Sunday, August 3, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 7



সৌরকলঙ্ক পর্ব-৭+৮

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৭

আদিব একটা শুকনো ঢোক গিলে এগিয়ে গেল সামনে।দাদির পাশে বেসে নীচু স্বরে দাদিকে ডাকলো বার কয়েক কিন্তু অপর পাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ এলো না।আদিবের ভয় হতে লাগলো এবার।সে উঠে দ্রুত বাবার ঘরে গেল। আশরাফ ফজরের নামাজ পড়ে মাত্রই শুয়েছিল ছেলের উতলা ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো।দরজা খুলে বাইরে আসতেই আদিবের ভয়ভীতি কণ্ঠ কানে এলো তার,

-বাবা দাদি…

আদিবের কথা শেষ হলো না, তার আগেই রুদ্ধ শ্বাস মায়ের ঘরের দিকে ছুটলো আশরাফ।মা কে নামাজের পাটিতে সেজদা রত অবস্থায় দেখে চোখ মুখে খেল গেল উদ্বিগ্নতা। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে জাহানারা বেগমের পাশে বসে কয়েকবার ডাকলো জাহানারা বেগম কে। কিন্তু তিনি ছেলের ডাকে সাড়া দিল না। আশরাফ অতি সাবধানে মায়ের বাহুতে হাত রাখলো ।হাল্ক হাতে ধাক্কা দিল তার বাহুতে।সাথে কাত হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো জাহানারা বেগমের প্রাণহীন নিথর দেহটা।

________________

জাহানারা বেগমের মৃত্যুতে সব থেকে বেশি আহত হলো আশরাফ।মায়ের মৃত্যুর শোকে হুঁশ জ্ঞান ভুলে সর্বসমক্ষে মায়ের মৃত্যুর জন্য তানিয়াকে তুলল কাঠগড়ায়। বারংবার উল্লেখ করলেন গত রাতের তিতকুটে স্মৃতি। আশরাফের আরোপের সামনে তানিয়া নিজের স্বপক্ষে কিছু বলতে পারলো না। শুধু অশ্রু শিক্ত নয়নে চেয়ে রইল আশরাফের দিকে।বোন ভাইদের সামনে আশরাফ যা ইচ্ছা তাই বলে চলল তানিয়া কে।তানিয়া সবটা মাথা পেত নিল।তবুও যেন আশরাফের রাগ কমলো না সদ্য মাতৃহারা আশরাফ রাগে ক্ষোভে সবার সামনে বলে উঠলো যার জন্য তার মা দুনিয়া ছেড়েছে, তার সাথে সে আর থাকবে না।তালাক দেবে তাকে।আশরাফের কথায় চমকে উঠলো উপস্থিত সবাই।জাহানারা বেগমেকে বহন করা খাটিয়া তখনো আশরাফের উঠানে রাখা।ঘর জুড়ে আত্মীয়-স্বজন, চেনা-পরিচিতদের ভিড়। আশরাফের পাগলামো এতক্ষণ সবাই চুপ করে সহ্য করলেও এবার যেন টনক নড়লো সবার।নাফিজা ভাইকে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল।বোঝাতে লাগলো তাকে, যেন সে হটকারী করে কোন সিদ্ধান্ত না নেয়। কিন্তু আশরাফ নাফিজার কথা শুনলে তো! সে তার কথায় অনঢ়। আশরাফের এক রোখা ভাব দেখে নাফিজা ভাইদের ডেকে পাঠালেন। চাচাদের পিছু পিছু আদিব গিয়ে দাঁড়ালো দরজার মুখে। সাজ্জাদ,জায়েদ,শাহেদ সবাই নিজের মতো করে বোঝাতে লাগলো আশরাফ কে।ভাবির রাগের মাথায় করা অপরাধে পর্দা টানতে লাগলো সবাই। কিন্তু আশরাফ তাদের কথা কানে তুলল বলে মনে হলো না।সবাই যখন হার মানল তখন আদিব এসে পা জড়িয়ে ধরলো বাবার। অশ্রু শিক্ত কণ্ঠে বলল,

-বাবা প্লিজ এমন করো না। মা’র কথা না ভাবলে, অন্তত আমাদের কথা ভাবো।

আশরাফ ছেলেকে নিজের পা থেকে ছাড়িয়ে পাথর কঠিন মুখটা ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে।বাবার নীরবতা ভেতরটা ফালা ফালা করে দিল আদিবের।নিজের পরিবারের ভগ্নপ্রায় দশা দেখে বিচলিত হলো মন। হঠাৎ মনে হলো আজ এসব কিছুর জন্য শুধু মাত্র জাহানারা নামের মেয়েটা দায়ী ।না সে তাকে পাওয়ার জেদ করতো,না দাদি তার চাওয়া নিয়ে আদিবের কাছে আসতো, না মা দাদিকে কিছু বলতো, না এসব কিছু হতো!রাগ হলো আদিবের জাহানারার উপর।ভীষণ রাগ।রাগের মাথায় আশরাফ যেমন ভুলে বসেছিল জন্ম, মৃত্যু সব আল্লাহর হাতে।সব নির্ধারিত। আদিব‌ও তেমন ভুলে বসলো।নিজের হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ঘোষণা দিল এসব কিছুর জন্য একমাত্র জাহানারা দায়ী।আর কেউ না। শাস্তি পেলে সে পাবে, তার মা নয়।গত দিনের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে সবার সামনে আনল আদিব।আদিবের কথা শেষ হতেই সাজ্জাদ বলল,

– জাহানারা ছোট মানুষ আদিব। তাছাড়া ও অসুস্থ। ওর মাথার ঠিক নেই।

-ও মোটেও অতটা ছোট না চাচা যতটা আপনি বলতে চাইছেন।আসল কথা কি জানেন চাচা, আমার মা’র থেকে ওর দোষটা কোন অংশে কম না কিন্তু আপনারা নিজেদের মেয়ে বলে ওর দোষ দেখছেন না। শুধু আমার মায়ের দোষটাই দেখছেন।

-আমরা কারো দোষ দেখছি না আদিব।জন্ম মৃত্যু আল্লাহর হাতে।আল্লাহ যার জন্য যতটুকু হায়াত নির্ধারিত করেছে সে ততদিন‌ই বাঁচবে।মায়ের মৃত্যু তে আমরা শোকাহত কিন্তু ভুল ঠিক বোঝার ক্ষমতা আমাদের আছে। জাহানারা যেটা করেছে সেটা অসুস্থ মস্তিষ্কে।যেটা তুমিও ভালো করে জানো।আর ভাবি যেটা করেছে সেটা সচেতন মস্তিষ্কে।আমরা জানি এবং মানী যে ভাবির জন্য মা মারা যায় নি।তার আয়ু ফুরিয়েছে তাই সে মারা গেছে। কিন্তু ভাবি তার সাথে যে ব্যবহার টা করেছে সেটা কি তার উচিত হয়েছে!তুমি বলো।

-মেজ চাচা ,মা রাগের মাথায় বলেছে ওসব। আপনার তো জানেন রাগ উঠলে মায়ের মাথা ঠিক থাকে না।

-আমরা জানি বলেই তাকে দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু তুমি এটা বলতে পারো না তার কোন অপরাধ নেই। একজনের দোষ ঢাকতে আরেকজন কে অপরাধী করো না।

শাহেদের স্পষ্ট কণ্ঠ।আদিবের ভালো লাগলো না চাচার কথা সে কাঠ কাঠ গলায় বলল,

-তাহলে আপনারা কি চাইছেন,মা কে অপরাধী করে বাবা ছেড়ে দিক মা কে?তালাক দিক তাকে?

-আদিব কথা বুঝে কথা বলবে ।আমরা কখনো সেটা চাই না।আমরা শুধু বলতে চাইছি রাগের মাথায় হোক আর যে কারণে হোক ভাবির ভুল ছিল।যার জন্য ভাইকে তার অন্তত একটা সরি বলা উচিত ছিল।

-মা অনেক দুঃখিত ছোট চাচু।সে গত রাতের ঘটনার জন্য বাবার সামনে লজ্জায় দাঁড়াতে পারছে না।মুখ ফুটে কিছু বলবে কি করে। আপনার‌ই বলুন আমার মা কে তো এতদিন ধরে দেখছেন,তাকে কখনো দেখেছেন দাদির সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলতে ?দাদিকে উলটা পালটা কিছু বলতে?

না, তানিয়ার এমন কোন আচরণ কখনো কারো চোখে পড়েনি।তানিয়া রাগী, অহংকারী হলেও কখনো জাহানারা বেগমের সাথে কোন ধরনের বেয়াদবি করেনি। সবসময় চেষ্টা করেছে জাহানারা বেগম কে যথাযথ সম্মান দেওয়ার তার সুবিধা অসুবিধা বোঝার।সবাই জানে এটা।আদিবের কথায় ঘর জুড়ে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করলো।আদিব এই নিরাবতায় নিজের ইতিবাচক উত্তর পেয়ে গেল। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল সে।বাবার কাছে আরো একবার মায়ের হয়ে ক্ষমা চাইলো। আশরাফ ছেলের কথার প্রতি উত্তরে এবার‌ও কিছু বলল না। কঠিন মুখে চুপ করে রইলো। যোহরের আজান পড়লো মসজিদে।সবার টনক নড়লো।মা কে নিয়ে যেতে হবে যে তার শেষ ঠিকানায়।বেরিয়ে এলো সকলে ঘর ছেড়ে। জাহানারা বেগমের মুখটা শেষ দেখার জন্য একে একে এগিয়ে গেল।ঘর থেকে বের হতেই জাহানারার কান্নার শব্দ কানে ঠেকলো সবার।গত রাতে জাহানারার শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্য তাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছিল আশরাফের পরামর্শে।তাই ঘুম ভাঙতে বেলা গড়িয়েছে।ঘুম ভাঙতেই দাদির মৃত্যুর কথা শুনে ছুটে এসেছে সে। জাহানারার কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হলো।শুষ্ক চোখগুলো ভিজে উঠলো আবার।মেয়েকে দেখেই জায়েদের চোয়াল শক্ত হলো।এতদিন জাহানারার সব পাগলামি ,সব কিছু মুখ বুজে মেনে নিলেও হঠাৎ তার কি হলো কে জানে সে মানুষজন উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল সামনে। মায়ের খাটিয়ার পাশ থেকে মেয়েকে বাহু ধরে টেনে তুলে সজোরে চড় বসালেন তার গালে।গর্জে উঠে ডাকলেন সালেহা কে। জাহানারা কে নিয়ে এই মুহূর্তে বাড়ি যেতে বলল তাকে।জায়েদের হঠাৎ এমন কাণ্ডে চমকে উঠলো সবাই।শাহেদ বিরক্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-তোমরা কি এবার তোমাদের নাটক থামাবে?কি শুরু করেছ কি। একজন ব‌উকে যাতা বলছো, একজন মেয়ের গায়ে হাত তুলছ।মানে কি এসবের! এবার থামো প্লিজ। ভালো লাগছে না আর এসব।

-মিয়া ভাই চলো,,, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

শাহেদের কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আশরাফ কে উদ্দেশ্য করে বলল জায়েদ।এ কথার পর আর কেউ কোন কথা বলল না।শাহেদ একটা হতাশ শ্বাস ফেলল।আদিব বুঝতে পারলো সেজ চাচা তার বলা কথায় কষ্ট পেয়েছে।আদিবের বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস।ভারি পায়ে এগিয়ে গেল দাদির শেষ যাত্রায়।

জাহানারার শেষ কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে বাবার কাছে মায়ের হয়ে আবার‌ও ক্ষমা চাইলো আদিব। আশরাফ ছেলের কথা শুনল বলে মনে হলো না।সে নীরব চোখে মায়ের ঘরের দরজার সামনে বসে রইল।
সে দিন আর মুখে দানা পানি তুললেন না আশরাফ। পরেরদিন সকালে তানিয়া এসে তার সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ।নিজের অপরাধ স্বীকার করে হাত জোড় করে মাফ চাইলো।তার ভুল হয়েছে বলে বারবার নিজেকে দুষতে লাগলো। আশরাফের মন নরম হলো তানিয়ার অপরাধ স্বীকারে। তবে সদ্য মা হারানোর শোক ভুলে স্ত্রী কে কাছে টেনে নিতে পারলেন না।শীতল কণ্ঠে বলল,

-আমি ক্লান্ত তানিয়া, আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

আদিব দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল। তানিয়া ঘর থেকে বের হতেই সে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল বাবাকে একটু সময় দা‌ও সব ঠিক হয়ে যাবে।দাদির মৃত্যুর পর থেকে চাচাদের সাথে সম্পর্ক একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হলো তাদের।আগের মতো সহজ সম্পর্ক গুলো একটু জটিল হলো।কেউ মুখে বলুক আর নাই বলুক আদিব বুঝলো সবাই দাদির মৃত্যুর জন্য মনে মনে তার মা-কে দায়ী করছে।আদিবের মনে হলো হয়ত তার তাদের জায়গা থেকে ঠিক। তার মায়ের সাথেও যদি কেও এমন কিছু করতো সেও তাদের মতোই করতো।দাদির মৃত্যুর তিনদিন পর আবার এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো।জাহানারা মাত্র অতিরিক্ত ঘু’মের ‌ঔ’ষুধ খেয়ে আবার হাসপাতালে ভর্তি হলো। ডাক্তার জানালো জাহানারা মধ্যে আ’ত্মহ’ত্যার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।শাহেদ ভাতিজির অবস্থা দেখে জায়েদ কে কঠিন করে কিছু কথা শুনিয়ে নিজের সাথে তাকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। জাহানারা বেগমের মিলাদের কাজ সম্পন্ন হ‌ওয়ার পরের দিন‌ই শাহেদ জাহানারাকে নিয়ে ঢাকার রাস্তায় পাড়ি জমালো।

জাহানারা যেদিন খুলনা ছেড়ে চলে যায় সেদিন রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় বারবার তাদের বাড়ির দিকে তাকচ্ছিল। আদিব নিজের ঘরের জানালা দিয়ে দেখেছিল সেটা।দেখেছিল দুটো তৃষ্ণার্ত চোখের তাকে দেখার চেষ্টা। কিন্তু সে যায় নি সামনে।মিটায়নি কারো তেষ্টা।যে গল্পের শেষ নেই, তার শুরু টেনে লাভ কি!

এরপরের সময়টা একটু দ্রুত পার হলো। আদিবের লন্ডন যা‌ওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো।সবার থেকে বিদায় নিয়ে মা বাবার সাথে র‌ওনা দিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় একদিন মামার বাসায় থেকে পরেরদিন মা বাবাকে সাথে নিয়ে এয়ারপোর্টের পৌঁছাল।ছোট চাচাও গিয়েছিল সেদিন তাকে বিদায় জানাতে।মা বাবা আর ছোট চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে বসলো সে লন্ডন******ফ্লাইটে।র‌ওনা হলো উন্নত জীবনের আশায়, ভিনদেশ।পিছনে ফেল গেল কিছু সুন্দর অসুন্দর স্মৃতি।ব্যস্ত হলো নিজেকে নিয়ে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে বছর পার হলো তার।সময় বাড়লো তার সাথে ব্যস্ততা‌ও।একদিকে পড়াশোনার ধাপ অন্যদিকে নানার দেওয়ার ঋণে চাপ। তোফায়েল তার দেওয়া টাকা ফেরত না চাইলেও আদিব সেটা শোধ করতে মরিয়া হলো।মামাদের বলা কথাগুলো হজম করে নিলেও ভুলতে পারেনি সে।তাই তো নিজের সবটুকু চেষ্টা চালালো নানার দেওয়া টাকাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিশোধ করার। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট বড় বিভিন্ন কাজে হাত লাগলো।এত এত ব্যস্ততার মাঝে কাছের সম্পর্ক গুলো দূর সরে গেল।প্রথম প্রথম ছোট চাচা আর ফুপি খোঁজ খবর নিলেও সময়ের সাথে সাথে তাদের তদারকি কমলো।মা-ও স্পষ্ট গলায় নিষেধ করলো তাদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে।নিজের কথা জোরালো করতে,তারা আদিবের ভালো চায় না এমন যুক্তি দেখালো। হঠাৎ মায়ের এমন কথার কারণ খুঁজে পেল না আদিব ।মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পেল না সে।পরে তৃপ্তির কাছে জানতে পারলো ফুপুর সাথে জাহানারা কে নিয়ে ঝগড়া হয়েছে মায়ের। ঝগড়ার কারণ সেজ চাচাকে দেওয়া বাবার কথা। তৃপ্তির ছেলে দেখতে এসেছিল ফুপু হাসপাতালে তখন এক কথায় দু কথায় জাহানারা সাথে তার বিয়ের কথা তুলতেই মা তাকে কড়া করে কথা শুনিয়েছে।ফুপু এবার চুপ থাকেনি। তানিয়া অহংকারী,লোভী বলে দুই কথা শুনিয়ে দিয়েছে।তারপর থেকেই তানিয়া চটে আছে। এরমধ্যে আবার মেজ চাচির সাথে ঝগড়া হয়েছে।কারণ চাচি না কি ইচ্ছা করে তাদের বাড়ির সামনে ময়লা ফেলে যায়।ঐ সব মেয়েলি ঝগড়া আর কি!তৃপ্তির কথা শুনে একটা দম ফেলল আদিব। বুঝতে পারলো সম্পর্কে দূরত্ব টানার সময় এসেছে।নিজেকে গুটিয়ে নিল সব থেকে।মা দিন শেষে ফোন দিলেও ভালো মন্দের বেশি কিছু বলা বাদ দিল।পুরো দস্তুর মনোযোগ দিল নিজের ক্যারিয়ারে।এরমাঝে একদিন কথায় কথায় তৃপ্তির কাছে জানতে পেল জাহানারা না কি মডেলিং শুরু করেছে।তাদের পাড়ার মোড়ে জাহানারার বিরাট এক হোডিং লাগিয়েছে বিজ্ঞাপন দাতা প্রতিষ্ঠান।সেজ চাচা এই নিয়ে ছোট চাচার সাথে রাগারাগি করেছে।ছোট চাচা তার কথার উত্তরে বলেছে, “মেয়ে তো ত্যাগ‌ই করে দিয়েছিলে, এখন সে যা ইচ্ছা করুক তাতে তোমার কি?”এরপর সেজ চাচা কিছু বলতে পারিনি ।রাগ করে ছোট চাচার সাথে কথা বন্ধ করেছে। জাহানারার কথা শুনে আদিবের কেমন যেন অস্বস্তি হলো সে তৃপ্তি কে কড়া গলায় বলল সে যেন জাহানারার বিষয়ে তার সাথে কিছু না বলে।এরপর থেকে তৃপ্তি আর জাহানারার বিষয়ে কিছু বলতো না তাকে। কিন্তু এর ঠিক চার বছর পর আবার জাহানারার বিষয়ে খবর সামনে এলো তার।সেটাও আবার খবরের কাগজে।
আদিবের এক বাঙালি রুম মেটের বাংলা খবরের কাগজ পড়ার দরুন আদিব জানতে পারলো তার সেজ চাচার এক মাত্র মেয়ে “খন্দকার জাহানারা আহাসান নিকুঞ্জ চলচিত্রে অভিনয় করার জন্য শ্রেষ্ঠ নারী চরিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাচ্ছেন।”খবরের কাগজে জাহানারার নাম পড়েও আদিবের বিশ্বাস হলো না যে এটাই তাদের জাহানারা ।সে তৃপ্তি কে ফোন লাগলো খবরের সত্যতা যাচাই করতে। তৃপ্তি আদিবের মুখে জাহানারার নাম শুনে প্রথমে একটু ভাব নিল,এর পরে জানালো, আদিব যেটা শুনেছে সেটা সত্যি। তারপর থেকে তৃপ্তি নিজেই জাহানারার টুকটাক নানান বিষয়ে নিজে থেকেই আদিব কে বলতো।আদিব শুনতো।মাঝে মাঝে হ্যাঁ হু করে জবাব দিত।এর বেশি না। তৃপ্তির মুখে জাহানারা সফলতা, ব্যর্থতা,তার ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষী এদের তার প্রতি ভালোবাসা, এসব কথাগুলো ভেবে আদিবের ভীষণ অবাক লাগত যে, যে মেয়েটাকে মানুষ একটু দেখার জন্য, একটু ছোঁয়ায় জন্য কত কিছু করছে, সেই মানুষটাকে সে কখনো ফিরে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি।তাকে পাওয়ার জন্য,তাকে ছোঁয়ার জন্য করা মেয়েটার আকুতি, মিনতির গুরুত্ব দেয়নি!রীতিমতো উপেক্ষা করেছে মেয়েটাকে।ছুঁড়ে ফেলেছে নিজের থেকে!
এই জন্য কি বলে, “মানুষ কোন জিনিস সহজে পেলে তার কদর করে না!”

দরজায় টোকা পড়ার শব্দে ধ্যান ভাঙলো আদিবের। হঠাৎ শব্দে চমকে উঠলো সে।ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো অনেকটা সময় পার হয়েছে।স্মৃতির পাতারা উল্টে পাল্টে তাকে কখন যে নিজেদের মধ্যে ঢেকে নিয়েছে সেটা সে খেয়াল‌ই করেনি। পুরোনো দিন গুলো সব যেন তার চোখের পাতায় রঙিন দৃশ্যের ছায়াছবির নেয় ফুটে উঠেছিল,যেটা সে স্থান কাল ভুলে বিভোর হয়ে দেখছিল।আরো একবার টোকা পড়লো দরজায়।আদিব গলা বাড়িয়ে বলল,

-দরজা খোলা আছে।

ভারি কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো তানিয়া।আদিব তখনো জানালার সামনে দাঁড়িয়ে।তানিয়া ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।তার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল,

-তোর দাদি কবে কবে জাহানারা কে এ জমি লিখে দিয়েছিল আমরা টের‌ও পাইনি।তার কি এটা করা ঠিক হয়েছে!তার জিনিসের পরে তো সবার হক ছিল…

-দাদির জিনিস দাদি যাকে ইচ্ছা দিয়েছে। সেখানে আমাদের কিছু বলার থাকতে পারে না।

তানিয়ার কথা কেটে গম্ভীর গলায় বলল আদিব।ছেলের গম্ভীর কণ্ঠে বলা কথাটায় কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো তানিয়া।বুঝলো এ ব্যাপারে ছেলের সাথে কথা বলে সুবিধা করতে পারবে না।সে কথা ঘোরালো।সোনিয়ারা কেমন আছে জানতে চাইলো। সিনথিয়া,প্রিথিলার কি খবর জিজ্ঞেস করলো।আদিব অল্প শব্দে‌ জানালো সোনিয়ারা ভালো আছে। সিনথিয়া‌ শ্বশুর বাড়ি আছে তার খবর আদিব জানে না আর প্রিথিলার খবর ঠিক বলতে পারবে না।আদিবের দায় সারা জবাব। তানিয়ার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ছেলে কথা বলতে চাইছে না।সে আর কথা বাড়ালো না।যে কথা বলতে এসেছিল সেটা‌ও তুলল না।আদিব কে রেস্ট করতে বলে যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

তানিয়া চলে যেতেই আদিব নিজের ল্যাপটপ খুলে বসলো। অনেক আরাম হয়েছে এখন একটু কাজ করতে হবে তার।একটা গুরুত্বপূর্ণ ই-মেইল আসার কথা ছিল সেটা এসেছে কি না চেক করতে ই-মেইল অ্যাপে ক্লিক করলো।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৮

-কি হলো আদিব তুমি কিছু নিচ্ছো না যে, রান্না ভালো হয় নি?

আন্তরিক কণ্ঠে লিলির।আদিব জোরপূর্বক হাসলো। বিনয়ী ভাবে বলল,

-এই তো নিচ্ছি আন্টি।

সামনে রাখা মোটা সোঁটা বাটিটা থেকে দুই টুকরো মুরগির মাংস নিজের প্লেটে নিল আদিব।হাত দিয়ে হাড়ের থেকে মাংস ছাড়াতে ছাড়াতে মায়ের দিকে একবার থমথমে মুখে তাকালো।তানিয়া ছেলের দিকে না তাকিয়েও ছেলের উত্তপ্ত দৃষ্টির আঁচ পেল। কিন্তু সেদিকে ভ্রূ ক্ষেপ করলো না।মায়ের নির্লিপ্ততা দেখে আদিবের মেজাজ আরো খারাপ হলো ।সে কোনোরকম নিজের খাবার শেষ করে উঠলো।তাকে উঠতে দেখে লিলি তার মেয়ে সামিয়া কে ডাকল।সামিয়াকে বলল সে যেন আদিব কে তাদের বাগান টা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসে।সামিয়া বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো।আদিব মায়ের দিকে আরো একবার কড়া চোখে তাকিয়ে পা বাড়ালো সামিয়ার পিছু।

-আমি কি দেখতে খুব খারাপ?

অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিল আদিব ঠিক তখন সামিয়ার প্রশ্নটা কানে এলো তার। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব।বাগানের শেষ মাথায় দুপুরের রোদ আটকে দাঁড়ানো ঝাপড়ানো জাম গাছটার দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলল,

-না।আপনি বেশ সুন্দর দেখতে।

-তাহলে আপনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন?

-মাঝে মাঝে সুন্দর জিনিসও দেখতে ইচ্ছা করে না।

-এমনটা তো তখন হয় যখন মনে অন্য কোনো ইচ্ছা থাকে। আপনার স্যাম‌ওয়ান স্পেশাল থাকলে আমাকে বলতে পারেন ।আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।

স্যাম‌ওয়ান স্পেশাল!শব্দ দ্বয় নিজ মনে একবার আ‌ওড়ালো আদিব।তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে সামিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

– তেমন কেউ নেই আমার।

এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা।আদিব কথা বলতে চাইছে না যেটা স্পষ্ট। কিন্তু সামিয়ার মনে হলো লোকটা ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের।সে বলল

-আপনি কি সবসময় এমন কম কথা বলেন না কি আমি স্পেশাল।

-আমার কথার পরিমাণ সাধারণত সামনের ব্যক্তি অনুযায়ী কম বেশি হয়ে থাকে।

আদিবের স্পষ্ট জবাব। সামিয়া বুঝতে পারলো আদিবের তার প্রতি উদাসীনতা।সে আদিবের মুখের দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মুখটায় বিরক্তির ছড়া ছড়ি।সামিয়ার গভীর দৃষ্টির সামনে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো আদিব।তার এমনিতেই ভালো লাগছিল না সামিয়ার সাথে কথা বলতে। তার‌উপর এখন তার এই চোখা দৃষ্টি! বিরক্তি চরমে পৌঁছাল আদিবের।মায়ের উপর প্রচণ্ড রাগ হলো তার।নানার অসুস্থতার কথা বলে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে আসা মানতে পারলেও দা‌ওয়াতের নাম করে মেয়ে দেখতে নিয়ে আসার ব্যাপারটা তার হজম হলো না।সে মনে প্রতিজ্ঞা করলো একবার এখান থেকে বের হতে পারলে এর পরে আর মায়ের সাথে কোথাও যাবে না।কখনো না। সামিয়ার দৃষ্টি উপেক্ষা করতে ঘড়িতে অযথা একবার সময় দেখলো আদিব।সামিয়া সেটা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলো,

-কোথাও যা‌ওয়ার আছে বুঝি?

-হু?

অন্যমনস্ক ভাবে সাঁড়া দিল আদিব। তারপর হঠাৎ কি মনে করে বলে উঠলো,

-জি।আসলে আমার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।আমাকে যেতে হবে।আমি আসছি ।আমার মা আমার বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে বলবেন আমি সময় পেলে তাকে ফোন করে সব জানাবো। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। আসসালামুয়ালাইকুম।

কথাটা বলে সামিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সদর দরজার দিকে হাঁটা দিল।সামিয়া আদিবের ব্যবহারে তাজ্জব বনে গেল।আদিব বুঝলো এভাবে হঠাৎ কথার মাঝ থেকে চলে যা‌ওয়াটা ভালো দেখালো না।তবে তার কিছু করার নেই।এই বিরাট অট্টালিকায় দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। এখান থেকে না বের হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না সে। দ্রুত পায়ে সদর দরজা পেরিয়ে বাইরে এলো আদিব।বাইরে বের হতেই বুক ফুলিয়ে একটা দম নিল।ফোন বের করে মায়ের উদ্দেশ্যে একটা ছোট বার্তা পাঠালো,”তুমি আজকে যেটা করেছ সেটা একদম ঠিক করোনি,আমি বড় আপার ওখানে যাচ্ছি,মন মেজাজ ঠান্ডা হলে বাড়ি ফিরবো।”সেন্ড বাটনে ক্লিক করে ম্যাসেজ টা পৌঁছে দিয়ে ফোন লক করে পকেটে ভরলো।এরপর কিছু দূর হেঁটে একটা রিকশা নিয়ে উঠে বসলো তাতে।রিকশা ওয়ালা কে গন্তব্য জানাতেই রিকশা ওয়ালা প্যাডেল পা চালালো।ঢাকা শহরের রাস্তা ঘাট সম্পর্কে আদিবের ধারণা সীমিত।তার বেড়ে ওঠা খুলনায়,সেখানেই তার বিস্তার এরপর লন্ডন। খুলনা ব্যতীত এদেশের আর কোন শহর বা গ্রাম আদিবের ঠিক সে ভাবে চেনা হয়ে ওঠেনি।মাঝে মাঝে আদিবের মনে হয় উন্নত ভবিষ্যতের সাধনায় সে দারুণ কিছু সময় পিছনে ফেলে এসেছে। যেগুলো চাইলেও হয়ত আর ফিরে পা‌ওয়া সম্ভব না। কথাটা ভাবতেই বুক চিরে একটা হতাশ শ্বাস বিরিয়ে এলো।রিকশা চালককে পাশের এটিএম বুথের সামনে রিকশা থামতে বলে সে নেমে গেল।এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে রিকশার দিকে আগালো।রিকশায় উঠতেই যাবে তখন কেউ পিছন থেকে শিষ দিয়ে ডেকে উঠলো,”আদিব্যা” বলে।চেনা সম্বোধন।আদিব তড়িৎ ঘাড় ঘোরালো।চোখে পড়লো মোটা তাজা শরীরের গোল গাল চেহারার ছেলেটাকে।আপনা আপনি ঠোঁটের কোণে চলে এলো মৃদু হাঁসি।অপর পাশের ব্যক্তিটি ভ্রূ নাচিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।আদিব দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল।সামনের জন‌ও এগিয়ে আসলো।আদিব হ্যান্ড সেক করার জন্য হাত বাড়ালেও মানুষ টা তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হেঁচকা টানে বুকে টেনে নিল।বলল,

-শালা ,,,,বিলেতি গিরি এখানে চলবে না।এতবছর পরে দেখা হলো,হাত মিলিয়ে শান্তি হবে।

আদিব দুই হাতে বন্ধু কে জড়িয়ে নিল।সেভাবে থেকেই আহাজারি করে বলে উঠলো,

-তোর গায়ে যে গন্ধ!তোর জন্য ঐ হাতে হাত মিলানো পর্যন্তই ঠিক ছিল। উঁহুহু!

আদিব মিছিমিছি না শিঁটকালো।তাহের তড়িঘড়ি ছেড়ে দিল আদিব কে ।হাত উচু করে নিজের শরীরের গন্ধ বার কয়েক শুঁকে বলল ,

-কৈ গন্ধ বের হচ্ছে!শালা তুই যেটা শুকে নাক শিটকাচ্ছিস, ওকে বলে সুগন্ধ। সুগন্ধ!তাও আবার ব্র্যান্ডেড।

ঠোঁট টিপে হাসলো আদিব।আদিবের হাসিটা তাহের কে বিভ্রান্তিতে ফেলল এবার।তার গায়ে গন্ধের সমস্যা সেই ছোট থেকেই যেটা সময়ের সাথে সাথে কড়া সুগন্ধি আর কিছু অভ্যাস পরিবর্তনের ফলে অনেকটা কম হয়েছে কিন্তু আদিবের মুখের মিটমিটে হাঁসি দেখে তার মনে সংশয় দেখা দিল।সে হাত উঁচু করে আরো দুইবার নিজের শরীরের গন্ধ নিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে আদিবের কাছে জানতে চাইলো,

-এই আদি সত্যি সত্যি গন্ধ বের হচ্ছে না কি?

তাহেরের বিচলিত কণ্ঠ আদিব দাঁত বের করে হাসলো।তাকে আরো একবার জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে বলল,

-আরে ইয়ারকি করছিলাম।কেমন আছিস?

-বিন্দ্যাস।তোর কি খবর?দেশে ফিরলি কবে?

-এই তো মাসখানেক হলো।

-মামা যাবেন না?

আদিব কে তাহের সাথে কথায় মশগুল দেখে রিকশাওয়ালা মামা পিছু ডেকে জানতে চাইলো।আদিবের টনক নড়লো এবার।সে তো তাহের কে দেখে ভুলেই গিয়েছিল যে তার রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। রিকশাওয়ালা মামার কথার জবাব দিতেই যাবে আদিব তার আগে আদিবের হয়ে জবাবটা তাহের দিল,

-নানা মামা,তোমার মামা এখন বন্ধুর সাথে যাইবো।তুমি কেটে পড়ো।

-এই না রে আজ না।আজ বড় আপার ওখানে যেতে হবে। অপেক্ষা করছে সে।

তাহেরের কথা শেষ না হতেই বলল আদিব।তাহের আদিবের কথা হা‌ওয়াই উড়িয়ে দিয়ে বলল,

-শোনো মিয়া অনেকদিন পর তোমারে বাগে পেয়েছি এত তাড়াতাড়ি ছাড়ছি না।তুমি এখন আমার সাথে ঘুরা ঘুরি করবা ।রাত ভোর হ‌ওয়ার আগে আমি তোমাকে সসম্মানে আপার ওখানে পৌঁছে দিব।কথা ক্লিয়ার?

-না রে তা হয় না ।আপা রাগ করবে ।

-তুই ফোন লাগা আপার কাছে আমি কথা বলছি আপার সাথে।

তাহের নাছোড়বান্দা।আদিব হাল ছাড়লো।আদিব দিপ্তীর ওখানে হঠাৎ গিয়ে তাকে চমকে দিতে চেয়েছিল। যার জন্য দীপ্তি কে কিছু জানায়নি নিজের যাওয়ার ব্যাপারে।সে শুধু তাহের কে কাটানোর জন্য দিপ্তীর অযুহাত দিয়েছিল। কিন্তু বুঝলো তার এই বন্ধুর কাছে তার দেওয়া অযুহাত টিকবে না।সে রিকশাওয়ালা কে তার পাওনা মিটিয়ে দিয়ে তাহেরের সাথে তার গাড়িতে উঠে বসলো।তাহের ইয়াসির আদিবের ছোট বেলার বন্ধু।এক সাথে স্কুল শেষ করেছে তারা এরপর তাহেরের বাবার সরকারি চাকরির দরুন ট্রান্সফার হলে তারা কুষ্টিয়ায় চলে যায়।তাহেররা ঢাকার স্থানীয় লোক।কলেজে ভর্তি হ‌ওয়ার পর একবার খুলনায় গিয়েছিল তাহের ।তখন আদিবদের ওখানে মাস খানেক ছিল।ঐ সময়টাতেই তাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়। লন্ডন যা‌ওয়ার পরেও বেশ কয়েক বছর তাহেরের সাথে যোগাযোগ ছিল আদিবের।এর পরে বিভিন্ন ব্যাস্ততায় কীভাবে কীভাবে যেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো তাদের।তাহেরের সাথে কথা বলে আদিব জানতে পারলো সে বর্তমানে হোটেল ব্যাবসা নিয়োজিত আছে।বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আর নানি বাড়ি থেকে মায়ের পাওয়া সম্পত্তির অংশ বিক্রি করে পাঁচ বছর আগে একটা ছোট্ট খাটো রেস্তোরাঁ শুরু করেছিল যেটা এখন বিরাট চার তারকা হোটেলে পরিবর্তিত হয়েছে।আদিব কে নিজের হোটেলে নিয়ে গেল তাহের। সারা বিকেলটা তাহেরের হোটেলের আনাচে কানাচে ঘুরেই কাটলো আদিবের।এরপর রাত আটটার দিকে তাহের তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে গেল।দুই বছর হলো বিয়ে করছে তাহের চার মাসের একটা মেয়েও আছে তার।তাহেরের তুলতুলে মেয়েটা দেখে আদিব আক্ষেপের সুরে তাহেরের সামনে বলেই বসলো,

– জীবন যুদ্ধে আমি তোদের থেকে পিছিয়ে গেলাম রে।

-তাতো যাবায়।আরো থাকো পড়ার টেবিলে প্রতিবন্ধীর মতো পড়ে।এখন বুঝতে পারছো কেন বলতাম আদিব্যা চারিদিকে একটু নজর বুলিয়ে দেখ ,কাউরে একটু চান্স দে ।তখন তো আমাদের কথার গুরুত্ব দাও নি।এখন রাত হলে বুঝতে পারো তো!

