Saturday, August 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 5



অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৬

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৫৬
“আমি বিয়ে করতে পারবো না৷
“বিয়ে করতে পারবো না মানে কি?
” মানে আমি আপনাকে বিয়ে করবো না৷ আপনার বাবা মা যদি আপনাকে আমার হাতে তুলে দেয় তবেই আমি আপনাকে নিজের করে নেবো নয়ত কোনদিন না৷ আপনার বাবা মা জন্মের পর থেকে আপনার জন্য যা, যা করেছে সেসবের বিনিময়ে তাদের অসম্মান আর লজ্জা উপহার দিবেন? বাসায় চলে যান৷
“নয়না বলল,ভাইয়া আপনি একদম সঠিক কথা বলেছেন৷ আগে ফুপ্পিকে রাজি করাতে হবে। তাদের মানিয়ে তবেই বিয়ে৷
” রেজা বলল তাহলে এখন কি করবো?
“কি করবো মানে কি? অনিকেত ভাইয়াকে নিয়ে আমরা সবাই ফুপ্পির বাসায় যাবো৷
” অনিকেত বলল,যদি মানা করে দেয়?
“মানা করলে একশবার যাবেন৷ একবার দুইবার, কতবার মানা করবে শুনি? কাউকে সারাজীবনের মত নিজের করতে চাইলে আঠার মত লেগে থাকতে হয়। যাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে বলে,দিয়ে দিলাম নিজেকে তোমায়।
” নাহিদ বলল,রেজা তুই জিতেছিস। ভাবির মত বৌ পেয়েছিস।আচ্ছা শোন তোরা যা আমাকে বাসায় যেতে হবে ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। শোন আপডেট জানাবি কিন্তু ।
“রেজা বলল,শালা তোর ইম্পর্ট্যান্ট কাজ বলতে তো ভাবির ঝাড়ি খাওয়া যাহহহ৷
” ভালো বৌ পেয়েছিস তো তাই বুঝিস না৷ আমার মত বৌয়ের মত বৌ পেলে বুঝতি জীবনে প্যারা কাকে বলে৷
“প্যারা হলেও ভালোবাসা। যাহহ ভাবির কাছে যা৷
” আসি ভাবি। আর হ্যা এরপরের বার আমাদের বাসায় যাবেন কিন্তু।
“জ্বি ভাইয়া ইনশাআল্লাহ যাবো৷
” নাহিদের সাথে সবাই একসাথে বের হলো৷
নাহিদ নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পরলো৷
“জিয়ান বলল,তোমরা গাড়ি নিয়ে এসেছো?
” হুম।
জিয়ান চুপচাপ কিছু একটা ভেবে নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ,তুমি শিউর তুমি ফুপিকে রাজি করাতে পারবে?
“কেন আপনি শিউর না? আপনার ফুপু আপনি তো আমার চেয়ে ভালো চিনবেন৷
“তুমি আমাকে আপনি করে কেন বলো!আমি তোমার পার্সোনাল প্রপারটি সো সব সময় তুমি করে বলবে। আর একবার আপনি করে বললে খবর আছে।
” আহাগো এতো বড় এক দামড়া বেডারে আমি তুমি করে বলবো! এই শিক্ষা আমি পাইনি৷ আর কয়টার খবর মিস্টার প্লেন ড্রাইভার?
“আহাগো বাটার মাশরুম। তুমি হাঁটুর বয়সী এমনি এমনি বলি!তোমার কর্মকাণ্ড দেখলে যে কেউ বলবে। শুনো তুমি আমার তিন কবুল পরা বৌ অতএব আমি যা বলবো সব তোমার শুনতে হবে!না শুনলে কিন্তু থেরাপি চলবে চুমু থেরাপি৷
” আপনি তো আমার কবুল বলা ছাড়া হ্যাসবেন্ড আপনার কথা আমি কেনো শুনবো!
“আহারে ময়নার মা। তোমার বাবা নিজে তোমাকে আমার কাছে শপে দিয়েছে৷ এখনো কানে বাজে তোমার বাবার মুখের কথা, আমি মাহবুব তালুকদার আমার একমাত্র কন্যা সুনয়না তালুকদারকে নাজিম চৌধুরির বড়পুত্র জিয়ান রেজা চৌধুরীর সাথে দশ লাখ বায়ান্ন টাকা মোহর ধার্য করিয়া বিবাহ দিচ্ছি।
” তারপর কি হয়েছে?
“তারপর আর কি কাজি সাহেব বলল,বলো বাবা আলহামদুলিল্লাহ কবুল। আমিও বললাম আলহামদুলিল্লাহ কবুল। এইতো তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে গেলে সারাজীবনের জন্য। ওয়েট তুমিও তো পর্দার ওপাশ থেকে কবুল, কবুল বলেছিলে। সো আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে৷
” অনিকেত পাশ থেকে বলল,তোরা তোদের প্রেম বাড়িতে যেয়ে করিস। যেখানে সেখানে পিরিত করার বৈধতা নেই। লজ্জা রাখ শা’লা৷
“নয়না বলল,ভাইয়া জানেন কি হয়েছে?
” কি হয়েছে বনু?
“আমরা তো বাসায় সবাই টেনশন কি হবে নীলাঞ্জনা আপি পালিয়ে গেলো। হঠাৎ আমার বাপ আমার হাত ধরে বলে,তোমার বিয়ে হয়ে গেছে নয়না৷ কিছু নেয়ার থাকলে ব্যাগ গুছিয়ে নাও তোমাকে একটু পর যেতে হবে। আমি তো এইকথা শুনে সব শোক ভুলে হাসিতে ফেটে পরলাম৷ ওই মূহুর্তে এরচেয়ে বড়জোক্স আমার কাছে আর কিছু মনে হয়নি৷
“জোক্সও সত্যি হয়ে গেছে তাই না?
” এরচেয়ে বড় শকড কি ছিলো জানেন?
“কি?
” এই প্লেন ড্রাইভার সয়তান বেডা সবার মাঝখান থেকে আমাকে টানতে টানতে গাড়িতে নিয়ে এসে ফেলেছে৷ গাড়ির দরজা বন্ধ করতেই আমি অজ্ঞান।
“থাক বনু সে-সব আর মনে করতে হবে না। মনে করো ওই ঝড় এসেছিলো তোমাদের এক করতে। সেই ঝড় তোমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছিলো।
” নয়না আর কোন উত্তর দিলো না৷ গাড়ির গ্লাসের বাহিরে দৃষ্টি স্থীর করলো।

🌿সায়নাদের বাসায় এসে সবাই নাস্তা করলো৷
“জিয়ান বলল,ফুপ্পি ও আমার ফ্রেন্ড অনিকেত মাহমুদ। আমরা ওরজন্য সায়নাকে পছন্দ করেছি৷ তোমার আপত্তি না থাকলে এগোতো পারি৷
” তা বাবা করো কি তুমি?
“ডাক্তার। বিএসএমএমইউ মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে কর্মরত। আর অবসরে দুটো চেম্বারে রোগি দেখি।
” কিসের ডাক্তার তুমি?
“কার্ডিওলজিস্ট।
“বাবা, মা, ভাই, বোন মানে ফ্যামিলি ব্যাকরাউন্ড কি?
” অনিকেত থমকালো সে এই প্রশ্নটাকেই ভয় পায়৷
“নয়না বলল ভাইয়ার পুরো নাম অনিকেত তালুকদার। আমার বড় ভাই।
” সায়নার মা খুশি হয়ে বলেন তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই এই বিয়েতে৷
“অনিকেত শান্ত স্বরে বলল,আমার বাবা, মা, ভাই,বোন কেউ নেই আমি একা।জানিনা ওনারা পৃথিবীতে আছেন কি না! আমি এতিমখানায় বড় হয়েছি৷ বাকিটা আপনার উপর ডিপেন্ড করছে৷
” সায়নার মা চুপ করে থাকলো কিছু সময় এরপর নিরবতা ভেঙে বলল,তোমরা যাও আমি পরে ভেবে চিন্তে জানাবো।
“অনিকেত বলল,আপনার উত্তর না হলেও আমরার বিন্দুমাত্র মন খারাপ হবে না। আমার সব আছে কিন্তু পিতৃ পরিচয় নেই৷ এই সমাজে আমারা মূল্যহীন। আজ আসি আন্টি কষ্ট দেয়ার জন্য দুঃখিত। অনিকেত উঠে বের হয়ে গেলো৷
” জিয়ান নয়নাও পেছনে পেছনে বের হলো৷
“অনিকেত বলল,রেজা তোর কাজ হয়ে গেছে তুই বের হ৷ আর আমাকে স্বান্তনা দিতে হবে না৷ বাস্তবতা মেনে নেয়ার মত ম্যাচিউরিটি আমার আছে৷ নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলল,কিউট বনু তুমি কিন্তু লাকি গার্ল। রেজা ছেলে হিসেবে তো ভালোই তবে হ্যাসবেন্ড হিসেবে বেস্ট। সব সময় একে অপরের ছায়া হয়ে থেকো৷ সম্পর্ক মজবুত রাখে বিশ্বাস, ভরসা। কখনো এই দু’টো হারাতে দিও না।অনিকেত চলে যেতেই জিয়ান নয়নাকে বলে,তাড়াতাড়ি চলো তো।
” আরেহহহ আমরা যাচ্ছি কোথায়?
“হানিমুনে যাচ্ছি।
” আহাগো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন আপনার প্লেন আপনাকে ড্রাইভিং করতে ডাকছে। সো তার কাছে ছুটে যেতে হবে সে খেয়াল আছে।
“দরকার পরলে তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো৷ হানিমুন হবে বিমানের ককপিটে৷
“আহাগো শখ তো কম না।
” শখ কম হবে কেন শখ তো বহুত।
“চলুন বাসায় যাবো।
” উঁহু বাসায় না। তোমার সাথে নিরিবিলি প্রাকৃতিতে কিছু হৃদয়স্পর্শী কথোপকথন আছে৷ যেখানে শুধু তুমি আমি আর আমাদের হৃদয়ের কথা হবে।
“আপনার বাসার রুফটফ কি কম নিরিবিলি!তাছাড়া সাউন্ডপ্রুফ রুম, রুমের মধ্যে দরজা বন্ধ করে বুঝি হৃদয়ের কথা বলা যায় না!
“উঁহু রোমান্টিক কথা বলার জন্য রোমান্টিক প্লেস লাগে বেব। হাঁটুর বয়সী তো তাই তুমি এসব বুঝবে না৷
“আমাকে হাঁটুর বয়সী না বলে,নিজেকে কাকুর বয়সী বললেই তো পারেন।
” কি বললে আমি কাকুর বয়সী! আঠাশ বছরের যুবক দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম ক্যাপ্টেন জিয়ান রেজা চৌধুরী।
“সতেরো বছরের জলন্ত রূপবতী কিশোরী সুনয়না চৌধুরী।
” উফফ আমিও তোমার রুপে জ্বলতে চাই।
“নয়না কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,ছুঁয়ে দিলেই জ্বলে যাবেন৷আমি আগুন কন্যা।
” জিয়ান নয়নার কাছ ঘেঁষে বলে,দুষ্ট বৌ তুমি ছুঁয়ে দিলে আমি জ্বলন্ত অগ্নিগিরি। আমার উত্তাপে তুমি ভস্ম হয়ে যাবে৷ ছুয়ে দাও বেব।
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৫

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৫৫

নিজের বোনের লাশের পাশে বসে আছে অন্তর। একজন ভাইয়ের জন্য এর চেয়ে বড় যন্ত্রণার আর কী হতে পারে? মেয়ে হলে নিশ্চিত অন্তর এখন হাউমাউ করে কাঁদত। পুরো হাসপাতাল ভারী হয়ে উঠত অন্তরের আত্মচিৎকারে। কিন্তু ছেলে মানুষ যে এভাবে কাঁদতে পারে না! কষ্টে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসে, বুকে ব্যথা হয়; তবুও শব্দ করে কাঁদে না তারা। অন্তর রিতুর মুখটা সাদা কাপড়ে ঢেকে দিল। তার বোন, যাদের জন্য মারা গেল, তারা তো এখনো জীবিত! আচ্ছা, এই সমাজে বিচারব্যবস্থা এত দুর্বল কেন? ধর্ষক দিব্যি ঘুরে-ফিরে মাথা উঁচু করে বাঁচে। আর ভিকটিম হয়তো সুইসাইড করে, নয়তো বেঁচে থাকলে সমাজের মানুষগুলো তাদের মেরে ফেলে!
জাহিন অন্তরের সাথে সাথে সবকিছু সামলে নিচ্ছে। রিতুকে কবরস্থ করে এসে অন্তরের পাশে বসল। অন্তরের চোখে তখন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা, হৃদয়ে দহনের অনল। জাহিন অন্তরের কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই এভাবে ভেঙে পড়লে আঙ্কেল-আন্টিকে কে সামলাবে?”
অন্তর হঠাৎ জাহিনের গলা চেপে ধরে বলল, “তোর বেড়াল কী করছিল সেই স্থানে?”
জাহিন ঠান্ডা মাথায় বলল, “তুই কি পাগল হয়েছিস! ম্যারিনো বাসায়। পৃথিবীতে একরকম দেখতে বেড়ালের অভাব নেই!”

“তাহলে রিতু তোর নাম কেন নিতে চাইছিল?”

“রিতু আমাকে ভালোবাসে, তুই জানিস তো। হয়তো শেষবার আমার সাথে কথা বলতে চাইছিল। বিশ্বাস কর, রিতু বেঁচে থাকলে আমি রিতুকেই বিয়ে করতাম। তুই নিজেকে সামলে নে, আমি রিতুর সাথে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ একত্র করি। এদেরকে ছাড়ব না।”

“আমি কী করে নিজেকে সামলাব! আমার ফুলের মতো নিষ্পাপ বোনটাকে ওরা কলুষিত করেছে। মেরে ফেলেছে আমার বোনটাকে। ওই তো সেদিন আমার বোনটা ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরল। আমাকে মান্নাতের সাথে কথা বলতে হবে। হতে পারে, যারা মান্নাতের সাথে এই জঘন্য কাজ করেছে, তারাই রিতুর সাথে এমনটা করেছে। আমার বোনটা ফুটে ওঠার আগেই ঝড়ে গেল। পৃথিবীতে থাকা মানুষ নামক পশুগুলো বাঁচতে দিল না আমার বোনটাকে।”

“ওদেরকে আমি ছাড়ব না। বাসায় চল।”

🌿

সায়না নয়নার সাথে কথা বলা শেষ করে মিতা বেগমের রুমের দিকে চলে গেল। নয়না খাবার শেষ করে উঠে বসল, সুন্দর দেখতে একটা জলপাই রঙের শাড়ি পরল। চুলগুলো আঁচড়ে বেণী করে নিল। ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগাল। আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে সরে এল। আবার গেল আয়নার সামনে। ড্রেসিং টেবিল থেকে কাজল তুলে চোখে লাগাল। শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে হিজাব ঠিক করে নিল।
পেছন থেকে মেহনুর বলে উঠল, “বয়স কম হলেও ছেলে বশ করার কলাকৌশল ঠিকই জানো দেখি।”
“আপু, আপনি!”
“তা, এত সাজগোজ করে কোথায় যাচ্ছ?”
“ওনার সাথে একটু বাইরে বের হব।”
“তুমি কি এই সংসার সামলাতে পারবে?”
“পারব না কেন? না পারলেও ধীরে ধীরে শিখে নেব।”
“তোমার বরকে খুশি করতে পারো তো?”

