্লোজ বলেই তাকে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না।
মাহিদও আমার মা-ভাইকে পছন্দ করে না। আম্মুকে আম্মু ডাকলেও ভাইয়াকে এখন স্যার বা ভাইয়া কখনোই ডাকে না। ওর নাকি কিছু সম্মোধন করতে রুচিতে বাঁধে। তবে সরাসরি অসম্মানও করে না। ওর যে ভাইয়ার প্রতি ভীষণ রাগ। কারণ তারা পারতো আমার শৈশবকে রঙিন করতে, তারা পারতো একটা সুস্থ জীবন দিতে।

এই ডায়েরিতে কেবল অনেক কষ্টের, খারাপ লাগার দিনগুলোতে হাত দেওয়া হতো। তবে কেনো যেন আবার হাত দিতে ইচ্ছে হলো। ইচ্ছে হলো খালি দুঃখের কথাই না লিখে এখানে কিছু সুখের কথা লিখি। এরপর আর এই ডায়েরিতে হাত দিবো না।

এখন আর ভুল করার প্রবণতা মনের মধ্যে কাজ করে না। অ্যাটেলোফোবিয়া মাহিদ সারিয়ে দিয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কথা শুনতে হয় না। আম্মি আমাকে সব শিখিয়ে দিয়েছে। রুমও অগোছালো থাকে না। মাহিদ আমাকে রুম ফিটফাট রাখনো শিখিয়ে দিয়েছে। আমিও নিজ থেকে কৌতুক বলতে পারি। এটা মুগ্ধ শিখিয়ে দিয়েছে। বড় কাউকে দেখে মিথ্যে সম্মান দিতে হয় না। মুনতাহা আপু শিখিয়ে দিয়েছে কি করে ভালোবেসে ছোটদের থেকে সম্মান পাওয়া যায়। আরেকজন ছোট সদস্য আছে যিনি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে মন খারাপ থাকলে ছোট ছোট হাত থেকে আদর পেয়ে মন ভালো করতে হয়।

আমি অহমিকা তাজরীন খুব ভালো আছি। আমার এই ডায়েরির বিভিন্ন পৃষ্ঠায় বিভিন্ন সময়ের খারাপ-কষ্ট-দুঃখ থাকার মুহুর্তের কথা লিখা থাকলেও ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় কোনো দুঃখের কথা লিখা নেই। আমি অনেক খুশি। অনেক সুখী। অহমিকার ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা তার আনন্দে ভরপুর।”

ডায়েরিটা বন্ধ হলো। ডেট লিখা হলো। সব পৃষ্ঠায় চোখের জল থাকলেও ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় ছিলো না। এই ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা অহমিকা তাজরীনের জীবনের অনেক অপ্রাপ্তির পরেও বৃহৎ প্রাপ্তির এক সামান্যতম অংশ মাত্র। যা তাকে এনে দিয়েছে তার অর্ধাঙ্গ, তার জীবনসঙ্গী।

_____________সমাপ্ত _____________

ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা পর্ব-০৯

0

#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৯
#সমৃদ্ধি_রিধী

আহির আর সাইফার বিয়ে, রিসেপশনের সব পার্ট গতকালের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। অহমি আগামীকালই মাহিদের বাসায় চলে যাবে। আপাতত আফরোজা বেগমের বাসায়ই আছে। মাহিদ, ফিরোজা বেগম আর মুগ্ধ গায়ে হলুদের দিন বিকলে এসেছিলেন। ফিরোজা বেগম, মুগ্ধ গতকালই রিসেপশনের অনুষ্ঠান শেষেই ফিরে গেছেন। কেবল অহমি আর মাহিদ আফরোজা বেগমের অনেক জোরাজোরি করায় থেকে যায়।

তখন সময় রাত এগারোটার মতো। অহমি ও মাহিদ মাত্রই ডিনার করে রুমে এসেছে। অহমির বাসায় তিনটা রুম। অনেক আত্মীয় স্বজন থাকার কারণে আহির আর সাইফাকে একটা রুম দিয়ে মহিলারা একরুমে ছিল, আর পুরুষরা আরেক রুমে ছিল। আজকে সকালেই ওদের সকল আত্মীয়রা নিজেদের বাসায় চলে যায়। এতে অহমি আবারও নিজের রুমটা ফিরে পায়। মাহিদ সকলে চলে যাওয়ার পর থেকেই বলছিল ‘রুমটা নিট এন্ড ক্লিন করে রাখো। এমনিতেও অনেকের সাথে একসাথে থাকার কারণে ঘুম হয়নি।’ অহমিও করবে করবে করে আর করেনি।

রুম দেখেই মাহিদের ভ্রু কুচকে যায়। বিরক্তিকর দৃষ্টিতে অহমির দিকে তাকায়। অহমি আমতাআমতা করে বলে, “আচ্ছা গুছিয়ে নিচ্ছি রুম। এভাবে তাকানোর কি আছে?”

“তোমার এই রুম কি কখনোই আমি ভালো অবস্থায় দেখবো না?”

অহমি বিছানার চাদর চেঞ্জ করতে করতে বলে, “এইবারই দেখছেন অগোছালো। এর আগে ছিলো না এমন।”

মাহিদ দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দরজার সাথেই হেলান দিয়ে বলে, “শুরু থেকেই এমন। যখন পড়তে আসতাম তখন মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখতাম তো রুমের অবস্থা। ”

“এই আপনি একটা মেয়ের রুমের দিকে আড়চোখে দেখতেন? ছিহঃ।”

“যাস্ট সাট আপ। তোমার ভাইয়ের রুমে ঢুকতেই তোমার রুম সামনে পড়ে৷ চোখ তো একবার দুইবার পড়তেই পারে না?”

” আমি তো রুমের দরজা লাগিয়ে রাখতাম।”

“হুম, তুমি যে কেয়ালফুল, সবসময় দরজা লাগিয়েই রাখতে।” ব্যঙ্গ করে বলে।

অহমি মাহিদের দিকে একবার ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফটাফট রুমটা গুছিয়ে ফেললো। মাহিদ বিছানায় বসে অহমির উদ্দেশ্যে বলে, “যাও, ঔষধের বক্সটা নিয়ে আসো।”

অহমির চোখ বড় বড় হয়ে যায়। শিট! ও তো ঠিকঠাক ঔষধ খায়নি। এবার!

“কি হলো নিয়ে আসো?”

“আমি খেয়ে নিবো তো।”

“আমাকে বক্সটা এনে দিতে সমস্যা?”

“আরেহ সমস্যা কেনো হবে? আমি খেয়ে নিচ্ছি।”

মাহিদের খটকা লাগে। মেয়েটাকে আগাগোড়া চিনে গেছে ও।

“অহমিকা। শুনবে না আমার কথা?” অত্যন্ত কড়া কণ্ঠে বলে।

মাহিদ সেই থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অহমির দিকে তাকিয়েই আছে। আর অহমি কাচুমাচু করে একবার মাহিদের দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে ফেলছে। অহমির ভয়ই হয় মাহিদের এহেন তাকানো দেখলে। এমন একবার দেখেছিল গাজীপুরের রিসোর্ট’টায়। এরপর সৌভাগ্যবশত দেখা হয়নি। আজ আবার এই রোষানল দৃষ্টির সম্মুখে পড়তে হচ্ছে।

মাহিদ অহমির দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবার ঔষধের পাতাগুলোর দিকে তাকায়। মাহিদ একসাথে বারোদিনের ঔষধ অহমির সাথে করে দিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে ও মাত্র পাঁচদিনের ঔষধ খেয়েছে। এই ঔষধগুলোর ব্যাপারে সর্তক থাকতে হতো। কিন্তু মেয়েটার এই বিষয়ে অবহেলা ওর সহ্য হচ্ছে না। নেহাৎ-ই মেয়েটা মাহিদের ভীষণ প্রিয়, তাই কড়াভাবে কিছু বলতে পারছে না।

“যা ইচ্ছে তাই করো।”

মাহিদ জেদের বশে হাতে থাকা ঔষধগুলো দূরে সরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অহমি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে রুমে লাইটটা নিভিয়ে দিলো। মাহিদ ওর দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে ছিলো। অহমি পিছন থেকে মাহিদের টি-শার্ট টানতে টানতে বলে, ” ঐ আর করবো না তো!”

মাহিদ অহমির হাত সরিয়ে দিলো। অহমি আরো কয়েকবার এমন হাত ধরে টানলো। নিজের দিকে ফিরানোর প্রয়াশ করলো। কিন্তু পুরুষের শক্তির কাছে কি পারা যায়? এবার অহমি মাহিদকে পিছন থেকে ঝাঁপটে ধরে পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বলে, “এই আতহার! আর করবো না! প্লিজ। এবার থেকে যা যা বলতে তাই তাই করবো।”

মাহিদ শক্ত কণ্ঠে বলে, “ছাড়ো, ঘুমাতে দাও।”

অহমির কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা। কম্পিত কণ্ঠে বলে, “প্লিজ আতহার! এভাবের মতো! লাস্ট!এরপর থেকে সব মেনে চলবো।”

“তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছো অহমিকা।”

আসলেই অহমি ওকে মিথ্যা বলেছে। প্রতিদিন রাতে মাহিদ ওকে ঔষধ খাওয়ানোর কথা মনে করিয়ে দিতো। প্রথম এক-দুইদিন নিয়মিত খেতোও। এমন হয়েছে যখন একেবারে ডিনার সেরে বিছানায় শুয়ে পড়ছে, তখন মাহিদ ওকে মনে করালেও আলসেমিতে খেতো না। এভাবেই অহমি ফাঁকিবাজিটা করতো।

“ওইটা তো যাতে বকা না শুনতে হয় তাই বলেছি।”

মাহিদের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর আসে না। অহমি মিনমিন করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে “আলসি লাগাতেই তো খেতাম না। আর মিস দিবো না। পাক্কা। ”

“তুমি হচ্ছো যে ‘যে কদু, সেই লাউ’ টাইপের মেয়ে।”

“না না! আমি সত্যি বলছি আর কখনোই আপনার কথার অবাধ্য হবো না। ”

“আচ্ছা, ঘুমাও এখন।”

“আপনি আমার দিকে ফিরুন আগে।”

মাহিদ এই মেয়ের সাথে বেশিক্ষণ রেগে থাকতেই পারে না। অহমির দিকে ফিরলেো। অহমি মাহিদকে জড়িয়ে ধরলেও মাহিদ ধরেনি। অহমি মাহিদের হাতটা নিজের পিঠে রেখে বলে, ” সরি বললাম না! আর করবো না।”

“আচ্ছা।”

“আপনার রাগ কমেনি না?”

“নাহ।”

এভাবে মুখের উপর কে বলে? বেশি বেশি সবসময়।

“আজব এমন মেয়েদের মতো রাগ করেন কেনো?”

এটা বলায় মাহিদ যেন আরো চটে গেল। অহমিকে ছেড়ে অন্যদিকে ফিরতে গেলে অহমি আবারও শক্ত করে ঝাঁপটে ধরে। নিচু কণ্ঠে বলে, “কি করতে হবে বলুন রাগ কমাতে?”

“যা বলবো তাই করবে?”

