বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2



অদৃশ্য দেয়াল পর্ব-০২

0

#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- দুই।
লেখা: সিহাব হোসেন।

ল্যাপটপের নীল আলোয় সায়নের মুখটা ভাবলেশহীন। সে গভীর মনোযোগে কাজ করে চলেছে। রাবেয়া বেগম নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করে তার পাশে বসলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষণ্ণ গলায় বললেন,
– “তোর খালা-খালু বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেছে।”
সায়ন ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করল,
– “কী বললে তুমি?”
– “কী আর বলব? এতবার করে বলে গেল, এখন না গিয়ে কি কোনো উপায় আছে?”
– “তোমরা যেতে পারো, কিন্তু আমি যাব না।”
– “কেন?”
– “যে মানুষগুলো আমাদের বারবার এতটা নিচু করে কথা বলেছে, তোমার কি মনে হয় এতকিছুর পরেও তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা উচিত?”
– “আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে নেই, সে যেমনই হোক। তারা মন্দ বলে কি তুইও তাদের মতো হবি? রাগ করে কোনো লাভ হবে না। তুই যদি না যাস, তাহলে আশেপাশের লোকেরা ভাববে, ওরা বিয়েটা দেয়নি বলেই আমরা অপমানে যাইনি।”
– “হুম, তা ঠিক বলেছ।”

আরিশার গায়ে হলুদের দিন। পুরো বাড়ি মেহমান আর উৎসবের কোলাহলে মুখর। সবাই হলুদ মাখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই উৎসবমুখর পরিবেশের মাঝে এক কোণে, একটা সাধারণ পোশাকে চুপচাপ বসে আছে সায়ন। তার চোখেমুখে কোনো ভাবান্তর নেই, চারপাশের কোনো দিকেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন সময় তার বন্ধু তৌহিদ একটা চেয়ার টেনে পাশে বসল। তাকে দেখে সায়ন বেশ অবাক হলো।
– “তুই এখানে?”
– “আমাকেও দাওয়াত দিয়েছে।”
– “ওহ।”
– “সত্যি বলতে, আরিশাকে তুই বিয়ে করলে মন্দ হতো না। কোন দিক দিয়ে ওর চেয়ে তুই কম? তোর সাথেই ওকে বেশি মানাত। তাছাড়া এখনকার দিনে ওর মতো ভালো মেয়ে পাওয়া অনেক কঠিন। আজকাল তো কমবেশি সবাই সম্পর্কে জড়ায়।”
সায়ন মৃদু হাসল। বলল,
– “সম্পর্কে জড়ালেই যে একটা মেয়ে খারাপ হয়ে যায়, ব্যাপারটা এমন না। ভালো বা খারাপ নির্ভর করে তার চরিত্র আর পারিবারিক শিক্ষার ওপর। তোর চোখে আরিশা হয়তো সবচেয়ে ভালো মেয়ে, কিন্তু আমি তোকে বলছি, ওকে বিয়ে করে কোনো মানুষ কোনোদিন সুখী হতে পারবে না।”
তৌহিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “কেন?”
– “সেটা না হয় অজানাই থাক। যদি কখনো ভাগ্যে থাকে, তাহলে এমনিতেই জানতে পারবি।”

তৌহিদ এবার শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল,

– “যাক, তাহলে তুই মানুষ চিনতে ভুল করিসনি। যে মেয়ে নিজেকে সবার কাছে বড় প্রমাণ করার জন্য অন্যকে ছোট করতে পারে, সে কেমন তা আমরা সবাই জানি। শুধু সামাজিকতার খাতিরে সবার সাথে তাল মিলিয়ে ভালো-মন্দ বলতে হয়। কারণ এই সমাজে সত্যি কথা বললে লাঞ্ছনা ছাড়া আর কী-ই বা জোটে?”

এরই মধ্যে আরিশাকে সাজিয়ে এনে স্টেজে বসানো হলো। চারপাশ থেকে সবাই তাকে ঘিরে ধরল। উজ্জ্বল আলোয় আরিশার মুখ ঝলমল করছে। সেই দিকে তাকিয়ে সায়নের মনে পড়ে গেল নিজের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো। এক অদ্ভুত, বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে।

বাড়ি বিক্রি করে ব্যবসাটা যখন সবেমাত্র লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে, তখন থেকেই বাবা-মা বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলেন। সেই মতোই শুরু হলো মেয়ে খোঁজা। প্রথম যে মেয়েটিকে দেখতে যাওয়া হলো, তার পরিবার আগে থেকেই সায়নের খোঁজখবর নিয়েছিল এবং মোটামুটি রাজি ছিল। সবাই বসার ঘরে অপেক্ষা করছে, এমন সময় মেয়েকে আনা হলো। মেয়েটি ছিল সায়নের চেয়ে তিন বছরের বড়। কোনো এক অদ্ভুত কারণে সায়নের মনে মনে নিজের চেয়ে সিনিয়র কাউকে বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মেয়েটি সায়নকে দেখা মাত্রই মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠল,

– “আরে, এই ছেলেকে তো দেখে মনে হচ্ছে আমার চেয়েও বয়সে ছোট! এর মধ্যে তো এখনো ম্যাচিউরিটিই আসেনি। একে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

প্রথম প্রত্যাখ্যান। এরপর আবার শুরু হলো মেয়ে দেখার পালা। কিন্তু বারবার একই জায়গায় এসে সব আটকে যেতে লাগল। সব পছন্দ হলেও পাত্রের নিজস্ব বাড়ি নেই, ভাড়া বাসায় থাকে, এই একটি কারণে বেশ কয়েকটা সম্বন্ধ ভেঙে গেল। এমনকি নিজেদের চেয়ে আর্থিক ভাবে দুর্বল পরিবারেও দেখা গেল তাদের চাহিদা আর দেমাগ আরও বেশি। সায়ন একসময় আশাই ছেড়ে দিল। সে বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তে তার বিয়ে করা হবে না। এই সমাজে একজন ভালো মানুষের চেয়ে তার সম্পদের পরিমাণটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছেলে চরিত্রহীন, নেশাখোর হলেও সমস্যা নেই, যদি তার টাকা আর বাড়ি থাকে।

শেষবার বাবা-মা জানালেন, এবার নাকি সব ঠিকঠাক। মেয়ের বাবা রাজি, শুধু পছন্দ হলেই তাড়াতাড়ি বিয়ের দিন ঠিক করা হবে। কিন্তু সায়নের মন বলছিল, এবারও কিছু একটা হবে। সে বাবা-মায়ের সাথে বসে অপেক্ষা করছিল মেয়ে দেখতে যাওয়ার জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটকের ফোন এল, মেয়ে তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে।

আর তারপর এল আরিশার প্রস্তাব। ওকে তো বিয়ে করার ইচ্ছাই ছিল না তার, কেবল বাবা-মায়ের জেদের কাছেই রাজি হয়েছিল। একদিন সে তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
– “মা, বারবার দেখছ আমার বিয়েটা হচ্ছে না, তারপরও কেন এত চেষ্টা করছ?”
– “তুই তো জানিস, আমাদের আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্কগুলোতে কেমন ভাটা পড়েছে। আর তা ছাড়া এই বাড়িতে আমার বড্ড একা লাগে। একজন নতুন মানুষ এলে আমার একাকিত্বটা ঘুচবে, নতুন করে সম্পর্কও গড়ে উঠবে।”

সায়ন মনে মনে ভাবল, সে-ও তো তাই চায়। জীবনে এমন একজন আসুক, যে তাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানসিক শান্তি দেবে, তাকে বুঝবে। ঠিক এমন সময় সাউন্ড বক্সের প্রবল আওয়াজে তার ভাবনার জগৎ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সে বাস্তবে ফিরে এল, যেখানে সবাই সুখী, শুধু সে ছাড়া।

এত কোলাহলের মাঝে হঠাৎ সায়নের চোখ আটকে গেল আরিশার পাশে বসে থাকা একটি মেয়ের ওপর। চারপাশে যখন হলুদের ছড়াছড়ি, তখন মেয়েটি পরেছে ধবধবে সাদা এক শাড়ি। মুখে নেই কোনো মেকআপের আস্তরন, চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করা, আর সেই খোঁপায় গোঁজা একটি টকটকে লাল গোলাপ। মেয়েটির সরল সৌন্দর্য যেন এই কৃত্রিম আলোর উৎসবে এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাস। ঠিক তখনই মেয়েটি সায়নের দিকে তাকাল। সায়নের চিনতে ভুল হলো না, এ তো লিমা!

সেই ক্লাস এইটের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। লিমা তখন তাদের ক্লাসে নতুন ভর্তি হয়েছিল। কেন যেন প্রথম দিন থেকেই মেয়েটাকে তার খুব ভালো লাগত। একা একা বসে থাকলেই লিমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠত, আর সে আনমনে হাসত। কিন্তু অদ্ভুত এক লজ্জায় কখনো তার সাথে সামনাসামনি কথা বলার সাহস হয়ে ওঠেনি। লিমার হাসি দেখলে বুকের ভেতর এক অন্যরকম অনুভূতি হতো, যা ছিল ছেলেমানুষি আর হাস্যকর।

সায়ন যখন অতীতের ভাবনায় ডুবে ছিল, ঠিক তখনই লিমা স্টেজ থেকে নেমে তার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। সায়ন তাকে আসতে দেখে বুকটা ধুকপুক করতে শুরু করল। লিমা সামনে এসে দাঁড়াতেই সে রীতিমতো ঘামতে শুরু করল। লিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “সায়ন?”
সায়ন কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল, পা দুটো যেন তার নিয়ন্ত্রণে নেই, রীতিমতো কাঁপছে। সে কোনোমতে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জবাব দিল।
– “এতদিন কোথায় ছিলে?”
– “কে… কেন? বাসায়।”
– “আরে, এমন কাঁপছ কেন? স্বাভাবিক হও। আমি কি বা*ঘ নাকি ভা-ল্লুক যে তোমাকে খেয়ে ফেলব?”

সায়ন কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তার আগেই পেটে প্রচণ্ড এক মোচড় দিল। সে বুঝতে পারল, আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। দ্রুত লিমার সামনে থেকে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে গেল সে। তার এই কাণ্ড দেখে লিমার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। সে মনে মনে ভাবল, এই ছেলেটা বোধ হয় আর কোনোদিনও পাল্টাবে না। আমি সামনে এলেই কেন যে এমন করে, কে জানে! ভেবেচিন্তে লিমা আবার স্টেজে গিয়ে আরিশার পাশে বসল।

কিছুক্ষণ পর সায়ন স্বস্তি পেয়ে আবার অনুষ্ঠানে ফিরে এল। কিন্তু মানুষের এত ভিড়, এত কোলাহল তার আর ভালো লাগছিল না। তাই সে বাইরে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে সে চমকে পেছনে তাকাল। লিমাকে দেখে সে যেন আবারও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
– “তোমার সমস্যাটা কী, বলো তো? আমাকে দেখলেই এভাবে পালিয়ে যাও কেন?”
– “জা-জানি না তো।”
– “আচ্ছা। তো বলো, কী খবর তোমার? আমি আরিশার কাছে তোমার খোঁজ কতবার করেছি, কিন্তু ও কখনো তোমার কথা ঠিকভাবে বলেনি। তোমার প্রসঙ্গ উঠলেই এড়িয়ে যেত। একবার তো বলেছিল, তুমি নাকি টোকাইদের সাথে ঘোরাফেরা করো।”
সায়ন ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “মজা করছ?”
– “একদম সিরিয়াসলি বলছি। আরও বলেছিল, তুমি নাকি ইচ্ছা করে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছ। কিন্তু আমার কেন যেন বিশ্বাস হয়নি। তোমার মতো একজন ভালো ছাত্র হুট করে লেখাপড়া ছেড়ে দেবে, এটা আমি ভাবতেই পারিনি। কী হয়েছিল সত্যি করে বলো তো?”
সায়ন কিছু বলার আগেই লিমা আবার বলল,
– “আচ্ছা, চলো এখান থেকে একটু বাইরে হাঁটি। এই প্রচণ্ড আওয়াজে আমার মাথা ধরে গেছে।”

ঠান্ডা বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে সায়ন তার জীবনের ঘটে যাওয়া সব ঝড়-ঝাপ্টার কথা লিমাকে খুলে বলল। বাবার ব্যবসায় লোকসান, খালুর কাছ থেকে সুদে টাকা নেওয়া, বাড়ি বন্ধক রাখা, আরিশার পরিবারের অপমান আর নিজের পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পেছনের সব কষ্টকর স্মৃতি সে অকপটে বলে গেল। সব শুনে লিমা অবাক হয়ে বলল,
– “আরিশা তো প্রায়ই বলত, তার মামা, খালু, দুলাভাই সবাই নাকি অনেক বড় বড় পদে চাকরি করে। তারা তো চাইলেই তোমাদের সাহায্য করতে পারত। কিন্তু তা না করে, উল্টো তোমাদের জীবনটা আরও কঠিন করে তুলেছে। এমন আত্মীয় থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।”
– “আমার ভাগ্যে যা ছিল, সেটাই হয়েছে। অন্যকে দোষ দিয়ে আর কী লাভ?” সায়নের কণ্ঠে ছিল গভীর এক উদাসীনতা।
– “আগে যখন আরিশাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেত, তখন ভাবতাম হয়তো ও তোমাকে ভালোবাসে, তাই লজ্জায় কিছু বলে না। কিন্তু এখন দেখছি, ঘটনা তো পুরোই অন্য।”
– “হুম।”

বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে তারা আবার অনুষ্ঠানের দিকে ফিরে এল। ভেতরে ঢুকতেই সায়ন দেখল, তার মা রাবেয়া বেগম তার এক খালাতো ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে নিচু গলায় কথা বলছেন আর ইশারায় তাকে দেখাচ্ছেন। ওই মহিলার একটি মেয়ে আছে। সায়নের আর বুঝতে বাকি রইল না যে, তার মা আবারও তার বিয়ের জন্য নতুন করে পাত্রী খোঁজার অভিযানে নেমেছেন। তার অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

চলবে….!

অদৃশ্য দেয়াল পর্ব-০১

0

#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- এক।
লেখা: সিহাব হোসেন।

“আরিশার বিয়ে তোর খালাতো ভাই নাহিদের সাথে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলেটা সরকারি চাকরি করে, জানিসই তো?”

মায়ের কথায় কোনো হেলদোল দেখা গেল না সায়নের। সে আপনমনে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে কাজ করে চলল। ছেলের এমনআচরণে রাবেয়া বেগমের মেজাজ বিগড়ে গেল। তিনি মুখের ওপর বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন,
– “তোকে কিছু বলেছি, কানে নিচ্ছিস না কেন?”
– “সবই তো শুনছি। যা হওয়ার, তাই হয়েছে।”
রাবেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “আমার কত ইচ্ছা ছিল আরিশাকে তোর বউ করে এই ঘরে আনব! কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় হলো না।”
– “আমাকে প্রত্যাখ্যান করার কারণ নিশ্চয়ই আমার লেখাপড়া কম।”
ছেলের কথায় রাবেয়া বেগমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। তিনি অসহায় গলায় বললেন,
– “আসলে তা নয়। তোর খালা-খালু খুব জোর করছিল। তার ওপর আরিশার দুলাভাইয়েরও ইচ্ছা ছিল নাহিদের সাথেই বিয়েটা হোক।”
– “বাদ দাও তো, মা। আমি তো আগেই বলেছিলাম ওইসব হবে না। কেন ওদের কাছে নত হতে গেলে? আজকাল বিয়ের বাজারে সরকারি চাকরিজীবী ছেলের দামই সবচেয়ে বেশি।”
– “হুম। ভালোর কোনো দাম নেই আজকাল।”

হতাশ হয়ে রাবেয়া বেগম উঠে চলে গেলেন। সায়ন চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। আরিশা, তার মেজো খালার মেয়ে। আর যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, সেই নাহিদ হলো বড় খালার ছেলে। আরিশা আর সায়ন প্রায় সমবয়সী। একসাথে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে। এরপর আর সায়নের পড়ালেখাটা এগোয়নি। পারিবারিক জটিলতায় তা আর সম্ভব হয়নি। পরে বাবা-মা চাইলেও পড়াশোনায় চার বছরের ব্যবধানটা সে মেনে নিতে পারেনি। তাই বাবার ব্যবসায় মন দিয়েছে। সেই সাথে অনলাইনে টুকটাক কাজ করে মাস শেষে বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে সে।

একটা সময় ছিল যখন আরিশা ও সায়নের সম্পর্ক ছিল মধুর। যেকোনো প্রয়োজনে সবার আগে ডাক পড়ত সায়নের। কলেজের অ্যাসাইনমেন্ট হোক বা কোথাও ঘুরতে যাওয়া, সায়ন ছিল তার প্রথম পছন্দ। খালাতো ভাই-বোন হলেও তাদের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু এই সুন্দর সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে বছর দুয়েক আগে।
হঠাৎ করেই সায়নের বাবার ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান হয়। ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ব্যাংকের দেনার চাপ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারলে জেলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঠিক সেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন আরিশার বাবা, সায়নের মেজো খালু। তার দেওয়া টাকায় সে যাত্রায় রক্ষা পাওয়া যায়।

সায়ন যেহেতু ব্যবসার হিসাব-নিকাশ দেখত, তার চোখে পড়ল প্রতি সপ্তাহে বাবা মোটা অঙ্কের একটা টাকা আলাদা করে রাখছেন। জিজ্ঞেস করলে বাবা এড়িয়ে যান। বিষয়টা খটকা লাগায় সে তার মাকে খুলে বলে। সব শুনে রাবেয়া বেগম জানান,
– “এই টাকাটা তোর খালুকে প্রতি সপ্তাহে দিতে হয়।”
– “একবারে বেশি টাকা নিয়ে এভাবে অল্প অল্প করে দিলে তো উনাদেরই ক্ষতি। তার চেয়ে বাবাকে বলো টাকা জমিয়ে একবারে বেশি করে দিতে।”
– “এটা কোনো আসলের টাকা নয়। এটা সুদের টাকা। আর তোর খালু আমাদের এমনি এমনি টাকা দেয়নি, আমাদের এই বাড়িটা বন্ধক রাখতে হয়েছে।”
মায়ের কথাগুলো সায়নের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে চমকে উঠল। যে মানুষটা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, ওমরাহ করে এসেছে, মসজিদ-মাদ্রাসায় উদার হাতে দান করে, সে কি না এমন একটা ঘৃণ্য কাজের সাথে জড়িত? তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। রাবেয়া বেগম আবার বলতে লাগলেন,
– “টাকা দিতে সামান্য দেরি হলেই খুব বা*জে ব্যবহার করে।”

সায়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে কোনোভাবেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিল না। সোজা আরিশাকে ফোন করে সবটা জানাল। কিন্তু সব শুনে আরিশার উত্তর ছিল অপ্রত্যাশিত।
– “বাবার এই কাজে তো আমি দোষের কিছু দেখি না। তিনি টাকার বিনিময়ে টাকা নিচ্ছেন। এর মাধ্যমে তো মানুষের উপকারই হচ্ছে।”
– “চড়া সুদে টাকা দিয়ে মানুষের উপকার হয়?”
– “তা নয়তো কী? আমার বাবার মতো মানুষেরা টাকা না দিলে তোমাদের মতো লোকদের তো না খেয়ে মরতে হতো।”
আরিশার কথায় সায়নের মাথা ঘুরে গেল। রাগে তার শরীর কাঁপছিল।
– “সুদের টাকা তোর পেটে গেছে তো, তাই এসব পক্ষ নিয়ে কথা বলছিস। তোর বাবাকে বলিস, ধর্মের এই লেবাস ছেড়ে খাতা-কলম নিয়ে ভালোভাবে এই ব্যবসাই শুরু করতে।”
ব্যস, আর যায় কোথায়! আরিশা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।
– “আমার বাবার নামে এত বড় কথা! দাঁড়া, আমি এক্ষুনি বাসায় গিয়ে সব বলছি।”

আরিশা সেদিন বাসায় গিয়ে সব বলেছিল। আর তার ফল হয়েছিল মারাত্মক। তার বাবা এমন চাপ সৃষ্টি করলেন যে, শেষ পর্যন্ত বাড়ি বিক্রি করে তাদের টাকা পরিশোধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।
যেদিন সব টাকা শোধ করে দেওয়া হলো, সেদিন সন্ধ্যায় আরিশার বাবা তাদের বাসায় এলেন। সায়নের বাবা শাহেদ সাহেবের হাত চেপে ধরে কান্নার অভিনয় করে বললেন,
– “দেখেন ভাই, আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। আপনি দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন। নয়তো আমি আখিরাতে আটকে যাব।”
সায়নের বাবা-মায়ের মন এতটাই নরম যে, তাদের এই মিষ্টি কথায় তারা মুহূর্তেই গলে গেলেন। কিন্তু সায়নের মন থেকে তাদের প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধা সেদিনই উঠে গিয়েছিল।

চেয়ারে হেলান দেওয়া সায়নের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক চিলতে তিক্ত হাসি। আরিশার প্রত্যাখ্যানের কারণ শুধু তার কম লেখাপড়া বা সরকারি চাকরি না থাকা নয়। কারণটা আসলে মূল্যবোধের, যা দুই বছর আগেই তাদের মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছিল। যে দেয়াল ভাঙার কোনো পথ আর খোলা নেই।
বাড়ি বিক্রি করে খালুর সব দেনা শোধ করার পরও হাতে বেশ কিছু টাকা রয়ে গিয়েছিল। সেই টাকাই ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র সম্বল। শাহেদ সাহেব আর সায়ন মিলে নতুন উদ্যমে আবার ব্যবসায় মন দিল। এবার ভাগ্য তাদের সহায় হলো। আগের অভিজ্ঞতা আর কঠোর পরিশ্রমে ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় লাগল না। ব্যবসা লাভের মুখ দেখতে শুরু করল।

এই সচ্ছলতার দিনগুলোতেও সায়নের মনে পড়ত সেই দুঃসময়ের কথা, যখন তারা দেনায় জর্জরিত ছিল। কত মানুষের কত কটু কথা! অবাক করা বিষয় হলো, পরের চেয়ে নিজের মামা-খালারাই বেশি আঘাত দিয়ে কথা বলেছে। অথচ চাচারা তাদের সাধ্যমতো পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তবে সবচেয়ে বেশি তাচ্ছিল্য আর নিচু চোখে দেখেছে আরিশার বড় বোন, দুলাভাই আর নাহিদের পরিবার। লেখাপড়া কম, এই খোঁটা দিয়ে তারা প্রায়ই বলত, জীবনে সায়ন কিছুই করতে পারবে না। এই অপমানই তার জেদকে শানিত করেছিল। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, জীবনে এমন কিছু করে দেখাবে, যাতে সবাই বোঝে যে পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়াও সফল হওয়া যায়। এরই মধ্যে একদিন সায়নের মা তাকে এসে জানালেন,
– “তোর খালার সাথে আমি কথা বলেছি।”
– “কী নিয়ে কথা হলো?”
– “তোর আর আরিশার বিয়ে নিয়ে। তুই তো এখন আল্লাহর রহমতে ভালোই আয় করছিস। তাই তারাও আর আপত্তি করছে না।”
সায়নের ভেতরটা তেতো হয়ে গেল। সে বলল,
– “আমার এমন সুদি পরিবারে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।”
– “ওরা যা ইচ্ছা করুক, তাতে কী? কিন্তু আরিশা তো মেয়ে হিসেবে খারাপ না। এমন শান্তশিষ্ট, ভদ্র মেয়ে এখনকার দিনে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।”
– “দেখো, তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো।”
সায়ন দায়সারাভাবে উত্তর দিল।
রাবেয়া বেগম একটু ইতস্তত করে বললেন,
– “এর আগে তোর বড় খালা নাহিদের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তোর খালু তখন রাজি হয়নি। নাহিদের বয়স বেশি, তার ওপর চাকরিরও কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। তবে শুনছি, একটা সরকারি চাকরির জন্য নাকি খুব চেষ্টা করছে।”
– “একবার চাকরিটা হতে দাও, তারপর দেখবে তোমার বোন আর তার স্বামী আমাকে বাদ দিয়ে নাহিদের সাথেই বিয়েটা ঠিক করবে।”
– “মোটেও না। এমনটা হতেই পারে না।”
– “তাহলে বলো তাড়াতাড়ি বিয়েটা দিয়ে দিতে। শুভ কাজে দেরি করতে নেই।”
– “আরে, বিয়েশাদির ব্যাপার, একটু তো সময় লাগবেই।”

সায়ন শুধু মুচকি হাসল। তার অনুমান যে কতটা সঠিক ছিল, তা প্রমাণ হতে বেশিদিন লাগল না। মাস খানেকের মধ্যেই নাহিদের সরকারি চাকরিটা হয়ে গেল। আর ঠিক পরদিনই খবর এল, আরিশার বিয়ে সায়নের পরিবর্তে নাহিদের সাথেই ঠিক হয়েছে। সায়ন বুঝতে পারছিল, আরিশার বাবা-মা নিশ্চয়ই কোনো অপমানজনক কথা বলেছে, যা তার মা লজ্জায় তাকে বলতে পারছেন না।

সেদিন বিকেলে সায়ন কলেজের পেছনের পুকুরঘাটের সিঁড়িতে একা বসে ছিল। চারপাশের প্রেমিক-প্রেমিকাদের কলরব তার একাকিত্বকে যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তার খেয়াল হলো, কেউ কেউ তার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে। কারণটা তার অজানা, তবে অনুমান করতে কষ্ট হলো না। এমন সময় পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠের ডাক এল, “সায়ন!”

সায়ন উঠে দাঁড়াল। আরিশা। সেই তাকে এখানে দেখা করতে বলেছে। দুজন পাশাপাশি নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। সায়নের মনে ভেসে উঠল শৈশবের স্মৃতি। কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো! যা-ই করত, দুজন একসাথেই করত। মাধ্যমিকের পরও সব ঠিক ছিল। কিন্তু মাঝখানের একটা ঝড় যেন সবকিছু ওলটপালট করে দিল। টাকার লেনদেন আত্মীয়তার সম্পর্ককে কতটা ঠুনকো করে দেয়, তা সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।
অবশেষে নীরবতা ভাঙল আরিশা। তার কণ্ঠে ছিল বিদ্রূপের সুর।
– “কেন ডেকেছি তা হয়তো বুঝতে পারছো? তোমার বাবা-মা তো তোমাকে খুব বুদ্ধিমান বলে। তাই বলো দেখি।”
– “নিশ্চয়ই তোর বাবা-মা কী কী অপমানজনক কথা বলে আমাকে বাতিল করেছে, তা জানানোর জন্য। কারণ যত যাই হোক, আমি কষ্ট পাব বলে মা আমাকে সবটা বলেনি।”
– “বাহ! আন্টি তো তোমাকে নিয়ে ভুল কিছু বলে না।”
– “দেরি না করে বলে ফেল।”
আরিশা তাচ্ছিল্যের সাথে বলতে শুরু করল,
– “প্রথমত, তোমাদের নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই। আর ভবিষ্যতে যে করতে পারবে, সেই নিশ্চয়তাও নেই। আমি সারাজীবন এ বাড়ি-ও বাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে পারব না। দ্বিতীয়ত, তোমার লেখাপড়া কম। সমাজে দশ জন মানুষের সামনে তোমাকে নিয়ে চলতে আমার অসুবিধা হবে। আর তৃতীয়ত, তোমার এই ব্যবসার আয়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আর কী… বাতিল।”
– “জানতাম। এজন্যই তো আমি নিষেধ করেছিলাম। তবে এটা হওয়া দরকার ছিল।”
আরিশা অবাক হয়ে বলল,
– “কেন?”
– “নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য। এই প্রত্যাখ্যানটা আমাকে জীবনে সফল হতে আরও বেশি সাহায্য করবে।”
আরিশা এবার ব্যঙ্গ করে হেসে উঠল।
– “নিজের ওই ব্যবসা আর অনলাইন জুয়া ছাড়া জীবনে কিছুই করতে পারবি না। যেদিন ধরা খাবে, সেদিন সব শেষ। যাইহোক, বিয়ের দাওয়াত রইল।”

কথাটা শেষ করে আরিশা হনহন করে নিজের পথে হাঁটতে শুরু করল। সায়ন তার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, অপমানই হবে তার সাফল্যের সিঁড়ি।

চলবে….!