আদিবের কথাটা হয়ত তখনো হাওয়া ঝুলছিল।তাহের সেটা মাটিতে পড়ার আগেই কটাক্ষের সুরে নিজের বাণী ব্যক্ত করলো।আদিব ভ্রূ কুঁচকালো।বলল,

-ছি :।এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেলি তা‌ও কথা বার্তা শুধরালো না।কথার কি শ্রী!

-আমার কথা ঠিকই আছে তোর কল কবজা ঠিক আছে কি না বল?

-মানে যাতা! হ্যাঁ?ফালতু লোক একটা।

-কথা ঘোরাস না যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে।তোকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়।

-থাক তোমার আর চিন্তা করতে হবে না।খেতে চলো।আমার খিধে লেগেছে।

আদিব কথা এড়াতে চাইলো কিন্তু তাহের ছাড়লে তো।তার এক প্রশ্ন বার বার।আদিব বিরক্তি তে চোখ মুখ কুঁচকে বলল,

-আই এম টোটালি প্যার্ফেক্ট।ওকে?হ্যাপি?

-ভীষণ।তবে আরেকটা কথা এত কনফিডেন্সের রহস্য কি? এরমধ্যে টেস্ট ড্রাইভ সেরে ফেলেছিস না কি? হুঁ?

-বাজে লোকজন, বাজে চিন্তা ভাবনা।ফালতু একটা। ভদ্র মানুষ হবি না তুই।

আদিব হাঁটা দিল সামনে।তাহের স্ত্রী শিলা এর মধ্যে তাদের খাওয়ার জন্য ডেকে গেছে কয়েকবার।সেদিকেই পা বাড়ালো আদিব।তাহের আদিব কে জব্দ করতে পেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।আদিব কে সহজে কণ্ঠসা করা যায় না তবে টপিক যদি এটা থাকে তাহলে আদিবের মুখটা দেখার মতো হয়।তাহেরর অট্টহাসি শুনে শিলা জিজ্ঞেস করলো,

-কি হয়েছে?ও ওভাবে হাসছে কেন?

-পা’গ’লের আবার হাসির কারণ লাগে না কি!

-তা ঠিক বলেছেন ভাইয়া।

আদিবের কথা সমর্থনে বলল শিলা।তাহের এসে যোগ দিল তাদের সাথে খাওয়ার টেবিলে।খাওয়া দাওয়া গল্প গুজবে সময় গড়িয়ে কখন যে রাত বারোটা বাজলো তাহের কিংবা আদিব কারো খেয়ালই র‌ইলো না।রাত অনেক হয়েছে দেখে আদিবকে তাহের তার এখানে থেকে যেতে বলল। কিন্তু আদিব রাজি হলো না। যতোই পুরোনো বন্ধু হোক হুট করে উড়ে এসে এমন রাত কাটানোটা তার কাছে ভালো লাগলো না।সে তাহেরের উপর অনেকটা জু’লু’ম করে তাকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করলো।শিলা মেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আর তাকে ডেকে তুলল না তাহের।ফ্লাটের বাইরে থেকে দরজা লক করে বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে।

দীপ্তি সাভারে থাকে।তাহেরের বাড়ি থেকে ওর ওখানে যেতে ঘণ্টা দেড়েক মতো সময় লাগলো।আদিবের একবার জন্য মনে হয়েছিল এই সময় দিপ্তীর ওখানে না গিয়ে মামাদের ওখানে ফিরে যাওয়া কিন্তু মায়ের আজকের করা কাজের জন্য সে সিদ্ধান্ত বদলালো। তাছাড়া এই সময় দিপ্তীর বাড়ি তার জন্য সব থেকে উপযোগী। দীপ্তি আর নিশান দুইজন থাকে সেখানে। কোন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই।নিশান যথেষ্ট ফ্রেন্ডলি।এই অসময়ে তাকে দেখলেও তারা খুশি হবে এটা সে নিশ্চিত।
দিপ্তীর বাড়ির মুখে আদিব কে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিল তাহের।আদিব তাহের কে বিদায় জানিয়ে আশেপাশে নজর ঘোরাল রাত একটার আশেপাশে সময়, রাস্তা ফাঁকা। দিপ্তীর বাড়ির নেমপ্লেটটার সাথে ফোনের স্ক্রিনে থাকা ঠিকানাটা মিলিয়ে নিল সে।সঠিক গন্তব্যে এসেছে বুঝতে পেরে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।পা বাড়ালো বাড়ির দিকে।বাড়ির সদর দরজাটা হাট করে খোলা পেল আদিব।আশেপাশে দারোয়ানকে খুঁজলো তবে আশ্চর্য জনক ভাবে কাউকে চোখে পড়লো না।বাড়ির বাইরে থেকে অন্ধকার আচ্ছন্ন বাড়িটা বেশ রহস্যময় ঠেকলো।খোলা দরজার কাছে দারোয়ান না থাকার বিষয়টা অদ্ভুত লাগলো আদিবের কাছে।এই মধ্য রাতে দরজা খোলা রেখে দারোয়ান কথায় গেল সেটা ভাবালো তাকে ।তবে পরক্ষণে মনে হলো হয়ত দিপ্তীর বাড়ি দারোয়ান‌ই নেই। কিন্তু দারোয়ান না থাকলে দরজায় তালা দিয়ে রাখেনি কেন এরা!তার আপা কি কোনোভাবে জানতে পেরেছে সে আসছে,তাই কি তাকে চমকে দেওয়ার জন্য দরজা খোলা রেখে গেছে!না।সেটা কি করে সম্ভব! সে আসছে এ খবর তো মা ছাড়া কেউ জানে না।আর তার জানা মতে মায়ের সাথে তার আপার কথা হয় না।তাহলে?নিজের মনে বিভিন্ন ভাবনা চিন্তার উদয় -অস্তচলের মাঝে বাড়ির দরজায় এসে থামলো আদিব।সাথে সাথে ভ্রূ তে ভাজ পড়লো তার।বাড়ির দরজাও সদর দরজার মতো হাঁ করে খোলা।ভেতরে ভেতরে এবার কেমন জানি একটা খটকা লাগলো আদিবের। খুঁত খুঁত করে উঠলো মন।আধারে ঢাকা নিকষ কালো বাড়িটা যেন কোন অশনি সংকেতের আভাস দিল তাকে।ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সে।পা সামনে আগানোর সাথেই কানে পর্দায় বাড়ি খেল মৃদু গোঙানির শব্দ।আদিবের প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে সাথে যেটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো।মন বলে উঠলো তার আপা কিংবা নিশান ভাইয়ের কিছু হয়নি তো?কথাটা মনে হতেই পায়ের গতি বাড়ালো আদিব।ফোন বের করে টর্চ অন করলো।অন্ধকার ঘরটা কিঞ্চিৎ আলোকিত হলো তাতে।ফোন টর্চের আলোয় দরজার পাশে থাকা সুইচবোর্ড টা চোখে পড়লো তার।সুইচ অন করলো আদিব।সাথে সাথে চোখে পড়ল ঘরের বিধ্বস্ত দশা।আদিবের বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক তাকে জানান দিল অনিষ্টের।ঠিক তখনই দৃষ্টি গিয়ে আটকালো সিঁড়ির সামনে ফ্লোরে পড়ে থাকা নিথর প্রায় শরীরটায়। ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো আদিবের। সাদা টাইলসের মেঝেতে রক্তের স্রোত আর নারী শরীরটা ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ করলো তাকে।
দীপ্তি অন্তঃসত্ত্বা।প্রায় তেরো বছর পর কত সাধ্য সাধনা করে কনসিভ করেছে।এ কথা আদিবের অজানা নয়।দীপ্তি আর তার অনাগত বাচ্চার অনিষ্ট চিন্তায় ভেতরটা কুঁকড়ে গেল আদিবের। ডিসেম্বরের এই শীতল আবহাওয়াতেও দরদর করে ঘামতে লাগলো সে।ছুটে গেল আহত মানুষটার দিকে।কাছ থেকে দৃশ্যমান হলো মানুষটার চেহারা।চমকালো আদিব।স্থান কাল ভুলে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো র’ক্তে মাখামাখি মুখটায়।নিজের অজান্তেই মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো চার অক্ষরের নামটা।

-জাহানারা!

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

সৌরকলঙ্ক পর্ব-০৬

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৬

আ’ত্মহ’ননের চেষ্টায় কিঞ্চিৎ ত্রুটি ছিল হয়ত যার কারণে বেঁচে গেল জাহানারা।তবে হাসপাতালে কাটাতে হলো বেশ কয়েকদিন। জাহানারা কে দেখতে ছোট চাচা ছুটে এলো ঢাকা থেকে।ফুপু গিয়ে র‌ইলো হাসপাতালে কতদিন। আশরাফ নিজের সবটুকু চেষ্টা দিয়ে ভাতিজির বোকামি লুকাতে চাইলেও লুকাতে পারলো না।এক কান দুই কান করে কথাটা রটেই গেল মহল্লায়। সেই সাথে আদিবের প্রতি জাহানারার অতি আগ্রহের কথাও জানলো সবাই।নানা লোকে নানান কথা বলল।কেউ আদিব কে দোষ দিল কেউ বা জাহানারা কে।তানিয়া ছেলের নামে মানুষের মুখে কটু কথা শুনে চিড়বিড়িয়ে উঠলো। সোনিয়ার আর তোফায়েলের সাথে কথা বলল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আদিবকে লন্ডনে নিয়ে যা‌ওয়ার জন্য।আদিবের কানে সবটাই এলো। জাহানারা কে জড়িয়ে নিজের নামে শোনা আউ ফাউ কথাগুলোর পরে জাহানারার উপর রাগ আরো বাড়লো।তবে পরক্ষণে যখন মনে হলো মেয়েটা আবেগের বসে যে বোকামি করছে, সেটা মানুষ তাকে সহজে ভুলতে দিবে না। ছোট্ট একটা ভুল পদক্ষেপ ,সারাজীবনের জন্য কলঙ্কের দাগ একে দিল মেয়েটার জীবনে।এ কলঙ্ক সে মুছবে কি ভাবে!এই সমাজ পুরুষের দোষ যত তাড়াতাড়ি ভুলে যায়, একজন মেয়ের দোষ অতোটা তাড়াতাড়ি ভুলতে পারে না।এসব কথা মনে হতেই জাহানারা জন্য উদায় হওয়া রাগ করুণায় পরিবর্তিত হলো।মায়া হলো মেয়েটার জন্য।

জাহানারা কে যেদিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো সেদিন ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল আদিব।উঠান পার করে ঘরে যাওয়ার স্বল্প সময়ের দূরত্ব টুকুতে ঘাড় উঁচিয়ে আদিবদের ছাদের দিকে তাকিয়েছিল জাহানারা।সেই সময় আদিবের চোখে চোখ পড়েছিল তার।এত কিছুর পরেও মেয়েটা যেমন কাতর চোখে আদিবের দিকে তাকিয়েছিল সেটা মনে পড়লে আজ‌ও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় আদিবের।সেদিন জাহানারার সেই দৃষ্টির সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেনি আদিব।নেমে এসেছিল ছাদ থেকে। একবারের জন্য মনে হয়েছিল জাহানারা তাকে যে ভালোবাসার দাবি করছে, সেটা শুধু মাত্র কিশোরী বয়সের আবেগ না।হয়ত আবেগ পেরিয়ে সত্যি তাকে ভালোবেসে ফেলেছে মেয়েটা। হঠাৎ করে খারাপ লাগছিল তার জাহানারার জন্য ।মনে হয়েছিল মেয়েটাকে এড়িয়ে না গিয়ে ভালো করে বোঝানো উচিত ছিল।হয়ত মেয়েটা তার কথা বুঝতো। নিজের বোকামির উপর নিজের‌ই রাগ হচ্ছিল আদিবের।সে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিল জাহানারার সাথে সরাসরি কথা বলবে সে এ বিষয়ে। স্পষ্ট কথা!

পরেরদিন তানিয়ার বাড়িতে না থাকার সুযোগ নিয়ে পা বাড়ালো সে সেজ চাচাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।তানিয়া বাড়ি থাকলে তাকে জায়েদের বাড়ি যেত দিত না ,যেটা আদিব ভালো করেই জানতো।এর আগে জাহানারা হাসপাতালে থাকাকালীন আশরাফ তাকে হাসপাতালে যেতে বলেছিল সৌজন্য রক্ষার্থে কিন্তু তানিয়া তাকে যেতে দেয় নি। আশরাফের সাথে এই নিয়ে অশান্তি করেছে।আদিব চায়নি সেজ চাচার বাড়িতে যাওয়া নিয়ে তার মা আবার কোনো অশান্তি করুক সেই জন্য মায়ের অন‌উপস্থির সুযোগ নিয়েছিল। কিন্তু আদিব যদি জানতো এটা তার জীবনের সব থেকে বড় ভুল হবে তাহলে কখনো মায়ের অনউপস্থিতিতে সেজ চাচার ওখানে যা‌ওয়ার কথা ভাবতো না!

আদিবের এখনো মনে আছে সেই এক চিলতে বিকেলের স্পষ্ট স্মৃতি।সেজ চাচার বাড়ির প্রবেশ মুখেই দেখা হল তার চাচির সাথে।চাচি কোথাও একটা যাচ্ছিল।আদিব কে দেখে সে মৃদু হাসলো।আদিব তাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো।সালেহা কোথায় যাচ্ছে সে কথা জানতে চাইলো আদিব।সালেহা জানালো রিপনদের বাড়ি যাচ্ছে সিরিয়ালের টাকা দিতে।আদিব কে বলল ভেতরে বসতে সে এই যাবে এই আসবে ।সজীব কে হাক ছেড়ে ডাকলো সালেহা।সজীব সালেহার কথার উত্তর নিলেও বাইরে এলো না,আদিবকে বলল তার ঘরে যেতে।সজীব কে কুড়ের উপাধি দিয়ে আদিব কে ভেতরে যেতে বলে বেরিয়ে গেল সালেহা।আদিব জাহানারার সাথে কথা বলবে ভেবে আসলেও পা বাড়ালো সজীবের ঘরে। সজীব উপুড় হয়ে পড়ে ছিল বিছানায়।এটা সজীবের ভীষণ পছন্দনীয় একটা কাজ ।আদিব ঘরে ঢুকেছে এটা বুঝতে পেরেও সে নড়লো-চড়লো না।আদিবের উদ্দেশ্যে বলল,” বস।”আদিব ওর শিয়রে বসলো।আদিব বসতেই চিত হয়ে শুলো সজীব ঘাড় ফিরিয়ে আদিবের দিকে তাকিয়ে বলল,

-বড় ভাবি বাড়ি নেই?

আদিব একটু অবাক হলো সজীবের কথায় ।তবে সজীবের কথার অর্থ বুঝতে পেরে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলল। সজীবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-এতদিন পরে দেখা হলো,ভালো‌ মন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করে খোঁচা মারছিস কেন?

-খোঁচা মারছি না শুধু জানতে চাইছি ভাবি বাড়ি আছে কি না!

-থাক আর কথা ঘোরাতে হবে না।আমি বুঝেছি তোমার জানতে চাওয়া কথার মানে। হ্যাঁ মা বাড়ি নেই তাই এসেছি।বাড়ি থাকলে হয়ত আসতে দিত না।পেয়েছ উত্তর ?খুশি?

আদিবের কণ্ঠে রাগের আভাস। সজীব শোয়া থেকে উঠে বসলো।বলল,

-চেতছিস কেন?আমি তো এমনি জিজ্ঞেস করেছিলাম। আচ্ছা বাদ দে চা খাবি?

-না কিছু খাবো না।একটা কাজে এসেছিলাম। তোর হেল্প চাই।

-কি কাজ?

কাঠের আলনা থেকে একটা গেঞ্জি হাতে নিয়ে সেটা পরতে পরতে বলল সজীব।আদিব একটু সময় নিল। তারপর বলল,

-আমি জাহানারার সাথে কথা বলতে চাই।

-এখন কথা বলে কি হবে আদিব?যা হ‌ওয়ার হয়ে গেছে।এখন তুই কিছু বলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।শোন ,জান নিজেকে সামলে নিয়েছে।ওকে ওর মতো ছেড়ে দে। তোর আর কিছু বলা লাগবে না।

-আর ইউ শিয়োর?

-ওয়ান হান্ড্রেড প্যারসেন্ট।

কথাটা বলে একটা শ্বাস ফেলল সজীব তারপর আদিবের মুখোমুখি বসে বলল,

-জান তোকে পছন্দ করে একথাটা তুই জানতি?

-হুম।

-আমাকে বলিস নি কেন?আমাকে বললে আমি হয়ত ওকে আগেই সামলে নিতাম।

-মনে হয়েছিল আমি সবটা নিজেই সামলে নিতে পারবো।তার থেকে বড় কথা আমি গুরুত্ব দেই নি ব্যাপারটা। ভেবেছিলাম কিশোরী বয়সের আবেগ,আমার থেকে কোন সাড়া না পেলে আপনা আপনি ঠিক হয়ে যাবে!

-আমি যদি বলি তোর প্রতি জানের মনে যে অনুভূতি আছে সেটা কিশোরী বয়সের আবেগ নয় , কিশোরী মনের প্রথম ভালোবাসা।

থমকালো আদিব। তড়িৎ তাকালো সজীবের মুখ পানে।সজীব হাসলো।সেই হাসিতে যেন বলতে চাইলো আমার ভাগ্নি মরেছে তোকে ভালোবেসে।আদিব একটা শুকনো ঢোক গিলল। শীতল শ্বাস টানলো। গম্ভীর অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,

-ইট ইজ আনফরচুনেট ফর হার। আমার মনে তার জন্য না তেমন কিছু আছে আর না ভবিষ্যতে হবে।

-জানের মধ্যে কি কমতি আছে আদিব?এখনকার কথা বাদ দিলাম কিন্তু ভবিষ্যতে‌ও তোর মনে ওর জন্য কোন অনুভূতি তৈরি হবে না সেটা কীভাবে বললি!এত অহংকার!

-অহংকার না আত্মবিশ্বাস।আমি আমার মন, আমার অনুভূতি সম্পর্কে জানি সেই আত্মবিশ্বাসে বললাম।

-ও…!

শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল সজীব।আর কথা বাড়ালো না।আদিবের‌ও মনে হলো বন্ধুর সাথে আর কথা জমবে না।আর যার জন্য এসেছিল সেটার যখন প্রয়োজন নেই তাহলে ওঠা উচিত।সে উঠে দাঁড়ালো।

-আচ্ছা থাক,আমি উঠি।

-এই তো এলি এখন‌ই চলে যাবি?একটু বস। কয়দিন পর তো নাগালের বাইরে চলে যাবি তখন তো চাইলেও তোকে পাবো না।

আদিবের ভিসা চলে এসেছে।এখন ফ্লাইট টিকিট কেনার পালা।সজীব তার‌ই ইঙ্গিত দিল আদিব কে।আদিব ম্লান হেসে বলল,

-এখনো অনেক দেরি আছে। আবার আসবো ।আজ উঠি একটা জরুরি কাজ আছে।

আদিবের কণ্ঠে ব্যস্ততা।সজীব আর বাঁধ সাধলো না।সেও উঠে দাঁড়ালো। আদিবকে এগিয়ে দিতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।সজীবের ঘর থেকে বের হতেই জাহানারার মুখোমুখি হলো তারা। জাহানারা কে দেখে কিঞ্চিৎ থমকালো আদিব।তাদের চাচাতো ভাই বোনের মধ্যে জাহানারার চেহারার সাথে কারো তুলনা করা যায় না।অসামান্য রূপ নিয়ে জন্মেছিল এই মেয়ে। আশরাফ প্রায় বলতো তার মা জাহানারা বেগম অল্প বয়সে যেমন ছিল ঠিক তেমন চেহারা ছিল ছোট বেলায় জাহানারার।জায়েদ মেয়ের সদ্য জন্মানো আদলে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখে মায়ের নামে মেয়ের নাম করণ করেছিলেন জাহানারা।আদিব মেয়েটাকে তেমন পছন্দ না করলেও এ কথা অস্বীকার করতে পারবে না যে তাদের এ তল্লাটে জাহানারার থেকে সুন্দর মেয়ে আর একটাও নেই।সেই জাহানারার ফ্যাকাশে মুখ,কোটোরে ঢুকে যাওয়া চোখ আর বিধ্বস্ত দৃষ্টি দেখে থমকাতে বাধ্য হলো আদিব। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জাহানারার দিকে। জাহানারা অশ্রু শিক্ত জ্বলজ্বলে চোখে আদিবের দিকে তাকালো।সজীব এগিয়ে আসলো তখন।আদিব কে আড়াল করে দাঁড়ালো জাহানারার সামনে। জাহানারার অবয়বটা সজীবের আবডালে যেতেই সম্বিত ফিরল আদিবের।কানে এলো সজীবের কথা।সজীব জাহানারা কে বলল,

-কি হয়েছে জান?বাইরে বের হয়েছিস যে!কিছু লাগবে?

সজীবের কথা শুনলো জাহানারা কিন্তু কোন প্রতি উত্তর দিল না।সজীবের হাত ধরে তাকে আদিবের সামনে থেকে সরিয়ে এক পা এগিয়ে গেল।আদিবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে ভঙ্গুর গলায় বলল,

-আমার মধ্যে কি কমতি আছে বললেন না তো?

জাহানারার প্রশ্নে ভেতরটা কেমন যেন ধক করে উঠলো আদিবের।মনের অস্থির আলোড়ন লুকিয়ে নির্লিপ্ত চোখে তাকালো জাহানারার দিকে।জাহানারার ভেতর কোন কমতি আছে কি না সেটা কখনো সেভাবে ভেবে দেখে নি আদিব।আসলে সে সময়‌ই পায়নি জাহানারাকে নিয়ে সেভাবে ভাবার। জাহানারা প্রশ্নের উত্তরে আদিব কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

-তোমার মধ্যে কোন কমতি নেই জাহানারা। ব্যাস তুমি আমার জন্য প্যার্ফেক্ট না।

-প্যার্ফেক্ট না হলে,প্যার্ফেক্ট করে নিয়েন।আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো আদিব ভাই।

জাহানারা কান্না ভেজা আকুতি।আদিব কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো।আদিব স্বপ্নেও ভাবেনি তার কথায় জাহানারা এমন একটা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে।সজীব হয়ত বুঝলো আদিবের অবস্থা।সে তড়িঘড়ি সামনে এসে জাহানারা কে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বোঝানোর সুরে বলল,

-জান, মা আমার এদিকে শোন আমার কথা

-ছোট মামা তুই তো ওনার বন্ধু।সব থেকে কাছের বন্ধু।তুই ওনাকে বল না আমাকে একটু ভালোবাসাতে।তুই বললে উনি ঠিক শুনবে।বল না ,একটু।

সজীবের কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো জাহানারা। জাহানারার এমন আকুতি মিনতির কাছে সজীবকে ভীষণ অসহায় লাগলো।আদিব লক্ষ্য করলো সেটা।সজীব জাহানারা কে কিছু বলতে যাবে তার আগে বাধ সাধলো আদিব।দৃঢ় কণ্ঠে জাহানারার উদ্দেশ্য বলল,

-জাহানারা আমি তোমাকে স্পষ্টভাবে একটা কথা বলছি।আশা করি তুমি মন দিয়ে শুনবে এবং বুঝবে।

একটু থামলো আদিব তারপর বলল,

-জাহানারা তুমি যেটাকে ভালোবাসা বলছো, সেটা আসলে তোমার আবেগ।মোহ।কিছুদিন পরে আমার থেকে ভালো কাউকে পেলে যেটা আর থাকবে না। তুমি ভুলে যাবে আমাকে।

-আদিব ভাই, রাকিব ভাইয়া কি আপনার থেকে ভালো না?উনি নিজে আমাকে হাঁটু গেঁড়ে নিজের মনের কথা বলেছে ,কতশত ওয়াদা করছে। আমি তো ওনাকে দেখে আপনাকে ভুলতে পারিনি।আমার ভালোবাসা কে প্লিজ আবেগের নাম দিয়েন না।আমি আপনাকে সত্যিই ভালোবাসি আদিব ভাই। ভীষণ ভালোবাসি।

রাকিব সরোয়ার।সাদেক সরোয়ারের একমাত্র ছেলে।খুলনা মেডিকেল দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।যেমন দেখতে,তেমন মেধাবী,টাকা পয়াসার‌ও অভাব নেই।খুলনা শহর ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় তাদের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে।খুলনা শহরে সবাই তাদের এক নামে চেনে। জাহানারার মুখে তার কথা শুনে অবাক হলো আদিব।মন চাইলো জাহানারার কাছে জিজ্ঞেস করতে রাকিব কে কীভাবে চেনে সে। আশরাফ খুলনা মেডিকেল কর্মরত অধ্যাপক হ‌ওয়ার সুবাদে রাকিবের সাথে আদিবের দুই একবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। মিষ্টি ভাষী একটা ছেলে।আদিবের সিনিয়র সে। কিন্তু জাহানারা সাথে তার কীভাবে পরিচয় হলো সেটা সেই মুহূর্তে জানার কৌতূহল দেখা দিল আদিবের মনে।তবে মনের কৌতূহল মনে দমিয়ে সে জাহানারা উদ্দেশ্যে বলল,

-তাহলে বলবো তুমি অযথা জেদ করছো।

-আমি একটুও জেদ করছি না ।আমি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠ মানুষ‌ পেলেও আমি আপনাকে ভুলতে পারবো না আদিব ভাই।প্লিজ আমাকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করবেন না।

জাহানারা নাছোড়বান্দা।আদিব হতাশ শ্বাস ফেলল।তার মনে জাহানারার জন্য সহানুভূতি ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।কি করবে সে!মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কীভাবে একজনকে মনে জায়গা দেবে!একজন কে খুশি করতে গিয়ে সে নিজের সাথে অন্যায় করতে পারবে না।আদিব সজীবের দিকে একবার তাকালো সাহায্যের আশায়। সজীব বুঝলো আদিবের দৃষ্টি।সে জাহানারা কে নানা কথা বলে বোঝাতে লাগলো। কিন্তু জাহানারা মানতে নারাজ।তার আদিব কে চায় মানে, আদিব কে চায়।সজীব আর জাহানারার কথোপকথনের মধ্যে ভেতরে প্রবেশ করলেন জাহানারা বেগম। জাহানারা দাদিকে দেখে যেন আরো বেপরোয়া হলো।দুর্বল শরীরে ছুটে গেল তার দিকে‌।বাচ্চারা যেমন আবদার করে তেমন আবদার করতে লাগলো দাদির কাছে। জাহানারা বেগম করুণ চোখে তাকালো আদিবের দিকে।দাদির ঐ দৃষ্টিটা একদম ভালো লাগলো না আদিবের।খুব খারাপ লাগলো।মনে হলো তার এখানে আসায় ভুল হয়েছে। জাহানারা এমন পাগলামো করবে জানলে সে কখনো এখানে আসতো না। জাহানারা বেগম নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা করতে লাগলো জাহানারা কে বোঝাতে কিন্তু সে দাদির একটা কথাও কানে তুলল না।আদিবের ভীষণ রাগ হলো মেয়েটার এক রোখা জেদ দেখে।বুঝলো এই মেয়ে কারো কথা কানে তুলবে না। জাহানারা বেগমের সাথে জাহানারার কথার ব্যস্ততার মাঝে সজীবকে বলে সেখান থেকে চলে আসতে উদ্যত হলো আদিব। কিন্তু দরজার কাছে আসতে জাহানারা এসে পথ আগলে দাঁড়ালো তার।হাত জোড় করে নিজের একতরফা ভালোবাসার আহাজারি করতে লাগলো।আদিবের ধৈর্য চ্যুত হল এবার।সে জাহানারার অসুস্থতা উপেক্ষা করে দারাজ গলায় ধমকে উঠলো। হঠাৎ আদিবের ধমকে কেঁপে উঠলো জাহানারা।আদিব তার কাঠখোট্টা কণ্ঠে চেতে উঠে বলল,

-ভালো ভাবে কথা বলছি কানে যাচ্ছে না ,না!বলছি না তোমার প্রতি কোন ইন্টারেস্ট নেই আমার।ভালো লাগেনা আমার তোমাকে।তোমাকে নিজের যোগ্য মনে হয় না আমার।কান খুলে শুনে রাখ আমার পক্ষে কখনো সম্ভব না তোমাকে ভালোবাসা।স্পষ্ট?

একদমে কথা গুলো বলে থামলো আদিব। জাহানারার ফ্যাকাশে মুখটা আরো ফ্যাকাশে হলো।এক পা পিছিয়ে আসলো যেন সে।আদিব সেটা লক্ষ্য করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলল। জাহানারা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখল তার মা দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজায়।আদিবের চোখে তানিয়ার চোখ পড়তেই তানিয়া ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,

-বাড়ি চলো আদিব।

আদিব মায়ের কথায় চুপচাপ পা বাড়ালো সামনে।বাড়ির সদর দরজার সামনে সালেহার সাথে দেখা হলো তাদের।সালেহা সালাম দিতে যাবে তার আগে তানিয়া শীতল অথচ রুক্ষ কণ্ঠে বলল,

-সালেহা আর কত সর্বনাশ করবে আমার?আমার মেয়েটার সর্বনাশ করে শান্তি হয় নি, এখন আমার ছেলেটার পিছনে পড়েছ!এবার তো অন্তত ক্ষান্ত দা‌ও।একটু শান্তিতে থাকতে দাও আমাকে।

কথাটা বলেই হন হন করে বড়ির পথে হাঁটা ধরলো তানিয়া।তানিয়ার কথার অর্থ উদ্ধার করতে সালেহার কিছুটা সময় লাগলো। দীপ্তি সালেহার বড় ভাইয়ের ছেলে নিশানের সাথে সবার অমতে বিয়ে করার পর থেকেই তানিয়া দিপ্তীর এই কাজের জন্য সালেহাকে দায়ী করে আসছে।সে কথাটায় আজ আবার বলল সে।তানিয়ার তীক্ষ্ণ কথা গুলো ধা’রালো তীরের নেয় বিঁধলো সালেহার বুকে।চোখ জ্বলে উঠলো।বিকেলের সাদাটে আলোয় আদিব স্পষ্ট দেখলো চাচির চোখে পানি। খারাপ লাগলো তার কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না।

আদিব ভেবেছিল বাড়ি ফিরেই মা তাকে সেজ চাচার বাড়ি যা‌ওয়ার জন্য কথা শোনাবে কিন্তু আদিবের ভাবনা কে ভুল প্রমাণিত করে তানিয়া কিছুই বলল না তাকে।এমনকি রাতে খাবার সময়‌ও তার সাথে কথা বলল না।আদিব চেষ্টা করলো মায়ের সাথে কথা বলার কিন্তু তার চেষ্টা সফল হলো না।আদিব বুঝলো তার মা নিরাবতার মাধ্যমে নিজের রাগ প্রদর্শন করছে।গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।রাতের খাবার শেষ করে ফিরে আসলো নিজের ঘরে।ঘরে এসে নিজের বিছানা ঠিক করে তাতে পিঠ রাখতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেল ।মা এসেছে ভেবে তড়িঘড়ি দরজা খুলল।দরজা খুলতেই দেখতে পেল দাদি দাঁড়িয়ে আছে।দাদিকে সেই বিকেলে সেজ চাচার ওখানে দেখার পর আর চোখে পড়েনি আদিবের।মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করায় জানতে পেরেছিল সেজ চাচার বাড়ি থেকে তখনো আসেনি দাদি।আদিব মনে করেছিল আজ হয়ত দাদি সেখানেই থাকবে। জাহানারার অসুস্থতার পর থেকে তার দাদি বেশিরভাগ সময় সেজ চাচার ওখানেই থাকে।তাই দাদির বাড়ি ফেরা নিয়ে মাথা ঘামায় নি।

দাদিকে ভেতরে আসতে বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো আদিব।দাদির দিকে লক্ষ্য করে দেখলো তাকে একটু অন্যরকম লাগছে।ভেতরে ঢুকলো জাহানারা বেগম, ধীর পায়ে আদিবের বিছানায় গিয়ে বসলো।আদিব দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে দাদির পাশে এসে বসলো।দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-কি হয়েছে দাদি?

জাহানারা বেগম হয়ত কিছু ভাবছিল, আদিবের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো তার।আদিবের প্রশ্নের জবাব বাদ দিয়ে তিনি আদিবের দুই হাত চেপে ধরলেন। আকুতি মাখা কণ্ঠে বললেন,

-দাদু আমার জান খুব ভালো মেয়ে।ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। দয়াকরে ওর ভালোবাসা পায়ে মাড়ি‌ও না।

দাদির কথায় ভড়কে গেল আদিব।দাদির কাছ থেকে এমন কিছু শুনবে বলে আশা করেনি সে।আদিব যতদূর জানে তার দাদি বিচক্ষণ মানুষ, সে এমন আবদার করতে পারে সেটা আদিবের কল্পনাতীত ছিল।দাদির একের পর এক আকুতিতে মিইয়ে গেল আদিব।অনেক কষ্টে বলল,

-দাদি তুমি অন্তত বোঝার চেষ্টা করো আমাকে। জাহানারা প্রতি আমার মনে কোন অনুভূতি নেই।আমি কীভাবে জোর করে নিজের অনুভূতি বদলাবো।আমি যদি আমাদের সম্পর্কে সম্মতি দিও, তাহলে সেটা মনের বিরুদ্ধে হবে।আর আমি আমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে যেখানে নিজে সুখে থাকতে পারবো না, সেখানে আরেকজন কে কীভাবে সুখে রাখবো।মনের উপর জোর করে সম্পর্ক তৈরি না হয় করলাম, কিন্তু সেটা জোর করে টিকিয়ে রাখবো কতদিন!

-সম্পর্কের নাম হলে মনে তখন এমনিতেই অনুভূতি তৈরি হবে।আমাকে নিরাশ করো না দাদু। মেয়েটার ঐ অবস্থা আমি আর দেখতে পারছি না।আজ আবার সালেহা গায়ে হাত তুলেছে। তোমার জন্য মরতে বসেছে তবুও তোমাকে ভুলতে নারাজ মেয়েটা। কাউকে কতক্ষনি ভালোবাসলে কেউ এমন করতে পারে সেটা একবার ভেবে দেখেছ!তুমি না হয় তোমার পছন্দের কথা আমাকে বলো আমি জাহানারা কে সেইভাবে গড়ে দেব।

-দাদি ব্যাপারটা পছন্দ অপছন্দের নয়!আমি ঠিক তোমাকে বোঝাতে পারছি না। আমার ভালো লাগে না ওকে। তুমি ওর দিকটা দেখছো আমার দিকটা একটু ভাবছো না কেন!

