বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 6



অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫১

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৫১

হাতে হাত রেখে রাতের শহর উপভোগ করছে জিয়ান নয়না৷ নয়নার হাতে একগুচ্ছ হলুদ গোলাপ, হলুদ গোলাপের মাঝখানে একটা টকটকে লাল গোলাপ।
“জিয়ান বলল,তোমার হৃদয়ে ওই লাল গোলাপের মত আমার জায়গা। সবার মাঝে থেকেও আমি ভিন্ন৷ তোমার হৃদয়ের চাঁদ আমি।”
“আপনি কি জানেননা হৃদয়ে সবাই থাকে না। হৃদয়ের মানুষ ছাড়া হৃদয়ে কারো জায়গা হয়না৷ বড্ড বোকা আপনি৷”
“তুমি আমাকে আপনি করে বলবা না। আমি তোমার একান্ত ব্যাক্তিগত তুমি।”
“পুরুষ মানুষ প্রেমে পরলে বোকা হয়ে যায়। কথাটা কি সত্য?”
“তা তো জানি। তবে তুমি তাকালেই আমি হয়ে যাই বোকা।আমার পৃথিবী যেনো থমকে যায় তোমার চাহনিতে। কি আছে তোমার এই আঁখি দুটিতে?”
“আফিম আছে। তাই আমার সাথে দৃষ্টি মেলানোর আগে সাবধান।”
“তোমার চাহনিতে যদি আফিম থাকে আমি সে নেশায় নেশাগ্রস্ত হতে রাজি৷ একবার না বহুবার শতবার।”
নয়না শাড়ীর কুচি ঠিক করছে। জিয়ান হাঁটু মুড়ে বসে পরলো,নয়নার হাত সরিয়ে দিয়ে নিজের হাতে ঠিক করতে লাগলো নয়নার কুঁচি। রাস্তায় কত মানুষ চলাচল করছে তারা বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখছে।
“কি করছেন সবাই দেখছে তো?”
“লোকে দেখলে দেখুক আমার। আমার বৌ আমার দ্বায়িত্ব, আমার ভালোবাসা৷ তার এতোটুকু কাজ করবো না! লোকে পাগল বলুক তবুও আমি তোমায় ভালোবাসবো।”
“ইশশ ভালোবাসার জন্য বাসায় আমাদের রুম আছে তো।”
“রুমের মধ্যে ভালোবাসায় চাহিদা থাকে৷ এই ভালোবাসায় যত্ন আছে। আমি শুধু রুমের মধ্যে ভালোবাসবো আর বাহিরে বৌকে পাত্তা দেবো না এমন মোটেই হবে না। দরকার পরলো তোমাকে কোলে তুলি নিয়ে হাঁটবো৷”
“হয়েছে চলুন ফুচকা খাবো।”
“এভাবে বললে নড়বো না।”
“চলো ফুচকা খাবো।”
“যো হুকুম মেরি রানী।”

এক প্লেট ফুচকা নিয়ে নয়না খাচ্ছে। জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা ভালোবাসার মানুষের প্রতিটি কাজ এতো মনোমুগ্ধকর কেন? মনে হয় আমি ফুচকা খাওয়া না, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখছি। ভালোবাসা মানুষকে এক অন্য রকম অনূভুতির জগতে নিয়ে যায়। নয়না জিয়ানের মুখের সামনে একটা ফুচকা ধরে বলে, “এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন?”
“দেখছি আমার বৌ ফুচকা খাচ্ছে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি আছে!”
“আপনি বড্ড বেশি কথা বলেন৷ নিন হা করুন তো৷”
জিয়ান হা করে ফুচকা মুখে নিলো।

দূর থেকে দাঁড়িয়ে জাহিন এই দৃশ্য দেখলো। একটা কেসের ইনভেস্টিগেশন করতে বের হয়ে ছিলো জাহিন। এমন দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ালো। তার মনে হচ্ছে সামনের মানুষ জিয়ান কেনো হলো। সে কেনো হলো না। হঠাৎ নিজের মধ্যে ফিরে এসে বলে, ছিহহহ জাহিন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনী সম্পর্কে তোর ভাবি৷ তোর চিন্তা ভাবনা এতো জঘন্য হতে পারে না। জাহিন কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো নিজের গন্তব্যের দিকে তবে কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে আসলো৷ এসে দেখে জিয়ান আর নয়না নেই। জাহিন বাইক রেখে সামনে হাঁটা শুরু করলো। দেখতে না পেয়ে ফিরে এসে আবার বাইক স্টার্ট দিলো।

নয়না ফুচকার প্লেট টুলের উপরে রেখে নিজে উঠে দাঁড়ালো টুলের উপর। ঝুঁকে জিয়ানের শার্টের বাটন লাগিয়ে দিলো।
জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,”ভালোবাসি প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।”
নয়না টুল থেকে নেমে বলে, “বিল পরিশোধ করে চলুন, এক জায়গায় কতক্ষণ থাকবো?”
জিয়ান বিল পরিশোধ করে নয়নার হাত ধরে বলে, “এই রাত যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হতো বলো তো?”
নয়না হেসে বলে, “সব কিছুর শেষ আছে তাই নিয়ম অনুসারে তা সমাপ্ত হবেই। সো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আকাশ কুসুম ভেবে লাভ নেই।”
“দূর ভাল্লাগে না। তোমার জন্য একটু রোমান্টিক হতে পারি না৷”
“আহা মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আবার নাকি রোমান্টিকও হতে পারে!”
“তো তোমার আমাকে আনরোমান্টিক মনে হয়!”
“তো তুমি তো আনরোমান্টিকই। তোমার তো হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ে রোমান্টিকতা শেখা উচিৎ।”
“ওসব শিখতে হয় নাকি? রাস্তা ফাঁকা থাকলে এখন কয়েকটা চুমু খেয়ে বুঝিয়ে দিতাম। আমি কতটা রোমান্টিক!”
“সুন্দরী মেয়ে দেখলে পুরুষ মানুষের হুস থাকে না৷”
“বৌ তুমি আমাকে উস্কে দিচ্ছো কিন্তু। এরপর এর দায় কিন্তু তোমার।”
নয়না হুট করে তার আঁচল নিয়ে জিয়ানের হাতের কব্জিতে বেঁধে দিলো। নরম স্বরে বলল, “মনের সুতোয় মন বেঁধেছে, দেহ বাঁধলাম আঁচলে।”
জিয়ান গেয়ে উঠলো, “এতো ভালোবাসা গো জান রাখিও অন্তরে, দোলাও তুমি দুলি আমি জগত বাড়ি দোলে৷”
“তুমি তো খুব ভালো গাইতে পারো৷”
“বেশি না তবে পারি। আমাদের দু-জনের কন্ঠই মোটামুটি ভালো। তবে জাহিন বেশি পছন্দ করে গানটান৷”
“হ্যা শুনেছি ভাইয়া খুব ভালো গায়। তবে তোমার মত না।”
“নিজের মানুষের সব কিছু সব সময় বেস্ট তারপর বাকি সব।”
জিয়ান নয়নার আঙুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে বলে, “এ বাঁধন কখনো ছিড়ে যাবে নাতো?”

নয়না স্থির হয়ে দাঁড়ালো রাস্তা এখন বেশ ফাঁকা মাঝে মাঝে দূরপাল্লার বাস শা শা করে চলে যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোতে জিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি আমার প্রথম অনুভূতি, প্রথম ভালোবাসা। আমি কোনদিন তোমাকে ভুলতে পারবো না৷ সম্ভব না আমার জন্য তোমাকে ভুলে থাকা৷ তবে আমার কি মনে হয় জানো? আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হলে তা তোমার জন্য হবে৷ তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে হয়ত কোন মাঝপথে অথবা অজানা গন্তব্যে।”

জিয়ানের দৃষ্টি এখনো নয়নার দৃষ্টিতে স্থীর৷ জিয়ান বলল, “আমি বলবো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি কারন ভালোবাসা অনুভব করার জিনিস মাপার জিনিস না। তবে এতোটুকু জেনে রেখো তুমি আমার জীবন থেকে কখনো হারিয়ে গেলে হয়ত আমি পাগল হয়ে যাবো৷ নয়ত আমি মরে যাবো। তোমাকে ছাড়া হয়ত এ জীবনে আর বেঁচে থাকা সম্ভব না।”

কথার মধ্য দু” জনে এতোটাই মগ্ন আশেপাশের অবস্থা তারা যেনো ভুলে বসেছে। হঠাৎ দূরপাল্লার বাসটা তাদের দিকে এগিয়ে আসলো। নয়না জিয়ান বলে, জোড়ে চিৎকার করলো৷ রাতের শহরে তার চিৎকার মিলিয়ে যেতে লাগলো ইটপাথরের কংক্রিটে।
****

অনিকেত বেডে বসে আছে। তার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তার মায়ের চেহারাটা। জানতে ইচ্ছে করছে কতটা অসহায় হলে মা তার সন্তানকে এতিম খানায় ফেলে যায়! কেনো সে আর খোঁজ নিলো না আর? আমাকে কি একবার দেখতে ইচ্ছে করেনি! জানতে ইচ্ছে হয়না আমি কেমন আছি! কোন মা কিভাবে সন্তানকে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে ছেড়ে দেয় একা একা! আমি শুধু একবার মা ডাকতে চাই। অনিকেতের ফোনটা সেই কখন থেকে বেজেই চলেছে৷ বিরক্ত হয়ে রিসিভ করে বলে, “কি সমস্যা আপনার! ছেলে দেখলেই গলায় ঝুলে পড়তে ইচ্ছে করে? আমি কোনদিন আপনাকে নিজের করবো না। কোনদিন না।”

সায়না মোটেই রাগ করলো না অনিকেতের কথা শুনে, শান্ত স্বরে বলল, “ভালোবাসি।”
অনিকেত থমকে গেলো তার রাগ যেনো মিশে গেলো অজানায়।
সায়না বলল,”আপনাকে ভালোবাসি মানে আপনার, রাগ অভিমান, খারাপ, ভালো সব কিছুই আমি ভালোবাসি। আপনাকে না বেসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না তাই আপনাকে ভালোবাসি।”
অনিকেত ফোনটা কেটে দিতে চাইলো।

সায়না বলল, “আপনার কথা বলতে হবে না, আপনি শুধু কানের কাছে ফোনটা ধরে রাখুন৷ আমি চাই আমি একাকীত্ব না আমাকে অনুভব করুন। শুনছেন ভালোবাসি আপনাকে৷ ভালোবাসি ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ কে৷”

হটাৎ করে অনিকেত ফোনটা বুকে চেপে ধরলো। এতোক্ষণ ধরে শূন্যতায় হাহাকার করতে থাকা বক্ষপিঞ্জর যেনো মূহুর্তেই শান্ত হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে কেউ একজন আছে এই পৃথিবীতে যে তাকে ভালোবাসে। টাকার অভাবের চেয়ে ভালোবাসার অভাব মানুষকে বেশী পোড়ায়।
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৫০

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৫০
জিয়ান নয়নার থুতনিতে হাত রেখে বলে, চলে যাবো মানে আমার ছুটিতো শেষ। যেতে হবে না?
“নয়নার মুডঅফ হয়ে গেলো! এটা কেমন কথা এতো তাড়াতাড়ি ছুটি শেষ?
” আমাদের ছুটিতো কম বেবি তবে তোমার সব কাগজ পত্র ঠিক করে তোমাকে পার্মানেন্ট ভাবে আমার সাথে নিয়ে যাবো।
“আপনি তো ককপিটে থকবেন আমি যেয়ে কি করবো!
” নয়নার গাল টেনে বলে, একদিন ফ্লাইট পরেরদিন রেস্ট এভাবেই আমাদের ডিউটি৷ যেদিন রেস্ট সেদিন তোমার আমার দিন।
“কিন্তু।
” কি গো খু্ব মিস করবে বুঝি আমাকে?
“নয়না উঠে দাঁড়ালো মিস করবো তবে একটু। এই চলুন তো ফুচকা খেয়ে আসি।
” আমি তো ফুচকা খাইনা বৌ।
“না খেলে খাবেননা আমি খাবো আপনি দেখবেন।
” আচ্ছা যাবো শর্ত হলো তোমাকে শাড়ি পরে বের হতে হবে।
“আচ্ছা এক্ষুনি চেঞ্জ করে আসি।
” জিয়ান নয়নার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো,নয়নার এলোমেলো চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দিয়ে বলে,হটাৎ করে এসে একদম হৃদয় জুড়ে বসে আছো৷ নয়নার কপালে চুমু খেয়ে বলে,ভালোবাসি আমার পিচ্চি বৌটাকে।
“নয়না সরে এসে বলে,আমি মোটেও পিচ্চি না। কয়েকদিন পরে কলেজে ভর্তি হবো। সো পিচ্চি পিচ্চি করবেন না।
” জিয়ান নয়নার ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বলে,বড্ড বেশি কখা বলো তুমি। তুমি হলে আমার বাটার মাশরুম।
“দেরি হচ্ছে তো ছাড়ুন আমাকে।
” ইশশ রে নিব্বি বৌ আমার ধরায় আগেই ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি করবে মাছের মত।
“নয়না একটু দূরে সরে যেয়ে বলে যাবোই না আপনার সাথে।
” আচ্ছা জান স্যরি এই কানে ধরছি আর বলবো না নিব্বি৷
“নয়না সোফায় বসলো কপট রাগ দেখিয়ে বলল আর একবার বললে,সোজা বাপের বাড়িতে চলে যাবো৷
“আমি থাকতে বাপের বাড়ি! তা হবে না। ঝগড়া হোক মারামারি কা’টাকা’ঠি যাহোক তবুও আমার কাছেই থকতে হবে। এতো কথা না বলে দ্রুত রেডি হও সময় নষ্ট হচ্ছে জান৷
” নয়না উঠে পেটিকোট আর ব্লাউজ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। আলমারি থেকে কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি বের করে পরলো। চুলগুলো বিনুনি করে নিলো এরপর খোপা করলো। ম্যাচিং হিজাব পরলো, হাতে রেশমি কাচের চুড়ি৷ পরে বলে চলুন আমি রেডি। একি আপনি ভিডিও করছেন কেনো?
“আমি তোমাকে বড্ড মিস করবো বাটার মাশরুম। তখন একাএকা কি করবো?এসব থেকে মনটাকে শান্ত রাখবো।
” আহাগো ডিয়ার হ্যাসবেন্ড। আপনার যখনই আমার কথা মনে পরবে সোজা কল করবেন মনপ্রাণ ভরে কথা বলবো৷
“জিয়ান উঠে এসে নিজের চুল ঠিক করে নিয়ে বলে,তোমার সাথে কথা বলে এজন্মে মন প্রাণ ভরবে বলে তো আমার মনে হয় না। উল্টো তখন আরো তৃষ্ণা বাড়বে।জিয়ান হুট করে বলল,তোমার হাইট কত?
” পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চি।
“জিয়ান নয়নাকে উঁচু করে ধরে বলে,অথচ বর পেয়েছো ছ’ফুটের। কপালে পাপ্পি দাও ডিয়ার ওয়াইফি।
” নয়না বলল,এখন দেয়া যাবেনা৷ এখন পাপ্পি দিলে আপনার কপালে লিপস্টিকের স্ট্যাম্প লেগে যাবে।সো ঝাপ্পি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন বাকিটা পরে হবে৷ নয়না জিয়ানে শার্টের বাটন ঠিক করে দিয়ে বলে,ব্ল্যাক আর কলাপাতা কালার দারুণ মানিয়েছে কিন্তু
“শাড়ী পরলেই মেয়েদের অদ্ভুত রকমের মায়াবতী লাগে! মনে হয় শাড়ী যেনো তোমাদের শোভা বর্ধন করার হাতিয়ার।শাড়ী এমন এক হাতিয়ার যা দিয়ে তোমরা আমাদের মত অবলা ছেলেদের হৃদয় কেড়ে নিতে পারো।
” অনেক বকবক করেছেন মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। এখন চলুন তো তাড়াতাড়ি।
“তবে হাত ধরো। হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাই দু’জনে৷ তুমি আমি আর আমাদের এই পথচলা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হোক।
🌿জাহিন একটা সিগারেট ধরিয়ে দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে,মুখ দিয়ে টেনে নিচ্ছে সিগারেটের ধোঁয়া।
“অন্তর জাহিনের হাত থেকে সিগারেটা নিয়ে নিজেও দু’টো টান দিলো।
” জাহিন সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলে,সিগারেটের মত বৌ ভাগ করা যায় না?
“শা’লা মুখ সামলে কথা বল সিগারেট আর বৌ কি এক!
” আরেহহ এক না আবার একই। দু’টোই নেশার মত কাজ করে।
“তোর কাছে এক মনে হলে তুই আরেকজনের সাথে ভাগাভাগি করিস। আমার বৌ আমার পার্সোনাল প্রপারটি আমি তাকে ভাগ তো দূরে থাক তার দিকে তাকালেও চোখ তুলে ফেলবো।
” হাইপার হচ্ছিস কেনো কথার কথা বললাস ইয়ার৷ আচ্ছা তোর বোনের কি অবস্থা? সুইসাইড করলো কেন?
“ওর অবস্থা বেশি ভালো না জানিনা কি হবে। হটাৎ করে কি এমন হলো সুইসাইড কেন করলো?
” চিন্তা করিস না সুস্থ হয়ে যাবে। সুস্থ হলে জেনে নিস৷
“জানিনা বেঁচে ফিরবে কিনা। আইসিইউ তে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে আমার চঞ্চল বোনটা। মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে।আচ্ছা মান্নাতের কেসের তদন্ত কতদূর এগোলো? তোকে দেখলাম মন্ত্রীর সাথে কথা বলতে?
” এই তো আগাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি সব দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা করবো।কথা বলতে বলতে জাহিন আরেকটা সিগারেট ধরালো।
“কি হয়েছে তোর? তুই তো কোন কিছু নিয়ে টেনশনে না থাকলে এতো সিগারেট খাস না।
” সিগারেটের পাওয়ার হলো ধোঁয়ার সাথে সব কষ্ট উড়িয়ে দিতে পারে৷ তবে জানিস ভালোবাসাও কিন্তু সিগারেটের চেয়ে কম না৷ আমরা জানি তাতে ক্ষতি তবুও ভালোবেসে ভুল করি৷ ঠিক সিগারেট যারা খায় সবাই জানে এর ক্ষতিকারক দিক।
“তোর কি হলো হঠাৎ? তুই ভালোবাসার কথা বলছিস? প্রেমে ট্রেমে পরিস নি তো?
” উঁহু জাহিন চৌধুরীর লাইফে প্রেম নিষিদ্ধ। তুই কেনো ডাকলি আমাকে?
“জাহিন আমি রিতুর সুইসাইডের মত ডিসিশন নেয়ার কারন জানতে চাই। আমার বোন মাত্র কলেজে পড়ে সে কেনো এতো বড় একটা পদক্ষেপ নিবে? এরজন্য তোর সাহায্য চাই।
” আচ্ছা টেনশন করিস না রিতু ঠিক হয়ে যাবে। আমি দেখছি বিষয়টা কিভাবে হ্যান্ডেল করা যায়। চল হসপিটালে যাই রিতুকে একবার দেখে আসি৷
“জাহিন আর অন্তর বাইক নিয়ে বের হয়ে গেলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে
🌿অনিকেত চেম্বার থেকে বের হয়ে এতিমখানায় আসলো।
জামাল সাহেবের সাথে দেখা করে বলল,আচ্ছা আঙ্কেল আমাকে এখানে কে রেখে গিয়েছিলো?
” জামাল সাহেব অনিকেতের দিকে তাকিয়ে বলে,এতোদিন পর হঠাৎ এই কথা কেনো বাবা?
“আঙ্কেল আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে৷ কে আমার বাবা, মা তারা কেনই বা আমাকে ফেলে রেখে গেলো? আমার দোষটা কোথায়?
” জামাল সাহেব লাঠি ভর দিয়ে উঠে গেলেন৷ এরপর ফিরে এসে বললো,এক ভদ্র মহিলা তোমার বয়স যখন দু’দিন বা এক সপ্তাহ তখন এখানে রেখে যায়। আমি আর তোমার চাচি দু”জনেই তখন এখানে নতুন। চেহারা ঠিকমতো মনে নেই তবে দেখে মনে হয়েছিলো বড়লোক বাড়ির মেয়ে হবে৷ জিজ্ঞেস করলাম এতো ফুটফুটে বাচ্চাটাকে ফেলে রেখে যাচ্ছেন!
“মেয়েটা কান্না করতে করতে বলল,আমি অভাগা। জানিনা বড় হয়ে এই সন্তান কোনদিন আমাকে ক্ষমা করবে কি না। তবে তাকে বলে দিয়েন তার মা অসহায়। তার মা’কে যেনো ক্ষমা করে দেয়।
” তারপর কোনোদিন আর আমার খোঁজ করতে আসেনি?
“এসেছিলো ছয়মাস পর্যন্ত আসতো। সে তখন ভার্সিটিতে পড়ালেখা করে। এসে এমে তোমাকে খাইয়ে যেতো। মুখ ঢাকা থাকতো শুধু চোখ দুটো দেখতাম। শরিফ স্যারের কাছে টাকাও দিয়েছিলো অনেক৷ তোমারে রাখার জন্য।
” তারপর আর কোনদিন আসেনি?
“নাহহ বাবা আর কোনদিন দেখিনি তাকে এই আঙিনায়। তয় আমার কি মনে হয় জানো?
” কি মনে হয় আঙ্কেল?
“মনে হয় প্রেম ঘটিত জটিলতা আছিলো তোমার মায়ের। বুঝোই তো উঠতি বয়সি মাইয়া আবিয়াইত্তা সমাজ কি হেরে মাইনা নিবো? সবাই কইবো না এই সন্তান কার? মনে হয় হের প্রেমিক হেরে ধোঁকা দিছে এরজন্য তোমারে রাইখা গেছে নিরুপায় হইয়া।
” আমি কি তার নাম জানতে পারি?
“শামসুন্নাহার নাম কইছিলো তোমার চাচির কাছে।আমারেও তিনলাখ টাকা দিয়া কইছিলো তোমার যেনো আদর যত্নে রাখি।
” অনিকেতের পা অবশ হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে একবার তার মা”কে জড়িয়ে ধরতে একবার তার কোলে মাথা রাখতে আচ্ছা মায়ের শরীরে গন্ধ কেমন হয়? মায়ের শরীরে নাকি মা মা গন্ধ থাকে আঁচলে থাকে সন্তানের জন্য ভালোবাসা। আমি একবার সেই অনুভূতি পেতে চাই মা৷
#চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন৷ আজকে রিচেক করা হয়নি৷

Dark Mystery পর্ব-২১+২২

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_21
#Sabrina_Summa

সুপ্তি রেগে চলে গেলো। সেই রাগ ভাঙ্গাতে মাহিরের আরও একদিন লাগলো।

বর্তমান.,.
সুপ্তি : আমার পছন্দের গান ধরবো। মাইন্ড করবেন না।
মাহিরের ধ্যান ভাঙলো সুপ্তির কথায়। মাহির কিছু বলার আগেই সুপ্তি গান শুরু করলো,
পাল ভার ঠেহের যায়ে
দিল হে সামহাল যায়ে
কেছে তোমহে রোকা কারো…..
মেরে তারাফ আতা, হার গাম পিসাল যায়ে
আখো মে তুমকো ভারো…
বিন বলে বাতে তুমছে কারো…
আগার তোম সাথ হো…….(ii)
———————————— তেরে নাজরো মে হে তেরে সাপনে, তেরে সাপনো মে নারাজি….
মোজে লাগতাহে কে বাতে দিল কি হতি লাফজো কি ধোঁকেবাজি।
তোম সাথ হো ইয়া না হো কিয়া…… ফার্ক হে…বেদার্ত থি জিনদিগী বেদার্ত হে….
আগার তোম সাথ হো….
সুপ্তি খুব আবেগ দিয়ে গাচ্ছিল। যখনই আবার বলছিল ” আগার তোম সাথ… ” তখনই মাহির সুপ্তির কাধে মাথা রেখে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। থেমে গেলো সুপ্তি। মাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলো৷
মাহির সুপ্তির চাহনি দেখে বুঝতেই পারছে না সুপ্তি বিরক্ত হচ্ছে নাকি রাগ করছে। অদ্ভুত সেই চাহনি।
মাহির : কি হলো গান বন্ধ করলে কেন?
সুপ্তি উত্তর না দিয়ে সেভাবেই তাকিয়ে রইলো। মাহির এবার সুপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে বললো, ” তোমার মতো তোমার গলার সুরও অনেক সুন্দর। তবে গানের একটা লাইন আমার পছন্দ হয় নি। ”
সুপ্তি চোখের ইশারায় বোঝালো কি?
মাহির : ওই যে ওই লাইনটা। ” তোম সাথ হো ইয়া না হো কিয়া ফার্ক হে। ” আচ্ছা, আমি না থাকলে তোমার যায় আসবে না?
সুপ্তি : তা একটু আসবে। ভালো ফ্রেন্ড বলে কথা।
মাহির : শুধু ফ্রেন্ড আমি! আর জাস্ট একটুই যায় আসবে!
সুপ্তি : না ভালোই যায় আসবে। আর আপনি তো ফ্রেন্ডই।
মাহির : আমি শুধুই ফ্রেন্ড?
সুপ্তি : তা না হলে কি ভাইয়া?
মাহির : ভাইয়া?
সুপ্তি : হ্যাঁ ভাইয়া।
মাহির : ভাইয়া মানেই ছাইয়া ছাইয়া। বিয়ে পর বুঝাবো ভাইয়া কি জিনিস!
বলা শেষ করে রেগে উঠে যেতে নিলো।
সুপ্তি : আরে আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছেন।
মাহির : জাহান্নামে।
সুপ্তি : নাউজুবিল্লাহ। রাগ করছেন? আমি কিন্তু রাগ ভাঙ্গাতে আসবো না।
মাহির : ভাঙ্গাতেও হবে না।
মাহিরের রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো।।
সুপ্তিও নিজের এপার্টমেন্টের দিকে চলে গেলো। তাদের রাতে আর কথা হলো না।
মাহির রাগ করেই রইলো।।

সকাল এগারোটা বেজে চল্লিশ কি পঞ্চাশ.,.
সুপ্তি অনবরত মাহিরকে কল করছে । ৫ বার হবে হয়তো। কিন্তু মাহির রাগ করে থাকায় কল রিসিভ করছে না ।
সুপ্তি বিরক্তিতে বিড়বিড় করে বললো, ” এতক্ষণে ইরফানকে একবার কল করলেই চলে আসতো। শুধুমাত্র এই সিমে ওর নাম্বার নেই বলে। ”
মাহির কল না ধরায় সুপ্তি রাস্তায়ই শুয়ে পড়লো ক্লান্তিতে।
শেষবারের মতো কল করলো সুপ্তি। এবারও ধরলো না মাহির ৷ তবে কিছুক্ষণের মাঝেই কল বেক করলো।
সুপ্তি কল রিসিভ করতেই মাহির উত্তেজিত কন্ঠে বললো, ” কি হয়েছে তোমার? তুমি যে মেয়ে এতবার কল তো শুধু শুধু করবে না ! কোনো বিপদ হয়েছে? তাড়াতাড়ি বলো। ”
সুপ্তি : ভার্সিটি গেটের পূর্বসাইডে আছি।
বলা শেষ করে কল কেটে দিলো। হয় তো মাহিরের চিন্তা বাড়ানোর জন্য। নয় তো তার বলতে কষ্ট হচ্ছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই মাহির গাড়ি নিয়ে চলে এলো।
সুপ্তিকে ফুটপাতে শুয়ে থাকতে দেখে অনেক মানুষ ভিড় করেছে। তা দেখে মাহির আরও বেশি ভয় পেয়ে গেলো। ভিড় সরিয়ে সুপ্তির কাছে গিয়ে বললো, ” কি হয়েছে তোমার? ”
সুপ্তি : আগে এদের সরান।
মাহিরের বডিগার্ড সবাইকে সরিয়ে দিলো।
মাহির ফুটপাতে বসে বললো, ” আরে বলছো না কেন, কি হয়েছে! তোমার মুখ লাল হয়ে আছে কেন? ” ( ভয়ে + রেগে )
সুপ্তি : একা একটা মেয়ে ১৫/১৬ জন ছেলের সাথে ফাইট করলে ক্লান্ত + একটু ব্যথা তো পাবেই।
( শুয়ে শুয়েই )
মাহির : তোমার পিছে সবসময় মানুষ লেগে থাকে কেন? কী করো তুমি?
সুপ্তি : আরে। কিছু মেয়েকে ডিস্টার্ব করছিল। তখন ঝামেলা বেঁধে গেছে। আমার আবার এসব সহ্য হয় না।
মাহির : তুমি কি গোয়েন্দা?
( সুপ্তির মুখের সামনে ঝুঁকে )
সুপ্তি : আমি আর গোয়েন্দা! হাও ফানি!
বলেই হাসতে শুরু করলো।
মাহির উঠে হাত ভাজ করে দাঁড়ালো।
সুপ্তি উঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। মাহির ভ্রু কুচকে তাকালো। সুপ্তি তোলার ইশারা করতেই মাহির কোলে তুলে নিলো ৷ এরপর গাড়িতে বসিয়ে বললো, ” আজকে তোমার সাথে টেনিং করবো। ”

#চলবে.,.

#Dark_Mystery (কালো রহস্য)
#Part_22
#Sabrina_Summa

প্রায় জনশূন্য মাঠ। চারপাশে শুধু বাতাসের গুঞ্জন, আর মাঝেমধ্যে গাছের পাতার মৃদু কাঁপুনি।
গাছের নিচে বসে আছে সুপ্তি। এক হাতে শুকনো একটা পাতা নিয়ে খেলছে। তার চুল বারবার বাতাসে মুখে এসে পড়ছে, কিন্ত তাতে কোনো হেলদোল নেই তার৷

ঠিক তখনই একটা ছায়া এসে পড়ল গাছের গায়ে।

সুপ্তি না তাকিয়েও বুঝতে পারে সামনে কে দাঁড়িয়ে।
সামনে দাঁড়িয়ে মাহির—সাদা রঙের হালকা টি-শার্টে, চোখে নির্লিপ্ত কিন্তু গভীর কিছু।
কণ্ঠে হালকা গম্ভীরতা—“ক্লাইম্বিং করতে পারো?”

সুপ্তি — “হ্যাঁ, পারি।”

মাহির হালকা মাথা নাড়ল, যেন এই উত্তরটাই সে আগে থেকেই জানত।
“আমি জানতাম তুমি পারবে।”

সুপ্তি অন্য দিকে তাকিয়েই বললো, “আমি মোটামুটি সবই পারি।”

মাহির —চলো, আমরা ক্লাইম্বিং করি।

সুপ্তি অবাক হয়ে চারপাশে তাকাল, তারপর আঙুল তুলে দেখাল পাশের বিল্ডিংটা—
“এই বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে?”

“হুম।” মাহিরের ঠাণ্ডা উত্তর।

সুপ্তি : “আপনি করুন, আমি করবো না।”

“তাহলে কী আমি ভেবে নেবো তুমি পারো না?”—মাহিরের কণ্ঠে খোঁচা।

সুপ্তির গলায় তখন একরকম অভিমান মেশানো রাগ— “আমি পারি। কিন্তু এটা অনেক উঁচু। আমি সবসময় বিল্ডিংয়ের ভেতরে ক্লাইম্বিং করেছি। বাইরে থেকে কখনো না।”

মাহির এগিয়ে এলো একটু, বললো,
“সেইফটি তো আছেই। সাথে আমিও আছি। এরপরও যদি বাহানা দাও, তাহলে ভাবতেই হবে—তুমি আসলে পারো না।”

সুপ্তির চোখে আগুন জ্বলে উঠলো। ইগোতে লাগল ব্যাপারটা।
সে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো—
“চলুন।”

মাহির নরম কন্ঠে বললো, “এই ড্রেস পড়ে পারবে না। চেঞ্জ করে এসো।”

সুপ্তি চুপচাপ উঠে চলে গেল চেঞ্জিং রুমে। কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো সাদা একটা টি-শার্ট পড়ে । বাগানে এসে দেখে মাহির আগেই ছাদে চলে গেছে। সে এক দৌড়ে উঠে গেল উপরে।

ছাদের কিনারায় একজন মাহিরকে সেইফটি কিট লাগাচ্ছিল। সুপ্তির উপস্থিতি টের পেয়ে মাহির একবার তাকালো, চোখ মিলিয়ে আবার নিচে নামিয়ে নিলো।

সুপ্তি এগিয়ে গেলে মাহির নিজেই তার সেইফটি কিট লাগিয়ে দিল। নিঃশব্দে, খুব যত্নে।

তারপর নামা শুরু হলো। একটানা।

বিল্ডিংয়ের পাশে গভীর একটা পুকুর।
তাই রিস্ক নেই বললেই চলে।

মাহির : মানুষ আমাদের দেখে কাপল বলবে। সেইম টি-শার্ট।

সুপ্তি : চুপ থেকে নিজের কাজে মনোযোগ দিন।

মাহির আর কথা বললো না।
২ তলার দিকে নামতেই মাহির বলে উঠলো, ” সুপ্তি আমার খুব ভয় লাগছে। প্লিজ হাতটা ধরো। ”

সুপ্তি হাত ধরতেই সেইফটি রশি খুলে ফেললো মাহির।
সুপ্তি অনেক কষ্টে মাহিরকে নিজের বরাবর আনলো।

মাহির সুপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। সুপ্তিও আতঙ্কিত চোখে মাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।

এদিকে মাহির সুপ্তির সেইফটি রশিটা খুলছে।
সুপ্তি প্রথমে বুঝতে না পারলেও যখন বুঝতে পারলো তখন আতঙ্কিত স্বরে মানা করে বললো, ” প্লিজ মাহির এটা…”

কথা শেষ করার আগেই মাহির ও সুপ্তি উভয়ই পানির দিকে পড়া শুরু করলো।
কিছু সেকেন্ডের মাঝে পানিতে পড়ে গেলো তারা।

সুপ্তি মাহিরকে জড়িয়ে ধরে থাকায় অনেক কষ্টে পার সাইডে আনলো মাহির সুপ্তিকে ।
সুপ্তি তখনও মাহিরের ঘাড়ে দুইহাত পেঁচিয়ে ঝুলছে।

মাহির আশেপাশে তাকিয়ে বললো, ” মানুষ দেখলে কি বলবে! আমরা পার সাইডে আছি। সো তুমি দাঁড়াতে পারবে। ”

সুপ্তির কিছুক্ষণ লাগলো মাহিরের কথা বুঝতে।
এরপর পা রেখেও মাহিরকে জড়িয়ে ধরেই রইলো।

মাহির : আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে তোমার অনেক ভালো লাগে!

