রিমঝিম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুছাচ্ছিল। ঠিক তখনই সালমান রুমে এসে হঠাৎ বলল,
“তুমি চাইলে আজ বাপের বাড়ি যেতে পারো। কয়েকদিন ঘুরে এসো।”
রিমঝিম থমকে গেল। আয়নার ফ্রেমে ধরা নিজের মুখটা যেন কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। গলায় স্পষ্ট বিস্ময় টেনে সে শুধায়,
“কি বললে? আমি যেতে পারি?”
সালমান চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, একটু দূরে গিয়ে নিজের মতো করে থাকো। তোমারও তো বিশ্রামের দরকার।”
রিমঝিম চুপ করে গেল। এটা সেই মানুষ, যে বিয়ের পর তাকে যেন নিজের ছায়ার মতো আগলে রাখতো -কিন্তু সেটা যত্ন নয়, যেন কোনো দায়িত্বে বাধা। সে কোথাও গেলে আগেই জানিয়ে রাখতে হতো, অনুমতির তালগোল পাকিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে না যাওয়াই ভালো -এই ছিল সালমানের অভ্যেস।
বাপের বাড়ি যেতে চাওয়ার মানেই ছিল অজস্র প্রশ্ন, একরাশ অনিচ্ছা, আর কেবল একদিনের অনুমতি, তাও ‘মা’কে একা ফেলে না যাওয়ার শর্তে।
আজ হঠাৎ নিজে থেকেই যেতে বলছে?
কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে… বা নেই। হয়তো আর কিছুই নেই।
রিমঝিম আয়নার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে নেয়। ভেতরে ভেতরে সে জানে, এটা ভালোবাসার স্থানচ্যুতি নয়-মায়ার মুক্তি নয়-এটা একটা সাময়িক ছুটি।
সবকিছুর উর্ধে রিমঝিম ভাবলো, যাবেই। নিজের মনটাকে নতুন করে গুছিয়ে আনার জন্য সময় দরকার। তাই সে শান্ত গলায় বলে,
“ঠিক আছে। আমি যাবো।”
এমন করে হয়তো প্রথমবার-সে কারো অনুমতিতে নয়, নিজের সিদ্ধান্তে হাঁটছে একটা দরজার দিকে।
সালমান ওয়াশরুমে ঢুকে পড়তেই রিমঝিম ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শরীরটায় এখনও ক্লান্তি ভর করে আছে, তবু কোনো এক অদৃশ্য অভ্যাসের টানে সে হাঁটতে শুরু করল রান্নাঘরের দিকে।
চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে তরকারি চড়ে দিল। অন্য হাতে রুটি বানাতে শুরু করল। চুলার আঁচে হাতের রন্ধন আর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘামের বিন্দু -দুটোই একসাথে যেন জ্বলছিল।
এদিকে সালমান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে চারপাশে তাকায়-রিমঝিম কোথাও নেই। রুম ফাঁকা। হালকা অস্বস্তি নিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে এগোতেই চোখে পড়ে-রিমঝিম একা হাতে একদিকে তরকারি নাড়ছে, আরেকদিকে বেলনায় রুটি গড়াচ্ছে।
রান্নাঘরের ছোট্ট জায়গাটা ভরে গেছে চুলার তাপ আর মাটির গন্ধে। কিন্তু তার মাঝেই রিমঝিমের মুখে এক অদ্ভুত নীরবতা।
সালমান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হালকা কণ্ঠে বলে, “তুমি এখানে? শরীর তো এখনও ভালো না।”
রিমঝিম তাকায় না। রুটি বেলতে বেলতে চোখ স্থির রাখে মাটির দিকে। তারপর মৃদু একটা হাসি ঝরে পড়ে তার ঠোঁটে।
সালমানের প্রতুৎত্তর করে,
“তাই বলে নিয়ম ভাঙলে চলে?”
শব্দগুলো স্নিগ্ধ, কিন্তু কোথায় যেন ব্যথা গাঁথা।
সালমান তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সেই চিরচেনা মেয়েটা যেন আজ একেবারে অপরিচিত। তার হাসিটাও যেন কোনো অভিমান পেরিয়ে এখন কেবল অভ্যাসে দাঁড়িয়ে আছে।
রিমঝিম থামলো। হালকা অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,
“কেন, এগুলো কি আজ নতুন কিছু?”
“মানে?” সালমান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়।
রিমঝিম একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
“মানে, আমি যখনই বাপের বাড়ি যেতাম, ততদিনের জন্য রান্না করে হিসাব করে রেখে যেতাম। প্রতিদিনের মতো খেতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। তুমি যেন বুঝতেই না পারো আমি নাই।হাহা।”
সালমান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ।
রিমঝিমের বলা কথাগুলো যেন মাথার ভেতর ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে-প্রতিবার যখন সে বাপের বাড়ি যেত, তখন আগেভাগেই হিসেব করে রান্না করে যেতো।
তাই বুঝি সে চলে যাওয়ার পরেও প্রতিদিন সেই একই স্বাদের খাবার পাওয়া যেত?
সেদিন সকালে রিমঝিম বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে।
রাতে অফিস থেকে ফিরে খেতে বসেছিল সালমান। পাশে বসা মা ধোঁয়া ওঠা পাতিল থেকে চামচে করে একে একে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন তার প্লেটে। নিজেও পরে খেতে বসে পড়লেন।
সালমান প্রথম লোকমাটা মুখে নিয়েই থমকে গিয়েছিল।
এই তো সেই চেনা স্বাদ- যা রোজ প্রতিদিন খায়। অথচ, আজ তো রিমঝিম নেই!
তবে কি মা-ই প্রতিদিন রান্না করতেন? মা তো সবসময় এটাই বলতেন।
তখনো সালমান দ্বিধায় ছিল। মন বলত, রিমঝিম এমন নয়। একটা মুরব্বিকে দিয়ে এভাবে সে মোটেও কাজ করাবে না। সে নিশ্চয়ই রান্না করে, কারণ মেয়েটা কখনো অভিযোগ করেনি, কখনো কৃতিত্ব দাবি করেনি।
কিন্তু মা যখন বলতেন, “প্রায়ই আমি রান্না করি। তোর বউ তো সবসময় পারে না”—তখনও একরকম মায়ের কথা বিশ্বাস করেই নিয়েছিল সে।
শুধু কারণ, সেই সময় তার মনটাও একটু একটু করে রিমঝিমের ওপর থেকে সরতে শুরু করেছিল।
আজ, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সালমান নিজেরই স্মৃতিকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
তার মনে হচ্ছে-রিমঝিমই প্রতিবার, প্রতিদিন নিঃশব্দে এই ঘরটাকে আগলে রেখেছিল।
এমনকি নিজের অনুপস্থিতিতেও, তার জন্য রান্না করে যেত, যেন খাবারের স্বাদে কোনো ফাঁক না থাকে।
এত বছর ধরে সেই খাবারে যে মায়া, যত্ন, ভালোবাসার স্পর্শ সে অনুভব করেছে, সেটা তো কারও আদেশে তৈরি হয়নি।
এটা ছিল একান্ত রিমঝিমের নিরব ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
সালমানের বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।
সে চোখ তুলে তাকাল রিমঝিমের দিকে -এক হাতে রুটি বেলছে, আরেক হাতে তরকারি নেড়ে দিচ্ছে।
মুখে হাসি, কিন্তু সেই হাসিতে একটা ক্লান্তির ছাপ।
একটা অপমানিত, অবহেলিত অথচ হৃদয়ভরা স্ত্রীর অসীম সহ্যশক্তির চিহ্ন যেন ফুটে আছে তার চোখে-মুখে।
সালমান আর কিছু বললো না। শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো মনে মনে—
“তাকে আমি কীভাবে দেখেছিলাম এতদিন? যে মেয়েটা নিরবে আমাকে আগলে রেখেছে, আমি তাকেই ভুল বুঝেছি। সত্যিই, আমি মানুষটাকে বুঝতে পারিনি।”
সালমানের মনে হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড়ে। সেদিন রাতে তার মাকে জিজ্ঞেস করার দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠে।
সেদিন রাতে খাবার চিবোতে চিবোতে সালমান থেমে গেল। চেনা স্বাদ মুখে এলেও মনটা কেমন খচখচ করছিল। চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখল মা বসে আছেন, ঠিক আগের মতোই ধোয়া ওঠা পাতিল থেকে খাবার তুলে দিয়েছেন তার প্লেটে।
সালমানের ভুরু কুঁচকে উঠল। কিছু একটা মিলছে না।
সে ধীরে কণ্ঠে শুধায়,
“খুব মজা হয়েছে খাবার… কিন্তু মা, রান্না কে করেছে?”
সালমান চুপচাপ তাকিয়ে রইল। এরপর খানিকটা থেমে আবার বলল,
“কিন্তু প্রতিদিনের মতো একই স্বাদ পাচ্ছি। একটুও হেরফের নেই। এটা কেমন করে সম্ভব?”
মুহূর্তের জন্য হালিমা বেগম থমকে গেলেন। তারপর গলার স্বর কড়া করে বললেন,
“তোর বউ তোরে যা খুশি তাই বোঝায়, আমি বলছি, প্রায়ই আমি নিজে রান্না করি। তাই তো স্বাদ একই পাচ্ছস। তোর বৌ এর প্রতিদিনের কারসাজি তো তোর তো জানাই নেই!”
সালমান তখন তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর না দিলেও আজ হারে হারে সব বুঝতে পারলো। মনে মনে অতীতের পাতা উল্টিয়ে কিছু একটা বুঝতে পেরে তার মধ্যে অনুশোচনা এলো।
সেইসব দিনগুলো, যখন রিমঝিম নিরবে সব দায়িত্ব পালন করতো।
সে বলতো না কিছু, দাবি করতো না কিছু।
তবুও রান্না থেকে শুরু করে ঘর সামলানো-সব কিছুতে ভালোবাসার ছাপ থাকতো।
কিন্তু মা?
তিনি কখনো স্বীকার করেননি,বরং এক ধরনের প্রতিযোগিতা চালিয়েছেন অদৃশ্যভাবে। নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে ছেলের স্ত্রীকে ছোট করতে কোনো কসুর করেননি।
আর সালমান?
সে চুপ থেকেছে। প্রশ্ন করেনি কিছু।চুপচাপ মায়ের কথা বিশ্বাস করেছে। একটা সময়, যখন সন্দেহ হয়েছিল-তখনও স্পষ্ট করে রিমঝিমকে কিছু না বলে মনে মনে কষ্ট পুষে রেখেছিল।
আজ বুঝতে পারছে—সে আসলে ভালোবাসার বদলে অবহেলাকেই পুরস্কার হিসেবে ফিরিয়ে দিয়েছে রিমঝিমকে।
চোখের কোণে একটা দগদগে লজ্জা এসে ভিড় করে।
আর মনে হয়—”আমি নিজেই তো কখনো জানতেই চাইলাম না, কে প্রতিদিন আমার জন্য এই মায়া মেখে রান্না করতো।
আমি যদি একবারও জিজ্ঞেস করতাম, তাহলে কি আজ এতটা দেরি হয়ে যেত?”
সালমান বাস্তবের মধ্যে ফিরে এল। গত রাতের স্মৃতি যেন এক টান দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনল -তখনও রিমঝিম তার প্রতি যত্নবান ছিল, আর সে? তার চোখে ছিল শুধু অবিশ্বাস আর মায়ের প্রতিটি কথা। আজ, সব পরিষ্কার। আজ সে দেখতে পাচ্ছে—রিমঝিম-ই প্রতিবার নিঃশব্দে দায়িত্ব পালন করে গেছে। কাল ডাক্তার যদি রিমঝিমের মেন্টালি ডিসটার্ব এর কথা না বলতো তাহলে হয়ত সে কোনোদিন ঐভাবে রিমঝিমকে খুঁটিয়ে দেখতোই না!
সালমান ভাবনা থেকে বেরিয়ে রিমঝিমের দিকে তাকায়। রিমঝিম তখন অসুস্থ শরীর নিয়ে একে একে টিফিন বক্সগুলো ভরছে। প্রতিটি বক্সে পরের কয়েকদিনের খাবার হিসেব করে গুছিয়ে রাখছে।
সালমান নরম স্বরে শুধায়,
“তুমি কি সত্যিই প্রতিবার এরকম করতে?”
রিমঝিম সংক্ষেপে বলে,
“হ্যাঁ।”
তারপর আর কিছু না বলে ফ্রিজের দরজা খুলে একে একে বক্সগুলো রাখতে শুরু করে। সালমান তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মলিন শ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে রিমঝিমের হাতে আলতো করে স্পর্শ করে,
“তুমি না অসুস্থ? তোমার বিশ্রাম দরকার। এত কিছু করতে যেও না, প্লিজ।”
রিমঝিম একবারও তাকায় না। শুধু শান্ত গলায় বলে,
“তোমার মায়ের জন্য আগামী ক’দিনের খাবার। উনি আর তুমি যেন খাবারের কষ্ট না পাও, এজন্যই করছি।”
ঠিক সেই মুহূর্তে হালিমা বেগম দ্রুত পায়ে এসে হাজির হন রান্নাঘরে।
ছেলেকে বৌয়ের হাত ধরা অবস্থা ময় দেখে তিনি ফুষে উঠেন। চোখে আগুন, কণ্ঠে কটাক্ষের ছোঁয়া ঢেলে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“তুমি কেন অসুস্থ শরীর নিয়ে এসব করতে যাচ্ছ? আমার ছেলের সামনে আমাকে ছোট করে দেখাতে চাইছো? যেন আমি কিছুই করি না?”
রিমঝিম ধীরে ফিরে তাকায়, ক্লান্ত গলায় বলে,
“আম্মা, আমি এমন কিছু বলিনি। আর দেখানোর কিছু নেই, আপনি তো প্রতিবার নিজেই এমন করে সব রেখে যাওয়ার জন্য বলতেন।”
হালিমা বেগম ছেলের দিকে এক পলক তাকান। এরপর রিমঝিমের উদ্দেশ্যে তোতলানো কণ্ঠে শুধায়,
“কখন বলেছি এসব করে রেখে যেতে?” এরপর এর প্রতুৎত্তর রিমঝিমকে দেওয়ার সময় না দিয়ে নিজেই বলে উঠলেন,
“আগবাড়িয়ে এসব করে আর ভালো সাজতে হবে না। যেখানে যাওয়ার সেখানে যাও।”
সালমান চুপ করে সব শুনছিল। এই প্রথম, তার চোখে নিজের মা সম্পর্কে এক অনুচ্চারিত প্রশ্ন জেগে উঠলো।
সে কিছু না বলে ধীরে ধীরে সরে আসে রান্নাঘর থেকে।
ভেতরে কোথাও অদৃশ্য কষ্ট খোঁচা দিচ্ছে।
একসময় যে মা’কে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতো, আজ তার প্রতিটি কথায় প্রশ্ন উঠছে।
আর যে স্ত্রীকে কখনো বোঝার প্রয়োজন মনে করেনি-তার নিঃশব্দ দায়িত্ববোধ আজ বুকের গভীরে গেঁথে যাচ্ছে।
রিমঝিম স্থির দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তোলে সালমানের দিকে তাকিয়ে বেশ শান্তস্বরে শুধায়,
“তোমার না, বিয়ে করা উচিতই ছিল না। তুমি মায়ের ছেলে হয়েছো ঠিকই কিন্তু এখনো মানুষ হওনি, স্বামী হওয়ার তো অনেক পরের কথা।”
তারপর ধীরে তাকায় হালিমা বেগমের দিকে। বিষাদে ভেজা কণ্ঠে শুধায়,
“আর আপনার উচিত ছিল, আপনার ছেলেকে আজও কোলে করে রেখে দেওয়া। কাউকে জীবনের সঙ্গী বানাতে পাঠানো নয়। বিয়ে করিয়ে বড়ো ভুল করেছেন। আর সেই ভুলের খেসারত আমি দিচ্ছি। আমি আপনাদের অভিশাপ দিচ্ছি না। কিন্তু যেদিন আপনার মেয়ের সাথেও কেউ এমন করবে- সেদিন বুঝতে পারবেন, কতোটা অন্যায় করেছেন একজন মেয়ের সাথে।”
রিমঝিনের কড়া কড়া কথায় হালিমা বেগমের চোখ কুঁচকে ওঠে। তিনি ধমকের ভঙ্গিতে বলেন,
কিন্তু সালমান চুপ। সে শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রিমঝিমের দিকে। চোখে বিস্ময়, অপরাধবোধ আর একফোঁটা অনুশোচনা। এই মেয়েটা – যে দুবছর ধরে মুখ বুঝে সহ্য করেছে, সে আজ এতো শক্ত হয়ে গেল কীভাবে?
এক মুহূর্তে তার মনে পড়ে, প্রথম প্রথম রিমঝিম কেমন ছিল ; নরম, নিঃশব্দ, একটু হাসলেই যেন চোখে আলো পড়ে যেতো। আর এখন? মুখে বিষ, চোখে বিদ্রোহ! ওর এই রূপের গড়ন কি তারাই নয়? সে আর তার মা?
সে নিঃশ্বাস ফেলে। কিছু বলার ছিল, কিন্তু কোনো ভাষা খুঁজে পায় না।
রিমঝিম ধীর পায়ে রুমে চলে যায়। দরজা বন্ধ হয়ে যায় উচ্চশব্দে।
হালিমা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সালমান কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে রিমঝিমের রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মুহূর্তপরে সে যেন নিজেই নিজের অজান্তে কয়েক পা রিমঝিমের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। কণ্ঠে একটুকরো অনুশোচনা ভেসে ওঠে, “রিমঝিম…”
এইটুকু উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই হালিমা বেগম তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে যান। কণ্ঠে রাগ আর অপমানের ঝাঁজ,
“তুই কি পাগল হইছোস সালমান? তোর ওই বেয়াদব বউকে শাসন করবি তা না করে উল্টো ডাকতে ডাকতে ওর পেছনে যাস? ছেলের বউয়ের কথায় এভাবে নত হইতে হয়?ছেলেমানুষ এমন হইলে চলে না।”
সালমান একদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মুখে আর আগের সেই চিরচেনা নির্ভরতা নেই, বরং কিছুটা ক্লান্তি আর স্পষ্ট উপলব্ধি।
“তুমি কি জানো, সে বেয়াদব হয়ে উঠেছে কার জন্য? আমরা তাকে বাধ্য করেছি, মা। তুমি,আমি—আমরাই তো ওর নরম মনটাকে পিষে পিষে এমন বানিয়ে দিয়েছি।”
হালিমা বেগম কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সালমান থামিয়ে দেয়।
“সত্যিই তো! ভেবে দেখেছ কখনো? আজ যদি এটা তোমার মেয়ের সাথেও কেউ বলতো—যে, ‘তুই নিচু জাত’—তখন কি তুমি চুপ থাকতে? তখন কি বলতে, ‘বউদের সব সহ্য করতে হয়’?”
কথাগুলো শেষ করেই সালমান ধীরে হেঁটে চলে যায় রিমঝিমের রুমের দিকে।
হালিমা বেগম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। গলা কেঁপে ওঠে। এরপর বিছানার পাশে বসে হঠাৎ করেই মুখ চাপা দিয়ে বিলাপের মতো কেঁদে ওঠেন।
“ওগো আল্লা, এ আমি কী কইরা ফেললাম! ছেলেও আমারে কথা কইতে ছাড় দেয় না…!”
—–
সালমান রুমে ঢুকতেই রিমঝিমকে এক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। তার চোখে অনুশোচনা। কণ্ঠে এক ধরনের নম্রতা টেনে নিয়ে সে শুধায়,
“রিমঝিম… আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার… ঐরকম রিঅ্যাক্ট করা উচিত হয়নি।”
রিমঝিম ধীরে ফিরে তাকায়। চোখে হতাশা জমাট। কিন্তু কণ্ঠে ক্ষীণ স্থির ঝাঁজ রেখে সে প্রত্যুত্তর করে,
“হিসাব করে দেখো তো? মানুষ ভুল কয়বার করে? এই দুই বছরে তুমি ভুল করছো নিয়ম করে, মাসে নয়—প্রায় প্রতিদিন। তুমি ক্লান্ত হচ্ছ না?”
সালমান ব্যাকুল হয়ে এক কদম এগিয়ে আসে, যেন কাছে গিয়ে বোঝাতে চায়, সান্ত্বনা দিতে চায়। কিন্তু রিমঝিম হাত তুলে থামিয়ে দেয়।
“থাক। আর দরকার নেই। সেই একই নাটক বারবার না করলেও চলবে। তুমি ক্লান্ত না হলেও আমি ক্লান্ত। আমি বিরক্ত, আমি বিদ্ধস্ত। তুমি এখন স্যরি বলবে, তারপর কালকে আবার মায়ের পক্ষ নেবে। আবার বলবে, ‘ক্ষমা করে দাও রিমঝিম’। এসব আর ভালো লাগে না। এবার থামো।”
সালমান স্তব্ধ। কণ্ঠে বিস্ময়ের ছোঁয়া, “আমি নাটক করছি? তুমি এটা বলতে পারলে?”
রিমঝিম কণ্ঠ নামিয়ে ঠান্ডাভাবে বলে, “হ্যাঁ। যদি এভাবে মায়ের আঁচলের নিচে থাকার সিদ্ধান্ত আরো আগে নিতে,তাহলে বিয়ে না করে সেখানেই থেকে যেতে পারতে!” বলেই একটু থেমে দম নেয়। কণ্ঠটা হাল্কা কেঁপে উঠলেও সে নিজেকে সামলে আবার বলা শুরু করে,
“সংসার মানে শুধু বউ নয়, শুধু মা-ও নয়। ব্যালান্স রাখতে হয়, সালমান। প্লিজ এটা বুঝো। আজ যদি তোমার বোনের সাথে এমন কিছু হতো—এক বউ হয়ে তাকে কেউ এভাবে ছোট করতো—তাহলে তুমি ভাই হয়ে এটা কী মেনে নিতে?”
রিমঝিম কথাটা আস্তে বললেও সালমানের মনে হলো ; কথাটার রেশ যেন ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সে চুপ করে রইল।
রিমঝিম আরো কিছু বলতে নেয়ার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতে নিতেই হঠাৎই রিমঝিমের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আসে। সে কপাল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মুহূর্তখানেক। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা লাগে।
সালমান বিস্ময়ে ডেকে ওঠে, “রিমঝিম?”
রিমঝিম কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ তার হাঁটু ভেঙে পড়ে যেতে থাকে। সালমান দৌঁড়ে এসে তাকে ধরে ফেলে, “এই! রিমঝিম! কী হলো তোমার?”
ভোরের আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে। রিমঝিমের ঘুম ভাঙলো কারো ধাক্কাধাক্কিতে। সে তড়িঘড়ি করে চোখ খুলতেই হঠাৎই চারপাশটা চিনে উঠতে একটু সময় লাগে। নিজেকে আবিষ্কার করে ব্যালকনিতে।
রাতে গ্রিলের সঙ্গে মাথা রেখে হয়ত কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে খেয়াল নেই। ভেজা চোখ, ক্লান্ত শরীর আর গুমোট অভিমান হয়ত ঘুমের দিকে টেনে নিয়েছিল।
গ্রিলের কাছে মাথা রেখে ঘুমানোর ফলে কান ধরে ওঠা ব্যথা যেন মাথার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, তবু সে সেই ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে পাশে তাকায়।
সালমান দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে আছে স্পষ্ট।
রিমঝিমকে উদ্দেশ্যে করে ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে,
“আমার অফিস টাইমও তো দেখি ভুলতে বসেছো। বলেছি না, আজ মিটিং আছে? খালি পেটে যেতে হবে দেখছি!”
রিমঝিম হকচকিয়ে ওঠে। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়, মুখে কথার আগা-গোড়া গুছিয়ে বলার আগেই বলে ওঠে,
“আসলে রাতে…”
কিন্তু সালমান তার কথা থামিয়ে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে,
“উফফ, তোমার সেই রাতের ড্রামা শুনতে ইচ্ছে করছে না এখন। আপাতত আমার খাবার চাই।”
এই কথাটা রিমঝিমের বুকে যেন কাঁটা হয়ে বিঁধে যায়। সে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তবু মুখে কিছু না বলে নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
“তুমি একটু অপেক্ষা করো… আমি কিছু বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
তার গলার কম্পন সালমান হয়ত শুনতেই পায়নি! সে কাপড় নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে ,আর রিমঝিম হৃদয়ে জমে থাকা অগণিত অপমানের ভার নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
আজ সকালটাও বুঝিয়ে দিল -এই সংসারে ভালোবাসার জায়গা তার জন্য বরাদ্দ নেই। তবু তার নিয়ম করে প্রতিদিনের ন্যায় খাবারের হাঁড়িতে পানি ঢালতে হবে,কারণ – এখানে কান্নার চেয়ে পেট ভরানোটা অনেক বেশি জরুরি।
রিমঝিম চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
শরীর ক্লান্ত, মন ভাঙা, কিন্তু হাত থামলে সংসার থেমে যাবে –
এই ভয়টা এতদিন ধরে পেয়ে এসেছে।
কিন্তু রান্নাঘরের চৌকাঠ মাড়াতেই হালিমা বেগমের কণ্ঠ যেন বজ্রাঘাতের মতো আঘাত হানলো তার কানে,
“মহারানীর অবশেষে ঘুম ভাঙলো বুঝি! আমার ছেলেটার অফিস আছে আর সে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। এখন রান্না করবে কখন? আমার ছেলেটা ক্ষুধার্ত পেটে অফিসে যাবে, এই তো অবস্থা!”
শাশুড়ির কথায় এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস আটকে গেল রিমঝিমের। কথাগুলো মাথার মধ্যে গুঁড়ি মেরে থাকা আবেগগুলোকে জাগিয়ে তুললো।
আজ আর সে নীরব থাকলো না। চোখেমুখে জমে থাকা অভিমান, অপমান আর ক্লান্তির ছাপ নিয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে কড়াভাষায় বলে উঠল,
“আপনার ছেলের দায়িত্ব কি শুধু তার বউয়ের? আপনি তো তার মা! শুনেছি, বউয়ের চেয়ে মায়ের দায়িত্ব আগে। আমি না এলে আপনি করে দিতে পারতেন না?”
মুহূর্তে ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হালিমা বেগম যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না নিজের কানে। একটু থমকে দাঁড়িয়ে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বোঝায় যাচ্ছে, রিমঝিমের মতো নরম মেয়ের কাছ থেকে এমন হুট্ করে জবাব আশা করেননি উনি।
দীর্ঘক্ষন পরে হুঁশ ফিরতেই হালিমা বেগম মুখ ভেংচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন বিলাপের সুরে,
“এই মেয়ে এখন আমার মুখে মুখে তর্ক করে! বাড়ির বউয়ের আওয়াজ থাকার কথা ঘরের ভেতরে, সে এখন রেঁধে খেতে শেখার বদলে আমাকে শেখায়!”
রিমঝিম শীতল গলায় জবাব দিল,
“আমার আওয়াজ বাইরে যায়নি আম্মা। আপনার আওয়াজই তো পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে।”
হালিমা বেগম থেমে গেলেন। নরম মেয়ে হুট্ করে এমন শক্ত হয়ে উঠাটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না।
রিমঝিম আর কোনো কথা বাড়াল না। চুপচাপ পা টেনে রান্নাঘরে চলে গেল। কিন্তু আজ তার ভেতরের নীরবতা আর আগের মতো নিষ্ক্রিয় না, বরং যেন তাতে জমাট অভিমান আর একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত জন্ম নিয়েছে।
এইভাবে আর নয়। যে ক’দিন আছে, নিজেকেই ভালোবাসবে। নিজেকেই গুরুত্ব দেবে।
রিমঝিম হাতে তুলে নিল সবজিগুলো। দুয়েকটা মেনু নয়, বরং সে আজ কয়েক পদ রান্না করলো।
নিজের পছন্দের মতন, যত্ন করে, সময় নিয়ে।
সে জানে, এই ঘরে তার কথা কেউ ভাবে না।
তাই এবার সে নিজেকে নিয়েই ভাববে।
রান্না শেষ করে, সালমানের জন্য খাবার সাজিয়ে দিল।
সালমান গম্ভীর মুখে এসে বসলো।vঅফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে আর কাউকে ডাকলো না সে। এমন কি হালিমা বেগমকেও না।
চুপচাপ তাড়াহুড়োয় সে খেতে লাগলো।
না কোনো অভিযোগ, না কৃতজ্ঞতা।
শুধু নিজেরটা বুঝে নেয়া,এটাই যেন তার অভ্যাস।
রিমঝিম একটুও পাত্তা দিল না এই নীরব প্রতিক্রিয়াগুলোকে। সালমান খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতেই রিমঝিম চুপচাপ নিজের প্লেট নিয়ে টেবিলে বসে পড়লো।
ধীরে ধীরে আয়েশী ভঙ্গিতে খেতে খেতে একসময় হালকা একটা ঢেকুর তুললো। শরীর একটু শান্তি পেলেও, মন ততটা না।bতবু একটা গভীর প্রশান্তি তার চোখে মুখে – নিজের হাতে রান্না করে, নিজের জন্য খাওয়া – সেই অধিকারটুকু আজ সে ছিনিয়ে নিয়েছে।
ঠিক তখনই হালিমা বেগম ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। চোখে তীব্র কৌতূহল আর অভিমান।
দীর্ঘ সময় কেউ না ডাকায় তিনি নিজেই আজ আগবাড়িয়ে বের হলেন।
আর বেরিয়ে দেখলেন- রিমঝিম টেবিলে একা বসে খাচ্ছে।
আর নিজের মতো করেই সন্তুষ্টিতে ঢেকুর তুলছে।
হালিমা বেগম আশেপাশে দৃষ্টি দিলেন। ছেলে তার কোথাও নেই। তার মানে! সালমান আজ একা একা খেয়ে বেরিয়ে গেছে! তাকে একবার ডাকলোও না!
তিনি আপন ভাবনায় মশগুল হলেন, তার ছেলেকে এই মেয়ে রাতে কিছু করেনি তো? নাহয়, সকালে উঠে এতো ফটর ফটর করে কোন সাহসে! বিয়ের এই দুইবছর তো কোনোদিন চোখ তুলে কথা বলেনি – সেই মেয়ে আজ এতো কথা! তার উপর, ছেলে আজ তাকে একটাবার খাওয়ার জন্যও ডাকলো না!
এসব ভেবে মনের মধ্যে ছেলের উপর অভিমান আসতেই মুহূর্তে তিনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন। এতো সহজে তার মা ভক্ত ছেলেকে ঐদিকে নিতে দেওয়া যাবে না। আসুক আজ সন্ধ্যায়। আপাতত এখনেরটা দেখা যাক।
হালিমা বেগম এগিয়ে গেলেন। তাদের চোখাচোখি হলো।
কিন্তু আজ রিমঝিম চোখ সরিয়ে নিল না। সে আপনমনে খেতে ব্যস্ত। চোখের ভাষায় যেন স্পষ্ট বলে দিল –
“এবার আমি আমার মতো করে বাঁচবো।”
হালিমা বেগম ধীরপায়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এলেন।
রিমঝিম তখনো নিজের প্লেট থেকে শেষ খাবার তুলছে মুখে।
হালিমা বেগম চেয়ারে বসে পড়েই বলে উঠলেন,
“কাল এই বাড়িতে তামাশা কম হলো নাকি! আর তুমি আজ দেখি আগে আগে খেয়েও নিচ্ছো! যাও তো, আমার নাস্তা আনো দেখি!”
“মানে? আমি খাবো না?” -চোখ কুঁচকে উত্তর দিলেন হালিমা বেগম।
রিমঝিম মৃদু হাসলো, কিন্তু সে হাসির নিচে চাপা পড়া অভিমানটা স্পষ্ট।
“আপনি খাবেন?”
“কী বলতে চাইছো তুমি? আমার সাথে মশকারা করছো তুমি?”
রিমঝিম এবার স্পষ্ট গলায় বলল,
“কাল রাতে আপনি আমাকে খেতে দেননি। এমনকি ইঙ্গিতে বলেছিলেন, আমি নিচু জাত। তাহলে সেই নিচু জাতের রান্না করা খাবার খেলে তো আপনার গায়ে লাগতেও পারে! তাই, আপনার কথা ভেবেই আজ আপনার জন্য কিছু বানাইনি, আম্মা।”
হালিমা বেগম থ হয়ে গেলেন। এমন কথা শোনার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রাগে আবার মুখ খুললেন,
“বাড়াবাড়ি কইরো না। যাও, আমার খাবার দাও।”
রিমঝিম এবার আর একচুলও সরলো না। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আপনি কি অসুস্থ আম্মা?”
“মানে?”
হালিমা বেগমের প্রশ্নে রিমঝিম স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“আপনার তো হাত-পা দিব্যি সবল আছে, আম্মা। নিজের জন্য কাজ করুন। কারণ যখন বয়স হবে, আর হাত-পা অবশ হয়ে যাবে – তখন কেউ এসে থালায় সাজিয়ে খাওয়াবে না। তখন আপনার এই অহংকারও আপনাকে ভাত তুলে দেবে না।”
এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো টেবিলে। রিমঝিম প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
রিমঝিম চেয়ারে বসেই একবার তাকালো হালিমা বেগমের দিকে। নিজেকে ছোট করে আর কারো অহংকারের খাদ্য হতে দেবে না সে।
সে প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে উঠল,
“যাকে আপনি ছেলের বউ করে আনতে চাইছেন, সে ভুল করেও কখনো কোনো অচল মানুষকে টেনে বাঁচাবে না, আম্মা। আপনার শরীর যদি একদিন চলতে না পারে, তখন সে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে।”
হালিমা বেগম বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। মুখে কোনো শব্দ নেই।
“আমি সব জানি। আপনি যা লুকিয়ে রেখেছেন, তা অনেক আগেই জেনেছি। চিন্তা করবেন না, এই অসুস্থ পরিবেশে আমি আর বেশিদিন থাকবো না। আপনার উদ্দেশ্য সফল হোক, এটাই চাই। ততদিন… দয়া করে আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। নাহয়, আমি অন্য ব্যবস্থার সাব্যস্ত হবো।”
কথাটা বলেই রিমঝিম ধীরে ধীরে টেবিলে রাখা বাকী খাবার প্লেটে তুলে নিল।
হালিমা বেগম চেয়ারে বসা অবস্থায় ঘামলেন। নীরবতার ভেতর চামচের আওয়াজও তখন যেন তার কাছে কর্কশ মনে হচ্ছিল।
রিমঝিম সব গুছিয়ে নিজের প্লেট নিয়ে সে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। পিঠ সোজা, চোখে জল নেই, কিন্তু বুকের ভেতর কষ্টটা জমে জমে শক্ত হয়ে উঠেছে।
নিজেকে সে আজ একটু বেশিই ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
‘সবসময় নরম থেকে জীবন চলে না।
কারো সম্মানের জন্য নিজের অপমান মেনে নেওয়া দুর্বলতা নয়—কিন্তু বারবার একই জায়গায় নিজেকে হারানোটা বোকামি।’
হালিমা বেগম চুপচাপ রিমঝিমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
রিমঝিমের হেঁটে চলে যাওয়া, দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ,সবকিছু যেন এক অলিখিত চাবুক হয়ে এসে আঘাত করলো তাঁর গায়ে।
—
সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছিল ঘরের কোণায়।
রিমঝিম একা বসে ছিল টেবিলের পাশে।
চোখের সামনে আচারের বয়ামগুলো সারি করে সাজানো।
একটা একটা করে ঢাকনা খুলে যাচ্ছিল আর একটা একটা থেকে চামচ তুলে মুখে দিচ্ছে। লেবুর আচার, আমের আচার, ঝাল কুল, আর নিজের হাতে বানানো মিষ্টি টক জাম। সবগুলো থেকে পরপর চামচ মুখে পুরে তৃপ্তির সহিত ঢেকুর তুলছে।
সে নিঃশব্দে আপনমনে খেয়ে যাচ্ছে।
“চলে যাবো যখন,আমার হাতে বানানো কিছু দিয়ে অন্যরা মুখ মিঠা করবে, সেটা কেন হবে?”
ভাবনাগুলো কাঁটার মতো খচখচ করছিল বুকের ভেতর। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সে পরপর আচারভর্তী চামচ মুখে তুলছে।
হঠাৎ…একটা থা’প্পড় এসে সজোরে পড়ে গালে।
তার চোখ কেঁপে উঠল। আচারের একটা বয়াম টেবিল থেকে পড়ে গড়িয়ে গেল। মেঝেতে ঠুকে “টুক” করে একটা শব্দ হলো।
সে ধীরে ধীরে চোখ তুলতেই দেখে সালমান দাঁড়িয়ে আছে। রক্তচোক্ষু দৃষ্টিতে চেহারায় ঘৃণা নিয়ে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
কিন্তু রিমঝিম কেঁদে উঠল না। চোখ ভর্তি জল নিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। না কোনো প্রশ্ন,না প্রতিবাদ।
শুধু গালে লালচে ছাপটা জ্বালিয়ে যাচ্ছে হাল্কা।
সেই যন্ত্রণার চেয়ে বড় যন্ত্রণা ছিল এই নীরব অপমান – যেটা সে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম।)
#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৩
সালমান গর্জে উঠল,
“তুমি আম্মার সাথে এরকম কেন করেছো?”
রিমঝিম স্থির চোখে তাকিয়ে শুধায়,
“কি করেছি?”
“কী করেছো জানো না?”
রিমঝিম শান্ত গলায় বলে,
“তুমিই বলো, কি করেছি আমি?”
“মায়ের জন্য রান্না করোনি কেন?”
রিমঝিম এবার চোখে একরাশ হতাশা নিয়ে বলে,
“তোমার আম্মা আমাকে খাবার ছাড়া রেখেছে একদিন। আমাকে নিচুজাত বলেছে। মুখে মুখে তর্ক করা মেয়ে বলেছে। সেই বেয়াদব মেয়ের হাতের রান্না খেতে তার গায়ে লাগবে না? তাই করিনি রান্না।”
রিমঝিম হালকা হেসে, গলার নিচে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা ঠেলে বলে,
“সব লজ্জা বাড়ির বউদেরই কেন হবে, সালমান?”
সালমান এবার এক ধাপ এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“একদিনেই মুখ বেশি চলছে তোমার।”
রিমঝিম আর চুপ থাকল না। ভাঙা গলায় জেদে ঠাসা সুরে বলল,
“তোমরাই বাধ্য করেছো আমার মুখ চালাতে। খেয়াল করে দেখো – আমি কি আগে এমন করেছিলাম? দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ আর পিছিয়ে যেতে পারে না। তখন সামনে এগোনো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আমিও আর পিছু হটতে পারছি না।”
রিমঝিমের কথার অর্থ সালমান বেশ বুঝলো। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একটু নরম হয়ে প্রশ্ন করে,
“বেশি বাড়াবাড়ি করছো না?”
রিমঝিম তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলে,
“সবসময়ই আমারটাই বাড়াবাড়ি হয়, তাই না? দু’বছর ধরে শুধু দিয়েই গেলাম। অথচ বিনিময়ে তো কোনো মনই পেলাম না।”
এই একটুকু কথায়, এতক্ষণ কঠিন মুখোশের আড়ালে থাকা রিমঝিম যেন মুহূর্তেই গলে যায়। চোখের কোণে জমে থাকা কষ্ট ফুঁপিয়ে উঠে বেরিয়ে আসে।
সালমান সুযোগ বুঝে রিমঝিমের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, চুপচাপ হাত রাখে রিমঝিমের গালে। তাতেই যেন রিমঝিমের সব ক্ষোভ, অভিমান, গলায় আটকে থাকা কান্না ঝরে পড়ে।
ভেজা গলায় রিমঝিম ফিসফিস করে বলে,
“তুমিও আমাকে সবসময় ভুল বুঝো। তুমি অন্তত যদি আমাকে বুঝতে, আমি কখনো এমনটা করতাম না।”
সালমান এবার একটুখানি হেসে আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“সারাদিন অফিস করে এসে এসব টানাপোড়েন আর ভালো লাগে না। তুমি একটু নরম হয়ে মাকে শুধিয়ে দিতে পারো না?”
সালমান এবার একটু গভীর হয়ে বলে,
“উঁহু, আরো পারতে হবে। আমি জানি তুমি পারবে।”
বলেই সে রিমঝিমকে আলতো করে বুকে টেনে নেয়।
রিমঝিমও নির্ভরতার সেই ছায়ায় ঢুকে পড়তেই
সব অভিমান, সব রাগ – নিমেষেই গলে পড়ে যায়।
——-
রাতের খাবারটা রিমঝিম ফুরফুরে মেজাজে নিজেই রান্না করেছিল। একে একে টেবিলে সাজিয়ে রেখে সালমানকে ডেকেছিল খেতে। সালমান এসে মাকে ডেকে নিয়ে এলো, তারপর দু’জনেই টেবিলে বসে পড়লো।
সালমান নিজের হাতেই হালিমা বেগমের প্লেটে খাবার তুলে দিল। নিজেও চুপচাপ খেতে শুরু করলো।
কিন্তু হালিমা বেগমের মুখ কঠিন। তিনি ঠোঁট শক্ত করে রেখেছেন। একবারও কোনো খাবার হাতে তুললেন না।
মুখে খাবার তুলবেন না ঠিকই, কিন্তু ছেলের পাশ থেকেও নড়বেনও না।
এই নীরব অনাস্থার মাঝে ছেলের মুখ থেকেও হাসি ঝরে গেল।
এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত – তারপরই সালমান ধীরে ধীরে মুখ তুলে কড়া চোখে রিমঝিমের দিকে তাকায়। সে দাঁড়িয়ে ছিল একটু দূরে।
সালমান ধীরকণ্ঠে আদেশের ভঙ্গিতে বলে,
“মায়ের কাছে ক্ষমা চাও। এক্ষুনি।”
রিমঝিম কিছুটা বিস্মিত হয়। চোখে বিস্ময়ের ছায়া।
শান্ত গলায় জবাব দেয়,
“উনার হয়ত বদহজম হয়েছে। তাই খাচ্ছেন না। এখানে আমি কেন ক্ষমা চাইবো?”
সালমানের কণ্ঠে রাগ বাড়তে শুরু করে। সে কিছু বলবে বলেই মুখ খুলেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে হালিমা বেগম নিজেই বলে উঠলেন,
“থাক বাবা, আমার জন্য তোদের মধ্যে অশান্তি করিস না। আমি পানি মুড়ি খেয়ে রাত কাটিয়ে দিবো।”
তার কণ্ঠে অভিমান, চোখে জল জমে আছে।
সালমান এবার চুপ করে গেলেও দৃষ্টিতে অনুযোগ স্পষ্ট।
সে ধীরে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে কড়াকণ্ঠে বলে,
“দেখছো? তুমি এখনো বুঝতে পারছো না? তুমি কেন ক্ষমা চাইবে?”
রিমঝিমের কণ্ঠ এবার অনেক শান্ত, অনেক ঠান্ডা। সে নিজেকে সামলে প্রতিত্তর করে,
“আমি কোনো ভুল করিনি যে ক্ষমা চাইবো।ভুল উনি করেছেন। ক্ষমা চাওয়ার হলে উনি চাইবে।”
এরপর একটু থেমে যায় রিমঝিম। যেন নিজের ভেতরেই কিছু ভেঙে যাচ্ছে, তবু গলায় অনুরণিত হয় এক কঠিন সিদ্ধান্তের রেশ,
“তবে, ক্ষমা চাইলে যদি সব ঠিকঠাক হয়… তাহলে আমি চাইতেই পারি। আমি চাই, সব ঠিক হয়ে যাক।”
সে ধীরে হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে,
“আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি… তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন, মা ।”
এতকিছুর পরেও রিমঝিম ক্ষমা চাইলো। শুধু এক ক্লান্ত মানুষের একটুখানি শান্তির আকুতির জন্য।
এতক্ষণ চুপচাপ থাকা হালিমা বেগম যেন নিজের জয় নিশ্চিত করলেন, তিনি মুখে বিজয়ের ছায়া টেনে নিলেন।
তবু ছাড় দেওয়ার পাত্রী উনি নন। রিমঝিমের কথার প্রেক্ষিতে তিনি মৃদু গলায় তীক্ষ্ণ কটাক্ষে বলে উঠলেন,
“তুমি যেটা করেছো, সেটা অনেক বড়ো ভুল। মায়ের মতো একজন মানুষকে না খাইয়ে রেখেছো। তোমার নিজের মা হলে, এমনটা করতে পারতে?”
রিমঝিম চোখ তুলে তাকায়। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে। তার গলায় ধ্বনিত হয় একরাশ ব্যথা ও প্রতিবাদ,
“আপনি কি কখনো আমাকে মেয়ে ভেবেছেন, যে আমি আপনাকে মায়ের মতো ভাববো? সামিয়াকে আর আমাকে তো আপনি সবসময় এক কাতারে ফেলেন না। আপনি তো কখনো মা হয়ে আসেননি আমার কাছে—আপনি যদি একদিনও মা হয়ে দেখাতেন, আমি দশদিন মেয়ে হয়ে দেখাতাম। আপনি যদি কিছু না দেন, তাহলে আমার কাছ থেকে কী আশা করেন?”
কথাগুলো শেষ না হতেই আচমকা,
সালমানের দ্বিতীয় চড়টা এসে পড়ে রিমঝিমের গালে।
সব শব্দ থেমে যায়।
রিমঝিম স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে, চোখের কোণে নীরবে ঝরে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রু।
সে কিছু বলে না। শুধু মনে মনে একটা চিরচেনা সত্যকে আবার অনুভব করে-
একটুখানি আদর পেলেই ভুলে যেতে নেই।
সে ভুলে গিয়েছিল, মা-ভক্ত ছেলেরা কখনোই একজন স্ত্রীকে সত্যিকার অর্থে ভালো রাখতে পারে না।
তারা বোঝে না, বিয়ের মানে শুধু একজন কাজের মেয়ে বাড়িতে আনা নয়।
তারা ভুলে যায়, বিয়ের পর মা আর বউ—এই দুই জনের দড়ির টান সামলাতে হয় ভারসাম্যে, কাউকে হারিয়ে নয়।
কিন্তু তারা পারে না।
তারা শুধু একপাশ নিজের দিকে রেখে, অন্যপাশটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
রিমঝিম জানে, সালমান আবার ক্ষমা চাইবে।
আবার একটু আদর করে বলবে, “ভুল হয়ে গেছে।”
আর আবারও সেই একই কষ্ট ফিরে আসবে।
কারণ, অতিরিক্ত মা-ভক্ত ছেলেরা স্ত্রীকে তার প্রকৃত মর্যাদা কোনোদিনও দিতে পারে না।
আর রিমঝিম?
সে আবারও গলে যাবে সেই একটুখানি মায়ায়, আবারও ক্ষমা করে দেবে।
এটাই তো নিয়ম!
কিন্তু কেন সে পারে না শক্ত হতে?
রিমঝিম ঠায় নিশ্চুপ বসে থাকে। শাশুড়ির এই কথাগুলো আজকের নতুন কথা নয়। বিয়ের দুই বছর পেরিয়ে গেছে।
এবং এরপর থেকেই নিয়ম করে পেটে খাবার না পড়লেও এরকম অনেক ‘কথা’ তার গলার কাঁটা হয়ে জড়িয়ে থাকে।
তৃপ্তির বদলে কষ্টে পেট টইটুম্বুর হয়ে যায়।
“কী হলো? কথা কানে যায় না? সবাই খাওয়ার সাথে সাথে এভাবে লাট সাহেবের মতো খেতে বসে গেছো ক্যান?”
আরও একবার বিদ্ধ করা হয় বাক্যবাণে।
রিমঝিম কাঁপা কণ্ঠে বলার চেষ্টা করে,
“এভাবে বলছেন কেন আম্মা?”
হালিমা বেগম চোয়াল শক্ত করে জবাব দেন,
“বলবো না তো কি করবো? বলি, বাড়ির বউরা খাবে সবার পরে। আমরা ছিলাম একরকম। আর তুমি হইছো ভিন্ন! যেদিন ভালো মন্দ খাবার হবে সেদিনের কথা তো বাদই দিলাম।”
“হো! যেদিন ভালোমন্দ রান্না হবে, সেদিনই বেছে বেছে তোমার ক্ষুধা লাগবে?”
হালিমা বেগম থেমে টিটকারির সুরে যোগ করেন,
“অবশ্য লাগবেই বা না কেন! বাপের জন্মে কোনোদিন এমন খাবার দেখেছো? নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থাও তো ছিল না!”
