বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 8



মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৪

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৪.
মৃদুলা প্রাইভেটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মুখোভাবে স্পষ্ট যে জামা কিনতে না পারার বিষয়টি নিয়ে তার এখনও মন খারাপ। অনেকক্ষণ ধরে মৃত্তিকা তাকে কিছু বলার জন্য কাঁচুমাচু করছে। কিন্তু বলা-ই হচ্ছে না। মৃদুলা যখন হিজাব পরছিল, তখন মৃত্তিকা তাকে প্রশ্ন করে ফেলল,
“আপাকে টাকার কথা বলেছিলি?”
মৃদুলা থমথমে গলায় উত্তর দিলো,
“বলব না।”
“জিজ্ঞেস করে দেখতে পারতি না?”
“এই মাসে আপা অনেক খরচ করে ফেলেছে। এখন আমি টাকা নিলে তার নিজের হাত খরচের টাকা-ও হয়তো থাকবে না। তোমার মতো আপার গলায় ছু’রি ধরে টাকা আদায় করার স্বভাব আমার নেই। লাগবে না আমার জামা।”
মৃত্তিকা মন খারাপ করল না। পুনরায় শুধাল,
“তাহলে কী করবি? অন্য জামা পরেই যাবি?”
“তা-ও জানি না।”
“জামা কি তোরা পছন্দ করে রেখেছিস?”
“হুম।”
“দাম কত?”
“বারোশো টাকা।”
“কিনে আবার বানাতে দিতে হবে না?”
“কিনবই না, আবার বানাতে দিবো।”

মৃত্তিকা আর কথা বাড়াল না। আলমারি খুলে তার ব্যাগ থেকে বারোশো টাকা বের করে নিয়ে এল। মৃদুলার হিজাব পরা শেষ হতেই সে হঠাৎ বোনের হাতটা ধরে মুঠোয় টাকাটা গুঁজে দিলো। প্রথমে মৃদুলা চমকে উঠল। তারপর মুঠো খুলে টাকা দেখে সে অবাক চোখে তাকাল। প্রশ্ন করার আগেই মৃত্তিকা বলল,
“টাকাটা নে বোন। জামা নিয়ে আসিস।”
মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“তুমি টাকা পেলে কোথায়?”
“আমার জমানো টাকা ছিল। এখন তো আমার লাগছে না, তুই নিয়ে কাজে লাগা।”
“তোমার জামাইয়ের টাকা না? আমি এই টাকা নিতে পারব না। পরে মা আমাকে যা-তা বলবে।”
মৃদুলা অসহায় মুখে বলল,
“এমন করিস না রে মৃদুলা। আমি জানি এখন তোর কেমন লাগছে। এমন অনেক অনুষ্ঠানে আমিও আপার থেকে টাকা নিয়েছিলাম। আপার কাছে টাকা আছে, না কি নেই, তা-ও আমি ভাবতাম না। আর তুই তো আমার চেয়ে কত বুদ্ধিমতী। তোর মতো সুন্দর মন আমার নেই। কিন্তু এটুকু বুঝার ক্ষমতা আছে যে, তোর সুন্দর মনটা হাসিমুখে কষ্ট গিলে নেয়। আমি কোনোদিনও নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবিনি। তোর প্রয়োজন নিয়েও মাথা ঘামাইনি। আজকাল তোকে দেখলে আমার নিজের প্রতি ধিক্কার আসে, জানিস? তুই এই টাকাটা নিলে আমি খুব খুশি হব। প্লিজ নে।”
মৃদুলা তবু আপত্তি জানিয়ে বলল,
“না-না আপা। এই টাকার জন্য না পরে আমাকে মায়ের কত বকা শুনতে হয়। তুমি বলেছ, এতেই আমি খুশি হয়েছি। তোমার টাকা তুমিই রেখে দাও, দরকার পড়লে খরচ করতে পারবে।”
“নে না রে। তুই তো আমার কাছে টাকা চাসনি। আমি নিজেই তোকে দিচ্ছি। মা কিছু বললে বলিস তুই নিতে চাসনি, আমিই তোকে জোর করে দিয়েছি। দরকার পড়লে আমিও মাকে বুঝিয়ে বলব। জামা কিনে ফেললে তো আর মা সেটা ফেরত দিতে পারবে না। তুই নিয়ে যা, আমার টাকা লাগবে না।”
মৃত্তিকা তারপরও একটু দোনামনা করল। মনে-মনে তার ভয় লাগছে। মা যদি বকাঝকা করে? আবার মৃত্তিকা এত করে বলার পর আর সে তাকে টাকা ফিরিয়ে-ও দিতে পারল না। শেষমেশ তাকে টাকা নিতেই হলো। ভাবল জামা কিনে আগেভাগেই মাকে জানাবে না। আগে বড়ো আপাকে জানিয়ে তারপর মাকে জানাবে। মৃত্তিকা আবার তাকে এ-ও বলে দিয়েছে যে, জামা এনে বাড়িতে না এনে যেন দরজির কাছে দিয়ে আসে। জামা বানানোর মজুরিটা-ও মৃত্তিকা দিয়ে দিবে। মৃদুলার বিস্ময় যেন কমতেই চাইছে না। এই কি তার ছোটো আপা, আজীবন যার নিজের স্বার্থ ছাড়া পরিবারের কাউকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না? যে আজীবন শুধু নিতেই জানত, সে দিতে শিখল কবে?


একহাতে কেক বক্স, আরেকহাতে গিফট বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাত। মৃন্ময়ীর আজ দেরী হচ্ছে কেন? তার হাত দুটো তো ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত হিসেবে আবার মশার কামড়-ও সহ্য করতে হচ্ছে। কামড়ে-কামড়ে পা দুটো শেষ করে দিলো। ইচ্ছে করছে মশার গলা চেপে ধরে কানের নিচে কয়েকটা চটকানা লাগিয়ে দিতে। অবশেষে যখন মৃন্ময়ীর দেখা মিলল, তখন প্রভাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে বলল,
“আজ তুমি এত দেরী করলে যে? এদিকে তোমার অনুপস্থিতিতে মশারা আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিল।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তোমার মশারা তোমার মতোই ঘাড়ত্যাড়া।”
“কী যে বলো! মশারা কেন আমার হতে যাবে? তুমি ছাড়া কেউ আমার না।”
“তোমার হাতে এসব কী?”
“ওহ্! এসব তোমার জন্য। শুভ জন্মদিন মৃন্ময়ী।”

প্রভাত হাসিমুখে কেক বক্সটা বাড়িয়ে ধরল। মৃন্ময়ী চরম অবাক হলো। আজ যে তার জন্মদিন তা হয়তো সে ছাড়া অন্য কারোরই মনে নেই। মনে থাকার কথাও না। আগে ফেসবুকে জন্মদিনের নোটিফিকেশন পেলে অনেকে পোস্টের মাধ্যমে তাকে শুভেচ্ছা জানাত। দুবছর ধরে মৃন্ময়ী জন্মতারিখ অনলি মি করে রেখেছে। কেন জানি তার এসব খুব একটা ভালো লাগে না। মায়ের তো কোনোকালেই কারোর জন্মতারিখ মনে থাকে না। মৃত্তিকা ফেসবুকে নোটিফিকেশন বন্ধ হওয়ার পর আর শুভেচ্ছা জানায়নি। মৃদুলার যেবার মনে থাকে, সেবার সে নিজের হাতে কার্ড বানিয়ে বোনকে শুভেচ্ছা জানায়। আর যেবার মনে না থাকে, পরবর্তীতে মনে পড়লে খুব আফসোস করে। প্রভাত-ই একমাত্র মানুষ যে দুবার ধরেই তার জন্মদিনে কেক, গিফটসহ শুভেচ্ছা জানাতে হাজির হয়। গত বছর সে প্রভাতের আনা উপহার গ্রহণ করেনি, কেক-ও ফিরিয়ে দিয়েছিল। তখন সে প্রভাতের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত ছিল। এবার আবার প্রভাত একই কাজ করল। মৃন্ময়ী বলল,
“ধন্যবাদ। কিন্তু তোমার এসব আনা উচিত হয়নি। গতবার তোমায় বারণ করেছিলাম তো, ভুলে গেছো?”
“তোমার ওসব বারণ প্রভাত তরফদার ভদ্র ছেলের মতো মেনে নিবে, এটা ভাবা-ও তোমার উচিত হয়নি। বেপরোয়া ছেলেরা এত বাধ্য হয় না। কিন্তু তুমি দয়া করে এবারেও অবাধ্যতা কোরো না। গতবার কেক নিয়ে বন্ধুদের দান করে দিয়েছিলাম, এবারে কিন্তু তা-ও করব না। আমি অত ভদ্র না।”
মৃন্ময়ী ঠিকঠাক উত্তর খুঁজে পেল না। চ-সূচক আওয়াজ করে বলল,
“কী মুশকিল! বুড়ো বয়সে তুমি এমন বাচ্চামি কেন করো?”
“কী মুশকিল! কারণটা বলতে-বলতে তো ‘ভালোবাসি’ শব্দটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার মনেই থাকছে না। এটা-ও কি আমার দোষ?”
“তুমি সত্যিই একটা অসম্ভব মানুষ। তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করাই আমার উচিত হয়নি।”
“করেই যখন ফেলেছ, এখন আরেকটু ভালো ব্যবহার করে কেকটা গ্রহণ করে আমায় ধন্য করো ম্যাডাম।”
“আমার এখন কেক খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খেয়ে ফেলো।”
“তা বললে তো হবে না ম্যাডাম। এক চিমটি হলেও খেতে হবে। নয়তো আজ আমি এই কেক নিয়ে তোমার বাসায় গিয়ে উঠব।”
মৃন্ময়ী হতাশ চোখে চাইল। এই ছেলেকে একদম বিশ্বাস নেই? সত্যি-সত্যি বাসায় গিয়ে উঠতে-ও এর কোনো দ্বিধা হবে না। দিশা না পেয়ে সে মনকে সান্ত্বনা দিলো, ‘কেকই তো! একটু খেলেই তো আর প্রেম হয়ে যাবে না।’ তারপর বলল,
“ঠিক আছে, দাও। কিন্তু আমি এক কামড়ের বেশি খেতে পারব না।”
প্রভাত দারুণ খুশিতে চমৎকার হাসিতে বলল,
“তোমার এক কামড়েই আমার কেক স্বার্থক। চলো কোথাও বসি।”

তারা একটা বন্ধ দোকানের সামনের টুলে বসল। প্রভাত বক্স খুলে প্লাস্টিকের ছু’রিটা মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে বলল,
“কাটো।”
নিজের সামনে প্রভাতকে এত খুশি মৃন্ময়ী এই প্রথম দেখল। কী উৎসুক চোখে সে মৃন্ময়ীর কেক কা’টার অপেক্ষা করছে! মৃন্ময়ী কেক কা’টল। সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাত কেকের কা’টা টুকরোটা হাতে তুলে নিয়ে মৃন্ময়ীর মুখের কাছে ধরল। মৃন্ময়ী ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বুঝতে পেরে প্রভাত হাসিমুখে বলল,
“খাও না, আমি খুব খুশি হব। জাস্ট ওয়ান বাইট, প্লিজ।”
অস্বস্তি পেরিয়ে মৃন্ময়ী প্রভাতের হাত থেকে এক কামড় কেক খেল। বাকি কেকটুকু প্রভাত নিসঙ্কোচে নিজের মুখে পুরে নিল। বিষয়টা মৃন্ময়ী ঠিকঠাক খেয়াল না করার ভান করল। খেয়াল করলেই যত অস্বস্তি। প্রভাত আরেক টুকরো কেক বাড়িয়ে ধরে বলল,
“আরেকটু খাও না। কেকটা খুব মজা। এমনিতেও তো কে’টে ফেলেছো।”
মৃন্ময়ী ওই কেকটুকু-ও খেল। তারপর বলল,
“আমি এখন উঠছি।”
“আরেকটু খাও না।”
“আর পারব না।”
“তাহলে আরেকটু সময় বসো।”
প্রভাত পকেট থেকে টিস্যু প্যাকেট বের করে মৃন্ময়ীকে একটা টিস্যু দিলো। তারপর নিজের হাত মুছে নিয়ে পাশ থেকে গিফট বক্সটা তুলে বাড়িয়ে ধরল। মৃন্ময়ী এবার দ্বিধাভরা কন্ঠে বলল,
“কেক পর্যন্ত ঠিক আছে প্রভাত। আমি তোমাকে একেবারেই ফিরিয়ে দিইনি। কিন্তু উপহার আমি গ্রহণ করতে পারব না, সরি।”
“আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। ঠিক এই কারণেই আমি খুব মূল্যবান কিছু কিনিনি, বিশ্বাস করো। আমি পারতাম তোমার জন্য মূল্যবান উপহার কিনতে, তবু কিনিনি শুধুমাত্র তুমি গ্রহণ করবে না বলে। তুমি এই প্যাকেট খুলে দেখলেই বুঝতে পারবে, আমি একদমই মিথ্যা বলছি না। এর ভেতরে খুবই সামান্য উপহার আছে। তুমি এটা গ্রহণ করলে এই সামান্য উপহারটাই আমার কাছে অসামান্য মনে হবে।”
“প্রভাত, আমাকে জোর কোরো না প্লিজ।”
“জোর করছি না। তোমাকে কোনো কিছুতে জোর করার সাহস আমার নেই। আমি চাই আমার এই সামান্য উপহারটা তুমি গ্রহণ করো। প্রেমিক হিসেবে না হোক, অন্তত একজন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো। তুমি ফিরিয়ে দিলে এই উপহার অন্য কাউকে দেওয়া সম্ভব না, ফিরিয়ে দেওয়া-ও সম্ভব না। প্লিজ মৃন্ময়ী, সামান্য উপহারই তো। খোলার পর যদি তোমার মনে হয় আমি বিশাল কিছু কিনে ফেলেছি, তাহলে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো। আমি কিছুই মনে করব না।”
মৃন্ময়ী আবারও হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল। আজ কী যে হচ্ছে তার সাথে! আগের মতো প্রভাতের ওপর প্রচণ্ডভাবে বিরক্ত-ও সে হতে পারছে না। ছেলেটা এমনভাবে অনুনয়-বিনয় করে যে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। তবু তো সে শক্ত থাকার যথেষ্ট চেষ্টা করে। শেষমেশ উপহারটা-ও মৃন্ময়ীকে গ্রহণ করতে হলো। প্রভাতের খুশি যেন আর ধরে না। খুশিতে সে বাকি কেকটুকু এক বসাতে একাই খেয়ে ফেলল। তারপর মৃন্ময়ীকে বাড়ি অবধি-ও পৌঁছে দিয়ে এল। বাড়িতে ঢোকার আগে যখন মৃন্ময়ী ছোটো করে তাকে ধন্যবাদ জানাল, ঠিক তখন প্রভাতের মনে হলো আজকের দিনটা আসলেই একটু বেশিই বিশেষ। এমন দিন সে তার জীবনে বারবার ফিরে পেতে চায়।

উপহারসহ বাড়িতে ঢুকতেই মৃন্ময়ী মায়ের প্রশ্নের মুখে পড়ল। সাজেদা বেগম বক্সটা হাতে নিয়ে দেখতে-দেখতে জিজ্ঞেস করলেন,
“এটা কী রে?”
“উপহার।”
“কে দিলো?”
“এক বন্ধু,” উত্তরটা মিথ্যা হয়েও সত্য মনে হলো মৃন্ময়ীর।
সাজেদা বেগম পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“কোন বন্ধু?”
“তুমি চিনবে না। আমার সহপাঠী ছিল।”
“তা হঠাৎ তোকে উপহার দিলো যে?”
“দিতে ইচ্ছা করেছে তাই দিয়েছে।”
“তোর অনেক ভালো বন্ধু বুঝি?”
“ওই ভালোই।”
“ওওও। এটার ভেতরে কী আছে?”
“জানি না, খুললে বলতে পারব।”
“তাহলে খুলে দেখ।”
“খুলব নে মা। একটু জিরিয়ে নিই।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। ঠান্ডা শরবত খাবি? বানিয়ে দিবো?”
“বানাবে? বানাও তাহলে। গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।”

সাজেদা বেগম তখনই শরবত বানাতে চললেন। মৃন্ময়ী নিজের ঘরে ঢুকতেই তার পেছন-পেছন মৃদুলা-ও এল। ভেতরে ঢুকেই সে মৃন্ময়ীকে দুহাতে জাপটে ধরে বলল,
“হ্যাপি বার্থডে আপু।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ বোন।”
মৃদুলা মৃন্ময়ীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“গিফটটা তোমায় প্রভাত ভাইয়া দিয়েছে, তাই না?”
মৃন্ময়ী অবাক চোখে তাকিয়ে জানতে চাইল,
“তুই জানলি কীভাবে?”
মৃদুলা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
“গণনা করে জেনেছি। দাঁড়াও, তোমার জন্য আমার তরফ থেকেও একটা ছোট্ট উপহার আছে।”
“কী উপহার?”
মৃদুলা এক ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। তাকে আলমারির ভেতরের জামাকাপড়ের নিচ থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করতে দেখে মৃত্তিকা প্রশ্ন করল,
“কী-রে? ওটা কী লুকিয়ে রেখেছিলি?”
মৃদুলা বলল,
“বড়ো আপুর বার্থডে গিফট।”
মৃত্তিকা একটু দ্বিধা নিয়ে জানতে চাইল,
“আজ আপার বার্থডে?”
“কেন? তুমি জানতে না?”
“মনে ছিল না।”
মৃদুলা উপহার নিয়ে ছুটল বড়ো বোনের কাছে। মৃত্তিকার হঠাৎ খুব খারাপ লাগল। নিজেকে প্রচণ্ডরকম স্বার্থপর মনে হলো। মা ঠিকই বলে, আপাকে সে কোনোকালেই বোঝেনি। বুঝতে চায়নি আর-কী। আচ্ছা, সে এখন খালি হাতে গিয়ে জন্মদিনের শুকনো একটা শুভেচ্ছা জানালে কি আপা খুশি হবে? না থাক, মৃদুলার মতো তো সে আপাকে ভালোবাসতেই পারে না। আজ হঠাৎ মিছে আবেগ দেখিয়ে কী হবে? তারচেয়ে বরং মৃদুলার সুন্দর শুভেচ্ছায় আপা খুশি থাকুক।

মৃদুলার উপহার খুলে মৃন্ময়ী অবাক হলো। এই মেয়ে তার জন্য দারুণ একটা শাড়ি কিনেছে। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে আবার চুড়ি আর কানের দুল-ও কিনেছে। মৃন্ময়ী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“এ তুই কী করেছিস মৃদুলা!”
মৃদুলা দাঁত বের করে হেসে বলল,
“তোমার ভাষায় অকাজ করে ফেলেছি, জানি। কিন্তু তুমি আমায় বকতে পারবে না। তুমিই সেদিন আমার জন্য পার্স কিনে এনে মাকে বলেছিলে মাঝে-মাঝে নিয়ম-কানুন ভেঙে পরিবারকে খুশি করতে ভালো লাগে। আমিও কিন্তু সেটাই করেছি।”
“তাই বলে তুই এত টাকা খরচ করবি? অল্প টাকায় কি উপহার দেওয়া যায় না?”
“আমার তোমাকে শাড়ি দেওয়ার শখ জেগেছিল, তাই শাড়িই কিনেছি। অন্যকিছু কিনলে মনে শান্তি পেতাম না।”
“এ মাসে নিশ্চয়ই হাত খরচে টানাটানি পড়ে গেছে?”
মৃদুলা হাসিমুখেই বলল,
“তা একটু পড়েছে। সমস্যা নেই, আগামী সপ্তাহেই আরেকটা টিউশনের টাকা পাব। এখন আমার গিফট তোমার পছন্দ হয়েছে কি না তা-ই বলো।”
মৃন্ময়ী মুচকি হেসে বলল,
“খুব পছন্দ হয়েছে। তোর পছন্দ কখনও খারাপ হয় না। কিন্তু এবারের মতো কিছু বললাম না, আর কখনও যেন এমন অকাজ করতে না দেখি।”
মৃদুলা বলল,
“তুমি খুশি হলে আমি এমন অকাজ বারবার করতে চাই। তারপর বকা শুনতে-ও আমার আপত্তি নেই।”
মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। বাড়িতে এই মেয়েটা আছে বলেই মাঝে-মাঝে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে সে হাসতে পারে। ভাগ্যিস সৃষ্টিকর্তা তার প্রতি এতটুকু দয়া করেছিলেন!

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৩

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৩.
নতুন পার্স পেয়ে খুব খুশি হলেও মৃদুলা বেজার মুখে বলল,
“পার্স আমি নিজেই কিনতাম আপু। তুমি কেন কিনতে গেলে?”
“কেন, তোর পছন্দ হয়নি?”
“পছন্দ হয়েছে। তোমাকে না বলেছি আমার পেছনে অযথা খরচ না করতে?”
“দাম বেশি না তো। মাত্র আড়াইশো টাকা।”
“হোক, আড়াইশো টাকা তোমারই উপকারে আসত।”
মৃন্ময়ী হেসে মাকে ডেকে বলল,
“মা দেখো, তোমার মেয়ে খুব বড়ো হয়ে গেছে। এমনভাবে বলছে যেন তার জন্য খরচ করা আমার দণ্ডনীয় অপরাধ।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“আমার মেয়ে ঠিকই বলে। যেটা কেনার সামর্থ ওর আছে, সেটা ও নিজেই কিনে নিবে। তোর এত বাড়তি খরচের কী দরকার? ওর যখন হাতে টাকা না থাকে, কিছু দরকার হলে তো ও নিজেই তোকে জানায়। দুজনেই কষ্ট করে টাকা রোজগার করিস। খরচ তেমনই ভেবেচিন্তে করা উচিত।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভেবেচিন্তে, মেপে-মেপে তো সবসময়ই খরচ করি মা। তবু কখনও-কখনও ভাবনাচিন্তার বাইরে গিয়ে তোমাদের জন্য কিছু করতে ইচ্ছা করে। এটা আমার কাছে অনেক আনন্দের। তোমাদের মুখের হাসিটাই তো আমার সবকিছু। তারজন্য মাঝে-মাঝে নিয়ম-কানুন ভাঙতে আমার কোনো আফসোস নেই।”
মৃদুলা মন খারাপী সুরে বলল,
“আমাদের ভালো রাখার তাগিদে তো তুমি নিজের জীবনটাকেই ব’লিদান দিয়ে দিচ্ছ আপু। আমরা তোমাকে ভুলিয়েই দিয়েছি তোমার-ও একটা জীবন আছে। তোমার-ও আমাদের মতো সবরকম চাহিদা আছে, হাসিখুশি থাকার ইচ্ছা আছে, একটা শান্তিপূর্ণ জীবনের আকাঙ্ক্ষা আছে। অথচ দায়িত্বের নামে আমরা তোমাকে টেনেহিঁচড়ে তোমার জীবন থেকে কতটা দূরে সরিয়ে এনেছি! আমরা খুবই স্বার্থপর, তাই না আপু?”

সাজেদা বেগম মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মৃদুলার কথায় যে মেয়েটার ক্লান্ত মনটায় মন খারাপের ছায়া পড়েছে, তা তিনি বেশ বুঝতে পারলেন। তাই তিনি মৃদুলাকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“তুই ওর কানের কাছে ভনভন না করে সর তো। ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দে। কী গরম পড়েছে দেখেছিস? মেয়েটা মাত্র বাইরে থেকে এসেছে না?”
“চলে যাচ্ছি, আমার পড়তে বসতে হবে,” বলে মৃদুলা উঠে পড়তেই মৃন্ময়ী তাকে পিছু ডাকল,
“শোন।”
“বলো আপু।”
মৃন্ময়ী তার ব্যাগ থেকে নতুন কেনা কানের দুলগুলো বের করে দিয়ে বলল,
“নে, কানের দুলের ডিজাইনটা পছন্দ হয়েছিল, তাই নিয়ে এসেছি।”
মৃদুলা হাতে নিয়ে দুই জোড়া দুল দেখে জিজ্ঞেস করল,
“একরকম দুই জোড়া দুল দিয়ে আমি কী করব?”
“মৃত্তিকাকে এক জোড়া দিয়ে আয়।”
মৃদুলা একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
“তুমি পারো-ও আপু!”

মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসে ছিল। মৃদুলা এসে তার হাতে এক জোড়া কানের দুল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“নাও, এটা তোমার।”
মৃত্তিকা কানের দুলটা নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে শুধাল,
“সুন্দর তো! তুই কিনেছিস?”
“উঁহু, বড়ো আপু আমার জন্য পার্স কিনতে গিয়েছিল। তখন এই দুলের ডিজাইন পছন্দ হয়েছে বলে তোমার আর আমার জন্য নিয়ে এসেছে।”
“ও, আসলেই সুন্দর।”
“আপু এখনও তোমাকে নিয়ে কত ভাবে! সত্যি, অবাক না হয়ে পারি না। তার জায়গায় আমি হলে হয়তো তোমার ছায়া-ও মাড়াতাম না। আপু একটা অদ্ভুত মানুষ!” কথাগুলো বলতে-বলতে মৃদুলা চলে গেল।

মৃত্তিকা প্রতিবাদ করল না। ইদানীং মা-বোনের কড়া কথার বিপরীতে তার আর প্রতিবাদ আসে না। তর্ক করার ইচ্ছা জাগে না। কথা-ও যেন সে খুব মেপে-মেপে বলছে। কী দরকার কথা বাড়িয়ে তর্কে জড়ানোর? তর্ক করার মতো কথাই তো আজ আর তার ঝুলিতে নেই। সম্পূর্ণ শূন্য ঝুলি নিয়ে সে এই সংসারে ফিরে এসেছে। এই সংসারে আগে তার ভিন্ন একটা জায়গা ছিল, অন্যরকম মনের জোর ছিল। সেই জায়গাটা-ও সে নিজের দোষে হারিয়েছে। তবু যখন তার শেষ আশ্রয়স্থল এই সংসারটাই, শেষ ভরসা বড়ো আপা-ই, তখন আর নিজেকে আগের জায়গায় কল্পনা করার অর্থ কী? আগের মৃত্তিকা আর আজকের মৃত্তিকার জীবনের মাঝে যে আকাশ-পাতাল ফারাক। আগের মৃত্তিকার জীবনে যে পরিবারের চেয়েও মূল্যবান একটা মানুষ ছিল, সে-ও আর তার নেই। মৃত্তিকা তার ফোনটার দিকে তাকাল। স্ক্রিনে তার আর তার স্বামীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভাসছে। ছবিটা তাদের বিয়ের দিনে তোলা। কী খুশি ছিল তারা সেদিন! পরমুহূর্তেই সে হাতের কানের দুলের দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে তার চোখ-মুখে অন্ধকার নেমে এল। বুক চিরে বেরিয়ে এল ধারালো দীর্ঘশ্বাস।


গরমে অতিষ্ঠ প্রভাত শার্টের ওপরের দিকের দুটো বোতাম খুলে হাঁটছে। একটু পরপরই সে শার্ট ঝাঁকিয়ে শরীরে হাওয়া দিচ্ছে আর আফসোসের সুরে বলছে,
“আহ্! সিঙ্গেল মানুষের এমন গরম লাগার মানে কী! বেয়াদব গরম কি জানে না সিঙ্গেল মানুষকে বাতাস করার কেউ নেই? মনে হচ্ছে এই গরমের থেকে বাঁচতে অতি শীঘ্র বিয়ে করতে হবে। বউ-ই এই বাড়াবাড়ি রকমের গরমের একমাত্র সমাধান।”
মৃন্ময়ীকে শুনিয়ে সে এত কথা বললেও মৃন্ময়ী যেন শুনেও শুনছে না। সে তার মতো হাঁটছে তো হাঁটছেই। প্রভাত মাথা কাত করে উঁকি দিয়ে তার মুখোভাব লক্ষ্য করে বলল,
“ও ম্যাডাম, একটু দয়া তো করতে পারো। না কি? বেচারা ছেলেটাকে আর কত কষ্ট দিবে? এই মাথাফাটা গরমে তোমার পেছনে ঘুরেঘুরে যদি মাথা ফেটে ম’রেটরে যাই, তখন তো আর কেঁদে-ও লাভ হবে না। এখন মানুষ আছি বলে তোমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন নিয়ে পেছনে ঘুরছি, ভূ’ত হলে তো তুমি আমাকে দেখলেই দৌড়ে পালাবে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভূত হলে পছন্দমতো একটা পেতনি খুঁজে নিয়ো‌।”
“পেতনিটা তুমি হলে আমি এক কথায় রাজি আছি।”
“আমার ঠেকা পড়েনি তোমার সাথে ম’রার।”
প্রভাত অবাক কন্ঠে বলল,
“তারমানে তুমি চাও আমি একাই ম’রে যাই? আমি তোমাকে এত ভালোবাসি, আর তুমি আমার মৃ’ত্যু কামনা করছো? এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয় মৃন্ময়ী।”
“আমি কিছুই চাইছি না। তুমি নিজেই মুখের কথায় ম’রে যাচ্ছ, আবার মুখের কথায় ভূ’ত হয়ে যাচ্ছ।”
প্রভাত মন খারাপ করে বলল,
“কী করব? তুমি তো আমার দুঃখ বোঝো না। আমার সব দুঃখ বারবার পিষে ফেলে রেখে চলে যাও।”
“বললাম তো আমি কিছুই করি না। যা করার তুমি নিজেই করো। দুঃখের কথা বললে সেটাও তুমি নিজের ইচ্ছায় জুটিয়ে নাও।”
প্রভাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তা অবশ্য মিথ্যা বলনি। দোষ তো আমারই। আমি নিজেই তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভে চারটা বছর ধরে পেছনে পড়ে আছি। তুমি আমায় বিন্দুমাত্র আশা দাওনি। তবু আমি মৃন্ময়ী নামক আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটে চলেছি। আমি জানি না এই সব অনিশ্চয়তা পেরিয়ে আমি কবে তোমার হৃদয়ে পৌঁছাতে পারব। তবু আমি ধোঁয়াশার মতো আশা ছাড়ব না। আমি তোমাকে জয় করবই। হয় আমি তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধব, নয় আজীবনের মতো ঘরের আশা ত্যাগ করব।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার কারণে তুমি ঘরের আশা ছাড়তে পারো না। যেহেতু আমি তোমাকে কোনোরকম আশা দিইনি, সেহেতু তুমি আমাকে আজন্মের দোষী-ও বানাতে পারো না।”
“নাহ্। আমি তো বলছি তুমি দোষী নও, দোষী আমি নিজেই। এটুকু দোষ না করলে কি আর অসম্ভব রকমের ভালোবাসা জয় করা যায়? দোষ যখন করেই ফেলেছি, চালিয়ে যাই না। জয়ী তো আমি একদিন হবই। আর দুর্ভাগ্যবশত হেরে গেলে, ঘর-টরের স্বপ্ন ওখানেই শেষ। তবে ভয় নেই, আমি কোনোদিনও তোমার দিকে আঙুল তুলব না। আমি জানি তুমি কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছো, কেন দিনের পর দিন প্রেম-ভালোবাসা এড়িয়ে চলছো। যেখানে আমি নিজেকে তোমার জায়গায় কল্পনা করতে-ও ভয় পাই, সেখানে তোমাকে দোষ দেওয়া তো অসম্ভব কাজ।”

মৃন্ময়ী কিছুক্ষণ নীরব রইল, প্রভাত-ও। তারপর মৃন্ময়ী নরম গলায় বলল,
“প্রভাত, জেনেবুঝে আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটে কী মজা পাচ্ছ? বয়স বাড়ছে, আর এমন বেপরোয়া হয়ো না।”
প্রভাত নিঃশব্দে হাসল। বলল,
“বেপরোয়া বলেই আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটছি। নয়তো বহু আগেই থেমে যেতাম।”
“এবার তো থামো। তুমি কি ক্লান্ত হও না?”
“থামার জন্য তো এতটা পথ হাঁটিনি। আর তোমার বেলায় আমার কোনো ক্লান্তি-ও নেই। যেদিন বুঝতে পেরেছিলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি, সেদিন থেকেই আমি আমার মনের সমস্ত ক্লান্তিদের ছুটি দিয়ে দিয়েছি। মৃন্ময়ী ম্যাডামকে জয় করার অভিযানে নেমেছি যে। এটুকু প্রস্তুতি তো নিতেই হত।”
“লাভ নেই প্রভাত। আমি তোমাকে বারবার বলেছি আমার পরিবারের বাইরে আমি এখন কিচ্ছু ভাবতে পারব না। আমার জীবন আমাকে সেই সুযোগ দিবে না।”
“আর যদি কোনোদিন সেই সুযোগ আসে, সেদিন কি তুমি আমাকে ভালবাসবে?”
“আসবে না।”
“যদি আসে?”
“অসম্ভব।”
“আচ্ছা, না আসুক। আমি শুধু তোমার মুখে সত্যি কথাটা জানতে চাই। সুযোগ এলে কি তুমি আমায় ভালবাসবে?”
“আমার জন্য ওসব কল্পনা ছাড়া কিছুই না।”
“বলো না। আমি একবার তোমার মনের কথা শুনতে চাই, শুধু একবার। মনে করো এটা কল্পনাই। তোমার সামনে সুযোগ এসেছে কাউকে ভালোবাসার। তুমি কী করবে? সেদিনও আমাকে এভাবেই ফিরিয়ে দিবে? না আমাকে গ্রহণ করে নিবে? না কি আমাকে অযোগ্য ভেবে অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে বসবে? বলো না প্লিজ।”

অবাক চোখে মৃন্ময়ী প্রভাতের ব্যাকুলতা দেখছে। যতই সে এই ছেলেটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুক, মাঝেমাঝে এমন কিছু মুহূর্তে ছেলেটার এসব ব্যাকুলতা দেখলে তার খারাপ লাগে। কোন সুখে এই ছেলে তাকে ভালোবাসল? কেন তার মনে মৃন্ময়ীর জন্যই এত পাগলামির সৃষ্টি হলো? সে তো অন্য কাউকে এমন পাগলের মতো ভালোবেসে একটা সুখী জীবন নিশ্চিত করতে পারত। তবে আর তাকে মৃন্ময়ীর অনিশ্চিত জীবনে প্রবেশ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে হত না। মৃন্ময়ী নিচু স্বরে বলল,
“আমি তোমাকে মিছে আশা দিতে পারব না।”
“তোমাকে আশা দিতে হবে না। তুমি মুখ দিয়ে শুধু এইটুকু বলো যে, কোনোদিন সুযোগ এলে তুমি আমাকেই ভালোবাসবে। ব্যস এটুকুই, আর কিচ্ছু বলতে হবে না তোমাকে। বাকিটা আমি নিজেই বুঝে নিব। প্লিজ মৃন্ময়ী।”
“তোমার নিজস্ব একটা জীবন আছে প্রভাত। আমি চাই না আমার জন্য তুমি তোমার জীবন থেকে সরে দাঁড়াও।”
“আর তুমি? তুমি কী করছো? তোমার কি নিজস্ব জীবন নেই? তা নিয়ে তো তোমার বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই। এটা কি নিজস্ব জীবন থেকে সরে যাওয়া নয়?”
“আমার আর তোমার জীবন এক নয়। তুমি তো জানো তোমার থেকে আমি সম্পূর্ণ আলাদা।”
“হোক আলাদা। তুমি শুধু আমার হয়ে যাও, আলাদাকেই আমি এক করে নিব।”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমার জন্য বিয়ে করা মানেই পরিবার ছাড়া। এই পরিবার ছাড়ার কথা আমি ভাবতেও পারব না।”
“আমি তো তোমাকে পরিবার ছাড়তে বলছি না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি কোনোদিনও তোমাকে তোমার পরিবার ছাড়তে বলব না। আমি শুধু চাইছি তুমি তোমার জীবনটা নিয়ে একটু ভাবো। তারপর তোমার-আমার জীবনে শুধু একটু পরিবর্তন আসবে। তোমার বাকি সব একইরকম থাকবে, আমি তোমাকে কিচ্ছু পরিবর্তন করতে বলব না। বিয়ে করলেই পরিবারের সাথে তোমার দূরত্ব তৈরি হবে, এমন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসো প্লিজ। আমি তো জানি তোমার পরিবারের তোমাকে কতটা দরকার। আমি তাতে কোনোদিনও আপত্তি করার সাহস দেখাব না। তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কী বুঝাতে চাইছি?”
“পারছি।”
“তাহলে কিছু তো বলো।”
“প্রভাত, মুখে অনেককিছুই বলা সম্ভব। চামড়ার মুখ তো, বলতে বাঁধে না। আর যদি হয় আবেগের কথা, তাহলে তো আরও আগে বাঁধে না। বাঁধে গিয়ে কোথায় জানো? যখন কথা রাখার সময় হয়। বাস্তবতার মুখোমুখি মানুষ তখনই হয়।”
“আমি ম’রে গেলেও আমার কথা ভাঙব না। তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিতে বললে আমি তা-ও করতে পারব।”
“মৃত্তিকার বর-ও হয়তো তাকে এমনভাবেই কথা দিয়েছিল। সে কি করেছে জানো? এত-এত ভালোবাসাসহ মৃত্তিকাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ওর নিজের হাতে সাজানো সংসারটা থেকে বের করে দিয়ে এখন নতুন বউ নিয়ে আনন্দ করছে।”
কথাটা শুনে প্রভাত ভীষণ অবাক হলো। মৃত্তিকার সাথে এমনটা হয়েছে, এই খবর তার জানা ছিল না। খবর নিতে হবে। আপাতত প্রভাত সে কথায় মাথা না ঘামিয়ে বলল,
“সব মানুষ তো এক হয় না। আমি খারাপ ছেলে হতে পারি, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে আমি খারাপ নই। তুমি একটা চিটারের সাথে আমার তুলনা করতে পারো না। আমি আর যা-ই করি, তোমার সঙ্গে চিট করব না।”
“আমি তুলনা করছি না, তোমাকে খারাপ-ও বলছি না। আমি শুধু বাস্তবতার বিষয়ে কথা বলছি। তুমি আমাকে যা বুঝাতে চাইছো, আমিও তারই প্রেক্ষাপট ধরে কথা বলছি।”
প্রভাত চরম হতাশ হয়ে বলল,
“তুমি আমাকে বুঝতে পারো না, না কি বুঝতে চাও না, তা-ই আমার বুঝে আসে না। এত ভালোবাসা চোখে দেখার পরও, এত সুযোগ সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও একটা মানুষ নিজের জীবন নিয়ে কীভাবে এতটা উদাসীন হয় মৃন্ময়ী?”
মৃন্ময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে উত্তর দিলো,
“মানুষটা আমি বলেই হয়তো।”


মৃদুলা আজ মৃত্তিকাকে ডাকাডাকি করে ঘর থেকে বের করেছে। মৃত্তিকা প্রয়োজন ছাড়া তেমন ঘর থেকে বেরোয় না। সে যে এই বাড়িতে আছে, তা-ই আজকাল বুঝা যায় না। অথচ আগে এ বাড়িতে তার কন্ঠস্বরই সবচেয়ে বেশি শোনা যেত। মৃদুলা আজ টিউশন থেকে ফেরার সময় ঝালমুড়ি কিনে এনেছে। বাড়ি ফিরে সে মা আর বোনকে ডেকে ঝালমুড়ি খেতে বসেছে। খেতে-খেতে মৃদুলা মাকে প্রশ্ন করল,
“মা, আপুর কাছে এখন টাকা চাইলে কি দিতে পারবে?”
সাজেদা বেগম বললেন,
“কেন? তোর টাকা লাগবে না কি?”
“ওই কিছু টাকা লাগত।”
“কিসের জন্য?”
“কলেজে।”
“কদিন আগে না টাকা দিলো?”
“ওই টাকা না।”
“তাহলে?”
মৃদুলা মিনমিনে গলায় বলল,
“আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান হবে। তারজন্য বান্ধবীরা সবাই একরকম জামা কিনবে।”
“তোর কাছে টাকা নেই?”
“যা আছে, তাতে হবে না।”
“তাহলে সবার সাথে পাল্লা দিয়ে জামা না কিনলে কী হয়? ঘরে কি তোর নতুন জামা নেই?”
মৃদুলা মুখে একরাশ অন্ধকার নামিয়ে বলল,
“সবাই একরকম জামা পরবে, তারমধ্যে আমি একা অন্যরকম জামা পরে যাব কীভাবে?”

