দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার, একে অপরকে অতিক্রম করতে গিয়ে কখনো এক হয়, কখনো দুই।
আন্নির জীবনটা যেন এই দুইয়ের মাঝে ভাসমান।
একটা সময় ছিল, যখন সাইফের প্রতি তার বিশ্বাস ছিল আকাশের মতো বড়—প্রেমে ছিল অটুট। কিন্তু এখন সে বিশ্বাস, সেই ভালোবাসা—সবই যেন একে একে সরে গেছে।
দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আন্নির জীবনে যেন কোনো পরিবর্তন নেই। এক এক করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু জীবনযাত্রার শীতলতা যেন কোনোভাবেই দূর হয় না। দিনের আলোও তার জন্য এখন আর আগের মতো উজ্জ্বল নয়, তার চারপাশে সব কিছু যেন ধূসর হয়ে গেছে। এক সময় সাইফের সাথে প্রতিটি দিন নতুন অনুভূতি নিয়ে আসতো, এখন তার মনে হয়, দিনগুলো একইরকম—শুধু সময় কাটছে, কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে না।
আজ আবার এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হলো।আবার নতুন একটি ঘটনা আন্নির মনকে আরো ভেঙে ফেলল।
তার বান্ধবী, রহিমা, ফোন করে জানালো,
— “তুই জানিস, সাইফ কি করছে? আজ বাইকের পেছনে এক মেয়ে নিয়ে ঘুরছিল। তুই কী করে এসব সহ্য করছিস? তুই তো জানিস, সাইফের আচরণ কেমন ছিল বিয়ের আগে। কিন্তু এখন তো তার কিছুই ঠিক নেই!”
আন্নি ফোনের স্ক্রীনে একমুঠো স্থির হয়ে যায়।
তার হাত কাঁপছিল, ফোনটা এতটাই শক্ত করে ধরেছিল যে, মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী তার হাত থেকে ছড়িয়ে পড়বে। সে কী বলবে? কীভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবে? সাইফের সঙ্গে তার সম্পর্ক তো অনেক আগেই ভেঙে গেছে, কিন্তু কোথাও ভেতরে একটা ভয় ছিল—শুধু তার নিজের দুঃখ গোপন করার চেষ্টা।
সে জানতো, সাইফ এখন আর আগের মতো নেই।
যতটুকু ভালোবাসা ছিল, ততটুকু আর নেই।
বিয়ের আগে সাইফ যেমন তাকে উষ্ণ ভালোবাসায় ঘিরে রাখতো, এখন সে পুরোপুরি বদলে গেছে। সে যেন একটা অচেনা মানুষ হয়ে গেছে, যার পাশে আর আন্নি থাকতে পারে না।
হঠাৎ ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়।
মনে হয় যেন পৃথিবীটা মাথার উপর ঘুরতে থাকে।
কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই সে।
কী বলবে? কী করে নিজেকে বোঝাবে যে, সাইফের এমন আচরণ তার কাছে নতুন নয়।
আন্নির নিজের পরিস্থিতি এমন হয়েছে, যে সে নিজেও জানে না, কেন সে এখনও সাইফের সঙ্গে রয়ে গেছে।
সে কি সত্যিই তার সঙ্গে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক রাখতে চায়? না কি সে শুধুমাত্র অভ্যাসের জায়গায় আটকে গেছে?
আজকাল আন্নি মনে করে, সাইফের কাছে সে শুধুই একটা কুকুরের মতো, যার দায়িত্ব শুধু রান্নাঘরে কাজ করা, কাপড় কাচা, আর বাড়ির সব কিছু দেখতে থাকা।
সাইফ তার প্রিয় মানুষ ছিল—এটা সত্য, কিন্তু আজকের সাইফ তাকে আর আগের মতো প্রিয় নয়। সেই ভালোবাসা কেমন যেন মুছে গেছে।
এখন আন্নি বুঝতে পারছে—সাইফের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যেন এক গহীন সাদাকালো অন্ধকারের মধ্যে চলে গেছে।
তখন ভালোবাসা ছিল, এখন শুধু নিঃসঙ্গতা, বিষণ্নতা আর হতাশা।
এখন সাইফের মনেও আর কোনো জায়গা নেই আন্নির জন্য।
এটা যেন জীবনের এক কঠিন রিয়েলিটি, যে এক সময় তাকে ভালোবাসত, সে আজ আর তাকে খেয়ালও করে না।
তার কেবল কানে একটা শব্দই বাজছে—“তুই থাকলে থাক, না থাকলে চলে যা।”
এখন আর আন্নির কোনো স্বপ্ন নেই, শুধু একটাই চিন্তা—কীভাবে একদিন এই জগৎ থেকে পালাবে?
তবে পালাবে কোথায়? সে জানে না।
কিন্তু প্রতিদিন, প্রতিটি দিন, সাইফের এই নিষ্ঠুরতায় এক একটা গহীন ক্ষত সৃষ্টি হয় তার হৃদয়ে।
……………
গভীর রাত,নিস্তব্ধ চারপাশ,ঘড়ির কাঁটা যখন একটাকে ছুঁয়েছে, তখনও আন্নি দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।চোখে ঘুম নেই, মনে শুধু অপেক্ষা—সাইফ কখন ফিরবে।
রাত প্রায় দুটো— কেবল দরজার খচখচ শব্দে তার অপেক্ষা ভাঙে।
অবশেষে দরজা খুলে যায়। সাইফ, নির্বিকার মুখে, একটাও কথা না বলে ঘরে ঢুকে, জুতা খুলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
আজ রাতেও সাইফ ফিরলো অনেক দেরিতে। আজকেও দরজা খুলে ঢুকেই যেন সমস্ত দুনিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো সে। একটাও কথা নয়, একটাও দৃষ্টি নয়—শুধু বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। আন্নি পাশে বসে ছিল নীরবে, ঠিক আগের রাতগুলোর মতো। একটা সময় সে আর অপেক্ষা করে না—কারণ সে জানে, এখন তার পাশে বসা একজন স্বামী নয়, একজন অভিমানহীন অপরিচিত পুরুষ।
আন্নি তাকিয়ে ভাবে, মনে হয় এক অপারিচিত মানুষ পাশে ঘুমিয়ে আছে। অথচ একসময় এই মানুষটাই তো তার চোখে ছিলো জীবন, স্বপ্ন, ভালোবাসা।
মনে প্রশ্ন জাগে বার বার—সে কি একদিন
ভালোবেসেছিল এই মানুষটিকে?
………..……
ভোর হতেই যেন যুদ্ধের মাঠে নামে আন্নি। রান্নাঘরের ভেতর গনগনে আগুন আর তাড়াহুড়ার শব্দ। শ্বশুরের সরকারি অফিস, সাইফের কলেজ—সবার সময়মতো খাওয়া চাই।
আজকের সকালটা যেনো আরও বিশৃঙ্খল। ঘড়ির কাঁটায় যেন আগুন ধরে গেছে। শ্বশুর সময়মতো অফিসে যাবেন, সাইফেরও কলেজ আছে। আন্নি তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে ছুটে যায়—সবজির ভাজি, ডাল, আর ভাতের আয়োজন। রাইস কুকার হঠাৎ কারেন্ট চলে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে গ্যাসে বসায় ভাতের হাঁড়ি।
এমন সময় শাশুড়ির ডাক—
“আন্নি, একটু আয় তো রে।”
আন্নি কাঁটা চামচ ফেলে, আঁচলে হাত মুছে দৌড়ে যায় শাশুড়ির রুমে।
কোনো দ্বিধা না করেই সে ছোটে। অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে তার এই ছুটে চলা। সংসার যেন এক বিশাল নাট্যমঞ্চ, আর সে সেখানে নেপথ্যের শিল্পী।
শাশুড়ি হয়তো গলার হারটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না,ভেতরে হয়তো শাড়ির ভাঁজ ঠিক করতে বলবে,কিংবা আলমারিতে কিছু খোঁজার দরকার হয়েছিল
কিন্তু রান্নাঘরে তখনও জ্বলছে গ্যাসের আগুন আর তার উপর চাপা পাত্রে ভাত।
মুহূর্তের মধ্যে পোড়া গন্ধে ভরে যায় পুরো বাড়ি।
শ্বশুর দরজা ঠেলে বের হয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলেন,
“ঘরে আগুন লাগছে নাকি?”
আন্নির বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে একটা আশঙ্কার ঢেউ।
ছুটে যায় সে রান্নাঘরে।
কালো ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারপাশ।
হাঁড়ির নিচে জ্বলে যাওয়া ভাত, আর তার ওপরে জমে থাকা পোড়া ধোঁয়া যেন আন্নির ভিতরকার কষ্টকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।
চুলার সামনে দাঁড়িয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়।
ঠিক তখনই সাইফ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
চোখ জ্বলে তার, মুখে ঘৃণা— গর্জন করে বলে—
এই বলে তার চুলের মুঠি ধরে এমন টান দেয়, যেন সে কোনো প্রিয়জন নয়, একেবারে ঘৃণার পাত্র।যেন সে তার স্ত্রী নয়, এক অপরাধী।
দুইটা চড় গালে এসে পড়ে সশব্দে।
আন্নির কান ঝিম ঝিম করে ওঠে। মাথার ভেতর যেন একটা সাইরেন বাজে—না, এটা তার ভালোবাসা হতে পারে না, এ ছেলে তো তার স্বপ্নের মানুষ ছিল না!
জ্বালা লাগে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জ্বলে ওঠে আত্মসম্মান।
ঘরটা কেঁপে ওঠে, কিন্তু কারও মুখে প্রতিবাদের শব্দ নেই।
শ্বশুর-শাশুড়ি দাঁড়িয়ে থাকেন নির্লিপ্ত, নীরবে। যেন কিছুই দেখেননি, যেন কিছুই ঘটেনি।
একবারও কেউ বলে না, “সাইফ, এটা কি করছো?”
যেন কিছুই হয়নি।কারও মুখে কোনো প্রতিবাদ নেই, কেউ সাইফকে থামায় না। যেন আন্নির প্রতি এই আচরণই স্বাভাবিক, যেন এটা তার প্রাপ্য।
হ্যাঁ ঠিকই তো,
এটাই তো এই ঘরের নিয়ম—স্বামীর হাতে স্ত্রীর অপমান, আর চারপাশের মৌন সমর্থন।
আন্নির চোখে জল আসে না।
দীর্ঘ সময়ের গুমোট যন্ত্রণায় কান্নাগুলো হারিয়ে গেছে কোথাও।
ভেতরে কেবল একটা প্রশ্ন গুমরে ওঠে—
“এই মানুষটার হাত ধরেই তো আমি পালিয়ে এসেছিলাম। এই ছিল তার ভালোবাসা?”
আন্নির বুকের ভেতর যেন কিছু একটা ধ্বসে পড়ে। সে শুধু ভাবতে থাকে—
“এই কি সেই সাইফ, যে একদিন বলেছিল, ‘তোর জন্য সব ছেড়ে দিব’? এই কি সেই সংসার, যার জন্য আমি বাবা-মাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম?”
তার ভেতরে জমে ওঠা শূন্যতা আজ যেন আরও ভারি হয়ে আসে।
সে জানে, ভালোবাসা পুড়ে গেছে আজকের ভাতের মতোই—নরম, নিরীহ, অথচ অবহেলার আগুনে অচেনা এক অন্ধকারে রূপান্তরিত।
ভাতের হাঁড়ির মতো পুড়ে যাচ্ছে তার সব স্বপ্ন। প্রেম, ভালোবাসা, বিশ্বাস—
একসময় সাইফ বলেছিল,
“তুই আমার জীবন, আন্নি।”
আজ সাইফ যেন বলে—
“তুই শুধু দায়িত্ব।”
একসময় সাইফ বলেছিল,
“তুই ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না, আন্নি।”
আর আজ সাইফ যেন বলে—
“তুই থাকলে থাক,না থাকলে না থাক।”
অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় আন্নি।
“এই ঘর না থাক, আমার নিজের মান থাকুক।”
কোনো ব্যাগ নেয় না, কোনো টাকা নয়, এমনকি পরনের ওড়নাটাও ঠিকঠাক টেনে নেয়নি সে।
চোখে ছিল কেবল জেদ, আর বুকভরা দুঃখ।
চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়—
এই শহরের ব্যস্ততা আর আলো-ছায়ার ফাঁকে হারিয়ে যেতে চায় এক নারীর না বলা গল্প।
ভোরের আলো এখনো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি। জানালার ফাঁক গলে এক ফালি সূর্য রশ্মি আন্নির মুখে এসে পড়তেই সে চোখ খুলে ফেলে। পাশ ফিরে তাকায়—সাইফ ঘুমোচ্ছে না, বরং ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখার ভান করে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। দু’জনের মাঝখানে শীতল নিঃশ্বাসের দেয়াল, যা স্পর্শ করা যায় না, শুধু টের পাওয়া যায়।
আন্নি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে পড়ে এক বছর আগের সেই বিকেলটা, যখন সে হাত ধরেছিল সাইফের, ভালোবাসার দায়ে সমস্ত কিছু ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলো। কত স্বপ্ন ছিল তাদের—একটা ছোট বাসা, দুটো টিকটিকি ঝগড়া করবে দেয়ালে, ছাদের কোণায় গুচ্ছ গুচ্ছ রোদ জমে থাকবে, আর সন্ধ্যায় ওরা মিলে একসাথে চা খাবে।
সেইদিন আন্নির বুকের ভেতর থেকে কিছু একটা চিরে বেরিয়ে গিয়েছিলো—ভালোবাসা নয়, বিশ্বাস ছিল সেটা।
আন্নি ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সাইফকে।
পরিবারের কেউ রাজি ছিল না। অনেক অনুরোধ, অনেক বোঝানো—সব ব্যর্থ। শেষমেশ ভালোবাসার টানেই এক ঝড়বিক্ষুব্ধ বিকেলে আন্নি পালিয়ে যায় সাইফের সঙ্গে।
সেই রাতে আকাশ ঝরেছিল, ঠিক যেমন তার বুকের ভেতর কান্না আর আনন্দ একসাথে ঝড় তুলেছিল।
সাইফ হাত ধরে বলেছিল,
— “এখন থেকে আমি শুধু তোমার। কোনো কষ্ট পেতে দেব না তোমায়।”
আন্নির মনে হয়েছিল,
“এটাই তো আমার স্বর্গ, আমার বাড়ি, আমার পৃথিবী।”
কিন্তু সে স্বর্গ ছিল খুব অস্থায়ী।
শুধু এক বছর।
এক বছর পর আন্নি টের পায়—সাইফ বদলে যাচ্ছে। তার চোখে অহনার প্রতিচ্ছবি।
অহনা, সাইফের ক্লাসমেট। স্মার্ট, চটপটে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
প্রথমে সন্দেহ, পরে নিশ্চিত বিশ্বাস।
সাইফ অহনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
প্রথমে সামান্য পরিবর্তন এসেছিলো সাইফের আচরণে। ফোনে কথা বলার সময় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেত, রাত করে বাসায় ফিরত। আন্নি যখন জানতে চাইত, সে বিরক্ত হতো, রাগ করত। তারপর একদিন আন্নির সামনে দাঁড়িয়ে সাইফ চিৎকার করে বলে উঠেছিলো,
— “তুমি একটা প্যারানিয়া,এত সন্দেহ তোমার?
ও আমার ক্লাসমেট।
এসব মানসিক রোগীর মতো আচরণ বাদ দাও!
আন্নি প্রতিবাদ করলে সাইফ এভাবে তেড়ে আসে—
সাইফ যখন অহনার মেসেঞ্জারে সিঙ্গেল হার্ট ইমোজি দেয়, আন্নি তখন আয়নায় নিজের চোখে চোখ রাখে—একটা মেয়ের ইতিহাস পড়ে যায় সেখানে। যে একদিন ভালোবেসেছিল, আবার একদিন নিজেকেই ভালোবাসতে শিখবে।
সাইফ একদিন চড় মারতে হাত তোলে।
যদিও সেই হাত থেমে যায়, কিন্তু আন্নির আত্মসম্মান থামে না।
শুরু হয় অশান্তি।
ভালোবাসার ঘর, এখন শুধুই অভিযোগের দেওয়াল।
শশুর-শাশুড়ির কাছ থেকেও কোনো সান্ত্বনা মেলেনি। বরং শাশুড়ি বলেছিলেন,
— “ছেলে মানুষ, একটু এদিক-ওদিক করতেই পারে।
সারাদিন কি বউয়ের আঁচলে বাঁধা থাকবে নাকি?”