নয়না শক্ত গলায় বলল, “এসব কেমন কথা, আপু! আমার বর আর আমার মধ্যকার বিষয় নিয়ে কথা বলার আপনি কে? আমরা কে কাকে কতটুকু খুশি করতে পারব, সেটা আমরা দু’জন জানলেই হবে। আমার দেরি হচ্ছে, আমি বের হব।”
“তো, তোমাকে ধরে রেখেছে কে?”
“আমার রুম থেকে আমি চলে যাব, আপনি কী করবেন?”
মেহনুর বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল, “বয়সের চেয়ে কথার ধার বেশি। এঁচড়ে পাকা মেয়ে।”

নয়না রুমের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল। মেহনুর আর জাহিন—এই দুটো মানুষকে ঠিক বুঝতে পারে না নয়না। উদ্ভট লাগে দু’জনকেই।মিতা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দু’জনে বেরিয়ে পড়ল।

সায়না বলল, “ভাবি, তুমি তোমার দেবকে বোঝাবা।”
“এত পাগল হয়ে যাচ্ছ কেন? পুরুষ মানুষ যদি একবার বুঝতে পারে তুমি তার জন্য পাগল, তাহলে সে তোমাকে মূল্য দেবে না। নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখে তারপর প্রেম-ভালোবাসা।”
“কিন্তু ওই ডাক্তারকে আমার চাই-চাই।”
“বুঝলাম, চাও; তাই বলে উন্মাদ হওয়া যাবে না।”
“আচ্ছা, ভাবি, এখন থেকে কম কম ভালোবাসা প্রকাশ করব।”

নয়না জিয়ানকে কল করল।জিয়ান নয়নার কল কেটে দিয়ে ব্যাক করল। এই বিষয়টা ভালো লাগে নয়নার। পুরুষ মানুষের ছোট ছোট কাজেও যত্ন লুকিয়ে থাকে।নয়না রিসিভ করে বলল, “আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, মেরি জান। কতদূর এসেছ?”
“আগে বলুন, সকাল-সকাল আমাকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?”
“নাহিদের সাথে দেখা করলাম, সেখান থেকে নাহিদকে নিয়ে অনিকেতের বাসায় এসেছি।”
“তো, বলে যাওয়া যায় না বুঝি?”
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে, তাই ডিস্টার্ব করিনি। আচ্ছা, শোনো, তুমি ভিডিও কল করো। আমিই করছি।”

“ভিডিও কল কেন?”
“দেখতাম বউটাকে কেমন লাগছে। সেই সকালে এক নজর দেখে এসেছি, এখন তো মন পোড়ে দেখার জন্য।”
“আহাগো। শুনুন, আমি তো আসছি, সরাসরি দেখতে পাবেন। মোবাইলে দেখতে হবে না।”
“হবে না কেন! আমি দেখবই।”
“কী বাচ্চামো করছেন! আপনি কিন্তু পাইলট রেজা চৌধুরী, ভুলে যাচ্ছেন?”
“তোমার কাছে আমি শুধুই তোমার হ্যাসবেন্ড, যে কখনো তোমার কাছে বাচ্চাদের মতো আবদার করবে, আবার কখনো রোমান্টিক বরের মতো আদরে ভরিয়ে দেবে।”
“চুপ করুন, পাশে সায়না আছে তো। মুখে কিছু আটকায় না?”
“এমন কী বললাম! আমি কি বলেছি তোমাকে কোলে নিয়ে ঠোঁটে চুমু খেতে ইচ্ছে করে? নাকি বলেছি তোমার কোমড়ের তিলটা আমাকে আকর্ষণ করে? নাকি বলেছি…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই নয়না বলল, “চুপ করুন, বেশরম লোক।”
“বউয়ের কাছে আবার কিসের শরম! শরম তো সব লুটিয়ে দিয়েছি তোমার ওপর, বউ।”
“আপনি শুধরাবেন না?”
“কোনো চান্স নেই, উল্টো বিগড়ে যাব। সামলাতে পারবে তো?”
“আপনাকে আমি কেন সামলাব! আপনি কি ফিডার খাওয়া বাচ্চা নাকি!”
“ফিডার খাওয়া বাচ্চা না হই, পুরো আস্ত বউকে খেয়ে ফেলা রোমান্টিক বর তো।”

নয়না খট করে কল কেটে দিল। লোকটার মুখে কিছু আটকায় না। যা মুখে আসে, তাই বলে!সায়না বলল, “এত লজ্জা পেতে হবে না, পিচ্চি ভাবি। আমি এসব কিছুই শুনিনি। আহা, কী রোমান্টিক প্রেম! তবে জানো, আম্মু কী বলে?”
“কী বলে, ফুপ্পি?”
“বিয়ের প্রথম বছর থাকে রসমালাইয়ের মতো প্রেম, দ্বিতীয় বছর থাকে মিষ্টির মতো প্রেম। এরপর পুরো জীবন করলার মতো।”

নয়না হেসে বলল, “দারুণ কথা তো। তবে একসাথে থাকতে থাকতে তো একজন আরেকজনের অভ্যাস হয়ে যায়।”
“সবার হয় না। বর্তমানে যে হারে ডিভোর্স বেড়েছে! কেউ কম্প্রোমাইজ করতে রাজি না। অথচ কম্প্রোমাইজ না করলে বিবাহিত জীবন মেন্টেন করা যায় না। যেকোনো একজনকে হালটা ধরতেই হয়। সবাই এখন বেটার খুঁজে, যাকে পেয়ে যায়, তার কদর কমে যায়।”নয়না বলল, “হয়তো।”
গাড়ি এসে অনিকেতের বাসার সামনে থামল।🌿
অনিকেত কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, “দেখ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি বিয়ে করব না। আমি সিরিয়াসলি বলছি, আমি বিয়ে করব না। আর করলেও আমার মতো অসহায় কাউকে করব। আমি ছেলে মানুষ, সফল একজন ডাক্তার, তারপরও আমাকে যদি রিজেক্ট হতে হয় পিতৃপরিচয়ের জন্য, তাহলে আমার মতো অবস্থানের মেয়েদের কী ফেস করতে হয়!”

“এসব ইমোশনাল কথাবার্তা বাদ দে। আমি ফুপির সাথে কথা বলব। তোকে সায়না ভালোবাসে, তোর ওকেই বিয়ে করতে হবে।”
“আমি তো ভালোবাসি না। কারণ আমি ভালোবাসার সীমারেখা জানি।”
“তুই মিথ্যে বলছিস। তুই জানিস, তুই ভুল। সায়নাকে তুই অল্প হলেও মনে জায়গা দিয়েছিস। নিজের মনের সাথে কেউ মিথ্যে বলতে পারে না!”
“আমি বিয়ে করব না।”
সায়না রুমে ঢুকেই বলল, “মগের মুল্লুক তো বিয়ে করবে না! বিয়ে করতেই হবে। আজ এক্ষুনি বিয়ে করব। ভাইয়া, কাজিটাজি কী কী লাগে, নিয়ে আসুন। আজ ডাক্তার অনিকেত মাহমুদের সাথে সায়নার বিয়ে। ব্যাস, এরপর আর কোনো কথা শুনব না।”

#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৪

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৫৪
সকালের আধো আলো এসে নয়নার মুখে পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুললো নয়না। পুরোপুরি ঘুমের রেশ কাটেনি। নয়নার ঘুমকাতুরে নিভু নিভু চোখ নিয়ে হাত দিয়ে জিয়ানকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু তার পাশে কেউ নেই! দ্রুত চোখ খুলে ফেললো। হঠাৎ যেন ঘুম গায়েব হয়ে গেল। কোথায় গেল মানুষটা? গায়ে কম্ফোর্ট টেনে নিজেকে ঢেকে নিলো। বেডের পাশ থেকে শাড়ি তুলে গায়ে জড়িয়ে নিলো। দ্রুত বেড থেকে নেমে কভার্ড থেকে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায়, করিডোরে খুঁজলো। না পেয়ে সোজা নিচে চলে এলো।

মেহনুর তখন পাউরুটিতে মিক্সড ফ্রুট জ্যাম লাগাচ্ছে। একজন সার্ভেন্ট দাঁড়িয়ে আছে, আর কেউ নেই টেবিলের আশপাশে। নয়না সার্ভেন্টের উদ্দেশে বলল, “বাকিরা সবাই কোথায়?”
মেহনুর পাউরুটি থেকে একটা বাইট নিলো। পাউরুটি চিবোতে চিবোতে বলল, “আম্মি আর আঙ্কেল হাসপাতালে। তুমি কাকে খুঁজছো?”

“রেজা কোথায়?”
“রেজা বাসায় নেই?”
“না,” বলেই নয়না উপরে চলে এলো।

বেডের ওপর বসলো মুড অফ করে। নিজের ফোনটা বের করে জিয়ানকে পরপর কয়েকবার কল করলো। ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স নেই। রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে। নয়না আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে ভালোভাবে লক্ষ করলো। দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, “আপনি চলে গেলে আমি থাকবো কী করে! আপনাকে যে খুব মিস করবো, মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। আজকে দিনটা তো আমাদের হওয়ার কথা ছিল। কোথায় গেলেন আপনি? চলে আসুন প্লিজ। মিস ইউ।” নয়নার চোখের পাপড়ি ভিজে উঠলো চোখের জলে। হঠাৎ তার চোখে পানি কেন এলো! নয়না নিজেও বেশ অবাক হলো!

একজন সার্ভেন্ট ট্রেতে করে নয়নার খাবার নিয়ে এলো। খাবার রেখে বলল, “বড় সাহেব আপনাকে নাস্তা করে রেডি থাকতে বলেছেন।”

“রেজা?”
“জ্বি, বৌমনি।”
“কখন বলল? রেজা কোথায় বের হয়েছে এত সকালে?”
“তা তো জানি না। যাওয়ার সময় বলে গেছেন। নাস্তা করে নিন।”

নয়না সোফায় বসে ট্রের দিকে তাকাতেই অবাক হলো! তার পছন্দের সব খাবার! ক্ষীর, লুচি, মুচমুচে পরোটা, ঘন দুধ চা। সাথে ফ্রেশ অরেঞ্জ জুস। পাশে রাখা দুটো ডার্ক চকোলেট। নয়নার পছন্দের ব্রেকফাস্ট। নয়না মনে মনে বলল, “আচ্ছা, কেউ কি এত ভালোবাসতে পারে? না বলতেই মনের কথা পড়তে পারে? আসলেই কি ভালোবাসা এত মধুর হয়! এসব কোনো কল্পনা নয় তো? নাকি আমার পড়া উপন্যাসের কোনো অধ্যায়? যদি এমনটা হয়, তবে আমি চাই এই কল্পনা কখনো শেষ না হোক। যুগ যুগ আমি উপন্যাসের এই অধ্যায়ে আটকে থাকতে চাই।”

একজন সার্ভেন্ট রুম গোছাচ্ছিল। সে বলল, “বৌমনি, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে? গরম করে এনে দিব?”
“না, দরকার নেই।”
“আমি আসি, বৌমনি। দরকার পড়লে ডেকে পাঠাবেন।”
“জ্বি, অবশ্যই।”নয়না মুচমুচে পরোটা চায়ে ডুবিয়ে খেতে খেতে ভাবছে, “আচ্ছা, মাত্র সতেরো বছর বয়সে আমি এমন স্বপ্নের মতো জীবন পেয়ে গেলাম! এই জীবনের আয়ু কত যুগ হবে?” এভাবে ভাবার বাজে অভ্যাস নয়নার। এসব ভাবনার মাঝে ধুম করে একজন রুমে ঢুকে বলল, “আগুন জ্বলছে আমার মনে, আর তুমি নাস্তা করছো সঙ্গোপনে!”
“আপনি?”
“কিসের আপনি? ননদকে কখনো আপনি বলতে হয় না, ডিয়ার ভাবি। তুমি করে বলো।”

“কী করেছি আমি?”
“এটাই তো সমস্যা, ভাবি। তুমি কেন কিছু করছো না! তোমার তো কিছু করা উচিত।”
“কী করা উচিত, কী বলছো তুমি?”
“ইশ, নিব্বি ভাবি পেয়েছি! আমার চোখ দেখে মন পড়তে পারে না।”
“বুঝিয়ে বলো, তাহলে আমি বুঝবো।”
“আচ্ছা, নাস্তা শেষ করে বোঝাচ্ছি।”নয়না ক্ষীর দিয়ে লুচি খাচ্ছিল। এটা তার খুব প্রিয় একটা খাবার। বাঁ হাতে ফোনটা নিলো জিয়ানকে কল করতে। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে জিয়ানের টেক্সট: “জান, নাস্তা করে সুন্দর টুকটুকে বৌ সেজে রেডি হও। আজকে তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো।”

নয়নার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। মন ভালো করার জন্য প্রিয় মানুষের ছোট একটা টেক্সট বা একটা কল যথেষ্ট। কী অদ্ভুতভাবে আমরা নিজের সুখ অন্যের কাছে দিয়ে দিই!
“হাসছো কেন, ভাবি? তোমার এখন প্রেম করতে হবে না। দ্রুত খেয়ে আমার বুকের আগুন নেভাও।”
“যদি নেভানোর বদলে আগুনে ঘি ঢেলে দিই?”
“জ্বলে আঙার হয়ে যাবো।”
নয়না হেসে বলল, “এত ব্যাকুলতা ভালো না, মেয়ে।”
🌿
অন্তর কোনোভাবেই কোনো প্রমাণ ধরে রাখতে পারছে না। সব প্রমাণ কেমন অদ্ভুতভাবে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। যে তিনজনের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল, তাদের ডিএনএ ম্যাচ করে রিপোর্ট রেখেছিল, কিন্তু এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না! এই কক্ষে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ আসে না, জানেও না এখানে কী থাকে। তাহলে কি জাহিন আর রাফির মধ্যে কেউ গাদ্দারি করছে? জাহিন তো ক্লিনিকে, বাকি রইলো রাফি। অন্তর নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল, “আমার বোনের সাথে অন্যায়কারীকে সাহায্য করা কেউ ছাড় পাবে না। অন্তর বেঁচে থাকতে কিছুতেই না।” অন্তর চোয়াল শক্ত করে আন্ডারগ্রাউন্ডে অবস্থিত রুম থেকে বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরালো। মেইন রোডের সাইডে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে অন্তর। সিগারেট শেষ না করেই ছুড়ে মারলো, সামনে-পিছে না তাকিয়ে।

তুষির হাতে শপিং ব্যাগ। তুষি “মাগো” বলে চিৎকার করলো। তুষির গলার আওয়াজ পেয়ে অন্তর পিছু ফিরলো। তুষি অগ্নিদৃষ্টিতে অন্তরের দিকে তাকিয়ে বলল, “অসভ্যতা করার আর জায়গা পাননি? সকালবেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসভ্যতা করছেন? বাড়িতে কি মা-বোন নেই নাকি?”
অন্তর নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। তুষির গলা চেপে ধরে বলল, “বাড়িতে মা-বোন আছে বলেই অসভ্যতা কাকে বলে তা দেখাতে পারলাম না।”
ততক্ষণে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। অন্তর দ্রুত গলা ছেড়ে দিয়ে বাইক নিয়ে পালিয়ে গেল, উৎসুক জনতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই। তুষি চিৎকার করে বলল, “আরে, দাঁড়িয়ে দেখছেন কী? গুন্ডাটাকে ধরুন।”
ততক্ষণে অন্তর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। দর্জির দোকান থেকে ড্রেস আনতে গিয়েছিল তুষি। হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গিয়েছিল। তুষি ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, “আরেকবার পাই তোকে, তারপর বোঝাবো তুষি কী চিজ।”
🌿
লাবিব জেলে আজ কতদিন। সে বাসার খাবার খায় না কতদিন হলো। কতদিন হলো মায়ের ভালোবাসা পায় না। রাগে চোয়াল শক্ত করে বলল, “তোকে আমি শান্তিতে থাকতে দেবো না, নীলাঞ্জনা। তুই আমার জীবন ধ্বংস করে কী করে শান্তিতে থাকিস, আমি দেখে নেবো। একবার শুধু বের হই এই কারাগার থেকে, তোর সব সুখ কেড়ে নেবো।”

নীলাঞ্জনা মাথা নিচু করে বসে আছে। শিল্পি বেগম রেগে আছেন। নীলাঞ্জনা প্রেগন্যান্ট, এটা শুনেই তিনি রেগে গেছেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “কয় মাস হলো?”
“দু’মাস।”
“তোর লজ্জা করলো না! এখন তোর এই বাচ্চাকে কী করবি? নষ্ট করা ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই। আমার গর্ভে এমন মেয়ে জন্ম নিলো! তোর মাথায় কোনো জ্ঞান নেই? বিয়ে করে মাস পেরোতে না পেরেই প্রেগন্যান্ট। যা করেছিস করেছিস, আজ সন্ধ্যায় আমি ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি। এটাকে এখানেই শেষ করে ফেল। এমনিতেই ডিভোর্সি মেয়ে, তার ওপর এক বাচ্চার মা হলে আর কেউ নেবে?”
নীলাঞ্জনা গর্জে উঠলো, “আমার বাচ্চা এই পৃথিবীতে আসবে। তাকে আসতেই হবে। আমার আর কাউকে লাগবে না। লাগলে ভিক্ষা করে মানুষ করবো। তবুও আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবো। পারবো না আমি আমার নিজের সন্তানকে হত্যা করতে।”

শিল্পি বেগম ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন নীলাঞ্জনার গালে। “এতই যখন শখ, তখন এত সুন্দর, টাকাওয়ালা ছেলে রেখে গাঁজাখোরের কাছে কেন গেলি? পালিয়ে গেলে মানুষ এমন কারো কাছে যায়, যে পরবর্তীতে বড় কথা বলতে পারে। দেখো, এরজন্য আমি গিয়েছিলাম। তুই কী করেছিস, বংশের মুখে চুনকালি দেওয়া ছাড়া? তোর কথা শুনবো না, সন্ধ্যায় আমার সাথে যাবি।”
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫৩

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৫৩
নয়নার চোখে ঘুম নেই। তার পাশে যে ব্যক্তি শুয়ে আছে, সে আসলে কে? নয়না নিজের মোবাইল নিয়ে করিডোরে চলে এলো। ডায়াল লিস্ট থেকে তুষির নম্বর বের করে তাকে কল করলো।
তুষি কল রিসিভ করে বলল, “এত রাতে জামাইয়ের সোহাগ ছেড়ে আমাকে মনে পড়লো কেন, ম্যাডাম?”
“টেনশনে আছি।”
“তোর টেনশন মানে আজগুবি চিন্তা। তা, কী নিয়ে টেনশন?”
“বিয়ে তো করিসনি, বুঝবি কী করে? বিবাহিত মেয়েদের কত শত টেনশন থাকে!”
“চুপ কর, বুড়ি! এমনভাবে বলছে, যেন ওর পাঁচ-দশটা বাচ্চা আছে। কী বলবি, বল।”
“আসলে কীভাবে বলবো, বুঝতে পারছি না।”
“গোলগোল না ঘুরিয়ে সোজাসাপ্টা বলে ফেল। আমার সঙ্গে কথা বলতে এত ভাবতে হয়?”
“আসলে জানিস তো, তোর দুলাভাই আর তার ছোট ভাই জমজ।”

“তাতে কী?”
“এখন আমি বুঝবো কী করে কোনটা কে? একই ড্রেস পরলে কীভাবে বুঝবো?”
“এটা বোঝা কোনো ব্যাপার হলো?”