এতক্ষণ মুখ বুজে থাকা রিমঝিম আর চুপ থাকতে পারলো না। তার পরিবারকে নিয়ে অপমান শুনে শরীরের রক্ত টগবগ করে ওঠে।
সে মাথা তুলে কড়া গলায় বলে,
“যাই থাকুক না কেন। আমার পরিবার আপনার মতো ছোটোলোকি কোনোদিন করেনি!”
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর…হুট্ করেই এগিয়ে এসে রিমঝিমের চুলের মুঠি ধরে টেনে ধরলো হালিমা বেগম।
ব্যথায় তার শরীর কুঁকড়ে উঠলো, চোখের জলে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল।
রিমঝিম আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। অশ্রুভেজা চোখে তাকালো স্বামীর দিকে,একটি আশার শেষ ঠিকানায়। কিন্তু সালমান নিরুত্তাপ। মুখে একফোঁটা স্পন্দন নেই। কোনো বিস্ময়ই নেই। তাকে যেন এই দৃশ্য ক্লান্ত করে তুলেছে কেবল।
মাথা তুলে চোখাচোখি করল না, শুধু বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“আহ আম্মা, ছেড়ে দাও। খেতে বসেও তোমাদের এসব নাটক দেখতে ইচ্ছে করছে না।”
সালমানের কথায় কোনো আবেগ নেই। শুধু কিছু উদাসীনতা বেছে আছে।
রিমঝিম বুঝতে পারলো – এই বাড়িতে তার শরীরের ব্যথা কাউকে না কাঁদালেও, স্বামীর অবহেলা তাকে নিঃশব্দে মাটিতে পুঁতে দিচ্ছে।
চুল টেনে ধরাতে হয়তো চোখে জল এসেছিল, কিন্তু স্বামীর এই এক চিলতে তাচ্ছিল্য – তাতে চোখের ভেতরের সব কান্না একসাথে ঝরে পড়লো।
হালিমা বেগম চুল ছেড়ে দিতেই রিমঝিম কিছু বললো না। শুধু ধীর পায়ে সামনে থাকা প্লেটটা ঠেলে উঠে দাঁড়াল।
প্লেটটা যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেল।
তাপমাত্রা কমে আসা ভাতের ধোঁয়া তখনও উপরের দিকে উঠছে। ভাতের উপর একটুকরো মাছ আর কিছু বাসি সবজির ঝোল, যা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জুটেছিল! কিন্তু আর খাওয়া হয়ে উঠেনি।
রিমঝিম একটুও আর কারোর দিকে ফিরে তাকালো না। শুধু নিঃশব্দে নিজের রুমে চলে গেল।
পেছনে পড়ে রইলো কিছু অসমাপ্ত লোকমা, কিছু ব্যথিত নিঃশ্বাস, আর একটুকরো ভালোবাসাহীন সংসার।
——-
রাত গড়িয়ে এলো। চুপচাপ ঘরে একা বসে রইলো রিমঝিম। অন্ধকারে ঠাসা রুমটা যেন তার মনটাকেও আরও গাঢ় কালোয় রাঙিয়ে দিল। বালিশে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে।
কিন্তু কেউ এলো না। না শাশুড়ি, না স্বামী, না সেই সংসারের কেউ – একটি লোকমার জন্যও তাকে জোর করে ডাকলো না।
একটু পরে দরজার সামনে হালকা পায়ের শব্দ পেল সে।
ছোট ননদ, সামিয়া। এই বাড়িতে রিমঝিমের একমাত্র ভরসা। পায়ে পায়ে হেঁটে দুয়েকবার রুমের সামনে পায়চারি করলো সে। কিন্তু হালিমা বেগমের তিরস্কারের সুর ভেসে এলো,
“তোর আবার কি দরকার এখানে?”
“ভাবিপু তো খায়নি।”
সামিয়ার নরম সুরের কথায় হালিমা বেগম বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে শুধায়,
“ওসব নাটক দেখতে হবে না তোকে। যা, ঘুমা গিয়ে!”
সামিয়া আর কোনো আওয়াজ শোনা গেল না। হয়ত চুপচাপ চলে গেল। এরপর আর ফিরে আসেনি।
রুম থেকে রিমঝিম সব শুনলো। দরজার ওপাশের প্রতিটি শব্দ যেন ছুরি হয়ে বিঁধছিল তার বুকে। তবু সে চুপ। শুধু কাঁদতেই থাকলো।
ননদ তো অনেক দূরের ব্যাপার। যেখানে স্বয়ং স্বামী?
সে তো আরও বহু আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
সেই দুপুরের পরে একবারও জানতে চায়নি – সে খেয়েছে কি না, কিংবা… ক্ষুদা লাগলো কিনা!
রিমঝিম হাসলো। এতদিন পরেও আর কী-ই বা আশা করা যায়! হয়তো এটাই তার কপালে লেখা ছিল।
এই নিঃসঙ্গতা, এই অবহেলা, এই গিলতে না পারা কান্নাগুলোই…
রাত গড়াচ্ছে। এই পুরোটা সময় রিমঝিমের পেটে একটা দানাও পড়েনি। অপমানে আর রুম থেকে বের হওয়া হয়নি। এখন বের হলেও রিমঝিম জানে, তার জন্য কোনো খাবার অবশিষ্ট রাখবে না । ক্ষুধায় পাক খেতে খেতে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে আসছে। কিন্তু রুমে কোথাও কোনো শুকনো খাবার নেই যে একটু মুখে দেবে।
রিমঝিম চুপচাপ বসে থাকে বিছানার এক কোনায়। দেয়ালে ছায়া পড়ছে জানালার পাশের গাছের পাতার – সেই ছায়াগুলোও যেন আজ তার মতোই কাঁপছে।
ক্ষণে ক্ষণে হেঁচকি উঠছে। ভেজা চোখে বালিশ চেপে ধরেছে বুকে।
একসময় দরজার আড়ালে শব্দ হয়। সালমান এসে দাঁড়ায়।
চোখে বিরক্তির ছাপ, মুখে ক্লান্তি।
রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
“এই সামান্য কারণে এত কান্নাকাটি করছো কেন?”
রিমঝিম ধীরে মাথা তোলে। চোখে কেবল একরাশ বিষণ্ণতা আর মলিন দৃষ্টি। সে কণ্ঠ ভারী করে বলে,
“তোমার কাছে এটা সামান্য? আমি খেতে বসে মার খেয়েছি আজ।”
সালমান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
“মার খাওয়ার মতো আচরণ করলে তো খাবেই। মা একটু বদমেজাজি, তা তো জানো। এসব মেনে চলতে শেখো। মুখে মুখে তর্ক করো কেন?”
রিমঝিম বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় সালমানের দিকে,
“তোমার কাছে আমার কথাগুলো তর্ক মনে হয়েছে? আর তোমার মা যা বললেন, করলেন, সেগুলো?”
রিমঝিম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বুক ভেঙে কান্না আসে, কিন্তু সে আর কিছু বলে না। কী বলবে! এই মানুষগুলোর সাথে কথা বলার ইচ্ছেটাও যে মরে যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এতক্ষনে ধরে চেপে রাখা কান্নাগুলো আরো বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন! নিজেকে সামলাতে পারলো না সে।
রিমঝিমের হিচকি তোলা দেখে সালমান বিছানার পাশের ল্যাম্প নিভাতে নিভাতে বলে,
“ফ্যাচফ্যাচ করো না তো কানের পাশে। সকালে অফিস আছে আমার, ঘুমাতে দাও।”
এই কথাগুলো আর একফোঁটা আলো নিভে যাওয়া – সব মিলে একসাথে যেন আঁধার নামিয়ে আনে রিমঝিমের ভেতরটায়। সে চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। নিরব পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় বারান্দায়।
অন্ধকার রাত। কোনোদিকে পূর্ণিমার আলো ছিটেফোঁটাও নেই। রাতের হাওয়া এসে তার চুল উড়িয়ে দেয়, তবু সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।
এই ঘর, এই মানুষগুলো, এই সম্পর্কগুলোতে – হয়তো তার সময় ফুরিয়েছে। সে তো চেয়েছিল টিকে থাকতে। ভুল করে ভালোবাসতে চেয়েছিল। কিন্তু যাকে ‘মা’ বলে ডাকতে চেয়েছিল, সেই হালিমা বেগম তাকে কোনোদিনই মেনে নেননি। দুই বছর পেরিয়ে গেছে।
তবু তিনি এখনো সেই একই অবজ্ঞা, একই আঘাত পুষে রেখেছেন।
রিমঝিম জানে, সে এই বাড়ির এক কোণাও নিজের করে পায়নি। সালমান – যাকে ভালোবেসে সব ভুল মেনে নিয়েছিল, তিনিও আজ কেবল মুখ ফিরিয়েই নয়, তাকে ছোট করতে দ্বিধা করেন না।
সে চোখের জল মুছে নেয় ধীরে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদটা লুকিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে পূর্ণিমার মতো আলো ছড়াতে চাচ্ছে আবার ঢেকে যাচ্ছে।
আর সে জানে – এই চাঁদের মতো বাঁচাই এখন তার জীবন।
ভুল তো সে শুরুতেই করেছিল। ভুল মানুষকে আঁকড়ে ধরেছিল, আর সেই ভুলের মাশুল এখন গিলে নিচ্ছে নিঃশব্দে, প্রতিটা রাতে… প্রতিটা নিঃশ্বাসে।
এই ‘বাড়ি’টাই হয়তো তার জন্য সঠিক ছিল না।
নাকি, এই সংসারটা কখনোই তার ছিলই না?
গাঢ় লাল রঙের ছোট্ট রত্নখণ্ডে চোখ পড়তেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল আদিবের। প্রায় দুই বছর আগে, এক সহকর্মীর অনুরোধে তার ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে লন্ডনের ****** শহরে গিয়েছিল সে। ফিরতি পথে এক ভিনটেজ জুয়েলারি শপে ঢুকে মায়ের জন্য কিছু কিনতে গিয়েই নজর কেড়েছিল চিকন সোনালি চেইনে বাঁধা রুবির লকেটটা। মূলত মায়ের জন্য কানের দুল কিনতে গিয়েছিল, কিন্তু এই লকেটটা দেখে অদ্ভুত এক টানে কিনে ফেলে। কাউকে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল না, নিছক ভালো লাগা থেকে সংগ্রহে রাখা।
জাহানারার জন্মদিন উপলক্ষে তাকে কী উপহার দেবে সেটা ভাবতে গিয়ে দুই বছর ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা লকেটটির কথা মনে পড়লো আজ। বাক্সবন্দি গয়নাটা হাতে তুলে নিয়ে আবার ব্রিফকেস যথাস্থানে রেখে দিল আদিব। আলমারি বন্ধ করে জাহানারার ঘরের দিকে রওনা হলো মন ভালো করা এক অনুভূতি নিয়ে।
জাহানারা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। দিন গড়ানোর সাথে সাথে মন খারাপ বাড়ছে তার। মাকে মনে পড়ছে খুব। গত বছর জন্মদিনেও মানুষটা তার সাথে ছিল। তার জন্য রান্নাঘর তোলপাড় করে রান্না করছিল, আর আজ সময়ের ব্যবধানে সেই মানুষটা তার সাথে নেই, কাছে নেই, কোথাও নেই। চোখ জলে উঠলো জাহানারার। ফুঁপিয়ে উঠলো সে। আদিব সেই সময় এসে দাঁড়িয়েছিল তার ঘরের দরজায়। জাহানারার শরীরের কম্পন দেখে আদিবের বুঝতে অসুবিধা হলো না—জাহানারা কাঁদছে। সে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল সামনে। হাতের ছোট বাক্সটা লুকিয়ে ফেলল ট্রাউজারের পকেটে। জাহানারার ঘাড়ে হাত দিয়ে উদ্বেগজড়িত কণ্ঠে জানতে চাইলো,
-কী হয়েছে?
আদিবকে দেখে নিজের চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করলো জাহানারা। স্বাভাবিক করতে চাইলো নিজেকে, কিন্তু ব্যর্থ হলো সে। ফুঁপিয়ে উঠলো ঠোঁট চেপে। আদিব তাকে নিজের দিকে ফেরালো। অশ্রুসিক্ত মুখটা হাতের আঁজলায় নিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলো,
-কী হয়েছে, বলো আমাকে? কেউ কিছু বলেছে?
দুই দিকে মাথা নাড়লো জাহানারা।মানে কিছু হয় নি ,কেউ কিছু বলে নি।
-তাহলে?
ফের প্রশ্ন আদিবের। জাহানারা মুখ খুলল,
-আম্মুর কথা মনে পড়ছে। কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।
কান্নায় ভেঙে পড়লো জাহানারা। আদিব আগলে নিল তাকে। জাহানারার মুখে সেজ চাচির কথা শুনে ভেতরটা ধক করে উঠলো তার। মানুষটা চলে গেছে, তাও প্রায় ছয় মাস হবে, অথচ মনে হয় না মানুষটা তাদের মাঝে নেই। আদিবের তো প্রায় এটা ভাবে, ঐ বাড়িতেই আছে মানুষটা। সে গেলেই বেরিয়ে আসবে রান্নাঘর থেকে, একগাল হেসে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলবে, “এতোদিনে চাচির কথা মনে পড়লো বুঝি, আদিব?” কিন্তু আদিব জানে, সেটা সম্ভব না। মানুষটা শুধু তার স্মৃতিতেই আছে, এই দুনিয়ায় নয়। কথাটা ভাবতেই আদিবের বুক চিরে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। জাহানারাকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। তাকে সময় দিল শান্ত হওয়ার। অনেকটা সময় নিয়ে শান্ত হলো জাহানারা। চোখ মুছলো। আদিব তার মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো
-ফিল বেটার?
-কিছুটা।
নাক টেনে বলল জাহানারা। তারপর আদিবের উদ্দেশ্যে বলল,
নেহার কথা শেষ হতেই ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল জাহানারা। ভাই যে তার জন্মদিন উপলক্ষে এসেছে, এটা বুঝতে ভুল হলো না তার। জাহানারা চলে যেতেই ট্রাউজারের পকেট থেকে ছোট বাক্সটা বের করে দেখলো আদিব। সেটা আবার পকেটে রাখলো। মনে মনে ঠিক করলো,এখন যেহেতু দেওয়া হলো না জিনিস টা ,তখন একেবারে রাতেই দেবে।
____
নিচে নেমে ভাইয়ের পাশে বাবাকে দেখে চমকালো জাহানারা। চলার গতি ধীর হলো তার। গাঢ় অভিমানে দৃষ্টি হলো ঘোলাটে। চোখের পানি লুকাতে মুখ গুঁজে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো মেঝেতে। সেভাবেই বলল,
-তোমরা এখানে…
গলার স্বর কেঁপে উঠলো জাহানারর। অজ্ঞাত থামতে হলো। ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো। চেষ্টা করলো নিজেকে সামলানোর। জায়েদ বুঝলো মেয়ের অভিমান। পুরোনো কথা ভুলে এগিয়ে গেল সামনে। হাত রাখলো মেয়ের মাথায়। বাবার উষ্ণ স্পর্শে এতদিনে মনে জমা বরফ গললো জাহানারার। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো সে। কান্নারত গলায় অনবরত বলতে লাগলো,
জায়েদ আলতো হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
-আই অ্যাম অলসো স্যরি, মা। আব্বুরও ভুল হয়েছে।তোমাকে বোঝা উচিত ছিল তার।তোমার বয়সের দোষ ছিল কিন্তু আমি তো বুঝাদার ছিলাম—।আমাকে মাফ করে দিও, প্লিজ।
জায়েদের গলায় অনুতাপের ছাপ।সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এতো দিনে।বুঝতে পেরেছে সন্তান পথ হারালে তাকে পথ দেখাতে হয়। শক্ত করে হাত ধরে সঠিক পথে আনতে হয়।সমাজ কিংবা সম্মানের ভয়ে তার থেকে মুখ ফিরাতে হয় না।
বাবার কথায় জাহানারার কান্নার বেগ আরো বাড়লো। জায়েদের বুকের শার্ট ভিজলো মেয়ের চোখের পানিতে। এই মুহূর্তে এসে সে উপলব্ধি করলো, মা মারা যাওয়ার পর এত বছর বুকের ভেতর যে খাঁ খাঁ ভাবটা ছিল, যার জন্য কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে, কোনো ঔষধে যার উপশম হয়নি—সেটা মেয়েকে বুকে নিতেই এক নিমিষে উধাও হয়ে গেল। অন্তঃকরণ জুড়ে ছেয়ে গেল শীতলতা। প্রশান্তির শ্বাস ফেলল সে।
-না, তোমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। তোমাদের ছোট করেছি, কষ্ট দিয়েছি। আই অ্যাম স্যরি, আব্বু।
ফের বলতে লাগলো জাহানারা।
-আচ্ছা হয়েছে।আর কত কাঁদবি ।এখন পুরোনো কথা বাদ দে। এদিকে আই, কেক কাট। দেখ, তোর জন্য পুতুলওয়ালা কেক এনেছি।
জাহানারার কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলল আকিব। জাহানারা নাক টেনে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। জায়েদ চোখের পানি মুছিয়ে দিল মেয়ের। বলল,
-সব ভুলে যাও, মা। যা হয়েছে, সেগুলো তো আর আমরা ঠিক করতে পারবো না, কিন্তু সামনের দিনগুলো তো ভালোভাবে কাটাতে পারবো। তাই না?
এগিয়ে গেল জাহানারা। আকিব বাক্স থেকে কেক বের করলো। গোলাপি রঙের কাস্টমাইজড পুতুল বসানো কেকটা দেখে চোখ ছলছল করে উঠলো জাহানারার। মিতু আপুর জন্মদিনে এমন কেক এনেছিল মেজ চাচা। জাহানারার খুব শখ হয়েছিল, তার জন্মদিনে অমন একটা কেক আনতে। পুরো দুই মাস এই নিয়ে মায়ের পিছু পিছু ঘুরেছিল সে। সালেহা তেমন পাত্তা দেয়নি। তাছাড়া, সেইবার আকিবের ক্যাডেটে ভর্তির জন্য কোচিং-টিউশন ফি বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়েছিল, যার দরুন জায়েদের হাতটান ছিল। কিন্তু জাহানারা ওসব শুনতে নারাজ। মেয়ের খুঁতখুঁতানিতে অতিষ্ঠ হয়ে সালেহা তার গায়ে হাত তুললো। জায়েদ বাড়ি ফিরে দেখে মেয়ে তার দরজায় বসে কাঁদছে, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। জায়েদ তড়িঘড়ি মেয়েকে কোলে নিল। সালেহাকে কেন মেয়েকে মেরেছে, তার জন্য তাকে ডেকে ধমকাধমকি দিল। মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে তাকে বলল, সে যেমন কেক চায়, তেমন নিয়ে আসবে। জাহানারা তো সেই খুশি। দাদিকে নেচে নেচে বলল সে কথা। দীপ্তি আপু, তৃপ্তি আপুকে বলল। নিতুকে বলল। সবাইকে দাওয়াত দিলো তাদের বাড়ি। সালেহা মেয়ের খুশিতে বাধা সাধলো না। বাড়ির পোষা বড় মোরগটা জবাই করে মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে অল্প-স্বল্প আয়োজন করলো। জাহানারা সেজেগুজে বসে ছিল সেদিন—আব্বু কেক নিয়ে আসলে সে কেক কাটবে, অবশ্য তার আগে বড় চাচার ক্যামেরায় কেক সামনে নিয়ে ছবি তুলবে। কিন্তু আব্বু এলো না সঠিক সময়ে। তার খবর এলো, এক্সিডেন্ট হয়েছে তার, হাসপাতালে আছে। বড় চাচা, মেজ চাচা ছুটলো সেখানে। আম্মুর মাথায় পানি দিল চাচিরা। জাহানারা পড়লো চিন্তায়—তার আব্বুকে নিয়ে না, তার জন্মদিনের কেক নিয়ে। আব্বু হাসপাতালে থাকলে তার কেক কী করে আসবে, এটা ভেবেই দৌড়ে গেল মায়ের কাছে। সরল মনে জিজ্ঞেস করলো,
-আম্মু, আমার কেক নিয়ে আসবে না আব্বু?
কথা বলা মাত্রই মেয়ের মুখে চড় বসালো সালেহা। খেকিয়ে উঠলো তার উপর। জাহানারা বেগম এসে ধরলো জাহানারাকে।সালেহা কে ধমকে বলল,
-বউমা !ও অতো বোঝে না কী? ওর গায়ে হাত তুলছো কেন?
-ওর জন্য তো আপনার ছেলের এমন অবস্থা মা। অসভ্য মেয়ে—বাপ হাসপাতালে, তার খেয়াল নেই। ওনার কেক লাগবে!দূর হ এখান থেকে!
মায়ের বিকট ধমকে জাহানারা দাদির পিছনে লুকালো। ঠোঁট বেঁকিয়ে এলো তার। ছোট্ট জাহানারা সেদিন মনে মনে ঠিক করলো, আর কখনো সে জন্মদিন-জন্মদিন করবে না। সত্যি, তারপর জাহানারা আর কখনো মায়ের পিছু ঘোরেনি পুতুলওয়ালা কেকের জন্য, কখনো মাতামাতি করে নি নিজের জন্মদিন নিয়ে। আব্বু কখনো চাইলেও এড়িয়ে গেছে সে। জন্মদিনের আগে আগে কখনো গিয়ে নানা বাড়ি বসে থেকেছে, তো কখনো ছোট খালার বাড়ি। সবার সামনে মায়ের বলা কথাগুলো তার ছোট্ট মেয়ে মনে জিইয়ে রেখে এমন করেছে—সেটা সালেহা বুঝলেও মেয়ের মান ভাঙাতে পারেনি।প্রতিবছর এই দিনটাতে সূক্ষ্ম এক অপরাধবোধে কুঁকড়ে থেকেছে সে। চেষ্টা করেছে নিজের সাধ্য মতো মেয়ের জন্মদিন টা বিশেষ বানানোর কিন্তু জাহানারা মাঝে কখনো সেই উচ্ছাস দেখেনি যেটা সেই ছোট্ট বেলায় শেষ বার দেখেছিল।সালেহা নিজের বলা কথায় অনুতপ্ত হয়ে কতবার ছেলের সামনে চোখ ভিজিয়েছে ছেলের সামনে।মেয়ের মান ভাঙাতে না পারার আফসোসে কত না দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।
আকিব মায়ের সেই আফসোস মিটাতে নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা করেছে বোনের মান ভাঙানোর, কিন্তু জাহানারা এত ব্যস্ত, তাকে বাগে পাওয়ায় দায়। তবে এবার বোন কে কাছে পিঠে পেয়ে এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি, তাই তো সেই একই রকম কেক অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছে। এতে যদি তার বোনের মান ভাঙে, এতো দিন পরে এসে যদি তার মায়ের সুপ্ত ইচ্ছাটা পূর্ণ হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আকিব। সকলের অগোচরে মুছে নিলো চোখের পানি। মুখে হাসি টেনে বলল,
-ঐ দেখ, আবার কাঁদতে বসেছে। কাল-নাগিনী থেকে ছিচকাঁদুনি হলি কবে!
অন্য সময় আকিবের মুখে কথাটা শুনলে ছ্যাঁৎ করে উঠতো জাহানারা। তবে আজ কিছু বলল না। চুপচাপ কেকে ছুরি বসালো। আব্বুকে কেক খাইয়ে আকিবের মুখের সামনে কেকের টুকরো ধরে কান্না ভেজা গলায় বলল,
-মা থাকলে ভালো হতো না, ভাই?
জাহানারার কথায় চোখর পানি ছলকে উঠলো আকিবের। কেকের টুকরো মুখে নিয়ে মাথা নাড়ালো সে। বোনের মাথায় হাত দিয়ে বলল,
অনেকক্ষণ এসেছে আদিব। দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সে। আকিবের ডাকে সামনে গেল।
এরপরের সময়টা বেশ আনন্দঘন কাটলো জাহানারার। আম্মুর শূন্যতা পোড়ালেও আব্বুর উপস্থিতি কিছুটা স্বস্তি দিলো। কিছু সময় বসে আকিব চলে গেল নিজের কাজে। জাহানারাকে জায়েদ বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলো, কিন্তু আদিব বাধা দিল। জানালো, সে জাহানারার জন্মদিন উপলক্ষে রান্না বান্না করবে। কথাটা বলতে বলতে রান্নাঘরে ছুটলো আদিব। নেহা রান্নার যোগাড় করেই রেখেছিল। আদিবের খুব একটা অসুবিধা হলো না। রান্নাবান্না শেষ করতে করতে আকিব ফিরে এলো আবার। একসাথে খেতে বসলো সবাই। তারিনকে ডাকতে চেয়েছিল তারা, কিন্তু ওর বাচ্চা নিয়ে এখন এই পরিস্থিতিতে বাইরে বের হওয়া ঠিক হবে না বলে ওকে ডাকতে দিল না আকিব।
খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব শেষ করে উঠতে উঠতে রাত গড়ালো। অনেকদিন পর আব্বুর সান্নিধ্য পেয়ে কথা যেন ফুরাতেই চাইছিল না জাহানারার। জায়েদের রাতের ওষুধ আছে, দেরি হয়ে যাচ্ছে—এসব বলে আসর ভাঙলো আকিব। তবে জাহানারা জানালো, সে কালও বাড়ি যাবে। জাহানারার ওই বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করলো আদিবের মনে। তবে সে সেটা প্রকাশ করলো না।
সারাদিনের হৈচৈয়ের পর ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুতেই ঘুম জড়িয়ে আসলো আদিবের চোখ। কিন্তু ঘুম গাঢ় হওয়ার আগে বিছানায় ধপ করে কিছু পড়তেই ঘুম ছুটে গেল তার। ধুচমুচ করে উঠে বসলো সে। পাশ ফিরে দেখলো জাহানারা। তাকে দেখে ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললো আদিব। বুঝলো শব্দের উৎপত্তি। জাহানারা তাকে হুড়মুড়িয়ে উঠতে দেখে দাঁত বের করে হাসলো। বলল,
-ভয় পেয়েছেন?
আদিব নিজের জায়গায় আবার পিঠ ঠেকালো। ভাবলেশহীনভাবে বলল,
-না।
তারপর চোখ বন্ধ করে সেভাবেই বলল,
-এতদিন তো এমন ভাব করছিল, যেন আমার মুখ দেখলেও পাপ হবে। আজ একদম গায়ে হুমড়ি দিয়ে পড়ছো—ঘটনা কী?
এতদিন জাহানারা অনুভূতি লুকাতে আদিবের থেকে দূরে ছিল। যেটা গতকাল রাতে তাদের কাছাকাছি আসার পর আর প্রয়োজন নেই। তাছাড়া, কাল এতবার ছেলেটাকে “ভালোবাসি” বলেছে…!সব তো ফাঁস হয়েই গেছে এখন আর কি লুকাতে দূরে থাকবে।
-ঘটনা যা ঘটার, তা তো ঘটেই গেছে। আর রাখঢাক রেখে লাভ কী?
তড়িৎ চোখ খুলে তার দিকে তাকালো আদিব। চোখ-মুখ গুটিয়ে বলল,
-লজ্জা-শরমের বালাই নেই না তোমার?
-ওমা, আপনার সামনেও কিসের লজ্জা? তাছাড়া, আমি আপনার মতো অমন না।
-আমার মতো অমন না মানে? কী বলতে চাইছো?
চোখ সরু করলো আদিব। জাহানারা তার দিকে ফিরলো মুখের পাশে দুই হাত দিয়ে আরাম করে শুয়ে বলল
-চুপ! একদম চুপ! আর একটা কথা বললে জালনা দিয়ে তোমাকে ফেলে দেব, বেয়াদব!
কপট ধমক দিল আদিব।মেয়েটার লাগামহীন কথার আচ পেয়ে কান লাল হয়ে উঠলো তার।জাহানারা ঠোঁট টিপে হাসলো। ছেলেটাকে এতদিনে শায়েস্তা করতে পেরে ভীষণ আনন্দ হলো।আদিব কে লজ্জায় ফেলতে এমন সব কথা শুরু করলো যে আদিবের মনে হলো মাটিতে মিশে যেতে পারলে ভালো হতো। বাধ্য হয়ে সে মুখ চেপে ধরলো জাহানারার। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, আর কখনো এই মেয়ের ধারে-কাছে ঘেঁষবে না। কোনোদিন না। আদিবের চোখ-মুখ লজ্জায় লাল হলো, না রাগে লাল হলো, সেটা বোঝা গেল না। তবে জাহানারা মনে হলো, এবার তার থামা উচিত। সে থামলো। আদিবের হাতের নিচ থেকে ঠোঁট নেড়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-আর কিছু বলছি না, ছাড়েন। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আদিব ছেড়ে দিল তাকে। চোখ রাঙিয়ে হাতের আঙুল তুলে শাসালো—যার অর্থ এবার কিছু উল্টোপাল্টা বললে খবর আছে।জাহানারা মাথা নাড়লো। হাতের আঙুল ঠোঁট চেপে বোঝালো, সে আর কিছু বলবে না। আদিব আশ্বস্ত হয়ে পাশ ফিরলো। হাত বাড়িয়ে ঘরের আলো বন্ধ করলো। জাহানারা আর সত্যি ‘টু’ শব্দ করলো না। আদিবও কিছু বলল না। সাইড টেবিলে রাখা ছোট বাক্সটার দিকে তাকালো—যেটা বাইরে থেকে আসা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাতে নিল সেটা। খুলে দেখলো। নানা ব্যস্ততায় জাহানারাকে দেওয়া হয়নি এটা।মনে মনে ঠিক করলো,মেয়েটা ঘুমিয়ে গেলে সাবধানে পরিয়ে দেবে।সকালে উঠে চমকাবে যাবে। ভাবনা অনুযায়ী জাহানারার গভীর ঘুমের অপেক্ষা করতে লাগলো আদিব। একসময় জাহানারার শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হলো। আদিব আন্দাজ করলো, জাহানারা ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশ ফিরলো সে। জাহানারার মুখের উপর হাওয়ায় হাত নাড়ালো—জাহানারা আদো ঘুমিয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করলো। যখন আশ্বস্ত হলো মেয়েটা সত্যি ঘুমিয়েছে, তখন বাক্স থেকে চেইনটা বের করে খুব সাবধানে পরিয়ে দিল তাকে। সাদা মসৃণ ত্বকে র’ক্তরঙা পাথরটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। আদিবের ঠোঁটের কোণেও দেখা দিল মৃদু হাসি। মোহগ্রস্তের মতো এক ভাবেই তাকিয়ে রইলো সে পাথরটায়। তারপর হুট করে ঠোঁট ছোঁয়ালো সেখানে। নিজের কাণ্ডে নিজেই হকচকিয়ে গেল সে। ঠোঁট সরিয়ে উঠে আসতে চাইলো তড়িঘড়ি, কিন্তু তা আর হলো না—জাহানারা তার গলা নিজের হাতের বন্ধনীতে নিয়ে তার কানে ফিসফিস করে বলল,
-একেই বলে মনে সাজ, মুখে লাজ। বুঝেছেন?
-বুঝেছি।
নিজের সাথে জাহানারাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে জাহানারার ভঙ্গিতে বলল আদিব।পরপর দুই বার ঠোঁট ছোঁয়ালো পূর্বের জায়গায়। ধরা যখন পড়েই গেছে, তখন আর লুকিয়ে লাভ কী? জাহানারার ঠোঁট চওড়া হলো। ফিসফিস করে বলল,
-বেশ করেছি। আমার বউ, আমি ধরেছি। এখন পকপক না করে ঘুমাও।
-না, ঘুমাবো না। ছাড়েন।
রাগান্বিত স্বর জাহানারার।আদিব নাছোড়বান্দা।
-ছাড়বো না।
ছটফটিয়ে উঠলো জাহানারা। আদিবের গায়ের জোরের সাথে পারলো না। একসময় হার মানলো। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
-আমাকে একটু ভালোবাসলে কী ক্ষতি হবে আপনার?
কথাটা যেন বুকে গিয়ে বিধলো আদিবের। সে জাহানারাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। জাহানারার মাথার তালুতে সময় নিয়ে চুমু খেল। নিজের স্পর্শে যেন বোঝাতে চাইলো নিজের অব্যক্ত অনুভূতি। জাহানারা বুঝলো তার কথা। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো প্রাপ্তির হাসি। আদিবের বুকের মাঝে গুটিশুটি হয়ে চোখ বুজলো প্রশান্তিতে।
____
হাতের কব্জিতে তীব্র ব্যথা নিয়ে চোখ খুলল রাকিব। চোখ মেলতেই মাকে পেল সামনে। সময় অপচয় না করে অধৈর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-জাহান এসেছে?
-না।
-আসেনি? আমার এমন অবস্থা শুনেও আসেনি?
স্বগোতক্তি করলো রাকিব।আশাহত হলো সে।তার এমন অবস্থা শুনেও জাহানারা আসে নি এটা ভেবে কষ্ট পেল।তার ভাবনার মাঝেই কথা বলল মিসেস সারোয়ার,
-একতরফা ভালোবাসা ততদিন সম্মানিত থাকে, যতদিন সেটা ভালোবাসার মানুষের স্বাভাবিক জীবনে বাধা না সাধে। জাহানারাকে তুমি ভালোবাসো—ইটস টোটালি অলরাইট, তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি জোর করে তোমার অনুভূতি মেয়েটার উপর চাপিয়ে দেবে, ওর স্বাভাবিক জীবনে অস্থির করে তুলবে—সেটা হতে পারে না। আমার ছেলেকে জেনে বুঝে আমি এমন অন্যায় করতে দিতে পারি না। এর জন্য যদি তুমি আত্ম’ঘাতী হও, তাহলে হও। আমি সন্তান ছাড়া থাকতে পারবো, কিন্তু সন্তানের অপকর্মের কলঙ্ক নিয়ে নয়।”**
উঠে দাঁড়ালো মিসেস সারোয়ার। রাকিব এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল। তার মা কখনো অন্যায়ের সাথে আপোস করে না, এটা অজানা নয় তার। তাকেও এমনটাই শিক্ষা দিয়েছে সে।মায়ের সেই শিক্ষাকে জেদের বশে ছোট করেছে—এটা ভাবতেই ভেতরটা কুঁকড়ে গেল অপরাধ বোধে।
-জাহানারা এতদিন একা ছিল, তুমি কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়া তার পাশে থেকেছো—এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু এখন সে বিবাহিত, অন্য একজনের স্ত্রী। এখান থেকে তোমাদের যাত্রাপথ আলাদা হওয়া উচিত। বুদ্ধি মানের জন্য ইশরায় যথেষ্ট।আই হোপ, তুমি আমার কথার মানে বুঝেছ রাকিব?
-ইয়েস, মা।
মিনমিনিয়ে বলল রাকিব।
-শুনতে পাইনি আমি।
-বুঝেছি মা।
গলার স্বর উঁচু করল রাকিব।ছেলে তার কথা বুঝেছে সেটা নিশ্চিত হতেই স্বস্তি পেল সে। ছেলের মাথায় হাত বুলালো। মুখের কঠোর ভাব সরিয়ে বলল,
-গেট ওয়েল সুন, আব্বা। আমি তোমার বাবাকে ফোন করে আসছি।
রাকিব ঘাড় নাড়লো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মিসেস সারোয়ার। রাকিব তার গমনরত পথের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল। মেনে নিল নিজের ভবিতব্য।
______
প্রায় দুই বছর পরের কথা। জাহানারা তখন অন্তঃসত্ত্বা, পাঁচ মাস চলছে তার। আদিব ছুটি নিয়ে দেশে এসেছে জাহানারার ডেলিভারির জন্য। তার বাড়ি ফেরার উপলক্ষে তানিয়া মেয়ে-জামাইসহ জায়েদ আর সাজ্জাদের পরিবারকে দাওয়াত করেছে। বাড়িতে বেশ রমরমা পরিবেশ। খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজবে মুখর চারিদিক। তানিয়া জাহানারাকে এখনো আড়চোখে দেখলেও ছেলের খুশির ভেতর নাক গলায় না। তাছাড়া, নিশানকেই যখন মেনে নিয়েছে, সেখানে সালেহার উপর রাগ করে জাহানারাকে কেন বঞ্চিত করবে—এমন ভাবনা থেকে ছেলের বউ নিয়ে খুশি সে। কিন্তু জাহানারার ঠোঁটকাটা স্বভাব আর ঐ সিনেমায় কাজ করার ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারে না সে। এই সিনেমায় কাজ করার জন্য মেয়েটা তার ছেলের সাথে লন্ডন যায়নি,ঐ মেয়ের জন্য আবার আশরাফ যায়নি—এই দুই চাচা-ভাতিজির কারণে তার লন্ডন যাওয়া হয়নি।যাওয়া না যাওয়ার এই ঘূর্ণিপাকে অতিষ্ঠ হয়েছে সে।তার এতদিনের আশা ভণ্ডুল হওয়ায় তিক্ত-বিরক্ত সে জাহানারার উপর। কিন্তু জাহানারা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে হৃদয় পরিবর্তন হয়েছে তার। সবসময় চেষ্টা করেছে তার সুবিধা-অসুবিধা দেখার, তাকে খুশি রাকার। জাহানারা কে নিয়ে এতোটা ভাবছে তানিয়া যে তার ইচ্ছা পূরণেই নিজের মনের বিপক্ষে গিয়ে এই দাওয়াতের ব্যবস্থা করেছে । না হলে এই ছাইগুষ্টির পিছনে খেটে মরতে বয়েই গেছে তার!
এই গরমে একরাশ বিরক্তি নিয়ে টেবিল থেকে খাবার বাটিগুলো সরিয়ে রান্নাঘরে রাখছিল তানিয়া। সেই সময় আদিবের চিৎকার কানে এলো তার। জাহানারার শরীর ভালো লাগছিল না, তাই তাকে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়েছিল আদিব।তার চিৎকার শুনে ছুটলো সবাই।
আদিবের ঘরে যেতেই সবাই দেখলো, জাহানারা পেটে হাত দিয়ে ছটফট করছে আর আদিব উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বার বার জানতে চাইছে কি হচ্ছে তার।
-মা, সব তো ঠিক ছিল, হঠাৎ কি হলো।ও এমন করেছে কেন?তুমি একটু দেখো প্লিজ ।
কথাটা বলতে বলতে চোখে পানি জমলো আদিবের। তানিয়ার বুকের ভেতরটা ছলাৎ করে উঠলো। ছেলের দেখা-দেখি তার চোখও ভিজলো। তৃপ্তিকে জাহানারার চিকিৎসারত ডাক্তার কে তৎক্ষণাৎ ডাকতে বলল। তারপর জাহানারার মাথায়-গোড়ায় বসে হাত বুলাতে বুলাতে আহাজারি করে বলতে লাগলো,
-ও মা, খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে তোমার? খুব কষ্ট হচ্ছে। এই জন্য বলেছিলাম, এই গরমে এত ছোটাছুটি না করতে। কিন্তু আমার কথা কানে তোলে কেও!
আশরাফের দিকে রুক্ষ চোখে তাকালো তানিয়া। আশরাফ হতবুদ্ধি হলো। বুঝে পেল না, তার কী দোষ এখানে। সে তো শুধু বলেছিল, আদিব এসেছে, এই সুযোগে সবাইকে ডেকে খাওয়াদাওয়া করলে কেমন হয়। দিনক্ষণ তো আর সে ফেলেনি। আশ্চর্য! স্ত্রীর দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে আড়ালে গেল সে। দীপ্তিকে ডেকে বলল,
-তোর মা কে দেখ, কেমন খাবো-খাবো করছে। আমি বলেছিলাম, শুধু আয়োজন করতে দিনক্ষণ কিন্তু সেই ফেলল। এখন আমার উপর গরম দেখাচ্ছে।
-আচ্ছা, তুমি এখন কিছু বলো না। কিছু বললেই কিন্তু ফেঁসে যাবে ।দেখছো না, তার ছেলে কাঁদছে—মাথা ঠিক আছে না কি তার!
দিপ্তীর সাবাধানী বাণীতে এক পাশে সরে এলো আশরাফ ভুলেও আর স্ত্রী সামনে গেল না।
ডাক্তার শারমিন এলো প্রায় ফোন করার সাথেসাথে। এসে জানালো, ভয়ের কিছু নেই। লিগামেন্ট পেইন এটা। গর্ভাশয় প্রসারিত হচ্ছে, যার থেকে ব্যথার সৃষ্টি। জাহানারার প্রথম প্রেগন্যান্সি, তাই হয়তো ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ছটফটিয়ে উঠেছে। ডাক্তার শারমিনের কথা শুনে উপস্থিত সকলে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। তিনি অল্প পাওয়ারের *****ঔষুধ লিখে আরো কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে বিদায় নিলেন।
জাহানারা তখন স্থির হয়েছে। ব্যথা পুরোপুরি যায়নি, তবে তীব্রতা কম। সে সেভাবেই তানিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
-চাচিমা, আপনার ছেলে তো শেষমেষ আমার জন্য কেঁদেই ফেলল। তাহলে নাম আর বদলাতে হচ্ছে না আমার, কী বলেন?
স্তম্ভিত হলো তানিয়া।কত বড় সাহস মেয়েটা সেই পুরনো কথা তুলে তাকে খোঁটা দিচ্ছে।কথাটা মনে হতেই রাগে শরীর রিরি করতে লাগলো তানিয়ার।তার রাগ বাড়াতে আগুনে ঘি ঢাললো ডালিয়া।
– শুধু আদিব কেন? ভাবিও তো কাঁদছিল!
ফোড়ন কাটলো ডালিয়া।সাজ্জাদ স্ত্রীকে চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল। কিন্তু তাতে লাভ কি? যা বলার তো বলা হয়ে গেছে। জাহানারা মেজো চাচির কথা টেনে অবাক হওয়ার ভ্যান করে বলল—
-তাই না কি?
ঠোঁট টিপে হাসল উপস্থিত সবাই। তানিয়া অগ্নিচোখে তাকাল ছেলের দিকে। মনে মনে বলল,‘কাঁদতে গেলি কোন দুঃখে? এতো পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়েছিস, আর এতটুকু বুঝতে পারিস না কোনটা স্বাভাবিক ব্যথা আর কোনটা গুরুতর? ঘোড়ার ডাক্তার হয়েছে। যত সব!’*
ভিড় ঠেলে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এল তানিয়া। মেয়েটা নিজের কথা সত্যি করেই দেখালো— এটা মেনে নিতে পারল না সে। ছেলের উপর রাগ হলো খুব, তবে তার থেকে বেশি রাগ হলো ছেলের বাপের উপর।‘না সে এই গরমে দাওয়াত রাখতো, না ঐ মেয়ের শরীর দুর্বল হতো, না সে নেতিয়ে পড়তো, না আর তার ছেলে কেঁদে বুক ভাসাতো।এখানে দোষ যদি কারোর থাকে তাহলে সে টা এ লোকের’!
সবাই জাহানারা ঘর থেকে বের হতেই আদিব ক্ষিপ্ত গলায় বলল—
-উনি কম খোঁচা দেননি আমাকে। আর শুনুন, এসব আমাদের শ্বাশুড়ি-বউমার ব্যাপার, আপনি নাক গলাবেন না। আমার লড়ব-মরব, আবার এক হব। আপনি থার্ড পার্টি হয়ে ভেতরে ঢুকলে ব্যাপার সেনসেটিভ হবে। সুতরাং দূরে থাকুন। বেশি দরদ দেখাতে গিয়ে আমাদের সম্পর্কের সমীকরণ নষ্ট করেন না।
-তোমার এসব কথা-বার্তা আমার একটুও পছন্দ হয় না! কোথায় মিলেমিশে থাকবা, তা না— মেন্টাল একটা!
ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব।ঘর জুড়ে পায়চারি করে নিজের রাগদমালো তারপর বলল,
-পেটের ব্যথা কমেছে?
-হ্যাঁ।শোনেন…
-বলো, শুনছি।
-আমাকে ভালোবাসেন না, তো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিলেন কেন?
জাহানারার গা জ্বালানো ভঙ্গিতে পুরোনো প্রশ্ন। আদিব তার দিকে হতাশ চোখে তাকাল। দুই বছর হয়ে গেল বিয়ের, বাচ্চা হতে চলেছে তাদের। দুইজন একে অপরের সাথে থাকার কত শত শপথ করেছে,আদিব কতবার তাকে বুঝিয়েছে তার জীবনে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ জাহানারা— তারপরেও মেয়েটা এখনো ঐ এক শব্দে আটকে আছে!মেয়েটা কি বোঝে না, সব কিছু মুখে বলতে হয় না, কিছু জিনিস বুঝে নিতে হয়?দুই দিকে মাথা নাড়ল সে। শব্দ করে শ্বাস ফেলল।
ঠিক তখনই কানে এল মায়ের গলা— বাবার উপর চটেছে মা।বুঝলো তার রাগ বাবার উপর ঝাড়ছে। জাহানারার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই পড়ি মরি ছুটল সে।
জাহানারা মুচকি হাসল। তার গমনরত পথের দিকে চেয়ে হাত রাখল উঁচু পেটে। স্নেহভরে হাত বুলাল সেখানে। ধিমে স্বরে আওড়ালো,
– “তোমাকে আমি বোকা মনে করেছিলাম, আদিব। কিন্তু তুমি দেখি ধুরন্ধর! মানে, প্রথমে জাহানারাকে পছন্দ করো না, সে তোমার যোগ্য না—ইত্যাদি ইত্যাদি বলে কি নাটকটাই না করলে! তারপর যেই দেখলে মেয়েটা নাম-যশ-খ্যাতি অর্জন করেছে, তোমার থেকে ভালো আছে, অমনি তল্পিতল্পা গুছিয়ে ওর জীবনে গেড়ে বসলে! লজ্জা করলো না তোমার?”
সামনে দৃষ্টি রেখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল রাকিব। আদিব তার কথা শুনে শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। রাকিব এবার ঘাড় ঘুরাল। দৃষ্টি ফেলল আদিবের মুখে। আদিব তাকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে ঠোঁট কোণে বাঁকা হাসি টানলো। শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
– “রাকিব ভাই, ইউ সাউন্ড লাইক সেলিনা আ্যন্টি। ভদ্রমহিলা আমাদের ঐ সামনের বাসায় থাকে,কখনো সোজা কথা সোজা ভাবে বলে না,ইনিয়ে বিনিয়ে মানুষ কে ছোট করে। আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে তার এই কথার ধরণ ঠিক মানাচ্ছ না।।যা বলার সোজাসুজি বলুন। খামাখা মেয়েলি প্যাচাল পাড়ছেন কেন? যার নাম-যশের লোভের কথা বলছেন, তার নাম-যশ-খ্যাতি পাওয়ার জন্য মনে হয় না আমার সামান্যতম এফোর্টের প্রয়োজন ছিল।সে যে আমার নামে সব লুটিয়ে বসে আছে— এটা আর কেউ না জানলেও, আশা করি আপনি ভালোই জানেন! অ্যাম আই রাইট?”
আদিবের স্পষ্ট কথা। রাকিবের চোয়াল শক্ত হলো। সহজে রাগের বশবর্তী না হওয়া মানুষটা তড়াক করে রেগে উঠল। আদিবের দিকে এগিয়ে এল। মুখোমুখি দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
– “স্বামীর অভিনয় করতে বলা হয়েছিল তোমাকে,স্বামী হতে বলা নয়! হাউ ডেয়ার ইউ টাচ মাই জাহান?”
রাকিবের কণ্ঠে আক্রোশ, চোখে আগুন। যে মেয়েটাকে এতগুলো বছর আগলে আগলে রেখেছে, কাউকে তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেয়নি, তার গায়ে একটা ফুলের টোকা পড়তে দেয়নি—সেই মেয়ের গায়ে এই ছেলের থাবা মেনে নিতে পারছে না সে। ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে তার। তার জাহানকে কেউ ছুঁয়েছে—এটা ভেবে দুনিয়া জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে।
– “অ্যান্ড হু আর ইউ? আপনি কে হন?আমি আমার স্ত্রীকে স্পর্শ করবো কি করবো না, সেই কৈফিয়ত আপনাকে কেন দেব?”
“স্ত্রী” শব্দটা ধারালো ছুরির মতো বিধল রাকিবের অন্তরে। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিল সে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু পুরনো অভ্যাস নতুন যন্ত্রণায় খুব একটা কার্যকর হলো না। উল্টো, বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠল জাহানারার মসৃণ গলায় লালচে বর্ণের সূক্ষ্ম ক্ষতটা—যেটা তার বেদাগ ত্বকে মানিয়ে গেলেও রাকিবের মন মানলো না। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলল সে। আদিবের চোখে চোখ রাখল। বিষধর সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
– “আই হেইট ইউ, আদিব!”
