Tuesday, August 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 10



সবিতা পর্ব-০৮

0

সবিতা
পর্ব: ০৮
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা তার লেখালেখির জগতে নিজের অবস্থান শক্ত করে রাখলো। বইটি সফলতার সাথে বিক্রি হতে থাকল, এবং তার গল্প অন্যদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠলো। তবে তার জন্য সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল নিজের অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং আত্মবিশ্বাস। সে জানত, তার জীবনের পথে যে পথচলা শুরু হয়েছিল, তা শুধু তার জন্য নয়, আরও অনেকের জন্য একটি নতুন আলো হতে পারে।সবিতা তার লেখার মাধ্যমে সেই আলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।

একদিন সন্ধ্যায়, সাইফ আবার সবিতার কাছে এসে দাঁড়াল। অনেক দিন পর তাদের মধ্যে আবার দেখা হয়েছিল, কিন্তু এবারের পরিবেশ অনেকটা ভিন্ন ছিল। সাইফ, যে আন্নিকে একসময় মনে করত নিজের জীবনের অংশ, আজ তাকে একেবারেই অপরিচিত মনে হচ্ছিল। সাইফ বলল—

– “আন্নি, আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি,তোমার কাছে এজন্য বার বার ক্ষমাও চেয়েছি।কিন্তু তুমি ক্ষমা করে দাও নি। আমি কি তোমার কাছ থেকে একেবারে হারিয়ে গেছি?”তোমার মনে আমার কি সত্যি কোনো জায়গা নেই?
আজকেই শেষ, আর কখনো বলবো না আমার ভুল হয়ে গেছে আন্নি,আমাকে ক্ষমা করে দাও,আর একটিবার তোমার জীবনের সাথে জড়িয়ে নাও।

সবিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে, গভীরভাবে সাইফের দিকে তাকাল। তার মধ্যে আর কোনো ক্ষোভ বা কষ্ট ছিল না। তার কণ্ঠে শান্তি ছিল, তবে এক অদ্ভুত শক্তি, যা সে নিজের থেকে পেয়েছিল—

– “সাইফ, আমি এখন সত্যি বলতে ভয় পাই না।আমি আগেও বলেছি আর বার বার বলছি তুমি আমার জীবনের অতীত,কিন্তু অতীত আর বর্তমান এক নয়। আমি আমার জীবনের নতুন পথ তৈরি করেছি। তুমি যদি ক্ষমা চাও, হ্যাঁ দিলাম ক্ষমা করে,কিন্তু তুমি তো এতে আন্নিকে আর ফিরে পাবে না।আন্নি হারিয়ে গেছে সাইফ,তুমি নিজের হাতে আন্নিকে মেরে ফেলেছো,এখন যাকে আন্নি ভেবে বার বার কাছে ডাকছো সে হলো সবিতা।
আর সবিতার জীবনে সাইফের কোনো জায়গা নেই।সবিতা একা নিজের পথ চালিয়ে যেতে পারে এখন, আর আমি আশা করি তুমিও তোমার পথ খুঁজে পাবে।”

সাইফ আর রিকুয়েষ্ট করে না সবিতাকে,সে অনেকক্ষণ তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধু একটা হাসি দিলো,আর বললো,

নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা সবিতা।
তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।তোমার থাকলে ক্ষমা করে দিও।তুমি থাকতে তোমাকে মূল্যায়ন করি নি ঠিকই এখন হারিয়ে ঠিক বুঝতে পারছি তুমি কি ছিলে আমার জীবনে?

সাইফ চলে গেলো।
সে আজ ব্যর্থ।
আর সবিতা তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল।এতটা কঠোর সবিতা।

সবিতা এবার তার সৃষ্টিকর্তাকে বললো আমি কয়েক মিনিটের জন্য আন্নি হতে চাই,আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে চাই,আমি অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে সাইফ,কিন্তু তোমার দুর্ব্যবহার, তোমার অবহেলা দিন দিন আমাকে এতো টাই কঠিন বানিয়েছে যে আজ আমি পুরোপুরি সবিতা তে পরিবর্তিত হয়েছি।সবিতা থেকে আর কখনোই আমি আন্নি রুপে ফিরে যেতে চাই না।

সবিতা তার নতুন বই লিখতে শুরু করল, যা ছিল তার জীবনের আরেকটি মাইলফলক। বইটির নাম ছিল ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’, যেখানে সে নিজের অভ্যন্তরীণ মুক্তি, সম্পর্কের দুর্বলতা এবং আত্মবিশ্বাসের পুণঃউৎপাদন নিয়ে লিখলো। এটি ছিল তার অভ্যন্তরীণ যাত্রার একটি প্রতিচ্ছবি, যেখানে সে প্রতিটি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান নির্মাণ করেছিল।

বইটি যখন প্রকাশিত হলো, তখন সেটি খুব দ্রুত সাড়া ফেলল। পাঠকরা বইটির গল্প এবং তাতে থাকা সাহসিকতা ও শক্তি সম্পর্কে অনেক ভালো মতামত দিল। সবিতা বুঝতে পারছিল, তার লেখালেখির মাধ্যমে সে শুধু নিজের কষ্টের কথা বলছে না, বরং অনেক মানুষের আড়ালে থাকা কষ্টের গল্পকেও ফুটিয়ে তুলছে।

___________

এক সন্ধ্যায়, তাওহীদ সবিতার কাছে এসে বলল—

– “সবিতা,তোমার লেখা শুধু মানুষের মন স্পর্শ করে না, তা তাদের অন্তরের গহীনে পৌঁছে যায়। তুমি যদি এই লেখার মাধ্যমে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারো, তাহলে অনেক মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবে। তোমার বইয়ের ক্লাস শুরু করতে পারো।”

সবিতা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তার মনে হচ্ছিল, এটা যেন তার জীবনের পরবর্তী ধাপ হতে পারে। কিন্তু সে জানত, এটি সহজ হবে না। লেখক হিসেবে সে নিজের কিছু জ্ঞান শেয়ার করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা ঠিক কিভাবে করবে, তা বুঝতে পারছিল না।

– “তাওহীদ, তুমি ঠিক বলেছ, কিন্তু আমি জানি না, কীভাবে শুরু করতে হবে। আমি তো নিজেই শিখছি।”

তাওহীদ হাসি দিয়ে বলল—

– “তুমি তো জানো, যে কোনও যাত্রা প্রথম পদক্ষেপ দিয়ে শুরু হয়। তুমি যা শিখেছ, তা অন্যদের শিখিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তুমি আরও বেশি কিছু অর্জন করতে পারবে।”

এখন সবিতার মনের মধ্যে একটা নতুন স্বপ্ন জেগে উঠেছিল। সে ভাবছিল, কি দারুণ হবে যদি সে তার লেখা বা অভিজ্ঞতা শেয়ার করে অন্যদের সঙ্গে।

______

সবিতা এবার তার পরবর্তী বইটি লেখার পরিকল্পনা করল। এটি ছিল তার জীবনের সংগ্রাম, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প, এবং সেখান থেকে তার পরবর্তী পথের শুরু। বইটির নাম রাখল ‘অজানা পথে যাত্রা’, যেখানে সবিতা তার অভ্যন্তরীণ যাত্রা, আত্মবিশ্বাসের প্রাপ্তি এবং জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার গল্প বলেছিল।

এই বইটি অন্য অনেক মানুষের মতামত এবং তাদের জীবনকেও প্রতিফলিত করেছিল।সবিতা বুঝতে পারছিল, লেখালেখির মাধ্যমে সে শুধু নিজের কষ্টের গল্প শেয়ার করছে না, বরং অন্যদেরও জীবনকে আলোকিত করছে।

________

সবিতা জানত, তার জীবনে এখনও অনেক কিছু বাকি রয়েছে। তাকে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে, নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। তবে সে জানত, তার ভেতরের শক্তি আর বিশ্বাস তাকে কখনোই পথভ্রষ্ট করবে না। সে যে পথই বেছে নিক, সেটি তার জন্য নতুন অভ্যন্তরীণ শান্তির এবং স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাবে।

সবিতার বইয়ের ক্লাসের প্রথম সেশন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।সবিতা তার লেখালেখি আর জীবনের গল্পগুলো শেয়ার করার জন্য প্রস্তুত ছিল। সেমিনারের দিন, সে বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তটি তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু।

সবিতা সেমিনারের রুমে প্রবেশ করল, তার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল। আগে যে সবিতা ভয়ে নিজের লেখা শেয়ার করতে পারেনি, আজ সে সেই লেখাগুলো শত শত মানুষকে উপস্থাপন করতে চলেছে। তাওহীদ তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে সাহস দিতে।

যতক্ষণ ক্লাস চলছিল, সবিতা বুঝতে পারছিল, তার লেখার মাধ্যমে সে শুধু মানুষদের গল্প শোনাচ্ছে না, বরং তাদের অভ্যন্তরীণ যাত্রার একটা অংশ তৈরি করছে। অনেকেই তার গল্প শুনে চোখে জল নিয়ে বলেছিল—

– “আপনার লেখা আমাদের জীবনের বাস্তব চিত্র, আমরা মনে করেছি আমাদের একান্ত বেদনা শুধু আমাদেরই, কিন্তু আপনি দেখালেন, আমরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত।”

সবিতার চোখে জলের ঝরনা ছিল, কিন্তু সে জানত—এই আবেগগুলো শুধু তার নয়, সবার ছিল। এই বই, এই ক্লাস, যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল।

তাওহীদও তার জীবনের পথে সবিতার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে অনুভব করছিল, সবিতার প্রতি তার শ্রদ্ধা এখন শুধু বন্ধুত্বের দিকে অতিক্রম করেছে না, একটা গভীর সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাওহীদ একদিন সবিতার সঙ্গে বসে বলল—

– সবিতা, আমি তোমাকে দেখে শিখেছি, তুমি শুধু লেখালেখি করে না, তুমি অন্যদের মনোযোগও পরিবর্তন করতে পারো। এই বইয়ের ক্লাস তোমার এক নতুন দিগন্তকে উন্মোচন করেছে। আমি চাই তুমি আরও অনেক মানুষের জীবনে এই পরিবর্তন নিয়ে আসো।”

সবিতা তার হাসি দিয়ে বলল—

– “তাওহীদ, তোমার সহযোগিতা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না। তোমার পাশে থাকার কারণে আমি অনেক কিছু শিখেছি।”

তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হচ্ছিল। তারা একে অপরের মধ্যে অন্য ধরনের শক্তি দেখতে পাচ্ছিল, যেখানে শুধু ভালোবাসা নয়, সম্মান আর শ্রদ্ধাও ছিল।

বইয়ের ক্লাসের সফলতা দেখে, সবিতা আরও অনেক নতুন উদ্যোগ নিতে শুরু করল। সে শিখতে চেয়েছিল, সমাজে মানুষের দুর্বলতাগুলো কীভাবে উঠে আসে এবং কীভাবে তাকে শক্তি হিসেবে পরিণত করা যায়। সে নিজের ক্লাসে বিভিন্ন ধরনের সেমিনার আয়োজন করেছিল যেখানে মানুষ নিজেদের গল্প শেয়ার করতে পারতো।

এই ক্লাসগুলো ছিল শুধু তার জীবনের অভিজ্ঞতা বা লেখার পাঠ নয়, বরং এক ধরনের সেশনের মতো যেখানে মানুষ তাদের নিজের ভেতরের শক্তি খুঁজে পেতে পারতো। সবিতা বুঝতে পারছিল, একসময় তার লেখালেখি শুধু কথামালার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি মানুষের বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাবে।

__

সবিতা যখন তার বইয়ের প্রথম প্রকাশনার আয়োজন করল, তখন তার মনে এক আশ্চর্য রকমের অনুভূতি ছিল। বইটি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে তার ব্যক্তিগত জীবনের লড়াইগুলোকে একজন অনুপ্রেরণার রূপে পরিণত করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে যখন সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের লেখার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, তখন তার কণ্ঠে এক ধরনের দৃঢ়তা এবং আবেগের ছোঁয়া ছিল।

– “আমি লিখেছি শুধু আমার গল্প নয়, বরং সেইসব মানুষের গল্প যারা নিঃশব্দে কষ্টে ভুগছে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের জীবনে সবসময় অন্ধকার আসে, কিন্তু সেই অন্ধকারের মাঝে যদি একটু আলো থাকে, তাহলে আমরা জীবনকে অন্যভাবে দেখতে পারি।”

এতটা সময়ে, সবিতা বুঝতে পারছিল, তার বই আর সেমিনার শুধুমাত্র তার নিজের জন্য ছিল না, বরং এটা আরও অনেক মানুষের জন্য ছিল যারা নিজেদের কষ্টের সাথে একাকী ছিল।

_____

সবিতার নতুন লক্ষ্য,
সবিতা বুঝেছিল, তার জীবন শুধু তার নিজের জন্য নয়, আরও অনেক মানুষের জন্য। তাকে তার লেখার মাধ্যমে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে হবে। সে তার লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছিল—এখন সে শুধু তার অভ্যন্তরীণ শক্তির বিকাশে মনোযোগী হবে না, বরং সে নিজের চিন্তা-ভাবনা দিয়ে সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।

একদিন, সবিতা তার শখের ঘরে বসে একটি নতুন বইয়ের কাজ শুরু করল, যার নাম ছিল—“জীবনের নতুন দিগন্ত”। এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় কাজ, যেখানে সে মানুষের জীবনের ব্যথা, আনন্দ, লড়াই ও জয়কে একত্রিত করেছিল।

সবিতার জীবন এখন এক নতুন দিগন্তে পৌঁছেছে। সেমিনারের সফলতা এবং তার নতুন বই “জীবনের নতুন দিগন্ত”-এর প্রস্তুতির মাঝে সে যেন নিজের ভিতরের শক্তি, অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং আত্মবিশ্বাসের নতুন এক স্তরে পৌঁছে গেছে। এখন তার কাছে স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবতার দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে।

__________

সাইফ, যাকে সবিতা একসময় কেবল এক কাপুরুষ হিসেবে চিনেছিল, এখন সে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে দেখতে শিখেছে। সাইফ তার অতীত ভুল বুঝতে পেরে সবিতার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই আলাপ করতে আসে।

সাইফের মনোভাবের পরিবর্তন সবিতার জন্য এক ধরনের আশার আলো হয়ে উঠল।

সাইফ, সবিতার প্রতি আগের চেয়ে অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়েছে। একদিন সাইফ সবিতার কাছে গিয়ে বলল—

– “আমি জানি, আমরা একসাথে থাকতে পারি না,আমার ইচ্ছা থাকলেও তুমি আর নিবে না আমাকে,তবে আমি চাই, তোমার পাশে ছায়ার মতো থাকতে। তোমার পথে যা কিছু বাধা আসুক না কেন, এখন থেকে আমি সামলাবো।।”

সবিতা ধীরে ধীরে মাথা নত করে বলল—

– “সাইফ, তুমি যা বলেছ, তার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমাকে শুধু নিজের পথে হাঁটতে হবে।”তোমার সাহায্য লাগবে না।

সাইফ তার মুখে এক কঠিন হাসি দিয়ে বলল—

– “আমি জানি, তুমি নিজের পথ খুঁজে পেয়েছ। আমার সাহায্যের তোমার কোনো দরকার নাই।তবুও আমি জোর করেই থাকবো।
কারণ তুমি আমার সেই আলোর রশ্মি, যে কিনা জীবনের অন্ধকারকে উজ্জ্বল করতে পারে।”
তুমি ছাড়া আমার জীবনের অঅন্ধকার কখনোই দূর হবে না।

চলবে_______

সবিতা পর্ব-০৭

0

সবিতা
পর্ব: ০৭
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতার বাবা-মা তাকে কখনোই পুরোপুরি বোঝেনি। তাদের কাছে সবিতা ছিল সেই মেয়ে, যে পরিবারের জন্য ভালো কিছু করে নি,পরিবারের মানসম্মান নষ্ট করেছে সেজন্য সে বাবা মার ভালোবাসা কখনোই পায়নি।

কিন্তু সবিতা যে এতটা কষ্ট পেয়েছে, তা তারা কখনো বুঝতে পারেনি। একদিন সবিতা তাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে গিয়ে বলে—

– “আমার জীবনের এই সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিয়েছি। তবে আমি আপনাদের কাছে যা চেয়েছিলাম, তা কখনোই পাই নাই। আমি জানি, আপনারা আমাকে বুঝতে পারেন নি, তবে আমি জানি, নিজের পথ বেছে নিলে, একদিন আমি সফল হব।”হ্যাঁ আমি সফল হয়েছি।

সবিতার মা এক লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লেন, তারপর বললেন—

– “তুমি যদি এখনো এই পথে থাকতে চাও, তবে তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবো।”পারলে আমাদের ক্ষমা করে দিও।আমরা তোমাকে সত্যি বুঝতে পারি নি।

বাবাও কিছুটা মনোযোগ দিয়ে বললেন—

– “তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো, তা তোমার জীবনের জন্য সঠিক কিনা, তা শুধুমাত্র তুমি বুঝবে।”তবে আমাদের ভুল একটাই আমরা সাইফের উপর করা রাগের শাস্তি তোমাকে দিয়েছিলাম,আমাদের উচিত ছিলো সাইফ কে উচিত শাস্তি দিয়ে তোমাকে নিজের ঘরে ফিরে আনা।

সবিতা বাবা মার কথা শুনে দীর্ঘ নি:শ্বাস ছাড়লো।তবে তার বাবা মার কথা শুনে মনের মধ্যে ক্ষোভের পরিবর্তে এক নতুন শক্তি তৈরি হয়েছিল। সে জানত, তার মা-বাবা তাকে ভালোবাসে, কিন্তু তাদের ভালবাসা ও সমর্থন তার দু:সময়ের জীবনের সময় ছিল না,এটাই তার অনেক বড় আফসোস।

_____________

সবিতার নতুন জীবন ঠিক যেমনটি সে চেয়েছিল, তেমন সহজ ছিল না। শুরুর দিকে সমস্ত কিছুই স্বপ্নের মতো মনে হলেও, বাস্তবতার কঠিন বাস্তবতা সবিতার পথে আঘাত হানে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে বাধা ছিল। তবে সে থামল না, কারণ সে জানত, তার সামনে কেবল নিজের এক নতুন লক্ষ্য। কিন্তু, সামনে যেসব প্রলোভন ছিল, তা তাকে বাধ্য করেছিল এক নতুন দ্বিধার মধ্যে পড়তে।

মোহাইমিন তার পায়ের নিচে জমে থাকা মাটি আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সবিতা তার কাছ থেকে দূরে চলে আসার পর সে অনেক চেষ্টা করেছে তাকে ফিরিয়ে আনতে, তবে একবারও সবিতা তার কাছে ফিরে যায়নি। তবে, মোহাইমিনের মনের মধ্যে এক ভয়াবহ পরিকল্পনা গড়ে উঠছিল।

একদিন, মোহাইমিন সবিতার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং বলে—