সুপ্তি : কেন করলেন এমন? আমার ভয় লাগে হাইটে।

মাহির এবার কিছুটা রেগে গেলো। সুপ্তি ছাড়িয়ে বললো, ” কেন ভয় লাগে? এই যে তুমি উপর থেকে পড়লে এতে কি তুমি মরে গেছো! বা হাত-পা ভেঙ্গেছে বা কোথাও ব্যথা পেয়েছো? ”

সুপ্তি ভয়ে কান্না শুরু করলো ।
মাহির সুপ্তিকে জড়িয়ে ধরে তানিশাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” টাওয়াল নিয়ে এসো। ”

তানিশা টাওয়ালের জন্য চলে যেতেই মাহির সুপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” সরি। কান্না করো না প্লিজ। দেখো জন্ম থেকে হাইটের ভয়টা সবারই থাকে। তবে তোমার একটু বেশিই আছে। এভাবে তুমি ট্রমাট্রাইস্ট হয়ে যাবে তো! এরজন্য এমন করেছি। সরি। আর করবো না। ”

সুপ্তি : আমি কালকে রিইউনিয়ন পার্টিতে ঘাটাইল যাচ্ছি । ভেবেছিলাম আপনাকে পার্টিতে নিয়ে যাবো। কিন্তু এখন আর নিবো না।
( বাচ্চাদের মতো করে )

মাহির তানিশাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” এতক্ষণ লাগে টাওয়াল আনতে। তাড়াতাড়ি দেও। ”

তানিশা টাওয়াল দিলে মাহির সুপ্তিকে পেঁচিয়ে বললো, ” এখন এসব বাদ। আগে তুমি চেঞ্জ করে নেও। হেঁটে হেঁটে যাবা। আমি কোলে নিতে পারবো না। কেন পারবো না আশা করি তুমি বুঝেছো! ”

সুপ্তির কোনো হেলদোল নেই। তাই মাহির নরম স্বরে বললো, ” তুমি সম্পূর্ণ ভিজে গেছো সুপ্তি। খারাপ দেখাচ্ছে। প্লিজ সু…”

বাকি কথা আর বলতে হলো না মাহিরের । সুপ্তি হাঁটা শুরু করলো। পিছে পিছে মাহিরও। দুইজনেই চেঞ্জ করে নিলো। সুপ্তি বের হতেই মাহির তাকে তার সামনের একটা চেয়ারে বসিয়ে বললো, ” কি যেন বলছিলে? ”

সুপ্তি : আমি তিন দিনের জন্য ঘাটাইল যাচ্ছি ।

মাহির : তিন…..দিন….! ( টেনে ) একদিনই তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না সেখানে তিনদিন! ইম্পসিবল।

সুপ্তি : আমি আপনাকে নিয়ে যাবো না।

মাহির : বাবা আমাকে এমনিতেও যেতে দিবে না। সো তুমিও যাবে না।

সুপ্তি : এটা সম্ভবই না। আমি অনেক দিন হলো বাড়িতে যাই না। আমাকে যেতেই হবে।

মাহির : প্লিজ, ট্রাই টো আন্ডারস্ট্যান্ড।

সুপ্তি : আমি কালকে সকালে রওনা দিবো। আপনি গেলে বলতে পারেন। ( দাঁড়িয়ে )

মাহির : কিন্তু বাবা….

সুপ্তি : মিস সিক্রেটের সাথে যোগাযোগ করুন। বলেই চলে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করলো।

মাহির বিষয়টা নিয়ে ভাবতে লাগলো। রাত পেরিয়ে দিন হয়ে গেল। সুপ্তি ঘাটাইল চলে গেলো কিন্তু মাহির এখনও এটাই চিন্তা করছে মাহফুজ চৌধুরীকে মিস সিক্রেট রাজি করাতে পারবে কিনা!

#চলবে.,.

Dark Mystery পর্ব-১৯+২০

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_19
#Sabrina_Summa

বৃহস্পতিবার.,.
আগামীকাল মিস সিক্রেটের বিয়ে। আজ তার এবং রুদ্রের গায়ে হলুদ।
এখনও রুদ্র সকলেই সামনে আসেনি। তবে তার অবস্থান সম্পর্কে সবই জানা মিস সিক্রেটের।
মাহিরকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। মিস সিক্রেটের বিয়ে হলেই তো মাহির বাঁচে।
তাই তো মাহির যদি বেঈমানী করেও তবুও একটা উল্টো চাল দিবে মিস সিক্রেট ।

হলুদ লেহেঙ্গা পড়ে বসে আছে মিস সিক্রেট। সাথে মেচিং হুডি এবং মাস্ক তো আছেই।
সবাই নাচ গান করছে আর সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তবে এগুলো তে মন নেই তার। সে তো নিজের ভাবনায় ডুবে। সে ভাবছে –
” যদি আজ বা কাল মাহির বেঈমানী করে তবে সে সত্যিই সুপ্তিকে হারাবে। আর মিস সিক্রেট রুদ্রকে খুন করবে। ”
হলুদের দিন চলে গেলো। তবে হলুদই লাগানো হলো না। কারণ মাহির লাগাতে দেয় নি।
এই কয়েকদিন ধরে মাহির আর সুপ্তির দেখা হয় নি। শুধু মেসেজে কথা হয়েছে। কারণ মাহির খুব বিজি থাকে ৷

শুক্রবার।
আজ মিস সিক্রেট আর রুদ্রর বিয়ে ৷ সবাই মজা করছে। সব জায়গায় মানুষ। কেউই সত্যিটা জানে না শুধু মাহির, মিস সিক্রেট ও তার টিম এবং কিছু ফোর্স ব্যতিত।
যারা জানে তারা সবাই তাদের পজিশন নিয়ে ছদ্মবেশে আছে।
একটা রুমের সোফায় কালো কালারের গর্জিয়াস লেহেঙ্গা পড়ে পা সোফায় তুলে আরামছে ফোন চালাচ্ছে মিস সিক্রেট। বাহিরে কি হচ্ছে তাতে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই।
“বিয়েতে কালো লেহেঙ্গা ঠিক মানানসই না ” এই উক্তিটা মাহির মিস সিক্রেটকে বুঝাতে অক্ষম। তাই তো মাহিরকে কালো লেহেঙ্গা কিনতে হয়েছে। কারণ মিস সিক্রেট তো নাছোড়বান্দা। কালো তার পছন্দ তো সবকিছু কালো হওয়া চাই।
কারো রুমের শব্দ পেলো মিস সিক্রেট। তবে কোনো ভাবান্তর দেখালো না। পুরুষালী কন্ঠে বলে উঠলো, ” হাই বেবি।”
মিস সিক্রেট ফোনের দিকে তাকিয়েই বললো, ” আমাকে দেখে বাচ্চা মনে হয়? ”
সেই মানুষটি আবারও বললো, ” তুমি বাচ্চা হবে কেন! আমি আদর করে তোমাকে বেবি ডাকছি। ”
” তোর আদর তোর কাছেই রাখ বুইড়া। ৩৫ বছরের বুইড়া হইয়া ২৫ বছরের যুবতিকে বিয়ে করতে আসছিস। লজ্জা করে না? ” ( মনে মনে )
মিস সিক্রেট : তা এখানে কেন রুদ্র শেখ? এসেছো যখন বসে পড়ো।
রুদ্র : ছিঃ ছিঃ। জামাইয়ের নাম ধরে ডাকছো।
” তোকে তো মনে হচ্ছে এখানেই শুট করে মারি। কি ন্যাকা কথা! ওয়াক থু। “( মনে মনে )
রুদ্র : একটু পর তো আমাদের বিয়েই হবে। তো আমি আসতে পারি না!
মিস সিক্রেট : মেয়েদের কিন্তু এখনও ছাড়ো নি।
রুদ্র : এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? আগে বিয়েটা হোক।
মিস সিক্রেট নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ” ২ মিনিট টাইম দিলাম। যদি মেয়েগুলো নিরাপদ স্থানে না পৌঁছায় তবে বিয়েটাই হবে না। আর যদি বিয়ে না হয়, তাহলে বুঝতেই পারছো তোমার কি হবে! ”
রুদ্র : ওকে, ছাড়ছি।
কাউকে কল করে মেয়েগুলোকে ছাড়ার আদেশ দিলো এবং মিস সিক্রেট ছাড়ার সিসি টিভি ফোটেজ দেখালো।
মিস সিক্রেটের ফোনে মেসেজ আসলো মেয়েগুলো নিরাপদে আছে ৷
সাথে সাথে সেও মেসেজ করলো ইরফানকে। তার কিছু মুহূর্ত পর রুদ্রকে ঘেড়াও করে ফেললো বিভিন্ন ফোর্স।
রুদ্র মিস সিক্রেটের দিকে গান তাক করলো। কিন্তু মিস সিক্রেটের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে তার মতোই আরামছে সোফায় বসে রইলো।
মিস সিক্রেট : তোমার কি মনে হয়, আমার দিকে গান তাক করে তোমার ১% ও লাভ হবে!
রুদ্র : খুব বড় ভুল করছো। আমি মরে গেলেও আমার সকল কর্মের খবর তুমি পাবে না। আমার লোক তোমাকে ছাড়বে না।
মিস সিক্রেট : তোমার সকল গোডাউন, তোমার সকল লোক এখন আমার আন্ডারে।
এরই মাঝে রুদ্র মিস সিক্রেটের বুক বরাবর গুলি করে দিলো। সুযোগ বুঝে ইরফান গানটা ছিনিয়ে নিলো।
এই গুলিতে মিস সিক্রেটের কিছুই হলো না। উল্টো মিস সিক্রেট রুদ্রর পায়ে গুলি করে বললো, ” হয়তো তুমি নিশানা তাক করতে ভুলে গেছো। আমার মতো মানুষকে শুট করতে হলে বুকে না মাথায় করতে হবে। কারণ আমার মতো মানুষ সবসময় বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়ে থাকে। ”
রুদ্র পায়ে হাত দিয়ে বসে আছে।
তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো।

মিস সিক্রেট মাহিরের দিকে রাগী চোখে তাকালো। তারপরই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল।
মাহির মিস সিক্রেটকে ধরলো কিন্তু পরে ইরফানকে বললো, ” ওকে নিয়ে যাও। ”
কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে চেক করে বললো, ” লো প্রেশার। খুব স্ট্রেজে থাকে সবসময়। ”
ইরফান : হ্যাঁ, তা তো থাকতেই হয়।

#চলবে.,.

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_20
#Sabrina_Summa

কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে চেক করে বললো, ” লো প্রেশার। খুব স্ট্রেসে থাকে সবসময়। ”
ইরফান :হ্যাঁ, তা তো থাকতেই হয়।
ডক্টর : যদি কিছু মনে না করতেন। ম্যামের মাস্কটা কিন্তু খোলা প্রয়োজন।
মাহির : আপনার কি মরার খুব শখ হয়েছে?
ডক্টর : না, কিন্তু এটা প্রয়োজন ৷
ইরফান : এটা যদি করি তাহলে আপনি তো মরবেন মরবেনই। সাথে আমাকেও মরতে হবে।
মাহির : এমনিতেই যা করেছি! মাস্কটা খোলা ছাড়া অন্য কোনো আইডিয়া দেন।
ডক্টর : আমার আর কিছু বলার নেই। স্যালাইন দেওয়া আছে জ্ঞান ফিরে যাবে । ম্যামকে ভারি ড্রেস থেকে নরমাল ড্রেসে আনুন। আমি চললাম।
বলা শেষ করে বেরিয়ে গেলো।
ইরফান : মহিলাদের তো আগেই এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন চেঞ্জ করাবে কে!
মাহির : এই ডক্টরের সব মারার মতো আইডিয়া। যাইহোক ইরফান তুমি থাকো ৷ আমাকে বাকি বিষয়টা দেখতে হবে।
মাহিরও বেরিয়ে গেলো।
ইরফান ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো, ” আমাকে রেখে সবাই পালাচ্ছে কেন? শেষে তো আমিই মরবো।”

আধা ঘণ্টার মাঝে জ্ঞান ফিরলো মিস সিক্রেটের।
এরপর ড্রেস আপ চেঞ্জ করে ইরফানকে বললো, ” মাহির কোথায়? ”
ইরফান : ম্যাম,ওই দিকটা সামলাতে গেছে।
মিস সিক্রেট : ওকে কল দেও।
১ সপ্তাহের মাঝে ভালো বন্ধুত্বই হয়ে গেছে তাদের ৷ মাহিরের চিন্তাভাবনা বদলেছে ৷ মিস সিক্রেটের ক্ষতি করার ইচ্ছাটা এখন আর তার নেই।
মাহির কল রিসিভ করতেই মিস সিক্রেট রেগে বললো, ” মাহিরের বাচ্চা, তোরে খালি পাই আমি। তোকে আমিই খুন করবো। ”
মাহির : সরি, সরি। আমি জানতাম না ও শুট করে দিবে। আর আমাকে একদম মাহির বলবে না। মাহির শুধু সুপ্তি বলবে। আর তুই তুকারিও করবে না। ফ্রেন্ড বলেই এমন করতে পারো না তুমি!
মিস সিক্রেট : তুমি শুধু আসো। আমি কি করতে পারি আর না করতে পারি দেখাবো নি।
মাহির : ওকে বাবা, আসছি।
মিস সিক্রেট : আমি বাবা নই। আর মরতে না চাইলে তাড়াতাড়ি আসো। বাই।
বলেই কল কেটে দিলো।

মাহির আসতেই মিস সিক্রেট রাগী চোখে তাকালো।।
মাহির : সারেন্ডার করছি। তবুও মেরো না। ( হাত উপরে তুলে )। তোমার জন্য ছোট একটা গিফট আছে।
মিস সিক্রেট : কি গিফট?
মাহির একটা ছোট ডাইরি এগিয়ে দিয়ে বললো, ” এতে তোমার ফেয়ারগুলো সম্পর্কে লেখা আছে এবই প্রতিকারও আছে। একদিনের জন্য ঘুষ দিচ্ছি। তারপর ফেরত দিবে। ওভারঅল, আমার প্রেমিকার বলে কথা। ”
” আমার জিনিস আমাকেই গিফট দিচ্ছে। তাই তো বলি আমার নাম্বার পাও কোথা থেকে! “( মিস সিক্রেট মনে মনে )
মিস সিক্রেট : আমি বাহিরে যাবো কি করে? সাংবাদিকরা তো অপেক্ষা করছে।
মাহির : এখানেই থেকে যাও।
মিস সিক্রেট : আমার কি খাইয়া দাইয়া আর কোনো কাম নাই? এমনিতেই এক সপ্তাহ ধরে তোমার কাজে পড়ে আছি। ( রেগে )
মাহির : একদিনই তো। না, হয় মাস্ক হুডি খুলে বেরিয়ে যাও। কেউ চিনতেও পারবে না।
মিস সিক্রেট : মাস্ক, হুডি খোলার থেকে এখানে থাকাও ভালো আছে।
মাহির: তাহলে থাকো।
বলেই চলে গেলো।

রাতে মিস সিক্রেট লাইভে এসে সব কিছু ক্লেয়ার করলো।।

কেটে গেলো আরও কয়েকটি দিন। সবাই আবারও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। এখনও বিভিন্ন বাহানায় মাহির সুপ্তির ক্যাম্পাসে যায়। তবে কারোরই বুঝার বাকি নেই সে কেন আসে এখানে! সবাই জানলেও সুপ্তিকে এখনও কনফেস করে নি নিজের ফিলিংস সম্পর্কে।

সময় বিকেল পাঁচটা বেজে তিপ্পান্ন মিনিট।
বহু দিন পরে, বহু ক্রোশ দূরে ঘুরতে এসেছে মাহির ও সুপ্তি। বহু ক্রোশ দূরে বলতে ক্যাম্পাস থেকে দূরে একটা পার্কের লেকের এক কোনে বসে আছে তারা। কিছু বডিগার্ডও আছে। তবে তারা কিছুটা দূরে। মিডিয়া এড়াতে ক্যাপ পড়ে আছে মাহির। হাতে তার গিটার। তবে এখানে গান কম গল্প বেশি হচ্ছে। হঠাৎ করে সুপ্তি বলে উঠলো, ” গিটারটা আমাকে দিন। ”
মাহির অবাক হয়ে বললো, ” তুমি গিটারও বাজাতে পারো? ”
সুপ্তি : হ্যাঁ, আমি সবই পারি। শুধু ওই বাস্কেটবলেই যা সমস্যা।
মাহির বাস্কেটবল শব্দটা শুনতেই হেসে দিলো।
সুপ্তি : হাসছেন কেন?
মাহির : সেদিনের কথা মনে পড়লো।

দুদিন আগে.,.
মাহির চুপচাপ বসে ছিল। মাহিরকে দেখে সুপ্তিও চুপচাপ বসে ছিল।
হঠাৎ মাহির বলে উঠলো, ” চলো, তোমাকে বাস্কেটবল খেলা শিখায়। ”
সুপ্তি মুখ ভাঙ্গিয়ে বললো, ” আমি পারি। ”
মাহির : তাহলে চলো, এক ম্যাচ খেলা যাক।
সুপ্তিও উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ” ওকে। ”
খেলা শুরু হলো। কিন্তু বাস্কেটবল হূকটা উপরে থাকায় মাহির সুপ্তি দুইজনেই বিরক্ত হলো। কারণ সুপ্তি গোল করতে পারছে না।
মাহির বিরক্ত হয়ে বললো, ” তুমি পারবে না। তুমি বেশি শর্ট। ”
সুপ্তি কিছুক্ষণ রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, ” আমি শর্ট না। তুই বেশি লম্বা। ”
মাহির তো এ কথা শুনে হাসতে হাসতে রীতিমতো গড়াগড়ি খেল। আর সুপ্তি রাগ করেই রইলো।
মাহির নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো, ” আপনি থেকে সরাসরি তুই এ চলে গেলে? ”
সুপ্তি : তাছাড়া কি করবো। আমি ৫ ফুট ৪ হয়েও যদি শর্ট হই তবে যারা আসলেই শর্ট তারা কি? ( রেগে )
মাহির : আচ্ছা, সরি। সব দোষ ওই হূকের ৷
সুপ্তি রেগে চলে গেলো। সেই রাগ ভাঙ্গাতে আরও একদিন লাগলো মাহিরের।

#চলবে.,.

Dark Mystery পর্ব-১৭+১৮

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_17
#Sabrina_Summa

ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই, তবে সময় মনে হয় মাহিরের জন্য থমকে রয়েছে । প্রতিটি মিনিট যেন ঘন্টা হয়ে দাঁড়িছে ।
মাহির তার গাড়ির ভেতরে বসে, ভার্সিটির মেইন গেটের ঠিক ভেতরের দিকে অপেক্ষা করছে । সময় তখন সকাল ৯ টা হবে । গাড়ির এয়ারকন্ডিশনের মৃদু বাতাসেও যেন তার হৃদয়ের উত্তেজনা কমছে না। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে এতদিন পর একবার দেখার জন্য।

অবশেষে, মাহিরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ৯টা ৪৫-এ কাঙ্ক্ষিত মানুষটি গেট পেরিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এলো।
মাহির আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। মুহূর্তের মধ্যে গাড়ির দরজা ঠেলে নেমে এলো ।

সুপ্তির দিকে এগিয়ে গিয়ে কোনো কিছু বলার আগেই তাকে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল।
সমস্ত কোলাহল, চারপাশের ভিড়, কৌতূহলী চোখ কিছুই যেন তার গ্রাহ্য করার বিষয় না।
চারপাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেল মাহিরের বডিগার্ডরা, দৃঢ় একটা বলয় তৈরি করে, যেন এই দুই প্রাণের মাঝখানে বাতাসও প্রবেশ করতে দিবে না তারা ।

সুপ্তি অবাক হয়ে একটু কেঁপে উঠলেও মুহূর্তের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললো, ” আরে মিয়া….”
কথা শেষ করতে না দিয়ে মাহির বললো, ” আমি তোমার কোনো মিয়া টিয়া নই। ”
মাহির এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে সুপ্তি মাহিরকে সরাতেই পারছে না।
সুপ্তি : তাহলে কি? প্লে বয় অর ক্যারেক্টারলেস!
মাহির : না জামাই। জামাই বলবে আমাকে।
সুপ্তি : ঠ্যাকা গো আমার ৷
( আবারো মাহিরকে ধাক্কা দিয়ে )
সুপ্তি মাহিরকে যতই ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেষ্টা করে মাহির ততই আরো শক্ত করে সুপ্তিকে জড়িয়ে ধরে।
মাহির : হ্যাঁ ঠ্যাকাই।
সুপ্তি : আরে ছাড়ুন তো । মিডিয়াতে চলে যাবে। ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাবে। ( রেগে )
মাহির সুপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে বললো, ” আচ্ছা। এখন বলো কোথায় ছিলে এতদিন ? ”
সুপ্তি : বাসায়।
মাহির : তাহলে কল কেন ধরো নি? ফোন কেন বন্ধ ছিল?
সুপ্তি : সিম হারিয়ে গেছিলো।
মাহির : অন্য সিম দিয়ে কল করতে পারতে বা ভার্সিটিতে আসতে।
সুপ্তি : সিম খুঁজতে খুঁজতে দুইদিন চলে গেছে।
মাহির : ফাজলামো পাইছো! সিম খুঁজতে কেউ দুইদিন বাসায় বইসা থাকে?
সুপ্তি : কেউ না থাকলেও আমি থাকি।
মাহির : কেন খেলছো আমার সাথে এভাবে?
সুপ্তি : আমি কি করলাম?
মাহির : কিছু না। গাড়িতে বসো।
( গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে )
সুপ্তি : আমি ভার্সিটিতে যাবো।
মাহির : না। তুমি আমার সাথে যাবে৷ দুদিন আমাকে সময় দেও নি। আজকে সারাদিন সময় দিবে।
সুপ্তির খুব বিরক্ত লাগছে। কি নেশা জড়ানো কথাগুলো।
সুপ্তি : আই’ম ইক্ট্রেইমলি সরি। আমার ক্লাস আছে।
মাহির : এই দুইদিন ছিল না?
সুপ্তি : এই দুইদিন করি নি দেখেই তো নোট নিতে হবে।
মাহির কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ” আচ্ছা চলো ৷ আজকে তোমার সাথে আমিও ক্লাস করবো। ”
বলেই কোলে তুলে গাড়িতে বসালো। নিজেও বসলো।
” এই ছেলে আজকে একটু বেশিই করছে না?”( সুপ্তি মনে মনে )
সুপ্তি : প্লিজ। আমার ক্লাসে যাবেন না। আমার মান ইজ্জতের কথাটাও একটু ভাবুন।
মাহির সুপ্তির কথা আমলেই নিলো না।
এবকর সুপ্তি একটু রেগে বললো, ” যদি একটু আগেকার ঘটনাটা মিডিয়াতে যায়, আপনার খবর আছে তাহলে! ”
মাহির : আরে যাবে না। আমার বডিগার্ডরা ছিল তো।
সুপ্তি আর কথা বললো না। তাই মাহিরও বললো না।

ভার্সিটির ক্লাসে আজ যে স্যাররাই আসছে তারা মাহিরকে দেখে খুব অবাক হচ্ছে । ভালো মন্দ জিজ্ঞেসও করছে ৷
সবাই আজ ক্লাস বাদ দিয়ে মাহিরকেই দেখছে। আর সুপ্তি! তার তো মনে হচ্ছে সে যদি অদৃশ্য হতে পারতো! যতই চাচ্ছে মানুষ থেকে দূরে থাকতে ততই মানুষ তাকে চিনে ফেলছে । ফলে তার একাকী জীবনও নষ্ট হচ্ছে।।

আজ শুক্রবার। সময় ১১ টা কি ১২ টা হবে।
মাহিরের জন্য একটা স্পেশাল দিনও বলা চলে। কারণ এদিন মাহির সুপ্তির ঘুরতে যাওয়ার দিন।
আজকের ঘুরতে যাওয়া নিয়ে মাহির অনেক এক্সসাইটেড।
তবে হঠাৎই সুপ্তি রেগে রেগে মাহিরকে কল করলো। মাহির কল রিসিভ করতেই বললো, ” ব্রেকিং নিউজ দেখছেন? ”
মাহির : না দেখি নি। ওয়েট, এখান দেখি।
সুপ্তি : আপনার আর দেখতে হবে না।
শোনেন, যে পর্যন্ত এই ব্রেকিং নিউজ সকল চ্যানেল থেকে না যাবে সে পর্যন্ত আমি বাসার বাহিরে এক পাও দিবো না। ”
মাহিরের আর বোঝার বাকি নেই ব্রেকিং নিউজটা কি!
মাহির : আজকে তোমার আমার সাথে ঘুরার কথা ছিল। প্লিজ এমন করো না।
সুপ্তি : আমি বলেছি মানে বলেছি ৷ আমি এক পাও দিবো না।
বলা শেষ করে রেগে কল কেটে দিলো।

মাহিরের নিউজটা ডিলিট করতে করতে প্রায় রাত ৮ টা বেজে গেলো। যদিও সুপ্তি অরপে মিস সিক্রেট এটাকে ১ ঘন্টায়ই সরাতে পারতো কিন্তু এতে মাহিরের সন্দেহ করার চান্স ছিল। তাই তো সে কোনো হেল্পই করলো না।
সুপ্তিকে নিয়ে ১ ঘন্টা ঘুরলো মাহির। সুপ্তি অবশ্য বের হতে চাই নি। তবে তার শর্ত পূরণ হওয়ায় বের হতে বাধ্য হয়েছে।

#চলবে.,.

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_18
#Sabrina_Summa

শনিবার।
মিস সিক্রেট অনেকদিন পর মন্ত্রীর বাড়িতে এসেছে কিছু কাজে। কাজ শেষ করে চলে যাবে তখনই আটকালো মাহির।
মাহির : একটু সাইডে আসো কথা আছে।
মিস সিক্রেট ভাবছে আবারও সেই ভুলটাই করবে কিনা! তবুও মাহিরের সাথে চলে গেলো।
মাহির : তুমি হইতো জানো বাংলাদেশে সবথেকে কুকর্মে বিখ্যাত কে?
মিস সিক্রেট :হ্যাঁ। রুদ্র। রুদ্র শেখ তাই তো!
মাহির : হ্যাঁ। তাহলে এটাও জানো ও দেশ থেকে পালিয়েছে। আর বিভিন্ন ফোর্স ওকে ধরতে চাচ্ছে!
মিস সিক্রেট : হ্যাঁ সবই জানি আমি। এত ভঙ্গিতা না করে সোজাসাপ্টা কথা বলো।
” হ্যাঁ, তুমি সবজান্তা সমসেরের বউ। ” ( মাহির মনে মনে )
মাহির : কিছুদিন আগে ও বলেছে তোমাকে বিয়ে করলে আটকে রাখা ১০০০ জন নারীকে ছেড়ে দিবে।
মিস সিক্রেট কিছুক্ষণ হেসে বললো, ” আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখা শুধুমাত্র একটা বিলাসিতা! ”
মাহির : একটা রিকোয়েস্ট করছি। প্লিজ ওকে তুমি বিয়ে করো।
মিস সিক্রেট : কিহ? বিয়ে! আর আমি! জীবনেও না।
মাহির : সিরিয়াসলি, তোমাকে বিয়ে করতে হবে না। শুধু নাটক করতে হবে।
মিস সিক্রেট : মানে তুমি আমার লাইফ নিয়ে খেলতে চাচ্ছো?
মাহির : হ্যাঁ। মানে তেমন কিছুই।
মিস সিক্রেট : সাহস কিভাবে হয়?
মাহির : তুমি তোমার লাইফ নিয়ে খেলো না?
মিস সিক্রেট : আমার অধিকার আছে । তবে তোমার নেই।
মাহির : ট্রাস্ট মি। আমি সুপ্তিকে সাক্ষী রেখে বলছি বিয়েটা হবে না। হয়তো তোমাকে বিয়ের কনে সাজতে হতে পারে তবে বিয়েটা হবে না।
মিস সিক্রেট : তুমি তো হাজারটা মেয়ের সাথে থাকো। বিশ্বাস করবো কিভাবে? আর তাছাড়াও ওই রুদ্রকে বের করতে আমার জাস্ট একটা দিন লাগবে। বড়জোড় দুইদিনই লাগবে ধরলাম। তাহলে আমি নাটকটা করবো কেন?
মাহির : তুমি খুব ভালো করে জানো বলেই আশা করছি মিস সিক্রেট। যে হাজারটা মেয়ে আর সুপ্তি আমার কাছে এক নই। আমি তোমার কাছেই প্রথম স্বীকার করছি আমি সুপ্তিকে ভালোবাসি। আর তাছাড়াও একটু খেলি না রুদ্রর সাথে প্লিজ। আমি প্রমিস করছি ওই রুদ্র তোমাকে টাচও করতে পারবে না।
মিস সিক্রেট মাহিরের কথা শুনে পুরোই হ্যাং হয়ে গেছে। এতটা দ্ধিধায় অনেক দিন পর পড়লো সে।
” ভুল মানুষের কাছে তুমি ভুল কথা বলে ফেলেছো মাহির। ” ( মনে মনে )
মাহির : লিসেন, তুমি রুদ্রকে বের করতে পারলেও মেয়েগুলোকে বের করতে পারবে না। রুদ্রও কিন্তু কাঁচা খেলোয়াড় না। আশা করি সেটাও তুমি বুঝতে পারছো।
মিস সিক্রেট : ওকে। যা ইচ্ছা করো।
“একটু না হয় খেলিই রুদ্রর সাথে। ” ( মনে মনে ) “বাট একটা কানা কড়িও আমি দিবো না। মাইন্ড ইট। আর বিয়ের লেহেঙ্গা যদি আমার পছন্দ না হয় তো আমি বিয়ের আগের দিনই বিয়ে ক্যান্সেল করবো। ”
বলা শেষ করে বেরিয়ে গেলো।
মাহির ভাবতে লাগলো, ” এই মেয়ে কী মজা করে গেল নাকি সিরিয়াসলি বলে গেল!”
মাহির : যাইহোক। বিয়ের কাজ শুরু করি। টাকা কারো না কারো কাছ থেকে ওশুল করেই নিবো। এত বড় ক্রিমিনাল ধরিয়ে দিবো বলে কথা।
মাহিরের ফোনে একটা মেসেজ আসলো মিস সিক্রেটের পক্ষ থেকে। মেসেজটা হলো –
” আমার যদি কিছু হয় মনে রেখো তুমি সুপ্তিকে হারাবে। খুব প্রস্তাবে। খুব বেশিই প্রস্তাবে। ”
মাহির মেসেজটা দেখে হেসে বললো, ” ডোন্ট ওয়ারি। আমি আর কোনো ক্ষতি করবো না তোমার৷ অন্তত সুপ্তির জন্য হলেও। ”
কিছু একটা টাইপ করেও সেন্ট করলো না মাহির।

পুরো দেশে ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেল মিস সিক্রেট আর রুদ্রর বিয়ের কথা ।
অনেকেই খুশি হতে পারলো না। কারণ রুদ্র মিস সিক্রেটকে বিয়ে করলে শাস্তি থেকে বেঁচে যেতে পারে। ওয়ারঅল মিস সিক্রেট তো আর নিজের হাসবেন্ডের কিছু হতে দিবে না।
রুদ্রও ঠিক এটা ভেবেই মিস সিক্রেটকে বিয়ে করতে চেয়েছিল।

মাহফুজ চৌধুরী রীতিমতো মিস সিক্রেটকে জিজ্ঞাসার উপর রেখেছে। মিস সিক্রেট এ বিয়েতে রাজি কিনা। এটা নিয়ে।
মিস সিক্রেট বার বার বলছে সে রাজি না থাকলে তবে কেউ কি তার বিয়ে দিতে পারতো?
এক প্রকার বিরক্ত হয়েই মাহফুজ চৌধুরী চলে গেলো। সে চাই না এ বিয়ে হোক।

মাহিরই সব শপিং করলো। আর রুদ্রও প্রচুর শপিং করে পাঠিয়েছে।
শুক্রবার বিয়ে ধার্য করা হলো। তাদের বিয়েটা মাঝারি আয়োজনে হচ্ছে।
এগুলোতে মিস সিক্রেটের কোনো কিছুই যায় আসছে না। সে খাচ্ছে- দাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, কাজ করছে আর দিন গুনছে।।

#চলবে.,.