কথাটা বলে হাঁটা দিল সদর দরজার দিকে। আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। যেকোনো সময় নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে সে—যেটা তার জন্য ভালো হবে না, মোটেও ভালো হবে না। এ কথা মাথায় রেখে প্রস্থান করল রাকিব।
রাকিব চলে যেতেই সামনে পড়ে থাকা গাছের খালি টবে সজোরে লাথি মারল আদিব। টবটা ছিটকে গিয়ে পড়ল সামনে। ইটের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে ঠাস করে শব্দ তুলে ভেঙে গেল সেটা। টব ভাঙার শব্দে চমকে তাকাল হাশেম। আদিব অবশ্য সেদিকে খেয়াল করল না। সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ভেতরে ঢুকল। ড্রইংরুম পার করার সময় জাহানারা এসে সামনে দাঁড়াল। তার পিছন দিকে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “রাকিব ভাই আপনার সঙ্গে ছিল না? কোথায় গেল?”
রাকিবের কথা শুনে ক্রমবর্ধমান রাগটা আরো বাড়ল আদিবের। জাহানারার দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে বলল,
– “জাহান্নামে।”
কথাটা বলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল সে। জাহানারা তার কথায় অবাক হলো। বুঝতে পারল না, হঠাৎ কী হলো ছেলেটার। উঁকি মারল বাইরে, কিন্তু রাকিব কিংবা তার বড় গাড়িটাও চোখে পড়ল না। অজ্ঞাত নেহাকে রাকিবের নাম্বারে ফোন করার কথা বলে ছুটল সে আদিবের পিছু। আদিবের ঘরে ঢুকে বারবার জিজ্ঞেস করল,
– “কী হয়েছে? আপনি এমন করছেন কেন?”
কিন্তু আদিব তার কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না।
– “কী হয়েছে, বলবেন তো? এমন উইয়ার্ড বিহেভ এর মানে কি?”
এবার ধৈর্য্য চ্যুত হলো আদিব। জাহানারার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
– “ভাইয়ের ভাগারের আকাল পড়েছে তোমার, যে আবার একটা ভাই যোগাড় করেছ? রাকিব সারোয়ারের সঙ্গে কি তোমার?কান খুলে শুনে রাখো, আজ থেকে ওনার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করবে তুমি। আন্ডারস্টুড?”
গর্জে উঠল আদিব। জাহানারা চমকাল। ভয়ভীত চোখে তাকাল। আদিব ছেড়ে দিল তাকে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে পায়চারি করতে লাগল। *”কত বড় সাহস! সে তার বউকে ছুঁবে কি ছুঁবে না, তার কৈফিয়ত না কি বাইরের লোককে দিতে হবে!”* বয়সে বড় না হলে থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিত লোকটার। বেয়াদব!ভেতরে ভেতরে ফুসে উঠে বলল আদিব।
আদিবের গর্জন-তর্জন দেখে প্রাথমিকভাবে জাহানারা ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নিল।একটু সময় নিয়ে ধাতস্থ হলো । তারপর ইতস্তত কণ্ঠে জানতে চাইল,
– “রাকিব ভাই কিছু বলেছে আপনাকে?”
আদিব চুপ। বড় বড় দম ফেলছে। জাহানারা একটু এগিয়ে গেল। রাগে গনগনে লাল মুখটার দিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বলল,
– “এমন ধোঁড়া সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছেন কেন? কী হয়েছে, বলুন!”
জাহানারার কথা শেষ হতেই তার উপর অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল আদিব। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– “গেট আউট!”
– “আরে, বলবেন তো—”
– “আউট!”
ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল আদিব। জাহানারা তড়িঘড়ি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। জাহানারা বের হতেই স্বজোরে ঘরের দরজা আটল আদিব। জাহানারা বিরক্ত হলো তার উপর। কী হয়েছে সেটা না বলে জংলি হাতির মতো আদিবের এই দাপাদাপি পছন্দ হলো না তার। তবে চিন্তিত হলো কিঞ্চিৎ। হঠাৎ কী এমন হলো, ভেবে পেল না। রাকিব আর আদিব পূর্বপরিচিত—খুব বেশি সখ্যতা না থাকলেও একেবারে খারাপ সম্পর্ক না তাদের। দেখা-সাক্ষাৎ হলে খুব সুন্দরভাবে নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে। তাহলে আজ কী এমন হলো যে আদিব এমন করেছে?
এমন সব বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে নিচে নামল জাহানারা। সোফায় বসে নেহাকে ডাকল। চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
মুখ কাঁচুমাচু করে বলল নেহা। তার মনে হচ্ছে, আদিব হয়তো কিছু বলেছে রাকিবকে। তখন যেভাবে তার কাছে রাকিব আর তার ম্যামের সম্পর্কে প্রশ্ন করছিল… নেহা আমতা আমতা করে বলল,
– “ম্যাম, আমার মনে হচ্ছে আদিব স্যার কিছু বলেছেন রাকিব স্যারকে।”
– “এবং এটা তোমার কেন মনে হচ্ছে?”
– “আদিব স্যার তখন আমার কাছে রাকিব স্যার আর আপনার বিষয়ে জানতে চাইছিলেন। এই যেমন—রাকিব স্যার প্রতি বছর আপনার জন্মদিনে এভাবে আসে কি না, তারপর আপনাদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক…”
– “এসব আদিব ভাই জিজ্ঞেস করেছে?”
বিস্মিত কণ্ঠে জাহানারা। আদিব সচরাচর কারো বিষয়ে মাথা ঘামায় না—আর যদি বিষয়টা হয় তার, তাহলে তো প্রশ্নই ওঠে না। আদিবের তার প্রতি এমন কৌতূহল তার বিস্ময়ের কারণ।
নেহা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। নেহার সম্মতি পেয়ে জাহানারার ঠোঁটের কোণে দেখা দিল বাঁকা হাসি। টি-টেবিলের উপর দুই পা তুলে আয়েশ করে বসল সে। মাথার পিছনে দুই হাত দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে বলল,
– “বুঝেছো, নেহা? চাচির ছেলে জেলাস। তাও আবার সেই লেভেলের!”
ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো জাহানারার। নেহা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষণ আদিব তার কথা শুনে কী না কী মনে করেছে, এটা ভেবে ভয়ে ভীত হওয়া মনের ভয় দূর হলো।
______
– “রাকিব সারোয়ার বলেছে তোকে এসব কথা?”
অবিশ্বাস্য কণ্ঠে সজীবের। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা, যে রাকিব সারোয়ারের মতো ভদ্র-সভ্য, শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের লোক এমন কিছু বলতে পারে। আদিব বিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ বের করে তেতে উঠে বলল,
– “না, আমি মিথ্যা বলছি। খুশি?”
– “আহা…! চেতছিস কেন? আমি তো শুধু মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করছি। আসলে লোকটাকে এত বছর ধরে যেমন দেখে আসছি, মনে হয়নি এমন ধরনের কথা সে বলতে পারে। যাই হোক, তুই কি চুপচাপ তার কথা হজম করেছিস?”
– “আমার যা বলার বলেছি। ওসব বাদ দে। তুই তোর ভাগ্নীকে একটু বোঝা। আমি সতর্ক করেছি, তবে মনে হয় না মহারানী আমার কথা শুনবে। রাকিব ভাইকে আমার মোটেও সুবিধার লাগেনি, সজীব। আমার মনে হচ্ছে, লোকটা এতদিন একটা সভ্য-ভদ্র, পশ ভাব বজায় রেখেছিল—জাহানারার কাছাকাছি থাকার জন্য, তাকে পাওয়ার জন্য। এখন যেই দেখেছে জাহানারাকে পাওয়ার সম্ভাবনা আর নেই, সেই নিজের খোলস ছাড়তে শুরু করেছে।”
থামল আদিব। সজীব তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আদিব কি যেন ভেবে ফের বলল,
– “এটা অবশ্য আমার ধারণা, আমি নিশ্চিত না।আবার হতে পারে ‘ভালোবাসার মানুষ’কে হারানোর ভয়ে ভড়কে গিয়ে এমন আচরণ করেছে। অনেক কিছুই হতে পারে, তবে আমার একটুও ভালো লাগেনি তার ব্যবহার। তাছাড়া, তার চোখে যে আক্রোশ দেখেছি, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। ইট কুড বি হার্মফুল ফর জাহানারা।”
শ্বাস ফেলল আদিব। সজীব তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
– “আচ্ছা, তুই চিন্তা করিস না। আমি দেখছি। বাই দ্য ওয়ে, আজ পাগলিটার জন্মদিন—ইচ্ছা হলে স্পেশাল কিছু করিস।”
রাকিবের গা জ্বালানো কথার তাপে জাহানারার জন্মদিনের কথা মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিল আদিবের।সজীবের কথায় শুনে যেটা মনে হলো।তবে স্পেশাল কী করবে, সেটা ভেবে চিন্তায় পড়লো। কারো জন্য কীভাবে স্পেশাল কিছু করা যায়, সে সম্পর্কে একদম ধারণা নেই আদিবের। সারাজীবন পড়াশোনার নামে বইয়ের পুকুরে ডুবে থেকেছে। কপালগুণে যে সব বন্ধুবান্ধব জুটেছে, তাদের সাথে নির্দিষ্ট বিষয় ব্যতীত ব্যক্তিগত ব্যাপারে খুব একটা খোশগল্প হয়নি। কথাটা অদ্ভুত হলেও সত্য যে, আজ পর্যন্ত কোনো বন্ধুবান্ধবের বিয়ে-শাদি বা জন্মদিনে যাওয়া হয়ে ওঠেনি তার। খুব কাছের কেউ হলে শুধু ‘হ্যাপি বার্থডে’ টেক্সট পাঠিয়ে নিজের দায় সেরেছে। সুতরাং, তার তেমন কোনো জ্ঞান নেই এ বিষয়ে। সজীব বলল, “ইচ্ছে হলে কিছু করিস।” কিন্তু ইচ্ছা হলেই যে সব কিছু করা যায় না বা পারা যায় না, এটা কীভাবে বোঝাবে সে ছেলেটাকে?
সজীবের কথার প্রেক্ষিতে নীরব রইল আদিব। সজীব ধারণা করল, তার ভাগ্নির প্রতি এখনো অতটা টান আসেনি আদিবের। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ম্লান হেসে বলল,
– “বেশি চিন্তা করতে হবে না। বাগান থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে দিস, তাতেই মেয়েটা খুশি হয়ে যাবে। আচ্ছা,ভালো থাকিস। রাখছি।”
ফোন কাটল সজীব। সজীব ফোন কাটতেই জানালা দিয়ে বাগানে উঁকি দিল আদিব। তার ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে দেখা যায় তাদের বাগান। হাশেম ইতিমধ্যে বাগানের ময়লা পরিষ্কার করে পরিপাটি করে গুছিয়ে নিয়েছে। আদিব চারিদিকে চোখ বোলাল, কিন্তু ফুল তো দূরের কথা, ফুলের কলিও চোখে পড়ল না। গত রাতের ঝড় বাগানের গাছগাছালি সব পিষে রেখে গেছে। নিরাশ হলো আদিব। জাহানারাকে ঠিক কী দেওয়া যায়, এটা ভেবে পেল না।
এরমধ্যে দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। আদিবের বুঝতে অসুবিধা হলো না কে এসেছে। দরজা খুলল সে। দরজা খুলতেই জাহানারা দাঁত কেলিয়ে হাসল। আদিবের হাতের নিচ দিয়ে চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে ঘরে ঢুকে গেল। দাঁত বের করে হেসে বলল,
– “আপনি যে এত হিংসুক, জানা ছিল না তো! আদিব ভাই।”
– “আই অ্যাম নট ইয়োর ভাই।”
শব্দ মিশ্রিত হতাশ শ্বাস ফেলল আদিব। দরজা ঠেলে দিয়ে সোফায় এসে বসল। তারপর জাহানারার দিকে তাকিয়ে সেভাবেই বলল,
– “এক সময় তো মেরে মেরেও মুখ দিয়ে ‘ভাই’ বের করা যেত না। এখন কথায় কথায় তিনবার করে ‘ভাই’ ডাকো। তোমার কি মনে হয়, আমি বুঝি না তুমি কেন এমন করো?”
আদিবের কথায় থতমত খেল জাহানারা। সে ইচ্ছাকৃতভাবে আদিবকে ‘ভাই’ বলে, যেন আদিব বিরক্ত হয়। কিন্তু ছেলেটা যে তার অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে, এটা ভেবে একটু অপ্রস্তুত হলো। তবে স্বভাবসুলভ দমল না। আদিবের পাশে গিয়ে বসল। অবুঝ সুরে বলল,
– “আমি কেন এমন করছি, আদিব ভাই……?”
জাহানারার এই বিরক্তিকর কথায় ভাবান্তর হলো না আদিবের।সে নির্লিপ্ত চোখে জাহানারার দিকে তাকাল।চোখ পড়ল জাহানারার পরিবর্তিত ঠোঁটে ও গলায় থাকা লালচে দাগে। মনে পড়ল গতকাল রাতের কথা। আদিবের মনে হলো, মেয়েটা ভুলে গেছে হয়তো গতকালের কথা, তাই তো এতটা স্বাচ্ছন্দ্যে তার চোখে চোখ রাখছে, তার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে আদিবের মনে দুষ্ট বুদ্ধি উঁকি দিল।মন বলল,” মেয়েটাকে গতকালের কথা বলে একটু লজ্জায় ফেললে কেমন হয়!”
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। কোনো কথাবার্তা ছাড়া হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল রাখল সে জাহানারার ঠোঁটে। মিহি কণ্ঠে বলল,
– “কিন্তু কাল রাতে তো লাইট ছিল না, অন্ধকারে আপনি আমার ঠোঁট দেখলেন কীভাবে?”
বাকশূন্য হলো আদিব। বুঝতে পারল, ভুল হয়েছে তার। লজ্জাহীন মানুষকে অযথাই লজ্জায় ফেলতে চেয়েছে সে। জাহানারাকে লজ্জায় ফেলতে গিয়ে আদিব নিজেই লজ্জায় পড়ল। এমন পরিস্থিতিতে পরিত্রাণ পেতে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো । দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। যেতে যেতে দুই দিকে মাথা নেড়ে বিড়বিড়ালো,
– “শেমলেস!”
আদিব উঠে যেতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল জাহানারা। তবে সেই হাসিটা ততক্ষণই স্থায়ী হলো, যতক্ষণ আদিবের পদধ্বনি শোনা গেল। আদিবের পায়ের শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যেতেই বড় বড় দম ফেলল জাহানারা। সামনে থাকা পানির জগ হাতে তুলে নিয়ে জগ থেকেই পানি খেতে লাগল। পানির জগ নিচে রেখে কম্পমান হাত দিয়ে সোফার ফোম চেপে ধরে অনেকটা স্বগোতক্তি করে বলল,
– “ওয়েল ডান, জাহানারা! আরেকটু হলে ইজ্জত পাংচার হয়ে যেতো!”
আদিবের স্পর্শ পাওয়ার পর নিজেকে কিভাবে যে স্বাভাবিক রেখেছে সেটা জাহানারা নিজেও জানে না।তবে আদিবের হঠাৎ কথার মোড় ঘুরানো তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল— ছেলেটা তাকে নাস্তানাবুদ করতে চাইছে।সেই জন্য নিজের অনুভূতির আলোড়ন লুকিয়ে আদিবের সামনে এমন ভাব করেছে যেন উল্টো সে লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যায়। কারণ এই ছেলে কে সে যতটুকু জানে ,যদি একবার বুঝতে পারতো জাহানারা লজ্জা পাচ্ছে তাহলে সেটা নিয়ে বারবার তাকে লজ্জায় ফেলতো।সময় নতুন হলেও মানুষ টা তো পুরনো! কথাটা মনে করে ঠোঁট চওড়া হলো জাহানারর ।এ যাত্রায় এক ভ’য়াব’হ বি’পদ থেকে রক্ষা পেয়েছে সেটা ভেবে স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে।
_______
– পাগলামির একটা সীমা আছে, রৌদ্র! কী শুরু করেছো কী?”
মায়ের কণ্ঠে ভাবান্তর হলো না রাকিবের। হাতে থাকা ফোটো ফ্রেমটা শ্বেতপাথরের মেঝেতে সজোরে ছুঁড়ে ফেলল। মায়ের দিকে ফিরে শীতল কণ্ঠে বলল,
– পাগলামি তো এখনো শুরুই করিনি এখ…
কথা শেষ করতে পারল না রাকিব। তার আগেই মিসেস সারোয়ার সজোরে চড় বসাল ছেলের গালে। রাকিব স্তব্ধ হলো। তবে ‘টু’ শব্দ করল না। ক্লান্ত পথিকের মতো পা ছড়িয়ে বসে পড়ল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা চূর্ণ-বিচূর্ণ জড়বস্তুর মাঝে।মিসেস সারোয়ার ছেলের এমন স্থবিরতায় গুরুত্ব দিল না।সে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
– “বড্ড বাড়া বেড়েছো, হ্যাঁ? কিছু বলি না বলে যা খুশি তাই করবে? বেয়াদব! আর একটা কথা বললে চাপকে পিঠের ছাল তুলে নেবো তোমার!”
চোখ ঘুরিয়ে ঘরের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে মেজাজ খারাপ হলো মিসেস সারোয়ারের। সে রাগে গজগজ করতে করতে ফের বলল,
– “আমি তোমার বাবাকে আজই বলছি—শামসুল ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। লাবিবার সাথে তোমার বিয়ে পাকা করতে। অনেক হয়েছে, আর না। জাহান-জাহান করতে করতে পাগল হয়ে গেছ। এবার—! রৌদ্র!”
আতকে উঠল মিসেস সারোয়ার। রাকিব মায়ের আতঙ্কিত মুখ দেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। হাতে থাকা ধারালো কাঁচের টুকরোটা কব্জির কাছে আরেকটু গেঁথে পাগলের মতো হেসে বলল,
পরের দিন, খুলনা মেডিকেল থেকে সজীবের পাঠানো স্বাস্থ্যকর্মী এসে করোনা টেস্টের জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করল আদিবের থেকে। সরকারি ল্যাবগুলোতে সাধারণত সময় বেশি লাগলেও সজীবের উপস্থিতিতে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই রিপোর্ট হাতে এলো। রিপোর্ট দেখে সজীব নিশ্চিত হলো আদিবের করোনা হয়নি। জাহানারাকে কথাটা বলতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। এই অসময়ে সজীবের সাহায্যের জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতেই যাচ্ছিল জাহানারা, তার আগেই থমথমে গলায় সজীব বলে উঠলো,
—পাপ তো কম করিসনি, এবার ছেলেটার সেবা করে একটু সওয়াব কামা।
—এননোনমঙনোও…!
সজীবের কথার উত্তরে ভেঁচি কাটলো জাহানারা। এটা তার পুরনো অভ্যাস, এবং সজীব তার ভুক্তভোগী। সজীব রেগে উঠল তার কাণ্ডে। রাগান্বিত স্বরে তেতে উঠে বলল,
—মানুষ হবি না তুই? ডাইনি! এই দুলাভাইকে কি বলেছিলি তুই? মানুষটা এমনি অসুস্থ! তোর কথা শুনে দুই দিন বিছানায় ছিল সে।
বাবার অসুস্থতার কথা শুনে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো জাহানারার। চোখ জ্বলতে লাগলো। কান্না গলায় দলা পাকিয়ে এলো। কথা জোগালো না আর। সজীব তার কথার জন্য অপেক্ষাও করলো না। সে নিজের মতো বলতে লাগলো,
—যা হয়েছে, হয়ে গেছে জান। সেসব পুরনো অতীত। কেন শুধু শুধু সেসব টেনে আজ, আগামী নষ্ট করছিস? এত বছর তো অতৃপ্ত আত্মার মতো ঘুরে বেড়াতিস এই বলে যে আদিব তোর ভালোবাসার মূল্য দিলো না, ওর জন্য তোর সাথে এই হলো, ঐ হলো। এখন তো ছেলেটা তোকে সুযোগ দিচ্ছে, এখন তাহলে বাড়াবাড়ি করছিস কেন? এখনো সময় আছে, ভালো হয়ে যা।
—তোর বন্ধুর কাছে তোর সাথে কুটনামি করা হয়ে গেছে! শোন ছোট মামা, তোর জ্ঞান তোর কাছে রাখ। আমার যা মনে চাই, আমি তাই করব।
—কর! যা ইচ্ছা কর। মর! আমার কি?
খট করে কল কাটলো সজীব। জাহানারা আদিবের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালো। গত দুই রাত মাথা যন্ত্রণায় ঘুম হয়নি ছেলেটার। সজীবের পাঠানো ওষুধ দিয়েছিল, তাতেও কাজ হয়নি। পরে আদিব নিজে ওষুধের নাম লিখে দিয়েছিল জাহানারাকে। জাহানারা দারোয়ানকে দিয়ে সেটা আনিয়ে খাওয়ানোর পর ঘুমাতে পেরেছে সে।
সজীবের কাছ থেকে তার ও আদিবের মধ্যকার কথোপকথনের আভাস পেয়ে রাগ হলো জাহানারার। তার ধারণা ছিল, আদিব আর যাই হোক, তাদের ভেতরের স্বামী-স্ত্রীর কথা কাউকে বলবে না। তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেল সে। যদিও কষ্ট পাওয়াটা নিরর্থক ছিল, কারণ আপাতদৃষ্টিতে জাহানারা থেকে সজীবের সাথে সম্পর্ক ভালো আদিবের। দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও ফোনে নিয়ম করে কথা হয় তাদের। সেখানে জাহানারার সাথে নেই-নেই, আছে-আছে সম্পর্ক। সুতরাং আদিব তার বিষয়ে সজীবের কাছে বলতেই পারে; তাছাড়া সজীব তার আপন মামা। জায়েদ কিংবা আকিবের থেকে জাহানারা তাকে মান্য করে, তার ভাগ্নির কীর্তি আদিব তাকে বলবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জাহানারা এসব যুক্তি-তর্ক দেখলো না, সে মুখ ফুলিয়ে রইলো।
আদিবের ঘুম ভাঙলো দুপুর গড়িয়ে। জাহানারা তখনো তার সামনে বসা। জাহানারাকে নিজের সামনে গুম হয়ে বসে থাকতে দেখে আদিবের ভ্রূতে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো। অলস শরীর টেনে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে বলল,
—কি হয়েছে?
—আপনি ছোট মামার সাথে আমার নামে কুটনামি করেছেন কেন? ছিঃ ছিঃ! আমি আপনাকে এরকম ভাবিনি!
জাহানারার কথা শুনে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো আদিব। সেদিন সন্ধ্যায় রাগের মাথায় সজীবকে ফোন করে কথাগুলো বলেছিল সে। সজীব যে তার ভাগ্নির কানে সেসব পৌঁছে দেবে, এটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। সে নিজের স্বপক্ষে ইতস্তত করে বলল,
—মোটেও কুটনামি করিনি আমি। শুধু সত্যি বলেছি। এখন সজীব সে কথা যদি বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বলে, সেখানে আমার কি?
—আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ভেতরের কথা আপনি উগলাতে গেলেন কেন মামার কাছে?
স্বামী-স্ত্রীর ভেতরের কথা! আদিব ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো জাহানারার দিকে। ফিক করে হাসলো। জাহানারা যেন বুঝতে পারল না আদিবের হাসির মানে, সে তড়াক করে বলল,
—অমন শয়তানি হাসি দিবেন না। আপনাকে আমি স্বামীও মানি, আবার আমরা স্বামী-স্ত্রী—সেটাও মানি।
—কখন বললাম সংসার মানি না? আজব! শোনেন, আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনাকে শান্তিতে থাকতে দিতে চাই না—এর মানে এই নয় যে ঘর-সংসার মানবো না। হ্যাঁ, সেটা আলাদা ব্যাপার যে আমি ঘর-সংসার কিভাবে করতে হয়, আপাতত জানি না। তবে শিখে নেব। এর মানে এই নয় যে আমি আপনাকে স্বামী মানি না, আমাদের বিয়ে মানি না। একটা কথা ভালো করে শুনে রাখুন—আমাদের ভিতরে মারামারি, কাটাকাটি যা হয় হোক, কাউকে বলবেন না। এমনকি আপনার মাকেও না।
জাহানারা একদম ঠোট সেঁটে কথাগুলো বলে থামলো। আদিব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এই মেয়ে কখন কি বলে, কখন কি করে, কিছু বোধগম্য হয় না তার। এই তো দুই দিন আগের কথা, কার সাথে ফোনে কথা বলছিল আদিব—তাদের কথোপকথন স্পষ্ট শুনেছে—সে চিৎকার করে বলছিল, এই বিয়ে সে মানে না, আদিবকে স্বামী মানে না, এই বিয়েটা শুধু একটা প্রাঙ্ক, আদিবের কোনো যোগ্যতা নেই তার পাশে দাঁড়ানোর, ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো শুনে আদিবের খারাপ লেগেছিল খুব। অজানা এক বিশ্রী অনুভূতি বিষাক্ত সাপের মতো জড়িয়ে ধরেছিল ভেতরটা। সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, জাহানারার সাথে আর না। তার জীবনে এখনো অনেক কিছু করার বাকি। এই সম্পর্ক নিয়ে পড়ে থাকার সময় নেই তার। জাহানারা থেকে মুক্তি নিয়ে দ্রুত চলে যাবে সে লন্ডন। মনোযোগী হবে নিজের কাজে, নিজের সাধ্য-সাধনায়। সংসার জীবন আর পা রাখবে না। এই ভাবনা অনুযায়ী দুজন উকিলের সাথে কথা বলেছিল সে। তাদের মধ্যে একজন জানালো, আইনি কাজের জন্য তারপর মাত্রই বিয়ে হয়েছে, অন্তত তিন-চার মাস সময় লাগবে। আদিব তাকে কার্যক্রম আগে বাড়াতে বলল। সিদ্ধান্ত নিল, এর মধ্যে সে লন্ডন ফিরে যাবে; ডিভোর্সের দিন-তারিখ পড়লে তখন না হয় আবার আসবে। কিন্তু এর মধ্যে করোনা যে তাণ্ডব শুরু করলো! আদিবের ভেবে-চিন্তা রাখা প্ল্যানের বারোটা বাজালো।
—ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
আদিবকে নিজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল জাহানারা। জাহানারার কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো আদিবের। সে একটা শ্বাস টেনে বলল,
—দুই দিন আগেও আমি তোমার যোগ্য না এ কথা বলে আমাকে নিয়ে উপহাস করছিলে, বিয়েটাকে প্রাঙ্ক বলছিলে, আরো কত কথাই না বলছিলে। আর এখন আরেক কথা বলছো। তুমি আসলে চাও কি, জাহানারা?
আদিবের প্রশ্নে ভড়কে গেল জাহানারা। আদিবের দিনের পর দিন তাকে এড়িয়ে যাওয়ায় রাগে-ক্ষোভে আদিবকে শুনানোর জন্য ফোনে কথা বলার মিথ্যা অভিনয় করছিল সেদিন সে। কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য ছিল, আদিব যেন নিজে থেকে এসে কথা বলে, প্রতিবাদ করে, ঝগড়া করে। কিন্তু আদিবের নির্লিপ্ত ভাব তাকে আশাহত করেছিল। সেদিন রাগের মাথায় কি কি বলেছিল, আপাতত কিছু মনে পড়ছে না জাহানারার। আজকাল অনেক জিনিস মনে থাকে না। মাথায় লাগা আঘাতটা ভালোই ক্ষতি করেছে তার। মাঝে মাঝে দিপ্তীর ঐ কাজের মেয়েটার উপর ভীষণ রাগ হয় তার। “তোরা চুরি করে পালাবি পাল, চুরি-লুকাতে মা’র্ডার আর হাঁপ মা’র্ডার করতে গেলি কেন? ভালো হয়েছে, দুটোর যাবজ্জীবন জেল হয়েছে!”
—আপনি আড়ি পেতে আমার কথা শুনছিলেন?
নিজের অহেতুক ভাবনা পাশে রেখে চোখ সরু করে বলল জাহানারা।আদিবের মেজাজ খারাপ হলো এবার। রাগান্বিত কণ্ঠে সে বলে উঠলো,
—এতো বিরক্তিকর কেন তুমি? একটা সোজা কথার সোজা জবাব দেওয়া যায় না?
—এতো হাইপার হচ্ছেন কেন? কবে কি বলেছি, মনে নেই তো।
—ও প্লিজ, নাটক বন্ধ করো জাহানারা।
—সত্যি বলছি তো।
অসহায় মুখে বলল জাহানারা। জাহানারার সরল মুখটা দেখে আদিবের মন বলল, মেয়েটা সত্যি বলছে; কিন্তু মস্তিষ্ক বলল, এর ফাঁদে পা দিও না আদিব আহাসান। মস্তিষ্কের সাবধান বাণীতে টনক নড়লো আদিবের। সে শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—ফরগেট ইট। সজীব ফোন করেছে? রিপোর্ট কি এসেছে আমার?
—নেগেটিভ।
স্বস্তির শ্বাস ফেলল আদিব। অবশ্য সে কিছুটা আন্দাজ করেছিল, কিন্তু করোনা ভাইরাস তার যে আলাদা আলাদা রূপ দেখাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে তার নিজের থেকে বেশি জাহানারাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। একগুঁয়ে মেয়েটাকে শত ভয় দেখালেও তার কাছ ছাড়া করতে পারিনি। আদিবের তো ভয় হচ্ছিল, তার সেবা-যত্ন করতে গিয়ে মেয়েটা না আক্রান্ত হয়!
উঠে দাঁড়ালো আদিব। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে আবার পিছনে ফিরলো। জাহানারার লটকানো মুখটা দেখে বলল,
—মুখ লটকে আছে কেন? কি হয়েছে?
—আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। কেন?
—তুমি এ যাবৎ এত মিথ্যা কথা বলেছো যে, তোমার কথা বিশ্বাস করা আমার জন্য কষ্টসাধ্য। তোমার অবস্থা এখন সেই রাখাল আর বাঘের গল্পের রাখালের মতো। কেউ তোমাকে বিশ্বাস করবে না।
—আমাকে বাঘে খেয়ে ফেললে তখন?
—তোমার দোষে তোমাকে খাবে। এখানে আমরা কি করতে পারি!
—আমি মরে গেলে আপনি কাঁদবেন?
হুট করে কি ভেবে প্রশ্নটা করলো জাহানারা। তার খুব জানতে ইচ্ছা করলো, তার কিছু হলে আদিব কষ্ট পাবে কি না।আদিব তার প্রশ্নের উত্তরটা সাথে সাথেই দিল,
—না। হাঁপ ছেড়ে বাঁচবো।
—জানি তো, আবার বিয়ে করবেন। মনে মনে তো লাড্ডু ফুটছে আমার মরার কথা শুনে। আমি অত সহজে মরছি না, সোনা। সারাজীবন ঘাড়ের উপর বসে থাকবো। আরেকটা বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দেন।
ছ্যাঁৎ করে উঠলো জাহানারা। তারপর চোখ-মুখ কুঁচকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে আদিবের দিকে কটমটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধুপধাপ পা ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। জাহানারা চলে যেতেই আদিবের ঠোঁটের কোণে দেখা দিল মুচকি হাসি। কিছুক্ষণ পূর্বে জাহানারার মরার কথা শুনে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়ায় যে সামান্য বিঘ্ন ঘটেছিল, সেটা পুনর্বহল হলো।
_________
জাহানারা নিচে এসে দেখলো মহুয়ার রান্না-বান্না সব শেষ। সে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জায়েদদের বাড়িতেই থাকে সে। সালেহা বাবার বাড়ি থেকে মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিল। সালেহার কেমন দূরসম্পর্কের চাচার মেয়ে মহুয়া। মা-বাবা মারা গেছে বছর তিনেক। চাচার থেকে এক নে’শাখোরের সাথে বিয়ে দিয়েছিল মেয়েটার। সে নে’শা’র ঘোরে রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার আর জায়গা হয়নি শ্বশুরের ভিটায়। বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে, কিন্তু সেখানেও গতি হয়নি। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর চাচারা বাবার সহায়-সম্পত্তি শরীয়তের নামে জোর-জবরদস্তি দখল করেছে।
জাহানারার বড় মামা রাজীব মেয়েটার তোর দুরবস্থা দেখে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল, কিন্তু জাহানারার বড় মামির পছন্দ হয়নি সেটা। স্বামীর মুখের উপর কিছু না বললেও আড়ালে-আবডালে কথা শুনাতো সে মহুয়াকে। সালেহা সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয় একবার। তার ভালো লাগেনি বিষয়টা, তাই ভাইয়ের সাথে কথা বলে মহুয়াকে নিজের সাথে বাড়ি নিয়ে আসে। সেই থেকে এখানে থাকে মহুয়া। কাজে পারদর্শী, স্বল্পভাষী মেয়েটাকে সালেহা জাহানারার থেকে কম চোখে দেখতো না। কিন্তু সালেহা মরার পর তার অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তারিন এমনিতে ভালো হলেও শ্বাশুড়ির মতো অত মানবদরদী নয়। সে আর পাঁচটা কাজের লোকের মতো মহুয়াকে ট্রিট না করলে, সে যে একজন বাইরের মানুষ—সেই সূক্ষ্ম রেখাটা মেনে চলে। মহুয়া অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। এক যুবতী মেয়ে সে, এই বাড়িতে খাওয়া-পরার সাথে সুরক্ষা পাচ্ছে—এই তার কাছে ঢের।
—রান্না হয়ে গেছে?
ঢেকে রাখা পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো জাহানারা। মহুয়া থালাবাসন পরিষ্কার করছিল। সে সেগুলো করতে করতে স্পষ্ট কণ্ঠে উত্তর দিল,
—জ্বি।
জাহানারা তাকে বাসন মাজতে দেখে বলে উঠলো,
—ওগুলো করা লাগবে না আপনার। আপনি শুধু রান্না করে দিলেই হবে। আসলে ঐ ছেলেটা অসুস্থ, আর আমি রাঁধতে পারি না!
লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল জাহানারা। মহুয়া তার কথায় মৃদু হাসলো। বলল,
—সমস্যা নেই। আমি এগুলোও করে দেব। আপনার কষ্ট কম হবে।
—আপনার অসুবিধা হবে না?
—না। আমার অভ্যাস আছে।
—গ্রেট! তাহলে আপনি যতদিন আমাদের কাজের লোকগুলো ফিরে না আসে, আমাদের কাজ করে দিয়েন। আমি মাসে দশ হাজার করে দেবো, কেমন?
মাথা নাড়ালো মহুয়া। বুঝলো, জাহানারা তাকে তারিন হয়তো বাড়ির কাজের লোক হিসাবে পরিচয় দিয়েছে। সে আর নিজের পরিচয় দিল না। অবশ্য দিয়েও বা কি!
আজ প্রায় দুই দিন পর নিচে নেমলো আদিব। এই দুই দিন নিজের ঘরেই ছিল সে। চাচির এই অন্ত কুঁড়ে ,অলস মেয়েটা তার জন্য খাবার-দাবার উপরে নিয়ে যেতো। শুধু তাই নয়, নিজে হাতে খাইয়ে দিতো। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। যে মেয়ে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে গড়িমসি করে, সে না কি তার সেবা-যত্ন করেছে— যাকে না কি সে ঘৃণা করে! ইন্টারেস্টিং!
জাহানারা আদিবের পাশের চেয়ারে এসে বসলো। তারপর আদিব সেদিন যেভাবে খাইয়ে দেওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিল, ঠিক সেভাবেই বলল,
—হাত দিয়ে খেতে পারবেন? না খাইয়ে দেবো?
—নো থ্যাংকস, আমি পারবো। এমনিতে অনেক করেছেন।
কথাটা বলেই পাশ ফিরে তাকালো আদিব। চোখ পড়লো মহুয়ার দিকে। সাথে সাথে থমকালো সে। চোখ-মুখে খেলে গেল বিস্ময়। উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে।
—মাহিরা!
বহুদিন পর বাবার দেওয়া ভালো নামটা শুনে চমকে তাকালো মহুয়া। আদিবকে দেখে অবাক হলো কিঞ্চিৎ। প্রায় এগারো বছর পর ছেলেটাকে দেখছে সে। চেহারা-ছবি সব পাল্টে গেছে ছেলেটার, তবে কণ্ঠস্বরটা আগের মতোই আছে।
—আদিব? আদিব আহাসান?
—হ্যাঁ। তুমি এখানে…?
মহুয়ার হাতে খাবারের পাত্র আর তার মলিন কাপড়-চোপড় আদিবকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলল, তবে তার বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক খুব বেশি সময় নিলো না ব্যাপারটা বুঝতে। এর মধ্যে জাহানারা ফোড়ন কাটলো,
—আপনারা চেনেন একে অপরকে?
—হুম।
ছোট করে উত্তর দিল আদিব, তারপর মহুয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
—তোমার এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে? আঙ্কেল কোথায়?
*********কলেজে একসাথে ছিলো আদিব আর মহুয়া। খুলনায় বাসা ভাড়া করে থাকতো সে। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। বাবার টাকা-পয়সারও কমতি ছিল না। আদিবের সাথে খুব গলায় গলায় ভাব না থাকলেও ভালো একটা সম্পর্ক ছিল। আরো একটা কারণ আছে, যার কারণে মেয়েটাকে আজো মনে আছে তার। সজীব পছন্দ করতো মেয়েটাকে। আদিবকে প্রায় বলতো, “মামি হয় তোর রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলবি।”
বাবার নাম উঠতেই চোখে পানি ছলকে উঠলো মহুয়ার। কোনরকমে বলল,
—বাবা মারা গেছে, তিন বছর হলো।
আদিবের মুখটা চুপসে গেল কথাটা শুনে। দুই-একবার দেখা হয়েছে তার মহুয়ার বাবার সাথে। ভদ্রলোক সরকারি কলেজের প্রফেসর ছিলেন, অমায়িক আচার-ব্যবহার তার। মেয়ের পড়াশোনার খোঁজ নিতে প্রায় আসতো কলেজে, কোচিংয়ে তখন সজীবের সাথে আদিব থাকার দরুন দেখা হতো তার। অমায়িক হেসে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতেন, মাঝে মাঝে তাদের দুইজনকে পাশের হোটেলে নিয়ে গরম গরম ছানা জিলাপি খাওয়াতো। আদিবের এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেসব। সজীবের কাছে শুনেছে, টাকা-পয়সার কমতি ছিল না তাদের। তাহলে আজ তার একমাত্র মেয়ের এ দশা কেন—সেটা ভাবালো আদিবকে। তার ভাবনার মাঝেই কথা বলল মহুয়া,
—বাবা-মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর বড় চাচা জোর করে এক নেশাখোরের সাথে বিয়ে দেয় আমার। এক মাসের সংসারের মাথায় আমার স্বামী মারা যায়। বাড়ি ফিরে দেখি, চাচারা বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি শরীয়তের বিধান দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছে। আমি সন্তান হিসাবে যেটুকু পাবো, সেটুকুও না কি আমার বিয়েতে খরচ করে শেষ হয়েছে। আমার আর কিছু নেই বলে দাবি করেছে। আমার আর কিছুই নেই। কিছু না।
কথাগুলো বলতে গিয়ে ডুকরে উঠলো মহুয়া। আদিব তার দিকে তাকিয়ে জাহানারার দিকে তাকালো, চোখের ইশারায় তাকে সামলাতে বলল। কিন্তু জাহানারা তো জাহানারাই, সে এসব পারে না। বড়জোর মুখ দিয়ে দুটো মিষ্টি কথা বের করতে পারবে সে, কিন্তু কাউকে সান্ত্বনা দেওয়া, তার দুঃখে তাকে আগলে নেওয়া—এটা তার জন্য কষ্টকর। সে আদিবের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো, ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ালো—যার অর্থ, “কি করবে?” আদিব হতাশ শ্বাস ফেলল একটা, তারপর নিজেই বোঝানোর সুরে বলল,
—মহুয়া, শান্ত হও। বসো। পানি খাও একটু।
গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিল আদিব। মহুয়া বসলো। একটু খানি চুমুক দিয়ে পানি খেল। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলালো। একটু সামলে উঠতেই আদিব জিজ্ঞেস করলো,
—পড়াশোনা শেষ করোনি? তুমি তো ভালো স্টুডেন্ট ছিলে।
—মেডিকেলে পরপর দুবার দিয়েও তো হলো না। এরপর পাবলিকে ভর্তি হলাম। তৃতীয় সেমিস্টারের মাঝামাঝি পর্যায় এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। যক্ষ্মা ধরা পড়লো। যক্ষ্মা সারিয়ে পড়াশোনার জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে সেমিস্টার গ্যাপ হলো। এরপর মাথায় কি চাপলো, পড়াশোনা আর হলো না।
একটা ভারী দীর্ঘশ্বাসের সাথে নিজের কথা শেষ করলো মহুয়া। তার এই স্বল্প জীবনের করুণ গল্পে ভারী হলো পরিবেশ। আদিব কিছু সময় চুপ থেকে মনের এক অদম্য কৌতূহলে নিজের সীমা অতিক্রম করে একটা প্রশ্ন করে বসলো,
—ইমরান ভাই…
আদিবের অসামাপ্ত বাক্যে ক্লিষ্ট চোখে তার দিকে তাকালো মহুয়া। তার চোখের দৃষ্টি আদিবকে বলে দিল, ভুল হয়েছে তার। মহুয়ার পুরনো ক্ষতে কৌতূহলী হয়ে আঘাত হেনেছে সে!
চলবে, ইনশাআল্লাহ।
#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৭
সাহসের অভাবে আদিবকে সাথে নিয়েই মহুয়ার কাছে নিজের মনের কথা জানাতে গিয়েছিল সজীব। কিন্তু সেখানে পৌঁছে মহুয়াকে এক ছেলের সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে থমকে গেল সে। মুহূর্তেই মন পাল্টালো।
মহুয়া প্রথমে অপ্রস্তুত হলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে জানালো—ছেলেটি তার বাগদত্তা, নাম ইমরান। বড় খালার ছেলে। ঘরোয়া পরিবেশে তাদের আংটি বদল হয়েছে, তাই এখনো সবার কাছে জানানো হয়নি।
মহুয়া আদিব আর সজীবকে ইমরানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর সেদিন অনেকটা সময় বসেছিল তারা। একে অপরের সামনে বেশ গল্প-আলাপ হয়েছিল তিনজনের ভেতরে। আদিব অবশ্য সজীবকে নিয়ে চিন্তিত ছিল। কিন্তু ছেলেটা তার চিন্তা হওয়া উড়িয়ে দিয়ে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখেছিল। যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখা—এটা অবশ্য সজীবের মহৎ গুণ। আদিব সেটা বুঝতে পেরেই কোচিংয়ের দোহাই দিয়ে সজীবকে নিয়ে উঠে এসেছিল। ওদের সামনে থেকে আসার পর আদিব দেখেছিল সজীবের সেই ভগ্ন রূপ। আভাস পেয়েছিল, প্রথম ভালোবাসার ব্যর্থতা মানুষকে কতোটা পীড়িত করে। সেদিন মনে মনে ভেবে নিয়েছিল, ভালোবাসা নামক এই জঞ্জালে সে কখনো জড়াবে না। কখনো না।
—আমার যক্ষ্মা ধরা পড়ার পর খালা সম্পর্ক ভেঙে দিল। ইমরানও চুপচাপ মেনে নিল।
নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল মহুয়া। আদিবের ভাবনায় ছেদ পড়লো। মহুয়ার কথা কিঞ্চিৎ অবাক হলো সে। ইমরানের সাথে দুই-একবার যা দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, আদিবের কখনো মনে হয়নি ছেলেটা এমন মেরুদণ্ডহীন।
—ব্লাডি মামার বয়!
বিড়বিড় করে বলল জাহানারা। মহুয়া কথাটা না শুনলেও আদিবের কানে গেল সেটা। আড়চোখে তাকালো সে জাহানারার দিকে। মুখ থমথমে তার। মনে হচ্ছে, ইমরান মহুয়ার সাথে না, তার সাথেই প্রতারণা করেছে। আদিবের দৃষ্টি অনুভব করে তার দিকে তাকালো জাহানারা। সঙ্গে সঙ্গে নজর ঘুরালো আদিব। মহুয়ার দিকে দৃষ্টি ফেরালো। মহুয়া চোখের পানি মুছে বলল,
—আমার কথা বাদ দাও, তোমার কি খবর? শুনেছিলাম বিদেশে গিয়েছ? কবে ফিরলে?
—এতো দিনে ফিরে যেতাম, কিন্তু একটু ঝামেলায় পড়লাম। এরপর যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলামই, কি করোনা প্রকোপে আটকে গেলাম। দেখি সামনে পরিস্থিতি কী হয়। তবে ফিরতে হবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল আদিব। আদিবের ফিরে যাওয়ার কথা শুনে জাহানারা বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই আদিবের বলা “ঝামেলা” শব্দটা মনে হতেই বিরহের সুর যেন অপমানের গান গাইলো। মুখ জুড়ে অন্ধকার নামলো তার। ঝামেলা বলতে আদিব যে জাহানারাকে বুঝিয়েছে—এটা যেন দৈববাণী হলো তার কানে। চোয়াল শক্ত হলো তার।
আদিবের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই, সে মহুয়ার সাথে কথায় ব্যস্ত। মহুয়া কোথায়, কীভাবে আছে, সেটা আগ্রহভরে শুনছে। জাহানারা নামক মেয়েটা যে এখানে উপস্থিত, সেটা ভুলে বসেছ। একের পর এক প্রশ্ন করছে সে মহুয়াকে। মহুয়াও খুশি মনে তার উত্তর দিচ্ছে। জাহানারা যেন অদৃশ্য তাদের কাছে। নিজের এমন অবহেলা গায়ে লাগলো জাহানারার। রাগ হলো আদিবের ওপর।
মনে মনে প্রশ্ন জাগলো—মহুয়া অসহায়, কিন্তু তাই বলে তার বিষয়ে এতো আগ্রহ কেন দেখাতে হবে? দিন-দুনিয়া ভুলে এতো কথা বলতে হবে কেন? কৈ, সে তো এতদিন ধরে ছেলেটার সাথে আছে, কখনো তো তার বিষয়ে এতো কৌতূহল দেখায় না! অথচ কারো কোনো সহপাঠীকে নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই! এই ছেলে না কি কারো সাথে কথা বলে না, কারো বিষয়ে কৌতূহল দেখায় না—তাহলে মহুয়ার ব্যাপারে এতো মনোযোগী হচ্ছে কেন?
সন্দেহের ছায়ায় প্রশ্নগুলো মনের গভীরে উঁকি দিতেই মহুয়ার ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো জাহানারা। মলিন কাপড়েও মেয়েটার সৌন্দর্য ভাটা পড়েনি। চোখ-মুখে এক আলাদা মায়া, আর সবচেয়ে আকর্ষণীয়—কোমর ছাড়ানো লম্বা বেণী, যা তার সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মহুয়ার লম্বা বেণী দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো জাহানারার। জ্বলে উঠলো ভেতরটা। ঈর্ষান্বিত হলো মন। হাত চলে গেল ঘাড়ে। অপারেশনের পর চার মাস অতিক্রম হয়েছে, কিন্তু তার চুল মাত্র মাথার ত্বক ঢেকে ঘাড় ছুঁয়েছে। এই চুল লম্বা হয়ে আগের মতো হাঁটু ছাড়াতে কত সময় লাগবে, আল্লাহই জানেন। মনে মনে দিপ্তীর কাজের মেয়ে রেণু আর তার প্রমিকের উদ্দেশ্যে মোটা মোটা দুটো গালি দিল জাহানারা। তবু যেন ভেতরের আগুন নিভলো না।
এটা অবশ্য নতুন নয়। আদিবের আশেপাশে কাউকে দেখলেই অকারণে এমন ঈর্ষান্বিত হয় জাহানারা। চুলের শোক, আদিবের মহুয়ার প্রতি মনোযোগ—ঠিক কী কারণে জাহানারার মেজাজ টঙে উঠলো, কে জানে! সে তাদের কথার ছন্দে বাধা দিতে কাঠখোট্টা গলায় আদিবের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
—খাবেন না, না কি কথা বলেই পেট ভরবেন?