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৮

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৬৮
তিন মাস ভালো কেটেছে নয়নার। চৌধুরী বাড়িতে আর ফেরা হয়নি তার। মাঝেমাঝে নাজিম চৌধুরী আর মিতা বেগমের সাথে ফোনে কথা হয়। কলেজ, নিজের বাসা, আর সঙ্গে আছে মিস্টার ড্রাইভারের ভালোবাসা—সব মিলিয়ে বিন্দাস জীবন কাটছে নয়নার। তবে ইন্টারে সায়েন্স নেওয়াটা ঠিক হয়নি। সুখের জীবনে এই সায়েন্স যেন একটা বোঝা। কাউকে যদি সুখে থাকতে ভূতে কিলায়, সে ইন্টারে সায়েন্স নেয়। বাপরে! ফিজিক্স আর ম্যাথ—এই দুটো সাবজেক্ট যেন নয়নার শান্তি গিলে খায়।
বারান্দায় বসে দোলনায় পা দোলাচ্ছে নয়না। আকাশে অগণিত তারা মিটিমিটি জ্বলছে। চাঁদের আলো ক্ষীণ হলেও নয়নার মন বেশ ফুরফুরে। অবশেষে জিয়ানের আসার সময় হয়েছে। নয়না জিয়ানকে ভিডিও কল করল।
জিয়ান কল রিসিভ করতেই মুচকি হেসে বলল, “হেই রঙ্গনা, কী অবস্থা?”
নয়না জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে এই লুকে মারাত্মক হ্যান্ডসাম লাগছে।”
“দেখতে হবে না, শার্টটা কার পছন্দ করা!”
“কার জন্য কেনাকাটা করছেন, ডিয়ার হাসবেন্ড?”
“আমার একমাত্র প্রিয়তমা, অর্ধাঙ্গিনীর জন্য।”
“আপনি আসলেই আসবেন?”
“নাহ, নকল করে আসব।”
“শার্টের বাটন লাগান।”
“মাত্র দুটো খোলা, বেব।”
“একটা লাগান।”
জিয়ান হাতে থাকা ব্যাগটা রেখে একটা বাটন বন্ধ করে নিল। “এবার চলবে?”
“দৌড়াবে, মিস্টার ড্রাইভার।”
“আচ্ছা, কেনাকাটা শেষ করে তোমাকে কল করব।”
“অপেক্ষা করব, কিন্তু আমি।”
“এই জান, অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে কথা হবে।”
“উহু, আমার ইচ্ছে করছে প্রেম করতে। নরম প্রেম।”
“প্রেম বুঝি নরম-শক্ত আছে?”
“হুম, আছেই তো। আপনি বুঝবেন না, মিস্টার পাইলট।”
জিয়ান শপিংমল থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসে বলল, “সো, মিসেস চৌধুরী, আমি তোমার সাথে নরম প্রেম করতে চাই।”
নয়নার চুল বাতাসে উড়ছে, দোলনাটা দুলছে। হেসে বলল, “প্রেম করবে তুমি? প্রেম করার দায়িত্ব তো ছেলেদের। আমরা তোমাদের প্রেমে মত্ত হব, পাগল হব, লুটিয়ে পড়ব তোমাদের বুকে।”
“ওহ, আচ্ছা। কিন্তু আমি তো জানি না, নরম প্রেম আবার কী, গো?”
“কানে কানে বলি, শোন।”
জিয়ান ফোনের স্ক্রিনের কাছে এসে বলল, “বলো গো, সুন্দরী বৌ।”
“চোখ বন্ধ করো। গভীরভাবে অনুভব করো। আমাদের রুফটপে আমি তোমার কোলে বসে আছি। তুমি আমার কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছ। আমি তোমার গলা জড়িয়ে ধরেছি। শহরজুড়ে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির শীতল ফোঁটা আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। তুমি মৃদু স্বরে ডাকলে, ‘সুনয়না’। তোমার এই ডাকে আমি কেঁপে উঠলাম। তুমি আমার দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছ। আমার ভেজা ঠোঁট তোমাকে চুম্বকের মতো টানছে। ধীরে ধীরে তুমি তোমার ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে আনলে, তারপর আমার কাঁপতে থাকা ভেজা ঠোঁট দুটো দখল করে নিলে তোমার ঠোঁটের আড়ালে।”
জিয়ান হঠাৎ চোখ খুলে বলল, “ওরে, দুষ্ট বৌ! এই মধ্যরাতে আমাকে মাতাল করার ধান্দা? এটা কিন্তু ঠিক না।”
নয়না জিয়ানের দিকে একভাবে তাকিয়ে বলল, “আই নিড ইওর লিপস। এই মুহূর্তে তোমার ঠোঁটের স্পর্শ খুব মিস করছি। আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠছে।”
জিয়ান ডাকল, “সুনয়না, সুনয়না। শুনছ তুমি?”
নয়নার চোখের কোণে অশ্রু টলমল করছে।
“কী হলো তোমার? তুমি কী ভাবছ, বলো জান।”
“জানি না, আমার খুব করে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আমি কি মরে যাব?”
“জান, এসব কথা কখনো বলবে না। এই তো, আর এক সপ্তাহ, তারপর আমি সত্যি সত্যি তোমার কাছে থাকব, একদম কাছে। যতটা কাছাকাছি থাকলে তোমার নিশ্বাস আমার নিশ্বাসে মিলিত হয়। ঠিক ততটা কাছে।”
নয়নার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। জিয়ানকে বলল, “এবার আসলে আমাকে নিয়ে যাবে, কিন্তু।”
“এবার হবে না, জান। তবে পরবর্তীতে নিশ্চিত নিয়ে যাব। নাহিদকে দায়িত্ব দিয়ে আসব, ও কাগজপত্র সব রেডি করে রাখবে।”
🌿
জাহিন এই ক’দিন একদম গায়েব। মাঝেমাঝে জাহিন এমন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশে ট্রাভেল করে বেড়ায়। ধরতে গেলে তখন কারো সাথে যোগাযোগ করে না।
জাহিন বসে আছে মান্নাতের সাথে এক টেবিলে। মান্নাতের ঘৃণা হচ্ছে সামনে বসা মানুষটার দিকে তাকাতে। জাহিন কফি মগে চুমুক দিয়ে বলল, “মিস্টার জন, আপনার হবু স্ত্রীকে বলুন নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে। যারা চলে গেছে, তাদের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করতে মানা করুন।”
মাইকেল জন এরিক। জনের সাথে মান্নাতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তারা বিয়েও করবে। কিন্তু আজ যখন জাহিন তাকে তিক্ত সত্যগুলো বলল, ইচ্ছে করছে জাহিনকে খুন করে ফেলতে। কিন্তু এই মানুষটার জন্যই সে এখনো সুস্থভাবে বেঁচে আছে। জন বলল, “ঠিক আছে, মান্নাত আর বাংলাদেশের কারো সাথে যোগাযোগ করবে না।”
জাহিন কফি মগে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, “গুড বাই, মিস মান্নাত। মনে রাখবেন, জীবনের বেড়াজাল খুব কঠিন। জাল ছিঁড়তে গেলে আরো গভীর জালে আটকে পড়তে হয়। আমাকেই দেখুন, গোয়েন্দা হয়ে জাল কাটতে গিয়ে গভীর জালে আটকে পড়েছি। এখন আমি গভীর জলের মাছ। গুড বাই।”
জাহিন সোজা এয়ারপোর্টে চলে এল। তিন মাস পর সে বাড়ি ফিরবে। আজ তার ফ্লাইট।
🌿
অন্তর বসে আছে তুষির সাথে। এই তিন মাসে তাদের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা এগিয়েছে। অন্তর বলল, “জাহিনের সাথে আমি তিন মাসে কোনো রকম যোগাযোগ করতে পারিনি।”
“এটা কেমন কথা? টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক—সোশ্যাল সাইটেও কি যোগাযোগ করা যায় না?”
“জাহিন এমনই। মাঝেমাঝে সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ট্রাভেল লাভার। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে পছন্দ করে। ও নিজে থেকে যোগাযোগ না করলে আর কোনো ব্যবস্থা নেই।”
“তবে খুব শিগগির দেশে ফিরবে হয়তো। কারণ সামনে বড় একটা কেসের শুনানি।” অন্তর বেখেয়ালে কথাটা বলে ফেলল।
“কীসের কেস? কেসের সাথে কী সম্পর্ক ওনার?”
“আরে, ওর বিয়ে। বিয়ে তো জীবনের সবচেয়ে বড় কেস।”
“আচ্ছা, আপনি বিয়ে করবেন না?”
“জেনেবুঝে কেস খাব? আজীবন মেয়াদি হাজতবাস! এর চেয়ে সিঙ্গেল ভালো আছি।”
তুষি কিছু বলল না। চুপচাপ থেকে বলল, “আচ্ছা, আজ তাহলে আসি।”
“আপনি কি সত্যি সত্যি জাহিনকে ভালোবাসতেন? না, মানে, কোনোভাবে আপনার মনে ওর জন্য সফট কর্নার জন্মেছিল?”
তুষি অন্তরের দিকে তাকিয়ে বলল, “লোভ জন্মেছিল। এত এত চকোলেট আর গিফটের লোভ। তাই কোনো ফিলিংস জন্মাতে পারেনি। যার জন্য সব ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলাম, সেই তো ধোঁকা দিল। বাদ দিন সেসব কথা। এখন বাবা-মায়ের পছন্দে সোজা বিয়ে করব। আপনি দেখুন, যত দ্রুত সম্ভব জাহিনের কান পর্যন্ত কথাটা পৌঁছে দিন।”
“একটু ওয়েট করুন, বিল পরিশোধ করে আসছি। আপনাকে বাসা পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে আসি।”
তুষি বাইরে এসে দাঁড়াল। এই কয়েকদিন তুষির দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার ভুলের জন্য নয়নার জীবনে কী বিপদ অপেক্ষা করছে? এসব ভেবে ভেবে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। মানুষ ভুল করে একদিন, সাফার করে চিরদিন।
🌿
সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বেশ বেলা হয়ে গেল নয়নার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল, ওড়না জড়িয়ে নিল গায়ে। হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হল। মোবাইল হাতে নিয়ে অবাক হল নয়না—জিয়ানের নাম্বার থেকে বিশ প্লাস মিসড কল! সাথে সাথে কল ব্যাক করল। ফোন বন্ধ বলছে। নয়নার সুন্দর সকাল মুহূর্তে কালো মেঘে ঢেকে গেল। বারবার কল দিতে থাকল, কিন্তু বন্ধ ফোনে তো কল যায় না।
নয়না ছুটে এল ড্রয়িংরুমে। কিছু বলতে চায়, কিন্তু কাকে বলবে? নীলাঞ্জনা কাতরাচ্ছে সোফায়। নীলাঞ্জনা ইদানীং খুব অসুস্থ থাকে। তার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও এর থেকে মুক্তি পায়নি। নয়নার মাথা চক্কর দিচ্ছে। দুচোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে তার পুরো পৃথিবীটা ঘুরছে। কিছু বলতে চাইল, তার আগেই ঢলে পড়ল ফ্লোরে।
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৭

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬৭

জিয়ান ফোনটা কেটেই রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “সাহস কী করে হয় আমার রুমে প্রবেশ করার?”
“স্যার, আমার একটা দরকার ছিল।”
“দরকার মাই ফুট! গেট লস্ট। জাস্ট লিভ।”
“স্যার, আমার কথাটা শুনুন।” মেয়েটি দু’কদম সামনে এগিয়ে এল।
জিয়ান তার সামনে থাকা আয়নায় ঘুষি মেরে বলল, “এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বের হোন। নির্লজ্জ, বেহায়া, ডার্টি মহিলা।” অন্য হাতে গার্ডকে কল করে বলল, “আপনাদের কেন কাজে রাখা হয়েছে, ঘাস কাটতে? এত রাতে আমার রুমে আসার সাহস কী করে কেউ পায়? আগামীকাল সকালে যেন এর মুখ আর না দেখি।”
সিকিউরিটি গার্ড আসার আগে মেয়েটি জিয়ানের কাছে এগিয়ে গেল। জিয়ান নিজের সামনে থাকা ফুলদানি হাতে তুলে নিল।
মেয়েটি দু’কদম পিছিয়ে বলল, “স্যার, আপনি কাজটা ভালো করলেন না। আমি প্রমোশনের জন্য আপনার মনোরঞ্জন করতে এসেছিলাম। আমরা একই দেশের মানুষ। ছেলে হিসেবে আপনার ফিজিক্যাল নিড আছে। আজ রাতে আপনার সেই নিড আমি পূরণ করার জন্য স্বেচ্ছায় ধরা দিতে চেয়েছিলাম, আর আপনি!”
সিকিউরিটি গার্ড আসতেই জিয়ান বলল, “এই অসভ্য মহিলার চেহারা যেন আর না দেখি। পাইলট রেজা চৌধুরী এত সস্তা নয়। কেউ যেন দ্বিতীয়বার এই দুঃসাহস না করে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।”
বেডের ওপর বসল জিয়ান। পাইলট আর কেবিন ক্রু-সহ সবার খাবার সার্ভ করে তিনজন মহিলা। তাদের মধ্যে একজন মিস রায়া। মেয়েটি এতটা নির্লজ্জ, জিয়ান সেটা কল্পনাও করেনি। লজ্জা ছাড়া মানুষ পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট। যার লজ্জা নেই, সে যা খুশি করতে পারে। দরজা বন্ধ করে বেডে বসল। মোবাইলটা হাতে নিল নয়নাকে কল করার জন্য। কিন্তু তার আগেই ওপাশ থেকে কল এল।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের রুমে মধ্যরাতে একটা মেয়ে কেন প্রবেশ করে? এর উত্তর অজানা নয় নয়নার। তবুও নিজের মনকে সে বোঝাচ্ছে। হয়তো কোনো প্রয়োজনে এসেছে, অথবা কোনো বিপদও হতে পারে। নয়না পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল। এই পাঁচ মিনিট তার কাছে পাঁচ হাজার বছরের মতো মনে হয়েছে। মোবাইল হাতে নিয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতে জিয়ানের নম্বরে ভিডিও কল করল। রিং হচ্ছে? না, যেন নয়নার হৃদয়ে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে!
জিয়ান সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করে বলল, “তর সইছে না, বউ?”
নয়না হকচকিয়ে গেল। জিয়ানের পেছনের আয়নাটা ভাঙা, হাতে রক্ত লেগে আছে, তবুও মুখে হাসি! নয়না শান্ত স্বরে বলল, “কোন সুনামি ঘটিয়েছেন? আপনি নিজের রাগ সংযত করতে পারেন না কেন?”
“তুমিই বলো, আমি রুমে ঢুকে দরজা নক করতে ভুলে গেছি, ড্রেস চেঞ্জ করে শুয়েছি। এই রাতে এই মেয়ের এত বড় সাহস, না বলে আমার রুমে ঢুকে পড়ে! মেয়েমানুষ, তার গায়ে তো হাত তোলা যাবে না। তাই এই হাল।”
নয়না জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “ফার্স্ট এইড বক্স কোথায়? বক্সটা নিন আর এখনই হাতে ব্যান্ডেজ করুন।”
“ সেরকম জখম হয়নি, জান।”
“যা বলেছি, তাই করুন।”
জিয়ান বক্স এনে হাতে অ্যান্টিসেপটিক লাগাল। নয়না মুগ্ধ নয়নে জিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা মানুষ আর কতভাবে তাকে মুগ্ধ করবে? কঠিন মানুষের ভালোবাসা আরও কঠিন। তাদের ভালোবাসায় কোনো ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ থাকে না।
“এভাবে কী দেখছ, বউ? এমনিতেই মেজাজ খারাপ, তোমার সঙ্গে দেহমন তোমাকে চাচ্ছে । তার ওপর এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো দিশেহারা হয়ে যাব।”
নয়না দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল, “এত সুন্দর আয়নাটা ভেঙে ফেললেন, দয়ামায়া নেই?”
“দয়া, মায়া, ভালোবাসা সব আছে, কিন্তু তা শুধু তোমার জন্য, বাটার মাশরুম। এই শুনছ…”
“বলুন।”
“তোমার চোখদুটো মারাত্মক। আমাকে হত্যা করার জন্য তোমার দুটি চোখই যথেষ্ট।”
“এ আবার কেমন কথা, মিস্টার ড্রাইভার?”
“এ হত্যা সে হত্যা নয়, গো রঙ্গনা। এ হলো হৃদয় হত্যা। তোমার দৃষ্টির সীমানার বাইরে আছি, তাই দৃষ্টির প্রখরতা আমাকে হত্যা করছে। ভালোবাসি তোমাকে, প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।”
“কবে আসবেন আপনি?”
“এই তো, খুব তাড়াতাড়ি। আমিও যে ব্যাকুল হয়ে আছি। উফ, কবে যে তোমার উষ্ণ আলিঙ্গনে হৃদয় সতেজ করব?”
নয়না মৃদু স্বরে বলল, “এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। আমিও ঘুমাই।”
“আমার রিপ্লাই কই, জান?”
“অপেক্ষা করুন, মিস্টার ড্রাইভার।”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভোর হতে বেশি বাকি নেই। নয়না বাইরে তাকিয়ে বলল, “আমার শহরে ভোরের আলো, তোমার শহর মধ্যরাতের নিকষকালো। এক আকাশের নিচে, তবুও হাজার মাইলের দূরত্ব।”
🌿
তুষি কয়েকবার শ্বাস নিল। চোখ বন্ধ করে বলল, “আমি যে ভুল মজার ছলে করেছি, আমি চাই না সে ভুলের মাশুল অন্য কেউ দিক।”
অন্তর বলল, “এত হেঁয়ালি না করে সোজাসাপটা বলুন।”
“জাহিন চৌধুরী নয়নাকে পছন্দ করে।”
অন্তর উত্তর দিল না। “তারপর?”
“তিন বছর আগে নয়নার সঙ্গে জাহিনের দেখা হয় শপিংমলে। হয়তো সেদিনই প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যায়। এরপর আমি আর নয়না স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন আরেকবার দেখা হয়। নয়না যদিও খেয়াল করেনি, আমি খেয়াল করেছি। জাহিন ছেলে হিসেবে সুদর্শন। একজন সুদর্শন ছেলে আমাদের পিছু নিচ্ছে, ব্যাপারটা জোস লাগল আমার। প্রেমের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট আগে থেকেই ছিল। নয়নার কাছে পড়াশোনা ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছুতেই ইন্টারেস্ট ছিল না।”
“জাহিন একদিন আমাদের স্কুলের দারোয়ানের কাছে অনেকগুলো চকোলেট পাঠায়—ক্যাডবেরি, কিটক্যাট। নয়নাকে দিতে বলে, কিন্তু নয়নাকে না পেয়ে দারোয়ান আমার হাতে দিয়ে যায়। সঙ্গে একটা কাগজে নম্বরও লেখা ছিল।”
“এরপর শুরু হয় ফোন আলাপ। বিভিন্ন সময়ে অনেক গিফট সে পাঠায়। আমাদের প্রেম হয় ফোনে ফোনে। আমি কিন্তু টাইমপাস করছিলাম—চকোলেট, গিফট আর এত অ্যাটেনশনের লোভে। আমার তখন প্রেমিক ছিল। এরপর এভাবে চলতে থাকে। কথা হতো মাঝেমধ্যে, খুব বেশি না হলেও নিয়মিত টুকটাক কথা হতো। একদিন আমার বয়ফ্রেন্ড বিষয়টা জেনে যায়। সমস্যা হয় আমাদের মাঝে। আমি কথা বলা বন্ধ করে দিই। কিন্তু ততদিনে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। নয়না এই বিষয়ে কিছুই জানে না। নয়না বারবার বলে, জাহিনের চাহনি ওর ভালো লাগে না। আমি বুঝি জাহিন নয়নাকে ভালোবাসে। মানুষ নিজের প্রথম প্রেম কখনো ভুলতে পারে না। জাহিনও পারছে না। জাহিনের মনে হচ্ছে নয়না জাহিনকে ঠকিয়ে জিয়ানকে বিয়ে করেছে। অথচ বিয়েটা হয়েছে কাকতালীয়ভাবে।”
অন্তরের রাগ হচ্ছে তুষির ওপর। তিন বছর আগে এই মেয়ে ছিল ক্লাস নাইনে বা এইটে। ওইটুকু বয়সে এত কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে! বিরক্ত লাগছে তুষিকে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে। নিজের রাগ সংযত করে বলল, “কতদিন কথা হয়েছে আপনাদের?”
“প্রায় দেড় বছর।”
“কেমন টাইপ কথা হতো?”
“খুবই সাধারণ কথা। তবে ‘লাভ ইউ জান’, ‘লাভ ইউ টু জান’, ‘মিস ইউ জান’, ‘মিস ইউ টু জান’—এই কথাগুলো আমাদের মধ্যে বেশি আদান-প্রদান হতো।”
“জাহিনের কাছে যান আর এসব স্বীকার করুন। নয়তো জানি না এর পরিণাম কী হবে।”
তুষি অন্তরের হাত আঁকড়ে ধরল। কান্নারত কণ্ঠে বলল, “আমি জানি আমি ভুল করেছিলাম। বিশ্বাস করুন, ওই বয়সে ওই দামি দামি চকোলেট আর গিফটের লোভে এসব করেছি। আমি খারাপ, আমি জানি, কিন্তু এতটাও খারাপ না। প্লিজ আমাকে হেল্প করুন। আমার জন্য আমার বোনের মতো বান্ধবীর জীবনে ঝড় আসুক, আমি চাই না।”
অন্তর কঠিন মানুষ, তবুও শান্ত স্বরে বলল, “এখন অনেক দূর গড়িয়ে গেছে জল। এই ঝড় কীভাবে সামলাবো, আমার জানা নেই। তবে আমি চেষ্টা করব।”
তুষি মনে মনে ভেঙে পড়েছে। না জানি কত বড় বিপদ সে ডেকে এনেছে নয়নার জীবনে।
🌿
মেহনুর মিতা বেগমকে বলল, “আম্মি, আমি জাহিনকে বিয়ে করতে রাজি।”
“হ্যাঁ, তুই তো বলেছিস আমাকে। কিন্তু জাহিনকে তো শোনাতে পারছি না। এই ছেলেটাকে আমি বুঝতে পারি না, কখন কী যে করে!”
“তোমার ছেলেরা আমাকে এত অপছন্দ করে কেন, আম্মি? আমি কি এতটাই খারাপ?”
“এসব কী বলছিস? অপছন্দ করবে কেন? আজকালের ছেলেমেয়েরা প্রেম-ট্রেম করে নিজেই পছন্দ করে রাখে। তাই এই সমস্যা হয়। তুই চিন্তা করিস না, তোর জন্য ভালো পাত্র খুঁজব।”
মেহনুর মিতা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই, আম্মি।”
🌿
জাহিন কোট হাতে নিয়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে টেবিলের ওপর পা তুলে বসে বলল, “মন্ত্রী সাহেব, সব হলো মানি পাওয়ার। মানি পাওয়ার না থাকলে মানুষের কোনো মূল্য নেই।”
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৬

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬৬
জিয়ান টিভি বন্ধ করে বলল, “ধুর, এত হট আর সুইট বৌ থাকতে টিভি দেখব কেন? আমি তো লাইভ শো দেখব, বেবি। লেটস ড্যান্স, জানু।”
“ওয়ে, মিস্টার ড্রাইভার! আপনি বললেই আমি নাচব?”
“জানু, আজ রাত’কা সিন বানা দো।”
“ছিহ! কী সব কথা!”
“তোমার ডার্টি মাইন্ড। আমি ‘ছিহহ বলার মতো কি বললাম, জানু?”
“এই তো একটু আগেই বললেন।”
জিয়ান উঠে এসে নয়নার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের একেবারে কাছে টেনে এনে বলল, “কী বললাম?”
নয়না জিয়ানের শার্ট খামচে ধরে বলল, “ছাড়ুন।”
“ছাড়ব বলে তো ধরিনি, জানু।”
“আপনার মাথায় সব সময় এসব ঘুরতে থাকে!”
“কোন সব?”
“ওই যে, ওইসব।”
“সেটা আবার কী, জানু?”
“বুঝতে পেরেছি, জানুর গভীর আদর লাগবে।”
জিয়ান নয়নার ঠোঁটে চুমু দিয়ে তাকে কোলে তুলে বলল, “চলো, নাচব দুজন।”
নয়না মৃদু স্বরে বলল, “আমার এখন নাচতে ইচ্ছে করছে না।”
জিয়ান নয়নার কানের কাছে মুখ এনে বলল,
“বন্ধু, তোমার ভালোবাসায় থাকব মাটির পিঞ্জিরায়,
তুমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আর তো কোনো বন্ধু নাই।
মাথা রেখে আমার বুকে, ঘুমাও তুমি সুখে।
তোমায় দেখিয়া দেখিয়া নয়নও জুড়ায়,
তোমায় দেখিয়া, দেখিয়া, জীবনও ফুরায়।”
নয়না হঠাৎ খেয়াল করল, সে বিছানায় বসে আছে। তাহলে জিয়ানের কোলে ওই মেয়েটা কে? নয়না উঠে জিয়ানের সামনে দাঁড়াল। অশ্রু টলমল চোখে জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমার সঙ্গে এরকমটা করতে পারেন না, মিস্টার পাইলট রেজা চৌধুরী। আপনি শুধু আমার। আপনি আমার ব্যক্তিগত প্রিয় পুরুষ।”
নয়না ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। ঘর জুড়ে কেমন অন্ধকার। হাত দিয়ে বেডসাইড সুইচ অন করল। আশপাশে তাকিয়ে বুঝল, এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে! নয়না মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল, রাত সাড়ে তিনটা বাজে। দ্রুত ফোনে ডাটা অন করল। জিয়ান তাকে রিপ্লাই করেনি? এখন তো তার ফ্লাইট নেই। বিশ্রাম নেওয়ার সময়, তবুও কোনো রিপ্লাই নেই কেন! নয়না নিজেই কল করল। সোজা ভিডিও কল।
জিয়ান নিজের পোশাক খুলে সবে বাসার পোশাক পরেছে। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে আছে, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। কপাল কুঁচকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল বেডসাইড টেবিল থেকে। ‘রঙ্গনা’ নিকনেমটা দেখেই যেন জিয়ানের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে উঁকি দিল হাসির ঝলক। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কথা শুরু হল।
ফোন রিসিভ হতেই নয়না এক নাগাড়ে বলতে শুরু করল, “একদম ভালোবাসেন না আমাকে? দু’দিনেই ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে। পুরোনো হয়ে গেছি, তাই এখন আর ভালোবাসবেন কেন!”
জিয়ান চুপচাপ নয়নার দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছে।
নয়না আরও ক্ষেপে গেল। “আশ্চর্য! এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কথা বলার জন্য মুখ নেই নাকি?”
জিয়ান মৃদু হেসে বলল, “এই গভীর রাতে এমনভাবে সামনে এলে আর কিছু খেয়াল থাকে, রঙ্গনা?”
নয়না নিজের দিকে তাকাল। শর্ট টি-শার্ট, যার ফলে পেট থেকে নাভি পর্যন্ত উন্মুক্ত। প্লাজো উঠে এসেছে বেশ খানিকটা। নয়না দ্রুত চাদর টেনে নিল। রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “অসভ্য!”
জিয়ান বুকে হাত দিয়ে বলল, “আই নিড ইউ, ডিয়ার বাটার মাশরুম। উফ! আজ আর ঘুম আসবে না। কেন এত রাতে এমন মোহনীয় রূপে ধরা দিলে? এখন নিজেকে কন্ট্রোল করব কী করে, বেব?”
নয়নার রাগ হচ্ছে। লোকটার মাথায় কি সাধারণ কোনো বোধবুদ্ধি নেই? জিজ্ঞেস করছে না, আমি এত রাতে কেন কল করেছি?
জিয়ান নিরাশ গলায় বলল, “কী স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে, মিসেস চৌধুরী?”
“আপনি আমাকে সত্যি ভালোবাসেন?”
“সুনয়না, ফোনটা কাটো। এই মুহূর্তে এসব কথা বলার কোনো ইন্টারেস্ট আমার নেই।”
নয়না কল কাটার আগেই জিয়ান কল কেটে দিল। নয়না স্পষ্ট দেখতে পেল, জিয়ানের রুমে এক নারীমূর্তির ছায়া। কাঁধ পর্যন্ত চুল, জিন্স আর শার্ট পরা মেয়েটা। নয়নার হৃদয়ে মুহূর্তে শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল। পুরো পৃথিবীর সব সত্য তার কাছে মিথ্যে মনে হতে লাগল।
🌿
অন্তর কয়েকদিন ধরে জাহিনের ওপর নজর রেখেছে। সে খোলা মাঠের এক প্রান্তে বসে আছে। “আচ্ছা, সত্যি সত্যি কি জাহিন আমার বোনের খুনিদের সহযোগী? এটা কী করে সম্ভব? সেই ক্লাস থ্রি থেকে আজ পর্যন্ত আমরা কখনো একে অপরকে ছাড়া একটা চকোলেট পর্যন্ত খাইনি। আমাদের বন্ধুত্ব রক্তের সম্পর্কের চেয়েও গভীর। সেই বন্ধু কি এমন জঘন্য কাজ করতে পারে? নাকি আমার কোথাও ভুল হচ্ছে?” মাটির দিকে তাকিয়ে অন্তর বলল, “আমি চাই না এসব সত্যি হোক। আমি চাই, পৃথিবীর সব মিথ্যে হোক, তবুও তুই আমার বোনের খুনিদের সহযোগী না—এটা কখনো সত্যি হোক।”
অন্তর নিজের মনে বসে ছিল। এমন সময় কেউ তার কাঁধে হাত রাখল।
অন্তর পেছনে তাকিয়ে বলল, “আপনি?”
“আমার আপনার হেল্প দরকার। প্লিজ আমাকে হেল্প করুন।”
“কিসের হেল্প?”
“তার আগে বলুন, আপনার চোখ ভেজা কেন? পুরুষ মানুষের চোখে পানি তো সহজে আসে না! এত কঠিন কাজ?”
অন্তর বলল,”মানুষের হৃদয়ে কিছু কষ্ট থাকে, যেগুলো ভাষা হয়ে বের হয় না কখনো। বলতে চাইলেও শব্দেরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। বেদনাগুলো কেবল বুকের গহীনে চাপা পড়ে থাকে, অপ্রকাশিত এক নিঃশব্দ আর্তি হয়ে। সে কষ্ট কোনোদিন প্রকাশ পায় না। শুধু জমে থাকে, জমে থাকা মেঘের মতো, অনুভবের আকাশে।
হৃদয় যখন আর সেই ভার সইতে পারে না, তখন মনে কালো মেঘ নামে, নীরবতা ঘনিয়ে আসে, আর চোখের কোণেই হয় যেন সেই বেদনার একমাত্র আশ্রয়স্থল। অশ্রুগুলো ঝরে পড়ে, ঠিক যেন নির্জন বর্ষায় একলা কোনো বৃক্ষ কাঁদে।
এই দুঃখের নেই কোনো সঙ্গী, নেই কোনো আশ্রয়। এ এক নিঃসঙ্গ পথচলা, অন্তরের অন্তরালে জমে থাকা এক অমলিন মৌনতা।”
তুষি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “জানেন, আমি কঠিন কথা বুঝি না। খুব সহজ একটা মানুষ আমি। তবে এমন এক কঠিন জালে আটকে পড়েছি, বুঝতে পারছি না এই জাল ছিঁড়ে কীভাবে বের হব।”
“আমি কী হেল্প করতে পারি, সেটা বলুন।”
🌿
সায়না আর অনিকেতের বিয়ে হয়ে গেল। রাতের আঁধারে চারজন মানুষকে সাক্ষী রেখে, আল্লাহ তা’আলার ওপর ভরসা করে সায়না হয়ে গেল অনিকেতের বৌ। সায়নার চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে।
অনিকেত কাজি সাহেবকে বিদায় দিয়ে সায়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “জীবনটা ছেলেখেলা নয়। আর বিয়ে মানে এক বিশাল জার্নি। আপনি বুঝদার হয়েও অবুঝের মতো কাজ করলেন, মিস সায়না।”
সায়না শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় তুলে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, ডিয়ার হাসবেন্ড। আমি আপনার ওয়াইফ। মিসেস অনিকেত মাহমুদ। সুতরাং নিজের সদ্য বিয়ে করা বৌকে ‘আপনি’ করে বলবেন না।”
নাহিদ হেসে বলল, “ভাবি, আপনার মতো মেয়েই দরকার ছিল অনিকেতের।”
“আমাদের জন্য আপনাকে কষ্ট করতে হলো?”
“কষ্ট কিসের? এত আনন্দের। আমার বন্ধুর বিয়ে বলে কথা, এত মহাখুশির কাজ।”
অনিকেত রাগ দেখিয়ে বলল, “এসব মজা মনে হচ্ছে তোর?”
“বিয়ে মানেই তো মজা, দোস্ত। তুই জানিস না? না জানলে সমস্যা নেই, ভাবিজি তোকে জানিয়ে দেবে।”
“চুপ কর, নাহিদ। আমার কিছু ভালো লাগছে না।”
নাহিদ অনিকেতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “বৌকে আদর-সোহাগ করলেই ভালো লাগা শুরু হয়ে যাবে। আজকের মতো টাটা।”
নাহিদ বের হওয়ার আগে সায়নাকে বলল, “ভাবি, বেশি কিছু করতে পারিনি। যতটুকু সম্ভব, এই রাতে ততটুকু সাজিয়ে দিলাম। বাকিটা কাল করব। শুভকামনা রইল, ভাবি।”
🌿
জিয়ান কল কেটে সামনে তাকাতেই রাগে তার কপালের রগ ফুলে উঠল। চোখ দুটো লাল হয়ে উঠছে। “আপনার সাহস কী করে হয় আমার রুমে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করার?”
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৫

