Wednesday, June 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 8



সবিতা পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0

সবিতা
শেষ পর্ব
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্র এখন স্থানীয় পর্যায়ে একটা পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে।
এটা আর শুধু একটামাত্র স্কুল না, এটি একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি মেয়ের মধ্যে স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাসের আলো জ্বলে উঠছে।
তবে এই সফলতার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা অপেক্ষা করছে।

একদিন দুপুরের দিকে সবিতা স্কুলে পৌঁছানোর আগেই একজন পুরুষ শিক্ষার্থী এসে তাকে জানায়,

— “আপু, একদল লোক এসেছিল স্কুলের সামনে, তারা কিছু বলতে চাইছিল।”

সবিতার মন খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু কিছু বলার আগেই তাওহীদ আসে।

— “সব ঠিক আছে।তবে তারা শুধু জানিয়ে গিয়েছে যে আমরা অগ্রহণযোগ্য।”

এটা ছিল তাদের জন্য প্রথম বড় প্রতিবাদ।
স্থানীয় কয়েকজন সমাজকর্মী এবং আত্মীয়স্বজন এই স্কুলের বিরোধিতা শুরু করেছে।
তারা বলতে শুরু করেছে, “এই স্কুল মেয়েদেরকে খারাপ পথে পরিচালিত করছে, এখান থেকে মেয়েরা স্বাধীন হয়ে যাবে, তাদের চরিত্র নষ্ট হবে।”

এই অভিযোগগুলো সবিতার মনের ভিতরে গুরতর ভাবে আঘাত হানে।
কিন্তু সে জানত, এসব বাধা শুধু তার পথকে শক্ত করবে।
যেহেতু সে নিজেই নিজের সংগ্রাম, নিজের সাহস, আর নিজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জেনেছে—অন্ধকারে একটু আলোই পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে।

রুমাইসা স্কুলে প্রথম এসেছিল শঙ্কিত মন নিয়ে, কিন্তু এখন সে পুরোপুরি বদলে গেছে।
প্রতিদিন নতুন কিছু শিখে, নিজের সাহস বাড়িয়ে, আজ সে নবআলোর সেরা শিক্ষার্থী।

একদিন সবিতা তাকে বসিয়ে বলল,

— “রুমাইসা, আজকে তোর যা অর্জন, সেটা আমি শুধু চেহারায় দেখলাম না, তোর চোখেও দেখলাম।
তুই এখন সাহসী, তুই এখন নিজের ভালোবাসার জন্য লড়াই করতে জানিস।”

রুমাইসা মাথা নিচু করে বলে,

— “আপু, আমি জানতাম না, আমাকে শিক্ষার আলো দিবে এমন কেউ কখনও আসবে। আজ আমি জানি—আমার কাছে আর কোনো বাধা নেই।”

এটা সবিতার চোখে অশ্রু এনে দেয়।
এটা সেই মুহূর্ত ছিল, যখন সে বুঝেছিল, তার সংগ্রাম একমাত্র নিজের জন্য নয়, বরং এই মেয়েদের জন্য।

একদিন স্কুলের শিক্ষিকা রুনা আপু এসে সবিতার কাছে জানান,

— “কিছু স্থানীয় নেতারা বলেছে, তারা নবআলোকে বন্ধ করতে চায়।
তাদের দাবি, এই স্কুলে পড়া মেয়েরা অনেক কিছু শিখছে যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর।”

সবিতা অবাক হয়ে যায়,

— “এটা তো কখনোই ভাবিনি। কিন্তু আমি তাদের বলব—এখানে আমরা শুধু মেয়েদের শিক্ষা নয়, মানবিকতা ও স্বাধীনতা শেখাই।”

তাওহীদ আসে, এবং তাকে সমর্থন দেয়।

— “তুমি একা না সবিতা। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। এই সংগ্রাম আমরা একসঙ্গে করব।”

সবিতার মনে শান্তি ফিরে আসে।
এটা তার সংগ্রামের দ্বিতীয় বড় পর্ব।
কিন্তু সে জানে, এবার কোনোরকম ভয় বা সন্ত্রাস তাকে থামাতে পারবে না।

একদিন রাতে সবিতা বসে থাকে একা, নতুন কিছু পরিকল্পনা নিয়ে।
— “আমি আর থামব না। এখানে কিছু পাথর ফেলা হলে, আমি সেই পাথরগুলো নিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করব।
আমার মেয়েরা সব ধরণের বাধা টপকাতে পারবে।”

সে ঠিক করে, এই প্রতিবাদকেই শক্তি হিসেবে নিতে হবে।
যে সমাজ তাকে বাধা দিতে চায়, সেই সমাজকে দেখিয়ে দিতে হবে—মেয়েরা শুধু দাসত্বের জন্য জন্ম নেয় না,
তারা স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার রাখে।

তাওহীদ এসে দাঁড়িয়ে বলল,

— “তুমি একদিন পুরো সমাজের চোখ খুলে দিবে সবিতা, তোমার স্বপ্নগুলো রূপান্তরিত হবে বাস্তবে।
তোমার সংগ্রাম শুরুর দিকে ছিল একক, কিন্তু এখন সেটা সবার। আর আমরা সবাই তোমার পাশে আছি।”

নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্রের পথ চলা ক্রমশ আরও জটিল হয়ে উঠছে। সবিতা জানে, এই যাত্রা সহজ হবে না। সমাজের পুরনো ধ্যানধারণা আর বদ্ধমূল বিশ্বাসগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে আরও শক্ত হতে হবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা কেবল সমাজের মানুষই নয়, কিছু রাজনৈতিক শক্তিও। এখন এই পথটাই সবিতার জন্য সত্যিকারের পরীক্ষা।

একদিন দুপুরের পরে সবিতা স্কুলে পৌঁছানোর আগে, স্থানীয় এক নেতা এসে জানায়,

— “তোমার স্কুলের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠেছে। যদি এসব বন্ধ না হয়, আমরা তোমাকে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করব।”

সবিতা একটু থমকে দাঁড়িয়ে যায়।

— “অভিযোগ কি ধরনের?”

— “মেয়েদের মনে স্বাধীনতার ভাবনা, অশিক্ষার পরিবেশ। এমনকি, অনেকের মতে, এখানে এসে মেয়েরা সমাজের নৈতিকতার বিরুদ্ধে কাজ করছে।”

এই কথাগুলো সবিতার মনকে একেবারে শূন্য করে দেয়, তবে সে জানে, হাল ছাড়লে তো চলবে না। সে দৃঢ়তার সাথে জানায়,

— “আমরা শুধু মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করছি। আর এই শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের জন্য ভালো কিছু হতে পারে, এটাই আমার বিশ্বাস।”

নেতা কিছু না বলে চলে যায়, কিন্তু তার কথাগুলো সবিতার মাথায় ঘুরতে থাকে।
তার মনের ভিতরে একটা ঝড় চলছে, তবে সে জানে—কোনো ভয়েই তাকে থামানো যাবে না।

একদিকে সবিতা লড়াই করছে বাইরে, অন্যদিকে তার শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনে নতুন সুযোগ ও পরিবর্তন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
রুমাইসা, যাকে একসময় অন্ধকারের পথে চলতে দেখেছিল, এখন অন্য মেয়েদের কাছে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা শেয়ার করে।
একদিন, সে সবিতার কাছে এসে বলে,

— “আপু, আমি জানি, আমি যদি এখানে না আসতাম, তাহলে হয়তো আমি আজও সেই পুরনো জীবনেই থাকতাম। এই স্কুলে এসে আমি শুধু পড়াশোনা শিখিনি, আমি শিখেছি কীভাবে নিজেকে সম্মান করতে হয়।”

সবিতা গর্বিত হয়ে বলে,
— “তুমি যেভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছো, সেটা খুবই প্রশংসনীয়। তবে মনে রেখো, এখনও অনেক পথ চলা বাকি।”

আয়ন, রুমাইসার বন্ধু, এবার স্কুলে যোগ দিয়েছে। সে আসে, তার মুখে আত্মবিশ্বাস এবং চোখে নতুন স্বপ্নের আভা।
একদিন সবিতা আয়শাকে বলে,
— “তুমি কি জানো, তুমি যদি সাহসী না হতে, তাহলে এখানে আসা হতো না।”

আয়শা মাথা নিচু করে বলে,
— “আপু, আমার কাছে এই স্কুল শুধু শিক্ষা নয়, এটা আমার বেঁচে থাকার পথ।”

________

একদিন, সবিতা এক বিশেষ সভার আয়োজন করে, যেখানে তার শিক্ষার্থীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবে।
সভায় উপস্থিত হয় স্থানীয় অনেক গুণী মানুষ এবং সাংবাদিকও।
রুমাইসা, আয়শা, সিমলা—এরা সবাই নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে, কিভাবে তারা নবআলোতে এসে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে।

তারপর সবিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

— “আজ আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে জানাচ্ছি—আমরা শুধু মেয়ে শিক্ষার জন্য কাজ করছি না, আমরা তাদের জীবনের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছি।
এই স্কুল শুধু শিক্ষার জায়গা নয়, এটা একটি আন্দোলন, যেখানে প্রতিটি মেয়ে তাদের সঠিক জায়গা খুঁজে পাবে।”

সকলের চোখে চোখে আবেগ দেখা যায়, কেউ বা কেঁদে ফেলে, কেউ আবার হাসে।
এই দিনটা সবিতার জীবনের সবচেয়ে বড় মুহূর্ত।
সে বুঝতে পারে, তার সংগ্রাম শুধু নিজের জন্য নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য।

অল্প সময়ের মধ্যে নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্র ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু জনপ্রিয়তার সঙ্গে বেড়ে ওঠে সমস্যাও।
একদিন সবিতা হঠাৎই খবর পায়, যে রাজনৈতিক দলের নেতারা আরেকবার তাদের স্কুলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইছে।
এবার তারা জানিয়েছে, “এই স্কুলের কর্মকাণ্ডের জন্য সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে পড়ছে। যদি না বন্ধ করা হয়, তাহলে আরো বড় বিপদ আসবে।”

সবিতা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে জানে, এবার পরিস্থিতি আরো কঠিন হতে যাচ্ছে।
তবে তার মন দৃঢ়। সে জানে, সত্যের পথে চলতে থাকলে, একসময় আলোর দেখা পাওয়া যাবে।
সে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

— “আমরা আমাদের সংগ্রামে অবিচল। যখন মানুষ একসঙ্গে হয়, তখন তারা কোনকিছুই হারাতে পারে না।”

নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্রের কক্ষগুলোতে এখন আর কেবল বইয়ের পাতা উল্টানোর শব্দ নয়, বরং প্রতিদিনই নতুন স্বপ্নের জন্ম হয় এখানে। মেয়েরা যে সমাজ তাদের ‘বোঝা’ ভেবে অবহেলা করেছে, সেই সমাজেই তারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ শুরু করেছে। কিন্তু ঠিক তখনই শুরু হলো আরেকটি ঝড়।

এক দুপুরে স্কুলে ঢোকে এক অফিসার, সঙ্গে হাতে কাগজ।
— “আপনার নামে অভিযোগ এসেছে ম্যাডাম। আপনি নাকি মেয়েদের উসকে দিচ্ছেন, পরিবার আর সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছেন। আপনার স্কুল বন্ধের নির্দেশ এসেছে।”

সবিতা অবাক হলেও ভেঙে পড়েনি। সে চুপচাপ কাগজটা পড়ে, তারপর মাথা উঁচু করে বলে,

— “যে সমাজ অন্যায় মেনে নেয়, সেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে কেউ একজন তো দাঁড়াবেই। আমি পিছিয়ে যাবো না। আমার মেয়েরা জানে কীভাবে লড়তে হয়।”

অফিসার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
— “আপনার কথা ঠিক। কিন্তু প্রভাবশালীরা চায় না এই জায়গা টিকে থাকুক। সাবধান থাকবেন।”

সবিতা জানে, ঝড় এসে গেছে। এখন লড়াইটা শুধু একটা স্কুল টিকিয়ে রাখার নয়—এটা একটি আদর্শ বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।

সেদিন সন্ধ্যায় সবিতা মেয়েদের ডেকে বলে,

— “আমাদের স্কুল হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। তোমাদের যদি ভয় হয়, তাহলে চলে যেতে পারো। আমি কাউকে দোষ দেবো না।”

কিন্তু সিমলা বলে ওঠে,
— “আপু, যদি আপনি লড়েন, আমরা কেন পালাবো? আপনি আমাদের দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। এবার আমরাও দাঁড়াবো আপনার পাশে।”

আয়শা বলে,
— “এই স্কুলটা আমার আত্মার মতো। কেউ যদি এটা কেড়ে নিতে চায়, তাকে আমার বুকের রক্তের ওপর দিয়ে যেতে হবে।”

সবার চোখে দৃঢ়তা।
সবিতা অনুভব করে, সে আর একা নেই।

আন্দোলনের শুরু,

মেয়েরা নিজেরাই একটি প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে।
স্থানীয় গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে—”একদল মেয়ে, তাদের শিক্ষিকার নেতৃত্বে, নারী শিক্ষার অধিকার বাঁচাতে পথে নেমেছে।”

সমাবেশে এক বুড়ি মা এসে বলেন,
— “আমার ছেলেও চায় না আমি স্কুলে পড়ি। কিন্তু সবিতা আপুর স্কুলে এসে আমি শিখছি কীভাবে নাম লিখতে হয়। আমার জীবনটা নতুনভাবে শুরু হচ্ছে।”

এই ধরনের বক্তব্যে চারপাশ নড়ে ওঠে।
যারা সবিতার বিরুদ্ধে ছিল, তারাও এবার একটু থেমে যায়,সবাই বুঝতে পারে সবিতাকে আর আটকানো যাবে না,সে তার আলো সকল অবহেলিত আর নির্যাতিত মেয়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিবে।

শেষ দৃশ্য

সবিতা রাতে নবআলো’র ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশে চাঁদ, চারপাশে নীরবতা।
তার পাশে এসে এক এক করে সকল মেয়েরা দাঁড়ায়।
সিমলা বলে,
— “আপু, ভয় লাগছে?”

সবিতা হালকা হাসে,

— “ভয় লাগে, কিন্তু ভয় পেয়ে থেমে থাকলে তো আলো জ্বলবে না।”

সবিতা বুঝে যায়—এই মেয়েগুলোই তার শক্তি। এটাই তার সত্যিকারের পরিবার।

সমাপ্ত

সবিতা পর্ব-১১

0

সবিতা
পর্ব : ১১
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতার জীবনে এখন শান্ত একটা রুটিন।

স্কুল, শিক্ষার্থীদের গল্প, আয়শার ঘুরে দাঁড়ানো… সব মিলিয়ে সে এখন একজন সত্যিকারের পথপ্রদর্শক।
কিন্তু জীবনের বাঁকে বাঁকে যে টানাপোড়েন জমে থাকে, একদিন সেই পুরনো মুখ ঠিকই ফিরে আসে।

একদিন হঠাৎ…
স্কুল ছুটির পর গেটের সামনে একটা সাদা গাড়ি।
সবিতা প্রথমে পাত্তা দেয় না।
কিন্তু ভেতর থেকে যখন লোকটা নামে, তার চোখ আটকে যায়— সাইফ।

হাঁটুর ওপর একটা দামী পাঞ্জাবি, চোখে ক্লান্তি, আর মুখে একটা অনুশোচনাময় ভঙ্গি।

— সবিতা, তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”

সবিতার কণ্ঠ ঠান্ডা, কিন্তু দৃঢ়।

— “তুমি তো ভেবেছিলে আমাকে ঠকিয়ে তুমি ভালো থাকবে, ভালো আছো কি?

সাইফ চুপ। তারপর কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলে,
— “ভুল করেছি। অনেক বড় ভুল। তুমি থাকতে বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝি আমি কী হারিয়েছি।”

সবিতা তাকিয়ে থাকে সাইফের চোখে।
এই মানুষটা একসময় তার সব ছিল।
আজ শুধু একটা পরিচিত ছায়া।

— “তুমি যেটা হারিয়েছ, সেটা আমি একটুও হারাইনি, সাইফ। বরং আমি নিজেরে খুঁজে পেয়েছি। নিজের একটা আলোকপথ বানিয়ে নিয়েছি।”

সাইফ কণ্ঠ নরম করে নির্লজ্জের মতো আজও বলে,
— “তুমি চাইলে… আবার শুরু করতে পারি?”