কথাটা বলেই ঠপ করে চেয়ারে বসলো জাহানারা। আদিব তার বাজখাই গলায় চমকে উঠলো। মহুয়াও কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। জাহানারা তাদের সেই পরিবর্তিত অভিব্যক্তি দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না। সে নিজের প্লেট টেনে খাবার নিতে লাগলো। খাবারের বাটিতে চামচের আঘাতের অস্বাভাবিক শব্দ যেন তার রুষ্টতা প্রকাশ করলো।
জাহানারা হঠাৎ এমন আচরণে আদিব অবাক হলো। এই তো ঠিক ছিল, মেয়েটা হঠাৎ আবার কী হলো? ভ্রূতে গাঢ় ভাঁজ পড়লো। তবে মহুয়ার কাচুমাচু মুখ দেখে তার সামনে পরিস্থিতি সামলাতে জোরপূর্বক হেসে বলল,
—হ্যাঁ, খেতে হবে। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। মহুয়া, বসো আমাদের সাথে। একসাথে লাঞ্চ করি।
—আমি খেয়েছি, তোমরা খাও।
মিথ্যা বলল মহুয়া। জাহানারার ঠেস দেওয়া কথা আর থমথমে মুখ তাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তার সাথে আদিবের সহজ আলাপ পছন্দ হয়নি তার। এবং জাহানারার চোখে-মুখে স্পষ্ট—সে তাদের দুইজনের মধ্যে তৃতীয় জনের উপস্থিতি মানতে নারাজ। সুতরাং তার প্রস্থান করা উচিত। সে ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে ইতস্তত করে বলল,
—তুলি আমাকে ছাড়া কিছু বোঝে না। আমার দেরি হলে তারিন মামিকে বিরক্ত করবে। আমি আসি। তোমরা খাও।
কথাটা বলে অনেকটা তড়িঘড়ি করে সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো মহুয়া। আদিব পিছু ডাকতে গিয়েও জাহানারার অন্ধকার মুখ দেখে থেমে গেল। মহুয়া চলে যেতেই মুখ খুললো আদিব।
—আশ্চর্য! এখানে আমি কথা বলি না বলি, সে প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?
কণ্ঠে বিরক্তি আদিবের। জাহানারার এই ক্ষণে রূপ বদলানো বিষয়টা অসহ্য লাগছে তার। আদিবের বিরক্তির আঁচ পেয়ে জাহানারা দাঁতে দাঁত পিষলো। স্থির চোখে তাকিয়ে আদিবের অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর হুট করে বলল,
—আপনি এই মেয়েকে পছন্দ করতেন?
চোখ লাল হয়ে উঠেছে জাহানারার। খুব খারাপ লাগছে তার। এতো বছর পর আজ প্রথম কেন জানি মনে হচ্ছে, আদিবের জীবনে হয়তো কেউ ছিল, যার কারণে তাকে বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে ছেলেটা। সেই সাথে এটাও মনে হচ্ছে—সেই মেয়েটা মহুয়া নয় তো?
আদিবের এতো দিনের প্রত্যাখ্যানও তাকে এতো পীড়া দেয়নি, যেটা এটা ভেবে পাচ্ছে যে আদিবের জীবনে অন্য কেউ ছিল, যার জন্য সে তার দিকে ফিরে তাকায়নি। চোখ ভিজে উঠলো জাহানারার। জাহানারার অশ্রুসজল জ্বলজ্বলে চোখ দেখে ভড়কে গেল আদিব। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—কী হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?
—আপনি এই মেয়েকে ভালোবাসতেন?
—তুমি কি পাগল হয়েছো? কীসব বলছো? কীসের মধ্যে কী ঢুকাচ্ছো? ও জাস্ট পরিচিত আমার।
রাগান্বিত কণ্ঠ আদিবের। জাহানারার এমন উদ্ভট কথা শুনে মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। জাহানারার যেন হুঁশ ফিরলো আদিবের গর্জনে। সঙ্গে সাথে নিজেকে সামলালো সে। একটা ঢোক গিলে, “সরি” বলে উঠে গেল খাওয়া ছেড়ে। আদিব তার গমনরত পথের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। “এই গরম, তো এই নরম! মেয়েটা আসলে চায় কী?” ফোঁস করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলল।
জাহানারার পিছু নিতে গিয়েও থামলো। নিজেকে কড়া গলায় বোঝালো, *”এই মেয়ের প্রতি অত আহ্লাদ দেখানোর দরকার নেই।”*
অবশেষে নিজের খাবারে মন দিল। পেটে ক্ষিদে তার। দুই দিন ঠিকভাবে খেতে পারিনি। ঐ তার ছেঁড়া মেয়েটা ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে তার ঘরে হাজির হলেও মুখে কিছু তুলতে পারিনি সে। মুখের সামনে ভাতের লোকমা তুলেও হাত থেমে গেল আদিবের। সামনে আধখাওয়া প্লেটটার দিকে তাকালো। খাবারের প্লেটে খাবার সব ঠিকই আছে, শুধু খাবার মাখিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে মেয়েটা। দুই দিকে মাথা নাড়লো, হতাশ শ্বাস ফেলল। ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে।
ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াতেই থমকালো আদিব। জাহানারা হাপুস নয়নে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে লক্ষ্য করে তড়িঘড়ি চোখ মুছলো সে। কান্না লুকাতে রাগ দেখিয়ে বলল,
—ঘরে ঢোকার সময় নক করতে পারেন না? বেয়াদব!
—ঘরের দরজা খোলা ছিল।
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে স্বাভাবিক স্বরে বলল আদিব। জাহানারা তার কথার জবাবে কী বলবে ভেবে পেল না। সে আমতা-আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগে আদিব কথা কেটে বলল,
—খুব ক্ষিদে পেয়েছে আমার। ঢং বাদ দিয়ে চুপচাপ এসে খেয়ে নাও।
গত দুই দিন আদিব ঠিকঠাকভাবে কিছু মুখে তোলেনি—এটা অজানা নয় জাহানারার। আদিবের কথা শুনে সে আর টু শব্দ করলো না। এসে বসলো তার সামনে। আদিবও আর কথা বাড়ালো না, খাবারের প্লেটে মন দিল।
খাওয়া শেষে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসে জাহানারা সামনে বসলো আদিবের। এরপর কোনো ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলো,
—সমস্যা কী তোমার?
—আমার কোনো সমস্যা নেই।
ঘাড় গুঁজে মিনমিনিয়ে বলল জাহানারা।
—তাহলে তখন ওভাবে কাঁদছিলে কেন?
—ইচ্ছা হয়েছিল, তাই কাঁদছিলাম।
—আর ওসব প্রশ্নের মানে?
—মনে হলো, তাই।
—কী মনে হলো?
—এতো প্রশ্ন করছেন কেন?
অধৈর্য হয়ে উঠলো জাহানারা। তার ভালো লাগছে না এসব। বুকের ভেতর জ্বলছে। পুরোনো কোনো ব্যথা আয়োজন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
আদিব তার কথার গুরুত্ব দিল না। সে আগের থেকে আরো গম্ভীর হলো। শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—কী মনে হলো, জাহানারা?
—মনে হলো, আপনি ঐ মেয়েটাকে পছন্দ করতেন, হয়তো ভালোবাসতেনও। সেই জন্য আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
মনের কথা মুখ পর্যন্ত এসেই থামলো জাহানারার। নিজের ওপর এই মুহূর্তে রাগ হলো তার। কেন যে মনের ভাব বেশিক্ষণ মনে চেপে রাখতে পারে না, এটা ভেবে আক্ষেপ হলো খুব।
—আর এটা মনে হলো কেন? আমি মহুয়ার সাথে দুটো কথা বলেছি, তাই?
—দুটো কথা না, একটু বেশিই কথা বলছিলেন। শুধু তাই নয়, কথা বলার সময় মুখ দিয়ে মধু ঝরছিল আপনার।
ছ্যাঁৎ করে উঠলো জাহানারা। আদিব তার দিকে নিঃশব্দে তাকালো, সেভাবেই বলল,
—আমি সবার সাথেই এভাবেই কথা বলি। বলতে পারো, এর থেকে বেশি মধু ঝরিয়ে কথা বলি।
—কৈ, আমার সাথে তো বলেন না?
—তুমি আর বাকি সবাই তো এক না।
—কেন? আমি কি ক্ষতি করেছি আপ—
গলা কেঁপে উঠলো জাহানারার। নিজের কথা থামাতে হলো। চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করলো সে। কিন্তু অবাধ্য অশ্রুরা তার শাসন অমান্য করে মসৃণ গাল বেয়ে গড়িয়েই পড়লো। ভেতরটা রাগ, ক্ষোভ, হিংসা, বিরক্তি মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতির জানান দিল। বুঝলো, সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো সে।
জাহানারা জোর করে নিজেকে আটকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা দেখে শব্দ করে ঠোঁটের কোণে ফিসফিসিয়ে হাসি দেখা দিল আদিবের। বলল,
—তুমি আমার সাথে কথা বলতে আসলে বি’ষ উগলাও, আমি তোমার বি’ষের বদলে মধু ঝরাই কী করে?
—সরেন তো যান এখান থেকে!
আদিবের কথায় তেতে উঠে বলল জাহানারা। আদিবকে এই মুহূর্তে নিজের সামনে থেকে সরাতে চাইলো। কিন্তু আদিব নড়লো না। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো জাহানারার দিকে। আদিবের দৃষ্টির সামনে আড়ষ্ট হলো জাহানারা। ভয় হতে লাগলো। মনের অনুভূতির আলোড়ন টের পেয়ে নিজের অনুভূতি আড়ালে রাখতে রাগ দেখিয়ে বলল,
—কী হলো? যান এখান থেকে। বের হন।
গলার জোরের সাথে চোখের পানির জোরও বাড়লো। জাহানারার নিয়ন্ত্রিত সত্তা অনিয়ন্ত্রিত হলো।
—তুমি কি জেলাস, জাহানারা?
নিজের কাছে নিজের জয়-পরাজয়ের এই দুর্বল মুহূর্তে আদিবের কথাটা যেন কানে ঝংকার তুললো তার। তড়াক করে মেজাজ চড়লো। গনগনে আগুন চোখে তাকালো সে আদিবের দিকে।
সে জ্বলছে—তাও আবার ঐ মেয়ের জন্য! এই ছেলে কি ভুলে গেছে, সে নায়িকা জাহানারা আহসান, লাখো ভক্ত তার, হাজার ছেলের স্বপ্ন সে। কতো মেয়ের আকাঙ্ক্ষা তার মতো জীবনের। আত্মঅহংকারী মন ফেটে পড়লো আত্মগরিমায়। কিন্তু পরক্ষণেই মহুয়ার মৃত সাপের মতো পড়ে থাকা বেণীটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মনে পড়লো—সৌন্দর্যে খুত পড়েছে তার। কথাটা ভাবতেই মিইয়ে গেল সে। কাঁচের মতো নয় ভেঙে গেল দম্ভ। আগুন চোখে দেখা দিল স্বচ্ছ পানি। কান্না এসে দলা পাকালো গলায়। হীনমন্যতার মতো বাজে অনুভূতি ঘিরে ধরলো তাকে। কিছু না ভেবেই একরাশ সংশয় নিয়ে সে আদিবকে জিজ্ঞেস করলো,
—আমাকে কি এখন খুব বাজে দেখা যায়, আদিব ভাই?
কথাটা বলতে বলতে ঘাড়ে হাত দিল জাহানারা। জাহানারার কথায় তার দিকে ভালোভাবে তাকালো আদিব। জাহানারা সুন্দর। তাকে আহামরি সুন্দরী বললে ভুল হবে না। একদৃষ্টিতে চোখ আটকে যাওয়ার মতো রূপ তার। সামান্য চুলের জন্য সেই শ্রীতে ব্যাঘাত ঘটেনি। অন্তত আদিবের কাছে তেমনটাই মনে হলো। কিন্তু জাহানারার সংশয়ী গলা আর ভীতু চোখদুটো দেখে সত্যিটা বলতে ইচ্ছে করলো না তার। তাছাড়া মেয়েটা অনেক জ্বালিয়েছে তাকে—সে তো একটু মজা নিতেই পারে। এমন মনোভাব নিয়ে মনের কথা মনে রেখেই বলল,
—সে তো তুমি বরাবরই বাজে দেখতে, এ আর নতুন কী!
এমনিতে ছেলেদের মতো এই ছোট ছোট চুল নিয়ে দুঃখের শেষ ছিল না জাহানারার। তার ওপর আদিবের মহুয়ার প্রতি কৌতূহল একযোগে মনে হাজার সুইয়ের খোঁচা দিচ্ছিল। সবকিছু মিলিয়ে কোনো রকমে সামলে রেখেছিল সে নিজেকে। বহু কষ্টে এক মুঠো আত্মবিশ্বাস জিইয়ে রেখেছিল সে। আদিবের রসিকতায় তার সেই জিইয়ে রাখা আত্মবিশ্বাসটুকুও তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে পড়লো। চোখের পানি বাঁধ ভেঙে ফেললো। ফুঁপিয়ে উঠলো সে।
জাহানারার কান্ডে ভড়কালো আদিব। সে ভাবেনি, তার ঠাট্টার ছলে বলা কথা জাহানারা সিরিয়াসলি নেবে। সে তড়িঘড়ি করে বলল,
—আরে, আমি ইয়ার্কি করছিলাম, জাহানারা। ইয়ার্কি করছিলাম। তুমি অনেক সুন্দর। অনেক সুন্দর। প্লিজ থামো…
আদিব জাহানারাকে চুপ করাতে তাকে বোঝাতে যা মুখে আসলো বলে গেল। কিন্তু কে শোনে কার কথা? তার কষ্টরা বাঁধ ভেঙেছে আজ। সারা জীবন এই একটা জিনিসের ভরসায় তো টিকে ছিল সে। যেই রূপের ভরসায় এতো হম্বিতম্বি, সেটাই না কি কোনো কালে ছিল না? এটা মেনে নেওয়া যায়!
এই জন্য হয়তো বলে, কাছের মানুষের একটা কথা দূরের মানুষের হাজারটা কথার সমান। না হলে, যার সৌন্দর্যে হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হয়, সে সামান্য রসিকতায় কাতর হয়! নিজস্ব চিন্তাভাবনা সব বাদ দিয়ে আদিবের বলা ঐ এক কথার জেরে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে কাঁদলো জাহানারা। আদিব যখন কোনো কথাতেই তাকে থামাতে পারলো না, তখন বাধ্য হয়ে হাল ছাড়লো।
সময় অতিবাহিত হলো। জাহানারা কান্নার বেগ ধীর হলো। থামলো সে।কিছু একটা ভাবলো তারপর কান্না ভেজা কণ্ঠে সরল মনে প্রশ্ন করলো,
—আপনি তখন আমাকে সুন্দর বললেন—এটা মন থেকে বলেছেন, না আমাকে চুপ করাতে মিথ্যা মিথ্যা বলেছেন?
জাহানারার কথার ধরন শুনে হেসে ফেলল আদিব। দাঁত বের হলো তার সেই হাসিতে। আদিবের সেই হাসিতে মুগ্ধ হলো জাহানারা।অনেক দিন পর বিনা ভয়-ডরে মন বলল,”এই হাসির জন্য হলেও এই ছেলেকে তোমার আবার ভালোবাসা উচিত, জাহানারা।” নিজের মনের চাটুকারিতায় নিজেই হতবাক হলো জাহানারা। বুঝলো, এই ছেলেকে ভালোবাসার জন্য র’ক্তপিণ্ডের দলাটা আবার অযুহাত খুঁজছে। সঙ্গে সঙ্গে শাসালো নিজেকে। জোরপূর্বক কঠোরতা এনে বলল, “একদম না!”
তার কড়া গলায় মনের গদগদ ভাব মিইয়ে গেলেও দমলো না।ঠিক তখন জাহানারার মন-মস্তিষ্কের সংঘর্ষের মধ্যেই আদিব টোকা দিল তার নাকে। মুখভরা হাসি নিয়ে বলল,
—পাগল একটা! আজ পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে তুমি।
ব্যাস! জাহানারার মন-মস্তিষ্কের টানাপোড়েনে এগিয়ে গেল তার মন।আদিবের আদুরে ছোঁয়া আর সহজ স্বীকারোক্তি তাকে মুড়িয়ে রাখা শক্ত খোলসটা ভেঙে ফেলল নিমিষে। মাথা চাড়া দিলো পুরোদমে। এতদিন ছলে-বলে আদিবের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের যে সুযোগ খুঁজছিল, সেটা পেয়ে ডগমগিয়ে উঠলো।
চলবে, ইনশাআল্লাহ।
#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৮
জাহানারার পরিবর্তিত মুখভঙ্গি দেখে হুশ ফিরলো আদিবের।বুঝলো,মুখ ফসকে মনের কথা বলে ফেলেছে। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি সামাল দিতে অযথা গলা ঝাড়া দিল সে। কোনোমতে বলল,
– মা ফোন দিয়েছিল। বলছিল, জরুরি কথা আছে।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল আদিব। আদিব চলে যেতেই একটা শুকনো ঢোক গিলল জাহানারা। গলা-বুক অকারণে শুকিয়ে আসছে তার। একগুঁয়ে মন জেদ ধরে বসে আছে তার কথা না শোনার। তবে জাহানারাও বদ্ধপরিকর—সে এত সহজে হাল ছাড়বে না। এই ছেলেটাকে বারবার ভালোবেসে সে নিঃস্ব হতে পারবে না। কিছুতেই না।
সেদিন রাতে কোনোরকমে দুই মুঠো খেয়ে গেস্টরুমে ঢুকলো জাহানারা। আদিব পিছু ডেকে ও ঘরে কেন যাচ্ছে সে কথা জিজ্ঞেস করায় থমথমে গলায় জানাল, “সে একটু একা থাকতে চাই।”তার কথায় আদিবের কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়লো। বুঝতে পারলো না, হঠাৎ কি হলো জাহানারার। তার এই আকস্মিক পরিবর্তন ভাবালো আদিবকে।তবে কিছু বললো না সে।
জাহানারার ঘুম হলো না সে রাতে। অনেক যুক্তি-তর্ক, অনেক বোঝাপড়া হলো তার নিজের সাথে।কিন্তু পরিশেষে “আদিব তার স্বামী” এই এক বাক্যে ব্যর্থ হলো তার সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা— ভেতরর স্বত্বা স্পষ্ট কণ্ঠে ঘোষণা দিল, “তাকে ভালোবাসায় কোনো অন্যায় নেই। ভালোবাসতেই পারে সে তাকে, এত এত ভাবা-ভাবির কি আছে!”
মনের উপর কোনো কালেই জোর খাটেনি জাহানারার। এবারো খাটলো না। হার মানলো। কাকডাকা ভোরে খুব গোপনে স্বীকার করলো, আদিবকে ভালোবাসে সে। নিজের মনে ছেলেটাকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিলেও তার মনের ভাব চেপে গেল আদিবের থেকে। এতদিন অভিনয় জগতে যতটা অভিনয় শিল্প রপ্ত করেছিল, তার সবটুকু ঢেলে দিল তার ভালোবাসা লুকাতে। আদিব যেন তার মনের কথা জানতে না পারে, তার জন্য নিজেদের মাঝে টানলো দূরত্ব।
অন্যদিকে, জাহানারার হঠাৎ এমন পরিবর্তনে চিন্তিত হলো আদিব। মনে মনে খুঁজতে লাগলো জাহানারার এমন আচরণের কারণ। মনে হলো, মহুয়ার আসা-যাওয়া, তার সাথে আদিবের কথাবার্তা হয়তো পছন্দ হচ্ছে না জাহানারর , তাই এমন করছে মেয়েটা। অজ্ঞাত তারিনকে ফোন করলো সে। করোনা ভাইরাসের তীব্র প্রকোপের কথা বলে মহুয়ার এ বাড়ি আসা বন্ধ করলো। কিন্তু তাতেও ভাবান্তর হলো না জাহানারার। দিন যেতে লাগলো, সময় অতিবাহিত হলো। আদিবের ভাবনা আস্তে আস্তে রাগে পরিণত হলো।নিজের প্রতি জাহানারার এমন অবহেলা সহ্য হলো না তার। সিদ্ধান্ত নিল জাহানারা যতদিন নিজে থেকে এগিয়ে না আসছে ততদিন সেও তার কাছে পিঠে ঘেঁষবে না।নিজের নিজের অনুভূতি বজায় রেখে একে অন্যের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগলো দুইজন।
এরপর একদিন রাতের কথা। ডাক্তার স্টিফেনের সাথে একটা জরুরি কেস নিয়ে আলোচনা করতে করতে রাত গড়িয়ে বারোটা বাজলো।কথা শেষ করে ফোন রেখে নিচে নামলো আদিব। ফ্রিজ খুলে খাবার বের করতেই দেখলো, দুপুরে খাওয়ার পর খাবার যেমন রেখেছিল, তেমনি আছে।অর্থাৎ, জাহানারা রাতে খায়নি। আজকাল তার সাথে খায় না জাহানারা, নিজের মতো আগে ভাগে খেয়ে নেয়।প্রথম প্রথম আদিবের ব্যাপরটা একটু খারাপ লাগলেও জাহানারার দিকটা ভেবে তেমন মাথা ঘামায় নি।ভেবেছে মেয়েটা হয়তো ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না তাই তার জন্য অপেক্ষা করে না। কিন্তু আজ রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছে এটা ভেবে মেজাজ খারাপ হলো আদিবের।এতোদিনের গিলে নেওয়া রাগ ঠেলে বাইরে আসতে লাগলো।
খাবারদাবার সব আবার ফ্রিজে রেখে পা বাড়ালো সে জাহানারার ঘরের দিকে,“অনেক হয়েছে। আর না। মেয়েটার সমস্যা কি? এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? আজ তাকে জানতেই হবে।”
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জাহানারার ঘরের দরজায় থামলো আদিব।দরজার কপাট খোলা ছিল। আদিব হাত দিতেই পুরনো কব্জায় অদ্ভুত শব্দ তুলে খুলে গেল সেটা। দরজা খুলতেই আদিবের চোখে পড়লো অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা জাহানারার দিকে। সাথে সাথে বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠলো। যে রাগ-ক্ষোভ নিয়ে কৈফিয়ত জারি করতে এসেছিল, সেগুলো ভুলে গেলো নিমিষে। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল ভেতরে।
জাহানারার পাশে ঝুঁকে হাত রাখলো কপালে। যেটা ভেবেছিল, তাই। জ্বর এসেছে মেয়েটার। জ্বরের তাপে গায়ে হাত রাখা যাচ্ছে না। ঘরের লাইট জ্বালালো আদিব। জাহানারা তখনো বেহুঁশের মতো পড়ে। আদিব পানি নিয়ে আসলো বালতি ভরে। পানি দিলো জাহানারার মাথায়। হাত-পা মুছিয়ে দিলো ভিজে গামছা দিয়ে। কাজটা করতে গিয়ে একটা অস্বস্তি বোধ তার আপদমস্তক ঘিরে ধরলেও জাহানারার অসুস্থতার কথা ভেবে গলধঃকরণ করলো সেটা।
এক ফাকে জাহানারা নিভু চোখে তাকালো তার দিকে। মনে হলো, তাকে দেখে মৃদু হাসলো। আদিব অবশ্য সেদিকে খেয়াল করলো না। সে মেয়েটাকে বিছানায় শুইয়ে চটপট স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসলো। জাহানারাকে ধৈর্য্য নিয়ে সেটা খাওয়ালো, তারপর ওষুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে কাঁথা টেনে দিল তার গায়ে। জাহানারার ফ্যাকাশে মুখটা দেখে চোখে মুখে চিন্তার ছাপ পড়লো আদিবের।আদিব লক্ষ্য করে দেখেছে প্রায় প্রতিমাসে দুই-তিনবার করে জ্বর আসছে মেয়েটার—ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগছে না তার কাছে।ভেতরে কোন বড় অসুখ বাসা বাধলে এমনটা হয়।সে মনে মনে ঠিক করলো, মেয়েটা এবার সুস্থ হলে নিজ দায়িত্বে তাকে নিয়ে গিয়ে একটা সিটি স্ক্যান করাবে।আদিবের কেন জানি মনে হচ্ছে, মেয়েটার এমন হুটহাট শরীর খারাপের পিছনে মাথায় পাওয়া আঘাতটা দায়ী।
নিজ মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে খাবার টেবিলে বসলো আদিব।পেটে ক্ষিদে থাকা সত্ত্বেও জাহানারার চিন্তায় গলা দিয়ে খাবার নামলো না তার কোনরকমে আধপেটা খেয়ে উঠে দাড়ালো। খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে সবকিছু জাহানারার ঘরে গেল।ঠিক করলো, আজ রাতটা সেখানেই থাকবে। রাতবিরাতে মেয়েটার যদি কিছু হয়। নিজের ঘর থেকে ফোন নিয়ে এসে ঘরের দরজা দিল।দরজা দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো তার মাথার পাশে। জাহানারার রক্তশূন্য মুখটার দিকে তাকালো নরম চোখে। সাথে সাথে বুকের ভেতর হুঁহুঁ করে উঠলো তার। বুঝলো, এই জেদি মেয়েটার প্রতি একটু না, অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। মেয়েটার কিছু হলে খারাপ লাগে তার, অন্তর পোড়ে। মেয়েটার অনুপস্থিতিতে খালি খালি লাগে ভেতরটা। মাঝে মাঝে মনে হয়, চার মাস আগে স্বার্থপরতা দেখিয়ে চলে গেলেই পারতো সে। কেন যে শুধু শুধু মায়া দেখাতে গেল। অসুস্থ মেয়েটার অসুখ সারাতে গিয়ে নিজেই যেন নাম না-জানা অসুখ বাধিয়ে বসলো।বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
ঠিক সেই সময় জানালার কপাট বাড়ি খেল গ্রিলে। চমকে উঠলো সে। জাহানারাও যেন কেঁপে কেঁপে উঠলো একটু। জানালার দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো, বাইরে বাতাস বইছে, ঝড় উঠেছে। বসা থেকে উঠে জানালার দিকে এগিয়ে গেল আদিব।খোলা জানালা দিয়ে বাইরে চোখ ফেলতেই নুইয়ে পড়া সুপারি গাছটা চোখে বাধলো।বাইরে ইতিমধ্যে তান্ডব শুরু করেছে। গাছগাছালি বাতাসের দাপটে মুষড়ে পড়ছে। জানালার কপাট টেনে জানালা লাগিয়ে দিল আদিব। আলমারির ওপর থেকে চার্জার লাইটটা বের করে হাতের কাছে রাখলো। “ঝড় উঠেছে মানে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হবে—সুতরাং প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো।” কিন্তু চার্জার লাইট অন করতেই খেয়াল করলো, আলো নিভুনিভু। তার মানে, চার্জ নেই। তাড়াতাড়ি সেটা চার্জে বসালো সে। চার্জার লাইট চার্জে দিতে না দিতেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো।আদিব বিরক্তিসূচক শব্দ বের করলো মুখ দিয়ে। চার্জার লাইট টেবিলের উপর রেখে ফোনের ফ্ল্যাশ জালিয়ে মোমবাতি খুঁজতে লাগলো। বাবাকে বলেছিল আইপিএস লাগাতে, কিন্তু তার বাবা “করছি, করবো” করে আজো লাগায়নি।
মোমবাতি জ্বালিয়ে বিছানার পাশে সাইড টেবিলে রাখার সময় পিটপিট করে চোখ মেলল জাহানারা। আদিবকে দেখে মৃদু হাসলো সে। আদিব মোমবাতি টেবিলের উপর রেখে জাহানারার দিকে ঝুঁকলো। কপালে হাত দিয়ে বলল,
– এখন কেমন লাগছে?
জাহানারা ঘোর লাগা চোখে তাকালো তার দিকে। হাত বাড়িয়ে তার হাতটা দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে মুখের একপাশে রেখে চোখ বুজে অন্যরকম স্বরে বলল,
– এবার ভালো লাগছে।
কেমন যেন শোনালো জাহানারার গলাটা। আদিবের শরীরে কাঁটা দিল। সে আরো খানিকটা ঝুঁকলো। জাহানারার বাঁধন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
– তাহলে ঘুমাও।
কথাটা বলতে বলতে উত্তরের জানালার দিকে চোখ গেল আদিবের। জানালাটা খোলা থেকে গেছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানি এসে ফ্লোর ভেজাচ্ছে। জানালা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সেদিকে পা বাড়াতেই জাহানারা পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো আদিবের। আদিব অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে?
দুই দিকে মাথা নাড়লো জাহানারা। যার অর্থ, *“কিছু না।”* হাত ছেড়ে দিল তার। হাত ছাড়া পেতেই জানালার দিকে গেল আদিব। জানালা বন্ধ করে ফিরে এলো বিছানার কাছে। জাহানারার পাশে থাকা খালি জায়গায় উঠে বসলো। বিছানায় শরীর এলিয়ে জাহানারার দিকে তাকালো। জাহানারা তখন জেগেই। আদিব তার পাশে শুতেই পাশ ফিরে তাকালো সে। আদিব তাকে নিজের দিকে তাকাতে দেখেই মৃদু হাসলো। তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
– পাশেই আছি। কিছু লাগলে বলবে। ঠিক আছে?
– হুঁ।
মৃদু হেসে সায় দিল জাহানারা। আদিব নিশ্চিন্তে চোখ বুজলো। ঠান্ডা আবহাওয়ায় খুব বেশি সময় লাগলো না তার চোখে ঘুম নামতে। মাত্র তন্দ্রা আচ্ছন্ন হয়েছিল আদিব, ঠিক তখন বুকের উপর ভারি কিছু অনুভব হতেই ঘুম ছুটে গেল তার। চোখ মেলে দেখলো, জাহানারা তার বুকের উপর মাথা দিয়ে রেখেছে। মেয়েটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।বুকের কাছে ভেজা ভেজা ঠেকলো। আদিবের বুঝতে অসুবিধা হলো না—কাঁদছে মেয়েটা। সে কিছু বলল না। আলতো হাতে জড়িয়ে নিল মেয়েটাকে। আদিবের আলতো হাতের নরম স্পর্শ জাহানারা যেন বেসামল হলো। আদিবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো,
– আমার আপনাকে লাগবে। আপনাকে লাগবে আমার। দিবেন আপনাকে।
চোখ বন্ধ করে একটা দম খিচলো আদিব। জাহানারার কথাটায় কি ছিল কে জানে, ভেতরটা কেমন যেন শিউরে উঠলো তার। একটা ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো সে। নিজেকে ধাতস্থ করলো সময় নিয়ে। তারপর জাহানারা কে সামলাতে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগে নিজের পুরু ঠোঁটে জাহানারার ঠোঁটের স্পর্শ পেলো।থমকালো সে। জাহানারার কোমল ঠোটের ছোঁয়ায় শিহরিত হলো সারা শরীর। জাহানারার আদুরে স্পর্শে ব্যাকুল হলো মন। সাথে সাথে নিজের মাঝে জড়িয়ে নিলো জাহানারাকে। সাড়া দিল তার স্পর্শে। গ্রহণ করলো তার নীরব আত্মসমর্পণ। মিশে গেল জাহানারার নরম শরীরে।
__________
শেষ রাতে ঘুমাতে যাওয়ায় ঘুম ভাঙতে দেরি হলো আদিবের। ঘুম ভেঙে সবার প্রথম বিছানা হাতড়ালো সে। খালি বিছানা হাত পড়তেই আস্তে ধীরে চোখ খুললো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। ঘরের চারিদিকে চোখ বুলালো। প্রত্যাশিত মানুষটাকে সামনে না পেয়ে কিঞ্চিৎ হতাশ হলো। তবে সেটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামালো না। হাই তুলতে তুলতে অলস শরীরটা টেনে পা বাড়ালো নিজের ঘরের। ফ্রেশ হতে হবে তাকে। এ ঘরে জামাকাপড় নেই তার, সুতরাং নিজের ঘরে যেতে হবে।
অনেকটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হলো আদিব। ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় জাহানারার ঘরে একবার উকি দিতে ভুলল না। তবে জাহানারাকে এবারও ঘরে দেখতে পেল না। জাহানারা নিচে আছে ভেবে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো সে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে জাহানারার কলকলিয়ে হাসির শব্দ কানে এসে বাড়ি খেলো তার। অন্যসময় হলে জাহানারার এমন হা-হা-হি-হি টাইপের হাসি শুনে বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলতো আদিব। মনে মনে শব্দদূষণের আরোপ লাগাতো জাহানারার উপর। কিন্তু আজ তেমন কিছুই মনে হলো না তার। বরং জাহানারার উচ্ছ্বাসিত হাসি শুনে তার ঠোঁট প্রশস্ত হলো। মনে মনে একটা প্রশান্তি অনুভব করলো। উৎফুল্ল চিত্তে এগিয়ে গেল সামনে।
কিন্তু যতটা উৎফুল্লতা নিয়ে সামনে এগিয়েছিল, তার সবটা এক নিমিষেই উধাও হলো, যখন জাহানারার পাশে রাকিব সারোয়ারকে দেখলো। মুখ জুড়ে অন্ধকার নামলো আদিবের। ভেতরটা অজানা কারণে কুঁকড়ে গেল।
জাহানারা তখনো খেয়াল করেনি আদিবকে। সে রাকিবের সাথে কথায় ব্যস্ত। অনেকদিন পর বন্ধুকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত। আদিব এসে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণ পর তাকে খেয়াল করলো তারা। আদিবের দিকে জাহানারা তাকাতেই চোখ পড়লো।সাথে দৃষ্টি নত করলো জাহানারা।আদিব এগিয়ে গেল সামনে।রাকিব কে দেখে মনে সদ্য তৈরি হওয়া তিক্ত অনুভূতিটা এক পাশে রেখে হাত মিলালো রাকিবের সাথে। কুশলাদি বিনিময় করলো। তারপর একটু সময় নিয়ে এদিক-সেদিকের কথা বলে রাকিবের এ বাড়িতে আসার কথা জানতে চাইলো। রাকিবের হয়ে উত্তরটা জাহানারাই দিল। জানালো আজ জন্মদিন তার। প্রতিবারের মতো তাকে শুভেচ্ছা জানাতে রাকিব হাজির হয়েছে এ বাড়ি।
– আমি অবশ্য কাল রাতেই আসতাম। কিন্তু এখন তো জাহানারা বিবাহিত। রাতবিরাতে আসলে যদি তুমি কিংবা তোমার বাড়ির লোক মাইন্ড করো, সেটা ভেবেই আসিনি।
জাহানারার কথা টেনে বলল রাকিব। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো সে। আদিবের গায়ে জ্বালা ধরালো সেই হাসি।মনে মনে আওড়ালো, “এতই যখন ভাবলেন, তাহলে সাতসকালে আসলেন কেন? রাত-দিনের ব্যবধানে শ্বশুরবাড়ি, বরের মাইন্ড বদলে যাবে না কি? যতসব!”
– আরে, কেউ কিছু মনে করতো না। তুমি বেশি ভেবে ফেলেছো।
রাকিবের কথার প্রেক্ষিতে বলল জাহানারা। তার বর, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন উন্মুক্ত খেয়ালের—এটা বোঝাতে চাইলো রাকিবকে। রাকিব ব্যাপারটা বুঝলো কি বুঝলো না সেটা রাকিবই জানে। কিন্তু জাহানারার এমন আগবাড়িয়ে কথা বলায় চোয়াল শক্ত হলো আদিবের। জাহানারার রাকিবকে *“তুমি”* সম্বোধনটা আদিবের মনে তীরের নেয় বিধলো। থমথমে হলো তার মুখভঙ্গি।
রাকিব খেয়াল করলো আদিবের বদলে যাওয়া অভিব্যক্তি। সাথে সাথে তার ঠোঁটের কোণে দেখা দিল বাঁকা হাসি। সে আরেকটু সরে বসলো জাহানারার দিকে। কথা শুরু করলো জাহানারার আসন্ন প্রজেক্ট নিয়ে। কাজের কথা উঠলে জাহানারা হুঁশজ্ঞান থাকে না।আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। সে আদিবকে উপেক্ষা করে রাকিবের কথায় মগ্ন হলো।
জাহানারা আর রাকিবের কথার মাঝে নিজেকে অযথা মনে হলো আদিবের। বুঝলো, তাদের মধ্যে তার কোনো কাজ নেই। উঠে দাঁড়ালো সে। জরুরি ফোনকলের দোহাই দিয়ে সরে আসলো সেখান থেকে।এসে দাঁড়ালো বাগানে।
কাল রাতের ঝড়ে বাগানের গাছপালা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।সেগুলো ঠিক করছে তাদের হাসেম।হাসেম এই বাড়িতেই থাকে, দাররক্ষার পাশাপাশি মালির কাজটাও সেই করে। বাগানের এমন এলোমেলো অবস্থা দেখে গত রাতের একখণ্ড এলোমেলো স্মৃতি চোখে ভেসে উঠলো আদিবের। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিল সে। বুকের ভেতর তৈরি হওয়া ধড়ফড়ানিটা শান্ত করতে শ্বাস নিলো বুক ভরে।
– স্যার, আপনার কফি।
নেহার আচমকা ডাকে চমকে উঠলো আদিব। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে নেহা। মুখে অমায়িক হাসি। আদিব নিজেকে ধাতস্থ করে কফির মগটা হাতে নিল। আদিব কফির মগ হাতে নিতেই চলে আসছিল নেহা, কিন্তু আদিব পিছু ডাকলো।আটকালো তাকে। নিজের মনে উদয় হওয়া প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার আদিবের—তার জন্য এই মেয়েটাই এখন তার একমাত্র ভরসা।
– তুমি কখন এলে?
– সকালে রাকিব স্যারের সাথে।
– ছোট চাচুরা সব কেমন আছে?
– আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।
নেহার সাথে ঠিক তেমন সখ্যতা নেই আদিবের। তার সাথে সেভাবে আগবাড়িয়ে কথাও বলে না আদিব। আজ নিজে থেকে কথা বলায় একটু অবাক হলো নেহা। যেটা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠলো। আদিব বুঝলো সেটা, কিন্তু গুরুত্ব দিল না। সে নিজের কথা চালিয়ে গেল। এদিক-সেদিকের কথা বলে নেহার সাথে সহজ হলো। তারপর আসলো মূল কথায়। জানতে চাইলো,
– রাকিব সারোয়ার কি তোমার ম্যামের জন্মদিনে প্রতিবছর এমন ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হয়? না কি এবার স্পেশাল কিছু?
নেহা সহজ-সরল মানুষ। কেউ একটু ভালোভাবে কথা বললে গলে যায়। আর যদি মানুষটা তার ম্যামের সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আদিবের প্রশ্নের উত্তরে সে গড়গড় করে বলল,
– প্রতিবছরই আসে। সবার প্রথমে সেই উইশ করে ম্যামকে। একবার তো ধুমধাম করে সারপ্রাইজ পার্টিও রেখেছিল। কিন্তু ম্যাম যায়নি। খুব কষ্ট পেয়েছিল স্যার।অনেক মানুষ ছিল, ভালোই অপদস্ত হয়েছিল উনি।
সহানুভূতির সুর নেহার। তার সত্যিই খারাপ লেগেছিল সেবার রাকিব স্যারের জন্য। কিন্তু তার ম্যামের বা কি দোষ? সে বারবার রাকিব স্যারকে বলেছিল, সে যেতে পারবে না। কিন্তু রাকিব স্যার অযথা জেদ ধরলো। ফলস্বরূপ, ঘরভরা লোকের মধ্যে অপমানিত হতে হলো।এখানে অবশ্যই তার ম্যামের দোষ নেই!
– তোমার ম্যামের সাথে উনার কেমন সম্পর্ক?
নেহার ভাবনার মাঝে বলল আদিব। সন্দেহহীন কণ্ঠ আদিবের। তবে নেহা অত সব খেয়াল করলো না। জাহানারার প্রতি রাকিবের মনের দুর্বলতা সম্পর্কে জানা থাকলেও জাহানারা মনের ভাব জানে না আদিব। সেটা জানার ক্ষুদ্র চেষ্টা করলো সে। নেহা সময় অপচয় না করে আদিবের প্রশ্নের জবাবে বলল,
– রাকিব স্যার তো ইন্ডাস্ট্রিতে আছে। *“আরএস মাল্টিমিডিয়া”* সেটা তো তার প্রোডাকশন হাউজ। ম্যাম বেশ কয়েকটা কাজ করেছে আরএস থেকে। সেখান থেকেই একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাদের। তবে ম্যামের দিক থেকে কিছু না থাকলেও রাকিব স্যার ম্যামের উপর লাট্টু—
জিভ কাটলো নেহা। কার সামনে কি বলছে সেটা ভেবে ঢোক গিলল। বুঝলো, আদিবের সহজ আচরণে খুব বেশিই সহজ হয়ে গেছে সে। নিজের নিয়ন্ত্রণহীন কথা বলার স্বভাবের জন্য নিজের উপর রাগ হলো তার। মনে মনে নিজেকে কড়া করে দুটো গালি দিলো সে। তারপর নিজের কথা ঢাকতে আমতা আমতা করে বলল,
– রাকিব স্যার আর ম্যাম তো পূর্বপরিচিত। সেই সুবাদে স্যার ম্যামকে স্নেহ করে, আর কি।
– *স্নেহ* করে!
তাচ্ছিল্যে হাসল আদিব। নেহার কাছে যেটা মোটেও সুবিধার লাগলো না। এমনিতেই আদিব আর তার ম্যামের সম্পর্ক যে সমীকরণ! তার কথায় তাদের মধ্যে আবার কোনো সমস্যা হয় কি না—সেটা ভেবে মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করতে লাগলো। তার মনের ভাবনা-চিন্তার মাঝেই ডাক পড়লো ভেতর থেকে। জাহানারা ডাকছে তাকে। মনে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে ছুটলো সে ভেতরে।
নেহা চলে যেতেই রাকিব এসে দাঁড়ালো আদিবের পাশে। আদিব তখন সামনে তাকিয়ে একমনে কিছু ভাবছে। রাকিবের উপস্থিতি টের পায়নি সে। রাকিব আদিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গলা ঝাড়া দিল। আদিবের ধ্যান ভাঙলো। পাশ ফিরে তাকালো। ঠোঁট চওড়া করে জোরপূর্বক হাসলো। রাকিবও প্রতিউত্তরে হাসলো। তারপর সামনে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
– ডিভোর্স ফাইল করে, বউর কাছে যাওয়ার যুক্তিটা ঠিক বুঝলাম না, আদিব।
রাকিবের কথা যেন গরম সীসার মতো গিয়ে ঠেকলো আদিবের কানে।সাথে সাথে মুখভঙ্গি কঠোর হলো তার।রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো চোখ। মুষ্টি বদ্ধ হলো হাত।
-আপনার জন্য আমার সাজানো জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। আপনার জন্য আমি পরিবার থাকতেও অনাথের মতো জীবন কাটিয়েছি। আপনার জন্য আমি আমার মায়ের শেষ সময়টাতে তার সাথে থাকতে পারিনি। আপনার জন্য—শুধু আপনার জন্য!
জাহানারা উঠে দাঁড়ালো। রাগে-ক্ষোভে অন্ধ হয়ে সজোরে ধাক্কা মারল আদিবের বুকে। জাহানারার আচমকা আক্রমণে টালমাটাল হলো আদিব, পিছিয়ে গেল এক পা। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তার, চোখে ভেসে উঠল কঠোরতা। নিজেকে সামলে নিয়ে শীতল অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সে জাহানারার দিকে।
জাহানারার চোখে তখন উন্মাদনা। মানসপটে ঘূর্ণায়মান বীভৎস স্মৃতিগুলো যেন একেকটা আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হচ্ছে। চোখ ভিজে উঠেছে, কিন্তু তাতে আগুন নেভেনি। আদিবের মুখটা দুঃসহ লাগছে তার কাছে।
চিৎকার করে উঠল জাহানারা। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ফের বলল,
-কি ক্ষতি করেছিলাম আমি আপনার? কেন আমার এত বড় সর্বনাশ করলেন? কেন আমাকে অপরাধী করলেন? আপনাকে একটু ভালোবেসেছিলাম, আর তো কিছু করিনি। আমার অন্তহীন ভালোবাসার বিনিময়ে একটুখানি ভালোলাগা চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি! আপনি কি করলেন? অপবাদ দিলেন? নিজের কাছের মানুষটার মৃত্যুর জন্য আমাকে কাঠগড়ায় তুললেন! কেন?
সাইড টেবিলে থাকা পানির জগটা আছড়ে ফেলল জাহানারা। কাঁচের জগটা টাইলসের মেঝেতে আছড়ে পড়ার সাথে সাথে চূর্ণ-বিচূর্ণ হলো। সেই শব্দে যেন টনক নড়ল আদিবের। থমকালো সে ক্ষণিকের জন্য। বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক সময় নিল না জাহানারার কথার তাৎপর্য বুঝতে। মনে পড়ল দাদির মৃত্যুর দিন, বাবা যখন মাকে দাদির মৃত্যুর জন্য দায়ী করে তালাক দিতে বদ্ধপরিকর, তখন নিজের পরিবারের আসন্ন ভাঙনের ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল সে। রাগ হয়েছিল জাহানারার উপর। অপরিপক্ব মস্তিষ্ক বুঝিয়েছিল, জাহানারা তাকে পাওয়ার জেদ না করলে এত অশান্তি হতো না। সেই মুহূর্তে রাগে অন্ধ মন বলে উঠেছিল—সব কিছুর জন্য জাহানারা দায়ী। একমাত্র জাহানারা। মনে হওয়া কথাটা সে নির্দ্বিধায় বলেছিল সবার সামনে। পরবর্তীতে নিজের বলা কথার জন্য অনেকবার মনে মনে অনুতপ্ত হয়েছে, কিন্তু কখনো ভাবেনি তার ঐ কথার উপর ভিত্তি করে জাহানারার জীবন এলোমেলো হয়ে যাবে!
একটা শুকনো ঢোক গিলল আদিব। নিজের স্বপক্ষে বলল,
-বাবা মাকে তালাক দিতে যাচ্ছিল। পরিবার ভেঙে যাচ্ছিল আমার। তখন সেই মুহূর্তে আমার যা মনে হয়েছে, তাই বলেছি। অত কিছু ভাবিনি।
আদিবের কথা শেষ না হতেই তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল জাহানারার মুখে। সে আদিবের দিকে এগিয়ে এলো এক পা। সাথে সাথে আহত পাটা ব্যথায় শিরশির করে উঠলো, জানান দিল—শরীরের ভর নিতে অপারগ সে। ব্যথায় জাহানারার চোখ-মুখ কুঁচকে গেল আপনা-আপনি। বসে পড়ল বিছানায়।
জাহানারার মুখের ব্যথাতুর অভিব্যক্তি দেখে ছুটে এল আদিব। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, “কি হয়েছে?” জাহানারা কোনো প্রতিউত্তর করল না, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল যন্ত্রণা। জাহানারার এমন একগুঁয়েমি দেখে ধৈর্য্য হারাল আদিব।
-আপনাকে ভালোবেসে যে পাপ করেছিলাম, সে পাপের শাস্তি পাচ্ছি।
-দেখো জাহানারা, তোমার অনুভূতি নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। একদিন তুমিই ভালোবাসার দাবি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিলে, আজ আবার তুমিই ঘৃণার দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছ। আমাকে তুমি ভালোবাসলে কি ঘৃণা করলে—আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার। তবে আমার কোনো কথা কিংবা কাজের জন্য তুমি সাফার করেছ বা করছ—এই কথাটা আমাকে ভাবাচ্ছে। তুমি প্লিজ স্পষ্ট করে কথা বলো?
– বলবো না।
-এত অসহ্য কেন তুমি!
ফুঁসে উঠল আদিব। সজোরে লাথি মারল খাটের পায়ায়। আদিবের এমন অভিব্যক্তি দেখে এত কষ্টের মধ্যেও জাহানারার মুখে হাসির রেখা দেখা দিল। আদিব সেটা দেখে তিক্ত বিরক্ত হলো। বলল,
-বুলশিট! তোমার অবস্থার জন্য তুমি নিজে দায়ী, আমি নই।”
-আমার অবস্থার জন্য আমি যতটা দায়ী, আপনিও ততটা দায়ী। এতদিন আমি একা সবটা ভোগ করেছি, এবার দুজন একসাথে ভোগ করবো। ভালো হবে না?
-হুম! খুব ভালো হবে—মেন্টাল একটা!
