Tuesday, June 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 5



সৌরকলঙ্ক পর্ব-১৫+১৬

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৫

ঘড়ির কাঁটায় আবার চোখ ফেলল তানিয়া ।এই দিয়ে কতবার যে সে সময় দেখলো তার হিসাব নেই।রাত বাজে একটা অথচ আদিব এখনো বাড়ি ফেরেনি।তানিয়া বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছে আদিবের রাত করে বাড়ি ফেরার ব্যাপারটা।রোজ রোজ আদিবের এই রাত বিরাত বাড়ি ফেরা পছন্দ হচ্ছে না তানিয়ার।বেশ কয়েকবার এ নিয়ে আদিবের সাথে কথাও বলতে চেয়েছে সে।
কিন্তু আদিব কে বাগে পেলে তো!সে জায়েদের বাড়ি ঘাটি গেড়েছে, এখন তার খাওয়া-দাওয়া,উঠা-বসা সব সেখানেই।মায়ের জন্য তার সময় কোথায়! তার সব সময় তো জাহানারার। জাহানারা জাহানারা করে পাগল হয়েছে ছেলেটা।তানিয়া মানছে মেয়েটা অসুস্থ কিন্তু তাতে তার ছেলের কি? জাহানারার বাবা আছে ,ভাই ,ভাবি আছে,মামারা আছে,চাচা ,ফুপু সবাই আছে তার দেখুক না। কিন্তু না, এতো সব থাকতেও তার ছেলেকে লাগবে তার! আজকাল এসব কথা ভাবতেই রক্ত গরম হয়ে ওঠে তানিয়ার।রাগ হয় আদিবের উপর।একটা উচ্চ শিক্ষিত ছেলে এতোটা আহাম্মক কীভাবে হয় ভেবে পায় না সে।কি দরকার ছিল আদিবের যেচে পড়ে ঝামেলায় জড়ানোর। মানবিকতার চক্করে কাজ কাম ছেড়ে এখানে বসে তার ছেলে এসব করছে,সহ্য করা যায়?

রাগে গজগজ করতে করতে আরো একবার ঘড়ি দেখলো তানিয়া। ঘড়ির কাঁটা জানান দিল একটা তিরিশ বাজে।না আর এভাবে চুপ করে বসে থাকলে হবে না।আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।তানিয়ার ধৈর্য চ্যুত হলো।সে রাবেয়া কে ডেকে সদর দরজা দিতে বলে বাইরে বেরিয়ে গেল।

____________
জাহানারার শরীর ভালো না।জ্বর এসেছে।সকাল থেকে বেশ কয়েকবার বমি করে ফ্লোর ভাসিয়েছে।জায়েদ, আকিব বাড়ি নেই।সালেহার বাবার বাড়ি জমি জায়গা নিয়ে কি এক ঝামেলা বেঁধেছে যার জন্য তাদের সেখানে যেতে হয়েছে।নেহা ছিল কিন্তু সেও কোন এক কাজে আজ সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে র‌ওনা দিয়েছে।বাড়িতে জাহানারা আর তারিন একা। জাহানারার এমন অবস্থায় ভড়কে গিয়েছিল তারিন তাই কোন কিছু না ভেবে বাধ্য হয়ে আদিব কে ডেকে পাঠিয়েছিল।আদিব আসার পর জাহানারার অবস্থা আরো খারাপ হয়।জ্বরের তেজে জ্ঞান হারায় সে। জ্ঞান ফেরার পর আবার বমি করে।আদিব ******ইনজেকশন দেওয়ার পর কিছুটা উন্নতি হয় জাহানারার শরীরের কিন্তু আদিব কে পাশে পেয়ে ছাড়তে চায় না সে।আদিব‌ও ভেবে দেখে বাড়িতে তারিন ছাড়া এ সময় কেউ নেই, তারিনের একটা ছোট্ট মেয়ে আছে, এখন সে মেয়েকে সামলাবে না জাহানারা কে? তাছাড়া রাত বিরাত যদি জাহানারা কিছু হয় তখন সে একা কি করবে? এসব ভেবে আজ রাতটা এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই আদিব। আজ বাড়ি ফিরবে না এ কথা মা কে ফোন করে বলতে চেয়েছিল সে, কিন্তু রাত দশটার পরে জাহানারার অবস্থা হঠাৎ করে আবার খারাপ হয়।ম্যাথা ব্যথা করে ছটফটিয়ে ওঠে সে।একসময় নাক দিয়ে বের হয় সরু র’ক্তের ধারা।ভয় পেয়ে যায় আদিব।আদিব সময় নষ্ট না করে কল করে রাকিব কে ।রাকিব তৎক্ষণাৎ একটা ***** ঔষধ দিতে বলে জাহানারা কে।আদিব সেই মুহূর্তে তারিন কে জাহানারা পাশে রেখে ছুটে যায় ডিসপেনসারিতে।****ঔষধ নিয়ে আসে। ইনজেকশনের মাধ্যমে জাহানারা অবচেতন শরীরের প্রয়োগ করে সেটা।******ঔষধ ইনজেক্ট করার পর জাহানারা স্টেবেল হয়।তারিন আর আদিবের জানে পানি আসে।এসব দৌড়াদৌড়ির মধ্যে সে যে আজ এ বাড়িতে থাকবে এ কথা মা কে জানাতে ভুলে যায়।

মাঝ রাতে কলিং বেলের শব্দে চমকে ওঠে তারিন।সবে মাত্র মেয়েকে ঘুম পাড়িয়েছে সে।তার মেয়েরে ঘুম ভীষণ পাতলা ।ঘরে একটু ঠুকঠাক হলেই উঠে যায়।মেয়ে কলিং বেলের শব্দে মেয়ের ঘুম না ভাঙে তাই তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে গেল তারিন।এত রাতে কে এসেছে সেটা দেখার জন্য কি হল চোখ দিতেই তানিয়ার থমথমে মুখটা চোখে পড়লো তার।বুঝলো তার বড় চাচি শাশুড়ি ছেলের টানে এই মাঝ রাতে ছুটে এসেছে।তারিন সময় নষ্ট না করে দরজা খুলে দিল।সালাম দিয়ে তানিয়া কে ভেতরে আসতে বলল।তানিয়া চুপচাপ ভেতরে প্রবেশ করলো।তানিয়ার অন্ধকার আচ্ছন্ন মুখটা দেখে তারিন কোন রকমে জিজ্ঞেস করলো,

-ভালো আছেন বড় চাচি?

তানিয়া হয়ত এমন একটা প্রশ্নেরই অপেক্ষা করছিল।সে ঠেস দিয়ে বলে উঠলো,

-তোমরা ভালো আর থাকতে দিচ্ছো কোথায়!যাই হোক ,আদিব কোথায় ওকে ডাকো।

জাহানারা ঘর থেকে বের হ‌ওয়ার সময় আদিবকে তার শিয়োরে দেখেছিল তারিন।তানিয়ার কথা শেষ হতেই সে বলল,

-আমি ডেকে আনছি।

কথাটা বলেই জাহানারা ঘরের দিকে পা বাড়ালো তারিন।কি যেন মনে করে তানিয়াও পিছু নিল তারিনের। জাহানারার ঘরের দরজা খোলায় ছিল।তারিন ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল।আদিব জাহানারার শিয়োরে বসে বিছানার হেড বোর্ডে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।আদিবের এক হাত জাহানারা মাথার উপর রাখা আরেক হাত জাহানারা দুই হাতে জাপটে ধরে রেখেছে নিজের বুকের মাঝে। রক্ষণশীল পরিবারের মানুষের জন্য এমন একটা দৃশ্য দৃষ্টি কটু।তারিন একটু অপ্রস্তুত হলো।সে ইতস্তত করে ডাকলো আদিব কে।ঘুম তখনো গাঢ় হয়নি আদিবের , মাত্রই চোখ লেগেছিল।তারিনের ডাকে চমকে উঠলো সে। উদ্ভ্রান্তের মতো তারিনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো ,

-কি হয়েছে ভাবি? জাহানারা?

কথাটা বলে উঠতে নিতেই হাতে টান পড়লো আদিবের নিজের গা ঘেঁষে জাহানারা কে নিশ্চিন্তে শুতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে।তবে তার স্বস্তি টা দীর্ঘ স্থায়ী হলো না যখন তারিনের পিছনে থাকা মায়ের গনগনে চোখে চোখ পড়লো ।তানিয়া অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। জাহানারা কে ছেলের এত কাছে দেখে ভেতরটা জ্বলছে তার।মা কে এই মুহূর্তে এখানে আশা করেনি আদিব। সে জাহানারার হাত থেকে নিজের হাতটা সাবধানে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।এগিয়ে এসে মায়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইলো হয়ত। কিন্তু তার আগেই তানিয়া স্থান ত্যাগ করলো।

তানিয়ার রাগে উত্তপ্ত চোখ আর থমথমে মুখ দেখে আদিবের বুঝতে বাকি রইলো মায়ের রাগের তীব্রতা। সে তড়িঘড়ি ছুটলো মায়ের পিছু।তানিয়া তখন জাহানারাদের ড্র‌ইংরুম পর্যন্ত পৌঁছেছে আদিব অনেকটা দৌড়ে গিয়ে পথরোধ করলো মায়ের।নরম স্বরে নিজের স্বপক্ষে বলল,

-মা আই ক্যান এক্সপ্লেইন।শোনো

-তোমার এক্সপ্লেনেশনের কোন প্রয়োজন নেই আমার।আমি যা বোঝার বুঝে গেছি।তুমি আমাকে ঠকিয়েছ আদিব।

আদিবের কথা কেটে বলল তানিয়া।তার কণ্ঠে রাগ স্পষ্ট। এলোমেলো শ্বাস প্রশ্বাস।আদিব জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।বোঝানোর সুরে বলল,

-মা তুমি ভুল বুঝছো।আসলে জাহানারা অসুস্থ ছিল।তারিন ভাবি ছাড়া বাড়ি কেউ নেই, তাই আমি থেকে গিয়েছিলাম। যদি রাত বিরাত কিছু হয়!তোমাকে ফোন করে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু জাহানারার শরীর হঠাৎ এতো অসুস্থ হয়ে পড়লো যে ওকে সামলাতে সামলাতে তোমাকে ইনফর্ম করার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল।আমি…

আদিবের কথা অসমাপ্ত রেখেই সদর দরজার দিকে হাঁটা দিল তানিয়া।তার ভেতরটা কেমন কেমন জানি করছে।তার ছেলেকে তার থেকে ভালো আর কেউ চেনে না।ছেলের চোখে মুখে জাহানারার জন্য আজ যে অভিব্যক্তি দেখেছে সেটা বারবার তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার সব চেষ্টা প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কথা।ভয় হচ্ছে তার, ভীষণ ভয়।কানে বাজছে জাহানারা বলা বর্ষ পুরোনো কিছু কথা।

ঘটনাটা আদিব লন্ডন যা‌ওয়ার দুই বছর পরের। সাজ্জাদের বড় মেয়ে মিতুর বিয়েতে পরিবারের সবাই এক জায়গায় হয়েছিল আবার।নতুন পুরোনো অনেক আত্মীয় স্বজন এক হয়েছিল সাজ্জাদের বাড়ির উঠানে।সে আত্মীয়-স্বজনের মাঝে জাহানারা বেগমের খালাতো বোন লতিফাও ছিল।লতিফা কে জাহানারা বেগমের বোন কম ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বললেও ভুল হবে না। জাহানারা বেগম যতদিন বেঁচে ছিল তার সাথে নিজের মনের সকল কথা বলতো সে।স্থানের দূরত্ব থাকলেও টেলিফোন দুই মিনিটের কথা কোনোদিন বাদ যেত না তাদের। জাহানারা আর আদিব কে নিয়ে জায়েদ কে দেওয়া আশরাফের কথা সম্পর্কেও জানতো সে। জাহানারা বেগমের এ বিষয়ে তীব্র আগ্রহ‌ও অজানা ছিল না লতিফার ।তিনি সকলের উপস্থিতিতে সেই বার আবার পুরোনো কথা তুলেছিলেন।একটা চেষ্টা করেছিলেন তানিয়ার মন পরিবর্তনের কিন্তু তানিয়া তার কথা কানে তোলে নি।উলটো সবার সামনে জাহানারা কে তার ছেলের অযোগ্য বলে অপমান করেছিল। জাহানারা তার ছেলের নখের যোগ্য না এমন কথাও উচ্চরণ করেছিল।সেই সাথে সালেহার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে খোটা তুলেছিল। অহংকারে বশবর্তী হয়ে সবার সামনে ছোট করেছিল জায়েদ আর সালেহাকে।নিজের কথার বাণে ক্ষ’তবি’ক্ষত করেছিল সালেহার অন্তর‌আত্মা।

জাহানারা সেদিন সেখানেই উপস্থিত ছিল। তখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি জাহানারা।সাইক্যাট্রিস্টের কাছে তখনো আসা যাওয়া নিয়মিত তার।শাহেদ ডাক্তারের পরামর্শ মতোই সবার মাঝে নিয়ে এসেছিল তাকে।কিন্তু শাহেদ ভাবেনি মেয়েটার সুস্থতার আশায় তাকে আবার এমন একটা বাজে পরিস্থিতির স্বীকার করবে।

জাহানারা বড় চাচির প্রতিটা কথা ,শব্দ ,বাক্য সব শুনেছিল সেদিন।দেখেছিল বাবার লজ্জা আড়ষ্ট মুখ আর মায়ের চোখের পানি।নিজের বিষয়ে বলা কথা গুলো যদিও সে সহ্য করে নিয়েছিল কিন্তু মা কে বলা কথা সহ্য করতে পারেনি সে।কারো পরোয়া না করে সবার সামনে বড় চাচির মুখোমুখি মুখি দাঁড়িয়েছিল সে। ভেতরের জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপ কণ্ঠে এনে বলেছিল,

-আপনার ঐ যোগ্য ছেলেকে যদি আমার পিছনে নাকে দড়ি দিয়ে না ঘুরিয়েছি তো আমার নাম জাহানারা না।খুব অহংকার না আপনার ছেলেকে নিয়ে! আপনার এই অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দেব একদম।মা ছেলে কেঁদে কুল পাবেন না!

জাহানারা কথা শুনে রাগ চরমে উঠলো তানিয়ার। রাগে অন্ধ হয়ে হাত উঠল জাহানারার উপর। সজোরে চড় বসালো জাহানারার গালে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

-বেয়াদব।

জাহানারা কথা আর তানিয়ার কাজে স্তব্ধ হলো সবাই।শাহেদ এসে ভাতিজিকে সামলালো।সবার সামনে তানিয়ার সম্মানের কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে বেরিয়ে গেল জাহানারা কে নিয়ে। পরেরদিন তানিয়া আশরাফ কে বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলল জাহানারা বলা কথাগুলো। আশরাফ সেদিন সেখানে অন‌উপস্থিত থাকলেও সাজ্জাদের কাছ থেকে সবটা শুনেছিল।জায়েদ আর সালেহাকে করা তানিয়ার অপমান সম্পর্কে‌ও অবগত ছিল সে। সাজ্জাদের কাছ থেকে সব শুনে তৎক্ষণাৎ মেজাজ খারাপ হয়েছিল আশরাফের তবে জাহানারার বলা কথা শুনে কেন জানি একটু শান্তি পেয়েছিল।মনে হয়েছিল তার দামড়া দামড়া ভাই গুলো ভদ্রতার খ্যাতিরে যেটা করতে পারিনি তার কিছুটা তো ঐ ছোট্ট মেয়েটা করতে পেরেছে।তানিয়ার কাছ থেকে তার রং মাখানো কথা শোনার পর আশরাফ কণ্ঠে মাত্র অতিরিক্ত শীতলতা এনে বলেছিল,

-তানিয়া তোমাকে একটা স্পষ্ট কথা জানিয়ে দিচ্ছি, এরপর যদি তুমি সালেহা কিংবা জায়েদ কোন ধরনের বাজে কথা বলো বা অপমান করো তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।অ্যান্ড আই মিন ইট।

আশরাফের ঐ শীতল কণ্ঠে কি ছিল কে জানে! তানিয়া এরপর আর কখনো সালেহা কিংবা জায়েদ কে কোনো কটু কথা বলিনি।এমনকি তাদের কে এবং তাদের যে কোনো বিষয় সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে গেছে।

এতগুলো দিন, এতগুলো বছরের ব্যবধানে জাহানারার বলা সেদিনের কথাগুলো ভুলে বসেছিল তানিয়া। কিন্তু আজ ছেলেকে জাহানারা কে আগলে বসে থাকতে দেখে সেই কথাগুলো যেন কানে বাজতে লাগলো।আদিবের কথা গুলো শুনতে ইচ্ছা করলো না তার।তাই তো ছেলের কথা উপেক্ষা করে পা বাড়ালো সামনে।

তানিয়া চলে যেতেই ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব। তারিন কে জাহানারার খেয়াল রাখতে বলে ছুটলো মায়ের পিছনে।

______________

বাড়ির দরজায় আসতেই “বড় ভাবি” বলে রাবেয়ার দেওয়া চিৎকার কানে এলো আদিবের।সে সাথে সাথে দৌড়ালো ভেতরে।ভেতরে ঢুকে মা-কে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেই গলা বুক শুকিয়ে এলো তার।ছুটে গেল মায়ের কাছে।মায়ের মাথাটা কোলে নিয়ে পাগলের মতো ডাকতে লাগলো তাকে।রাবেয়া পানি নিয়ে এলো তাড়াতাড়ি। রাবেয়ার হাত থেকে পানি নিয়ে বারকয়েক তানিয়ার চোখে মুখে পানি ছিটালো আদিব। কিন্তু তানিয়ার জ্ঞান ফিরলো না।আদিবের ভয় হতে লাগলো এবার।তার মায়ের হার্টের সমস্যা আছে।চার বছর আগে ধরা পড়েছে রোগটা।আদিবের হঠাৎ মনে হলো মায়ের আবার ক্যার্ডিয়াক অ্যাটাক আসেনি তো?মায়ের বিবর্ণ মুখ আর নিথর দেহ দেখে নিজের পেশাদারিত্ব ভুলে বসলো সে।কিছু না ভেবেই ফোন করলো নিকটস্থ হাসপাতালে।মিনিট পাঁচেক সময় লাগলো আ্যম্বুলেন্স আসতে।আদিব মা কে নিয়ে উঠে বসলো আ্যম্বুলেন্স।

হাসপাতালে ভর্তি করা হলো তানিয়াকে। আশরাফ হাসপাতালেই ছিল।আদিব তানিয়াকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তার সাথে দেখা হল।বাবাকে দেখে আদিব যেন কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেল। হাসপাতালে নিয়ে আসার প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে জ্ঞান ফিরলো তানিয়ার। আশরাফ আদিব কে জানালো এখন ঝুঁকি মুক্ত সে।পেশার ফল করে শারীরিক দুর্বলতায় জ্ঞান হারিয়েছিল।আদিব অবশ্য তানিয়ার অবস্থা দেখে এটাই আশঙ্কা করেছিল কিন্তু নড়বড়ে মনের জোর নিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু করার সাহস পায়নি। আশরাফের কথা শুনে আটকে থাকা শ্বাস ছাড়লো আদিব।তার মনে হচ্ছিল এতক্ষণ গলার গোড়ায় কি যেন আটকে ছিল।খুব কষ্ট হচ্ছিল।এক কাক ডাকা ভোরে দাদিকে যে অবস্থায় দেখেছিল সেই দৃশ্য বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিল। বাবার কথায় বুকের ভেতর থেকে বড় একটা চাপ সরে গেল যেন।একটা লম্বা শ্বাস টেনে ওয়াশরুম থেকে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে এলো।তানিয়াকে ততক্ষণে কেবিনে দেওয়া হয়েছে।আদিব ধীর পায়ে প্রবেশ করলো মায়ের কক্ষে।

তানিয়া নিষ্প্রাণ চোখে তাকালো ছেলের দিকে।আদিব টুল টেনে মায়ের পাশে বসলো।মায়ের হাতটা মুঠোয় নিয়ে কাতর স্বরে বলল,

-আই এম স্যরি মা,আই এম স্য

-আমি রুবাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে দিতে চাই আদিব।আমার খুশির জন্য তুমি এই বিয়েটা করতে পারবে না?

আদিবের কথা কেটে বলল তানিয়া।মায়ের কথা হতবাক হলো আদিব। তানিয়া ছেলের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

-পারবে না আমার খুশির জন্য এই বিয়েটা করতে?

কথাটা বলতে বলতে চোখের কোণে পানি জমলো তার।আদিব মায়ের পূর্বের প্রশ্নের জবাব হাতড়াচ্ছিল নিজের মধ্যে ঠিক সেই সময় মায়ের অশ্রু শিক্ত চোখ দেখে ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগলো।সে আর কিছু না ভেবেই বলল,

-পারবো।

-সত্যি!

-হুম।

আদিবের ইতিবাচক উত্তরে সাথে মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো তানিয়ার।আদিব মায়ের মুখের হাঁসি দেখে জোর করে মুখে হাঁসি টানলো। আশরাফ দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল।মা ছেলের কথোপকথন শুনেছ সে।তানিয়া যে ছেলেকে আবেগের চাপে ফেলে নিজের কার্য সিদ্ধি করেছে সেটাও বুঝেছে। তানিয়ার মুখের হাসি দেখে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো আশরাফের।সশব্দে বেরিয়ে এলো তপ্ত শ্বাস।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৬

ছেলের সম্মতি পাওয়ার পর তানিয়া যেন আর এক মুহূর্তও দেরি করতে চাইলো না আদিব আর রুবাইয়ার আগত সম্পর্কে।তাই তো পরেরদিন বাড়ি ফিরেই ভাইকে ফোন করে ছেলের মতামত জানালেন।শামীম খুশি হলো আদিবের ইতিবাচক সাড়া পেয়ে তবে কিছু একটা ভেবে তানিয়ার কাছে জানতে চাইলো আশরাফের কি মত?তানিয়া ছেলের উত্তর পাওয়ার পর আশরাফের সাথে আর এ বিষয়ে কোন কথা বলেনি।শামীমের সাথে সে যখন কথা বলছিল আশরাফ তখন তার সামনে বসা।ভাইয়ার কথা শুনে সে আশরাফের দিকে তাকালো। আশরাফের নজর খবরের কাগজে থাকলেও কান তানিয়া আর শামীমের কথোপকথনে ছিল। তানিয়া ফোনের স্পিকারে হাত চেপে আশরাফের উদ্দেশ্যে বলল,

-এই শুনছো,ভাইয়া তোমার মত জানতে চাইছে কি বলবো?

-বলো, ছেলের সম্মতিতেই ছেলের বাপের সম্মতি।

খবরের কাগজ চোখ রেখেই বলল আশরাফ। তানিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ঠোঁটের কোণে দেখা দিল তার চ‌ওড়া হাঁসি। আশরাফ এই বিয়েতে আদৌও রাজি হবে কি না এই নিয়ে খুব চিন্তায় ছিল তানিয়া।সে আশরাফের বলা কথাটা আরো সাজিয়ে গুছিয়ে বলল শামীম কে।শামীম আশরাফের সম্মতি পেয়ে বলল,

-তাহলে তোরা আংটি বদলের দিন ঠিক করে আমাকে জানাস

-আংটি বদল না ভাইয়া, একেবারে আকদ করতে চাইছি আমি।এখন আকদটা হয়ে থাক আদিব ফেরার আগে না হয় ধুম ধাম করে অনুষ্ঠান করে রুবাইয়া কে নিয়ে আসবো।কি বলো?

শামীমের কথা কেটে বলল তানিয়া। আশরাফ স্ত্রী দিকে আড় চোখে তাকালো।বুঝলো এই বিয়ে নিয়ে শামীমের থেকে তানিয়ার তাড়া বেশি। তানিয়ার কথা শুনে শামীম একটু ভাবুক হলো বলল,

-আমরা তো সামনের সপ্তাহ ফেরত যাচ্ছি এর মাঝে আকদ !কীভাবে কি করবি? আয়োজনের একটা ব্যাপার আছে না।কাউকে না বললেও ভাই বোনেদের তো নিতেই হবে।না হলে কথা হবে না?

-আয়োজন নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না ও ঠিক আমি ম্যানেজ করে নিবো।আর র‌ইলো সবাইকে বলার ফোন করে বললেই হয়ে যাবে। তাছাড়া এখন তো আর সেইরকম কিছু করা হচ্ছে না। সবাই বুঝবে।তোমার আপত্তি না থাকলে তাহলে সামনের শুক্রবার ডেট ফেলা যায়।

-তোর কোন সমস্যা না থাকলে আমার কোন আপত্তি নেই।তবে একা একা সব মাতব্বরি করিস না। আশরাফের কাছে থেকেও কিছু পরামর্শ নিস।

বোনের স্বেচ্ছাচারী স্বভাব সম্পর্কে ভলি ভাতি অবগত শামীম ,যার কারণে কথাটি বলল।ভাইয়ের কথা শুনের কিঞ্চিৎ দমলো তানিয়া তবে সেটা শামীম কিংবা আশরাফ কাউকে বুঝতে না দিয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল,

-ওর কাছ থেকে না শুনে আমি কিছু করি না কি?অত সাহস এখনো তোমার বোনের হয়নি।

কথাটা বলতে বলতে চোরা চোখে একবার আশরাফের মুখের দিকে তাকালো তানিয়া।সাথে সাথে তার চোখে পড়লো আশরাফের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা তাচ্ছিল্যের হাসিতে। তানিয়া বুঝলো তার কথা এই হাসির কারণ।সে অযথা গলা ঝাড়া দিয়ে কথা ঘুরিয়ে শামীমের উদ্দেশ্যে বলল,

-তাহলে ঐ কথাই র‌ইলো সামনের শুক্রবার তোমরা আসছো।

-হুম।কোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানাস।

-ঠিক আছে।

ফোন রাখলো তানিয়া। আশরাফ তখনো তার সামনে বসা।তানিয়া শামীমের সাথে হওয়া কথোপকথন আবার উল্লেখ করলো আশরাফের সাথে। আশরাফ সব শুনে মাথা নাড়ালো,বলল,

-ভালো। তোমার যা ইচ্ছা করো ।কোন প্রয়োজন হলে বলো।

-প্রয়োজন হলে বলবো মানে! তোমার ছেলের বিয়ে, তুমি এমন গা ঝাড়া দিয়ে বসে থাকলে হবে?

-ছেলের মা যখন সব দায়িত্ব গায়ে মেখে বসে আছে তখন আর ছেলের বাপের দরকার হবে না!

থামলো আশরাফ তারপর তানিয়ার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

-তোমার মনে যা চলছে তাই করো।আমাকে এসবের মধ্যে জড়িও না। আমার হস্তক্ষেপ তোমার পছন্দ হবে না।

আশরাফ যেন নিজের কথার মাঝে তানিয়াকে জানান দিল এই সম্বন্ধে তার আপত্তির কথা।তানিয়া অবাক চোখে তাকালো তার দিকে।মনে হলো এতগুলো বছরেও এই মানুষটাকে সে চিন্তে পারেনি। হঠাৎ একটু খারাপ লাগা কাজ করলো মনের ভেতর।আশরাফের অমতে ছেলের বিয়ে দিয়ে ভুল করছে না তো, এ চিন্তা মাথায় এলো। কিন্তু পরক্ষণেই যেই মনে পড়লো আশরাফের মতামত দেখতে গেলে তো জায়েদের ঐ বেয়াদব মেয়েকে বাড়ির ব‌উ করতে হতো!এ কথা মনে হতেই মনের খারাপ লাগাটা মুহূর্তে মিইয়ে গেল তানিয়ার। আশরাফের কথা উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ালো। তৃপ্তি কে ফোন করলো।ডেকে পাঠালো শিমুল আর তৃপ্তি কে।সময় কম এর মধ্যে অনেক কিছু করতে হবে। এবং তাকেই সব করতে হবে!

___________

-আদিব তুমি একটু আমাদের বাড়ি আসতে পারবে?

-আদিব যেতে পারবে না আকিব।আমাকে বলো, কিছু প্রয়োজন?

ফোনের অপর পাশে বড় চাচির কণ্ঠ শুনে ফোন কান থেকে সরিয়ে সামনে এনে দেখলো আকিব।ফোন স্ক্রিনে আদিবের নাম্বার দেখে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না কল চাচি রিসিভ করেছে।তবে সেটা আদিবের উপস্থিতিতে না অন‌উপস্থিতিতে সেটা বুঝতে একটু অসুবিধা হলো আকিবের।আকিব কে চুপ থাকতে দেখে অপর পাশ থেকে পরপর দুইবার হ্যালো ,হ্যালো বলে উঠলো তানিয়া।আকিবের ভাবনায় ছেদ পড়লো।সে নিজের ভাবনা এক পাশে রেখে বড় চাচিকে সালাম দিয়ে তার শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলো। তানিয়া হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সেই কথা ইতিমধ্যে কম বেশি সবাই জানতে পেরেছে।আদিব যে সেই কারণে তাদের বাড়ি আসছে না এটাও অজানা নয় আকিবের।আকিবের কথার উত্তরে তানিয়া জানালো,

-আমি ভালো আছি ।তোমাদের কি অবস্থা।

-আমরাও ভালো আছি চাচি।

একটু থামলো আকিব তারপর ইতস্তত করে বলল,

-চাচি আদিব কে একটু দেওয়া যাবে আসলে জাহানারা শরীরটা খুব খারাপ।সকাল থেকে কিছু মুখে তোলেনি। বারবার আদিব কে ডাকতে বলছে।

আকিবের কণ্ঠে অসহায়ত্বের ছাপ।তানিয়া সেটা বুঝলো কি না কে জানে।সে বলল,

-আদিব তো বাড়ি নেই। শপিংয়ে গেছে।ফোন ফেলে গেছে।

নিরাশ হলো আকিব ছোট করে বলল,

-ও।

তারপর কিছু একটা ভেবে বলল,

-চাচি আদিব ফিরলে কি ওকে একটু আমাদের বাড়ি পাঠাতে পারবেন?

-আকিব জানোই তো কাল আদিবের আকদ।ছেলেটা শপিং করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে তোমাদের বাড়ি আবার কীভাবে যাবে? তাছাড়া, আদিব অনেক তো সাহায্য করলো তোমাদের, এবার ওর বিকল্প কিছু ভাবো।কতদিন আর এভাবে চলবে, হুম?আমি কি বলছি আশা করি বুঝেছো?

যথেষ্ট নমনীয় কণ্ঠস্বর তানিয়ার। কিন্তু কথা গুলো বেশ ধারালো।আদিবকে তার বড় চাচি যে আর এ বাড়ি মুখো হতে দিবে না সেটা বুঝতে কষ্ট হলো না আকিবের।সে চাচির কথার প্রেক্ষিতে ছোট করে বলল,

-হুম।

আকিবের উত্তরে তানিয়ার ঠোঁটের কোণে দেখা দিল চ‌ওড়া হাঁসি।সে মুখে হাঁসি রেখেই বলল,

-কাল সন্ধ্যার সময় চলে এসো কিন্তু।তোমাকে দেখে তোমার চাচু আর আদিব ভীষণ খুশি হবে।

-জি।

ছোট করে বলল আকিব এরপর তানিয়ার সৌজন্যমূলক কিছু কথার প্রেক্ষিতে কথা বলে ফোন রাখলো আকিব।তারিন তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল।থমথমে মুখে আকিবকে ফোন রাখতে দেখে বলল,

-কি হলো ?

-কি আবার হবে,আদিব আসতে পারবে না।তোমার ননদকে কিছু একটা বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাওয়াও।

-আদিব আসবে না, এই কথা আদিব বলেছে?

-না,বড় চাচি বলেছে।আদিব বাড়ি নেই।ফোন রেখে বিয়ের শপিংয়ে গিয়েছে।

আদিবের আকদের ব্যাপারে আশরাফ বোন ভাইদের ইতিমধ্যে অবগত করেছে।সেই সুবাদে পরিবারের লোকজন‌ও জানে সবটা।তারিন বলল,

-আদিব আসলে আরেক বার ফোন করো ও ঠিক আসবে।

-পারবো না‌।

-কেন ?কি হয়েছে ?চাচি কিছু বলেছে?

-হ্যাঁ বলেছে।তার ছেলের বিকল্প খুঁজতে বলেছে। অস্পষ্টভাবে বুঝিয়েছে তার ছেলে আমাদের আর কোনো সাহায্য করতে পারবে না।শোনো তারিন তুমি জাহান কে একটু সামলাও আমি রাকিবের সাথে কথা বলছি।সত্যি এভাবে আর চলতে পারে না। কতদিন কারো পা মলে এভাবে সাহায্য ভিক্ষা করা যায়!

কথাটা বলেই রাগে গজগজ করতে করতে স্থান ত্যাগ করলো আকিব।তারিন স্বামীর গমনরত পথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ডাইনিং টেবিলে ঢেকে রাখা খাবার গুলোর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।কাল রাতে আদিব ফোন করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে জাহানারা কে কিছু খাওয়াতে পারলেও আজ সকাল থেকে মেয়েটা দাঁতে একটা কুটোও কাটেনি।দুপুরের পর থেকে না খেয়ে দিয়ে একবারে নেতিয়ে পড়েছে।এদিকে শরীরে জ্বর‌ও ব‌ইছে পাল্লা দিয়ে।তার এমন অবস্থা দেখেই আকিব কে তারিন জোর করেছিল আদিবকে ফোন করতে। ভেবেছিল আকিবের ফোন পেলে আদিব নিশ্চয়ই আসবে।

তারিন যেদিন প্রথম আদিবের জাহানারার স্বামী হিসাবে অভিনয়ের কথা জানতে পেরেছিল তার সেদিন‌ই মনে হয়েছিল এমনভাবে কতদিন চলবে।আকিব কে বলেও ছিল এভাবে বেশিদিন চলতে দেওয়া যাবে না যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহানারা কে সুস্থ করার অন্য পথ দেখো কিন্তু তখন আকিব তার কথায় কান দেয় নি।অবশ্য এতে আকিবের‌ও দোষ নেই রাকিবের সেই পরিচিত ডাক্তার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইছিল সে।এর মধ্যে যে আদিব কে আর পাওয়া যাবে না সেটা কে জানতো। তারিন মাঝে মাঝে ভেবে পায় না এদের‌ই বা কেমন আক্কেল মেয়ে অসুস্থ আর তারা কোন না কোন ডাক্তারের ভরসায় বসে আছে।রাকিব বলতে সব এতোটা অন্ধ হয়েছে যে সে যা বলবে তাই!কেন দুনিয়ায় কি আর কোনো ডাক্তার নেই। যত্তসব!

নিজের মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জাহানারার ঘরে উপস্থিত হলো তারিন। জাহানারা তখন জ্বরে উত্তপ্ত থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে বিছানায়।নেহা তার পাশে বসা।কি যেন বলছে তাকে।তারিন কে দেখেই থেমে গেল।উঠে দাঁড়ালো।তারিনের মাঝে মাঝে নেহা নামের এই মেয়েটার উপর কেমন সন্দেহ হয়।কেন সেটা তারিন‌ নিজেও জানে না। কিন্তু মেয়েটাকে দেখলেই সন্দেহর দানাটা মনে ঘুরপাক খায়।

-জাহান একটু কিছু খেয়ে নাও।আদিব শপিংয়ে গেছে।আসতে দেরি হবে।ফোনে চার্জ নেই, তাই ফোন দিতে পারছে না।

খাবার ট্রে বিছানার উপর রাখতে রাখতে বলল তারিন। জাহানারা অবাক চোখে তার দিকে তাকালো।জ্বরে কাতর দুর্বল স্বরে উৎফুল্ল হয়ে বলল,

-আমার জন্য শপিংয়ে গেছে?

-হুম।

কথাটা বলতে বলতে আলমারিতে থাকা নতুন শাড়ি দুটোর কথা একবার মনে করে নিল তারিন।সে এ কয়দিনে আদিব কে যতটুকু চিনেছে সেটা থেকে এটা বুঝেছে যে ছেলেটা তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে না।তারিনের মন বলছে রাত যতোই হোক ছেলেটা একবার হলেও এ বাড়ি আসবে।কাল কথা দিয়েছিল তো সে জাহানারা কে সুতরাং আসবেই, তখন শাড়ি দুটো তাকে দিয়ে বলবে জাহানারা কে দিতে।তারিনের কথা শুনে জাহানারা আশ্বস্ত হলো।বিনা বাক্যব্যয়ে চুপচাপ নিজের হাতে তুলে নিল খাবার প্লেট। তাল বাহানা না করে খেয়ে নিল সবটা। খাওয়ার পর নিজে থেকে ঔষধ খেলো। তারিন হাফ ছাড়ালো।

রাত ঠিক দশটার দিকে তারিনের ভাবনা অনুযায়ী আদিব এসে দাঁড়ালো তাদের দরজায়।ঘামে জবজবে শরীর হাতে দুইটা শপিং ব্যাগ।তারিন তাকে দেখে বুঝলো বাড়ি না ফিরে ছেলেটা সোজা এখানে এসেছে।তারিন আদিবের হাতে ব্যাগ দুটো দেখেও কিছু জিজ্ঞেস করলো না।আদিব তারিনের সাথে সামান্য কটা কথা বলে সোজা জাহানারার ঘরে গেল। জাহানারা তখন গভীর ঘুমে। অসুস্থ ক্লান্ত শরীরে ঘুম জাঁকিয়ে বসেছে চোখে।আদিব চেয়ার টেনে তার পাশে গিয়ে বসলো। জ্বরে উত্তপ্ত লাল মুখটা দেখে বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো তার।মেয়েটার লালচে মুখটা জানান দিচ্ছে তার তীব্র জ্বরের কথা।আদিব হাত বাড়িয়েও আবার পিছিয়ে নিল হাতটা। পকেট থেকে স্যানিটাইজার বের করে দুই ফোটা হাতে ফেলে ভালোভাবে ঘষে হাত জীবাণু মুক্ত করলো। তারপর হাত ছোঁয়ালো জাহানারার কপালে।আদিবের হাতের শীতল স্পর্শ পেয়ে একটু কেঁপে উঠলো জাহানারা।ঘুমটাও ছুটে গেল তার।চোখ পিটপিট করে তাকালো।ঘাড় ফিরিয়ে আদিব কে দেখতেই মুখে ফুটে উঠলো হাঁসি ।গদগদ হয়ে বলল,

-তুমি এসেছো?

-হুম।তোমার শরীর কেমন এখন?

-ভালো।খুব ভালো।

চোখ লালা হয়ে আছে। কণ্ঠে শরীরের সকল দুর্বলতা তারপরেও মেয়েটা বলছে সে ভালো আছে।আদিব ম্লান হাসলো।বলল,

-আমাকে মিস করছিলে।

নিজের কথাটায় নিজের কানে ঝংকার তুললো আদিবের।সে বুঝে পেল না এমন একটা প্রশ্ন সে কেন করলো।তবে এটা বুঝলো তার অবচেতন মন জানতে চাইছে এটা। জাহানারা তার প্রশ্নের জবাবে বলল,

-অনেক।তুমি মিস করেছো আমায়?

-হুম।

এটা সত্যি। আদিব বিগত চারদিনে খুব বেশি মিস করেছে জাহানারা কে।প্রতি ক্ষণে মনে পড়েছে তার মেয়েটাকে।বুঝতে পেরেছে মানবিকতা দেখাতে গিয়ে এক অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে সে।

-তাহলে আসো নি কেন?

-তোমাকে বলেছিলাম না,আমার মা অসুস্থ।সেই জন্য‌ও আসতে পারেনি।

-কি অসুখ হয়েছে তার?এখনো কি সুস্থ হয় নি?

-এখন সুস্থ তবে আমি তার পাশে থাকলে তার ভালো লাগে। তাই এই কয়দিন তার কাছে ছিলাম।বুঝেছো?

-হ্যাঁ, বুঝেছি।এই গুলো আমার জন্য?

আদিবের পাশে রাখা শপিং ব্যাগের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো জাহানারা।আদিব ব্যাগ গুলোর দিকে তাকালো। শপিংয়ের সময় রুবাইয়ার জন্য কাপড় পছন্দ করতে করতে হঠাৎ কি মনে করে শাড়ি দুটো জাহানারার জন্য নিয়ে নিল সে।তৃপ্তি ভাইয়ের কান্ডে অবাক হয়ে কারণ জানতে চেয়েছিল কিন্তু আদিব কিছু বলতে পারেনি।আসলে তার কাছে কোন কারণ ছিলোই না বলার।তার শুধু মনে হয়েছে শাড়ি দুটোতে জাহানারা কে মানাবে, ব্যাস।

জাহানারা হাত বাড়িয়ে শাড়ির প্যাকেট দুটো নিতে যেতেই আদিব থামিয়ে দিল তাকে।চীনে নতুন ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।যা দ্রুততার সাথে ছাড়াচ্ছে।এই সময় একটু সতর্ক না হলে সমস্যা আছে।সে নেহাকে ডেকে ওগুলো আলমারিতে রাখতে বলল জাহানারা কে বলল সে কাল দেখবে। জাহানারা জেদ করায় ভাইরাসের কথা তুলল আদিব। জাহানারা বুঝলো তার কথা।আদিব নেহাকে নির্দেশ দিল হাত ভালো করে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে তবেই অন্য কিছু স্পর্শ করতে।

আদিব ক্লান্ত ছিল যার কারণে আজ আর বেশিক্ষণ বসলো না। জাহানারার খাওয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালো।আদিব যখন দরজার সামনে তখন জাহানারা পিছু ডাকলো তাকে।বলল,

-কাল আসবে তো?

জাহানারার প্রশ্নে আদিবের মনে পড়লো কাল তার আকদ।সে থমকালো। হঠাৎ কেমন অস্বস্তি হলো। জাহানারার মুখটার দিকে তাকিয়ে অকারণে বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠলো।তবে সেটা জাহানারা কে বুঝতে না দিয়ে ম্লান হেঁসে বলল

– আসবো।

এরপর আর এক মুহূর্ত অপচয় না করে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।

_________
পরেরদিন সকাল পার হলো, দুপুর পার হলো কিন্তু আদিবের দেখা পেল না জাহানারা।তবে আদিবের দেখা না পেলেও আদিবের বিয়ের সংবাদ ঠিক তার কানে এলো।কথাটা শোনা মাত্রই উতলা হয়ে উঠলো সে।ঘরের জিনিসপত্র এদিক ওদিক করে ছুঁড়তে লাগলো।তারিন বাঁধা দিতে যা‌ওয়ায় আঘাত লাগলো তার। রক্ত ঝরলো তারিনের শরীর বেয়ে। আকিব বোনের পাগলামো সহ্য করতে পারলো না।হাত উঠালো তার গায়ে। জাহানারা ছিটকে পড়লো মেঝেতে নেহা গিয়ে ধরলো তাকে।তারিন থামালো আকিব কে।জায়েদ বাড়ি নেই। শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর সে সালেহার কবর জিয়ারত করতে যায়। সেখানে বসে থাকে একেবারে ইশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরে।আজ‌ও ফেরেনি সে।
আকিব রাগে দুঃখে বোনকে ঘর বন্দি করলো। জাহানারা ভাইয়ের এ আচরণ মেনে নিতে পারলো না।সে আরো চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো । কিন্তু আকিব তার সেসব চিৎকার চেঁচামেচি কানে তুললো না। জাহানারা এক সময় ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।জানালা দিয়ে তার এমন অবস্থা দেখে আহাজারি করে বাড়ির মানুষ জড়ো করলো নেহা।আকিব ছুটে এলো।বোনের অবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে বড় চাচাকে ফোন করলো। আশরাফ বাড়িতেই ছিল।ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে ছুটি তার।আকিবের ফোন পাওয়া মাত্র উপস্থিত হলো সেখানে। জাহানারা কে জরুরি ভিত্তিতে ****ইনজেকশন দিল। তৎক্ষণাৎ জাহানারার জ্ঞান না ফিরলেও কিছুটা উন্নতি হলো তার অবস্থার‌।

বোনের অবস্থা দেখে অনুশোচনায় চোখ ভিজে উঠলো আকিবের। আশরাফকে জাহানারা গায়ে হাত তোলার কথা বলতে বলতে অঝোরে অশ্রু গড়ালো চোখ দিয়ে। আশরাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-ও নিজের মাঝে নেই আকিব। তোদের ওর দিকটাও তো বোঝা উচিত।

-রাগে মাথা ঠিক ছিল না চাচু।স্যরি।

-আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে।এখন জ্ঞান ফিরলে আর কিছু বলিস না।

আকিব মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। জাহানারার জ্ঞান ফিরলো ঘণ্টা খানেক পর । জ্ঞান ফিরতেই তার মনে পড়লো সন্ধ্যায় আদিবের বিয়ে।কথাটা মনে হতেই দিক বেদিক ভুলে ছুটলো সে। জাহানারা যখন নিচে নামলো আকিব তখন লনে।ফোনে কথা বলছিল কারো সাথে জাহানারা কে ছুটতে দেখে সে উচ্চস্বরে পিছু ডাকলো কিন্তু জাহানারা থামলো না।সে উদ্ভ্রান্তের নেয় ছুটে গেল বড় চাচার বাড়ির দিকে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

সৌরকলঙ্ক পর্ব-১৩+১৪

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৩

গতকাল হঠাৎ তানিয়ার মেজ ভাইয়ের ছেলে এসে উপস্থিত হলো তার বাড়ি। খুলনায় ছোট ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে তারা ,তাই তানিয়াকে সাথে নিতে চায়।বাড়ি তে আদিব আশরাফ কেউ নেই তানিয়া একা শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছিল।ভাতিজার কথা শুনে সে আর দ্বিরুক্তি করলো না।তাদের সঙ্গ নিল।মেয়ে দেখে পছন্দ হলো সকলের, আ্যংটি পরিয়ে বিয়ের দিন ধার্য করলো সেই সময়।তানিয়া বুঝলো সবাই প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল শুধু তাকে কিছু জানানো হয় নি। খারাপ লাগলো তার তবে কিছু বলতে পারলো না। আশরাফের সাথে বিয়ে করার পর থেকে তার বাপের বাড়ির লোকজন তাকে প্রায় এড়িয়েই চলে।কোন আচার অনুষ্ঠান বাঁধলে কিংবা বাড়ি কিছু হলে সবার শেষে সে খবর পায়।এ নতুন না।এখন বিষয়গুলো তার গা স‌ওয়া হয়ে গেছে।তবে মাঝে মাঝে অভিমান হয় ভাইদের উপর।সে ভাই ভাই করে জীবন পাত করে অথচ তার ভাইরা তাকে গণনায়‌ও ধরে না।তানিয়া জানে বাবা যতদিন বেঁচে আছে ততদিন পর্যন্ত ঐ বাড়িতে তার সমাদর আছে তারপর হয়ত কেউ আর তার খোঁজ নেওয়ার সৌজন্যটুকুও দেখাবে না।এসব কথা ভেবে নিশ্বাস ভারী হয় তানিয়ার। দ্বীর্ঘশ্বাসের সংখ্যা বাড়ে।

মেয়ে দেখার পর তানিয়ার মেজ বোন জেদ ধরলো তারা তানিয়াকে সাথে নিয়ে যাবে ঢাকায়।বিয়ের দিন ক্ষণ পড়ে গেছে, এখন থেকেই আয়োজন শুরু করতে হবে।তানিয়া আপত্তি জানালো, বাড়ি কেউ নেই ফাঁকা বাড়ি রেখে সে যাবে না। কিন্তু তার বোন শুনলো না ফাঁকা বাড়িতে তানিয়া একা কি করবে এসব নানা কথা বলে রাজি করালো তানিয়া কে।বোনের জেদের কাছে হার মানল তানিয়া। আশরাফকে ফোন করে বাপের বাড়ি যা‌ওয়ার কথা বলে র‌‌ওনা দিল তাদের সাথে। এরমধ্যে আদিবের সাথে একবার কথা হয়েছিলো কিন্তু তাকে জানানো হয় নি সে ঢাকা যাচ্ছে।

বাবার বাড়ি পৌঁছানোর পর তানিয়া দেখলো অনুষ্ঠানের তোড়জোড় ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে তার কোন প্রয়োজনই নেই।ভাবির বাপের বাড়ির লোকজন‌ই এখানে সর্বেসর্বা।তার প্রতি ভাই ভাবির উদাসীনতা দেখে মনে হলো এখানে সে না আসলেই ভালো হতো, একবারের জন্য মন চাইলো কোন একটা অযুহাত দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়তে কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা আর হলো না।সবার ব্যস্ততার মাঝে একঘেয়েমি ঘিরে ধরলো তাঁকে ভাবলো ঢাকায় যখন এসেছেই তখন বসে না থেকে তৃপ্তি আর ওর বাচ্চাদের জন্য কিছু কেনাকাটা করা যাক।যেমন ভাবা তেমন কাজ বাবাকে বলে বাড়ি থেকে একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নিকটস্থ শপিং মলের উদ্দেশ্যে।গাড়ি হাসপাতালের সামনে দিয়ে যা‌ওয়ার সময় হাসপাতালের গেঁটে চোখ পড়লো তার।আদিব তখন হাসপাতালে ঢুকছে।আদিব কে দেখে ড্রাইভার কে গাড়ি থামাতে বলল তানিয়া। ড্রাইভার কে তার জন্য সেখানে অপেক্ষা করতে বলে কিছু না ভেবেই ছুটে গেল আদিবের দিকে।ছেলেকে একবার পিছু ডাকতে গিয়েও আশেপাশে মানুষজনের ভিড় দেখে থেমে গেল।পিছু নিল ছেলের।ছেলে এসময় হাসপাতালে কি করছে মনে এ প্রশ্ন উদয় হতেই ভেতরটা খুঁত খুঁত করে উঠলো।সবার প্রথমে মনে এলো দিপ্তীর কথা মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা।তার কিছু হলো না তো?এ ভাবনায় মন ব্যাকুল হলো।পায়ের গতি বাড়ালো।আদিব কে ধরবে ধরবে ভাব এমন সময় ২৬৭নং রুমে প্রবেশ করলো আদিব।তানিয়া রুম নাম্বার টায় একবার চোখ বুলিয়ে ঘরের খোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। দৃশ্যমান হলো ঘরের পরিস্থিতি।কানে এলো জাহানারা আর আদিবের কথোপকথন। স্থবির হলো পা।থমকে গেল সে।ছেলে তাকে মিথ্যা কথা বলে এখানে এসেছে, জাহানারার সেবা শুশ্রূষা করছে এই ব্যাপারটা হজম হলো না তার।ছেলেকে যে মেয়ে থেকে দূরে রাখতে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বাবার কাছে হাত পেতে টাকা নিয়েছে, ভাইদের কাছে ছোট হয়েছে ,ভাবিদের এতো এতো কথা সহ্য করছে, ছেলে সেই মেয়ের শরীর ঘেঁষে বসে আছে এটা সহ্য করতে পারলো না সে। চোয়াল শক্ত হলো তার।ধীর পায়ে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে।বের হলো হাসপাতাল থেকে। অপেক্ষা করতে লাগলো ছেলের।সময় অতিবাহিত হলো, একসময় হাসপাতাল গেটে দেখা মিলল আদিবের।তানিয়া ফোন বের করে কল লাগালো ছেলেকে ।জানতে চাইলো সে কোথায় আছে।আদিব জানালো সে দিপ্তীর বাড়ি আছে।ছেলের মুখে মিথ্যা শুনে দাঁতে দাঁত চাপলো তানিয়া।ছেলের মিথ্যা শুনে রাগ হলো তার।রাগে মাথার রগ দপদপ করে উঠলো।নিজেকে অতি সাবধানে সামলে ছেলেকে বলল গাড়িতে এসে বসতে।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল ছেলের সাথে এ বিষয়ে কথা বলা দরকার। পরিষ্কার কথা।যার জন্য ড্রাইভার কে গাড়ি নিতে বলল খুলানর দিকে।বাবাকে ম্যাসেজে জানালো হঠাৎ একটা জরুরি কারণে বাড়ি যেতে হচ্ছে তাকে।এখন কিছু বলতে পারছে না।পরে কথা বলবে। গাড়ি আগামীকাল পাঠিয়ে দেবে।

তানিয়া আর আদিব যখন বাড়ি পৌঁছাল তখন রাত প্রায় দশটা।তানিয়া রাবেয়া কে বলে গাড়ি চালককের তদারকির দায়িত্ব দিয়ে, শীতল গলায় আদিব কে বলল,

-আদিব ফ্রেশ হয়ে আমার ঘরে আসো।

এরপর আদিব কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই স্থান ত্যাগ করলো।আদিব মায়ের প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়ে একটা দম ফেলল।পা বাড়ালো নিজের ঘরে।আজ অন্যদিনের থেকে একটু বেশি সময় নিলো ফ্রেশ হতে।এ সময়ের মধ্যে মনে মনে গুছিয়ে নিলো মা যদি হাসপাতালে যা‌ওয়ার ব্যাপারে তার কাছে কিছু জানতে চাই তাহলে কি বলবে।

আদিব মায়ের ঘরের দরজায় একবার টোকা দিতেই তানিয়া গমগমে গলায় ভেতরে আসতে বলল তাকে।সে ছেলের অপেক্ষাতেই ছিল।আদিব ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো তানিয়া বিছানার উপর গুম হয়ে বসে আছে।আদিব কে ভেতরে ঢুকতে দেখে তার দিকে তাকালো তানিয়া।কোন ভণিতা ছাড়া প্রশ্ন করলো ,

-হাসপাতালে কি করছিলে?