থামলো আদিব। জাহানারা বেগম নাতির কথার প্রেক্ষিতে আর কোন কথা খুঁজে পেল না।বিবশ নয়নে শূন্যে তাকিয়ে র‌ইলো কিছুক্ষণ। তারপর স্বগোতক্তি করে বলল,

-সবার দিক বুঝছি আমি। কিন্তু কি করবো ?মেয়েটাকে অমন ধুকে ধুকে মরতে দেখতে পারছি না।কি কুক্ষণে যে আমি ওকে বলেছিলাম জায়েদ কে আশরাফের দেওয়া কথাটা।ঐ কথায় মেয়েটার কাল হলো।আমার জন্য মেয়েটার আজ এই দষা।আমার জন্য।

শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলো জাহানারা বেগম।আদিবের ভেতরটা কেমন যেন নড়ে উঠলো।দাদিকে এতোটা অসহায়, এতোটা হতাশ তার জ্ঞান হওয়ার পর কখনো দেখিনি সে। হঠাৎ তার মন বলে উঠলো,”আদিব তোর একটা হ্যাঁ তে যদি সবাই খুশি হয় ,ভালো থাকে, তাহলে সমস্যা কোথায়? তাছাড়া জাহানারা এখন নরম কাদার মতো। ওকে নিজের মনের মতো যে ছাঁচে গড়ে নিবি সেই ছাঁচে তৈরি হবে। একবার না হয় ভেবে দেখ।”

-আপনার থেকে এমনটা আশা করিনি মা।

তানিয়ার তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ভাবনা ছিন্ন হলো আদিবের।সে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো।মায়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে তার আগে তানিয়া হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল তাকে।চুপসে গেল আদিব। তানিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বলল,

-আপনি আমাকে কখনো মন থেকে মেন নেন নি সেটা আমি জানতাম। কিন্তু তাই বলে আমার সন্তানদের‌ও কখনো আপন ভাবেন নি, সেটা জানা ছিল না।

থামলো তানিয়া, একটা দম নিল। জাহানারা বেগম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তানিয়া পাথর কঠিন কণ্ঠে ফের বলল,

-আপনার নাতনি মরলো কি বাঁচলো তা আমার কিংবা আমার ছেলের দেখার প্রয়োজন নেই।তার মা আছে বাপ আছে তারা দেখুক । আপনি তাদের বলুন মেয়েকে সামলাতে তাছাড়া অমন বেহায়া মেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যা‌ওয়ায় ভালো।

-ব‌উমা!

-মা প্লিজ স্টপ।আমি দাদির সাথে কথা বলেছি তো।তুমি শুধু শুধু কথা বাড়িও না।এখন রেগে আছো কি বলতে কি বলছো নিজেও বুঝতে পারছো না।তুমি প্লিজ ঘরে যাও।

মা আর দাদির মাঝে বলে উঠলো আদিব। জাহানারা বেগম উঠে দাঁড়ালো।সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে এলো আদিবের ঘর থেকে।বাইরে বের হ‌ওয়ার সময় অশ্রু শিক্ত চোখ দুটো মুছে নিলেন আঁচল দিয়ে। আশরাফ তখন সবে মাত্র বাড়ি ফিরেছে, মায়ের দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখটা দেখে বিচলিত হলো সে। এগিয়ে এসে বারবার জানতে চাইলো কি হয়েছে। জাহানারা বেগম কিছু হয় নি বলে পাশ কাটাতে চাইলেও আশরাফ তার কথায় ভুলল না। ইদানীং স্ত্রী রুক্ষ্ম ব্যবহার গুলো বেশ চোখে পড়ছে তার।সুযোগ পেলেই জায়েদের আর্থিক অবস্থা আর সালেহাকে নিয়ে নানান ধরনের বাজে কথা বলছে। সবসময় চেষ্টা করছে ওদের ছোট করার।তাদের পরিবার নিও বিভিন্ন কথা বলা শুরু করেছে।আদিবের বাইরে যা‌ওয়ার জন্য বাবার বাড়ি থেকে টাকা নিচ্ছে এ নিয়েও খোঁটা দিতে পিছপা হচ্ছে না। আশরাফ ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবং অযথা অশান্তির ভয়ে এ যাবৎ চুপ করে ছিল কিন্তু আজ মায়ের অশ্রু শিক্ত নরম চোখ দুটো দেখে নিজকে সামলাতে পারলো না।হাক ছাড়লো তানিয়ার নাম ধরে।তানিয়া বেরিয়ে এলো আদিবের ঘর থেকে ।আদিব‌ও মায়ের পিছু পিছু আসলো।তানিয়া কে দেখেই আশরাফ তিরিক্ষি মেজাজে জানতে চাইলো সে কি বলেছে জাহানারা বেগম কে।তানিয়া শ্বাশুড়ির পরে আগে থেকেই চটে ছিল। আশরাফের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। জাহানারা বেগমের উপর ছেলের কাছে কথা লাগানোর আরোপ করে ছি : ছি : করে উঠলেন। তানিয়ার মিথ্যা আরোপে আশরাফের মেজাজ আরো চড়া হলো সে রাগান্বিত কণ্ঠে হুংকার ছেড়ে তানিয়াকে সংযত হতে বলল।তানিয়া আশরাফের কথায় সংযত তো হলোই না বরং আরো তেতে গেল।মুখে যা আসলো তাই বলতে লাগলো। পরিশেষে জাহানারা বেগম তার সংসারে অশান্তির মূল কারণ সেটা বলে থামলেন।মায়ের নামে কটু কথা শুনে রক্ত মাথায় চড়লো আশরাফের সে রুখে গেল তানিয়ার দিকে।আদিব ঢাল হয়ে দাঁড়ালো মায়ের সামনে। জাহানারা বেগম আশরাফের হাত চেপে ধরলো।তানিয়া যেন এবার নিজের হুঁশ জ্ঞান হারালো দারাজ কণ্ঠে ঘোষণা দিল, হয় এই বাড়ি জাহানারা বেগম থাকবে না হয় তিনি।তার কথা শুনে আশরাফ বলল তানিয়া চাইলে এখুনি চলে যেতে পারেন কিন্তু তার মা কোথাও যাবে না। আশরাফের কথা শেষ হতেই তানিয়া নিজের ঘরে ছুটলো। নিজের জিনিস পত্র ব্যাগে ভরতে লাগলো।আদিব মা বাবাকে শান্ত করার,তাদের বোঝানোর এত চেষ্টা করলো কিন্তু কেউ তার একটা কথা শুনলো না।তানিয়া নিজের ব্যাগ গুছিয়ে যখন বসার ঘরে এলো আশরাফ তখন সোফায় বসা। জাহানারা বেগম তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। জাহানারা বেগম তানিয়ার হাতে ব্যাগ দেখে উঠে এলো, তানিয়ার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম গলায় বললেন তার কোন কথায় যদি তানিয়া কষ্ট পেয়ে থাকে তাহলে সে মাফ চাইছে কিন্তু তানিয়া যেন এমন রাগারাগি করে কোথাও না যায়। শ্বাশুড়ির কথায় হয়ত মন নরম হলো তানিয়ার।তবে ভেতরে গেল না সে ঠায় দাঁড়িয়ে র‌ইলো চৌকাঠে। জাহানারা বেগম শেষ মেষ ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন,

-ব‌উমা তুমি ঘরে যা‌ও।এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে, না হলে আমি এক্ষুনি জায়েদের ওখানে চলে যেতাম।কাল ভোরে ঠিক চলে যাবো।আর রাগ করে না।যাও মা ভেতরে যাও।

-তুমি কোথাও যাবে না।যা‌ওয়ার হলে…

-আর একটাও বাজে কথা না খোকা।আমার কথার উপরে একটাও কথা বলবি না।বাইরে থেকে এসেছিস ,ঘরে যা ফ্রেশ হ‌।আমি তোর সাথে কাল কথা বলবো।

আশরাফের কথা শেষ না হতেই গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল জাহানারা বেগম। আশরাফ মায়ের কথা অমান্য করলো না। উঠে চলে গেল নিজের ঘরে।তানিয়াও ব্যাগ রেখে গেস্ট রুমে গিয়ে সিধালো।মা বাবা চলে যেতেই আদিব মায়ের হয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো দাদির কাছে। জাহানারা বেগম আদিবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-ব‌উমার কথায় আমি কিছু মনে করিনি দাদু।আমি তো জানি ও রগচটা ধরনের, অল্পতে রেগে যায়।আর তাছাড়া তোমার মা চাচিদের আমি আমার সন্তানের মতো দেখি । সন্তানের কথায় রাগ করা যায়!

ম্লান হাসলো জাহানারা বেগম। তারপর কিছু একটা মনে করে আদিবের কাছে জানতে চাইলো,

-দাদু তোমার‌ও কি মনে হয় আমি তোমার, তোমাদের ভালো চাই না?

-না।আমার একদম তেমন মনে হয় না।আমি তো চিনি আমার দাদিকে।জানি সে কেমন।তুমি প্লিজ মায়ের কথা মনে নিও না।

-নিচ্ছি না।তুমি যা‌ও ঘরে যাও।রাত অনেক হয়েছে।না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে।যাও।

জোর করে আদিব কে ঘরে পাঠালো জাহানারা বেগম।দাদির কথা শুনে আদিব ঘরে আসলেও ঘুম হলো না।সারারাত উশ খুশ করেই কাটলো তার। ঘুমহীন ভারি মাথা নিয়ে বিছানা ছাড়লো আদিব।ঘর ছেড়ে বের হয়ে বাগানে হাঁটা হাঁটি করলো কিছুক্ষণ তারপর ভেতরে ঢুকে দাদির ঘরের দিকে চোখ যেতেই দেখলো দাদির ঘরের দরজা খোলা।কাল রাতের কথা মনে হতেই আদিবের মস্তিষ্ক সচল হলো।দাদি তার মায়ের উপর রাগ করে চলে গেল কিনা সেটা দেখতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো দাদির ঘরে।ঘরে ঢুকতেই দেখলো দাদি নামাজের পাটিতে সেজদা রত অবস্থায় আছে।আদিব ঘড়ি দেখলো।ফজরে ওয়াক্ত পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।দাদি নফল নামাজ আদায় করে, কিন্তু কখনো এত দেরি তো হয় না। অজানা অশনি সংকেত ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো তার।

চলবে, ইনশাআল্লা

সৌরকলঙ্ক পর্ব-০৫

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৫

আদিবের বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক বেশি সময় নিল না এটা বুঝতে যে তার বাবা কোন এক কালে জাহানারার সাথে তার বিয়ে দিবে বলে সেজ চাচাকে কথা দিয়েছিল।মা এখন যেটা মানতে চাইছে না।দাদি এবং মায়ের বলা কথার সারমর্ম বুঝতে পেরে ভেতরটা বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল আদিবের।গলা দিয়ে আর খাবার নামলো না তার।খা‌ওয়ার মাঝপথে খাবার রেখে উঠে দাঁড়ালো সে।জাহানারা বেগম তাকে এভাবে উঠতে দেখে জানতে চাইলেন কি হয়েছে?আদিব কোন মতে পেট ভরে গেছে বলে স্থান ত্যাগ করলো।

জাহানারার সাথে নিজেকে ভেবে সে রাতে ভালো ভাবে ঘুম হলো না আদিবের।পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই বাবার সামনে উপস্থিত হলো।কোনো ভণিতা ছাড়া বাবাকে বলল,

-“বাবা আমি জাহানারা কে বিয়ে টিয়ে করতে পারবো না।”

আশরাফ খবরের কাগজ পড়ছিল, ছেলের কথা শুনে সেটা ভাজ করতে করতে বলল,

-কেন?

-আমার তাকে ভালো লাগে না।চাচাতো বোন হিসাবে সে ঠিক আছে, কিন্তু জীবন সঙ্গী হিসেবে আমি তাকে ভাবতে চাই না‌।

-ঠিক আছে।

আশরাফের গলার স্বর একদম স্বাভাবিক।আদিব বাবার মুখ পানে অবাক চোখে চাইলো।বাবা যে তার কথা এত সহজে মেনে নেবে সেটা সে ভাবতে পারেনি।আদিব কে নিজের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আশরাফ আদিবকে জিজ্ঞেস করল,

-আর কিছু বলবে?

আদিব দুই দিকে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে কিছু বলবে না। আশরাফ খবরের কাগজের ভাজ খুলে আবার সামনে ধরলো।আদিব চলেই আসছিল কিন্তু কি মনে করে দাঁড়ালো।বলল,

-বাবা তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?

-বলো।

খবরের কাগজে চোখ রেখেই বলল আশরাফ।আদিব একটু সময় নিল।নিজ মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল একবার। তারপর বলল,

-বাবা তুমি জ্ঞানী মানুষ।আমার থেকে বেশি জানো তুমি।আমার কথায় কিছু মনে করো না তবে আমার মনে হচ্ছে সেজ চাচাকে আমার আর জাহানারার বিয়ের বিষয়ে কথা দেওয়া উচিত হয় নি তোমার।

ছেলের কথায় ঘাড় উঁচু করে তার দিকে তাকালো আশরাফ। বাবার চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামালো আদিব। আশরাফ কিছুক্ষণ ছেলের দিকে সেভাবেই তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ছোট করে বলল,

-হুম।

নিজের কথা শেষ করে আশরাফের সামনে থেকে সরে এলো আদিব। এরপর থেকে অকারণেই জাহানারার প্রতি একটা বিরক্তি কাজ করতে লাগলো আদিবের মনে।সে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে লাগলো জাহানারা কে।এভাবে সময় অতিবাহিত হলো।
নিজের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হলো আদিব। জাহানারা নামক মেয়েটা মোটা মোটা অ্যাডমিশন ব‌ইয়ের আড়ালে ঝাপসা হলো। এরপর একদিন বিকেলের কথা অনেকদিন পর ছাদে গিয়েছিল আদিব। ছাদ থেকে সেজ চাচাদের বাড়ির উঠানে চোখ যেতেই দেখলো সেজ চাচি চুলায় রান্না করা খড়ি কাঠ নিয়ে জাহানারা কে শাসাচ্ছে।আর জাহানারা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।দূর থেকে চাচির কথা তো কিছু বোঝা গেল না তবে মেয়েটা যে আবার কোনো অকাজ করছে সেটা বেশ বুঝলো আদিব।মন আরো একবার বলে উঠলো, “আদিব অ্যান্ড জাহানারা!” নো চান্স।এর ঠিক বেশ কিছু দিন পর এক শেষ বিকেলের সময়, আদিব কোন এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছিল তখন রাস্তা আগলে দাঁড়ালো জাহানারা। জাহানারার হঠাৎ আগমনে ভ্রূতে ভাঁজ পড়লো আদিবের।সে জাহানারার মুখের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো মেয়েটাকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। চারদিকে ফাগুনের দমকা বাতাস থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা দরদর করে ঘামছে ,হাতটাও কেমন যেন একটু কাঁপছে তার। জাহানারাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করার পর আদিবের মনে হলো মেয়েটা হয়ত অসুস্থ।সে নরম গলায় বলল,

-জাহানারা তুমি ঠিক আছো?

আদিবের ভারি গলায় একটু কেঁপে উঠলো জাহানারা।শরীরের কম্পন দৃশ‌্যমান হলো।আদিবের চোখের দিকে ভীতু চোখে চেয়ে চোখে নামিয়ে নিল সে।চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানলো ভেতরে।বাধো বাধো গলায় বলল,

-আমি আপনাকে ভালোবাসি আদিব ভাই।

জাহানারার কম্পিত কণ্ঠ।আদিব বাকরুদ্ধ জাহানারার সাহস দেখে।সে তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জাহানারা দিকে।তার মন চাইলো এমন নির্লজ্জতার জন্য মেয়েটার ফরসা গালে চটাস করে একটা চড় বসাতে। কিন্তু সম্পর্কের দূরত্ব অনুভব করে মনের চাওয়া মনেই দাবিয়ে দিল। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।ফোঁস করে একটা উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

-বাড়ি যা‌ও জাহানারা।

কথাটা বলেই নিজের পথের হাঁটা ধরলো আদিব। জাহানারা তার প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ যেটা আদিব বুঝতে পারলেও পিছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।
বাড়ি ফিরে সোজা দাদির ঘরে ঢুকলো আদিব।দাদিকে জানাল তাকে বলা জাহানারার কথাটা।আদিবের কথা শুনে জাহানারা বেগমের মুখে অন্ধকার নামলো।সে আদিব কে কোনোরকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলল জাহানারার বলা কথাটা আদিব যেন আর কাউকে না বলে।এ কথা জানাজানি হলে জাহানারার বদনামি হবে , পরিবারের মধ্যে অশান্তি হবে।সে সময় করে সালেহাকে জানাবে।দাদির কথা শুনে আদিবর‌ও তেমনটাই মনে হলো।সে বাধ্য ছেলের মত দাদির কথা মেনে নিল।চেপে গেল জাহানারার সরল স্বীকারোক্তি।সেই বিকেলের এক খণ্ড স্মৃতি মুছে দিল নিজের মন থেকে।
এরপর থেকে জাহানারা কে আগের থেকে আরো বেশি এড়িয়ে চলতে লাগলো আদিব।তবে সমস্যা হলো আদিব যত বেশি জাহানারা কে এড়িয়ে চলতে চাইলো জাহানারা যেন তোতবেশি তার সামনে ঘোরাফেরা করতে লাগলো।সেদিনের পরে আদিবকে জাহানারা কিছু না বললেও নিজের চাতক পাখির নেয় অধীর দৃষ্টি দিয়ে অপ্রস্তুত করতে লাগলো যেখানে সেখানে।জাহানারার সেই অধীর দৃষ্টি গায়ে বাঁধতো আদিবের, বিরক্ত লাগতো তার।একটা মেয়ে কীভাবে এতোটা নির্লজ্জ হতে পারে সেটা ভেবে ভেবে রাগ হত জাহানারার উপর।তবে কোন এক অজ্ঞাত কারণে জাহানারা কে কিছু বলতে পারতো না সে। মাঝে মাঝে জাহানারা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি কারণে অগ্নি চোখের দৃষ্টি ফেলতো জাহানারা উপর।ব্যাস এতটুকুই। এর বেশি সে জাহানারা সাথে কঠোর হতে পারতো না। জাহানারার জন্য‌ সেজ চাচার বাড়ির রাস্তা ভুলতে হলো আদিবকে।সজীবের সাথে দেখা সাক্ষাৎ রাস্তা ঘাটেই সারতে হলো। আদিব নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল জাহানারা থেকে দূরে থাকার। কিন্তু আদিবের উপস্থিত কিংবা অন‌উপস্থিতি কোনোটাই তেমন প্রভাব ফেলল না জাহানারার অনুভবে। সে নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে ভালোবাসতে লাগলো আদিব কে। সময় গড়ালো।বছর পেরুলো।আদিবের প্রতি জাহানারার ভালোবাসার তীব্রতা বৃদ্ধি পেল।মরিয়া হয়ে উঠলো সে আদিব কে বোঝাতে, যে সে আদিবকে কতটা ভালোবাসে। আদিব সবটা দেখেও না দেখার ভ্যান করে গেল।আদিবের এই নির্লিপ্ততা জাহানারা কে যেন আরো উতলা করে তুলল।সে কোন কিছু না ভেবেই একদিন আবার আদিবের সামনে দাঁড়ালো।চোখ না তুলেই কম্পিত কণ্ঠে বলল,

-আদিব ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি আপনি…

-আদিব ,জাহান !

মেজ চাচির হঠাৎ আগমনে থামতে হলো জাহানারা কে। কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো সে। তড়িঘড়ি নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ডালিয়া এগিয়ে আসতেই আদিব তাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো।আদিবের সাথে কথা শেষ করে জাহানারার ঘাবড়ে যা‌ওয়া মুখের দিকে তাকালো ডালিয়া। জিজ্ঞেস করল,

-এই জাহান এভাবে ঘামছিস কেন ?কি হয়েছে?

জাহানারা চাচির কথায় আমতা আমতা করে বলল,

-নিতুর সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম তো তাই ঘামছি। আচ্ছা চাচি থাকেন আমি আসছি।

কথাটা বলেই দৌড়ালো জাহানারা। জাহানারার গমনরত পথের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ডালিয়া।তার চোখে মুখে সন্দেহীন ভাব।আদিবের চোখে এড়ালো না যেটা।তার মনে হলো এবার আর চুপ থাকলে চলবে না।সেজ চাচিকে ব্যাপারটা জানাতে হবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ পা বাড়ালো সে সেজ চাচার বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে ছোট খালাকে নামতে দেখে পথ বদলাতে হলো।ছোট খালাদের আগমনে জাহানারার কথা সরে গেল আদিবের মাথা থেকে। ব্যস্ত হলো সে তাদের নিয়ে।

দুই দিন পরে আবার জাহানারার সাথে দেখা হল আদিবের। আদিব তার খালাতো বোন সিনথিয়া কে নিয়ে তাদের বাড়ির পাশে দিঘির পাড়ে গিয়েছিল। সেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে জাহানারা আর নিতুকে দেখতে পেল।আদিব সিনথিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল তাদের। সিনথিয়ার সাথে জাহানারার পরিচয় করবার সময় জাহানারার মুখটা থমথমে দেখালো।আদিবের কেমন যেন লাগলো বিষয়টা। কিন্তু সেভাবে পাত্তা দিল না সে।সিনথিয়াকে নিয়ে দিঘির পাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটা হাঁটি করে র‌ওনা দিল বাড়ির পথে। যাওয়ার আগে নিতুকে বলল সে আর জাহানারা যেন তাদের সাথে আসে।কথাটা আদিব নিতুকে বললেও তার হয়ে জাহানারা উত্তর দিল। বলল তারা আরো কিছুক্ষণ থাকবে সেখানে।জাহানারার কটকটে গলাটা কেমন যেন শোনাল আদিবের কাছে। আপনা আপনি ভ্রূতে ভাজ পড়লো তার। জাহানারা কে উপেক্ষা করে সে নিতুর উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলল তারা যেন বেশি দেরি না করে। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে যায়।নিতু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেও জাহানারা চোখ মুখ কাঠ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদিবের দিকে।আদিব সেটা দেখেও না দেখার ভান করে সিনথিয়া কে নিয়ে চলে আসলো সেখান থেকে।
কিছুদূর আসার পর আদিবের মনে হলো তাদের পিছু নিয়েছে কেউ।সে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো।দেখলো নিতু আর জাহানারা আসছে।নিতু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাটলেও জাহানারার হাঁটার ধরন ভিন্ন। অস্বাভাবিক।আদিব লক্ষ্য করে দেখলো শুধু হাঁটার ধরন না জাহানারাকেও অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।টকটকে লাল চোখ,গনগনে দৃষ্টি,ফোলানো নাকের পাটা,আর ফ্যাকাশে মুখ। আদিব ভ্রূ কুঁচকালো।তবে থামলো না।ঘাড় ফিরিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে সিনথিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যেত লাগলো।

মা আর ছোট খালার জোরাজুরিতে আদিব লন্ডনের ******মেডিকেলে ভর্তির জন্য *****টেস্ট দিয়েছিল যার প্রথম ধাপে সে উত্তীর্ণ হয়েছে এখন দ্বিতীয় ধাপ পার করতে পারলে অ্যাডমিশন কনফার্ম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লন্ডনে পড়াশোনার যে খরচ সেটা হয়ত আশরাফ টানতে পারবে না।আদিবের এ কথা শুনে সিনথিয়া জানালো তার বড় খালা মানে তানিয়া না কি বলেছে আদিবের নানার কাছ থেকে হেল্প নিবে। সিনথিয়ার কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য থমকালো আদিব।তার মা বাবা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল একে অপরকে, যার কারণে নানা তাদের বিয়ে মেনে নেয় নি।আদিবের জন্মের পর নানার রাগ কমলেও বাবাকে এখনো তারা বক্র চোখেই দেখে।আদিব কিংবা তার বোনেরা‌ও তেমন যায় না নানা বাসায়।এ অবস্থায় ছেলের পড়াশোনার জন্য নানার কাছ থেকে সাহায্য কিছুতেই নেবে না তার বাবা। সিনথিয়ার মুখে মায়ের পরিকল্পনা শুনে বেশ চিন্তিত হলো আদিব।তার কেন যেন মনে হলো সামনে বেশ বড় সড় একটা ঝামেলা হতে চলেছে।আদিবকে অন্যমনস্ক দেখে তার বাহুতে হাত রাখলো সিনথিয়া।আদিবের ভাবনায় ছেদ পড়লো। সিনথিয়া জানতে চাইলো আদিব কি ভাবছে।আদিব নিজের মনের ভাব লুকিয়ে অন্যকথা তুলল। সিনথিয়ার সাথে কথার মাঝে আদিব লক্ষ্য করলো নিতু আর জাহানারা তাদের পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে‌।ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে সিনথিয়ার কথায় মনোযোগ দিল আদিব। সিনথিয়া তার স্কুলের কথা বলছে।তাদের পরীক্ষা ব্যবস্থার কথা বলছে।আদিব মন দিয়ে সেসব শুনছে আর অলস পায়ে হাঁটছে।তার অন্য কোনোদিকে খেয়াল নেই।সে লক্ষ্য‌ই করলো না জাহানারা কে তার দিকে আসতে।যখন লক্ষ্য করলো তখন জাহানারা আর তার মধ্যে এক হাতের দূরত্ব।ডুবন্ত সূর্যের আলসে রোদে জাহানারা ছায়া সিনথিয়ার উপর পড়তেই আদিব তাকালো সামনে। জাহানারার অশ্রু শিক্ত জ্বলজ্বলে চোখ দুটো দেখতেই অকারণে ধক করে উঠলো ভেতরটা। হঠাৎ কি হলো মেয়েটার এটা ভেবে উদ্বিগ্ন হলো আদিব।পুরু ঠোঁট নেড়ে জানতে চাইলো,

-কি হয়েছে জাহানারা?

আদিবের চিন্তিত কণ্ঠ স্বর। জাহানারা পলক ঝাপটালো সাথে সাথে ভাসা ভাসা চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।আদিব কে বাকরুদ্ধ করে হুট করে তাকে জড়িয়ে ধরলো জাহানারা।জাহানারার আকস্মিক কাণ্ডে চমকে উঠলো নিতু।ভড়কে গেল আদিব। সিনথিয়া একটু অবাক হলো। উপস্থিত তিন জনের মুখে খেলে গেল তিনরকম অভিব্যক্তি।জাহানারা আদিব কে জড়িয়ে ধরে কান্নারত কণ্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

-আদিব ভাই,আপনি আমার। শুধু আমার…

নিজের কথায় দাড়ি টানতে পারলো না জাহানারা।তার আগে আদিব নিজের থেকে জাহানারা কে ছাড়িয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল তার গালে।আদিবের কঠোর হাতের থাবায় ছিটকে পড়লো জাহানারা।নিতু তড়িঘড়ি ধরলো তাকে।আদিব আহত সিংহের নেয় ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।পায়ের কাছে পড়ে থাকা ইটের আদলায় সজোরে একটা লাথি মেরে গর্জে উঠে বলল,

-আর একটা ফালতু কথা বললে আমি তোমার জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলবো বেয়াদব!খুব বাড় বেড়েছো না তুমি!

আদিবের রাগান্বিত কণ্ঠ। জাহানারা কেঁপে উঠলো।তার সাথে নিতুও যেন একটু চমকালো।আদিবের এমন রাগ দেখে সিনথিয়া‌ও যেন একটু ভয় পেল।আদিবের সেই বিধ্বংসী রাগ দেখে নিতু কিংবা সিনথিয়ার সাহস হলো না একটাও শব্দ করতে।নিতু ভয়ে জাহানারার বাহু ধরে তাকে ওঠানোর চেষ্টা করতে লাগলো।তবে জাহানারা উঠলো না।সে বিবস হয়ে জেদ করে বসে র‌ইলো ধুলোর মাঝে।যেটা দেখে আদিবের আরো রাগ হলো।সে ধমকে উঠলো,

-এই মেয়ে ওঠো!ওঠো বলছি।

আদিবের ধমকে কাজ হলো, উঠে দাঁড়ালো জাহানারা।আদিবের উত্তপ্ত শ্বাসে ভারি হলো পরিবেশ।সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো আদিব। নিতুর উদ্দেশ্যে গমগমে গলায় বলে উঠলো,

-নিতু তুমি ওকে নিয়ে সোজা সেজ চাচার বাড়ি যাবে ।আমি আসছি।

নিতু তড়িঘড়ি ঘাড় নাড়ালো। সম্মতি জানালো। জাহানারা কে অনেকটা টানতে টানতে নিয়ে গেল সে।আদিব পিছু গেল তাদের। সিনথিয়া কে বাড়ির গেটে রেখে পা বাড়ালো সেজ চাচার বাড়ির উদ্দেশ্যে।

সেজ চাচার বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই জাহানারা কান্নার আ‌ওয়াজ আর সালেহার রাগান্বিত কণ্ঠস্বর পায়ের গতি ধীর করলো আদিবের।বুঝতে পারলো তার বলতে আসা কথা চাচি ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছে।আদিব আর ভেতরে ঢুকলো না ফিরে আসলো।বাড়ি ঢুকতেই বসার ঘরে তানিয়া ধরলো তাকে কড়া গলায় জানতে চাইলো,

-তোমার আর জাহানারার মধ্যে কি চলছে?

মায়ের কথায় আকাশ থেকে পড়লো আদিব। সিনথিয়ার দিকে তাকালো একবার। সিনথিয়া দুইদিকে মাথা নাড়ালো যার অর্থ সে কিছু বলেনি।আদিব চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানলো।নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

-কিছু চলছে না।

-কিছু যখন চলছে না তাহলে লিচু বাগানের রাস্তায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?

-আপা!

তানিয়ার লাগামহীন ভাষা।সোনিয়া বাধ সাধলো।আদিবের লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাইলো।চোখ তুলে তাকাতে পারলো না সে মায়ের দিকে। জাহানারা উপর তৈরি হওয়া কিছুক্ষণ পূর্বের রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো আবার।মন হলো মেয়েটাকে আরো দুটো চড় লাগাতে পারলে শান্তি হত।

-আদিব, দীপ্তি যেটা করছে সেটা আমি এখনো মানতে পারেনি।এখন তুমি যদি আবার এক‌ই কাজ করবে বলে ভেবে থাকো ,তাহলে আগে থাকতে বলে দা‌ও আমাকে। মানুষের কাছে লজ্জিত অপমানিত হ‌ওয়ার চেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ি।

আদিব বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মায়ের দিকে।সোনিয়া বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

-আপা কি বলছিস?মাথা ঠিক আছে তোর।

-না, মাথা ঠিক নেই আমার।ও জানে না ;ওর বড় বোনের কীর্তির জন্য আমাদের কতটা অপমানিত হতে হয়েছে! তারপর আবার কোন সাহসে ঐ মেয়ের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রং তামাশা করে! লজ্জা করে না ওর!

চোখে পানি, কণ্ঠে তেজ তানিয়ার।ঠিক সেই সময় বাড়িতে ঢুকলো আশরাফ। তানিয়ার চোখ মুখের দশা দেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো কি হয়েছে। আশরাফের কথা যেন তানিয়ার রাগের আগুনে ঘৃতাহুতি দিল।সে চেতে উঠে বলল,

-তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। তোমার ছেলে তোমার আশা পূরণ করার জন্য একধাপ এগিয়ে গেছে। এবার শান্তি হবে তোমার।যা‌ও ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করো। তোমার সেজ ভাইকে খবর দা‌ও দুই ভাই মিলে আনন্দ করো। উল্লাস করো।

আশরাফ তাজ্জব বনে গেল তানিয়ার কথায়। তানিয়ার কথাগুলো তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।সে তানিয়ার কথা উপেক্ষা করে আদিব কে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।মায়ের কথা শুনে আদিব স্থবিরের নেয় দাঁড়িয়ে ছিল।সে চেয়েও বাবার কথার উত্তর দিত পারলো না।আদিবের মৌনতা দেখে সোনিয়া এগিয়ে এলো, জানাল কিছুক্ষণ আগের কথা।পাশের বাড়ির আতিয়ার সাহেবের স্ত্রী আদিব আর জাহানারা কে লিচু তলার রাস্তায় একে অপরের সাথে অপ্রস্তুত ভাবে দেখেছ।যেটা তিনি বাড়ি বয়ে এসে জানিয়ে গেছেন।তাই নিয়ে তানিয়া চাটছে। সোনিয়ার কথা শেষ হতেই আশরাফ তাকালো আদিবের দিকে জানতে চাইলো তার উপর কৃত আরোপের সত্যতা।আদিব লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিল।বাবা কে জাহানারা করা কাজটা বলতে তার জিভ সংকোচ বোধ করলো।আদিব কে এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে সিনথিয়া মুখ খুললো। সবিস্তারে সবটা বলল সবাইকে। সিনথিয়ার কথা শুনে তানিয়া ক্ষান্ত হলো। আশরাফ জাহানারার পক্ষ নিয়ে বলে উঠলো,

-জাহান ছোট মানুষ, আবেগের বসে ভুল করে ফেলেছে।দেখি আমি ওর সাথে কথা বলবো।

-তোমার ঐ ছোট মানুষ ভাতিজির আজ বিয়ে দিলে কাল বাচ্চা কাচ্চা হয়ে যাবে।খবরদার ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে আসবে না। তোমার ভাইকে বল মেয়েকে সামলাতে, না হলে আমি বলতে গেলে ব্যাপারটা ভালো হবে না‌ বলে দিচ্ছি!

কথা শেষ করে পায়ে গটগট শব্দ তুলে নিজের ঘরে ঢুকলো তানিয়া।আদিব‌ও ধীর পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।সেদিনের পরে তানিয়া জেদ ধরলো ছেলেকে সোনিয়ার সাথে বিদেশ পাঠানোর।সে আর এসব ছোট লোকদের মধ্যে রাখবে না‌ তার ছেলেকে।যত টাকা লাগে লাগুক দরকার হলে সে নিজের বাপের বাড়ি থেকে প্রাপ্ত সম্পদ বিক্রি করে দেবে ,তবুও ছেলেকে লন্ডন পাঠাবে।তানিয়া বাবার সাথে দেখা করলো এই নিয়ে আলোচনা করতে। তোফায়েল সাহেব মেয়ের কথা শুনে বললেন তানিয়াকে কিছু করতে হবে না। সেই আদিবের লন্ডনে যা‌ওয়া থেকে শুরু করে পড়াশোনার যাবতীয় খরচ বহন করবে। তানিয়ার বাবা তোফায়েল সাহেব বিরাট শিল্পপতি তার কাছে লন্ডনে আদিবের পড়াশোনার খরচ বহন করা তেমন কোনো ব্যাপার না কিন্তু সমস্যা হলো তার বয়স বেড়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য ছেলেদের হাতে চলে গেছে।তার এই সিদ্ধান্ত শুনে ছেলের খুব একটা খুশি হলো না।আদিবের মামারা আশরাফ কে খুব একটা পছন্দ করে না।তানিয়ার ছেলের জন্য এই সাহায্যের আবদারে তাদের এতো দিনকার আক্রোশটা যেন আর চাপা থাকলো না। আশরাফের আর্থিক অবস্থা নিয়ে তাদের পরিবার নিয়ে অনেক তীক্ষ্ণ কথা বললেন তারা।আদিব মায়ের সাথে উপস্থিত ছিল সেখানে। বাবার সম্পর্কে শ্রুতি কটু বাক্য শুনে চোয়াল শক্ত হলো তার।মামাদের মুখের উপর বলে দিল তাদের কোন সাহায্য তার লাগবে না। কিন্তু তোফায়েল একমাত্র নাতির কথায় আপত্তি জানালো।আদিব কে তিনি ভীষণ ভালোবাসে, তার জন্য নিজের সবটাও দিয়ে দিতে পারে। সেখানে এ কটা টাকা তার কাছে কিচ্ছু না।সে ছেলেদের কঠিন গলায় বলল নিজেদের ভাষা নিয়ন্ত্রণে আনতে। তানিয়া‌ও ছেলেকে কোনোমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করলো।মা আর নানার কথায় দমলো আদিব।
মায়ের অশ্রু শিক্ত আকুতিতে বাবার অপমান গলদ্ধ করলো। চুপচাপ লন্ডন ******মেডিকেলের *****টেস্টের প্রস্তুতি নিতে লাগলো। IELTS এর রেজাল্ট‌ও হাতে আসলো তার মধ্যে।এখন শুধু লন্ডন *****মেডিকেলের অ্যাডমিশন টেস্টের ধাপ গুলো ক্লিয়ার করার অপেক্ষা। রাতদিন এক করে পড়ার টেবিলে পড়ে র‌ইলো সে।আদিবের সেই কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতা সফল হলো। লন্ডন****মেডিকেলের অ্যাডমিশন টেস্টের ধাপ গুলো একে একে পিছনে ঠেলে উপরে উঠলো আদিব। কনফার্ম হলো তার অ্যাডমিশন।ছোট খালারা ততদিনে লন্ডন ফিরে গেছে।তানিয়া ছেলেকে সোনিয়ার সাথে পাঠাতে চাইলেও ভিসা টিসার নানান ঝামেলায় সেটা হয়নি।নিজের ক্যারিয়ার গোছানোর তোড়জোড়ে জাহানারাকে ভুলে বসেছিল আদিব তাছাড়া তানিয়া নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে জাহানারা কেন;তার বিষয়ে কোন খবরাখবর খবর‌ও ছেলের কাছে না আসে। কিন্তু তবুও আদিবের কানে এলো খবরটা। জাহানারা কে দেখতে আসছে আগামী কাল। জায়েদের এক কলিগের ছেলে ।এখন আংটি পরিয়ে রাখবে। জাহানারার আঠারো হলেই বিয়ে। খাওয়ার টেবিলে দাদি বলল কথাটা।কথাটা শুনে আশরাফের মুখটা কেমন যেন মলিন হলো।আদিবের খারাপ লাগলো বাবার মলিন মুখটা দেখে।তবে বাবার জন্য খারাপ লাগলেও তার কিছু করার ছিল না, জাহানারা চাচাতো বোন হিসাবে সমাদরের হলেও , জীবনসঙ্গী হিসেবে মোটেও নয়। তাছাড়া যেখানে তার মা এই সম্পর্কে ঘোর বিরোধী সেখানে সে আগাবে কি করে।আদিব একবারের জন্য নিজের অনুভূতি পাশে রেখে বাবার কথা মানলেও মা কে অখুশি করে কীভাবে আগাতো!নিজের মনে কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আদিব।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবে মাত্র ডাইনিং পৌঁছেছিল আদিব ঠিক তখন উদ্ভ্রান্তের নেয় ছুটতে ছুটতে নিতু এলো তাদের বাড়ি। আশরাফ তখন ডাইনিং টেবিলে বসা। সকালের নাস্তা করছে।নিতু হাঁফাতে হাঁফাতে এসে আশরাফের উদ্দেশ্যে বলল,

-বড় চাচা! জান হাতের শি’রা কে’টেছে, আপনি একটু চলুন তাড়াতাড়ি।

নিতুর গলা কম্পমান। আশরাফ তার কথার অর্থ বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো।হাতে পানি ঢেলে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁত পিষে বলল,

-এবার খুশি তো!