– “তুমি যদি আমার সঙ্গে কাজ করো, তাহলে তুমি যা চাও, তা পেতে পারবে। আমার সাহায্য ছাড়া তুমি কিছুই করতে পারবে না।”

সবিতা হাসল, এই হাসি ছিল বিজয়ের হাসি।

– “তুমি যদি ভাবো, আমার জন্য তুমি এতটা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তুমি ভুল ভাবছো। আমি নিজের পথই চয়ন করেছি। আমি আর কারো হাতের পুতুল হতে চাই না।”

মোহাইমিন চলে যায়, কিন্তু সে জানে, সবিতা তাকে সব সময় অতিক্রম করে যাবে। মোহাইমিনের মতো মানুষ হয়তো তার পথের অংশ ছিল, তবে সবিতার জীবনে সেই ছায়ার স্থান নেই।

এই সমস্ত ঘটনার পর, সবিতার জীবনে এক নতুন সূচনা হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রস্তাব মেনে নিয়ে, সে এক নতুন জীবন শুরু করে। পুরনো সম্পর্ক আর পারিবারিক সমস্যা তাকে আর থামাতে পারে না। সে জানে, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, কিন্তু সে প্রতিটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

যারা সবিতাকে তুচ্ছ বুঝেছিল, তাদের জন্য সে এক প্রমাণ হয়ে উঠবে। নারী স্বাধীনতা, অধিকার—এগুলোই তার মূল লক্ষ্য। সবিতা এই মুহূর্তে বুঝতে পারে, পুরনো জীবন ছেড়ে নতুন পথের দিকে এগিয়ে যাওয়াই তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।

একদিন সবিতা নিজেই তার জীবনের অনেক গুলো গল্প লিখবে। সে জানবে, তার সংগ্রাম কেবল তার জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য ছিল। সে ছিল একটি সাহসী পথিক, যে নিজের জীবনের গল্পে জয়লাভ করেছে।

_________

সবিতা এখন পুরো দমে লেখালেখি শুরু করেছে, তবে তার প্রতিটি লেখায় তার জীবন এবং অভিজ্ঞতার গভীরতা ফুটে ওঠে। তাকে একে একে প্রতিটি কথা, অনুভূতি এবং শোককে অক্ষরে বন্দী করতে হচ্ছিল, কিন্তু সে জানত—এটি তার মুক্তির পথ হতে পারে। সেই রাতে, যখন সে তার প্রথম ছোট গল্পটি শেষ করেছিল, সেজন্য সে নিজের মনে এক অদৃশ্য প্রশান্তি অনুভব করেছিল।

একদিন সবিতা অফিসে কাজ করতে বসে ছিল, তখন তার সহকর্মী তাওহীদ এসে তাকে কিছু কাজে সাহায্য করার প্রস্তাব দেয়। তাওহীদ একজন সদ্য চাকরি করা ছেলে, তার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা সবিতার মনকে একটু উজ্জীবিত করেছিল। তাওহীদ তার সঙ্গে কথা বলার সময় কখনও বেশি চাপ দেয়নি, বরং আন্তরিকতা দেখিয়েছে।সবিতার মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস জন্মাল, যে মানুষ সত্যিই ভালো হতে পারে, যদিও সে এখন পর্যন্ত এরকম কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না।

তাওহীদের সাথে কিছু সময় কাটানোর পর সবিতা বুঝতে পারে, এই মানুষটিই সম্ভবত তার জন্য নতুন শক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে তাওহীদকে তার জীবনের কিছু ঘটনা শেয়ার করতে শুরু করে, আর তাওহীদ একান্তভাবে তার কথা শুনে যায়। এই বন্ধুত্বের মাঝে সবিতা এমন এক নিরাপত্তা অনুভব করছিল, যা তাকে আবার বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল যে, ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব এখনও সম্ভব।

তাওহীদ মাঝে মাঝে সবিতাকে উৎসাহিত করত।

– “সবিতা তুমি কি জানো, তোমার মধ্যে আর তোমার লেখার মধ্যে একটা বিরাট শক্তি আছে।যা আমি দেখছি, তা একদিন পৃথিবীকে আলো দেখাবে।”

একদিন সবিতার শান্ত জীবন আবার এক দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করল। সাইফ, তার পুরনো স্বামী, একদিন তাকে ফোন করে বলল—

– “সবিতা, আমি জানি আমি ভুল করেছি। তুমি কি একবার আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবে? আমি এখন অনেক কিছু শিখেছি।”প্লিজ একবার একটু আসো।আমি তোমাকে না দেখতে পেয়ে দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি।”

সবিতা বুঝতে পারলো, সাইফ তার পুরনো চরিত্রে ফিরে আসতে চাইছে, সাইফ বর্তমানে নিজের অনুশোচনায় ভুগছে, কিন্তু অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছে সাইফ।এখন সে কিছুতেই সাইফের জীবনে ফিরতে পারবে না।

সে সাইফের কলের উত্তর দিল না, কিন্তু তার মন প্রচন্ড ভাবে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে মনের মধ্যে ভাবল—

– আমার সামনে এসব কিসের পরীক্ষা চলছে সৃষ্টিকর্তা?সাইফের অনুনয় বিনয় আর সহ্য করতে পারছি না আমি। তাকে যে এক সময় আমি প্রচন্ড ভালোবেসে ছিলাম।
তবে আমি আর কখনোই ফিরবো না তার কাছে।আমি সাইফের কাছে ফিরলে নিজের সাথে প্রতারণা করে ফেলবো।তখন এই আমার আমি আমাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না।যখন আমার পাশে কেউ ছিলো না তখন এই আমার আমি টাই ছিলো শুধু।সেজন্য আমার তার কথা শুনতে হবে এখন।

সবিতার কাছে এখন নিজেকে মেলে ধরার সময় এসেছে, আর কোনো অতীতের জটিলতা নিয়ে সে ভাবতে চায় না।সাইফ তার অতীত।

সবিতা তার লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত।তাওহীদ তাকে অনেক সাহায্য করছে।সবিতা তার লেখা বিভিন্ন প্রকাশনার জন্য পাঠাচ্ছিল, তবে প্রতিটি গল্পের পেছনে তার জীবন ছিল। একদিন সবিতা একটি বড় প্রকাশনীর কাছে তার প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস পাঠাল।

কিছুদিন পরই তারা তাকে জানায়, তারা তার বইটি প্রকাশ করতে চায়। সবিতার মনে তীব্র উত্তেজনা ছিল, কিন্তু সে জানত—এটা তার কঠোর পরিশ্রমের ফল।

এখন তার জীবনের প্রথম বড় প্রকাশনা হয়ে গেল, যা তার পুরনো দুঃখের চেয়েও বড় হয়ে উঠল। তার লেখালেখি যে শুধু তার নিজের জন্য ছিল না, বরং অন্যদের জন্যও ছিল। সবিতা জানত, তার এই প্রথম সফলতা একদিন অনেক দূর যাবে।

তাওহীদ তাকে নিয়ে ভীষণ আনন্দিত ছিল, এবং সবিতা তার কাছ থেকে আরও অনেক শিক্ষা পেয়েছিল। তাদের বন্ধুত্ব আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, এবং সবিতা তার জীবনে তৌহিদের মতো একজন বিশ্বস্ত বন্ধু পেয়ে অনেক খুশি ছিলো।

রাইয়া, সবিতার একমাত্র বন্ধু, তার নতুন বইটি পড়ে অনেক খুশি হয়েছিল। সে বলেছিল—

– “তুমি শুধু তোমার জীবনের গল্পই লিখছো না, সবিতা, তুমি সবার জন্য একটা পাঠ শিখাচ্ছো।”

সবিতা তার বইয়ের প্রথম প্রচ্ছদে রাইয়ার নাম লিখেছিল, কারণ সে জানত, রাইয়া ছাড়া তার এই পথ চলা কখনোই সম্ভব হত না। সবিতা জানত, যদি তার জীবনে কখনো কোনো সত্যিকারের মানুষ থাকে, তবে তা হলো রাইয়া।

রাইয়া বলল—

– “সবিতা, তুমি যেভাবে আছো, সেভাবে সবাইকে দেখাও। তুমি যদি নিজের জন্য কিছু করতে পারো, তবে পৃথিবীটাও বদলাতে পারবে।”

এখন সবিতা জীবনের নতুন সুরে চলতে শুরু করছে। তার পৃথিবী বদলানোর প্রস্তুতি চলছে। তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তার সামনে শুধু এক নতুন দিন অপেক্ষা করছে।

……..

সবিতা তার জীবনের পথে এক নতুন সূচনা করেছে, তবে পুরনো অধ্যায় তাকে তাড়া করেই যাচ্ছিল। তার জীবন এখন অনেক বেশি স্থিতিশীল, কিন্তু মাঝে মাঝে পুরনো স্মৃতি, পুরনো যন্ত্রণাগুলি ফিরে আসত। সেগুলিকে উপেক্ষা করেই সে নিজের পথে চলতে শুরু করেছিল। তাওহীদ তার লেখালেখির ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে, কিন্তু সবিতার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল—নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা, নতুন করে দাঁড়িয়ে থাকা।

একদিন সবিতা আবার সাইফের ফোন পেল, যে ফোনটি তার জন্য একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ সবিতা সেদিন সাইফ কে মুখের উপরই না করে দিয়েছে যেনো সে আর তাকে কল না করে।

“তুমি কেন এভাবে নিজের জীবন টা নষ্ট করছো? পরিবারে ফিরে যাও। আমরা আবার একসাথে সব ঠিক করে নিতে পারি।”কারণ আমরা একে অপরকে অনেক ভালোবাসি।

সবিতার চোখে ক্ষোভ, তবে তার মুখে শান্তি।

“এই তুমি—এখনও বুঝতে পারো না! আমি আর কখনো তোমার কাছে ফিরে যাব না। আমি স্বাধীন, আমার জীবন আর তোমার দাসত্ব নয়।”

– “সবিতা, আমি জানি আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি। কিন্তু আমি এখন অনেক কিছু বুঝেছি। তুমি কি একবার আমাকে আবার সুযোগ দেবে?”প্লিজ সবিতা।তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে এক সময়।

সাইফের কথাগুলি যেন পুরনো যন্ত্রণা আবার ফিরে আনে। সবিতা তার জীবনে সাইফের প্রভাব বুঝে উঠতে পারছিল না।সে বুঝতে পারছিল যে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা তার নিজের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।

সবিতা কিছু সময় চুপ থাকল, তারপর ধীরে ধীরে বলল—

– “সাইফ,আমি যখন তোমার প্রয়োজন ছিলাম না, তখন আমি নিজেকে গড়েছি। তুমি যদি ভাবো আমি তোমার কাছে ফিরব, তাহলে তুমি ভুল ভাবছো। আমার জীবন এখন আমি নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছি। আমি আর তোমার অতীতের অংশ হতে চাই না।”প্লিজ আমাকে মুক্তি দাও।আর আমাকে ভালোবাসার অজুহাত দেখিয়ে ব্লাকমেল করো না।আমি আগেও বলেছি আর এখনো বলছি আমি আর তোমার জীবনে কখনোই ফিরবো না।কারণ তোমার সেই ভালোবাসার কাঙাল আন্নি মারা গেছে অনেক আগেই।

এ কথাগুলি সাইফকে চমকে দিয়ে গেল,সাইফের অজান্তেই দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো, অন্যদিকে সবিতাও কাঁদছে,যত কিছুই হোক এক সময় তো তাকে সে প্রচন্ড ভাবে ভালোবেসে ছিলো।

তবে সবিতা ভালো করেই জানে—এই সিদ্ধান্তটি তার জীবন ও স্বকীয়তার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।আজ এসব না বললে সাইফ বার বার তাকে বিরক্ত করতো।
সবিতা সাইফের প্রতি ভালোবাসার জন্যই তাকে আইনি ভাবে শাস্তি দেয় নি কোনো,তবে সে সাইফের জীবন থেকে এখন অনেক দূরে চলে গেছে।

তাওহীদ বন্ধু হিসেবেই সবিতার পাশে থাকলো। তার লেখালেখির সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও, তাওহীদ কখনোই তাকে ব্যক্তিগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দেয়নি। সবিতা বুঝতে পারছিল, তাওহীদ তাকে নিঃস্বার্থভাবে সহ্য করে এবং তার সব বিপদের সময় তাকে শক্তি দেয়। সবিতা তাওহীদের সঙ্গে অনেক রাত কেটেছে গল্প, কবিতা, এবং সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছে। তাওহীদ তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তারা কখনো একে অপরকে বেশি ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেনি।

তাওহীদ একদিন বলেছিল—

– “সবিতা, তোমার লেখার মধ্যে তুমি যেমন তোমার যন্ত্রণাকে প্রকাশ করো, তেমনই তুমি জীবনের আরো অনেক বড় চিত্রও ফুটিয়ে তুলবে। তোমার লেখায় এক শক্তি রয়েছে যা আমি কখনো কোনো লেখকের মধ্যে দেখি নি।”

এটা সবিতার জন্য বড় প্রশংসা ছিল। তার কাছে তাওহীদ শুধু একজন বন্ধু ছিল না, বরং তার জীবনের চলমান সঙ্গী, এক মানুষ যাকে সে কখনো হারাতে চায় না।

একদিন সবিতা তার বন্ধু রাইয়ার সঙ্গে বসে পুরনো স্মৃতি চারণা করছিল। তারা মজা করছিল, হাসছিল এবং একে অপরকে জীবন সম্পর্কে তাদের অনুভূতি জানাচ্ছিল। রাইয়া বলেছিল—

– “তুমি জানো, সবিতা, তুমি আজ যা আছো, তা তোমার নিজের শক্তির ফল। তুমি যদি ভেবো, তোমার জীবনের কোনো মুহূর্তেও কেউ তোমাকে মূল্যায়ন করেনি, তবে সেটা পুরোপুরি ভুল হবে। তোমার ভিতরে যা কিছু আছে, তা তোমার আত্মবিশ্বাস থেকে এসেছে।”

রাইয়ার কথাগুলি সবিতার মনকে আরো গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার পথের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি কষ্ট, শুধুমাত্র তার নিজের তৈরি। রাইয়া তাকে জীবন সম্পর্কে একটি নতুন দৃষ্টি দিয়েছে—যে দৃষ্টি দিয়ে সে দেখতে পায়, কোনো কিছুই সহজে আসে না, কিন্তু যদি তুমি নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, তবে তুমি সবকিছু অর্জন করতে পারো।

একদিন সবিতা তার লেখালেখি সম্পূর্ণ করে একটি নতুন বই প্রস্তুত করল। এই বইটির নাম ছিল “জীবনের শেষ কথা”।

এটি তার জীবনের সমস্ত চ্যালেঞ্জ, তার সংগ্রাম এবং তার আত্মবিশ্বাসের গল্প তুলে ধরেছিল। তার বইটি প্রকাশনা থেকে এক মাস পরই বিক্রি হয়ে যায়, এবং এই প্রথমবার সবিতা অনুভব করেছিল, সে সফল হয়েছে। এটি তার জন্য এক নতুন সূচনা ছিল, একটি নতুন অধ্যায়।

সে জানত, এই পথ তার জন্য কঠিন ছিল, কিন্তু সেই কঠিন পথে গিয়েই সে নিজেকে গড়ে তুলেছিল। এখন তার সামনে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল, যেখানে সে তার জীবনের সবকিছু নতুন করে সাজাতে পারবে।

সবিতার নতুন বইয়ের প্রকাশনা খুব ভালো হয়েছিল। সে জানত, একদিন তার লেখা সারা পৃথিবীজুড়ে পরিচিত হবে। তার জীবনের গল্প ও সংগ্রাম একদিন অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে। এই বিশ্বাস সবিতার হৃদয়ে শক্তি যোগাচ্ছিল।

তাওহীদ এবং রাইয়া তার পাশে ছিল, এবং সবিতা জানত—তার জীবন আর কখনো অন্ধকারে হারাবে না। তার সামনে শুধু একটি উজ্জ্বল, স্বাধীন, সফল জীবন অপেক্ষা করছে।

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৬

0

সবিতা
পর্ব : ০৬
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
মোহাইমিনের প্রস্তাব উপেক্ষা করতে তার আর কোনো ইচ্ছা নেই।
তার মধ্যে এক নতুন শক্তি তৈরি হচ্ছে, এবং তার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট—

“আমি নিজের পথেই চলব।”

মোহাইমিন জানেন, তার যাত্রার শেষ কোথায়—
অন্য কেউ এটা জানে না।
কিন্তু, সবিতা জানে, তার কাজের উদ্দেশ্য একটাই—

“নারীর স্বাধীনতা, সম্মান, আর অধিকার।”

তবে সেই যাত্রায় এক নতুন বিপদ তৈরি হয়।
কিছু অন্ধকারমনা মানুষ সবিতার কাজকে একেবারে বিপজ্জনক মনে করতে শুরু করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবিতার বিরুদ্ধে ঘৃণিত পোস্ট আসতে থাকে,

তার উদ্যোগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অভিযোগ তোলে—
“এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর, এর ফলে পরিবার ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।”

কিন্তু সবিতা জানে, যে কাজ সে করছে, তা সত্যি ও প্রয়োজনীয়—
এটা চলতেই থাকবে।

একদিন সবিতা অফিসে ছিল।
তখন তার ফোনে একটি কল আসে—
এটা সাইফের ফোন।

সবিতা ফোন ধরে নীরবে শুনতে থাকে—

সাইফ বলে—
– “আমি জানি, আমি অনেক কিছুই ভুল করেছি। আমি যা করেছি তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার কাছে নেই। কিন্তু আমি শুধু চাই, তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও, যেন আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারি।”

সবিতা চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

সে জানে, সাইফ তার জীবনে অনেক কিছুই ভুল করেছে।সে সবিতার বিশ্বাস কে একদম চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে,যা আর পূর্বের অবস্থায় ফিরবে না কখনো।

তবে একটা জায়গায় সাইফ একেবারে সঠিক—

সাইফ সবিতার জীবনে আর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না।

সাইফের আকুতি মিনতি আজ আর কোনো কাজে আসবে না সবিতার জীবনে।এজন্য সবিতা চুপ করে থাকে,
কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেয়।

রাইয়া ও সবিতার সম্পর্ক এখন নতুন একটা স্তরে পৌঁছেছে।
রাইয়া শুধু তার সহকর্মী নয়, বরং তার আত্মবিশ্বাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
একদিন রাইয়া সবিতার কাছে এসে বলে—

– “আপা, আপনি জানেন, আপনি ছাড়া আমি কখনো এগোতে পারতাম না। আপনিই তো আমাকে সেই সাহস দিয়েছিলেন।”

সবিতা রাইয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চুপ হয়ে যায়।
তার চোখে এক অনিচ্ছাকৃত অনুভূতি চলে আসে—

“আমিও তো নিজের জন্য কিছু করতে পারিনি। কিন্তু আমরা একে অপরকে শক্তি দিচ্ছি।”

রাইয়া তখন বলেন—
– “আপনি একা নন, আপা। আমরা একসাথে আছি। আপনার সকল স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে।

এদিকে মোহাইমিন আবার সবিতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকে।

সে জানে, সবিতা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
তবে তার ধারণা ছিল, সবিতা হয়তো কিছুটা সময় নেবে, পরে সে তার প্রস্তাবে সম্মত হবে।

কিন্তু সবিতা জানে—
এবার তার পথ আলাদা।

একদিন মোহাইমিন অফিসে এসে বলেন—

– “আপনি জানেন, আমি চাই আপনার কাজ আরেকটি স্তরে উঠুক। আপনার আন্দোলন সমাজের জন্য অনেক প্রয়োজনীয়। আমি আবারও বলছি,

আমি আপনাকে সহযোগিতা করতে চাই।”

সবিতা তখন গভীরভাবে মোহাইমিনের দিকে তাকায়।
তার মনে এক ধরনের সন্দেহ চলে আসে।
“এটা কি শুধুই সহযোগিতা, না কি তার ভেতরে অন্য কিছু?”

