Wednesday, June 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 10



মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-২১ এবং শেষ পর্ব

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২১.
মৃত্তিকাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছেন সাজেদা বেগম আর মৃদুলা। প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে তার‌। মৃন্ময়ীকে কল করে খবর দিয়েছেন। প্রভাত আর মৃন্ময়ী তাদের কল পাওয়ামাত্র রেডি হয়ে হসপিটালে ছুটে এসেছে। বেচারি মৃত্তিকার অবস্থা শোচনীয়। গতকাল পর্যন্ত-ও সে নরমাল ডেলিভারির আশায় ছিল। ডক্টর-ও তাকে তেমন আশ্বাস-ই দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তার অবস্থা থেকে ডক্টর-ই বললেন আজকের মধ্যে সিজারিয়ান ডেলিভারি করতে হবে। নয়তো বাচ্চার ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এ কথা শুনে মৃত্তিকার মাথায় যেন বাজ পড়ল। ডেলিভারির জন্য সে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তা সিজারিয়ান ডেলিভারির জন্য যথেষ্ট নয়। সাজেদা বেগম এবং মৃত্তিকার জন্য তো এত টাকা দেওয়া অসম্ভব। একমাত্র ভরসা তাদের মৃন্ময়ীর মুখেই। মা যখন ভরসার চোখ দুটো তার দিকে তুলে ধরল, মৃন্ময়ী অন্ধকার মুখে বলল,
“আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তা দিলেও তো হবে না মা।”
সাজেদা বেগম দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ে বললেন,
“এত করেও শেষমেশ এসে বাচ্চাটাকে আমরা হারাব?”
মৃদুলা বলল,
“এসব বোলো না মা। আপু, কিছু একটা উপায় খুঁজে বের করা যায় না?”
মৃন্ময়ী ভাবুক মুখে বলল,
“তা তো করতেই হবে।”
“আমাদের কাছে যা টাকা আছে, তা একসঙ্গে করে রাখি। বাকি টাকাটা কারো কাছ থেকে ধার নেওয়া গেলে ভালো হয়। পরে না হয় আমরা সবাই মিলে শোধ করে দিবো।”
“আমি দেখছি কী করা যায়। তোরা চিন্তা করিস না।”

মৃন্ময়ী কেবিনের বাইরে সরে গিয়ে দ্রুত ভাবতে শুরু করল কার-কার কাছ থেকে টাকা চাওয়া যায়। আগে বিপদে পড়লে অনেকের কাছেই টাকা চাওয়া যেত। এখন তা সবাই সহজভাবে দেখবে না। বরং তার স্বামী থাকতে অন্যদের কাছে টাকা ধার চাওয়ার বিষয়টা নির্ঘাত সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মৃন্ময়ী বেছে-বেছে বিশ্বাসযোগ্য দু-এক জন মানুষকে কল করার সিদ্ধান্ত নিতেই তার সামনে প্রভাত উপস্থিত হলো। প্রভাত তার চিন্তাগ্রস্থ মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে প্রশ্ন করল,
“তোমাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর তুমি এখানে কী করছো?”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার একটা কল করতে হবে। তুমি ভেতরে যাও, আমি আসছি।”
“আমি ভেতর থেকেই এসেছি। ডক্টরের সাথে কথা বললাম। সিজারিয়ান ডেলিভারি ছাড়া উপায় নেই। আমি বলেছি যেটা ভালো হয়, সেটাই করতে। মৃত্তিকা আর বাচ্চা সুস্থ থাকলেই হয়। আমরা সিদ্ধান্ত জানালেই ওনারা ডেলিভারির টাইম জানিয়ে দিবেন। টাকা-পয়সার কথা-ও আমি জেনে এসেছি। তাড়াতাড়ি চলো।”
“তুমি যাও, আমি আসছি।”
“কেন? কাকে কল করবে তুমি?”
“করব একজনকে।”
“কোনো সমস্যা?”
“না।”
প্রভাত চলে যেতে গিয়েও আবার থেমে গেল। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি টাকা নিয়ে চিন্তিত?”
মৃন্ময়ী বলল,
“হ্যাঁ, একটু চিন্তা তো হচ্ছেই।”
“কেন?”
“আমার আর মৃদুলার কাছে দিয়ে দিয়েছি। আরও কিছু টাকা লাগবে।”
“আচ্ছা, বাকি টাকা কার কাছে চাইলে?”
“চাইনি এখনও। জোগাড় হয়ে যাবে। তুমি ওদের কাছে যাও।”
প্রভাত কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে মৃন্ময়ীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। মৃন্ময়ী শুধাল,
“কী? তাকিয়ে আছো কেন?”
“তুমি কি আদৌ আমাকে নিজের পরিবার ভাবতে পেরেছ মৃন্ময়ী?”
“এ আবার কেমন কথা?”
“আমাকে সামনে রেখে তুমি অন্য মানুষের কাছে টাকা ধার চাওয়া ধরেছে, এটা কেমন কথা?”
“ব্যাপারটা তেমন নয়। আমি-”
তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রভাত বলল,
“যেমন ব্যাপার-ই হোক। কারোর কাছ থেকে টাকা ধার চাইবে না। চলো।”
“আরে আমার কথা তো শোনো।”
“কথা বাড়ি ফিরে শুনব।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। তাকে কেবিনের সামনে পৌঁছে দিয়ে সে শুধু বলল,
“মৃদুলাকে নিয়ে গিয়ে ডক্টরের সাথে কথা বলো। আমি টাকা তুলে নিয়ে আসছি।”

কথাটা বলেই সে প্রস্থান করল। মৃন্ময়ীকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। মৃদুলা এগিয়ে এসে বলল,
“ভাইয়া কি রাগ করেছে?”
“অন্য মানুষের কাছে টাকা ধার চাওয়ার কথা শুনে অসন্তুষ্ট হয়েছে।”
“এখন কোথায় গেল?”
“টাকা তুলতে।”
“ভাইয়াকে না বলে আগেই টাকা ধার চাওয়া উচিত হয়নি। কথাটা তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল আমার।”
“টাকা চাইনি। ও যেমনটা ভাবছে, আমি তো তা ভেবে টাকা ধার করার কথা ভাবিনি। ও তো কম করে না আমার পরিবার নিয়ে। তবু বারবার আমি ওর টাকা নিই কী করে বল? কিছু টাকা ধার করলে কি আমি পরে শোধ করে দিতে পারতাম না? ওর জন্যই তো এখন আমার আগের মতো টানাপোড়েন নেই। ওকে তা কে বুঝাতে?”
মৃদুলা বলল,
“বুঝাতে হবে না। তোমার থেকে ভাইয়া ভালোই বোঝে। তুমি তাকে অসন্তুষ্ট কোরো না আর।”

মৃত্তিকার ডেলিভারির পুরো টাকাটাই শেষে প্রভাত দিয়েছে। রাত দুইটায় মৃত্তিকা একজন কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে। তারা দুজনেই সুস্থ আছে। প্রভাত আর মৃন্ময়ী রাতে হসপিটালেই থেকে গেছে। রাতের খাবার রাহেলা বেগম রান্না করে প্রভাতের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সকালে মৃত্তিকাকে অপারেশন রুম থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। সকালের খাবারটা-ও প্রভাত বাইরে থেকে কিনে নিয়ে এসেছে। প্রভাত যখন মৃত্তিকাকে দেখতে গেল, সে তখন দুচোখে টলমল জল নিয়ে প্রভাতের দিকে তাকাল। কন্ঠে কৃতজ্ঞতা মেখে বলল,
“আপনার কাছে আমি ঋণী থাকব ভাইয়া। আপনি না থাকলে এই বিপদের দিনে আমার বোনদের না জানি কত ভোগান্তি পোহাতে হত। আমি সুস্থ হয়ে চাকরি কনটিনিউ করার পর আমি আপনার পাওনা শোধ করে দিবো। আপনার এই উপকার আমি আজীবন মনে রাখব।”
প্রভাত বলল,
“এসব বলে আমাকে পর করে দিয়ো না মৃত্তিকা। আমি বলেছি না তোমরা যেমন মৃন্ময়ীর পরিবার, তেমনি আমার-ও পরিবার? ওর পরিবারের গুরুত্ব আমার কাছে কোনো অংশে কম নয়। আমাকে পরিবারের একজন ভাবলে ঋণ শব্দটা আর কখনও মুখে আনবে না। আপনজনদের কাছে আবার ঋণ কিসের? তোমার বাচ্চা-ও এখন থেকে আমাদের পরিবার। তুমি নিজেই যদি আমাকে পরিবার না ভাবো, তোমার বাচ্চা ভাববে কীভাবে?”
মৃত্তিকা বলল,
“না-না ভাইয়া। আমরা কখনোই আপনাকে পর ভাবি না। আপনি সবসময় আমাদের পরিবার হয়ে পাশে থেকেছেন। আমার বাচ্চার তো ভাগ্য ভালো যে ও আপনার মতো পরিবার পেয়েছে।”
পাশ থেকে মৃদুলা বলল,
“আমাকে খালামনি হিসেবে পাওয়া-ও তোমার বাচ্চার সৌভাগ্য, হুহ্!”
মৃত্তিকা হেসে বলল,
“তা দেখব খালামনি কেমন যত্ন করে।”
“দেখো, দেখো। বাড়ি চলো, তারপর তোমাকেই আমি শেখাব কীভাবে বাচ্চার যত্ন নিতে হয়।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“যাক, তাহলে তো বাচ্চা নিয়ে আমার আর কোনো চিন্তা নেই।”

মৃন্ময়ীর স্কুলে যেতে হবে বলে, প্রভাতের সঙ্গেই তাকে ফিরে যেতে হলো। তার অবশ্য চিন্তা হচ্ছিল মা-বোনদের নিয়ে। মৃদুলা আর মা বলল তাদের সমস্যা হবে না। মৃন্ময়ী যেন ক্লাস শেষ করে আসে। প্রভাত মৃন্ময়ীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই অফিসে চলে যাবে। বাইকে বসে প্রভাতকে চুপচাপ দেখে মৃন্ময়ী নরম গলায় প্রশ্ন করল,
“এই, তুমি কি আমার সাথে রেগে আছো?”
প্রভাত ছোটো করে জবাব দিলো,
“উঁহু।”
“মিথ্যা বলছো।”
“মিথ্যা বলব কেন?”
“তুমি টাকার বিষয়টা নিয়ে আমার সাথে রেগে আছো। তাই না?”
“তুমি ভালো করেই জানো আমি তোমার সাথে রাগ করি না।”
“তাহলে কি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছ?”
“বাদ দাও, যা গেছে তো গেছে।”
মৃন্ময়ী বাদ দিলো না। প্রভাতের পেটের কাছের শার্টটা আরও একটু চেপে ধরে বলল,
“সরি গো। আমি বুঝতে পারিনি তুমি এত অসন্তুষ্ট হবে। আসলে আমি ব্যাপারটা তেমনভাবে ভাবিনি।”
“তাহলে কেমনভাবে ভেবেছিলে?”
“আমি ভেবেছিলাম তুমি তো এইমাসে অলরেডি অনেক খরচ করে ফেলেছ। এটা যদি আমি সামলাতে পারি।”
“সব খরচ আর এক না। তুমি নিজে ব্যাপারটা সামলাতে চেয়েছ, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি তা করতেই পারো। কিন্তু অন্য কারো থেকে টাকা ধার নিয়ে কেন? ধার মানুষ কখন নেয়? যখন নিজেদের হাতে কোনো উপায় না থাকে। তোমার তো আমি ছিলাম। আমি তোমার নিজের মানুষ না। তুমি নিজের মানুষ রেখে অন্যদের কাছে কেন সাহায্য চাইবে?”
মৃন্ময়ী চুপ হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে সে সত্যিই ভুল করে ফেলেছে। প্রভাত পুনরায় বলল,
“ভবিষ্যতে আর এমনটা কোরো না মৃন্ময়ী। তোমার যখন সবচেয়ে বেশি সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, তখন আমি অধিকারের অভাবে যখন-তখন তোমার পাশে দাঁড়াতে পারিনি। এখনও যদি তুমি আমাকে সুযোগ না দাও, আমি সত্যিই ভীষণ কষ্ট পাব। তোমাকে সাহায্য করতে না পারার মতো বড়ো ব্যর্থতা আমার জীবনে দ্বিতীয়টি নেই।”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“আর করব না, প্রমিস। প্লিজ তুমি আমার সাথে রাগ কোরো না।”
প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“রাগ করিনি। তুমি চা খাবে?”
“না, এখন চা খেলে দুজনেরই দেরী হয়ে যাবে।”


টিউশন থেকে ফিরেই মৃদুলা ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিয়েছে। মৃত্তিকা চেঁচিয়ে ডেকে বলছে,
“হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়। তোর জন্য আমিও না খেয়ে বসে আছি। বাবু জেগে গেলে খেতে পারব না।”
মৃদুলা দুর্বল কন্ঠে উত্তর দিলো,
“আমার অনেক ক্লান্ত লাগছে আপু। একটু জিরিয়ে নিই। তোমার বেশি ক্ষুধা পেলে খেয়ে নাও।”
“তাহলে আমি এতক্ষণ তোর জন্য বসে ছিলাম কেন? তোর বিশ্রাম শেষ হলে ডাকিস আমাকে।”
“আচ্ছা।”
ফোনটা হাতে নিয়ে মৃদুলা ফেসবুকে ঢুকল। মৃত্তিকার মেয়ের সঙ্গে আজ সে দারুণ কিছু ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। এখন নিউজফিডে ঢুকেই দেখল অনেক রিয়্যাক্ট, কমেন্ট পড়েছে। নোটিফিকেশন চেক করতেই মৃদুলা চমকে উঠে বসে পড়ল। তার পোস্টে জাহিদের রিয়্যাক্ট! কী করে? চলে যাওয়ার পর জাহিদ তো আর এই আইডিতে অ্যাক্টিভ হয়নি। পরক্ষণেই সে খেয়াল করল জাহিদ তাকে ম্যাসেজ-ও দিয়েছে। অবিশ্বাস্য লাগল মৃদুলার। কাঁপা হাতে সে ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে দেখল অনেক বড়ো ম্যাসেজ। জাহিদ লিখেছে,
“কেমন আছো মৃদুলা? আমি খুব আশা করি তুমি ভালো থাকো। জানি আমি তোমাকে কেমন আঘাত করেছি। তবু আমি আশা রাখি তুমি ভালো থাকো। এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করার সাধ্য যে আমার নেই। এখানে আসার পর তোমার একটু খোঁজ নেওয়ার জন্য আমি প্রভাত ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ভাই বোধহয় আমার সাথে যোগাযোগ করতে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে কিছু সময়ের জন্য এই আইডি অ্যাক্টিভ করলাম। তুমি হয়তো ভেবেছ আমি তোমার সঙ্গে চিট করেছি। সে তুমি ভাবতেই পারো। সত্যিই তো, আমি তোমার বিশ্বাস রাখতে পারিনি, তোয়ায় ঠকিয়েছি। কিন্তু জানো, আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম মাকে মানানোর। জীবনে প্রথমবার আমি তোমার জন্য মায়ের হাত-পা ধরে অনুরোধ করেছিলাম। তবু আমি ব্যর্থ হয়েছি। মৃদুলা, তোমাকে ভালোবাসার দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি। আর তোমাকে হারানো আমার জীবনের সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা। অমি জানি না এই তিক্ততা কাটিয়ে উঠতে আমার ঠিক কত যুগ লাগবে। তবু বলব, তুমি আমাকে ভুলে যেয়ো। আমি তোমার স্মৃতিতে বাঁচার যোগ্যতা রাখি না। আমি চাই তুমি আমাকে ঘৃণা করো। আমাকে ঘৃণা করে হলেও তুমি আবার প্রেমে পড়ো। জীবনে একজন সঠিক মানুষকে বেছে নিয়ো যে কোনোদিন তোমার বিশ্বাস ভাঙবে না। মাঝপথে তোমার হাত ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাবে না। তার সঙ্গে তুমি খুশি থেকো। তোমার ওই চাঁদমুখে দুঃখ শোভা পায় না। তোমার প্রাপ্য একটি সুন্দর, সুখী জীবন। আমার হয়তো আর কোনোদিন দেশে ফেরা হবে না। ফিরলেও হয়তো আর তোমার মুখোমুখি হব না। তাই আর তোমাকে মিছে সান্ত্বনা দিতে চাই না। তোমাকে এই ম্যাসেজের উত্তর দিতে হবে না। আমি এই আইডি নষ্ট না করলেও আজকের পর আর এটা আমার কাজে আসবে না। যদি কোনোদিন সম্ভব হয়, এই অপরাধীকে ক্ষমা কোরো। সবসময় ভালো থেকো মৃদুলা।”