অন্যরকম স্বর। অহমি বুঝে এই টোনে কথা বলার অর্থ। পুরো রুম অন্ধকার থাকলেও অহমি মাহিদের গভীর চাহুনিও বুঝলো। ধীর কণ্ঠে কেবল বললো, “হুম।”

__________________________

সময় যেন এক অদৃশ্য চিত্রকর। মানুষের হাসি, কান্না, ভালোলাগা, বিচ্ছেদ সকলকিছুকে একত্রে ধারণ করে বয়ে চলে। বাস্তবতা, স্বপনের মিশেলে গল্প বুনতে থাকে। অহমির জীবন থেকেও এভাবে বছর দুয়েক কেটে গেছে। অহমির অর্নাস, মাসটার্স শেষ। সংসার জীবনেও পরিপক্বতা লাভ করেছে। প্রানোজ্জ্বল ভাবে দিন কাটাতে পারছে। এখন অহমি সবসময় ও সবকিছু ভুল করে এমন প্রবণতা থেকেও বেরিয়ে আসছে। ফিরোজা বেগমের সাথে থাকতে থাকতে অনেক কিছু শিখেছে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা শিখেছে। মাহিদের রুমও এখন সবসময় গুছানো থাকে। মোদ্দা কথা অহমির প্রতি কারো অভিযোগ করার সুযোগ থাকে না।

অহমি গতকালকে ও আজকে ভার্সিটির কাগজপত্র তুলতে হবে এমন মিথ্যে অযুহাত দিয়ে বাইরে একটা কাজে গিয়েছিল। সেই যে আটটায় বের হয়েছিল বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে বারোটা বেজে যায়। মাহিদের বোন মুনতাহা ও ওনার পাঁচ বছরের মেয়ে মেহাও অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে এসেছে এই দেড় মাস হবে। ওনার হাসবেন্ড এসেছিলেন, তিনি একমাসের মতো থেকে আবার অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন। এবার মুনতাহা চলে যাওয়ার সময় ফিরোজা বেগমকেও সাথে নিয়ে যাবে। ফিরোজা বেগম টুরিস্ট ভিসায় ঘুরে আসবেন। মেয়ের সাথে লম্বা একটা সময় থাকা হবে।

এক্সট্রা চাবি দিয়ে বাসায় ঢুকেই মুগ্ধকে দেখে অবাক হলো। কিছুদিন পরই ওর মেডিকেল এডমিশন। এখন তো আসার কথা ছিল না! আগে থেকে বলা থাকলে তো জানতে পারতো। মেহা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে। অহমি মুগ্ধর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, “মুগ্ধ তুমি এখন বাসায়?”

মুগ্ধর চোখ-মুখ বসে গেছে। গ্লাসে পানি ঢেলে খেলো। অহমির আবারও প্রশ্ন করলো, “তোমার কি শরীর খারাপ? কি হয়েছে?”

মুগ্ধ মাথা নিচু করে রুমের দিকে যেতে যেতে বলে, “তুমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে নিও।”

অহমি অনেকটাই অবাক হলো। মুগ্ধ ওকে কখনোই ইগনোর করে না। তাহলে আজ এমন করলো কেনো? এতক্ষণে মেহা অহমির গলা পেয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। অহমি মেহার দিকে তাকাতেই মেহা অহমিকে জড়িয়ে ধরে। বলে, “মামিমণি খিদে পেয়েছে।”

বিদেশী বাচ্চাগুলোর কথা শুনতেও কিউট লাগে। কিভাবে যেন ভুলভাল আধভাঙ্গা উচ্চারণে বাংলা বলে। তবে অবাক হলো মেহার তো এতোক্ষণ না খেয়ে থাকার কথা না।

“মাম্মা খাইয়ে দেয়নি?”

“নাহ। নানুমণি আর মাম্মা শুধু কান্না করে।”

অহমির ভ্রু কুচকে গেলো। মুগ্ধর চোখ মুখের এমন অবস্থা। আম্মি আর মুনতাহা আপুই বা কাঁদে কেনো? মেহাকে এই বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না।

মেহার গালে হাত দিয়ে বলে, “মেহা তাহলে এখন কি খাবে?”

মেহা গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবার ভঙ্গিতে কি কি যেনো চিন্তা করে। তারপর এক গাল হেসে বলে, “ইন্সটেন্ট নুডলস।”

অহমি মুচকি হাসি দিয়ে আর রুমে না গিয়ে ড্রয়িংরুমের সাথে লাগোয়া কমন ওয়াশরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুঁয়ে আসে। বাইরের পরিধেয় পোশাক পড়েই মেহাকে নুডলস রান্না করে দেয়। মেহাও টিভি দেখতে দেখতে নুডলস খেতে থাকে।

মুনতাহারা আসার পর থেকে ফিরোজা বেগমের সাথেই থাকেন। তাই অহমি ফিরোজা বেগমের রুমের দিকে গেলো। সেখানকার চিত্রও বড় অদ্ভুত। ফিরোজা বেগম নিরবে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন। মুনতাহা ফিরোজা বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পর শরীরটা কেঁপে উঠলো। বুঝাই যাচ্ছে কাঁদছে।

“আম্মি আসবো?”

অহমির কণ্ঠস্বর শুনে মুনতাহা উঠে বসে। ফিরোজা বেগম অনুমতি দিতেই অহমি রুমে ঢুকে বলে, “কোনো সমস্যা আম্মি? আপনি, আপু, মুগ্ধ সকলের অবস্থা এমন কেনো? কিছু হয়েছে?”

ফিরোজা বেগম কাঁদেননি, তবে উনি যেন অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন। অহমি এবার মুনতাহার উদ্দেশ্যে বলে, “আপু ভাইয়া ঠিক আছে?”

মুনতাহা জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বলে, “হুম। তুমি মাহিদের কাছে যাও।”

অহমির খারাপ লাগে। ওকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না কেনো? বিস্ময়ের সুরে বলে, “উনি বাসায়?”

“হুম যাও রুমে আছে।”

অহমি কিছু না বলে রুমে আসে। মাহিদের শরীর খারাপ করলো কিনা! রুমে আসার পর অবাকই হয়েছে। মাহিদ ফ্লোরে খাটের সাথে হেলান দিয়ে হাঁটুর উপর রাখা দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে বসে আছে। অহমি আঁতকে উঠে। সকলের এই অবস্থা কেনো?

অহমি মাহিদের সামনে গিয়ে ওর মুখটা উঁচু করে ধরে। চুলটা এলোমেলো হয়ে আছে।

“এই আতহার! কি হয়েছে? এমন করছেন কেনো সকলে?”

মাহিদ অহমিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ওর কাঁধে মুখ গুজে রাখে। অহমির বড্ড ভয় হয়। চাকরিক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়েছে? বলছে না কেনো? ওর তো সবাইকে একটা খবর দেওয়ার আছে।

“এই বলেন না কি হয়েছে? এমন করছেন কেনো?”

মাহিদের গলা কাঁপে। অহমি মাহিদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

” প্লিজ আতহার কিছু বলুন না! আমার সত্যিই খুব ভয় লাগছে।”

” আজকে আমরা চারজন আমাদের জীবনের এমন একজনকে হারিয়েছি যাকে আমরা খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু তিনি আমাদের মূল্য দেননি। তাকে মনে মনে প্রচন্ড ঘৃণা করলেও আজ আমি ঘৃণা করতে পারছি না! পারছি না! আমার খুব খারাপ লাগছে অহমিকা। এমন আমার কখনো মনে হয়নি। ওনার জানাজায়ও আমরা যেতে পারিনি। অথচ ওখানে আমার আর মুগ্ধর অধিকার ছিলো সবচেয়ে বেশি।”

অহমি কয়েক মুহুর্তের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যায়। ধীর কণ্ঠে বলে, “আপনার বাবা?”

মাহিদ ওকে আরো শক্ত করে ধরে। অহমি কিছুক্ষণ মাহিদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “কিভাবে মারা গেলেন?”

মাহিদ সেসবের উত্তর দিলো না। নিজের মতো প্রলাপ বকতে লাগলো।

“আমি স্বীকার না করলেও তাকে খুব ভালোবাসতাম। আজকে যখন হসপিটালে রক্তমাখা লাশটা দেখলাম বিশ্বাস করো দুনিয়ায় সবচেয়ে অসহায় লাগছিলো নিজেকে। ওনার সেকেন্ড ওয়াইফ, অবৈধ বাচ্চা সবাই ছিলো শুধু আমার, মুগ্ধর সামনে যাওয়ার অধিকার ছিল না।”

অহমি অস্পষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “মুগ্ধ? ”

“উনার অবৈধ ছেলে মুগ্ধর সাথেই পড়ে। ওই ছেলের থেকেই মুগ্ধ প্রথমে খবর পায়। তারপর মুগ্ধ আমাকে কল করে জানায়। এবং কাকতালীয়ভাবে আমার হসপিটালের সামনেই এক্সিডেন্টটা হয় এবং কয়েকজন ওনাকে নিয়ে আসে। প্রায় আধা ঘন্টার মতো নাকি বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পড়ে ছিলো। আমার বায়োলজিকাল ফাদার নাকি বেওয়ারিশ লাশ! হাহ।”

মাহিদ আর কথা বলতে পারে না। সকালে হসপিটালের করিডরে এমন অবস্থা দেখবে কল্পনাও করতে পারেনি। এক্সিডেন্টে স্পটেই মারা গেছেন। অহমি কখনো বাবাকে অনুভব করতে পারেনি। হয়তো দেখলে, তার সান্নিধ্য পেলে কিছুটা অনুভব করতো। তাই বাবাকে মিস করে কিনা ও বলতে পারে না। কিন্তু মাহিদের যে বাবার প্রতি অনেক ভালোবাসা ছিল তা বোঝাই যাচ্ছে।

“মাহমুদ হুসাইন ওয়াজ আ কাওয়ার্ড। হি লেফ্ট আস। বাবা হওয়ার মতো কেনো যোগ্যতাই উনার ছিলো না। উনি জীবিত অবস্থায়ও আমাদেয় শান্তি দেননি, মরে গিয়েও দিচ্ছেন না।”

অহমি মাহিদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, “মৃত মানুষকে নিয়ে এইসব বলতে নেই। বাদ দিন।”

অহমি কেবল মাহিদের মাথায় বুলিয়ে দিতে থাকে। মাহিদ অহমিকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। দু’হাতে মুখ ভালোভাবে মুছে। বলে, “আম্মি আপুর কাছে যাওয়া উচিত। ওনার জন্য কষ্ট পেয়ে লাভ নেই। ওনার মতো বাবা করো না হউক। কারো অবস্থাও আমাদের মতো যেন না হয়।”

অহমি মাহিদের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে, “উনার মতো কেউ হবে না। আপনিও খুব শিঘ্রই একজন চমৎকার বাবা হবেন। আমাদের সন্তানের অবস্থা আপনাদের মতো হবে না।”

“হুম,,, কি বললে?”

অহমি মাথা উঁচু নিচু করে হ্যাঁ বোঝালো। মাহিদ নিজের হাতটা অহমির পেটে ছুঁইয়ে বলে, “তুমি সিউর?”