তবে সে আর কিছু বলে না, শুধু বলে—

– “আমার কাজের সাথে আপনি আর যুক্ত হবেন না।”

মোহাইমিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, মুখে একটা সঙ্কুচিত হাসি দেয় এবং চলে যায়।

..………….

দিন কয়েক পরে সবিতার কাছে এক অপ্রত্যাশিত সুযোগ আসে।
একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা তাদের কাজে সবিতাকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেয়—
তারা জানায়, তারা চায় সবিতা তাদের ট্রেইনার হিসেবে কাজ করুক, যেখানে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে নারীদের অধিকার নিয়ে বক্তৃতা দেবেন, সেমিনার পরিচালনা করবেন, এবং কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

সবিতার মনে এক নতুন আশা জাগে।
এটা তার কাজকে আরও বিস্তৃত করতে পারবে, আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।
তবে একে অপরের সাথে ঘনীভূত সম্পর্কের ফলে, সবিতা কি এটি গ্রহণ করবে?

সবিতা এখনও সেই আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রস্তাবটি চিন্তা করছে। তার সামনে নতুন সুযোগ, নতুন যাত্রা, কিন্তু সে জানে—এটি সহজ হবে না। সে অনেক কিছু হারিয়েছে, অনেক কিছু শিখেছে, কিন্তু এখন তার সামনে এক নতুন যুদ্ধ আসছে। এই যুদ্ধ শুধু নিজের জন্য নয়, বরং দেশের নারীদের জন্যও।

……….

একদিন সাইফ একাধিক বার ফোন করে সবিতার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। সবিতা জানে, সাইফ বুঝতে পারছে না, তার সাথে সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সাইফের পরিবর্তন আসেনি, সে আবারও সবিতার কাছে ফিরে আসতে চায়, কিন্তু সে জানে, সবিতা আর কখনো তার কাছে ফিরে যাবে না।

এদিকে সবিতা যখন এই ভেবে নিশ্চিন্ত যে, সে সাইফের থেকে মুক্তি পেয়েছে, সাইফ আবার তার জীবনে প্রবাহিত হতে শুরু করে।

একদিন সবিতা অফিসে বসে ছিল, সাইফ তার সামনের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে।

– “আমি জানি, আমি তোমার অনেক কিছু ভেঙে ফেলেছি, কিন্তু আমি শুধু চাচ্ছি তোমার পাশে থাকতে। প্লিজ সবিতা, একবার আমাকে সুযোগ দাও।”

সবিতা এক মুহূর্ত চুপ থাকে। তার চোখে ঝিলমিল করা অশ্রু।

তবে সে জানে—এটা আর হবে না। সে জানে, তার পথের সঙ্গে সাইফের পথ আর কখনো মেলানো যাবে না।

“এবার তুমি আমাকে প্লিজ একে অপরের থেকে দূরে থাকার সুযোগ দাও।”সবিতা শান্তভাবে বলে।

সাইফ একেবারে চুপ থাকে, কিছু বলার সাহস পায় না। সে আজও আবার ধীরে ধীরে চলে যায়।

এতদিন যে তীব্র অসন্তোষ ছিল, যে অস্থিরতা সবিতার মধ্যে ছড়িয়ে ছিল, সেটি কিছুটা হলেও শান্ত হয়। সবিতা সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর অপেক্ষা করবে না। এই সুযোগ তার জন্য তৈরি হয়েছে, এবং সে এটি গ্রহণ করবে। তার জীবনের স্বপ্ন, তার লক্ষ্য, তার কামনা—সবই তার হাতের নাগালে।

রাইয়া তাকে সমর্থন জানায়। রাইয়া জানে,সবিতা যখন কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাকে কেউ থামাতে পারবে না।

– “তুমি সেই সাহসী মেয়ে, যে সবার আগে দাঁড়িয়ে আছে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য। তুমি জানো, আমাদের সকলের পক্ষে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই পথে চলতে চলতে তুমি এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।”

সবিতা তার দিকে তাকায় এবং তার চোখে এক নতুন আশার ঝিলিক দেখা দেয়।

কিন্তু নতুন পথ সহজ হতে যাচ্ছে না।
সবিতার নতুন যাত্রায় তাকে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। একদিকে সাইফের পরিবার আবারও তার বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ তুলতে শুরু করে—তারা সবিতার সম্পর্কে নিন্দা করতে থাকে, তার সামাজিক সম্মানহানি করতে চায়।

এদিকে, যখন সবিতা আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মসূচিতে অংশ নেয়, তখন তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হয়—কেউ কেউ তাকে ‘ঘরবাড়ি ভাঙানোর অপরাধী’ বলেও অভিহিত করে।

কিন্তু সবিতা এসবকে কিছু মনে না করে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। সে জানে, এই পথ সত্যি হলেও কঠিন, তবে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। তার কাছে একমাত্র লক্ষ্য হলো—নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাদের জন্য একটি সমতাভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি করা।

মোহাইমিনও জানে, সবিতা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু সে সবিতাকে আরেকটি সুযোগ দিতে চায়। মোহাইমিন সবিতার সাথে আবার যোগাযোগ শুরু করে, এইবার সে সবিতার পক্ষে কিছু কাজ করতে চায়।

– “তুমি যে কাজ শুরু করেছ, সেটি আমি বিশ্বাস করি। আমি চাই, তুমি আমার মধ্যে কাজ করতে থাকো, এবং আমাদের যৌথ উদ্যোগ দেশের উন্নতি করবে।”

সবিতা মোহাইমিনের দিকে তাকিয়ে, এক মুহূর্ত ভাবনায় ডুবে যায়। সে জানে, এই প্রস্তাব তার জন্য কোনো ভালোর দিকে নিয়ে যাবে না। তবে সে আর কিছু বললে না, শুধু ঘাড় নেড়ে তার সিদ্ধান্ত জানায়—

“ধন্যবাদ, কিন্তু আমি নিজের পথে চলব।”

মোহাইমিন হতাশ হয়ে ফিরে যায়, তবে তার চোখে এক অদ্ভুত লুক থাকে, যেন সে কিছু পরিকল্পনা করছে যা সবিতার ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হতে পারে।

সবিতা আজকে একটা নতুন পৃষ্ঠা লিখছে। তার সামনে পৃথিবী এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। এই নতুন প্রস্তাব, নতুন পথ—তার মধ্যে এক নতুন শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। একদিন, সে জানবে যে, তার এই যুদ্ধ শুধুমাত্র তার নিজস্ব নয়, পুরো সমাজের জন্য। তার গল্প, তার সংগ্রাম, তার জয়—সেটি অন্যদের জন্যও একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।

সে বুঝতে পারে, জীবনে যতই অন্ধকার আসুক, শেষ পর্যন্ত সব কিছু আলোকিত হয়ে ওঠে।

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৫

0

সবিতা
পর্ব: ০৫
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

রাইয়া কাঁপা গলায় নিজের গল্প বলা শুরু করে—
সে কিশোরী বয়সেই এক আত্মীয়ের লালসার শিকার হয়।
কেউ বিশ্বাস করেনি তাকে।
মা বলেছে, “মেয়ে হয়ে এত কথা বলে না।”
বাবা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

একদিন রাইয়া রাগ করে শুধু একটা ব্যাগ আর কিছু বই নিয়ে পালিয়ে আসে ঢাকায়।

শেল্টার হোমে এসে সে দেখে, এখানে ওরকম আরও অনেকে আছে।

কিন্তু সবচেয়ে অবাক হয়—যখন সে দেখে সবিতার মতো মেয়েও তার ভালোবাসার মানুষের কাছে দিনের পর দিন নির্যাতিত আর অবহেলিত।কিন্তু বর্তমানে তার আত্নবিশ্বাস প্রখর,চোখে কোনো ভয় নেই,মনের ভিতর এক আকাশ পরিমাণ বড় হওয়ার বাসনা,যাতে অন্যের মুখাপেক্ষী না হতে হয় তাকে।

সবিতা বলে—
– “তুই একা না, বুঝলি?”
রাইয়া জিজ্ঞেস করে—
– “আপনি কীভাবে এত শক্ত হন?”
সবিতা বলে—
– “যেদিন থেকে আমি অন্যের জন্য নিজেকে শক্ত করলাম, সেদিন থেকে।”


সবিতা এখন শুধু ব্লগার না।
সে চায় একটা ‘আশ্রয় ও পুনর্গঠন কেন্দ্র’ গড়তে—যেখানে নির্যাতিত নারীরা শুধু আশ্রয় নয়, পাবে শিক্ষা, কাজ শেখা, আইনি সহায়তা, এবং সম্মান।

প্রজেক্টের নাম দেয়—
“আলোকধারা”

নওরীন আপু ও একাধিক এনজিও পাশে দাঁড়ায়।

মিডিয়াতে আবার সবিতার নাম উঠে আসে—
“সাবেক গৃহবধূ থেকে নারী অধিকারকর্মী:সবিতার পথচলা।”

একদিন সন্ধ্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়।
নামেন একজন ব্যক্তি—পরিচিত মুখ, কিন্তু চোখে একেবারে অচেনা ভাষা।

মোহাইমিন চৌধুরী।
নতুন এক এনজিওর পরিচালক, দেশের বাইরে থেকেও কাজ করেন।
সে আগেই সবিতার কাজের কথা শুনে এসেছে।
আজ সরাসরি দেখা করতে।

– “আপনার সাহস আর স্পষ্টতা আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছে,”—সে বলে।

সবিতা চমকে ওঠে না।
কারণ এখন এসব প্রশংসায় সে মাথা ঘোরায় না।
তবু তার চোখে প্রশ্ন—
“আপনি কেন এখানে?”

মোহাইমিন হেসে বলে—
– “কারণ আমি চাই, আপনি দেশজুড়ে ‘আলোকধারা’র শাখা খুলুন। আমরা সহায়তা দেব। আপনি নেতৃত্ব দিন।”

সবিতার মুখে এক অদ্ভুত নির্ভরতা।
তবু ভিতরে ভিতরে একটা দ্বিধা খেলে যায়।

রাইয়া এখন শুধু নিরাপদ নয়—সে শিখছে ডিজাইন, কথা বলা, নেতৃত্ব।
একদিন সে বলে—
– “আপা, আপনি যদি না থাকতেন, আমি হয়তো বেঁচেই থাকতাম না।”

সবিতা চেয়ে থাকে—
আসলে সে তো নিজেকেও বাঁচাতে চেয়েছিল।
এখন বাঁচাচ্ছে আরো অনেককে।

…..……

সবিতা যখন ‘আলোকধারা’ শুরু করে, তখন এর সাফল্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এটা একদিকে মানুষের জন্য আশ্রয়, অন্যদিকে সবিতার জন্য নতুন এক পরিচিতি তৈরি করে।
কিন্তু সাফল্যের সাথে আসতে থাকে নতুন চ্যালেঞ্জ।
এখন সবিতা শুধু নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে না—সে হয়ে উঠছে সমাজের চোখে এক প্রতীকি লড়াকু।

এদিকে, মোহাইমিনের পাশে দাঁড়ানোর পর সবিতার মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা চলে আসে।
সে জানে না, মোহাইমিন কেবল সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, নাকি তার মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
তার মানসিক দ্বন্দ্ব ঘিরে ধরে।
সে কখনো মোহাইমিনের সাহায্যকে মেনে নেয়, কখনো আবার তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠে।

আজ সবিতা তার বাড়িতেই আছে।হঠাৎ সাইফ তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
তার চোখে অনুরোধ।
সে বলে—
– “আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি, কিন্তু তোমার পাশে দাঁড়াতে চাই।”প্লিজ আন্নি সুযোগ দাও একটা।প্লিজ।

সবিতা নির্বিকারভাবে সাইফের দিকে তাকায়।

সে ভালো করেই জানে, সাইফ এখনও তার পুরনো গন্ডির মধ্যে আটকে আছে।সাইফ বিন্দুমাত্র নিজেকে চেঞ্জ করে নি।
তার জীবনে আসলে সবিতা ছিল একটা অস্থায়ী পরিসর।
সে নিজেকে এতটাই গুটিয়ে ফেলেছে যে,সবিতার এমন পরিণতি, যা তার কারণেই হয়েছে,সেটা স্বীকার করতে এখনো সক্ষম হয়নি সাইফ।

তবে সবিতা জানে, এই সময়ে সাইফের তার সামনে এসে দাঁড়ানোর পেছনে এক বড় কারণ আছে—

সে কি শুধুই অপরাধবোধের কারণে ফিরে এসেছে?

না কি তার জীবনের প্রতি পূর্ণ ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করছে?

সবিতা এদের কোনোটাই বিশ্বাস করতে পারে না।
সে বলে—
– “তুমি কি কখনো আমার জন্য কিছু করতে চেয়েছিলে? আমি চলে যাওয়ার পর তুমি কি এক মুহূর্তও আমাকে খুঁজেছিলে? না, সাইফ, তুমি তা করো নি,আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে দাও,আর তুমি শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচো।”প্লিজ আমার সামনে আর এসো না।আমি তোমাকে ছাড়া বেশ ভালো আছি।আমাকে ভালো থাকতে দাও দয়া করে।

সাইফ আজও সেখান থেকে চলে যায়, নিঃশব্দে।

সে এতো বড় অপরাধ করেছে যে যার কোনো দিন কোনো ক্ষমা নেই সবিতার কাছে।

সবিতা বর্তমানে অনেক ভালো ভালো কাজ করছে,তার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, এজন্য তার কিছু শত্রুরাও হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

একদিকে কিছু পুরনো পরিচিত মুখ তাকে অপমান করতে চায়, তো অন্যদিকে তার কাজের প্রতি বিরোধিতা জানায়।

কিছু মানুষ মনে করে যে, সবিতার কাজ নারীদের জন্য আসলেই উপকারী, কিন্তু তারা যে সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে এর বিরোধিতা করে, তা নিয়ে সবিতার সন্দেহ বাড়ে।

কিছু লোক সবিতার প্রতিষ্ঠানে তার কাজকে অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক বলে মনে করে।
তারা মনে করে—

“সবিতা যদি নারীদের অধিকার নিয়ে এত কথা বলে, তাহলে তার শিখানো মূলনীতি সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করবে।”

একদিন, সবিতা যখন নিজেই খুঁজতে থাকে কাদের বিরোধিতা তাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত দেয়, তখন সে বুঝতে পারে—

এর মধ্যে এক ধরনের বৃহত্তর ষড়যন্ত্র কাজ করছে।
একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শিক লড়াইয়ে সবিতা পড়ে গেছে।
অথবা, কেউ সবিতার অর্জনগুলিকে হুমকি মনে করছে।
সবিতার চারপাশে এক অদৃশ্য যুদ্ধ শুরু হয়।

রাইয়া একদিন সবিতাকে বলে—

– “আপা, আপনি ভাবছেন, সমাজ ও পরিবার আমাদের বিরোধিতা করছে, কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি যে কাজ শুরু করেছেন, তা চিরকাল আপনাদের বিশ্বাস ও উদাহরণ হয়ে থাকবে।”

রাইয়ার কথায় সবিতার মনে এক নতুন শক্তি খেলে যায়।
সে বুঝতে পারে, সমাজের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সে একা নয়।
এখন তার পাশে অনেক সঙ্গী, যারা একে অপরকে শক্তি দেয়।
এই অনুভূতি সবিতাকে দৃঢ় করে তোলে।

মোহাইমিন আবার সবিতার কাছে আসে—

– “আপনি জানেন, আপনাকে আমি শুধু সহায়তা দিতে চাই না, বরং আপনার কাজে যোগ দিতে চাই। আমি চাই, আপনার প্রজেক্টকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে।”

সবিতা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।
তার সামনে একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—
কীভাবে সে এই মানুষটির প্রস্তাব মেনে নেবে?

সবিতা মোহাইমিনের মনোভাব সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।
তবে সে জানে, তার কাজের জন্য সহযোগিতা দরকার।
এটা কি তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হবে?

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৪

0

সবিতা
পর্ব:০৪
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা এখন এনজিওর শেল্টার হোমেই আছে। রোজ নিজেকে একটু একটু গড়ছে।
দিনে সেলাই শেখে, সন্ধ্যায় কম্পিউটার ক্লাস, রাতে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ।
এক ধরনের ছন্দে চলতে থাকা এই দিনগুলো হঠাৎ বদলে গেল এক বিকেলে।

সেইদিন এনজিওতে আয়োজিত ছিল একটি ওয়ার্কশপ—
“সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা”
ওয়ার্কশপে স্পিকার ছিলেন নওরীন আফরিন, একজন সাইকোলজিস্ট এবং লেখিকা।

ছিমছাম পোশাক, মিষ্টি গলা, আত্মবিশ্বাসী চোখ—
সবিতার মনে হলো, এই প্রথম একজন নারীকে দেখে তার নিজের প্রতি ভরসা বাড়ছে।

নওরীন যখন বলছিলেন—

– “নিজেকে দোষারোপ করো না। যে চলে আসে, সে সাহসী। যে প্রতিবাদ করে, সে বেঁচে থাকার জন্য লড়ে। তুমি যদি নিজেকে ভালোবাসো, তাহলেই তুমি জীবনের কাছে দায়মুক্ত।”

সবিতার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
তার ভিতরের ক্ষতগুলো যেন কারও কথায় সাড়া দিচ্ছে।

ওয়ার্কশপ শেষে সবিতা নওরীনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখ নিচু করে।

নওরীন হাসেন, বলেন,
– “তোমার চোখ অনেক কিছু বলে। তোমার গল্প শুনতে পারি?”