আশপাশে কেউ না থাকলে এই মুহূর্তে হয়তো মৃদুলা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদত। কিন্তু তার ম্যাসেজ পড়া শেষ হওয়ার আগেই মৃত্তিকা আবারও তাকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছে। মৃদুলার আর কাঁদা হলো না। বুকের ভেতর জমাট বাঁধা কষ্টগুলো উগড়ে ফেলা হলো না। একবার ভাবল খেতে যাবে না। মৃত্তিকা এতক্ষণ পর্যন্ত না খেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করেছে ভেবে আবার না-ও করতে পারল না। গলাভর্তি কান্না গিলে নিয়ে সে ভাত খেতে গেল। পেট পুরে ভাত খাওয়ার পর না হয় সে কাঁদবে। সারারাত কাঁদবে। এতগুলো দিন যত কান্না সে জমিয়ে রেখেছে, আজ সমস্ত কান্নাকে সে একেবারে মুক্তি দিয়ে দিবে। আজকের পর যে তাকে নতুনভাবে বাঁচতে হবে। নতুন মানুষের জন্য হৃদয়ে নতুন জায়গা তৈরি করতে হবে। এমনটাই তো হওয়ার ছিল।


বারান্দায় কিছু ফুলগাছ লাগিয়েছে মৃন্ময়ী। গাছগুলো অবশ্য প্রভাত এনে দিয়েছে। হঠাৎ করে তার খুব ফুলগাছের শখ হয়েছিল। প্রভাতকে বলার পরদিনই সে কিছু চারাগাছ নিয়ে হাজির হয়েছে। সেগুলো টবে লাগাতে-ও মৃন্ময়ীকে সাহায্য করেছে। মৃন্ময়ী রোজ দুবেলা করে গাছের যত্ন নেয়। সকালে নামাজ আদায় করার পর একবার, বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আরেকবার। রাতেও সে বারান্দায় বসে ফুলগাছ দেখে আর তাদের বড়ো হওয়ার অপেক্ষা করে। সে মনে-মনে কল্পনা করে গাছগুলো বড়ো হয়ে ফুল দেওয়ার পর তার বারান্দাটা কেমন দেখাবে। বারান্দা জুড়ে নানান রঙের ফুলে অবশ্যই সুন্দর দেখাবে। আচ্ছা, মৃত্তিকার মতো তার কোল জুড়ে-ও যদি ফুলের মতো একটা ফুটফুটে বাচ্চা আসে, সে-ও নিশ্চয়ই তার ঘর সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিবে? ইদানীং প্রভাত খুব বাচ্চাদের গল্প করছে। মৃত্তিকার বাচ্চাকে যতবার দেখে আসছে, ততবারই বাড়ি ফিরে মৃন্ময়ীকে বলছে তার ঘরে আরও একজন সদস্য দরকার। মৃন্ময়ী নিজেও এখন বিষয়টা নিয়ে ভাবছে। এখন তার চাকরি-বাকরির ঝামেলা মিটে গেছে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে সে। চাকরিটা পাওয়ার পর আগের স্কুল, কোচিং দুটোই ছেড়ে দিয়েছে। টাকা-পয়সা নিয়েও তার দুশ্চিন্তা নেই। প্রভাত তার বেতন নিয়ে মাথা ঘামায় না। নিজের ইচ্ছামতো সে খরচ করে। মায়ের ঔষধের খরচ প্রভাত যেচে নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে। এখন তার পরিবারে প্রয়োজনীয় খরচ দেওয়ার পরও তার হাতে টাকা অবশিষ্ট থাকে। মৃত্তিকার খরচ সে নিজেই চালাতে পারে। আর তার বাচ্চা তো বড়ো হচ্ছে সবার দায়িত্ব। প্রথমদিকে মৃত্তিকা নিজেও ভাবতে পারেনি তার বাচ্চা এতগুলো মানুষের পরিবার হয়ে উঠবে। তারা তাকে পরিবারের অভাব টেরই পেতে দেয় না। মৃন্ময়ীর চিন্তা এখন শুধু মৃদুলার জন্য। মেয়েটা পড়াশোনা শেষ না করা পর্যন্ত তার দিকটা মৃন্ময়ীকেই দেখতে হবে।

“কী আকাশ-কুসুম ভাবছেন ম্যাডাম?”
প্রভাতের ডাকে মৃন্ময়ীর ভাবনায় ছেদ পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল,
“কিছু না।”
“অবশ্যই কিছু ভাবছিলে। নয়তো আমার উপস্থিতি টের পেলে না কেন?”
“কতকিছুই ভাবছিলাম।”
“তা ম্যাডামের ভাবনায় কি এই অধমের ঠাঁই হয়েছিল?” মৃন্ময়ীকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে শুধাল প্রভাত।
মৃন্ময়ী ওপর-নিচে মাথা দুলিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
“হুমমম।”
“কী ভাবা হচ্ছিল আমাকে নিয়ে?”
“ভাবছিলাম কোন ভালো কাজের উপহারস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা আমার পোড়া কপালে একজনকে লিখে দিয়েছিলেন।”
প্রভাত কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“পোড়া কপালে?”
মৃন্ময়ী মৃদু হেসে দুহাতে প্রভাতের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“একজন মলম লাগিয়ে সারিয়ে নিয়েছে।”
প্রভাত নিচু স্বরে বলল,
“কেউ কি আমার প্রশংসা করছে।”
“তোমার প্রশংসা কে করছে? আমি তো আমার বরের কথা বলছি।”
“ওওও…আপনার বর আপনাকে এত ভালোবাসে?”
“অবশ্যই।”
“বাহ্! ভীষণ গর্বিত দেখছি। তা আপনি আপনার বরকে কতটুকু ভালোবাসেন?”
“তার মতো করে হয়তো ভালোবাসতে পারি না। তবে অনেক ভালোবাসি।”
“অনেক?”
“হ্যাঁ, অনেক।”
“তাহলে তো আপনার বরকে ভাগ্যবান বলা যায়।”
“উঁহু, ভাগ্যবতী তো আমি। তাকে জীবনে না পেলে হয়তো আমি একজন প্রকৃত প্রেমিককে হারাতাম। ভেতর থেকে কোনোদিন অনুভব করতে পারতাম না পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ আছে যার কাছে আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমার দুঃখে সে দুঃখ পায়, আমার আনন্দে সে আনন্দিত হয়। সে আমার জীবনের জাদুকর। সে নিজেও জানে না আমার টানাহেঁচড়ার জীবনটাকে সে কতটা বদলে দিয়েছে। আমাকে সে আগাগোড়া সুখী মানুষ বানিয়ে দিয়েছে।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“এই সুখ তোমার পাওনা ছিল ম্যাডাম। আর তোমাকে বিয়ে না করলে আমার ভাগ্য বদলাত কী করে? এদিক থেকে আমি নিজেই তো ভাগ্যবান। তুমি আমায় সংসারের মায়ায় না বাঁধলে হয়তো আজীবনই আমি ভবঘুরে, বেপরোয়া প্রভাত তরফদার থেকে যেতাম। নয়তো কেউ কি কোনোদিন ভেবেছিল আমার মতো মানুষ একদিন বাধ্য স্বামীতে পরিণত হবে?”
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে বলল,
“তুমি বাধ্য স্বামী?”
“অবশ্যই। তোমার তাতে কোনো সন্দেহ আছে?”
“না-না, তুমি তো খুব বাধ্য স্বামী। আমার কথায় ওঠো, বসো, খাও, ঘুমাও, সব করো। একদম বউভক্ত স্বামী।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“আমি যে খাস বউভক্ত, তাতে অন্তত তোমার সন্দেহ থাকা উচিত নয়। নয়তো আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না কেন?”
মৃন্ময়ী প্রভাতের বাহুতে চিমটি কে’টে বলল,
“তুমি তো এক নির্লজ্জ, একটাদিন-ও তোমার জন্য শান্তিতে বাবার বাড়ি থাকতে পারি না। ঢেংঢেং করে পেছন-পেছন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে হাজির হও।”
“আমি আজীবন এমন নির্লজ্জ-ই থাকতে চাই। আমার বউকে আমি ছাড়ব কেন? এমনিতেই জীবনের কতগুলো সময় নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি আমায় পাত্তা না দিয়ে আরও সময় নষ্ট করেছ। আমার অবশ্যই উচিত জীবনের বাকি সময়ের পুরোটা তোমার সঙ্গে কা’টানো। এতেও কি তোমার আপত্তি আছে?”
“আমার আপত্তি থাকলে কি তুমি আমার কথা শুনবে?”
“অবশ্যই না। এমন আপত্তি আমি মোটেও অ্যালাউ করব না। তুমি আমার বউ, সবসময় আমার কাছাকাছি থাকবে। এতে আমাদের ভালোবাসা আরও-আরও-আরও বাড়বে। এতে তোমার আপত্তি থাকা কি উচিত?”
মৃন্ময়ী দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“একদমই না।”
প্রভাত তার নাক টিপে দিয়ে বলল,
“এইতো আমার লক্ষ্মী বউ বুঝতে পেরেছে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ফাজিল একটা। সরো, আমার ঘুম পাচ্ছে।”
প্রভাত তাকে আটকে রেখে আদুরে গলায় বলল,
“শোনো না।”
“শুনছিই তো, বলো।”
“মৃত্তিকার বাবুটা আজ কী করেছে জানো? আমি গিয়ে কোলে নেওয়ার পর একহাতে আমার শার্ট মুঠোয় শক্ত করে যে ধরেছিল, মৃত্তিকা-ও ছাড়াতে পারছিল না। আমার যে কী ভালো লাগছিল তখন!”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“আদর পেয়ে-পেয়ে ও নিশ্চয়ই তোমাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে।”
“হুম। এই, আমাদের-ও ওর মতো একটা বাবু থাকলে অমন কিউট-কিউট আচরণ করবে, তাই না?”
“সব বাচ্চারাই অমন কিউট আচরণ করে।”
“সব বাচ্চাদেরটা তো আমরা সবসময় দেখতে পারি না। ঘরে থাকলে তো চব্বিশ ঘন্টা দেখতে পারব, আদর করতে পারব।”
“সে-ই, কথার মাঝে একশোটা প্যাঁচ না দিয়ে সোজাসুজি বললেই হয়।”
“আমি তো সবসময় বলি, তুমিই তো এখনও পরিষ্কারভাবে কিছু বলছো না।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা, তোমার ছেলে চাই, না মেয়ে চাই?”
“আল্লাহ্ যা দিবে তাতেই আলহামদুলিল্লাহ্। আল্লাহর পরিকল্পনার চেয়ে তো আমার চাওয়া বড়ো না।”
“ভেরি গুড। তাহলে তোমার ছেলে-মেয়ের নাম খোঁজা শুরু করো।”
প্রভাত চোখ দুটো গোলাকার করে বলে উঠল,
“সত্যি?”
“হুম।”
“তুমি সিরিয়াস?”
“অবশ্যই।”
খুশিতে প্রভাত মৃন্ময়ীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,,
“থ্যাংক ইউ বউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ। আমি প্রচণ্ড খুশি।”
“খুশিতে আমাকেই মে’রে ফেলো না।”
প্রভাত হাতের বাঁধন আলগা করে বলল,
“সরি, বেশি এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম।”
“কিন্তু আমি চিন্তায় আছি আল্লাহ্ আমাদের সন্তান দিলে ওকে সময় দিবো কীভাবে? আমি তো সারাদিন থাকি স্কুলে।”
প্রভাত বলল,
“তাতে কী? তোমার সাথে যারা চাকরি করে, তাদের বুঝি বাচ্চা নেই? আমি আছি তো।”
“তোমার-ও তো কাজের ব্যস্ততা।”
“বাড়িতে মা আছে না? সে দেখবে। একটু বড়ো হলে তখন তুমি-আমি দুজনেই সঙ্গে রাখতে পারব। ওসব নিয়ে ভেবো না তো। সবাই মিলে ঠিক সামলে নেওয়া যাবে।”
“আর যদি হয় তোমার মতো বেপরোয়া?”
“হলেই সমস্যা কোথায়? তুমি সামলে নিতে পারবে।”
“কীভাবে?”
“আমাকে সামলাতে পারলে বাচ্চাকে পারবে না কেন?”
মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। বলল,
“দারুণ উদাহরণ।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“একটা পরিপূর্ণ পরিবার পাওয়ার পর আমার জীবনে আর কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকবে না ম্যাডাম। ওপরওয়ালার কাছে আমি সবসময় তোমাকে চেয়েছি, তিনি আমার জীবনে তোমাকেই জুড়ে দিয়েছেন। এরপর তোমার ছোট্ট একটা অংশ যেদিন আমাকে বাবা বলে ডাকবে, ব্যস, এ পৃথিবীতে আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে। এক জীবনে সুখী হতে এরচেয়ে বেশি কিছু আর আমার চাই না।”

~সমাপ্ত~

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-২০

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২০.
শুক্রবার। মৃদুলার জন্য বিশেষ দিন। বরাবরের মতো সে নিজেকে সাজিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। তারপর থেকে সে টানা আধঘন্টা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। জাহিদের অপেক্ষায়? নাহ্! এখন আর তাকে কারো জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে বিরক্তি আসে না। বারবার রাস্তার দিকে তাকাতে হয় না। সে জানে তার অপেক্ষা থেমে গেছে। তবু কোন ব্যর্থ আশায় তার মন বারবার এভাবে ছুটে আসে, জানে না সে। আধঘন্টা পর কোত্থেকে এক বাইক এসে থামল তার সামনে। মৃদুলা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল। হেলমেট খুলে প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“কী? এখনও চিনতে পারনি?”
কপালের ভাঁজ মিলিয়ে নিয়ে মৃদুলা বলল,
“ভাইয়া, আপনি কোত্থেকে এলেন?”
“মহাকাশ থেকে টপকে এলাম। কারণ কোনো এক এলিয়েন আমার কানে-কানে খবর দিলো আমার ছোটোবোন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বিরহবিলাস করছে।”
মৃদুলা হেসে বলল,
“ধুর! আপনি বাইক কিনলেন কবে?”
“কিনলাম গতকাল। তোমার আপাকে নিয়ে মাঝে-মাঝে আকাশে ওড়ার জন্য।”
“বাহ্! আপনার বাইক-ও আকাশপথে চলে?”
“তোমার আপা সাথে থাকলে আমি নিজেই তো আকাশপথে চলি, বাইক কেন নয়?”
“আচ্ছা, বুঝলাম। কোথায় যাচ্ছিলেন?”
“যাচ্ছিলাম না, তোমার খোঁজেই এলাম।”
“হঠাৎ আমার খোঁজ কেন?”
প্রভাত কপাল কুঁচকে বলল,
“কেন? আমি কি তোমার খোঁজ নিতে পারি না? বোনদের খোঁজ নেওয়া বারণ?”
“না, এমনিতেই বললাম।”
প্রভাত গাড়িটা পার্ক করে রেখে বলল,
“চলো, কিছু খাই। বেশিক্ষণ বসব না আমি।”
“এখন আমার খেতে ইচ্ছা করছে না।”
“তাহলে আমি খাই, তুমি দেখো। এসো।”