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬৫

জাহিন নয়নাকে ড্রপ করে দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো।
অন্তর বলল, “তোর মনে কী চলছে, বল তো?”
“আমার মনে কী চলবে?”
“তুই কি কোনোভাবে ভাবির প্রতি দুর্বল বোধ করছিস?”
জাহিন হার্ড ব্রেক করে গাড়ি থামিয়ে, রক্তচক্ষু নিয়ে অন্তরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর সাহস হয় কী করে এতো লেইম কথা বলার?”
“এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? তুই আজ যা করলি, এসব তো তোর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। আর আমার চিরচেনা জাহিনকে দিয়ে এসব কল্পনাও করা যায় না। দেখ, আমি খেয়াল করেছি, তুই বারবার ভাবিকে টিচ করার চেষ্টা করেছিস।”
জাহিন নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল, “আরে, ইয়ার, আমি জাস্ট ফান করছিলাম। নয়না আমাকে দেখলে কেমন উদ্ভট ব্যবহার করে। মনে হয় যেন আমি তাকে খেয়ে ফেলবো! তাই আমিও আজ সুযোগ পেয়ে ফান করলাম।”
“আচ্ছা, তুই যে শামসুল হক খান স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতি, ওই মেয়েটার কী খবর?”
“কোন মেয়ে? আর আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম? কী বলছিস এসব? মাথা ঠিক আছে তোর? জাহিন চৌধুরীর যোগ্য মেয়ে পেলে জাহিন চৌধুরী সোজা তুলে নিয়ে বিয়ে করে নিতো। এসব দাঁড়িয়ে থাকা, ইম্প্রেস করা—এসব জাহিন চৌধুরীর সঙ্গে যায় না।”
অন্তর আর কথা বাড়ালো না। তবে জাহিনের সূক্ষ্ম মিথ্যে কথা শুনে বেশ অবাক হলো। অন্তর সবটা জেনেই প্রশ্ন করেছিল। সত্যিটা জানার পর মিথ্যে গল্প শুনতে ভালোই লাগে।
জাহিন অন্তরকে নামিয়ে দিয়ে বলল, “তুই বাসায় যা, আমার একটু কাজ আছে। দু’দিন পর ফিরব।”
জাহিন নিজের সিক্রেট অ্যাপার্টমেন্টে এসে দরজা বন্ধ করে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। বাথটাবে শুয়ে গিজার অন করে দিল। উপর থেকে শাওয়ার ছেড়ে চোখ বন্ধ করে রাখল। আজকের ঘটনা একে একে মেলাতে লাগল। হঠাৎ চোখ খুলে বলল, “বি কেয়ারফুল, জাহিন। এমনভাবে এগোতে হবে যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে।”
প্রায় ঘণ্টাখানেক শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো। হাফপ্যান্ট পরে লাইটার হাতে নিয়ে সিগারেট ধরাল। আয়েশ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসল। দেওয়ালজুড়ে নয়নার শতসহস্র ছবি টাঙানো। উঠে এসে একটা ছবির ওপর হাত রেখে বলল, “তোমার তো শুধু আমার হওয়ার কথা ছিল। তাহলে তুমি আমার ভাইয়ের কী করে হলে? প্রেম করবে আমার সঙ্গে, আর বিয়ে করবে আমার ভাইকে! তা হবে না, সুইটহার্ট। জাহিন চৌধুরী এতটা ভদ্র নয়।”
নিজের মোবাইল নিয়ে একজনকে কল করল। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই জাহিন বলল, “কী, মন্ত্রী সাহেব, ডিসিশন ফাইনাল করলেন, নাকি আমি শাস্তি ফাইনাল করব? সব প্রমাণ কিন্তু আমার হাতে।”
“মিস্টার চৌধুরী, আপনি যা বলবেন, তাই হবে। আপনি আমার ফার্মহাউসে চলে আসুন আজ রাতে। আপনার জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে রেখেছি।”
“কোনো মেয়ে যেন না থাকে। আর কোনো ধরনের চালাকি করলে আমি কী কী করতে পারি, তা কল্পনাও করতে পারবেন না।”
“মিস্টার চৌধুরী, আপনি যেমনটা চাইবেন, ঠিক তেমনটাই হবে। ডোন্ট ওয়ারি। আপনি আমার স্পেশাল গেস্ট, আপনার যত্নে কোনো ত্রুটি হবে না।”
🌿
নয়না বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসল। তুষিও খাচ্ছিল। নয়নার মুড অফ। বাসায় এসে শুধু জাহানারা বেগমকে বলেছিল, “আমরা ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি খাবার রেডি করো তো, আম্মু। আর এখন কিছু জিজ্ঞেস করবে না। বাকি কথা রাতে বলব।”
নীলাঞ্জনা এসে নয়নার পাশের চেয়ারে বসল। এই মুহূর্তে নীলাঞ্জনাকে নয়নার সহ্য হচ্ছিল না। নীলাঞ্জনা এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। মানুষের দৃষ্টি দেখলেই নীলাঞ্জনা এখন সেখানে তার জন্য ঘৃণা দেখতে পায়। নীলাঞ্জনা নিজের পেটে হাত রেখে বলল, “আমি তো ঘৃণিত মানুষ, তুইও কি আমাকে ঘৃণা করবি? নাকি তুই এসে তোর মায়ের পৃথিবী ভালোবাসা দিয়ে রাঙিয়ে দিবি? তোকে নিয়ে না হয় অন্যরকম এক ভালোবাসার পৃথিবী গড়ে তুলব।”
নীলাঞ্জনার ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল, নম্বরটা অপরিচিত। ফোন বাজতে বাজতে কেটে গেল। আবার বেজে উঠল। নীলাঞ্জনা ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই লাবিব বলল, “বাইরে আয়, নয়তো তোমার বিবস্ত্র ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দেব।”
নীলাঞ্জনা বোরকা পরে, গায়ে একটা ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। লাবিব ইশারা করে নীলাঞ্জনাকে গাড়িতে উঠতে বলল। দুজনে পাশাপাশি বসল, অথচ মনের মধ্যে বিশাল ফারাক।
লাবিব বলল, “তোর এসব কিসের দেমাগ? চল আমার সঙ্গে।”
নীলাঞ্জনা শান্ত স্বরে বলল, “আপনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি আমার জন্য অপরিচিত।”
“তুই কি বুঝতে পারছিস, তুই লুজার। হেরে গেছিস পুরোপুরি। তোর এখন এক পয়সারও দাম নেই এই সমাজে।”
“আমি কিছুই হারাইনি। বরং আপনি এমন একজনকে হারিয়েছেন, যে আপনাকে ভালোবাসত। আমি তো এমন একজনকে হারিয়েছি, যে মানুষটা কোনোদিন আমাকে ভালোবাসেনি! এবার আপনিই বলুন, কে হেরে গেল, আর কে জিতে গেল?”
“আমি হারব কেন? হারবি তুই। এই বালের ভালোবাসা আবার কী?”
নীলাঞ্জনা আর কথা বাড়ালো না। এর মধ্যেই পুলিশ এসে রিকশা ঘিরে ধরল। লাবিব রক্তচক্ষু নিয়ে নীলাঞ্জনার দিকে তাকাল। নীলাঞ্জনা ততক্ষণে রিকশা থেকে নেমে গেছে। পুলিশ নীলাঞ্জনাকে ধন্যবাদ দিল।
লাবিবের হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। নীলাঞ্জনা বলল, “এক মিনিট, স্যার।” নীলাঞ্জনা লাবিবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, “আমি কিছু হারাইনি, জানো?
হয়তো হারিয়েছি একটি মাত্র মানুষ,
কিন্তু সে তো কখনো ছিলই না আমার।
ভালোবাসার নামে শুধু ছিল কিছু মিথ্যে শব্দ,
আর আমি সেগুলোকেই সত্যি ভেবেছিলাম!
হারিয়েছ তুমি,
একজন এমন মানুষকে, যে তোমাকে ভালোবাসত নিঃস্বার্থভাবে, যার হৃদয়টা ছিল কেবল তোমার জন্য। তুমি বুঝোনি… তখনও না, এখনও না। আমি তো শুধু হারিয়েছি একটি ছায়া, একটি মুখ, একটি অস্তিত্ব, যার মধ্যে আমার জন্য কোনো ভালোবাসা ছিল না। তোমার ক্ষতি গভীর, আমার নয়। কারণ আমি ভালোবাসতে পেরেছি। আর তুমি?
তুমি তো ভালোবাসা কী জিনিস, সেটাই অনুভব করোনি কখনো।কিতাহলে বলো, কে হেরে গেল? আর কে জিতে গেল?”
নীলাঞ্জনা রিকশায় উঠে বসল। লাবিব পুলিশের গাড়িতে। এই প্রথমবার কোনো কথা তার হৃদয়ে লাগল। এই সাধারণ কথাগুলো যেন লাবিবের হৃদয় ভীষণ ভারী করে তুলল!
🌿
নয়না খেয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। মোবাইল নিয়ে কল করল জিয়ানকে। কল যাচ্ছে না। নয়না টাইম দেখল। মনে পড়ল, আজ জিয়ানের ফ্লাইট আছে। এখন নিশ্চিতভাবে বিমানে।
নয়না জিয়ানের টেক্সট দেখতে লাগল।
“তুমি কখনো আমাবস্যা, তো কখনো পূর্ণচন্দ্র। তবে তুমি যেরূপেই ধরা দাও, সব রূপেই মোহনীয়। মিসেস চৌধুরী, মুড সুইং হলো কেন হঠাৎ? আপনার কি পি**ড ডেট কাছাকাছি চলে এসেছে নাকি? শুনুন, ম্যাডাম, মাথা ঠান্ডা করুন, দুটো চকোলেট খান। এরপর আমাকে নক দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবেন। মনে থাক যেন।”
লাস্ট টেক্সটে লেখা, “তুমি রেগে গেলে তোমাকে টুপ করে কামড় দিতে ইচ্ছে করে। তোমার ওই লাল টুকটুকে গালে, নাকের টোকায়। আমি না তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। তুমি আমার সবটা দখল করে নিয়েছ। ভালোবাসি তোমাকে। প্রিয় সুনয়না, তুমি শুধু ক্যাপ্টেন রেজা চৌধুরীর। আই লাভ ইউ সো মাচ, ডিয়ার ওয়াইফি।”
নয়না হাসছে। লোকটা একেবারে রসগোল্লার মতো কিউট। ইচ্ছে করে টুপ করে খেয়ে ফেলতে। “ইশ, আমার বরটা এত কিউট কেন! ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কতদিন তার উষ্ণ বক্ষে মাথা রাখিনি।”
পাশ থেকে তুষি বলল, “ভাই, একটু আস্তে বল পিরিতের কথা। ভুলে যাস না, তোর পাশে একটা সিঙ্গেল, অসহায় মেয়ে আছে। তার প্রতি একটু তো দয়ামায়া কর।”
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৪

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৬৪

ঠোঁটের স্বাদ নিতে খুবই মজা, আর বিয়ের কথা আসলেই ভেজা বেড়াল! সায়নার কথা শুনে অনিকেত অসহায় দৃষ্টিতে সায়নার দিকে তাকিয়ে আছে।
সায়না চোখ পাকিয়ে বলল, “কিস যখন করেছেন, তাও নিজের ইচ্ছায়, সুতরাং এখনই কাজিকে কল করুন।”
অনিকেত ফোন নিয়ে নাহিদকে কল করল। সব শুনে নাহিদ জোরে জোরে হাসতে হাসতে বলল, “অবশেষে আমাদের পবিত্র ডাক্তার বাবু কিস করে কট খেয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে! ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ উইথ কট ম্যারেজ। অপেক্ষা করো চান্দু, আমি কাজি নিয়ে আসছি।”
নাহিদের বউয়ের সন্দেহ করার রোগ আছে। সে কটমট চোখে তাকিয়ে বলল, “এই রাতে বন্ধুর বাহানায় কোন মেয়ের কাছে যাচ্ছ?”
নাহিদ বলল, “বউ, তুমি ভিডিও কল করো আমাকে। যতক্ষণ না ফিরে আসি, তুমি ঘুমাবে না। দুই চোখ মেলে তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে। আমার ফোনে ফুল চার্জ আছে, তোমার চার্জ না থাকলে চার্জে লাগিয়ে হলেও তাকিয়ে থাকো।” নাহিদ শার্ট-প্যান্ট পরে বেরিয়ে গেল।সায়না পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। গুনগুন করে গান গাইছে।
অনিকেত আড়চোখে সায়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “সুন্দরী মেয়েরা ভয়ংকর। এদের ছলনায় পড়া মানেই কট। নিজেই ঠোঁট বাড়িয়ে দিল, এত সুন্দর ঠোঁট কী করে উপেক্ষা করতাম! এই কিস করার অপরাধে বিয়ে করতে হবে!”
“এভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন? আমি জানি আমি সুন্দরী, এত দেখার কিছু নেই। সারাজীবন আপনিই দেখবেন।”
“তোমার পরিবারকে কী বলবে?”
“আচ্ছা, আমি কোন ক্লাসে পড়ি?”
“অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।”
“আমার বয়স কত?”
“ঊনিশ-কুড়ি তো হবেই।”
“তো মিস্টার অনিকেত মাহমুদ, একটা একুশ বছরের অ্যাডাল্ট মেয়ে নিজের ইচ্ছায় নিজের পছন্দে বিয়ে করতে পারে না?”
“কিন্তু আমার তো তোমাকে বিয়ে করার যোগ্যতা নেই!”
“বাংলাদেশের এত বড় একটা হাসপাতালের ডাক্তার আপনি, তাও যেমন-তেমন ডাক্তার নন, সুনামধন্য কার্ডিওলজিস্ট। আপনি নিজেকে অযোগ্য বলার আগে কচুগাছের সঙ্গে গলায় দড়ি দিলেন না কেন?”
“আমি এতিম। বাবা-মায়ের কোনো খোঁজ নেই। পরিবার-পরিজন বলতে দুই-তিনজন বন্ধু।”
“তো আমি কি সংসার আপনার দাদার সঙ্গে করতাম? নাকি আপনার চৌদ্দগুষ্টির সঙ্গে? আমি বিয়ে আপনাকে করব। সংসার আপনার সঙ্গে করব। সুতরাং এসব লেম এক্সকিউজ দেওয়া বন্ধ করুন। আর হ্যাঁ, সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরে আসুন। আচ্ছা, আপনার বাসায় কোনো আংটি বা চেইন আছে?”
অনিকেত সায়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই মেয়েকে বোঝানোর চেয়ে নিজের মাথায় বাড়ি দেওয়া ভালো।”
“কবুল বলে মাথায় বাড়িটাড়ি যা দেওয়ার দিন। কবুল বলার আগ পর্যন্ত সুস্থ থাকতে হবে আপনাকে।”
“ডেঞ্জারাস মেয়ে!”
“আপনার বউ ডেঞ্জারাস, ডাক্তার বাবু।”
🌿
নয়না চেয়ারে বসে আছে, মোবাইল হাতে নিয়ে জিয়ানকে নিজের তোলা ছবি পাঠাল। মেসেজ ডেলিভারি হয়েছে, কিন্তু রিপ্লাই আসল না। নয়না আরেকটা টেক্সট লিখল, “আপনি কি জানেন, আমি জিতে গেছি। ভেবেছিলাম হেরে যাব। অথচ আমি জিতে গেছি!” নয়না মোবাইল রেখে সামনের মঞ্চে মনোযোগ দিল। একদল ছেলে-মেয়ে নাচছে। সবাই হাততালি দিচ্ছে।
তুষি কনুই দিয়ে নয়নাকে গুঁতো দিয়ে বলল, “ওই যে বাঁ-পাশের ছেলেটাকে দেখ, কী হ্যান্ডসাম, তাই না?”
“তুষির বাচ্চা, এখানে প্রেম করতে এসেছিস?”
“শোন, সিঙ্গেল মানুষ একটু-আধটু ক্রাশ খেয়েই থাকে।”
“চুপচাপ বসে থাক।” নয়না নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সামনে তাকাতেই দেখল জাহিন গিটারে সুর তুলছে। নয়না উঠে যেতে চাইল। তুষি নয়নার হাত ধরে বলল, “বসে থাক, তুই ওভার রিয়্যাক্ট কেন করিস! মনে কর, সামনে তোর দেবর নয়, আমার হবু বর দাঁড়িয়ে আছে। তাও মনে করতে না চাইলে শুধু এই গানটায় ফোকাস কর। কী সুন্দর গান গাইছে!”
*Tera sang yeh raat
Khush rang bahara
Tu raat deewani
Main zart sitaraO karam khudaya hai
Tujhe mujhse milaya hai
Tujhpe mar ke hi toh
Mujhe jeena aaya haiOh tera sang yeh raat khush rang bahara
Tu raat deewani
Main zart sitaraKahin kisi bhi gali mein jaaun main
Tere khushbu se takraaun main
Har raat jo aata hai mujhko woh khwaab tuTera mera milna taqdeer hai
Tere hone se mujh mein noor hai
Main hoon soona sa ek aasman, mehtab tuO karam khudaya hai
Tujhe mujhse milaya hai
Tujhpe mar ke hi toh
Mujhe jeena aaya hai*

নয়না একবারও উপরের দিকে তাকাল না। অন্তর খেয়াল করল, জাহিনের দৃষ্টি ঘুরে-ফিরে নয়নার ওপর এসে পড়ছে! গান শেষ হতেই কড়া তালিতে মুখরিত হলো কলেজ প্রাঙ্গণ।
জাহিন স্টেজ থেকে নামার পর নয়না উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল, বাসায় চলে যাব।”
“তোর মাথা ঠিক আছে? এতক্ষণ থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট না নিয়ে চলে যাব?”
নয়না দাঁত কামড়ে বলল, “তুই বাইরে চল, তোকে বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছি।”
নয়না বাইরে এসে দেখল, গাড়ি তাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিল। নয়না আর তুষি উঠে বসল। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, এর মধ্যেই গাড়ি চলতে লাগল। নয়না তখনও সামনে খেয়াল করেনি। সে বলল, “আঙ্কেল, সুবর্ণ রেস্তোরায় যাব।” নয়না হঠাৎ সামনে তাকিয়ে বলল, “আপনি!”
“চমকে গেলে নাকি! আরে, আমি আর অন্তর বেরিয়ে দেখি আমাদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। ওটা ড্রাইভারের দায়িত্ব দিয়ে আসলাম। গন্তব্য যখন এক, তখন আর সমস্যা কী?”
অন্তর বলল, “আসসালামু আলাইকুম ভাবি। আমি অন্তর, আপনার ছোট ভাইয়ের মতো।”
নয়না উত্তর দেওয়ার আগেই তুষি বলল, “আপনি তো সেই বেয়াদব লোকটা! এসেছেন ভদ্র সাজতে।”
নয়না নিজেকে সামলে বলল, “ভাইয়া, আমাকে একটু তালুকদার ম্যানশনে নামিয়ে দিয়ে আসুন। মাত্র দেখলাম আম্মু টেক্সট করেছে, দ্রুত বাসায় যেতে বলেছে। আর হ্যাঁ, বাসায় গিয়ে আম্মাকে বলে দিয়েন আমি বাসায় এসেছি।”
অন্তর গভীরভাবে জাহিনকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। হঠাৎ তার পাশে বসা মানুষটাকে অপরিচিত লাগছে।
জাহিন শান্ত কণ্ঠে বলল, “রেস্তোরাঁ থেকে লাঞ্চ সেরে তারপর ড্রপ করে আসব।”
নয়না বলল, “না, আমাকে এখনই যেতে হবে। আপনার কাজ থাকলে আমাকে এখানে নামিয়ে দিন, তুষির সঙ্গে রিকশায় চলে যাব।”
🌿
নীলাঞ্জনার চার মাস চলছে। শরীর দুর্বল, রক্তশূন্যতা, আবার মস্তিষ্ক জুড়ে নানা ধরনের টেনশন। এই সমাজে সিঙ্গেল মাদার হওয়া তো সহজ কথা নয়। তার ওপর বিয়েটা করেছিল পালিয়ে। অনেকেই জানে না এই বিয়ের কথা। মানুষ বলে ভুল শুধরে নিতে, ভুল থেকে শিক্ষা নিতে। কিন্তু জীবনে এমন কিছু ভুল থাকে, যে ভুলের শাস্তি সারাজীবন পেতে হয়। তার ভুলের জন্য এই অনাগত সন্তান পিতৃহারা। তার ভুলের জন্য সমাজে বড় হয়েও এই সন্তান থাকবে কোণঠাসা। এসব আজকাল ভাবতে পারে না নীলাঞ্জনা। তার মাথা ধরে যায়। এই সময় মেয়েদের সবচেয়ে ভরসার স্থান তার মা। অথচ তার নিজের মা তার দিকে মুখ তুলেও তাকায় না। জাহানারা বেগম নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে নীলাঞ্জনার খেয়াল রাখেন। কিন্তু নীলাঞ্জনার মা নীলাঞ্জনার চারপাশে ঘেঁষে না। চোখের জল মুছে সামনে থাকা জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে পান করল। জুসের গ্লাস রেখে শুয়ে পড়ল বিছানায়। নিজের জীবন নিজের হাতে নষ্ট করেছে। অভিযোগ বা অভিমান করার মতো কোনো স্থান নেই।
🌿
জিয়ান রেডি হয়ে নয়নাকে কল করার জন্য মোবাইল হাতে নিল। নয়নার টেক্সট দেখে উত্তর লিখল, “তা ম্যাডাম, আপনি কী করে জিতে গেলেন?”
নয়নার তখন মেজাজ তুঙ্গে। নয়না রিপ্লাই করল, “ছাতার মাথা, জিতেছি।”
জিয়ান হাহা ইমোজি দিয়ে লিখল, “ব্যাঙের ছাতা?”
নয়না রাগী ইমোজি দিয়ে লিখল, “আপনার মাথা।”
“কী করল আমার মাথা?”
নয়না রিপ্লাই না করে ডাটা অফ করে দিল।জিয়ান মনে মনে হাসল। মেয়েদের মন বোঝার মতো কঠিন কাজ আর নেই।
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬৩

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬৩
“মিস ইউ জান, মিস ইউ ভেরি ব্যাডলি।”
নয়না মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে টেক্সট দেখে মুচকি হাসছে। সকাল সকাল উঠে প্রিয় পুরুষের টেক্সট দেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। নয়না রিপ্লাই করল না। সে জানে জিয়ান এখন ঘুমাচ্ছে। তাই উঠে নিজের মতো ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে রুমে এল।
তুষির দেওয়া লাল পারের সাদা শাড়ি পরে রেডি হলো নয়না। সাদা হিজাব পরেছে। হাতে লাল ও সাদা রেশমি চুড়ি। চোখে হালকা কাজল দেওয়া শেষ করে লিপস্টিক হাতে নিল। লিপস্টিকের বক্সটা হাতে নিতেই নয়না থমকে গেল। এই লিপস্টিক সেটটা জিয়ান তাকে গিফট করেছিল—Forever Dior-এর লিপস্টিক সেট। এখানে বারোটা কালার অ্যাভেইলেবল। নয়না ডিপ রোজউড টোন, স্মুদ শাইন শেডটা নিল। এটার কালার নয়নার সবচেয়ে বেশি পছন্দ। হালকা করে ঠোঁটে অ্যাপ্লাই করলেই অসাধারণ একটা কালার ফুটে ওঠে। নয়না নিজের লিপস্টিক সেট থেকে দুটো লিপস্টিক তুষির জন্য নিয়ে নিল। রুম থেকে বের হওয়ার সময় থমকে দাঁড়াল। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে স্বর্ণের একটা ব্রেসলেট বের করে হাতে পরে নিল। শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। নিজের রুম থেকে সোজা গেল মিতা বেগমের রুমে।
মিতা বেগম নয়নাকে দেখে বললেন, “মাশাআল্লাহ! মনে হচ্ছে আসমান থেকে পরী নেমে এসেছে জমিনে! কারো নজর না লাগুক।” বলেই দোয়া পড়ে নয়নার মাথায় ফুঁ দিয়ে দিলেন। “সাবধানে যাবি। ড্রাইভারের সাথে যাবি, আবার ঠিক সময় চলে আসবি।”
নয়না মৃদু স্বরে বলল, “ঠিক আছে আম্মু। আসি এখন।”
নয়না গেট দিয়ে বের হবে, ঠিক তখন কেউ ডেকে উঠল, “সুনয়না, শুনছো?”
নয়না থমকে দাঁড়াল। জিয়ান আসল কোথা থেকে! পেছনে ফিরতেই নয়নার চেহারায় রাগ ফুটে উঠল।“নিজের ভাবিকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়, এই শিক্ষা আপনার কি জানা নেই?”
“উপস! সরি, তুমি এত কথায় কথায় রেগে যাও কেন? আমার চেয়ে বয়সে ছোট, তাই তুমি করে বলি।”
“আপনার মুখ থেকে ‘তুমি’ ডাক শুনলে আমার শরীর ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। গা গুলিয়ে আসে।” বলেই সামনে পা বাড়াল।
জাহিন নয়নার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বলল, “আই লাইক ইয়োর অ্যাটিটিউড।”
জাহিনের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। জাহিন ফোন বের করে কল রিসিভ করে বলল, “অবশেষে মনে পড়ল আমাকে, মন্ত্রী মহাশয়? তা, আপনার অপরাধের লিস্ট তো বিশাল।”
ওপাশ থেকে শব্দ এল, “আমার বাগানবাড়িতে চলে আসুন, সামনাসামনি বসে কথা হবে।”
“কথার আর কী বাকি? জাহিন চৌধুরী যা বলে, সেটাই শেষ কথা। ওই কথা রাখতে পারলে তবেই দেখা পাবেন, মন্ত্রী মহাশয়।”
“আচ্ছা, আসুন, সিক্রেট গোয়েন্দা অফিসার জাহিন চৌধুরী।”
“ওকে।” জাহিন কল কেটে দিল। গান গাইতে গাইতে নিজের রুমে যাচ্ছে, “সাদা সাদা, কালা কালা, রঙ জমেছে সাদা-কালা।” সিস বাজাচ্ছে আর শাওয়ার নিচ্ছে। তার মনে আজ আনন্দ আর আনন্দ। অবশেষে একটা বিগ ডিল হতে যাচ্ছে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ব্ল্যাক জিন্স আর হোয়াইট শার্ট পরে নিল। হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ। চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে নিজের পছন্দের পারফিউম লাগিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।মেহনুর চুপিচুপি আড়ালে দাঁড়িয়ে জাহিনের কর্মকাণ্ডে নজর রেখেছে। মেহনুর একটা ব্ল্যাক চুরিদার পরেছে। ফর্সা শরীরে ব্ল্যাক চুরিদারে যেন মেহনুরের রূপ উপচে পড়ছে।
***
গাড়িতে উঠেই নয়না জিয়ানকে কল করল। কল করতেই সাথে সাথে রিসিভ।
জিয়ান হাই তুলতে তুলতে বলল, “এসব কী হু! বর নেই দেশে, বউ পরী সেজে কোথায় যাচ্ছে?”
“মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, আজ তো নবীনবরণ অনুষ্ঠান। শাড়িটা তুষি আমাকে গিফট করেছে।”
জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বলল, “বউটা দিন দিন আরো কিউট হয়ে যাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে জব-টব ছেড়ে দেশে গিয়ে রিকশা চালাব, তবুও বউয়ের আঁচলের তলায় থাকব সারাক্ষণ।”
“এই যে, হ্যালো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, এত কী ভাবছেন?”
“ভাবছি, জব ছেড়ে দিয়ে রিকশা চালাব। তবুও বউ ছেড়ে দূরে থাকব না।”
“আহাগো, শখ কত নাগরের?”
“বহুত শখ, বউ।”
“তো রিকশা চালককে তো সুনয়না তালুকদার মেনে নেবে না।”
“নিষ্ঠুর রমনী, আমার কাজ দেখছে, ভালোবাসা দেখছে না।”
“এই শোনো…”
“বলো, জান।”
“এই যে তোমার-আমার ভালোবাসার মাঝে সাময়িক দূরত্ব আসে, তুমি কি জানো, এই দূরত্ব আমাদের ভালোবাসার উন্মাদনা আরো বাড়িয়ে তোলে? এই যে তিন মাস পর মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য তোমাকে কাছে পাই, প্রতিবার তোমাকে নতুন লাগে। মনে হয় দীর্ঘ অপেক্ষার পর তৃষ্ণা নিবারণ হচ্ছে।”
জিয়ান অবাক চোখে চেয়ে আছে তার বাচ্চা বউটার দিকে। কে বলবে এই মেয়ে কেবল সতেরোয় পা দিয়েছে!“ওগো, শুনছো? এভাবে তাকিয়ে থেকো না। আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি না। আমি তোমার আছি, তোমারই থাকব, প্রিয়।”
জিয়ান ফিসফিস করে বলল, “এই ঠোঁট এগিয়ে আনো তো।”
“কেন?”
“তোমার গোলাপ রাঙা ঠোঁট দুটো আমাকে বড্ড টানছে। ইচ্ছে করছে এখনই তোমার উষ্ণ ঠোঁট দুটো আমার রুক্ষ ঠোঁট দিয়ে আড়াল করে ফেলতে।”
নয়না লজ্জা পাচ্ছে, তবুও নিজেকে সংযত করে বলল, “প্রেমিক পুরুষ, তুমি প্রেম জমিয়ে রাখো। আমি তৃষ্ণার্ত হতে থাকি তোমার স্পর্শের। এরপর এসে আমার তৃষ্ণা নিবারণ করবে।”
জিয়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কতকাল হয়ে গেল তোমাকে জড়িয়ে ধরিনি! মনে হচ্ছে শত যুগ পার হয়ে গেছে। আমার বক্ষপিঞ্জরের আদুরে পাখিটার উষ্ণ আলিঙ্গনের অভাবে বক্ষপিঞ্জর হাহাকার করছে।”
“চোখ বন্ধ করে অনুভব করো। আমি আছি খুব কাছে। তোমার সবটা জুড়ে তোমার সাথে। আমার অনুভবে যেমন তুমি জীবন্ত, তোমার অনুভবেও আমাকে জীবন্ত করে নাও, প্রিয়।”
“মিস ইউ, জান।”
“মিস ইউ সো সো মাচ। মিস্টার ড্রাইভার, আমি চলে এসেছি কলেজে। আপনি এবার আবার ঘুমিয়ে পড়ুন। ভালোবাসি, আমার ভালোবাসার প্রথম পুরুষ।” কন্টাক্ট বিচ্ছিন্ন হলো। জিয়ানের চোখে কি আর ঘুম নামবে! বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। এই মুহূর্তে ছুটে গিয়ে নয়নাকে জড়িয়ে ধরতে পারলে ভালো লাগত। ইশ, বউ, তুমি এত দূরে কেন!
🌿
অনিকেত কোনোমতে দরজা খুলতেই দেখল, শাড়ি পরিহিতা এক রমনীর চিন্তিত মুখশ্রী। সায়না অনিকেতকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ঠিক আছেন আপনি? কী হয়েছিল আপনার? কথা বলছেন না কেন?”
অনিকেত দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। সায়না সোফায় বসে আছে। রুম জুড়ে পিন ড্রপ নীরবতা। নীরবতা ভেঙে অনিকেত বলল, “আজ আপনার এনগেজমেন্ট ছিল, তাহলে এনগেজমেন্ট ছেড়ে চলে এসেছেন কেন?”
সায়না শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে অনিকেতের কলার ধরে বলল, “শালা ভাঙবে, তবু মচকাবে না! ভালো যখন বাসেন, স্বীকার করতে কিসের ভয়? মেয়েমানুষের ভয় থাকে, পুরুষমানুষ হয়ে ‘ভালোবাসি’ বলতে ভয়? আজ, এখনই কাজি ডেকে আমাকে বিয়ে না করলে পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে দেব আপনার নামে বদনাম।”
“এই, ছাড়ুন! এসব কী হচ্ছে? ডাকিনী নাকি আপনি?”
“ন্যাকা, কী হচ্ছে বোঝে না! মোবাইল বের করে কাজি ডাকুন, নয়তো পুরো এপার্টমেন্টের মানুষ জড়ো করব এখন।”
“কাজি ডাকুন বললেই হয়ে গেল! বিয়ে কি মামার বাড়ির মোয়া?”
“মামার বাড়ির মোয়া হোক আর না হোক, আজ আমি আপনাকে ‘কবুল’ বলে তবেই ছাড়ব। ভালোয় ভালোয় কাজি ডাকুন, নয়তো আগামীকাল সকালে সংবাদপত্রের হেডলাইন হবে—‘সুন্দরী প্রেমিকার হাতে বলদ ডাক্তার খুন। ভালোবাসা অস্বীকার করার অপরাধে খুন হলেন ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ।’”
“আপনি তো ডেঞ্জারাস!”
“আপনি ‘কবুল’ বললেই আমি হাওয়াই মিঠাই হয়ে যাব।”
অনিকেত আর কিছু বলার আগে সায়না অনিকেতের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল, “তোমাকে আমার চাই, সারাজীবনের জন্য শুধু তোমাকেই চাই। আমি তোমার পৃথিবীতে একমাত্র ভালোবাসা হতে চাই। আমি এ জন্মে তোমার পিছু ছাড়ব না। ভালোবাসি তোমাকে।”
অনিকেত প্রথমবারের মতো সায়নার সাথে রেসপন্স করতে লাগল। দু’জনে হারিয়ে যেতে লাগল দু’জনের ঠোঁটের মাদকতায়।
🌿
মান্নাতের সাথে আজ অনেক কথা বলেছে অন্তর। অন্তর নিজের বোনের শোকে ভুলেই গিয়েছিল মান্নাতের বাবা-মায়ের কথা।
আচ্ছা, এই সবকিছুর নেপথ্যে কে রয়েছে? জাহিন মান্নাতকে সেফ করার জন্য বাইরের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ও জানল কী করে মান্নাতের ক্ষতি হবেই? অন্তর কিছু ভাবতে পারছে না। সব গোলকধাঁধার মতো তার মাথায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। অন্তরের ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। রিসিভ করতেই জাহিনের কণ্ঠ কর্ণপাত হল, “কিরে, বের হবি কখন? আজ না আমাদের প্রোগ্রাম আছে কলেজে?”
অন্তর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল, “এই তো, বের হব। তুই এগো, আমি আসছি।”
#চলবে।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬২