Dark Mystery পর্ব-১৫+১৬

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_15
#Sabrina_Summa

সোমবার।
দুপুর প্রায় ১২ টার কাছাকাছি। আজ প্রকৃতিতে কেমন যেন শুনশান নীরবতা। রোদ আছে, বাতাস আছে শুধু মনে শান্তি নেই। সবার না শুধুমাত্র মাহিরের মনে।
মাহিরের নিত্যদিনের অভ্যাস সকালে ঘুম থেকে উঠেই সুপ্তিকে কল করা। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বহুবার কল করেছে মাহির। তবে পরিচিত নাম্বারে অপরিচিত কন্ঠ “কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটি তে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না!” একই কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত মাহির। তাই তো ফোনটা এক কোনে ফেলে দিলো।।

সন্ধ্যে সাতটা। মাহির বাসায় বসে কিছুটা ছটপট করছে। কারণ আজ সারাটা দিন তার সুপ্তির সাথে দেখা বা কথা কোনোটিই হয় নি ৷
তানিশা অনেকক্ষণ ধরে মাহিরকে পর্যবেক্ষণ করে বললো, ” মনে হচ্ছে তুমি সুপ্তির প্রেমে পড়ে গেছো। ” ( শান্ত কণ্ঠে )
মাহির মানতে নারাজ। তাই বিরক্তি নিয়ে বললো, ” অসম্ভব।”
তানিশা : তাহলে এত ছটপট কেন করছো?
মাহির নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো, ” কোথায়! ”
তানিশা : তাশরিফ। ভুলে যেও না আমি তোমাকে তোমার ১৮ বছর থেকে দেখছি। এখন তোমার বয়স ২৬ অর্থাৎ ৮ বছর ধরে আমি তোমার এসিস্ট্যান্ট। আর তাছাড়াও তোমার বয়স আমিও পার করেছি ওয়ারঅল তোমার থেকে বড় আমি।
মাহির : বাদ দেও তো ৷ একটু ভালো ফ্রেন্ড হয়ে গেছে তাই একটু চিন্তা হচ্ছে।
তানিশা : ওকে ফাইন। মেনে নিলাম।
বলেই চলে গেলো।
” তানিশা তো ভুল কিছুই বলে নি। তার পছন্দ না কোনো মেয়ে তাকে পাত্তা দিবে না এই বিষয়টা। এরজন্যই তো সে সুপ্তির সাথে এমন করতো৷ কিন্তু আজ কেন তার এত চিন্তা হচ্ছে। কেন মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে গেছে। যা তার দরকার ছিল। সত্যিই কি সে ভালোবেসে ফেলেছে! ”
মাহির নিজের ভাবনাকে ধমক দিয়ে বললো, ” ছিঃ মাহির। তুই কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারিস না। ”
” এখন এগুলো থেকে বের হওয়ার জন্য খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। ”
তার ব্রেইন যা বললো সে তাই করলো। সাড়ে নয়টার মাঝে শুয়ে পড়লো। এতে হতভম্ব বাড়ির সবাই। যেই ছেলে দশটা এগারোটার আগে বাসায় ফিরে না সেই ছেলে আজ দশটার মধ্যে শুয়ে পড়েছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লো মাহির।

১২ টার ঘর পেরিয়ে ঘড়ির ছোট কাটা এখন ৩ টায় গিয়ে পৌঁছেছে। বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ কেমন যেন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আর মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রাণীর শব্দ তো আছেই।
এমন সময় ঘুম ভেঙে যায় মাহিরের। আর ভালো লাগছে না তার। খুব চিন্তা হচ্ছে। তারমাঝে তার দুঃস্বপ্ন তার চিন্তাকে হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সে এক ক্লাস পানি খেল কিন্তু নিজেকে শান্ত করতে পারলো না।
আর না পেরে কয়েকবার সুপ্তিকে কল করলো। এখনো বন্ধই আছে।
এরপর তানিশাকে কল করলো।
তানিশা কল রিসিভ করে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বললো, ” আরে ভাই। এত রাতে জালাচ্ছিস কেন? ”
মাঝে মাঝেই তানিশা ফান করে মাহিরকে তুই বলে। সো এতে মাইন্ড করলো না মাহির। আর মাইন্ড করার পরিবেশেও নেই সে।
মাহির : তাড়াতাড়ি আমার রুমে এসো।
তানিশা আর দেরি করলো না। কল কেটেই রুমে চলে এলো।
তানিশা : কি হয়েছে! কেউ অ্যাটাক ট্যাটাক করেছে নাকি?
মাহির : আরে না। আমার ভালো লাগতাছে না।

তানিশা রাগী চোখে তাকিয়ে আছে ৷ মাহিরের ভালো লাগছে না তাতে সে কি করবে? তার মধ্যে সে কত আতঙ্কিত হয়ে গেয়েছিল!

মাহির : লোক পাঠিয়ে সুপ্তিকে খুঁজে আনো। ( করুণ কন্ঠে )
তানিশা : পাগল হয়ে গেছো?
মাহির চুপ করে রইলো।
তানিশা : আমি এখন লোক পাঠালে স্যার আমাকে জুতা মেরে বাসা থেকে বের করে দিবে।
মাহির এখনও চুপ রইলো। তার ভালো লাগছে না কিছুই।
তানিশা : ভাই এখন ঘুমা। সকালে দেখা যাবে ৷
বলেই তানিশা চলে গেলো।
মাহির আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তার ঘুম আজ মরে গেছে। তাই পায়চারি করা শুরু করলো।

সকাল ৯ টা।
প্রতিদিনের মতোই আজও মাহফুজ চৌধুরী চিৎকার করে ডাকছে, ” রাগী, এই রাগী। ”
রাগিনী বেগম এসে বললো, ” কি হয়েছে ডাকছো কেন? আর আমার নাম রাগিনী। রাগী না। ”
মাহফুজ চৌধুরী : তো কি হয়েছে। আমি কি বউকে আদর করে ছোট নামে ডাকতে পারি না!
রাগিনী বেগম : মানুষ শুনলে মনে করবে আমি সত্যিই রাগী।
মাহফুজ চৌধুরী : যা সত্যি তাই তো মনে করবে।
রাগিনী বেগম : কিহ! আমি রাগী? কে বলেছে তোমাকে?
মাহফুজ চৌধুরী : তোমার বাবা মানে আমার শশুর।
রাগিনী বেগম : বাবা মারা গেছে কিন্তু তার কথা এখনও রয়ে গেছে।
মাহফুজ চৌধুরী : হুম। এখন বলো তোমার ছেলে কোথায়? ৯ টার সময় আমরা একসাথে খেতে বসি। জানে না সে! সবসময় ডেকে আনতে হয়৷
( ড্রাইনিং এ বসতে বসতে )
রাগিনী : ও পরে খেয়ে নিবে।
মাহফুজ চৌধুরী : পরে খাবে কেন? বিভিন্ন অজুহাতে ভার্সিটিতে যাবে না আজ! এমনিতে তো ৯ টার দিকেই বের হয়ে যায়।
তানিশা : না স্যার। আজকে যাবে না।
( ড্রাইনিং এ বসতে বসতে )
মাহফুজ চৌধুরী : তুমি এসেছো তাহলে তাশরিফ কোথায়?
তানিশা : স্যার, তাশরিফকে রুমে খাবার দিয়ে আসবো ৷
মাহফুজ চৌধুরী : কেন অসুস্থ নাকি?
তানিশা : অসুস্থ না তবে কেমন জানি মনমরা হয়ে আছে।
মাহফুজ চৌধুরী আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো ।

#চলবে.,.

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_16
#Sabrina_Summa

সূর্য আজ তার প্রখরতা একটু বেশিই দেখাচ্ছে । তাই তো সময় ধারণা করাটা একটু কঠিনই হয়ে পড়েছে।
মধ্যাহ্নের খাবার খাওয়া সবারই শেষ সেই ২ টার দিকে । তবে একজন বাদে। সে হলো মাহির। মধ্যাহ্নের খাবার তো দূর, সকালের খাবারই খাওয়া হয় নি তার।
মাহফুজ চৌধুরী অবশ্য এসেছিল ছেলেকে দেখতে। তবে ছেলের আপদারে বিরক্ত সে।
মাহির বারবার একটা কথায় বলছিল, ” বাবা, একটা মেয়েকে খুঁজে এনে দেও না প্লিজ। জীবনে যা বলবে সব মেনে নিবো। ”
এ কথা শুনে মাহফুজ চৌধুরী বের হয়ে গেছে। যেতে যেতে রাগিনী বেগমকে বললো, ” তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে। ”
রাগিনী বেগম মাহিরের রুমে ঢুকলেন।
মাহির ফ্লোরে বসে আছে। সেভাবেই বললো, ” আম্মু প্লিজ বাবাকে বলো না সুপ্তিকে খুঁজে এনে দিতে। আমি প্রমিস করছি কখনো অন্য মেয়ের দিকে তাকাবো না। ”
রাগিনী বেগম কিছুক্ষণ মাহিরকে পর্যবেক্ষণ করে বললো, ” কেন খুঁজছিস মেয়েটাকে? ”
মাহির : আমি জানি না। আমি শুধু জানি, আই ওয়ান্ট হার। ( চিৎকার করে )
তানিশা : স্যারের পারমিশন ছাড়া আমি কিছুই করতে পারবো না। তবে তোমার বডিগার্ডদের ওকে খুঁজতে লাগিয়েছি।
মাহির : মিস সিক্রেটকে কল দেও।
তানিশা : মিস সিক্রেট কল ধরবে না।
মাহির : ধরবে ৷ দরকার হয় আমি পায়ে ধরে ক্ষমা চাবো ৷ তাও প্লিজ সুপ্তিকে খুঁজে দিতে বলো। ওর বেশি সময় লাগবে না খুঁজতে।
তানিশা : আরে তুমি জানো না মিস সিক্রেট কোনো মিশনে গেলে কল রিসিভ করে না! মিস সিক্রেট মিশনে দেশের বাহিরে গেছে দুইদিনের জন্য।
মাহির : এই মেয়ের এখনই যাইতে হইলো।

ছেলের পাগলামি দেখে আর সহ্য করতে পারছে না রাগিনী বেগম । তাই নিজের স্বামীকে বুঝাতে চলে গেলো।

বিকেল ৫ টা। সময় যেন কাটছে না মাহিরের। কারো জন্য মনটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। তাই তো সে ব্যক্তির খোঁজ নেওয়ার জন্য সুশমিতাকে কল করলো মাহির ৷
সুশমিতা কল রিসিভ করতেই মাহির উত্তেজিত কন্ঠে বললো, ” সুশমিতা, সুপ্তির কোনো খোঁজ জানো? ”
সুশমিতার চিনতে সমস্যা হলো না কলদাতা ব্যক্তিকে। তাই তো স্বাভাবিক ভাবেই বললো, ” না ভাইয়া। আমিও এই প্রশ্নটা করার জন্যই আপনাকে খুঁজছিলাম। ”
মাহির : বাসা কোথায় জানো?
সুশমিতা : না ভাইয়া। কখনো বলে না কতবার জিজ্ঞেস করেছি।
আচ্ছা ভাইয়া চিন্তা করবেন না। সুপ্তি মাঝে মাঝেই এমন উধাও হয়ে যায় । কোনো খোঁজ পেলে বলবেন।
মাহির : তুমি পেলেও বলো।
কল কেটে দিলো মাহির। আবারো ব্যর্থ হলো তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজতে।
” এই মেয়ে এত জেদি কেন? নিজের বাসার এড্রেস কেন দেয় না কাউকে? ”
বলা শেষ করে রাগে দুঃখে ফোনটাকে আছাড় মারলো মাহির। তবে ফোনের তেমন ক্ষতি হলো না।
তানিশা : আচ্ছা এত পাগলামির মানে টা কি? ( রেগে )
মাহির : আই ডোন্ট নো। আই ডোন্ট নো এনিথিং। আই অনলি নো দ্যাট আই নিড হার এট এনি কস্ট। গেট আউট ফম হেয়ার। আই কান্ট বেয়ার এনিওয়ান।
বলা শেষ করে পাশের টেবিলে থাকা পানির গ্লাস আছাড়রমেরে ভেঙে ফেললো ৷
তানিশা রুম থেকে চলে এলো। এখন সেখানে থাকা মানে নিজের সাথে সাথে মাহিরেরও ক্ষতি করা৷

সন্ধ্যার পর থেকে লোক লাগানো হলো সুপ্তিকে খোঁজার জন্য।
মাহফুজ চৌধুরী ছেলের পাগলামিতে বাধ্য হয়েছে লোক লাগাতে। তবে শর্ত দিয়েছে মাহিরকে খাবার খেতে হবে৷।

৭ টার দিকে মাহির খাবার খেল। তার কিছুক্ষণ পরই ঘুমিয়ে পড়লো। কারণ খাবারে ঘুমের ঔষধ মেশানো ছিল। এটাও মাহফুজ চৌধুরী বাধ্য হয়ে করেছে।
সারারাত খোঁজার পরও সুপ্তির কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। এমন কি সুপ্তি কোথায় থাকে সেটা পর্যন্ত জানা গেল না। শুধু পাওয়া গেল সুপ্তির বাবা-মার নাম্বার। সেখানে কল করেও জানা গেল সুপ্তি সেখানে নেই।
তাহলে কোথায় গেল সুপ্তি? এই প্রশ্নটায় সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে ।

মিস সিক্রেট দেশে থাকুক বা বিদেশে। ছোট থেকে বড় সকল খবর তার কাছে থাকবেই। তাই বেশি সময় লাগলো না তার জানতে যে, মাহফুজ চৌধুরী সুপ্তিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে।

মাহিরের ঘুম ভাঙলো সুশমিতার কলে।
গভীর ঘুম নিয়েই কলটা রিসিভ করলো।
সুশমিতা : ভাইয়া। সুপ্তি আমাকে কল করেছিল।
সাথে সাথে মস্তিষ্ক সচল হয়ে গেল মাহিরের। দ্রুত বেগে উঠে বসে বললো, ” কোথায় ও? কি হয়েছিল? ফোন কেন ধরে না? ”
সুশমিতা : এতকিছু তো বলে নি। শুধু বলেছে আজ ভার্সিটিতে আসবে।
মাহির : থ্যাংক ইউ সো মাচ ইনফরমেশনটা দেওয়ার জন্য। এখন রাখি।
বলেই কল কেটে দিলো। ধপাস করে আবারো শুয়ে পড়লো।
প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে তার। এমনিতেই সারাদিন টেনশনে ছিল। তারপর আবার কিছু খাই নি। তারমধ্যে ঘুমের ঔষধ আর এখন তাড়াহুড়ো করে উঠা।
তবে তার একটু হলেও মনে শান্তি লাগছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিলো পুনে আটটা।

#চলবে.,.

Dark Mystery পর্ব-১২+১৩+১৪

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_12
#Sabrina_Summa

আজ আকাশটা ভালোই মেঘলা। সময় প্রায় ২ টার কাছাকাছি । তবে রোদের ছিটেফোঁটাও নেই।
সুপ্তি আর সুশমিতা ক্লাস থেকে বের হলো। দেখলো একটা মেয়েদের ঝটলা।
সুপ্তির বুঝতে দেরি হলো ভিড়ের কারণ। তবে সুশমিতা বুঝতে না পেরে বললো, ” চলতো দেখি কি হচ্ছে। ”
সুপ্তি এককোনায় দাঁড়িয়ে বললো, ” দরকার নেই। এখানে দাঁড়িয়ে থাক একটু পরেই বুঝবি। ”
প্রায় ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন সুশমিতা কিছু বুঝতে পারলো না তখন আবারও বললো, ” কিছুই তো বুঝতেছি না। ”
সুপ্তিরও আর ভালো লাগছে না দাঁড়িয়ে থাকতে। তাই তারা ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলো।
এতে ভিড় জমিয়েছে যার জন্য সেই কাঙ্খিত ব্যক্তিটি দেখতে পেলো সুপ্তিকে।
ভিড় থেকে কোনোমতে বের হয়ে সুপ্তির হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজের গাড়ির কাছে গেল ।
সুপ্তি হাতটা ঝাপটা মেরে সরিয়ে দিয়ে বললো, ” যখন তখন হাত ধরেন কেন ? প্লে….”
মাহির : চুপ। একদম প্লে বয় বলবে না।
সুপ্তি : ক্যারেক্টার লেস।
মাহির বিরক্ত হলো। সাথে সাথে রেগেও গেল। কিন্তু রাগটা খাটালো না।
সুপ্তি সুশমিতাকে বিদায় দিয়ে দিলো।
মাহির : কোথায় যাচ্ছি আমরা?
সুপ্তি : পুরো ঢাকা ঘুরবো। চলুন।
মাহির : গাড়িতে উঠো।
সুপ্তি : না। গাড়িতে নই হেঁটে হেঁটে। আর হ্যাঁ আপনার বডিগার্ড এসিস্ট্যান্টকে এখানেই রেখে যাবেন।
মাহির চিন্তিত হয়ে বললো, ” কিন্তু আমার সেইফটির বিষয়টাও তো দেখতে হবে।”
সুপ্তি : আমাকে বিশ্বাস করেন না?
মাহির : তা না। বাট…
সুপ্তি : আরে চলুন তো। আপনাকে কেউ চিনবেই না।
সুপ্তি নাছোড়বান্দা হওয়ায় অনেক কষ্টে তার এসিস্ট্যান্টকে বুঝিয়ে বের হলো তারা।
সুপ্তি দোকান থেকে একটা মাস্ক আরেকটা ক্যাপ নিয়ে এলো। সুপ্তি মাহিরকে পড়তে বললে মাহির বললো, ” তুমি পড়বে না? ”
সুপ্তি : আমি আপনার মতো এত ফেইমাস নই। তবে আপনার জন্য আমার ক্লাস আমাকে চিনে ফেলেছে। ( বিরক্ত হয়ে )
মাহির : জাস্ট ওয়েট । তোমার পিছেও সাংবাদিকরা ঘুরবে। দেখো৷
সুপ্তি : আমার পছন্দ না মিডিয়া।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে তারা রাস্তায় এসে পৌঁছেছে।
মাহির : সুপ্তি, দেখো মেয়েটা সুন্দর না?
” তোর কাছে তো দুনিয়ার সব মেয়েই সুন্দর ” (সুপ্তি মনে মনে)
সুপ্তি : কেন বলুন তো?
বলতে গিয়ে খেয়াল করলো মেয়ে দুইটাও মাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।
” এই বেডা মাস্ক পইড়া আছে তাও মাইয়াগুলা ড্যাব ড্যাব কইরা তাকাই আছে ৷ মানলাম সুন্দর। তাই বইলা মাস্ক পড়া থাকলেও তাকাইতে হবো ৷ নিশ্চিত সানগ্লাসের জন্য। তোর সানগ্লাস আমি খুলাইতাছি দাঁড়া! এই বেডারে সানগ্লাস পড়লে এত সুন্দর লাগে ক্যান? ” ( সুপ্তি মনে মনে নিজের সাথে রীতিমতো ঝগড়া করছে )
মাহির সুপ্তিকে জেলাস করানোর জন্য বললো,” আমার সাথে ভালো যাবে না? ”
সুপ্তি : ও আচ্ছা। আমি ডেকে আনছি দাঁড়ান।
বলেই হাঁটা লাগাতে নিলো। আর মাহির হাত ধরে আটকে দিলো।
সুপ্তি বিরক্ত নিয়ে বললো, ” আরে মিয়া সমস্যাটা কি! কথায় কথায় হাত ধরেন।”
মাহির : মেয়েটার চুলও কিন্তু সুন্দর। তবে তোমার বাটারফ্লাই হেয়ারটা বেশি সুন্দর।
সুপ্তির দিকে তাকিয়ে । সুপ্তিও রাগী চোখে তাকালো।
মাহির : প্রশংসা করলেও দোষ! আচ্ছা দেখো না মেয়েগুলো তাকিয়ে আছে। আমাকে কি এতই হ্যান্ডসাম লাগছে?
সুপ্তি : আপনার কি মনে হয়। ওরা আপনার রুপের জন্য তাকিয়ে আছে ! না। ওরা আপনাকে একটা চোর ভাবছে। যে কিনা মাস্ক আর সানগ্লাস পরে নিজের চেহারা ঢাকছে।
মাহির : কিহ!
সুপ্তি : কি না জ্বি।
মাহির : তাহলে আমি কি করবো?
সুপ্তি : সানগ্লাসটা খুলে পকেটে রাখুন।
মাহিরও তাই করলো। সুপ্তি দেখলো মেয়েগুলো আরো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মাহিরও খেয়াল করলো।
সুপ্তির রাগ হচ্ছে মাহিরের উপরে। আর মাহিরের মনে হচ্ছে তারা তাকে চিনে ফেলেছে।
তাই সুপ্তি আর মাহির দুইজনেই সেখান থেকে চলে এলো।
সারাদিন তারা অনেক ঘুরাঘুরি করলো।
সুপ্তি ইচ্ছে করেই মাহিরকে বস্তুিতে নিয়ে গিয়েছিল। কারণ মাহির যেন দরিদ্রদের কষ্টটা বুঝতে পারে।
মাহফুজ চৌধুরী দান খয়রাত করে এটা সত্য তবে মাহির তা পছন্দ করে না। তাই তাকে এখানে আনা। যদি কোনো উন্নতি হয়।
সুপ্তি খেয়াল করলো কিছু হলেও মাহির বুঝতে পারছে। কয়েক বছরের ধারণা তো আর একদিনে চলে যাবে না!

#চলবে.,.

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_13
#Sabrina_Summa

ধীরে ধীরে কেটে গেছে কয়েকটি মাস। সময়ের নীরব ধারায় সুপ্তি আর মাহিরের সম্পর্ক এখন এক গভীর, শান্ত বন্ধুত্বের রূপ নিয়েছে—যেখানে আবেগ আছে, অথচ দাবি নেই।।
আড্ডার মাঝে কাটে তাদের দিন। সুপ্তি এখন নিয়মিত ভার্সিটিতে আসে। আর মাহিরও সুপ্তিকে দেখার জন্য কোনো না কোনো বাহানাতে আসে।

আজ মাহির সুপ্তিকে একটা অফিশিয়াল অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছে। সুপ্তি আসতে চাই নি তবে মাহিরের জোরাজোরিতে আসতে বাধ্য হয়েছে। এখানে অবশ্য তার প্রবেশের অনুমতি ছিল না কিন্তু মাহিরের সাথে আসায় প্রবেশ করতে পেরেছে। মাহফুজ চৌধুরী ও মিস সিক্রেটকে আমন্ত্রণ করা হলেও তারা আসে নি।
সুপ্তি পিছনে বসে আছে । সকলের বক্তৃতা শুনছে মনোযোগ সহকারে। মাহির বক্তৃতার জন্য স্টেজে উঠলে সুপ্তি ছবি তোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু পিছে বসায় ব্যর্থ হলো।
অনুষ্ঠান শেষ হতেই সবাই গেল মিটিং রুমে। সুপ্তিও গেল মাহিরের পিছে পিছে ।
সুপ্তি থাকায় কেউ মিটিং শুরু করছে না । বিষয়টা মাহির খুব ভালোই বুঝছে। তবে সে নাছোড়বান্দার মতো বললো, ” আমার ফ্রেন্ড ও। ও বের হয়ে যাওয়াই মানে আমি বের হওয়া। যদি বেশি সমস্যা হয় আমরা দুইজনেই বের হয়ে যাচ্ছি পরে দেখবো মিটিং কিভাবে হয়! ”
এরপর আর কারোই কিছু বলার থাকলো না।
” মিস সিক্রেটের জন্য ভালোই হলো। পরবর্তী কাজে লাগবে ৷ ” ( সুপ্তি মনে মনে )
সুপ্তি এমনভাবে ফোন চালাচ্ছে যে মনে হচ্ছে সে কিছুই খেয়াল করছে না । তবে সবার প্রতিই নজর রাখছে সে।
মিটিং শেষ হতেই সকলে বেড়িয়ে গেল। কয়েকজন যেতে যেতে বললো, ” তাশরিফ তুমি যাবে না?”
মাহির : আপনারা যান আমি একটু পর আসছি।
সকলে যেতেই মাহির সুপ্তির কাছে আসলো। চেয়ারটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো, ” তখন ছবি তুলছিলে না! এখন তুলো। ”
সুপ্তি : এখন কেন তুলবো?
মাহির : কেন তখন সুন্দর লাগছিল এখন লাগছে না?
সুপ্তি : আপনাকে কে বললো আমি সুন্দরের জন্যই তুলছিলাম!
” সুন্দরের জন্যই তো তুলছিলাম। ফর্মাল গ্রেটআপে খুবই হ্যান্ডসাম লাগছিল তখন। এখনও লাগছে। “( সুপ্তি মনে মনে )
মাহির : মেয়েদের সাথে মিশতে মিশতে তাদের এক্সপ্রেসন দেখেই বুঝতে পারি। স্প্রেশালি তোমাকে।
সুপ্তি : ওকে, দাঁড়ান তুলছি।
মাহির একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। সুপ্তি চেয়ারে বসে ক্যামেরা ধরে বললো, ” একটু কাছে আসুন। ”
এটাই যেন মাহির শুনতে চাচ্ছিল । একটু একটু করে এগিয়ে আসছে ।
সুপ্তি বিরক্ত নিয়ে তাকালো। মাহির এগিয়ে এসে সুপ্তির চেয়ার ধরে সুপ্তির সামনে ঝুঁকলো ৷ সুপ্তি পিছিয়ে যেতেই মাহির আরেকটু ঝুঁকে বললো, ” এখন ঠিক আছে? ”
সুপ্তির হাতের চাপে এভাবেই কিছু ছবি উঠে গেল।
সুপ্তি : না আরেকটু কাছে আসলে ভালো হতো। সরুন এখান থেকে।
মাহির সরে যেতেই সুপ্তি চেয়ার নিয়ে পড়ে গেলো। সুপ্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতেই পারে নি মাহিরের ধরাতে চেয়ারটা ভারসাম্যহীন অবস্থায় ছিল। মাহির হাত এগিয়ে দিল।
সুপ্তি ধরতেই যাবে তার আগে মাহির বললো,” আরে ফোনটা চাচ্ছি। ”
আরেকটা ঝটকা খেল সুপ্তি।
সুপ্তি না দেওয়ায় মাহিরই ফোনটা নিয়ে বললো, ” কতদিন যাবত ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়ে রেখেছি এফবিতে। কিন্তু তুমি এক্সসেপ্টই করছো না। ”
সুপ্তি দাঁড়িয়ে বললো, ” আমাকে এফবি, ইনস্টা, ইমো এগুলোতে পাওয়া যায় না। ”
মাহির : এখন থেকে পাওয়া যাবে।
ফোনে কিছু একটা করার পর ফোনটা দিয়ে বললো, ” চলো তোমাকে ড্রপ করে আসি। ”
সুপ্তি : আপনার বিরক্ত লাগে না এ কথা বলতে! গত কয়েকমাস ধরে বলে আসছেন।
মাহির : কি করবো তুমি রাজিই হও না।
সুপ্তি : হবোও না।
মাহির : এত প্রাইভেট কি রাখো বলো তো?
সুপ্তি : কিছুই না। শুধু কেউ যাক তা পছন্দ করি না।
মাহির হতাশার হাসি দিলো।
” না “শব্দটা শুনতে কারোরই ভালো লাগে না। ভাগ্যিস তার ধৈর্যটা আছে।।
কথা শেষ করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গেল দুজন।।।

#চলবে.,.

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_14
#Sabrina_Summa

সকাল প্রায় পুনে সাতটা।
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে উকি দিচ্ছিল সকালের হালকা রোদ যা চোখে পড়ছিল সুপ্তির, কিন্তু চোখের পাতায় যেন সেঁটে ছিল ঘুমের ভার। ঠিক তখনই ফোনটা কাঁপতে কাঁপতে বেজে উঠল — বিরক্তিকর অথচ পরিচিত শব্দে।

“সুশমিতা”
স্ক্রিনে নামটা দেখে এক মুহূর্ত থমকে গেল। কপালের উপর পড়ে থাকা চুল সরিয়ে আলতোভাবে ফোনটা কানে ধরল সে।

“হ্যালো…” – আধো ঘুমে ঢুলে পড়া কণ্ঠ, যেন শব্দ নয়, নিঃশ্বাস বের হলো।
সুশমিতা বিরক্ত ঢেলে বললো, ” আরে রাখ তোর হ্যালো। এফবিতে ঢুক। তাশরিফ তোকে মেনশন দিছে।”
কল কেটে দিলো সুশমিতা। সুপ্তি বিরক্ত হলো তবুও এফবি লগ ইন করলো। কিন্তু তার মনেই পড়ছে না, তাশরিফটা কে? আর তাকে মেনশন দিছে তাতেই বা কি সমস্যা হয়েছে?
এফবিতে ঢুকেই দেখলো ৯৯৯+ নোটিফিকেশন। এটা তার জন্য অবাক করার কিছু নই। কারণ সে এফবিতে ঢুকে না।
নোটিফিকেশন লিস্টে প্রথমেই তাশরিফের মেনশন করাটা পেয়ে গেল।
সেটাতে ক্লিক করতেই দেখলো, @Rishita Khanom I LOVE YOU…
এতক্ষণে বুঝতে পারলো সুশমিতা কেন এত উত্তেজিত ছিল।
সুশমিতা সুপ্তির আইডিটা দেখাশোনা করে। খুব শখ করে আইডির পাসওয়ার্ড নিয়ে ছিল সে। কিন্তু যেদিন এফবিতে ঢুকলো হাজারটা মেসেজ, নোটিফিকেশন দেখে সেদিনই তার শখ মরে গেছে। মাঝে মাঝে লগ ইন করে। আজও তাই করেছিল। তাই তো মাহিরের মেনশন চোখে পড়েছে।
সুপ্তি তাশরিফের মেনশনে কমেন্ট করলো,” আরে মিয়া মজা পাইছেন! ”
কয়েক সেকেন্ডের মাঝে রিপ্লাই আসলো, ” হ্যাঁ।”
সুপ্তি লিখলো,” ধূর এসব পাগল ছাগল কোথা থেকে যে আসে! ”
সাথে সাথেই মাহির কল করলো।
মাহির : আসসালামু আলাইকুম।
সুপ্তি : ওয়ালাইকুম আসসালাম। আচ্ছা, সূর্য কি আজ পশ্চিম দিকে উঠেছে!
মাহির : কেন? তবে এটা আমারও মনে হচ্ছে।
সুপ্তি : না মানে আপনি সালাম দিচ্ছেন! কিন্তু আপনার কেন মনে হচ্ছে ?
মাহির : তুমি এত সকালে উঠেছো তাই।
সুপ্তি : আমাকে সুশমিতা উঠিয়েছে ।
মাহির : ও৷ আচ্ছা এটা বললো আমি কি পাগল নাকি ছাগল?
সুপ্তি : কেন?
মাহির : তুমিই তো বললে।
সুপ্তি : কখন!
মনে পড়ায় বললো, ” ও আচ্ছ। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আপনার ডাকনাম তাশরিফ। ”
মাহির : কিহ! এটাও ভুলার জিনিস!
সুপ্তি : আচ্ছা আপনি এটা কেন করলেন? মানুষ কি মনে করবে!
মাহির : এখানে লেখায় আছে। @ দেওয়ার পর যার নাম আসবে তাকে মেনশন করে I LOVE YOU বলতে হবে। No cheating ও লেখা আছে।
সুপ্তি : এমন বাচ্চামি আপনার মানায় না। ডিলিট করুন।
মাহির : আগে বলো সত্যিই এটা বললে কি করতে?
সুপ্তি : আমার উত্তর শুনতে চাচ্ছেন?
মাহির : হুম।
সুপ্তি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো, ” আপনি তো বলেন নি তাহলে উত্তর কেন দিবো! ”
মাহির : ধরো আমি বলছি।
সুপ্তি : আমি জীবনে “ধরো” এবং “যদি” এই দুইটা শব্দকে বিশ্বাস করি না।
মাহির : তাহলে আমি ডিলিটও করবো না।
সুপ্তি : মাহির… ( টেনে )
মাহির : এভাবে বলো না হার্টে গিয়ে লাগে তো!
বলেই ধপাস করে বেডে পড়ে গেলো।
সুপ্তি : আমার সাথে ফ্লাটিং করে লাভ হবে না।
মাহির : কি করবো বলো। অন্য মেয়েদের সাথে ফ্লাটিং করতেও তো আর ভালো লাগে না। তাি তোমার সাথেই করছি।
” যাইহোক তোমাকে ভালো বানানোর কাজে এক ধাপ এগিয়েছি তার মানে! “( সুপ্তি মনে মনে )
মাহির : কি হলো চুপ কেন! আমার কথা শুনে পটে গেলে নাকি?
সুপ্তি : ডিলিট করুন।
মাহির : ওকে, করছি।
সুপ্তি : গুড নাইট।
বলেই কল কেটে দিলো।
মাহির বলে উঠলো, ” সাড়ে সাতটায় গুড নাইট হয় কবে থেকে! এ মেয়ে পাগল হয়ে গেল নাকি! ”

আজও তারা আড্ডা দিলো। তারা যে শুধু আড্ডা দেয় তা নয়। মাহির সুপ্তিকে পড়াশোনাতেও হেল্প করে। মাহিরও তো সামাজিক বিজ্ঞান নিয়েই পড়েছে ।।

#চলবে.,.

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৪৯

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪৯
মেহনুরের সারারাত ঘুম হয়নি৷ বেডে এপাশ ওপাশ করে রাতটা কাটিয়ে দিয়েছে। খুব ভোরে রুম থেকে বের হয়েছিলো বাগানে হাঁটতে যাওয়ার জন্য। তখন চোখে পড়লো জিয়ান নয়নাকে চাদরে পেঁচিয়ে কোলে করে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে। মেহনুর নিজের চোখের জল উল্টো পিঠে মুছে নিলো৷ সহ্য হচ্ছে না তার নয়নাকে! একটা সতেরো বছরের বাচ্চা মেয়ে! সে-সব পেয়ে গেলো যা সে চব্বিশ বছরেও পেলো না! একজন আদর্শ হ্যাসবেন্ড,পরিপূর্ণ সংসার সব পেয়েছে৷ মেহনুর নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো৷ ইচ্ছে করছে নিজেকে শেষ করে দিতে নিজের হার সে মানতে পারছে না। কেনে হলো এমন! নয়না কেন জিয়ানের সাথে থাকবে? জিয়ানের মত ছেলে ওর মত মেয়ে ডিজার্ভ করে না৷ ওতো আমার মতো এডুকেডেট কাউকে ডিজার্ভ করে। তাহলে কেনো নয়না এই বাড়িতে আমার স্থানে!