সবিতার উত্তর আসে ধীরে, কিন্তু অমোঘভাবে—
— “আমি শুরু করেছি, সাইফ। তবে সেটা তোমার সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গে। আর সেই শুরুতে তোমার কোনো জায়গা নেই।”

সাইফ আজ ও শূন্য হাতেই ফিরে যায়।

তবে রাতের ডায়েরিতে সবিতা লেখে

> “আজ আমি তাকে ক্ষমা করেছি।
কিন্তু ফিরে যাওয়া আমার জীবনের লক্ষ্য নয়।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই তো আমি সেই রাতে বেরিয়ে এসেছিলাম… অন্ধকার পেরিয়ে আলোর খোঁজে।”সেই আলো আমি খুঁজে পেয়েছি,তাহলে কেনো আবার অন্ধকারে যাবো?

সবিতার জীবনটা যেন সত্যিই একটা বইয়ের মতো—

প্রতিটি অধ্যায়ে নতুন কিছু, নতুন যুদ্ধ, আর নতুন আলো।
সাইফের ফিরে আসা তাকে কাঁপিয়ে দেয়নি, বরং নিজের অবস্থানটা আরও পরিষ্কার করে দিয়েছে।
এখন সে জানে—নিজের পথেই সে আলোর খোঁজ পেয়েছে।

আয়শা এখন শুধু আঁকেনা, কথা বলতেও শিখে গেছে।
সে অন্য মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়, তাদের গল্প শোনে, সাহস দেয়।
একদিন সবিতাকে বলল,

— “আপু, আমি যদি নিজের একটা গ্রুপ বানাই?
যারা নিজেদের গল্প বলবে, আর একে অপরের পাশে দাঁড়াবে?”

সবিতার মুখে প্রশংসার হাসি।

— “এই পথটাই তো তোদের জন্য খুলে দিতে চেয়েছিলাম।
তুই নিজেই নিজের ‘আয়শা’ হয়ে উঠেছিস।”

আয়শা মাথা নেড়ে বলে,
— “আপু, আমি একদিন আপনার মতোই হবো।
মানুষকে বোঝাবো—আগুন দিয়ে নয়, আলো দিয়ে বাঁচতে হয়।”

এদিকে তাওহীদ নিজের উদ্যোগ নিয়ে ব্যস্ত।
সবিতার স্কুলকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
একদিন দুজনে ছাদে বসে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলে—

তাওহীদ বলল,
— “স্কুলটাকে আরও বড় করতে চাই।
নিজের একটা জায়গা, যেখানে তুমি ইচ্ছামতো স্বপ্ন বুনবে।
আমিও পাশে থাকব—সহযোদ্ধা হয়ে।”

সবিতা তাকিয়ে থাকে তাওহীদের দিকে।
এই মানুষটা কখনোই তাকে দাবী করেনি, কিন্তু প্রতিটি স্বপ্ন পূরণের পথে এক শক্ত ভরসার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাওহীদ অনেক সাহস নিয়েই বলে,

— “একদিন একটা বাড়ি হবে আমাদের,
যেখানে থাকবে শুধু সম্মান, ভালোবাসা আর স্বপ্ন,”

সবিতা মুচকি হাসে।

এতো কিছুর মধ্যেও সমাজ থেমে থাকে না।
মেয়ে হয়ে এতদূর আসার পরও সবিতাকে কটাক্ষ করা হয়—
“নিজের সংসার না গড়েই নাকি এত নারী ক্ষমতায়নের কথা!”
“ভাঙা সংসার নিয়ে এসব নাটক!”

কিন্তু সবিতা জানে, এদের জবাব কথায় নয়—কাজে দিতে হয়।
প্রতিদিন আরও একজন মেয়ের জীবন বদলানোই তার সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ এখন।

একদিন তাওহীদ সবিতাকে নিয়ে যায় একটা জমির সামনে—
খালি জায়গা, পাশে গাছপালা, আর দূরে ছোট্ট একটা নদী।

— “এখানেই হবে তোমার নতুন স্কুল—‘নবআলো’।”
— “নতুন ঠিকানা, নতুন শুরু।
তুমি মেয়েদের শেখাবে নিজের মতো করে বাঁচতে, আর আমি তোমার ছায়া হয়ে থাকব।”

সবিতার চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।
নিজের স্বপ্নগুলোকে এতদিন কাগজে আঁকতো, আজ সে স্বপ্নগুলো মাটিতে গেঁথে যাবে।

সে মনে মনে বলে—
“আমি ফিরে যাচ্ছি না। আমি এগিয়ে যাচ্ছি—নিজের গল্প, নিজের মানুষ, আর নিজের আলো নিয়ে।”

দুই মাস পেরিয়ে গেছে। খালি জমিটা এখন আর খালি নেই। বাঁশের চটা ঘর, টিনের ছাউনি আর দেয়ালে রঙিন আঁকা—
লেখা আছে বড় করে:

“নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্র”

এই ছোট্ট স্কুলঘর এখন যেন একটা বিপ্লবের কেন্দ্র।
প্রতিদিন সকাল হতেই আশেপাশের গ্রামের মেয়েরা ভিড় জমায়।
কারও চোখে ভয়, কারও মুখে কৌতূহল, আর কারও মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা আশা।

সবিতা দাঁড়িয়ে থাকে গেটের পাশে,
যেন এই আলো তার নয়, বরং তাদের জন্য—যারা পথ হারিয়ে খুঁজে ফিরছে নিজের নাম, নিজের সম্মান, নিজের স্বপ্ন।

একটা মেয়ে প্রথমদিন এসেই কোণায় বসে পড়ে। কারও সঙ্গে কথা বলে না।

নাম?
রুমাইসা।
বয়স ১৫। বাবা নেই, সৎমায়ের হাতে নির্যাতন। পড়াশোনা বলতে খুব সামান্য। মুখে একটা দগদগে দাগ।

সবিতা তার পাশে বসে।

— “আয়নার দিকে তাকাতে ভয় পাও?”

রুমাইসা চোখ ঘোরায়, কিছু বলে না।

সবিতা ধীরে বলে—

— “এই দাগটা তোমার না, সমাজের। তুমি ওটা নিয়েই সুন্দর। আমরা সবাই কিছু না কিছু নিয়ে এসেছি এখানে। নবআলোতে তুমি আর ‘অসুন্দর’ নও, তুমি শক্তি।”

রুমাইসা চোখ মুছে তাকায়।
একটা ভেতরের তোলপাড় যেন তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।
সেদিন থেকে সে প্রতিদিন নিয়ম করে আসে।

স্কুলের প্রথম মাস শেষ হলে, তাওহীদ এক সন্ধ্যায় এসে সবিতাকে একটি ছোট বাক্স দেয়।

— “খুলে দেখো।”

সবিতা খুলে দেখে ভেতরে ছোট ছোট কার্ড।

প্রতিটি মেয়ের হাতে লেখা চিঠি।

“আপু, আপনি না থাকলে আমি এখনো রান্নাঘরের কাজ করতাম।”

“আপু, আপনি আমাকে নাম দিয়েছেন। ‘বেকার’ থেকে ‘শিক্ষার্থী’ বানিয়েছেন।”

“আপু, আপনি আমার মা, আপু, আলোর মানুষ।”

সবিতা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

তাওহীদ হেসে বলে—
— “শুধু শিক্ষা নয়, তুমি ভালোবাসাও শিখিয়েছো ওদের।”

এক সন্ধ্যায়

সবিতা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে আকাশ লালচে।
হাতের চায়ের কাপটা ধরে ফিসফিস করে বলে—
“আমি হারাইনি, বরং পেয়েছি।
নিজেকে, আমার মানুষগুলোকে, আর এই আলোর পথটাকে।”

তাওহীদ এসে পাশে দাঁড়ায়।
— “তুমি একা নও সবিতা। তোমাকে দেখে আমরাও পথ খুঁজে পাই।”

সবিতা হেসে বলে—

— “আমার নাম হলো সবিতা, মানে সূর্য।
এজন্য আমি যত দিন বেঁচে থাকবো গরীব,অসহায় আর নির্যাতিত মেয়েদের আলো দিয়ে যাবো।

আজ আমি কেবল আলোর মাঝেই বাস করছি, আর চাই যেন এই আলো কারও চোখে আর নিভে না যায়।”

চলবে_____

সবিতা পর্ব-১০

0

সবিতা
পর্ব : ১০
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

নতুন পথের শুরুতে সবসময়ই কিছু প্রশ্ন থাকে।
তাওহীদের বিয়ের প্রস্তাবের পর সবিতা এখন রাতজাগে। একা একা পুরনো দিনের ডায়েরি পড়ে—সাইফের নির্লিপ্ততা, শ্বশুরবাড়ির চুপচাপ সহ্য করা অত্যাচার , নিজের কান্নাভেজা রাতগুলো।
সবকিছু মিলিয়ে সে একটাই সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর কারো সংসারে নয়, নিজের পরিচয়ের ভেতরেই বাঁচতে চায়।

সবিতা এখন জানে, জীবন কখনো সোজা হয় না।
তবু তার গল্প থেমে নেই। সে লিখছে একেকটা মেয়ের মুক্তির গল্প।
আর তার পাশে একজন মানুষ—তাওহীদ—যে ভালোবাসা দাবি করতে চায় না, শুধু থাকতে চায় তার ছায়া হয়ে।আর সবিতাও তাকে বন্ধু হিসেবেই রেখে দিয়েছে।

বিকেলের আলো গা ছুঁয়ে যায়।
সবিতার স্কুলে আজ বিশেষ আয়োজন—নারী উদ্যোক্তা উৎসব।
সবিতার হাতে গড়া ছাত্রীরা আজ নিজেদের বানানো হ্যান্ডিক্রাফট, জামা-কাপড়, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে।
লোকজন মুগ্ধ। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না—এই মেয়েগুলো একসময় নির্যাতিত, পরিত্যক্ত ছিল।

এই উৎসবের মাঝেই তাওহীদ পাশে এসে দাঁড়ায়।

– “তোমার মেয়েগুলো তোমার মতোই জেদি, জানো?”
সবিতা মুচকি হেসে বলে,
– “তাদের জেদটুকু দিয়েই ওরা বাঁচবে।”

সবকিছুর মাঝে একদিন অপ্রত্যাশিত একজন অতিথি আসে—সাইফের মা।

হঠাৎ তাকে দেখে সবিতা থমকে যায়।

– “তোমার সঙ্গে কথা আছে মা রে,” কাঁপা গলায় বলে।
সবার চোখের আড়ালে তারা একটু দূরে গিয়ে বসে।

– “আমি জানি, তোকে কোনোদিন আমরা তোর প্রাপ্য সম্মান টুকু দিতে পারিনি।অনেক অত্যাচার করেছি তোর সাথে,তুই মুখ বুঝে সব শুধু সহ্য করে গেছিস।এখন আমরা সবাই আমাদের ভুল বুঝতে পারি, ভুলটা আমাদের ই ছিল,তুই নিষ্পাপ, ফুলের মতো পবিত্র ছিলি।

সবিতা চুপচাপ, তার কোনো উত্তর নেই,আর কি উত্তর দেবে সে?
সাইফের মা এবার বললো,
তুই নিজের মতো করে উঠেছিস—আমি সবাই গর্বিত।”এটা ধরে রাখ।

এবার সবিতার চোখে জল আসে। সে কিছু বলে না। কিন্তু এই অনুতপ্ত স্বীকারোক্তি তার দীর্ঘ ক্লান্ত পথের প্রতি একধরনের স্বীকৃতি।

সবিতা মনে মনে বলে, সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি,কারণ তোমরা সেদিন আমার উপর এই নির্যাতন না করলে আজ আমি সবিতা হতে পারতাম না।

দেখতে দেখতে আরও এক বছর কেটে যায়।

সবিতার স্কুল এখন রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত।
পাঁচজন ছাত্রী আজ চাকরি পেয়েছে এনজিওতে।
তিনজন নিজের দোকান খুলেছে।

সবিতা নিজেও একটা প্রজেক্ট হেড পদে যোগ দেয়—নারী অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে বড় এক প্রোগ্রামে।

এক সন্ধ্যায় ছাদে বসে চা খাওয়ার সময়, তাওহীদ খুব সহজ করে বলে—

– “সবিতা, এবার যদি তুমি রাজি থাকো, তবে চল একটা ছোট্ট বাসা নিই।
তুমি স্কুল চালাবে, আমি অফিস করব, আর সন্ধ্যায় একসঙ্গে চা খাব।
ভালোবাসার চেয়ে সম্মানের জায়গাটা আগে থাকবে, এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”

সবিতা শুধু হাসে,কিন্তু কিছু বলে না।

হেমন্তের হাওয়া বইছে।
নতুন একটা ভোর এসেছে—শান্ত, ধূসর, অথচ আশায় ভরা।
সবিতা আজ প্রথমবার নিজের নামে একটা চেক হাতে পেয়েছে।
নিজের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে, নিজের স্বাক্ষরসহ।
চোখে জল চলে আসে—এ যেন কাগজের মধ্যে জীবনের ছাপ।

তাওহীদ এসে বলে,
— “আজ তোমাকে গাড়ি করে স্কুলে নিয়ে যাবো। সময় হয়ে গেছে ‘সাইকেলচালিত স্বপ্ন’ ছাড়ার।”

সবিতা হেসে ওঠে।
সেই হাসির ভিতর ছিল নতুন জীবনের দৃঢ়তা।

একদিন হঠাৎ কাকুলির ফোন আসে।
— “তুই এত দূর চলে গেছিস, আন্নি। আমি গর্বিত, জানিস?”

সবিতা তা শুনে বলে একদিন দেখতে আসিস আমাকে,আমাকে কি দেখতে ইচ্ছে করে না?

কাকুলি হেসে উত্তর দেয়,যাবো,যাবো।তুই রেডি থাকিস।

জানিস,কাকুলি মা-ও ফোন দেয় মাঝে মাঝে।
বলে,
— “তোর বাচ্চাগুলোকে একদিন আমাদের বাড়িতে আনিস।”
সেই কণ্ঠে অনুশোচনা নেই, আছে একধরনের শান্ত সমর্পণ।

আমার যে কত খুশি লাগে এখন।

কাকুলি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে তুই সার্থক হয়েছিস আন্নি।তুই আমাদের সবার গর্ব।

__________

সবিতা বার বার সাইফ কে ফিরিয়ে দেওয়ায় আর যোগাযোগ করেনি সাইফ।
তবে শোনা যায়, অহনার সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই,সবিতা সাইফ কে ছেড়ে চলে আসার পর পরই সে অহনার থেকেও দূরে সরে যায়।সাইফ তার ভুল বুঝতে পারে,সে সবিতাকে ছাড়া ভালো নেই।

একসময় মানুষ যে ফাঁকা জায়গায় ভালোবাসা খোঁজে, সেখানে শুধু আজ ক্ষমা জেগে থাকে।

সবিতার স্কুলে এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে।

একটা মেয়েকে স্কুলে নিয়ে আসে স্থানীয় ওসি সাহেব।
মেয়েটা নাকি আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।

নাম—আয়শা।
চোখে ভয়ার্ত অন্ধকার।
মুখে একটাও শব্দ নেই।
কিন্তু সবিতা জানে, এই মেয়েটাই আগামী দিনের আগুন হবে—জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নয়, আলো ছড়িয়ে।

সবিতা তার পাশে বসে বলে,

— “তোকে আর কিছু বলতে হবে না। আমি তোর মতই একদিন গুমরে কেঁদেছিলাম।”

আয়শা চুপ করে থাকে। কিন্তু তার ঠোঁটে একটুখানি কম্পন—
কোনো এক ভরসার ইশারা যেন।

সবিতা আর তাওহীদ একসাথে ছাদে দাঁড়িয়ে।
নিচে শহরের আলো, মাথার ওপর তারা।
তাওহীদ বলে,

— “তোমার প্রতিটি যুদ্ধের পাশে থাকার শপথ আজ আবার করছি।”

সবিতা তখন হঠাৎ কোনো কিছু না ভেবে বলে,

— “আমি আর কোনোদিন পালাতে চাই না। এবার আমি থাকবো—নিজের গল্পের কেন্দ্রে, নিজের মতো করে।”

তাওহীদ হেসে ওঠে শুধু,কিন্তু কিছু বলে না।সবিতা যে তাকে অগাধ বিশ্বাস করে তা তাওহীদ ভালো করেই জানে।হয় তো একটু আধটু পছন্দও করে।কিন্তু বলার সাহস পায় না।সবিতা সংসার জীবন টাকে আজকাল অনেক বেশি ভয় পায়।

সবিতা আর তাওহীদ একসাথে আকাশের দিকে তাকায়।
তারা আজ অনেক দূরে।ঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

সকালবেলা।
স্কুলের বারান্দায় সূর্যের আলো এসে পড়ে।
আয়শা এখনো চুপচাপ। কেউ কোনো প্রশ্ন করে না।
সবিতা জানে—প্রথমে কথা নয়, দরকার ভরসা।