সাজেদা বেগমের হঠাৎ কী হলো কে জানে? তিনি ধুম করে রেগে গেলেন। রাগত স্বরে বলে উঠলেন,
“না যেতে পারলে আমাকে বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে আন। আর কী করবি? আমার তো আর দুই টাকা রোজগার নেই যে বললেই দিয়ে দিবো। একজন দিন-রাত খেটে ম’রছে আর আমাদের টানছে। টানতে-টানতে তার দম ফুরানোর জোগাড় হচ্ছে, তা তোরা বুঝবি কী করে? তোরা তো তার কাছে হাত পাতলেই সব পেয়ে যাস। তারপর তার নিমক খেয়ে তার সাথেই নিমকহারামি করে পার পেয়ে যাস। আমার এই মেয়ে কি তোদের জন্য খাটতে-খাটতে ম’রে যেতে জন্মেছে রে? তোদের কাছে ওর কী এমন ঠেকা যে নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে তোদের সুখে রাখছে? তারপরও তোরা আমার মেয়েটার র’ক্ত পানি করা জীবনটার ওপর থুথু কেন ছিটাস? বলতে পারিস? কী পাপ করেছিল ও? কেন করিস তোরা এমন?”

কথা শেষ করার আগেই সাজেদা বেগম কেঁদে ফেলেছেন। মৃদুলা ব্যথাতুর মুখে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে আছে। সাজেদা বেগম উঠে সরে যেতেই মৃত্তিকা-ও উঠে পড়ল। সে উঠতেই মৃদুলা শক্ত মুখে বলে উঠল,
“শান্তি হয়েছ তুমি? তোমার কারণে মায়ের এসব কথা আমাকেও শুনতে হয়? আমি কী করেছি? আজব! তোমার দোষে আমিও কেন এসব কথা শুনব? আপু কি তোমার জন্য কম করেছে? আমার তো মনে হয় আপু আমার চেয়েও বেশি করেছে তোমার জন্য। তবু তুমি তাকে এত কষ্ট কী করে দাও? আল্লাহ্ কি তোমাকে মন বলতে কিছু দেয়নি আপা?”
মৃত্তিকা জবাব দিতে পারল না। মাথা নিচু করে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। সঙ্গে-সঙ্গে তার মুখের রং বদলে গেল। বিছানার কাছে গিয়ে সে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার কান্নার শব্দ দরজার ওপাশে বসা মৃদুলার কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। অনুশোচনায় দ’গ্ধ হৃদয়টা দেখল না কেউ। আবদ্ধ রুমের দেয়ালে-দেয়ালে কান্নার শব্দ ধাক্কা খেয়ে তার নিজের কানেই ফিরে এল। মৃত্তিকার যেন নিজের কান্নার শব্দটা-ও সহ্য হলো না। সে দুহাতে নিজের কান চেপে ধরল। সে আজীবন সন্ধি করে এল আনন্দের সাথে। হাসতে-হাসতে একটা জীবন কা’টিয়ে দিতে চাইল। অথচ কান্নারা হঠাৎ কেন তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে গেল? আশ্চর্য!

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০২

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২.
মৃত্তিকা মৃন্ময়ীর সামনে এল সকালে। গতকাল এসে হতে সে অভুক্ত। রাতে মৃদুলা তাকে খেতে ডেকেছিল। কিন্তু তার খাওয়ার ইচ্ছা ছিল না বলে খায়নি। সকালে ঘুম ভাঙতেই পেটের মধ্যে ক্ষুধার জ্বালাতন শুরু হয়ে গেছে। এখন আর কিছু না খেয়ে থাকা সম্ভব নয়। এতটা সময় না খেয়ে থাকার অভ্যাস নেই তার। হাত-মুখ ধুয়েই সে রান্নাঘরে হাজির হলো। সাজেদা বেগম তখন সবে নাশতা বানানো শেষ করেছেন। মৃত্তিকাকে দেখে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন,
“রুটি-ভাজি করেছি। নিয়ে খা।”
মৃত্তিকা প্রত্যুত্তর না করে চুপচাপ প্লেটে রুটি-ভাজি নিয়ে চলে এল। টেবিলের কাছে এসে দেখল মৃন্ময়ী বসে রুটি খাচ্ছে। রান্নাঘরে যাওয়ার সময় সে মৃন্ময়ীকে খেয়াল করেনি। মৃন্ময়ী স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে খেতে বসেছে। মৃত্তিকা আসতেই সে বলল,
“বোস, কাল রাত থেকে না কি কিছু খাসনি? তোর শরীর ভালো?”
মৃত্তিকা চেয়ার টেনে বসে বলল,
“ভালো।”

শরীর ভালো থাকলেও যে মন ভালো নেই, সেটা তার মলিন মুখটাই বলে দিচ্ছে। মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে বোনের মনের অবস্থা ভালো না। এই মুহূর্তে সে কীভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। মৃত্তিকা রাগ, বিরক্তি তাদের দুবোনের চেয়ে বেশি। কারো কথা পছন্দ না হলে সে খুব বিরক্ত হয়। আচ্ছা, কোন কথা দিয়ে শুরু করলে আজ মৃত্তিকা বিরক্ত হবে না? এটা তো তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মৃন্ময়ীকে চুপ দেখে মৃত্তিকা নিজেই বলল,
“আপা কি খুব শক খেয়েছিস?”
মৃন্ময়ী কথাটার কারণ বুঝেও জানতে চাইল,
“শক খাব কেন?”
“এই যে তোদের জ্বালাতে চলে এলাম।”
মৃত্তিকার ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি। তাচ্ছিল্যটা আসছে তার কপালের প্রতি। মৃন্ময়ীর কেন জানি খারাপ লাগল। মৃত্তিকাকে আরও একটু সময় দিতে ইচ্ছা করল। কাঁচা ক্ষত খুঁচিয়ে র’ক্তাক্ত করতে তার দ্বিধা হচ্ছে। যদিও সকালে মা তাকে বারবার করে বলে দিয়েছে মৃত্তিকার পেট থেকে কথা বের করতে। সে সত্যিই আর ফিরবে কি না জানতে। মৃত্তিকা খেতে-খেতে বলল,
“কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে করতে পারিস, সমস্যা নেই। তোর ঘাড়ে যখন আবার ফিরে এসেছি, সবকিছু জানার অধিকার তো তোর আছেই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তোর যখন মন ভালো হবে তখন তুই বলিস।”
“এখন আর মন নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এসে যখন পড়েছি, তোদের কাছে সবটা পরিষ্কার থাকাই ভালো।”
এই পর্যায়ে মৃন্ময়ী নড়েচড়ে বসে প্রশ্ন করল,
“তুই কি একেবারেই চলে এসেছিস? না কি প্রতিবারের মতো রাগ কমলে চলে যাবি?”
“যাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই।”
“কেন? এবার কী সমস্যা হয়েছে তোদের?”
“সমস্যা তো একটার পর একটা চলছিলই। পুরো পরিবার জোট বেঁধে নেমেছিল আমাকে সংসার থেকে ছাঁটাই করার জন্য। স্বামীর জন্য তবু সবার সাথে যুদ্ধ করে টিকে ছিলাম। শেষমেশ সেই মানুষ নিজেই আমাকে সংসার থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো।”
“অনেকদিন ধরে তোদের ঝগড়াবিবাদ চলছিল, তা তো জানি। এবার এমন কি হলো যে তোকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো, আর তুইও চলে এলি?”
“ওরা যে কিছু একটা ঘটাবে তা আমার কয়েকদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল। কয়েকদিন ধরে আমার ডাইনি শাশুড়িটা সবসময় ছেলের সাথে ফুসুরফুসুর করছিল। আমাকে দেখলেই তারা চুপ। আর আমার সঙ্গে-ও খারাপ ব্যবহার আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার জামাই আমার সাথে দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিল। আমার পাশে ঘুমাত না, ঠিকমতো কথা বলত না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই ধমকে উঠত। দুদিন আগে তারা সবাই মিলে আমার নানা শ্বশুরকে দেখতে গিয়েছিল, তার অবস্থা না কি খুব খারাপ ছিল। আমাকে একা বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। তখন তো আর বুঝিনি তারা আমার সংসার ভাঙার হাতিয়ার আনতে গেছে।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল,
“হাতিয়ার মানে?”
“সতিন, সতিন। তারা গতকাল সকালে নতুন ছেলের বউ নিয়ে বাড়িতে উঠেছে। আমার জামাইকে এত করে জিজ্ঞেস করলাম সে আমার সাথে এমন কেন করেছে, সে এমন ভাব করল যেন আমি তার কেউ না। তারা সবাই ব্যস্ত নতুন বউ নিয়ে। আমি যেন কীটপতঙ্গ, কেউ চোখেই দেখে না। রাগ করে আমি যখন চেঁচামেচি শুরু করেছি, তখন তারা সুযোগ বুঝে বলে দিয়েছে তারা তাদের পছন্দমতো ছেলের বউ এনেছে। সহ্য না হলে আমি যেন আমার বাপের বাড়ি চলে আসি। আমার জামাই তো বলেই দিয়েছে সে আমাকে তালাক দিয়ে দিবে। আমি ওখানে থাকলে সে আর আমাকে স্ত্রীর জায়গা দিবে না। এই আর-কী। কথায়-কথায় গায়ে হাত-ও তুলল। তারপর দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিলো। তাই আমিও চলে এলাম। যার জন্য ওই বাড়িতে পড়ে ছিলাম, তার কাছেই যদি জায়গা না পাই, থেকে আর কী হবে? থাকুক তারা তাদের নতুন বউ নিয়ে। আমি তো শান্তি দিইনি। নতুন বউ যদি তাদের শান্তি দেয়।”

মৃন্ময়ী হতভম্ব হয়ে গেল। ঘরে বউ রেখে আবার নতুন বউ এনেছে? তা-ও প্রথম বউয়ের অজান্তে? আশ্চর্য! মানুষ এমন বিশ্রী কাজ কীভাবে করতে পারে? সে অবাক কন্ঠে বলল,
“সংসারে ঝগড়া-বিবাদ তবু মানা যায়। কিন্তু ও তোর সাথে এমন একটা কাজ কীভাবে করতে পারল? ও তো নিজের পছন্দেই তোকে বিয়ে করেছিল।”
“তখন পছন্দের ছিলাম তাই বিয়ে করেছিল। এখন অপছন্দের হয়ে গেছি, তাই ছেড়ে দিয়েছে। আমার কপালে আসলে এটাই হওয়ার ছিল। মা বলেছিল না আমার এই আবেগী বিয়ে বেশিদিন টিকবে না? শেষপর্যন্ত মায়ের কথাই সত্যি হলো।”
“তা তো মা তোর ওপর রাগ করে বলত। কোনো মা কি চায় মেয়ের সংসার ভেঙে যাক? তখন এ কথা বলত, এখন দেখ তুই চলে এসেছিস বলে মা কত দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।”
মৃত্তিকা আবারও হেসে বলল,
“মা দুশ্চিন্তায় পড়েছে তোকে নিয়ে রে আপা। তোর ঘাড়ে বসে আবারও লাফালাফি শুরু করি কি না, সেই ভয় পাচ্ছে।”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“মা তোর-আমার সবার চিন্তাই করে রে। শুধু মুখে প্রকাশ করে না বলে আমরা তার খিটখিটে মেজাজটাই সত্যি ভেবে নিই।”
মৃত্তিকা ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“যাক, এখন এসব কথা রাখ। তোর স্কুলে যেতে দেরী হয়ে যাবে। ওঠ-ওঠ।”
মৃন্ময়ী দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যিই তার দেরী হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাত ধুয়ে এক গ্লাস পানি পান করল সে। এঁটো প্লেট ধরতেই মৃত্তিকা বলল,
“আমি ধুয়ে রাখব নে। তুই যা।”
অবাক করার মতো কথা। মৃত্তিকার মুখে এমন কথা কোনোদিন শুনেছে বলে মৃন্ময়ীর মনে পড়ে না। সে খাবার খেয়ে নিজের এঁটো প্লেট-ও ফেলে রেখে উঠে যাওয়া মেয়ে। কিন্তু মৃন্ময়ীর এখন অবাক হওয়ার সময়-ও হাতে নেই।‌ উঁচু গলায় মাকে বলেই সে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল।


বেতন হাতে পেয়ে আজ মৃন্ময়ী কোচিং থেকে বেরিয়ে সোজা মার্কেটে চলে এসেছে। অনেকদিন ধরে সে লক্ষ্য করছে মৃদুলার হাতের পার্সটা পুরোনো হয়ে গেছে। মেয়েটা নতুন পার্স না কিনে সেটা নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃন্ময়ী বোনের জন্য একটা পার্স কিনল। নতুন এক ডিজাইনের কানের দুল মৃন্ময়ীর খুব পছন্দ হলো। তার থেকে সে দুই জোড়া কানের দুল কিনে নিল। মায়ের জন্য ঔষধ কিনতে যাওয়ার সময় হঠাৎ মৃন্ময়ীর চোখ আটকে গেল পাশের জুয়েলারি দোকানে। মৃত্তিকার বর দোকানে ঢুকছে, অর্থাৎ প্রাক্তন বর। সঙ্গের মেয়েটা নিশ্চয়ই তার নতুন বউ? নিমেষেই মৃন্ময়ীর মেজাজ বিগড়ে গেল। ইচ্ছা করল ছুটে গিয়ে বাটপারটার কলার ধরে কানের নিচে কষে কয়েকটা থাপ্পড় মা’রতে। এক বউয়ের সঙ্গে বাটপারি করে এখন আরেকজন নিয়ে ঘুরে-ঘুরে জুয়েলারি কেনা হচ্ছে? মনের তীব্র ইচ্ছাটা মনে চেপে মৃন্ময়ী ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে দ্রুত বাড়ির পথে হাঁটা দিলো। প্রভাত তার পেছনেই ছিল। হঠাৎ করে মৃন্ময়ীকে তাড়াহুড়া করে হাঁটতে দেখে সে দৌড়ে তার কাছাকাছি চলে গেল। মৃন্ময়ীকে ডেকে বলল,
“ম্যাডাম, হঠাৎ গতি বেড়ে গেল যে? আজ আবার কিসের তাড়া?”
মৃন্ময়ী দ্রুত পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে গম্ভীর মুখে বলল,
“আমার পিছু নিয়ো না প্রভাত। চলে যাও।”
প্রভাত সে কথা গায়ে না মেখে বলল,
“তা তো তুমি রোজই বলো। নতুন কী?”
“রোজ বললেও তুমি শোনো না, আজ একবার শোনো প্লিজ। আমার পেছনে এসো না।”
মৃন্ময়ীর অন্যরকম কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে প্রভাত প্রশ্ন করল,
“তুমি কি রেগে আছো?”
“না।”
“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি রেগে আছো। একটু আগেও না তোমায় স্বাভাবিক দেখলাম? হঠাৎ কী হলো?”
“কিছু হয়নি। তুমি চুপ করো।”
প্রভাত মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, কিছু তো একটা হয়েছে। আমাকে বলো না কী হয়েছে।”
মৃন্ময়ী হঠাৎ থেমে গিয়ে রেগেমেগে বলে উঠল,
“বলছি তো কিছু হয়নি? তারপরও এত নাক গলাচ্ছ কেন তুমি? আমি একটু একা হাঁটতে চাইছি। সেই স্পেসটুকু-ও কি তুমি আমায় দিবে না?”
“তোমাকে একা ছাড়ার মতো স্পেস আমি দিতে চাই না।”
মৃন্ময়ী গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“তোমার সাথে আমি কথা বাড়াতে চাই না। দয়া করে এখানেই থেমে যাও, আর এসো না। কারোর সঙ্গ আমার ভালো লাগছে না। চলে যাও।”
তবু প্রভাত ত্যাড়া সুরে বলল,
“যদি না যাই?”
মৃন্ময়ী এবার উত্তর না দিয়ে রাগত চোখে চেয়ে রইল। প্রভাত বলল,
“আচ্ছা, আমি বুঝতে পারছি না কদিন ধরে তোমার কী হয়েছে। কদিন ধরেই খেয়াল করছি তোমার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। বাসায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“আমার সমস্যা জানার বিশেষ কোনো প্রয়োজনীয়তা তোমার নেই। আমি যাচ্ছি, আমার পিছু নিবে না।”
প্রভাত মন খারাপ করে বলল,
“এমন করছো কেন? আমি চুপচাপ চলি না, কথা বলে তোমাকে বিরক্ত করব না।”
“হাসিয়ো না। তুমি যেদিন চুপচাপ থাকতে পারবে, সেদিন আমি এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করব।”
“তাহলে আমি তোমাকে হাসাতেই চাই।”
“প্রভাত, তুমি কেন বুঝতে চাইছো না আমার একটু স্পেস দরকার? তুমি না আমার সহপাঠী?”
“আচ্ছা দাঁড়াও, রিকশা নিয়ে দিই।”
“আমি রিকশায় যাব না, হেঁটে যাব।”
“তুমিও তো এখন জেদ করছো। রাত বাড়ছে দেখেছ? রাস্তাঘাটে যদি একা ভয় পাও?”
“তুমি পিছু নেওয়ার বহু আগে থেকে আমি একা চলাফেরা করছি। আমাকে নিয়ে অযথা ভেবো না। নিজের কাজে যাও।”
প্রভাত আবারও ত্যাড়া সুরে বলল,
“তোমাকে নিয়ে অবশ্যই আমি ভাবব। একা যেতে চাইলে রিকশায় ওঠো, নয়তো আমার সাথেই চলো।”

মৃন্ময়ী মুখে চ-সূচক শব্দ তুলে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে রইল। প্রভাত একটা রিকশা ডেকে তাকে উঠতে বলল। উপায়ান্তর না দেখে মৃন্ময়ী রিকশায় উঠে বসল। প্রভাত তার কথা না শুনে গাড়ি ভাড়াটা-ও দিয়ে দিলো। রিকশা চোখের আড়ালে চলে গেল। প্রভাত কিছুক্ষণ চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। পকেট থেকে ফোন বের করে বন্ধু সাঈদকে ফোন করে শুধাল,
“কোথায় আছিস রে?”
“বাড়িতে।”
“বাজারে আয়, চা খাই।”
সাঈদ সহাস্যে কৌতুক করে বলল,
“কীরে মামা? এই সময় তো বারবার ফোন দিলেও তোমার পাত্তা মিলে না। আজকে কি ম্যাডামের দেখা পাওনি?”
“পাব না কেন?”
“তাহলে? যাসনি তার পেছনে?”
“না।”
“ম্যাডাম কি আজ ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ানি মা’রছে?”
“ফালতু কথা রাখ। বাজারে আয় তাড়াতাড়ি।”
“আচ্ছা আসছি। অপেক্ষা কর।”
ফোন রেখে প্রভাত উলটো পথে হাঁটা ধরল। আপনমনে বিড়বিড় করে বলল,
“রোজই তো এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসি। আজ গেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে চা, নাশতা খেতে চাইতাম না ম্যাডাম।”

মৃন্ময়ীকে ভালোবাসাটা প্রভাতের জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনার একটি। সেই স্কুলজীবন থেকেই সে মৃন্ময়ীকে চেনে। কিন্তু কখনও ভাবেনি সে একদিন ওই ভদ্র-সভ্য মেয়েটাকে ভালোবাসবে। ছাত্রজীবনে প্রভাত বেশ কয়েকবার কয়েকটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু কাউকেই ঠিক ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি। প্রেমে তো মানুষ অসংখ্যবার পড়ে। সব প্রেমেই কি আর ভালোবাসা হয়? প্রভাত-ও প্রেমে পড়েছিল। কলেজে ভর্তির পর পরপর দুটো মেয়ের সঙ্গেই অল্প কিছুদিনের সম্পর্ক-ও হয়েছিল তার। দুটোই আবেগে ভেসে গিয়েছিল। না মেয়েগুলো তাকে ভালোবেসেছিল, না সে তাদের ভালোবেসেছিল। প্রেম করার ইচ্ছা জেগেছিল তাই প্রেম করেছিল। অনেক মেয়েরা তো তাকেই পাত্তাই দেয়নি। এই কাজটা করেছিল সব ভালো মেয়েগুলো। ভালো মেয়েরা তার মতো বেপরোয়া স্বভাবের ছেলেকে পাত্তা দিবে না, এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনার্সে ওঠার পর-ও সে এক মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই মেয়ে কয়েকদিন পরেই বিয়ে করে জামাইয়ের বাইকের পেছনে বসে কলেজে উপস্থিত হয়েছিল। প্রভাত টের পেয়েছিল তার লাভ লাইফ পুরোটাই লসে পরিপূর্ণ। তাই প্রেম থেকে সে একপ্রকার সরেই দাঁড়িয়েছিল। মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছিল সে আর কোনো মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করবে না। ঠিক সেই সময় আচমকা একদিন সে মৃন্ময়ীর প্রেমে পড়ে গেল। একদম মেঘশূন্য হঠাৎ বৃষ্টির মতোই তার হৃদয়ে ঝমঝমিয়ে প্রেমের বৃষ্টি নেমে এসেছিল। তখন ছিল মাঘ মাসের ভরপুর শীতকাল। সেদিন ঠান্ডাটা একটু বেশিই পড়েছিল। সাঁঝের বেলায় প্রভাত বন্ধুদের আড্ডা থেকে বিদায় নিয়েছিল বাড়ি গিয়ে কম্বলের নিচে আশ্রয় নেওয়ার আশায়। একা পথ চলতে-চলতে হঠাৎ করেই সে বাচ্চাদের কোচিং সেন্টারের সামনে এক মেয়েকে দেখতে পেয়েছিল। কনকনে শীতের মধ্যে মেয়েটা সোয়েটার হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে বসে ছিল। প্রভাত কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে মৃন্ময়ীকে দেখতে পেয়েছিল। মৃন্ময়ীর চোখ ভর্তি জল ছিল, মুখে ছিল তীব্র বিষাদের ছায়া। কেঁদেকেটে চোখ লাল করে ফেলেছিল মেয়েটা। প্রভাতকে দেখেই সে দ্রুত চোখ মুছে নিয়েছিল। প্রভাত তার পাশে গিয়ে বসেছিল। তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কিসের কষ্ট, সে কেন একা বসে কাঁদছে। মৃন্ময়ী তাকে বলতে চায়নি। কিন্তু প্রভাত জেদ ধরে বসেছিল। মৃন্ময়ীর কান্নার কারণ না জেনে সে কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। সে খুব করে জিজ্ঞেস করায় মৃন্ময়ী-ও সেদিন নিজের মন হালকা করার প্রয়োজন বোধ করেছিল। তাই সে প্রভাতের সঙ্গে অনেক কথা বলেছিল। প্রভাতকে শুনিয়েছিল তার দায়িত্বের গল্প। সংসার নামক এক যুদ্ধক্ষেত্রের গল্প। যেখানে সে প্রতিনিয়ত অভাব-অনটন, শোক-অসুখ আর সীমাহীন দায়িত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে। তবু তার এ দায়িত্ব শেষ হবার নয়। বরং দিনেদিনে বেড়েই চলেছে। বাবা তার কাঁধে নিজের সংসারের ভার চাপিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন যে। প্রভাত শুধু অবাক হয়ে মৃন্ময়ীর অশ্রুভেজা মুখের দিকে চেয়ে ছিল। এত সুন্দর, কোমল মেয়েটা যে মনে এত দুঃখ চেপে রেখেছিল, তা হয়তো কেউই জানত না। প্রভাতের যত কষ্ট ছিল তার মনমতো একটা পরিবারের অভাবে। কিন্তু টাকা-পয়সার অভাব তার কোনোকালেই ছিল না। বাবার কাছ থেকে সে ঠিকই প্রয়োজনীয় সবকিছু আদায় করে নিত। অথচ মৃন্ময়ীর সুন্দর একটা পরিবার থাকা সত্ত্বেও তার কষ্ট ছিল প্রভাতের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। একটা সংসারের দায়িত্ব কীভাবে সামলায় মেয়েটা? তার ওপর ওই মুহূর্তে মৃন্ময়ীর মায়ের ডায়বেটিস খুব বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছোটো বোনের স্কুলের বকেয়া পরিশোধ করে তার হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। সব শুনে সেদিন প্রভাত জোর করে তার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছিল। মৃন্ময়ী নিতে না চাইলে সে বলেছিল ধার হিসেবে নিতে। মৃন্ময়ী ধার হিসেবেই নিয়েছিল। এক সপ্তাহের মাথায় আবার পরিশোধ-ও করে দিয়েছিল। প্রভাতের হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল মৃন্ময়ী তার পাওনা টাকা ফেরত দিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তারচেয়েও খুব বড়ো কিছু চুরি করে নিয়েছে। ব্যস, নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রভাত আরও একবার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সেই সাথে সে এ-ও বুঝতে পারছিল যে, এবারের প্রেম মোটেও বাকিগুলোর মতো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ মৃন্ময়ী-ও ভালো মেয়েদের কাতারেই। প্রেম বিনিময় করলে নির্ঘাত প্রত্যাখ্যান করে দিবে। প্রভাত প্রেম বিনিময় করেনি। সেই থেকে সে মৃন্ময়ীকে আড়াল থেকেই দেখে গিয়েছিল। সুযোগ পেলেই মৃন্ময়ীর বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করত। মৃন্ময়ী-ও ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল। তার সাথে বন্ধুর মতোই আচরণ করেছিল। সময় যত গড়াচ্ছিল, প্রভাত তত বুঝতে পারছিল এটাই তার প্রথম দীর্ঘস্থায়ী প্রেম। মৃন্ময়ী-ই প্রথম মেয়ে যার প্রতি তার বিরক্তি আসে না, বিতৃষ্ণা আসে না, অধৈর্য আসে না; বরং দিনেদিনে প্রেম বাড়ে। একেক দিন সে নতুন করে মৃন্ময়ীর প্রেমে পড়ে, মুগ্ধ হয়। কিন্তু সে কোনোভাবেই নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছিল না। প্রভাত তরফদার, যে কি না একের পর এক মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করেছিল, সে একদিন মৃন্ময়ীর সামনে সাহস হারিয়ে বসেছিল। ব্যাপারটা নিয়ে তার বন্ধুরা খুব মজা করত, সবসময় হাসিঠাট্টা করত। কিন্তু প্রভাত সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল মৃন্ময়ীকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। এই ভালোবাসা সে কোনোভাবেই হারাতে চায় না। মৃন্ময়ীর মুখে হাসি ফোটানোর, তাকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার, একটা সুখী সংসার উপহার দেওয়ার স্বপ্ন তার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। টানা দেড় বছর প্রভাত আড়াল থেকে মৃন্ময়ীকে ভালোবেসেছিল। তারপর যখন দেখেছিল মৃন্ময়ীর এই জীবন পরিবর্তন হবার নয়, তখন সে ভাবনা বদল করেছিল। মৃন্ময়ীর সংসার-ই তার সবকিছু, দায়িত্ব পালন-ই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। নিজস্ব জীবন নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সেই মাথাব্যথাটাই প্রভাত তার মাথায় ঢুকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যাকে সে এতটা সময় ধরে ভালোবেসে এসেছে, সে যদি নিজের সংসার জীবন নিয়েই না ভাবে, তাহলে প্রভাতের এত স্বপ্ন কী করে পূরণ হবে? সে তো মৃন্ময়ীর সঙ্গে সংসার বাঁধার স্বপ্ন নিয়েই তার পেছনে পড়ে ছিল। মৃন্ময়ীর পর যে আর কোনো মেয়ের প্রেমে পড়া হয়ে ওঠেনি তার। ভেবেচিন্তে তখন প্রভাত মৃন্ময়ীকে মনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল। নিজের মনের সম্পূর্ণ সত্য অনুভূতি সে মৃন্ময়ীকে শুনিয়েছিল। মৃন্ময়ী সেদিন খুব শক খেয়েছিল। হয়তো সে কখনও কল্পনা-ও করেনি যে প্রভাত তাকে ভালোবাসবে। স্বাভাবিকভাবেই মৃন্ময়ী তার সাথে সম্পর্কে জড়াতে নারাজ ছিল। প্রভাত অবশ্য এর বেশি কিছু আশা-ও করেনি। সে জানত মৃন্ময়ী রাজি হবে না। তাই বলে তো আর সে সরে যেতে পারে না। তাকে লেগে থাকতে হবে। মৃন্ময়ীর মন সে জয় করেই ছাড়বে। সেই থেকে প্রভাত মৃন্ময়ীর পেছনে পড়েছিল। পড়েছিল তো পড়েছিল, আজও মৃন্ময়ী তার হাত ধরে তুলে নেয়নি। সংসার জীবনে পা বাড়ানোর দুঃসাহস মৃন্ময়ীর নেই। কারণটা যে একমাত্র তার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, এটা প্রভাত খুব ভালোভাবেই জানে। তবু সে আশা ছাড়ার পাত্র নয়। সে অপেক্ষায় আছে, একদিন মৃন্ময়ী নিজের দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে তার কাছে আসবে। দুহাত ভরে তার ভালোবাসা গ্রহণ করে নিবে। সেদিন যত দূরেই হোক, প্রভাত অপেক্ষা করবে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০১

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১.
“তোর জামাই না কি তুই বলতে পাগল? তাহলে এক বছরের মাথায় তালাক দেওয়ার জন্য কপাল ঠুকে ম’রে কীভাবে? খুব তো বড়ো গলা করে বলেছিলি ওই ছেলে তোকে আমাদের চেয়েও বেশি সুখে রাখবে। সুখ এমন বাড়া-ই বেড়েছিল যে চার-পাঁচটা ব্যাগ ভরে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো?”

মায়ের মুখে এমন কটুক্তি শুনে-ও ঠোঁটকাটা মৃত্তিকা তর্কে জড়াতে পারছে না। সময়টা এক বছর আগে হলে তার মুখ কোনোমতেই বন্ধ থাকত না। ঠিকই মুখের ওপর জবাব দিয়ে দিত। কিন্তু আজ সে জবাব দেওয়ার মতো মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরেনি। শ্বশুরবাড়ি থেকে ব্যাগপত্র বগলদাবা করে একেবারে বাবার বাড়ি চলে এসেছে। ব্যাগের আকার আর সংখ্যা দেখেই বুঝা যাচ্ছে শশুরবাড়িতে ফেরার আর কোনো নিশ্চয়তা নেই। ব্যাগপত্রের যা অবস্থা, ভুল করে কোনোকিছু ফেলে রেখে এসেছে বলেও মনে হচ্ছে না। মা সাজেদা বেগম আহাজারি শুরু করেছেন মেয়ে এসে হতে। মৃত্তিকা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল,
“মা, এখানেও কি একটু শান্তিতে থাকতে দিবে না আমায়? নাওয়া, খাওয়া, ঘুম কবে ঠিকমতো করেছি, তা আমি নিজেই ভুলে গেছি। তোমার আমাকে যা বলার পরে বোলো। দয়া করে এখন আপাতত মুখটা বন্ধ রাখো।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“যা মা, শান্তি কর এখন তুই। আমাকে তো তুই কম শান্তি দিসনি। যা, যা। বড়ো বোনের রোজগার আছে, ছোটো বোনের রোজগার আছে, তুই কি আর অশান্তিতে থাকবি?”

মৃত্তিকা মায়ের কথায় কান না দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। সাজেদা বেগম কপালে এক হাত ঠেকিয়ে কিছু সময় চুপচাপ বসে রইলেন। তার দুচোখ জলে ভরে উঠেছে। টেবিলের ওপর থেকে ছোটো বাটন ফোনটা নিয়ে কল করলেন বড়ো মেয়ে মৃন্ময়ীকে। মৃন্ময়ী স্কুলের বাচ্চাদের শেষ ক্লাস করিয়ে মাত্রই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়েছে। মায়ের ফোন পেয়ে ভাবল বাড়িতে কিছু লাগবে। রিসিভ করার পর সাজেদা বেগম ধরা গলায় আহাজারি করে বলে উঠলেন,
“তোর বোনের সংসারের স্বাদ মিটে গেছে রে। তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। দেখ ব্যাগপত্র গুছিয়ে শশুরবাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছে।”

মৃন্ময়ী একটু হোঁচট খেলেও খুব বেশি অবাক হলো না। এমন কিছু যে হবে, তা সে পূর্বেই আঁচ করেছিল। সে শান্ত গলায় জানতে চাইল,
“ও নিজের ইচ্ছায় চলে এসেছে, না কি ওনারা পাঠিয়ে দিয়েছে?”
“এবার ও নিজের ইচ্ছাতেই এসেছে। আগেরবার যাওয়ার সময় বলেছিলাম না, ওই সংসারের ভাত ওর কপালে নেই? দেখলি? মাস না পেরোতে নিজেই আবার চলে এল। এই সংসারে ওকে বসিয়ে কে খাওয়াতে পারবে বুঝা আমাকে।”
“মা, আমি বাড়ি ফিরে কথা বলছি তোমার সাথে। এখন রাখো।”
“আচ্ছা, আয় তাড়াতাড়ি। এসে ওর সাথে কথা বল ভালোভাবে। আমার সাথে তো জীবনেও খোলাখুলি কোনো কথা বলে না।”
“আচ্ছা, আমি আসছি। তুমি আগেই ওর সাথে রাগারাগী কোরো না।”


বোনকে নিয়ে ভাবতে-ভাবতে পথ চলছে মৃন্ময়ী। সে দ্রুত পা চালাতে চাইলেও তার পা চলতে চাইছে না। দুশ্চিন্তায় শরীরের শক্তি নিভু-নিভু করছে। তার বোনটা বিয়ের আগে থেকে এই পর্যন্ত তাদের কম দুশ্চিন্তা দেয়নি। তাদের বাবা নেই আজ চারটা বছর। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে গোটা একটা সংসারের ভার তার মাথায় এসে পড়েছে। সংসারের রোজকার খাবারের জোগান, চারজনের পোশাকের জোগান, দুই বোনের পড়াশোনার খরচ জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। ছোটো বোন মৃদুলা বরাবরই তার কষ্ট বোঝে। তাই তো বোনের কাঁধ থেকে একটুখানি ভার কমানোর প্রচেষ্টায় সে ক্লাস টেন থেকেই টিউশন শুরু করেছিল। এখন তার কলেজ জীবন-ও শেষের পথে। তবে আগের থেকে এখন তার ছাত্র-ছাত্রী বাড়ার সাথে উপার্জন-ও বেড়েছে। টিউশন থেকে প্রাপ্ত মাসিক বেতন সে কোনোভাবেই অপ্রয়োজনে ব্যয় করে না। নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর চেষ্টা করে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে সে বড়ো বোনের কাছ থেকে টাকাও চায় না। তবে মৃন্ময়ী বোঝে টিউশনের টাকায় কলেজের বেতন পরিশোধ করে, নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার পর মেয়েটার সারা মাসের হাত খরচে টানাটানি পড়ে। তাই সে প্রতি মাসেই মৃদুলাকে কিছু হাত খরচ দেয়। এই বোনটার প্রতি মৃন্ময়ী খুব কৃতজ্ঞতা বোধ করে। কিন্তু মৃত্তিকা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত তার পড়াশোনার খরচ মৃন্ময়ীকেই বহন করতে হয়েছে। তার ওপর সামর্থের তুলনায় মেয়েটার চাহিদা বেশি ছিল। সাজগোজের প্রতি তার খুব ঝোঁক ছিল। নতুন পোশাকের সাথে একেক সময় একেক সাজের সামগ্রী কেনার জন্য মৃন্ময়ীকে সে পাগল করে ফেলত। অনার্সে ভর্তি হওয়ার পরপরই পার্শ্ববর্তী এলাকার এক ছেলের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ছেলেটাকে তার পরিবারের সবাই চিনত। এটাও জানত ছেলেটা কোনো দিক থেকেই সুপাত্র না। তাদের সম্পর্কের খবর জানার পর ওই সবাই তাকে অনেক বারণ করেছিল যেন ওই ছেলের সাথে সম্পর্ক না রাখে। কিন্তু বারবার সাবধান করার পরও সে কারোর কথা কানে না তুলে দিনদিন ওই ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। এই নিয়ে সাজেদা বেগম অধৈর্য হয়ে শেষমেশ মেয়ের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছিলেন। জেদি মৃত্তিকা তাতে নিজের ভুল বুঝার বদলে উলটো আরও বড়ো ভুলের পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল। সুযোগ বুঝে ব্যাগপত্র বগলদাবা করে সেই ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিল সে। তবু যদি বিবাহিত জীবনে কিঞ্চিত সুখ মিলত! শশুরবাড়ির লোকজন তাদের একমাত্র আদরের ছেলের জন্য মৃত্তিকাকে ঘরে তোলে ঠিকই, কিন্তু কোনোদিনই পুত্রবধূর জায়গা দেয়নি। প্রতিটি মানুষের থেকে সে শুধু অবহেলা আর মুখ ঝামটা পেয়েছে। তার জন্য অবশ্য তার নিজের ব্যক্তিত্বের একাংশ-ও দায়ী ছিল। টেনেটুনে সংসার জীবনের এক বছর গড়াতেই স্বামীর চোখেও সে বি’ষে পরিণত হয়। স্বামী তার পড়াশোনা চালাতেও অস্বীকার করে বসে। তারপর থেকেই শুরু হয় তাদের নিত্যদিনের ঝামেলা। কদিন পরপরই সে শশুরবাড়ি থেকে ঝগড়াবিবাদ করে বাবার বাড়ি এসে আশ্রয় নেয়। এভাবে চলতে-চলতেই আজ তার শশুরবাড়ি থেকে একেবারে ফিরে আসা। মৃন্ময়ী জানে না এরপর কী হবে। সামনের দিনগুলো সে কীভাবে সামাল দিবে। ছোটো বোনটার এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। সামনে সে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পদার্পণ করবে। মেয়েটার খুব ইচ্ছা ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। যদিও সে মৃন্ময়ীকে কখনও সেভাবে বলেনি খরচের ভয়ে। তবে মৃন্ময়ীর-ও ইচ্ছা ছোটো বোনটাকে মোটামুটি একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর। মেয়েটা পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো। সে চায় মেয়েটার এত মেধা, এত প্রচেষ্টা একদিন সফলতার মুখ দেখুক। নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতে তার খরচ আরও বাড়বে। এই মুহূর্তে আবার মৃত্তিকার খরচ সে কীভাবে জোগান দিবে?