🌿

দুপুরের ঝকঝকে রোদ জানালার পর্দার ফাঁকফোকর ভেদ করে নয়নার চোখে মুখে খেলা করছে৷ নয়না বারবার চোখ পিটপিট করছে। রোদের তীব্রতা আরো বাড়তে লাগলো। নয়না কপাল কুঁচকে চোখ মেললো। পর্দা সরিয়ে জানালার সামনে নগ্ন দেহে দাঁড়িয়ে আছে জিয়ান।
“নয়না ঘড়ির দিকে তাকালো বেলা একটা পনেরো বাজে! নয়নার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো৷ তারমানে এতোক্ষণে রেজাল্ট প্রকাশ হয়ে গেছে! নয়নার মুখ ফেকাসে হয়ে গেলো।

“জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,গুডমর্নিং ডিয়ার বাটার মাশরুম। হ্যাভ এ নাইস ডে মিসেস চৌধুরী।”
“নয়না নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোন হেলদোল নেই।”
“জিয়ান নয়নার পাশে এসে বসলো, নয়নাকে ধরে নিজের কোলে বসিয়ে বলে,পিচ্চি বৌ কি হয়েছে গো তোমার?এমন চাঁদের মত মুখশ্রীতে আমাবস্যা নেমে আসলো কেনো?”
“নয়না চুপ করে রইলো। জিয়ান নয়নাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরতে লাগলো।
“কি হচ্ছে ছাড়ুন আমাকে। এসব একদম ভালো লাগছে না৷”
“আমার ভালো লাগছে আজ আমার খুশির দিন সবচেয়ে আনন্দের দিন। জান, জান, জান, তুমি ঢাকা বিভাগে টপ রেজাল্ট করেছো।ইশশ আজ পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করবো। লাভ ইউ জান৷ লাভ ইউ সো সো সো মাচ।”
“নয়না জিয়ানের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো৷ তার চোখ ভিজে উঠলো।”
“জিয়ান নয়নাকে চুমু দিতে লাগলো পুরো মুখ আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলে,এখনো মন খারাপ করে থাকবে ডিয়ার পিচ্চি বৌ?”
“একদম বিচ্চি বৌ বলবেন আমার বয়স সতেরো বছর।”
” আহা টপার বৌ যা বলবে তাই তো শুনতে হবে৷ যাও রেডি হও৷ সবাই ভাবছে ছেলে আর বৌ পুরো রাত বাসর করেছে এখন অর্ধেক দিনও বাসর করছে!”
“নামান আমাকে৷”
“নয়না ওড়না খুঁজে জড়িয়ে নিলো গায়ে৷ চুপচাপ বেডের উপর বসে রইলো৷”
“জিয়ান ব্ল্যাক কালারের টিশার্ট পরলো। চুলগুলো ঠিক করে বলে,যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো বড্ড খিদে পেয়েছে খেতে হবে তো। বৌ খেয়ে মন ভরে পেট তো ভরে না৷”
” আমার লজ্জা লাগছে। কি করে নিচে যাবো!সবাই কি ভাববে?”
“সবাই কি ভাববে মানে! সবাই ভাববে তাদের পিচ্চি বৌ স্বামী সোহাগি হয়ে গেছে।বোকা বোকা কথা না বলে উঠো তো৷”
” না আমি যাবো না আমার লজ্জা লাগছে।”
“হাঁটুর বয়সী নিব্বি বিয়ে করলে এই এক সমস্যা সব সময় বেশি বুঝে!”
“নয়না বেডের উপর দাঁড়িয়ে বলে, হাঁটুর বয়সী আবার কি! দেখুন তো কে লম্বা?”
“আপনি লম্বা ম্যাম দয়া করে, নিচে চলুন।”
“নয়না বলল,আপনি যান আমি আসছি।”
“জিয়ান নিচে এসে দেখে,মাহবুব তালুকদার, মিজান তালুকদার, জাহানারা বেগম, সূচনা সোফায় বসা৷
“সবাইকে সালাম দিয়ে বলে,আপনারা কখন আসলেন?”
“মেয়ের রেজাল্ট শুনে চলে আসলাম।”
“মিতা বেগম বললেন, খুব ভালো করেছেন৷ আজ দুপুর সবাই একসাথে খাবো। জিয়ানের বাবাও আসছে।”
“জিয়ান সুচনার পাশে বসে বলে,কিগো পাঁকা বুড়ি আজ এতো চুপচাপ কেনো!”
“সূচনা চুপ কোন কথার উত্তর দিচ্ছেনা।”
“জাহিন বাসায় ঢুকে এতো মানুষ দেখে সালাম দিলো৷”
“ওনারা সবাই অবাক! দুজন শুধু দেখতেই নয় কন্ঠও প্রায় সেম।”
“জিয়ান হেসে বলে,ও আমার ছোট ভাই জাহিন৷ জাহিন এনারা আমার শ্বশুর বাড়ির মানুষ। ইনি আমার চাচা শ্বশুর, আর ইনি আমার বাবা, ইনি আমার শ্বাশুড়ি আম্মা৷ আর এই যে সুইট গার্ল সে হচ্ছে আর্ধেক ঘরওয়ালী৷”
“জাহিন সবার সাথে কুলশ বিনিময় করলো।জিয়ানের পাশেই বসে আছে জাহিন।”
” নয়না নিচে এসে সবাইকে দেখে খুশি হয়ে গেলো তার আনন্দ দ্বিগুন হয়ে গেলো৷”
“জাহিন আড়চোখে নয়নার দিকে তাকালো৷ মনে মনে বলে,বিয়ে করলে এমন একটা কিউটের ডিব্বাকেই করবো।”

“সবাই একসাথে সুন্দর একটা দিন কাটালো৷ তালুকদার বাড়ির সবাই বাসায় চলে গেলো৷ নয়না জানালার পাশের সোফায় বসে আছে। রুমের লাইট অফ। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। এতোকিছুর পরেও নয়নার মনটা কেমন উদাস৷ সে যেনো সব পেয়েও অপূর্ণ! যে কিনা তার হ্যাসবেন্ডের স্পর্শ অনুভব করতে ব্যর্থ। চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। মন কখন কি চায় মন হয়ত নিজেও তা জানেনা। নয়না মৃদু স্বরে আওড়াচ্ছে….

“নির্জনে বয়ে চলে বাতাস, চুপচাপ সুরে গান গায় বিরহের , আকাশের কোলে চাঁদ হাসে, নক্ষত্রেরা চুপচাপ ডাকে জোছনা বিলায়, তবুও লোকে চাঁদের প্রেমে পরে!
বনপথে পাতা ঝরে যায়, কিংবা নদী বহে দূর প্রবাহে, তারা কেউ জানেনা, হৃদয়ে কি এক অশান্তি, যা নেই কোথাও, তা অদৃশ্য, প্রগাঢ়।সে যেনো জেনেও জানেনা, বুঝেও বুঝে না মনের গহীন ক্ষত!
মনের গভীরে রয়ে যায় অপূর্ণ স্বপ্ন, যা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছি, এ জীবনে তা যেনো পেয়েও হারিয়েছি৷ এ জীবন হোক কিংবা পরবর্তী, আমি তো শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছি সে অসীম সুধা যা আমায় তৃষ্ণায় বিতৃষ্ণ করছে।”
“জিয়ান চুপিসারে নয়নার পায়ের উপর মাথা রেখে শুয়ে পরলো।
“নয়না দ্রুত চোখ মুছলো,আপনি কখন এলেন?”
“যখন কেউ তার হরিণের মত মায়াবী চোখ থেকে টুপটাপ বৃষ্টি ঝড়াচ্ছিল তখন। তুমি কি জানো তুমি কাঁদলে আমার মনের আকাশেও মেঘ জমে? কোন অজুহাত শুনবো না আমি জানতে চাই কেনো কান্না করছিলে?”
“নয়নার চোখ যেনো বাঁধ মানছে না। সে বর্ষণমুখর হয়ে গেলো।”
“জিয়ান উঠে বসলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নয়নাকে৷ বিচলিত কন্ঠ শুধালো, কি হয়েছে তোমার! আমি কি তবে আবারও তোমার হৃদয় গভীর কোন ক্ষত তৈরি করেছি? আমি জানি তোমার বয়স কম। কিন্তু আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি৷ আমি ব্যর্থ হয়েছে আমার পুরুষত্বের কাছে! আমি এবার গেলে তোমার আঠারো বছর পূর্ন না হওয়া পর্যন্ত আসবো না৷ দূর থেকে তোমাকে ভালোবাসবো। তবুও তোমার কষ্টের কারন হতে চাই না। তোমাকে এতো কাছে পেয়েও দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব না।”
“নয়না শব্দ করে কান্না করছে। জিয়ানের টিশার্ট শক্ত করে খামচে ধরে বলে,আমি আপনাকে পরিপূর্ণ ভাবে পেতে চাই। আমার হৃদয় তৃষ্ণায় ছটফট করছে৷ সে তৃপ্ত হচ্ছে না৷ আমি আপনার স্পর্শ অনুভব করতে চাই।”
” জিয়ান থমকে গেলো! তবে কি কাল রাতে নয়না নিজের সাথে যুদ্ধ করে সবটা সহ্য করেছে! কিছুক্ষণ পর জিয়ান নয়নার থুতনিতে হাত রেখে বলে,কি হয়েছে আমাকে বলো,তোমার জন্য কষ্টকর হলে আমাকে বাঁধা দিলে না কেনো!”
“নয়না নিজের দৃষ্টি নত করে বলে,আমার নানুমনি বলেছে,নিজের পুরুষকে সব সময় নিজের আঁচলে বেঁধে রাখতে হলে নিজেকে পুরোপুরি শপে দিতে হয়৷ আমি আপনাকে সব সময় আমার করে রাখতে চাই৷ আমি এতোটাও অবুঝ না যে স্বামী স্ত্রীর এই মিলন সম্পর্কে অবগত না। কিন্তু আপনি আমার যত কাছে আসেন আমি না চাইতেও ওই রাত আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। গতকাল রাত ছিলো আপনাকে পুরোপুরি আমার করার রাত৷ অথচ আমি আপনার স্পর্শের মাদকতা অনুভব করতে পারিনি!আমি সব ভাবে আপনাকে চাই।আপনাকে চাই আপনাকেই চাই৷”
“জিয়ান নয়নার চোখের কোনের জমে থাকা জলটুকু মুছে দিয়ে বলে,আমি শুধু তোমার, তোমার পাইলট মহাশয় শুধু তার বাটার মাশরুমের। এজন্মে আমি তোমাকে ছাড়বো না৷”

দু’জনে দু’জনের কপালে কপাল ঠেকিয়ে রাখলো দীর্ঘ সময়। জিয়ান নয়নার কপালে চুমু দিলো। জিয়ানের চুলগুলোতে আঙ্গুল ডুবিয়ে আলতে হাতে হাত বোলাতে লাগলো৷ নয়না জিয়ানের বুকে মাথা রেখে বসে আছে।
“জিয়ান বলল,আমার ছুটি তো শেষ আগামীকাল আমাকে চলে যেতে হবে। কি করে থাকবো আমার বাটার মাশরুমকে ছাড়া!”
“নয়না সামনে ঘুরে বলে,চলে যাবেন মানে?”
#চলবে

সবিতা পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0

সবিতা
শেষ পর্ব
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্র এখন স্থানীয় পর্যায়ে একটা পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে।
এটা আর শুধু একটামাত্র স্কুল না, এটি একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি মেয়ের মধ্যে স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাসের আলো জ্বলে উঠছে।
তবে এই সফলতার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা অপেক্ষা করছে।

একদিন দুপুরের দিকে সবিতা স্কুলে পৌঁছানোর আগেই একজন পুরুষ শিক্ষার্থী এসে তাকে জানায়,

— “আপু, একদল লোক এসেছিল স্কুলের সামনে, তারা কিছু বলতে চাইছিল।”

সবিতার মন খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু কিছু বলার আগেই তাওহীদ আসে।

— “সব ঠিক আছে।তবে তারা শুধু জানিয়ে গিয়েছে যে আমরা অগ্রহণযোগ্য।”

এটা ছিল তাদের জন্য প্রথম বড় প্রতিবাদ।
স্থানীয় কয়েকজন সমাজকর্মী এবং আত্মীয়স্বজন এই স্কুলের বিরোধিতা শুরু করেছে।
তারা বলতে শুরু করেছে, “এই স্কুল মেয়েদেরকে খারাপ পথে পরিচালিত করছে, এখান থেকে মেয়েরা স্বাধীন হয়ে যাবে, তাদের চরিত্র নষ্ট হবে।”

এই অভিযোগগুলো সবিতার মনের ভিতরে গুরতর ভাবে আঘাত হানে।
কিন্তু সে জানত, এসব বাধা শুধু তার পথকে শক্ত করবে।
যেহেতু সে নিজেই নিজের সংগ্রাম, নিজের সাহস, আর নিজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জেনেছে—অন্ধকারে একটু আলোই পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে।

রুমাইসা স্কুলে প্রথম এসেছিল শঙ্কিত মন নিয়ে, কিন্তু এখন সে পুরোপুরি বদলে গেছে।
প্রতিদিন নতুন কিছু শিখে, নিজের সাহস বাড়িয়ে, আজ সে নবআলোর সেরা শিক্ষার্থী।

একদিন সবিতা তাকে বসিয়ে বলল,

— “রুমাইসা, আজকে তোর যা অর্জন, সেটা আমি শুধু চেহারায় দেখলাম না, তোর চোখেও দেখলাম।
তুই এখন সাহসী, তুই এখন নিজের ভালোবাসার জন্য লড়াই করতে জানিস।”

রুমাইসা মাথা নিচু করে বলে,

— “আপু, আমি জানতাম না, আমাকে শিক্ষার আলো দিবে এমন কেউ কখনও আসবে। আজ আমি জানি—আমার কাছে আর কোনো বাধা নেই।”

এটা সবিতার চোখে অশ্রু এনে দেয়।
এটা সেই মুহূর্ত ছিল, যখন সে বুঝেছিল, তার সংগ্রাম একমাত্র নিজের জন্য নয়, বরং এই মেয়েদের জন্য।

একদিন স্কুলের শিক্ষিকা রুনা আপু এসে সবিতার কাছে জানান,

— “কিছু স্থানীয় নেতারা বলেছে, তারা নবআলোকে বন্ধ করতে চায়।
তাদের দাবি, এই স্কুলে পড়া মেয়েরা অনেক কিছু শিখছে যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর।”

সবিতা অবাক হয়ে যায়,

— “এটা তো কখনোই ভাবিনি। কিন্তু আমি তাদের বলব—এখানে আমরা শুধু মেয়েদের শিক্ষা নয়, মানবিকতা ও স্বাধীনতা শেখাই।”

তাওহীদ আসে, এবং তাকে সমর্থন দেয়।

— “তুমি একা না সবিতা। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। এই সংগ্রাম আমরা একসঙ্গে করব।”

সবিতার মনে শান্তি ফিরে আসে।
এটা তার সংগ্রামের দ্বিতীয় বড় পর্ব।
কিন্তু সে জানে, এবার কোনোরকম ভয় বা সন্ত্রাস তাকে থামাতে পারবে না।

একদিন রাতে সবিতা বসে থাকে একা, নতুন কিছু পরিকল্পনা নিয়ে।
— “আমি আর থামব না। এখানে কিছু পাথর ফেলা হলে, আমি সেই পাথরগুলো নিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করব।
আমার মেয়েরা সব ধরণের বাধা টপকাতে পারবে।”

সে ঠিক করে, এই প্রতিবাদকেই শক্তি হিসেবে নিতে হবে।
যে সমাজ তাকে বাধা দিতে চায়, সেই সমাজকে দেখিয়ে দিতে হবে—মেয়েরা শুধু দাসত্বের জন্য জন্ম নেয় না,
তারা স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার রাখে।

তাওহীদ এসে দাঁড়িয়ে বলল,

— “তুমি একদিন পুরো সমাজের চোখ খুলে দিবে সবিতা, তোমার স্বপ্নগুলো রূপান্তরিত হবে বাস্তবে।
তোমার সংগ্রাম শুরুর দিকে ছিল একক, কিন্তু এখন সেটা সবার। আর আমরা সবাই তোমার পাশে আছি।”

নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্রের পথ চলা ক্রমশ আরও জটিল হয়ে উঠছে। সবিতা জানে, এই যাত্রা সহজ হবে না। সমাজের পুরনো ধ্যানধারণা আর বদ্ধমূল বিশ্বাসগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে আরও শক্ত হতে হবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা কেবল সমাজের মানুষই নয়, কিছু রাজনৈতিক শক্তিও। এখন এই পথটাই সবিতার জন্য সত্যিকারের পরীক্ষা।

একদিন দুপুরের পরে সবিতা স্কুলে পৌঁছানোর আগে, স্থানীয় এক নেতা এসে জানায়,

— “তোমার স্কুলের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠেছে। যদি এসব বন্ধ না হয়, আমরা তোমাকে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করব।”

সবিতা একটু থমকে দাঁড়িয়ে যায়।

— “অভিযোগ কি ধরনের?”

— “মেয়েদের মনে স্বাধীনতার ভাবনা, অশিক্ষার পরিবেশ। এমনকি, অনেকের মতে, এখানে এসে মেয়েরা সমাজের নৈতিকতার বিরুদ্ধে কাজ করছে।”

এই কথাগুলো সবিতার মনকে একেবারে শূন্য করে দেয়, তবে সে জানে, হাল ছাড়লে তো চলবে না। সে দৃঢ়তার সাথে জানায়,

— “আমরা শুধু মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করছি। আর এই শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের জন্য ভালো কিছু হতে পারে, এটাই আমার বিশ্বাস।”

নেতা কিছু না বলে চলে যায়, কিন্তু তার কথাগুলো সবিতার মাথায় ঘুরতে থাকে।
তার মনের ভিতরে একটা ঝড় চলছে, তবে সে জানে—কোনো ভয়েই তাকে থামানো যাবে না।

একদিকে সবিতা লড়াই করছে বাইরে, অন্যদিকে তার শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনে নতুন সুযোগ ও পরিবর্তন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
রুমাইসা, যাকে একসময় অন্ধকারের পথে চলতে দেখেছিল, এখন অন্য মেয়েদের কাছে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা শেয়ার করে।
একদিন, সে সবিতার কাছে এসে বলে,

— “আপু, আমি জানি, আমি যদি এখানে না আসতাম, তাহলে হয়তো আমি আজও সেই পুরনো জীবনেই থাকতাম। এই স্কুলে এসে আমি শুধু পড়াশোনা শিখিনি, আমি শিখেছি কীভাবে নিজেকে সম্মান করতে হয়।”

সবিতা গর্বিত হয়ে বলে,
— “তুমি যেভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছো, সেটা খুবই প্রশংসনীয়। তবে মনে রেখো, এখনও অনেক পথ চলা বাকি।”

আয়ন, রুমাইসার বন্ধু, এবার স্কুলে যোগ দিয়েছে। সে আসে, তার মুখে আত্মবিশ্বাস এবং চোখে নতুন স্বপ্নের আভা।
একদিন সবিতা আয়শাকে বলে,
— “তুমি কি জানো, তুমি যদি সাহসী না হতে, তাহলে এখানে আসা হতো না।”

আয়শা মাথা নিচু করে বলে,
— “আপু, আমার কাছে এই স্কুল শুধু শিক্ষা নয়, এটা আমার বেঁচে থাকার পথ।”

________

একদিন, সবিতা এক বিশেষ সভার আয়োজন করে, যেখানে তার শিক্ষার্থীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবে।
সভায় উপস্থিত হয় স্থানীয় অনেক গুণী মানুষ এবং সাংবাদিকও।
রুমাইসা, আয়শা, সিমলা—এরা সবাই নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে, কিভাবে তারা নবআলোতে এসে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে।

তারপর সবিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

— “আজ আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে জানাচ্ছি—আমরা শুধু মেয়ে শিক্ষার জন্য কাজ করছি না, আমরা তাদের জীবনের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছি।
এই স্কুল শুধু শিক্ষার জায়গা নয়, এটা একটি আন্দোলন, যেখানে প্রতিটি মেয়ে তাদের সঠিক জায়গা খুঁজে পাবে।”

সকলের চোখে চোখে আবেগ দেখা যায়, কেউ বা কেঁদে ফেলে, কেউ আবার হাসে।
এই দিনটা সবিতার জীবনের সবচেয়ে বড় মুহূর্ত।
সে বুঝতে পারে, তার সংগ্রাম শুধু নিজের জন্য নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য।

অল্প সময়ের মধ্যে নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্র ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু জনপ্রিয়তার সঙ্গে বেড়ে ওঠে সমস্যাও।
একদিন সবিতা হঠাৎই খবর পায়, যে রাজনৈতিক দলের নেতারা আরেকবার তাদের স্কুলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইছে।
এবার তারা জানিয়েছে, “এই স্কুলের কর্মকাণ্ডের জন্য সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে পড়ছে। যদি না বন্ধ করা হয়, তাহলে আরো বড় বিপদ আসবে।”

সবিতা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে জানে, এবার পরিস্থিতি আরো কঠিন হতে যাচ্ছে।
তবে তার মন দৃঢ়। সে জানে, সত্যের পথে চলতে থাকলে, একসময় আলোর দেখা পাওয়া যাবে।
সে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

— “আমরা আমাদের সংগ্রামে অবিচল। যখন মানুষ একসঙ্গে হয়, তখন তারা কোনকিছুই হারাতে পারে না।”

নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্রের কক্ষগুলোতে এখন আর কেবল বইয়ের পাতা উল্টানোর শব্দ নয়, বরং প্রতিদিনই নতুন স্বপ্নের জন্ম হয় এখানে। মেয়েরা যে সমাজ তাদের ‘বোঝা’ ভেবে অবহেলা করেছে, সেই সমাজেই তারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ শুরু করেছে। কিন্তু ঠিক তখনই শুরু হলো আরেকটি ঝড়।

এক দুপুরে স্কুলে ঢোকে এক অফিসার, সঙ্গে হাতে কাগজ।
— “আপনার নামে অভিযোগ এসেছে ম্যাডাম। আপনি নাকি মেয়েদের উসকে দিচ্ছেন, পরিবার আর সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছেন। আপনার স্কুল বন্ধের নির্দেশ এসেছে।”

সবিতা অবাক হলেও ভেঙে পড়েনি। সে চুপচাপ কাগজটা পড়ে, তারপর মাথা উঁচু করে বলে,

— “যে সমাজ অন্যায় মেনে নেয়, সেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে কেউ একজন তো দাঁড়াবেই। আমি পিছিয়ে যাবো না। আমার মেয়েরা জানে কীভাবে লড়তে হয়।”

অফিসার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
— “আপনার কথা ঠিক। কিন্তু প্রভাবশালীরা চায় না এই জায়গা টিকে থাকুক। সাবধান থাকবেন।”

সবিতা জানে, ঝড় এসে গেছে। এখন লড়াইটা শুধু একটা স্কুল টিকিয়ে রাখার নয়—এটা একটি আদর্শ বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।

সেদিন সন্ধ্যায় সবিতা মেয়েদের ডেকে বলে,

— “আমাদের স্কুল হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। তোমাদের যদি ভয় হয়, তাহলে চলে যেতে পারো। আমি কাউকে দোষ দেবো না।”

কিন্তু সিমলা বলে ওঠে,
— “আপু, যদি আপনি লড়েন, আমরা কেন পালাবো? আপনি আমাদের দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। এবার আমরাও দাঁড়াবো আপনার পাশে।”

আয়শা বলে,
— “এই স্কুলটা আমার আত্মার মতো। কেউ যদি এটা কেড়ে নিতে চায়, তাকে আমার বুকের রক্তের ওপর দিয়ে যেতে হবে।”

সবার চোখে দৃঢ়তা।
সবিতা অনুভব করে, সে আর একা নেই।

আন্দোলনের শুরু,

মেয়েরা নিজেরাই একটি প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে।
স্থানীয় গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে—”একদল মেয়ে, তাদের শিক্ষিকার নেতৃত্বে, নারী শিক্ষার অধিকার বাঁচাতে পথে নেমেছে।”

সমাবেশে এক বুড়ি মা এসে বলেন,
— “আমার ছেলেও চায় না আমি স্কুলে পড়ি। কিন্তু সবিতা আপুর স্কুলে এসে আমি শিখছি কীভাবে নাম লিখতে হয়। আমার জীবনটা নতুনভাবে শুরু হচ্ছে।”

এই ধরনের বক্তব্যে চারপাশ নড়ে ওঠে।
যারা সবিতার বিরুদ্ধে ছিল, তারাও এবার একটু থেমে যায়,সবাই বুঝতে পারে সবিতাকে আর আটকানো যাবে না,সে তার আলো সকল অবহেলিত আর নির্যাতিত মেয়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিবে।

শেষ দৃশ্য

সবিতা রাতে নবআলো’র ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশে চাঁদ, চারপাশে নীরবতা।
তার পাশে এসে এক এক করে সকল মেয়েরা দাঁড়ায়।
সিমলা বলে,
— “আপু, ভয় লাগছে?”

সবিতা হালকা হাসে,

— “ভয় লাগে, কিন্তু ভয় পেয়ে থেমে থাকলে তো আলো জ্বলবে না।”

সবিতা বুঝে যায়—এই মেয়েগুলোই তার শক্তি। এটাই তার সত্যিকারের পরিবার।

সমাপ্ত

সবিতা পর্ব-১১

0

সবিতা
পর্ব : ১১
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতার জীবনে এখন শান্ত একটা রুটিন।

স্কুল, শিক্ষার্থীদের গল্প, আয়শার ঘুরে দাঁড়ানো… সব মিলিয়ে সে এখন একজন সত্যিকারের পথপ্রদর্শক।
কিন্তু জীবনের বাঁকে বাঁকে যে টানাপোড়েন জমে থাকে, একদিন সেই পুরনো মুখ ঠিকই ফিরে আসে।

একদিন হঠাৎ…
স্কুল ছুটির পর গেটের সামনে একটা সাদা গাড়ি।
সবিতা প্রথমে পাত্তা দেয় না।
কিন্তু ভেতর থেকে যখন লোকটা নামে, তার চোখ আটকে যায়— সাইফ।

হাঁটুর ওপর একটা দামী পাঞ্জাবি, চোখে ক্লান্তি, আর মুখে একটা অনুশোচনাময় ভঙ্গি।

— সবিতা, তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”

সবিতার কণ্ঠ ঠান্ডা, কিন্তু দৃঢ়।

— “তুমি তো ভেবেছিলে আমাকে ঠকিয়ে তুমি ভালো থাকবে, ভালো আছো কি?

সাইফ চুপ। তারপর কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলে,
— “ভুল করেছি। অনেক বড় ভুল। তুমি থাকতে বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝি আমি কী হারিয়েছি।”

সবিতা তাকিয়ে থাকে সাইফের চোখে।
এই মানুষটা একসময় তার সব ছিল।
আজ শুধু একটা পরিচিত ছায়া।

— “তুমি যেটা হারিয়েছ, সেটা আমি একটুও হারাইনি, সাইফ। বরং আমি নিজেরে খুঁজে পেয়েছি। নিজের একটা আলোকপথ বানিয়ে নিয়েছি।”

সাইফ কণ্ঠ নরম করে নির্লজ্জের মতো আজও বলে,
— “তুমি চাইলে… আবার শুরু করতে পারি?”

সবিতার উত্তর আসে ধীরে, কিন্তু অমোঘভাবে—
— “আমি শুরু করেছি, সাইফ। তবে সেটা তোমার সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গে। আর সেই শুরুতে তোমার কোনো জায়গা নেই।”

সাইফ আজ ও শূন্য হাতেই ফিরে যায়।

তবে রাতের ডায়েরিতে সবিতা লেখে

> “আজ আমি তাকে ক্ষমা করেছি।
কিন্তু ফিরে যাওয়া আমার জীবনের লক্ষ্য নয়।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই তো আমি সেই রাতে বেরিয়ে এসেছিলাম… অন্ধকার পেরিয়ে আলোর খোঁজে।”সেই আলো আমি খুঁজে পেয়েছি,তাহলে কেনো আবার অন্ধকারে যাবো?

সবিতার জীবনটা যেন সত্যিই একটা বইয়ের মতো—

প্রতিটি অধ্যায়ে নতুন কিছু, নতুন যুদ্ধ, আর নতুন আলো।
সাইফের ফিরে আসা তাকে কাঁপিয়ে দেয়নি, বরং নিজের অবস্থানটা আরও পরিষ্কার করে দিয়েছে।
এখন সে জানে—নিজের পথেই সে আলোর খোঁজ পেয়েছে।

আয়শা এখন শুধু আঁকেনা, কথা বলতেও শিখে গেছে।
সে অন্য মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়, তাদের গল্প শোনে, সাহস দেয়।
একদিন সবিতাকে বলল,

— “আপু, আমি যদি নিজের একটা গ্রুপ বানাই?
যারা নিজেদের গল্প বলবে, আর একে অপরের পাশে দাঁড়াবে?”

সবিতার মুখে প্রশংসার হাসি।

— “এই পথটাই তো তোদের জন্য খুলে দিতে চেয়েছিলাম।
তুই নিজেই নিজের ‘আয়শা’ হয়ে উঠেছিস।”

আয়শা মাথা নেড়ে বলে,
— “আপু, আমি একদিন আপনার মতোই হবো।
মানুষকে বোঝাবো—আগুন দিয়ে নয়, আলো দিয়ে বাঁচতে হয়।”

এদিকে তাওহীদ নিজের উদ্যোগ নিয়ে ব্যস্ত।
সবিতার স্কুলকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
একদিন দুজনে ছাদে বসে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলে—

তাওহীদ বলল,
— “স্কুলটাকে আরও বড় করতে চাই।
নিজের একটা জায়গা, যেখানে তুমি ইচ্ছামতো স্বপ্ন বুনবে।
আমিও পাশে থাকব—সহযোদ্ধা হয়ে।”

সবিতা তাকিয়ে থাকে তাওহীদের দিকে।
এই মানুষটা কখনোই তাকে দাবী করেনি, কিন্তু প্রতিটি স্বপ্ন পূরণের পথে এক শক্ত ভরসার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাওহীদ অনেক সাহস নিয়েই বলে,

— “একদিন একটা বাড়ি হবে আমাদের,
যেখানে থাকবে শুধু সম্মান, ভালোবাসা আর স্বপ্ন,”

সবিতা মুচকি হাসে।

এতো কিছুর মধ্যেও সমাজ থেমে থাকে না।
মেয়ে হয়ে এতদূর আসার পরও সবিতাকে কটাক্ষ করা হয়—
“নিজের সংসার না গড়েই নাকি এত নারী ক্ষমতায়নের কথা!”
“ভাঙা সংসার নিয়ে এসব নাটক!”

কিন্তু সবিতা জানে, এদের জবাব কথায় নয়—কাজে দিতে হয়।
প্রতিদিন আরও একজন মেয়ের জীবন বদলানোই তার সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ এখন।

একদিন তাওহীদ সবিতাকে নিয়ে যায় একটা জমির সামনে—
খালি জায়গা, পাশে গাছপালা, আর দূরে ছোট্ট একটা নদী।

— “এখানেই হবে তোমার নতুন স্কুল—‘নবআলো’।”
— “নতুন ঠিকানা, নতুন শুরু।
তুমি মেয়েদের শেখাবে নিজের মতো করে বাঁচতে, আর আমি তোমার ছায়া হয়ে থাকব।”

সবিতার চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।
নিজের স্বপ্নগুলোকে এতদিন কাগজে আঁকতো, আজ সে স্বপ্নগুলো মাটিতে গেঁথে যাবে।

সে মনে মনে বলে—
“আমি ফিরে যাচ্ছি না। আমি এগিয়ে যাচ্ছি—নিজের গল্প, নিজের মানুষ, আর নিজের আলো নিয়ে।”

দুই মাস পেরিয়ে গেছে। খালি জমিটা এখন আর খালি নেই। বাঁশের চটা ঘর, টিনের ছাউনি আর দেয়ালে রঙিন আঁকা—
লেখা আছে বড় করে:

“নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্র”

এই ছোট্ট স্কুলঘর এখন যেন একটা বিপ্লবের কেন্দ্র।
প্রতিদিন সকাল হতেই আশেপাশের গ্রামের মেয়েরা ভিড় জমায়।
কারও চোখে ভয়, কারও মুখে কৌতূহল, আর কারও মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা আশা।

সবিতা দাঁড়িয়ে থাকে গেটের পাশে,
যেন এই আলো তার নয়, বরং তাদের জন্য—যারা পথ হারিয়ে খুঁজে ফিরছে নিজের নাম, নিজের সম্মান, নিজের স্বপ্ন।

একটা মেয়ে প্রথমদিন এসেই কোণায় বসে পড়ে। কারও সঙ্গে কথা বলে না।

নাম?
রুমাইসা।
বয়স ১৫। বাবা নেই, সৎমায়ের হাতে নির্যাতন। পড়াশোনা বলতে খুব সামান্য। মুখে একটা দগদগে দাগ।

সবিতা তার পাশে বসে।

— “আয়নার দিকে তাকাতে ভয় পাও?”