তাই প্রতিদিন সবিতা নিজের হাতে তাকে নাস্তা দেয়, পাশে বসে গল্প করে।
একদিন হঠাৎ আয়শা বলে ওঠে,

– “আপু, আমি আসলে মরতে চাইনি। শুধু সবাইকে একটু বোঝাতে চেয়েছিলাম, আমি কতটা কষ্টে আছি।”

সবিতা থেমে থাকে। তারপর মাথায় হাত রেখে বলে,
– “তুই বেঁচে আছিস, সেটাই এখন আমাদের শক্তি।”

দুপুরের রোদ্দুরে আয়শা একদিন নিজের গল্প খুলে বলে—
তার চাচাতো ভাইয়ের হাতে নিপীড়িত হওয়া,
মা-বাবার চুপচাপ মুখ,
আর একদিন তার মায়ের বলা কথা—
“তোর মুখ বন্ধ রাখ, নয়তো তোর জন্যই আমাদের মান-ইজ্জত যাবে।”

সেই দিন থেকেই আয়শার ভিতরে আগুন জমে।
একদিন আগুন দিয়েই নিজের শরীর পোড়াতে চেয়েছিল।
কিন্তু ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছে।

সবিতার চোখে জল আসে, তবু গলা শক্ত করে বলে,
– “তুই একটা যুদ্ধিনী, আয়শা। যুদ্ধ না করলে তো অন্যায়েরাই জয়ী হয়।”

পরবর্তী কিছুদিনে আয়শা আবার আঁকতে শুরু করে।
তার ছবিতে এক মেয়ের মুখে থাকে আগুন, চোখে অশ্রু আর পেছনে বিশাল এক ডানা।

স্কুলে আয়োজিত “আলোকিত বাঁচা” প্রতিযোগিতায় সে এই আঁকা জমা দেয়।
প্রথম পুরস্কার তার হয়ে যায়।
লোকজন ভীষণ মুগ্ধ হয়। সংবাদপত্রেও আসে এই খবর—
“আগুন থেকে আলোর পথে: আয়শার গল্প”

শেষে এক চিঠি

এক সন্ধ্যায় আয়শা সবিতাকে একটা চিঠি দেয়—

> “আপু, আপনি না থাকলে আমি সত্যিই থাকতাম না।
আমি এখন জানি, আমি কারও বোঝা না।
আমি নিজেই একটা স্বপ্ন।
আপনার কাছ থেকে আমি শুধু ভরসা না, একটা নতুন জীবন পেয়েছি।
আমি বড় হয়ে ঠিক আপনার মতো একটা স্কুল খুলব।
যেখানে আরেকটা আয়শা আসলে, তাকে কেউ মরতে না বলে—বাঁচতে বলবে।”

সবিতার চোখে জল আসে।
সে জানে, এই গল্পের শুরুটা কষ্টের হলেও শেষটা আলোর, সাহসের আর শক্তির।

চলবে______

সবিতা পর্ব-০৯

0

সবিতা
পর্ব: ০৯
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা, যেটি ছিল তার জীবনের একক সংগ্রাম, এখন সেটি হয়ে উঠেছে একটি বৃহৎ উদ্যোগ—সমাজে পরিবর্তন আনা। তার বই, সেমিনার এবং লেখালেখি জীবনে সবার সাথে একযোগভাবে প্রভাব ফেলছিল। এবার সে একটি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করল, যার নাম ছিল “শক্তি সচেতনতা”। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সবিতা অনেক তরুণ-তরুণীকে জীবনে তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছিল। সে বিশ্বাস করেছিল, যখন একজন মানুষ নিজের আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায়, তখন সে পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর করতে পারে।

সবিতা তাঁর এই উদ্যোগের মাধ্যমে আরও অনেক মানুষকে নিজেদের ভেতরের শক্তি এবং সম্ভাবনার প্রতি বিশ্বাসী করতে চাইছিল। তার এই প্রজেক্টে এমন হাজারো তরুণ-তরুণী একত্রিত হয়েছিল যারা নিজেদের জীবনের নতুন পথ খুঁজছিল।

____

সবিতার জীবন এখন এক নতুন মোড় নিতে চলেছে। তার শুরু করা উদ্যোগ “শক্তি সচেতনতা” এখন এক বৃহৎ আন্দোলনে পরিণত হতে চলেছে। মানুষ আরও বেশি করে তার গল্পের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে এবং জীবনের উদ্দেশ্য খোঁজার জন্য একত্রিত হচ্ছে।সবিতা জানতো, এটি এক রাতের ব্যাপার নয়, তবে সে শুরু করেছে, এবং তার মনোবল সবার মাঝে আশার আলো জ্বালিয়েছে।

সবিতা তার উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছিল। সে জানতো, সঠিক পথ চলতে পারলে একজন মানুষ কীভাবে তার জীবনে বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে। সেমিনার, বই আলোচনা, এবং প্রাকটিক্যাল ক্লাসের মাধ্যমে সবিতা তরুণদের জীবন সম্পর্কে ধারণা দিতে চাইছিল। তার প্রতিটি বক্তৃতা যেন একটি অনুপ্রেরণার ঝরনা হয়ে পড়েছিল।

সেখানে, একদিন এক তরুণী সবিতার কাছে এসে বলল—

– “আপনার বই এবং সেমিনারের পর আমার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। আমি এখন জানি, আমি কী চাই। আমি জানি, আমি শুধু স্বপ্ন দেখতে চাই না, স্বপ্ন বাস্তব করার জন্য কাজ করতে হবে।”

সবিতা তার চোখে এক উজ্জ্বল হাসি দিয়ে বলল—

– “আমরা কেউ কখনো একা নই। আমাদের মধ্যে যে শক্তি রয়েছে, সেটিই আমাদের একে অপরের দিকে টেনে আনে। তোমরা যদি বিশ্বাস রাখো, তুমি তোমার পথ খুঁজে পাবে।”

এভাবেই সবিতা তার কাজকে আরও গভীর করে চলছিল। তার প্রতিটি উদ্যোগ নতুন আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু এখন, সবিতার সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে।

________

একদিন সবিতা একটি বড় সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন পেশার মানুষ—কর্মী, উদ্যোক্তা, শিক্ষিকা, চাকরিজীবী, এমনকি ছাত্রছাত্রীরাও।সবিতা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো—

– “আমরা সবাই জানি, জীবনে চ্যালেঞ্জ আসে, সমস্যা আসে, তবে যদি আমরা একে অপরকে সহায়তা করি, একে অপরের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি, তবে কোনো বাধাই আমাদের অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। আমি চাই এই মঞ্চ থেকে আমরা সবাই মিলে একটি সংকল্প নি—নিজেকে বিশ্বাস করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।”

তার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হর্ষধ্বনিতে মাতিয়ে তোলে। তাদের মধ্যে অনেকেই উঠে দাঁড়িয়ে সবিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। সবিতা জানতো, তার কাজটা সঠিক পথে যাচ্ছে।

___

একদিন, সবিতা তার এক বন্ধু রিয়া’র সাথে বসে কথা বলছিল। রিয়া বলল—

– “তুমি জানো, সবিতা, তুমি একাই অনেক কিছু করতে পারো। কিন্তু এখন তুমি একে অপরকে সাহায্য করার মাধ্যমে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারছো। তোমার কাজের জন্য আমি গর্বিত।”

সবিতা হাসিমুখে বলল—

– “ধন্যবাদ, রিয়া। তবে আমি জানি, এই পথ কখনো শেষ হবে না। প্রতিটি নতুন দিন একটি নতুন সুযোগ এনে দেয়।”

এভাবেই সবিতা তার জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এখন তার পথের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল, তবে সে জানতো, তার মাঝে যে শক্তি আছে, তা দিয়ে কোনো কিছুই অতিক্রম করা অসম্ভব নয়।
………

সন্ধ্যা নামে ঢাকার আকাশে। ক্লান্ত শহরের গা ঘেঁষে এক নিঃশব্দ বাসার জানালায় বসে সবিতা চুপচাপ চা খাচ্ছে। তাওহীদ আসেনি আজ। হঠাৎই একটা ফোন আসে—আমেনা আপার।

– “আন্নি মা খুব অসুস্থ। অনেকদিন ধরে তোকে দেখতে চাইছে। তুই যদি একটু…”

চুপ করে থাকে সবিতা। কিছু বলার মতো শব্দ পায় না। অনেক অভিমান, তবু মা তো মা-ই। পরদিনই সে ছুটে যায় মায়ের কাছে।

মায়ের চোখে জল

মা বিছানায় শুয়ে আছেন। শরীর শুকিয়ে গেছে, কণ্ঠ ক্ষীণ।

– “তুই ভালো আছিস তো মা?”

সবিতা চোখের জল আটকে রাখে। অনেকদিন পর এই মমতা-মাখানো কণ্ঠ শুনে বুকের ভেতরটা গলে যায়।

– “ভালো থাকার লড়াই করছি মা…”

– “তোর মতো মেয়ে… একদিন অনেক উঁচুতে যাবে। সাইফ বোঝে নাই, তাতে কী হয়েছে? তুই নিজের মতো করে আলো হবি…”

সবিতা মায়ের হাত ধরে রাখে। কাঁদে না, শুধু খুব নীরবে হাসে।

সবিতা আবার কাজ শুরু করে। “উত্তরণ”-এর ক্যাম্পেইন এবার গ্রামে, যেখানে নারীদের শিক্ষার অভাব এখনো প্রকট।
সে প্রতিদিন সকালে বের হয়, ছুটে বেড়ায় একেকটা ইউনিয়নে। তার চোখে নতুন স্বপ্ন—একটা প্রজন্ম বদলে দেওয়ার।

তাওহীদ প্রতিদিন পাশে থাকে, কখনো কিছু বলে না, শুধু বোঝে। আর সবিতা, ধীরে ধীরে তাওহীদ কে বিশ্বাস করতে শেখে।

এক সন্ধ্যায়, ক্যাম্প থেকে ফিরে চায়ের কাপ হাতে, তাওহীদ বলে,

– “সবিতা, আমি জানি তুমি ভেঙে পড়েছো,গড়েছো আবার ভেঙেছো… কিন্তু যদি তুমি চাও, তবে আমি তোমার পাশে থেকে এই যাত্রাটা ভাগ করে নিতে চাই।”

সবিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

– “তুমি জানো তাওহীদ , আমি প্রেমে না, জীবনে বিশ্বাস করতে চাই। যদি তুমি আমার জীবনকে সম্মান করতে পারো,তাহলে বন্ধু হিসেবে তোমাকে ভাবা যেতে পারে…”তবে সারাজীবন এর সঙ্গী হিসেবে আমি দ্বিতীয় কাউকে আর গ্রহণ করতে চাই না।

তাওহীদ মৃদু হাসে। সম্মান, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব—সব আছে তোমার প্রতি,জীবন তোমার সিদ্ধান্ত ও তোমার,যদি কখনো মনে হয় আমি তোমার পার্টনার হওয়ার যোগ্য তাহলে ভেবে দেখতে পারো, আমি অপেক্ষায় থাকবো আজীবন।

সবিতা চুপ হয়ে রইলো।

সবিতার গল্প এখানেই শেষ নয়। এই তো শুরু।

একজন নারীর একা পথ চলা, আত্মপরিচয় খোঁজা, সম্মান কুড়িয়ে পাওয়া আর নতুন করে বিশ্বাস করতে শেখার গল্প এটা।

একটা সম্পর্ক ভেঙে গেলে জীবন থেমে যায় না—নতুন কোনো গল্প সেখানে গাঁথা হতে থাকে…

“উত্তরণ”-এর কাজ এখন শহর পেরিয়ে বিভিন্ন জেলার নারীদের জীবনে আলো দিচ্ছে।
আন্নি একটি ছোট্ট স্কুল চালু করে, যেখানে নির্যাতিত, বঞ্চিত মেয়েরা শিক্ষা পায়, সেলাই শেখে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখে।
তাকে এখন সকলে “আপা” বলে ডাকে, কেউ কেউ “ম্যাডাম”।

তাওহীদ পাশে থাকে, কিন্তু কোনো চাপ দেয় না। শুধু সবিতার সঙ্গে হেঁটে চলে, নিজের জায়গা থেকে।
এই বন্ধুতা একরকম নির্ভরতার মতো।তবে সে সবিতার হ্যাঁ উত্তর শোনার অপেক্ষায় আছে।

এক সন্ধ্যায়, সবিতার বড়বোন আমেনা তাকে খুঁজে বের করে। কান্নাভেজা চোখে বলে—

– “আমরা সবাই ভুল করেছিলাম, আন্নি। তুই সাহস দেখিয়েছিস, যা আমরা পারিনি। তুই আমাদের গর্ব।”

সেই দিন, বহুদিন পরে, সবিতা প্রথমবার কোনো আপনজনের বাহুডোরে নিজেকে সঁপে দিয়ে কান্না করতে পারে।

একদিন সবিতা যখন তার স্কুলে কাজ করছিল,

আমেনা আপা নিজে এসে জানালেন—মা আসছেন।
আজকাল আমেনা মাঝেমধ্যেই সবিতার সাথে দেখা করতে আসে।আগে সবাই ঘৃণা করলেও এখন সবিতাকে নিয়ে সবার গর্ব হয়।

মা এলেন। চোখ ভরা জল, মুখে একটাই কথা—

– “আমার মেয়ে শুধু এই সমাজে টিকে নেই, নিজেই একটা পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

বাবাও এসেছেন। মুখে আর বকুনি নেই। আজ তিনি শুধু বললেন—

– “তুই আমাদের গর্ব, মা।”

সবিতার চোখে জল আসে, কিন্তু এবার সেটা কান্না নয়—অভিমান গলে গিয়ে শান্তির জল।

সবিতা এখন নিজেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ও স্বাধীন একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। কিন্তু শক্তির এই উত্থানের পেছনে যে গভীর একাকিত্ব ও মানসিক যুদ্ধ চলেছে, তা খুব কম মানুষ জানে। রাতের পর রাত সে নিঃশব্দে কেঁদেছে, নিজের সিদ্ধান্তগুলোর বিশ্লেষণ করেছে, ভুল স্বীকার করেছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।

একদিন, একটি সেমিনার শেষ করে ফেরার পথে সবিতা হঠাৎ রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। স্থানীয় এক তরুণী ও তার মা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানায়, সবিতা দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্রামহীন কাজ করে গেছে, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক ছিল না, যার ফলে সে শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছে।

জ্ঞান ফিরে পেয়ে সবিতা প্রথমে কিছুটা ভয় পায়, কারণ তার পাশে কেউ পরিচিত ছিল না। কিন্তু সে চমকে যায় যখন দেখে যে অচেনা সেই মা-মেয়ে খুব যত্ন করে তার সেবা করছে।

তারা জানায়—

– “আপনার নাম আমরা জানি না, কিন্তু আপনার মুখে আত্মবিশ্বাস ছিল, আর আপনার ব্যাগে পাওয়া ফাইলগুলোতে লেখা কিছু কথায় আমরা খুব অনুপ্রাণিত হয়েছি।”

সবিতার চোখে পানি চলে আসে। এই প্রথমবার সে বুঝতে পারে, তার কাজ কতদূর ছড়িয়ে পড়েছে।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সবিতার মনে পড়ে তার ছোটবেলার কথা। বাবার কড়া শাসন, মায়ের গলা টিপে রাখা দুঃখ, বড় বোন আমেনার ঝাড়ি, আর সেই নিঃসঙ্গ আঙ্গিনায় বসে থাকাটা। সে বুঝতে পারে, শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত সে শুধু ভালবাসার জন্য ছুটেছে। অথচ জীবন তাকে বারবার আত্মনির্ভরশীলতা শেখাতে চেয়েছে।

সবিতা এবার সিদ্ধান্ত নেয়, সে কেবল অন্যকে পরিবর্তনের কথা বলবে না, নিজের যত্নও নেবে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে সে কয়েক দিনের জন্য নিজেকে সময় দেয়।

সে এক নির্জন কফি শপে গিয়ে ডায়েরিতে লিখে—

– “আমি সবিতা, আমি একা হলেও অসম্পূর্ণ নই। আমার জীবন, আমার যুদ্ধ, আমার ভালোবাসা—সবটাই আমি নিজে গড়ে নিচ্ছি। যারা পাশে থাকবে তারা সম্মান নিয়ে থাকবে, আর যারা নয়—তাদের জায়গা জীবনে নেই।”

সবিতা এখন শুধু একটি নাম নয়, একটি আন্দোলন। নারীদের সম্মান, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে সে।