“হুম টেস্ট করিয়ে এসেছি। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, তাই বলিনি।”

মাহিদ অহমির দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলে, “আমি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছি না।”

অহমি মাহিদকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলে, “অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে না। এমনভাবে ভালোবাসলেই হবে।”

“আমি তোমায় ভালোবাসি না। বাবাও নাকি আম্মিকে ভালোবাসতো। যে ভালোবাসায় ছাড়ার ক্ষমতা থাকে আমি তা করি না।

আমি তোমায় ভালোবাসি না। তবে অনুভব করি। তুমি আমার ভীষণ যত্নের একজন। তুমি আমার ভীষণ প্রিয় একজন।”

একটু থেমে বলে, “তুমি, তোমরা আমার ভীষণ প্রিয়।”

চলমান……

ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা পর্ব-০৮

0

#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৮
#সমৃদ্ধি_রিধী

অহমির ইচ্ছে হলো মাহিদের মাথায় একটা বাড়ি মারতে। তাও শান্ত দৃষ্টিতে মাহিদের দিকে তাকিয়ে ওদের গ্রুপটার পিপল ওপশানে গিয়ে সাতজনের গ্রুপটার সকলের নাম বের করলো। তারপর মাহিদের দিকে মোবাইল তাক করে বলে, “এইযে এখানে আমার নাম অহমিকা তাজরীন, আর আমার আরেকটা ফ্রেন্ডের নাম তাজরীন আহমেদ। সাবিহা সেই তাজরীনকে ট্যাগ দিয়েছে। আমাকে ওরা অহম বলেই ডাকে।”

মাহিদ হা করে রয়। হুদাই চোটপাট করলো নাকি? ছোট করে বলে, “সরি!”

অহমি একবার ভাবলো এমন মাতব্বরির জন্য আর খাবারের অফার দিবে না। তাও শান্ত স্বরে বললো, “টেবিলে খাবার দিচ্ছি। ভদ্র ছেলের মতো খেতে আসেন।”

মাহিদও অহমির পিছন পিছন ডাইনিং টেবিলে গেলো। অহমি দুটো প্লেটে খাবার বাড়ছে। মাহিদ হাত ধুঁয়ে নিজের জায়গায় বসতে বসতে বলে, “নয়টা বা দশটা বাজলে খেয়ে ফেলতে পারো না? আমার জন্য লেট করার মানে হয় না।”

সব হচ্ছে কথা বলার অযুহাত। বিয়ের নবম দিনের মাথায় মাহিদ বলেছিলো- লাঞ্চ তো একসাথে করা হয় না তবে অহমি যে ওর জন্য বসে থাকে, তারপর একসাথে ডিনার করে মাহিদের ওইটা খুবই ভালো লাগে। অহমি মুখে খাবার তুলতে তুলতে ধীমে কণ্ঠে বলে, “আচ্ছা কালকে থেকে আম্মির সাথে খেয়ে ফেলবো।”

ফিরোজা বেগম সবসময় নয়টা থেকে দশটার ভিতর ডিনার সেরে ফেলেন। আগে মাহিদের জন্য ঘুমে ঝুঁড়তে ঝুঁড়তে এগারোটা বা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ওয়েট করে তারপর ঘুমাতে যেতেন। এখন আর ঘুমে ঝুঁড়তে হয় না ওনাকে। উনি খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। অহমিই এখন রাতের রান্নাঘরের বিষয়ে সবটা সমলায়।

মাহিদ মাত্রই মুখে খাবার তুলতে যাচ্ছিলো। অহমির এমন কথা শুনে থতমত খেয়ে যায়।

“সত্যিই খেয়ে ফেলবে?”

“হুম।”

“আমি কি তাহলে একা ডিনার করবো?”

“তা তো করতেই হবে। আম্মির সাথে খেয়ে ফেললে আমি তো আবার আপনার সাথে ডিনার করতে পারি না।”

“আমি একা খেতে পছন্দ করি না, জানো না?”

“ওমাহ আপনিই না বললেন লেট করার দরকার নেই?”

“ওইটা তো কথা বলার জন্য বলেছিলাম।”

অহমির হাসি এলেও টুপ করে তা গিলে ফেলে। মাহিদ বাম হাতে মাথা চুলকে বলে, “আচ্ছা সরি আর ভুলভাল বকবো না।”

অহমি চুপচাপ খেতে থাকে। মাহিদ কাচুমাচু করে বলে, “কিছু তো বলো?”

“চুপচাপ খাবার খান। অহেতুক ঝামেলা করা লোকদের আমার ভালো লাগে না।”

“আচ্ছা তাহলে পরেরবার ঝামেলা করার সময় তোমার থেকে খোঁজখবর নিয়ে ঝামেলা করবো।”

কিসব কথাবার্তা! অহমির সব হাসি যেন মুখে একসাথে আসছে। অনেক বর মুচকি হাসি দিয়েও তা গিলে ফেলে। তবে এখন আর থাকতে না পেরে খুব জোরেই হেসে ফেলে। মাহিদ ছোট ছোট চোখ করে বলে, “মজা করছিলে?”

অহমি মাথা উপর নিচে করে হ্যাঁ বুঝায়। বলে, “প্রথমে ভেবেছিলাম রাগ করবো।পরে ভাবলাম আমার জন্য কেউ জেলাসিতে কয়লা হয়ে গেলে খারাপ কি? ভালেবাসার বহিঃপ্রকাশই তো।”

অহমি একটু থেমে বলে, “ওহ ভালো কথা। আপনি কখনো ভালোবাসার কথা বলেননি।”

“এইসব কথা বলতে হয় না। অনুভব করাই যথেষ্ট।”

“বললে সম্পর্ক মজবুত থাকে।”

“উহু বললে নজর লাগে। একে অপরের যত্ন নিলেই তো হয়। এতো বলতে হবে কেনো? যা মুখে মুখে বেশি ভালোবাসি-ভালোবাসি করে তারাদের ভিতর ফাঁপা থাকে।”

“বাবাহ! ভালোবাসার উপর পিএইচডি করেছেন মনে হচ্ছে।”

“অবশ্যই। যে ভালোবাসাকে ভালোবেসে আগলে রাখে, সেই ভালোবেসে তার ভালোবাসাকে সরাসরি প্রকাশ করে না। অনুভব করাতে সাহায্য করে।”

“এইসব কি ভালোবাসা আর ভালোবাসা!!”

মাহিদ হেসে আবারো বলে, ” ভালোবাসা ভালোবেসে তাকে ভালোবাসায় ভালোবাসাকে বেঁধে রাখে যে।”

“আমি আর ভালোবাসার কথা শুনতে চাইবো না। প্লিজ থামুন।”

মাহিদ হেসে আবারও বলে, “ভালোবাসা ভালোবাসাকে ভালোবাসতে ভালোবাসে।”

অহমি হাসতে হাসতে বলে, “আর নিতে পারছি না। প্লিজ। কিন্তু পয়েন্ট হচ্ছে সাইক্রিয়াটিস্ট এমন কবি হলো কি করে?”

মাহিদও হালকা হাসে তবে তার ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। রাতের খাবার খেতে খেতে টুকটাক কথাবার্তা বলে। সময়টা ওদের ভালোই কাটে।

_______________________________________

তার পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার সকালে মুগ্ধ না বলে হুট করে বাসায় আসে।ওর নাকি বাসার খাবার খেতে মন চাচ্ছিলো। ছেলেটা মাত্রই দুই মাসের মতো হোস্টেলে থাকছে। খাবারের সাথে এডজাস্ট হতে পারছে না। তাই অহমি, ফিরোজা বেগম বিভিন্ন ধরনের ইটেম রান্না করেছে। আবার বিকালের দিকে অহমি রান্নাঘরে পিজ্জার ডে তৈরি করছিলো। এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠলো। মাহিদ, মুগ্ধ টিভি দেখছিলো। মুগ্ধ দিয়ে দরজা খুলে। আফরোজা বেগম আর আহির এসেছে। মুগ্ধ চেঁচিয়ে ভাবিকে ডেকে পাঠায়। অহমি হাত ধুঁয়ে জামার ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বের হয়। মা- ভাইকে দেখেই অবাক হয়।

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। ফিরানিতে গিয়েছিল। মাত্র একদিন থেকে চলে এসেছে। মাঝের বারো-তেরো দিন পর মা ভাইকে দেখে মনে হলো কতদিন পর এসেছে। আহিরের বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয়েছে। পরের শুক্রবারে। ওনারা মাহিদদের দাওয়াত দিতে এসেছেন। একই সাথে একটা আর্জি নিয়ে হাজির হয়েছেন। ওনারা আজকে সাথে করে অহমিকে বাসায় নিয়ে যেতে চান। আফরোজা বেগম ফিরোজা বেগমের থেকে অনুমতির আাশায় চেয়ে আছেন। ফিরোজা বেগম একবার মাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার সমস্যা নেই। ভাইয়ের বিয়েতে বোনের থাকাটা উচিত। মাহিদ তোমার কি মতামত?”

মাহিদ আড়চোখে একবার অহমির দিকে তাকায়। মাথা নাড়িয়ে বলে, “আমার সমস্যা নেই। অহমিকা যেতে চাইলে অবশ্যই যাবে।”

আহির অহমির দিকে তাকিয়ে বলে, “যাবি আজকে আমাদের সাথে বাসায়? কোনো সমস্যা হবে?”

অহমি মাথা নিচু করে মাথা ডানে-বামে নাড়ে। অর্থাৎ, সমস্যা নেই। মাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে। ভেবেছিলো ওর দিকে তাকালে ইশারা দিয়ে বোঝাবে এতো তাড়াতাড়ি যওয়ার দরকার নেই। কিন্তু মেয়েটা তো তাকালোই না।

ফিরোজা বেগম অহমির দিকে তাকিয়ে বলে, “তাহলে গোছগাছ করে ফেলো। ঘুরেও এসো, আনন্দ করো। ভালো লাগবে।”

আফরোজা বেগম ফিরোজা বেগনের উদ্দেশ্যে বলেন, “ভাবি আপনারা যাবেন না? মুগ্ধ আর আপনিও..”

অহমি আর ওখানে দাঁড়ালো না। মাথা নিচু করে রুমে এসে আলমারি থেকে কয়েকটা নতুন শাড়ি আর জামা বের করে। ওই বাসায় তো ওর সব জামা কাপড় আছেই। খুব বেশি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।একটু পরই মাহিদ রুমে আসে। দরজাটা বন্ধ করে না, তবে হালকা করে চাপিয়ে রাখে। অহমি মাত্র ব্যাগ গুছিয়ে চেন মারছিলো। মাহিদ ওর হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নেয়।

“চলে যাচ্ছো যে?”

“আপনি বললেন না কেনো কিছু? তাহলেই তো যেতে হতো না।”

“আমি কি বলতাম গুরুজনের সামনে? আমি আমার বউ ছাড়া থাকতে পারবো না? তাও বিয়ের সতেরোদিনের মাথায়?”

অহমি মাহিদের হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নেয়। বলতে মন চাইলো, “কেনো বিয়ের সতেরোদিনের মাথায়ই বউ ছাড়া থাকতে পারবেন না এটা মানতে খারাপ লাগবে?”

কিন্তু দায়সারাভাবে বললো, “আমি কি জানি?”