রুমাইসা চোখ ঘোরায়, কিছু বলে না।

সবিতা ধীরে বলে—

— “এই দাগটা তোমার না, সমাজের। তুমি ওটা নিয়েই সুন্দর। আমরা সবাই কিছু না কিছু নিয়ে এসেছি এখানে। নবআলোতে তুমি আর ‘অসুন্দর’ নও, তুমি শক্তি।”

রুমাইসা চোখ মুছে তাকায়।
একটা ভেতরের তোলপাড় যেন তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।
সেদিন থেকে সে প্রতিদিন নিয়ম করে আসে।

স্কুলের প্রথম মাস শেষ হলে, তাওহীদ এক সন্ধ্যায় এসে সবিতাকে একটি ছোট বাক্স দেয়।

— “খুলে দেখো।”

সবিতা খুলে দেখে ভেতরে ছোট ছোট কার্ড।

প্রতিটি মেয়ের হাতে লেখা চিঠি।

“আপু, আপনি না থাকলে আমি এখনো রান্নাঘরের কাজ করতাম।”

“আপু, আপনি আমাকে নাম দিয়েছেন। ‘বেকার’ থেকে ‘শিক্ষার্থী’ বানিয়েছেন।”

“আপু, আপনি আমার মা, আপু, আলোর মানুষ।”

সবিতা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

তাওহীদ হেসে বলে—
— “শুধু শিক্ষা নয়, তুমি ভালোবাসাও শিখিয়েছো ওদের।”

এক সন্ধ্যায়

সবিতা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে আকাশ লালচে।
হাতের চায়ের কাপটা ধরে ফিসফিস করে বলে—
“আমি হারাইনি, বরং পেয়েছি।
নিজেকে, আমার মানুষগুলোকে, আর এই আলোর পথটাকে।”

তাওহীদ এসে পাশে দাঁড়ায়।
— “তুমি একা নও সবিতা। তোমাকে দেখে আমরাও পথ খুঁজে পাই।”

সবিতা হেসে বলে—

— “আমার নাম হলো সবিতা, মানে সূর্য।
এজন্য আমি যত দিন বেঁচে থাকবো গরীব,অসহায় আর নির্যাতিত মেয়েদের আলো দিয়ে যাবো।

আজ আমি কেবল আলোর মাঝেই বাস করছি, আর চাই যেন এই আলো কারও চোখে আর নিভে না যায়।”

চলবে_____

সবিতা পর্ব-১০

0

সবিতা
পর্ব : ১০
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

নতুন পথের শুরুতে সবসময়ই কিছু প্রশ্ন থাকে।
তাওহীদের বিয়ের প্রস্তাবের পর সবিতা এখন রাতজাগে। একা একা পুরনো দিনের ডায়েরি পড়ে—সাইফের নির্লিপ্ততা, শ্বশুরবাড়ির চুপচাপ সহ্য করা অত্যাচার , নিজের কান্নাভেজা রাতগুলো।
সবকিছু মিলিয়ে সে একটাই সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর কারো সংসারে নয়, নিজের পরিচয়ের ভেতরেই বাঁচতে চায়।

সবিতা এখন জানে, জীবন কখনো সোজা হয় না।
তবু তার গল্প থেমে নেই। সে লিখছে একেকটা মেয়ের মুক্তির গল্প।
আর তার পাশে একজন মানুষ—তাওহীদ—যে ভালোবাসা দাবি করতে চায় না, শুধু থাকতে চায় তার ছায়া হয়ে।আর সবিতাও তাকে বন্ধু হিসেবেই রেখে দিয়েছে।

বিকেলের আলো গা ছুঁয়ে যায়।
সবিতার স্কুলে আজ বিশেষ আয়োজন—নারী উদ্যোক্তা উৎসব।
সবিতার হাতে গড়া ছাত্রীরা আজ নিজেদের বানানো হ্যান্ডিক্রাফট, জামা-কাপড়, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে।
লোকজন মুগ্ধ। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না—এই মেয়েগুলো একসময় নির্যাতিত, পরিত্যক্ত ছিল।

এই উৎসবের মাঝেই তাওহীদ পাশে এসে দাঁড়ায়।

– “তোমার মেয়েগুলো তোমার মতোই জেদি, জানো?”
সবিতা মুচকি হেসে বলে,
– “তাদের জেদটুকু দিয়েই ওরা বাঁচবে।”

সবকিছুর মাঝে একদিন অপ্রত্যাশিত একজন অতিথি আসে—সাইফের মা।

হঠাৎ তাকে দেখে সবিতা থমকে যায়।

– “তোমার সঙ্গে কথা আছে মা রে,” কাঁপা গলায় বলে।
সবার চোখের আড়ালে তারা একটু দূরে গিয়ে বসে।

– “আমি জানি, তোকে কোনোদিন আমরা তোর প্রাপ্য সম্মান টুকু দিতে পারিনি।অনেক অত্যাচার করেছি তোর সাথে,তুই মুখ বুঝে সব শুধু সহ্য করে গেছিস।এখন আমরা সবাই আমাদের ভুল বুঝতে পারি, ভুলটা আমাদের ই ছিল,তুই নিষ্পাপ, ফুলের মতো পবিত্র ছিলি।

সবিতা চুপচাপ, তার কোনো উত্তর নেই,আর কি উত্তর দেবে সে?
সাইফের মা এবার বললো,
তুই নিজের মতো করে উঠেছিস—আমি সবাই গর্বিত।”এটা ধরে রাখ।

এবার সবিতার চোখে জল আসে। সে কিছু বলে না। কিন্তু এই অনুতপ্ত স্বীকারোক্তি তার দীর্ঘ ক্লান্ত পথের প্রতি একধরনের স্বীকৃতি।

সবিতা মনে মনে বলে, সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি,কারণ তোমরা সেদিন আমার উপর এই নির্যাতন না করলে আজ আমি সবিতা হতে পারতাম না।

দেখতে দেখতে আরও এক বছর কেটে যায়।

সবিতার স্কুল এখন রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত।
পাঁচজন ছাত্রী আজ চাকরি পেয়েছে এনজিওতে।
তিনজন নিজের দোকান খুলেছে।

সবিতা নিজেও একটা প্রজেক্ট হেড পদে যোগ দেয়—নারী অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে বড় এক প্রোগ্রামে।

এক সন্ধ্যায় ছাদে বসে চা খাওয়ার সময়, তাওহীদ খুব সহজ করে বলে—

– “সবিতা, এবার যদি তুমি রাজি থাকো, তবে চল একটা ছোট্ট বাসা নিই।
তুমি স্কুল চালাবে, আমি অফিস করব, আর সন্ধ্যায় একসঙ্গে চা খাব।
ভালোবাসার চেয়ে সম্মানের জায়গাটা আগে থাকবে, এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”

সবিতা শুধু হাসে,কিন্তু কিছু বলে না।

হেমন্তের হাওয়া বইছে।
নতুন একটা ভোর এসেছে—শান্ত, ধূসর, অথচ আশায় ভরা।
সবিতা আজ প্রথমবার নিজের নামে একটা চেক হাতে পেয়েছে।
নিজের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে, নিজের স্বাক্ষরসহ।
চোখে জল চলে আসে—এ যেন কাগজের মধ্যে জীবনের ছাপ।

তাওহীদ এসে বলে,
— “আজ তোমাকে গাড়ি করে স্কুলে নিয়ে যাবো। সময় হয়ে গেছে ‘সাইকেলচালিত স্বপ্ন’ ছাড়ার।”

সবিতা হেসে ওঠে।
সেই হাসির ভিতর ছিল নতুন জীবনের দৃঢ়তা।

একদিন হঠাৎ কাকুলির ফোন আসে।
— “তুই এত দূর চলে গেছিস, আন্নি। আমি গর্বিত, জানিস?”

সবিতা তা শুনে বলে একদিন দেখতে আসিস আমাকে,আমাকে কি দেখতে ইচ্ছে করে না?

কাকুলি হেসে উত্তর দেয়,যাবো,যাবো।তুই রেডি থাকিস।

জানিস,কাকুলি মা-ও ফোন দেয় মাঝে মাঝে।
বলে,
— “তোর বাচ্চাগুলোকে একদিন আমাদের বাড়িতে আনিস।”
সেই কণ্ঠে অনুশোচনা নেই, আছে একধরনের শান্ত সমর্পণ।

আমার যে কত খুশি লাগে এখন।

কাকুলি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে তুই সার্থক হয়েছিস আন্নি।তুই আমাদের সবার গর্ব।

__________

সবিতা বার বার সাইফ কে ফিরিয়ে দেওয়ায় আর যোগাযোগ করেনি সাইফ।
তবে শোনা যায়, অহনার সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই,সবিতা সাইফ কে ছেড়ে চলে আসার পর পরই সে অহনার থেকেও দূরে সরে যায়।সাইফ তার ভুল বুঝতে পারে,সে সবিতাকে ছাড়া ভালো নেই।

একসময় মানুষ যে ফাঁকা জায়গায় ভালোবাসা খোঁজে, সেখানে শুধু আজ ক্ষমা জেগে থাকে।

সবিতার স্কুলে এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে।

একটা মেয়েকে স্কুলে নিয়ে আসে স্থানীয় ওসি সাহেব।
মেয়েটা নাকি আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।

নাম—আয়শা।
চোখে ভয়ার্ত অন্ধকার।
মুখে একটাও শব্দ নেই।
কিন্তু সবিতা জানে, এই মেয়েটাই আগামী দিনের আগুন হবে—জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নয়, আলো ছড়িয়ে।

সবিতা তার পাশে বসে বলে,

— “তোকে আর কিছু বলতে হবে না। আমি তোর মতই একদিন গুমরে কেঁদেছিলাম।”

আয়শা চুপ করে থাকে। কিন্তু তার ঠোঁটে একটুখানি কম্পন—
কোনো এক ভরসার ইশারা যেন।

সবিতা আর তাওহীদ একসাথে ছাদে দাঁড়িয়ে।
নিচে শহরের আলো, মাথার ওপর তারা।
তাওহীদ বলে,

— “তোমার প্রতিটি যুদ্ধের পাশে থাকার শপথ আজ আবার করছি।”

সবিতা তখন হঠাৎ কোনো কিছু না ভেবে বলে,

— “আমি আর কোনোদিন পালাতে চাই না। এবার আমি থাকবো—নিজের গল্পের কেন্দ্রে, নিজের মতো করে।”

তাওহীদ হেসে ওঠে শুধু,কিন্তু কিছু বলে না।সবিতা যে তাকে অগাধ বিশ্বাস করে তা তাওহীদ ভালো করেই জানে।হয় তো একটু আধটু পছন্দও করে।কিন্তু বলার সাহস পায় না।সবিতা সংসার জীবন টাকে আজকাল অনেক বেশি ভয় পায়।

সবিতা আর তাওহীদ একসাথে আকাশের দিকে তাকায়।
তারা আজ অনেক দূরে।ঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

সকালবেলা।
স্কুলের বারান্দায় সূর্যের আলো এসে পড়ে।
আয়শা এখনো চুপচাপ। কেউ কোনো প্রশ্ন করে না।
সবিতা জানে—প্রথমে কথা নয়, দরকার ভরসা।

তাই প্রতিদিন সবিতা নিজের হাতে তাকে নাস্তা দেয়, পাশে বসে গল্প করে।
একদিন হঠাৎ আয়শা বলে ওঠে,

– “আপু, আমি আসলে মরতে চাইনি। শুধু সবাইকে একটু বোঝাতে চেয়েছিলাম, আমি কতটা কষ্টে আছি।”

সবিতা থেমে থাকে। তারপর মাথায় হাত রেখে বলে,
– “তুই বেঁচে আছিস, সেটাই এখন আমাদের শক্তি।”

দুপুরের রোদ্দুরে আয়শা একদিন নিজের গল্প খুলে বলে—
তার চাচাতো ভাইয়ের হাতে নিপীড়িত হওয়া,
মা-বাবার চুপচাপ মুখ,
আর একদিন তার মায়ের বলা কথা—
“তোর মুখ বন্ধ রাখ, নয়তো তোর জন্যই আমাদের মান-ইজ্জত যাবে।”

সেই দিন থেকেই আয়শার ভিতরে আগুন জমে।
একদিন আগুন দিয়েই নিজের শরীর পোড়াতে চেয়েছিল।
কিন্তু ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছে।

সবিতার চোখে জল আসে, তবু গলা শক্ত করে বলে,
– “তুই একটা যুদ্ধিনী, আয়শা। যুদ্ধ না করলে তো অন্যায়েরাই জয়ী হয়।”

পরবর্তী কিছুদিনে আয়শা আবার আঁকতে শুরু করে।
তার ছবিতে এক মেয়ের মুখে থাকে আগুন, চোখে অশ্রু আর পেছনে বিশাল এক ডানা।

স্কুলে আয়োজিত “আলোকিত বাঁচা” প্রতিযোগিতায় সে এই আঁকা জমা দেয়।
প্রথম পুরস্কার তার হয়ে যায়।
লোকজন ভীষণ মুগ্ধ হয়। সংবাদপত্রেও আসে এই খবর—
“আগুন থেকে আলোর পথে: আয়শার গল্প”

শেষে এক চিঠি

এক সন্ধ্যায় আয়শা সবিতাকে একটা চিঠি দেয়—

> “আপু, আপনি না থাকলে আমি সত্যিই থাকতাম না।
আমি এখন জানি, আমি কারও বোঝা না।
আমি নিজেই একটা স্বপ্ন।
আপনার কাছ থেকে আমি শুধু ভরসা না, একটা নতুন জীবন পেয়েছি।
আমি বড় হয়ে ঠিক আপনার মতো একটা স্কুল খুলব।
যেখানে আরেকটা আয়শা আসলে, তাকে কেউ মরতে না বলে—বাঁচতে বলবে।”

সবিতার চোখে জল আসে।
সে জানে, এই গল্পের শুরুটা কষ্টের হলেও শেষটা আলোর, সাহসের আর শক্তির।

চলবে______

সবিতা পর্ব-০৯

0

সবিতা
পর্ব: ০৯
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা, যেটি ছিল তার জীবনের একক সংগ্রাম, এখন সেটি হয়ে উঠেছে একটি বৃহৎ উদ্যোগ—সমাজে পরিবর্তন আনা। তার বই, সেমিনার এবং লেখালেখি জীবনে সবার সাথে একযোগভাবে প্রভাব ফেলছিল। এবার সে একটি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করল, যার নাম ছিল “শক্তি সচেতনতা”। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সবিতা অনেক তরুণ-তরুণীকে জীবনে তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছিল। সে বিশ্বাস করেছিল, যখন একজন মানুষ নিজের আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায়, তখন সে পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর করতে পারে।

সবিতা তাঁর এই উদ্যোগের মাধ্যমে আরও অনেক মানুষকে নিজেদের ভেতরের শক্তি এবং সম্ভাবনার প্রতি বিশ্বাসী করতে চাইছিল। তার এই প্রজেক্টে এমন হাজারো তরুণ-তরুণী একত্রিত হয়েছিল যারা নিজেদের জীবনের নতুন পথ খুঁজছিল।

____

সবিতার জীবন এখন এক নতুন মোড় নিতে চলেছে। তার শুরু করা উদ্যোগ “শক্তি সচেতনতা” এখন এক বৃহৎ আন্দোলনে পরিণত হতে চলেছে। মানুষ আরও বেশি করে তার গল্পের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে এবং জীবনের উদ্দেশ্য খোঁজার জন্য একত্রিত হচ্ছে।সবিতা জানতো, এটি এক রাতের ব্যাপার নয়, তবে সে শুরু করেছে, এবং তার মনোবল সবার মাঝে আশার আলো জ্বালিয়েছে।

সবিতা তার উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছিল। সে জানতো, সঠিক পথ চলতে পারলে একজন মানুষ কীভাবে তার জীবনে বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে। সেমিনার, বই আলোচনা, এবং প্রাকটিক্যাল ক্লাসের মাধ্যমে সবিতা তরুণদের জীবন সম্পর্কে ধারণা দিতে চাইছিল। তার প্রতিটি বক্তৃতা যেন একটি অনুপ্রেরণার ঝরনা হয়ে পড়েছিল।

সেখানে, একদিন এক তরুণী সবিতার কাছে এসে বলল—

– “আপনার বই এবং সেমিনারের পর আমার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। আমি এখন জানি, আমি কী চাই। আমি জানি, আমি শুধু স্বপ্ন দেখতে চাই না, স্বপ্ন বাস্তব করার জন্য কাজ করতে হবে।”

সবিতা তার চোখে এক উজ্জ্বল হাসি দিয়ে বলল—

– “আমরা কেউ কখনো একা নই। আমাদের মধ্যে যে শক্তি রয়েছে, সেটিই আমাদের একে অপরের দিকে টেনে আনে। তোমরা যদি বিশ্বাস রাখো, তুমি তোমার পথ খুঁজে পাবে।”

এভাবেই সবিতা তার কাজকে আরও গভীর করে চলছিল। তার প্রতিটি উদ্যোগ নতুন আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু এখন, সবিতার সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে।

________

একদিন সবিতা একটি বড় সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন পেশার মানুষ—কর্মী, উদ্যোক্তা, শিক্ষিকা, চাকরিজীবী, এমনকি ছাত্রছাত্রীরাও।সবিতা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো—

– “আমরা সবাই জানি, জীবনে চ্যালেঞ্জ আসে, সমস্যা আসে, তবে যদি আমরা একে অপরকে সহায়তা করি, একে অপরের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি, তবে কোনো বাধাই আমাদের অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। আমি চাই এই মঞ্চ থেকে আমরা সবাই মিলে একটি সংকল্প নি—নিজেকে বিশ্বাস করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।”

তার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হর্ষধ্বনিতে মাতিয়ে তোলে। তাদের মধ্যে অনেকেই উঠে দাঁড়িয়ে সবিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। সবিতা জানতো, তার কাজটা সঠিক পথে যাচ্ছে।

___

একদিন, সবিতা তার এক বন্ধু রিয়া’র সাথে বসে কথা বলছিল। রিয়া বলল—

– “তুমি জানো, সবিতা, তুমি একাই অনেক কিছু করতে পারো। কিন্তু এখন তুমি একে অপরকে সাহায্য করার মাধ্যমে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারছো। তোমার কাজের জন্য আমি গর্বিত।”

সবিতা হাসিমুখে বলল—

– “ধন্যবাদ, রিয়া। তবে আমি জানি, এই পথ কখনো শেষ হবে না। প্রতিটি নতুন দিন একটি নতুন সুযোগ এনে দেয়।”

এভাবেই সবিতা তার জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এখন তার পথের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল, তবে সে জানতো, তার মাঝে যে শক্তি আছে, তা দিয়ে কোনো কিছুই অতিক্রম করা অসম্ভব নয়।
………

সন্ধ্যা নামে ঢাকার আকাশে। ক্লান্ত শহরের গা ঘেঁষে এক নিঃশব্দ বাসার জানালায় বসে সবিতা চুপচাপ চা খাচ্ছে। তাওহীদ আসেনি আজ। হঠাৎই একটা ফোন আসে—আমেনা আপার।

– “আন্নি মা খুব অসুস্থ। অনেকদিন ধরে তোকে দেখতে চাইছে। তুই যদি একটু…”

চুপ করে থাকে সবিতা। কিছু বলার মতো শব্দ পায় না। অনেক অভিমান, তবু মা তো মা-ই। পরদিনই সে ছুটে যায় মায়ের কাছে।

মায়ের চোখে জল

মা বিছানায় শুয়ে আছেন। শরীর শুকিয়ে গেছে, কণ্ঠ ক্ষীণ।

– “তুই ভালো আছিস তো মা?”

সবিতা চোখের জল আটকে রাখে। অনেকদিন পর এই মমতা-মাখানো কণ্ঠ শুনে বুকের ভেতরটা গলে যায়।

– “ভালো থাকার লড়াই করছি মা…”

– “তোর মতো মেয়ে… একদিন অনেক উঁচুতে যাবে। সাইফ বোঝে নাই, তাতে কী হয়েছে? তুই নিজের মতো করে আলো হবি…”

সবিতা মায়ের হাত ধরে রাখে। কাঁদে না, শুধু খুব নীরবে হাসে।

সবিতা আবার কাজ শুরু করে। “উত্তরণ”-এর ক্যাম্পেইন এবার গ্রামে, যেখানে নারীদের শিক্ষার অভাব এখনো প্রকট।
সে প্রতিদিন সকালে বের হয়, ছুটে বেড়ায় একেকটা ইউনিয়নে। তার চোখে নতুন স্বপ্ন—একটা প্রজন্ম বদলে দেওয়ার।

তাওহীদ প্রতিদিন পাশে থাকে, কখনো কিছু বলে না, শুধু বোঝে। আর সবিতা, ধীরে ধীরে তাওহীদ কে বিশ্বাস করতে শেখে।

এক সন্ধ্যায়, ক্যাম্প থেকে ফিরে চায়ের কাপ হাতে, তাওহীদ বলে,

– “সবিতা, আমি জানি তুমি ভেঙে পড়েছো,গড়েছো আবার ভেঙেছো… কিন্তু যদি তুমি চাও, তবে আমি তোমার পাশে থেকে এই যাত্রাটা ভাগ করে নিতে চাই।”

সবিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

– “তুমি জানো তাওহীদ , আমি প্রেমে না, জীবনে বিশ্বাস করতে চাই। যদি তুমি আমার জীবনকে সম্মান করতে পারো,তাহলে বন্ধু হিসেবে তোমাকে ভাবা যেতে পারে…”তবে সারাজীবন এর সঙ্গী হিসেবে আমি দ্বিতীয় কাউকে আর গ্রহণ করতে চাই না।

তাওহীদ মৃদু হাসে। সম্মান, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব—সব আছে তোমার প্রতি,জীবন তোমার সিদ্ধান্ত ও তোমার,যদি কখনো মনে হয় আমি তোমার পার্টনার হওয়ার যোগ্য তাহলে ভেবে দেখতে পারো, আমি অপেক্ষায় থাকবো আজীবন।

সবিতা চুপ হয়ে রইলো।

সবিতার গল্প এখানেই শেষ নয়। এই তো শুরু।

একজন নারীর একা পথ চলা, আত্মপরিচয় খোঁজা, সম্মান কুড়িয়ে পাওয়া আর নতুন করে বিশ্বাস করতে শেখার গল্প এটা।

একটা সম্পর্ক ভেঙে গেলে জীবন থেমে যায় না—নতুন কোনো গল্প সেখানে গাঁথা হতে থাকে…

“উত্তরণ”-এর কাজ এখন শহর পেরিয়ে বিভিন্ন জেলার নারীদের জীবনে আলো দিচ্ছে।
আন্নি একটি ছোট্ট স্কুল চালু করে, যেখানে নির্যাতিত, বঞ্চিত মেয়েরা শিক্ষা পায়, সেলাই শেখে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখে।
তাকে এখন সকলে “আপা” বলে ডাকে, কেউ কেউ “ম্যাডাম”।

তাওহীদ পাশে থাকে, কিন্তু কোনো চাপ দেয় না। শুধু সবিতার সঙ্গে হেঁটে চলে, নিজের জায়গা থেকে।
এই বন্ধুতা একরকম নির্ভরতার মতো।তবে সে সবিতার হ্যাঁ উত্তর শোনার অপেক্ষায় আছে।

এক সন্ধ্যায়, সবিতার বড়বোন আমেনা তাকে খুঁজে বের করে। কান্নাভেজা চোখে বলে—

– “আমরা সবাই ভুল করেছিলাম, আন্নি। তুই সাহস দেখিয়েছিস, যা আমরা পারিনি। তুই আমাদের গর্ব।”

সেই দিন, বহুদিন পরে, সবিতা প্রথমবার কোনো আপনজনের বাহুডোরে নিজেকে সঁপে দিয়ে কান্না করতে পারে।

একদিন সবিতা যখন তার স্কুলে কাজ করছিল,

আমেনা আপা নিজে এসে জানালেন—মা আসছেন।
আজকাল আমেনা মাঝেমধ্যেই সবিতার সাথে দেখা করতে আসে।আগে সবাই ঘৃণা করলেও এখন সবিতাকে নিয়ে সবার গর্ব হয়।

মা এলেন। চোখ ভরা জল, মুখে একটাই কথা—

– “আমার মেয়ে শুধু এই সমাজে টিকে নেই, নিজেই একটা পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

বাবাও এসেছেন। মুখে আর বকুনি নেই। আজ তিনি শুধু বললেন—

– “তুই আমাদের গর্ব, মা।”

সবিতার চোখে জল আসে, কিন্তু এবার সেটা কান্না নয়—অভিমান গলে গিয়ে শান্তির জল।

সবিতা এখন নিজেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ও স্বাধীন একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। কিন্তু শক্তির এই উত্থানের পেছনে যে গভীর একাকিত্ব ও মানসিক যুদ্ধ চলেছে, তা খুব কম মানুষ জানে। রাতের পর রাত সে নিঃশব্দে কেঁদেছে, নিজের সিদ্ধান্তগুলোর বিশ্লেষণ করেছে, ভুল স্বীকার করেছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।

একদিন, একটি সেমিনার শেষ করে ফেরার পথে সবিতা হঠাৎ রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। স্থানীয় এক তরুণী ও তার মা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানায়, সবিতা দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্রামহীন কাজ করে গেছে, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক ছিল না, যার ফলে সে শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছে।

জ্ঞান ফিরে পেয়ে সবিতা প্রথমে কিছুটা ভয় পায়, কারণ তার পাশে কেউ পরিচিত ছিল না। কিন্তু সে চমকে যায় যখন দেখে যে অচেনা সেই মা-মেয়ে খুব যত্ন করে তার সেবা করছে।

তারা জানায়—

– “আপনার নাম আমরা জানি না, কিন্তু আপনার মুখে আত্মবিশ্বাস ছিল, আর আপনার ব্যাগে পাওয়া ফাইলগুলোতে লেখা কিছু কথায় আমরা খুব অনুপ্রাণিত হয়েছি।”

সবিতার চোখে পানি চলে আসে। এই প্রথমবার সে বুঝতে পারে, তার কাজ কতদূর ছড়িয়ে পড়েছে।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সবিতার মনে পড়ে তার ছোটবেলার কথা। বাবার কড়া শাসন, মায়ের গলা টিপে রাখা দুঃখ, বড় বোন আমেনার ঝাড়ি, আর সেই নিঃসঙ্গ আঙ্গিনায় বসে থাকাটা। সে বুঝতে পারে, শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত সে শুধু ভালবাসার জন্য ছুটেছে। অথচ জীবন তাকে বারবার আত্মনির্ভরশীলতা শেখাতে চেয়েছে।

সবিতা এবার সিদ্ধান্ত নেয়, সে কেবল অন্যকে পরিবর্তনের কথা বলবে না, নিজের যত্নও নেবে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে সে কয়েক দিনের জন্য নিজেকে সময় দেয়।

সে এক নির্জন কফি শপে গিয়ে ডায়েরিতে লিখে—

– “আমি সবিতা, আমি একা হলেও অসম্পূর্ণ নই। আমার জীবন, আমার যুদ্ধ, আমার ভালোবাসা—সবটাই আমি নিজে গড়ে নিচ্ছি। যারা পাশে থাকবে তারা সম্মান নিয়ে থাকবে, আর যারা নয়—তাদের জায়গা জীবনে নেই।”

সবিতা এখন শুধু একটি নাম নয়, একটি আন্দোলন। নারীদের সম্মান, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে সে।

চলবে_______

সবিতা পর্ব-০৮

0

সবিতা
পর্ব: ০৮
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা তার লেখালেখির জগতে নিজের অবস্থান শক্ত করে রাখলো। বইটি সফলতার সাথে বিক্রি হতে থাকল, এবং তার গল্প অন্যদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠলো। তবে তার জন্য সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল নিজের অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং আত্মবিশ্বাস। সে জানত, তার জীবনের পথে যে পথচলা শুরু হয়েছিল, তা শুধু তার জন্য নয়, আরও অনেকের জন্য একটি নতুন আলো হতে পারে।সবিতা তার লেখার মাধ্যমে সেই আলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।

একদিন সন্ধ্যায়, সাইফ আবার সবিতার কাছে এসে দাঁড়াল। অনেক দিন পর তাদের মধ্যে আবার দেখা হয়েছিল, কিন্তু এবারের পরিবেশ অনেকটা ভিন্ন ছিল। সাইফ, যে আন্নিকে একসময় মনে করত নিজের জীবনের অংশ, আজ তাকে একেবারেই অপরিচিত মনে হচ্ছিল। সাইফ বলল—

– “আন্নি, আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি,তোমার কাছে এজন্য বার বার ক্ষমাও চেয়েছি।কিন্তু তুমি ক্ষমা করে দাও নি। আমি কি তোমার কাছ থেকে একেবারে হারিয়ে গেছি?”তোমার মনে আমার কি সত্যি কোনো জায়গা নেই?
আজকেই শেষ, আর কখনো বলবো না আমার ভুল হয়ে গেছে আন্নি,আমাকে ক্ষমা করে দাও,আর একটিবার তোমার জীবনের সাথে জড়িয়ে নাও।

সবিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে, গভীরভাবে সাইফের দিকে তাকাল। তার মধ্যে আর কোনো ক্ষোভ বা কষ্ট ছিল না। তার কণ্ঠে শান্তি ছিল, তবে এক অদ্ভুত শক্তি, যা সে নিজের থেকে পেয়েছিল—

– “সাইফ, আমি এখন সত্যি বলতে ভয় পাই না।আমি আগেও বলেছি আর বার বার বলছি তুমি আমার জীবনের অতীত,কিন্তু অতীত আর বর্তমান এক নয়। আমি আমার জীবনের নতুন পথ তৈরি করেছি। তুমি যদি ক্ষমা চাও, হ্যাঁ দিলাম ক্ষমা করে,কিন্তু তুমি তো এতে আন্নিকে আর ফিরে পাবে না।আন্নি হারিয়ে গেছে সাইফ,তুমি নিজের হাতে আন্নিকে মেরে ফেলেছো,এখন যাকে আন্নি ভেবে বার বার কাছে ডাকছো সে হলো সবিতা।
আর সবিতার জীবনে সাইফের কোনো জায়গা নেই।সবিতা একা নিজের পথ চালিয়ে যেতে পারে এখন, আর আমি আশা করি তুমিও তোমার পথ খুঁজে পাবে।”

সাইফ আর রিকুয়েষ্ট করে না সবিতাকে,সে অনেকক্ষণ তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধু একটা হাসি দিলো,আর বললো,

নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা সবিতা।
তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।তোমার থাকলে ক্ষমা করে দিও।তুমি থাকতে তোমাকে মূল্যায়ন করি নি ঠিকই এখন হারিয়ে ঠিক বুঝতে পারছি তুমি কি ছিলে আমার জীবনে?