চলবে_______

সবিতা পর্ব-০৮

0

সবিতা
পর্ব: ০৮
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা তার লেখালেখির জগতে নিজের অবস্থান শক্ত করে রাখলো। বইটি সফলতার সাথে বিক্রি হতে থাকল, এবং তার গল্প অন্যদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠলো। তবে তার জন্য সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল নিজের অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং আত্মবিশ্বাস। সে জানত, তার জীবনের পথে যে পথচলা শুরু হয়েছিল, তা শুধু তার জন্য নয়, আরও অনেকের জন্য একটি নতুন আলো হতে পারে।সবিতা তার লেখার মাধ্যমে সেই আলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।

একদিন সন্ধ্যায়, সাইফ আবার সবিতার কাছে এসে দাঁড়াল। অনেক দিন পর তাদের মধ্যে আবার দেখা হয়েছিল, কিন্তু এবারের পরিবেশ অনেকটা ভিন্ন ছিল। সাইফ, যে আন্নিকে একসময় মনে করত নিজের জীবনের অংশ, আজ তাকে একেবারেই অপরিচিত মনে হচ্ছিল। সাইফ বলল—

– “আন্নি, আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি,তোমার কাছে এজন্য বার বার ক্ষমাও চেয়েছি।কিন্তু তুমি ক্ষমা করে দাও নি। আমি কি তোমার কাছ থেকে একেবারে হারিয়ে গেছি?”তোমার মনে আমার কি সত্যি কোনো জায়গা নেই?
আজকেই শেষ, আর কখনো বলবো না আমার ভুল হয়ে গেছে আন্নি,আমাকে ক্ষমা করে দাও,আর একটিবার তোমার জীবনের সাথে জড়িয়ে নাও।

সবিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে, গভীরভাবে সাইফের দিকে তাকাল। তার মধ্যে আর কোনো ক্ষোভ বা কষ্ট ছিল না। তার কণ্ঠে শান্তি ছিল, তবে এক অদ্ভুত শক্তি, যা সে নিজের থেকে পেয়েছিল—

– “সাইফ, আমি এখন সত্যি বলতে ভয় পাই না।আমি আগেও বলেছি আর বার বার বলছি তুমি আমার জীবনের অতীত,কিন্তু অতীত আর বর্তমান এক নয়। আমি আমার জীবনের নতুন পথ তৈরি করেছি। তুমি যদি ক্ষমা চাও, হ্যাঁ দিলাম ক্ষমা করে,কিন্তু তুমি তো এতে আন্নিকে আর ফিরে পাবে না।আন্নি হারিয়ে গেছে সাইফ,তুমি নিজের হাতে আন্নিকে মেরে ফেলেছো,এখন যাকে আন্নি ভেবে বার বার কাছে ডাকছো সে হলো সবিতা।
আর সবিতার জীবনে সাইফের কোনো জায়গা নেই।সবিতা একা নিজের পথ চালিয়ে যেতে পারে এখন, আর আমি আশা করি তুমিও তোমার পথ খুঁজে পাবে।”

সাইফ আর রিকুয়েষ্ট করে না সবিতাকে,সে অনেকক্ষণ তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধু একটা হাসি দিলো,আর বললো,

নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা সবিতা।
তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।তোমার থাকলে ক্ষমা করে দিও।তুমি থাকতে তোমাকে মূল্যায়ন করি নি ঠিকই এখন হারিয়ে ঠিক বুঝতে পারছি তুমি কি ছিলে আমার জীবনে?

সাইফ চলে গেলো।
সে আজ ব্যর্থ।
আর সবিতা তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল।এতটা কঠোর সবিতা।

সবিতা এবার তার সৃষ্টিকর্তাকে বললো আমি কয়েক মিনিটের জন্য আন্নি হতে চাই,আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে চাই,আমি অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে সাইফ,কিন্তু তোমার দুর্ব্যবহার, তোমার অবহেলা দিন দিন আমাকে এতো টাই কঠিন বানিয়েছে যে আজ আমি পুরোপুরি সবিতা তে পরিবর্তিত হয়েছি।সবিতা থেকে আর কখনোই আমি আন্নি রুপে ফিরে যেতে চাই না।

সবিতা তার নতুন বই লিখতে শুরু করল, যা ছিল তার জীবনের আরেকটি মাইলফলক। বইটির নাম ছিল ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’, যেখানে সে নিজের অভ্যন্তরীণ মুক্তি, সম্পর্কের দুর্বলতা এবং আত্মবিশ্বাসের পুণঃউৎপাদন নিয়ে লিখলো। এটি ছিল তার অভ্যন্তরীণ যাত্রার একটি প্রতিচ্ছবি, যেখানে সে প্রতিটি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান নির্মাণ করেছিল।

বইটি যখন প্রকাশিত হলো, তখন সেটি খুব দ্রুত সাড়া ফেলল। পাঠকরা বইটির গল্প এবং তাতে থাকা সাহসিকতা ও শক্তি সম্পর্কে অনেক ভালো মতামত দিল। সবিতা বুঝতে পারছিল, তার লেখালেখির মাধ্যমে সে শুধু নিজের কষ্টের কথা বলছে না, বরং অনেক মানুষের আড়ালে থাকা কষ্টের গল্পকেও ফুটিয়ে তুলছে।

___________

এক সন্ধ্যায়, তাওহীদ সবিতার কাছে এসে বলল—

– “সবিতা,তোমার লেখা শুধু মানুষের মন স্পর্শ করে না, তা তাদের অন্তরের গহীনে পৌঁছে যায়। তুমি যদি এই লেখার মাধ্যমে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারো, তাহলে অনেক মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবে। তোমার বইয়ের ক্লাস শুরু করতে পারো।”

সবিতা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তার মনে হচ্ছিল, এটা যেন তার জীবনের পরবর্তী ধাপ হতে পারে। কিন্তু সে জানত, এটি সহজ হবে না। লেখক হিসেবে সে নিজের কিছু জ্ঞান শেয়ার করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা ঠিক কিভাবে করবে, তা বুঝতে পারছিল না।

– “তাওহীদ, তুমি ঠিক বলেছ, কিন্তু আমি জানি না, কীভাবে শুরু করতে হবে। আমি তো নিজেই শিখছি।”

তাওহীদ হাসি দিয়ে বলল—

– “তুমি তো জানো, যে কোনও যাত্রা প্রথম পদক্ষেপ দিয়ে শুরু হয়। তুমি যা শিখেছ, তা অন্যদের শিখিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তুমি আরও বেশি কিছু অর্জন করতে পারবে।”

এখন সবিতার মনের মধ্যে একটা নতুন স্বপ্ন জেগে উঠেছিল। সে ভাবছিল, কি দারুণ হবে যদি সে তার লেখা বা অভিজ্ঞতা শেয়ার করে অন্যদের সঙ্গে।

______

সবিতা এবার তার পরবর্তী বইটি লেখার পরিকল্পনা করল। এটি ছিল তার জীবনের সংগ্রাম, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প, এবং সেখান থেকে তার পরবর্তী পথের শুরু। বইটির নাম রাখল ‘অজানা পথে যাত্রা’, যেখানে সবিতা তার অভ্যন্তরীণ যাত্রা, আত্মবিশ্বাসের প্রাপ্তি এবং জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার গল্প বলেছিল।

এই বইটি অন্য অনেক মানুষের মতামত এবং তাদের জীবনকেও প্রতিফলিত করেছিল।সবিতা বুঝতে পারছিল, লেখালেখির মাধ্যমে সে শুধু নিজের কষ্টের গল্প শেয়ার করছে না, বরং অন্যদেরও জীবনকে আলোকিত করছে।

________

সবিতা জানত, তার জীবনে এখনও অনেক কিছু বাকি রয়েছে। তাকে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে, নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। তবে সে জানত, তার ভেতরের শক্তি আর বিশ্বাস তাকে কখনোই পথভ্রষ্ট করবে না। সে যে পথই বেছে নিক, সেটি তার জন্য নতুন অভ্যন্তরীণ শান্তির এবং স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাবে।

সবিতার বইয়ের ক্লাসের প্রথম সেশন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।সবিতা তার লেখালেখি আর জীবনের গল্পগুলো শেয়ার করার জন্য প্রস্তুত ছিল। সেমিনারের দিন, সে বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তটি তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু।

সবিতা সেমিনারের রুমে প্রবেশ করল, তার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল। আগে যে সবিতা ভয়ে নিজের লেখা শেয়ার করতে পারেনি, আজ সে সেই লেখাগুলো শত শত মানুষকে উপস্থাপন করতে চলেছে। তাওহীদ তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে সাহস দিতে।

যতক্ষণ ক্লাস চলছিল, সবিতা বুঝতে পারছিল, তার লেখার মাধ্যমে সে শুধু মানুষদের গল্প শোনাচ্ছে না, বরং তাদের অভ্যন্তরীণ যাত্রার একটা অংশ তৈরি করছে। অনেকেই তার গল্প শুনে চোখে জল নিয়ে বলেছিল—

– “আপনার লেখা আমাদের জীবনের বাস্তব চিত্র, আমরা মনে করেছি আমাদের একান্ত বেদনা শুধু আমাদেরই, কিন্তু আপনি দেখালেন, আমরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত।”

সবিতার চোখে জলের ঝরনা ছিল, কিন্তু সে জানত—এই আবেগগুলো শুধু তার নয়, সবার ছিল। এই বই, এই ক্লাস, যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল।

তাওহীদও তার জীবনের পথে সবিতার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে অনুভব করছিল, সবিতার প্রতি তার শ্রদ্ধা এখন শুধু বন্ধুত্বের দিকে অতিক্রম করেছে না, একটা গভীর সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাওহীদ একদিন সবিতার সঙ্গে বসে বলল—

– সবিতা, আমি তোমাকে দেখে শিখেছি, তুমি শুধু লেখালেখি করে না, তুমি অন্যদের মনোযোগও পরিবর্তন করতে পারো। এই বইয়ের ক্লাস তোমার এক নতুন দিগন্তকে উন্মোচন করেছে। আমি চাই তুমি আরও অনেক মানুষের জীবনে এই পরিবর্তন নিয়ে আসো।”

সবিতা তার হাসি দিয়ে বলল—

– “তাওহীদ, তোমার সহযোগিতা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না। তোমার পাশে থাকার কারণে আমি অনেক কিছু শিখেছি।”

তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হচ্ছিল। তারা একে অপরের মধ্যে অন্য ধরনের শক্তি দেখতে পাচ্ছিল, যেখানে শুধু ভালোবাসা নয়, সম্মান আর শ্রদ্ধাও ছিল।

বইয়ের ক্লাসের সফলতা দেখে, সবিতা আরও অনেক নতুন উদ্যোগ নিতে শুরু করল। সে শিখতে চেয়েছিল, সমাজে মানুষের দুর্বলতাগুলো কীভাবে উঠে আসে এবং কীভাবে তাকে শক্তি হিসেবে পরিণত করা যায়। সে নিজের ক্লাসে বিভিন্ন ধরনের সেমিনার আয়োজন করেছিল যেখানে মানুষ নিজেদের গল্প শেয়ার করতে পারতো।

এই ক্লাসগুলো ছিল শুধু তার জীবনের অভিজ্ঞতা বা লেখার পাঠ নয়, বরং এক ধরনের সেশনের মতো যেখানে মানুষ তাদের নিজের ভেতরের শক্তি খুঁজে পেতে পারতো। সবিতা বুঝতে পারছিল, একসময় তার লেখালেখি শুধু কথামালার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি মানুষের বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাবে।

__

সবিতা যখন তার বইয়ের প্রথম প্রকাশনার আয়োজন করল, তখন তার মনে এক আশ্চর্য রকমের অনুভূতি ছিল। বইটি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে তার ব্যক্তিগত জীবনের লড়াইগুলোকে একজন অনুপ্রেরণার রূপে পরিণত করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে যখন সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের লেখার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, তখন তার কণ্ঠে এক ধরনের দৃঢ়তা এবং আবেগের ছোঁয়া ছিল।

– “আমি লিখেছি শুধু আমার গল্প নয়, বরং সেইসব মানুষের গল্প যারা নিঃশব্দে কষ্টে ভুগছে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের জীবনে সবসময় অন্ধকার আসে, কিন্তু সেই অন্ধকারের মাঝে যদি একটু আলো থাকে, তাহলে আমরা জীবনকে অন্যভাবে দেখতে পারি।”

এতটা সময়ে, সবিতা বুঝতে পারছিল, তার বই আর সেমিনার শুধুমাত্র তার নিজের জন্য ছিল না, বরং এটা আরও অনেক মানুষের জন্য ছিল যারা নিজেদের কষ্টের সাথে একাকী ছিল।

_____

সবিতার নতুন লক্ষ্য,
সবিতা বুঝেছিল, তার জীবন শুধু তার নিজের জন্য নয়, আরও অনেক মানুষের জন্য। তাকে তার লেখার মাধ্যমে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে হবে। সে তার লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছিল—এখন সে শুধু তার অভ্যন্তরীণ শক্তির বিকাশে মনোযোগী হবে না, বরং সে নিজের চিন্তা-ভাবনা দিয়ে সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।

একদিন, সবিতা তার শখের ঘরে বসে একটি নতুন বইয়ের কাজ শুরু করল, যার নাম ছিল—“জীবনের নতুন দিগন্ত”। এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় কাজ, যেখানে সে মানুষের জীবনের ব্যথা, আনন্দ, লড়াই ও জয়কে একত্রিত করেছিল।

সবিতার জীবন এখন এক নতুন দিগন্তে পৌঁছেছে। সেমিনারের সফলতা এবং তার নতুন বই “জীবনের নতুন দিগন্ত”-এর প্রস্তুতির মাঝে সে যেন নিজের ভিতরের শক্তি, অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং আত্মবিশ্বাসের নতুন এক স্তরে পৌঁছে গেছে। এখন তার কাছে স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবতার দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে।

__________

সাইফ, যাকে সবিতা একসময় কেবল এক কাপুরুষ হিসেবে চিনেছিল, এখন সে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে দেখতে শিখেছে। সাইফ তার অতীত ভুল বুঝতে পেরে সবিতার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই আলাপ করতে আসে।

সাইফের মনোভাবের পরিবর্তন সবিতার জন্য এক ধরনের আশার আলো হয়ে উঠল।

সাইফ, সবিতার প্রতি আগের চেয়ে অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়েছে। একদিন সাইফ সবিতার কাছে গিয়ে বলল—

– “আমি জানি, আমরা একসাথে থাকতে পারি না,আমার ইচ্ছা থাকলেও তুমি আর নিবে না আমাকে,তবে আমি চাই, তোমার পাশে ছায়ার মতো থাকতে। তোমার পথে যা কিছু বাধা আসুক না কেন, এখন থেকে আমি সামলাবো।।”

সবিতা ধীরে ধীরে মাথা নত করে বলল—

– “সাইফ, তুমি যা বলেছ, তার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমাকে শুধু নিজের পথে হাঁটতে হবে।”তোমার সাহায্য লাগবে না।

সাইফ তার মুখে এক কঠিন হাসি দিয়ে বলল—

– “আমি জানি, তুমি নিজের পথ খুঁজে পেয়েছ। আমার সাহায্যের তোমার কোনো দরকার নাই।তবুও আমি জোর করেই থাকবো।
কারণ তুমি আমার সেই আলোর রশ্মি, যে কিনা জীবনের অন্ধকারকে উজ্জ্বল করতে পারে।”
তুমি ছাড়া আমার জীবনের অঅন্ধকার কখনোই দূর হবে না।

চলবে_______

সবিতা পর্ব-০৭

0

সবিতা
পর্ব: ০৭
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতার বাবা-মা তাকে কখনোই পুরোপুরি বোঝেনি। তাদের কাছে সবিতা ছিল সেই মেয়ে, যে পরিবারের জন্য ভালো কিছু করে নি,পরিবারের মানসম্মান নষ্ট করেছে সেজন্য সে বাবা মার ভালোবাসা কখনোই পায়নি।

কিন্তু সবিতা যে এতটা কষ্ট পেয়েছে, তা তারা কখনো বুঝতে পারেনি। একদিন সবিতা তাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে গিয়ে বলে—

– “আমার জীবনের এই সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিয়েছি। তবে আমি আপনাদের কাছে যা চেয়েছিলাম, তা কখনোই পাই নাই। আমি জানি, আপনারা আমাকে বুঝতে পারেন নি, তবে আমি জানি, নিজের পথ বেছে নিলে, একদিন আমি সফল হব।”হ্যাঁ আমি সফল হয়েছি।

সবিতার মা এক লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লেন, তারপর বললেন—