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬২
জিয়ান নয়নাকে ভিডিও কল করেছে।
নয়নার চোখে-মুখে তখন রাজ্যের টেনশন।
“কী হলো তোমার? চেহারার অবস্থা এমন করে রেখেছ কেন? তুমি কি চাও আমি জব ছেড়ে চলে আসি?”
নয়না উত্তর দিল, “উঁহু, তা কেন চাইব? তুমি তো বললে আম্মুর সাথে রান্না করতে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
“এবার বলো, মন খারাপ কেন? এত কিউট চেহারায় আমাবস্যা মানায় না। এই চেহারা হলো বারোমাসি পূর্ণিমা। সব সময় ঝলমল করবে চাঁদের হাসি।”
নয়নার চোখের পাতা ভারি হয়ে এল। নিম্ন স্বরে বলল, “মিস ইউ। আমি তোমাকে ভীষণ মিস করছি।”
জিয়ান আদুরে স্বরে বলল, “এদিকে তাকাও জান। জান, আমি কি তোমাকে মিস করছি না?”
নয়না কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, “তুমি যখন পাশে ছিলে, পৃথিবীটা অন্যরকম ছিল। সব কিছুই তখন রঙিন লাগত। প্রতিদিন মনে হতো বসন্তের আগমন ঘটছে আমার জীবনে। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতাম। তুমি ছাড়া সব কিছু যেন অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ; সব যেন ফিকে মনে হচ্ছে। তোমার হাসি, তোমার স্পর্শ, তোমার নিঃশ্বাস যেন চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করতে পারি। প্রতিটি মুহূর্তে তোমার মধ্যে হারিয়ে যেতাম, মনে হতো সময় থেমে গেছে। তুমি ছাড়া আমি যেন কিছুই নই, আমার সব কিছু তোমার সাথে চলে গেছে। নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে।”
“জান, আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছ পাখি। কী হয়েছে তোমার?”
নয়না কথার প্রত্যুত্তর না করে নিজের মতো বলতে লাগল, “তোমার হাত ধরলে মনে হতো যেন সমস্ত পৃথিবী কেবল আমাদের জন্য থেমে গেছে। এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না। তোমার চোখে আমি আমার প্রতিটি স্বপ্ন দেখতাম, আর তোমার সাথে কথা বললেই সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হতো। কেন তুমি আমাকে ছেড়ে এত দূরে? তবে যখন তুমি চলে গেলে, তখন আমার অস্তিত্ব যেন মুছে যেতে থাকে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত তোমার অভাবে ভরা। পৃথিবীটা আজ আর আমার আর তোমার নয়। আমি জানি না, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলব। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। হয়তো আমি জানি না কীভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু তোমার প্রতি আমার অনুভূতি চাঁদ আর সূর্যের মতোই সত্য।”
জিয়ান ডাকল, “সুনয়না, শুনছ?”
নয়না জিয়ানের দিকে দৃষ্টি দিল।
কিছুক্ষণ কথা হলো চোখে চোখে।
“জান পাখি, আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি সারাদিন রুমে ছিলে, যাও, কিচেনে গিয়ে আম্মুর সাথে কাজ করো।”
নয়না জিয়ানের দিকে তাকাল।
“লাভ ইউ জান।”
নয়না মুচকি হেসে বলল, “লাভ ইউ মিস্টার প্লেন ড্রাইভার।”
নয়না নিচে এসে কিচেনে গিয়ে দেখে, মেহনুর আর মিতা বেগম দাঁড়িয়ে আছে।
“আম্মু, আমিও রান্না করব।”
“আয়, মাংসটা ধুয়ে বসিয়ে দে। আমি ততক্ষণে কলমি শাক ভাজিটা করি।”
“আম্মি, আমিও রান্না করব,” মেহনুর বলল।
“তুই বাঙালি রান্না করতে পারবি না। তুই বরং সন্ধ্যাবেলা সবার জন্য হোয়াইট সস পাস্তা রান্না করিস। বিকেলে সবাই তোর হাতের বানানো পাস্তা খেতে খেতে আড্ডা দেব।”
মিতা বেগম মেহনুরের সাথে কথা বলার মাঝে খেয়াল করলেন, নয়না সুন্দর করে মাংসটা বসিয়ে দিয়েছে। অবাক হয়ে ভাবলেন, মেয়েটা শুধু দেখতে সুন্দর নয়, যেমন রূপবতী তেমনি গুণবতী। মিতা বেগম নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “নয়না, আজ যেহেতু তোর প্রথম রান্না, এক কাজ কর, পায়েসও রান্না করিস।”
নয়না মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক সম্মতি দিল।
🌿
সায়নাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। সায়না নিজের ফোন থেকে অনিকেতকে কল করল।
সাথে সাথে ওপাশ থেকে রিসিভ হল।
“আপনি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন না, ডাক্তার সাহেব?”
অনিকেত কম্পিত কণ্ঠে বলল, “কে?”
সায়না বিচলিত কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে আপনার? আপনি ঠিক আছেন তো?”
ওপাশ থেকে আর কোনো উত্তর এল না।
সায়না দ্রুত উঠে ড্রয়ার থেকে সাইডব্যাগ নিয়ে বসার রুমে আসতে উদ্যত হল।
সায়নার মা এসে সায়নার হাত ধরে বললেন, “রঙতামাশা পরে করবি। তোর জন্য ওনারা সেই কখন থেকে বসে আছে। ব্যাগ রাখ আর চল আমার সাথে।”
সায়না ব্যাগ রেখে বসার রুমে এল।
পাত্রপক্ষের সায়নাকে পছন্দ হল। খুশি হয়ে সায়নার হাতে দুশো টাকার এক বান্ডিল নোট ধরিয়ে দিল।
সায়না আর কালবিলম্ব না করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার ফ্রেন্ডের দাদি মারা গেছে, আমাকে এখনই যেতে হবে।” বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল।
উপস্থিত সবাই সায়নার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল।
🌿
জিয়ানের আর ঘুম হলো না। উঠে বসল। নিজের ফোন থেকে জাহানারা বেগমকে কল করল।
ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই সালাম দিয়ে বলল, “কেমন আছেন আম্মু?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তুমি কেমন আছ বাবা?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আম্মু, আমি বলছিলাম, আপনি যদি সুনয়নাকে কয়েকটা দিনের জন্য আপনার বাসায় এনে রাখতেন। কিছু মনে করবেন না। সুনয়নার মন খারাপ দেখলাম, তাই বলছি আর কি।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি আজ বিকেলে গিয়েই নিয়ে আসব। তুমি চিন্তা করো না বাবা।”
“আম্মু, আরেকটা কথা। আমি যে বলেছি, এটা যেন ও না জানে।”
“চিন্তা করতে হবে না বাবা, ও জানবে না। খেয়েছ তুমি?”
“জি। আচ্ছা আম্মু, ভালো থাকবেন। রাখি।”
জিয়ান কল কেটে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বেডে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বলল, “তোমার কথাগুলো শুনে ইচ্ছে করছিল একছুটে তোমার কাছে গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরি বুকের মাঝে। মিস ইউ আমার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী। আমি তোমাকে অনেক বেশি মিস করছি। তোমার মন খারাপে তোমার মন ভালো করতেও পারছি না। জান, কী হলো তোমার মনের? কী করলে তোমার মনটা হেসে উঠবে? আমার মনেও মেঘ জমে তোমার মন খারাপে।”
🌿
এতিমখানায় এসে দোয়া পড়িয়ে এতিম বাচ্চাদের এক বেলা খাবার খাওয়াল জাহিন আর অন্তর। এতিমখানা থেকে বের হয়ে রমনা পার্কে এসে নিরিবিলিতে বসল দু’জনে। অন্তর চুপ করে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। এরপর বলল, “জাহিন, আমি জানি আমার বোনের হত্যাকারী কে।”
হঠাৎ কথাটা শুনে জাহিন ঘাবড়ে গেল। কপালে আঙুল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “তাই? তাহলে বল, কে সে?”
“তুই এত ঘামছিস কেন জাহিন?”
“প্রচণ্ড গরম পড়েছে আজ। এত জার্নি করলাম, তাই ঘামছি।”
“মন্ত্রীর ছেলে, তার ভাগ্নে, তার এক বন্ধু আর একজন।”
“আর একজন! কে সেই একজন?”
“জানি না। তার কাছে ঠিক ম্যারিনোর মতো বেড়াল ছিল। স্পটে যে বেড়ালটার লাশ পাওয়া গেল?”
“এভিডেন্স লাগবে। আমাদের কাছে যতটুকু আছে, তা এত জোরালো নয়।”
“আমি এভিডেন্স বের করে ফেলব। আচ্ছা, ম্যারিনোকে তোর সাথে আর দেখা যায় না কেন? আগে তো ম্যারিনোকে ছাড়া বের হতিস না।”
“ম্যারিনো অসুস্থ, তাই আর ম্যারিনোকে নিয়ে বের হই না।”
“আচ্ছা, বলতো, চারজন মানুষ ছিল, কিন্তু তিনজন মানুষ অপরাধী। বাকি একজন কী করছিল সেখানে?”
“একজনকে এনে উত্তম-মাধ্যম দিলেই জানা যাবে।”
অন্তরের হঠাৎ চোখ পড়ল একটা মেয়ে দুই-তিনটা পথশিশুকে আইসক্রিম কিনে দিচ্ছে। অন্তর বলল, “তুই বস, আমি আসছি।”
তুষির মা পিজি হাসপাতালে ভর্তি। তুষি বেরিয়েছিল মেডিসিন নিতে। হাসপাতালে মেডিসিনের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই একটু নিজেকে সতেজ করতে পার্কে ঢুকেছিল।
অন্তর তুষির হাত ধরে বলল, “আর একটু পর সূর্য ডুবে যাবে। এখানে কোনো ভদ্র মেয়ে এই সময় থাকে না।”
তুষি অবাক হয়ে বলল, “ধরুন আমি অভদ্র মেয়ে, তাতে আপনার কী?”
“নিজের ইজ্জতের ভয় নেই? নাকি রাস্তার মেয়ে?”
তুষি অন্তরের কলার চেপে বলল, “নিজের লিমিট ক্রস করবেন না। আপনার সাহস কত বড়, আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেন? লোক জড়ো করে গণধোলাই খাওয়াতে এক সেকেন্ড সময় লাগবে না।”
ইতিমধ্যে কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে গেছে।
তুষি কলার ছেড়ে অন্তরের হাত ধরে বলল, “আপনি একাই রাগতে পারেন? দেখলেন, আমিও নায়িকাদের মতো রাগ দেখাতে পারি।”
কয়েকজন বলল, “কী হচ্ছে এখানে?”
তুষি হেসে বলল, “কিছু না, আমার হ্যাসবেন্ডের সাথে একটু মজা করছিলাম।”
তুষি অন্তরের হাত ধরে পার্ক থেকে বের হয়ে সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “শুধুমাত্র রেজা জিজুর জন্য আপনাকে ধোলাই খাওয়ালাম না। চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখুন, আমার হাতে মেডিসিন। আমার আম্মুর এখানে হার্টের সার্জারি হয়েছে। কারো সম্পর্কে না জেনে কথা বলা কোনো ভদ্রতা নয়। ডিসগাস্টিং।”
“তুষির কোনো কথার উত্তর দিল না অন্তর। তুষি চলে যাচ্ছে, সে দাঁড়িয়ে দেখছে।
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬১

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৬১

তুষির সাথে কলে কথা বলছিলো তখন টুং করে নোটিফিকেশন আসলো। মিস্টার প্লেন ড্রাইভার টেক্সট করেছে৷ এই লোকটা অদ্ভুত রকমের! কিজানি তার টেক্সট বা কল দেখলেই নয়নার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে অটোমেটিক। এটা কে নিশ্চয়ই ভালোবাসার জাদু বলে৷ যে জাদুর মোহে আটকে পরে নিজেকে বিলীন করা যায় আরেকজনের বক্ষে। নয়না কিছুক্ষণ চুপ রইলো৷
তুষি আবার বলল “সবই বুঝলাম কিন্তু সহ্য না হওয়ার থিওরি বুঝলাম না৷”
নয়না কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলে, ,”না বোঝার মত কি আছে তুষি! তুই বল তখন এই ছেলে কেন বললো না! ও যে জিয়ান না! জাহিন।”
“হয়ত ভাবির সাথে মজা করেছে।”
“কেমন অদ্ভুত মজা! আর জানিস উনি আমাকে ভাবি বলে না৷ আমি ওনার বড় ভাইয়ের বৌ আমাকে ভাবি ডাকে না কেন!”
“তোর বয়স কম তাই হয়তো। তুই সব কিছু নিয়ে একটু বেশি ভাবিস। এতো ওভার থিংকিং না করে রিলাক্স কর। এক সপ্তাহ পর কলেজে নবীন বরণ আমি কিন্তু লাল পাড় সাদা শাড়ি অর্ডার করেছি দুটো। আমরা দুজন সেম সেম পরবো৷ জানিস সেখানে একজন গায়ক আসবে। যদিও প্রফেশনাল গায়ক না তবুও সে নাকি খুবই ভালো গান গায় আর দেখতেও নাকি সুপার হ্যান্ডসাম।”
নয়না নিরাশ গলায় আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। এখন তার এসব শোনার ইচ্ছে হচ্ছে না৷ নয়না হতাশ, কি অদ্ভুত তার মনের ফিলিংস সে কাউকে বোঝাতে পারছে না! কেউ কেনো বুঝতে পারছে না জাহিনের সামনে যেতে তার কেমন যেনো লাগে। এই কেমন লাগাটা সে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। মেয়ে মানুষের অদ্ভুত এক শক্তি আছে, কোন পুরুষ তার দিকে তাকালে তারা চট করে বুঝে যায় সে দৃষ্টিতে কি আছে, মোহ, ভালোবাসা, নাকি কুদৃষ্টি। এই সেন্স বেশিরভাগ মেয়েদেরই প্রখর। নয়না বুঝতে পারছে না জাহিনের সাথে কিভাবে এক বাসায় দুজন থাকবে! জাহিনকে দেখলেই নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নয়নার। মনে হয় কোন খোলসে নিজেকে আড়াল করতে পারলে তার স্বস্তি লাগতো৷ আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে চোখ বুঝে এলো নয়নার৷ ঘুম যেনো নয়নার চিরসঙ্গী। গভীর দুঃখ, টেনশন যাহোক তার চোখ থেকে ঘুম কখনো উবে যায় না। এতে সুবিধা ও আছে। ঘুম থেকে উঠলে নিজেকে অনেকটা রিলাক্স লাগে৷ এই কারণেই হয়ত গভীর কোন দুঃখ নয়নাকে তেমন ভাবে আঘাত করতে পারে না৷ তবে একজন আছে তার ঘুমের শত্রু। সেই মানুষটার সাথে তার ঘুমের তুমুল শত্রুতা। সে মানুষটা রেজা চৌধুরী। রাতে নয়নার সাথে গল্প করতে করতে খেয়াল করে নয়না ঘুমিয়ে পরেছে৷ রেজা রেগে যায় একটা মানুষ এভাবে কি করে ঘুমাতে পারে! এদিকে মাঝে মাঝে নয়না টেক্সট দেখে রিপ্লাই করবে ওইটুকু সময়ের মধ্যে ও সে ঘুমিয়ে যায়। জিয়ান টেক্সটের রিপ্লাই পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মত অপেক্ষায় থাকে, এদিকে নয়না গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়! এই যে সে জিয়ানকে অপেক্ষায় রেখে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। ঘুমের অদ্ভুত রকমের শক্তি আছে,ঘুমালে মস্তিষ্ক সুখ, দুঃখ দুটোই মনে হয় ভুলে যায়। ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর দুঃখের ভার কমে যায়! পৃথিবীতে তারা’ই হয়তো সবচেয়ে সুখী মানুষ যারা ঘুমখোর। যাদের চোখে ঘুম সহজে আসে না, যারা দুঃখ পেলেই রাত জাগে তাদের মত দুঃখী মানুষ জগতে খুবই কম আছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের দুঃখ বাড়তে থাকে। রাতের গভীরতা আর অন্ধকারের সাথে তাদের দুঃখও প্রখর হতে থাকে। ঘুমিয়ে পরা মানুষ সে দুঃখ অনুভব করতে অক্ষম।
“নয়নার টেক্সটের রিপ্লাই না পেয়ে ঘুম নিয়ে গবেষণা করে ফেললো জিয়ান। সে জানে তার অর্ধাঙ্গিনী এখন হয়ত ঘুমাচ্ছে। ঘুমালে তাকে মায়াবী লাগে৷ তখন যেনো নয়নার মুখশ্রী জুড়ে সরলতা ছড়িয়ে থাকে!” জিয়ান তাকিয়ে আছে তার পাঠানো টেক্সটের দিকে। প্রেমে পরলে মানুষ কিছুটা কাব্যিক হয়ে উঠে। এই যে জিয়ান এতো সুন্দর টেক্সট লিখেছে….. “আমার একটা আকাশ হোক, সেই আকাশ জুড়ে তোমার ভালোবাসার চাঁদ জ্বলতে থাকুক৷
আমার একটা নদী হোক,
সে নদীতে তোমার ভালোবাসার ঢেউ হোক।
আমার একটা সন্ধ্যা হোক,সেই সন্ধ্যা জুড়ে তোমায় নিয়ে গল্প হোক৷”
নিজেই বার কয়েক নিজের লেখা টেক্সট পড়ে মুচকি হাসছে। এই মেয়েটা খুবই অদ্ভুত, পৃথিবীতে কত মেয়ের সাথে তার দেখা হয়েছে কই কাউকে তো এতো স্পেশাল মনে হয়নি?অথচ নয়না নামের হাঁটুর বয়সী মেয়েটি যেনো পৃথিবীর সব নারীর যেয়ে আলাদা। সে জেনো ভালোবাসায় মোড়ানো এক বাসন্তী ফুল৷ যার প্রতিটি পাপড়িতে নানা রঙের মুগ্ধতা জমা আছে৷ জিয়ান একটা জিনিস নোটিশ করেছে, নয়নাকে যে কেউ দেখলে বা নয়নার সাথে কয়েক মিনিট কথা বললেও তার প্রেমে পরতে বাধ্য। এমন এক মুগ্ধ রমনী তার বৌ। অথচ মেয়েটি জানেনা এমন মেয়েকে নিজের করে পাওয়া শত জনমের সাধনা থাকে পুরুষের। এমন এক নিষ্পাপ মেয়ে তাকে ভালোবাসে এই অনূভুতি যেনো জিয়ানকে পৃথিবীর সবচেয়ে লাকী পুরুষ সে এই অনুভূতি দেয়।

নয়নার ঘুম ভাঙ্গলো একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। কেউ জিয়ানকে কেড়ে নিচ্ছে তার থেকে৷ ধড়ফড় করে উঠে বসলো নয়না৷ জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। অসময়ে ঘুমালে এই এক অসুবিধা আজেবাজে স্বপ্ন আসে! নয়না দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে জিয়ানের শেষ টেক্সট সিন করা কিন্তু রিপ্লাই করা নেই। দ্রুত রিপ্লাই করলো, “আমি তোমাকে ভিষণ ভালোবাসি৷ তোমাকে হারালে আমার জীবনের সব রঙ হারিয়ে যাবে৷ মানুষ হয়ত নিজের প্রিয় মানুষকে ছাড়া বাঁচে তবে সেই বাঁচার মধ্যে প্রাণ থাকে না।”
জিয়ান অবাক দৃষ্টিতে নয়নার টেক্সটের দিকে তাকিয়ে আছে! হঠাৎ এমন টেক্সট দেখে সে বিচলিত হলো। এতো সুন্দর রোমান্টিক টেক্সটের রিপ্লাই এতো করুণ বিরহের কেন!

🌿
অন্তর রিতুর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে বসে আছে৷ তিনজন মানুষের সিমটম পাওয়া গেছে। জাহিন তদন্ত করছে এই কেসের। জাহিনের হাতে প্রমান এলেই অপরাধীরা শাস্তি পাবে। জাহিনের প্রতি ওর অগাধ বিশ্বাস আছে। অন্তর নিজের হাতমুষ্টি বদ্ধ করে বলে,আমি বেঁচে থাকতে তোর অপরাধীরা ছাড় পাবে না বোন৷ আমি তাদের শাস্তি দেবোই।
অন্তর নিজের ফোন থেকে জাহিনকে কল করলো। জাহিন রিসিভ করে বলে, “তুই এতো টেনশন করছিস কেন? আমার উপর ভরসা নেই নাকি! তোর বোন কি আমার নিজের বোনের থেকে কম!”
“আমি জানি তুই সর্বোচ্চ চেষ্টা করবি। তোর প্রতি আমার ভরসা আছে তবুও হাহাকার করে বুকটা। আমার বোনটা এই পৃথিবীতে নেই! যার হাসিতে যার চাঞ্চল্যে মেতে থাকতো পুরো বাড়ি আর সে বেঁচে নেই। আর কখনো বলবে না ভাইয়া আমার জন্য এটা আনো ওটা না৷ হুট করে কল করে টাকা চাইবে না কোনদিন আর কোন বায়না করবে না। আমি কি করে মেনে নেবো আমার ফুলের মত বোনটা আর কোনদিন আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে না। আমার মনে হয় এইতো হুট করেই আমাকে ডেকে উঠবে ভাইয়া বলে, অথচ এজন্মে আমাকে কেউ আর ওমন করে ভাই ডাকবে না। আর কেউ ওরমতো আবদার করবে না। ঠুনকো কথায় নাক টেনে কাঁদবে না। আমার বোন আর কোনদিন এই পৃথিবীর সূর্য উদয় দেখবে না। রাতের তারা ভরা চাঁদেে আলো উপভোগ করবে না। এই হাতে তাকে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত করে এসেছি। এই হাতেই মাটি চাপা দিয়ে রেখে এসেছি। আচ্ছা ওর কি ভয় হচ্ছে এখন ওতো অন্ধকারে ভয় পায় একা থাকতে পারে না।”
জাহিন শীতল কন্ঠে বলল, “একটু শান্ত হ। আল্লাহ তায়ালা রিতুকে জান্নাত বাসি করুক। এক কাজ কর কাল তুই আমি একটা এতিমখানায় দুপুরে খাবার খাওয়াবো রিতুর জন্য দোয়া পড়াবো।”
অন্তর কল কেটে দিলো। এই পৃথিবীতে বোন হারানোর বেদনা বোঝার মত কি কেউ নেই? এই যন্ত্রণার ভার তার হৃদয়ে পাহাড় চেপে আছে কি করে এই বেদনার পাহাড় সরাবে সে! এই পৃথিবীতে কি এ যন্ত্রনার নিরাময় আছে?
🌿
অনিকেত বারান্দায় বসে আছে মেঘে ঢাকা আকাশ। কোথাও একটা তারাও নেই বিস্তৃত আকাশ জুড়ে! কালো মেঘ যেনো আকাশকে গিলে নিয়েছে৷ খুব দ্রুত ধরনী কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টির পর আবার সব স্বাভাবিক হবে। আকাশে তারা জ্বলবে, চাঁদ আলো ছড়াবে। কিন্তু তার জীবনে কি আলো জ্বলে উঠবে? সে কি কখনো সায়না নামক চাঁদের নাগাল পাবে? তীব্র ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার যন্ত্রণা মৃত্যুর মত। তারচেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হতে দেখা। জগতে এরচেয়ে যন্ত্রনার হয়ত আর কিছু নেই। ভালোবাসা বিষয়টা মানুষকে শিশুতোষ করে দেয়, নির্বোধ করে দেয় শুধু একমাত্র একটা মানুষের কাছেই,যাকে সে ভালোবাসে। তার সাথে একটু থাকার আশায় তাকে হারানোর ভয়ে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েও পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে চায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অনিকেত বাহিরে তখন ঝুম বৃষ্টি, হাত বাড়িতে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিলো অনিকেত। বৃষ্টির ঝাপটা এসে তার চোখে মুখে পরছে৷ আড়াল করে দিচ্ছে তার অশ্রু। চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে, “মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করিনি কভু। তবে তোমাকে হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করছি, মনে হচ্ছে দেহ থেকে কেউ শ্বাস কেড়ে নিচ্ছে। এই দমবন্ধ কর যন্ত্রণা ব্যখ্যা করার ভাষা আমার জানা নেই প্রিয়তমা। তুমি অন্য কারো গল্পের পূর্নতা হয়ে ভালো থাকো৷ পৃথিবীর সব সুখ তোমার হোক।সব ভালোবাসা পূর্নতা পায় না। সব ভালোবাসা পূর্নতা পেলে পৃথিবীতে না পাওয়ার যন্ত্রণা যে মৃত্যুর সাক্ষাৎ করায় তা কেউ অনুভব করতে পারতো না।” অনিকেতের চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে, ঠোঁটের কোনে তবুও প্রেয়সীর সুখ প্রর্থনার হাসি!
#চলবে

আগন্তুক পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0

#আগন্তুক
#অন্তিম_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

অন্তরার যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন দেখলো, আর্য তার পায়ের কাছে বসে আছে। হয়তো সারা রাত জেগে থাকার জন্য ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে গেছে, তাই চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায়, অন্তরার বেডে মাথা নামিয়ে রেখেছে। এখন কি ডাকা ঠিক হবে? না থাক একটু এইভাবেই চোখ বন্ধ করে থাকুক। কি যে হয়ে গিয়েছিল নিজেই মনে করতে পারছে না অন্তরা। হঠাৎই কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল, তারপর আর কিছু মনে নেই। বিশ্বজিৎ এর কাছে বাড়ির একটা চাবি থাকে, ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করে খবর নেয় ছেলেটা। হয়তো ফোনে না পেয়ে সোজা বাড়ি চলে এসেছিল। পেটে হাত দিয়ে কিছু অনুভব করতে চাইলো অন্তরা, বাচ্চাটা ঠিক আছে তো?