প্রভাত মৃদুলাকে নিয়ে পাশের ছোটো রেস্ট্রন্টে বসল। হালকা কিছু খাবার অর্ডার দিলো। মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“আপার কী খবর?”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“আপার খবর জানতে না চেয়ে আমার খবর জানতে চাও। তোমার আপা সবসময়-ই বিন্দাস আছে। চব্বিশ ঘন্টা আমাকে শাসনের মধ্যে রাখছে। বিয়ে করে ঘরে বউ না, অভিভাবক তুলেছি আমি।”
মৃদুলা হেসে বলল,
“এত তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন?”
“আরে নাহ্! কী বলছো? আমি ধৈর্য হারাব কেন? ধৈর্য হারানোর কথা তো তোমার আপার, আমার মতো মানুষকে ও সামলাচ্ছে। ও যেখানে ধৈর্য হারাচ্ছে না, আমি হারাব কোন সাহসে? এত কষ্ট করে বিয়ে করেছি কি ধৈর্য হারানোর জন্য?”
“হুম, তা ঠিক। লাস্টবার বাড়ি এসে আপা মায়ের থেকে আপনার পছন্দের পিঠা বানানো শিখে গিয়েছিল। বানিয়ে খাইয়েছে আপনাকে?”
প্রভাত চোখ বড়ো করে বলে উঠল,
“বলো কী! সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
প্রভাত অত্যধিক খুশি হয়ে বলল,
“খাওয়াবে হয়তো সময় পেলে। খবরটা দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার আপা যেদিন আমাকে ওই পিঠা বানিয়ে খাওয়াবে, সেদিন অবশ্যই তাকে আমি বিশেষ পুরষ্কার দিবো।”
“তাহলে তো আমি ভুল করে ফেললাম। আপা হয়তো আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। আমি তার বারোটা বাজিয়ে দিলাম। যাহ্!”
“ব্যাপার নাহ্। তোমার আপাকে আমি বলব না আমি জেনে গেছি।”
“তাহলে ঠিক আছে।”
একটু চুপ থেকে প্রভাত প্রশ্ন করে বসল,
“তুমি কি সত্যিই মুভ অন করতে পেরেছ মৃদুলা?”
মৃদুলা মৃদু হেসে শুধাল,
“এখনও সন্দেহ আছে?”
“আছে বলেই তো জানতে চাইছি।”
“কেন? আমি কি আপনার সাথে কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলছি?”
“কথা ঘুরিয়ো না। সোজাসাপ্টা উত্তর দাও।”
“ধুর! এসব কোনো বিষয় হলো? মুভ অন করতে পারব না কেন? অবশ্যই পেরেছি।”
প্রভাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“সত্যিই কি পেরেছ?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আজ কার জন্য বেরিয়েছ?”
“টিউশন ছিল।”
“আমি জানি শুক্রবার তোমার টিউশন নেই।”
“সন্ধ্যায় আছে। ছুটির দিন একটু ঘোরাফেরা করার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়েছি।”
প্রভাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“অন্যকে মিথ্যা বুঝানো গেলেও, নিজেকে বুঝানো যায় না মৃদুলা। তুমি জানো জাহিদ আসবে না। তবু কোন আশায় ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকো?”
মৃদুলার মুখটা নিমেষেই কেমন মলিন হয়ে গেল। এদিক-ওদিক এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে সে বলল,
“আমি কারোর আশায় বাঁচি না।”
“এ কথা অন্তত আমাকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা কোরো না। তোমাদের সম্পর্কে আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আমি জানি তোমার পরিস্থিতি।”
মৃদুলা মিইয়ে পড়া স্বরে বলল,
“জেনে কী হবে ভাইয়া? কিছু তো আর পরিবর্তন হবে না।”
“জানি কিছু পরিবর্তন হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে না পারলেও নিজেকে তো পরিবর্তন করতে হবে। এক জায়গায় আটকে থেকে তুমি কখনোই জীবনযাপন করে শান্তি পাবে না।”
“এটাই তো ও চেয়েছিল, আমার জীবন থেকে যেন সমস্ত শান্তি হারিয়ে যায়।”
“তোমাকেই এটা পরিবর্তন করতে হবে। তোমার বয়সটা নিতান্তই কম। আল্লাহ্ বাঁচিয়ে রাখলে গোটা একটা জীবন পড়ে আছে তোমার সামনে। তোমার জীবনের জন্য তোমাকেই ভাবতে হবে। মনে রাখবে, এটা তোমার জীবন। তোমার মূল্যবান জীবনকে নষ্ট করার অধিকার পৃথিবীর কোনো মানুষের নেই। তারজন্য আগে নিজের জীবনের মূল্য নিজেকে বুঝতে হবে। নিজের জীবনের মূল্য বুঝার পর দেখবে তুমি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া সৃষ্টিকর্তা কার কপালে কী লিখে রাখেন বলা যায় না। হতেও পারে তোমার জন্য তিনি আরও ভালো কাউকে ঠিক করে রেখেছেন। তাই ভুল মানুষকে আগেভাগেই সরিয়ে দিয়েছেন। আমার মতে ভালোই হয়েছে ভুল মানুষটা তোমার জীবন থেকে দ্রুত সরে গেছে। আরও কয়েক বছর থেকে গেলে তোমার জন্য মুভ অন করা আরও কষ্টকর হয়ে যেত। তাই বলছি ধৈর্য ধরো। ভাগ্য মেনে নাও।”
মৃদুলা বলল,
“আমি সবই বুঝি। আপনি এত চিন্তা করবেন না ভাইয়া। আমাকে আরেকটু একটু সময় দিন। জীবনের প্রতি অবিচার করার মতো মানসিকতা অন্তত আমার নেই।”
“আমি জানি তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। সবই বোঝো। তবু আমার যতটুকু বলা প্রয়োজন মনে হয় বলি। আমি চাই তুমি যেন এসব কা’টিয়ে উঠতে পারো।”
মৃদুলা মাথা নেড়ে বলল,
“পারব। ধন্যবাদ ভাইয়া।”
“কেন?”
“আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য।”
প্রভাত বলল,
“তুমি আমার জন্য যা করেছ, তার কাছে এসব কিছুই না।”
মৃদুলা হাসল। বলল,
“আমি আপনার জন্য কিছুই করিনি। যা কিছু করেছি আমার আপার জন্য। আমি জানতাম আমার আপা লাকি হবে।”
প্রভাত ভাব নিয়ে বলল,
“ইনডিরেক্টলি আমার-ই প্রশংসা করলে।”

খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে প্রভাত নানান কথায় মৃদুলাকে হাসানোর চেষ্টা করল। মেয়েটার জন্য তার খারাপ লাগে। মৃন্ময়ীর সাথে তার বিয়ের ঠিক দুদিন আগে হঠাৎ জাহিদ তার কাছে এসেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সবসময়ের মতো তার সাথে চা খেয়েছিল। বাড়ি ফেরার আগমুহূর্তে সে বলে বসেছিল পরদিন সন্ধ্যায় তার ফ্লাইট। সে ইউরোপ যাচ্ছে। জাহিদের বাবা ইউরোপ থাকেন। গত দুই বছর ধরে তিনি স্ত্রী-সন্তানকে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। পরিবার নিয়ে যাওয়ার পর দেশে আসার আর ইচ্ছা ছিল না তার। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে জাহিদ আপত্তি জানিয়েছিল। তার আপত্তি ধোপে টিকবে না বুঝে পড়াশোনার অযুহাতে মাকে আটকে রেখেছিল। কিন্তু তার মা-ও অপেক্ষায় ছিলেন কবে তার পড়াশোনা শেষ হবে। জাহিদ তখন বলেছিল পড়াশোনা শেষ করে সে ভেবে দেখবে। কিন্তু পড়াশোনা শেষে দেশে থেকে যাওয়ার মতো আর কোনো পোক্ত অযুহাত তার কাছে ছিল না। তবু সে বাবা-মাকে বুঝানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। লাভ হয়নি। কেউই তাকে সমর্থন করেনি। বাধ্য হয়ে সে মায়ের কাছে মৃদুলার কথা জানিয়েছিল। মৃদুলার পরিচয় শুনে বাবা-মা কেউই কোনোরূপ আগ্রহ দেখায়নি। উলটা তার মা দেশ ছাড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। জাহিদ বরাবরই মা ভক্ত ছেলে। মা চলে গেলে তার এদেশে থাকার কোনো উপায় ছিল না। একবার গেলে যে আর সে ফিরবে না। মৃদুলাকে সে মন উজাড় করে ভালোবেসেছিল। তার হৃদয়ের অনেকটা অংশ জুড়ে মৃদুলা ছিল। মেয়েটাকে ঠকানোর কথা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারত না। অথচ ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়ে তাকে বিশ্বাসঘাতক সাজতে হয়েছিল। পরিবারের জন্য নেওয়া মাত্র একটা সিদ্ধান্তের কারণে মৃদুলার সমস্ত বিশ্বাস গুড়িয়ে দিয়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ছেলেটা সেদিন ছিঁচকাদুনে মেয়েদের মতো কেঁদেছিল। প্রভাতের দুহাত চেপে ধরে অনুরোধ করেছিল মৃদুলাকে যেন তার চলে যাওয়ার আগে খবরটা না দেওয়া হয়। আরও বলেছিল বিশ্বাস ভাঙার জন্য মৃদুলা যেন তাকে ক্ষমা না করে। সে ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য। প্রভাতের কেবল শোনা এবং দেখা ছাড়া আর কিছুই করার সাধ্য ছিল না। সে জানত জাহিদ নিরুপায়। তবু সেদিনের পর থেকে সে জাহিদের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখেনি। তার অভিযোগ ছিল একটাই। ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে বুঝেও জাহিদ কেন পরিবারের থেকে লুকিয়ে মৃদুলার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়েছিল? অনুভূতির জন্য এতটাও অন্ধ হওয়া ঠিক নয়, যা ভবিষ্যতে কাল হয়ে দাঁড়াবে। বিয়ের পর প্রভাত যখন মৃন্ময়ীর বাড়ি গিয়েছিল, তখন মৃদুলার মানসিক অবস্থা সে লক্ষ্য করেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে সে মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। তবু প্রভাত আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়নি। মৃদুলা নিজেই একদিন তার কাছে এসেছিল জাহিদের খবর জানতে। সেদিন আর সে কিছু লুকায়নি। জাহিদের প্রস্থানের খবরটা শোনার পর শক্তপোক্ত মেয়েটা তার সামনে চোখের পানি না ফেললেও, কতটা আঘাত পেয়েছিল, তা তার মুখ দেখেই প্রভাত বুঝতে পেরেছিল। সেই থেকেই সে মাঝে-মাঝে মৃদুলার খোঁজ-খবর নেয়। কারণ প্রভাত-ই একমাত্র ব্যক্তি, যে মৃদুলার মানসিক অবস্থার বিষয়ে অবগত। মৃদুলার অনুরোধে সে মৃন্ময়ীকে-ও এসব বিষয় জানায়নি। সে আশা রাখে মৃদুলা ঠিক এই পরিস্থিতি কা’টিয়ে উঠতে পারবে। তবেই সে চিন্তামুক্ত হবে।


মৃন্ময়ী আজকাল রোজ খাবারের টেবিলের চিত্র পরিবর্তনের চেষ্টা করে। বরাবরের মতো টেবিলে খাবার দিয়ে রাহেলা বেগমকে সরে যেতে দেয় না। নিজে তাকে খাবার বেড়ে দিয়ে খেতে বসায়। প্রভাতকে-ও সে টেবিল ছাড়তে দেয় না। রোজ তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে পালটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। মৃন্ময়ীর মুখে রাহেলা বেগমের জীবনকাহিনি শোনার পর থেকে অবশ্য তার আচরণে ধীরে-ধীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। এখন আর রাহেলা বেগমের প্রতি তার খুব একটা ঘৃণা বোধ হয় না। কিন্তু মৃন্ময়ী যে রাহেলা বেগমকে মা ডাকার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে, এটা তার জন্য জটিল। মায়ের জায়গায় অন্য কাউকে বসানোর কথা সে ভাবতেই পারে না। এ কথা শুনলেই মৃন্ময়ী বলে,
“মায়ের জায়গায় বসাতে হবে কেন? তোমার মা তোমার মনে যে জায়গায় আছে, সে জায়গাতেই থাকবে। সে জায়গা তো আর কেউ দখল করতে পারবে না। তাই বলে যে তুমি আরেকজনকে মা ডাকতে পারবে না, এমন তো কোনো নিয়ম নেই। তুমি তার সন্তান নও, তবু সে তোমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করে। আর সে তোমার মা নয় বলে তুমি তাকে মায়ের মতো ভালোবাসতে পারবে না? একজন মাকে এভাবে কষ্ট দিয়ো না প্রভাত। এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি তো তোমার আছে। তবু কেন আমার এত বুঝাতে হচ্ছে?”
প্রভাত চুপ হয়ে যায়। তারপর আকাশ-পাতাল ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়ে। মৃন্ময়ী হাল ছাড়ে না। প্রভাতকে পালটাতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আজ তারা মার্কেটে গিয়েছিল কিছু কেনাকাটা করতে। দরকারি কেনাকাটা করে প্রভাত মৃন্ময়ীর জন্য একটা শাড়ি-ও কিনেছে। শাড়িটা না কি মৃন্ময়ীর উপহার। গতকাল সে প্রভাতের পছন্দের পিঠা বানিয়ে খাইয়েছিল, তাই। সেই সুযোগে মৃন্ময়ী তাকে দিয়ে রাহেলা বেগমের জন্য-ও একটা শাড়ি কিনিয়েছে। বাড়ি ফিরে আবার প্রভাতকেই ঠেলে পাঠিয়েছে রাহেলা বেগমকে শাড়ি দিয়ে আসতে। প্রভাত বারবার বলছিল মৃন্ময়ীকে যেতে। কিন্তু মৃন্ময়ী তাকে দিয়েই শাড়ি দেওয়াবে। এদিকে অস্বস্তিতেই প্রভাতের পা বারবার থেমে যায়। মৃন্ময়ী আবার তাকে পেছন থেকে তাড়া দেয়। রাহেলা বেগম তখন ডাইনিংয়ে বসে লাউশাক কে’টে রাখছিলেন আগামীকালের রান্নার জন্য। প্রভাতকে আসতে দেখে তিনি মাথা তুলে তাকালেন। প্রভাত তখন ইতস্তত ভঙ্গিতে শাড়ির প্যাকেটটা এগিয়ে ধরল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। রাহেলা বেগম প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালেন,
“কী এটা?”
প্রভাত শুধু বলল,
“নিন।”
রাহেলা বেগম মনে প্রশ্ন নিয়েই প্যাকেটটা নিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাত চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই মৃন্ময়ী এসে তার পথরোধ করে দাঁড়াল। ততক্ষণে রাহেলা বেগম প্যাকেট খুলে বুঝেও গেছেন ভেতরে কী আছে। রাহেলা বেগম হঠাৎ চোখেমুখে একপ্রকার উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করে ফেললেন,
“তুমি এনেছ বাবা?”
প্রভাতের আগে মৃন্ময়ী দ্রুত মাথা দুলিয়ে বলে উঠল,
“জি আম্মা। আমার জন্য আর আপনার জন্য কিনেছে।”
প্রভাত মিনমিনে গলায় বলল,
“মৃন্ময়ী পছন্দ করেছে।”
রাহেলা বেগম হাসিমুখে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ্ বাবা, সুন্দর শাড়ি।”
রাহেলা বেগম হাসছেন, অথচ তার চোখ ছলছল করছে। প্রভাত সে হাসিমুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে দ্রুত প্রস্থান করল। প্রভাত যেতেই মৃন্ময়ী খুশিমনে প্রশ্ন করল,
“আম্মা, আপনি খুশি হয়েছেন?”
রাহেলা বেগম আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“অনেক খুশি হয়েছি মা। আমার ছেলে এই প্রথম আমার জন্য শাড়ি কিনে এনেছে। আমি খুশি না হয়ে পারি?”
“শাড়িটা পছন্দ করে দিয়েছি কিন্তু আমি। আপনার ছেলের পছন্দ একদম ভালো না।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“আমি তো বলব আমার ছেলের পছন্দ একশোতে একশো। নয়তো তোমার মতো এমন বউ আনল কী করে?”
মৃন্ময়ী লজ্জা পেয়ে বলল,
“আমি তো শাড়ি পছন্দের কথা বললাম।”

