Tuesday, June 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 3



Dark Mystery পর্ব-৩০+৩১

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_29
#Sabrina_Summa

নিচে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলো তানিশা ডাবল সোফায় বসে আছে।
তাই সুপ্তি ও মাহির দুইজনে দুইটা সিঙ্গেল সোফায় বসলো।

তানিশা ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বললো, ” এতক্ষণে আসার সময় হলো দুজনের! তোমাদের জন্য আমি ঘুমাতে পারছি না। ”

তানিশার কথা শেষ হতে না হতেই কলিং বেল বাজলো।

সুপ্তি উঠে যেতে নিলে তানিশা বলে উঠলো, ” আমি যাচ্ছি। ”

বলেই দরজা খুলে দিলো। দরজার বাহিরে থাকা মানুষগুলোকে চিনতে পারলো না তানিশা। তাই বলে বসলো, ” আপনি কে? ”

একজন বললো, ” উনি ঘাটাইলের ইউনো। আর আমি তার পিএ। মাহির স্যার এ বাসাতেই আছেন তাই না? ”

তানিশা দরজা থেকে সরে ভিতরে আসতে বললো।

সামনের মানুষটিকে দেখে মাহির দাঁড়িয়ে বললো, ” আরে আরে, ইউনো যে! ”

ইউনো এসে মাহিরের সাথে হ্যান্ডশেক করলো।

হ্যান্ডশেক করতে দেখে সুপ্তির সম্ভবত সারা শরীর জ্বলে গেল। যদিও সে জানে এই মহিলা ইউনো বিবাহিত এবং ইউনোর বয়স মাহিরের আন্টির বয়সী। তারপরও কেন যেন তার খুব জেলাসি ফিল হচ্ছে।
তারমধ্যে আবার এই ইউনোর জন্য সুপ্তির নিজের সিট ছাড়তে হয়েছে। তাতে তার রাগ আউট ওফ কন্ট্রোলে যাচ্ছে ৷

তবুও কিছুক্ষণ মাহিরের সোফার পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন শুনলো।
মাহিরের হাসি মুখে কথা বলা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো ৷
তাই সুপ্তি রেগে রুমে গিয়ে উচ্চ শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো।

” বাব্বাহ কি রাগ! এটাই তো দেখতে চাচ্ছিলাম এতদিন। ” ( মাহির মনে মনে )

এত শব্দে সুপ্তির মা ঘুম থেকে উঠে বাহিরে এসে আরেক দফায় শক খেলেন।
তারপর নাস্তা দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ৷
তার বাসায় আজ এত ভিআইপি গেস্ট দেখে কেন যেন তার মন বড্ড কু ডাকছে । তারমাঝে কিছুক্ষণ আগের সেই ঘটনা তো আছেই।
আজকের রাতটা যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না!

সুপ্তি রুমে গিয়ে পুরো দমে চেষ্টা করছে কিছু খোঁজার।
প্রথমেই সে সুপ্তি থেকে মিস সিক্রেট হওয়ার ফুটেজ ডিলিট করলো। তারপর আশেপাশের যত সিসি টিভি আছে সব হ্যাক করলো।
কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটির পর মৃদু স্বরে চিৎকার করে বললো, ” ইয়েস। ”

এরপর নাম্বার ৩ কে কল করে বললো, ” তুমি ঘাটাইল আছো না? ”

অপর পাশ থেকে হ্যাঁ সূচক বার্তা আসতেই মিস সিক্রেট কিছু বললো।

নাম্বার ৩ : ওকে, ম্যাম। আমি তাড়াতাড়ি করছি ৷

মিস সিক্রেট ওকে বলেই কেটে দিলো।

সুপ্তি ড্রয়িং রুম পার হওয়ার সময় মাহির চিন্তিত নয়নে ঘড়ির দিকে তাকালো। সময় ১০ বেজে ৩৫ মিনিট।
সুপ্তি দ্রুত পার্কিং এরিয়ায় গিয়ে কালো রংয়ের গাড়ি নিয়ে নিজের হুডি মাস্ক পড়ে বেরিয়ে গেল ৷

সুপ্তি অরপে মিস সিক্রেট একা একটা রুমে বসে আছে। কিছুক্ষণের মাঝে নাম্বার ৩ একটা বস্তা নিয়ে আসলো।

মিস সিক্রেট : চেয়ারে বসাও।

নাম্বার ৩ ও তাই করলো। বস্তা সরাতেই দেখা গেল একটা মানুষ। বয়স ৫০ এর কাছাকাছি।

মিস সিক্রেট : মুখ খুলে দাও।

নাম্বার ৩ মুখ খুলে দিতেই লোকটা বলা শুরু করলো, ” আমি আপনাদের কি ক্ষতি করেছি? কেন এমন করছেন? ”

মিস সিক্রেট : বাসার নকশা দিলে কেন?

লোকটা কিছুটা আঁতকে উঠলো। তবুও না জানার ভান করে বললো, ” আমি দেই নি। ”

মিস সিক্রেট : একদম মিথ্যে বলবে না। এখন সুপ্তির বাবা-মার কি হবে! তুমি নকশা না দিলে এত সহজে কেউ ঢুকতে পারতো না। কারণ নকশাই করা ওভাবে ৷ নকশা ছাড়া বাসায় কেউ ঢুকলে বার বার ফাঁদে পড়বে।

লোকটা আকুতি করে বললো, ” ম্যাম, প্লিজ ক্ষমা করে দিন। দারোয়ানের চাকরি করে আর কতই পাই। তাই টাকার লোভে পড়ে করে ফেলেছি। ”

মিস সিক্রেট : ৫০ হাজার টাকাও কম মনে হয় ! যদি মনেই হয় তাহলে সুপ্তিকে বলতি।

” প্লিজ ম্যাম, মাফ করে দিন। আমার পরিবার আছে। ”

মিস সিক্রেট : তোর পরিবারই সব। সুপ্তির পরিবার কিছুই না!
নাম্বার ৩ নিরব দর্শক । তবে তার বার বার প্রশ্ন জাগছে তার ম্যাম বার বার কেন সুপ্তিকে টানছে?

লোকটি : প্লিজ, ম্যাম।

মিস সিক্রেট : তোর পরিবারকে আমি দেখবো।
বলেই পায়ের কাছ থেকে গান বের করলো।

লোকটার চোখ ভয়ে বড় বড় হয়ে গেল।

মিস সিক্রেট : আর হ্যাঁ, মরার আগে আমায় দেখবে না তা কি হয়!
বলেই এগিয়ে এসে মাস্ক খুললো ৷

হালকা আলোয় লোকটি মিস সিক্রেটের মুখ দেখে যখনই বলা শুরু করলো ‘স’ তখনই মিস সিক্রেট শুট করলো।

মাস্কটা পড়ে নাম্বার ৩ এর দিকে তাকাতেই দেখলো নাম্বার ৩ ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। হয়তো মিস সিক্রেটকে প্রথম খুন করতে দেখায়।

মিস সিক্রেট : প্রফেশনাল কিলার হয়ে অন্যকে খুন করতে দেখে এত ভয় পাওয়াটা তোমায় সাজে না ।

কয়েক সেকেন্ড সময় দিলো নাম্বার ৩ কে স্বাভাবিক হতে। তারপর বললো, ” যাও এটাকে বস্তায় পুরে উপজেলা গেটের সামনে ফেলে এসো। ”

নাম্বার ৩ : কিন্তু ম্যাম…

সম্পূর্ণ কথা বলতে না দিয়ে মিস সিক্রেট বললো, ” আমি কোনো এক্সকিওস শুনতে চাই না। ”

নাম্বার ৩ আর কিছু না বলে বস্তায় পুরে যাওয়া শুরু করলো।

নাম্বার ৩ চলে যেতেই মিস সিক্রেট বললো, ” অনেকদিন পর খুন করলাম। ”

১০ মিনিট পর সেও বের হলো। উপজেলার সামনে দিয়ে আসার সময় একটা বাঁকা হাসি দিলো।
কিছুক্ষণ ড্রাইভ করে মিস সিক্রেট সুপ্তির বাসায় প্রবেশ করলো।

এবার কলিং বেল বাজাতে হলো না। দরজা খোলায় ছিল।
ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই তার চোখ গেল ঘড়ির দিকে। ১০ টা ৫৫ বাজে।

” বাহ, খুব তাড়াতাড়ি কাজ করা শিখে গেছি তো। ” ( নিজের মনে মনে নিজেকেই বাহবা দিলো।)

মিস সিক্রেটকে দেখেই ইউনো এবং মাহির দাঁড়িয়ে পড়লো। ইউনো সালাম দিলে তার উত্তর দিতে দিতে মিস সিক্রেট এগিয়ে আসলো।
ইউনো নিজের সিট ছেড়ে দিলো মিস সিক্রেটের বসার জন্য।

এটা দেখে মিস সিক্রেট তৃপ্তির হাসি হেসে মনে মনে বললো, ” এখন বুঝবে, অন্য কেউ নিজের জায়গা দখল করলে কেমন টা লাগে! ”

কিছুক্ষণ স্বাভাবিকভাবে কুশল বিনিময় করলো। তারপর সিরিয়াস হয়ে বললো, ” আপনি তো এখানে বসে আছেন ৷ কিন্তু আমি তো দেখে আসলাম উপজেলার সামনে অনেক ভিড়। সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে! ”

ইউনো আতঙ্কিত স্বরে বললো, ” এত রাতে কোনো ঝামেলা! ”

মিস সিক্রেট : নিজে গিয়েই দেখে নিন।

ইউনো বিদায় নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেল।

মাহির : থ্যাংকস, এতক্ষণে বাঁচলাম।

মিস সিক্রেট কিছু বললো না।

মাহির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চিন্তিত স্বরে বললো, ” ১১ টা ১০ বাজে। সেই কখন বেড়িযেছে এখনও আসলো না। ”

#চলবে

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_30
#Sabrina_Summa

মাহির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চিন্তিত স্বরে বললো,
” ১১ টা ১০ বাজে। সেই কখন বেড়িয়েছে এখনও আসলো না। ”

মিস সিক্রেট চলে যেতে যেতে বললো,
” সুপ্তি অনেক আগেই চলে এসেছে। ”

মাহির অবাক হয়ে বললো,
” কোথায়? মানে কখন? আমি তো দেখলাম না! ”

মিস সিক্রেট পিছনে ঘুরে বললো,
” মন অন্য দিকে থাকলে অনেক কিছুই দেখা যায় না। যাইহোক, ডিস্টার্ব করো না। ঘুমিয়ে পড়েছে। ”

তাই মাহির, তানিশা সবাই রুমে চলে গেল। আর সুপ্তির মা তো কিছুক্ষণ আগেই রুমে চলে গেছে।

এ সুযোগে মিস সিক্রেট চুপি চুপি সুপ্তির রুমে প্রবেশ করলো।।

সকালে.,.

সকলে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে এখন বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে । সবাই বসে আছে তবে তানিশা এবং সুপ্তি ব্যতিত ।

মাহির হঠাৎ বলে উঠলো, ” আঙ্কেল, আন্টি আমি কিছু বলতে চাই । প্লিজ মাইন্ড করবেন না। ”

সকলের উৎসুক দৃষ্টি মাহিরের দিকে। মাহির বলা শুরু করলো, ” আমি সুপ্তিকে পছন্দ করি। শুধু বন্ধুত্বের খাতিরে তা নয়। বরং তার থেকে অনেক বেশি! ”

কয়েক সেকেন্ড থেমে আবার বললো, ” মূলত আমি সুপ্তিকে ভালোবাসি। আপনাদের সম্মতি থাকলে খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে চাই । ”

এতক্ষণ কথাগুলো নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেও এখন সুপ্তির বাবা মার রিয়েকশন দেখার জন্য উপর দিকে তাকালো। দেখলো সবাই তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

সুপ্তির হার্ট বিট বেড়ে গেছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খুব অস্বস্তি লাগছে। তারপরও সে যেতে পারছে না কারণ তার বাবা মা যদি আবার ভাবে সে লজ্জা পেয়েছে! তাহলে তার মান ইজ্জত চলে যাবে না?

” তোর মনে তাহলে এই ছিল? তুই ঘাটাইল এর জন্য আসছোস? ” ( তানিশা মনে মনে রাগে ফুঁসছে )

সকলকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হঠাৎই মাহির বলে উঠলো, ” ইনফ্যাক্ট, সুপ্তিও আমাকে পছন্দ করে।
যদি পছন্দ নাই করতো তাহলে আমার দেওয়া রিং কি ওর হাতে থাকতো! ”

সুপ্তি অবাক হয়ে একবার মাহিরের দিকে তাকালো আরেকবার আংটি টার দিকে তাকালো।
সুপ্তির বাবা মার সুপ্তির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
সেদিকে চোখ পড়তেই আংটি টা খুলে টেবিলে রাখতে রাখতে বললো, ” না, না। বিশ্বাস করো আম্মু, ওনি এটা বন্ধুত্বের খাতিরে দিয়েছিলেন। ”

সুপ্তি ভালোই বুঝতে পারছে তার মা তাকে বিশ্বাস করছে না। তাই মাহিরের দিকে তাকিয়ে বললো, ” কেন আপনি মিথ্যে বলছেন? ”
” এর পরিমাণ খুব খারাপ হতে পারে যা আপনার বোধগম্য হচ্ছে না! ” এই কথাটুকু বলতে তার খুব ইচ্ছে করলো কিন্তু বলতে না পারায় রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।

সুপ্তির মা আবারো দিকে তাকালো। যদিও তিনি স্বাভাবিক ভাবেই তাকিয়ে আছেন কিন্তু মাহিরের সুপ্তির মার তাকানো মনে ইচ্ছে তার আত্মা এখনই বের হয়ে যাবে।

সুপ্তির মা : এ বিষয়ে আর কথা তুলো না। তোমার বাবা মাকে আসতে বলো তাদের সাথেই কথা হবে। বলে তিনিও উঠে গেলেন।

মাহিরের এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। সুপ্তির বাবার সাথে তার যেমন ভালো সখ্যতা হয়েছে সুপ্তির মার সাথে তেমনটা হয় নি। তাই তো তাকে দেখে মাহিরের ভয় লাগে।

মাহির : আঙ্কেল, আমি কিছুক্ষণ পর ঢাকায় ব্যাক করবো। সুপ্তিও তো আজই ঢাকা যাবে তাই না?

সুপ্তির বাবা : হ্যাঁ। কালকে থেকে নাকি আবার বার্সিটিতে জয়েন দিবে।

মাহির : তাহলে একসাথেই ব্যাক করি।

সুপ্তির বাবা : ওকে। ( ভাবলেশহীন ভাবে )

বলে চলে গেল। সুপ্তির বাবা চলে যেতেই তানিশা বললো, ” ওই পাগল ওই । তোর কি বিবেগ বুদ্ধি সব লোভ পাইছে? ”

মাহির : কেন? আমি আবার কি করলাম?

তানিশা : নিজের বিয়ের কথা কেউ নিজে বলে !

মাহির দাঁত কেলিয়ে বললো, ” আমি না বললে কে বলবে। আম্মু আসতে রাজি হতো কিন্তু বাবা জীবনেও না। ”

তানিশা : তাহলে এখন বুঝ। কীভাবে আনবি স্যারকে!

মাহির সিরিয়াস মুখ করার ভান করে নিজের রুম অর্থাৎ গেস্ট রুমের দিকে চলে গেলো।।

চলবে.,.

Dark Mystery পর্ব-২৭+২৮

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_27
#Sabrina_Summa

মাহিরের আবারও মনে হচ্ছে সুপ্তিই মিস সিক্রেট!
একটু পর মাহির নিজেই নিজেকে ধমক দিয়ে বললো, ” এটা সম্ভবই না। ”

এরপর আবারো খাওয়ায় মনোযোগ দিলো ৷
কোনো এক অজানা কারণে তার বার বার মনে হচ্ছে সুপ্তিই মিস সিক্রেট!