-জাহানারা কে দেখতে গিয়েছিলাম।

নিজের ভেবে রাখা উত্তরটা সময় অপচয় না করেই বলল আদিব।তানিয়া দৃষ্টি রুক্ষ হলো।মায়ের দৃষ্টির সামনে নড়েচড়ে দাঁড়ালো আদিব।এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো মা কি কোনোভাবে সম্পূর্ণ সত্যি জেনে গেছে? কিন্তু আবার মনে হলো সেটা কি করে সম্ভব।সে জাহানারার স্বামী হ‌ওয়ার নাটক করছে, এ বিষয়টা রাকিব ব্যতীত বাইরের কেউ জানে না, এমন কি আকিবের স্ত্রী তারিন‌ও না।তাহলে?তার ভাবনা চিন্তার মধ্যে তানিয়া আবার বলল,

-কেন গিয়েছিলে?তোমাকে কি আমি বলিনি ঐ মেয়ে থেকে দূরে থাকবে?

তানিয়ার শীতল কণ্ঠ স্বর আদিব অবাক চোখে তাকালো।তানিয়া ছেলের চোখে চোখ রেখে বলল,

-আদিব তুমি কি চা‌ও সেটা স্পষ্ট করে বলবে আজ ,তুমি কি চাও ঐ মেয়েকে বিয়ে করতে।

রাগে ফুঁসছে তানিয়া।আদিব মায়ের কথা শুনে হতাশ হলো।”মানে কীসের মধ্যে কি পানতা ভাতে ঘি” এই টাইপের কথা বলছে তার মা।সে একটা হতাশ শ্বাস ফেলল বলল,

-মা তুমি ওভাররিয়াক্ট করছো

-তুমি দিনের পর দিন ঐ মেয়ের স্বামী সেজে তার সাথে রং ঢং করছো !আর আমাকে বলছো আমি ওভাররিয়াক্ট করছি?

দাঁতে দাঁত পিষে বলল তানিয়া। আদিব চমকালো।বুঝলো তার মা কোনো ভাবে সত্যিটা জেনে গেছে।আদিবের মুখের পরিবর্তিত অভিব্যক্তি দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো তানিয়া ,বলল,

-কি মনে করেছিলে আমার থেকে সত্যি লুকাবে আর আমি কিছু বুঝতে পারবো না!

-মা তুমি যেমন ভাবছো তেমন কিছু না।আমি জাস্ট মানবিকতার খ্যাতিরে ওদের হেল্প করছি। ব্যাস।

আদিব নিজের সপক্ষে বলল।এরপর এগিয়ে গিয়ে মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে, জাহানারার জ্ঞান ফেরার পর থেকে যা যা ঘটেছে সমস্তটা খুলে বলল তানিয়া কে।তানিয়া চুপচাপ শুনলো সবটা। শেষ হতে দিলো ছেলের কথা। জাহানারার মানসিক অসুস্থতার কথা তার কানে গিয়েছিল কিন্তু তার সুস্থতার দায় যে তার ছেলের কাঁধে এসেছে সেটা জানা ছিল না।আদিবের কথা শেষ হতেই সে বলল,

-কে পাগল হলো কি,কি হলো না, তাতো তোমার দেখার দরকার নেই আদিব।শোনো আদিব, তুমি ওদের চেন না,ওরা খেতে দিলে শুতে চাই এমন ধরনের মানুষ। তোমার ভালো মানুষীর সুযোগ নিচ্ছে ওরা।আমার কথা শোনো ,যা করছো করছো এবার ওদের সাফ সাফ বলে দাও তুমি এসব নাটক ফাটক করতে পারবে না।আমি চাই না তুমি ঐ মেয়ের আশে পাশে থাকো।

তানিয়ার এমন স্বার্থপর মনোভাবটা ভালো লাগলো না আদিবের।তার মায়ের রাগ বেশি, সে জেদী,নিজের মতো থাকতে পছন্দ করে এই জিনিস গুলো মানতে পারলেও তার মায়ের এই স্বার্থপর মনোভাব মানতে পারলো না সে।চোখ মুখে অন্ধকার নামলো।গম্ভীর গলায় বলল,

-মেয়েটা অসুস্থ মা।আমার একটু সহযোগিতায় যদি ও সুস্থ হয়ে ওঠে তো ক্ষতি কী?

-আর যদি কখনো সুস্থ না হই? তাহলে কি সারাজীবন ওর বর হ‌ওয়ার নাটক করবে তুমি! হ্যাঁ?

তানিয়ার রাগান্বিত কণ্ঠ স্বর।আদিব বলল,

-তার প্রয়োজন পড়বে না। তাছাড়া আমি সেজ চাচুকে বলেছি সামনের মাসে আমি চলে যাবো। এরমধ্যে ওরা ঠিক কোনো না কোন ব্যবস্থা করে নেবে।

কণ্ঠে দৃঢ়তা আদিবের।তানিয়া ছেলের দিকে তাকালো।ছেলেকে আজ অন্যরকম লাগলো তার কাছে।অবাধ্য, অনড়।অজনা ভয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো তার।সে হড়বড়িয়ে বলে উঠলো,

-তোমার বড় মামা রুবাইয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে।

-স্যরি?

হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলানোতে মায়ের কথা বুঝতে অসুবিধা হলো আদিবের।সে ভ্রূতে ভাজ ফেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তানিয়া একটু সময় নিয়ে বলল,

-তোমার বড় মামা রুবাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে দিতে চায়।সে জন্য প্রস্তাব দিয়েছে।

-শামীমের আশরাফ কে পছন্দ না, কিন্তু তার ছেলেকে পছন্দ! ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না তানিয়া?

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল আশরাফ। আশরাফের হঠাৎ আগমনে চমকালো তানিয়া। ভড়কালো কিঞ্চিৎ।বাবাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো আদিব। আশরাফ কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে সোফায় বসলো।জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাস হাতে নিয়ে ফের বলল,

-কি হলো!থামলে কেন?কথা বলো ছেলের সাথে।আমার উপস্থিতি ভুলে যাও।

নির্লিপ্ত কণ্ঠে কথাটা বলে গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াল আশরাফ। আশরাফের ঠেস দেওয়া কথার রেষ তখনো তানিয়ার কানে বাজছে,সে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো আশরাফের দিকে, সেভাবেই বলল,

-আশরাফ আর আশরাফের ছেলের মধ্যে পার্থক্য আছে, যার জন্য

-টাকা আর পাউন্ডের বুঝি?

তানিয়ার কথা শেষ করতে না দিয়ে কটাক্ষের সুরে বলল আশরাফ।তানিয়ার চোয়াল শক্ত হলো।সে দাঁত পিষে বলল,

-তুমি ভুলে গিয়ে থাকলে, তোমাকে একবার মনে করে দিই যে,তোমার ছেলের পাউন্ড থেকে তাদের ডলার‌ও কম নেই। সুতরাং যা বলবে ভেবে চিন্তে বলবে।

তানিয়ার কথায় আশরাফের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্যের হাঁসি।সে অর্ধেক পানি ভর্তি গ্লাসটা সামনের টি টেবিলের উপর রাখলো। হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল,

-ভাবনা চিন্তা করার জোর নেই।তুমিই বলো হঠাৎ তোমার বড় লোক ভাইয়ের আমার ছেলেকে মেয়ের জন্য বেছে নেওয়ার কি কারণ?

-আদিব আমার ছেলে এটাই যথেষ্ট।

তানিয়া সময় নষ্ট না করে বলে উঠলো।তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট।তানিয়ার কথাটা কানে যেতেই উচ্চ স্বরে হাসলো আশরাফ।বলল,

-তাই না কি!তা বেশ।ভালো।ভালো। আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা মা ছেলে তাহলে নিজের আলোচনা শেষ করো, আমি ফ্রেশ হয়ে নিই।

আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো আশরাফ।তানিয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো তার কাজ কর্ম।বাবা মায়ের মধ্যে এই সুপ্ত রেষারেষি দেখে গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আদিব। আশরাফ চলে যেতেই তানিয়া একটা শ্বাস টেনে উঠে দাঁড়ালো। ছেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

-আদিব , তোর বড় মামা অনেক আশা নিয়ে আমাকে এই প্রস্তাব টা দিয়েছে ,আমি তাকে না করতে পারে নি

-না করতে পারো নি মানে?তুমি কি মামাকে কথা দিয়োছো?
মায়ের কথা কেটে প্রশ্ন করলো আদিব।তানিয়া ছেলেকে আশ্বস্ত করে বলল,

-না কথা দেয় নি।বলেছি তোর মতামত নিয়ে জানাবো।তুই সময় নে। ভাব।রুবাইয়া মেয়ে হিসাবে খুব ভালো। আমি এক দুইবার কথা বলেছি তো ওর সাথে,কি আন্তরিক ব্যবহার!তার‌উপর যেমন চেহারা, তেমন লেখা পড়া।নিজের ভাতিজি বলে বলছি না, এই যুগে অমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দায়।

রুবাইয়ার প্রশংসায় আরো কিছু বাক্য ব্যয় করলো তানিয়া তবে আদিব সেসব শুনলো বলে মনে হলো না।তাকে অন্যমনস্ক দেখালো।তানিয়া অবশ্য সেদিকে খেয়াল করলো না।সে নিজের মতো ভাতিজির প্রশংসা চালিয়ে গেল।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৪

এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল আশরাফ আর শামীম।এ বন্ধুত্বের দরুন আশরাফের আসা যা‌ওয়া ছিল শামীমের বাড়ি। সেখান থেকেই তানিয়ার সাথে তার প্রেমের সূত্রপাত হয়।দুই বছর শামীমের অলক্ষ্যে তানিয়ার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যায় আশরাফ।এরপর যখন তানিয়ার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ পড়তে শুরু হয় ,তখন বন্ধুর দ্বারস্থ হয় আশরাফ।বন্ধু তার দিক টা বুঝবে এমন আশায় বন্ধুর সামনে সাহস নিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আশরাফের মনের ভাবনাকে তুষের নেয় উড়িয়ে দিয়ে তার উপর ক্ষিপ্ত হয় শামীম।তার বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে তার বোনকে সম্পত্তির লোভে ফাঁসিয়েছে আশরাফ এমন দোষ আরোপ করে। শামীমের কথায় ক্ষত বিক্ষত হয় আশরাফের ভেতরটা। আশরাফের আর্থিক অবস্থা তাদের মতো অত উন্নত না হলেও কখনো কারো কাছে হাত পাততে হয় নি। তাছাড়া শামীম তাকে এতো বছর ধরে চেনার পরেও এমন কথা বলতে পারলো…… এটা ভেবে মুষড়ে পড়ে সে। বন্ধুর উপর অভিমান করে সিদ্ধান্ত নেয় তানিয়ার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করবে।নিজের মনের কথা কাগজের পৃষ্ঠায় সাজিয়ে গুছিয়ে লিখে পাঠায় তানিয়া কে।ভুলে যা‌ওয়ার চেষ্টা করে তাকে। আশরাফের সেই চেষ্টা বিফল করে দিয়ে তার দরজায় হাজির হয় তানিয়া।জাহির করে নিজের ভালোবাসা। আশরাফ কে জানায় সে নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে ।এখন আশরাফ তাকে বিয়ে না করলে মৃত্যু ছাড়া তার আর গতি নেই। অজ্ঞাত সব ভাবনা চিন্তা ফেলে,শামীমের অপমান দূরে ঠেলে আশরাফ বিয়ে করে তানিয়াকে।

তানিয়ার বিয়ের খবর বাড়ি পৌঁছানোর পর তানিয়ার মা বিছানা নেয়, তোফায়েল মেয়ের সাথে সব সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা দেন,শামীমের জন্য তানিয়া এমন একটা কাজ করেছে বলে শমীম কে যাচ্ছে তাই শোনান।এই ঘটনার পর শামীম রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে আশরাফের কাছে ছুটে যায়। আশরাফ তখন বউ নিয়ে খুলনায়।আহাসান‌উল্লাহ ছেলের হঠাৎ বিয়ে করে বাড়ি ব‌উ নিয়ে আসায় রাগ করলেও ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে। জাহানারা বেগম‌ও ধৈর্যের সাথে সবটা মেনে নিয়েছে। শ্বশুর বাড়ি থেকে তিরস্কার পেলেও বাবা মায়ের নরম ব্যবহারে আশরাফ সবে মাত্র স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল ঠিক সেই সময় তার সামনে উপস্থিত হয় শামীম। আশরাফ *****বাজারে ছিল,সাথে জায়েদ।দুই ভাই মায়ের কথা মতো জরুরি কিছু সদয় করে ফিরছিল। হঠাৎ সেখানে শামীমের অপ্রত্যাশিত আগমনে কিঞ্চিৎ চমকালো আশরাফ। শামীমের চোখে মুখে তখন রাগের গনগনে আগুন।দ্বীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের দরুন শামীমের এই রাগকে চেনে আশরাফ।এমন রাগে শামীমের হুঁশ জ্ঞান থাকে না ,কি বলে, কি করে নিজেও জানে না, এটা খুব ভালো করে জানে আশরাফ। আশরাফ শামীমের মাত্র অতিরিক্ত রাগের কথা ভেবেই তার দিকে এগিয়ে গেলে, নরম স্বরে সাবধানে কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু শামীম তার কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না তাই তো কোন কিছু না ভেবেই আশরাফের গায়ে হাত তুললো।সপাটে চড় বসালো আশরাফের গালে ,শুধু তাই নয় হিংস্র বাঘের মতো খুবলে ধরলো আশরাফের শার্টের কলার। গালাগালি করতে লাগলো অকথ্য ভাষায়।ভরা বাজারে মানুষ জনের মধ্যে শামীমের এমন নিয়ন্ত্রণ হীন আচরণ দেখে জায়েদ হতভম্ব হলো, ভাইকে শামীমের থেকে ছাড়াতে এগিয়ে গেল।ছাড়াতে চাইলো শামীমের বজ্র মুষ্টি থেকে আশরাফ কে। কিন্তু শামীমের আক্রোশের কাছে জায়েদের প্রচেষ্টা সফল হলো না, উলটো আশরাফ কে ছেড়ে রাগের মাথায় সজোরে ধাক্কা দিল জায়েদকে।সাথে সাথে পিচ ঢালা রাস্তায় ছিটকে পড়লো জায়েদ……

-বাবা!

-হু!

আদিবের ডাকে চমকে উঠলো আশরাফ।বেরিয়ে এলো সেই বী”ভৎস স্মৃতি থেকে।হাত দিয়ে কানের পাশের ঘাম মুছে সামনে টেবিলের উপর থাকা পানি ভর্তি গ্লাসটা হাতে তুলে নিল, ঢকঢক করে পান করলো পানি।একটু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো আশরাফ। তারপর আদিবের উদ্দেশ্যে বলল,

-কিছু বলবে?

আশরাফ নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও আদিবের চোখ এড়ায়নি বাবার অস্থিরতা।সে বলল,

-তোমাকে অস্থির দেখাচ্ছে!কিছু হয়েছে?

-না তেমন কিছু না।তোমার ডাকে চমকে উঠেছি এই।

আদিব এগিয়ে গেলো।বাবার সামনে রাখা সোফায় বসে আশরাফের দিকে সন্দেহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

-সত্যি?

-তোমার মায়ের মতো কথা বলো না!তোমার মুখে মানাচ্ছে না।

-সব কথায় মা-কে টানো কেন?

-বেশি ভালোবাসি তো তাই।

ফিচলে হেঁসে বলল আশরাফ।বাবার কথায় মৃদু হাসলো আদিব। আশরাফ ফের বলল,

-হঠাৎ এ সময় বাবার কাছে! কিছু বলবে?

-হুম।মা কালকে যে বিষয়ে কথা বলছিল সেটা নিয়ে একটু কথা বলার ছিল।কি করবো বলতো?

-তোমার কি মনে হচ্ছে সেটা বলো আগে।

-সত্যি কথা বলতে আমি এখন বিয়ে সাদি করতে চাই না।

-বিয়ে শাদি করতে চাও না, না কি রুবাইয়া কে বিয়ে করতে চাও না?

ছেলের কথা কেটে জিজ্ঞেস করলো আশরাফ।আদিব বাবার দিকে তাকালো। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল,

-দুটোই।

-তাহলে সেটা তোমার মা কে বলো।

-বলেছি।কাজ হয় নি।মায়ের এক কথা, মেয়েটা ভালো, একটু ভেবে দেখ, সময় নে।

-তাহলে সময় নাও ।ভাবো।

-তোমার কোন আপত্তি নেই এই সম্বন্ধে?

-না।বিয়ে করবে তুমি, সংসার করবে তুমি, সেখানে আমি আপত্তি করে কী করবো।

-এমন দায় সারা কথা বলছো কেন?

-দায় সারা কথা বলছি না,সত্যি বলছি।দেখো ,ভাবো ,সময় না‌ও । তারপর সিদ্ধান্ত না‌ও। তোমার জীবন, তোমার যেটা ভালো মনে হয় তাই করো।বড় হয়েছে তুমি,এখন তো অন্তত মা বাবার সিদ্ধান্তের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসো।বি ইয়োর সেল্ফ আদিব।

ছেলের মুখে দৃষ্টি রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল আশরাফ।আদিবের মনে হয়েছিল মামার সাথে মন মালিন্যের কারণে বাবা হয়ত এই সম্বন্ধে আপত্তি জানাবে কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে বাবার এই ইতিবাচক মনোভাব তাকে নিরাশ করলো।সে ভেবেছিল বাবার আপত্তির জের ধরে মা-কে না করবে কিন্তু বাবার কথা শুনে মন পরিবর্তন করলো। সিদ্ধান্ত নিল রুবাইয়ার সাথে কথা বলার। সম্বন্ধ টা নিয়ে ভেবে দেখার।

______________
জাহানারার ডিসচার্জের পর তাকে খুলনা নিয়ে আসা হলো ,আদিব নিজে গিয়েছিল তাকে যশোর এয়ার পোর্টে রিসিভ করতে। ডিসচার্জের সময় আদিব থাকেনি এই নিয়ে জাহানারা খুব কান্না কাটি করেছে, কষ্ট পেয়েছে সে, যার কারণে তিন দিন পর আদিবের সাথে দেখা হলেও সে কথা বলল না।আদিব বুঝলো সেটা। কিন্তু তার‌ই বা কি করার ছিল। জাহানারার কাছে আসার জন্য তানিয়াকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করতে করতে তার পুরো তিন দিন লেগে গেল। জাহানারার থমথমে মুখটা দেখে একটা হতাশ শ্বাস ফেলল আদিব।

সারা রাস্তা আদিবের সাথে কোন কথা বলল না জাহানারা কিন্তু বাড়ি ফিরতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো।একের পর এক অভিযোগ করলো।আদিব একটু তাকে ভালোবাসে না,তার কেয়ার করে না ইত্যাদি ইত্যাদি ।আদিব চুপ চাপ জাহানারার অভিযোগ মাথা পেতে নিল।অনেকটা সময় নিয়ে খ্যান্ত হলো জাহানারা।আদিব সহ বাকি সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সারাদিন কোন রকমে কাটলেও রাত বাঁধলো আরেক বিপত্তি। জাহানারা হাসপাতালে থাকাকালীন আদিব রাতে থাকলেও বাইরে এদিক-ওদিক হাঁটা হাঁটি করে ওয়েটিং রুমে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিত।জাহানারা কিছু বললে তার অসুস্থতার দোহাই দিত। কিন্তু আজ যখন জাহানারা ঘুমাতে যা‌ওয়ার প্রস্তুতির সময় আদিব কে নিজের সাথে, নিজের পাশে বিছানায় শোয়ার কথা বলল তখন যেন চমকে উঠলো আদিব।অবাক চোখে তাকালো জাহানারার দিকে।তারপর যখন নিজেদের মিছিমিছি সম্পর্কের কথা মনে হলো তখন কিছু না বলে হুট করে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।বাইরে এসেই শব্দ করে একটা দম ফেলল।সময় অপচয় না করে সোজা হাঁটা দিল ছোট চাচুর কাছে। জাহানারার সাথে শাহেদ‌ও এসেছে খুলনা।শাহেদ জায়েদের সাথে কথায় ব্যস্ত ছিল।আদিব কে একপ্রকার তার দিকে ছুটে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো,

-কি হয়েছে আদিব?জাহান ঠিক আছে?

চাচুর প্রশ্ন শুনে আদিব সেজ চাচার দিকে এক পলক তাকালো জোরপূর্বক হাসলো। হেঁসে বলল,

-জাহানারা ঠিক আছে চাচু।তুমি একটু এদিকে এসো, তোমার সাথে কথা আছে।

-কি কথা?

বলতে বলতে সামনে এগিয়ে গেল শাহেদ।আদিব সেজ চাচার দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে শাহেদের বাহু ধরে তাকে এক পাশে নিয়ে বলল,

-জাহানারা আমাকে ওর সাথে এক বিছানায় থাকতে বলছে।এখন কি করবো?

-কি!

-হ্যাঁ।চাচু শোনো আমার না এসব ভালো লাগছে না। তাছাড়া আমি “সম্পূর্ণ রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়া” সম্পর্কে যতটুকু জানি সেখানে রোগীর কিন্তু এত জ্ঞান থাকেনা।সে একদম বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়, তাকে জ্ঞান ফেরানোর পর যা বোঝানো হয় সে তাই বোঝে, তাই জানে,তার নিজস্ব কোনো বোধ থাকেনা।এখন কথা হচ্ছে স্বামী -স্ত্রীর, তাদের মধ্যকার সম্পর্ক এ বিষয়ে তো আমরা জাহানারা কে কিছু জানায়নি। তাহলে সে এত কিছু কি করে জানলো? ইজেন্ট ইট’স স্ট্রেঞ্জ!

থামলো আদিব।তার কণ্ঠে সন্দেহের ছাপ।শাহেদ বুঝলো যেটা।তবে আদিবের কথা গুলো ফেলে দিতে পারলো না সে ।তাকেও ভাবালো কথা গুলো। চিন্তার একটা মৃদু রেখা খেলে গেল তার চোখে মুখে।সেই সময় সেখানে উপস্থিত হলো নেহা। ইতস্তত করে বলল,

-স্যার স্যরি আমি আপনাদের কথা শুনে ফেলেছি, আসলে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই কানে এলো কথাগুলো।আসলে ম্যাম যেগুলো বলছে বা করছে সেখানে ওনার কোনো ভুল নেই উনি একদিন আমার কাছে জিজ্ঞেস করছিল স্বামী স্ত্রীর কি?তাদের সম্পর্ক কি আমি কিছু না ভেবেই ওনাকে নিজের মতো বলেছিলাম।

-তুমি কি পাগল নেহা?এসব বলার আগে আমাদের বলবে না?

-স্যরি স্যার। কিন্তু আমি তো মিথ্যা বলিনি। তাছাড়া এসব বিষয়ে ম্যামের‌ও তো জানার দরকার ছিল।তাই না।

নিজেকে সঠিক প্রমাণিত করার একটা চেষ্টা করলো নেহা।এটা তার পুরোনো অভ্যাস।নিজের ভুল কে সঠিক প্রমাণিত করার জন্য সে এমন ছোট বড় যুক্তি ব্যবহার করেই থাকে। দীর্ঘ দিনের পরিচয়ের সুবাদে শাহেদ জানে সেটা।সে বিরক্তি নিয়ে বলল,

-নেহা তুমি একটু বেশি বোঝো।যা‌ও এখান থেকে।

শাহেদের বকা খেয়ে চুপসে গেল নেহা।সে মুখ কাঁচুমাচু করে স্থান ত্যাগ করলো।আদিব চোখ মুখ গুটিয়ে বলল,

-এসব ক্যার্টুন কোথা থেকে জোগাড় করেছো!

-আমি করি নি তোর চাচাতো বোন করছে।বাদ দে। আচ্ছা চল আমার সাথে, দেখি কি করা যায়।

কথা বলতে বলতেই সিঁড়ির দিকে হাঁটা ধরলো শাহেদ আদিব‌ও তার পিছু নিল। জাহানারা রুমের সামনে এসে থামলো তারা। জাহানারা তখন তারিনের সাথে কথা বলছে।তারিন কে তার ভালো লেগেছে।তবে আকিব কে ভালো লাগেনি।আকিব তাকে কথায় কথায় ধমক দেয় এটা নিয়েই তারিনের কাছে অভিযোগ করছে জাহানারা।তারিন মুচকি হেসে তার সেই অভিযোগে সাঁই দিচ্ছে। জাহানারা সেই সাঁই পেয়ে আরো বাড়িয়ে চাড়িয়ে কথা বলছে।শাহেদ আর আদিব ঘরে ঢুকতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তারিন। শাহেদের কিছু প্রয়োজন কি না জানতে চাইলো।

আদিবের জাহানারার সাথে স্বামীর অভিনয় করার বিষয়ে তারিন এখনো কিছু জানে না।আজ‌ও তাকে অন্ধকারে রাখতে শাহেদ বলল তাদের রাতের খাবারের সময় হয়েছে, তারিন যদি সেদিকটা একটু দেখে।তারিন চাচা শ্বশুরের কাছ থেকে আদেশ স্বরূপ অনুরোধ পেয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।তারিন চলে যেতেই শাহেদ বসলো জাহানারার সামনে।এদিকে ওদিকের কথা বলে কিছু সময় অপচয় করে বলল আদিবের মা অসুস্থ তাকে বাড়ি যেতে হবে।আদিবের চলে যা‌ওয়ার কথা শুনে মুখটা একটুখানি হয়ে গেল জাহানারার।আদিব সেটা দেখে তড়িঘড়ি বলে উঠলো,

-জাহানারা কাল সকালে চলে আসবো আমি।

আদিবের কথা শুনে তার দিকে তাকালো জাহানারা। অশ্রু স্বজল টলমলে চোখে বলল,

-সত্যি?

-হুম, সত্যি।

-কিন্তু আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।তুমি একবার গেলে আসতে চাও না।আমার ফোন‌ও ধরো না।

জাহানারা কথায় মনে একটু অপরাধবোধ উদয় হলো আদিবের।সে সত্যি এমনটা করে থাকে।তবে এই পরিস্থিতিতে জাহানারা কে আশ্বস্ত করতে বলল,

-আমি প্রমিস করছি আর এমন করবো না।

আদিবের কথায় জাহানারা আশ্বস্ত হলো কি না বোঝা গেল না।সে মাথা নাড়লো।আদিব স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। আরো কিছু সময় জাহানারা সাথে বসে এটা সেটা নিয়ে গল্প করলো। তারপর জাহানারার খাওয়া হলে তাকে ঔষধ খাইয়ে বিদায় নিল।

আদিব যখন বাড়ি পৌঁছাল রাত তখন বারোটা।তানিয়া ছেলের অপেক্ষাতে জেগেই ছিল।আদিব আসতেই তাকে বলল খাবার টেবিলে আসতে।আদিব যদিও ও বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছিল কিন্তু মায়ের কথার পরে কথা বলল না। ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসলো।তানিয়া না খেয়ে বসেছিল ছেলের জন্য।ছেলেকে খাবার দিয়ে সেও খেতে বসলো কিন্তু ছেলেকে খাবার প্লেটে খাবার নাড়াচাড়া করতে দেখে সে বুঝলো ছেলে খেয়ে এসেছে ঐ বাড়ি থেকে।সাথে সাথে খিধে মরে গেল তার।তবে আদিব কে সেটা বুঝতে না দিয়ে খাবার প্লেটে হাত রেখেই জিজ্ঞেস করলো ,

-জাহানারা কেমন আছে এখন?

-আগের থেকে অনেকটা ভালো।

-ওদের সেই ডাক্তার কবে আসবে যেন?

-সামনের মাসে পনেরো তারিখে।

এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা। তারপর তানিয়া ফের বলল,

-ও… ভালো কথা তোমার মামা ফোন করেছিল।আমার কাছে জানতে চাচ্ছিলো তুমি কি বলেছো।

-তুমি বলো নি আমার সময় চাই?

-বলেছি। কিন্তু ওরা আবার ফিরবে তো, তাই চাইছিল ফেরার আগে যদি আকদটা হয়ে যেত, তাহলে সুবিধা হতো।

অনেকটা ইতস্তত করে বলল তানিয়া।আদিব মায়ের দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল,

-এত তাড়াহুড়ো করতে পারবো না আমি, আমার সময় চাই মা।মামাদের তাড়া থাকলে অন্য ছেলে দেখতে বলো, আমার সমস্যা নেই।

-না না ওদের তাড়া নেই।তুই সময় নে।কোনো সমস্যা নেই।

ছেলের নেতিবাচক মনোভাব দেখে তড়িঘড়ি বলে উঠলো তানিয়া।এরপর আর কথা জমলো না মা ছেলের।আদিব ভর্তি পেটেও নিজের প্লেটের খাবার শেষ করলো।তানিয়া সবটা বুঝেও বাক্য ব্যয় করলো না।ছেলে তার অমতে যে রাস্তায় হাঁটছে তার জন্য এতটুকু ভোগান্তি তো তাকে পোহাতে হবেই!

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

সৌরকলঙ্ক পর্ব-১১+১২

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১১

ঔষুধের প্রভাব কাটিয়ে জাহানারার যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন সে উন্মাদ প্রায়।কাউকে চিন্তে পারছে না,কাউকে সহ্য করতে পারছে না।নিজের নাম পরিচয় আর অবস্থান নির্ণয়ে চিৎকার চেঁচামেচিতে অস্থির করে তুলছে চারপাশ। জাহানারার কে সামলে ওঠা মুশকিল হল।তার অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হলো সকলে।বাধ্য হয়ে অল্প পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ প্রয়োগ করা লাগলো তার শরীরে।জাহানারার মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট আসলো পরেরদিন বিকেলে।রাকিব রিপোর্ট দেখে ভারী কণ্ঠে জানালো সে যে ভয় পাচ্ছিল সেটাই হয়েছে। জাহানারা রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়া আক্রান্ত হয়েছে। এবং তার মধ্যে কমপ্লিট রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়ার আভাস দেখা গেছে।এ কথা শুনে জায়েদ এবার চিন্তিত হলো।আকিব ভেবে পেল না কি করবে।শাহেদ এই মুহূর্তে এসে পাশে দাঁড়ালো তাদের।রাকিবের সাথে কথা বলে আশরাফের সাথে পরামর্শ করে জাহানারা যত দ্রুত সম্ভব উন্নত চিকিৎসার আওতাধীন নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল।

আদিব মায়ের সাথে মেজ খালার বাড়ি গিয়েছিল বেড়াতে যে জন্য জাহানারার শারীরিক অবস্থার খবরটা তার কানে পৌঁছাতে দুই দিন লাগলো।খবরটা শুনে জাহানারার জন্য দুঃখ হলো তার।সবে মাত্র মা-কে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠেছিল মেয়েটা আর তারমধ্যেই এমন একটা দুর্ঘটনা হলো যে সে নিজের অতীত সহ নিজের অস্তিত্ব টাই ভুলে বসলো। দিপ্তীর কাছ থেকে জাহানারার বেপরোয়া ব্যবহার আর পাগলামির কথা শুনে আদিবের খুব খারাপ লাগলো।হঠাৎ করে আবার ,সেদিন রাতে জাহানারার বলা কথাটা কানে বেজে উঠলো।সাথে সাথে বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো আদিবের ,গলা বুক শুকিয়ে গেল। দিপ্তীর সাথে কোন রকমে কথা শেষ করে ফোন লাগালো সে সজীব কে। সজীবের থেকে জাহানারার অবস্থা জানতে পেরে তার মনে হলো খুলনা ফেরার আগে মেয়েটাকে একবার চোখের দেখা দেখে গেলে মন্দ হয় না।মা কে জরুরি কাজের দোহাই দিয়ে গাড়ি ছাড়াই নানা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আদিব।

আদিব যখন হাসপাতালে পৌঁছাল সময় তখন সন্ধ্যা সাতটার আশেপাশে। জাহানারার কেবিনের সামনে এসে থমকালো আদিব।কেবিনের ভেতর থেকে জাহানারার চিৎকার চেঁচামেচির আ‌ওয়াজ ভেসে আসছে।সেই সাথে রাকিবের শান্ত কণ্ঠ।মেয়েটাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে রাকিব তবে সফল হচ্ছে না। জাহানারা পাগলের মতো বারবার এক কথা বলে যাচ্ছে,ওকে ডাকুন,ওকে ডাকুন,আমার হ্যাজবেন্ড কে,আমার হ্যাজবেন্ড কে ডাকুন,আমার হ্যাজবেন্ড কে ডাকুন, প্লিজ,আমার কেমন কেমন লাগছে লাগছে,ওকে ডাকুন প্লিজ,প্লিজ ওকে ডাকুন।

এক কথার পুনরাবৃত্তি।আদিব এগিয়ে গেল সামনে। দাঁড়ালো কেবিনের দরজার মুখে।দরজা খোলাই ছিল।জাহানারার অশ্রু সিক্ত চোখ মুখ,সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া মাথা,আকুতি ভরা কণ্ঠে বলা প্রতিটা কথা অদ্ভুত লাগলো আদিবের কাছে।সে স্থবিরের নেয় এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো জাহানারার দিকে।তার যেন বিশ্বাস‌ই হলো না এই সেই জাহানারা যার গোছানো কথা আর দাপুটে মেজাজে তটস্থ থাকে তার আশে পাশের মানুষ।প্রায় এগারো বছর আগে এক পড়ন্ত বিকেলে আদিব যে অসহায় জাহানারা কে নিজের সামনে দেখেছিল সেই জাহানারার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো যেন এই জাহানারার মধ্যে।সে থমকালো।

রাকিব তখনো ধৈর্যের সাথে জাহানারা কে শান্ত করার চেষ্টা করছে।তবে জাহানারা তার কথা কানে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।সে এক কথা বারবার আওড়াচ্ছে,”ওকে ডাকুন,ওকে ডাকুন।”অস্থির ভাবে এক কথা বলতে বলতে একসময় কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়লো জাহানারা। অসুস্থ শরীর জিদের কাছে আর সাঁই দিল না হয়। শক্তি হারালো।ঢলে পড়লো পিছনে দিকে।জাহানারার পাশে থাকা নার্সটা সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেল। ধরলো তাকে।যত্ন নিয়ে আস্তে করে শুইয়ে দিল বালিশে।রাকিব তড়িঘড়ি এগিয়ে গেল।চোখের সামনে থেকে রাকিবের চ‌ওড়া শরীরটা সরতেই দরজার বাইরে চোখ পড়লো জাহানারার। অশ্রু শিক্ত চোখ গিয়ে আটকালো আদিবের মুখে। অশ্রু ভেজা চোখে মুখে সাথে সাথে খেল গেল প্রাপ্তির হাঁসি। জাহানারা তার উৎফুল্ল ধিমী কণ্ঠে বলে উঠলো,

-তুমি এসেছো,তুমি এসেছো,তুমি এসেছ…!

কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো জাহানারা। স্তব্ধ হলো উপস্থিত সবাই।কেবিনের বাইরে থাকা সজীব,শাহেদ,এগিয়ে এলো কেবিনের দিকে।আদিব কে দেখে জাহানারার বলা কথায় হুঁশ ফিরলো তাদের।বুঝতে পারলো বিগত দুই দিন ধরে জাহানারা কার কথা তাদের বোঝাতে চায়ছিল।
জাহানারা কথায় তড়িৎ পিছনে ফিরে তাকালো রাকিব।আদিব কে দেখতেই ভ্রূ তে ভাঁজ গাঢ় হলো তার। জাহানারার কথার তাৎপর্য বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো আদিবের।সে চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানলো, গভীর শ্বাস।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে টেনে নেওয়া শ্বাস টা নাসারন্ধ্র দিয়ে শব্দ করে বের করে জাহানারর দিকে তাকালো। জাহানারার মুখে দৃষ্টি রেখেই নিজের স্থির কদম বাড়িয়ে দিল তার দিকে।ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।
জাহানারার পাশে বেড ঘেঁষে দাঁড়ালো ।জাহানারার নরম হাতটা নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে একটু ঝুঁকে নিজের গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

-কি হয়েছে?

-কোথায় ছিলে তুমি?আমার কেমন কেমন জানি হচ্ছিল।খুব কষ্ট হচ্ছিল।এখনো হচ্ছে।আমি কিছু মনে করতে পারছি না ।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।বুকের মধ্যে কেমন হচ্ছে।আমি মনে হয় মরে যাবো।এরা কিসব বলছে,কাকে দেখাচ্ছে আমি কাউকে চিন্তে পারছি না কিচ্ছু বুঝতে পাচ্ছি না……

কান্না ভেজা স্বরে অভিযোগের সুরে একের পর এক বলে গেল জাহানারা।আদিব টুল টেনে বসলো তার পাশে। জাহানারা বলা প্রতিটি শব্দ ,বাক্য, অক্ষর শুনলো মনোযোগ দিয়ে। জাহানারা এক সময় থামলো।চোখের পানিতে ভেজা পত্রপল্লব ঝাপটিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বলল,

-আমি বাঁচবো না মনে হয়!

আদিবের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো সাথে সাথে। সেদিন রাতের সেই বীভৎস স্মৃতি টুকু ভেসে উঠলো চোখে।সে নিজের বা হাতটা আলতো করে জাহানারার ব্যান্ডেজ আবৃত কপালে রেখে নরম সুরে বলল,

-তোমার কিচ্ছু হবে না,আমরা তোমার কিচ্ছু হতে দেবো না।তুমি শান্ত হ‌ও।

-আমার কাউকে লাগবে না ,তুমি হলেই হবে।তুমি হলেই আমি ঠিক হয়ে যাবো।তুমি কোথাও যেও না প্লিজ।

-ঠিক আছে।আমি কোথাও যাবোনা।

আশ্বস্ত সুরে বলল আদিব। জাহানারা তার কথায় আশ্বস্ত হলো। বাধ্য মেয়ের মত শান্ত হলো। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হলো তার। জাহানারা থির হতেই ঘাঢ় ফিরিয়ে রাকিবের দিকে একবার তাকালো আদিব।চোখের ইশারায় বোঝালো আমি সামলে নেব।রাকিব আদিবের চোখের ভাষা বুঝে নিল ।বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে।

-আমার পেটের ভেতর জ্বলছে, খুব।খিধে লেগেছে।আমাকে কিছু খেতে দিবা?

আদিব রাকিবের প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়ে ছিল তখন জাহানারার কথাটা কানে গেল তার।সে জাহানারা দিকে তাকালো। মেয়েটার কথা শুনে তার অভুক্ত নিস্তেজ মুখটা দেখে মায়া হলো আদিবের।সে সাথে সাথে পাশে দাঁড়ানো নার্স কে বলল কিছু খাবার এনে দিতে।পরিপূর্ণ ভাবে জ্ঞান ফেরার পর থেকে একটা দানা পানি মুখে নেয় নি জাহানারা। দুই দিন ধরে স্যালাইনের উপরেই আছে সে ।আজ নিজে থেকে খাওয়ার আর্জি করায় তার দায়িত্বরত নার্স আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না।ছুটলো খাবার আনতে।তবে খাবার নিয়ে আসার পরে বাঁধলো বিপত্তি। জাহানারা নার্সের হাতে খাবে না,সে আদিবের হাতে খাবে। ডাক্তারি পেশা মানুষের সেবা করার জন্য বেছে নিলেও মানুষকে আজ পর্যন্ত এভাবে সেবা করা হয়নি আদিবের। জাহানারা কে খাওয়াতে গিয়ে একটু অস্বস্তিতে ভুগতে হলো তাকে। জাহানারা খাওয়ার ফাঁকে নিজের কথা,নিজের পরিবারের কথা,সে এখানে কি করে এলো,এসব নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো।আদিব সময় নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে ধৈর্যের সাথে জাহানারার সব প্রশ্নের উত্তর দিলো।

জাহানারা কে খাবার খাওয়ানোর পর ঔষধ দিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কেবিন থেকে বের হতে অনেকটা সময় লাগলো আদিবের।বাইরে বের হতে‌ই রাকিবের সাথে দেখা হলো তার।রাকিব তার জন্য‌ই অপেক্ষা করছিল।আদিব কে দেখতেই সে আদিব কে আর শাহেদ কে নিজের কেবিনে আসতে বলল। আকিব হাসপাতালে উপস্থিত নেই আর জায়েদ মেয়ের অবস্থা দেখে বিধ্বস্ত প্রায় এই মুহূর্তে জাহানারার অভিভাবক হিসাবে শাহেদ‌কেই একমাত্র উপযুক্ত মানুষ মনে হলো রাকিবের কাছে ।সেই জন্য জায়েদ কে উপেক্ষা করে তাকে ডাকলো রাকিব।রাকিবের কেবিনে পৌঁছাতেই রাকিব আদিব আর শাহেদ কে বসতে বলল চেয়ারে।তারপর টেবিলের অপর পাশে গিয়ে নিজের বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসলো রাকিব।রাকিব চেয়ারে বসতেই শাহেদ তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো জাহানারা কেন আদিব কে নিজের স্বামী মনে করছে।উত্তরে রাকিব একটা হতাশ শ্বাস ফেলে বলল সেদিন জ্ঞান ফেরার পর নার্স নাহিদার বলা কথাটা জাহানারার মস্তিষ্কে বিরাট ছাপ ফেলেছে যার দরুন এই অবস্থা।

-কিন্তু তুমি তো বলেছিলে জাহান সব কিছু ভুলে গেছে, এমন কি নিজেকেও, তাহলে?

আবার প্রশ্ন করলো শাহেদ।আদিব দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিক তাকিয়ে এক নজরে সময় টা দেখে নিলো।মা-কে বলে আসা সময় ইতিমধ্যে পার হয়েছে।ফোন বের করে মায়ের উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটা বার্তা পাঠিয়ে তাকালো রাকিবের দিকে।মন দিল তার কথায়।চাচার করা প্রশ্নটা তার মাথাতেও ঘুরছে। শাহেদের করা প্রশ্নের উত্তরে রাকিব বলল,

-চাচু , মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে জাহানারার স্মৃতি শক্তি নষ্ট হয়েছে এটা স্পষ্ট ।এখন আদিব কে তার কীভাবে মনে আছে সেটা আমি সঠিকভাবে বলতে পারছি না তবে ধারণা করছি জাহানারা আহত হ‌ওয়ার পর আদিব কে চোখের সামনে পা‌ওয়ায় তার মুখটা হয়ত ভুলতে পারেনি। তারপর আবার সেদিন নার্সের বলা ভুল স্টেটমেন্টেটা জাহানারার মস্তিষ্কে এমন একটা বিভ্রান্তির তৈরি করেছে যে, সেদিন নার্সের বলা কথাটা সত্যি মেনে নিয়েছে জাহানারা।এখন যেহেতু সে কাউকে চিন্তে পারছে না তাই নার্সের বলা কথাটাই তার কাছে সত্যি মনে হচ্ছে।তবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত না।এটা শুধু মাত্র আমার ধারণা।আমি কিছু টেস্ট করে আমার স্যারের সাথে কথা বলে তবেই নিশ্চিত ভাবে আপনাদের কিছু জানাতে পারবো।

-এখন আমাদের করণীয় কি ?

গম্ভীর কণ্ঠে আদিবের সোজা প্রশ্ন। রাকিব শাহেদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আদিবের উপর ফেলল।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের আকর্ষণীয় চেহারার মুখটা হঠাৎ কেমন যেন জ্বালা ধরলো তার বুকে।এমন একটা মুহূর্তে হঠাৎ এমন অনুভূতির কোন কারণ খুঁজে পেল না রাকিব।তবে আদিবের মুখটা তার দেখতে ইচ্ছা করলো না।মনে হলো আজ এই ছেলেটা এখানে না আসলে ভালো হতো।খুব ভালো হতো।মনের নেতিবাচক ভাবটা খুব সাবধানে গোপন করলো রাকিব তারপর বলল,

-আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার স্যারের সাথে কথা বলে জাহানারাকে ইউএসএ নিয়ে যা‌ওয়ার ব্যবস্থা করছি তুমি ততদিন একটু ওকে সামলে নাও।ও তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না।তুমি এখন যা বলবে ওর কাছে সেটাই সত্যি। সেটাই ব্যাস্তব।

শেষ কথাটুকু সময় নিয়ে বলল রাকিব।আদিব তার চোখে চোখ রাখলো।রাকিব সাথে সাথে দৃষ্টি পরিবর্তন করলো। মেডিকেল ফাইলের কাগজ গুলো অকারণে এদিক সেদিক উল্টে বলল,

-আদিব এই মুহূর্তে আমাদের তোমার হেল্পর প্রয়োজন।আশা করি তুমি আমাদের এই সাহায্য টুকু করবে।তুমি যদি

– চব্বিশ তারিখ আমার ফ্লাইট।

রাকিবের কথা শেষ না হতেই বলল আদিব।আদিবের কথা শুনে থামলো রাকিব। চব্বিশ তারিখ মানে হাতে আছে আর মাত্র পনেরো দিন। এরমধ্যে সব বন্দোবস্ত করতে হবে তাকে।সে বলল,

-দ্যাট’স এনাফ।

জাহানারা শারীরিক অবস্থা নিয়ে আরো কিছু টুকিটাকি সতর্কতা দিয়ে নিজের কথা শেষ করলো রাকিব।রাকিবের সাথে কথা শেষ হতেই তার কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো আদিব আর শাহেদ।রাকিবের কেবিন থেকে বের হতেই শাহেদ আদিবের দিকে লক্ষ্য করতেই তার চিন্তিত মুখটা চোখে পড়লো।শাহেদ আদিবের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,

-কি হলো?কি ভাবছিস?

আদিব তানিয়ার কথা ভাবছিল।তার মা যদি জানতে পারে আদিব পনেরো টা দিন জাহানারার আশেপাশে ঘুরবে তাহলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিবে।আদিব চাইছে না ফিরে যাওয়ার আগে কোনো ঝামেলা ঝঞ্ঝাটের তিক্ত স্মৃতি নিয়ে যেতে।সে মায়ের কাছ থেকে কীভাবে বিষয়টা লুকাবে সেটাই ভাবছিল। শাহেদের কথায় তার ভাবনায় ছেদ পড়ল।জোরপূর্বক হেঁসে মনের ভাবনা লুকিয়ে বলল,

-কিছু না।

শাহেদের মনে হলো আদিব তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে কিন্তু সে এ বিষয়ে আদিবের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। প্রসঙ্গ বদলালো।

এরপরের সময়টা ভীষণ অস্বস্তিকর ছিল আদিবের জন্য। জাহানারার স্বামী হিসাবে দিনের পর দিন অভিনয় করা বেশ কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠেছিল তার জন্য।তবুও সেজ চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে, মানবিকতার খাতিরে নিজের চেষ্টায় ত্রুটি রাখছিল না সে। কিন্তু এভাবে দেখতে দেখতে যখন তেরো দিন অতিবাহিত হলো তখন বাঁধলো বিপত্তি।এমন অবস্থা হলো আদিবের যে পরশু তার ফ্লাইট কিন্তু সে যাবে কি না ?সেটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগলো।বিগত দিনগুলো দিপ্তীর বাসায় আছে এ কথা বলে মা-কে বোঝালেও লন্ডন যা‌ওয়ার দিন ঘনিয়ে আসতেই তানিয়ার ছটফটানি বাড়লো।আদিব কে বলল খুলনায় ফিরতে।ফেরার আগে অন্তত একদিন তার কাছে কাটিয়ে যেতে।আদিব মায়ের আবদার রাখতে জাহানারাকে তার জরুরি কাজের বাহানা দিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে র‌ওনা দিল খুলনা। জাহানারা ততদিনে নিজের আশেপাশের মানুষের সাথে সহজ হয়েছে।আদিব তার জরুরি কাজের কথা বলতেই জাহানারা আপত্তি করলো না যেতে দিল তাকে। তাছাড়া আদিবের জন্য ভীষণ মায়া তার।তার জন্য লোকটা নিজের কাজ কাম ফেলে রাত জেগে হাসপাতালে পড়ে থাকে এটা দেখে কষ্ট হয় তার। খারাপ লাগে লোকটার জন্য।সেই জন্য তো আদিবের কথা বোঝার চেষ্টা করে।তার কথা শোনে।

রাকিব বলেছিল পনেরো দিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলবে কিন্তু কিছু কারণে সময় আরো বাড়লো।সে আদিব কে অনুরোধ করলো তাকে আরো পনেরো দিন সময় দেওয়ার জন্য।রাকিবের কথায় এবার দোটানায় পড়লো আদিব।তার ছুটির মেয়াদ শেষ।ফিরতে হবে তাকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হঠাৎ ছুটি বাড়ানোতে রুষ্ট হবে।চাকরি হয় তো যাবেনা প্রফেসর “স্টিফিনের” জন্য। কিন্তু দাগহীন ক্যারিয়ারে দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার দাগ পড়বে। কিন্তু এদিকে জাহানারার অবস্থা‌ও ভালো না।মেয়েটা সবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।এই মুহূর্তে তাকে ফেলে যা‌ওয়া মানে মাঝ দরিয়ায় ধাক্কা মা’রা।কি করবে, কি করবে ভেবে আশরাফের শরণাপন্ন হলো আদিব। আশরাফ ছেলেকে অল্প শব্দে বলল,

-নিজের চকচকে ভবিষ্যতের পিছনে, একটা মানুষের সুস্থতা ফেলা যাওয়া কতটা উচিত সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা!তুমি বুদ্ধিমান ছেলে আশা করি ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবে।

বাবার কথায় টনক নড়লো আদিবের।নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব্যাকুল না হয়ে সে জাহানারার সুস্থতা কে প্রাধান্য দিল। সিদ্ধান্ত নিল আরো কিছু দিন দেশে থাকার।বেছে নিল জাহানারার সুস্থতা।
নিজের ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করে ডাক্তার “স্টিফিনের” সুপারিশে আরো তিন মাস ছুটি বাড়ালো।থেকে গেল দেশে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১২

-আমাদের বিয়ে কীভাবে হয়েছিল আদিব?

জাহানারার প্রশ্নে সুপের চামচটা বাটিতে রেখে তার দিকে তাকালো আদিব। জাহানারার প্রশ্নের জবাবে কি বলবে ভেবে পেল না। যেখানে বিয়েই হয় নি সেখানে বিয়ে কীভাবে হয়েছিল সেটা কি করে বলবে সে।আদিব কে চিন্তিত দেখালো।আদিব কে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে নেহা এগিয়ে এলো।,বলল,

-আপনাদের ল্যাভ ম্যারেজ হয়েছিল ম্যাডাম। একেবারে গোপনে।

জাহানারা নেহার দিকে তাকালো।নেহার মুখে চ‌ওড়া হাঁসি।মেয়েটা জাহানারার ব্যক্তিগত সহকারী। জাহানারা অভিনয় জগতে প্রবেশ করার সময় থেকে তার সাথে আছে। জাহানারার সুখ দুঃখ সহ অনেক গোপন অভিসারের খবর জানে সে।

-আমি কি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি?তুমি এত পটপট করো কেন,একটু চুপ করে থাকতে পারো না।শোন, যদি চুপ করে থাকতে না পারো তাহলে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে কিন্তু আমাদের স্বামী স্ত্রীর কথার মধ্যে কথা বলতে যাবে না।

জাহানারার রুক্ষ কণ্ঠ।নেহার মুখের হাসিটা দপ করে নিভে গেল।তবে জাহানারা সেটা গুরুত্ব দিল না। সে আদিবের উদ্দেশ্যে ফের প্রশ্ন ছুড়লো,

-আমাকে ডিসচার্জ দেওয়ার পর কি তুমি আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে?

-না!

তড়িৎ বলে উঠলো আদিব।এটা তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ছিল। জাহানারা কে ব‌উ হিসাবে নিজের বাড়ি নিয়ে যা‌ওয়ার কথা শুনতেই মায়ের অ’গ্নিমূর্তি ভেসে উঠলো চোখের সামনে মুখ দিয়ে আপনা আপনি “না” শব্দটা ছিটকে এলো।

-কেন?

জাহানারার বিষণ্ন কণ্ঠ।আদিব তাকে নিজের সাথে তার বাড়ি নিয়ে যাবে না এটা ভেবে মন খারাপ হলো।আদিব জিব দিয়ে ঠোঁট ভেজালো,একটু সময় নিয়ে বলল,

-আমাদের বিয়ের বিষয়ে তোমার পরিবার জানলেও আমার পরিবার এখনো কিছু জানে না জাহানারা।

-কেন জানে না?

আবার প্রশ্ন!আদিবের বিরক্ত লাগলো এবার।সে কোন মতে বলল,

-আমার কিছু সমস্যা আছে ,সেটা মিটমাট হলেই বাড়ি জানাবো ভেবেছিলাম এরমধ্যে তোমার অ্যাকসিডেন্টটা হলো, তাই আর জানানো হয় নি।

-কী সমস্যা?