তাদের কথোপকথন শুরু হয় ধীরে ধীরে।
দিনের পর দিন, সবিতা তার জীবনের প্রতিটা যন্ত্রণার কাহিনি খুলে বলে।
নওরীন শুধু শোনেন না, তাকে জড়িয়েও ধরেন।

একদিন নওরীন বলেন—

– “তুমি চাও, আমি তোমার একটা কেস ফাইল করে রাখি? চাইলে আইনি সহায়তা, থেরাপি ও একটা শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”

সবিতা চমকে ওঠে।
সে কখনো ভাবেইনি কেউ তার পাশে এভাবে দাঁড়াবে।

কিন্তু ঠিক তখনই—
আবার এক ঝড় উঠে যায়।

একদিন এনজিওর অফিসে আসে দুই পুলিশ ও সবিতার শশুর।

তিনি এসে বলেন—

– “আমাদের বউমা হারিয়ে গেছে। অনেক খুঁজছি। এখন শুনছি এখানে আছে। তাকে নিতে এসেছি।”

নওরিন তখন সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

– “মেয়েটির নিজের মতামত ও সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করে কেউ তাকে নিতে পারবে না। আপনারা চাইলে আইনগতভাবে দাবি পেশ করুন। তবে এখন ওর সিদ্ধান্ত ওর নিজের।”

সবিতা প্রথমবার এতটা নিরাপদ অনুভব করে।

সেই রাতে সবিতা চুপচাপ নওরীনকে জিজ্ঞেস করে,

– “আপু, আমি লেখাপড়া করতে চাই, নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চাই।তাহলে কি বয়স দোষ হয়ে দাঁড়াবে?”

নওরীন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
– “বয়স নয়, সংকল্পই সব। তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে ভর্তি করিয়ে দেব।”

সবিতার চোখে আশার আলো জ্বলে ওঠে।
এক নতুন যাত্রার শুরু।
নওরীন আপুর উৎসাহে সবিতা ভর্তি হয় একটি বেসরকারি কলেজের অনলাইন প্রোগ্রামে।
পুরো স্কলারশিপে।
সকালে সেলাই, বিকেলে পড়াশোনা, রাতে নিজের ডায়েরির পাতা খুলে বসা—এভাবেই কাটে তার দিনগুলো।

একদিন নওরীন হঠাৎ বলল,
– “তুমি কি জানো, তোমার জীবনের গল্প যদি তুমি নিজেই লেখো, তাহলে সেটাই হয়ে উঠবে অন্য নারীর সাহস?”

সবিতা অবাক হয়ে চেয়ে থাকল।
সে কখনো ভাবেনি তার যন্ত্রণার ভেতরেও কারো পথ দেখানোর আলো লুকিয়ে থাকতে পারে।

সে লিখতে শুরু করে—
প্রথম পাতায় লেখে—

> “আমি ছিলাম কারো ঘরের বউ, অথচ সেই ঘরটা আমার ছিল না কোনোদিন।
আমি এখন কারো স্ত্রী নই, কারো মেয়ে নই—আমি শুধু আমি।”

প্রথমে ছোট ছোট লেখালেখি।
তারপর একটা ব্লগ খুলে ফেলে নওরীনের সহায়তায়।
নাম দেয়: “জীবনযুদ্ধিনী”।

প্রতিদিন হাজার হাজার মেয়ে তার পোস্টে মন্তব্য করে।
অনেকেই লিখে—
“তুমি আমার মতো…”, “তুমি না লিখলে বুঝতাম না আমি একা নই।”

সবিতার ভিতরে এক নতুন শক্তি জন্ম নেয়।
তার কণ্ঠস্বর এখন শুধু তার না, অনেকের কণ্ঠ।

কিন্তু পুরোনো অন্ধকার তো চুপ করে বসে থাকে না।

একদিন, তার ব্লগে একটা কমেন্ট আসে—

“তোমার নাম তো আন্নি।তুমি সাইফের বউ ছিলে না? এত বড় বড় কথা বলার আগে আয়নায় নিজের মুখ দেখে নে।”

সবিতা প্রথমে ভয় পায়।
তারপর লেখে এক জবাব—

> “হ্যাঁ, আপনি সঠিক ধরেছেন,আন্নি সাইফের স্ত্রী। কিন্তু সে আন্নি নিজেকে ভেঙে চুরে সবিতা হিসেবে তৈরি করেছে।সবিতা এখন তার নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে শিখেছে।
সবিতা ভাঙিনি, সবিতা তৈরি হয়েছে।”

এই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়।
দেশজুড়ে অনেক মিডিয়া তার সাক্ষাৎকার চায়।

নওরীন একদিন বলে,
– “তুমি যদি চাও, আমরা তোমার লেখা দিয়ে একটি বই প্রকাশ করব। তুমি সম্মেলনে যাবে, অন্য নারীদের সামনে কথা বলবে।”

সবিতার চোখ ছলছল করে ওঠে।
সে ছোট করে বলে—
– “আমি পারবো তো?”

নওরীন জবাব দেন,
– “তুমি তো সেই দিনই পেরেছিলে যেদিন ঘর ছেড়ে বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে।”

সবিতার বই “জীবনযুদ্ধিনী” প্রকাশের পর সে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে সে সেমিনার, টক শো-তে ডাক পায়।
তাকে “মহিলা ক্ষমতায়ন” বিষয়ক এক সরকারি সেমিনারে বক্তা হিসেবে ডাকা হয়।
মঞ্চে উঠে সে বলে—

> “আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছেড়েছিলাম, আজ সেই কান্না দিয়ে পথ গড়েছি।”

হলজুড়ে করতালি।
কেউ একজন বসে আছে শেষ সারিতে—চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে।
সে সাইফ।

হ্যাঁ, সে ফিরে এসেছে।

সাইফের মনোভাব বদল, না কি মুখোশ?

সেমিনার শেষে সবিতাকে গেটের বাইরে পায় সাইফ।
একটা চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে বলে—
– “তুমি এত বড় হয়ে যাবে বুঝি নি কখনো। আমি তো ভাবতেও পারিনি।”

সবিতা জবাব দেয় না।
চোখে একরাশ তীব্র ঠাণ্ডা।

সাইফ বলে—
– “ভুল হয়ে গেছে আমার, আমি তোমাকে বুঝতে পারি নি। তুমি ফিরে আসো না প্লিজ…”

সবিতা হেসে ফেলে।
আর বলে,আমাকে যদি আন্নি ভেবে নিতে আসেন তাহলে আমি যেতে পারবো না,কারণ আন্নি এখন মৃত।
আর যদি সবিতাকে ফেরত নিতে আসেন,
তাকেও নিয়ে যেতে পারবেন না।
কারণ,,,,,
সবিতা থেমে গেলো।
কিন্তু সে একটা চিঠি বের করে সাইফের হাতে দেয়।

চিঠির শিরোনাম—
“যে মেয়েটা একদিন তোমার ছিল, সে আজ মৃত।কিন্তু এখন যাকে দেখছো সে একান্তই নিজের।”

সাইফ পেছনে হাঁটা দেয়।
এই প্রথম সে বুঝতে পারে, ক্ষমতা কাকে বলে।
আর এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারে আন্নি আর তার জীবনে কখনোই ফিরবে না।

সবিতার সামনে নতুন পথ

নওরীন আপু বলে—
– “তুমি চাইলে বিদেশে একটা স্কলারশিপের সুযোগ আছে, লেখালেখির ওপর।”

সবিতা চুপ করে থাকে।
তার মনে পড়ে তার মতো হাজার মেয়ের কথা।
সে বলে—

– “আমি থাকব। আমি চাই আমার মতো মেয়েরা যখন ভেঙে পড়বে, তখন আমি তাদের যেনো পাশে দাঁড়াতে পারি। যেমন তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে।”

নওরীন গর্বিত চোখে তাকায়।

একদিন…

এক সন্ধ্যায় শেল্টার হোমে আসে এক কিশোরী।
মুখ থেঁতলে গেছে, চোখে ভয়।

সবিতা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে—
– “তোমার নাম কী?”

মেয়েটি ফিসফিসিয়ে বলে—
– “রাইয়া…”

সবিতা তাকে জড়িয়ে ধরে।
নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমস্ত ভয়, যন্ত্রণা, অভিমান… সব কিছু মিলিয়ে একটাই কথা বলে—

> “তুমি এখন নিরাপদ, রাইয়া। আজ থেকে তুমিও একজন জীবনযুদ্ধিনী।”

[চলবে…]

সবিতা পর্ব-০৩

0

সবিতা
পর্ব: ০৩
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

“আমি মানুষ তো, না কি শুধুই এক কাজের মেয়ের মতো বসবাস করা মেশিন?”

সেই ভাবনা থেকেই আচমকা এই সিদ্ধান্ত—
আজ এই ঘর, এই সংসার, এই চেনা অথচ অচেনা মানুষের দল ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।
কোনো ব্যাগ নয়, কোনো টাকা-পয়সা নয়, এমনকি নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নয়।

আন্নি বেরিয়ে যায় খালি হাতে। পরনের ওড়নাটাও ঠিকমতো নেই তার গায়ে।
তবুও মনে এক অদ্ভুত শান্তি—
“এই নির্যাতন আর নয়।”

চাঁদের আলোয় ছায়া পড়ে তার চোখের নিচে।
রাস্তার বাতি মাঝে মাঝে কেঁপে উঠে।
সে হাঁটছে, উদ্দেশ্যহীন ভাবে।
জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন কোথাও না যাওয়াটাও একটা যাত্রা হয়ে দাঁড়ায়।
আজ আন্নির সেই যাত্রা।

হাঁটতে হাঁটতে পা আর চলে না।
চোখের জল শুকিয়ে গাল নোনা করে রেখেছে অনেক আগেই।
কোনো ঠিকানা নেই তার কাছে, নেই কারো আশ্রয় চাওয়ার অধিকার।
কিন্তু তবু সে চলেছে, একা, নিশ্চুপ।

ক্ষুধা লেগেছে, গা ভেঙে যাচ্ছে, চোখে অন্ধকার।
কিন্তু তবুও থামে না সে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায়—মাথা নিচু, কাঁধ ঝুঁকে গেছে ক্লান্তিতে।

ঠিক তখনই পেছন থেকে এক চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—

“আন্নি?”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কাকুলি আর আনোয়ার।
তার বান্ধবী, তার একমাত্র সমব্যথী।
কিন্তু এতটা ভাঙা অবস্থায় নিজেকে কারো সামনে প্রকাশ করতে চায় না আন্নি।
তাই সে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয়, চোখের জল লুকাতে চায়।

আনোয়ার উদ্বিগ্ন গলায় বলে ওঠে,
“আন্নি, কী হয়েছে তোমার?
এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? সব ঠিক আছে তো?”
কাকুলিও এগিয়ে আসে।
তার চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ, কণ্ঠে কাঁপুনি—
কাকুলি কাছে এসে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আবার সাইফের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস?”

আন্নি কোনো উত্তর দেয় না। তার চুপ থাকা যেন আকাশভরা উত্তর হয়ে নেমে আসে।
তার ঠোঁট থরথর করছে, চোখ আবারও জলে ভরে যাচ্ছে।

কাকুলি তার হাত ধরে—
“চল, আমাদের বাসায় চল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। তুই তো কাঁপছিস, আন্নি।”

আন্নি নিচু গলায় বলে—
“আমি আর কোনো ঘরে ফিরতে চাই না।আমি… রাস্তাতেই থাকবো।”
এটাই আমার শান্তি।”

কাকুলি চোখ বড় করে তাকায়।
“তুই পাগল নাকি? এভাবে কেউ থাকে? দুঃখে মন ভেঙে গেল মানে কি নিজের জীবনও ছুড়ে ফেলা?”

আন্নি কিছু বলে না।
শুধু তার দৃষ্টিতে ক্লান্তি, কষ্ট আর ভাঙা স্বপ্নের ছায়া।

আনোয়ার এবার একটু কঠোর গলায় বলে—

“দেখো, সাহস করে বেরিয়ে এসেছো, তার জন্য তোমার সাহসকে আমি সম্মান করি।
কিন্তু এর মানে এই না যে তুমি নিজেকে শেষ করে দেবে।
চলো, আমাদের বাসায় যাও। কালকের দিন কী হবে, পরে ভাবা যাবে।”

কাকুলি তার চোখে চোখ রেখে বলে—
“যা হবার হয়েছে। এবার তুই নিজের কথা ভাব।
তুই যে জীবিত আছিস, সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”
আন্নি একবার তাদের দিকে তাকায়।

শেষমেশ কাকুলি আর কোনো কথা না শুনেই জোর করে তার হাত ধরে ফেলে—
তোকে আমি একা রাস্তায় রেখে যেতে পারবো না।”

এই প্রথম সে অনুভব করে, কারও ছায়া এখনও আছে তার জীবনে।
অপমানের ঘর ছাড়লেও, আশ্রয়ের হাত এখনও থেমে যায়নি।

সে ধীরে ধীরে কাঁপা পায়ে হাঁটতে থাকে কাকুলি আর আনোয়ারের সাথে।
আর সেই মুহূর্তে তার চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসে শান্তির জল।
সেই চোখের জলে কষ্ট ছিল, তবে এবার ছিল নতুন শুরুর ইঙ্গিতও।

……..

অবাক করার মতো বিষয় হলো—আন্নি বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরেও কেউ খোঁজ নিলো না।
এদিকে সাইফ রাতে বাড়িই ফেরে নি।

সকাল বেলা শাশুড়ি অবশেষে সাইফকে ফোন করলেন।

“আন্নি বাসায় নাই।”—কণ্ঠটা যেন নিস্পৃহ।

সাইফের প্রতিউত্তর ছিল যেন তার চরিত্রেরই প্রতিচ্ছবি—“কই যাবে আর? বাপের বাড়িতে গেছে নিশ্চয়।”

একটুও উদ্বেগ, একটুও দায়িত্বের বোধ—কিছুই ছিল না কণ্ঠে। এমন কাপুরুষ স্বামী নিয়ে বেঁচে থাকার মানে কী?

এতটাই স্বার্থপর, এতটাই নির্দয় সে!
যে নারী বছরের পর বছর প্রেম করে অবশেষে তার সংসারে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে, তার মানসিক যন্ত্রণা আর অপমানের বোঝা টানতে টানতে আজ নিজেকে ভেঙে ফেলেছে—তার খোঁজে একটাবার বেরিয়ে পড়ার প্রয়োজন বোধ করে না সাইফ।

আন্নি তখন কাকুলিদের বাসায়।
বন্ধু কাকুলি একটিবার জড়িয়ে ধরেছিল—
“থাক তুই আমার কাছে। ঠিক হয়ে যাবে সব।”
আন্নি একটুও হাসতে পারেনি। তার মুখে কেবল নিঃস্পৃহতা, আর মনে একটাই প্রশ্ন—এই “সব” ঠিক হওয়ার মতো আছে কি?

কিন্তু কাকুলির বাসায় তো চিরকাল থাকা যায় না।
এটা তার স্থায়ী ঠিকানা নয়।সব সময় দয়া-ভিত্তিক সম্পর্ক মানুষকে কুরে কুরে খায়।

নিজের বাবা-মায়ের বাড়ি?
না,
বাবার বাড়ির দরজাও তার জন্য আজ বন্ধ।

পরের গন্তব্য—বড় বোন আমেনার বাড়ি।
তবে সেখানেও মিলল না আশ্রয়।
বরং শুনতে হলো চরম কথাগুলো—

“এইভাবে বাড়ি থেকে চলে আসে কেউ?”
“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?”
তুই কি ছোট শিশু?”
“আর কিছুদিন সহ্য করতে পারলি না?”

রক্তের সম্পর্কগুলোও এখন প্রশ্ন তোলে।

আন্নির চোখ ভরে ওঠে অশ্রুতে। গলার স্বর কাঁপে—
গলা ধরে আসে। সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে—

“আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। একদম না।”
আমি ভেঙে পড়ছিলাম, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো আমার!”

কেউ বুঝলো না তার যন্ত্রণার ভাষা, শুধু সিদ্ধান্তের জন্যই দোষারোপ।
শুধু বলে—তুই ভুল করেছিস।

কয়েকদিনের মাথায় মা-বাবা এসে হাজির আমেনার বাড়িতে। মা একদিকে ঝাড়ছে, বাবা আরেকদিকে। কেউ একটা প্রশ্নও করলো না—“তুই কেমন আছিস?”
তাদের চোখে আন্নি যেন এক অপবিত্র বোঝা।

মা বলে—“তোর মতো মেয়ে আমাদের মুখ দেখায় কেমনে!”
বাবা বলে—“তুই আমাদের মুখ পুড়ালি!”

আন্নি মাথা নিচু করে।
তাদের চোখে চোখ রাখার সাহসও তার আর নেই।
একটা মানুষের ভেতরকার সবটুকু তুচ্ছতা আজ তার দেহমুখে লেখা।

অভিমান আর অপমানে রাগ করে বোনের বাসা থেকেও বেরিয়ে পড়ে আন্নি।
আর তখনই শুরু হয় তার নিঃসঙ্গ ভ্রাম্যমান অধ্যায়।

সাইফের পরিবার ভাবে সে হয়তো মা-বাবার বাড়ি গেছে। মা-বাবা ভাবে সে হয়তো স্বামীর বাড়ি ফিরেছে।
কিন্তু আসলে, আন্নি কোনো বাড়িতেই নেই।
সে এখন রাস্তায়—নির্জন, অচেনা, একা।

সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে—একটা ঠাঁইহীন, ভালোবাসাহীন, নির্বাসিত নারীর মতো।

চোখের সামনে মানুষ আসে-যায়। কেউ তাকে দেখে না।
জীবনের গাঢ় অন্ধকারে সে হাঁটছে—অচেনা এক ভবিষ্যতের দিকে।
তবুও সে থেমে নেই।
একটুও।

….……….

ঢাকার শহর রাত নামলেই যেন অন্য এক রূপ নেয়।
লোকের ভিড় কমে, আলো কমে, শব্দ কমে… আর ভয় বাড়ে।

পায়ে পায়ে হেঁটে ক্লান্ত আন্নি একটা ফুটপাথের কিনারে বসে পড়ে।
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিখারিদের ভিড়ে আজ সে-ও যেন এক হয়ে গেছে।

একসময় যার সাজগোজে ব্যস্ত থাকত সন্ধ্যা, আজ তার চুল এলোমেলো, গায়ে ধুলোমাখা, চোখে শূন্যতা।

মুখ ফিরিয়ে কেউ তাকায় না তার দিকে।

হঠাৎ একটা ছেলে থামে।
চিন্তা করে বসে, কাঁধে ব্যাগ, হাতে পানির বোতল।চেহারার মতিগতি ঠিক মনে হচ্ছে না।

– “আপু ঠিক আছেন?”
আন্নি ভয় পেয়ে যায়। চোখে চোখ রাখে না, মাথা নিচু করে শুধু বলে,
– “ভালো আছি। এই বলে সে অন্য জায়গায় গিয়ে বসলো।

আন্নির চোখের কোণ ভিজে ওঠে—এই শহরে মানুষ আছে, আবার নেইও।

একটা ভাঙা বেঞ্চে বসে থাকে সে।
রাত বাড়ে।
রাতের গাড়িগুলোর হেডলাইটে মাঝে মাঝে তার মুখটা ঝলসে ওঠে।
সাথে আসে কত প্রশ্ন—

“কোথায় যাবো আমি?”
“কেউ কি আর কখনও আমাকে বিশ্বাস করবে?”
পরক্ষণেই ভাবে,
“আমি কি এতটাই দুর্বল?”