শশুর আবার গলা গলিয়ে যোগ করেন,
— “ছোট মানুষকে বিয়ে করেছো, এখনও তো কলেজে পড়ে! সে বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে না?”
আন্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো তাঁদের দিকে। যাদের কাছে সে একটু আশ্রয় খুঁজতে চেয়েছিলো, তারা তাকে আরও ভেঙে দিলো।
আন্নি সবার কথা চুপ করে শোনে শুধু।
তার চোখে এখন আর জল নেই, শুধু একরাশ বিস্ময় আর আত্মসম্মানের স্পষ্ট ছায়া।
রাতের পর রাত ঘুম হয় না আন্নির। বুকের ভেতর জমে থাকা কান্নাগুলো শুধু বালিশ ভিজিয়ে যায়। কখনো মনে হয়, ফিরে যাই মায়ের কাছে, আবার মনে পড়ে—মা-ও তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেই পালিয়ে যাওয়ার রাতে।
বলেছিলেন,
“ভালোবাসা দিয়ে সংসার চলে না”—মায়ের বলা কথাগুলো কানের ভেতর এখনো গুনগুন করে।
কিন্তু আন্নি এখনো ভেঙে পড়ে না। কারণ সে জানে, তার ভিতরে এখনো অনেক গল্প বাকি। সে হয়তো একা, হয়তো হারিয়েছে বিশ্বাস আর ভালোবাসার প্রিয় মুখ, কিন্তু তার আত্মসম্মান এখনো জাগ্রত।
হাতের ডায়েরির ভাঁজে লুকানো চিঠিটা আজ ও পুড়ছে,
তবে আন্নির চোখে যে জলের ফোঁটা, তা এখন সাইফের প্রতি নয়—
তা নিজের জীবনের প্রতি ক্ষোভ,
নিজের ভুলগুলোকে না বলতে পারার তীব্র আক্ষেপ।
সেদিনের কথা মনে পড়ে—এইচএসসি পরীক্ষার শেষ দিন।
প্রথমবার হাতে হাত ধরে,
সাইফ বলেছিল,
“চলো, সবকিছুকে পেছনে ফেলে আমাদের একটা গল্প লিখি।”
আন্নি বিশ্বাস করেছিল।
ভেবেছিল, ভালোবাসা মানেই মুক্তি।
ভেবেছিল, যেখানেই থাকুক—ভালোবাসার সংসারেই আশ্রয় থাকবে।
কিন্তু কে জানত, সেই গল্পের কালি এত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে?
সেই ভুলটা…
এইচ,এস,সি এক্সাম শেষ করেই সাইফের হাত ধরে সব ফেলে চলে যাওয়া।
মা-বাবার চোখের জল, বড় বোন আমেনার রাগ, ছোট ভাইয়ের ভেঙে পড়া মুখ—সব এখন আন্নির বুকের ভেতর ছাইয়ের মতো জমে আছে।
এক বছরের সংসারে, সাইফ একবারও বলেনি—“তুমি আবার পড়ো”।
আন্নির সব স্বপ্ন ধীরে ধীরে গিলে ফেলেছে রান্নাঘরের ধোঁয়া, শাশুড়ির চাহনি, সাইফের চুপ থাকা।
আজ হঠাৎ করে মনে হলো—এই সংসারটা সে নিজেই তো বেছে নিয়েছিল।
তবে কেন এখানে এতটা একা?
কেন তার দু:খটাও এখন শেয়ার করার মতো কেউ নেই?
আজ হঠাৎ বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ঝড় উঠে আছে।
মাথা কাঁপছে, কিন্তু হাত চলে যায় ফোনের দিকে।
কল ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর গলা,
— “হ্যাঁ? কী হয়েছে?”
দূর থেকে বোনের গলা শুনেই কান্না আটকে রাখতে পারল না আন্নি।
কথা না বলে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে।
আন্নি এক ফোঁটা স্বরে বলে,
— “আপু… আমি আর পারছি না।”
কিন্তু উল্টো সান্ত্বনা নয়,
বোনের কণ্ঠে উঠে আসে উপেক্ষা আর বিদ্রুপ।
ওপাশ থেকে তীব্র রাগে উত্তর এলো,
— “তখন তো কারো কথা শুনোনি। প্রেমে অন্ধ হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে। এখন কাঁদছো?
মা-বাবাকে ফেলে পালিয়ে গিয়ে এখন চোখে পানি এসেছে?”
মা-বাবা মরলেও খোঁজ নিতে আসবে না তুমি, বুঝে নিও।”
আন্নি নিশ্চুপ হয়ে গেল।
আমেনার কথাগুলো বুকের ভেতর গর্ত করে দেয়।
কোনো উত্তর দেয় নি আন্নি।
চোখের জল মোছে নি, কথা বলে নি, তার সামনে মাথা নোয়ায় নি,
শুধু ফোনটা নিঃশব্দে কেটে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
বুকের ভেতর জমে থাকা জলের সাগর, আজ বালিশ ভিজিয়ে দেয়।
বার বার শুধু বোনের বলা কথাগুলো মাথায় বাজতে থাকল—
“তুমি তো নিজের ইচ্ছেতে নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছিলে।”
সেই রাতে, আন্নি আর কাউকে কিছু বলেনি।
না সাইফকে, না শাশুড়িকে।
নিজের বুকের ভিতরই আগুনটাকে চেপে রাখল।
তবে সেই আগুনের মাঝে একটা স্বপ্ন আবার মাথা তুলল—
ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়া।
পরদিন সকালে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চা বানাতে বানাতে ভাবছিল—এই কি তার জীবন?
চা, ডিমভাজি, সাইফের পোশাক ইস্ত্রি করা, শাশুড়ির ওষুধ, বাজারের লিস্ট,
আর… নিজের পছন্দ-অপছন্দ-স্বপ্ন গিলে ফেলা একটা মেয়ের গল্প?
হঠাৎ বুকের গভীর থেকে একটা ইচ্ছা মাথা তোলে।
ডিগ্রিতে ভর্তি হবো। যেভাবেই হোক।
শাশুড়ি ডাইনিং টেবিলে বসতেই আন্নি সাহস করে বলে উঠল,
— “মা, আমি যদি আবার পড়াশোনা শুরু করি? কলেজে ভর্তি হতে চাই ডিগ্রিতে।”
শাশুড়ি থমকে তাকালেন,
তার চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
শাশুড়ির মুখখানা রঙ পাল্টাল এক নিমিষে।
চোখে উঠল অবিশ্বাস, কণ্ঠে ঝলকে উঠল কষ্ট ও শাসন।
— “এই বয়সে আবার কী পড়া? ঘরের কাজ ছেড়ে?
ঘরের কাজ সামলাও, এই তো অনেক হয়েছে!”
তারপর গলা নীচু করলেন,
— “সাইফ জানলে তো একদম মেনে নেবে না। মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার?”
সে শুনলে রাগে পুড়ে যাবে!
আন্নির বুকের ভিতর যেন কিছু একটা টুপ করে ভেঙে গেল।সে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
কিছু বলল না।
তার চোখে তখন ঠিকরে পড়ছিল একরাশ প্রতিজ্ঞা।
সেই রাতে আন্নি শুয়ে শুয়ে ভাবছিল—এই ঘরটা কি তার?
নাকি শুধু এক বাঁচিয়ে রাখা শ্বাসের নাম?
তার যদি কোনো জিনিস একান্ত নিজের হয়ে থাকে,
তা শুধু একটা—
তার স্বপ্ন।
পৃথিবীর সবাই ছেড়ে দিলেও,
স্বপ্ন একবার ধরা দিলে,
সে আর হাত ছাড়ে না।
এই স্বপ্নই তার একমাত্র নিজের জিনিস।
কারণ সবাই চলে গেলেও, স্বপ্ন তো কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
“সোহেল অফিস শেষে কি একটু ফ্রি আছিস? জরুরী একটা কথা ছিল দোস্ত!” লাঞ্চের পর পর আসিফের কলটাতে একটু অবাক হলাম। আজ ওকে বেশ উদ্বিগ্ন বলেই মনে হল।
“না রে ফ্রি নাই, তানিশার কোচিং আছে! অফিস শেষে ওকে ড্রপ করতে হবে। তবে তোর বিষয়টা খুব বেশি জরুরী হলে আমি না হয় সোমাকে বলবো, মেয়েকে কোচিংয়ে ড্রপ করে দিতে!” স্কুল জীবন থেকেই বন্ধুরা আমার কাছে প্রায়োরিটি পায়, তাইতেো আসিফকে নিরাশ করলাম না।
“ঠিক আছে বন্ধু, আমি ছয়টার মধ্যে তোর অফিসে আসছি। তারপর দুজন কাছাকাছি কোন একটা রেস্টুরেন্টে বসব নে।” তড়িঘড়ি করে আসিফের ফোন রাখার পর বুঝলাম, ও নিশ্চয়ই খুব বড় ধরনের একটা ঝামেলায় আছে। আমি অবশ্য খুব বেশি চিন্তা না করে নিজের কাজে মনোযোগ দিলাম। নিজেরই এখন হাজারো সমস্যা, তাইতো ইদানিং অন্যের বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ পাই না।
“দোস্ত, শায়লা কে বিয়ে করতে চাই। অনেকদিন ধরে চিন্তাভাবনা করে আমার এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিষয়টাতে তোর একটু সাহায্য চাইছি!” মতিঝিলে আমার অফিস লাগোয়া একটা রেস্টুরেন্টে বসতেই, আসিফের বলা এ কথাটা আমার মাথায় যেন বাজ হয়ে পড়লো। তিন কন্যা সন্তানের বাবা, সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মুখে এ এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শুনে আমি বসা থেকে উত্তেজনায় সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম।
“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস আসিফ? না আমার সাথে ফাজলামো করছিস।” আমার অবিশ্বাস্য চোখ আর রাগের গর্জনে রেস্টুরেন্টে বসা আশেপাশের মানুষরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আসিফ মেধাবী ছেলে, আমি উত্তেজিত হয়ে গেছি তাইতো পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাকে নিয়ে দ্রুতই রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে চলে এলো। আমি তখনো রাগে গজরানোতে। ও একটা রিক্সা ডেকে আমাদের দুজনেরই প্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিল, পুরোটা রাস্তাতে ও চুপচাপ৷ আমিও ওর দিকে একবারের জন্য তাকালাম না।
টিএসসির কাছাকাছি এসে রিক্সাটা ছেড়ে দিয়ে ও বেশ স্বাভাবিক গলায় “দোস্ত প্রথমে আমার পুরো কথাটা শোন, তারপর রিয়েক্ট কর! আমার নিজেরও তো অনেক ভেবে চিন্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। আর তুই ই একমাত্র ব্যক্তি যার কাছে আমি কথাটা শেয়ার করতে চাচ্ছি। আমি শায়লাকে ছাড়া বাঁচবো না। ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। ”
কাহিনীটা হঠাৎ নাটক সিনেমার মতো করে শুরু করে দেওয়ার জন্য দুঃখিত। মূল অংশটা শুরু করার আগে আমার বন্ধু আসিফ আর আমাদের আরেক বন্ধু শায়লার পরিচয় দিয়ে রাখছি। আমরা তিনজনই মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সহপাঠী, ক্লাস টেনে কালাম স্যারের বাসায় ব্যাচে প্রাইভেট পড়ার সময় থেকেই আসিফ-শায়লার পরিচয় ও প্রেমের শুরু। ওদের তুমুল প্রেম চলল কলেজ জীবনেও। এরপর একসাথে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করা আর কাকতালীয়ভাবে আমি, আসিফ আর শায়লা, তিনজনেরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে যাওয়া। আমি শায়লা ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে আর আসিফ হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের। আমাদের সে সময়ের উত্তাল বন্ধুত্ব ও অসাধারণ সব স্মৃতি, শিকি শতক পরে এসেও মাঝেমধ্যে সুখ স্মৃতি হয়ে ধরা দেয়।
সংক্ষেপেই বলছি, আসিফ আর শায়লার বিয়েটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি, আর তা নানানবিধ কারণে। এক নাম্বার কারণ হলো, আসিফদের পারিবারিক অবস্থা আর দ্বিতীয়টা ওর অনিশ্চিত ক্যারিয়ার। শায়লার বাবা ছিলেন সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, ভদ্রলোক সম্ভবত শেষ পর্যন্ত সচিব হিসাবে রিটায়ারমেন্টে যায়। তাইতো মুগদাতে থাকা ব্যাংকের এক তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর সন্তান আসিফের সাথে শায়লার বাবা কিছুতেই বিয়েতে রাজি হয়নি। আর সত্য বলতে কি, এমবিএ করার সময়টাতে শায়লা নিজেও আসিফ এর বিষয়ে কনফিউজড ছিল, অন্ততপক্ষে কথাটা আমি জানতাম।
আইবিএ থেকে এমবিএ করা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে যখন শায়লার বিয়ে হল, আসিফ অনেক কষ্ট পেয়ে আমাদের বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। ও বিষয়টাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। আসিফ শায়লাকে মন থেকেই ভালোবাসতো, আমরা বন্ধুরা ভালো করে জানতাম। তাইতো আমরা সবাই ছেলেটার প্রতি সমবেদনায় আবার একই সাথে শায়লাকেও কিন্তু বন্ধু বলেই মনে করতাম। খুব খারাপ লাগতো, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবারের প্রবল বিরোধিতায় মেয়েটার আস্তে আস্তে প্রেম থেকে দূরে সরে যাওয়ার সেইসব দৃশ্য দেখে।
এরপর আমাদের সবার জীবন চলতে লাগে জীবনের নিয়মে। আমিও একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকুরী নিলাম, এরপর বিয়ে থা করে সংসার জীবনে। আসিফ আমাদের স্কুলের মেধাবী ছাত্রদের একজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ছাত্র হলেও ছেলেটা আসলেই তুখোড়। আর তার প্রমাণও দিল বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একেবারে প্রথম দিকে নিজের অবস্থান রেখে। সরকারি চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে আসিফের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল রাতারাতি, বন্ধুদের মাঝেও ও বেশ গুরুত্ব পায় আর কর্মক্ষেত্রেও খুব ভালো করতে লাগে। এই তো কিছুদিন আগে সরকারের যুগ্ম সচিব পদেও পদোন্নতি পেল।
আসিফের স্ত্রী, লায়লা ভাবি আমাদের খুব পছন্দের একজন। পুরোপুরি গৃহিণী এই ভদ্রমহিলা ওদের তিন কন্যা সন্তানকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকেন। ওদের বড় মেয়েটা এ বছর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হয়েছে, বাকি দুটো মেয়ে ভিকারুন্নেসাতে পড়ে। সব মিলিয়ে আসিফ লায়লার আপাত সুখের এক সংসার, সমাজের অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। আমরা বন্ধুরা এখনো প্রায়ই ওদের ইস্কাটনের সরকারি কোয়ার্টারে জড়ো হই, আড্ডা আার ভাবীর মজার মজার রান্না সাবার চলে মাঝরাত পর্যন্ত।
স্ত্রী কন্যাদেরসহ সুখের সংসার, প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়সে এসে আসিফের প্রাক্তনকে বিয়ে করার ফের অভিপ্রায়, আমাকে আজ উন্মাদ করে দিল। এই ছেলেটার সাথে আমার বন্ধুত্ব প্রায় চল্লিশ বছরের, আজ কেন যেন মনে হল ভুল মানুষের সাথে আমার এতদিনের বন্ধুত্ব। সে আদতেই একজন খারাপ মানুষ, তাহলে এসব ভাবতে পারে কিভাবে!
আসিফের প্রাক্তন শায়লার সাথে অন্যান্য স্কুল বন্ধুদের মত আমার এখনো যোগাযোগ আছে, আর তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে। আমাদের বন্ধুদের সবার জানা, প্রায় বছর দশেক আগে শায়লার ডিভোর্স হয়েছে। একমাত্র কন্যাকে নিয়ে বেইলি রোডে নিজেদের এপার্টমেন্টে থাকে। নিজে একটা বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি ও নিজের চাকুরী, মেয়েকে নিয়ে ও খুব ভালো আছে। অন্ততপক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিন্তু তা ই বলে।
আমার মনে খচখচ করছে, হঠাৎ করে কি এমন হলো যে আসিফ তার প্রাক্তন শায়লার জন্য বিয়ে করার জন্য উতলা হয়ে গেল। একবার ভাবলাম এ প্রসঙ্গটাতেই আর যাব না, অযথা আসিফের এই অনৈতিক ভাবনাতে সায় দেওয়ার কোন মানে নেই। তারপরও বন্ধুর ভুল ভাঙানোর চেষ্টায় খানিকটা অনিচ্ছা সত্বেও জিজ্ঞেস করা “তুই কি সিরিয়াস, শায়লার সাথে কি আবারো রিলেশনে জড়িয়েছিস? একবারও তোর স্ত্রী বাচ্চাদের কথা চিন্তা করিস নি?”