কথাটা বলতে বলতে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল আদিব। ফাস্ট এইড বক্স বের করে জাহানারার সামনে মেঝেতে বসলো। জাহানারা আহত পাটা নিজের হাঁটুর উপর রেখে রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজটা সাবধানে খুলল। রক্তে ভিজে চটচটে হয়ে আছে সেটা। আদিব সেটা দেখে মাথা নাড়ালো। একটা হতাশ শ্বাস ফেলে। ক্ষত পরিষ্কার করতে করতে বলল,
-এর পরে পায়ের উপর ভর দেওয়ার ইচ্ছা জাগলে ল্যাংড়া হওয়ার কথা মনে করে নিও।
ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে উঠে দাঁড়াল আদিব। একটা পেইন কিলার জাহানারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-ইচ্ছা হলে খেয়ে নিও।
কথাটা বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল আদিব, তারপর কি মনে করে আবার থামলো। পিছন ফিরে বলল,
-“তোমার হয়তো অনেক টাকা আছে, কিন্তু আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ। ঘরের একটা জিনিস নষ্ট হলেও আমাদের খারাপ লাগে। সুতরাং, এর পরের বার আমার বাড়িতে কিছু ভাঙার আগে দ্বিতীয় বার ভেবে নেবে। আর যদি ভাবাভাবির সময় না পাও, তাহলে যেটা ভাঙবে, সেই রকম একটা কিনে আনবে। ঠিক আছে?
বেরিয়ে গেল আদিব। জাহানারা তার প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল, বিড়বিড় করে বলল,
-গোঁয়ার!
—
-তুমি ভুল ছিলে, চাচু। তোমার ভাতিজি ঘৃণা করে আমাকে। আমার ভুল হয়েছে তোমার কথা শুনে ওকে বিয়ে করা।
-এতো সংলাপ না শুনিয়ে কি হয়েছে সেটা খুলে বলো।
শাহেদের সোজাসাপ্টা কথা। আদিবের সাথে আজ তিন দিন পর কথা হচ্ছে তার। আদিবের বিয়ের আগে শেষবার কথা হয়েছিল তাদের। জাহানারার সত্যিটা জানতে পেরেই সবার প্রথম ছোট চাচার কাছে ফোন করেছিল আদিব। চাচুকে জানিয়েছিল জাহানারার সত্যিটা। সব শুনে শাহেদ বলেছিল, জাহানারাকে একটা সুযোগ দিতে। মেয়েটা এত বছর পরেও তাকে আগের মতোই ভালোবাসে—সেটা বুঝিয়েছিল আদিবকে। আদিব তখন মায়ের কাজে এমনিতেই রেগে ছিল, চাচুর কথা শুনে মনে হয়েছিল, মায়ের কথা ভেবেই তো এতদিন জাহানারার ভালোবাসা নজরআন্দাজ করেছে সে। মা যখন তার সাথে এত বড় একটা নাটক করতে পারলো, তখন আর সে মায়ের কথা কেন ভাববে? জাহানারাকে দেবে তার প্রাপ্য সুযোগ। এসব ভেবেই চাচুর কথায় রাজি হয়েছিল আদিব। সুযোগ দিতে চেয়েছিল জাহানারাকে। কিন্তু তাদের চাচা-ভাতিজার ভাবনা যে জাহানারা এভাবে উল্টে দেবে—সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি তারা।
বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত সমস্তটা খুলে বলল আদিব শাহেদকে। সব শুনে শাহেদের কপালে চিন্তার গাঢ় ভাঁজ পড়লো।
জাহানারা বেগমের মৃত্যুর দিন আদিব যে কথাগুলো বলেছিল, সেই কথাগুলো তারা তেমন গুরুত্ব না দিলেও জায়েদ ভালোভাবেই মনে নিয়েছিল। আদিবের কথা সমর্থন করে সবার সামনে মেয়েকে ত্যাগ করেছিল সে। সালেহা তার কথার বিরোধিতা করায় গায়ে হাত তুলেছিল তার। জাহানারা তখন দাদির শোকে অচেতন, বসার ঘরে এতকিছু হচ্ছে—সেটা তার অজানা। জ্ঞান ফেরার পর বাবা তার জন্য মায়ের গায়ে হাত তুলেছে—একথা শুনে আরো ভেঙে পড়ে সে। আবারো চেষ্টা করে আত্মহত্যার। ডাক্তার জানায়, জাহানারার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। জায়েদের পাগলামো আর বাড়ির পরিবেশ দেখে শাহেদ স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় জাহানারাকে তাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার। জাহানারা তখনো জানে না, তার গায়ে দাদির মৃত্যুর জন্য যে দায় চেপেছে, সেটা আদিবের দেওয়া। এর ঠিক দুই-তিন মাস পর নাফিজা মুখ ফসকে বলে ফেলে কথাটা। আদিব তাকে এই অপবাদ দিয়েছে—কথাটা জানতে পেরে কেমন স্থবির হয়ে যায় জাহানারা। যে মানুষটাকে ভালোবেসে সব উজাড় করে দিলো, সেই মানুষটা তাকে এত বড় অপবাদ দিয়েছে—মেনে নিতে পারে না সে। মুষড়ে পড়ে একদম। এরপর একদিন হঠাৎ শাহেদের সামনে এসে বলে, “চাচু, আমি বাঁচতে চাই। তুমি আমাকে প্লিজ বাঁচাও।”
সময়ের ব্যবধানে সব ভুলে বসেছিল শাহেদ। আজ আদিবের কথা শুনে পুরোনো স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বুকটা হুঁ করে উঠল জাহানারার সেই বিধ্বস্ত দশা মনে করে। বুক চিরে বেরিয়ে এল একটা দীর্ঘশ্বাস। মনে হলো, ভুল হয়েছে একটা। তার উচিত হয়নি আদিবকে জাহানারার দিকে ঠেলে দেওয়া। মেয়েটা মনে মনে ছেলেটার জন্য যে ঘৃণা পুষে রেখেছে—ছেলেটার জীবন তো জাহান্নাম বানিয়ে দেবে।
-“কি হলো? চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো?
শাহেদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বলল আদিব। শাহেদের ভাবনায় ছেদ পড়ল আদিবের কণ্ঠে।
-“কি বলবো, ভেবে পাচ্ছি না তো। জাহানারাকে আমি যতদূর চিনি, ও তো তোকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। এতদিনের হিসাব সব কড়ায়-গণ্ডায় নেবে। সেদিন কেন যে ও কথা বলতে গিয়েছিলি, বাপ! এ জন্যই কথা-বার্তা বলার আগে ভেবে-চিন্তে বলতে হয়।
-তোমার ভাই আমার মাকে তালাক দিচ্ছিল। সেই মুহূর্তে ভাবনা-চিন্তার অবস্থায় ছিলাম না আমি। যা মনে এসেছে, তাই বলেছি। সেই কথা নিয়ে সেজ চাচা এমন জল ঘোলা করবে—কে জানতো! কি করেছি, কি বলেছি—ওসব বাদ দিয়ে এখন সমাধান বলো। তোমার ভাতিজির রাগ-বাগ সহ্য হচ্ছে না আমার।
-সমাধান বলতে আমার কাছে একটাই উপদেশ আছে—তোর জন্য একটু ধৈর্য্য ধর, ধৈর্য্য ধরে হ্যান্ডেল কর। মেয়েটার উপর এত বছর যা গিয়েছে—”
-“চাচু, থামো তো। তোমার এই কথার চক্করে আমি ফেঁসে গেছি। মেয়েটা অসহায় হ্যান ত্যান—ও অসহায় না, আমি অসহায়। ওর তো শুধু অতীত নষ্ট হয়েছে—নষ্ট বললেও ভুল হবে, টাকা-পয়সা, চেহারা-ছবি, নাম-ডাক—সব আছে ওর। আমার থেকে ভালো পজিশনে আছে ও। হ্যাঁ, মানছি, পরিবার থেকে দূরে থেকেছে—সেটা আমিও থেকেছি। ও তো তাও তোমাদের মধ্যে ছিল।
একটু থামল আদিব, দম ফেলল। জাহানারার অসহায়ত্বের গান শুনতে ইচ্ছে করেছে না তার।বুক ভরে দম নিয়ে আবার বলল,
-চাচু শোন, আমি সহজ-সরল মানুষ, এতো প্যাঁচ-ঘোঁচ বুঝি না। দীপ্তি আপুর বিয়ের পর থেকে পরিবারে অশান্তি দেখছি। মা বলেছে আমার কথা শোনো, বা বলেছে আমাকে বোঝ—বোনেরা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আমি নিজের দিকটা বোঝানোর মতো কোনো মানুষ পাইনি। ইচ্ছা ছিল এমন একটা মানুষকে বিয়ে করবো যে আমার দিকটা বুঝবে, আমাকে স্বস্তি দিবে। কিন্তু এমন একজনকে বিয়ে করলাম যে ঘাড় ধরে পুঁ’তে দিতে পারলে বাঁচে!”
-সব দোষ আমাকে দিবি না। আমি তোকে বললাম, জাহানারাকে একটা সুযোগ দে। তুই দিনের দিন বিয়ে করতে গেলি কেন?
-তোমার ভাতিজি ফকিরের মতো এসে দাঁড়ালো, নাটক করতে লাগলো। তো কি করতাম! আমি কি জানতাম তোমার ভাতিজির পেটে এতো শয়তানি? শালা… দেশে আসায় ভুল হয়েছে আমার।”
ফোন কাটল আদিব। রাগে গজগজ করতে করতে হাঁটা দিল বাড়ির উল্টো দিকে। ঠিক করল, আজ আর বাড়ি ফিরবে না।
—
রাত বাড়ার সাথে সাথে চিন্তা বাড়ল তানিয়ার। ছেলে সেই ভর সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে বের হয়েছে, যাওয়ার সময় কিছু বলে যায়নি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, দমকা বাতাস বইছে। দুই-দুই বার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এমন দুর্যোগের সময় ছেলে বাইরে কোথায়, কেমন আছে—ভেবেই ছটফটিয়ে উঠল মন। নিজে ফোন করে ক্লান্ত হয়ে শেষমেষ আশরাফকে বলল ছেলেকে ফোন করতে। আশরাফ প্রথমে তানিয়ার কথায় গুরুত্ব না দিলেও রাত বাড়ার সাথে সাথে তার মনে চিন্তার দানা বাঁধলো। কল করল সে ছেলের নাম্বারে, কিন্তু কল ঢুকল না। এক যান্ত্রিক নারীকণ্ঠ জানালো—ফোন বন্ধ। আদিবের ফোন বন্ধ পেতেই চিন্তিত হলো আশরাফ।
এগারোটার পরে বাড়ি ঢুকল আদিব। তাকে দেখতেই তানিয়া একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল—কি হয়েছে? কোথায় গিয়েছিলে? এতো দেরি হলো কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। আদিব মায়ের উপর রেগে থাকলেও ধৈর্য্য নিয়ে উত্তর দিল। মানুষ হিসাবে মহান না হলেও, মা হিসাবে অনন্য মানুষটা।
আদিবের জবাবে স্বস্তি পেল দুইজন। আদিবকে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে আসতে বলল আশরাফ। ছেলের অপেক্ষায় এখনো খাওয়া হয়নি তাদের। আদিব মাথা নেড়ে নিজের ঘরের দিকে বাড়ালো। ঘরের সামনে আসতেই চোখ পড়ল নেহার উপর—সে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আদিব যাওয়ার সময় তাকে যেভাবে দেখে গিয়েছিল, ফিরে এসেও সেভাবে দেখে ভ্রতে মোটা ভাঁজ ফেলল। জিজ্ঞেস করল,
-আপনি এখনো এখানে?
-আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, স্যার।
-আমার জন্য? কিছু বলবেন?
-জি, স্যার।
একটু থেমে নিজ মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল নেহা। আদিবের সামনে কথা বলতে গেলে কেন জানি জিভ নড়বড় করে তার, অকারণেই ভয় লাগে।
-ম্যামের স্মৃতিশক্তি সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেটাও একেবারে কম না। ডাক্তার ম্যামকে মানসিক চাপমুক্ত রাখতে বলেছে, না হলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে। তাই—
-আপনার ম্যাম পাগল হয়ে যাক তো! এই হাফ পাগল সামলানোর থেকে ফুল পাগল সামলানো সহজ হবে আমার জন্য। যতসব!
স্বগতোক্ত করে কথাটা বলল আদিব। তারপর ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করলো। আদিবের প্রতিক্রিয়ায় হতবুদ্ধ হলো নেহা। জাহানারার ভালোর কথা ভেবে আদিবকে কথাগুলো বলছিল সে, কিন্তু আদিব তার কথা শেষ না করতেই দিয়ে যেভাবে মেজাজ দেখালো—তাতে বেশ নিরাশ হলো নেহা। তার ম্যাডাম একটু রগচটা হলেও মানুষ খারাপ না। এত বছর ধরে তার সাথে আছে, কোনোদিন তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। হ্যাঁ, রাগের মাথায় একটু ঝাড়ি দিয়েছে, কিন্তু রাগ ঠান্ডা হলেই আবার কাছে টেনে নিয়েছে। মানুষটা যেভাবে তার বিপদে-আপদে পাশে থেকেছে, তার জন্য কৃতজ্ঞ নেহা। পেশাদারিত্ব পার করে মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছে জাহানারার। সেই জন্য তো তার ভালো-খারাপে মন দুলে ওঠে।
নেহার আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে, আদিবের সাথে বিয়ে না হয়ে যদি তার ম্যাডামের রাকিব সারোয়ারের সাথে বিয়ে হতো, তাহলে ভালো হতো। লোকটা ম্যাডামের জন্য জান বাজি রাখে। অথচ ম্যাডাম তার ভালোবাসা বুঝল না। যার জন্য জীবনে এতো ঠোকর খেল, আবার তার কাছে হাজির হলো। হতাশামিশ্রিত শ্বাস ফেলল নেহা। জাহানারার ভবিষ্যৎ চিন্তায় চিন্তিত হয়ে পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে—যেটা এ বাড়িতে তার থাকার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।
—
ঘরে ঢুকতেই আদিবের চোখ পড়ল বিছানায়। জাহানারা সেখানে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। জাহানারার দিকে চোখ নিবদ্ধ রেখেই শার্ট খুলল সে। জাহানারাকে গভীর ঘুমে দেখে নিঃশব্দে ঢুকল বাথরুমে। ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল জাহানারার দিকে। লক্ষ্য করে দেখল, সাইড টেবিলে তার দেওয়া ওষুধটা পড়েছে—মানে খায়নি তিনি। রাতের খাবারটাও টেবিলের উপর ঢাকা, নেহা দিয়ে গিয়েছিল হয়তো—যেটাও ছুঁয়ে দেখেনি মেয়েটা। অথচ ম্যাডামের রাতের ভারী কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো না খেলে সুস্থতায় ব্যাঘাত পড়বে তার।
একটা উষ্ণ শ্বাস ফেলল আদিব। দুইবার ডাকল জাহানারাকে, কিন্তু জাহানারার কোনো সাড়া নেই। বাধ্য হয়ে ঝুঁকল আদিব, হাত রাখল বাহুতে। বাহুতে হাত রাখতেই বুঝল, ম্যাডামের জ্বর এসেছে। ছোটবেলায় প্রায় এমন জ্বর বাধিয়ে বিছানা নিত ম্যাডাম। তার এই জ্বরকে সেজ চাচি বলত “ভালুকে জ্বর”—যেটা না কি পড়ার ভয়ে ইচ্ছে করে বাঁধাত ইনি।
সেজ চাচি! সেজ চাচির কথা মনে হতেই মন ভারী হলো আদিবের। মনে হলো, মানুষটা বেঁচে থাকলে এই মেয়েটাকে সহজে সামলানো যেত। সেই সাথে তার অপরাধবোধও কম হতো। ছোট চাচাকে যতই যাই বলুক সে ,কিন্তু মন তো মানছে না। মন বলছে, জাহানারা ঠিকই বলেছে—তার জন্য সেজ চাচির শেষ সময় মেয়েটা তার পাশে থাকতে পারেনি। কথাটা যতবার মনে হচ্ছে, ভেতরটা লজ্জা-অপরাধে মুড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি করার? যা হয়েছে, সেটা তো আর বদলানো যাবে না। এখন অতীত বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে, সেই সাথে মেয়েটাকেও তার অতীত থেকে বের করতে হবে। কি এক জ্বালা—নিজের ক্যারিয়ার গোছানোর সময় তাকে বউ গোছাতে হচ্ছে!
নিজের ভাবনা-চিন্তার মাঝে আরো কয়েকবার নরম স্বরে ডাকল সে জাহানারাকে।একসময় আদিবের ডাকে সাড়া দিল জাহানারা, চোখ পিটপিট করে তাকাল। ক্লান্ত দৃষ্টি তার।আদিব বুঝলো জ্বরে ইতিমধ্যে কুপোকাত করেছে ম্যাডাম কে।আদিবের ভাবনার মাঝেই জাহানারা হাত বাড়িয়ে আচমকা জড়িয়ে ধরল তাকে। জাহানারার আকস্মিক কাজে হকচকিয়ে গেল আদিব, পড়তে পড়তে হাতের ভরে নিজেকে সামলে নিল। জাহানারা তাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কাতর কণ্ঠে অভিযোগের সুরে বলে উঠল,
-“আমাকে একটুখানি ভালোবাসলে কি ক্ষতি হতো আপনার?”
চলবে, ইনশাআল্লাহ।
#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৪
জাহানারার কথাগুলো কানে পৌঁছাতেই আদিবের ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল—শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল এক শীতল শিহরণ। মেয়েটার কাতর কণ্ঠ নাড়া দিল ভেতরটা। কয়েক ঘণ্টা পূর্বে জাহানারার করা অভিযোগগুলোর জন্য মনের মাঝে যে অশান্তির ঝড় শুরু হয়েছিল, সেটা যেন এই উষ্ণ আলিঙ্গনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অজানা এক ভালোলাগায় ভেতরটা খলখলিয়ে উঠলো। কী হলো আদিবের? কে জানে! সে এক হাতের ভরে নিজেকে সামলে অন্য হাত দিয়ে জাহানারাকে নিজের সাথে আরও নিবিড় করে জড়ালো। আদিবের শীতল হাতের নিবিড় স্পর্শে কেঁপে উঠল জাহানারা। ঘোর কাটল তার। বুঝতে পারল, জ্বরের ঘোরে কল্পনা আর বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলেছে সে। আদিবকে জড়িয়ে ধরা হাত দুটো তৎক্ষণাৎ শিথিল করল। একটা শ্বাস টেনে ঢোক গিলল। নিজেকে ধাতস্থ করে আদিবের বুকে হাত রেখে তাকে নিজের থেকে দূরে ঠেলল। জ্বরাগ্রস্ত দুর্বল কণ্ঠে বলে উঠল—
-আদিব, সরুন।
আচমকা এমন প্রত্যাখ্যানে থমকে গেল আদিব। এক নিঃশব্দ অপমানে মুখটা শক্ত হয়ে উঠল তার। মুহূর্তেই নিজেকে সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। জাহানারার এই দ্বিমুখী আচরণ—কাছে টেনে নিয়ে দূরে ঠেলে দেওয়া—এ ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ হলো না তার। অপমানিত বোধ করল সে, ভিতরে ভিতরে রাগে ফেটে পড়ল। মুখের ভঙ্গি কঠোর হলো। নিজের থমথমে মুখটা ঘুরিয়ে নিল জাহানারার বিপরীতে। ঘনঘন শ্বাস টেনে নিজের রাগ দমাতে চাইল, কিন্তু সফল হলো না। অজান্তেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্থান ত্যাগ করল। ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। যাওয়ার সময় স্বশব্দে দরজা দিয়ে নিজের উদ্বেলিত রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে ভুলল না।
দরজা দেওয়ার বিকট শব্দে কেঁপে উঠল জাহানারা। চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল। আদিবের গভীর স্পর্শে মনের মাঝে যে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, সেটা দমানোর চেষ্টা করল। একটু সময় লাগল, তবে নিজেকে সামলে নিল জাহানারা। ধাতস্থ হয়ে উঠে বসল শোয়া থেকে।
আদিবকে কল্পনা করে তার সাথে কথোপকথনের এই অভ্যাস অনেক পুরোনো জাহানারার। সেই অভ্যাসবশত আজ বাস্তব আর কল্পনার মাঝের পার্থক্যটা বুঝতে পারেনি সে। জ্বরের ঘোরে আদিবের বাস্তব সত্তাকে অবাস্তব ভেবে নিজের মনের অভিযোগ ব্যক্ত করছে নির্দ্বিধায়! নিজের এই বোকামির জন্য নিজের উপর রাগ হলো জাহানারার। তিক্ত বিরক্ত হয়ে ফুঁসে একটা শ্বাস ফেলল। সাইড টেবিল থেকে পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে এক নিশ্বাসে সবটুকু পানি শেষ করল। খালি গ্লাসটা আবার সাইড টেবিলে রাখতে গিয়ে চোখ পড়ল নতুন জগটায়। আদিব চলে যাওয়ার পর নেহাকে ডেকে বলেছিল, আদিবের ঘরে যেমন জগ ছিল, তেমন একটা জগ কিনে আনতে। জাহানারা লক্ষ্য করে দেখল, নেহা তার কথা মতোই আগের জগটার অনুরূপ একটা জগ নিয়ে এসেছে। নেহা ফিরে আসার আগে ঘুমিয়ে পড়ায় সেটা দেখা হয়নি জাহানারার। এখন জগটা দেখে নেহার উপর সন্তুষ্ট হলো সে। মনে মনে ঠিক করল, নেহার যে ফোনটা আজ সন্ধ্যায় সে নিজ হাতে ভেঙেছে, তার বদলে মার্কেটে সদ্য আসা আইফোনের নতুন ভার্সনটা কিনে দেবে নেহাকে। নিজ মনে কথাটা ভাবতে ভাবতে অর্ধেক পানি ভর্তি জগটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল জাহানারা। জগের সূক্ষ্ম কারুকার্যের ভাজে ভুলে গেল কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা।
—
সেদিন রাতে আর নিজের ঘরে ফিরল না আদিব। দুই তলার একটা গেস্ট রুমে সকলের অলক্ষ্যে কাটিয়ে দিল রাত। পরের দিন খুব ভোরে আস্তে ধীরে নিজের ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে ঢুকে জাহানারাকে সজাগ দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো, তবে কিছু বলল না। জাহানারাও কিছু জিজ্ঞেস করল না। আদিব প্রতিদিনের মতো নিজের কাপড় নিয়ে ঢুকল ওয়াশরুমে। অনেকটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হলো। তোয়ালেটা বারান্দার রেলিংয়ে শুকাতে দিয়ে ফিরে এল ঘরে। জাহানারা তার প্রতিটি পদক্ষেপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লক্ষ্য করল। নিজেকে পরিপাটি করে জাহানারার সামনে বিছানায় বসল আদিব। আজ আর চেয়ার টানল না। জাহানারা তাকে নিজের সামনে বসতে দেখে লম্বা করে ছড়িয়ে রাখা পা গুটিয়ে নিল। সোজা হয়ে বসল। আদিব তার চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো ভণিতা ছাড়া স্পষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল—
কটাক্ষ করে বলল জাহানারা। মুখে তার গা জ্বালানো হাসি।
-তাছাড়া আর কিছু না? নাথিং?
অন্যরকম কণ্ঠ আদিবের। মুখের ভঙ্গিও শীতল।
-না। অন্য কিছু না।
ফোঁশ করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব। তারপর বলল—
-তোমার সিদ্ধান্ত যদি এই হয়, তাহলে আমাদের সম্পর্কটা এখানেই ইতি টানা দরকার। দেখো, আমার একটা কথার জন্য তোমার জীবনে কী কী হয়েছে, সেটা আমি জানি না। তবে এটা বুঝেছি, আমার জন্য তোমার জীবনের অনেক অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, যার ক্ষতিপূরণ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।
একটু থামল আদিব। তারপর অন্যদিকে একপলক তাকিয়ে আবার জাহানারার দিকে তাকাল। জাহানারা তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে তার দিকে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে তার। আদিব সেই জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে ফের বলল—
-আমার জন্য তোমাকে যে সাফার করতে হয়েছে, জাহানারা, তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমি হাত জোড় করে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।
-আপনার ক্ষমা চাওয়া-না-চাওয়াতে আমার কিছু যায় আসে না, আদিব।
-তোমার যায় না আসলেও আমার যায় আসে। আমাকে আমার কথা শেষ করতে দাও। গতকাল রাতে তোমার কথা শুনে আমি যেটুকু বুঝেছি, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে আমাদের একসাথে থাকা সম্ভব না। তোমার উগ্রতা, তোমার ঘৃণা—এসব আমার কাছে অসহনীয়।
-আপনি কি আমাকে ডিভোর্সের কথা বলতে চাইছেন?
আদিবের কথা কেটে বলল জাহানারা। নিজের কথায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় চোয়াল শক্ত হলো আদিবের। নিজেকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণে রাখছিল সে। ধৈর্য ধরে কথা বলার চেষ্টা করছিল। একটা সুস্থ আলোচনা করতে চাইছিল। কিন্তু এই মেয়ের জন্য সেটা সম্ভব হওয়ার নয়। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানল আদিব। গতকাল সারারাত ভেবেছে সে তাদের এই প্যাঁচানো-ঘোচানো সম্পর্ক নিয়ে, তার প্রতি জাহানারার বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব নিয়ে। শেষমেষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, জাহানারা যদি সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে তার সাথে সম্পর্কটা কনটিনিউ না করতে চায়, তাহলে এ সম্পর্ক থেকে অব্যাহতি দেবে তাকে। একটা সম্পর্কে গুমরে গুমরে থাকার চেয়ে নিজেদের পথ আলাদা করে নেওয়া ঢের ভালো।
-আপনি যদি ডিভোর্সের কথা ভুলেও মাথায় এনে থাকেন, তাহলে সেটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন, আদিব ভাই। আমি বেঁচে থাকতে আপনাকে সুখ অনুভব করতে দেব না।
দাঁতে দাঁত পিষল আদিব। জাহানারার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। তার এই রাগান্বিত মূর্তি দেখে জাহানারা স্বস্তি পেল। ঠোঁটের কোণে উঁকি দিল মিটমিটে হাসি। আদিব সেটা দেখে দাঁত কিড়মিড় করে বলল—
-সাইকো একটা!
মুখ ঘুরিয়ে নিল আদিব। জাহানারা তার কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠল। বলল—
-আপনি আজ জানলেন বুঝি সেটা!
জাহানারার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা। আদিব বুঝল, মেয়েটার সাথে কথা বলে লাভ নেই। যা করার, তাকেই করতে হবে। আদিবকে উঠে যেতে দেখে পিছু ডাকল জাহানারা। কণ্ঠে হাসির ছাপ রেখেই বলল—
-নিজের সীমা অতিক্রম করো না, জাহানারা! ফল ভালো হবে না কিন্তু!
-ফল ভালো হোক বা খারাপ, দুটোই মেনে নেওয়ার সাহস আছে আমার। আমি ভাবছি, আপনার কথা—আপনি তো চড়ুইর ঘায়ে কাত হচ্ছেন!
উপহাসের সুর জাহানারার। আদিব যেন এবার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাল। জাহানারার চোয়াল চেপে ধরে বলল—
-মুখ সামলে! নাহলে—
-নাহলে কী করবেন? মারবেন?
সেভাবেই বলল জাহানারা। ঝাঁকা মেরে ছেড়ে দিল তাকে আদিব। আহত সিংহের মতো গর্জে উঠে বলল—
-সমস্যা কী তোমার? তোমার কী ক্ষতি করেছি আমি? মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি? ভালোবাসার অভিনয় করেছি? ঠকিয়েছি? কেন শুধু শুধু আমার জীবনটা নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছ? কেন?
জাহানারা নীরব। দৃষ্টি ঘোলাটে তার।
-কী হলো? জবাব দাও।
জাহানারাকে চুপ থাকতে দেখে ধমকে উঠল আদিব। জাহানারা তার ধমকে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল, কিন্তু দমল না। গোঁ ধরে বলল—
-আপনার সাথে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাইছি না আমি। বুঝতে পারছেন না?
-বুঝছি, খুব ভালোভাবেই বুঝছি। তোমার তো বলার মতো কিছু নেই। তুমি নিজেকে অসহায় ভিক্টিম দেখিয়ে এতদিন সবার কাছ থেকে যে সহানুভূতি নিয়েছো, সেগুলো তো তোমার চাল ছিল—আমাকে নিচু করার, আমাকে ছোট দেখানোর! তাছাড়া কিছু না। নিজেকে অসহায় দেখাতে গেলে একজনকে জালিম তো বানাতেই হবে। তো আমাকে জালিম বানিয়ে দিলে। আমাকে ভালোবাসার দাবি করে এতদিন যে প্যানপ্যানানি করলে, সেসব তো তোমার নাটক ছিল। আসলে আমাকে কোনোদিন ভালোবাসোই নি তুমি। আমাকে পাওয়া তোমার জেদ ছিল। তার থেকে বড়, নিজেকে খুব সুন্দরী মনে করতে—তখনই তোমার মাথা নষ্ট হলো, যখন দেখলে এই ‘কোনোরকম দেখতে’ ছেলেটা তোমাকে দাম দিচ্ছে না। আমাকে নিজের সামনে নত করার জন্য যা নয়, তাই করতে লাগলে।
-মুখ সামলে কথা বলবেন, আদিব। যা জানেন না, তা নিয়ে কথা বলবেন না। আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না।
চিৎকার করে উঠল জাহানারা। আদিব সেটা দেখে ঠেস দিয়ে বলল—
-একশোবার তুলব? কেমন ভালোবাসা তোমার? হ্যাঁ? যে ভালোবাসা পাওয়া-না-পাওয়ার মাঝে ঝুলে থাকে! ভালোবাসা পাওয়া-না-পাওয়ার ঊর্ধ্বে, বুঝেছো?
আদিবের প্রশ্নে থতমত খেল জাহানারা। মুহূর্তে ফ্যাকাশে হলো মুখ। বুঝতে পারল, রাগের মাথায় খুব বেশি কথা বলে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল সে। মুখে ফিকরে হাসি এনে বলল—
-আমি আপনাকে ভালোবাসি কি না বাসি, সেটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন, বলুন তো? আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন বুঝি?”
-ইন ইউর ড্রিমস। আমার এত খারাপ দিন আসেনি যে তোমাকে ভালোবাসতে যাব।
-খারাপ দিনই তো চলছে আপনার। না হলে, যাকে নিজের অযোগ্য বলে পায়ে ঠেলেছিলেন, তার কাছে একটা সুস্থ-স্বাভাবিক সংসারের ভিক্ষা চান? নাকি এই জাহানারা নাম-ডাক আছে বলে—
-তুমি সেদিনও যেমন আমার অযোগ্য ছিলে, আজও তেমনই আমার অযোগ্য। শুধু এতটুকু পার্থক্য—সেদিন অন্তত তোমার মাঝে একটা শুদ্ধতা ছিল। আর এখন পুরোপুরিভাবে অশুদ্ধ তুমি। নিজের নাম-ডাকের রোয়াব নিজের কাছে রাখো। এই আদিব আহসান তোমার মতো সো-কল্ড নামি-দামি লোককে গোনায় রাখে না।”
জাহানারা কথা শেষ হতে না দিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ল আদিব। আদিবের বলা কথাগুলো বুকের মাঝে তীক্ষ্ণ ফালার মতো বিঁধল জাহানারার। মুখে মুখে যতই বলুক সে ছেলেটাকে ঘৃণা করে, মন তো জানে, তার কতটা জুড়ে আছে এই অহংকারী ছেলেটা। আজ এতদিন পরে নিজের এত এত প্রাপ্তি ঠুনকো লাগল জাহানারার কাছে। মনে হলো, চাচু তাকে যে তেজস্বী সূর্য হতে বলেছিল, তার এক চিকন রশ্মিও হতে পারেনি সে। না হলে এই ছেলের কথা কেন গায়ে বাধছে তার? কেন ভেতরটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে? চোখ ভিজে উঠল জাহানারার। আদিব অবশ্য সেসব লক্ষ্য করল না। সে রাগে অন্ধ হয়ে গজগজ করে ফুঁসতে লাগল।
বাবা আর সেজ চাচার কথা ভেবে বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে চাইছিল সে। সেই জন্য মেয়েটাকে বারবার সুযোগ দিচ্ছিল। ভেবেছিল, তার কথাতেই যখন মেয়েটা এত আঘাত পেয়েছে, তাহলে সেই না হয় সেই আঘাতেই ঔষুধ লাগাক। কিন্তু এখন মেয়েটার কথা শুনে আদিব স্পষ্ট বুঝতে পারছে, মেয়েটা তার এই বিনয়ী ভাবকে লোভ মনে করছে। ভাবছে, তার নাম-ডাক-অর্থ-সম্পদের লোভে তাকে আটকাতে চাইছে আদিব। আচ্ছা, তাহলে এই ঠিক! আর আটকাবে না আদিব তাকে। ভাববে না আর কারো কথা। তার যা মনে হয়, তাই করবে।
-“তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখব না আমি, জাহানারা। তুমি যদি মিউচুয়ালি যেতে না চাও, তাহলে আমাকে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। চয়েস ইজ ইয়োর।”
চলে গেল আদিব। জাহানারার দৃষ্টি ঝাপসা হলো। এতক্ষণ আটকে রাখা অশ্রু সব বাধ ভাঙল। আদিবের গমনরত পথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে ছাড়বে না আদিবকে। ছেলেটা কী করে, সেও দেখে নেবে।
—
এরপরের দিনগুলো বেশ দ্রুত অতিবাহিত হলো। আদিব জাহানারার সাথে সব কথা-বার্তা বন্ধ করল। জাহানারাও অবশ্য খুব একটা চেষ্টা করল না তার সাথে কথা বলার।
আদিব আর জাহানারা এমন রেষারেষির মধ্যে খবর এল, দীপ্তির একটা ছেলে বাবু হয়েছে। আল্লাহর রহমতে মা-ছেলে দুইজনেই ভালো আছে। তানিয়া নাতি হওয়ার খুশিতে সারা পাড়া মিষ্টি বিতরণ করল। এমনকি এতদিনের রাগ-অভিমান ভুলে আশরাফের সাথে ঢাকার পথে রওনা হলো মেয়ে আর নাতিকে দেখতে। আদিব যেতে চেয়েছিল তাদের সাথে, কিন্তু জাহানারা একা থাকবে বাড়িতে—সেই কথা বলে আশরাফ তাকে রেখে গেল। আদিব এত করে বলল, নেহা আছে, কাজের লোক আছে, কিন্তু আশরাফ তার কথা কানে তুলল না। অগত্যা তাকে থেকে যেতে হলো। জাহানারা অবশ্য আদিবের সামনে এমন ভাব করল যে আদিবের থাকা-না-থাকায় তার কিছু যায় আসে না। অথচ মনে মনে এটা ভেবে খুশি হলো যে ছেলেটাকে একা পেয়ে এবার ইচ্ছা মতো শায়েস্তা করতে পারবে।
চলবে, ইনশাআল্লাহ।
#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৫
জাহানারা ভেবেছিল আদিবকে একা পেয়ে ইচ্ছেমতো নাস্তানাবুদ করবে। কিন্তু জাহানারার ভাবনার গুড়ে একমুঠো বালি চেলে আদিবই যেন তাকে জব্দ করতে লাগল। এই যেমন, আশরাফ আর তানিয়া ঢাকায় যাওয়ার পরদিনই কাকতালীয়ভাবে সব কাজের লোক ছুটিতে চলে গেল। এমনকি রাবেয়া খালা, যে দীর্ঘ দুই বছর এই বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়ি যায়নি, সেও হঠাৎ মনের টানে বাড়ি ছুটল। জাহানারার কপাল ভালো, নেহা ছিল সাথে, তাই খাওয়া-দাওয়ায় কোনো অসুবিধা হলো না। কিন্তু নেহাকে যখন জরুরি প্রয়োজনে ঢাকা যেতে হলো, তখনই বাধল বিপত্তি। রান্না-বান্না, মাজা-ঘসা—কোনো কালেই শেখা হয়নি জাহানারার। ছোটবেলায় সালেহা বকাঝকা করে যা দুটো-একটা কাজ করাতো, কিন্তু বাড়ি ছেড়ে ছোট চাচার সাথে ঢাকায় যাওয়ার পর ছোট চাচি তাকে যতটা সম্ভব আদরে-আহ্লাদে রেখেছে। খড়কুটো ভাঙতে পর্যন্ত দেয়নি। তাছাড়া, সে মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত ছিল যে তাকে কিছু বলার আগে শাহেদ কিংবা তার স্ত্রী দুইবার ভাবতো। এরপর আঠারো গড়াতে না গড়াতেই শোবিজের দুনিয়ায় পা রাখল। ঝকমকে জগতে মেকআপ, ক্যামেরা, অভিনয়ের গোলকধাঁধায় গৃহস্থালি পিছনে পড়ে রইল অবহেলায়। শেখা হয়ে উঠল না নিত্যপ্রয়োজনীয় ঘরের কাজ!
নেহা যতদিন ছিল আরামেই ছিল জাহানারা।নেহা চলে যেতেই সে পড়ল বিপাকে। খাবার-দাবার রাবেয়া যা রান্না করে গিয়েছিল, সেগুলো যোগেযোগে দুই-তিন দিন চলল তার। আদিব অবশ্য ফ্রিজের খাবার ছুঁয়েও দেখেনি। সে সর্বগুণে গুণান্বিত পুরুষ! নিজে রাঁধতে-বাড়তে পারে। নিজের রান্না সে নিজেই করে খেয়েছে। এবং শুধু নিজের জন্যই রান্না করেছে। জাহানারাকে তার রান্না খাবার থেকে এক চা-চামচ পরিমাণও দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। এমনকি যে পাত্রে রান্না করেছে, সেটাও মেজে ঘষে রেখে দিয়েছে। জাহানারা দুই দিন নিজে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে বিষয়টা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এটো বাসন দেখে জীবনে প্রথমবার তার এত কষ্ট লেগেছে, যেটা বলে বোঝানো সম্ভব না। অনলাইনে কিছু অর্ডার করবে, তারও উপায় নেই। দেশে করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। ইতিমধ্যে চারজন মারা গেছে, শতাধিক আক্রান্ত। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। গণমাধ্যমগুলো বেশ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। এমন অবস্থায় দেশের একজন সচেতন ভীতু নাগরিক হিসেবে সে কিভাবে বাইরে থেকে খাবার এনে খাবে?
ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে মুখ লটকিয়ে আদিবের দিকে তাকালো জাহানারা। আদিব তার খাবার প্রস্তুত করছে। আজ চারদিন ধরে এভাবেই নিজের খাবার নিজে রান্না করে আসছে সে। খুব বেশি কিছু খায় না ছেলেটা। এক বাটি ভাত, একটা সাধারণ সবজি (যেটাতে মাছ থাকবেই), আর একটা ডিম সিদ্ধ—বাস, এই তার খাওয়া। তবে এটা শুধু রাতের জন্য। দুপুর আর সকালের মেনু আবার আলাদা। সে যাই হোক, খাবার অল্প খেলেও জোগাড় করে রাঁধতে তো হয়। এখন জাহানারার কথা হচ্ছে—এত কষ্ট করে জোগাড়-টোগাড় করে যখন রান্না করছেই, তখন তার কথা ভেবে একটু পরিমাণে বেশি রান্না করলে কি হয়! কিন্তু না, তা তো করবে না ছেলেটা। সে তো জাহানারাকে শায়েস্তা করতে চায়। সেই জন্য তো বাড়ি থেকে সবাইকে তাড়িয়ে তাকে এমন ফাঁদে ফেলেছে। জাহানারা বুঝি বোঝে না! সে সব বোঝে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ফোনের দিকে তাকালো। একদিনের নাম করে গিয়েছিল নেহা, দুই দিন হয়ে গেল, তার দেখা নেই। ফিরে আসা তো দূরের কথা, ফোনটাও তুলছে না। জাহানারার রাগ হলো ভীষণ মেয়েটার ওপর। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নেহার উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠালো, *”তোমাকে আর আসতে হবে না। রেজিগনেশন লেটারটা মেইল করে দিও।”* সেন্ড বাটনে ক্লিক করে মেসেজটা পাঠিয়ে আদিবের দিকে আরো একবার তাকালো। আদিব তখনো তার কাজে ব্যস্ত জাহানারা দিকে তাকানোর সময় নেই তার।
আদিবের রান্না খাবারের গন্ধ ইতিমধ্যে পাত্র থেকে বের হয়ে হাওয়ায় দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করেছে। জাহানারার নাকে এসে লাগল সেই ঘ্রাণ। খাবারের সুগন্ধে ক্ষুধা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার। একটা ঢোক গিলল সে। আদিবের রান্না শেষ। জাহানারা গন্ধ শুঁকে বুঝলো—মুরগির মাংস রান্না করেছে ছেলেটা। জাহানারাকে অগ্রাহ্য করে সবটুকু খাবার বাটিতে ঢেলে নিল আদিব। খাবারের প্লেটে খাবার সাজিয়ে এটো বাসনগুলো সিংকে ফেলল। সাথে সাথে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল জাহানারার। আদিব রান্নাঘর থেকে বের হতেই সে কিচেন ক্যাবিনেটের দিকে হাঁটা দিল। পায়ের ক্ষতটা প্রায় সেরে গেছে। একটু ব্যথা আছে, তবে সেটা গায়ে সওয়া। ক্যাবিনেট থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে সেটা নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসল। আদিব তখন মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে। রান্নাঘরে ঘেমে-নেয়ে রান্না করার পরেও ফ্রেশ হয়নি ছ্যাঁড়টা। সাথে সাথে গিলতে বসেছে! পিচাস! নিজের মনে কথাটা বলে টিভির রিমোটে হাত দিল জাহানারা। টিভি অন করতেই মাথায় বাজ পড়ল তার। *”২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। এই সময় জরুরি সেবা ছাড়া সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।”*
এর মানে নেহা চাইলেও খুলনা আসতে পারবে না। চিন্তিত হলো জাহানারা। একবার ভাবলো, খুলনায় মেইড এজেন্সি বলে যে সংস্থাটা আছে, সেখান থেকে কাউকে রান্নার জন্য ডেকে নিতে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, এই সময় কাকে না কাকে পাঠাবে এজেন্সি—সে দেখা গেল কাজ করতে এসে ভাইরাস বাঁধিয়ে দিল। এসব চিন্তাভাবনার মধ্যে একবার তারিনের কথাও মাথায় এলো, কিন্তু বাবার সাথে সেদিন ওভাবে কথা বলা পর আবার আকিবের ফোন উপেক্ষা করায় ওই বাড়ি থেকে সামান্য সাহায্য চাইতেও বিবেকে বাধল তার। তাই তারিনের কাছে সাহায্য নেওয়ার চিন্তা তৎক্ষণাৎ বাদ দিল।
আদিবের প্লেট-বাটির টুংটাং শব্দে ভাবনা ছুটল জাহানারার। খাওয়া-দাওয়া শেষ ছেলেটার। থালা-বাসন পরিষ্কার করছে সে। আজকেও তার জন্য কিছু রাখেনি। কথাটা মনে হতেই রাগে-দুঃখে ঠোঁট বেঁকে গেল তার। বিস্কুটের প্যাকেটটা শব্দ করে টি-টেবিলের ওপর রেখে নিজের ঘরে গেল।
ঘরে ঢুকে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সাইড টেবিলের ওপর রাখা পানির জগটা হাতে নিল। গ্লাসে পানি ঢেলে জগটা আবার রাখতে গিয়ে কিছু একটা মনে করে থামল। তারপর সময় নষ্ট না করে আদিবের শোয়ার জায়গায় সুন্দর করে পানি ভর্তি জগের পানি ঢেলে দিল। কাজটা করতে গিয়ে তার মুখে খেলে গেল এক পৈশাচিক হাসি। জগের পানি শেষ করে জগটা তার জায়গায় রেখে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল। ঘুমের ভান করে চোখ বুজে পড়ে রইল আদিবের অপেক্ষায়।
আদিব এল আরো কিছুক্ষণ পর। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানার দিকে যেতেই চোখ পড়ল ভেজা অংশে। বুঝতে অসুবিধা হলো না—কাজটা সুনিপুণ হস্তে ইচ্ছাকৃতভাবে করা। শীতল দৃষ্টি ফেলল সে আপদমস্তক কাঁথায় মোড়া লতানো শরীরটার দিকে। ফুঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। নিজের ল্যাপটপ আর ফোন নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যাওয়ার সময় শব্দ তুলে দরজা দিয়ে বুঝিয়ে গেল সে চলে যাচ্ছে। আদিব চলে যেতেই মুখের ওপর থেকে কাঁথা সরাল জাহানারা। খেয়াল করল আদিব যাওয়ার সময় লাইট বন্ধ করে ডিম লাইট জ্বেলে গেছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন নিঃশব্দ ঘরটা যেন গিলে নিতে চাইল জাহানারাকে। তড়াক করে উঠে বসল সে। তাড়াতাড়ি লাইট জ্বালাল। একা থাকার অভিজ্ঞতা থাকলেও এই অপরিচিত জায়গায় হঠাৎ করেই ভয় হতে লাগল তার। বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আদিব যে ঘরে আছে, সে ঘরের দরজায় উকি দিয়ে দেখল—সে ল্যাপটপ খুলে বসেছে, কাজে মগ্ন। জাহানারা ভেবে পায় না—ডাক্তার মানুষ সারাদিন ল্যাপটপে কী করে?
আদিবকে নিজের কাজে মগ্ন দেখে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল সে। উদ্দেশ্য রান্নাঘর। পুরো বাড়িতে এখনো আলো জ্বলছে। আদিব ঘুমানোর আগে এই আলো বন্ধ করে অল্প পাওয়ারের ডিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। জাহানারা অবশ্য আদিব ঘরে যাওয়ার আগেই তার ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়ে। কেমন জানি গা ছমছম করে তার এই ফাঁকা বাড়িতে। শিউলি আর রাবেয়া খালাকে অকারণে বাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আদিবের ওপর রাগ হয় তার। মনে হয়, আদিবকে কাঁচা গিলে খেতে পারলে ভালো হতো। খাওয়ার কথা মনে হতেই পেটের ভেতর অদ্ভুত শব্দ করে উঠল জাহানারার। ক্ষুধা নিবারণে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। ফ্রিজে ফল আছে, ডিম আছে—সেগুলোই এখন ভরসা। হাতসাফ মুখে ফ্রিজের দরজা খুলল জাহানারা। সাথে সাথে দুটো নতুন টিফিন বক্স চোখে পড়ল। বাইরে থেকে দেখেই সে আন্দাজ করল—ভেতরে আদিবের রান্না মাংস ও ভাত আছে। সাথে সাথে ভেতরটা খুশিতে ডগমগ করে উঠল। টিফিন বক্স দুটো খুলে দেখল—ভেতরে বেশ অনেকটা ভাত ও মাংস আছে। এখান থেকে এক টুকরো মাংস আর এক চামচ ভাত নিলে আদিব বুঝবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ—একটা প্লেটে একটুখানি ভাত আর এক পিস মাংস তুলে নিল জাহানারা। তারপর টিফিন বক্স দুটো যেমন ছিল তেমনভাবে রেখে দিল ফ্রিজে। রান্নাঘরে থাকা টুল টেনে বসে খাবারে হাত দিল। খাবারে হাত দিতেই লক্ষ করল—খাবার ঠান্ডা। এই ঠান্ডা খাবার খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তাদের ওভেন নষ্ট, দুই দিন যাবৎ। তানিয়া না আসা পর্যন্ত ঠিক হবে না হয়তো। অগ্নিচুলোর দিকে এগাল জাহানারা। চুলো জ্বালাতে, খাবার গরম করতে—এইটুকু পারে সে।
ফ্রাইং প্যান চুলায় দিয়ে তার মনে হলো—ছোটবেলায় সালেহা যেমন তেল, লঙ্কা দিয়ে ভাত ভেজে দিতো, তেমন কিছু ট্রাই করতে। রান্নাঘরের কোণায় রাখা বাস্কেটে মরিচ-পেঁয়াজ পেয়ে গেল সে। পেঁয়াজ কুঁচি করা ঝামেলা বিধায় গ্রেটার দিয়ে গ্রেট করে নিল। নিজের এমন বুদ্ধিমত্তা দেখে নিজেই নিজের ওপর গর্বিত হলো খানিক। যাই হোক, মরিচ-পেঁয়াজ কাটা হলে চুলো জ্বালিয়ে ফ্রাইং প্যানে তেল ঢেলে সেটা একটু গরম হতে দিল। সালেহা যেমন করতো, সবটা মনে রেখে কাজ করতে লাগল। কিন্তু গরম তেলে পেঁয়াজ-মরিচ দিতেই বাধল বিপত্তি। পানিসহ পেঁয়াজ যেমন চড়বড় করে উঠল, মরিচের বিচগুলোও তেমন সমানতালে ফুটতে লাগল। চুলোর আঁচ বেশি থাকায় মুহূর্তের মধ্যে কী দিয়ে কী হয়ে প্যানে আগুন উঠল। সেই দেখে জাহানারা হুঁশ-জ্ঞান হারিয়ে চিৎকার করতে লাগল।
আদিব তখন নিচে নামছিল। রান্নাঘরের খুটখট আওয়াজ কানে যেতেই সে ভেবেছিল বিড়াল ঢুকেছে কিনা। জাহানারার চিৎকার শুনে অনেকটা দৌড়ে এল সে। রান্নাঘরে তখন যাচ্ছেস তাই অবস্থা। আদিব সবার প্রথমে গ্যাস বন্ধ করল। তারপর ফ্রাইং প্যান সিংকে ফেলে ট্যাপ ছেড়ে রুদ্ধশ্বাসে বলল,
—”পাগল তুমি! চুলা বন্ধ করতে পারোনি?”