বোনের ভাবনায় মগ্ন মৃন্ময়ী ভুলেই গিয়েছিল তার নিত্যদিনের উটকো ঝামেলার কথা। হুট করে চোখের সামনে প্রভাতের রোজকার হাসিমুখটা ধরা দিতেই ক্ষণিকের জন্য সে হকচকিয়ে গেল, কিন্তু পা থামাল না। অতিদ্রুত নিজেকে সামলে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। পাশ কে’টে সে চলে যাওয়ার আগেই প্রভাত পিছু নিল। সে-ও মৃন্ময়ীর সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে আর জিজ্ঞেস করছে,
“ম্যাডামের আজ এত তাড়া কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
মৃন্ময়ী কোনোরূপ প্রত্যুত্তর তো করলই না, বরং তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে প্রভাতকে খেয়ালই করছে না। প্রভাতের মনে সন্দেহ জাগল মৃন্ময়ী নিশ্চয়ই কোনো সমস্যায় পড়েছে। নয়তো গত দেড় বছরে-ও প্রভাত তাকে রাস্তায় এত দ্রুত গতিতে হাঁটতে দেখেনি। সে সবসময়ই খুব ভদ্রভাবে চলাফেরা করে। স্বভাবে কোনো চঞ্চলতা চোখে পড়ে না। প্রভাত পুনরায় প্রশ্ন করল,
“এত তাড়া কেন? ম্যাডাম কি কোনো সমস্যায় পড়েছো?”
এ পর্যায়ে মৃন্ময়ী থমকে দাঁড়াল। বরাবরের মতোই শান্ত দৃষ্টি মেলে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সমস্যায় পড়লেও তোমাকে বললে আমার সমস্যার সমাধান হবে না। তাই অযথা প্রশ্ন কোরো না। আর আজ আমার তাড়া আছে দেখছো তো। আজ অন্তত পিছু ছাড়ো, প্লিজ।”
প্রভাত বলল,
“ঠিক আছে, আর কোনো প্রশ্ন করছি না। মুখ বন্ধ করে হাঁটছি শুধু।”
মৃন্ময়ী চরম বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,
“একটা দিন কি তুমি আমায় একা চলতে দিবে না প্রভাত?”
“আজ কোনো কথা বলব না। চুপচাপ শুধু হাঁটব।”
“প্রভাত প্লিজ। দেখছো তো আমি তাড়াহুড়া করে হাঁটছি। তোমাকে এভাবে আমার পেছনে ছুটতে দেখলে এলাকার লোকজন কী বলবে?”
প্রভাত বরাবরের মতোই বেপরোয়াভাবে বলল,
“লোকজনের কথার তোয়াক্কা প্রভাত করে না ম্যাডাম।”
“তুমি না করলেও আমি করি। কারণ আমি একটা মেয়ে। লোকজন বাজে মন্তব্যটা আগে আমার দিকেই ছুঁড়ে দিবে। তুমি তাদের চোখে পড়বে না। আর কতবার বললে বুঝবে তুমি?”

প্রভাতের মুখ দেখে মনে হলো সে একটু অসন্তুষ্ট হয়েছে। মুখ ভার করে সে বলল,
“দেড় বছর ধরে তোমার এই এক কথা শুনতে-শুনতেই পেছনে ঘুরছি। এলাকার লোকজন তোমাকে খুব ভালো করেই চেনে। এ-ও খুব ভালোভাবেই জানে যে, প্রভাত তরফদার নিজেই মৃন্ময়ী ম্যাডামের পেছনে পাগলা কুকুরের মতো ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ম্যাডাম তাকে পাত্তা দেয় না। তারা খারাপ বললেও আমাকেই বলে, তোমাকে না। জেনেবুঝে বারবার এলাকার লোকজনের দোহাই কেন দাও ম্যাডাম?”
মৃন্ময়ী ততক্ষণে তাকে পেছনে ফেলে দূরে চলে গেছে। একে তো মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তার পাহাড়, তারমধ্যে প্রভাত নামক উটকো ঝামেলাটা তার বিরক্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।


বাড়ি ফিরে মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে দেখতে পেল না। মৃদুলা এ সময় পড়াতে যায়। মা সাজেদা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, হয়তো তার-ই অপেক্ষায়। সে ঘরে ঢুকতেই শক্ত মুখে বলে উঠলেন,
“এসেছিস? যা দেখে আয় তোদের রাজরানি এসেছে। এসে হতে দরজা আটকে বসে আছে। ডেকে দেখ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে কি না। জিজ্ঞেস কর রাজমহল ছেড়ে এখানে এসেছে কেন।”

মৃন্ময়ী কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে ক্লান্ত মুখে বলল,
“মাথা গরম কোরো না মা। এসেছে যখন, তখন তো সারাদিনই দরজা আটকে বসে থাকবে না। বেরোলে আমি কথা বলব। তুমি শান্ত হয়ে বসো।”
সাজেদা বেগম ভারী নিঃশ্বাস ফেলে শুধালেন,
“তুই নিজে কি শান্ত আছিস?”
“আমি তো শান্তই আছি মা। তোমার কল পেয়ে ছুটির পর কত তাড়াহুড়া করে বাড়ি ফিরেছি জানো? তবু তো আমি তোমার মতো এত উত্তেজিত হইনি।”
“তুই পারিস, আমি পারি না মা।”
অত দ্রুত হেঁটে এসে মৃন্ময়ীর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে ঢকঢক করে পরপর দুই গ্লাস পানি পান করল। তা দেখে সাজেদা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। সন্দিহান কন্ঠে শুধালেন,
“আজও হেঁটে এসেছিস?”
মৃন্ময়ী মুখে হাসি টেনে বলল,
“কী করব বলো? আমি রাস্তায় বেরোলেই সব রিকশা হাওয়া হয়ে যায়। রিকশার জন্য যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, ততক্ষণে আমি হেঁটে-ই বাড়ি চলে আসতে পারি।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“তুই রিকশা পাস না, না কি রিকশা তোকে পায় না, তা কি আমি বুঝি না ভাবিস? রিকশা খুঁজলে তো তুই পাবি। মোটে বিশটা টাকা ভাড়া। দশ টাকা বাঁচিয়ে কি তুই সংসার উদ্ধার করে ফেলবি?”

মৃন্ময়ী কেবল হাসল। বিশ টাকায় সংসার উদ্ধার? হ্যাঁ, তাই তো করছে সে। এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসারে খাবারের জোগান দিতে রোজকার যাতায়াত ভাড়া থেকে বাঁচিয়ে আনা ওই বিশটা টাকাই তার কাছে অনেক মূল্যবান। স্কুল, কোচিং দুই জায়গা থেকেই মাস শেষে বেতন আসে। সেই বেতন দিয়ে পুরো একটা মাস তাদের খুব হিসাব করে চলতে হয়। আজকাল আবার খরচ কিছু বেড়েছে। মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ডায়বেটিস আগের চেয়ে বেড়েছে। তার জন্য প্রতি মাসে ঔষধ কেনা লাগছে। মৃন্ময়ী ঘরে গিয়ে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। পরক্ষণেই আবার উঠে বসল। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। তাড়াহুড়া করে হেঁটে আসায় তার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। পরনের কাপড় থেকে ঘামের দুর্গন্ধ আসছে। গোসল করা দরকার। সকালবেলায় একবার সে গোসল করে স্কুলে গিয়েছিল। তবু এই মুহূর্তে আরেকবার গোসল না করে থাকা যাচ্ছে না। মৃন্ময়ী বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ঠান্ডা পানিতে গোসল করল। গোসল সেরে বেরিয়ে দেখল মৃদুলা চলে এসেছে। চেয়ারে বসে সে মৃত্তিকার বাড়ি ফেরা নিয়ে মায়ের আহাজারি শুনছে। তাকে দেখেই মৃদুলা হাসিমুখে বলল,
“আপু, এদিকে এসো। এই দেখো কী এনেছি।”
“কী এনেছিস?”

কৌতূহল নিয়ে মৃন্ময়ী এগিয়ে গিয়ে দেখল টেবিলের ওপর নীল রংয়ের পলিথিন ব্যাগ। মৃদুলা ব্যাগের মুখ খুলে লিচু দেখতে পেল। লিচু কিনে এনেছে মেয়েটা। মৃন্ময়ীর বুঝতে বাকি রইল না তার বোন লিচু কেন এনেছে। দুদিন আগে কথায়-কথায় সে বলে ফেলেছিল এবারের সিজনে তাদের একদিন-ও লিচু খাওয়া হয়নি। এ মাসে বেতন পেলে সে কিনে আনবে। তার আগেই মৃদুলা নিয়ে হাজির। মৃন্ময়ী বলল,
“তুই আবার লিচু কিনতে গেলি কেন? আমি বলেছিলাম না বেতন পাওয়ার পর কিনে আনব?”
মৃদুলা বলল,
“তাতে কী? আজ আমি একটা টিউশনের বেতন পেয়েছি, তাই নিয়ে এলাম। আমি তো আর তোমার মতো বাজার-টাজার করে দিতে পারি না। টুকটাক কিছু কিনি, তাতে-ও এত আপত্তি করো কেন?”
“আমি তো সেজন্য বলি না বোন। তোর টাকা তো তোর নিজেরই কাজে লাগে। এভাবে খরচ করলে তোরই ক্ষতি।”
“এটুকু খরচে আমার বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে না আপু। আগে খাও তো। বসো এখানে। দাও, আমি কাপড় মেলে দিয়ে আসছি।”

মৃন্ময়ীর হাত থেকে মৃদুলা ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে চলে গেল। মৃন্ময়ী আর কথা বাড়াল না। মেয়েটা এমনই। টিউশনের বেতন পেলেই টুকটাক কিছু না কিনে সে বাড়ি ফিরতে পারে না। মাঝে-মাঝে আবার দুই-এক রকম খুচরা বাজার নিয়েও হাজির হয়। মৃন্ময়ী বারণ করলেও সে কানে তোলে না। মৃন্ময়ী ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে লিচুর খোসা ছাড়াতে-ছাড়াতে মাকে শুধাল,
“মৃত্তিকা একবারও বেরোয়নি?”
সাজেদা বেগম উত্তর দিলেন,
“একবার বেরিয়েছিল পানি খাওয়ার জন্য। পানি খেয়ে ঘুমাবে বলে আবার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়েছে। তোর সামনে বেরোনোর মুখ না থাকলে বেরোবে কীভাবে? ডেকে দেখ।”
“না থাক। এখন হয়তো মন-মেজাজ ভালো নেই। রাতে কোচিং থেকে ফিরে কথা বলব।”
“তখন আবার দেখবি ঘুমের ভং ধরে পড়ে আছে।”
“আহা মা! সবে তো এলো। প্রতিদিনই কি ও ঘুমিয়ে কা’টাবে? সকালে হলেও তো আমার সাথে দেখা হবে। আজ কিছু বোলো না। কিছু সময়ের জন্য ওকে একা ছেড়ে দাও। মৃদুলাকে আজ আমার ঘরে ঘুমাতে বোলো। ও একটু শান্ত হোক, তারপর কথা বলা যাবে।”


কোচিং থেকে বেরিয়ে মৃন্ময়ী আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। নাহ্, প্রভাতকে দেখা যাচ্ছে না। যদিও সে নিশ্চিত মাঝপথে হলেও ওই ছেলে তার সুদর্শন চেহারা দেখাতে হাজির হবেই। তবু আপাতত সে আপনমনে হাঁটা ধরল। ছেলেটা বড্ড ঘাড়ত্যাড়া। কিছুতেই কথা শুনানো যায় না। রেগে কথা বললেও এক কানে তুলে অপর কান দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দেয়। সেই মাধ্যমিক থেকে প্রভাতকে সে শুধুমাত্রই সহপাঠী হিসেবে চিনত। তখন থেকেই প্রভাত খুব ডানপিটে স্বভাবের। ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছাত্র ছিল সে। স্কুলের শিক্ষকরা-ও তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ট ছিলেন। সপ্তাহের আগায়-মাথায় স্কুলে তার বাবার ডাক পড়ত। এলাকার লোকজনের অভিযোগ তো ছিল নিত্যদিনের। তবু প্রভাতের দুষ্টুমি এক ফোঁটাও কমত না। প্রভাত যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন হঠাৎ তার মা ব্রেইন স্ট্রোক করে মা’রা যান। মৃন্ময়ীর স্পষ্ট মনে আছে, মায়ের মৃত্যুর পর কিছুদিনের জন্য তারা এক অন্য প্রভাতকে দেখতে পেয়েছিল। দুষ্টুমি বন্ধ, দৌড়ঝাঁপ বন্ধ, অকারণ অট্টহাসি বন্ধ। শোনা গিয়েছিল দুষ্টু প্রভাত মাকে খুব ভালোবাসত। মা ছিল তার একমাত্র ছায়া। বাবার শাসন খুব একটা পায়নি সে। তাই মায়ের শোক কা’টিয়ে ওঠার পরেই প্রভাতের দুষ্টুমি দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল। একবার তো দুষ্টুমির সূত্রে এক দূর্ঘটনা ঘটিয়ে বাবার হাতে বেদম মা’র খেয়েছিল। তার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। দুষ্টু প্রভাতকে আজ পর্যন্ত সেই মহিলা ভালো চোখে দেখতে পারেননি। ফলস্বরূপ প্রভাত নিজেও মহিলাকে মায়ের জায়গা দেয়নি। সবাই ভেবেই নিয়েছিল এই দুষ্টু প্রভাতের পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটবে কলেজের ত্রিসীমানায় পা রাখতেই। যদিও সবাইকে অবাক করে দিয়ে পড়াশোনার চেয়ে বেশি দুষ্টুমি করে-করেই প্রভাত কোনোমতে এইচএসসি পাস করে আবার অনার্সে-ও ভর্তি হয়েছিল। বন্ধুরা যখন একে-একে কাজকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল, তখন হয়তো তার-ও কিছু শুভ বোধদয় হয়েছিল। কম্পিউটারের কাজের বিষয়ে তার বেশ জানাশোনা ছিল। অন্য কোনো কাজে আগ্রহ জন্মায়নি বলে সে কম্পিউটারকেই বেছে নিয়েছিল। কম্পিউটারের দোকানে পার্ট টাইম কাজ করতে-করতে ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল সে। অনার্স শেষ করে এখন সে মোটামুটি ভালো একটা কোম্পানিতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করছে। বয়স বাড়ার সাথে আগের মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি কিছুটা কমলেও এখনও সে সবার কাছে দুষ্টু প্রভাত-ই রয়ে গেছে। কারণ সুযোগ পেলে বাঁদরামি সে এখনও করে। এলাকার লোকজন তো তাকে কোনোদিন ভদ্রবেশে দেখার আশাই ছেড়ে দিয়েছে। আগাগোড়াই যে ছেলে লাগাম ছাড়া, সে ভালো হবে কীভাবে? বরং তাদের ভাবনায় প্রভাতের সঙ্গ যে ছেলে পাবে, সে-ই বেপরোয়া হবে।

মৃন্ময়ীর ধারণা একশো ভাগ সত্য প্রমাণ করে দিয়ে প্রভাত রাস্তার মোড়েই দেখা দিলো। মৃন্ময়ীকে দেখেই সে উজ্জ্বল হাসিতে মনের প্রশান্তি প্রকাশ করল। বরাবরের মতোই মৃন্ময়ী তাকে দেখেও থামল না। প্রভাত নিজেই তার পিছু নিল। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,
“ম্যাডামের কি সমস্যার সমাধান হয়েছে?”
মৃন্ময়ী তাকেই পালটা প্রশ্ন করল,
“কিসের সমস্যা?”
“বিকালে যে খুব তাড়া দেখিয়ে বাড়ি ফিরলে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম তা তো আর বললে না।”
“আপাতত তোমার চেয়ে বড়ো সমস্যা আমার জীবনে আর একটাও নেই।”
“সত্যিই কি?”
“সন্দেহের কোনো কারণ নেই নিশ্চয়ই?”
“অবশ্যই আছে। ভেবে দেখো, আমি তোমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলে তুমি আমাকে উপড়ে ফেলার জন্য চাকরিবাকরি ছেড়ে দিতে পারো, যেন আমি আর তোমার পেছনে ঘুরতে না পারি। কিন্তু তুমি সেটা করবে না। কেন করবে না? কারণ এরচেয়েও বড়ো সমস্যা তোমার জীবনে আছে। যা সামলাতে হলে তোমার এই চাকরিবাকরি-ও প্রয়োজন। আর তোমার চাকরিবাকরি প্রয়োজন মানেই আমাকে তুমি উপড়ে ফেলতে পারবে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে আমিও তোমার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াব, বিশেষ প্রয়োজন।”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“আমি কি বলেছি তোমাকে আমার প্রয়োজন? আমি যে সবসময় তোমাকে বলি আমার পেছন ছাড়ো, শোনো না কেন তুমি?”
“তোমায় ভালোবাসি যে, বোঝো না কেন তুমি?”
মৃন্ময়ী হতাশ গলায় বলল,
আমি তো বারবার তোমাকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি যে আমি তোমার সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাই না।”
“চাইবে, চাইবে। আমি যেহেতু চাই, তুমিও একদিন চাইবে।”
“তোমার এত শখ থাকলে এখন থেকে গার্লস স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো। ওখানে মেয়ের অভাব নেই। পছন্দমতো কারো পেছনে এভাবে ঘুরঘুর করে শখ মিটিয়ে নাও। তবু আমাকে ছাড়ো। তোমার শখ মিটানোর শখ আমার নেই।”
তবু প্রভাত দৃঢ় গলায় বলল,
“ওসব গার্লস আমার চাই না। আমার শুধু মৃন্ময়ী ম্যাডাম হলেই চলবে।”
মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত দুটো একসঙ্গে জড়ো করে বলল,
“মাফ দাও, রোজ-রোজ এক কথা আর ভালো লাগে না।”
“চলো বিয়ে করে ফেলি, ভালো লাগবে।”
মৃন্ময়ী গম্ভীর মুখে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি বোঝো না আমি তোমার সাথে রাগ করি? তোমার কি মানসম্মানে-ও লাগে না?”
প্রভাত শব্দ তুলে হেসে বলল,
“আমার আবার মানসম্মান আছে কবে থেকে? তোমার পেছনে ঘুরেঘুরে এমনিতেই সবার চোখে বেহায়া হয়ে গেছি। আরেকটু ধৈর্য্য ধরে তোমাকে পেয়ে গেলেই মানসম্মান রক্ষা করা শিখে নিব।”
“বাচ্চাদের মতো কথা বোলো না তো। ছাব্বিশে দাঁড়িয়েও আঠারো বছরের যুবকের মতো আচরণ করো কীভাবে তুমি? লজ্জা লাগে না?”
“অত লজ্জা কোলে নিয়ে বসে থাকলে কি তোমায় ঘরে তুলতে পারব? এজন্যই তো বলি, দুজনেই বুড়িয়ে যাচ্ছি, চলো বিয়ে করে ফেলি। তারপর আমার আচরণ তুমি নিজেই পালটে দিতে পারবে। ভেবে দেখো, বিরাট চান্স কিন্তু। মিস করে গেলে তোমারই ক্ষতি। পৃথিবী জুড়ে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও তুমি আর এমন প্রেমিক পুরুষ পাবে না।”
“দরকার-ও নেই আমার। বকবক বন্ধ করে নিজের পথে হাঁটো।”
“তোমার সঙ্গে হেঁটে-হেঁটেও যে পথ ফুরাতে চায় না, সে পথে আমি একা হাঁটতে চাই না ম্যাডাম।”
“ঠিক আছে, তবে আমি নিজেই সে পথ ধরছি।”

বলেই মৃন্ময়ী বিকালের মতো আবারও দ্রুত গতিতে পা চালাল। প্রভাত তার পেছনে ছুটল না, স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে চলল। সে মৃন্ময়ীকে চেনে। তার জ্বালাতনে অতিষ্ট মৃন্ময়ী সবসময়ই তার সঙ্গে একটু-আধটু রাগ দেখায়, বকাঝকা করে। কিন্তু সে যখন পারিবারিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায়, তখনই তার মেজাজ একটু অন্যরকম থাকে। রাগের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রভাত নিশ্চিত তার মনে আজ-ও কিছু চলছে। মেয়েটা এত চাপা স্বভাবের! দেড় বছর ধরে পেছনে ঘুরেও সে এই মেয়েটার মনের কথা বুঝতে পারে না। তবু তার চেষ্টায় কোনো কমতি নেই। যেভাবে চলছে চলতে থাকুক না। একদিন হয়তো মেয়েটা-ও তাকে বুঝবে। মেয়েটা তাকে বুঝে গেলেই মেয়েটাকে বুঝা-ও তার জন্য সহজ হবে। চেষ্টা সে চালিয়ে যাবেই। চেষ্টা করতে তো আর টাকা-পয়সা লাগে না? লাগে শুধু একটু ধৈর্য। মৃন্ময়ীর মনের গহীনে পৌঁছাতে যতটুকু পথ তাকে হাঁটতে হয়, সে হাঁটবে। এটুকু ধৈর্য তার আছে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৪৭

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪৭
নয়না ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে৷ তার হলুদ গোলাপ পছন্দ ভিষণ রকমের পছন্দ। আচ্ছা না বলতেই সে বুঝলো কি করে! ওই প্লেন ড্রাইভারও কি আমাকে ভালোবাসে?বলেই নয়না দু’হাতে মুখ ঢাকলো৷ নয়না মনে মনে আওড়ালো ভালো যখন বাসেন তখন মুখে বললে কি হয়!ইশশ এই পাইলট মহাশয় এতো কিউট কেন? আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে, ফুলগুলো বৃত্তের মত তার চারো সাইডে রেখে নয়না মাঝখানে শুয়ে পরলো। গোলাপের ঘ্রাণ আর প্রিয় মানুষের ভালোবাসা অনুভব করছে নয়না। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি ছড়িয়ে পরছে নয়নার দেহমন জুড়ে! যে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না!
নয়না বেডের উপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে৷ তার দৃষ্টি স্থীর চলন্ত পাখার দিকে। মনের মধ্যে কেমন যেনো করছে। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে নয়নার৷ ভয়ে কপালে ঘাম জমেছে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে বার্থডে আর রেজাল্ট একি দিনে হতে হলো! হাসফাস লাগছে নয়নার৷ দ্রুত বেড ছেড়ে উঠলো। ওড়না গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বের হতেই মিতা বেগমের সাথে দেখা হলো৷
“মিতা বেগম বলে, সুনয়না কিছু লাগবে তোমার আম্মু?”
“নয়নার লম্বা চুলগুলো ওড়না গলিয়ে বাহির হয়ে আছে।”
“মিতা বেগম নয়নাকে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। নয়নার মাথাভর্তি রেশমি চুলগুলো তার ভিষণ পছন্দ হলো৷ তোমাকে তো দেখে শুনে আনতে পারিনি তবুও তুমি আমাদের মনের মত হয়েছো আলহামদুলিল্লাহ । মনে হয় শত জনমের সম্পর্ক তোমার সাথে আমাদের।”
‘মেহনুর মিতা বেগমের রুমে এসে এই দৃশ্য দেখে মনে মনে রেগে গেলো। মেয়েটাকে সবাই এতো প্রায়োরিটি কেন দেয়! নিজের ঠোঁটে মেকি হাসি টেনে বলল,আম্মি আমাদের রেজার বৌ কি একদম পরীর মতো৷ কিউট একটা বাচ্চা পরী।”
“ঠিক বলেছিস৷ ওর চুলগুলো দেখ?রুপাঞ্জেলের মত। ঘন সিল্কি,লম্বা, মসৃণ। আমার রেজা একদম লক্ষী একটা পরীবৌ পেয়েছে যেমন দেখতে মিষ্টি তেমনি মধুর মত ব্যবহার৷”
“মেহনূর বলল একদম ঠিম বলেছো। আর কতক্ষণ লাগবে তোমাদের আম্মি? আমার তোমার সাথে কথা ছিলো৷”
“কি কথা বলে ফেল। সুনয়নাতো আমাদেরই মানুষ ওর থেকে লুকানোর কিছু নেই৷”
“নয়না বলল,আম্মু আমি একটু ঘুমাবো। তোমরা কথা বলো৷ নয়না রুম থেকে বের হয়ে আসলো৷ জিয়ানের সাথে এখনো নয়নার একবারও দেখা হয়নি৷ কই গেলো লোকটা? নয়না নিচে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিলো৷ হঠাৎ গানের আওয়াজ পেয়ে নয়না স্থীর হলো।”

“জাহিন গিটারে সুর তুলে,গাইছে এলোকেশী কন্যারে তুই সদ্য ফোটা ফুল,তোরে দেখিয়া আমার মন হইলো ব্যাকুল।
তুই হাসলে যেনো মুক্ত ঝড়ে, তুই তাকালে ফোটে ফুল, এলোকেশী কন্যারে তুই সদ্য ফোটা ফুল৷”
“নয়না উঁকি দিতে যেয়ে সরে গেলো। জাহিনকে তার বিশেষ পছন্দ হয়নি। নয়না রুমে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে বারোটা সতেরো বাজে। নয়না বারান্দায় যেয়ে বসলো,মনে মনে বলে,কারো মনে নেই আমার বার্থডের কথা! রেজাল্ট দিলে তো সবাই ঠিক কল করে করে পাগল করে ফেলবে এখন একটা বার্থডে উইশ করতে পারছে না!”
“নয়না ফোনটা বেজে উঠলো, তুষির কল দেখে নয়না খুশি হয়ে গেলো৷ নিশ্চয়ই উইশ করবে।উৎসাহ নিয়ে কল রিসিভ করলো৷”
“কিরে কি করছিস! তোর টেনশন হচ্ছে না! আমার তো টেনশনে ঘুম আসছে না। পেটের ভেতর গুড়গুড় করছে।”
“তুই কি এসব বলার জন্য কল করেছিস তুষি?”
“হ্যা টেনশনে ঘুম আসছিলো না। তাই ভাবলাম তোর খোঁজ নেই৷”
” আর কিছু বলবি?”
“নাহহ আর কি বলবো৷ ওহহ হ্যা মনে পড়েছে৷”
“বল”
“দুলাব্রো কই?”
“নয়না খট করে কল কেটে দিলো। রাগ হচ্ছে তার৷”
নয়না রুমে এসে সোফায় শুয়ে আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে ঝিমাচ্ছে।
“এমন সময় কেউ দরজায় নক করে বলে,আসতে পারি?”
“কন্ঠ শুনে মনে হলো জিয়ান৷ তবুও বেড থেকে ওড়না নিয়ে, উঁকি দিয়ে বলে,আপনি কি জাহিন?”
“নাহহ জাহিন না আপনার বর।”
“নয়না দ্রুত দরজা বন্ধ করে বলে,আপনার ভাই রুমে নেই সে না আসলে এখানে আসবেন না। এইটুকু ম্যানারস নেই নাকি!”
“জাহিন বলল,মজা করছিলাম ওকে গুডনাইট প্রিটিগার্ল।”
“জাহিনকে দেখলেই নয়নার রাগ হয়। নয়না আবার এসে শুয়ে মোবাইল হাতে নিলো। রাত দেড়টা বাজে এখনো কোন খোঁজ নেই লোকটার! বৌ রেখে কোন বেডা মানুষ এমন টো টো করে রাত বিরতে! আবার কথায় কথায় বলে,বাসর সেরে ফেলবো। যাহহ এই জন্মে তোর বাসর করার শখ মিটবে না বদদোয়া দিলাম প্লেন ড্রাইভারের বাচ্চা।”

নয়না মোবাইল নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো তার আইডির নাম, সিরাত চৌধুরী। নয়না ঘেটে ঘেটে জিয়ানের আইডি খুঁজে বের করলো।লক করা৷ প্রোফাইল। নয়না রেগে বলে,প্লেন ড্রাইভারের ভাব তো কম না! খোমাটা একটু সুন্দর বলে,প্রোফাইল লক করে রাখবে! তাহলে হ্যান্ডসাম হয়ে লাভটা কি!হ্যান্ডসাম ছেলে প্রোফাইল পাবলিক করে রাখবে মেয়েরা ক্রাশ খাবে। লাবি’ডাবি কমেন্ট করবে,ইনবক্সে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। প্লেন ড্রাইভার আসলে মাথা মোটা৷ নয়ত এতো সুদর্শন হয়ে প্রোফাইল লক রাখে গাধা ছাড়া কেউ! নয়না উঠে এসে কাভার্ড খুললো সেদিন জিয়ান তার জন্য অনেকগুলো শাড়ি অর্ডার করেছে নয়না সেগুলো বের করে আনলো। সব ঘেটে ঘেটে দেখছে,লাল পাড় সাদা জমিন সুন্দর এই জামদানী শাড়িতে নয়নার দৃষ্টি স্থীর হলো। শাড়ীর সাথে লাল কালার ম্যাচিং রেডিমেড ব্লাউজ। নয়না ফোন হাতে নিয়ে জিয়ানকে কল করলো৷
“ওপাশ থেকে রিসিভ হলো৷ নয়না বলল,আপনি কই?”
“বাটার মাশরুম খুব বেশি মিস করছো বুঝি আমাকে?”
“মোটেই না৷ আপনি না আসলে আমি ঘুমাবো।”
“ঘুমিয়ে পরো লিলিপুট আজ আমি ফিরবো না৷”
“নয়না কল কেটে দিলো৷ এখন তার শাড়ি পরার নেশা জেগেছে তাই কথা না বাড়িয়ে শাড়িটা পরে নিলো৷ লম্বা চুলগুলো খোলা রেখে কানে গুঁজে নিলো দু’টো হলুদ গোলাপ। লাল রঙের লিপস্টিক লাগালো,ঠোঁটে। নিজেকে নিজে আয়নায় দেখে নয়না নিজের মুখ ডেকে বলে, তোমার কোন অধিকার নেই এতো সুন্দর হওয়ার! উফফ নিজেই না নিজেকে নজর দিয়ে বসি। নয়নার ইচ্ছে করছে নাচতে। এতো সুন্দর লাগছে তাকে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দেড়টা ছাড়িয়ে গেছে। হঠাৎ চোখ গেলো সোফার উপর পরে থাকা জিয়ানের ব্লেজারের উপর। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যেয়ে তুলি নিলো ব্লেজার। নাক ডুবিয়ে দিলো ব্লেজারে। কেমন মাতাল করা একটা ঘ্রাণ। ইশশ কারো শরীরের ঘ্রাণেও বুঝি মাদকতা থাকে! নয়না ব্লেজারে চুমু খেয়ে বলে,আপনি কি জানেন আমার এই ছোট হৃদয়ে আপনার ভালোবাসার অঙ্কুর গজিয়েছে। তারা কেমন ডাল-পালা ছড়িয়ে আপনার প্রতি আমাকে দূর্বল করে দিচ্ছে! জানেন তো কম বয়সের প্রেম মারাত্মক ভয়ংকর। অসম প্রেম যা নিজেকে ভুলিয়ে দেয় তবুও ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে পারে না। নয়না আনমনে জড়িয়ে নিলো জিয়ানের ব্লেজার। অদ্ভুত অনুভূতিরা ঘিরে ধরেছে তাকে।হৃদয় জুড়ে বয়ে যাচ্ছে শীতল প্রবাহ স্নায়ু জুড়ে ছড়িয়ে পরছে প্রিয় পুরুষের স্পর্শের মাদকতা। ইশশ কাউকে স্পর্শ না করেও এতো গভীর ভাবে অনুভব করা যায়! আজকের এই মূহুর্ত না আসলে হয়ত নয়না বুঝতো না৷ হৃদযন্ত্র ধীরে ধীরে কেমন বেসামাল হচ্ছে। নয়না চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো পরম আবেশে। দ্রুত চোখ খুলে ব্লেজার ছুড়ে ফেললো বেডে। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,একেমন সুখকর দমবন্ধ মুগ্ধতার মোহজালে ঘেরা অনুভূতি!শাড়ি খামচে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। শরীর জুড়ে বয়ে চলেছে অদ্ভুত শিহরন, হৃদয় জুড়ে বইছে ভালোবাসার মোহমায়া।

🌿

জিয়ান বাসায় এসেছে ঘন্টা খানেক আগে। বাসায় এসে তার প্রিয়তমার জন্য বার্থডে সারপ্রাইজ প্ল্যান করছে,তাদের ছাদে সুইমিংপুল আছে একপাশে আরেক পাশে সুন্দর বসার জায়গা বেশ সাজানো পরিপাটি ছাদটা।
“পুরো সুইমিংপুলের পানির উপরে,লাল আর হলুদ গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। মাঝখানে লেখা শুভ জন্মদিন ডিয়ার বাটার মাশরুম। জিয়ানের সাথে অনিকেত আর একজন ডেকোরেশনের লোক সব কিছু গুছিয়ে দিচ্ছে৷ কাজ শেষ হতেই। জিয়ান বলল,অনি এবার যাহহ তোর কাজটা করে আয়। উইশটা আবার চেঞ্জ করলো জিয়ান৷

🌿

নীলাঞ্জনা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে দূরের আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা চাঁদের দিকে।মনে মনে বলে,আজকের চাঁদটা এতো সুন্দর কেনো!নীলাঞ্জনার মনে পড়লো জিয়ানের বলা একটা কথা, ” পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর তার অর্ধেকটা জুড়ে নারী। নারী ছাড়া সৌন্দর্য তার পূর্নতা মেলে ধরতে পারে না। কোন এক পূর্নিমা রাতে পূর্ন চাঁদকে দেখাবো আমার পাশে তারচেয়ে উজ্জ্বল চাঁদ আছে৷ তখন মোবাইলের অপরপাশ থেকে এমন কথা শুনে নীলাঞ্জনা বলেছিল, এতো বেহুদা কথা কোথায় পাও তুমি! তুমি এতো,বোরিং কেন রেজা! আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এরচেয়ে সুন্দর কথা হয়ত নেই। চোখের অশ্রু মুছে নিয়ে বলে,আমি তোমাকে ডিজার্ভ করি না। তাই তোমাকে অবহেলায় হারিয়েছি। যে প্রেম আমি চেয়েছিলাম সেই কলুষিত প্রেমিক তুমি ছিলে না। তাই আমি তোমার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে কলুষিত মানুষের প্রেমে পরে ছিলাম। তার প্রেমে পড়ে মনে হয়েছিলো আমি এমন প্রেম চাইছিলাম৷ অথচ সে শুধু আমার দেহের বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রেমে মত্ত ছিলো। আমি তোমাকে হারিয়েছি আমি জীবনের সব সুখ হারিয়েছি। আমি কি করবো এই সন্তানের?একা একা কিভাবে সামলাবো তাকে! কাউকে ঠকিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না৷ তোমাকে ঠকাতে যেয়ে নিজের জীবন ধ্বংস হয়ে গেলো। তুমি ভালো আছো আমি ভালো নেই রেজা৷ একবারও কি আমার কথা তোমার মনে পরে না! একটুও তোমার মন পোড়ে না আমার জন্য! এটা যে আমি মেনে নিতে পারছিনা খুব কষ্ট হচ্ছে আমার খুব বেশি। তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারলে হয়ত এই কষ্টের ভার সামান্য কমতো।
তুমি আমাকে ভুলে যেয়ে ভালো আছে এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। কেনো পারছি না বলতে পারবে রেজ!
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৪৬

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪৬

জিয়ান নয়নার হাতটা ধরে বলে, “তুমি শুধু আমার, আমি কোন কিছুর বিনিময়ে তোমাকে হারাতে পারবো না৷”
“এতো ইমোশনাল হতে হবে না।এসব আমি নাটক সিনেমা দেখে শিখেছি হু।”
“আরেহহহ নায়িকা সুনয়না চৌধুরী অটোগ্রাফ প্লিজ৷”
“সুনয়না চৌধুরী যাকে তাকে অটোগ্রাফ দেয়না।”
“ম্যাডাম আপনি অটোগ্রাফ না দিলে আমার ভবিষ্যতে বাচ্চারা বলবে ছিহহহ বাবা সামান্য একটা অটোগ্রাফ ও নিতে পারোনি!”
“তেল মারা বন্ধ করুন। কেক, একটা ফুলের বুকে আর কি পছন্দ করে অনিকেত ভাইয়া৷”
“ও তোমার কোন জন্মের ভাই?”
“যে জন্মে আপনি আমার হ্যাসবেন্ড সেই জন্মের।”
“জিয়ান আড়চোখে চেয়ে দেখে নয়না হলুদ গোলাপগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে৷ জিয়ান দোকানি কে বলল,মামা এখানে কয় পিস ইয়োলো গোলাপ আছে?”
“সাতশ বা ছয়শ হবে। আপনার কতগুলো লাগবে স্যার?”
“সবগুলো দিয়ে দিন মামা।”

নয়না একটা গাজরা নিয়ে হাতে বাঁধার চেষ্টা করছিলো কিন্তু সে ব্যর্থ হচ্ছে বাঁধতে।

“জিয়ান নয়নার হাত ধরে গাজরাটা বেঁধে দিলো৷ নয়নার হাত ধরে রেখে বলে,বেলিফুল কি জানে তার সৌন্দর্য বর্ধন করছে কারো প্রিয়তমা! সে কি জানে তার শুভ্রতাকে হার মানাচ্ছে কারো মুচকি হাসি! হতাম যদি বেলিফুলের মালা তোমার গলাজুড়ে জড়িয়ে থকতাম সারাবেলা।”

“নয়না মৃদু স্বরে বলে,আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন মিস্টার রোমিও এটা আপনার বাসা না। আর বেলিফুলের গাজরা হাতে থাকে গলায় না৷”

“জিয়ান নয়নার হাত ছেড়ে বলে, শোনো বৌ পুরুষ মানুষ প্রেমে পড়লে ভুলভাল বকবে ইট’স নরমাল, বোঝেনা বৌ আমরা আমি তার প্রেমে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি। এই তুমি শাড়ি পরে বের হওনি কেন! তুমি শাড়ি পরে বের হলে আমি তোমার কুচি ঠিক করে দিতাম। তোমার শাড়ীর আঁচলে আমার হাত বেঁধে সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম। সবাই ভাবতো বৌ পাগল জামাই। কেউ কেউ ভাবতো এমন জামাই কই পাওয়া যায়?”
“দোকানদার ফুল বেঁধে দিয়ে বলে,সাহেব কি নতুন বিয়ে করছেন? আপনাকে আর ম্যাডামকে দারুণ মানিয়েছে। মনে হচ্ছে মানিকজোড়া৷ সব সময় ভালা থাহেন৷ আগের দিনে এমনই বিয়া হইতো জামাইয়ের তন বৌয়ের বয়সের পার্থক্য কম থাকতো।”
“জিয়ান হেসে বলে হ্যা মামা নতুন বিয়ে হইছে,তবে বৌ আমার বোঝে কম চিল্লায় বেশি। বাচ্চা মানুষ তো তবে আক্কেল ম্যালা ভালা আছে।”
“বৌ জ্বালাইবোই। আপনাগো চাচি আমারে কি কম জ্বালায়! তবুও হের ভালোবাসা অসীম আমি জানি৷ আমি না খাইলে খাইতো না৷ যত রাইতে দোকান বন্ধ করি যাইয়া দেখমু আমার লাইগা বইসা আছে। বুড়ির লগে দুইডা কথা কইলেই পরাণডা ঠান্ডা হইয়া যায়।”
“জিয়ান টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে বলে,বাকি টাকা দিয়ে চাচিরে একটা শাড়ি কিনা দিয়েন৷ দোয়া কইরেন আমাদের জন্য।”
“নয়না জিয়ানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে জিঙ্গেসু দৃষ্টিতে।
“এই যে এভাবে তাকালে কিন্তু ভরা রাস্তায় চুমুটুমু খেয়ে বসবো।”
“রিকশায় আমি বসবো নাকি ফুল বসবে?”
“তুমি তো নিজেই একটা জ্যান্ত ফুল। ফুলের মাঝে জ্যান্ত ফুলকে দারুণ লাগবে।”
“এতোগুলা ফুল কেনো কিনেছেন!”
“ভাবছি এসব নিয়ে সোজা বাসায় যাবো৷ বাসরটা সেরেই ফেলবো আজ। তাজা গোলাপের সুবাস সাথে সদ্য ফোটা জীবন্ত ফুলের নেশায় বুদ হবো,মাতাল হবো তার ভালোবাসায়।”
“আজেবাজে কথা বন্ধ করেন আমরা কিন্তু অনিকেত ভাইয়ার বার্থডেতে যাচ্ছি। দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করেন, ভুলে যাবেননা ফুলে কিন্তু কাটাও থাকে।”
“ফুলের কোমল স্পর্শ আর মাতাল করা ঘ্রাণ সহ্য করার জন্য কাটার আঘাত সহ্য করা কোন ব্যাপারনা জান৷”
“চুপ করুন। সময় যাচ্ছে না হচ্ছে!”
” সবকিছু কিনে নিয়ে অনিকেতের বাসার উদ্যেশে রওনা দিলো দু’জনে।”