“দোস্ত, আমি শায়লাকে ছাড়া বাঁচবো না! আমি ওকে একেবারে ছোটবেলা থেকে ভালবাসতাম, এখনো বাসি। আর মেয়েটা সত্যই খুব কষ্টে আছে রে বন্ধু, আমার সাথে কথা হয়েছে! আমি এখন আমার সত্যিকারের ভালোবাসাকে পরিণতি দিতে চাই। আমি শায়লাকে বিয়ে করব। বন্ধু, তোর কাছে জোর মিনতি, আমাকে একটু সাহায্য কর।”
সিদ্ধান্ত (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।)
“তোর বাইশ বছরের সংসার জীবন, স্ত্রী তিন কন্যা, সেই সাথে চাকুরী ও সামাজিক অবস্থান! এর সব কিছু কি একবার ভেবে দেখেছিস? শায়লাকে যদি এ অবস্থায় বিয়ে করিস, আগে ভাগেই বলে রাখছি তুই কিন্তু সব হারাবি। অন্য বন্ধুদেরতো নয়ই, আমাকেও তোর এসব পাগলামিতে পাবি না। একটা কথাই বলতে চাই, তুই কিন্তু খাল কেটে কুমির আনছিস! এখনো সময় আছে সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে!” পঁচিশ বছর আগে প্রেমিককে ছুড়ে ফেলে দিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করা শায়লাকে আসিফের বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ, বিষয়টাকে মোটেও সহজভাবে নিলাম না। আসিফ সম্ভবত আমার অবস্থানে সন্তুষ্ট হলো না। তাইতো তার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টায়।
“সোহেল, দোস্ত তোকে আজ একটা গোপন কথা বলছি। সংসার জীবনে তোদের ভাবির সাথে কিন্তু আমি মোটেও সুখী নই। হ্যাঁ, ও নিঃসন্দেহে ভালো একজন গৃহিণী, পরিবারের সবার দেখভাল করে। কিন্তু বেশ অনেকদিন ধরেই লায়লা কিন্তু আমাকে আর আকর্ষণ করে না। কেন জানি প্রেম-ভালোবাসা এই জিনিসগুলো ওর মধ্যে এখন আর নেই। কেমন একটা রোবট জীবনে, বাচ্চাদের নিয়েই ওর শত ব্যস্ততা। আরও একটা কথা তোকে শেয়ার করছি, ও কিন্তু অনেকদিন ধরেই আমার সাথে বিছানাও শেয়ার করে না। নানান অজুহাতে রাতের বেলায় ছোট মেয়েটার সাথে ঘুমায়। আচ্ছা দোস্ত তুই ই বল, আমি তো একটা পুরুষ মানুষ। আমারও তো দৈহিক কিংবা মানসিক চাহিদা রয়েছে, তাই না? লায়লা কিন্তু এই জিনিসগুলো একেবারে বোঝার চেষ্টা করে না। তাইতো বছর দুয়েক আগে হঠাৎ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে আমার জীবনে শায়লার উপস্থিতি যেন তপ্তদিনে এক পশলা বৃষ্টি! ওর সঙ্গ কিংবা কথোপকথন, আমি ভীষণ এনজয় করি! একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতো করে।” আসিফ আর আমি হাঁটতে হাঁটতে পাবলিক লাইব্রেরির সিড়ির গোড়ায় চলে এলাম, ওখানেই আমাদের বসে পড়া।
আজ আমি ওর গল্পের এক মনোযোগী শ্রোতা। প্রতিটা কথায় ভীষণ অবাক হচ্ছি। ইদানিংকালে আধুনিক পরিবারগুলো যে কত রকমের সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই!
“তুই যে তোর প্রাক্তনের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে গেছিস, এটা কি ভাবি বা তোর পরিবারের কেউ জানে?” আসিফকে ইন্টারাপ্ট করলাম।
“আরে না, আমার বউয়ের কি আমাকে নিয়ে চিন্তা করার সময় আছে। আমি যদি রাতে বাসায় নাও ফিরি, লায়লা হয়তোবা আমার কাছে এই বিষয়ে কৈফিয়তও চাবে না! না দোস্ত, শায়লার বিষয়টা এখনো পর্যন্ত কেউউ জানে না। আজ ই তোর কাছে প্রথমবারের মতো কনফেস করলাম।” পুরো বিষয়টি যে এখনো গোপন আছে, জানতে পেরে ভালো লাগলো।
“তোর নেওয়া বিয়ের এই সিদ্ধান্তে, শায়লার কি মত? ও কি ওর মতামত তোকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে!” কথোপকথন আর না বাড়িয়ে, আসিফের কাছ থেকে ঘটনাটার সর্বশেষ কি অবস্থা, বোঝার চেষ্টা করলাম।
“তুই তো শায়লাকে চিনিস দোস্ত। ও কি কখনো মুখ ফুটে কিছু বলেছে। আমি অবশ্য আমার ভালোলাগা ও বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা ওকে জানিয়ে দিয়েছি! ও অবশ্য প্রত্যুত্তরে এখনো কিছু বলেনি, তবে আমি ওকে খুব ভালো করে জানি। নীরবতা যে ওর সম্মতির লক্ষণ, তা ধরেও নিয়েছি। কিন্তু আমার সমস্যাটা কিন্তু অন্য জায়গায়, পরিবার বা প্রফেশন সামলিয়ে পুরো বিষয়টাকে কিভাবে সামলাবো! এই বিষয়টাতে তোর একটু সাপোর্ট চাচ্ছি বন্ধু, আমার মাথা ইদানিং ঠিকভাবে কাজ করছে না। তবে আমি আমার জীবনে শায়লাকে চাই, প্রকৃত ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে।” আসিফের সাথে কথোপকথনের এই পর্যায়ে এসে আমার একটু খটকা লাগে।
ছেলেটাকে আজ আমার প্রথম থেকেই একটু অন্যরকম লাগছে। সত্য বলতে কি, বন্ধু আসিফকে সাহায্য করার জন্যই এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। তাইতো ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম “দোস্ত তুই বিষয়টা নিয়ে কোন চিন্তা করিস না, আমি দেখছি। আপাতত তোর কারো সাথে কথা বলার দরকার নেই। ইনশাল্লাহ তোর জন্য যেটা ভালো হবে, সেটাই করবো। বন্ধু হিসাবে তোকে এই নিশ্চয়তাটা দিলাম।” খুব খুশি হয়ে সে রাতে আসিফ বাসায় ফিরেও গেল।
আর এদিকে আমি বলতে গেলে সারারাত ঘুমোতে পারলাম না, বারবার আসিফের বাচ্চাদের ও ওর পরিবারের কথা মনে পড়তে লাগলো। আবার একই সাথে আসিফকে পুরোপুরি সুস্থ বলেও মনে হলো না বলে কষ্টবোধে। ওর জন্য কিছু একটা করতে হবে এই ভাবনা নিয়ে ভোরের দিকে ঘুমোতে গেলাম।
“তোর কি মাথা খারাপ সোহেল? আমি কেন আসিফকে বিয়ে করতে যাব? ওর স্ত্রী আছে, তিনটা মেয়ে, কত সুন্দর একটা সংসার! আমি কেন জেনে শুনে একটা সংসার ভাঙতে যাব। আর সত্য বলতে কি, হাসিবের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, জীবনে কারো সাথে আর সম্পর্কে জড়াবো না। মেয়ে আরিশাকে নিয়ে আমি এখন বেশ ভালোই আছি!” পরদিন লাঞ্চ শেষে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সোজা চলে এলাম গুলশানে, শায়লার অফিসে। বাইরের একটা রেস্টুরেন্টে, খোলামেলা ভাবে আসিফের নেওয়া বিয়ের সিদ্ধান্ত বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই শায়লার দেওয়া এই উত্তরে প্রাণ ফিরে পেলাম। শায়লাকেও আমার অনেকদিন ধরে চেনা, ও যে কোনরকম ভনিতা করছে না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম।
“তবে যে আসিফ বলল, তোর সাথে গত দুই বছর ধরে ওর খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, প্রতিদিন কথা হয় । তোরা না কি প্রায়ই দেখাও করিস? আর আসিফ না কি বিয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়টা তোকে জানিয়েছেও?” অনেকদিনের বন্ধুত্বের খাতিরে, শায়লাকে বিষয়গুলো নিয়ে আমার সরাসরি জিজ্ঞেস।
“আসিফ একেবারে মিথ্যে বলেনি! হ্যাঁ ওর সাথে আমার প্রায়ই কথা হয়, সামনাসামনি দেখাও হয়েছে বার কয়েক! কিন্তু এর সব কিছু একেবারে বন্ধু হিসাবে, অন্ততপক্ষে আমার দিক থেকে কোন রিলেশনে জড়ানোর ইচ্ছা গোড়া থেকেই নেই। ও রাতের বেলায় ফ্রি থাকে! আচ্ছা তুই ই বল, নিঃসঙ্গ এই আমাকে কাছের কোন বন্ধু যদি প্রতিদিন সময় দেয়, ভালো ভালো কথা বলে! আমার কি ইচ্ছা করবে না তার সঙ্গ পেতে?” শায়লার দেওয়া এই যুক্তি মেনে নিতে পারলাম না। আমি নিশ্চিত, শায়লা প্রশ্রয়েই আসিফের এই তিলকে তাল বানানো। আর আসিফকেও দোষ দিতে পারি না, ও যে স্কুল জীবন থেকেই শায়লা পাগল। আমি আর কথা বাড়ালাম না, সমস্যাটার দ্রুত সমাধান করতেই।
“শায়লা তুই যেটা করছিস, এটা মোটেও এথিকাল না। ফেইসবুকে বা গ্রুপে তোর প্রাক্তন বা বন্ধুরা থাকতেই পারে। তাই বলে তাদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা কিংবা সামনাসামনি দেখা করা, অন্ততপক্ষে তোর মত মেয়ের কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি। তোদের এইসব নিছক আনন্দের জন্য একটা সুন্দর পরিবার এখন ধ্বংস হওয়ার প্রান্তে। বন্ধু হিসেবে তোর কাছে জোর অনুরোধ, পুরো বিষয়টি চাইলে তুই আজই শেষ করে দিতে পারিস।” শায়লার আত্মসম্মানবোধ প্রচন্ড, ও আমার বলা শেষ কথাটায় সম্ভবত ভীষণ অপমান বোধ করল।
” যা, দিস ইজ ওভার!” এই কথা বলে আমার সামনে দিয়ে হনহন করে চলে যাওয়া এই মেয়েটার জন্যও খারাপ অনুভবে। হয়তো মেয়েটা বুঝতেও পারেনি, ওর টাইম পাস করার বিষয়গুলোতে যে আসিফ এতটা পাগল হয়ে যাবে। তবে শায়লাকে যে পুরো বিষয়টির গুরুত্ব বুঝাতে পেরেছি, এতেই সান্তনা পেলাম।
এরপর গুলশান দুই থেকে জ্যাম ঠেলে খিলগাঁওয়ে আমাদের বাসায় ফেরার পথটুকুতেই যে অনেক কিছু হয়ে গেছে, তা বুঝতে পারিনি। আমাদের স্কুল বন্ধুদের নিয়ে ফেসবুকে একটা গ্রুপ রয়েছে, শায়লা ওখান থেকে এরই মধ্যে লিভ নিয়ে নিয়েছে। আমার মত নির্দোষ ব্যক্তিকেও ওর ফেইসবুক থেকে ছেঁটে ফেলেছে। বুঝতে পারলাম শায়লা পুরো বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এখন সমাধানের চেষ্টায়।
“সোহেল তুই কই? আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে বন্ধু! শায়লা আবারো আমার সাথে বেঈমানি করেছে! একটু আগে ফোন করে আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, আমি যেন ওর সাথে আর কখনো যোগাযোগ না রাখি! ও আমাকে না কি কখনো ভালবাসেনি, এখনো না। শুধুমাত্র টাইম পাস করার জন্য বন্ধু হিসাবে না কি আমার সাথে ওর সময় কাটানো! তোর সাথে কি শায়লার কোন কথা হয়েছে?” ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে আসিফের একটানা উদ্বেগ।
“না আমার সাথে শায়লার কোন কথা হয়নি। দোস্ত মন খারাপ করিস না, আমি এখুনি আসছি। বল তুই এখন কোথায়?”
ইচ্ছা করেই আজ প্রিয় বন্ধুর সাথে মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য হলাম। একটা মিথ্যা সম্পর্ককে ধ্বংস করতে। আর অযথাই বিষয়টাকে কমপ্লিকেটেড করতে চাইলাম না।
শায়লা যে আসিফকে ভালবাসে না, আর বিয়ে করা তো প্রশ্নই আসে না! এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই আসিফকে আমার মিথ্যা এই বলা। শায়লার ব্যক্তিত্ববোধ সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ধারণা আছে। মেয়েটা যে এ জীবনে আর কখনোই আসিফের সামনে আসবে না, এ ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে আসতেই আসিফকে আজ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় পেলাম। এরপর প্রায় ঘন্টা দুই কথোপকথনের পর আসিফকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে শায়লা ওকে কখনোই মন থেকে ভালোবাসেনি, এখনোও না। মেয়েটা ওর জীবনে শুধুই একটা মরীচিকা। পরিবারের সাথে ওর সম্পর্কের উন্নতি, বিষয়টিতে কাজ করার অনুরোধও করলাম।
সে রাতেই আমি আসিফ সহ আমাদের কাছের পাঁচ বন্ধু পরিবারের একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করলাম! পরের শুক্রবার, ঢাকার কাছেই সুন্দর একটা রিসোর্টে। উদ্দেশ্য আসিফকে একটু স্বাভাবিক করা, পরিবারের সাথে তৈরি হওয়া ওর গ্যাপটা একটু কমানো। লায়লা ভাবি খুব সহজ সরল ভালো একজন মানুষ, অন্ততপক্ষে আমাদের বন্ধুদের তা ই ধারণা। পরদিন অফিস শেষে ভাবিকে পিকনিকের দাওয়াত দিতে ওদের বাসায় পৌঁছাতেই আসিফকে বেশ হাসি খুশি ও স্বাভাবিক বলেই মনে হলো। বুঝে নিলাম, শায়লার বিষয়টা এখন বিপরীতে হিত!
“দোস্ত তোর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা। অযথাই নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছিলাম। তোর কথাই সত্য, শায়লা আসলে কখনোই আমাকে ভালবাসেনি। ও আমার সাথে সারা জীবনই টাইম পাস করল!” পিকনিকের সকালে রিসোর্টের ব্রেকফাস্টে বলা আসিফের কথাটাকে আর বাড়াতে দিলাম না।
“আজকের এই সুন্দর দিনে শুধু শুধু আজেবাজে প্রসঙ্গ নিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করেছিস কেন? যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো বিষয়টা যে অল্পতেই শেষ হয়ে গেল। আমার ভালো লাগছে, তোকে অনুতপ্ত হতে দেখে! দেরিতে হলেও যে ভুল বুঝতে পেরেছিস, এতেই আমি খুশি। আশেপাশে অন্যান্য উদাহরণ দেখ, এসব বিষয়ের পরিণতি খুব খারাপ!” আসিফ মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দিল।
“ও আরেকটা কথা, ভাবির সাথে তোর সম্পর্কটা উন্নত করার যে পরামর্শটা দিয়েছিলাম। সেটার কি অবস্থা? ঠিকঠাক মত কাজ করছিস তো? মেয়েদের রোমান্টিক আর ভালোবাসার মানুষ বানানোর দায়িত্ব কিন্তু পুরুষদেরই!” আমার বলা শেষ কথাটাতে কিছু একটার ইঙ্গিত পেয়ে আসিফের দেওয়া জোর হাসিতে, সোমা আর লায়লা ভাবি এসেও যোগ দিল। আমরা সবাই মিলে এখন একটানা হাসি আর আনন্দে!