মৃন্ময়ী আনন্দিত মনে ঘরে ফিরতেই প্রভাত টিপ্পনি কে’টে বলে উঠল,
“একজনকে বলতে শুনলাম আমার পছন্দ না কি ভালো না। সে কি নিজের রূপ নিয়ে সন্দিহান?”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে ফেলে বলল,
“আরেকজন তাহলে আড়ি পেতে আমার আর আম্মার কথা শুনেছে?”
প্রভাত বলল,
“আড়ি কে পেতেছে? ঘর থেকেই শোনা যাচ্ছিল।”
“ঘর থেকে মোটেও শোনা যাচ্ছিল না। আড়ি পেতেছিলে, তা-ই বলো।”
“নিজের ঘরে আড়ি কে পাতে? দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, তাই কানে চলে এসেছে।”
“হয়েছে, আর নাটক করতে হবে না।”
প্রভাত দুই হাতে মৃন্ময়ীর গাল টিপে দিয়ে বলল,
“তা আমার নায়িকার রূপ নিয়ে এত সন্দেহ কেন শুনি?”
মৃন্ময়ী তার হাতে মৃদু চড় মে’রে বলল,
“আমি শাড়ির কথা বলছিলাম।”
“ওওও, আর তোমার শাশুড়ি কী বলল?”
“আমার শাশুড়ি কী? তোমার মা বলো।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর দুই হাত মুঠোবন্দী করে সবগুলো আঙুল তার আঙুলের ভাঁজে বন্দী করে নিল। তারপর বলল,
“এবার বলো তো আমার পছন্দ কেমন?”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি ছাড়া সব বাজে।”
“তুমি ছাড়া সব বাজে?”
“হুম।”
“সবের মধ্যে তুমি পড় না?”
“না।”
“কে বলেছে?”
“তোমার মা।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর ঠোঁটে, কপালে চুমু এঁকে দিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“এটা-ও আমার পছন্দ।”
মৃন্ময়ী কোনোমতে হাসি আটকে বলল,
“বাজে।”
প্রভাত ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
“শিওর?”
“উফ্! হাত ছাড়ো তো। তোমার ফাজলামি দেখার সময় নেই। আমার কাজ আছে।”
“এই রাতে বেচারা বরকে ঘরে ফেলে রেখে তোমার আর কাজ কী?”
“খাওয়ার পর যে থালা-বাসন রেখে দিয়েছি, ওগুলো কি জিন-পরী এসে ধুয়ে দিবে?”
“আমি থাকতে তোমার আবার জিন-পরী লাগে? চলো আজ আমি তোমার জিন হয়ে যাই।”
“তোমার কাজের নামে অকাজ বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। তুমি আমার হাত ছাড়ো, তাহলেই হবে।”
মৃন্ময়ী হাত মোচড়াতেই প্রভাত তার আঙুলগুলো মুক্ত করে দিলো। ছাড়া পেয়ে মৃন্ময়ী হাত ঝাড়া দিয়ে বলল,
“উফ্! আঙুলগুলো একদম ব্যথা বানিয়ে দিয়েছ।”
“সরি বউ।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর দুহাতের আঙুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। তার চুলগুলো ঠিক করে দিতে-দিতে ফিসফিস করে বলল,
“তাড়াতাড়ি ফিরে এসো ম্যাডাম। অপেক্ষা করিয়ে বুকব্যথা বাড়িয়ো না।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১৮+১৯

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৮.
মৃন্ময়ীর বিয়ে। আয়োজন ছোট্ট। কিন্তু আনন্দ উপচে পড়া। মৃত্তিকা-মৃদুলা এত খুশি! তাদের এত বেশি খুশি শেষ কবে দেখেছিল মনে নেই মৃন্ময়ীর। সাজেদা বেগম আজ পুরোদস্তুর ব্যস্ত। মৃন্ময়ীর কাছে আসার সময় পাচ্ছেন না। পূর্বের কথামতো মৃত্তিকা-ই মৃন্ময়ীকে বউ সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে। মৃদুলা-ও মায়ের সাথে কাজে ব্যস্ত। কাজের ফাঁকে সে এসে মৃন্ময়ীর সাজগোজ দেখে যাচ্ছে। মৃত্তিকাকে সাহায্য করছে মৃন্ময়ীর দুই বান্ধবী। মৃন্ময়ী বারবার করে বলছে,
“বেশি সাজাবি না, আমাকে ভূতের মতো লাগবে।”
অনামিকা বলল,
“আরে লাগবে না। আমার বিয়েতে আমি সাজিনি? আমাকে কি ভূতের মতো লেগেছিল?”
“তোর অভ্যাস আছে, আমার তো নেই।”
“চিন্তা করিস না। আমার মতো তোকে ভারি সাজ দিচ্ছে না। তোর হবু বর এসে হতে আমাকে ম্যাসেজে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে আমার মতো যেন তোকে না সাজাই।”
মৃন্ময়ীর আরেক বান্ধবী প্রিয়া দুষ্টুমি করে বলল,
“তার তো তর সইছে না বউকে দেখার জন্য, তাই অল্পতে সাজ শেষ করতে বলছে।”

বান্ধবীর মুখে এ কথা শুনে মৃন্ময়ীর লজ্জা লাগল। প্রিয়া তাকে আরও লজ্জায় ফেলে দেওয়ার পাঁয়তারা করে বলল,
“প্রভাতের নতুন বউ দেখছি লজ্জা পাচ্ছে। বেচারাকে এত ঘুরিয়ে লাভ কী হলো বল তো? সেই তো এখন তার জন্যই বউ সাজছিস।”
অনামিকা বলল,
“ঘুরিয়েছে বলেই তো বুঝতে পেরেছে আমাদের প্রভাত খাঁটি প্রেমিক। সঙ্গে-সঙ্গে পাত্তা দিয়ে দিলে তো বুঝতে পারত না তার মনে কী আছে।”
মৃত্তিকা হেসে বলল,
“একদম ঠিক বলেছ আপু। রাজি হতে এতটা সময় নিয়েছে বলেই আপু প্রভাত ভাইয়ার খাঁটি প্রেম বুঝতে পেরেছে। আমরাও এখন তাকে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করতে পারছি।”
অনামিকা হাসিমুখে বলল,
“চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রভাতকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারো। আমরা জানি ও কেমন ছেলে। মৃন্ময়ী-ই একমাত্র মেয়ে, যার প্রতি ও শুরু থেকে এত লয়াল। মৃন্ময়ীকে যে ও আজীবনে-ও কষ্ট দিবে না, এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকো।”
প্রিয়া বলল,
“এক কথায় বলা যায় আমাদের মৃন্ময়ী ভাগ্যবতী।”
মৃত্তিকা বলল,
“তা-ই যেন হয় আপু। আমার আপার ভাগ্যের পরিবর্তন দেখার বড়ো সাধ আমার মায়ের। আমার আপা যেন বাকি জীবন একটা সুখী সংসার পায়।”

মৃদুলা সেখানে উপস্থিত হয়ে বাকি কথা না শুনলেও, মৃত্তিকার শেষ কথাটা শুনতে পেল। সঙ্গে-সঙ্গে সে বলে উঠল,
“আমার আপাকে যেচে বিয়ে করতে এসেছে মানে তাকে সুখী রাখতেই হবে। নচেৎ আমি নিজ দায়িত্বে দুলাভাইয়ের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাব। আমি আমার আপার মতো অত ভদ্র মানুষ নই।”
মৃত্তিকা তাকে চোখের ইশারায় একটু ধমকে দিলো। অনামিকা শব্দ তুলে হেসে বলল,
“বেচারা প্রভাত যদি জানত বিয়ের আগেই ওর শ্যালিকা ওকে হুমকি দিচ্ছে।”
প্রিয়া বলল,
“ওর জন্য এমন শ্যালিকা-ই ঠিক আছে।”

মৃন্ময়ীকে সাজানো শেষ করে মৃত্তিকা বলল,
“দেখো তো সবাই সাজ ঠিকঠাক আছে কি না?”
মৃত্তিকা বলল,
“ঠিক আছে। এর বেশি সাজানোর দরকার নেই। এতেই আপাকে সুন্দর লাগছে।”
প্রিয়া দুষ্টুমি করে বলল,
“আরে সবাই দেখে কী করবে? একজন দেখলেই হবে। আজ মৃন্ময়ীকে যা মারাত্মক লাগছে, ওই একজন দেখে জ্ঞান না হারালেই হয়।”
মৃন্ময়ী তাকে খোঁচা মেরে মিনমিনে গলায় বলল,
“আর বাজে বকিস না তো।”
প্রিয়া বলল,
“এখন আমার কথা বাজে বকবক-ই মনে হবে। তোমার জামাই যখন হা করে তাকিয়ে থাকবে, তখন বুঝবে আমার কথায় কোনো ভেজাল নেই। এখন প্রভাতের নাম শুনেই লজ্জা লাগছে তো? দুদিন পর দেখব এই লজ্জা কোথায় থাকে।”

প্রভাত-মৃন্ময়ীর বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর যখন তাদের পাশাপাশি বসানো হলো, মৃন্ময়ী তখন লাজুক বধূ হয়ে ঘোমটা টেনে বসে রইল। তা-ও প্রভাত সুযোগ বুঝে ফিসফিসিয়ে বলে বসল,
“আজ তোমায় মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে বউ।”

বউ! ডাকটা শুনেই যেন মৃন্ময়ীর হৃদস্পন্দন এক মুহুর্তের জন্য দ্বিগুণ বেড়ে গেল। লজ্জায় সে মুখ তুলে তাকাল না। যে মুখে সে এই অবধি ‘ম্যাডাম’ ডাক শুনেই অভ্যস্ত, আজ সে মুখ তাকে ‘বউ’ ডাকছে। ভাবা যায়! আজ প্রথমবারের মতো সে কীভাবে প্রভাতের মুখোমুখি হবে, তা নিয়ে সে এখনই চিন্তায় পড়ে গেছে। শুরুটা তার জন্য নিশ্চয়ই সহজ হবে না।

মৃদুলা বারবার বলে রেখেছিল মৃন্ময়ীর বিদায়ে সে একদম কাঁদবে না। কাঁদবে কেন? আজীবনের জন্য তো সে বোনকে বিদায় জানাচ্ছে না। বোনের জীবনের এই সুদিনটি দেখার জন্য সে কত অপেক্ষা করে ছিল। অপেক্ষায় ছিল একজন সুপাত্র এসে কবে তার আপার জীবনটা রাঙিয়ে তুলবে। তার সকল অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। আজ সে হাসিমুখে বোনকে বিদায় জানাবে, সাময়িক বিদায়। সে যতবারই এ কথা বলেছিল, মৃত্তিকা খুব হেসে বলেছিল, ‘সময় আসুক, দেখব কত হাসতে পারিস।’ শেষমেশ গিয়ে মৃত্তিকার কথাই সত্যি হলো। মৃন্ময়ীর বিদায় মুহূর্তে মা যখন তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, নিমেষেই মৃদুলার সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। কাঁদবে না বলে সে নিজেই সবার চেয়ে বেশি কাঁদল। মৃন্ময়ীকে নিয়ে পাত্রপক্ষ বিদায় নেওয়ার পরও তার কান্না থামল না। তখন মৃত্তিকা-ই তাকে শান্ত করতে এগিয়ে এল।


প্রভাতের বাড়িতে প্রথমদিনেই মৃন্ময়ী অবাক হয়ে প্রভাতের সৎ মায়ের কাণ্ড দেখছে। রাহেলা বেগম নিজের কাজের ফাঁকে বারবার এসে তার খোঁজ নিচ্ছে, তার কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করছে। বিয়ের চাপে ঠিকঠাক খেতে পেরেছে কি না ভেবে নিজ হাতে মৃন্ময়ীর জন্য খাবার-ও বয়ে এনেছে। মৃন্ময়ী খেতে চায়নি বলে সে নিজেই জোর করে কিছু খাবার খাইয়ে দিয়েছে। খাবার খাইয়ে চলে যাওয়ার আগে সে বারবার করে মৃন্ময়ীকে বলে গিয়েছে যেকোনো প্রয়োজন যেন তাকে বলে। মৃন্ময়ী কেবল মনের ভেতর বিস্ময় চেপে রাখল। বাড়ি এসে হতে মৃন্ময়ীর চারপাশে মহিলাদের আনাগোনা প্রভাতকে বিরক্ত করে তুলেছে। অবশেষে রাতে যখন তার সুযোগ মিলল, ঘরে ঢুকে মৃন্ময়ীর পাশে বসেই সে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“উফ্! অবশেষে মুক্তি মিলল। বিয়ে করলাম আমি, অথচ মানুষজনের জন্য আমি নিজেই আমার বউয়ের কাছে আসার সুযোগ পাচ্ছি না। এ কেমন অবিচার!”
পরক্ষণেই মৃন্ময়ীর নতমুখের দিকে উঁকি মে’রে তাকিয়ে বলল,
“ম্যাডাম দেখি এখনও লাজুক বধূ হয়ে আছেন। কী ব্যাপার? বর পছন্দ হয়নি?”
মৃন্ময়ী তখন লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। মুখ তুলে তাকানোর অবস্থায়-ও নেই সে। এতদিন যাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে, আজ তার চোখে চোখ রাখবে কী করে? প্রভাত হেসে বলল,
“এত লজ্জা পেতে হবে না। আমরা তো আর অপরিচিত কেউ নই। আমি তোমার বন্ধু ছিলাম না? কত কথা বলেছো তুমি আমার সাথে। সেভাবে একটু কথা বলো তো। অপরিচিতদের মতো মুখ নুইয়ে রেখো না। দেখি, তাকাও। তোমার বর এদিকে বসে।”