🌿

কলিংবেলের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে অনিকেত দরজা খুলল,সামনে থাকা রমনিকে দেখে চশমা ঠিক করে বলে,আপনি এখানেও?
“জলে স্থলে,জঙ্গলে যেখানে থাকবেন আমাকে পাবেন।”
“কেনো এসেছেন?”
“আহাগো সখের নাগরের ভাব দেখলে বাঁচিনা৷ আজকে আমার একমাত্র সখের বেডার বার্থডে আসবো না! তোমার জন্য পুরো ঢাকার শহর ঘুরে দোলনচাঁপা ফুল নিয়ে আসলাম কই জড়িয়ে ধরে দুইচারটা চুমু খাবা তা’না আবার জেরা করছো! সরো সাইডে চাপো।”
“দেখুন মিস সায়না এসব একদম ঠিক হচ্ছে না।”
“সায়না সোফায় বসে চারপাশ ভালোভাবে লক্ষ্য করে বলে,আরেহহহ বাহহহ বিয়ের পর তো আরামে থাকতে পারবো৷ তুমি আমি আর আমাদের ভালোবাসার সংসার৷”
” শোন।”
“শোনাও আমি তো তোমাকেই শুনতে চাই।”
” কেন করছেন এমন?”
“আমি তো করবো না যা করার তুমি করবে। মেয়েরা কিছু করে নাকি লজ্জা লাগে না বুঝি!তোমার বাসার কিচেন কোনদিকে?”
“কিচেনে কি?”
“আজ দেড় ঘন্টা ব্যয় করে তোমার জন্য রান্না শিখেছি বিফ তেহারি রান্না করবো।”
“আমার বাসায় কিচেন নেই। আমি বাহির থেকে খাবার অর্ডার করি।”
” ওভেন আছে?”
“সায়না ওভেন খুঁজে পেলো। সাইড ব্যগ থেকে একটা বক্স বের করলো তেহারী প্লেটে ঢেলে গরম করতে দিলো ওভেনে। শাড়ীর আঁচল কোমড়ে গুঁজে রাখা। পিঠ জুড়ে খোলা চুলগুলো বারংবার দোলখাচ্ছে অনিকেত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে নব বিবাহিতা কোন রমনী। তার এতোদিনের স্বপ্ন যেনো বাস্তবে এসে ধরা দিয়েছে।”
“সায়না তেহারির প্লেট নিয়ে এসে বলে,লুকিয়ে দেখতে মজা তাই না।”
“আমি আপনাকে দেখছিলাম না আমি তো দেখছিলাম আমার ওভেন।”
“আমি কখন বললাম তুমি আমাকে দেখছো! রান্না ঘরে কে? আমি তো গুঁড়োদুধ খাইনি। এমন হয়ে গেলো না ব্যাপারটা?”
“চাইছো টা কি?”
” তোমার বৌ হতে চাইছি।”
“আবার কলিং বেল বেজে উঠলো।”
” অনিকেত দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলে দেখে জিয়ান আর নয়না। অনিকেত হতবুদ্ধি হয়ে যায়। এখন সে কি করবে! তুই এসেছিস ভাবিকে নিয়ে?”
“হ্যা এসেছি। এখন কি বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি ভেতরে আসতে দিবি?”
“আয়। অনিকেত সরে যেতেই দেখে নাহিদও এসেছে সাথে। রুমে ঢুকেই সবাই একত্রে বলে উঠলো হ্যাপি বার্থডে ডাক্তার সাহেব।”
“অনিকেতের চক্ষু টলমল করছে। এই মানুষ দু’টো সেই কলেজ লাইফ থেকে তাকে কখনো ফিল করতে দেয়নি সে অনাথ! সব সময় আগলে রেখেছে নিজের ভাইয়ের মত।”
” অনিকেত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,নাহিদ্দা ভাবি কই?”
“ভাবি এখন তোদের চাচ্চু বানানোর কাজে ব্যস্ত৷”
” নয়না সাইডে যেয়ে দাঁড়ালো।
“অনিকেত যেয়ে বলে,ভাবি আজকে তো আপনি আমাদের চিফ গেস্ট। প্লিজ আপনার আসন গ্রহন করুন।”
“সায়না কিচেন থেকে চানাচুর, বিস্কুট, ফল ট্রে তে করে সাজিয়ে নিয়ে এসে বলে,ডিয়ার দেবরগন আপনাদের ভাবির তরফ থেকে সামান্য খাতির যত্ন গ্রহণ করুন৷”
“জিয়ান হেসে বলে,বাহহ আমার আলাভোলা বন্ধুটাকে ফাঁসাচ্ছিস?”
” নাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে,এটা তোর বোন না?”
“জিয়ান হেসে বলে,আগে বোন ছিলো এখন ভাবি হয়ে গেছে।”
ওরা দু’জন হেসে উঠলো৷
“অনিকেত চোখের চশমা ঠিক করে বলে,আপনি এখানে এসেছেন কেনো? বললাম না, আসতে না।”
“নাহিদ বলল,চুপ কর শা’লা ফ্রীতে বৌ পাচ্ছিস চুপচাপ গ্রহণ করে নে। এরকম বৌ এতো সহজে পাওয়া যায় না।”
সবাই মিলে খাবার খেতে খেতে আড্ডা দিলো। এরপর কেক দুটো কাটা হলো কেক নিয়ে মজা হলো। অনিকেত বলল,”সব ঠিক থাকলে লাবিবও এখানে থাকতো আজ৷ কেনো যে নিজেকে ধ্বংস করলো ও!”
“জিয়ান বলল,আমি কখনো ভাবিনি আমার সাথে লাবিব গাদ্দারি করবে! তোরা আমার কাছে কিভাবে আড়াল করলি এতো বড় কথাটা! তবে ওরে তো আমার ট্রিট দেয়া উচিৎ ওর জন্য এতো সুইট কিউট একটা বৌ পেলাম।”
“নয়না লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে নখ খুটছে। মনে মনে বলে,এই লোকটার কোন লজ্জা টজ্জা নেই অসভ্য লোক একটা।”
“নাহিদ বলল,লাবিব তো জেলে নারী নির্যাতন মামলা খেয়েছে। তবে যাই বলিস নীলাঞ্জনা মেয়েটারও দোষ ছিলো৷ ছেলেদের মেয়েরা সুযোগ না দিলে তারা কোন মেয়ের কাছে ঘেঁষেতে পারে না।”
“অনিকেত বলল,দু’টোই একি কোয়ালিটির বাদ দে ওদের কথা। চল মুভি দেখে আসি সবাই মিলে।”
“বৌটাকে বাসায় রেখে আমরা তিনজন বের হবো। ব্যাচালার লাইফের মজা নেবো একটা দিন।”
“অনিকেত বলল,ডাক্তার অপর্ণা ঘোষ নিউরোলজিস্ট ওনাকে আসতে বলেছি। এসে পরবে কিছুক্ষণের মধ্যে। ভাবির মস্তিষ্ক থেকে তোর প্রতি ভয়টাকে বিদায় করতে হবে তো? নয়ত এজন্মে চাচ্চু হতে পারবো না৷”
“নয়না লজ্জায় এখন মিয়ে যাচ্ছে।”
“জিয়ান বলল,এই যে সায়না ভাবি আমার বৌটাকে নিয়ে আপনাদের বেডরুমে চলে যান।”
“ওরা দুজন রুমে এসে বসলো,সায়না বলল,বয়স কত তোমার?”
“আর একদিন পর সতেরো হবে।”
“তোমার কি সমস্যা আমাকে বলতে পারো। আমি শুধু অনিকেতের হবু বৌ না তোমার আদরের ননদিনী ও।”
“নয়না সে-সব কথা এখন মনে করতে চাইছে না৷ এমননা এখন জিয়ানের স্পর্শ তার খারাপ লাগে কিন্তু হঠাৎ কি যে হয়ে যায় লোকটা কাছে আসলে!”
“সায়না নয়নার কাঁধে হাত রেখে বলে,ইতস্তত না হয়ে বলে,ফেলো।সমস্যা না বললে সমাধান পাবে কই?”
” নয়না বেডসিট খামচে ধরে বলা শুরু করলো,চোখ বন্ধ করে সবটা বলে ফেললো গল গল করে,কপালে জমা হয়েছে বিন্দু বিন্দুঘাম।”
“সায়না নয়নাকে বলল,স্বাভাবিক হও নয়না৷ আমি জানি হুট করে তোমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা তুমি কেনো! কোন মেয়েই মেনে নিতে পারবে না। কিন্তু এখন তো তোমাকে সামনে আগাতে হবে ওই রাতটাকে ভুলে যেয়ে। জিয়ান খুব ভালো ছেলে কিন্তু রাগ কন্ট্রোল করতে পারেনি হয়ত। আমি জানি কাজটা অন্যায় করেছে। আচ্ছা ওইরাতে সবটা হয়েছে তোমাদের মধ্যে?”
” নয়না এসব বুঝে তবুও একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরেছে তাকে।”
“এমন সময় ডাক্তার অপর্ণা ঘোষ আসলো৷ নয়নার সাথে একান্তে কথা বলল,কিছু পরামর্শ দিলো সাথে তিনটা মেডিসিন দিলো।”

🌿

জাহিন ফাঁকা রুমে একটা চেয়ারের উপর পায় তুলে বসে আছে চোখ বন্ধ করে,তার কানে ভেসে আসছে তার বাবার কথাগুলো,তোকে দিয়ে কিছু হবে না৷ তুই কোন কাজের যোগ্য না। অপদার্থ একটা। জাহিন কপালে আঙ্গুল ঘষছে। এমন সময় ফোনটা স্ব শব্দে বেজে উঠলো৷ বিরক্ত নিয়ে চোখ খুলে দেখে অন্তরের কল,রিসিভ করে বলে,”কিরে শালা ডিস্টার্ব করার আর সময় পেলিনা!”

“অন্তর কাতর কন্ঠে বলে,রিতু সুইসাইড করেছে৷ প্লিজ স্কয়ার হসপিটালে চলে আয় দ্রুত।”
“জাহিন সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। রুমটা লক করে ছুটে বের হলো৷”
“মেহনুর হাত ধরে বলে এভাবে কোথায় যাচ্ছো?”
“জাহিন এক ঝটকায় হাত সরিয়ে বলে,জাহান্নামে যাচ্ছি তুই যাবি তাহলে আয়।জাহিন ততক্ষণে গেট ক্রস করেছে৷”
“মেহনুর কান্নার নাটক করে মিতা বেগমকে বলল,তোমার ছেলে আমাকে অসম্মান করেছে এবাড়িতে আমি আর থাকবো না।”
#চলবে

Dark Mystery পর্ব-১১

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_11
#Sabrina_Summa

দীর্ঘ চারদিন পর ক্যাম্পাসে আসলো সুপ্তি। নিমিষেই এ খবর চলে গেলো মাহিরের কানে।

আজও সুপ্তি বকা খাচ্ছে স্যারের কাছে। এভস্যান্ট থাকার জন্য।
তাকে বসানোর একটু পরই ক্লাসে প্রবেশ করলো মাহির।
মাহিরকে দেখে স্যার বলে উঠলো, ” আরে আরে তাশরিফ যে! ”
মাহির : সরি স্যার। বাট আমার একজনকে লাগবে। ( উকি ঝুকি দিয়ে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করে)
স্যার : কাকে?
মাহির : সুপ্তিকে৷
স্যার : সুপ্তি নামে কেউ আছো? স্ট্যান্ড আপ কুইকলি।
কেউ দাঁড়ালো না। সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
সুপ্তি নিজের নাম শুনে হেড ডাউন করে বসে আছে। আর সুশমিতা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
এরই মাঝে স্যার নামের লিস্টটা ভালো করে দেখে বললো, ” সুপ্তি নামে কেউ নেই। ”
মাহির ভ্রু কুচকে বললো, ” তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি ভুল ইনফরমেশন নিয়ে এসেছি! ”
স্যার : না তাশরিফ। আমি তা মিন করি নি।
মাহির : ওয়েট, আমিই খুঁজছি।
সানগ্লাসটা খুলে টি-শার্টের সাথে ঝুলিয়ে বেঞ্চের দিকে আগালো মাহির।
সুপ্তি বসে আছে ক্লাসের মিডেলের বেঞ্চের দিকে। লুকিয়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা তার৷ কিন্তু সুশমিতা কৌতুহল আটকাতে না পেরে অবাক হয়ে বলে উঠলো, ” সুপ্তি, তোকে তাশরিফ চৌধুরি খুঁজছে? ”
সুপ্তি : আরে চুপ থাক এখন। পরে বলবো কাহিনি।
বলতে গিয়ে খেয়াল করলো পুরো ক্লাস তার দিকে তাকিয়ে আছে ৷
মূলত মাহিরের উপস্থিতিতে একটা কানাগোষা চলতেও তা খুবই ধীরে। এক প্রকার বলা চলে পুরো ক্লাস নিরব। আর সুশমিতা অবাক হয়ে সুপ্তি নামটা একটু জোরেই বলে ফেলেছিল। ফলস্বরূপ সকলের দৃষ্টি এখন সুপ্তির দিকে।
সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাহিরও সে জায়গায় দ্রুত গেল। তারপর নিজের কোমরে হাত রেখে বললো, ” চলো৷ ”
স্যার বলে উঠলো, ” স্ট্যান্ড আপ। ”
সুপ্তি খুবই অস্বস্থিকর পরিবেশে পড়ে গেছে। তাও উঠে দাঁড়ালো।
সুপ্তিকে দেখেই স্যার বলে উঠলো, ” ও তো রিশিতা খানম। ”
মাহির : হ্যাঁ। ডাকনাম সুপ্তি। ভুলেই গিয়েছিলাম।
স্যার : কি করেছে ও?
মাহির : কিছুই না। আমার ফ্রেন্ড ও। নিয়ে যাচ্ছি। মাইন্ড করবেন না।
বলা শেষ করে সুপ্তিকে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। সুপ্তিও বাধ্য মেয়ের মতো হাটাঁ করলো। এখানে কিছু বলে আর সিন ক্রিয়েট করতে চাই না সে। মাহিরও সুপ্তির পিছে পিছে হাঁটা শুরু করলো।
পুরো ক্লাস তাদের যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে।
একটা মেয়ে বললো, ” এই ছেলেটা এত হ্যান্ডসাম কেন! ”
মেয়েটার পাশেরজন মেয়েটার কথায় তাল মিলিয়ে বললো, ” এই সুপ্তিকে তো আমি চিনতামই না। যদি আমি ওই সুপ্তির জায়গায় থাকতে পারতাম।।

মাহির সুপ্তিকে ৩১৯ নাম্বার কক্ষ অর্থাৎ মাহিরের প্রশিক্ষণ কক্ষে নিয়ে গেলো। রুমের ভিতরে প্রবেশ করার আগে পর্যন্ত দুইজনই চুপ ছিল। নিরবতা ভেঙে মাহিরই বললো, ” এই নাটকের কি দরকার ছিল? ”
সুপ্তি একটা চেয়ারে বসে বললো, ” আপনার এই নাটকের কি দরকার ছিল? ”
মাহির : নিজেকে চিনো না নাকি!
সুপ্তি : কেন আনলেন সেটা বলেন।
মাহির : কতদিন ধরে দেখি না বলো তো!
সুপ্তি বিরক্ত হয়ে বললো, ” আপনার কি মেয়ের অভাব পড়লো নাকি? ”
মাহির আর কি বলবে! সে সুপ্তিকে একবার দেখার জন্য এতটা উৎফুল্ল কেন সেটাই তো বুঝতে পারছে না। তার মাঝে এ মেয়ে তো আছেই সবসময় তাকে প্লে বয় প্রমাণ করার জন্য!
মাহির : কোথায় ছিলে এতদিন?
সুপ্তি : বলেছি তো অসুস্থ ছিলাম।
মাহির : এতটাই যে একবারও ভার্সিটিতে এলে না!
সুপ্তি : আপনার কি মনে হয় আমি ইচ্ছে করে ভার্সিটি অফ দিবো সামনে এক্সাম থাকা সত্ত্বেও!
মাহির : তিন বছরও তো দিয়েছো!
” আমি কি ইচ্ছে করে দিয়েছি । কাজে ব্যস্ত থাকলে কি করবো! ” ( মনে মনে )
মাহির : পড়ছো তো কঠিন বিষয় রাজনীতি নিয়ে। ফেল করলে কি করবে?
” সেটা তো আমারো চিন্তা। কোটি কোটি টাকা থাকা সত্ত্বেও আমাকে অসহায় অবলা নারী হয়ে থাকতে হবে। আমি তো ব্যবসার ‘ব’ ও বুঝি না। শুধু বুঝি রাজনীতি । কিন্তু আমি ভোটে দাঁড়ালে তো কেউ ভোটই দিবে না। কারণ সবাই চিনে মিস সিক্রেটকে সুপ্তিকে নয়। এগুলো ছাড়া এত রিচ দেখানো সম্ভবও না। “( মনে মনে )
মাহির : মনে মনে উত্তর না দিয়ে সরাসরিই তো দিতে পারো যাতে আমি শুনতে পারি।
সুপ্তি : আচ্ছা একটা গল্প শুনবেন।
মাহির : হুম বলো৷
সুপ্তি : একছিল মাফিয়া কুইন। তার ছিলো অনেক টাকা।…
মাহির কথার মাঝখানে বললো, ” মাফিয়া। অবৈধ টাকা তো থাকবেই। ”
সুপ্তি : আরে চুপ থাকেন। আমাকে বলতে দেন। কথার মাঝখানে কথা বলবেন না।
মাহির মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
সুপ্তি : তবে কেউ তার পরিচয় জানতো না। রাতের বেলায় ছিল মাফিয়া কুইন এবং দিনের বেলায় সাধারণ মানুষ। এতটাই সাধারণ যে তার চলার মতো টাকায় নেই। কোটি টাকা থাকা সত্ত্বেও দিনের বেলায় তা ব্যবহার করতে পারতো না। কারণ একটাই কেউ তো তার পরিচয় জানে না। হঠাৎ করে ধনী হয়ে গেলে মানুষ অবৈধ টাকা বলবে না! কিন্তু তার টাকা তো অবৈধ নই। তাকে জেলেও দিতে পারে। তখন তার পরিচয় তো মানুষের সামনে চলে আসবে। সে তো এটা হতে দিবে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো দিনের বেলায় ভিক্ষা করবে।…”
মাহির আবারো কথার মাঝে কথা বললো, ” তাহলে বড়লোক কাউকে বিয়ে করলেই হয়! ”
সুপ্তির বলতে ইচ্ছে করলো, ” তুই করবি বিয়ে এক ফকিরকে! ” কিন্তু বললো না। শুধু চোখ রাঙ্গিয়ে তাকালো। তাতেই চুপ হয়ে গেল মাহির৷
সুপ্তি : আমরা এই ঘটনায় মাফিয়া কুইনকে কি বলতে পারি! সে হলো কোটিপতি ফকির।

” আর সেটা হলাম আমি। ” ( মনে মনে )
মাহিরের কাছে গল্পটা তেমন ইন্টারেস্টিং লাগলো না। তবুও কিছু বললো না।
সুপ্তি : আজ আসি।
মাহির : পরে যাও। আগে এক রাউন্ড ফাইট করে যাও৷
সুপ্তি : আজ না।
মাহির : কেন ভয় পেলে?
সুপ্তি : না। তবে আমি সুস্থ নই। আজকে তোমার জিতার চান্স ৭০% ।
মাহির : এত কনফিডেন্স। যে ৩০% নিয়ে নিলে।
সুপ্তি : হ্যাঁ। আজ আসি।
বলেই উঠে দাঁড়ালো।
মাহির : কাল কখন দেখা হচ্ছে?
সুপ্তি : ক্লাস শেষে। ক্যাম্পাসে।
বলা শেষ করে চলে গেলো। ক্লাসে গিয়ে সুশমিতাকে সব বললো ৷
সুশমিতার মনে হচ্ছে মাহির সুপ্তিকে ভালোবাসে । তবে সুপ্তির ধারণা কোনো প্লে বয় কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারে না। আর যদি বাসে তবে সেটা তারই লাভ।।।

#চলবে.,.

Dark Mystery পর্ব-১০

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_10
#Sabrina_Summa

মাহফুজ চৌধুরী ও তার বডিগার্ড চলে যেতেই একজন ডক্টর দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, ” ম্যা আই কাম ইন ম্যাম। ”
মিস সিক্রেট ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো, ” এসো। ”
ডক্টর ভিতরে এসে বললো, ” ম্যাম, আমি খুবই খুশি হয়েছি আপনার ট্রিটমেন্ট করতে পেরে। বাট ম্যাম, আপনার এ অবস্থা কেন? ”
মিস সিক্রেট : গুলি লেগেছে দেখতেই তো পাচ্ছো।
ডক্টর : ম্যাম, চিনেও না চিনার ভান করবেন?
মিস সিক্রেট : নাম্বার ১১। তোমার উচিৎ নই আমার অর কারো সামনে আসা ওয়িদআউট মাস্ক এ্যান্ট হুডি। ( রেগে )
ডক্টর : আমি জানতাম আপনি চিনেছেন ইনফ্যাক্ট আমাদের সকলের ইনফরমেশন আছে আপনার কাছে। তবে মাস্ক খুললে প্রবলেমটা কোথায়?
মিস সিক্রেট : এত টাস্ট করো না আমায়।
ডক্টর : কেন ম্যাম, ধোঁকা দিবেন?
মিস সিক্রেট চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই নাম্বার ১১ একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রেগে বললো, ” ম্যাম, একবার শুধু পারমিশন দেন। যে আপনাকে শুট করেছে তাকে মাটিতে পুতে ফেলা পর্যন্ত দায়িত্ব আমার। ”
মিস সিক্রেট তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ” আমাকে তো চিনো! আমি মারতে চাইলে ও বাঁচতে পারতো না।
তবে ওকে আমি মারতে পারবো না। ( শেষেরটুকু শান্তভাবে)
“কেননা ও মাহফুজ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে। যে আমাকে হেল্প করেছিল আমার আপুর খুনিকে মারতে। তার বিনিময়ে শুধু চেয়েছিল নিজের পরিবারের সেইফটি। কীভাবে মারি বলো তো! ”
“ম্যাম, কেন মারতে পারবেন না? ” নাম্বার ১১ এর প্রশ্নে হুশ ফিরলো মিস সিক্রেটের ৷
নিজেকে সামলে বললো, ” এমনিই কিছু পার্সোনাল ইস্যু আছে। ”
নাম্বার ১১ আর জানতে চাইলো না। কেউ যখন পার্সোনাল শব্দটা ব্যবহার করে তখন প্রশ্ন করাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। তাই নাম্বার ১১ চুপ থাকাটাই বেস্ট মনে করলো।
নিরবতা ভেঙে মিস সিক্রেটই বললো, ” আমি খুব প্রাউড ফিল করছি যে আমার টিমে একজন ডক্টরও আছে। ”
ডক্টর : থ্যাংক ইউ, ম্যাম।
মিস সিক্রেট : আচ্ছা আমি রিলিস কবে পাবো?
ডক্টর : ১ সপ্তাহের আগে তো না। আর যদি ৩/৪ দিনের মাঝে পেয়েও যান তবুও ঠিক করে হাঁটতে পারবেন না। প্রচুর পেইন করবে।
মিস সিক্রেট : ওকে। এখন তুমি যাও৷ আমি রেস্ট নিবো।
ডক্টর : ওকে, ম্যাম।
ডক্টর চলে যেতেই মিস সিক্রেট অরপে সুপ্তি মাস্ক ও হুডি খুলে বিড়বিড় করে বললো, ” ১ সপ্তাহ কেন! ২/৩ দিনও আমার এখানে থাকা অনেক ট্রাফ। এর জন্য দায়ী শুধু তুমি মাহির চৌধুরী অরপে তাশরিফ। এর মাশুল তোমাকে দিতেই হবে। ভেবেছিলাম বন্ধুত্ব করে তোমাকে ঠিক করবো। তবে এখন আমি তোমাকে নিয়ে খেলবো।
ওয়েট ফর মি.,.!”

নিজের সাথে কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে গেছে সে নিজেও জানে না। তার ঘুম ভাঙলো সুশমিতার কলে। সুপ্তি কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে বলে উঠলো, ” দোস্ত রাগ আছিস?”
সুপ্তি : কেন রে?
সুশমিতা : সেদিন গিয়ে দেখলাম তুই নেই। ভাবলাম আমার লেট হচ্ছে দেখে তুই রাগ করে চলে গেছিস।
সুপ্তি : না। আমাকে আরেকজন পিক করেছিল।
সুশমিতা : ভালোই তো। তোকে পিক করা মানুষের অভাব নেই!
সুপ্তি : পরে কাহিনি বলবো নি। আগে বল রবিবারে ক্যাম্পাসে এলি না কেন?
সুশমিতা : আরে আগে তুই বল। তুই আজ এলি না কেন?
সুপ্তি : অসুস্থ।
সুশমিতা : আমারো সেইম ক্যাস ছিল। তোর কি হয়ছে?
সুপ্তি : এই একটু ঠান্ডা জ্বর।
সুশমিতা : এড্রেস বল। আমি আসছি।
সুপ্তি : আমি বাসায় নেই।
সুশমিতা : তাহলে কোথায়, হসপিটালে?
সুপ্তি : আরে না। আত্মীয় বাড়ি। আচ্ছা দোস্ত রাখি এখন ৷
বলেই কল কেটে দিলো। না হয় সুশমিতা আরো হাজারটা প্রশ্ন করতো।
১ সপ্তাহও হয় নি তাদের পরিচয় হয়েছে । তবে দুইজন খুবই ক্লোজ হয়ে গেছে। মনে হয় দুই বোন।
সুপ্তি নিজের মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো, ” হসপিটাল আমার আত্মীয় বাড়ি হলো কীভাবে! হোয়াট ইভার, আমার টিমের সদস্য থাকে এখানে। সরি আমার না মিস সিক্রেটের । সো আত্মীয় বাড়ি তো হলোই ।।
( গল্পটি ভালো লাগলে “ক্ষুদে লেখিকা.,.” পেইজটি ফলো করবেন প্লিজ। )

মাঝে তিনটে দিন কেটে গেলো। এই তিন দিনে মাহফুজ চৌধুরী দুইবার দেখা করতে এসেছিল। মিস সিক্রেটের টিমের সদস্যরাও এসেছিল। সবথেকে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো মাহিরও এসেছিল। তবে সেটা নিজ ইচ্ছায় নয় বাধ্য হয়ে।।
মিস সিক্রেট ও সুপ্তি উভয়কেই কল করে জ্বালিয়ে মারছে সকলে। প্রথম দিন মিস সিক্রেটের মনে হয়েছিল সে এসব থেকে অবসর নিয়েছে। কিন্তু পরের দুইদিন ফোনের উপর ফোন করায় অতিষ্ঠ সে।
মিস সিক্রেটের হসপিটালের ভর্তির খবর মিডিয়া পর্যন্ত যায় নি। মূলত মিস সিক্রেট যেতে দেই নি। শুধু শুধু একটা এক্সটা ঝামেলা। আর তাছাড়াও এতে মাহির ফেঁসে যেতো। যা আপাতত সে চাই না।।

#চলবে.,.

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
#শেষ_পর্ব
-তামান্না

–রাফি:হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের উপর এনে ফেলে রিফাকে।হঠাৎ টান দিয়ে নিজের বুকের উপর ফেলায় ভয় পেয়ে যায় রিফা।
নেশা জড়া কন্ঠে বলে কেন আমায় বুঝো না?একটু বুঝলে আরও আগেই সুন্দর হতো।
–রিফা:মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,, তাহলে আপনি কেন আমার সামনে পাগলামি করলেন না?আগে কেন আসলেন না?তাহলেই তো মনে জুলুম করে আরেক জন আসতে চেষ্টা ও করতে পারতো না।
–রাফি:জোর পূর্বক হেসে বলে,, এসেছি আরও আগেই আবেগে পাগলামি তে না,, ভালোবাসায়।কিন্তু তুমি সেটা দেখতে পাও নি।
রিফা তড়িঘড়ি করে দূরে সরে দাঁড়ায়। রাফি আবার কাছে টেনে নেয়।
–রিফা:আপনার কি হয়েছে?এমন করছেন কেন?তাছাড়া আপনার ভালোবাসার মানুষ আপনার দুশ্চরিত্র সম্পর্কে জানলে কষ্ট পাবে।
–রাফি :শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে আপাতত কষ্ট পাক।হুট করে কপালে চুমু খেয়ে বলে ভালোবাসি রিফু।প্রথম থেকে শেষ অব্ধি তোমাতেই আমি।
মজা করে বলে অবশ্য মাঝখানের এই ভুলের জন্য বেশি করে ভালোবাসা দিলেই ভুলে যাবো।রিফা হাসতে হাসতে কয়েক টা কিল মারে।

–নিরু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে আসবো?তাড়াতাড়ি করে দুজনে সরে দাঁড়ায়।ভিতরে এসে মুচকি হেসে বলে,,হালালে আবদ্ধ করে তাড়াতাড়ি পেতে চাইলে নিচে আসেন হবু বর কনে।
–রিফা:এগিয়ে এসে বলে মানে?
–নিরু:মানে হলো রাফির আর ছুটি নেই তোমার ভাইয়ার ও শহরের বাইরে কাজ পড়ছে সুতরাং বিয়ে টা কালকেই হয়ে যাবে।কাবিন বিয়ে তারপর..
–রিহান :এগিয়ে আসতে আসতে বলে তারপর দুই মাস পর দুই ভাই বোন মিলে আবার বিয়ে করবো।
–রিফা:কিহ?আমি আবার বিয়ে করবো কেন? একটা বর হলেই হয়ে যাবে আমার।এতো বিয়ে করতে পারবো না বাবা!
রিফার কথায় সবাই হেসে ওঠে।
.
.
–রাত এগারোটায় বউ নিয়ে চলে যায় রাফি।তেমন বেশি আয়োজনে বিয়ে হয় নি।ঘরোয়া ভাবেই কাবিনের কাজটা শেষ করা হয়েছে।রিফার বিদায়ের পর,,সব কিছু গুছিয়ে রুমে আসে নিরু।
–কিন্তু রুমের ভিতর থেকে দরজা আটকানো।এমনিতেই পড়নে শাড়ী এবার ভীষণ গরম লাগছে।কয়েক বার দরজায় টোকা দেওয়ার পর দরজা খুলে দেয় রিহান।ভিতরে প্রবেশ করে দেখে রুমটা অন্ধকার।এগিয়ে গিয়ে লাইটটা অন করতে গেলে এক টানে কাছে টেনে নেয় রিহান।নিরু ভয় পেয়ে যায়।শাড়ীর কুচি খুলে গেছে।
–নিরু:ছুটাছুটির চেষ্টা করে বলে,,আর একটু হলে দুজনেই পড়ে যেতাম।কি হতো তখন?
–শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয় রিহান।রিহানের এমন স্পর্শে স্তব্ধ হয়ে যায় নিরু।চোখ বন্ধ করে ঘনঘন নিশ্বাস নিতে থাকে।
–নিরু:ছছছাড়ুন শশশুতে যযযাই।
–রিহান :কোলে তুলে নেয় নিরুকে।তারপর এগিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে দেয়।উঠে লাইট অন করতে এলে নিরু হাত ধরে আটকে নেয়।এমনিতেই লজ্জা লাগছে তারপর লাইট অন করলে তো লজ্জায় মরেই যাবে।

–রিহান শুতেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিরু।বুকে মাথা গুজিয়ে বলে,,শুরুতেই এমন হলে কি এমন ক্ষতি হতো?
–রিহান :নিরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,, মাফ করে দিও।হয়তো এতটুকু হয়েছে বলে আজকের দিনটা এতো সুন্দর।সহজে সব কিছু হয়ে গেলে তৃপ্তির মজা পাওয়া যায় না।
আজকের দিনে লজ্জা দিও না বউ।পবিত্রতার আরও একটু ধাপ এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিবে কি?আমি যে বউয়ের তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছি আর কতো?
–নিরু:নিরু লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বলে আমি মানেই তো পুরোটাই আমার বরের।এতে এতো অনুমতির কিছু নেই।
–রিহান :হাসতে হাসতে বলে ব্যাপারটা বেশি লেট হয়ে গেলো না?ছোট বোনের বিয়ের দিন বড় ভাইয়ের বাসর হলো।
–নিরু লজ্জায় হাসে।

–তারপর সুন্দর একটা একটা সম্পর্কের আরও একটা নতুন তৃপ্তির স্বাদ নেওয়া হলো।নিরুর কপালে চুমু খেয়ে বলে,,আমি চাই আমার বউ সব সময় আমার উপর অধিকার খাটাক ভালো মন্দ চোখে চোখ রেখে মোকাবিলা করুক।আমি চাই না সব সময় #নৈশব্দে_নিরুপমা আমায় ত্যাগ করুক দূরত্ব বাড়াক।
–নিরু:হুম!আমি ও চাই আমার বর ভালোবেসে সব সময় আমায় নিরুপমা বলেই সম্বোধন করুক।তোমার মুখে নিরুপমা নাম শুনলে অদ্ভুত ভালো লাগে।
–রিহান :বুকের সাথে মিশিয়ে বলে আমার নিরুপমা।ভালোবাসা শব্দ টার সার্থক হলো আমাদের জীবনে।এতো দিন ভালো ছিলাম না,, শুনছো আমি আমার ভালোবাসা পেয়ে ভালো আছি।আমার সঙ্গী আজ আমার সাথে আষ্টেপৃষ্টে ভালোবাসাময় হয়ে আছে।
–নিরু রিহানের কথায় শুধু হাসে।প্রিয় ভালোবাসার পুরুষের বুকে মাথা রাখায় ভীষণ শান্তি।

——————————————— –এদিকে রাফিরা বাসায় পৌঁছে রাত সাড়ে এগারোটায়।রিফাকে নিয়ে বাইকে করেই ফিরে। পুরো চারপাশ ঘুরিয়ে নিয়ে আসে।
–রাফি:শ্বশুর বাড়িতে প্রথম পা দিচ্ছো অনুভূতি কেমন?
–রিফা:মোটে ও না,,আমি শ্বশুরবাড়ি বহু এসেছি সুতরাং অনুভূতি নেই।
–রাফি:বিয়ে কয়টা হয়েছে তোমার?কতো বিয়ে করেছো যে শ্বশুর বাড়ি বহু এসেছো?
–রিফা:আরে ভাই!কয়টা না আমি বলতে চাচ্ছি এই বাসায় তো বহু এসেছি।
–রাফি:কে ভাই?কিসের ভাই? কেমন ভাই?
–রিফা:তুমি বরং এক কাজ করো আমাকে তাড়াতাড়ি করে শ্বশুর বাড়িতে রেখে চলে যাও।তোমার সাথে থাকলে আমার শুধু ঝগড়ায় হবে এর থেকে ভালো আমাকে রেখে তুমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে।
–রাফি :তাহলে বিয়ে কেন করলাম?বিয়েই তো করলাম বউকে জ্বালানোর জন্য।আর আমার এতো দিনের অপেক্ষার জন্য প্রতিশোধ তো নিতেই হবে।
–এবার রিফা বাইকের পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।মাথাটা রাফির পিঠে রেখে বলে,, শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো নিতে পারবে প্রতিশোধ?
–মাথাটা তুলে লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখে রাফি মুচকি হাসছে।

–বাসায় পৌছানোর পর সব নিয়ম শেষ করা হলে রুমে দিয়ে আসে শ্বাশুড়ি।বাসায় মেয়ে মানুষ বলতে এই শ্বাশুড়িই আছে।রাফির কোনো ভাই বোন নেই।

–রুমে গিয়ে আগে দুজনেই ফ্রেশ হয়ে নেয়।রাফি আগে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে।তারপর রিফা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে বলে,,তুমি চাকরিতে চলে গেলে কিভাবে থাকবো?এই বাড়িতে একটা মানুষ ও নেই তাছাড়া আন্টি ও তো আঙ্কেলের সাথে থাকে।আমি একা কিভাবে থাকবো?
–রাফি :তাড়াতাড়ি একটা বাচ্চা নিয়ে নিলেই তোমার সঙ্গী হয়ে যাবে,,মজা করেই কথা টা বলে ।কথাটা শুনে নিরুর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়।চুপচাপ অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।

–রাফি:ঘুম পেয়েছে
–রিফা:নাহ মানে হ্যা।
–রাফি:উঠে রিফার দিকে ঝুঁকে বলে আজকের দিনে ও তুমি নিরবের শোকে আমাকে দূরে রাখবে?
–রিফা:ফট করে উঠে বসে।তারপর কান্না করে দেয়। রাফি হাত ধরতে গেলে ঝটকা মারে।কান্না করতে করতে বলে এটা কিন্তু কথা ছিলো না।

–রাফি:কানে ধরে বলে প্লিজ থামো আর হবে সরি।প্লিজ সরি।
–রিফার কান্নার গতি আরও বাড়ে।
–রাফি:এগিয়ে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে সরি বউ।তুমি তো জন্মের সময় থেকেই আমার বউ আর এমনটা হবে না।আমাদের ভাগ্য নাম সবটাই তো একসাথে জোড়ে পাঠিয়েছে উপর ওয়ালা।আমি তো তোমাকে রাগানোর জন্য এই কথাটা বললাম।প্লিজ আর হবে না। তারপর রিফা ঠাস করে বুকে এসে পড়ে ঝাপটায় ধরে।সম্পর্কে পূর্ণতা নেমে আসে নতুন জুটির।
.
.
–সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে গোসল শেষ করে রিহান কে নিয়ে বের হয় নিরু।প্রথমে বাবার কবর তারপর নীলা আর ওর বরের কবর জিয়ারত করে।তারপর গিয়ে উঠে রাফিদের বাসায়।ভোরে বের হওয়ায় এখানে আসতে তেমন বেলা হয় নি।
রিফার পছন্দের কিছু খাবার নিয়ে এসেছে।সাথে মেহমান বাড়ির জন্য কিছু উপহার।
–রাফির আম্মু :তোমাদের সকাল সকাল পেয়ে ভীষণ খুশি হলাম।তোমরা বসো আমি নাস্তা করে আনছি।
–নিরু:মোটেও না।রিফা কই আন্টি আজকে আমরা দুজনে রান্না করবো আপনারা খাবেন।
–আন্টি:আসলে অনেক রাত করে এসেছে তো তাই ওঠে নি এখনো।রাফি উঠে ছিলো আমিই রুমে পাঠিয়ে দিয়েছি ঘুমানোর জন্য।
–নিরু:আমি ডেকে আনছি আপনি ড্রয়িং রুমে বসুন আজকে মেয়েদের হাতের রান্না খাবেন।রাফির মা হেসে বলে এখন আমার মিষ্টি দু দুটো মেয়ে হয়ে গেলো।নিরু ও প্রতি উওরে হাসে।

–নিরু কয়েকবার দরজায় টোকা দেওয়ার পর উঠে দরজা খুলে দেয় রাফি।নিরুকে দেখেই চমকে যায়।
–নিরু:কই আমার ননদিনী হুম?এতক্ষণ কেউ ঘুমায়?উঠতে হবে তো তারপর আবার রেস্ট নিবে না হয়।
–রাফি কিছু বলতে যাবে তারপর আগেই চোখ যায় রিফার দিকে।কালকে রাতে গরম থাকায় রাফির টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়েই শুয়ে ছিলো।লজ্জায় জোর পূর্বক হেসে কোনো রকমে কাপড় নিয়ে বের হয়ে যায়।গেস্ট রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিবে।

–নিরু:কি গো রিফা উঠো।অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর উঠে বসে।লজ্জায় নিজেই জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে গরম করছিল বেশি তা..।
–নিরু:হয়েছে।এবার ফ্রেশ হয়ে আসুন জলদি। সবার জন্য দুজনে মিলে নাস্তা টা করবো।

–নতুন দুটি সংসার নতুন প্রাণ নিয়ে সতেজ হলো।ওদের এই পৃথিবীর যাত্রা দীর্ঘতম হোক।সকল ভুল বুঝাবুঝি আর অভিমান শেষ হয়ে নতুন সম্পর্ক স্থাপন হোক।ভালোবাসা ভালো থাকুক।ভালোবেসে ভালো থাকার জন্যই তো জীবন সঙ্গী।

(সমাপ্ত)

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-১৭

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১৭]
-তামান্না

–আমি চাই আমার নিরুপমা আমার রাগকে পাত্তা না দিয়ে,, আমার বদমেজাজে গরম পানি ঢেলে দিয়ে একেবারে ঠান্ডা করে দিক।আমি জানি আমার মতো পুরুষ কে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা আমার নিরুপমার আছে। শুধু সেটা একটু প্রয়োগ করুক আমার বউ।
নিরু এবার শান্ত মেয়ের মতো কান্না করে শব্দ ছাড়া।রিহান বুঝতে পারছে কারণ তারপর টিশার্ট পুরো টা ভিজে যাচ্ছে।

–এভাবেই এক সময় দুজনে ঘুমিয়ে পড়ে।পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে পড়ে রিহান।

–নিরুর মুখের উপর থেকে চুল গুলো সরিয়ে কপালে চুমু খেয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এতো দিনের ছটফটানি নিমিষেই দূর করে দিতে পারে এই সুন্দর অনুভূতি।পৃথিবীর সব থেকে স্বস্তির আর আরামের অনুভূতির মধ্যে এটা একটা।শুয়ে শুয়ে অনেক কিছু ভাবতে থাকে রিহান।
এরমধ্যে নিরুর ঘুম ভেঙে যায়।রিহান ঘুমের ভান করে থাকে।চুপিচুপি উঠে বসে নিরু,,রিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি দিতেই দেখে তাকিয়ে আছে রিহান। লজ্জায় তাড়াতাড়ি করে উঠে যেতে নিলে রিহান একটানে নিজের উপর এনে ফেলে।
–রিহান :লজ্জা নারীর ভূষণ তবে স্বামীর সামনে অতো দরকার নেই।নিরু লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে।রিহান ঠাট্টার ছলে বলে,, আমি একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।
–নিরু:কি বিষয়?
–রিহান :সব সময় ভাবতাম যা লাজুকে বউ আমার ধরা কি সহজে দিবে?এখন দেখছি ধরা আসলেই দিচ্ছে না।
নিরু হালকা কিল দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।খানিকটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,, রিফা?ওর ব্যবস্থা?