“আমি এতটা নিলজ্জ নাহ। তাছাড়া বড়দের সামনে বেফাঁস কথাবর্তা বলা আমার পছন্দ না। এইসব থাকাথাকির কথা বলা বড্ড বেমানান।”

“হুম,, যেতে হবে আমাকে।”

” তাই বলে এতো তাড়াতাড়ি যাওয়ার কি দরকার?”

“ভাইয়াকে নিষেধ করতাম?”

মাহিদ উত্তর দেয় না। ভাইয়ের বিয়েতে বোনের এক সপ্তাহ আগে যাওয়াটা অযৌক্তিক না। অহমির গালে হাত দিয়ে বলে,

“সাবধানে থাকবে। কেউ কিছু বললে গায়ে মাখবার দরকার নেই।”

অহমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। মাহিদ সময় নিয়ে একটা বড় বক্সের মধ্যে অহমির যাবতীয় ঔষধগুলো গুছিয়ে রাখে। তারপর ঔষধের বক্সটা অহমির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

” ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখো। প্রতিদিন সকালে আর রাতে মনে করে খাবে। তুমি তো জানোই কোনটা কখন খেতে হয়। ওহহো তোমার তো আবার ঔষধ খাওয়ার কথা মনে থাকে না।”

অহমি ঔষধের বক্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে। গাদা গাদা ঔষধ খেতে ভালো লাগে না ওর। তারচেয়ে বড় কথা ঔষধ খাওয়ার কথা মনে থাকে না। তাই ঔষধের প্রসঙ্গ এড়াতে বলে,

“আপনি কবে যাবেন?”

” বুধবারে নাহলে বৃহস্পতিবারে চেম্বার থেকে একেবারে যাবো।”

“এতো দেরীতে?”

“শ্বশুরবাড়িতে ছেলেদের এতোদিন থাকতে নেই।”

“বলেছে আপনাকে!” অহমি ব্যঙ্গ করে বলে।

“তোমার ভাইয়া তো আম্মি আর মুগ্ধকেও দাওয়াত দিয়েছেন। আমি আম্মি আর মুগ্ধকে নিয়ে একেবারে বুধবার রাতেই আসবো। ঠিক আছে?”

অহমি মাহিদকে জড়িয়ে ধরে। “মিস করবো।”

“রাতে কল দিলে রিসিভ করো। একবার রিং হতেই যেন রিসিভ করা হয়। তোমার তো আবার কেউ কল দিলে কাকে কি বলবে তা ভাবতে ভাবতেই সময় পার হয়ে যায়।”

একটু থেকে বলে, “তবে পিজ্জাটা খাইয়ে প্লিজ যেও।”

______________________________________

অহমি বাড়ি এসেছে আজ তিনদিন। বাসায় আবার বিয়ের আগেকার সময়ের মতো ছিল। রুম গুছানোর কোনো ঝামেলা ছিল না। যখন ইচ্ছে খেয়েছে, ঘুমিয়েছে। মাহিদ হাসবেন্ড হিসেবে চমৎকার, তবে সিঙ্গেল লাইফটাই দারুণ। নিজের মতো খাও-দাও, ঘুমাও। কেউ অসময়ে ঘুমানোর জন্য চেঁচামেচি করে না। মেডিসিন নিলে নাও, না নিলে নেই। রাতে দেরীতে ঘুমাও, সকালে বারোটায় ঘুম থেকে উঠো, হু কেয়াস!
যদিও মাহিদ ফ্রি হলেই কল করে। আবার রাতে অনেকক্ষণ কথা তো বলেই।

অহমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়েছিল।
এমন সময় দরজায় আহির নক করে। অহমি উঠে বসে। আহির ধীর পায়ে এসে বিছানায় অহমির পাশে বসে। চোখ-মুখে দারুণ হতাশা, আত্মগ্লানি। আফরোজা বেগমও গত পরশু মেয়ের কাছে অনেক কান্নাকাটি করেন। অহমি প্রতিবারের মতোই নির্বিকার ছিলো। মাকে শান্ত মুখে কেবল সাত্ত্বনা দিয়ে গেছে। তা ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে। যাক গে সেসব কথা।

“কিছু বলবে ভাইয়া?”

“ভালো আছিস?”

অহমি অবাক হয়। কি ধরনের প্রশ্ন এগুলো? ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, “হুম ভালো আছি।”

আহির হঠাৎ ফ্লোরে বসে অহমির হাত দুটো আগলে ধরে, “তোর সাথে খুব অন্যায় করেছি না?”

অহমি কিছু বলতে পারে না। নিরবে তাকিয়ে থাকে।

“আম সরি অহম। সরি ফর এভরিথিং। তোর ছোটবেলাটা এভাবে নষ্ট না করলেও পারতাম৷ আমি জানি না কেন, আমার মাথায় তখন কাজ করেনি তোর সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত নয়। ভাবতাম দাদি যা বলতো তাই ঠিক। কখনো মাথায় আসেনি এতটুকু মেয়েও একটা সুস্থ পরিবেশ ডিজার্ভ করে।”

আহির থেমে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমি বাবাকে অনেক ভালোবাসতাম। সবার স্কুলে বাবা যেতো, সেইসব দেখে আমার সত্যি কষ্ট হতো।দাদি যখন বলতো তোর জন্য বাবাকে হারিয়েছি, তোর জন্য সবার মতো আমারও বাবা নেই। তখন আমার খুব কষ্ট হতো। আমার মধ্যে একধরনের জেদ কাজ করতো তোকে কিভাবে কষ্ট দেওয়া যায়।”

অহমির চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কণ্ঠস্বর আটকে যায়। তবুও যেন অনেক কষ্টে বলে, “বাবা তো আমারও ছিল না। মাকে থেকেও পায়নি।”

আহির এবার অহমির হাতে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদেই ফেলে। “আমার কোনো অধিকার ছিলো না তোর লাইফটা নষ্ট করার। আমাকে মাফ করে দে। আমি এই দুইদিন কি করে ছিলাম কেবল আমিই জানি। আমার..”

অহমি ভাইয়ের মুখটা উপর তুলে চোখ মুছে দেয়। “তোমাকে এভাবে মানায় না ভাইয়া।”

অহমি আহিরের এইসব কথাতে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। আহির আর অহমির মধ্যে অনেক দূরত্ব। আহির এতোদিন না বুঝলেও এখন বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। কম্পিত কণ্ঠে বলে, “তুই আমাকে মাফ করবি না?”

“এইসব ভুলে যাও ভাইয়া। আমিও মনে রাখবো না। তবে ক্ষমা করতে পারবো কিনা জানি না। আমাকে এগুলো আর মনে করিয়ো না। আমার অস্বস্তি হয়।”

আহির আরো কিছুক্ষণ ওইভাবে থেকে চলে যায়। খুব আফসোস হচ্ছে। অন্যান্য ভাই-বোনের মতো কেনো নয় তারা! অহমি দরজাটা বন্ধ করে দরজায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে। বিড়বিড় করতে থাকে, ” সরি সবকিছুর সমাধান হয় না ভাই। যদি হতো সরি দিয়েই সব সমস্যা সমাধান হয়ে যেতো তাহলে সমস্যা, অভিযোগ নামে কোনো ওয়ার্ডই থাকতো না। কি হবে তোমার সরি দিয়ে?তোমার সরিতে আমি আমার শৈশব আবার ফিরে পাবো?”

অহমির ফোনে একবার কল এসে কেটে যায়। তবুও ও এভাবেই দরজার সাথে লেগে থাকলো। কেনো ওকে বারবার ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দেয়? ও যে এইসব ভালো লাগে না!

চলমান…..

ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা পর্ব-০৭

0

#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৭
#সমৃদ্ধি_রিধী

মাহিদ তার কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই অহমি মাহিদের শার্টের কলার খামছে ধরে। একই সাথে মাহিদের গলার কাছটার চামড়ার ছিলে যায়। অহমি মাহিদের কলার ঝাঁকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আপনি কোন সাহসে আমার ডায়েরিতে হাত দিয়েছেন? আপনাকে আমি কোনো অধিকার দেয়নি আমার ডায়েরিতে হাত দেওয়ার। কেনো করেছেন?”

মাহিদের গলার বাম সাইডটা পুরো জ্বলে গেল। সে ওইসব পাত্তা দিলো না। অহমির হাত কলার থেকে ছাড়িয়ে দুটো হাত ধরে বলে, “আমি তোমার হাসবেন্ড। আমার রাইট আছে তোমার বিষয়ে সবকিছু জানার।”

অহমি ছটফট করতে থাকে। মাহিদ অহমির গাল দু হাতে আগলে ধরে বলে, “দেখো আমার কাছে লুকানোর মতো কিছু নেই। তুমি মন দিয়ে আমার কথা শুনো তারপর….”

মাহিদ তার কথা সম্পূর্ণ করতে পারে না। অহমি ওর বুকে অনবরত কিল-ঘুষি দিতে দিতে হবে, “আপনি আমার অনুমতি ছাড়া কেনো আমার ডায়েরিতে হাত দিবেন? আমি আপনার কোনো কথাই শুনবো না।”

মাহিদ অহমিকে আগলে ধরে বলে, ” শান্ত হও। আমার পুরো কথা শুনো। আমাকে বলতে দাও।”

অহমি আরো ছটফট করে। মাহিদ এক কাজ করে বসলো। দৃঢ়ভাবে অধরে অধর ছুঁইয়ে দিলো। অহমির ছটফটানিও কমে গেল। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ফ্লোরে বসেই মাহিদের বুকের সাথে মিশে রইলো। সংকীর্ণ কণ্ঠে বলে, “আপনার আগে আমার থেকে পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।”

মাহিদ চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, “হাসবেন্ডদের পারমিশন নিতে হয় না।”

তারপর মাহিদ অহমির চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলে, “অহমিকা কেউই কখনো পারফেক্ট হয় না। যদি পারফেক্ট হতোই তাহলে ‘মানুষ মাত্রই ভুল’ প্রবাদটা কিন্তু আসতো না।”

একটু থেমে অহমির দিকে তাকায়। অহমিকে এতো দ্রুত শান্ত করা যেতো না। আহির যেহেতু বিয়ের দিন অহমির অ্যাটেলোফোবিয়া থাকার আশঙ্কা মাহিদকে জানিয়েছিল, মাহিদ তাই শুরু থেকেই একটু একটু করে অহমির বিশ্বাস, ভরসা, স্বস্তির জায়গা হওয়ার প্রচেষ্টা করেছে। এমনকি ও হতেও পেরেছে। একজন সাইক্রিয়াটিস্ট হিসেবে এই কাজ খুব একটা কঠিন ছিল না মাহিদের জন্য।

মাহিদ অহমির মাথার উপর মাথা রেখে আরেকটু শক্ত করে ধরে বলে, “তুমিও পারফেক্ট হবে না, আমিও হবো না ৷ ভয় পেয়ো না। তুমি মানুষ, যন্ত্র না। আমরা ভুলগুলো ঠিক করে নেবো।”

অ্যাটেলোফোবিয়ার রোগীকে একটু সান্ত্বনা দেওয়াই যথেষ্ট। অহমি স্থির হয়ে রয়। মাহিদকে ওর শুরু থেকেই ভালো লাগে। ওর সাথে থাকলেই অহমির কেমন শান্তি শান্তি লাগে। কিন্ত এবার অহমি ফুঁপিয়ে উঠে। বলে,” আমি কিছু পারি না বলে আম্মু কথা শুনাতো। ভাইয়া কথা শুনাতো। এখন আম্মিও আমাকে বলে। আপনিও কথা শুনান। কালকেও কথা শুনিয়েছেন। ”

মাহিদ কপালে অধর ছুঁইয়ে বলে, “আর বলবো না। সরি বউ।”

“আপনারা সব কথার কথা বলেন। ঠিকই পরে আমাকে কথা শুনাবেন। আমি জানি।”

“কেনো তোমাকে কথা শুনাবো?”