আর্যর ঘুমটা ভাঙতেই দেখলো, অন্তরার জ্ঞান ফিরে এসেছে। হাসিমুখে বললো, গুড মর্নিং।
অন্তরা বললো, সারারাত আমার জন্য কত ক ষ্ট হলো বলো? আর্য বললো, কই না তো, ক ষ্ট কেন হবে? আর তুই এত বেশি ভাবিস বলেই এমন হলো। বিপি এত হাই হলো কিভাবে? নিজের না হোক বাচ্চাটার কথা ভাব। এবার থেকে আমি যা বলবো তাই করবি। অনেক হয়েছে তোর।
অন্তরা মনে মনে হাসতে লাগলো। আজ যদি ও ম্যারেড হতো, সমাজে এই বাচ্চার বাবার পরিচয় থাকতো, কত মানুষ মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো, মা এটা করলে বাচ্চার ভালো হবে, এটা করো না, বাচ্চার ক্ষ তি হবে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বলার কেউ নেই। গুটিকয়েক বন্ধু ছাড়া, যদিও তারা বেশির ভাগই পুরুষ। সেদিন আর্য ঠিকই বলেছিল, সব পুরুষ এক নয়।

বিশ্বজিৎ চলে এসেছে খাবার নিয়ে, অন্তরাকে সুস্থ দেখে বললো, উফ কি ভ য় খাইয়ে দিয়েছিলে মাইরি! এখনও মনে পড়লে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস আর্য দার ফোন নাম্বারটা ছিল, নয়তো কি যে হতো। অন্তরা একবার মুচকি হাসি দিয়ে আর্যর দিকে তাকালো। তারপর বললো, আমার আর ভ য় নেই। আমি না থাকলেও আমার বাচ্চা অনেক মা পাবে।
কথাটা শোনা মাত্রই আর্য আর বিশ্বজিৎ একে অপরের দিকে তাকালো।

গাড়ি থেকে নামতেই, পাশের বাড়ির আন্টিরা সবাই দেখা করতে এলেন। অন্তরা বেশ অবাকই হলো। কেউ কেউ ধমকের সুরে বললেন, এই সময় কেউ এত স্ট্রেস নেই? কেউ কেউ বললেন, খাবার-দাবার কেমন খাচ্ছে কে জানে? ওনারাই অন্তরাকে ধরে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এই প্রথম অন্তরা যেন এত ভালোবাসা পেল। কা ন্না আসছে কিন্তু সেটা আড়াল করার চেষ্টা করছে। যদিও সেটা আর্য ভালো করেই বুঝতে পারছে।

এই কদিনে যেন আর্য মেয়েটার মায়ায় বেশি জড়িয়ে পড়েছে। আর্য দুনিয়ার সব খুশি অন্তরাকে এনে দিতে চায়। অন্তরার খুশিতে যেন তার ভালোলাগা জড়িয়ে আছে। সেই প্রথম দেখা থেকে আজ অব্দি অন্তরার প্রতি একটা অনুভূতি কাজ করছে। সেটা কি শুধুই বন্ধুত্ব নাকি অন্য কিছু। এই অবস্থায় নিজের কথাগুলো বললে, অন্তরা বুঝবে?

অন্তরার ডাকে সম্বিৎ ফিরলো, তারপর বললো, হুম বল।
অন্তরা হেসে বললো, কী ভাবছো?
আর্য বললো, কই কিছু না তো।
ফোনটা বেজে উঠলো, স্ক্রিনে ডক্টর অরুন্ধতীর নাম্বার। অন্তরার থেকে একটু সরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো আর্য। অরুন্ধতী বললেন, এখন কিছুতেই অন্তরাকে একা রাখা যাবে না। কিন্তু ২৪ ঘন্টা ওর দেখাশোনা করবে এমন মানুষই তো নেই। আর্য বললো, আমি সব ম্যানেজ করে নেব।

অন্তরার কাছ থেকে সবাই চলে যেতেই, আর্য বললো, ফ্রেশ হয়ে নে, আমি এখানেই আছি। তোর সব দরকারী জিনিস আমি প্যাকিং করছি। অন্তরা অবাক হয়ে বললো, আমি কোথায় যাবো? আর্য অন্তরার ওষুধ গুলো দেখতে দেখতে বললো, আমার বাড়িতে থাকবি।
অন্তরা বললো, তা হয় না আর্য। আমি আর তোমার উপর বোঝা হতে চাই না। তাছাড়া তোমারও একটা জীবন আছে। আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে গেলে সবাই নানারকম কথা বলবে। আমি চাই না, আমার জন্য তোমার কোনো ব’দনাম হোক।
আর্য এবার রা গী চোখে তাকিয়ে বললো, তোকে এত ভাবতে কে বলেছে? তোকে যা বলছি তুই শুধু তাই কর।
অন্তরাও উত্তেজিত হয়ে বললো, কিছুতেই না। আমি আর তোমার জীবনে বোঝা হতে চাই না। এইভাবে দুজনের কথা কা’টাকা’টিতে হঠাৎ করে অন্তরা থেমে গিয়ে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়লো। আর্য অন্তরার কাছে গিয়ে বললো, কী হয়েছে অন্তরা? তুই ঠিক আছিস তো? সরি সরি। আমার মাথার ঠিক ছিল না, তোর সাথে জোর গলায় কেমন কথা বলছিলাম, ভুলেই গিয়েছিলাম তোর শরীরটা ভালো নেই।
অন্তরা কিছু না বলে আর্যর হাতটা তার পেটের কাছে রাখতেই আর্য চমকে উঠলো। বাচ্চাটা নড়ছে। যেন বলতে চাইছে, তোমরা ঝ গ ড়া করছো কেন? আমি যে তোমাদের সাথে আছি, সেটা কি ভুলে গেছ?
এই অনুভূতিটা যে কত সুন্দর তা বলে বোঝানো যাবে না। যাঁরা এটা অনুভব করেছেন তাঁরাই শুধু জানেন। আর্যর চোখে জল, ধীরে ধীরে বললো, আমাকে বিয়ে করবি অন্তরা? আমি জানি তোর কাউকে দরকার নেই। কিন্তু আমার প্রয়োজন তোদেরকে। আমি এই অল্প সময়েই তোদের অনেক আপন করে নিয়েছি। আমাকে একটু অধিকার দে না, যাতে আমি জোর গলায় বলতে পারি, এই সন্তান আমারও।
অন্তরা কাঁ’দতে কাঁ’দতে বললো, আমাকে দয়ায় রেখো না। আমি দয়ার পাত্রী হয়ে থাকতে চাই না।
আর্য এবার অন্তরার গাল দুটো ধরে বললো, একদম দয়া করছি না আমি, আমি দয়া করার কে? আমি শুধু তোর মনে আমার একটা জায়গা করতে চাইছি। বাচ্চাটা যখন হাঁটতে শিখবে, আমি আমার আঙুলটা বাড়িয়ে দিতে চাইছি। তোর এই সুন্দর জার্নিটা থেকে শুরু করে, যতদিন প্রাণ থাকবে ততদিন সাথে রাখতে চাই। আমাকে ফিরিয়ে দিস না। আমি অনেক ভেবেছি, তারপর সিন্ধান্ত নিয়েছি। কোনো আবেগ বা দয়া করে নয়।

এক মাস পর,
রেজিস্ট্রি ম্যারেজ অফিসে হাজির আছে, অরুন্ধতী, বিশ্বজিৎ, আর কিছু অন্তরা আর আর্যর বন্ধু, আর অন্তরাকে যিনি বড়ো করেছেন, সেই ফাদার। সকলে যেন ভীষণ খুশি। আর্য অন্তরার হাত ধরে ঢুকলো অফিসে।
অরুন্ধতী, অন্তরাকে দেখেই বুঝতে পারছেন, মেয়েটা শরীর এবং মন দুদিক দিয়েই ভালো আছে। অন্তরার মুখের হাসি যেন ভেজালহীন। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়ে গেল।
আর্যর ফোনে একটা ফোন আসতেই, আর্য বললো, একটু পরেই যাচ্ছি।
অন্তরা জিজ্ঞাসা করলো কয়েকবার, আমরা কোথায় যাবো? আর্য ততবারই হেসে বললো, সারপ্রাইজ।
ফাদার অনেক আশীর্বাদ করলেন ওদের। আর্যকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি।
তারপর আর্য, অন্তরা, বিশ্বজিৎ আর ডক্টর অরুন্ধতী গেলেন অন্তরার বাড়িতে।
অন্তরা একটু অবাকই হলো, কারণ সে এই একমাস আর্যর বাড়িতে ছিল। হঠাৎ করে আবার ওর বাড়ি যাওয়ার কারণ সে জানে না।
গাড়ি এসে বাড়ির কাছে থামতেই, অন্তরার পাশের বাড়ির আন্টিরা উলুধ্বনি দিতে লাগলেন। সকলে অন্তরাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। অন্তরার এখন নয় মাস চলছে। তাই নিয়মানুযায়ী এই মাসেই অন্তরার সাধ। আন্টিরা নিজেদের মতো রান্নাবান্না করেছেন। অন্তরাকে বসিয়ে সব খাবার সাজিয়ে দিলেন। লাল শাড়িতে অন্তরাকে আরও যেন সুন্দর লাগছে। আর্য যেন এক মুহুর্তের জন্য চোখ সরাতে পারছে না। তার জীবনে এই প্রথম ভালোবাসার বসন্ত এসেছে। অরুন্ধতী বললেন, খুব গর্ব হচ্ছে আপনার জন্য ডক্টর আর্য। এত সুন্দর একটা সিন্ধান্ত নেওয়ার জন্য। আপনাদের ভালোবাসা সারাজীবন অটুট থাকুক।

… কী ভাবছিস?
… কিছু না তো।
… বললেই আমি শুনে নেব। বল কী ভাবছিস?
… একটা সম্পর্কের নাম থাকা খুবই আবশ্যক? দেখো আমার বাড়ির পাশের আন্টিদের ব্যবহার কেমন পালটে গেল। যে মানুষগুলো আমার মুখ দেখতে চাইতেন না, তাঁরাই আজ আমায় কত আশীর্বাদ করলেন।
… ব্যাপারটা ঠিক তেমন না। সমাজের কথা বাদই দিলাম, আমরা যতই নামহীন সম্পর্ক নিয়ে মাতামাতি করি না কেন, একটা সময় পর সব মানুষই অধিকার খোঁজে।
যেমন ধর, প্রথম প্রথম এমন একটা সম্পর্ক শুরু হলো, যেখানে বলা হলো, আমাদের সম্পর্ক মুক্ত, আমরা নিজেদের মতো স্বাধীন, আমরা যেমন চাইবো সেভাবে নিজেদের জীবন কা’টাবো। কিন্তু একটা সময় পর মানুষ অধিকার খুঁজে। সারাদিন কাজের পর কেউ অপেক্ষা করে না থাকলে, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। অপেক্ষা, অধিকার, বিশ্বাস, ভালোবাসা আর সম্মান এইগুলো যেকোনো সম্পর্কের একটা স্তম্ভ।
বিয়ে মানেই যে সেই সম্পর্ক পবিত্র হয়ে গেল তেমন না। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে সেটা বিয়েই না। আর রইলো সমাজ, সেটাও একদিন পালটে যাবে সময়ের সাথে সাথে। চল রাত হলো, ঘুমিয়ে পড়।

এতক্ষণ ধরে ডক্টর মেঘা, ডক্টর আর্যর প্রেমকাহিনী শুনছিল। এবার আর্য একটু থামলো। মেঘা বললো, তারপর কী হলো?
আর্য বললো, আমাদের জীবনে এল রাজকুমারী। আমার সন্তান।
উঠি এবার, ভোর হয়ে গেল। আবার রাউন্ডে যেতে হবে।

মেঘার মন তখনও ভরে নি। নিশ্চয় এর পরে আরও কিছু হয়েছিল, যেটা ডক্টর আর্য এড়িয়ে গেল। না, মেঘাকে জানতেই হবে।

দুপুরে কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুললো আর্য। সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেঘা। বেশ অবাক হয়ে বললো, আপনি আমার বাড়িতে?
মেঘা বললো, আসলে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনার অন্তরাকে একবার দেখে যায়।
আর্য হেসে বললো, ওহ এই ব্যাপার। আসুন ভিতরে।

আর্য জলের গ্লাসটা নামিয়ে ডাকলো অন্তরাকে।
রুম থেকে বেরিয়ে এল, একটি ৩ বছরের বাচ্চা মেয়ে, আদো আদো গলায় বললো, আমায় ডাকছো কেন?
আর্য বললো, এই আন্টিটা তোমায় দেখতে এসেছেন। আন্টিকে হ্যালো বলো।
বাচ্চা মেয়েটি তখন মিষ্টি গলায় বললো, হ্যালো আন্টি!
মেঘা অবাক হলেও, মুখে হাসি নিয়ে বললো, হ্যালো বেটা! কী নাম তোমার?
বাচ্চা মেয়েটি বললো, আমার নাম অন্তরা।
কথাটি বলেই কোলে থাকা পুতুলটিকে দেখিয়ে বললো, এবার আমি যাই, মিমিকে ঘুম পাড়াতে হবে।
মেঘা ঘাড় নাড়লো।
বাচ্চা মেয়েটি চলে যেতেই, আর্য বললো, আপনি যার খোঁজে এসেছেন, তাকে দেখতে পাবেন না। সে ছিল স্বাধীন পাখি। অনেক চেষ্টা করেছিলাম, তাকে আটকে রাখার, কিন্তু পারি নি। অন্তরাকে জন্ম দিয়ে ওই অন্তরা হারিয়ে গেল। বহু চেষ্টা করেছিলেন ডক্টর অরুন্ধতী এবং বাকি সব ডক্টর। কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো। সে ছিল ক্ষণিকের অতিথি। তবে সেই ছিল আমার ভালোবাসা।

অনেকক্ষণ আগেই মেঘা, আর্যর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। মনে মনে ভাবছে, এমনও মানুষ পৃথিবীতে আছে বলেই, এখনও পৃথিবী টিকে আছে।

সমাপ্ত

আগন্তুক পর্ব-০৩

0

#আগন্তুক
#তৃতীয়_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

বিশ্বজিৎ-এর দেওয়া ঠিকানায় গাড়ি নিয়ে পৌঁছালো আর্য। আগে থেকেই বিশ্বজিৎ-এর কাছে জেনে নিয়েছে, এইসময় অন্তরা থাকবে কিনা।
গাড়ি এসে বাড়ির কাছে থামতেই সামনেই কিছু আন্টিরা বসে গল্প করছেন, গাড়ি দাঁড়াতে দেখেই চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন তাঁরা। আর্য মনে মনে ভাবলো, অন্তরার সাথে অন্তরার মতো করেই মিশতে হবে। এই তিনবার দেখাতেই আর্যর মনে হয়, সে অন্তরাকে পুরোটা চিনে নিয়েছে। এতটাও কঠিনও ছিল না যদিও। অন্তরার বাচ্চাদের মতো হাবভাব, কথাবার্তা। তবে পরোপকারীও, আবার কঠোর আর জেদি।
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ফোনটা বের করে অন্তরাকে ফোন করলো আর্য।
এদিকে আন্টিরা নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছিলেন।

ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিল অন্তরা। আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসতে একটু অবাকই হয়েছিল। যে পরিস্থিতিতে সে এখন আছে, তাতে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া আর কেউই খোঁজ রাখে না। তারমধ্যে চার্চের ফাদার আর কয়েকজন বন্ধুর রোজ ফোন আসে। কখনো সখনো কাস্টমার ফোন করে ফটোশুটের জন্য। তবে এখন বেশ ক ষ্ট হয় অন্তরার। সময়ের সাথে সাথে পেটও বেড়েছে, সন্তানের নড়াচড়া ভালোই অনুভব করতে পারে। অন্তরার এখন অনেক কাজ, সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর ভালো ভাবে বড় করতে হবে। তাকে মানুষের মতো মানুষ গড়ে তুলতে হবে। এখন আর মন খা’রাপ হয় না। সুমনের উপর কোনো রা গ নেই অন্তরার। সুমন হয়তো এইসবের জন্য প্রস্তুত নয়। তবে অন্তরা কিছুতেই এই বাচ্চা ন ষ্ট করতে পারবে না, তাই তো জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও, তাকে পৃথিবীর আলো দেখাবে বলে সিন্ধান্ত নিয়েছে। ফাদারকে বারবার বলেছে, আমি যদি না থাকি, তুমি আমার মতই আমার সন্তানকে বড় করবে।

আরও একবার ফোনটা বেজে উঠতেই সম্বিৎ ফিরলো অন্তরার। আবারও সেই আননোন নাম্বার থেকে ফোন। ফোন রিসিভ করতেই, ওই প্রান্ত থেকে একজন বললো, একবার ব্যালকনিতে আসতে পারবেন ম্যাডাম? একটু দরকার ছিল।
অন্তরা কিছু বলার আগেই ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। অন্তরা বেশ অবাক হল। ল্যাপটপটা বিছানায় রেখে, ব্যালকনিতে গেল অন্তরা। নীচে ডক্টর আর্যকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল। আর্য হাসি মুখে হাত নাড়লো। অন্তরার চোখ গেল এবার পাশে বসে থাকা আন্টিদের দিকে। এমনিতেই তাঁদের এখন হট টপিক অন্তরা। অন্তরার গর্ভে কার বাচ্চা আছে, এই নিয়ে তাঁদের চিন্তার শেষ নেই। এই অবস্থায় ডক্টর আর্যকে দেখে তাঁদের টপিকে আরও স্পাইসি মশলা এড করা যাবে। এই ভেবেই অন্তরা হেসে বললো, কী ব্যাপার ডক্টর আর্য, আপনি আমার প্রেমে পড়লেন নাকি? আজ একেবারে বাড়ি অব্দি চলে এলেন।
আর্য হেসে বললো, কী করবো বলুন, আপনাকে দেখার পর রাতের ঘুম উড়ে গেছে। দিনরাত শুধু আপনার কথা ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই রোগের ট্রিটমেন্ট এবার আপনাকেই করতে হবে।
অন্তরা হো হো করে হেসে বললো, কিন্তু ডক্টর তো আপনি।
আর্য বললো, ডক্টর নিজের ট্রিটমেন্ট নিজে করতে পারবে না।
দুজনে কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর আর্য বললো, দরজাটা খুলবেন, একটু কথা ছিল। অন্তরা হাসি মুখে বললো, আসুন।
আন্টিরা কিছুই বুঝতে পারলেন না। অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। এদিকে আর্য একবার তাঁদের দিকে তাকিয়ে চশমাটা খুলে অন্তরার বাড়ির দরজার কাছে গেল।
অন্তরা ধীরে ধীরে নীচে নামার সময় ভাবলো, ডক্টর আর্য কীভাবে তার ঠিকানা পেল? এতদূর যখন এসেছেন, নিশ্চয় তিনি অন্তরার ব্যাপারে সবটুকু জেনে গেছেন। কিন্তু উনি কেন এমন করছেন? কী উদ্দেশ্য ওনার?

অন্তরা দরজাটা খুলতেই আর্য বললো, দুকাপ চা বানা তাড়াতাড়ি।
অন্তরা অবাক হয়ে বললো, দু কাপ?
আর্য বললো, হ্যাঁ দু কাপ, তোর আর আমার। সেদিন আমাকে আসতে বলে নিজে বেপাত্তা। আচ্ছা চল ছাড়, আমি বানাচ্ছি। কিচেনটা কোন দিকে? অন্তরা তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আর্যর দিকে। আর্য আবারও বললো, কিচেনটা কোনদিকে? অন্তরা হাতের ইশারা করে বোঝালো, মুখে কিছু বললো না। আর্য বললো, ওকে তুই চুপ করে এখানে বস, আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। আর হ্যাঁ মুখটা বন্ধ কর, নয়তো মাছি ঢুকে যাবে।

আর্য চা বানাতে গেল। অন্তরা নিজেকে চিমটি কে টে দেখলো, এইসব সত্যি নাকি স্বপ্ন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আর্য চা বানিয়ে নিয়ে এসে বসলো অন্তরার কাছে। অন্তরাকে এক কাপ চা দিয়ে বললো, দেখ তো কেমন বানিয়েছি। চিনি দিই নি। এইসময় তোর চিনি খাওয়া ঠিক নয়।
অন্তরা আর্যর দিকে তাকিয়ে বললো, কেন করছেন এমন?
আর্য অন্তরার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো, কাল সকালের দিকে নিতে আসবো, ডক্টর অরুন্ধতীর কাছে নিয়ে যাব চেক আপের জন্য। পালাবার চেষ্টা করিস না, যেখানে যাবি, সেখান থেকে খুঁজে তোকে বের করবো।

অন্তরা হাউহাউ করে কেঁ দে উঠলো। আর্য, অন্তরার আরও একটু কাছে গিয়ে বসলো। তারপর বললো, আমি বিশ্বজিৎ-এর কাছে গিয়েছিলাম। ওখান থেকেই তোর ঠিকানা আর ফোন নাম্বার পেয়েছি। আমি ওর কাছে সবটা জেনেছি। আমি তোকে জাজ করছি না অন্তরা। তুই যে ডিসিশনটা নিয়েছিস, সেটা আমি রেসপেক্ট করছি। তবে তোকে বুঝতে হবে, সব পুরুষ এক নয়। তোর আর কোথাও পালাবার পথ নেই। আমি তোকে ছাড়ছি না। তোর এই জার্নিটাতে আমাকে সাথে নিবি? আমি জানি না, আমি কেন এমন করছি? এমন তো পাগলামি আমি কোনোদিন করিনি। এই যে হঠাৎ একজন অপরিচিতকে এতটাই কাছের মনে হচ্ছে যে, আমি সোজা আপনি থেকে তুই করে বলছি। আমি জানি তুই ভীষণ স্ট্রং, তোর কাউকে প্রয়োজন নেই। তবুও আমি তোর পাশে থাকতে চাই। তোর এই জার্নিটা আরও সুন্দর করে তুলতে চাই। আমাকে রাখবি প্লিজ?
অন্তরা কান্না ভেজা গলায় ধীরে ধীরে বললো, রাখবো। যে কোনো বাহানায়, এই ছেড়ে যাওয়ার যুগে, কেউ থাকতে চাইলে তাকে ফিরিয়ে দিতে নেই। এটা আমাকে ফাদার বলেছেন। দুজনেই হাসছে। এই সুন্দর মুহুর্ত দেখার মতো কেউ নেই। তবুও সাক্ষী থাকলো এই বিকেল, এই চায়ের কাপদুটো।

চা শেষ করেই আর্য বললো, চল রেডি হয়ে নে, একটু ঘুরে আসি।
এই প্রথম অন্তরা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না, আর্যর কাছে যেন নিজেকে মেলে ধরলো। আর্য কাপদুটো নিয়ে বেসিনে গিয়ে বললো, একদম আঁটোসাঁটো ড্রেস পরবি না, ঢিলেঢালা কিছু পরিস, যেটাতে তুই আর বাবু দুজনেই কম্ফোর্টেবল ফিল করবি।
অন্তরা রেডি হয়ে এসে বললো, চলো, আজ আমাকে ফুচকা খাওয়াবে? অনেকদিন খাই নি।

অন্তরার হাসিমুখটা দেখে কিছুক্ষণ আর্য তাকিয়ে থাকলো। যেন একটা গাছ বৃষ্টির জল পেয়ে সবুজ আর সতেজ হয়েছে। আর্য মনে মনে ভাবলো, এই মেয়েটা অনেক কিছু একা সামলেছে, এবার ওর দুনিয়ার সব আনন্দ, সুখ দেখার পালা। ওকে আর ক ষ্ট পেতে দেওয়া যাবে না।
অন্তরার হাতটা ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল আর্য। আন্টিদের নজর তখনও ওদের দিকে। আর্য সেদিকে আর না তাকিয়ে, গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে গেল। গাড়ির স্পিড একদম কম। অন্তরা সেটা বুঝতে পারলো। তারপর নীরবতা ভে ঙে অন্তরা বললো, তুমি তো আমার জন্য ব’দনাম হয়ে গেলে ওই আন্টিদের কাছে। আর্য হেসে বললো, তা হলে হবো। কি করি বল, তোর মতো বন্ধুর জন্য এইটুকু সহ্য আমি করে নেব।
কথাটা বলা মাত্রই দুজনে আবার হেসে উঠলো।

এইভাবেই কে টে গেল আরও কয়েকটা দিন। এই কটা দিনে আর্য আর অন্তরার বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে। অন্তরা এইটুকু বুঝতে পেরেছে, আর্য কোনো স্বার্থ ছাড়াই তার জীবনে এসেছে। ডক্টর অরুন্ধতী, অন্তরার চেক আপের পর আর্যকে জানালেন, বেবি ঠিক আছে। কিন্তু অন্তরার ওভারিতে যে টিউমার আছে, সেটা নিয়ে ভ য় থেকেই যায়।
আর্য বললো, সেরকম হলে ওভারি বাদও তো দেওয়া যাবে বেবি হওয়ার পর।
অরুন্ধতী বললেন, রিস্ক আছে, ব্লি ডিং এর পরিমাণ বেড়ে গেলে, তখন কিছু করা যাবে না।
আপাতত এখন ওকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। সব থেকে বড় কথা ওকে হাসিখুশি রাখতে হবে। কিন্তু ওর ব্যাপারে যেটুকু শুনলাম, তাতে ওকে একা থাকতে হয়। এইসময় মোটেই ওকে একা রাখা যাবে না। এতদিন সেভাবে ও কোনো চেক আপ বা ট্রিটমেন্টের মধ্যে ছিল না। যদি প্রথম থেকে ব্যাপারটা ধরা পড়তো, তবুও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম। এখন চান্স অনেকটাই কম। আমাদের ডক্টরদের অনেক ব’দনাম হয়, কিন্তু পেশেন্ট যদি প্রথম থেকে রোগের ট্রিটমেন্ট না করায়, তাহলে অনেক সময় আমাদের হাতে কিছুই করার থাকে না। তবে আমি সবরকম চেষ্টা করবো অন্তরার জন্য। আমি আরও সিনিয়র ডক্টরদের সাথেও কথা বলবো।

কিছুক্ষণ পর বিশ্বজিৎ-এর ফোন এল আর্যর ফোনে। ফোনে বিশ্বজিৎ-এর কথা শুনে ভ য় পেয়ে গেল। অরুন্ধতী শুধু এইটুকু বুঝতে পারলেন, অন্তরা বাথরুমে পড়ে গেছে।

পরের পর্বে সমাপ্ত…

ভুলত্রুটি মার্জনীয় 🙏

আগন্তুক পর্ব-০২

0

#আগন্তুক
#দ্বিতীয়_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

দুপুরের পর থেকে জ্বরটা আর নেই আর্যর। তবে মনটা কেমন যেন বি ষ ণ্ণ। সারাদিনের বৃষ্টির পর বিকেলে মেঘের গুমোট ভাব এখনও রয়ে গেছে। হয়তো আরও বৃষ্টি হবে। এইভাবে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না আর। তাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো আর্য। কিছুক্ষণ পর ঝমঝম করে আবার বৃষ্টি নামলো। গাড়ির ভিতর থেকে ঝাপসা অথচ অন্তরাকে দেখেই চিনতে পারলো আর্য। এই মেয়েটাকেই তো গত একমাস ধরে খুঁজছিল সে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গাইনোকোলজিস্ট অরুন্ধতীর কাছে গিয়ে খবর নিয়েছিল আর্য, অন্তরা আর চেক আপে এসেছিল কিনা। কিন্তু অরুন্ধতীর কাছে অন্তরা আর আসেনি।
আর একটুও দেরি করলো না আর্য। অন্তরার কাছে গিয়ে আর্য বললো, এই ভাবে ভিজছেন কেন? গাড়িতে উঠে আসুন। অন্তরা হঠাৎ করে আর্যকে দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়েছিল, হয়তো প্রথমে চিনতে অসুবিধা হয়েছিল, তারপর চিনতে পেরেই বললো, ও ডক্টর যে, আপনি এখানে কী করছেন?
আর্য বললো, সব কথা গাড়িতে বলাও যাবে, আপনি উঠে আসুন। অন্তরা সাথে সাথে বললো, আর আপনি ব্যস্ত হবেন না, এখনই আমি কোনো গাড়ি পেয়ে যাব। আর্য এবার কিছুটা রা গ দেখিয়ে বললো, আপনি আসবেন, নাকি আমি গাড়ি থেকে নামবো?
অন্তরা আর কথা বাড়ালো না। গাড়িতে এসে চাপলো।
তারপর আর্য গাড়ি স্টার্ট করে এগিয়ে গেল।
অন্তরা বললো, উফ দেখলেন তো, আপনার গাড়ির সিট কেমন ভিজে গেল আমার জন্য। আমি বললাম তো তখন, আমি কোনো না কোনো গাড়ি পেয়ে যেতাম।
আর্য অন্তরার কোনো কথা পাত্তা না দিয়ে বললো, শরীর কেমন আছে এখন?
অন্তরা বললো, ঠিক আছে, তবে মাঝেমধ্যে মাথাটা খুব ঘোরায়। আর পুষ্টিকর খাবার দেখলে বমি আসে। তবে ফাস্টফুড দেখলে সেটা হয় না। এখন তো ছয় মাস চলছে। একটু একটু করে ওর নড়াচড়া অনুভব করতে পারি। কথাটা বলেই অন্তরা পেটে হাত দিয়ে মনে মনে হাসলো। সেটা খেয়াল করলো আর্য। এখনই অন্তরার সাথে কথা বলা ঠিক হবে না। আগে ওর হাজব্যান্ডের সাথে কথা বলতে হবে। কিছুক্ষণ থেমে আর্য বললো, বাড়ির ঠিকানাটা দিন, আপনাকে পৌঁছে দেবো। অন্তরা সাথে সাথে বললো, না না এখনই বাড়ি যাবো না, আমার এখনও ফটোশুটের কাজ আছে। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে। সামনেই শপিংমল আছে, তার অপজিট সাইডে দাঁড়িয়ে যাবেন। আর্য অন্তরার কথা না শুনে, সোজা গিয়ে শপিংমলের কাছে এসে দাঁড়ালো। অন্তরা অবাক হয়ে বললো, এখানে দাঁড়ালেন কেন?
আর্য কোনো কথা না বলে, গাড়ি থেকে নেমে, অন্তরার কাছে এসে, গাড়ির দরজা খুলে নামতে বললো। অন্তরা অবাক হলো ঠিকই, কিন্তু আর্যর কথা মতো নেমে গেল। তারপর আর্য বললো, যেমন বলবো, তেমন করবেন, কোনো প্রশ্ন করবেন না। শপিংমলে ঢুকে আর্য একটা ঢিলেঢালা পোশাক খুঁজছিল, যা অন্তরার পরতে সাচ্ছন্দ্য হবে। সে রকমই একটা পেয়ে অন্তরাকে বললো, যাও চেঞ্জ করে এসো। অন্তরা আর কোনো কথা না বলে আর্যর কথা মতো ড্রেস চেঞ্জ করে এল। তখন আর্যর বিল পেমেন্ট করা হয়ে গেছে। দুটো কফি নিয়ে বসেছে দুজনে। আর্য বললো, আপনার হাজব্যান্ডের নাম্বারটা একবার দিন। এমনি একটু পরিচয় করবো। অন্তরা সাথে সাথে বললো, আসলে ও একটু ব্যস্ত আছে। এক কাজ করুন, কাল এইসময় এখানে আসুন, আমিও আমার হাজব্যান্ডকে নিয়ে আসবো। পরিচয়টা হয়ে যাবে। আর্য মুখে বললো, ঠিক আছে। কিন্তু অন্তরার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ যেন আর্যর কাছে কেমন যেন লাগলো। কিছু একটা লুকাচ্ছে মেয়েটা। কিন্তু অরুন্ধতীর কথা মতো, এই বাচ্চাটা নিতে গেলে অন্তরার জীবনের ঝুঁকি আছে। ছয়মাস হয়ে গেছে, এখন কিছুই করা যাবে না। তবে হাজব্যান্ডের সাথে কথা বলে দেখতে হবে, নিশ্চয় কিছু একটা পথ বেরোবে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, অন্তরা রিপোর্টের ব্যাপারে সব জানে, তাও বিন্দুমাত্র ওর মধ্যে কোনো টেনশন বা ভ য় নেই। সুন্দর কাজ করে যাচ্ছে। আরও কয়েকবার অন্তরার হাজব্যান্ডের ব্যাপারে জানার চেষ্টা করলো আর্য, কিন্তু প্রতিবার অন্তরা খুব স্মার্টলি কথা ঘুরিয়ে দিল।