যথারীতি খাওয়া শেষ করে গল্পের আসর বসালো সবাই। তবে এবার আর সুপ্তি তাদের সাথে যোগ দিলো না। সে নিজের রুমে চলে গেল।

সুপ্তির কাছে এ বাসার সবথেকে প্রিয় হলো বেলকনি । তবে সেই বেলকনিতেই আসা হয় না দীর্ঘ দিন ধরে।
এ বাসার সব কিছু যে তাকে বড্ড স্মৃতিকাতর করে তুলে। বার বার অতীতকে নিয়ে ভাবায়।।

তবুও সবকিছু উপেক্ষা করে আজ বহুদিন পরে বেলকনিতে গেল সে।
কৃত্রিম আলোয় সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

আশেপাশে তাকাতে তাকাতে নজর গেল গেটের দিকে ৷ সন্দেহ হলো গেটে কাউকে পাহাড়ায় না দেখে । তাই দ্রুত ছাদে চলে গেলো।
তারপর মিস সিক্রেট রূপে এসে যা দেখলো তাতে তার রক্ত মাথায় উঠলো।

খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে মিস সিক্রেট, এতজনের সাথে পারবে না সে।
তাই মাহফুজ চৌধুরীর কাছে আর্মি ফোর্স চাইলো। নিজেও কল করলো হেল্পের জন্য।

এরপর ধীরে ধীরে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলো। সে প্রবেশ করতেই সকলেই মনোযোগ তার দিকে চলে এলো।
একজন বলে উঠলো, ” তুই এখানে কি করিস? তোর তো ঢাকা থাকার কথা, তোর এসিস্ট্যান্টের বিয়েতে!”

মিস সিক্রেটের রাগ ক্রমশ বাড়ছে তবে সে বিভিন্নভাবে তাদের মনোযোগ অন্যদিকে নিচ্ছে।
সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তাদের উদ্দেশ্য মাহিরকে কিডনাপ করা। কারণ মারার হলে এতক্ষণে মেরেই ফেলতো!

মনোযোগ অন্যদিকে নিতে পেরে মিস সিক্রেট সুপ্তির বাবা মাকে হাতের ইশারায় রুমে যেতে বললো।
ইশারা বুঝতে পেরে তারা খুব সাবধানে রুমে চলে গেল। কিন্তু বিপত্তি ঘটালো সুপ্তির বাবা। তিনি গান নিয়ে বেরিয়ে এলেন।

ফলশ্রুতিতে সকলেই তার দিকে গান তাক করলো।
সাথে সাথেই মিস সিক্রেট ও তানিশাও গান তাক করলো তাদের দিকে।।

মাহির মিস সিক্রেটের পিছনে এসে ফিসফিসিয়ে বললো, ” আমাকে একটা গান দাও।”

মিস সিক্রেট মাহিরকে একটা গান দিয়ে পায়ের কাছ থেকে আরেকটা গান বের করলো ৷ তার দুই হাতে দুইটা গান।

পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে খুনাখুনি হয়ে যাবে।
তবে পার্ফেক্ট টাইমে এন্ট্রি নিলো আর্মি ৷ দুইজনকে গানের টিগারে চাপ দিতে দেখে শুট করলো।

সাথে সাথে পড়ে গেল ফ্লোরে। আর বাকিরা কোনো মতে জান নিয়ে পালালো ৷ কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সম্পূর্ণ ঘটনাটা ঘটে গেল। সেদিকে মিস সিক্রেটের কোনো হেলদোল নেই।

সে একবার লাশ দুটোকে দেখে বিরক্ত হয়ে বললো, ” থ্যাংকস টাইম টো টাইম আসার জন্য। বাট এখন এগুলো পরিষ্কার করুন। মারলে আমিও মারতে পারতাম তবে এ বাসায় খুনাখুনি হয় না। সো তাদের লাশ দেখে অভ্যাস নেই। ”
নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ” ২০ মিনিট দিলাম পরিষ্কার করুন। আর কিছু বাহিরে গিয়ে পাহাড়া দিন। ”

সকলের অবাক দৃষ্টি মিস সিক্রেটের দিকে।
তার ক্ষমতা আছে ঠিকই তবে এভাবে আর্মিদের উপর অডার করা মানাচ্ছে না বলেই সকলের ধারণা ৷ তাই যে যার মতোই দাঁড়িয়ে রইলো মিস সিক্রেটকে অবজ্ঞা করে।

এতে অবশ্য মিস সিক্রেটের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। সে মাহিরের সামনে গিয়ে হাত পাতলো ৷ মাহির কিছু বুঝতে না পেরে হাই ফাই মনে করে হাত মিলালো ৷

কিন্তু মিস সিক্রেট ভ্রু কুচকে বললো, ” আমি আমার গানটা চাচ্ছি ৷ ”

মাহির একটু ইম্বারেস ফিল করলো। তবে গানটা দিয়ে দিলো।

সুপ্তির মা রুম থেকে বের হয়ে বললেন, ” সুপ্তি কোথায়? ”

মিস সিক্রেট কাউকে কল করতে করতে বললো, ” ছাদে। ”

সুপ্তির মা : আজকে এখানেই থেকে যাও। রাত তো ভালোই হলো।

মিস সিক্রেট চলে যেতে যেতে পিছনে ঘুরে বললো, ” আমি থাকলে আবার কেউ পছন্দ নাও করতে পারে! ”
( মাহিরের দিকে তাকিয়ে )

” আমি এতটাও খারাপ নই। তাছাড়াও আমি আবার কি করলাম! ” ( মাহির মনে মনে )

ততক্ষণে মিস সিক্রেট চলে গেছে। তবে তার রাগান্বিত কন্ঠ শুনা গেল, ” আপনাকে আমি খুন করতে বলেছি? আপনার লোক খুন করে বসে আছে। আমি ২০ মিনিট টাইম দিয়েছি তারমধ্যে ৫ মিনিট চলে গেছে। বাকি ১৫ মিনিটে যদি এগুলো পরিষ্কার না হয় তাহলে কি হবে তার জন্য অপেক্ষা করুন। ”

ধীরে ধীরে শব্দ কমে গেল। যার অর্থ হয়তো মিস সিক্রেট চলে গেছে না হয় কল কেটে দিয়েছে।

তখনই কারো ফোন বাজার শব্দ হলো। ফোন রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো তীব্র ধমক আর কিছু আদেশ। যা কিছুক্ষণ পূর্বেই মিস সিক্রেট করেছিল তাই আবার রিপিট করা হলো। সকলেই কমান্ড অনুযায়ী কাজ শুরু করলো।

মাহির সবাইকে বলে ছাদে চলে এলো। সুপ্তিকে দেখতে পেয়েই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। সুপ্তির পাশে দাঁড়িয়ে কপালে হাত দিয়ে বললো, ” দেখি জ্বর এসেছে কিনা!”

সুপ্তি হাত সরিয়ে দিয়ে বললো, ” না আসে নি। ”

মাহির : একটু আগে কি হয়েছে জানো?

সুপ্তি আনমনেই উত্তর দিলো, ” হুম।”

মাহির অবাক হলো। সুপ্তি জানার পরও নিচে গেল না! এমন মেয়ে তো সুপ্তি নয়।

মাহির : কিভাবে জানো?

সুপ্তি : মিস সিক্রেটের সাথে দেখা হয়েছিল। আর নিচে যেতে নাও করেছিল।

মাহির ” ও” বললো।

কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবারো বললো, ” পুনে দশটায় তুমি ছাদে কি করো? ”

সুপ্তি : অমাবস্যা দেখি।

মাহির : আচ্ছা। তখন যে তুমি বললে উধাও হওয়ার কাহিনি পরে বলবে! এখন কি জানতে পারি?

সুপ্তি কয়েক মিনিট চুপ থেকে বলা শুরু করলো।।

#চলবে.,.

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_28
#Sabrina_Summa

সুপ্তি কয়েক মিনিট চুপ থেকে বলা শুরু করলো, ” আপু কিভাবে মারা গেছে তা আপনাকে বাবা বলেছে? ”

মাহির : না। তবে আমি জানি। কিছু মানুষের মুখোশ খুলতে গিয়ে।

সুপ্তি : হুম। আপুর মৃত্যুর পর আমি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। কয়েক মাস সময় নেই তবে কোনো লাভ হয় না। মানিয়ে নিতে পারি নি এ বাড়িটাকে। কিছুদিন স্কুলে যাই তারপর স্বপরিবারে ঢাকা চলে যাই। সেখানে পড়াশোনা শুরু করি। সাথে নিজের সেইফটির জন্য ফাইটিং এর যাবতীয় সবকিছু শেখা শুরু করি।
এরজন্যই সবাই বলছিল উধাও হওয়ার কথা। মূলত কারো সাথে যোগাযোগ ছিল না + হঠাৎ করে ঢাকা যাওয়া এগুলোই।।

আকাশের দিকে তাকিয়ে একনাগাড়ে বলে গেল কথাগুলো। অতীত নিয়ে কথা বললে অধিকাংশ মানুষেরই গুছিয়ে বলার সামর্থ্য থাকে না। সুপ্তিও তাদের মাঝে একজন ৷

মাহির চুপ থেকে কথা বুঝার চেষ্টা করলো। তারপর হঠাৎই প্রশ্ন করে উঠলো, ” আচ্ছা, আমরা তো প্রায় সেইম ইয়ারের। তাহলে আমার গ্রেচুয়েশন শেষ হলো আরো দুই বছর আগে। আর তোমার এখনও শেষই হচ্ছে না! কাহিনী কি? ”

সুপ্তি শব্দ করে হেসে উঠলো। অন্য সময় হলে হয়তো সে এত প্রশ্নের উত্তর দিতো না। তবে আজ কেন যেন উত্তরগুলো দিতে ইচ্ছে করছে তার।

সুপ্তি হাসতে হাসতেই বললো, ” লজ্জা দেওয়ার জন্য প্রশ্নটা করলেন!”

মাহির এমন উত্তরে কিছুটা ভড়কে গেল।

সুপ্তি : আসলে আমি এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম। দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিয়ে পাস করে তারপর কলেজে ভর্তি হতে হয়েছে। এইচএসসি টেনে টুনে পাস করি। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেলাম। অবশ্য পাওয়ারও কথা ছিল না। মানুষ কত কষ্ট করেই পায় না আর আমি তো চেষ্টায় করি নি। ভাবলাম দ্বিতীয়বার চেষ্টা করবো কিন্তু দ্বিতীয় বার তো পরিক্ষায় দিতে পারলাম না!

মাহির : কেন? কেন দিতে পারলে না?

সুপ্তি এতক্ষণ হাসি মুখে কথা বললেও এ প্রশ্নে ভ্রু কুচকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিকভাবে বললো, ” সবকিছু একবারে জেনে গেলে পরে জানার ইচ্ছেটা মরে যাবে। ”

মাহিরের মনে হাজারটা প্রশ্ন বাসা বাধছে। তবে করতে পারছে না ।

অন্ধকার নিরব পরিবেশ ভেঙ্গে সুপ্তি বললো, ” জানেন, আমাকেও গুম করা হয়েছিল! ”

মাহির অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

সুপ্তি একধ্যানে বলা শুরু করলো, ” আপুর মৃত্যুর ঘটনাটা খুব ভাইরাল হয়। অনেক সাংবাদিক আসে আমাদের বাসায়। এত মানুষ আমার পছন্দ হচ্ছিল না। তাই পরের দিন স্কুল বন্ধ থাকা সত্ত্বেও স্কুলের উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
সকাল আটটা কি নয়টা। রাস্তাঘাটে মানুষ কম। তারমধ্যে আমি আমার চিরচেনা গলি দিয়ে যাওয়া শুরু করি। সেখানে কিছু বখাটে ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো। জীবনে প্রথম সেখানেই ইভটিজিংয়ের স্বীকার হই। অনেক কষ্টে পালিয়ে আসি সেখান থেকে।
আমার ছোট মন পর পর এত বড় বড় ধাক্কা নিতে পারছিলো না ৷ ভেঙে পড়ার পরিবর্তে কিভাবে যে কঠোর হয়ে পড়েছিলাম। ওই যে প্রবাদ আছে না, ‘ একটু শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর! ‘ আমারও ঠিক সেই অবস্থা হয়েছিল।
আপুর মৃত্যুর তৃতীয় দিন আমাকে আমার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কারণ হিসেবে বলা হয় আমি নাকি আমার বোনের সাথে জড়িত।
আমার হাত-পা, চোখ-মুখ বেঁধে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া হয়। চোখ খুললে দেখতে পাই অন্ধকার একটা রুম। আশেপাশে কেউ নেই। ”
এতটুকু বলেই থেমে গেল সুপ্তি।

মাহির বলে উঠলো, ” তারপর? তারপর কি হলো?”

সুপ্তি : আমার আর ভালো লাগছে না। আর বলবো না। অনেক বড় লেকচার দিয়ে ফেলছি। পরে আরেকদিন বলবো ৷

বলা শেষ করে হাঁটা শুরু করলো। মাহির হাত ধরে আটকে বললো, ” না, এখনই বলবে। ”

সুপ্তি মাহিরের দিকে ঘুরে বললো, ” বললাম না পরে বলবো! ”

মাহির : কেন এভাবে খেলছো? বলবেই না যখন তাহলে শুরু করলে কেন?

সুপ্তি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আবারও চলে যেতে নিলে মাহির একটান দিয়ে সুপ্তিকে নিজের সামনে এনে বললো, ” তোমাকে এখনই বলতে হবে। বুঝতে পেরেছো! ” ( রেগে )

সুপ্তির রাগ হলো। রাগী চোখেই তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পরমুহূর্তেই হেসে দিয়ে বললো, ” কেন? ”

মাহির: আমার জানা প্রয়োজন তাই!
( সুপ্তির হাসিতে ভড়কে গেলেও স্বাভাবিক হয়ে বললো )

সুপ্তি : কেন প্রয়োজন?

মাহির এবার প্রচুর রেগে গেল। যা প্রকাশ পেল রক্তবর্ণ ধারণ করা একজোড়া চোখে।

সুপ্তি মাহিরের কানে ফিসফিসিয়ে বললো, ” আপনার কি মনে হচ্ছে আমারো আপুর মতোই…”

এতটুকু বলতেই মাহিরের কাঁপনি খেয়াল করলো সুপ্তি। এতে অবশ্য তার মজাই লাগছে। তাই আরেকটু জ্বালানোর জন্য বললো, ” ওমন কিছু হয়ে থাকলে কি, আমাদের বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যাবে মাহির? ”

সুপ্তির এমন প্রশ্নে মাহির রাগান্বিত কন্ঠে বললো, ” সুপ্তি শুধু একবার সত্য বলো। ”

সুপ্তি : বললে কি করবেন?

মাহির : শয়তান গুলাকে খুন করবো।

সুপ্তি হাসতে হাসতে বললো, “তার আর প্রয়োজন পড়বে না। ওই দুইটা অলরেডি উপরে আই মেইন কবরে। আর হ্যাঁ আমার সাথে ওমন কিছুই হয় নি। ”

মাহির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আজ সুপ্তির এমন ফাজলামো মাহিরের একদম সহ্য হচ্ছে না।

মাহির : সেখান থেকে ফিরলে কি করে?

মাহিরের এমন সোজাসাপটা প্রশ্নে সুপ্তি আবারও বলা শুরু করলো, ” মূলত আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আপুর মতো করেই খুন করার জন্য। ( “কিন্তু ভাগ্যের পরিক্রমায় ওরাই খুন হলো! ” মনে মনে।)
কিছুক্ষণের মাঝেই বিষয়টা আমি বুঝতে পারি।
আমকর হাতে অলঅয়েস স্মার্ট ওয়াচ থাকে। সেই ওয়াচ দিয়েই ইনফর্ম করি মিস সিক্রেটের টিমকে। তখন অবশ্য মিস সিক্রেট তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠে নি ।
আমার ওয়াচে থাকা সিম ট্র্যাক করে উদ্ধার করে মিস সিক্রেটের টিম।
এই তিনটে ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আমাদের ঢাকা চলে যাওয়া।

” এখন বুঝলাম মিস সিক্রেটের সাথে তোমার পরিচয় কিভাবে! আমি শুধু শুধুই উল্টা পাল্টা ভাবছিলাম। ”

সুপ্তি : রাত তো ভালোই হলো এখন কী আমরা নিচে যেতে পারি?