রুবাইদা একা থাকলে কখনোই লিফটে উঠে না। তিন বছর আগে বান্ধবীর বাসার লিফটে ওঠার পরপরই কারেন্ট চলে গিয়েছিল, মোবাইল বের করে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেও কাউকে ফোন দিতে পারছিল না নেটওয়ার্কের অভাবে। দুপুরের সময় হওয়াতে সেসময় লোকজনের আসা-যাওয়া কম ছিল, বিশ মিনিটকে মনে হয়েছিল বিশ বছর। এই স্মৃতি মনে হলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু আজ অন্যমনস্ক ভাবে লিফটে উঠে গেল কিভাবে যেন।
দরজাটা যখন বন্ধ হয়েই যাচ্ছে এমন সময় দৌড়ে এসে উঠে গেল ফয়সাল। লিফটে একা থাকার ভয় দূর হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখন অজানা একটা অস্বস্তি হতে লাগল।
কিছুদিন আগে বাড়িওয়ালী, মানে ফয়সালের মা সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন রুবাইদার মা , হাসনাহেনার কাছে। বাড়ি-গাড়ি প্রতিপত্তি সবই আছে, ফয়সাল ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ভালো চাকরি করে, পাত্র হিসেবে কোন ভাবেই অযোগ্য নয়। তারপরও হাসনাহেনা সময় নিয়েছেন। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে তো আর হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এভাবে খোঁজখবর নিতে হবে। টাকা থাকলেই তো আর ছেলে ভালো হয়ে গেল না।
—কেমন আছেন রুবাইদা?
—ভাল। আপনি? রুবাইদা যেন পালিয়ে বাঁচে।এর আগেও কয়েক জায়গা থেকে প্রস্তাব এসেছে।কিন্তু পাত্রকে চোখের সামনে এভাবে এতবার করে দেখতে হয় নি। মনে মনে ভাবে ,কেন যে এমন হয়, সে কি বাঘ নাকি ভাল্লুক? তাকে দেখলেই বুকের ভিতরে ধুক ধুক করে আর গলাটা শুকিয়ে যায়।
লিফট তিনতলা পার হয়ে গেলেও ফয়সাল নামলো না।
—আপনার সাথে ফেসবুকে এড হতে পারি?এই বলে নিজের মোবাইলটা অন করে রইল। ভাবটা এমন এখন ই রিকোয়েস্ট পাঠাবে।রুবাইদা সম্পূর্ণ নামটা বলল। লিফট ছয়তলায় পৌঁছে যাওয়াতে রুবাইদা নেমে গেল, পেছন থেকে শুনতে পেল –রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করবেন প্লিজ।
ফরিদা বসে ,শুয়ে একেক সময় একেক ভাবে যথারীতি স্টার প্লাসের সিরিয়াল দেখছেন। তার মেদবহুল শরীর নিয়ে উঠে এসে দরজা খুলতে অনেকটা সময় লাগলো।
—বড় চাচী মা কোথায়?
—তোর চাচাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছেন তোর বাবা-মা। আমারতো হাটুতে ব্যথা, তাই গেলাম না। টেবিলে চাউমিন বানিয়ে রেখেছে তোর মা, গরম করে খেতে বলেছে।
আসলে ফরিদা যাননি তার সিরিয়াল দেখা হবে না বলে।
রুবাইদা ফ্রেশ হয়ে, চওমিন নিয়ে বসল টিভির সামনে। ছয় দিন থেকে টিভির সামনে বসলে ই দেখতে হয় স্টার প্লাস, স্টার জলসা এই সব।এমনিতেও খুব একটা টিভি দেখা হয় না। রাত দশটার পরে আবার বাবা- চাচা খবর দেখবেন। হাসনাহেনা খুব একটা টিভি দেখেন না। তার মতে টিভি দেখা হলো সময়ের অপচয়। এখন যা দেখায়, শুধু মানুষের সংসার ভাঙ্গা আর কুটকৌশল শেখায়। আহ্ আগের সেই নাটক, সেই ইত্যাদি ।
বড় চাচীর সিরিয়াল ব্রেক এসেছে,এখন মনোযোগ দিলেন রুবাইদার উপর
—কি রে কাল তোর মায়ের সাথে এভাবে জোরে জোরে কথা বল্লি কেন?
—আমাদের গ্রুপের সবাই ঘুরতে যাবে সেন্টমার্টিন। কিন্তু মা আমাকে যেতে দেবে না। এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না।
—রাইয়ান চাইলে তো ঠিকই দিতো।
—একদম ঠিক বলেছেন চাচী।
—তোকে দেখি সব কিছুতেই না করে। ভার্সিটিতে পড়িস, এত বড় হয়েছিস, নিজের ভালো তো ভালই বুঝতে পারিস। রাইয়ান কে তো এত শাসন করে না।
—রাইয়ান কেউ মানা করে মা। সবকিছু মেনে নেয় না।
একটু গম্ভীর হয়ে, করুন চোখে তাকিয়ে ফরিদা, রুবাইদা যেন শুনতে পায় ততটুকু আস্তে বললেন,
—-নিজের মা হলে এমন করত না তোর সঙ্গে।
—এর মানে কি?
—না না কিছু না।
—কিছু না মানে? মাত্র যে বললেন আমার নিজের মা না?
—কাউকে কিন্তু বলিস না। আমার আবার সবকিছুতেই দোষ ধরে মানুষ।তবে তোর কষ্ট দেখে সহ্য হচ্ছে না আমার, তাই বলছি। জন্মের সময় তোর মা মারা যায়। এরপর তোর খালা মানে হাসনাহেনা কে তোর বাবা বিয়ে করে।
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। রুবাইদা যেন নাড়াচাড়ার শক্তি পাচ্ছে না।
রাইয়ান এসে তোড়জোড় শুরু করলো, খুব খিদে পেয়েছে।মা কোথায়? রোবাইদা কোন উত্তর না দিয়ে রুমে চলে গেল। ফরিদা বলে দিলেন টেবিলে খাবার আছে।
কয়েক বার ডাকার পরেও রুবাইদা খাবার টেবিলে আসলো না দেখে, হাসনাহেনা গিয়ে দেখেন রুবাইদার চোখ ফোলা ফোলা লাল হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, সে অনেক কেঁদেছে। হাসনাহেনা অস্থির হয়ে গেলেন, অনেকবার জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে,
একসময় ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বলল–
— তুমি নাকি আমার মা না?
চলবে।
দুই পর্বের গল্প
ছবির মানুষ
শেষ পর্ব
এই প্রশ্ন শুনে মনে হলো একটা তীর কেউ বিঁধিয়ে দিয়েছে হাসনাহেনার বুকে। শরীরটা যেন টলে উঠল। রুবাইদা মাথা নিচু করে আছে, সে কিছুই দেখতে পেল না। অন্য সময় অন্য কোন প্রশ্ন শুনলে হাসনাহেনা চেঁচামেচি করতেন কিন্তু এখন তিনি খুব শান্ত স্বরে বললেন-
—যদি পেটে ধরলেই শুধু মা হয়, তাহলে সে হিসেবে আমি তোর মা না।
আর একটা কথা না বলে, ডাইনিং এর কাছে এসে দাঁড়িয়ে ফরিদাকে বলতে লাগলেন-
—-এই বার আপনার আত্মা শান্তি পেয়েছে? সত্যিই একটা অজগর আপনি। আমার শাশুড়ি আপনাকে ঠিকই চিনেছিল। মানুষের সুখ আপনি গিলে খেয়ে ফেলতে চান।ষোল বছর আগের ঘটনা আবার আপনি ঘটিয়ে দেখালেন। এত বছর পরে এসেই আপনার আসল রূপ আবার দেখালেন।
হাসনাহেনা কথা বলতে বলতে কাঁপতে লাগলো রাগে।রাকিব এগিয়ে এসে হাসনাহেনাকে ধরে, কি হয়েছে বার বার জানতে চাইলেন —
—-এই হাসনা কি হলো ,বল
হাসনাহেনা তার স্বামীর বুকে দুই হাত রেখে, ধরা গলায় বলতে লাগলো-
—-এই মহিলা রুবাইদাকে বলেছে, আমি ওর মা না। তুমি শুনছ , ভাল করে শুন। রুবাইদার মায়ের নারী কাটার পর থেকেই আমার ভালোবাসা দিয়ে ওকে পেচিয়ে ধরে ছিলাম। এতগুলো বছর রুবাইদার মনে তো এই প্রশ্ন আসেনি।আজ এই মহিলা রুবাইদার মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
—তুমি একটু শান্ত হও। প্লিজ শান্ত হও।
—কি বল তুমি?আমি শান্ত হব?এই মহিলা আমাদের মা -সম্পর্কের মধ্যে আগুন লাগাতে এসেছে।
হাসনাহেনা নিজের রুমে চলে গেলেন একা একা কথা বলতে বলতে। রাইয়ান ও বুঝতে পারছেনা কিছু, দাঁড়িয়ে থেকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
রাকিব আর জুনাইদ এক সঙ্গে ফরিদার দিকে
তাকালো। ফরিদার কোন ভাবান্তর নেই। সে অবলীলায় বলতে লাগলো-
—অন্যায় কি করেছি। কিছুদিন পর বিয়ে দেবে, তখন তো সত্যিটা জানাতেই হবে। আগে থেকে জানলে সমস্যা কি?
—তুমি আর মানুষ হবে না। এক পা কবরে চলে গেছে তবুও কুটনামি কমেনা। জুনায়েদ কথাগুলো বলে ছি ছি করে উঠলেন।
তোমার মায়ের তখন ক্রিটিক্যাল অবস্থা ,আমরা সবাই হসপিটালে খুব অস্থিরতার মধ্যে ছিলাম, হাসনাহেনার কোলে তোমাকে এনে দেয়া হল , এর কিছুক্ষণ পরেই তোমার মা চলে গেলেন। হাসনার সেই বছর অনার্স ফাইনাল দেওয়ার কথা ছিল। ওর কোলে থাকলে তুমি কাঁদতে না, পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতে। ও পরীক্ষা দিতে পারল না সে বছর। আমার মা হাসনার হাতে ধরলেন তোমার মা হওয়ার জন্য। তার বড় বোনের শেষ স্মৃতির কাছে, স্নেহের টানে সেও বাধা পড়ে গিয়েছিল।
এমনটা হতেই পারে কিন্তু অনেক বড় আত্মত্যাগ করেছিল নিজের ভালবাসাকে বিসর্জন দিয়ে, শুধু তোমার জন্য।
তোমাকে আর রাইয়ান কে কখনো আলাদা করে দেখেছে?বরং তোমাকেই বেশি ভালোবাসে।কিভাবে তোমাদের ভবিষ্যত ভালো হবে নিরাপদ থাকবে সারাক্ষণ সেই চিন্তায় শুধু সে করে।
—বাবা আমি মাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য প্রশ্ন করিনি।বড় চাচীর কাছে হঠাৎ কথাটা শোনার পরে আমার কি যে হলো বলতে পারব না। আমার কাছে কেন তোমরা গোপন করলে এত বছর?
—প্রথম থেকে তুমি যদি জানতে তাহলে রাইয়ানের সঙ্গে সব সময় পার্থক্য খুঁজতে।ভালোর জন্য শাসন করলেও মনে মনে ভাবতে সে আমার সৎ মা। সম্পর্কের মাঝে তিক্ততা ছড়িয়ে পড়তো। এসব কোনো প্রশ্ন যেন তোমার মনে না আসে তাই তোমার দাদু এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
কথা বলতে বলতে রাকিব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
হাসনাহেনা কিছুই খেলেন না রাতে। রাকিব তার পাশে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন, আসলে বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। হঠাৎ হাসনাহেনা রাকিবের বুকে মাথা রেখে কাঁদে উঠল। রাকিব তাকে গভীর মমতায় জরিয়ে নিল।এত বছরে কখন ও হাসনা এমন করে নি।
সংসারধর্ম , সন্তান সবকিছু ঠিকঠাক পালন করেছে কিন্তু অদৃশ্য একটা পর্দা সবসময় ঝুলতো তাদের মাঝে।
বিয়ের কিছুদিন পরে, রাকিবকে হাসনাহেনা নিজেই জানিয়েছিল শাহেদের কথা। আগে জানলে কি অন্য রকম হতে পারত,হলেও হত, আবার নাও হতো। অপরাজিতার সঙ্গে রাকিবের বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হলেও তাদের তিন বছরের সংসার জীবন আনন্দময় ছিল।তার বিয়োগে হঠাৎ করে অন্য একজনকে জীবনসঙ্গী করা তার পক্ষেও কঠিন ছিল। সবকিছু ছাপিয়ে সবার আগে রুবাইদার চিন্তাটাই সবার সামনে প্রধান ছিল।
ভালোবাসার মানুষ শাহেদেকে ছেড়ে নিজের প্রিয় বোনের স্বামীকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নিতে দিনের পর দিন নিজের সঙ্গে কী পরিমাণ যুদ্ধ করতে হয়েছে তা শুধু হাসনাহেনা জানে। সবকিছু করেছে শুধু রুবাইদার জন্য। আর আজ সেই রুবাইদাই—-
বাসাথেকে বের হওয়ার সময় হাসনাহেনা সবসময় সন্তানদের মাথায় আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুক্ দেন,যেন বিপদাপদ না ঘটে। আজ এই প্রথম রুবাইদা বাসা থেকে বের হয়ে গেল কাউকে কিছু না বলে।
গেটের কাছে ফয়সাল দাঁড়িয়ে। সে রুবাইদার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
—আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেননি কেন?
রুবাইদা দাঁড়ালো না। হন্ হন্ করে হেঁটেই যাচ্ছে। ফয়সালের কথা তার যেন কানেই ঢোকে নি।
এবার ফয়সাল একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
—কি ব্যাপার কথা বলছেন না যে? ক্লাসের কি দেরি হয়ে যাচ্ছে?
রুবাইদা চোখ তুলে তাকাতেই, ফয়সাল কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। চোখ- মুখ ফোলা ফোলা কেমন যেন লাগছে রুবাইদা কে।
—ক্লাসে যাচ্ছি না। কোথায় যাব এখনো বুঝতে পারছি না। সবুজের কাছাকাছি ইচ্ছে করছে যেতে। প্রকৃতির মাঝে কিছুক্ষণ থাকলে ভালো লাগবে আমার।
—-যেতে পারি সাথে?
—অফিস নেই?
বুঝতে পারলো রুবাইদার সম্মতি আছে।
ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসলো ফয়সাল।রুবাইদার এখন ভালো লাগছে, পা থেকে স্যান্ডেল খুলে ঘাসের উপর খালিপায়ে গোল গোল হয়ে কিছুক্ষণ বাচ্চাদের মত হেটে, বসে পরলো ফয়সালের থেকে এক হাত দূরে।
কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পেরেও ফয়সাল কিছু জিজ্ঞেস করছে না , মনে মনে ভয় ও পাচ্ছে যদি তার স্বপ্নটা ভেঙে যায়। এই মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই কি যে হলো তার,বার বার একই ভাবনা ,রুবাইদা তার জীবনে না আসলে জীবন অচল হয়ে যাবে। আসলে মেয়েটা তার মনে ঝড় তুলে দিয়েছে।ঠিক যেন টিন এজারদের মত।এই বিষয়টা তার নিজের কাছেই অবাক লাগে।
রুবাইদাদের দোতলা বাড়ি ডেভলপারদের দিয়ে মাসপাঁচেক আগে তাদের বাসায় ভাড়া এসেছে। তাদের ফ্ল্যাট কমপ্লিট হলেই চলে যাবে। অবশ্য ফয়সালের কিছু বলার আগেই তার মা রুবাইদার মায়ের কাছে প্রস্তাব দেন। তার মায়ের ভাষ্য মতে ,এমন মেয়ে নাকি সচরাচর দেখাই যায়না।
অনেকক্ষণ কেউই কথা বলল না।এক ফাঁকে ফয়সাল মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে, বিশেষ কারণে আজ অফিস যেতে পারবে না।
—আমার জন্মের সময়ই আমার মা মারা যান। পরে আমার খালাকে বাবা বিয়ে করেন।এই কথাটা গতকাল ই আমি জেনেছি বড় চাচীর কাছে।মাকে খুব খারাপভাবে আমি প্রশ্ন করেছি, মায়ের মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে মায়ের আদর দেওয়ার জন্য অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন মা। একদমই এমন করা ঠিক হয়নি। মায়ের দিকে কি ভাবে তাকাবো এটা ভেবেই কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি।
—-বাসার সবাই তাহলে তো খুবই চিন্তা করছে। ফোন করে ওনাদের জানিয়ে দাও।
—মোবাইল হাতে নিতেই অনেকগুলো মিসডকল দেখতে পেল। সে বাবাকে মেসেজ করে দিল, আমি ভালো আছি, কিছুক্ষণ পরে বাসায় চলে আসব।
—এখন আমার কি করা উচিত?