-আছে একটা সমস্যা।তুমি খাবারটা শেষ করতো।আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে।কাজ আছে আমার কিছু।

জাহানারার মুখের সামনে সুপের চামচ ধরে বলল আদিব। জাহানারা সুপ ভর্তি চামচটা মুখে নিয়ে সেটা গলদ্ধ করণ করে ফের বলল,

-কি কাজ?

এবার ধৈর্য চ্যুত হলো আদিব।সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,

-এত প্রশ্ন করো কেন জাহানারা।

-তুমি নিজে থেকে কিছু বলো না তো,সেই জন্য তো প্রশ্ন করতে হয়।

একটু থামলো জাহানারা তারপর অভিযোগের সুরে বলল,

-তুমি আমার হ্যাজবেন্ড, কিন্তু আমি তোমার নাম ছাড়া তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না।আমার বুঝি জানতে ইচ্ছা করে না?

-তুমি তো নিজের সম্পর্কেও কিছু জানো না ,নিজের সম্পর্কে তোমার কিছু জানতে ইচ্ছা করে না?

-না, জ্ঞান ফেরার পর থেকে নিজের বিষয়ে শুনেই যাচ্ছি।এখন আর শুনতে ইচ্ছা করছে না।আমি তোমার ব্যাপারে জানতে চাই।

আদিব জাহানারার মুখের দিকে তাকালো। অসুস্থ নির্জীব মুখটায় কিছুটা প্রাণের ছোঁয়া এসেছে তার। ব্যান্ডেজ বিহীন চুল ছাড়া মাথাটা মেয়েটার সৌন্দর্যে যথেষ্ট ঘাটতি তৈরি করতে চাইলেও সেভাবে সফল হয় নি।চুল ছাড়া একটু অদ্ভুত দেখাচ্ছে জাহানারা কে, তবে একেবারে অসুন্দর না। জাহানারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আদিবে ছোট বেলার একটা কথা মনে পড়লো। জাহানারা তখন নতুন নতুন স্কুলে যা‌ওয়া শুরু করেছে।স্কুলে থেকে মাথায় উকুন বাধিয়েছে। সারাদিন মাথা চুলকে বেড়ায়।সালেহা মেয়ের নাজেহাল অবস্থা দেখে জোর করে চুল কেটে ন্যাড়া করে দিল তাকে।চুলের শোকে জাহানারা সে কি কান্না। কান্নার চোটে বাড়ির উঠানে গড়াগড়ি দিতে লাগলো সে।দাদি গিয়ে কোনোরকমে সামলালো তাকে।দুই দিন চুলের শোকে বাড়ি থেকে বের হলো না জাহানারা। তারপর যেদিন বাইরে এলো সেদিন তাদের মহল্লার মামুন নামের এক ছেলে তাকে দেখে,
“টাক টাক চার‌আনা,
চাবি দিলে ঘোরেনা।
টাকের কি অবস্থা,
বেগুন কি সস্তা।”
এই ছড়া কাটতে লাগলো। জাহানারা তাকে নিষেধ করলেও সে শুনলো না।রাগ হলো জাহানারার। রাস্তা থেকে ইট কুড়িয়ে চেলে মারলো মামুনের দিকে।ভারি ইটের টুকরো গিয়ে লাগলো মামুনের কপালে, সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বের হলো মামুনের কপালের ক্ষ’ত থেকে। জাহানারা রাগে ইট চেলে মারলেও ভাবেনি এমন কিছু হবে। রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গেল সে।দৌড়ে ঢুকলো আদিবদের বাড়ি।দাদির কাছে আশ্রয় নিতে। কিন্তু দাদি বাড়ি নেই ,বাঁচাবে কে তাকে!তানিয়া জাহানারা কে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসতে দেখে এগিয়ে গেল। ছোট্ট শরীরটা আগলে নিল যত্নে। জাহানারা বড় চাচির আহ্লাদ পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তানিয়া কি হয়েছে জানতে চাইলে গড়গড় করে সব বলে দিল।আদিব তখন ডাইনিং টেবিলে বসা। স্কুল থেকে ফিরে নাস্তা করছে। জাহানারার মুখে টাক টাক চার‌আনা ছড়া শুনে সে নিজেকে সামলাতে পারলো না, খিকখিক করে হেঁসে উঠলো।আদিবের হাঁসি দেখে জাহানারা কান্না আরো বাড়লো।তানিয়া আদিবকে কপট ধমক দিয়ে তার হাঁসি থামলেও জাহানারার কান্না থামাতে পারলো না।সে নিজের মতো কেঁদে গেল।তানিয়াকে বেশ বেগ পোহাতে হল তার কান্না থামাতে।সে দিনের সে কথা মনে পড়তেই আপনি আপনি আদিবের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিল। জাহানারা যেটা লক্ষ্য করলো।আদিবকে নিজের দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে সাথে সাথে মাথায় হাত উঠলো তার। চুলহীন মাথায় হাত পড়তেই ঠোঁট উল্টোলো সে।বলল,

-তুমি আমাকে দেখে হাসছো?

যদিও আদিব জাহানারা কে দেখে হাসছিল না তবুও এই মুহূর্তে এসে জাহানারার অমন মুখো ভঙ্গি দেখে কেন জানি নিজেকে আটকাতে পারলো না আদিব।স্থান কাল ভুলে শরীর কাঁপিয়ে হেঁসে উঠলো। জাহানারা অবাক হলো। ড্যাবড্যাবে চোখে দেখতে লাগলো আদিবের হাঁসি। জাহানারা হঠাৎ আবিষ্কার করলো ছেলেটার হাঁসি মারাত্মক সুন্দর। জাহানারা কে নিজের দেখে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকাতে দেখে কোনোরকমে নিজের হাঁসি থামালো আদিব। ঠোঁটের মাঝে হাসির ছাপ রেখেই বলল,

-আই এম স্যরি ,কিন্তু তোমাকে দেখে হাঁসি নি।আসলে একটা পুরোনো কথা মনে পড়েছিল তাই…!

– সমস্যা নেই, তুমি হাসো।তোমাকে হাসলে সুন্দর দেখায়।

আবিষ্ট চিত্তে বলল জাহানারা।আদিবের হাসি দেখে তার হাসির কারণেই ভুলে বসেছে সে। জাহানারার কথায় নেহার সামনে একটু অপ্রস্তুত হলো আদিব।অযথা গলা ঝাড়া দিয়ে বলল,

-আচ্ছা এবার খেয়ে না‌ও, ঔষধ খেতে হবে।দেরি হচ্ছে।

-খাচ্ছি কিন্তু তুমি তো কিছু বললে না।

বাচ্চাদের মতো কথা জাহানারার।রাকিব বলেছিল অসুস্থতার দরুন জাহানারার মধ্যে বেশ কিছু মানসিক পরিবর্তন দেখা দিবে।যেমন,রাগ,জেদ,বাচ্চামো,অভিমান ইত্যাদি। প্রথম প্রথম জাহানারার এমন ব্যবহারে সবাই চিন্তিত হলেও এখন সয়ে গেছে।

-বললাম তো তোমাকে দেখে হাঁসি নি

-হাসার কথা বলছি না তো।তোমার ব্যাপারে বলবে না।

আদিবের কথা কেটে বলল জাহানারা।আদিব একটা শ্বাস ফেলল,

-বলো কি শুনতে চাও।

-সব শুনতে চাই।

-ওকে।আমার নাম খন্দকার আদিব আহসান।বাবার নাম খন্দকার আশরাফ আহাসান,মায়ের নাম তানিয়া।আমার বাড়ি খুলনার **** শহরে।আমার দুইটা বোন আছে।বড় বোনের নাম দীপ্তি, ছোট বোনের নাম তৃপ্তি।দুই জনের বিয়ে হয়ে গেছে দুইজনেই স্বামীর বাড়ি সুখে শান্তিতে সংসার করছে।

-এগুলো তো আমি জানি!তোমার সম্পর্কে বলো।

-এগুলোও তো আমার সম্পর্কে!আমার পরিবার কে নিও তো আমি।

-হ্যাঁ তোমার পরিবারকে নিও তুমি কিন্তু তুমি আমার কথা বুঝছো না! আমি তোমার বিষয়ে শুনতে চাইছি। শুধু তোমার বিষয়ে।

শেষক্ত কথাটা গাঢ় স্বরে বলল জাহানারা।আদিব হাতের খালি প্লেট টা নেহার দিকে এগিয়ে দিল। মৃদু হেঁসে বলল,

-আমার বিষয়ে শুনতে গেলে বোর হবে।আমার জীবন অতোটা হ্যাপেনিং না।

-তবুও শুনবো।

-ফাইন,আমি আদিব। লন্ডন *****হসপিটালে জুনিয়র কার্ডিওলজিস্ট হিসাবে কর্মরত আছি। লন্ডনের *****শহরে থাকি।দুই রুমের নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট আছে সেখানে।একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি আছে।যেটাতে করে রোজ হসপিটালে যা‌ওয়া আসা করি।ব্যাস।

-ব্যাস!আর কিছু নেই! বন্ধু বান্ধব,ঘোরা ফেরা,শখ আহ্লাদ? কিচ্ছু না?

-নো।

-এতো পানি পান্তা! তোমার প্রেমে পড়লাম কি করে আমি?

অনেকটা স্বগোতক্তি করে বলল জাহানারা।আদিব প্রশশ্ত হাসলো। জাহানারার নিজেকে করা প্রশ্নটা নিজ মনে সেও একবার আওড়ালো।”তোমার প্রেমে পড়ালাম কি করে ?”এই প্রশ্নটা তো এতগুলো বছরে সেও একাধিক বার করেছে নিজেকে যে, জাহানারা ম্যাডাম তার প্রেমে পড়লো কি করে । তবে আজ জাহানারা কথা শুনে মনে হচ্ছে জাহানারার তার প্রতি যে অনুভূতি ছিল সেটা কিশোরী বয়সের আবেগ ব্যতীত আর কিছুই নয়।

-কি জানি কীভাবে পড়েছিলে!

-আচ্ছা আমি তোমাকে প্রপোজ করেছিলাম, না তুমি?

ভাবুক কণ্ঠ জাহানারা।আদিবের হাঁসি পেল আবার।সেদিন বিকেলে জাহানারা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলা কথাগুলো আবার মনে পড়লো।সে বলল,

-তুমিই করেছিলে।

-হুম সেটাই স্বাভাবিক।তুমি যে বোরিং, তুমি তো আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না। আচ্ছা আমি তোমার সাথে লন্ডনে থাকতাম ,না ঢাকায় ,না কি খুলনায়?

-এবার থামো। একদিনে সব জানবে না কি?

-হ্যাঁ।আজকেই জানবো, তোমাকে তো পা‌ওয়া যায় না।আর এরা যা বলে আমার বিশ্বাস হয় না।তুমি বলো প্লিজ।

জাহানারা নাছোড়বান্দা।আদিব হতাশ চোখে তার দিকে তাকালো।আবার মিথ্যা বলতে হবে তাকে। কিন্তু কি বলবে সেটাই তো মাথায় আসছে না তার।আদিব অনেক ভেবেও বুঝে পেল না কি বলবে। ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। সাহায্যের জন্য তাকালো নেহার দিকে।নেহা জাহানারার বেডের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। জাহানারার ক্যাটকেটে কথা শোনার পর আর একটাও টু শব্দ করেনি।তবে এই মুহূর্তে আদিব কে অসহায় অবস্থায় দেখে মায়া হলো তার।আদিবের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো সে।আদিবের হয়ে সে বলল,

-আপু আপনাদের তো লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ ছিল।ছোট বেলার প্রেম ,তারপর ভাইয়া পড়াশোনার জন্য বিদেশ গেল এরপর ফোনে ফোনে আলাপ সালাপ।

-তাহলে আমাদের বিয়ে হলো কবে?

আবার প্রশ্ন করলো জাহানারা।নেহা তড়িঘড়ি বলল,

-এই তো মাস তিনেক আগে। আপনার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল সেই জন্য তো ভাইয়া ছুটে এলো লন্ডন থেকে।তারপর এসেই সোজা কাজী অফিস।

একদমে কথাগুলো বলে থামলো নেহা।আদিব অবাক চোখে তাকালো।মেয়েটার বানিয়ে মিথ্যা বলার কৌশল দেখে মনে মনে খুশি হলো।তবে জাহানারা খুশি হতে পারলো না তার মনে আরো প্রশ্নের উদয় হলো সে বলল,

-আমার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল কেন?আমার বাবা কে দেখে তো মনে হলো সে আদিব কে বেশ পছন্দ করে !তাহলে?

-আর একটাও কথা না জাহানারা।কত প্রশ্ন করো তুমি!নেহা দেখি ঔষধের বাক্স টা দাও তো।

জাহানারা কথা শেষ না হতেই বলে উঠলো আদিব‌। একপ্রকার ঔষধ খাওয়ানোর অযুহাতে জাহানারার কৌতূহল দমালো।তবে জাহানারা কৌতূহল দমলো কি না বোঝা গেল না।সে বাধ্য মেয়ের মতো ঔষধ খেলেও তাকে বেশ ভাবুক দেখালো।আদিব বুঝলো ঔষধ খাওয়ানো হলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে হবে না হলে এই মেয়ে আবার প্রশ্নের সয়লাব আনবে।এই মুহূর্তে এসে নাহিদা নামক সেই ভদ্রমহিলার উপর ভীষণ রাগ হলো আদিবের।কেন যে ভদ্রমহিলা পণ্ডিতি করে তাকে এই মেয়ের স্বামী বলতে গিয়েছিল……!না হলে আজ এত ঝামেলা পোহাতে হত তাকে!রাগে দুঃখে তপ্ত শ্বাস ফেলল আদিব। ঔষধ খাওয়ানো শেষে জাহানারা কে কোন কথার সুযোগ না দিয়ে বলল,

-জাহানারা আমার একটা কাজ আছে, আমি দুই দিন হসপিটালে আসতে পারবো না হয়ত।

-আবার কাজ ?এই তো দুই সপ্তাহ কাজের দোহাই দিয়ে এলে না,আজ এসে আবার বলছো কাজ আছে!তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না, না?

অভিযোগের সুরে বলল জাহানারা।আদিবের ভেতরটা কেমন ধক করে উঠলো। সেদিন রাতে জাহানারার বলা কথাটা আবার কানে বাজলো।সে অযথা গলার শ্লেষ পরিষ্কার করে বলল,

-জরুরি কাজ।একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ।

-পরশু আমাকে ডিসচার্জ দেবে হাসপাতাল থেকে।তুমি থাকবে না?

উদাস কণ্ঠে বলল জাহানারা।আদিব ঔষুধের বাক্স টা নেহার হাতে দিয়ে ছোট করে বলল,

-দেখি।

-থাক, তোমার আর দেখা লাগবে‌ না।বুঝেছি, থাকতে পারবে না।

গাল ফুলিয়ে বলল জাহানারা।আদিব মুচকি হাসলো।বলল,

-আমি চেষ্টা করবো তোমার ডিসচার্জ এর আগে ফেরার, তবে যদি না ফিরতে পারি, তাহলে আশা করবো আমার বউ বুঝবে আমার দিকটা।

কথাটা বলে থমাকালো আদিব।নিজের কথাটা নিজের কানেই কেমন যেন লাগলো।”আমার বউ”এই শব্দদ্বয় কানে ঝংকার তুলল তার। অপ্রস্তুত হলো কিঞ্চিৎ। কিন্তু জাহানারার মুখে দেখা গেল এক গাল হাসি।সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

-ঠিক আছে, তোমার ব‌উ বুঝবে।

-ওকে,তাহলে থাকো তুমি, আমি আসছি।

ব্যস্ততা দেখিয়ে অনেকটা পালিয়ে এলো আদিব।সেটা জাহানারার থেকে না নিজের মনের অবচেতন অনুভূতি থেকে সেটা বোঝা গেল না। কেবিন থেকে আসার আগে নেহা কে জাহানারা খেয়াল রাখার কথা একবার মনে করিয়ে দিল।

বাইরে বের হতেই জায়েদের সাথে দেখা হলো আদিবের।জায়েদের থেকে জানতে পারলো। জাহানারা কে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ দেওয়ার পর খুলনা নিয়ে যাবে।রাকিবের প্রফেসর ডাক্তার মার্লিন না কি বলেছে এই মুহূর্তে জাহানারার পরিচিত পরিবেশ আর আপনজনদের কাছে থাকা উচিত।তাহলে না কি সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।এ কথাটা শুনে আদিবের চাচার কাছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হলো, রাকিব যে জাহানারা কে চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় নিয়ে যা‌ওয়ার কথা বলেছিল তার কি হলো?আদিবের মনের কথা হয়ত পড়ে নিল জায়েদ ,তাই তো নিজে থেকেই বলল জাহানারার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে এখনো তিন চার সপ্তাহ লাগবে সেখানে যেতে।তবে ডাক্তার মার্লিনের ভাষ্যমতে জাহানারার এখন উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামের থেকে বন্ধু-বান্ধব ও আপনজনদের হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার আর সহযোগিতার বেশি প্রয়োজন। তাছাড়া সামনের মাসে তিনি এক মেডিকেল কনফারেন্সে আসছে বাংলাদেশে।সেই সুযোগে তিনি এসে জাহানারা কে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তবে জানাবে তাকে আদৌ আমেরিকা নিয়ে যা‌ওয়ার প্রয়োজন আছে কি না। ডাক্তার মার্লিনের সামনের মাসে আসার কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচল আদিব।তার জন্য জাহানারার সাথে স্বামীর অভিনয় করা কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠছে দিনকে দিন।এখন ডাক্তার মার্লিন আসার পর যদি কিছু উপায় বের হয় তাহলে সে বেশ উপকৃত হবে। তাছাড়া তাকে ফিরতে হবে!ছুটি শেষ হচ্ছে।

জায়েদের সাথে কথা শেষ করে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসলো আদিব। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছিল সে তখন পকেটে থাকা ফোনটা তার স্বরে চেচিয়ে উঠলো।আদিব ফোন বের করে দেখলো তার মা ফোন করছে।ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই অপর পাশ থেকে তানিয়ার থমথমে গলা কানে ঠেকলো তার ,

-আদিব তুমি কোথায়?

মায়ের মুখি তুমি সম্বোধন শুনে ভ্রূতে ভাজ পড়লো আদিবের।মা সাধারণত রেগে থাকলে তুমি সম্বোধন করে থাকে।আদিব বোঝার চেষ্টা করলো মা তার‌উপরে রেগে আছে কি না। কিন্তু আপত দৃষ্টিতে তার উপরে তার মায়ের রাগের কোনো কারণ মনে পড়লো না।সে একটু সময় নিয়ে ইতস্তত করে বলল,

-কি হয়েছে মা?

-তুমি কোথায় আদিব।

-আমি বড় আপার বাড়ি।

-তাহলে *******হাসপাতালের সামনে কে?

মায়ের কথায় চমকালো আদিব। তড়িৎ নজর ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালো।খুব বেশি কষ্ট করতে হলো না আদিবের। বা পাশে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো গাড়ির কাছে দেখা মিলল তার।আদিব সাথে সাথে চোখ বন্ধ করল নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,”সিট”।মনে পড়লো বাবার বলা অনেক পুরোনো এক প্রবাদ,”চোরের দশ দিন,গৃহস্থের একদিন।”

-আমি অপেক্ষা করছি।গাড়িতে এসে বসো।

ফোন কাটলো তানিয়া।আদিব ধীর পায়ে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে।আদিব গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি চালু করলো গাড়ি চালক।তানিয়া গাড়ি চালককে আদেশ করলো গাড়ি খুলনার দিকে নিতে।তার কথায় গাড়ি চালককে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখালো। কিন্তু তানিয়ার অস্বাভাবিক নিরাবতার সামনে কিছু বলতে সাহস পেল না।গাড়ি ঘোরালো সে।ঢাকা থেকে খুলনা সড়কের দূরত্ব প্রায় ৩৩৩ কিলোমিটার, পাঁচ ছয় ঘণ্টার রাস্তা।তানিয়ার মাজার হাড়ের সমস্যা আছে ।সে বেশি সময় একাধারে বসে থাকতে পারে না।কষ্ট হয়।আদিব মায়ের কথা ভেবে মায়ের দিকে একবার তাকালো।তানিয়ার থমথমে মুখটায় চোখ রেখে সাহস করে কিছু বলতে উদ্যত হতেই তাকে থামিয়ে দিল তানিয়া,বলল,

-আদিব একটা কথাও বলবে না।বাড়ি ফিরে কথা হবে।

মায়ের এ কথার পর আর কোনো কথা বলতে পারলো না আদিব।শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল সে। দৃষ্টি রাখলো বাইরে। দেখতে লাগলো, কীভাবে গাড়িটা ঢাকা শহরের ইমারত গুলো একে একে পিছনে ফেলে নিজ গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

সৌরকলঙ্ক পর্ব-০৯+১০

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৯

জাহানারাকে এমতো অবস্থায় দেখে সময় অপচয় করলো না আদিব। ঝুঁকে তাকে কোলে তুলে নিল। দরজার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে আবার পিছিয়ে আসলো।নিজে চোখে দেখে এসেছে বাইরেটা কতটা জনমানব শূন্য এখন কোনো যানবাহন তো দূরের কথা একটা মানুষ পাওয়াও দায়। জাহানারা কে সোফায় শুইয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি পকেট থেকে ফোন বের করলো।ব্যস্ত হাতে ৯৯৯ কল করে জরুরি ভিত্তিতে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলল।ফোনটা পকেটে রেখে হাঁটু গেড়ে জাহানারা পাশে বসলো আদিব। জাহানারার প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজন।সে জাহানারা কে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। জাহানারাকে পর্যবেক্ষণ করে তার ডান পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাত আর মাথার পিছনে বা পাশে গ্যাদগ্যাদে ক্ষত লক্ষ করলো। জাহানারার মাথার পিছনের ক্ষতটা দেখে আদিবের গলা শুকিয়ে এলো।একজন ডাক্তার হিসাবে এটা বুঝলো ক্ষতটা বেশ ভোগাবে মেয়েটাকে।একটা শুকনো ঢোক গিলল আদিব।টি টেবিলের উপর থাকা সুতি কাপড়ের টেবিল ক্লথটা উঠিয়ে জাহানারার মাথায় শক্ত করে বেঁধে দিল।কাপড় বাধার সময় অসাবধানতা বশত জাহানারার ক্ষততে চাপ পড়লো।সাথে সাথে ব্যথায় কেকিয়ে উঠলো সে।নিজের ভুলে অনুতপ্ত হলো আদিব সে বার কয়েক স্যরি শব্দটা আওড়ালো। অল্প একটু জ্ঞান তখনো অবশিষ্ট ছিল জাহানারার সে বন্ধ প্রায় চোখটা মেলার চেষ্টা করলো দেখার চেষ্টা করলো তার পাশে থাকা মানুষ টা কে।আদিব তখন জাহানারার পায়ের ক্ষততে নিজের সাদা রঙের রুমালটা বাঁধতে ব্যস্ত। জাহানারা আদিব কে দেখার চেষ্টা করলেও ভারি চোখের পাতা টেনে খুলতে সক্ষম হলো না।সে কোনোরকমে বিড়বিড় করে সামনের মানুষটার কাছে বাঁচার আকুতি জানালো। জাহানারার ব্যাথতুর কণ্ঠে বলা,”আমাকে প্লিজ বাঁচান।আমি বাঁচতে চাই।”এই সাহায্য প্রার্থনা আদিবের ভেতরটা নাড়িয়ে দিল।সে জাহানারা মুখের উপর ঝুঁকে এলো। বলল,

-জাহানারা আমি আদিব।আমি তোমার আদিব ভাই,শুনতে পাচ্ছ আমাকে।শোনো চোখ খোলো ।আমার দিকে তাকাও। জাহানারা।শুনছো!

-হুম!

-গুড। গুড।কথা বলো আমার সাথে।

-কি কথা বলবো?

জাহানারার নিভু নিভু গলা।আদিব কান বাড়িয়ে রাখলো তার ঠোঁটের কাছে।বুঝতে পারলো মেয়েটার শরীরের সাথে সাথে মস্তিষ্ক‌ও নিথর হচ্ছে। কিন্তু এটা হতে দিলে তো চলবে না।মেয়েটা একবার জ্ঞান হারালে জ্ঞান ফেরা হয়ত মুশকিল হয়ে যাবে তার জন্য। আদিব জিভে দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।এটা তার বহু পুরোনো অভ্যাস যখন সে নার্ভাস থাকে তখন এমনটা করে থাকে। জাহানারার কথার প্রতি উত্তরে বলল,

-যা মনে আসছে তাই বলো।

-কিন্তু কিছু তো মনে আসছে না। শুধু ঘুম আসছে।

কথাটা বলতে বলতে আবার শরীরে প্রাপ্ত আ’ঘা’তের য’ন্ত্রণা’য় কেকিয়ে উঠলো জাহানারা। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

-আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আদিব ভাই।খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি মনে হয় বাঁচবো না।আমাকে প্লিজ বাঁচান।আমি বাঁচতে চাই।প্লিজ আমাকে বাঁচান।

-কিচ্ছু হবে না তোমার।আমরা এখুনি হাসপাতালে পৌঁছে যাবো।তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।আমার কথা শুনতে থাকো, প্লিজ।তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে।দেখি চোখ খোলো তো আমার দিকে তাকাও।আমার দিকে তাকাও।

আদিবের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর। জাহানারা কে এখন কোনোভাবেই অচেতন হতে দিলে চলবে না।ও’টিতে ঢোকানোর আগ পর্যন্ত যতোটা সময় পারা যায় মেয়েটাকে সজাগ রাখতে হবে। জাহানারা আদিবের কথা শুনলো কিনা বোঝা গেল না তবে আদিব নিজের মতো সবটুকু চেষ্টা করলো জাহানারা কে জাগিয়ে রাখার। জাহানারার সাথে কথার মাঝে আরো একবার ফোন চেক করলো আদিব , অ্যাম্বুলেন্স কতদূর পৌঁছাল তার খোঁজ করলো।মিনিট পনেরো লাগলো অ্যাম্বুলেন্স আসতে। অ্যাম্বুলেন্সের সাথে পুলিশের গাড়িও এসে দাঁড়ালো দরজায়।আদিব অ্যাম্বুলেন্স কল করার পর জাহানারার সাথে কথা বলার ফাঁকে পুলিশ কেও ইনফর্ম করেছিল। পুলিশ ইন্সপেক্টর কে বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে জাহানারার সাথে অ্যাম্বুলেন্স উঠে বসলো আদিব। ইন্সপেক্টর মাহফুজুর আদিবের সাথে একজন কনস্টেবল পাঠালো।আদিব তাদের ফোন করে খবর দিলেও আসল অপরাধী না ধরা পর্যন্ত কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না ,হতেও তো পারে আদিব মেইন কালপ্রিট। মাহফুজুরের সন্দেহের কড়া দৃষ্টি টা আদিব লক্ষ্য করলো না। জাহানারা কে নিয়ে ব্যস্ত হলো।অ্যাম্বুলেন্স ডাক্তার তো দূরের কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একজন প্যারামেডিক কেও পাঠায় নি অ্যাম্বুলেন্সে।অথচ এই মুহূর্তে একজন দক্ষ ডাক্তারের ভীষণ প্রয়োজন ছিল।আদিব মনে হলো এখানে সে না থাকলে মেয়েটা কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে যে পরিমাণে ক্ষতি হতো সেটা হয়ত কখনোই পূরণ করা যেত না।এই মুহূর্তে এসে এদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার উপর ভীষণ রাগ হলো আদিবের। অ্যাম্বুলেন্স থাকা চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে সে নিজেই জাহানারার প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ করলো।

রাতের ফাঁকা রাস্তায় সর্বোচ্চ গতিতে অ্যাম্বুলেন্স টান দিল ড্রাইভার যার জন্য নির্ধারিত সময়ের আগেই হাসপাতালে এসে পৌঁছালো তারা। কপাল ভালো ছিল অভিজ্ঞ ডাক্তার ডিউটিতে ছিল। জাহানারাকে দেখা মাত্রই তিনি তাকে ও’টিতে ঢোকাতে বললেন।আদিবকে বলল সকল ফর্মালিটি পূরণ করতে।রিসিপশন থেকে কনসেন্ট ফর্ম হাতে নিয়ে অটির সামনে বসলো আদিব। জাহানারার নাম আর বয়স ব্যতীত তার সম্পর্কে আর কিছুই জানে না আদিব এমনকি জাহানারার বর্তমান ঠিকানাও না। এমতাবস্থায় তার মাথায় সবার প্রথম এলো ছোট চাচার কথা।সাথে সাথে ছোট চাচাকে কল করলো সে।শাহেদ হয়ত জেগেই ছিল।আদিবের কল পাওয়া মাত্রই রিসিভ করলো।আদিব তাকে জাহানারার অবস্থা সংক্ষেপে বলল।শাহেদ তাকে জানালো সে এখুনি আসছে। জাহানারার ব্যাপারটা পুলিশ কেস বিধায় কনসেন্ট ফর্মে রোগী কিংবা তার অভিভাবকের স্বাক্ষরের বিষয়টা বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখলো না ডাক্তার। জাহানারার চিকিৎসা শুরু করলো। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে হাসপাতালে এসে পৌঁছালো শাহেদ তার সাথে সজীব‌ও ছিল।তাদের দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল আদিব।শাহেদ আর সজীব কে এ যাবৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা সবিস্তারে শোনালো।আদিবের থেকে সমস্তটা শুনে হতবাক হলো তারা।শাহেদ কিংবা সজীব কেউ ভেবে পেল না অত রাতে জাহানারা নিশানের বাড়ি কি করছিল।সজীব শাহেদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-আজ সকালেও জানের সাথে দেখা হয়েছে আমার।কৈ ও তো আমাকে নিশান আঙ্কেলের ওখানে যাওয়ার কথা বলল না।

নিশান সজীবের ভাতিজা হলেও বয়সে তার থেকে গুনে গুনে বারো বছরের বড়।যার কারণে সজীব তাকে আঙ্কেল সম্বোধন করে থাকে। সজীবের কথা শুনে শাহেদের ভ্রূ তে গাড়ো ভাঁজ পড়লো। সে অনেকটা স্বগোতক্তি করে বলল,

-জাহান তো মাঝে মাঝেই যায় দিপ্তীর ওখানে কিন্তু আমি এটা ভেবে পাচ্ছি না সোহেল কোথায় ছিল?আর গার্ড ছাড়া মেয়েটা একা বাড়ি থেকে বের হলো কীভাবে!

চিন্তিত কণ্ঠ শাহেদের।সে ফোন বের করলো পকেট থেকে, কল লাগালো জাহানারার দেহরক্ষী সোহেল কে।দুইবার রিং হতেই কল ধরলো সোহেল ঘুম ঘুম কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলল,

-জি স্যার বলেন।

-তুমি কোথায়? যেখানেই থাকো না কেন এই মুহূর্তে ****** হাসপাতালে আসো।

-কি হয়েছে স্যার?এনি প্রবলেম?

সোহেলের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।শাহেদ তার কথা উপেক্ষা করে ফোন রাখলো। সোহেলের সাথে কথা শেষ করে আকিব কে ফোন করলো শাহেদ। সংক্ষেপে জাহানারা কথা বলে ফোন রাখলো।ফোন রাখার আগে অবশ্য জায়েদ কে যেন জাহানারার কথা আপাতত না জানায় সে বিষয়ে সতর্ক করতে ভুলল না।জায়েদ হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী।
তাকে এই মুহূর্তে এসব জানানো নতুন দু’র্ঘটনা’র জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখা। তাছাড়া সালেহার মৃত্যুর পর থেকে সে অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে। যতই মুখে বলুক মেয়েকে সে ত্যাগ করেছে, মেয়ের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু সেসব যে তার লোক-দেখানো মুখের কথা সেটা শাহেদের থেকে ভালো আর কে জানে!

-সজীব নিশান কে ফোন কর তো, দেখ কোথায় ওরা।

বলল শাহেদ। সজীব শাহেদের কথা মতো ফোন করতেই যাচ্ছিল কিন্তু আদিবের কথায় থেমে গেল,

-লাভ নেই।আমি অনেকবার ট্রাই করেছি ফোন ধরছে না কেউ।

– আশ্চর্য! রাতারাতি কোথায় গেল ছেলে মেয়ে দুটো?

শাহেদের উত্তেজিত কণ্ঠ।আদিব আর সজীব একে অপরের মুখের দিকে তাকালো।কেউ বুঝে উঠতে পারছে না কি হচ্ছে। হঠাৎ সজীবের কিছু মনে পড়েছে এমনভাবে বলল,

-ছোট ভাইয়া! নিশান আংকেলরা মনে হয় তাপসী আপার বাড়ি আছে।

-তাপসী?

নামটা শোনা শোনা হলে ঠিক চিন্তে পারলো না শাহেদ।সজীব ফের বলল,

-বড় ভাবির বোন। বসুন্ধরায় থাকে।

-ওনার নাম্বার আছে তোর কাছে।

-ছিল তো অনেক দিন কথা হয় নি।দেখতে হবে।

কথা বলতে বলতে ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট বার করলো সজীব খুঁজতে লাগলো তাপসীর নাম্বার।আদিব সজীবের পাশ থেকে সরে গিয়ে বসলো সামনে রাখা চেয়ারে।তার মাথাটা হঠাৎ কেমন ভারভার লাগছে।চোখ জ্বলছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেই মাথা ঠেকলো পিছনের দেওয়ালে।স্বস্তিতে আপনা আপনি চোখ বুজে এলো তার। তন্দ্রা ভাব আচ্ছন্ন হলো চোখে।বন্ধ চোখে সাথে সাথে ভেসে উঠলো রক্তে মাখামাখি ব্যথা তুর মুখ ,কানে ভাসল জাহানারার ধীমি কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলা কথাটা,”আপনি আমাকে একটুও কি ভালোবাসতে পারতেন না আদিব ভাই? একটুও?”নিদ্রা ভাব ছুটে গেল আদিবের তড়াক চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো।শুকনো ঢোক গিলে একটা শ্বাস নিল ভেতরে।আরো একবার মনে করলো জাহানারার বলা কথাটা। অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগে স্ট্রেচারে শোয়ানোর সময় জাহানারা কে নিজ বাহুতে নিয়েছিল আদিব তখন খুব কাছ থেকে জাহানারার মুখ নিঃসৃত কথাগুলো কানে গিয়েছিল তার।থমকেছিল আদিব মুহূর্তের জন্য, তবে গুরুত্ব দেয় নি, ভেবেছিল যন্ত্রণা কাতর শরীর মস্তিষ্ক বিকল করেছে যার জন্য মেয়েটা ভুলভাল বকছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এসে সে উপলব্ধি করলো জাহানারার বলা কথার প্রতিটি শব্দ,প্রতিটি অক্ষর তার প্রতি জাহানারার গভীর ভালোবাসার জানান দিচ্ছিল।বুকের ভেতর কেমন একটু ধুকপুক করে উঠলো আদিবের।অযথা ঘাম ছুটতে লাগলো।সে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে।শাহেদ কে ওয়াশরুমে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে আসলো খোলা হা‌ওয়ায়।বাইরে এসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল কতটা। নিঃশ্বাসের সাথে বের করে দিতে চাইলো ভেতরের ছটফটানি। কতটুকু সক্ষম হলো সেটা আদিব নিজেও বুঝতে পারলো না।তবে ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান কে হাসপাতালের সামনে নিজের জিপ থেকে নামতে দেখে মনের আড়াল হলো মনের সমস্যা।আদিবের দিকেই এগিয়ে এলো মাহফুজুর।এসে বলল,

-কি ব্যাপার পালাচ্ছিলেন না কি?

মাহফুজুর এর অবান্তর প্রশ্ন।ভ্রূতে ভাজ পড়লো আদিবের।অবাক হয়ে বলল,

-পালাবো কেন?

-অপরাধী কেন পালায়?

নিজের ভেতরের উথালপাতাল নিয়ে এমনিতেই অতিষ্ঠ ছিল আদিব এখন আবার মাহফুজুরের এমন হেঁয়ালি কথা তাকে আরো উত্ত্যক্ত করে তুলল।সে নিজের ভেতরে অস্থিরতা কোনোরকমে লুকিয়ে বলল,

– ইন্সপেক্টর আপনি কী বলতে চাইছেন সেটা স্পষ্ট করে বললে ভালো হতো।

-আচ্ছা স্পষ্ট করেই বলছি,আপনাকে আমার সাথে থানায় যেতে হবে।

-কারণ?

-প্রাথমিকভাবে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

– ইন্সপেক্টর আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন?

সরু দৃষ্টি আদিবের। কণ্ঠে শীতলতা। মাহফুজুর একটা শ্বাস ফেলল।বলল,

-ইয়েস।

-কোন ভিত্তিতে?

আদিবের প্রশ্নটা বোকা বোকা ঠেকলো মাহফুজুরের কাছে সে ফিচলে হেঁসে বলল,

-মাঝ রাতে একটা অন্ধকার প্রায় ফাঁকা বাড়িতে , আ’ঘাত প্রাপ্ত র’ক্তাক্ত মেয়ের পাশে আপনাকে দেখা গেছে।এখন এই অবস্থায় আপনাকে সন্দেহ করা কি স্বাভাবিক নয় মিস্টার!

মাহফুজুরের কথা যুক্তিযুক্ত।আদিব জিভে দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। মনে হলো পুলিশ কে ইনফর্ম করা ভুল হয়েছে তার।সেই সাথে এটাও মনে হলো নিজের অজান্তেই বিশ্রী কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো সে।

-ইন্সপেক্টর আপনি দেখছি বাংলা সিনেমার মতো ভিলেন কে রেখে নায়ককে ধরছেন।

আদিবের ভাবনায় ছেদ পড়ল শাহেদের কণ্ঠে।শাহেদ বাড়ি থেকে বের হ‌ওয়ার সময় তাড়াহুড়ায় নিজের ম্যানি ব্যাগ নিয়ে আসতে ভুলে গেছে। হাসপাতালে কখন কি প্রয়োজন হয় তার ঠিক নেই, সেই জন্য বিকাশ থেকে ক্যাশ‌আউট করতে বাইরে এসেছিল কিন্তু মাঝপথে ইন্সপেক্টর মাহফুজুর আর আদিবের কথা শুনে তাকে থামতে হলো। মাহফুজুর ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো।শাহেদ এগিয়ে এলো তাদের দিকে। ইন্সপেক্টর মাহফুজুর ভ্রূ তে মোটা একটা ভাঁজ ফেলে শাহেদের পরিচয় জানতে চাইলো।শাহেদ নিজের পরিচয় দিয়ে বলল,

-আপনি অযথা আমার ভাতিজার উপর সন্দেহ করছেন অফিসার। একটু ভালো করে বাড়িটার তদন্ত করুন।ঐ বাড়িতে একজন দারোয়ান ও গৃহকর্মী ছিল তারা কোথায় গেল সেটা খোঁজ করুন।আর র‌ইলো প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যাপার সেটা বরং কাল সকালে করবেন।কাল আমি নিজে না হয় আমার ভাতিজাকে নিয়ে থানায় আসবো।

-বাড়িতে আরো দুইজন ছিল?
ভাবুক কণ্ঠে বলে উঠলো মাহফুজুর।শাহেদ ফের বলল,
-জি।আমার ভাতিজি জামাই, মানে বাড়ির মালিক নিজে কনফার্ম করছে এ বিষয়ে।

-বাড়ির মালিক কোথায়?

-তারা এক আত্মীয়ের বাড়ি পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। রাত বেশি হ‌ওয়ায় সেখান থাকতে হয়েছে তাদের।আমার মতে বাড়িটা আপনাদের আরো একটু ভালো করে খোঁজা খুঁজি করা উচিত।আমার মনে হচ্ছে এটা মে বি চুরির কেস।

-কেস কীসের সেটা তো সময় হলেই বোঝা যাবে! আমার টিম তদন্ত করছে,সত্য দ্রুতই বেরিয়ে আসবে।

আদিবের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে কথাটা বলল মাহফুজুর তারপর কি যেন মনে পড়ছে এমন ভাবে বলল,

-ভিকটিম, নায়িকা জাহানারা আহাসান না?

-জি।

শাহেদ উত্তর দিল। জাহানারাকে নিয়ে আসার সময় মাহফুজুর এক ঝলক দেখেছিল জাহানারার চেহারাটা,তবে নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু শাহেদের উত্তরে সে নিশ্চিত হলো সেই সাথে কিঞ্চিৎ চিন্তিতও।নায়িকা জাহানারা আহাসান ভিকটিম মানে, কেসটা এখন যেমন তেমন ভাবে ফেলে রাখলে হবে না। জুনিয়রের উপরে ফেলে রেখে নিশ্চিন্তেও থাকা যাবে না। খাটাখাটুনি বাড়লো ভেবে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো মাহফুজুর।আদিব কে কাল সকাল দশটার মধ্যে থানয় যেতে বলে শাহেদের কাছ থেকে নিশানের নাম্বার নিয়ে বেরিয়ে গেল হাসপাতালের গেট দিয়ে। মাহফুজুর চলে যেতেই।শাহেদ কিঞ্চিৎ বিরক্ত কণ্ঠে বলল,

-পুলিশ কে ফোন করতে গিয়েছিলি কি ভেবে।পুলিশ কে ফোন করার আগে অন্তত নিজের অবস্থান তো মাথায় রাখতি? তুই আর জাহান ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই সুতরাং পুলিশ আসলে সবার প্রথমে ওর অবস্থার জন্য তোকেই দায়ী করবে এই সিম্পল বিষয়টা কি তোর মাথায় আসে নি?

-জাহানারা অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তাছাড়া জাহানারা কে নির্মম ভাবে আঘাত করা হয়েছে,অপরাধী কে সেটাও তো খুঁজতে হবে!এসব ভেবেই ফোন করেছিলাম।তখন নিজের কথা মাথায় আসেনি।

শাহেদ এক দৃষ্টিতে তাকালো আদিবের দিকে। ছেলেটার চোখ মুখ,গায়ের রং সব কিছু তার বড় ভাবির মতো।মায়ের ছেলে হিসাবে আদিবকে কখনো নিজের পরিচয় দেওয়ার কষ্ট করতে হয় না। মানুষ দেখলেই বুঝে যায় এ তানিয়ার ছেলে।তার মিয়া ভাই প্রায়শ বলে “মা যেমন ছা তেমন” আদিব তার মায়ের মতো হয়েছে।এক গুয়ে,এক রোখা, অহংকারী।নিজের কথা আগে ভাবে।অথচ সেই ছেলে না কি আজ নিশ্চিত বিপদেও নিজের কথা ভাবার সময় পাইনি!আদিবের এই মনোভাব দেখে শাহেদের হঠাৎ একটা হিন্দি প্রাবাদ মনে পড়লো।

“বাপ কা বেটা, সিপাই কা ঘোড়া, কুচ নেহি তো থোড়া থোড়া।”

তার ভাবির শত চেষ্টাকে বিফল করে বাবার ভালো গুণ ঠিকই নিজের মাঝে যত্ন করে গুছিয়ে নিয়েছে আদিব।এ কথাটা মনে হতেই এ বিপদের মুহূর্তেও শাহেদের ঠোঁটে খেলে গেল প্রশস্ত হাঁসি।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১০

ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান এবং তার টিম নিশানের বাড়ি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে চুরির আলামত পেল পরের দিন, সেই সাথে একটা ঘরে নেশালো ঔষধ মিশোনো অর্ধেক কাপ চা।যে ঘর থেকে চায়ের কাপ টা পেয়েছিল সে ঘরে জাহানারার ক্ষণিকের উপস্থিতির ছোঁয়া পাওয়া গেল।যা থেকে স্পষ্ট হলো নেশালো দ্রব্য যুক্ত চা টা জাহানারার জন্য ছিল।সে যেটা থেকে হয়ত কয়েক চুমুক খেয়েছিল‌ও।পুরো বাড়ি খুঁজে অপরাধ সংলগ্ন আরো অনেক কিছু পেলেও নিশানের বক্তব্য মতো বাড়ির দারোয়ান মনসুর আর কাজের মেয়ে রেণুকে কোথাও পা‌ওয়া গেল না।তাদের অন‌উপস্থিতিতে সন্দেহের তীর তাদের দিকেই ঘুরলো। দিপ্তীর প্রেগন্যান্সির পরে রেণু কে কাজে রাখা হয়েছিল যার কারণে তার প্রতি বিশ্বাস টা একটু নড়বড় হলেও ,মনসুর কে কেন যেন অবিশ্বাস করতে পারলো না দীপ্তি আর নিশান।লোকটা নিশানের নানা বাড়ি এলাকার মানুষ। খুব ভদ্র আর অমায়িক। প্রায় সাত বছর ধরে তাদের সাথে আছে মনসুর।কতবার তার ভরসায় ফাঁকা বাড়ি রেখে দিনের পর দিন নিশ্চিন্তে ঘুরেছে তারা স্বামী-স্ত্রী ,কখনো কোনো ক্ষয় ক্ষতি হয় নি। সুতরাং আজ তাকে অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মনসুর এর বাড়ি খোঁজ নিয়ে যখন তাকে পাওয়া গেল না তখন নিশান আর দিপ্তীর বিশ্বাস কিঞ্চিৎ টালমাটাল হলো। মাহফুজুর রেণু আর মনসুর কে অপরাধী মেনে তার খোঁজ শুরু করলো।

নায়িকা জাহানারা আহাসান কেসের সাথে জড়িত থাকার কারণে উপর থেকে বেশ পেশার এলো মাহফুজুরের উপর।বাধ্য হয়ে নিজের তথাকথিত কচ্ছপ গতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলো মাহফুজুর কে।দ্রুততার সহিত তদন্তে মনোযোগী হলো সে।দুই দিনের মাথায় খোঁজ পাওয়া গেল রেণুর। বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে তাকে এবং তার প্রেমিকে আটক করা হলো।তাদের সাথে পাওয়া গেল বিপুল অর্থ। গ্রেফতার করে তাদের ঢাকা নিয়ে আসা হলো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময়‌ই তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করলো। ফাঁকা বাড়ি পেয়ে চুরির উদ্দেশ্যে নিজের প্রেমিককে ডেকে এনেছিল রেণু।ইচ্ছা ছিল প্রেমিকের হাতে চুরির মাল গুছিয়ে দিয়ে কিছু দিন চুপচাপ এখানে থাকবে সে, তারপর একটা সময় কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়বে।সব কিছু প্ল্যান ম্যাফিক আগাচ্ছিল কিন্তু রাত দশটার পরপর অপ্রত্যাশিত ভাবে জাহানারা এসে দাঁড়ালো দিপ্তীর চৌকাঠে।রেণু দিপ্তীরা বাড়িতে নেই এই কথা বলে জাহানারা কে কাটাতে চাইলেও জাহানারা রেণুর কথা কানে তুললো না। সে সোজা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে গিয়ে ঢুকলো।যা‌ওয়ার আগে রেণুকে চায়ের কথা বলে যেতে ভুলল না। জাহানারা যখন বাড়ি প্রবেশ করেছে রেণুর প্রেমিক রুবেল তখন রান্না ঘরেই উপস্থিত ছিল। জাহানারা আসার মিনিট পাঁচেক আগে রেণুর সাহায্যে সে পিছনের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। জাহানারা আর রেণুর সমস্ত কথোপকথন রুবেল স্পষ্ট শুনেছে।বাড়িতে জাহানারার উপস্থিতিতে রেণু বিচলিত হলেও রুবেল থির থাকলো। ঠান্ডা মাথায় নিজের পকেট থেকে *****বের করে রেণুর হাতে দিল। বলল জাহানারার চায়ে মিশিয়ে দিতে। রেণুর ভরসায় হাত সাফ করতে আসলেও নিজের মতো সব ব্যবস্থা করে এসেছিল রুবেল।
জাহানারা কে চা দিয়ে আসার পর তারা অপেক্ষা করতে লাগলো তার অচেতন হ‌ওয়ার।এর পর রেণু জাহানারার ঘরে উঁকি দিয়ে তাকে ঘুমাতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।আর সময় নষ্ট না করে রুবেল কে সাথে নিয়ে নিশানের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। দীপ্তি আলমারির অতিরিক্ত চাবি কোথায় রাখে সেটা অজানা নয় রেণুর।এর আগে লুকিয়ে চুরিয়ে বেশ কয়েকবার জায়গাটা দেখেছে সে। সেদিন‌ও নির্ধারিত জায়গায় চাবি পেল।
আলমারি থেকে টাকা,গহনা,আর যে-সব দামি জিনিস পেল সব গুছিয়ে তুলে নিল তারা।সব কিছু গোছ গাছ করে সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নেমেই আসছিল কিন্তু সেই সাবধানতায় কিঞ্চিৎ ফাঁক থেকে গেল, যার কারণে রুবেলের হাত লেগে সিঁড়ির পাশে দেওয়ালে লাগানো নিশান আর দিপ্তির কাচের ফোটোফ্রেমটা পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কাচ ভাঙার বিকট শব্দে নীরব বাড়ি সরব হলো।বাড়ির দারোয়ান মনসুর ভেতরে কোনো অঘটন ঘটেছে কিনা সেটা দেখতেই রেণুর নাম ধরে হাঁক ছেড়ে ভেতরে ছুটে আসলো।দরজা খোলাই ছিল। জাহানারা বাড়িতে ঢোকার পর তার থেকে কীভাবে বাঁচা যায় এই তড়িঘড়িতে রেণু ভুলে বসেছিল দরজা বন্ধ করার কথা। মনসুর দরজায় হাত দিতেই দরজা খুলে গেল।সে ভেতরে এসে কালো রঙের বড় ব্যাগ সহ রেণুর পাশে অপরিচিত ছেলে আর রেণুর অপ্রস্তুত মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে নিল।ছুটে গিয়ে রুবেলের কলার চেপে ধরলো মনসুর।ফোন বের করে পুলিশ কে ফোন করতে লাগলো তখন শুরু হলো রুবেল আর তার মধ্যে ধস্তাধস্তি। মনসুর নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা করলেও, তার বয়স্ক শরীরে পেরে উঠলো না রুবেল আর রেণুর সাথে।পরাস্ত হলো সে। মনসুর এর হাত পা বেঁধে ***** দিয়ে তাকে অচেতন করে সিঁড়ির ঘরের ভাঙা ফার্নিচার আড়ালে প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে রেখে আসলো রেণু আর রুবেল।এই সময় হয়ত জাহানারার ঘুম ভেঙ্গে ছিল সে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে রেণু আর রুবেল কে নামতে দেখে বিপদের আশঙ্কায় দ্রুত পায়ে ছুটে যাচ্ছিল সিঁড়ির দিকে, হয়ত উদ্দেশ্যে ছিল বাড়ি থেকে বের হওয়া। জাহানারা কে সিঁড়ির দিকে যেতে দেখে নিজেদের নিশ্চিত বিপদের আঁচ পায় রুবেল। তাই কোনো কিছু না ভেবেই জাহানারার পিছনে ছুটে যায়। সিঁড়ির ঘর থেকে পা‌ওয়া মোটা লোহার টুকরোটা দিয়ে আঘাত করে জাহানারা কে।মাথায় আঘাত পাওয়ার সাথে সাথে মুখ থুবড়ে পড়ে জাহানারা। সিঁড়ির প্রত্যেক টা ধাপ তার শরীর ছুঁয়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। জাহানারার ঐ রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ভড়কে যায় রুবেল আর রেণু।পরিকল্পনা পরিবর্তন করে রুবেলের সাথে রেণুও পালানোর প্রস্তুতি নেয়।তবে যাওয়ার আগে জাহানারার শরীরটা লুকাতে চেয়েছিল তারা, কিন্তু আদিবের আগমনে সেটা হয়ে ওঠেনি।তড়িঘড়ি স্থান ত্যাগ করেছে।

রেণু আর রুবেলে জবানবন্দি অনুযায়ী সিঁড়ি ঘরে পুরোনো জিনিস পত্রের পিছনে বস্তায় মোড়া মৃত মনসুরে এর শরীরটা পেল পুলিশ। প্লাস্টিকের বস্তায় পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে তিন আগেই মারা গেছে মনসুর।তার শরীর হাসপাতালে পাঠানো হলো।গ্রামের বাড়ি ফোন করে খবর পাঠালো নিশান। মনসুরের বড় ছেলে এলো ছোট ভাইকে নিয়ে বাবার লাশ নিয়ে যেতে। বাবার লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো তারা।তাদের আহাজারি তে মুখর হলো হাসপাতাল প্রাঙ্গণ।নিশান তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা‌ও খুঁজে পেল না।মনে হলো রেণু কে কাজে রাখার আগে যদি তার বিষয়ে আরেকটু খোঁজ খবর নিতো তাহলে হয়ত আজ মনসুর তাদের মাঝে থাকতো, জাহানারার এমন দশা হতো না।নিজের অসতর্কতার জন্য ভীষণভাবে অনুতপ্ত হলো নিশান।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো এরপর আর কখনো এমন বোকামি করবে না।

_____________
জাহানারার অপারেশন সফল হলেও ডাক্তারের দেওয়া নির্ধারিত সময়ে জ্ঞান ফিরলো না তার। ডাক্তার জানালো মাথায় আঘাত লাগার কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা রোধ পেয়েছে জাহানারার ,যার কারণে কোমায় চলে গেছে সে।লাইফ সাপোর্টের জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট রাখা হলো জাহানারা কে।আকিব বোনের অবস্থা দেখে ভেঙ্গে পড়লো।আকিব ভেঙ্গে পড়লেও জায়েদ নিজের কঠিন ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখলো। আকিব কে নির্দেশ দিল যদি দেশে ভালো চিকিৎসা না হয় তাহলে বোন কে নিয়ে সে যেন বিদেশ যায়। আকিব বাবার কথা মতো ডাক্তারের সাথে কথা বলল। কিন্তু ডাক্তার জানালো জাহানারা এখন যে দুর্বল মুহূর্তে আছে এই সময় তাকে স্থানান্তর করা ঝুঁকি পূর্ণ হতে পারে। ডাক্তার তাদের কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে বলল।সেই সাথে এটাও জানালো এরমধ্যে জাহানারার জ্ঞান ফিরতেও পারে। জাহানারার চিকিৎসাধীন ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর এ বিষয়ে আশরাফের সাথে কথা বলল আকিব।আশরাফ সব শুনে, বুঝে আকিব কে বলল দেরি করার দরকার নেই।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব ব্যবস্থা করে জাহানারা কে নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিতে। আশরাফের কথা শুনে আকিব আর দেরি করলো না জাহানারা কে আমেরিকা নিয়ে যা‌ওয়ার প্রস্তুতিতে লেগে পড়লো।

_____________

আদিব গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই গাড়ি চালক আন্তরিক হেঁসে বলল,

-স্যার আপনার কাজ শেষ হলে আমাকে ফোন দিয়েন আমি আশেপাশেই থাকবো।

-তার দরকার নেই আপনি বাড়ি চলে যান।আমি কাজ শেষ হলে নিজেই ফিরে যাবো।

-না,না, স্যার একথা বলবেন না,বড় স্যার রাগ করবে।বড় স্যার শক্ত গলায় বলেছে আপনাকে না নিয়ে যেন না ফিরি। আপনি ঢাকা শহরের কিছু চিনেন না। আপনার যাতায়াতে কষ্ট হয়।

ড্রাইভার হানিফের কথা শুনে ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব।দায় সারা ভাবে বলল,

-আচ্ছা ঠিক আছে, আমি বাড়ি যা‌ওয়ার আগে আপনাকে ফোন করে জানাবো।

আদিবের ইতিবাচক সম্মতি পেয়ে গাড়ি পিছিয়ে নিল হানিফ।পিছিয়ে যা‌ওয়া গাড়িটার চলমান চাকার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদিব।

সপ্তাহ খানেক আগে জাহানারা কে নিয়ে দিপ্তীর বাড়িতে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা কম বেশি সবাই জানতে পেরেছে।তানিয়া এই ঘটনা জানার পর থেকে ছেলেকে এক প্রকার চোখে চোখে রেখেছে।আদিবের বাইরে ঘোরা ফেরার জন্য তোফায়েল কে বলে গাড়ি বরাদ্দ করেছে।আদিব মায়ের এসব কাজ কর্ম ভালো লাগছে না কিন্তু নানা বাড়ি সকলের মধ্যে একটা সিনক্রিয়েট হবে বলে মা কে কিছু বলতেও পারছে না। খুলনা ফিরে যাবে তার‌ও উপায় নেই।সামনে নানির মৃত্যু বার্ষিকী। যার জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।নানা চায় আদিব যেন এই দোয়া মাহফিলে উপস্থিত থাকে ,এই কারণে ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও বাড়ি ফিরতে পারছে না আদিব।অথচ তার ছুটির আর মাত্র তিন সপ্তাহ বাকি তাকে ফিরতে হবে লন্ডন।এই শেষ সময়টা সে বাবার সাথে কাটাতে চায়।নিজের শহরে থাকতে চায়,আবার কবে ফিরবে তার কি ঠিক আছে।বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আদিবের। একটা শ্বাস ফেলে হাসপাতালের ভেতরে পা বাড়ালো। জাহানারার অপারেশন সফল হয়েছে সেটা জানার পর সেই যে হাসপাতাল থেকে গিয়েছিল তারপর আর এ মুখো হওয়া হয়নি।এমন নয় যে তার ইচ্ছা হয় নি,আসলে মায়ের তীক্ষ্ণ নজরের ধার মনে করে আসতে চায়নি।

আদিব দুই তলায় উঠতেই করিডোরে দেখা হলো আকিবের সাথে। সালাম দিল আদিব। সালেহার মিলাদের পর আবার এই দেখা হয়েছে আদিব আর আকিবের।আকিব আদিবের সালামের উত্তর দিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলো।আকিব কে দেখা মনে হচ্ছিল সে কোথাও যাচ্ছে।আদিব সেটা জিজ্ঞেস করতেই জানালো নামাজ পড়তে যাচ্ছে।আদিব ঘড়িতে সময় দেখলো আসরের ওয়াক্ত পেরিয়ে যাচ্ছে।সে আকিব কে আর আটকালো না।এমনিতে জাহানারার জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত এখানে থাকা না থাকা সমান।তবুও আকিব কাজ কাম ফেলে বোনের জন্য ওয়েটিংরুমে সকাল থেকে রাত অবধি বসে থাকে।আকিব চলে যেতেই আদিব পা বাড়ালো আইসিউর দিকে। উদ্দেশ্য জাহানারা কে এক পলক দেখে চলে যাবে সে। কিন্তু আইসিইউ এর সামনে এসে দাঁড়ানোর পর থমকে গেল আদিব।চেয়েও নিস্তেজ সুন্দর মুখটা থেকে চোখ সরাতে পারলো না সে। স্মৃতির পাতায় হুড়মুড় করে ভিড় জমালো কিছু প্রিয় অপ্রিয় স্মৃতি।আইসিইউর দরজার লাগানো ছোট্ট গোলাকার কাচ ভেদ করে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অক্সিজেন মাস্ক লাগানো জাহানারার মুখটায়।সেভাবে কত সময় অতিবাহিত হলো জানা নেই আদিবের। হঠাৎ ভারি কণ্ঠের নারী স্বরে ধ্যান ভাঙলো তার।

-ওয়াইফ?