– “তুমি যদি এখনো এই পথে থাকতে চাও, তবে তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবো।”পারলে আমাদের ক্ষমা করে দিও।আমরা তোমাকে সত্যি বুঝতে পারি নি।

বাবাও কিছুটা মনোযোগ দিয়ে বললেন—

– “তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো, তা তোমার জীবনের জন্য সঠিক কিনা, তা শুধুমাত্র তুমি বুঝবে।”তবে আমাদের ভুল একটাই আমরা সাইফের উপর করা রাগের শাস্তি তোমাকে দিয়েছিলাম,আমাদের উচিত ছিলো সাইফ কে উচিত শাস্তি দিয়ে তোমাকে নিজের ঘরে ফিরে আনা।

সবিতা বাবা মার কথা শুনে দীর্ঘ নি:শ্বাস ছাড়লো।তবে তার বাবা মার কথা শুনে মনের মধ্যে ক্ষোভের পরিবর্তে এক নতুন শক্তি তৈরি হয়েছিল। সে জানত, তার মা-বাবা তাকে ভালোবাসে, কিন্তু তাদের ভালবাসা ও সমর্থন তার দু:সময়ের জীবনের সময় ছিল না,এটাই তার অনেক বড় আফসোস।

_____________

সবিতার নতুন জীবন ঠিক যেমনটি সে চেয়েছিল, তেমন সহজ ছিল না। শুরুর দিকে সমস্ত কিছুই স্বপ্নের মতো মনে হলেও, বাস্তবতার কঠিন বাস্তবতা সবিতার পথে আঘাত হানে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে বাধা ছিল। তবে সে থামল না, কারণ সে জানত, তার সামনে কেবল নিজের এক নতুন লক্ষ্য। কিন্তু, সামনে যেসব প্রলোভন ছিল, তা তাকে বাধ্য করেছিল এক নতুন দ্বিধার মধ্যে পড়তে।

মোহাইমিন তার পায়ের নিচে জমে থাকা মাটি আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সবিতা তার কাছ থেকে দূরে চলে আসার পর সে অনেক চেষ্টা করেছে তাকে ফিরিয়ে আনতে, তবে একবারও সবিতা তার কাছে ফিরে যায়নি। তবে, মোহাইমিনের মনের মধ্যে এক ভয়াবহ পরিকল্পনা গড়ে উঠছিল।

একদিন, মোহাইমিন সবিতার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং বলে—

– “তুমি যদি আমার সঙ্গে কাজ করো, তাহলে তুমি যা চাও, তা পেতে পারবে। আমার সাহায্য ছাড়া তুমি কিছুই করতে পারবে না।”

সবিতা হাসল, এই হাসি ছিল বিজয়ের হাসি।

– “তুমি যদি ভাবো, আমার জন্য তুমি এতটা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তুমি ভুল ভাবছো। আমি নিজের পথই চয়ন করেছি। আমি আর কারো হাতের পুতুল হতে চাই না।”

মোহাইমিন চলে যায়, কিন্তু সে জানে, সবিতা তাকে সব সময় অতিক্রম করে যাবে। মোহাইমিনের মতো মানুষ হয়তো তার পথের অংশ ছিল, তবে সবিতার জীবনে সেই ছায়ার স্থান নেই।

এই সমস্ত ঘটনার পর, সবিতার জীবনে এক নতুন সূচনা হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রস্তাব মেনে নিয়ে, সে এক নতুন জীবন শুরু করে। পুরনো সম্পর্ক আর পারিবারিক সমস্যা তাকে আর থামাতে পারে না। সে জানে, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, কিন্তু সে প্রতিটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

যারা সবিতাকে তুচ্ছ বুঝেছিল, তাদের জন্য সে এক প্রমাণ হয়ে উঠবে। নারী স্বাধীনতা, অধিকার—এগুলোই তার মূল লক্ষ্য। সবিতা এই মুহূর্তে বুঝতে পারে, পুরনো জীবন ছেড়ে নতুন পথের দিকে এগিয়ে যাওয়াই তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।

একদিন সবিতা নিজেই তার জীবনের অনেক গুলো গল্প লিখবে। সে জানবে, তার সংগ্রাম কেবল তার জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য ছিল। সে ছিল একটি সাহসী পথিক, যে নিজের জীবনের গল্পে জয়লাভ করেছে।

_________

সবিতা এখন পুরো দমে লেখালেখি শুরু করেছে, তবে তার প্রতিটি লেখায় তার জীবন এবং অভিজ্ঞতার গভীরতা ফুটে ওঠে। তাকে একে একে প্রতিটি কথা, অনুভূতি এবং শোককে অক্ষরে বন্দী করতে হচ্ছিল, কিন্তু সে জানত—এটি তার মুক্তির পথ হতে পারে। সেই রাতে, যখন সে তার প্রথম ছোট গল্পটি শেষ করেছিল, সেজন্য সে নিজের মনে এক অদৃশ্য প্রশান্তি অনুভব করেছিল।

একদিন সবিতা অফিসে কাজ করতে বসে ছিল, তখন তার সহকর্মী তাওহীদ এসে তাকে কিছু কাজে সাহায্য করার প্রস্তাব দেয়। তাওহীদ একজন সদ্য চাকরি করা ছেলে, তার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা সবিতার মনকে একটু উজ্জীবিত করেছিল। তাওহীদ তার সঙ্গে কথা বলার সময় কখনও বেশি চাপ দেয়নি, বরং আন্তরিকতা দেখিয়েছে।সবিতার মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস জন্মাল, যে মানুষ সত্যিই ভালো হতে পারে, যদিও সে এখন পর্যন্ত এরকম কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না।

তাওহীদের সাথে কিছু সময় কাটানোর পর সবিতা বুঝতে পারে, এই মানুষটিই সম্ভবত তার জন্য নতুন শক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে তাওহীদকে তার জীবনের কিছু ঘটনা শেয়ার করতে শুরু করে, আর তাওহীদ একান্তভাবে তার কথা শুনে যায়। এই বন্ধুত্বের মাঝে সবিতা এমন এক নিরাপত্তা অনুভব করছিল, যা তাকে আবার বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল যে, ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব এখনও সম্ভব।

তাওহীদ মাঝে মাঝে সবিতাকে উৎসাহিত করত।

– “সবিতা তুমি কি জানো, তোমার মধ্যে আর তোমার লেখার মধ্যে একটা বিরাট শক্তি আছে।যা আমি দেখছি, তা একদিন পৃথিবীকে আলো দেখাবে।”

একদিন সবিতার শান্ত জীবন আবার এক দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করল। সাইফ, তার পুরনো স্বামী, একদিন তাকে ফোন করে বলল—

– “সবিতা, আমি জানি আমি ভুল করেছি। তুমি কি একবার আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবে? আমি এখন অনেক কিছু শিখেছি।”প্লিজ একবার একটু আসো।আমি তোমাকে না দেখতে পেয়ে দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি।”

সবিতা বুঝতে পারলো, সাইফ তার পুরনো চরিত্রে ফিরে আসতে চাইছে, সাইফ বর্তমানে নিজের অনুশোচনায় ভুগছে, কিন্তু অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছে সাইফ।এখন সে কিছুতেই সাইফের জীবনে ফিরতে পারবে না।

সে সাইফের কলের উত্তর দিল না, কিন্তু তার মন প্রচন্ড ভাবে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে মনের মধ্যে ভাবল—

– আমার সামনে এসব কিসের পরীক্ষা চলছে সৃষ্টিকর্তা?সাইফের অনুনয় বিনয় আর সহ্য করতে পারছি না আমি। তাকে যে এক সময় আমি প্রচন্ড ভালোবেসে ছিলাম।
তবে আমি আর কখনোই ফিরবো না তার কাছে।আমি সাইফের কাছে ফিরলে নিজের সাথে প্রতারণা করে ফেলবো।তখন এই আমার আমি আমাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না।যখন আমার পাশে কেউ ছিলো না তখন এই আমার আমি টাই ছিলো শুধু।সেজন্য আমার তার কথা শুনতে হবে এখন।

সবিতার কাছে এখন নিজেকে মেলে ধরার সময় এসেছে, আর কোনো অতীতের জটিলতা নিয়ে সে ভাবতে চায় না।সাইফ তার অতীত।

সবিতা তার লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত।তাওহীদ তাকে অনেক সাহায্য করছে।সবিতা তার লেখা বিভিন্ন প্রকাশনার জন্য পাঠাচ্ছিল, তবে প্রতিটি গল্পের পেছনে তার জীবন ছিল। একদিন সবিতা একটি বড় প্রকাশনীর কাছে তার প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস পাঠাল।

কিছুদিন পরই তারা তাকে জানায়, তারা তার বইটি প্রকাশ করতে চায়। সবিতার মনে তীব্র উত্তেজনা ছিল, কিন্তু সে জানত—এটা তার কঠোর পরিশ্রমের ফল।

এখন তার জীবনের প্রথম বড় প্রকাশনা হয়ে গেল, যা তার পুরনো দুঃখের চেয়েও বড় হয়ে উঠল। তার লেখালেখি যে শুধু তার নিজের জন্য ছিল না, বরং অন্যদের জন্যও ছিল। সবিতা জানত, তার এই প্রথম সফলতা একদিন অনেক দূর যাবে।

তাওহীদ তাকে নিয়ে ভীষণ আনন্দিত ছিল, এবং সবিতা তার কাছ থেকে আরও অনেক শিক্ষা পেয়েছিল। তাদের বন্ধুত্ব আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, এবং সবিতা তার জীবনে তৌহিদের মতো একজন বিশ্বস্ত বন্ধু পেয়ে অনেক খুশি ছিলো।

রাইয়া, সবিতার একমাত্র বন্ধু, তার নতুন বইটি পড়ে অনেক খুশি হয়েছিল। সে বলেছিল—

– “তুমি শুধু তোমার জীবনের গল্পই লিখছো না, সবিতা, তুমি সবার জন্য একটা পাঠ শিখাচ্ছো।”

সবিতা তার বইয়ের প্রথম প্রচ্ছদে রাইয়ার নাম লিখেছিল, কারণ সে জানত, রাইয়া ছাড়া তার এই পথ চলা কখনোই সম্ভব হত না। সবিতা জানত, যদি তার জীবনে কখনো কোনো সত্যিকারের মানুষ থাকে, তবে তা হলো রাইয়া।

রাইয়া বলল—

– “সবিতা, তুমি যেভাবে আছো, সেভাবে সবাইকে দেখাও। তুমি যদি নিজের জন্য কিছু করতে পারো, তবে পৃথিবীটাও বদলাতে পারবে।”

এখন সবিতা জীবনের নতুন সুরে চলতে শুরু করছে। তার পৃথিবী বদলানোর প্রস্তুতি চলছে। তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তার সামনে শুধু এক নতুন দিন অপেক্ষা করছে।

……..

সবিতা তার জীবনের পথে এক নতুন সূচনা করেছে, তবে পুরনো অধ্যায় তাকে তাড়া করেই যাচ্ছিল। তার জীবন এখন অনেক বেশি স্থিতিশীল, কিন্তু মাঝে মাঝে পুরনো স্মৃতি, পুরনো যন্ত্রণাগুলি ফিরে আসত। সেগুলিকে উপেক্ষা করেই সে নিজের পথে চলতে শুরু করেছিল। তাওহীদ তার লেখালেখির ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে, কিন্তু সবিতার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল—নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা, নতুন করে দাঁড়িয়ে থাকা।

একদিন সবিতা আবার সাইফের ফোন পেল, যে ফোনটি তার জন্য একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ সবিতা সেদিন সাইফ কে মুখের উপরই না করে দিয়েছে যেনো সে আর তাকে কল না করে।

“তুমি কেন এভাবে নিজের জীবন টা নষ্ট করছো? পরিবারে ফিরে যাও। আমরা আবার একসাথে সব ঠিক করে নিতে পারি।”কারণ আমরা একে অপরকে অনেক ভালোবাসি।

সবিতার চোখে ক্ষোভ, তবে তার মুখে শান্তি।

“এই তুমি—এখনও বুঝতে পারো না! আমি আর কখনো তোমার কাছে ফিরে যাব না। আমি স্বাধীন, আমার জীবন আর তোমার দাসত্ব নয়।”

– “সবিতা, আমি জানি আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি। কিন্তু আমি এখন অনেক কিছু বুঝেছি। তুমি কি একবার আমাকে আবার সুযোগ দেবে?”প্লিজ সবিতা।তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে এক সময়।

সাইফের কথাগুলি যেন পুরনো যন্ত্রণা আবার ফিরে আনে। সবিতা তার জীবনে সাইফের প্রভাব বুঝে উঠতে পারছিল না।সে বুঝতে পারছিল যে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা তার নিজের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।

সবিতা কিছু সময় চুপ থাকল, তারপর ধীরে ধীরে বলল—

– “সাইফ,আমি যখন তোমার প্রয়োজন ছিলাম না, তখন আমি নিজেকে গড়েছি। তুমি যদি ভাবো আমি তোমার কাছে ফিরব, তাহলে তুমি ভুল ভাবছো। আমার জীবন এখন আমি নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছি। আমি আর তোমার অতীতের অংশ হতে চাই না।”প্লিজ আমাকে মুক্তি দাও।আর আমাকে ভালোবাসার অজুহাত দেখিয়ে ব্লাকমেল করো না।আমি আগেও বলেছি আর এখনো বলছি আমি আর তোমার জীবনে কখনোই ফিরবো না।কারণ তোমার সেই ভালোবাসার কাঙাল আন্নি মারা গেছে অনেক আগেই।

এ কথাগুলি সাইফকে চমকে দিয়ে গেল,সাইফের অজান্তেই দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো, অন্যদিকে সবিতাও কাঁদছে,যত কিছুই হোক এক সময় তো তাকে সে প্রচন্ড ভাবে ভালোবেসে ছিলো।

তবে সবিতা ভালো করেই জানে—এই সিদ্ধান্তটি তার জীবন ও স্বকীয়তার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।আজ এসব না বললে সাইফ বার বার তাকে বিরক্ত করতো।
সবিতা সাইফের প্রতি ভালোবাসার জন্যই তাকে আইনি ভাবে শাস্তি দেয় নি কোনো,তবে সে সাইফের জীবন থেকে এখন অনেক দূরে চলে গেছে।

তাওহীদ বন্ধু হিসেবেই সবিতার পাশে থাকলো। তার লেখালেখির সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও, তাওহীদ কখনোই তাকে ব্যক্তিগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দেয়নি। সবিতা বুঝতে পারছিল, তাওহীদ তাকে নিঃস্বার্থভাবে সহ্য করে এবং তার সব বিপদের সময় তাকে শক্তি দেয়। সবিতা তাওহীদের সঙ্গে অনেক রাত কেটেছে গল্প, কবিতা, এবং সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছে। তাওহীদ তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তারা কখনো একে অপরকে বেশি ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেনি।

তাওহীদ একদিন বলেছিল—

– “সবিতা, তোমার লেখার মধ্যে তুমি যেমন তোমার যন্ত্রণাকে প্রকাশ করো, তেমনই তুমি জীবনের আরো অনেক বড় চিত্রও ফুটিয়ে তুলবে। তোমার লেখায় এক শক্তি রয়েছে যা আমি কখনো কোনো লেখকের মধ্যে দেখি নি।”

এটা সবিতার জন্য বড় প্রশংসা ছিল। তার কাছে তাওহীদ শুধু একজন বন্ধু ছিল না, বরং তার জীবনের চলমান সঙ্গী, এক মানুষ যাকে সে কখনো হারাতে চায় না।

একদিন সবিতা তার বন্ধু রাইয়ার সঙ্গে বসে পুরনো স্মৃতি চারণা করছিল। তারা মজা করছিল, হাসছিল এবং একে অপরকে জীবন সম্পর্কে তাদের অনুভূতি জানাচ্ছিল। রাইয়া বলেছিল—

– “তুমি জানো, সবিতা, তুমি আজ যা আছো, তা তোমার নিজের শক্তির ফল। তুমি যদি ভেবো, তোমার জীবনের কোনো মুহূর্তেও কেউ তোমাকে মূল্যায়ন করেনি, তবে সেটা পুরোপুরি ভুল হবে। তোমার ভিতরে যা কিছু আছে, তা তোমার আত্মবিশ্বাস থেকে এসেছে।”

রাইয়ার কথাগুলি সবিতার মনকে আরো গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার পথের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি কষ্ট, শুধুমাত্র তার নিজের তৈরি। রাইয়া তাকে জীবন সম্পর্কে একটি নতুন দৃষ্টি দিয়েছে—যে দৃষ্টি দিয়ে সে দেখতে পায়, কোনো কিছুই সহজে আসে না, কিন্তু যদি তুমি নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, তবে তুমি সবকিছু অর্জন করতে পারো।