যার সঙ্গে কোন দিন ভাল করে কথাই বলেনি আজ তার মতামত চাচ্ছে। কেন যেন ফয়সালের সঙ্গ ভাল লাগছে।
তার সঙ্গে শেয়ার করে হালকা লাগছে।
এই প্রথম রুবাইদা ফয়সালের চোখের দিকে তাকালো। ফয়সালের চোখ খুব সুন্দর কিন্তু বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলো না, কেমন যেন লজ্জা লাগছে। কি প্রশ্ন করেছে সেটাও ভুলে গেল।
—আন্টিকে সরি বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। মা তো মা ই। সবকিছু ভুলে ক্ষমা করে দেবেন। যিনি এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তোমার জন্য, এই সামান্য ভুল ক্ষমা করবেন না? আর তোমার জন্মদাত্রী মা যিনি এই পৃথিবীতে নেই শুধু ছবির মানুষ হয়ে আছেন, তার থেকে তোমার এই মা কোন অংশে কম?
কখন থেকে তুমি বলা শুরু হলো,সেটা কারো নজরে এলো না।
—এখন চল, সকাল থেকে খাওয়া হয়নি বোধহয়?
হাসনাহেনাকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে রুবাইদা।কত কথা বলবে ,সরি বলবে চিন্তা করেছিল রুবাইদা সেসবের কিছুই বলা হলো না। হাসনাহেনা ও গভীর মমতায় জড়িয়ে রাখলেন মেয়েকে ঠিক যেন ছোট্ট শিশু মায়ের কোলে।
তুশি কুঁকড়ে আছে ভয়ে। আমি গিয়ে তুশিকে কোলে তুলে নিলাম। তুশি আমার কোলে উঠে কাঁপতে লাগলো।
আপু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘জানালায় ঐ মহিলা দুটোকে দেখেছিলো তুশি। তাই কাঁপছিলো।’
আপু জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই মহিলা দুটোকে আগে দেখেছিস?’
আমি বললাম, ‘না। তোদের ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটা মানুষকেই তো আমি চিনি। কতোদিন ধরেই যাতায়াত করি তোদের ফ্ল্যাটে।
অথচ উনাদের দেখে একদমই চিনতে পারিনি এরা কারা। ঐদিন তোদের বাড়িতে ঢুকতেই ওদের একতলা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে দেখে সন্দেহ হয়েছিলো। কেমন একটা অশুভ ব্যাপার ছিলো দুজনের মধ্যে। তখনই ডাক দিয়েছিলাম দুজনকে।’
আপুর ফোনে ভাইয়ার কল তখনো চলছে। ফোনে ভাইয়ার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। ‘আমি পালিয়ে এসেছি পুষ্পা বাড়ি থেকে। অনেক কষ্টে পালিয়েছি। এগুলা সব জান্নাবার কাজ, আমি জানি। পুষ্পা, তোমাকে আমি তখনই মানা করেছিলাম, তুমি শোনোনি। এখন আমি সেই শঙ্খবুড়ির কাছে যাবো। তুমি তুশিকে সাবধানে রাখ।’
ভাইয়ার কথা শুনে আপু হু হু করে কেঁদে দিলো। আমার কাছ থেকে তুশিকে প্রায় কেড়ে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বুকে। ওর গালে কপালে চুমু খেতে লাগলো। তুশি মায়ের কোলে গিয়ে ভয় অনেকটা কাটিয়ে উঠলো। ছোট্ট একটা সাদা বিড়ালের মতো গুটিসুটি মে*রে রইলো মায়ের বুকে। আপু তুশিকে আঁকড়ে ধরলো, যেন এখনই হারিয়ে ফেলবে ওকে।
কিছুই বুঝলাম না আপুর কথায়। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’
আপু ছোট্ট পুতুলের মতো তুশিকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে বললো, ‘তুশি হওয়ার আগে, আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম বেবি নেওয়ার। কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। ডাক্তার দেখাচ্ছিলাম, টেস্টে জানা গেলো আমারই সমস্যা। এর কোনো চিকিৎসা নেই। বিদেশে গিয়েও খুব একটা লাভ হবে না। আমি সারাজীবন মা ডাক শুনতে পাবো না।
তোর দুলাভাইকে বলেছিলাম আরেকটা বিয়ে করতে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, ‘আমার জন্য যদি ইরানের রাণী শেহেরজাদকেও নিয়ে আসা হয়, তবুও তোমার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবো না।’
আমি জানতাম ওকে ছাড়া আমি কিংবা আমাকে ছাড়া ও বাঁচতে পারবে না। কিন্তু এক না একটা সময় তো আফসোস হবেই একটা ছোট্ট বাবুর জন্য, নিজের একটা সন্তানের জন্য। আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন শুধু কাঁদতাম আর উপরওয়ালাকে ডাকতাম। এরমধ্যেই একদিন শঙ্খবুড়ির খোঁজ পেলাম।
শঙ্খবুড়ি থাকে তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশে এক বস্তিতে। খুব নোংরা আর ছোট ঘরে থাকে ও। ওর সাথে সঙ্গী বলতে আছে একটা টিয়া পাখি। টিয়া পাখিটাই কেবল বুড়ির সাথে কথাবার্তা বলে। বুড়ি অর্ধেক পাগল, সবসময় বিড়বিড় করে কি বলে নিজেই নাকি বোঝে না।
এমন একটা বুড়ির কাছে আমাকে নিয়ে গেলো আমার কলেজের এক বান্ধবী। সে বললো, বুড়ির চেহারা দেখে ভুলিস না। এই বুড়ির অনেক ক্ষমতা। তুই যা চাবি, তাই তোকে এনে দিতে পারবে।
বুড়ির কাছে গেলাম। বুড়ি সেসময় একটু ভালো অবস্থায় ছিলো। আমাকে দেখে বললো, ‘তোকে আমার ভাল লাগছে। তোকে আমি সাহায্য করবো। কিন্তু তোর নিজের একটা ছাড় দেওয়া লাগবে।
আমি বললাম, ‘কি ছাড়?’
সে বললো, ‘তোর প্রথম বাচ্চা হবার কিছুদিন পর দ্বিতীয় বাচ্চা হবে। দ্বিতীয় বাচ্চা পেটে আসার সাথে সাথেই তোর প্রথম বাচ্চাকে নিতে জান্নাবা আসবে। ওদের কাছে তোদের প্রথম বাচ্চাটা দিয়ে দিবি।
আমি বললাম, ‘যদি না দেই?’
বুড়ি বললো, ‘তাইলে দুটো বাচ্চাই মা*রা যাবে। এখন চিন্তা করে দেখ, একটা বাচ্চা হারিয়ে আরেকটা বাচ্চা নিবি, না সারাজীবন এরকম বাঁজাই থেকে যাবি?’
আমি বললাম, ‘একটা বাচ্চা খুইয়ে আরেকটা বাচ্চা নিবো। অন্তত একটা বাচ্চা তো বেঁচে থাকবে আমার। আমি ওতেই খুশি।’
বুড়ি খিলখিল করে হেসে বললো, ‘ঠিক আছে। যা। বাসায় গিয়ে শুয়ে থাক। ঠিক সময়েই তোর বাচ্চা হবে।’
এর কয়দিন পরই তুশি এলো আমার কোলে।’
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এসব কি বলে আপু? এরকম একটা কাজ সে কিভাবে করতে পারলো?
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই একদিনও এসব কথা আমাদের বলিসনি কেন?’
‘ভেবেছিলাম পাগলা বুড়ি উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে। এরকম কিছু হবেনা। কিন্তু…’
‘আপু, তুই বেবি এক্সপেক্ট করছিস?’
আপু মাথা নিচু করে বললো, ‘হ্যাঁ। আজকে সকালেই টেস্টের রিপোর্ট এসেছে। পজিটিভ।’
‘এখন কি করবি তাহলে?’
‘শঙ্খবুড়ির কাছে যাবো। তার পা ধরে কান্নাকাটি করবো। আমার তুশির প্রাণভিক্ষা চাইবো। আমি শিওর তিনি একটা না একটা উপায় বের করতে পারবেন। তার অনেক ক্ষমতা।’
আপুর চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছে। তুশিকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে বলতে লাগলো, ‘তোমায় কোথাও যেতে দিবো না আম্মু। কোথাও যেতে দিবো না।’ মায়ের চোখের কান্না দেখে তুশিরও চোখ ভিজে আসছে। মা এবং মেয়ে, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, এমন মায়াবী দৃশ্য খুব কম দেখা যায়। আমার চোখও কেন জানি ভিজে আসলো। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো, এই মায়াবী দৃশ্য আমি আর কোনোদিন দেখতে পারবো না।
ভাইয়া ফোন করলো সেসময়। আপু ফোন ধরলো।
‘পুষ্পা। আমি শঙ্খবুড়ির বাসার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। বুড়ি মা*রা গেছে। তার টিয়া পাখিটাও নাই। দুজনের মাথা ধরেই কে যেন ছিঁ*ড়ে দুটুকরো করে দিয়েছে। আমি যতো তাড়াতাড়ি পারি বাসায় আসছি। তুমি তুশিকে সামলে রেখো।’
আপু ফোনটা রেখে দিয়ে চুপচাপ তুশিকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। তার চোখে পানির বাঁধ ভেঙেছে।
তুশি বললো, ‘আম্মু, এতো কান্না করো কেন তুমি?’
আপু তুশির কপালে চুমু খেয়ে বললো, ‘মা রে, তোর সব বিপদের কারণ আমি রে মা। আমাকে মাফ করে দিস।’
বাতাসে পোড়া কাঠের ঘ্রাণ। বারান্দার দরজাটা খুলে গেল। দুজন মহিলা এসে ঢুকলো ঘরে। সেই দুজন মহিলা, যাদের প্রথম সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখেছি। যারা এতোদিন দেখা দিচ্ছিলো আমাদের। জান্নাবা।
আপু ওদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘দোহাই তোমাদের। এতোটুকু বাচ্চা আমার। ওকে ছেড়ে দাও। আমাকে মাফ করে দাও। ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও না।’
মহিলা দুটো হাসলো। হাসতে হাসতে বললো, ‘কথা দেওয়া মানে কথা দেওয়া। তুমি আমাদের কথা দিয়েছিলে তোমার প্রথম বাচ্চাকে আমাদের কাছে দিয়ে দিবে। এখন সময় এসেছে ওকে আমাদের কাছে দিয়ে দেওয়ার। ওকে আমাদের হাতে তুলে দাও।’
তুশি মহিলা দুটোকে দেখে ভয়ে কুঁকড়ে আছে। ওকে দেখাচ্ছে ছোট্ট বাচ্চা একটা বিড়ালছানার মতো। আপু তুশিকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। কিছুতেই তুশিকে কাছ-ছাড়া করবে না।
মহিলা দুটো তুশির দিকে এগোচ্ছে।
আপুর ঘরের টেবিলের ওপর একটা ছুরি পড়েছিলো। মনে হয় ফল কাটার জন্য আনা হয়েছিলো। আমি ছুরিটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে বললাম, ‘খবরদার। আমার ভাগ্নির দিকে কেউ এক হাত বাড়ালে ওর সেই হাত কেটে আরেক হাতে ধরায় দিবো।’
আপু, আর জান্নাবা, সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
আমার ছুরির ফলাটা চিকচিক করে উঠলো আলো পড়ে। জান্নাবা পিছিয়ে গেলো কেন যেন।
আপু বললো, ‘তুই কি বলিস এগুলা? পাগল হয়ে গেছিস?’
আমি বলি, ‘আপু, ঠিকই বলতেসি সব। তোর বাচ্চা দেওয়ার ক্ষমতা ওদের আছে? আছে কেবল একমাত্র ওপরওয়ালার। উনি চেয়েছেন বলেই তোর বেবি হয়েছে। এরা তোর বেবি দেওয়ার কে? বেবি হয়েছে আর মাঝখান থেকে ফায়দা লুটতে আসছে। দালালের বাচ্চা সব।’
আপু বললো, ‘তুই পাগল হয়ে গেছিস। এরা মানুষ না, বুঝতে পারছিস না। মানুষের মতো ধমকালে এরা ভয় পাবে না। উল্টো রেগে যাবে।’
আমি বললাম, ‘মানুষ না বুঝলাম, ওপরওয়ালার একটা সৃষ্টিই তো। আমি, তুই ওপরওয়ালার যেমন একটা সৃষ্টি, গরু ছাগল যেমন একটা সৃষ্টি, এরাও তেমনি একটা সৃষ্টি। গরু ছাগলকে দেখে তুই অকারণে ভয় পাস? এদের কেন ভয় পাবি?’
আপু বললো, ‘এদের অনেক ক্ষমতা…’
‘ক্ষমতা তো কি হয়েছে? এদের অনেক ক্ষমতা আছে, আর মানুষের কোনো ক্ষমতা নাই? মানুষের অনেক ক্ষমতা আপু। মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত এমনি এমনি বলা হয় না। মানুষের ক্ষমতার জন্যই এরা মানুষকে ভয় পায়, মানুষের সাথে লোকালয়ে থাকে না, বনে-জঙ্গলে গিয়ে থাকে। আমরা আমাদের এতো ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারি না, কারণ আমরা ভয় পাই। সব কিছুতেই আমাদের ভয়। কেউ নজর দিলো কিনা ভয়, কেউ বান মারলো কিনা ভয়। শরীর একটু খারাপ হলেই ভাবি জ্বীনের আছড়। বউয়ের সাথে একটু ঝগড়া হলেই ভাবি জ্বীনের আছড়। এসব ভয়ের জন্যই আমাদের মন দূর্বল থাকে আপু। মন একটু শক্ত কর, এরা তোর চুলটাও ছিঁড়তে পারবে না।’
জান্নাবা দুজন চিৎকার করে উঠলো, ‘ভুল করছিস, অনেক বড় ভুল করছিস। আমরা শঙ্খবুড়িকে শেষ করে দিয়ে এসেছি। তোকেও শেষ করে দিবো।’
আমি ছুরিটায় দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে ওদের দিকে আগাতে আগাতে বললাম, ‘আয়, কাছে আয়। দেখি কে কাকে শেষ করে।’
জান্নাবা পেছাতে পেছাতে বারান্দার বাইরে চলে গেলো। এরপর বারান্দার গ্রিল দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে মিলিয়ে গেলো বাতাসে। যাওয়ার সময় বলে গেলো, ‘ভুল করলি। খুব বড় ভুল করলি। আমরা আবার আসবো।’
আপু ভয়ে কাঁপতে লাগলো। বললো, ‘ওরা যদি আসে আবার? যদি আমাদের কোনো ক্ষতি করে?’
আমি বললাম, ‘ওরা কিছুই করতে পারবে না। আজ যে বেইজ্জতিটা হয়ে গেলো, এরপর আর ওরা এদিকে মুখ ফেরানোর কথাও চিন্তা করবে না। ওরা তো আর মানুষ না। মানুষ ওদের চেয়েও খারাপ।’
আপু তুশিকে জড়িয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বললো, ‘তোমাকে আমি কোথাও যেতে দিবো না আম্মু। আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে দিবো না।’
তুশি হাত দিয়ে ওর মায়ের কান্না মুছিয়ে দিলো। আমি চলে এলাম। আমারও খুব কান্না পাচ্ছে। সব কান্না সবাইকে দেখাতে হয় না।
***
তিন বছর পর। আপুর আরেকটা পুতুল হয়েছে। এটার নাম রাখা হয়েছে টুশি। তুশি আর টুশি দুটো মিলে আপুর বাসা মাতিয়ে রাখে। এই দৌড়াদৌড়ি করছে, এই মারা*মারি করছে, এই লাফালাফি করছে, এক সেকেন্ডও শান্তিতে বসে নাই দুজন।
আপু হাফাতে হাফাতে বলতে থাকে,’উফ রে, পিন্ডিটা জ্বালিয়ে খাচ্ছে দুটা। একটুও শান্তি দেয় না। দুই ঘন্টা যে শান্তিতে ঘুমাবো, সেই সুযোগটাও নাই। বিরক্ত করে মা*রলো আমাকে।’ বলতে বলতে আপুর চোখে কান্না ঝিকমিক করতে থাকে। আনন্দের কান্না। আপু পুতুল দুটোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। একটুও এদিক ওদিক যেতে দেয় না।
ভাইয়াও অফিস থেকে ফিরলে পুতুল দুটোকে নিয়েই মেতে থাকে। ওরাও বাবা বলতে অজ্ঞান, বাবা ফিরলে বাবার কাছে গিয়ে যে বসে থাকে, আর কাছ ছাড়া হয় না। একটা থাকে বাবার এক বগলের নিচে, আরেকটা থাকে অন্য বগলের নিচে।
ছুটির দিনে ভাইয়া আপু আর তার দুই মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যায়। পার্কে আপু আর ভাইয়া বসে থাকে, তাদের মেয়ে দুটো ছোট ছোট পায়ে তাদের ঘিরে ঘুরতে থাকে প্রজাপতির মতো। অদ্ভুত শান্তি শান্তি লাগে তাদের দেখতে।
আমি আগের মতোই আছি। তবে এখন মাঝে মাঝেই মাঝরাতে ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙলে দেখতে পাই, আমার বিছানার পাশের জানালায় দুজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি আমার বালিশের নিচে হাত রাখি। হাতে ছুরির ধাতব স্পর্শ পাই। তখন ওরা চলে যায়। আমি আবার মুচকি হেসে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি।
মাঝে মাঝে অবশ্য একটু ভয় লাগে। যদি কোনোদিন বালিশের নিচে ছুরি রাখতে ভুলে যাই? যদি সেদিন কেউ আসে আমার রুমে?