নিজের চিকিৎসার ব্যাগ টা হাতে নিয়ে সে ছুটলো নিতুর পিছনে। আদিব হতবাক হলো।বাবার প্রস্থানরত পথের দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলো।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

সৌরকলঙ্ক পর্ব-৩+৪

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৩

সজীবকে দ্রুত পায়ে সামনে আগাতে দেখে পিছু ডাকলো আদিব।সজীব তার ডাকের উত্তরে সেভাবেই সামনে আগাতে আগাতে বলল,

-পরে কথা হবে আদি। আসছি।

সজীবের বিচলিত কণ্ঠ।আদিব বুঝলো সেজ চাচার বাড়ি কিছু হয়েছে। সজীবের পিছু নিতে পা বাড়ালো সামনে কিন্তু পরক্ষণে পুরোনো কিছু ঘটনা মনে পড়তেই বেড়িয়ে নেওয়া পা থেমে গেল শূন্যে।স্থির হলো পা জোড়া।চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ফেলল।পিছিয়ে এলো।পকেট থেকে টাকা বের করে গাড়ি চালক কে তার পাওনা মিটিয়ে নিজের মালপত্র নামালো গাড়ি থেকে।গাড়ির ডিকিতে নিজের মালপত্রের সাথে সজীবের ল্যাগেজটা চোখে পড়লো তার। সজীবের ল্যাগেজটা ডিকি থেকে নামিয়ে সেটা আপাতত নিজের কাছে রাখলো।গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে গাড়ি চালককে বিদায় করে মাত্র‌ই সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আদিব ঠিক তখন চোখ গেল রাস্তার অপরপাশে‌। ল্যাম্পপোস্টের উজ্জ্বল আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেল বাবার শুকনা শরীরটা।বাবাকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে দেখা দিল মৃদু হাসির রেখা। আশরাফ অবশ্য তখনো ছেলেকে খেয়াল করেনি।সে আতিয়ার সাহেবের সাথে কথায় ব্যস্ত।আদিবদের প্রতিবেশী আতিয়ার সাহেব।আদিব চেনে তাকে।তার বাবার পুরোনো বন্ধু তিনি।আশরাফ কে ভালো করে পরখ করে আদিবের মনে হলো বাবাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।দূর থেকে বাবার মুখটা যতটুকু দেখা গেল তাতে বাবার মুখের বিষণ্ন ভাবটা তার চোখ এড়ালো না।আদিবের মন আবার বলে উঠলো কিছু একটা হয়েছে।বাবার বিষণ্ন মুখ আর বাইরের পরিবেশ দেখে মনের ভেতর খুঁতখুঁত করে উঠলো। একবার মনে হলো কারো কি কিছু হয়েছে! কিন্তু ফের মনে হলো কারো কিছু হলে তো সে জানতো।ছোট আপা কম বেশি সবার কথাই তো তাকে বলে। ফ্লাইটে ওঠার আগেও তো তার সাথে কথা হয়েছে কৈ তাকে তো তেমন কিছু বলল না।না কি কারো বাড়ি কোনো অনুষ্ঠান বাঁধলো।এটা হতে পারে।ছোট আপা তাকে বলেও ছিল নিতুর বিয়ের বিষয়ে কথা হচ্ছে।তাহলে কি নিতুর বিয়ে! কিন্তু সজীব ওভাবে ছুটলো কেন?আর বাবাকেই বা অমন মন মরা দেখাচ্ছে কেন? এতটুকু সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ভেবে ফেলল আদিব।তার ভাবনা চিন্তার মাঝেই আশরাফ লক্ষ্য করলো তাকে।ছেলেকে দেখা মাত্র একপ্রকার ছুটে এলো আশরাফ।বাবাকে নিজের দিকে আসতে দেখে ভাবনায় ছেদ পড়লো আদিবের।বাবাকে সালাম জানালো সে। আশরাফ সালামের জবাব দিল।আদিবের আসতে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না সেটা জানতে চাইলো। তারপর আদিবের মুখে নির্নিমেষ দৃষ্টি রেখে বলল,

-অনেক বড় হয়ে গেছ আদিব!

বাবার কথায় মৃদু হাসলো আদিব।বলল,

-আর তুমি বুড়ো হয়ে গেছ।

কথাটা বলেই বাবাকে জড়িয়ে ধরলো আদিব। আশরাফ‌ও হাত বাড়ালো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাতের বাঁধন শক্ত করলো।এভাবে কতসময় অতিবাহিত হলো জানা নেই দুইজনের।জায়েদের বাড়ি চিৎকার চেঁচামেচির আ‌ওয়াজে ধ্যান ভাঙল তাদের।আদিব বাবাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।জায়েদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-বাড়ির সামনে এত মানুষজন কিছু হয়েছে বাবা?সেজ চাচাদের বাড়ি

-আজ সন্ধ্যায় তোমার সেজ চাচি ইন্তেকাল করেছেন।

আদিবের কথা মাঝ পথে কেটে বলল আশরাফ।
বাবার কথায় হতবাক হলো আদিব।বিস্ফোরিত চোখে তাকালো বাবার দিকে।নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না তার।সে আবার জিজ্ঞেস করলো,

-স্যরি !কি বললে?

-সালেহা মারা গেছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়েদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল আশরাফ।আদিবের মুখ দিয়ে যেন আর কোন কথা যোগাল না। হঠাৎ ভেতরটা কেমন জানি করে উঠলো তার।চোখের সামনে ভেসে উঠলো গোলগাল আকৃতির হাস্যোজ্জ্বল এক মুখ।যে মুখে সরলতা ব‌ই কিছুই নেই।নিজের অজান্তেই চোখের কোন ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। অন্ধকার রাতে আলো আধারী তে যেটা সন্তর্পণে মুছে নিল সে।কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

-হঠাৎ কি হলো?মানে কীভাবে…?

নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না আদিব।গলার স্বর আটকে আসলো। আশরাফ বুঝলো ছেলের অসম্পূর্ণ প্রশ্নটা।বলল,

-বেশ কয়েকদিন ধরেই শরীর ভালো ছিল না সালেহার।গত কালকে একটু বেশি খারাপ হয়েছিল।জায়েদ আমাকে খবর দিলে আমি গিয়ে দেখলাম সালেহার অবস্থা তেমন ভালো না। তৎক্ষণাৎ ******* এর একটা ইনজেকশন পুশ করলাম।জায়েদ কে বললাম এতে কাজ না হলে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে।কাল রাত এগারোটা পর্যন্ত ওদের ওখানেই ছিলাম আমি। সালেহার অবস্থার উন্নতি দেখে বাড়ি ফিরেছিলাম।আজকে বিকেল চেম্বারে যাওয়ার সময় জায়েদের সাথে দেখা হলো তখন সালেহার কথা জিজ্ঞেস করায় বলল,”সালেহা ভালো আছে।কোন সমস্যা নেই।নাতনির সাথে খেলছে।”এরপর মাগরিবের পরপর আকিব ফোন করে বলল,”বড় চাচা মা কেমন যেন করছে। নিশ্বাস নিতে পারছে না। হাঁস ফাঁস করছে।”আকিবের কথা শুনে আমি দ্রুত সালেহাকে নেবুলাইজার দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার ওখানে নিয়ে যেতে বললাম।

থামলো আশরাফ।একটু সময় নিল।একটা শ্বাস টেনে ফের বলল,

-আমার ওখানে যখন সালেহাকে নিয়ে পৌঁছাল ওরা তখন অলরেডি যা হ‌ওয়ার হয়ে গেছে………!দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাসকষ্ট হ‌ওয়ার ফলে হৃদপিণ্ডে চাপ পড়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে।নেবুলাইজার ব্যবহারের আগেই হয়ত অ্যাটাক হয়েছে।সালেহা হয়ত শেষ পর্যন্ত সহ্য করার চেষ্টা করেছে যখন আর পারিনি তখন ছটফটিয়ে উঠেছে।আমি ওকে এতবার বলেছিলাম তোমার কিছু হলে জায়েদ কে বলবা। নিজের মধ্যে সব চেপে রাখবে না। কিন্তু ও আমার কথা কানে নেই নি।এর আগেও একবার শ্বাস নালীতে সর্দি এঁটে মরেই যাচ্ছিল।সেইবার আমি কাছে পিঠে ছিলাম তাই কিছু করতে পেরেছিলাম ।কিন্তু এই বার…!

আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আশরাফ। সালেহার মৃত্যু টা কেন জানি সে মেনে নিতে পারছে না ।মনে হচ্ছে একটুর জন্য মানুষটাকে বাঁচাতে পারলো না সে।তার হাটুর বয়েসি মেয়েটা চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল।
এই তো সেদিন তার চোখের সামনে জন্মালো মেয়েটা ।তার মা জাহানারা গিয়েছিল দুই সেট কাপড় নিয়ে সালেহা কে দেখতে।আসতে দেরি হচ্ছিল বিধায় বাবা তাকে ফুপুর ওখানে পাঠালো মা কে আনতে।সে গিয়ে দেখে এইটুকু একটা কাপড়ের পুঁটলিতে একটা ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে শীতের রোদে উঠানে বসে আছে মা আর ফুপু।তাকে দেখে ফুপু হ‌ই হ‌ই করে উঠলো।অনেকদিন পর ফুপু বাড়ি গিয়েছে সে,ফুপু তার খ্যাতির যত্নে কি করতে কি করে ভেবে পায় না। ছোট্ট দুধের সালেহাকে রেখে তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ফুপু। খাওয়া দাওয়া শেষ তারা সবাই বারান্দায় বসেছিল তখন
মা সালেহাকে জোর করে তার কোলে দিয়েছিল।আশরাফ মায়ের জোরাজুরিতে কোন রকমে সালেহাকে কোলে নিল।কোলের মধ্যে থাকা ছোট্ট শরীরটা আশরাফ অবাক চোখে দেখছিল। পুতুলের মতো মেয়েটাও বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল তার দিকে এরপর কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো । আশরাফ তড়িঘড়ি মায়ের কোলে দিয়ে হাফ ছেঁড়ে বাঁচলো।তার সেই তড়িঘড়ি দেখে মা আর ফুপুর সে কি হাসি।

আজও চোখের সামনে সবটা ভাসে আশরাফের।মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। সেদিনের সেই ছোট্ট সালেহা না কি মা’রা গেছে!তার চোখের সামনে বেড়ে ওঠা মেয়েটা না কি আজ তাদের সাথে নেই!এ কঠিন সত্যিটা ভাবতেও যে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে কথা গুলো ভাবছিল আশরাফ।ছেলের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো।চোখের চশমাটা খুলে ফতুয়ার প্রান্ত ভাগের কাপড়ে মুছে আবার চোখে দিয়ে বলল,

-আমি জায়েদের ওখানে যাচ্ছি দেখি কি অবস্থা ওদিকের।তুমি যাবে?

-জ্বি।

তড়িৎ জবাব দিল আদিব। আশরাফ বাড়ির দারোয়ান কে ডেকে আদিবের জিনিসপত্রগুলো ভেতরে নিয়ে যেতে বলল। তারপর বাপ ছেলে এগিয়ে গেল জায়েদের বাড়ির দিকে। সালেহার মৃত্যুর সংবাদ শুনে এরমধ্যে অনেক আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী জমা হয়েছে জায়েদের বাড়ির উঠানে।আকিবের কাজের সূত্রে পরিচিত,
তার সাথে কর্মরত সিনিয়র জুনিয়র অনেকেই ছুটে এসেছে। আশরাফের বাড়ি থেকে জায়েদের বাড়ি যাওয়ার এই স্বল্প দূরত্বের রাস্তায় অনেক পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলো আদিবের ।তবে কারো সাথে সেভাবে কথা হয়ে উঠলো না। চোখাচোখি আর সালাম বিনিময় পর্যন্ত‌ই সীমাবদ্ধ থাকলো।

জায়েদের বাড়ির সামনে মাত্রই এসে দাঁড়িয়েছিল আদিব, ঠিক তখন পিছন থেকে ভেসে আসলো গাড়ির হর্নের শব্দ।পিছন ফিরে দেখলো পরপর তিনটা গাড়ি রাস্তার ধার ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে থামলো।ভ্রূ তে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে গাড়ির বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়েই ছিল সে হঠাৎ গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে আসা মানুষটাকে দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।অবাক চোখে তাকালো সে অশ্রু শিক্ত গোলগাল সুন্দর মুখের মেয়েটার দিকে। পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলো দুইজনের মধ্যকার দূরত্ব কমতে।

আদিবের নির্নিমেষ দৃষ্টি কিন্তু অপরপাশের ব্যক্তিটি তার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।সে গাড়ি থেকে নেমেই উন্মাদিনীর নেয় ছুট তে লাগলো।কয়েক পা আসতেই রাস্তায় থাকা এবড়োখেবড়ো আদলা ইটে আঘাত লাগলো পায়ে। ভারসাম্য হারলো সে। আদিব সামনেই ছিল তার ।মুখ থুবড়ে পড়লো সে আদিবের বুকে।আদিব সযত্নে আগলে নিল সাথে সাথে।সাবধানি কণ্ঠে আ‌ওড়ালো,

-কেয়ারফুল!

আদিবের বলা সতর্ক বাণী টা মেয়েটার কানে গেল বলে মনে হলো না।সে পায়ের নিচে শক্ত মাটি ফিরে পেতেই আবার ছুটলো।শোকে তাপে বিভোর মেয়েটা এটাও লক্ষ্য করলো না যে আদিবের ঘড়িতে বেঁধে তার এক গাছি কাঁচা চুল পটপট শব্দ তুলে ছিঁড়ে গেল।যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিল ঠিক সেভাবেই প্রস্থান করলো।
আদিব তার প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়েই ছিল তখন আশরাফের বলা কথা কানে গেল।

-আকিব তো কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়েছে কিন্তু মেয়েটা যে কি করবে!

-আদিব !তুই এখানে! তোমার আক্কেল তো ভালো!ছেলেটা এতোটা পথ জার্নি করে বাড়ি ফিরল। তুমি তাকে রেস্ট করতে না দিয়ে এখানে নিয়ে এলে!

জায়েদের বাড়ির ভেতর থেকে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলল তানিয়া।কণ্ঠে তার উদ্বিগ্নতা। সেটা ছেলে ক্লান্ত শরীরে এখানে আসার জন্য না অন্য কারণে সেটা বোঝা গেল না।তবে আশরাফ কিছু আন্দাজ করলো।সে গভীর চোখে তাকালো সহধর্মিণীর দিকে। আশরাফের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো তানিয়া।বাবা মায়ের এই শীতল সমীকরণ চোখ এড়ালো না আদিবের।সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,

-আমি ঠিক আছি মা।

-সত্যি তো?

-হুম।

-তাহলে চোখ মুখ অমন শুকনা শুকনা লাগছে কেন?খারাপ লাগলে না হয় বাড়ি যা ।রেস্ট নে।সালেহাকে নিয়ে যাওয়ার আগে না হয় দেখে যাস।

-আমি সত্যি ঠিক আছি মা।তুমি অযথা চিন্তা করো না।

ছেলের কথায় আশ্বস্ত হলো তানিয়া।ছেলের কোন অসুবিধা হলে যেন তাকে জানায় এ কথা কয়েকবার মনে করিয়ে দিয়ে ফিরে গেল ভেতরে।তানিয়া চলে যেতেই শাহেদ উপস্থিত হলো সেখানে।আদিব কে দেখে কিছুটা অবাক হলো সে।চোখ মুখ দেখেই বোঝা গেল এখানে এই মুহূর্তে আদিব কে আশা করেনি সে।আদিব ছোট চাচাকে সালাম দিল।শাহেদ তার সালামের উত্তর দিয়ে বলল,

-এমন এক পরিস্থিতিতে এলি যে ভালো-মন্দ টুকুও মন খুলে জিজ্ঞেস করতে পারছি না।তা কখন এলি?

-এই তো কিছুক্ষণ আগে।

-সেজ ভাইয়ের সাথে দেখা করেছিস?

-না। মাত্রই এলাম এখনো দেখা করিনি।

-ও।

আদিবের সাথে কথা শেষ করে শাহেদ আশরাফের উদ্দেশ্যে বলল,

-মিয়া ভাই ভাবিকে নিয়ে এখন‌ই বের হবো?জাহানের জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করা হচ্ছিল।ও যখন চলে এসেছে তখন বের হওয়া যাক কি বলো?রাত‌ও তো বাড়ছে আর দেরি করা কি ঠিক হবে!

-মেয়েটা মাত্র‌ই এলো।একটু মা’র পাশে বসুক। অনন্ত কিছু সময় দা‌ও তাকে।রাত এখনো অনেক বাকি।এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। মানুষটাকে সেই তো একবারে রেখে আসতে হবে, একটু দেরি করেই না হয় যা‌ওয়া যাক।

আশরাফের কথায় সম্মতি জানিয়ে শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল শাহেদ। তারপর আদিবকে সাথে আসতে বলে সামনে পা বাড়ালো সে।ভেতরে যেতে যেতে আদিবের সাথে কিছু টুকটাক কথা হলো তার।বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই ডান পাশে কামিনী গাছ তলায় দেখা মিলল জায়েদের।আদিব এগিয়ে গেল সেজ চাচার দিকে।জায়েদ ক্লিষ্ট চোখে তার দিকে চেয়ে কোন রকমে জিজ্ঞেস করলো,

-কখন এলে?

– কিছুক্ষণ আগে।

এরপর আর কোন কথা যোগাল না কারো মুখে।আদিব সেজ চাচার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। জায়েদের কাছে অনেকে আসলো,অনেকে বসলো।কেউ দ্বীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত সান্ত্বনা দিল তো কেউ এতো তাড়াতাড়ি সালেহার মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করলো।কেউ বা আবার জাহানারার জন্য জায়েদ কে শক্ত হতে বলল।জায়েদ তাদের কথার উত্তরে, প্রতি উত্তরে শুধু হাঁ,হু করে গেল। কিছুক্ষণ পর শাহেদ এসে জানালো সালেহাকে নিয়ে বের হবে তারা।জানাজার নামাজ ইশার নামাজের পরেই সম্পন্ন হয়েছে সালেহার। এতক্ষণ শুধু জাহানারার জন্য অপেক্ষায় ছিল। জাহানারা যেন মাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারে সেই জন্য এতো দেরি।এখন উঠতে হবে। শাহেদের কথা শুনে টালমাটাল পায়ে উঠে দাঁড়ালো জায়েদ।পা দুটো কেমন জানি ভারি ঠেকলো জায়েদের কাছে তবুও এগিয়ে গেল সামনে ।খাটিয়ার কাছাকাছি যেতেই দেখলো জাহানারা আকিব কে ধরে আকুলি বিকুলি করে কাঁদছে।বুকের ভেতরট হুঁ হুঁ করে উঠলো জায়েদের।সে আর আকিব তবুও নিজেকে সামলে নেবে কিন্তু মেয়েটা কীভাবে নিজেকে সামলাবে এটা ভেবেই দৃষ্টি ঝাপসা হলো তার। জাহানারার আর্তনাদে ভারি হলো পরিবেশ।আকিব অনেক কষ্টে সামলালো বোন কে। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে নিস্তেজ হলো জাহানারার শরীর। জ্ঞান হারালো সে।বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে মাথায় পানি দেওয়া হলো তার। জাহানারা কে সে অবস্থায় রেখেই এগিয়ে গেল শবযাত্রা।

_____________
সালেহার শেষ কাজ সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বাজলো আদিবের।আদিব কবরস্থান থেকে সোজা বাড়ি ফিরলো।সেজ চাচার ওখানে আর গেল না।মা কে যতোই বলুক সে ঠিক আছে কিন্তু সত্যি কথা বলতে ভীষণ ক্লান্ত সে।শরীর আর কুলাচ্ছে না। বিশ্রাম চাইছে।বাড়ি ফিরে কলিং বেল চাপতেই তাদের বাড়ির পুরোনো গৃহকর্মী রাবেয়া দরজা খুলে দিল। আদিব কে দেখে একগাল হাসলো সে।আদিব ম্লান হেঁসে সালাম দিল।

-কেমন আছেন খালা?

-এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ফ্রেশ হয়ে নেও আব্বা, আমি খাবর দিচ্ছি।

-এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না খালা।আমি একটু ঘুমাবো।ঘুম থেকে উঠে খাবো। আপনি টেবিলে খাবার রেখে দিয়েন আমি গরম করে খেয়ে নিবো।

-সে কি আব্বা!একেবারে খালি পেটে ঘুমাবা!শরীর খারাপ করবে তো।এক গ্লাস গরম দুধ দিই সেটা অনন্ত খেয়ে শুইও।

রাবেয়ার কথায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো আদিব।তারপর ক্লান্ত শরীর টা নিয়ে এগিয়ে গেল নিজের ঘরের দিকে।ঘরে এসে দেখলো তার লাগেজগুলো আলমারির পাশে রাখা। সেখান থেকে একটা লাগেজ নিয়ে জামাকাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে।ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো রাবেয়া খালা বিছানার পাশের সাইড টেবিলে দুধের গ্লাস ঢেকে রেখে গেছেন।আদিব গ্লাসটা নিয়ে দুধটুকু খেয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকালো। ক্লান্ত শরীরে চোখ বুজতেই ঘুম নেমে এলো চোখে।

আদিবের ঘুম ভাঙলো পরের দিন দুপুর বারোটায়।ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই দেখলো তৃপ্তি আর তার মা বসে কথা বলছে।কথা শুনে বুঝলো সেজ চাচিকে নিয়ে কথা হচ্ছে।আদিব কে দেখেই তৃপ্তি বলে উঠলো,

-ঘুম ভেঙ্গেছে তাহলে।আমি তো ভেবেছিলাম তোর সাথে হয়ত দেখা না করেই চলে যেতে হবে।

-কখন এলে?

সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো আদিব।তানিয়া ছেলের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতে উঠে গেল সেখান থেকে।

– কাল রাতেই এসেছি।

আদিবের প্রশ্নের উত্তরে বলল তৃপ্তি।

-কাল রাতে! কিন্তু আমি তো তোমাকে দেখালাম না।

-সেজ চাচার ওখানে ছিলাম।

-আমি‌ও তো ছিলাম সেখানে কৈ তোমাকে তো চোখে পড়লো না।

-আমাকে সত্যি দেখিসনি?

চোখ সরু করলো তৃপ্তি। সন্দেহীন কণ্ঠ।আদিব একটু ভাবুক হলো।মনে করার চেষ্টা করলো কাল তৃপ্তি কে ও বাড়িতে দেখেছে কি না। কিন্তু তেমন কিছু মনে পড়লো না। তৃপ্তি আদিবের ভাবুক মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো।বলল,

-থাক কষ্ট করে মনে করতে হবে না।আমি হেল্প করছি। জাহানারার ঠিক পাশেই ছিলাম আমি।তুই খেয়াল করিস নি।অবশ্য আমাকে খেয়াল না করার‌ই কথা!দৃষ্টি অন্য কাউতে আটকালে আর কাউকে কি চোখে পড়ে!

তৃপ্তির কথায় শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব।সোফায় হেলান দিয়ে ঘাড় এলিয়ে দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বলল,

– পিঞ্চ করার পদ্ধতিটা ঠিক ছিল কিন্তু বিষয়টা ভুল ছিল।

-বিষয়টা একদম সঠিক ছিল ।মা-ও খেয়াল করছে তোমার ঐ ড্যাবড্যাবে দৃষ্টি।আমাকে বলা‌ও হয়ে গেছে তার।

-মোটেও আমি ড্যাবড্যাব করে তাকায় নি।

তড়াক করে সোজা হয়ে বসলো আদিব।তেতে উঠে বলল উক্ত কথাটা।ভাইয়ের কথা শুনে ফিচলে হাসলো তৃপ্তি।আয়েশ করে সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে বলল,

-দেশ বিদেশ ঘুরে এলি কিন্তু পুরোনো অভ্যাস বদলাতে পারলি না!তোর এই গলার স্বর উঁচু করে মনের ভাব লুকানোর ট্রিক্স অন্য কাউকে দেখাস, আমাকে না।

তৃপ্তির কথায় বিরক্ত হলো আদিব।মুখ দিয়ে বিরক্ত সূচক শব্দ বের করে বলল,

-ফালতু কথা বলো না।শুনতে ভালো লাগছে না।তুমি যেটা বলতে চাইছো আমি বেশ বুঝছি।তোমার অবগতির জন্য জানিয়ে দিই তুমি ভুল ভাবছো।অনেকদিন পর দেখলাম মেয়েটাকে তাই একটু তাকিয়েছিলাম।ব্যাস, দ্যাট সিট।এটা নিয়ে এতো টন্ট মারার দরকার নেই!

-টন্ট মারছি না, সত্যি কথা বলছি।তুই হ্যাঁ করে তাকিয়ে ছিলি মেয়েটার দিকে।

-আহ…! আপা লুক আট ইয়োর ল্যাংগুয়েজে।কি বিশ্রী শোনাচ্ছে।ডোন্ট ফরগেট তুমি যার বিষয়ে কথা বলছো সে বোন হয় আমার।

-চাচাতো বোন।

আদিবের কথা শেষ না হতেই বলল তৃপ্তি।

-ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।তোমার সাতে তর্ক করায় বৃথা!

-তোদের আবার কি নিয়ে তর্ক শুরু হলো?

তৃপ্তি আর আদিবের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে জানতে চাইলো তানিয়া। তৃপ্তি আদিব কে কিছু বলতেই যাচ্ছিল তানিয়াকে দেখে থেমে গেল।কথা ঘোরালো।তানিয়া স্পষ্ট বুঝতে পারলো মেয়ে কিছু লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে কিন্তু কিছু বলল না।আদিব কে তাড়া দিল ডাইনিংয়ে যেতে।আদিব সোফা ছেড়ে উঠতে
উঠতে সাবধানি দৃষ্টিতে বোনের দিকে একবার তাকালো।যার অর্থ উলটো পালটা ভাবা বাদ দাও। তৃপ্তি বুঝতে পারলো ভাইয়ের দৃষ্টির অর্থ।সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৪

তৃপ্তির মুখের হাসিটা দীর্ঘ স্থায়ী হলো না যখন মনে পড়লো জাহানারার বর্তমান অবস্থান। তৃপ্তির সাথে সাথে মনে হলো তার মা হয়ত জীবনের সব থেকে বড় ভুল করেছিল জাহানারা কে ছেলের অযোগ্য ঘোষিত করে।কথাটা মনে হতেই আপনা আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। দূরে ডাইনিংয়ে দাঁড়ানো তানিয়ার দিকে তাকালো সে।তানিয়া সযত্নে ছেলের খাবার পরিবেশন করছে।চোখে মুখে তার উচ্ছ্বাস। অনেকদিন পর ছেলেকে নিজ হাতে খেতে দিতে পেরে সন্তুষ্ট সে। তৃপ্তি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।এগিয়ে গল ডাইনিংয়ের দিকে।তানিয়া তখন আদিবের শরীর স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়ে আহাজারি করছে।আদিব মায়ের আহাজারি কান নিচ্ছে বলে মনে হলো না।তাকে নিজের খাবার প্লেটে মনোযোগী দেখালো। তৃপ্তি ডাইনিংয়ের চেয়ারে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো।মায়ের কথা শুনে টিপ্পনী কেটে বলল,

-মা তুমি তোমার ছেলের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে অযথা কান্না কাটি করছো!ছেলেকে একবার ভালো করে দেখো!লিকলিকে একটা বাছুর পাঠিয়েছিলে তুমি লন্ডনে যেটা মোটা তাজা ষাঁড় হয়ে ফিরে এসেছে! তারপরও তুমি যদি ছেলের স্বাস্থ্য শরীর কমে গেছে,শুকিয়ে গেছে এই ধরনের কথা বলো তাহলে মানায়!এমন কথা শুনলে লোকে হাসবে। বলবে তুমি ছেলে নিয়ে ন্যাকামি করছো!

তৃপ্তির কথা শুনে খাবার প্লেটে হাত থেমে গেল আদিবের। তানিয়া চোখ গরম করে মেয়ের দিকে তাকালো। আদিব ঘাড় উঁচিয়ে তৃপ্তির দিকে তাকালো ভ্রূ তে গিঁট দিয়ে বলল,

– আমাকে নিয়ে বডি শেমিং না করেও মাকে বোঝানো যেত কথাটা!

-বডি শেমিং করলাম কোথায়!আমি তো শুধু মা কে বোঝাতে চাইলাম তোর শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে মায়ের অত আক্ষেপ করার দরকার নেই।তুই আগের থেকে এখন আরো বেশি হিষ্ট পুষ্ট হয়েছিস।

তড়িঘড়ি বলল তৃপ্তি।আদিব চোখ সরু করলো। তৃপ্তি দাঁত বের করে হেসে বলল,

-ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন।আমার বলা কথায় গুরুত্ব না দিয়ে,তার পিছনের অর্থ কে গুরুত্ব দে।

থামলো তৃপ্তি।আদিব আর কিছু বলল না। খাবার প্লেটে মন দিল। তৃপ্তি তা দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।আদিবের যে হুট হাট রেগে যা‌ওয়ার ধ্যাত! তার কথায় যে আদিব এতক্ষণে রেগে বো’মা হয়নি তার জন্য স্বস্তি পেল।আদিব খাবার প্লেটে হাত চালাতে চালাতে তানিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

-মা সেজ চাচাদের কি অবস্থা?জানো কিছু?

-আছে কোনোরকম। মৃত্যু শোক কাটিয়ে ওঠা কি অত সহজ।একটু সময় তো লাগবে স্বাভাবিক হতে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কথার দাড়ি টানলো তানিয়া। সালেহার প্রতি তার মনে একটা সূক্ষ্ম রাগ থাকলেও সালেহার এত তাড়াতাড়ি চলে যা‌ওয়াটা সে মেনে নিতে পারছে না।মুখে প্রকাশ না করলেও খারাপ লাগছে তার।

-আকিব আর সেজ চাচা শক্ত মনের ওরা ঠিক নিজেদের সামলে নেবে। কিন্তু জাহান টা যে কি করবে!আজ সকালেও জ্ঞান ফেরার পর চিৎকার চেঁচামেচি করছিল।কোনোভাবে সামলানো যাচ্ছিল না।শেষ মেষ ভুলিয়ে ভালিয়ে সজীব ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।

-এখন এত দাপাদাপি করে কী লাভ !মা বেঁচে থাকতে তো মা’র খোঁজ‌ই নেয়নি।ধিঙ্গি পানা করে বেড়িয়েছে।এখন একেবারে কেঁদে কেটে পুকুর করছে!

তৃপ্তির কথা মুখ থেকে ফুরাতে না ফুরাতেই কটাক্ষের সুরে বলে উঠলো তানিয়া।মায়ের কথায় তাজ্জব বনে গেল তৃপ্তি।সে মানছে তার মা জাহানারা কে পছন্দ করে না কিন্তু তাই বলে এমন সময়ে মেয়েটার সম্পর্কে এমন কথা সে আশা করেনি মায়ের কাছ থেকে। তৃপ্তির সহ্য হলো না মায়ের কথাটা।সে তড়াক করে বলল,

-যা জানো না সে বিষয়ে কথা বলো না মা। জাহানারা যথেষ্ট করেছে চাচির জন্য।মানছি চাচির কাছে পিঠে থাকতে পারেনি, কিন্তু সেখানে তার কোন দোষ নেই।দোষ তোমাদের।তোমাদের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো যে……!

-তোমাদের বলতে কি বোঝাতে চাইছো আপু?

তৃপ্তির অসমাপ্ত কথার মাঝে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো আদিব। তৃপ্তি কোন রাখ ঢাক না রেখেই তার প্রশ্নে জবাবে বলল,

-আদিব শোন যেচে পড়ে কথা গাঁয়ে মাখিস না।আমি মা আর সেজ চাচার কথা বলছি।তবে তুই যদি নিজের ঘাড়েও দোষ নিতে চাস নিতে পারিস।তুই মানিস আর না মানিস কিছু দোষ তোর‌ও ছিল।

তৃপ্তির কথা শুনে চোয়াল শক্ত হলো আদিবের। খাওয়া এখনো শেষ হয়নি আদিবের।প্লেটে অবশিষ্ট কিছু খাবার তখনো বিদ্যমান যেটা রেখে‌ই উঠে দাঁড়ালো সে।প্লেটে পানি ঢেলে হনহন করে বেরিয়ে গেল ডাইনিং ছেড়ে।তানিয়া বারবার পিছু ডাকলো কিন্তু আদিব থামলো না।আদিব চলে যেতেই তৃপ্তির উপর চটে উঠলো তানিয়া,

-ছেলেটার খাওয়ার সময় এসব কথা না তুললে হতো না!