তা-ও মৃন্ময়ী মুখ তুলে তাকাল না। চুপচাপ বসে নখ খুঁটছে সে। প্রভাত আরও একটু এগিয়ে তার গা ঘেঁষে বসল। মৃন্ময়ীর সামনে নিজের দুহাত পেতে ধরে বলল,
“তোমার হাতটা দিবে ম্যাডাম?”
মৃন্ময়ী সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া দিতে পারল না। প্রভাতের হাতের দিকে তাকিয়ে নিজের হাতে হাত চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল সে। প্রভাত তাকে তাড়া দিলো না, অপেক্ষা করল। সময় নিয়ে মৃন্ময়ী নিজের ডান হাতটা তুলে দিলো প্রভাতের হাতে। প্রভাত সে হাতটা অতি যত্নে মুঠোবন্দী করে নিল। বলল,
“এই হাতটা ধরার জন্য আমি অনেক অপেক্ষায় ছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল একদিন আমার জীবনে এই দিনটি আসবে। ফাইনালি আমার অপেক্ষা শেষ হলো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর আমি এই হাত ছাড়ছি না ম্যাডাম।”

প্রভাত অনেক কথাই বলল। মৃন্ময়ী কেবল চুপ করে শুনে গেল। প্রভাত আজ একটুও মজা করছে না। তবে মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে প্রভাত নানান কথায় তার মনোভাব সহজ করতে চাইছে। তার লজ্জা ভাঙানোর চেষ্টা করছে। প্রভাত মৃন্ময়ীকে একটা উপহার দিলো। সেই উপহার পেয়ে মৃন্ময়ী যারপরনাই অবাক হলো। কয়েক মাস আগে প্রভাতের তাকে যে গহনা সেট উপহার দিয়েছিল, সে ফিরিয়ে দেওয়াতে যার স্থান হয়েছিল রাস্তার ধারের দিঘির জলে, সেই গহনাগুলোই আজ প্রভাত তাকে উপহার দিয়েছে। মৃন্ময়ী হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। নাহ্, চিনতে তার একদম ভুল হয়নি। এগুলো সেই গহনাগুলোই। মৃন্ময়ী দুচোখে বিস্ময় নিয়ে প্রভাতের দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাল। প্রভাত মুচকি হাসছে। সে বুঝতে পেরেছে মৃন্ময়ীর মনে কী প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। মৃন্ময়ী প্রশ্ন করার আগেই সে প্রশ্ন করল,
“কী ম্যাডাম? চেনা-চেনা লাগছে?”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“হুঁ, এগুলো ওই গহনাগুলোই না? কিন্তু তুমি তো ওগুলো পানিতে ফেলে দিয়েছিলে।”
“তোমার স্বামী তোমার জন্য ডুবুরি দিয়ে এই অতি মূল্যবান গহনা উদ্ধার করে এনেছে।”

মৃন্ময়ীর কপালে ভাঁজ পড়ল। প্রভাতের ফাজলামি তার বিশ্বাস হয়নি। প্রভাত হেসে বলল,
“আবার কিনেছিলাম।”
“আবার কেন কিনেছিলে?”
“আগেরগুলো পানিতে ফেলে দিয়ে দুদিন পর মনে হয়েছিল কাজটা একদম ঠিক হয়নি। রেখে দিলে পরে তোমাকেই দিতে পারতাম। তাই আবার কিনে রেখেছিলাম।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আবার কেনার দরকার ছিল না।”
“তোমার দরকার না থাকলেও, আমার বউয়ের জন্য আমার দরকার ছিল।”

মৃন্ময়ী মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করল,
“আমার প্রতি তোমার হাসি আসছে না প্রভাত?”
প্রভাত পালটা প্রশ্ন করল,
“হাসি? কেন?”
“বিয়ে করব না বলেও সেই তোমাকেই বিয়ে করলাম যে।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“ওহ্! এই কারণে? নাহ্, আমার হাসি আসছে না। তবে আনন্দ আসছে।”
“হাসি আসছে না?”
“উঁহু। কারণ আমি জানি আগের ওসব কথা তোমার মুখের ছিল। মনে তো আমার জন্য ঠিকই অনুভূতি ছিল, কিন্তু বুঝতে দাওনি। আজো কি মনের কথা লুকিয়ে রাখতে চাও? না কি শোনার সৌভাগ্য হবে আমার?”
মৃন্ময়ী লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। প্রভাত হেসে বলল,
“থাক, লজ্জা পেতে হবে না। একটু সহজ হলে তুমি নিজেই সব বলে দিবে। অবশ্য তুমি না বললেও বুঝে নেওয়ার দৈব শক্তি আছে আমার।”
তারপর প্রভাত মৃন্ময়ীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“আমার আজ সত্যিই ভীষণ আনন্দ হচ্ছে মৃন্ময়ী। আজ আমার শুধুই আনন্দের দিন। আমি তোমাকে পেয়েছি। এরচেয়ে বড়ো পাওয়া আর আমার জীবনে দ্বিতীয়টি নেই। শোনো, আজ থেকে আমি তোমার পরিবার, তোমার নিজের মানুষ। তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। তোমার যেকোনো সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, সবকিছু আমার সাথে শেয়ার করবে। সবকিছু মনে চেপে রেখে নিজের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে না। আমি এটা একদম বরদাস্ত করব না। আজ থেকে তোমার সমস্ত সমস্যা আমার‌। আজ এই মুহূর্ত থেকে সবসময় আমি তোমার মুখে হাসি দেখতে চাই। বাকি জীবন আমি সুখী মৃন্ময়ীর সাথে কা’টাতে চাই। শুনতে পেয়েছ আমার কথা? আজীবন তোমাকে সুখে রাখার জন্য যা করতে হয় আমি করব। কোনো পরিস্থিতিতে আমি তোমায় একা ছাড়ব না। এখন থেকে তুমি একজন নও, দুজন। তুমি আমি, আমি তুমি। মনে থাকবে?”

মৃন্ময়ী মুখে উত্তর না দিয়ে মাথাটা মৃদু দোলাল। প্রভাত ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখল মৃন্ময়ীর চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াতেই সে চট করে মুছে নিচ্ছে। প্রভাত তার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল,
“কাঁদছো কেন? আমি কি তোমাকে বকেছি, না কড়া কথা শুনিয়েছি? দেখি, কান্না বন্ধ করো। বিদায়ের সময় যথেষ্ট কেঁদেছ। মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে জোর করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসছি। নতুন বউটাকে আর কাঁদতে দেখতে চাই না।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর চোখের পানি মুছে দিলো। আহ্লাদ পেয়ে মৃন্ময়ীর কান্না থামার বদলে বেড়ে গেল। প্রভাত ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল,
“কী হলো? আরে! কান্নাকাটির কী হলো আবার?”
মৃন্ময়ী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। প্রভাতের এক হাত চেপে ধরে সে ভেজা গলায় বলল,
“সরি প্রভাত। আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি।”
“তোমাকে কে বলেছে আমি কষ্ট পেয়েছি? আমি তো কেবল অপেক্ষা করেছি। তোমায় নিয়ে একসঙ্গে হাসার জন্য অপেক্ষা করেছি। হাসো তো একটু বউ। হাসো, হাসো। কতদিন তোমার হাসি দেখি না!”
মৃন্ময়ী হাসল না। ব্যথিত গলায় বলল,
“আমি ক্লান্ত প্রভাত।”
এতটুকু একটা কথায় যেন আকাশ সমান ব্যথা লুকিয়ে ছিল। সে ব্যথা গিয়ে লাগল প্রভাতের বুকের ভেতরটায়। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে অতি আদরে মৃন্ময়ীর কপালে চুমু খেল। তারপর তাকে যত্ন সহকারে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে রাখল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি জানি এতটা বছর তোমার ওপর দিয়ে কেমন চাপ গিয়েছে। প্রতিটা দিন তুমি কীভাবে বেঁচে ছিলে, আমি সব জানি। আর নয় ম্যাডাম। আজ এখানেই তোমার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-ক্লান্তি বিসর্জন দাও। আমি আর তোমায় পুরোনো জীবনে ফিরতে দিবো না। আজ থেকে আমি তোমায় নিয়ে নতুন জীবনে যাত্রা শুরু করলাম। জীবনের সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা আমি তোমায় উপহার দিবো। আমার হৃদয়ে যতটুকু ভালোবাসা জমা আছে, সবটাই তোমার, কখনও এক চুলও ছাড় দিয়ো না।”


মৃন্ময়ীর বিয়েতে জাহিদ আসেনি। অথচ তার দাওয়াত ছিল দুই পক্ষ থেকেই। দুদিন আগেও সে মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কোন পক্ষে থাকা উচিত। মৃদুলা বলেছিল তার যেদিকে ইচ্ছা থাকতে পারে। যে পক্ষেই থাকুক, অনুষ্ঠান তো একই বাড়িতেই হবে। প্রভাতের কথামতো বরযাত্রী এসেছিল গোটা কয়েক মানুষ। তারমধ্যে জাহিদকে দেখতে না পেয়ে মৃদুলা ভেবেছিল জাহিদ হয়তো তার অতিথি হয়েই আসবে। কিন্তু জাহিদ আসেনি। নিজের ব্যস্ততার মাঝেও মৃদুলা তাকে কয়েকবার কল করেছিল। কলটা-ও রিসিভ করেনি। মৃদুলা আশা করেছিল রাতে আবার কল করে জাহিদের না আসার কারণ জেনে নিবে। কিন্তু জাহিদ রাতে-ও কল রিসিভ করল না। মৃদুলা এখন পড়ে গেছে চিন্তায়। জাহিদ কখনও এমন করে না। মৃদুলা কল দিয়েছে, আর সে ইচ্ছাকৃত কল এড়িয়ে গেছে, এমন আজ পর্যন্ত হয়নি। উলটা কল ঘুরাতে দেরি হলে সে দুঃখ প্রকাশ করে। তবে আজ তার কী হলো? কোনো সমস্যায় পড়েনি তো? না কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে? চিন্তায় মৃদুলার দুচোখের ঘুম উড়ে গেছে। অথচ তার সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা এখন একটু বিশ্রাম চাইছে। জাহিদের খোঁজ নেওয়ার কোনো উপায় সে খুঁজে পাচ্ছে না। একমাত্র উপায় ছিল প্রভাত। কিন্তু এত রাতে সে প্রভাতকে-ও বিরক্ত করতে পারবে না। মৃত্তিকা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তারা আজ আপার ঘরে ঘুমাতে এসেছে। মৃদুলা চুপচাপ বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বসার ঘরে আলো জ্বলছে। মৃদুলা নিজেই ওই ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে গিয়েছিল। মৃদুলা এগিয়ে গিয়ে দেখল তার মা এই ঘরে আছে। চুপচাপ বসে আছে। মৃদুলা মাকে ডেকে বলল,
“এখানে কী করছো মা? ঘুমাওনি কেন?”
সাজেদা বেগম তাকে দেখে বললেন,
“ঘুম আসছিল না, তাই বসে আছি। তুই ঘুমাসনি কেন?”
“আমারও ঘুম আসছে না।”
মৃদুলা মায়ের পাশে বসল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল মুখটা কেমন উদাসীন দেখাচ্ছে। মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“আপার জন্য চিন্তা করছো মা?”
সাজেদা বেগম চিন্তিত মুখে বললেন,
“আমার মেয়েটা কি সত্যিই সুখ পাবে রে মৃদুলা?”
মৃদুলা বলল,
“পাবে মা, পাবে। এখনও তুমি ভরসা পাচ্ছ না?”
“ভরসা তো করতে চাইছি, ছেলেটা তো ভরসা করার মতোই মনে হয়। তবু মন থেকে খটকা দূর হচ্ছে না।”
“কটা দিন যাক, নিজের চোখে আপার সুখ দেখলে তোমার মনের খটকা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। এত চিন্তা কোরো না। আপা ভালোই থাকবে। ঘুমাতে যাও, সারাদিন অনেক খাটাখাটুনি করেছ।”
সাজেদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ভালো লাগছে না। মেয়েটাকে আর ঘরে হাঁটাচলা করতে দেখব না, ভাবলেই ঘরটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে।”
মৃদুলার মনের কথাই যেন মা বলে দিলো। এখন থেকে আপাকে আর রোজ চোখের সামনে দেখবে না, ছুঁতে পারবে না ভাবলে তারও কষ্ট লাগছে। সাজেদা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“যাই, শুই গিয়ে। তুই ঘুমাবি না?”
“যাচ্ছি।”
‘যাচ্ছি’ বলেও মৃদুলা উঠল না। মা চলে যাওয়ার পরও সে এক জায়গাতেই ঠাঁয় বসে রইল। জাহিদের নাম্বারে আবারও দুবার কল দিলো। এবারে কল-ই ঢুকল না। নাম্বার বন্ধ বলছে। মৃদুলার হঠাৎ চোখ দুটো জ্বলে উঠল। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। আপার অজুহাতে কিছুটা সময় সে কেঁদেও নিল। কেউ দেখল না তার কান্না।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৯.
বিয়ের পর থেকে মৃন্ময়ী রোজ প্রভাতের সঙ্গে তার মায়ের ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করেছে। অথচ প্রভাত তার সঙ্গে কথা-ই বাড়াতে চায় না। প্রসঙ্গ তুললেই এড়িয়ে যায়। মৃন্ময়ীকে অনুরোধ করে তার সঙ্গে ওই মহিলাকে নিয়ে কথা না বলার জন্য। মৃন্ময়ী হাল ছাড়ে না। এ কদিনে সে স্পষ্ট বুঝে গেছে তাদের মা-ছেলের মধ্যকার সমস্যা গভীর। এটা মোটেও সৎ-মায়ের হিংসাত্মক ঘটনা নয়। কারণ রাহেলা বেগমকে সে যতটুকু দেখেছে, চিনেছে, তাতে তার মনে হয়েছে এই মহিলা একদমই হিংসুটে বা খারাপ মনের মানুষ না। প্রভাতের জন্য তিনি যথেষ্ট মায়া করেন। মৃন্ময়ীর সঙ্গে তার আচার-ব্যবহার এমন যে, মৃন্ময়ীর কখনও মনেই হয়নি এই মহিলা তার সৎ শাশুড়ি। মৃন্ময়ী খুব চেষ্টা করছে এই ভালো মানুষটির সাথে প্রভাতে সম্পর্কের জটিলতার আসল কারণ জানার। এতদিনে সে যতটুকু লক্ষ্য করেছে, তাতে তার মনে হয়েছে সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি প্রভাতের মাঝেই। সে তার মায়ের ধারেকাছেও ঘেঁষে না, যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে। অন্যদিকে রহিমা বেগম বেছে-বেছে প্রভাতের পছন্দের খাবারটা রান্না করার চেষ্টা করেন। প্রভাত ঠিকঠাক খাচ্ছে কি না, তা নিয়েও তার ভাবনার শেষ নেই। খাবার নিয়ে মৃন্ময়ীর সঙ্গেও মহিলা এখন খুব তোড়জোড় করেন। মৃন্ময়ী কোনো খাবার খাবে না বললেও তাকে শোনানো যায় না। তার একটাই কথা, মৃন্ময়ী বয়সের তুলনায় খাবার কম খায়। তার স্বাস্থ্যের জন্য এতটুকু খাবার যথেষ্ট নয়। খাবার নিয়ে মৃন্ময়ীর সাথে এত জোরাজুরি তার মা-ও কখনও করতে পারেনি। কারণ তার ব্যস্ত জীবনে আরামসে বসে খাবার খাওয়া খুব কমই হয়েছে। ফলস্বরূপ তাড়াহুড়ায় দিন-দিন তার খাবারের পরিমাণ-ও কমে গিয়েছে। মৃন্ময়ী মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে যে করে হোক প্রভাতকে চেপে ধরে তার পেট থেকে সত্য কথা বের করবে, আর নয়তো রাহেলা বেগমকেই জিজ্ঞেস করবে। ভেবেচিন্তে আগে সে রাহেলা বেগমের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করল। তাই ছুটির দিনে যখন প্রভাত বাড়ির বাইরে গেল, সেই সুযোগ সে কাজে লাগাল। রান্নাঘরে রাহেলা বেগমের সাথে হাতে-হাতে কাজ করতে-করতে কথা গুছিয়ে নিল। তারপর এ-কথা, ও-কথার মাঝে প্রভাতের প্রসঙ্গ টেনে বলল,
“আম্মা, কিছু মনে না করলে প্রভাতের ব্যাপারে দুটো কথা জিজ্ঞেস করব?”
রাহেলা বেগম মৃদু হেসে বললেন,
“কিছু মনে করব কেন? প্রভাতকে নিয়ে তুমি প্রশ্ন করতেই পারো।”
“প্রশ্নটা আসলে আপনার সাথে প্রভাতের সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে। তাই ভাবছি আপনি আবার কিছু মনে করেন কি না।”
“কী জানতে চাও, বলো।”
রাহেলা বেগমের মাঝে কোনো জড়তা নেই দেখে মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“প্রভাত কেন আপনার কাছ থেকে দূরে সরে থাকে? আমি যতটুকু দেখেছি, আপনি ওকে যথেষ্ট ভালোবাসেন। তবু এই দূরত্ব কেন? সমস্যাটা আসলে কী বা কার? আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কি আমাকে একটু সত্যিটা বুঝিয়ে বলবেন?”
রাহেলা বেগম বললেন,
“একসঙ্গে থেকে এসব দেখতে তোমার ভালো লাগছে না নিশ্চয়ই?”
মৃন্ময়ী ওপর-নিচে মাথা দোলাল। রাহেলা বেগম বললেন,
“বুঝেছি। এসব আমাদের এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। তুমি পরিবারে নতুন বলে তোমার চোখে লেগেছে। আমাদের সম্পর্ক সবসময়ই এমন।”
“কেন?”
“জানতে যখন চেয়েছ, তোমাকে প্রথম থেকেই খুলে বলি, শোনো।”