এইসব প্রশ্নের ভেতরেই হঠাৎ একটা কাঁপা গলা,

– “এই যে মা, এইখানে ঘুমাইও না, খুব বিপদ হইতে পারে।”

বয়স পঞ্চাশের মতো এক মহিলা। মুখে ক্লান্তির রেখা, হাতে পাতলা চাদর।

আন্নিকে দেখে থমকে দাঁড়ায়।

– “নতুন আইছো?”

আন্নি কোনো কিছু না ভেবে মাথা নাড়ে।

– “চলো, আমার সঙ্গে চলো। যতটা পারি যত্নে রাইখা দিব। শুইস না এইখানে। খারাপ মানুষ এলা দ্যাখলে তো খোদারেও ভয় করে না।”একদম গিলে খাবে।

আন্নি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

তারপর অনেক ভেবেচিন্তে ধীরে ধীরে মহিলার পিছু নেয়।তাছাড়া অনেক রাত ও হয়েছে।এই পরিবেশে একা থাকা ঠিক হবে না।এখন এই পরিস্থিতিতে তাকে কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতেই হবে।

একটা পুরোনো ভবনের নিচতলায় কিছু মেয়েরা বসে আছে, কেউ রান্না করছে, কেউ কাপড় শুকাচ্ছে, কেউ নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে।

এ যেন ছিন্নভিন্ন মেয়েদের এক অস্থায়ী সংসার।
কেউ বাসা থেকে বেরিয়ে আসা, কেউ পেটের দায়ে চলে আসা, কেউ সমাজের চোখে “অযোগ্য” হয়ে পড়া।

আন্নিকে এক কোণে বসতে দেয় সেই মহিলা টি।
তার নাম—”রহিমা।”

রহিমা বলে,
– “ভয়ে থাকিস না মা। কয়দিন থাকিস, তারপর যদি চানস পাই, তো চাকরির কিছু দেখি, না হলে মহিলা হোস্টেল আছে, আমি ঠিকানাও জানি। তুই শুধু দম ছাড়িস না।”

এই কথায় চোখ ভিজে যায় আন্নির।
রহিমা যেন অন্ধকারে একটা হালকা আলো।
এই প্রথম কেউ তাকে “মা” ডেকে স্নেহে কিছু বললো।

রাত গভীর হয়।

আন্নি ছোট্ট একটা কম্বলের নিচে কেঁপে কেঁপে ঘুমায়।
ঘুম আসে না ঠিক। আসে এক ধরনের অবচেতন—
যেখানে তার বাপ-মায়ের মুখ ভেসে ওঠে,
সাইফের ঠান্ডা কণ্ঠ,
আমেনার গালমন্দ,
আর আজকের রহিমা।

হয়তো এই শহরের বুকেই কোথাও তার জন্য একটা ছোট্ট জায়গা আছে।
যেখানে কেউ তার ভালোবাসা পাবে না বলে ঠেলে দেবে না।
যেখানে সে নিজের নামে একটা পরিচয় গড়তে পারবে।
নিজেকে খুঁজে পাবে।
রহিমা খালার সেই ছোট্ট ঘরেই ক’দিন কাটিয়ে দেয় সে।

…………..

সকালে আশপাশের বাসাগুলোর রান্নার গন্ধে চোখ মেলে আন্নি।
কেউ তাকে জোরে ডাকে না, কেউ দায়িত্ব চাপায় না,
তবু তার মধ্যে এক অদ্ভুত খালি জায়গা তৈরি হয়েছে।

একদিন রহিমা বলে,
– “চল মা, তোকে একটা জায়গায় লইয়া যাই।”

আন্নি চুপচাপ যায় তার সঙ্গে।
ছোট একটা অফিস, দরজার সামনে লেখা—
“নারী সহায়তা কেন্দ্র – প্রশিক্ষণ ও সহায়তা কার্যক্রম”

একটা আপু জিজ্ঞেস করেন নাম কি তোমার?

___আ,,,,বলতেই থেমে যায় আন্নি।

না,সে আজ থেকে আন্নি নয়।তার নতুন নাম সে নিজেই ঠিক করে।
কারণ আন্নি মারা গেছে স্বামীর অযত্ন আর ভালোবাসার অভাবে,আন্নি মারা গেছে শশুড় শাশুড়ীর অবহেলায়,আন্নি মারা গেছে বাবা মার দুর্ব্যবহারে,আন্নি মারা গেছে বোনের গালমন্দে।

কি হলো?নাম কি?

____সবিতা।

____নাইচ নেইম।
আপুটি হাসিমুখে বলেন,

–সবিতা “তুমি চাইলে এখানে থেকে সেলাই শেখা, কম্পিউটার শেখা বা হেল্প ডেস্কে কাজ করতে পারো। আর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে।”

সবিতার চোখে জল এসে যায়। এতদিন পর কেউ তাকে মানুষ মনে করছে, অবহেলা করছে না।

তিনদিন পরই সে সেলাই শেখা শুরু করে।
রোজ ঠিক সময়ে উঠে পড়ে, আয়নায় নিজের চোখে চোখ রাখে।

“আমি পারবো”— নিজেকে বলতে শেখে।

প্রথম নিজের বানানো থ্রিপিস যখন নিজের গায়ে পরে দেখে, মনে হয় কতকাল পরে যেন নিজেকে সাজিয়েছে।

রাতে রহিমা খালা একদিন বলে,
– “তোরে এই শহর ঠেকাইতে পারে নাই মা, তুই একদিন ঠিকই উঠবি।”

সবিতা মাথা নিচু করে হাসে।
সে নিজেকে একধরনের মুক্ত পাখি মনে করে, যার পাখায় এখনও আঘাত আছে, কিন্তু উড়ার শক্তি জমে উঠছে।

কিন্তু পুরোনো ছায়া কি এত সহজে পিছু ছাড়ে?

এক সন্ধ্যায় সবিতা যখন এনজিওর বারান্দায় বসে সেলাইয়ের কাজ করছিল,
তখন একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পায়।

– “আপনারা কি আন্নি নামের কাউকে চেনেন?

গলা শুনেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

এ তো সাইফ।

সবিতা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে—সাইফ দাঁড়িয়ে আছে।
মুখে অস্থিরতা, হাতে তার একটা ছবি।

কেউ একজন বলে,
– “না ভাই, এই নামে তো কেউ নাই।”

আন্নি ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে দেয়।
তার ভিতরটা কাঁপে।
সাইফ তাকে খুঁজছে, কিন্তু কেন?

ভালোবাসায়?
নাকি সমাজের ভয়ে?
নাকি “মেয়েটা আবার যেন মুখ না তোলে” সেই অভিপ্রায়ে?

রাতে রহিমা খালা দেখে সবিতার চেহারায় অদ্ভুত এক হতাশা।
জিজ্ঞেস করে না কিছু, শুধু পাশে বসে চুপচাপ হাত ধরে।

সবিতা বলে,
– “আমি কি কিছু ভুল করলাম খালা?”

– না,মা।
“তুই এখন বেঁচে আছিস,আর পূর্বে বেঁচে থেকেও মৃত ছিলি। সঠিক পথেই তুই আছিস।

চলবে……….

সবিতা পর্ব-০২

0

সবিতা
দ্বিতীয় পর্ব
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার, একে অপরকে অতিক্রম করতে গিয়ে কখনো এক হয়, কখনো দুই।
আন্নির জীবনটা যেন এই দুইয়ের মাঝে ভাসমান।
একটা সময় ছিল, যখন সাইফের প্রতি তার বিশ্বাস ছিল আকাশের মতো বড়—প্রেমে ছিল অটুট। কিন্তু এখন সে বিশ্বাস, সেই ভালোবাসা—সবই যেন একে একে সরে গেছে।

দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আন্নির জীবনে যেন কোনো পরিবর্তন নেই। এক এক করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু জীবনযাত্রার শীতলতা যেন কোনোভাবেই দূর হয় না। দিনের আলোও তার জন্য এখন আর আগের মতো উজ্জ্বল নয়, তার চারপাশে সব কিছু যেন ধূসর হয়ে গেছে। এক সময় সাইফের সাথে প্রতিটি দিন নতুন অনুভূতি নিয়ে আসতো, এখন তার মনে হয়, দিনগুলো একইরকম—শুধু সময় কাটছে, কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে না।

আজ আবার এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হলো।আবার নতুন একটি ঘটনা আন্নির মনকে আরো ভেঙে ফেলল।
তার বান্ধবী, রহিমা, ফোন করে জানালো,

— “তুই জানিস, সাইফ কি করছে? আজ বাইকের পেছনে এক মেয়ে নিয়ে ঘুরছিল। তুই কী করে এসব সহ্য করছিস? তুই তো জানিস, সাইফের আচরণ কেমন ছিল বিয়ের আগে। কিন্তু এখন তো তার কিছুই ঠিক নেই!”

আন্নি ফোনের স্ক্রীনে একমুঠো স্থির হয়ে যায়।
তার হাত কাঁপছিল, ফোনটা এতটাই শক্ত করে ধরেছিল যে, মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী তার হাত থেকে ছড়িয়ে পড়বে। সে কী বলবে? কীভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবে? সাইফের সঙ্গে তার সম্পর্ক তো অনেক আগেই ভেঙে গেছে, কিন্তু কোথাও ভেতরে একটা ভয় ছিল—শুধু তার নিজের দুঃখ গোপন করার চেষ্টা।

সে জানতো, সাইফ এখন আর আগের মতো নেই।
যতটুকু ভালোবাসা ছিল, ততটুকু আর নেই।
বিয়ের আগে সাইফ যেমন তাকে উষ্ণ ভালোবাসায় ঘিরে রাখতো, এখন সে পুরোপুরি বদলে গেছে। সে যেন একটা অচেনা মানুষ হয়ে গেছে, যার পাশে আর আন্নি থাকতে পারে না।

হঠাৎ ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়।
মনে হয় যেন পৃথিবীটা মাথার উপর ঘুরতে থাকে।
কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই সে।
কী বলবে? কী করে নিজেকে বোঝাবে যে, সাইফের এমন আচরণ তার কাছে নতুন নয়।

আন্নির নিজের পরিস্থিতি এমন হয়েছে, যে সে নিজেও জানে না, কেন সে এখনও সাইফের সঙ্গে রয়ে গেছে।
সে কি সত্যিই তার সঙ্গে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক রাখতে চায়? না কি সে শুধুমাত্র অভ্যাসের জায়গায় আটকে গেছে?
আজকাল আন্নি মনে করে, সাইফের কাছে সে শুধুই একটা কুকুরের মতো, যার দায়িত্ব শুধু রান্নাঘরে কাজ করা, কাপড় কাচা, আর বাড়ির সব কিছু দেখতে থাকা।
সাইফ তার প্রিয় মানুষ ছিল—এটা সত্য, কিন্তু আজকের সাইফ তাকে আর আগের মতো প্রিয় নয়। সেই ভালোবাসা কেমন যেন মুছে গেছে।

এখন আন্নি বুঝতে পারছে—সাইফের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যেন এক গহীন সাদাকালো অন্ধকারের মধ্যে চলে গেছে।
তখন ভালোবাসা ছিল, এখন শুধু নিঃসঙ্গতা, বিষণ্নতা আর হতাশা।
এখন সাইফের মনেও আর কোনো জায়গা নেই আন্নির জন্য।
এটা যেন জীবনের এক কঠিন রিয়েলিটি, যে এক সময় তাকে ভালোবাসত, সে আজ আর তাকে খেয়ালও করে না।

তার কেবল কানে একটা শব্দই বাজছে—“তুই থাকলে থাক, না থাকলে চলে যা।”

এখন আর আন্নির কোনো স্বপ্ন নেই, শুধু একটাই চিন্তা—কীভাবে একদিন এই জগৎ থেকে পালাবে?
তবে পালাবে কোথায়? সে জানে না।
কিন্তু প্রতিদিন, প্রতিটি দিন, সাইফের এই নিষ্ঠুরতায় এক একটা গহীন ক্ষত সৃষ্টি হয় তার হৃদয়ে।

……………

গভীর রাত,নিস্তব্ধ চারপাশ,ঘড়ির কাঁটা যখন একটাকে ছুঁয়েছে, তখনও আন্নি দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।চোখে ঘুম নেই, মনে শুধু অপেক্ষা—সাইফ কখন ফিরবে।

রাত প্রায় দুটো— কেবল দরজার খচখচ শব্দে তার অপেক্ষা ভাঙে।
অবশেষে দরজা খুলে যায়। সাইফ, নির্বিকার মুখে, একটাও কথা না বলে ঘরে ঢুকে, জুতা খুলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
আজ রাতেও সাইফ ফিরলো অনেক দেরিতে। আজকেও দরজা খুলে ঢুকেই যেন সমস্ত দুনিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো সে। একটাও কথা নয়, একটাও দৃষ্টি নয়—শুধু বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। আন্নি পাশে বসে ছিল নীরবে, ঠিক আগের রাতগুলোর মতো। একটা সময় সে আর অপেক্ষা করে না—কারণ সে জানে, এখন তার পাশে বসা একজন স্বামী নয়, একজন অভিমানহীন অপরিচিত পুরুষ।

আন্নি তাকিয়ে ভাবে, মনে হয় এক অপারিচিত মানুষ পাশে ঘুমিয়ে আছে। অথচ একসময় এই মানুষটাই তো তার চোখে ছিলো জীবন, স্বপ্ন, ভালোবাসা।
মনে প্রশ্ন জাগে বার বার—সে কি একদিন
ভালোবেসেছিল এই মানুষটিকে?

………..……

ভোর হতেই যেন যুদ্ধের মাঠে নামে আন্নি। রান্নাঘরের ভেতর গনগনে আগুন আর তাড়াহুড়ার শব্দ। শ্বশুরের সরকারি অফিস, সাইফের কলেজ—সবার সময়মতো খাওয়া চাই।

আজকের সকালটা যেনো আরও বিশৃঙ্খল। ঘড়ির কাঁটায় যেন আগুন ধরে গেছে। শ্বশুর সময়মতো অফিসে যাবেন, সাইফেরও কলেজ আছে। আন্নি তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে ছুটে যায়—সবজির ভাজি, ডাল, আর ভাতের আয়োজন। রাইস কুকার হঠাৎ কারেন্ট চলে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে গ্যাসে বসায় ভাতের হাঁড়ি।
এমন সময় শাশুড়ির ডাক—
“আন্নি, একটু আয় তো রে।”

আন্নি কাঁটা চামচ ফেলে, আঁচলে হাত মুছে দৌড়ে যায় শাশুড়ির রুমে।
কোনো দ্বিধা না করেই সে ছোটে। অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে তার এই ছুটে চলা। সংসার যেন এক বিশাল নাট্যমঞ্চ, আর সে সেখানে নেপথ্যের শিল্পী।

শাশুড়ি হয়তো গলার হারটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না,ভেতরে হয়তো শাড়ির ভাঁজ ঠিক করতে বলবে,কিংবা আলমারিতে কিছু খোঁজার দরকার হয়েছিল
কিন্তু রান্নাঘরে তখনও জ্বলছে গ্যাসের আগুন আর তার উপর চাপা পাত্রে ভাত।
মুহূর্তের মধ্যে পোড়া গন্ধে ভরে যায় পুরো বাড়ি।

শ্বশুর দরজা ঠেলে বের হয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলেন,
“ঘরে আগুন লাগছে নাকি?”

আন্নির বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে একটা আশঙ্কার ঢেউ।
ছুটে যায় সে রান্নাঘরে।
কালো ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারপাশ।
হাঁড়ির নিচে জ্বলে যাওয়া ভাত, আর তার ওপরে জমে থাকা পোড়া ধোঁয়া যেন আন্নির ভিতরকার কষ্টকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।
চুলার সামনে দাঁড়িয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়।

ঠিক তখনই সাইফ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
চোখ জ্বলে তার, মুখে ঘৃণা— গর্জন করে বলে—

“তুই সারাদিন করিস টা কী রে? ঘরে খালি শুয়ে বসে থাকিস,শুয়ে বসে খাস!”
একবেলার ভাত ঠিকঠাক রান্ধতে পারিস না?

এই বলে তার চুলের মুঠি ধরে এমন টান দেয়, যেন সে কোনো প্রিয়জন নয়, একেবারে ঘৃণার পাত্র।যেন সে তার স্ত্রী নয়, এক অপরাধী।
দুইটা চড় গালে এসে পড়ে সশব্দে।

আন্নির কান ঝিম ঝিম করে ওঠে। মাথার ভেতর যেন একটা সাইরেন বাজে—না, এটা তার ভালোবাসা হতে পারে না, এ ছেলে তো তার স্বপ্নের মানুষ ছিল না!

জ্বালা লাগে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জ্বলে ওঠে আত্মসম্মান।
ঘরটা কেঁপে ওঠে, কিন্তু কারও মুখে প্রতিবাদের শব্দ নেই।

শ্বশুর-শাশুড়ি দাঁড়িয়ে থাকেন নির্লিপ্ত, নীরবে। যেন কিছুই দেখেননি, যেন কিছুই ঘটেনি।
একবারও কেউ বলে না, “সাইফ, এটা কি করছো?”
যেন কিছুই হয়নি।কারও মুখে কোনো প্রতিবাদ নেই, কেউ সাইফকে থামায় না। যেন আন্নির প্রতি এই আচরণই স্বাভাবিক, যেন এটা তার প্রাপ্য।
হ্যাঁ ঠিকই তো,
এটাই তো এই ঘরের নিয়ম—স্বামীর হাতে স্ত্রীর অপমান, আর চারপাশের মৌন সমর্থন।

আন্নির চোখে জল আসে না।
দীর্ঘ সময়ের গুমোট যন্ত্রণায় কান্নাগুলো হারিয়ে গেছে কোথাও।
ভেতরে কেবল একটা প্রশ্ন গুমরে ওঠে—
“এই মানুষটার হাত ধরেই তো আমি পালিয়ে এসেছিলাম। এই ছিল তার ভালোবাসা?”

আন্নির বুকের ভেতর যেন কিছু একটা ধ্বসে পড়ে। সে শুধু ভাবতে থাকে—
“এই কি সেই সাইফ, যে একদিন বলেছিল, ‘তোর জন্য সব ছেড়ে দিব’? এই কি সেই সংসার, যার জন্য আমি বাবা-মাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম?”