সুপ্তির প্রশ্নে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো মাহির ৷ হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে হাঁটা শুরু করলো। সাথে সুপ্তিও।

#চলবে.,.

Dark Mystery পর্ব-২৫+২৬

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_25+26
#Sabrina_Summa

মাহির ও সুপ্তি পাশাপাশি দুইটি চেয়ারে বসলো।

অনুষ্ঠান অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সবাই তাদের পার্সোনাল লাইফ, প্রফেশনাল লাইফ নিয়ে স্টেজে গিয়ে মাইকে বলছে। মাহিরকেও ডাকা হলো কিছু বলার জন্য।

মাহিরের বলা শেষ হলেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ডাকা হলো সুপ্তিকে। যা আশা করে নি সুপ্তি। মাইকে কথা বলতে তার একদমই ভালো লাগে না। কিন্তু প্রধানশিক্ষক ডাকছে তাই তাকে যেতে হলো। প্রধানশিক্ষক তাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিলো মাহিরকে এখানে আনার জন্য।

প্রধানশিক্ষক হাত মিলাতে চাইলে সুপ্তি ‘ধন্যবাদ’ বলে মুচকি হাসলো। যার অর্থ সে হাত মিলাবে না। মাইকের কাছে গেলো।

“এমনিতে তো আমাকে এই স্কুলে কেউ পাত্তাই দিতো না যখন আমি পড়তাম। আর এখন দেখো কত ডং!” ( মনে মনে )

সুপ্তির কথা বলার স্টাইল দেখে মাহির ভাবতে লাগলো।
” মিস সিক্রেটের সাথে সুপ্তির অনেক মিল। কথা বলার ধরণ, হাত না মিলানো, একই ট্রমা, একই রং, একই ব্যবহার…..”
ভাবনার দুনিয়া থেকে বের হয়ে মাহির নিজের মাথায় থাপ্পড় দিয়ে বললো, কী আজাইরা জিনিস ভাবছিস। মিল যেমন আছে তেমন অমিলও আছে।
একজন কালো সহ্যই করতে পারে না আরেকজন কালো ছাড়া কিছু বুঝেই না।
একজনের গলার স্বর গম্ভীর আরেকজনের স্বাভাবিক।
তবে যাইহোক, সুপ্তি মিস সিক্রেট না হলেও ওর টিম মেম্বার তো হতেও পারে! ”

নিজের সাথেই কথা বলছিল মাহির। তবে হাত তালির শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। সুপ্তি পাশে এসে বসতেই বললো, ” মাইকে কথা বলার অভ্যাস করো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। ”

” আমার অভ্যাস আছে তাও আবার আপনার থেকে বেশি। ” মনে মনে বললেও মুখে কিছু বললো না।

অনেকক্ষণ অনুষ্ঠান চললো। তারপর গ্রুপ ফটোশুট করা হলো।

বিকেলের দিকে সবাই ট্রুথ ডেয়ার খেললো। এরপর নাচগান হলো। সুপ্তি আজ মন খুলে সব কাজ করছে। সুপ্তি যে নাচতেও পারে তা মাহিরের জানা ছিল না।
সে তো অবাক হয়ে বলেই ফেলেছিল, ” তুমি নাচতেও পারো! ”

সুপ্তি : শুধু নাচতে না নাচাতেও পারি।

মাহির বিড়বিড় করে বললো, ” হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝছি। তুমি ডিম ব্যতিত সবই পারো, আমার জিজ্ঞেস করাটাই ভুল। ”

রাত ৮ টার দিকে মাহির ও সুপ্তি রওনা দিলো সুপ্তির বাসার উদ্দেশ্যে । বাকি সবাই আরো রাত পর্যন্ত আড্ডা দিবে।
তাই সুপ্তি, মাহির চলে এসেছে। যদিও মাহির গেস্ট হাউসে থাকার বন্দবস্ত করে এসেছিল কিন্তু সুপ্তির একটা কথা মাহিরের মন ছুঁয়ে গেছে। সে বলেছিল, ” গেস্ট হাউস তো গেস্টদের জন্য। আপনি তো গেস্ট নন আমার পরিচিত মানুষ! ”
এতেই গলে গিয়ে বাধ্য হয়ে সুপ্তির সাথে সুপ্তির বাসায় যাচ্ছে সে।।

বাসায়.,.

সুপ্তির কলিং বেল বাজানোর এক সেকেন্ডের মাঝেই শাহানাজ পারভীন দরজা খুলে দিলো সুপ্তি বলে উঠলো, “আম্মু। ”

শাহানাজ পারভীন একটু হাসলেন। মেয়ের আশেপাশে চোখ পড়তেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
মেয়ের পাশের ছেলেটির উদ্দেশ্যে বললো, ” তুমি তাশরিফ না? ”

মাহির : জ্বী আন্টি।
বলেই সালাম দিলো।

শাহানাজ পারভীন সালামের উত্তর দিয়ে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তার মেয়ের এত বড় বড় মানুষের সাথে উঠা-বসা তা তিনি জানতেন না।

সুপ্তি : আম্মু, তুমি এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা ভিতরে ঢুকবো কিভাবে?

মেয়ের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে শাহানাজ পারভীনের। সাথে সাথেই দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন।

সবাই ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলো। সুপ্তির বাবাও রুম থেকে বের হয়ে শাহানাজ পারভীনের মতোই অবাক হলেন। তবে তা প্রকাশ করলেন না।

শাহানাজ পারভীন সুপ্তির কাছে এসে বললো, ” তাশরিফ আসবে আগে বলবি না। কি খেতে দিবো। রুমও গোছানো হয় নি।” ( চিন্তিত স্বরে )

শাহানাজ পারভীন আস্তে বললেও সুপ্তি উচ্চ স্বরে জবাব দিলো, ” আম্মু, মাহির কোনো স্প্রেশাল গেস্ট টেস্ট না। তাই আমরা যা খাবো তাই খেতে দিবা। আর রুম গোছাও এখন। মাহির মাইন্ড করবে না। ”

সুপ্তির কথায় শাহানাজ পারভীন কিছুটা লজ্জা পেলেন।

মাহির হেসে বললো, ” আস্টি এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই ৷ এখন আপনারা যদি আমাকে নরমাল মানুষের মতো ট্রিট না করেন তাহলে কিন্তু আমি আর কখনো আসবো না। ”

শাহানাজ পারভীন হেসে রান্না ঘরে চলে গেলেন।

মাহির নিজের পরিবারের মানুষের মতো করেই কথা বলছে সুপ্তির বাবার সাথে।
সুপ্তির বাবাও এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে গেছে ।

সুপ্তি বসে বসে মাহির ও তার বাবার গল্প শুনছে। মাঝেমধ্যে নিজের মাকে হেল্প করতে যাচ্ছে ।
এই তো এখনো গেছে। তবে যথা সাধ্য মাহির ও তার বাবার কাছেই থাকার চেষ্টা করছে সে। হয়তো এই ভয়ে যে তার বাবা বা মাহির ভুল কোনো তথ্য মুখ ফসকে বলে না ফেলে।!

মাহির বিষয়টা খুব ভালো করেই খেয়াল করেছে তবে সেভাবে ভাবে নি।

সুপ্তি আবারও এসে বসলো।
মাহির এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা ফ্যামিলি ছবি দেখলো।

ছবিটার সামনে গিয়ে বললো, ” এইটা সুমি আপু না? আপু আপনাদের কি হয়? ”

প্রশ্নটা শুনেই সুপ্তি রুমে চলে গেল।

সুপ্তির বাবা বললেন, ” আমাদের প্রথম মেয়ে। ”

মাহির চোখ বড় বড় করে বললো, ” আমরা প্রতিবছরই যাই আপুর কবরে ফুল দিতে! ”

সুপ্তির বাবা মৃদু হেসে বললেন, ” হ্যাঁ জানি। ”

মাহির : সুপ্তি ওভাবে চলে গেলো কেন?

সুপ্তির বাবা আবারও মৃদু হেসে বললেন, ” সুপ্তি ওমনই। সুমির কথা উঠলেই এড়িয়ে যেতে চাই।
আসলে খুব ভালোবাসতো এর জন্য! ”

সুপ্তির বাবাকে ইমোশনাল হতে দেখে মাহির টপিক চেঞ্জ করে ফেললো।

কিছুক্ষণ পরই সবার ডাইনিং রুমে ডাক পড়লো।
সবাই ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলো।

মাহির ও তানিশা বসতে গিয়েই খুব অবাক হলো এত পদ দেখে।

তারমধ্যে আবার সুপ্তির মা বললেন, ” তোমাদের হইতো খেতে অসুবিধা হবে তাও কষ্ট করে খেয়ে নেও। আসলে সুপ্তি আগে কিছু বলে নি তো তাই বেশি পদ করতে পারি নি। ”

মাহির শুকনো ঢোক গিলে বললো, ” ভাগ্যিস সুপ্তি কিছু বলে নি। না হলে তো আস্তো বিয়ে বাড়ির আয়োজন হয়ে যেতো। ”

মাহিরের কথা শুনে সবাই একটু হাসলেন। এরপর সবাই খেতে বসলো। সুপ্তির মাও সবার প্লেটে খাবার দিলেন।

সুপ্তির প্লেটে সবকিছু না দিতে দেখে মাহির প্রশ্ন করেই ফেললো, ” আন্টি, সুপ্তি কি এগুলো খাই না? ”

সুপ্তির মা হেসে বললেন, ” না, আসলে এলার্জি আছে তো তাই। ”

মাহির ‘ও’ বললো।
মাহিরের মনে পড়লো, ” মিস সিক্রেটও যখন মাঝেমধ্যে থাকতো তখন ইরফান বেছে বেছে মিস সিক্রেটের জন্য খাবার নিয়ে যেতো। ”

#চলবে.,.

(edited)

Dark Mystery পর্ব-২৩+২৪

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_23
#Sabrina_Summa

চিন্তায় ডুবে আছে মাহির। সময়ের গতিতে সময় যাচ্ছে তবে তার চিন্তা শেষ হচ্ছে না। সারাদিন তার চিন্তায়ই গেলো। শেষে আর না পেরে মিস সিক্রেটকে কল করলো।

মিস সিক্রেট কল রিসিভ করে বললো, ” এতদিন পর আমায় মনে পড়লো! ”

মাহির সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো, ” সুপ্তির মিনি ডাইরিটা কোথায়? ”

মিস সিক্রেট : যার ডাইরি তার কাছেই।

মাহির : কেন দিলে? আমাকে দেওয়ার কথা ছিল! এরজন্যই কারো উপকার করতে নেই।
( এক নিশ্বাসে, কিছুটা রেগে )

মিস সিক্রেট : অন্য কিছু কি বলবে নাকি কল কেটে দিবো?

মাহির : না না। একটা হেল্প করবে প্লিজ… ( টেনে )

মিস সিক্রেট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো, ” বলে ফেলো। ”

মাহির : আমি ঘাটাইল যাবো….

বাকি কিছু বলার আগেই মিস সিক্রেট বললো, ” সুপ্তির জন্য নিশ্চয়ই ! ভালো একটা উপদেশ দিচ্ছি ওর পিছ ছেড়ে দাও না হয় পরে তোমাকে পস্তাতে হবে। ”

মাহিরের কথাটা পছন্দ হলো না। পছন্দ না হওয়াটাই স্বাভাবিক। একতো সে সুপ্তিকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে।
আর দ্বিতীয়তো কেউই ফ্রী ফ্রী উপদেশ পাওয়া বা নেওয়া পছন্দ করে না।

তাই মাহির মিস সিক্রেটের কথা এড়িয়ে গিয়ে বললো, ” বাবাকে একটু রাজি করাও না। প্লিজ। ”

মিস সিক্রেট জানতো হয়তো মাহির এমন কিছুই বলবে। কারণ এমনিতেই মাহির তার কথা শুনে না। আর এ বিষয়ে তো প্রশ্নই ওঠে না। তবুও কেন যেন আজ মুখ ফসকে বলে ফেলেছে।

মিস সিক্রেট : ওকে, একটু পর আঙ্কেলের কাছে যাও।

ঝড়ের গতিতে বলেই কল কেটে দিলো। যাতে বিরক্ত হলো মাহির ৷
বিরক্তিতে বলে উঠলো, ” ধূর। কি অদ্ভুত মানুষ রে বাবা। কতদিন থাকবো সেটাও বলতে দিলো না। ”

মাহির কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সাহস যুগিয়ে মাহফুজ চৌধুরীর রুমের সামনে গিয়ে বললো, ” বাবা, আসবো? ”

মাহফুজ চৌধুরী : চলে এসো।

মাহির ভিতরে প্রবেশ করতেই বললো, “বসো।”

মাহির বসে বললো, ” বাবা, আমার একটু ঘাটাইল যেতে হবে। ”

মাহফুজ চৌধুরী : কবে যাচ্ছো?

মাহির : কালকে।

মাহফুজ চৌধুরী : সেখানকার বর্তমান ইউনো আমার ক্লাসমেট ছিল। দেখা করে এসো।

মাহির : আচ্ছা বাবা।

মাহির মাহফুজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, ” তোমার এত ডং না করলেই চলবে আমি জানি বাবা, তুমি কেন এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়েছো। ”

মাহফুজ চৌধুরীও মনে মনে বললো, ” শুধু মিস সিক্রেট বলে ছিলো বলে যেতে পারছো। ”

দুইজনের মনে মনে কথা শেষ হলে মাহফুজ চৌধুরী মাহিরকে বললো, ” যাও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো। সকাল সকালই তো রওনা দিবে! ”

মাহির : হ্যাঁ বাবা।

বলেই রুম থেকে বের হতে হতে বিড়বিড় করে বললো, ” কত ভালো ব্যবহার! ” ( তিরস্কার করে )

খুব সকালেই রওনা দিলো মাহির। গন্তব্য তার ঘাটাইল নয়, গন্তব্য তার প্রিয়তমার বাড়ি।
এ বিষয়ে সুপ্তিকে কিছু বলে নি সে, সরাসরি সারপ্রাইজ দিতে চাই। তবে তার প্রিয়তমা তো সেই কবেই জেনে গেছে।

জেমে পড়তে হয় নি তার। তবুও পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। পৌঁছে সুপ্তিকে কল করলো।
সুপ্তি এসে মাহিরকে তার পুরোনো স্কুলে নিয়ে গেল। কারণ রিইউনিয়ন পার্টি তো সেখানেই। একটু পরই অনুষ্ঠান শুরু হবে ৷

স্কুলের সামনে যেতেই প্রধানশিক্ষক এসে মাহিরকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়ে গেল। হয়তো সুপ্তি বলেছিল মাহির আসছে!
রিইউনিয়ন পার্টিটা ছোট করার কথা থাকলেও তা এখন বড় করেই করা হচ্ছে।

একটা ক্লাস রুমে বসে আছে সবাই। সেখানে মাহির ও সুপ্তি প্রবেশ করতেই সুপ্তিকে দেখে সবাই বলে উঠলো, ” তুই হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেছিলি আপুর মৃত্যুর পর? ”

এমন প্রশ্ন যে আসবে তা সুপ্তির জানায় ছিল তবুও মন খারাপ হলো শেষের কথাটুকু শুনে। সুপ্তি উত্তর দিলো না। একজন কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো, ” কেমন আছো, সুপ্তি? ”

সামনের মানুষটিকে দেখে অনেক কষ্টে মুচকি হাসি দিলো। কখন না আবার গন্ডগোল বাধিয়ে দেয় এই ভয়েই আছে সে। তবে উত্তর তো দিতেই হবে তাই বললো, ” এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি? ”

অন্যদিকে মাহিরকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মাহিরের নজর তো সুপ্তির দিকেই। তার এসব সহ্য হচ্ছে না।

— ” আছি মোটামুটি। ”

সুপ্তি : মোটামুটি কেন?