–রিহান :উঠে দাঁড়িয়ে বলে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও।বাসায় ফিরবো তবে আশা করি ফিফটি পার্সেন্ট কাজ এগিয়ে আছে।তারপর রাফির কাহিনি খুলে বলে।

–এদিকে সকাল থেকে মনমরা হয়ে আছে রিফা।ফোন টা ও বন্ধ।সে পণ করেছে এই ফোন আর ব্যবহার করবে না।নিজের উপর রাগ হচ্ছে কেন এমন বাজে ভাবে জড়ালো বাজে লোকের সাথে?

*****************
–রিহান নিরু রাফি রিফা আর নিরব।সবাই মিলে উপস্থিত হয়েছে একটা রেস্টুরেন্টে।নিরব তো ভীষণ খুশি ভেবেছে রিফা রাজি করিয়ে ওদের এনেছে।রিহান আর নিরু খানিকটা দূরে অবস্থান করছে।ফোনে কিছু কথা বলছে এরপর সামনে আসবে।
–রাফি:তুই ওদের জন্য কেন রিফার দিকে হাত বাড়িয়েছিস?ওদের সামনে তো ভীতুর মতো চুপসে থাকিস,মেয়ে মানুষের দিকে নরম ভেবে চোখ তোলা তো?
–নিরব:তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই।রিফার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, কথিত প্রেমিককে নিয়ে কেন আসলা?রাফি শোন তোর চরিত্র সম্পর্কে জানা আছে।রিফা আমায় ভালোবাসে বলে হিংসা হচ্ছে তাই না?নিজে তো ধারে ও ঘেঁষতে পারলি না।
রাফি রাগে হাত মুষ্টি করে ফেলে।

–রিফা:তোমার সাথে সারাজীবন থাকবো তাই তো?
–নিরব:হুম অবশ্যই!
–রিফা:তাহলে শুরুতেই যদি আমার লোকের কথা সয্য না করতে পারো,, সারাজীবন কিভাবে থাকবো?
–নিরব:হাসার চেষ্টা করে বলে,,কোল বেবি।আর রাফি তো তোমার লোক নয়!
–রিফা:সেটা তুমি বললেই তো হবে না।আমার লোক কে সেটা আমি বলবো।
–নিরব:উঠে দাঁড়িয়ে রিফার হাত চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,, এতো ত্যাড়া কথা কই থেকে শিখলি?
–রাফি:ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে বলে,, দূরত্ব বজায় রেখে কথা বল।মেয়ে মানুষ কে সম্মান দিয়ে কথা বলতে শিখ।
–নিরব:এগিয়ে আসতে আসতে বলে লাগে?খুব লাগে?সুন্দরী হাত ছাড়া হয়ে গেলো বলে?আহা রে মা*ল টারে আমি পেয়ে যাবো,,আফসোস হচ্ছে?
–রিফা:ছি ছি ছি!এগুলো কোনো মানুষের ভাষা?
–রাফি :দুই তিন টা ঘুষি মারে।এক পর্যায়ে ভালোই হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়।রিফা ভয়ে ওদের আটকাতে না পেরে কান্না করে দেয়।

–নিরব:তুই আমাদের মধ্যে আসিস না রাফি।জাস্ট কয়েক দিন আমার হাতে দে তারপর তোর হাতে দিয়ে দিবো।
আরও অনেক গুলো নোংরা ভাষা ইউজ করে।

–হিতে বিপরীত হওয়ার আগেই পুলিশ সহ এসে উপস্থিত হয় রিহান আর নিরু।
–নিরব:রিফার দিকে তাকিয়ে বলে ভাইয়ের মতো করলি তো?তোকে আমি দেখে নিবো।দেখবো জীবনে কিভাবে বিয়ে বসিস।
নিরু এগিয়ে গিয়ে রিফাকে জড়িয়ে ধরে।রিফা ভয়ে বাচ্চাদের মতো গুটিয়ে আছে।
–নিরব:পাগলের মতো হাসতে হাসতে বলে নিরু? আমি ফিরে আসলে তোর ভালো হবে না।শুধু সবুর কর তোর অস্তিত্ব মুছে দিবো।
–রিহান :হাতটা মুচড়ে কয়েক টা লাত্থি মেরে বলে আগে নিজের চিন্তা কর।পৃথিবীর বুকে রিহানের শেষ নিশ্বাস অব্দি তোর অস্তিত্ব সংকট হবে।নিরু আর রিফা আমার দুই পাশ ওদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর কল্পনা ও করবি না।আর রইলো রিফার বিয়ে তোকে আমি চ্যালেন্জ করলাম আগামী তিন দিনের ভিতর ওকে আমি বিয়ে দিবো।আর কানের ফিসফিস করে বলে,,আর আমার আর নিরুর অস্তিত্বের নতুন অতিথি আনার প্রসেসিং করবো।নেক্সট যেন মামা ডাক শুনতে পারিস ওখে?

–তারপর বিভিন্ন কথা-কাটাকাটির পর পুলিশ নিরবকে নিয়ে যায়।প্রমাণ স্বরুপ কিছু ভিডিও আর কল রেকর্ড জমা দেওয়া হয়।

–রাফি:রেগে বলে,, আমি আসছি।কালকে চলে যাবো।
–রিহান :কালকে কেন?তুই না বললি আরও দুই সপ্তাহ ছুটি আছে।
–রাফি:অন্য দিকে ঘুরে হাতটা মুষ্টি বদ্ধ করে চোখ বন্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বলে,,আমার রাগ হচ্ছে রিহান।আমাকে যেতে দে নয়তো নিজেকে কন্ট্রোল করা মুশকিল হয়ে যাবে।
–রিহান :হাত ধরে টেনে বলে চল।তুই আজকে আমার সাথে আমার বাসায় থাকবি।তারপর জোর করে গাড়িতে উঠায়।

*********
–ড্রয়িং রুমে সবাই মিলে বসে আছে।রিহান কিছু খাবার এনেছে সবাই এক সাথে খাবে বলে নিচে পাটি বিছিয়ে রেডি করছে।রিহানের আব্বু আম্মু রুমেই আছে।রেডি করে ওদের ডাক দিবে।এসে ফ্রেশ হয়ে খানিকটা রেস্ট নিয়ে এসেছে।
সোফায় এক কোণায় ভেজা চুল ছেড়ে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে রিফা।আর সামনাসামনি এই মাথায় বসে ফোন ঘাঁটছে রাফি।

–রাফি:এক কাজ কিন্তু বাকি রয়ে গেলো রিহান?
–রিহান :মাথা তুলে রাফির দিকে তাকিয়ে বলে কি কাজ?
–রাফি:আসল কাজ টাই।নিরবের সাথে আরও একজন কে রেখে আসা উচিত ছিলো।সে যে দুঃখের সাগরে প্রেমিক বিহীন ভেসে যাচ্ছে।
–রিফা:সোজা হয়ে বসে।একবার আড় চোখে রাফিকে দেখে নেয়।নিরু এগিয়ে এসে বলে এমন করছেন কেন রাফি ভাইয়া?দেখতেই তো পাচ্ছেন মন খারাপ ওর।
–রাফি:কেমন করছি?মন ঠিক করার ব্যবস্থা করতে ভুল হয়ে গেছে সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছি।

–রিফা রাগে উঠে চলে যেতে নিলে রাফি বলে দেখলে যা বললাম তাই সত্যি।
–নিরু:এগিয়ে গিয়ে ধরে এনে বসায় ওদের সাথে।
.
.
–সবাই মিলে একসাথে বসে আছে।রিফা সোফায় বসে কার্টুন দেখছে পাশে সবাই।এরমধ্যে রিহান বলে।
–রিহান :এক সপ্তাহ হয়ে গেলো,,আমি বলেছিলাম তিন সপ্তাহের ভিতরে রিফার বিয়ে দিবো।
–আব্বু :হুম!ভালো পাত্র দেখে দিয়ে দেওয়ায় ভালো।
–রিহান :আমার কাছে ভালো পাত্র আছে আর সেটা তোমরা ও চেনো।
–রিফা এবার সোজা হয়ে বসে।মলিন চোখে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের মুখের দিকে।
–আম্মু :কে?
–রিহান :রাফি।আর রিফা কে খুব ভালো ও বাসে।
–রিফা:উঠে দাঁড়িয়ে কান্না করতে করতে বলে কখনোই না।আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো না।আর রইলো রাফি ভাইয়ার কথা আমি একে বিয়ে করতে পারবো না।বিয়ের পর দাঁতে দাঁত চেপে বলে নিরইব্বা রে নিয়েই খোটা দিবে সারাক্ষণ।
রিহান নিরু সহ সবাই হেসে ওঠে।আর এদিকে মাত্রই বাসার ভিতরে প্রবেশ করেছিল রাফি।তাই রিফার প্রত্যেকটা কথা শুনে ফেলে।

–রাফি:খোঁটার কাজ করলে তো খোঁটা শুনতেই হবে।আচ্ছা মানুষ জন এতো বোকা আর গাধা কেন?নরমাল জিনিস বুঝতে পারে না?

–রিফা:রেগে কোনো কথা না বলে চলে যায় রুমে।

–রিহান :আমার প্রস্তাবে কি তুই রাজি?প্লিজ না করিস না।
–রাফি:হেসে বলে আগে রিফার সাথে কথা বলতে চাই সিরিয়াস মোডে।তারপর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,,তারপর রিকোয়েস্ট তুই নয় আমি করবো তোর কাছে।বাঁকা হেসে চলে যায় রিফার রুমে।

–রিফা রুমে এসে বসে বসে কান্না করছে।রাফি গলা খাঁকারি দিয়ে রুমে প্রবেশ করে।রিফা তাড়াতাড়ি করে উঠে চোখের পানি মুছে দাঁড়িয়ে থাকে।
–রাফি:তোমার রুমে এলাম।
–রিফা:জোর পূর্বক হেসে বলে,, স্বাগতম।
–রাফি:বিছানায় বসে চারপাশে তাকিয়ে বলে মন্দ না,চলবে।
–রিফা:কি চলবে? আর কিছু বলতে আসলেন নাকি?ভাইয়া রা কোথায়?
–রাফি:বলবো তো অবশ্যই।আর রইলো ভাইয়ারা,, ওরাই আমাকে পাঠিয়েছে এখানে।
–রিফা:একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের রুমে একা একজন ছেলেকে পাঠিয়ে দিলো?বাহ্ বাহ্ বেশ দায়িত্ব সচেতন মানুষ তো আমার পরিবার।
–রাফি:এক্সকিউজ মি!তুমি কি বলতে চাচ্ছো তোমার সাথে জোর পূর্বক রোমান্স করতে এসেছি?
–রিফা:ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।
–রাফি:উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,,আমি ও অলরেডি একজন কে ভালোবাসি আর সেটাই বলতে এসেছি।
রাফির এগিয়ে আসা দেখে রিফা ও পিছনে যাচ্ছিলো কিন্তু এই কথা শুনে থমকে দাঁড়ায়।চুপচাপ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।ভীষণ ভয় হচ্ছিল।চোখ দিয়ে আপনা আপনি কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।অন্য দিকে ঘুরে চোখের পানি মুছে বলে আচ্ছা।
–রাফি:পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে শুধুই আচ্ছা?
–রিফা:কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলে হুম সাথে শুভকামনা ও।
–রাফি:এদিকে তাকিয়ে বলো?আমার আবার মুখ না দেখে কথা বলতে ভালো লাগে না।
–রিফা:মাথা নুয়ে এদিকে ফিরে বলে বলুন।
–রাফি:বাহ্ বাহ্ বেশ তো বলুন?কিন্তু কথা তো আমি না আপনি বলবেন।
–রিফা:শুভকামনা রইলো।
–রাফি:হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের উপর এনে ফেলে রিফাকে।হঠাৎ টান দিয়ে নিজের বুকের উপর ফেলায় ভয় পেয়ে যায় রিফা।

#চলবে

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-১৬

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১৬]
-তামান্না

–রিহান :এগিয়ে গিয়ে পাশে শুয়ে এক টানে কাছে নিয়ে আসে।হঠাৎ করে এমনটা হওয়ায় ভয় পেয়ে যায় নিরু।যার ফলে শক্ত করে ঝাপটায় ধরে রিহানকে।
তারপর অনেকক্ষণ যাবত মোচড়া মুচড়ি করে নিরু।কিন্তু কোনো ভাবেই রিহান ছাড়ছে না।অন্ধকারে কথা ও বলছে না।তবে নিরুর কাছে পারফিউমের স্মেল টা পরিচিত লাগে।
–রিহান :চুপচাপ শুয়ে থাকো নড়েচড়ে কোনো কাজ হবে না।
–নিরু:ইচ্ছে মতো কিল দিয়ে ছুটার চেষ্টা করে। তারপর না পেড়ে কান্না করে দেয়।একদম নরম হয়ে পড়ে।
–রিহান :আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে শুনেছি অতিরিক্ত রাগ হলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে হয়।এতে রাগ কমে।

–নিরু:ছাড়ুন আমায়।আপনি আমাদের বাসায় এসেছেন কেন?আমার অনুমতি ব্যতীত আমাকে আবার স্পর্শ ও করছেন?
–রিহান :সে জবাব তোমাকে দিবো কেন?আমি তো তোমায় জড়িয়ে ধরি নি,আমি আমার বউকে জড়িয়ে ধরেছি।
–নিরু:একদম ঠেলে তারপর উঠে দাঁড়ায়।ওড়না টা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেয়।তারপর লাইট টা অন করে।
–রিহান :এগিয়ে গিয়ে নিরুর হাত ধরতে গেলে নিরু সরে দাঁড়ায়।আবার ও ধরতে গেলে সরিয়ে ফেলে হাত।মুচকি হেসে বলে,,রাগ কমবে কিভাবে?
–নিরু:অন্য দিকে ফিরে বলে, কমবে না।
–রিহান :সোফায় বসে। একটানে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলে,,এতো রাগ?
–নিরু:হুম!আজকে কিন্তু বড্ড বেশি গায়ে হাত দিচ্ছেন।
–রিহান :তাই!কোথায় হাত দিচ্ছি?
–নিরু:সেদিন সন্ধ্যা বেলা একা একটা মেয়ে কে বাসা থেকে বের করে দিলেন,,আজকে মাঝরাতে এসে এসব করছেন?কান্না করতে করতে বলে আপনি কি চান?
–রিহান :নিরুর চোখে চোখ রেখে বলে,, সেদিন আমি চোখের সামনে থেকে যেতে বলেছি বাসা থেকে নয়।তাছাড়া আমার বন্ধু তোমার বাসা অব্দি পৌঁছানো পর্যন্ত পিছন পিছন ছিলো।
–নিরু:বিছানায় বসে বলে,কথা শেষ হলে আসতে পারেন।
–রিহান :আমার শ্বশুর বাড়ি আমি থাকবো না যাবো সেটা আমি বুঝবো।বউ মানুষ কই জামাইয়ের সাথে আষ্টেপৃষ্টে থাকবা তা না শুধু তাড়িয়ে দেওয়ার ধান্দা।এতো নাক ছিটকানো বউ কেন তুমি?

–এদিকে নিরব অনেক বার চেষ্টা করে ও রিফার সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি।ভিতরে ভিতরে প্রচুর ভয় হচ্ছে হাত ছাড়া হয়ে গেলো না তো?এখনো নিরু আর রিহানের জীবন ধ্বংস করা হয় নি।

–রিফা ভাইয়ের কথায় নিরবের সাথে যোগাযোগ আজকে রাখে নি।তাছাড়া এখন এসব কখনোই নিরু বলতো না শুধু মাত্র নিরব বুঝিয়েছে বলেই জানিয়েছে।তাছাড়া ওদের সম্পর্ক ও বেশি দিনের না।
একা শুয়ে আছে রিফা হঠাৎ নোটিফিকেশনের শব্দে ফোন টা অন করে।তারপর রাফির আইডি থেকে একটা ভিডিও আসে। রাফি হলো রিহানের বন্ধু।ভিডিও টা অন করে এক প্রকার মাথা ঘুরে যায়।রিহান আর নিরবের সেদিনের ঝগড়ার ভিডিও সাথে কিছু গোপন কথা নিরবের মুখ থেকে।
ভিডিও টা দেখা মাত্রই চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ে।সম্পর্কে জড়িয়েছিল নিরবের ব্ল্যাকমেইল স্বরূপ পাগলামি দেখে।এটা ওটা নিয়ে ভয় দেখাতো ওকে ছাড়া বাঁচবে না।কোচিং কলেজ সব কিছুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় থাকতো।এক পর্যায়ে রিফা বাধ্য হয়ে সম্পর্কে জড়ায়।কখনো এর আগে রিলেশন করে নি রিফা।যেহেতু প্রথম প্রেম খানিকটা আবেগ ও জন্মায়।তবে কয়েক দিন পর থেকেই ওর মনে হতো নিরবের তার প্রতি আবেগ কম লাগছে।আচরণে পরিবর্তন চলে আসছে।কিন্তু মনে হলেও মনকে পাত্তা দিতো না।
রিফার প্রয়োজনে নয় নিরবের প্রয়োজন হলেই যোগাযোগ করতো।বাসায় জানানোর জন্য এটা ওটা বলে পাগল বানিয়ে ফেলতো।

–এক পর্যায়ে নজরে আসে রাফির।কয়েকবার মেসেজে ওকে নিষেধ ও করে নিরবের সাথে না মিশতে।রিফা কথা দিয়ে ভাইকে না জানাতে নিষেধ করে রাফিকে।
রাফি রিহানের রাগ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হওয়ায় আর রিহান কে জানায় নি।এরপর ঠিক ঠাক প্রমাণ পেয়ে আজকে রিফাকে পাঠায়।

–ফোনে রিং হচ্ছে রিফা চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে।কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন টা হাতে নিয়ে দেখে রাফি কল করেছে।রিসিভ করে কানে ধরতেই রাফি বলে,, ঠিক আছো?
–রিফা:নিশ্চুপ!
–রাফি:কষ্ট পাচ্ছিস?সেদিন আমি ও ভীষণ কষ্ট পেয়েছি রিফু।সেই যখন ছোট্ট ছিলি তখন থেকে তোকে পছন্দ করতাম।রিহানের সাথে ছুতো ধরে তোদের বাসায় চলে যেতাম।যখন তুই ছোট্ট ছিলি কোলে ও নিতাম।যদিও আমি অতোটাও বড় ছিলাম না তবে তোর থেকে তো গুনে গুনে কয়েক বছরের বড়ো।আম্মু মাঝে মধ্যেই তোকে নিয়ে আসতো আমাদের বাসায়। তারপর বড় হলাম তুই বড় হলি তবে আমার নজরের বাইরে যেতে দেই নি।

–সময় বাড়লো রিহানের সাথে বন্ধুত্ব গাঢ় হলো,, আস্তে আস্তে ভয় ভীষণ বাড়ে।তোকে পছন্দ করি জানলে যদি রিহান বন্ধুত্ব নষ্ট করে দেয়?এই প্রশ্ন সারাক্ষণ মনে ঘুরতো।
তুই জানতি ও না আমি তোকে সব জায়গায় পাহারা দিতাম।মাঝে মধ্যে তোর নজরে পড়ে গেলে কতো কাহিনি বলে কেটে পড়তাম।তারপর আমার চাকরি হলো সেখানে সময় দিতে গিয়ে তিন মাস পেড়িয়ে যায়।এখানে ওখানে আর খোঁজ রাখার সময় হয়ে উঠে নি।নিরব সম্পর্কে ও অবগত ছিলাম না।
একদিন ছুটিতে এলাম।অনেকদিন পর রিহানের সাথে দেখা।বসে আড্ডা দিলাম দুই বন্ধু।এক পর্যায়ে রিহান বলে বসে।
–রিহান:তুই আর রিফাত আমার সব থেকে কাছের বন্ধু,, ভাবছি বোন জামাই বানিয়ে তোর সাথে সম্পর্ক টা আর ও মজবুত করবো।কি বলিস?
এই কথা শুনার পর ভীষণ আনন্দ হলেও রিহানের সামনে প্রকাশ করি নি।তবে লজ্জা পেয়েছি রিহান বুঝতে পেরেছে।জানি না রিহান কেন প্রস্তাব দিয়েছিল,,হয়তো আমার মনের ধারণা কিছু টা হলেও বুঝতে পেরেছিল।

–বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলে,,তিন দিন আয়নার সামনে প্র্যাক্টিস করে তারপর সামনে গিয়ে ছিলাম তোর।নিজের সাথে যুদ্ধ করে অনুভূতি প্রকাশ করে ছিলাম।এর আগে আমার ভিতরের এই গোপন খবর কাউকে বলি নি।
তুই প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও পরে সিরিয়াস ভেবে বলেছিলি,, অলরেডি রিলেশনে আবদ্ধ আছিস।
বিশ্বাস কর সেদিন এই শব্দ টা মনে হয়ে ছিলো পৃথিবীর সব থেকে যন্ত্রণা দায়ক শব্দ।

–সেদিন দ্বিতীয় বার উঠে তোর মুখের দিকে তাকায় নি লজ্জায়।তবে বাসায় এসে ভেবে মনে হলো তুই ভুলে আটকে আছিস।নিরব ভালো ছেলে নয় এবং রিহান নিরুর সাথে ও সম্পর্ক ভালো না।কয়েকবার তোকে বুঝালাম কাজ না হওয়ায় প্রমাণ জোগাড় করলাম।
এর ভিতরে রিহান কয়েকবার জিজ্ঞেস করে গেছে বিয়ের প্রস্তুতি কেমন বাসায় কথা বলবে কি না।আমি কথা কাটিয়ে ঘুরিয়েছি।
তবে যখন নিরবের সাথে তোর বিষয়ে কথা বলতে যাবে যখন আমায় বলেছিল রিহান। সেদিন অপরাধীর মতো ফেইসটা করে রেখেছিল আমার সামনে।

–রিফা:নিরব এতো বাজে আমার চোখে কেন পড়ে নি?
–রাফি:ধূলো দিয়ে রেখেছিল চোখে তাই।ভাবিস না আমি পছন্দ করি বলে মিথ্যা বলেছি।এগুলো সবটাই সত্যি রিফু।
–রিফা:কান্না করতে করতে বলে ,,বাজে একজন মানুষের জন্য আমি আমার পরিবারে অশান্তি ডেকে এনেছি ঝগড়া দূরত্ব তৈরি করেছি রাফি ভাই।কেন আমাকে নিরব এভাবে ব্যবহার করলো?আমি কি ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার মতো মানুষ?
–রাফি:সব জায়গায় ভালো কে কদর করতে জানে না।নিজের পিছনে সময় দিয়ে দেখো ঝাপটায় ধরে বুকে রাখার মানুষ আছে।তোমাকে ও কদর করার ভালোবাসার মানুষ আছে।শুধু মন থেকে কয়েক মাসের অধ্যায় টা মুছে ফেলো। নতুন বছরের মতো ক্যালেন্ডার পাল্টে কাল থেকে নতুন করে জীবন শুরু করো।
.
.
–রিহান:প্লিজ চলো বাসায় যেতে হবে এখন।
–নিরু:মাথা নুয়ে বলে,আমার কোনো বাসা নেই। লাগবে না বাসা।
–রিহান:এগিয়ে গিয়ে ফ্লোরে বসে নিরুর হাত ধরে বলে,,রাগ হলে ইচ্ছে মতো মারো একেবারে মেরে ফেলো তাও প্লিজ বাসায় ফিরে চলো।
–নিরু:অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলে বিয়ের আগে এমনটা কথা ছিলো না!
–রিহান:উঠে দাঁড়িয়ে নিরুকে ঠাস করে কোলে তুলে নেয়।তারপর লাইটটা বন্ধ করে বিছানায় চলে যায়।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে।এভাবে শক্ত করে ধরে থাকায় নিরুর নিশ্বাস ফেলতে ও কষ্ট হচ্ছে।

–রিহান:ওকে নিজের থেকে খানিকটা আলতো করে ছেলে এগিয়ে গিয়ে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দেয়।নিরুর নিশ্বাস ফেলতে আরও কষ্ট হয়।এবার বড় বড় করে নিশ্বাস ছাড়ে।রিহান ঘাড় থেকে আস্তে আস্তে নিচে নামতে গেলে কান্না করে দেয় নিরু।
রিহান নিরুর মুখে হাত দিয়ে বলে কি হয়েছে?তুমি কান্না করছো কেন?তোমার খারাপ লাগছে?
–নিরু:কান্না করতে করতে বলে,,যখন ইচ্ছে দূরে ঠেলে দিবেন আবার নিজের ইচ্ছায় ভালোবাসবেন এ কেমন আচরণ?
–রিহান:নিরুর চোখের পানি মুছে দিয়ে নিজের বুকের সাথে নিরুর মাথা টা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে।বড় বড় করে নিজেও নিশ্বাস ফেলে।

–নিরু এখন যেন রিহানের পুরো হার্টবিটের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।এইটুকু বুঝতে পারছে দুজনেরই হার্টবিট বেড়ে গেছে।

–খানিকক্ষণ চুপ থেকে রিহান এভাবেই থেকে পুরো ঘটনা খুলে বলে।নরম গলায় বলে আমার মানুষ আমাকে বুঝার মানুষ তো তুমি নিরু।তুমি যদি আমার রাগ অভিমান না বুঝো কোথায় যাবো?
অভিমান আর রাগ হলে অধিকার দেখাতে হয়,, সব সময় নৈশব্দে চলে এলে সম্পর্কে ফাটল ধরে।আমি জানি আমরা দুজনেই দুজনকে ভীষণ ভালোবাসি।তাহলে কাছের মানুষের থেকে অনুভূতি লুকিয়ে দূরে থাকার কোনো মানে আছে?
লজ্জা ভয় এসব শব্দ প্রিয় এবং ভালোবাসার মানুষের জন্য নয়।নিরুর কপালে চুমু খেয়ে বলে,,

–আমি চাই আমার নিরুপমা আমার রাগকে পাত্তা না দিয়ে,, আমার বদমেজাজে গরম পানি ঢেলে দিয়ে একেবারে ঠান্ডা করে দিক।আমি জানি আমার মতো পুরুষ কে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা আমার নিরুপমার আছে। শুধু সেটা একটু প্রয়োগ করুক আমার বউ।

#চলবে

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-১৫

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১৫]
-তামান্না

–রিফা:এগিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে নিরুকে আগলে ধরে।নিরু এখনো স্তব্ধ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।বুঝতে পারছে না ঠিক কি হয়েছে?বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তো এমন ছিলো না?চোখ দিয়ে আপনা আপনি কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।এমন দিন কেন বারবার ফিরে আসে? যা হজম করার ক্ষমতা উপর ওয়ালা দেয় নি এমন দিন কেন দেয়?কেন এমন পরিস্থিতি তে ফেলে।মনে মনে এই কথা গুলোই চিন্তা করে।

–রিহানের আম্মু এসে ডাকাডাকির পরে দরজা খুলে রিহান।নিরু রিফা রিহান ওর আব্বু সবাই উপস্থিত।থমথমে পরিবেশ।
–আম্মু :কি হয়েছে তোর?নিরুর সাথে এমন খারাপ ব্যবহার কেন করছিস?
–রিহান :নিশ্চুপ!
–রিফা:ককককি হয়েছে?
–রিহান :একদম চুপ।উঠে দাঁড়িয়ে বলে আমার আর ভালো লাগছে না।প্লিজ তোমরা আমায় ডিস্টার্ব করো না।আর রইলো এই মেয়ে নিরুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে,, একে আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলো।
–আম্মু :কি হচ্ছে কি?এগুলো কি ধরনের আচরণ রিহান?রাগ হয়েছে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করো।
–রিহান :অন্য দিকে তাকিয়ে বলে আমি নিরুর মুখ আজকের পর আর দেখতে চাই না আম্মু।আমি আর চাই না আর না।

–রিফা:এগিয়ে এসে ভাইয়ের পা ধরে বলে এমন করছো কেন ভাইয়া?দোষ করে থাকলে আমি করেছি আপুকে কেন শাস্তি দিচ্ছো?নিরুর দিকে তাকিয়ে বলে তুমি কেন কিছু বলছো না আপু?
–নিরু:অন্য পাশে এগিয়ে গিয়ে ফোন টা হাতে নিয়ে বলে,,আমি কেন কিছু বলবো?সব সময় আমার অবস্থান এভাবে না বুঝিয়ে দিলে ও তো হয়।সব থেকে ভালো হয় আমার গন্ডির বাইরে থাকলে এতে কষ্ট কম হয়।এগিয়ে গিয়ে শ্বাশুড়ির পাশে দাঁড়ায়।

–শ্বাশুড়ি :এমন করো না। রিহান রেগে বলেছে একটু পর সব ঠিক হয়ে যাবে।এগিয়ে গিয়ে রিহান কে জিজ্ঞেস করে নিরুর অন্যায় টা কি?
–নিরু:মাফ করবেন মা,আমি প্রতিবাদ করে কিংবা নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে আগ্রহী নই।আমি সব থেকে বেশি পছন্দ করি বিনা শব্দে জায়গা ত্যাগ করা।যেখানে আমার প্রয়োজন নেই সেখানে শব্দ ব্যবহার করেই বা কি হবে।অভিমানে মাথা নুয়ে আসছি বলে বের হয়ে যায়।রিহান একবার ও পিছনে ফিরে তাকায় নি।

–রিফা আর শ্বাশুড়ি পিছন পিছন আসলে ও নিরু শুনে নি কারো কথা।সন্ধ্যা হয়ে গেছে সেই কতক্ষণ। দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির জন্য।কিছু নিয়ে আসে নি।ফোন টা শুধু,ফোনের কভারের ভিতরে কয়েক টা টাকা আছে এ দিয়েই হয়ে যাবে।

–রিহান জানালা দিয়ে নিরুপমা কে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে।একবার ও কেন কিছু জিজ্ঞেস করলো না?তবে কি নিরব যা বলেছে তাই সত্যি? নাকি আগের মতোই সব সময় নিরু অভিমানে সবটা মেনে নৈশব্দে জায়গা ত্যাগ করলো?দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বলে, কোনটা সত্যি?আমি কি বিশ্বাস করবো,, কাকে বিশ্বাস করবো?পুরো রুমের জিনিস পত্র ছুড়ে ফেলে দেয়।

–একা রাতের শহরে কখনো চলাচল করা হয় নি নিরুর।তেমন একটা অভিজ্ঞতা ও নেই।আজকেই প্রথম,, ভীষণ ভয়েই ছিলো পুরো রাস্তা।তারপর আবার বোরখা হিজাব ছাড়া বের হওয়া।খানিকটা সময় লাগলে ও রিকশায় করেই আসে। মুরব্বি লোকের রিকশায় উঠে খানিকটা স্বস্তি পায়।পুরো রাস্তা কান্না করতে করতে এসেছে।কিভাবে রিহান পারলো এই সন্ধ্যা বেলা বাসা থেকে বের করে দিতে।একটা বার পিছনে তাকালো না?এখন বাসায় ফিরে কি জবাব দিবে আম্মু কে?