-যা সত্যি তাই বলেছি এতে তোমার ছেলের রাগ হলে আমি কি করবো। কথায় আছে,” যার মনে দোষ ,তার কথায় রোষ!”তোমার ছেলের অবস্থা হয়েছে তেমন।মা শোনো তোমাকে আমি এর আগেও বলেছি আবার‌ও বলছি কথা বলার আগে ভেবে চিন্তে বলবে।

রসকষহীন কথা তৃপ্তির।তানিয়া অগ্নি দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,

-তোমার জ্ঞান দেওয়া হয়ে গেলে যা‌ও এখান থেকে।

তানিয়ার কণ্ঠ শীতল হলেও তার চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। তৃপ্তি এই মুহূর্তে আর কথা বাড়াতে চাইলো না।নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করলো।

_______________
ঘরে এসে রাগে ফুঁসতে লাগলো আদিব।রাগে ভেতরটা গনগন করে উঠলো। তৃপ্তির বলা কথাগুলো তীক্ষ্ণ ফলার মতো খোঁচাতে লাগলো তাকে। হাঁস ফাঁস করে উঠলো ভেতরটা।
নিজের ভেতরকার অস্থিরতা কমাতে ঘরের জানালা গুলো খুলে দিল সে।দক্ষিণের জানালাটা খুলতেই চোখে পড়লো দুই তলা বিশিষ্ট বিশাল বাংলো বাড়ি।জানালা দিয়ে যার উঠানসহ বাগান টা স্পষ্ট দৃশ্য মান। দৃষ্টি স্থির হলো আদিবের।

তৃপ্তির কাছ থেকে শুনেছিল আদিব, জাহানারার নামে লিখে দেওয়া দাদির জমিতে বিরাট বাড়ি তুলেছে জাহানারা। তবে এতোটা বিরাট আশা করেনি।নিজের স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলো জাহানারা বেশ মোটা অঙ্ক ঢেলেছে বাড়ির পিছনে।জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায় ততদূর আদিব নিজের দৃষ্টি ঘোরালে। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো বাড়ির শৈল্পিক কারুকার্য।বাড়ি নিখুঁত প্রকৌশল দেখতে দেখতে আদিবের চোখ আটকালো বাড়ির উত্তর পাশে প্রাচীর ঘেঁষে বেড়ে ওঠা লিচু গাছটার দিকে।কিয়ৎক্ষণের জন্য থমকালো আদিব।এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো গাছটার দিকে। মৃদু বাতাসে গাছের ছোট ছোট পাতাগুলোর নড়ন চড়ন যেন আদিবের মানসপটে পুরোনো স্মৃতির আলোড়ন তুলল। স্মৃতির পাতা উল্টে হুড়মুড় করে চোখের সামনে লুটিয়ে পড়লো স্পষ্ট স্মৃতি গুলো।

তখন ক্লাস এইটে পড়ে আদিব।সেজ চাচার কাছে অঙ্ক আর বিজ্ঞানের প্রাইভেট টিউশনের জন্য চাচাদের বাড়ি রোজ আসা যাওয়া তার।
রোজকার নেয় সেদিন‌ও সেজ চাচার কাছে পড়া শেষ করে বের হচ্ছিল আদিব ঠিক তখন সেজ চাচির টিনের রান্নাঘরের টিন ঘেঁষে ছোট্ট একটা লিচুর চারা চোখে পড়লো।যেটা ঝিল কাকরের মধ্যে অযত্নে বেড়ে উঠছে।চাচির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গাছটা সাবধানে সেখান থেকে তুলছিল আদিব সে সময় কোথা থেকে তীরের বেগে ছুটে এলো জাহানারা।কোমরে হাত দিয়ে চোখ মুখ গুটিয়ে বলল,

-আদিব ভাই ওটা আমার গাছ।আপনি কেন তুলছেন?

আদিব জাহানারা কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সযত্নে গাছটা ঝিলকাকড়‌ওয়ালা মাটি থেকে আলাদা করতে করতে ভাবলেশহীনভাবে বলল,

-এটা তোমার গাছ! কিন্তু কোথাও তো তোমার নাম লেখা নেই!

-আমি লিচু খেয়ে লিচুর আঁটি ফেলেছিলাম ওখানে সেটা থেকেই গাছ হয়েছে। বুঝেছেন!

-না বুঝলাম না।এ বাড়িতে লিচু তুমি একা খাও! যে শুধু তোমার ফেলা লিচুর বীচে এই গাছ হয়েছে।হতেও তো পারে এটা অন্য কারো ফেলা বীচে জন্মেছে!

-না এটা আমার ফেলা লিচুর বীচে হয়েছে।আমি জানি।আমি এই এই খানে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে ফুঁ করে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম ওখানে।মনে আছে আমার। আপনি রাখেন ওটা।রাখেন বলছি।

চেঁচিয়ে উঠলো জাহানারা।সেজ চাচি তার আওয়াজ শুনে রান্নাঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।জানতে চাইলো কি হয়েছে।মা কে দেখে আহ্লাদে গদগদ হয়ে আদিবকে বলা কথাটা মা কে শোনাল জাহানারা। জাহানারার কথা শুনে সালেহা চোখ পাকিয়ে বলল,

-তোর গাছ হ্যাঁ!তা এতো দিন কোথায় ছিলি?এতো দিন তো ফিরেও তাকাস নি গাছটার দিকে ।এখন যেই আদিব নিতে গেল অমনি দরদ উতলে উঠলো!পাঁজি মেয়ে।এক চড়ে তোমার হিংসা ছুটিয়ে দেব আমি!

মায়ের শাসানির সামনে আর কিছু বলতে সাহস পেল না জাহানারা।তবে রাগে ক্ষোভে গজগজ করতে আদিবের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আদিব তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে গাছাটা হাতে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যা‌ওয়ায় গাছটা তাদের বাগানে এক পাশে রেখে পরের দিন কোথায় লাগাবে সেটা ঠিক করে ঘরে ঢুকলো আদিব। পরেরদিন সকালে যখন গাছটা লাগতে যাবে তখন দাদি এসে বলল,তাদের বাগানে পাশের বাড়ির আতিয়ার সাহেবের বাগানের মেহগনি গাছের ছায়া পড়ে সুতরাং সেখানে গাছটা ভালো ভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না।আদিব ভেবে দেখলো দাদির কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু গাছটা কোথায় লাগাবে সেটা ভেবে আদিব ভাবুক হলো। জাহানারা বেগম আদিব কে নিজ মনে কিছু ভাবতে দেখে জানতে চাইলো আদিব কি ভাবছে।দাদির কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো আদিবের।সে দাদিকে তার ভাবনার কথা বলতেই দাদি বলল আদিবদের বাড়ির পিছনে যে খালি জায়গা আছে সেখানে গাছটি লাগাতে।খোলা জায়গা, আলো বাতাসের কমতি নেই। গাছটির জন্য একদম উপযুক্ত স্থান।দাদির কথায় সম্মতি জানালো আদিব।দাদির সাথে সেখানে গিয়ে দাদির দেখানো জায়গায় মাটির নিচে আবদ্ধ করলো ছোট্ট চারা গাছটার নরম শেকড়।গাছ লাগিয়ে পানি দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই জাহানারা কোথা থেকে উদয় হয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলো। বলল,

-আদিব ভাই গাছটা কিন্তু আমার‌ও হলো না, আপনার‌ও হলো না।

জাহানারার কথার তাৎপর্য বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো আদিবের।ওর কথার অর্থ উদ্ধার করতে পের সদ্য লাগানো গাছটার দিকে তাকালো আদিব।গাছটা এখন আর এই জায়গা থেকে তোলা ঠিক হবে না এটা বুঝতে পেরে রাগে ফুঁসে উঠলো।দাদির উদ্দেশ্যে বলল,

-দাদি তুমি এই মেয়ের জন্য আমাকে মিথ্যা বললে!

– না দাদু।তুমি কি পাগল হলে?আমি তোমাকে মিথ্যা বলবো!তুমিই বলো তোমাদের বাগানে আতিয়ারের মেহগনি গাছের ছায়া পড়ে না? তুমিই বলো ওখানে গাছটা ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারতো?আমি গাছটা যেন ভালোভাবে বেড়ে ওঠে সেইজন্য এখানে লাগাতে বললাম।

আদিবকে রাগে ফুঁসতে দেখে তড়িঘড়ি বলল জাহানারা বেগম। তারপর একটু থেমে জাহানারার দিকে চোখ পাকিয়ে আদিব কে উদ্দেশ্য করে বলল,

-তুমি জানের কথায় কান দিচ্ছো দাদু!তুমি বুঝতে পারছো না ,ও তোমাকে রাগাতে চাচ্ছে।

দাদির কথায় দমলো আদিব। শক্ত চোখে তাকালো জাহানারার দিকে। জাহানারা তার সেই দৃষ্টি পাত্তা দিল না।যেভাবে নাচাতে নাচতে এসেছিল সেভাবেই নাচতে নাচতে চলে গেল। এরপর দাদি আদিব কে কত কিছু বোঝাল কিন্তু আদিবের মনের খচখচানি বন্ধ হলো না।কানে বাজতে থাকলো,”গাছটা কিন্তু আমার‌ও হলো না,আপনার‌ও হলো না।”এই কথাটা অনেকদিন পর্যন্ত ঘুরলো আদিবের মাথায়।রাগ হলো জাহানারার উপর। অভিমান জমলো দাদির দিকে।ভেতর থেকে কেউ যেন বলল,দাদি তার আদরের নাতনির আবদার রাখতে গাছটা ওখানে লাগানোর যুক্তি দিয়েছিল। তাছাড়া আর কিছুই না!এই কথাটা মনে হতেই আদিব খুব করে চাইলো ঐ হিংসুটে মেয়েটা যেন চাচির কাছে খুব শীঘ্রই চরম ঝাড় খায়।
এই কাজটা অবশ্য সে নিজেই করতে পারতো কিন্তু নালিশ ,কুটনামি এসব করা তার স্বভাব বিরোধী।তাই তো কিছু বলল না চাচিকে। চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলো সেই দিনের। জাহানারার যে পূর্ব অতীত সেই অতীত অনুযায়ী সপ্তাহে দুই তিন বার সে মায়ের হাতে ঠেঙানি খায়।এটা নতুন না।তবে সেবার সময় একটু বেশি লাগলো কিন্তু অবশেষে আদিবের মনের ইচ্ছা পূরণ হলো।স্কুলে কোন এক ছেলের সাথে মারামারি করতে গিয়ে তার চোখে কলম দিয়ে খোঁচা মেরেছে জাহানারা।সেই নালিশ জানাতে সেজ চাচা কে ডেকে পাঠালো জাহানারার স্কুলের হেডস্যার।সেজ চাচা কোন রকমে মেয়েকে হেড স্যারের হাত থেকে বাঁচিয়ে ফেরালেও, সালেহার হাত থেকে বাঁচতে পারলো না। জাহানারা বাড়ির গেটের সামনে আসতে না আসতেই সালেহা রাস্তার মধ্যে তার কান ধরে পিঠে দুমদাম কিল বসিয়ে দিল।আদিব তখন স্কুল থেকে ফিরছিল রাস্তার মাঝে এই দৃশ্য দেখে সাইকেলের প্যাডেলে পায়ের গতি ধীর করলো।জাহানারার নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো।ঠিক তখনই লক্ষ্য করলো জাহানারা ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জাহানারার খাবো খাবো দৃষ্টি দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না আদিব ,ফিক করে হেসে ফেলল এবার।আদিবের সেই হাঁসি দেখে রাগে ক্ষোভে কেঁদে ফেলল জাহানারা।সালেহা মেয়ের চোখের পানি দেখে থামলো।বকতে বকতে মেয়েকে বাড়ির ভেতরে নিল।

আদিবের সেই হাসি টুকুই যেন আদিবের কাল হলো। শুধু মাত্র ঐ হাঁসির কারণে এরপর থেকে জাহানারা আদিব কে দেখলেই চোখ মুখ গুটিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভেংচি কাটত।প্রথম প্রথম আদিব ব্যাপার টা তেমন গুরুত্ব দিল না। এককথায় নির্লিপ্ত ভাব দেখালো।
তবে আদিবের এই নির্লিপ্ত ভাবটা জাহানারা কে সাহস যোগাল।সে যেন পেয়ে বসলো।যখন তখন যেখানে সেখানে শুরু করলো অমন বেয়াদবি।একটা সময় পর আদিবের মনে হলো এবার ব্যাপারটা থামানো উচিত।যেমন ভাবা তেমন কাজ একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে জাহানারা কে চোখে পড়লো তার।মেজ চাচাদের বাড়ির সামনে নিতুর সাথে গল্প করছে। কাঁধে স্কুল ব্যাগ।আদিব কে দেখেই মুখ বেকালো সে।সাথে সাইকেলর ব্রেক কষলো আদিব। সাইকেল স্ট্যান্ডে দাড় করিয়ে পিছন ফিরে সোজা এসে দাঁড়ালো জাহানারার সামনে।কোন ভণিতা না করে বাজখাঁই গলায় বলল,

-কিছু বলছি না বলে তোমার বেশি সাহস হয়ে গেছে না! বেয়াদব।আর একবার মুখ ভেংচিয়ে দেখো থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো তোমার।

আদিবের আকস্মিক আক্রমণে থতোমতো খেল জাহানারা।সে হয়ত আশা করেনি আদিব এভাবে তেড়ে আসবে। আদিবের ব্যবহার জাহানারা কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হল তবে দমলো না।আদিবের কথার জবাবে পালটা বলে উঠলো,

-আমি আপনাকে ভেংচি দেইনি।আমি নিতুকে ভেংচি দিয়েছি।এই নিতু বল।

নিজের কথার সত্যতা প্রমাণে নিতুকে সাক্ষী হিসেবে দাড় করালো জাহানারা।জাহানারার এমন কাজে নিতু যেন আকাশ থেকে পড়লো।এমনিতে ভিতু স্বভাবের সে।তাছাড়া আদিবকে সে ভয়‌ পায়।জাহানারার কথায় সে বুঝে পেল না কি করবে।নিতুর সম্মতি দিতে দেরি হতে দেখে তাড়া লাগালো জাহানারা।আদিব স্পষ্ট বুঝতে পারলো জাহানারা নিজেকে সঠিক প্রমাণিত করতে নিজে মিথ্যা কথা বলছে সেই সাথে নিতুকেও বাধ্য করছে।মেজাজ চড়া গেল আদিবের।

-চুপ বেয়াদব!আর একটাও কথা বলবে না।একত বেয়াদবি করেছ আবার এখন সেটা ঢাকতে মিথ্যা কথা বলছো! অসভ্য একটা!

আদিবের উচ্চ কণ্ঠ। জাহানারা কেঁপে উঠলো।আদিবের গলার আ‌ওয়াজ পেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নিতুর মা ডালিয়া।এসেই আদিবের কাছে জানতে চাইলো কি হয়েছে।আদিব সবটা বলতেই ডালিয়া ছি : ছি : করে উঠলো।বলল,

-বড় ভাইয়ের সাথে কেও এমন করে জাহান!আদিব তোর বড় না!ওর সাথে এমন বেয়াদবি করলি কি করে তুই! ছি : ছি :!

মেজ চাচির কথা শুনে চোখ টলমলে হলো জাহানারার।আদিব আর দাঁড়ালো না সেখানে।রাগে গজ গজ করতে করতে স্থান ত্যাগ করলো।সেদিনে সেই ঘটনা সেখান থেমে থাকলো না। ডালিয়া বেশ রসিয়ে কষিয়ে সালেহা কে বললেন। সালেহা রাগে দুঃখে মেয়ে কে ইচ্ছা মতো মার লাগলো।সেই সাথে হুঁশিয়ারি দিল জাহানারা কে আর যদি কোনোদিন কারো সাথে বেয়াদবি করতে দেখে তাহলে জাহানারার একদিন কি তার একদিন।মায়ের সেই হুমকি মাথা পেতে নিলো জাহানারা।এরপর আদিবের থেকে একশ হাত দূরত্ব তৈরি করলো।
আদিবের সাথে বেয়াদবি করার জন্য জাহানারা কে সালেহা উত্তম মাধ্যম দিয়েছে এই কথা নিয়ে তিন বাড়িতেই কম বেশি আলোচনা হলো। আশরাফ কথাটা শুনে আফসোস করে বলল, “এটুকু বিষয়ে সালেহার মেয়ের গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি,ছোট মানুষ অত বোঝে না কি!আর আদিব তুমিও বা কি?ঐটুকু মানুষের কথায় কেউ রাগে!ওর কি অত ভালো মন্দ জ্ঞান হয়েছে !”বাবার কথায় আদিবের মনে হলো অন্যায় টা তার।তানিয়া আশরাফের কথায় সহমত হতে পারলো না সে বলল,”সালেহা যা করেছে ভালো করেছে। মেয়েটা একটু বেশিই অবাধ্য হচ্ছে ,এই সময় শাসন না করলে হিতে বিপরীত হবে।”আদিব বাবা মায়ের কথায় বুঝলো যা হয়েছে হয়েছে এতে তার কিছু করার নেই।সে নিজের খাবার চুপচাপ শেষ করে নিজের ঘরে গেল।

এরপর বেশ কিছুদিন জাহানারা কে আদিবের আশেপাশে লক্ষ্য করা গেল না।আদিবের মনে হলো সেজ চাচির মারে মেয়ের বুঝ এসেছে। কিন্তু আদিবের সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে মেয়েটা যেন আরো বাড়লো।এই ঘটনার আগে যদি‌ও বা আদিবের সাথে তার তেমন কোন কথাবার্তা কিংবা তেমন কোন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। জাহানারা যথা সম্ভব আদিবের থেকে দূরেই থাকতো কিন্তু এই ঘটনার পর মেয়েটা যেন আদিব কে নিজের শত্রু হিসেবে দেখতে লাগলো।আড়ালে আবডালে নানাভাবে বিরক্ত করতে লাগলো সে আদিব কে।এই যেমন:- সেজ চাচার কাছে পড়তে গেলে তার পায়ের একটা স্যান্ডেল পড়ে থাকলে আরেকটার হদিস থাকতো না,কখনো বা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কোথা থেকে গায়ে ছোট ইটের টুকরো উড়ে এসে লাগতো। আবার কখনো বা পাড়ার বাচ্চাদের দিয়ে তাকে কানা বক বলে ডাকাতো।এসব ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে আদিব একদিন জাহানারা কে ডেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে যেন তার এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করে।আদিবের কথা শুনে জাহানারা আকাশ থেকে পড়ার ভ্যান করে বলল,সে এসব কিছু জানেই না।সে তো মায়ের কথা শুনে এখন আদিবের সামনেও যায় না , ইত্যাদি ইত্যাদি। জাহানারার কথা শুনে দাঁতে দাঁত চাপলো আদিব।এই নিয়ে আর জাহানারা কে কিছু বলল না।সবটা হজম করে তক্কে তক্কে থাকলো কবে মেয়েটাকে হাতে নাতে ধরবে।এভাবে সময় গড়াতে লাগলো। কিন্তু আদিব কোন ভাবেই মেয়েটার নাগাল পেল না। বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অন্যদিকে আর খেয়াল র‌ইলো না। এরমধ্যে জাহানারা‌ বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানা বাড়ি বেড়াতে গেল।আদিব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল।তবে সেটা ছিল সীমিত সময়ের জন্য।
পরের বছর ক্লাস ফাইভ পাস করে জাহানারা আদিবের স্কুলে ভর্তি হলো।সজীব‌ও সে বছর সালেহার এখানে এসে উঠলো।আদিবের ক্লাসে ভর্তি হলো সজীব। পূর্ব পরিচিত হ‌ওয়ার দরুন দুইজনের বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগলো না।বেশ কয়েকদিন যেতে না যেতেই সজীব লক্ষ্য করলো জাহানারার আদিবের সাথে করা শয়তানি গুলো।একদিন আদিবের স্যান্ডেল বাড়ির পিছনের বাগানে ফেলতে নিতেই সজীব হাতে নাতেও ধরলো জাহানারা কে। সজীব জাহানারার এই শয়তানি সালেহাকে বলতে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই জাহানারা হাতে পায়ে ধরলো তার।আদিব‌ও ছিল সেখানে আদিবের থেকেও বারবার মাফ চাইলো জাহানারা বলল আর কখনো এমন কিছু করবে না। রীতিমতো কথা দিল সে।আদিব সজীব কে বলল এবারের মতো ছেড়ে দিতে এরপরে যদি আবার এমন কিছু করে তখন দেখা যাবে।সেদিনের পর সত্যি জাহানারা আর তেমন কিছু করলো না।এমনকি তাকে আদিবের ধারে কাছে দেখা গেল না।তবে আদিব উড়ো উড়ো শুনতে পেত আড়ালে তাকে জাহানারার কানা বক বলে ডাকা সম্বোধন টা।কিন্তু তেমন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করতো না।তাছাড়া আদিবের তখন সময় কোথায়!স্কুল শেষ করে ক্লাস নাইনে বিভাগীয় বিষয়গুলোর জন্য আলাদা কোচিং করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় তার। যেখানে দুপের খাওয়া টাও ঠিক মতো হয় না সেখানে জাহানারা কি করলো না করলো তা দেখবে কখন!

ছেলের কথা চিন্তা করে আশরাফ জায়েদ কে বলে বাড়ি এসে পড়িয়ে যা‌ওয়ার ব্যবস্থা করলো।যার দরুন সেজো চাচার বাড়ি যা‌ওয়া বন্ধ হলো আদিবের।এরপর পড়াশোনার চাপে, স্কুল, কোচিংয়ের ব্যাস্ততায় কীভাবে কীভাবে যেন এস‌এসসি পরীক্ষা নাকের দোর গোড়ায় এসে পৌঁছাল।পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যা‌ওয়া বন্ধ হলো আদিবের। আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি, এই সময়টুকুতে জাহানারার সাথে তার দেখা হলো না বললেই চলে।কোন এক অদৃশ্য কারণে হঠাৎ জাহানারার উড়ু উড়ু চলা ফেরায় সীমা টানলো সালেহা। জাহানারা‌ও যেন বাধ্য মেয়ের মতো ঘর মুখো হলো।

এরপর অনেকদিন পর ফের জাহানারার সাথে দেখা হলো আদিবের।এস‌এসসি পরীক্ষা গোল্ডেন পা‌ওয়ার খুশিতে মিষ্টি দিতে গিয়েছিল সে সেজ চাচার বাড়ি। জাহানারা উঠানে লাফদড়ি খেলছিল।আদিব কে দেখে খেলা থামিয়ে এগিয়ে এলো সে।জাহানারা কে অনেদিন পর দেখে আদিবের কাছে মনে হলো মেয়েটা হঠাৎ বড় হয়ে গেছে।আদিব কে দেখেই এক গাল হাসলো জাহানারা।হাতে থাকা লাফদড়ি একপাশে রেখে বলল,

-আপনি না কি গোল্ডেন প্লাস পেয়েছেন আদিব ভাই।তা আমাদের মিষ্টি কৈ?

আদিব হাতে থাকা মিষ্টির থালা জাহানারার হাতে দিয়ে বলল,

-এই যে মিষ্টি।চাচিকে দিও।আমি মেজ চাচিদের বাড়ি যাচ্ছি। সজীব আছে?

-ছোট মামা বাড়ি গেছে।

-ও ফিরলে আমার সাথে দেখা করতে বলবে।

ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে আসলো আদিব।সেদিন অনেকদিন পর সেই এক চিলতে কথা হয়েছিল জাহানারার সাথে তার। তারপর রাস্তা ঘাটে মাঝে সাঝে দেখা হলেও ভালো মন্দ ব্যতীত আর কোন বাক্য বিনিময় হয়নি দুজনের।
আদিব নিজের পড়াশোনা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতো যে কোথায় কি হচ্ছে,কারকি খবর এসবের জন্য সময়‌ই ছিল না তার কাছে। তবে একদিন খাবার টেবিলে হঠাৎ জাহানারার কথা উঠলো।দাদি তুললেন কথাটা। জাহানারার জন্য না কি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে ফুপুর বড় জা।কথাটা শুনতেই আশরাফ বলে উঠলো,

-মানুষের আক্কেল‌ও বলিহারি! ঐ টুকু মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয় কীভাবে!তুমি নাফিজাকে কিছু বলো নি?

-নাফিজা বলেছিল জাহানারা এখন ছোট, জায়েদ এখন মেয়ে বিয়ে দেবে না। ওর জা শোনেনি‌।বাধ্য হয়ে নাফিজা জায়েদের সাথে কথা বলতে এনেছিল।

-জায়েদ কি বলল?

আদিব লক্ষ্য করলো বাবার গলাটা কেমন জানি শোনালো।দাদি বললেন,

-বোনের জা বলে কথা, মুখের উপর না করে কি করে।আমতা আমতা করছিল।বাধ্য হয়ে যা বলার আমি বলেছি।বলেছি আমাদের মেয়ে অন্য কোথাও পাঠাবো না, বাড়িতেই রাখবো।

দাদির কথার তাৎপর্য বুঝলো না আদিব তবে লক্ষ্য করলো খাওয়ার প্লেটে হাত থেমে গেল তার মায়ের।বাবা কিছু বলতে যাচ্ছিল তার কথা মাঝ পথে কেটে তার মা বলল,

-মা আপনি কি জাহানারার জন্য আদিবের কথা বলছেন?

মায়ের প্রশ্নে আকাশ থেকে পড়লো আদিব।তবে দাদির মুখে চ‌ওড়া হাসি দেখা দিল।সে সেভাবেই বলল,

-হ্যাঁ ব‌উমা।কেন তোমার মনে নেই খোকা তো বলেছিল জাহানারা কে সে আদিবের জন্য নিবে।ভুলে গেলে না কি।

-আপনার ছেলে কি বলেছিল, না বলেছিল তার দায় আমার ছেলে নিতে যাবে না মা! আপনার খোকা যা বলেছিলো সব ভুলে যান মা।

-সে কি ব‌উমা এসব কি বলছো তুমি!ভুলে যাবো মানে!খোকা কথা দিয়েছিল জায়েদ কে।তুমিও তো ছিল সেদিন, কৈ তখন তো আপত্তি করোনি তাহলে এখন কি হলো!

-এখন আপত্তি করছি।

কথাটা বলে খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে গেল তানিয়া।আদিব হতবাক হয়ে বসে র‌ইলো কিছুক্ষণ। বোঝার চেষ্টা করলো এতক্ষণ ঠিক কি নিয়ে কথা হলো।

চলবে,ইনশাআল্লাহ

সৌরকলঙ্ক পর্ব-১+২

0

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১

-আদিব বাড়ি ফিরছিস তুই?

-হুম।

-হঠাৎ বাড়ি আসতে চাইছিস?কিছু হয়েছে? বাবা কিছু বলেছে?

ফোনের অপর পাশে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর তানিয়ার।তার কেন জানি মনে হচ্ছে, তার ছেলের হঠাৎ দেশে আসতে চাওয়ার পিছনে তার স্বামী আশরাফের বিশেষ কোন ভূমিকা আছে।না হলে যে ছেলেকে বিগত এগারো বছরে হাতে পায়ে ধরেও, কেও এ মুখো করতে পারে নি, সে কেন হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিল।তানিয়া ছেলের এই সিদ্ধান্ত জানার পর থেকে বেশ চিন্তিত। চিন্তার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে,ছেলেটা সবে লন্ডনের মাটিতে পা শক্ত করেছে।এখনো কত কিছু বাকি।আর এখুনি যদি সে বাবার কথায় খ্যামখেয়ালিপানা করে! একেবারের জন্য দেশে চলে আসে,তাহলে চিন্তা হবে না!সে তো জানে কত কষ্ট করে ছেলে তার আজকের অবস্থান তৈরি করেছে।সেই অবস্থান বাপের কথায় আবেগি হয়ে ছেড়ে আসলে ছেলের কত বড় ক্ষতি হবে ,সেটা ছেলে না বুঝলেও তানিয়া ঠিক বুঝেছে।তাই তো ছোট মেয়ের কাছ থেকে ছেলে দেশে ফেরার খবর শুনে তড়িঘড়ি ছেলেকে ফোন করেছে। উদ্দেশ্য সে যে খবর শুনেছে তার সত্যতা যাচাই করা।

আশরাফ বরাবরই ছেলের প্রবাসে থাকা নিয়ে অসন্তুষ্ট।সে সবসময় ইনিয়ে বিনিয়ে চেষ্টা করেছে ছেলেকে দেশে ফেরাতে। কিন্তু ছেলের পোক্ত মনোভাবের কাছে তার কথাগুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি।তবে তানিয়ার মনে হচ্ছে এবার তার স্বামীর আবেগি কথায় ফেসেছে ছেলে।তাই তো বাড়ি আসতে চাইছে। এবং সেই কথাটা তার থেকে গোপন‌ও করেছে! বাপের কথা শুনে ছেলে কোন বোকামো না করে বসে, এটা ভেবেই মন উদ্বিগ্ন হচ্ছে তানিয়ার।
এতগুলো বছরে ছেলেটা লন্ডনের মতো বিলাসবহুল শহরে কত কষ্টে নিজের অবস্থান তৈরি করছে সেটা তার অজানা নয়।কত কঠোর পরিশ্রম আর ত্যাগতিতিক্ষার ফল আদিবের এই বর্তমান অবস্থান।সেই অবস্থান বাবার কথায় এত সহজে ছেড়ে দিবে ছেলে!সেটা তানিয়া হতে দিতে পারে না। কিছুতেই না।
এগারো বছর!প্রায় এগারোটা বছর সে তার বুকে পাথর বেঁধে ছেলেকে এতদূর এমনি এমনি তো রাখেনি।এখন যখন ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,নিজের সুউচ্চ অবস্থান তৈরি করছে, তখন সেসব ছেড়ে বাড়ি আসার প্রশ্নই ওঠে না।তার স্বামীর বোকামির জন্য সে ছেলের এতো বড় সর্বনাশ হতে দিতে পারে না!
মায়ের উদ্বেগ বুঝলো আদিব ।সে একটা শ্বাস গোপন করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

-বাবা কিছু বলে নি মা।একটা লম্বা ছুটি পেয়েছি, তাই মনে হলো একটু ঘুরে আসি বাড়ি থেকে। তাছাড়া তোমাদের দেখতে ইচ্ছা করছিল।তাই…

-আমরা আসছি তো বাবু তোর কাছে।আর কটা দিন একটু সবুর কর।এতোটাকা খরচ করে তুই আসবি, আবার ফিরবি!বাবু ফ্লাটের ইএমআই তো এখনো বাকি।এখন এতো খরচা খরচ করলে চলবে!

আদিবের কথা শেষ না হতেই বলল তানিয়া। মুখস্থ কথা ,যেন প্রস্তুত ছিল সে আদিবের কথার প্রেক্ষিতে কথাটা বলতে।মায়ের কথা শুনে মনে মনে হাসলো আদিব।খরচা খরচের ভয় দেখিয়ে মা যে তাকে পরোক্ষভাবে দেশে ফিরতে বারণ করছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না তার।তবে সেটা মা কে বুঝতে না দিয়ে মায়ের কথার প্রতি উত্তরে বলল,

-তোমাদের কাগজপত্র ঠিক করে এখানে আসতে এখনো অনেক দেরি মা।আর র‌ইলো ফ্লাটের ইএম‌আই,ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না ।সেটা গতমাসে ক্লিয়ার হয়েছে।

আদিবের ভণিতাহীন জবাব।ছেলের কথায় কিঞ্চিৎ নিরাশ হলো তানিয়া।সে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,

-ও। আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে আই।ঘুর যা।

একটু থামলো তানিয়া তারপর কি যেন মনে পড়েছে এমন ভাব করে আবার বলল,

– আদিব,, তুই একবারে চলে আসছিস না তো বাবা?

-মা বললাম তো ছুটিতে আসছি।আমার কথা কি ঠিক করে শোনোনি? ওকে ফাইন, তোমার আপত্তি থাকলে আমি আসছি না!

-আহা; আমি কখন বললাম আমার আপত্তি আছে।আমি ভাবছিলাম তুই আবার তোর বাপের কথা শুনে সব ফেলে চলে আসছিস কি না; তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।রাগ করছিস কেন! আচ্ছা শোন ওসব বাদ দে।সকালে নাস্তা করেছিস?আজ কি খেলি?

প্রসঙ্গ বদলাতে কথা ঘোরালো তানিয়া।ছেলের অল্পতে রেগে যাওয়া স্বভাব সম্পর্কে ভলিভাতি অবগত সে।এক কথা একবারের বেশি শুনতে পছন্দ করে না আদিব।রেগে যায়। বিরক্ত হয়।এখন ছেলের কাজের সময়। তানিয়া চায় না এখন ছেলেকে রাগাতে সুতরাং কথা ঘোরানোই ভালো।

আজ ঘুম থেকে উঠতে দরী হয়েছে আদিবের যার কারণে সকালের খাবার টা এখনো পেটে পড়েনি।তবে সে কথা মা কে বললে সে অন্য কথা টেনে আনবে। যেটা আদিব এই মুহূর্তে চাইছে না।সে কোনোরকমে বলল,

-ব্রেড-জ্যাম,কফি।

তারপর একটু থেমে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,

-মা রাউন্ডে যেতে হবে, ফোন রাখছি।রাতে ফোন দিবো।

– দাড়া,কল কাটিস না।বলছি তুই কবে আসছিস?এই সপ্তাহে?

-হুম।সামনের সোমবার।

-এই সোমবার!আজ তো শনিবার।তাহলে পরশু?

-পরশু রাতে এখান থেকে ফ্লাইটে উঠবো। বাংলাদেশে পৌঁছতে মঙ্গলবার দুপুর দুটো তিনটা বাজবে হয়ত।

-মঙ্গলবার! আচ্ছা ,আমি তোর মামাকে বলবো তোকে এয়ার পোর্টে নিতে যেতে।সেদিন ওদের ওখানে থেকে পরেরদিন খুলনা আসিস।অবশ্য তোর মামাকে বললে সে গাড়ি করে তোকে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে যাবে।

অনেকটা স্বগোতক্তি করে বলল তানিয়া।নিজের সহজ সরল সাজেশন শোনাল ছেলেকে।তবে আদিবের মায়ের সাজেশন টা পছন্দ হলো না।সে আপত্তি জানিয়ে বলল,

-মামাদের এখন কিছু জানাতে হবে না।আমি ঢাকা টু যশোর ফ্লাইট নিবো। যশোর থেকে গাড়ি ভাড়া করে সোজা খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দেব।

-সে কি এত পথ পাড়ি দিয়ে, আবার জার্নি করবি! তার থেকে ওদের ওখানে একদিন থাক। রেস্ট নে। তারপর বাড়ি আই।

-মা কেন শুধু শুধু মানুষকে বিরক্ত করা!আর তাছাড়া তুমি তো জানো আমার ওখানে যেতে ভালো লাগে না।তাহলে কেন বলছো।আমি সোজা বাড়ি যাবো। আচ্ছা এখন রাখছি।পরে কথা বলবো।

নিজের মতো কথা বলে কল কেটে দিল আদিব।তানিয়া ছেলের কণ্ঠের রুক্ষতা স্পষ্ট বুঝতে পারলো। মনে মনে ছেলের ব্যবহারে রুষ্ট হলো সে। শব্দ করে স্মার্ট ফোন টা সামনের টি টেবিলের উপর রেখে নিজের সূক্ষ্ম রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো।এরপর কিছু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে আশরাফের দিকে চোখা চোখে চেয়ে বলল

-সত্যি করে বলো তো তুমি কি বলছো আদিব কে?

আশরাফ সকালের বাসি খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল। তানিয়ার কথা শুনে খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই কাটকাট গলায় বলল,

-তোমার ছত্রছায়ায় আবদ্ধ ছেলের… বাপের প্রতি অতটান নেই, যে সে বাপের কথায় সুদূর লন্ডন থেকে দৌড়ে আসবে!

আশরাফের কটাক্ষ পূর্ণ কথা। তানিয়া তেতে উঠে বলল,

-একটা সামান্য কথা জিজ্ঞেস করেছি আমি, এতে এমন টিটকারি করার কি আছে!

-সামান্য কথাটা আমার কাছে বৃহত্তর মনে হলো তাই টিটকারি করলাম।

আশরাফের কথায় তানিয়ার রাগ আরো চরমে উঠলো।একে তো ছেলে তাকে কিছু জানায়নি ,তার‌উপর তার কথা অসম্পূর্ণ রেখে কল কে’টে’ছে , এখন আবার এই লোক তাকে ঠেস দিয়ে কথা বলছে!একদিনে এতো কিছু সহ্য করা যায়! রাগে দুঃখে তার চোখ মুখ থমথমে হলো।সে আশরাফের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো। আশরাফ খবরের কাগজে চোখ নিবদ্ধ রেখেও বুঝতে পারলো তানিয়া তাকে নিজের অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে ভস্মীভূত করারা তীব্র প্রয়াসে আছে।বুঝলো প্রতিবারের মতো এবারও তাকেই হার মানতে হবে। না হলে এই অগ্নি চক্ষু যেকোনো মুহুর্তে বর্ষার পানিতে ডোবা খালে পরিণত হবে।সে খবরের কাগজ একপাশে রেখে বলল,

-আদিবের সাথে এরমধ্যে আমার কোন কথা হয় নি।এক সপ্তাহ আগে ও নিজে ফোন দিয়েছিল আমাকে।ফোন দিয়ে বলল ভিডিও কলে আসতে।আমাকে দেখবে। এরপর মনে হয় হাতে গুনে দুই মিনিট কথা হয়েছিল।ওটুকু সময়ে না আমি তাকে বাড়ি আসার কথা বলেছি ,আর না সে আমাকে তার দেশে আসার বিষয়ে কিছু জানিয়েছে। গতকাল তৃপ্তি আমাকে জানাল আদিবের দেশে ফেরার কথা। ব্যাস।পেয়েছ উত্তর?খুশি?