— ” ভালো আর থাকতে দিলে কই! ১০ বছর আগে হঠাৎ ব্রেকাপ করে উধাও হয়ে গেলে। এতটাই কি অযোগ্য ছিলাম আমি! ”

সুপ্তি বুঝতে পারলো সে ভুল পয়েন্টে হাত দিয়ে ফেলেছে। যেহেতু ভুল করেই ফেলেছে সেহেতু আরেকটু বাজানো যাক। এই ভেবেই বললো, ” হঠাৎ এসব কথা বলছো কেন। ”

উত্তর দেওয়ার পূর্বেই মাহির এসে হাজির। তাও আবার প্রশ্ন নিয়ে, ” ও কে সুপ্তি?” ( লোকটিকে দেখিয়ে )

সুপ্তি : সোহম, আমার ফ্রেন্ড।

সোহম : আপনি এখন একটু যান। আমার সুপ্তির সাথে কথা আছে। ( মাহিরকে উদ্দেশ্য করে )

মাহির : ও হ্যালো। শি ইজ মাইন। মেইনটেইন ডিস্টেন, ওকে?

সোহম : তোমার বয়ফ্রেন্ড? ( সুপ্তিকে উদ্দেশ্য করে )

সুপ্তির বলার আগেই মাহির বললো, ” নো। উড বি হাসবেন্ড। ”

সোহম কিছু বলতে নিচ্ছিলো। কিন্তু সোহমকে বলার সুযোগ না দিয়ে মাহির সুপ্তিকে টেনে বাহিরে নিয়ে এলো।।

#চলবে.,.

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_24
#Sabrina_Summa

কিন্তু সোহমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাহির সুপ্তিকে টেনে বাহিরে নিয়ে এলো।

সুপ্তি : থ্যাংকস, পার্ফেক্ট টাইমে আসার জন্য। বাট আপনি একটু বেশিই বলে ফেলেছেন।

মাহির কিছুটা রেগে গেছে সোহমের ব্যাপারটা নিয়ে। তবুও শান্তভাবে প্রশ্ন করলো, ” ছেলেটা কে? কোনো নরমাল ফ্রেন্ড তো মনে হচ্ছে না! ”

সুপ্তি : আমার ওয়ান এ্যান্ড অনলি এক্স।

মাহির : তোমার এক্স? ( রেগে )

সুপ্তি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলতেই মাহিরের রাগ বাড়লো। রাগ দেখাতে যাবে তার আগেই সুপ্তির ডাক পড়লো। তাই সুপ্তি চলে গেলো।

এরপর আর সুযোগ হয়ে উঠলো না কথা বলার। শপিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল।
মূলত শাড়ির সাথে মেচিং করে জুয়েলারি কিনবে।
একরকম শাড়ি, ব্লাউজ, পাঞ্জাবি – পায়জামা আগেই অর্ডার করা ছিল। যা আজকেই রিসিভ করেছে।

মাহিরের রাগ কিছুটা হলেও কমলো প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে পাঞ্জাবি পায়জামা পেয়ে ৷

ছেলেরা অফ হোয়াইট কালারের মাঝে গোল্ডেন কারুকার্যের পাঞ্জাবি পড়েছে । সাথে মেচিং সুজ, ওয়াচ এ্যান্ড সানগ্লাস।
মাহির মোটামুটি এক ঘন্টা ধরে মেয়েদের সাজার রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা+পাহাড়া দিচ্ছে। তবে এত প্রতীক্ষা যার জন্য সেই আসছে না।

সুপ্তি গোল্ডেন পাড়ের লাল শাড়ি পড়ে বের হলো।
বাঙালি স্টাইলে পড়া। চুল খোলা তবে পিছনে লাল গোলাপ ফুল দেওয়া। হাতে লাল রেশমি চুড়ি। চোখে কাজল আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। সাথে কিছু জুয়েলারি তো আছেই। এতেই সুন্দর লাগছে তাকে।
সত্য বলতে ফর্সা মানুষের কম সাজলেও হয় তার প্রমাণ সুপ্তি।।

সুপ্তি মাহিরকে দেখে অবাক হলো। বললো, ” দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ”

মাহির সুপ্তির দিকে না তাকিয়েই বলা শুরু করলো, ” এতক্ষণ লাগে কারো সা…”
সুপ্তির দিকে তাকাতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল। শুধু বললো, ” মাশাল্লাহ। ”

এরপর নিজেকে সংযত করে বললো, ” এত সেজেছো কেন? ”

সুপ্তি : কেন খারাপ লাগছে? জানেন, আমি প্রায় ১০ বছর পর সাজলাম।

” এই মেয়েকে কিভাবে বুঝাই ওকে এতই সুন্দর লাগছে যে কেউ ক্রাশ খাবে! “( মনে মনে )

সুপ্তি : এক মিনিট। আপনি আমাকে এতটুকুতেই এত সাজ বলছেন! আগে তো আমি বউ সাজতাম। সে তুলনায় এটা তো কিছুই না।

মাহির : কার বউ সাজতে?

সুপ্তি : আমার ফিউচার হাসবেন্ডের।

মাহির : ও আচ্ছা, আমার জন্য সাজতে।

সুপ্তির রিয়েকশন দেখে মাহির কথা ঘুরানোর জন্য বললো, ” চলো ওই দিকে যাই। ”

সুপ্তি দ্বিমত করলো না। হাঁটা শুরু করলো।

মাহির হাঁটতে হাঁটতে বললো, ” আমাদের বিয়েতে তোমাকে শাড়ি পড়তে দিবো না। ”

সুপ্তি : আমাদের বিয়ে মানে! আপনাকে কে বিয়ে করবে? আর সেকেন্ড কথা আমি এমনিতেও শাড়ি পড়বো না কারণ এটা সামলানো অনেক কঠিন।

কথা শেষ করতেই তার মাথায় আরেকটা প্রশ্ন আসলো তাই বললো,” যাইহোক, এইটা কথা বলুন শাড়ি পড়লে কি হবে? ”

মাহিরের ঝটপট উত্তর, ” সবাই তোমাকেই দেখবে। আমাকে কেউ পাত্তাও দিবে না। ”

সুপ্তি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে তারপর বললো, ” হাইরে প্লে বয় রে! মানুষ পাত্তা পাওয়ার জন্য কত কিই করে।
আপনার সাথে একটা গানের দুই লাইন পার্ফেক্টলি যায়। ”

মাহির : কোন গান? একটু সুর দিয়ে বলো তো।

সুপ্তি : কারো একদিন হবো, কারো এক রাত হবো
এর বেশি কারো রুচি হবে না।

মাহিরের তো গান শুনে মাথায় হাত।
” তুমি আমায় এমন ভাবো? ”

সুপ্তি : এখন ভাবি না।

মাহির : তাহলে আগে ভাবতা?

সুপ্তি : আরে বাদ দেন তো। এই গান এখন উপন্যাসে খুব ভাইরাল। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকলেই এসব গান তাই বললাম।

মাহির : তুমি সোশ্যাল মিডিয়াও চালাও।

সুপ্তি : একদম ডং করবেন না। আপনার জন্যই তো। কখন কোথায় মেনশন দিয়ে দিবেন আর সুশমিতা আমাকে জ্বালাইয়া মারবে।

মাহির হাসলো। এ বিষয়ে কথা বাড়ালে যদি সুপ্তি রেগে যায় তাই কথা ঘুরিয়ে বললো, ” আচ্ছা, তুমি নাকি উধাও হয়ে গেছিলে? ”

সুপ্তি : হুম। পরে বলবো নি সম্পূর্ণ কাহিনি। এখন মুড নেই।

মাহির জোর করলো না। যেহেতু সুপ্তি বলেছে পরে বলবে তার মানে পরেই বলবে ৷ নিরবতা চললো কিছুক্ষণ। এতক্ষণে সম্পূর্ণ স্কুল মাঠে পাঁচ বার রাউন্ড দেওয়া শেষ।।

নিরবতা ভেঙে মাহিরই বললো, ” একটা কাজ করবে! একদম বলবে না তোমার মুড নেই। ”

সুপ্তি : কি কাজ? ( সিরিয়াস হয়ে )
‘কাজ’ শব্দটা শুনলেই কেমন যেন সিরিয়াস ভাব চলে আসে তার মাঝে।

মাহির : আমার সাথে একটু ফ্লাটিং করো তো।

সুপ্তির এক্সপ্রেশন দেখে মাহির দ্রুত বলে উঠলো, ” প্লিজ, প্লিজ, প্লি…”

বলার পূর্বেই সুপ্তি বললো, ” ওকে। ”

সুপ্তি কিছুক্ষণ ভাবলো। এরপর কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর বললো, ” যাই হয়ে যাক। আপনি হাসবেন না কিন্তু! ওকে?”

মাহির মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো ৷

সুপ্তি ফিল নিয়ে বলার জন্য মাহিরের চোখের দিকে তাকালো। তারপর বললো, ” জানেমান। ”

মাহির বিড়বিড় করে বললো, ” আজ আমি শেষ!”

সুপ্তি : আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড হতে চাই না। আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী হতে চাই। আপনার বাঁ পাঁজরের হাড়ের অস্তিত্ব হতে চাই! সেই সুযোগটা কি আমাকে দিবেন!

মাহির হ্যাঁ বলতেই সুপ্তি নিজের ইমোশন আর কন্ট্রোল করতে পারলো না। জোরে হাসা শুরু করলো। সেই অবস্থাতেই মাহির সুপ্তিকে জড়িয়ে ধরলো। সুপ্তি তাও হাসতেই রইলো। অনেকদিন পর মন খুলে হাসছে সে ৷

কিছুক্ষণ পর মাহিরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললো, ” ‘বাঁ পাঁজরের হাড় ‘ কথাটা ইন্টারেস্টিং করার জন্য বললাম। ডোন্ট মাইন্ড। ”

মাহির : তুমি যে কারণেই বলে থাকো না কেন! আমি তোমার প্রেমে আবারো পড়ে গেছি ।

সুপ্তির কেন যেন রাগ দেখাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে কিছু না শোনার ভান করে বললো, ” চলুন স্টেজের দিকে যায়। ”

দুইজন স্টেজের একদম সামনের দিকটাই বসলো।।

#চলবে.,.

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৬

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৫৬
“আমি বিয়ে করতে পারবো না৷
“বিয়ে করতে পারবো না মানে কি?
” মানে আমি আপনাকে বিয়ে করবো না৷ আপনার বাবা মা যদি আপনাকে আমার হাতে তুলে দেয় তবেই আমি আপনাকে নিজের করে নেবো নয়ত কোনদিন না৷ আপনার বাবা মা জন্মের পর থেকে আপনার জন্য যা, যা করেছে সেসবের বিনিময়ে তাদের অসম্মান আর লজ্জা উপহার দিবেন? বাসায় চলে যান৷
“নয়না বলল,ভাইয়া আপনি একদম সঠিক কথা বলেছেন৷ আগে ফুপ্পিকে রাজি করাতে হবে। তাদের মানিয়ে তবেই বিয়ে৷
” রেজা বলল তাহলে এখন কি করবো?
“কি করবো মানে কি? অনিকেত ভাইয়াকে নিয়ে আমরা সবাই ফুপ্পির বাসায় যাবো৷
” অনিকেত বলল,যদি মানা করে দেয়?
“মানা করলে একশবার যাবেন৷ একবার দুইবার, কতবার মানা করবে শুনি? কাউকে সারাজীবনের মত নিজের করতে চাইলে আঠার মত লেগে থাকতে হয়। যাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে বলে,দিয়ে দিলাম নিজেকে তোমায়।
” নাহিদ বলল,রেজা তুই জিতেছিস। ভাবির মত বৌ পেয়েছিস।আচ্ছা শোন তোরা যা আমাকে বাসায় যেতে হবে ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। শোন আপডেট জানাবি কিন্তু ।
“রেজা বলল,শালা তোর ইম্পর্ট্যান্ট কাজ বলতে তো ভাবির ঝাড়ি খাওয়া যাহহহ৷
” ভালো বৌ পেয়েছিস তো তাই বুঝিস না৷ আমার মত বৌয়ের মত বৌ পেলে বুঝতি জীবনে প্যারা কাকে বলে৷
“প্যারা হলেও ভালোবাসা। যাহহ ভাবির কাছে যা৷
” আসি ভাবি। আর হ্যা এরপরের বার আমাদের বাসায় যাবেন কিন্তু।
“জ্বি ভাইয়া ইনশাআল্লাহ যাবো৷
” নাহিদের সাথে সবাই একসাথে বের হলো৷
নাহিদ নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পরলো৷
“জিয়ান বলল,তোমরা গাড়ি নিয়ে এসেছো?
” হুম।
জিয়ান চুপচাপ কিছু একটা ভেবে নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ,তুমি শিউর তুমি ফুপিকে রাজি করাতে পারবে?
“কেন আপনি শিউর না? আপনার ফুপু আপনি তো আমার চেয়ে ভালো চিনবেন৷
“তুমি আমাকে আপনি করে কেন বলো!আমি তোমার পার্সোনাল প্রপারটি সো সব সময় তুমি করে বলবে। আর একবার আপনি করে বললে খবর আছে।
” আহাগো এতো বড় এক দামড়া বেডারে আমি তুমি করে বলবো! এই শিক্ষা আমি পাইনি৷ আর কয়টার খবর মিস্টার প্লেন ড্রাইভার?
“আহাগো বাটার মাশরুম। তুমি হাঁটুর বয়সী এমনি এমনি বলি!তোমার কর্মকাণ্ড দেখলে যে কেউ বলবে। শুনো তুমি আমার তিন কবুল পরা বৌ অতএব আমি যা বলবো সব তোমার শুনতে হবে!না শুনলে কিন্তু থেরাপি চলবে চুমু থেরাপি৷
” আপনি তো আমার কবুল বলা ছাড়া হ্যাসবেন্ড আপনার কথা আমি কেনো শুনবো!
“আহারে ময়নার মা। তোমার বাবা নিজে তোমাকে আমার কাছে শপে দিয়েছে৷ এখনো কানে বাজে তোমার বাবার মুখের কথা, আমি মাহবুব তালুকদার আমার একমাত্র কন্যা সুনয়না তালুকদারকে নাজিম চৌধুরির বড়পুত্র জিয়ান রেজা চৌধুরীর সাথে দশ লাখ বায়ান্ন টাকা মোহর ধার্য করিয়া বিবাহ দিচ্ছি।
” তারপর কি হয়েছে?
“তারপর আর কি কাজি সাহেব বলল,বলো বাবা আলহামদুলিল্লাহ কবুল। আমিও বললাম আলহামদুলিল্লাহ কবুল। এইতো তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে গেলে সারাজীবনের জন্য। ওয়েট তুমিও তো পর্দার ওপাশ থেকে কবুল, কবুল বলেছিলে। সো আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে৷
” অনিকেত পাশ থেকে বলল,তোরা তোদের প্রেম বাড়িতে যেয়ে করিস। যেখানে সেখানে পিরিত করার বৈধতা নেই। লজ্জা রাখ শা’লা৷
“নয়না বলল,ভাইয়া জানেন কি হয়েছে?
” কি হয়েছে বনু?
“আমরা তো বাসায় সবাই টেনশন কি হবে নীলাঞ্জনা আপি পালিয়ে গেলো। হঠাৎ আমার বাপ আমার হাত ধরে বলে,তোমার বিয়ে হয়ে গেছে নয়না৷ কিছু নেয়ার থাকলে ব্যাগ গুছিয়ে নাও তোমাকে একটু পর যেতে হবে। আমি তো এইকথা শুনে সব শোক ভুলে হাসিতে ফেটে পরলাম৷ ওই মূহুর্তে এরচেয়ে বড়জোক্স আমার কাছে আর কিছু মনে হয়নি৷
“জোক্সও সত্যি হয়ে গেছে তাই না?
” এরচেয়ে বড় শকড কি ছিলো জানেন?
“কি?
” এই প্লেন ড্রাইভার সয়তান বেডা সবার মাঝখান থেকে আমাকে টানতে টানতে গাড়িতে নিয়ে এসে ফেলেছে৷ গাড়ির দরজা বন্ধ করতেই আমি অজ্ঞান।
“থাক বনু সে-সব আর মনে করতে হবে না। মনে করো ওই ঝড় এসেছিলো তোমাদের এক করতে। সেই ঝড় তোমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছিলো।
” নয়না আর কোন উত্তর দিলো না৷ গাড়ির গ্লাসের বাহিরে দৃষ্টি স্থীর করলো।