.
.
–রিফা:আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে নিরব!তারপর পুরো ঘটনা টা খুলে বলে। নিরব মনে মনে খুশি হলেও মুখে প্রকাশ করে নি।আর বলে ও নি যে রিহানের সাথে দেখা হয়েছে।
–নিরব:আচ্ছা!দেখছি সবটা কিভাবে সামাল দেওয়া যায়।রিহান হয়তো এখনো আমাকে ভুল জানে কিন্তু তুমি তো জানো আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি।
–রিফা:কান্না করতে করতে বলে,, প্লিজ তুমি একটু নিজেকে প্রমাণ করো ওদের সামনে।তাহলে সব কিছু সহজ হয়ে যাবে।আমাদের সম্পর্ক মেনে নিবে।আমার জন্য অযথা ওদের মধ্যে সমস্যা হলো।এটা আমি সত্যি চাই না।
–রিহান :মনে মনে বলে,, কিন্তু আমি তো চাই।মুখে শয়তানি হাসি টেনে কল কেটে দেয়।

–এদিকে বাড়িতে ফিরে এসেছে আজকে দুই দিন।নিরু রুম আর খাওয়ার টেবিল ছাড়া একবার ও মায়ের মুখোমুখি হয় নি।কিছু জিজ্ঞেস করলে ও উওর দেয় না।রিহানদের বাসায় ফোন দিতে বললে নিষেধ করে দেয়।

–রাতে ছাঁদে বসে আছে একা।পূর্ণিমায় চারপাশ টা জ্বলজ্বল করছে।আকাশের দিকে নিরবে চোখের পানি ফেলছে।কেন সে বারবার ভুল করে। রিহান তো কোনো দিন ও ভালোবাসে নি।যদি বাসতো তাহলে কখনো রাতের বেলা বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলতো না।বাড়ি এসেছে আজকে দুই দিন একটা বার কল পর্যন্ত করলো না।আচ্ছা ভালোবাসলে কি এমন নিষ্ঠুর হওয়া যায়?মনে হাজারও প্রশ্ন জমে আছে।

–এদিকে নিশার ফোনে খোঁজ নেওয়ার জন্যই মাত্র কল করলো রিহান।রাগ জমলে ও মুছে তো ফেলবে না।হয়তো এখনো রাগ শেষ হয় নি তবে ভুলে ও তো যাওয়া যাবে না।
নিশা কলে রেখেই ছাঁদে আসে।ফোন টা হাতে রেখেই বোন কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,,
–কি করছো?
–নিরু:আনমনা হয়ে বলে,,আব্বুর সাথে কথা বলছি।
–নিশা:কি কথা বলছো?
–নিরু:জিজ্ঞেস করছি কেন আমাকে একা রেখে চলে গেলো?আব্বু যাওয়ার পর তো আমায় আর কেউ বুঝে নি।সাথে কেন নিয়ে গেলো না?আমার জন্যই তো সবার জীবনে অশান্তি।আমার জন্যই আজ তোরা বাড়ি ছাড়া,, আমার জন্যই তো নিরব ভাইয়া এতো কিছু করছে।কথাটা বলেই কান্না করে দেয়।
–নিশা:বোকা।তুমি জানো তুমি আছো বলেই আমাদের জীবন এতো সুন্দর।তুমি ভালো হয়ে জন্মেছো বলেই মন্দ লোক হাত বাড়ায়।ভালোদের লড়াই করেই বাঁচতে হয়।জীবনে যুদ্ধ না করলে বিজয়ের স্বাদ পাবে কি করে? ভাইয়ার সাথে কিছু হয়েছে?
–নিরু:চোখের পানি মুছে বলে,,জানি না।তবে হয়তো নিরব ভাইয়া কিছু বলেছে,,কি বলেছে তাও জানি না।তবে এটুকু জানি আমি তার প্রিয় মানুষ নই।দূরের বলেই বের করে দিয়েছে।কথাটা বলেই তাড়াতাড়ি করে ছাঁদ থেকে নেমে আসে নিরু।

–নিশা:শাসনের সুরে বলে কি করেছো আবার? আমার বোনকে সহজ সরল পেয়ে শুধু কষ্ট দাও তাই না?
–রিহান :বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলে,,আবার ভুল করে ফেলেছি।আমার কি শাস্তি হওয়া উচিত বল তো?তারপর পুরো ঘটনা খুলে বলে যে,,নিরব সেদিন বলেছে নিরুই রিফাকে ওর হাতে তুলে দিয়েছে নিজের সেফটির জন্য।প্রমাণ স্বরূপ নিরুর সাথে রিফা আর নিরবের ছবি দেখায়।
–নিশা:কিহ?তুমি বিশ্বাস করে নিলে?তোমার তো মিয়া শাস্তি স্বরূপ আজীবন বউ ছাড়া থাকা উচিত। আমি বাবা কোনো শত্রু পক্ষ নই আমার বোনের,, যে তোমার মতো অবিশ্বাসের বস্তার হাতে তুলে দিবো।

–রিহান :আপাতত রাখছি পরে কথা হবে।কলটা কেটে রিফার কাছে যায়।
–রিফা:কিছু বলবে,, এতো রাতে?
–রিহান :ভয় পাস না।আমি কিছু কথা জিজ্ঞেস করবো উওর চাই।
–রিফা:ববববলো?
–রিহান :নিরবের সাথে পরিচয় কিভাবে?
–রিফা:ভয় পেলে রিহান আশ্বাস দিয়ে বলে কিছু বলবো না।তারপর বলে কোচিং করার সময় প্রায় দাঁড়িয়ে থাকতো।এটা ওটা বলে ডিস্টার্ব করতো।তারপর একসময় বান্ধবীর থেকে নাম্বার নিয়ে কল করে বিরক্ত করা শুরু করে।তবে নিরব প্রথম থেকেই জানতো আমি যে তোমার বোন।তারপর আস্তে আস্তে এভাবেই এটা ওটা বলে হাত কাটে পাগলামি করে অবশেষে সম্পর্কের শুরু।

–রিহান :মাথা নুয়ে বলে আর নিরু?ওর সাথে তুই নিরু একসাথে কখনো দেখা হয়েছে?
–রিফা:মাথা নেড়ে বলে নাহ।কখনো নামটা ও নেওয়া হয় নি আপুর।
–রিহান ফোন থেকে একটা ছবি বের করে বলে তাহলে তোদের সাথে বোরখা পড়া এই মেয়ে টা কে?
–রিফা:ও তো অনন্যা।আপুর মতো খানিকটা দেখা যাচ্ছে কিন্তু হাত দেখো,,আপু তো সব সময় চুড়ি পড়ে।কিন্তু তোমার এমনটা মনে হলো কেন ভাইয়া?
–রিহান :বোনের মাথায় হাত রেখে বলে এই কয়দিন বাসা থেকে বের হবি না,,আমি অবশ্যই তোর জন্য যা কল্যানকর তা করবো।যাকে নিয়ে সুখী হবি আমার বোনের তার সাথেই বিয়ে হবে।প্লিজ অবাধ্য হোস না।রিফা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

***************
–রাত বারোটা নিরুর ফোন বাজছে।আজকে পাশে নিশা নেই অথচ বিয়ের আগে একসাথে থাকতো।নিশা এখন মায়ের সাথেই থাকে।যদি ও নিরু একাই থাকতে চাচ্ছিলো।ফোন মিউট করে রাখায় প্রথমে বুঝতে পারে নি যে কল বাজছে। তবে দুই একবার রিং হওয়ার পর ফোনের আলোয় বুঝতে পারে।হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে রিহান কল করেছে।
দুই তিন বার কল কেটে দেয়।তারপর মেসেজ আসে কল রিসিভ করো।
এরপর আর কল আসে নি কারণ নিরু সুইচড অফ করে রেখেছে।

–এদিকে রিহান বাসার নিচে দাঁড়িয়ে কল করছিল।রিসিভ না করায় নিশাকে কল করে। তারপর নিশা দরজা খুলে দিলে ভিতরে আসে।
–নিশা:বর হিসেবে খুব বাজে তুমি।বউয়ের রাগ ভাঙাতে আসলে দুই দিন পর।বউ কিন্তু একা একা অপেক্ষা করছে বর গিয়ে ঝাপটায় ধরবে বলে।
–রিহান :কানটা মুলে বলে পাকা হয়ে গেছিস?গিয়ে দোয়া কর রাগটা যেন ভাঙাতে পারি ওকে?তারপর নিশা হাসতে হাসতে চলে যায়।

–রিহান চুপচাপ এসে দেখে দরজা খুলাই আছে। রুমে গিয়ে আগে দরজা টা আটকে নেয়।নিরু তাড়াতাড়ি করে চোখের পানি মুছে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে বলে,, এতো রাতে আসলি কেন?আমি একাই ঠিক আছি।
–রিহান :এগিয়ে গিয়ে পাশে শুয়ে এক টানে কাছে নিয়ে আসে।হঠাৎ করে এমনটা হওয়ায় ভয় পেয়ে যায় নিরু।যার ফলে শক্ত করে ঝাপটায় ধরে রিহান।

#চলবে

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-১৪

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১৪]
-তামান্না

রিহান:সালাম দিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একজন অপরিচিত মানুষের গলার শব্দ শুনতে পায়।কিছু একটা শুনে হাত থেকে ঠাস করে ফোন টা নিচে পড়ে যায়।
নিরু মাত্রই রুমে এসেছে।ফোন পড়ে যেতে দেখে মোবাইল টা হাতে নেয়।নিয়ে দেখে অচেনা নাম্বার। কয়েকবার হ্যালো বলার পর কেউ একজন বলে নীলা আর রিফাত এক্সিডেন্ট করেছে,, দুজনেরই অবস্থা খুবই গুরুতর।বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম।আর যে ফোন করেছে সে হলো রিফাতের কাজিন নয়ন।

–নিরু ফোন টা টেবিলের উপর রাখতেই স্যান্সলেস হয়ে পড়ে যেতে নিলে রিহান ধরে ফেলে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজে ও বসে পড়ে নিচে।

–সবচেয়ে কাছের মানুষের মধ্যে একজন হলো রিফাত।তার এমন বাজে পরিণতি শুনে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।কেমন যেন ফাঁকা লাগছে।ফাঁকা বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিরুকে।

–বাসা থেকে মানবে না মানবে না করে কতো যুদ্ধ পেড়িয়ে গত সপ্তাহে ওদের বিয়ের কাবিন হলো। দুটি ভালোবাসার পরিণত হলেও একসাথে বাঁচা হলো না একজীবন।আফসোস ভালোবাসা এবং খাঁটি ভালোবাসা গুলো অকালেই ঝড়ে গেলো।অথচ চারপাশে এতো বিশ্বস্ত এবং খাঁটি মানুষ আজকাল পাওয়া যায় না।

–হঠাৎ করেই বুকটা কেঁপে ওঠে নিরুকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা ও করে না রিহান।মাথা সোজা করে দেখে সেন্স নেই,, তাড়াতাড়ি করে বিছানায় শুয়ায় পানি এনে চোখে মুখে দেয়।
নিরুর জ্ঞান ফিরতেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিহান। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,তুমি যাবে হসপিটাল?তোমার বেশি খারাপ লাগছে?
–নিরু:প্রিয় মানুষ গুলো এমন কেন?খুব সহজেই ছেড়ে চলে যায়।ওদের ছাড়া আমাদের যে কষ্ট হয় বুঝে না কেন?আচ্ছা! ওরা কি নিজ ইচ্ছায় আমাদের ছেড়ে চলে যায়?

–রিহান:জীবনের আয়ু ফুরিয়ে গেলে কিভাবে থাকবে বলো?ওদের কিছু হবে না চলো তোমাকে সাথে নিয়ে যাবো।তারপর দুজনে এভাবেই বেড়িয়ে যেতে নিলে রিহান এসে নামাজ পড়ার হিজাব টা দিয়ে বলে এটা পড়ে নাও।
.
.
–এক ঘন্টা পর হসপিটালে এসে পৌঁছায় রিহানরা এসে দেখতে পায় ওদের আত্মীয় স্বজনরা চলে এসেছে।সবাই কান্না কাটি করছে। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে দুজনেই মা-রা গেছে।

–তারপর এখান থেকে সবাই রিফাতদের বাসায় চলে যায়।ওখানে দাফন দিতে দিতে পরদিন বিকেল হয়ে যায়।নিরুর বাড়ির মানুষ রিহানদের বাসার মানুষ সবাই এসেছে।
–রিহান:নিরু!এবার বাসায় চলো?ফ্রেশ হতে হবে তো!
–নিরু:নীলা রিফাত ভাইয়া অনেক আরামে আছে বলেন? পৃথিবীর সাথে আর যুদ্ধ করতে হবে না।
–রিহান:এগিয়ে এসে নিরুর মাথা ওর পেটে চেপে ধরে। নিরু বসে থাকায় আর রিহান দাঁড়িয়ে থাকায় এভাবেই ধরতে হয়েছে।নিশা আর রিফা ও এগিয়ে এসে অনেক কষ্টে ওকে নিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে আসে।

সারা রাস্তা নিরবে শুধু চোখের পানি ফেলেছে আর একটু পরপর হেঁচকি দিয়েছে।যতই সবাই বুঝাক মন কি আর মানে।প্রিয় মানুষ গুলোর শূন্যতা যে ভীষণ কঠিন।

*********-
–ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ আনমনা হয়ে বেলকনিতে বসে আছে নিরু।কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। নিশা আর রিফা রুমে আসে।এগিয়ে এসে নিরুর পাশে বসে।
–রিফা:কিছু করার নেই আপু।জীবনে সবচেয়ে চরম সত্যি মৃত্যু সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে। প্লিজ তুমি একটু স্বাভাবিক হও।
–নিশা:বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,,কষ্ট পেও না।
–নিরু:চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।জোর পূর্বক হেসে বলে,একদিন আমি ও হারিয়ে যাবো।আচ্ছা!যদি এমন অকালে হারিয়ে যাই কেমন হবে?
–রিহান :ভালোই হবে।নীলা আর রিফাতের মতো তোমার আর আমার জানাজা এক সাথে সবাই মিলে পড়ে যেতে পারবে।রিফা আর নিশা উঠে চলে যায়।

–নিরু এবার শব্দ করে কান্না করতে থাকে।রিহান এগিয়ে এসে পাশে বসে বলে,,মৃত্যু চিরন্তন সত্যি। তবে হয়তো অকালে ঝড়ে গেছে দুটি প্রাণ কিন্তু ভালো কিন্তু একটা হলেও উপর ওয়ালা করেছে।

“নিরু:যেমন?
–রিহান :ভেবে দেখো রিফাত আর নীলা যথেষ্ট কষ্ট করে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে।ওদের ভালোবাসা মনে গেঁথে যাওয়ার মতো।আজকে যদি একজন মা-রা যেতো তাহলে?তাহলে অন্য জন বেঁচে থাকলে ও জীবনের কোনো স্বাদ পেতো না।ভালোবাসা হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকা সহজ না।এর থেকে ভালো দুজনের ভালোবাসার সমাপ্তি একসাথে থেকেই হয়েছে।হয়তো কষ্ট অনেক তবে মেনে তো নিতেই হবে বলো?
–নিরু:আমি যদি হঠাৎ করে মা-রা যাই?আমার জন্য তো কারো জীবনের স্বাদ চলে যাবে না?
–রিহান :নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে উঠে দাঁড়ায়। রুমে গিয়ে পাশে থাকা ফুলদানি টা ছুড়ে মারে ফ্লোরে।সাথে সাথে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

–নিরু চোখে পানি নিয়ে ও জোর পূর্বক হাসে।এর মধ্যে রুমে আসে মিরা।
–মিরা:আসার পর তো তোর বউয়ের সাথে কথায় হলো না রিহান।জানি তোদের ভীষণ মন খারাপ নিরুপমা কই?
–রিহান :সাবধানে পা কেটে যাবে।প্লিজ মিরা আমি মারতে পারছি না তুই একটু আমার হয়ে ফাজিল মেয়ের গালে দুটো থাপ্পড় দিয়ে দিছ তো।
–মিরা:চারপাশে তাকিয়ে বলে এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে?
–নিরু:বেলকনি থেকে এগিয়ে এসে সালাম দেয়। মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করে ভালো আছে কি না!

–মিরা:বাহ্ খুব মিষ্টি বউ পেয়েছিস তো।আসো আমার পাশে বসো।এগিয়ে গিয়ে মিরার পাশে বসে নিরু।সুন্দর করে ওড়না দিয়ে শরীর ঢেকে নম্র ভদ্র একটা মিষ্টি মেয়ে মাথা নুয়ে বসে আছে। আড় চোখে কয়েকবার দেখে নেয় রিহান।মনে মনে বলে মনে হচ্ছে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না।অথচ আমাকেই ভেজে ফেলে।

–মিরা:হাসতে হাসতে বলে ভাই!তোর বউ তুই সারাজীবন দেখতে পাবি চুরি করে নিয়ে যাবো না।
এবার রিহান লজ্জা পেয়ে যায়।এরমধ্যে কাজ করে যে আন্টি রুম পরিষ্কার করে দিয়ে যায়।

–মিরা:এতো সহজ সুন্দর বউ পেয়ে ও রাগ হয় কেমনে?একটু তো কন্ট্রোল করতে শিখ নিজেকে!
–রিহান:সহজ?তুই নিরুপমা কে সহজ বলছিস? তুই জানিস তোকে আর আমাকে ও সন্দেহ করতে ছাড়ে নি এই পাকা মেয়ে।

–নিরু এবার চোখ বড় বড় করে রিহানের দিকে তাকায়।মিরা হাসতে হাসতে বলে,,সত্যি নিরুপমা?
–নিরু:দ্রুত মাথা নেড়ে বলে না না।
–রিহান :আচ্ছা!তবে মনে মনে স্বস্তি নাও মিরা বিবাহিত মহিলা!তারপর হাসতে থাকে।
–মিরা:বিয়ে হয়েছে বলেই মহিলা হয়ে গেলাম?
–নিরু:দেখলা আপু কেমন সে?
–রিহান :তো!
–নিরু:মহিলা বলা হয় আম্মু চাচিদের বয়সী লোকদের।
.
.
কয়েকদিন পর,,
–রিফা:তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো ভাইয়া!
–রিহান :হুম!বলে ফেল,আমার সাথে কথা বলতে আবার কবে অনুমতি নিয়েছিস?
–নিরু ও খানিকটা চমকে যায়।যে মেয়ে সব সময় বকবক করে ভাইয়ের সাথে সে কিনা আজকে অনুমতি নিতে আসছে?
–রিফা:জানি তুমি রেগে যাবে।কিন্তু আমার কিছু করার নেই।আমি অনেক ভেবে দেখেছি।
–রিহান :ল্যাপটপ টা বন্ধ করে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে কি?
–রিফা:চোখ বন্ধ করে বলে আমি একজনকে ভালোবাসি ভাইয়া।
–নিরু:সাথে সাথে মুখ টা মলিন করে বলে,, কে সে?
–রিফা:আমি ওকেই বিয়ে করতে চাই।রিহান একবার নিরুর দিকে তাকায় আবার বোনের দিকে তাকিয়ে বলে,,আচ্ছা!পরিচয় করিয়ে দিস দেখি ভালো হলে সমস্যা নেই।

–রিফা:তুমি তাকে ভালো ভাবেই চেনো।কিন্তু বিশ্বাস করো ভাইয়া সে পাল্টে গেছে।আমাকে বলেছে কখনো বাজে কাজ,, ব্যবহার করবে না।

–রিহান :ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে কে সে?
–রিফা:চোখ বন্ধ করে বলে নিরব ভাইয়া।সাথে সাথে মনে হলো একটা কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে।চোখ খুলে দেখে চেয়ার টা ছিটকে পড়ে আছে সাথে জিনিস পত্র ও।
–নিরু:প্লিজ!শান্ত হও তোমরা।রিফাকে দু’হাতে আগলে ধরে বলে মজা করে বলেছে হয়তো।
–রিহান:চিৎকার করে বলে,ওর সাহস হয় কি করে?রিহানের চিৎকারের শব্দ শুনে ওর আব্বু আম্মু ও চলে আসে।

–তারপর ছোট খাটো একটা ঝড় বয়ে যায় পুরো বাড়িতে।রিফা কান্না করতে করতে যে রুমে গিয়ে দরজা আটকে রেখেছে।নিরু সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছে খুলছে না।

********************************************–রিফার কান্ড দেখে দেখা করতে বাধ্য হলো রিহান।নয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে।মুখোমুখি বসে আছে নিরব রিহান আর এক বন্ধু।

–রিহান :ঠান্ডা মাথায় বলে ,, তোর সাথে আমাদের শত্রুতা তুই এরমধ্যে রিফা কে কেন জড়াচ্ছিস?
–নিরব:কেন?ভুল হয়ে গেছে বুঝি?প্রিয় মানুষ গুলোতে হাত বাড়ালে কেমন লাগে?খুব কষ্ট হয় বুঝি?

–রিহান :দাঁতে দাঁত চেপে বলে সন্ধান পেলি কোথায়? তোর সাথে তো রিফার যোগাযোগ হওয়ার মতো সুযোগ সুবিধা নেই?

–নিরব:হাসতে হাসতে বলে,,নরম খেলোয়াড় ভেবেছিস?একেবারে পিষে দেবো।

একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়ে যায়।চারপাশের কয়েকজন এগিয়ে এসে থামায়।কিন্তু লাস্ট কথার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না রিহান।দুকদম পিছিয়ে পড়ে যেতে নিলে ধরে ফেলে ওর বন্ধু।
কোনো রকম তর্কে না জড়িয়ে চুপচাপ চলে আসে বাসায়।

–নিরু:কি হয়েছে?এমন অস্বাভাবিক লাগছে কেন তোমায়?নিরব ভাইয়া কি বলেছে?দেখা হয়েছে?আরও কিছু বলতে নিলে এর আগেই ঠাস করে থাপ্পড় মা’রে রিহান।ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দরজা আটকে ফেলে ভিতর থেকে।
–রিফা:এগিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে নিরুকে আগলে ধরে।নিরু এখনো স্তব্ধ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।বুঝতে পারছে না ঠিক কি হয়েছে?বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তো এমন ছিলো না?চোখ দিয়ে আপনা আপনি কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।এমন দিন কেন বারবার ফিরে আসে? যা হজম করার ক্ষমতা উপর ওয়ালা দেয় নি এমন দিন কেন দেয়?কেন এমন পরিস্থিতি তে ফেলে।মনে মনে এই কথা গুলোই চিন্তা করে।

#চলবে

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-১৩

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১৩]
-তামান্না

–নিরু:রিহানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে এতো হাইপার হচ্ছেন কেন?কে হই আমি আপনার?আমার হাত কেটে যাক মা-রা যাই আপনার কি?আপনার তো রূপবতী ধবধবে সাদা বালিকা রুপী নব্য প্রেমিকা আছে।আমি তো কুৎসিত আমার জন্য এমন করছেন কেন??
–রিহান :দুই হাতে নিরুর দুই বাহু চেপে ধরে বলে সেটা আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই।
–নিরু:মানুষ দেখছে ছাড়ুন!
–রিহান :দেখুক!তোমার পাড়ার মানুষজন যে তুমি কতোটা অসভ্য স্বামীর কথা অব্দি শুনো না।
–নিরু:আপাতত স্বামী স্ত্রীর কথা শুনছে না।রাগ করে চলে যাচ্ছে।
রিহান ছেড়ে দিয়ে কতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
–রিহান :বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলে বাসায় ফিরে চলো?
–নিরু:চলেন!
–রিহান :আমাদের বাসায়।
–নিরু:নাহ্।এক সপ্তাহ ছুটি দিয়েছেন আম্মু।
–রিহান :খানিকটা মন খারাপ করে বলে আচ্ছা।

–খাওয়া দাওয়া শেষ করে বের হয়ে যায় শ্বাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে।যাওয়ার আগে একবার ও নিরুর সাথে কথা বলে নি।
.
.
–এভাবেই বাবার বাড়ি তে এক সপ্তাহ কেটে যায়। রিহান ফোন ও করে নি একবার আসে ও নি।তবে মায়ের সাথে কথা হয়েছে নিরুর।আজকে শ্বশুর শ্বাশুড়ি রিফা ওদের বাসায় বেড়াতে আসবে।এবং নিরু কে নিয়ে যাবে।নিরুর মা ও এখন সুস্থ।

–নিশা:রিহান ভাইয়ার সাথে কি ঝগড়া হয়েছে?
–নিরু:তার সাথে কবেই বা ভাব ছিলো?
–নিশা:এতো প্রশ্ন করলে বাচ্চাদের ব্রেণ নষ্ট হয়ে যায় জানিস না?প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন নয় উওর চাই।
–নিরু:মন খারাপ করে বেলকনির গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে বলে,, তুই আম্মু আর আব্বুর মতো কেউ আমাকে বুঝে না।রিহান সে তো প্রশ্নই আসে না।
–নিশা:সমাধান করা যায় না?
–নিরু:চমকে গিয়ে পিছনে ফিরে ভয় পাওয়ার কন্ঠে বলে তুই কি ডিভোর্সের কথা বলছিস?আমি আমার জীবন থাকতে এসবে যেতে পারবো না।
–নিশা:বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে বোকা।বাবা মায়ের বড় সন্তান যে বোকা থাকে তা তোকে দেখে শিউর হলাম।সমাধান মানেই কিন্তু বিয়োগ নয়।বিয়োগে বিচ্ছেদ আর সমাধানে শান্তি।মিলন বুঝলি।আমি বলছি প্রকাশ কর কাছে টেনে নে দেখবি সুখ কাকে বলে।

–রিফা:ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলে শুনে ফেলেছি। বুঝলে ভাবি,তোমার বিচ্ছু বোনকে বরং বিয়ে দিয়ে দাও বেচারি সুখের সাথে আষ্টেপৃষ্টে থাকতে চাচ্ছে।
–নিশা:বোনকে ছেড়ে দিয়ে বলে বাজে চিন্তা ভাবনার লোকজন কোথাকার।খারাপ লোক সর।
–নিরু:হয়েছে এবার থামো।কখন এলে?আব্বু আম্মু কোথায়?
–রিফা:বিয়াই বিয়াইনরা বসে আড্ডা দিচ্ছেন।

–নিশা:ভাইয়া আসে নি?
–রিফা:চোখ টিপ দিয়ে বলে বাসায় কাজিন এসেছে একা রেখে আসতে চায় নি।আমার মামাতো বোন ভাইয়ার সাথে বন্ডিং ভালো তাই আড্ডা দিচ্ছে।
–নিশা:কি বলিস?দেখতে কেমন রে?একা একটা বাড়ি তে ছেলে মেয়ে, একা কিভাবে রেখে এলি?
ইশ আমার তো ভয় করছে একটা মাত্র বোনের জামাই বল।
–নিরু:তোরা থামবি।রাগ দেখিয়ে চলে যায়।

–এদিকে রিহান ইচ্ছে করেই দূরত্ব তৈরি করেছে। অফিসের কাজেই ব্যস্ত রেখেছে নিজেকে। মামাতো বোন এসেছে বাসায় বেড়াতে সাথে ওর বর।বর হলো ওদের খালাতো ভাই। দুজনেই রিহানের ক্লাসমেট এবং বন্ধু।সুতরাং ভীষণ ভালো সম্পর্ক।
নিরুদের বাসায় অনেক বার যেতে বলেছে কিন্তু মাহিন(বর)একটু অফিসের কাজে ট্যুরে যাবে তাই মিরা(বউ)কে নিয়ে বের হবে।বিকেলে মিরা বাসায় চলে আসবে আর মাহিন ট্যুরে চলে যাবে।মাহিন ফিরে এলেই মিরা কে নিয়ে নিজেদের বাসায় ফিরবে এই কয়দিন মিরা ওর ফুপ্পির বাসাতেই থাকবে।

–নিরুরা বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়।এসে দেখে কেউ নেই।তারপর রুমে চলে যায়।। পুরো রুম খুব সুন্দর ভাবে গুছাতে থাকে। পুরো রুম এলোমেলো হয়ে আছে।
–রিফা :কি করছো?
–নিরু:তোমার খাচ্চোর ভাই কি অবস্থা করে রেখেছে দেখো!
–রিফা:ওহ আচ্ছা!এখানে মিরা আপু ভাইয়া আড্ডা দিয়েছে এই কয়দিন।বাসায় ফিরে নি আপুর সাথে বাইরে আছে।
–নিরু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবার কাজ করতে থাকে।এই মিরা টা কে দেখতে হবে তো।আচ্ছা এটাই কি তার বালিকা প্রেমিকা নাকি?কিছু একটা ভেবে বলে।

–নিরু:আচ্ছা রিফা তোমার মিরা আপুর বয়স কেমন দেখতে কেমন গো?
–রিফা:কোনো রকম হাসি আটকে রেখে বলে,, ভাইয়ার বয়সীই তবে ধবধবে ফর্সা।চেহারা কাটিং ভালোই।
–নিরু:ওঁরা প্রতিদিনই বাইরে বের হয়?
–রিফা:হ্যাঁ!কলিং বেলের শব্দে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় রিফা।
.
.
–রিহান :খাবারের প্যাকেট গুলো ড্রয়িং রুমে রেখে বলে খাবার নিয়ে এসেছি সবার জন্য।নিরু রান্না ঘরে থেকে সবটা শুনে।
–রিফা:এতো রাত হলো যে?
–রিহান :হয়েছে এমনি।সর বলে রুমে চলে যায়। মিরা আগেই চলে গেছে।
–রিফা:ফিসফিস করে বলে বউ কিন্তু চটে আছে।
–রিহান :ফিসফিস করে বলে কেন?
–রিফা:মেয়ে নিয়ে রাত বিরাতে ঘুরছো বলে।তারপর মিটিমিটি হাসতে থাকে।রিহান ও মুচকি হেসে চলে যায়।

–এদিকে রেগে রেগেই খাবার গুলো খুলে রাখে।রিহানের চেহারা খানা দর্শন করার জন্য রুমে আসে।
–রিহান :ফর্মাল ড্রেস আপেই শুয়ে আছে।নিরুকে দেখে চমকে যাওয়ার ভান করে বলে, তুমি? তুমি কখন এলে?
–নিরু:সেটা না জানলে ও চলবে।বউ তো আর চারপাশে কম অভাব পড়ছে না!
–রিহান :সেটাই তাহলে তুমি আসলে কেন?আমি তো বলিনি তোমায় প্রয়োজন।
–নিরু:তেড়ে গিয়ে শার্টের কলার টা ধরে বলে এখন তো প্রয়োজন হবেই না।বিয়ে করার সময় তো তা মনে হয় নি।তারপর আবার হঠাৎ করেই নরম গলায় বলে,আসলে আমারই ব্যর্থতা।মায়ায় জড়াতে পারি নি।আমি শুধু কলঙ্ক বয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা নিয়েই জন্মেছি ভালোবাসা নয়।হুট করে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।রিহান স্তব্ধ হয়ে গেছে।পাঁচ মিনিট এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলো।

–নিরু কতক্ষণ দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলে।তারপর চোখ মুছে বের হয়ে আসে রুম থেকে।

–মাথায় লম্বা করে ঘুমটা টেনে চুপচাপ সবাই কে খাবার বেড়ে দেয়।সবাই খেতে বসেছে রিহান ও।তবে মিরা রুম থেকে বের হয় নি।
–শ্বাশুড়ি :নিরু ও বসে পড়ো একসাথে খেয়ে ফেলি সবাই।
–নিরু:আমি খাবো না।ভালো লাগছে না আম্মু।
–রিহান উঠে হাত ধুয়ে চুপচাপ চলে যায়।
–শ্বশুর :এর আবার কি হলো?
–নিরু:খাবার রুমে দিয়ে আসবো আব্বু।

–সবাই খেয়ে চলে গেলে সুন্দর করে গুছিয়ে খাবার প্লেটে নিয়ে রুমে আসে নিরু।অন্য দিকে ঘুরে আছে রিহান চুপচাপ প্লেট টা রেখে বলে খাবার রেখে গেলাম। রিহান এদিকে ফেরার আগেই বেড়িয়ে যায় নিরু।
নিরু আজকে রিফার সাথে থাকবে বলে ওর রুমে চলে এসেছে।
–রিফা:ঝগড়া হয়েছে তোমাদের?
–নিরু:বিছানায় শুতে শুতে বলে, নাহ্।ভালো লাগছে না নিশাকে ভীষণ মিস করছি তাই তোমার সাথে থাকতে চলে এসেছি।তারপর শুয়ে শুয়ে দুজনে অনেক গল্প করে।

–এদিকে রিহান অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কিন্তু নিরু ফিরে আসছে না দেখে উঠে খুঁজে।কোথাও না পেয়ে রিফার রুমে আসে।এসেই লাইট অন করে ফেলে।
আচমকা লাইটের আলোয় উঠে বসে রিফা আর নিরু।
–রিহান:এই রুমে কি করছো নিরু?
–নিরু:ঘুমুতে এসেছি।
–রিহান:তুই একটু বাইরে যা রিফা আমার ওর সাথে কথা আছে।
–নিরু:তুমি বাইরে যাবে না রিফা।আর আপনি আপনার রুমে যান।
–রিহান:জোরে ধমক দিয়ে রিফাকে বলে, কিছু বলেছি আমি?
–রিফা:যেতে যেতে বলে,,কার ঝাঁজ কার উপর। ভাই তোদের ব্যাপারে হুদাই আমি ধমক খাচ্ছি কিন্তু মোড ভালো হলে একটা ট্রিট দিয়ে দিও।রিহান চোখ গরম করে তাকাতেই দৌড়ে বের হয়ে যায় রিফা।

–রিহান:রুমে চলো?
–নিরু:এই রুমে থাকবো।
–রিহান:বেশ!তাহলে আমি রিফাকে বলে দিচ্ছি আমার রুমে ঘুমিয়ে পড়ুক।
–নিরু:আমি আপনার সাথে থাকতে চাই না।
–রিহান:বিছানায় বসে নরম ভঙ্গিতে বলে আচ্ছা! তুমি কি চাও?
–নিরু:কিছু চাই না!
–রিহান:তাহলে আলাদা রুমে আসলে কেন?যত যাইহোক স্বামী স্ত্রী আলাদা রুমে থাকলে শয়তান সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলে।রাগ অভিমান সব করার অধিকার তোমার আছে কিন্তু আলাদা থাকার নেই।সেটা আমি দিবো না কখনো।
–নিরু:প্লিজ আর কথা বাড়িয়ো না তো।যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো।তোমার থেকে আমি কোনো অভিনয় নিতে পারি না রিহান।কথাটা বলেই কান্না করতে করতে বসে পড়ে।

–সব সময় রিহান কে তুমি বলে ডাকলে ও সেই ঘটনার পর থেকে আপনি বলেই সম্বোধন করে নিরু।তবে অনেক দিন পর আবার নিরুর মুখ থেকে তুমি এবং নিজের নাম শুনে ভালোই লাগে।
–রিহান :কান্না করো না উঠো!
–নিরু:খানিকটা চিৎকার করে বলে,, ভালো লাগছে না বলছি তো!
–রিহান :রুমে চলো ভালো লাগবে।নিরুর হাতটা ধরে বলে চলো!
–নিরু:এক ঝটকায় হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে, আমায় ছুবেন না।
–রিহান :আচ্ছা!তাহলে কাকে পাঠাবো তোমায় ছুয়ার জন্য।
–নিরু:নির্লজ্জ পুরুষ।খারাপ লোক।তারপর হনহন করে রুমে চলে যায়।
–রিহান :হাসতে হাসতে বলে বোকা বউ আমার।
.
.
–রিহান :উঠো খেয়ে ঘুমাবা।
–নিরু:খাবো না।
–রিহান :আরে খাও!বিয়ে তো আরেক টা করতেই হবে।রোগা কাউকে কি আর তখন কেউ বিয়ে করবে?
–নিরু:আমার জন্য আপনার না ভাবলে ও চলবে।
–রিহান :উঠো তো বলেই এক টানে বসায় দেয়।তারপর জোর করে মুখে খাবার তুলে দেয়।মুখে দিলে ও এভাবেই বসে থাকে।চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি পড়তে থাকে।এক পর্যায়ে হেঁচকি উঠে।রিহান তাড়াতাড়ি করে পানি এনে দিলে ও দৌড়ে গিয়ে ওয়াশরুমে বমি করে দেয়।

–রিহান ও অস্থির হয়ে যায়।নিরুর পিছনে যেতে নিলেই ওর ফোন বেজে ওঠে।তাকিয়ে দেখে অপরিচিত নাম্বার।

–রিহান:সালাম দিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একজন অপরিচিত মানুষের গলার শব্দ শুনতে পায়।কিছু একটা শুনে হাত থেকে ঠাস করে ফোন টা নিচে পড়ে যায়।

#চলবে

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-১২

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১২]
-তামান্না

–রিহান:শায়েস্তা না মেরে ফেলবে। সাথে সাথে মুখটা মলিন হয়ে যায় নিরুর।মৃত্যু শব্দ টা ভীষণ যন্ত্রণার নিজের বাবা আর নানু নানার মৃত্যুতে বুঝে গেছে।ভালোবাসার মানুষ বলতে এরাই ছিলো এখন কয়েক জন আছে।ওঁরা ও থাকবে না ভাবতে ও পারে না নিরু।
কোনো কথা না বলে মন খারাপ করে চলে আসে।চুপচাপ বেলকনিতে চলে যায়।
–কিছুক্ষণ পর রিহান চুপচাপ এসে নিরুর পিছনে দাঁড়ায়।
–রিহান:তুমি কি চাচ্ছো এখনই ফোন করে নিয়ে আসবো নিরবকে?নাহ মানে আমাকে মে’রে ফেলার জন্য।আচমকা এসে রিহানের গলার শব্দ পেয়ে ভয় পেয়ে যায়।বুকে থুতু দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,আপনাকে কেন মারবে?এরচেয়ে ভালো এসে আমাকেই বরং মেরে দিয়ে যাক।

–রিহান:এমা তোমাকে কেন মারবে? আর আমি দিবো কেন?আমি তো তোমায় ভালোবাসি।তুমি তো আর আমায় ভালোবাসো না।এতে তো তোমারই লাভ।
–নিরু:কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাইরে তাকিয়ে বলে ভালো তো আমি নিজেকে ও বাসি না।বরং ক্ষতিটা আমারই হোক।
–রিহান:তোমার কেন নিজেকে ভালোবাসতে হবে? তোমাকে ভালোবাসার জন্য তো আমি আছি তাই না!
–নিরু একবার পিছনে ফিরে রিহানের দিকে চোখ গরম করে তাকায়।তারপর আবার ঘুরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,, আপনার মতো সুদর্শন যুবকের মুখে কুৎসিত মানুষ কে ভালোবাসা মানায় না।আপনি বরং সাদা ধবধবে নতুন একজন বালিকার প্রেমে পড়ুন এতে মনের খায়েশ মিটবে।

–রিহান :স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলে,, আর?
–নিরু:পছন্দ হওয়ার মতো কথাটাই বললাম!
–রিহান :হুম!আর আসলেই তো তুমি অসুন্দর তোমায় কেন ভালো বাসতে যাবো?সেদিন সত্যিই বলেছি।রিহানের এমন কথা শুনে পিছনে ছলছল চোখে ঘুরে তাকায় নিরু।
রিহান কোনো কথা না বলে রুম থেকে বের হয়ে যায়।ইচ্ছে করেই নিরুকে হার্ট করার জন্য কথা টা বলে রিহান।আর দূরত্ব নয় কাছে আসার জন্য খানিকটা আঘাত কিংবা কষ্ট দেওয়া দরকার।মানুষ ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে সুতরাং ব্যথা দেওয়া টা ও জরুরি।

–আজকে রাতে আর রিহান নিরুর রুমে ফিরে আসে নি।গেস্ট রুমে থেকে গেলেও নিরু জানে না রিহান বাসায় আছে কি না!

–খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রুমে এসে অপেক্ষা করে নিরু।চিন্তায় কিছু খেতে ও পারে নি।কেউ জানে ও না রিহান কোথায়।নিরু প্রায় অর্ধেক রাত অব্দি অপেক্ষা করে, ইচ্ছে করছিল ফোন করে জানতে তবে করে নি।
মনে পড়ে তারপর অপমান করা পরিস্থিতি চারপাশ মানুষের তাচ্ছিল্য,, যা আজকে নিজের মুখে স্বীকার করেছে রিহান,, সবটা মন থেকেই করেছে তাহলে!
বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের পানি মুছে শুয়ে পড়ে।মনে মনে বলে নতুন করে মায়ায় জড়াবে না।এমনি যা জন্মেছে তা মৃত্যু ব্যতীত মুছে ফেলা সম্ভব নয় সুতরাং এর পরিধি আর বাড়তে দেওয়া যাবে না
.
.
–সকাল সকাল মায়ের ফোন পেয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ি মায়ের বাসায় পাঠায় নিরুকে।নিরুর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে একা নিশা সামলাতে পারছে না।সারা রাত রুমে না ফেরায় নিরু ভেবেছে রিহান বাসায় ফিরে আসে নি।
তাই আর বলা হয় নি রিহান কে না বলেই চলে আসে।শ্বাশুড়ি বলে দিয়েছেন এক সপ্তাহ থেকে আসতে।

–নয়টায় ঘুম থেকে ওঠে জানতে পারে নিরু বাসায় নেই।রিহানের প্রচুর রাগ হয়।ওর বউ ওর থেকে অনুমতি না নিয়ে বাসায় চলে গেলো? ঠিক ঠাক ভাবে শায়েস্তা করেই ছাড়বে।
রেডি হয়ে অফিসে চলে যায়।যাওয়ার সময় মা বলে দিয়েছে যেন নিরুদের বাসায় চলে যায়।

–নিরু বাসায় এসে নিজের হাতে রান্না করে মা আর বোনকে খাওয়ায়।মায়ের জ্বর হয়েছে।তাছাড়া শরীর ও ভীষণ দূর্বল।এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে নিয়েছে।আসার পর থেকে হাজার টা প্রশ্ন রিহান কে বলে এসেছে কি না। আসে নি কেন? নিরু কোনো রকম কথা কাটিয়ে নিয়েছে।বড় সন্তান ভীষণ আদুরে সুতরাং বাবা মায়ের এক্সপেকটেশন ও থাকে বেশি।
এতো দিন এই বাসায় অভ্যস্ত হলেও আজকে কেন জানি ভালো লাগছে না নিরুর।ফাঁকা লাগছে।মনে হচ্ছে শূন্যতায় ছেয়ে গেছে চারপাশ।

–শ্বাশুড়ির খোঁজ ফোনে নিয়ে নিয়েছে রিহান।তারপর অফিসের কাজ শেষ করে কিছু কেনাকাটা করে হাত ভরে নিয়ে চলে যায় শ্বশুর বাড়ি।
এতো রাতে কলিং বেলের শব্দে ভ্রু কুঁচকে আসে নিরুর।নিশাকে মায়ের পাশে বসিয়ে এসে দরজা খুলে দেয়।রিহান কে দেখে হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়। তাড়াতাড়ি পিছন দিকে ঘুরে ওড়না টেনে মাথায় কাপড় দিয়ে নেয়।বাসায় থাকায় মাথায় কাপড় ছিলো না।পিছনে ফিরেই বুকে থুতু দিয়ে সামনে ঘুরে তাকায়।নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,, আপনি এতো রাতে?
–রিহান:সোফায় ব্যাগপত্র গুলো রেখে আবার গাড়ির কাছে চলে যায় পিছন পিছন নিরু ও আসে।নিরু হাতে কিছু দিয়ে বাকি গুলো নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।
–নিরু:এতো কিছু আনতে গেলেন কেন?
–রিহান :টাকা বেশি হয়েছে তাই!সরো বলে মিতার রুমে চলে যায়।

–নিরু:ফাজিল লোক।এই বাজে লোকের মোড মনে হয় না আমার জীবনে বুঝা হবে।

–মিতা:রিহান কে রুমে নিয়ে যা নিরু।ওকে কাপড় দে ফ্রেশ হওয়ার জন্য।তারপর রিহান কে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসে।রিহান এসেই ওয়াশরুম থেকে পা ধুয়ে ধুপ করে শুয়ে পড়ে।

–নিরু:রাতে থেকে যাবেন?
–রিহান :হেসে তুমি চাচ্ছো?
–নিরু:আমি চাওয়ার কে?রাতে বাসায় না ফিরলেই বা আমার কি?
–রিহান :তাই তো!
–নিরু:তারপর কি করবেন?
–রিহান :বিয়ে তো করে নিয়েছি আপাতত রোমাঞ্চ করবো।
–নিরু:ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
–রিহান :ভয় পাই না।তারপর উঠে নিরুর হাত থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।

************** ************* **************
–রাত এগারোটা নিরু মাত্রই নুডলস রান্না করে রুমে এলো।রিহান রাতে খানা খায় নি।মা ও খানিকটা সুস্থ নিশা পাশে আছে।তবে রুমে এসে দেখে ফোনে কথা বলছে রিহান।ভীষণ হাসিখুশি ভাবে কথা বললেও ভীষণ আস্তেই কথা বলছে।
–রিহান:সরি!আজকে আসতে পারবো না রাতে। অফিসের কাজে বাইরে আছি।এবার কথা টা জোরেই বলে।যেন নিরু শুনতে পারে।

–নিরু:মনে মনে কালকে রাতে তাহলে অন্য কোথাও ছিলো?
–রিহান :ফোন টা রেখে পিছনে ঘুরে চমকে যাওয়ার ভান করে বলে তুমি কখন এলে?
–নিরু:আজকে রাতে যেতে পারছেন না সেই দুঃখ প্রকাশের এক মিনিট আগে।আর আপনার পায়ে কেউ বেঁধে রাখে নি সুতরাং যেতে পারেন।
–রিহান :হাসার চেষ্টা করে এগিয়ে এসে নুডলস এর বাটি হাতে নিয়ে বলে,,থাক!আজকে রেস্ট করুক।খুব সুন্দরী একটা অল্প বয়সী বালিকা গায়ের রং ধবধবে সাদা পেয়েছি।তুমি মনে হয় সেদিন মন থেকেই দোয়া করে ছিলে তাই এতো তাড়াতাড়ি পেয়েছি।ধন্যবাদ।তারপর খেতে বসে।

–নিরু:গম্ভীর কন্ঠে বলে,, বিয়ে করে নিন।
–রিহান :হাসতে হাসতে বলে অনুমতি দিচ্ছো?
–নিরু:সে অধিকার নেওয়ার প্রয়োজন নেই। হারামে না থেকে খানিকটা আরামের জন্য হলেও বিয়ে করে নিন।
–রিহান :বিয়ে করে কি করবো?
–নিরু:ড্রয়িং রুমের কর্ণার র্্যাগে সাজিয়ে রাখবেন।
–রিহান :তাহলে তো আগে তোমাকে রাখতে হয়।
–নিরু:খানিকটা মন খারাপ করে বলে আমি কি আর আপনার বউ নাকি?আমি ধবধবে সাদা বালিকা নই যে সাজিয়ে রাখলে ঘরটা সুন্দর লাগবে।
–রিহান :তাহলে তুমি কে?
–নিরু:আমি নিরুপমা।
–রিহান :বাটিটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলে মিসেস রিহান।এরপর সোজা লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে।
.
.
–সারারাত ঘুম হয়নি নিরুর।ওর রুমের সোফাটা ও অনেক ছোট তাই শুতে পারে নি।রিহান বুঝতে পেরে ওকে নিয়ে ছাঁদে বসে আড্ডা দেয়। অবশ্য নিরু বলেছিল রুমে এসে শুয়ে থাকতে তবে রিহান শুনে নি।
ভোরের আজানের শব্দে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে রিহান।নিরু নামাজ শেষ করে গেস্ট রুমে খানিকটা জিরিয়ে চলে আসে রান্না ঘরে।নতুন জামাই একটু ভালো মন্দ তো করতেই হয়।আম্মু ও যখন অসুস্থ দায়িত্ব টা আপাতত নিরুই নিয়ে নিয়েছে।

–রান্না শেষ করতে করতে বেলা বারোটা বেজে গেছে।এরমধ্যে নাস্তা করে আম্মু আর নিশাকে দেওয়া হয়েছে তবে রিহান কে ডাকলে ও ওঠে নি।বেচারা শুয়েছেই মাত্র কতক্ষণ।
সব কিছু গুছিয়ে সালাত কাটতে গিয়ে হাত কেটে যায় নিরুর।খানিকটা বেশিই কেটে গেছে।এমন বেখেয়ালি তো কখনোই হয় নি।তারপর রক্ত থামছে না দেখে ভয় পেয়ে যায়।চিৎকার করতেই আম্মু আর নিশা বের হয়ে আসে।রিহান ও মাত্র ই উঠলো শব্দ শুনে রুমের বাইরে এসে দেখে নিরু কান্না করছে।তাড়াতাড়ি করে ওকে ধরে রুমে নিয়ে যায়।

–নিরু চুপচাপ বসে আছে।আপাতত সবাই রুম থেকে বের হয়ে যায়।
–রিহান:দাঁড়িয়ে অন্য দিকে ঘুরে চোখের উপর হাত রেখে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।
–নিরু:এএএএমন কককককরছেন কককেন?
–রিহান :দাঁতে দাঁত চেপে কি করছিলে রান্না ঘরে?এতো সুন্দর ভাবে হাতটা কাটলে কেন?
–নিরু:ভয়ে উঠে দাঁড়ায়।মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলে রান্না করছিলাম।আম্মু তো অসুস্থ।
–রিহান এগিয়ে আসতে আসতে বলে কার জন্য?
নিরু পিছিয়ে যেতে যেতে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়।আমতা আমতা করে বলে, আপনার জন্য।আপনি এভাবে এগুচ্ছেন কেন?
–রিহান :দেয়ালের দুই পাশে হাত রেখে বলে,, আমি কি রাক্ষস?নাকি তোমার মনে হয় জীবনে কিছু খাই নি?
নিরু ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।রিহান পাশে রাখা মগটা ফ্লোরে আছাড় মেরে ওয়াশরুমে চলে যায়।তারপর কোনো রকম কাপড় পাল্টে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

–নিরু দৌড়ে পিছন পিছন এসে বলে কোথায় যাচ্ছেন?এই দুপুরে কেউ বের হয়?তাছাড়া খাওয়া দাওয়া ও করেন নি।খেয়ে যান।
–রিহান :তাই তো!আমি তো কয়েক হাজার বছরের অভুক্ত আমাকে খাওয়ানোর জন্য হাত পা পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়।
–নিরু:রিহানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে এতো হাইপার হচ্ছেন কেন?কে হই আমি আপনার?আমার হাত কেটে যাক মা-রা যাই আপনার কি?আপনার তো রূপবতী ধবধবে সাদা বালিকা রুপী নব্য প্রেমিকা আছে।আমি তো কুৎসিত আমার জন্য এমন করছেন কেন??

#চলবে

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-১১

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১১]
-তামান্না

–নিরু রান্না শেষ করে রুমে এসে শুয়ে আছে।ভয় হচ্ছে সব কিছু ঠিকঠাক হলো তো?রিফা তো বললো হয়েছে। রিহান ও বাসায় নেই কোথায় গেছে বলে ও যায় নি।শ্বশুর বাড়িতে যতই বিশ্বস্ত মানুষ থাকুক না কেন।স্বামী ছাড়া কি থাকা যায়? স্বামী বিহীন শ্বশুর বাড়ি তে কেমন জানি এতিম এতিম লাগে।

–রিহান বাসায় পৌঁছে সবাই কে ড্রয়িং রুম অব্দি নিয়ে এসে তুলে দেয় মা আর আর বোনের দায়িত্বে আড্ডা দেওয়ার জন্য।গোসল করতে হবে তারপর আবার বউয়ের মুখ টা ও তো পরিদর্শন করতে হবে।
–রুমে এসে দেখে শাড়ী পড়ে ঘোমটা টেনে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে নিরু।ভিতরে প্রবেশ করে ফেললে ও আবার বেরিয়ে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দেয়।
–নিরু:পিছনে ফিরে বলে,, এমন করার কি আছে আপনার ই তো রুম।
–রিহান :ভিতরে প্রবেশ করে আলমারি থেকে কাপড় বের করে বলে,, নাহ মানে হাত দিয়ে দূরত্ব দেখিয়ে বলে,,ঘরে দূরত্বশীল বউ থাকলে অনুমতি লাগে।কথাটা শেষ হতে দেরি হয় নি এর আগেই ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ।

–রিহান ওয়াশরুমে যেতেই রুমে রিফার সাথে নিশা আর নীলা দৌড়ে এসে নিরুকে ঝাপটায় ধরে।
–নিরু:অবাক হয়ে বলে তোমরা এখানে?কখন এলে?
–রিফা:হাসতে হাসতে বিছানায় বসে বলে,, তোমার প্রাণপ্রিয় বর তোমার হাতের শ্বশুর বাড়ি তে প্রথম রান্না খাওয়াতে গিয়ে নিয়ে এসেছে।সাথে মন ভালো করার বিষয়টা ও সাইডে রেখেছে আরকি।

–নিশা হাসতে হাসতে রিফার পাশে বসে বলে,, বুড়ি হয়ে যাচ্ছে মেয়ে টা ওকে ও একটা জামাইয়ের ব্যবস্থা করে দে না আপু!নিশার কথায় সবাই হাসলে ও রিফা বালিশ নিয়ে দৌড়াতে থাকে।
–এরমধ্যে রিহান ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ওদের কান্ড দেখে বলে কি হয়েছে?
–নিশা:তোমার বোন কে জামাই দিচ্ছি না দেখে মারছে আমায়!
–রিহান:কেন?তুই কি রিফার জামাই নিয়ে নিছিস নাকি??ছিছিছি এটা করতে পারলি?
এবার সবার হাসির শব্দ আরও বেড়ে যায়।নিশা রিফা নীলা বিরবির করতে করতে বের হয়ে যায়। রিহান তোয়ালে টা হাতে নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে নিরুর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,, হাসলে কিন্তু আগের থেকে ও দারুণ লাগে। রিহানের কথা শুনে হাসি বন্ধ হয়ে যায়।তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে আঁচল টা মাথায় টেনে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

–নিরু:রুমের বাইরে এসে হাসি আটকে রেখে বলে এই লোকের সামনে বেশিক্ষণ থাকলে মনে হয় না রাগ আমার থাকবে।

–সবাই মিলে একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করার জন্য আজকে সব কিছু গুছিয়েছে নিরু। সবাই কে সুন্দর ভাবে খাবার সার্ভ করে।অনেক দিন পর এতো উৎসাহ এবং হাসোজ্জল চারপাশ দেখে দারুণ লাগছে নিরুর।সবাই খাওয়া শুরু করলে রিহান বলে,,তুমি ও বসে পরো নিরু একা খেতে ভালো লাগবে না।

–শ্বাশুড়ি :বসে পড় একসাথে দারুণ লাগবে।
–শ্বশুর :অনেক দিন পর সবাই একসাথে খেতে বসলাম এতো সুন্দর আনন্দ হয় না বহুবছর।নিরুর বাবা বেঁচে থাকতে সবাই একসাথে হতাম আর নিরু রিহান পাশে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করতো।আর নিশা ছোট ছিলো ঘুম পাড়িয়ে খেতে আসতো মিতা।
নিরুর এসব কথা শুনে ভীষণ লজ্জা লাগছে।রিহান আর ও একসাথে থাকতো ভাবা যায়?রিহান মুখ টিপে হাসছে আর খাচ্ছে সাথে বাবা মা শ্বাশুড়ির কথা শুনছে।
অবশেষে সবাই কে জোরে জোরে হাসতে দেখে নিরু ও হাসি আঁটকে রাখতে পারে নি।রিহান মুচকি হাসলে ও শব্দ করে হাসছে না।বউয়ের সাথে আগেই বোধহয় রোমান্স ভালো ছিলো পাশাপাশি থাকা হতো।হাত ধরা হতো ঝগড়া ও হতো আর বড় হয়ে রোমান্সের র ও হচ্ছে না।

–সারাদিন মিতা নিশা নীলা সবাই থাকে।সন্ধ্যা বেলা সবাই চলে যায়।কালকে আবার নিরুরা যাবে।বিয়ের পর এই সময়টাই যেতে হয় এটা নিয়ম।
–সারাদিন সবার সাথে থাকলে ও সন্ধ্যার পর রুমে আসে নিরু।খুব ভালো কেটেছে আজকের দিন।শাড়ী পাল্টে আগে ফ্রেশ হয়ে নেয়।রিহান এখনো রুমে আসে নি।রিফা ও নিজের রুমে আছে।শ্বশুর শ্বাশুড়ি ও সারাদিন ভীষণ খুশি ছিলেন।

–রিহান বাইরে গেয়েছিলো আসার সময় ফুসকা নিয়ে এসেছে।এসে কাউকে পায়নি আর রিফা এসব পছন্দ করে না আব্বু আম্মু তো না-ই।নিরুর আবার সব সময় এসব পছন্দ। কতো বকেছে ওকে তারপর ও অভ্যাস পাল্টায় নি।তাই আজকে নিয়ে এসেছে।রুমে এসে দেখে নিরু উপন্যাস নিয়ে বসেছে।লাইব্রেরি রুমে অনেক গুলো উপন্যাসের বই রাখা আছে তাছাড়া আরও অনেক বই আছে কিছু নিজে সাজেস্ট করে কেনা কিছু রিভিউ দেখে আর কিছু নিরুর কথায় কেনা হয়েছিল।
নিরুর সামনে ফুসকার প্যাকেট টা রেখে রিহান লাইব্রেরি রুমে চলে যায়।নিরু দেখলে ও হাতে নেয় নি।

–রিহান:ফিরে এসে বলে,,কেউ চাইলে খেতে পারে আমরা এসব খাই না।
–নিরু:বইয়ের দিকেই তাকিয়ে বলে,,কেউ অতোটাও রাক্ষস নই যে উড়া উড়া বললেই লম্বা জিহ্বা বের করে খেতে বসবে।
–রিহান:হাসতে হাসতে সোফায় বসে বলে, তোমার জিহ্বা লম্বা নিরু?না মানে কখনো দেখিনি তো!
–নিরু:ভ্রু কুঁচকে বলে মিল দেওয়ার ধান্দা!
–রিহান:হয়েছে!তবে খেতে পারো তোমার জন্যই আনলাম।
–নিরু:হাতে নিয়ে বলে কতো টাকা?একসময় দিয়ে দিবো!
–রিহান:উঠে দাঁড়িয়ে রাগ দেখিয়ে বলে কয়েকশো কোটি!এরপর আর দাঁড়ায় নি বের হয়ে যায়।নিরু পিছন থেকে বলে, দিয়ে দিবো আমার বরের থেকে নিয়ে।ফিসফিস করে বলে বরের থেকে নিয়ে বরকে দিবো হাহাহা।

*********
–রাতে খাওয়া দাওয়া করে সবাই শুয়ে পড়লে রিফা ভাইয়ের রুমে আসে। ঘুম আসছে না তার।
–রিফা:ভাবি চলো আমরা আজকে একটু লুডু খেলি।
–নিরু:ফিসফিস করে বলে তোমার ভাইয়া কে বলো!এসব খেলায় মজার মানুষ না থাকলে জমে না।
–রিহান:ছোট মানুষের সাথে এসব খেলি না লুডু হচ্ছে বড়দের খেলা।ছোট মানুষ ছোট ব্রেণ দেত!
–নিরু:মোটেও না রিফা।তুমি বলে দাও যে এসব বলছে আমি তার সমবয়সী।মোটেও ছোট মানুষ না।
–রিহান:গুনে গুনে আমি তিন মাসের বড় হুম।

–রিফা দুজনকে থামিয়ে বসে।নিরু বসে মাথায় ওড়না সুন্দর করে দিয়ে বালিশে হাত গুঁজে বসে আছে।
রিহান একটু পরপর নিরুকে দেখছে।রিফা বুঝতে পারলে ও নিরু বুঝতে পারছে না।রিফা সারাক্ষণ মিটিমিটি হাসে।অবশেষে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় রিহান মাথায় গাট্টি মেরে বলে,, ফাজিল বের হ।রিফা হাসতে হাসতে বলে,,এনজয় ব্রো হাহাহা হাহাহা!

–নিরু:রিহান পাশের রুমে চলে যাওয়ার সময় বলে ধন্যবাদ।এতো সুন্দর একটা দিন উপহার দেওয়ার জন্য।
–রিহান:আহা এই ধন্যবাদ দিবে বলে কাছের মানুষের সাথে ভালো সময় কাটালাম বুঝলে!
–নিরু:সোজা কথা বেশি সুন্দর কঠিন এবং জটিল হলেও।এমনিতেই ঘুরানো পেচানো কথা সোজা করতে লাগে কষ্ট সোজা করার পর মানে বুঝতে পেরে লাগে আরেক কষ্ট।
–রিহান:হেসে আবার থেমে বলে,,নিরব পাগল হয়ে গেছে আমাদের ক্ষতি করার জন্য সুতরাং খুব সাবধান।
–নিরু:যার যার কর্মফল ঠিক তাকেই ভোগ করতে হবে করুক না।
–রিহান:কর্মফল যেন পায় সেজন্যই তো সাবধানে থাকতে হবে।তাছাড়া সে কতোটা হিংস্র তা তো তুমি জানো।ইদানীং বুদ্ধি ব্রেণ আরও খেয়ে ফেলেছে আর মানুষ নেই।

–নিরু:বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,বাড়ি ছাড়া করেছে আমাদের ইজ্জত নিয়ে খেলেছে আর কি বা ক্ষতি করবে?
–রিহান:আমাকে,,একেবারে মেরে ফেলার ফন্দি নাকি আঁটছে।ওর টার্গেট আমি এবং একমাত্র আমি।আর সে খবর আমার কাছের একজন ওর সাথে মিশে জানিয়েছে।
–নিরুর বুকটা কেঁপে ওঠে।বুকে হাত দিয়ে বলে,, এতো জঘন্য?এখন কি করা উচিত?বড় বড় করে নিশ্বাস নিতে থাকে।
–রিহান:এতো হাইপার হচ্ছো কেন?এতো সহজ নাকি?একটা ধ্বংস স্তুপের ও শেষ ধ্বংস আছে আর সেটা আমার হাতেই ধ্বংস হবে।নিরবের বিকৃত মন আমি উপরে ফেলবো।আমি জানি ও কতোটা আমার লাইফের ক্ষতি করেছে।
–নিরু:সে খুব খারাপ তার সাথে লাগতে যাওয়া টা ও বোকামি।নিজের চাচা চাচি চাচাতো বোনকে পর্যন্ত ছাড় দিতে জানে না।

–রিহান:ফোন হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে তোমার ই তো ভালো আমার ক্ষতি হলে,,আমি তো আর তোমার কেউ না।কথাটা বলে লাইব্রেরি রুমে চলে যায়।
–নিরু ফুঁসতে ফুঁসতে পিছন পিছন এসে বলে এতোই যখন কিছু না তবে বিয়ে কেন করলি? আমি পিছন পিছন এসে বলি নি বিয়ে কর আমায় বিয়ে কর।
–রিহান:ইশশ! ভুল হয়ে গেছে।আর একটু অপেক্ষা করলে বোধহয় শুনতে পেতাম তাই না?
–নিরু:এরচেয়ে ভালো নিরব ভাইয়াই ঠিক আছে শায়েস্তা করুক।
–রিহান:শায়েস্তা না মেরে ফেলবে। সাথে সাথে মুখটা মলিন হয়ে যায় নিরুর।মৃত্যু শব্দ টা ভীষণ যন্ত্রণার নিজের বাবা আর নানু নানার মৃত্যুতে বুঝে গেছে।ভালোবাসার মানুষ বলতে এরাই ছিলো এখন কয়েক জন আছে।ওঁরা ও থাকবে না ভাবতে ও পারে না নিরু।

#চলবে

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-১০

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১০]
-তামান্না

এরপর রিহান মাথা তুলে বসে।এবং একবার আড় চোখে নিরুকে ও দেখে নেয়।যা দেখে আপনা আপনি মুখ টা ঠিক হয়ে যায়।খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসে।ফটাফট সবাই মিলে এক সাথে ছবি তুলে অনেকক্ষণ।
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই নিরুপমার কান্নার শব্দ ভেসে ওঠে।নিশা দৌড়ে এসে বোন কে জড়িয়ে ধরে। এক মিনিটের ভিতরে পুরো বাসায় একেক করে সবাই কান্না করতে থাকে।নিশা আর নিরুর কান্না কোনো ভাবেই থামাতে পারছে না।

–অতঃপর বিদায় নিয়ে যেতে হয় নতুন গন্তব্যে।যেখানে অপেক্ষা করছে অনিশ্চিত নিয়তি পরিস্থিতি এবং চারপাশ।ভালো হলে তো খুশির শেষ নেই।তবে খারাপ হলে গোটা জীবন শেষ হয়ে যায়।একটা খারাপ সম্পর্কে পুরুষের থেকে ও বেশি কলঙ্ক বহন করতে হয় একজন মেয়ে কে।এতে যে পক্ষেরই দোষ থাকুক না কেন।পুরুষ মানুষের কোনো কলঙ্ক থাকে না তারা সব সময় শুদ্ধই থাকে।অবশ্য সমাজের চোখে।

–রিহান চুপচাপ বসে আছে নিরুর পাশে।ড্রাইভারের পাশে রিফা আর কেউ নেই এই গাড়ি তে।নিরু কান্না করেই যাচ্ছে।রিহান কিছু বলতে ও পারছে না।ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে শক্ত করে আকড়ে ধরতে তার প্রিয়তমা স্ত্রী কে।কিন্তু ভাগ্য এতো সুন্দর আর সহজ যে রাখে নি।

***********
–বিয়ে বাড়ি হলেও বাসাটা একদম ফাঁকা।কোনো মেহমান সাজসজ্জা রুম কোনো কিছুই নেই।রিহান নিয়ম শেষ করে যে রুমে গেছে আর বেরই হয় নি।নিরুকে ও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে নি।তবে নিরুর অভিমান হচ্ছে রিহান আসছে না দেখে।
–সবাই মিলে একসাথে খাবার খায় রাতের।তখন রিহান ও উপস্থিত ছিলো তবে মাথা তুলে একবার ও তাকায় নি।নিরু বিয়ের শাড়ি পাল্টে থ্রি পিছ পড়ে আছে।মাথায় লম্বা করে ঘুমটা।
–রিফা:ভাইয়ার কি মন খারাপ?এভাবে মনমরা হয়ে আছো কেন?
রিফার কথায় নিরুর বুকটা কেঁপে ওঠে।মন খারাপ হয়ে যায় আরও।
–রিহান :মাথা তুলে জোর পূর্বক হেসে বলে,, তেমন টা না।মাথা টা ধরে আছে,,একটু রেস্টের প্রয়োজন।কথাটা বলেই হাত ধুয়ে উঠে চলে যায়।

–খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিরুকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসে শ্বাশুড়ি।কিছু জামা কাপড় শাড়ি আর গয়না তুলে দেয় ওর হাতে।নিজ হাতে গহনা আর শাড়ী পড়িয়ে তারপর রিফাকে দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দেয় অন্য কিছু বলে নি।যদিও ওনাদের ও মন খারাপ এমন টা হওয়ায়।
–রিফা:ভাইয়া আসবো?
–রিহান:তাড়াতাড়ি করে উঠে দরজা খুলে স্বাভাবিক হয়ে বলে আয়!আর নিরুপমা কে কোন রুমে থাকতে দিয়েছিস?সব কিছু হাতের কাছে আছে তো?
–রিফা:নিরুকে নিয়ে রুমে চলে আসে।হাত থেকে জিনিস পত্র গুলো বিছানায় রেখে বলে,, আম্মু বলেছে ভাবি আজ থেকে এই রুমে থাকবে আর তুমি গেস্ট রুমে।অবশ্যই তাড়াতাড়ি মন জয় করে যেন এই রুমে আসতে পারো সেই দোয়ায় করবে।কথাটা বলেই রিফা রুম থেকে বের হয়ে যায়।

–রিহান:ওয়ালেট ফোন আর ব্লুটুথ টা নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে নিলে…।
–নিরু:দরকার নেই।অযথা এতে আব্বু আম্মুর চিন্তা বাড়বে।আপনি এখানেই থেকে যান আমি লাইব্রেরি রুমের সোফায় ঠিক মানিয়ে নিবো।
–রিহান:আচ্ছা!তবে আমি লাইব্রেরি রুমে চলে যাচ্ছি তুমি বরং এখানেই থেকে যাও।তারপর পাশের রুমে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলে,, রুম সাজাতে আমিই বারণ করেছি।সমস্যা নেই তুমি যা চাও না তা হবে না।আমি যথেষ্ট মানিয়ে নিতে পারবো।

–রিহান পাশের রুমে গিয়ে দরজা আটকে ফেলতেই নিরু বসে পড়ে বিছানায়। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।ইচ্ছে করছে নিয়ম পরিস্থিতি পৃথিবী সব ছেড়ে চলে যেতে।
লাইট টা অফ করে এভাবেই কাপড় না পাল্টে শুয়ে পড়ে।প্রিয় মানুষের গায়ের গন্ধ মিশে আছে বিছানায় পুরো রুমটায়, কেমন যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।অর্ধেক রাত অব্দি কান্নাই করে।আজ কে ভীষণ আব্বু কে মনে পড়ছে।আব্বু মা-রা যাওয়ার সময় যেমন কষ্ট হয়েছিলো আজ কে ও সেই রকম কষ্ট হচ্ছে।
একা একটা বিছানায় কখনো শুয়া হয় নি হয়তো পাশে আম্মু নয়তো নিশা থাকতো।তাই আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে।
**********
–রিহান ভোরে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয়।এসব আর ভালো লাগছে না সুতরাং যেতে হবে এসব থেকে দূরে।ব্যবসার অযুহাত দেখিয়ে দূরে থাকবে কয়েক দিন।সারারাত না ঘুমুতে পাড়ায় চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।চুপচাপ রুমে এসে দেখে নিরু শুয়ে আছে।এদিকে না তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
একটা ভালো টিশার্ট আর পেন্ট ওয়ালেট ফোন আর হাতে ঘড়ি।গায়ে কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ।
আস্তে করে এগিয়ে আসতে নিলে আচমকা উঠে বসে নিরু।রিহান ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিরু কাপড় টাও চেঞ্জ করে নি।সাজ গহনা সব কিছু এখনো শরীরেই।চোখ নামিয়ে বিছানার পাশে থাকা ড্রয়ার থেকে নিজের আইডি কার্ড নিয়ে বের হয়ে আসে।
কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে এসে বলে,,তোমাকে ছুটি দিয়ে যাচ্ছি।ফিরবো না আপাতত তবে তোমার বিশ্রাম শেষ হলে জানিয়ে দিও।আসছি বলে আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়ায় নি।

–নিরু চুপচাপ বিছানায় হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে।চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে তা না করে কি না রিহান দূরত্ব টানছে?কিন্তু দূরত্ব যে সংসার সম্পর্ক মজবুত নয় বরং নষ্ট করে দিবে।
মিনিট পাঁচেকের ভিতরে রিহান রুমে ফিরে আসে।সোফায় হেলান দিয়ে হাত রেখে বসে আছে।
–রিফা:ভিতরে আসবো?
–নিরু:হাত দিয়ে চোখ মুছে বিছানা থেকে নেমে বলে আসো।
–রিফা:তুমি কি গো ভাবি?বিয়ের পরদিন বরকে ছেড়ে দিচ্ছো অমঙ্গল ডেকে আনার জন্য?কথা গুলো বলতে বলতে রুমে ঢুকে মুখ টা হা হয়ে যায়। কপালে হাত দিয়ে বলে এখনো কাপড় ও চেঞ্জ করো নি?তাড়াতাড়ি যাও,কিছু নিয়ম আছে।আর হ্যা শাড়ী পড়ে নিও আলমারি তে রাখা আছে।একেবারে গোসল করে দুই জন বর বউ মিলে একসাথে নিচে আসবে।আর তোমাদের দেখে আমাদের চোখ দুটো জুড়াবে।

–রিহান :চুপ!আমি তোর বড় নাকি তুই আমার বড়?সেই কখন থেকে ভাষণ শুনে যাচ্ছি।
–রিফা:ভেংচি কেটে বলে এহহ বুঝে না কিছু আবার আসছে!এরপর আর পায় কে সোজা এক দৌড়ে বাইরে।

–নিরু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে রিহানের দিকে। রিহান জোর পূর্বক হেসে বলে,, যেতে দেয় নি তো!তোমার শ্বাশুড়ি আর ননদ কান্না কাটি জুড়ে দিয়েছে।ফিসফিস করে বলে কই বউ কেঁদে ভাসাবে তা না।
–নিরু:আচ্ছা!মুখে আচ্ছা বললেও মনে মনে বেশ খুশিই হয়েছে।

**********
–শ্বাশুড়ি :আমাদের বংশের নিয়ম বিয়ের পরদিন নতুন বউকে নিজ হাতে রান্না করে সবাই কে খাওয়াতে হয়।তোকে কিছু করতে হবে না নিরু আমি মরিয়মের মাকে সব রান্না করে ফেলতে বলেছি।সব সময় তো সে-ই রান্না করে।
–নিরু:এগিয়ে এসে শ্বাশুড়ির ঘা ঘেঁষে বলে আমি পারবো।তুমি শুধু রেসিপির নাম টা ফটাফট বলে দাও।
–রিফা:আর সাহায্য করার জন্য আমি আছি তো।তারপর নিরুকে জড়িয়ে ধরে।আজকে ভীষণ মিস করছে নিশাকে।মেয়ে টা নিরুকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না।মন খারাপ এটা ওটা সবটাই জুড়ে থাকতো নিরু।একটু আগে ও মা বোনের সাথে কথা হয়েছে নিশা ভীষণ কান্না করেছে।

–নিরু রিফা রান্না ঘরে আড্ডা দিতে দিতে রান্না করছে।নতুন গিন্নী রা রান্না করছে তার আভাস ড্রয়িং রুম থেকেই পাওয়া যাচ্ছে।রিহান হাসতে হাসতে বের হয়ে যায় বাসা থেকে।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবে ওদের ও আসতে বলেছে দুপুরে,, নিশা আর শ্বাশুড়ি কে ও নিয়ে আসবে।তাহলে নিরু এবং ওদের পরিবার সবাই খুশি হবে।

–এদিকে মিতা নিশাকে নিয়ে শুয়ে আছে।বাচ্চা মেয়েটার ভীষণ মন খারাপ।পুরো বাড়িটাই একদম ফাঁকা হয়ে গেছে।দুই বোন মিলে সারাদিন কতোই না খুনসুটি করতো।স্বামী মা-রা যাওয়ার পর আজকের মতো মন খারাপ কোনো দিন হয় নি।
রিহান বন্ধুদের নিয়ে সাথে নীলাকে ও নিয়ে সবাই এক সাথে চলে আসে নিরুদের বাড়িতে।কলিং বেলের শব্দে মিতা চোখ টা মুছে দরজা টা খুলে দেয়।রিহান কে দেখে অনেক টাই অবাক হয়ে যায়।
–রিহান:হা করে আছো কেন?ছেলেকে ঘরে আসতে বলবে না?
–মিতা:এবার কান্না করে দেয় রুম থেকে দৌড়ে চলে আসে নিশা,দুজনকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রিহান।মুখে হাসি রেখে বলে,, যখন ইচ্ছে করবে মেয়ের কাছে চলে যাবে এখানে নিয়ে আসবে,,মন খারাপ করছো কেন?শুধু মেয়ের পিছন পিছন আমাকে ও রেখো।
–মিতা:হাসতে হাসতে চোখের পানি মুছে দিয়ে সবাই কে ভিতরে নিয়ে বসায়।

–মিতা:তোমরা বসো আমি নাস্তা আনছি বলে ভিতরে চলে যায়।

–নিশা:আপুকে আনলে না কেন?
–রিহান:আপু কিন্তু এখন আমার সম্পত্তি মাঝে মধ্যে খানিকটা সুযোগ দিতে হবে নাকি?
–নিশা:হাসতে হাসতে বলে কাগজ পত্র ঠিক হলেও আশা করি সম্পত্তির মধ্যে খানিকটা ময়লা ঝড়া পাতা জমে আছে,, পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়ো।
–রিহান:তোমার কি মনে হয় পরিষ্কার করা যাবে?
–নিশা:অবশ্যই!সুন্দর এবং নরম মনের মানুষের মনে রাগ জমে থাকে না তবে অভিমান জন্মে আর সেটা ভালোবাসা দিয়ে দূর করা যায়।

–নীলা :নিশার কানটা টেনে দিয়ে বলে,বেশি পাকা হয়ে গেছিস তাই না?
–নিশা:হাসতে হাসতে বলে,,বেশি না একটু।বড়দের থেকে শিখেছি।সবাই এক সাথে হেসে ওঠে।

–সবাই মিলে আড্ডা দেয় অনেকক্ষণ।রিহান শ্বাশুড়ির সাথে রুমে বসে আড্ডা দেয়।
–মিতা:খারাপ ব্যবহার করেছে নিরু?
–রিহান:নাহ্।তবে দূরত্ব অনেক অনেক।
–মিতা:বুঝিয়ে বলবো?
–রিহান:থাক!জোর করে কোনো কিছু স্থায়ী হয় না।এরচেয়ে ভালো আমি না হয় ভালোবেসে আগের নিরুকে ফিরিয়ে আনবো।আগের নিরু হলেই হবে কোনো কমতি থাকবে না।
–মিতা:দোয়া করি সব কিছু তাড়াতাড়ি করে ঠিক হয়ে যাক।
–রিহান:এতো কিছু জানি না।তুমি এখন আমাদের সাথে যাবে।
–মিতা:এখন?এখন কিভাবে যাবো বাবা?
–রিহান :হাত ধরে টেনে দাড় করিয়ে বলে,, তোমার মেয়ে প্রথম বার রান্না করছে শ্বশুর বাড়ি তে আর সে খাবার তুমি খাবে না তা কি করে হয়?

–নিরু রান্না শেষ করে রুমে এসে শুয়ে আছে।ভয় হচ্ছে সব কিছু ঠিকঠাক হলো তো?রিফা তো বললো হয়েছে। রিহান ও বাসায় নেই কোথায় গেছে বলে ও যায় নি।শ্বশুর বাড়িতে যতই বিশ্বস্ত মানুষ থাকুক না কেন।স্বামী ছাড়া কি থাকা যায়? স্বামী বিহীন শ্বশুর বাড়ি তে কেমন জানি এতিম এতিম লাগে।

#চলবে

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-০৯

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[৯]
-তামান্না

–নিরু:আমি রিহানের সাথে আলাদা কথা বলতে চাই।
–রিহানের আব্বু :আচ্ছা!তোমরা কথা বলে আসো তবে উওর টা কিন্তু হ্যাঁ – ই চাই!নিরু কিছু বলে নি চুপচাপ উঠে আগে আগে ছাঁদে চলে যায়।

–রিহান:বলো?
–নিরু:বিয়ে হবে?
–রিহান:সত্যি?খুশি হয়ে বলে,, সত্যি বলছো?
–নিরু:আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, বিয়ে হবে কি না?
–রিহান:এটা কেমন কথা?তুমি বিয়ে টা হোক চাও না?
–নিরু:যেহেতু ইচ্ছে সিদ্ধান্ত সবটাই বড়রা নিয়েছে বিয়ে করে সংসার টা আমি তাদের সাথেই করতে চাই।আপনার সাথে নরমাল স্বামী স্ত্রীর মতো নয়।
–রিহান:হোয়াট?
–নিরু:এরপর যদি না করতে চান আমার কিছু করার নেই।তবে আপনার সাথে সংসার এক রুম এক বিছানা আমি ভাবতে ও পারছি না।কারণ ঠকে যাওয়া মানুষের মনে আশঙ্কা থাকে বেশি,, ঠকে যাওয়ার।বিশ্বাস টা সহজে আগের মতো স্থাপন হয় না।

–রিহান:খানিকটা থেমে এবং ভেবে বলে,, যাইহোক আমি এতো কিছু চাই না।তুমি আমাকে বিয়ে করছো এটাই না হয় আমার হয়ে থাকুক বাকি সব তোমার ইচ্ছে।আর উপর ওয়ালা চাইলে সবকিছু অবশ্যই সহজ হবে।তুমি অন্য কারো হবে না এটা তো নিশ্চিত থাকবো।
–নিরু:এভাবে বিরক্তি আসলে ছেড়ে দিতে পারবেন আমার কোনো বাঁধা কিংবা আপত্তি থাকবে না।আমি আমার মতামত জানালাম বাকি দায়িত্ব আপনার,,কিভাবে সবাই কে ম্যানেজ করবেন।
–রিহান:বিয়ে টা তো করছো?
–নিরু:শুধু মাত্র বড়দের ওয়াদা পালনের লক্ষ্যে।আমার কাছে আমার দৃষ্টিতে আপনি বলতে সেদিন কলেজে ঘটে যাওয়া ঘটনোর মতো চরিত্রের।ভালো এবং বিশ্বস্ত ভাবার মতো কোনো কারণ কিংবা ঘটনা এখন অব্ধি আমার চোখে পড়ে নি। নিরুপমা সব সময় একরকম আছে তবে খানিকটা চালাক হয়েছে।বুঝতে শেখেছে মানুষ,, এখন মানুষ পড়তে পারে তবে অতো সময় কই?তাই পড়া বা দেখার ঝামেলায় না গিয়ে সোজা এড়িয়ে চলে।

–রিহান:আমার বর্ণনা আমি মুখে নয় কাজে দেখাতে চাই যেন ছেড়ে যাওয়ার বদলে ঝাপটায় ধরতে বাধ্য হও।
–নিরুপমা এবার তাচ্ছিল্যের মতো হেসে বলে,, আপাতত আপনি আপনার দিকটা সহজ করুন।না করতে পারলে দায়ভার আপনি নিয়ে সমাপ্ত করবেন বলে আশা করি।
–রিহান:সে গুড়ে বালি।সিদ্ধান্ত নড়চড় হচ্ছে না শিউর থাকো।বাকিটা আমার ব্যাপার ওকে?এরপর আর রিহানই দাঁড়ায় নি।আগে আগে নিচে নেমে আসে।কোনো রকম একটা অজুহাত দেখিয়ে বের হয়ে যায়।রাতে নিরু আর ওর সম্পর্কে কথা বলবে বলে যায়।আপাতত বাদ দিয়ে নিশ্চিত থাকতে বলে।

–নীলা :আমি নিরুর বাসায় দরকারে এসেছি আম্মু।চলে আসবো সন্ধ্যার আগে।
–আম্মু :এই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।তোর বাবা রাগারাগি করছে তোর উপর।
–নীলা:ফোন টা ঘুরিয়ে অন্য কানে নিয়ে বলে,, আমি বলেছি তো গ্রাজুয়েশন শেষ না করে এসবে আমি নেই।তারপর ও কেন এভাবে জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছো আম্মু?
–আম্মু :তোর আব্বু বাসায় এসে না পেলে অশান্তি করবে,, তাড়াতাড়ি চলে আয়।ছেলে তোকে এমনিতেই পছন্দ করেছে এবার বাড়ির লোক দেখে ডেট ঠিক করবে।তারপর তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার কথা বলে কল কেটে দেয়।নীলার ভীষণ ভয় হচ্ছে।হাত পা কাঁপছে।হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিজে একটা সিদ্ধান্ত নিবে তার ও তো রাস্তা নেই।রিফাত তো হ্যা না কিছুই কখনো বলে নি।বাইরে এসেছিল কথা বলার জন্য।এখানে দাঁড়িয়েই নিরু কে টেক্সট করে বের হয়ে যায়।একটা রিকশা নিয়ে নেয়।যদিও রিকশায় করে বাসায় যেতে সময় লাগবে অনেক বেশি,, সি এন জি করে গেলে তাড়াতাড়ি হয়।কিন্তু ইচ্ছে করছে না অনেক গুলো মানুষের সাথে বসে যেতে।অস্বস্তি হবে যে।