-হু!

অন্যমনস্ক ভাবে চমকে উঠলো আদিব।পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো এই হাসপাতালের সেবিকাদের জন্য বরাদ্দকৃত ইউনিফর্ম পরা মধ্যবয়স্ক এক ভদ্র মহিলা।আদিবের তার পোশাক দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না সে এই হাসপাতালের নার্স।আদিব কে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্র মহিলা নিজে থেকে নিজের পরিচয় দিলেন।তার নাম নাহিদা, সে জাহানারার দায়িত্বে আছেন।তিনি একজন ক্রিটিক্যাল কেয়ার নার্স।আদিব তার কাছে জানতে চাইলো জাহানারা বর্তমান অবস্থা। নাহিদা জানালেন আগের থেকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে জাহানারার। ডাক্তার আশা করছে দুই এক দিনের মধ্যে জ্ঞান ফিরতে পারার।আদিব ভদ্র মহিলার থেকে জাহানারার রিকভারি কথা শুনে মনে মনে স্বস্তি পেল।এই স্বস্তিটা মানবিকতার জন্য ছিল ,কি চাচাতো ভাই হিসাবে চাচাতো বোনের জন্য ছিল সেটা জানা নেই আদিবের তবে স্বস্তি টা তার মনের বিগত দিনের অস্থিরতা অনেকটা কম করলো। নাহিদার সাথে জাহানারার শারীরিক বিষয়ে আরো টুকটাক কথা বলে চলে আসার জন্য সামনে পা বাড়ালো আদিব।এত সব কথার মাঝে নাহিদার তাকে জাহানারার স্বামী মনে করা ভুলটা কথায়-কথায় হারিয়ে গেল।আদিব স্পষ্টভাবে কথাটা না শোনায় তাকে নিজের পরিচয় পরিষ্কার করলো না,নাহিদাও দ্বিতীয় বার কথাটা তুলল না। অজ্ঞাত একটা ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝি থেকেই গেল।

আদিব জাহানারা কে দেখে যাওয়ার তিন দিন পরের কথা। নানির মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে করা দোয়া মাহফিলের কাজে ব্যস্ত ছিল আদিব ঠিক সেই সময় দিপ্তীর ফোন এলো তার কাছে।ফোনটা দীপ্তি রোজকার নিয়মে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করতে করলেও ,কথার মাঝে দীপ্তি বলল জাহানারার জ্ঞান ফিরেছে।তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। নিশান দেখতে যাচ্ছে তাকে। দিপ্তীর কাছ থেকে জাহানারার জ্ঞান ফেরার খবরটা শুনে আদিবের মনে হলো তার‌ও একবার জাহানারা কে দেখে আসা উচিত। আগামীকাল সে খুলনা ফিরে যাচ্ছে। জাহানারা ঢাকতেই থাকবে। এরপর আর দেখা হয় কি না হয়!

বিকেলের পরে সব কাজ শেষ হতেই মা কে না বলেই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো আদিব। হাসপাতালে গিয়ে দেখলো জাহানারা কেবিনের সামনে শাহেদ, সজীব ,সজীবের স্ত্রী শিপ্রা সহ আরো কিছু অপরিচিত মুখ তবে এসব অপরিচিত মুখের মাঝে একটা স্বল্প পরিচিত মুখ আদিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।রাকিব সরোয়ার।ভ্রূ তে ভাঁজ পড়লো আদিবের। শাহেদের কাছ থেকে জানতে পারলো এই হাসপাতালের সিনিয়র নিউরোসার্জন রাকিব সরোয়ার। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কিছুদিনের জন্য আমেরিকা গিয়েছিল সে। গত কাল ফিরছে।এখন থেকে জাহানারার কেস সেই হ্যান্ডেল করবে।শাহেদ আর আদিবের কথার মাঝে ফোড়ন কেটে শাহেদের উদ্দেশ্যে শিপ্রা বলল,

-ছোট ভাইয়া এবার আপনাদের উচিত রাকিবের প্রস্তাবটা ভেবে দেখার। জাহানারার বয়স হচ্ছে,এমন ছেলে হাতছাড়া করলে পরে পস্তাতে হবে।

-কীসের মধ্যে কি বলিস! জায়গা দেখে কথা বল।বুড়ি হতে গেলি তবুও কোথায় কি বলতে হয় শিখলি না! অদ্ভুত!

শিপ্রা কথা সবার মাঝে পড়তে না পড়তেই তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো সজীব।শিপ্রা যেন একটু চুপসালো।অন্য সময় হলে সজীবের এমন কথার প্রতিবাদে শিপ্রা এক ঘর ঝগড়া করতো কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন ।জাহানারার কে নিয়ে চিন্তিত সজীব। শিপ্রা জানে সেটা,বোঝে আদরের ভাগ্নির জন্য মামার উদ্বিগ্নতা।সে আর কথা বাড়ালো না। চুপসানো মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।সজীব একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।রাগ হচ্ছে তার শিপ্রা প্রতি। জাহানারা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারলো না আর সে আছে তার বিয়ে নিয়ে। আহাম্মক একটা!

শিপ্রার কথার তাৎপর্য বুঝতে অসুবিধা হলো না আদিবের।রাকিব সরোয়ার এখনো জাহানারা ম্যাডামের জন্য অপেক্ষা করছে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলো সে। মনে মনে খুশি হলো সে।রাকিব নিঃসন্দেহে একজন ভালো ছেলে, তার থেকে বড় কথা জাহানারা এখন যে স্ট্যাটাসে আছে তার জন্য উপযুক্ত রাকিব সরোয়ার। দুইজন দুইজনের জন্য একদম প্যার্ফেক্ট।আদিবের ভাবনা চিন্তার মাঝে রাকিব তার দিকে তাকালো।আদিবের ভাবনায় ছেদ পড়লো। সরাসরি চোখে চোখ পড়ায় কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো আদিব।তবে নিজেকে দ্রুত‌ই সামলে নিল।আদিব কে দেখে তার দিকে এগিয়ে এলো রাকিব।
আদিব ভেবেছিল রাকিব হয়ত তাকে চিনবে না।সেই কবে দুই দিন কথা হয়েছিল ,এর মধ্যে কত সময় অতিবাহিত হয়েছে; তাকে না চেনায় স্বাভাবিক। কিন্তু তার ভাবনা কে ভুল প্রমাণিত করে রাকিব এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে।খুব স্বাভাবিক ভাবে কুশলাদি বিনিময় করলো।রাকিবের এমন সহজ ব্যবহারে একটু অবাক হলো আদিব।সে আশা করেনি এতোটা।আদিবের সাথে কথা শেষে হতেই শাহেদ রাকিব কে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো,

-জাহানের অবস্থা কেমন দেখলে রাকিব?

-এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না চাচু। তবে আন্দাজ করতে পারছি ডেমেজ বেশ ভালোই হয়েছে। তারপরও দেখি কি হয়।জয়েদ আঙ্কেল কোথায়?ওনাকে ভেতরে যেতে হবে।

-ভাই!ছিল তো এখানে, কোথায় গেল!সজীব দেখ তো কোথায় গেল ভাই।

শাহেদের কথায় জায়েদ কে খুঁজতে ছুটলো সজীব।রাকিব আদিব কে “আবার দেখা হবে ,সময় পেল এসো আমাদের বাড়ি” এ জাতীয় কথা বলে স্থান ত্যাগ করলো।রাকিবের সাথে শাহেদের কথোপকথন আদিবের কাছে স্পষ্ট করলো রাকিব সরোয়ারের সাথে তার চাচাদের ঘনিষ্ঠতা।তার হঠাৎ জানতে ইচ্ছা করলো রাকিবের সাথে জাহানারার সম্পর্ক টা কতটা ঘনিষ্ঠ?মনে প্রশ্ন জাগলো তাদের মধ্যে কি কোন গভীর সম্পর্ক আছে? পরক্ষণেই মনে হলো কোনো গভীর সম্পর্ক থাকলে হয়ত খবরের কাগজে বা এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেল গুলোতে বেশ ফলাও করে সে খবর ছাড়াতো। জাহানারা ম্যাডাম তো এখন বেশ চর্চায় আছে। যেখানে তিনি নতুন গাড়ি কিনলেও নিউজ হয়, সেখানে তার প্রণয়ের খবর চাপা থাকবে! কিন্তু আবার মনে হলো থাকতেও পারে, এই দুর্ঘটনার ব্যাপারটাও তো গোপন রাখা হয়েছে। জাহানারা ম্যাডামের পিআর টিম যে দক্ষতার সাথে এতবড় দুর্ঘটনা লুকিয়েছে, তাদের কাছে ম্যাডামের প্রেমের সম্পর্ক লুকানোটা খুব বেশি কষ্টকর নয়।নিজের মনের এমন অহেতুক ভাবনার উদয়ে বিব্রত হলো আদিব। জাহানারা জীবন নিয়ে মনের এত কৌতূহল পছন্দ হলো না তার জোর করে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল সবটা। কতখানি সফল হলো কে জানে!তবে সিদ্ধান্ত নিল এখান থেকে চলে যাওয়ার। তাছাড়া এত মানুষজনের মধ্যে জাহানারার সাথে তার আজ দেখা করাটা হয়ত হবে না। সুতরাং খামাখা দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।মনে মনে ঠিক করলো লন্ডন ফেরত যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাবে মেয়েটার সাথে।

এসব ভেবেই হাসপাতাল থেকে বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে কিন্তু যাওয়ার আগে সেজ চাচার সাথে দেখা করে যা‌ওয়া সমীচীন মনে করে আবার পিছিয়ে এলো।সেজ চাচার খোঁজ করতেই জানতে পরলো জায়েদ জাহানারা কেবিনে।আদিব বুঝলো চাচার বের হতে দেরি হবে।হাত ঘড়িতে সময় দেখলো , একটা কাজ আছে তার যেতে হবে তাকে। অজ্ঞাত সে আকিব কে বলে প্রস্থান করবে ভাবলো। আকিব জাহানারার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল আদিব এগিয়ে গেল সেদিকে।আকিব কে বলল সে চলে যাচ্ছে, পরে সময় করে একবার আসবে। আকিব মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। কিছু এদিক ওদিকের কথা বলে আদিব চলেই আসছিল তখন জায়েদ কেবিনের দরজা খুলে উদাস মুখে বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে ।আদিব চাচাকে দেখে সামনে এগিয়ে গেল।দুই পা আগাতেই কেবিনের ভেতরটা দৃশ্যমান হলো আদিবের।চোখ পড়লো জাহানারার ফ্যাকাশে মুখে।বেড একটু উঁচু করে রাখায় জাহানারার মুখটা দৃশ্যমান।আদিব কে দেখেই চোখ স্থির হলো জাহানারার হাত উঁচিয়ে মৃদু স্বরে কি যেন বলল সে।সাথে সাথে নাহিদা নামের নার্সটি উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,

-ওনাকে চিন্তে পারছেন?

জাহানারা আলতো করে মাথা নাড়ালো। ক্ষীণ স্বরে বলল,

-উনি?

-উনি আপনার হাজবেন্ড।

নাহিদা কথাটা বলা মাত্রই তাকে ধমকে উঠলো রাকিব। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,

-আপনি কি পাগল?দেখতে পারছেন না রোগীর কি অবস্থা।এমন সময় আমাদের একটা স্টেটমেন্ট রোগীর উপর কি ভয়ানক প্রভাব ফেলবে আপনার ধারণা আছে!

-স্যার কিন্তু আমি তো ভুল বলেনি, উনি তো পেশেন্টের স্বামী।

নিজের সপক্ষে আমতা আমতা করে বলল নাহিদা।রাকিবের মেজাজ এবার চড়লো।সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-আর এই কথা আপনাকে কে বলেছেন?

-উনি বলেছেন।

আদিবের দিকে ইশারা করে বলল নাহিদা। আদিব যেন আকাশ থেকে পড়লো।সে এমন কথা কখন বলছে সেটা মনে করার চেষ্টা করলো। ভ্রূ তে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইলো কখন সে নাহিদা কে এমন কিছু বলেছে।উত্তরে নাহিদা তার আর আদিবের গত দিনের কথোপকথন সবিস্তারে উল্লেখ করলো।তার কথা শুনে আদিব স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,

-আপনি ভুল বুঝেছেন।আমি ওনার হাজবেন্ড না,আমি ওনার ক্যাজিন।

আদিবের কথায় চুপসে গেল নাহিদা বুঝলো তার ভুল হয়েছে।সে আমতা আমতা করে বারবার স্যরি বলতে লাগলো।রাকিব তার স্যরি শুনলো কি না বোঝা গেল না।সে তখন জাহানারা কে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত।কড়া এন্টিবায়োটিকের প্রভাবে জাহানারা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।রাকিব জাহানারার অবস্থা দেখে স্বস্তি পেল।নাহিদা কে ইমিডিয়েটলি রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলল।তার রাগ হচ্ছে ভদ্র মহিলার উপর।তার উপস্থিতিতে ভদ্রমহিলা কেন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেল সেটা ভেবে পাচ্ছে না সে!ভদ্রমহিলার অবান্তর ভাবনার জন্য আজ বড় সড় একটা সমস্যা হতে পারতো সেটা ভেবেই মেজাজ গরম হচ্ছে তার। ভাগ্য ভালো ছিল যে জাহানারা ঔষুধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল।না হলে তাকে সামলাতে বেগ পেতে হতো।

রাকিব জাহানারা কে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে জানালো সে আশঙ্কা করছে জাহানারা রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়া আক্রান্ত হয়েছে।তবে সে নিশ্চিত না। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হবে।রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়ার কথা শুনে আদিবের চোখে মুখে চিন্তার গাঢ় ছাপ পড়লো।রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়ার ব্যাপারে খুব ভালোভাবে জানা না থাকলেও সে যেটুকু জানে তা হলো,

রেট্রোগ্রেড অ্যামনেশিয়া হলো এমন একটি স্মৃতিভ্রংশ অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি তার অতীতের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন, কিন্তু নতুন তথ্য গ্রহণ ও মনে রাখতে পারেন। এটি সাধারণত মস্তিষ্কের আঘাত বা রোগের কারণে ঘটে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ভুলে যেতে পারেন।

এটি সাধারণত মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ, বিশেষ করে হিপোক্যাম্পাস, থ্যালামাস বা টেম্পোরাল লোবের ক্ষতির কারণে হয়।আদিব ধারণা করলো জাহানারার মাথায় আঘাত লাগার কারণে হয়ত এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।কথাটা ভেবেই চিন্তা বাড়লো আদিবের।রেট্রোগ্রেড অ্যামনেশিয়ার যে ধরণগুলো আছে তার মধ্যে জাহানারা ঠিক কোনধরণে আক্রান্ত হয়েছে সেটাই আদিবের চিন্তার কারণ হলো।

রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়ার সাধারণ তিনটা ধরণ আছে, সীমিত, সম্পূর্ণ, প্রগতিশীল।এখন সীমিত পর্যায়ে হলে জাহানারা দুর্ঘটনার আগের কিছু অতীতের অংশ ভুলে যাবে।যেটা হয়ত তার জীবনে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না কিন্তু যদি সম্পূর্ণ হয়…… তাহলে?তাহলে তো সে নিজের অতীত জীবন ,এমনকি নিজের পরিচয়‌ও ভুলে যাবে।আবার যদি প্রগতিশীল হয় তাহলে ধীরে ধীরে মেয়েটা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হবে যেটাও খুব একটা সুবিধার না!এই রোগের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে জাহানারার জন্য মায়া হলো আদিবের।মনে মনে দোয়া করলো রাকিবের ধারণা যেন ভুল হয়।

চলবে, ইনশাআল্লাহ

সৌরকলঙ্ক পর্ব-৭+৮

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৭

আদিব একটা শুকনো ঢোক গিলে এগিয়ে গেল সামনে।দাদির পাশে বেসে নীচু স্বরে দাদিকে ডাকলো বার কয়েক কিন্তু অপর পাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ এলো না।আদিবের ভয় হতে লাগলো এবার।সে উঠে দ্রুত বাবার ঘরে গেল। আশরাফ ফজরের নামাজ পড়ে মাত্রই শুয়েছিল ছেলের উতলা ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো।দরজা খুলে বাইরে আসতেই আদিবের ভয়ভীতি কণ্ঠ কানে এলো তার,

-বাবা দাদি…

আদিবের কথা শেষ হলো না, তার আগেই রুদ্ধ শ্বাস মায়ের ঘরের দিকে ছুটলো আশরাফ।মা কে নামাজের পাটিতে সেজদা রত অবস্থায় দেখে চোখ মুখে খেল গেল উদ্বিগ্নতা। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে জাহানারা বেগমের পাশে বসে কয়েকবার ডাকলো জাহানারা বেগম কে। কিন্তু তিনি ছেলের ডাকে সাড়া দিল না। আশরাফ অতি সাবধানে মায়ের বাহুতে হাত রাখলো ।হাল্ক হাতে ধাক্কা দিল তার বাহুতে।সাথে কাত হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো জাহানারা বেগমের প্রাণহীন নিথর দেহটা।

________________

জাহানারা বেগমের মৃত্যুতে সব থেকে বেশি আহত হলো আশরাফ।মায়ের মৃত্যুর শোকে হুঁশ জ্ঞান ভুলে সর্বসমক্ষে মায়ের মৃত্যুর জন্য তানিয়াকে তুলল কাঠগড়ায়। বারংবার উল্লেখ করলেন গত রাতের তিতকুটে স্মৃতি। আশরাফের আরোপের সামনে তানিয়া নিজের স্বপক্ষে কিছু বলতে পারলো না। শুধু অশ্রু শিক্ত নয়নে চেয়ে রইল আশরাফের দিকে।বোন ভাইদের সামনে আশরাফ যা ইচ্ছা তাই বলে চলল তানিয়া কে।তানিয়া সবটা মাথা পেত নিল।তবুও যেন আশরাফের রাগ কমলো না সদ্য মাতৃহারা আশরাফ রাগে ক্ষোভে সবার সামনে বলে উঠলো যার জন্য তার মা দুনিয়া ছেড়েছে, তার সাথে সে আর থাকবে না।তালাক দেবে তাকে।আশরাফের কথায় চমকে উঠলো উপস্থিত সবাই।জাহানারা বেগমেকে বহন করা খাটিয়া তখনো আশরাফের উঠানে রাখা।ঘর জুড়ে আত্মীয়-স্বজন, চেনা-পরিচিতদের ভিড়। আশরাফের পাগলামো এতক্ষণ সবাই চুপ করে সহ্য করলেও এবার যেন টনক নড়লো সবার।নাফিজা ভাইকে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল।বোঝাতে লাগলো তাকে, যেন সে হটকারী করে কোন সিদ্ধান্ত না নেয়। কিন্তু আশরাফ নাফিজার কথা শুনলে তো! সে তার কথায় অনঢ়। আশরাফের এক রোখা ভাব দেখে নাফিজা ভাইদের ডেকে পাঠালেন। চাচাদের পিছু পিছু আদিব গিয়ে দাঁড়ালো দরজার মুখে। সাজ্জাদ,জায়েদ,শাহেদ সবাই নিজের মতো করে বোঝাতে লাগলো আশরাফ কে।ভাবির রাগের মাথায় করা অপরাধে পর্দা টানতে লাগলো সবাই। কিন্তু আশরাফ তাদের কথা কানে তুলল বলে মনে হলো না।সবাই যখন হার মানল তখন আদিব এসে পা জড়িয়ে ধরলো বাবার। অশ্রু শিক্ত কণ্ঠে বলল,

-বাবা প্লিজ এমন করো না। মা’র কথা না ভাবলে, অন্তত আমাদের কথা ভাবো।

আশরাফ ছেলেকে নিজের পা থেকে ছাড়িয়ে পাথর কঠিন মুখটা ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে।বাবার নীরবতা ভেতরটা ফালা ফালা করে দিল আদিবের।নিজের পরিবারের ভগ্নপ্রায় দশা দেখে বিচলিত হলো মন। হঠাৎ মনে হলো আজ এসব কিছুর জন্য শুধু মাত্র জাহানারা নামের মেয়েটা দায়ী ।না সে তাকে পাওয়ার জেদ করতো,না দাদি তার চাওয়া নিয়ে আদিবের কাছে আসতো, না মা দাদিকে কিছু বলতো, না এসব কিছু হতো!রাগ হলো আদিবের জাহানারার উপর।ভীষণ রাগ।রাগের মাথায় আশরাফ যেমন ভুলে বসেছিল জন্ম, মৃত্যু সব আল্লাহর হাতে।সব নির্ধারিত। আদিব‌ও তেমন ভুলে বসলো।নিজের হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ঘোষণা দিল এসব কিছুর জন্য একমাত্র জাহানারা দায়ী।আর কেউ না। শাস্তি পেলে সে পাবে, তার মা নয়।গত দিনের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে সবার সামনে আনল আদিব।আদিবের কথা শেষ হতেই সাজ্জাদ বলল,

– জাহানারা ছোট মানুষ আদিব। তাছাড়া ও অসুস্থ। ওর মাথার ঠিক নেই।

-ও মোটেও অতটা ছোট না চাচা যতটা আপনি বলতে চাইছেন।আসল কথা কি জানেন চাচা, আমার মা’র থেকে ওর দোষটা কোন অংশে কম না কিন্তু আপনারা নিজেদের মেয়ে বলে ওর দোষ দেখছেন না। শুধু আমার মায়ের দোষটাই দেখছেন।

-আমরা কারো দোষ দেখছি না আদিব।জন্ম মৃত্যু আল্লাহর হাতে।আল্লাহ যার জন্য যতটুকু হায়াত নির্ধারিত করেছে সে ততদিন‌ই বাঁচবে।মায়ের মৃত্যু তে আমরা শোকাহত কিন্তু ভুল ঠিক বোঝার ক্ষমতা আমাদের আছে। জাহানারা যেটা করেছে সেটা অসুস্থ মস্তিষ্কে।যেটা তুমিও ভালো করে জানো।আর ভাবি যেটা করেছে সেটা সচেতন মস্তিষ্কে।আমরা জানি এবং মানী যে ভাবির জন্য মা মারা যায় নি।তার আয়ু ফুরিয়েছে তাই সে মারা গেছে। কিন্তু ভাবি তার সাথে যে ব্যবহার টা করেছে সেটা কি তার উচিত হয়েছে!তুমি বলো।

-মেজ চাচা ,মা রাগের মাথায় বলেছে ওসব। আপনার তো জানেন রাগ উঠলে মায়ের মাথা ঠিক থাকে না।

-আমরা জানি বলেই তাকে দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু তুমি এটা বলতে পারো না তার কোন অপরাধ নেই। একজনের দোষ ঢাকতে আরেকজন কে অপরাধী করো না।

শাহেদের স্পষ্ট কণ্ঠ।আদিবের ভালো লাগলো না চাচার কথা সে কাঠ কাঠ গলায় বলল,

-তাহলে আপনারা কি চাইছেন,মা কে অপরাধী করে বাবা ছেড়ে দিক মা কে?তালাক দিক তাকে?

-আদিব কথা বুঝে কথা বলবে ।আমরা কখনো সেটা চাই না।আমরা শুধু বলতে চাইছি রাগের মাথায় হোক আর যে কারণে হোক ভাবির ভুল ছিল।যার জন্য ভাইকে তার অন্তত একটা সরি বলা উচিত ছিল।

-মা অনেক দুঃখিত ছোট চাচু।সে গত রাতের ঘটনার জন্য বাবার সামনে লজ্জায় দাঁড়াতে পারছে না।মুখ ফুটে কিছু বলবে কি করে। আপনার‌ই বলুন আমার মা কে তো এতদিন ধরে দেখছেন,তাকে কখনো দেখেছেন দাদির সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলতে ?দাদিকে উলটা পালটা কিছু বলতে?

না, তানিয়ার এমন কোন আচরণ কখনো কারো চোখে পড়েনি।তানিয়া রাগী, অহংকারী হলেও কখনো জাহানারা বেগমের সাথে কোন ধরনের বেয়াদবি করেনি। সবসময় চেষ্টা করেছে জাহানারা বেগম কে যথাযথ সম্মান দেওয়ার তার সুবিধা অসুবিধা বোঝার।সবাই জানে এটা।আদিবের কথায় ঘর জুড়ে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করলো।আদিব এই নিরাবতায় নিজের ইতিবাচক উত্তর পেয়ে গেল। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল সে।বাবার কাছে আরো একবার মায়ের হয়ে ক্ষমা চাইলো। আশরাফ ছেলের কথার প্রতি উত্তরে এবার‌ও কিছু বলল না। কঠিন মুখে চুপ করে রইলো। যোহরের আজান পড়লো মসজিদে।সবার টনক নড়লো।মা কে নিয়ে যেতে হবে যে তার শেষ ঠিকানায়।বেরিয়ে এলো সকলে ঘর ছেড়ে। জাহানারা বেগমের মুখটা শেষ দেখার জন্য একে একে এগিয়ে গেল।ঘর থেকে বের হতেই জাহানারার কান্নার শব্দ কানে ঠেকলো সবার।গত রাতে জাহানারার শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্য তাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছিল আশরাফের পরামর্শে।তাই ঘুম ভাঙতে বেলা গড়িয়েছে।ঘুম ভাঙতেই দাদির মৃত্যুর কথা শুনে ছুটে এসেছে সে। জাহানারার কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হলো।শুষ্ক চোখগুলো ভিজে উঠলো আবার।মেয়েকে দেখেই জায়েদের চোয়াল শক্ত হলো।এতদিন জাহানারার সব পাগলামি ,সব কিছু মুখ বুজে মেনে নিলেও হঠাৎ তার কি হলো কে জানে সে মানুষজন উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল সামনে। মায়ের খাটিয়ার পাশ থেকে মেয়েকে বাহু ধরে টেনে তুলে সজোরে চড় বসালেন তার গালে।গর্জে উঠে ডাকলেন সালেহা কে। জাহানারা কে নিয়ে এই মুহূর্তে বাড়ি যেতে বলল তাকে।জায়েদের হঠাৎ এমন কাণ্ডে চমকে উঠলো সবাই।শাহেদ বিরক্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-তোমরা কি এবার তোমাদের নাটক থামাবে?কি শুরু করেছ কি। একজন ব‌উকে যাতা বলছো, একজন মেয়ের গায়ে হাত তুলছ।মানে কি এসবের! এবার থামো প্লিজ। ভালো লাগছে না আর এসব।

-মিয়া ভাই চলো,,, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

শাহেদের কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আশরাফ কে উদ্দেশ্য করে বলল জায়েদ।এ কথার পর আর কেউ কোন কথা বলল না।শাহেদ একটা হতাশ শ্বাস ফেলল।আদিব বুঝতে পারলো সেজ চাচা তার বলা কথায় কষ্ট পেয়েছে।আদিবের বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস।ভারি পায়ে এগিয়ে গেল দাদির শেষ যাত্রায়।

জাহানারার শেষ কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে বাবার কাছে মায়ের হয়ে আবার‌ও ক্ষমা চাইলো আদিব। আশরাফ ছেলের কথা শুনল বলে মনে হলো না।সে নীরব চোখে মায়ের ঘরের দরজার সামনে বসে রইল।
সে দিন আর মুখে দানা পানি তুললেন না আশরাফ। পরেরদিন সকালে তানিয়া এসে তার সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ।নিজের অপরাধ স্বীকার করে হাত জোড় করে মাফ চাইলো।তার ভুল হয়েছে বলে বারবার নিজেকে দুষতে লাগলো। আশরাফের মন নরম হলো তানিয়ার অপরাধ স্বীকারে। তবে সদ্য মা হারানোর শোক ভুলে স্ত্রী কে কাছে টেনে নিতে পারলেন না।শীতল কণ্ঠে বলল,

-আমি ক্লান্ত তানিয়া, আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

আদিব দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল। তানিয়া ঘর থেকে বের হতেই সে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল বাবাকে একটু সময় দা‌ও সব ঠিক হয়ে যাবে।দাদির মৃত্যুর পর থেকে চাচাদের সাথে সম্পর্ক একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হলো তাদের।আগের মতো সহজ সম্পর্ক গুলো একটু জটিল হলো।কেউ মুখে বলুক আর নাই বলুক আদিব বুঝলো সবাই দাদির মৃত্যুর জন্য মনে মনে তার মা-কে দায়ী করছে।আদিবের মনে হলো হয়ত তার তাদের জায়গা থেকে ঠিক। তার মায়ের সাথেও যদি কেও এমন কিছু করতো সেও তাদের মতোই করতো।দাদির মৃত্যুর তিনদিন পর আবার এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো।জাহানারা মাত্র অতিরিক্ত ঘু’মের ‌ঔ’ষুধ খেয়ে আবার হাসপাতালে ভর্তি হলো। ডাক্তার জানালো জাহানারা মধ্যে আ’ত্মহ’ত্যার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।শাহেদ ভাতিজির অবস্থা দেখে জায়েদ কে কঠিন করে কিছু কথা শুনিয়ে নিজের সাথে তাকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। জাহানারা বেগমের মিলাদের কাজ সম্পন্ন হ‌ওয়ার পরের দিন‌ই শাহেদ জাহানারাকে নিয়ে ঢাকার রাস্তায় পাড়ি জমালো।

জাহানারা যেদিন খুলনা ছেড়ে চলে যায় সেদিন রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় বারবার তাদের বাড়ির দিকে তাকচ্ছিল। আদিব নিজের ঘরের জানালা দিয়ে দেখেছিল সেটা।দেখেছিল দুটো তৃষ্ণার্ত চোখের তাকে দেখার চেষ্টা। কিন্তু সে যায় নি সামনে।মিটায়নি কারো তেষ্টা।যে গল্পের শেষ নেই, তার শুরু টেনে লাভ কি!

এরপরের সময়টা একটু দ্রুত পার হলো। আদিবের লন্ডন যা‌ওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো।সবার থেকে বিদায় নিয়ে মা বাবার সাথে র‌ওনা দিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় একদিন মামার বাসায় থেকে পরেরদিন মা বাবাকে সাথে নিয়ে এয়ারপোর্টের পৌঁছাল।ছোট চাচাও গিয়েছিল সেদিন তাকে বিদায় জানাতে।মা বাবা আর ছোট চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে বসলো সে লন্ডন******ফ্লাইটে।র‌ওনা হলো উন্নত জীবনের আশায়, ভিনদেশ।পিছনে ফেল গেল কিছু সুন্দর অসুন্দর স্মৃতি।ব্যস্ত হলো নিজেকে নিয়ে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে বছর পার হলো তার।সময় বাড়লো তার সাথে ব্যস্ততা‌ও।একদিকে পড়াশোনার ধাপ অন্যদিকে নানার দেওয়ার ঋণে চাপ। তোফায়েল তার দেওয়া টাকা ফেরত না চাইলেও আদিব সেটা শোধ করতে মরিয়া হলো।মামাদের বলা কথাগুলো হজম করে নিলেও ভুলতে পারেনি সে।তাই তো নিজের সবটুকু চেষ্টা চালালো নানার দেওয়া টাকাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিশোধ করার। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট বড় বিভিন্ন কাজে হাত লাগলো।এত এত ব্যস্ততার মাঝে কাছের সম্পর্ক গুলো দূর সরে গেল।প্রথম প্রথম ছোট চাচা আর ফুপি খোঁজ খবর নিলেও সময়ের সাথে সাথে তাদের তদারকি কমলো।মা-ও স্পষ্ট গলায় নিষেধ করলো তাদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে।নিজের কথা জোরালো করতে,তারা আদিবের ভালো চায় না এমন যুক্তি দেখালো। হঠাৎ মায়ের এমন কথার কারণ খুঁজে পেল না আদিব ।মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পেল না সে।পরে তৃপ্তির কাছে জানতে পারলো ফুপুর সাথে জাহানারা কে নিয়ে ঝগড়া হয়েছে মায়ের। ঝগড়ার কারণ সেজ চাচাকে দেওয়া বাবার কথা। তৃপ্তির ছেলে দেখতে এসেছিল ফুপু হাসপাতালে তখন এক কথায় দু কথায় জাহানারা সাথে তার বিয়ের কথা তুলতেই মা তাকে কড়া করে কথা শুনিয়েছে।ফুপু এবার চুপ থাকেনি। তানিয়া অহংকারী,লোভী বলে দুই কথা শুনিয়ে দিয়েছে।তারপর থেকেই তানিয়া চটে আছে। এরমধ্যে আবার মেজ চাচির সাথে ঝগড়া হয়েছে।কারণ চাচি না কি ইচ্ছা করে তাদের বাড়ির সামনে ময়লা ফেলে যায়।ঐ সব মেয়েলি ঝগড়া আর কি!তৃপ্তির কথা শুনে একটা দম ফেলল আদিব। বুঝতে পারলো সম্পর্কে দূরত্ব টানার সময় এসেছে।নিজেকে গুটিয়ে নিল সব থেকে।মা দিন শেষে ফোন দিলেও ভালো মন্দের বেশি কিছু বলা বাদ দিল।পুরো দস্তুর মনোযোগ দিল নিজের ক্যারিয়ারে।এরমাঝে একদিন কথায় কথায় তৃপ্তির কাছে জানতে পেল জাহানারা না কি মডেলিং শুরু করেছে।তাদের পাড়ার মোড়ে জাহানারার বিরাট এক হোডিং লাগিয়েছে বিজ্ঞাপন দাতা প্রতিষ্ঠান।সেজ চাচা এই নিয়ে ছোট চাচার সাথে রাগারাগি করেছে।ছোট চাচা তার কথার উত্তরে বলেছে, “মেয়ে তো ত্যাগ‌ই করে দিয়েছিলে, এখন সে যা ইচ্ছা করুক তাতে তোমার কি?”এরপর সেজ চাচা কিছু বলতে পারিনি ।রাগ করে ছোট চাচার সাথে কথা বন্ধ করেছে। জাহানারার কথা শুনে আদিবের কেমন যেন অস্বস্তি হলো সে তৃপ্তি কে কড়া গলায় বলল সে যেন জাহানারার বিষয়ে তার সাথে কিছু না বলে।এরপর থেকে তৃপ্তি আর জাহানারার বিষয়ে কিছু বলতো না তাকে। কিন্তু এর ঠিক চার বছর পর আবার জাহানারার বিষয়ে খবর সামনে এলো তার।সেটাও আবার খবরের কাগজে।
আদিবের এক বাঙালি রুম মেটের বাংলা খবরের কাগজ পড়ার দরুন আদিব জানতে পারলো তার সেজ চাচার এক মাত্র মেয়ে “খন্দকার জাহানারা আহাসান নিকুঞ্জ চলচিত্রে অভিনয় করার জন্য শ্রেষ্ঠ নারী চরিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাচ্ছেন।”খবরের কাগজে জাহানারার নাম পড়েও আদিবের বিশ্বাস হলো না যে এটাই তাদের জাহানারা ।সে তৃপ্তি কে ফোন লাগলো খবরের সত্যতা যাচাই করতে। তৃপ্তি আদিবের মুখে জাহানারার নাম শুনে প্রথমে একটু ভাব নিল,এর পরে জানালো, আদিব যেটা শুনেছে সেটা সত্যি। তারপর থেকে তৃপ্তি নিজেই জাহানারার টুকটাক নানান বিষয়ে নিজে থেকেই আদিব কে বলতো।আদিব শুনতো।মাঝে মাঝে হ্যাঁ হু করে জবাব দিত।এর বেশি না। তৃপ্তির মুখে জাহানারা সফলতা, ব্যর্থতা,তার ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষী এদের তার প্রতি ভালোবাসা, এসব কথাগুলো ভেবে আদিবের ভীষণ অবাক লাগত যে, যে মেয়েটাকে মানুষ একটু দেখার জন্য, একটু ছোঁয়ায় জন্য কত কিছু করছে, সেই মানুষটাকে সে কখনো ফিরে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি।তাকে পাওয়ার জন্য,তাকে ছোঁয়ার জন্য করা মেয়েটার আকুতি, মিনতির গুরুত্ব দেয়নি!রীতিমতো উপেক্ষা করেছে মেয়েটাকে।ছুঁড়ে ফেলেছে নিজের থেকে!
এই জন্য কি বলে, “মানুষ কোন জিনিস সহজে পেলে তার কদর করে না!”

দরজায় টোকা পড়ার শব্দে ধ্যান ভাঙলো আদিবের। হঠাৎ শব্দে চমকে উঠলো সে।ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো অনেকটা সময় পার হয়েছে।স্মৃতির পাতারা উল্টে পাল্টে তাকে কখন যে নিজেদের মধ্যে ঢেকে নিয়েছে সেটা সে খেয়াল‌ই করেনি। পুরোনো দিন গুলো সব যেন তার চোখের পাতায় রঙিন দৃশ্যের ছায়াছবির নেয় ফুটে উঠেছিল,যেটা সে স্থান কাল ভুলে বিভোর হয়ে দেখছিল।আরো একবার টোকা পড়লো দরজায়।আদিব গলা বাড়িয়ে বলল,

-দরজা খোলা আছে।

ভারি কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো তানিয়া।আদিব তখনো জানালার সামনে দাঁড়িয়ে।তানিয়া ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।তার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল,

-তোর দাদি কবে কবে জাহানারা কে এ জমি লিখে দিয়েছিল আমরা টের‌ও পাইনি।তার কি এটা করা ঠিক হয়েছে!তার জিনিসের পরে তো সবার হক ছিল…

-দাদির জিনিস দাদি যাকে ইচ্ছা দিয়েছে। সেখানে আমাদের কিছু বলার থাকতে পারে না।

তানিয়ার কথা কেটে গম্ভীর গলায় বলল আদিব।ছেলের গম্ভীর কণ্ঠে বলা কথাটায় কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো তানিয়া।বুঝলো এ ব্যাপারে ছেলের সাথে কথা বলে সুবিধা করতে পারবে না।সে কথা ঘোরালো।সোনিয়ারা কেমন আছে জানতে চাইলো। সিনথিয়া,প্রিথিলার কি খবর জিজ্ঞেস করলো।আদিব অল্প শব্দে‌ জানালো সোনিয়ারা ভালো আছে। সিনথিয়া‌ শ্বশুর বাড়ি আছে তার খবর আদিব জানে না আর প্রিথিলার খবর ঠিক বলতে পারবে না।আদিবের দায় সারা জবাব। তানিয়ার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ছেলে কথা বলতে চাইছে না।সে আর কথা বাড়ালো না।যে কথা বলতে এসেছিল সেটা‌ও তুলল না।আদিব কে রেস্ট করতে বলে যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

তানিয়া চলে যেতেই আদিব নিজের ল্যাপটপ খুলে বসলো। অনেক আরাম হয়েছে এখন একটু কাজ করতে হবে তার।একটা গুরুত্বপূর্ণ ই-মেইল আসার কথা ছিল সেটা এসেছে কি না চেক করতে ই-মেইল অ্যাপে ক্লিক করলো।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৮

-কি হলো আদিব তুমি কিছু নিচ্ছো না যে, রান্না ভালো হয় নি?

আন্তরিক কণ্ঠে লিলির।আদিব জোরপূর্বক হাসলো। বিনয়ী ভাবে বলল,

-এই তো নিচ্ছি আন্টি।

সামনে রাখা মোটা সোঁটা বাটিটা থেকে দুই টুকরো মুরগির মাংস নিজের প্লেটে নিল আদিব।হাত দিয়ে হাড়ের থেকে মাংস ছাড়াতে ছাড়াতে মায়ের দিকে একবার থমথমে মুখে তাকালো।তানিয়া ছেলের দিকে না তাকিয়েও ছেলের উত্তপ্ত দৃষ্টির আঁচ পেল। কিন্তু সেদিকে ভ্রূ ক্ষেপ করলো না।মায়ের নির্লিপ্ততা দেখে আদিবের মেজাজ আরো খারাপ হলো ।সে কোনোরকম নিজের খাবার শেষ করে উঠলো।তাকে উঠতে দেখে লিলি তার মেয়ে সামিয়া কে ডাকল।সামিয়াকে বলল সে যেন আদিব কে তাদের বাগান টা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসে।সামিয়া বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো।আদিব মায়ের দিকে আরো একবার কড়া চোখে তাকিয়ে পা বাড়ালো সামিয়ার পিছু।

-আমি কি দেখতে খুব খারাপ?

অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিল আদিব ঠিক তখন সামিয়ার প্রশ্নটা কানে এলো তার। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব।বাগানের শেষ মাথায় দুপুরের রোদ আটকে দাঁড়ানো ঝাপড়ানো জাম গাছটার দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলল,

-না।আপনি বেশ সুন্দর দেখতে।

-তাহলে আপনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন?

-মাঝে মাঝে সুন্দর জিনিসও দেখতে ইচ্ছা করে না।

-এমনটা তো তখন হয় যখন মনে অন্য কোনো ইচ্ছা থাকে। আপনার স্যাম‌ওয়ান স্পেশাল থাকলে আমাকে বলতে পারেন ।আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।

স্যাম‌ওয়ান স্পেশাল!শব্দ দ্বয় নিজ মনে একবার আ‌ওড়ালো আদিব।তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে সামিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

– তেমন কেউ নেই আমার।

এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা।আদিব কথা বলতে চাইছে না যেটা স্পষ্ট। কিন্তু সামিয়ার মনে হলো লোকটা ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের।সে বলল

-আপনি কি সবসময় এমন কম কথা বলেন না কি আমি স্পেশাল।

-আমার কথার পরিমাণ সাধারণত সামনের ব্যক্তি অনুযায়ী কম বেশি হয়ে থাকে।

আদিবের স্পষ্ট জবাব। সামিয়া বুঝতে পারলো আদিবের তার প্রতি উদাসীনতা।সে আদিবের মুখের দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মুখটায় বিরক্তির ছড়া ছড়ি।সামিয়ার গভীর দৃষ্টির সামনে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো আদিব।তার এমনিতেই ভালো লাগছিল না সামিয়ার সাথে কথা বলতে। তার‌উপর এখন তার এই চোখা দৃষ্টি! বিরক্তি চরমে পৌঁছাল আদিবের।মায়ের উপর প্রচণ্ড রাগ হলো তার।নানার অসুস্থতার কথা বলে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে আসা মানতে পারলেও দা‌ওয়াতের নাম করে মেয়ে দেখতে নিয়ে আসার ব্যাপারটা তার হজম হলো না।সে মনে প্রতিজ্ঞা করলো একবার এখান থেকে বের হতে পারলে এর পরে আর মায়ের সাথে কোথাও যাবে না।কখনো না। সামিয়ার দৃষ্টি উপেক্ষা করতে ঘড়িতে অযথা একবার সময় দেখলো আদিব।সামিয়া সেটা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলো,

-কোথাও যা‌ওয়ার আছে বুঝি?

-হু?

অন্যমনস্ক ভাবে সাঁড়া দিল আদিব। তারপর হঠাৎ কি মনে করে বলে উঠলো,

-জি।আসলে আমার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।আমাকে যেতে হবে।আমি আসছি ।আমার মা আমার বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে বলবেন আমি সময় পেলে তাকে ফোন করে সব জানাবো। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। আসসালামুয়ালাইকুম।

কথাটা বলে সামিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সদর দরজার দিকে হাঁটা দিল।সামিয়া আদিবের ব্যবহারে তাজ্জব বনে গেল।আদিব বুঝলো এভাবে হঠাৎ কথার মাঝ থেকে চলে যা‌ওয়াটা ভালো দেখালো না।তবে তার কিছু করার নেই।এই বিরাট অট্টালিকায় দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। এখান থেকে না বের হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না সে। দ্রুত পায়ে সদর দরজা পেরিয়ে বাইরে এলো আদিব।বাইরে বের হতেই বুক ফুলিয়ে একটা দম নিল।ফোন বের করে মায়ের উদ্দেশ্যে একটা ছোট বার্তা পাঠালো,”তুমি আজকে যেটা করেছ সেটা একদম ঠিক করোনি,আমি বড় আপার ওখানে যাচ্ছি,মন মেজাজ ঠান্ডা হলে বাড়ি ফিরবো।”সেন্ড বাটনে ক্লিক করে ম্যাসেজ টা পৌঁছে দিয়ে ফোন লক করে পকেটে ভরলো।এরপর কিছু দূর হেঁটে একটা রিকশা নিয়ে উঠে বসলো তাতে।রিকশা ওয়ালা কে গন্তব্য জানাতেই রিকশা ওয়ালা প্যাডেল পা চালালো।ঢাকা শহরের রাস্তা ঘাট সম্পর্কে আদিবের ধারণা সীমিত।তার বেড়ে ওঠা খুলনায়,সেখানেই তার বিস্তার এরপর লন্ডন। খুলনা ব্যতীত এদেশের আর কোন শহর বা গ্রাম আদিবের ঠিক সে ভাবে চেনা হয়ে ওঠেনি।মাঝে মাঝে আদিবের মনে হয় উন্নত ভবিষ্যতের সাধনায় সে দারুণ কিছু সময় পিছনে ফেলে এসেছে। যেগুলো চাইলেও হয়ত আর ফিরে পা‌ওয়া সম্ভব না। কথাটা ভাবতেই বুক চিরে একটা হতাশ শ্বাস বিরিয়ে এলো।রিকশা চালককে পাশের এটিএম বুথের সামনে রিকশা থামতে বলে সে নেমে গেল।এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে রিকশার দিকে আগালো।রিকশায় উঠতেই যাবে তখন কেউ পিছন থেকে শিষ দিয়ে ডেকে উঠলো,”আদিব্যা” বলে।চেনা সম্বোধন।আদিব তড়িৎ ঘাড় ঘোরালো।চোখে পড়লো মোটা তাজা শরীরের গোল গাল চেহারার ছেলেটাকে।আপনা আপনি ঠোঁটের কোণে চলে এলো মৃদু হাঁসি।অপর পাশের ব্যক্তিটি ভ্রূ নাচিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।আদিব দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল।সামনের জন‌ও এগিয়ে আসলো।আদিব হ্যান্ড সেক করার জন্য হাত বাড়ালেও মানুষ টা তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হেঁচকা টানে বুকে টেনে নিল।বলল,

-শালা ,,,,বিলেতি গিরি এখানে চলবে না।এতবছর পরে দেখা হলো,হাত মিলিয়ে শান্তি হবে।

আদিব দুই হাতে বন্ধু কে জড়িয়ে নিল।সেভাবে থেকেই আহাজারি করে বলে উঠলো,

-তোর গায়ে যে গন্ধ!তোর জন্য ঐ হাতে হাত মিলানো পর্যন্তই ঠিক ছিল। উঁহুহু!