🌿সায়নাদের বাসায় এসে সবাই নাস্তা করলো৷
“জিয়ান বলল,ফুপ্পি ও আমার ফ্রেন্ড অনিকেত মাহমুদ। আমরা ওরজন্য সায়নাকে পছন্দ করেছি৷ তোমার আপত্তি না থাকলে এগোতো পারি৷
” তা বাবা করো কি তুমি?
“ডাক্তার। বিএসএমএমইউ মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে কর্মরত। আর অবসরে দুটো চেম্বারে রোগি দেখি।
” কিসের ডাক্তার তুমি?
“কার্ডিওলজিস্ট।
“বাবা, মা, ভাই, বোন মানে ফ্যামিলি ব্যাকরাউন্ড কি?
” অনিকেত থমকালো সে এই প্রশ্নটাকেই ভয় পায়৷
“নয়না বলল ভাইয়ার পুরো নাম অনিকেত তালুকদার। আমার বড় ভাই।
” সায়নার মা খুশি হয়ে বলেন তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই এই বিয়েতে৷
“অনিকেত শান্ত স্বরে বলল,আমার বাবা, মা, ভাই,বোন কেউ নেই আমি একা।জানিনা ওনারা পৃথিবীতে আছেন কি না! আমি এতিমখানায় বড় হয়েছি৷ বাকিটা আপনার উপর ডিপেন্ড করছে৷
” সায়নার মা চুপ করে থাকলো কিছু সময় এরপর নিরবতা ভেঙে বলল,তোমরা যাও আমি পরে ভেবে চিন্তে জানাবো।
“অনিকেত বলল,আপনার উত্তর না হলেও আমরার বিন্দুমাত্র মন খারাপ হবে না। আমার সব আছে কিন্তু পিতৃ পরিচয় নেই৷ এই সমাজে আমারা মূল্যহীন। আজ আসি আন্টি কষ্ট দেয়ার জন্য দুঃখিত। অনিকেত উঠে বের হয়ে গেলো৷
” জিয়ান নয়নাও পেছনে পেছনে বের হলো৷
“অনিকেত বলল,রেজা তোর কাজ হয়ে গেছে তুই বের হ৷ আর আমাকে স্বান্তনা দিতে হবে না৷ বাস্তবতা মেনে নেয়ার মত ম্যাচিউরিটি আমার আছে৷ নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলল,কিউট বনু তুমি কিন্তু লাকি গার্ল। রেজা ছেলে হিসেবে তো ভালোই তবে হ্যাসবেন্ড হিসেবে বেস্ট। সব সময় একে অপরের ছায়া হয়ে থেকো৷ সম্পর্ক মজবুত রাখে বিশ্বাস, ভরসা। কখনো এই দু’টো হারাতে দিও না।অনিকেত চলে যেতেই জিয়ান নয়নাকে বলে,তাড়াতাড়ি চলো তো।
” আরেহহহ আমরা যাচ্ছি কোথায়?
“হানিমুনে যাচ্ছি।
” আহাগো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন আপনার প্লেন আপনাকে ড্রাইভিং করতে ডাকছে। সো তার কাছে ছুটে যেতে হবে সে খেয়াল আছে।
“দরকার পরলে তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো৷ হানিমুন হবে বিমানের ককপিটে৷
“আহাগো শখ তো কম না।
” শখ কম হবে কেন শখ তো বহুত।
“চলুন বাসায় যাবো।
” উঁহু বাসায় না। তোমার সাথে নিরিবিলি প্রাকৃতিতে কিছু হৃদয়স্পর্শী কথোপকথন আছে৷ যেখানে শুধু তুমি আমি আর আমাদের হৃদয়ের কথা হবে।
“আপনার বাসার রুফটফ কি কম নিরিবিলি!তাছাড়া সাউন্ডপ্রুফ রুম, রুমের মধ্যে দরজা বন্ধ করে বুঝি হৃদয়ের কথা বলা যায় না!
“উঁহু রোমান্টিক কথা বলার জন্য রোমান্টিক প্লেস লাগে বেব। হাঁটুর বয়সী তো তাই তুমি এসব বুঝবে না৷
“আমাকে হাঁটুর বয়সী না বলে,নিজেকে কাকুর বয়সী বললেই তো পারেন।
” কি বললে আমি কাকুর বয়সী! আঠাশ বছরের যুবক দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম ক্যাপ্টেন জিয়ান রেজা চৌধুরী।
“সতেরো বছরের জলন্ত রূপবতী কিশোরী সুনয়না চৌধুরী।
” উফফ আমিও তোমার রুপে জ্বলতে চাই।
“নয়না কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,ছুঁয়ে দিলেই জ্বলে যাবেন৷আমি আগুন কন্যা।
” জিয়ান নয়নার কাছ ঘেঁষে বলে,দুষ্ট বৌ তুমি ছুঁয়ে দিলে আমি জ্বলন্ত অগ্নিগিরি। আমার উত্তাপে তুমি ভস্ম হয়ে যাবে৷ ছুয়ে দাও বেব।
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৫

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৫৫

নিজের বোনের লাশের পাশে বসে আছে অন্তর। একজন ভাইয়ের জন্য এর চেয়ে বড় যন্ত্রণার আর কী হতে পারে? মেয়ে হলে নিশ্চিত অন্তর এখন হাউমাউ করে কাঁদত। পুরো হাসপাতাল ভারী হয়ে উঠত অন্তরের আত্মচিৎকারে। কিন্তু ছেলে মানুষ যে এভাবে কাঁদতে পারে না! কষ্টে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসে, বুকে ব্যথা হয়; তবুও শব্দ করে কাঁদে না তারা। অন্তর রিতুর মুখটা সাদা কাপড়ে ঢেকে দিল। তার বোন, যাদের জন্য মারা গেল, তারা তো এখনো জীবিত! আচ্ছা, এই সমাজে বিচারব্যবস্থা এত দুর্বল কেন? ধর্ষক দিব্যি ঘুরে-ফিরে মাথা উঁচু করে বাঁচে। আর ভিকটিম হয়তো সুইসাইড করে, নয়তো বেঁচে থাকলে সমাজের মানুষগুলো তাদের মেরে ফেলে!
জাহিন অন্তরের সাথে সাথে সবকিছু সামলে নিচ্ছে। রিতুকে কবরস্থ করে এসে অন্তরের পাশে বসল। অন্তরের চোখে তখন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা, হৃদয়ে দহনের অনল। জাহিন অন্তরের কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই এভাবে ভেঙে পড়লে আঙ্কেল-আন্টিকে কে সামলাবে?”
অন্তর হঠাৎ জাহিনের গলা চেপে ধরে বলল, “তোর বেড়াল কী করছিল সেই স্থানে?”
জাহিন ঠান্ডা মাথায় বলল, “তুই কি পাগল হয়েছিস! ম্যারিনো বাসায়। পৃথিবীতে একরকম দেখতে বেড়ালের অভাব নেই!”

“তাহলে রিতু তোর নাম কেন নিতে চাইছিল?”

“রিতু আমাকে ভালোবাসে, তুই জানিস তো। হয়তো শেষবার আমার সাথে কথা বলতে চাইছিল। বিশ্বাস কর, রিতু বেঁচে থাকলে আমি রিতুকেই বিয়ে করতাম। তুই নিজেকে সামলে নে, আমি রিতুর সাথে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ একত্র করি। এদেরকে ছাড়ব না।”

“আমি কী করে নিজেকে সামলাব! আমার ফুলের মতো নিষ্পাপ বোনটাকে ওরা কলুষিত করেছে। মেরে ফেলেছে আমার বোনটাকে। ওই তো সেদিন আমার বোনটা ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরল। আমাকে মান্নাতের সাথে কথা বলতে হবে। হতে পারে, যারা মান্নাতের সাথে এই জঘন্য কাজ করেছে, তারাই রিতুর সাথে এমনটা করেছে। আমার বোনটা ফুটে ওঠার আগেই ঝড়ে গেল। পৃথিবীতে থাকা মানুষ নামক পশুগুলো বাঁচতে দিল না আমার বোনটাকে।”

“ওদেরকে আমি ছাড়ব না। বাসায় চল।”

🌿

সায়না নয়নার সাথে কথা বলা শেষ করে মিতা বেগমের রুমের দিকে চলে গেল। নয়না খাবার শেষ করে উঠে বসল, সুন্দর দেখতে একটা জলপাই রঙের শাড়ি পরল। চুলগুলো আঁচড়ে বেণী করে নিল। ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগাল। আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে সরে এল। আবার গেল আয়নার সামনে। ড্রেসিং টেবিল থেকে কাজল তুলে চোখে লাগাল। শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে হিজাব ঠিক করে নিল।
পেছন থেকে মেহনুর বলে উঠল, “বয়স কম হলেও ছেলে বশ করার কলাকৌশল ঠিকই জানো দেখি।”
“আপু, আপনি!”
“তা, এত সাজগোজ করে কোথায় যাচ্ছ?”
“ওনার সাথে একটু বাইরে বের হব।”
“তুমি কি এই সংসার সামলাতে পারবে?”
“পারব না কেন? না পারলেও ধীরে ধীরে শিখে নেব।”
“তোমার বরকে খুশি করতে পারো তো?”

নয়না শক্ত গলায় বলল, “এসব কেমন কথা, আপু! আমার বর আর আমার মধ্যকার বিষয় নিয়ে কথা বলার আপনি কে? আমরা কে কাকে কতটুকু খুশি করতে পারব, সেটা আমরা দু’জন জানলেই হবে। আমার দেরি হচ্ছে, আমি বের হব।”
“তো, তোমাকে ধরে রেখেছে কে?”
“আমার রুম থেকে আমি চলে যাব, আপনি কী করবেন?”
মেহনুর বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল, “বয়সের চেয়ে কথার ধার বেশি। এঁচড়ে পাকা মেয়ে।”

নয়না রুমের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল। মেহনুর আর জাহিন—এই দুটো মানুষকে ঠিক বুঝতে পারে না নয়না। উদ্ভট লাগে দু’জনকেই।মিতা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দু’জনে বেরিয়ে পড়ল।

সায়না বলল, “ভাবি, তুমি তোমার দেবকে বোঝাবা।”
“এত পাগল হয়ে যাচ্ছ কেন? পুরুষ মানুষ যদি একবার বুঝতে পারে তুমি তার জন্য পাগল, তাহলে সে তোমাকে মূল্য দেবে না। নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখে তারপর প্রেম-ভালোবাসা।”
“কিন্তু ওই ডাক্তারকে আমার চাই-চাই।”
“বুঝলাম, চাও; তাই বলে উন্মাদ হওয়া যাবে না।”
“আচ্ছা, ভাবি, এখন থেকে কম কম ভালোবাসা প্রকাশ করব।”

নয়না জিয়ানকে কল করল।জিয়ান নয়নার কল কেটে দিয়ে ব্যাক করল। এই বিষয়টা ভালো লাগে নয়নার। পুরুষ মানুষের ছোট ছোট কাজেও যত্ন লুকিয়ে থাকে।নয়না রিসিভ করে বলল, “আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, মেরি জান। কতদূর এসেছ?”
“আগে বলুন, সকাল-সকাল আমাকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?”
“নাহিদের সাথে দেখা করলাম, সেখান থেকে নাহিদকে নিয়ে অনিকেতের বাসায় এসেছি।”
“তো, বলে যাওয়া যায় না বুঝি?”
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে, তাই ডিস্টার্ব করিনি। আচ্ছা, শোনো, তুমি ভিডিও কল করো। আমিই করছি।”

“ভিডিও কল কেন?”
“দেখতাম বউটাকে কেমন লাগছে। সেই সকালে এক নজর দেখে এসেছি, এখন তো মন পোড়ে দেখার জন্য।”
“আহাগো। শুনুন, আমি তো আসছি, সরাসরি দেখতে পাবেন। মোবাইলে দেখতে হবে না।”
“হবে না কেন! আমি দেখবই।”
“কী বাচ্চামো করছেন! আপনি কিন্তু পাইলট রেজা চৌধুরী, ভুলে যাচ্ছেন?”
“তোমার কাছে আমি শুধুই তোমার হ্যাসবেন্ড, যে কখনো তোমার কাছে বাচ্চাদের মতো আবদার করবে, আবার কখনো রোমান্টিক বরের মতো আদরে ভরিয়ে দেবে।”
“চুপ করুন, পাশে সায়না আছে তো। মুখে কিছু আটকায় না?”
“এমন কী বললাম! আমি কি বলেছি তোমাকে কোলে নিয়ে ঠোঁটে চুমু খেতে ইচ্ছে করে? নাকি বলেছি তোমার কোমড়ের তিলটা আমাকে আকর্ষণ করে? নাকি বলেছি…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই নয়না বলল, “চুপ করুন, বেশরম লোক।”
“বউয়ের কাছে আবার কিসের শরম! শরম তো সব লুটিয়ে দিয়েছি তোমার ওপর, বউ।”
“আপনি শুধরাবেন না?”
“কোনো চান্স নেই, উল্টো বিগড়ে যাব। সামলাতে পারবে তো?”
“আপনাকে আমি কেন সামলাব! আপনি কি ফিডার খাওয়া বাচ্চা নাকি!”
“ফিডার খাওয়া বাচ্চা না হই, পুরো আস্ত বউকে খেয়ে ফেলা রোমান্টিক বর তো।”

নয়না খট করে কল কেটে দিল। লোকটার মুখে কিছু আটকায় না। যা মুখে আসে, তাই বলে!সায়না বলল, “এত লজ্জা পেতে হবে না, পিচ্চি ভাবি। আমি এসব কিছুই শুনিনি। আহা, কী রোমান্টিক প্রেম! তবে জানো, আম্মু কী বলে?”
“কী বলে, ফুপ্পি?”
“বিয়ের প্রথম বছর থাকে রসমালাইয়ের মতো প্রেম, দ্বিতীয় বছর থাকে মিষ্টির মতো প্রেম। এরপর পুরো জীবন করলার মতো।”

নয়না হেসে বলল, “দারুণ কথা তো। তবে একসাথে থাকতে থাকতে তো একজন আরেকজনের অভ্যাস হয়ে যায়।”
“সবার হয় না। বর্তমানে যে হারে ডিভোর্স বেড়েছে! কেউ কম্প্রোমাইজ করতে রাজি না। অথচ কম্প্রোমাইজ না করলে বিবাহিত জীবন মেন্টেন করা যায় না। যেকোনো একজনকে হালটা ধরতেই হয়। সবাই এখন বেটার খুঁজে, যাকে পেয়ে যায়, তার কদর কমে যায়।”নয়না বলল, “হয়তো।”
গাড়ি এসে অনিকেতের বাসার সামনে থামল।🌿
অনিকেত কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, “দেখ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি বিয়ে করব না। আমি সিরিয়াসলি বলছি, আমি বিয়ে করব না। আর করলেও আমার মতো অসহায় কাউকে করব। আমি ছেলে মানুষ, সফল একজন ডাক্তার, তারপরও আমাকে যদি রিজেক্ট হতে হয় পিতৃপরিচয়ের জন্য, তাহলে আমার মতো অবস্থানের মেয়েদের কী ফেস করতে হয়!”