“দুজন মানুষের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আমি কীভাবে বুঝবো কোনটা কে?”

তুষি নয়নার কথা শুনে বলল, “এতদিন স্বামীর বগলদাবা হয়ে থেকে এখন বলছিস কীভাবে চিনবি? বলদি, তোর স্বামীর শরীরের ঘ্রাণ তুই চিনতে না পারলে কেমন বউ তুই? বেঁচে আছিস কেন এখনো? যা, কচুগাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়।”

“চুপ থাক, ভুষি! তুই আমাকে বুদ্ধি না দিয়ে অপমান করছিস। যা, লাগবে না তোর পরামর্শ।” বলেই খট করে কল কেটে দিলো।

নয়না কীভাবে বোঝাবে তার কনফিউশন কী নিয়ে? আচ্ছা, দুজন মানুষ একই ড্রেস পরা, একই চেহারা, একই কণ্ঠ! আমি কীভাবে আলাদা করবো তাদের? নয়না চোখ বন্ধ করে জিয়ানকে অনুভব করার চেষ্টা করছে। মনে মনে বলল, “আচ্ছা, আজকের কিস আর এতদিনের কিসের টেস্ট মেলালেই তো বোঝা যাবে, আমার সঙ্গে আসলটা নাকি নকলটা!” নয়না আবার চোখ বন্ধ করে গভীর মনোযোগ দিয়ে অনুভব করতে লাগলো।

জিয়ান চোখ বন্ধ করে নয়নার কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করছিলো। এবার চোখ খুলে বলল, “কী করছো? ধ্যান, নাকি তপস্যা? নাকি কোনো সাধনা করছো?”
“টেস্ট করার চেষ্টা করছি।”
“কিসের টেস্ট?”
“চুমুর টেস্ট।”

জিয়ান নয়নার হাত ধরে টান দিলো। নয়না রাগী চোখে তাকিয়ে বলল, “কী অসভ্যতা করছেন? ছাড়ুন। একদম আমাকে স্পর্শ করবেন না।”

জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “এমন করছো কেন? জ্বিনে-টিনে ধরেনি তো আবার?”

“চুপ করে থাকেন, একদম কোনো কথা বলবেন না।”

“আরে, বুদ্ধু, আমাকে চিনতে পারছো না? আমি তোমার প্লেন ড্রাইভার।”

নয়না জিয়ানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল, “জানি না, আমার মনে কেন কনফিউশন তৈরি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনি জাহিন। সত্যি করে বলুন, আপনি কে?”

“আমি কে মানে? এতদিন আমার সঙ্গে থেকেও আমার স্পর্শ চিনতে পারছো না? আচ্ছা, এখনই আমার স্পর্শ অপরিচিত মনে হচ্ছে? আমি ফিরে আসলে তো ভুলেই যাবে আমাকে। নাহ, এমন ভোলা-মনা বউ রেখে কাজে যাওয়া মুশকিল। এখন কি ছেড়ে দেবো জব? ঘরে বসে বউ পাহারা দেবো? এছাড়া আর কোনো অপশন দেখছি না আপাতত।”

নয়না জিয়ানের অনেকটা কাছে এলো। হঠাৎ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জিয়ানকে। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জিয়ানকে জড়িয়ে রেখেছে, যেন জিয়ান কোথাও পালিয়ে যাবে।

জিয়ান নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “বাটার মাশরুম, আমি শুধু তোমার প্লেন ড্রাইভার। আমি ছাড়া অন্য কারো সাহস নেই তোমাকে টাচ করার। যদি কেউ এমন দুঃসাহস দেখায়, তাহলে তাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো।”

নয়নার মনে বিশ্বাস জন্মালো, এটা তার পাইলট রেজা চৌধুরী। তার দেহ-মন জানান দিচ্ছে, তার মানুষটাকে সে জড়িয়ে ধরে আছে। নয়নার চোখ ভিজে উঠলো নিজের অজান্তেই।

জিয়ান নয়নাকে নিজের কাছ থেকে আলাদা করে বলল, “এই পাগলি, কাঁদছো কেন? আমি ছাড়া তোমাকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। তুমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত ফুল, যার সৌরভের মাদকতায় একমাত্র আমি আসক্ত হবো। আমি ছাড়া এই সৌরভে মুখরিত হতে পারবে না। তুমি শুধুই আমার অর্ধাঙ্গিনী। কাল চলে যাবো, এখন এভাবে কাঁদবে জান?”
“জানি না, আমার মন মানছে না। এসব কিছু কাকতালীয় মনে হচ্ছে! তুমিই বলো, জাহিন ভাইয়া ওই রাতে একই ড্রেসে কীভাবে এলো? আর কেনই বা এলো? সে জানলো কীভাবে আমরা সেখানে আছি? এতসব কাকতালীয় কীভাবে হয়? তুমি চলে গেলে আমি এই বাসায় থাকবো না। আমার জাহিন ভাইয়াকে মোটেও পছন্দ না।”
“আচ্ছা, বুঝলাম। আমি চলে গেলে তুমি তোমার বাসায় থেকো। এখন সব বাদ দিয়ে কাছে এসো। একদম কাছে এসে বুকে মাথা রাখো। মিশে যাও তোমার মানুষের সঙ্গে।”

নয়না জিয়ানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। জিয়ান নয়নাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। নয়নার মাথায় চুমু দিয়ে বলল, “পিচ্চি, একটা কিউট বউ পেয়েছি। সবকিছু নিয়ে ওভারথিঙ্কিং করে। এই যে পিচ্চি বউ, এইটুকু মাথায় ইয়া বড় লম্বা-লম্বা চুল। এতটুকু মাথায় এত প্রেশার দেওয়া চলবে না। তুমি জিয়ান রেজা চৌধুরীর অর্ধাঙ্গিনী। আমি বেঁচে থাকতে তোমার কাছে আসার সাহস কারো হবে না।”

নয়না জিয়ানের বুকে আলতো করে চুমু দিচ্ছে। জিয়ান নয়নার কানে ফিসফিস করে বলল, “কী গো, বউ, আগুনে ঘি ঢালার কাজ করছো কেন? উত্তাপ বাড়ালে কিন্তু তোমাকেই শান্ত করতে হবে।”
নয়না লজ্জা পেলো। আলতো কামড় বসিয়ে দিলো জিয়ানের বক্ষে। জিয়ান এক ঝটকায় নয়নাকে ঘুরিয়ে তার উপর ঝুঁকে নেশালো কণ্ঠে বলল, “আই নিড ইউ। এই মুহূর্তে আমার তোমাকে চাই, একদম পুরোপুরি।”

নয়না নিজেও বেসামাল হচ্ছে। শক্ত করে খামচে ধরলো বেডশিট। জিয়ান নয়নার গলায় মুখ ডুবালো। রাতের অন্ধকারের সঙ্গে মিলিয়ে যেতে লাগলো একজোড়া কপোত-কপোতী।

🌿

জাহিন হাসপাতালের বেডে হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সে যা চায়, তা ঠিক নয়, কিন্তু তার মন তাকে দিয়ে তা করাচ্ছে! আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সারাজীবন নিঃসঙ্গ থাকবো, ঠিক চাঁদের মতো।” জাহিন হঠাৎ কিছু একটা ভেবে হাসলো। তার হাসির কারণ কী, সেটা ঠিক বোঝা গেল না।অন্তর জাহিনের জন্য ছুটে এসেছে। জাহিনের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “কী হয়েছে তোর?”

“আরে, বলিস না। রিতুর সুইসাইড কেসের তদন্তের জন্য বেরিয়েছিলাম। এরপর ভাইয়ার সঙ্গে দেখা। তাকে বাঁচাতে গিয়ে সামান্য লেগেছে। ঠিক হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি, তেমন গুরুতর আঘাত নয়। রিতুর কী অবস্থা?”

অন্তর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হয়তো আর বাঁচবে না। আমার হাসিখুশি বোনটা এখন মৃত্যুর পথে। আমি ভাই হয়ে কিছু করতে পারছি না।”

“তুই টেনশন করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই ভেঙে পড়লে চলবে না।”

জাহিনের বিরক্ত লাগছে অন্তরকে। হঠাৎ তার একা থাকতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর এমন কোনো স্থানে যেতে, যেখানে তার ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। মানুষের উপস্থিতি তার সহ্য হচ্ছে না।

অন্তর চলে গেলো। তার হাতে সময় নেই। জাহিন নিজের ফোন বের করে কাউকে কল করলো। দু’মিনিট কথা বলেই ফোনটা ছুড়ে ফেললো।কর্তব্যরত নার্স দ্রুত এসে বলল, “কোনো সমস্যা, স্যার? আপনার কিছু লাগবে?”

জাহিন গর্জে উঠে বলল, “এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বের হয়ে যান, নয়তো মেরে ফেলবো।”

নার্স ঘাবড়ে গেলো। রুম থেকে বের হয়ে ডাক্তারকে ইনফর্ম করলো। ডাক্তার নাজিম চৌধুরীকে কল করলো। নাজিম চৌধুরী মাত্র বাসায় ঢুকেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে এলেন। তার এই ছেলেটাকে তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না। ছোটবেলা থেকেই খুব জেদি আর একরোখা। কখন যে কী করে, কিছুই জানা যায় না। বাবা হয়েও ছেলের সম্পর্কে তিনি তেমন কিছুই জানেন না!
#চলবে

নবপূর্ণিমা পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৭(অন্তিম)

সালমান দরজায় ঢুকতেই বুঝতে পারলো।
ঘরের পরিবেশ এক অদ্ভুত নীরবতায় মোড়ানো।
ডাইনিং টেবিলের এক কোণে হালিমা বেগম বসে আছেন, মুখটা কুঁচকে, চোখে কেমন একটা দুঃখ আর অভিমান মিশে আছে। তার চোখে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে নেন।
সালমান বুঝে যায়-সকালবেলার ঘটনাগুলো এখনো তার মায়ের মনে গেঁথে আছে। তিনি অভিমান করেছেন, আর আজকের রাতের খাবারটা সেই নীরব অভিমানের সাক্ষী। খেতে বসেও হালিমা বেগম টু শব্দও করলেন না।
সবকিছু যেন বোবা ভাষায় বলছে—“তুমি আজকে আমার হয়ে কথা রাখোনি!”
খাওয়ার পর সালমান এগিয়ে যায়, ধীরে গিয়ে বসে পড়ল মায়ের পায়ের কাছে।
একটু ঝুঁকে আদুরে ভঙ্গিতে ডাক দিলো,
– “মা।”

হালিমা বেগম মুখ ফিরিয়ে নিলেন, কথা বললেন না।

সালমান এবার তার কণ্ঠে কোমলতা মিশিয়ে আবার বলল,
– “মা, একটা কথা বলবো? রাগ করে থেকো না… শুধু শুনো।”

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলল সে,
– “তুমি জানো? তুমি আমার জীবনের সেরা মা। কিন্তু একটা প্রশ্ন করবো? যেটা তুমি তোমার সময়ে পাওনি, সেটা তুমি অন্য কাউকে দিতে চাও না কেন? তুমি তো বলো, মায়ের মতো কেউ হয় না। তুমি তো নিজে ভালো, কিন্তু কেন নিজের ভেতরে এখনো অতীতের সেই কষ্টের পাথর বয়ে বেড়াচ্ছো?”

হালিমা বেগম চোখ তুলে তাকান ছেলের দিকে। এরপর বেশ রাগীস্বরে শুধালেন,
“বউ এর হয়ে সাফাই গাইতে এসেছিস? এমন কবে হলি তুই?”
সালমান হাসলো। হেসে শুধায়,
“এটাকে সাফাই গাওয়া বলে না মা। সেটা তুমি নিজেও জানো।”
হালিমা বেগম মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রতিত্তর করে,
“আমি ছোট বাচ্চা না। আমাকে কিছু বোঝাতে আসিস না। আমি রুমে যাবো। ছাড় আমায়।”
সালমান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো হালিমা বেগমকে। এরপর আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“গল্প তো প্রতিদিনই হয়। আজ নাহয় বাস্তবতা নিয়ে হোক।”

“আমার দরকার নেই। তুই সর।”

সালমান ছাড়ে না। সে তার আগের কথা চালিয়ে যায়,
– “জানি, তুমি অনেক কষ্টে সংসার করেছো। বিয়ের পর দাদু তোমাকে শুধু দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু অধিকার বা ভালোবাসা না। আমি জানি মা, তুমি ভালো থাকতে পারোনি।
কিন্তু তুমি কি সত্যিই চাও, রিমঝিমও তেমনি একটা চাপা রাগ নিয়ে বেড়ে উঠুক? সেও যেন ভবিষ্যতে কারো শাশুড়ি হয়ে বলে—‘আমি পাইনি, ওকে কেন দেবো?’”

সালমান থেমে যায় কিছুক্ষণের জন্য।
তারপর একটু ঝুঁকে মায়ের কোলের কাছে মাথা রাখে।

– “মা, তুমি যদি তোমার কষ্টের চক্রটা এখানেই ভেঙে ফেলো… তাহলে বুঝবে, তুমি শুধু মা নও, তুমি ইতিহাস বদলে দেওয়া একজন নারী। কারণ তুমি সবকিছু বুঝে নিতে পারলে, পরেরগুলোও বুঝে নিতে পারবে। তুমি ভালো থেকো না থেকো, অন্তত পরের কেউ তো ভালো থাকুক।”

সালমানের কণ্ঠের কথাগুলো যেন হালিমা বেগমের হৃদয়ের দেয়ালে ছুরির মতো বিঁধে যায়।
সে চুপ করে যায়, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে একেকটা ঝড় বইতে থাকে।
সে সামনে তাকিয়ে থাকলেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার নিজের অতীত—একটা বিষণ্ন, অপমান আর অবহেলার দিনগুলো।

সে মনে করতে থাকে…

তখন সদ্য বিয়ে হয়ে এসেছে হালিমা। শাশুড়ি একটিবারের জন্যও তাকে বউ বলে গৃহে স্বাগত জানায়নি।
বরং রান্নাঘরে ঢুকেই শুনতে হয়েছিল—
“ঘরের বউ যদি কাজে পারদর্শী না হয়, তাহলে তার জায়গা রান্নাঘরের মেঝেতে, সবার পায়ের নিচে।”
প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই ঘুম থেকে উঠে কাজ সামলাতে হতো।
একদিন বাবার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করায় শুনতে হয়েছিল—
“ঘনঘন এতো বাপের বাড়ি কিসের?শোনো মেয়ে, বাপের বাড়ি টারি ভুলে যাও। বছরে একদিনের জন্য গিয়ে ঘুরে আসবে। এতে বাপের বাড়িতে কদর থাকবে। ”
হালিমা তখন হেসে দিতো। তার ইচ্ছে হতো জবাব দিতে যে -বাপের বাড়িতে মেয়েরা কদরের জন্য যায় বুঝি! কিন্তু সেই জবাব মুখ ফুটে দিতে পারতো না। রিমঝিম এখন সেই জবাব মুখ ফুটে দেয়। রিমঝিমের জবাব দেওয়া দেখে তার নিজের অতীত মনে পড়ে বি’ষ ধরে যায় শরীরে।
তারপর বাপের বাড়ি গেলেও, যাত্রার আগের রাতে দুই-তিন দিনের ডাবল রান্না করে রেখে যেতে হতো, প্রতিটা লোকের জন্য আলাদা আলাদা করে।
তবু ফিরে এসে শাশুড়িরকে প্রতিবেশী আর স্বামীকে বলার সময় শুনত—
“সব কাজ আমি একাই করেছি!”