—”আমার চোখ জ্বলছে, আদিব ভাই! আহ…!”
আদিবের কথা উপেক্ষা করে বলে উঠল জাহানারা। ছটফট করতে লাগল সে। মরিচ কাটা হাত না ধুয়ে কখন যে চোখে ঘষেছে, নিজেও জানে না মেয়েটা। ওর কথা শুনে এগিয়ে এল আদিব। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
—”দেখি কী হয়েছে।”
জাহানারা চোখ মেলে তাকাতে পারল না। ছটফট করতে লাগলো। আদিব লক্ষ করল—মরিচের বিচ লেগে আছে হাতে। তার বুঝতে বাকি রইল না—আহাম্মক মেয়ে করেছে কী! রান্নাঘরের পাশে থাকা বাথরুমে নিয়ে গেল সে জাহানারাকে। নিজের হাত পরিষ্কার করে জাহানারার চোখে পানির ঝাপটা দিল। একদম জ্বালা বন্ধ না হলেও কিছুটা আরাম পেল জাহানারা। আদিব তার হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে দিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে তাকে বসাল। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে সেটা এক বাটিতে ঢেলে পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে জাহানারার চোখে রাখল। ভেজা কাপড় চোখে দিতেই আরাম বোধ করল জাহানারা। সেভাবেই কিছুক্ষণ কাটল। একসময় দাপাদাপি বন্ধ হলো জাহানারার। আদিব স্বস্তি পেল। জিজ্ঞেস করল,
মাথা নাড়ল জাহানারা—যার অর্থ সে পারবে। আদিব আশ্বস্ত হয়ে রান্নাঘরে গেল। ছড়ানো-ছিটানো রান্নাঘর পরিচ্ছন্ন করে ভাত আর মাংস গরম করে, জাহানারার জন্য প্লেটে খাবার নিয়ে তার সামনে টেবিলে রাখল। নরম কণ্ঠে বলল,
—”খেতে পারবে? না খাইয়ে দেব?”
আদিবের কথা শুনে লজ্জায়-দুঃখে চোখে পানি এল জাহানারার। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। তেজ নিয়ে বলল,
—”এত দরদ দেখাতে হবে না। যান এখান থেকে।”
জাহানারার নাক ফুলানো কথা শুনে এই পরিস্থিতিতে হেসে ফেলল আদিব।নিশব্দ হাসিতে উজ্জ্বল হলো তার মুখ।চোখের উপর ভেজা কাপড় থাকায় জাহানারা তার হাসি দেখল না, সে সেভাবেই বলল,
—”আজ দুই দিন ধরে আধপেটা খেয়ে আছি। একবারো খোঁজ নেননি। আর আজ যখন পুড়ে-ধুড়ে মরতে বসেছিলাম, তখন আসছেন আহ্লাদ দেখাতে? আপনার আহ্লাদ আপনার কাছেই রাখুন।যান এখান থেকে!”
—”আহ্লাদ দেখাচ্ছি না, মানবতা দেখাচ্ছি। আর রইল বাকি দুই দিনের কথা—তোমার জন্য পর্যাপ্ত খাবার ছিল ফ্রিজে।আমি জানি সেটা ।তাই খোঁজ নেয়নি।”
আদিবের কথায় থতমত খেল জাহানারা। ফ্রিজে সত্যিই তার জন্য পর্যাপ্ত খাবার ছিল আজ দুপুরে সেটা শেষ হয়েছে।সে তবুও হার মানলো না।নিজেকে সঠিক প্রমাণিত করতে আমতা আমতা করে বলল,
—”ফ্রিজের বাসি খাবার রোজ রোজ খাওয়া যায়? আপনার ওভেনও তো নষ্ট! কেন নিজে যখন রান্না করছিলেন, তখন আমার জন্য দু মুঠো চাল বেশি নেওয়া যায়নি?”
অভিযোগের সুর জাহানারার। আদিব একটা শ্বাস ফেলল। ফ্রিজে জাহানারার জন্য খাবার আছে এটা ভেবেই গত দুই দিন সে নিজের মতো রান্না করেছে। ম্যাডাম যে ফ্রিজের বাসি খাবার খাবে না, সেটা জানলে নিজের সাথে তার জন্য দু মুঠো রান্না করত। ঠিক আজ যেমনটা করেছিল।
আদিব বিড়বিড়ালো। জাহানারার কানে গেল কথাটা।সে তড়িৎ চেয়ারে এলিয়ে রাখা ঘাড় সোজা করলো চোখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে বলল,
-কি বললেন আপনি? আরেকবার বলুন?
—”কাপড় সরালে কেন? চোখ জ্বালা কমেছে?”
—”না, কমেনি। আপনার মুখ দেখে কথা না বললে শান্তি পাচ্ছি না।”
আদিব হতাশ শ্বাস ফেলল।দুই দিকে মাথা নাড়লো।নিজের বলা কথাটা কৌশলে আড়াল করে বলল,
—কিছু বলিনি।মুখ খোলো, নাও।”
জাহানারা তৎক্ষণাৎ মুখ খুলল না। ক্ষুধা আছে তার পেটে। ইচ্ছা করছে এখনই প্লেট ধরে গপাগপ সব খেয়ে নিতে, কিন্তু ভদ্রতা বলেও তো কথা আছে। এমনিতে একটু আগে যে কাণ্ড হলো, আদিব কিছু না বললেও সে জানে—তাকে ছ্যাঁচড়া ভাবছে ছেলেটা। একটু সময় নিয়ে মুখ খুলল জাহানারা। নিজের হাতে না খেলে শান্তি পায় না সে, কিন্তু আদিবের হাতে খেতে অন্যরকম একটা সুখ-সুখ অনুভূতি হয়। এই ব্যাপারটা সে আদিব যখন তার আদর্শ স্বামী হওয়ার অভিনয় করতো, তখন লক্ষ্য করেছে।আদিবের একটু যত্নআত্তি যেন ভেতরটা উৎফুল্ল করে তোলে ।
—”বাড়ির সব কাজের লোক তাড়িয়েছেন কেন আপনি? আমাকে জব্দ করার জন্য?”
মুখে ভাত নিয়েই জেরা করার সুরে বলল জাহানারা।আদিব ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
—”রাবেয়া খালার মা অসুস্থ। মেয়ে ছাড়া তার আর কেউ নেই।”
—”আর শিউলি?”
—”তার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। সে মায়ের সাথে কথা বলে গিয়েছে।”
—”সবাই একসাথে চলে গেল—ব্যাপারটা অদ্ভুত না, আদিব ভাই?”
চোখ সরু করল জাহানারা। আদিব ভাতের লোকমা তার মুখের সামনে ধরল। তারপর তারমতো করেই বলল,
—”তোমার নেহা, যে তুমি ওয়াশরুমে গেলেও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে, সে তোমার ফোনও তুলছে না—এটা আরো ইন্টারেস্টিং না জাহানারা?”
—”মানে?”
বিস্মিত কণ্ঠ জাহানারার।আদিব মুচকি হাসলো।বুঝলো মেয়েটা যতোই হম্বিতম্বি করুক না কেন।বুদ্ধির ঘট এখনো কিঞ্চিৎ ফাকা তার।না হলে তার ইশারা বুঝে নিতো।কথায় বলে বুদ্ধি মানের জন্য ইশরায় যথেষ্ট!
ছোট চাচু নিজের শিয়ালী বুদ্ধি খাটিয়ে বাড়ি ফাঁকা করেছে, উদ্দেশ্য যেন ফাঁকা বাড়িতে আদিব আর জাহানারা একে অপরের কাছাকাছি আসে।তাদের মধ্যকার দূরত্ব কমে।এ ক্ষেত্রে ছোট চাচু বাবার সাহয্যও নিয়েছে।বাবাও তার কথা মতো রাবেয়া খাল ও শিউলিকে অগ্রীম বেতন দিয়ে বাড়ি ছাড়া করেছে। হঠাৎ করে সবাই ছুটি নিয়ে কেটে পড়ায় সন্দেহ হয়েছিল আদিবের তবে মাথা ঘামায় নি সে। কিন্তু নেহা জরুরি কাজের দোহাই দিয়ে যখন চলে গেল তখন টনক নড়লো আদিবের।বুঝলো এখানে কোন কিন্ত আছে। আদিবের সেই কিন্তুর পরন্তু জানতে পারলো তৃপ্তির পেট-পাতালা স্বভাবের কল্যাণে।নিজের মনের কথাগুলো ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আদিব।
—”মানে কিছু না। তাড়াতাড়ি খাও। আমার ঘুম পাচ্ছে।”
—”তা যান ঘুমান। আমি কি আপনাকে আটকে রেখেছি না কি?”
এক ভ্রূ উঁচিয়ে তাকাল আদিব। এঁটো হাতের দিকে দৃষ্টি ফেলল। জাহানারা বুঝলো নিজের ভুল।বোকা হেসে বলল,
—”ওভাবে তাকাবেন না। আপনাকে বিদঘুটে লাগে।”
—”তাতে তোমার কি?”
—”আমারই তো সব। আপনি আমার বর না?”
—”বর মানো আমাকে?”
—”ওমা, কি অদ্ভুত কথা বলছেন? বর মানবো না কেন? বিয়ে করছি আপনাকে, আর বর মানবো না?”
—”হুম, বিয়ে করেছো আমাকে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”
কটাক্ষের সুর আদিবের।জাহানারা সন্দেহভরে তাকাল।আদিবের দিকে ভালো করে তাকাতেই লক্ষ্য করলো ছেলেটাকে আজ কেমন নিস্তেজ দেখাচ্ছে।কথা বার্তা কেমন প্রতিদিনের মতো ঝাঁজালো না। জাহানারা চিন্তিত হলো।বলল,
—”কি হয়েছে আপনার? বলুন তো। এমন অসুখওয়ালা মুরগির মতো ঝিমাচ্ছেন কেন?”
—”কিছু হয়নি। ক্লান্ত লাগছে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো।”
সত্যিই ক্লান্ত দেখাচ্ছে আদিবকে। চোখ দুটোও কেমন লাল হয়ে আছে।দেখেই মনে হচ্ছে শরীর ভালো না ছেলেটার। জাহানারা আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ খেয়ে নিল। জাহানারার খাওয়া শেষ হতেই আদিব থালা-বাসন নিয়ে রান্না ঘরে গেল।সেগুলো পরিষ্কার করে উপরের দিকে যেতে নিলেই জাহানারা পিছু ডেকে বলল,
—”আপনি ঐ ঘরে ঘুমাবেন প্লিজ। আমার ভয় করছে। আমি বিছানার চাদর পাল্টে দিচ্ছি।”
—”শরীর ভালো লাগছে না আমার। আমি যেটা ভাবছি, তেমন কিছু হলে আমার এখন তোমার থেকে দূরে থাকা ভালো।”
—”আপনার করোনা হয়েছে না কি?”
আৎকে উঠল জাহানারা। আদিব দায়সারা ভাবে বলল,
—”হতেও পারে।”
—”আরে যান বাইরে! কে বলেছিল আপনাকে বাইরে যেতে? দেখেছেন, দেশের এমন অবস্থা!আপনি না ডাক্তার!আপনি যদি এমন কান্ড জ্ঞানহীন হন তো আমারা কি করবো!”
চিন্তিত-রাগান্বিত কণ্ঠ জাহানারার। আদিব প্রতিউত্তর করল না।দোষ তার সুতরাং কথা বলা চলে না। জাহানারা কে উদ্বিগ্নত রেখে নিজের ঘরের দিকে আগালো। জাহানারাও তার কথার উত্তর না পেয়ে পিছু নিল আদিবের। আদিব ঘরে ঢুকতেই সেও ঢুকলো ঘরে।আদিবের অনুমতি ছাড়া চওড়া সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে বলল,
—”আমি এখানে ঘুমাবো, আপনি বিছানায় ঘুমান। কোনো সমস্যা হবে না।”
—”পাগলামি করো না, জাহানারা। নিজের ঘরে যাও। এ সময় সচেতন থাকা জরুরি।”
—”একটু আগে যে নিজে হাতে খাইয়ে দিলেন, তখন সচেতনতা কোথায় ছিল আপনার?”
—”তখন অত ভাবিনি। তাছাড়া তুমি আমার থেকে এক হাতের দূরত্বে ছিলে, আর আমি আমার হাত খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করেছিলাম তোমাকে খাওয়ানোর আগে।”
—”এখনো আমি আপনার থেকে দশ হাত দূরে আছি। আপনি ঘুমান।”
—”এত বিরক্তিকর কেন তুমি!”
তিক্ত বিরক্ত হয়ে বলল আদিব। চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। জাহানারা তার কথার জবাবে দাঁত বের করে হাসল। আদিব একটা হতাশ শ্বাস ফেলে পায়ের কাছে থাকা সবুজ-লাল সুতায় কাজ করা সাদা কাঁথাটা টেনে গায়ে দিল। শীত করছে তার। মনে হচ্ছে, নিয়াজের ডাকে বাইরে যাওয়াটা উচিত হয়নি। করোনা হলে খবর আছে। যেভাবে টপাটপ মানুষজন মরছে, মৃতের তালিকায় তার নাম না ওঠে।
—”জাহানারা, শোন। তোমার ঘরে যাও। বেশি ভয় করলে না হয় তোমাদের বাড়ি যাও। আকিব ভাই মাত্র বাড়ি ফিরল, আমি দেখেছি। ভাবি হয়তো জেগে আছে।”
—”চুপচাপ ঘুমান। আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।”
তেতে উঠে বলল জাহানারা। তবে আদিব দমল না। মেয়েটা এখনো ঔষুধের ওপর আছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাধারণ মানুষের থেকে কম তার। আদিব যদিও শক্ত-সামর্থ্য, হয়তো এই ধাক্কাটা সামলে নেবে, কিন্তু মেয়েটা তা পারবে না।
—”জাহানারা, বোঝার চেষ্টা করো। ব্যাপারটা এত হালকাভাবে নিয়ো না।”
শব্দ করে শ্বাস ফেলল আদিব।বুঝতে পারলো কথা বললেই এই মেয়ে সে কথা টেনে কথা বাড়াবে। সুতরাং চুপ থাকাই ভালো। মুখে কুলুপ এঁটে চোখ বন্ধ করল সে। ক্লান্ত শরীর বেশি সময় নিল না ঘুমে ডুবতে।
জাহানারাও আর বিরক্ত করল না তাকে। ঘুমানোর চেষ্টা করল। এই ঘরের সোফাটা বড় হলেও সোফা তো সোফাই, সে তো আর বিছানা হবে না। সোফার সংকীর্ণ জায়গায় জাহানারার চোখে ঘুম ধরতে বেগ পেতে হলো। তবে শেষমেশ ঘুম ধরা দিল চোখে।
জাহানারা সবেমাত্র তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছিল, ঠিক সেই সময় মৃদু গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই মনে পড়ল—আদিব অসুস্থ। তড়াক করে উঠে বসল সে। দ্রুত এগিয়ে গেল আদিবের দিকে। আদিবের নিষেধ-বারণ উপেক্ষা করে গায়ে-মাথায় হাত দিল তার। বুঝতে পারল—জ্বরটা বেশ জাঁকিয়ে এসেছে ছেলেটার। আদিব তখন অচেতনপ্রায়, মাঝেমধ্যে গুঙ্গিয়ে উঠছে। জাহানারা ওর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল। এই অসময়ে কাকে কী বলবে ভাবতেই সজীবের নাম মাথায় এল। সাথে সাথে ফোন করল তাকে।
জাহানারা স্মৃতিশক্তি হারানোর অভিনয় করেছে—এই কথা জানার পর থেকে সজীব কথা বলে না তার সাথে। এমনকি ফোনও ধরে না। তবে আজ কী মনে করে ফোন ধরল। গম্ভীর কণ্ঠে কাঠখোট্টা স্বরে বলল,
—”কি হয়েছে?”
জাহানারা সময় নষ্ট না করে আদিবের কথা বলল। আদিবের জ্বর এসেছে—এই কথা শুনে সজীবের মাথায় প্রথম যে কথাটা এল, সেটা হলো—ছেলেটা করোনায় আক্রান্ত হয়নি তো?
—”দেখ তো, আদিবের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক কি না?”
জাহানারা ঝুঁকে এল। নাকের কাছে হাত দিল, বুকে হাত রাখলো, অনুভব করল আদিবের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি-প্রকৃতি। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক আদিবের। কথাটা সজীব কে জানাতেই আরো কিছু প্রশ্ন করল সজীব।জাহানারা বাধ্য মেয়ের মতো তার সব প্রশ্নের উত্তর দিল। জাহানারার কথায় সজীব এতটুকু নিশ্চিত হলো যে—আদিব সিজনাল জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে।তবে পরক্ষণে কিছু একটা ভাবলো। তারপর জাহানারাকে তৎক্ষণাৎ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে বলল—আগামীকাল খুলনা মেডিকেল থেকে করোনা টেস্টের জন্য লোক পাঠাবে সে।আদিবের স্যাম্পল নিয়ে যাবে তারা।আদিবের করোনা টেস্টের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত জাহানারা যেন বিধি নিষেধ মেনে আদিবের কাছে যায়।এই দূর্বল সময়ে কোন কিছু হাল্কাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না!
– তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে, আদিব। আমি দেখেছি জাহানারার রিপোর্ট।
– রিপোর্টটা তোমার ভাতিজি হয়তো কড়া মূল্যে তৈরি করেছিল। বানোয়াট ওটা।
– কী বলছো!
আশরাফের কণ্ঠে বিস্ময়। আদিব মাথা নাড়ালো, যার অর্থ সে সত্যি বলছে। বিয়ের দিন সন্ধ্যাবেলা যখন মনে মনে খুব গোপনে জাহানারার স্মৃতিচারণ করছিল সে, তখন জাহানারাকে মুমূর্ষু অবস্থায় পাওয়ার পর জাহানারা তাকে ভালোবাসার যে অভিযোগ করেছিল, সেটা মনে হতেই আদিব যেন একটু থমকালো। তার হঠাৎ মনে হলো, কোথাও কি কিছু ভুল হচ্ছে! জাহানারা যেখানে অবচেতন অবস্থাতেও তার কথা ভোলেনি, সেখানে জ্ঞান ফেরার পর সমস্ত কিছু কিভাবে ভুলে গেল! তারপর মনে হলো, তখনো হয়তো সেভাবে ক্ষতি হয়নি। কিন্তু আবার মনে হলো, কিন্তু সে যেটা ভাবছে, সেটা যদি সত্যি হয়!
নিজের ভাবনার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে তার মনে পড়লো, ছোট চাচা তাকে জাহানারার রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, যেটা সময়ের অভাবে দেখা হয়নি। আদিব সেই রিপোর্ট ফাইল খুলল। খুব সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। কিন্তু ডাক্তার রাকিবের সারোয়ারের দেওয়া স্টেটমেন্ট তাকে আরো দিশেহারা করলো। মন বলল, সে অহেতুক সন্দেহ করছে। হতে পারে, অবচেতন মনে ভুলভাল বকছিল জাহানারা। ফাইল ক্লোজ করে বের হতেই মনে পড়লো, ছোট চাচা যখন জাহানারার MRI ও CT স্ক্যানের রিপোর্ট কালেক্ট করে, তখন রাকিবকে দেখানোর আগে তাকে ছবি তুলে পাঠিয়েছিল। ল্যাপটপ গ্যালারিতে প্রবেশ করলো সে। দুই মাস পুরনো ছবিটা নতুন ছবির ভিড়ে হারিয়ে ছিল, সেটা খুঁজতে একটু সময় লাগলো। তবে ছবি পেলেও নিজের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে বুঝতে একটু অসুবিধা হলো।
MRI-এর নির্দিষ্ট টেকনিক্যাল টার্ম ও নিউরোলজিক্যাল ডিটেইল, যেমন হিপোক্যাম্পাস, টেম্পোরাল লোবের ক্ষতি বা নিউরোপ্লাস্টিসিটি সম্পর্কিত বিশ্লেষণ, কনকাশন বা ক্ষুদ্র রক্তক্ষরণের সূক্ষ্ম লক্ষণ (Microbleeds, Diffuse Axonal Injury) এগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারলো না সে। একজন কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে সাধারণত মস্তিষ্কের MRI রিপোর্ট সরাসরি বিশ্লেষণ করতে অভ্যস্ত না সে, এটি তার বিশেষায়িত ক্ষেত্রের বাইরে। তবে MRI রিপোর্ট অনুযায়ী জাহানারার মস্তিষ্কে ক্ষতির পরিমাণ দেখে ভ্রূতে গাঢ় ভাঁজ পড়লো তার।মনকে বোঝাতে চাইলো হয়তো ভুল হয়েছে কোথাও।মন বুঝলেও মস্তিষ্ক মানতে চাইলো না। মাথায় হাত উঠলো তার। ভাবনায় পড়লো সে। অজ্ঞাত নিজের সন্দেহে পোক্ত মোহর লাগাতে ফোন করলো রিচার্ডকে। কোনো ভণিতা ছাড়া খুলে বলল তার সংশয়। রিচার্ড ব্যস্ত ছিল হয়তো, সে রিপোর্ট পাঠাতে বলে কিছু সময় নিল। ঠিক এক ঘন্টা পর রিচার্ড আবার ফোন করলো আদিবকে। আদিব তখন এশার নামাজ শেষ করে মাত্রই উঠেছে। রিচার্ডের কল রিসিভ করতেই রিচার্ড সম্পূর্ণ তথ্য রাখলো তার সামনে। জানালো, যার রিপোর্ট পাঠিয়েছে, তার মস্তিষ্কের সকল অংশ স্বাভাবিক রয়েছে, কোনো আঘাতজনিত পরিবর্তন বা ক্ষত দেখা যায়নি।
গ্রে ম্যাটার (Gray Matter) ও হোয়াইট ম্যাটার (White Matter) স্বাভাবিক।
হিপোক্যাম্পাস ও টেম্পোরাল লোব (Hippocampus & Temporal Lobes):
কোনো অস্বাভাবিক সংকোচন (Atrophy) বা আঘাতজনিত পরিবর্তন নেই।
কোনো সিগন্যাল ইন্টেনসিটির পরিবর্তন নেই, যা স্মৃতিভ্রংশ বা নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের ইঙ্গিত দেয়।
একে একে প্রতিটি পয়েন্ট উপস্থাপন করলো রিচার্ড। আদিব চুপচাপ সবটা শুনলো। রিচার্ডের কথার তাৎপর্য অনুযায়ী আদিব বুঝে নিল। তাকে বিশ্রীভাবে প্রতারিত করা হয়েছে। খুব বিশ্রীভাবে। সাথে সাথে রাগে সারা শরীর জ্বলে উঠলো তার। মাথার শিরা দপদপ করতে লাগলো। রিচার্ডের সাথে কথা শেষ করে বাবার ঘরের দিকে গেল সে। তাকে জানাতে চাইলো, যার জন্য সে নিজের আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে তার কাছে দয়া ভিক্ষা চেয়েছে, সেই মেয়ে তার সে দয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু বাবার ঘরের সামনে এসে সে আরো একবার হতাশ হলো।
– আমি জানতাম ঐ মেয়ের কিছু হয়নি। তোমাকে কি আমি এমনি এমনি ঐ মেয়ে থেকে দূরে থাকতে বলতাম! তখন মায়ের কথা শুনলে না। চলে গেলে সেবা-যত্ন করতে। এখন নাও ভোগো।
আদিবের ভাবনা ছিন্ন হলো মায়ের কথায়। তানিয়া রাগে গজগজ করতে করতে বসলো সোফায়। আশরাফ তখনো আদিবের কথা বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে তানিয়ার কথায় সে বিরক্ত হলো। আদিব মায়ের কথা শুনে মায়ের মুখের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকালো। তানিয়া তখনো নিজের মত বকবক করেছে।
– ওদের আমি চিনি না। হাড়ে হাড়ে চিনি ওদের। আমার ছেলে-মেয়ের সর্বনাশ করার জন্য সবসময় মুখিয়ে থাকে ওরা। কিন্তু তোমার বাপ, তোমরা, আমার কোনো কথা তো শুনবে না। তোমরা তো…
– তোমার একটা কথায় তিনটে মিথ্যা থাকে, মা। তোমাকে কিভাবে বিশ্বাস করবো?
ছেলের কথায় হতবাক হলো তানিয়া। অবাক চোখে তার দিকে তাকালো। আদিব তাচ্ছিল্যে হাসলো। বলল,
– তোমার সব কথায় তো শুনি আমি, তাহলে হঠাৎ জ্ঞান হারানোর নাটক করতে গেলে কেন? আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমার একটু সময় চাই। তুমি ঐ সময়টুকু দিতে পারলে না? এত অবিশ্বাস তোমার ছেলের প্রতি!
থামলো আদিব। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল।
– তোমার আর জাহানারার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, মা। তোমরা দুজনেই সমান। নিজের জেদ পূরণ করার জন্য যে কোনো সীমা অতিক্রম করতে পারো তোমরা। তাতে সামনের জনের মনের উপর কি প্রভাব পড়লো, তা দেখার প্রয়োজন বোধ করো না। অবশ্য দোষ তোমার না, দোষ আমার। নিজের দুর্বলতা যে তোমাকে বুঝতে দিয়েছি!তোমার সামনে বারবার জাহির করেছি, “আমার মা আমার সব”। ব্যাস! তুমি সুযোগ নিয়েছো!
ছেলের কথা শুনে উত্তপ্ত চোখে আশরাফের দিকে তাকালো তানিয়া। সেদিন রাতে যে তার কিছু হয়নি, এ কথা সে আর আশরাফ ছাড়া কেউ জানতো না। BP একটু লো ছিল তার। মাথাও ঘুরছিল, কিন্তু শরীর তখনো ভেঙে পড়েনি। আদিবকে জাহানারার সাথে এক বিছানায় এত কাছে দেখে তার মাথা কাজ করছিল না। মন শুধু বলছিল, ছেলেকে ঐ মেয়ের থেকে যেকোনো উপায়ে দূরে রাখতে হবে। তার জন্য যা করার লাগে, সে করবে। এসব ভেবেই জ্ঞান হারানোর ভান করে মাটিতে শুয়ে পড়েছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আদিব আসার কিছুক্ষণ পরে উঠেও যেত, কিন্তু মায়ের অবস্থা দেখে ছেলে এত উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, এটা ভাবেনি তানিয়া। তবে সে তার সাধ্য মতো নিখুঁত অভিনয় চালিয়ে গেছে। আদিব তার অভিনয় দেখে বুঝতেই পারেনি তার মায়ের কিছু হয়নি। তবে তানিয়া ছেলের চোখেকে ধোঁকা দিতে পারলেও আশরাফকে ধোঁকা দিতে পারেনি। তানিয়ার হৃদস্পন্দনের স্বাভাবিকতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে সত্যিটা। কিন্তু স্ত্রীকে ছেলের সামনে ছোট করতে চায়নি, তাই কিছু বলে নি আশরাফ। গতকাল শামীমরা চলে যাওয়ার পরে জাহানারার সাথে আদিবের বিয়ে নিয়ে বাকবিতণ্ডাতার দরুণ আশরাফ তাকে কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছে, ছেলেকে বোকা বানাতে পারলেও তাকে বোকা বানাতে পারেনি তানিয়া। আদিবের কথা শুনে তানিয়া বুঝলো, আশরাফ ছেলেকে সে কথা জানিয়ে দিয়েছে। আদিব বাবার দিকে মায়ের চোখা দৃষ্টি দেখে বলল,
– বাবা কিছু বলে নি আমাকে। তুমি নিজে মুখে যখন মেজ খালাকে তোমার মাস্টার প্ল্যান শোনাচ্ছিলে, দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তখন শুনেছি। এনিওয়ে, সামনের মাসে আমি লন্ডন ফিরে যাচ্ছি। জাহানারা হয়তো এখানেই থাকবে। তোমরা দুইজন যত খুশি নাটক নাটক খেলো। কেমন?
– নিজের সহবত ভুলো না, আদিব। মায়ের সাথে কথা বলছো তুমি। আমি যা করেছি, তোমার ভালোর জন্য। আজ তুমি আমাকে না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝবে। ঐ মেয়ে কখনো তোমার জন্য সঠিক ছিল না, এবং আমার ধারণা মতে ভবিষ্যতেও হবে না। মনে রেখো।
উঠে গেল তানিয়া। আশরাফ একটা হতাশ শ্বাস ফেলল। আদিবের কাছ থেকে জাহানারার সত্যি জানতে পেরে কেন জানি তারও আজ মনে হচ্ছে, জাহানারা আদিবের জন্য সত্যিই সঠিক জীবনসঙ্গী নয়। তার হয়তো ভুল হলো কোথাও!
– আদিব, আমি দুঃখিত। আমার জন্য হয়তো তোমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। জাহানারা যে অভিনয় করছে, সেটা আমি বুঝতে পারিনি। আই এম সরি।
– ডোন্ট বি সরি, বাবা। তোমার কোনো দোষ নেই এখানে। তুমি তো জানতে না তোমার ভাতিজির কাণ্ডকারখানা। তাছাড়া, বিয়ের আগে আমি সব জানতে পেরেছিলাম। আমি এই বিয়েটা করেছি শুধুমাত্র মাকে আর ঐ মেয়েটাকে শিক্ষা দিতে। দুইজন দুইজনের সামনে থাকবে, জ্বলবে-পুড়বে, বেশ হবে!
আদিবের ছেলেমানুষি কথা। আশরাফ হাসলো। বলল,
– চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত ঢেলে খাওয়ার মত অবস্থা হলো না আদিব?
– মানে?
– মানে, মায়ের উপর রাগ করে বিয়েটা করা মনে হয় তোমার ঠিক হয়নি। আমি যদি জানতাম জাহানারা সুস্থ-স্বাভাবিক, সে অভিনয় করছে, তাহলে কখনো তোমাকে এই বিয়ে করতে দিতাম না। ছোট্ট সেই জাহানারা আর এই জাহানারার মধ্যে বিস্তর ফারাক, আদিব। এই জাহানারা বাংলাদেশের অন্যতম সফল অভিনেত্রী। লাখ লাখ ভক্ত তার। তার জীবনের ছোট থেকে ছোট বিষয় নিউজ চ্যানেলগুলোতে ফলাও করে প্রচার করে। তোমার অতি সাধারণ জীবন, তার জীবনের সাথে খাপ খায় না।
– আমি আর জাহানারা কোন কালে একরকম ছিলাম, বাবা? আমরা তো সবসময় দুই মেরুর দুই প্রান্তের ছিলাম। একদিন এসব ভেবেই তোমাকে বলেছিলাম, আমি চাই না জাহানারার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক হোক।
শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব। তারপর একটু সময় নিয়ে আবার বলল,
– যাই হোক, আমাকে পাওয়ার জন্য জাহানারা ম্যাডাম এত কিছু করার বদলে তাকে একটা সুযোগ দেওয়া দরকার ছিল। তাই তাকে সুযোগটা দিয়েছি। যেন কখনো কেউ আমার দিকে আঙুল তাক করে বলতে না পারে, “একটা মেয়ে তোমাকে দুনিয়া সমান ভালোবেসে শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তুমি সামান্য ভ্রুক্ষেপও করোনি।” বিয়েটা করে নিজের ইমেজ ক্লিন করলাম, আর কি!
এবার একটু শব্দ করে হাসলো আদিব। আশরাফ ছেলের হাসির আড়ালে কিছু অব্যক্ত কথা পড়ে নিল হয়তো, সেজন্য তার হাসিতে তাল মিলাতে পারলো না। আদিব বাবার গাঢ় দৃষ্টির সামনে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো। তার বাবা যদি জানতে পারে, জাহানারা তাকে ভালোবেসে নয়, শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এতকিছু করেছে, তাহলে হয়তো সহ্য করতে পারবে না। তার জন্য ছেলের জীবনে ভুল মানুষ এসেছে, সেটা ভেবে আত্মগ্লানিতে হয়তো কুঁকড়ে যাবে। এসব ভেবেই অতি সাবধানে জাহানারার তাকে বিয়ে করার আসল উদ্দেশ্য গোপন করলো সে। ভেতরে ভেতরে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকালো। কথা ঘোরালো।
__________
– এই মেয়ে, তুমি কে?
সবে মাত্র চৌকাঠের ভেতরে পা রেখেছিল নেহা, ঠিক তখন কর্কশ গলায় তাকে উদ্দেশ্য করে বলল তানিয়া। নেহাকে তানিয়া না চিনলেও নেহা তাকে চেনে। জাহানারার কাছে এই ভদ্র মহিলার অনেক কিসসা-কাহিনী শুনেছে সে। সালেহার মৃত্যুর সময় একবার দেখেছেও। জাহানারার একজন অনুগত ভৃত্য হিসেবে নেহার একদম পছন্দ নয় তানিয়াকে। সে তানিয়ার কথার উত্তরে নিজের পেশাদারিত্ব বজায় রেখে স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
– আমি ইরিন নেহা। জাহানারা ম্যামের ব্যক্তিগত সহকারী।
জাহানারার কথা শুনতেই তানিয়ার নিভে যাওয়া রাগটা আবার দপ করে জ্বলে উঠলো। সে কাঠকাঠ গলায় বলল,
– তোমার এখানে কি কাজ?
– আমি যেখানে সেখানেই ওর কাজ, চাচিমা…।
নেহার হয়ে উত্তর দিল জাহানারা। তার আকস্মিক আগমনে একটু চমকালো তানিয়া। পিছন ফিরে তাকালো। সিঁড়ির শেষ ধাপে সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে জাহানারা। পায়ের ক্ষত এখনো তাজা তার। কিন্তু তবুও নিজে থেকে হাঁটা-চলা করতে হচ্ছে। এছাড়া তো উপায়ও নেই। বাড়ির কাজের লোকগুলো তার ঘরে ঘেঁষে না। তিন বেলা নিয়ম করে খাবার দিয়েই তাদের কাজ শেষ। আর ঐ আদিব, সে তো এই দুই দিনে তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। আজ সকালেও এক পায়ের ভরে বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়েছে সে। ঐ অহংকারী ছেলেটা তখন ঘরেই ছিল, কিন্তু একটু এগিয়েও যায়নি।বিগত দুই দিনে এ বাড়িতে এত অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে যে, আজ বাধ্য হয়ে নেহাকে ডেকেছে। অবশ্য এ জন্য ঐ ছেলের অনুমতি নিতে হয়েছে। ভাগ্য ভালো, আপত্তি করেনি। তবে জাহানারা জানতো, মায়ের ছেলে আপত্তি না করলেও তার মা ঠিক আপত্তি করবে, তাই তো নিজের ঘরের জানালা দিয়ে নেহাকে এ বাড়িতে আসতে দেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে এসেছে।
– জীবনে তো কোনদিন ভালো করে চাচি বলেও ডাকোনি, আজ আবার চাচিমা বলছো কোন দুঃখে?
চলবে, ইনশাআল্লাহ।
#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২১
– “জীবনে তো কোন দিন ভালো করে চাচি বলেও ডাকো নি, আজ আবার চাচিমা বলছো কোন দুঃখে!”
তানিয়ার কথা পুরোপুরি মিথ্যা নয়, তবে নির্ভেজাল সত্যও নয়। ছোটবেলা থেকেই জাহানারা তাকে বড় চাচি বলে সম্মান করে এসেছে। কিন্তু সেই লিচুতলার ঘটনা—যেদিন আদিবকে জড়িয়ে ধরেছিল—তার রেশ ধরেই সেদিন বিকেলে তানিয়া বাড়িতে গিয়ে সালেহা ও জাহানারাকে কঠোর ভাষায় অপমান করে, জাহানারাকে রাস্তার মেয়েছেলে বলে তিরস্কার করে। সেই মুহূর্তের অপমান জাহানারার মনে গভীর দাগ কাটে। যে শ্রদ্ধা ও সম্মান তানিয়ার জন্য তার মনে ছিল, তা যেন ধূলিসাৎ হয় সেদিন। এরপর থেকে আর কখনো বড় চাচি বলে সম্বোধন করা হয়নি জাহানারাকে। তাছাড়া তাদের খুব বেশি দেখা-সাক্ষাৎও হতো না, যার কারণে প্রয়োজনও পড়েনি কোনো সম্বোধনের। তানিয়ার কটাক্ষপূর্ণ কথা শুনে ফিচলে হাসি দেখা দিল জাহানারার ঠোঁটের কোণে। সে তানিয়ার কথার প্রেক্ষিতে বলল,
– “আপনার হয়তো মনে নেই চাচিমা। কিন্তু ছোটবেলায় কিন্তু চাচি বলেই ডাকতাম। এরপর তো আপনার ছেলের প্রেমে উল্টে পাল্টে পড়লাম, যার ফলস্বরূপ আপনি আমাকে যা তা শোনালেন। আমার আপনার কথা পছন্দ হলো না। ব্যাস, সে কারণে ক্ষণিকের জন্য ঐ ডাক স্থগিত রাখলাম। যাকগে, ওসব পুরোনো কথা। নেহা, একটু এদিকে এসে তো।”
জাহানারা আদেশ পাওয়া মাত্রই ব্যাগপত্র ফেলে অনেকটা দৌড়ে এগিয়ে গেল নেহা। জাহানারা তার হাতে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো, সোফায় আরাম করে বসলো। তারপর বলল,
– “তো যা বলছিলাম। সম্পর্কে আপনি আমার চাচি, এখন আবার আমার বরের মা হন। একটা না, দুই দুটো সম্পর্ক! মান তো রাখতেই হবে। সেই জন্য দুই সম্পর্ক মিলিয়ে একটা সম্বোধন। আপনি আবার আমার ডাক শুনে আবেগে আপ্লুত হবেন না, প্লিজ। আমি জাস্ট ফর্ম্যালিটি পালন করছি। নাথিং এলস, চাচিমা…!”
জাহানারার স্পষ্ট কণ্ঠ, স্বাভাবিক বচনভঙ্গি। সে যে এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে আদিবের জীবনে প্রবেশ করছে, তার জন্য বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই তার চোখে-মুখে। তানিয়া এমন কিছু আশা করেনি তার থেকে। সে ভেবেছিল জাহানারা হয়তো তার কাজের জন্য লজ্জায়-ভয়ে ঘরে সিটিয়ে থাকবে, নিজের জন্য সাফাই গাইবে, চোখের পানি-নাকের পানি ফেলে আকুলি-বিকুলি করে কান্নাকাটি করবে। জাহানারার এমন নির্লিপ্ত স্বাভাবিক ভঙ্গি দেখে চোয়াল শক্ত হলো তানিয়ার। ইচ্ছা করলো মেয়েটাকে কষে দুটো চড় বসাতে, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজেকে সামলালো। নিঃশব্দে একটা শ্বাস টেনে ভেতরের রাগটা দমন করলো। তারপর জাহানারার দিকে শীতল চোখে চেয়ে বলল,
– “বেহায়া তো ছিলেই, অভদ্রতাও দেখছি ভালো করেই রপ্ত করেছ। খুব ভালো! তো তোমার বাপ জানে তোমার এসব কীর্তিকলাপ সম্পর্কে?”
– “না, জানে না। তবে আশা করছি আপনি নিজ দায়িত্বে খুব শীঘ্রই তাকে জানাবেন।”
– “তা তো জানাবোই। মেয়ে কী গুনের কাজ করে বেড়াচ্ছে, বাপ হিসাবে তারও তো জানা দরকার! তাই না?”
কথাটা বলতে বলতেই নিজের ফোনটা সোফার উপর থেকে নিজের হাতে নিল তানিয়া। কল লাগালো জায়েদের নাম্বারে। দুই বার রিং হতেই কল ধরলো জায়েদ। তানিয়া কোনো ভণিতা ছাড়া বলল,
– “জায়েদ, এক্ষুনি আমার বাড়ি এসো।”
কথাটা বলেই ফোন কাটলো তানিয়া। এরপর সাজ্জাদ আর নাফিজাকে কল করলো। তাদেরকেও এই মুহূর্তে এ বাড়ি আসতে বলে ফোন রাখলো। তাদের আদরের ভাতিজি কী করেছে, সেটা তাদেরও জানা দরকার! ফোন সোফার সাইড টেবিলে রেখে জাহানারার মুখোমুখি সোফায় বসল তানিয়া। জাহানারা তার ভঙ্গি দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো। ছোটবেলায় অনেকটা সময় এই মানুষটার সাথে কাটানো হয়েছে তার। আদরে-আহ্লাদে সবসময় তাকে ভরিয়ে রাখতো মানুষটা। কোথাও সাথে করে নিয়ে গেলে কেউ তার পরিচয় জানতে চাইলে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলত, “আমাদের মেয়ে”। কখনো দিপ্তী-তৃপ্তি থেকে আলাদা করে দেখতো না তাকে। জাহানারাও লেপ্টে থাকতো সবসময় তার সাথে। এরপর দিপ্তী আপুর বিয়ের ঘটনা ঘটলো। জাহানারার এখনো মনে আছে সেই রাতটা। বাবা পহেলা বৈশাখের মেলা থেকে তার জন্য মাটির পুতুল কিনে এনেছিল এক ঝুড়ি। সে বাবার ডাকে ঘুম থেকে উঠে সেগুলোই দেখছিল। বাবা তাকে কাঁচা ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিল বলে মা চোখ-মুখ গুটিয়ে বাবার দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে ছিল। জাহানারার অবশ্য মায়ের দিকে অত খেয়াল ছিল না। সে তার পুতুল দেখতে ব্যস্ত ছিল। আকিব তার পাশেই বসা, দুই ভাইবোন একে একে ঝুড়ি থেকে পুতুল বের করছিল। তখন হঠাৎ বাইরে থেকে বড় চাচির গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। রাত তখন বেশ হয়েছে। এত রাতে চাচির গলা শুনে বিপদ-আপদের আশঙ্কায় মা-বাবা অনেকটা দৌড়ে গেল বাইরে। আকিবও তার পিছু নিল। সবাইকে বাইরে ছুটতে দেখে জাহানারাও কৌতূহলী হলো। বিছানা থেকে নেমে সেও এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো দরজার মুখে। সেখানে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকতেই চোখ পড়লো বড় চাচির রাগে গনগনে লাল মুখটায়। চাচির চোখে পানি, সবসময় মাথায় থাকা ঘোমটাটা অনাদরে পড়ে আছে ঘাড়ের উপর। চুল উশখুশ। বিধ্বস্ত অবস্থা তার। বড় চাচিকে ওভাবে দেখে একটু ভালো লাগলো না জাহানারার। ইচ্ছা করলো দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে তার কী হয়েছে। কিন্তু কেন জানি সাহস হলো না। এরমধ্যে জাহানারার কানে বাজলো চাচির বলা কথাগুলো। দিপ্তী আপু তার নানু বাড়ি থেকে বের হয়ে নিশান ভাইয়ের সাথে কোথায় যেন চলে গেছে। চাচি আম্মুর কাছে জানতে চাইছে তারা কোথায়। আম্মু এত বলছে সে জানে না, কিন্তু চাচি শুনছে না। তার এক কথা, দিপ্তী তার সাথে সব কিছু বলে, সে সব জানে। বাবাও চাচির কথা শুনে গমগমে গলায় দুই বার বলল,
– “সালেহা, তুমি কিছু জানলে লুকিও না।”
বাবার কথা শুনে আম্মুকে আরো অসহায় দেখালো। সে অসহায় ভাবে বলল,
– “বিশ্বাস করো, আমি কিছু জানি না।”
– “তোমার নাকের নিচে সব কিছু হয়েছে, আর তুমি বলছো তুমি কিছু জানো না! এই কথা কিভাবে বিশ্বাস করবো আমি, সালেহা? যাই হোক, সেসব আমি কিছু জানতে চাইছি না। আমি শুধু জানতে চাই আমার মেয়ে কোথায়! আমি তাকে দেখতে চাই।”
বড় চাচির উচ্চ গলার শব্দ মেজ চাচাদের বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল হয়তো, তাই তো মেজ চাচা, মেজ চাচি সেই রাতে উপস্থিত হলো তাদের বসার ঘরে। তাদের আগমনে বড় চাচির মুখে আরো অন্ধকার নামলো। জাহানারা ড্যাবড্যাব চোখে দেখলো সেটা। ছয় বছর বয়সে পরিস্থিতির গম্ভীরতা বুঝতে সে না পারলেও এটা বুঝতে পারলো, খুব খারাপ কিছু হয়েছে। মেজ চাচা, মেজ চাচি আসার ঠিক সঙ্গে সঙ্গে বড় চাচা আর দাদি এলো সেখানে। বড় চাচা গম্ভীর কণ্ঠে বড় চাচির উদ্দেশ্যে বলল,
– “তানিয়া, বাড়ি চলো। দিপ্তী ঢাকায় আছে। বিয়ে করছে সে নিশানকে। টেলিফোন করেছিল।”
বড় চাচার কথা শোনা মাত্রই মেঝেতে থপ করে বসে পড়লো বড় চাচি। রক্তলাল চোখের কর্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো পানি। দিপ্তী আপু আর নিশান ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনে জাহানারার আনন্দ লাগলেও চাচির অবস্থা দেখে সে চমকে উঠলো। চাচির চোখে পানি দেখে তার কেমন কেমন যেন লাগলো। এর মধ্যে ঘরের নিরবতা ভেদ করে মেজ চাচি টিপনি কাটলো,
– “এ তো হবারই ছিল। দুইজন রাস্তাঘাটে যে পরিমাণ হাসাহাসি-কেলাকেলি করতো, আমি তো আগেই বুঝেছিলাম কিছু চলছে ওদের মাঝে। সালেহাকে তো বলেও ছিলাম, কিন্তু ঐ তো বলল, তেমন কিছু না। ওরা ভাইবোনের মতো!”
– “আহ! ডালিয়া!”
মেজ চাচির কথার মাঝে ধমক দিয়ে তাকে চুপ করালো মেজ চাচা। তবে খুব একটা লাভ হলো না তাতে। বড় চাচি তার কথা শুনে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালো। আম্মুর দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল,
– “তুমি আমার যে সর্বনাশ করলে, সেটা আমি কোনদিন ভুলবো না, সালেহা।”
আর দাঁড়ালো না চাচি, বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে গেল তাদের বাড়ি থেকে। সেদিনের পর তিন বাড়ির যাতায়াতের জন্য যে ছোট্ট একটা দরজা ছিল, সেটাতে তালা পড়লো। তৃপ্তি আপুর আনা-গোনা বন্ধ হলো দুই বাড়ি। আদিব ভাইকেও কিছুদিন সেভাবে দেখা গেল না আর। জাহানারা বড় চাচার বাড়ি যেতে চাইলে আম্মু বকে-ধমকে তাকে ঘরে আটকালো। তারপরও একদিন অনেক জেদ করে দাদির সাথে গিয়েছিল সে বড় চাচার বাড়ি। চাচিকে দেখে দৌড়ে গিয়েছিল তার কাছে। কিন্তু চাচি কথা বলেনি তার সাথে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল অবহেলায়। দিন প্রতিদিন বড় চাচির বদলে যাওয়া আচরণ জাহানারাকে উপলব্ধি করিয়েছিল, সে আর চাচির কাছে ঘেঁষতে পারবে না, তার থেকে আদর-আহ্লাদ পাবে না। তার সেই উপলব্ধি আস্তে দূরে সরিয়ে এনেছিল তাকে চাচির থেকে, তৈরি করেছিল সম্পর্কে ব্যবধান।
কোন একসময় যেই মানুষটার প্রতিচ্ছবি হতে চেয়েছিল, সেই মানুষটার প্রতিদ্বন্দ্বী হবে, সেটা কখনো ভাবেনি জাহানারা। অথচ আজ দেখ! সময়! সত্যি বড় নিষ্ঠুর!একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো জাহানারা।
কিছু সময় পর জায়েদের আগমন হলো। সে একা আসেনি, আকিবকে সাথে নিয়ে এসেছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছে জায়েদ। এখন খারাপ কিছুর আশঙ্কা দেখলেই কেন জানি ছেলেকে ছাড়া বের হতে চায় না বাড়ি থেকে। তানিয়া ভেবেছিল বাবাকে দেখে জাহানারার অভিব্যক্তি পরিবর্তিত হবে, তবে তাকে অবাক করে দিয়ে সে ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইলো। ভদ্রতার খাতিরে বসা থেকে উঠলো পর্যন্ত না। তানিয়া তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে মনে মনে একটু অবাক হলো। সে যে জাহানারাকে চিনতো, সে একটু বোকা-বোকা ফটফটে হলেও এত বেয়াদব তো ছিল না। তার চেনা-জানা জাহানারার সাথে এই জাহানারাকে সে মিলাতে পারলো না।
জায়েদ ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো বড় ভাবির কাছে। জানতে চাইলো হঠাৎ কী কারণে এত জরুরি তলব। তানিয়া তার কথার উত্তরে বলল, সাজ্জাদ আর নাফিজা আসুক, তারপর সে কথা বলবে। জায়েদ আর এরপর কিছু বলার সাহস পেল না। আকিব অবশ্য নেহার কাছে বার দুয়েক জানতে চাইলো ঘটনা কী, কিন্তু নেহা কিছু বলল না। জাহানারাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে আকিব একবার চাচির কাছে জিজ্ঞেস করলো, তার বোন কিছু করেছে কিনা? প্রতি উত্তরে তানিয়া তাচ্ছিল্য হাসলো। আকিব অজ্ঞাত জাহানারাকে প্রশ্ন করলো, কিন্তু সেও উত্তর দিল না। এর মধ্যে সাজ্জাদ আর নাফিজা এসে উপস্থিত হলো। তানিয়া আর সময় অপচয় করলো না। জাহানারার বিষয়ে সবটা পাই টু পাই খুলে বলল সকলকে। সব শুনে কিছু সময়ের জন্য স্তম্ভিত হলো জায়েদ। আকিব অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে উঠলো,
– “আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি না, চাচি।”
– “আমার কথা বিশ্বাস না হলে বোনের কাছে শোনো। ঐ তো বসেই আছে।”
আকিব জাহানারার বাহু ধরে তার দিকে ফেরালো। জেরা করলো,
– “চাচি যা বলছে, সব সত্যি?”