অন্তরার কথা মতো সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আর্য অনেক আগেই ফিরে গেছে বাড়িতে। বারবার মনে হচ্ছে, অন্তরা কিছু লুকাচ্ছে। যা জানতেই হবে আর্যকে। এমনিতেও কাল তো দেখা হচ্ছেই ওর হাজব্যান্ডের সাথে।

হসপিটালে গিয়ে আগে অরুন্ধতীর সাথে দেখা করলো আর্য। অরুন্ধতীকে জানালো অন্তরার ব্যাপারে। অরুন্ধতী সাথে সাথে বললেন, গ্রেট জব ডক্টর আর্য। অন্তরার হাজব্যান্ডের সাথে দেখা করাটা খুবই জরুরি। অন্তরার প্রেগন্যান্সির জটিলতার মাঝে আরও একটা সমস্যা হলো ওর Rh নেগেটিভ, যার জন্য ওর হাজব্যান্ডের ব্লাড টেস্ট খুব জরুরি। যদি ওরা অন্য কোথাও টেস্ট করিয়ে নিয়েছে বা অন্তরাকে অন্য কোথাও দেখিয়েছে, সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কিছু নেই। তবে যদি না করিয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই করতে হবে। আর্য বললো, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, অন্তরা কিছু লুকাচ্ছে আমাদের কাছে। আমি ওর হাজব্যান্ডের কথা জানতে চাইলাম, আর ও বারবার সেটা এড়িয়ে গেল। অরুন্ধতী বললেন, সেদিন আমিও চেষ্টা করেছিলাম, আমার সাথেও তাই করেছে। আপনি প্লিজ ব্যাপারটা একটু দেখুন।
আর্য মাথা নাড়লো।

নির্দিষ্ট সময় মতো আর্য চলে এসেছে। কিন্তু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও অন্তরা এল না। প্রায় ২ ঘন্টা থাকার পরও এল না। পরের দিনও আর্য এল, সেদিনও অন্তরা এল না। আর্যর এবার ধৈর্যর বাঁধ যেন ভা ঙ লো। খুব রা গ হলো অন্তরার উপর। যেখানে অন্তরাকে নামিয়েছিল, সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়েও কিছু জানতে পারলো না। রা গ, হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে এল আর্য। কে টে গেল আরও কয়েকটা দিন। এর মাঝে একদিন ডক্টর অরুন্ধতী আর্যর কাছে এসে সবটা শুনে বললো, আমাদের তাহলে করার কিছু নেই। হতে পারে ওরা অন্য কোথাও দেখিয়েছে। এই অবস্থায় তো ফেলে রাখা যাবে না। হয়তো আমরা এই কেসটা নিয়ে একটু বেশি ভাবছি। আসলে এমন জটিলতা আমি আর কোনো পেশেন্টের মধ্যে পাই নি। তাই মনটা যেন কেমন লাগছে।
আর্য কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো, কয়েক মাস আগে, ওর এক বন্ধু এখানে এডমিট হয়েছিল। রিসেপশনিস্টকে বলে যদি তার ঠিকানাটা বের করতে পারি, তাহলে কিন্তু অন্তরার খোঁজ পাওয়া যাবে।
অরুন্ধতী বললেন, চলুন তাহলে, একবার দেখা যাক।
অনেক খোঁজার পর বিশ্বজিৎ কুমারের ঠিকানাটা পেল আর্য।
অরুন্ধতী বললেন, আর দেরি না করে যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমিও যাব দরকার হলে আপনার সাথে।

বিকেলে একটু ফ্রি হতেই দুজনে বেরিয়ে গেল বিশ্বজিৎ কুমারের ঠিকানায়।
দরজার কলিং বেলের আওয়াজ শুনে বিশ্বজিৎ এসে দরজা খুললো। আর্য বললো, আপনি আমাকে চিনবেন না, আমরা আপনার কাছে অন্তরার খোঁজে এসেছি। বিশ্বজিৎ শান্ত গলায় বললো, ভিতরে আসুন।
আর্য আর অরুন্ধতী দুজনে ভিতরে গিয়ে বসলো। বিশ্বজিৎ বললো, বলুন কী জানার আছে অন্তরার ব্যাপারে?
আর্য বললো, আপনি যে হসপিটালে এডমিট হয়েছিলেন অ্যা ক্সি ডে ন্টের পর, আমরা সেই হসপিটালের ডক্টর। তখনই পরিচয় হয়েছিল অন্তরার সাথে। মনে আছে আপনার? অন্তরা আপনাকে দেখতে গিয়েছিল?
বিশ্বজিৎ বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে তো। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আমাকে বলুন তো।
এবার অরুন্ধতী বললেন, অন্তরা প্রেগন্যান্ট। সেজন্য পরে আবার হসপিটালে গিয়েছিল। আমি কয়েকটা টেস্ট করাতে দিয়েছিলাম, রিপোর্টে অনেক সমস্যা আছে, যার জন্য ওর বাড়ির কারোর সাথে কথা বলাটা খুব জরুরী। ওকে বলেছিলাম, কিন্তু ও পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে।
বিশ্বজিৎ উদাস সুরে বললো, বাড়ির কেউ থাকলে তো, ও যোগাযোগ করাবে। খুব ছোটবেলাতেই মা-বাবাকে হারিয়েছে। চার্চের ফাদারের কাছে বড়ো হয়েছে। ওখানে থেকেই পড়াশোনা। কলেজে আমাদের পরিচয় হয়, তখন থেকে আমরা বন্ধু। সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকা চঞ্চল মেয়ে একটা। কিন্তু ওর জীবনেই এমন ঘটে যাবে, কেউ বুঝতে পারি নি।
আর্য বললো, তাহলে ওর হাজব্যান্ডের সাথে আমরা দেখা করবো, ওনার সাথে কথা বলবো।
বিশ্বজিৎ কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো, ওর বিয়ে হয়নি। কয়েকবছর আগে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছিল অন্তরা। ফটোগ্রাফি নেশা ছেড়ে প্রফেশন হয়ে দাঁড়ালো। বেশ নামও হয়েছিল ওর। সেই সময় ওর জীবনে আসে সুমন। বেশ ভালোই চলছিল ওদের জীবন। কিন্তু কয়েকমাস আগে, সুমন যখন জানতে পারলো অন্তরা প্রেগন্যান্ট, তখন ওর কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেল। বারবার এই বাচ্চা ন ষ্ট করার কথা বলতো। অন্তরা রাজি ছিল না। শেষ পর্যন্ত ব্রেক আপ হয়ে যায় ওদের। আমরা বন্ধুরা মিলে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। সুমন বুঝলো না। নিজের সন্তানকেই মে রে ফেলার কথা বলতে লাগলো। শেষে অন্তরা যেন কঠোর হয়ে বললো, এই সন্তানের উপর অধিকার শুধু অন্তরার। কোনোদিন সুমনের কাছে কোনো অধিকার দাবি করবে না। এই বাচ্চাকে অন্তরা একা মানুষ করবে। আমরা সবাই ওর সাথে ছিলাম। যে মেয়েটা বন্ধুর বি’পদে সবার আগে ঝাঁ’পিয়ে পড়তো, তার এই কঠিন সময়ে কী করে একা ছাড়ি বলুন? তবে ওর প্রেগন্যান্সির জটিলতার ব্যাপারে আমরা সবাই পরে জেনেছি। আগে জানলে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যেত। ওর কিছু হয়ে গেলে, ফাদার ওর সন্তানের দায়িত্ব নেবেন। আর আমরা বন্ধুরা তো আছিই। এখন একটাই প্রার্থনা, মেয়েটার জীবনে সবকিছু ভালো হোক। খা’রাপ কিছু যেন না হয়, তবে সবদিকটা আমাদের ভাবতে হচ্ছে। এমন জেদি মেয়ে যে একটা কথা শোনে না। এই অবস্থাতেও কাজ করে যাচ্ছে।
অরুন্ধতী আর আর্য অসহায় দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
আর্য এবার বিশ্বজিৎ এর কাছে অন্তরার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার নিল।

বাইরে বেরিয়ে আসার পর অরুন্ধতী জিজ্ঞাসা করলেন, এবার কী করবেন ডক্টর আর্য?
আর্য আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, জানি না। তবে মেয়েটাকে একা ছাড়া যাবে না। যেভাবেই হোক আমি ওর সাথে যোগাযোগ করবো।

চলবে…

ভুলত্রুটি মার্জনীয় 🙏

আগন্তুক পর্ব-০১

0

#আগন্তুক
#প্রথম_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

…মানে আপনার কথা শুনে যা দাঁড়ালো, তা হলো, ৬ মাসের মধ্যে আপনার একজনের সাথে পরিচয় হলো, বিয়ে হলো, আবার সন্তানও হয়ে গেল। খুব অবাক লাগছে শুনে। কিছু মনে করবেন না ডক্টর আর্য, আপনি একজন ডক্টর, আপনার মুখে এই অবিশ্বাস্য কথা ঠিক মানায় না।

মেঘার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো আর্য। তারপর হাসি থামিয়ে বললো, ডক্টর মেঘা, এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। আমার জীবনে এমনি ঘটেছে৷ ভালোই আছি আমরা। আমার একটি কন্যা সন্তানও আছে। একদিন আলাপ করিয়ে দেবো সবার সাথে।

আর্য উঠে দাঁড়াতেই মেঘা বললো, বাড়ি যাওয়ার যদি তাড়া না থাকে, তাহলে পুরো গল্পটা আমি শুনতে চাই, আসলে এই পুরো গল্পটা না জানলে, আমার ঘুম আসবে না রাতে।

আর্য আবার হেসে বললো, এমনিতেও আজ রাতে আপনার ঘুম আসবে না, আপনার আজ নাইটে ডিউটি। আর সাথে আমারও।

মেঘা বললো, তাহলে তো ভালোই, যদি একটু ফ্রি থাকি তাহলে রাতেই তো শোনাতে পারেন আপনার প্রেম কাহিনী?
আর্য বললো, ঠিক আছে তাহলে তাই হবে, এখন একটা বাড়িতে ফোন করে আসি।

আর্য এই হসপিটালে আছে গত ৪ বছর ধরে। মেঘা এই নতুন এসেছে। একটু আধটু পরিচয় হয়েছে কর্ম সূত্রের প্রয়োজনে। কিন্তু যেদিন থেকে মেঘা শুনেছে আর্য ৬ মাসের মধ্যে একজনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে, এবং ৬ মাসেই এক সন্তানের বাবা হয়েছে, সেদিন থেকেই তার কৌতূহলী মন বারবার জানতে চেয়েছে, আর্যর জীবনের কাহিনী। কিন্তু সেইভাবে সময় হয়ে উঠছিল না। আজ নিজেই আর্যকে একা দেখে ভাব জমিয়েছে কাহিনী শোনার জন্য।

রাত্রি প্রায় ১২ টা…
মেঘা একবার রাউন্ড দিয়ে এসে বসেছে নিজের চেয়ারে। আর মনে মনে আর্যর জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে যাবার পর, আর্যকে দূর থেকে দেখতে পেল, হাসতে হাসতে আসছে।
আর্য বেশ সুদর্শন পুরুষ। একজন ভালো ডাক্তারও। সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকে। রোগীদের ব্যাপারে একদম ধৈর্য হারায় না। ব্যবহারের জন্য সবাই তাকে ভালোবাসে। তবে এক নার্সের কাছে শুনেছে আর্য আগে এমন ছিল না। চুপচাপ, কম কথা বলতো, গম্ভীর ছিল।
বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলো না মেঘা। এমন সুদর্শন বিবাহিত পুরুষ দেখে তার মনটা ভে ঙে গেছে আগেই। তবুও আর কি করার। বিবাহিত শুনেই সে বেশি আর ঘেঁষে নি আর্যর কাছে। কিন্তু আর্যর ব্যাপারে একটু-আধটু জেনে কৌতূহলবশত একটু ভাব জমাতেই হলো মেঘাকে।

… মেঘা, আপনি খেয়েছেন।
… হ্যাঁ ডক্টর আর্য। আপনি খেয়েছেন?
… হ্যাঁ। ডিনারটা রাত্রি ৮ টার মধ্যেই করে ফেলি। তারপর তো সারারাত এখন চলতেই থাকবে, এই পেশেন্টকে দেখুন ওই পেশেন্টকে দেখুন।
কথাটা বলেই আবার হেসে উঠলো আর্য। মেঘা চোখটা নামিয়ে নিল। এমন সুন্দর হাসি দেখলে যে কেউ ক্রাশ খেয়ে যেতে পারে। মেঘা তারপর বললো, এখন আপনার সময় হবে, কাহিনী শোনানোর জন্য?
আর্য হাতের ঘড়িটা দেখে বললো, হ্যাঁ একবার তো রাউন্ড দিয়ে এসেছি, ডাক না পড়লে এখন আর যেতে হবে না। সেই আবার সকালে।
তবে আপনার ধৈর্য হবে তো? আসলে কাহিনী কিন্তু অনেক বড়।
মেঘা সাথে সাথে বললো, হবে হবে। বলুন।

আর্য মুচকি হাসলো। তারপর শুরু করলো তার প্রেম কাহিনী। বলতে বলতে হারিয়ে গেল অতীতের পাতায়…

… দেখুন আমি এখানে একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি। নাম বুম্বা। বাইক অ্যা ক্সি ডে ন্ট হয়েছে। তবে যমে নেয় নি। বেঁ চে আছে এখনও। আমার বন্ধু হয়, তার সাথেই দেখা করবো।
… দেখুন ম্যাম এই নামে এই হসপিটালে কেউ এডমিট হয় নি।
… আরে দেখুন না ভালো করে। এখানেই এডমিট হয়েছে। গায়ের রঙ শ্যামলা। জিরাফের মতো লম্বা। দেখলেই মনে হবে নে শাখো র।
… সরি ম্যাম, এইভাবে বর্ননা দিলেও আমি কোনো হেল্প করতে পারবো না।

পাশ থেকে পুরোটা শুনছে আর্য। এই সদ্য এই হসপিটালে এসেছে। এমনিতেই কাজের প্রেশার নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছে। একটু ফ্রি হতেই নীচে নেমে এসেছিল। পাশে এমন উত্তেজিত ভাবে একজনকে দেখে হেল্প করার জন্য এগিয়ে এল। কিন্তু যে ভাবে উনি বর্ননা দিচ্ছেন তাতে হাসিই পেল আর্যর। নিজের হাসি কন্ট্রোল করে সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো, দেখুন ম্যাম আপনি যে ভাবে বলছেন, তাতে পেশেন্টকে খোঁজা মুশকিল এত বড় হসপিটালে। আর আমার মনে হয় পেশেন্টের কোনো ভালো নাম আছে, সেটা আপনি বলুন।
অন্তরা মাথা চুলকিয়ে বললো, বুম্বা নামেই তো ডেকে এসেছি, ভালো নামটা মনে নেই।
আর্য এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
… আচ্ছা কবে অ্যা ক্সি ডে ন্ট হয়েছে।
… আজ সকালে।
… আপনি শিওর তো এই হসপিটালেই এডমিট আছেন উনি?
… হ্যাঁ হ্যাঁ দেখুন, আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে এখানেরই ঠিকানা দিয়েছে। কিন্তু এখন ওর ফোনটা বন্ধ। নয়তো ওকে ফোন করে জেনে নিতাম।
আর্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তাতে নাম সেভ করা আছে বুম্বা মাঙ্কি বলে।
আর্য এবার অন্তরার দিকে তাকালো, মেয়েটাকে স্বাভাবিক বলে মনে হলো না তার, মাথায় কিছু সমস্যা থাকলেও থাকতে পারে। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে, রিসেপশনিস্টকে বললো, আজ সকালের কোনো অ্যা ক্সি ডে ন্ট কেস ছিল?
তিনি কম্পিউটারে দেখে বললেন, হ্যাঁ ডক্টর আছে। নাম বিশ্বজিৎ কুমার। ৭ নম্বর বেডে আছেন উনি।
সবটা শুনে অন্তরা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল আর্যর কাছে।
ও ডক্টর আপনি একবার চলুন না আমার সাথে। আমি তো কিছুই চিনি না।
আর্য নিরুপায়, এই যা মেয়ে, কিছুতেই মনে হয় ছাড়বে না। একবার পেশেন্টের সাথে দেখা করিয়ে দিলে, আর কোনো ঝামেলা থাকবে না। তাই বাধ্য হয়ে বললো, চলুন।
যেতে যেতে অন্তরা বললো, আপনি গাইনোকোলজিস্ট?
আর্য বললো, না আমি জেনারেল ফিজিশিয়ান।
অন্তরা তখন বললো, ও আচ্ছা।
আর্য তখন বললো, কেন বলুন তো? আমাকে দেখে এমন মনে হওয়ার কারণ কী?
অন্তরা হেসে বললো, না এমন হ্যান্ডসাম মেয়েদের ডক্টর হলে তো কথায় নেই।
আর্য মনে মনে ভাবলো, এই মেয়ের সত্যিই মাথায় সমস্যা আছে।
অন্তরা বললো, আমি অন্তরা। আমি একজন ফটোগ্রাফার। আপনার নাম কী?
আর্য গাম্ভীর্য নিয়ে বললো, আমার নাম আর্য চৌধুরী। নিন চলে এসেছি আপনার পেশেন্টের কাছে। দূর থেকে দেখেই চিনতে পারলো অন্তরা। এই তো গাধাটা। ওখান থেকে চিৎকার করে বললো, ওই বুম্বার বাচ্চা, বেঁ চে আছিস, চল ট্রিট দে।
আর্য বললো, আস্তে আস্তে, এটা হসপিটাল। অন্তরা জিভ কে টে বললো, ও সরি সরি। আসলে বন্ধু ভালো আছে দেখে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। সরি সরি। আর অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কথাটা বলেই অন্তরা এগিয়ে গেল। পেছন থেকে আর্য ডেকে বললো, আপনার বন্ধুর নাম বিশ্বজিৎ। নামটা আশা করি এবার মনে থাকবে৷ অন্তরা পেছন ফিরে বললো, হ্যাঁ ভুলেই গিয়েছিলাম, গাধাটার নাম বিশ্বজিৎ।
আর্য আবার বললো, গাধা হলে, হোয়াটসঅ্যাপে নামের পাশে মাঙ্কি সেভ করা কেন? আর তখন রিসেপশনিস্টকে বলছিলেন আপনার বন্ধু জিরাফের মতো লম্বা। একটা মানুষের মধ্যে এত গুলো প্রাণী থাকে কিভাবে?
কথাটা বলেই আর্য হেসে চলে গেল। কিছুটা যেয়ে খেয়াল হলো, ওর মতো গম্ভীর ছেলেকেও মেয়েটা হাসিয়ে দিল। মেয়েটার মধ্যে নিশ্চয় কোনো জাদু আছে।

কয়েকদিন পর….

আর্য ডিউটি টাইমে একটু ফ্রি হতেই নীচে নেমে এল। দূর থেকে অন্তরাকে দেখেই চিনতে পারলো। এই মেয়ের মুখ সহজে ভোলার নয়। কথাবার্তায় ছেলেমানুষী ভাব থাকলেও, মুখখানা খুব মায়াবী। যে কোনো মানুষকে হাসানোর ক্ষমতা আছে মেয়েটার। আসলে এখানকার যুগে এমন মানুষ খুবই বিরল। আর্য, অন্তরার কাছে গিয়ে বললো, কী ব্যাপার ম্যাডাম? বন্ধুর তো সেদিনই ছুটি হয়ে গেছে। আজ আবার এখানে কেন?
অন্তরা মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে, ধীরে ধীরে বললো, আজ আমি নিজে এসেছিলাম। গাইনোকোলজিস্টকে দেখানোর জন্য। কয়েকটা টেস্টের রিপোর্ট দেখানোর ছিল।
আর্য বললো, হয়ে গেছে দেখানো?
অন্তরা বললো, হ্যাঁ হয়ে গেছে। আসলে মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিল, তাই একটু এখানে বসলাম।
আর্য বললো, সে কি আপনি ঠিক আছেন তো? বিপি চেক করিয়েছেন?
অন্তরা বললো, হ্যাঁ করিয়েছি। আসলে এই সময় এমন হয়। আমি প্রেগন্যান্ট।
আর্য বললো, ওহ আচ্ছা। তা আপনার সাথে কেউ আসেনি?
অন্তরা আবার ধীরে ধীরে বললো, না। এবার যাই আমি, কাজ আছে আমার। কয়েকটা ফটো তুলতে হবে।
আর্য সাথে সাথে বললো, কিন্তু এখন এই অবস্থায় একটু রেস্ট নিলেই তো পারতেন।
অন্তরা বললো, এখন রেস্ট নিলে হবে না। কাজ করতে হবে, এই তো চার মাস। ধীরে ধীরে কাজ করলে সমস্যা হবে না। আসি আর্য বাবু।

অন্তরা চলে যেতেই। গাইনোকোলজিস্ট অরুন্ধতী, আর্যকে ডেকে বললো, ডক্টর আর্য একবার শুনবেন?
আর্য কাছে গিয়ে বললো,
…হ্যাঁ বলুন।
… আপনি চেনেন মেয়েটিকে? যার সাথে কথা বলছিলেন?
… না না সেভাবে পরিচিত নই আমরা। কেন কী হয়েছে বলুন তো?
… ওনার শরীরের যা কন্ডিশন, তাতে বেবি নেওয়ার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। বাড়ির কাউকে নিয়ে আসেন নি উনি। কার সাথে কথা বলবো বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় বাড়ির ব্যাপারে উনি কিছু লুকাচ্ছেন। হাজব্যান্ডের ফোন নাম্বার চাইলাম, কিছুতেই দিল না।
… আপনি এই কথাগুলো আগে বললেন না কেন, যখন উনি ছিলেন?
… আপনারা কথা বলছিলেন, তাই ডিস্টার্ব করি নি।

আর্য ছুটে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দেখলো, সেখানে অন্তরা নেই। মনটা কেমন যেন করে উঠলো। কতই বা বয়স হবে মেয়েটির, বড় জোর ২৪/২৫। মনে মনে ভাবলো, যে ভাবেই হোক, মেয়েটিকে খুঁজে বের করতেই হবে।

চলবে।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৬০

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৬০

সকালে ঘুম থেকে উঠে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেজার টেক্সটের দিকে।
“গুড মর্নিং, হানি।
আচ্ছা, বলো তো, বিলাল আব্বাস খান না সাদাত হোসাইন—তোমার জীবনে এদের মধ্যে কে আসলে আমাকে ছেড়ে যাবে? ডার্লিং, সত্যি বলবে কিন্তু। আমি তোমার রিপ্লাইয়ের অপেক্ষায় থাকবো, সোনাবউ।”
নয়না হাসছে। “আচ্ছা, প্রেমে পড়লে ছেলেরা কি আসলেই বোকা হয়ে যায়? এমন উদ্ভট প্রশ্ন কেউ করে?”
নয়না রিপ্লাই করলো, “সুপ্রভাত।
দুজনের কারও জন্যই আপনাকে ছেড়ে যাব না। কল্পনার জগত আর বাস্তবতা ভিন্ন। তাদের কেউ আপনার জায়গা কখনো নিতে পারবে না, মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। আপনি আমার চিরস্থায়ী ব্যক্তিগত প্রিয় পুরুষ।”
জিয়ান সাথে সাথে রিপ্লাই করলো, “তাহলে কার জন্য আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে?”
“মৃত্যুর জন্য। যদি মৃত্যু আসে, তবে বলবো আমাকে কেড়ে নিয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে।”
“ভিডিও কল করি, ওয়েট।”
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে দুজন মানুষ দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। নয়নার আধখোলা বেণী, ফোলা চেহারা, টি-শার্ট আর প্লাজো পরা।রেজা নয়নার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে, “তোমাকে মোহনীয় লাগছে, বেব। ইচ্ছে করছে এলোমেলো চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দিয়ে কপালে উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া দিতে।”
“তারপর?”
“তারপর? তারপর বললে তো কল কেটে দিবে। সামনাসামনি থাকলে বুঝতে পারতে তারপর কী।”
“বদলোক! সব সময় মাথায় উল্টোপাল্টা চিন্তা।”
“উল্টোপাল্টা চিন্তা কেন হবে? তোমাকে দেখলেই তো ভালোবাসা উথলে ওঠে, এতে দোষটা তো তোমার।”
“আহা, নিজের দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাও!”
“ক্লাস কবে থেকে শুরু হবে?”
“সামনের সপ্তাহ থেকে। শোনো, আমি বাসায় গিয়ে কয়েকটা দিন থেকে আসি?”
“যাও, থেকে আসো। তবে আমাকে কিন্তু পুরো মনোযোগ দিতে হবে, জানো।”
“তোমাকে ছাড়া আমার আর কে আছে?”
“আহা, আদুরী বউ আমার। যাও, উঠো, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করো।”
“এই, শোনো।”
“এভাবে না।”
“তো কীভাবে?”
“বলো, ওগো, শুনছো?”
“শুনতে হবে না, টেক্সট পড়ুন, ডিয়ার হ্যাসবেন্ড। আমি এসে আপনাকে নক দিবো। টাটা।”

নয়না ফ্রেশ হয়ে ফুরফুরে মেজাজে নাস্তা করতে আসলো। প্রিয় মানুষ ম্যাজিকের মতো মন ভালো করে দিতে পারে। নয়না নাস্তার টেবিলে এসে তার নিত্যদিনের প্রিয় নাস্তা—পরোটা আর চা—নিয়ে আয়েশ করে খেতে লাগলো। আজ যেন সবকিছুই নয়নার কাছে রঙিন লাগছে!

হঠাৎ জাহিন চেয়ার টেনে নয়নার সামনে সোজাসুজি বসে বলল, “গুড মর্নিং।”
নয়না আড়চোখে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। এই মানুষটাকে নয়না একদম সহ্য করতে পারে না। দেখলেই রাগ লাগে। নয়না নিজের মতো চায়ের মধ্যে পরোটা ডুবিয়ে খেতে লাগলো।জাহিন বলল, “এটা কি খুব টেস্টি?”
নয়না উত্তর দিলো না।

সার্ভেন্ট এসে জাহিনের সামনে ফ্রুট সালাদ দিয়ে বলল, “স্যার, অ্যাভোকাডো টোস্ট দিবো?”
“না, আমার জন্য পরোটা আর চা নিয়ে আসো।”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন সার্ভেন্ট সবাই অবাক হলো জাহিনের কথা শুনে! যে সারাজীবন সকালে টক দই, চিয়া সিড, বিভিন্ন ফল দিয়ে সালাদ আর চিনি ছাড়া গ্রিন টি, আর অ্যাভোকাডো টোস্ট খায়, সে খাবে হেভি লিকারের দুধ চা দিয়ে পরোটা!
নয়না এক গ্লাস ফ্রেশ অরেঞ্জ জুস নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো।
মেহনুর সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। নয়নাকে দেখে বলল, “বাহ, আগে বড়টার মাথা খেয়েছো, এখন ছোটটার মাথা খাওয়ার প্ল্যান করছো!”