“এসব ইমোশনাল কথাবার্তা বাদ দে। আমি ফুপির সাথে কথা বলব। তোকে সায়না ভালোবাসে, তোর ওকেই বিয়ে করতে হবে।”
“আমি তো ভালোবাসি না। কারণ আমি ভালোবাসার সীমারেখা জানি।”
“তুই মিথ্যে বলছিস। তুই জানিস, তুই ভুল। সায়নাকে তুই অল্প হলেও মনে জায়গা দিয়েছিস। নিজের মনের সাথে কেউ মিথ্যে বলতে পারে না!”
“আমি বিয়ে করব না।”
সায়না রুমে ঢুকেই বলল, “মগের মুল্লুক তো বিয়ে করবে না! বিয়ে করতেই হবে। আজ এক্ষুনি বিয়ে করব। ভাইয়া, কাজিটাজি কী কী লাগে, নিয়ে আসুন। আজ ডাক্তার অনিকেত মাহমুদের সাথে সায়নার বিয়ে। ব্যাস, এরপর আর কোনো কথা শুনব না।”

#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৪

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৫৪
সকালের আধো আলো এসে নয়নার মুখে পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুললো নয়না। পুরোপুরি ঘুমের রেশ কাটেনি। নয়নার ঘুমকাতুরে নিভু নিভু চোখ নিয়ে হাত দিয়ে জিয়ানকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু তার পাশে কেউ নেই! দ্রুত চোখ খুলে ফেললো। হঠাৎ যেন ঘুম গায়েব হয়ে গেল। কোথায় গেল মানুষটা? গায়ে কম্ফোর্ট টেনে নিজেকে ঢেকে নিলো। বেডের পাশ থেকে শাড়ি তুলে গায়ে জড়িয়ে নিলো। দ্রুত বেড থেকে নেমে কভার্ড থেকে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায়, করিডোরে খুঁজলো। না পেয়ে সোজা নিচে চলে এলো।

মেহনুর তখন পাউরুটিতে মিক্সড ফ্রুট জ্যাম লাগাচ্ছে। একজন সার্ভেন্ট দাঁড়িয়ে আছে, আর কেউ নেই টেবিলের আশপাশে। নয়না সার্ভেন্টের উদ্দেশে বলল, “বাকিরা সবাই কোথায়?”
মেহনুর পাউরুটি থেকে একটা বাইট নিলো। পাউরুটি চিবোতে চিবোতে বলল, “আম্মি আর আঙ্কেল হাসপাতালে। তুমি কাকে খুঁজছো?”

“রেজা কোথায়?”
“রেজা বাসায় নেই?”
“না,” বলেই নয়না উপরে চলে এলো।

বেডের ওপর বসলো মুড অফ করে। নিজের ফোনটা বের করে জিয়ানকে পরপর কয়েকবার কল করলো। ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স নেই। রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে। নয়না আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে ভালোভাবে লক্ষ করলো। দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, “আপনি চলে গেলে আমি থাকবো কী করে! আপনাকে যে খুব মিস করবো, মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। আজকে দিনটা তো আমাদের হওয়ার কথা ছিল। কোথায় গেলেন আপনি? চলে আসুন প্লিজ। মিস ইউ।” নয়নার চোখের পাপড়ি ভিজে উঠলো চোখের জলে। হঠাৎ তার চোখে পানি কেন এলো! নয়না নিজেও বেশ অবাক হলো!

একজন সার্ভেন্ট ট্রেতে করে নয়নার খাবার নিয়ে এলো। খাবার রেখে বলল, “বড় সাহেব আপনাকে নাস্তা করে রেডি থাকতে বলেছেন।”

“রেজা?”
“জ্বি, বৌমনি।”
“কখন বলল? রেজা কোথায় বের হয়েছে এত সকালে?”
“তা তো জানি না। যাওয়ার সময় বলে গেছেন। নাস্তা করে নিন।”

নয়না সোফায় বসে ট্রের দিকে তাকাতেই অবাক হলো! তার পছন্দের সব খাবার! ক্ষীর, লুচি, মুচমুচে পরোটা, ঘন দুধ চা। সাথে ফ্রেশ অরেঞ্জ জুস। পাশে রাখা দুটো ডার্ক চকোলেট। নয়নার পছন্দের ব্রেকফাস্ট। নয়না মনে মনে বলল, “আচ্ছা, কেউ কি এত ভালোবাসতে পারে? না বলতেই মনের কথা পড়তে পারে? আসলেই কি ভালোবাসা এত মধুর হয়! এসব কোনো কল্পনা নয় তো? নাকি আমার পড়া উপন্যাসের কোনো অধ্যায়? যদি এমনটা হয়, তবে আমি চাই এই কল্পনা কখনো শেষ না হোক। যুগ যুগ আমি উপন্যাসের এই অধ্যায়ে আটকে থাকতে চাই।”

একজন সার্ভেন্ট রুম গোছাচ্ছিল। সে বলল, “বৌমনি, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে? গরম করে এনে দিব?”
“না, দরকার নেই।”
“আমি আসি, বৌমনি। দরকার পড়লে ডেকে পাঠাবেন।”
“জ্বি, অবশ্যই।”নয়না মুচমুচে পরোটা চায়ে ডুবিয়ে খেতে খেতে ভাবছে, “আচ্ছা, মাত্র সতেরো বছর বয়সে আমি এমন স্বপ্নের মতো জীবন পেয়ে গেলাম! এই জীবনের আয়ু কত যুগ হবে?” এভাবে ভাবার বাজে অভ্যাস নয়নার। এসব ভাবনার মাঝে ধুম করে একজন রুমে ঢুকে বলল, “আগুন জ্বলছে আমার মনে, আর তুমি নাস্তা করছো সঙ্গোপনে!”
“আপনি?”
“কিসের আপনি? ননদকে কখনো আপনি বলতে হয় না, ডিয়ার ভাবি। তুমি করে বলো।”

“কী করেছি আমি?”
“এটাই তো সমস্যা, ভাবি। তুমি কেন কিছু করছো না! তোমার তো কিছু করা উচিত।”
“কী করা উচিত, কী বলছো তুমি?”
“ইশ, নিব্বি ভাবি পেয়েছি! আমার চোখ দেখে মন পড়তে পারে না।”
“বুঝিয়ে বলো, তাহলে আমি বুঝবো।”
“আচ্ছা, নাস্তা শেষ করে বোঝাচ্ছি।”নয়না ক্ষীর দিয়ে লুচি খাচ্ছিল। এটা তার খুব প্রিয় একটা খাবার। বাঁ হাতে ফোনটা নিলো জিয়ানকে কল করতে। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে জিয়ানের টেক্সট: “জান, নাস্তা করে সুন্দর টুকটুকে বৌ সেজে রেডি হও। আজকে তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো।”

নয়নার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। মন ভালো করার জন্য প্রিয় মানুষের ছোট একটা টেক্সট বা একটা কল যথেষ্ট। কী অদ্ভুতভাবে আমরা নিজের সুখ অন্যের কাছে দিয়ে দিই!
“হাসছো কেন, ভাবি? তোমার এখন প্রেম করতে হবে না। দ্রুত খেয়ে আমার বুকের আগুন নেভাও।”
“যদি নেভানোর বদলে আগুনে ঘি ঢেলে দিই?”
“জ্বলে আঙার হয়ে যাবো।”
নয়না হেসে বলল, “এত ব্যাকুলতা ভালো না, মেয়ে।”
🌿
অন্তর কোনোভাবেই কোনো প্রমাণ ধরে রাখতে পারছে না। সব প্রমাণ কেমন অদ্ভুতভাবে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। যে তিনজনের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল, তাদের ডিএনএ ম্যাচ করে রিপোর্ট রেখেছিল, কিন্তু এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না! এই কক্ষে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ আসে না, জানেও না এখানে কী থাকে। তাহলে কি জাহিন আর রাফির মধ্যে কেউ গাদ্দারি করছে? জাহিন তো ক্লিনিকে, বাকি রইলো রাফি। অন্তর নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল, “আমার বোনের সাথে অন্যায়কারীকে সাহায্য করা কেউ ছাড় পাবে না। অন্তর বেঁচে থাকতে কিছুতেই না।” অন্তর চোয়াল শক্ত করে আন্ডারগ্রাউন্ডে অবস্থিত রুম থেকে বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরালো। মেইন রোডের সাইডে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে অন্তর। সিগারেট শেষ না করেই ছুড়ে মারলো, সামনে-পিছে না তাকিয়ে।

তুষির হাতে শপিং ব্যাগ। তুষি “মাগো” বলে চিৎকার করলো। তুষির গলার আওয়াজ পেয়ে অন্তর পিছু ফিরলো। তুষি অগ্নিদৃষ্টিতে অন্তরের দিকে তাকিয়ে বলল, “অসভ্যতা করার আর জায়গা পাননি? সকালবেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসভ্যতা করছেন? বাড়িতে কি মা-বোন নেই নাকি?”
অন্তর নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। তুষির গলা চেপে ধরে বলল, “বাড়িতে মা-বোন আছে বলেই অসভ্যতা কাকে বলে তা দেখাতে পারলাম না।”
ততক্ষণে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। অন্তর দ্রুত গলা ছেড়ে দিয়ে বাইক নিয়ে পালিয়ে গেল, উৎসুক জনতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই। তুষি চিৎকার করে বলল, “আরে, দাঁড়িয়ে দেখছেন কী? গুন্ডাটাকে ধরুন।”
ততক্ষণে অন্তর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। দর্জির দোকান থেকে ড্রেস আনতে গিয়েছিল তুষি। হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গিয়েছিল। তুষি ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, “আরেকবার পাই তোকে, তারপর বোঝাবো তুষি কী চিজ।”
🌿
লাবিব জেলে আজ কতদিন। সে বাসার খাবার খায় না কতদিন হলো। কতদিন হলো মায়ের ভালোবাসা পায় না। রাগে চোয়াল শক্ত করে বলল, “তোকে আমি শান্তিতে থাকতে দেবো না, নীলাঞ্জনা। তুই আমার জীবন ধ্বংস করে কী করে শান্তিতে থাকিস, আমি দেখে নেবো। একবার শুধু বের হই এই কারাগার থেকে, তোর সব সুখ কেড়ে নেবো।”

নীলাঞ্জনা মাথা নিচু করে বসে আছে। শিল্পি বেগম রেগে আছেন। নীলাঞ্জনা প্রেগন্যান্ট, এটা শুনেই তিনি রেগে গেছেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “কয় মাস হলো?”
“দু’মাস।”
“তোর লজ্জা করলো না! এখন তোর এই বাচ্চাকে কী করবি? নষ্ট করা ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই। আমার গর্ভে এমন মেয়ে জন্ম নিলো! তোর মাথায় কোনো জ্ঞান নেই? বিয়ে করে মাস পেরোতে না পেরেই প্রেগন্যান্ট। যা করেছিস করেছিস, আজ সন্ধ্যায় আমি ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি। এটাকে এখানেই শেষ করে ফেল। এমনিতেই ডিভোর্সি মেয়ে, তার ওপর এক বাচ্চার মা হলে আর কেউ নেবে?”
নীলাঞ্জনা গর্জে উঠলো, “আমার বাচ্চা এই পৃথিবীতে আসবে। তাকে আসতেই হবে। আমার আর কাউকে লাগবে না। লাগলে ভিক্ষা করে মানুষ করবো। তবুও আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবো। পারবো না আমি আমার নিজের সন্তানকে হত্যা করতে।”

শিল্পি বেগম ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন নীলাঞ্জনার গালে। “এতই যখন শখ, তখন এত সুন্দর, টাকাওয়ালা ছেলে রেখে গাঁজাখোরের কাছে কেন গেলি? পালিয়ে গেলে মানুষ এমন কারো কাছে যায়, যে পরবর্তীতে বড় কথা বলতে পারে। দেখো, এরজন্য আমি গিয়েছিলাম। তুই কী করেছিস, বংশের মুখে চুনকালি দেওয়া ছাড়া? তোর কথা শুনবো না, সন্ধ্যায় আমার সাথে যাবি।”
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৩

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৫৩
নয়নার চোখে ঘুম নেই। তার পাশে যে ব্যক্তি শুয়ে আছে, সে আসলে কে? নয়না নিজের মোবাইল নিয়ে করিডোরে চলে এলো। ডায়াল লিস্ট থেকে তুষির নম্বর বের করে তাকে কল করলো।
তুষি কল রিসিভ করে বলল, “এত রাতে জামাইয়ের সোহাগ ছেড়ে আমাকে মনে পড়লো কেন, ম্যাডাম?”
“টেনশনে আছি।”
“তোর টেনশন মানে আজগুবি চিন্তা। তা, কী নিয়ে টেনশন?”
“বিয়ে তো করিসনি, বুঝবি কী করে? বিবাহিত মেয়েদের কত শত টেনশন থাকে!”
“চুপ কর, বুড়ি! এমনভাবে বলছে, যেন ওর পাঁচ-দশটা বাচ্চা আছে। কী বলবি, বল।”
“আসলে কীভাবে বলবো, বুঝতে পারছি না।”
“গোলগোল না ঘুরিয়ে সোজাসাপ্টা বলে ফেল। আমার সঙ্গে কথা বলতে এত ভাবতে হয়?”
“আসলে জানিস তো, তোর দুলাভাই আর তার ছোট ভাই জমজ।”

“তাতে কী?”
“এখন আমি বুঝবো কী করে কোনটা কে? একই ড্রেস পরলে কীভাবে বুঝবো?”
“এটা বোঝা কোনো ব্যাপার হলো?”

“দুজন মানুষের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আমি কীভাবে বুঝবো কোনটা কে?”

তুষি নয়নার কথা শুনে বলল, “এতদিন স্বামীর বগলদাবা হয়ে থেকে এখন বলছিস কীভাবে চিনবি? বলদি, তোর স্বামীর শরীরের ঘ্রাণ তুই চিনতে না পারলে কেমন বউ তুই? বেঁচে আছিস কেন এখনো? যা, কচুগাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়।”

“চুপ থাক, ভুষি! তুই আমাকে বুদ্ধি না দিয়ে অপমান করছিস। যা, লাগবে না তোর পরামর্শ।” বলেই খট করে কল কেটে দিলো।

নয়না কীভাবে বোঝাবে তার কনফিউশন কী নিয়ে? আচ্ছা, দুজন মানুষ একই ড্রেস পরা, একই চেহারা, একই কণ্ঠ! আমি কীভাবে আলাদা করবো তাদের? নয়না চোখ বন্ধ করে জিয়ানকে অনুভব করার চেষ্টা করছে। মনে মনে বলল, “আচ্ছা, আজকের কিস আর এতদিনের কিসের টেস্ট মেলালেই তো বোঝা যাবে, আমার সঙ্গে আসলটা নাকি নকলটা!” নয়না আবার চোখ বন্ধ করে গভীর মনোযোগ দিয়ে অনুভব করতে লাগলো।

জিয়ান চোখ বন্ধ করে নয়নার কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করছিলো। এবার চোখ খুলে বলল, “কী করছো? ধ্যান, নাকি তপস্যা? নাকি কোনো সাধনা করছো?”
“টেস্ট করার চেষ্টা করছি।”
“কিসের টেস্ট?”
“চুমুর টেস্ট।”

জিয়ান নয়নার হাত ধরে টান দিলো। নয়না রাগী চোখে তাকিয়ে বলল, “কী অসভ্যতা করছেন? ছাড়ুন। একদম আমাকে স্পর্শ করবেন না।”

জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “এমন করছো কেন? জ্বিনে-টিনে ধরেনি তো আবার?”

“চুপ করে থাকেন, একদম কোনো কথা বলবেন না।”

“আরে, বুদ্ধু, আমাকে চিনতে পারছো না? আমি তোমার প্লেন ড্রাইভার।”

নয়না জিয়ানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল, “জানি না, আমার মনে কেন কনফিউশন তৈরি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনি জাহিন। সত্যি করে বলুন, আপনি কে?”