– “হ্যাঁ।”
আকিব ভাষা হারালো নিজের। অপরাধী যেখানে নিজে অপরাধ স্বীকার করছে, সেখানে আর কী বলবে! হতভম্ব চোখে সে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে। নাফিজা আহাজারি করে উঠলো,
– “ও মা, এরকম করলি কেন? জীবনটা কি নাটক-সিনেমা! ও আল্লাহ!”
– “জাহান, এমন করলে কেন?”
সাজ্জাদের দারাজ কণ্ঠ। জাহানারা একটু যেন ঘাবড়ালো। তবে সেটা প্রকাশ করলো না। কোনোমতে বলল,
– “আমি আমার কাজের এক্সপ্লিনেশন দিতে চাইছি না কারো কাছে।”
জাহানারার রূঢ় গলায় কথাটা বলতেই মেজাজ চড়লো আকিবের। চাচার সাথে এমন বেয়াদবি পছন্দ হলো না তার। রাগে ফুঁসে উঠলো সে। হাত উঠাতে গেল বোনের গায়ে, কিন্তু মাঝপথেই হাত আটকে দিল কেউ। নিজের কাজে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রাগান্বিত চোখে পাশ ফিরে তাকালো সে। আদিবের মুখটা দেখে জ্বলে ওঠা রাগ যেন দুপ করে নিভে গেল তার। আদিব তার হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বুকে হাত বেঁধে বলল,
-কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা খুব খারাপ অভ্যাস, আকিব ভাই। সে আপনার বোন, থানার অপরাধী নয়।
ঠোঁটে একটুকরো ছোট্ট হাসি টেনে কথা শেষ করল আদিব। এরপর মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে, তারপর দৃষ্টি ফেরাল জাহানারার দিকে। জাহানারা তখনো একই জায়গায় গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। এই কারণেই সে জাহানারা কে কখনো পছন্দ করতে পারেনি-এত ত্যাড়া মেয়েটা!
ঘরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আদিব বুঝতে পারল, তার মা ইতিমধ্যেই যা বলার সব বলে ফেলেছেন। দুই দিকে মাথা নাড়লো সে, এই দুই ভদ্রমহিলার মাঝে তার আগত জীবন কেমন হতে চলেছে সেই ভবিষ্যৎ চিন্তায় হতাশ শ্বাস ফেলল।
– জাহানারা, বাড়ি চলো।
জায়েদের থমথমে কণ্ঠে চমকে তাকাল জাহানারা। চোখ মুহূর্তেই অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। প্রায় এগারো বছর পর সরাসরি তাকে কিছু বলল জায়েদ! জাহানারা বাবার দিকে তাকাতেই তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। সেই মুহূর্তে জাহানারার ভেতরটা ক্ষোভে জ্বলে উঠল। অশ্রুসিক্ত চোখ রক্তিম হয়ে উঠল। জেদ ধরে বলল,
-যাব না! আর আপনি কোন অধিকারে আমাকে আদেশ করছেন?
জাহানারার রোষপূর্ণ কণ্ঠ। উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। জায়েদও বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে মেয়ের দিকে চেয়ে থাকার পরও কিছু বলতে পারলেন না। জাহানারা বাবার দৃষ্টি লক্ষ্য করে বলল,
-ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন! আমি কি ভুল কিছু বলেছি? বরং আপনিই হয়তো কিছু ভুলে গেছেন! সমস্যা নেই, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। এগারো বছর, তিন মাস, নয় দিন আগে, আপনি সর্বসমক্ষে আমাকে ত্যাজ্য করেছিলেন। আমার প্রতি আপনার থাকা সব দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, আমার ওপর আপনার আর কোনো অধিকার নেই, আমারও আপনার কাছে চাওয়া পাওয়া নেই। তাহলে আজ আপনি কোন ভিত্তিতে আমাকে আদেশ দিচ্ছেন?
– জাহান!
– চেঁচাবেন না, ভাই! যা সত্যি, সেটাই বলছি আমি। এত বছর ধরে যা মেনে এসেছি, সেটাই উচ্চারণ করেছি মাত্র। তোমার বাবা আমার কেউ নন, সুতরাং তার আমাকে কিছু বলার অধিকার নেই! নেই!
শেষ কথাগুলো উচ্চস্বরে বলে উঠে দাঁড়াল জাহানারা। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের ব্যথায় পুরো শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু সেই ব্যথাকে উপেক্ষা করেই সে সামনে এগিয়ে গেল। রাগে, জেদে, আহত পায়ে আরো যন্ত্রণা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। পেছনে ফেলে গেল হতভম্ব কিছু মুখ।
– কি সাংঘাতিক! আদিব, তুই এই মেয়ে নিয়ে সংসার কিভাবে করবি?
তানিয়ার কথায় ঘরের নীরবতা ভাঙ্গল।আদিব মায়ের কথা উপেক্ষা করে সেজ চাচার দিকে তাকালো ।বুঝতে চেষ্টা করল তার মনের অবস্থা।সেজ চাচার মুখ দেখে খুব একটা অসুবিধা হলো এটা বুঝতে যে, জাহানারার বলা কথাগুলো মানুষটাকে মা’রা’ত্মক ভাবে আহত করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গলা ঝাড়া দিল আদিব। বলল,
– সেজ চাচা, জাহানারা এখন আমার স্ত্রী। আমি সব জেনে-শুনেই তাকে বিয়ে করেছি, পুরোপুরি সজ্ঞানে। আমাদের বিয়েটা সত্যি হয়েছে, এখন চাইলেও অস্বীকার করা যাবে না। আর আমি তা চাইও না। আমি জাহানারার সঙ্গে একটা সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই। যা হয়েছে, তা অতীত, আপনারা দয়া করে সব ভুলে যান।
আদিবের এই কথার পর আর কেউ কিছু বলার সাহস পেল না। যখন সে-ই ভুক্তভোগী হয়ে সবকিছু সহজে মেনে নিচ্ছে, তখন অন্য কারও কিছু বলার থাকতে পারে না!
বাকি সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও তানিয়া পারল না। ছেলের এই অতিরিক্ত ভালোমানুষী দেখে রাগ হলো তার ছেলের উপর। ঠিক আছে, বিয়েটা হয়ে গেছে, মেয়েটাকে নিয়েই তাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে, তা সে মানছে। তাছাড়া আর কিছু করারও নেই।তানিয়া নিজেও চায়না ছেলের বিয়েটা ভাঙুক। ডিভোর্স টিভোর্স তাদের চৌদ্দ গুষ্টিতে নেই,ছেলেকে দিয়ে সেটা শুরুও হতে দেবে না সে। মেয়েটা যেমনই হোক ,এখন তার সাথেই সংসার করতে হবে ছেলেকে।
তাই বলে মেয়েটাকে এতো সহজে মেনে নিবে!যা ইচ্ছা তাই করতে দেবে!একটু শাসন বারণ না করলে হবে!এমনিতে বেয়াদব মেয়ে এরপর তো তার ছেলের এমন মহনাতা দেখে তার মাথায় চড়ে বসবে!
– বাড়ি চলো, আকিব। আমাদের আর এখানে থাকার প্রয়োজন নেই।
আর দাঁড়ালেন না জায়েদ। ভারী পা দুটো টেনে নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।
চলবে, ইনশাআল্লাহ।
# সৌরকলঙ্ক
# উম্মে প্রভা
# পর্ব ২২
– চাচার সাথে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি তোর!
– আমাকে উচিত-অনুচিত শিখাতে হবে না তোকে। যা করেছি, বেশ করেছি। তোর চাচা আমার সাথে যা করেছে, তার তুলনায় আমি কিছুই বলেনি। শুধু তার বলা কথাগুলোই তাকে শুনিয়েছি। আর কেউ না জানুক, তুই তো জানিস—আমার আজকের এই অবস্থার জন্য পরোক্ষভাবে তোর চাচা দায়ী। আমি কখনো ঐ আদিবের দিকে তাকাতাম? কখনো না। তোর চাচার জন্য তাকিয়েছি। তার জন্য নিজের মনকে কনভিন্স করেছি যে ঐ আদিব আমার ভবিষ্যৎ। নিজের চাওয়ার আগে তোর চাচার ইচ্ছা প্রাধান্য দিয়েছি। একটা অপছন্দনীয় মানুষকে পছন্দ করেছি। আমার জন্য এটা কত কষ্টের ছিল, জানিস? কিন্তু যার জন্য এসব কিছু করলাম, সে কি করলো? আমাকে দোষী করে বনবাসে দিলো। শুধুমাত্র ঐ মানুষটার জন্য আমি আমার মায়ের থেকে দূরে থেকেছি। শেষ সময়টাতে পর্যন্ত…
গলা ধরে এলো জাহানারার। টলমল করলো চোখ, কেঁপে উঠলো গলা। নিতুর খুব খারাপ লাগলো। মুঠোফোন টা হাত বদল করে অন্য কানে ধরলো। বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস।
নাফিজার বড় জা যেদিন জাহানারার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে জায়েদের বসার ঘরে হাজির হয়েছিল, সেদিন কাকতালীয়ভাবে নিতু আর জাহানারা ঘরের দরজার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তখন অপ্রত্যাশিতভাবে কানে আসে তাদের ভেতরের সব কথোপকথন। নিতু আদিব ভাইয়ের সাথে জাহানারার ভবিষ্যৎ সম্পর্কের কথা শুনে খুশিতে নেচে উঠলেও জাহানারার ওপর যেন বজ্রপাত হলো। আদিবকে তার কোনো কালেই পছন্দ ছিল না। ঠিকঠাক চেহারার গোমড়া মুখো একটা ছেলে। কথা বলে দাঁড়ি-পাল্লায় ওজন করে। ভালো রেজাল্টের ভারে মাটিতে পা পড়ে না তার। এমন একটা মানুষকে জাহানারার জন্য নিজের জীবনসাথী হিসেবে ভাবাও কষ্টকর ছিল। সে তো দাদির মুখে কথাটা শোনামাত্র ভেতরে যেতে উদ্বত হচ্ছিল, ঠিক তখন বাধা দিল নিতু। ফুপুর বড় জা এমনি মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও মানুষ সুবিধার না, জাহানারা তার সামনে উল্টোপাল্টা কিছু বললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এসব ভেবে জাহানারাকে কোনো রকমে সামলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজের সাথে বাড়ি নিয়ে গেল নিতু।
জাহানারা সেদিন তার সাথেই ছিল। নিতু বাড়িতে একা। বাবা-মা বড় আপুকে নিয়ে রাজশাহী গেছে। ভর্তি পরীক্ষা বড় আপুর। যাওয়ার সময় তার মা সেজ চাচিকে বলে গেছে, জাহানারা যেন আজ রাতটা নিতুর সাথে থাকে। সালেহা সচরাচর মেয়েকে কারো বাড়ি রাত থাকতে দেয় না, কিন্তু নিতু একা থাকবে—চিন্তা করে আপত্তি করেনি। তাছাড়া সাজ্জাদের বাড়ি গোছানো, সদর দরজায় একটা তালা মারলেই সব সুরক্ষিত। দুই বোনের কোনো সমস্যা হবে না। সালেহার চিন্তার কারণ নেই।
সেই রাতে জাহানারা কাঁদতে কাঁদতে বন্যা বইয়ে দিল। সে কিছুতেই আদিবকে বিয়ে করবে না। দরকার পড়লে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে, এই করবে, ঐ করবে—ইত্যাদি ইত্যাদি। জাহানারার কথাবার্তা শুনে নিতুর মনে হলো, সে বেশি বাড়িয়ে বলছে। আদিব ভাইয়ের মতো ভদ্র-সভ্য ছেলে আর একটা নেই এই তল্লাটে। দেখতে একেবারে বিশ্রী নয়। জাহানারার প্যানপ্যানানিতে সে বিরক্ত হলো, কিন্তু সেই মুহূর্তে কিছু বলা সমীচিন মনে করলো না। সে তো চেনে জাহানারাকে কিছু বললেই তেতে উঠবে। চুপচাপ জাহানারার সব কথা শুনলো নিতু। একসময় জাহানারা শান্ত হলো। ঠিক তখন নিতু বলল,”আদিব ভাই কথা কম বলে, কিন্তু খারাপ না। তাছাড়া সেজ চাচা আদিব ভাইকে খুব পছন্দ করে।”অনেকটা ভয়ে ভয়ে কথাটা বলল নিতু।
নিতুর কথায় থমকালো জাহানারা। গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো। এরপর আর একটা ‘টু’ শব্দ করলো না সে। নিজের বালিশ টেনে ঘুমিয়ে পড়লো। নিতুও আর তাকে খোঁচালো না। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই মা-বাবাকে বাড়ি দেখে জাহানারার সাথে আর এ বিষয়ে কথা বলতে পারল না।
এরপর কোচিংয়ে মডেল টেস্টের চাপে জাহানারার সাথে বেশ কয়েকদিন দেখা সাক্ষাৎ হলো না। এক বিকেলে সেজ চাচি এসেছিল বাড়ি। তার থেকে জানতে পারলো, জাহানারার না কি ভীষণ জ্বর। জ্বরের তোড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে।নিতু কথাটা শুনে তখনই ছুটে গেল জাহানারার কাছে। গিয়ে দেখলো, বেহুঁশের মতো বিছানায় পড়ে আছে জাহানারা। তার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকালো। ম্লান হেসে বলল, “আমি মনে হয় মরে যাবো। ভালোই হবে, পড়াশোনার ঝামেলা চুকে যাবে।”
ওর কথা শুনে বিরক্ত হয়ে নিতু বলল, “ফালতু কথা বলবি না।”
নিতুর কথা শুনে দাঁত বের করে হাসলো জাহানারা। নিতু ঘণ্টাখানেক বসলো তার পাশে। তারপর জাহানারা ঘুমিয়ে পড়তেই বাড়ি ফিরে এলো।
এর দুই দিন পর নিতু যখন আবার জাহানারা কে দেখতে গেল, তখন জাহানারা অনেকটা সুস্থ। নিতুকে দেখেই সে বলে উঠলো,
– নিতু, আমি ঠিক করেছি—আব্বু যা বলবে, তাই হবে। আব্বু যদি চায় আমি আদিব ভাইকে বিয়ে করি, তাহলে সেটাই হবে।
– তুই কি আদিব ভাইয়ের সাথে বিয়ের কথা শুনে শোকে শোকে জ্বর বাধিয়েছিলি?**
চোখ সরু করলো নিতু। সে জানে, জাহানারা কোনো জিনিস মেনে নিতে না পারলে মনের শোকে শরীর তাতায়। এটা নতুন না।তাই তো জাহানারা কথা উপেক্ষা করেই প্রশ্ন করলো নিতু। জাহানারা নিতুর কথা শোনেইনি, এমন ভাব করে ফের বলল,
– আমি আব্বুর জন্য জীবনে কিছুই তো করতে পারলাম না। অন্তত তার মনমতো জামাই পাওয়াতে বাধা না দিই। কি বলিস?
একটা সূক্ষ্ম ম্লান হাসিতে নিজের কথা শেষ করলো জাহানারা। কথা যখন সেজ চাচার বিষয়ে হয়, ব্যাপার তখন ভিন্ন। সেই সময় কোনো কথা বলা চলে না। কিন্তু তবুও নিতু কথা বলল,
– মনের ওপর জোর দিয়ে কিছু করিস না। হ্যাপি থাকতে পারবি না। তোর খুশি চাচার কাছে তার খুশির থেকে বড়!
– জানি তো। জেনে-বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চিন্তা করিস না, আমি হ্যাপি থাকবো।
জাহানারার আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ। নিতু আশ্বস্ত হলো। এরপর কী দিয়ে কী হলো, কে জানে—জাহানারা নিজমনে একটু একটু করে ঝুঁকতে লাগলো আদিব ভাইয়ের দিকে। নিতু সেটা দেখলো, বুঝলো, কিন্তু কিছু বলতে পারলো না।
দিনগুলো এভাবেই গড়াতে থাকলো। জাহানারা নিজের মনে জোর করে করা আপসের সিদ্ধান্তকে ধীরে ধীরে ভালোলাগার যুক্তিতে রূপান্তরিত করলো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ভালোলাগা একসময় গভীর ভালোবাসায় পরিণত হলো। কিশোরী হৃদয়ে জন্ম নিলো এক অকৃত্রিম ভালোবাসা, যা সব বাধা অতিক্রম করার সাহস রাখে।নিতু জাহানারার সেই ভালোবাসার সাক্ষী হলো।
ঠিক তারপর আসলো সেই টালমাটাল দিন গুলো।একদিন নিতুর কানে এলো বড় চাচির সুপ্ত মনোকামনা। বড় চাচি তার বোনের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চায় ছেলের। কথাটা শোনামাত্রই নিতুর গলা-বুক শুকিয়ে এলো। ইতিমধ্যে জাহানারা আদিব ভাইকে যে ভাবে ভালোবেসে ফেলেছে, চাচির ইচ্ছা শুনলে জাহানারা কি করবে—সেটা ভেবে ভেতরে ভেতরে ভয় দানা বাঁধলো নিতুর। সময় অপচয় না করে জাহানারাকে সে কথাটা জানালো। যদিও জানতো, তখন আর কিছু করার নেই। জাহানারা ততদিনে আদিব ভাইয়ের প্রেমে গলা পানিতে ডুবুডুবু।
– দোষ আমার ছিল, না? আমিও মানছি, দোষ আমার ছিল। কিন্তু তোর চাচা আমার মায়ের গায়ে হাত তুলল কেন? আমার মা তো কিছু করেনি, তাকে দোষ দিল কেন? আমি তোর চাচার ভরসায় ঐ ছেলের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, আমার জীবনে ভালো-খারাপ সব পরিস্থিতিতে সে আমার পাশে থাকবে। কিন্তু সে পাশে থাকা তো দূর, আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। ছোট চাচু না থাকলে তো আমি মরেই যেতাম। যখন আমার তার প্রয়োজন ছিল, তখন যেহেতু সে আমার পাশে থাকেনি—তাহলে এখন তার মাতব্বরি আমার দরকার নেই।
রাগে গজগজ করতে করতে বলল জাহানারা। পানি ভর্তি চোখে আগুনের আঁচ তার। চোখের পানি সামলানোর চেষ্টা করলো সে, কিন্তু তার চোখের পানি তার মতোই অবাধ্য। তার সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে গড়িয়ে পড়লো চোখের কর্ণিশ বেয়ে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে রাগ হলো খুব। সঙ্গে সঙ্গে হাতের ফোনটা সজোরে ছুঁড়ে মারলো সামনে। ভারি ফোনটা আছড়ে পড়লো টাইলসের ফ্লোরে। নেহা আৎকে উঠলো দৃশ্যটা দেখে। তার অতি সাধের আইফোনটা মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। জাহানারার দিকে অসহায় চোখে তাকালো সে।
রাগের মাথায় তার ম্যাডামের জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলার অভ্যাস পুরোনো, কিন্তু আজ পর্যন্ত ফোন ভাঙার রেকর্ড নেই। আজ তার ফোনটা ভেঙে সেই রেকর্ড তৈরি করলো ম্যাডাম। নিজের ওপর রাগ হলো তার। মনে হলো, কেন শুধু শুধু নিতু আপুকে ওসব বলতে গেল? তাকে কিছু না বললে সে ম্যাডামের সাথে কথাও বলতে চাইতো না, ম্যাডাম এমন তেতেও উঠতো না, তার ফোনটাও ভাঙতো না। কিন্তু তারই বা কি দোষ? ম্যাডামের হুকুম—নিতু আপু ফোন করলে যে পরিস্থিতিতেই থাকুক না কেন, কল রিসিভ করতে হবে। সে তো সেই আদেশই পালন করছিল। তাছাড়া কিছু না।
– নেহা, তোমাকে লাস্ট বার বলছি—আমার বিষয়ে কাকে কি বলতে হবে, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস না করে আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না।
নেহাকে শাসিয়ে বলল জাহানারা। নেহা একটা শুকনো ঢোক গিলল। জাহানারার উত্তপ্ত দৃষ্টির সামনে নিজের নজর ঝুঁকালো। কোনো রকমে স্বপক্ষে সাফাই দিল,
– স্যরি ম্যাম, আসলে তখন নিতু আপু ফোন করেছিল। উনি আপনার গলা শুনে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে?তাই …
-তাই তুমি গড়গড় করে সব বলে দিলে। তোমার কোনো সেন্স নেই। বুঝতে পারো না—সব কথা সবাইকে বলতে হয় না? এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়েছ?
– সবাই আর নিতু আপু তো এক না, ম্যাম!
– মুখে মুখে তর্ক করবে না, নেহা!
নিতু আর বাকি সবাই এক না—জাহানারার কাছে। এই জরুরি পার্থক্যটা জাহানারা খুব স্পষ্টভাবে বুঝিয়েছিল নেহাকে। নেহা তার কথা মতোই সেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে। এখানে নেহার কোনো দোষ নেই, সেটা জাহানারাও ভালো জানে। কিন্তু তার রাগ তো আর সেটা জানে না। রাগ তো তার জায়গা খুঁজছে কারো উপর আঁছড়ে পড়ার। নেহা হয়তো বুঝলো জাহানারা মনের অবস্থা,সে আর প্রতিউত্তর না করে বিনা অপরাধে ক্ষমা চাইলো।
**- স্যরি ম্যাম।**
নেহার আত্মসমর্পনে জাহানারার রাগের পারদ নামলো কি না—বোঝা গেল না। নেহা আড়চোখে একবার তাকালো জাহানারার দিকে। ঠোঁট কামড়ে বসে আছে সে, নজর মেঝেতে পড়ে থাকা ফোনের দিকে। শীতল দৃষ্টি তার। জাহানারার দৃষ্টি অনুসরণ করে চোখ সরাতেই নেহার চোখ গেল জাহানারার পায়ের দিকে। জাহানারার পায়ের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখতে পেল, সাদা ব্যান্ডেজ রক্তে ভিজে উঠছে।এই মুহূর্তে নেহার ভীষণ মায়া হলো জাহানারার জন্য। একবার ভাবলো,এগিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেজটা বদলে দিবে, কিন্তু পরক্ষণেই জাহানারার অগ্নিমূর্তি স্মরণ করে সাহস হলো না আগাতে। অজ্ঞাত নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়।
– নেহা, বাইরে যাও। তোমার ম্যাডামের সাথে কথা আছে আমার।
ঘরে ঢুকেই গম্ভীর কণ্ঠে নেহাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল আদিব। আদিবের হঠাৎ আগমনে, অন্যমনস্কতার দরুন চমকে উঠলো নেহা। জাহানারা অবশ্য স্থির রইলো।আদিবের আকস্মিক আগমনে তার মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না। আদিবের কথাটা বোধগম্য হতেই তড়িঘড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল নেহা।
নেহা চলে যেতেই আদিব গিয়ে দাঁড়ালো জাহানারার সামনে। শীতল কণ্ঠে বলল,
– সবসময় এত বি’ষ উগলাও কেন?
– মুখ সংযত করে কথা বলুন।
– আমাকে বলার আগে নিজের মুখ সংযত করো। কোন সাহসে সেজ চাচুর সাথে ওভাবে কথা বললে তুমি? একবারো বুক কাঁপলো না তোমার?
বাবাকে কথাগুলো বলার সময় শুধু বুক না ,পুরো ভেতরটা কাঁপছিল জাহানারার। কথাগুলো জোর করে গলা চিরে বের করেছিল সে। বাবাকে যতটা কষ্ট দিতে কথাগুলো বলেছিল, তার থেকে দশগুণ কষ্ট সে নিজে পেয়েছে। ভেতরটা ছারখার হয়ে গেছে তার। আদিবের কথাটা তাকে যেন আবার তখনকার সেই অনুভূতিটা ফেরত দিল।সাথে সাথে নিভে যাওয়া রাগটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। মনে পড়লো—সব কিছুর জন্য এই ছেলেটা দায়ী। শুধুমাত্র এই ছেলেটা। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো সে। তীব্র আক্রোশের সহিত বলে উঠলো,
– আই হেইট ইউ, আদিব আহাসান।
জাহানারা এভাবে ফুঁসে ওঠায় হতবুদ্ধ হলো আদিব। এমন প্রতিক্রিয়া একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল তার।ভ্রূতে ভাঁজ পড়লো আদিবের।
– তৃপ্তি শিমুলকে আরেকবার ফোন করে দেখ তো ওরা কতদূর পৌঁছাল। আকাশে মেঘ করেছে, ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে মনে হয়।
– ফোন করেছি, বলল **** বাজারে। আধা ঘণ্টা মতো লাগবে।
তানিয়ার কথার প্রেক্ষিতে বলল তৃপ্তি। তানিয়া রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আরো একবার মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা দেখলো। শামীমরা এখনো এসে পৌঁছায়নি। শিমুল তাদের নিয়ে আসতে গেছে। তানিয়া শামীমকে বলেছিল গতকালই তাদের বাড়ি চলে আসতে। কিন্তু শামীম রাজি হয়নি। প্রথমত ছেলের বাড়ি মেয়ে নিয়ে আসছে বিয়ে দিতে, যেটাই তথাগত নিয়মবিরোধী, আবার সেই বাড়ি এসে দুই দিন সপরিবারে থাকবে! এটা হয়? শামীম অবশ্য তানিয়াকে বলেছিল আকদটা তাদের ঢাকার বাড়িতে করার কথা, কিন্তু আশরাফ সেখানে যাবে না। তাছাড়া আশরাফের বোন-ভাই, বন্ধুবান্ধব সব এখানে। কাউকে সেভাবে না বললেও দুই-তিনজন কাছের লোককে তো বলতেই হবে। এখন সেটা ঢাকায় হলে তো আর সম্ভব না। তাই সব দিক বিবেচনা করে শামীম নিয়ম ভেঙে মেয়েকে নিয়ে খুলনায় আসতে রাজি হলো।
রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে তানিয়া আরো একবার হাঁক ছেড়ে ডাকলো তৃপ্তিকে। দেখতে বলল আদিব তৈরি হয়েছে কি না। মায়ের কথা মতো আদিবের ঘরের দিকে হাঁটা দিল তৃপ্তি। আদিবের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। তৃপ্তি তবুও দুইবার টোকা দিল। আদিব ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে বলল,
– দরজা খোলা আছে।
ভেতরে প্রবেশ করলো তৃপ্তি। ভেতরে ঢুকে দেখলো মায়ের কেনা সাদা পাঞ্জাবিটা এখনো পড়ে আছে আদিবের বিছানায়। আদিবের পরণে বাড়ির পুরনো কাপড়। সে গভীর মনোযোগে ল্যাপটপে কিছু দেখছে। তৃপ্তি তার এ অবস্থা দেখে বলল,
– এখনো তৈরি হও নি?
– হ্যাঁ, এই তো যাবো। মামারা চলে এসেছে?
– না, এখনো আসেনি।
– আর কে কে এসেছে?
– ফুফু আর মেজ চাচা। সেজ চাচা পরে আসবে।
– ছোট চাচা আসেনি?
ল্যাপটপ কিবোর্ডে হাত চালাতে চালাতে জানতে চাইলো আদিব। তৃপ্তি জানালার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে বাতাস শুরু হয়েছে। আদিবের ঘরের জানালা খোলা। খোলা জানালা দিয়ে ভেতরে ময়লা ঢুকতে পারে। তৃপ্তি হাত দিয়ে জানালার কপাট দিতে দিতে আদিবের প্রশ্নের জবাবে ছোট করে বলল,
– না।
আদিবের জানা ছিল ছোট চাচা আসবে না। তবুও জিজ্ঞেস করেছিল।
– নিশান ভাইও তো আসেনি?
– বড় আপার শরীর অসুস্থ, তাই সে আসতে পারেনি।
দীপ্তির অসুস্থতার কথা শুনে হাত থামলো আদিবের। সে এবার তৃপ্তির দিকে তাকালো জানতে চাইলো,
– কী হয়েছে আপার?
– তেমন কিছু না, ঐ সর্দি-কাশি।
তৃপ্তির কথা শুনে একটু স্বস্তি পেল আদিব। দীপ্তির প্রেগন্যান্সিতে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে, যেটা আদিবের অজানা নয়। সে নিজে দেখেছে দীপ্তির রিপোর্ট, যার কারণে একটু ভয়ে আছে সে। দীপ্তির বাচ্চাটা সুস্থভাবে ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। সেই জন্য আপার শারীরিক অসুস্থতার কথা শুনে একটু চমকে উঠেছিল। তৃপ্তি আদিবের সাথে কথা বলতে বলতে জাহানারা বাড়িটার দিকে একবার তাকালো। সন্ধ্যা নামার সাথেই বাড়িটা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করা হয়েছে। এখন আরো সুন্দর লাগছে। তৃপ্তি সেদিকে তাকিয়ে আদিবের উদ্দেশ্যে বলল,
– জাহানারার ব্যাপারে আরেকবার ভাবতে পারতিস!
– না, পারতাম না। জাহানারার বরের অভিনয় করতে গিয়ে ওর একটু ক্লোজ হয়েছি মাত্র, তাই তোমার মা জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর তার সত্যিকারের বর হওয়ার কথা মাথায় আনলে তোমার মাকে হয়ত আর বাঁচানোই যাবে না।
– তার মানে মা রাজি থাকলে তুই জাহানারাকে বিয়ে করতি?
জানালা ছেড়ে দ্রুত পায়ে আদিবের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো তৃপ্তি। আদিব ল্যাপটপ স্ক্রিনে চোখ রেখে নির্লিপ্তভাবে বলল,
– ভেবে দেখতাম।
ভাইয়ের কথা শুনে নিরাশ হলো তৃপ্তি। মা রাজি থাকলেও না কি জাহানারাকে বিয়ে করার বিষয়ে ছেলেটা “ভেবে দেখতো”। তার মানে জাহানারার প্রতি তার মনের অনুভূতি এখনো স্পষ্ট না। অথচ গতকাল তৃপ্তির মনে হয়েছিল ছেলেটা জাহানারাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। সে বলল,
– বিয়ে না, আকদ। না, বন্ধ করবো না। তুই বল, তুই জাহানারাকে পছন্দ করিস কি না?
– এতো এনয়িং কেন তুমি? একটু পরে অন্য একটা মেয়ে আমার জীবনে আসতে চলেছে আর তুমি আর একটা মেয়েকে আমি পছন্দ করি কি না সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছো! সত্যি?
– হ্যাঁ, তুলছি। কারণ আমার মনে হচ্ছে তুই আবেগে পড়ে ভুল করছিস। পরে পস্তাবি। শোন, এখনো সময় আছে। তুই বললে আমি বড় মামার সাথে কথা বলবো। বড় মামা বিচক্ষণ মানুষ। উনি ঠিক বুঝবেন।
আদিবের মনের অবস্থা এমনিতেই ভালো ছিল না। তার উপর তৃপ্তির কথাগুলো যেন তাকে আরো উতক্ত করলো। সে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে গেল। বিরক্তি প্রকাশ করে নিজের মনের ভাব লুকাতে চাইলো। তৃপ্তি তখন তার দিকেই তাকিয়ে। সত্যি যদি আদিব এখন তাকে বলে সে এই বিয়েটা করতে চাই না, তাহলে তৃপ্তি বড় মামার সাথে কথা বলে এই মুহূর্তে বিয়েটা ভেঙে দেবে। এতে মা যা বলে বলুক। কিন্তু তার ভাইকে সে কম্প্রোমাইজ করতে দেবে না।
– আমি রেডি হবো, তুমি নিচেও যাও।
তৃপ্তিকে হতাশ করে বলল আদিব। তৃপ্তি দুই দিকে মাথা নেড়ে শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিকে যেতে রাগান্বিত মুখে বলল,
– পস্তাবি তুই।
তৃপ্তি চলে যেতেই কোমরে দুই হাত রেখে বড় করে দম ফেলল আদিব। হঠাৎ অক্সিজেনের অভাব অনুভব করলো সে। তড়িঘড়ি এগিয়ে গিয়ে বন্ধ জানালাটা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির পানি বয়ে আনা বাতাসে ভিজিয়ে দিল তার বক্ষপট। শ্বাস টানলো সে বুক ভরে। প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে নিল। সাথে সাথে বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠলো জাহানারার চন্দ্রাকৃতির নিখুঁত মুখটা। কানে বাজলো তিরতির করে কাঁপতে থাকা চিকন কণ্ঠে বলা, “আমি আপনাকে ভালোবাসি” কথাটা। তড়িৎ চোখ খুলল আদিব। জ্বলে উঠলো চোখ। ভেতরটা আবার অস্থির হলো। এ ঘটনা নতুন না। আদিবের অবচেতন মন প্রায় তার সামনে আনে সেই শেষ বিকেলের স্মৃতিটুকু। মনে করায় জাহানারার কথা। তবুও আদিব যেন এটাতে অভ্যস্ত হতে পারে না। স্মৃতিটুকু মানসপটে ভেসে ওঠার সাথে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি এলোমেলো হয়। ভেতরে একটা সূক্ষ্ম অপরাধবোধ কাজ করে। মনে হয় একটা বোকা মেয়ের আকাশসম ভালোবাসার বিনিময়ে সে মেয়েটার প্রতি নিজের ভালোলাগাটুকুও জাহির করতে পারিনি। বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। কষ্ট দিয়েছে নিজের কথা দিয়ে। দাঁড় করিয়েছে মৃত্যুর মুখে। সেরাতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে জাহানারার বলা কথাটা আবার মনে পড়লো আদিবের। “আপনি আমাকে একটুও কি ভালোবাসতে পারতেন না আদিব ভাই? একটুও?”
এই মুহূর্তে আবার কথাটা মনে হতেই আদিবের ভ্রূতে ভাঁজ পড়লো। গভীর ভাজ।থমকালো সে। মনে মনে মিলাতে লাগলো কিছু বিচ্ছিন্ন সমীকরণ। ব্যস্তপায়ে এগিয়ে এলো নিজের ল্যাপটপের কাছে। ল্যাপটপ চালু করে গুরুত্বপূর্ণ একটা ফাইল খুলল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পড়তে লাগলো প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অক্ষর। তবে নিজের জ্ঞানের সামান্য সীমাবদ্ধতার কারণে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলো না কিছু। অজ্ঞাত সঠিক তথ্যের জন্য কল লাগালো নিজের কলিগ কম বন্ধু রিচার্ডকে। দুই বার রিং হতেই অপরপাশ থেকে কল রিসিভ করলো রিচার্ড। আদিব কোনো ভণিতা ছাড়া নিজের প্রয়োজনের কথা বলল তাকে। রিচার্ড কিঞ্চিৎ অবাক হলো আদিবের কথায়। একমাস যাবৎ তাদের মধ্যে কোনো কথা-বার্তা নেই, আজ হঠাৎ আদিব ফোন করে তাকে এমন একটা কথা বলছে! অবাক হওয়াই তো স্বাভাবিক। তবে সে আদিবের কণ্ঠের গম্ভীরতা লক্ষ্য করে কিছু বলল না। আদিবের কথার প্রেক্ষিতে শুধু জানালো তার ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে। আদিব সম্মতি জানিয়ে ফোন কাটলো। রিচার্ডের সাথে কথা বলার পর ফোন রেখে কী যেন ভাবছিল আদিব। তার সেই ভাবনায় ছেদ পড়লো গাড়ির তীব্র হর্নে। বুঝতে পারলো মামারা চলে এসেছে। নিজের ভাবনা এক পাশে রেখে শব্দ করে শ্বাস ফেলল সে। উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। বিছানার উপর থেকে কাপড় নিয়ে ঢুকলো বাথরুমে।
_____________
জিনিয়া সহ বাকি ভাই ও ভাইয়ের পরিবারের সকলকে তানিয়া আমন্ত্রণ জানালেও জিনিয়া ছাড়া কেউ আসেনি শামীমের সাথে। এতে শামীম তেমন একটা ভ্রূক্ষেপ না করলেও তানিয়া বেশ কষ্ট পেয়েছে। ভাই-ভাবির না আসার ব্যাপারে এক ফাঁকে জিনিয়াকে জিজ্ঞেস করলে, জিনিয়া তাকে জানালো মেজো ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল রুবাইয়াকে নিজের শালকের ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার। শামীমের কাছে প্রস্তাবও রেখেছিল, কিন্তু শামীম রাজি হয়নি। সেই রাগে আসেনি মেজো ভাই। আর ছোট ভাই কেন আসেনি সেটা জিনিয়া জানে না। ছোট ভাইয়ের না আসার কারণ জিনিয়া বলতে না পারলেও তানিয়া ঠিক বুঝলো। তার ছোট ভাই আশরাফকে পছন্দ করে না। আশরাফের সাথে তার সম্পর্ক তোফায়েল মেনে নিলেও সে হয়ত মেনে নেয়নি। সে জন্য তো এতগুলো বছরেও এদিক মুখো হয়নি। আজও হয়ত নিজের জেদ বজায় রেখে আসেনি।
– তোমার ননদ-দেবররা আসেনি?
– হ্যাঁ?
অন্যমনস্ক ছিল তানিয়া, যার দরুন জিনিয়ার কথা শুনতে পায়নি। জিনিয়া সেটা বুঝতে পেরে আবার বলল,
– তোমার ননদ, দেবররা আসেনি?
– সাজ্জাদ আর নাফিজা এসেছে। ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের ঘরে। জায়েদ হয়ত একটু পরে আসবে। আর শাহেদ জরুরি কাজে আটকে পড়েছে।
– সোনিয়ার কাছে শুনেছিলাম তোমার ছোট দেবর নাকি নাসা থেকে ডাক পেয়েছে।
– হ্যাঁ। আমিও শুনেছি। তবে সত্যি কি না জানিনা। তোর দুলাভাই আমাকে তার ভাই-ভাগার সম্পর্কে তেমন কিছু বলে না।
তানিয়ার সাথে যে তার ননদ-দেবরদের সম্পর্ক তেমন একটা ভালো না, সেটা অজানা নয় জিনিয়ার। সে আর এ বিষয়ে কথা তুলল না। প্রসঙ্গ বদলালো।
এশার নামাজের পরেই ড্রইংরুমে জড়ো হলো সবাই। সন্ধ্যার সময় আকদের কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও শামীমদের আসতে দেরি হওয়ার কারণে এবং রুবাইয়া সঠিক একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায়, আকদের সময় এশার নামাজের পর সময় ধার্য করা হলো। এশার পরেই কাজি সাহেব এলো। কাবিননামায় লেখালেখির কাজ শুরু করলো। বাইরে তখন ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। তীব্র গতিতে বাতাস বইছে। আদিব বসার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। প্রকৃতির আলোড়নে নিজের ভেতরের আলোড়নকে দমাতে চাইলো। কতটা সক্ষম হলো বোঝা গেল না। তবে কাজি সাহেব যখন তার কাছে তার সম্মতি জানতে চাইলো, তখনো তাকে অন্যমনস্ক দেখালো। তার ধ্যান ভাঙলো কারো আর্তচিৎকারে। সাথে সাথে দৃষ্টি ঘোরালো সে, চোখ পড়লো মেঝেতে লুটিয়ে পড়া জাহানারার দিকে।
জাহানারার বিধ্বস্ত অবস্থা। গায়ে-পায়ে কাদায় মাখামাখি। লম্বা হাতার কাপড়টা ছেঁড়া প্রায়। গলায় কোনরকমে ঝুলছে ওড়না। বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবুথবু সে। আদিব জাহানারার অমন অবস্থা দেখে এক মুহূর্ত দেরি না করে উঠে এলো। নাফিজাও এগিয়ে এলো সাথে সাথে। আদিব সামনে এসে দাঁড়াতেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো জাহানারা, কিন্তু উঠতে পারলো না। আদিব লক্ষ্য করে দেখলো জাহানারার ডান পায়ের পাতায় কাদার সাথে রক্ত। সে তাড়াতাড়ি ঝুঁকে জাহানারার পায়ে হাত দিল। সাথে সাথে “আহ্” বলে ব্যথাতুর শব্দ ছিটকে এলো জাহানারার মুখ দিয়ে।
জাহানারার পায়ের গোড়ালির কাজটাই আড়াআড়ি করে খুব বিশ্রীভাবে কেটে গেছে। আদিব সেটা দেখে হতাশ শ্বাস ফেলল। জাহানারার মুখের দিকে তাকালো। অশ্রুশিক্ত লাল চোখ, বৃষ্টিতে ভেজা ফ্যাকাসে মুখ। কান্নার তোড়ে বেকে যাওয়া ঠোঁট, ফুলে ওঠা নাকের পাটা।আদিবের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো সাথে সাথে। উপস্থিত সকলে যে যার মতো বিভিন্ন কথা বললেও আদিব সেসব শুনলো বলে মনে হলো না। সে জাহানারার চোখে নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে সেভাবেই তাকিয়ে রইল। এর মধ্যে তৃপ্তি তোয়ালে নিয়ে এসে জাহানারার গায়ে রাখল। নাফিজা সেটা জাহানারার গায়ে জড়িয়ে দিল। তৃপ্তি আর নাফিজা মিলে জাহানারাকে ধরে তুলল। তাকে সোফায় বসালো। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও আদিবের দৃষ্টি সরল না জাহানারার মুখ থেকে।
তাকে নিজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে এতক্ষণে মুখ খুলল জাহানারা, কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল,
-মিথ্যাবাদী, আমার কাছে যাওয়ার কথা বলে এখানে সেজেগুজে বিয়ে করছো তুমি! হ্যাঁ? লজ্জা করলো না আমাকে রেখে আবার বিয়ে করতে?
-বিয়ে হয়নি এখনো আমার।
আদিবের শীতল কণ্ঠ। কিছু সময়ের জন্য হয়তো জাহানারার মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন হলো। যেটা কারো চোখে না পড়লেও আদিব ঠিক দেখল। ব্যাপারটা চোখে পড়তেই আদিবের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা উঁকি দিল। যেটা সে সকলের অগোচরে লুকিয়ে জাহানারার উদ্দেশ্যে আবার বলল,
জাহানারার কথায় সবাই অবাক। এই মেয়ে কি না ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বন-জঙ্গলে ঘেরা ঐ প্রাচীর টপকে এসেছে! জাহানারা কথা শেষ হতেই নাফিজা বলে উঠল,
-তুই পাগল জাহান! এই অন্ধকারে ঐ দিকে গেলি কেন? তুই জানিস ঐ বনের মধ্যে বেজি থাকে, সোড়েল থাকে। যদি তোকে কামড়ে দিত?
নাফিজা মাঝে মাঝেই ভুলে যায় যে তার ভাতিজির মানসিক ভারসাম্য আগের মতো নেই। এটা নতুন না। তার কথার উত্তরে আদিব বলল,
-জ্বি ফুপু, আপনার ভাতিজি পাগল। বলতে পারেন বদ্ধ উন্মাদ।
এরপর একটু থেমে জাহানারার উদ্দেশ্যে বলল,
-আর এতসব কেন করতে গেলে? রাস্তা দিয়েও তো আসতে পারতে?
-সন্ধ্যার সময় আসতে চেয়েছিলাম রাস্তা দিয়ে, কিন্তু ভাইয়া আসতে দিল না। জোর করে নিয়ে গেল বাড়ি। আটকে রাখল ঘরের ভেতর। বলল আমি নাকি পাগল হয়ে গেছি!
কথাটা বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল জাহানারা। আদিব নির্লিপ্ত চোখে তার দিকে তাকাল। টি-টেবিলের উপর থেকে মিষ্টির প্লেটটা সরিয়ে জাহানারার মুখোমুখি বসলো। তৃপ্তিকে বলল একটা গামলায় গরম পানি আর ফার্স্ট এইড বাক্স নিয়ে আসতে। তারপর জাহানারার উদ্দেশ্যে বলল,
-তাহলে ভাইয়া আপনাকে ঘরে আটকে রেখেছিল, আপনি ঘর থেকে বের হলেন কীভাবে?
জাহানারার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল আদিব। জাহানারা তার দৃষ্টির সামনে একটু মিইয়ে গেল। আর কোনো কথা বলল না। তৃপ্তি রাবেয়াকে দিয়ে আদিবের বলা জিনিসগুলো নিয়ে এসে রাখল তার সামনে। আদিব উপস্থিত সবাইকে উপেক্ষা করে জাহানারার পা নিজের হাঁটুর উপর তুলল। সাথে সাথে সাদা পাঞ্জাবিতে রক্ত আর কাদা লেপ্টে গেল। আদিবের কাণ্ডে অবাক হলো সবাই।
তানিয়া এতক্ষণ মানুষজন আছে ভেবে চুপ করে থাকলেও এবার আর সহ্য করতে পারলো না। মুখ খুলল সে। শীতল কণ্ঠে ছেলের নাম ধরে ডাকল। ছেলেকে বোঝাতে চাইলো সে কোন পরিস্থিতিতে আছে। বোঝাতে চাইলো সবাই দেখছে তাকে, তার সংযত হওয়া উচিত। আদিব মায়ের শীতল কণ্ঠের পিছনে লুকিয়ে থাকা সাবধানী বাণীটা হয়তো বুঝলো, তাই তো বড় মামার উদ্দেশ্যে বলল,
-মামা, আমি যদি রুবাইয়াকে বিয়ে না করি, তাহলে কি আপনি খুব বেশি রাগ করবেন?
-বিয়ে না করার কারণ জানতে পারলে রাগের পরিমাণ কম বেশি হতে পারে।
-আদিব, তুমি কি বলছো? মাথা ঠিক আছে তোমার? ভাইয়া, তুমি ওর কথায় কান দিও না।
শামীমের কথা কেটে বলল তানিয়া। শামীম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-তানি, চুপ কর। আদিবকে বলতে দে, ও কী বলতে চায় শুনি।
-থ্যাংক ইউ, মামা।
একটু সময় নিল আদিব, তারপর নিজের মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলল,
-এই মেয়েটা না কি আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। ভীষণ।যার কারণে আমি বারবার প্রত্যাখ্যান করার পরেও সে ফিরে আসে। আরো তীব্রভাবে আমাকে ভালোবাসে।এখন, এমন ভালোবাসাকে কত বার পায়ে ঠেলা যায়!তাই ভাবছি মেয়েটাকে একটা সুযোগ দিই।
-আর এই কথাটা তোমার এখন মনে হলো! যখন তোমার জন্য অন্য একটা মেয়ে প্রতীক্ষা করছে! লাইক সিরিয়াসলি?
– এতদিন তো তার ভালোবাসা বুঝিনি আমি। আজ হঠাৎ উপলব্ধি করলাম।তাই মনে হলো…!