আমি ভাবতে চাই না ওসব। যখন হবে, তখন দেখা যাবে।
আমি তুশিকে কোলে নিয়ে দৌড় দিলাম। ঝাড়া দৌড়। এক দৌড়ে বিল্ডিংয়ের বাইরে।
আমাকে দেখে দারোয়ান অবাক হয়ে বললো, ‘দৌড়ান কেন স্যার?’
আমি বললাম, ‘পুলিশ ডাকেন, জলদি পুলিশ ডাকেন। আমাদের বাসায় কারা জানি ঢুকেছে।’
দারোয়ান বললো, ‘পুলিশ ডাকার আগে আমি একটু দেইখা আসি। কে এমনে ঢুকলো। আমি তো এতোক্ষণ বসা আছিলাম। একটা তেলাপোকাও তো ঢুকতে দেই নাই।’
দারোয়ান উপরে আমাদের বাড়ি গেলো। আমি নিচে তুশিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তুশির মুখটা শুকনো। ভয় পেয়েছে খুব।
পনেরো মিনিট পর দারোয়ান এলো। গিয়েছিলো সে চোখমুখ শক্ত করে। দেখে মনে হচ্ছিলো, চোর ছ্যাচ্ছর সব একাই পিটিয়ে বের করে নিয়ে আসবে।
অথচ যখন এলো, তখন তাকে দেখে আমিই ভয় পেয়ে গেলাম। পুরো লম্বা দৈত্যের মতো দেখতে লোকটা ভয়ে কাঁপছে। পাগলের মতো কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতেই বললো, ‘এই চাকরি করুম না। এই চাকরি করুম না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে।’
দারোয়ান আমার দিকে তাকালো। তারপর হাসলো। পাগলের মতো হাসলো। বললো, ‘আমি জ্বীন দেখসি স্যার। সত্যিকারের জ্বীন দেখসি। এমন ভয়ংকর জিনিস দুনিয়ার আর কেউ দেখে নাই।’
লোকটা বেরিয়ে চলে গেলো। তার আর দেখা পাওয়া গেলো না।
আমি তুশিকে নিয়ে বিল্ডিংয়ের নিচে বসে রইলাম। সন্ধ্যা পার হলো। আপু ফিরলো আগে। এসেই বললো, ‘তোরা এখানে কেন?’
আমি বললাম, ‘এখানে তোর জন্য বসেছিলাম। আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না এখানে। আমার সাথে এখনই আমাদের বাসায় চল। দুলাভাইকেও ফোন করে দে ওখানে যেতে। আমার ফোনটা উপরে রেখে এসেছি, ফোন করতে পারছি না।’
আপু বললো, ‘কি সব পাগলামি শুরু করলি।’
আমি বললাম, ‘চল আপু, চল। রাস্তায় সব বলবো তোকে।’
রিকশায় উঠতে উঠতে আপুর বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালাম। আপুদের ফ্ল্যাটটা অন্ধকার। জানালা দিয়ে ওখানে কিছুই দেখা যায় না।
অথচ আমি দেখলাম।দুজন মহিলাকে দেখলাম। তারা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। জানালার দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে ওদের।
বাসায় ফিরতে ফিরতে আপুকে সব বললাম। সে বিশ্বাস করলো না। বললো ফাজলামি করছি। আমাকে অনেক বকলো তুশিকে ভয় দেখানোর জন্য। তুশি ভয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে।
আপু ফোন দিলো দুলাভাইকে। বললো যে সে আজ রাতে মায়ের বাসাতেই থাকবে। ভাইয়া যেন সোজা বাড়িতে চলে যায়। ফ্রিজে খাবার রাখা আছে, গরম করে খেয়ে নিবে। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘এটা কি বললি আপু। সত্যিই ঐ বাড়িতে থাকলে ভাইয়ার বিপদ হবে।’
আপু চোখ রাঙিয়ে বললো , ‘চোপ ফাজিল। তোর ফাজলামির জন্য আমার মায়ের বাসায় যাওয়া লাগছে। তোর দুলাভাইকেও এমনে বোকা বানাবো নাকি। ও বাসাতেই যাক। বাসা খালি রাখা ঠিক হবে না।’
আপুকে কোনোভাবেই মানাতে পারলাম না।রাতে ভাইয়া ঐ বাসাতেই থাকবে। একা। আমরা আমাদের বাসায়। আপু আর তুশি এক রুমে ঘুমাতে গেলো। আমি তাদের পাশের রুমে।
আমি রাতে জেগে রইলাম। খুব ভয় করছিলো। মনে হচ্ছিলো, এখনই ফোন বাজবে আপুর। আপু ফোন ধরবে।আর ওপাশ থেকে আসবে কোনো খারাপ খবর।
রাত তখন একটা বাজে। ফোনটা এলো।
আপু ধরলো ফোন।
আমি আপুদের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আপু কণ্ঠটা কেমন গম্ভীর শোনালো প্রথমে। তারপর ভয়, অদ্ভুত ভয় জাগলো তার কন্ঠে। আপু কান্না কান্না গলায় বললো, ‘কি দেখছো তুমি? কি দেখছো? বেরিয়ে যাও, এখনই বেরিয়ে যাও বাসা থেকে।’
আমি দরজা ঠকঠক করলাম। আপু খুললো দরজা। চোখ দুটো ভেজা। ভয়ে কাঁপছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’
আপু বললো, ‘তোর ভাইয়া শুয়ে ছিলো। ঘুম ভেঙ্গে দেখে, দুটো মানুষ সিলিঙে চারহাতপায়ে টিকটিকির মতো হেঁটে বেড়াচ্ছে।’
হঠাৎ চিৎকারের শব্দ। আপুর ফোনে। আপুর ফোনটা অন করা। ভাইয়া অন কলে ছিলেন। চিৎকারটা ভাইয়ার।
আমার তখন ভাইয়ার চিৎকারের দিকে মন নেই। আমার দৃষ্টি আপুদের বিছানায়। সেখানে তুশি বসে আছে। জানালার দিকে তাকিয়ে আছে সে। জানালার ওপারে বারান্দা। বারান্দায় স্নিগ্ধ জোছনা। জোছনায় বারান্দার অনেকখানি আলোকিত হয়ে আছে।
সেই জোছনার ভয়ংকর আলোয় আমি দেখলাম, দুজন চাদর পরা মহিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে তুশির দিকে তাকিয়ে আছে। হাত নেড়ে ডাকছে তুশিকে।
দুজন অপরিচিত মহিলাকে দেখলাম বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে। দুজনের সারা শরীর কালো চাদরে ঢাকা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা কে? কোন বাসায় আসছেন?’
তারা আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো।
আমি জানি না, আমার কেন ভয় লেগেছিলো সেদিন। কেমন গা ছমছমে ভয়। ভয়ে আমার সারা গা কেঁপে উঠেছিলো।
আমি দারোয়ানকে গিয়ে বললাম, ‘দুইজন মহিলা উঠছিলো সিঁড়ি বেয়ে। উনারা কারা?’
দারোয়ান পানের পিক থু করে ফেলে বললো, ‘কি যে বলেন ভাইজান। সিঁড়ি দিয়ে উঠবো কেডা? লিফট তো চালু।’
আমিও দেখলাম, লিফট চালু। তাহলে সিঁড়ি বেয়ে তারা উঠছিলো কেন? দারোয়ানও বা তাদের দেখেনি কেন?
এই বাড়িটা আমার বোন-দুলাভাইয়ের।ভাইয়া এখানেই ফ্ল্যাট কিনেছেন। আদাবরে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। এই বাড়িতে ভাইয়া ভাবি ছাড়াও থাকে তুশি।
তুশি হলো আপুর চার বছরের পিচ্চিটা। একদম ছোট্ট পুতুলের মতো। ছোট ছোট পায়ে যখন ও ‘মামা, মামা’ বলে হাঁটে, মনে হয় চাঁদের একমুঠো আলো মাখা ছোট্ট একটা গোলুমোলু কিউট পুতুল হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওকে কোলে নিলে একটুও নামাতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় সারাক্ষণ ওকে আদর করি।
তুশির ইদানিং সমস্যা হচ্ছে।এইজন্যই ডেকেছে আপু। ও ইদানিং ভয় পায়। কাকে নাকি দেখে। রাতে একা থাকতে পারে না। এইরুম থেকে ও রুমে যেতে পারে না ভয়ে। রাতে লাইট নেভাতে দেয় না। সারারাত লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে হয় আপা আর দুলাভাইকে।
আমি তুশির এই প্রবলেম সলভ করতে যে এখানে এসেছি, এমনটা না। এসেছি এই বাসায় ঘুরতে। কালকে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে, সামনে তেপান্তরের মাঠের মতো আদিগন্ত বিস্তৃত লম্বা ছুটি। কষিয়ে ছুটি কাটাবো। এই ছুটি কাটানোর প্ল্যানেই আপুর বাড়িতে আসা।
আপু সন্ধ্যায় আমাকে আর তুশিকে রেখে একটু শপিংয়ে গেলো। ভাইয়া অফিসে।বাসায় খালি আমি আর তুশি। আমি ড্রয়িংরুমে টিভি চালিয়ে বসে আছি। তুশি খেলছে। খেলতে খেলতে ও কেমন যেন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে, মামা?’
তুশি কিছু বলে না। ভীতু বিড়ালের মতো আমার কাছে এসে জড়োসড়ো হয়ে থাকে।
#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪৮
নয়না জিয়ানের বাহুতে আবদ্ধ। নয়নার চোখ দুটো কাপড়ে বাঁধা। হৃদপিণ্ড বেসামাল, খামচে ধরে আছে জিয়ানের পাঞ্জাবি।
“জিয়ান নয়নার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,ডিয়ার বাটার মাশরুম। এতোটুকু ছোঁয়ায় হাওয়াই মিঠার মতো মিলিয়ে যেও না। তোমার জীবনের সবচেয়ে স্বরণীয় দিনের জন্য প্রস্তুতি নাও প্রাণ।”
নয়না এখনো জিয়ানের পাঞ্জিবর কলার শক্ত করে ধরে আছে।
জিয়ান নয়নার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,”ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসা যায়। স্পর্শে ব্যাকুলতা ছড়িয়ে মিশে যেতে হয় একে অপরের পাজরে। অপূর্ণ থেকে পূর্ন হওয়া যায়, মিশে যাওয়া যায় একে অপরের মাঝে,লোকে জানবে, তুমি আমি দুটি দেহ, একটি প্রাণ৷ কবুল বললেই অপরিচিত নারীকে অর্ধাঙ্গিনী রুপে পাওয়া যায়। তবে সে নারীর ভালোবাসায় উন্মাদ হওয়া যায় জানা ছিলো না৷ তুমি আমার সব শূন্যতার প্রিয় পূর্নতা।”
“নয়না ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে চাইলো৷ তার আগেই ঠোঁট দুটো দখল করে নিলো অপর দু’টি ঠোঁট। নয়না কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো৷ খামচে ধরলো জিয়ানের পিঠ।
পেছন থেকে অনিকেত বলে,”ভাই আমরা অবিবাহিত একটু দয়া কর আমাদের উপর। তোদের যা করার আমরা সরলে করিস।”
“জিয়ান নয়নার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে সরে আসলো কিছুটা। অনিকেতকে উদ্দেশ্য করে বলে,”শা’লা কয়েক মিনিট চোখ বন্ধ করে রাখতে পারলি না!মনমত কিসটা করতেও পারলাম না৷”
“বৌ তোরই, ফুরিয়ে যাচ্ছে না। সারাজীবন মনভরে যা খাওয়ার খেয়ে নিস। খাওয়ার আগে খেয়াল রাখিস আগে পিছে কেউ আছে নাকি। যেখানে সেখানে খেতে হয় না৷”
“নয়না মনে মনে বলে,এই লোকটা এতো ঠোঁট কাটা! লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই। এভাবে কেউ সবার সামনে বলে!অসভ্য,নির্লজ্জ,বেকুব প্লেন ড্রাইভার।”
জিয়ান বলল,”মনে মনে বকছো কেন! যত যায়ই বলো আমি কিন্তু তোমারই, তাই বকে টকে লাভ তেমন নাই সহ্য সারাজীবন করতেই হবে নো অপশন।”
জিয়ান নয়নার হাত ধরে নিয়ে আসে। আস্তে আস্তে নয়নার চোখ খুলে দেয়৷ নয়নার দৃষ্টি তখন আকাশে, সুন্দর করে লেখা, প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী শুভ জন্মদিন। লেখাটা মিলিয়ে যায় কয়েক মূহুর্তে। এরপরই নয়নার উপর বর্ষিত হতে থাকে নানা রকম সুগন্ধি ফুল৷ সবাই একসাথে উইশ করছে,হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার সুনয়না। হেলিকপ্টার থেকে বর্ষিত হচ্ছিলো ফুলের পাপড়িগুলো৷ এরপর উপর থেকে লাল আর সাদা রঙের বেলুন৷ নয়নার চোখেমুখে বিস্ময় আনন্দ দু’টো প্রকাশ পাচ্ছে।
“জিয়ান বলল,হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার বাটার মাশরুম। বেচে থাকার প্রার্থনায় তোমার সাথে বৃদ্ধ হতে চাই প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।নয়নার খালি হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্য আবদ্ধ করে নেয়। এরপর অপর হাত দিয়ে নিজের পাঞ্জাবির পকেটে থেকে বের করে আনে, লাল রঙের রেশমি কাঁচের চুড়ি।
“নয়না অবাক নেত্রে তাকিয়ে আছে জিয়ানের দিকে। মানুষটা তাকে কত যত্ন নিয়েই ভালোবাসে! পরম যত্ন নয়নার শুন্য হাত ভরে উঠলো লাল কাঁচের চুড়িতে৷ হাত ছাড়তেই চুড়ি ঝুনঝুন করে উঠলো।”
“জিয়ান বলল,তোমার হাত এই চুড়ির সৌন্দর্য বর্ধন করে দিয়েছে।”
” নাজিব চৌধুরী, মিতা বেগম ওনারাও এসেছেন৷ যদিও কিছুটা দেরিতে ডেকে এনেছে ওনাদের। তবুও দু’জনেই বেশ খুশি হলো।সবাই মিলে একত্রিত হয়ে কেক কাটলো৷ নয়না সর্বপ্রথম কেকের পিসটা নিয়ে মিতা বেগমের মুখে তুলে দিলো৷ এরপর নাজিম সাহেবকে খাইয়ে দিয়ে কেকের পিসটা রেখে দিলো।”
সবাই বেশ আনন্দিত। তবে মেহনুরের মন যেনো আমাবস্যারাত। বেশি সময় সবাই থাকলো না৷ সবাই চলে গেলো যে যার মত।
“অনিকেত জিয়ানের, কানের কাছে মুখ এনে বলে,ভাই আমার তাল হারিয়ে ফেলিস না৷ নয়ত সেবারের মত ভাবি জ্ঞান হারাবে আর তুই এবারও ফুলকোর্স কম্পিলিট করতে পারবি না। একটু রয়ে সয়ে খাইস ভাই। জিনিস তোরই সারাজীবন খেতে পারবি।”
“শা’লা ইতর তুই যাবি নাকি সায়নাকে ফোন করে ডেকে আনবো?”