“আমি ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে থাকতে পারি না। ভালো রাঁধতে পারি না। আরো কতকি! যা করি তা-ই তো ভুল।”

“নাহ, তুমি অনেক ভালো রাঁধো। আম্মির পরে তোমার রান্না আমার প্রিয়। আপু তো নিজের বিয়ের সময় কিছুই করতে পারতো না। সেই হিসেবে তুমি ভালোই বাঁধো। আর তোমার সব ভুল নয়। তুমি সুন্দর করে গল্পও লিখতে পারো। এগুলো এক্সট্রা অডিনারি কোয়ালিটি অহমিকা। তাছাড়া মানুষ ভুল করে কিন্তু যা করে তা-ই ভুল হয় না।”

“তারপরেও আপনি কথা শুনাবেন।”

“কেউ শুনাবে না।”

“শুনাবেন আমি জানি। আপনি আমার ডায়েরি পড়ে ফেলেছেন। আপনি আমাকে এখন ক্রিন্জ ভাববেন। আমি পুরোই ওয়েটলেস হয়ে গেলাম।”

“কিছুই হয়নি। হাসবেন্ড ওয়াইফের একজন আরেকজনের সম্পর্কে সবকিছু বা কোনো পাস্ট জানলে কিছুই হয় না।”

“হয়, আপনি মনে মনে ঠিকই একদিন ভাববেন কেমন পাগল ছাগল বিয়ে করেছেন। আমাকে মনে মনে ঠিকই ছোট চোখে দেখবেন।”

“তারমানে তুমিও আমার বাবার ইন্সিডেন্টটার জন্য আমাকে ছোট চোখে দেখো? তুমিও তাহলে ভাবো এর বাবা এমন
ক্যারেক্টারলেস,তাহলে ছেলেও এমনই হবে।”

” না, না আমি তেমন কিছুই ভাবি না।” অহমি তড়িঘড়ি করে
বলে।

“আমিও তেমন তোমাকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবিও না, ভাববোও না। ”

“আপনি আমাকে এখনই সরি বলবেন। আমার অনুমতি না নিয়ে কেনো ডায়েরি পড়েছেন?”

“কোনো সরি ফরি বলবো না। আমার হকের জিনিস নিয়ে এতো কিসের অনুমতি? তাছাড়া কাব্যিক কথা আছে না কিছু! ‘যাহা তোমার তাহাই আমার’। তুমি আমার ব্যাপারে সবকিছু জানতে পারো, তবে আমিও পারবো।”

অহমি শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ ওইভাবেই থাকে। মা, ভাই কেনো ওকে ওইভাবে বুঝাতো না, বুঝতো না! অহমি হঠাৎই মাহিদকে ধাক্কা দিয়ে উঠে যায়। বলে, “যতই সান্তনা দেন না কেনো, আমি ভুলবো না আপনি আমার অনুমতি না নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়েছেন।”

অহমি চোখ-মুখ মুছে রাগে গজগজ করতে করতে বাথরুমে চলে যায়৷ মাহিদ অহমির এই কান্ড দেখে মাথা চুলকে নিরবে হেসে ফেলে। নিজেও উঠে বেলকনিতে চলে যায়। যদি বাইপোলার ডিসওর্ডার থাকতো তাহলে অহমি এত দ্রুত শান্ত হয়ে যেতো না। যেহেতু হাইপার হয়ে গেছিলো সো ওইটা ম্যানিক এপিসোড। আর ম্যানিক এপিসোডে রোগীকে এত দ্রুত শান্ত করা যায় না। মাহিদ মন প্রাণে চাইলো অহমির যেন বাইপোলার ডিসওর্ডার না থাকে।
________________________________________

খাবার খেতে বসে অহমি মাহিদকে পুরোপুরি ইগনোর করে গেলো। তবে সর্বোচ্চ খাতিরযত্ন করে খাইয়েছে। মাহিদ অনেকবার কথা বলতে চেয়েছে, কিন্তু অহমি কেবল হু-হা করেই গেছে। অহমি রান্নাঘর থেকে বাসনপত্র ধুয়েমুছে রুমে এসে আড়চোখে একবার মাহিদের দিকে তাকালো। লোকটা আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। অহমি সত্যি সত্যি রাগ করেনি, তবে রাগ করার ভান করে আছে। লাভ কি হলো? মাহিদ তো একবার সরি টরি বলে মানাতেও এলো না!

রাগে গজগজ করতে করতে একেবারে ফ্রেশ হয়ে লাইট নিভিয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ড্রিম লাইট অবশ্য জ্বালালো। মাহিদের এই ড্রিম লাইট খুবই অপছন্দের । তারউপর ও বই পড়ছিলো। লাইটটা নিভালো কেনো? তাও কিছু বললো না। চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিজেও শুয়ে পড়ে।

অহমি মাহিদের দিকে পিঠ করে শুয়েছিল। মানে ছেলেটা অনুমতি না নিয়ে ডায়েরি পড়েছে, এখন অহমি সে বিষয়ে রাগ করেছে কিন্তু মাহিদ কি করলো! ও এখনও মানাতেও এলো না? ঘুমিয়ে গেছে নাকি? ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মাহিদের দিকে তাকালো। ওমাহ ছেলে ওর দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। অহমি চট করে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। মাহিদ চট করে ওকে পিছন থেকে ঝাঁপটে ধরলো। কানের পিছনে অধর ছুঁইয়ে ধীমে কণ্ঠে বলে, “রাগ তো করোনি, তাও কেনো এমন করছো?”

অহমি কণ্ঠে কৃত্রিম তেজ এনে বলে, “কে বলেছে রাগ করিনি?”

“আমি জানি আমার অহমিকা আমার সাথে রাগ করতেই পারে না।” আরো জোরে আঁকড়ে ধরলো।

অহমি দমে গেল। মাহিদ ওকে এতো ভালো করে বুঝে কি করে? মাহিদের সাথে মিশে রইলো। হঠাৎ মনে আসতেই বলে,
“আমার ডায়েরিগুলো আমাকে দিবেন না?”

“নাহ।”

“ওমাহ কেনো?” অহমি জোরালো কন্ঠে বলে উঠলো।

“ওই ডায়েরিতে লিখতে হবে না আর। এখন থেকে যা যা মনে আসবে, সব আমাকে বলবে। কোনো দু:খের কাহিনি লিখতে হবে না। সুখ-দুঃখ যে কথাই থাকুক না কেনো, আমাকে বোলো।”

অহমির মুখ কুচকে গেল।
“সব বলা যায় নাকি?”

“চাইলেই বলা যায়। আমি তোমার তালতো ভাই না যে বলা যাবে না।”

“আমার গল্পের ডায়েরি?”

“সেটা দিয়ে দিবো। কিন্তু একটা কথা দিতে হবে। কালকে আমার সাথে একবার আমার চেম্বারে যেতে হবে।”

অহমি মিনমিন করে বলে, “আচ্ছা সেটা করবো, কিন্তু প্লিজ ডায়েরিগুলো ফিরিয়ে দিয়েন৷”

“কিছুতেই না।”

“আপনি খুব খুব খারাপ।”

“হুম, সেটা প্রায় রাতেই শুনি। নতুন কিছু বলো।”

অহমি বেশ লজ্জা পেলো। মুখ দিয়ে শব্দ বের করতে পারলো না। মাহিদও আর শব্দ করলো না। একটার মতো বাজে। এখন আর বেশি কথা বাড়ানের মানে হয় না। চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
__________________________________________

তার পরদিন অহমি মাহিদের সাথে গিয়ে বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল টেস্ট, ব্লাড টেস্ট করে এসেছিল। এবং মাহিদের পরবর্তী সন্দেহ সঠিক হয়। অহমির সিমটোমসগুলোকে ও বাইপোলার ডিসওর্ডার এর সাথে তুলনা করেছিল অতিরিক্ত মুড চেঞ্জ হয় বলে। অহমির বাইপোলার ডিসওর্ডার নেই, তবে ভিটামিন বি-টুয়েলভ এবং ভিটামিন ডি এর একত্রে ঘাটতি হওয়ার কারণে অতিরিক্ত মুড সুইং এর প্রবলেম হচ্ছনিয়মিত মেডিসিন নিলে এটা ঠিক করা যাবে। আর মাহিদ ডিসিশন নিয়েছে অহমিকে “টক থেরাপি বা সাইকোথেরাপি ” দিয়ে নিজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করবে।

মাহিদ মাত্রই ওর চেম্বার থেকে ফিরেছে। রুমে ঢুকেই দেখতে পেলো অহমি বই পড়ছে। ওর অর্নাস ফাইনাল ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তাই নিয়মিত সংসারের পাশাপাশি টুকটাক পড়াশোনাও করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । অহমি বই এর মাঝে এতটাই মনোযোগী অবস্থায় ছিল, মাহিদের উপস্থিতি টের পায়নি। মাহিদ ওয়ারড্রব থেকে টি-শার্ট আর টাউজার নিয়ে ধাম করে বাথরুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। অহমি প্রায় লাফিয়ে উঠলো।

ডিভানের উপর রাখা কালো ব্যাগটা দেখে বুঝতে পারে মাহিদ
এসেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে এগারোটার মতো বাজে। সাধারণত মাহিদ বৃহস্পতিবার এতো দেরীতে তাড়াতাড়ি বাসায় আসে না। আজকে কেনো এলো? পেশেন্টের চাপ নেই নাকি? তারউপর ভদ্রলোক এমন রেগে আছে কেনো? মাহিদ বাথরুম থেকে বের হতেই অহমি মাহিদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাহিদ অহমিকে পাশ কাটিয়ে বেলকনি থেকে টাওয়ালটা নিয়ে আসে। অহমির ভ্রু কুচকে যায়। এমন করছে কেনো?

অহমি বলে, “আপনি কি রেগে আছেন? ”

“নাহ!”

মানে রেগে আছে। অহমি মনে করার চেষ্টা করে সে তো কিছু করেনি। তাহলে এমন রেগে আছে কেনো? মাহিদ গিয়ে বিছানার উপর আধশোয়া হয় মাথার চুল মুছতে থাকে। অহমি মাহিদের টি-শার্টের হাতাটা টেনে বলে, “আচ্ছা, ডিনার করতে আসেন।”

মাহিদ অহমির হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে দেয়। রাগে ফোসফোস করতে করতে বলে, “তোমার সিফাতকে খাওয়াও।”

অহমি হতভম্ব হয়ে যায়। মাহিদ ওর দিকে রোষানল দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে।

“এই সিফাত আবার কে?” অবাক সুরে প্রশ্ন করে। মাহিদ আবারও রোষানল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়।

“আরেহ আমি আসলেই চিনি না।”

মাহিদ উত্তর দেয় না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চুল মুছতে থাকে। অহমি হাত থেকে টাওয়ালটা কেড়ে দেয়। মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,

“এই,, সিফাত কে? আমি চিনিও না।”

“মিথ্যা বলছো কেনো?”