তার ভেতরে জমে ওঠা শূন্যতা আজ যেন আরও ভারি হয়ে আসে।
সে জানে, ভালোবাসা পুড়ে গেছে আজকের ভাতের মতোই—নরম, নিরীহ, অথচ অবহেলার আগুনে অচেনা এক অন্ধকারে রূপান্তরিত।

ভাতের হাঁড়ির মতো পুড়ে যাচ্ছে তার সব স্বপ্ন। প্রেম, ভালোবাসা, বিশ্বাস—

একসময় সাইফ বলেছিল,
“তুই আমার জীবন, আন্নি।”
আজ সাইফ যেন বলে—
“তুই শুধু দায়িত্ব।”

একসময় সাইফ বলেছিল,
“তুই ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না, আন্নি।”
আর আজ সাইফ যেন বলে—
“তুই থাকলে থাক,না থাকলে না থাক।”

অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় আন্নি।
“এই ঘর না থাক, আমার নিজের মান থাকুক।”
কোনো ব্যাগ নেয় না, কোনো টাকা নয়, এমনকি পরনের ওড়নাটাও ঠিকঠাক টেনে নেয়নি সে।
চোখে ছিল কেবল জেদ, আর বুকভরা দুঃখ।
চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়—
এই শহরের ব্যস্ততা আর আলো-ছায়ার ফাঁকে হারিয়ে যেতে চায় এক নারীর না বলা গল্প।

চলবে………

সবিতা পর্ব-০১

0

#সবিতা
সূচনা পর্ব
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

ভোরের আলো এখনো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি। জানালার ফাঁক গলে এক ফালি সূর্য রশ্মি আন্নির মুখে এসে পড়তেই সে চোখ খুলে ফেলে। পাশ ফিরে তাকায়—সাইফ ঘুমোচ্ছে না, বরং ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখার ভান করে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। দু’জনের মাঝখানে শীতল নিঃশ্বাসের দেয়াল, যা স্পর্শ করা যায় না, শুধু টের পাওয়া যায়।

আন্নি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে পড়ে এক বছর আগের সেই বিকেলটা, যখন সে হাত ধরেছিল সাইফের, ভালোবাসার দায়ে সমস্ত কিছু ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলো। কত স্বপ্ন ছিল তাদের—একটা ছোট বাসা, দুটো টিকটিকি ঝগড়া করবে দেয়ালে, ছাদের কোণায় গুচ্ছ গুচ্ছ রোদ জমে থাকবে, আর সন্ধ্যায় ওরা মিলে একসাথে চা খাবে।

সেইদিন আন্নির বুকের ভেতর থেকে কিছু একটা চিরে বেরিয়ে গিয়েছিলো—ভালোবাসা নয়, বিশ্বাস ছিল সেটা।

আন্নি ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সাইফকে।
পরিবারের কেউ রাজি ছিল না। অনেক অনুরোধ, অনেক বোঝানো—সব ব্যর্থ। শেষমেশ ভালোবাসার টানেই এক ঝড়বিক্ষুব্ধ বিকেলে আন্নি পালিয়ে যায় সাইফের সঙ্গে।

সেই রাতে আকাশ ঝরেছিল, ঠিক যেমন তার বুকের ভেতর কান্না আর আনন্দ একসাথে ঝড় তুলেছিল।
সাইফ হাত ধরে বলেছিল,
— “এখন থেকে আমি শুধু তোমার। কোনো কষ্ট পেতে দেব না তোমায়।”

আন্নির মনে হয়েছিল,
“এটাই তো আমার স্বর্গ, আমার বাড়ি, আমার পৃথিবী।”

কিন্তু সে স্বর্গ ছিল খুব অস্থায়ী।
শুধু এক বছর।

এক বছর পর আন্নি টের পায়—সাইফ বদলে যাচ্ছে। তার চোখে অহনার প্রতিচ্ছবি।
অহনা, সাইফের ক্লাসমেট। স্মার্ট, চটপটে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

প্রথমে সন্দেহ, পরে নিশ্চিত বিশ্বাস।
সাইফ অহনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।

প্রথমে সামান্য পরিবর্তন এসেছিলো সাইফের আচরণে। ফোনে কথা বলার সময় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেত, রাত করে বাসায় ফিরত। আন্নি যখন জানতে চাইত, সে বিরক্ত হতো, রাগ করত। তারপর একদিন আন্নির সামনে দাঁড়িয়ে সাইফ চিৎকার করে বলে উঠেছিলো,

— “তুমি একটা প্যারানিয়া,এত সন্দেহ তোমার?
ও আমার ক্লাসমেট।
এসব মানসিক রোগীর মতো আচরণ বাদ দাও!

আন্নি প্রতিবাদ করলে সাইফ এভাবে তেড়ে আসে—

সাইফ যখন অহনার মেসেঞ্জারে সিঙ্গেল হার্ট ইমোজি দেয়, আন্নি তখন আয়নায় নিজের চোখে চোখ রাখে—একটা মেয়ের ইতিহাস পড়ে যায় সেখানে। যে একদিন ভালোবেসেছিল, আবার একদিন নিজেকেই ভালোবাসতে শিখবে।

সাইফ একদিন চড় মারতে হাত তোলে।
যদিও সেই হাত থেমে যায়, কিন্তু আন্নির আত্মসম্মান থামে না।

শুরু হয় অশান্তি।
ভালোবাসার ঘর, এখন শুধুই অভিযোগের দেওয়াল।

শশুর-শাশুড়ির কাছ থেকেও কোনো সান্ত্বনা মেলেনি। বরং শাশুড়ি বলেছিলেন,
— “ছেলে মানুষ, একটু এদিক-ওদিক করতেই পারে।
সারাদিন কি বউয়ের আঁচলে বাঁধা থাকবে নাকি?”

শশুর আবার গলা গলিয়ে যোগ করেন,

— “ছোট মানুষকে বিয়ে করেছো, এখনও তো কলেজে পড়ে! সে বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে না?”

আন্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো তাঁদের দিকে। যাদের কাছে সে একটু আশ্রয় খুঁজতে চেয়েছিলো, তারা তাকে আরও ভেঙে দিলো।
আন্নি সবার কথা চুপ করে শোনে শুধু।
তার চোখে এখন আর জল নেই, শুধু একরাশ বিস্ময় আর আত্মসম্মানের স্পষ্ট ছায়া।

রাতের পর রাত ঘুম হয় না আন্নির। বুকের ভেতর জমে থাকা কান্নাগুলো শুধু বালিশ ভিজিয়ে যায়। কখনো মনে হয়, ফিরে যাই মায়ের কাছে, আবার মনে পড়ে—মা-ও তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেই পালিয়ে যাওয়ার রাতে।
বলেছিলেন,
“ভালোবাসা দিয়ে সংসার চলে না”—মায়ের বলা কথাগুলো কানের ভেতর এখনো গুনগুন করে।

কিন্তু আন্নি এখনো ভেঙে পড়ে না। কারণ সে জানে, তার ভিতরে এখনো অনেক গল্প বাকি। সে হয়তো একা, হয়তো হারিয়েছে বিশ্বাস আর ভালোবাসার প্রিয় মুখ, কিন্তু তার আত্মসম্মান এখনো জাগ্রত।

……….

রাত গভীর।
জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকেছে, ছায়া ফেলেছে দেওয়ালে।
দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির টিকটিক শব্দটা যেন খুব স্পষ্ট হয়ে বাজে আন্নির কানে।
যেন সময়টাও আন্নির নিঃসঙ্গতা গুনে চলেছে।
সাইফ ফেরেনি এখনও।
আন্নি বসে আছে জানালার ধারে একলা।

রাতটা অদ্ভুতভাবে নিরব।

হাতের ডায়েরির ভাঁজে লুকানো চিঠিটা আজ ও পুড়ছে,
তবে আন্নির চোখে যে জলের ফোঁটা, তা এখন সাইফের প্রতি নয়—
তা নিজের জীবনের প্রতি ক্ষোভ,
নিজের ভুলগুলোকে না বলতে পারার তীব্র আক্ষেপ।

সেদিনের কথা মনে পড়ে—এইচএসসি পরীক্ষার শেষ দিন।
প্রথমবার হাতে হাত ধরে,
সাইফ বলেছিল,
“চলো, সবকিছুকে পেছনে ফেলে আমাদের একটা গল্প লিখি।”
আন্নি বিশ্বাস করেছিল।
ভেবেছিল, ভালোবাসা মানেই মুক্তি।
ভেবেছিল, যেখানেই থাকুক—ভালোবাসার সংসারেই আশ্রয় থাকবে।

কিন্তু কে জানত, সেই গল্পের কালি এত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে?

সেই ভুলটা…
এইচ,এস,সি এক্সাম শেষ করেই সাইফের হাত ধরে সব ফেলে চলে যাওয়া।
মা-বাবার চোখের জল, বড় বোন আমেনার রাগ, ছোট ভাইয়ের ভেঙে পড়া মুখ—সব এখন আন্নির বুকের ভেতর ছাইয়ের মতো জমে আছে।

এক বছরের সংসারে, সাইফ একবারও বলেনি—“তুমি আবার পড়ো”।
আন্নির সব স্বপ্ন ধীরে ধীরে গিলে ফেলেছে রান্নাঘরের ধোঁয়া, শাশুড়ির চাহনি, সাইফের চুপ থাকা।

আজ হঠাৎ করে মনে হলো—এই সংসারটা সে নিজেই তো বেছে নিয়েছিল।
তবে কেন এখানে এতটা একা?
কেন তার দু:খটাও এখন শেয়ার করার মতো কেউ নেই?

আজ হঠাৎ বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ঝড় উঠে আছে।
মাথা কাঁপছে, কিন্তু হাত চলে যায় ফোনের দিকে।

হাত কাঁপতে কাঁপতে মোবাইলটা নিয়ে বড় বোন
আমেনার নাম্বারে কল দিল।

কল ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর গলা,
— “হ্যাঁ? কী হয়েছে?”
দূর থেকে বোনের গলা শুনেই কান্না আটকে রাখতে পারল না আন্নি।
কথা না বলে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে।
আন্নি এক ফোঁটা স্বরে বলে,

— “আপু… আমি আর পারছি না।”

কিন্তু উল্টো সান্ত্বনা নয়,
বোনের কণ্ঠে উঠে আসে উপেক্ষা আর বিদ্রুপ।
ওপাশ থেকে তীব্র রাগে উত্তর এলো,

— “তখন তো কারো কথা শুনোনি। প্রেমে অন্ধ হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে। এখন কাঁদছো?
মা-বাবাকে ফেলে পালিয়ে গিয়ে এখন চোখে পানি এসেছে?”
মা-বাবা মরলেও খোঁজ নিতে আসবে না তুমি, বুঝে নিও।”

আন্নি নিশ্চুপ হয়ে গেল।

আমেনার কথাগুলো বুকের ভেতর গর্ত করে দেয়।
কোনো উত্তর দেয় নি আন্নি।
চোখের জল মোছে নি, কথা বলে নি, তার সামনে মাথা নোয়ায় নি,
শুধু ফোনটা নিঃশব্দে কেটে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
বুকের ভেতর জমে থাকা জলের সাগর, আজ বালিশ ভিজিয়ে দেয়।

বার বার শুধু বোনের বলা কথাগুলো মাথায় বাজতে থাকল—
“তুমি তো নিজের ইচ্ছেতে নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছিলে।”

সেই রাতে, আন্নি আর কাউকে কিছু বলেনি।
না সাইফকে, না শাশুড়িকে।
নিজের বুকের ভিতরই আগুনটাকে চেপে রাখল।

তবে সেই আগুনের মাঝে একটা স্বপ্ন আবার মাথা তুলল—
ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়া।

পরদিন সকালে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চা বানাতে বানাতে ভাবছিল—এই কি তার জীবন?
চা, ডিমভাজি, সাইফের পোশাক ইস্ত্রি করা, শাশুড়ির ওষুধ, বাজারের লিস্ট,
আর… নিজের পছন্দ-অপছন্দ-স্বপ্ন গিলে ফেলা একটা মেয়ের গল্প?

হঠাৎ বুকের গভীর থেকে একটা ইচ্ছা মাথা তোলে।
ডিগ্রিতে ভর্তি হবো। যেভাবেই হোক।

শাশুড়ি ডাইনিং টেবিলে বসতেই আন্নি সাহস করে বলে উঠল,
— “মা, আমি যদি আবার পড়াশোনা শুরু করি? কলেজে ভর্তি হতে চাই ডিগ্রিতে।”

শাশুড়ি থমকে তাকালেন,
তার চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
শাশুড়ির মুখখানা রঙ পাল্টাল এক নিমিষে।
চোখে উঠল অবিশ্বাস, কণ্ঠে ঝলকে উঠল কষ্ট ও শাসন।
— “এই বয়সে আবার কী পড়া? ঘরের কাজ ছেড়ে?
ঘরের কাজ সামলাও, এই তো অনেক হয়েছে!”
তারপর গলা নীচু করলেন,
— “সাইফ জানলে তো একদম মেনে নেবে না। মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার?”
সে শুনলে রাগে পুড়ে যাবে!

আন্নির বুকের ভিতর যেন কিছু একটা টুপ করে ভেঙে গেল।সে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
কিছু বলল না।
তার চোখে তখন ঠিকরে পড়ছিল একরাশ প্রতিজ্ঞা।

সেই রাতে আন্নি শুয়ে শুয়ে ভাবছিল—এই ঘরটা কি তার?
নাকি শুধু এক বাঁচিয়ে রাখা শ্বাসের নাম?
তার যদি কোনো জিনিস একান্ত নিজের হয়ে থাকে,
তা শুধু একটা—
তার স্বপ্ন।

পৃথিবীর সবাই ছেড়ে দিলেও,
স্বপ্ন একবার ধরা দিলে,
সে আর হাত ছাড়ে না।

এই স্বপ্নই তার একমাত্র নিজের জিনিস।
কারণ সবাই চলে গেলেও, স্বপ্ন তো কেউ কেড়ে নিতে পারে না।

চলবে……….

সিদ্ধান্ত

0

সিদ্ধান্ত! (প্রথম পর্ব।)

“সোহেল অফিস শেষে কি একটু ফ্রি আছিস? জরুরী একটা কথা ছিল দোস্ত!” লাঞ্চের পর পর আসিফের কলটাতে একটু অবাক হলাম। আজ ওকে বেশ উদ্বিগ্ন বলেই মনে হল।

“না রে ফ্রি নাই, তানিশার কোচিং আছে! অফিস শেষে ওকে ড্রপ করতে হবে। তবে তোর বিষয়টা খুব বেশি জরুরী হলে আমি না হয় সোমাকে বলবো, মেয়েকে কোচিংয়ে ড্রপ করে দিতে!” স্কুল জীবন থেকেই বন্ধুরা আমার কাছে প্রায়োরিটি পায়, তাইতেো আসিফকে নিরাশ করলাম না।

“ঠিক আছে বন্ধু, আমি ছয়টার মধ্যে তোর অফিসে আসছি। তারপর দুজন কাছাকাছি কোন একটা রেস্টুরেন্টে বসব নে।” তড়িঘড়ি করে আসিফের ফোন রাখার পর বুঝলাম, ও নিশ্চয়ই খুব বড় ধরনের একটা ঝামেলায় আছে। আমি অবশ্য খুব বেশি চিন্তা না করে নিজের কাজে মনোযোগ দিলাম। নিজেরই এখন হাজারো সমস্যা, তাইতো ইদানিং অন্যের বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ পাই না।

“দোস্ত, শায়লা কে বিয়ে করতে চাই। অনেকদিন ধরে চিন্তাভাবনা করে আমার এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিষয়টাতে তোর একটু সাহায্য চাইছি!” মতিঝিলে আমার অফিস লাগোয়া একটা রেস্টুরেন্টে বসতেই, আসিফের বলা এ কথাটা আমার মাথায় যেন বাজ হয়ে পড়লো। তিন কন্যা সন্তানের বাবা, সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মুখে এ এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শুনে আমি বসা থেকে উত্তেজনায় সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম।

“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস আসিফ? না আমার সাথে ফাজলামো করছিস।” আমার অবিশ্বাস্য চোখ আর রাগের গর্জনে রেস্টুরেন্টে বসা আশেপাশের মানুষরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আসিফ মেধাবী ছেলে, আমি উত্তেজিত হয়ে গেছি তাইতো পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাকে নিয়ে দ্রুতই রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে চলে এলো। আমি তখনো রাগে গজরানোতে। ও একটা রিক্সা ডেকে আমাদের দুজনেরই প্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিল, পুরোটা রাস্তাতে ও চুপচাপ৷ আমিও ওর দিকে একবারের জন্য তাকালাম না।

টিএসসির কাছাকাছি এসে রিক্সাটা ছেড়ে দিয়ে ও বেশ স্বাভাবিক গলায় “দোস্ত প্রথমে আমার পুরো কথাটা শোন, তারপর রিয়েক্ট কর! আমার নিজেরও তো অনেক ভেবে চিন্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। আর তুই ই একমাত্র ব্যক্তি যার কাছে আমি কথাটা শেয়ার করতে চাচ্ছি। আমি শায়লাকে ছাড়া বাঁচবো না। ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। ”

কাহিনীটা হঠাৎ নাটক সিনেমার মতো করে শুরু করে দেওয়ার জন্য দুঃখিত। মূল অংশটা শুরু করার আগে আমার বন্ধু আসিফ আর আমাদের আরেক বন্ধু শায়লার পরিচয় দিয়ে রাখছি। আমরা তিনজনই মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সহপাঠী, ক্লাস টেনে কালাম স্যারের বাসায় ব্যাচে প্রাইভেট পড়ার সময় থেকেই আসিফ-শায়লার পরিচয় ও প্রেমের শুরু। ওদের তুমুল প্রেম চলল কলেজ জীবনেও। এরপর একসাথে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করা আর কাকতালীয়ভাবে আমি, আসিফ আর শায়লা, তিনজনেরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে যাওয়া। আমি শায়লা ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে আর আসিফ হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের। আমাদের সে সময়ের উত্তাল বন্ধুত্ব ও অসাধারণ সব স্মৃতি, শিকি শতক পরে এসেও মাঝেমধ্যে সুখ স্মৃতি হয়ে ধরা দেয়।

সংক্ষেপেই বলছি, আসিফ আর শায়লার বিয়েটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি, আর তা নানানবিধ কারণে। এক নাম্বার কারণ হলো, আসিফদের পারিবারিক অবস্থা আর দ্বিতীয়টা ওর অনিশ্চিত ক্যারিয়ার। শায়লার বাবা ছিলেন সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, ভদ্রলোক সম্ভবত শেষ পর্যন্ত সচিব হিসাবে রিটায়ারমেন্টে যায়। তাইতো মুগদাতে থাকা ব্যাংকের এক তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর সন্তান আসিফের সাথে শায়লার বাবা কিছুতেই বিয়েতে রাজি হয়নি। আর সত্য বলতে কি, এমবিএ করার সময়টাতে শায়লা নিজেও আসিফ এর বিষয়ে কনফিউজড ছিল, অন্ততপক্ষে কথাটা আমি জানতাম।

আইবিএ থেকে এমবিএ করা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে যখন শায়লার বিয়ে হল, আসিফ অনেক কষ্ট পেয়ে আমাদের বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। ও বিষয়টাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। আসিফ শায়লাকে মন থেকেই ভালোবাসতো, আমরা বন্ধুরা ভালো করে জানতাম। তাইতো আমরা সবাই ছেলেটার প্রতি সমবেদনায় আবার একই সাথে শায়লাকেও কিন্তু বন্ধু বলেই মনে করতাম। খুব খারাপ লাগতো, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবারের প্রবল বিরোধিতায় মেয়েটার আস্তে আস্তে প্রেম থেকে দূরে সরে যাওয়ার সেইসব দৃশ্য দেখে।

এরপর আমাদের সবার জীবন চলতে লাগে জীবনের নিয়মে। আমিও একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকুরী নিলাম, এরপর বিয়ে থা করে সংসার জীবনে। আসিফ আমাদের স্কুলের মেধাবী ছাত্রদের একজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ছাত্র হলেও ছেলেটা আসলেই তুখোড়। আর তার প্রমাণও দিল বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একেবারে প্রথম দিকে নিজের অবস্থান রেখে। সরকারি চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে আসিফের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল রাতারাতি, বন্ধুদের মাঝেও ও বেশ গুরুত্ব পায় আর কর্মক্ষেত্রেও খুব ভালো করতে লাগে। এই তো কিছুদিন আগে সরকারের যুগ্ম সচিব পদেও পদোন্নতি পেল।

আসিফের স্ত্রী, লায়লা ভাবি আমাদের খুব পছন্দের একজন। পুরোপুরি গৃহিণী এই ভদ্রমহিলা ওদের তিন কন্যা সন্তানকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকেন। ওদের বড় মেয়েটা এ বছর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হয়েছে, বাকি দুটো মেয়ে ভিকারুন্নেসাতে পড়ে। সব মিলিয়ে আসিফ লায়লার আপাত সুখের এক সংসার, সমাজের অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। আমরা বন্ধুরা এখনো প্রায়ই ওদের ইস্কাটনের সরকারি কোয়ার্টারে জড়ো হই, আড্ডা আার ভাবীর মজার মজার রান্না সাবার চলে মাঝরাত পর্যন্ত।

স্ত্রী কন্যাদেরসহ সুখের সংসার, প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়সে এসে আসিফের প্রাক্তনকে বিয়ে করার ফের অভিপ্রায়, আমাকে আজ উন্মাদ করে দিল। এই ছেলেটার সাথে আমার বন্ধুত্ব প্রায় চল্লিশ বছরের, আজ কেন যেন মনে হল ভুল মানুষের সাথে আমার এতদিনের বন্ধুত্ব। সে আদতেই একজন খারাপ মানুষ, তাহলে এসব ভাবতে পারে কিভাবে!