একদিন সবিতা তার লেখালেখি সম্পূর্ণ করে একটি নতুন বই প্রস্তুত করল। এই বইটির নাম ছিল “জীবনের শেষ কথা”।

এটি তার জীবনের সমস্ত চ্যালেঞ্জ, তার সংগ্রাম এবং তার আত্মবিশ্বাসের গল্প তুলে ধরেছিল। তার বইটি প্রকাশনা থেকে এক মাস পরই বিক্রি হয়ে যায়, এবং এই প্রথমবার সবিতা অনুভব করেছিল, সে সফল হয়েছে। এটি তার জন্য এক নতুন সূচনা ছিল, একটি নতুন অধ্যায়।

সে জানত, এই পথ তার জন্য কঠিন ছিল, কিন্তু সেই কঠিন পথে গিয়েই সে নিজেকে গড়ে তুলেছিল। এখন তার সামনে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল, যেখানে সে তার জীবনের সবকিছু নতুন করে সাজাতে পারবে।

সবিতার নতুন বইয়ের প্রকাশনা খুব ভালো হয়েছিল। সে জানত, একদিন তার লেখা সারা পৃথিবীজুড়ে পরিচিত হবে। তার জীবনের গল্প ও সংগ্রাম একদিন অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে। এই বিশ্বাস সবিতার হৃদয়ে শক্তি যোগাচ্ছিল।

তাওহীদ এবং রাইয়া তার পাশে ছিল, এবং সবিতা জানত—তার জীবন আর কখনো অন্ধকারে হারাবে না। তার সামনে শুধু একটি উজ্জ্বল, স্বাধীন, সফল জীবন অপেক্ষা করছে।

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৬

0

সবিতা
পর্ব : ০৬
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
মোহাইমিনের প্রস্তাব উপেক্ষা করতে তার আর কোনো ইচ্ছা নেই।
তার মধ্যে এক নতুন শক্তি তৈরি হচ্ছে, এবং তার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট—

“আমি নিজের পথেই চলব।”

মোহাইমিন জানেন, তার যাত্রার শেষ কোথায়—
অন্য কেউ এটা জানে না।
কিন্তু, সবিতা জানে, তার কাজের উদ্দেশ্য একটাই—

“নারীর স্বাধীনতা, সম্মান, আর অধিকার।”

তবে সেই যাত্রায় এক নতুন বিপদ তৈরি হয়।
কিছু অন্ধকারমনা মানুষ সবিতার কাজকে একেবারে বিপজ্জনক মনে করতে শুরু করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবিতার বিরুদ্ধে ঘৃণিত পোস্ট আসতে থাকে,

তার উদ্যোগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অভিযোগ তোলে—
“এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর, এর ফলে পরিবার ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।”

কিন্তু সবিতা জানে, যে কাজ সে করছে, তা সত্যি ও প্রয়োজনীয়—
এটা চলতেই থাকবে।

একদিন সবিতা অফিসে ছিল।
তখন তার ফোনে একটি কল আসে—
এটা সাইফের ফোন।

সবিতা ফোন ধরে নীরবে শুনতে থাকে—

সাইফ বলে—
– “আমি জানি, আমি অনেক কিছুই ভুল করেছি। আমি যা করেছি তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার কাছে নেই। কিন্তু আমি শুধু চাই, তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও, যেন আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারি।”

সবিতা চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

সে জানে, সাইফ তার জীবনে অনেক কিছুই ভুল করেছে।সে সবিতার বিশ্বাস কে একদম চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে,যা আর পূর্বের অবস্থায় ফিরবে না কখনো।

তবে একটা জায়গায় সাইফ একেবারে সঠিক—

সাইফ সবিতার জীবনে আর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না।

সাইফের আকুতি মিনতি আজ আর কোনো কাজে আসবে না সবিতার জীবনে।এজন্য সবিতা চুপ করে থাকে,
কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেয়।

রাইয়া ও সবিতার সম্পর্ক এখন নতুন একটা স্তরে পৌঁছেছে।
রাইয়া শুধু তার সহকর্মী নয়, বরং তার আত্মবিশ্বাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
একদিন রাইয়া সবিতার কাছে এসে বলে—

– “আপা, আপনি জানেন, আপনি ছাড়া আমি কখনো এগোতে পারতাম না। আপনিই তো আমাকে সেই সাহস দিয়েছিলেন।”

সবিতা রাইয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চুপ হয়ে যায়।
তার চোখে এক অনিচ্ছাকৃত অনুভূতি চলে আসে—

“আমিও তো নিজের জন্য কিছু করতে পারিনি। কিন্তু আমরা একে অপরকে শক্তি দিচ্ছি।”

রাইয়া তখন বলেন—
– “আপনি একা নন, আপা। আমরা একসাথে আছি। আপনার সকল স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে।

এদিকে মোহাইমিন আবার সবিতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকে।

সে জানে, সবিতা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
তবে তার ধারণা ছিল, সবিতা হয়তো কিছুটা সময় নেবে, পরে সে তার প্রস্তাবে সম্মত হবে।

কিন্তু সবিতা জানে—
এবার তার পথ আলাদা।

একদিন মোহাইমিন অফিসে এসে বলেন—

– “আপনি জানেন, আমি চাই আপনার কাজ আরেকটি স্তরে উঠুক। আপনার আন্দোলন সমাজের জন্য অনেক প্রয়োজনীয়। আমি আবারও বলছি,

আমি আপনাকে সহযোগিতা করতে চাই।”

সবিতা তখন গভীরভাবে মোহাইমিনের দিকে তাকায়।
তার মনে এক ধরনের সন্দেহ চলে আসে।
“এটা কি শুধুই সহযোগিতা, না কি তার ভেতরে অন্য কিছু?”

তবে সে আর কিছু বলে না, শুধু বলে—

– “আমার কাজের সাথে আপনি আর যুক্ত হবেন না।”

মোহাইমিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, মুখে একটা সঙ্কুচিত হাসি দেয় এবং চলে যায়।

..………….

দিন কয়েক পরে সবিতার কাছে এক অপ্রত্যাশিত সুযোগ আসে।
একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা তাদের কাজে সবিতাকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেয়—
তারা জানায়, তারা চায় সবিতা তাদের ট্রেইনার হিসেবে কাজ করুক, যেখানে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে নারীদের অধিকার নিয়ে বক্তৃতা দেবেন, সেমিনার পরিচালনা করবেন, এবং কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

সবিতার মনে এক নতুন আশা জাগে।
এটা তার কাজকে আরও বিস্তৃত করতে পারবে, আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।
তবে একে অপরের সাথে ঘনীভূত সম্পর্কের ফলে, সবিতা কি এটি গ্রহণ করবে?

সবিতা এখনও সেই আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রস্তাবটি চিন্তা করছে। তার সামনে নতুন সুযোগ, নতুন যাত্রা, কিন্তু সে জানে—এটি সহজ হবে না। সে অনেক কিছু হারিয়েছে, অনেক কিছু শিখেছে, কিন্তু এখন তার সামনে এক নতুন যুদ্ধ আসছে। এই যুদ্ধ শুধু নিজের জন্য নয়, বরং দেশের নারীদের জন্যও।

……….

একদিন সাইফ একাধিক বার ফোন করে সবিতার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। সবিতা জানে, সাইফ বুঝতে পারছে না, তার সাথে সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সাইফের পরিবর্তন আসেনি, সে আবারও সবিতার কাছে ফিরে আসতে চায়, কিন্তু সে জানে, সবিতা আর কখনো তার কাছে ফিরে যাবে না।

এদিকে সবিতা যখন এই ভেবে নিশ্চিন্ত যে, সে সাইফের থেকে মুক্তি পেয়েছে, সাইফ আবার তার জীবনে প্রবাহিত হতে শুরু করে।

একদিন সবিতা অফিসে বসে ছিল, সাইফ তার সামনের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে।

– “আমি জানি, আমি তোমার অনেক কিছু ভেঙে ফেলেছি, কিন্তু আমি শুধু চাচ্ছি তোমার পাশে থাকতে। প্লিজ সবিতা, একবার আমাকে সুযোগ দাও।”

সবিতা এক মুহূর্ত চুপ থাকে। তার চোখে ঝিলমিল করা অশ্রু।

তবে সে জানে—এটা আর হবে না। সে জানে, তার পথের সঙ্গে সাইফের পথ আর কখনো মেলানো যাবে না।

“এবার তুমি আমাকে প্লিজ একে অপরের থেকে দূরে থাকার সুযোগ দাও।”সবিতা শান্তভাবে বলে।

সাইফ একেবারে চুপ থাকে, কিছু বলার সাহস পায় না। সে আজও আবার ধীরে ধীরে চলে যায়।

এতদিন যে তীব্র অসন্তোষ ছিল, যে অস্থিরতা সবিতার মধ্যে ছড়িয়ে ছিল, সেটি কিছুটা হলেও শান্ত হয়। সবিতা সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর অপেক্ষা করবে না। এই সুযোগ তার জন্য তৈরি হয়েছে, এবং সে এটি গ্রহণ করবে। তার জীবনের স্বপ্ন, তার লক্ষ্য, তার কামনা—সবই তার হাতের নাগালে।

রাইয়া তাকে সমর্থন জানায়। রাইয়া জানে,সবিতা যখন কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাকে কেউ থামাতে পারবে না।

– “তুমি সেই সাহসী মেয়ে, যে সবার আগে দাঁড়িয়ে আছে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য। তুমি জানো, আমাদের সকলের পক্ষে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই পথে চলতে চলতে তুমি এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।”

সবিতা তার দিকে তাকায় এবং তার চোখে এক নতুন আশার ঝিলিক দেখা দেয়।

কিন্তু নতুন পথ সহজ হতে যাচ্ছে না।
সবিতার নতুন যাত্রায় তাকে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। একদিকে সাইফের পরিবার আবারও তার বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ তুলতে শুরু করে—তারা সবিতার সম্পর্কে নিন্দা করতে থাকে, তার সামাজিক সম্মানহানি করতে চায়।

এদিকে, যখন সবিতা আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মসূচিতে অংশ নেয়, তখন তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হয়—কেউ কেউ তাকে ‘ঘরবাড়ি ভাঙানোর অপরাধী’ বলেও অভিহিত করে।

কিন্তু সবিতা এসবকে কিছু মনে না করে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। সে জানে, এই পথ সত্যি হলেও কঠিন, তবে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। তার কাছে একমাত্র লক্ষ্য হলো—নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাদের জন্য একটি সমতাভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি করা।

মোহাইমিনও জানে, সবিতা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু সে সবিতাকে আরেকটি সুযোগ দিতে চায়। মোহাইমিন সবিতার সাথে আবার যোগাযোগ শুরু করে, এইবার সে সবিতার পক্ষে কিছু কাজ করতে চায়।

– “তুমি যে কাজ শুরু করেছ, সেটি আমি বিশ্বাস করি। আমি চাই, তুমি আমার মধ্যে কাজ করতে থাকো, এবং আমাদের যৌথ উদ্যোগ দেশের উন্নতি করবে।”

সবিতা মোহাইমিনের দিকে তাকিয়ে, এক মুহূর্ত ভাবনায় ডুবে যায়। সে জানে, এই প্রস্তাব তার জন্য কোনো ভালোর দিকে নিয়ে যাবে না। তবে সে আর কিছু বললে না, শুধু ঘাড় নেড়ে তার সিদ্ধান্ত জানায়—

“ধন্যবাদ, কিন্তু আমি নিজের পথে চলব।”

মোহাইমিন হতাশ হয়ে ফিরে যায়, তবে তার চোখে এক অদ্ভুত লুক থাকে, যেন সে কিছু পরিকল্পনা করছে যা সবিতার ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হতে পারে।

সবিতা আজকে একটা নতুন পৃষ্ঠা লিখছে। তার সামনে পৃথিবী এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। এই নতুন প্রস্তাব, নতুন পথ—তার মধ্যে এক নতুন শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। একদিন, সে জানবে যে, তার এই যুদ্ধ শুধুমাত্র তার নিজস্ব নয়, পুরো সমাজের জন্য। তার গল্প, তার সংগ্রাম, তার জয়—সেটি অন্যদের জন্যও একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।

সে বুঝতে পারে, জীবনে যতই অন্ধকার আসুক, শেষ পর্যন্ত সব কিছু আলোকিত হয়ে ওঠে।

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৫

0

সবিতা
পর্ব: ০৫
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

রাইয়া কাঁপা গলায় নিজের গল্প বলা শুরু করে—
সে কিশোরী বয়সেই এক আত্মীয়ের লালসার শিকার হয়।
কেউ বিশ্বাস করেনি তাকে।
মা বলেছে, “মেয়ে হয়ে এত কথা বলে না।”
বাবা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

একদিন রাইয়া রাগ করে শুধু একটা ব্যাগ আর কিছু বই নিয়ে পালিয়ে আসে ঢাকায়।

শেল্টার হোমে এসে সে দেখে, এখানে ওরকম আরও অনেকে আছে।

কিন্তু সবচেয়ে অবাক হয়—যখন সে দেখে সবিতার মতো মেয়েও তার ভালোবাসার মানুষের কাছে দিনের পর দিন নির্যাতিত আর অবহেলিত।কিন্তু বর্তমানে তার আত্নবিশ্বাস প্রখর,চোখে কোনো ভয় নেই,মনের ভিতর এক আকাশ পরিমাণ বড় হওয়ার বাসনা,যাতে অন্যের মুখাপেক্ষী না হতে হয় তাকে।

সবিতা বলে—
– “তুই একা না, বুঝলি?”
রাইয়া জিজ্ঞেস করে—
– “আপনি কীভাবে এত শক্ত হন?”
সবিতা বলে—
– “যেদিন থেকে আমি অন্যের জন্য নিজেকে শক্ত করলাম, সেদিন থেকে।”


সবিতা এখন শুধু ব্লগার না।
সে চায় একটা ‘আশ্রয় ও পুনর্গঠন কেন্দ্র’ গড়তে—যেখানে নির্যাতিত নারীরা শুধু আশ্রয় নয়, পাবে শিক্ষা, কাজ শেখা, আইনি সহায়তা, এবং সম্মান।

প্রজেক্টের নাম দেয়—
“আলোকধারা”

নওরীন আপু ও একাধিক এনজিও পাশে দাঁড়ায়।

মিডিয়াতে আবার সবিতার নাম উঠে আসে—
“সাবেক গৃহবধূ থেকে নারী অধিকারকর্মী:সবিতার পথচলা।”

একদিন সন্ধ্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়।
নামেন একজন ব্যক্তি—পরিচিত মুখ, কিন্তু চোখে একেবারে অচেনা ভাষা।

মোহাইমিন চৌধুরী।
নতুন এক এনজিওর পরিচালক, দেশের বাইরে থেকেও কাজ করেন।
সে আগেই সবিতার কাজের কথা শুনে এসেছে।
আজ সরাসরি দেখা করতে।

– “আপনার সাহস আর স্পষ্টতা আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছে,”—সে বলে।

সবিতা চমকে ওঠে না।
কারণ এখন এসব প্রশংসায় সে মাথা ঘোরায় না।
তবু তার চোখে প্রশ্ন—
“আপনি কেন এখানে?”