” যাচ্ছি। তবে এবার কিন্তু ইনকম্পিলিট রাখিস না।”
জিয়ান ছাদের দরজা বন্ধ করে নয়নাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নয়নার চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো। শুষে নিতে থাকলো নয়নার চুলের মাতাল করা ঘ্রাণ৷
“নয়না চোখ বন্ধ করে ডাক্তারের কথাগুলো স্বরণ করলো,তুমি বর্তমান উপভোগ করো অতীত কে বর্তমানে আসার সুযোগ না দিয়ে৷ যদি বর্তমান আর অতীত একসাথে আসতে চায় একটু শ্বাস নাও ট্রাই করো বর্তমানকে অনুভব করার। মৃদু স্বরে বলল, চুলে কি তেলের বদলে আফিম ব্যবহার করো নাকিগো!কেমন মাতাল হয়ে যাচ্ছি। জিয়ান ধীরে ধীরে নয়নার কাঁধ থেকে চুলগুলো সরিয়ে নয়নার ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দেয়।
“নয়না কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে দু”হাতে শাড়ি খামচে ধরে। নয়নার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,এতোটুকুতেই জমে গেলে এই পুরো আমি টাকে কি করে সামলাবে বাটার মাশরুম !”
“নয়নার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। নিশ্বাসের শব্দ ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
“পরপর কয়েবার জিয়ান নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের উষ্ণতা অনুভব করালো নয়নার ঘাড়ে৷”
” নয়না ঘুরে জিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো,কোমল কন্ঠে,বলল,আমার কেমন জেনো লাগছে।”
“জিয়ান পরম আদরে জড়িয়ে নিলো নয়নাকে নিজের বক্ষপিঞ্জরে, আদুরে স্বরে বলল,কেমন লাগছে বাটার মাশরুম? এই অনুভূতি এক্সপ্লেইন করতে পারবে?”
“নয়নার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি টের পাচ্ছে জিয়ান৷ বলো না জান কেমন লাগছে তোমার?”
“নয়না জিয়ান পাঞ্জাবি ভেদ করে নখ বসিয়ে দিলো জিয়ানের পিঠে,মৃদু কন্ঠে বলল,জানিনা তুমি আমাকে কোন ঘোরে নিয়ে যাচ্ছো!মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাচ্ছি তোমার স্পর্শে।”
“জিয়ান নিজের জমিয়ে রাখা কন্ট্রোল হারিয়ে বসলো, নয়নার মুখ থেকে তুমি ডাক শুনো৷ হুট করে নয়নার ঠোঁট ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো গভীর ভাবে।”
“নয়না পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।সে যেনো হারিয়ে যাচ্ছে নিজের মধ্য থেকে৷ ইচ্ছে করছে জিয়ানের ভেতর নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলতে।”
“প্রায় পাঁচ মিনিট পর নয়নার ঠোঁট জোড়া মুক্ত হলো জিয়ানের ঠোঁট থেকে৷ নয়না জোড়ে জোড়ে নিঃস্বাস নিচ্ছে। একমন সুখকর অদ্ভুত অনুভূতি!
“জিয়ান নিজেও শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,ডিয়ার বাটার মাশরুম আজকে তোমাতে ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে।জানিনা কতক্ষণ নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখতে পারবো। তুমি বুঝতে পারছো আমি বলছি? আমার ভেতরের পুরুষসত্তা তীব্রতা ধারণ করছে সুইটহার্ট। তোমার কোন সমস্যা হোক আমি চাইনা৷ তোমার কষ্ট হলে বলে দিও রাঙাবৌ। আমি সারাজীবন অপেক্ষা করবো তবুও তোমার অমতে তোমার সাথে ঘনিষ্ঠ হবো না জান৷”
“নয়না এসবের মানে বুঝে। নয়নার গাল দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো,শরীরে বয়ে যেতে লাগলো অন্য রকম এক শিহরণ।”
” জিয়ান নয়নার চোখে হাত রেখে বলে,এই পূর্নিমা রাত তুমি আমি জোছনাস্নাত করবো। দেহের মিলন না আমি তোমার সাথে আমার আত্মার মিলন ঘটাতে চাই প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী। তুমি বাঁধা দিওনা আজ সব বাঁধা ছিন্ন করে আসো একে অপরকে শপে দেই৷ এই সময়টুকুতে ভুলে যাও সব৷ আমার ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে উন্মাদ হও আমার সাথে। চলো হারিয়ে যাই উন্মাদনায়।”
“কাঁপা কাঁপা কন্ঠে নয়না সুধালো, কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“তোমাকে ভালোবাসার সমুদ্রে ভাসিয়ে নিতে নিয়ে যাচ্ছি বাটার মাশরুম। প্লিজ তুমি করে বলো জান৷ তুমিময় ভালোবাসায় সিক্ত হতে চাই৷ আমি তোমার কন্ঠে আদুরে স্বরে তুমি সম্বোধন শুনতে চাই সখী।”
“জিয়ান সুইমিংপুলের কাছে এসে নয়নার চোখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে নিলো৷ চারপাশে লাল,নীল, সবুজ, হলুদ নারা রঙের লাইটিং পুরো পুল জুড়ে লাল গোলাপের পাপড়ি। মাঝখানে হলুদ গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা, শুভ জন্মদিন প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।”
“নয়নার ছোট হৃদয় জুড়ে রঙিন প্রজাপতি উড়তে লাগলো৷ মনে হচ্ছিলো সে যেনো কোন অষ্টাদশী কন্যা। জিয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,ভালোবাসি তোমাকে৷ একটু বেশিই ভালোবাসি। আমি কি সত্যি তোমার! আমার নিজের এই ভাগ্য যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না!”
“জিয়ান কল্পনাও করেনি নয়না তার এতো কাছে এসে এভাবে তাকে প্রপোজ করে বসবে৷ জিয়ান দু’হাতে নয়নাকে নিজের বক্ষে জড়িয়ে নিয়ে বলে,তোমার প্লেন ড্রাইভার তোমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে বাটার মাশরুম। আমার বাটার মাশরুম একান্ত ব্যাক্তিগত সুরভিত ফুল তুমি, যার মাতাল করা ঘ্রানে আমি সব সময় আসক্ত থাকতে চাই। ভালোবাসি, ভালোবাসি। ভালোবাসায় মোড়ানো আমার ছোট বাটার মাশরুম।”
“নয়না জিয়ানকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো৷ তার যেনো ইচ্ছে করছে জিয়ানের ভেতরে নিজেকে আড়াল করে ফেলতে৷”
“জিয়ান নয়নাকে ঘুরিয়ে সামনে এনে নয়নার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে পুলে জাম্প মারলো। পানির শীতলতা যেনো আরো উত্তাপ জড়িয়ে দিলো দু’জন কপোত-কপোতীর দেহ-মন জুড়ে। গোলাপের সুভাষ আর প্রিয়তমার সান্নিধ্যে পাগল করে তুলেছে জিয়ানকে৷”
অবশেষে আজকের পূর্নিমার রাত আর এই শীতল বাতাস সাক্ষী হতে যাচ্ছে দু’জন কপোত-কপোতীর পবিত্র মিলনের।
#চলবে
ছাদ থেকে নিচে নেমে অনুভব এক কোণার সোফায় গিয়ে বসে পড়লো। ঘরে উচ্ছ্বসিত কোলাহল,একরকম উৎসবমুখর পরিবেশ। মনে হচ্ছিল, সব কিছু বুঝি চূড়ান্ত।
কোনো কথা না বলে মোবাইলটা বের করে স্ক্রলিং শুরু করল অনুভব। চোখ হয়তো স্ক্রিনে, কিন্তু মন আর কান কথোপকথনের দিকে।
কিছু সময়ের ভেতরই পুরো পরিবেশটা উপলব্ধি করতে পারল সে।
পাশে এসে বসল ছোটবোন নিহি। চাপা হাসি ঠোঁটের কোণে।
অনুভব নিচু গলায় বলল,
“এখনো এদের প্যাচাল শেষ হলো না? বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়নি?”
নিহি ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে বলল,
“উফ ভাইয়া, তুই তো এখনো একেবারে রসকসহীন রয়ে গেলি! এখানে কাহিনী উল্টে গেছে রে!”
ভ্রু কুঁচকে অনুভব তাকাল,
“মানে?”
রিহি তখন ফিসফিস করে পুরো কাহিনী খুলে বলল। কানে কথাগুলো পৌঁছাতেই, অনুভব চোখ তুলে তাকাল ঘরের দিকটায়। বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল। তার মানে, ছাদে পিছনের সাইট দেখা সেই মেয়েটাই প্রথমে পাত্রী ছিল!
হঠাৎ করেই তার বুকের ভেতর কিছু একটা খচখচ করে উঠল। নিজের উপর বিরক্তি ভর করল। কেন সে চলে এলো? কেন ছাদের সেই মুহূর্তে কিছু বলল না, কিছু করল না?
ঘরভর্তি মানুষের হাসি তার কানে কাঁটার মতো বাজলো। কী অবলীলায় সবাই বদল মেনে নিল!
আর সেই মেয়েটার পরিবারও? তাদের পরিবারেরই একজনের চোখের জল কি এদের কারও চোখে পড়ে না?
সবার দিকে তাকিয়ে, অনুভব প্রথমবারের মতো গভীর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তার মনে হলো, কেউ একজন নীরবে কান্না করছে,আর পুরো পৃথিবী উদাসীন হয়ে হাসছে। এমনকি তার কাছের মানুষগুলোও!
“কিরে, এভাবে চুপচাপ বসে আছো কেন, অনুভব ভাই?”
নরম কণ্ঠে পেছন থেকে বলল আরিশ।
অনুভব ধীর চোখে তার দিকে তাকাল। গলায় কোনো উত্তাপ না রেখেই বলল,
“তুই এটা ঠিক করিস নি।”
আরিশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “অনুভব ভাই, তুমি অন্তত এই কথাটা আর বলো না। জানি তুমি আমাদের সবার চেয়ে আলাদা। কিন্তু এভাবে মুখের ওপর এমন কথা বলে মন খারাপ করে দিও না।”
— “যেটা সত্যি, সেটাই তো বলছি।”
— “ওই মেয়েটার সাথে আমার কিছুতেই মানাবে? তুমি সত্যি করে বলো তো।”
অনুভব এবার কণ্ঠে একটু শীতল রাগ ঢেলে বলল,
— “রঙই কি সব সৌন্দর্য?”
— “হ্যাঁ, অবশ্যই। এখন আবার তুমি উল্টো ব্যাখ্যা কোরো না প্লিজ।”
অনুভব উঠে দাঁড়াতেই সবার দৃষ্টি তার দিকে পড়লো।
সে পা বাড়াতেই পেছন থেকে আরিশের গলা শোনা গেল,
— “কই যাচ্ছ তুমি?”
— “আমি আর এখানে থাকতে পারছি না, আরিশ। বাড়ি ফিরবো।”
আরিশ উঠে এলো, গলায় একরাশ অনুরোধ নিয়ে বলল,
— “না, আমরা ভাবছি আজই সব পাকাপাকি করে ফেলবো। তুমি না থাকলে—আমার এই বিশেষ দিনে, তা কি হয়?”
অনুভব এক ঝটকায় ঘুরে তাকালো। কণ্ঠে ব্যঙ্গ মিশিয়ে শুধালো,
— “এই বাণীগুলো না বললেই ভালো হতো। পাত্রী দেখতে এসে শালিকা যার পছন্দ হয়ে যায়, তার মুখে এমন ‘সত্যি কথা’ শুনে হজমের ওষুধ ঠিক হজম হচ্ছে না।”
— “অনুভব ভাই…”
— “তোর এই তথাকথিত শুভদিনে, আমার উপস্থিতি মুখ দুটোই অশুভ হয়ে উঠুক—এটা আমি চাই না। তোরই খারাপ লাগবে পরে, বুঝে নিস।”
আরিশ থমকে দাঁড়ায়। একটু থেমে কাঁপা গলায় বলল,
— “তুমি এমন বলতে পারলে! তাহলে তুমি আমাকে কোনোদিন ভাই ভাবোনি। শুধু একটা চাচাতো সম্পর্কই মেনে দায়িত্ব পালনে এসেছো তাহলে, তার বাইরে আর কিছু না?”
অনুভব এবার একটু নরম হলো, কিন্তু কণ্ঠে ক্লান্তি ও রাগের দাগ স্পষ্ট,
— “ভেবেছি বলেই তো উঠে যাচ্ছি। কেউ না থাকলে এখনই তোকে দুটো থাপ্পড় দিতাম, জানিস। যাই।”
এই বলে সে ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
উঠানে এসে পৌঁছতেই তার চোখ টানল ছাদের কোণায়।
সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে, একা। চুলগুলো এলোমেলো হাওয়ায় ওড়ে, মুখ অস্পষ্ট হলেও অনুভবের চোখে স্পষ্ট একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে- একটা মেয়ে, যার চোখে ছিল অসম্মান, যার পাশে ছিল না কেউ, আর যার কান্না ছিল শুধুই নিজের জন্য।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে মনে মনে বলল,
“আমার পরিবারের জন্য… তোমাকে হেনস্থার মুখে পড়তে হলো। ক্ষমা করে দিও।”
কিন্তু অনুভব বেশিদূর এগোতে পারলো না। দরজার কাছে পৌঁছাতেই আরিশ এসে পথ আটকে দাঁড়াল। চোখেমুখে কোনো অভিমান,অদৃশ্য অনুরোধ। অনুভব থেমে দাঁড়ালো—কোলেপিঠে করে মানুষ করা সেই ছোটভাইয়ের এমন শুভদিনে এভাবে চুপচাপ চলে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? সে বুঝে গেল, ইচ্ছে না থাকলেও, আজকের এই ঘটনায় সে নিজেও একটুকরো অন্যায়ের অংশ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে আন্টির ডাকে যখন রিমি নিচে নামলো, তখন তার চোখে এখনও কান্নার দাগ। তবুও সে মুখে একরাশ হাসি এনে নিচে নামলো।
ভেবেছিল, আজ সে ছাদেই থাকবে, নিজেকে আড়ালে রাখবে।
কিন্তু এক সময় মনে হলো, এই আনন্দের দিনে বোনের পাশে না থেকে সে কি করে পারবে?এই সম্পর্কটা শুধুই এক বিয়ের নয়,এটা ভালোবাসার, যত্নের, বন্ধনের।
রিমি নিজেকে বোঝালো-দুঃখ এখন দূরে রাখতে হবে।
আজ যদি ছোটবোনের জায়গায় সে থাকতো, তবে রিমি-ই কি আগলে রাখতো না সবকিছু?
নিজের মনেই সে উত্তর পেল—
হ্যাঁ, অবশ্যই রাখতো। একজন অভিভাবকের মতো, বুক চিতিয়ে পাশে দাঁড়াতো। তাহলে আজ কেন সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে?
এই ভাঙা হৃদয়ের ভেতরের সঙ্গে এক খণ্ড দায়িত্ববোধ মিশে রিমিকে আবারো টেনে আনলো, সবার মাঝে। কারণ কিছু সম্পর্ক কাঁটার মতো নয়, যারা কাঁটা ছুঁয়ে বুঝিয়ে দেয়-ভালোবাসা শুধু নিজের জন্য নয়, কিছু কিছু আপনজনের জন্যও!