“সত্যি! মিথ্যা বলবো কেনো?”

“অহমিকা ভুলে যেও না, তোমার আইডি আমার মোবাইলেও লগ ইন করা।”

“হ্যাঁ তো!”

মাহিদ খাটের পাশে থাকা ছোট্ট টেবিলটার উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে অহমির দিকে কড়া দৃষ্টি দিয়ে বলে, “তোমার পুরা নাম কি?”

অহমি অবাক। আজ মৃধা ওর জায়গায় থাকলে সিউর প্রশ্ন করতো, “আপনি কি ম*দ খাইছেন?না গা*জা?” তবে অহমি সোজাসাপ্টাই উত্তর দিলো, “অহমিকা তাজরীন।”

মাহিদ গ্রুপের মেসেজ কনভারসেশনে গিয়ে কি যেন সার্চ দিয়ে অহমির দিকে মোবাইল তাক করে বললো, “এখানে সাবিহা কেনো তাজরীনকে ট্যাগ দিয়ে বলবে’আজকে তোর ক্রাশ সিফাতকে দেখলাম’? এটা তো তুমিই না?”

অহমির ইচ্ছে হলো মাহিদের মাথায় একটা বাড়ি মারতে। তাও শান্ত দৃষ্টিতে মাহিদের দিকে তাকিয়ে ওদের গ্রুপটার পিপল ওপশানে গিয়ে সাতজনের গ্রুপটার সকলের নাম বের করলো। তারপর মাহিদের দিকে মোবাইল তাক করে বলে, “এইযে এখানে আমার নাম অহমিকা তাজরীন, আর আমার আরেকটা ফ্রেন্ডের নাম তাজরীন আহমেদ। সাবিহা সেই তাজরীনকে ট্যাগ দিয়েছে। আমাকে ওরা অহম বলেই ডাকে।”

চলমান…..

ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা পর্ব-০৬

0

#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৬
#সমৃদ্ধি_রিধী

ছয়টা ডায়েরি তো একসাথে পড়া সম্ভব নয় তাই মাহিদ একটা ডায়েরি নিয়ে পড়া শুরু করেছিল। দুর্ভাগ্যবশত মাহিদ গল্প লিখার ডায়েরিটা পড়ে। মাহিদ অহমির লিখা গল্পগুলো পড়ে অবাকই হয়েছিল। মেয়েটার এমন সুপ্ত প্রতিভাও থাকতে পারে মাহিদ তা কল্পনাও করেনি। মাহিদ জীবনে একাডেমিক বই ছাড়া অন্য কিছু পড়েনি। এখনও কেবল নিজের পড়াশোনা, কাজ আর পেসেন্ট রিলেটেড জিনিসপত্রই পড়ে। আর এই মেয়ের লেখা সবকিছুই হাই কেয়ালিটির। এইজন্য অবশ্যই বেশ রিসার্চও করতে হয়েছে। প্রায় ওর দু’ঘন্টা মতো লেগেছে পুরো গল্পের ডায়েরিটা শেষ করতে। ডিনারের সময় হয়ে যাওয়ায় অন্য ডায়েরিগুলো পড়ার সময় পায়নি।

ডিনার শেষ হওয়ার পর মাহিদ রুমে এসে প্রথমে আলমারির কিছু অংশের জামাকাপড় এলেমেলো করে ফেললো। অহমির প্যান্টিং এর জিনিসপত্র থেকে রং একটু নিয়ে খাটের পায়ার কাছের ফ্লোরটায় মেখে নিলো। অহমির চুল ঝড়ে রুমের ফ্লোরে পড়ে থাকে বলে মাহিদ ওকে চুল আঁচড়ে ঝরে যাওয়া চুল একটা পলিথিনে ভরে রাখতে বলেছিল। অহমিও তাই করে কথা মতো। মাহিদ সেই পলিথিন থেকে কয়েকটা চুল নিয়ে বাথরুমের দেয়ালে, সাবানে রেখে দিলো। আহির ওকে অ্যাটেলোফোবিয়ার কথা বললেও মাহিদ নিজে তা পরীক্ষা করে দেখতে চায়। বাকিটা অহমির রুমে আসার পর দেখা যাবে। কিন্তু সাড়ে এগারোটা বাজার পরও যখন অহমি রুমে আসে না। মাহিদ এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করতে থাকে। রুমের এই অবস্থা দেখে ওর গা খিটখিট করছে যেন। মাহিদ তাই কিচেন থেকে ধরে-বেঁধে অহমিকে আনতে গেল।

আর বাইপোলার ডিসওর্ডার আছে কিনা সেটা মাহিদ অহমির আচার-আচরণ দেখে পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও বাকিটা একদিন নিজের চেম্বারে নিয়ে ডিএসএম-ফাইভ, স্ক্রীনিং টুলস ব্যবহার করে সিউর হয়ে নিবে। আর যদি অহমির বাইপোলার ডিসওর্ডার না থাকে তবে ব্রেন টিউমার, ভিটামিন বি-টুয়েলভ এবং ডি এর ঘাটতির ফলে মুড চেঞ্জের প্রবলেম হতে পারো। অথবা হাই-থাইরয়েডের প্রবলেমও হতে পারে। টেস্ট করতে হবে। এইসবের লক্ষণও যেহেতু বাইপোলার ডিসওর্ডারের সাথে মিলে, তাই মাহিদ সিউরলি বলতে পারছে না অহমির এটা আছে নাকি নিছক ওর সন্দেহ।

__________________________________________________

অহমি ব্যবহৃত থালাবাসনগুলো ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে চোখ বুজে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। আজকেও মাথাটা চিনচিন করে ব্যাথা করেই যাচ্ছে। ঔষধ খেতেই হবে এমন অবস্থা।

“তুমি এখনও রুমে যাওনি যে?”

অহমি চোখ খুলে দেখতে পায় মুগ্ধ পানির বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অহমি তো বলতে পারে না তোমার ভাই এর পল্টিবজির জন্য যাবো না।

“এইতো যাচ্ছি।”

মুগ্ধ ওর পাশে সোফায় বসে বলে, “তোমার কি শরীর খারাপ?”

“তেমন কিছু না, মাথা ব্যাথা করছে। ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“আরেহ ঔষধ খেতে হয় না। তুমি আইসক্রিম খেয়ে দেখো মাথা ব্যাথা পুরো গায়েব হয়ে যাবে। নিয়ে আসবো? ফ্রিজে আছে এক বক্স।”

অহমি স্মিত হেঁসে বলে, “লাগবে না। তাছাড়া কালকে হোস্টেলে চলে যাবে। এখন এতকিছু করতে হবে বা। গিয়ে ঘুমিয়ে পরো।”

মুগ্ধ চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, “উফ তুমি খেলে আমিও খেতাম।”

“এই না। হোস্টেলে গিয়ে ঠান্ডা-কাশি বাঁধানোর দরকার নেই। ঘুমচাপ গিয়ে ঘুমাও।”

“মুগ্ধ ঘুমাতে যা।”

হঠাৎ মাহিদের কণ্ঠস্বর শুনে মুগ্ধ আর অহমি দুইজনই চমকে উঠে। মাহিদের কণ্ঠে অত্যন্ত গাম্ভীর্যের ছোঁয়া ছিল। সচারাচর মাহিদ এতোটা ক্ষুব্ধ থাকে না। মুগ্ধ তাই কিছু না বলে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। হাসি-ঠাট্টার সম্পর্ক হলেও মুগ্ধ ভাইকে ভালোই ভয় পায়।

“অহমিকা তুমিও রুমে এসো।” অহমিও দিরুত্তর না করে মাহিদের পিছন পিছন রুমে প্রবেশ করলো। মাহিদ দরজা লাগিয়ে মুখটা যথাসম্ভব কঠিন করে বলে, “তোমাকে আমি কতোবার বলেছি রুম সবসময় গুছিয়ে রাখতে? তাও এমন অগোছালো হয়ে থাকো কেনো?”

প্রথমত মাহিদ এমন কড়া সুরে সেই গাজীপুরের ঘটনার পর একবারও কথা বলেনি। দ্বিতীয়ত, ও তো রুম গুছিয়েই রাখার চেষ্টা করে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে সুধায়, “রুম তো গুছানোই। জায়গার জিনিস জায়গা মতোই রাখা।”

মাহিদ এবারও বেশ কড়া সুরে অহমির হাত টেনে আলমারির কাছে নিয়ে অগোছালো হয়ে থাকা জামাকাপড় দেখিয়ে বলে, “তাহলে এগুলোর এই অবস্থা কেনো?কাপড়চোপড় এভাবে রাখা আমার পছন্দ নয় জানো না?”

অহমি অবাক হয়ে বলে, “আমি এগুলো সত্যিই করিনি। তাছাড়া কালকেই তো সবকিছু গুছালাম।”

“তাহলে আমি করেছি? তোমাকে ইচ্ছা করে দোষ দিচ্ছি? ”

অহমির মুখটা কালো হয়ে গেল। ধীমে কণ্ঠে বলে, “আচ্ছা আমি গুছিয়ে রাখবো।”

“সে নাহয় গুছাবে, ফ্লোরের রং এর দাগ, সবান, দেওয়ালে যে চুল লাগানো সেগুলো কে করবে?”

অহমি আনমনে বলে ফেললো, “আচ্ছা আমি এখনই সব ঠিক করে দিচ্ছি।”

তবে অহমির পুরোটা সময় মনে হচ্ছিলো ও তো সবকিছু ঠিকঠাক করেই রেখেছিল। কিন্তু কনফিডেন্সের সাথে বলতে পারেনি। অহমি পুরোটা সময় ভ্রু কুচকে কাজ করতে লাগলো। সাবানে চুল লাগার বিষয়টাতে ওর বেশি সন্দেহ হচ্ছিলো। আবার ভাবলো ভুলে কোনো কারণে মনে হয় করে ফেলেছিল। কিন্তু প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করার কারণে আর বেশি একটা ঘাটলো না বিষয়টা।

মাহিদ তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। ও অহমির সব আচরণ, গতিবিধি বেশ সুক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষণ করছিলো। অহমি কাজগুলো শেষ করে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছে রুমে এসে বিছানায় বসতেই মাহিদ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠে,” তুমি একটা কাজও ঠিকঠাক করতে পারো না। পারফেকশন নামে কোনো ওয়ার্ডই তোমার কাছে নেই। এইযে বিছানায় ভিজা টাওয়ালটা রাখলে চাদরটা ভিজে গেলো না?”