মোহাইমিন হেসে বলে—
– “কারণ আমি চাই, আপনি দেশজুড়ে ‘আলোকধারা’র শাখা খুলুন। আমরা সহায়তা দেব। আপনি নেতৃত্ব দিন।”

সবিতার মুখে এক অদ্ভুত নির্ভরতা।
তবু ভিতরে ভিতরে একটা দ্বিধা খেলে যায়।

রাইয়া এখন শুধু নিরাপদ নয়—সে শিখছে ডিজাইন, কথা বলা, নেতৃত্ব।
একদিন সে বলে—
– “আপা, আপনি যদি না থাকতেন, আমি হয়তো বেঁচেই থাকতাম না।”

সবিতা চেয়ে থাকে—
আসলে সে তো নিজেকেও বাঁচাতে চেয়েছিল।
এখন বাঁচাচ্ছে আরো অনেককে।

…..……

সবিতা যখন ‘আলোকধারা’ শুরু করে, তখন এর সাফল্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এটা একদিকে মানুষের জন্য আশ্রয়, অন্যদিকে সবিতার জন্য নতুন এক পরিচিতি তৈরি করে।
কিন্তু সাফল্যের সাথে আসতে থাকে নতুন চ্যালেঞ্জ।
এখন সবিতা শুধু নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে না—সে হয়ে উঠছে সমাজের চোখে এক প্রতীকি লড়াকু।

এদিকে, মোহাইমিনের পাশে দাঁড়ানোর পর সবিতার মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা চলে আসে।
সে জানে না, মোহাইমিন কেবল সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, নাকি তার মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
তার মানসিক দ্বন্দ্ব ঘিরে ধরে।
সে কখনো মোহাইমিনের সাহায্যকে মেনে নেয়, কখনো আবার তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠে।

আজ সবিতা তার বাড়িতেই আছে।হঠাৎ সাইফ তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
তার চোখে অনুরোধ।
সে বলে—
– “আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি, কিন্তু তোমার পাশে দাঁড়াতে চাই।”প্লিজ আন্নি সুযোগ দাও একটা।প্লিজ।

সবিতা নির্বিকারভাবে সাইফের দিকে তাকায়।

সে ভালো করেই জানে, সাইফ এখনও তার পুরনো গন্ডির মধ্যে আটকে আছে।সাইফ বিন্দুমাত্র নিজেকে চেঞ্জ করে নি।
তার জীবনে আসলে সবিতা ছিল একটা অস্থায়ী পরিসর।
সে নিজেকে এতটাই গুটিয়ে ফেলেছে যে,সবিতার এমন পরিণতি, যা তার কারণেই হয়েছে,সেটা স্বীকার করতে এখনো সক্ষম হয়নি সাইফ।

তবে সবিতা জানে, এই সময়ে সাইফের তার সামনে এসে দাঁড়ানোর পেছনে এক বড় কারণ আছে—

সে কি শুধুই অপরাধবোধের কারণে ফিরে এসেছে?

না কি তার জীবনের প্রতি পূর্ণ ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করছে?

সবিতা এদের কোনোটাই বিশ্বাস করতে পারে না।
সে বলে—
– “তুমি কি কখনো আমার জন্য কিছু করতে চেয়েছিলে? আমি চলে যাওয়ার পর তুমি কি এক মুহূর্তও আমাকে খুঁজেছিলে? না, সাইফ, তুমি তা করো নি,আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে দাও,আর তুমি শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচো।”প্লিজ আমার সামনে আর এসো না।আমি তোমাকে ছাড়া বেশ ভালো আছি।আমাকে ভালো থাকতে দাও দয়া করে।

সাইফ আজও সেখান থেকে চলে যায়, নিঃশব্দে।

সে এতো বড় অপরাধ করেছে যে যার কোনো দিন কোনো ক্ষমা নেই সবিতার কাছে।

সবিতা বর্তমানে অনেক ভালো ভালো কাজ করছে,তার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, এজন্য তার কিছু শত্রুরাও হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

একদিকে কিছু পুরনো পরিচিত মুখ তাকে অপমান করতে চায়, তো অন্যদিকে তার কাজের প্রতি বিরোধিতা জানায়।

কিছু মানুষ মনে করে যে, সবিতার কাজ নারীদের জন্য আসলেই উপকারী, কিন্তু তারা যে সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে এর বিরোধিতা করে, তা নিয়ে সবিতার সন্দেহ বাড়ে।

কিছু লোক সবিতার প্রতিষ্ঠানে তার কাজকে অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক বলে মনে করে।
তারা মনে করে—

“সবিতা যদি নারীদের অধিকার নিয়ে এত কথা বলে, তাহলে তার শিখানো মূলনীতি সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করবে।”

একদিন, সবিতা যখন নিজেই খুঁজতে থাকে কাদের বিরোধিতা তাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত দেয়, তখন সে বুঝতে পারে—

এর মধ্যে এক ধরনের বৃহত্তর ষড়যন্ত্র কাজ করছে।
একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শিক লড়াইয়ে সবিতা পড়ে গেছে।
অথবা, কেউ সবিতার অর্জনগুলিকে হুমকি মনে করছে।
সবিতার চারপাশে এক অদৃশ্য যুদ্ধ শুরু হয়।

রাইয়া একদিন সবিতাকে বলে—

– “আপা, আপনি ভাবছেন, সমাজ ও পরিবার আমাদের বিরোধিতা করছে, কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি যে কাজ শুরু করেছেন, তা চিরকাল আপনাদের বিশ্বাস ও উদাহরণ হয়ে থাকবে।”

রাইয়ার কথায় সবিতার মনে এক নতুন শক্তি খেলে যায়।
সে বুঝতে পারে, সমাজের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সে একা নয়।
এখন তার পাশে অনেক সঙ্গী, যারা একে অপরকে শক্তি দেয়।
এই অনুভূতি সবিতাকে দৃঢ় করে তোলে।

মোহাইমিন আবার সবিতার কাছে আসে—

– “আপনি জানেন, আপনাকে আমি শুধু সহায়তা দিতে চাই না, বরং আপনার কাজে যোগ দিতে চাই। আমি চাই, আপনার প্রজেক্টকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে।”

সবিতা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।
তার সামনে একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—
কীভাবে সে এই মানুষটির প্রস্তাব মেনে নেবে?

সবিতা মোহাইমিনের মনোভাব সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।
তবে সে জানে, তার কাজের জন্য সহযোগিতা দরকার।
এটা কি তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হবে?

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৪

0

সবিতা
পর্ব:০৪
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা এখন এনজিওর শেল্টার হোমেই আছে। রোজ নিজেকে একটু একটু গড়ছে।
দিনে সেলাই শেখে, সন্ধ্যায় কম্পিউটার ক্লাস, রাতে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ।
এক ধরনের ছন্দে চলতে থাকা এই দিনগুলো হঠাৎ বদলে গেল এক বিকেলে।

সেইদিন এনজিওতে আয়োজিত ছিল একটি ওয়ার্কশপ—
“সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা”
ওয়ার্কশপে স্পিকার ছিলেন নওরীন আফরিন, একজন সাইকোলজিস্ট এবং লেখিকা।

ছিমছাম পোশাক, মিষ্টি গলা, আত্মবিশ্বাসী চোখ—
সবিতার মনে হলো, এই প্রথম একজন নারীকে দেখে তার নিজের প্রতি ভরসা বাড়ছে।

নওরীন যখন বলছিলেন—

– “নিজেকে দোষারোপ করো না। যে চলে আসে, সে সাহসী। যে প্রতিবাদ করে, সে বেঁচে থাকার জন্য লড়ে। তুমি যদি নিজেকে ভালোবাসো, তাহলেই তুমি জীবনের কাছে দায়মুক্ত।”

সবিতার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
তার ভিতরের ক্ষতগুলো যেন কারও কথায় সাড়া দিচ্ছে।

ওয়ার্কশপ শেষে সবিতা নওরীনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখ নিচু করে।

নওরীন হাসেন, বলেন,
– “তোমার চোখ অনেক কিছু বলে। তোমার গল্প শুনতে পারি?”

তাদের কথোপকথন শুরু হয় ধীরে ধীরে।
দিনের পর দিন, সবিতা তার জীবনের প্রতিটা যন্ত্রণার কাহিনি খুলে বলে।
নওরীন শুধু শোনেন না, তাকে জড়িয়েও ধরেন।

একদিন নওরীন বলেন—

– “তুমি চাও, আমি তোমার একটা কেস ফাইল করে রাখি? চাইলে আইনি সহায়তা, থেরাপি ও একটা শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”

সবিতা চমকে ওঠে।
সে কখনো ভাবেইনি কেউ তার পাশে এভাবে দাঁড়াবে।

কিন্তু ঠিক তখনই—
আবার এক ঝড় উঠে যায়।

একদিন এনজিওর অফিসে আসে দুই পুলিশ ও সবিতার শশুর।

তিনি এসে বলেন—

– “আমাদের বউমা হারিয়ে গেছে। অনেক খুঁজছি। এখন শুনছি এখানে আছে। তাকে নিতে এসেছি।”

নওরিন তখন সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

– “মেয়েটির নিজের মতামত ও সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করে কেউ তাকে নিতে পারবে না। আপনারা চাইলে আইনগতভাবে দাবি পেশ করুন। তবে এখন ওর সিদ্ধান্ত ওর নিজের।”

সবিতা প্রথমবার এতটা নিরাপদ অনুভব করে।

সেই রাতে সবিতা চুপচাপ নওরীনকে জিজ্ঞেস করে,

– “আপু, আমি লেখাপড়া করতে চাই, নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চাই।তাহলে কি বয়স দোষ হয়ে দাঁড়াবে?”

নওরীন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
– “বয়স নয়, সংকল্পই সব। তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে ভর্তি করিয়ে দেব।”

সবিতার চোখে আশার আলো জ্বলে ওঠে।
এক নতুন যাত্রার শুরু।
নওরীন আপুর উৎসাহে সবিতা ভর্তি হয় একটি বেসরকারি কলেজের অনলাইন প্রোগ্রামে।
পুরো স্কলারশিপে।
সকালে সেলাই, বিকেলে পড়াশোনা, রাতে নিজের ডায়েরির পাতা খুলে বসা—এভাবেই কাটে তার দিনগুলো।

একদিন নওরীন হঠাৎ বলল,
– “তুমি কি জানো, তোমার জীবনের গল্প যদি তুমি নিজেই লেখো, তাহলে সেটাই হয়ে উঠবে অন্য নারীর সাহস?”

সবিতা অবাক হয়ে চেয়ে থাকল।
সে কখনো ভাবেনি তার যন্ত্রণার ভেতরেও কারো পথ দেখানোর আলো লুকিয়ে থাকতে পারে।

সে লিখতে শুরু করে—
প্রথম পাতায় লেখে—

> “আমি ছিলাম কারো ঘরের বউ, অথচ সেই ঘরটা আমার ছিল না কোনোদিন।
আমি এখন কারো স্ত্রী নই, কারো মেয়ে নই—আমি শুধু আমি।”

প্রথমে ছোট ছোট লেখালেখি।
তারপর একটা ব্লগ খুলে ফেলে নওরীনের সহায়তায়।
নাম দেয়: “জীবনযুদ্ধিনী”।

প্রতিদিন হাজার হাজার মেয়ে তার পোস্টে মন্তব্য করে।
অনেকেই লিখে—
“তুমি আমার মতো…”, “তুমি না লিখলে বুঝতাম না আমি একা নই।”

সবিতার ভিতরে এক নতুন শক্তি জন্ম নেয়।
তার কণ্ঠস্বর এখন শুধু তার না, অনেকের কণ্ঠ।

কিন্তু পুরোনো অন্ধকার তো চুপ করে বসে থাকে না।

একদিন, তার ব্লগে একটা কমেন্ট আসে—

“তোমার নাম তো আন্নি।তুমি সাইফের বউ ছিলে না? এত বড় বড় কথা বলার আগে আয়নায় নিজের মুখ দেখে নে।”

সবিতা প্রথমে ভয় পায়।
তারপর লেখে এক জবাব—

> “হ্যাঁ, আপনি সঠিক ধরেছেন,আন্নি সাইফের স্ত্রী। কিন্তু সে আন্নি নিজেকে ভেঙে চুরে সবিতা হিসেবে তৈরি করেছে।সবিতা এখন তার নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে শিখেছে।
সবিতা ভাঙিনি, সবিতা তৈরি হয়েছে।”

এই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়।
দেশজুড়ে অনেক মিডিয়া তার সাক্ষাৎকার চায়।

নওরীন একদিন বলে,
– “তুমি যদি চাও, আমরা তোমার লেখা দিয়ে একটি বই প্রকাশ করব। তুমি সম্মেলনে যাবে, অন্য নারীদের সামনে কথা বলবে।”

সবিতার চোখ ছলছল করে ওঠে।
সে ছোট করে বলে—
– “আমি পারবো তো?”

নওরীন জবাব দেন,
– “তুমি তো সেই দিনই পেরেছিলে যেদিন ঘর ছেড়ে বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে।”

সবিতার বই “জীবনযুদ্ধিনী” প্রকাশের পর সে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে সে সেমিনার, টক শো-তে ডাক পায়।
তাকে “মহিলা ক্ষমতায়ন” বিষয়ক এক সরকারি সেমিনারে বক্তা হিসেবে ডাকা হয়।
মঞ্চে উঠে সে বলে—

> “আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছেড়েছিলাম, আজ সেই কান্না দিয়ে পথ গড়েছি।”

হলজুড়ে করতালি।
কেউ একজন বসে আছে শেষ সারিতে—চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে।
সে সাইফ।

হ্যাঁ, সে ফিরে এসেছে।

সাইফের মনোভাব বদল, না কি মুখোশ?

সেমিনার শেষে সবিতাকে গেটের বাইরে পায় সাইফ।
একটা চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে বলে—
– “তুমি এত বড় হয়ে যাবে বুঝি নি কখনো। আমি তো ভাবতেও পারিনি।”

সবিতা জবাব দেয় না।
চোখে একরাশ তীব্র ঠাণ্ডা।

সাইফ বলে—
– “ভুল হয়ে গেছে আমার, আমি তোমাকে বুঝতে পারি নি। তুমি ফিরে আসো না প্লিজ…”

সবিতা হেসে ফেলে।
আর বলে,আমাকে যদি আন্নি ভেবে নিতে আসেন তাহলে আমি যেতে পারবো না,কারণ আন্নি এখন মৃত।
আর যদি সবিতাকে ফেরত নিতে আসেন,
তাকেও নিয়ে যেতে পারবেন না।
কারণ,,,,,
সবিতা থেমে গেলো।
কিন্তু সে একটা চিঠি বের করে সাইফের হাতে দেয়।

চিঠির শিরোনাম—
“যে মেয়েটা একদিন তোমার ছিল, সে আজ মৃত।কিন্তু এখন যাকে দেখছো সে একান্তই নিজের।”

সাইফ পেছনে হাঁটা দেয়।
এই প্রথম সে বুঝতে পারে, ক্ষমতা কাকে বলে।
আর এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারে আন্নি আর তার জীবনে কখনোই ফিরবে না।

সবিতার সামনে নতুন পথ

নওরীন আপু বলে—
– “তুমি চাইলে বিদেশে একটা স্কলারশিপের সুযোগ আছে, লেখালেখির ওপর।”

সবিতা চুপ করে থাকে।
তার মনে পড়ে তার মতো হাজার মেয়ের কথা।
সে বলে—

– “আমি থাকব। আমি চাই আমার মতো মেয়েরা যখন ভেঙে পড়বে, তখন আমি তাদের যেনো পাশে দাঁড়াতে পারি। যেমন তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে।”

নওরীন গর্বিত চোখে তাকায়।

একদিন…

এক সন্ধ্যায় শেল্টার হোমে আসে এক কিশোরী।
মুখ থেঁতলে গেছে, চোখে ভয়।

সবিতা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে—
– “তোমার নাম কী?”

মেয়েটি ফিসফিসিয়ে বলে—
– “রাইয়া…”

সবিতা তাকে জড়িয়ে ধরে।
নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমস্ত ভয়, যন্ত্রণা, অভিমান… সব কিছু মিলিয়ে একটাই কথা বলে—

> “তুমি এখন নিরাপদ, রাইয়া। আজ থেকে তুমিও একজন জীবনযুদ্ধিনী।”

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৩

0

সবিতা
পর্ব: ০৩
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

“আমি মানুষ তো, না কি শুধুই এক কাজের মেয়ের মতো বসবাস করা মেশিন?”

সেই ভাবনা থেকেই আচমকা এই সিদ্ধান্ত—
আজ এই ঘর, এই সংসার, এই চেনা অথচ অচেনা মানুষের দল ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।
কোনো ব্যাগ নয়, কোনো টাকা-পয়সা নয়, এমনকি নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নয়।

আন্নি বেরিয়ে যায় খালি হাতে। পরনের ওড়নাটাও ঠিকমতো নেই তার গায়ে।
তবুও মনে এক অদ্ভুত শান্তি—
“এই নির্যাতন আর নয়।”

চাঁদের আলোয় ছায়া পড়ে তার চোখের নিচে।
রাস্তার বাতি মাঝে মাঝে কেঁপে উঠে।
সে হাঁটছে, উদ্দেশ্যহীন ভাবে।
জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন কোথাও না যাওয়াটাও একটা যাত্রা হয়ে দাঁড়ায়।
আজ আন্নির সেই যাত্রা।

হাঁটতে হাঁটতে পা আর চলে না।
চোখের জল শুকিয়ে গাল নোনা করে রেখেছে অনেক আগেই।
কোনো ঠিকানা নেই তার কাছে, নেই কারো আশ্রয় চাওয়ার অধিকার।
কিন্তু তবু সে চলেছে, একা, নিশ্চুপ।

ক্ষুধা লেগেছে, গা ভেঙে যাচ্ছে, চোখে অন্ধকার।
কিন্তু তবুও থামে না সে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায়—মাথা নিচু, কাঁধ ঝুঁকে গেছে ক্লান্তিতে।

ঠিক তখনই পেছন থেকে এক চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—

“আন্নি?”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কাকুলি আর আনোয়ার।
তার বান্ধবী, তার একমাত্র সমব্যথী।
কিন্তু এতটা ভাঙা অবস্থায় নিজেকে কারো সামনে প্রকাশ করতে চায় না আন্নি।
তাই সে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয়, চোখের জল লুকাতে চায়।

আনোয়ার উদ্বিগ্ন গলায় বলে ওঠে,
“আন্নি, কী হয়েছে তোমার?
এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? সব ঠিক আছে তো?”
কাকুলিও এগিয়ে আসে।
তার চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ, কণ্ঠে কাঁপুনি—
কাকুলি কাছে এসে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আবার সাইফের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস?”