আদিব মিছিমিছি না শিঁটকালো।তাহের তড়িঘড়ি ছেড়ে দিল আদিব কে ।হাত উচু করে নিজের শরীরের গন্ধ বার কয়েক শুঁকে বলল ,

-কৈ গন্ধ বের হচ্ছে!শালা তুই যেটা শুকে নাক শিটকাচ্ছিস, ওকে বলে সুগন্ধ। সুগন্ধ!তাও আবার ব্র্যান্ডেড।

ঠোঁট টিপে হাসলো আদিব।আদিবের হাসিটা তাহের কে বিভ্রান্তিতে ফেলল এবার।তার গায়ে গন্ধের সমস্যা সেই ছোট থেকেই যেটা সময়ের সাথে সাথে কড়া সুগন্ধি আর কিছু অভ্যাস পরিবর্তনের ফলে অনেকটা কম হয়েছে কিন্তু আদিবের মুখের মিটমিটে হাঁসি দেখে তার মনে সংশয় দেখা দিল।সে হাত উঁচু করে আরো দুইবার নিজের শরীরের গন্ধ নিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে আদিবের কাছে জানতে চাইলো,

-এই আদি সত্যি সত্যি গন্ধ বের হচ্ছে না কি?

তাহেরের বিচলিত কণ্ঠ আদিব দাঁত বের করে হাসলো।তাকে আরো একবার জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে বলল,

-আরে ইয়ারকি করছিলাম।কেমন আছিস?

-বিন্দ্যাস।তোর কি খবর?দেশে ফিরলি কবে?

-এই তো মাসখানেক হলো।

-মামা যাবেন না?

আদিব কে তাহের সাথে কথায় মশগুল দেখে রিকশাওয়ালা মামা পিছু ডেকে জানতে চাইলো।আদিবের টনক নড়লো এবার।সে তো তাহের কে দেখে ভুলেই গিয়েছিল যে তার রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। রিকশাওয়ালা মামার কথার জবাব দিতেই যাবে আদিব তার আগে আদিবের হয়ে জবাবটা তাহের দিল,

-নানা মামা,তোমার মামা এখন বন্ধুর সাথে যাইবো।তুমি কেটে পড়ো।

-এই না রে আজ না।আজ বড় আপার ওখানে যেতে হবে। অপেক্ষা করছে সে।

তাহেরের কথা শেষ না হতেই বলল আদিব।তাহের আদিবের কথা হা‌ওয়াই উড়িয়ে দিয়ে বলল,

-শোনো মিয়া অনেকদিন পর তোমারে বাগে পেয়েছি এত তাড়াতাড়ি ছাড়ছি না।তুমি এখন আমার সাথে ঘুরা ঘুরি করবা ।রাত ভোর হ‌ওয়ার আগে আমি তোমাকে সসম্মানে আপার ওখানে পৌঁছে দিব।কথা ক্লিয়ার?

-না রে তা হয় না ।আপা রাগ করবে ।

-তুই ফোন লাগা আপার কাছে আমি কথা বলছি আপার সাথে।

তাহের নাছোড়বান্দা।আদিব হাল ছাড়লো।আদিব দিপ্তীর ওখানে হঠাৎ গিয়ে তাকে চমকে দিতে চেয়েছিল। যার জন্য দীপ্তি কে কিছু জানায়নি নিজের যাওয়ার ব্যাপারে।সে শুধু তাহের কে কাটানোর জন্য দিপ্তীর অযুহাত দিয়েছিল। কিন্তু বুঝলো তার এই বন্ধুর কাছে তার দেওয়া অযুহাত টিকবে না।সে রিকশাওয়ালা কে তার পাওনা মিটিয়ে দিয়ে তাহেরের সাথে তার গাড়িতে উঠে বসলো।তাহের ইয়াসির আদিবের ছোট বেলার বন্ধু।এক সাথে স্কুল শেষ করেছে তারা এরপর তাহেরের বাবার সরকারি চাকরির দরুন ট্রান্সফার হলে তারা কুষ্টিয়ায় চলে যায়।তাহেররা ঢাকার স্থানীয় লোক।কলেজে ভর্তি হ‌ওয়ার পর একবার খুলনায় গিয়েছিল তাহের ।তখন আদিবদের ওখানে মাস খানেক ছিল।ঐ সময়টাতেই তাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়। লন্ডন যা‌ওয়ার পরেও বেশ কয়েক বছর তাহেরের সাথে যোগাযোগ ছিল আদিবের।এর পরে বিভিন্ন ব্যাস্ততায় কীভাবে কীভাবে যেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো তাদের।তাহেরের সাথে কথা বলে আদিব জানতে পারলো সে বর্তমানে হোটেল ব্যাবসা নিয়োজিত আছে।বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আর নানি বাড়ি থেকে মায়ের পাওয়া সম্পত্তির অংশ বিক্রি করে পাঁচ বছর আগে একটা ছোট্ট খাটো রেস্তোরাঁ শুরু করেছিল যেটা এখন বিরাট চার তারকা হোটেলে পরিবর্তিত হয়েছে।আদিব কে নিজের হোটেলে নিয়ে গেল তাহের। সারা বিকেলটা তাহেরের হোটেলের আনাচে কানাচে ঘুরেই কাটলো আদিবের।এরপর রাত আটটার দিকে তাহের তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে গেল।দুই বছর হলো বিয়ে করছে তাহের চার মাসের একটা মেয়েও আছে তার।তাহেরের তুলতুলে মেয়েটা দেখে আদিব আক্ষেপের সুরে তাহেরের সামনে বলেই বসলো,

– জীবন যুদ্ধে আমি তোদের থেকে পিছিয়ে গেলাম রে।

-তাতো যাবায়।আরো থাকো পড়ার টেবিলে প্রতিবন্ধীর মতো পড়ে।এখন বুঝতে পারছো কেন বলতাম আদিব্যা চারিদিকে একটু নজর বুলিয়ে দেখ ,কাউরে একটু চান্স দে ।তখন তো আমাদের কথার গুরুত্ব দাও নি।এখন রাত হলে বুঝতে পারো তো!

আদিবের কথাটা হয়ত তখনো হাওয়া ঝুলছিল।তাহের সেটা মাটিতে পড়ার আগেই কটাক্ষের সুরে নিজের বাণী ব্যক্ত করলো।আদিব ভ্রূ কুঁচকালো।বলল,

-ছি :।এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেলি তা‌ও কথা বার্তা শুধরালো না।কথার কি শ্রী!

-আমার কথা ঠিকই আছে তোর কল কবজা ঠিক আছে কি না বল?

-মানে যাতা! হ্যাঁ?ফালতু লোক একটা।

-কথা ঘোরাস না যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে।তোকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়।

-থাক তোমার আর চিন্তা করতে হবে না।খেতে চলো।আমার খিধে লেগেছে।

আদিব কথা এড়াতে চাইলো কিন্তু তাহের ছাড়লে তো।তার এক প্রশ্ন বার বার।আদিব বিরক্তি তে চোখ মুখ কুঁচকে বলল,

-আই এম টোটালি প্যার্ফেক্ট।ওকে?হ্যাপি?

-ভীষণ।তবে আরেকটা কথা এত কনফিডেন্সের রহস্য কি? এরমধ্যে টেস্ট ড্রাইভ সেরে ফেলেছিস না কি? হুঁ?

-বাজে লোকজন, বাজে চিন্তা ভাবনা।ফালতু একটা। ভদ্র মানুষ হবি না তুই।

আদিব হাঁটা দিল সামনে।তাহের স্ত্রী শিলা এর মধ্যে তাদের খাওয়ার জন্য ডেকে গেছে কয়েকবার।সেদিকেই পা বাড়ালো আদিব।তাহের আদিব কে জব্দ করতে পেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।আদিব কে সহজে কণ্ঠসা করা যায় না তবে টপিক যদি এটা থাকে তাহলে আদিবের মুখটা দেখার মতো হয়।তাহেরর অট্টহাসি শুনে শিলা জিজ্ঞেস করলো,

-কি হয়েছে?ও ওভাবে হাসছে কেন?

-পা’গ’লের আবার হাসির কারণ লাগে না কি!

-তা ঠিক বলেছেন ভাইয়া।

আদিবের কথা সমর্থনে বলল শিলা।তাহের এসে যোগ দিল তাদের সাথে খাওয়ার টেবিলে।খাওয়া দাওয়া গল্প গুজবে সময় গড়িয়ে কখন যে রাত বারোটা বাজলো তাহের কিংবা আদিব কারো খেয়ালই র‌ইলো না।রাত অনেক হয়েছে দেখে আদিবকে তাহের তার এখানে থেকে যেতে বলল। কিন্তু আদিব রাজি হলো না। যতোই পুরোনো বন্ধু হোক হুট করে উড়ে এসে এমন রাত কাটানোটা তার কাছে ভালো লাগলো না।সে তাহেরের উপর অনেকটা জু’লু’ম করে তাকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করলো।শিলা মেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আর তাকে ডেকে তুলল না তাহের।ফ্লাটের বাইরে থেকে দরজা লক করে বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে।

দীপ্তি সাভারে থাকে।তাহেরের বাড়ি থেকে ওর ওখানে যেতে ঘণ্টা দেড়েক মতো সময় লাগলো।আদিবের একবার জন্য মনে হয়েছিল এই সময় দিপ্তীর ওখানে না গিয়ে মামাদের ওখানে ফিরে যাওয়া কিন্তু মায়ের আজকের করা কাজের জন্য সে সিদ্ধান্ত বদলালো। তাছাড়া এই সময় দিপ্তীর বাড়ি তার জন্য সব থেকে উপযোগী। দীপ্তি আর নিশান দুইজন থাকে সেখানে। কোন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই।নিশান যথেষ্ট ফ্রেন্ডলি।এই অসময়ে তাকে দেখলেও তারা খুশি হবে এটা সে নিশ্চিত।
দিপ্তীর বাড়ির মুখে আদিব কে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিল তাহের।আদিব তাহের কে বিদায় জানিয়ে আশেপাশে নজর ঘোরাল রাত একটার আশেপাশে সময়, রাস্তা ফাঁকা। দিপ্তীর বাড়ির নেমপ্লেটটার সাথে ফোনের স্ক্রিনে থাকা ঠিকানাটা মিলিয়ে নিল সে।সঠিক গন্তব্যে এসেছে বুঝতে পেরে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।পা বাড়ালো বাড়ির দিকে।বাড়ির সদর দরজাটা হাট করে খোলা পেল আদিব।আশেপাশে দারোয়ানকে খুঁজলো তবে আশ্চর্য জনক ভাবে কাউকে চোখে পড়লো না।বাড়ির বাইরে থেকে অন্ধকার আচ্ছন্ন বাড়িটা বেশ রহস্যময় ঠেকলো।খোলা দরজার কাছে দারোয়ান না থাকার বিষয়টা অদ্ভুত লাগলো আদিবের কাছে।এই মধ্য রাতে দরজা খোলা রেখে দারোয়ান কথায় গেল সেটা ভাবালো তাকে ।তবে পরক্ষণে মনে হলো হয়ত দিপ্তীর বাড়ি দারোয়ান‌ই নেই। কিন্তু দারোয়ান না থাকলে দরজায় তালা দিয়ে রাখেনি কেন এরা!তার আপা কি কোনোভাবে জানতে পেরেছে সে আসছে,তাই কি তাকে চমকে দেওয়ার জন্য দরজা খোলা রেখে গেছে!না।সেটা কি করে সম্ভব! সে আসছে এ খবর তো মা ছাড়া কেউ জানে না।আর তার জানা মতে মায়ের সাথে তার আপার কথা হয় না।তাহলে?নিজের মনে বিভিন্ন ভাবনা চিন্তার উদয় -অস্তচলের মাঝে বাড়ির দরজায় এসে থামলো আদিব।সাথে সাথে ভ্রূ তে ভাজ পড়লো তার।বাড়ির দরজাও সদর দরজার মতো হাঁ করে খোলা।ভেতরে ভেতরে এবার কেমন জানি একটা খটকা লাগলো আদিবের। খুঁত খুঁত করে উঠলো মন।আধারে ঢাকা নিকষ কালো বাড়িটা যেন কোন অশনি সংকেতের আভাস দিল তাকে।ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সে।পা সামনে আগানোর সাথেই কানে পর্দায় বাড়ি খেল মৃদু গোঙানির শব্দ।আদিবের প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে সাথে যেটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো।মন বলে উঠলো তার আপা কিংবা নিশান ভাইয়ের কিছু হয়নি তো?কথাটা মনে হতেই পায়ের গতি বাড়ালো আদিব।ফোন বের করে টর্চ অন করলো।অন্ধকার ঘরটা কিঞ্চিৎ আলোকিত হলো তাতে।ফোন টর্চের আলোয় দরজার পাশে থাকা সুইচবোর্ড টা চোখে পড়লো তার।সুইচ অন করলো আদিব।সাথে সাথে চোখে পড়ল ঘরের বিধ্বস্ত দশা।আদিবের বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক তাকে জানান দিল অনিষ্টের।ঠিক তখনই দৃষ্টি গিয়ে আটকালো সিঁড়ির সামনে ফ্লোরে পড়ে থাকা নিথর প্রায় শরীরটায়। ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো আদিবের। সাদা টাইলসের মেঝেতে রক্তের স্রোত আর নারী শরীরটা ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ করলো তাকে।
দীপ্তি অন্তঃসত্ত্বা।প্রায় তেরো বছর পর কত সাধ্য সাধনা করে কনসিভ করেছে।এ কথা আদিবের অজানা নয়।দীপ্তি আর তার অনাগত বাচ্চার অনিষ্ট চিন্তায় ভেতরটা কুঁকড়ে গেল আদিবের। ডিসেম্বরের এই শীতল আবহাওয়াতেও দরদর করে ঘামতে লাগলো সে।ছুটে গেল আহত মানুষটার দিকে।কাছ থেকে দৃশ্যমান হলো মানুষটার চেহারা।চমকালো আদিব।স্থান কাল ভুলে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো র’ক্তে মাখামাখি মুখটায়।নিজের অজান্তেই মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো চার অক্ষরের নামটা।

-জাহানারা!

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

সৌরকলঙ্ক পর্ব-০৬

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৬

আ’ত্মহ’ননের চেষ্টায় কিঞ্চিৎ ত্রুটি ছিল হয়ত যার কারণে বেঁচে গেল জাহানারা।তবে হাসপাতালে কাটাতে হলো বেশ কয়েকদিন। জাহানারা কে দেখতে ছোট চাচা ছুটে এলো ঢাকা থেকে।ফুপু গিয়ে র‌ইলো হাসপাতালে কতদিন। আশরাফ নিজের সবটুকু চেষ্টা দিয়ে ভাতিজির বোকামি লুকাতে চাইলেও লুকাতে পারলো না।এক কান দুই কান করে কথাটা রটেই গেল মহল্লায়। সেই সাথে আদিবের প্রতি জাহানারার অতি আগ্রহের কথাও জানলো সবাই।নানা লোকে নানান কথা বলল।কেউ আদিব কে দোষ দিল কেউ বা জাহানারা কে।তানিয়া ছেলের নামে মানুষের মুখে কটু কথা শুনে চিড়বিড়িয়ে উঠলো। সোনিয়ার আর তোফায়েলের সাথে কথা বলল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আদিবকে লন্ডনে নিয়ে যা‌ওয়ার জন্য।আদিবের কানে সবটাই এলো। জাহানারা কে জড়িয়ে নিজের নামে শোনা আউ ফাউ কথাগুলোর পরে জাহানারার উপর রাগ আরো বাড়লো।তবে পরক্ষণে যখন মনে হলো মেয়েটা আবেগের বসে যে বোকামি করছে, সেটা মানুষ তাকে সহজে ভুলতে দিবে না। ছোট্ট একটা ভুল পদক্ষেপ ,সারাজীবনের জন্য কলঙ্কের দাগ একে দিল মেয়েটার জীবনে।এ কলঙ্ক সে মুছবে কি ভাবে!এই সমাজ পুরুষের দোষ যত তাড়াতাড়ি ভুলে যায়, একজন মেয়ের দোষ অতোটা তাড়াতাড়ি ভুলতে পারে না।এসব কথা মনে হতেই জাহানারা জন্য উদায় হওয়া রাগ করুণায় পরিবর্তিত হলো।মায়া হলো মেয়েটার জন্য।

জাহানারা কে যেদিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো সেদিন ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল আদিব।উঠান পার করে ঘরে যাওয়ার স্বল্প সময়ের দূরত্ব টুকুতে ঘাড় উঁচিয়ে আদিবদের ছাদের দিকে তাকিয়েছিল জাহানারা।সেই সময় আদিবের চোখে চোখ পড়েছিল তার।এত কিছুর পরেও মেয়েটা যেমন কাতর চোখে আদিবের দিকে তাকিয়েছিল সেটা মনে পড়লে আজ‌ও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় আদিবের।সেদিন জাহানারার সেই দৃষ্টির সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেনি আদিব।নেমে এসেছিল ছাদ থেকে। একবারের জন্য মনে হয়েছিল জাহানারা তাকে যে ভালোবাসার দাবি করছে, সেটা শুধু মাত্র কিশোরী বয়সের আবেগ না।হয়ত আবেগ পেরিয়ে সত্যি তাকে ভালোবেসে ফেলেছে মেয়েটা। হঠাৎ করে খারাপ লাগছিল তার জাহানারার জন্য ।মনে হয়েছিল মেয়েটাকে এড়িয়ে না গিয়ে ভালো করে বোঝানো উচিত ছিল।হয়ত মেয়েটা তার কথা বুঝতো। নিজের বোকামির উপর নিজের‌ই রাগ হচ্ছিল আদিবের।সে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিল জাহানারার সাথে সরাসরি কথা বলবে সে এ বিষয়ে। স্পষ্ট কথা!

পরেরদিন তানিয়ার বাড়িতে না থাকার সুযোগ নিয়ে পা বাড়ালো সে সেজ চাচাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।তানিয়া বাড়ি থাকলে তাকে জায়েদের বাড়ি যেত দিত না ,যেটা আদিব ভালো করেই জানতো।এর আগে জাহানারা হাসপাতালে থাকাকালীন আশরাফ তাকে হাসপাতালে যেতে বলেছিল সৌজন্য রক্ষার্থে কিন্তু তানিয়া তাকে যেতে দেয় নি। আশরাফের সাথে এই নিয়ে অশান্তি করেছে।আদিব চায়নি সেজ চাচার বাড়িতে যাওয়া নিয়ে তার মা আবার কোনো অশান্তি করুক সেই জন্য মায়ের অন‌উপস্থির সুযোগ নিয়েছিল। কিন্তু আদিব যদি জানতো এটা তার জীবনের সব থেকে বড় ভুল হবে তাহলে কখনো মায়ের অনউপস্থিতিতে সেজ চাচার ওখানে যা‌ওয়ার কথা ভাবতো না!

আদিবের এখনো মনে আছে সেই এক চিলতে বিকেলের স্পষ্ট স্মৃতি।সেজ চাচার বাড়ির প্রবেশ মুখেই দেখা হল তার চাচির সাথে।চাচি কোথাও একটা যাচ্ছিল।আদিব কে দেখে সে মৃদু হাসলো।আদিব তাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো।সালেহা কোথায় যাচ্ছে সে কথা জানতে চাইলো আদিব।সালেহা জানালো রিপনদের বাড়ি যাচ্ছে সিরিয়ালের টাকা দিতে।আদিব কে বলল ভেতরে বসতে সে এই যাবে এই আসবে ।সজীব কে হাক ছেড়ে ডাকলো সালেহা।সজীব সালেহার কথার উত্তর নিলেও বাইরে এলো না,আদিবকে বলল তার ঘরে যেতে।সজীব কে কুড়ের উপাধি দিয়ে আদিব কে ভেতরে যেতে বলে বেরিয়ে গেল সালেহা।আদিব জাহানারার সাথে কথা বলবে ভেবে আসলেও পা বাড়ালো সজীবের ঘরে। সজীব উপুড় হয়ে পড়ে ছিল বিছানায়।এটা সজীবের ভীষণ পছন্দনীয় একটা কাজ ।আদিব ঘরে ঢুকেছে এটা বুঝতে পেরেও সে নড়লো-চড়লো না।আদিবের উদ্দেশ্যে বলল,” বস।”আদিব ওর শিয়রে বসলো।আদিব বসতেই চিত হয়ে শুলো সজীব ঘাড় ফিরিয়ে আদিবের দিকে তাকিয়ে বলল,

-বড় ভাবি বাড়ি নেই?

আদিব একটু অবাক হলো সজীবের কথায় ।তবে সজীবের কথার অর্থ বুঝতে পেরে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলল। সজীবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-এতদিন পরে দেখা হলো,ভালো‌ মন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করে খোঁচা মারছিস কেন?

-খোঁচা মারছি না শুধু জানতে চাইছি ভাবি বাড়ি আছে কি না!

-থাক আর কথা ঘোরাতে হবে না।আমি বুঝেছি তোমার জানতে চাওয়া কথার মানে। হ্যাঁ মা বাড়ি নেই তাই এসেছি।বাড়ি থাকলে হয়ত আসতে দিত না।পেয়েছ উত্তর ?খুশি?

আদিবের কণ্ঠে রাগের আভাস। সজীব শোয়া থেকে উঠে বসলো।বলল,

-চেতছিস কেন?আমি তো এমনি জিজ্ঞেস করেছিলাম। আচ্ছা বাদ দে চা খাবি?

-না কিছু খাবো না।একটা কাজে এসেছিলাম। তোর হেল্প চাই।

-কি কাজ?

কাঠের আলনা থেকে একটা গেঞ্জি হাতে নিয়ে সেটা পরতে পরতে বলল সজীব।আদিব একটু সময় নিল। তারপর বলল,

-আমি জাহানারার সাথে কথা বলতে চাই।

-এখন কথা বলে কি হবে আদিব?যা হ‌ওয়ার হয়ে গেছে।এখন তুই কিছু বলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।শোন ,জান নিজেকে সামলে নিয়েছে।ওকে ওর মতো ছেড়ে দে। তোর আর কিছু বলা লাগবে না।

-আর ইউ শিয়োর?

-ওয়ান হান্ড্রেড প্যারসেন্ট।

কথাটা বলে একটা শ্বাস ফেলল সজীব তারপর আদিবের মুখোমুখি বসে বলল,

-জান তোকে পছন্দ করে একথাটা তুই জানতি?

-হুম।

-আমাকে বলিস নি কেন?আমাকে বললে আমি হয়ত ওকে আগেই সামলে নিতাম।

-মনে হয়েছিল আমি সবটা নিজেই সামলে নিতে পারবো।তার থেকে বড় কথা আমি গুরুত্ব দেই নি ব্যাপারটা। ভেবেছিলাম কিশোরী বয়সের আবেগ,আমার থেকে কোন সাড়া না পেলে আপনা আপনি ঠিক হয়ে যাবে!

-আমি যদি বলি তোর প্রতি জানের মনে যে অনুভূতি আছে সেটা কিশোরী বয়সের আবেগ নয় , কিশোরী মনের প্রথম ভালোবাসা।

থমকালো আদিব। তড়িৎ তাকালো সজীবের মুখ পানে।সজীব হাসলো।সেই হাসিতে যেন বলতে চাইলো আমার ভাগ্নি মরেছে তোকে ভালোবেসে।আদিব একটা শুকনো ঢোক গিলল। শীতল শ্বাস টানলো। গম্ভীর অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,

-ইট ইজ আনফরচুনেট ফর হার। আমার মনে তার জন্য না তেমন কিছু আছে আর না ভবিষ্যতে হবে।

-জানের মধ্যে কি কমতি আছে আদিব?এখনকার কথা বাদ দিলাম কিন্তু ভবিষ্যতে‌ও তোর মনে ওর জন্য কোন অনুভূতি তৈরি হবে না সেটা কীভাবে বললি!এত অহংকার!

-অহংকার না আত্মবিশ্বাস।আমি আমার মন, আমার অনুভূতি সম্পর্কে জানি সেই আত্মবিশ্বাসে বললাম।

-ও…!

শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল সজীব।আর কথা বাড়ালো না।আদিবের‌ও মনে হলো বন্ধুর সাথে আর কথা জমবে না।আর যার জন্য এসেছিল সেটার যখন প্রয়োজন নেই তাহলে ওঠা উচিত।সে উঠে দাঁড়ালো।

-আচ্ছা থাক,আমি উঠি।

-এই তো এলি এখন‌ই চলে যাবি?একটু বস। কয়দিন পর তো নাগালের বাইরে চলে যাবি তখন তো চাইলেও তোকে পাবো না।

আদিবের ভিসা চলে এসেছে।এখন ফ্লাইট টিকিট কেনার পালা।সজীব তার‌ই ইঙ্গিত দিল আদিব কে।আদিব ম্লান হেসে বলল,

-এখনো অনেক দেরি আছে। আবার আসবো ।আজ উঠি একটা জরুরি কাজ আছে।

আদিবের কণ্ঠে ব্যস্ততা।সজীব আর বাঁধ সাধলো না।সেও উঠে দাঁড়ালো। আদিবকে এগিয়ে দিতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।সজীবের ঘর থেকে বের হতেই জাহানারার মুখোমুখি হলো তারা। জাহানারা কে দেখে কিঞ্চিৎ থমকালো আদিব।তাদের চাচাতো ভাই বোনের মধ্যে জাহানারার চেহারার সাথে কারো তুলনা করা যায় না।অসামান্য রূপ নিয়ে জন্মেছিল এই মেয়ে। আশরাফ প্রায় বলতো তার মা জাহানারা বেগম অল্প বয়সে যেমন ছিল ঠিক তেমন চেহারা ছিল ছোট বেলায় জাহানারার।জায়েদ মেয়ের সদ্য জন্মানো আদলে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখে মায়ের নামে মেয়ের নাম করণ করেছিলেন জাহানারা।আদিব মেয়েটাকে তেমন পছন্দ না করলেও এ কথা অস্বীকার করতে পারবে না যে তাদের এ তল্লাটে জাহানারার থেকে সুন্দর মেয়ে আর একটাও নেই।সেই জাহানারার ফ্যাকাশে মুখ,কোটোরে ঢুকে যাওয়া চোখ আর বিধ্বস্ত দৃষ্টি দেখে থমকাতে বাধ্য হলো আদিব। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জাহানারার দিকে। জাহানারা অশ্রু শিক্ত জ্বলজ্বলে চোখে আদিবের দিকে তাকালো।সজীব এগিয়ে আসলো তখন।আদিব কে আড়াল করে দাঁড়ালো জাহানারার সামনে। জাহানারার অবয়বটা সজীবের আবডালে যেতেই সম্বিত ফিরল আদিবের।কানে এলো সজীবের কথা।সজীব জাহানারা কে বলল,

-কি হয়েছে জান?বাইরে বের হয়েছিস যে!কিছু লাগবে?

সজীবের কথা শুনলো জাহানারা কিন্তু কোন প্রতি উত্তর দিল না।সজীবের হাত ধরে তাকে আদিবের সামনে থেকে সরিয়ে এক পা এগিয়ে গেল।আদিবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে ভঙ্গুর গলায় বলল,

-আমার মধ্যে কি কমতি আছে বললেন না তো?

জাহানারার প্রশ্নে ভেতরটা কেমন যেন ধক করে উঠলো আদিবের।মনের অস্থির আলোড়ন লুকিয়ে নির্লিপ্ত চোখে তাকালো জাহানারার দিকে।জাহানারার ভেতর কোন কমতি আছে কি না সেটা কখনো সেভাবে ভেবে দেখে নি আদিব।আসলে সে সময়‌ই পায়নি জাহানারাকে নিয়ে সেভাবে ভাবার। জাহানারা প্রশ্নের উত্তরে আদিব কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

-তোমার মধ্যে কোন কমতি নেই জাহানারা। ব্যাস তুমি আমার জন্য প্যার্ফেক্ট না।

-প্যার্ফেক্ট না হলে,প্যার্ফেক্ট করে নিয়েন।আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো আদিব ভাই।

জাহানারা কান্না ভেজা আকুতি।আদিব কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো।আদিব স্বপ্নেও ভাবেনি তার কথায় জাহানারা এমন একটা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে।সজীব হয়ত বুঝলো আদিবের অবস্থা।সে তড়িঘড়ি সামনে এসে জাহানারা কে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বোঝানোর সুরে বলল,

-জান, মা আমার এদিকে শোন আমার কথা

-ছোট মামা তুই তো ওনার বন্ধু।সব থেকে কাছের বন্ধু।তুই ওনাকে বল না আমাকে একটু ভালোবাসাতে।তুই বললে উনি ঠিক শুনবে।বল না ,একটু।

সজীবের কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো জাহানারা। জাহানারার এমন আকুতি মিনতির কাছে সজীবকে ভীষণ অসহায় লাগলো।আদিব লক্ষ্য করলো সেটা।সজীব জাহানারা কে কিছু বলতে যাবে তার আগে বাধ সাধলো আদিব।দৃঢ় কণ্ঠে জাহানারার উদ্দেশ্য বলল,

-জাহানারা আমি তোমাকে স্পষ্টভাবে একটা কথা বলছি।আশা করি তুমি মন দিয়ে শুনবে এবং বুঝবে।

একটু থামলো আদিব তারপর বলল,

-জাহানারা তুমি যেটাকে ভালোবাসা বলছো, সেটা আসলে তোমার আবেগ।মোহ।কিছুদিন পরে আমার থেকে ভালো কাউকে পেলে যেটা আর থাকবে না। তুমি ভুলে যাবে আমাকে।

-আদিব ভাই, রাকিব ভাইয়া কি আপনার থেকে ভালো না?উনি নিজে আমাকে হাঁটু গেঁড়ে নিজের মনের কথা বলেছে ,কতশত ওয়াদা করছে। আমি তো ওনাকে দেখে আপনাকে ভুলতে পারিনি।আমার ভালোবাসা কে প্লিজ আবেগের নাম দিয়েন না।আমি আপনাকে সত্যিই ভালোবাসি আদিব ভাই। ভীষণ ভালোবাসি।

রাকিব সরোয়ার।সাদেক সরোয়ারের একমাত্র ছেলে।খুলনা মেডিকেল দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।যেমন দেখতে,তেমন মেধাবী,টাকা পয়াসার‌ও অভাব নেই।খুলনা শহর ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় তাদের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে।খুলনা শহরে সবাই তাদের এক নামে চেনে। জাহানারার মুখে তার কথা শুনে অবাক হলো আদিব।মন চাইলো জাহানারার কাছে জিজ্ঞেস করতে রাকিব কে কীভাবে চেনে সে। আশরাফ খুলনা মেডিকেল কর্মরত অধ্যাপক হ‌ওয়ার সুবাদে রাকিবের সাথে আদিবের দুই একবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। মিষ্টি ভাষী একটা ছেলে।আদিবের সিনিয়র সে। কিন্তু জাহানারা সাথে তার কীভাবে পরিচয় হলো সেটা সেই মুহূর্তে জানার কৌতূহল দেখা দিল আদিবের মনে।তবে মনের কৌতূহল মনে দমিয়ে সে জাহানারা উদ্দেশ্যে বলল,

-তাহলে বলবো তুমি অযথা জেদ করছো।

-আমি একটুও জেদ করছি না ।আমি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠ মানুষ‌ পেলেও আমি আপনাকে ভুলতে পারবো না আদিব ভাই।প্লিজ আমাকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করবেন না।

জাহানারা নাছোড়বান্দা।আদিব হতাশ শ্বাস ফেলল।তার মনে জাহানারার জন্য সহানুভূতি ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।কি করবে সে!মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কীভাবে একজনকে মনে জায়গা দেবে!একজন কে খুশি করতে গিয়ে সে নিজের সাথে অন্যায় করতে পারবে না।আদিব সজীবের দিকে একবার তাকালো সাহায্যের আশায়। সজীব বুঝলো আদিবের দৃষ্টি।সে জাহানারা কে নানা কথা বলে বোঝাতে লাগলো। কিন্তু জাহানারা মানতে নারাজ।তার আদিব কে চায় মানে, আদিব কে চায়।সজীব আর জাহানারার কথোপকথনের মধ্যে ভেতরে প্রবেশ করলেন জাহানারা বেগম। জাহানারা দাদিকে দেখে যেন আরো বেপরোয়া হলো।দুর্বল শরীরে ছুটে গেল তার দিকে‌।বাচ্চারা যেমন আবদার করে তেমন আবদার করতে লাগলো দাদির কাছে। জাহানারা বেগম করুণ চোখে তাকালো আদিবের দিকে।দাদির ঐ দৃষ্টিটা একদম ভালো লাগলো না আদিবের।খুব খারাপ লাগলো।মনে হলো তার এখানে আসায় ভুল হয়েছে। জাহানারা এমন পাগলামো করবে জানলে সে কখনো এখানে আসতো না। জাহানারা বেগম নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা করতে লাগলো জাহানারা কে বোঝাতে কিন্তু সে দাদির একটা কথাও কানে তুলল না।আদিবের ভীষণ রাগ হলো মেয়েটার এক রোখা জেদ দেখে।বুঝলো এই মেয়ে কারো কথা কানে তুলবে না। জাহানারা বেগমের সাথে জাহানারার কথার ব্যস্ততার মাঝে সজীবকে বলে সেখান থেকে চলে আসতে উদ্যত হলো আদিব। কিন্তু দরজার কাছে আসতে জাহানারা এসে পথ আগলে দাঁড়ালো তার।হাত জোড় করে নিজের একতরফা ভালোবাসার আহাজারি করতে লাগলো।আদিবের ধৈর্য চ্যুত হল এবার।সে জাহানারার অসুস্থতা উপেক্ষা করে দারাজ গলায় ধমকে উঠলো। হঠাৎ আদিবের ধমকে কেঁপে উঠলো জাহানারা।আদিব তার কাঠখোট্টা কণ্ঠে চেতে উঠে বলল,

-ভালো ভাবে কথা বলছি কানে যাচ্ছে না ,না!বলছি না তোমার প্রতি কোন ইন্টারেস্ট নেই আমার।ভালো লাগেনা আমার তোমাকে।তোমাকে নিজের যোগ্য মনে হয় না আমার।কান খুলে শুনে রাখ আমার পক্ষে কখনো সম্ভব না তোমাকে ভালোবাসা।স্পষ্ট?

একদমে কথা গুলো বলে থামলো আদিব। জাহানারার ফ্যাকাশে মুখটা আরো ফ্যাকাশে হলো।এক পা পিছিয়ে আসলো যেন সে।আদিব সেটা লক্ষ্য করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলল। জাহানারা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখল তার মা দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজায়।আদিবের চোখে তানিয়ার চোখ পড়তেই তানিয়া ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,

-বাড়ি চলো আদিব।

আদিব মায়ের কথায় চুপচাপ পা বাড়ালো সামনে।বাড়ির সদর দরজার সামনে সালেহার সাথে দেখা হলো তাদের।সালেহা সালাম দিতে যাবে তার আগে তানিয়া শীতল অথচ রুক্ষ কণ্ঠে বলল,

-সালেহা আর কত সর্বনাশ করবে আমার?আমার মেয়েটার সর্বনাশ করে শান্তি হয় নি, এখন আমার ছেলেটার পিছনে পড়েছ!এবার তো অন্তত ক্ষান্ত দা‌ও।একটু শান্তিতে থাকতে দাও আমাকে।

কথাটা বলেই হন হন করে বড়ির পথে হাঁটা ধরলো তানিয়া।তানিয়ার কথার অর্থ উদ্ধার করতে সালেহার কিছুটা সময় লাগলো। দীপ্তি সালেহার বড় ভাইয়ের ছেলে নিশানের সাথে সবার অমতে বিয়ে করার পর থেকেই তানিয়া দিপ্তীর এই কাজের জন্য সালেহাকে দায়ী করে আসছে।সে কথাটায় আজ আবার বলল সে।তানিয়ার তীক্ষ্ণ কথা গুলো ধা’রালো তীরের নেয় বিঁধলো সালেহার বুকে।চোখ জ্বলে উঠলো।বিকেলের সাদাটে আলোয় আদিব স্পষ্ট দেখলো চাচির চোখে পানি। খারাপ লাগলো তার কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না।

আদিব ভেবেছিল বাড়ি ফিরেই মা তাকে সেজ চাচার বাড়ি যা‌ওয়ার জন্য কথা শোনাবে কিন্তু আদিবের ভাবনা কে ভুল প্রমাণিত করে তানিয়া কিছুই বলল না তাকে।এমনকি রাতে খাবার সময়‌ও তার সাথে কথা বলল না।আদিব চেষ্টা করলো মায়ের সাথে কথা বলার কিন্তু তার চেষ্টা সফল হলো না।আদিব বুঝলো তার মা নিরাবতার মাধ্যমে নিজের রাগ প্রদর্শন করছে।গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।রাতের খাবার শেষ করে ফিরে আসলো নিজের ঘরে।ঘরে এসে নিজের বিছানা ঠিক করে তাতে পিঠ রাখতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেল ।মা এসেছে ভেবে তড়িঘড়ি দরজা খুলল।দরজা খুলতেই দেখতে পেল দাদি দাঁড়িয়ে আছে।দাদিকে সেই বিকেলে সেজ চাচার ওখানে দেখার পর আর চোখে পড়েনি আদিবের।মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করায় জানতে পেরেছিল সেজ চাচার বাড়ি থেকে তখনো আসেনি দাদি।আদিব মনে করেছিল আজ হয়ত দাদি সেখানেই থাকবে। জাহানারার অসুস্থতার পর থেকে তার দাদি বেশিরভাগ সময় সেজ চাচার ওখানেই থাকে।তাই দাদির বাড়ি ফেরা নিয়ে মাথা ঘামায় নি।

দাদিকে ভেতরে আসতে বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো আদিব।দাদির দিকে লক্ষ্য করে দেখলো তাকে একটু অন্যরকম লাগছে।ভেতরে ঢুকলো জাহানারা বেগম, ধীর পায়ে আদিবের বিছানায় গিয়ে বসলো।আদিব দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে দাদির পাশে এসে বসলো।দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-কি হয়েছে দাদি?

জাহানারা বেগম হয়ত কিছু ভাবছিল, আদিবের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো তার।আদিবের প্রশ্নের জবাব বাদ দিয়ে তিনি আদিবের দুই হাত চেপে ধরলেন। আকুতি মাখা কণ্ঠে বললেন,

-দাদু আমার জান খুব ভালো মেয়ে।ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। দয়াকরে ওর ভালোবাসা পায়ে মাড়ি‌ও না।

দাদির কথায় ভড়কে গেল আদিব।দাদির কাছ থেকে এমন কিছু শুনবে বলে আশা করেনি সে।আদিব যতদূর জানে তার দাদি বিচক্ষণ মানুষ, সে এমন আবদার করতে পারে সেটা আদিবের কল্পনাতীত ছিল।দাদির একের পর এক আকুতিতে মিইয়ে গেল আদিব।অনেক কষ্টে বলল,

-দাদি তুমি অন্তত বোঝার চেষ্টা করো আমাকে। জাহানারা প্রতি আমার মনে কোন অনুভূতি নেই।আমি কীভাবে জোর করে নিজের অনুভূতি বদলাবো।আমি যদি আমাদের সম্পর্কে সম্মতি দিও, তাহলে সেটা মনের বিরুদ্ধে হবে।আর আমি আমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে যেখানে নিজে সুখে থাকতে পারবো না, সেখানে আরেকজন কে কীভাবে সুখে রাখবো।মনের উপর জোর করে সম্পর্ক তৈরি না হয় করলাম, কিন্তু সেটা জোর করে টিকিয়ে রাখবো কতদিন!

-সম্পর্কের নাম হলে মনে তখন এমনিতেই অনুভূতি তৈরি হবে।আমাকে নিরাশ করো না দাদু। মেয়েটার ঐ অবস্থা আমি আর দেখতে পারছি না।আজ আবার সালেহা গায়ে হাত তুলেছে। তোমার জন্য মরতে বসেছে তবুও তোমাকে ভুলতে নারাজ মেয়েটা। কাউকে কতক্ষনি ভালোবাসলে কেউ এমন করতে পারে সেটা একবার ভেবে দেখেছ!তুমি না হয় তোমার পছন্দের কথা আমাকে বলো আমি জাহানারা কে সেইভাবে গড়ে দেব।

-দাদি ব্যাপারটা পছন্দ অপছন্দের নয়!আমি ঠিক তোমাকে বোঝাতে পারছি না। আমার ভালো লাগে না ওকে। তুমি ওর দিকটা দেখছো আমার দিকটা একটু ভাবছো না কেন!

থামলো আদিব। জাহানারা বেগম নাতির কথার প্রেক্ষিতে আর কোন কথা খুঁজে পেল না।বিবশ নয়নে শূন্যে তাকিয়ে র‌ইলো কিছুক্ষণ। তারপর স্বগোতক্তি করে বলল,

-সবার দিক বুঝছি আমি। কিন্তু কি করবো ?মেয়েটাকে অমন ধুকে ধুকে মরতে দেখতে পারছি না।কি কুক্ষণে যে আমি ওকে বলেছিলাম জায়েদ কে আশরাফের দেওয়া কথাটা।ঐ কথায় মেয়েটার কাল হলো।আমার জন্য মেয়েটার আজ এই দষা।আমার জন্য।

শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলো জাহানারা বেগম।আদিবের ভেতরটা কেমন যেন নড়ে উঠলো।দাদিকে এতোটা অসহায়, এতোটা হতাশ তার জ্ঞান হওয়ার পর কখনো দেখিনি সে। হঠাৎ তার মন বলে উঠলো,”আদিব তোর একটা হ্যাঁ তে যদি সবাই খুশি হয় ,ভালো থাকে, তাহলে সমস্যা কোথায়? তাছাড়া জাহানারা এখন নরম কাদার মতো। ওকে নিজের মনের মতো যে ছাঁচে গড়ে নিবি সেই ছাঁচে তৈরি হবে। একবার না হয় ভেবে দেখ।”

-আপনার থেকে এমনটা আশা করিনি মা।

তানিয়ার তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ভাবনা ছিন্ন হলো আদিবের।সে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো।মায়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে তার আগে তানিয়া হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল তাকে।চুপসে গেল আদিব। তানিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বলল,

-আপনি আমাকে কখনো মন থেকে মেন নেন নি সেটা আমি জানতাম। কিন্তু তাই বলে আমার সন্তানদের‌ও কখনো আপন ভাবেন নি, সেটা জানা ছিল না।

থামলো তানিয়া, একটা দম নিল। জাহানারা বেগম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তানিয়া পাথর কঠিন কণ্ঠে ফের বলল,

-আপনার নাতনি মরলো কি বাঁচলো তা আমার কিংবা আমার ছেলের দেখার প্রয়োজন নেই।তার মা আছে বাপ আছে তারা দেখুক । আপনি তাদের বলুন মেয়েকে সামলাতে তাছাড়া অমন বেহায়া মেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যা‌ওয়ায় ভালো।

-ব‌উমা!

-মা প্লিজ স্টপ।আমি দাদির সাথে কথা বলেছি তো।তুমি শুধু শুধু কথা বাড়িও না।এখন রেগে আছো কি বলতে কি বলছো নিজেও বুঝতে পারছো না।তুমি প্লিজ ঘরে যাও।

মা আর দাদির মাঝে বলে উঠলো আদিব। জাহানারা বেগম উঠে দাঁড়ালো।সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে এলো আদিবের ঘর থেকে।বাইরে বের হ‌ওয়ার সময় অশ্রু শিক্ত চোখ দুটো মুছে নিলেন আঁচল দিয়ে। আশরাফ তখন সবে মাত্র বাড়ি ফিরেছে, মায়ের দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখটা দেখে বিচলিত হলো সে। এগিয়ে এসে বারবার জানতে চাইলো কি হয়েছে। জাহানারা বেগম কিছু হয় নি বলে পাশ কাটাতে চাইলেও আশরাফ তার কথায় ভুলল না। ইদানীং স্ত্রী রুক্ষ্ম ব্যবহার গুলো বেশ চোখে পড়ছে তার।সুযোগ পেলেই জায়েদের আর্থিক অবস্থা আর সালেহাকে নিয়ে নানান ধরনের বাজে কথা বলছে। সবসময় চেষ্টা করছে ওদের ছোট করার।তাদের পরিবার নিও বিভিন্ন কথা বলা শুরু করেছে।আদিবের বাইরে যা‌ওয়ার জন্য বাবার বাড়ি থেকে টাকা নিচ্ছে এ নিয়েও খোঁটা দিতে পিছপা হচ্ছে না। আশরাফ ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবং অযথা অশান্তির ভয়ে এ যাবৎ চুপ করে ছিল কিন্তু আজ মায়ের অশ্রু শিক্ত নরম চোখ দুটো দেখে নিজকে সামলাতে পারলো না।হাক ছাড়লো তানিয়ার নাম ধরে।তানিয়া বেরিয়ে এলো আদিবের ঘর থেকে ।আদিব‌ও মায়ের পিছু পিছু আসলো।তানিয়া কে দেখেই আশরাফ তিরিক্ষি মেজাজে জানতে চাইলো সে কি বলেছে জাহানারা বেগম কে।তানিয়া শ্বাশুড়ির পরে আগে থেকেই চটে ছিল। আশরাফের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। জাহানারা বেগমের উপর ছেলের কাছে কথা লাগানোর আরোপ করে ছি : ছি : করে উঠলেন। তানিয়ার মিথ্যা আরোপে আশরাফের মেজাজ আরো চড়া হলো সে রাগান্বিত কণ্ঠে হুংকার ছেড়ে তানিয়াকে সংযত হতে বলল।তানিয়া আশরাফের কথায় সংযত তো হলোই না বরং আরো তেতে গেল।মুখে যা আসলো তাই বলতে লাগলো। পরিশেষে জাহানারা বেগম তার সংসারে অশান্তির মূল কারণ সেটা বলে থামলেন।মায়ের নামে কটু কথা শুনে রক্ত মাথায় চড়লো আশরাফের সে রুখে গেল তানিয়ার দিকে।আদিব ঢাল হয়ে দাঁড়ালো মায়ের সামনে। জাহানারা বেগম আশরাফের হাত চেপে ধরলো।তানিয়া যেন এবার নিজের হুঁশ জ্ঞান হারালো দারাজ কণ্ঠে ঘোষণা দিল, হয় এই বাড়ি জাহানারা বেগম থাকবে না হয় তিনি।তার কথা শুনে আশরাফ বলল তানিয়া চাইলে এখুনি চলে যেতে পারেন কিন্তু তার মা কোথাও যাবে না। আশরাফের কথা শেষ হতেই তানিয়া নিজের ঘরে ছুটলো। নিজের জিনিস পত্র ব্যাগে ভরতে লাগলো।আদিব মা বাবাকে শান্ত করার,তাদের বোঝানোর এত চেষ্টা করলো কিন্তু কেউ তার একটা কথা শুনলো না।তানিয়া নিজের ব্যাগ গুছিয়ে যখন বসার ঘরে এলো আশরাফ তখন সোফায় বসা। জাহানারা বেগম তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। জাহানারা বেগম তানিয়ার হাতে ব্যাগ দেখে উঠে এলো, তানিয়ার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম গলায় বললেন তার কোন কথায় যদি তানিয়া কষ্ট পেয়ে থাকে তাহলে সে মাফ চাইছে কিন্তু তানিয়া যেন এমন রাগারাগি করে কোথাও না যায়। শ্বাশুড়ির কথায় হয়ত মন নরম হলো তানিয়ার।তবে ভেতরে গেল না সে ঠায় দাঁড়িয়ে র‌ইলো চৌকাঠে। জাহানারা বেগম শেষ মেষ ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন,

-ব‌উমা তুমি ঘরে যা‌ও।এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে, না হলে আমি এক্ষুনি জায়েদের ওখানে চলে যেতাম।কাল ভোরে ঠিক চলে যাবো।আর রাগ করে না।যাও মা ভেতরে যাও।

-তুমি কোথাও যাবে না।যা‌ওয়ার হলে…

-আর একটাও বাজে কথা না খোকা।আমার কথার উপরে একটাও কথা বলবি না।বাইরে থেকে এসেছিস ,ঘরে যা ফ্রেশ হ‌।আমি তোর সাথে কাল কথা বলবো।

আশরাফের কথা শেষ না হতেই গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল জাহানারা বেগম। আশরাফ মায়ের কথা অমান্য করলো না। উঠে চলে গেল নিজের ঘরে।তানিয়াও ব্যাগ রেখে গেস্ট রুমে গিয়ে সিধালো।মা বাবা চলে যেতেই আদিব মায়ের হয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো দাদির কাছে। জাহানারা বেগম আদিবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-ব‌উমার কথায় আমি কিছু মনে করিনি দাদু।আমি তো জানি ও রগচটা ধরনের, অল্পতে রেগে যায়।আর তাছাড়া তোমার মা চাচিদের আমি আমার সন্তানের মতো দেখি । সন্তানের কথায় রাগ করা যায়!

ম্লান হাসলো জাহানারা বেগম। তারপর কিছু একটা মনে করে আদিবের কাছে জানতে চাইলো,

-দাদু তোমার‌ও কি মনে হয় আমি তোমার, তোমাদের ভালো চাই না?

-না।আমার একদম তেমন মনে হয় না।আমি তো চিনি আমার দাদিকে।জানি সে কেমন।তুমি প্লিজ মায়ের কথা মনে নিও না।

-নিচ্ছি না।তুমি যা‌ও ঘরে যাও।রাত অনেক হয়েছে।না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে।যাও।

জোর করে আদিব কে ঘরে পাঠালো জাহানারা বেগম।দাদির কথা শুনে আদিব ঘরে আসলেও ঘুম হলো না।সারারাত উশ খুশ করেই কাটলো তার। ঘুমহীন ভারি মাথা নিয়ে বিছানা ছাড়লো আদিব।ঘর ছেড়ে বের হয়ে বাগানে হাঁটা হাঁটি করলো কিছুক্ষণ তারপর ভেতরে ঢুকে দাদির ঘরের দিকে চোখ যেতেই দেখলো দাদির ঘরের দরজা খোলা।কাল রাতের কথা মনে হতেই আদিবের মস্তিষ্ক সচল হলো।দাদি তার মায়ের উপর রাগ করে চলে গেল কিনা সেটা দেখতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো দাদির ঘরে।ঘরে ঢুকতেই দেখলো দাদি নামাজের পাটিতে সেজদা রত অবস্থায় আছে।আদিব ঘড়ি দেখলো।ফজরে ওয়াক্ত পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।দাদি নফল নামাজ আদায় করে, কিন্তু কখনো এত দেরি তো হয় না। অজানা অশনি সংকেত ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো তার।

চলবে, ইনশাআল্লা

সৌরকলঙ্ক পর্ব-০৫

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৫

আদিবের বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক বেশি সময় নিল না এটা বুঝতে যে তার বাবা কোন এক কালে জাহানারার সাথে তার বিয়ে দিবে বলে সেজ চাচাকে কথা দিয়েছিল।মা এখন যেটা মানতে চাইছে না।দাদি এবং মায়ের বলা কথার সারমর্ম বুঝতে পেরে ভেতরটা বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল আদিবের।গলা দিয়ে আর খাবার নামলো না তার।খা‌ওয়ার মাঝপথে খাবার রেখে উঠে দাঁড়ালো সে।জাহানারা বেগম তাকে এভাবে উঠতে দেখে জানতে চাইলেন কি হয়েছে?আদিব কোন মতে পেট ভরে গেছে বলে স্থান ত্যাগ করলো।

জাহানারার সাথে নিজেকে ভেবে সে রাতে ভালো ভাবে ঘুম হলো না আদিবের।পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই বাবার সামনে উপস্থিত হলো।কোনো ভণিতা ছাড়া বাবাকে বলল,

-“বাবা আমি জাহানারা কে বিয়ে টিয়ে করতে পারবো না।”

আশরাফ খবরের কাগজ পড়ছিল, ছেলের কথা শুনে সেটা ভাজ করতে করতে বলল,

-কেন?

-আমার তাকে ভালো লাগে না।চাচাতো বোন হিসাবে সে ঠিক আছে, কিন্তু জীবন সঙ্গী হিসেবে আমি তাকে ভাবতে চাই না‌।

-ঠিক আছে।

আশরাফের গলার স্বর একদম স্বাভাবিক।আদিব বাবার মুখ পানে অবাক চোখে চাইলো।বাবা যে তার কথা এত সহজে মেনে নেবে সেটা সে ভাবতে পারেনি।আদিব কে নিজের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আশরাফ আদিবকে জিজ্ঞেস করল,

-আর কিছু বলবে?

আদিব দুই দিকে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে কিছু বলবে না। আশরাফ খবরের কাগজের ভাজ খুলে আবার সামনে ধরলো।আদিব চলেই আসছিল কিন্তু কি মনে করে দাঁড়ালো।বলল,

-বাবা তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?