সাইফ চলে গেলো।
সে আজ ব্যর্থ।
আর সবিতা তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল।এতটা কঠোর সবিতা।

সবিতা এবার তার সৃষ্টিকর্তাকে বললো আমি কয়েক মিনিটের জন্য আন্নি হতে চাই,আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে চাই,আমি অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে সাইফ,কিন্তু তোমার দুর্ব্যবহার, তোমার অবহেলা দিন দিন আমাকে এতো টাই কঠিন বানিয়েছে যে আজ আমি পুরোপুরি সবিতা তে পরিবর্তিত হয়েছি।সবিতা থেকে আর কখনোই আমি আন্নি রুপে ফিরে যেতে চাই না।

সবিতা তার নতুন বই লিখতে শুরু করল, যা ছিল তার জীবনের আরেকটি মাইলফলক। বইটির নাম ছিল ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’, যেখানে সে নিজের অভ্যন্তরীণ মুক্তি, সম্পর্কের দুর্বলতা এবং আত্মবিশ্বাসের পুণঃউৎপাদন নিয়ে লিখলো। এটি ছিল তার অভ্যন্তরীণ যাত্রার একটি প্রতিচ্ছবি, যেখানে সে প্রতিটি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান নির্মাণ করেছিল।

বইটি যখন প্রকাশিত হলো, তখন সেটি খুব দ্রুত সাড়া ফেলল। পাঠকরা বইটির গল্প এবং তাতে থাকা সাহসিকতা ও শক্তি সম্পর্কে অনেক ভালো মতামত দিল। সবিতা বুঝতে পারছিল, তার লেখালেখির মাধ্যমে সে শুধু নিজের কষ্টের কথা বলছে না, বরং অনেক মানুষের আড়ালে থাকা কষ্টের গল্পকেও ফুটিয়ে তুলছে।

___________

এক সন্ধ্যায়, তাওহীদ সবিতার কাছে এসে বলল—

– “সবিতা,তোমার লেখা শুধু মানুষের মন স্পর্শ করে না, তা তাদের অন্তরের গহীনে পৌঁছে যায়। তুমি যদি এই লেখার মাধ্যমে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারো, তাহলে অনেক মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবে। তোমার বইয়ের ক্লাস শুরু করতে পারো।”

সবিতা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তার মনে হচ্ছিল, এটা যেন তার জীবনের পরবর্তী ধাপ হতে পারে। কিন্তু সে জানত, এটি সহজ হবে না। লেখক হিসেবে সে নিজের কিছু জ্ঞান শেয়ার করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা ঠিক কিভাবে করবে, তা বুঝতে পারছিল না।

– “তাওহীদ, তুমি ঠিক বলেছ, কিন্তু আমি জানি না, কীভাবে শুরু করতে হবে। আমি তো নিজেই শিখছি।”

তাওহীদ হাসি দিয়ে বলল—

– “তুমি তো জানো, যে কোনও যাত্রা প্রথম পদক্ষেপ দিয়ে শুরু হয়। তুমি যা শিখেছ, তা অন্যদের শিখিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তুমি আরও বেশি কিছু অর্জন করতে পারবে।”

এখন সবিতার মনের মধ্যে একটা নতুন স্বপ্ন জেগে উঠেছিল। সে ভাবছিল, কি দারুণ হবে যদি সে তার লেখা বা অভিজ্ঞতা শেয়ার করে অন্যদের সঙ্গে।

______

সবিতা এবার তার পরবর্তী বইটি লেখার পরিকল্পনা করল। এটি ছিল তার জীবনের সংগ্রাম, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প, এবং সেখান থেকে তার পরবর্তী পথের শুরু। বইটির নাম রাখল ‘অজানা পথে যাত্রা’, যেখানে সবিতা তার অভ্যন্তরীণ যাত্রা, আত্মবিশ্বাসের প্রাপ্তি এবং জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার গল্প বলেছিল।

এই বইটি অন্য অনেক মানুষের মতামত এবং তাদের জীবনকেও প্রতিফলিত করেছিল।সবিতা বুঝতে পারছিল, লেখালেখির মাধ্যমে সে শুধু নিজের কষ্টের গল্প শেয়ার করছে না, বরং অন্যদেরও জীবনকে আলোকিত করছে।

________

সবিতা জানত, তার জীবনে এখনও অনেক কিছু বাকি রয়েছে। তাকে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে, নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। তবে সে জানত, তার ভেতরের শক্তি আর বিশ্বাস তাকে কখনোই পথভ্রষ্ট করবে না। সে যে পথই বেছে নিক, সেটি তার জন্য নতুন অভ্যন্তরীণ শান্তির এবং স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাবে।

সবিতার বইয়ের ক্লাসের প্রথম সেশন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।সবিতা তার লেখালেখি আর জীবনের গল্পগুলো শেয়ার করার জন্য প্রস্তুত ছিল। সেমিনারের দিন, সে বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তটি তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু।

সবিতা সেমিনারের রুমে প্রবেশ করল, তার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল। আগে যে সবিতা ভয়ে নিজের লেখা শেয়ার করতে পারেনি, আজ সে সেই লেখাগুলো শত শত মানুষকে উপস্থাপন করতে চলেছে। তাওহীদ তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে সাহস দিতে।

যতক্ষণ ক্লাস চলছিল, সবিতা বুঝতে পারছিল, তার লেখার মাধ্যমে সে শুধু মানুষদের গল্প শোনাচ্ছে না, বরং তাদের অভ্যন্তরীণ যাত্রার একটা অংশ তৈরি করছে। অনেকেই তার গল্প শুনে চোখে জল নিয়ে বলেছিল—

– “আপনার লেখা আমাদের জীবনের বাস্তব চিত্র, আমরা মনে করেছি আমাদের একান্ত বেদনা শুধু আমাদেরই, কিন্তু আপনি দেখালেন, আমরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত।”

সবিতার চোখে জলের ঝরনা ছিল, কিন্তু সে জানত—এই আবেগগুলো শুধু তার নয়, সবার ছিল। এই বই, এই ক্লাস, যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল।

তাওহীদও তার জীবনের পথে সবিতার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে অনুভব করছিল, সবিতার প্রতি তার শ্রদ্ধা এখন শুধু বন্ধুত্বের দিকে অতিক্রম করেছে না, একটা গভীর সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাওহীদ একদিন সবিতার সঙ্গে বসে বলল—

– সবিতা, আমি তোমাকে দেখে শিখেছি, তুমি শুধু লেখালেখি করে না, তুমি অন্যদের মনোযোগও পরিবর্তন করতে পারো। এই বইয়ের ক্লাস তোমার এক নতুন দিগন্তকে উন্মোচন করেছে। আমি চাই তুমি আরও অনেক মানুষের জীবনে এই পরিবর্তন নিয়ে আসো।”

সবিতা তার হাসি দিয়ে বলল—

– “তাওহীদ, তোমার সহযোগিতা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না। তোমার পাশে থাকার কারণে আমি অনেক কিছু শিখেছি।”

তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হচ্ছিল। তারা একে অপরের মধ্যে অন্য ধরনের শক্তি দেখতে পাচ্ছিল, যেখানে শুধু ভালোবাসা নয়, সম্মান আর শ্রদ্ধাও ছিল।

বইয়ের ক্লাসের সফলতা দেখে, সবিতা আরও অনেক নতুন উদ্যোগ নিতে শুরু করল। সে শিখতে চেয়েছিল, সমাজে মানুষের দুর্বলতাগুলো কীভাবে উঠে আসে এবং কীভাবে তাকে শক্তি হিসেবে পরিণত করা যায়। সে নিজের ক্লাসে বিভিন্ন ধরনের সেমিনার আয়োজন করেছিল যেখানে মানুষ নিজেদের গল্প শেয়ার করতে পারতো।

এই ক্লাসগুলো ছিল শুধু তার জীবনের অভিজ্ঞতা বা লেখার পাঠ নয়, বরং এক ধরনের সেশনের মতো যেখানে মানুষ তাদের নিজের ভেতরের শক্তি খুঁজে পেতে পারতো। সবিতা বুঝতে পারছিল, একসময় তার লেখালেখি শুধু কথামালার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি মানুষের বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাবে।

__

সবিতা যখন তার বইয়ের প্রথম প্রকাশনার আয়োজন করল, তখন তার মনে এক আশ্চর্য রকমের অনুভূতি ছিল। বইটি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে তার ব্যক্তিগত জীবনের লড়াইগুলোকে একজন অনুপ্রেরণার রূপে পরিণত করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে যখন সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের লেখার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, তখন তার কণ্ঠে এক ধরনের দৃঢ়তা এবং আবেগের ছোঁয়া ছিল।

– “আমি লিখেছি শুধু আমার গল্প নয়, বরং সেইসব মানুষের গল্প যারা নিঃশব্দে কষ্টে ভুগছে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের জীবনে সবসময় অন্ধকার আসে, কিন্তু সেই অন্ধকারের মাঝে যদি একটু আলো থাকে, তাহলে আমরা জীবনকে অন্যভাবে দেখতে পারি।”

এতটা সময়ে, সবিতা বুঝতে পারছিল, তার বই আর সেমিনার শুধুমাত্র তার নিজের জন্য ছিল না, বরং এটা আরও অনেক মানুষের জন্য ছিল যারা নিজেদের কষ্টের সাথে একাকী ছিল।

_____

সবিতার নতুন লক্ষ্য,
সবিতা বুঝেছিল, তার জীবন শুধু তার নিজের জন্য নয়, আরও অনেক মানুষের জন্য। তাকে তার লেখার মাধ্যমে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে হবে। সে তার লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছিল—এখন সে শুধু তার অভ্যন্তরীণ শক্তির বিকাশে মনোযোগী হবে না, বরং সে নিজের চিন্তা-ভাবনা দিয়ে সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।

একদিন, সবিতা তার শখের ঘরে বসে একটি নতুন বইয়ের কাজ শুরু করল, যার নাম ছিল—“জীবনের নতুন দিগন্ত”। এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় কাজ, যেখানে সে মানুষের জীবনের ব্যথা, আনন্দ, লড়াই ও জয়কে একত্রিত করেছিল।

সবিতার জীবন এখন এক নতুন দিগন্তে পৌঁছেছে। সেমিনারের সফলতা এবং তার নতুন বই “জীবনের নতুন দিগন্ত”-এর প্রস্তুতির মাঝে সে যেন নিজের ভিতরের শক্তি, অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং আত্মবিশ্বাসের নতুন এক স্তরে পৌঁছে গেছে। এখন তার কাছে স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবতার দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে।

__________

সাইফ, যাকে সবিতা একসময় কেবল এক কাপুরুষ হিসেবে চিনেছিল, এখন সে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে দেখতে শিখেছে। সাইফ তার অতীত ভুল বুঝতে পেরে সবিতার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই আলাপ করতে আসে।

সাইফের মনোভাবের পরিবর্তন সবিতার জন্য এক ধরনের আশার আলো হয়ে উঠল।

সাইফ, সবিতার প্রতি আগের চেয়ে অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়েছে। একদিন সাইফ সবিতার কাছে গিয়ে বলল—

– “আমি জানি, আমরা একসাথে থাকতে পারি না,আমার ইচ্ছা থাকলেও তুমি আর নিবে না আমাকে,তবে আমি চাই, তোমার পাশে ছায়ার মতো থাকতে। তোমার পথে যা কিছু বাধা আসুক না কেন, এখন থেকে আমি সামলাবো।।”

সবিতা ধীরে ধীরে মাথা নত করে বলল—

– “সাইফ, তুমি যা বলেছ, তার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমাকে শুধু নিজের পথে হাঁটতে হবে।”তোমার সাহায্য লাগবে না।

সাইফ তার মুখে এক কঠিন হাসি দিয়ে বলল—

– “আমি জানি, তুমি নিজের পথ খুঁজে পেয়েছ। আমার সাহায্যের তোমার কোনো দরকার নাই।তবুও আমি জোর করেই থাকবো।
কারণ তুমি আমার সেই আলোর রশ্মি, যে কিনা জীবনের অন্ধকারকে উজ্জ্বল করতে পারে।”
তুমি ছাড়া আমার জীবনের অঅন্ধকার কখনোই দূর হবে না।

চলবে_______

সবিতা পর্ব-০৭

0

সবিতা
পর্ব: ০৭
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতার বাবা-মা তাকে কখনোই পুরোপুরি বোঝেনি। তাদের কাছে সবিতা ছিল সেই মেয়ে, যে পরিবারের জন্য ভালো কিছু করে নি,পরিবারের মানসম্মান নষ্ট করেছে সেজন্য সে বাবা মার ভালোবাসা কখনোই পায়নি।

কিন্তু সবিতা যে এতটা কষ্ট পেয়েছে, তা তারা কখনো বুঝতে পারেনি। একদিন সবিতা তাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে গিয়ে বলে—

– “আমার জীবনের এই সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিয়েছি। তবে আমি আপনাদের কাছে যা চেয়েছিলাম, তা কখনোই পাই নাই। আমি জানি, আপনারা আমাকে বুঝতে পারেন নি, তবে আমি জানি, নিজের পথ বেছে নিলে, একদিন আমি সফল হব।”হ্যাঁ আমি সফল হয়েছি।

সবিতার মা এক লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লেন, তারপর বললেন—

– “তুমি যদি এখনো এই পথে থাকতে চাও, তবে তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবো।”পারলে আমাদের ক্ষমা করে দিও।আমরা তোমাকে সত্যি বুঝতে পারি নি।

বাবাও কিছুটা মনোযোগ দিয়ে বললেন—

– “তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো, তা তোমার জীবনের জন্য সঠিক কিনা, তা শুধুমাত্র তুমি বুঝবে।”তবে আমাদের ভুল একটাই আমরা সাইফের উপর করা রাগের শাস্তি তোমাকে দিয়েছিলাম,আমাদের উচিত ছিলো সাইফ কে উচিত শাস্তি দিয়ে তোমাকে নিজের ঘরে ফিরে আনা।

সবিতা বাবা মার কথা শুনে দীর্ঘ নি:শ্বাস ছাড়লো।তবে তার বাবা মার কথা শুনে মনের মধ্যে ক্ষোভের পরিবর্তে এক নতুন শক্তি তৈরি হয়েছিল। সে জানত, তার মা-বাবা তাকে ভালোবাসে, কিন্তু তাদের ভালবাসা ও সমর্থন তার দু:সময়ের জীবনের সময় ছিল না,এটাই তার অনেক বড় আফসোস।

_____________

সবিতার নতুন জীবন ঠিক যেমনটি সে চেয়েছিল, তেমন সহজ ছিল না। শুরুর দিকে সমস্ত কিছুই স্বপ্নের মতো মনে হলেও, বাস্তবতার কঠিন বাস্তবতা সবিতার পথে আঘাত হানে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে বাধা ছিল। তবে সে থামল না, কারণ সে জানত, তার সামনে কেবল নিজের এক নতুন লক্ষ্য। কিন্তু, সামনে যেসব প্রলোভন ছিল, তা তাকে বাধ্য করেছিল এক নতুন দ্বিধার মধ্যে পড়তে।

মোহাইমিন তার পায়ের নিচে জমে থাকা মাটি আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সবিতা তার কাছ থেকে দূরে চলে আসার পর সে অনেক চেষ্টা করেছে তাকে ফিরিয়ে আনতে, তবে একবারও সবিতা তার কাছে ফিরে যায়নি। তবে, মোহাইমিনের মনের মধ্যে এক ভয়াবহ পরিকল্পনা গড়ে উঠছিল।

একদিন, মোহাইমিন সবিতার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং বলে—

– “তুমি যদি আমার সঙ্গে কাজ করো, তাহলে তুমি যা চাও, তা পেতে পারবে। আমার সাহায্য ছাড়া তুমি কিছুই করতে পারবে না।”

সবিতা হাসল, এই হাসি ছিল বিজয়ের হাসি।

– “তুমি যদি ভাবো, আমার জন্য তুমি এতটা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তুমি ভুল ভাবছো। আমি নিজের পথই চয়ন করেছি। আমি আর কারো হাতের পুতুল হতে চাই না।”

মোহাইমিন চলে যায়, কিন্তু সে জানে, সবিতা তাকে সব সময় অতিক্রম করে যাবে। মোহাইমিনের মতো মানুষ হয়তো তার পথের অংশ ছিল, তবে সবিতার জীবনে সেই ছায়ার স্থান নেই।

এই সমস্ত ঘটনার পর, সবিতার জীবনে এক নতুন সূচনা হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রস্তাব মেনে নিয়ে, সে এক নতুন জীবন শুরু করে। পুরনো সম্পর্ক আর পারিবারিক সমস্যা তাকে আর থামাতে পারে না। সে জানে, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, কিন্তু সে প্রতিটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

যারা সবিতাকে তুচ্ছ বুঝেছিল, তাদের জন্য সে এক প্রমাণ হয়ে উঠবে। নারী স্বাধীনতা, অধিকার—এগুলোই তার মূল লক্ষ্য। সবিতা এই মুহূর্তে বুঝতে পারে, পুরনো জীবন ছেড়ে নতুন পথের দিকে এগিয়ে যাওয়াই তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।

একদিন সবিতা নিজেই তার জীবনের অনেক গুলো গল্প লিখবে। সে জানবে, তার সংগ্রাম কেবল তার জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য ছিল। সে ছিল একটি সাহসী পথিক, যে নিজের জীবনের গল্পে জয়লাভ করেছে।

_________

সবিতা এখন পুরো দমে লেখালেখি শুরু করেছে, তবে তার প্রতিটি লেখায় তার জীবন এবং অভিজ্ঞতার গভীরতা ফুটে ওঠে। তাকে একে একে প্রতিটি কথা, অনুভূতি এবং শোককে অক্ষরে বন্দী করতে হচ্ছিল, কিন্তু সে জানত—এটি তার মুক্তির পথ হতে পারে। সেই রাতে, যখন সে তার প্রথম ছোট গল্পটি শেষ করেছিল, সেজন্য সে নিজের মনে এক অদৃশ্য প্রশান্তি অনুভব করেছিল।

একদিন সবিতা অফিসে কাজ করতে বসে ছিল, তখন তার সহকর্মী তাওহীদ এসে তাকে কিছু কাজে সাহায্য করার প্রস্তাব দেয়। তাওহীদ একজন সদ্য চাকরি করা ছেলে, তার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা সবিতার মনকে একটু উজ্জীবিত করেছিল। তাওহীদ তার সঙ্গে কথা বলার সময় কখনও বেশি চাপ দেয়নি, বরং আন্তরিকতা দেখিয়েছে।সবিতার মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস জন্মাল, যে মানুষ সত্যিই ভালো হতে পারে, যদিও সে এখন পর্যন্ত এরকম কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না।

তাওহীদের সাথে কিছু সময় কাটানোর পর সবিতা বুঝতে পারে, এই মানুষটিই সম্ভবত তার জন্য নতুন শক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে তাওহীদকে তার জীবনের কিছু ঘটনা শেয়ার করতে শুরু করে, আর তাওহীদ একান্তভাবে তার কথা শুনে যায়। এই বন্ধুত্বের মাঝে সবিতা এমন এক নিরাপত্তা অনুভব করছিল, যা তাকে আবার বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল যে, ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব এখনও সম্ভব।

তাওহীদ মাঝে মাঝে সবিতাকে উৎসাহিত করত।

– “সবিতা তুমি কি জানো, তোমার মধ্যে আর তোমার লেখার মধ্যে একটা বিরাট শক্তি আছে।যা আমি দেখছি, তা একদিন পৃথিবীকে আলো দেখাবে।”

একদিন সবিতার শান্ত জীবন আবার এক দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করল। সাইফ, তার পুরনো স্বামী, একদিন তাকে ফোন করে বলল—

– “সবিতা, আমি জানি আমি ভুল করেছি। তুমি কি একবার আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবে? আমি এখন অনেক কিছু শিখেছি।”প্লিজ একবার একটু আসো।আমি তোমাকে না দেখতে পেয়ে দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি।”

সবিতা বুঝতে পারলো, সাইফ তার পুরনো চরিত্রে ফিরে আসতে চাইছে, সাইফ বর্তমানে নিজের অনুশোচনায় ভুগছে, কিন্তু অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছে সাইফ।এখন সে কিছুতেই সাইফের জীবনে ফিরতে পারবে না।

সে সাইফের কলের উত্তর দিল না, কিন্তু তার মন প্রচন্ড ভাবে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে মনের মধ্যে ভাবল—

– আমার সামনে এসব কিসের পরীক্ষা চলছে সৃষ্টিকর্তা?সাইফের অনুনয় বিনয় আর সহ্য করতে পারছি না আমি। তাকে যে এক সময় আমি প্রচন্ড ভালোবেসে ছিলাম।
তবে আমি আর কখনোই ফিরবো না তার কাছে।আমি সাইফের কাছে ফিরলে নিজের সাথে প্রতারণা করে ফেলবো।তখন এই আমার আমি আমাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না।যখন আমার পাশে কেউ ছিলো না তখন এই আমার আমি টাই ছিলো শুধু।সেজন্য আমার তার কথা শুনতে হবে এখন।

সবিতার কাছে এখন নিজেকে মেলে ধরার সময় এসেছে, আর কোনো অতীতের জটিলতা নিয়ে সে ভাবতে চায় না।সাইফ তার অতীত।

সবিতা তার লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত।তাওহীদ তাকে অনেক সাহায্য করছে।সবিতা তার লেখা বিভিন্ন প্রকাশনার জন্য পাঠাচ্ছিল, তবে প্রতিটি গল্পের পেছনে তার জীবন ছিল। একদিন সবিতা একটি বড় প্রকাশনীর কাছে তার প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস পাঠাল।

কিছুদিন পরই তারা তাকে জানায়, তারা তার বইটি প্রকাশ করতে চায়। সবিতার মনে তীব্র উত্তেজনা ছিল, কিন্তু সে জানত—এটা তার কঠোর পরিশ্রমের ফল।

এখন তার জীবনের প্রথম বড় প্রকাশনা হয়ে গেল, যা তার পুরনো দুঃখের চেয়েও বড় হয়ে উঠল। তার লেখালেখি যে শুধু তার নিজের জন্য ছিল না, বরং অন্যদের জন্যও ছিল। সবিতা জানত, তার এই প্রথম সফলতা একদিন অনেক দূর যাবে।

তাওহীদ তাকে নিয়ে ভীষণ আনন্দিত ছিল, এবং সবিতা তার কাছ থেকে আরও অনেক শিক্ষা পেয়েছিল। তাদের বন্ধুত্ব আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, এবং সবিতা তার জীবনে তৌহিদের মতো একজন বিশ্বস্ত বন্ধু পেয়ে অনেক খুশি ছিলো।

রাইয়া, সবিতার একমাত্র বন্ধু, তার নতুন বইটি পড়ে অনেক খুশি হয়েছিল। সে বলেছিল—

– “তুমি শুধু তোমার জীবনের গল্পই লিখছো না, সবিতা, তুমি সবার জন্য একটা পাঠ শিখাচ্ছো।”

সবিতা তার বইয়ের প্রথম প্রচ্ছদে রাইয়ার নাম লিখেছিল, কারণ সে জানত, রাইয়া ছাড়া তার এই পথ চলা কখনোই সম্ভব হত না। সবিতা জানত, যদি তার জীবনে কখনো কোনো সত্যিকারের মানুষ থাকে, তবে তা হলো রাইয়া।

রাইয়া বলল—

– “সবিতা, তুমি যেভাবে আছো, সেভাবে সবাইকে দেখাও। তুমি যদি নিজের জন্য কিছু করতে পারো, তবে পৃথিবীটাও বদলাতে পারবে।”

এখন সবিতা জীবনের নতুন সুরে চলতে শুরু করছে। তার পৃথিবী বদলানোর প্রস্তুতি চলছে। তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তার সামনে শুধু এক নতুন দিন অপেক্ষা করছে।

……..

সবিতা তার জীবনের পথে এক নতুন সূচনা করেছে, তবে পুরনো অধ্যায় তাকে তাড়া করেই যাচ্ছিল। তার জীবন এখন অনেক বেশি স্থিতিশীল, কিন্তু মাঝে মাঝে পুরনো স্মৃতি, পুরনো যন্ত্রণাগুলি ফিরে আসত। সেগুলিকে উপেক্ষা করেই সে নিজের পথে চলতে শুরু করেছিল। তাওহীদ তার লেখালেখির ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে, কিন্তু সবিতার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল—নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা, নতুন করে দাঁড়িয়ে থাকা।

একদিন সবিতা আবার সাইফের ফোন পেল, যে ফোনটি তার জন্য একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ সবিতা সেদিন সাইফ কে মুখের উপরই না করে দিয়েছে যেনো সে আর তাকে কল না করে।

“তুমি কেন এভাবে নিজের জীবন টা নষ্ট করছো? পরিবারে ফিরে যাও। আমরা আবার একসাথে সব ঠিক করে নিতে পারি।”কারণ আমরা একে অপরকে অনেক ভালোবাসি।

সবিতার চোখে ক্ষোভ, তবে তার মুখে শান্তি।

“এই তুমি—এখনও বুঝতে পারো না! আমি আর কখনো তোমার কাছে ফিরে যাব না। আমি স্বাধীন, আমার জীবন আর তোমার দাসত্ব নয়।”

– “সবিতা, আমি জানি আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি। কিন্তু আমি এখন অনেক কিছু বুঝেছি। তুমি কি একবার আমাকে আবার সুযোগ দেবে?”প্লিজ সবিতা।তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে এক সময়।

সাইফের কথাগুলি যেন পুরনো যন্ত্রণা আবার ফিরে আনে। সবিতা তার জীবনে সাইফের প্রভাব বুঝে উঠতে পারছিল না।সে বুঝতে পারছিল যে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা তার নিজের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।

সবিতা কিছু সময় চুপ থাকল, তারপর ধীরে ধীরে বলল—

– “সাইফ,আমি যখন তোমার প্রয়োজন ছিলাম না, তখন আমি নিজেকে গড়েছি। তুমি যদি ভাবো আমি তোমার কাছে ফিরব, তাহলে তুমি ভুল ভাবছো। আমার জীবন এখন আমি নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছি। আমি আর তোমার অতীতের অংশ হতে চাই না।”প্লিজ আমাকে মুক্তি দাও।আর আমাকে ভালোবাসার অজুহাত দেখিয়ে ব্লাকমেল করো না।আমি আগেও বলেছি আর এখনো বলছি আমি আর তোমার জীবনে কখনোই ফিরবো না।কারণ তোমার সেই ভালোবাসার কাঙাল আন্নি মারা গেছে অনেক আগেই।

এ কথাগুলি সাইফকে চমকে দিয়ে গেল,সাইফের অজান্তেই দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো, অন্যদিকে সবিতাও কাঁদছে,যত কিছুই হোক এক সময় তো তাকে সে প্রচন্ড ভাবে ভালোবেসে ছিলো।

তবে সবিতা ভালো করেই জানে—এই সিদ্ধান্তটি তার জীবন ও স্বকীয়তার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।আজ এসব না বললে সাইফ বার বার তাকে বিরক্ত করতো।
সবিতা সাইফের প্রতি ভালোবাসার জন্যই তাকে আইনি ভাবে শাস্তি দেয় নি কোনো,তবে সে সাইফের জীবন থেকে এখন অনেক দূরে চলে গেছে।

তাওহীদ বন্ধু হিসেবেই সবিতার পাশে থাকলো। তার লেখালেখির সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও, তাওহীদ কখনোই তাকে ব্যক্তিগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দেয়নি। সবিতা বুঝতে পারছিল, তাওহীদ তাকে নিঃস্বার্থভাবে সহ্য করে এবং তার সব বিপদের সময় তাকে শক্তি দেয়। সবিতা তাওহীদের সঙ্গে অনেক রাত কেটেছে গল্প, কবিতা, এবং সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছে। তাওহীদ তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তারা কখনো একে অপরকে বেশি ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেনি।

তাওহীদ একদিন বলেছিল—

– “সবিতা, তোমার লেখার মধ্যে তুমি যেমন তোমার যন্ত্রণাকে প্রকাশ করো, তেমনই তুমি জীবনের আরো অনেক বড় চিত্রও ফুটিয়ে তুলবে। তোমার লেখায় এক শক্তি রয়েছে যা আমি কখনো কোনো লেখকের মধ্যে দেখি নি।”

এটা সবিতার জন্য বড় প্রশংসা ছিল। তার কাছে তাওহীদ শুধু একজন বন্ধু ছিল না, বরং তার জীবনের চলমান সঙ্গী, এক মানুষ যাকে সে কখনো হারাতে চায় না।

একদিন সবিতা তার বন্ধু রাইয়ার সঙ্গে বসে পুরনো স্মৃতি চারণা করছিল। তারা মজা করছিল, হাসছিল এবং একে অপরকে জীবন সম্পর্কে তাদের অনুভূতি জানাচ্ছিল। রাইয়া বলেছিল—

– “তুমি জানো, সবিতা, তুমি আজ যা আছো, তা তোমার নিজের শক্তির ফল। তুমি যদি ভেবো, তোমার জীবনের কোনো মুহূর্তেও কেউ তোমাকে মূল্যায়ন করেনি, তবে সেটা পুরোপুরি ভুল হবে। তোমার ভিতরে যা কিছু আছে, তা তোমার আত্মবিশ্বাস থেকে এসেছে।”

রাইয়ার কথাগুলি সবিতার মনকে আরো গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার পথের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি কষ্ট, শুধুমাত্র তার নিজের তৈরি। রাইয়া তাকে জীবন সম্পর্কে একটি নতুন দৃষ্টি দিয়েছে—যে দৃষ্টি দিয়ে সে দেখতে পায়, কোনো কিছুই সহজে আসে না, কিন্তু যদি তুমি নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, তবে তুমি সবকিছু অর্জন করতে পারো।

একদিন সবিতা তার লেখালেখি সম্পূর্ণ করে একটি নতুন বই প্রস্তুত করল। এই বইটির নাম ছিল “জীবনের শেষ কথা”।

এটি তার জীবনের সমস্ত চ্যালেঞ্জ, তার সংগ্রাম এবং তার আত্মবিশ্বাসের গল্প তুলে ধরেছিল। তার বইটি প্রকাশনা থেকে এক মাস পরই বিক্রি হয়ে যায়, এবং এই প্রথমবার সবিতা অনুভব করেছিল, সে সফল হয়েছে। এটি তার জন্য এক নতুন সূচনা ছিল, একটি নতুন অধ্যায়।

সে জানত, এই পথ তার জন্য কঠিন ছিল, কিন্তু সেই কঠিন পথে গিয়েই সে নিজেকে গড়ে তুলেছিল। এখন তার সামনে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল, যেখানে সে তার জীবনের সবকিছু নতুন করে সাজাতে পারবে।

সবিতার নতুন বইয়ের প্রকাশনা খুব ভালো হয়েছিল। সে জানত, একদিন তার লেখা সারা পৃথিবীজুড়ে পরিচিত হবে। তার জীবনের গল্প ও সংগ্রাম একদিন অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে। এই বিশ্বাস সবিতার হৃদয়ে শক্তি যোগাচ্ছিল।

তাওহীদ এবং রাইয়া তার পাশে ছিল, এবং সবিতা জানত—তার জীবন আর কখনো অন্ধকারে হারাবে না। তার সামনে শুধু একটি উজ্জ্বল, স্বাধীন, সফল জীবন অপেক্ষা করছে।

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৬

0

সবিতা
পর্ব : ০৬
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
মোহাইমিনের প্রস্তাব উপেক্ষা করতে তার আর কোনো ইচ্ছা নেই।
তার মধ্যে এক নতুন শক্তি তৈরি হচ্ছে, এবং তার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট—

“আমি নিজের পথেই চলব।”

মোহাইমিন জানেন, তার যাত্রার শেষ কোথায়—
অন্য কেউ এটা জানে না।
কিন্তু, সবিতা জানে, তার কাজের উদ্দেশ্য একটাই—

“নারীর স্বাধীনতা, সম্মান, আর অধিকার।”

তবে সেই যাত্রায় এক নতুন বিপদ তৈরি হয়।
কিছু অন্ধকারমনা মানুষ সবিতার কাজকে একেবারে বিপজ্জনক মনে করতে শুরু করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবিতার বিরুদ্ধে ঘৃণিত পোস্ট আসতে থাকে,

তার উদ্যোগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অভিযোগ তোলে—
“এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর, এর ফলে পরিবার ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।”

কিন্তু সবিতা জানে, যে কাজ সে করছে, তা সত্যি ও প্রয়োজনীয়—
এটা চলতেই থাকবে।

একদিন সবিতা অফিসে ছিল।
তখন তার ফোনে একটি কল আসে—
এটা সাইফের ফোন।

সবিতা ফোন ধরে নীরবে শুনতে থাকে—

সাইফ বলে—
– “আমি জানি, আমি অনেক কিছুই ভুল করেছি। আমি যা করেছি তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার কাছে নেই। কিন্তু আমি শুধু চাই, তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও, যেন আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারি।”

সবিতা চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

সে জানে, সাইফ তার জীবনে অনেক কিছুই ভুল করেছে।সে সবিতার বিশ্বাস কে একদম চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে,যা আর পূর্বের অবস্থায় ফিরবে না কখনো।

তবে একটা জায়গায় সাইফ একেবারে সঠিক—

সাইফ সবিতার জীবনে আর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না।

সাইফের আকুতি মিনতি আজ আর কোনো কাজে আসবে না সবিতার জীবনে।এজন্য সবিতা চুপ করে থাকে,
কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেয়।

রাইয়া ও সবিতার সম্পর্ক এখন নতুন একটা স্তরে পৌঁছেছে।
রাইয়া শুধু তার সহকর্মী নয়, বরং তার আত্মবিশ্বাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
একদিন রাইয়া সবিতার কাছে এসে বলে—

– “আপা, আপনি জানেন, আপনি ছাড়া আমি কখনো এগোতে পারতাম না। আপনিই তো আমাকে সেই সাহস দিয়েছিলেন।”

সবিতা রাইয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চুপ হয়ে যায়।
তার চোখে এক অনিচ্ছাকৃত অনুভূতি চলে আসে—

“আমিও তো নিজের জন্য কিছু করতে পারিনি। কিন্তু আমরা একে অপরকে শক্তি দিচ্ছি।”

রাইয়া তখন বলেন—
– “আপনি একা নন, আপা। আমরা একসাথে আছি। আপনার সকল স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে।

এদিকে মোহাইমিন আবার সবিতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকে।

সে জানে, সবিতা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
তবে তার ধারণা ছিল, সবিতা হয়তো কিছুটা সময় নেবে, পরে সে তার প্রস্তাবে সম্মত হবে।

কিন্তু সবিতা জানে—
এবার তার পথ আলাদা।

একদিন মোহাইমিন অফিসে এসে বলেন—

– “আপনি জানেন, আমি চাই আপনার কাজ আরেকটি স্তরে উঠুক। আপনার আন্দোলন সমাজের জন্য অনেক প্রয়োজনীয়। আমি আবারও বলছি,

আমি আপনাকে সহযোগিতা করতে চাই।”

সবিতা তখন গভীরভাবে মোহাইমিনের দিকে তাকায়।
তার মনে এক ধরনের সন্দেহ চলে আসে।
“এটা কি শুধুই সহযোগিতা, না কি তার ভেতরে অন্য কিছু?”

তবে সে আর কিছু বলে না, শুধু বলে—

– “আমার কাজের সাথে আপনি আর যুক্ত হবেন না।”

মোহাইমিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, মুখে একটা সঙ্কুচিত হাসি দেয় এবং চলে যায়।

..………….

দিন কয়েক পরে সবিতার কাছে এক অপ্রত্যাশিত সুযোগ আসে।
একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা তাদের কাজে সবিতাকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেয়—
তারা জানায়, তারা চায় সবিতা তাদের ট্রেইনার হিসেবে কাজ করুক, যেখানে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে নারীদের অধিকার নিয়ে বক্তৃতা দেবেন, সেমিনার পরিচালনা করবেন, এবং কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

সবিতার মনে এক নতুন আশা জাগে।
এটা তার কাজকে আরও বিস্তৃত করতে পারবে, আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।
তবে একে অপরের সাথে ঘনীভূত সম্পর্কের ফলে, সবিতা কি এটি গ্রহণ করবে?

সবিতা এখনও সেই আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রস্তাবটি চিন্তা করছে। তার সামনে নতুন সুযোগ, নতুন যাত্রা, কিন্তু সে জানে—এটি সহজ হবে না। সে অনেক কিছু হারিয়েছে, অনেক কিছু শিখেছে, কিন্তু এখন তার সামনে এক নতুন যুদ্ধ আসছে। এই যুদ্ধ শুধু নিজের জন্য নয়, বরং দেশের নারীদের জন্যও।

……….