অনুভব মাকে নিয়ে একটু আড়ালে সরে এল। ভিড়ভাট্টা, লোকজনের হাসি-ঠাট্টা থেকে দূরে—শুধু মা আর ছেলে।
সে ধীর গলায় বলল,
“মা, এগুলো ঠিক হচ্ছে না।”
আমেনা বেগম একবারে ছেলের চোখের দিকে তাকালেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমি কী করবো বল? ওদের বাবা-মা যদি এমন সিদ্ধান্তে সায় দেয়, আমি কি গিয়ে কিছু বলতে পারি? তাছাড়া আরিশ তো আমার কাছেও নিজের ছেলের মতোই। তোদের মধ্যে কখনো পার্থক্য করিনি। কিন্তু এখন আমি কিছু বললে সেটা উল্টোভাবে নেবে।”
অনুভব নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল। মায়ের বলা কথাগুলো এতটা নির্মমভাবে সত্য।
“কিন্তু জানিস” আমেনা বেগম একটু থেমে যোগ করল,
“ওই বড়ো মেয়েটা না, ভীষণ শান্ত। একটুও উচ্চবাচ্য না করে মেনে নিল সব। তার চেহারাটা… কেমন এক ধরনের মায়া মাখানো! অথচ আমাদেরই লোকজন শুধু রঙ দেখে রায় দিচ্ছে।”
আমেনা বেগম একটু হেসে বলছিলেন, “হ্যাঁ, ভীষণ।”
কিন্তু হঠাৎ থেমে গেলেন, চোখে প্রশ্ন ভেসে উঠলো।
“তুই এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
অনুভব গভীরভাবে মায়ের চোখে চোখ রাখল।
তারপর একটিমাত্র বাক্যে উত্তর দিল—
“আমি বিয়ে করবো।”
আমেনা বেগমের মুখে বিস্ময়ের পর খুশির ঝলক দেখা গেল। অবশেষে, তার ছেলে নিজের ইচ্ছেতে বিয়ের কথা বলছে! কিন্তু পরমুহূর্তেই চোখে ভাঁজ পড়ল চিন্তার, একটু গম্ভীর গলায় বললেন,
“এই কথার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির কী সম্পর্ক? আমি তো কিছুই বুঝলাম না।”
মায়ের চোখে বিস্ময় আরও গাঢ় হয়।
“মানে? মানে… তুই ওই মেয়েটাকে করবি? কিন্তু… এটা তো দেখতে ভালো লাগবে না। ভাইয়ের জন্য যাকে দেখে এলি, পরে তাকেই করবি?”
মায়ের কণ্ঠে স্বাভাবিক দ্বিধা। খুশির মাঝে এক টুকরো সমাজের ভয়।
অনুভব এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
“ওরা যেটা করেছে, সেটার চেয়ে আমি অনেক ভালো কিছুই করছি মা। অন্তত কাউকে হেয় করছি না, কেউ অপমানিত বোধ করবেও না। তোমার বরং আমার উপর গর্ব করা উচিত।”
আমেনা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।
“তোকে নিয়ে আমি সবসময়ই গর্ব করি। কিন্তু একটা কথা বল, তুই কি শুধুই মায়া থেকে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস?”
অনুভব একটু থেমে, স্থির গলায় বলল,
“ভালোবাসার প্রথম ধাপটাই তো মায়া, মা। আমি সেই মায়া থেকেই সংসার শুরু করতে চাই। ধাপে ধাপে ভালোবাসাটাও তৈরি হয়ে যাবে।”
মা ছেলের মুখে এক অপূর্ব স্থিরতা দেখলেন। চোখে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের দীপ্তি নিয়ে বললেন,
“আমি রাজি।”
অনুভব মুচকি হেসে মাথা ঝুঁকাল। তারপর চুপিচুপি তাকাল ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে—রিমির দিকে।
তার এলোমেলো চুলে সন্ধ্যার বাতাস খেলা করছে।
সে নিজের মনে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আই প্রমিস, তুমি অনেক ভালো থাকবে। রত্নের কদর সবাই জানে না, কিন্তু আমি জানি—তোমার বোন যদি হয় সোনা, তবে তুমি তার চেয়ে ১০গুণ এগিয়ে একটা রত্ন। করুণার মাঝেই হোক আমাদের ভালোবাসার সূচনা।”
ভিড়ের মাঝেও সেই মুহূর্তটা নিঃশব্দ, অথচ সবচেয়ে গভীর ছিল,যেখানে সম্মান আর অনুভব মিশে এক আশ্চর্য সাহসে রূপ নিল ভালোবাসা। আর একটা সুন্দর সম্পর্কের সূচনা।
#সমাপ্ত
(এটা এটুকুই থাক। থিমটা দিয়ে কয়েকদিন সময় নিয়ে আবারও আসবে গল্প। এরপর থেকে শুরু হবে পরবর্তী পর্ব, সম্পূর্ণ নতুনরূপে, এটা জাস্ট এমনিতে আগের অংশটুকুই । এটা ছোটগল্প হিসেবে ভেবে নিতে পারেন। আবার পরের গল্পের শুরুর দিকও ভাবতে পারেন।)
বড়ো বোনকে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ ছোট বোনকে পছন্দের কথা জানাতেই রিমির গাল গড়িয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এটা আজকে নতুন নয়, এ নিয়ে সতেরোবার। সতেরোটি সম্বন্ধ এসেছিল—সব ফিরে গেছে। কারণ একটাই,সে কালো।
“আসলে আমরা ছোট মেয়েটাকেই বেশি পছন্দ করলাম। তাকেই পুত্রবধূ হিসেবে নিয়ে যেতে চাই।”
দ্বিতীয়বার একই শব্দগুলো যেন অদৃশ্য তীর হয়ে বিঁধলো রিমির বুকের গভীরে। রিমি তাকালো না কারো দিকে। মনের গহীন থেকে একটা চাপা নিঃশব্দ শ্বাস বেরিয়ে এলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোঁটা অশ্রু। খুব চেনা এই অনুভূতি। নতুন নয় একটুও।
এইবারের সম্বন্ধটার কাছ থেকেও রিমি বেশি-কিছু আশা করেনি। সে জানতো এমন কিছুই হবে কিন্তু পাত্র ভীষণ ভালো, সরকারি চাকুরীজীবি তাই রিমির বাবার জোর-জবরদস্তির উপর হেরে গিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে এসেছিল। তাও আগেরই মতো ফল পেলো। তবে এবারের ফল একটু ভিন্ন।
রিমি ড্রয়ইং রুমের সবার মাঝখানে থেকে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল, “আমি একটু আসছি।”
তারপর নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
বাড়ির পরিসর ছোট, নিজের ঘরটাও আজ মেহমানদের দখলে। একটুকু নিঃসঙ্গ হবার, একফালি কাঁদার জায়গাটুকুও যেন কেড়ে নিয়েছে ভাগ্য।
ছাদ ছিল রিমির শেষ আশ্রয়। সেই পুরোনো রেলিং আর চেনা আকাশটাই আজ যেন একমাত্র সাক্ষী তার ভাঙাচোরা মনের।
উঠেই এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। প্রথমে ঠোঁট কাঁপলো, তারপর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। পরক্ষণেই এক বুক কান্না চেপে ধরে ডুকরে উঠল—হঠাৎ করেই, বিনা শব্দে, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা ব্যথাটা নিজেই মুখ খুঁজে নিয়েছে।
আজ তো তার কাঁদার কথা ছিল না। আজকের দিনটা যে বাবা খুব আশা নিয়ে শুরু করেছিলেন।
যখন বাবার মুখে শুনেছিল,
“ছেলেটা খুব ভালো রে রিমি, সরকারি চাকরি করে। এইবার হয়তো তোর ভাগ্য ফিরবে।”
বাবা যখন খুশি খুশি মনে সম্বন্ধটা রিমির সামনে এসে বলেছিল তখন বাবার উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে সে না বলতে পারলো না। শেষবারের মতো আবারো অপমান হবে জেনেও সম্বন্ধের সামনে যেতে রাজি হয়েছিল।
নিচের ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে আসছে প্রাণখোলা হাসির শব্দ। শব্দগুলো যেন রিমির বুকের গভীরে ঢুকে বিষ ছড়াচ্ছে। হাসির সাথে তাল মিলিয়ে যেন তার কান্নার বেগও বাড়ছে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে।
সে তো এসব দৃশ্যের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই।
তবুও আজ কেন এমন কান্না পাচ্ছে তার?
কেন এই অজানা ভার বুকের ওপরে চেপে বসেছে?
——-
ছাদের এক কোণে, ধরা ছোঁয়ার বাইরের একান্ত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল অনুভব। হাতে ধরা সিগারেটটার ধোয়ার আবরণে নিজেকে আড়াল করে নিচ্ছে সে।
এইসব পাত্রপক্ষের আনাগোনা, মেয়ে দেখা, পছন্দ অপছন্দ—সবই অনুভবের চোখে বড্ড নিচু মানসিকতার পরিচয়। তার কাছে এসব কিছুই একরকম পণ্য বাছাইয়ের মতো মনে হয়—যেখানে মেয়ের মুখের হাসি, চোখের জলের কোনো দাম থাকে না।
সবাই মিলে একসাথে হুট করে হাজির হয়ে মেয়ের পরিবারকে অস্বস্তিতে ফেলা, তাকে যেন অপমানিত করে ফেলে ভেতর থেকে। সে জানে,আজ সে নিজেও সেই একই অন্যায়ের অংশ।
সে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো চারপাশে। এই বাড়িতে পা রাখার পর থেকেই তাদের উদ্দেশ্যে করা এতসব আয়োজন দেখে অস্বস্তিতে ভুগছে সে। তাই তো আসার সাথে সাথে নিজেকে জায়গা দিতে সোজা ছাদে চলে এসেছে।
এইসব লোকজন, আত্মীয়স্বজনের ঠেলাঠেলি, বাহারি পোশাকে হাসিমুখে সাজানো মেয়ে দেখা,সবই তার কাছে বিরক্তির এক প্রবল উৎস। তবুও আজ কেন যেন নিজেকে মানানো যায়নি। হয়ত অভিমানে ছোট ভাইয়ের অভিমানে মোড়ানো কথাটার জন্যই আর না করতে পারেনি সে।
“তুমি না গেলে আমার দিনটাই মাটি হয়ে যাবে ভাই!”
—সেই কণ্ঠের আবদার ফেলতে পারেনি অনুভব। যায় হোক না কেন,সে বুঝতে পারছে—আজ তার আসাটা ছিল একটা ভুল। একেবারে চরম ভুল।
——-
রিমি নিজেকে থামাতে চাইল। বারবার আপনমনেই আওড়ালো,এই কান্না অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন।
কিন্তু কান্না থামে না, বরং আরও বেশি তীব্র হয়ে ফিরে আসে যেন। হঠাৎই মনে হলো—এই কান্নার পেছনে কি অন্য কোনো কারণ লুকিয়ে আছে? নাহয়, এরূপ পরিস্থিতিতে তো সে অভ্যস্ত ছিল! তবু কেন আজ ব্যতিক্রম হচ্ছে!
পাত্র তো এসেছিল তাকে দেখতে… এখন সে হয়তো ছোটবোনের সঙ্গে বিয়ের কথা বলছে। তার জন্যই কি কান্নার বেগ বাড়ছে! এই ভেবেই তার বুকটা ধক করে উঠল।
তাহলে কি সে… সে তার ছোটবোনকে হিংসা করছে?
ভাবনাটা মাথায় আসতেই রিমি চমকে উঠল। আপন বোন! যার জন্য সবসময় নিজের চেয়ে ভালো কিছু চেয়েছে–তার প্রতি এমন ভাবনা!
নিজেকেই ধিক্কার দিল সে।
“ছি রিমি! এ কী ভাবছিস তুই!”
নিজেকে বুঝ দিতে চাইল—ছোটবোন তো রূপে, গুণে, আচরণে তার চেয়ে অনেক এগিয়ে। ওর এমন একটা পরিবারে বিয়ে হওয়া মানেই তো স্বপ্নপূরণ। এই তো, রিমি সবসময় চেয়েছিল ছোটবোনটা যেন ভালো ঘরে যায়, সুখী হয়।
বাবার আনা শখের প্রস্তাবটা তাকে দিয়ে পূরণ নাহলেও তার রূপবতী ছোট আদরের বোনকে দিয়ে পূরণ হচ্ছে, এই তো সুখ! নিজের এই দ্বন্দ্বময় ভাবনার মাঝে এই ভেবে একটুখানি প্রশান্তির আশ্রয় খুঁজে পায় রিমি।
ড্রয়ইং রুম থেকে আরো একবার হাসির আওয়াজ এলো।হয়ত-বা মা ছোট বোনের সাথে বিয়ের কথা পাকা-পোক্ত করে ফেলেছে। আর করবে না বা কেন! এতো ভালো একটা পরিবার, ছেলে- মেয়ের বিয়ের জন্য সাধারণত সবাই এমনই তো পরিবার খুঁজে। তবু খারাপ লাগলো এই ভেবে যে,রিমি ওখান থেকে চলে আসাতে কারো কিছু যাই আসেনি। তবু সে এতসবের মাঝে ছোটবোনের ভালো ঘরে বিয়ের কথা হওয়াতে প্রশান্তি খুঁজে নিল।
——
অনুভব সিগারেট শেষ করে শেষ অংশটা পা দিয়ে পিষে ফেলল। এই জিনিসটা সে নিজের উপর ক্ষোভ হলে খায়।হাতেগুনা একদম। যদিও পরিবারের কেউ তার এই বিষয়টা জানে না।
অনুভব আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো। ছাদটা ছোট হলেও পরিপাটি। বাঁদিকে টিনের কিনারে সারি দিয়ে রাখা কয়েকটা ফুলের টব—মালতী, জবা, আর এক কোণে একটা অচেনা গাছ। কার হাতের ছোঁয়ায় এত যত্নে গড়া এই সবুজের সারি?
অনুভবের চোখে ভেসে উঠলো এক অদেখা মায়া-মাখা মুখ। যে করেছে সে নিশ্চই খুব যত্ন করে গাছগুলোকে। যে গাছকে যত্ন করে, সে নিশ্চই ভালো মনের। অনুভবের ইচ্ছে আছে, তার খোলামেলা বারান্দায় একদিন কেউ একজন এসে এভাবে গাছ দিয়ে সতেজ বাতাস করে দিবে। পরমুহূর্তে নিজের ভাবনার অদ্ভুততায় আবারও মুচকি হেসে নিল অনুভব। কাজ না থাকলে যা হয়! এখন কোনো কাজ নেই তাই গাছগুলোর পেছনের মালকিনের কথাও তার মাথায় আসছে।
সিগারেটের প্যাকেটটা পকেটে গুঁজে ঘুরে দাঁড়ালো অনুভব। নেমে যাবার জন্য পা বাড়িয়েই ছিল, ঠিক তখনই এক টানা হেঁচকির শব্দ তার কানে এলো। অস্পষ্ট, ভাঙা ভাঙা কান্নার মতো—যেমনটা হয় অনেকক্ষণ ধরে কেউ নিজেকে চেপে ধরে রাখার পর হঠাৎ ভেঙে পড়লে।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখে পড়লো—ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। এলোমেলো শাড়ির আঁচল বাতাসে ওড়ছে, মুখটা আড়ালে, কিন্তু কাঁধের কাঁপনে কান্না লুকানো যাচ্ছে না।
অনুভব থমকে গেল। ছাদে ওঠার সময় তো এমন কাউকে দেখেনি সে। হয়ত তখন মেয়েটি দেয়ালের পাশে বসে ছিল, অথবা সেও তার মতোই ভিড় এড়িয়ে এক কোণে গা ঢাকা দিয়েছিল।
এক পা এগিয়ে আবার থেমে গেল অনুভব। আপনমনেই বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“কেন যাব আমি? ওর কান্না থামানোর দায়িত্ব তো আমার না। যার মন চাই কাঁদুক, মরুক—আমার কী!”
অন্য কেউ হলে হয়তো দৌড়ে গিয়ে বলত,
“কাঁদছেন কেন আপনি?”
কিংবা পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ একটা সান্ত্বনার হাত রাখত কাঁধে। কিন্তু অনুভব দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠল,
“ওর কান্নার পেছনের কারণ জানার দরকার তো আমার নেই।”
তার এই নিষ্ঠুর প্রশ্নটাই হয়ত তার পরিবারকে বারবার বলে উঠতে বাধ্য করে—
“তুই একটা পাথর।”
সে জানে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা এই কাঁদতে থাকা মেয়েটির কান্না আজ হয়ত কাউকে স্পর্শ করছে না। নয়তো নিচ থেকে এমন হাসির আওয়াজ ভেসে আসতো না। পাষান হৃদয়ের অনুভব চলে আসতে নিলেও থেমে গেল। একটা ক্ষীণ অনুভব তাকে ছুঁয়ে গেল—সে পিছু ফিরে আরেকবার তাকালো। তবুও সে এগিয়ে গেল না। কোনো প্রশ্ন না করে, কোনো উত্তর না খুঁজে অনুভব সামনে ফিরে সিঁড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।
পায়ের ধাপে ধাপে তার ভেতরে যেন একটা অচেনা অপরাধবোধ জমে উঠলো, তবুও মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ানোর মতো মন গললো না তার। এভাবে ছাদে কেউ অসহায়ের মতো কাঁদল, আর অনুভব শুধু দূর থেকে দেখে ফিরে গেল—নিজের মতো করেই, নির্লিপ্ত, নিঃসঙ্গ, আর একফোঁটা হালকা হাওয়া হয়ে।