-বলো।

খবরের কাগজে চোখ রেখেই বলল আশরাফ।আদিব একটু সময় নিল।নিজ মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল একবার। তারপর বলল,

-বাবা তুমি জ্ঞানী মানুষ।আমার থেকে বেশি জানো তুমি।আমার কথায় কিছু মনে করো না তবে আমার মনে হচ্ছে সেজ চাচাকে আমার আর জাহানারার বিয়ের বিষয়ে কথা দেওয়া উচিত হয় নি তোমার।

ছেলের কথায় ঘাড় উঁচু করে তার দিকে তাকালো আশরাফ। বাবার চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামালো আদিব। আশরাফ কিছুক্ষণ ছেলের দিকে সেভাবেই তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ছোট করে বলল,

-হুম।

নিজের কথা শেষ করে আশরাফের সামনে থেকে সরে এলো আদিব। এরপর থেকে অকারণেই জাহানারার প্রতি একটা বিরক্তি কাজ করতে লাগলো আদিবের মনে।সে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে লাগলো জাহানারা কে।এভাবে সময় অতিবাহিত হলো।
নিজের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হলো আদিব। জাহানারা নামক মেয়েটা মোটা মোটা অ্যাডমিশন ব‌ইয়ের আড়ালে ঝাপসা হলো। এরপর একদিন বিকেলের কথা অনেকদিন পর ছাদে গিয়েছিল আদিব। ছাদ থেকে সেজ চাচাদের বাড়ির উঠানে চোখ যেতেই দেখলো সেজ চাচি চুলায় রান্না করা খড়ি কাঠ নিয়ে জাহানারা কে শাসাচ্ছে।আর জাহানারা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।দূর থেকে চাচির কথা তো কিছু বোঝা গেল না তবে মেয়েটা যে আবার কোনো অকাজ করছে সেটা বেশ বুঝলো আদিব।মন আরো একবার বলে উঠলো, “আদিব অ্যান্ড জাহানারা!” নো চান্স।এর ঠিক বেশ কিছু দিন পর এক শেষ বিকেলের সময়, আদিব কোন এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছিল তখন রাস্তা আগলে দাঁড়ালো জাহানারা। জাহানারার হঠাৎ আগমনে ভ্রূতে ভাঁজ পড়লো আদিবের।সে জাহানারার মুখের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো মেয়েটাকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। চারদিকে ফাগুনের দমকা বাতাস থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা দরদর করে ঘামছে ,হাতটাও কেমন যেন একটু কাঁপছে তার। জাহানারাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করার পর আদিবের মনে হলো মেয়েটা হয়ত অসুস্থ।সে নরম গলায় বলল,

-জাহানারা তুমি ঠিক আছো?

আদিবের ভারি গলায় একটু কেঁপে উঠলো জাহানারা।শরীরের কম্পন দৃশ‌্যমান হলো।আদিবের চোখের দিকে ভীতু চোখে চেয়ে চোখে নামিয়ে নিল সে।চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানলো ভেতরে।বাধো বাধো গলায় বলল,

-আমি আপনাকে ভালোবাসি আদিব ভাই।

জাহানারার কম্পিত কণ্ঠ।আদিব বাকরুদ্ধ জাহানারার সাহস দেখে।সে তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জাহানারা দিকে।তার মন চাইলো এমন নির্লজ্জতার জন্য মেয়েটার ফরসা গালে চটাস করে একটা চড় বসাতে। কিন্তু সম্পর্কের দূরত্ব অনুভব করে মনের চাওয়া মনেই দাবিয়ে দিল। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।ফোঁস করে একটা উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

-বাড়ি যা‌ও জাহানারা।

কথাটা বলেই নিজের পথের হাঁটা ধরলো আদিব। জাহানারা তার প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ যেটা আদিব বুঝতে পারলেও পিছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।
বাড়ি ফিরে সোজা দাদির ঘরে ঢুকলো আদিব।দাদিকে জানাল তাকে বলা জাহানারার কথাটা।আদিবের কথা শুনে জাহানারা বেগমের মুখে অন্ধকার নামলো।সে আদিব কে কোনোরকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলল জাহানারার বলা কথাটা আদিব যেন আর কাউকে না বলে।এ কথা জানাজানি হলে জাহানারার বদনামি হবে , পরিবারের মধ্যে অশান্তি হবে।সে সময় করে সালেহাকে জানাবে।দাদির কথা শুনে আদিবর‌ও তেমনটাই মনে হলো।সে বাধ্য ছেলের মত দাদির কথা মেনে নিল।চেপে গেল জাহানারার সরল স্বীকারোক্তি।সেই বিকেলের এক খণ্ড স্মৃতি মুছে দিল নিজের মন থেকে।
এরপর থেকে জাহানারা কে আগের থেকে আরো বেশি এড়িয়ে চলতে লাগলো আদিব।তবে সমস্যা হলো আদিব যত বেশি জাহানারা কে এড়িয়ে চলতে চাইলো জাহানারা যেন তোতবেশি তার সামনে ঘোরাফেরা করতে লাগলো।সেদিনের পরে আদিবকে জাহানারা কিছু না বললেও নিজের চাতক পাখির নেয় অধীর দৃষ্টি দিয়ে অপ্রস্তুত করতে লাগলো যেখানে সেখানে।জাহানারার সেই অধীর দৃষ্টি গায়ে বাঁধতো আদিবের, বিরক্ত লাগতো তার।একটা মেয়ে কীভাবে এতোটা নির্লজ্জ হতে পারে সেটা ভেবে ভেবে রাগ হত জাহানারার উপর।তবে কোন এক অজ্ঞাত কারণে জাহানারা কে কিছু বলতে পারতো না সে। মাঝে মাঝে জাহানারা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি কারণে অগ্নি চোখের দৃষ্টি ফেলতো জাহানারা উপর।ব্যাস এতটুকুই। এর বেশি সে জাহানারা সাথে কঠোর হতে পারতো না। জাহানারার জন্য‌ সেজ চাচার বাড়ির রাস্তা ভুলতে হলো আদিবকে।সজীবের সাথে দেখা সাক্ষাৎ রাস্তা ঘাটেই সারতে হলো। আদিব নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল জাহানারা থেকে দূরে থাকার। কিন্তু আদিবের উপস্থিত কিংবা অন‌উপস্থিতি কোনোটাই তেমন প্রভাব ফেলল না জাহানারার অনুভবে। সে নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে ভালোবাসতে লাগলো আদিব কে। সময় গড়ালো।বছর পেরুলো।আদিবের প্রতি জাহানারার ভালোবাসার তীব্রতা বৃদ্ধি পেল।মরিয়া হয়ে উঠলো সে আদিব কে বোঝাতে, যে সে আদিবকে কতটা ভালোবাসে। আদিব সবটা দেখেও না দেখার ভ্যান করে গেল।আদিবের এই নির্লিপ্ততা জাহানারা কে যেন আরো উতলা করে তুলল।সে কোন কিছু না ভেবেই একদিন আবার আদিবের সামনে দাঁড়ালো।চোখ না তুলেই কম্পিত কণ্ঠে বলল,

-আদিব ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি আপনি…

-আদিব ,জাহান !

মেজ চাচির হঠাৎ আগমনে থামতে হলো জাহানারা কে। কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো সে। তড়িঘড়ি নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ডালিয়া এগিয়ে আসতেই আদিব তাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো।আদিবের সাথে কথা শেষ করে জাহানারার ঘাবড়ে যা‌ওয়া মুখের দিকে তাকালো ডালিয়া। জিজ্ঞেস করল,

-এই জাহান এভাবে ঘামছিস কেন ?কি হয়েছে?

জাহানারা চাচির কথায় আমতা আমতা করে বলল,

-নিতুর সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম তো তাই ঘামছি। আচ্ছা চাচি থাকেন আমি আসছি।

কথাটা বলেই দৌড়ালো জাহানারা। জাহানারার গমনরত পথের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ডালিয়া।তার চোখে মুখে সন্দেহীন ভাব।আদিবের চোখে এড়ালো না যেটা।তার মনে হলো এবার আর চুপ থাকলে চলবে না।সেজ চাচিকে ব্যাপারটা জানাতে হবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ পা বাড়ালো সে সেজ চাচার বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে ছোট খালাকে নামতে দেখে পথ বদলাতে হলো।ছোট খালাদের আগমনে জাহানারার কথা সরে গেল আদিবের মাথা থেকে। ব্যস্ত হলো সে তাদের নিয়ে।

দুই দিন পরে আবার জাহানারার সাথে দেখা হল আদিবের। আদিব তার খালাতো বোন সিনথিয়া কে নিয়ে তাদের বাড়ির পাশে দিঘির পাড়ে গিয়েছিল। সেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে জাহানারা আর নিতুকে দেখতে পেল।আদিব সিনথিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল তাদের। সিনথিয়ার সাথে জাহানারার পরিচয় করবার সময় জাহানারার মুখটা থমথমে দেখালো।আদিবের কেমন যেন লাগলো বিষয়টা। কিন্তু সেভাবে পাত্তা দিল না সে।সিনথিয়াকে নিয়ে দিঘির পাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটা হাঁটি করে র‌ওনা দিল বাড়ির পথে। যাওয়ার আগে নিতুকে বলল সে আর জাহানারা যেন তাদের সাথে আসে।কথাটা আদিব নিতুকে বললেও তার হয়ে জাহানারা উত্তর দিল। বলল তারা আরো কিছুক্ষণ থাকবে সেখানে।জাহানারার কটকটে গলাটা কেমন যেন শোনাল আদিবের কাছে। আপনা আপনি ভ্রূতে ভাজ পড়লো তার। জাহানারা কে উপেক্ষা করে সে নিতুর উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলল তারা যেন বেশি দেরি না করে। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে যায়।নিতু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেও জাহানারা চোখ মুখ কাঠ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদিবের দিকে।আদিব সেটা দেখেও না দেখার ভান করে সিনথিয়া কে নিয়ে চলে আসলো সেখান থেকে।
কিছুদূর আসার পর আদিবের মনে হলো তাদের পিছু নিয়েছে কেউ।সে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো।দেখলো নিতু আর জাহানারা আসছে।নিতু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাটলেও জাহানারার হাঁটার ধরন ভিন্ন। অস্বাভাবিক।আদিব লক্ষ্য করে দেখলো শুধু হাঁটার ধরন না জাহানারাকেও অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।টকটকে লাল চোখ,গনগনে দৃষ্টি,ফোলানো নাকের পাটা,আর ফ্যাকাশে মুখ। আদিব ভ্রূ কুঁচকালো।তবে থামলো না।ঘাড় ফিরিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে সিনথিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যেত লাগলো।

মা আর ছোট খালার জোরাজুরিতে আদিব লন্ডনের ******মেডিকেলে ভর্তির জন্য *****টেস্ট দিয়েছিল যার প্রথম ধাপে সে উত্তীর্ণ হয়েছে এখন দ্বিতীয় ধাপ পার করতে পারলে অ্যাডমিশন কনফার্ম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লন্ডনে পড়াশোনার যে খরচ সেটা হয়ত আশরাফ টানতে পারবে না।আদিবের এ কথা শুনে সিনথিয়া জানালো তার বড় খালা মানে তানিয়া না কি বলেছে আদিবের নানার কাছ থেকে হেল্প নিবে। সিনথিয়ার কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য থমকালো আদিব।তার মা বাবা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল একে অপরকে, যার কারণে নানা তাদের বিয়ে মেনে নেয় নি।আদিবের জন্মের পর নানার রাগ কমলেও বাবাকে এখনো তারা বক্র চোখেই দেখে।আদিব কিংবা তার বোনেরা‌ও তেমন যায় না নানা বাসায়।এ অবস্থায় ছেলের পড়াশোনার জন্য নানার কাছ থেকে সাহায্য কিছুতেই নেবে না তার বাবা। সিনথিয়ার মুখে মায়ের পরিকল্পনা শুনে বেশ চিন্তিত হলো আদিব।তার কেন যেন মনে হলো সামনে বেশ বড় সড় একটা ঝামেলা হতে চলেছে।আদিবকে অন্যমনস্ক দেখে তার বাহুতে হাত রাখলো সিনথিয়া।আদিবের ভাবনায় ছেদ পড়লো। সিনথিয়া জানতে চাইলো আদিব কি ভাবছে।আদিব নিজের মনের ভাব লুকিয়ে অন্যকথা তুলল। সিনথিয়ার সাথে কথার মাঝে আদিব লক্ষ্য করলো নিতু আর জাহানারা তাদের পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে‌।ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে সিনথিয়ার কথায় মনোযোগ দিল আদিব। সিনথিয়া তার স্কুলের কথা বলছে।তাদের পরীক্ষা ব্যবস্থার কথা বলছে।আদিব মন দিয়ে সেসব শুনছে আর অলস পায়ে হাঁটছে।তার অন্য কোনোদিকে খেয়াল নেই।সে লক্ষ্য‌ই করলো না জাহানারা কে তার দিকে আসতে।যখন লক্ষ্য করলো তখন জাহানারা আর তার মধ্যে এক হাতের দূরত্ব।ডুবন্ত সূর্যের আলসে রোদে জাহানারা ছায়া সিনথিয়ার উপর পড়তেই আদিব তাকালো সামনে। জাহানারার অশ্রু শিক্ত জ্বলজ্বলে চোখ দুটো দেখতেই অকারণে ধক করে উঠলো ভেতরটা। হঠাৎ কি হলো মেয়েটার এটা ভেবে উদ্বিগ্ন হলো আদিব।পুরু ঠোঁট নেড়ে জানতে চাইলো,

-কি হয়েছে জাহানারা?

আদিবের চিন্তিত কণ্ঠ স্বর। জাহানারা পলক ঝাপটালো সাথে সাথে ভাসা ভাসা চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।আদিব কে বাকরুদ্ধ করে হুট করে তাকে জড়িয়ে ধরলো জাহানারা।জাহানারার আকস্মিক কাণ্ডে চমকে উঠলো নিতু।ভড়কে গেল আদিব। সিনথিয়া একটু অবাক হলো। উপস্থিত তিন জনের মুখে খেলে গেল তিনরকম অভিব্যক্তি।জাহানারা আদিব কে জড়িয়ে ধরে কান্নারত কণ্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

-আদিব ভাই,আপনি আমার। শুধু আমার…

নিজের কথায় দাড়ি টানতে পারলো না জাহানারা।তার আগে আদিব নিজের থেকে জাহানারা কে ছাড়িয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল তার গালে।আদিবের কঠোর হাতের থাবায় ছিটকে পড়লো জাহানারা।নিতু তড়িঘড়ি ধরলো তাকে।আদিব আহত সিংহের নেয় ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।পায়ের কাছে পড়ে থাকা ইটের আদলায় সজোরে একটা লাথি মেরে গর্জে উঠে বলল,

-আর একটা ফালতু কথা বললে আমি তোমার জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলবো বেয়াদব!খুব বাড় বেড়েছো না তুমি!

আদিবের রাগান্বিত কণ্ঠ। জাহানারা কেঁপে উঠলো।তার সাথে নিতুও যেন একটু চমকালো।আদিবের এমন রাগ দেখে সিনথিয়া‌ও যেন একটু ভয় পেল।আদিবের সেই বিধ্বংসী রাগ দেখে নিতু কিংবা সিনথিয়ার সাহস হলো না একটাও শব্দ করতে।নিতু ভয়ে জাহানারার বাহু ধরে তাকে ওঠানোর চেষ্টা করতে লাগলো।তবে জাহানারা উঠলো না।সে বিবস হয়ে জেদ করে বসে র‌ইলো ধুলোর মাঝে।যেটা দেখে আদিবের আরো রাগ হলো।সে ধমকে উঠলো,

-এই মেয়ে ওঠো!ওঠো বলছি।

আদিবের ধমকে কাজ হলো, উঠে দাঁড়ালো জাহানারা।আদিবের উত্তপ্ত শ্বাসে ভারি হলো পরিবেশ।সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো আদিব। নিতুর উদ্দেশ্যে গমগমে গলায় বলে উঠলো,

-নিতু তুমি ওকে নিয়ে সোজা সেজ চাচার বাড়ি যাবে ।আমি আসছি।

নিতু তড়িঘড়ি ঘাড় নাড়ালো। সম্মতি জানালো। জাহানারা কে অনেকটা টানতে টানতে নিয়ে গেল সে।আদিব পিছু গেল তাদের। সিনথিয়া কে বাড়ির গেটে রেখে পা বাড়ালো সেজ চাচার বাড়ির উদ্দেশ্যে।

সেজ চাচার বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই জাহানারা কান্নার আ‌ওয়াজ আর সালেহার রাগান্বিত কণ্ঠস্বর পায়ের গতি ধীর করলো আদিবের।বুঝতে পারলো তার বলতে আসা কথা চাচি ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছে।আদিব আর ভেতরে ঢুকলো না ফিরে আসলো।বাড়ি ঢুকতেই বসার ঘরে তানিয়া ধরলো তাকে কড়া গলায় জানতে চাইলো,

-তোমার আর জাহানারার মধ্যে কি চলছে?

মায়ের কথায় আকাশ থেকে পড়লো আদিব। সিনথিয়ার দিকে তাকালো একবার। সিনথিয়া দুইদিকে মাথা নাড়ালো যার অর্থ সে কিছু বলেনি।আদিব চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানলো।নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

-কিছু চলছে না।

-কিছু যখন চলছে না তাহলে লিচু বাগানের রাস্তায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?

-আপা!

তানিয়ার লাগামহীন ভাষা।সোনিয়া বাধ সাধলো।আদিবের লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাইলো।চোখ তুলে তাকাতে পারলো না সে মায়ের দিকে। জাহানারা উপর তৈরি হওয়া কিছুক্ষণ পূর্বের রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো আবার।মন হলো মেয়েটাকে আরো দুটো চড় লাগাতে পারলে শান্তি হত।

-আদিব, দীপ্তি যেটা করছে সেটা আমি এখনো মানতে পারেনি।এখন তুমি যদি আবার এক‌ই কাজ করবে বলে ভেবে থাকো ,তাহলে আগে থাকতে বলে দা‌ও আমাকে। মানুষের কাছে লজ্জিত অপমানিত হ‌ওয়ার চেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ি।

আদিব বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মায়ের দিকে।সোনিয়া বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

-আপা কি বলছিস?মাথা ঠিক আছে তোর।

-না, মাথা ঠিক নেই আমার।ও জানে না ;ওর বড় বোনের কীর্তির জন্য আমাদের কতটা অপমানিত হতে হয়েছে! তারপর আবার কোন সাহসে ঐ মেয়ের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রং তামাশা করে! লজ্জা করে না ওর!

চোখে পানি, কণ্ঠে তেজ তানিয়ার।ঠিক সেই সময় বাড়িতে ঢুকলো আশরাফ। তানিয়ার চোখ মুখের দশা দেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো কি হয়েছে। আশরাফের কথা যেন তানিয়ার রাগের আগুনে ঘৃতাহুতি দিল।সে চেতে উঠে বলল,

-তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। তোমার ছেলে তোমার আশা পূরণ করার জন্য একধাপ এগিয়ে গেছে। এবার শান্তি হবে তোমার।যা‌ও ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করো। তোমার সেজ ভাইকে খবর দা‌ও দুই ভাই মিলে আনন্দ করো। উল্লাস করো।

আশরাফ তাজ্জব বনে গেল তানিয়ার কথায়। তানিয়ার কথাগুলো তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।সে তানিয়ার কথা উপেক্ষা করে আদিব কে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।মায়ের কথা শুনে আদিব স্থবিরের নেয় দাঁড়িয়ে ছিল।সে চেয়েও বাবার কথার উত্তর দিত পারলো না।আদিবের মৌনতা দেখে সোনিয়া এগিয়ে এলো, জানাল কিছুক্ষণ আগের কথা।পাশের বাড়ির আতিয়ার সাহেবের স্ত্রী আদিব আর জাহানারা কে লিচু তলার রাস্তায় একে অপরের সাথে অপ্রস্তুত ভাবে দেখেছ।যেটা তিনি বাড়ি বয়ে এসে জানিয়ে গেছেন।তাই নিয়ে তানিয়া চাটছে। সোনিয়ার কথা শেষ হতেই আশরাফ তাকালো আদিবের দিকে জানতে চাইলো তার উপর কৃত আরোপের সত্যতা।আদিব লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিল।বাবা কে জাহানারা করা কাজটা বলতে তার জিভ সংকোচ বোধ করলো।আদিব কে এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে সিনথিয়া মুখ খুললো। সবিস্তারে সবটা বলল সবাইকে। সিনথিয়ার কথা শুনে তানিয়া ক্ষান্ত হলো। আশরাফ জাহানারার পক্ষ নিয়ে বলে উঠলো,

-জাহান ছোট মানুষ, আবেগের বসে ভুল করে ফেলেছে।দেখি আমি ওর সাথে কথা বলবো।

-তোমার ঐ ছোট মানুষ ভাতিজির আজ বিয়ে দিলে কাল বাচ্চা কাচ্চা হয়ে যাবে।খবরদার ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে আসবে না। তোমার ভাইকে বল মেয়েকে সামলাতে, না হলে আমি বলতে গেলে ব্যাপারটা ভালো হবে না‌ বলে দিচ্ছি!

কথা শেষ করে পায়ে গটগট শব্দ তুলে নিজের ঘরে ঢুকলো তানিয়া।আদিব‌ও ধীর পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।সেদিনের পরে তানিয়া জেদ ধরলো ছেলেকে সোনিয়ার সাথে বিদেশ পাঠানোর।সে আর এসব ছোট লোকদের মধ্যে রাখবে না‌ তার ছেলেকে।যত টাকা লাগে লাগুক দরকার হলে সে নিজের বাপের বাড়ি থেকে প্রাপ্ত সম্পদ বিক্রি করে দেবে ,তবুও ছেলেকে লন্ডন পাঠাবে।তানিয়া বাবার সাথে দেখা করলো এই নিয়ে আলোচনা করতে। তোফায়েল সাহেব মেয়ের কথা শুনে বললেন তানিয়াকে কিছু করতে হবে না। সেই আদিবের লন্ডনে যা‌ওয়া থেকে শুরু করে পড়াশোনার যাবতীয় খরচ বহন করবে। তানিয়ার বাবা তোফায়েল সাহেব বিরাট শিল্পপতি তার কাছে লন্ডনে আদিবের পড়াশোনার খরচ বহন করা তেমন কোনো ব্যাপার না কিন্তু সমস্যা হলো তার বয়স বেড়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য ছেলেদের হাতে চলে গেছে।তার এই সিদ্ধান্ত শুনে ছেলের খুব একটা খুশি হলো না।আদিবের মামারা আশরাফ কে খুব একটা পছন্দ করে না।তানিয়ার ছেলের জন্য এই সাহায্যের আবদারে তাদের এতো দিনকার আক্রোশটা যেন আর চাপা থাকলো না। আশরাফের আর্থিক অবস্থা নিয়ে তাদের পরিবার নিয়ে অনেক তীক্ষ্ণ কথা বললেন তারা।আদিব মায়ের সাথে উপস্থিত ছিল সেখানে। বাবার সম্পর্কে শ্রুতি কটু বাক্য শুনে চোয়াল শক্ত হলো তার।মামাদের মুখের উপর বলে দিল তাদের কোন সাহায্য তার লাগবে না। কিন্তু তোফায়েল একমাত্র নাতির কথায় আপত্তি জানালো।আদিব কে তিনি ভীষণ ভালোবাসে, তার জন্য নিজের সবটাও দিয়ে দিতে পারে। সেখানে এ কটা টাকা তার কাছে কিচ্ছু না।সে ছেলেদের কঠিন গলায় বলল নিজেদের ভাষা নিয়ন্ত্রণে আনতে। তানিয়া‌ও ছেলেকে কোনোমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করলো।মা আর নানার কথায় দমলো আদিব।
মায়ের অশ্রু শিক্ত আকুতিতে বাবার অপমান গলদ্ধ করলো। চুপচাপ লন্ডন ******মেডিকেলের *****টেস্টের প্রস্তুতি নিতে লাগলো। IELTS এর রেজাল্ট‌ও হাতে আসলো তার মধ্যে।এখন শুধু লন্ডন *****মেডিকেলের অ্যাডমিশন টেস্টের ধাপ গুলো ক্লিয়ার করার অপেক্ষা। রাতদিন এক করে পড়ার টেবিলে পড়ে র‌ইলো সে।আদিবের সেই কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতা সফল হলো। লন্ডন****মেডিকেলের অ্যাডমিশন টেস্টের ধাপ গুলো একে একে পিছনে ঠেলে উপরে উঠলো আদিব। কনফার্ম হলো তার অ্যাডমিশন।ছোট খালারা ততদিনে লন্ডন ফিরে গেছে।তানিয়া ছেলেকে সোনিয়ার সাথে পাঠাতে চাইলেও ভিসা টিসার নানান ঝামেলায় সেটা হয়নি।নিজের ক্যারিয়ার গোছানোর তোড়জোড়ে জাহানারাকে ভুলে বসেছিল আদিব তাছাড়া তানিয়া নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে জাহানারা কেন;তার বিষয়ে কোন খবরাখবর খবর‌ও ছেলের কাছে না আসে। কিন্তু তবুও আদিবের কানে এলো খবরটা। জাহানারা কে দেখতে আসছে আগামী কাল। জায়েদের এক কলিগের ছেলে ।এখন আংটি পরিয়ে রাখবে। জাহানারার আঠারো হলেই বিয়ে। খাওয়ার টেবিলে দাদি বলল কথাটা।কথাটা শুনে আশরাফের মুখটা কেমন যেন মলিন হলো।আদিবের খারাপ লাগলো বাবার মলিন মুখটা দেখে।তবে বাবার জন্য খারাপ লাগলেও তার কিছু করার ছিল না, জাহানারা চাচাতো বোন হিসাবে সমাদরের হলেও , জীবনসঙ্গী হিসেবে মোটেও নয়। তাছাড়া যেখানে তার মা এই সম্পর্কে ঘোর বিরোধী সেখানে সে আগাবে কি করে।আদিব একবারের জন্য নিজের অনুভূতি পাশে রেখে বাবার কথা মানলেও মা কে অখুশি করে কীভাবে আগাতো!নিজের মনে কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আদিব।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবে মাত্র ডাইনিং পৌঁছেছিল আদিব ঠিক তখন উদ্ভ্রান্তের নেয় ছুটতে ছুটতে নিতু এলো তাদের বাড়ি। আশরাফ তখন ডাইনিং টেবিলে বসা। সকালের নাস্তা করছে।নিতু হাঁফাতে হাঁফাতে এসে আশরাফের উদ্দেশ্যে বলল,

-বড় চাচা! জান হাতের শি’রা কে’টেছে, আপনি একটু চলুন তাড়াতাড়ি।

নিতুর গলা কম্পমান। আশরাফ তার কথার অর্থ বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো।হাতে পানি ঢেলে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁত পিষে বলল,

-এবার খুশি তো!

নিজের চিকিৎসার ব্যাগ টা হাতে নিয়ে সে ছুটলো নিতুর পিছনে। আদিব হতবাক হলো।বাবার প্রস্থানরত পথের দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলো।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

সৌরকলঙ্ক পর্ব-৩+৪

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৩

সজীবকে দ্রুত পায়ে সামনে আগাতে দেখে পিছু ডাকলো আদিব।সজীব তার ডাকের উত্তরে সেভাবেই সামনে আগাতে আগাতে বলল,

-পরে কথা হবে আদি। আসছি।

সজীবের বিচলিত কণ্ঠ।আদিব বুঝলো সেজ চাচার বাড়ি কিছু হয়েছে। সজীবের পিছু নিতে পা বাড়ালো সামনে কিন্তু পরক্ষণে পুরোনো কিছু ঘটনা মনে পড়তেই বেড়িয়ে নেওয়া পা থেমে গেল শূন্যে।স্থির হলো পা জোড়া।চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ফেলল।পিছিয়ে এলো।পকেট থেকে টাকা বের করে গাড়ি চালক কে তার পাওনা মিটিয়ে নিজের মালপত্র নামালো গাড়ি থেকে।গাড়ির ডিকিতে নিজের মালপত্রের সাথে সজীবের ল্যাগেজটা চোখে পড়লো তার। সজীবের ল্যাগেজটা ডিকি থেকে নামিয়ে সেটা আপাতত নিজের কাছে রাখলো।গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে গাড়ি চালককে বিদায় করে মাত্র‌ই সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আদিব ঠিক তখন চোখ গেল রাস্তার অপরপাশে‌। ল্যাম্পপোস্টের উজ্জ্বল আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেল বাবার শুকনা শরীরটা।বাবাকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে দেখা দিল মৃদু হাসির রেখা। আশরাফ অবশ্য তখনো ছেলেকে খেয়াল করেনি।সে আতিয়ার সাহেবের সাথে কথায় ব্যস্ত।আদিবদের প্রতিবেশী আতিয়ার সাহেব।আদিব চেনে তাকে।তার বাবার পুরোনো বন্ধু তিনি।আশরাফ কে ভালো করে পরখ করে আদিবের মনে হলো বাবাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।দূর থেকে বাবার মুখটা যতটুকু দেখা গেল তাতে বাবার মুখের বিষণ্ন ভাবটা তার চোখ এড়ালো না।আদিবের মন আবার বলে উঠলো কিছু একটা হয়েছে।বাবার বিষণ্ন মুখ আর বাইরের পরিবেশ দেখে মনের ভেতর খুঁতখুঁত করে উঠলো। একবার মনে হলো কারো কি কিছু হয়েছে! কিন্তু ফের মনে হলো কারো কিছু হলে তো সে জানতো।ছোট আপা কম বেশি সবার কথাই তো তাকে বলে। ফ্লাইটে ওঠার আগেও তো তার সাথে কথা হয়েছে কৈ তাকে তো তেমন কিছু বলল না।না কি কারো বাড়ি কোনো অনুষ্ঠান বাঁধলো।এটা হতে পারে।ছোট আপা তাকে বলেও ছিল নিতুর বিয়ের বিষয়ে কথা হচ্ছে।তাহলে কি নিতুর বিয়ে! কিন্তু সজীব ওভাবে ছুটলো কেন?আর বাবাকেই বা অমন মন মরা দেখাচ্ছে কেন? এতটুকু সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ভেবে ফেলল আদিব।তার ভাবনা চিন্তার মাঝেই আশরাফ লক্ষ্য করলো তাকে।ছেলেকে দেখা মাত্র একপ্রকার ছুটে এলো আশরাফ।বাবাকে নিজের দিকে আসতে দেখে ভাবনায় ছেদ পড়লো আদিবের।বাবাকে সালাম জানালো সে। আশরাফ সালামের জবাব দিল।আদিবের আসতে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না সেটা জানতে চাইলো। তারপর আদিবের মুখে নির্নিমেষ দৃষ্টি রেখে বলল,

-অনেক বড় হয়ে গেছ আদিব!

বাবার কথায় মৃদু হাসলো আদিব।বলল,

-আর তুমি বুড়ো হয়ে গেছ।

কথাটা বলেই বাবাকে জড়িয়ে ধরলো আদিব। আশরাফ‌ও হাত বাড়ালো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাতের বাঁধন শক্ত করলো।এভাবে কতসময় অতিবাহিত হলো জানা নেই দুইজনের।জায়েদের বাড়ি চিৎকার চেঁচামেচির আ‌ওয়াজে ধ্যান ভাঙল তাদের।আদিব বাবাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।জায়েদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-বাড়ির সামনে এত মানুষজন কিছু হয়েছে বাবা?সেজ চাচাদের বাড়ি

-আজ সন্ধ্যায় তোমার সেজ চাচি ইন্তেকাল করেছেন।

আদিবের কথা মাঝ পথে কেটে বলল আশরাফ।
বাবার কথায় হতবাক হলো আদিব।বিস্ফোরিত চোখে তাকালো বাবার দিকে।নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না তার।সে আবার জিজ্ঞেস করলো,

-স্যরি !কি বললে?

-সালেহা মারা গেছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়েদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল আশরাফ।আদিবের মুখ দিয়ে যেন আর কোন কথা যোগাল না। হঠাৎ ভেতরটা কেমন জানি করে উঠলো তার।চোখের সামনে ভেসে উঠলো গোলগাল আকৃতির হাস্যোজ্জ্বল এক মুখ।যে মুখে সরলতা ব‌ই কিছুই নেই।নিজের অজান্তেই চোখের কোন ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। অন্ধকার রাতে আলো আধারী তে যেটা সন্তর্পণে মুছে নিল সে।কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

-হঠাৎ কি হলো?মানে কীভাবে…?

নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না আদিব।গলার স্বর আটকে আসলো। আশরাফ বুঝলো ছেলের অসম্পূর্ণ প্রশ্নটা।বলল,

-বেশ কয়েকদিন ধরেই শরীর ভালো ছিল না সালেহার।গত কালকে একটু বেশি খারাপ হয়েছিল।জায়েদ আমাকে খবর দিলে আমি গিয়ে দেখলাম সালেহার অবস্থা তেমন ভালো না। তৎক্ষণাৎ ******* এর একটা ইনজেকশন পুশ করলাম।জায়েদ কে বললাম এতে কাজ না হলে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে।কাল রাত এগারোটা পর্যন্ত ওদের ওখানেই ছিলাম আমি। সালেহার অবস্থার উন্নতি দেখে বাড়ি ফিরেছিলাম।আজকে বিকেল চেম্বারে যাওয়ার সময় জায়েদের সাথে দেখা হলো তখন সালেহার কথা জিজ্ঞেস করায় বলল,”সালেহা ভালো আছে।কোন সমস্যা নেই।নাতনির সাথে খেলছে।”এরপর মাগরিবের পরপর আকিব ফোন করে বলল,”বড় চাচা মা কেমন যেন করছে। নিশ্বাস নিতে পারছে না। হাঁস ফাঁস করছে।”আকিবের কথা শুনে আমি দ্রুত সালেহাকে নেবুলাইজার দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার ওখানে নিয়ে যেতে বললাম।

থামলো আশরাফ।একটু সময় নিল।একটা শ্বাস টেনে ফের বলল,

-আমার ওখানে যখন সালেহাকে নিয়ে পৌঁছাল ওরা তখন অলরেডি যা হ‌ওয়ার হয়ে গেছে………!দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাসকষ্ট হ‌ওয়ার ফলে হৃদপিণ্ডে চাপ পড়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে।নেবুলাইজার ব্যবহারের আগেই হয়ত অ্যাটাক হয়েছে।সালেহা হয়ত শেষ পর্যন্ত সহ্য করার চেষ্টা করেছে যখন আর পারিনি তখন ছটফটিয়ে উঠেছে।আমি ওকে এতবার বলেছিলাম তোমার কিছু হলে জায়েদ কে বলবা। নিজের মধ্যে সব চেপে রাখবে না। কিন্তু ও আমার কথা কানে নেই নি।এর আগেও একবার শ্বাস নালীতে সর্দি এঁটে মরেই যাচ্ছিল।সেইবার আমি কাছে পিঠে ছিলাম তাই কিছু করতে পেরেছিলাম ।কিন্তু এই বার…!

আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আশরাফ। সালেহার মৃত্যু টা কেন জানি সে মেনে নিতে পারছে না ।মনে হচ্ছে একটুর জন্য মানুষটাকে বাঁচাতে পারলো না সে।তার হাটুর বয়েসি মেয়েটা চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল।
এই তো সেদিন তার চোখের সামনে জন্মালো মেয়েটা ।তার মা জাহানারা গিয়েছিল দুই সেট কাপড় নিয়ে সালেহা কে দেখতে।আসতে দেরি হচ্ছিল বিধায় বাবা তাকে ফুপুর ওখানে পাঠালো মা কে আনতে।সে গিয়ে দেখে এইটুকু একটা কাপড়ের পুঁটলিতে একটা ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে শীতের রোদে উঠানে বসে আছে মা আর ফুপু।তাকে দেখে ফুপু হ‌ই হ‌ই করে উঠলো।অনেকদিন পর ফুপু বাড়ি গিয়েছে সে,ফুপু তার খ্যাতির যত্নে কি করতে কি করে ভেবে পায় না। ছোট্ট দুধের সালেহাকে রেখে তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ফুপু। খাওয়া দাওয়া শেষ তারা সবাই বারান্দায় বসেছিল তখন
মা সালেহাকে জোর করে তার কোলে দিয়েছিল।আশরাফ মায়ের জোরাজুরিতে কোন রকমে সালেহাকে কোলে নিল।কোলের মধ্যে থাকা ছোট্ট শরীরটা আশরাফ অবাক চোখে দেখছিল। পুতুলের মতো মেয়েটাও বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল তার দিকে এরপর কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো । আশরাফ তড়িঘড়ি মায়ের কোলে দিয়ে হাফ ছেঁড়ে বাঁচলো।তার সেই তড়িঘড়ি দেখে মা আর ফুপুর সে কি হাসি।

আজও চোখের সামনে সবটা ভাসে আশরাফের।মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। সেদিনের সেই ছোট্ট সালেহা না কি মা’রা গেছে!তার চোখের সামনে বেড়ে ওঠা মেয়েটা না কি আজ তাদের সাথে নেই!এ কঠিন সত্যিটা ভাবতেও যে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে কথা গুলো ভাবছিল আশরাফ।ছেলের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো।চোখের চশমাটা খুলে ফতুয়ার প্রান্ত ভাগের কাপড়ে মুছে আবার চোখে দিয়ে বলল,

-আমি জায়েদের ওখানে যাচ্ছি দেখি কি অবস্থা ওদিকের।তুমি যাবে?

-জ্বি।

তড়িৎ জবাব দিল আদিব। আশরাফ বাড়ির দারোয়ান কে ডেকে আদিবের জিনিসপত্রগুলো ভেতরে নিয়ে যেতে বলল। তারপর বাপ ছেলে এগিয়ে গেল জায়েদের বাড়ির দিকে। সালেহার মৃত্যুর সংবাদ শুনে এরমধ্যে অনেক আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী জমা হয়েছে জায়েদের বাড়ির উঠানে।আকিবের কাজের সূত্রে পরিচিত,
তার সাথে কর্মরত সিনিয়র জুনিয়র অনেকেই ছুটে এসেছে। আশরাফের বাড়ি থেকে জায়েদের বাড়ি যাওয়ার এই স্বল্প দূরত্বের রাস্তায় অনেক পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলো আদিবের ।তবে কারো সাথে সেভাবে কথা হয়ে উঠলো না। চোখাচোখি আর সালাম বিনিময় পর্যন্ত‌ই সীমাবদ্ধ থাকলো।

জায়েদের বাড়ির সামনে মাত্রই এসে দাঁড়িয়েছিল আদিব, ঠিক তখন পিছন থেকে ভেসে আসলো গাড়ির হর্নের শব্দ।পিছন ফিরে দেখলো পরপর তিনটা গাড়ি রাস্তার ধার ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে থামলো।ভ্রূ তে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে গাড়ির বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়েই ছিল সে হঠাৎ গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে আসা মানুষটাকে দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।অবাক চোখে তাকালো সে অশ্রু শিক্ত গোলগাল সুন্দর মুখের মেয়েটার দিকে। পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলো দুইজনের মধ্যকার দূরত্ব কমতে।

আদিবের নির্নিমেষ দৃষ্টি কিন্তু অপরপাশের ব্যক্তিটি তার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।সে গাড়ি থেকে নেমেই উন্মাদিনীর নেয় ছুট তে লাগলো।কয়েক পা আসতেই রাস্তায় থাকা এবড়োখেবড়ো আদলা ইটে আঘাত লাগলো পায়ে। ভারসাম্য হারলো সে। আদিব সামনেই ছিল তার ।মুখ থুবড়ে পড়লো সে আদিবের বুকে।আদিব সযত্নে আগলে নিল সাথে সাথে।সাবধানি কণ্ঠে আ‌ওড়ালো,

-কেয়ারফুল!

আদিবের বলা সতর্ক বাণী টা মেয়েটার কানে গেল বলে মনে হলো না।সে পায়ের নিচে শক্ত মাটি ফিরে পেতেই আবার ছুটলো।শোকে তাপে বিভোর মেয়েটা এটাও লক্ষ্য করলো না যে আদিবের ঘড়িতে বেঁধে তার এক গাছি কাঁচা চুল পটপট শব্দ তুলে ছিঁড়ে গেল।যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিল ঠিক সেভাবেই প্রস্থান করলো।
আদিব তার প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়েই ছিল তখন আশরাফের বলা কথা কানে গেল।

-আকিব তো কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়েছে কিন্তু মেয়েটা যে কি করবে!

-আদিব !তুই এখানে! তোমার আক্কেল তো ভালো!ছেলেটা এতোটা পথ জার্নি করে বাড়ি ফিরল। তুমি তাকে রেস্ট করতে না দিয়ে এখানে নিয়ে এলে!

জায়েদের বাড়ির ভেতর থেকে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলল তানিয়া।কণ্ঠে তার উদ্বিগ্নতা। সেটা ছেলে ক্লান্ত শরীরে এখানে আসার জন্য না অন্য কারণে সেটা বোঝা গেল না।তবে আশরাফ কিছু আন্দাজ করলো।সে গভীর চোখে তাকালো সহধর্মিণীর দিকে। আশরাফের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো তানিয়া।বাবা মায়ের এই শীতল সমীকরণ চোখ এড়ালো না আদিবের।সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,

-আমি ঠিক আছি মা।

-সত্যি তো?

-হুম।

-তাহলে চোখ মুখ অমন শুকনা শুকনা লাগছে কেন?খারাপ লাগলে না হয় বাড়ি যা ।রেস্ট নে।সালেহাকে নিয়ে যাওয়ার আগে না হয় দেখে যাস।

-আমি সত্যি ঠিক আছি মা।তুমি অযথা চিন্তা করো না।

ছেলের কথায় আশ্বস্ত হলো তানিয়া।ছেলের কোন অসুবিধা হলে যেন তাকে জানায় এ কথা কয়েকবার মনে করিয়ে দিয়ে ফিরে গেল ভেতরে।তানিয়া চলে যেতেই শাহেদ উপস্থিত হলো সেখানে।আদিব কে দেখে কিছুটা অবাক হলো সে।চোখ মুখ দেখেই বোঝা গেল এখানে এই মুহূর্তে আদিব কে আশা করেনি সে।আদিব ছোট চাচাকে সালাম দিল।শাহেদ তার সালামের উত্তর দিয়ে বলল,

-এমন এক পরিস্থিতিতে এলি যে ভালো-মন্দ টুকুও মন খুলে জিজ্ঞেস করতে পারছি না।তা কখন এলি?

-এই তো কিছুক্ষণ আগে।

-সেজ ভাইয়ের সাথে দেখা করেছিস?

-না। মাত্রই এলাম এখনো দেখা করিনি।

-ও।

আদিবের সাথে কথা শেষ করে শাহেদ আশরাফের উদ্দেশ্যে বলল,

-মিয়া ভাই ভাবিকে নিয়ে এখন‌ই বের হবো?জাহানের জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করা হচ্ছিল।ও যখন চলে এসেছে তখন বের হওয়া যাক কি বলো?রাত‌ও তো বাড়ছে আর দেরি করা কি ঠিক হবে!

-মেয়েটা মাত্র‌ই এলো।একটু মা’র পাশে বসুক। অনন্ত কিছু সময় দা‌ও তাকে।রাত এখনো অনেক বাকি।এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। মানুষটাকে সেই তো একবারে রেখে আসতে হবে, একটু দেরি করেই না হয় যা‌ওয়া যাক।

আশরাফের কথায় সম্মতি জানিয়ে শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল শাহেদ। তারপর আদিবকে সাথে আসতে বলে সামনে পা বাড়ালো সে।ভেতরে যেতে যেতে আদিবের সাথে কিছু টুকটাক কথা হলো তার।বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই ডান পাশে কামিনী গাছ তলায় দেখা মিলল জায়েদের।আদিব এগিয়ে গেল সেজ চাচার দিকে।জায়েদ ক্লিষ্ট চোখে তার দিকে চেয়ে কোন রকমে জিজ্ঞেস করলো,

-কখন এলে?

– কিছুক্ষণ আগে।

এরপর আর কোন কথা যোগাল না কারো মুখে।আদিব সেজ চাচার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। জায়েদের কাছে অনেকে আসলো,অনেকে বসলো।কেউ দ্বীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত সান্ত্বনা দিল তো কেউ এতো তাড়াতাড়ি সালেহার মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করলো।কেউ বা আবার জাহানারার জন্য জায়েদ কে শক্ত হতে বলল।জায়েদ তাদের কথার উত্তরে, প্রতি উত্তরে শুধু হাঁ,হু করে গেল। কিছুক্ষণ পর শাহেদ এসে জানালো সালেহাকে নিয়ে বের হবে তারা।জানাজার নামাজ ইশার নামাজের পরেই সম্পন্ন হয়েছে সালেহার। এতক্ষণ শুধু জাহানারার জন্য অপেক্ষায় ছিল। জাহানারা যেন মাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারে সেই জন্য এতো দেরি।এখন উঠতে হবে। শাহেদের কথা শুনে টালমাটাল পায়ে উঠে দাঁড়ালো জায়েদ।পা দুটো কেমন জানি ভারি ঠেকলো জায়েদের কাছে তবুও এগিয়ে গেল সামনে ।খাটিয়ার কাছাকাছি যেতেই দেখলো জাহানারা আকিব কে ধরে আকুলি বিকুলি করে কাঁদছে।বুকের ভেতরট হুঁ হুঁ করে উঠলো জায়েদের।সে আর আকিব তবুও নিজেকে সামলে নেবে কিন্তু মেয়েটা কীভাবে নিজেকে সামলাবে এটা ভেবেই দৃষ্টি ঝাপসা হলো তার। জাহানারার আর্তনাদে ভারি হলো পরিবেশ।আকিব অনেক কষ্টে সামলালো বোন কে। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে নিস্তেজ হলো জাহানারার শরীর। জ্ঞান হারালো সে।বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে মাথায় পানি দেওয়া হলো তার। জাহানারা কে সে অবস্থায় রেখেই এগিয়ে গেল শবযাত্রা।

_____________
সালেহার শেষ কাজ সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বাজলো আদিবের।আদিব কবরস্থান থেকে সোজা বাড়ি ফিরলো।সেজ চাচার ওখানে আর গেল না।মা কে যতোই বলুক সে ঠিক আছে কিন্তু সত্যি কথা বলতে ভীষণ ক্লান্ত সে।শরীর আর কুলাচ্ছে না। বিশ্রাম চাইছে।বাড়ি ফিরে কলিং বেল চাপতেই তাদের বাড়ির পুরোনো গৃহকর্মী রাবেয়া দরজা খুলে দিল। আদিব কে দেখে একগাল হাসলো সে।আদিব ম্লান হেঁসে সালাম দিল।

-কেমন আছেন খালা?

-এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ফ্রেশ হয়ে নেও আব্বা, আমি খাবর দিচ্ছি।

-এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না খালা।আমি একটু ঘুমাবো।ঘুম থেকে উঠে খাবো। আপনি টেবিলে খাবার রেখে দিয়েন আমি গরম করে খেয়ে নিবো।

-সে কি আব্বা!একেবারে খালি পেটে ঘুমাবা!শরীর খারাপ করবে তো।এক গ্লাস গরম দুধ দিই সেটা অনন্ত খেয়ে শুইও।

রাবেয়ার কথায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো আদিব।তারপর ক্লান্ত শরীর টা নিয়ে এগিয়ে গেল নিজের ঘরের দিকে।ঘরে এসে দেখলো তার লাগেজগুলো আলমারির পাশে রাখা। সেখান থেকে একটা লাগেজ নিয়ে জামাকাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে।ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো রাবেয়া খালা বিছানার পাশের সাইড টেবিলে দুধের গ্লাস ঢেকে রেখে গেছেন।আদিব গ্লাসটা নিয়ে দুধটুকু খেয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকালো। ক্লান্ত শরীরে চোখ বুজতেই ঘুম নেমে এলো চোখে।

আদিবের ঘুম ভাঙলো পরের দিন দুপুর বারোটায়।ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই দেখলো তৃপ্তি আর তার মা বসে কথা বলছে।কথা শুনে বুঝলো সেজ চাচিকে নিয়ে কথা হচ্ছে।আদিব কে দেখেই তৃপ্তি বলে উঠলো,

-ঘুম ভেঙ্গেছে তাহলে।আমি তো ভেবেছিলাম তোর সাথে হয়ত দেখা না করেই চলে যেতে হবে।

-কখন এলে?

সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো আদিব।তানিয়া ছেলের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতে উঠে গেল সেখান থেকে।

– কাল রাতেই এসেছি।

আদিবের প্রশ্নের উত্তরে বলল তৃপ্তি।

-কাল রাতে! কিন্তু আমি তো তোমাকে দেখালাম না।

-সেজ চাচার ওখানে ছিলাম।

-আমি‌ও তো ছিলাম সেখানে কৈ তোমাকে তো চোখে পড়লো না।

-আমাকে সত্যি দেখিসনি?

চোখ সরু করলো তৃপ্তি। সন্দেহীন কণ্ঠ।আদিব একটু ভাবুক হলো।মনে করার চেষ্টা করলো কাল তৃপ্তি কে ও বাড়িতে দেখেছে কি না। কিন্তু তেমন কিছু মনে পড়লো না। তৃপ্তি আদিবের ভাবুক মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো।বলল,

-থাক কষ্ট করে মনে করতে হবে না।আমি হেল্প করছি। জাহানারার ঠিক পাশেই ছিলাম আমি।তুই খেয়াল করিস নি।অবশ্য আমাকে খেয়াল না করার‌ই কথা!দৃষ্টি অন্য কাউতে আটকালে আর কাউকে কি চোখে পড়ে!

তৃপ্তির কথায় শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব।সোফায় হেলান দিয়ে ঘাড় এলিয়ে দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বলল,

– পিঞ্চ করার পদ্ধতিটা ঠিক ছিল কিন্তু বিষয়টা ভুল ছিল।

-বিষয়টা একদম সঠিক ছিল ।মা-ও খেয়াল করছে তোমার ঐ ড্যাবড্যাবে দৃষ্টি।আমাকে বলা‌ও হয়ে গেছে তার।

-মোটেও আমি ড্যাবড্যাব করে তাকায় নি।

তড়াক করে সোজা হয়ে বসলো আদিব।তেতে উঠে বলল উক্ত কথাটা।ভাইয়ের কথা শুনে ফিচলে হাসলো তৃপ্তি।আয়েশ করে সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে বলল,

-দেশ বিদেশ ঘুরে এলি কিন্তু পুরোনো অভ্যাস বদলাতে পারলি না!তোর এই গলার স্বর উঁচু করে মনের ভাব লুকানোর ট্রিক্স অন্য কাউকে দেখাস, আমাকে না।

তৃপ্তির কথায় বিরক্ত হলো আদিব।মুখ দিয়ে বিরক্ত সূচক শব্দ বের করে বলল,

-ফালতু কথা বলো না।শুনতে ভালো লাগছে না।তুমি যেটা বলতে চাইছো আমি বেশ বুঝছি।তোমার অবগতির জন্য জানিয়ে দিই তুমি ভুল ভাবছো।অনেকদিন পর দেখলাম মেয়েটাকে তাই একটু তাকিয়েছিলাম।ব্যাস, দ্যাট সিট।এটা নিয়ে এতো টন্ট মারার দরকার নেই!

-টন্ট মারছি না, সত্যি কথা বলছি।তুই হ্যাঁ করে তাকিয়ে ছিলি মেয়েটার দিকে।

-আহ…! আপা লুক আট ইয়োর ল্যাংগুয়েজে।কি বিশ্রী শোনাচ্ছে।ডোন্ট ফরগেট তুমি যার বিষয়ে কথা বলছো সে বোন হয় আমার।

-চাচাতো বোন।

আদিবের কথা শেষ না হতেই বলল তৃপ্তি।

-ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।তোমার সাতে তর্ক করায় বৃথা!

-তোদের আবার কি নিয়ে তর্ক শুরু হলো?

তৃপ্তি আর আদিবের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে জানতে চাইলো তানিয়া। তৃপ্তি আদিব কে কিছু বলতেই যাচ্ছিল তানিয়াকে দেখে থেমে গেল।কথা ঘোরালো।তানিয়া স্পষ্ট বুঝতে পারলো মেয়ে কিছু লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে কিন্তু কিছু বলল না।আদিব কে তাড়া দিল ডাইনিংয়ে যেতে।আদিব সোফা ছেড়ে উঠতে
উঠতে সাবধানি দৃষ্টিতে বোনের দিকে একবার তাকালো।যার অর্থ উলটো পালটা ভাবা বাদ দাও। তৃপ্তি বুঝতে পারলো ভাইয়ের দৃষ্টির অর্থ।সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৪

তৃপ্তির মুখের হাসিটা দীর্ঘ স্থায়ী হলো না যখন মনে পড়লো জাহানারার বর্তমান অবস্থান। তৃপ্তির সাথে সাথে মনে হলো তার মা হয়ত জীবনের সব থেকে বড় ভুল করেছিল জাহানারা কে ছেলের অযোগ্য ঘোষিত করে।কথাটা মনে হতেই আপনা আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। দূরে ডাইনিংয়ে দাঁড়ানো তানিয়ার দিকে তাকালো সে।তানিয়া সযত্নে ছেলের খাবার পরিবেশন করছে।চোখে মুখে তার উচ্ছ্বাস। অনেকদিন পর ছেলেকে নিজ হাতে খেতে দিতে পেরে সন্তুষ্ট সে। তৃপ্তি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।এগিয়ে গল ডাইনিংয়ের দিকে।তানিয়া তখন আদিবের শরীর স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়ে আহাজারি করছে।আদিব মায়ের আহাজারি কান নিচ্ছে বলে মনে হলো না।তাকে নিজের খাবার প্লেটে মনোযোগী দেখালো। তৃপ্তি ডাইনিংয়ের চেয়ারে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো।মায়ের কথা শুনে টিপ্পনী কেটে বলল,

-মা তুমি তোমার ছেলের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে অযথা কান্না কাটি করছো!ছেলেকে একবার ভালো করে দেখো!লিকলিকে একটা বাছুর পাঠিয়েছিলে তুমি লন্ডনে যেটা মোটা তাজা ষাঁড় হয়ে ফিরে এসেছে! তারপরও তুমি যদি ছেলের স্বাস্থ্য শরীর কমে গেছে,শুকিয়ে গেছে এই ধরনের কথা বলো তাহলে মানায়!এমন কথা শুনলে লোকে হাসবে। বলবে তুমি ছেলে নিয়ে ন্যাকামি করছো!