হালিমা বেগমের বুকটা হঠাৎ টনটন করে ওঠে।
সে তখন অসহায় ছিল। কিন্তু এখন?

তার সামনে এখন একজন মেয়ে, যে তার নিজের ছেলের ঘরের বউ।
সেই মেয়েটাকেই সে নিজের শাশুড়ির মতো আচরণ করে ধীরে ধীরে পিষে ফেলছে!
সে নিজে যতটা কষ্ট পেয়েছে, ঠিক ততটাই অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়ার অজান্তেই প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে!

সে হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পাওয়ার মতো চমকে ওঠে।

“আমি কি এতটাই খারাপ হয়ে গেছি…?”
সে ফিসফিস করে নিজের মনে।

তখনই সালমান তার কণ্ঠে একরাশ ব্যথা মিশিয়ে বলে ওঠে,
– “আমরা কি পারি না, মা?আমরা কি পারি না, রিমঝিমকে তোমার মতো অতীত না দিয়ে, একটা সুন্দর অতীত দিতে?
তুমি কি এতটাই স্বার্থপর, মা?”

এই কথাগুলো যেন হালিমা বেগমের ভেতরটা চুরমার করে দেয়। সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে।
তার ভেতরের কঠিন দেয়ালগুলো যেন একটা একটা করে ভাঙতে শুরু করে।

না, সে আর সেই বিষাক্ত ইতিহাস কাউকে দেবে না।
সে রিমঝিমের ওপর তার নিজের অতীতের রাগ চাপিয়ে দেবে না।
সে জানে, আজ যদি না বদলায়—তবে ভবিষ্যতের আরেকটা হালিমা তৈরি হবে, আরেকটা ছেলের সংসার বিষিয়ে যাবে।

সালমান ধীরে ধীরে মায়ের হাতটা ধরে আদুরে ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
– “আমি যেটা পাইনি সেটা আর কাউকে দেবো না—এটা না ভেবে বরং এটা ভাবো-যেটা আমি পাইনি, তার অভাব আর কাউকে বুঝতে দেবো না। বরং তাকে তার প্রাপ্যটা পূর্ণ করে দেবো, যাতে সে কোনো কষ্ট না পায়।”
একটু থেমে সে আবার বলে,
– “তুমি যদি তোমার শাশুড়ির মতোই হও, তাহলে তোমার আর তার মধ্যে পার্থক্য কোথায়, মা? তুমি তো তারই পথ ধরে হাঁটছো। আর যদি রিমঝিমও এই ব্যথা আর বিষ বুকে জমিয়ে রাখে, তবে হয়তো একদিন সেও তার ছেলের বউয়ের সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। তখন তো এই বি’ষ এক বংশের ভেতর চলতেই থাকবে। একবার ভাবো মা, এই পুরো চক্রে ছেলের বউ হয়ে আসা মেয়েটার দোষ কোথায় থাকে?
তুমি যদি স্বার্থপরতা ছেড়ে দিয়ে অন্যের ভালোটা ভাবো তাহলে এই চক্র এখানেই ভেঙে যাবে। তুমি বরং সব রাগ ভুলে গিয়ে সবার জন্য একটা সুন্দর, উষ্ণ সংসার তৈরি করে দাও, মা…”

এরপর থেমে আবার বলে উঠে,
“তুমি কি বুঝতে পারছো না? তুমি নিজের অতীতের সেই বি’ষ ঢালতে গিয়ে নিজের ছেলের ক্ষতি করছো মা! অন্য মেয়ের সংসার মানে তো সেটা তোমার ছেলের সংসার। সেই মেয়েকে যদি তুমি কষ্ট দাও -সেই মেয়ে যদি অসুখী হয় তাহলে তোমার ছেলে কীভাবে সুখী হবে মা! তুমি একটু স্যাক্রিফাইস করো মা।”
সালমানের কথাগুলো যেন হালিমা বেগমের বুকের দেয়াল ভেঙে দেয়।

তার চোখের কোণে জমে ওঠে দীর্ঘদিনের অভিমান, চাপা ব্যথা, আর একরাশ অনুশোচনার জল।
সে বুঝতে পারে, সত্যিই তো -সে তো নিজের মতো করেই ভালো হতে পারত। কিন্তু না… সে তো অবচেতনেই সেই একই পুরোনো বিষকে বেছে নিয়েছে।
শুধু বদলেছে চরিত্র, বদলায়নি মন।
সে তো ভুলে গিয়েছিল—অন্যের সুখ দেখে জ্বলে ওঠা নয়, নিজের কষ্টের শেষ হোক সেইটুকুই সবচেয়ে বড় জয়।

সালমান মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“তুমি কি আসলেই এতটা খারাপ? মা?

হালিমা বেগম চোখেজল গড়িয়ে পড়ে। আপনমনেই বিড়বিড় করে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠে,
– “ না, আমি খারাপ হতে চাইনি। আমি খারাপ না।”

মায়ের চোখে জল দেখে সালমানের খারাপ লাগে। তবু থামলে তার চলবে না। সে মায়ের হাতের উপর হাত রেখে শুধায়,
“আমি জানি তুমি খারাপ নও। কিন্তু সময় আর অভিমান আমাকে এমন বানিয়ে ফেলেছিল…তাই শুধরে নিয়ে ভালো থাকো মা।”
হালিমা বেগম হুট্ করেই বলে উঠলেন,
“তোর বউকে আমি কষ্ট দেবো না। এবার থেকে ওকে মেয়ের মতোই ভালোবাসার চেষ্টা করব…!”

সালমান শান্ত হেসে মাথা হেলিয়ে বলে,
– “এই তো আমার মা…”

ঘরের কোণার বাতি তখনো জ্বলে। ঘরের বাতাসে তখন কোনো অভিযোগ নেই, শুধু একধরনের নরম উষ্ণতা।
বিষণ্ন ইতিহাসের চক্র ভেঙে এক নতুন ভোর আসার ইঙ্গিত দেয়।একটা সম্পর্ক বুঝে ওঠে—ভালোবাসা কেবল অধিকার নয়, দায়িত্বও।

সেই মুহূর্তে, বাপের বাড়ির বারান্দায় বসে থাকা রিমঝিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কানের পাশ থেকে ফোনটা সে নামিয়ে নেয়। এতক্ষন ধরে একটা সুন্দর কথোপকথন শুনেছে সে। এখন আর প্রয়োজন নেই।
ঠিক তখনই সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে হেসে ওঠে এক ফালি পূর্ণিমা।
তার মুখেও ধরা পড়ে এক শান্ত, হালকা হাসি।
এই তো সে—রিমঝিম।
যে এতদিন কেবল বুঝে গেছে, কেবল সহ্য করে গেছে।
আজ বুঝেছে, কখনো কখনো নীরব প্রতিবাদই বদলের প্রথম আলো হয়ে ওঠে।

আজ তার জীবনের আকাশেও এক নতুন চাঁদ উঠেছে।
অভিমানের রাত পার করে
তার জীবনেও আজ—”নবপূর্ণিমা”।

সমাপ্ত।
(উঁহু না, আপনাদের কি মনে হয়! হালিমা বেগম সব বুঝে,ওদের সংসার জীবন সুন্দর হবে তো! নো নেগেটিভিটি, অলওয়েজ বী পজেটিভ। অবশ্যই সুন্দর হবে 💙)

নবপূর্ণিমা পর্ব-০৬

0

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৬

আজ যেন রিমঝিম একটু বেশিই অবাক। গোসল শেষে চুল শুকাতে শুকাতে রুমে ফিরতেই দেখে,সালমান খাটের ওপর তার প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে রাখছে। জামাকাপড়, ব্যাগ, স্কার্ফ-সব সাজানো। রিমঝিম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ এমন পরিবর্তন?
নাকি… তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে দিতে চাইছে?
এটা ভেবেই হঠাৎ বুকটা ধক করে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো-না, এমনটা ভাবা উচিত না। হয়তো সত্যিই সালমান শুধরাতে চাইছে।

এমনিও আজ রিমঝিম নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাপের বাড়ি যাওয়ার। কাউকে না জানিয়েই, কারও অনুমতি বা অনুমোদনের অপেক্ষা না করে। বহুদিন ধরে এই বাড়িতে তার ইচ্ছের কোনো দাম নেই। প্রতিবার যেতে চাইলে তাকে অনেক আগেই জানাতে হতো, তাও মাত্র দুদিনের জন্য অনুমতি মিলত।
কিন্তু আজ, অবাক করা ব্যাপার-সালমান নিজেই যেন পথ করে দিচ্ছে তার জন্য।
রিমঝিম চুপচাপ নিজের হাতের ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়।
ধীরে বোরকা পরে নেয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। পিছন থেকে সালমানও অফিসের পোশাকে তৈরি হয়ে নেয়।
তাকে দেখে মনে হয়, যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে।
রিমঝিম আড়চোখে দু-একবার তাকায়। নিজের ব্যাগটা তুলতে যায়, তখনই সালমান চুপচাপ এগিয়ে এসে ব্যাগটা তুলে নেয়।

রিমঝিম কিছু বলে না। এখন এসব নিয়ে কথা বাড়ানোর মানে নেই। সে সোজা এগিয়ে গিয়ে হালিমা বেগমের সামনে দাঁড়ায়। চুপচাপ পায়ের কাছে বসে সালাম করে।

হালিমা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

রিমঝিম একটুও বিস্মিত হয় না। আঘাত পেলেও, অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন।
যে কারণে একসময় সে পায়ে না পড়লে ‘বেয়াদব’ আখ্যা পেত, আজ সেই একই সালামের জবাবে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হয়। সে জানে-এই বাড়িতে তার যেকোনো কাজেই খুঁত ধরা হবে। সে থাকলেও ভুল। না থাকলেও হয়তো ভুল।
তবু আজ, নিজের তুচ্ছ জায়গাটা রিমঝিম ছেড়ে যাচ্ছে সাময়িক শান্তির আশায়।

রিমঝিম পা ছুঁয়ে সালাম করতেই হালিমা বেগম মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা সালমান সেটা স্পষ্ট দেখল। সে চুপ করে থাকতে পারলো না। তার ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো।
সে মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধালো,
“মা, রিমঝিম কয়েক দিনের জন্য বাপের বাড়ি যাচ্ছে।”

হালিমা বেগম মুখ শক্ত করে বললেন,
“যাচ্ছে তো ভালো কথা। কিন্তু অনুমতি তো কেউ নিলো না!”

সালমান অবাক হলো না মোটেও। সে প্রতুৎত্তর করলো,
“আশ্চর্য মা! ওর বাপের বাড়িতে ও যাবে, তাও আবার এতজনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে?”

হালিমা বেগম ভ্রু কুঁচকে শুধালেন,
“এতজন মানে? তুই আমার কথাই বলছিস বুঝি?”

সালমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ মা। আমি আর তুমি-এখানে আলাদা করে অনুমতির কিছু দেখি না। বিয়ে করার পরেও যদি একটা মেয়ে তার নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য ফর্মালিটি মেইনটেইন করে, তাহলে তো সে এখনো এখানে অতিথিই রয়ে গেলো!”

হালিমা বেগম ছেলের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। এমন প্রতিবাদী কথা সালমানের মুখে কখনো শোনেননি তিনি।
তবু নিজেকে সামলে নিয়ে রাগ চেপে বললেন,
“তোমার বউয়ের কি এখানে কদর নেই বুঝি? এখানে যত্ন পাবে না? একটু অসুস্থ হলেই বাপের বাড়ি ছুটছে-এই হচ্ছে এখনকার বউ!”

রিমঝিম পাশে দাঁড়িয়ে হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ, যত্ন তো অনেকই পাই এখানে। এতটা যে, বাঁচার জন্যই এখন একটু দূরে যেতে হচ্ছে।”

সালমান শুনেও কিছু বলল না। সে হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে বলল,
“রিমঝিমের মতো করে যত্ন তো আর তুমি দিতে পারবে না, মা। তুমি বয়স্ক হচ্ছ। আর মা তো মা-ই—তার নিজের মা নিশ্চয়ই ওকে ভালো করে দেখবে। হয়তো তুমিও বিয়ের পর এমনটিই চেয়েছিলে!”

শেষ কথাটা বলতে না বলতেই হালিমা বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখে এক অদ্ভুত ছায়া নেমে এলো।
মনে পড়ে গেল পুরোনো দিনের কিছু দৃশ্য।
বিয়ের পর যখন বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা উঠত, তখন তাকে জনে জনে বলে অনুমতি নিতে হতো। যতদিনের জন্য যেতেন, ততদিনের রান্নাবান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সব আগেভাগেই সেরে যেতে হতো।
অনুমতি পেতেন দুই দিনের, কিন্তু প্রথম দিনের কাজ শেষ করতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে যেত।
তখন শাশুড়ি বলতেন,
“বাড়ির বউ সন্ধ্যার পর বেরোয় না।”
আর সেই সন্ধ্যায় আর যাওয়া হতো না। পরেরদিন, অল্প কিছু সময়ের জন্য বাপের বাড়ি গিয়ে, মায়ের আঁচলে একটু মাথা রাখতেই আবার ফিরতে হতো শ্বশুরবাড়ির দায়ে, দায়িত্বে।
চোখের পলকে সেই শান্তির মুহূর্তগুলো হারিয়ে যেত।
হাসিমাখা মুখে থাকত গভীর হাঁসফাঁস আর অতৃপ্তির চাদর।
কখনো কাউকে বলেননি, কিন্তু বুকের মধ্যে জমে থাকা হতাশাগুলো আজও ঝরে পড়ে দীর্ঘশ্বাসে।

হালিমা বেগম মনে মনে স্বীকার করলেন,তিনি বিয়ের পর স্বস্তিময় জীবন পাননি, শান্তি পাননি। তাই তার ছেলের বউকেও সেই সুন্দর স্বস্তি জীবন সে চাইলেও দিতে পারবে না। কারণ ছেলে বৌমার সুন্দর মুহূর্ত দেখলে তার আফসোস হবে, বুক হাহাকার করে উঠবে।
হ্যাঁ, এটা অন্যায়—সে জানে। কিন্তু তিনি বদলাতে পারবেন না।
কারণ, যেটা তিনি পাননি, সেটা কাউকে দিতে চাইলেও দিবেন না। তিনি নিজেও নিজেকে খারাপ জানেন, তবুও নিজের খারাপত্ব আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকবেন। তবু নিজেকে আফসোস করতে দিবেন না।

হালিমা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নেন। তার চোখেমুখে একরকম অস্বস্তি। আর ঠিক তখনই সালমান হালকা হেসে বলল,
“যাই হোক মা, নিজের মায়ের মতো তো কেউ হয় না।
যেমন তুমি আমার জন্য সব করো, ঠিক তেমনি তো তোমার মা তোমার জন্য করতেন, আর দাদু – আমার বাবার জন্য। যেমনটা ঠিক এখন আমার জন্য করছো তুমি! তাই না মা?”