স্বামীর কথা শুনে তানিয়া যেন একটু স্বস্তি পেল।মনের ভেতর তৈরি হ‌ওয়া খুঁতখুঁতুনি টা কিছুটা শান্ত হলো। তানিয়ার মুখের পরিবর্তিত অভিব্যক্তি দেখে আশরাফ ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।বসে থাকার ফলে কুঁচকে যাওয়া ফতুয়ার নিচের অংশ হাত দিয়ে টেনে সোজা করতে করতে বলল,

-ছেলে দেশে ফিরছে এ নিয়ে এত চিন্তা করছো কেন তানিয়া?তোমার তো খুশি হ‌ওয়া উচিত,এতদিন পরে ছেলে বাড়ি ফিরছে।আর কেউ না জানুক আমি তো জানি, প্রতি রাতে ছেলের জন্য কীভাবে চোখের পানি ফেল তুমি।ছেলেকে একপলক দেখার জন্য কতটা অধীর আগ্রহে সময় পার করো।তাহলে!ছেলে ফেরার কথা শুনে এত ছটফট করছো কেন?

আশরাফের সন্দেহীন কণ্ঠ।ভড়কালো তানিয়া।এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো হয়ত আশরাফ কোন জাদু বলে তার মন পড়ে নিয়েছে।সে স্থির চোখে তাকালো আশরাফের দিকে।
দুই মেয়ের পরে জন্মেছিল আদিব।শুরু থেকে একটা ছেলের ইচ্ছা ছিল তানিয়ার কিন্তু পর পর দুই মেয়ে হ‌ওয়ায় সেই ইচ্ছা ত্যাগ করেছিল । কিন্তু সৃষ্টি কর্তার মনে হয়ত অন্য কিছুই ছিল। তাই তো ছোট মেয়ে তৃপ্তির জন্মের প্রায় এগারো বছর পর অপ্রত্যাশিত ভাবে আবার কনসিভ করলো তানিয়া।কনসিভ করার পর মনে থাকা ইচ্ছা টা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার।খুশিতে আত্মহারা হলো মনে মনে। কিন্তু খুশিটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার কারণে।প্রথমতো বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, তার‌উপরে থাইরয়েডের সমস্যা তুঙ্গে।ডাক্তার বলল এই বয়সে এতো ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।ডাক্তারের কথায় আশরাফ‌ও সম্মতি জানালো।কিন্তু আশরাফের মা জাহানারা বেগম বেঁকে বসলেন।তানিয়াও শ্বাশুড়ির কথায় সাঁই দিল। আল্লাহ ভরসা, যা হবে দেখা যাবে।এই কথায় আমল করে অপেক্ষা করতে লাগল অনাগত সন্তানের।এরপর যেদিন আদিব ভুমিষ্ঠ হলো সেদিন তানিয়ার জান নিয়ে টানাটানি অবস্থা। নরমাল ডেলিভারি কিন্তু র’ক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। রক্ত শূন্য হয়ে একটু একটু করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে সে।চোখের সামনে নামছে অন্ধকার। ডাক্তার তার অবস্থা দেখে হিস্টেরেকটমি করতে বাধ্য হলো।বাদ পড়লো তার নারী শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।আজো চোখের সামনে সেই দিনটা ভাসে।
এতো এতো কষ্টের পরে পাওয়া ছেলে তার। সেই ছেলেকে এতোগুলো বছর নিজের থেকে দূরে রাখা তানিয়ার জন্য মোটেও সহজসাধ্য ছিল না।তবুও সে সেটা করেছে।ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মাতৃ স্নেহ কে দূরে ঠেলেছে।

-এতো কীসের ভয় তানিয়া!যে ভয়ে ছেলেকে দেশ ছাড়া করেছিলে সেসব তো কবেই চুকে গেছে। আমার মা‌ও তো বেঁচে নেই……!তুমি যার ভয় পাচ্ছো…… স্যরি যে কারণে ভয় পাচ্ছো তা তো আর সম্ভব না।

আশরাফের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো তানিয়ার।নিজের ভাবনা একপাশে রেখে সংযত কণ্ঠে সে বলল,

-আমি কোন ভয় পাচ্ছি না।আমরা যাচ্ছিলাম‌ই ওখানে।সেই জন্য চাইছিলাম আদিব যেন আবার অতগুলো টাকা খরচ করে এখানে না আসে।

যথেষ্ট শান্ত কণ্ঠ তানিয়ার।নিজের মনের ভাব লুকানোর ত্রুটিহীন চেষ্টা। তবুও যেন আশরাফ তার মনের ভাব বুঝে নিল। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাঁসি।

-ভয় না পেলেই ভালো।তবে যদি তোমার মনে উলটো পালটা কিছু উদয় হয়, আর সেটা ভেবে ছেলেকে দেশে ফেরা থেকে আটকাতে চাও, তাহলে তোমার অবগতির জন্য জানিয়ে দিচ্ছি যে তুমি যার থেকে তোমার ছেলেকে আড়ালে রাখতে এতো কসরত করছো। সে এখন তোমার ছেলের দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করবে না। সুতরাং তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।

নিজের কথা শেষ করে তানিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল আশরাফ।তানিয়া আশরাফের গমনরত পথের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল।আশরাফের বলা কথাগুলোর তাৎপর্য মনে করতেই চোখ বন্ধ করে একটা গভীর শ্বাস টানলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো সময় নিয়ে।
আশরাফের বলা কথা,নিজের অহেতুক ভাবনা সব একপাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো।ছেলে বাড়ি ফিরছে তার। এখন বসে থাকলে হবে না।ছেলের থাকা খাওয়ার যেন কোন‌ অযত্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।বাড়ি কাজের লোক আছে তবে তাদের ভরসায় ছেলের কাজ ফেলা রাখা যাবে না। তাছাড়া আদিব খুঁতখুঁতে স্বভাবের, কোন কিছু এদিক ওদিক হলেই চটে যায়। সুতরাং তানিয়া কোন ঝুঁকি নিতে চায় না।

দুই তলার দক্ষিণের ঘরের সামনে এসে থামলো তানিয়া।এই ঘরটা আদিবের।দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে।আদিব না থাকলেও রোজ নিয়ম করে ঘরটা পরিষ্কার করায় তানিয়া। তবুও আজ যেন মনে হলো ঘরের আনাচে কানাচে বেশ ধুলো জমেছে।সেই সাথে একটা ভ্যাপসা গন্ধ‌ নাকে আসছে।ঘরের জানালা গুলো খুলে দিল তানিয়া। দক্ষিণের জানালা টা খুলতেই চোখ পড়লো সামনের আলিশান দোতলা বাড়িটা। সাথে সাথে মুখে জুড়ে অন্ধকার নামলো তার।জানালার আধ খোলা পাটটা শব্দ করে আবার বন্ধ করলো সে।অনেকদিন পর ফের রাগ হলো শ্বাশুড়ির উপর।
_______________
-কি খবর জায়েদ?শরীর গতি ভালো?

-জ্বি,মিয়া ভাই।

-শরীর ভালো; তাহলে চোখ মুখ অমন দেখাচ্ছে কেন রাতে ঘুম হয় নি?

-সালেহার শরীর ভালো না।কাল রাতেও গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে , সারারাত ঘুমায় নি।আবোল তাবোল বকেছে।

-সে কি কথা!এত খারাপ অবস্থা,আমাকে ডাকিসনি কেন?

-অত রাতে আর তোমাকে বিরক্ত করতে চাই নি।তাই আর কি…!

-রাবিস।তোমাকে কে বলল আমি বিরক্ত হবো।নিজের মনে যাতা ভাববেনা।চলো দেখি ,ভেতরে চলো, দেখি কি অবস্থা।

কথাটা বলতে বলতে নীল রঙের গেটটা ঠেলে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো আশরাফ।এই বাড়িটা তার সেজ ভাই জায়েদের। আশরাফের বাবা আহাসান‌উল্লার সহায় সম্পত্তি বলতে খুলনা শহরে পাঁচ বিঘা জমি ছিল।যা মৃত্যুর আগে তাদের চার ভাই,বোন আর তাদের মা জাহানারার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন তিনি।আহাসান‌উল্লার অবশ্য ইচ্ছা ছিল ছেলেরা একসাথে থাকবে এক ছাদের তলে কিন্তু পুত্র বধূদের আচার আচরণ দেখে সে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয় তাকে ।পরবর্তীতে যার যার অংশ তাকে বুঝিয়ে দিয়ে প্রাচীর টানেন জমিতে।ছেলেরা দূরে থাকুক তবুও একে অপরের মনে থাকুক এমন ভাবনা থেকে এ সিদ্ধান্ত নেন।
বাবার রেখে যা‌ওয়া সেই জমিতে পরে তারা তিন ভাই পাশাপাশি বাড়ি তৈরি করে।পরপর তিনটে বাড়ি, দূর থেকে দেখলে মনে হয় গলা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায় তাদের মধ্যকার দূরত্ব।ঠিক যেমন এ বাড়ির মানুষগুলোর সাথে একে অপরের দূরত্ব।
তিক্ত হলেও কথাটা সত্যি ,বাড়িগুলো একে অপরের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাড়ির লোকেরা কালে ভাদ্রেও একে অপরের সামনাসামনি হয় না। জাহানারার মৃত্যুর আগে যদিও কিছু আন্তরিকতা অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু জাহানারার মৃত্যুর পর সেটাও প্রায় নিঃশেষ হয়েছে।ভাই ভাইয়ে এখনো হয়ত কিছুটা সম্পর্ক আছে যার দরুন একে অন্যের বিপদে তারা এগিয়ে যায়,ভালো মন্দে পাশে থাকে হোক সেটা শুধু চৌকাঠ পর্যন্ত তবুও কিছু আছে। কিন্তু বাড়ির ব‌উ ছেলে-মেয়েরা ভুলেও একে অপরের ছায়া মাড়ায় না।কি জানি কোন অদেখা প্রতিযোগিতায় একে অপরের থেকে এগিয়ে থাকতে চায় তারা! যার জন্য নিজেদের মাঝে এই দূরত্ব টেনেছে!

আজ অনেক দিন পর জায়েদের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো আশরাফ।বছর পাঁচেক আগে জায়েদের একতলা টিনের ঘর ভেঙ্গে তিন তলা বিশিষ্ট বিরাট বিল্ডিং তুলেছে আকিব।আকিবের তৈরি কৃত এই বিল্ডিংয়ে আজ প্রথম ঢুকছে আশরাফ।অবশ্য বাড়ি তৈরি করার সময় একবার দেখে গিয়েছিল কিন্তু তারপর আর আসা হয়নি। বাড়িতে ওঠার সময় আকিব চাচাদের দাওয়াত করেছিল তবে আশরাফ আসতে পারেনি। তৃপ্তির শ্বশুর মারা গিয়েছিল। আশরাফ কে সেদিন সেখানে যেতে হয়েছিল।আজ ভেতরে ঢুকে চকচকে ঝকঝকে বাড়িটা দেখে মুখের কোণে এক চিলতে হাঁসি খেলে গেল আশরাফের।যাকে বলে প্রশান্তির হাঁসি।

এক দুর্ঘটনায় জায়েদ যখন পায়ে আঘাত পেয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করলো তখন সব কিছু থমকে গিয়েছিল তাদের পরিবারের জন্য।তার বাবার মতো শক্ত মানুষ‌ও ভেঙ্গে পড়েছিলেন!অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক।হাতে ছেলের পুলিশ সুপার হিসাবে জয়েন্ট করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আর ছেলের পায়ের শিরা থেঁতলে যা‌ওয়ার জন্য অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন চলছে ।এমন পরিস্থিতিতে যে কেউ ভেঙ্গে পড়বে।তবে মা শক্ত হাতে সব সামলেছিল। জায়েদ কে নতুন ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যুগিয়েছিলেন।ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য যা যা করণীয় তাই তাই করেছিল।জায়েদ‌ও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সামান্য প্রাইমারি স্কুলের চাকরি করে তাদের দুই ভাইয়ের মতো সমাজে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।পারেনি সংসারে অভাব অনটন ঠেলে সচ্ছল জীবন কাটাতে। জায়েদের সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন দেখে তার মা প্রায়স চিন্তা করতো।আফসোস করে বলতো,” আমার সবচেয়ে যোগ্য ছেলেটা ভাগ্যের ফেরে আজ সবার থেকে পিছিয়ে গেল!” মায়ের কত চিন্তায়ই না ছিল জায়েদ কে নিয়ে। জায়েদের অসচ্ছল অবস্থা নিয়ে।
অথচ আজ, আজ জায়েদ তাদের চার ভাইবোনের মধ্যে সবার থেকে এগিয়ে। সবার চেয়ে উপরে।তার আর্থিক সচ্ছলতা আর সামাজিক মর্যাদার সামনে এখন তারা চার ভাই বোন কিছুই না।মা আজ বেঁচে থাকলে আকিবের এই উন্নতি, জায়েদের এই সুখ দেখে কত খুশিই না হত!
কথা গুলো নিজ মনে ভাবতে ভাবতে সামনে এগিয়ে গেল আশরাফ।মায়ের অন‌উপস্থিতি শরণ করে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলতে ভুলল না।জায়েদ তার পাশেই ছিল।ভাইয়ের দ্বীর্ঘশ্বসের শব্দ তার কানে ঠিক পৌঁছাল।

-কি হলো? হঠাৎ দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললে যে?

-মা’র কথা মনে পড়লো হঠাৎ। আজকাল মা’র কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়।মনে হয় বাবা যতটুকু সুখ স্বস্তি দিয়ে গিয়েছিল, আমরা তার সিকি কণাও দিতে পারিনি তাকে।সেই জন্য হয়ত এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে।না হলে হয়ত আরো কটা দিন বাঁচতো।

-ও কথা বলতে নেই।হায়াত ম‌ওত আল্লাহর হাতে। আল্লাহ যা ভালো মনে করেছে করেছেন।

জায়েদের পাথর কঠিন কণ্ঠ।হয়ত কণ্ঠের কঠোরতার আড়ালে মনের দুর্বলতা লুকাতে চাইছে। ব্যাপার টা আন্দাজ করলো আশরাফ তবে কিছু বলল না।

-ব‌উমা বাড়ি নেই?

তিন তলার বিরাট ফ্ল্যাটটার ভেতরে প্রবেশ করে এদিক ওদিক তাকিয়ে জানতে চাইলো আশরাফ।জায়েদ সামনে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,

-না।বাবার বাড়ি গেছে।আজ চলে আসবে।আকিব আনতে গেছে।

-এইবার বুঝেছি!ব‌উ বাড়ি নেই সালেহা নিশ্চয়ই পানি ঘাঁটাঘাঁটি করেছে।সেই জন্য এই অবস্থা!

-সে কথা বলতে।উনি তো সুযোগ পেলেই ঐ করে।বাড়ি যে এতোগুলো কাজের লোক আছে তাদের কাজ ওনার পছন্দ হয় না।তারিন থাকলে যাও একটু বকে ধমকে রাখে কিন্তু সে নেই এই সুযোগে যা মনে চায় তাই করে।

সালেহার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল জায়েদ।সালেহা জেগেই ছিল বড় ভাসুরের গলার স্বর শুনে দুর্বল শরীরে উঠে বসলো।মাথায় কাপড় টেনে সালাম দিল আশরাফ কে।জায়েদ একটা চেয়ার টেনে বিছানার সামনে রাখলো।আশরাফ সালেহাকে সালামের উত্তর দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,

-চেহারা ছবি যা বানিয়েছ তোমাকে দেখে তো ভয় করছে আমার।একি অবস্থা করেছ! হ্যাঁ! ঔষধ পানি ঠিকঠাক খাও তো না কি?

-খাই তো ভাই।তাও এরকম হলে কি করবো বলুন!

অসুখে পেঁচিয়ে ধরা ভাঙ্গা গলায় ম্লান হেঁসে বলল সালেহা। আশরাফ তার কথা শুনে বলল,

-শুধু ঔষধ খেলে তো হবে না।নিয়ম মাফিক চলতেও হবে।যে রাজ রোগ নিয়ে বেড়াচ্ছ;তাতে একটু এদিক ওদিক হলেই ভোগান্তির শেষ নেই।দেখি হাত দাও পেশার টা দেখি কি অবস্থা।

জায়েদ স্ফিগমোম্যানোমিটার এগিয়ে দিল আশরাফের দিকে।মায়ের অসুস্থতার জন্য এটা অনেকদিন হলো কিনেছে আকিব। আশরাফ পেশার মেপে যন্ত্র টা একপাশে রাখতে রাখতে বলল,

-পেশার লো।ভালো করে খাওয়া দাওয়া করো সালেহা।জায়েদ খেয়াল রাখ ওর দিকে।

এরপর প্রেসক্রিপশনে দুটো নতুন ঔষধ লিখে দিয়ে আবার বলল,

-ঔষধ দুটো খেয়ে উন্নতি হয় কি না সেটা জানাবে।আমি আবার কাল আসবো।আর ভুলেও পানির কাজ করতে যাবে না। শ্বাস কষ্টের রোগী তুমি, ওসব করতে গেলে হয়। তাছাড়া বাড়িতে কাজের মানুষ থাকতে তুমি ওসব করতে যাও কেন।ছেলে তোমার আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করছে,সেটা একটু ভোগ করো।কেন শুধু শুধু খাটা খাটনি করে শরীরের উপর জুলুম করছো!

কথা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালো আশরাফ।সালেহা তড়িঘড়ি দুর্বল কণ্ঠে জায়েদের উদ্দেশ্যে বলল,

-আকলিমাকে বলো ভাই কে চা নাস্তা দিতে।

-না, আজ আর কিছু খাবো না। তুমি সুস্থ হ‌ও, একবারে তোমার হাতে এলাচি দিয়ে দুধ চা খাবো।

-সে না হয় খাবেন।তবে আজ একটু কিছু মুখে দিন, অন্তত এক কাপ চা। কতদিন পরে আসলেন। হ্যাগো !দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও আকলিমাকে বলো।

সালেহা তাড়া দিল জায়েদ কে ।জায়েদ ব্যস্ত পায়ে সামনে আগাচ্ছিল তার আগে তাকে থামিয়ে দিল আশরাফ।বলল,

-আজ সময় নেই সালেহা ।এক জায়গায় যেতে হবে। আবার আসবো তো, সেদিন চা নাস্তা খাওয়া যাবে।আজ আসি।তুমি নিজের খেয়াল রেখ ।আর কোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানিয়ো।

আশরাফের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো সালেহা। আশরাফ জায়েদের সাথে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।দুই ভাই কথা বলতে বলতে নিচে নেমে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই চোখ গেল রাস্তার অপর পাশে।নাজিফা নামছে রিকশা থেকে। সালেহার অসুস্থতার কথা শুনে তাকে দেখতে এসেছে সে। আশরাফ কে দেখেই এক প্রকার দৌড়ে এলো সে। আশরাফ কে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো। কুশলাদি বিনিময় শেষে আশরাফ অভিযোগের সূরে বলল,

-জায়েদের এখানে আসতে পারো তুমি আর দুই পা বাড়িয়ে আমার বাড়ি যেত পারো না!না কি মিয়া ভাইকে ভুলে গেছ তোমরা?সেদিন দেখলাম শাহেদ খুলনা এলো, সাজ্জাদের বাড়ি গেল, জায়েদের এখানে দুই রাত কাটালো আমার বাড়ি গেল না। আবার তুমিও আমার বাড়ি মুখো হ‌ও না। ঘটনা কি বলো তো !সবাই মিলে আমাকে এক ঘরে করার পরিকল্পনা করছো না কি?

-না না,মিয়া ভাই তেমন কিছু না।আসলে বাড়ি থেকে বের হওয়া হয় না,আজ‌ও আসা হতো না। মেয়ের কোচিংয়ে যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে তাই ভাবলাম সেজো ভাবি অসুস্থ তাকে দেখে যাই।তোমার ওখানে সময় করে যাবো একদিন।

আশরাফের কথার জবাবে তড়িঘড়ি নিজের স্বপক্ষে বলল নাফিজা। আশরাফ বোনের কথা শুনে ম্লান হাসলো।সে জানে তার বোনের তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য ঐ একদিন হয়ত কখনোই আসবে না।মায়ের মৃত্যুর পর মাকে বহন করা খাটিয়ার পিছু পিছু আশরাফের বাড়ির উঠান থেকে তার বোন-ভাইয়েরা সেই যে বের হয়েছে আর তার চৌকাঠ মাড়াই নি।এতে অবশ্য সে তাদের দোষ দিতে পারে না।সে অধিকার তার নেই।দোষ যেখানে নিজের সেখানে অন্যকে দোষ দেওয়া চলে না।কথাগুলো নিজ মনে ভেবে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আশরাফ।বোনকে নিজের বাড়ি যা‌ওয়ার কথা আরো একবার মনে করিয়ে দিয়ে অনেকটা ব্যাস্ততার সাথে স্থান ত্যাগ করলো।মা মা’রা যাওয়ার পর থেকে কেন জানি ভাই বোনেদের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না সে।নিজেকে বড্ডো ছোট্ট ছোট্ট লাগে।অপরাধী মনে হয়।মনে পড়ে সেই বিভৎস রাতটা টা।বাবা মারা যা‌ওয়ার পরে মায়ের চোখে দেখা সেই প্রথম অশ্রু,সেই অসহায় মুখ ।সবটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।মাঝে মাঝে তার মনে হয় মা হয়ত তার উপর অভিমান করেই তাদের ছেঁড়ে চলে গেছেন। কষ্ট হয় কথাটা মনে হলেই।বুক ভারী হয়ে আসে। পুরুষ মানুষকে কাঁদতে নেই ,এই অঘোষিত নিয়ম ভেঙ্গে চোখের কোণ ভিজে যায়।
আশরাফের মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় পিছনে ফিরে গিয়ে সবকিছু ঠিক করতে।এই যে সম্পর্কের দূরত্ব গুলো, এই দূরত্বের শুরুটা রুখে দিতে।পুরোনো সময়টা ফিরে পেতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না।
চলে যাওয়া সময় কি আর ফিরে পা‌ওয়া যায়!যায় না…!

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২

আদিবের যশোর এয়ার পোর্ট থেকে বের হয়ে গাড়ি ঠিক করতে করতে মাগরিবের আজান পড়লো।সে গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলো গাড়িচালক।গাড়ির ছিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলো আদিব।শরীর ক্লান্ত ছিল তাই তো একটু আরামে চোখ বুজে এলো তার। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো সেটা নিজেও টের পেল না।তার ঘুম ভাঙল পরিচিত কণ্ঠস্বরে।চোখ পিটপিট করে পাশ ফিরে জানালার বাইরে তাকাতেই লম্বাটে ভারি মুখটা দেখে ঘুম ছুটে গেল তার।মুখে ফুটে উঠল চ‌ওড়া হাঁসি।অপরপাশের ব্যক্তিটির‌ও চোখ পড়লো আদিবের সেই হাঁসি।সেও দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ভ্রূ নাচিয়ে বলল,

-ঘুম ভেঙ্গেছে ডিজনি প্রিন্স!না কি প্রিন্সেস লাগবে?

সেই পুরোনো ভঙ্গিতে নতুন রসিকতা। আদিব ডান ভ্রুতে তর্জনী বুলিয়ে দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে হাসলো। হাঁসির সময় তার ত্যাড়া বাঁকা গজ দন্তটা উঁকি দিল ঠোঁটের ফাঁকে। দারুণ দেখালো ছেলেটাকে।আদিবের সেই দারুণ ভঙ্গির হাসি দেখে সজীব নিজের বুকের পাশে হাত রেখে নাটকীয় ভাবে বলল,

-ইশশশশ…খন্দকার সাহেব, জান নিবেন না কি!এত সুন্দর করে কেউ হাসে বুঝি!

সজীবের কথা শেষ না হতেই শব্দ করে হেঁসে উঠলো আদিব।গাড়ি থেকে বের হয়ে দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো পুরোনো বন্ধু কে। সজীব‌ও দৃঢ় আলিঙ্গনে আগলে নিল তাকে।একে অপরকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই আদিব বলল,

-গুড টু সি ইউ ম্যান।আমি কল্পনাও করতে পারিনি দেশে ফিরেই তোর সাথে দেখা হবে।আমি খুব খুশি হয়েছি তোকে দেখে। খুব খুশি।কিন্তু তুই এখানে! মানে কীভাবে…?

সজীবকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো আদিব। তার দেশে ফেরার কথা তার পরিবার ছাড়া কারো জানার কথা না।আর সজীবের তো প্রশ্নই ওঠে না!

-খূলনার দিকে যাচ্ছিলাম,মাঝপথে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল।এই ভর সন্ধ্যা বেলায় হাইওয়েতে গাড়ি ঘোড়া কিছু পাচ্ছিলাম না বাধ্য হয়ে তোর এই গাড়ির সামনে জীবন বাজি রেখে দাঁড়াতে হলো।তোর ড্রাইভার সঠিক সময়ে ব্রেক না মারলে আজ আমার ভবলীলা সাঙ্গ হতো। ধন্যবাদ মামা সঠিক সময়ে ব্রেক কষার জন্য।
একদমে কথা বলে থামলো সজীব।শেষের কথাটা ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল। ড্রাইভার তার কথা শুনে মুখ কুঁচকালো।নিজের আঞ্চলিক ভাষায় থড়বড়িয়ে বলল,

-ওরকম পাগলামো করে কেউ! যদি আমি ঠিক সময় গাড়ি না থামাতাম, তাহলে কি হতো! গাড়ির চাকা আপনার উপরে উঠে যেত, আমাকে জেল খাটতে হত!

-আরে মামা এতো নাক মুখ শিটকাচ্ছেন কেন, ওঠেনি তো গাড়ির চাকা আমার উপর।সামলে নিছেন তো আপনি। সো জাস্ট চিল।

সজীবের কথা শুনে বিরক্তিতে ঠোঁট বেকালো গাড়ি চালক ।তারপর গাড়ি থেকে নেমে বিড়বিড় করতে করতে রাস্তার পাশে ঝোপের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। সজীব তা দেখে ঠোঁট চেপে হেঁসে বলল,

-বুঝেছিস ,গাড়ির ব্রেক কষতে গিয়ে, মামার ব্রেক ঢিলা হয়ে গেছে।

সজীবের কথা শুনে দাঁত বের করে শব্দহীন হাঁসি হাসলো আদিব।হাসতে হাসতেই বলল,

-আমি ভেবেছিলাম এত বছরে হয়ত সজীব ওয়াহিদ বদলে গেছে ।বাট স্যরি আই ওয়াজড রং।সে একটুও বদলায়নি।

স্বগোতক্তি করলো আদিব। সজীব আদিবের কথা শুনে নিজেকে ভালোভাবে পরখ করে বলল,
-কৈ! বদলেছি তো!ভালো করে দেখ। স্বাস্থ্য শরীর আগের থেকে উন্নত লাগছে না?

-আমি বাইরের পরিবর্তনের কথা বলছি না। বলছি ভেতরের পরিবর্তনের কথা।থাক তুই বুঝবি না।তুই তোর ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে আই র‌ওনা দিই।বাকি কথা যেতে যেতে হবে।

-ব্যাগ ব্যাগেজ!ওরে আল্লাহ! দাঁড়া আসছি।

আদিবের কথা শুনে হঠাৎ সজীবের কি যেন মনে পড়ছে এমন ভাবে ছুটলো গাড়ির দিকে।গাড়ির দরজা খুলতেই ব্যাকসিটে ছোট্ট তুলিকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। ঝুঁকে আলতো হাতে মেয়েকে কোলে নিয়ে ড্রাইভারকে বলল তার লাগেজ আদিবের গাড়িতে উঠিয়ে দিতে।তারপর মেয়েকে আদিবের সামনে নিয়ে গিয়ে অনেকটা ফিসফিস করে বলল,

-আমার মেয়ে,তুলি।

-তুই বিয়ে করলি ক

-আস্তে !আস্তে কথা বল।উঠে পড়বে তো।উঠলেই মায়ের জন্য প্যানপ্যান করবে।

আদিবের কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলল সজীব।কথাটা বলতে যেয়ে চোখ মুখে খেলে গেল তার অসহায়ত্ব।আদিব সেটা দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো।সজীব তা দেখে চোখ সরু করলো।মানে হাসছিস কেন?আদিব সাথে সাথে নিজেকে সংযত করলো।
তুলির ঘুম ভীষণ পাতলা একটু শব্দ কানে গেলেই ঘুম ছুটে যায় তার।এখন যদি এই মাঝ রাস্তায় মেয়ের ঘুম ভেঙ্গে যায় তাহলে ব্যাপারটা সজীবের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না।তাই এতো সাবধানতা।এতে এত হাসির কি আছে!

-বিয়ে করেছিস কবে?

সজীবের মতো ফিসফিসিয়ে বলল আদিব। সজীব গাড়ির দিকে আগাতে আগাতে বলল,

-ভেতরে চল বলছি।

গাড়িতে উঠে বসলো তারা। সজীব মেয়েকে একটা পাতলা চাদর দিয়ে মুড়ে নিজের সাথে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বসলো।সজীবের গাড়ি লক করে তার ড্রাইভার কেও সাথে নিলো।সামনে ********বড় বাজার পড়বে সেখান থেকে মেকানিক নিয়ে এসে গাড়ি ঠিক করে বাড়ি নিয়ে যাবে সে।গাড়ি চলমান হতেই আদিব তার করা প্রশ্নটা পুনরাবৃত্তি করলো।সজীব মেয়েকে নিজের সাথে আর একটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

-সামনের ডিসেম্বরে বিয়ের বয়স পাঁচ বছর পড়বে।

-ভালো, তা ব‌উর নাম কি?

-শিপ্রা।

-কি! শিপ্রা!আমাদের শিপ্রা?
বিস্মিত কণ্ঠে আদিবের প্রশ্ন। উত্তরে সজীব মাথা ঝাঁকালো।সজীবের উত্তরে অবাকতা ছেয়ে গেল আদিবের চোখে মুখে।আদিব যতদূর জানতো শিপ্রা আর সজীব একে অপর কে দুই চোখে সহ্য করতে পারতো না।এমন কোন দিন যেত না, যেদিন দুজনের মধ্যে চুল ছেড়াছিড়ি ঝগড়া হতনা!তারা দুজন নাকি পাঁচ বছর ধরে একসাথে আছে।আবার একটা কন্যা সন্তানের মা-বাপ‌ও হয়েছে!এমন কথা শুনে অবাক হ‌ওয়াই তো স্বাভাবিক।আদিবের রিয়াকশন এমন হবে সেটা জানা ছিল সজীবের। সে আদিবের অবকতা নজর আন্দাজ করে বলল,

-অত অবাক হয়েও না মামা।তুমি তো আমাকে একা ফেলে লন্ডন উড়াল দিলে।আমি কলেজে এতিমের মতো ঘুরতে লাগলাম। শিপ্রা চুন্নির আমাকে দেখে মায়া হলো।চোখ মুখ কুঁচকে আমার পাশে এসে বসলো,ফেরার পথে পায়ে পা মিলালো।ব্যাস শুরু হলো একসাথে ওঠা-বসা, হাঁটা -চলা,পড়া-শোনা। দিন অতিবাহিত হলো।আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলাম মেয়েটা অতোটাও খারাপ না।বছর গড়াতেই দুইজনের বন্ধুত্ব গভীর হলো।সেই বন্ধুত্ব কখন কখন ভালোবাসার রূপ নিলো জানা নেই আমার।যাই হোক ভালো তো বাসলাম, কিন্তু বলার সাহস হলো না।যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া শয়তান ছেমড়ি তখনো আমাকে দেখে নাক কুচকাতো সুতরাং যেচে পড়ে অপমানিত হ‌ওয়ার ঝুঁকি নিলাম না।এভাবে সময় গড়ালো।দেখতে দেখতে এমবিবিএস শেষ হলো দুইজনের। বিসিএস দিলাম। কপাল ভালো ছিল আমার, তাই প্রথমবারেই টপকে গেলাম বিসিএসের গণ্ডি।এরপর এ ট্রেনিং, ও ট্রেনিং শেষ করে ঝিনাইদহের এক ভুঁড়ো গ্রামে সরকারি হাসপাতালে ডিউটি শুরু হলো আমার। সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি করে বাড়ি ফিরলেই ঘুমে চোখ বুজে আসতো।এই নতুন ব্যস্ততায় শিপ্রার কথা মনে থাকলেও যোগাযোগ করা হয়ে উঠতো না।এমন করে মাস ছয়েক অতিক্রম হ‌ওয়ার পর হঠাৎ একদিন ম্যাডাম আমার হাসপাতালে হাজির।আমাকে দেখেই ভালো-মন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করেই কালিবাজির মতো পটপট করে ফুটতে লাগলো।জানিস তো রেগে গেলে কেমন মুখ দিয়ে খ‌ই ফুটায়!নিজের সব রাগ অভিমান শেষ হ‌ওয়ার পর ফ্যা-ফ্যা করে কাঁদতে লাগলো।কেন কাঁদছে আমি জানি না সান্ত্বনা দেব কি বলে,ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার ভাবনার মধ্যে আর তার কান্নার মধ্যেই বিশ্রী শব্দ করে নাক টেনে বলল,”মা বিয়ে ঠিক করেছে,আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি।”
বিশ্বাস কর এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলবো কিচ্ছু বুঝে পেলাম না। সৌজন্য রক্ষার্থে বললাম,”ও”।এই “ও” বলায় আমার কাল হলো।কালনাগিনীর মতো ফুঁসে উঠে ছোবল মারতে উদ্যত হলো।আমি তো ভয়ে একদম চুপসে গেলাম।বুঝতে পারলাম আমার “ও” বলতে অসন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি।নিজের ভুল বুঝতে পেরে সাথে সাথে মুখে কুলুপ আঁটলাম।এরপর কতসময় নিয়ে তিনি ফোঁস ফোঁস করলো আমার জানা নেই।শান্ত হ‌ওয়ার পর বলল,”কাজী অফিসে চল তোকে বিয়ে করবো।” কথাটা শুনে মন জুড়িয়ে গেলরে।এরপর একটা শব্দও ব্যয় না করে সোজা কাজী অফিসে হাজির হলাম।বিয়ে সম্পন্ন হতেই শিপ্রা ওর বাপকে ফোন লাগালো।ওর বাপ ফোন ধরে বলল,”বিয়ে করেছিস ভালো কথা, এবার মন দিয়ে সংসার কর।খবরদার ভুলেও বরের সাথে মারামারি করে এ বাড়ি আসিস না ।তাহলে কিন্তু প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে যাবে।তোর মাকে তো চিনিস!”বাপের কথা শুনে উনি ফোন রাখলেন।আমরা গিয়ে উঠলাম আমার ছোট্ট ভাড়া বাসায়।এরপর আর কি সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগলাম।একবছর পরে এই ছানাটা হলো।এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তবে শাশুড়ি এখনো কেমন আড় চোখে তাকায়। আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের এই একটা সমস্যা।

-শাশুড়িকে দামি দামি মিষ্টি খাওয়ান, দেখবেন শাশুড়ি আর আড় চোখে তাকাবে না।

সজীবের কথা শেষ হতেই গাড়ি চালক তাদের কথার মাঝে ফোড়ন কাটল। সজীব তার উত্তরে বলল,

-আরে মামা সে কথা বলতে,গত পাঁচ বছরে ঢাকা শহরের সব নামিদামি দোকানের মিষ্টি তার পেটে ফেলেছি কিন্তু তার সেই আড় চোখ সোজা হয়নি।

-কি বলেন মামা!তাই নাকি?তাহলে তো আপনার শাশুড়ি খুব কঠিন মনের!