“আমি কে মানে? এতদিন আমার সঙ্গে থেকেও আমার স্পর্শ চিনতে পারছো না? আচ্ছা, এখনই আমার স্পর্শ অপরিচিত মনে হচ্ছে? আমি ফিরে আসলে তো ভুলেই যাবে আমাকে। নাহ, এমন ভোলা-মনা বউ রেখে কাজে যাওয়া মুশকিল। এখন কি ছেড়ে দেবো জব? ঘরে বসে বউ পাহারা দেবো? এছাড়া আর কোনো অপশন দেখছি না আপাতত।”

নয়না জিয়ানের অনেকটা কাছে এলো। হঠাৎ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জিয়ানকে। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জিয়ানকে জড়িয়ে রেখেছে, যেন জিয়ান কোথাও পালিয়ে যাবে।

জিয়ান নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “বাটার মাশরুম, আমি শুধু তোমার প্লেন ড্রাইভার। আমি ছাড়া অন্য কারো সাহস নেই তোমাকে টাচ করার। যদি কেউ এমন দুঃসাহস দেখায়, তাহলে তাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো।”

নয়নার মনে বিশ্বাস জন্মালো, এটা তার পাইলট রেজা চৌধুরী। তার দেহ-মন জানান দিচ্ছে, তার মানুষটাকে সে জড়িয়ে ধরে আছে। নয়নার চোখ ভিজে উঠলো নিজের অজান্তেই।

জিয়ান নয়নাকে নিজের কাছ থেকে আলাদা করে বলল, “এই পাগলি, কাঁদছো কেন? আমি ছাড়া তোমাকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। তুমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত ফুল, যার সৌরভের মাদকতায় একমাত্র আমি আসক্ত হবো। আমি ছাড়া এই সৌরভে মুখরিত হতে পারবে না। তুমি শুধুই আমার অর্ধাঙ্গিনী। কাল চলে যাবো, এখন এভাবে কাঁদবে জান?”
“জানি না, আমার মন মানছে না। এসব কিছু কাকতালীয় মনে হচ্ছে! তুমিই বলো, জাহিন ভাইয়া ওই রাতে একই ড্রেসে কীভাবে এলো? আর কেনই বা এলো? সে জানলো কীভাবে আমরা সেখানে আছি? এতসব কাকতালীয় কীভাবে হয়? তুমি চলে গেলে আমি এই বাসায় থাকবো না। আমার জাহিন ভাইয়াকে মোটেও পছন্দ না।”
“আচ্ছা, বুঝলাম। আমি চলে গেলে তুমি তোমার বাসায় থেকো। এখন সব বাদ দিয়ে কাছে এসো। একদম কাছে এসে বুকে মাথা রাখো। মিশে যাও তোমার মানুষের সঙ্গে।”

নয়না জিয়ানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। জিয়ান নয়নাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। নয়নার মাথায় চুমু দিয়ে বলল, “পিচ্চি, একটা কিউট বউ পেয়েছি। সবকিছু নিয়ে ওভারথিঙ্কিং করে। এই যে পিচ্চি বউ, এইটুকু মাথায় ইয়া বড় লম্বা-লম্বা চুল। এতটুকু মাথায় এত প্রেশার দেওয়া চলবে না। তুমি জিয়ান রেজা চৌধুরীর অর্ধাঙ্গিনী। আমি বেঁচে থাকতে তোমার কাছে আসার সাহস কারো হবে না।”

নয়না জিয়ানের বুকে আলতো করে চুমু দিচ্ছে। জিয়ান নয়নার কানে ফিসফিস করে বলল, “কী গো, বউ, আগুনে ঘি ঢালার কাজ করছো কেন? উত্তাপ বাড়ালে কিন্তু তোমাকেই শান্ত করতে হবে।”
নয়না লজ্জা পেলো। আলতো কামড় বসিয়ে দিলো জিয়ানের বক্ষে। জিয়ান এক ঝটকায় নয়নাকে ঘুরিয়ে তার উপর ঝুঁকে নেশালো কণ্ঠে বলল, “আই নিড ইউ। এই মুহূর্তে আমার তোমাকে চাই, একদম পুরোপুরি।”

নয়না নিজেও বেসামাল হচ্ছে। শক্ত করে খামচে ধরলো বেডশিট। জিয়ান নয়নার গলায় মুখ ডুবালো। রাতের অন্ধকারের সঙ্গে মিলিয়ে যেতে লাগলো একজোড়া কপোত-কপোতী।

🌿

জাহিন হাসপাতালের বেডে হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সে যা চায়, তা ঠিক নয়, কিন্তু তার মন তাকে দিয়ে তা করাচ্ছে! আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সারাজীবন নিঃসঙ্গ থাকবো, ঠিক চাঁদের মতো।” জাহিন হঠাৎ কিছু একটা ভেবে হাসলো। তার হাসির কারণ কী, সেটা ঠিক বোঝা গেল না।অন্তর জাহিনের জন্য ছুটে এসেছে। জাহিনের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “কী হয়েছে তোর?”

“আরে, বলিস না। রিতুর সুইসাইড কেসের তদন্তের জন্য বেরিয়েছিলাম। এরপর ভাইয়ার সঙ্গে দেখা। তাকে বাঁচাতে গিয়ে সামান্য লেগেছে। ঠিক হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি, তেমন গুরুতর আঘাত নয়। রিতুর কী অবস্থা?”

অন্তর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হয়তো আর বাঁচবে না। আমার হাসিখুশি বোনটা এখন মৃত্যুর পথে। আমি ভাই হয়ে কিছু করতে পারছি না।”

“তুই টেনশন করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই ভেঙে পড়লে চলবে না।”

জাহিনের বিরক্ত লাগছে অন্তরকে। হঠাৎ তার একা থাকতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর এমন কোনো স্থানে যেতে, যেখানে তার ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। মানুষের উপস্থিতি তার সহ্য হচ্ছে না।

অন্তর চলে গেলো। তার হাতে সময় নেই। জাহিন নিজের ফোন বের করে কাউকে কল করলো। দু’মিনিট কথা বলেই ফোনটা ছুড়ে ফেললো।কর্তব্যরত নার্স দ্রুত এসে বলল, “কোনো সমস্যা, স্যার? আপনার কিছু লাগবে?”

জাহিন গর্জে উঠে বলল, “এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বের হয়ে যান, নয়তো মেরে ফেলবো।”

নার্স ঘাবড়ে গেলো। রুম থেকে বের হয়ে ডাক্তারকে ইনফর্ম করলো। ডাক্তার নাজিম চৌধুরীকে কল করলো। নাজিম চৌধুরী মাত্র বাসায় ঢুকেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে এলেন। তার এই ছেলেটাকে তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না। ছোটবেলা থেকেই খুব জেদি আর একরোখা। কখন যে কী করে, কিছুই জানা যায় না। বাবা হয়েও ছেলের সম্পর্কে তিনি তেমন কিছুই জানেন না!
#চলবে

নবপূর্ণিমা পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৭(অন্তিম)

সালমান দরজায় ঢুকতেই বুঝতে পারলো।
ঘরের পরিবেশ এক অদ্ভুত নীরবতায় মোড়ানো।
ডাইনিং টেবিলের এক কোণে হালিমা বেগম বসে আছেন, মুখটা কুঁচকে, চোখে কেমন একটা দুঃখ আর অভিমান মিশে আছে। তার চোখে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে নেন।
সালমান বুঝে যায়-সকালবেলার ঘটনাগুলো এখনো তার মায়ের মনে গেঁথে আছে। তিনি অভিমান করেছেন, আর আজকের রাতের খাবারটা সেই নীরব অভিমানের সাক্ষী। খেতে বসেও হালিমা বেগম টু শব্দও করলেন না।
সবকিছু যেন বোবা ভাষায় বলছে—“তুমি আজকে আমার হয়ে কথা রাখোনি!”
খাওয়ার পর সালমান এগিয়ে যায়, ধীরে গিয়ে বসে পড়ল মায়ের পায়ের কাছে।
একটু ঝুঁকে আদুরে ভঙ্গিতে ডাক দিলো,
– “মা।”

হালিমা বেগম মুখ ফিরিয়ে নিলেন, কথা বললেন না।

সালমান এবার তার কণ্ঠে কোমলতা মিশিয়ে আবার বলল,
– “মা, একটা কথা বলবো? রাগ করে থেকো না… শুধু শুনো।”

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলল সে,
– “তুমি জানো? তুমি আমার জীবনের সেরা মা। কিন্তু একটা প্রশ্ন করবো? যেটা তুমি তোমার সময়ে পাওনি, সেটা তুমি অন্য কাউকে দিতে চাও না কেন? তুমি তো বলো, মায়ের মতো কেউ হয় না। তুমি তো নিজে ভালো, কিন্তু কেন নিজের ভেতরে এখনো অতীতের সেই কষ্টের পাথর বয়ে বেড়াচ্ছো?”

হালিমা বেগম চোখ তুলে তাকান ছেলের দিকে। এরপর বেশ রাগীস্বরে শুধালেন,
“বউ এর হয়ে সাফাই গাইতে এসেছিস? এমন কবে হলি তুই?”
সালমান হাসলো। হেসে শুধায়,
“এটাকে সাফাই গাওয়া বলে না মা। সেটা তুমি নিজেও জানো।”
হালিমা বেগম মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রতিত্তর করে,
“আমি ছোট বাচ্চা না। আমাকে কিছু বোঝাতে আসিস না। আমি রুমে যাবো। ছাড় আমায়।”
সালমান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো হালিমা বেগমকে। এরপর আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“গল্প তো প্রতিদিনই হয়। আজ নাহয় বাস্তবতা নিয়ে হোক।”

“আমার দরকার নেই। তুই সর।”

সালমান ছাড়ে না। সে তার আগের কথা চালিয়ে যায়,
– “জানি, তুমি অনেক কষ্টে সংসার করেছো। বিয়ের পর দাদু তোমাকে শুধু দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু অধিকার বা ভালোবাসা না। আমি জানি মা, তুমি ভালো থাকতে পারোনি।
কিন্তু তুমি কি সত্যিই চাও, রিমঝিমও তেমনি একটা চাপা রাগ নিয়ে বেড়ে উঠুক? সেও যেন ভবিষ্যতে কারো শাশুড়ি হয়ে বলে—‘আমি পাইনি, ওকে কেন দেবো?’”

সালমান থেমে যায় কিছুক্ষণের জন্য।
তারপর একটু ঝুঁকে মায়ের কোলের কাছে মাথা রাখে।

– “মা, তুমি যদি তোমার কষ্টের চক্রটা এখানেই ভেঙে ফেলো… তাহলে বুঝবে, তুমি শুধু মা নও, তুমি ইতিহাস বদলে দেওয়া একজন নারী। কারণ তুমি সবকিছু বুঝে নিতে পারলে, পরেরগুলোও বুঝে নিতে পারবে। তুমি ভালো থেকো না থেকো, অন্তত পরের কেউ তো ভালো থাকুক।”

সালমানের কণ্ঠের কথাগুলো যেন হালিমা বেগমের হৃদয়ের দেয়ালে ছুরির মতো বিঁধে যায়।
সে চুপ করে যায়, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে একেকটা ঝড় বইতে থাকে।
সে সামনে তাকিয়ে থাকলেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার নিজের অতীত—একটা বিষণ্ন, অপমান আর অবহেলার দিনগুলো।

সে মনে করতে থাকে…

তখন সদ্য বিয়ে হয়ে এসেছে হালিমা। শাশুড়ি একটিবারের জন্যও তাকে বউ বলে গৃহে স্বাগত জানায়নি।
বরং রান্নাঘরে ঢুকেই শুনতে হয়েছিল—
“ঘরের বউ যদি কাজে পারদর্শী না হয়, তাহলে তার জায়গা রান্নাঘরের মেঝেতে, সবার পায়ের নিচে।”
প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই ঘুম থেকে উঠে কাজ সামলাতে হতো।
একদিন বাবার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করায় শুনতে হয়েছিল—
“ঘনঘন এতো বাপের বাড়ি কিসের?শোনো মেয়ে, বাপের বাড়ি টারি ভুলে যাও। বছরে একদিনের জন্য গিয়ে ঘুরে আসবে। এতে বাপের বাড়িতে কদর থাকবে। ”
হালিমা তখন হেসে দিতো। তার ইচ্ছে হতো জবাব দিতে যে -বাপের বাড়িতে মেয়েরা কদরের জন্য যায় বুঝি! কিন্তু সেই জবাব মুখ ফুটে দিতে পারতো না। রিমঝিম এখন সেই জবাব মুখ ফুটে দেয়। রিমঝিমের জবাব দেওয়া দেখে তার নিজের অতীত মনে পড়ে বি’ষ ধরে যায় শরীরে।
তারপর বাপের বাড়ি গেলেও, যাত্রার আগের রাতে দুই-তিন দিনের ডাবল রান্না করে রেখে যেতে হতো, প্রতিটা লোকের জন্য আলাদা আলাদা করে।
তবু ফিরে এসে শাশুড়িরকে প্রতিবেশী আর স্বামীকে বলার সময় শুনত—
“সব কাজ আমি একাই করেছি!”

হালিমা বেগমের বুকটা হঠাৎ টনটন করে ওঠে।
সে তখন অসহায় ছিল। কিন্তু এখন?

তার সামনে এখন একজন মেয়ে, যে তার নিজের ছেলের ঘরের বউ।
সেই মেয়েটাকেই সে নিজের শাশুড়ির মতো আচরণ করে ধীরে ধীরে পিষে ফেলছে!
সে নিজে যতটা কষ্ট পেয়েছে, ঠিক ততটাই অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়ার অজান্তেই প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে!

সে হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পাওয়ার মতো চমকে ওঠে।

“আমি কি এতটাই খারাপ হয়ে গেছি…?”
সে ফিসফিস করে নিজের মনে।

তখনই সালমান তার কণ্ঠে একরাশ ব্যথা মিশিয়ে বলে ওঠে,
– “আমরা কি পারি না, মা?আমরা কি পারি না, রিমঝিমকে তোমার মতো অতীত না দিয়ে, একটা সুন্দর অতীত দিতে?
তুমি কি এতটাই স্বার্থপর, মা?”

এই কথাগুলো যেন হালিমা বেগমের ভেতরটা চুরমার করে দেয়। সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে।
তার ভেতরের কঠিন দেয়ালগুলো যেন একটা একটা করে ভাঙতে শুরু করে।

না, সে আর সেই বিষাক্ত ইতিহাস কাউকে দেবে না।
সে রিমঝিমের ওপর তার নিজের অতীতের রাগ চাপিয়ে দেবে না।
সে জানে, আজ যদি না বদলায়—তবে ভবিষ্যতের আরেকটা হালিমা তৈরি হবে, আরেকটা ছেলের সংসার বিষিয়ে যাবে।

সালমান ধীরে ধীরে মায়ের হাতটা ধরে আদুরে ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
– “আমি যেটা পাইনি সেটা আর কাউকে দেবো না—এটা না ভেবে বরং এটা ভাবো-যেটা আমি পাইনি, তার অভাব আর কাউকে বুঝতে দেবো না। বরং তাকে তার প্রাপ্যটা পূর্ণ করে দেবো, যাতে সে কোনো কষ্ট না পায়।”
একটু থেমে সে আবার বলে,
– “তুমি যদি তোমার শাশুড়ির মতোই হও, তাহলে তোমার আর তার মধ্যে পার্থক্য কোথায়, মা? তুমি তো তারই পথ ধরে হাঁটছো। আর যদি রিমঝিমও এই ব্যথা আর বিষ বুকে জমিয়ে রাখে, তবে হয়তো একদিন সেও তার ছেলের বউয়ের সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। তখন তো এই বি’ষ এক বংশের ভেতর চলতেই থাকবে। একবার ভাবো মা, এই পুরো চক্রে ছেলের বউ হয়ে আসা মেয়েটার দোষ কোথায় থাকে?
তুমি যদি স্বার্থপরতা ছেড়ে দিয়ে অন্যের ভালোটা ভাবো তাহলে এই চক্র এখানেই ভেঙে যাবে। তুমি বরং সব রাগ ভুলে গিয়ে সবার জন্য একটা সুন্দর, উষ্ণ সংসার তৈরি করে দাও, মা…”

এরপর থেমে আবার বলে উঠে,
“তুমি কি বুঝতে পারছো না? তুমি নিজের অতীতের সেই বি’ষ ঢালতে গিয়ে নিজের ছেলের ক্ষতি করছো মা! অন্য মেয়ের সংসার মানে তো সেটা তোমার ছেলের সংসার। সেই মেয়েকে যদি তুমি কষ্ট দাও -সেই মেয়ে যদি অসুখী হয় তাহলে তোমার ছেলে কীভাবে সুখী হবে মা! তুমি একটু স্যাক্রিফাইস করো মা।”
সালমানের কথাগুলো যেন হালিমা বেগমের বুকের দেয়াল ভেঙে দেয়।

তার চোখের কোণে জমে ওঠে দীর্ঘদিনের অভিমান, চাপা ব্যথা, আর একরাশ অনুশোচনার জল।
সে বুঝতে পারে, সত্যিই তো -সে তো নিজের মতো করেই ভালো হতে পারত। কিন্তু না… সে তো অবচেতনেই সেই একই পুরোনো বিষকে বেছে নিয়েছে।
শুধু বদলেছে চরিত্র, বদলায়নি মন।
সে তো ভুলে গিয়েছিল—অন্যের সুখ দেখে জ্বলে ওঠা নয়, নিজের কষ্টের শেষ হোক সেইটুকুই সবচেয়ে বড় জয়।

সালমান মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“তুমি কি আসলেই এতটা খারাপ? মা?