সালমানের কণ্ঠে ছিল না কোনো অভিযোগ, ছিল কেবল র দীর্ঘশ্বাস মেশানো সত্যের আর্তি।
হালিমা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। শেষকথাটা যেন তার ছেলে তাকে ইচ্ছে করেই বলেছে।
আজ তার ছেলের কথা, আচরণ, এমনকি দৃষ্টিভঙ্গিটাও যেন তার বোধের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
এই ছেলে তো তার চেনা সেই ছেলেটা নয়- যে ছোট্ট একটা কথায় সব ভুলে গিয়ে মায়ের কথায় উঠে দাঁড়িয়ে যেত, যে কখনো স্ত্রীর পক্ষ নিত না!

তিনি মনে মনে ফুঁসলেন।
‘গেলেই যাক, কয়েকটা দিনের মধ্যেই ছেলেকে তিনি আবার নিজের করে নিবেন। যেমনটা তার শাশুড়ি স্বামীকে করতো। ঠিক তেমন করে তিনিও ছেলেকে হাত করে নিয়ে নিবেন।’
তিনি মনে মনে ঠিক করলেন,আগে যেভাবে মুখ করে তাকে নিজের পক্ষে নিয়ে এসেছেন, আবারো তাই করবেন।

সালমান মায়ের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসলেন।
তার চোখে যেন এক নরম উপলব্ধি,এই মুহূর্তে রিমঝিমকে বাপের বাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্তটা ঠিকই হয়েছে।
উভয়েরই সময় দরকার। একটু নিজের মতো করে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দরকার। যাতে দুদিকেরই উপলব্ধি আসে।

রিমঝিম পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। শুনছে সব,বুঝে নিচ্ছে সবটাই। সে কিছু বলে না। কারণ এ তো এখন তার চিরচেনা অভ্যাস। কিন্তু সালমানেরটা তাকে ভাবিয়ে তুললে।
সে চোখ নামিয়ে নিয়ে চুপচাপ দরজার দিকে পা বাড়ায়।

রিমঝিম গাড়িতে উঠে বসে।
চোখে মুখে কোনো ভাব প্রকাশ নেই। পাশে এসে বসে সালমান, গাড়ি স্টার্ট দেয়।
শব্দ করে কিছু না বললেও রিমঝিমের ভিতরটা অদ্ভুত এক কৌতূহলে ছটফট করছে।
এই সালমানকে সে যেন চিনতেই পারছে না।
প্রতিদিনকার পরিচিত রুক্ষ, একরোখা স্বামীটি যেন আজ অন্য কারো মতো আচরণ করছে।
এত সহজে তাকে যেতে দিচ্ছে! তাও আবার নিজ হাতে ব্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে তুলে—এতটা নম্র আচরণ তার কল্পনাতেও ছিল না। তার উপর মাকে এতো এতো কথা!

গাড়ি চলছে, আর রিমঝিম চুপচাপ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে যাচ্ছে।
মনে মনে সে ভাবে,তার ইচ্ছে ছিল চুপিচুপি চলে আসবে। কোনো বিদায় নয়, কোনো ব্যাখ্যা নয়। এই সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছে বহুদিন ধরে জমে উঠেছিল তার মনে।
কিন্তু মেয়েদের সংসার ফেলে যাওয়া এতো সহজ নয়।

একটা সংসার মানেই শত বাঁধনের টান।
শুধু মানুষ না, জড়িয়ে থাকে স্বপ্ন, অভ্যাস, শিকড়—আর সমাজ নামের কঠিন এক দেয়াল।
যদিও সমাজের মুখগুলোকে সে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু তার মা? মায়ের কান্না, মায়ের উপদেশ, আর সেই মায়ের ইচ্ছার সামনে সে বারবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
আর এই সংসার…
কতটুকুই বা না জড়িয়ে পড়েছে সে!
শুধু রান্নাঘরের গন্ধ নয়, ঘরের প্রতিটা কোণ যেন তার হাতে গড়া।

তাই সে ভাবছিল, কয়েকটা দিন দূরে গেলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা নরম হবে, সালমান ভাববে, বুঝবে।
কিন্তু সালমান এমন করে নিজেই তার জন্য পথ করে দেবে—এইটা তার কল্পনারও বাইরে ছিল।

সে কিছু বলে না।
চোখ শুধু বাইরের দৃশ্যে আটকে থাকে।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার ভিতরটা ফুঁড়ে উঠছে একটাই প্রশ্ন—
এই বদলে যাওয়া সালমান, আজকে কি সত্যিই তাকে বুঝেছে? নাকি সবটাই শুধুই সাময়িক এক শান্তির ছায়া? নাকি এসেই আবার সেই আগের সালমানকেই পাবে! যে শুধুই তার শাশুড়ির ছেলে। তার স্বামী নয়!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

নবপূর্ণিমা পর্ব-০৫

0

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৫

রিমঝিম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুছাচ্ছিল। ঠিক তখনই সালমান রুমে এসে হঠাৎ বলল,
“তুমি চাইলে আজ বাপের বাড়ি যেতে পারো। কয়েকদিন ঘুরে এসো।”

রিমঝিম থমকে গেল। আয়নার ফ্রেমে ধরা নিজের মুখটা যেন কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। গলায় স্পষ্ট বিস্ময় টেনে সে শুধায়,
“কি বললে? আমি যেতে পারি?”

সালমান চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, একটু দূরে গিয়ে নিজের মতো করে থাকো। তোমারও তো বিশ্রামের দরকার।”

রিমঝিম চুপ করে গেল। এটা সেই মানুষ, যে বিয়ের পর তাকে যেন নিজের ছায়ার মতো আগলে রাখতো -কিন্তু সেটা যত্ন নয়, যেন কোনো দায়িত্বে বাধা। সে কোথাও গেলে আগেই জানিয়ে রাখতে হতো, অনুমতির তালগোল পাকিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে না যাওয়াই ভালো -এই ছিল সালমানের অভ্যেস।
বাপের বাড়ি যেতে চাওয়ার মানেই ছিল অজস্র প্রশ্ন, একরাশ অনিচ্ছা, আর কেবল একদিনের অনুমতি, তাও ‘মা’কে একা ফেলে না যাওয়ার শর্তে।
আজ হঠাৎ নিজে থেকেই যেতে বলছে?
কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে… বা নেই। হয়তো আর কিছুই নেই।
রিমঝিম আয়নার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে নেয়। ভেতরে ভেতরে সে জানে, এটা ভালোবাসার স্থানচ্যুতি নয়-মায়ার মুক্তি নয়-এটা একটা সাময়িক ছুটি।

সবকিছুর উর্ধে রিমঝিম ভাবলো, যাবেই। নিজের মনটাকে নতুন করে গুছিয়ে আনার জন্য সময় দরকার। তাই সে শান্ত গলায় বলে,
“ঠিক আছে। আমি যাবো।”

এমন করে হয়তো প্রথমবার-সে কারো অনুমতিতে নয়, নিজের সিদ্ধান্তে হাঁটছে একটা দরজার দিকে।

সালমান ওয়াশরুমে ঢুকে পড়তেই রিমঝিম ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শরীরটায় এখনও ক্লান্তি ভর করে আছে, তবু কোনো এক অদৃশ্য অভ্যাসের টানে সে হাঁটতে শুরু করল রান্নাঘরের দিকে।

চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে তরকারি চড়ে দিল। অন্য হাতে রুটি বানাতে শুরু করল। চুলার আঁচে হাতের রন্ধন আর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘামের বিন্দু -দুটোই একসাথে যেন জ্বলছিল।

এদিকে সালমান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে চারপাশে তাকায়-রিমঝিম কোথাও নেই। রুম ফাঁকা। হালকা অস্বস্তি নিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে এগোতেই চোখে পড়ে-রিমঝিম একা হাতে একদিকে তরকারি নাড়ছে, আরেকদিকে বেলনায় রুটি গড়াচ্ছে।
রান্নাঘরের ছোট্ট জায়গাটা ভরে গেছে চুলার তাপ আর মাটির গন্ধে। কিন্তু তার মাঝেই রিমঝিমের মুখে এক অদ্ভুত নীরবতা।
সালমান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হালকা কণ্ঠে বলে, “তুমি এখানে? শরীর তো এখনও ভালো না।”

রিমঝিম তাকায় না। রুটি বেলতে বেলতে চোখ স্থির রাখে মাটির দিকে। তারপর মৃদু একটা হাসি ঝরে পড়ে তার ঠোঁটে।
সালমানের প্রতুৎত্তর করে,
“তাই বলে নিয়ম ভাঙলে চলে?”
শব্দগুলো স্নিগ্ধ, কিন্তু কোথায় যেন ব্যথা গাঁথা।

সালমান তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সেই চিরচেনা মেয়েটা যেন আজ একেবারে অপরিচিত। তার হাসিটাও যেন কোনো অভিমান পেরিয়ে এখন কেবল অভ্যাসে দাঁড়িয়ে আছে।

“এতগুলো খাবার কেন রান্না করছো?” সালমান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

রিমঝিম থামলো। হালকা অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,
“কেন, এগুলো কি আজ নতুন কিছু?”

“মানে?” সালমান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়।

রিমঝিম একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
“মানে, আমি যখনই বাপের বাড়ি যেতাম, ততদিনের জন্য রান্না করে হিসাব করে রেখে যেতাম। প্রতিদিনের মতো খেতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। তুমি যেন বুঝতেই না পারো আমি নাই।হাহা।”

সালমান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ।
রিমঝিমের বলা কথাগুলো যেন মাথার ভেতর ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে-প্রতিবার যখন সে বাপের বাড়ি যেত, তখন আগেভাগেই হিসেব করে রান্না করে যেতো।
তাই বুঝি সে চলে যাওয়ার পরেও প্রতিদিন সেই একই স্বাদের খাবার পাওয়া যেত?

একটা পুরনো দৃশ্য আচমকাই স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল সালমানের চোখের সামনে-

সেদিন সকালে রিমঝিম বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে।
রাতে অফিস থেকে ফিরে খেতে বসেছিল সালমান। পাশে বসা মা ধোঁয়া ওঠা পাতিল থেকে চামচে করে একে একে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন তার প্লেটে। নিজেও পরে খেতে বসে পড়লেন।

সালমান প্রথম লোকমাটা মুখে নিয়েই থমকে গিয়েছিল।
এই তো সেই চেনা স্বাদ- যা রোজ প্রতিদিন খায়। অথচ, আজ তো রিমঝিম নেই!
তবে কি মা-ই প্রতিদিন রান্না করতেন? মা তো সবসময় এটাই বলতেন।
তখনো সালমান দ্বিধায় ছিল। মন বলত, রিমঝিম এমন নয়। একটা মুরব্বিকে দিয়ে এভাবে সে মোটেও কাজ করাবে না। সে নিশ্চয়ই রান্না করে, কারণ মেয়েটা কখনো অভিযোগ করেনি, কখনো কৃতিত্ব দাবি করেনি।
কিন্তু মা যখন বলতেন, “প্রায়ই আমি রান্না করি। তোর বউ তো সবসময় পারে না”—তখনও একরকম মায়ের কথা বিশ্বাস করেই নিয়েছিল সে।
শুধু কারণ, সেই সময় তার মনটাও একটু একটু করে রিমঝিমের ওপর থেকে সরতে শুরু করেছিল।

আজ, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সালমান নিজেরই স্মৃতিকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

তার মনে হচ্ছে-রিমঝিমই প্রতিবার, প্রতিদিন নিঃশব্দে এই ঘরটাকে আগলে রেখেছিল।
এমনকি নিজের অনুপস্থিতিতেও, তার জন্য রান্না করে যেত, যেন খাবারের স্বাদে কোনো ফাঁক না থাকে।

এত বছর ধরে সেই খাবারে যে মায়া, যত্ন, ভালোবাসার স্পর্শ সে অনুভব করেছে, সেটা তো কারও আদেশে তৈরি হয়নি।
এটা ছিল একান্ত রিমঝিমের নিরব ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

সালমানের বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।
সে চোখ তুলে তাকাল রিমঝিমের দিকে -এক হাতে রুটি বেলছে, আরেক হাতে তরকারি নেড়ে দিচ্ছে।
মুখে হাসি, কিন্তু সেই হাসিতে একটা ক্লান্তির ছাপ।
একটা অপমানিত, অবহেলিত অথচ হৃদয়ভরা স্ত্রীর অসীম সহ্যশক্তির চিহ্ন যেন ফুটে আছে তার চোখে-মুখে।

সালমান আর কিছু বললো না। শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো মনে মনে—
“তাকে আমি কীভাবে দেখেছিলাম এতদিন? যে মেয়েটা নিরবে আমাকে আগলে রেখেছে, আমি তাকেই ভুল বুঝেছি। সত্যিই, আমি মানুষটাকে বুঝতে পারিনি।”

সালমানের মনে হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড়ে। সেদিন রাতে তার মাকে জিজ্ঞেস করার দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠে।
সেদিন রাতে খাবার চিবোতে চিবোতে সালমান থেমে গেল। চেনা স্বাদ মুখে এলেও মনটা কেমন খচখচ করছিল। চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখল মা বসে আছেন, ঠিক আগের মতোই ধোয়া ওঠা পাতিল থেকে খাবার তুলে দিয়েছেন তার প্লেটে।

সালমানের ভুরু কুঁচকে উঠল। কিছু একটা মিলছে না।

সে ধীরে কণ্ঠে শুধায়,
“খুব মজা হয়েছে খাবার… কিন্তু মা, রান্না কে করেছে?”

হালিমা বেগম একটুও না থেমে সোজা জবাব দিলেন,
“আমি-ই তো! এইতো এখনই তো রান্না করলাম। ধোয়া উঠছে,দেখছিস না?”

সালমান চুপচাপ তাকিয়ে রইল। এরপর খানিকটা থেমে আবার বলল,
“কিন্তু প্রতিদিনের মতো একই স্বাদ পাচ্ছি। একটুও হেরফের নেই। এটা কেমন করে সম্ভব?”

মুহূর্তের জন্য হালিমা বেগম থমকে গেলেন। তারপর গলার স্বর কড়া করে বললেন,
“তোর বউ তোরে যা খুশি তাই বোঝায়, আমি বলছি, প্রায়ই আমি নিজে রান্না করি। তাই তো স্বাদ একই পাচ্ছস। তোর বৌ এর প্রতিদিনের কারসাজি তো তোর তো জানাই নেই!”

সালমান তখন তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর না দিলেও আজ হারে হারে সব বুঝতে পারলো। মনে মনে অতীতের পাতা উল্টিয়ে কিছু একটা বুঝতে পেরে তার মধ্যে অনুশোচনা এলো।
সেইসব দিনগুলো, যখন রিমঝিম নিরবে সব দায়িত্ব পালন করতো।
সে বলতো না কিছু, দাবি করতো না কিছু।
তবুও রান্না থেকে শুরু করে ঘর সামলানো-সব কিছুতে ভালোবাসার ছাপ থাকতো।
কিন্তু মা?
তিনি কখনো স্বীকার করেননি,বরং এক ধরনের প্রতিযোগিতা চালিয়েছেন অদৃশ্যভাবে। নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে ছেলের স্ত্রীকে ছোট করতে কোনো কসুর করেননি।

আর সালমান?
সে চুপ থেকেছে। প্রশ্ন করেনি কিছু।চুপচাপ মায়ের কথা বিশ্বাস করেছে। একটা সময়, যখন সন্দেহ হয়েছিল-তখনও স্পষ্ট করে রিমঝিমকে কিছু না বলে মনে মনে কষ্ট পুষে রেখেছিল।
আজ বুঝতে পারছে—সে আসলে ভালোবাসার বদলে অবহেলাকেই পুরস্কার হিসেবে ফিরিয়ে দিয়েছে রিমঝিমকে।
চোখের কোণে একটা দগদগে লজ্জা এসে ভিড় করে।
আর মনে হয়—”আমি নিজেই তো কখনো জানতেই চাইলাম না, কে প্রতিদিন আমার জন্য এই মায়া মেখে রান্না করতো।
আমি যদি একবারও জিজ্ঞেস করতাম, তাহলে কি আজ এতটা দেরি হয়ে যেত?”

সালমান বাস্তবের মধ্যে ফিরে এল। গত রাতের স্মৃতি যেন এক টান দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনল -তখনও রিমঝিম তার প্রতি যত্নবান ছিল, আর সে? তার চোখে ছিল শুধু অবিশ্বাস আর মায়ের প্রতিটি কথা। আজ, সব পরিষ্কার। আজ সে দেখতে পাচ্ছে—রিমঝিম-ই প্রতিবার নিঃশব্দে দায়িত্ব পালন করে গেছে। কাল ডাক্তার যদি রিমঝিমের মেন্টালি ডিসটার্ব এর কথা না বলতো তাহলে হয়ত সে কোনোদিন ঐভাবে রিমঝিমকে খুঁটিয়ে দেখতোই না!