আসিফের প্রাক্তন শায়লার সাথে অন্যান্য স্কুল বন্ধুদের মত আমার এখনো যোগাযোগ আছে, আর তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে। আমাদের বন্ধুদের সবার জানা, প্রায় বছর দশেক আগে শায়লার ডিভোর্স হয়েছে। একমাত্র কন্যাকে নিয়ে বেইলি রোডে নিজেদের এপার্টমেন্টে থাকে। নিজে একটা বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি ও নিজের চাকুরী, মেয়েকে নিয়ে ও খুব ভালো আছে। অন্ততপক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিন্তু তা ই বলে।

আমার মনে খচখচ করছে, হঠাৎ করে কি এমন হলো যে আসিফ তার প্রাক্তন শায়লার জন্য বিয়ে করার জন্য উতলা হয়ে গেল। একবার ভাবলাম এ প্রসঙ্গটাতেই আর যাব না, অযথা আসিফের এই অনৈতিক ভাবনাতে সায় দেওয়ার কোন মানে নেই। তারপরও বন্ধুর ভুল ভাঙানোর চেষ্টায় খানিকটা অনিচ্ছা সত্বেও জিজ্ঞেস করা “তুই কি সিরিয়াস, শায়লার সাথে কি আবারো রিলেশনে জড়িয়েছিস? একবারও তোর স্ত্রী বাচ্চাদের কথা চিন্তা করিস নি?”

“দোস্ত, আমি শায়লাকে ছাড়া বাঁচবো না! আমি ওকে একেবারে ছোটবেলা থেকে ভালবাসতাম, এখনো বাসি। আর মেয়েটা সত্যই খুব কষ্টে আছে রে বন্ধু, আমার সাথে কথা হয়েছে! আমি এখন আমার সত্যিকারের ভালোবাসাকে পরিণতি দিতে চাই। আমি শায়লাকে বিয়ে করব। বন্ধু, তোর কাছে জোর মিনতি, আমাকে একটু সাহায্য কর।”

সিদ্ধান্ত (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।)

“তোর বাইশ বছরের সংসার জীবন, স্ত্রী তিন কন্যা, সেই সাথে চাকুরী ও সামাজিক অবস্থান! এর সব কিছু কি একবার ভেবে দেখেছিস? শায়লাকে যদি এ অবস্থায় বিয়ে করিস, আগে ভাগেই বলে রাখছি তুই কিন্তু সব হারাবি। অন্য বন্ধুদেরতো নয়ই, আমাকেও তোর এসব পাগলামিতে পাবি না। একটা কথাই বলতে চাই, তুই কিন্তু খাল কেটে কুমির আনছিস! এখনো সময় আছে সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে!” পঁচিশ বছর আগে প্রেমিককে ছুড়ে ফেলে দিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করা শায়লাকে আসিফের বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ, বিষয়টাকে মোটেও সহজভাবে নিলাম না। আসিফ সম্ভবত আমার অবস্থানে সন্তুষ্ট হলো না। তাইতো তার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টায়।

“সোহেল, দোস্ত তোকে আজ একটা গোপন কথা বলছি। সংসার জীবনে তোদের ভাবির সাথে কিন্তু আমি মোটেও সুখী নই। হ্যাঁ, ও নিঃসন্দেহে ভালো একজন গৃহিণী, পরিবারের সবার দেখভাল করে। কিন্তু বেশ অনেকদিন ধরেই লায়লা কিন্তু আমাকে আর আকর্ষণ করে না। কেন জানি প্রেম-ভালোবাসা এই জিনিসগুলো ওর মধ্যে এখন আর নেই। কেমন একটা রোবট জীবনে, বাচ্চাদের নিয়েই ওর শত ব্যস্ততা। আরও একটা কথা তোকে শেয়ার করছি, ও কিন্তু অনেকদিন ধরেই আমার সাথে বিছানাও শেয়ার করে না। নানান অজুহাতে রাতের বেলায় ছোট মেয়েটার সাথে ঘুমায়। আচ্ছা দোস্ত তুই ই বল, আমি তো একটা পুরুষ মানুষ। আমারও তো দৈহিক কিংবা মানসিক চাহিদা রয়েছে, তাই না? লায়লা কিন্তু এই জিনিসগুলো একেবারে বোঝার চেষ্টা করে না। তাইতো বছর দুয়েক আগে হঠাৎ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে আমার জীবনে শায়লার উপস্থিতি যেন তপ্তদিনে এক পশলা বৃষ্টি! ওর সঙ্গ কিংবা কথোপকথন, আমি ভীষণ এনজয় করি! একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতো করে।” আসিফ আর আমি হাঁটতে হাঁটতে পাবলিক লাইব্রেরির সিড়ির গোড়ায় চলে এলাম, ওখানেই আমাদের বসে পড়া।

আজ আমি ওর গল্পের এক মনোযোগী শ্রোতা। প্রতিটা কথায় ভীষণ অবাক হচ্ছি। ইদানিংকালে আধুনিক পরিবারগুলো যে কত রকমের সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই!

“তুই যে তোর প্রাক্তনের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে গেছিস, এটা কি ভাবি বা তোর পরিবারের কেউ জানে?” আসিফকে ইন্টারাপ্ট করলাম।

“আরে না, আমার বউয়ের কি আমাকে নিয়ে চিন্তা করার সময় আছে। আমি যদি রাতে বাসায় নাও ফিরি, লায়লা হয়তোবা আমার কাছে এই বিষয়ে কৈফিয়তও চাবে না! না দোস্ত, শায়লার বিষয়টা এখনো পর্যন্ত কেউউ জানে না। আজ ই তোর কাছে প্রথমবারের মতো কনফেস করলাম।” পুরো বিষয়টি যে এখনো গোপন আছে, জানতে পেরে ভালো লাগলো।

“তোর নেওয়া বিয়ের এই সিদ্ধান্তে, শায়লার কি মত? ও কি ওর মতামত তোকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে!” কথোপকথন আর না বাড়িয়ে, আসিফের কাছ থেকে ঘটনাটার সর্বশেষ কি অবস্থা, বোঝার চেষ্টা করলাম।

“তুই তো শায়লাকে চিনিস দোস্ত। ও কি কখনো মুখ ফুটে কিছু বলেছে। আমি অবশ্য আমার ভালোলাগা ও বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা ওকে জানিয়ে দিয়েছি! ও অবশ্য প্রত্যুত্তরে এখনো কিছু বলেনি, তবে আমি ওকে খুব ভালো করে জানি। নীরবতা যে ওর সম্মতির লক্ষণ, তা ধরেও নিয়েছি। কিন্তু আমার সমস্যাটা কিন্তু অন্য জায়গায়, পরিবার বা প্রফেশন সামলিয়ে পুরো বিষয়টাকে কিভাবে সামলাবো! এই বিষয়টাতে তোর একটু সাপোর্ট চাচ্ছি বন্ধু, আমার মাথা ইদানিং ঠিকভাবে কাজ করছে না। তবে আমি আমার জীবনে শায়লাকে চাই, প্রকৃত ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে।” আসিফের সাথে কথোপকথনের এই পর্যায়ে এসে আমার একটু খটকা লাগে।

ছেলেটাকে আজ আমার প্রথম থেকেই একটু অন্যরকম লাগছে। সত্য বলতে কি, বন্ধু আসিফকে সাহায্য করার জন্যই এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। তাইতো ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম “দোস্ত তুই বিষয়টা নিয়ে কোন চিন্তা করিস না, আমি দেখছি। আপাতত তোর কারো সাথে কথা বলার দরকার নেই। ইনশাল্লাহ তোর জন্য যেটা ভালো হবে, সেটাই করবো। বন্ধু হিসাবে তোকে এই নিশ্চয়তাটা দিলাম।” খুব খুশি হয়ে সে রাতে আসিফ বাসায় ফিরেও গেল।

আর এদিকে আমি বলতে গেলে সারারাত ঘুমোতে পারলাম না, বারবার আসিফের বাচ্চাদের ও ওর পরিবারের কথা মনে পড়তে লাগলো। আবার একই সাথে আসিফকে পুরোপুরি সুস্থ বলেও মনে হলো না বলে কষ্টবোধে। ওর জন্য কিছু একটা করতে হবে এই ভাবনা নিয়ে ভোরের দিকে ঘুমোতে গেলাম।

“তোর কি মাথা খারাপ সোহেল? আমি কেন আসিফকে বিয়ে করতে যাব? ওর স্ত্রী আছে, তিনটা মেয়ে, কত সুন্দর একটা সংসার! আমি কেন জেনে শুনে একটা সংসার ভাঙতে যাব। আর সত্য বলতে কি, হাসিবের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, জীবনে কারো সাথে আর সম্পর্কে জড়াবো না। মেয়ে আরিশাকে নিয়ে আমি এখন বেশ ভালোই আছি!” পরদিন লাঞ্চ শেষে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সোজা চলে এলাম গুলশানে, শায়লার অফিসে। বাইরের একটা রেস্টুরেন্টে, খোলামেলা ভাবে আসিফের নেওয়া বিয়ের সিদ্ধান্ত বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই শায়লার দেওয়া এই উত্তরে প্রাণ ফিরে পেলাম। শায়লাকেও আমার অনেকদিন ধরে চেনা, ও যে কোনরকম ভনিতা করছে না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম।

“তবে যে আসিফ বলল, তোর সাথে গত দুই বছর ধরে ওর খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, প্রতিদিন কথা হয় । তোরা না কি প্রায়ই দেখাও করিস? আর আসিফ না কি বিয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়টা তোকে জানিয়েছেও?” অনেকদিনের বন্ধুত্বের খাতিরে, শায়লাকে বিষয়গুলো নিয়ে আমার সরাসরি জিজ্ঞেস।

“আসিফ একেবারে মিথ্যে বলেনি! হ্যাঁ ওর সাথে আমার প্রায়ই কথা হয়, সামনাসামনি দেখাও হয়েছে বার কয়েক! কিন্তু এর সব কিছু একেবারে বন্ধু হিসাবে, অন্ততপক্ষে আমার দিক থেকে কোন রিলেশনে জড়ানোর ইচ্ছা গোড়া থেকেই নেই। ও রাতের বেলায় ফ্রি থাকে! আচ্ছা তুই ই বল, নিঃসঙ্গ এই আমাকে কাছের কোন বন্ধু যদি প্রতিদিন সময় দেয়, ভালো ভালো কথা বলে! আমার কি ইচ্ছা করবে না তার সঙ্গ পেতে?” শায়লার দেওয়া এই যুক্তি মেনে নিতে পারলাম না। আমি নিশ্চিত, শায়লা প্রশ্রয়েই আসিফের এই তিলকে তাল বানানো। আর আসিফকেও দোষ দিতে পারি না, ও যে স্কুল জীবন থেকেই শায়লা পাগল। আমি আর কথা বাড়ালাম না, সমস্যাটার দ্রুত সমাধান করতেই।

“শায়লা তুই যেটা করছিস, এটা মোটেও এথিকাল না। ফেইসবুকে বা গ্রুপে তোর প্রাক্তন বা বন্ধুরা থাকতেই পারে। তাই বলে তাদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা কিংবা সামনাসামনি দেখা করা, অন্ততপক্ষে তোর মত মেয়ের কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি। তোদের এইসব নিছক আনন্দের জন্য একটা সুন্দর পরিবার এখন ধ্বংস হওয়ার প্রান্তে। বন্ধু হিসেবে তোর কাছে জোর অনুরোধ, পুরো বিষয়টি চাইলে তুই আজই শেষ করে দিতে পারিস।” শায়লার আত্মসম্মানবোধ প্রচন্ড, ও আমার বলা শেষ কথাটায় সম্ভবত ভীষণ অপমান বোধ করল।

” যা, দিস ইজ ওভার!” এই কথা বলে আমার সামনে দিয়ে হনহন করে চলে যাওয়া এই মেয়েটার জন্যও খারাপ অনুভবে। হয়তো মেয়েটা বুঝতেও পারেনি, ওর টাইম পাস করার বিষয়গুলোতে যে আসিফ এতটা পাগল হয়ে যাবে। তবে শায়লাকে যে পুরো বিষয়টির গুরুত্ব বুঝাতে পেরেছি, এতেই সান্তনা পেলাম।

এরপর গুলশান দুই থেকে জ্যাম ঠেলে খিলগাঁওয়ে আমাদের বাসায় ফেরার পথটুকুতেই যে অনেক কিছু হয়ে গেছে, তা বুঝতে পারিনি। আমাদের স্কুল বন্ধুদের নিয়ে ফেসবুকে একটা গ্রুপ রয়েছে, শায়লা ওখান থেকে এরই মধ্যে লিভ নিয়ে নিয়েছে। আমার মত নির্দোষ ব্যক্তিকেও ওর ফেইসবুক থেকে ছেঁটে ফেলেছে। বুঝতে পারলাম শায়লা পুরো বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এখন সমাধানের চেষ্টায়।

“সোহেল তুই কই? আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে বন্ধু! শায়লা আবারো আমার সাথে বেঈমানি করেছে! একটু আগে ফোন করে আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, আমি যেন ওর সাথে আর কখনো যোগাযোগ না রাখি! ও আমাকে না কি কখনো ভালবাসেনি, এখনো না। শুধুমাত্র টাইম পাস করার জন্য বন্ধু হিসাবে না কি আমার সাথে ওর সময় কাটানো! তোর সাথে কি শায়লার কোন কথা হয়েছে?” ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে আসিফের একটানা উদ্বেগ।

“না আমার সাথে শায়লার কোন কথা হয়নি। দোস্ত মন খারাপ করিস না, আমি এখুনি আসছি। বল তুই এখন কোথায়?”

ইচ্ছা করেই আজ প্রিয় বন্ধুর সাথে মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য হলাম। একটা মিথ্যা সম্পর্ককে ধ্বংস করতে। আর অযথাই বিষয়টাকে কমপ্লিকেটেড করতে চাইলাম না।

শায়লা যে আসিফকে ভালবাসে না, আর বিয়ে করা তো প্রশ্নই আসে না! এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই আসিফকে আমার মিথ্যা এই বলা। শায়লার ব্যক্তিত্ববোধ সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ধারণা আছে। মেয়েটা যে এ জীবনে আর কখনোই আসিফের সামনে আসবে না, এ ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে আসতেই আসিফকে আজ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় পেলাম। এরপর প্রায় ঘন্টা দুই কথোপকথনের পর আসিফকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে শায়লা ওকে কখনোই মন থেকে ভালোবাসেনি, এখনোও না। মেয়েটা ওর জীবনে শুধুই একটা মরীচিকা। পরিবারের সাথে ওর সম্পর্কের উন্নতি, বিষয়টিতে কাজ করার অনুরোধও করলাম।

সে রাতেই আমি আসিফ সহ আমাদের কাছের পাঁচ বন্ধু পরিবারের একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করলাম! পরের শুক্রবার, ঢাকার কাছেই সুন্দর একটা রিসোর্টে। উদ্দেশ্য আসিফকে একটু স্বাভাবিক করা, পরিবারের সাথে তৈরি হওয়া ওর গ্যাপটা একটু কমানো। লায়লা ভাবি খুব সহজ সরল ভালো একজন মানুষ, অন্ততপক্ষে আমাদের বন্ধুদের তা ই ধারণা। পরদিন অফিস শেষে ভাবিকে পিকনিকের দাওয়াত দিতে ওদের বাসায় পৌঁছাতেই আসিফকে বেশ হাসি খুশি ও স্বাভাবিক বলেই মনে হলো। বুঝে নিলাম, শায়লার বিষয়টা এখন বিপরীতে হিত!

“দোস্ত তোর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা। অযথাই নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছিলাম। তোর কথাই সত্য, শায়লা আসলে কখনোই আমাকে ভালবাসেনি। ও আমার সাথে সারা জীবনই টাইম পাস করল!” পিকনিকের সকালে রিসোর্টের ব্রেকফাস্টে বলা আসিফের কথাটাকে আর বাড়াতে দিলাম না।

“আজকের এই সুন্দর দিনে শুধু শুধু আজেবাজে প্রসঙ্গ নিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করেছিস কেন? যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো বিষয়টা যে অল্পতেই শেষ হয়ে গেল। আমার ভালো লাগছে, তোকে অনুতপ্ত হতে দেখে! দেরিতে হলেও যে ভুল বুঝতে পেরেছিস, এতেই আমি খুশি। আশেপাশে অন্যান্য উদাহরণ দেখ, এসব বিষয়ের পরিণতি খুব খারাপ!” আসিফ মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দিল।

“ও আরেকটা কথা, ভাবির সাথে তোর সম্পর্কটা উন্নত করার যে পরামর্শটা দিয়েছিলাম। সেটার কি অবস্থা? ঠিকঠাক মত কাজ করছিস তো? মেয়েদের রোমান্টিক আর ভালোবাসার মানুষ বানানোর দায়িত্ব কিন্তু পুরুষদেরই!” আমার বলা শেষ কথাটাতে কিছু একটার ইঙ্গিত পেয়ে আসিফের দেওয়া জোর হাসিতে, সোমা আর লায়লা ভাবি এসেও যোগ দিল। আমরা সবাই মিলে এখন একটানা হাসি আর আনন্দে!