তৃপ্তির কথা শুনে খাবার প্লেটে হাত থেমে গেল আদিবের। তানিয়া চোখ গরম করে মেয়ের দিকে তাকালো। আদিব ঘাড় উঁচিয়ে তৃপ্তির দিকে তাকালো ভ্রূ তে গিঁট দিয়ে বলল,

– আমাকে নিয়ে বডি শেমিং না করেও মাকে বোঝানো যেত কথাটা!

-বডি শেমিং করলাম কোথায়!আমি তো শুধু মা কে বোঝাতে চাইলাম তোর শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে মায়ের অত আক্ষেপ করার দরকার নেই।তুই আগের থেকে এখন আরো বেশি হিষ্ট পুষ্ট হয়েছিস।

তড়িঘড়ি বলল তৃপ্তি।আদিব চোখ সরু করলো। তৃপ্তি দাঁত বের করে হেসে বলল,

-ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন।আমার বলা কথায় গুরুত্ব না দিয়ে,তার পিছনের অর্থ কে গুরুত্ব দে।

থামলো তৃপ্তি।আদিব আর কিছু বলল না। খাবার প্লেটে মন দিল। তৃপ্তি তা দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।আদিবের যে হুট হাট রেগে যা‌ওয়ার ধ্যাত! তার কথায় যে আদিব এতক্ষণে রেগে বো’মা হয়নি তার জন্য স্বস্তি পেল।আদিব খাবার প্লেটে হাত চালাতে চালাতে তানিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

-মা সেজ চাচাদের কি অবস্থা?জানো কিছু?

-আছে কোনোরকম। মৃত্যু শোক কাটিয়ে ওঠা কি অত সহজ।একটু সময় তো লাগবে স্বাভাবিক হতে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কথার দাড়ি টানলো তানিয়া। সালেহার প্রতি তার মনে একটা সূক্ষ্ম রাগ থাকলেও সালেহার এত তাড়াতাড়ি চলে যা‌ওয়াটা সে মেনে নিতে পারছে না।মুখে প্রকাশ না করলেও খারাপ লাগছে তার।

-আকিব আর সেজ চাচা শক্ত মনের ওরা ঠিক নিজেদের সামলে নেবে। কিন্তু জাহান টা যে কি করবে!আজ সকালেও জ্ঞান ফেরার পর চিৎকার চেঁচামেচি করছিল।কোনোভাবে সামলানো যাচ্ছিল না।শেষ মেষ ভুলিয়ে ভালিয়ে সজীব ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।

-এখন এত দাপাদাপি করে কী লাভ !মা বেঁচে থাকতে তো মা’র খোঁজ‌ই নেয়নি।ধিঙ্গি পানা করে বেড়িয়েছে।এখন একেবারে কেঁদে কেটে পুকুর করছে!

তৃপ্তির কথা মুখ থেকে ফুরাতে না ফুরাতেই কটাক্ষের সুরে বলে উঠলো তানিয়া।মায়ের কথায় তাজ্জব বনে গেল তৃপ্তি।সে মানছে তার মা জাহানারা কে পছন্দ করে না কিন্তু তাই বলে এমন সময়ে মেয়েটার সম্পর্কে এমন কথা সে আশা করেনি মায়ের কাছ থেকে। তৃপ্তির সহ্য হলো না মায়ের কথাটা।সে তড়াক করে বলল,

-যা জানো না সে বিষয়ে কথা বলো না মা। জাহানারা যথেষ্ট করেছে চাচির জন্য।মানছি চাচির কাছে পিঠে থাকতে পারেনি, কিন্তু সেখানে তার কোন দোষ নেই।দোষ তোমাদের।তোমাদের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো যে……!

-তোমাদের বলতে কি বোঝাতে চাইছো আপু?

তৃপ্তির অসমাপ্ত কথার মাঝে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো আদিব। তৃপ্তি কোন রাখ ঢাক না রেখেই তার প্রশ্নে জবাবে বলল,

-আদিব শোন যেচে পড়ে কথা গাঁয়ে মাখিস না।আমি মা আর সেজ চাচার কথা বলছি।তবে তুই যদি নিজের ঘাড়েও দোষ নিতে চাস নিতে পারিস।তুই মানিস আর না মানিস কিছু দোষ তোর‌ও ছিল।

তৃপ্তির কথা শুনে চোয়াল শক্ত হলো আদিবের। খাওয়া এখনো শেষ হয়নি আদিবের।প্লেটে অবশিষ্ট কিছু খাবার তখনো বিদ্যমান যেটা রেখে‌ই উঠে দাঁড়ালো সে।প্লেটে পানি ঢেলে হনহন করে বেরিয়ে গেল ডাইনিং ছেড়ে।তানিয়া বারবার পিছু ডাকলো কিন্তু আদিব থামলো না।আদিব চলে যেতেই তৃপ্তির উপর চটে উঠলো তানিয়া,

-ছেলেটার খাওয়ার সময় এসব কথা না তুললে হতো না!

-যা সত্যি তাই বলেছি এতে তোমার ছেলের রাগ হলে আমি কি করবো। কথায় আছে,” যার মনে দোষ ,তার কথায় রোষ!”তোমার ছেলের অবস্থা হয়েছে তেমন।মা শোনো তোমাকে আমি এর আগেও বলেছি আবার‌ও বলছি কথা বলার আগে ভেবে চিন্তে বলবে।

রসকষহীন কথা তৃপ্তির।তানিয়া অগ্নি দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,

-তোমার জ্ঞান দেওয়া হয়ে গেলে যা‌ও এখান থেকে।

তানিয়ার কণ্ঠ শীতল হলেও তার চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। তৃপ্তি এই মুহূর্তে আর কথা বাড়াতে চাইলো না।নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করলো।

_______________
ঘরে এসে রাগে ফুঁসতে লাগলো আদিব।রাগে ভেতরটা গনগন করে উঠলো। তৃপ্তির বলা কথাগুলো তীক্ষ্ণ ফলার মতো খোঁচাতে লাগলো তাকে। হাঁস ফাঁস করে উঠলো ভেতরটা।
নিজের ভেতরকার অস্থিরতা কমাতে ঘরের জানালা গুলো খুলে দিল সে।দক্ষিণের জানালাটা খুলতেই চোখে পড়লো দুই তলা বিশিষ্ট বিশাল বাংলো বাড়ি।জানালা দিয়ে যার উঠানসহ বাগান টা স্পষ্ট দৃশ্য মান। দৃষ্টি স্থির হলো আদিবের।

তৃপ্তির কাছ থেকে শুনেছিল আদিব, জাহানারার নামে লিখে দেওয়া দাদির জমিতে বিরাট বাড়ি তুলেছে জাহানারা। তবে এতোটা বিরাট আশা করেনি।নিজের স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলো জাহানারা বেশ মোটা অঙ্ক ঢেলেছে বাড়ির পিছনে।জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায় ততদূর আদিব নিজের দৃষ্টি ঘোরালে। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো বাড়ির শৈল্পিক কারুকার্য।বাড়ি নিখুঁত প্রকৌশল দেখতে দেখতে আদিবের চোখ আটকালো বাড়ির উত্তর পাশে প্রাচীর ঘেঁষে বেড়ে ওঠা লিচু গাছটার দিকে।কিয়ৎক্ষণের জন্য থমকালো আদিব।এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো গাছটার দিকে। মৃদু বাতাসে গাছের ছোট ছোট পাতাগুলোর নড়ন চড়ন যেন আদিবের মানসপটে পুরোনো স্মৃতির আলোড়ন তুলল। স্মৃতির পাতা উল্টে হুড়মুড় করে চোখের সামনে লুটিয়ে পড়লো স্পষ্ট স্মৃতি গুলো।

তখন ক্লাস এইটে পড়ে আদিব।সেজ চাচার কাছে অঙ্ক আর বিজ্ঞানের প্রাইভেট টিউশনের জন্য চাচাদের বাড়ি রোজ আসা যাওয়া তার।
রোজকার নেয় সেদিন‌ও সেজ চাচার কাছে পড়া শেষ করে বের হচ্ছিল আদিব ঠিক তখন সেজ চাচির টিনের রান্নাঘরের টিন ঘেঁষে ছোট্ট একটা লিচুর চারা চোখে পড়লো।যেটা ঝিল কাকরের মধ্যে অযত্নে বেড়ে উঠছে।চাচির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গাছটা সাবধানে সেখান থেকে তুলছিল আদিব সে সময় কোথা থেকে তীরের বেগে ছুটে এলো জাহানারা।কোমরে হাত দিয়ে চোখ মুখ গুটিয়ে বলল,

-আদিব ভাই ওটা আমার গাছ।আপনি কেন তুলছেন?

আদিব জাহানারা কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সযত্নে গাছটা ঝিলকাকড়‌ওয়ালা মাটি থেকে আলাদা করতে করতে ভাবলেশহীনভাবে বলল,

-এটা তোমার গাছ! কিন্তু কোথাও তো তোমার নাম লেখা নেই!

-আমি লিচু খেয়ে লিচুর আঁটি ফেলেছিলাম ওখানে সেটা থেকেই গাছ হয়েছে। বুঝেছেন!

-না বুঝলাম না।এ বাড়িতে লিচু তুমি একা খাও! যে শুধু তোমার ফেলা লিচুর বীচে এই গাছ হয়েছে।হতেও তো পারে এটা অন্য কারো ফেলা বীচে জন্মেছে!

-না এটা আমার ফেলা লিচুর বীচে হয়েছে।আমি জানি।আমি এই এই খানে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে ফুঁ করে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম ওখানে।মনে আছে আমার। আপনি রাখেন ওটা।রাখেন বলছি।

চেঁচিয়ে উঠলো জাহানারা।সেজ চাচি তার আওয়াজ শুনে রান্নাঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।জানতে চাইলো কি হয়েছে।মা কে দেখে আহ্লাদে গদগদ হয়ে আদিবকে বলা কথাটা মা কে শোনাল জাহানারা। জাহানারার কথা শুনে সালেহা চোখ পাকিয়ে বলল,

-তোর গাছ হ্যাঁ!তা এতো দিন কোথায় ছিলি?এতো দিন তো ফিরেও তাকাস নি গাছটার দিকে ।এখন যেই আদিব নিতে গেল অমনি দরদ উতলে উঠলো!পাঁজি মেয়ে।এক চড়ে তোমার হিংসা ছুটিয়ে দেব আমি!

মায়ের শাসানির সামনে আর কিছু বলতে সাহস পেল না জাহানারা।তবে রাগে ক্ষোভে গজগজ করতে আদিবের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আদিব তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে গাছাটা হাতে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যা‌ওয়ায় গাছটা তাদের বাগানে এক পাশে রেখে পরের দিন কোথায় লাগাবে সেটা ঠিক করে ঘরে ঢুকলো আদিব। পরেরদিন সকালে যখন গাছটা লাগতে যাবে তখন দাদি এসে বলল,তাদের বাগানে পাশের বাড়ির আতিয়ার সাহেবের বাগানের মেহগনি গাছের ছায়া পড়ে সুতরাং সেখানে গাছটা ভালো ভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না।আদিব ভেবে দেখলো দাদির কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু গাছটা কোথায় লাগাবে সেটা ভেবে আদিব ভাবুক হলো। জাহানারা বেগম আদিব কে নিজ মনে কিছু ভাবতে দেখে জানতে চাইলো আদিব কি ভাবছে।দাদির কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো আদিবের।সে দাদিকে তার ভাবনার কথা বলতেই দাদি বলল আদিবদের বাড়ির পিছনে যে খালি জায়গা আছে সেখানে গাছটি লাগাতে।খোলা জায়গা, আলো বাতাসের কমতি নেই। গাছটির জন্য একদম উপযুক্ত স্থান।দাদির কথায় সম্মতি জানালো আদিব।দাদির সাথে সেখানে গিয়ে দাদির দেখানো জায়গায় মাটির নিচে আবদ্ধ করলো ছোট্ট চারা গাছটার নরম শেকড়।গাছ লাগিয়ে পানি দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই জাহানারা কোথা থেকে উদয় হয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলো। বলল,

-আদিব ভাই গাছটা কিন্তু আমার‌ও হলো না, আপনার‌ও হলো না।

জাহানারার কথার তাৎপর্য বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো আদিবের।ওর কথার অর্থ উদ্ধার করতে পের সদ্য লাগানো গাছটার দিকে তাকালো আদিব।গাছটা এখন আর এই জায়গা থেকে তোলা ঠিক হবে না এটা বুঝতে পেরে রাগে ফুঁসে উঠলো।দাদির উদ্দেশ্যে বলল,

-দাদি তুমি এই মেয়ের জন্য আমাকে মিথ্যা বললে!

– না দাদু।তুমি কি পাগল হলে?আমি তোমাকে মিথ্যা বলবো!তুমিই বলো তোমাদের বাগানে আতিয়ারের মেহগনি গাছের ছায়া পড়ে না? তুমিই বলো ওখানে গাছটা ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারতো?আমি গাছটা যেন ভালোভাবে বেড়ে ওঠে সেইজন্য এখানে লাগাতে বললাম।

আদিবকে রাগে ফুঁসতে দেখে তড়িঘড়ি বলল জাহানারা বেগম। তারপর একটু থেমে জাহানারার দিকে চোখ পাকিয়ে আদিব কে উদ্দেশ্য করে বলল,

-তুমি জানের কথায় কান দিচ্ছো দাদু!তুমি বুঝতে পারছো না ,ও তোমাকে রাগাতে চাচ্ছে।

দাদির কথায় দমলো আদিব। শক্ত চোখে তাকালো জাহানারার দিকে। জাহানারা তার সেই দৃষ্টি পাত্তা দিল না।যেভাবে নাচাতে নাচতে এসেছিল সেভাবেই নাচতে নাচতে চলে গেল। এরপর দাদি আদিব কে কত কিছু বোঝাল কিন্তু আদিবের মনের খচখচানি বন্ধ হলো না।কানে বাজতে থাকলো,”গাছটা কিন্তু আমার‌ও হলো না,আপনার‌ও হলো না।”এই কথাটা অনেকদিন পর্যন্ত ঘুরলো আদিবের মাথায়।রাগ হলো জাহানারার উপর। অভিমান জমলো দাদির দিকে।ভেতর থেকে কেউ যেন বলল,দাদি তার আদরের নাতনির আবদার রাখতে গাছটা ওখানে লাগানোর যুক্তি দিয়েছিল। তাছাড়া আর কিছুই না!এই কথাটা মনে হতেই আদিব খুব করে চাইলো ঐ হিংসুটে মেয়েটা যেন চাচির কাছে খুব শীঘ্রই চরম ঝাড় খায়।
এই কাজটা অবশ্য সে নিজেই করতে পারতো কিন্তু নালিশ ,কুটনামি এসব করা তার স্বভাব বিরোধী।তাই তো কিছু বলল না চাচিকে। চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলো সেই দিনের। জাহানারার যে পূর্ব অতীত সেই অতীত অনুযায়ী সপ্তাহে দুই তিন বার সে মায়ের হাতে ঠেঙানি খায়।এটা নতুন না।তবে সেবার সময় একটু বেশি লাগলো কিন্তু অবশেষে আদিবের মনের ইচ্ছা পূরণ হলো।স্কুলে কোন এক ছেলের সাথে মারামারি করতে গিয়ে তার চোখে কলম দিয়ে খোঁচা মেরেছে জাহানারা।সেই নালিশ জানাতে সেজ চাচা কে ডেকে পাঠালো জাহানারার স্কুলের হেডস্যার।সেজ চাচা কোন রকমে মেয়েকে হেড স্যারের হাত থেকে বাঁচিয়ে ফেরালেও, সালেহার হাত থেকে বাঁচতে পারলো না। জাহানারা বাড়ির গেটের সামনে আসতে না আসতেই সালেহা রাস্তার মধ্যে তার কান ধরে পিঠে দুমদাম কিল বসিয়ে দিল।আদিব তখন স্কুল থেকে ফিরছিল রাস্তার মাঝে এই দৃশ্য দেখে সাইকেলের প্যাডেলে পায়ের গতি ধীর করলো।জাহানারার নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো।ঠিক তখনই লক্ষ্য করলো জাহানারা ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জাহানারার খাবো খাবো দৃষ্টি দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না আদিব ,ফিক করে হেসে ফেলল এবার।আদিবের সেই হাঁসি দেখে রাগে ক্ষোভে কেঁদে ফেলল জাহানারা।সালেহা মেয়ের চোখের পানি দেখে থামলো।বকতে বকতে মেয়েকে বাড়ির ভেতরে নিল।

আদিবের সেই হাসি টুকুই যেন আদিবের কাল হলো। শুধু মাত্র ঐ হাঁসির কারণে এরপর থেকে জাহানারা আদিব কে দেখলেই চোখ মুখ গুটিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভেংচি কাটত।প্রথম প্রথম আদিব ব্যাপার টা তেমন গুরুত্ব দিল না। এককথায় নির্লিপ্ত ভাব দেখালো।
তবে আদিবের এই নির্লিপ্ত ভাবটা জাহানারা কে সাহস যোগাল।সে যেন পেয়ে বসলো।যখন তখন যেখানে সেখানে শুরু করলো অমন বেয়াদবি।একটা সময় পর আদিবের মনে হলো এবার ব্যাপারটা থামানো উচিত।যেমন ভাবা তেমন কাজ একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে জাহানারা কে চোখে পড়লো তার।মেজ চাচাদের বাড়ির সামনে নিতুর সাথে গল্প করছে। কাঁধে স্কুল ব্যাগ।আদিব কে দেখেই মুখ বেকালো সে।সাথে সাইকেলর ব্রেক কষলো আদিব। সাইকেল স্ট্যান্ডে দাড় করিয়ে পিছন ফিরে সোজা এসে দাঁড়ালো জাহানারার সামনে।কোন ভণিতা না করে বাজখাঁই গলায় বলল,

-কিছু বলছি না বলে তোমার বেশি সাহস হয়ে গেছে না! বেয়াদব।আর একবার মুখ ভেংচিয়ে দেখো থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো তোমার।

আদিবের আকস্মিক আক্রমণে থতোমতো খেল জাহানারা।সে হয়ত আশা করেনি আদিব এভাবে তেড়ে আসবে। আদিবের ব্যবহার জাহানারা কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হল তবে দমলো না।আদিবের কথার জবাবে পালটা বলে উঠলো,

-আমি আপনাকে ভেংচি দেইনি।আমি নিতুকে ভেংচি দিয়েছি।এই নিতু বল।

নিজের কথার সত্যতা প্রমাণে নিতুকে সাক্ষী হিসেবে দাড় করালো জাহানারা।জাহানারার এমন কাজে নিতু যেন আকাশ থেকে পড়লো।এমনিতে ভিতু স্বভাবের সে।তাছাড়া আদিবকে সে ভয়‌ পায়।জাহানারার কথায় সে বুঝে পেল না কি করবে।নিতুর সম্মতি দিতে দেরি হতে দেখে তাড়া লাগালো জাহানারা।আদিব স্পষ্ট বুঝতে পারলো জাহানারা নিজেকে সঠিক প্রমাণিত করতে নিজে মিথ্যা কথা বলছে সেই সাথে নিতুকেও বাধ্য করছে।মেজাজ চড়া গেল আদিবের।

-চুপ বেয়াদব!আর একটাও কথা বলবে না।একত বেয়াদবি করেছ আবার এখন সেটা ঢাকতে মিথ্যা কথা বলছো! অসভ্য একটা!

আদিবের উচ্চ কণ্ঠ। জাহানারা কেঁপে উঠলো।আদিবের গলার আ‌ওয়াজ পেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নিতুর মা ডালিয়া।এসেই আদিবের কাছে জানতে চাইলো কি হয়েছে।আদিব সবটা বলতেই ডালিয়া ছি : ছি : করে উঠলো।বলল,

-বড় ভাইয়ের সাথে কেও এমন করে জাহান!আদিব তোর বড় না!ওর সাথে এমন বেয়াদবি করলি কি করে তুই! ছি : ছি :!

মেজ চাচির কথা শুনে চোখ টলমলে হলো জাহানারার।আদিব আর দাঁড়ালো না সেখানে।রাগে গজ গজ করতে করতে স্থান ত্যাগ করলো।সেদিনে সেই ঘটনা সেখান থেমে থাকলো না। ডালিয়া বেশ রসিয়ে কষিয়ে সালেহা কে বললেন। সালেহা রাগে দুঃখে মেয়ে কে ইচ্ছা মতো মার লাগলো।সেই সাথে হুঁশিয়ারি দিল জাহানারা কে আর যদি কোনোদিন কারো সাথে বেয়াদবি করতে দেখে তাহলে জাহানারার একদিন কি তার একদিন।মায়ের সেই হুমকি মাথা পেতে নিলো জাহানারা।এরপর আদিবের থেকে একশ হাত দূরত্ব তৈরি করলো।
আদিবের সাথে বেয়াদবি করার জন্য জাহানারা কে সালেহা উত্তম মাধ্যম দিয়েছে এই কথা নিয়ে তিন বাড়িতেই কম বেশি আলোচনা হলো। আশরাফ কথাটা শুনে আফসোস করে বলল, “এটুকু বিষয়ে সালেহার মেয়ের গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি,ছোট মানুষ অত বোঝে না কি!আর আদিব তুমিও বা কি?ঐটুকু মানুষের কথায় কেউ রাগে!ওর কি অত ভালো মন্দ জ্ঞান হয়েছে !”বাবার কথায় আদিবের মনে হলো অন্যায় টা তার।তানিয়া আশরাফের কথায় সহমত হতে পারলো না সে বলল,”সালেহা যা করেছে ভালো করেছে। মেয়েটা একটু বেশিই অবাধ্য হচ্ছে ,এই সময় শাসন না করলে হিতে বিপরীত হবে।”আদিব বাবা মায়ের কথায় বুঝলো যা হয়েছে হয়েছে এতে তার কিছু করার নেই।সে নিজের খাবার চুপচাপ শেষ করে নিজের ঘরে গেল।

এরপর বেশ কিছুদিন জাহানারা কে আদিবের আশেপাশে লক্ষ্য করা গেল না।আদিবের মনে হলো সেজ চাচির মারে মেয়ের বুঝ এসেছে। কিন্তু আদিবের সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে মেয়েটা যেন আরো বাড়লো।এই ঘটনার আগে যদি‌ও বা আদিবের সাথে তার তেমন কোন কথাবার্তা কিংবা তেমন কোন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। জাহানারা যথা সম্ভব আদিবের থেকে দূরেই থাকতো কিন্তু এই ঘটনার পর মেয়েটা যেন আদিব কে নিজের শত্রু হিসেবে দেখতে লাগলো।আড়ালে আবডালে নানাভাবে বিরক্ত করতে লাগলো সে আদিব কে।এই যেমন:- সেজ চাচার কাছে পড়তে গেলে তার পায়ের একটা স্যান্ডেল পড়ে থাকলে আরেকটার হদিস থাকতো না,কখনো বা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কোথা থেকে গায়ে ছোট ইটের টুকরো উড়ে এসে লাগতো। আবার কখনো বা পাড়ার বাচ্চাদের দিয়ে তাকে কানা বক বলে ডাকাতো।এসব ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে আদিব একদিন জাহানারা কে ডেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে যেন তার এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করে।আদিবের কথা শুনে জাহানারা আকাশ থেকে পড়ার ভ্যান করে বলল,সে এসব কিছু জানেই না।সে তো মায়ের কথা শুনে এখন আদিবের সামনেও যায় না , ইত্যাদি ইত্যাদি। জাহানারার কথা শুনে দাঁতে দাঁত চাপলো আদিব।এই নিয়ে আর জাহানারা কে কিছু বলল না।সবটা হজম করে তক্কে তক্কে থাকলো কবে মেয়েটাকে হাতে নাতে ধরবে।এভাবে সময় গড়াতে লাগলো। কিন্তু আদিব কোন ভাবেই মেয়েটার নাগাল পেল না। বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অন্যদিকে আর খেয়াল র‌ইলো না। এরমধ্যে জাহানারা‌ বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানা বাড়ি বেড়াতে গেল।আদিব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল।তবে সেটা ছিল সীমিত সময়ের জন্য।
পরের বছর ক্লাস ফাইভ পাস করে জাহানারা আদিবের স্কুলে ভর্তি হলো।সজীব‌ও সে বছর সালেহার এখানে এসে উঠলো।আদিবের ক্লাসে ভর্তি হলো সজীব। পূর্ব পরিচিত হ‌ওয়ার দরুন দুইজনের বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগলো না।বেশ কয়েকদিন যেতে না যেতেই সজীব লক্ষ্য করলো জাহানারার আদিবের সাথে করা শয়তানি গুলো।একদিন আদিবের স্যান্ডেল বাড়ির পিছনের বাগানে ফেলতে নিতেই সজীব হাতে নাতেও ধরলো জাহানারা কে। সজীব জাহানারার এই শয়তানি সালেহাকে বলতে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই জাহানারা হাতে পায়ে ধরলো তার।আদিব‌ও ছিল সেখানে আদিবের থেকেও বারবার মাফ চাইলো জাহানারা বলল আর কখনো এমন কিছু করবে না। রীতিমতো কথা দিল সে।আদিব সজীব কে বলল এবারের মতো ছেড়ে দিতে এরপরে যদি আবার এমন কিছু করে তখন দেখা যাবে।সেদিনের পর সত্যি জাহানারা আর তেমন কিছু করলো না।এমনকি তাকে আদিবের ধারে কাছে দেখা গেল না।তবে আদিব উড়ো উড়ো শুনতে পেত আড়ালে তাকে জাহানারার কানা বক বলে ডাকা সম্বোধন টা।কিন্তু তেমন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করতো না।তাছাড়া আদিবের তখন সময় কোথায়!স্কুল শেষ করে ক্লাস নাইনে বিভাগীয় বিষয়গুলোর জন্য আলাদা কোচিং করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় তার। যেখানে দুপের খাওয়া টাও ঠিক মতো হয় না সেখানে জাহানারা কি করলো না করলো তা দেখবে কখন!

ছেলের কথা চিন্তা করে আশরাফ জায়েদ কে বলে বাড়ি এসে পড়িয়ে যা‌ওয়ার ব্যবস্থা করলো।যার দরুন সেজো চাচার বাড়ি যা‌ওয়া বন্ধ হলো আদিবের।এরপর পড়াশোনার চাপে, স্কুল, কোচিংয়ের ব্যাস্ততায় কীভাবে কীভাবে যেন এস‌এসসি পরীক্ষা নাকের দোর গোড়ায় এসে পৌঁছাল।পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যা‌ওয়া বন্ধ হলো আদিবের। আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি, এই সময়টুকুতে জাহানারার সাথে তার দেখা হলো না বললেই চলে।কোন এক অদৃশ্য কারণে হঠাৎ জাহানারার উড়ু উড়ু চলা ফেরায় সীমা টানলো সালেহা। জাহানারা‌ও যেন বাধ্য মেয়ের মতো ঘর মুখো হলো।

এরপর অনেকদিন পর ফের জাহানারার সাথে দেখা হলো আদিবের।এস‌এসসি পরীক্ষা গোল্ডেন পা‌ওয়ার খুশিতে মিষ্টি দিতে গিয়েছিল সে সেজ চাচার বাড়ি। জাহানারা উঠানে লাফদড়ি খেলছিল।আদিব কে দেখে খেলা থামিয়ে এগিয়ে এলো সে।জাহানারা কে অনেদিন পর দেখে আদিবের কাছে মনে হলো মেয়েটা হঠাৎ বড় হয়ে গেছে।আদিব কে দেখেই এক গাল হাসলো জাহানারা।হাতে থাকা লাফদড়ি একপাশে রেখে বলল,

-আপনি না কি গোল্ডেন প্লাস পেয়েছেন আদিব ভাই।তা আমাদের মিষ্টি কৈ?

আদিব হাতে থাকা মিষ্টির থালা জাহানারার হাতে দিয়ে বলল,

-এই যে মিষ্টি।চাচিকে দিও।আমি মেজ চাচিদের বাড়ি যাচ্ছি। সজীব আছে?

-ছোট মামা বাড়ি গেছে।

-ও ফিরলে আমার সাথে দেখা করতে বলবে।

ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে আসলো আদিব।সেদিন অনেকদিন পর সেই এক চিলতে কথা হয়েছিল জাহানারার সাথে তার। তারপর রাস্তা ঘাটে মাঝে সাঝে দেখা হলেও ভালো মন্দ ব্যতীত আর কোন বাক্য বিনিময় হয়নি দুজনের।
আদিব নিজের পড়াশোনা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতো যে কোথায় কি হচ্ছে,কারকি খবর এসবের জন্য সময়‌ই ছিল না তার কাছে। তবে একদিন খাবার টেবিলে হঠাৎ জাহানারার কথা উঠলো।দাদি তুললেন কথাটা। জাহানারার জন্য না কি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে ফুপুর বড় জা।কথাটা শুনতেই আশরাফ বলে উঠলো,

-মানুষের আক্কেল‌ও বলিহারি! ঐ টুকু মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয় কীভাবে!তুমি নাফিজাকে কিছু বলো নি?

-নাফিজা বলেছিল জাহানারা এখন ছোট, জায়েদ এখন মেয়ে বিয়ে দেবে না। ওর জা শোনেনি‌।বাধ্য হয়ে নাফিজা জায়েদের সাথে কথা বলতে এনেছিল।

-জায়েদ কি বলল?

আদিব লক্ষ্য করলো বাবার গলাটা কেমন জানি শোনালো।দাদি বললেন,

-বোনের জা বলে কথা, মুখের উপর না করে কি করে।আমতা আমতা করছিল।বাধ্য হয়ে যা বলার আমি বলেছি।বলেছি আমাদের মেয়ে অন্য কোথাও পাঠাবো না, বাড়িতেই রাখবো।

দাদির কথার তাৎপর্য বুঝলো না আদিব তবে লক্ষ্য করলো খাওয়ার প্লেটে হাত থেমে গেল তার মায়ের।বাবা কিছু বলতে যাচ্ছিল তার কথা মাঝ পথে কেটে তার মা বলল,

-মা আপনি কি জাহানারার জন্য আদিবের কথা বলছেন?

মায়ের প্রশ্নে আকাশ থেকে পড়লো আদিব।তবে দাদির মুখে চ‌ওড়া হাসি দেখা দিল।সে সেভাবেই বলল,

-হ্যাঁ ব‌উমা।কেন তোমার মনে নেই খোকা তো বলেছিল জাহানারা কে সে আদিবের জন্য নিবে।ভুলে গেলে না কি।

-আপনার ছেলে কি বলেছিল, না বলেছিল তার দায় আমার ছেলে নিতে যাবে না মা! আপনার খোকা যা বলেছিলো সব ভুলে যান মা।

-সে কি ব‌উমা এসব কি বলছো তুমি!ভুলে যাবো মানে!খোকা কথা দিয়েছিল জায়েদ কে।তুমিও তো ছিল সেদিন, কৈ তখন তো আপত্তি করোনি তাহলে এখন কি হলো!

-এখন আপত্তি করছি।

কথাটা বলে খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে গেল তানিয়া।আদিব হতবাক হয়ে বসে র‌ইলো কিছুক্ষণ। বোঝার চেষ্টা করলো এতক্ষণ ঠিক কি নিয়ে কথা হলো।

চলবে,ইনশাআল্লাহ

সৌরকলঙ্ক পর্ব-১+২

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১

-আদিব বাড়ি ফিরছিস তুই?

-হুম।

-হঠাৎ বাড়ি আসতে চাইছিস?কিছু হয়েছে? বাবা কিছু বলেছে?

ফোনের অপর পাশে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর তানিয়ার।তার কেন জানি মনে হচ্ছে, তার ছেলের হঠাৎ দেশে আসতে চাওয়ার পিছনে তার স্বামী আশরাফের বিশেষ কোন ভূমিকা আছে।না হলে যে ছেলেকে বিগত এগারো বছরে হাতে পায়ে ধরেও, কেও এ মুখো করতে পারে নি, সে কেন হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিল।তানিয়া ছেলের এই সিদ্ধান্ত জানার পর থেকে বেশ চিন্তিত। চিন্তার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে,ছেলেটা সবে লন্ডনের মাটিতে পা শক্ত করেছে।এখনো কত কিছু বাকি।আর এখুনি যদি সে বাবার কথায় খ্যামখেয়ালিপানা করে! একেবারের জন্য দেশে চলে আসে,তাহলে চিন্তা হবে না!সে তো জানে কত কষ্ট করে ছেলে তার আজকের অবস্থান তৈরি করেছে।সেই অবস্থান বাপের কথায় আবেগি হয়ে ছেড়ে আসলে ছেলের কত বড় ক্ষতি হবে ,সেটা ছেলে না বুঝলেও তানিয়া ঠিক বুঝেছে।তাই তো ছোট মেয়ের কাছ থেকে ছেলে দেশে ফেরার খবর শুনে তড়িঘড়ি ছেলেকে ফোন করেছে। উদ্দেশ্য সে যে খবর শুনেছে তার সত্যতা যাচাই করা।

আশরাফ বরাবরই ছেলের প্রবাসে থাকা নিয়ে অসন্তুষ্ট।সে সবসময় ইনিয়ে বিনিয়ে চেষ্টা করেছে ছেলেকে দেশে ফেরাতে। কিন্তু ছেলের পোক্ত মনোভাবের কাছে তার কথাগুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি।তবে তানিয়ার মনে হচ্ছে এবার তার স্বামীর আবেগি কথায় ফেসেছে ছেলে।তাই তো বাড়ি আসতে চাইছে। এবং সেই কথাটা তার থেকে গোপন‌ও করেছে! বাপের কথা শুনে ছেলে কোন বোকামো না করে বসে, এটা ভেবেই মন উদ্বিগ্ন হচ্ছে তানিয়ার।
এতগুলো বছরে ছেলেটা লন্ডনের মতো বিলাসবহুল শহরে কত কষ্টে নিজের অবস্থান তৈরি করছে সেটা তার অজানা নয়।কত কঠোর পরিশ্রম আর ত্যাগতিতিক্ষার ফল আদিবের এই বর্তমান অবস্থান।সেই অবস্থান বাবার কথায় এত সহজে ছেড়ে দিবে ছেলে!সেটা তানিয়া হতে দিতে পারে না। কিছুতেই না।
এগারো বছর!প্রায় এগারোটা বছর সে তার বুকে পাথর বেঁধে ছেলেকে এতদূর এমনি এমনি তো রাখেনি।এখন যখন ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,নিজের সুউচ্চ অবস্থান তৈরি করছে, তখন সেসব ছেড়ে বাড়ি আসার প্রশ্নই ওঠে না।তার স্বামীর বোকামির জন্য সে ছেলের এতো বড় সর্বনাশ হতে দিতে পারে না!
মায়ের উদ্বেগ বুঝলো আদিব ।সে একটা শ্বাস গোপন করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

-বাবা কিছু বলে নি মা।একটা লম্বা ছুটি পেয়েছি, তাই মনে হলো একটু ঘুরে আসি বাড়ি থেকে। তাছাড়া তোমাদের দেখতে ইচ্ছা করছিল।তাই…

-আমরা আসছি তো বাবু তোর কাছে।আর কটা দিন একটু সবুর কর।এতোটাকা খরচ করে তুই আসবি, আবার ফিরবি!বাবু ফ্লাটের ইএমআই তো এখনো বাকি।এখন এতো খরচা খরচ করলে চলবে!

আদিবের কথা শেষ না হতেই বলল তানিয়া। মুখস্থ কথা ,যেন প্রস্তুত ছিল সে আদিবের কথার প্রেক্ষিতে কথাটা বলতে।মায়ের কথা শুনে মনে মনে হাসলো আদিব।খরচা খরচের ভয় দেখিয়ে মা যে তাকে পরোক্ষভাবে দেশে ফিরতে বারণ করছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না তার।তবে সেটা মা কে বুঝতে না দিয়ে মায়ের কথার প্রতি উত্তরে বলল,

-তোমাদের কাগজপত্র ঠিক করে এখানে আসতে এখনো অনেক দেরি মা।আর র‌ইলো ফ্লাটের ইএম‌আই,ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না ।সেটা গতমাসে ক্লিয়ার হয়েছে।

আদিবের ভণিতাহীন জবাব।ছেলের কথায় কিঞ্চিৎ নিরাশ হলো তানিয়া।সে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,

-ও। আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে আই।ঘুর যা।

একটু থামলো তানিয়া তারপর কি যেন মনে পড়েছে এমন ভাব করে আবার বলল,

– আদিব,, তুই একবারে চলে আসছিস না তো বাবা?

-মা বললাম তো ছুটিতে আসছি।আমার কথা কি ঠিক করে শোনোনি? ওকে ফাইন, তোমার আপত্তি থাকলে আমি আসছি না!

-আহা; আমি কখন বললাম আমার আপত্তি আছে।আমি ভাবছিলাম তুই আবার তোর বাপের কথা শুনে সব ফেলে চলে আসছিস কি না; তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।রাগ করছিস কেন! আচ্ছা শোন ওসব বাদ দে।সকালে নাস্তা করেছিস?আজ কি খেলি?

প্রসঙ্গ বদলাতে কথা ঘোরালো তানিয়া।ছেলের অল্পতে রেগে যাওয়া স্বভাব সম্পর্কে ভলিভাতি অবগত সে।এক কথা একবারের বেশি শুনতে পছন্দ করে না আদিব।রেগে যায়। বিরক্ত হয়।এখন ছেলের কাজের সময়। তানিয়া চায় না এখন ছেলেকে রাগাতে সুতরাং কথা ঘোরানোই ভালো।

আজ ঘুম থেকে উঠতে দরী হয়েছে আদিবের যার কারণে সকালের খাবার টা এখনো পেটে পড়েনি।তবে সে কথা মা কে বললে সে অন্য কথা টেনে আনবে। যেটা আদিব এই মুহূর্তে চাইছে না।সে কোনোরকমে বলল,

-ব্রেড-জ্যাম,কফি।

তারপর একটু থেমে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,

-মা রাউন্ডে যেতে হবে, ফোন রাখছি।রাতে ফোন দিবো।

– দাড়া,কল কাটিস না।বলছি তুই কবে আসছিস?এই সপ্তাহে?

-হুম।সামনের সোমবার।

-এই সোমবার!আজ তো শনিবার।তাহলে পরশু?

-পরশু রাতে এখান থেকে ফ্লাইটে উঠবো। বাংলাদেশে পৌঁছতে মঙ্গলবার দুপুর দুটো তিনটা বাজবে হয়ত।

-মঙ্গলবার! আচ্ছা ,আমি তোর মামাকে বলবো তোকে এয়ার পোর্টে নিতে যেতে।সেদিন ওদের ওখানে থেকে পরেরদিন খুলনা আসিস।অবশ্য তোর মামাকে বললে সে গাড়ি করে তোকে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে যাবে।

অনেকটা স্বগোতক্তি করে বলল তানিয়া।নিজের সহজ সরল সাজেশন শোনাল ছেলেকে।তবে আদিবের মায়ের সাজেশন টা পছন্দ হলো না।সে আপত্তি জানিয়ে বলল,

-মামাদের এখন কিছু জানাতে হবে না।আমি ঢাকা টু যশোর ফ্লাইট নিবো। যশোর থেকে গাড়ি ভাড়া করে সোজা খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দেব।

-সে কি এত পথ পাড়ি দিয়ে, আবার জার্নি করবি! তার থেকে ওদের ওখানে একদিন থাক। রেস্ট নে। তারপর বাড়ি আই।

-মা কেন শুধু শুধু মানুষকে বিরক্ত করা!আর তাছাড়া তুমি তো জানো আমার ওখানে যেতে ভালো লাগে না।তাহলে কেন বলছো।আমি সোজা বাড়ি যাবো। আচ্ছা এখন রাখছি।পরে কথা বলবো।

নিজের মতো কথা বলে কল কেটে দিল আদিব।তানিয়া ছেলের কণ্ঠের রুক্ষতা স্পষ্ট বুঝতে পারলো। মনে মনে ছেলের ব্যবহারে রুষ্ট হলো সে। শব্দ করে স্মার্ট ফোন টা সামনের টি টেবিলের উপর রেখে নিজের সূক্ষ্ম রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো।এরপর কিছু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে আশরাফের দিকে চোখা চোখে চেয়ে বলল

-সত্যি করে বলো তো তুমি কি বলছো আদিব কে?

আশরাফ সকালের বাসি খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল। তানিয়ার কথা শুনে খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই কাটকাট গলায় বলল,

-তোমার ছত্রছায়ায় আবদ্ধ ছেলের… বাপের প্রতি অতটান নেই, যে সে বাপের কথায় সুদূর লন্ডন থেকে দৌড়ে আসবে!

আশরাফের কটাক্ষ পূর্ণ কথা। তানিয়া তেতে উঠে বলল,

-একটা সামান্য কথা জিজ্ঞেস করেছি আমি, এতে এমন টিটকারি করার কি আছে!

-সামান্য কথাটা আমার কাছে বৃহত্তর মনে হলো তাই টিটকারি করলাম।

আশরাফের কথায় তানিয়ার রাগ আরো চরমে উঠলো।একে তো ছেলে তাকে কিছু জানায়নি ,তার‌উপর তার কথা অসম্পূর্ণ রেখে কল কে’টে’ছে , এখন আবার এই লোক তাকে ঠেস দিয়ে কথা বলছে!একদিনে এতো কিছু সহ্য করা যায়! রাগে দুঃখে তার চোখ মুখ থমথমে হলো।সে আশরাফের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো। আশরাফ খবরের কাগজে চোখ নিবদ্ধ রেখেও বুঝতে পারলো তানিয়া তাকে নিজের অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে ভস্মীভূত করারা তীব্র প্রয়াসে আছে।বুঝলো প্রতিবারের মতো এবারও তাকেই হার মানতে হবে। না হলে এই অগ্নি চক্ষু যেকোনো মুহুর্তে বর্ষার পানিতে ডোবা খালে পরিণত হবে।সে খবরের কাগজ একপাশে রেখে বলল,

-আদিবের সাথে এরমধ্যে আমার কোন কথা হয় নি।এক সপ্তাহ আগে ও নিজে ফোন দিয়েছিল আমাকে।ফোন দিয়ে বলল ভিডিও কলে আসতে।আমাকে দেখবে। এরপর মনে হয় হাতে গুনে দুই মিনিট কথা হয়েছিল।ওটুকু সময়ে না আমি তাকে বাড়ি আসার কথা বলেছি ,আর না সে আমাকে তার দেশে আসার বিষয়ে কিছু জানিয়েছে। গতকাল তৃপ্তি আমাকে জানাল আদিবের দেশে ফেরার কথা। ব্যাস।পেয়েছ উত্তর?খুশি?

স্বামীর কথা শুনে তানিয়া যেন একটু স্বস্তি পেল।মনের ভেতর তৈরি হ‌ওয়া খুঁতখুঁতুনি টা কিছুটা শান্ত হলো। তানিয়ার মুখের পরিবর্তিত অভিব্যক্তি দেখে আশরাফ ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।বসে থাকার ফলে কুঁচকে যাওয়া ফতুয়ার নিচের অংশ হাত দিয়ে টেনে সোজা করতে করতে বলল,

-ছেলে দেশে ফিরছে এ নিয়ে এত চিন্তা করছো কেন তানিয়া?তোমার তো খুশি হ‌ওয়া উচিত,এতদিন পরে ছেলে বাড়ি ফিরছে।আর কেউ না জানুক আমি তো জানি, প্রতি রাতে ছেলের জন্য কীভাবে চোখের পানি ফেল তুমি।ছেলেকে একপলক দেখার জন্য কতটা অধীর আগ্রহে সময় পার করো।তাহলে!ছেলে ফেরার কথা শুনে এত ছটফট করছো কেন?

আশরাফের সন্দেহীন কণ্ঠ।ভড়কালো তানিয়া।এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো হয়ত আশরাফ কোন জাদু বলে তার মন পড়ে নিয়েছে।সে স্থির চোখে তাকালো আশরাফের দিকে।
দুই মেয়ের পরে জন্মেছিল আদিব।শুরু থেকে একটা ছেলের ইচ্ছা ছিল তানিয়ার কিন্তু পর পর দুই মেয়ে হ‌ওয়ায় সেই ইচ্ছা ত্যাগ করেছিল । কিন্তু সৃষ্টি কর্তার মনে হয়ত অন্য কিছুই ছিল। তাই তো ছোট মেয়ে তৃপ্তির জন্মের প্রায় এগারো বছর পর অপ্রত্যাশিত ভাবে আবার কনসিভ করলো তানিয়া।কনসিভ করার পর মনে থাকা ইচ্ছা টা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার।খুশিতে আত্মহারা হলো মনে মনে। কিন্তু খুশিটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার কারণে।প্রথমতো বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, তার‌উপরে থাইরয়েডের সমস্যা তুঙ্গে।ডাক্তার বলল এই বয়সে এতো ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।ডাক্তারের কথায় আশরাফ‌ও সম্মতি জানালো।কিন্তু আশরাফের মা জাহানারা বেগম বেঁকে বসলেন।তানিয়াও শ্বাশুড়ির কথায় সাঁই দিল। আল্লাহ ভরসা, যা হবে দেখা যাবে।এই কথায় আমল করে অপেক্ষা করতে লাগল অনাগত সন্তানের।এরপর যেদিন আদিব ভুমিষ্ঠ হলো সেদিন তানিয়ার জান নিয়ে টানাটানি অবস্থা। নরমাল ডেলিভারি কিন্তু র’ক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। রক্ত শূন্য হয়ে একটু একটু করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে সে।চোখের সামনে নামছে অন্ধকার। ডাক্তার তার অবস্থা দেখে হিস্টেরেকটমি করতে বাধ্য হলো।বাদ পড়লো তার নারী শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।আজো চোখের সামনে সেই দিনটা ভাসে।
এতো এতো কষ্টের পরে পাওয়া ছেলে তার। সেই ছেলেকে এতোগুলো বছর নিজের থেকে দূরে রাখা তানিয়ার জন্য মোটেও সহজসাধ্য ছিল না।তবুও সে সেটা করেছে।ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মাতৃ স্নেহ কে দূরে ঠেলেছে।

-এতো কীসের ভয় তানিয়া!যে ভয়ে ছেলেকে দেশ ছাড়া করেছিলে সেসব তো কবেই চুকে গেছে। আমার মা‌ও তো বেঁচে নেই……!তুমি যার ভয় পাচ্ছো…… স্যরি যে কারণে ভয় পাচ্ছো তা তো আর সম্ভব না।

আশরাফের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো তানিয়ার।নিজের ভাবনা একপাশে রেখে সংযত কণ্ঠে সে বলল,

-আমি কোন ভয় পাচ্ছি না।আমরা যাচ্ছিলাম‌ই ওখানে।সেই জন্য চাইছিলাম আদিব যেন আবার অতগুলো টাকা খরচ করে এখানে না আসে।

যথেষ্ট শান্ত কণ্ঠ তানিয়ার।নিজের মনের ভাব লুকানোর ত্রুটিহীন চেষ্টা। তবুও যেন আশরাফ তার মনের ভাব বুঝে নিল। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাঁসি।

-ভয় না পেলেই ভালো।তবে যদি তোমার মনে উলটো পালটা কিছু উদয় হয়, আর সেটা ভেবে ছেলেকে দেশে ফেরা থেকে আটকাতে চাও, তাহলে তোমার অবগতির জন্য জানিয়ে দিচ্ছি যে তুমি যার থেকে তোমার ছেলেকে আড়ালে রাখতে এতো কসরত করছো। সে এখন তোমার ছেলের দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করবে না। সুতরাং তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।

নিজের কথা শেষ করে তানিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল আশরাফ।তানিয়া আশরাফের গমনরত পথের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল।আশরাফের বলা কথাগুলোর তাৎপর্য মনে করতেই চোখ বন্ধ করে একটা গভীর শ্বাস টানলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো সময় নিয়ে।
আশরাফের বলা কথা,নিজের অহেতুক ভাবনা সব একপাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো।ছেলে বাড়ি ফিরছে তার। এখন বসে থাকলে হবে না।ছেলের থাকা খাওয়ার যেন কোন‌ অযত্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।বাড়ি কাজের লোক আছে তবে তাদের ভরসায় ছেলের কাজ ফেলা রাখা যাবে না। তাছাড়া আদিব খুঁতখুঁতে স্বভাবের, কোন কিছু এদিক ওদিক হলেই চটে যায়। সুতরাং তানিয়া কোন ঝুঁকি নিতে চায় না।

দুই তলার দক্ষিণের ঘরের সামনে এসে থামলো তানিয়া।এই ঘরটা আদিবের।দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে।আদিব না থাকলেও রোজ নিয়ম করে ঘরটা পরিষ্কার করায় তানিয়া। তবুও আজ যেন মনে হলো ঘরের আনাচে কানাচে বেশ ধুলো জমেছে।সেই সাথে একটা ভ্যাপসা গন্ধ‌ নাকে আসছে।ঘরের জানালা গুলো খুলে দিল তানিয়া। দক্ষিণের জানালা টা খুলতেই চোখ পড়লো সামনের আলিশান দোতলা বাড়িটা। সাথে সাথে মুখে জুড়ে অন্ধকার নামলো তার।জানালার আধ খোলা পাটটা শব্দ করে আবার বন্ধ করলো সে।অনেকদিন পর ফের রাগ হলো শ্বাশুড়ির উপর।
_______________
-কি খবর জায়েদ?শরীর গতি ভালো?

-জ্বি,মিয়া ভাই।

-শরীর ভালো; তাহলে চোখ মুখ অমন দেখাচ্ছে কেন রাতে ঘুম হয় নি?

-সালেহার শরীর ভালো না।কাল রাতেও গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে , সারারাত ঘুমায় নি।আবোল তাবোল বকেছে।

-সে কি কথা!এত খারাপ অবস্থা,আমাকে ডাকিসনি কেন?

-অত রাতে আর তোমাকে বিরক্ত করতে চাই নি।তাই আর কি…!

-রাবিস।তোমাকে কে বলল আমি বিরক্ত হবো।নিজের মনে যাতা ভাববেনা।চলো দেখি ,ভেতরে চলো, দেখি কি অবস্থা।

কথাটা বলতে বলতে নীল রঙের গেটটা ঠেলে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো আশরাফ।এই বাড়িটা তার সেজ ভাই জায়েদের। আশরাফের বাবা আহাসান‌উল্লার সহায় সম্পত্তি বলতে খুলনা শহরে পাঁচ বিঘা জমি ছিল।যা মৃত্যুর আগে তাদের চার ভাই,বোন আর তাদের মা জাহানারার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন তিনি।আহাসান‌উল্লার অবশ্য ইচ্ছা ছিল ছেলেরা একসাথে থাকবে এক ছাদের তলে কিন্তু পুত্র বধূদের আচার আচরণ দেখে সে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয় তাকে ।পরবর্তীতে যার যার অংশ তাকে বুঝিয়ে দিয়ে প্রাচীর টানেন জমিতে।ছেলেরা দূরে থাকুক তবুও একে অপরের মনে থাকুক এমন ভাবনা থেকে এ সিদ্ধান্ত নেন।
বাবার রেখে যা‌ওয়া সেই জমিতে পরে তারা তিন ভাই পাশাপাশি বাড়ি তৈরি করে।পরপর তিনটে বাড়ি, দূর থেকে দেখলে মনে হয় গলা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায় তাদের মধ্যকার দূরত্ব।ঠিক যেমন এ বাড়ির মানুষগুলোর সাথে একে অপরের দূরত্ব।
তিক্ত হলেও কথাটা সত্যি ,বাড়িগুলো একে অপরের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাড়ির লোকেরা কালে ভাদ্রেও একে অপরের সামনাসামনি হয় না। জাহানারার মৃত্যুর আগে যদিও কিছু আন্তরিকতা অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু জাহানারার মৃত্যুর পর সেটাও প্রায় নিঃশেষ হয়েছে।ভাই ভাইয়ে এখনো হয়ত কিছুটা সম্পর্ক আছে যার দরুন একে অন্যের বিপদে তারা এগিয়ে যায়,ভালো মন্দে পাশে থাকে হোক সেটা শুধু চৌকাঠ পর্যন্ত তবুও কিছু আছে। কিন্তু বাড়ির ব‌উ ছেলে-মেয়েরা ভুলেও একে অপরের ছায়া মাড়ায় না।কি জানি কোন অদেখা প্রতিযোগিতায় একে অপরের থেকে এগিয়ে থাকতে চায় তারা! যার জন্য নিজেদের মাঝে এই দূরত্ব টেনেছে!