সালমান ভাবনা থেকে বেরিয়ে রিমঝিমের দিকে তাকায়। রিমঝিম তখন অসুস্থ শরীর নিয়ে একে একে টিফিন বক্সগুলো ভরছে। প্রতিটি বক্সে পরের কয়েকদিনের খাবার হিসেব করে গুছিয়ে রাখছে।

সালমান নরম স্বরে শুধায়,
“তুমি কি সত্যিই প্রতিবার এরকম করতে?”

রিমঝিম সংক্ষেপে বলে,
“হ্যাঁ।”

তারপর আর কিছু না বলে ফ্রিজের দরজা খুলে একে একে বক্সগুলো রাখতে শুরু করে। সালমান তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মলিন শ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে রিমঝিমের হাতে আলতো করে স্পর্শ করে,
“তুমি না অসুস্থ? তোমার বিশ্রাম দরকার। এত কিছু করতে যেও না, প্লিজ।”

রিমঝিম একবারও তাকায় না। শুধু শান্ত গলায় বলে,
“তোমার মায়ের জন্য আগামী ক’দিনের খাবার। উনি আর তুমি যেন খাবারের কষ্ট না পাও, এজন্যই করছি।”

ঠিক সেই মুহূর্তে হালিমা বেগম দ্রুত পায়ে এসে হাজির হন রান্নাঘরে।
ছেলেকে বৌয়ের হাত ধরা অবস্থা ময় দেখে তিনি ফুষে উঠেন। চোখে আগুন, কণ্ঠে কটাক্ষের ছোঁয়া ঢেলে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“তুমি কেন অসুস্থ শরীর নিয়ে এসব করতে যাচ্ছ? আমার ছেলের সামনে আমাকে ছোট করে দেখাতে চাইছো? যেন আমি কিছুই করি না?”

রিমঝিম ধীরে ফিরে তাকায়, ক্লান্ত গলায় বলে,
“আম্মা, আমি এমন কিছু বলিনি। আর দেখানোর কিছু নেই, আপনি তো প্রতিবার নিজেই এমন করে সব রেখে যাওয়ার জন্য বলতেন।”

হালিমা বেগম ছেলের দিকে এক পলক তাকান। এরপর রিমঝিমের উদ্দেশ্যে তোতলানো কণ্ঠে শুধায়,
“কখন বলেছি এসব করে রেখে যেতে?” এরপর এর প্রতুৎত্তর রিমঝিমকে দেওয়ার সময় না দিয়ে নিজেই বলে উঠলেন,
“আগবাড়িয়ে এসব করে আর ভালো সাজতে হবে না। যেখানে যাওয়ার সেখানে যাও।”

সালমান চুপ করে সব শুনছিল। এই প্রথম, তার চোখে নিজের মা সম্পর্কে এক অনুচ্চারিত প্রশ্ন জেগে উঠলো।
সে কিছু না বলে ধীরে ধীরে সরে আসে রান্নাঘর থেকে।
ভেতরে কোথাও অদৃশ্য কষ্ট খোঁচা দিচ্ছে।

একসময় যে মা’কে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতো, আজ তার প্রতিটি কথায় প্রশ্ন উঠছে।
আর যে স্ত্রীকে কখনো বোঝার প্রয়োজন মনে করেনি-তার নিঃশব্দ দায়িত্ববোধ আজ বুকের গভীরে গেঁথে যাচ্ছে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

নবপূর্ণিমা পর্ব-০৪

0

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৪

রিমঝিম স্থির দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তোলে সালমানের দিকে তাকিয়ে বেশ শান্তস্বরে শুধায়,

“তোমার না, বিয়ে করা উচিতই ছিল না। তুমি মায়ের ছেলে হয়েছো ঠিকই কিন্তু এখনো মানুষ হওনি, স্বামী হওয়ার তো অনেক পরের কথা।”

তারপর ধীরে তাকায় হালিমা বেগমের দিকে। বিষাদে ভেজা কণ্ঠে শুধায়,
“আর আপনার উচিত ছিল, আপনার ছেলেকে আজও কোলে করে রেখে দেওয়া। কাউকে জীবনের সঙ্গী বানাতে পাঠানো নয়। বিয়ে করিয়ে বড়ো ভুল করেছেন। আর সেই ভুলের খেসারত আমি দিচ্ছি। আমি আপনাদের অভিশাপ দিচ্ছি না। কিন্তু যেদিন আপনার মেয়ের সাথেও কেউ এমন করবে- সেদিন বুঝতে পারবেন, কতোটা অন্যায় করেছেন একজন মেয়ের সাথে।”

রিমঝিনের কড়া কড়া কথায় হালিমা বেগমের চোখ কুঁচকে ওঠে। তিনি ধমকের ভঙ্গিতে বলেন,

“দেখছোস সালমান? তোর বউয়ের জবান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! কত বড়ো সাহস!”

কিন্তু সালমান চুপ। সে শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রিমঝিমের দিকে। চোখে বিস্ময়, অপরাধবোধ আর একফোঁটা অনুশোচনা। এই মেয়েটা – যে দুবছর ধরে মুখ বুঝে সহ্য করেছে, সে আজ এতো শক্ত হয়ে গেল কীভাবে?
এক মুহূর্তে তার মনে পড়ে, প্রথম প্রথম রিমঝিম কেমন ছিল ; নরম, নিঃশব্দ, একটু হাসলেই যেন চোখে আলো পড়ে যেতো। আর এখন? মুখে বিষ, চোখে বিদ্রোহ! ওর এই রূপের গড়ন কি তারাই নয়? সে আর তার মা?

সে নিঃশ্বাস ফেলে। কিছু বলার ছিল, কিন্তু কোনো ভাষা খুঁজে পায় না।

রিমঝিম ধীর পায়ে রুমে চলে যায়। দরজা বন্ধ হয়ে যায় উচ্চশব্দে।

হালিমা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সালমান কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে রিমঝিমের রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মুহূর্তপরে সে যেন নিজেই নিজের অজান্তে কয়েক পা রিমঝিমের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। কণ্ঠে একটুকরো অনুশোচনা ভেসে ওঠে, “রিমঝিম…”

এইটুকু উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই হালিমা বেগম তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে যান। কণ্ঠে রাগ আর অপমানের ঝাঁজ,

“তুই কি পাগল হইছোস সালমান? তোর ওই বেয়াদব বউকে শাসন করবি তা না করে উল্টো ডাকতে ডাকতে ওর পেছনে যাস? ছেলের বউয়ের কথায় এভাবে নত হইতে হয়?ছেলেমানুষ এমন হইলে চলে না।”

সালমান একদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মুখে আর আগের সেই চিরচেনা নির্ভরতা নেই, বরং কিছুটা ক্লান্তি আর স্পষ্ট উপলব্ধি।

“তুমি কি জানো, সে বেয়াদব হয়ে উঠেছে কার জন্য? আমরা তাকে বাধ্য করেছি, মা। তুমি,আমি—আমরাই তো ওর নরম মনটাকে পিষে পিষে এমন বানিয়ে দিয়েছি।”

হালিমা বেগম কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সালমান থামিয়ে দেয়।

“সত্যিই তো! ভেবে দেখেছ কখনো? আজ যদি এটা তোমার মেয়ের সাথেও কেউ বলতো—যে, ‘তুই নিচু জাত’—তখন কি তুমি চুপ থাকতে? তখন কি বলতে, ‘বউদের সব সহ্য করতে হয়’?”

কথাগুলো শেষ করেই সালমান ধীরে হেঁটে চলে যায় রিমঝিমের রুমের দিকে।

হালিমা বেগম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। গলা কেঁপে ওঠে। এরপর বিছানার পাশে বসে হঠাৎ করেই মুখ চাপা দিয়ে বিলাপের মতো কেঁদে ওঠেন।

“ওগো আল্লা, এ আমি কী কইরা ফেললাম! ছেলেও আমারে কথা কইতে ছাড় দেয় না…!”

—–

সালমান রুমে ঢুকতেই রিমঝিমকে এক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। তার চোখে অনুশোচনা। কণ্ঠে এক ধরনের নম্রতা টেনে নিয়ে সে শুধায়,

“রিমঝিম… আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার… ঐরকম রিঅ্যাক্ট করা উচিত হয়নি।”

রিমঝিম ধীরে ফিরে তাকায়। চোখে হতাশা জমাট। কিন্তু কণ্ঠে ক্ষীণ স্থির ঝাঁজ রেখে সে প্রত্যুত্তর করে,

“হিসাব করে দেখো তো? মানুষ ভুল কয়বার করে? এই দুই বছরে তুমি ভুল করছো নিয়ম করে, মাসে নয়—প্রায় প্রতিদিন। তুমি ক্লান্ত হচ্ছ না?”

সালমান ব্যাকুল হয়ে এক কদম এগিয়ে আসে, যেন কাছে গিয়ে বোঝাতে চায়, সান্ত্বনা দিতে চায়। কিন্তু রিমঝিম হাত তুলে থামিয়ে দেয়।

“থাক। আর দরকার নেই। সেই একই নাটক বারবার না করলেও চলবে। তুমি ক্লান্ত না হলেও আমি ক্লান্ত। আমি বিরক্ত, আমি বিদ্ধস্ত। তুমি এখন স্যরি বলবে, তারপর কালকে আবার মায়ের পক্ষ নেবে। আবার বলবে, ‘ক্ষমা করে দাও রিমঝিম’। এসব আর ভালো লাগে না। এবার থামো।”

সালমান স্তব্ধ। কণ্ঠে বিস্ময়ের ছোঁয়া, “আমি নাটক করছি? তুমি এটা বলতে পারলে?”

রিমঝিম কণ্ঠ নামিয়ে ঠান্ডাভাবে বলে, “হ্যাঁ। যদি এভাবে মায়ের আঁচলের নিচে থাকার সিদ্ধান্ত আরো আগে নিতে,তাহলে বিয়ে না করে সেখানেই থেকে যেতে পারতে!” বলেই একটু থেমে দম নেয়। কণ্ঠটা হাল্কা কেঁপে উঠলেও সে নিজেকে সামলে আবার বলা শুরু করে,
“সংসার মানে শুধু বউ নয়, শুধু মা-ও নয়। ব্যালান্স রাখতে হয়, সালমান। প্লিজ এটা বুঝো। আজ যদি তোমার বোনের সাথে এমন কিছু হতো—এক বউ হয়ে তাকে কেউ এভাবে ছোট করতো—তাহলে তুমি ভাই হয়ে এটা কী মেনে নিতে?”

রিমঝিম কথাটা আস্তে বললেও সালমানের মনে হলো ; কথাটার রেশ যেন ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সে চুপ করে রইল।
রিমঝিম আরো কিছু বলতে নেয়ার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতে নিতেই হঠাৎই রিমঝিমের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আসে। সে কপাল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মুহূর্তখানেক। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা লাগে।
সালমান বিস্ময়ে ডেকে ওঠে, “রিমঝিম?”

রিমঝিম কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ তার হাঁটু ভেঙে পড়ে যেতে থাকে। সালমান দৌঁড়ে এসে তাকে ধরে ফেলে, “এই! রিমঝিম! কী হলো তোমার?”

রিমঝিম কোনো উত্তর দেয় না। চোখ বুঁজে আসে।

সালমানের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, “রিমঝিম! রিমঝিম..!”

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

নবপূর্ণিমা পর্ব-২+৩

0

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ২ + ৩

ভোরের আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে। রিমঝিমের ঘুম ভাঙলো কারো ধাক্কাধাক্কিতে। সে তড়িঘড়ি করে চোখ খুলতেই হঠাৎই চারপাশটা চিনে উঠতে একটু সময় লাগে। নিজেকে আবিষ্কার করে ব্যালকনিতে।

রাতে গ্রিলের সঙ্গে মাথা রেখে হয়ত কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে খেয়াল নেই। ভেজা চোখ, ক্লান্ত শরীর আর গুমোট অভিমান হয়ত ঘুমের দিকে টেনে নিয়েছিল।

গ্রিলের কাছে মাথা রেখে ঘুমানোর ফলে কান ধরে ওঠা ব্যথা যেন মাথার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, তবু সে সেই ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে পাশে তাকায়।
সালমান দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে আছে স্পষ্ট।
রিমঝিমকে উদ্দেশ্যে করে ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে,
“আমার অফিস টাইমও তো দেখি ভুলতে বসেছো। বলেছি না, আজ মিটিং আছে? খালি পেটে যেতে হবে দেখছি!”

রিমঝিম হকচকিয়ে ওঠে। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়, মুখে কথার আগা-গোড়া গুছিয়ে বলার আগেই বলে ওঠে,
“আসলে রাতে…”

কিন্তু সালমান তার কথা থামিয়ে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে,
“উফফ, তোমার সেই রাতের ড্রামা শুনতে ইচ্ছে করছে না এখন। আপাতত আমার খাবার চাই।”

এই কথাটা রিমঝিমের বুকে যেন কাঁটা হয়ে বিঁধে যায়। সে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তবু মুখে কিছু না বলে নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
“তুমি একটু অপেক্ষা করো… আমি কিছু বানিয়ে নিয়ে আসছি।”

তার গলার কম্পন সালমান হয়ত শুনতেই পায়নি! সে কাপড় নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে ,আর রিমঝিম হৃদয়ে জমে থাকা অগণিত অপমানের ভার নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
আজ সকালটাও বুঝিয়ে দিল -এই সংসারে ভালোবাসার জায়গা তার জন্য বরাদ্দ নেই। তবু তার নিয়ম করে প্রতিদিনের ন্যায় খাবারের হাঁড়িতে পানি ঢালতে হবে,কারণ – এখানে কান্নার চেয়ে পেট ভরানোটা অনেক বেশি জরুরি।

রিমঝিম চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
শরীর ক্লান্ত, মন ভাঙা, কিন্তু হাত থামলে সংসার থেমে যাবে –
এই ভয়টা এতদিন ধরে পেয়ে এসেছে।

কিন্তু রান্নাঘরের চৌকাঠ মাড়াতেই হালিমা বেগমের কণ্ঠ যেন বজ্রাঘাতের মতো আঘাত হানলো তার কানে,
“মহারানীর অবশেষে ঘুম ভাঙলো বুঝি! আমার ছেলেটার অফিস আছে আর সে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। এখন রান্না করবে কখন? আমার ছেলেটা ক্ষুধার্ত পেটে অফিসে যাবে, এই তো অবস্থা!”

শাশুড়ির কথায় এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস আটকে গেল রিমঝিমের। কথাগুলো মাথার মধ্যে গুঁড়ি মেরে থাকা আবেগগুলোকে জাগিয়ে তুললো।
আজ আর সে নীরব থাকলো না। চোখেমুখে জমে থাকা অভিমান, অপমান আর ক্লান্তির ছাপ নিয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে কড়াভাষায় বলে উঠল,

“আপনার ছেলের দায়িত্ব কি শুধু তার বউয়ের? আপনি তো তার মা! শুনেছি, বউয়ের চেয়ে মায়ের দায়িত্ব আগে। আমি না এলে আপনি করে দিতে পারতেন না?”

মুহূর্তে ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হালিমা বেগম যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না নিজের কানে। একটু থমকে দাঁড়িয়ে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বোঝায় যাচ্ছে, রিমঝিমের মতো নরম মেয়ের কাছ থেকে এমন হুট্ করে জবাব আশা করেননি উনি।

দীর্ঘক্ষন পরে হুঁশ ফিরতেই হালিমা বেগম মুখ ভেংচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন বিলাপের সুরে,
“এই মেয়ে এখন আমার মুখে মুখে তর্ক করে! বাড়ির বউয়ের আওয়াজ থাকার কথা ঘরের ভেতরে, সে এখন রেঁধে খেতে শেখার বদলে আমাকে শেখায়!”