অহমির গলা মনে হয় চেপে ধরলো। হাত-পা গুলো ঠান্ডা হয়ে গেলো। একেই তো প্রচন্ড মাইগ্রেনের ব্যাথা। তারউপর মাহিদের এমন কথা। গা কাঁপতে কাঁপতে বিছানার কিনারা থেকে ফ্লোরে পড়ে গেলো। মাহিদ নিজের বিস্ময় প্রকাশ করার অবকাশটুকুই পায়নি। “ওওহ শিট!” বলে দৌড়ে অহমিকে ফ্লোর থেকে টেনে তুলে। অহমির চোখ দুটো শান্ত, নিষ্প্রাণ। কেবল চোখের কিনারায় পানি চিকচিক করছে।

__________________________________

দুপুর ২টা। লাঞ্চ আওয়ার। মাহিদ আজ লাঞ্চের জন্য খাবার আনেওনি আর ক্যান্টিনেও যাচ্ছে না। হসপিটালের ক্যাবিনের ডেক্সের উপর রাখা পেপারওয়েট’টার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পাশেই স্তুপ আকারে অহমির ডায়েরিগুলো রাখা। মাহিদ ওগুলো সবগুলো পড়েছে। এবং ওর অনেক বেশি রিগ্রেট হচ্ছে অহমির ব্যাপারে পুরো সবটা না জেনে গতকালকের স্টেপটা নেওয়া। সাধারণত ওরা পেসেন্টের ফ্যামিলি মেম্বার বা খোদ পেসেন্ট থেকেই তাদের সম্পর্কে আগে জেনে তারপর ট্রিটমেন্ট করে। কিন্তু অহমির ব্যাপারে নিজে থেকে পরীক্ষা করতে গিয়ে এই কাজটা করলো।

অহমিকে কালকে রাতে মেডিসিন দিয়ে কেনো রকম ঠিক করে মাহিদ ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটা সকাল থেকে একবারও তার সাথে কথা বলেনি। অনেকবার চেষ্টা করেও অহমির মুখ থেকে একটাও শব্দ বের করতে পারেনি। এমন অ্যাটাকের কারণ প্রথমে না বুঝতে পারলেও ‘অহমিকার ডায়েরির বিভিন্ন পৃষ্ঠা’ নামক শিরোনাম দেওয়া ডায়েরিটা পড়ার পর মাহিদের নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছিলো। দুই হাত দিয়ে মাথার চুল ধামছে ধরলো। এমন সময় কেউ ক্যাবিনের দরজায় দুবার নক করলো। মাহিদ ডেক্সের উপর থেকে মাথা না তুলেই বলে, “কাম।”

“অহমের কি অবস্থা? ” আহির মাহিদের মুখোমুখি চেয়ারে বসতে বসতে প্রশ্ন করলো।

মাহিদের দৃষ্টি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলো। তেছড়া কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “আপনার ভাই হিসেবে লজ্জা হয় না?”

“মানে?”

“আপনি, আপনার সো ক্লড দাদি, ফুফু কিভাবে ভাবতেন আপনার বাবা মারা যাওয়ার জন্য অহমিকা দায়ী? আমার ধারনা যদি সঠিক হয় তবে আপনাদের জন্য অহমিকা এখন কমরবিডিটির মতো প্রবলেমে ভুগছে।”

“কমরবিডিটি?” আহিরের কণ্ঠে বিস্ময়। “দুটো প্রবলেম একসাথে?”

“ইয়েস। একটা অ্যাটেলোফোবিয়া আরেকটা আমি সন্দেহ করছি বাইপোলার ডিসওর্ডার। যদিও কেনো যেন বাইপোলার ডিসওর্ডার না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি মনে হচ্ছে, তাও আমি চেক করবো। ”

“বাইপোলার ডিসওর্ডার?”

“সিউর না, সন্দেহর বশে কিছু বলতেও পারছি না।”

আহিরের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। অ্যাটেলোফোবিয়ার কথা আন্দাজ করেছিল। কিন্তু ও সাইক্রিয়াটিস্ট না, সার্জন হওয়ায় এইসব খুব গভীরভাবে বুঝতে পারেনি।

“আপনার দাদি, ফুফু ওরা সেকেলে, আপনিও কিভাবে অহমিকার সাথে এমন আচরণ করতেন? অযথাই মারতেন, নিজে বই খাতা ছিড়ে ওর নাম দিয়ে মায়ের হাতে মার খাওয়াতেন? সকালে খেতে দিতেন না? দুপুরে খাবারে পানি ঢেলে দিতেন? মে মাসের তীব্র গরমে স্কুলে আসা-যাওয়া করার ভাড়া দিতেন না? ওর ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এমন করেছেন?”

“আমি তখন ছোট ছিলাম মাহিদ। আর দাদি আমাকে যা করতে বলতো তাই করতাম আমি। ”

“প্লিজ আর নিজের দোষ ঢাকতে যাবেন না। অহমিকার ক্লাস ফাইভ মানে আপনি এসএসসি পরীক্ষার্থী। এতোটাও ছোট না যে ছোট বোনের সাথে কেমন বিহেব করতে হবে বুঝতেন না।”

“তুমি আমাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে না জেনে কথা বলতে পারো না।”

“আপনার থেকেও ডিফিকাল্টি আমি ফেস করেছি। আমার এডমিশানের মতো এতো বড় একটা টাইমে আমার বাবা সেকেন্ড ওয়াইফ নিয়ে বাসায় আসে। তখন মুগ্ধর মাত্র দশ কি এগারো বছর। বাবা-আম্মির সেপারেশন হয়। আপুর গ্রেডুয়েশান কমপ্লিট হয়নি। আমাদের খুব ভালো অবস্থা ছিল না। তাও আমরা পরিবারের কাউকে পরিস্থিতির অযুহাত দিয়ে ফেলে যায়নি। ” “হাহ অহমিকার ডায়েরি না পড়লে এমনও পরিবার, ভাই হয় তা জানতেও পারতাম না।”

মাহিদ নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আজকে অনেক
অয়েন্টমেন্ট আছে। আবার আজকেই অহমির এমন অবস্থা। অন্যদিকে আহির সন্দিহীন আসলেই কি ওর দোষ আছে? ওর দাদি ওকে অনেক স্নেহ করতো, তাই যা বলতো তাই তাই করতো। এতোকিছু ভাবেনি কখনো। বোনের প্রতি অনেক বেশি অন্যায় করে ফেললো না? কিন্তু পরে তে অহমির সাথে স্বাভাবিক হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে। অহমির পছন্দের অনেক কিছু করে দিতে চেয়েছে। সর্বোচ্চ খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছে। ভাই হিসেবে পরবর্তীতে করা অন্যায়ের শাসন করাও কি ভুল ছিল।
_______________________________

মাহিদ সচারাচর বাসায় ফিরে রাত সাড়ে দশটার মধ্যে। কিন্তু আজকে ফিরতে ফিরতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। জ্যামে বসে থাকতে হয়েছে অনেকক্ষণ। এক্সট্রা চাবি দিয়ে বাসায় ঢুকেই আবহাওয়া খুব শান্ত দেখলো। ফিরোজা বেগম ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওনার রুমের লাইট অফ। এমনকি মাহিদের রুমের লাইটও অফ। অহমি তো এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না।

মাহিদ রুমে গিয়ে আগে লাইট জ্বালালো। রুমে চোখ বুলাতেই দেখে ওয়াড্রবের সামনে হাঁটুতে মুখ গুঁজে অহমি বসে আছে। মাহিদের পিলে চমকে উঠলো। ও দৌড়ে অহমির কাছে গিয়ে অহমির মাথাটা তুলে মুখটা আগলে ধরলো। চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। মাহিদের প্রচন্ড খারাপ লাগে। কিছু কথা বলতে চায়।

“অহমিকা লু……”

শেষ করতে পারে না। তার আগেই অহমি মাহিদের শার্টের কলার খামছে ধরে। একই সাথে মাহিদের গলার কাছটার চামড়ার ছিলে যায়। অহমি মাহিদের কলার ঝাঁকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আপনি কোন সাহসে আমার ডায়েরিতে হাত দিয়েছেন? আপনাকে আমি কোনো অধিকার দেয়নি আমার ডায়েরিতে হাত দেওয়ার। কেনো করেছেন?”

চলমান….

ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা পর্ব-০৫

0

#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৫
#সমৃদ্ধি_রিধী

মাহিদের আচমকা কি হলো কে জানে! অহমির হাতে টান মেরে নিজের খুব সন্নিকটে আনে। অহমি মাহিদের বুকে আঁচড়ে পরে। ভারসাম্য রক্ষার্থে অহমি মাহিদের বুকে হাত রাখে। মাহিদ অহমির চোখে চোখ রেখে বলে , “যে মানুষটা এখন থেকে সম্পুর্ন আমার, যার জীবনের সাথে আমার নাম ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে গেছে তার হাতে শুধু শুধু নাম খুঁজে পাওয়া বা না পাওয়ায় কি লাভ অথবা ক্ষতি হবে অহমিকা আতহার হুসাইন?”

মাহিদের চোখে-মুখে অন্য আভাস। অহমি আর তাকাতে পারলো না ওই চোখের দিকে। সন্তপর্ণে চোখ বুজে নিলো।
______________________________________________

মাহিদ ভীষণ ফিটফাট মানুষ। ও সবসময় সবকিছু গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করে। মেঝেতে সামান্য একটু দাগ লেগে থাকলেও বিরক্তিতে ওর চোখ-মুখ কুচকে যায়। আলমারিতে সারি সারিভাবে তার শার্ট, টি-শার্ট গুছানো থাকে। একটাও আগুপিছু অবস্থায় থাকে না। বিছানার চাদর সবসময় টানটান অবস্থায় থাকে।

অহমি ভেবেছিলো মাহিদের সাথে ওর পরবর্তী দিনগুলো খুব ভালো যাবে। কিন্তু শুধুমাত্র রুম অগোছালো অবস্থায় ফেলে রাখার জন্য ও দু-তিনবার মাহিদের কাছে ঝাড় খেয়েছে। অহমি বুঝতে পেরেছে মাহিদ মানুষটা খারাপ না,ওর সবকিছু ঠিকঠাক। শুধু একটু অগোছালো অবস্থায় থাকলেই ওকে ঝাড় খেতে হয়। অহমি নিরানব্বই পয়েন্ট নাই নাই পার্সেন্ট সিউর মাহিদের ওসিডি আছে।

এই বাসায় অহমি মাহিদ ছাড়াও মাহিদের মা আর ওর ছোট ভাই মুগ্ধ রয়েছে। প্রথমেই আসি মাহিদের মায়ের ব্যাপারে। উনি সবসময় সবকিছু পারফেক্টলি করতে চান। মাহিদ যেন পুরোপুরি তার মায়ের স্বভাবই পেয়েছে। উনি চটপট কিভাবে যেন সব কাজ একা হাতে করে ফেলেন। এই কয়দিন অহমিও চেষ্টা করছে ওর শ্বাশুড়িকে টুকটাক সাহায্য করতে। কিন্তু ওর কাজ যে মাহিদের মা ফিরোজা বেগমের খুব একটা পছন্দ হয় না ও তা ভালো ভাবেই বুঝতে পারে। তবে তিনি অহমির কাজগুলোকে শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করে। অহমিও শ্বাশুড়ির কথা মতো কাজ করার চেষ্টা করে। পাছে ওকে যাতে কথা না শুনতে হয়। আর মুগ্ধ, ও অবশ্য হোস্টেলেই থাকে। কলেজ থেকে ওদের বাসার দূরত্ব বেশি হওয়ার কারণে এই অবস্থা। এইযে ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে এসেছিল, কালকেই আবার হোস্টেলে ফিরে যাবে। আর মাহিদের বড় বোন বিয়ে করে স্বামীর সাথে ‘কেএসএ’তে স্যাটেল। দুইবার ভিডিওকলে কথা বলেছিল ওনার সাথে অহমির।