আন্নি কোনো উত্তর দেয় না। তার চুপ থাকা যেন আকাশভরা উত্তর হয়ে নেমে আসে।
তার ঠোঁট থরথর করছে, চোখ আবারও জলে ভরে যাচ্ছে।

কাকুলি তার হাত ধরে—
“চল, আমাদের বাসায় চল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। তুই তো কাঁপছিস, আন্নি।”

আন্নি নিচু গলায় বলে—
“আমি আর কোনো ঘরে ফিরতে চাই না।আমি… রাস্তাতেই থাকবো।”
এটাই আমার শান্তি।”

কাকুলি চোখ বড় করে তাকায়।
“তুই পাগল নাকি? এভাবে কেউ থাকে? দুঃখে মন ভেঙে গেল মানে কি নিজের জীবনও ছুড়ে ফেলা?”

আন্নি কিছু বলে না।
শুধু তার দৃষ্টিতে ক্লান্তি, কষ্ট আর ভাঙা স্বপ্নের ছায়া।

আনোয়ার এবার একটু কঠোর গলায় বলে—

“দেখো, সাহস করে বেরিয়ে এসেছো, তার জন্য তোমার সাহসকে আমি সম্মান করি।
কিন্তু এর মানে এই না যে তুমি নিজেকে শেষ করে দেবে।
চলো, আমাদের বাসায় যাও। কালকের দিন কী হবে, পরে ভাবা যাবে।”

কাকুলি তার চোখে চোখ রেখে বলে—
“যা হবার হয়েছে। এবার তুই নিজের কথা ভাব।
তুই যে জীবিত আছিস, সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”
আন্নি একবার তাদের দিকে তাকায়।

শেষমেশ কাকুলি আর কোনো কথা না শুনেই জোর করে তার হাত ধরে ফেলে—
তোকে আমি একা রাস্তায় রেখে যেতে পারবো না।”

এই প্রথম সে অনুভব করে, কারও ছায়া এখনও আছে তার জীবনে।
অপমানের ঘর ছাড়লেও, আশ্রয়ের হাত এখনও থেমে যায়নি।

সে ধীরে ধীরে কাঁপা পায়ে হাঁটতে থাকে কাকুলি আর আনোয়ারের সাথে।
আর সেই মুহূর্তে তার চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসে শান্তির জল।
সেই চোখের জলে কষ্ট ছিল, তবে এবার ছিল নতুন শুরুর ইঙ্গিতও।

……..

অবাক করার মতো বিষয় হলো—আন্নি বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরেও কেউ খোঁজ নিলো না।
এদিকে সাইফ রাতে বাড়িই ফেরে নি।

সকাল বেলা শাশুড়ি অবশেষে সাইফকে ফোন করলেন।

“আন্নি বাসায় নাই।”—কণ্ঠটা যেন নিস্পৃহ।

সাইফের প্রতিউত্তর ছিল যেন তার চরিত্রেরই প্রতিচ্ছবি—“কই যাবে আর? বাপের বাড়িতে গেছে নিশ্চয়।”

একটুও উদ্বেগ, একটুও দায়িত্বের বোধ—কিছুই ছিল না কণ্ঠে। এমন কাপুরুষ স্বামী নিয়ে বেঁচে থাকার মানে কী?

এতটাই স্বার্থপর, এতটাই নির্দয় সে!
যে নারী বছরের পর বছর প্রেম করে অবশেষে তার সংসারে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে, তার মানসিক যন্ত্রণা আর অপমানের বোঝা টানতে টানতে আজ নিজেকে ভেঙে ফেলেছে—তার খোঁজে একটাবার বেরিয়ে পড়ার প্রয়োজন বোধ করে না সাইফ।

আন্নি তখন কাকুলিদের বাসায়।
বন্ধু কাকুলি একটিবার জড়িয়ে ধরেছিল—
“থাক তুই আমার কাছে। ঠিক হয়ে যাবে সব।”
আন্নি একটুও হাসতে পারেনি। তার মুখে কেবল নিঃস্পৃহতা, আর মনে একটাই প্রশ্ন—এই “সব” ঠিক হওয়ার মতো আছে কি?

কিন্তু কাকুলির বাসায় তো চিরকাল থাকা যায় না।
এটা তার স্থায়ী ঠিকানা নয়।সব সময় দয়া-ভিত্তিক সম্পর্ক মানুষকে কুরে কুরে খায়।

নিজের বাবা-মায়ের বাড়ি?
না,
বাবার বাড়ির দরজাও তার জন্য আজ বন্ধ।

পরের গন্তব্য—বড় বোন আমেনার বাড়ি।
তবে সেখানেও মিলল না আশ্রয়।
বরং শুনতে হলো চরম কথাগুলো—

“এইভাবে বাড়ি থেকে চলে আসে কেউ?”
“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?”
তুই কি ছোট শিশু?”
“আর কিছুদিন সহ্য করতে পারলি না?”

রক্তের সম্পর্কগুলোও এখন প্রশ্ন তোলে।

আন্নির চোখ ভরে ওঠে অশ্রুতে। গলার স্বর কাঁপে—
গলা ধরে আসে। সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে—

“আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। একদম না।”
আমি ভেঙে পড়ছিলাম, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো আমার!”

কেউ বুঝলো না তার যন্ত্রণার ভাষা, শুধু সিদ্ধান্তের জন্যই দোষারোপ।
শুধু বলে—তুই ভুল করেছিস।

কয়েকদিনের মাথায় মা-বাবা এসে হাজির আমেনার বাড়িতে। মা একদিকে ঝাড়ছে, বাবা আরেকদিকে। কেউ একটা প্রশ্নও করলো না—“তুই কেমন আছিস?”
তাদের চোখে আন্নি যেন এক অপবিত্র বোঝা।

মা বলে—“তোর মতো মেয়ে আমাদের মুখ দেখায় কেমনে!”
বাবা বলে—“তুই আমাদের মুখ পুড়ালি!”

আন্নি মাথা নিচু করে।
তাদের চোখে চোখ রাখার সাহসও তার আর নেই।
একটা মানুষের ভেতরকার সবটুকু তুচ্ছতা আজ তার দেহমুখে লেখা।

অভিমান আর অপমানে রাগ করে বোনের বাসা থেকেও বেরিয়ে পড়ে আন্নি।
আর তখনই শুরু হয় তার নিঃসঙ্গ ভ্রাম্যমান অধ্যায়।

সাইফের পরিবার ভাবে সে হয়তো মা-বাবার বাড়ি গেছে। মা-বাবা ভাবে সে হয়তো স্বামীর বাড়ি ফিরেছে।
কিন্তু আসলে, আন্নি কোনো বাড়িতেই নেই।
সে এখন রাস্তায়—নির্জন, অচেনা, একা।

সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে—একটা ঠাঁইহীন, ভালোবাসাহীন, নির্বাসিত নারীর মতো।

চোখের সামনে মানুষ আসে-যায়। কেউ তাকে দেখে না।
জীবনের গাঢ় অন্ধকারে সে হাঁটছে—অচেনা এক ভবিষ্যতের দিকে।
তবুও সে থেমে নেই।
একটুও।

….……….

ঢাকার শহর রাত নামলেই যেন অন্য এক রূপ নেয়।
লোকের ভিড় কমে, আলো কমে, শব্দ কমে… আর ভয় বাড়ে।

পায়ে পায়ে হেঁটে ক্লান্ত আন্নি একটা ফুটপাথের কিনারে বসে পড়ে।
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিখারিদের ভিড়ে আজ সে-ও যেন এক হয়ে গেছে।

একসময় যার সাজগোজে ব্যস্ত থাকত সন্ধ্যা, আজ তার চুল এলোমেলো, গায়ে ধুলোমাখা, চোখে শূন্যতা।

মুখ ফিরিয়ে কেউ তাকায় না তার দিকে।

হঠাৎ একটা ছেলে থামে।
চিন্তা করে বসে, কাঁধে ব্যাগ, হাতে পানির বোতল।চেহারার মতিগতি ঠিক মনে হচ্ছে না।

– “আপু ঠিক আছেন?”
আন্নি ভয় পেয়ে যায়। চোখে চোখ রাখে না, মাথা নিচু করে শুধু বলে,
– “ভালো আছি। এই বলে সে অন্য জায়গায় গিয়ে বসলো।

আন্নির চোখের কোণ ভিজে ওঠে—এই শহরে মানুষ আছে, আবার নেইও।

একটা ভাঙা বেঞ্চে বসে থাকে সে।
রাত বাড়ে।
রাতের গাড়িগুলোর হেডলাইটে মাঝে মাঝে তার মুখটা ঝলসে ওঠে।
সাথে আসে কত প্রশ্ন—

“কোথায় যাবো আমি?”
“কেউ কি আর কখনও আমাকে বিশ্বাস করবে?”
পরক্ষণেই ভাবে,
“আমি কি এতটাই দুর্বল?”

এইসব প্রশ্নের ভেতরেই হঠাৎ একটা কাঁপা গলা,

– “এই যে মা, এইখানে ঘুমাইও না, খুব বিপদ হইতে পারে।”

বয়স পঞ্চাশের মতো এক মহিলা। মুখে ক্লান্তির রেখা, হাতে পাতলা চাদর।

আন্নিকে দেখে থমকে দাঁড়ায়।

– “নতুন আইছো?”

আন্নি কোনো কিছু না ভেবে মাথা নাড়ে।

– “চলো, আমার সঙ্গে চলো। যতটা পারি যত্নে রাইখা দিব। শুইস না এইখানে। খারাপ মানুষ এলা দ্যাখলে তো খোদারেও ভয় করে না।”একদম গিলে খাবে।

আন্নি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

তারপর অনেক ভেবেচিন্তে ধীরে ধীরে মহিলার পিছু নেয়।তাছাড়া অনেক রাত ও হয়েছে।এই পরিবেশে একা থাকা ঠিক হবে না।এখন এই পরিস্থিতিতে তাকে কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতেই হবে।

একটা পুরোনো ভবনের নিচতলায় কিছু মেয়েরা বসে আছে, কেউ রান্না করছে, কেউ কাপড় শুকাচ্ছে, কেউ নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে।

এ যেন ছিন্নভিন্ন মেয়েদের এক অস্থায়ী সংসার।
কেউ বাসা থেকে বেরিয়ে আসা, কেউ পেটের দায়ে চলে আসা, কেউ সমাজের চোখে “অযোগ্য” হয়ে পড়া।

আন্নিকে এক কোণে বসতে দেয় সেই মহিলা টি।
তার নাম—”রহিমা।”

রহিমা বলে,
– “ভয়ে থাকিস না মা। কয়দিন থাকিস, তারপর যদি চানস পাই, তো চাকরির কিছু দেখি, না হলে মহিলা হোস্টেল আছে, আমি ঠিকানাও জানি। তুই শুধু দম ছাড়িস না।”

এই কথায় চোখ ভিজে যায় আন্নির।
রহিমা যেন অন্ধকারে একটা হালকা আলো।
এই প্রথম কেউ তাকে “মা” ডেকে স্নেহে কিছু বললো।

রাত গভীর হয়।

আন্নি ছোট্ট একটা কম্বলের নিচে কেঁপে কেঁপে ঘুমায়।
ঘুম আসে না ঠিক। আসে এক ধরনের অবচেতন—
যেখানে তার বাপ-মায়ের মুখ ভেসে ওঠে,
সাইফের ঠান্ডা কণ্ঠ,
আমেনার গালমন্দ,
আর আজকের রহিমা।

হয়তো এই শহরের বুকেই কোথাও তার জন্য একটা ছোট্ট জায়গা আছে।
যেখানে কেউ তার ভালোবাসা পাবে না বলে ঠেলে দেবে না।
যেখানে সে নিজের নামে একটা পরিচয় গড়তে পারবে।
নিজেকে খুঁজে পাবে।
রহিমা খালার সেই ছোট্ট ঘরেই ক’দিন কাটিয়ে দেয় সে।

…………..

সকালে আশপাশের বাসাগুলোর রান্নার গন্ধে চোখ মেলে আন্নি।
কেউ তাকে জোরে ডাকে না, কেউ দায়িত্ব চাপায় না,
তবু তার মধ্যে এক অদ্ভুত খালি জায়গা তৈরি হয়েছে।

একদিন রহিমা বলে,
– “চল মা, তোকে একটা জায়গায় লইয়া যাই।”

আন্নি চুপচাপ যায় তার সঙ্গে।
ছোট একটা অফিস, দরজার সামনে লেখা—
“নারী সহায়তা কেন্দ্র – প্রশিক্ষণ ও সহায়তা কার্যক্রম”

একটা আপু জিজ্ঞেস করেন নাম কি তোমার?

___আ,,,,বলতেই থেমে যায় আন্নি।

না,সে আজ থেকে আন্নি নয়।তার নতুন নাম সে নিজেই ঠিক করে।
কারণ আন্নি মারা গেছে স্বামীর অযত্ন আর ভালোবাসার অভাবে,আন্নি মারা গেছে শশুড় শাশুড়ীর অবহেলায়,আন্নি মারা গেছে বাবা মার দুর্ব্যবহারে,আন্নি মারা গেছে বোনের গালমন্দে।

কি হলো?নাম কি?

____সবিতা।

____নাইচ নেইম।
আপুটি হাসিমুখে বলেন,

–সবিতা “তুমি চাইলে এখানে থেকে সেলাই শেখা, কম্পিউটার শেখা বা হেল্প ডেস্কে কাজ করতে পারো। আর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে।”

সবিতার চোখে জল এসে যায়। এতদিন পর কেউ তাকে মানুষ মনে করছে, অবহেলা করছে না।

তিনদিন পরই সে সেলাই শেখা শুরু করে।
রোজ ঠিক সময়ে উঠে পড়ে, আয়নায় নিজের চোখে চোখ রাখে।

“আমি পারবো”— নিজেকে বলতে শেখে।

প্রথম নিজের বানানো থ্রিপিস যখন নিজের গায়ে পরে দেখে, মনে হয় কতকাল পরে যেন নিজেকে সাজিয়েছে।

রাতে রহিমা খালা একদিন বলে,
– “তোরে এই শহর ঠেকাইতে পারে নাই মা, তুই একদিন ঠিকই উঠবি।”

সবিতা মাথা নিচু করে হাসে।
সে নিজেকে একধরনের মুক্ত পাখি মনে করে, যার পাখায় এখনও আঘাত আছে, কিন্তু উড়ার শক্তি জমে উঠছে।

কিন্তু পুরোনো ছায়া কি এত সহজে পিছু ছাড়ে?

এক সন্ধ্যায় সবিতা যখন এনজিওর বারান্দায় বসে সেলাইয়ের কাজ করছিল,
তখন একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পায়।

– “আপনারা কি আন্নি নামের কাউকে চেনেন?

গলা শুনেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

এ তো সাইফ।

সবিতা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে—সাইফ দাঁড়িয়ে আছে।
মুখে অস্থিরতা, হাতে তার একটা ছবি।

কেউ একজন বলে,
– “না ভাই, এই নামে তো কেউ নাই।”

আন্নি ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে দেয়।
তার ভিতরটা কাঁপে।
সাইফ তাকে খুঁজছে, কিন্তু কেন?

ভালোবাসায়?
নাকি সমাজের ভয়ে?
নাকি “মেয়েটা আবার যেন মুখ না তোলে” সেই অভিপ্রায়ে?

রাতে রহিমা খালা দেখে সবিতার চেহারায় অদ্ভুত এক হতাশা।
জিজ্ঞেস করে না কিছু, শুধু পাশে বসে চুপচাপ হাত ধরে।

সবিতা বলে,
– “আমি কি কিছু ভুল করলাম খালা?”

– না,মা।
“তুই এখন বেঁচে আছিস,আর পূর্বে বেঁচে থেকেও মৃত ছিলি। সঠিক পথেই তুই আছিস।

চলবে……….