রিমঝিম শীতল গলায় জবাব দিল,
“আমার আওয়াজ বাইরে যায়নি আম্মা। আপনার আওয়াজই তো পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে।”

হালিমা বেগম থেমে গেলেন। নরম মেয়ে হুট্ করে এমন শক্ত হয়ে উঠাটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না।

রিমঝিম আর কোনো কথা বাড়াল না। চুপচাপ পা টেনে রান্নাঘরে চলে গেল। কিন্তু আজ তার ভেতরের নীরবতা আর আগের মতো নিষ্ক্রিয় না, বরং যেন তাতে জমাট অভিমান আর একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত জন্ম নিয়েছে।
এইভাবে আর নয়। যে ক’দিন আছে, নিজেকেই ভালোবাসবে। নিজেকেই গুরুত্ব দেবে।

রিমঝিম হাতে তুলে নিল সবজিগুলো। দুয়েকটা মেনু নয়, বরং সে আজ কয়েক পদ রান্না করলো।
নিজের পছন্দের মতন, যত্ন করে, সময় নিয়ে।
সে জানে, এই ঘরে তার কথা কেউ ভাবে না।
তাই এবার সে নিজেকে নিয়েই ভাববে।

রান্না শেষ করে, সালমানের জন্য খাবার সাজিয়ে দিল।
সালমান গম্ভীর মুখে এসে বসলো।vঅফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে আর কাউকে ডাকলো না সে। এমন কি হালিমা বেগমকেও না।
চুপচাপ তাড়াহুড়োয় সে খেতে লাগলো।
না কোনো অভিযোগ, না কৃতজ্ঞতা।
শুধু নিজেরটা বুঝে নেয়া,এটাই যেন তার অভ্যাস।

রিমঝিম একটুও পাত্তা দিল না এই নীরব প্রতিক্রিয়াগুলোকে। সালমান খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতেই রিমঝিম চুপচাপ নিজের প্লেট নিয়ে টেবিলে বসে পড়লো।
ধীরে ধীরে আয়েশী ভঙ্গিতে খেতে খেতে একসময় হালকা একটা ঢেকুর তুললো। শরীর একটু শান্তি পেলেও, মন ততটা না।bতবু একটা গভীর প্রশান্তি তার চোখে মুখে – নিজের হাতে রান্না করে, নিজের জন্য খাওয়া – সেই অধিকারটুকু আজ সে ছিনিয়ে নিয়েছে।

ঠিক তখনই হালিমা বেগম ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। চোখে তীব্র কৌতূহল আর অভিমান।
দীর্ঘ সময় কেউ না ডাকায় তিনি নিজেই আজ আগবাড়িয়ে বের হলেন।
আর বেরিয়ে দেখলেন- রিমঝিম টেবিলে একা বসে খাচ্ছে।
আর নিজের মতো করেই সন্তুষ্টিতে ঢেকুর তুলছে।
হালিমা বেগম আশেপাশে দৃষ্টি দিলেন। ছেলে তার কোথাও নেই। তার মানে! সালমান আজ একা একা খেয়ে বেরিয়ে গেছে! তাকে একবার ডাকলোও না!
তিনি আপন ভাবনায় মশগুল হলেন, তার ছেলেকে এই মেয়ে রাতে কিছু করেনি তো? নাহয়, সকালে উঠে এতো ফটর ফটর করে কোন সাহসে! বিয়ের এই দুইবছর তো কোনোদিন চোখ তুলে কথা বলেনি – সেই মেয়ে আজ এতো কথা! তার উপর, ছেলে আজ তাকে একটাবার খাওয়ার জন্যও ডাকলো না!
এসব ভেবে মনের মধ্যে ছেলের উপর অভিমান আসতেই মুহূর্তে তিনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন। এতো সহজে তার মা ভক্ত ছেলেকে ঐদিকে নিতে দেওয়া যাবে না। আসুক আজ সন্ধ্যায়। আপাতত এখনেরটা দেখা যাক।

হালিমা বেগম এগিয়ে গেলেন। তাদের চোখাচোখি হলো।
কিন্তু আজ রিমঝিম চোখ সরিয়ে নিল না। সে আপনমনে খেতে ব্যস্ত। চোখের ভাষায় যেন স্পষ্ট বলে দিল –
“এবার আমি আমার মতো করে বাঁচবো।”

হালিমা বেগম ধীরপায়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এলেন।
রিমঝিম তখনো নিজের প্লেট থেকে শেষ খাবার তুলছে মুখে।

হালিমা বেগম চেয়ারে বসে পড়েই বলে উঠলেন,
“কাল এই বাড়িতে তামাশা কম হলো নাকি! আর তুমি আজ দেখি আগে আগে খেয়েও নিচ্ছো! যাও তো, আমার নাস্তা আনো দেখি!”

রিমঝিম মুখে শেষ গ্রাসটা গিলে নিয়ে শান্ত স্বরে শুধালো,
“কিসের নাস্তা?”

“মানে? আমি খাবো না?” -চোখ কুঁচকে উত্তর দিলেন হালিমা বেগম।

রিমঝিম মৃদু হাসলো, কিন্তু সে হাসির নিচে চাপা পড়া অভিমানটা স্পষ্ট।
“আপনি খাবেন?”

“কী বলতে চাইছো তুমি? আমার সাথে মশকারা করছো তুমি?”

রিমঝিম এবার স্পষ্ট গলায় বলল,
“কাল রাতে আপনি আমাকে খেতে দেননি। এমনকি ইঙ্গিতে বলেছিলেন, আমি নিচু জাত। তাহলে সেই নিচু জাতের রান্না করা খাবার খেলে তো আপনার গায়ে লাগতেও পারে! তাই, আপনার কথা ভেবেই আজ আপনার জন্য কিছু বানাইনি, আম্মা।”

হালিমা বেগম থ হয়ে গেলেন। এমন কথা শোনার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রাগে আবার মুখ খুললেন,
“বাড়াবাড়ি কইরো না। যাও, আমার খাবার দাও।”

রিমঝিম এবার আর একচুলও সরলো না। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আপনি কি অসুস্থ আম্মা?”

“মানে?”

হালিমা বেগমের প্রশ্নে রিমঝিম স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“আপনার তো হাত-পা দিব্যি সবল আছে, আম্মা। নিজের জন্য কাজ করুন। কারণ যখন বয়স হবে, আর হাত-পা অবশ হয়ে যাবে – তখন কেউ এসে থালায় সাজিয়ে খাওয়াবে না। তখন আপনার এই অহংকারও আপনাকে ভাত তুলে দেবে না।”

এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো টেবিলে। রিমঝিম প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

রিমঝিম চেয়ারে বসেই একবার তাকালো হালিমা বেগমের দিকে। নিজেকে ছোট করে আর কারো অহংকারের খাদ্য হতে দেবে না সে।
সে প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে উঠল,
“যাকে আপনি ছেলের বউ করে আনতে চাইছেন, সে ভুল করেও কখনো কোনো অচল মানুষকে টেনে বাঁচাবে না, আম্মা। আপনার শরীর যদি একদিন চলতে না পারে, তখন সে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে।”

হালিমা বেগম বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। মুখে কোনো শব্দ নেই।

“আমি সব জানি। আপনি যা লুকিয়ে রেখেছেন, তা অনেক আগেই জেনেছি। চিন্তা করবেন না, এই অসুস্থ পরিবেশে আমি আর বেশিদিন থাকবো না। আপনার উদ্দেশ্য সফল হোক, এটাই চাই। ততদিন… দয়া করে আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। নাহয়, আমি অন্য ব্যবস্থার সাব্যস্ত হবো।”
কথাটা বলেই রিমঝিম ধীরে ধীরে টেবিলে রাখা বাকী খাবার প্লেটে তুলে নিল।

হালিমা বেগম চেয়ারে বসা অবস্থায় ঘামলেন। নীরবতার ভেতর চামচের আওয়াজও তখন যেন তার কাছে কর্কশ মনে হচ্ছিল।

রিমঝিম সব গুছিয়ে নিজের প্লেট নিয়ে সে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। পিঠ সোজা, চোখে জল নেই, কিন্তু বুকের ভেতর কষ্টটা জমে জমে শক্ত হয়ে উঠেছে।
নিজেকে সে আজ একটু বেশিই ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

‘সবসময় নরম থেকে জীবন চলে না।
কারো সম্মানের জন্য নিজের অপমান মেনে নেওয়া দুর্বলতা নয়—কিন্তু বারবার একই জায়গায় নিজেকে হারানোটা বোকামি।’

হালিমা বেগম চুপচাপ রিমঝিমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
রিমঝিমের হেঁটে চলে যাওয়া, দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ,সবকিছু যেন এক অলিখিত চাবুক হয়ে এসে আঘাত করলো তাঁর গায়ে।

সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছিল ঘরের কোণায়।
রিমঝিম একা বসে ছিল টেবিলের পাশে।
চোখের সামনে আচারের বয়ামগুলো সারি করে সাজানো।
একটা একটা করে ঢাকনা খুলে যাচ্ছিল আর একটা একটা থেকে চামচ তুলে মুখে দিচ্ছে। লেবুর আচার, আমের আচার, ঝাল কুল, আর নিজের হাতে বানানো মিষ্টি টক জাম। সবগুলো থেকে পরপর চামচ মুখে পুরে তৃপ্তির সহিত ঢেকুর তুলছে।
সে নিঃশব্দে আপনমনে খেয়ে যাচ্ছে।
“চলে যাবো যখন,আমার হাতে বানানো কিছু দিয়ে অন্যরা মুখ মিঠা করবে, সেটা কেন হবে?”
ভাবনাগুলো কাঁটার মতো খচখচ করছিল বুকের ভেতর। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সে পরপর আচারভর্তী চামচ মুখে তুলছে।

হঠাৎ…একটা থা’প্পড় এসে সজোরে পড়ে গালে।

তার চোখ কেঁপে উঠল। আচারের একটা বয়াম টেবিল থেকে পড়ে গড়িয়ে গেল। মেঝেতে ঠুকে “টুক” করে একটা শব্দ হলো।
সে ধীরে ধীরে চোখ তুলতেই দেখে সালমান দাঁড়িয়ে আছে। রক্তচোক্ষু দৃষ্টিতে চেহারায় ঘৃণা নিয়ে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

কিন্তু রিমঝিম কেঁদে উঠল না। চোখ ভর্তি জল নিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। না কোনো প্রশ্ন,না প্রতিবাদ।
শুধু গালে লালচে ছাপটা জ্বালিয়ে যাচ্ছে হাল্কা।
সেই যন্ত্রণার চেয়ে বড় যন্ত্রণা ছিল এই নীরব অপমান – যেটা সে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম।)

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৩

সালমান গর্জে উঠল,
“তুমি আম্মার সাথে এরকম কেন করেছো?”

রিমঝিম স্থির চোখে তাকিয়ে শুধায়,
“কি করেছি?”

“কী করেছো জানো না?”

রিমঝিম শান্ত গলায় বলে,
“তুমিই বলো, কি করেছি আমি?”

“মায়ের জন্য রান্না করোনি কেন?”

রিমঝিম এবার চোখে একরাশ হতাশা নিয়ে বলে,
“তোমার আম্মা আমাকে খাবার ছাড়া রেখেছে একদিন। আমাকে নিচুজাত বলেছে। মুখে মুখে তর্ক করা মেয়ে বলেছে। সেই বেয়াদব মেয়ের হাতের রান্না খেতে তার গায়ে লাগবে না? তাই করিনি রান্না।”

সালমান রেগে গলা চড়িয়ে বলে,
“কি বড়ো মুখ করে সেটা বলছো! লজ্জা করছে না?”

রিমঝিম হালকা হেসে, গলার নিচে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা ঠেলে বলে,
“সব লজ্জা বাড়ির বউদেরই কেন হবে, সালমান?”

সালমান এবার এক ধাপ এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“একদিনেই মুখ বেশি চলছে তোমার।”

রিমঝিম আর চুপ থাকল না। ভাঙা গলায় জেদে ঠাসা সুরে বলল,
“তোমরাই বাধ্য করেছো আমার মুখ চালাতে। খেয়াল করে দেখো – আমি কি আগে এমন করেছিলাম? দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ আর পিছিয়ে যেতে পারে না। তখন সামনে এগোনো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আমিও আর পিছু হটতে পারছি না।”

রিমঝিমের কথার অর্থ সালমান বেশ বুঝলো। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একটু নরম হয়ে প্রশ্ন করে,
“বেশি বাড়াবাড়ি করছো না?”

রিমঝিম তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলে,
“সবসময়ই আমারটাই বাড়াবাড়ি হয়, তাই না? দু’বছর ধরে শুধু দিয়েই গেলাম। অথচ বিনিময়ে তো কোনো মনই পেলাম না।”

সালমান এবার শান্ত গলায় বলে,
“মা তো বয়স্ক মানুষ। একটু বুঝে নিতে পারো না?”

এই একটুকু কথায়, এতক্ষণ কঠিন মুখোশের আড়ালে থাকা রিমঝিম যেন মুহূর্তেই গলে যায়। চোখের কোণে জমে থাকা কষ্ট ফুঁপিয়ে উঠে বেরিয়ে আসে।
সালমান সুযোগ বুঝে রিমঝিমের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, চুপচাপ হাত রাখে রিমঝিমের গালে। তাতেই যেন রিমঝিমের সব ক্ষোভ, অভিমান, গলায় আটকে থাকা কান্না ঝরে পড়ে।
ভেজা গলায় রিমঝিম ফিসফিস করে বলে,
“তুমিও আমাকে সবসময় ভুল বুঝো। তুমি অন্তত যদি আমাকে বুঝতে, আমি কখনো এমনটা করতাম না।”

সালমান এবার একটুখানি হেসে আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“সারাদিন অফিস করে এসে এসব টানাপোড়েন আর ভালো লাগে না। তুমি একটু নরম হয়ে মাকে শুধিয়ে দিতে পারো না?”

রিমঝিম চোখ মুছে মাথা নাড়ে,
“চেষ্টা করছি তো, পারছি কই!”

সালমান এবার একটু গভীর হয়ে বলে,
“উঁহু, আরো পারতে হবে। আমি জানি তুমি পারবে।”

বলেই সে রিমঝিমকে আলতো করে বুকে টেনে নেয়।
রিমঝিমও নির্ভরতার সেই ছায়ায় ঢুকে পড়তেই
সব অভিমান, সব রাগ – নিমেষেই গলে পড়ে যায়।

——-

রাতের খাবারটা রিমঝিম ফুরফুরে মেজাজে নিজেই রান্না করেছিল। একে একে টেবিলে সাজিয়ে রেখে সালমানকে ডেকেছিল খেতে। সালমান এসে মাকে ডেকে নিয়ে এলো, তারপর দু’জনেই টেবিলে বসে পড়লো।
সালমান নিজের হাতেই হালিমা বেগমের প্লেটে খাবার তুলে দিল। নিজেও চুপচাপ খেতে শুরু করলো।

কিন্তু হালিমা বেগমের মুখ কঠিন। তিনি ঠোঁট শক্ত করে রেখেছেন। একবারও কোনো খাবার হাতে তুললেন না।
মুখে খাবার তুলবেন না ঠিকই, কিন্তু ছেলের পাশ থেকেও নড়বেনও না।
এই নীরব অনাস্থার মাঝে ছেলের মুখ থেকেও হাসি ঝরে গেল।

এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত – তারপরই সালমান ধীরে ধীরে মুখ তুলে কড়া চোখে রিমঝিমের দিকে তাকায়। সে দাঁড়িয়ে ছিল একটু দূরে।
সালমান ধীরকণ্ঠে আদেশের ভঙ্গিতে বলে,
“মায়ের কাছে ক্ষমা চাও। এক্ষুনি।”

রিমঝিম কিছুটা বিস্মিত হয়। চোখে বিস্ময়ের ছায়া।
শান্ত গলায় জবাব দেয়,
“উনার হয়ত বদহজম হয়েছে। তাই খাচ্ছেন না। এখানে আমি কেন ক্ষমা চাইবো?”

সালমান এবার খানিক কড়া সুরে প্রশ্ন করে,
“কেন চাইবে তুমি জানো না?”

“না ”

সালমানের কণ্ঠে রাগ বাড়তে শুরু করে। সে কিছু বলবে বলেই মুখ খুলেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে হালিমা বেগম নিজেই বলে উঠলেন,
“থাক বাবা, আমার জন্য তোদের মধ্যে অশান্তি করিস না। আমি পানি মুড়ি খেয়ে রাত কাটিয়ে দিবো।”
তার কণ্ঠে অভিমান, চোখে জল জমে আছে।
সালমান এবার চুপ করে গেলেও দৃষ্টিতে অনুযোগ স্পষ্ট।

সে ধীরে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে কড়াকণ্ঠে বলে,
“দেখছো? তুমি এখনো বুঝতে পারছো না? তুমি কেন ক্ষমা চাইবে?”