একদিন সাইফ একাধিক বার ফোন করে সবিতার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। সবিতা জানে, সাইফ বুঝতে পারছে না, তার সাথে সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সাইফের পরিবর্তন আসেনি, সে আবারও সবিতার কাছে ফিরে আসতে চায়, কিন্তু সে জানে, সবিতা আর কখনো তার কাছে ফিরে যাবে না।

এদিকে সবিতা যখন এই ভেবে নিশ্চিন্ত যে, সে সাইফের থেকে মুক্তি পেয়েছে, সাইফ আবার তার জীবনে প্রবাহিত হতে শুরু করে।

একদিন সবিতা অফিসে বসে ছিল, সাইফ তার সামনের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে।

– “আমি জানি, আমি তোমার অনেক কিছু ভেঙে ফেলেছি, কিন্তু আমি শুধু চাচ্ছি তোমার পাশে থাকতে। প্লিজ সবিতা, একবার আমাকে সুযোগ দাও।”

সবিতা এক মুহূর্ত চুপ থাকে। তার চোখে ঝিলমিল করা অশ্রু।

তবে সে জানে—এটা আর হবে না। সে জানে, তার পথের সঙ্গে সাইফের পথ আর কখনো মেলানো যাবে না।

“এবার তুমি আমাকে প্লিজ একে অপরের থেকে দূরে থাকার সুযোগ দাও।”সবিতা শান্তভাবে বলে।

সাইফ একেবারে চুপ থাকে, কিছু বলার সাহস পায় না। সে আজও আবার ধীরে ধীরে চলে যায়।

এতদিন যে তীব্র অসন্তোষ ছিল, যে অস্থিরতা সবিতার মধ্যে ছড়িয়ে ছিল, সেটি কিছুটা হলেও শান্ত হয়। সবিতা সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর অপেক্ষা করবে না। এই সুযোগ তার জন্য তৈরি হয়েছে, এবং সে এটি গ্রহণ করবে। তার জীবনের স্বপ্ন, তার লক্ষ্য, তার কামনা—সবই তার হাতের নাগালে।

রাইয়া তাকে সমর্থন জানায়। রাইয়া জানে,সবিতা যখন কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাকে কেউ থামাতে পারবে না।

– “তুমি সেই সাহসী মেয়ে, যে সবার আগে দাঁড়িয়ে আছে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য। তুমি জানো, আমাদের সকলের পক্ষে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই পথে চলতে চলতে তুমি এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।”

সবিতা তার দিকে তাকায় এবং তার চোখে এক নতুন আশার ঝিলিক দেখা দেয়।

কিন্তু নতুন পথ সহজ হতে যাচ্ছে না।
সবিতার নতুন যাত্রায় তাকে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। একদিকে সাইফের পরিবার আবারও তার বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ তুলতে শুরু করে—তারা সবিতার সম্পর্কে নিন্দা করতে থাকে, তার সামাজিক সম্মানহানি করতে চায়।

এদিকে, যখন সবিতা আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মসূচিতে অংশ নেয়, তখন তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হয়—কেউ কেউ তাকে ‘ঘরবাড়ি ভাঙানোর অপরাধী’ বলেও অভিহিত করে।

কিন্তু সবিতা এসবকে কিছু মনে না করে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। সে জানে, এই পথ সত্যি হলেও কঠিন, তবে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। তার কাছে একমাত্র লক্ষ্য হলো—নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাদের জন্য একটি সমতাভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি করা।

মোহাইমিনও জানে, সবিতা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু সে সবিতাকে আরেকটি সুযোগ দিতে চায়। মোহাইমিন সবিতার সাথে আবার যোগাযোগ শুরু করে, এইবার সে সবিতার পক্ষে কিছু কাজ করতে চায়।

– “তুমি যে কাজ শুরু করেছ, সেটি আমি বিশ্বাস করি। আমি চাই, তুমি আমার মধ্যে কাজ করতে থাকো, এবং আমাদের যৌথ উদ্যোগ দেশের উন্নতি করবে।”

সবিতা মোহাইমিনের দিকে তাকিয়ে, এক মুহূর্ত ভাবনায় ডুবে যায়। সে জানে, এই প্রস্তাব তার জন্য কোনো ভালোর দিকে নিয়ে যাবে না। তবে সে আর কিছু বললে না, শুধু ঘাড় নেড়ে তার সিদ্ধান্ত জানায়—

“ধন্যবাদ, কিন্তু আমি নিজের পথে চলব।”

মোহাইমিন হতাশ হয়ে ফিরে যায়, তবে তার চোখে এক অদ্ভুত লুক থাকে, যেন সে কিছু পরিকল্পনা করছে যা সবিতার ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হতে পারে।

সবিতা আজকে একটা নতুন পৃষ্ঠা লিখছে। তার সামনে পৃথিবী এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। এই নতুন প্রস্তাব, নতুন পথ—তার মধ্যে এক নতুন শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। একদিন, সে জানবে যে, তার এই যুদ্ধ শুধুমাত্র তার নিজস্ব নয়, পুরো সমাজের জন্য। তার গল্প, তার সংগ্রাম, তার জয়—সেটি অন্যদের জন্যও একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।

সে বুঝতে পারে, জীবনে যতই অন্ধকার আসুক, শেষ পর্যন্ত সব কিছু আলোকিত হয়ে ওঠে।

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৫

0

সবিতা
পর্ব: ০৫
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

রাইয়া কাঁপা গলায় নিজের গল্প বলা শুরু করে—
সে কিশোরী বয়সেই এক আত্মীয়ের লালসার শিকার হয়।
কেউ বিশ্বাস করেনি তাকে।
মা বলেছে, “মেয়ে হয়ে এত কথা বলে না।”
বাবা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

একদিন রাইয়া রাগ করে শুধু একটা ব্যাগ আর কিছু বই নিয়ে পালিয়ে আসে ঢাকায়।

শেল্টার হোমে এসে সে দেখে, এখানে ওরকম আরও অনেকে আছে।

কিন্তু সবচেয়ে অবাক হয়—যখন সে দেখে সবিতার মতো মেয়েও তার ভালোবাসার মানুষের কাছে দিনের পর দিন নির্যাতিত আর অবহেলিত।কিন্তু বর্তমানে তার আত্নবিশ্বাস প্রখর,চোখে কোনো ভয় নেই,মনের ভিতর এক আকাশ পরিমাণ বড় হওয়ার বাসনা,যাতে অন্যের মুখাপেক্ষী না হতে হয় তাকে।

সবিতা বলে—
– “তুই একা না, বুঝলি?”
রাইয়া জিজ্ঞেস করে—
– “আপনি কীভাবে এত শক্ত হন?”
সবিতা বলে—
– “যেদিন থেকে আমি অন্যের জন্য নিজেকে শক্ত করলাম, সেদিন থেকে।”


সবিতা এখন শুধু ব্লগার না।
সে চায় একটা ‘আশ্রয় ও পুনর্গঠন কেন্দ্র’ গড়তে—যেখানে নির্যাতিত নারীরা শুধু আশ্রয় নয়, পাবে শিক্ষা, কাজ শেখা, আইনি সহায়তা, এবং সম্মান।

প্রজেক্টের নাম দেয়—
“আলোকধারা”

নওরীন আপু ও একাধিক এনজিও পাশে দাঁড়ায়।

মিডিয়াতে আবার সবিতার নাম উঠে আসে—
“সাবেক গৃহবধূ থেকে নারী অধিকারকর্মী:সবিতার পথচলা।”

একদিন সন্ধ্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়।
নামেন একজন ব্যক্তি—পরিচিত মুখ, কিন্তু চোখে একেবারে অচেনা ভাষা।

মোহাইমিন চৌধুরী।
নতুন এক এনজিওর পরিচালক, দেশের বাইরে থেকেও কাজ করেন।
সে আগেই সবিতার কাজের কথা শুনে এসেছে।
আজ সরাসরি দেখা করতে।

– “আপনার সাহস আর স্পষ্টতা আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছে,”—সে বলে।

সবিতা চমকে ওঠে না।
কারণ এখন এসব প্রশংসায় সে মাথা ঘোরায় না।
তবু তার চোখে প্রশ্ন—
“আপনি কেন এখানে?”

মোহাইমিন হেসে বলে—
– “কারণ আমি চাই, আপনি দেশজুড়ে ‘আলোকধারা’র শাখা খুলুন। আমরা সহায়তা দেব। আপনি নেতৃত্ব দিন।”

সবিতার মুখে এক অদ্ভুত নির্ভরতা।
তবু ভিতরে ভিতরে একটা দ্বিধা খেলে যায়।

রাইয়া এখন শুধু নিরাপদ নয়—সে শিখছে ডিজাইন, কথা বলা, নেতৃত্ব।
একদিন সে বলে—
– “আপা, আপনি যদি না থাকতেন, আমি হয়তো বেঁচেই থাকতাম না।”

সবিতা চেয়ে থাকে—
আসলে সে তো নিজেকেও বাঁচাতে চেয়েছিল।
এখন বাঁচাচ্ছে আরো অনেককে।

…..……

সবিতা যখন ‘আলোকধারা’ শুরু করে, তখন এর সাফল্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এটা একদিকে মানুষের জন্য আশ্রয়, অন্যদিকে সবিতার জন্য নতুন এক পরিচিতি তৈরি করে।
কিন্তু সাফল্যের সাথে আসতে থাকে নতুন চ্যালেঞ্জ।
এখন সবিতা শুধু নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে না—সে হয়ে উঠছে সমাজের চোখে এক প্রতীকি লড়াকু।

এদিকে, মোহাইমিনের পাশে দাঁড়ানোর পর সবিতার মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা চলে আসে।
সে জানে না, মোহাইমিন কেবল সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, নাকি তার মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
তার মানসিক দ্বন্দ্ব ঘিরে ধরে।
সে কখনো মোহাইমিনের সাহায্যকে মেনে নেয়, কখনো আবার তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠে।

আজ সবিতা তার বাড়িতেই আছে।হঠাৎ সাইফ তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
তার চোখে অনুরোধ।
সে বলে—
– “আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি, কিন্তু তোমার পাশে দাঁড়াতে চাই।”প্লিজ আন্নি সুযোগ দাও একটা।প্লিজ।

সবিতা নির্বিকারভাবে সাইফের দিকে তাকায়।

সে ভালো করেই জানে, সাইফ এখনও তার পুরনো গন্ডির মধ্যে আটকে আছে।সাইফ বিন্দুমাত্র নিজেকে চেঞ্জ করে নি।
তার জীবনে আসলে সবিতা ছিল একটা অস্থায়ী পরিসর।
সে নিজেকে এতটাই গুটিয়ে ফেলেছে যে,সবিতার এমন পরিণতি, যা তার কারণেই হয়েছে,সেটা স্বীকার করতে এখনো সক্ষম হয়নি সাইফ।

তবে সবিতা জানে, এই সময়ে সাইফের তার সামনে এসে দাঁড়ানোর পেছনে এক বড় কারণ আছে—

সে কি শুধুই অপরাধবোধের কারণে ফিরে এসেছে?

না কি তার জীবনের প্রতি পূর্ণ ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করছে?

সবিতা এদের কোনোটাই বিশ্বাস করতে পারে না।
সে বলে—
– “তুমি কি কখনো আমার জন্য কিছু করতে চেয়েছিলে? আমি চলে যাওয়ার পর তুমি কি এক মুহূর্তও আমাকে খুঁজেছিলে? না, সাইফ, তুমি তা করো নি,আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে দাও,আর তুমি শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচো।”প্লিজ আমার সামনে আর এসো না।আমি তোমাকে ছাড়া বেশ ভালো আছি।আমাকে ভালো থাকতে দাও দয়া করে।

সাইফ আজও সেখান থেকে চলে যায়, নিঃশব্দে।

সে এতো বড় অপরাধ করেছে যে যার কোনো দিন কোনো ক্ষমা নেই সবিতার কাছে।

সবিতা বর্তমানে অনেক ভালো ভালো কাজ করছে,তার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, এজন্য তার কিছু শত্রুরাও হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

একদিকে কিছু পুরনো পরিচিত মুখ তাকে অপমান করতে চায়, তো অন্যদিকে তার কাজের প্রতি বিরোধিতা জানায়।

কিছু মানুষ মনে করে যে, সবিতার কাজ নারীদের জন্য আসলেই উপকারী, কিন্তু তারা যে সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে এর বিরোধিতা করে, তা নিয়ে সবিতার সন্দেহ বাড়ে।

কিছু লোক সবিতার প্রতিষ্ঠানে তার কাজকে অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক বলে মনে করে।
তারা মনে করে—

“সবিতা যদি নারীদের অধিকার নিয়ে এত কথা বলে, তাহলে তার শিখানো মূলনীতি সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করবে।”

একদিন, সবিতা যখন নিজেই খুঁজতে থাকে কাদের বিরোধিতা তাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত দেয়, তখন সে বুঝতে পারে—

এর মধ্যে এক ধরনের বৃহত্তর ষড়যন্ত্র কাজ করছে।
একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শিক লড়াইয়ে সবিতা পড়ে গেছে।
অথবা, কেউ সবিতার অর্জনগুলিকে হুমকি মনে করছে।
সবিতার চারপাশে এক অদৃশ্য যুদ্ধ শুরু হয়।

রাইয়া একদিন সবিতাকে বলে—

– “আপা, আপনি ভাবছেন, সমাজ ও পরিবার আমাদের বিরোধিতা করছে, কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি যে কাজ শুরু করেছেন, তা চিরকাল আপনাদের বিশ্বাস ও উদাহরণ হয়ে থাকবে।”

রাইয়ার কথায় সবিতার মনে এক নতুন শক্তি খেলে যায়।
সে বুঝতে পারে, সমাজের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সে একা নয়।
এখন তার পাশে অনেক সঙ্গী, যারা একে অপরকে শক্তি দেয়।
এই অনুভূতি সবিতাকে দৃঢ় করে তোলে।

মোহাইমিন আবার সবিতার কাছে আসে—

– “আপনি জানেন, আপনাকে আমি শুধু সহায়তা দিতে চাই না, বরং আপনার কাজে যোগ দিতে চাই। আমি চাই, আপনার প্রজেক্টকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে।”

সবিতা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।
তার সামনে একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—
কীভাবে সে এই মানুষটির প্রস্তাব মেনে নেবে?

সবিতা মোহাইমিনের মনোভাব সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।
তবে সে জানে, তার কাজের জন্য সহযোগিতা দরকার।
এটা কি তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হবে?

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৪

0

সবিতা
পর্ব:০৪
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা এখন এনজিওর শেল্টার হোমেই আছে। রোজ নিজেকে একটু একটু গড়ছে।
দিনে সেলাই শেখে, সন্ধ্যায় কম্পিউটার ক্লাস, রাতে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ।
এক ধরনের ছন্দে চলতে থাকা এই দিনগুলো হঠাৎ বদলে গেল এক বিকেলে।

সেইদিন এনজিওতে আয়োজিত ছিল একটি ওয়ার্কশপ—
“সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা”
ওয়ার্কশপে স্পিকার ছিলেন নওরীন আফরিন, একজন সাইকোলজিস্ট এবং লেখিকা।

ছিমছাম পোশাক, মিষ্টি গলা, আত্মবিশ্বাসী চোখ—
সবিতার মনে হলো, এই প্রথম একজন নারীকে দেখে তার নিজের প্রতি ভরসা বাড়ছে।

নওরীন যখন বলছিলেন—

– “নিজেকে দোষারোপ করো না। যে চলে আসে, সে সাহসী। যে প্রতিবাদ করে, সে বেঁচে থাকার জন্য লড়ে। তুমি যদি নিজেকে ভালোবাসো, তাহলেই তুমি জীবনের কাছে দায়মুক্ত।”

সবিতার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
তার ভিতরের ক্ষতগুলো যেন কারও কথায় সাড়া দিচ্ছে।

ওয়ার্কশপ শেষে সবিতা নওরীনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখ নিচু করে।

নওরীন হাসেন, বলেন,
– “তোমার চোখ অনেক কিছু বলে। তোমার গল্প শুনতে পারি?”

তাদের কথোপকথন শুরু হয় ধীরে ধীরে।
দিনের পর দিন, সবিতা তার জীবনের প্রতিটা যন্ত্রণার কাহিনি খুলে বলে।
নওরীন শুধু শোনেন না, তাকে জড়িয়েও ধরেন।

একদিন নওরীন বলেন—

– “তুমি চাও, আমি তোমার একটা কেস ফাইল করে রাখি? চাইলে আইনি সহায়তা, থেরাপি ও একটা শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”

সবিতা চমকে ওঠে।
সে কখনো ভাবেইনি কেউ তার পাশে এভাবে দাঁড়াবে।

কিন্তু ঠিক তখনই—
আবার এক ঝড় উঠে যায়।

একদিন এনজিওর অফিসে আসে দুই পুলিশ ও সবিতার শশুর।

তিনি এসে বলেন—

– “আমাদের বউমা হারিয়ে গেছে। অনেক খুঁজছি। এখন শুনছি এখানে আছে। তাকে নিতে এসেছি।”

নওরিন তখন সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

– “মেয়েটির নিজের মতামত ও সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করে কেউ তাকে নিতে পারবে না। আপনারা চাইলে আইনগতভাবে দাবি পেশ করুন। তবে এখন ওর সিদ্ধান্ত ওর নিজের।”

সবিতা প্রথমবার এতটা নিরাপদ অনুভব করে।

সেই রাতে সবিতা চুপচাপ নওরীনকে জিজ্ঞেস করে,

– “আপু, আমি লেখাপড়া করতে চাই, নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চাই।তাহলে কি বয়স দোষ হয়ে দাঁড়াবে?”

নওরীন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
– “বয়স নয়, সংকল্পই সব। তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে ভর্তি করিয়ে দেব।”

সবিতার চোখে আশার আলো জ্বলে ওঠে।
এক নতুন যাত্রার শুরু।
নওরীন আপুর উৎসাহে সবিতা ভর্তি হয় একটি বেসরকারি কলেজের অনলাইন প্রোগ্রামে।
পুরো স্কলারশিপে।
সকালে সেলাই, বিকেলে পড়াশোনা, রাতে নিজের ডায়েরির পাতা খুলে বসা—এভাবেই কাটে তার দিনগুলো।

একদিন নওরীন হঠাৎ বলল,
– “তুমি কি জানো, তোমার জীবনের গল্প যদি তুমি নিজেই লেখো, তাহলে সেটাই হয়ে উঠবে অন্য নারীর সাহস?”

সবিতা অবাক হয়ে চেয়ে থাকল।
সে কখনো ভাবেনি তার যন্ত্রণার ভেতরেও কারো পথ দেখানোর আলো লুকিয়ে থাকতে পারে।

সে লিখতে শুরু করে—
প্রথম পাতায় লেখে—

> “আমি ছিলাম কারো ঘরের বউ, অথচ সেই ঘরটা আমার ছিল না কোনোদিন।
আমি এখন কারো স্ত্রী নই, কারো মেয়ে নই—আমি শুধু আমি।”

প্রথমে ছোট ছোট লেখালেখি।
তারপর একটা ব্লগ খুলে ফেলে নওরীনের সহায়তায়।
নাম দেয়: “জীবনযুদ্ধিনী”।

প্রতিদিন হাজার হাজার মেয়ে তার পোস্টে মন্তব্য করে।
অনেকেই লিখে—
“তুমি আমার মতো…”, “তুমি না লিখলে বুঝতাম না আমি একা নই।”

সবিতার ভিতরে এক নতুন শক্তি জন্ম নেয়।
তার কণ্ঠস্বর এখন শুধু তার না, অনেকের কণ্ঠ।

কিন্তু পুরোনো অন্ধকার তো চুপ করে বসে থাকে না।

একদিন, তার ব্লগে একটা কমেন্ট আসে—

“তোমার নাম তো আন্নি।তুমি সাইফের বউ ছিলে না? এত বড় বড় কথা বলার আগে আয়নায় নিজের মুখ দেখে নে।”

সবিতা প্রথমে ভয় পায়।
তারপর লেখে এক জবাব—

> “হ্যাঁ, আপনি সঠিক ধরেছেন,আন্নি সাইফের স্ত্রী। কিন্তু সে আন্নি নিজেকে ভেঙে চুরে সবিতা হিসেবে তৈরি করেছে।সবিতা এখন তার নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে শিখেছে।
সবিতা ভাঙিনি, সবিতা তৈরি হয়েছে।”

এই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়।
দেশজুড়ে অনেক মিডিয়া তার সাক্ষাৎকার চায়।

নওরীন একদিন বলে,
– “তুমি যদি চাও, আমরা তোমার লেখা দিয়ে একটি বই প্রকাশ করব। তুমি সম্মেলনে যাবে, অন্য নারীদের সামনে কথা বলবে।”

সবিতার চোখ ছলছল করে ওঠে।
সে ছোট করে বলে—
– “আমি পারবো তো?”

নওরীন জবাব দেন,
– “তুমি তো সেই দিনই পেরেছিলে যেদিন ঘর ছেড়ে বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে।”

সবিতার বই “জীবনযুদ্ধিনী” প্রকাশের পর সে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে সে সেমিনার, টক শো-তে ডাক পায়।
তাকে “মহিলা ক্ষমতায়ন” বিষয়ক এক সরকারি সেমিনারে বক্তা হিসেবে ডাকা হয়।
মঞ্চে উঠে সে বলে—

> “আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছেড়েছিলাম, আজ সেই কান্না দিয়ে পথ গড়েছি।”

হলজুড়ে করতালি।
কেউ একজন বসে আছে শেষ সারিতে—চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে।
সে সাইফ।

হ্যাঁ, সে ফিরে এসেছে।

সাইফের মনোভাব বদল, না কি মুখোশ?

সেমিনার শেষে সবিতাকে গেটের বাইরে পায় সাইফ।
একটা চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে বলে—
– “তুমি এত বড় হয়ে যাবে বুঝি নি কখনো। আমি তো ভাবতেও পারিনি।”

সবিতা জবাব দেয় না।
চোখে একরাশ তীব্র ঠাণ্ডা।

সাইফ বলে—
– “ভুল হয়ে গেছে আমার, আমি তোমাকে বুঝতে পারি নি। তুমি ফিরে আসো না প্লিজ…”

সবিতা হেসে ফেলে।
আর বলে,আমাকে যদি আন্নি ভেবে নিতে আসেন তাহলে আমি যেতে পারবো না,কারণ আন্নি এখন মৃত।
আর যদি সবিতাকে ফেরত নিতে আসেন,
তাকেও নিয়ে যেতে পারবেন না।
কারণ,,,,,
সবিতা থেমে গেলো।
কিন্তু সে একটা চিঠি বের করে সাইফের হাতে দেয়।

চিঠির শিরোনাম—
“যে মেয়েটা একদিন তোমার ছিল, সে আজ মৃত।কিন্তু এখন যাকে দেখছো সে একান্তই নিজের।”

সাইফ পেছনে হাঁটা দেয়।
এই প্রথম সে বুঝতে পারে, ক্ষমতা কাকে বলে।
আর এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারে আন্নি আর তার জীবনে কখনোই ফিরবে না।

সবিতার সামনে নতুন পথ

নওরীন আপু বলে—
– “তুমি চাইলে বিদেশে একটা স্কলারশিপের সুযোগ আছে, লেখালেখির ওপর।”

সবিতা চুপ করে থাকে।
তার মনে পড়ে তার মতো হাজার মেয়ের কথা।
সে বলে—

– “আমি থাকব। আমি চাই আমার মতো মেয়েরা যখন ভেঙে পড়বে, তখন আমি তাদের যেনো পাশে দাঁড়াতে পারি। যেমন তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে।”

নওরীন গর্বিত চোখে তাকায়।

একদিন…

এক সন্ধ্যায় শেল্টার হোমে আসে এক কিশোরী।
মুখ থেঁতলে গেছে, চোখে ভয়।

সবিতা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে—
– “তোমার নাম কী?”

মেয়েটি ফিসফিসিয়ে বলে—
– “রাইয়া…”

সবিতা তাকে জড়িয়ে ধরে।
নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমস্ত ভয়, যন্ত্রণা, অভিমান… সব কিছু মিলিয়ে একটাই কথা বলে—

> “তুমি এখন নিরাপদ, রাইয়া। আজ থেকে তুমিও একজন জীবনযুদ্ধিনী।”

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৩

0

সবিতা
পর্ব: ০৩
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

“আমি মানুষ তো, না কি শুধুই এক কাজের মেয়ের মতো বসবাস করা মেশিন?”

সেই ভাবনা থেকেই আচমকা এই সিদ্ধান্ত—
আজ এই ঘর, এই সংসার, এই চেনা অথচ অচেনা মানুষের দল ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।
কোনো ব্যাগ নয়, কোনো টাকা-পয়সা নয়, এমনকি নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নয়।

আন্নি বেরিয়ে যায় খালি হাতে। পরনের ওড়নাটাও ঠিকমতো নেই তার গায়ে।
তবুও মনে এক অদ্ভুত শান্তি—
“এই নির্যাতন আর নয়।”

চাঁদের আলোয় ছায়া পড়ে তার চোখের নিচে।
রাস্তার বাতি মাঝে মাঝে কেঁপে উঠে।
সে হাঁটছে, উদ্দেশ্যহীন ভাবে।
জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন কোথাও না যাওয়াটাও একটা যাত্রা হয়ে দাঁড়ায়।
আজ আন্নির সেই যাত্রা।

হাঁটতে হাঁটতে পা আর চলে না।
চোখের জল শুকিয়ে গাল নোনা করে রেখেছে অনেক আগেই।
কোনো ঠিকানা নেই তার কাছে, নেই কারো আশ্রয় চাওয়ার অধিকার।
কিন্তু তবু সে চলেছে, একা, নিশ্চুপ।

ক্ষুধা লেগেছে, গা ভেঙে যাচ্ছে, চোখে অন্ধকার।
কিন্তু তবুও থামে না সে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায়—মাথা নিচু, কাঁধ ঝুঁকে গেছে ক্লান্তিতে।

ঠিক তখনই পেছন থেকে এক চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—

“আন্নি?”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কাকুলি আর আনোয়ার।
তার বান্ধবী, তার একমাত্র সমব্যথী।
কিন্তু এতটা ভাঙা অবস্থায় নিজেকে কারো সামনে প্রকাশ করতে চায় না আন্নি।
তাই সে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয়, চোখের জল লুকাতে চায়।

আনোয়ার উদ্বিগ্ন গলায় বলে ওঠে,
“আন্নি, কী হয়েছে তোমার?
এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? সব ঠিক আছে তো?”
কাকুলিও এগিয়ে আসে।
তার চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ, কণ্ঠে কাঁপুনি—
কাকুলি কাছে এসে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আবার সাইফের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস?”

আন্নি কোনো উত্তর দেয় না। তার চুপ থাকা যেন আকাশভরা উত্তর হয়ে নেমে আসে।
তার ঠোঁট থরথর করছে, চোখ আবারও জলে ভরে যাচ্ছে।

কাকুলি তার হাত ধরে—
“চল, আমাদের বাসায় চল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। তুই তো কাঁপছিস, আন্নি।”

আন্নি নিচু গলায় বলে—
“আমি আর কোনো ঘরে ফিরতে চাই না।আমি… রাস্তাতেই থাকবো।”
এটাই আমার শান্তি।”

কাকুলি চোখ বড় করে তাকায়।
“তুই পাগল নাকি? এভাবে কেউ থাকে? দুঃখে মন ভেঙে গেল মানে কি নিজের জীবনও ছুড়ে ফেলা?”

আন্নি কিছু বলে না।
শুধু তার দৃষ্টিতে ক্লান্তি, কষ্ট আর ভাঙা স্বপ্নের ছায়া।

আনোয়ার এবার একটু কঠোর গলায় বলে—

“দেখো, সাহস করে বেরিয়ে এসেছো, তার জন্য তোমার সাহসকে আমি সম্মান করি।
কিন্তু এর মানে এই না যে তুমি নিজেকে শেষ করে দেবে।
চলো, আমাদের বাসায় যাও। কালকের দিন কী হবে, পরে ভাবা যাবে।”

কাকুলি তার চোখে চোখ রেখে বলে—
“যা হবার হয়েছে। এবার তুই নিজের কথা ভাব।
তুই যে জীবিত আছিস, সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”
আন্নি একবার তাদের দিকে তাকায়।

শেষমেশ কাকুলি আর কোনো কথা না শুনেই জোর করে তার হাত ধরে ফেলে—
তোকে আমি একা রাস্তায় রেখে যেতে পারবো না।”

এই প্রথম সে অনুভব করে, কারও ছায়া এখনও আছে তার জীবনে।
অপমানের ঘর ছাড়লেও, আশ্রয়ের হাত এখনও থেমে যায়নি।

সে ধীরে ধীরে কাঁপা পায়ে হাঁটতে থাকে কাকুলি আর আনোয়ারের সাথে।
আর সেই মুহূর্তে তার চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসে শান্তির জল।
সেই চোখের জলে কষ্ট ছিল, তবে এবার ছিল নতুন শুরুর ইঙ্গিতও।

……..

অবাক করার মতো বিষয় হলো—আন্নি বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরেও কেউ খোঁজ নিলো না।
এদিকে সাইফ রাতে বাড়িই ফেরে নি।

সকাল বেলা শাশুড়ি অবশেষে সাইফকে ফোন করলেন।

“আন্নি বাসায় নাই।”—কণ্ঠটা যেন নিস্পৃহ।

সাইফের প্রতিউত্তর ছিল যেন তার চরিত্রেরই প্রতিচ্ছবি—“কই যাবে আর? বাপের বাড়িতে গেছে নিশ্চয়।”

একটুও উদ্বেগ, একটুও দায়িত্বের বোধ—কিছুই ছিল না কণ্ঠে। এমন কাপুরুষ স্বামী নিয়ে বেঁচে থাকার মানে কী?

এতটাই স্বার্থপর, এতটাই নির্দয় সে!
যে নারী বছরের পর বছর প্রেম করে অবশেষে তার সংসারে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে, তার মানসিক যন্ত্রণা আর অপমানের বোঝা টানতে টানতে আজ নিজেকে ভেঙে ফেলেছে—তার খোঁজে একটাবার বেরিয়ে পড়ার প্রয়োজন বোধ করে না সাইফ।

আন্নি তখন কাকুলিদের বাসায়।
বন্ধু কাকুলি একটিবার জড়িয়ে ধরেছিল—
“থাক তুই আমার কাছে। ঠিক হয়ে যাবে সব।”
আন্নি একটুও হাসতে পারেনি। তার মুখে কেবল নিঃস্পৃহতা, আর মনে একটাই প্রশ্ন—এই “সব” ঠিক হওয়ার মতো আছে কি?

কিন্তু কাকুলির বাসায় তো চিরকাল থাকা যায় না।
এটা তার স্থায়ী ঠিকানা নয়।সব সময় দয়া-ভিত্তিক সম্পর্ক মানুষকে কুরে কুরে খায়।

নিজের বাবা-মায়ের বাড়ি?
না,
বাবার বাড়ির দরজাও তার জন্য আজ বন্ধ।

পরের গন্তব্য—বড় বোন আমেনার বাড়ি।
তবে সেখানেও মিলল না আশ্রয়।
বরং শুনতে হলো চরম কথাগুলো—

“এইভাবে বাড়ি থেকে চলে আসে কেউ?”
“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?”
তুই কি ছোট শিশু?”
“আর কিছুদিন সহ্য করতে পারলি না?”

রক্তের সম্পর্কগুলোও এখন প্রশ্ন তোলে।

আন্নির চোখ ভরে ওঠে অশ্রুতে। গলার স্বর কাঁপে—
গলা ধরে আসে। সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে—

“আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। একদম না।”
আমি ভেঙে পড়ছিলাম, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো আমার!”

কেউ বুঝলো না তার যন্ত্রণার ভাষা, শুধু সিদ্ধান্তের জন্যই দোষারোপ।
শুধু বলে—তুই ভুল করেছিস।

কয়েকদিনের মাথায় মা-বাবা এসে হাজির আমেনার বাড়িতে। মা একদিকে ঝাড়ছে, বাবা আরেকদিকে। কেউ একটা প্রশ্নও করলো না—“তুই কেমন আছিস?”
তাদের চোখে আন্নি যেন এক অপবিত্র বোঝা।

মা বলে—“তোর মতো মেয়ে আমাদের মুখ দেখায় কেমনে!”
বাবা বলে—“তুই আমাদের মুখ পুড়ালি!”

আন্নি মাথা নিচু করে।
তাদের চোখে চোখ রাখার সাহসও তার আর নেই।
একটা মানুষের ভেতরকার সবটুকু তুচ্ছতা আজ তার দেহমুখে লেখা।

অভিমান আর অপমানে রাগ করে বোনের বাসা থেকেও বেরিয়ে পড়ে আন্নি।
আর তখনই শুরু হয় তার নিঃসঙ্গ ভ্রাম্যমান অধ্যায়।

সাইফের পরিবার ভাবে সে হয়তো মা-বাবার বাড়ি গেছে। মা-বাবা ভাবে সে হয়তো স্বামীর বাড়ি ফিরেছে।
কিন্তু আসলে, আন্নি কোনো বাড়িতেই নেই।
সে এখন রাস্তায়—নির্জন, অচেনা, একা।

সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে—একটা ঠাঁইহীন, ভালোবাসাহীন, নির্বাসিত নারীর মতো।

চোখের সামনে মানুষ আসে-যায়। কেউ তাকে দেখে না।
জীবনের গাঢ় অন্ধকারে সে হাঁটছে—অচেনা এক ভবিষ্যতের দিকে।
তবুও সে থেমে নেই।
একটুও।

….……….