আদিবের কথা শুনে ফিচলে হাসলো শামীম। তারপর কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই যাচ্ছিল, তখন জায়েদকে ভেতরে ঢুকতে দেখে থেমে গেল।
চোখ পড়ল জায়েদের ত্রুটিযুক্ত পায়ে। সাথে সাথে অপরাধবোধে ভেতরটা মিইয়ে গেল শামীমের।
আশরাফের সাথে বন্ধুত্বের কারণে তার ভাইদের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল শামীমের। তার মধ্যে জায়েদের সাথে সম্পর্কটা একটু বেশিই গাঢ় ছিল। ছেলেটাও শামীম ভাই বলতে পাগল ছিল। নিজের শখ-স্বপ্ন সব বলত শামীমের সাথে। শামীমও খুব মন দিয়ে শুনত। ভালো লাগত তার। নিজের ভাইরা সবসময় দূরে দূরে থাকত বলে বন্ধুর ভাইয়ের এমন আন্তরিক, হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার তাকে আপ্লুত করত।
শামীমের এখনো মনে আছে, জায়েদ পুলিশ সুপারের চাকরির জন্য দেওয়া সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শারীরিক পরীক্ষার জন্য গিয়েছিল ঢাকায়। তার সাথে ছিল শামীম আর আশরাফ। জায়েদ শারীরিক পরীক্ষা শেষে বাইরে বেরিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলেছিল,
— শামীম ভাই, ধরে নেন চাকরি কনফার্ম।
জায়েদের আত্মবিশ্বাস দেখে শামীমেরও মনে হয়েছিল, জায়েদের চাকরিটা হয়ে যাবে। এবং তাই হয়েছিল।
কিন্তু তার সেই আত্মবিশ্বাস, তার স্বপ্ন— সব এক নিমেষে ধুলিসাৎ করে দিল শামীম। সেদিন আশরাফের উপর রাগে অন্ধ হয়ে সে শুধু জায়েদকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলেনি, বরং জীবন থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। তার স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। কেড়ে নিয়েছিল জায়েদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা।
সেদিন আশরাফকে শামীমের বদ্ধ মুষ্টি থেকে ছাড়াতে জায়েদ এগিয়ে গেলে, শামীম রাগে ক্রুদ্ধ হয়ে ধাক্কা দেয় জায়েদকে। জায়েদ ছিটকে পড়ে মাঝরাস্তায়, সাথে সাথে এক দ্রুতগামী মোটরবাইক চলে যায় তার পায়ের উপর দিয়ে। থেঁতলে যায় জায়েদের পায়ের পপলিটিয়াল ধমনী। কেটে বাদ দিতে হয় সেটা। জায়েদের স্বাভাবিক হাঁটা-চলার ইতি ঘটে সেখানে। পুলিশ সুপার হিসেবে জয়েন করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে এসেও চাকরিতে যোগদান করা হয় না তার।
— আসসালামু আলাইকুম, শামীম ভাই। কেমন আছেন?
ঘরে ঢুকে সবার প্রথমে শামীমের দিকে চোখ পড়ল জায়েদের। সে প্রশস্ত হেসে সালাম দিয়ে জানতে চাইলো, শামীম কেমন আছে।
জায়েদের কথায় ভাবনা ছিন্ন হলো শামীমের। ম্লান হেসে বলল,
— ভালো। তুমি কেমন আছো?
— আলহামদুলিল্লাহ, আপন…
কথা শুরু করতে পারল না জায়েদ। তার আগেই তার চোখ গেল জাহানারার দিকে। মুখে অন্ধকার নেমে এল তার। জাহানারার দিকে তাকিয়ে বলল,
— তুমি এখানে কী করছো?
বাবাকে দেখে আদিবের কোলে থেকে নিজের পা টানতে লাগল জাহানারা। তবে আদিব তার পা ছাড়ল না। সে সেভাবে তুলো দিয়ে স্যাভলন লাগাতে লাগাতে বলল,
— তার বরের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তাই বিয়ে আটকাতে এসেছে, চাচা। রাগ করবেন না, প্লিজ।
আদিবের কথায় রসিকতার ছাপ। তানিয়ার যেন সহ্য হচ্ছে না এসব। সে জায়েদকে বলল,
— জায়েদ, তোমার পাগল মেয়েকে নিয়ে যাও তো এখান থেকে।
— চাচা, আপনি দেখছি ভিজে গেছেন। আসুন, বসুন।
মায়ের কথা উপেক্ষা করে বলল আদিব। তানিয়ার রাগ যেন আরও বেড়ে গেল। সে এবার গর্জে উঠল আদিবের উপর। তবে আদিব তার নির্লিপ্ততা বজায় রেখে শামীমের উদ্দেশ্যে বলল,
— মামা, আমার প্রশ্নের উত্তরটা এখনো বাকি।
— আমার কোনো সমস্যা নেই, আদিব।
ম্লান হেসে বলল শামীম।
তানিয়ার মাথায় যেন এবার বাজ পড়ল। সে তিলমিলিয়ে উঠে বলল,
— আদিব, তুমি কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছো! আমার এসব ভালো লাগছে না। মাথা ঠিক আছে তোমার? ঐ পাগল মেয়ের সাথে থাকতে থাকতে তুমিও পাগল হয়ে গেছো?
— আমাকে বিয়ে করবে, জাহানারা?
তানিয়ার কথা শুনেও না শোনার ভান করে সবার সামনে জাহানারাকে বলল আদিব।
জাহানারা একটা শুকনো ঢোক গিলল। বলল,
— আমাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে, আবার বিয়ে করবে?
— হুম। আবার বিয়ে করবো। করবে?
ছেলের কথা শুনে পাশে টি-টেবিলের উপর রাখা ফুলদানিটা এবার ফ্লোরে ছুঁড়ে মারল তানিয়া।
আশরাফ এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে থাকলেও এবার শক্ত গলায় বলে উঠলো,
— তানিয়া, চুপচাপ নিজের ঘরে যাও।
রাগে-দুঃখে চোখে পানি এলো তানিয়ার। ছেলের উপেক্ষা আর বরের এমন চোখ রাঙানিতে সবার সামনে অপমানিত বোধ করল সে। আর একটাও কথা না বলে ধুপধাপ পা ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। সারা বাড়ি কাঁপিয়ে শব্দ তুলে দরজা দিল। জিনিয়া গেল তার পিছু।
আদিব সেদিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলল। জাহানারার উদ্দেশ্যে আবার বলল,
— কী? করবে না বিয়ে?
তড়িৎ মাথা ঝাঁকাল জাহানারা। অর্থাৎ, সে আদিবকে বিয়ে করবে।
আদিব জাহানারার উত্তর পেয়ে তার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। জাহানারা আদিবের প্রখর দৃষ্টির সামনে অপ্রস্তুত হয়ে দৃষ্টি ঝুকিয়ে নিল।
জাহানারার অপ্রস্তুত অভিব্যক্তি দেখে আদিবের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি।
চলবে, ইনশাআল্লাহ।
#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৮
-পুরোনো বন্ধুত্ব ঠিক করার জন্য মেয়ে বিয়ে দিতে নিয়ে এলে, তারপর পুরোনো ভুলের কথা মনে করে অনুতপ্ত হয়ে সেই বিয়ে ভেঙ্গে দিলে। তোমার ভাবনা চিন্তা দেখলে মাঝে মাঝে আমার শরীর জ্বলে ওঠে শামীম।সহ্য হয় না তোমার এসব খামখেয়ালি!
তিক্ত বিরক্ত হয়ে বলল রিনা।শামীম স্ত্রীর কথা শুনে তার দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো। স্ত্রী কে বোঝাতে চাইলো মেয়ে আছে তাদের সামনে কথা বার্তা যেন একটু হিসাব করে বলে।শামীমের সেই দৃষ্টির অর্থ রিনা বুঝলেও সেটা পাত্তা না দিয়ে ক্যাটকেটে গলায় বলল,
-ওভাবে তাকচ্ছো কেন?আমি কিছু ভুল বলেছি?তোমার জায়গায় আমি হলে তো আমার গুষ্টির তুষ্টি করে দিতে।অথচ নিজের বেলায় ষোল আনা!নিজের দোষ তো মানছই না আবার চোখ গরম করছো?
-চোখ গরম করলাম কখন?
– পঁয়ত্রিশ বছর সংসার করছি তোমার সাথে তোমার কোন দৃষ্টির কি মানে সেটা আমার মুখস্থ।আমাকে বোঝাতে এসো না।
-আম্মু প্লিজ স্টপ।কি শুরু করেছো বলতো? মানুষের বাসায় আছি আমরা। ফুপুর কথা একবার ভাবো সে শুনলে কি মনে করবে?
-যা মনে করার করুক।আমার তাতে কিছু যায় আসে না।তার জন্য তো আজ এমন পরিস্থিতি হ
-রিনা তুমি কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছো!
রিনা কে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলো শামীম।শামীমের কাঠ কণ্ঠে রিনা যেন একটু চমকে উঠলো।তবে সে দমলো না । স্বামীর দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-আমার মেয়ের হওয়া বিয়ে ভেঙ্গে গেল।তাকে প্রত্যাখ্যান করে তার হবু বর অন্য একজনকে বিয়ে করলো, সেটা তোমার কাছে বাড়াবাড়ি হলো না। কিন্তু আমার দুই চারটে কথা তোমার কাছে বাড়াবাড়ি হয়ে গেল?বাহ!ভালো।
রাগে গজগজ করতে করতে বলল রিনা।শামীম একটা হতাশ শ্বাস ফেলল।সেও বুঝতে পারছে তার তড়িঘড়ি নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে, মেয়ের জীবনে বিয়ে ভাঙার যে অনাকাঙ্ক্ষিত দাগটা পড়লো সেটা একেবারে অদেখার নয়। কিন্তু সেই বা কি করতো।আদিব যখন সবার সামনে বলল সে বিয়েটা করতে চাইছে না তখন কি সে জোর করে তার ঘাড়ে মেয়েকে ঝোলাতো!আবার রাগ বাগ করেই বা কি করতো। একবার করেছিল তো রাগ যার অনুতাপ এখনো নিয়ে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া রুবাইয়া শিক্ষিত, সুন্দরী,আত্মনির্ভরশীল, সে ভবিষ্যতে আদিবের থেকে ভালো জীবন সঙ্গী পাবে এটা শামীম নিশ্চিত যার জন্য মেয়েকে নিয়ে সে খুব বেশি চিন্তিত না। কিন্তু রিনা,সে তো সেটা মানতে চাইছে না।তার এক কথা মেয়ের গায়ে বিয়ে ভাঙার যে দাগটা লাগলো এরপর ভালো জায়গায় মেয়ের বিয়ে হবে! ভদ্রমহিলা এতো দিন অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে থেকেও চিন্তা ধারা উন্নত করতে পারে নি।সে এখনো সেই নব্বইয়ের দশকে আটকে আছে।যার কাছে লোকে কি বলবে সেটা মেয়ের স্বস্তি পূর্ণ জীবনের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বাবা মায়ের কথা চালা চালিতে রুবাইয়া এত সময় চুপ থাকলেও মা কে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেখে সে মুখ খুলল,
-আম্মু,তুমি একটু শান্ত হও প্লিজ।আমার দিকে তাকাও ,দেখ আমি ঠিক আছি।
-তা তো থাকবেই তুমি তো তোমার বাপের হুকুমের দাস,বাপ উঠতে বললে উঠবে,বসতে বললে বসবে।মায়ের কথা তো তোমার কানে ঢোকে না।
মেয়ের উপর চিড়বিড়িয়ে উঠলো রিনা। রুবাইয়া একটু চুপসে গেল।আর কিছু বলা সমীচীন মনে করলো না।পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকে জানে এখন সে কিছু বললেই তার গুষ্টি, র’ক্ত,জাত সব টেনে এনে ঠেস দিয়ে বাবাকে কথা শোনাবে তার মা, যার ফলে পরিস্থিতি আরো বিগড়াবে সুতরাং এখন চুপ থাকাই ভালো।রিনা নিজের মনের রাগ উগ্রাতে যা মনে আসলো তাই বলে গেল। শামীম অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকালো।দোষ যেহেতু তার সে তাই স্ত্রী কে কিছু বলতেও পারলো না। রুবাইয়া বাবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ইশারায় বলল একটু সহ্য করো!মায়ের বকবকানিতে অতিষ্ঠ হয়ে
রুবাইয়ার একসময় মনে হলো ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতে কিন্তু সে জানে এখন এখান থেকে বের হলে তার মা আরো ক্ষ্যেপপে। অজ্ঞাত সেও বাবার সাথে চুপচাপ বসে রইলো।
রিনা শান্ত হলো প্রায় তিরিশ মিনিট পর তাও আবার দরজায় টোকা পড়ার শব্দে। দরজায় দ্বিতীয় বার টোকা পড়তেই শামীমের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো সে। অর্থাৎ এ সময় কে এলো। শামীম তার সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঠেস দিয়ে বলল,
-থামলে কেন? তোমার রেকর্ড চালাও মানুষ কে শোনাও।
কথাটা বলতে দরজা খুলতে বসা থেকে উঠে গেল শামীম।রিনা শামীমের কথা শুনে চোখ মুখ কুঁচকালো।শামীম দরজা খুলতেই দেখতে পেলো আশরাফ দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।শামীমের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে।শামীম কে উপেক্ষা করে রিনার উদ্দেশ্যে বলল,
-ভাবি ভেতরে আসতে পারি?
-জি ভাইয়া।
জোরপূর্বক হেসে বলল রিনা।কণ্ঠে তার আন্তরিকতা। নিজের তিক্ত মনোভাব লুকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা। রুবাইয়া মায়ের এমন দ্রুত ভোল পরিবর্তন দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো।রিনা অবশ্য মেয়ের সে হাঁসি লক্ষ্য করলো না।সে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করতে ব্যস্ত হলো।
আশরাফ ভেতরে প্রবেশ করে কোনো ভণিতা ছাড়া রিনার উদ্দেশ্যে বলল,
-ভাবি আমাদের জন্য রুবাইয়ার সাথে যেটা হলো তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।আমার পরিবারের হয়ে আমি আপনাদের কাছে মাফ চাইছি।
আশরাফ হাত জোড় করে কথাটা বলতে নিতেই।সাথে ছি ছি করে উঠলো রিনা। বলল,
-ভাইয়া এভাবে কথা বলে লজ্জা দিবেন না ,প্লিজ।আমি বুঝছি আপনাদের দিকটা।আমার একটু রাগ হয়েছিল তখন কিন্তু ছেলে যখন সবার সামনে বললই সে এ বিয়ে করতে চায় না তখন আপনাদেরই বা কি করার ছিল।আমি অবশ্য আপনাদের ভাইকে বলেছিলাম এত তাড়াহুড়া না করতে।আজ কাল কার ছেলে মেয়েদের মন না মতি,একটু সময় নেওয়া ভালো। কিন্তু তিনি আমার কথা শুনলেন না। তিড়িং বিড়িং করে বিয়ের দিনক্ষণ ফেললেন।
কথা বলতে শামীমের দিকে তাকালো রিনা।শামীম তার কথা শুনে এক ভ্রূ উঁচিয়ে তার দিকে তাকালো।এই ভদ্র মহিলাকে গত এক ঘণ্টা যাবৎ তিনি আর তার মেয়ে দুইজন মিলে কত ভাবেই না আজকের ব্যাপরাটা বোঝাতে চেয়েছে কিন্তু সে কিছুতেই কিছু বুঝতে রাজি ছিল না।অথচ এখন কি সুন্দর আশরাফের সামনে দাবি করছে সে তাদের দিকটা বুঝছে! দারুণ!
গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শামীম।
আশরাফ রিনার কথায় আশ্বস্ত হলো।রিনার কথায় বুকের উপর থেকে যেন একটা ভারি পাথর সরে গেল। স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে।রিনা কে তাদের এখানে আরো দুটো দিন থাকার অনুরোধ করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।আসার সময় শামীমের সাথে চোখাচোখি হলো কিন্তু কেউ কারো সাথে বাক্যবিনিময় করলো না।দুইজন সামনাসামনি হওয়ায় পুরোনো বন্ধুত্বের উষ্ণ আঁচ কিঞ্চিৎ তৈরি হলেও,ভেতরে জমে থাকা এত বছরের বরফ গলতে সময় তো লাগবে!
_______________
আজ বিকেলে জাহানারা কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে আসার পর থেকে আশরাফের ভেতরটা ছটফট করছিল। বারবার মনে পড়ছিল অনেক বছর আগে জায়েদ কে দেওয়া কথা,মায়ের ইচ্ছা।আদিবকে পাওয়ার জন্য জাহানারার করা পাগলামো।সব যেন একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তার।ভেতরটা হাঁস ফাঁস করছিল অপরাধ বোধে।মনের সেই অস্থিরতার ক্ষণে আশরাফের হঠাৎ মনে হলো একটা শেষ চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়! কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো আদিব কি মানবে তার কথা।ছেলের কাছে অপমানিত হতে হবে না তো!
ভাবনা চিন্তার দোলা চলে সে গিয়ে পৌঁছাল ছেলের দরজায়।আদিব তখন তৈরি হচ্ছে, বাবা কে এসময় তার ঘরে দেখে একটু অবাক হলো। আশরাফ সচার আচার আদিবের ঘরে যায় না সুতরাং একটু অবাক হওয়া স্বাভাবিক। আশরাফ এগিয়ে গেল ছেলের কাছে।আদিব বাবাকে এই মুহূর্তে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই। আশরাফ একটু ভাবনায় পড়লো।আদিব কে নিজের মনের কথাটা বলবে কি ,বলবে না এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলো।অনেকটা সময় নিয়ে নিজের মনের অস্থিরতা কোনোরকমে সামলে বলল,
-আদিব তুমি কি আমার একটা কথা রাখবে?
বাবার দ্বিধাদ্বন্দ্বিত চেহারা আর কণ্ঠের অসহায়ত্ব তার বাবার শক্ত সামর্থ্য ব্যক্তিত্বের সাথে সে মেলাতে পারলো না। খারাপ লাগলো তার। ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো।সে নরম গলায় বলল,
-বাবা তুমি কি বলতে চাও নির্দ্বিধায় বলতে পারো।আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তোমার কথা রাখার।
নিজের অন্যায় আবদারের কথা মনে করে ছেলের কথায় আশ্বস্ত হতে পারলো না আশরাফ।সে তো জানে ছেলের জাহানারা প্রতি উদাসীনতা। সে একটা শ্বাস ফেলল তারপর পিতৃত্বের দাবি নিয়ে জানালো, “এই বিয়ে ভাঙতে,জায়েদ কে দেওয়া তার পুরোনো কথা রাখতে।”বাবার কথায় তার দিকে হতবাক চোখে তাকালো আদিব।আশরাফের কাছ থেকে এসময় এমন কথা আশা করিনি সে।বাবার কথার রেশ কাটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে কিঞ্চিৎ সময় ব্যয় করলো আদিব।মনে করলো তার জীবনে বাবার গুরুত্ব।
তাদের ভাই বোনেদের জীবনে বাবার ভূমিকা অপরিসীম হলেও কখনো বাবা তাদের জীবনে হস্তক্ষেপ করেনি। সবসময় তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা কে প্রাধান্য দিয়েছে বলা ভালো তাদের চাওয়া পাওয়াকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছে।আজ যখন সেই মানুষ টা এভাবে অসহায়ের মতো তার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন তাকে ফেরাতে পারলো না আদিব।মেনে নিল বাবার অন্যায় আবদার।কথা দিল তার কথা রাখার।
শামীমের ঘর থেকে বের হতেই সন্ধ্যায় আদিবের সাথে হওয়া কথোপকথন মনে পড়তেই বুক চিরে আরো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আশরাফের। এগিয়ে গেল সে আদিবের ঘরের দিকে।
আদিবের ঘরের দরজা হ্যাঁ করে খোলা ছিল। আশরাফ ভেতরে ঢুকতেই দেখলো জাহানারা বেহুঁশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, তৃপ্তি তার মাথায় পানি দিচ্ছে।নাফিজা চিন্তিত মুখে তার শিয়োরে বসা।আদিব পড়ার টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি জাহানারার মুখে নিবদ্ধ। নির্লিপ্ত ভঙ্গি তার। আশরাফ ভেতরে ঢুকতেই তৃপ্তি বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
-আদিব একটা ******ইনজেকশন দাও, আশা করি কাজ হবে।না হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
-শরীর দুর্বল ******ইনজেকশন সহ্য করতে পারবে?মাথায় পানি দেওয়া হচ্ছে দেখা যাক কি হয়।
থামলো আদিব। আশরাফও তার কথাতে সম্মতি জানালো। এরপর নিরবতা। আশরাফ চেয়ার টেনে বসলো জাহানারা পাশে। মৃদু স্বরে ডাকলো তাকে। জাহানারা অবচেতন ভাবে সাঁড়া দিল।মেয়েটার জ্ঞান আছে দেখে কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেল আশরাফ।
-মা কোথায়?রাগ কমেছে তার?
নিরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করলো তৃপ্তি। আশরাফ শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল, বলল,
-নিজের ঘরে,রাগ এত তাড়াতাড়ি কমবে না।আদিব তোমার একবার মায়ের কাছে যাওয়া উচিত।
-এখন ইচ্ছা করছে না।
ভাবলেশহীন ভাবে বলল আদিব।আদিবের কথা শুনে উপস্থিত সবাই যেন একটু থমকালো।আদিবের কাছে তানিয়া ফাস্ট প্রায়োরিটি, এই কথাটা কম বেশি সবাই জানে সেই ছেলের মায়ের প্রতি এই অবহেলা ভাবালো সকলকে।তবে আদিব সেসব পাত্তা দিল না।সে তৃপ্তির উদ্দেশ্যে বলল,
-আপু এবার থামো। ঠান্ডা লেগে যাবে।
আদিবের কথায় তৃপ্তি জাহানারা মাথায় পানি ঢালা বন্ধ করলো।আদিব এগিয়ে এসে থ্যার্মোমিটার মুখে দিল জাহানারার।জ্বর মেপে দেখলো আগের থেকে কমেছে।থ্যার্মোমিটার ঝাড়া দিয়ে ফাস্টএইড বাক্সে রেখে বলল,
-বাবা,ফুপু তোমরা যাও রেস্ট নাও।আপু তুমিও যাও। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে এখন একটু আরাম করো।কোনো সমস্যা হলে আমি তোমাদের ডাকবো।
সত্যি সারাদিন অনেক ধকল গেছে সবার উপর। তৃপ্তি তো সেই ভোর থেকে মায়ের হাতে হাতে এটা ওটা করেছে। শরীর আর চলছে না তার।আদিবের কথা শুনে সে উঠে গেল।নাফিজাও আর বসলো না।আদিব যখন মেয়েটার সাথে আছে তখন চিন্তার কিছু নেই।নাফিজা আর তৃপ্তি চলে যেতেই আশরাফ উঠে দাঁড়ালো।আদিব কে জাহানারার খেয়াল রাখতে বলে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আশরাফ চলে যেতেই।ঘরের দরজা দিল আদিব।টেবিলের উপর রাখা খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে মরে যাওয়া ক্ষিদেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার। কিন্তু খেতে ইচ্ছা করলো না। বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো সে। জাহানারা গায়ে কম্বল টা ভালো করে টেনে দিয়ে তার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসলো।তারপর জাহানারার কানের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে ফিসফিসিয়ে বলল,
-আই হেইট উই জাহানারা!আই হেইট ইউ।
চলবে, ইনশাআল্লাহ।
#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৯
-“”নিজেকে চাঁদের মতো নিঃশব্দ ও শীতল করে তুলিস না, বরং সূর্যের মতো প্রজ্বলিত হ। যেন তোর কলঙ্ক কেউ সহজে দেখতে না পায়, উপভোগ তো দূরের কথা! তোর শক্তি ও দীপ্তি এত প্রবল হোক যে, তোর সামান্য দাগ খোঁজার জন্যও মানুষকে বিশেষ যন্ত্র আর গভীর জ্ঞানের আশ্রয় নিতে হয়। এমন অসাধারণ হ, যেন তোকে বুঝতে হলে আলোচনার নয়, গবেষণার প্রয়োজন হয়!”
অনেক বছর আগে ছোট চাচার বলা কথাগুলো আজ আবার স্মরণ করলো জাহানারা।সাথে সাথেই বন্ধ চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।চোখ মেলে তাকালো সে।ঘুম অনেকক্ষণ ভেঙ্গেছে তার, অভ্যাসবশত চোখ বুজে শুয়ে ছিল।জীবনের চাওয়া পাওয়ার সমীকরণ মিলাচ্ছিল, ঠিক তখনই ছোট চাচার বলা কথাটা মনে পড়লো।
আদিব কে ভালোবেসে যখন সে পাগল প্রায়,মানুষের কথাও তখন তুঙ্গে।কথায় কথায় তার চরিত্র নিয়ে কথা বলে মানুষ।তাকে নির্লজ্জ বলে কথা শোনায়।ভয় ধরায় তাকে স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে।সে যত সবটা ভুলে আগাতে চায় মানুষ তাকে ততো ধাক্কা দিয়ে পিছনে সরিয়ে দেয়।একতরফা ভালোবাসার অপরাধে তাকে কলঙ্কিত করে। জাহানারার ছোট্ট মন সহ্য করতে পারে না সেসব। প্রতিদিন নিয়ম করে কাঁদে সে।দিন গুলো যেমন তেমন কাটলেও রাতগুলো কাটে দুর্বিষহ।প্রতি রাতে চোখের পানির সাথে নিজের কলুষিত অতীতের মুক্তি চায়। কিন্তু পারে না।ছোট চাচি তার সাধ্য মতে চেষ্টা করে তাকে আগলে রাখার। বাইরের মানুষ থেকে আগলে রাখলেও, কাছের মানুষ গুলো থেকে মেয়েটাকে রক্ষা করতে পারে না।তারা ঠিক বাড়ি বয়ে এসে মেয়েটার বোকামির প্রশংসা করে,ঠেস দিয়ে কথা বলে,সে আদিবের কতটা অযোগ্য সেটা দায়িত্ব নিয়ে মনে করায়।জাহানারা এসব চুপ চাপ শোনে।ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ে।পিছিয়ে নেই নিজেকে সবার থেকে।লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে সবার আড়ালে। যেখানে কেউ তাকে দেখবে না, কেউ তাকে চিনবে না।এভাবে দিন কাটে,সময় যায়।
একসময় অসুস্থ হয়ে পড়ে জাহানারা।।ভুগতে থাকে “সোশ্যাল ফোবিয়ায়”।বাধা গ্রস্থ হয় তার স্বাভাবিক জীবন যাপন।জায়েদ তখন মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে।সালেহা মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত হলেও কিছুই করতে পারছে না।আকিব তখন মাত্র ভ্যার্সিটি থেকে বের হয়েছে। চাকরির পড়াশোনায় তার দম নেওয়ার ফুরসত নেই।তারউপর দীর্ঘ পথের দূরত্ব। মোবাইল ফোনই তখন ভরসা।বোনের কাছে যেতে না পারলেও রোজ নিয়ম করে বোনকে ফোন করে,তার মন ভালো করার চেষ্টা করে, সাহস যোগায়। বোনের কাছে না থাকতে পারার জন্য গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে জাহানারার জীবনে তখন ভরাডুবি।শাহেদ ভাতিজির অবস্থা দেখে সেজ ভাইকে নিজের সাধ্যমতো বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু শাহেদ মেয়ের মুখ দেখবে না।যে মেয়ের জন্য তার মা তাদের ছেড়ে চলে গেছে, তাকে নিজের চোখের সামনে রাখবে না।সেজ ভাইয়ের জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে শাহেদ নিজেই এগিয়ে যায় ভাতিজির উদ্ধারে।
জাহানারার জীবনের ভরাডুবিতে হাল ধরে। জাহানারার ছোট বড় প্রতিটা পদক্ষেপে তার সাথে পা ফেলে।তাকে প্রতিদিন একটু একটু করে নিজকে চিন্তে শেখায়।তার দোষ ছাপিয়ে গুণ তুলে ধরে।তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে।নিজেকে ভালোবাসতে বাধ্য করে। পরিশেষে সফল হয় শাহেদ।উঠে দাঁড়ায় জাহানারা।নিজের ভয় ছাপিয়ে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে যায় সামনে।লুফে নেয় একের পর এক সাফল্য।
ছোট চাচা না থাকলে হয়ত জাহানারা আহাসান সেই কবেই অন্ধকারে হারিয়ে যেত। এবং , এবং যার জন্য,যার কারণে সে নিশ্বেষ হয়ে যেত সে হয়ত তার সমাপ্তিতে “আহ্ ” টুকু করতো না!নিজের মনেই তাচ্ছিল্য হাসলো জাহানারা।চোখ মেলে তাকালো সিলিংয়ের দিকে।রাত এখনো খানিক বাকি।ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে চোখ দিতেই শেষ প্রহরের নিঃশব্দ অন্ধকার দৃষ্টি ছুঁলো।একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো জাহানারা।জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিজের বা পাশে তাকালো ,দেখল বিছানার হেড বোর্ডে হেলান দিয়ে আদিব বসে আছে।চোখ বন্ধ তার।তবে পায়ের অনবরত নড়ন চড়ন বলছে সজাগ সে।ডিম লাইটের ঝাপসা আলোই অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে।আলো আধারিতে আদিব কে নিজের পাশে দেখে প্রথমে একটু চমকে ছিল জাহানারা তবে সেটা ক্ষণিকের জন্য।নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিয়েছিল সাথে সাথে।জাহানারার দৃষ্টি আদিবেই নিবদ্ধ ছিল ঠিক তখন আদিব তার থমথমে কণ্ঠে বলে উঠলো,
কথা বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে ঘরের বাতি জ্বালালো সে। দৃশ্যমান হলো তার চেহারা। জাহানারা দেখলো তার ঠোঁটের কোণের তাচ্ছিল্যের হাঁসি।আদিবের মুখের দিকে তাকিয়ে সেও মৃদু হাসলো, ঠোঁটের কোণে হাঁসি ধরে রেখে ছোট করে বলল,
-থ্যাংক ইউ।
নিজের কটাক্ষের বিনিময়ে জাহানারার এমন প্রতি উত্তর আশা করেনি আদিব।তার চোয়াল শক্ত হলো। জাহানারা যেটা স্পষ্ট দেখলো।তবে খুব একটা গুরুত্ব দিল না।মাথা ঝিমঝিম করছে তার।পেটে জ্বলছে।খিধে লেগেছে।এই মুহূর্তে কিছু না খেলে হচ্ছে না।এখন তার খাওয়া দরকার ।এই ছেলের রাগ বাগ পরে দেখা যাবে।শোয়া থেকে উঠে বসতে চেষ্টা করলো জাহানারা।সাথে সাথে সারা শরীর ব্যথায় ঝনঝনিয়ে উঠলো।সব থেকে বেশি পীড়া দিল পায়ের নিচের ক্ষতটা। দাঁতে দাঁত রাখল সে।চোখ মুখ নীল হলো ব্যথায়।
নেহার উপর ভীষণ রাগ হলো।মেয়েটাকে বলেছিল, তারিনের কাছ থেকে কোনোভাবে পিছনের পকেট গেটের চাবি আনতে, কিন্তু বোকা মেয়ে পারলো না, অজ্ঞাত প্রাচীর টপকাতে হলো তাঁকে।মনে মনে আহাম্মক বলে গালি দিল সে নেহা কে। তারপর ধীরে সুস্থ উঠে বসলো। আদিব ততক্ষণে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।এক দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।রাগ ক্ষোভ মিলে অদ্ভুত মুখো ভঙ্গি করে রেখেছে। জাহানারা তার দিকে এক পলক তাকিয়ে টেবিলের দিকে তাকালো চোখ পড়লো টেবিলের উপর রাখা ঢাকা পাত্র গুলোর দিকে।সেদিকে তাকিয়ে আদিব কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-খাবার কিছু আছে, না আপনি সব খেয়ে ফেলেছেন?
আদিবের দৃষ্টি আরো একটু রুক্ষ হলো মনে হয়।তবে জাহানারা ভ্রূক্ষেপ করলো না।সে ফের বলল,
-কিছু জিজ্ঞেস করছি।উত্তর দিন প্লিজ। ভীষণ খিধে লেগেছে।
-কেন আমার পুরো ভবিষ্যৎ টা খেয়ে পেট ভরে নি?
-না,ওটাতে শুধু মন ভরেছে।
– তুমি কি জানো তুমি একটা অসহ্য রকমের মিথ্যাবাদী,অসভ্য,বেয়াদব মেয়ে!
জাহানারার দিকে আঙুল তাক করে দাঁতে দাঁত পিষে বলল আদিব।
-এতো দাঁত পিষবেন না। দাঁত ভেঙে যাবে। এমনিতেই চুলে পাক ধরেছে, দাঁত ভেঙ্গে গেল কিন্তু সার্টিফাইড বুড়ো হয়ে যাবেন।
-জাহানারা!
-আস্তে!বাড়ি মানুষজন আছে না।তারা কি ভাববে!
-তোমার নির্লজ্জতা দেখে অবাক হচ্ছি আমি।সামান্য পরিমাণ লজ্জা নেই তোমার, না? এতগুলো দিন ধরে মিথ্যা নাটক করলে,আশে পাশের মানুষ গুলোকে অতিষ্ঠ করলে।বাপ ভাই কে কাঁদালে…!
আমার সাথে এতদিন অভিনয় করলে।এত এত অন্যায় করেও তোমার চোখে মুখে অপরাধ বোধের ছায়া টুকু নেই! উলটো তুমি এই ভোর রাতে আমার সাথে ইয়ারকি করছো!
-ইয়ারকি করছি না।সত্যি বলছি।যাই হোক আমাকে কিছু খেতে দিন।
-আমাকে খাও!
রাগে তিলমিলিয়ে উঠে বলল আদিব। এগিয়ে গেল জানালার দিকে।খুলে দিল জানালা।ভোরের নরম ঠান্ডা বাতাসে দমাতো চাইলো ভেতরের তাপ।রাগে শরীর জ্বলছে তার।সে ভেবেছিল এই মেয়েটা এত দিন যা কাণ্ড কারখানা করেছে তার জন্য দুঃখিত হবে।নিজের কাজের জন্য ক্ষমা চাইবে, অনুতপ্ত হবে। কিন্তু তার মধ্যে যে অনুতাপের ছিটে ফোঁটাও থাকবে না সেটা ভাবেনি।খোলা জানালার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো আদিব।নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য জোরে জোরে দম ফেলতে লাগলো।
-আজ না, পরে একদিন সময় করে খাবো।
সবে মাত্র রাগটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল আদিবের, সে সময় জাহানারার লাগামহীন কথায় নিয়ন্ত্রণ হওয়া রাগটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।অনেকটা তেড়ে এলো সে জাহানারার দিকে হাত উঁচিয়ে বলল,
-আর একটা ফালতু কথা বললে থাপ্পড়িয়ে তোমার দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদব।
রাগে গনগনে আদিবের চোখ মুখ। জাহানারা বুঝলো একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।তবে সেটা প্রকাশ করলো না।মনের ভাব লুকিয়ে গলার শ্লেষ পরিষ্কার করে কথা ঘোরালো,
-খিধে লেগেছে।
ভ্রূতে ভাঁজ পড়লো আদিবের।জাহানারার রোগে ক্লিষ্ট দুর্বল মুখটা দেখে এতক্ষণে টনক নড়লো।মেয়েটা অসুস্থ এটা রাগের চোটে মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল তার। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল সে। জাহানারার দিকে একটা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে।ঢাকনা উঠিয়ে দেখলো,তার সাথে জাহানারার জন্যও খাবার রেখে গেছে তৃপ্তি। কিন্তু এই গরমে খাবার ভালো আছে কি না সেটা নিয়ে সংশয় দেখা দিল।
ঢেকে রাখা পাত্রের ঢাকনা সরালো আদিব।ঢাকনা সরাতেই নাকে এসে ঠেকলো উৎকট গন্ধ।বুঝলো খাবার নষ্ট হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক। সেই কোন সন্ধ্যায় রান্না বান্না হয়েছে এতক্ষণ সেসব ঠিক থাকে!প্লেটটা নিচে নামিয়ে তার পাশে রাখা কেকের প্লেটটা হাতে নিল আদিব।এটা দেখে মনে হলো ঠিক আছে, তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য চামচ দিয়ে কেটে একটু মুখে নিল। কেক নষ্ট হয়নি বুঝতে পেরে জাহানারা কে বলল,
-পৌলাও মাংস সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে।দুই টুকরো পেস্ট্রি আছে, খাবে?
-মিষ্টি নেই?
-কি?
-মিষ্টি-টিষ্টি নেই?
ঘাড় ফিরালো আদিব।টেবিলের দিকে তাকালো।একটা বড় প্লেট।প্লেটের ঢাকনা সরাতেই তিন চার রকমের মিষ্টি চোখে পড়লো।সে ওখান থেকে দুটো মিষ্টি ছোট্ট বাটিতে তুলতেই জাহানারা বলল,
-প্লেট ধরে নিয়ে আসেন।
আদিব জাহানারার কথা শুনে তার দিকে সরু চোখে তাকালো।চোখের ভাষায় বলতে চাইলো এতো খেতে পারবে? জাহানারা বুঝলো তার দৃষ্টির মানে।বলল,
-ওভাবে তাকিয়েন না। একবার নিয়ে আসেন, সব শেষ করে ফেলবো।
শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব প্লেট দুটো নিয়ে গিয়ে জাহানারার সামনে রাখলো।বসলো তার সামনে। জাহানারা বিনা বাক্য ব্যয়ে হাতে তুলে নিল প্লেট।মন দিলো খাওয়ায়। কি মনে করে একবার আদিবের দিকে তাকালো।জানতে চাইলো সে খেয়েছে কি না।আদিব তার কথার উত্তরে বিরক্ত হয়ে বলল,
-আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে নিজে খাও।
-ফাইন।
নিজের খাওয়ায় আবার মনোযোগী হলো জাহানারা।একটা পেস্ট্রি সহ পুরো মিষ্টির প্লেট খালি করে থামলো সে।পানি খেয়ে মুখ মুছে তৃপ্তির ঢেকুর তুললো।আদিব তখন তার দিকে তাকিয়ে।তার গোগ্রাসে গেলা দেখছিল সে।আদিব কে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জাহানারা দাঁত বের করে হাসলো,বলল,
-আপনার বিরহে দুই দিন প্রায় না খাওয়া। তাছাড়া জানেন তো মিষ্টি আমার কত পছন্দ।
-সব শেষ করলে যখন তখন ওটা বাকি রাখলে কেন?
প্লেটে বেঁচে যাওয়া কেকের টুকরো দেখে কটাক্ষ করে বলল আদিব।
-ওটা তো আপনি খেয়েছেন।আমি কারো এঁটো খাই না।
জাহানারার কথাটা শুনে এক ভ্রূ উঁচিয়ে চোখ সরু করলো আদিব।দুই সপ্তাহ আগেও নির্লজ্জের মত তার খাওয়া “এঁটো” জুস এক প্রকার কেড়ে খেয়ে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা বৃদ্ধির জ্ঞান দিতো আর আজ তার খাওয়া জিনিস “এঁটো” বলে খেতে পারছে না!বাহ!
-কথায় কথায় ওভাবে ত্যাড়া বাঁকা করে তাকান কেন! অদ্ভুত!
চোখ সরালো আদিব।উঠে গেল তার সামনে থেকে।বিড়বিড়ালো বেয়াদব শব্দটা। জাহানারা যেটা স্পষ্ট শুনলো। আদিবের অলক্ষ্যে ঠোঁট টিপে হাসলো।আদিব গিয়ে বসলো সামনের সোফায়। জাহানারা আরাম বিছানার হেড বোর্ডে হেলান দিলো।আদিব নিজের জায়গায় বসে শীতল দৃষ্টিতে চাইলো তার পানে। জাহানারা ভ্রূ নাচালো কিন্তু আদিব কিছু বলল না।ওভাবে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলো ।আদিব কোন কথা বলছে না বিধায় জাহানারাও কিছু বলল না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকাতাকি করে নিজের চঞ্চল দৃষ্টি স্থির করলো আদিবের ওপর।আদিবের চোখে চোখ রাখলো।এবার নীরবতা ভাঙলো আদিব।
-আমার কিছু মনে নেই,ষ!আমি কাউকে চিন্তে পারছি না!কান্না কাটি ইত্যাদি ইত্যাদি এত ,এত নাটক সব আমার সাথে বিয়ে করার জন্য?
-ইয়েস।
সময় অপচয় না করেই উত্তর দিল জাহানারা।আদিবের মুখ থমথমে হলো।
-এসব করতে তোমার লজ্জা করেনি একটুও?
-লজ্জা ,ঘৃণা,ভয় দিন থাকতে নয়! মোশাররফ স্যারের অমোঘ বাণী।আমার কিন্তু মনে আছে আপনার মনে নেই?
-এসব করার সময় একবারও আমার কথা মনে হলো না?আমার
আদিবের কথার মাঝে ফিক করে হেসে উঠলো জাহানারা।বলল,
-স্যরি,বাট আপনার কথা ভেবেই তো এত কিছু করালাম।আর আপনি জিজ্ঞেস করছেন আপনার কথা মনে হলো কি না!
-জাহানারা আমার সাথে একদম হেঁয়ালি করবে না।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি, ধৈর্য চ্যুত হলে খবর আছে তোমার!
-আপনার সুখ শান্তি আমার কেন জানি পছন্দ হয় না।গায়ে জালা ধরে, আপনি ভালো আছেন সুখে আছেন এ কথা শুনলে। আপনাকে আমার সাধ্য মত খারাপ রাখার জন্য এতো কিছু করতে হয়েছে আমাকে। ক্লিয়ার?
আদিব চমকালো।চোখে মুখে খেলে গেল তার বিস্ময়।তার ধারণা ছিল জাহানারা তাকে ভালোবাসে, তাই তাকে পাওয়ার জন্য এত কিছু করছে।মুখে যায় বলুক মেয়েটার তার জন্য করা এই পাগলামি অল্প স্বল্প নাড়া দিয়েছিল তার মনে। ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিল মেয়েটা একতরফা ভালোবেসে তার জন্য এত কিছু করতে পারলে, ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা পেলে কি করবে!এসব ভেবেই তো তার অবচেতন মন বারবার এগিয়ে যেত মেয়েটার দিকে, চেষ্টা করতো তাঁকে বোঝার ,তার কথিত ভালোবাসা বোঝার।অথচ তার সব ধারণা মিথ্যা ছিল!ঠুনকো ছিল! জাহানারার কথা শুনে নিজের ভাবনা চিন্তা আঁস্তাকুড়ে ফেলল আদিব। গম্ভীর স্বরে বলল,
-ভালোবাসো না! ঘৃণা করো?
-ইয়েস।
-তাহলে বিয়েতে সম্মতি দিলে কেন?
-বাইরে থেকে আপনার সুখ শান্তি কতটাই বা নষ্ট করতে পারতাম! তাই আপনার অন্দরে প্রবেশ করলাম। তাছাড়া কিছু না।
-আমাকে এতো ঘৃণা করার কারণ?
– বলতে চাইছি না। আমার মন।আমার অনুভূতি।আপনাকে জানাতে ইচ্ছুক নই।
দৃষ্টি সুচালো হলো আদিবের।তার পছন্দ হলো না জাহানারার এমন ঔদ্ধত্য আচরণ।সর্ব শরীর জ্বলে উঠলো। রক্ত মাথায় চড়লো।তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো সে ক্ষিপ্র গতিতে জাহানারার দিকে এগিয়ে গেল।নিজের শক্ত হাতে চোয়াল চেপে ধরলো জাহানারার। নিজেদের মধ্যের দূরত্ব কম করে নিঃশ্বাসে নিশ্বাস মিশিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,
-বিয়ে করছো, সুস্থ ভাবে সংসার করবে ,বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।আমার সুখ শান্তি নষ্ট করার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের চিন্তা করো।
নিজের কথা শেষ হতেই মৃদু বল প্রয়োগ করে ঝাঁকি দিয়ে জাহানারার চোয়াল ছাড়লো আদিব।জাহানারার ঘাড়ে সামান্য ব্যথা লাগলো তাতে। কিন্তু আদিবের সামনে সেটা প্রকাশ করলো না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকালো আদিবের দিকে।শীতল দৃষ্টি রাখলো আদিবের চোখে।আদিব তার সেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি গেঁথে ফের বলল,
-“এন্ড আই মীন ইট”।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আদিব।তার গমনরত পথের দিকে তাকিয়ে জাহানারার সুন্দর মুখ অন্ধকার আচ্ছন্ন হলো।দৃষ্টিতে অস্বচ্ছতা নিয়ে সে বিড়বিড়ালো,
-আই হেইট ইউ টু আদিব আহাসান।
_____________
-মা কিছু খেয়ে নাও। ঔষধ খেতে হবে।
-কানের গোড়ায় ঘ্যান ঘ্যান করিস না তো।যা এখান থেকে।
তৃপ্তির উপর খেঁকিয়ে উঠলো তানিয়া। তৃপ্তি মায়ের ঝাড়ি খেয়ে চোখ মুখ গোটাল। খালার দিকে তাকালো।জিনিয়া চোখের ইশারায় তাকে কে আশ্বস্ত করলো যে, সে দেখছে। তৃপ্তি খালার কথায় আশ্বস্ত হলো।সরে গেল ঘর থেকে।জিনিয়া বোনের গায়ে হাত বুলিয়ে বোঝানোর সুরে বলল,
-আপা রাগ ফেলে এবার কিছু মুখে দাও।কাল রাতে কিছু মুখে তোলো নি ,সকালেও কিছু খেলে না,এখন বাজে দুপুর দুইটা, এতসময় না খেয়ে আছো, আবার বলছো খাবে না। এমন করলে হয়! শরীর খারাপ করবে তো!
-শরীর খারাপ হোক।মরে যায় আমি।এত অপমান সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। আল্লাহ আমার মরণ করুক।
-আপা!ওসব কথা কেন বলছো।জানো না এসব বলতে নেই। আল্লাহ নারাজ হয়।
জিনিয়ার কথা শেষ হতেই দরজা টোকা পড়লো।জিনিয়া পিছন ফিরে তাকালো।তানিয়ার মনে হয়েছিল ছেলে এসেছে হয়ত নিজের কাজের সাফাই দিতে। কিন্তু তাকে নিরাশ করে শামীম ঢুকলো ঘরে।তানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-তুই কি ছোট্ট বাচ্চা!কি শুরু করেছিস!রাগ হয়েছে বুঝলাম কিন্তু এর সাথে খাওয়ার সম্পর্ক কি।আর তাছাড়া আমি তো তোর রাগ করার কোনো কারণ দেখছি না।তুই অনেক বছর আগে বাবা মা’র সাথে যা করেছিস তোর সাথে তাই হচ্ছে।একে বলে কর্মফল, এখানে তো তোর রাগ করার প্রশ্নই ওঠে না।
শামীমের ধা’রা’লো তীরের নেয় কথা।জিনিয়ার সামনে এভাবে বলায় লজ্জায় অপমানে কুঁকড়ে গেল তানিয়া। দিপ্তীর বিয়ের পর থেকে একাধিক বার আত্মীয় স্বজনের মুখ থেকে সে শুনেছে,”মা বাবা পালিয়ে বিয়ে করছে মেয়ে তো করবেই”।এসব কথা শুনে শুনেই তৃপ্তি আর আদিব কে সবসময় নিজের চোখে চোখে রেখেছে।নিয়ম শৃঙ্খলার বেড়া জালে আটকেছে। সবসময় চেষ্টা করেছে তারা যেন দিপ্তীর মতো কিছু না করে।অথচ তার ছেলে তার চেষ্টা প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তাকে আবার দাড় করিয়েছে পুরোনো কাঠ গড়ায়!ছোট করেছে তাকে সবার সামনে।
-চুপ চাপ ওঠ।খেতে চল।ঐদিকে তোর বর, মেয়ে তোর জন্য না খেয়ে বসে আছে।আর তুই এখানে গুম হয়ে বসে আছিস!ওঠ।চল।
-তুমি যাও আমি যাবো না।
গো ধরে বলল তানিয়া।
-তানি!আমাকে রাগাস না কিন্তু। এখুনি ওঠ।ওঠ বলছি।কি হলো ওঠ…!
শামীমের ধমকা ধমকিতে এক প্রকার বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়ালো তানিয়া।পা বাড়ালো শামীমের পিছু।তার প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে আদিবের প্রতি রাগ,অভিমান আরো গাঢ় হলো।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো ছেলেকে তার কাজের জন্য সে কখনো মাফ করবে না।