-কঠিন মানে, সেই কঠিন! একদম ইস্পাতের মতো!

কথাটা বলে হাসলো সজীব।তার হাঁসিতে উপস্থিত সবার ঠোঁটের কোণেও দেখা দিল মৃদু হাঁসির রেখা।সজীব হাসতে হাসতে গাড়ি চালকের উদ্দেশ্যে ফের বলল,

-মামা কি নোয়াখালীর না কি?

-জ্বি মামা।

-আমি কথা শুনেই বুঝছি…।মামার রাগ কমেছে?

-রাগ কমেছে তবে আপনি তখন কাজটা একদম ঠিক করেননি।উপর নিচে কিছু যদি একটা হয়ে যেত!

-স্যরি মামা।আসলে ভর সন্ধ্যা বেলা এমন জায়গায় গাড়িটা খারাপ হলো!মেয়ে রয়েছে সাথে এদিকে আশেপাশে কোন বাড়ি ঘর নেই তারপর লিফট চাইলে কোন গাড়িও দাঁড়াচ্ছে না। বাধ্য হয়ে একটু ডেয়ারিং দেখাতে হলো।

-বুঝেছি।তবে এমন আর করবেন না।আর কেউ আমার মতো ব্রেক না‌ও কষতে পারে।

-জ্বি মামা মনে রাখবো।

কথাটা বলে প্রশস্ত হাসলো সজীব।সে আসলে নিরুপায় হয়ে তখন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল।গাড়ি নষ্ট হ‌ওয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টা দেড়িয়ে ছিল তারা সেখানে। ড্রাইভার তার সাধ্য মতো চেষ্টা করছে গাড়ি ঠিক করতে কিন্তু পারেনি।এদিকে সন্ধ্যায় ঘনিয়ে আসছে।আসে পাশে কোন বাড়ি ঘর‌ও নেই যে সাহায্য নেবে। মেয়েটা এদিকে কাঁদছে। অক্টোবর মাস চলছে। শীত না পড়লেও বাইরে ভালোই ঠান্ডা। বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে মেয়েটার শরীর খারাপ করবে।এমনিতে মেয়েটার অল্পতে শরীর খারাপ হ‌ওয়ার ধ্যাত।এই হাইওয়েতে লিফটের উদ্দেশ্যে হাত দেখালেও কোনো গাড়ি থামছে না। উপায়ান্তর না পেয়ে বাধ্য হয়ে সামনে ধেয়ে আসা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে।কপাল ভালো ছিল গাড়ির ড্রাইভার তার থেকে কিছুদূরে গাড়ির ব্রেক করলো। হ্যাঁ দুই চারটে আঞ্চলিক ভাষায় গালিগালাজ করলো তাকে কিন্তু সেসব শোনার সময় কোথায়! সে ছুটলো সাহায্যের জন্য।গাড়ির কাছে গিয়ে ড্রাইভার কে কিছু বলতেই যাবে তখন চোখ গেল পিছনের ছিটে।খুব পরিচিত একটা মুখের পরিবর্তিত রূপ চোখে পড়লো তার। তৎক্ষণাৎ নিজের চোখকে বিশ্বাস না করতে পারলেও পরে বুঝলো সে ঠিক দেখছে।এটা তার পুরোনো বন্ধু আদিব।সাথে সাথে ডাক লাগালো আদিব কে।গাড়ি চালক এই সময়টুকুতে কত কথা যে বলল তাকে কিন্তু সেসব কানে তুলল না সজীব।

-আমার তখনকার কথা গুলো মনে নিয়েন না ভাই আসলে রাগের মাথায় তখন কি না কি বলেছি।

অনেকটা ইতস্তত করে বলল গাড়ি চালক।নিজের রাগের মাথায় করা ব্যবহারের জন্য লজ্জিত সে।সজীব বুঝলো তার মনোভাব।সে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।বলল,

-আপনি তো তাও গালির উপর দিয়ে গেছেন। আপনার জায়গায় আমি হলে মাইর লাগাতাম।আমি বুঝেছি আপনার সিচুয়েশন,কিছু মনে করিনি।

গাড়ি চালক ইনার রিয়ার ভিউ মিরারে সজীবের হাস্যোজ্জ্বল মুখটার দিকে অবাক চোখে তাকালো।সজীবের বেশ-ভূষা, কথা-বার্তায় স্পষ্ট সে একবারে সাধারণ কেউ নয়।বেশ বড়সড় মাপের কেউ। সাধারণত এমন ধরনের মানুষকে একটু কড়া গলায় সর বললেও তারা তেড়ে মারতে আসে।অথচ এই লোক তার সাথে আন্তরিক গলায় কথা বলছে, আবার নিজের দোষ‌ও মানছে!গাড়ি চালক নিশ্চিত এই লোকের জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তাহলে নিজের দোষ মানা তো দূরের কথা, উলটো তার তখনকার ব্যবহারের জন্য তাকে দুই চার ঘা লাগিয়ে দিত। কিন্তু এই মানুষ টা তার দিক বোঝার দাবি করছে।নিজের ভুল গুনছে!

আদিব আর সজীব কথা বলছিল তার মাঝেই সজীবের ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।সে ফোন হাতে নিয়ে তার ড্রাইভার মতিন কে দেখিয়ে বলল,

-দেখো মতিন এখন দরকার নেই অথচ নেটওয়ার্ক এখন টঙে।চারকাঠি একদম জ্বলজ্বল করছে।আবার সিম কোম্পানির ফোন‌ও আসছে। কিন্তু যখন দরকার ছিল তখন পাওয়া যাচ্ছিল না।এদের সিম ফেলে দেব আমি। মতিন তুমিও ফেলে দেবে।বিপদে পড়লে যাদের নেটওয়ার্ক আগে পালায়, তাদের সিম রাখবো না।

-জ্বি স্যার।

সজীবের কথায় সম্মতি জানালো মতিন। সজীবের সাথে তাল মিলিয়ে সিম অপরেটারদের উদ্দেশ্যে সেও কিছু কটু বাক্য ব্যবহার করলো।মতিন আর সজীব মন মতো সিম অপরেটারদের কথা শুনিয়ে খ্যান্ত হলে আদিব বলল,

-ভালোই হয়েছে তখন কোন সাহায্য পাস নি। না হলে আমার সাথে কি তোর দেখা হত!আমার দাদি প্রায় একটা কথা বলতো ,”আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন!”

আদিবের সাথে সাথে সমস্বরে কথাটা বলে উঠলো সজীব।আদিব চকিত কণ্ঠে বলল,

-মনে আছে তোর?

-হ্যাঁ ,আছে।

ম্লান হাসলো সজীব।জাহানারা বেগম কে অনেক কাছ থেকে দেখার, জানার সৌভাগ্য হয়েছিল সজীবের।সেই সুবাদে অনেক সময় কাটিয়েছে সে তার সাথে।আজ হঠাৎ আদিবের মুখ থেকে মানুষ টার বলা কথা শুনে অনেকগুলো পুরোনো স্মৃতি হুড়মুড় করে মানসপটে ভেসে উঠলো।সাথে সাথে মনটা কেমন মিইয়ে গেল।তবে সেটা আদিবকে বুঝতে না দিয়ে প্রসঙ্গ বদলালো সে।বলল,

-তুই হঠাৎ দেশে ফিরলি যে! লন্ডন থেকে লাথি মেরে বের করে দিয়েছে না কি?

-অনেকদিন পর লম্বা একটা ছুটি পেলাম, তাই ভাবলাম তুই বেঁচে আছিস কি না দেখে আসি।

-হা…!ওসব বয়ান বাদ দাও চাদু!আমি মরে গেলেও যে তুমি আসতে না, সে আমার ভালো করে জানা আছে। লন্ডন যা‌ওয়ার আগে আমাকে বলে পর্যন্ত যাওনি।কি মনে করেছ সব ভুলে গেছি!না। কিচ্ছু ভুলিনি। নেহাত গাড়িটা নষ্ট হলো তাই দায় ঠেকে পিরিত দেখালাম ,না হলে কথা‌ও বলতাম না তোমার সাথে! হুঁ!

-ওরে শালা ! তোর মনে মনে তাহলে এই ছিল!আর আমি ভাবলাম তুই পুরোনো কথা ভুলে গেছিস!

– শালা না, সম্পর্কে মামা হ‌ই।তোর কপাল ভালো থাকলে মামা শ্বশুর হতা

নিজের কথা শেষ না করেই থেমে গেল সজীব।আদিবের মুখের পাল্টে যাওয়া রং দেখে বুঝতে পারলো মুখ ফসকে যে কথাটা বলতে যাচ্ছিল সেটা বলা উচিত হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে অযথা গলা ঝাড়া দিল।কথা ঘুরিয়ে বলল,

-কত দিনের জন্য এসেছিস দেশে?

-তিন মাস।

-তারপর আবার ফেরত যাবি?

-হুম।

-এবার কী মিয়া ভাই আর ভাবিকে নিয়ে যাবি সাথে?

-আমি থাকতে থাকতে যদি তাদের ভিসার কাজটা হয়ে যায় তাহলে নিয়ে যাবো। আমার কথা বাদ দে তোদের খবর বল।তোর বাড়ির সবাই কেমন আছে?
একটু থামলো আদিব তারপর একটু ইতস্তত করে বলল,
-সেজো চাচারা কেমন আছে?
এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আদিবের কেমন জানি লজ্জা করছিল।নিজের আপন চাচার খবর তাকে অন্য কারো কাছ থেকে শুনতে হচ্ছে ব্যাপারটা একটু লজ্জা জনক।তবে লজ্জার হলেও কথাটা সত্যি যে সে নিজের ফুপু চাচাদের কোন খবর জানে না।বিগত এগারো বছরে তাদের সাথে তার সেভাবে যোগাযোগ হয় না।
বিদেশ যাওয়ার পর প্রথম প্রথম ছোট্ট চাচু আর ফুপুর সাথে যোগাযোগ রেখেছিল আদিব কিন্তু তানিয়া জানার পর অশান্তি শুরু করলো। বিভিন্ন কথা বার্তা বলতে লাগলো। যার জন্য অনেকটা বাধ্য হয়ে সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হলো আদিবের। এরপর নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে এতোটাই ব্যস্ত হলো যে সম্পর্ক গুলো সব পিছনে ছুটে গেল।একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আদিব।

-বড় বু’র শরীর ভালো না। তাছাড়া সবাই ভালোই আছে।

-কি হয়েছে সেজ চাচির?
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো আদিব। সজীব একটা দীর্ঘশ্বাস শ্বাস ফেলে বলল,

-বছর সাতেক হলো শ্বাস কষ্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিছুদিন হলো সেটা বেড়েছে।

সজীবের কথার মাঝেই গাড়িতে ব্রেক কষলো ড্রাইভার। স্থানীয় বড় বাজারে থামিয়েছে সে গাড়ি। মতিন গাড়ি থেকে নেমে গেল।সজীব তাকে কিছু টাকা দিয়ে কি কি করতে হবে সেই দিকনির্দেশনা দিয়ে গাড়ি ছাড়তে বলল।গাড়ি আবার চলমান হলো।বাকি পথটুকু আর তেমন কোথা জমলো না দুইজনের।তুলির ঘুম ভাঙল। সজীব তাকে নিয়ে ব্যস্ত হলো আদিব‌ও নিজের ফোনে মনোযোগ দিল।
গাড়ি যখন আদিবের বাড়ির সামনে এসে থামলো রাত তখন প্রায় নয়টা।আদিব আর সজীব গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই লক্ষ্য করলো তাদের বাড়ির সামনে থেকে শুরু করে তার মেজ চাচা সাজ্জাদের বাড়ি পর্যন্ত বিভিন্ন মানুষের ছড়াছড়ি।যার মধ্যে কেউ পরিচিত তো কেউ অপরিচিত।বাড়ির সামনে এমন অবস্থা দেখে আদিবের কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ পড়লেও সজীবের ভেতরটা কেমন যেন কু ডেকে উঠলো। সে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল সামনে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

মায়ের কথা পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

#মায়ের_কথা
পর্বঃ ৬(শেষ পর্ব)
#সাবাব_খান

‘তোমার কি এমন স্বপ্ন আম্মা?’

আম্মা করুন কণ্ঠে বললেন, ‘এইটা আমার অনেক দিনের একটা স্বপ্নের কথা বাপ!’

‘কি কথা আম্মা?’
আম্মা ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি অবাক হলাম। ধ’মকের সুরে বললাম, ‘তুমি কি বলবা কিছু?’
আম্মা কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘শোন বাপ, তোর বাপের মাথা নষ্ট হওয়ার পর আমি অনেক মাইনষেরে অনুরোধ করছি। তোর চাচাগুলারে তোর মামাগুলারেও অনুরোধ করছি। তোর খালু,ফুফা কেউরে বাদ রাখি নাই। একটাই অনুরোধ করছিলাম। কইছিলাম আমার সোনা-গয়না যা আছে সব বেইচ্চা টাকা দিমু। খালি তোর বাপেরে একটু বিদেশে নিয়া চিকিৎসা করাইতে। ইন্ডিয়া নিয়াও যদি চিকিৎসা করাইতে পারতাম আমার মনে হয় কিছুটা ভালো হইতো। কিন্তু সাবাব, কেউ আমার অনুরোধ শোনে নাই। সময় কইরা কেউ তোর বাপেরে চিকিৎসা করতে নিয়া যায় নাই। সবাই নিজেরে নিয়া ব্যস্ত। কে নিয়া যাইবো তোর অসুস্থ বাপেরে চিকিৎসা করতে? তোর বাপের ভাই-বোন কেউই আগায়া আসে নাই আমার অনুরোধে। আমি কেউরে দিয়া ইট্টু মনের মত চিকিৎসা করাইতে পারি নাই। আমি মহিলা মানুষ। তিনডা বাচ্চা নিয়া নিজেও দৌড়াদৌড়ি করতে পারি নাই। আমার মনের একটাই স্বপ্ন তোর বাপেরে বিদেশ নিয়া যদি ইট্টু চিকিৎসা দিতে পারতাম। স্বপ্নটা কেউ পূরণ করতে আগায়া আসে নাই। আমি স্বামী নিয়া বিপদে পড়ছি। সবাই আমারে অনেক কতা কয়। কিন্তু আমার কামডা কেউ কইরা দেয় না। তুই আমার একমাত্র পোলা। তোর বাপ অসুস্থ। আমি তোরে কোনদিন ঐ দূরের দেশে পাঠাইতাম না। আমি তোরে একটা আশায় পাঠাইছি। আমার আশা তুই তোর বাপেরে এমেরিকা নিয়া চিকিৎসা করাবি। কত উন্নত দেশ এমেরিকা! কত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। আমার মনডায় কয় এমেরিকা নিয়া চিকিৎসা করাইলে তোর বাপে সুস্থ অইতো। শুধু এই কারণেই আমি তোর বউ কইরা আমার ভাইঝিরে আনতে চাইছিলাম। বাইরের মাইয়া আনতে চাই নাই। আমি ভাবছিলাম আমার ভাইঝিডা অনেক ভালো অইবো। তোর বউ হইলেও আমার স্বপ্নে বাধা দিব না। কিন্তু না, আমার ধারণা ভুল। অরা অনেক স্বা’র্থপর। অগো চাপ্টার বাদ। তোর কাছে এহন আমার একটাই অনুরোধ ; তুই বিয়া করার আগে তোর বাপেরে ইট্টু এমেরিকা নিয়া চিকিৎসা করাইস। তোর বাপের সুস্থ হওয়ার স্বপ্নডা পূরণ করিস বাবা। আমার স্বামী থাকতেও আমি অসহায়। যে স্বামীরে নিয়া বিপদে পড়ে সে বোঝে জীবনডা কতো কষ্টের। আপন বলতে তার কেউ থাকে না। আমার তুইই আপন। তুই আমার কথাডা শুনিস বাপ।’

আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। আম্মার কথার মাঝে হাহাকার ছিলো। ছিলো জীবনের প্রতি। আমার প্রতি অনুরোধ আর দায়বদ্ধতা। আমি কি জবাব দেবো? খানিক ভেবে আমি আম্মাকে বললাম, ‘আমি তো মাত্র আসছি এমেরিকায়! এখনই আব্বারে আনতে পারমু কিনা জানিনা! তবে আমি চেষ্টা করমু।’

আমি ফোন রেখে দিলাম। আব্বাকে নিয়ে আম্মার মনের কথা শুনে ভীষণ অবাক লাগলো। এতোটা হাহাকার যে আম্মার মনে, আমি নিজেও জানতাম না। আমি দুদিনের মধ্যেই আসিফ ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। দেশ থেকে সুস্থ মানুষকে এমেরিকায় আনাই অনেক কষ্টকর। সেখানে আব্বার মত একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষকে আনাটা একদম দুসাধ্য,কষ্টসাধ্য।

অনেকের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না। নিজেরও কষ্ট লাগলো আম্মার কথা শুনতে পারবো না বলে। অবশেষে একজন আইনজীবী আমাকে বিনোদন মিডিয়ার লোকদের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেন। মিডিয়ার লোকেরা খুব সহজেই ইউরোপ-এমেরিকায় আসতে পারে।

আমি অনেক কষ্টে মিডিয়ার কয়েকজন লোকের সাথে পরিচিত হলাম। তারপর এক পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করলাম। আব্বাকে অভিনেতা প্রমাণ করার জন্য তিনি আমাকে কিছু পরামর্শ দিলেন। আমি এফডিসিতে যোগাযোগ করে পরামর্শ অনুযায়ী আব্বার জন্য কিছু কাগজ তৈরি করলাম। আব্বাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত অভিনেতা সাজালাম। তারপরে বিনোদন মিডিয়ার টিমের সাথে নিয়ে এলাম এমেরিকায়। সেদিন আম্মার সাথে কথা বলার ছয় মাসের মধ্যেই আব্বাকে এমেরিকায় নিয়ে আসি। এখানেও টেনশন ছিল। আব্বাকে চিকিৎসার জন্য হসপিটালে রাখতে হবে। দেশে তো আশেপাশে সব একই রকমের লোকজন ছিলো। আর এখানে তো সব সাদা-কালো লোকজন। কেউ কেউ খুব ফর্সা আবার কেউ কেউ খুব কালো। আব্বা এদের মাঝে হাসপাতালে থাকতে গিয়ে আরো ভয় পেয়ে যায় কিনা। এসব চিন্তা ছিল আমার মনে। আমি অনেক ভয় নিয়েই আব্বাকে হাসপাতালে দিলাম ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে। ভিজিটিংয়ের দিন গিয়ে দেখে আসতাম। বুকে পাথরের মত ভয় ছিল। না জানি আব্বার আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যায়! এখানকার পরিবেশে লোকজন আব্বার সম্পূর্ণ অচেনা। একটা অসুস্থ মানুষ অচেনা পরিবেশে আরো অসুস্থ হয়ে যায়। এদের ভাষাও আলাদা। তবে একটা জিনিস সাপোর্ট ছিল। আমার আব্বা তো লেখাপড়া ছিলেন। ইংরেজিতে কথা বললে আব্বা খুব খুশি হয়ে যেতেন। তাকে শিক্ষিত মনে করে কিছু উত্তর দিতে পারতেন। সেটা যেরকমই হোক। আগে থেকেই তো এলোমেলো,অসংলগ্ন কথা বলতেন। এখানেও উত্তরে অসংলগ্ন কথাই বলতেন। তবে ইংরেজিতেই সব বলতেন। মাসখানেক যেতেই আব্বার মাঝে একটু পরিবর্তন আসে। পরিবর্তনটা পজিটিভ ছিল না। ছিলো নেগেটিভ পরিবর্তন। আব্বা বেশি পা’গলামো করতে শুরু করে। থাকতেই চাচ্ছিলো না হাসপাতালে। সেখানকার পরিবেশ,মানুষজন কিছুই পছন্দ হয়নি আব্বার।

আমি অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে আসতাম। অসুস্থ মানুষ কি আর এত বোঝে। নতুন এবং অচেনা পরিবেশের কারণেই মূলত সমস্যা হয়েছে। এভাবে একমাস কে’টে যায়। আব্বাও সেট হয়ে যায় হসপিটালে। শুধু সেট হয়ে যায় নি। অন্যান্য অসুস্থ লোকদের সাথে খেলাধুলাও করতেন, আড্ডাও দিতেন। কিছু কথাবার্তাশও ঠিক ঠিক জবাব দিতে পারতেন। এভাবে কে’টে যায় তিন মাস। এবার আব্বা জামা-কাপড় সব নিজে পড়তে পারতেন। হসপিটাল থেকে এসবই জানিয়েছিল আমায়। আমি নিজেও খেয়াল করেছি আবার চেহারায় এবং সবকিছুতে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ছাপ এসেছে। একটা পরিবর্তন চলে এসেছে। সেই তিন মাস পরেই এক সাক্ষাতে আব্বা আমার কাছে বললেন, ‘আমি কিন্তু সুস্থ হইতাছি বাবু! তোর মা’র কাছে এইডা কইস না। ওর কাছে বলবি আমি পা’গলই আছি। আমরা একসাথে সারপ্রাইজ দিমু তোর মায়রে।’

আমি বুঝতে পারলাম আব্বা আসলেই সুস্থ হচ্ছেন। কারণ আম্মার সাথে দুষ্টুমি করার ব্যাপারটাও আব্বার মাথায় আছে। এভাবে কে’টে যায় পুটো ছয় মাস। আব্বা পুরো সুস্থ এখন। ডাক্তার বলেছিলেন উনি অ্যা’ক্সিডেন্ট করার পরপরই যদি সুচিকিৎসা দেয়া হতো তাহলে এত সময় লাগতো না।

সুস্থ হবার পরে আমি আব্বাকে বাসায় নিয়ে এলাম। আব্বা বাসায় থাকতে চাচ্ছিলেন না। টুকিটাকি কাজ শুরু করেছিলেন। তবে একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে আব্বা আম্মার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতেন না। আব্বার গেটআপ পুরো চেঞ্জ হয়ে গেছিল। আম্মা দেখলেই বুঝতে পারতো যে আব্বা সুস্থ। আব্বা ফোনে কথা বলতেন আম্মার সাথে। কিন্তু পুরোপুরি পা’গল সেজে। আব্বা আমাকেও বলতে দেয়নি আম্মাকে। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। আমিও আব্বা-আম্মার দুষ্টুমির মাঝখানে বাধা হতে চাইনি।

আরো দু’মাস পরের কথা। আম্মা জানে আব্বা সুস্থ হয়নি। তারপরেও আমি এমেরিকায় এনে চিকিৎসা করেছি। এতেই আম্মা অনেক সন্তুষ্ট। কোনো আফসোস নেই আম্মার। দেশে আমার বিয়ে ঠিক করেছি। আমার সেই গার্লফ্রেন্ডের সাথেই। আজ আমরা বাপ-ছেলে বাড়ি এসেছি। বাড়ির সামনে এসে আমাদের গারি থামলো। আম্মা কিন্তু জানেনা যে আব্বা সুস্থ। বাড়ি কেউই জানে না। আগেই জানে আমি বাড়ি আসব। ঢাকা থেকে ভাড়াকৃত গাড়ি নিয়ে এসেছি। গাড়ির শব্দ পেয়ে আম্মাসহ আমার বোনেরা দৌড়ে এসেছে। আমি প্রথমে নামলাম গাড়ি থেকে। এরপরে স্যুটবুট পরিহিত কমপ্লিট মডার্ন ভদ্রলোকের ন্যায় আব্বা নামলেন। আম্মার চোখের দৃষ্টি বরফের ন্যায় স্থির হয়ে গেছে। আম্মা ভাবছে এ আমি কাকে দেখছি। আব্বার সেই পা’গলাটে চেহারাটা আর নেই। পরনের কাপড়গুলোও এলোমেলো নয়। হাঁটাচলায়ও কোনো অসংলগ্নতা নেই। কমপ্লিট একজন ভদ্রলোক তার স্বামী। আম্মার চোখের পলক সরছে না। কদমও চলছে না তার। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আব্বাই এগিয়ে গিয়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাদের সবার মাঝেই। আম্মা কান্না শুরু করে দিয়েছেন। আমি জোরগলায় বললাম, ‘ঘরে গিয়ে তোমরা কান্নাকাটি করো তো! বাইরে পাবিলিকলি কিছু কইরো না!’

কয়েকদিন পরের ঘটনা। আজ আমি বিয়ে করেছি। বউ নিয়ে আছি বাসর ঘরে। নিজের নতুন জীবনের কথা আর কি বলবো! আব্বা-আম্মার নতুন জীবন দেখেই কূল তো পাইনা। একদম নব বিবাহিত দম্পতির ন্যায় আচরণ করছে তারা। আব্বা বারবার রান্নাঘরে গিয়ে খোঁজ নেয় আম্মা হাঁপিয়ে উঠেছে কিনা। আজ সন্ধ্যায় দেখলাম আম্মাকে স্যালাইন বানিয়ে খাওয়াচ্ছে। ঈদের সুখে আছে তারা দুজন। আমারও সুখ লেগেছে তাদের সুখে। বাসর ঘরে বসে আমার বউকে বললাম, ‘তোমার জন্য আমি রাফারে এক গোল দিয়া সরাইয়া দিছি!’
বউ জবাব দিলো, ‘তুমি নিজেই তো ঠকছো! এক গোল দেয়া লোক আমি চাইনা!’

‘মানে?’

‘আমি চাই আমার জামাই হ্যাট্রিক করুক।
এরকম ব’দমাইশগুলার সবগুলারপ সরায়া দেউক!’

‘আমি কিন্তু হ্যাট্রিকই করেছি। মামার গুষ্ঠী, দাদার গুষ্ঠী দুইটারেই শিক্ষা দিছি। আবার আমার আব্বার চিকিৎসাও করছি। এখন আর আমার কোনো টেনশন নাই। বউ নিয়া সুখের সংসার করমু।’
‘বউরে আগে এমেরিকা নেয়ার ব্যবস্থা করো। নয়তো এমেরিকা বইসা বাংলাদেশে সংসার করা লাগবো।’
‘আরে দুনিয়ার যেই জায়গায়ই যাই বউরে বুকে কইরা নিয়া যাইমু।
‘দেখা যাবে!’
……

দুই বছর পরের কথা। আমার বউকে এমেরিকায় নিয়ে এসেছি। আব্বা-আম্মা দেশে ভালো আছেন। আমার বোন বড়টার বিয়ে হয়েছে ব্যাংকারের সাথে। বোনও চাকরির ট্রাই করছে। নানার গুষ্ঠি, দাদার গুষ্ঠি এখন আর আমাদের সাথে ঝা’মেলা করতে আসে না। আব্বা একাই সবাইকে ফেস করতে পারেন। আম্মাও তার ভাইদেরকে কোন প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। আমার মায়ের গোপন স্বপ্ন ছিলো,গোপন কথা ছিল নিজের স্বামীকে সুস্থ দেখা। আমি #মায়ের_কথা শুনেছি। আম্মা-আব্বা শান্তিতে বসবাস করছেন। একদম নবদম্পতি ন্যায় তাদের সুখের সংসার। মায়ের গোপন কথা শুনে সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে আমিও গর্বিত। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হোক। তাদের গোপন কথা শোনার মত কেউ থাকুক। তাহলে শেষ জীবনে এসেও আমার মায়ের মত হয়তো সবাই সুখের দেখা পাবে।

সমাপ্ত।

মায়ের কথা পর্ব-০৫

0

#মায়ের_কথা
পর্বঃ৫
#সাবাব_খান

পরদিন রাতে দেশে আসিফ ভাই খবর পাঠালো আমি ভয়াবহ এ’ক্সিডেন্ট করেছি। আমার মাথাটাই মেইনলি আ’ঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। একদম সিরিয়াসলি আ’ঘাতপ্রাপ্ত। মগজ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। এ জীবনে আর আমি মানসিকভাবে সুস্থ হবো না। আমার আব্বার মতই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে থাকবো। আম্ম তো পা’গল হয়ে গেলেন। দেশে কান্নাকাটি পড়ে গেল। আসিফ ভাই আম্মাকে জানিয়েছে আমি শারীরিকভাবে একটু সুস্থ হলে আমাকে কোনোভাবে প্লেনে করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে। আমি কখনোই মানসিক ভারসাম্য ফিরে পাবো না।

এ খবর দেশে পৌঁছানোর সাত দিনের মধ্যে পাল্টে গেল সব সমীকরণ। মামা,চাচা সবাই আম্মাকে বিভিন্ন কু’টূক্তি করতে লাগলো। ওরা এখন আর আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে না। আগে যেরকম আম্মার সাথে খা’রাপ ব্যবহার করত তার থেকে আরো বেশি খা’রাপ ব্যবহার করতে শুরু করে। যেখানে দেশে খবর গেছে আমি অসুস্থ। আম্মার ছেলে অসুস্থ, কোথায় সবাই একটু ভালো ব্যবহার করবে! সেটা কেউ করে নি। উল্টো আম্মাকে বলেছে, ‘পুতেরে আমেরিকা পাঠায়া কয়েকদিন একদম দাঁত জ্বালায়া গেছিল। আল্লায় বিচার করছে!’

আরো কত কি! এমনও বলেছে, ‘ পা’গল-ছা’গলের সাথে যে মাইয়া বিয়া দিতে হয় না এইটাই অনেক। আল্লায় বাঁ’চাইছে।’

এমনকি যেদিন আমার অ্যা’ক্সিডেন্টের খবর দেশে গেছে সেদিন আম্মার শোকে আমাদের চুলোয় আ’গুন জ্বলেনি। কেউ আমাদের ঘরে একটু খাবারও দেয়নি। অথচ নানা বাড়ি,দাদা বাড়ি দুইটাই আমাদের পাশে।

ঘটনার ঠিক দশ দিন পরে আমি ফোন দিলাম আম্মাকে,’হ্যালো আম্মা!’

‘কিরে বাপ, তুই কথা কইতে পারোস?’

‘হ আম্মা, আমি কথা কইতে পারি।’
‘আমি তো মনে করছিলাম এ’ক্সিডেন্টে তুই একদম পা’গল হয়া গেছোস!’

আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম, ‘আসলে আম্মা আমি কোনো এ’ক্সিডেন্টই করি নাই।’

‘কি কস তুই এইসব?’

‘আমি নাটক সাজাইছিলাম। আমার মামা,চাচাকে তোমার সাথে আবার পরিচয় করায়া দিতে চাইছিলাম। চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইতে চাইছিলাম ওরা কত খা’রাপ। কতটা স্বা’র্থপর!’

আম্মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ঠিকই কইছস বাপ! অরা অনেক স্বা’র্থপর।

‘তাইলে তুমি কেমনে এই স্বা’র্থপরের মাইয়া আমার জন্য আনতে চাইছো?’

আম্মা চুপ হয়ে গেলেন। আমি বললাম, ‘আল্লাহ আমাদেরকে বাঁচাইছে! ওরা নিজেরাই সরে গেছে। মামা নাকি বলছে আমার কাছে আর মেয়ে বিয়ে দেবে না। এবার আর ওরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতেই পারবে না।’

‘আমি আর আনমু না অগো কারো মাইয়া। তোর যারে পছন্দ হয় তারেই বিয়া করিস। তয় আমার একখান…

আম্মা কথা কমপ্লিট করতে পারেন নি। আমাদের এক প্রতিবেশী নাকি চলে এসেছে ঘরে। তবে আমি আম্মাকে ঠিকই বলে রেখেছিলাম, ‘তোমার বড় ভাইয়ের কাছে যাও। গিয়ে তোমার সম্পত্তি আদায় করে নিয়ে আসো। আমি এইটাই চাইছি বে’ঈমানদেরকে আমাদের কোনোকিছু খেতে দেবো না।’

সেদিন আমি ফোন রেখে দেই। আম্মা তার ভাইয়ের কাছে সম্পত্তির জন্য যায়। তখন আমার বড় মামা আমাকে জানায়, ‘তোর ছেলে সাবাব তো পুকুর বিক্রি কইরা এমেরিকা গেছে। তোরে সম্পত্তি দিলে ওইগুলাও সাবাব বিক্রি কইরা খাইবো। তোর পোলা তো কু’লাঙ্গার। এক্সিডেন্টেরও মিথ্যা নাটক সাজায়। এমন নাটক কইরা তোর কাজ থিকাও টাকা নিতে পারবো। তোর জমিনডা আমার কাছে আছে, আমার কাছেই থাউক। জমিনডা ভালো আছে। তোর জিনিস তোরই থাকবো। কিন্তু দলিল কইরা দিলে তোর নাটকবাজ পোলা কোন সময় কি কইরা বসে, কে জানে!’

আম্মা ভীষণভাবে থ্রেট দেয় বড় মামাকে, ‘ভাই, আপনে সম্পত্তি বুঝায় দিবেন কিনা কন! যদি না দেন, তাইলে আমি মামলা দিমু।’

আম্মা তার সম্পত্তি আদায়ে বদ্ধপরিকর। বড় মামা এখন আর আম্মার কাছে এসে কোনো বুদ্ধি দেয়ার সাহস পায় না। আমার চাচারাও না। আম্মা সবাইকে সমান প্রতিবাদ করে। আমি কিন্তু এটাই চেয়েছিলাম। আম্মা বুঝুক বাস্তবতা। আগেও বুঝেছে। এখন আরেকটু ভালো করে বুঝুক। একটু শক্ত হোক। আম্মাকে শক্ত করার জন্যই আমি রাফাকে বিয়ে করার কথা দিয়েছিলাম। আর এ’ক্সিডেন্টের নাটক সাজিয়ে ওদের আসল চেহারাটা আবার বের করে এনেছিলাম। আম্মা এখন সবই বোঝে। বড় মামাও শীঘ্রই আম্মার জমি বুঝিয়ে দিচ্ছে।

আজ সকালে আম্মা আবার ফোন দিল। খুব নরম সুরে আমাকে বলল, ‘সাবাব, তুই কি এহনই বিয়া করতে চাস?’

‘না মা! এখনই বিয়া করমু না। আগে এস্টাবলিশড হই, তারপরে বিয়া করমু।’

‘আমার অন্য একটা কতা ছিল। অনেক গোপন একটা কতা। একটা স্বপ্ন। ল এই কারণেই আমি রাফারে তোর বউ কইরা আনতে চাইছিলাম।’

আমি ধ’মক দিয়ে বললাম,’ আবার রাফারে বউ বানাইতে চাইতাছো?’

‘না বাপ। রাফারে আমি বউ বানাইমু না। কিন্তু তোর বিয়ার আগে আমার গোপন কথাটা শুইনা একটা পদক্ষেপ নিস। আমি মনে করছিলাম রাফা আমার ভাইজি। আমার ঘরে আনলে তোর বিয়ার পরও আমার কথা শুনবো। আমার মনের গোপন স্বপ্ন পূরণ করতে পারমু। আপন ভাইজি বেশি গ’ন্ডগোল করব না আমার সাথে। এখন তো দেখি ওরা বে’ঈমান। তুই বিয়া করার আগেই আমার স্বপ্নের কথাটা শুনিস। আর আমার স্বপ্নডাও পূরণ কইরা দিস, যদি পারোস। কারণ তোর বউ আসলে আমার আর তোর মাঝখানে বউ থাকবো। বউ যদি আমার স্বপ্নটা পূরণ করতে না দেয়! অনেক কঠিন স্বপ্ন তো! আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে পইড়া যাইমু। আমার জীবনে যদিও এই একটাই স্বপ্ন। তুই আমার স্বপ্নের কথাটা শুইনা একটু কাজ করিস। তারপরে যারে খুশি তারে বিয়া করিস।’

‘তোমার কি এমন স্বপ্ন আম্মা?’

চলবে

মায়ের কথা পর্ব-০৪

0

#মায়ের_কথা
পর্বঃ৪
#সাবাব_খান

আমি আর কথা বাড়ালাম না আম্মার সাথে। এমনিতেই ব্যস্ত জীবন। আম্মাও কত দূরে থাকে! তাই অপছন্দের ব্যাপার আর টানলাম না। এমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সময় ব্যবধান অনেক। আমার এখানে যখন সকাল বাংলাদেশে তখন রাত। সাতদিন পর এক আম্মা আবার প্রসঙ্গ উঠালেন, ‘কিরে কিছু জানালি না যে?’