বাসার সকল কিছু বুঝতে অহমির সময় লেগেছে ১৫ দিন। হ্যাঁ আজকে ওদের বিয়ের পঞ্চদশতম দিন। তবে বর্তমানের সমস্যা হচ্ছে মাহিদের সামনে থাকা চটপটে অহমি আবারো গুমরে যাচ্ছে। সবসময় আবারো নিজেকে পারফেক্টশনের খোলসে আবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করছে। যদি এমন হতো এখানে আসর পর ও কারো কাছে কোনো প্রকার অভিযোগ শুনতো না, তবে হয়তো প্রফুল্লভাবে থাকতে পারতো। ফিরোজা বেগমের মাঝেমধ্যের বিরক্তিকর চাহুনি, মাহিদের ঝাড় খেয়ে ও আবারো বিষন্নতায় ভুগছে। কিন্তু যেটা প্রকাশ করছে না।

____________________________________________________

মাহিদ একজন সাইক্রিয়েটিস্ট। বিয়ের আগে অহমির সাথে কথা বলার সময় ওর কিছু অদ্ভুত না লাগলেও ওকে যত সামনে থেকে দেখছে মাহিদ নিরানব্বই শতাংশ সিউর অহমির ‘বাইপোলার ডিসওর্ডার’ বা ‘দ্বিমেরু বিকার’ রয়েছে। অর্থাৎ, এতে একজন মানুষ কখনো অত্যন্ত উৎফুল্ল থাকে, আবার কখনো গভীর বিষণ্নতায় চলে যায়। তারা কিছু কিছু মানুষের সাথে মন খুলে কথা বলে আবার কিছু মানুষের সাথে ফ্রি হতেই পারে না। বিয়ের প্রথম দুই তিন দিন অহমি হাসি-খুশি থাকলেও লাস্ট তিন-চার দিন এই গুমরে থাকছে, তো কিছুক্ষণ পর নরমাল হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মাহিদকে তো আহির অহমির অ্যাটেলোফোবিয়ার কথা আগেই বলেছিল।তাও ও একবার চেক করে দেখবে। সেই হিসেবে ওর দুইটা ডিসওর্ডার একইসাথে আছে। দ্যাসট মিন “কমরবিডিটি।”

মাহিদ পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায়। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে অহমির ব্যাপারেই ভাবছিলো। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। এই শুক্রবার দুপুরে কি রোদ টাই না ছিল।সন্ধ্যা হওশার সাথে সাথপ আবহাওয়াটা একটু শীতল হলো মনে হচ্ছে। মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুমন্ত অহমির দিকে তাকালো। মেয়েটা যে দুপুরে ভাতঘুম দিয়েছিল এখনো উঠার নাম গন্ধ নেই। তারউপর অহমি খুবই এলোমেলো ভাবে ঘুমায়। গায়ে কাঁথা থাকে না অথচ ঠান্ডায় কুঁকড়ে থাকে। মাহিদ অহমির মাথায় হাত বুলিয়ে পরপর দুইবার ডাকে।

“হুম উঠবো,” ঘুমঘুম কণ্ঠে বলে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে।

মাহিদ গায়ের জোড় খাটিয়ে অহমিকে আধশোয়া করে বসায়। অহমি হকচকিয়ে উঠে ।

“রিল্যাক্স! তোমার দুপুরে ঘুমুলে ঘুম ভাঙ্গে না, কিন্তু রাত ঘুম কেনো হয় না? হ্যাঁ?

অহমির চোখ থেকে তখনোও পুরোপুরিভাবে ঘুম কাটেনি।ঘুমে তখনো ঢুলছে।চোখ পিটপিট করছে। মাহিদ বাম হাত বাড়িয়ে অহমিকে ডাকে,”এদিকে এসো।”

অহমি মাহিদের বুকের উপর মাথা রেখে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলে। মেয়েটার ঘুম কাটেনি এখনো। মাহিদ হাত বাড়িয়ে অহমির চুলগুলো গুছিয়ে দিতে থাকে। আস্তে ধীরে বলে, “যাও ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নাও।”

“একটু পরে। প্লিজ।” মাহিদকে ঝাপটে ধরে বলে।

মাহিদ অহমির হাত ছড়িয়ে নিতে নিতে বলে,” অহমিকা আর একটুও পরে না। তুমি অনেকক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছো। তোমার সাথে ঘুমিয়েও আমি আরো ঘন্টাখানেক আগে ঘুম থেকে উঠেছি। যাও। আমি কিন্তু সব কাজ টাইম টু টাইম করা পছন্দ করি।”

“আর পাঁচমিনিট প্লিজ”

মাহিদ এবার যথাসম্ভব কড়া গলায় বলে, “আহমিকা! তুমি আমার কথা শুনবে না, না?”

অহমির আর সাধ্য কোথায় প্রস্তাব নাকচ করবার?

“দূররর!” অহমি উঠে বাথরুমে চলে যায়। মাহিদ পিছন থেকে চিল্লিয়ে বলে, “প্লিজ অহমিকা বাথরুমের সাবানে যাতে চুল লেগে না থাকে। আমার ওইটা সহ্য হয় না। ”

________________________________________

মুগ্ধ ভাবির কাছে আবদার করেছিল মোমো খাবে। যেহেতু মুগ্ধ কালকেই চলে যাবে তাই অহমিও বানিয়ে দিতে রাজি হয়। কিন্তু অহমি মোমো বানাতে পারে না বলে ফিরোজা বেগম ওকে দেখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে কি করতে হয় না করতে হয়। ফিরোজা বেগম মোমোর ডো তৈরি করছিলেন আর অহমি মাংসটা রান্না করছিল। মাহিদ এমন সময় রান্নাঘরে এসে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে, “আম্মি এক কাপ চা দিও তো।”

আড়চোখে একবার অহমির কালো হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মুগ্ধ ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলো। মাহিদও মুগ্ধর পাশে বসে মুগ্ধর হাত থেকে রিমোটটা কেড়ে নেয়। মুগ্ধ তেতিয়ে উঠে।

“কি সমস্যা ভাই? আজকে টিভি দেখতে দাও। কালকে হোস্টেলে গেলে তো আর দেখতে পাবো না।”

মাহিদ সে কথায় পাত্তা না দিয়ে রান্নাঘরের দিকে ইশারা দিয়ে বলে, ” তোর ভাবির মুখ এমন কালো হয়ে আছে কেনো?”

ড্রয়িংরুমের সে জায়াগাটা থেকে রান্নাঘর পুরোপুরিভাবেই দেখা যায়।

“ভাবি ফ্রিজ থেকে মুরগি যে পলিথিনে রাখা ছিল , সেই পলিথিনটা বের করে আম্মি থালাবাসন ধুয়ে যেপাশে রাখে সেইপাশে রেখেছিল। এরপর আম্মি ভাবিকে বকেছে। সেই থেকেই ভাবির মুড অফ।”

এরপর মাকে ব্যাঙ্গ করে বলে, “অহমি তোমাকে কতবার বলেছি থালাবাসনের জায়গায় অন্য কিচ্ছু রাখবে না? এতদিন বলার পরও ভুল হয় কি করে?”

মাহিদ ভ্রু কুচকে বলে, “আম্মির শুচিবায়ুর স্বভাবটা তো দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে।”

মুগ্ধ মাহিদের গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিমোটটা কেড়ে নেয়। বলে, “লুক হুউস টকিং।”

মাহিদ চেঁচিয়ে উঠে “ইয়ু বারিশ!! গায়ে কি গন্ধ!! গোসল করিস নি? ছিহ!”

__________________________________________________

মাহিদ রুমে এসে গায়ে আচ্ছা মতো বডি স্প্রে মারে। এমন সময় অহমি রুমে এক কাপ চা নিয়ে প্রবেশ করে। মেয়েটার চোখ-মুখ অসম্ভব আঁধার হয়ে আছে। চা টা ওয়াড্রবের উপর রেখে রুম থেকে বের হতে নিলেই মাহিদ ওর হাত ধরে আকটায়। দরজাটা ভিতর থেকে চাপিয়ে দিয়ে অহমিকে আকড়ে ধরে। অহমির পিঠ গিয়ে ঠেকে মাহিদের বুকের সাথে। মাহিদ অহমির কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে প্রশ্ন করে, ” মন খারাপ?”

অহমি উত্তর দেয় না। মাহিদ ওর সকল আচরণ লক্ষ্য করে। মাহিদের সন্দেহের সাথে অহমির সব আচরণ মিলে যাচ্ছে। মাহিদ আবারও প্রশ্ন করে, “মন খারাপ বউ?”

অহমি মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝায়। মাহিদ অহমির ডান গালে অধর ছুঁয়ে বলে, “এখনোও মন খারাপ?”

অহমি মাহিদের চোখে চোখ রেখে আবার মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। মাহিদ এবার অহমির বাম গালে পরপর কয়েকবার অধর ছুঁইয়ে আবারও প্রশ্ন করে, “এখনো মন খারাপ বউ?

অহমির অধর কোণে হাসি ফুটে উঠে। চোখ বন্ধ করলেই যেন অহমির সামনে হাজারো প্রজাপ্রতি উড়াউড়ি করছে। কথা ঘুরাতে বলে, “আপনি এই অসময়ে গায়ে এভাবে পারফিউম দিয়েছেন কেনো?”

মাহিদ অহমির কথা ঘুরানো বুঝেও অহমিকে ছেড়ে চায়ের কাপটা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে কাপের দিকে ইশারা দিয়ে বলে, ” খাবে?”

অহমি মাথা নাড়িয়ে না বুঝায়।

“তাহলে স্বামীর সাথে ভর সন্ধ্যাবেলা রুমের দরজা আটকে যে থাকছো লজ্জা করছে না? যাও গিয়ে রান্নাঘরে শ্বাশুড়ির সাথে হাতে হাতে কাজ করো।”

অহমি হা করে থাকে । এভাবে কে পাল্টি খায় ভাই? নিজেই তো ধরে বেঁধে আটকে রেখেছিল।অহমি গাল ফুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আসবেই না আজ রুমে। অহমি রুম থেকে বের হতেই মাহিদ তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে ফেলে।ঘুমের ভান করে মাহিদ এই নিয়ে চারবার অহমিকে রাতে রাতে ডায়েরি লিখতে দেখেছে। কাল রাতে সুযোগ বুঝে ডায়েরিগুলো কোথায় রাখে সেটাও দেখে নিয়েছে। আলমারি খুলে অহমির কাপড়ের ভাজ থেকে ডায়েরিগুলো বের করে। হিসেবে মোট ছয়টা ডায়েরি।হয়তো আরো আছে। আগের বাসায়। সেগুলোও কালেক্ট করতে হবে। এইসব থেকে যদি ওর সিমটোমস আরো ভালো বুঝতে পারে। ট্রিটমেন্টটাও যে দ্রুত করতে হবে।

চলমান…….