নয়না ভ্রু কুঁচকে মেহনুরের দিকে তাকালো। কিছু বলতে যেয়েও চুপ হয়ে গেলো। রেজা যাওয়ার সময় বলেছিল, “যে যা বলুক, চুপ থাকতে। কোনো কথার উত্তর দিতে না। কোনো কথা খারাপ লাগলে আমাকে শোনাতে, আমি বুঝে নেবো।”
নয়না রুমে এসে বেডের ওপর ওড়নাটা রেখে চুলগুলো খুলে বসলো। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে রেজাকে কল করলো।
“হেই, সুইটহার্ট, এত দেরি কেন?”
নয়না চুপ করে রইলো।
জিয়ান খানিকক্ষণ নয়নার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কে কী বলল তোমাকে? হঠাৎ করে চাঁদে গ্রহণ লাগলো কেন?”
নয়না তবুও চুপ করে রইলো।
“দেখো, জান, আমি তো বলেছি, তুমি সবকিছু আমাকে বলবে। আমি তোমাকে জাজ করবো না। খুলে বলো, কী হয়েছে।”
নয়না সবটা খুলে বলল। জিয়ান বলল, “শোনো, জাহিন তো সব সময় ওইসব রুক্ষ খাবার খায়। আজ হয়তো তোমাকে মজা করে চা দিয়ে পরোটা খেতে দেখে ওর খেতে ইচ্ছে করলো। আর মেহনুরের ব্যাপারে আমি দেখে নিচ্ছি। এবার তো হাসো।”
“কিন্তু আমার তোমার ভাইকে একদম সহ্য হয় না।”
“সহ্য হয় না বলেই তো ওর কোনো কাজ তোমার ভালো লাগে না। তুমি সহজভাবে নাও। মনে করো জাহিন তোমার বড় ভাই।”
“ধুর, বাদ দাও। এমন ভাই আমার লাগবে না।”
“আচ্ছা, বাদ দিবো। তবে আমি না, তুমি। এখন আম্মুর কাছে যাও। গিয়ে বলো, আজ তুমি তার সাথে রান্না করবে।”
“আমি তো রান্না পারি।”
“হ্যাঁ, তুমি রান্না পারো, তাই তো রান্নার কাজে সাহায্য করবে। তাহলে তোমার বোরিং সময় কাটবে না।”
“ওখে, ডিয়ার। তোমার ফ্লাইট কবে?”
“আজ রেস্ট, কাল ব্যস্ত থাকবো।”
“আচ্ছা, রেস্ট করো।”
“আবার কথা হবে, খুব তাড়াতাড়ি।”

নয়না কল কেটে তুষিকে কল করলো।
“কিরে, আবার স্মরণ করলি যে?”
“তোর মনে আছে, আমি যে একবার বলেছিলাম, যমুনা ফিউচার পার্কে একটা ছেলের সাথে দেখা হয়েছিল? ওই যে ঘড়ি আটকে গেলো?”
“হ্যাঁ, মনে আছে। কিন্তু হঠাৎ এই কথা?”
“ওই ছেলেটা জাহিন।”
“জাহিন আবার কে?”
“তোর দুলাভাইয়ের জমজ ভাই।”
“এখন কী কোনো সমস্যা?”
“আরে, সমস্যা বলতে, মাঝখানে আমি ভুল বুঝে ওকে তোর দুলাভাই ভেবে রাগ-অভিমান দেখিয়েছিলাম। এখন ওকে দেখলেই আমার সহ্য হয় না।”
“সবই বুঝলাম, কিন্তু সহ্য না হওয়ার থিওরি বুঝলাম না।”
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৯

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৫৯

“জিয়ান চলে গেছে ঘন্টা খানেক হবে৷ আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে নয়না৷ আজকাল আকাশে প্লেন দেখলেই নয়নার মন কেমন করে উঠে! মনে হয় তার আপন মানুষটা জুড়ে আছে এই দূর আকাশে উড়তে থাকা প্লেনে।আচ্ছা তোমার মনে আমার কথা কি এমন করেই জাগে? এমন করেই কি মন পোড়ে তোমার? নাকি তুমি ব্যস্তার ভারে ভুলে যাও আমাকে? নয়নার চোখের কোনে চিক চিক করছে নোনাপানি।বুকটাভার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। শ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে নয়নার৷ মনে মনে বলে,এই যে আমার বুকভার, এ ভার কি তোমার হৃদয়ে ও পরে?নয়না জিয়ানের সাথে এয়ারপোর্টে যায় নি৷ হাতে সময় খুব কম ছিলো দ্রুত পৌঁছাতে হবে। তাই নয়নাও বায়না করেনি৷ যাওয়ায় সময় যখন নয়নাকে আলিঙ্গন করলো নয়নার ভেতরটা কেমন হাহাকারে ছেঁয়ে গেছে৷ মানুষটার চোখেও ছিলো রাজ্যের কষ্ট। কি নিদারুণ দৃশ্য। মেয়ে মানুষ তাও কাঁদতে পারে ছেলে মানুষ তো চাপা কান্না হৃদয় আটকে রেখে দিব্যি চলে। রোজ কত মানুষ এমন করেই প্রিয় মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে কে রাখছে সে-সবের খবর? জীবিকার তাগিদে বা একটু ভালো থাকার আশায় রোজ বেদনা লুকায় দুই প্রান্তে থাকা দু’টি মানুষ। অথচ সুখ সে তো সোনার ডিম সহজে তো ধরা ছোঁয়া যায় না৷ তবুও মানুষ একটু সুখের আশায় তেপান্তরে পারি জমায়।
“হাতের উল্টো পিটে চোখের কোনে জমে থাকা জলটুকু মুছে নিলো নয়না৷ মোবাইল হাতে নিতেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো মৃদু হাসি। এই যে প্রিয় মানুষের ছোট একটা টেক্সট নিমিষেই মনের মেঘ কাটিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারে এক চিলতে রোদ। এই ক্ষমতা তো পৃথিবীতে এই মানুষটার ছাড়া কারো কাছে নেই। ছোট একটা টেক্সট অথচ নয়নার মনজুড়ে ছেঁয়ে গেছে প্রশান্তি।….আমি আছি। যত দূরেই থাকি তোমার হৃদয়ে আমি আছি প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।
” নয়না রিপ্লাই করলো না। এখন রিপ্লাই করলেও টেক্সট সেন্ট হবে না। সকালের তোলা পিকগুলো দেখতে লাগলো। মনে মনে বলে,আপনি তো ছিলেন চির অচেনা অথচ আজ আপনি ছাড়া অচল হয়ে পরে হৃদয়ের গতিপথ!
🌿নয়নার দেয়া ঠিকানায় পৌঁছে দাঁড়িয়ে আছে তুষি৷ বিশাল বড় আলিশান বাড়ি। গেঠের সামনে বড় করে লেখা চৌধুরী ম্যানশন। নয়না দারোয়ানকে নিজের পরিচয় দিলো৷ দারোয়ান তুষির জন্য গেট খুলে দিলো৷ সুন্দর এক গার্ডেন এরিয়া৷ দুইপাশে পানির ফোয়ারাও আছে৷ ছোট ছোট দু’টো চেয়ার টেবিল আছে দুই পাশেই৷ তুষি ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো ঘরের প্রবেশ দ্বারে। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে ব্যালেন্স হারিয়ে পরতে নিলে কারো হাতে বন্দি হয় তুষির হাত।
“তুষি সামনে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলে,আপনি!
” অন্তর তুষির হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,এখানে কেন এসেছেন মতলব কি? চুরিটুরি করার ধান্দা নাকি?
“মুখ সামলে কথা বলুন মিস্টার। এটা আমার জিজুর বাড়ি। সাইডে সরুন।
” অন্তরের মন ভালো নেই তাই কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো বের হয়ে। এসেছিলো জাহিনের সাথে রিতুর কেসের বিষয়ে কথা বলতে। জাহিন জিয়ানের সাথে এয়ারপোর্টে গেছে তাই দেখা হয়নি৷
“তুষি বাসায় ঢুকে সার্ভেন্টের সাথে নয়নার রুমের দিকে গেলো৷ নয়না তখন বিরহবিলাস করতে ব্যস্ত। তুষি সার্ভেন্টকে হাতের ইশারায় সরিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে নয়নার কাছে এসে পেছন থেকে নয়নার চোখে হাত রাখলো।
” নয়না চমকে উঠে বলে কে? পর মূহুর্তে তুষির কথা মনে পরতেই বলে,ভুষি তুই চলে এসেছিস?
“তুষি চোখ ছেড়ে দিয়ে বলে,না এসে উপায় আছে৷ নয়না তুই তো একদম রাজ্যসহ রাজপুত্র পেয়েছিস। আগে ছিলে মাম্মাস প্রিন্সেস এখন হয়েছিস মহা রাজার, মাহা রানী।
” হু। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তায়ালা আমাকে আমার কল্পনার চেয়েও বেশি দিয়েছেন৷ সব ঠিক আছে। এখন এসব বাদ দিয়ে তুই এবার তোর কথা বল৷ ফোন-টোন বন্ধ করে কই গা ঢাকা দিয়েছিলি আর দিয়েছিলি কেন সেটা বল? হঠাৎ করে গায়েব হওয়ার ভূত মাথায় চাপলো কেনো?
“নিজেকে একটু সময় দিতে। আসলে আমরা যত যত্ন করে ভালোবাসি অপর মানুষটা ঠিক ততটা যত্নে আমাদের ঠকায়।
” রাফিন ভাই তোকে ঠকিয়েছে? এটা ইম্পসিবল!
“আমিও প্রথমে এটাই ভাবতাম৷ অথচ কত নিখুঁত ভাবেই না আমাকে সে ঠকিয়ে গেছে। জানিস আমি দম বন্ধ হওয়া অনূভুতি নিয়ে কেঁদেছি এই ঠকবাজের জন্য। এখন এসব ভাবলেও হাসি পায়। আমি মৃত্যু যন্ত্রণা দেখিনি অথচ তাকে হারানো শোক আমাকে সে অনুভূতির সাক্ষাৎ করিয়েছে৷
” এটা কিভাবে সম্ভব?
“রাফিনের যে কাজিনটাকে নিয়ে আমাদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া ঝামেলা হতো। ও যে বারবার বলতো আমরা যাস্ট কাজিন এ-র বেশী কিছু না। সামনের শুক্রবার তার সাথেই ওর বিয়ে।
” কি বলছিস! তোকে বিয়ে করার জন্য তো রাফিন ভাই পাগল ছিলো৷ তো ভালোবাসা না থাকলে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়?
“শোন কিছু পুরুষ মানুষের মুখ আর মুখোশ চেনা বড়ই কষ্টসাধ্য। বিয়ে করতে চাইলেই সে সত্যি কারের ভালোসতো এটা তো নয়।ভালোবাসা আর চাহিদা দু’টোই ভিন্ন। আমি থাকতেও যার অন্য নারীর সঙ্গ প্রয়োজন ছিলো আমি কিনা তার জন্য এমন পাগলের মত কেঁদেছি! যাক বাদ দে এসব মানুষের কথা মুখে আনতেও ঘৃণা হয়। তাকে ঘৃনা করবো সেই যোগ্য ও সে না। আমার ঘৃণাও সে ডিজার্ভ করে না৷ অথচ তাকে আমি সর্বস্ব উজার করে ভালোবেসেছিলাম!
” আচ্ছা মন খারাপ করিস না৷ কথায় আছে যে যেমন তার সাথে তেমনটাই মেলে৷ কামারের দোকানে কি হিরে জহরত থাকে! তোর মত ভালো মেয়ে ওর কপালে নেই।মনে রাখিস যে যেমন তার সাথে তেমটাই মেলে৷ এসব ছাড় চল আমার সাথে।
“কই?
” আম্মুর সাথে দেখা করিয়ে আনি।
“আন্টি এই বাসায়?
” আরেহহহ নাহহ আমার শ্বাশুড়ি আম্মু।
🌿জিয়ান বিমানে উঠে বসেছে।এবার তার মনটা খারাপ। নয়না সাথে আসলে হয়ত একটু ভালো লাগতো৷ কিন্তু এতো সর্ট সময়! এরমধ্যে নয়নাকে আনা সম্ভব হলো না৷ মোবাইল বের করে নিজের ওয়ালপেপারে নয়নার হাসোজ্জল মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,এরপরের বার তোমাকে ছাড়া এই পাইলট বিমানে উঠবে না৷ তোমাকে নিয়ে তবেই উঠবো৷ নিজের খেয়াল রেখো প্রেয়সী প্রিয়তমা৷ দশ দিনের ছুটির বদলে পনেরোদিনের ছুটি কাটিয়েছে জিয়ান৷ এবার হয়ত ছুটি পাবে না সহজে৷ এই দীর্ঘ সময় কি করে কাটাবো তোমাকে ছাড়া! এই যে আমি যাচ্ছি আমার সাথে কেবল আমার দেহ আছে। মন মস্তিষ্ক, চিন্তা, ভালোবাসা সবটা ফেলে রেখে যাচ্ছি তোমার কাছে। ফেরার পথ দীর্ঘ হলেও অপেক্ষায় ভালোবাসা সুমিষ্ট স্বাদে ভরপুর হয়ে উঠে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তোমার স্পর্শে আবার সতেজ হবে আমার দেহ-মন। ততদিন জলহীন মাছের মতই ঝটফট করবে ভেতরটা।
🌿জিয়ানকে ড্রপ করে জাহিন নিজের প্রাইভেট এপার্টমেন্টে চলে আসলো৷ আসতে আসতে চার পাঁচটা সিগারেট খাওয়া শেষ! আজকাল সিগারেট ছাড়া যেনো জাহিনের চলেই না৷ শার্ট খুলে রেখে আয়নার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বলে,ঠোঁটটা তোমার ঠোঁটের উষ্ণ পরশের অভাবে কেমন শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। তুমি তো কোনদিন আমায় ভালোবাসবে না। উন্মুক্ত বডির দিকে তাকিয়ে বলে,বডি বানিয়ে কি হবে যদি ভালোবাসার মানুষই পাশে না থাকে!হঠাৎ জাহিনের চোখ রক্ত বর্ণ ধারণ করলো রাগে কপালের রগ ফুটে উঠছে। স্বজোড়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আঘাত করলো৷ সাথে সাথে চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো কাঁচের টুকরোগুলো৷ হাতের উল্টো পিঠ গেঁধে গিয়ে সেখান থেকে ঝড়তে লাগলো র’ক্ত৷
“বেডে বসে চিৎকার করে বলে,আই হেইড ইউ বাবা। সেই ছোট থেকে পদে পদে আমাকে বুঝিয়েছো আমি লুজার৷ তোমার সব ভালোবাসা কেবল জিয়ানের জন্য। আমি কেউ না! লাগবে না আমার তোমার মত বাবা৷ রাখবো না আমি জিয়ানকে এই পৃথিবীতে ও মরলেই তুমি আমার কদর বুঝতে শিখবে। তোমার আর আম্মুর সব ভালোবাসা, সব কেয়ার, সব প্রায়োরিটি রেজা পেয়েছে। আমি কে সেটা আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেবো৷ আমার কাউকে দরকার নেই কাউকে না। হাত থেকে র’ক্ত ঝড়ে সাদা বেডসিট রঙিন হয়ে যাচ্ছে। তার শরীরের ব্যথা যেনো তার মনের ব্যথার কাছে তুচ্ছ।
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৮

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৫৮
রাতে জিয়ান সোফায় শুয়েছে নয়না বেডে৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে নয়না জিয়ানের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে৷ হটাৎ তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে জিয়ানের পায়ের উপর পরে৷ নয়নার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে৷ ছোট একটা কথার জন্য এতো অভিমান কেন হলো তাদের মাঝে? কেনো শেষ রাতটা নিজের মানুষটার বুকে মাথা রেখে শুতে পারলো না?নয়নার ভেতরে দগ্ধ দগ্ধ করছে রাতের ক্ষত। কেন জেদ করলো সে নিজের উপর মহা রাগ হচ্ছে তার।
“জিয়ান চোখ মেলেই দেখে নয়না দাঁড়িয়ে কাঁদছে৷ রাতের সব মান অভিমান ভুলে নয়নাকে জড়িয়ে নিলো বুকের মাঝে।
” জিয়ানের স্পর্শে নয়নার কান্না যেনো আরো বেড়ে গেলে হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো৷
“প্লিজ কেঁদো না। স্যরি জান৷ সব দোষ আমার। প্লিজ কেঁদো না।
” জিয়ানের কথা যেনো আগুনে ঘী ঢালার মতই নয়নার কান্নার গতি আরো বাড়িয়ে দিলো।
“জিয়ান নয়নাকে বুক থেকে সরিয়ে নয়নার থুতনিতে হাত রেখে বলে,জান এই কানে ধরলাম আর কখনো এমন আবদার করবো না যা তুমি অপছন্দ করো। কেঁদো না প্লিজ। এতো সুন্দর সকাল তোমার কান্না দেখে বিষাদে ছেয়ে গেছে৷ দেখে ঝলমলে রোদটাও কেমন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যাচ্ছে।
” নয়না নাক টেনে বলল,স্যরি। আমি জানি ভুলটা আমার৷ কিন্তু তাই বলে,আমাকে রেখে ঘুমাবা! আমার কি কষ্ট হয়নি তোমার সঙ্গ ছাড়া। কাল রাতে তো থাকবে না তখন আমি কি করে এই দুঃখ ঘুচাবো?
“জিয়ানের খুব মায়া হচ্ছে এবার সাথে অনুশোচনাও৷ তার বোঝা উচিৎ ছিলো নয়নার বয়সটা কম। তার সাথে সে কেন অভিমান ধরলো!
” জিয়ান নয়নার গালে চুমু দিয়ে বলে, আমি স্যরি জান৷ দোষটা আমার৷ আমার তোমাকে বোঝা উচিৎ ছিলো৷
“নয়না জিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলে,আমাকে অনেক ভালোবাসা দাও জান৷ আমি এতোদিন কি করে থাকবো তোমাকে ছেড়ে! আমার যে তোমার স্পর্শের অভ্যাস হয়ে গেছে।
” জিয়ান নয়নাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। চুলে চুমু দিয়ে বলে,বাহহহ রাতের অপূর্ণতা এখন ভোরের আলোয় পূরণ করতে চাও। বৌটা একটু অবুঝ হলেও ভীষণ সরল আর স্নিগ্ধ। ঠিক ভোরের শিশিরের মত।
“নয়না জিয়ানকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,আদর করো জান৷ গভীর ভাবে ভালোবাসো আমাকে৷
” জিয়ান নয়নার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলে,এ মাতাল করা আবদার উপেক্ষা করার সাধ্য জগতে কারো নেই। তুমি আমার শিশিরস্নাত ভোরের ভেজা বকুলফুল আমি শুষে নেবো তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা সমস্ত ঘ্রাণ। আমার শরীর জুড়ে লেপ্টে রবে তোমার স্পর্শের মাতাল করা সৌরভ৷
ঘন্টা দুয়েক জড়িয়ে রইলো একে অপরের চাদর হয়ে৷
“ফ্রেশ হয়ে দু’জনে একসাথে নাস্তা করতে নিচে আসলো৷
” নয়না ব্ল্যাক আর রেড কালারের কম্বিনেশনে একটা ড্রেস পরেছে। রেজার গায়ে জড়িয়ে আছে ব্ল্যাক টিশার্ট ব্ল্যাক প্যান্ট।
“নাস্তার টেবিলে সবাই উপস্থিত।
” নাজিম চৌধুরী বলল,রেজা আজ ক’টা বাজে তোমার ফ্লাইট?
“বাবা দুপুর তিনটে বাজে৷
” আজ রাতে আমারও সিঙ্গাপুর যাওয়ার টিকেট বুক করা৷ এই বয়সে আর ভালো লাগে না এসব৷
“জিয়ান জাহিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,তুই তো ফ্রী আছিস ব্যবসাটা সামলা৷ বাবা আর কত টানবে একার ঘাড়ে?
” ভাই এসব প্যারা আমাকে দিয়ে হবে না৷ তারচেয়ে বরং পাইলটের জবটা ছেড়ে অফিস জয়েন করো তাহলেই তো হয়।
“নাজিম চৌধুরী রেগে গেলেও রাগটা সংযাত করে ফেললো৷ শান্ত স্বরে বলল,তোরা দুজন একি সাথে পৃথিবীতে এসেও দু’জন দুই মেরুর৷ জাহিনকে দেখলে মনে হয় আমি অতীতে নিশ্চিত কোন পাপ করেছি এই কারণে ও মানুষ হতে পারেনি৷ নয়ত এতো ভালো পরিবার এতো সুন্দর পরিবেশে থেকেও এতো অভদ্রতা কি করে শিখলো! জিয়ানের হওয়ার কথা ছিলো সিঙ্গার৷ এতো ভালো গান গাইতো ছেলেটা। ক্লাস টেনে যখন পড়িস তোরা সেদিন জিয়ানকে বললাম,জানিস আমার অনেক শখ আমার ছেলে পাইলট হবে৷ আকাশে প্লেন চালাবে৷
” জিয়ান তখন কি বুঝলো জানিনা৷ জড়িয়ে ধরে বলল,অবশ্যই তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে বাবা৷
“জাহিন খাবার অর্ধেক প্লেটে রেখে উঠে চলে গেলো৷
” জিয়ান নাজিম চৌধুরীর কাঁধে হাত রেখে বলে,বাবা নাহিদকে আমি আমাদের অফিস জয়েন করতে বলবো৷ ওর সাথে জোড়াজুড়ি করে তো কোন লাভ হবে না জানোই। কোন খারাপ কাজ তো করেনা। চলুক ওর মনমতো যতদিন চলতে চায়। একদিন ঠিক নিজের দ্বায়িত্ব বুঝে নেবে।
“সকালের নাস্তা শেষ করে জিয়ান নয়নাকে বলল,চলো তো আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে।
” আপনি ওয়েট করেন আমি রেডি হয়ে আসছি।
“আর কি রেডি হবা! তোমাকে মাশা আল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছে। চুলটা শক্ত করে হাত খোপা করে নিয়ে মাথায় ওড়না টেনে চলে আসোতো।
” নয়না জিয়ানের কথা মতো চলে আসলো৷ বাড়ির সামনের গার্ডেনে এসে জিয়ান নয়নার সাথে সেল্ফি নিলো৷
“জিয়ান নিজের বাইক নিয়ে এসে বলে,আসো জান৷
” নয়না জিয়ানের পাশে বসে জিয়ানের কাঁধে হাত রাখলো।
“শুনো বৌ হ্যাসবেন্ডের সাথে বাইকে বসলে মাঝখানে কোন ফাঁকা রাখতে নেই। একদম লেপ্টে বসো আমার শরীরের সাথে। তবেই না ফিল হবে বৌকে নিয়ে বাইক চালানোর।
” নয়না চুপচাপ জিয়ানের শরীরের সাথে মিশে বসলো। জিয়ান মুচকে হেসে বলে,তোমার আমাকে ভয় পেতে হবে না প্রিয়তমা। তোমার যা ইচ্ছে মানা করতে পারো। আমি তোমারই।
“নয়না দু’হাতে জিয়ানের বুক জড়িয়ে ধরে বলে,শোন আমি হ্যাসবেন্ডের সাথে বাইকে বসেছি সো এভাবে চিপকে না বসলে ফিল করবো কি করে। চুপচাপ ড্রাইভ করুন তো আই ফিল বেটার।
” জিয়ান ড্রাইভা করছে। ইশশ এই অনুভূতি ব্যখ্যা করার মত না। মনের মধ্যে যেনো শত ডানার প্রজাপতি উড়ছে।
“নয়না জিয়ানে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে একটা গান ধরুন মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। থুরি বাইক ড্রাইভার।
” এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো?

“গাড়ি এসে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে থামলো।
জিয়ান বাইক পার্ক করে নয়নাকে নিয়ে শপিংমলে ঢুকলো। নিজের জন্য নয়নার পছন্দের, শার্ট, টিশার্ট, প্যান্ট, টাউজার কিনে নিলো।
” নয়না বলল,আমার না আপনাকে লুঙ্গী পরা দেখার শখ।
“লুঙ্গী!এই না আমি কোনদিন লুঙ্গী পরিনি। এসব না।
” আরেহহহ জান আমিই তো। প্লিজ প্লিজ।
” জিয়ান চোখ ছোট করে বলে তাহলে তোমাকেও বিকিনি পরে দেখাতে হবে।
“ছিহহহ আপনাকে কি আমি জাঙ্গিয়া পরতে বলছি!
” আরেহহ ঠিক আছে আমি লুঙ্গী পরবো এবার না পরেরবার।
“শপিং শেষ করে দ্রুত বাসায় এসে সব গুছিয়ে নিচ্ছে।
” নয়নাও হেল্প করে জিয়ানকে৷
“হুট করে জিয়ান প্যাকিং ছেড়ে নয়নাকে জড়িয়ে ধরলো।
” নয়না বললো,কি হলো?
“জানিনা আমার ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। তোমাকে ছেড়ে কি করে থাকবো পাখি!
” নয়না নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,মোবাইল আছে তো মিস্টার পাইলট মহাশয়। ফোনে প্রেম জমে ক্ষীর হবে।
“তবুও ইচ্ছে করছে তোমাকে একদম নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে।
” এতো উতলা হতে নেই। আমি আপনার সারাজীবনের জন্য পাশে আছি ফুরিয়ে যাচ্ছি না৷ আপনার অর্ধাঙ্গিনী শুধু আপনার৷
“জিয়ান নয়নার উষ্ণ ঠোঁট দুটি দখল করে নিলো নিজের ঠোঁট দিয়ে।
আচ্ছা ভালোবাসার সময় এতো দ্রুত ফুরিয়ে যায় কেন! এইযে জিয়ানের মনে রাজ্যের শূন্যতা এসে ভর করেছে। এই আকুলতা কেই বুঝি ভালোবাসা বলে?চেনা নেই জানা নেই তবুও কবুল বলার মাধ্যমে দুটি প্রাণ আজ যেনো মিলেমিশে একাকার। একজন অপরজনকে ছাড়া যেনো শূন্য। লাভ ম্যারেজ ইট’স ওকে বাট এরেঞ্জ ম্যারেজ হিট ডিফারেন্ট।
” নয়না আজকাল অনুভব করে তার নিজের একটা মানুষ আছে। বাবা মায়ের বাইরে তার একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষ। ইশশ মানুষটা শুধু তার নিজের। তার শরীর থেকে মন সব জায়গায় শুধু তার রাজত্ব। সিংহাসন বিহীন এক রাজ্যের রানী সে৷ যা সে দখল করেছে হৃদয়ের বিনিময়ে। হৃদয়ের লেনাদেনার মাধ্যমে হয়ে উঠেছে এক কঠিন যুবকের হৃদয়ের রানী।
#চলবে।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৭