মৃন্ময়ী কৌতুহল নিয়ে রাহেলা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাহেলা বেগমের মুখটা হঠাৎ কেমন রং বদলে নিয়েছে। হয়তো দুঃখবোধ থেকে। তিনি বলতে শুরু করলেন,
“আমার প্রথম বিয়ে হয়েছিল খুব কম বয়সে। তখন ঠিকমতো সংসারের কাজ-ও জানতাম না। তবু পরিবারে ভাই-বোন বেশি ছিল, আর বাপের রোজগার কম ছিল বলে বাবা-মা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। যার সাথে বিয়ে হয়েছিল, সে ছিল আমার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী। তারা তিন ভাই ছিল। তিন ভাইয়ের পরিবার একসঙ্গেই থাকত। যৌথ পরিবার ছিল। খুব বড়ো পরিবার। একে তো ঠিকঠাক কাজ জানতাম না, তার ওপর এতগুলো মানুষের রান্নাবান্নার সব কাজ আমাকে দিয়ে করানো হত। তারপর কাপড় ধোয়া, ঘরদোর পরিষ্কার করা। কোনো কারণে কাজ করতে না চাইলে আমার শাশুড়ি যা নয় তা বলে গালাগাল করত। আর তার ছেলে তো কোনোদিন আমার কথা শোনার-ও প্রয়োজন মনে করত না। মা-ভাবিদের মুখে নালিশ শোনামাত্রই গায়ে হাত তুলত। এজন্য শরীর খারাপ হলেও কাউকে বলতে পারতাম না। একা-একা কান্নাকাটি করে আবার কাজে লেগে পড়তাম। কাঁদতে দেখলেও বলত প্রতিবেশীদের কাছে তাদের বদনাম ছড়ানোর জন্য নাটক করি। মায়ের সঙ্গে অনেকবার কেঁদেছিলাম। মায়ের তো আর কিছু করার ছিল না। তার নিজের সংসার-ই চলত ঠেলাগাড়ির মতো। বাবা বলত বয়স কম বলে আমার সহ্যশক্তি কম। সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে। অথচ আমি যে কী সহ্য করেছিলাম, তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। তাই দাঁতে দাঁত চেপে সব যন্ত্রণা সহ্য করে শ্বশুরবাড়িতেই পড়ে ছিলাম। কিন্তু একদিন চুরির অপবাদ দিয়ে তারা আমাকে এমনভাবে মারল-”
“কিসের চুরির?” কথার মাঝে বাঁধ সেধে প্রশ্ন করল মৃন্ময়ী।
“টাকা চুরির। আমার প্রাক্তন স্বামী টাকা রেখেছিল তার মায়ের কাছে। আমি জানতাম-ও না সেই টাকা উনি কোথায় রেখেছিলেন। দুদিন পরেই শুনি টাকা গায়েব। টাকা না কি রেখেছিলেন বিছানার নিচে। বিছানা গোছাতাম তো আমি, দোষ এসে পড়ল আমার ওপর। আমার কথা কেউই বিশ্বাস করেনি। স্বামী বিশ্বাস না করলে আর কাকেই বা বিশ্বাস করাতাম? সে তার মা-ভাবিদের কথা শুনেই আমাকে মারধর করে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। শরীরে মারের দাগ নিয়ে প্রমাণসহ যখন বাবার ঘরে উঠেছিলাম, তখন আমার বাবা আমাকে বিশ্বাস করেছিল। তারপর একমাস কেটে গেলেও আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আমার কোনো খোঁজ নেয়নি, ফিরিয়ে নেওয়া তো দূর। আমারও আর ওই সংসারে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। তারপর আমার বাবা লোকজন ধরে তালাকের ব্যবস্থা করে আমাকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তি কি আর এত সহজে মিলে? তখনই আমার শরীরে আরও একটা প্রাণের উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর জানতে পেরেছিলাম আমার পেটে দুই মাসের বাচ্চা।”
কথাটা বলেই রাহেলা বেগম থেমে গেলেন। বোধহয় পুরোনো ব্যথাগুলো নতুন করে তিনি অনুভব করতে পারলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“বাচ্চার কথা জানার পর আমার মা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। তাই তালাকের সিদ্ধান্ত থেকে পিছাতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সন্তানের জন্য হলেও সংসার নামক নরকে আবার ফিরে যাব। বাবার ঘরে আমি একা মানুষ-ই বাড়তি বোঝা ছিলাম। তার ওপর একটা বাচ্চার দায়িত্ব আমি কাকে দিতাম? আমার বাবা আমাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে। অথচ সে বাড়িতে যাওয়ার পর আমাদের ঘরের ভেতর পা-ও রাখতে দেয়নি আমার শাশুড়ি। আমার সঙ্গে আমার বাবাকে যা-তা বলে গালাগাল করেছিলেন। বাবা আমার পেটের সন্তানের কথা বলার পর মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে। তখন তাদের ছেলে বাড়ি ছিল না। আমি বলেছিলাম তাদের ছেলেকে খবর দিতে। সন্তানের খবর জানার পর আমাকে রাখবে কি না, তা আমার সন্তানের বাবার কথার ওপর নির্ভর করে। তারা তাদের ছেলেকে খবর দিয়ে বাড়ি এনেছিলেন। ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আর বাবা বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমার শরীর খারাপ লাগছিল। তবু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এই আশায় যে, সন্তানের খবর শোনার পর ওর বাবার মন যদি একটু গলে। অথচ আমার প্রাক্তন স্বামী বাড়ি ফিরে আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তার মা ব্যঙ্গ করে আমার সন্তানের কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে সে নিজের সন্তানকে অস্বীকার করেছিল। তার কথা শুনে আমার দুনিয়া নড়ে উঠেছিল। আমি শরীরের শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। তবু তার হাতে-পায়ে ধরে অনেক অনুনয় বিনয় করেছিলাম যেন আমার সন্তানকে সে ফিরিয়ে না দেয়। আমি নিজের প্রতি হওয়া সব অন্যায় মেনে নিলেও সন্তানের প্রতি এই অবিচার মানতে পারছিলাম না। সন্তানের জন্য আমি সেদিন আমার শাশুড়ির পা পর্যন্ত ধরেছিলাম। আমার বাবা বয়সে বড়ো হয়েও মেয়ে জামাইয়ের হাতে ধরে বহু অনুরোধ করেছিলেন। তবু তারা আমাকে রাখেনি। নিজেদের রক্তের সন্তানসহ তারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। পিতৃপরিচয়হীন সন্তান নিয়ে আমার কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। এত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি বিছানা থেকেই উঠতে পারিনি।”

মৃন্ময়ী ব্যথিত দৃষ্টি মেলে রাহেলা বেগমের যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে চেয়ে আছে। মনে-মনে সে ওই জঘন্যতম মানুষগুলোর প্রতি ভীষণ ঘৃণা অনুভব করছে, যারা একটা বাচ্চার প্রতিও একফোঁটা মায়া দেখায়নি। যে লোকটা নিজের সন্তানকে অস্বীকার করেছে, তাকে কাপুরুষ বলে গালাগাল দিতে ইচ্ছা করছে। মুখ ফুটে সে রাহেলা বেগমকে কিছু বলে সান্ত্বনা-ও দিতে পারছে না। কেমন অস্বস্তি লাগছে। অথচ রাহেলা বেগম কী নির্দ্বিধায় তাকে নিজের জীবনের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে শোনাচ্ছেন। যেন সে তার পুত্রবধূ না, সমবয়সী বান্ধবী। রাহেলা বেগম মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বাচ্চাটার কী হলো, কোথায় আছে জানার কৌতুহল জেগেছে, না?”
মৃন্ময়ী ধীর গতিতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। রাহেলা বেগমের ঠোঁটের কোণে এক ফালি তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে উঠেও মিলিয়ে গেল। সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন,
“অসুস্থ হয়ে আমি যখন বিছানায় পড়ে ছিলাম, তখনই আমার স্বামী আমাকে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমার অবস্থা তখন আরও খারাপ হয়ে পড়েছিল। আমার মা আমাকে নাকে-কানে বুঝিয়ে বলেছিলেন বাচ্চাটা না রাখতে। বাচ্চা রাখলে আমার আর বাচ্চার, দুজনের ভবিষ্যত-ই নষ্ট হবে। এক বাচ্চা নিয়ে আমাকে আরেক ঘরে পাঠাতে কষ্ট হবে। আমি রাজি হইনি। যা-ই হোক, নিজের শরীরের অংশকে কে এভাবে মেরে ফেলতে চায়? বাবা শুনে বলেছিল বাচ্চাকে যদি আমি নিজের টাকায় চালাতে পারি, তবেই যেন রাখি। আমি কোথায় টাকা পাব? উপার্জন করার ক্ষমতা তো আমার ছিল না। জীবনে ঘরের বাইরের জগত দেখিনি। বাইরের মানুষের সাথে মিশিনি। একা আমি কীভাবে দুটো জীবন সামলাব? নদীর মাঝখানে পড়ার পরও ছোট্ট একটা প্রাণকে মারার সাহস আমার হচ্ছিল না। সন্তান নিয়ে কীভাবে জীবন-যাপন করব, সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা না থাকলেও বাবা-মাকে আমি অনেক অনুরোধ করেছিলাম বাচ্চাটাকে রাখার জন্য। কিন্তু আমি কারোর মন গলাতে পারিনি। অসুস্থ অবস্থায় মা আমাকে ধরে-বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন আমি গলা ফাটিয়ে এত কেঁদেছিলাম, আমার আজন্ম মনে থাকবে। অমন কান্না হয়তো আমি পুরো জীবনেও কাঁদিনি। একইসঙ্গে সংসার হারিয়ে, বাচ্চা হারিয়ে আমি কেমন পাগল-পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক হতে আমার প্রায় দুই মাস লেগে গিয়েছিল।”

রাহেলা বেগম মোটেও কাঁদছেন না। এত পুরোনো ব্যথা তার বহু আগেই সয়ে গেছে। এখন আর কান্না আসে না। তবে বুকের ভেতরটা জমাট বেঁধে থাকে। জমাট বাঁধা কষ্টটুকু হালকা করতেই হয়তো তিনি আবারও কিছু সময় চুপ রইলেন। মৃন্ময়ী অনুভূতিশূন্য গলায় মৃদু স্বরে জানতে চাইল,
“তারপর কী হয়েছিল?”
রাহেলা বেগম বললেন,
“ছাড়াছাড়ির পর শুধু দশ মাস বাবার বাড়িতে ছিলাম। দশ মাসেই আমার বাবা-মায়ের কাছে আমি বোঝা হয়ে উঠেছিলাম। দশ মাসে আমার বাবা আমার জন্য বিশ বার ঘটক ধরেছিলেন। দশ মাস পর এক ঘটক প্রভাতের বাবার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে গিয়েছিল। ভালো পরিবার, পয়সা দেখে বাবা জেদ ধরে বসেছিলেন এখানেই আমার বিয়ে দিবেন। আমার ইচ্ছা বা মতামতের কোনো গুরুত্ব ছিল না। অভাবের সংসারে বাড়তি বোঝা হয়ে ছিলাম। বাবা-মা বোঝা হালকা করতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। বয়স কম ছিল, বুঝ-ও কম ছিল; তবু নিজের নিয়তি মেনে নিয়েছিলাম। এছাড়া তো আর আমার কিছু করার ছিল না। পড়াশোনা যতটুকু জানি, তাতে নাম লেখার চেয়ে বেশি কিছু করা যেত না। যাইহোক, প্রভাতের বাবার কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। ঘরোয়াভাবে বিয়ে করে আমাকে এনেছিলেন। বিয়ের আগে শুনেছিলাম তার একটা ছেলে আছে। কিন্তু জানতাম না ছেলে কতটুকু। এ বাড়িতে আসার পর প্রভাতকে দেখেছিলাম। ওর বয়স তখন পনেরো বছর। আমি নিজেই ছিলাম অল্পবয়সী, তার ওপর এক সন্তানহারা মা। আমার জন্য তখন পনেরো বছর বয়সী ছেলেকে সন্তানের স্নেহ দেওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই প্রভাত আমার কাছ থেকে দূরে থাকত। প্রথমদিকে আমার-ও ওকে ডাকতে অস্বস্তি হত। তাই নিজেও ওকে এড়িয়ে চলতাম। তখন আমার শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন। একটা কথা না বললেই নয় মা, এক শাশুড়ি আমাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল ঠিকই, পরবর্তীতে যে আমি মায়ের মতো শাশুড়ি পাব, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রভাতের দাদি আমাকে খুব ভালো জানতেন। কোনোদিন আমার সঙ্গে একটু রেগেও কথা বলেননি। বরং খুব বুঝিয়ে কথা বলতেন। তিনিই আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন প্রভাতকে যেন আমি এড়িয়ে না চলি। নিজের মাকে হারানোর পর থেকে প্রভাত একটু চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আমিও যদি ওকে দূরে ঠেলে রাখি, তাহলে ও পরিবারের সঙ্গে থেকেও একা হয়ে পড়বে। তার ওপর ওর বাবার সঙ্গে ওর খুব একটা ভাব ছিল না। ও না কি মায়ের পাগল ছিল। ওর বাবা-ও আমাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। আস্তে-আস্তে আমি বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলাম। প্রভাত সত্যিই পরিবারের সঙ্গে থেকেও নিজেকে আলাদা করে রাখত। অথচ ওর বয়সটা একা কাটানোর মতো ছিল না। ওকে দেখে আমার তখন খারাপ লাগত। কপালপোড়া আমি এই পরিবারে বউ হয়ে আসার পর আমার জীবনটাই বদলে গিয়েছিল। এই পরিবারে আমি যে সম্মান আর ভালোবাসা পেয়েছিলাম, তা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। অথচ প্রভাত এই পরিবারের ছেলে হয়েও কারোর ভালোবাসা ওর মন ছুঁতে পারত না। ব্যাপারটা খারাপ লাগার মতোই ছিল। তারপর থেকে আমি ওকে কাছে ডাকতাম, ওর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু ততদিনে প্রভাত যেন আমাকে নিজের শত্রু ভেবে নিয়েছিল। আমি ডাকলেও ও সাড়া দিত না। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে কথা বলত না। ওর দাদি এত করে বুঝিয়ে বলত আমাকে ‘মা’ বলে ডাকতে, ও তা মানতেই পারত না। বুঝাতে-বুঝাতে বিরক্ত হয়ে ওর বাবা কয়েকদিন ওকে মারতে-ও গিয়েছিলেন, তবু ওকে কোনোভাবেই মানানো যায়নি। উলটো ওর বাবাকে-ও ও পর ভাবতে শুরু করেছিল। এই যে দেখছো না ওর বাবার সঙ্গে ওর কেমন নীরব দূরত্ব, এসবের সূচনা তখন থেকেই। ওর একটাই কথা, ওর মা নেই। নিজের মা ছাড়া অন্য কাউকে ও মা বলে ডাকবে না। যদিও তখন আমার খুব একটা খারাপ লাগত না। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম আমি আর কোনোদিন মা হতে পারব না, তারপর থেকেই খারাপ লাগাটা অনুভব করতে পেরেছিলাম। নিজের কোনো সন্তান ছিল না, যাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতে চাইতাম, সে আমাকে মায়ের জায়গা দিতেই নারাজ ছিল। কষ্টটা তখন থেকেই বুকের ভেতর জমাট বেঁধে ছিল। ভেবেছিলাম প্রভাত বড়ো হলে হয়তো বুঝতে পারবে আমি ওর শত্রু নই। তখন হয়তো আমাকে মা ডাকবে। কিন্তু আমার কপালে আর সেই সোনার দিন দেখা হয়ে ওঠেনি। আজ পর্যন্ত-ও প্রভাতের মুখে মা ডাক শোনার ভাগ্য আমার হয়নি। এক ছাদের নিচে থাকি ঠিকই, খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ও আমার সঙ্গে কথাও বলতে চায় না। ওকে টেবিলে খাবার দিয়ে আমার উঠে যেতে হয়। আমার সামনে বসে খেতেও ওর আপত্তি।”