‘কোন ব্যাপারে আম্মা?’

‘তোর বিয়ার ব্যাপারে।’
‘সেদিনই তো বইলা দিছি। রাফারে বিয়া করমু না।’

‘আরেহ্ আহাম্মক, তোর পিছনে শ’ত্রু লাগছে,শত্রু!’
‘কে? এমেরিকায় তো আমার তেমন কোনো শ’ত্রু নাই।’
‘আরে দ্যাশে শত্রু লাগছে!’
‘দ্যাশে তো সবসময়ই আমাগো শত্রু আছে।’

‘এহন নতুন কাহিনী শুরু হইছে।’
‘কি কাহিনী আম্মা?’

‘তোর মেজো চাচায়ও তোর কাছে মাইয়া বিয়া দিতে চায়।’
‘কি কও তুমি আম্মা? মেজো চাচী আর বড় মামি তো আপন দুই বোন। দুই বোনই মেয়ে নিয়া লাগছে আমার পিছনে?’
‘আরেহ্ হ! তোর চাচাতো বইনডা তো এক নম্বরের ব’দমাইশ। আমার ভাইঝিডা কিন্তু খুব ভালো। তোর জন্য একটা ব্রেকআপও দিছে।’

‘আমার জন্য না। গত সপ্তাহে তুমি যখন বলছিলা রাফা আমার জন্য ব্রেকআপ করছে। তারপরও আমি খোঁজ লাগাইছি। আমাগো সারা নিজেই সব খোঁজ নিয়া আমারে জানাইছে। সারা তোমারে কিছু কয় নাই এই ব্যাপারে?’
‘আরেহ্ ধুর! আমার বড় মাইয়াডা নানা বাড়ির মানুষ দেখতেই পারে না, রাফারেও না। তুই তোর বইনের বুদ্ধি লইস না। ওরে এতো কইলাম সাবাবরে কিছু জানাবি না। অয় তোরে জানাইছেই জানাইছে।’
‘জানাইবো না ক্যান? রাফা ভুং-ভাং বুঝাইছিলো তোমারে। এক ছেলের সাথে সম্পর্ক করছে। ঐ ছেলে রাফারে ছ্যাকা দিছে আমি আমেরিকায় আসার মাস খানেক আগে। তোমার ভাইজি কেমনে কইতে পারল; যে আমার জন্য ব্রেকআপ দিছে?’

‘আরেহ্ সারার একটা কতা! অর কতা বিশ্বাস করিস না!’

‘বুঝছি মা! তুমি তোমার ভাইয়ের মেয়েরে বউ কইরা আনার জন্য নিজের মেয়েরেও অবিশ্বাস করতেছো। শোনো মা, কোন কিছুতেই কইরাই লাভ নাই। আমি তোমার ভাইজিরে বিয়া করমু না।’

‘তাইলে তো তোর চাচায় তোর কাছে মাইয়া বিয়া দিবো। সমস্যাডা বোঝোস না?’

‘কেন,বাংলাদেশে কি আর মাইয়া নাই? মামা,চাচার মাইয়া ছাড়া তোমার মাথায় কিছু ঢোকে না?’

‘শোন, তোর চাচায় ভালো না! চাচাতো বইনেও ভালো না। তোগো গুষ্টির কেউ ভালো না
পুরা গুষ্টিডাই খা’রাপ। এই গুষ্টির মাইয়ার লগে আমার ভাইঝির তুলনা! হুহ্!’

‘হুম, তোমার ভাইঝি তো খুব ভালো! তুমি কি ভুইলা গেছো সবসময় অরা আমারে কইতো পা’গলের পুত! তোমার ভাইঝিও কিন্তু পা’গলের বইন। সারাজীবন আমারে পা’গলের পুত কইছে।কত অপমান করছে! আমিও এহন পা’গলের বইনে রাফারে বিয়া করমু না।’

‘তুই জানোস দেশের খবর! তোর মামায় প্রত্যেকদিন আইসা আমারে দেইখা যায়। আমার সব ভালো-মন্দে আগায়া আসে!’

‘এখন তো আসবোই! প্রতিদিন কেন! দিনে চাইর-পাঁচ বারও আসবো। মাইয়া বিয়া দেওনের ধান্দা না! তোমার তো খোঁজখবর নিবোই? আর তুমি ভাইয়ের দুই দিনের ভালো ব্যবহারেই সব ভুইলা গেলা!’

‘আমার ভাইয়ের মতো ভাই অয় না।’

‘আচ্ছা শোনো, সারা আমারে কইল। মেজো চাচায়ও নাকি মাইয়া বিয়া দেয়ার জইন্য খুব খোঁজখবর নেয় তোমাগো!’

‘তোর চাচা হইছে স্বা’র্থপর! অয় খোঁজ নেয় স্বার্থের জইন্য।’

‘মামা-চাচা দুইটাই স্বার্থপর। সবাই এখন স্বা’র্থের জন্য খোঁজ নেই। মাইয়া বিয়া দেয়ার জন্য। আমি কারো মাইয়াই বিয়া করমু। আমি আমার পছন্দ মত বিয়া করমু।’

‘এই শোন হা’রা’মজাদা, আমার ভাইজিডার মনডা খা’রাপ। মনটা একদম নষ্ট হয়া যাইতেছে। মনের কষ্টে আছে। তুই বিয়া করলে আমার ভাইডা খুশি হইতো!’

‘এমেরিকা আসছি কি তোমার ভাইরে খুশি করতে? আর একটা কথাও বলবা না। আমি কারো মেয়েই বিয়া করমু না। আমার পছন্দ মত বিয়া করমু। এইটাই শেষ কথা।’

…………
এদিকে মেজো চাচাও আমাকে বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলেন তার মেয়ের কথা বলতে। আমি ভদ্রতার খাতিরে একবার কল রিসিভ করে আর রিসিভই করিনি। দুনিয়াতে যে কত রঙের মানুষ আছে! সবাই কোনো না কোনোভাবে স্বার্থপর! আপনি যদি ভি’কটিম না হন তাহলে আপনি বুঝবেন না। আমিও বুঝতাম না ভাগ্য পরিবর্তন করতে না এলে। আমার মনে হল, চাচা-মামা কারোরই অতীতের কথা মনে নেই। সেইসব দুর্ব্যবহারের কথাও মনে নেই। কতো যে ভালো মানুষ তারা!

এমেরিকায় আসার দু’মাস না পেরোতেই আম্মা বড় রকমের ঝামেলা শুরু করেন। অনেক কান্নাকাটি করে যাচ্ছেন। বড় মামার মেয়ে রাফাকে বিয়ে করতেই হবে। নয়তো মামার সাথে নাকি সম্পর্ক থাকবে না। আমি আম্মাকে বোঝালাম আমার যে মেজো চাচীটা সারাজীবন জ্বালিয়েছে সে হচ্ছে বড় মামীর আপন বোন। আমি যদি রাফাকে বিয়ে করি তাহলে বড় মামী আর তার বোন মিলে আম্মাকেই বের করে দিবে আমার জীবন থেকে। আম্মা বুঝতে চাইলেন না। জোর করলেন আমার সাথে। আমি শেষ পর্যন্ত আমার গার্লফ্রেন্ডের কথা বললাম। তারপরও আম্মার মন গলাতে পারলাম না। আম্মা অনেক কান্নাকাটি করলেন। শেষ পর্যন্ত সু’ই’সাইডের ভয় দেখালেন। রাফাও নাকি সু’ই’সাইড করবে। এগুলো সবই বড় মামার শেখানো বুদ্ধি। ভাইয়ের দুই দিনের ভালো ব্যবহারে আম্মা অতীতের সব ভুলে গেছেন। আগের অপমানের কোন কিছু মনে নেই তার। রাফা নাকি খুশি হবে আমি বিয়ে করলে! কান্নাকাটি করে আমার জন্য! রাফার মন খা’রাপ! ওর ভবিষ্যতের কি হবে? এসবই আম্মার অজুহাত। তার ভাইঝির যদি কিছু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আম্মাকে ওয়াদা দিলাম রাফা কেই বিয়ে করবো।

বিয়ের ওয়াদা দিলেও আমার প্ল্যান কিন্তু আমার মনেই আছে।

চলবে

মায়ের কথা পর্ব-০৩

0

#মায়ের_কথা
পর্বঃ৩
#সাবাব_খান

আমি গোপন প্ল্যান করলাম। আমার আত্মীয়-স্বজনদের সমানে থাকতে হলে জীবনে বড় কিছু করতে হবে। নয়তো সারাজীবন ওদের হাতে শো’ষিত হতে হবে। বড় মাপের সরকারি চাকরি করলে ওদের সমানে থাকতে পারবো। কিন্তু সরকারি চাকরি পাওয়া এত সোজা নয়। দীর্ঘমেয়াদি পড়ালেখা করা লাগে। এই ধরুন বিসিএস পরীক্ষা দিতে গেলে প্রিলি,রিটেন,ভাইবা সব মিলিয়ে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এত বছর সময় তো আর আমার নেই। এত ধৈর্যও নেই। মনটাও স্থির নয়। ছোটবেলা থেকেই সংসারের চিন্তা মাথায় ঢুকে গেলে তখন আর দীর্ঘমেয়াদি পড়ালেখা হয় না। আম্মার স্বপ্ন ছিল আমি বিসিএস অফিসার হই। কিন্তু মাকে বোঝালাম অতোটা সময় আমি পাবো না। তাছাড়া বোন দুটোও বড় হচ্ছে। সারা অনার্সে,স্নিগ্ধা ইন্টারমিডিয়েটেড পড়ে। ওদেরও তো ভবিষ্যৎ আছে। আমি ভালো কিছু না করলে ওদেরকেও যোগ্য করে তুলতে পারবো না।

আম্মাকে আমার গোপন প্ল্যানের কথা বললাম। আমাদের ভা’গের পুকুরটাকে বিক্রি করে দিতে চাই। কারণ এই পুকুরে ব্যবসা করা হয়তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। যখনই মাছ চাষ করতে যাবো তখনই হয় বি’ষ মিশিয়ে দেবে। না হয় মাছ চু’রি করবে। অথবা অন্য কোনো ঝামেলাও করতে পারে। তাই মা’কে বললাম মা পুকুরটা বিক্রি করে দিয়ে আমি ভবিষ্যত দাঁড় করাতে চাই। আম্মা বলল, ‘ তোর চাচারা শুনলে কখনোই বিক্রি করতে দেবে না।’

আমি বুঝিয়ে বললাম, ‘পুকুরটা তো আমাদের। চাচারা বিক্রি করতে দেবে না কেন?’

আম্মা বলল, ‘তারপর ওরা বাধা দেবে!’

আমি চিন্তা করলাম চাচাদেরকে না জানিয়েই পুকুরটাকে বিক্রি করব। যদি চাচারা কিছু টের পেয়ে যায় সেক্ষেত্রে বলবো পুকুরটা লিজ দিচ্ছি। মিথ্যেই বলব।

এদিকে আমি পড়াশোনা শুরু করলাম। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পড়াশোনা। আইএলটস্ কোচিং অনলাইনে। পুকুর ক্রয়ের কাস্টমারও খুঁজছিলাম। আইএলটস কেন বেছে নিয়েছি জানেন? সময় কম লাগে পাশ করতে। স্বল্পমেয়াদি প্রসেস। সরকারি চাকরি পাওয়া তো দীর্ঘমেয়াদি প্রসেস। আবার সরকারি চাকরিতে ইদানিং ঘু’ষেরও প্রয়োজন হয়। ঘু’ষ দিয়ে চাকরি নিয়ে সেই টাকা উঠানোর জন্য চাকরিতে ঢুকে ঘু’ষও খেতে হয়। পুরো জীবনটাই বরবাদ। মেধায় কয়জনের চাকরি হয় বলুন! বছরের পর বছর পড়াশোনা করে যদি চাকরি না পাই সেই চিন্তাও মাথায় ছিল। তাই আইএলটস পড়া শুরু করেছি। বন্ধুরা বলেছিল তুই ইংরেজিতে অনার্স করেছিস। তোর বিদেশ যেতে আইএলটস লাগবে না। আমি চিন্তা করলাম আইএলটস করেই বিদেশ যাবো। তাহলে বিদেশ গিয়ে আমি মাস্টার্স করবো। বিদেশ মাস্টার্সের সাটিফিকেট থাকলে পরবর্তীতে ভালো একটা চাকরি পাবো। আইএলটস না করে গেলে ভালো চাকরি পাওয়া যাবে না। এসব চিন্তা করেই সব শুরু করলাম।

কয়েক মাসের মধ্যে পুকুরে ক্রয় করার লোকও পেয়ে যাই। এদিকে আমার আইএলটস পরীক্ষার রেজাল্ট হয়। মেধা তো আর খা’রাপ না। ভালো পয়েন্ট পেয়েছি। বিশাল পুকুর আমাদের। মোটা অংকে পুকুরটাকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। এরমধ্যে চাচারা কিভাবে যেন কিছুটা টের পেয়ে যায়। আমিও জানিয়ে দেই পুকুরটাকে লিজ দিচ্ছি। চাচারা লিজের কথা শুনেও বিরোধিতা করে, ‘ আমাদের বাপ,দাদার জমির মধ্যে পুকুরটাকে লিজ দিবি কেন? জমির মধ্যে অন্য মানুষ আসা যাওয়া করবে! বাড়ির মধ্যে অন্য মানুষ আসা ভালো না!’

আমি জানিয়ে দিলাম এছাড়া উপায় নেই। চাচারাও আগের মতোই বিরোধিতা করে। উনাদেরকে না জানিয়েই পুকুরটাকে বিক্রি করে ফেলি। এরপরে শুরু হয় বিদেশ যাওয়ার প্রসেস। বেশিদিন লাগেনি। অন্যের টাকারও প্রয়োজন হয়নি। পুকুর বিক্রির টাকাতেই হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজন কারো কাছেই বলিনি আমি এমেরিকায় আসবো। ভিসা হয়েছে, প্লেনের টিকেট হয়েছে। তখনও বলি নি। কারণ যেকোনো ক্ষতি করতে পারতো আত্মীয়-স্বজন। ওদেরকে এখন আর বিশ্বাস করি না। দুর্বলকে সবাই আরো চেপে চেপে মারতে চায়। ফ্লাইটে ওঠার আগের দিন ঢাকায় বসে সবাইকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিলাম।

যথাসময়ে আমি চলে আসি এমেরিকায়।
দুই সপ্তাহ হলো এসেছি। নিউইয়র্কে আছি। এখনো ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়নি। আমার এক বন্ধুর বড় ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি কয়েকদিনের জন্য। দেশ থেকেই বন্ধুর সাথে কথা বলে সব ঠিক করে এসেছিলাম। ওদের সাথে আমার আরেকটা সম্পর্কও আছে। বন্ধু কিন্তু ছেলে নয়, মেয়ে বন্ধু। ওর নাম রিম্পা। রিম্পাই ওর ভাইকে বুঝিয়েছে আমাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য। এখানে প্রবাসী জীবনটা খুব সহজ নয়। সেটেলড হতে হলে প্রথমে খুব কষ্ট করতে হয়। এখনো চাকরি খুঁজতে হচ্ছে আমায়। চাকরি না পেলে কি করব, না করব! রিম্পার বড় ভাইও কাজ খুঁজছেন আমার জন্য।

আজ হঠাৎ করে ফেসবুকে টেক্সট আসে, রাফার টেক্সট। জানেন তো, রাফা আমার বড় মামার মেয়ে। আমায় টেক্সট পাঠিয়েছে, ‘কেমন আছো সাবাব ভাইয়া?

আমি রিপ্লাই দিলাম, ‘ভালো! তুই কেমন আছোস?’

‘মনটা ভালো না সাবাব ভাইয়া?’

‘কি হইছে তোর মনের?’

‘আমার কথা বাদ দাও। তুমি এত তাড়াতাড়ি এমেরিকা গেলা কেমনে?’

‘আইএলটস করে এসেছি।’

‘আমারও না এমেরিকা যাবার খুব স্বপ্ন!’

‘তাহলে তুইও আইএলটস করে চলে আয়!’

‘পড়ালেখা আমার মাথায় ঢুকে না!’

‘তাহলে অনার্স করছিস কিভাবে?’
‘এইতো কোন ভাবে পাশ করছি। ভালো কোনো রেজাল্ট তো আর করছি না। আচ্ছা সাবাব ভাইয়া, অন্য কোন উপায়ে এমেরিকা যেতে পারবো না?’

‘পারবি! এমেরিকা প্রবাসী ছেলেকে বিয়ে করে চলে আসবি!’
‘এমন ছেলে কই পাবো!’

‘খোঁজ, খুঁজলে পেয়ে যাবি! আশেপাশে কতো এমেরিকা প্রবাসী ছেলে আছে!’

‘সত্যি কইতাছো তো?’

‘হুম!’

‘পরে কিন্তু অস্বীকার করতে পারবা না।’

‘এইখানে অস্বীকার করার কি আছে? আচ্ছা, তোর সাথে পরে একদিন চ্যাটিং করব। আমার একটু বের হতে হবে। সময়-অসময়ে নক দিস না তো। অনেক ব্যস্ত আমি!’

এরপরে আর কথা হয়নি রাফার সাথে। ইদানিং নাকি মামা-চাচা সবাই আম্মার খুব যত্ন করে। আসলে কি জানেন? তাদের ছেলেমেয়েকে যদি এমেরিকায় পাঠাতে পারে! আমি নিজেই তো আসলাম মাত্র কিছুদিন। নিজের সেট হতে হয়তো কয়েক বছর লাগবে। রিম্পার বড় ভাই আমাকে একটা কাজ খুঁজে দিয়েছে। আসলে বলা হয়নি আপনাদেরকে। রিম্পার সাথে আমার ভাব ছয় মাস ধরে। আমি কথা দিয়েছি ওকে বিয়ে করবো। এজন্যই ওর ভাইও আমাকে হেল্প করেছে। বিনা প্রয়োজনে কেউ কাউকে সাহায্য করে না।

রিম্পার সাথে প্রতিদিনই কথা হয়, ভার্সিটি আর কাজের ফাঁকে। আমি এখন অন্য জায়গায় শিফট হয়েছি। রিম্পার ভাইয়ের বাসায় আর থাকি না। ওনার নাম রিমন। সেই রিমন ভাইয়াই আমাকে অন্য জায়গায় উঠিয়ে দিয়েছে। আজ সকালে আম্মা ফোন করলেন। আমি রিসিভ করতেই আম্মা বললেন, ‘তোর সাথে দরকারি কথা আছে সাবাব!’
‘কি কথা আম্মা?’
‘তুই নাকি রাফারে পছন্দ করোস?’
‘এসব তুমি কি কইতাছো আম্মা?’

‘রাফা কইলো অরে ইনডাইরেক্টলি বিয়ার প্রস্তাব দিছোস!’

‘তুমি পা’গল হয়া গেলা আম্মা?’

‘শোন, চালাকি করিস না। তোর বড় মামা আজকে আসছে বিয়ার প্রস্তাব নিয়া! রাফায় আমারে মেসেজ দেখাইছে। তুই কইছোস আশেপাশে অনেক এমেরিকা প্রবাসী ছেলে আছে। খুঁজলেই নাকি পাওয়া যাইবো! এই কথার অর্থ কি?’

‘আর একটা কথাও বলবা না মা তুমি! আমি কি আমার কথা বলছি নাকি?’

‘দেখ, তুই বা’টপারি করলে আমার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক থাকবো না!’

‘তুমি কোনোদিন ঠিক হইবা না মা। বাপের বাড়ির মানুষের পেছনেই দৌড়াইবা।’

‘আর একটা কথাও কবি না সাবাব। তোর কথায় রাফা অর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ দিছে।’
‘ইয়ার্কি শুরু করছে অরা? ঐ বা’টপারের গুষ্ঠি তোমারে মিত্যা কইছে সব!’

চলবে

মায়ের কথা পর্ব-০২

0

#মায়ের_কথা
পর্বঃ ২
#সাবাব_খান

একদা আমার মাকে চো’র সাব্যস্ত করেছিলেন বড় মামী। তার জীবনে ঘটেছে বিচিত্র ঘটনা। আমার মামাতো ভাই অনার্সে পড়ে স্থানীয় একটি কলেজে। রকি নাম ভাইয়ের। কোনো ভার্সিটিতে চান্স পায় নি। কিছু খা’রাপ স্বভাবের কারণে ভাইটাকে কোনো প্রাইভেট ভার্সিটিতেও ভর্তি করায় নি। দূরে গিয়ে কখন কি করে বসে ঠিক আছে? খা’রাপ স্বভাব বলতে ইন্টারমিডিয়েট থেকেই নেশা করে ; ম’দ গাঁ’জা খায় আর কি! লাস্ট শীতের এক রাতে নে’শা করে পথ হারিয়ে ফেলে রকি ভাই। ভুলক্রমে ঢুকে পড়ে রাস্তার পাশের এক বাড়িতে। সেই বাড়ির পেছনে মাতাল অবস্থায় বসে ছিলো কিছুক্ষণ। একা একাই আবোল-তাবোল বকছিলো। পাশেই ছিল ঐ বাড়ির ছাগলের খোপ। তাদের শখের দুটো খা’সী ছিলো খোপে। রকি ভাইয়ের কথা শুনে খা’সী দুটোও ব্যা ব্যা,ম্যা ম্যা করে ডাকছিল। মা’তাল ভাইটা ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়েন খা’সী দুটোর বিরতিহীন ডাকে। রাগে জোরে জোরে লা’থি দিতে শুরু করেন ওদের খোপে। লা’থির শব্দে খা’সির ব্যা ব্যা,ম্যা ম্যা আরও বেড়ে যায়। তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে লোকজন বেরিয়ে আসে। চেহারা না দেখেই চোর ভেবে বাঁশ দিয়ে জোরে বারি মা’রে রকি ভাইয়ের মাথায়। সেখানেই জ্ঞান হারান ভাই। চেহারা দেখে বাড়ির লোকদেরও হুশ হয় এটা বড় মার্কেটের মালিকের ছেলে রকি। তবে মা’তাল ছেলে, নে’শাখোর ছেলে। নে’শার ঘোরে খা’সী চুরি করতে আসতেই পারে। তারা পুরোপুরি ধরেই নিয়েছে রকি ভাই খা’সি চুরি করতেই গেছে। রকি ভাইও এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে কিছু বলতে পারে নি। প্রথমত মা’তাল ছিল। দ্বিতীয়ত সেই রাতে মা’তাল অবস্থায় মাথায় আ’ঘাত পেয়ে ব্রেনে সমস্যা হয়েছে। এখনো মা’তালের মতোই আবোল-তাবোল বকে। অনেক চিকিৎসা হচ্ছে রকি ভাইয়ের। হয়তো ঠিক হবে কোনো একদিন। আমি চাই ঠিক হোক। কিন্তু এখন আমার আব্বার মতই কথা-বার্তায় এলোমেলো,অগোছালো।

বড় মামার ছেলে রকি ভাইয়ের জন্য আমার খা’রাপ লাগে। ভাইটা চোর ছিল না। চুরি করতেও যায় নি। অথচ খা’সী চুরি করতে যাবার দায় কাঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছে। ঠিক যেমনটা ওর মা আমার মাকে চুরির দায় দিয়েছিল। খা’সির মাংস চুরির দায়। এই কয়েক মাসে রকি ভাইয়ের পিছনে অনেক খরচ হয়েছে। টাকা পয়সার কমতি নেই এখনও। রকি ভাইয়েরা দুই ভাই-বোন শুধু। বোন রাফা ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। একমাত্র ছেলের পেছনে টাকা খরচ করতে কি দোষ! তবে আমার কেন যেন মনে হয় এই খা’সি চুরি করতে যাবার অপবাদ আল্লাহর বিচার। আমার আম্মাকে অনেক মানুষের মধ্যে খা’সির মাংস চোর সাব্যস্ত করেছিলো বড় মামী। আরেক কো’রবানির ঈদ আসার আগেই হয়তো আল্লাহ বিচার করেছে। জানি না, আমার ধারণা সত্যি কিনা! আল্লাহই ভালো জানেন।

আপনারা কি ভাবছেন? আমার দাদা বাড়ির লোকজন আমাদেরকে খুব ভালোবাসে? দাদা বাড়ির হিসেবটাও একটু বলি। আমার বাপ-চাচারা চার ভাই। আব্বা সবার বড়। আমাদের বাড়িটা পৌরসভার মধ্যেই তবে এক প্রান্তে। থানা শহরে পায়ে হেঁটে যেতে দশ মিনিটের মতো লাগে। সিএনজি কিংবা বাইকে আরও অনেক কম সময় লাগে। দুটো কারখানাও আছে বাড়ির অদূরে। এখানে কয়েক বছর ধরেই বাড়ি ভাড়া দেয়া যাচ্ছে। রাস্তার পাশে দোকান ভাড়াও দেয়া যাচ্ছে। আমার তিন চাচা ঘর করার জন্য জমি নিয়েছে বাড়ির সামনের দিকে,রাস্তার পাশের উঁচু অংশে। আমার আব্বাকে ঘর করার জমি দিয়েছে বাড়ির পেছনের দিকের বাগান এবং নালার ভেতরে, নিচু অংশে। আমরা ঘর করতে গেলেও বালি অথবা মাটি কিনে এনে বাগানের সেই নিচু জমি প্রথমে ভরাট করতে হবে। তারপরে ঘর নির্মাণ করতে হবে। তারা উচু জমিতে ঘর করে অলরেডি ভাড়াও দিচ্ছে। আমাদের কি সাধ্য আছে নিচু জমি ভরাট করে ঘর নির্মাণ করার? যেখানে পেট চালাতেই দায় সেখানে জমি ভরাট করে ঘর করবো কিভাবে? চাচারা রাস্তার পাশে জমি নেয়ায় ওনারা দোকানঘর উঠিয়ে ভাড়া দিচ্ছে। আমাদের জমি তো বাগানে। দোকান তৈরি করারও সুযোগ নেই। দাদার অনেকগুলো পুকুর ছিল। আমাদের ভা’গে পুরো একটা পুকুর পড়েছে। বাড়িতে অনেক বড় ফলের বাগান। সবকিছু এখনো চাচাদেরই হাতে। আব্বার এক্সিডেন্ট হবার আগে আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিলো। মেজো চাচা দেখতেন বাড়ির জমি-জমা। ঘর তৈরির জমি দেখিয়ে দিলেও আমাদের জমি-জমা এখনো মেজো চাচাই দ্যাখেন। সব সময় একটা কথাই বলে, ‘তোগো এখনো সবকিছু বুইঝা খাওয়ার বয়স হয়নাই।’

আর সবকিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আসে আমার আব্বার কাছে। আব্বা তো অসুস্থ। মানসিক ভারসাম্যহীন। সে তো ভালো-মন্দ কিছু বোঝেনা। আমার দাদী আর মেজো চাচা যা বুঝায় আব্বাকে; সেটা বুঝেই দায়িত্ব মেজো চাচাকেই দিয়ে দেয়। আব্বা অসুস্থ হবার পরে আমরা যৌথ পরিবার থেকে বের হয়ে যাই। আব্বার ইনকাম ছিলো না বলে তিন চাচী তখন আম্মাকে কাজের লোকের মতো খাটাতো। আব্বার যত্ন করারও সময় পেতেন না আম্মা। তারপর আমরা হাড়ি আলাদা করি। চেয়ারম্যান,মেম্বার আর আমার নানা বাড়ির লোকদের ডেকে আনেন আম্মা। চাচাদেরকে অনুরোধ করেন আব্বার ভা’গের জমিটুকু বুঝিয়ে দেবার জন্য যেন আমরা নিজেদের মতো করে চলতে পারি। তখন মেজো চাচা ব’দনাম ছড়িয়ে দেন আম্মার চরিত্রের নামে। আম্মার নাকি চরিত্র খা’রাপ। জমি ভা’গ করে দিলেই আব্বাকে বোকা বানিয়ে সব নিয়ে চলে যাবে। মামারা এই আম্মার নামে দেয়া এই অপবাদের প্রতিবাদ করেছিলেন প্রথমে। কিন্তু বড় মামা হুট করেই মেজো চাচার কথা বিশ্বাস করেন। আসলে আমার বড় মামী বুদ্ধি দিয়েছিলেন। বড় মামী আর মেজো চাচী আপন দুই বোন। বউ, শা’লী আর ভায়রার বুদ্ধিতে বড় মামাও আম্মার বিরুদ্ধে চলে যান। আমার দাদীও ওদের কথাই বিশ্বাস করেন। তখন আর আব্বার ভা’গের জমি বুঝিয়ে দেয়া হয় নি। একজন নারী যখন বিপদে পড়ে তখন তাকে শোষণ করার জন্য প্রথমেই চরিত্রের ব’দনাম দেয়া হয়। আমার মায়ের বেলায়ও সেটাই ঘটেছে। তাছাড়া আপনি যখন বিপদে পড়বেন তখন বাপের বাড়ি,শ্বশুর বাড়ি দুটোই একরকম থাকবে। পারলে দুই গ্রুপ এক হয়ে যাবে আপনাকে শাসানোর জন্য। এখনো আমাদের সম্পত্তি মেজো চাচার হাতে। উনি যা হাতে দেন তাই মাথা পেতে নিতে হয়।

আমি ভাবছি আমার আম্মার কথা। একটা মহিলার স্বামী যখন অসুস্থ থাকে তখন তার পাশে কেউ থাকেনা। আপনার মনে হবে বাপের বাড়ির মানুষগুলো এত অপমান করে, তারপরেও আম্মা কেন তাদের কাছে ছুটে যায়? আসলে কি আমার দাদা বাড়ি থেকে আমাদেরকে পুরোপুরি বের করে দিতো। তাই আম্মা অনেক অ’পমান,লা’ঞ্চনার পরেও ভাইদের সাথে একটু সম্পর্ক রাখে। হয়তো মেজো চাচা আব্বার সম্পত্তি নিজ দায়িত্বে রেখেছেন কিন্তু আমরা তো দাদাবাড়িতেই আছি। নানা বাড়ির সাপোর্ট না থাকলে আমাদেরকে দাদাবাড়ি থেকে বের করে দেয়া হতো। আমার মামাদের কথা কি বলবো? জানিনা কতদূর ভালবাসে আম্মাকে? নানা বাড়িতে যখন কোনো প্রোগ্রাম হয় তখন সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়। দায় এড়াতে আমাদেরকেও দাওয়াত দেয়। আমরা যাই না প্রথমে। আম্মা দৌড়ে দৌড়ে যান। সকল কাজ করেন। অনুষ্ঠান শেষের দিকে অথবা খাওয়ার আগে বিশাল একটা ত্রুটি বের হয় অনুষ্ঠানের। সব দায় এসে পড়ে আমার আম্মার মাথায়। বহুবার ঘটেছে এমন। সারাদিন নানা বাড়িতে বসে খেটে-খুটে বাপের বাড়ির প্রোগ্রাম তুলে দেন আম্মা। সে আম্মারই দোষ হয় সব। কেন যেন মনে হয় যেসব মহিলাদের শ্বশুরবাড়ি আর বাপেরবড়ি পাশাপাশি তাদের দোষ একটু বেশি। দোষ না করলেও দোষ। মাঝে মাঝে মনে হয় আম্মার লজ্জা কম। কিন্তু পরে আবার মনে হয় আপনজনের মুখ দেখে আম্মা সব ভুলে যান। আসতে-যেতে দেখা হয় তো বাপের ফ্যামিলির লোকের সাথে! র’ক্তের লোকদের চেহারা দেখে হয়তো সব ভুলে যান আম্মা। আমার মা,খালাদের মধ্যে আম্মাই বড়। বড় মামা সবার বড়, ভাই-বোন সবার মধ্যে। তারপরেই এই আম্মা। ছোট ভাই-বোনদের প্রতি আম্মার কি টান! একটু ঊনিশ-বিশ হলেই দৌড়ে যান। কখনো কখনো এমনও মনে হয় ; আম্মা মাফ করে দেন ছোট ভাই-বোনকে। আমার নানা,নানী জীবিত নেই। নানাবাড়িতে আম্মাকে সবচেয়ে বেশি জ্বালায় বড় মামি। আম্মার বড় ভাইয়ের বউ। আর অন্যরা তার সাথে সায় দেয়, তালি বাজায়। অনেক অনুরোধ করেও আম্মাকে ফেরাতে পারি না নানা বাড়ির দিক থেকে।

আমার পরিচয়টাই তো দেয়া হয়নি। আমার নাম সাবাব খান। গত কো’রবানির ঈদের সময় বলেছিলাম না ভার্সিটি কোচিং করছি! আমি একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি অলরেডি। ভালো কোন ভার্সিটি নয়। দেশের অনেক জেলাতেই ভার্সিটি হয়েছে। আমাদের জেলায়ও একটা ভার্সিটি আছে। ওখানেই চান্স পেয়েছি। তবে সাবজেক্টটা ভালো, ইংরেজি। টিউশনি করেই নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করি। আমার ছোট দুই বোন; সারা আর স্নিগ্ধা। আমরা তিন ভাই-বোন আর বাবা-মা নিয়ে আমাদের পরিবার। চাচাদের কয়েকটি বিল্ডিংয়ের পেছনে একটি কাঠের ঘরে আমাদের বসবাস।
…………

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছর। আমার অনার্সও শেষ। এর মধ্যে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। আমি মেজো চাচার কাছ থেকে আমাদের ভা’গের জমি আদায় করে নিয়েছি। বলেছি আমাদের জমি আমাদেরকে বুঝিয়ে না দিলে মা’মলা দেবো। অতঃপর মা’মলার ভয়ে ভা’গের জমি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। অনার্সের প্রথম বছর টিউশনি করে পড়েছিলাম। বুঝলাম এভাবে জীবনযু’দ্ধ করার কোন মানে হয় না। তখনই মেজো চাচার উপর চড়াও হয়েছি। দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন সব জমি বুঝে নিয়েছি। ইদানিং তিন চাচা নিত্য এসে ঝ’গড়া করেন। এদিক দিয়ে কম হয়ে গেছে, ঐদিক দিয়ে বেশি হয়ে গেছে। আমি বাড়ি থেকেই ভার্সিটিতে আসা-যাওয়া করেছি। বছর দু্য়েক আগে আমি আর মা বুদ্ধি করে আমাদের ভা’গের পুকুরটায় মাছ চাষ শুরু করি। রাত-দিন কাজ করি আমরা। ছোট বোন দুইটাও আমাদের সাথে খেটেছে ভাগ্য পরিবর্তনের তাগিদে। মায়ের সোনার চেইন বিক্রি করে সেই টাকায় মাছের খাবার যোগাড় করেছিলাম। আস্তে আস্তে মাছগুলো বড় হয়। এবার আসে বিক্রির পালা। মাছের আড়তদারদের সাথে কথা হয়, সকালে মাছ বিক্রি করব। আগের রাতে জেলে খবর দিয়ে রাখি পুকুর থেকে মাছ ধরার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সকালে উঠে দেখি পুকুরের সব মাছ ম’রে ভেসে উঠেছে। আসলে রাতের আঁধারে কেউ বি’ষ দিয়েছে আমাদের পুকুরে। এসব কে করেছে বোঝেন? আমার মেজো চাচার পরিবার। এতদিন ভো’গ করেছে তো পুকুরটা! যখন আমরা আমাদের হাতে নিয়ে এলাম তখন তাদের দুঃখ লেগেছে! ক্ষতি করে দিল আমাদের। অথচ রাত-দিন কষ্ট করেছি আমরা। কত আশা ছিল, কত স্বপ্ন ছিল! সব এক নিমিষে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।

আমি কারো ক্ষতি করলাম না। কারণ আমার বোন দুইটাও বড় হয়েছে। কে আবার ওদের ক্ষতি করে দেয়! আমি এক নতুন সিদ্ধান্ত নিলাম! সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলেই ভিতর থেকে নতুন কাজ করব। শুরু হলো আমার নতুন চিন্তা। এখন তো অনার্সও পাশ করেছি।

চলবে