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৫৭
“নয়না রাস্তায় বসে পরে৷ আমি কোথাও যাবো না বাসায় যাবো৷
“পাগলামি করছো কেন! তাড়াতাড়ি ওঠো। রাস্তায় কেউ বসে? নিব্বি বৌ জুটেছে আমার কপালে৷
” একদম নিব্বি বলবেন না৷ আমি সুনয়না চৌধুরী হু।
“মিসেস চৌধুরী এভাবে রাস্তায় বসে থাকতে নেই। দয়া করে উঠুন। আপনি যা বলবেন তাই হবে মিসেস চৌধুরী।
” নয়না দু”হাত প্রসারিত করে বলে,তাহলে কোলে নিন আমাকে।
“জিয়ান নয়নাকে কোলে তুলে নিলো৷
” নয়না জিয়ানে গলা জড়িয়ে ধরে বলে,শুনুন আমাকে আম্মুর কোল থেকে নিয়ে এসেছেন এখন আপনার কোলে তুলে রাখবেন৷
“আহাগো বৌয়ের কত আদুরে আহ্লাদ। চলো না যাই।
” নাহহ বাসায় যাবো।
“জিয়ান নয়নাকে বলল,এভাবে মানা করে দিচ্ছো নিষ্ঠুর বৌ।
” বাসায় যাবো তাড়াতাড়ি নিয়ে চলুন৷
জিয়ান নয়নাকে গাড়িতে বসালো নয়না জিয়ানের কাঁধে মাথা রেখে বলে,রাগ করেছেন মিস্টার প্লেন ড্রাইভার? নয়না জিয়ানর হাতের উপর হাত রেখে বলে,ছেলে মানুষের অভিমানী চেহারা এতো আকর্ষণীয় লাগে তোমাকে না দেখলে জানতাম না। তোমাকে এখন ঘুমন্ত গোলাপ মনে হচ্ছে জানো সখা।
“জিয়ানের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসির ঝলক ফুটে উঠলো। তার পিচ্চি বৌটা জানে কিভাবে তার বরকে মানাতে হবে৷ তবুও তা প্রকাশ করলো না৷
” এই শুনছো। ওগো শুনছো রাগ করে না প্রাণের স্বামী রাগলে তোমায় লাগে পঁচা আলু।
“জিয়ান গাল ফুলিয়ে বলে,পঁচা আলু!
“তো রাগ করলে কাউকে ভালো লাগে নাকি জানো না?
” জিয়ান নয়নার দিকে ঘুরে বলে,কে বলেছে রাগলে কাউকে ভালো লাগে না৷ এক হাঁটুর বয়সী পিচ্চি আছে যে রাগলে তাকে স্টবেরী লাগে। মনে হয় টুপ করে খেয়ে ফেলি।
“নয়না জিয়ানের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে,তোমার চুলগুলো এলোমেলো থাকলে বেশী হ্যান্ডসাম লাগে। মানে মেসি হেয়ার এ মানায় তোমাকে।
” জিয়ান নয়নার হাত ধরে বলে,এই প্রথম কেউ পাইলট রেজা চৌধুরীর হেয়ার টাচ করার সাহস করেছে৷
“আহা মিস্টার প্লেন ড্রাইভার এটা তৃতীয়বার আমি তোমার মাথায় হাত বোলাচ্ছি৷ বলতে পারো এটা আমার ফেবারিট কাজ।
” তো মিসেস চৌধুরী তুমি কেনো আমার সাথে রিসোর্টে যেতে রাজি হচ্ছো না?
“আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে বাসায় নিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে। ইচ্ছে করছে তোমার বাহুতে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে।
” জিয়ান নয়নার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,বুঝেছি মিসেস চৌধুরীর আদর আদর ফিল হচ্ছে। ইশশ বাসায় ঢুকে সোজা কোলে তুলে বেড রুমে নিয়ে যাবো৷
“নয়না লজ্জা পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
” জিয়ান নয়নার চোখের উপর ফু দিয়ে বলে,লাজে রাঙা বৌ আমার।
“গাড়ি এসে থামলো চৌধুরী ম্যানশনের সামনে।
” নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে,হাত বাড়িয়ে ম্যারিনোকে ধরে কোলে তুলে নিলো। ম্যারিনোর কথা মনে পরে মন মলিন হয়ে গেলো জাহিনের। ম্যারিনো মারা গেছে তার ছোট একটা ভুলে ম্যারিনো নেই। এই যে ম্যারিনোে মত দেখতে যে বেড়ালটা তার কাছে আছে তাকে কেনো অতোটা আপন লাগে না! আচ্ছা মানুষ তবে কেন বলে,চেহারার দেখে ভালোবাসা হয়। এই যে একি চেহারা তবুও তো মন পোড়ে সেই আমার পুরনো ম্যারিনোে জন্য।
জাহিন হটাৎ খেয়াল করলো জিয়ান নয়নাকে কোলে তুলে নিয়েছে৷ জিয়ানের হাত নয়নার কোমড়ে৷ শাড়ি কিছুটা সরে যেয়ে কোমড়ের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে।
জাহিন হুট করে বেড়ালটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
“দ্বিতীয় তলা থেকে বেড়ালটা পরে ম্যাও ম্যাঁও করে উঠে।
” নয়না ভয়ে চিৎকার দিয়ে জিয়ানের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
“জিয়ান নয়নাকে কোল থেকে নামিয়ে ম্যারিনো ভেবে নতুন বেড়ালটাকে কোলে তুলে নেয়৷ কিন্তু বেড়ালটা কেমন অপরিচিত লাগছে!
” নয়না জিয়ানের শার্ট খামচে ধরে বলে,আমি বেড়াল ভয় পাই ছাড়ুন ওকে।
“ওর নাম ম্যারিনো। জাহিনের আত্মা।
” সে যা হোক নামান।
“জিয়ান একজন সার্ভেন্ট ডাক দিয়ে ম্যারিনোকে তার কাছে দিয়ে বলে, ম্যারিনোকে ওর সঙ্গীর কাছে দিয়ে আসুন।
” জাহিন রুমে এসে একসাথে দুটো সিগারট ধরায়। সিগারেটের ধোয়ার সাথে উড়িয়ে দেয় তার উদ্ভট সব ভাবনা চিন্তা। সে জানেনা তার কি চাই সে জানে তার জিনিস তার ফেরত চাই। জাহিন দু’টো সিগারেটের ধোয়া টেনে নিয়ে বলে,যা আমার তা হয়ত আমার থাকবে নয়ত আর কারো হতে পারবে না৷
“জিয়ান বসায় এসে সোজা মিতা বেগমের রুমে ঢুকলো৷ মিতা বেগম তখন নামাজ শেষ করে সবে তাজবিহ নিয়ে বসছে।
” জিয়ান ডাকলো আম্মু আসবো?
“মিতা বেগম ঘাড় বাকিয়ে বলে,অনুমতি নিতে হবে না আয়৷
” জিয়ান এসেই মিতা বেগমের কোলে শুয়ে পরলো৷
“মিতা বেগম জিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,কিরে খোকা কিছু বলবি?
” কিছু না বললে,তোমার কাছে আসা যাবে না?
“মায়ের কাছে আসতে সন্তানের কোন কারণ লাগে না। তবুও আমি জানি তুই কিছু বলবি।
” আম্মু আমি তো কাল চলে যাবো। নয়নাকে দেখে রেখো ও খুব সেনসিটিভ মেন্টালিটির। বাসায় যেতে চাইলে যেতে দিও বাবা যাতে বাঁধ না সাধে৷
“তোর বাবা রাগী স্বাভাবের যদিও এটা তোদের বংশগত তবে মনটা একদম কোমল। সে নয়নাকে খুব স্নেহ করে।
” নয়না দরজায় এসে বলে,আম্মু আমাকে আদর দিবে না?
“জিয়ান নয়নার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে৷ নয়নার পরণে তার টিশার্ট যদিও গায়ে ওড়না জড়ানো।
” আয় এদিকে আয় তোকেই তো আদর বেশী করবো। ছেলেটাতো চলেই যাবে তার পর দুই মা মেয়ে মিলে সারাক্ষণ একসাথে ঘুরবো ফিরবো।
“জিয়ান চট করে উঠে বলে,আম্মু তাহলে এখন রুমে যাই।
” নয়না বলল,আজ আম্মুর সাথে ঘুমাবো৷
“জিয়ান চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে নয়নার দিকে৷
” মিতা বেগম নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,নিশ্চিত অভিমান হয়েছে আমার ছেলেটার উপর? আজ অভিমান ছেড়ে দে ফের যখন আসবে তখন করিস৷ যাহহ তোর বৌকে নিয়ে যা।
“জিয়ান নয়নার হাত ধরে রুম থেকে বের করে সাথে সাথে কোলে তুলে নিয়ে বলে, লজ্জা করে না বরের আদর না চেয়ে শ্বাশুড়ি আদর চাও?শুধু শুধু হাঁটুর বয়সী বলি?
” ছিহহহ কিসব কথা৷ থাকবো না আপনার সাথে চরম অসভ্য আপনি৷
“একবার রুমে চলো তারপর দেখাচ্ছি অসভ্যতা কাকে বলে৷
” মেহনুর মুখে হাত দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে পরলো,চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরতো লাগলো নোনাজল৷ তার কপালে কেন ভালোবাসা নেই?আচ্ছা নয়নার জায়গায় সে থাকলে তার জীবনটা নিশ্চিত রঙিন হতো।
“জিয়ান রুমে এসে নয়নাকে বেডে চেপে ধরে বলে,এবার বলো, আদর দাও জান৷
” ইশশ শখ কত জীবনেও বলবো না৷
“না বললে কিন্তু খবর আছে।
” বলবো না, না না৷
🌿নীলাঞ্জনা হসপিটালে থেকে চেকআপ করে বের হয়ে রিকশা নিলো। গাড়িতে তার দম বন্ধ লাগে তাই গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। রিকশা কিছুদূর এগোতেই লাবিব লাফ দিয়ে রিকশায় উঠে পরে৷
“রিকশা থেকো নামো।
” তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে তবে ফিরিয়ে দিচ্ছো কেন?
“ভালোবাসতাম। তবে আমি থাকতেও যার অন্য নারীর সঙ্গ প্রয়োজন হয়। তাকে ভালোবাসা তো দূর ঘৃণা করতেও ঘৃণা হয় আমার। নীলাঞ্জনা একদলা থুতু ফেলে বলে,ফেলে দেয়া থুতু আর তোমার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই আমার কাছে৷ লক্ষ কোটিবার পায়ে ধরলেও ফেরত নেবো না৷
” গাড়ি থেকে না নামলে ওইযে সামনে পুলিশ বক্স সেখানে যেয়ে চিৎকার করবো৷
“লাবিব নেমে গেলো রিকশা থেকে৷
” নীলাঞ্জনা তাচ্ছিল্য হেসে বলে,পুরুষ মানুষ জানেনা নারী যত যত্ন করে ভালোবাসতে পারে তারচেয়ে দ্বিগুণ ভাবে উপেক্ষাও করতে পারে৷ প্রিয়তম মানুষ ও একসময় তাদের কাছে মৃত হয়ে থেকে যায়। তাদের ধোঁকা জানার পর তাদের অস্তিত্ব থাকা না থাকা সমান। তারা চোখের সামনে থেকেও যেনো না থাকার মত এক্সজিস্ট করে।
#চলবে।

বিঃদ্র-ব্যস্তার কারণে রিচেক করা হয়নি৷ ভুলত্রুটি মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন৷

মরীচিকার সংসার পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0

#মরীচিকার_সংসার (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আমার মরীচিকার সংসার তার নিজ গতিতে চলছে। সেই একই নিয়ম। ঘরের সমস্ত কাজ করো। রাতে সবার অভিযোগ শোনো। স্বামীর মাঝে মাঝে গায়ে হাত তোলা সহ্য করো। সব মিলিয়ে মানিয়ে নিয়ে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কোনরকম টিকে আছি। আমি জানি এভাবে শত শত মেয়েরা মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। যাদের সন্তান আছে তারা তো ভুলেও সামনে পা বাড়ায় না। বাড়াতে চায় না।

অতঃপর এই মরীচিকার সংসারে আমার সাথে এমন একটি ঘটনা ঘটলো যে আমি বাধ্য হলাম নিজের কথা ভাবতে। সারাজীবন সংসার, পরিবার, সমাজ নিয়ে তো অনেক ভাবলাম। এবার আমাকে আমার কথা ভাবতে হবে। সেটা আমি বুঝে গেলাম। গত সাতদিন হলো আমার ননদ এই বাড়িতে এলো। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো। মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাকে কথা শোনানো, সমস্ত কাজে হুকুম করা। সব মিলিয়ে আমার জীবন যেমন ছিলো তেমনই। তবে একদিন বিকালবেলা ননদের কান্নার শব্দ পেয়ে অবাক হলাম। ঘটনাচক্রে সেদিন পলাশও বাড়িতে ছিলো। ননদের কান্না দেখে সবাই তার কাছে গেলাম। পলাশ বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,“তোর কি হয়েছে? কান্না করছিস কেন?”

“আর বলিস না বাবা। ওর কানের দুল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
শাশুড়ী মা ননদের হয়ে জবাব দিলো। পলাশ কিছুটা হতবাক হলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,“এই বাড়ি থেকে আর কত কানের দুল হারাবে।”

“এবার হারাইছে বলে তো আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় তোর বউ কিছু একটা করেছে।”
শাশুড়ীর এই কথায় পলাশ তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি বোকার মতো সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ননদ তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,“আগেরবার বলছিলো ওটা তার কানের দুল। আমার নয়। আমি নিশ্চিত তখনই তার আমার কানের দুলের উপর নজর পড়েছে। সেই সরিয়েছে।”

“তোমরা আমাকে চোর বলছো?”
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম। সেই মূহুর্তে শাশুড়ী তেলেবেগুনে জ্ব লে উঠলো। পলাশ থামিয়ে বলে,“রিমি তুমি যদি নিয়ে থাকো তাহলে দিয়ে দাও।”

পলাশের কথায় এবার আর আঘাত পেলাম না। এখন এসব সয়ে গেছে। এই মানুষটার একের পর এক ব্যবহার, বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে এই মানুষটি আমার আপন কেউ নয়। যাই হোক, কানের দুল নিয়ে ঘরে বিশাল হট্টগোল বেধে যায়। অতঃপর সেই কানের দুল আমার ঘরেই পাওয়া যায়। আমি বুঝতে পারলাম, এটা ননদের কাজ। আমাকে ছোট করার। কানের দুল আমাদের ঘরে পাওয়ার পর পলাশ আমাকে জিজ্ঞেস করে,“এসব কি রিমি? তুমি?”

“আমি এটা এখানে রাখিনি। আর আমি এটাও জানি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কাজটা যে তোমাদের।”
আমার কথাটি মাটিতে পড়তে পারলো না, তার মাঝে শাশুড়ী তেলেবেগুনে জ্ব লে উঠে। সে বলে,“মুখ সামলে কথা বল ছোটলোক। চো রের বাচ্চা চোর। সেদিন নিজের প্রমাণ করে দুলটা নিতে চাইছিলো আর আজ চুরি করে ফেললো।”

“খবরদার আম্মা। ভুলেও আমাকে চোরের বাচ্চা বলবেন না। আমার বাবা, মা যথেষ্ট সৎ মানুষ।”
আমি কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে পলাশ গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। আমার অপরাধ আমি চুরি করে আবার বড় গলায় কথা বলেছি। পুরো বিকাল জুড়ে তাদের আমার উপর অকথ্য গালা গালি, অপবাদ চললো। আবার আমার বাবাকে ডেকে বিচার বসাতে চাইলো। এবার আর আমি সহ্য করলাম না। কানের দুলগুলো কেড়ে নিয়ে বললাম,“আমার বাবাকে ডেকে পাঠাতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি। তোমাদের মতো নোংরা মানুষের সাথে যতই মানিয়ে নেই না কেন? কখনো একসঙ্গে থাকা হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি।”

“কি বললে তুমি?”
পলাশ রাগান্বিত গলায় বললো। এবার আমিও দুইটা গা লি দিয়ে বললাম,“যা শুনছিস তাই। ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। এভাবে প্রতিদিন কু কুরের মতো ব্যবহার করা। একটার পর একটা অপবাদ দেওয়া। সব মিলিয়ে তোমরা আমার জীবন নরক বানিয়ে ফেলেছো। এখন আমার বাবাকেও ছাড়ছো না। এভাবে চললে আমার বাবার এই বাড়িতে এসে আমার বিচার করতে করতে ম রতে হবে। আর আমাকে তো জীবিত অবস্থায় নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। অনেক হয়েছে আর নয়। সবকিছুর একটা সীমা থাকে। তোমরা আমাকে পুরোপুরি ছাড়তেও চাও না আবার ভালোভাবে বাঁচতেও দাও না। এতদিন তোমার মা তোমার হাতে মা র খাইয়ে মজা নিতো। আজ বোনের শখ হয়েছে তাই চুরির অপবাদ দিলো। এখন আমার বাবাকে ডেকে এনে যা নয় তাই বলে অপমান করবে তাই তো?”
একটু থেমে আবারও বললাম,“না। সেটা আর হচ্ছে না। অনেক হয়েছে। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে অনেক কাটিয়েছি তোমার বাড়ি। আর নয় তো। এবার আমার মুক্তি প্রয়োজন। এই নরক থেকে।”
এই পর্যায়ে কান্না করে দিয়ে বললাম,“যেদিন এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি সেদিন চোখে অনেক স্বপ্ন ছিলো। মা নেই, শাশুড়ীর মাঝে মাকে খুঁজে নিবো। ননদকে বোনের মতো ভালোবাসবো। কিন্তু পরিশেষে কি হলো? আসলে একপাক্ষিক কোনকিছু হয় না। তাছাড়া যদি এই বাড়ির একজন অন্তত আমার হয়ে লড়াই যদি করতো। তেমন কেউ নেই। যার হাত ধরে আমি এই বাড়িতে এসেছি, সেই তো আমাকে ভালোবাসে না, বিশ্বাস করে না। তার চোখে আমি অপরাধী, আমি শুধু তার প্রয়োজন। এমন এক অপ্রয়োজনীয় ঘরে কেন থাকবো? একটা যন্ত্রণাময় সংসারে।”

আমার কথার জবাবে পলাশ এবং তার মা চ্যাতে যায়। তারা অকথ্য ভাষায় আমার সাহস নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। আমিও তাদের জবাব দিয়ে দেই। সেই সাথে বলি,“এই কানের দুল আমার মায়ের। সেটা তোমরা চুরি করেছো। আজ আবার সেটা দিয়ে আমাকে চোর বানাতে চাচ্ছো। সমস্যা নাই। আমাকে চোর বানানোর প্রয়োজন নেই। এটা আমি তোমাদের চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এখন। এটা আমার মায়ের। এটা আমার। তোমাদের কারো না। তাই আমাকে বাধা দিও না। উল্টা চুরির দ্বায়ে জে লে যাবে। অনেকদিন সহ্য করেছি। আর নয়। আমার মায়ের জিনিস অনেক ভোগ করেছো। এবার বাদ দাও। মানুষের যখন সহ্যের সীমা পার হয়ে যায় তখন সে কি করতে পারে সেটাও তোমরাও দেখে নাও।”
এখানে অনেক তর্ক বিতর্ক চলে। অবশেষে তাদের সবাইকে সুন্দরমতো জবাব দিয়ে আমি ঘর থেকে বের হলাম। আমি বুঝে গিয়েছি, এই সংসারে আমি টিকতে পারবো না।আমি যতই চুপচাপ সব মেনে নিচ্ছি ততই তাদের অত্যাচারের পরিমান বাড়ছে। শারীরিক মানসিক সব অত্যাচার তারা করছে। এই অসুস্থ পরিবেশে আমি সারাজীবন কাটাতে চাই না। তাই আজ নিজেকে শক্ত করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
__
বাড়ির দরজায় আমাকে দেখে ভাবী মুখটা কালো করে ফেললো। তাকে পাত্তা না দিয়ে আমি ভেতরে আসলাম। বাবা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। ইতিমধ্যে পলাশ তাকে ফোন দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে আমার নামে বদনাম করে দিয়েছে। তাই বাবা সব জানে।এজন্যই ভাবী আমাকে দেখে খুশি হতে পারলো না। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে অসহয় গলায় বললাম,“বাবা আমি আমার সব দিয়ে ওখানে টিকে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজ আর পারছি না বাবা। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ঐ বাড়িতে আর মানিয়ে নিয়ে, মেনে নিয়ে থাকতে পারছি না বাবা।”

কথাগুলো বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। দিনের পর দিন কতটা যন্ত্রণা সহ্য করে ওখানে টিকে ছিলাম সেটা বললাম বাবাকে। এসব শুনে ভাবী বলে,“সংসার করবা না তো কি আমাদের ঘাড়ের উপর বসে খাবা? হায়রে আমার পোড়া কপাল, এক বুড়ার জন্য বাঁচি না এখন আবার মেয়ে এসে ঝুটছে।”

একটু থেমে পুনরায় বললেন,“আমার সংসারে এসব চলবে না। আসছো ভালো। একবেলা খেয়ে বিদায় হও।”
এবার প্রথমবারের মতো আমার বাবাও জবাব দিলেন। সে বললেন,“এটা তোমার বাড়ি নয় যে আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিবে। এখন অব্দি এই বাড়িটা আমার নামে। তাই তোমাদের অসুবিধা হলে তোমরা বাড়ি ছাড়তে পারো।”

“কি? বাবা এই কথা আপনি বললেন? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আপনি বললেন এটা? আচ্ছা তা এটা নাহয় আপনার বাড়ি কিন্তু গিলেন কার টাকায়? সেটা তো আমার স্বামীরই।”
এই কথা বলে ভাবী একের পর এক আমার বাবার খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিতে লাগলো। যা মেয়ে হিসাবে আমার শোনা কষ্টকর। আমিও বলে দিয়েছি, আর খাবে না। আমরা বাবা, মেয়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করবো। তাদের টাকায় কেনা খাবার খাবো না। আমরা আমাদেরটা ম্যানেজ করে নিতে পারবো। ভাবী এরপর আর কিছু বলতে পারলো না। চুপ করে নিজের ঘরে গেলেন।

পরিশেষে, আমি নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী ছোট একটি কাজ যোগাঢ় করে নিয়েছি। সেই সাথে আবার মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে নিয়েছি। আমার বাবা এবং আমি আমার টাকায় মোটামুটি ভাবে জীবন কাটাচ্ছি। ভাবী আমাদের সাথে তর্ক করে আলাদা হয়ে গেছেন৷ আমরাও তাদের আর বাধা দেইনি। অন্যদিকে পলাশ কয়েকবার নিতে আসছিলো কিন্তু যাইনি। আমি জানি পলাশের মতো মানুষ কখনো শুধরাবে না। তার পরিবারও ঠিক হবে না। এদের মতো পরিবারে যারা পড়ে সেই মেয়েরাই জানে জীবন কত কষ্টের। এদের কপালে সারাজীবনে কখনো সুখ জোটে না। তবে শেষ বয়সে যখন বিছানায় পড়ে তখন শাশুড়ীরা মা মা বলে কেঁদে ম রে। তখন যে অপমান, অপদস্ত করা বউরাই কাজে লাগে। পলাশরাও সেই যুগে শুধরে যায়। যখন একটা মেয়ের জীবনের সব রঙঢঙ করার সময় শেষ হয়ে যায়। তবে যুগের সাথে সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন হবে এই আশা নিয়েই আমি সমাজের মানুষের কটুক্তিগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। জীবনের রঙঢঙ উপভোগ করতে এগিয়ে যাচ্ছি সামনের পথে।

(সমাপ্ত)

মরীচিকার সংসার পর্ব-০৩

0

#মরীচিকার_সংসার (৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

গতরাতের পলাশের কর্মকান্ড আমাকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়। গত আট মাসের সংসার জীবনে শাশুড়ীর সব বিষয়ে দোষ ধরা। কটু কথা সবকিছুকে মানিয়ে নিয়ে সংসারটাকে আপন করেছিলাম। কখনো পলাশকে কোন কথা বলেনি। শাশুড়ীকে নিজের মায়ের মতো ভেবেছিলাম। কিন্তু কানের দুলটা আমার অনেক প্রিয় ছিলো। মায়ের শেষ স্মৃতি বলে কথা। সেজন্য পলাশকে না পেরে বললাম। পরিশেষে কপালে দূর্ভোগ ছাড়া কিছুই ঘটলো না। গতকালের ঘটনায় স্পষ্টভাবে আমি বুঝে গেলাম, পলাশকে তার মায়ের কটু কথা, বোনের ন্যাকামি নিয়ে বললে লাভ হতো না। দিনশেষে সে আমাকেই দোষ দিতো। যদিও মাঝে মাঝে আকারে ইঙ্গিতে পলাশকে তার খারাপ লাগা বোঝাতো। পলাশ সেসবে পাত্তা দিতো না। আমার মন খারাপ আছে জেনেও কাছে আসতো। সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও গতকালের ঘটনা আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারলাম না। তার উপর বাবার শুকনো মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম তার জীবনটা সুখের নয়। সব মিলিয়ে মনমরা হয়ে বসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আনমনে জীবন নিয়ে ভাবছিলাম যার ফলস্বরূপ দুধ উতলে পড়ে যায়। এটা দেখে হন্তদন্ত হয়ে বারান্দা থেকে ছুটে আসে শাশুড়ী মা। সে বলে,“এই নবাবের ঝি কোন দিকে তাকিয়ে দুধে ঝাল করছিস?”

শাশুড়ীর কর্কশ কন্ঠে হুঁশ ফিরে আমার। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। শাশুড়ী এসে দুধ উনুন থেকে নামিয়ে নিলো। সেই সাথে তার মুখও চলতাছে। কথায় কথায় এক কথা,“চোরের জাত আমাকে বলে চোর। এখন মন দিয়ে কার না কার কথা ভাবছিলো। আমার সংসারে আ গুন লাগানোর প্লান করছে। সংসারে অলক্ষী এনে ঘরে তুললে তো এটাই হবে।”
শাশুড়ী একা একা বলে যাচ্ছে। আমি কথা বললাম না। শাশুড়ীর চেঁচামেচি শুনে ননদ আসলো। সেও মায়ের কথায় সঙ্গ দিচ্ছে। আমি কথা না বাড়িয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাশুড়ী মা অবশিষ্ট দুধ দিয়ে চা বানিয়ে নিলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,“এখানে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে থালা-বাসন গুলো ধুঁয়ে আসো।”
আমি মাথা নাড়িয়ে সেই কাজে চলে গেলাম।
___
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে দরজা খুলে দেয় ভাবী। এতক্ষণ অব্দি দরজার বাহিরে বসে ঝিমুচ্ছিলো বাবা। ভাবী দরজা খুলে বাবাকে এমনভাবে দেখে অবাক হয় না। মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,“মেয়ের বাড়িতে রাতটুকু জায়গা হয় নাই?”

বাবা জবাব দিলো না। ভাবী আবারও বলে উঠলো,“তা আপনার মেয়ে কি কান্ড ঘটিয়েছে? নিশ্চয় শ্বশুড়বাড়িতে আমাদের মান-সম্মান ডুবিয়েছে? আমি জানতাম, রাতের বেলা আপনাকে জরুরিভাবে ডেকেছে মানেই কোন অঘটন ঘটিয়েছে। তাই তো আপনার ছেলেকে আপনার সাথে যেতে দেইনি।”
বাবা কোন কথার জবাব না দিয়ে আস্তে করে ভেতরে যায়। ভাবী এটা দেখে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,“যান যান। মেয়ে অপকর্ম ঘটিয়েছে না। এখন তো চুপচাপ যাবেনই। এগুলো আমি করলে ঠিকই সারা পাড়া করতেন।”
এই কথা শুনে বাবা চুপ করে থাকতে পারলেন না। সে শান্ত গলায় বলেন,“তুমি যা করো বৌমা সেসব নিয়ে কথা বললে প্রতি ঘন্টায় বিচারে বসতে হতো। আর হ্যাঁ আমার মেয়ে কিছু করেনি। তবুও তার আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে আমি আমার মেয়েকে ঐ বাড়িতে দাঁত কামড়ে যে পড়ে থাকতে বলেছি সেটাও তোমার জন্য বৌমা। নয়তো যে সামান্য কারণে তারা আমার মেয়েকে নিয়ে বিচার বসিয়েছে তাতে আমার বিবেক, আমার আত্মসম্মান আমাকে বারবার বলছিলো আমার মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে আসি। কিন্তু পারিনি।”
বাবার এই কথায় ভাবী তেলেবেগুনে জ্ব লে উঠে। সে অহংকারের সাথে নিজেকে এই সেই দাবি করে, শ্বশুরবাড়ির সবাইকে তুচ্ছ করে কথা বলে। এসব দেখে বাবা নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মাঝরাতে বাড়ি ফিরে দরজা ধাক্কালে নিজের গুনবতী বউয়ের মুখ দিয়ে কত যে বাজে কথা শুনতে হবে সেই ভয়ে বাহিরে ছিলো। এসব কারণেই বাবা নিজের মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে মাথানত করতে বাধ্য হয়েছেন। নয়তো মেয়েকে নিয়ে চলে আসতেন। কিন্তু এই বাড়িতে এখন আসলে যে জীবন আরও জাহান্নাম হয়ে উঠবে। সেজন্যই নিয়ে আসেননি। অনেকে বলে শাশুড়ী, ননদ খারাপ হয়। এরা জীবনে ভালো হয় না। কিন্তু বাস্তবতা এটা নয়। বাস্তব হলো যে মানুষ খারাপ সে সব সম্পর্কে খারাপ। কিন্তু সম্পর্কে ধরে মানুষ খারাপ হয় বিষয়টি ভুল। বাবা এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নেয়। বাহির থেকে ভাবীর মুখের কটুক্তির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

____
সকালের ঘটনাকে ভিন্নরূপে শাশুড়ী বাড়িয়ে পলাশের কাছে তুলে ধরে। এতদিন এসব করে বেড়ায়নি। কিন্তু গতকাল থেকে বুঝতে পেরেছে পলাশ কখনো বউয়ের হয়ে তর্ক করবে না। পলাশকে দিয়ে বউকে অকারণে শায়েস্তা করা যাবে। সেজন্য এখন এই কাজটিও করতে শুরু করেছে। আমি বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে পারলাম। হলোও তাই। পলাশ বিচার বিবেচনা ছাড়া আমাকে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,“এই ঘরে শান্তিতে থাকতে চাস না? যদি থাকতে চাস। তাহলে আমার মা যেভাবে বলে সেভাবে থাক। পরবর্তীতে জানো আমি এই বিষয়ে আর কোন কথা না শুনি।”
পলাশের মুখে এই কথা শুনে রাগে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। এই মানুষকে এখন আর কেন জানি সহ্য হচ্ছে না।

এটা তো সবে শুরু হলো। এতদিন কথার আঘাতে শাশুড়ী, ননদ জীবনটা তেজপাতা করে দিয়েছিলো। এখন শুরু করেছে নতুন নাটক। পলাশ তাদের দলের বুঝতে পেরে পলাশ আসার আগে ভারী কাজ নিয়ে বসে শাশুড়ী। পলাশকে দেখেই বলবে,“ও মা গো। কোমরের ব্যথায় টিকলাম না। এই দিন ছিলো আমার কপালে।”
শাশুড়ীর এই ন্যাকামি দেখে পলাশ কোন কথা ছাড়া এসে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। তার কথা হলো,“তুই থাকতে আমার মাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে হয় কেন?”

“বাড়ির কাজ সব আমিই করেছি। লোক দেখানো কাজ শেষ করছে। এখানে আমার কি করার?”
এই কথা বলতে দেরি পলাশের আমার পেটে লাথি মা রতে দেরি হয় না। কয়েকটা লাগিয়ে দিয়ে সে আমার উদ্দেশ্য বলে,“ভুল করে আবার মুখে মুখে তর্ক। উল্টাপাল্টা কথা বলিস। তোকে আমি…।”

“থাক বাবা ছাড়। ওর তো মা নেই। এসব শেখাবে কে? হয়তো বা ওর মায়ও এমন অজাতের ছিলো। তাকে দেখে শিখেছে।”
নিজের মাকে নিয়ে এমন কথা কোন সন্তান মে নে নিতে পারে। আমিও পারিনি। কড়া গলায় বললাম,“আমার মায়ের সম্পর্কে কোন বাজে কথা বলবেন না। একদম না। আমার মা আপনাদের মতো খারাপ ছিলো না।”

“তারমানে আমরা খারাপ?”
শুরু হলো শাশুড়ীর ন্যাকা কান্না। আহাজারি। তার ন্যাকা কান্নার শব্দের সাথে পলাশের গায়ে হাত তোলাও শুরু হলো। ইচ্ছামতো মে রে মুখ চেপে ধরে বলে,“তোর এই মুখ দিয়ে এমন কোন শব্দ বের করবি না যেটা আমার মাকে অসম্মান করে।”
আমি মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারলাম না। এতসব কান্ড সন্ধ্যাবেলা করে সেই পলাশ রাতে যখন কাছে আসে তখন নিজেকে মন চায় শেষ করে দেই। তার প্রতি কোন আগ্রহ জন্মায় না। না ভালোবাসা। শুধুমাত্র কোনমতে মরীচিকার এই সংসার করে যাই। এমন করেই পার হচ্ছে জীবন। দিনের পর দিন পলাশ এবং তার পরিবারের অত্যাচারও বাড়ছে। এমন এক পরিস্থিতির মাঝে পলাশ আবার চাচ্ছে বাচ্চা। সেদিন রাতে যখন পলাশ বললো,“চলো না বউ আমরা একটা বাচ্চা নেই।”

তৎক্ষনাৎ আমি মুখের উপর বলে ফেললাম,“না। এমন এক সংসারে বাচ্চা নিয়ে কি তাকে শেখাবো দেখ, তোর মাকে তোর বাবা কত অসম্মান করে? কত নিচু চোখে দেখে? এসব? তাকে এমন অসুস্থ পরিবেশে রাখবো।”
আমি কথাটি বলে পলাশের দিকে তাকালাম। পলাশ কিছু বলতে নেয় তখন আমি বললাম,“জানি এখন তুমি গায়ে হাত তুলবে। অকথ্য ভাষায় কথা বলবে। সত্যি বলতে ঠিক এই কারণেই বাচ্চার কথা ভাবতে ভয় হয়।”
প্রথমবার খুব শান্ত গলায় পলাশকে বোঝালাম। নারীরা বিয়ের পর একটা সংসারে আসে নিজেকে নতুনভাবে গড়তে। নিজের একটা সংসার সুন্দরভাবে সাজাতে। যেই সংসারে তার ছোট ছোট অনেক ইচ্ছের মূল্য দেওয়া হবে। অনেক স্বপ্নের মূল্য দেওয়া হবে। তার চাওয়া পাওয়ার মূল্য দেওয়া হবে। তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তার শক্ত খুঁটি তার স্বামী রুখে দাঁড়াবে। কিন্তু আমার জীবনে এসবের কিছুই হয়নি। শুধু কি তাই? এখানে তো আমার স্বামীই আমার বিপক্ষে একটা কিছুর সুযোগ খুঁজে। যাতে সে আমার গায়ে হাত তুলতে পারে। এমন এক পরিবেশে নিষ্পাপ এক বাচ্চা নিয়ে এসে কি তার জীবন জাহান্নাম করে দিবো? এই কথার পরিপেক্ষীতে পলাশ কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আমি শুনলাম না। আমি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। পলাশ বোধহয় কিছুটা আহত হলো।


চলবে,