হালিমা বেগম চোখেজল গড়িয়ে পড়ে। আপনমনেই বিড়বিড় করে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠে,
– “ না, আমি খারাপ হতে চাইনি। আমি খারাপ না।”

মায়ের চোখে জল দেখে সালমানের খারাপ লাগে। তবু থামলে তার চলবে না। সে মায়ের হাতের উপর হাত রেখে শুধায়,
“আমি জানি তুমি খারাপ নও। কিন্তু সময় আর অভিমান আমাকে এমন বানিয়ে ফেলেছিল…তাই শুধরে নিয়ে ভালো থাকো মা।”
হালিমা বেগম হুট্ করেই বলে উঠলেন,
“তোর বউকে আমি কষ্ট দেবো না। এবার থেকে ওকে মেয়ের মতোই ভালোবাসার চেষ্টা করব…!”

সালমান শান্ত হেসে মাথা হেলিয়ে বলে,
– “এই তো আমার মা…”

ঘরের কোণার বাতি তখনো জ্বলে। ঘরের বাতাসে তখন কোনো অভিযোগ নেই, শুধু একধরনের নরম উষ্ণতা।
বিষণ্ন ইতিহাসের চক্র ভেঙে এক নতুন ভোর আসার ইঙ্গিত দেয়।একটা সম্পর্ক বুঝে ওঠে—ভালোবাসা কেবল অধিকার নয়, দায়িত্বও।

সেই মুহূর্তে, বাপের বাড়ির বারান্দায় বসে থাকা রিমঝিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কানের পাশ থেকে ফোনটা সে নামিয়ে নেয়। এতক্ষন ধরে একটা সুন্দর কথোপকথন শুনেছে সে। এখন আর প্রয়োজন নেই।
ঠিক তখনই সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে হেসে ওঠে এক ফালি পূর্ণিমা।
তার মুখেও ধরা পড়ে এক শান্ত, হালকা হাসি।
এই তো সে—রিমঝিম।
যে এতদিন কেবল বুঝে গেছে, কেবল সহ্য করে গেছে।
আজ বুঝেছে, কখনো কখনো নীরব প্রতিবাদই বদলের প্রথম আলো হয়ে ওঠে।

আজ তার জীবনের আকাশেও এক নতুন চাঁদ উঠেছে।
অভিমানের রাত পার করে
তার জীবনেও আজ—”নবপূর্ণিমা”।

সমাপ্ত।
(উঁহু না, আপনাদের কি মনে হয়! হালিমা বেগম সব বুঝে,ওদের সংসার জীবন সুন্দর হবে তো! নো নেগেটিভিটি, অলওয়েজ বী পজেটিভ। অবশ্যই সুন্দর হবে 💙)

নবপূর্ণিমা পর্ব-০৬

0

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৬

আজ যেন রিমঝিম একটু বেশিই অবাক। গোসল শেষে চুল শুকাতে শুকাতে রুমে ফিরতেই দেখে,সালমান খাটের ওপর তার প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে রাখছে। জামাকাপড়, ব্যাগ, স্কার্ফ-সব সাজানো। রিমঝিম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ এমন পরিবর্তন?
নাকি… তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে দিতে চাইছে?
এটা ভেবেই হঠাৎ বুকটা ধক করে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো-না, এমনটা ভাবা উচিত না। হয়তো সত্যিই সালমান শুধরাতে চাইছে।

এমনিও আজ রিমঝিম নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাপের বাড়ি যাওয়ার। কাউকে না জানিয়েই, কারও অনুমতি বা অনুমোদনের অপেক্ষা না করে। বহুদিন ধরে এই বাড়িতে তার ইচ্ছের কোনো দাম নেই। প্রতিবার যেতে চাইলে তাকে অনেক আগেই জানাতে হতো, তাও মাত্র দুদিনের জন্য অনুমতি মিলত।
কিন্তু আজ, অবাক করা ব্যাপার-সালমান নিজেই যেন পথ করে দিচ্ছে তার জন্য।
রিমঝিম চুপচাপ নিজের হাতের ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়।
ধীরে বোরকা পরে নেয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। পিছন থেকে সালমানও অফিসের পোশাকে তৈরি হয়ে নেয়।
তাকে দেখে মনে হয়, যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে।
রিমঝিম আড়চোখে দু-একবার তাকায়। নিজের ব্যাগটা তুলতে যায়, তখনই সালমান চুপচাপ এগিয়ে এসে ব্যাগটা তুলে নেয়।

রিমঝিম কিছু বলে না। এখন এসব নিয়ে কথা বাড়ানোর মানে নেই। সে সোজা এগিয়ে গিয়ে হালিমা বেগমের সামনে দাঁড়ায়। চুপচাপ পায়ের কাছে বসে সালাম করে।

হালিমা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

রিমঝিম একটুও বিস্মিত হয় না। আঘাত পেলেও, অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন।
যে কারণে একসময় সে পায়ে না পড়লে ‘বেয়াদব’ আখ্যা পেত, আজ সেই একই সালামের জবাবে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হয়। সে জানে-এই বাড়িতে তার যেকোনো কাজেই খুঁত ধরা হবে। সে থাকলেও ভুল। না থাকলেও হয়তো ভুল।
তবু আজ, নিজের তুচ্ছ জায়গাটা রিমঝিম ছেড়ে যাচ্ছে সাময়িক শান্তির আশায়।

রিমঝিম পা ছুঁয়ে সালাম করতেই হালিমা বেগম মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা সালমান সেটা স্পষ্ট দেখল। সে চুপ করে থাকতে পারলো না। তার ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো।
সে মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধালো,
“মা, রিমঝিম কয়েক দিনের জন্য বাপের বাড়ি যাচ্ছে।”

হালিমা বেগম মুখ শক্ত করে বললেন,
“যাচ্ছে তো ভালো কথা। কিন্তু অনুমতি তো কেউ নিলো না!”

সালমান অবাক হলো না মোটেও। সে প্রতুৎত্তর করলো,
“আশ্চর্য মা! ওর বাপের বাড়িতে ও যাবে, তাও আবার এতজনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে?”

হালিমা বেগম ভ্রু কুঁচকে শুধালেন,
“এতজন মানে? তুই আমার কথাই বলছিস বুঝি?”

সালমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ মা। আমি আর তুমি-এখানে আলাদা করে অনুমতির কিছু দেখি না। বিয়ে করার পরেও যদি একটা মেয়ে তার নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য ফর্মালিটি মেইনটেইন করে, তাহলে তো সে এখনো এখানে অতিথিই রয়ে গেলো!”

হালিমা বেগম ছেলের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। এমন প্রতিবাদী কথা সালমানের মুখে কখনো শোনেননি তিনি।
তবু নিজেকে সামলে নিয়ে রাগ চেপে বললেন,
“তোমার বউয়ের কি এখানে কদর নেই বুঝি? এখানে যত্ন পাবে না? একটু অসুস্থ হলেই বাপের বাড়ি ছুটছে-এই হচ্ছে এখনকার বউ!”

রিমঝিম পাশে দাঁড়িয়ে হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ, যত্ন তো অনেকই পাই এখানে। এতটা যে, বাঁচার জন্যই এখন একটু দূরে যেতে হচ্ছে।”

সালমান শুনেও কিছু বলল না। সে হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে বলল,
“রিমঝিমের মতো করে যত্ন তো আর তুমি দিতে পারবে না, মা। তুমি বয়স্ক হচ্ছ। আর মা তো মা-ই—তার নিজের মা নিশ্চয়ই ওকে ভালো করে দেখবে। হয়তো তুমিও বিয়ের পর এমনটিই চেয়েছিলে!”

শেষ কথাটা বলতে না বলতেই হালিমা বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখে এক অদ্ভুত ছায়া নেমে এলো।
মনে পড়ে গেল পুরোনো দিনের কিছু দৃশ্য।
বিয়ের পর যখন বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা উঠত, তখন তাকে জনে জনে বলে অনুমতি নিতে হতো। যতদিনের জন্য যেতেন, ততদিনের রান্নাবান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সব আগেভাগেই সেরে যেতে হতো।
অনুমতি পেতেন দুই দিনের, কিন্তু প্রথম দিনের কাজ শেষ করতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে যেত।
তখন শাশুড়ি বলতেন,
“বাড়ির বউ সন্ধ্যার পর বেরোয় না।”
আর সেই সন্ধ্যায় আর যাওয়া হতো না। পরেরদিন, অল্প কিছু সময়ের জন্য বাপের বাড়ি গিয়ে, মায়ের আঁচলে একটু মাথা রাখতেই আবার ফিরতে হতো শ্বশুরবাড়ির দায়ে, দায়িত্বে।
চোখের পলকে সেই শান্তির মুহূর্তগুলো হারিয়ে যেত।
হাসিমাখা মুখে থাকত গভীর হাঁসফাঁস আর অতৃপ্তির চাদর।
কখনো কাউকে বলেননি, কিন্তু বুকের মধ্যে জমে থাকা হতাশাগুলো আজও ঝরে পড়ে দীর্ঘশ্বাসে।

হালিমা বেগম মনে মনে স্বীকার করলেন,তিনি বিয়ের পর স্বস্তিময় জীবন পাননি, শান্তি পাননি। তাই তার ছেলের বউকেও সেই সুন্দর স্বস্তি জীবন সে চাইলেও দিতে পারবে না। কারণ ছেলে বৌমার সুন্দর মুহূর্ত দেখলে তার আফসোস হবে, বুক হাহাকার করে উঠবে।
হ্যাঁ, এটা অন্যায়—সে জানে। কিন্তু তিনি বদলাতে পারবেন না।
কারণ, যেটা তিনি পাননি, সেটা কাউকে দিতে চাইলেও দিবেন না। তিনি নিজেও নিজেকে খারাপ জানেন, তবুও নিজের খারাপত্ব আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকবেন। তবু নিজেকে আফসোস করতে দিবেন না।

হালিমা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নেন। তার চোখেমুখে একরকম অস্বস্তি। আর ঠিক তখনই সালমান হালকা হেসে বলল,
“যাই হোক মা, নিজের মায়ের মতো তো কেউ হয় না।
যেমন তুমি আমার জন্য সব করো, ঠিক তেমনি তো তোমার মা তোমার জন্য করতেন, আর দাদু – আমার বাবার জন্য। যেমনটা ঠিক এখন আমার জন্য করছো তুমি! তাই না মা?”

সালমানের কণ্ঠে ছিল না কোনো অভিযোগ, ছিল কেবল র দীর্ঘশ্বাস মেশানো সত্যের আর্তি।
হালিমা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। শেষকথাটা যেন তার ছেলে তাকে ইচ্ছে করেই বলেছে।
আজ তার ছেলের কথা, আচরণ, এমনকি দৃষ্টিভঙ্গিটাও যেন তার বোধের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
এই ছেলে তো তার চেনা সেই ছেলেটা নয়- যে ছোট্ট একটা কথায় সব ভুলে গিয়ে মায়ের কথায় উঠে দাঁড়িয়ে যেত, যে কখনো স্ত্রীর পক্ষ নিত না!

তিনি মনে মনে ফুঁসলেন।
‘গেলেই যাক, কয়েকটা দিনের মধ্যেই ছেলেকে তিনি আবার নিজের করে নিবেন। যেমনটা তার শাশুড়ি স্বামীকে করতো। ঠিক তেমন করে তিনিও ছেলেকে হাত করে নিয়ে নিবেন।’
তিনি মনে মনে ঠিক করলেন,আগে যেভাবে মুখ করে তাকে নিজের পক্ষে নিয়ে এসেছেন, আবারো তাই করবেন।

সালমান মায়ের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসলেন।
তার চোখে যেন এক নরম উপলব্ধি,এই মুহূর্তে রিমঝিমকে বাপের বাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্তটা ঠিকই হয়েছে।
উভয়েরই সময় দরকার। একটু নিজের মতো করে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দরকার। যাতে দুদিকেরই উপলব্ধি আসে।

রিমঝিম পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। শুনছে সব,বুঝে নিচ্ছে সবটাই। সে কিছু বলে না। কারণ এ তো এখন তার চিরচেনা অভ্যাস। কিন্তু সালমানেরটা তাকে ভাবিয়ে তুললে।
সে চোখ নামিয়ে নিয়ে চুপচাপ দরজার দিকে পা বাড়ায়।

রিমঝিম গাড়িতে উঠে বসে।
চোখে মুখে কোনো ভাব প্রকাশ নেই। পাশে এসে বসে সালমান, গাড়ি স্টার্ট দেয়।
শব্দ করে কিছু না বললেও রিমঝিমের ভিতরটা অদ্ভুত এক কৌতূহলে ছটফট করছে।
এই সালমানকে সে যেন চিনতেই পারছে না।
প্রতিদিনকার পরিচিত রুক্ষ, একরোখা স্বামীটি যেন আজ অন্য কারো মতো আচরণ করছে।
এত সহজে তাকে যেতে দিচ্ছে! তাও আবার নিজ হাতে ব্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে তুলে—এতটা নম্র আচরণ তার কল্পনাতেও ছিল না। তার উপর মাকে এতো এতো কথা!

গাড়ি চলছে, আর রিমঝিম চুপচাপ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে যাচ্ছে।
মনে মনে সে ভাবে,তার ইচ্ছে ছিল চুপিচুপি চলে আসবে। কোনো বিদায় নয়, কোনো ব্যাখ্যা নয়। এই সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছে বহুদিন ধরে জমে উঠেছিল তার মনে।
কিন্তু মেয়েদের সংসার ফেলে যাওয়া এতো সহজ নয়।

একটা সংসার মানেই শত বাঁধনের টান।
শুধু মানুষ না, জড়িয়ে থাকে স্বপ্ন, অভ্যাস, শিকড়—আর সমাজ নামের কঠিন এক দেয়াল।
যদিও সমাজের মুখগুলোকে সে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু তার মা? মায়ের কান্না, মায়ের উপদেশ, আর সেই মায়ের ইচ্ছার সামনে সে বারবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
আর এই সংসার…
কতটুকুই বা না জড়িয়ে পড়েছে সে!
শুধু রান্নাঘরের গন্ধ নয়, ঘরের প্রতিটা কোণ যেন তার হাতে গড়া।

তাই সে ভাবছিল, কয়েকটা দিন দূরে গেলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা নরম হবে, সালমান ভাববে, বুঝবে।
কিন্তু সালমান এমন করে নিজেই তার জন্য পথ করে দেবে—এইটা তার কল্পনারও বাইরে ছিল।

সে কিছু বলে না।
চোখ শুধু বাইরের দৃশ্যে আটকে থাকে।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার ভিতরটা ফুঁড়ে উঠছে একটাই প্রশ্ন—
এই বদলে যাওয়া সালমান, আজকে কি সত্যিই তাকে বুঝেছে? নাকি সবটাই শুধুই সাময়িক এক শান্তির ছায়া? নাকি এসেই আবার সেই আগের সালমানকেই পাবে! যে শুধুই তার শাশুড়ির ছেলে। তার স্বামী নয়!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।