–খানিকটা ভেবে রিফাতের নাম্বারে কল করে।কিন্তু বারবার রিফাত ও কল কেটে দিচ্ছে।ভীষণ রাগ হচ্ছে।
তারপর পাঁচ মিনিট পর রিফাত কল ব্যাক করে।
–নীলা :রিসিভ করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।রিফাত ফোন রিসিভ করেই কান্না করে দেওয়ার মানে বুঝতে পারছে না।
–রিফাত:এই নীলু?কি হয়েছে?এভাবে বোকার মতো কান্না করছো কেন?
–নীলা :হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে বিয়ে দিতে চাচ্ছে সবাই।ছেলে পক্ষ আসছে।
–রিফাত:বাসায় ফিরলে কখন?তুমি না রিহানদের বাসায় গেছো?
–তারপর নীলা পুরো ঘটনা বলে।রিফাত তাদের কলেজ মাঠে নেমে পড়ার জন্য নীলাকে বলে কল কেটে দেয়।রিহান রিফাত আমান সবাই আড্ডা দিচ্ছিলো বসে।

******
–রিফাত:দুই টা তাজা গোলাপ সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে,, এতো কিছু জানি না শুধু জানি আজকে তোমার বিয়ে হবে না।তেজি রগচটা মেয়ে টা আমার সামনে ভীতু হয়ে যাওয়া,, আমার কথা মেনে চলা আর দেখতে অসম্ভব সুন্দরী না হওয়ার পরে ও আমি তোমায় ভালোবাসি।তুমি যদি রাজি হও তোমার বাবা মা কে রাজী করার দায়িত্ব আমি নিবো।
অতিরিক্ত বিলাসবহুল জীবন দিতে পারবো কি না জানি না তবে ভালোবাসার কোনো কমতি থাকবে না।এবার আর চুপচাপ থাকতে পারে নি নীলা।রিফাত কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।রিফাত ও সুন্দর করে আগলে রাখে নীলাকে আর মুখে প্রাপ্তির হাসি।

–এদিকে রিহান আড্ডা দিয়ে অনেক রাত করে বাসায় ফিরে আসে।বাসায় আসতেই ওর আব্বু আম্মু ডেকে জিজ্ঞেস করে।
–রিহান:মাথা নুয়ে মন খারাপ করে বলে,, একটু সুযোগ চাই আব্বু আম্মু।আমাদের উপর যদি ছেড়ে দাও আমি অবশ্যই জয়ী হবো।সম্পর্ক টা একটু স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ দিও।তারপর পুরো ঘটনা খুলে বলে।তবে নিরুকে জানাতে বারণ করে।খুব আত্নবিশ্বাসের সাথে পারবে বললে ও রিহানের মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে রিহান নার্ভাস।তবে ওদের ভিতরে কথা বলাটা ও যুক্তিসঙ্গত নয়।চাপিয়ে জোর করে তো আর সব হয় না।

–রিহান:খানিকটা থেমে বড় করে নিশ্বাস নিয়ে বলে,, বিয়ে টা কম আয়োজন কম মানুষের শেষ করো আব্বু।এরপর না হয় করা হবে।তারপর নিজের রুমে চলে আসে।

*******
–রিহান :নিরুর ফোনে মেসেজ পাঠায়,,বিয়ে নিয়ে আর কোনো প্ল্যান থাকলে জানাতে পারো।
–নিরু:খানিকটা ভেবে বলে,,,কম মানুষ অল্প আয়োজন আর রাতের বিয়ে।
–রিহান:লুকিয়ে করতে চাচ্ছো?
–নিরু:হুম!আমি চাই এই শহর আকাশ বাতাস মানুষ সবাই না জানুক আমাদের পরিণেয় কথা।কেননা এটা কোনো সুস্থ এবং ভালো সঙ্গীর পরিণয় নয়।
–রিহান:তারপর?
–নিরু:বিরক্ত হলে কিংবা মোড পরিবর্তন হলে মুক্তি দিয়ে চলে যেতে পারেন।
–রিহান:তোমাকে স্পর্শ করতে পারা পৃথিবীর সবচেয়ে অনিশ্চয়তা,,আমি মেনে নিয়েই এগুচ্ছি।তোমার শরীরের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই তবে জড়িয়ে ধরার গাল, হাত স্পর্শ করার লোভ অবশ্যই আছে।তবে তুমি না চাইলে এই এটা ও হবে না,,এতে যতই কষ্ট আমার হোক।

–নিরু:কোনো দরকারী কথা থাকলে বলতে পারেন।আর আপনার স্পর্শ করা চিন্তা ভাবনা সব কিছু প্ল্যান মাফিক হয় সেটা সেদিন ই বুঝতে পেরেছি।কমপক্ষে জোর করে আমার সামনে নিজেকে প্রমাণ করতে আসবেন না প্লিজ।এতে আমার নিজেরই লজ্জা লাগে।এরপর আর কোনো রিপ্লাই আসে নি।
হয়তো দুই প্রান্ত থেকেই দুজনে কষ্ট পাচ্ছে।

–আজকে রাতেই বিয়ে।ঘরোয়া ভাবে কম আয়োজন আর কম মানুষের সাথেই শেষ করবে। নীলা সকাল সকাল এসে পড়েছে।নিরুকে বাসন্তী আর খয়েরী রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে।যেহেতু ঘরোয়া ভাবেই হচ্ছে তাই বাসার সামনে বাগানেই করা হচ্ছে।
–নিশা:এই রঙে তোমায় দারুণ লাগছে আপু।
–নিরু:আপনার কাছে ঠিক কোন রঙে আমায় দারুণ লাগে না বলবেন আপা?
–নীলা:আমাদের প্রিয় মানুষ সব রঙেই আমাদের কাছে সুন্দর,, তাই না নিশা?
–নিশা:হুম।

–রিফা:নিরুকে ভিডিও কল করে।নিশা রিসিভ করে সুন্দর করে দেখাচ্ছে নিরুকে।শাড়ী পড়ে বসে আছে আর একেক করে সবাই হলুদ দিচ্ছে। রিফা নিজের দিকের ক্যামেরা টা অফ করে সাউন্ড মিউট করে ভাইকে দেখায়।
–রিহান:কি?
–রিফা:দেখো তোমার হবু বউকে কতো কিউট লাগছে।ইশশ কেন যে ছেলে হলাম না,,নয়তো আমিই বিয়ে টা করে ফেলতাম।করুন গলায় বলে,, ভাগ্য আমার সহায় হয় নি!
–রিহান:মাথায় গাট্টি মেরে বলে,, তবে ভালোই হয়েছে।সামনে আরও ভালো হলেই হয়ে যাবে।তারপর খপ করে ফোন টা নিজের কাছে নিয়ে নেয়।বিশ মিনিট পর্যন্ত নিজের কাছে রাখে।আর সব কিছু বসে বসে দেখে।নিরুর ব্রু কুঁচকে থেকে হলুদ মুখে নেওয়া আর পানি দেওয়া মাথায় নিয়ম কানুন সবটাই বসে দেখে।এক পর্যায়ে একজন নিরুর লম্বা চুল গুলো খুলে দিতেই মাটি পর্যন্ত পড়ে।মোড়াতে বসে থাকার পরে ও মাটি তে পড়ে খানিকটা জমে আছে।নিরুর এতো লম্বা চুল এর আগে দেখার সৌভাগ্য হয় নি।

–অথচ যখন রিহান বলতো আমার লম্বা চুল পছন্দ তখন নিরু এমন করতো যেন ওর চুল অনেক ছোট।এতো ঘণ লম্বা চুল কখনো বলে নি।

–এক পর্যায়ে কোনো সাড়া শব্দ ভিডিও কলে সামনে আসা না পেয়ে কল কেটে দেয় নিশা।

–তারপর একদম নরমাল ভাবে একটা কাতান শাড়ী আর দোপাট্টা সাথে কিছু গহনা আর হালকা সাজে সাজানো হয়।বিয়ের দিন এটুকু না হলে তো আর হয় না।
–নীলা :কানে কানে বলে,,বিয়ের পরে পিটিয়ে সোজা করে ফেলবি রিহান ভাই কে।যেন বাকি জীবনে কারো পাতা ফাঁদে পা না ফেলে।নিরু আর কিছু বলে নি।শরীর হাত পা কাঁপছে।না জানি কি অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে।

–রিহান সাদা শেরওয়ানি দামী ব্রান্ডের ঘড়ি আর কড়া ঘ্রাণের পারফিউম দিয়ে এসেছে।চুপচাপ ড্রয়িং রুমে মাথা নুয়ে বসে আছে।মেহমান বলতে বন্ধু বান্ধব আর বাইরের তিন চারজন লোক আর কেউ না।মন খারাপ করেই বসে আছে।সবাই হাসাহাসি এটা ওটা বলছে রিহানের কান পর্যন্ত যেন পৌঁছাচ্ছেই না।তারপর আবার একটু পরপর ঘাম মুছছে।

–নিরুকে এনে পাশে বসালে ও মাথা তুলে নি রিহান।
–রিফাত:একটু মুখ টা তুলে বস না ছবি তুলি।
–আমান:রিহান তুই কি নার্ভাস? এতো ঘামছিস কেন?আমানের কথায় বন্ধুরা সবাই একসাথে হেসে ওঠে।
এরপর রিহান মাথা তুলে বসে।এবং একবার আড় চোখে নিরুকে ও দেখে নেয়।যা দেখে আপনা আপনি মুখ টা ঠিক হয়ে যায়।খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসে।ফটাফট সবাই মিলে এক সাথে ছবি তুলে অনেকক্ষণ।

#চলবে

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-০৮

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[৮]
-তামান্না

–রিফাত :আর একদিন যদি এই মেয়ে কে সামনে দেখি মেরে ফেলবো বলে দিলাম কথাটা বলে রাগে চলে যায়।
–আমান:বাপরে এই আমি কাকে দেখছি?এটা আমাদের রিফাত তো?হঠাৎ এতো রিয়েক্ট করছে কেন?
–আরিফ:সামথিং সামথিং,,তারপর সবাই এক সাথে হেসে ওঠে।

–এরপর আর কারো সাথে কারো যোগাযোগ হয় নি।নীলার বাসা থেকে বিয়ের জন্য বলছে।কিন্তু নীলা রাজি হচ্ছে না এখন বিয়ে করতে তাই বিয়ে দিতে পারছে না।তারপর আবার আজকাল মেসেঞ্জারে প্রচুর কথা হয় রিফাতের সাথে। যদিও কেউ কাউকে প্রপোজ কিংবা মনের কথা বলে নি।তবে ফ্রী ভাবেই চলছে বন্ধুত্বের থেকে ও খানিকটা বেশি কথাবার্তা।
নীলা শিউর ও হতে পারছে না রিফাত সম্পর্কে,, রিফাত ওকে চায়?নাকি এমনি কথা বলে? এসব চিন্তায় এখন মাথায় ঘুরে।

********
–অবসরে দুই বোন মিলে পিকনিক করছে।নিজেরা রান্না করে খাবে আজকে।অবশ্য নিরুর রান্নার হাত ভীষণ ভালো।আর নিশা সাহায্য করে। নীলা কে বলে দিয়েছে নিরু দুপুরে যেন চলে আসে।এক সাথে খাবে ওঁরা।
প্রচুর গরম তারপর আবার আলগা মাটির চুলা।তবে এই বসন্ত কালে রোদ হলেও হালকা একটু বাতাস ভীষণ পছন্দ নিরুর।কোমরে ওড়না বেঁধে রান্না করছে,, গরমে শরীর মুখ ঘেমে একাকার। পড়নে প্লাজু আর ঢোলা কামিজ,,আর চুল গুলো খোঁপা করে আটকে রাখা।একদম অন্য রকম নিরু।তবে নরমালে বেশি ভালো লাগে নিরুকে,,মাঝে মধ্যে নীলা বলে,,তোর গঠন চেহারার সাথে নরমালই মানায়।নিরু ও এটাই বিশ্বাস করে তাই তো কোনো সাজগোছ ওর পছন্দ না তবে ভীষণ পরিপাটি।

–রিহান কে নিয়ে নিরুদের বাসায় ওর আব্বু আর রিফা এসেছে।যদিও মিতা জানে যে ওঁরা আসবে। রিহানের আম্মু ও আগের থেকে খানিকটা সুস্থ তবে একলা অতোটাও হাটাহাটি করতে পারে না।
রিহান আর রিফা এসে শুনতে পায় দুই বোন ছাঁদে আছে।তাই চলে আসে।আর রিহানের আব্বু ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলে।
–রিফা তাড়াতাড়ি করে ডাক দিয়ে ছাঁদে প্রবেশ করতে নিলে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে রিহান।
–রিহান:ফিসফিস করে বলে,, চুপ।দেখি এই দুই পাগল কি করে।
রিফা আর কিছু বলে নি।নিরু আর নিশা হাসাহাসি করছে আর রান্না করছে।
–নিশা:তুমি কি জানো আপু?তোমায় এখন পুরো ভূতনির মতো লাগছে।
–নিরু:হয়েছে আমার দাদিমা আর হিংসে করে মিথ্যা বলতে হবে না।তারপর একটু ঢং করে বলে আমি জানি আমি কতো কিউট।

–তারপর খানিকটা থেমে মন খারাপ করে বলে,, আমি কি সত্যিই অসুন্দর নিশা?গায়ের রং কি বেশি চাপা?আমাকে কি পছন্দ করা যায় না?
–নিশা:এবার উঠে এসে নিরুকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে তুমি তো আমার চোখে সব চেয়ে সুন্দরী আপু।তোমাকে পছন্দ করা যায় ভালোবাসা যায়।তারপর দুষ্টুমী করে বলে খেয়ে ফেলা ও যায়।এবার নিরু হেসে হাতে থাকা চামচ টা পিছনে ঘুরিয়ে বলে এবার কিন্তু মাইর খাবি।নিশা আর নিরু দুজনেই হেসে ওঠে।

–রিফা:ফিসফিসিয়ে,,এবার হয়েছে তোমার লুকিয়ে দেখা?আমি কি এবার যেতে পারি সামনে?
–রিহান :মাথায় গাট্টি মেরে বলে যাহ্ ফাজিল।রিহানের সাথে সম্পর্ক থাকলে ও কখনো এভাবে নিরুকে দেখা হয় নি।সব সময় মাথায় হিজাব থাকতো।আজকে যেন একদম অন্য রকম নিরুকে দেখছে।গলা মাথা চুল পিছনে খানিকটা পিঠ এসব কখনো খুলে রাখে না বাইরে।বাসায় আসায় দেখা মিললো।তারপর চুপচাপ নিচে চলে যায়।সামনে আর যায় নি,, সুযোগে যাবে বলে।

–রিফা:পিছনে গিয়ে চিল্লিয়ে বলে হাউউউউউ। হঠাৎ এমন শব্দে নিশা আর নিরু ভয় পেয়ে যায়।
–নিরু:খুশি হয়ে বলে,, খুব ভালো হয়েছে আমরা একসাথে খেতে পারবো।ঝুলাভাতি খেলতেছি একা খেতে মজা নেই দারুণ হবে।
–রিফা:ভালো সময় এসে পড়েছি বলো?
–নিশা:অবশ্যই ছোট সাহেবা।নিশার কথায় তিন জনেই একসাথে হেসে ওঠে।

–নিশা আর রিফা এসেছে রুমে।নিশা একেবারে গোসল করে প্লেট নিয়ে ছাঁদে যাবে রিফা কে নিয়ে। ওঁরা গেলে নিরু নিচে আসবে।এই ফাঁকে নিরু আলু ভাজা করে নিচ্ছে।
আজকের আইটেম গুলো হলো,, ভাত,আলু ভাজা,মুরগির গোস্তো আর ডাল সাথে ডিম ভোনা।

–রিহান এবার সুযোগ পেয়েছে চুপচাপ ছাঁদে চলে যায়।নিরুর পিছনে গিয়ে গলা খাঁকারি দেয়।
–নিরুর তো মাথায় ও আসে নি যে কার সাথে রিফা এলো?এবার কোনো পুরুষ মানুষের গলা খাঁকারির শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখে রিহান।হঠাৎ রিহান কে দেখে ভয় পেয়ে যায়।ভালো করে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়,, নাহ্ সত্যি ই তো দেখছি।

–নিরু:তাড়াতাড়ি ওড়না ঠিক করে মাথায় দিয়ে বলে আপনি?
–রিহান:হুম!বাড়ি বয়ে দেখা করতে চলে এলাম।এসে দেখছি প্রেমিকা আমার সত্যি সত্যি বউ হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।আগের থেকে বেশ গুলুমুলু হয়ে গেছো কিন্তু।
–নিরু:ভ্রু কুঁচকে চুলা থেকে কড়াই টা নামাতে নামাতে বলে,, ছিহ্ মুখের কি ভাষা।
–রিহান:তাই!একটু ভালো ভাষা শেখানোর দায়িত্ব তো নিতেই পারো।
–নিরু:শুনুন আমি কোনো শিক্ষক নই।আর রইলো দায়িত্ব,,নিজের থেকে ও ভারী কারো দায়িত্ব নেওয়া যায় না।
–রিহান:তুমি আমায় মোটা বলছো?তবে কি জিম কিংবা ডায়েট করতে হবে?
–নিরু:সে সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।আর আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?অসুন্দর মানুষের থেকে উপদেশ নিতে নেই,, ওদের উপদেশ গুলো ও না অসুন্দর হয়।কথা টা বলে চলে যেতে নিলে হাত ধরে ফেলে নিরুর।এক টান দিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,, এক কথার জন্য ঠিক কতোবার আঘাত করবে?কি চাও তুমি?
–নিরু:ছলছল চোখে রিহানের দিকে তাকিয়ে বলে,, মৃত্যুর মতো দূরত্ব।
–রিহান:এবার ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,, এটা কখনো সম্ভব না।তুমি থেকে যেয়ে শাস্তি দাও মাথা পেতে নিবো।
–নিরু:থেকে গেলে পৃথিবীর কোনো শাস্তিই অসয্যকর মনে হবে না।আর কিছু সম্পর্কে শেষ করে পূর্ণতার স্বপ্ন দেখা দুঃস্বপ্ন।
–রিহান:নিরুর হাত টা ধরে বলে ভুল করেছি নিরু।সেদিন সবটা মিথ্যে ছিলো আমার ভিতর টা এমন নয়।আমি জানি আমার মনে শুরু থেকে তুমি গেঁথে ছিলে।
–নিরু:মনের মানুষ কে জোর করে ভুল বুঝে অসম্মান করা ব্যক্তির ভালোবাসার যোগ্যতাই নেই। কথাটা বলেই হাতটা ঝাড়া দিয়ে ফেলে চলে যায়।

***************
–এরপর আর কেউ কারো মুখোমুখি হয় নি। রেজাল্ট বের হয়েছে।নিরু ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে নামকরা ভার্সিটিতে চান্স পায় এবং ভর্তি হয়ে যায়।
বাসা থেকে যাতায়াত করা যায়,, নীলা ও চান্স পেয়েছে তবে ডিপার্টমেন্ট আলাদা।একসাথেই যাওয়া আসা করা যায়।

–এদিকে রিহানের ইচ্ছে করছে না দেশ ছেড়ে যাওয়ার।তাই ভার্সিটিতে চেষ্টা না করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নেয়।কারণ এখানে নিয়মিত ক্লাস করতে হয় না।ফলে ব্যবসা টা সুন্দর ভাবে সামলানো সহজ হবে। বাবা আর মিতা আন্টি বলে দিয়েছে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে হবে নয়তো নিরুর আশা ছেড়ে দিতে।আর বাবার ও ব্যবসায় সব সময় নিয়মিত না থাকায় খুব বাজে হাল।নতুন করে সবটা করতে হচ্ছে। সেই সুবাদে ভীষণ ব্যস্ত রিহান।মাঝে মধ্যে গাড়ি নিয়ে ভার্সিটির সামনে অপেক্ষা করে এবং আড়াল থেকেই নিরুকে দেখে চলে যায়।এতো সময় ও তো হাতে নেই।

–মিতা:তোমার আন্টির জন্মদিন আজকে পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়ে যাবো।ভার্সিটি থেকে সোজা বাসায় চলে এসো।নিশা আমার সাথেই যাবে রাত হবে ফিরতে।
–নিরু:আমি ও যাবো।ভার্সিটি শেষ করে না হয় চলে যাবো,,শুধু মাত্র তোমার বান্ধবীর ছেলে বাসায় না থাকলেই হয়ে যাবে।
–মিতা:খুশি হয়ে,, তোমার আন্টি আঙ্কেল ভীষণ খুশি হবেন গেলে।তারপর একেবারে তৈরি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়।কালো একটা গাউন মাথায় সাদা হিজাব,, চাদরের মতো গায়ে মুড়ানো সাদা ওড়না আর একপাশে কলেজ ব্যাগ।চোখে নতুন ফ্রেমের চশমা।এটাই বেশি ভালো লাগে দেখতে নিরুকে।আগের থেকে ও খানিকটা ফর্সা আর মোটা ও হয়েছে।এখন মুখ টাও ভরে গেছে শুকনো লাগে না।গোল মুখে বড় বড় চোখ আর চোখে চশমা দারুণ লাগে দেখতে।

***********
–নিরু হাতে করে অনেক গুলো তাজা গোলাপ আর বেলি ফুলের মালা নিয়ে বিকেলে চলে আসে আন্টির বাসায়।আন্টির আবার ভীষণ পছন্দ বেলি ফুলের মালা আর তাজা গোলাপ।অবশ্য এটা নিরুর ও ভীষণ পছন্দের।তবে আজকে সাথে নীলাকে ও নিয়ে এসেছে।

–কলিং বেলে চাপ দিতেই রিফা এসে দরজা খুলে দেয়।ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে সাথে কিছু মেহমান ও।আন্টি কে দেখেই মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে।রিহানের আম্মু ও নিরুর মাথায় চুমু খেয়ে বলে এবার কিন্তু আমার মেয়ে সত্যি সত্যি বড় হয়ে গেছে।
নিরু আন্টির সামনে বসে বলে,, সারাজীবন ছোট থাকলে মায়েদের সেবা করবো কি করে?তারপর সবাই হেসে ওঠে।
–আঙ্কেল :তবে নিরু কিন্তু দিন দিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছে,, এবার নিরু লজ্জা পেয়ে যায়।এরমধ্যে মাথা মুছতে মুছতে শিড়ি বেয়ে নিচে নামে রিহান।নিরুকে দেখতে পায় নি।বাবার পাশে বসে বলে,, তোমার মেয়ে কে এবার আমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিত হও তো আন্টি।আর ভালো লাগে না এতো লুকো…..।আর কিছু বলতে পারে নি নিরুকে দেখে চুপসে যায়।রিহানের থেমে যাওয়া দেখে বড়রা সবাই শব্দ করে হেসে ওঠে। রিহান জোর করে হাসি দিয়ে মাথা চুলকাতে থাকে।

–রিহানের আব্বু :আমি চাই এবার সত্যি সত্যি আমাদের ইচ্ছে টা পূরণ হোক নিরুপমা।আমরা তোমার আব্বু কথা দিয়েছিলাম প্লিজ আর না করো না!
–মিতা:আমার উর্ধ্বে তুমি যেতে পারো না নিরু। আমরা সবাই আছি আর রিহান ঠিক তোমায় সুখে রাখবে।আর তোমরা আমাদের কষ্ট বাড়িয়ো না।তারপর কিছু ইমোশনাল কথা বলে সবাই মিলে।নিরু জানে এঁরা যে করেই হোক বিয়ে দিবেই।তাছাড়া সবার মন ভাঙ্গার সাহস ওর নেই। ঠিক তেমনি সহজে রিহান কে মেনে নেওয়া ও সম্ভব নয়।ভাঙ্গা মন জোড়া সহজে লাগে না হয়তো একটা সময় নতুন করে মেনে নেওয়া যায় তবে কষ্ট ঠিকই মনে গেঁথে থাকে।অতিরিক্ত ভালোবাসা পেলে ও কোনো সময় ভালোবাসা দিয়ে কষ্ট গুলো মাটি দেওয়া যায়।তবে অবশ্যই দরকার ভালোবাসা সেটা হতে হবে মজবুত এবং নিঃস্বার্থ।নিরুর ভালোবাসা খাঁটি হয়তো ক্ষমা করাও সহজ তবে সহজ মানেই প্রথমেই অন্যায় কে ভুলে যাওয়া নয়।নিজেকে অসম্মান করা নয়।
–নিরু:আমি রিহানের সাথে আলাদা কথা বলতে চাই।

#চলবে

নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-০৭

0

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[৭]
-তামান্না

–নিরবের প্রতিশোধের নেশা আরও বেড়ে গেছে।কারণ রিহান নিরবের আসল রুপ সবাই কে বলে দিয়েছে।এখন শুধু সুযোগ খুঁজছে কিভাবে ফাঁদে ফেলা যায়।এখন রিহানদের বন্ধু কারো সাথে মিশে না নিরব।আলাদা একটা টিম ওঁরা তৈরি করে নিয়েছে।তবে পড়াশোনার আশেপাশে ও নেই।
নিরুদের সাথে বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর কারো সাথে যোগাযোগ হয় নি।এমনকি এই শহরেই যে ওঁরা আছে তা ওদের চাচারা জানেন ও না।

–মিতা:পরীক্ষা দিয়ে সোজা বাসায় চলে আসবা আর নিরবকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবা।কখন কি করে বসে বলা যায় না। রিহান কে দিয়ে কতো বাজে একটা কাজ করালো।
–নিরু:রিহান ছোট বাচ্চা নয়।মানছি নিরব ভাইয়া খারাপ তবে তোমার আদরের বান্ধবীর ছেলে কে আমি ভালো বলতে পারছি না সরি!
–মিতা:কম বুঝার চেষ্টা করিস,,বড়দের থেকে বেশি বুঝতে নেই।
–নিরু:বাদ দাও না আম্মু।পরীক্ষা দিতে বের হবো এসবে আমার অস্বস্তি হয় ভালো লাগে না।মিতা কিছু বলে নি।মেয়ে কে তৈরি হতে বলে চলে যায় ভাত আনতে।প্রথম দিন সাথে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু আজকে স্কুলে ও দরকারী মিটিং আছে।

–নিশা:চলো তোমাকে প্রথম দিন পরীক্ষায় আমি নিয়ে যাই।বাবার দায়িত্ব আমিই না হয় পালন করে দেই।
–নিরু:খাবার মুখে নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে,, বাচ্চা মানুষ বাবার দায়িত্ব পালন করতে আসছে। পরে দেখা গেছে পরীক্ষা বাদ দিয়ে আমার তোকে খুঁজতে বের হতে হবে।চুপচাপ স্কুলে যা আর মনে মনে আমার জন্য দোয়া দুরুদ পড়।
–নিশা:মুখ ভেংচি কেটে বলে আমার অতো সময় নেই হুম।আমি নিজের জন্য দোয়া দুরুদ পড়বো।তারপর নিরু হেসে ওঠতেই চলে যায় নিশা।

–নীলা :নিরুকে কয়েক বার কল করে না পেলে ওর মায়ের নাম্বারে কল করে জিজ্ঞেস করে বের হয়েছে কি না।নীলা প্রায় পৌঁছে গেছে।
–নিরু:আসছি।তারপর মায়ের থেকে দোয়া আর বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায়।যেখানে পরীক্ষা হবে ঐ কলেজ গতকাল কে মায়ের সাথে দেখে এসেছে।

*****
–আব্বু :তোমার আম্মু কে ডাক্তার দেখিয়ে সেন্টারে যাবো।ভালো করে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা টা দিও।
–রিহান:আচ্ছা বলে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে মায়ের গালে একটা চুমু খেয়ে বের হয়ে যায়।বাসার গাড়ি নিয়েই যেতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু আব্বু বারণ করায় নেয় নি।পরীক্ষা দিতে যাবে এখানে এতো বড়লোকি ভাবের দরকার কি?
–আর কথা বাড়ায় নি।একটা রিকশা নিয়ে চলে যায় স্টেশনে ওখান থেকে বন্ধুদের নিয়ে চলে যায় কলেজে।

–নিরব:রিহান কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,,একটা লুজার কে খুব সুন্দর করে নিজের মতো নাচালাম।শা*লা হাঁদারাম হাহাহা।
–কথাটা একদম রিহানের কানে পৌঁছে যায়,, রাগে তেড়ে আসে রিহান।রিফাত আটকে দেয়।পরীক্ষায় এসে এসবে জড়ানো ঠিক হবে না।কোনো রকম নিজেকে কন্ট্রোল করে।তারপর সবাই কে রেখেই নিজের সিট খুঁজতে চলে যায়।

–নিরু নীলার সাথে খুঁজে নিজেদের সিট বের করে।বরাবরের মতোই ওদের দুই বান্ধবীর সিট আলাদা রুমে পড়ে।কখনো পাশাপাশি কিংবা এক রুমে বসে ওদের পরীক্ষা দেওয়া হয় নি।এই আফসোস বোধহয় থেকেই যাবে।কতক্ষণ দুজনে আড্ডা দিয়ে তারপর যার যার রুমে গিয়ে বসে।নিরু চুপচাপ বসে আছে।
কলেজ ড্রেস আর হিজাব চোখে চশমা,, মুখের মাস্ক টা খুলে রেখেছে।বেশিক্ষণ মাস্ক পড়ে থাকতে পারে না নিরু।কারণ চশমা টা ঘোলাটে হয়ে যায়।

–পরীক্ষা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিট পর নিরুর চোখ যায় পাশের বেঞ্চে।পাশাপাশি টেবিলে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে রিহান।এতোক্ষণ তো মাথায় ও আসে নি।নিরু আর রিহান চোখাচোখি হতেই চোখ ফিরিয়ে নেয় নিরু।
মনে মনে ভাবে তবে কি এতোক্ষণ আমায় দেখছিল রিহান?নাহলে আমায় দেখেই বা মুচকি হাসি দিবে কেন?পুরো অস্থির হয়ে যায় নিরু।নিজেকে স্বাভাবিক করে মনোযোগ দেয় খাতায়। তারপর আর কোথাও তাকায় নি।

–রিহান বসা ছিলো আগেই,, তবে নিরু আসার সময় দেখতে পায়।আর এই মেয়ে বেঞ্চে বসে অন্য কোথাও তাকায় নি ফলে রিহান কে দেখতে পায় নি।রিহান এতোক্ষণ বসে দেখছিল এই অতিসাধারণ আর সহজ মেয়ে বসে কি করছিল।চারপাশে এতো মেয়ে তবে একটা ও নিরুর মতো এতো সাধারণ নয়।কিন্তু নিরুকে সাধারণেই বেস্ট লাগে মায়াবী লাগে।সহজে একদম মনে বসে যাওয়ার মতো মায়াবতী।

–আসার সময় মেয়ে কে নিয়ে না আসতে পারলে ও পরীক্ষা শেষ হওয়ার বিশ মিনিট আগে এসে বসে থাকে।
নিরু পরীক্ষা শেষ করে বের হলে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রিহান।একটা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে ক্লান্ত লাগছে ভীষণ!মুখ টা মুছে নাও।
–খানিকটা দূরে থেকে টিজ করে নিরব বলে আহারে পুরনো প্রেম জেগে ওঠলো!
ভ্রু কুঁচকে মাস্ক টা পড়ে ডান পাশে তাকায় নিরু।মূহুর্তেই নরম হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে বলে,, এড়িয়ে চলা এবং শান্ত থাকা একজন ভালো মানুষের বৈশিষ্ট্য।সবাই কে সবার কথাকে মনে রাখতে এবং শুনতে নেই।তারপর চুপচাপ চলে যায়।এই কথা বলার কারণ হলো নিরু জানে ও চলে যেতেই রিহান তেড়ে যাবে নিরবের দিকে। তাই ঠান্ডা মাথায় একটা সুন্দর কথা বলে চলে গেলো।
রিহান বুকে হাত দিয়ে নিরুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।নিরুর এই রাগ আর নরম স্বভাব টা যেন তার সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত।এই হঠাৎ জড়িয়ে নিবে কিন্তু ফেইস পর্যন্ত ই,,মুখ দিয়ে উচ্চারণ করার আগেই নরম হয়ে যায়।এটা ইদানীং বেশি মিস করে রিহান।

–মিতা মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমন হলো পরীক্ষা?
–নিরু:আলহামদুলিল্লাহ ভালো।কিন্তু শুরুতেই তোমার বান্ধবীর ছেলেকে পাশের সিটে দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে ছিলাম।
–রিহান:কেন আন্টি?আমি কি পরীক্ষার সেন্টারে এসে তোমার মেয়ে কে মারতাম নাকি?রিহানের এমন কথায় পিছনে তাকায় নিরু।তবে এরপর আর দাঁড়ায় নি চলে যায় সামনে নীলার সাথে।

–মিতা:ভালো হয়েছে তো?
–রিহান:আলহামদুলিল্লাহ তবে তোমার মেয়ের থেকে ভালো নয়।ছেলে মানুষ কে থাকতে হয় উপরে কিন্তু তোমার মেয়ে দেখছি সব সময় আমায় পিছনেই রেখে দিবে।অবশ্য এতো সুন্দরী বউ পেলে পিছনে থাকতে ও আমি রাজি…কথা টা বলে মাথা চুলকাতে থাকে রিহান।
–মিতা:তোদের দুজনকে নিয়েই তো আমার যতো চিন্তা।
রিহান আর মিতা দুজনেই হেসে ওঠে একসাথে।

*****************
–তারপর এভাবেই পরীক্ষা টা দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়।আজকেই শেষ পরীক্ষা।একটু আগে এসেছে নীলা আর নিরু।এসে কলেজের বকুল গাছটার নিচে বসে।
এরমধ্যে কলেজের কয়েকজন ক্লাস মেট এগিয়ে এসে নিরুর থেকে ক্ষমা চায়।
–নিরু আচমকা ওদের ক্ষমা চাওয়ার কারণ টা বুঝতে পারে নি।
–সবাই :সত্যি সরি গো।তোমায় আমরা ভুল বুঝে ছিলাম কিন্তু রিহান নিজের মুখে সবাই কে ডেকে সত্যি টা বলেছে।তোমার মতো মানুষ কে খারাপ ভাবা না জেনে,, আমাদের অনেক অন্যায় হয়েছে। প্লিজ আমাদের মাফ করে দিও।
–নিরু:খানিকটা অবাক হলেও প্রকাশ না করে বলে,,তোমাদের দোষ নেই হয়তো আমার জীবনে এতোটুকু অসম্মান লেখা ছিলো।তারপর টুকটাক কথা বলে চলে আসে।এরপর নীলার থেকে পুরো কাহিনি শুনে।
নিরু কষ্ট পাবে বলে এরপর আর রিহানের কথা তুলে নি নীলা।নিরু খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চারপাশ টা একটু সহজ হয়।

–রিহান:নিরুপমা?পরীক্ষা শেষ হলে প্লিজ একটু দাঁড়িয়ো!
–নিরু কথাটা শুনলে ও চোখ তুলে ফিরে তাকায় নি।চুপচাপ পরীক্ষা দিতে থাকে।অর্ধেক পরীক্ষা দেওয়ার পর দেখে রিহান প্রশ্ন দেখছে তবে লিখতে পারছে না।বোধহয় কমন পড়ে নি।তারপর নিজ ইচ্ছায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? ইশারায় রিহান কয়েক টা প্রশ্ন কমন পড়ে নি বলে। তারপর নিরু খাতা তুলে ওকে দেখায়।

–নীলা :আজকে চল একটু ঘুরি?চারপাশে নাকি অনেক সুন্দর!
–নিরু:আন্টিকে বলে আমাদের বাসায় চলে আসবি পুরো শহর ঘুরে দেখাবো।আজকে না আজকে বাসায় চল।
–নীলা :মিরা বলছিল আজকে নাকি সামনের পার্কে তিন দিন ব্যাপী মেলা শুরু হয়েছে চল যাই।

–রিহান তাদের বন্ধুদের নিয়ে ওদের পিছনে এসে বলে চলো আমরা নিয়ে যাই।
–নিরু:শুনুন?আমাদের কোনো বডিগার্ড লাগবে না আর আপনারা যে বিনা পয়সায় মেয়েদের হেল্প করতে কলেজে আসেন তা কি বাবা মা জানে?
–রিহান:ওদের টা জানে কি না জানি না।তবে আমার আব্বু আম্মু জানে যে তাদের ছেলে নিরুপমার বডিগার্ড।
–নীলা :ভীষণ জ্বালাচ্ছেন কিন্তু।যার যার মতো আলাদা পথে হাঁটুন না!
–রিফাত:একধাপ বেশিই তো দেখি বুঝো,, তারপর খানিকটা ঝুঁকে বলে,, একটু সাহায্য করতে পারো না আমার বন্ধু কে?
–নীলা :বেশ জোরে বলে,, সরেন।আমি নিরু নই যে চুপচাপ সব শয়ে যাবো এবং ভুলে যাবো বা সরে যাবো।ভুল আর অন্যায় দুটো আমার কাছে এক শব্দ নয়।

–তারপর রাগে নীলা আগে চলে যায়।কিছুটা এগিয়ে যেতেই হাতে টান পড়ে।
–নীলা:চল আমরা মেলায় যাই নিরু,, ভীষণ মজা হবে।
–নিরব:এর থেকে বেশি ভালো হবে হোটেলে গেলে,,সত্যি অনেক ম*জা পাবে,, চলো!
–পিছনে তাকিয়ে নিরব কে দেখে ভয় পেয়ে যায়। নিরু কে ও দেখতে পাচ্ছে না।ভয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারছে না।এবার মনে হয় কান্নায় করে দিবে নীলা।
–নিরব:সাথে টাকা ও দিবো বোনাস হিসেবে চলো সুন্দরী?
–নিরব হাত ধরে টেনে নেওয়ার আগে চোখ বন্ধ করে ফেলে নীলা।হঠাৎ হাতটা আলগা হতেই চোখ খুলে দেখে রিফাত দুই তিন টা থাপ্পড় মেরে দিয়েছে অলরেডি।

–এরমধ্যে অনেক টা হাতাহাতি হয়ে যায় নিরবের সাথে।রিহান এগিয়ে আসতেই কেটে পড়ে নিরব।
–রিফাত :ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় নীলার গালে।রেগে বলে খুব তো গলা ফাটাতে এবং মুখ খারাপ করতে পারো।কই ছিলো এতোক্ষণ তোমার মুখ?নাকি নিজে ও প্রস্তাব গ্রহণ করে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলে?এবার মাথা নুয়ে কান্না করে দেয় নীলা।এরমধ্যে নিরু এগিয়ে আসতেই জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয় নীলা।
নিরু রিহানের আব্বুর সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার কথা বলতে বলতে খানিকটা সামনে এগিয়ে গিয়ে ছিলো।আর রিহানরা বকুল গাছটার নিচে বসে ছিলো।
তারপর পুরো ঘটনা আমানের থেকে শুনে নিরু।
–নিরু:কষ্ট পাস না।চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,, আমাদের দুজনের শুধু খারাপ লোকের সাথেই পরিচয় হয়।তবে এটাই বোধহয় উপর ওয়ালা ও চায় নয়তো এমন হতো না।কথা টা বলার সময় আড় চোখে রিহানের দিকে তাকায় নিরু।রিহান বুঝতে পারে এটা ওকে উদ্দেশ্য করেই নিরু বলেছে।

–রিফাত :আর একদিন যদি এই মেয়ে কে সামনে দেখি মেরে ফেলবো বলে দিলাম কথাটা বলে রাগে চলে যায়।
–আমান:বাপরে এই আমি কাকে দেখছি?এটা আমাদের রিফাত তো?হঠাৎ এতো রিয়েক্ট করছে কেন?
–আরিফ:সামথিং সামথিং,,তারপর সবাই এক সাথে হেসে ওঠে।

#চলবে