ব্যাপারটা ধরতে পেরে মৃন্ময়ী শুধাল,
“এই কারণেই প্রভাতের খাওয়া শেষ হলে আপনি খেতে বসেন?”
রাহেলা বেগম মাথা ঝাঁকালেন, অর্থাৎ হ্যাঁ। মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“তাই বলে প্রভাত এত বছরেও বুঝবে না? আমি ভাবতাম ও একটু পাগলাটে স্বভাবের হলেও চিন্তাধারার দিক থেকে অন্যরকম। এবার বুঝতে পারছি, কেন ও সবসময় আপনার প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলেই এড়িয়ে যায়।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“থাক মা, তুমি এসব নিয়ে ওর সাথে কথা বলতে যেয়ো না। শুধু-শুধু রেগে যাবে। আমি এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কখনও তো এসব কথা কারো সাথে বলি না। আজ তুমি জিজ্ঞেস করেছ বলে বললাম। নইলে আমার মনের কথা মনেই থাকত।”
“আমি তো আপনার ঘরের মানুষ আম্মা। এখন থেকে আপনি আমার সাথে সব কথা বলবেন। কোনো কথা মনে চেপে রাখবেন না।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“বলব মা, বলব। আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমার মতো একটা মেয়ে ঘরের বউ হয়ে আসুক। আমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। বিশ্বাস করো, আমার শ্বাশুড়ির কাছে আমি যেমন মেয়ের মতো ছিলাম, তুমিও আমার কাছে আমার মেয়ের মতোই থাকবে। আল্লাহর কাছে লাখ-লাখ শুকরিয়া, তিনি আমার ছেলের কপালে এত ভালো মেয়ে জুটিয়ে দিয়েছেন।”
মৃন্ময়ী হাসিমুখে বলল,
“দোয়া করবেন আম্মা, আমি যেন আজীবন আপনাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারি। আর আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি প্রভাতকে বুঝাব। ওকে বুঝতে হবে একজন মাকে ও দূরে সরিয়ে রাখছে। যেচে মায়ের স্নেহ, মমতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখনও না বুঝলে আর কবে বুঝবে? ওকে বুঝতেই হবে।”
রাহেলা বেগম চিন্তিত মুখে বারণ করে বললেন,
“না-না মা, এসবের কোনো দরকার নেই। তুমি বলেছ, এটাই আমার কাছে অনেক। আমার কারণে পরে ও তোমার সাথে রাগ করবে।”
মৃন্ময়ী তাকে আস্বস্ত করে বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমার সাথে ও রাগ করবে না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি আপনার কাছে আপনার সন্তান ফিরিয়ে দিবো। আপনি শুধু আমাকে দোআ করবেন।”


কোচিং থেকে বেরিয়েই রোজকার মতো প্রভাতের হাসিমুখটা চোখে পড়ল মৃন্ময়ীর। তাকে দেখামাত্রই প্রভাত এগিয়ে এসে তার ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। প্রশ্ন করল,
“টায়ার্ড?”
দুদিকে মাথা নেড়ে মৃন্ময়ী বলল,
“টায়ার্ড তো তোমার হওয়ার কথা। এত করে বললাম তাড়াহুড়া করে অফিস থেকে এসে আমাকে নিয়ে যেতে হবে না। এটুকু রাস্তা আমি একাই যেতে পারব। তুমি শুনছোই না।”
“বিয়ের আগে যে বিকেলে একবার স্কুল গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতাম, রাতে আবার কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম?”
“তখন তো আর আমি তোমার বউ ছিলাম না। আর এখন যেখানেই থাকি, সেই তোমার ঘরেই ফিরে যেতে হবে। এরপরও তোমার কী দরকার এত দৌড়ঝাঁপ করার?”
“তোমার কথায় আমি বিকালে স্কুল গেইটে যাওয়া বাদ দিয়েছি। সারাদিন অফিস করে রাতে তোমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরি, তা-ও বারণ করছো?”
“তোমার ভালোর জন্যই তো বলছি।”
“আমার ভালোর কথা ভাবলে তোমার উচিত আমাকে ডেকে তোমার কাছে আনা। তোমাকে নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফেরা থেকে শুরু করে সকালে ঘুম থেকে ওঠা পর্যন্তই তো আমি তোমাকে কাছে পাই। কত অল্প সময়! তোমার উচিত চব্বিশ ঘন্টা আমার কাছে থাকা।”
“তাহলে বরং এক কাজ করি। আমার চাকরি-বাকরি সব ছেড়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোমার অফিসে গিয়ে বসে থাকি। তুমি আমার চেহারা দেখে-দেখে কাজ করো। কেমন হয়?”
প্রভাত চমৎকৃত হয়ে বলল,
“খুবই ভালো হয়। এরচেয়ে ভালো মাস্টার্সের সার্টিফিকেটটা তুলেই তুমি আমার অফিসে জয়েন হয়ে যেয়ো।”
“অ্যাহ্! আমার ইচ্ছা শিক্ষকতা করা, আমি গিয়ে বসে থাকব তোমার অফিসে? বললেই হলো?”
“তাহলে তো আর আমার দৌড়ঝাঁপ করতে হত না। একসঙ্গে কাজ করতে পারতাম। সারাদিন তোমাকে চোখের সামনে পেতাম।”
মৃন্ময়ী বলল,
“সারাদিন চোখের সামনে থাকি না বলেই তো মনের ছটফটানি টের পাও। দেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। এটাই ভালো।”
“কাজ শেষে একসঙ্গে বাড়িও ফিরতে পারতাম।”
“একসঙ্গে বাড়ি ফেরা কি খুব জরুরী?”
“অবশ্যই। অফিস থেকে বেরিয়ে আমি কতক্ষণে বউয়ের মুখ দেখব, সেই তাড়ায় থাকি। আগেভাগে বাড়ি গিয়ে বসে থাকার চেয়ে কোচিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঢের ভালো। আর নিজের ভালোর জন্য রাত-বিরাতে তোমাকে একা বাড়ি ফিরতে দিবো, আমি কি এতটাই আহাম্মক?”
“আমার বাড়ি কোচিং থেকে দূরে বলে বিয়ের আগে তোমার চিন্তা ছিল। এখন তো তোমার বাড়ি কাছেই, এটুকু পথ যেতে আমার বিপদ হবে না।”
“আমি রিস্ক নেব কেন? আমার বউয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব অবশ্যই আমার। তুমি হাজারবার বারণ করলেও আমি আসব।”
মৃন্ময়ী হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা এসো। তোমাকে বারণ করাও ভুল।”
“বললাম চাইলে কোচিং ছেড়ে দিতে পারো, তা তো শুনছো না।”
“আগে একটা প্রোপার চাকরি পাই, তারপর ছেড়ে দিবো।”
প্রভাত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“তোমার ইচ্ছা। মাকে কল করেছিলে?”
মৃন্ময়ী দাঁতে জিব কে’টে কপাল চাপড়ে বলল,
“ক্লাসের চাপে একদম ভুলে গেছি। বাড়ি ফিরে কথা বলব নে।”
“আমি কল করার পর তো বলল তার মেয়ে না কি দিন-দিন তাকে ভুলেই যাচ্ছে।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“ওসব তো মায়ের অভিমানী কথা। তাছাড়া মায়ের এখন মেয়ের চেয়ে মেয়ের জামাইয়ের প্রতি দরদ বেশি।”
“হ্যাঁ, জামাই খোঁজ নেয় বলে তোমার নিতে হবে না।”
“হবে না কখন বললাম? নিই তো। মাঝে-মাঝে দেরী হয়ে যায়। মা কী বলল?”
“সে তো নিজের রোগ-শোক লুকিয়ে কথা বলে। মৃত্তিকা বলল মায়ের ডায়াবিটিস এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আছে। সুযোগ বুঝে গিয়ে দেখে এসো। দেখি, কাল-পরশু গিয়ে আমি ঔষধ কিনে দিয়ে আসব।”
“আমি যাওয়ার সময় ঔষধ কিনে নিয়ে যেতে পারব।”
“আমি নিয়ে গেলে তোমার কী সমস্যা?”
“সমস্যা নেই।”
“তাহলে?”
মৃন্ময়ী প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“কী কথা?”
“একটু দাঁড়াও। পরে বাড়ি ফিরি।”
মৃন্ময়ীর সঙ্গে প্রভাত-ও থামল। কৌতুহল নিয়ে সে মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“এখানে দাঁড়িয়ে কী কথা বলতে হবে? বাড়ি ফিরে বলতে পারবে না?”
“না, এখনই বলতে চাই। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা।”
“বলো তাহলে।”
“তুমি কেন তোমার মাকে এখনও পর্যন্ত মা বলে ডাকো না?”
প্রশ্ন শুনেই প্রভাত পা চালিয়ে বলল,
“বাড়ি চলো। আমার ক্ষুধা পেয়েছে।”
মৃন্ময়ী নড়ল না। এক জায়গাতেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। প্রভাত ফিরে তাকিয়ে বলল,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার কথা না শোনা পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়ব না।”
“কী মুশকিল! রাত বাড়ছে তো মৃন্ময়ী।”
“বাড়ুক। তুমি চলে যাও, তারপর আমাকে ভূতে ধরুক।”
প্রভাত দু’পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এসব তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা?”
“হ্যাঁ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। কারণ তুমি ইচ্ছা করে মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছ। আম্মা তোমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। কিন্তু তুমি তা চোখে দেখেও দেখো না। কেন প্রভাত? তুমি জানো আম্মা মনে-মনে কত কষ্ট পান?”
প্রভাত সশব্দে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি তোমাকে বারবার বলেছি এসব নিয়ে না ঘাঁটতে। তবু তুমি কেন সবসময় এই প্রসঙ্গ-ই টানো?”
মৃন্ময়ী বেজার মুখে বলল,
“তুমি আমার সাথে রাগ করছো?”
প্রভাত হোঁচট খেয়ে বলল,
“রাগ কখন করলাম?”
“এই তো মাত্রই করলে।”
“রাগ করিনি।”
“তাহলে বিরক্ত তো হয়েছ।”
“না।”
“বললেই হলো? তুমি তাহলে আজকাল আমার ওপর বিরক্ত হতে শুরু করেছ?”
প্রভাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“না রে বাবা, থুক্কু, বউ। তুমি হঠাৎ কেন বাচ্চামি করছো? অদ্ভুত!”
“তাহলে তুমি আমার কথা শুনছো না কেন?”
প্রভাত এগিয়ে এসে মৃন্ময়ীর হাত ধরে বলল,
“এমন অদ্ভুত আচরণ কোরো না ম্যাডাম। বাড়ি চলো প্লিজ।”
মৃন্ময়ী বলল,
“একটু বসে আমার দুটো কথা শোনার ধৈর্য তোমার নেই? আম্মার প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইছি বলে? তুমি কখনও তাকে বুঝতে চেয়েছ? জানো তার মনে কত দুঃখ? আজীবন সে কত কষ্ট ভোগ করে তোমাদের সংসারে এসেছিল? তোমাকে সে এত ভালোবাসে, তবু তুমি কোন কারণে এখনও তাকে এড়িয়ে চলো? তার সাথে আমার কথা হয়েছে। সে তার মনে চেপে রাখা সব কথা আমাকে বলেছে, যার এক অংশ-ও তুমি জানো না। তুমি শুধু নিজেকে মায়ের ভালোবাসা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছো না, একজন মাকে-ও সন্তানের ভালোবাসা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছো। কেন প্রভাত?”
“আমার মা বহু আগেই মরে গেছে। চলো।”
“তুমি কি চাও ভবিষ্যতে তোমার সন্তান নিজের বাবার আর দাদির সম্পর্কের জটিলতা দেখুক? তুমি এমন করলে তোমার সন্তান তোমার কাছ থেকে কি শিখবে, বলবে আমাকে?”
প্রভাত অনুরোধের সুরে বলল,
“এসব বাদ দাও না প্লিজ।”
“উঁহু, আজ তোমাকে এসব বিষয় ক্লিয়ার করতেই হবে। নইলে আমি এখান থেকে নড়ব না।”
“কেন এমন করছো?”
মৃন্ময়ী প্রভাতের হাত চেপে ধরে মুখ ফুলিয়ে ডাকল,
“প্রভাত-”

এরপর আর প্রভাত কথা বাড়াতে পারল না। মৃন্ময়ী গাল ফুলিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। এ চাহনি এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। এমন সাধ্য সে কোনোদিন পেতে-ও চায় না। শেষমেশ প্রভাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বলো, শুনছি।”
মৃন্ময়ী খুশি হয়ে বলল,
“চলো বসি।”
“বসতে হবে?”
“হ্যাঁ। চা-ও খাব।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর হাতটা মুঠোয় নিয়েই হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“হঠাৎ এমন ত্যাড়ামি কোত্থেকে শিখলে?”
একগাল হেসে মৃন্ময়ী বলল,
“হঠাৎ কোথায়? এক ত্যাড়া মানুষ যতদিন ধরে আমার পিছু নিয়েছে, ততদিন ধরেই তো হাতে-কলমে ত্যাড়ামি শিখে আসছি।”
প্রভাত হেসে ফেলল। বলল,
“আচ্ছা, সুযোগ বুঝে খোঁচা মারা হচ্ছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“একদমই না। আমি তো কেবল সত্য কথা বললাম। একদম ভেজালহীন সত্য কথা।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১৬+১৭