সমাপ্ত।

ছবির মানুষ

0

ছবির মানুষ
ফাহমিদা লাইজু
(১ম পর্ব)

রুবাইদা একা থাকলে কখনোই লিফটে উঠে না। তিন বছর আগে বান্ধবীর বাসার লিফটে ওঠার পরপরই কারেন্ট চলে গিয়েছিল, মোবাইল বের করে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেও কাউকে ফোন দিতে পারছিল না নেটওয়ার্কের অভাবে। দুপুরের সময় হওয়াতে সেসময় লোকজনের আসা-যাওয়া কম ছিল, বিশ মিনিটকে মনে হয়েছিল বিশ বছর। এই স্মৃতি মনে হলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু আজ অন্যমনস্ক ভাবে লিফটে উঠে গেল কিভাবে যেন।

দরজাটা যখন বন্ধ হয়েই যাচ্ছে এমন সময় দৌড়ে এসে উঠে গেল ফয়সাল। লিফটে একা থাকার ভয় দূর হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখন অজানা একটা অস্বস্তি হতে লাগল।

কিছুদিন আগে বাড়িওয়ালী, মানে ফয়সালের মা সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন রুবাইদার মা , হাসনাহেনার কাছে। বাড়ি-গাড়ি প্রতিপত্তি সবই আছে, ফয়সাল ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ভালো চাকরি করে, পাত্র হিসেবে কোন ভাবেই অযোগ্য নয়। তারপরও হাসনাহেনা সময় নিয়েছেন। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে তো আর হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এভাবে খোঁজখবর নিতে হবে। টাকা থাকলেই তো আর ছেলে ভালো হয়ে গেল না।

—কেমন আছেন রুবাইদা?
—ভাল। আপনি? রুবাইদা যেন পালিয়ে বাঁচে।এর আগেও কয়েক জায়গা থেকে প্রস্তাব এসেছে।কিন্তু পাত্রকে চোখের সামনে এভাবে এতবার করে দেখতে হয় নি। মনে মনে ভাবে ,কেন যে এমন হয়, সে কি বাঘ নাকি ভাল্লুক? তাকে দেখলেই বুকের ভিতরে ধুক ধুক করে আর গলাটা শুকিয়ে যায়।
লিফট তিনতলা পার হয়ে গেলেও ফয়সাল নামলো না।

—আপনার সাথে ফেসবুকে এড হতে পারি?এই বলে নিজের মোবাইলটা অন করে রইল। ভাবটা এমন এখন ই রিকোয়েস্ট পাঠাবে।রুবাইদা সম্পূর্ণ নামটা বলল। লিফট ছয়তলায় পৌঁছে যাওয়াতে রুবাইদা নেমে গেল, পেছন থেকে শুনতে পেল –রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করবেন প্লিজ।

ফরিদা বসে ,শুয়ে একেক সময় একেক ভাবে যথারীতি স্টার প্লাসের সিরিয়াল দেখছেন। তার মেদবহুল শরীর নিয়ে উঠে এসে দরজা খুলতে অনেকটা সময় লাগলো।
—বড় চাচী মা কোথায়?
—তোর চাচাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছেন তোর বাবা-মা। আমারতো হাটুতে ব্যথা, তাই গেলাম না। টেবিলে চাউমিন বানিয়ে রেখেছে তোর মা, গরম করে খেতে বলেছে।
আসলে ফরিদা যাননি তার সিরিয়াল দেখা হবে না বলে।
রুবাইদা ফ্রেশ হয়ে, চওমিন নিয়ে বসল টিভির সামনে। ছয় দিন থেকে টিভির সামনে বসলে ই দেখতে হয় স্টার প্লাস, স্টার জলসা এই সব।এমনিতেও খুব একটা টিভি দেখা হয় না। রাত দশটার পরে আবার বাবা- চাচা খবর দেখবেন। হাসনাহেনা খুব একটা টিভি দেখেন না। তার মতে টিভি দেখা হলো সময়ের অপচয়। এখন যা দেখায়, শুধু মানুষের সংসার ভাঙ্গা আর কুটকৌশল শেখায়। আহ্ আগের সেই নাটক, সেই ইত্যাদি ।

বড় চাচীর সিরিয়াল ব্রেক এসেছে,এখন মনোযোগ দিলেন রুবাইদার উপর
—কি রে কাল তোর মায়ের সাথে এভাবে জোরে জোরে কথা বল্লি কেন?
—আমাদের গ্রুপের সবাই ঘুরতে যাবে সেন্টমার্টিন। কিন্তু মা আমাকে যেতে দেবে না। এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না।

—রাইয়ান চাইলে তো ঠিকই দিতো।
—একদম ঠিক বলেছেন চাচী।
—তোকে দেখি সব কিছুতেই না করে। ভার্সিটিতে পড়িস, এত বড় হয়েছিস, নিজের ভালো তো ভালই বুঝতে পারিস। রাইয়ান কে তো এত শাসন করে না।
—রাইয়ান কেউ মানা করে মা। সবকিছু মেনে নেয় না।
একটু গম্ভীর হয়ে, করুন চোখে তাকিয়ে ফরিদা, রুবাইদা যেন শুনতে পায় ততটুকু আস্তে বললেন,
—-নিজের মা হলে এমন করত না তোর সঙ্গে।
—এর মানে কি?
—না না কিছু না।
—কিছু না মানে? মাত্র যে বললেন আমার নিজের মা না?
—কাউকে কিন্তু বলিস না। আমার আবার সবকিছুতেই দোষ ধরে মানুষ।তবে তোর কষ্ট দেখে সহ্য হচ্ছে না আমার, তাই বলছি। জন্মের সময় তোর মা মারা যায়। এরপর তোর খালা মানে হাসনাহেনা কে তোর বাবা বিয়ে করে।
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। রুবাইদা যেন নাড়াচাড়ার শক্তি পাচ্ছে না।

রাইয়ান এসে তোড়জোড় শুরু করলো, খুব খিদে পেয়েছে।মা কোথায়? রোবাইদা কোন উত্তর না দিয়ে রুমে চলে গেল। ফরিদা বলে দিলেন টেবিলে খাবার আছে।

কয়েক বার ডাকার পরেও রুবাইদা খাবার টেবিলে আসলো না দেখে, হাসনাহেনা গিয়ে দেখেন রুবাইদার চোখ ফোলা ফোলা লাল হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, সে অনেক কেঁদেছে। হাসনাহেনা অস্থির হয়ে গেলেন, অনেকবার জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে,
একসময় ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বলল–
— তুমি নাকি আমার মা না?

চলবে।

দুই পর্বের গল্প
ছবির মানুষ
শেষ পর্ব

এই প্রশ্ন শুনে মনে হলো একটা তীর কেউ বিঁধিয়ে দিয়েছে হাসনাহেনার বুকে। শরীরটা যেন টলে উঠল। রুবাইদা মাথা নিচু করে আছে, সে কিছুই দেখতে পেল না। অন্য সময় অন্য কোন প্রশ্ন শুনলে হাসনাহেনা চেঁচামেচি করতেন কিন্তু এখন তিনি খুব শান্ত স্বরে বললেন-
—যদি পেটে ধরলেই শুধু মা হয়, তাহলে সে হিসেবে আমি তোর মা না।
আর একটা কথা না বলে, ডাইনিং এর কাছে এসে দাঁড়িয়ে ফরিদাকে বলতে লাগলেন-
—-এই বার আপনার আত্মা শান্তি পেয়েছে? সত্যিই একটা অজগর আপনি। আমার শাশুড়ি আপনাকে ঠিকই চিনেছিল। মানুষের সুখ আপনি গিলে খেয়ে ফেলতে চান।ষোল বছর আগের ঘটনা আবার আপনি ঘটিয়ে দেখালেন। এত বছর পরে এসেই আপনার আসল রূপ আবার দেখালেন।
হাসনাহেনা কথা বলতে বলতে কাঁপতে লাগলো রাগে।রাকিব এগিয়ে এসে হাসনাহেনাকে ধরে, কি হয়েছে বার বার জানতে চাইলেন —
—-এই হাসনা কি হলো ,বল
হাসনাহেনা তার স্বামীর বুকে দুই হাত রেখে, ধরা গলায় বলতে লাগলো-
—-এই মহিলা রুবাইদাকে বলেছে, আমি ওর মা না। তুমি শুনছ , ভাল করে শুন। রুবাইদার মায়ের নারী কাটার পর থেকেই আমার ভালোবাসা দিয়ে ওকে পেচিয়ে ধরে ছিলাম। এতগুলো বছর রুবাইদার মনে তো এই প্রশ্ন আসেনি।আজ এই মহিলা রুবাইদার মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
—তুমি একটু শান্ত হও। প্লিজ শান্ত হও।
—কি বল তুমি?আমি শান্ত হব?এই মহিলা আমাদের মা -সম্পর্কের মধ্যে আগুন লাগাতে এসেছে।

হাসনাহেনা নিজের রুমে চলে গেলেন একা একা কথা বলতে বলতে। রাইয়ান ও বুঝতে পারছেনা কিছু, দাঁড়িয়ে থেকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

রাকিব আর জুনাইদ এক সঙ্গে ফরিদার দিকে
তাকালো। ফরিদার কোন ভাবান্তর নেই। সে অবলীলায় বলতে লাগলো-
—অন্যায় কি করেছি। কিছুদিন পর বিয়ে দেবে, তখন তো সত্যিটা জানাতেই হবে। আগে থেকে জানলে সমস্যা কি?
—তুমি আর মানুষ হবে না। এক পা কবরে চলে গেছে তবুও কুটনামি কমেনা। জুনায়েদ কথাগুলো বলে ছি ছি করে উঠলেন।

তোমার মায়ের তখন ক্রিটিক্যাল অবস্থা ,আমরা সবাই হসপিটালে খুব অস্থিরতার মধ্যে ছিলাম, হাসনাহেনার কোলে তোমাকে এনে দেয়া হল , এর কিছুক্ষণ পরেই তোমার মা চলে গেলেন। হাসনার সেই বছর অনার্স ফাইনাল দেওয়ার কথা ছিল। ওর কোলে থাকলে তুমি কাঁদতে না, পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতে। ও পরীক্ষা দিতে পারল না সে বছর। আমার মা হাসনার হাতে ধরলেন তোমার মা হওয়ার জন্য। তার বড় বোনের শেষ স্মৃতির কাছে, স্নেহের টানে সেও বাধা পড়ে গিয়েছিল।
এমনটা হতেই পারে কিন্তু অনেক বড় আত্মত্যাগ করেছিল নিজের ভালবাসাকে বিসর্জন দিয়ে, শুধু তোমার জন্য।
তোমাকে আর রাইয়ান কে কখনো আলাদা করে দেখেছে?বরং তোমাকেই বেশি ভালোবাসে।কিভাবে তোমাদের ভবিষ্যত ভালো হবে নিরাপদ থাকবে সারাক্ষণ সেই চিন্তায় শুধু সে করে।

—বাবা আমি মাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য প্রশ্ন করিনি।বড় চাচীর কাছে হঠাৎ কথাটা শোনার পরে আমার কি যে হলো বলতে পারব না। আমার কাছে কেন তোমরা গোপন করলে এত বছর?
—প্রথম থেকে তুমি যদি জানতে তাহলে রাইয়ানের সঙ্গে সব সময় পার্থক্য খুঁজতে।ভালোর জন্য শাসন করলেও মনে মনে ভাবতে সে আমার সৎ মা। সম্পর্কের মাঝে তিক্ততা ছড়িয়ে পড়তো। এসব কোনো প্রশ্ন যেন তোমার মনে না আসে তাই তোমার দাদু এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
কথা বলতে বলতে রাকিব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

হাসনাহেনা কিছুই খেলেন না রাতে। রাকিব তার পাশে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন, আসলে বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। হঠাৎ হাসনাহেনা রাকিবের বুকে মাথা রেখে কাঁদে উঠল। রাকিব তাকে গভীর মমতায় জরিয়ে নিল।এত বছরে কখন ও হাসনা এমন করে নি।
সংসারধর্ম , সন্তান সবকিছু ঠিকঠাক পালন করেছে কিন্তু অদৃশ্য একটা পর্দা সবসময় ঝুলতো তাদের মাঝে।

বিয়ের কিছুদিন পরে, রাকিবকে হাসনাহেনা নিজেই জানিয়েছিল শাহেদের কথা। আগে জানলে কি অন্য রকম হতে পারত,হলেও হত, আবার নাও হতো। অপরাজিতার সঙ্গে রাকিবের বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হলেও তাদের তিন বছরের সংসার জীবন আনন্দময় ছিল।তার বিয়োগে হঠাৎ করে অন্য একজনকে জীবনসঙ্গী করা তার পক্ষেও কঠিন ছিল। সবকিছু ছাপিয়ে সবার আগে রুবাইদার চিন্তাটাই সবার সামনে প্রধান ছিল।
ভালোবাসার মানুষ শাহেদেকে ছেড়ে নিজের প্রিয় বোনের স্বামীকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নিতে দিনের পর দিন নিজের সঙ্গে কী পরিমাণ যুদ্ধ করতে হয়েছে তা শুধু হাসনাহেনা জানে। সবকিছু করেছে শুধু রুবাইদার জন্য। আর আজ সেই রুবাইদাই—-

বাসাথেকে বের হওয়ার সময় হাসনাহেনা সবসময় সন্তানদের মাথায় আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুক্ দেন,যেন বিপদাপদ না ঘটে। আজ এই প্রথম রুবাইদা বাসা থেকে বের হয়ে গেল কাউকে কিছু না বলে।

গেটের কাছে ফয়সাল দাঁড়িয়ে। সে রুবাইদার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
—আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেননি কেন?
রুবাইদা দাঁড়ালো না। হন্ হন্ করে হেঁটেই যাচ্ছে। ফয়সালের কথা তার যেন কানেই ঢোকে নি।
এবার ফয়সাল একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
—কি ব্যাপার কথা বলছেন না যে? ক্লাসের কি দেরি হয়ে যাচ্ছে?
রুবাইদা চোখ তুলে তাকাতেই, ফয়সাল কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। চোখ- মুখ ফোলা ফোলা কেমন যেন লাগছে রুবাইদা কে।
—ক্লাসে যাচ্ছি না। কোথায় যাব এখনো বুঝতে পারছি না। সবুজের কাছাকাছি ইচ্ছে করছে যেতে। প্রকৃতির মাঝে কিছুক্ষণ থাকলে ভালো লাগবে আমার।
—-যেতে পারি সাথে?
—অফিস নেই?
বুঝতে পারলো রুবাইদার সম্মতি আছে।

ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসলো ফয়সাল।রুবাইদার এখন ভালো লাগছে, পা থেকে স্যান্ডেল খুলে ঘাসের উপর খালিপায়ে গোল গোল হয়ে কিছুক্ষণ বাচ্চাদের মত হেটে, বসে পরলো ফয়সালের থেকে এক হাত দূরে।

কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পেরেও ফয়সাল কিছু জিজ্ঞেস করছে না , মনে মনে ভয় ও পাচ্ছে যদি তার স্বপ্নটা ভেঙে যায়। এই মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই কি যে হলো তার,বার বার একই ভাবনা ,রুবাইদা তার জীবনে না আসলে জীবন অচল হয়ে যাবে। আসলে মেয়েটা তার মনে ঝড় তুলে দিয়েছে।ঠিক যেন টিন এজারদের মত।এই বিষয়টা তার নিজের কাছেই অবাক লাগে।

রুবাইদাদের দোতলা বাড়ি ডেভলপারদের দিয়ে মাসপাঁচেক আগে তাদের বাসায় ভাড়া এসেছে। তাদের ফ্ল্যাট কমপ্লিট হলেই চলে যাবে। অবশ্য ফয়সালের কিছু বলার আগেই তার মা রুবাইদার মায়ের কাছে প্রস্তাব দেন। তার মায়ের ভাষ্য মতে ,এমন মেয়ে নাকি সচরাচর দেখাই যায়না।

অনেকক্ষণ কেউই কথা বলল না।এক ফাঁকে ফয়সাল মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে, বিশেষ কারণে আজ অফিস যেতে পারবে না।

—আমার জন্মের সময়ই আমার মা মারা যান। পরে আমার খালাকে বাবা বিয়ে করেন।এই কথাটা গতকাল ই আমি জেনেছি বড় চাচীর কাছে।মাকে খুব খারাপভাবে আমি প্রশ্ন করেছি, মায়ের মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে মায়ের আদর দেওয়ার জন্য অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন মা। একদমই এমন করা ঠিক হয়নি। মায়ের দিকে কি ভাবে তাকাবো এটা ভেবেই কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি।
—-বাসার সবাই তাহলে তো খুবই চিন্তা করছে। ফোন করে ওনাদের জানিয়ে দাও।
—মোবাইল হাতে নিতেই অনেকগুলো মিসডকল দেখতে পেল। সে বাবাকে মেসেজ করে দিল, আমি ভালো আছি, কিছুক্ষণ পরে বাসায় চলে আসব।

—এখন আমার কি করা উচিত?
যার সঙ্গে কোন দিন ভাল করে কথাই বলেনি আজ তার মতামত চাচ্ছে। কেন যেন ফয়সালের সঙ্গ ভাল লাগছে।
তার সঙ্গে শেয়ার করে হালকা লাগছে।
এই প্রথম রুবাইদা ফয়সালের চোখের দিকে তাকালো। ফয়সালের চোখ খুব সুন্দর কিন্তু বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলো না, কেমন যেন লজ্জা লাগছে। কি প্রশ্ন করেছে সেটাও ভুলে গেল।

—আন্টিকে সরি বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। মা তো মা ই। সবকিছু ভুলে ক্ষমা করে দেবেন। যিনি এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তোমার জন্য, এই সামান্য ভুল ক্ষমা করবেন না? আর তোমার জন্মদাত্রী মা যিনি এই পৃথিবীতে নেই শুধু ছবির মানুষ হয়ে আছেন, তার থেকে তোমার এই মা কোন অংশে কম?
কখন থেকে তুমি বলা শুরু হলো,সেটা কারো নজরে এলো না।
—এখন চল, সকাল থেকে খাওয়া হয়নি বোধহয়?

হাসনাহেনাকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে রুবাইদা।কত কথা বলবে ,সরি বলবে চিন্তা করেছিল রুবাইদা সেসবের কিছুই বলা হলো না। হাসনাহেনা ও গভীর মমতায় জড়িয়ে রাখলেন মেয়েকে ঠিক যেন ছোট্ট শিশু মায়ের কোলে।

শেষ।।

ফাহমিদা লাইজু