রিমঝিমের কণ্ঠ এবার অনেক শান্ত, অনেক ঠান্ডা। সে নিজেকে সামলে প্রতিত্তর করে,
“আমি কোনো ভুল করিনি যে ক্ষমা চাইবো।ভুল উনি করেছেন। ক্ষমা চাওয়ার হলে উনি চাইবে।”
এরপর একটু থেমে যায় রিমঝিম। যেন নিজের ভেতরেই কিছু ভেঙে যাচ্ছে, তবু গলায় অনুরণিত হয় এক কঠিন সিদ্ধান্তের রেশ,
“তবে, ক্ষমা চাইলে যদি সব ঠিকঠাক হয়… তাহলে আমি চাইতেই পারি। আমি চাই, সব ঠিক হয়ে যাক।”
সে ধীরে হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে,
“আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি… তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন, মা ।”
এতকিছুর পরেও রিমঝিম ক্ষমা চাইলো। শুধু এক ক্লান্ত মানুষের একটুখানি শান্তির আকুতির জন্য।

এতক্ষণ চুপচাপ থাকা হালিমা বেগম যেন নিজের জয় নিশ্চিত করলেন, তিনি মুখে বিজয়ের ছায়া টেনে নিলেন।
তবু ছাড় দেওয়ার পাত্রী উনি নন। রিমঝিমের কথার প্রেক্ষিতে তিনি মৃদু গলায় তীক্ষ্ণ কটাক্ষে বলে উঠলেন,
“তুমি যেটা করেছো, সেটা অনেক বড়ো ভুল। মায়ের মতো একজন মানুষকে না খাইয়ে রেখেছো। তোমার নিজের মা হলে, এমনটা করতে পারতে?”

রিমঝিম চোখ তুলে তাকায়। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে। তার গলায় ধ্বনিত হয় একরাশ ব্যথা ও প্রতিবাদ,
“আপনি কি কখনো আমাকে মেয়ে ভেবেছেন, যে আমি আপনাকে মায়ের মতো ভাববো? সামিয়াকে আর আমাকে তো আপনি সবসময় এক কাতারে ফেলেন না। আপনি তো কখনো মা হয়ে আসেননি আমার কাছে—আপনি যদি একদিনও মা হয়ে দেখাতেন, আমি দশদিন মেয়ে হয়ে দেখাতাম। আপনি যদি কিছু না দেন, তাহলে আমার কাছ থেকে কী আশা করেন?”

কথাগুলো শেষ না হতেই আচমকা,
সালমানের দ্বিতীয় চড়টা এসে পড়ে রিমঝিমের গালে।

সব শব্দ থেমে যায়।

রিমঝিম স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে, চোখের কোণে নীরবে ঝরে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রু।
সে কিছু বলে না। শুধু মনে মনে একটা চিরচেনা সত্যকে আবার অনুভব করে-
একটুখানি আদর পেলেই ভুলে যেতে নেই।

সে ভুলে গিয়েছিল, মা-ভক্ত ছেলেরা কখনোই একজন স্ত্রীকে সত্যিকার অর্থে ভালো রাখতে পারে না।
তারা বোঝে না, বিয়ের মানে শুধু একজন কাজের মেয়ে বাড়িতে আনা নয়।
তারা ভুলে যায়, বিয়ের পর মা আর বউ—এই দুই জনের দড়ির টান সামলাতে হয় ভারসাম্যে, কাউকে হারিয়ে নয়।
কিন্তু তারা পারে না।
তারা শুধু একপাশ নিজের দিকে রেখে, অন্যপাশটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
রিমঝিম জানে, সালমান আবার ক্ষমা চাইবে।
আবার একটু আদর করে বলবে, “ভুল হয়ে গেছে।”
আর আবারও সেই একই কষ্ট ফিরে আসবে।

কারণ, অতিরিক্ত মা-ভক্ত ছেলেরা স্ত্রীকে তার প্রকৃত মর্যাদা কোনোদিনও দিতে পারে না।

আর রিমঝিম?
সে আবারও গলে যাবে সেই একটুখানি মায়ায়, আবারও ক্ষমা করে দেবে।
এটাই তো নিয়ম!
কিন্তু কেন সে পারে না শক্ত হতে?

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

নবপূর্ণিমা পর্ব-০১

0

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১

“এতো বড়ো মাছ বাপের ঘরে কোনোদিন দেখেছো?যে-পিস নিয়ে নিয়ে লাট সাহেবের মতো প্লেট নিয়ে খেতে বসে গেছো?”
শাশুড়ির কথায় রিমঝিমের চোখের কোণ বেয়ে টুপ করে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে প্লেটের ধারে। মুখে তোলা প্রথম লোকমাটা মাঝপথেই থেমে যায়।

“কী হলো? মুখে কুলুপ এঁটেছো ক্যান!”

হালিমা বেগমের কণ্ঠে কাটা বাঁশের মতো খচখচে সুর। উনার শব্দগুলো রান্নাঘর পেরিয়ে উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে।

রিমঝিম ঠায় নিশ্চুপ বসে থাকে। শাশুড়ির এই কথাগুলো আজকের নতুন কথা নয়। বিয়ের দুই বছর পেরিয়ে গেছে।
এবং এরপর থেকেই নিয়ম করে পেটে খাবার না পড়লেও এরকম অনেক ‘কথা’ তার গলার কাঁটা হয়ে জড়িয়ে থাকে।
তৃপ্তির বদলে কষ্টে পেট টইটুম্বুর হয়ে যায়।

“কী হলো? কথা কানে যায় না? সবাই খাওয়ার সাথে সাথে এভাবে লাট সাহেবের মতো খেতে বসে গেছো ক্যান?”
আরও একবার বিদ্ধ করা হয় বাক্যবাণে।

রিমঝিম কাঁপা কণ্ঠে বলার চেষ্টা করে,
“এভাবে বলছেন কেন আম্মা?”

হালিমা বেগম চোয়াল শক্ত করে জবাব দেন,
“বলবো না তো কি করবো? বলি, বাড়ির বউরা খাবে সবার পরে। আমরা ছিলাম একরকম। আর তুমি হইছো ভিন্ন! যেদিন ভালো মন্দ খাবার হবে সেদিনের কথা তো বাদই দিলাম।”

রিমঝিম মুখ নিচু করে বলে,
“আমিও তো মানুষ, আম্মা… আমারও তো ক্ষুধা লাগে।”

“হো! যেদিন ভালোমন্দ রান্না হবে, সেদিনই বেছে বেছে তোমার ক্ষুধা লাগবে?”
হালিমা বেগম থেমে টিটকারির সুরে যোগ করেন,
“অবশ্য লাগবেই বা না কেন! বাপের জন্মে কোনোদিন এমন খাবার দেখেছো? নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থাও তো ছিল না!”

এতক্ষণ মুখ বুজে থাকা রিমঝিম আর চুপ থাকতে পারলো না। তার পরিবারকে নিয়ে অপমান শুনে শরীরের রক্ত টগবগ করে ওঠে।
সে মাথা তুলে কড়া গলায় বলে,
“যাই থাকুক না কেন। আমার পরিবার আপনার মতো ছোটোলোকি কোনোদিন করেনি!”

এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর…হুট্ করেই এগিয়ে এসে রিমঝিমের চুলের মুঠি ধরে টেনে ধরলো হালিমা বেগম।
ব্যথায় তার শরীর কুঁকড়ে উঠলো, চোখের জলে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল।
রিমঝিম আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। অশ্রুভেজা চোখে তাকালো স্বামীর দিকে,একটি আশার শেষ ঠিকানায়। কিন্তু সালমান নিরুত্তাপ। মুখে একফোঁটা স্পন্দন নেই। কোনো বিস্ময়ই নেই। তাকে যেন এই দৃশ্য ক্লান্ত করে তুলেছে কেবল।
মাথা তুলে চোখাচোখি করল না, শুধু বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“আহ আম্মা, ছেড়ে দাও। খেতে বসেও তোমাদের এসব নাটক দেখতে ইচ্ছে করছে না।”

সালমানের কথায় কোনো আবেগ নেই। শুধু কিছু উদাসীনতা বেছে আছে।
রিমঝিম বুঝতে পারলো – এই বাড়িতে তার শরীরের ব্যথা কাউকে না কাঁদালেও, স্বামীর অবহেলা তাকে নিঃশব্দে মাটিতে পুঁতে দিচ্ছে।
চুল টেনে ধরাতে হয়তো চোখে জল এসেছিল, কিন্তু স্বামীর এই এক চিলতে তাচ্ছিল্য – তাতে চোখের ভেতরের সব কান্না একসাথে ঝরে পড়লো।

হালিমা বেগম চুল ছেড়ে দিতেই রিমঝিম কিছু বললো না। শুধু ধীর পায়ে সামনে থাকা প্লেটটা ঠেলে উঠে দাঁড়াল।
প্লেটটা যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেল।
তাপমাত্রা কমে আসা ভাতের ধোঁয়া তখনও উপরের দিকে উঠছে। ভাতের উপর একটুকরো মাছ আর কিছু বাসি সবজির ঝোল, যা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জুটেছিল! কিন্তু আর খাওয়া হয়ে উঠেনি।

রিমঝিম একটুও আর কারোর দিকে ফিরে তাকালো না। শুধু নিঃশব্দে নিজের রুমে চলে গেল।
পেছনে পড়ে রইলো কিছু অসমাপ্ত লোকমা, কিছু ব্যথিত নিঃশ্বাস, আর একটুকরো ভালোবাসাহীন সংসার।

——-

রাত গড়িয়ে এলো। চুপচাপ ঘরে একা বসে রইলো রিমঝিম। অন্ধকারে ঠাসা রুমটা যেন তার মনটাকেও আরও গাঢ় কালোয় রাঙিয়ে দিল। বালিশে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে।
কিন্তু কেউ এলো না। না শাশুড়ি, না স্বামী, না সেই সংসারের কেউ – একটি লোকমার জন্যও তাকে জোর করে ডাকলো না।
একটু পরে দরজার সামনে হালকা পায়ের শব্দ পেল সে।
ছোট ননদ, সামিয়া। এই বাড়িতে রিমঝিমের একমাত্র ভরসা। পায়ে পায়ে হেঁটে দুয়েকবার রুমের সামনে পায়চারি করলো সে। কিন্তু হালিমা বেগমের তিরস্কারের সুর ভেসে এলো,
“তোর আবার কি দরকার এখানে?”
“ভাবিপু তো খায়নি।”
সামিয়ার নরম সুরের কথায় হালিমা বেগম বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে শুধায়,
“ওসব নাটক দেখতে হবে না তোকে। যা, ঘুমা গিয়ে!”

সামিয়া আর কোনো আওয়াজ শোনা গেল না। হয়ত চুপচাপ চলে গেল। এরপর আর ফিরে আসেনি।

রুম থেকে রিমঝিম সব শুনলো। দরজার ওপাশের প্রতিটি শব্দ যেন ছুরি হয়ে বিঁধছিল তার বুকে। তবু সে চুপ। শুধু কাঁদতেই থাকলো।
ননদ তো অনেক দূরের ব্যাপার। যেখানে স্বয়ং স্বামী?
সে তো আরও বহু আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
সেই দুপুরের পরে একবারও জানতে চায়নি – সে খেয়েছে কি না, কিংবা… ক্ষুদা লাগলো কিনা!

রিমঝিম হাসলো। এতদিন পরেও আর কী-ই বা আশা করা যায়! হয়তো এটাই তার কপালে লেখা ছিল।
এই নিঃসঙ্গতা, এই অবহেলা, এই গিলতে না পারা কান্নাগুলোই…

রাত গড়াচ্ছে। এই পুরোটা সময় রিমঝিমের পেটে একটা দানাও পড়েনি। অপমানে আর রুম থেকে বের হওয়া হয়নি। এখন বের হলেও রিমঝিম জানে, তার জন্য কোনো খাবার অবশিষ্ট রাখবে না । ক্ষুধায় পাক খেতে খেতে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে আসছে। কিন্তু রুমে কোথাও কোনো শুকনো খাবার নেই যে একটু মুখে দেবে।

রিমঝিম চুপচাপ বসে থাকে বিছানার এক কোনায়। দেয়ালে ছায়া পড়ছে জানালার পাশের গাছের পাতার – সেই ছায়াগুলোও যেন আজ তার মতোই কাঁপছে।
ক্ষণে ক্ষণে হেঁচকি উঠছে। ভেজা চোখে বালিশ চেপে ধরেছে বুকে।
একসময় দরজার আড়ালে শব্দ হয়। সালমান এসে দাঁড়ায়।
চোখে বিরক্তির ছাপ, মুখে ক্লান্তি।
রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
“এই সামান্য কারণে এত কান্নাকাটি করছো কেন?”

রিমঝিম ধীরে মাথা তোলে। চোখে কেবল একরাশ বিষণ্ণতা আর মলিন দৃষ্টি। সে কণ্ঠ ভারী করে বলে,
“তোমার কাছে এটা সামান্য? আমি খেতে বসে মার খেয়েছি আজ।”

সালমান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
“মার খাওয়ার মতো আচরণ করলে তো খাবেই। মা একটু বদমেজাজি, তা তো জানো। এসব মেনে চলতে শেখো। মুখে মুখে তর্ক করো কেন?”

রিমঝিম বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় সালমানের দিকে,
“তোমার কাছে আমার কথাগুলো তর্ক মনে হয়েছে? আর তোমার মা যা বললেন, করলেন, সেগুলো?”

সালমান এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“এই তেজটাই তোমার সর্বনাশের কারণ। এখনো দেখো, আমার সাথেও মুখে মুখে করেই যাচ্ছো।”

রিমঝিম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বুক ভেঙে কান্না আসে, কিন্তু সে আর কিছু বলে না। কী বলবে! এই মানুষগুলোর সাথে কথা বলার ইচ্ছেটাও যে মরে যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এতক্ষনে ধরে চেপে রাখা কান্নাগুলো আরো বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন! নিজেকে সামলাতে পারলো না সে।

রিমঝিমের হিচকি তোলা দেখে সালমান বিছানার পাশের ল্যাম্প নিভাতে নিভাতে বলে,
“ফ্যাচফ্যাচ করো না তো কানের পাশে। সকালে অফিস আছে আমার, ঘুমাতে দাও।”

এই কথাগুলো আর একফোঁটা আলো নিভে যাওয়া – সব মিলে একসাথে যেন আঁধার নামিয়ে আনে রিমঝিমের ভেতরটায়। সে চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। নিরব পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় বারান্দায়।
অন্ধকার রাত। কোনোদিকে পূর্ণিমার আলো ছিটেফোঁটাও নেই। রাতের হাওয়া এসে তার চুল উড়িয়ে দেয়, তবু সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।

এই ঘর, এই মানুষগুলো, এই সম্পর্কগুলোতে – হয়তো তার সময় ফুরিয়েছে। সে তো চেয়েছিল টিকে থাকতে। ভুল করে ভালোবাসতে চেয়েছিল। কিন্তু যাকে ‘মা’ বলে ডাকতে চেয়েছিল, সেই হালিমা বেগম তাকে কোনোদিনই মেনে নেননি। দুই বছর পেরিয়ে গেছে।
তবু তিনি এখনো সেই একই অবজ্ঞা, একই আঘাত পুষে রেখেছেন।
রিমঝিম জানে, সে এই বাড়ির এক কোণাও নিজের করে পায়নি। সালমান – যাকে ভালোবেসে সব ভুল মেনে নিয়েছিল, তিনিও আজ কেবল মুখ ফিরিয়েই নয়, তাকে ছোট করতে দ্বিধা করেন না।
সে চোখের জল মুছে নেয় ধীরে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদটা লুকিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে পূর্ণিমার মতো আলো ছড়াতে চাচ্ছে আবার ঢেকে যাচ্ছে।
আর সে জানে – এই চাঁদের মতো বাঁচাই এখন তার জীবন।

ভুল তো সে শুরুতেই করেছিল। ভুল মানুষকে আঁকড়ে ধরেছিল, আর সেই ভুলের মাশুল এখন গিলে নিচ্ছে নিঃশব্দে, প্রতিটা রাতে… প্রতিটা নিঃশ্বাসে।
এই ‘বাড়ি’টাই হয়তো তার জন্য সঠিক ছিল না।
নাকি, এই সংসারটা কখনোই তার ছিলই না?

চলবে।