ঢাকার শহর রাত নামলেই যেন অন্য এক রূপ নেয়।
লোকের ভিড় কমে, আলো কমে, শব্দ কমে… আর ভয় বাড়ে।

পায়ে পায়ে হেঁটে ক্লান্ত আন্নি একটা ফুটপাথের কিনারে বসে পড়ে।
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিখারিদের ভিড়ে আজ সে-ও যেন এক হয়ে গেছে।

একসময় যার সাজগোজে ব্যস্ত থাকত সন্ধ্যা, আজ তার চুল এলোমেলো, গায়ে ধুলোমাখা, চোখে শূন্যতা।

মুখ ফিরিয়ে কেউ তাকায় না তার দিকে।

হঠাৎ একটা ছেলে থামে।
চিন্তা করে বসে, কাঁধে ব্যাগ, হাতে পানির বোতল।চেহারার মতিগতি ঠিক মনে হচ্ছে না।

– “আপু ঠিক আছেন?”
আন্নি ভয় পেয়ে যায়। চোখে চোখ রাখে না, মাথা নিচু করে শুধু বলে,
– “ভালো আছি। এই বলে সে অন্য জায়গায় গিয়ে বসলো।

আন্নির চোখের কোণ ভিজে ওঠে—এই শহরে মানুষ আছে, আবার নেইও।

একটা ভাঙা বেঞ্চে বসে থাকে সে।
রাত বাড়ে।
রাতের গাড়িগুলোর হেডলাইটে মাঝে মাঝে তার মুখটা ঝলসে ওঠে।
সাথে আসে কত প্রশ্ন—

“কোথায় যাবো আমি?”
“কেউ কি আর কখনও আমাকে বিশ্বাস করবে?”
পরক্ষণেই ভাবে,
“আমি কি এতটাই দুর্বল?”

এইসব প্রশ্নের ভেতরেই হঠাৎ একটা কাঁপা গলা,

– “এই যে মা, এইখানে ঘুমাইও না, খুব বিপদ হইতে পারে।”

বয়স পঞ্চাশের মতো এক মহিলা। মুখে ক্লান্তির রেখা, হাতে পাতলা চাদর।

আন্নিকে দেখে থমকে দাঁড়ায়।

– “নতুন আইছো?”

আন্নি কোনো কিছু না ভেবে মাথা নাড়ে।

– “চলো, আমার সঙ্গে চলো। যতটা পারি যত্নে রাইখা দিব। শুইস না এইখানে। খারাপ মানুষ এলা দ্যাখলে তো খোদারেও ভয় করে না।”একদম গিলে খাবে।

আন্নি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

তারপর অনেক ভেবেচিন্তে ধীরে ধীরে মহিলার পিছু নেয়।তাছাড়া অনেক রাত ও হয়েছে।এই পরিবেশে একা থাকা ঠিক হবে না।এখন এই পরিস্থিতিতে তাকে কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতেই হবে।

একটা পুরোনো ভবনের নিচতলায় কিছু মেয়েরা বসে আছে, কেউ রান্না করছে, কেউ কাপড় শুকাচ্ছে, কেউ নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে।

এ যেন ছিন্নভিন্ন মেয়েদের এক অস্থায়ী সংসার।
কেউ বাসা থেকে বেরিয়ে আসা, কেউ পেটের দায়ে চলে আসা, কেউ সমাজের চোখে “অযোগ্য” হয়ে পড়া।

আন্নিকে এক কোণে বসতে দেয় সেই মহিলা টি।
তার নাম—”রহিমা।”

রহিমা বলে,
– “ভয়ে থাকিস না মা। কয়দিন থাকিস, তারপর যদি চানস পাই, তো চাকরির কিছু দেখি, না হলে মহিলা হোস্টেল আছে, আমি ঠিকানাও জানি। তুই শুধু দম ছাড়িস না।”

এই কথায় চোখ ভিজে যায় আন্নির।
রহিমা যেন অন্ধকারে একটা হালকা আলো।
এই প্রথম কেউ তাকে “মা” ডেকে স্নেহে কিছু বললো।

রাত গভীর হয়।

আন্নি ছোট্ট একটা কম্বলের নিচে কেঁপে কেঁপে ঘুমায়।
ঘুম আসে না ঠিক। আসে এক ধরনের অবচেতন—
যেখানে তার বাপ-মায়ের মুখ ভেসে ওঠে,
সাইফের ঠান্ডা কণ্ঠ,
আমেনার গালমন্দ,
আর আজকের রহিমা।

হয়তো এই শহরের বুকেই কোথাও তার জন্য একটা ছোট্ট জায়গা আছে।
যেখানে কেউ তার ভালোবাসা পাবে না বলে ঠেলে দেবে না।
যেখানে সে নিজের নামে একটা পরিচয় গড়তে পারবে।
নিজেকে খুঁজে পাবে।
রহিমা খালার সেই ছোট্ট ঘরেই ক’দিন কাটিয়ে দেয় সে।

…………..

সকালে আশপাশের বাসাগুলোর রান্নার গন্ধে চোখ মেলে আন্নি।
কেউ তাকে জোরে ডাকে না, কেউ দায়িত্ব চাপায় না,
তবু তার মধ্যে এক অদ্ভুত খালি জায়গা তৈরি হয়েছে।

একদিন রহিমা বলে,
– “চল মা, তোকে একটা জায়গায় লইয়া যাই।”

আন্নি চুপচাপ যায় তার সঙ্গে।
ছোট একটা অফিস, দরজার সামনে লেখা—
“নারী সহায়তা কেন্দ্র – প্রশিক্ষণ ও সহায়তা কার্যক্রম”

একটা আপু জিজ্ঞেস করেন নাম কি তোমার?

___আ,,,,বলতেই থেমে যায় আন্নি।

না,সে আজ থেকে আন্নি নয়।তার নতুন নাম সে নিজেই ঠিক করে।
কারণ আন্নি মারা গেছে স্বামীর অযত্ন আর ভালোবাসার অভাবে,আন্নি মারা গেছে শশুড় শাশুড়ীর অবহেলায়,আন্নি মারা গেছে বাবা মার দুর্ব্যবহারে,আন্নি মারা গেছে বোনের গালমন্দে।

কি হলো?নাম কি?

____সবিতা।

____নাইচ নেইম।
আপুটি হাসিমুখে বলেন,

–সবিতা “তুমি চাইলে এখানে থেকে সেলাই শেখা, কম্পিউটার শেখা বা হেল্প ডেস্কে কাজ করতে পারো। আর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে।”

সবিতার চোখে জল এসে যায়। এতদিন পর কেউ তাকে মানুষ মনে করছে, অবহেলা করছে না।

তিনদিন পরই সে সেলাই শেখা শুরু করে।
রোজ ঠিক সময়ে উঠে পড়ে, আয়নায় নিজের চোখে চোখ রাখে।

“আমি পারবো”— নিজেকে বলতে শেখে।

প্রথম নিজের বানানো থ্রিপিস যখন নিজের গায়ে পরে দেখে, মনে হয় কতকাল পরে যেন নিজেকে সাজিয়েছে।

রাতে রহিমা খালা একদিন বলে,
– “তোরে এই শহর ঠেকাইতে পারে নাই মা, তুই একদিন ঠিকই উঠবি।”

সবিতা মাথা নিচু করে হাসে।
সে নিজেকে একধরনের মুক্ত পাখি মনে করে, যার পাখায় এখনও আঘাত আছে, কিন্তু উড়ার শক্তি জমে উঠছে।

কিন্তু পুরোনো ছায়া কি এত সহজে পিছু ছাড়ে?

এক সন্ধ্যায় সবিতা যখন এনজিওর বারান্দায় বসে সেলাইয়ের কাজ করছিল,
তখন একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পায়।

– “আপনারা কি আন্নি নামের কাউকে চেনেন?

গলা শুনেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

এ তো সাইফ।

সবিতা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে—সাইফ দাঁড়িয়ে আছে।
মুখে অস্থিরতা, হাতে তার একটা ছবি।

কেউ একজন বলে,
– “না ভাই, এই নামে তো কেউ নাই।”

আন্নি ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে দেয়।
তার ভিতরটা কাঁপে।
সাইফ তাকে খুঁজছে, কিন্তু কেন?

ভালোবাসায়?
নাকি সমাজের ভয়ে?
নাকি “মেয়েটা আবার যেন মুখ না তোলে” সেই অভিপ্রায়ে?

রাতে রহিমা খালা দেখে সবিতার চেহারায় অদ্ভুত এক হতাশা।
জিজ্ঞেস করে না কিছু, শুধু পাশে বসে চুপচাপ হাত ধরে।

সবিতা বলে,
– “আমি কি কিছু ভুল করলাম খালা?”

– না,মা।
“তুই এখন বেঁচে আছিস,আর পূর্বে বেঁচে থেকেও মৃত ছিলি। সঠিক পথেই তুই আছিস।

চলবে……….

সবিতা পর্ব-০২

0

সবিতা
দ্বিতীয় পর্ব
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার, একে অপরকে অতিক্রম করতে গিয়ে কখনো এক হয়, কখনো দুই।
আন্নির জীবনটা যেন এই দুইয়ের মাঝে ভাসমান।
একটা সময় ছিল, যখন সাইফের প্রতি তার বিশ্বাস ছিল আকাশের মতো বড়—প্রেমে ছিল অটুট। কিন্তু এখন সে বিশ্বাস, সেই ভালোবাসা—সবই যেন একে একে সরে গেছে।

দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আন্নির জীবনে যেন কোনো পরিবর্তন নেই। এক এক করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু জীবনযাত্রার শীতলতা যেন কোনোভাবেই দূর হয় না। দিনের আলোও তার জন্য এখন আর আগের মতো উজ্জ্বল নয়, তার চারপাশে সব কিছু যেন ধূসর হয়ে গেছে। এক সময় সাইফের সাথে প্রতিটি দিন নতুন অনুভূতি নিয়ে আসতো, এখন তার মনে হয়, দিনগুলো একইরকম—শুধু সময় কাটছে, কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে না।

আজ আবার এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হলো।আবার নতুন একটি ঘটনা আন্নির মনকে আরো ভেঙে ফেলল।
তার বান্ধবী, রহিমা, ফোন করে জানালো,

— “তুই জানিস, সাইফ কি করছে? আজ বাইকের পেছনে এক মেয়ে নিয়ে ঘুরছিল। তুই কী করে এসব সহ্য করছিস? তুই তো জানিস, সাইফের আচরণ কেমন ছিল বিয়ের আগে। কিন্তু এখন তো তার কিছুই ঠিক নেই!”

আন্নি ফোনের স্ক্রীনে একমুঠো স্থির হয়ে যায়।
তার হাত কাঁপছিল, ফোনটা এতটাই শক্ত করে ধরেছিল যে, মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী তার হাত থেকে ছড়িয়ে পড়বে। সে কী বলবে? কীভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবে? সাইফের সঙ্গে তার সম্পর্ক তো অনেক আগেই ভেঙে গেছে, কিন্তু কোথাও ভেতরে একটা ভয় ছিল—শুধু তার নিজের দুঃখ গোপন করার চেষ্টা।

সে জানতো, সাইফ এখন আর আগের মতো নেই।
যতটুকু ভালোবাসা ছিল, ততটুকু আর নেই।
বিয়ের আগে সাইফ যেমন তাকে উষ্ণ ভালোবাসায় ঘিরে রাখতো, এখন সে পুরোপুরি বদলে গেছে। সে যেন একটা অচেনা মানুষ হয়ে গেছে, যার পাশে আর আন্নি থাকতে পারে না।

হঠাৎ ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়।
মনে হয় যেন পৃথিবীটা মাথার উপর ঘুরতে থাকে।
কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই সে।
কী বলবে? কী করে নিজেকে বোঝাবে যে, সাইফের এমন আচরণ তার কাছে নতুন নয়।

আন্নির নিজের পরিস্থিতি এমন হয়েছে, যে সে নিজেও জানে না, কেন সে এখনও সাইফের সঙ্গে রয়ে গেছে।
সে কি সত্যিই তার সঙ্গে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক রাখতে চায়? না কি সে শুধুমাত্র অভ্যাসের জায়গায় আটকে গেছে?
আজকাল আন্নি মনে করে, সাইফের কাছে সে শুধুই একটা কুকুরের মতো, যার দায়িত্ব শুধু রান্নাঘরে কাজ করা, কাপড় কাচা, আর বাড়ির সব কিছু দেখতে থাকা।
সাইফ তার প্রিয় মানুষ ছিল—এটা সত্য, কিন্তু আজকের সাইফ তাকে আর আগের মতো প্রিয় নয়। সেই ভালোবাসা কেমন যেন মুছে গেছে।

এখন আন্নি বুঝতে পারছে—সাইফের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যেন এক গহীন সাদাকালো অন্ধকারের মধ্যে চলে গেছে।
তখন ভালোবাসা ছিল, এখন শুধু নিঃসঙ্গতা, বিষণ্নতা আর হতাশা।
এখন সাইফের মনেও আর কোনো জায়গা নেই আন্নির জন্য।
এটা যেন জীবনের এক কঠিন রিয়েলিটি, যে এক সময় তাকে ভালোবাসত, সে আজ আর তাকে খেয়ালও করে না।

তার কেবল কানে একটা শব্দই বাজছে—“তুই থাকলে থাক, না থাকলে চলে যা।”

এখন আর আন্নির কোনো স্বপ্ন নেই, শুধু একটাই চিন্তা—কীভাবে একদিন এই জগৎ থেকে পালাবে?
তবে পালাবে কোথায়? সে জানে না।
কিন্তু প্রতিদিন, প্রতিটি দিন, সাইফের এই নিষ্ঠুরতায় এক একটা গহীন ক্ষত সৃষ্টি হয় তার হৃদয়ে।

……………

গভীর রাত,নিস্তব্ধ চারপাশ,ঘড়ির কাঁটা যখন একটাকে ছুঁয়েছে, তখনও আন্নি দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।চোখে ঘুম নেই, মনে শুধু অপেক্ষা—সাইফ কখন ফিরবে।

রাত প্রায় দুটো— কেবল দরজার খচখচ শব্দে তার অপেক্ষা ভাঙে।
অবশেষে দরজা খুলে যায়। সাইফ, নির্বিকার মুখে, একটাও কথা না বলে ঘরে ঢুকে, জুতা খুলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
আজ রাতেও সাইফ ফিরলো অনেক দেরিতে। আজকেও দরজা খুলে ঢুকেই যেন সমস্ত দুনিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো সে। একটাও কথা নয়, একটাও দৃষ্টি নয়—শুধু বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। আন্নি পাশে বসে ছিল নীরবে, ঠিক আগের রাতগুলোর মতো। একটা সময় সে আর অপেক্ষা করে না—কারণ সে জানে, এখন তার পাশে বসা একজন স্বামী নয়, একজন অভিমানহীন অপরিচিত পুরুষ।

আন্নি তাকিয়ে ভাবে, মনে হয় এক অপারিচিত মানুষ পাশে ঘুমিয়ে আছে। অথচ একসময় এই মানুষটাই তো তার চোখে ছিলো জীবন, স্বপ্ন, ভালোবাসা।
মনে প্রশ্ন জাগে বার বার—সে কি একদিন
ভালোবেসেছিল এই মানুষটিকে?

………..……

ভোর হতেই যেন যুদ্ধের মাঠে নামে আন্নি। রান্নাঘরের ভেতর গনগনে আগুন আর তাড়াহুড়ার শব্দ। শ্বশুরের সরকারি অফিস, সাইফের কলেজ—সবার সময়মতো খাওয়া চাই।

আজকের সকালটা যেনো আরও বিশৃঙ্খল। ঘড়ির কাঁটায় যেন আগুন ধরে গেছে। শ্বশুর সময়মতো অফিসে যাবেন, সাইফেরও কলেজ আছে। আন্নি তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে ছুটে যায়—সবজির ভাজি, ডাল, আর ভাতের আয়োজন। রাইস কুকার হঠাৎ কারেন্ট চলে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে গ্যাসে বসায় ভাতের হাঁড়ি।
এমন সময় শাশুড়ির ডাক—
“আন্নি, একটু আয় তো রে।”

আন্নি কাঁটা চামচ ফেলে, আঁচলে হাত মুছে দৌড়ে যায় শাশুড়ির রুমে।
কোনো দ্বিধা না করেই সে ছোটে। অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে তার এই ছুটে চলা। সংসার যেন এক বিশাল নাট্যমঞ্চ, আর সে সেখানে নেপথ্যের শিল্পী।

শাশুড়ি হয়তো গলার হারটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না,ভেতরে হয়তো শাড়ির ভাঁজ ঠিক করতে বলবে,কিংবা আলমারিতে কিছু খোঁজার দরকার হয়েছিল
কিন্তু রান্নাঘরে তখনও জ্বলছে গ্যাসের আগুন আর তার উপর চাপা পাত্রে ভাত।
মুহূর্তের মধ্যে পোড়া গন্ধে ভরে যায় পুরো বাড়ি।

শ্বশুর দরজা ঠেলে বের হয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলেন,
“ঘরে আগুন লাগছে নাকি?”

আন্নির বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে একটা আশঙ্কার ঢেউ।
ছুটে যায় সে রান্নাঘরে।
কালো ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারপাশ।
হাঁড়ির নিচে জ্বলে যাওয়া ভাত, আর তার ওপরে জমে থাকা পোড়া ধোঁয়া যেন আন্নির ভিতরকার কষ্টকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।
চুলার সামনে দাঁড়িয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়।

ঠিক তখনই সাইফ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
চোখ জ্বলে তার, মুখে ঘৃণা— গর্জন করে বলে—

“তুই সারাদিন করিস টা কী রে? ঘরে খালি শুয়ে বসে থাকিস,শুয়ে বসে খাস!”
একবেলার ভাত ঠিকঠাক রান্ধতে পারিস না?

এই বলে তার চুলের মুঠি ধরে এমন টান দেয়, যেন সে কোনো প্রিয়জন নয়, একেবারে ঘৃণার পাত্র।যেন সে তার স্ত্রী নয়, এক অপরাধী।
দুইটা চড় গালে এসে পড়ে সশব্দে।

আন্নির কান ঝিম ঝিম করে ওঠে। মাথার ভেতর যেন একটা সাইরেন বাজে—না, এটা তার ভালোবাসা হতে পারে না, এ ছেলে তো তার স্বপ্নের মানুষ ছিল না!

জ্বালা লাগে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জ্বলে ওঠে আত্মসম্মান।
ঘরটা কেঁপে ওঠে, কিন্তু কারও মুখে প্রতিবাদের শব্দ নেই।

শ্বশুর-শাশুড়ি দাঁড়িয়ে থাকেন নির্লিপ্ত, নীরবে। যেন কিছুই দেখেননি, যেন কিছুই ঘটেনি।
একবারও কেউ বলে না, “সাইফ, এটা কি করছো?”
যেন কিছুই হয়নি।কারও মুখে কোনো প্রতিবাদ নেই, কেউ সাইফকে থামায় না। যেন আন্নির প্রতি এই আচরণই স্বাভাবিক, যেন এটা তার প্রাপ্য।
হ্যাঁ ঠিকই তো,
এটাই তো এই ঘরের নিয়ম—স্বামীর হাতে স্ত্রীর অপমান, আর চারপাশের মৌন সমর্থন।

আন্নির চোখে জল আসে না।
দীর্ঘ সময়ের গুমোট যন্ত্রণায় কান্নাগুলো হারিয়ে গেছে কোথাও।
ভেতরে কেবল একটা প্রশ্ন গুমরে ওঠে—
“এই মানুষটার হাত ধরেই তো আমি পালিয়ে এসেছিলাম। এই ছিল তার ভালোবাসা?”

আন্নির বুকের ভেতর যেন কিছু একটা ধ্বসে পড়ে। সে শুধু ভাবতে থাকে—
“এই কি সেই সাইফ, যে একদিন বলেছিল, ‘তোর জন্য সব ছেড়ে দিব’? এই কি সেই সংসার, যার জন্য আমি বাবা-মাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম?”

তার ভেতরে জমে ওঠা শূন্যতা আজ যেন আরও ভারি হয়ে আসে।
সে জানে, ভালোবাসা পুড়ে গেছে আজকের ভাতের মতোই—নরম, নিরীহ, অথচ অবহেলার আগুনে অচেনা এক অন্ধকারে রূপান্তরিত।

ভাতের হাঁড়ির মতো পুড়ে যাচ্ছে তার সব স্বপ্ন। প্রেম, ভালোবাসা, বিশ্বাস—

একসময় সাইফ বলেছিল,
“তুই আমার জীবন, আন্নি।”
আজ সাইফ যেন বলে—
“তুই শুধু দায়িত্ব।”

একসময় সাইফ বলেছিল,
“তুই ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না, আন্নি।”
আর আজ সাইফ যেন বলে—
“তুই থাকলে থাক,না থাকলে না থাক।”

অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় আন্নি।
“এই ঘর না থাক, আমার নিজের মান থাকুক।”
কোনো ব্যাগ নেয় না, কোনো টাকা নয়, এমনকি পরনের ওড়নাটাও ঠিকঠাক টেনে নেয়নি সে।
চোখে ছিল কেবল জেদ, আর বুকভরা দুঃখ।
চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়—
এই শহরের ব্যস্ততা আর আলো-ছায়ার ফাঁকে হারিয়ে যেতে চায় এক নারীর না বলা গল্প।

চলবে………

সবিতা পর্ব-০১

0

#সবিতা
সূচনা পর্ব
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

ভোরের আলো এখনো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি। জানালার ফাঁক গলে এক ফালি সূর্য রশ্মি আন্নির মুখে এসে পড়তেই সে চোখ খুলে ফেলে। পাশ ফিরে তাকায়—সাইফ ঘুমোচ্ছে না, বরং ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখার ভান করে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। দু’জনের মাঝখানে শীতল নিঃশ্বাসের দেয়াল, যা স্পর্শ করা যায় না, শুধু টের পাওয়া যায়।

আন্নি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে পড়ে এক বছর আগের সেই বিকেলটা, যখন সে হাত ধরেছিল সাইফের, ভালোবাসার দায়ে সমস্ত কিছু ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলো। কত স্বপ্ন ছিল তাদের—একটা ছোট বাসা, দুটো টিকটিকি ঝগড়া করবে দেয়ালে, ছাদের কোণায় গুচ্ছ গুচ্ছ রোদ জমে থাকবে, আর সন্ধ্যায় ওরা মিলে একসাথে চা খাবে।

সেইদিন আন্নির বুকের ভেতর থেকে কিছু একটা চিরে বেরিয়ে গিয়েছিলো—ভালোবাসা নয়, বিশ্বাস ছিল সেটা।

আন্নি ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সাইফকে।
পরিবারের কেউ রাজি ছিল না। অনেক অনুরোধ, অনেক বোঝানো—সব ব্যর্থ। শেষমেশ ভালোবাসার টানেই এক ঝড়বিক্ষুব্ধ বিকেলে আন্নি পালিয়ে যায় সাইফের সঙ্গে।

সেই রাতে আকাশ ঝরেছিল, ঠিক যেমন তার বুকের ভেতর কান্না আর আনন্দ একসাথে ঝড় তুলেছিল।
সাইফ হাত ধরে বলেছিল,
— “এখন থেকে আমি শুধু তোমার। কোনো কষ্ট পেতে দেব না তোমায়।”

আন্নির মনে হয়েছিল,
“এটাই তো আমার স্বর্গ, আমার বাড়ি, আমার পৃথিবী।”

কিন্তু সে স্বর্গ ছিল খুব অস্থায়ী।
শুধু এক বছর।

এক বছর পর আন্নি টের পায়—সাইফ বদলে যাচ্ছে। তার চোখে অহনার প্রতিচ্ছবি।
অহনা, সাইফের ক্লাসমেট। স্মার্ট, চটপটে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

প্রথমে সন্দেহ, পরে নিশ্চিত বিশ্বাস।
সাইফ অহনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।

প্রথমে সামান্য পরিবর্তন এসেছিলো সাইফের আচরণে। ফোনে কথা বলার সময় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেত, রাত করে বাসায় ফিরত। আন্নি যখন জানতে চাইত, সে বিরক্ত হতো, রাগ করত। তারপর একদিন আন্নির সামনে দাঁড়িয়ে সাইফ চিৎকার করে বলে উঠেছিলো,

— “তুমি একটা প্যারানিয়া,এত সন্দেহ তোমার?
ও আমার ক্লাসমেট।
এসব মানসিক রোগীর মতো আচরণ বাদ দাও!

আন্নি প্রতিবাদ করলে সাইফ এভাবে তেড়ে আসে—

সাইফ যখন অহনার মেসেঞ্জারে সিঙ্গেল হার্ট ইমোজি দেয়, আন্নি তখন আয়নায় নিজের চোখে চোখ রাখে—একটা মেয়ের ইতিহাস পড়ে যায় সেখানে। যে একদিন ভালোবেসেছিল, আবার একদিন নিজেকেই ভালোবাসতে শিখবে।

সাইফ একদিন চড় মারতে হাত তোলে।
যদিও সেই হাত থেমে যায়, কিন্তু আন্নির আত্মসম্মান থামে না।

শুরু হয় অশান্তি।
ভালোবাসার ঘর, এখন শুধুই অভিযোগের দেওয়াল।

শশুর-শাশুড়ির কাছ থেকেও কোনো সান্ত্বনা মেলেনি। বরং শাশুড়ি বলেছিলেন,
— “ছেলে মানুষ, একটু এদিক-ওদিক করতেই পারে।
সারাদিন কি বউয়ের আঁচলে বাঁধা থাকবে নাকি?”

শশুর আবার গলা গলিয়ে যোগ করেন,

— “ছোট মানুষকে বিয়ে করেছো, এখনও তো কলেজে পড়ে! সে বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে না?”

আন্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো তাঁদের দিকে। যাদের কাছে সে একটু আশ্রয় খুঁজতে চেয়েছিলো, তারা তাকে আরও ভেঙে দিলো।
আন্নি সবার কথা চুপ করে শোনে শুধু।
তার চোখে এখন আর জল নেই, শুধু একরাশ বিস্ময় আর আত্মসম্মানের স্পষ্ট ছায়া।

রাতের পর রাত ঘুম হয় না আন্নির। বুকের ভেতর জমে থাকা কান্নাগুলো শুধু বালিশ ভিজিয়ে যায়। কখনো মনে হয়, ফিরে যাই মায়ের কাছে, আবার মনে পড়ে—মা-ও তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেই পালিয়ে যাওয়ার রাতে।
বলেছিলেন,
“ভালোবাসা দিয়ে সংসার চলে না”—মায়ের বলা কথাগুলো কানের ভেতর এখনো গুনগুন করে।

কিন্তু আন্নি এখনো ভেঙে পড়ে না। কারণ সে জানে, তার ভিতরে এখনো অনেক গল্প বাকি। সে হয়তো একা, হয়তো হারিয়েছে বিশ্বাস আর ভালোবাসার প্রিয় মুখ, কিন্তু তার আত্মসম্মান এখনো জাগ্রত।

……….

রাত গভীর।
জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকেছে, ছায়া ফেলেছে দেওয়ালে।
দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির টিকটিক শব্দটা যেন খুব স্পষ্ট হয়ে বাজে আন্নির কানে।
যেন সময়টাও আন্নির নিঃসঙ্গতা গুনে চলেছে।
সাইফ ফেরেনি এখনও।
আন্নি বসে আছে জানালার ধারে একলা।

রাতটা অদ্ভুতভাবে নিরব।

হাতের ডায়েরির ভাঁজে লুকানো চিঠিটা আজ ও পুড়ছে,
তবে আন্নির চোখে যে জলের ফোঁটা, তা এখন সাইফের প্রতি নয়—
তা নিজের জীবনের প্রতি ক্ষোভ,
নিজের ভুলগুলোকে না বলতে পারার তীব্র আক্ষেপ।

সেদিনের কথা মনে পড়ে—এইচএসসি পরীক্ষার শেষ দিন।
প্রথমবার হাতে হাত ধরে,
সাইফ বলেছিল,
“চলো, সবকিছুকে পেছনে ফেলে আমাদের একটা গল্প লিখি।”
আন্নি বিশ্বাস করেছিল।
ভেবেছিল, ভালোবাসা মানেই মুক্তি।
ভেবেছিল, যেখানেই থাকুক—ভালোবাসার সংসারেই আশ্রয় থাকবে।

কিন্তু কে জানত, সেই গল্পের কালি এত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে?

সেই ভুলটা…
এইচ,এস,সি এক্সাম শেষ করেই সাইফের হাত ধরে সব ফেলে চলে যাওয়া।
মা-বাবার চোখের জল, বড় বোন আমেনার রাগ, ছোট ভাইয়ের ভেঙে পড়া মুখ—সব এখন আন্নির বুকের ভেতর ছাইয়ের মতো জমে আছে।

এক বছরের সংসারে, সাইফ একবারও বলেনি—“তুমি আবার পড়ো”।
আন্নির সব স্বপ্ন ধীরে ধীরে গিলে ফেলেছে রান্নাঘরের ধোঁয়া, শাশুড়ির চাহনি, সাইফের চুপ থাকা।

আজ হঠাৎ করে মনে হলো—এই সংসারটা সে নিজেই তো বেছে নিয়েছিল।
তবে কেন এখানে এতটা একা?
কেন তার দু:খটাও এখন শেয়ার করার মতো কেউ নেই?

আজ হঠাৎ বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ঝড় উঠে আছে।
মাথা কাঁপছে, কিন্তু হাত চলে যায় ফোনের দিকে।

হাত কাঁপতে কাঁপতে মোবাইলটা নিয়ে বড় বোন
আমেনার নাম্বারে কল দিল।

কল ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর গলা,
— “হ্যাঁ? কী হয়েছে?”
দূর থেকে বোনের গলা শুনেই কান্না আটকে রাখতে পারল না আন্নি।
কথা না বলে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে।
আন্নি এক ফোঁটা স্বরে বলে,

— “আপু… আমি আর পারছি না।”

কিন্তু উল্টো সান্ত্বনা নয়,
বোনের কণ্ঠে উঠে আসে উপেক্ষা আর বিদ্রুপ।
ওপাশ থেকে তীব্র রাগে উত্তর এলো,

— “তখন তো কারো কথা শুনোনি। প্রেমে অন্ধ হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে। এখন কাঁদছো?
মা-বাবাকে ফেলে পালিয়ে গিয়ে এখন চোখে পানি এসেছে?”
মা-বাবা মরলেও খোঁজ নিতে আসবে না তুমি, বুঝে নিও।”

আন্নি নিশ্চুপ হয়ে গেল।

আমেনার কথাগুলো বুকের ভেতর গর্ত করে দেয়।
কোনো উত্তর দেয় নি আন্নি।
চোখের জল মোছে নি, কথা বলে নি, তার সামনে মাথা নোয়ায় নি,
শুধু ফোনটা নিঃশব্দে কেটে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
বুকের ভেতর জমে থাকা জলের সাগর, আজ বালিশ ভিজিয়ে দেয়।

বার বার শুধু বোনের বলা কথাগুলো মাথায় বাজতে থাকল—
“তুমি তো নিজের ইচ্ছেতে নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছিলে।”

সেই রাতে, আন্নি আর কাউকে কিছু বলেনি।
না সাইফকে, না শাশুড়িকে।
নিজের বুকের ভিতরই আগুনটাকে চেপে রাখল।

তবে সেই আগুনের মাঝে একটা স্বপ্ন আবার মাথা তুলল—
ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়া।

পরদিন সকালে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চা বানাতে বানাতে ভাবছিল—এই কি তার জীবন?
চা, ডিমভাজি, সাইফের পোশাক ইস্ত্রি করা, শাশুড়ির ওষুধ, বাজারের লিস্ট,
আর… নিজের পছন্দ-অপছন্দ-স্বপ্ন গিলে ফেলা একটা মেয়ের গল্প?

হঠাৎ বুকের গভীর থেকে একটা ইচ্ছা মাথা তোলে।
ডিগ্রিতে ভর্তি হবো। যেভাবেই হোক।

শাশুড়ি ডাইনিং টেবিলে বসতেই আন্নি সাহস করে বলে উঠল,
— “মা, আমি যদি আবার পড়াশোনা শুরু করি? কলেজে ভর্তি হতে চাই ডিগ্রিতে।”

শাশুড়ি থমকে তাকালেন,
তার চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
শাশুড়ির মুখখানা রঙ পাল্টাল এক নিমিষে।
চোখে উঠল অবিশ্বাস, কণ্ঠে ঝলকে উঠল কষ্ট ও শাসন।
— “এই বয়সে আবার কী পড়া? ঘরের কাজ ছেড়ে?
ঘরের কাজ সামলাও, এই তো অনেক হয়েছে!”
তারপর গলা নীচু করলেন,
— “সাইফ জানলে তো একদম মেনে নেবে না। মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার?”
সে শুনলে রাগে পুড়ে যাবে!

আন্নির বুকের ভিতর যেন কিছু একটা টুপ করে ভেঙে গেল।সে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
কিছু বলল না।
তার চোখে তখন ঠিকরে পড়ছিল একরাশ প্রতিজ্ঞা।

সেই রাতে আন্নি শুয়ে শুয়ে ভাবছিল—এই ঘরটা কি তার?
নাকি শুধু এক বাঁচিয়ে রাখা শ্বাসের নাম?
তার যদি কোনো জিনিস একান্ত নিজের হয়ে থাকে,
তা শুধু একটা—
তার স্বপ্ন।

পৃথিবীর সবাই ছেড়ে দিলেও,
স্বপ্ন একবার ধরা দিলে,
সে আর হাত ছাড়ে না।

এই স্বপ্নই তার একমাত্র নিজের জিনিস।
কারণ সবাই চলে গেলেও, স্বপ্ন তো কেউ কেড়ে নিতে পারে না।

চলবে……….