আজ অনেক দিন পর জায়েদের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো আশরাফ।বছর পাঁচেক আগে জায়েদের একতলা টিনের ঘর ভেঙ্গে তিন তলা বিশিষ্ট বিরাট বিল্ডিং তুলেছে আকিব।আকিবের তৈরি কৃত এই বিল্ডিংয়ে আজ প্রথম ঢুকছে আশরাফ।অবশ্য বাড়ি তৈরি করার সময় একবার দেখে গিয়েছিল কিন্তু তারপর আর আসা হয়নি। বাড়িতে ওঠার সময় আকিব চাচাদের দাওয়াত করেছিল তবে আশরাফ আসতে পারেনি। তৃপ্তির শ্বশুর মারা গিয়েছিল। আশরাফ কে সেদিন সেখানে যেতে হয়েছিল।আজ ভেতরে ঢুকে চকচকে ঝকঝকে বাড়িটা দেখে মুখের কোণে এক চিলতে হাঁসি খেলে গেল আশরাফের।যাকে বলে প্রশান্তির হাঁসি।

এক দুর্ঘটনায় জায়েদ যখন পায়ে আঘাত পেয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করলো তখন সব কিছু থমকে গিয়েছিল তাদের পরিবারের জন্য।তার বাবার মতো শক্ত মানুষ‌ও ভেঙ্গে পড়েছিলেন!অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক।হাতে ছেলের পুলিশ সুপার হিসাবে জয়েন্ট করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আর ছেলের পায়ের শিরা থেঁতলে যা‌ওয়ার জন্য অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন চলছে ।এমন পরিস্থিতিতে যে কেউ ভেঙ্গে পড়বে।তবে মা শক্ত হাতে সব সামলেছিল। জায়েদ কে নতুন ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যুগিয়েছিলেন।ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য যা যা করণীয় তাই তাই করেছিল।জায়েদ‌ও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সামান্য প্রাইমারি স্কুলের চাকরি করে তাদের দুই ভাইয়ের মতো সমাজে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।পারেনি সংসারে অভাব অনটন ঠেলে সচ্ছল জীবন কাটাতে। জায়েদের সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন দেখে তার মা প্রায়স চিন্তা করতো।আফসোস করে বলতো,” আমার সবচেয়ে যোগ্য ছেলেটা ভাগ্যের ফেরে আজ সবার থেকে পিছিয়ে গেল!” মায়ের কত চিন্তায়ই না ছিল জায়েদ কে নিয়ে। জায়েদের অসচ্ছল অবস্থা নিয়ে।
অথচ আজ, আজ জায়েদ তাদের চার ভাইবোনের মধ্যে সবার থেকে এগিয়ে। সবার চেয়ে উপরে।তার আর্থিক সচ্ছলতা আর সামাজিক মর্যাদার সামনে এখন তারা চার ভাই বোন কিছুই না।মা আজ বেঁচে থাকলে আকিবের এই উন্নতি, জায়েদের এই সুখ দেখে কত খুশিই না হত!
কথা গুলো নিজ মনে ভাবতে ভাবতে সামনে এগিয়ে গেল আশরাফ।মায়ের অন‌উপস্থিতি শরণ করে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলতে ভুলল না।জায়েদ তার পাশেই ছিল।ভাইয়ের দ্বীর্ঘশ্বসের শব্দ তার কানে ঠিক পৌঁছাল।

-কি হলো? হঠাৎ দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললে যে?

-মা’র কথা মনে পড়লো হঠাৎ। আজকাল মা’র কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়।মনে হয় বাবা যতটুকু সুখ স্বস্তি দিয়ে গিয়েছিল, আমরা তার সিকি কণাও দিতে পারিনি তাকে।সেই জন্য হয়ত এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে।না হলে হয়ত আরো কটা দিন বাঁচতো।

-ও কথা বলতে নেই।হায়াত ম‌ওত আল্লাহর হাতে। আল্লাহ যা ভালো মনে করেছে করেছেন।

জায়েদের পাথর কঠিন কণ্ঠ।হয়ত কণ্ঠের কঠোরতার আড়ালে মনের দুর্বলতা লুকাতে চাইছে। ব্যাপার টা আন্দাজ করলো আশরাফ তবে কিছু বলল না।

-ব‌উমা বাড়ি নেই?

তিন তলার বিরাট ফ্ল্যাটটার ভেতরে প্রবেশ করে এদিক ওদিক তাকিয়ে জানতে চাইলো আশরাফ।জায়েদ সামনে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,

-না।বাবার বাড়ি গেছে।আজ চলে আসবে।আকিব আনতে গেছে।

-এইবার বুঝেছি!ব‌উ বাড়ি নেই সালেহা নিশ্চয়ই পানি ঘাঁটাঘাঁটি করেছে।সেই জন্য এই অবস্থা!

-সে কথা বলতে।উনি তো সুযোগ পেলেই ঐ করে।বাড়ি যে এতোগুলো কাজের লোক আছে তাদের কাজ ওনার পছন্দ হয় না।তারিন থাকলে যাও একটু বকে ধমকে রাখে কিন্তু সে নেই এই সুযোগে যা মনে চায় তাই করে।

সালেহার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল জায়েদ।সালেহা জেগেই ছিল বড় ভাসুরের গলার স্বর শুনে দুর্বল শরীরে উঠে বসলো।মাথায় কাপড় টেনে সালাম দিল আশরাফ কে।জায়েদ একটা চেয়ার টেনে বিছানার সামনে রাখলো।আশরাফ সালেহাকে সালামের উত্তর দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,

-চেহারা ছবি যা বানিয়েছ তোমাকে দেখে তো ভয় করছে আমার।একি অবস্থা করেছ! হ্যাঁ! ঔষধ পানি ঠিকঠাক খাও তো না কি?

-খাই তো ভাই।তাও এরকম হলে কি করবো বলুন!

অসুখে পেঁচিয়ে ধরা ভাঙ্গা গলায় ম্লান হেঁসে বলল সালেহা। আশরাফ তার কথা শুনে বলল,

-শুধু ঔষধ খেলে তো হবে না।নিয়ম মাফিক চলতেও হবে।যে রাজ রোগ নিয়ে বেড়াচ্ছ;তাতে একটু এদিক ওদিক হলেই ভোগান্তির শেষ নেই।দেখি হাত দাও পেশার টা দেখি কি অবস্থা।

জায়েদ স্ফিগমোম্যানোমিটার এগিয়ে দিল আশরাফের দিকে।মায়ের অসুস্থতার জন্য এটা অনেকদিন হলো কিনেছে আকিব। আশরাফ পেশার মেপে যন্ত্র টা একপাশে রাখতে রাখতে বলল,

-পেশার লো।ভালো করে খাওয়া দাওয়া করো সালেহা।জায়েদ খেয়াল রাখ ওর দিকে।

এরপর প্রেসক্রিপশনে দুটো নতুন ঔষধ লিখে দিয়ে আবার বলল,

-ঔষধ দুটো খেয়ে উন্নতি হয় কি না সেটা জানাবে।আমি আবার কাল আসবো।আর ভুলেও পানির কাজ করতে যাবে না। শ্বাস কষ্টের রোগী তুমি, ওসব করতে গেলে হয়। তাছাড়া বাড়িতে কাজের মানুষ থাকতে তুমি ওসব করতে যাও কেন।ছেলে তোমার আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করছে,সেটা একটু ভোগ করো।কেন শুধু শুধু খাটা খাটনি করে শরীরের উপর জুলুম করছো!

কথা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালো আশরাফ।সালেহা তড়িঘড়ি দুর্বল কণ্ঠে জায়েদের উদ্দেশ্যে বলল,

-আকলিমাকে বলো ভাই কে চা নাস্তা দিতে।

-না, আজ আর কিছু খাবো না। তুমি সুস্থ হ‌ও, একবারে তোমার হাতে এলাচি দিয়ে দুধ চা খাবো।

-সে না হয় খাবেন।তবে আজ একটু কিছু মুখে দিন, অন্তত এক কাপ চা। কতদিন পরে আসলেন। হ্যাগো !দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও আকলিমাকে বলো।

সালেহা তাড়া দিল জায়েদ কে ।জায়েদ ব্যস্ত পায়ে সামনে আগাচ্ছিল তার আগে তাকে থামিয়ে দিল আশরাফ।বলল,

-আজ সময় নেই সালেহা ।এক জায়গায় যেতে হবে। আবার আসবো তো, সেদিন চা নাস্তা খাওয়া যাবে।আজ আসি।তুমি নিজের খেয়াল রেখ ।আর কোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানিয়ো।

আশরাফের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো সালেহা। আশরাফ জায়েদের সাথে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।দুই ভাই কথা বলতে বলতে নিচে নেমে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই চোখ গেল রাস্তার অপর পাশে।নাজিফা নামছে রিকশা থেকে। সালেহার অসুস্থতার কথা শুনে তাকে দেখতে এসেছে সে। আশরাফ কে দেখেই এক প্রকার দৌড়ে এলো সে। আশরাফ কে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো। কুশলাদি বিনিময় শেষে আশরাফ অভিযোগের সূরে বলল,

-জায়েদের এখানে আসতে পারো তুমি আর দুই পা বাড়িয়ে আমার বাড়ি যেত পারো না!না কি মিয়া ভাইকে ভুলে গেছ তোমরা?সেদিন দেখলাম শাহেদ খুলনা এলো, সাজ্জাদের বাড়ি গেল, জায়েদের এখানে দুই রাত কাটালো আমার বাড়ি গেল না। আবার তুমিও আমার বাড়ি মুখো হ‌ও না। ঘটনা কি বলো তো !সবাই মিলে আমাকে এক ঘরে করার পরিকল্পনা করছো না কি?

-না না,মিয়া ভাই তেমন কিছু না।আসলে বাড়ি থেকে বের হওয়া হয় না,আজ‌ও আসা হতো না। মেয়ের কোচিংয়ে যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে তাই ভাবলাম সেজো ভাবি অসুস্থ তাকে দেখে যাই।তোমার ওখানে সময় করে যাবো একদিন।

আশরাফের কথার জবাবে তড়িঘড়ি নিজের স্বপক্ষে বলল নাফিজা। আশরাফ বোনের কথা শুনে ম্লান হাসলো।সে জানে তার বোনের তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য ঐ একদিন হয়ত কখনোই আসবে না।মায়ের মৃত্যুর পর মাকে বহন করা খাটিয়ার পিছু পিছু আশরাফের বাড়ির উঠান থেকে তার বোন-ভাইয়েরা সেই যে বের হয়েছে আর তার চৌকাঠ মাড়াই নি।এতে অবশ্য সে তাদের দোষ দিতে পারে না।সে অধিকার তার নেই।দোষ যেখানে নিজের সেখানে অন্যকে দোষ দেওয়া চলে না।কথাগুলো নিজ মনে ভেবে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আশরাফ।বোনকে নিজের বাড়ি যা‌ওয়ার কথা আরো একবার মনে করিয়ে দিয়ে অনেকটা ব্যাস্ততার সাথে স্থান ত্যাগ করলো।মা মা’রা যাওয়ার পর থেকে কেন জানি ভাই বোনেদের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না সে।নিজেকে বড্ডো ছোট্ট ছোট্ট লাগে।অপরাধী মনে হয়।মনে পড়ে সেই বিভৎস রাতটা টা।বাবা মারা যা‌ওয়ার পরে মায়ের চোখে দেখা সেই প্রথম অশ্রু,সেই অসহায় মুখ ।সবটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।মাঝে মাঝে তার মনে হয় মা হয়ত তার উপর অভিমান করেই তাদের ছেঁড়ে চলে গেছেন। কষ্ট হয় কথাটা মনে হলেই।বুক ভারী হয়ে আসে। পুরুষ মানুষকে কাঁদতে নেই ,এই অঘোষিত নিয়ম ভেঙ্গে চোখের কোণ ভিজে যায়।
আশরাফের মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় পিছনে ফিরে গিয়ে সবকিছু ঠিক করতে।এই যে সম্পর্কের দূরত্ব গুলো, এই দূরত্বের শুরুটা রুখে দিতে।পুরোনো সময়টা ফিরে পেতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না।
চলে যাওয়া সময় কি আর ফিরে পা‌ওয়া যায়!যায় না…!

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২

আদিবের যশোর এয়ার পোর্ট থেকে বের হয়ে গাড়ি ঠিক করতে করতে মাগরিবের আজান পড়লো।সে গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলো গাড়িচালক।গাড়ির ছিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলো আদিব।শরীর ক্লান্ত ছিল তাই তো একটু আরামে চোখ বুজে এলো তার। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো সেটা নিজেও টের পেল না।তার ঘুম ভাঙল পরিচিত কণ্ঠস্বরে।চোখ পিটপিট করে পাশ ফিরে জানালার বাইরে তাকাতেই লম্বাটে ভারি মুখটা দেখে ঘুম ছুটে গেল তার।মুখে ফুটে উঠল চ‌ওড়া হাঁসি।অপরপাশের ব্যক্তিটির‌ও চোখ পড়লো আদিবের সেই হাঁসি।সেও দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ভ্রূ নাচিয়ে বলল,

-ঘুম ভেঙ্গেছে ডিজনি প্রিন্স!না কি প্রিন্সেস লাগবে?

সেই পুরোনো ভঙ্গিতে নতুন রসিকতা। আদিব ডান ভ্রুতে তর্জনী বুলিয়ে দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে হাসলো। হাঁসির সময় তার ত্যাড়া বাঁকা গজ দন্তটা উঁকি দিল ঠোঁটের ফাঁকে। দারুণ দেখালো ছেলেটাকে।আদিবের সেই দারুণ ভঙ্গির হাসি দেখে সজীব নিজের বুকের পাশে হাত রেখে নাটকীয় ভাবে বলল,

-ইশশশশ…খন্দকার সাহেব, জান নিবেন না কি!এত সুন্দর করে কেউ হাসে বুঝি!

সজীবের কথা শেষ না হতেই শব্দ করে হেঁসে উঠলো আদিব।গাড়ি থেকে বের হয়ে দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো পুরোনো বন্ধু কে। সজীব‌ও দৃঢ় আলিঙ্গনে আগলে নিল তাকে।একে অপরকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই আদিব বলল,

-গুড টু সি ইউ ম্যান।আমি কল্পনাও করতে পারিনি দেশে ফিরেই তোর সাথে দেখা হবে।আমি খুব খুশি হয়েছি তোকে দেখে। খুব খুশি।কিন্তু তুই এখানে! মানে কীভাবে…?

সজীবকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো আদিব। তার দেশে ফেরার কথা তার পরিবার ছাড়া কারো জানার কথা না।আর সজীবের তো প্রশ্নই ওঠে না!

-খূলনার দিকে যাচ্ছিলাম,মাঝপথে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল।এই ভর সন্ধ্যা বেলায় হাইওয়েতে গাড়ি ঘোড়া কিছু পাচ্ছিলাম না বাধ্য হয়ে তোর এই গাড়ির সামনে জীবন বাজি রেখে দাঁড়াতে হলো।তোর ড্রাইভার সঠিক সময়ে ব্রেক না মারলে আজ আমার ভবলীলা সাঙ্গ হতো। ধন্যবাদ মামা সঠিক সময়ে ব্রেক কষার জন্য।
একদমে কথা বলে থামলো সজীব।শেষের কথাটা ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল। ড্রাইভার তার কথা শুনে মুখ কুঁচকালো।নিজের আঞ্চলিক ভাষায় থড়বড়িয়ে বলল,

-ওরকম পাগলামো করে কেউ! যদি আমি ঠিক সময় গাড়ি না থামাতাম, তাহলে কি হতো! গাড়ির চাকা আপনার উপরে উঠে যেত, আমাকে জেল খাটতে হত!

-আরে মামা এতো নাক মুখ শিটকাচ্ছেন কেন, ওঠেনি তো গাড়ির চাকা আমার উপর।সামলে নিছেন তো আপনি। সো জাস্ট চিল।

সজীবের কথা শুনে বিরক্তিতে ঠোঁট বেকালো গাড়ি চালক ।তারপর গাড়ি থেকে নেমে বিড়বিড় করতে করতে রাস্তার পাশে ঝোপের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। সজীব তা দেখে ঠোঁট চেপে হেঁসে বলল,

-বুঝেছিস ,গাড়ির ব্রেক কষতে গিয়ে, মামার ব্রেক ঢিলা হয়ে গেছে।

সজীবের কথা শুনে দাঁত বের করে শব্দহীন হাঁসি হাসলো আদিব।হাসতে হাসতেই বলল,

-আমি ভেবেছিলাম এত বছরে হয়ত সজীব ওয়াহিদ বদলে গেছে ।বাট স্যরি আই ওয়াজড রং।সে একটুও বদলায়নি।

স্বগোতক্তি করলো আদিব। সজীব আদিবের কথা শুনে নিজেকে ভালোভাবে পরখ করে বলল,
-কৈ! বদলেছি তো!ভালো করে দেখ। স্বাস্থ্য শরীর আগের থেকে উন্নত লাগছে না?

-আমি বাইরের পরিবর্তনের কথা বলছি না। বলছি ভেতরের পরিবর্তনের কথা।থাক তুই বুঝবি না।তুই তোর ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে আই র‌ওনা দিই।বাকি কথা যেতে যেতে হবে।

-ব্যাগ ব্যাগেজ!ওরে আল্লাহ! দাঁড়া আসছি।

আদিবের কথা শুনে হঠাৎ সজীবের কি যেন মনে পড়ছে এমন ভাবে ছুটলো গাড়ির দিকে।গাড়ির দরজা খুলতেই ব্যাকসিটে ছোট্ট তুলিকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। ঝুঁকে আলতো হাতে মেয়েকে কোলে নিয়ে ড্রাইভারকে বলল তার লাগেজ আদিবের গাড়িতে উঠিয়ে দিতে।তারপর মেয়েকে আদিবের সামনে নিয়ে গিয়ে অনেকটা ফিসফিস করে বলল,

-আমার মেয়ে,তুলি।

-তুই বিয়ে করলি ক

-আস্তে !আস্তে কথা বল।উঠে পড়বে তো।উঠলেই মায়ের জন্য প্যানপ্যান করবে।

আদিবের কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলল সজীব।কথাটা বলতে যেয়ে চোখ মুখে খেলে গেল তার অসহায়ত্ব।আদিব সেটা দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো।সজীব তা দেখে চোখ সরু করলো।মানে হাসছিস কেন?আদিব সাথে সাথে নিজেকে সংযত করলো।
তুলির ঘুম ভীষণ পাতলা একটু শব্দ কানে গেলেই ঘুম ছুটে যায় তার।এখন যদি এই মাঝ রাস্তায় মেয়ের ঘুম ভেঙ্গে যায় তাহলে ব্যাপারটা সজীবের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না।তাই এতো সাবধানতা।এতে এত হাসির কি আছে!

-বিয়ে করেছিস কবে?

সজীবের মতো ফিসফিসিয়ে বলল আদিব। সজীব গাড়ির দিকে আগাতে আগাতে বলল,

-ভেতরে চল বলছি।

গাড়িতে উঠে বসলো তারা। সজীব মেয়েকে একটা পাতলা চাদর দিয়ে মুড়ে নিজের সাথে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বসলো।সজীবের গাড়ি লক করে তার ড্রাইভার কেও সাথে নিলো।সামনে ********বড় বাজার পড়বে সেখান থেকে মেকানিক নিয়ে এসে গাড়ি ঠিক করে বাড়ি নিয়ে যাবে সে।গাড়ি চলমান হতেই আদিব তার করা প্রশ্নটা পুনরাবৃত্তি করলো।সজীব মেয়েকে নিজের সাথে আর একটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

-সামনের ডিসেম্বরে বিয়ের বয়স পাঁচ বছর পড়বে।

-ভালো, তা ব‌উর নাম কি?

-শিপ্রা।

-কি! শিপ্রা!আমাদের শিপ্রা?
বিস্মিত কণ্ঠে আদিবের প্রশ্ন। উত্তরে সজীব মাথা ঝাঁকালো।সজীবের উত্তরে অবাকতা ছেয়ে গেল আদিবের চোখে মুখে।আদিব যতদূর জানতো শিপ্রা আর সজীব একে অপর কে দুই চোখে সহ্য করতে পারতো না।এমন কোন দিন যেত না, যেদিন দুজনের মধ্যে চুল ছেড়াছিড়ি ঝগড়া হতনা!তারা দুজন নাকি পাঁচ বছর ধরে একসাথে আছে।আবার একটা কন্যা সন্তানের মা-বাপ‌ও হয়েছে!এমন কথা শুনে অবাক হ‌ওয়াই তো স্বাভাবিক।আদিবের রিয়াকশন এমন হবে সেটা জানা ছিল সজীবের। সে আদিবের অবকতা নজর আন্দাজ করে বলল,

-অত অবাক হয়েও না মামা।তুমি তো আমাকে একা ফেলে লন্ডন উড়াল দিলে।আমি কলেজে এতিমের মতো ঘুরতে লাগলাম। শিপ্রা চুন্নির আমাকে দেখে মায়া হলো।চোখ মুখ কুঁচকে আমার পাশে এসে বসলো,ফেরার পথে পায়ে পা মিলালো।ব্যাস শুরু হলো একসাথে ওঠা-বসা, হাঁটা -চলা,পড়া-শোনা। দিন অতিবাহিত হলো।আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলাম মেয়েটা অতোটাও খারাপ না।বছর গড়াতেই দুইজনের বন্ধুত্ব গভীর হলো।সেই বন্ধুত্ব কখন কখন ভালোবাসার রূপ নিলো জানা নেই আমার।যাই হোক ভালো তো বাসলাম, কিন্তু বলার সাহস হলো না।যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া শয়তান ছেমড়ি তখনো আমাকে দেখে নাক কুচকাতো সুতরাং যেচে পড়ে অপমানিত হ‌ওয়ার ঝুঁকি নিলাম না।এভাবে সময় গড়ালো।দেখতে দেখতে এমবিবিএস শেষ হলো দুইজনের। বিসিএস দিলাম। কপাল ভালো ছিল আমার, তাই প্রথমবারেই টপকে গেলাম বিসিএসের গণ্ডি।এরপর এ ট্রেনিং, ও ট্রেনিং শেষ করে ঝিনাইদহের এক ভুঁড়ো গ্রামে সরকারি হাসপাতালে ডিউটি শুরু হলো আমার। সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি করে বাড়ি ফিরলেই ঘুমে চোখ বুজে আসতো।এই নতুন ব্যস্ততায় শিপ্রার কথা মনে থাকলেও যোগাযোগ করা হয়ে উঠতো না।এমন করে মাস ছয়েক অতিক্রম হ‌ওয়ার পর হঠাৎ একদিন ম্যাডাম আমার হাসপাতালে হাজির।আমাকে দেখেই ভালো-মন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করেই কালিবাজির মতো পটপট করে ফুটতে লাগলো।জানিস তো রেগে গেলে কেমন মুখ দিয়ে খ‌ই ফুটায়!নিজের সব রাগ অভিমান শেষ হ‌ওয়ার পর ফ্যা-ফ্যা করে কাঁদতে লাগলো।কেন কাঁদছে আমি জানি না সান্ত্বনা দেব কি বলে,ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার ভাবনার মধ্যে আর তার কান্নার মধ্যেই বিশ্রী শব্দ করে নাক টেনে বলল,”মা বিয়ে ঠিক করেছে,আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি।”
বিশ্বাস কর এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলবো কিচ্ছু বুঝে পেলাম না। সৌজন্য রক্ষার্থে বললাম,”ও”।এই “ও” বলায় আমার কাল হলো।কালনাগিনীর মতো ফুঁসে উঠে ছোবল মারতে উদ্যত হলো।আমি তো ভয়ে একদম চুপসে গেলাম।বুঝতে পারলাম আমার “ও” বলতে অসন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি।নিজের ভুল বুঝতে পেরে সাথে সাথে মুখে কুলুপ আঁটলাম।এরপর কতসময় নিয়ে তিনি ফোঁস ফোঁস করলো আমার জানা নেই।শান্ত হ‌ওয়ার পর বলল,”কাজী অফিসে চল তোকে বিয়ে করবো।” কথাটা শুনে মন জুড়িয়ে গেলরে।এরপর একটা শব্দও ব্যয় না করে সোজা কাজী অফিসে হাজির হলাম।বিয়ে সম্পন্ন হতেই শিপ্রা ওর বাপকে ফোন লাগালো।ওর বাপ ফোন ধরে বলল,”বিয়ে করেছিস ভালো কথা, এবার মন দিয়ে সংসার কর।খবরদার ভুলেও বরের সাথে মারামারি করে এ বাড়ি আসিস না ।তাহলে কিন্তু প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে যাবে।তোর মাকে তো চিনিস!”বাপের কথা শুনে উনি ফোন রাখলেন।আমরা গিয়ে উঠলাম আমার ছোট্ট ভাড়া বাসায়।এরপর আর কি সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগলাম।একবছর পরে এই ছানাটা হলো।এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তবে শাশুড়ি এখনো কেমন আড় চোখে তাকায়। আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের এই একটা সমস্যা।

-শাশুড়িকে দামি দামি মিষ্টি খাওয়ান, দেখবেন শাশুড়ি আর আড় চোখে তাকাবে না।

সজীবের কথা শেষ হতেই গাড়ি চালক তাদের কথার মাঝে ফোড়ন কাটল। সজীব তার উত্তরে বলল,

-আরে মামা সে কথা বলতে,গত পাঁচ বছরে ঢাকা শহরের সব নামিদামি দোকানের মিষ্টি তার পেটে ফেলেছি কিন্তু তার সেই আড় চোখ সোজা হয়নি।

-কি বলেন মামা!তাই নাকি?তাহলে তো আপনার শাশুড়ি খুব কঠিন মনের!

-কঠিন মানে, সেই কঠিন! একদম ইস্পাতের মতো!

কথাটা বলে হাসলো সজীব।তার হাঁসিতে উপস্থিত সবার ঠোঁটের কোণেও দেখা দিল মৃদু হাঁসির রেখা।সজীব হাসতে হাসতে গাড়ি চালকের উদ্দেশ্যে ফের বলল,

-মামা কি নোয়াখালীর না কি?

-জ্বি মামা।

-আমি কথা শুনেই বুঝছি…।মামার রাগ কমেছে?

-রাগ কমেছে তবে আপনি তখন কাজটা একদম ঠিক করেননি।উপর নিচে কিছু যদি একটা হয়ে যেত!

-স্যরি মামা।আসলে ভর সন্ধ্যা বেলা এমন জায়গায় গাড়িটা খারাপ হলো!মেয়ে রয়েছে সাথে এদিকে আশেপাশে কোন বাড়ি ঘর নেই তারপর লিফট চাইলে কোন গাড়িও দাঁড়াচ্ছে না। বাধ্য হয়ে একটু ডেয়ারিং দেখাতে হলো।

-বুঝেছি।তবে এমন আর করবেন না।আর কেউ আমার মতো ব্রেক না‌ও কষতে পারে।

-জ্বি মামা মনে রাখবো।

কথাটা বলে প্রশস্ত হাসলো সজীব।সে আসলে নিরুপায় হয়ে তখন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল।গাড়ি নষ্ট হ‌ওয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টা দেড়িয়ে ছিল তারা সেখানে। ড্রাইভার তার সাধ্য মতো চেষ্টা করছে গাড়ি ঠিক করতে কিন্তু পারেনি।এদিকে সন্ধ্যায় ঘনিয়ে আসছে।আসে পাশে কোন বাড়ি ঘর‌ও নেই যে সাহায্য নেবে। মেয়েটা এদিকে কাঁদছে। অক্টোবর মাস চলছে। শীত না পড়লেও বাইরে ভালোই ঠান্ডা। বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে মেয়েটার শরীর খারাপ করবে।এমনিতে মেয়েটার অল্পতে শরীর খারাপ হ‌ওয়ার ধ্যাত।এই হাইওয়েতে লিফটের উদ্দেশ্যে হাত দেখালেও কোনো গাড়ি থামছে না। উপায়ান্তর না পেয়ে বাধ্য হয়ে সামনে ধেয়ে আসা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে।কপাল ভালো ছিল গাড়ির ড্রাইভার তার থেকে কিছুদূরে গাড়ির ব্রেক করলো। হ্যাঁ দুই চারটে আঞ্চলিক ভাষায় গালিগালাজ করলো তাকে কিন্তু সেসব শোনার সময় কোথায়! সে ছুটলো সাহায্যের জন্য।গাড়ির কাছে গিয়ে ড্রাইভার কে কিছু বলতেই যাবে তখন চোখ গেল পিছনের ছিটে।খুব পরিচিত একটা মুখের পরিবর্তিত রূপ চোখে পড়লো তার। তৎক্ষণাৎ নিজের চোখকে বিশ্বাস না করতে পারলেও পরে বুঝলো সে ঠিক দেখছে।এটা তার পুরোনো বন্ধু আদিব।সাথে সাথে ডাক লাগালো আদিব কে।গাড়ি চালক এই সময়টুকুতে কত কথা যে বলল তাকে কিন্তু সেসব কানে তুলল না সজীব।

-আমার তখনকার কথা গুলো মনে নিয়েন না ভাই আসলে রাগের মাথায় তখন কি না কি বলেছি।

অনেকটা ইতস্তত করে বলল গাড়ি চালক।নিজের রাগের মাথায় করা ব্যবহারের জন্য লজ্জিত সে।সজীব বুঝলো তার মনোভাব।সে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।বলল,

-আপনি তো তাও গালির উপর দিয়ে গেছেন। আপনার জায়গায় আমি হলে মাইর লাগাতাম।আমি বুঝেছি আপনার সিচুয়েশন,কিছু মনে করিনি।

গাড়ি চালক ইনার রিয়ার ভিউ মিরারে সজীবের হাস্যোজ্জ্বল মুখটার দিকে অবাক চোখে তাকালো।সজীবের বেশ-ভূষা, কথা-বার্তায় স্পষ্ট সে একবারে সাধারণ কেউ নয়।বেশ বড়সড় মাপের কেউ। সাধারণত এমন ধরনের মানুষকে একটু কড়া গলায় সর বললেও তারা তেড়ে মারতে আসে।অথচ এই লোক তার সাথে আন্তরিক গলায় কথা বলছে, আবার নিজের দোষ‌ও মানছে!গাড়ি চালক নিশ্চিত এই লোকের জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তাহলে নিজের দোষ মানা তো দূরের কথা, উলটো তার তখনকার ব্যবহারের জন্য তাকে দুই চার ঘা লাগিয়ে দিত। কিন্তু এই মানুষ টা তার দিক বোঝার দাবি করছে।নিজের ভুল গুনছে!

আদিব আর সজীব কথা বলছিল তার মাঝেই সজীবের ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।সে ফোন হাতে নিয়ে তার ড্রাইভার মতিন কে দেখিয়ে বলল,

-দেখো মতিন এখন দরকার নেই অথচ নেটওয়ার্ক এখন টঙে।চারকাঠি একদম জ্বলজ্বল করছে।আবার সিম কোম্পানির ফোন‌ও আসছে। কিন্তু যখন দরকার ছিল তখন পাওয়া যাচ্ছিল না।এদের সিম ফেলে দেব আমি। মতিন তুমিও ফেলে দেবে।বিপদে পড়লে যাদের নেটওয়ার্ক আগে পালায়, তাদের সিম রাখবো না।

-জ্বি স্যার।

সজীবের কথায় সম্মতি জানালো মতিন। সজীবের সাথে তাল মিলিয়ে সিম অপরেটারদের উদ্দেশ্যে সেও কিছু কটু বাক্য ব্যবহার করলো।মতিন আর সজীব মন মতো সিম অপরেটারদের কথা শুনিয়ে খ্যান্ত হলে আদিব বলল,

-ভালোই হয়েছে তখন কোন সাহায্য পাস নি। না হলে আমার সাথে কি তোর দেখা হত!আমার দাদি প্রায় একটা কথা বলতো ,”আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন!”

আদিবের সাথে সাথে সমস্বরে কথাটা বলে উঠলো সজীব।আদিব চকিত কণ্ঠে বলল,

-মনে আছে তোর?

-হ্যাঁ ,আছে।

ম্লান হাসলো সজীব।জাহানারা বেগম কে অনেক কাছ থেকে দেখার, জানার সৌভাগ্য হয়েছিল সজীবের।সেই সুবাদে অনেক সময় কাটিয়েছে সে তার সাথে।আজ হঠাৎ আদিবের মুখ থেকে মানুষ টার বলা কথা শুনে অনেকগুলো পুরোনো স্মৃতি হুড়মুড় করে মানসপটে ভেসে উঠলো।সাথে সাথে মনটা কেমন মিইয়ে গেল।তবে সেটা আদিবকে বুঝতে না দিয়ে প্রসঙ্গ বদলালো সে।বলল,

-তুই হঠাৎ দেশে ফিরলি যে! লন্ডন থেকে লাথি মেরে বের করে দিয়েছে না কি?

-অনেকদিন পর লম্বা একটা ছুটি পেলাম, তাই ভাবলাম তুই বেঁচে আছিস কি না দেখে আসি।

-হা…!ওসব বয়ান বাদ দাও চাদু!আমি মরে গেলেও যে তুমি আসতে না, সে আমার ভালো করে জানা আছে। লন্ডন যা‌ওয়ার আগে আমাকে বলে পর্যন্ত যাওনি।কি মনে করেছ সব ভুলে গেছি!না। কিচ্ছু ভুলিনি। নেহাত গাড়িটা নষ্ট হলো তাই দায় ঠেকে পিরিত দেখালাম ,না হলে কথা‌ও বলতাম না তোমার সাথে! হুঁ!

-ওরে শালা ! তোর মনে মনে তাহলে এই ছিল!আর আমি ভাবলাম তুই পুরোনো কথা ভুলে গেছিস!

– শালা না, সম্পর্কে মামা হ‌ই।তোর কপাল ভালো থাকলে মামা শ্বশুর হতা

নিজের কথা শেষ না করেই থেমে গেল সজীব।আদিবের মুখের পাল্টে যাওয়া রং দেখে বুঝতে পারলো মুখ ফসকে যে কথাটা বলতে যাচ্ছিল সেটা বলা উচিত হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে অযথা গলা ঝাড়া দিল।কথা ঘুরিয়ে বলল,

-কত দিনের জন্য এসেছিস দেশে?

-তিন মাস।

-তারপর আবার ফেরত যাবি?

-হুম।

-এবার কী মিয়া ভাই আর ভাবিকে নিয়ে যাবি সাথে?

-আমি থাকতে থাকতে যদি তাদের ভিসার কাজটা হয়ে যায় তাহলে নিয়ে যাবো। আমার কথা বাদ দে তোদের খবর বল।তোর বাড়ির সবাই কেমন আছে?
একটু থামলো আদিব তারপর একটু ইতস্তত করে বলল,
-সেজো চাচারা কেমন আছে?
এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আদিবের কেমন জানি লজ্জা করছিল।নিজের আপন চাচার খবর তাকে অন্য কারো কাছ থেকে শুনতে হচ্ছে ব্যাপারটা একটু লজ্জা জনক।তবে লজ্জার হলেও কথাটা সত্যি যে সে নিজের ফুপু চাচাদের কোন খবর জানে না।বিগত এগারো বছরে তাদের সাথে তার সেভাবে যোগাযোগ হয় না।
বিদেশ যাওয়ার পর প্রথম প্রথম ছোট্ট চাচু আর ফুপুর সাথে যোগাযোগ রেখেছিল আদিব কিন্তু তানিয়া জানার পর অশান্তি শুরু করলো। বিভিন্ন কথা বার্তা বলতে লাগলো। যার জন্য অনেকটা বাধ্য হয়ে সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হলো আদিবের। এরপর নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে এতোটাই ব্যস্ত হলো যে সম্পর্ক গুলো সব পিছনে ছুটে গেল।একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আদিব।

-বড় বু’র শরীর ভালো না। তাছাড়া সবাই ভালোই আছে।

-কি হয়েছে সেজ চাচির?
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো আদিব। সজীব একটা দীর্ঘশ্বাস শ্বাস ফেলে বলল,

-বছর সাতেক হলো শ্বাস কষ্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিছুদিন হলো সেটা বেড়েছে।

সজীবের কথার মাঝেই গাড়িতে ব্রেক কষলো ড্রাইভার। স্থানীয় বড় বাজারে থামিয়েছে সে গাড়ি। মতিন গাড়ি থেকে নেমে গেল।সজীব তাকে কিছু টাকা দিয়ে কি কি করতে হবে সেই দিকনির্দেশনা দিয়ে গাড়ি ছাড়তে বলল।গাড়ি আবার চলমান হলো।বাকি পথটুকু আর তেমন কোথা জমলো না দুইজনের।তুলির ঘুম ভাঙল। সজীব তাকে নিয়ে ব্যস্ত হলো আদিব‌ও নিজের ফোনে মনোযোগ দিল।
গাড়ি যখন আদিবের বাড়ির সামনে এসে থামলো রাত তখন প্রায় নয়টা।আদিব আর সজীব গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই লক্ষ্য করলো তাদের বাড়ির সামনে থেকে শুরু করে তার মেজ চাচা সাজ্জাদের বাড়ি পর্যন্ত বিভিন্ন মানুষের ছড়াছড়ি।যার মধ্যে কেউ পরিচিত তো কেউ অপরিচিত।বাড়ির সামনে এমন অবস্থা দেখে আদিবের কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ পড়লেও সজীবের ভেতরটা কেমন যেন কু ডেকে উঠলো। সে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল সামনে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

মায়ের কথা পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

#মায়ের_কথা
পর্বঃ ৬(শেষ পর্ব)
#সাবাব_খান

‘তোমার কি এমন স্বপ্ন আম্মা?’

আম্মা করুন কণ্ঠে বললেন, ‘এইটা আমার অনেক দিনের একটা স্বপ্নের কথা বাপ!’

‘কি কথা আম্মা?’
আম্মা ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি অবাক হলাম। ধ’মকের সুরে বললাম, ‘তুমি কি বলবা কিছু?’
আম্মা কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘শোন বাপ, তোর বাপের মাথা নষ্ট হওয়ার পর আমি অনেক মাইনষেরে অনুরোধ করছি। তোর চাচাগুলারে তোর মামাগুলারেও অনুরোধ করছি। তোর খালু,ফুফা কেউরে বাদ রাখি নাই। একটাই অনুরোধ করছিলাম। কইছিলাম আমার সোনা-গয়না যা আছে সব বেইচ্চা টাকা দিমু। খালি তোর বাপেরে একটু বিদেশে নিয়া চিকিৎসা করাইতে। ইন্ডিয়া নিয়াও যদি চিকিৎসা করাইতে পারতাম আমার মনে হয় কিছুটা ভালো হইতো। কিন্তু সাবাব, কেউ আমার অনুরোধ শোনে নাই। সময় কইরা কেউ তোর বাপেরে চিকিৎসা করতে নিয়া যায় নাই। সবাই নিজেরে নিয়া ব্যস্ত। কে নিয়া যাইবো তোর অসুস্থ বাপেরে চিকিৎসা করতে? তোর বাপের ভাই-বোন কেউই আগায়া আসে নাই আমার অনুরোধে। আমি কেউরে দিয়া ইট্টু মনের মত চিকিৎসা করাইতে পারি নাই। আমি মহিলা মানুষ। তিনডা বাচ্চা নিয়া নিজেও দৌড়াদৌড়ি করতে পারি নাই। আমার মনের একটাই স্বপ্ন তোর বাপেরে বিদেশ নিয়া যদি ইট্টু চিকিৎসা দিতে পারতাম। স্বপ্নটা কেউ পূরণ করতে আগায়া আসে নাই। আমি স্বামী নিয়া বিপদে পড়ছি। সবাই আমারে অনেক কতা কয়। কিন্তু আমার কামডা কেউ কইরা দেয় না। তুই আমার একমাত্র পোলা। তোর বাপ অসুস্থ। আমি তোরে কোনদিন ঐ দূরের দেশে পাঠাইতাম না। আমি তোরে একটা আশায় পাঠাইছি। আমার আশা তুই তোর বাপেরে এমেরিকা নিয়া চিকিৎসা করাবি। কত উন্নত দেশ এমেরিকা! কত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। আমার মনডায় কয় এমেরিকা নিয়া চিকিৎসা করাইলে তোর বাপে সুস্থ অইতো। শুধু এই কারণেই আমি তোর বউ কইরা আমার ভাইঝিরে আনতে চাইছিলাম। বাইরের মাইয়া আনতে চাই নাই। আমি ভাবছিলাম আমার ভাইঝিডা অনেক ভালো অইবো। তোর বউ হইলেও আমার স্বপ্নে বাধা দিব না। কিন্তু না, আমার ধারণা ভুল। অরা অনেক স্বা’র্থপর। অগো চাপ্টার বাদ। তোর কাছে এহন আমার একটাই অনুরোধ ; তুই বিয়া করার আগে তোর বাপেরে ইট্টু এমেরিকা নিয়া চিকিৎসা করাইস। তোর বাপের সুস্থ হওয়ার স্বপ্নডা পূরণ করিস বাবা। আমার স্বামী থাকতেও আমি অসহায়। যে স্বামীরে নিয়া বিপদে পড়ে সে বোঝে জীবনডা কতো কষ্টের। আপন বলতে তার কেউ থাকে না। আমার তুইই আপন। তুই আমার কথাডা শুনিস বাপ।’

আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। আম্মার কথার মাঝে হাহাকার ছিলো। ছিলো জীবনের প্রতি। আমার প্রতি অনুরোধ আর দায়বদ্ধতা। আমি কি জবাব দেবো? খানিক ভেবে আমি আম্মাকে বললাম, ‘আমি তো মাত্র আসছি এমেরিকায়! এখনই আব্বারে আনতে পারমু কিনা জানিনা! তবে আমি চেষ্টা করমু।’

আমি ফোন রেখে দিলাম। আব্বাকে নিয়ে আম্মার মনের কথা শুনে ভীষণ অবাক লাগলো। এতোটা হাহাকার যে আম্মার মনে, আমি নিজেও জানতাম না। আমি দুদিনের মধ্যেই আসিফ ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। দেশ থেকে সুস্থ মানুষকে এমেরিকায় আনাই অনেক কষ্টকর। সেখানে আব্বার মত একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষকে আনাটা একদম দুসাধ্য,কষ্টসাধ্য।

অনেকের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না। নিজেরও কষ্ট লাগলো আম্মার কথা শুনতে পারবো না বলে। অবশেষে একজন আইনজীবী আমাকে বিনোদন মিডিয়ার লোকদের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেন। মিডিয়ার লোকেরা খুব সহজেই ইউরোপ-এমেরিকায় আসতে পারে।

আমি অনেক কষ্টে মিডিয়ার কয়েকজন লোকের সাথে পরিচিত হলাম। তারপর এক পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করলাম। আব্বাকে অভিনেতা প্রমাণ করার জন্য তিনি আমাকে কিছু পরামর্শ দিলেন। আমি এফডিসিতে যোগাযোগ করে পরামর্শ অনুযায়ী আব্বার জন্য কিছু কাগজ তৈরি করলাম। আব্বাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত অভিনেতা সাজালাম। তারপরে বিনোদন মিডিয়ার টিমের সাথে নিয়ে এলাম এমেরিকায়। সেদিন আম্মার সাথে কথা বলার ছয় মাসের মধ্যেই আব্বাকে এমেরিকায় নিয়ে আসি। এখানেও টেনশন ছিল। আব্বাকে চিকিৎসার জন্য হসপিটালে রাখতে হবে। দেশে তো আশেপাশে সব একই রকমের লোকজন ছিলো। আর এখানে তো সব সাদা-কালো লোকজন। কেউ কেউ খুব ফর্সা আবার কেউ কেউ খুব কালো। আব্বা এদের মাঝে হাসপাতালে থাকতে গিয়ে আরো ভয় পেয়ে যায় কিনা। এসব চিন্তা ছিল আমার মনে। আমি অনেক ভয় নিয়েই আব্বাকে হাসপাতালে দিলাম ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে। ভিজিটিংয়ের দিন গিয়ে দেখে আসতাম। বুকে পাথরের মত ভয় ছিল। না জানি আব্বার আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যায়! এখানকার পরিবেশে লোকজন আব্বার সম্পূর্ণ অচেনা। একটা অসুস্থ মানুষ অচেনা পরিবেশে আরো অসুস্থ হয়ে যায়। এদের ভাষাও আলাদা। তবে একটা জিনিস সাপোর্ট ছিল। আমার আব্বা তো লেখাপড়া ছিলেন। ইংরেজিতে কথা বললে আব্বা খুব খুশি হয়ে যেতেন। তাকে শিক্ষিত মনে করে কিছু উত্তর দিতে পারতেন। সেটা যেরকমই হোক। আগে থেকেই তো এলোমেলো,অসংলগ্ন কথা বলতেন। এখানেও উত্তরে অসংলগ্ন কথাই বলতেন। তবে ইংরেজিতেই সব বলতেন। মাসখানেক যেতেই আব্বার মাঝে একটু পরিবর্তন আসে। পরিবর্তনটা পজিটিভ ছিল না। ছিলো নেগেটিভ পরিবর্তন। আব্বা বেশি পা’গলামো করতে শুরু করে। থাকতেই চাচ্ছিলো না হাসপাতালে। সেখানকার পরিবেশ,মানুষজন কিছুই পছন্দ হয়নি আব্বার।

আমি অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে আসতাম। অসুস্থ মানুষ কি আর এত বোঝে। নতুন এবং অচেনা পরিবেশের কারণেই মূলত সমস্যা হয়েছে। এভাবে একমাস কে’টে যায়। আব্বাও সেট হয়ে যায় হসপিটালে। শুধু সেট হয়ে যায় নি। অন্যান্য অসুস্থ লোকদের সাথে খেলাধুলাও করতেন, আড্ডাও দিতেন। কিছু কথাবার্তাশও ঠিক ঠিক জবাব দিতে পারতেন। এভাবে কে’টে যায় তিন মাস। এবার আব্বা জামা-কাপড় সব নিজে পড়তে পারতেন। হসপিটাল থেকে এসবই জানিয়েছিল আমায়। আমি নিজেও খেয়াল করেছি আবার চেহারায় এবং সবকিছুতে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ছাপ এসেছে। একটা পরিবর্তন চলে এসেছে। সেই তিন মাস পরেই এক সাক্ষাতে আব্বা আমার কাছে বললেন, ‘আমি কিন্তু সুস্থ হইতাছি বাবু! তোর মা’র কাছে এইডা কইস না। ওর কাছে বলবি আমি পা’গলই আছি। আমরা একসাথে সারপ্রাইজ দিমু তোর মায়রে।’

আমি বুঝতে পারলাম আব্বা আসলেই সুস্থ হচ্ছেন। কারণ আম্মার সাথে দুষ্টুমি করার ব্যাপারটাও আব্বার মাথায় আছে। এভাবে কে’টে যায় পুটো ছয় মাস। আব্বা পুরো সুস্থ এখন। ডাক্তার বলেছিলেন উনি অ্যা’ক্সিডেন্ট করার পরপরই যদি সুচিকিৎসা দেয়া হতো তাহলে এত সময় লাগতো না।

সুস্থ হবার পরে আমি আব্বাকে বাসায় নিয়ে এলাম। আব্বা বাসায় থাকতে চাচ্ছিলেন না। টুকিটাকি কাজ শুরু করেছিলেন। তবে একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে আব্বা আম্মার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতেন না। আব্বার গেটআপ পুরো চেঞ্জ হয়ে গেছিল। আম্মা দেখলেই বুঝতে পারতো যে আব্বা সুস্থ। আব্বা ফোনে কথা বলতেন আম্মার সাথে। কিন্তু পুরোপুরি পা’গল সেজে। আব্বা আমাকেও বলতে দেয়নি আম্মাকে। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। আমিও আব্বা-আম্মার দুষ্টুমির মাঝখানে বাধা হতে চাইনি।

আরো দু’মাস পরের কথা। আম্মা জানে আব্বা সুস্থ হয়নি। তারপরেও আমি এমেরিকায় এনে চিকিৎসা করেছি। এতেই আম্মা অনেক সন্তুষ্ট। কোনো আফসোস নেই আম্মার। দেশে আমার বিয়ে ঠিক করেছি। আমার সেই গার্লফ্রেন্ডের সাথেই। আজ আমরা বাপ-ছেলে বাড়ি এসেছি। বাড়ির সামনে এসে আমাদের গারি থামলো। আম্মা কিন্তু জানেনা যে আব্বা সুস্থ। বাড়ি কেউই জানে না। আগেই জানে আমি বাড়ি আসব। ঢাকা থেকে ভাড়াকৃত গাড়ি নিয়ে এসেছি। গাড়ির শব্দ পেয়ে আম্মাসহ আমার বোনেরা দৌড়ে এসেছে। আমি প্রথমে নামলাম গাড়ি থেকে। এরপরে স্যুটবুট পরিহিত কমপ্লিট মডার্ন ভদ্রলোকের ন্যায় আব্বা নামলেন। আম্মার চোখের দৃষ্টি বরফের ন্যায় স্থির হয়ে গেছে। আম্মা ভাবছে এ আমি কাকে দেখছি। আব্বার সেই পা’গলাটে চেহারাটা আর নেই। পরনের কাপড়গুলোও এলোমেলো নয়। হাঁটাচলায়ও কোনো অসংলগ্নতা নেই। কমপ্লিট একজন ভদ্রলোক তার স্বামী। আম্মার চোখের পলক সরছে না। কদমও চলছে না তার। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আব্বাই এগিয়ে গিয়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাদের সবার মাঝেই। আম্মা কান্না শুরু করে দিয়েছেন। আমি জোরগলায় বললাম, ‘ঘরে গিয়ে তোমরা কান্নাকাটি করো তো! বাইরে পাবিলিকলি কিছু কইরো না!’

কয়েকদিন পরের ঘটনা। আজ আমি বিয়ে করেছি। বউ নিয়ে আছি বাসর ঘরে। নিজের নতুন জীবনের কথা আর কি বলবো! আব্বা-আম্মার নতুন জীবন দেখেই কূল তো পাইনা। একদম নব বিবাহিত দম্পতির ন্যায় আচরণ করছে তারা। আব্বা বারবার রান্নাঘরে গিয়ে খোঁজ নেয় আম্মা হাঁপিয়ে উঠেছে কিনা। আজ সন্ধ্যায় দেখলাম আম্মাকে স্যালাইন বানিয়ে খাওয়াচ্ছে। ঈদের সুখে আছে তারা দুজন। আমারও সুখ লেগেছে তাদের সুখে। বাসর ঘরে বসে আমার বউকে বললাম, ‘তোমার জন্য আমি রাফারে এক গোল দিয়া সরাইয়া দিছি!’
বউ জবাব দিলো, ‘তুমি নিজেই তো ঠকছো! এক গোল দেয়া লোক আমি চাইনা!’

‘মানে?’

‘আমি চাই আমার জামাই হ্যাট্রিক করুক।
এরকম ব’দমাইশগুলার সবগুলারপ সরায়া দেউক!’

‘আমি কিন্তু হ্যাট্রিকই করেছি। মামার গুষ্ঠী, দাদার গুষ্ঠী দুইটারেই শিক্ষা দিছি। আবার আমার আব্বার চিকিৎসাও করছি। এখন আর আমার কোনো টেনশন নাই। বউ নিয়া সুখের সংসার করমু।’
‘বউরে আগে এমেরিকা নেয়ার ব্যবস্থা করো। নয়তো এমেরিকা বইসা বাংলাদেশে সংসার করা লাগবো।’
‘আরে দুনিয়ার যেই জায়গায়ই যাই বউরে বুকে কইরা নিয়া যাইমু।
‘দেখা যাবে!’
……

দুই বছর পরের কথা। আমার বউকে এমেরিকায় নিয়ে এসেছি। আব্বা-আম্মা দেশে ভালো আছেন। আমার বোন বড়টার বিয়ে হয়েছে ব্যাংকারের সাথে। বোনও চাকরির ট্রাই করছে। নানার গুষ্ঠি, দাদার গুষ্ঠি এখন আর আমাদের সাথে ঝা’মেলা করতে আসে না। আব্বা একাই সবাইকে ফেস করতে পারেন। আম্মাও তার ভাইদেরকে কোন প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। আমার মায়ের গোপন স্বপ্ন ছিলো,গোপন কথা ছিল নিজের স্বামীকে সুস্থ দেখা। আমি #মায়ের_কথা শুনেছি। আম্মা-আব্বা শান্তিতে বসবাস করছেন। একদম নবদম্পতি ন্যায় তাদের সুখের সংসার। মায়ের গোপন কথা শুনে সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে আমিও গর্বিত। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হোক। তাদের গোপন কথা শোনার মত কেউ থাকুক। তাহলে শেষ জীবনে এসেও আমার মায়ের মত হয়তো সবাই সুখের দেখা পাবে।

সমাপ্ত।