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৬.
আহমদ তরফদার মৃন্ময়ীর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। মৃন্ময়ীর মায়ের সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন। মৃন্ময়ীকে দেখতে যাওয়ার কথা বলেছেন। মৃন্ময়ীর মা এবারেও মৃন্ময়ীকে না জানিয়ে পাত্রপক্ষকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে দিয়েছেন। প্রভাত ভাবেনি বাবা এত সহজে রাজি হয়ে যাবে। সে ভেবেই নিয়েছিল ব্যাপারটা নিয়ে বাড়িতে আরও কদিন যুদ্ধবিগ্রহ চলবে। কিন্তু তার উলটোটা হওয়ায় সে একটু অবাকই হয়েছে। আহমদ তরফদার এত সোজা মানুষ না। কী ভেবে হঠাৎ নিজে থেকেই রাজি হয়ে গেলেন জানা নেই প্রভাতের। তবু ঝামেলা না বাড়ায় সে মনে-মনে খুশি হয়েছে। অধীর আগ্রহে সে অপেক্ষা করছে পাত্র হয়ে মৃন্ময়ীকে দেখতে যাওয়ার। তার চেয়েও বড়ো অপেক্ষা বর সেজে যাওয়ার। যদিও তার জন্য তাকে আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে। প্রস্তাব পাঠানোর পর আবার মৃন্ময়ী তাকে কী কথাবার্তা বলে, তা-ও শুনতে হবে। এই মেয়েটার ত্যাড়ামিই এখন তার সবচেয়ে বড়ো দুশ্চিন্তার কারণ। বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আর সাজেদা বেগম প্রভাতের পরিবারকে আসতে বলে দিয়েছেন, এই খবর মৃন্ময়ীকে প্রথমে দিলো মৃদুলা। খবর শুনে মৃন্ময়ী কিছু মুহূর্তের জন্য পুরোপুরি আহাম্মক বনে গেল। এবার আর সে মাকে জিজ্ঞেস করতে ছুটে গেল না। সবার আগে জিজ্ঞেস করল প্রভাতকে। আজ সে প্রভাতকে সরাসরি কল করে বসল। অন্য সময় হলে প্রভাত অবাক হত। আজ কাল পেয়ে অবাক হলো না। রিসিভ করে হাসিমুখে কথা বলল,
“ম্যাডাম আজকাল আমাকে এত বেশি মিস করছেন?”
মৃন্ময়ী সে কথার উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল,
“এটা কি করলে প্রভাত?”
“কী করলাম?” না বুঝার ভান করে শুধাল প্রভাত।
“তুমি জানো না তুমি কী করেছ?”
“ওহ্! বিয়ের কথা বলছো?”
“তুমি আমাকে জানিয়ে এটা কেন করলে?”
“না জানিয়ে কোথায়? তোমাকেই তো সবার আগে জানিয়েছিলাম। সেদিন যে বললাম, মনে নেই তোমার?”
“তাই বলে এতদূর? মায়ের সাথে কখন যোগাযোগ করলে, কখন বাড়ি আসার কথাবার্তা হলো, কোনোকিছু আমাকে জানিয়েছ তুমি?”
“জানালে কী হত?’
“কী হত মানে? এত বড়ো একটা ব্যাপার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?”
“জানালে বাঁধা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে?”
এবার আর মৃন্ময়ী উত্তর দিতে পারল না। সত্যিই তো। বাঁধা দেওয়া ছাড়া আর কীইবা বলত সে? প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“সত্য কথা শুনে চুপ হয়ে গেলে তো? এজন্যই তোমাকে জানাইনি। বাঁধা তো আমি তোমাকে দিতেই দিবো না।”
“এটা কেমন কাজ প্রভাত? তুমিও দেখি আমার মায়ের মতো আচরণ করছো।”
“শাশুড়ির আদরের হবু জামাই তো, তাই।”
“একটা সত্যি কথা বলো তো। মাকে তুমি কীভাবে পটালে?”
“আমার ভালোবাসার শক্তি দিয়ে।”
“ফাজলামি কোরো না, সিরিয়াসলি বলো।”
“একসঙ্গে এতকিছু জেনে কী করবে? একটু অপেক্ষা করো। বিয়ের পর তো সবসময় আমাকে কাছেই পাবে। তখন একান্তে বসে সব প্রশ্নের উত্তর জেনে নিয়ো।”
প্রভাত সবকিছুতে এত ত্যাড়া কথা বলে! অথচ মৃন্ময়ীর কাছে বর্তমান পরিস্থিতি খুবই সিরিয়াস। প্রভাত এমন ত্যাড়া কথা বললে কীভাবে হবে?


মায়ের সাথে মৃন্ময়ীর কথা হয়েছে। বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই মা যেভাবে তাকে কড়া গলায় কথা শুনালেন! সাথে এ-ও বললেন, এই প্রভাতকে পছন্দ করার কারণেই না কি এতদিন তার কোনো ছেলেকে পছন্দ হয়নি। মৃন্ময়ী অস্বীকার করলেও মা তার কথা মানতে নারাজ। ওদিকে প্রভাত-ও নাছোড়বান্দা। যতবার তার সাথে দেখা হয়েছে, ততবারই সে বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে পিছাতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। মৃন্ময়ীর কোনো অজুহাত-ই সে কানে তুলছে না। তার এক কথা, ‘হয় এবার তোমাকে বিয়ে করব, নয় আজন্মের মতো বিয়ের‌ নাম ভুলব।’ মৃন্ময়ী না পারছে কাউকে কিছু বুঝাতে, না পারছে নিজেকে বুঝাতে। অথচ এসব ক্যাচাল চলতে-চলতেই প্রভাতের প্রতিক্ষার দিন ফুরিয়ে এল। আগামীকাল তারা মৃন্ময়ীকে দেখতে আসবে। ঘরে বসে মৃন্ময়ী এসব নিয়েই আকাশ-পাতাল চিন্তা করছিল। তার চিন্তা-ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটাল মৃত্তিকা আর মৃদুলা। তারা দুজন হঠাৎ রুমে এসে উপস্থিত হলো। মৃত্তিকা বিছানায় বসতে-বসতে জিজ্ঞেস করল,
“কী করছিস আপা?”
মৃন্ময়ী দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“তোরা না ঘুমিয়ে এখানে কী করছিস?”
মৃদুলা বলল,
“আমরা তোমার সাথে গল্প করতে আসতে পারি না?”
“তা পারবি না কেন? বোস।”
মৃদুলা বসল। মৃত্তিকা শুধাল,
“কালকের বিষয়ে কী ভাবলি আপা?”
মৃন্ময়ী বলল,
“এই তোদের গল্পের বিষয়?”
মৃদুলা তার একহাত ধরে বলল,
“আহা আপা! রাগ কোরো না। কালকের বিষয়টা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সাথে একটু কথাবার্তা বলো না ওই বিষয়ে।”
“কী আর বলব বল? মা আমার কোনো কথা কানে তুলছে?”
“মায়ের কথা আপাতত বাদ দাও। সে তো আজীবনই এমন। তুমি আমাদের সাথে কথা বলো।”
মৃত্তিকা বলল,
“হ্যাঁ আপা, আমরা তোর সব কথা শুনতে চাই। তোর মনে যা চলছে বল আমাদের সাথে।”
মৃন্ময়ী মলিন মুখে বলল,
“আমার মনে যা চলছে সবটাই কনফিউশন রে।”
“কিসের কনফিউশন? তুই কি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিস?”
“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
মৃদুলা বলল,
“হয়তো স্বাভাবিক। তবু একটা মানুষ এত করে বুঝানোর পরও তোমার কনফিউশন কীভাবে থাকে আপা? এত কনফিউশন নিয়ে কি জীবন চলে?”
মৃন্ময়ী তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার জায়গায় থাকলে বুঝতি রে মৃদুলা, একটা মেয়ে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে থাকলে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতেও সাহস পায় না, কনফিউশনে ভোগে। নইলে একটা সুখী জীবন কি আমার-ও প্রাপ্য ছিল না, বল?”
মৃত্তিকা বলল,
“প্রাপ্য বলেই তো আমরা তোর সাথে কথা বলতে চাইছি আপা। তোর মনে আমাদের নিয়ে কনফিউশন চলছে তো? প্লিজ তুই এই কনফিউশন থেকে বেরিয়ে আয়।”
“কীভাবে? কীভাবে বেরোতে বলছিস তোরা আমাকে? বিয়ে করে? বিয়ে করলেই আমার কনফিউশন কে’টে যাবে?”
“বিয়ে করলে তোর কনফিউশন কাটবে না। তোকে কনফিউশন কাটিয়ে বিয়ে করতে হবে। যতদিন তুই মনের ভেতর কনফিউশন রাখবি, ততদিন তুই বিয়ের কথাও ভাবতে পারবি না।”
“কার ভরসায় আমি কনফিউশন কাটাব রে? কে আছে আমাদের? বাবা তো নেই।”

কথাটা বলতে গিয়ে মৃন্ময়ীর গলা ধরে গেল, চোখ ভর্তি জল চলে এল। মৃত্তিকা তার হাত চেপে ধরে বলল,
“আপা, কার জীবনের দৈর্ঘ্য কতটুকু তা আমরা কেউ জানি না। আজ আমরা এই পরিস্থিতিতে আছি। আল্লাহ্ চাইলে ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে। আমরা আজীবন এমন থাকব না। সবার জীবন পালটাবে। তোর জীবন-ও পালটাবে। জীবনের শেষ অবধি তুই একা কাটাতে পারবি না, এটা তোর নিজের প্রতি করা সবচেয়ে বড়ো অন্যায় হবে। অন্তত একজন মানুষকে আকড়ে ধরে বাকি জীবনের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একসঙ্গে জীবনযাপন করার জন্য হলেও তোকে বিয়ে করতে হবে। কারোর পছন্দে তোকে বিয়ে করতে হবে না। তোর যাকে নিজের জন্য সঠিক মনে হবে, যার সাথে তোর একটা শান্তিপূর্ণ জীবনের সম্ভাবনা দেখবি, তাকেই বিয়ে করবি।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তুইও তো নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলি মৃত্তিকা। শেষ পর্যন্ত শান্তি রয়েছে?”
“রয়নি, কারণ আমি ভুল মানুষকে পছন্দ করেছিলাম। আমি জানি তুই আমার মতো সেই ভুল করবি না। প্রভাত ভাই তোর জন্য কতটুকু সঠিক, তা তো আমাদের চেয়েও তোর মন ভালো জানে। তাই না, বল? তোর কি মনে হয়, প্রভাত ভাই আর শফিক এক পাল্লার মানুষ?”
মৃন্ময়ী ডানে-বায়ে মাথা দোলাল। মৃত্তিকা আবারও শুধাল,
“এতদিনে প্রভাত ভাইকে যতটুকু চিনেছিস তাতে কি ওনাকে বিশ্বাসযোগ্য মানুষ মনে হয়?”
মৃন্ময়ী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। মৃত্তিকা বলল,
“সত্যি করে বল।”
“মিথ্যা কোথায় বললাম? লোকের কাছে ও মানুষ যেমনই হোক, যারা ওকে কাছ থেকে চিনে তারাই শুধু জানে ওর মনটা আসলেই ভালো।”
“তারমানে তুই ওনাকে বিশ্বাস করিস?”
মৃন্ময়ী একটু ইতস্তত করে উত্তর দিলো,
“ওই… করি। অবিশ্বাস করার তো কারণ নেই।”
“তবু তো করছিস।”
“কোথায়?”
“এই যে নিজের জীবনের ক্ষেত্রে। ওনার প্রতি বিশ্বাস থাকলে তোর এত কনফিউশনে ভোগার প্রশ্নই আসত না।”
মৃন্ময়ী আবারও প্রত্যুত্তর হারাল। মৃদুলা বলল,
“আচ্ছা আপা, তোমার কি মনে হয় প্রভাত ভাই তোমাকে সত্যি-সত্যি ভালোবাসে?”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো,
“হুম।”
“তুমি তাকে ভালোবাসো?”
“মৃদুলা, বেশি পেকে গেছিস। নিজের কাজে যা।”
মৃন্ময়ীর কপট রাগ দেখে মৃদুলা হেসে বলল,
“দেখেছ? তুমিও তবে প্রভাত ভাইকে ভালোবাসো। কিন্তু স্বীকার করতে চাও না।”
মৃত্তিকা বলল,
“সে তোকে ভালোবাসে, তুইও তাকে ভালোবাসিস। দুজনের ভালোবাসা-ই সত্যি। একজন আরেকজনকে বুঝতে পারিস। তোরা একে অপরের জন্য পারফেক্ট। এর বেশি আর কী চাই? ভরসা রাখ আপা, উনি তোকে হতাশ করবেন না।”
মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি জানি রে। ওকে নিয়ে আমার তেমন ভয় নেই। আমি জানি ও আমাকে ভালো-ই রাখতে চায়। কথা দিয়ে তা ভাঙার মানুষ ও না। ও আমাকে এ-ও বলেছে যে, আমার পরিবারকে ও নিজের পরিবার ভাববে। আমার কোনো সিদ্ধান্তে, কোনো কাজে বাঁধা দিবে না। তবু বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবন তো এক হয় না।”
মৃদুলা বলল,
“প্রভাত ভাই যখন কথা দিয়েছে, তখন সব ঠিকঠাক থাকবে আপা। দেখো, আপুর ডেলিভারির পর তো আবার সে কাজে যাবে। দরকার হলে আমিও টিউশন বাড়িয়ে নেব। আমাদের জীবন চলে যাবে আপা।”

মৃত্তিকা-ও গলা মিলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আপা, তুই আর এসব নিয়ে ভাবিস না। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, আমি মাকে আর মৃদুলাকে দেখে রাখব। প্রভাত ভাইকে যতটুকু চিনেছি, তাতে আমার-ও মনে হয় না সে তার কথা ভাঙবে। প্লিজ আপা, তুই এবার শুধু নিজেকে নিয়ে ভাব। আমরা স্বার্থপরের মতো আর তোকে ধরে রাখতে চাই না। মা তোকে নিয়ে দিন-রাত দুশ্চিন্তা করে। তার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে দেখ। সে শুধু তোর একটা সুন্দর, সুখী সংসার দেখতে চায়।”
মৃদুলা অনুরোধের সুরে বলল,
“প্লিজ আপা, এবার আর ‘না’ কোরো না। প্রভাত ভাইয়ের মতো মানুষ হারালে এমন মানুষ আবার তোমার জীবনে আসবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। মা এবার অনেক আশা নিয়ে আছে।”
মৃন্ময়ী কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করল না। তার মাথা কেমন ফাঁকা লাগছে। মনটা এত বেশি আবেগী হয়ে উঠেছে যে চোখ দুটো বারবার ভিজিয়ে দিচ্ছে। এ কেমন কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়ল সে?


প্রভাতসহ তার বাবা, মা আর চাচি এসেছে মৃন্ময়ীর বাড়িতে। মৃন্ময়ীর মা তাদের খুশিমনে আপ্যায়ন করছেন। মৃদুলা সব কাজে মাকে সাহায্য করছে। মৃত্তিকা চেপে ধরেছে মৃন্ময়ীকে। মৃন্ময়ী সাজগোজ করতে নারাজ ছিল। মৃত্তিকা তাকে শাড়ি পরিয়ে হালকা সাজিয়ে ছেড়েছে। তাকে ভীষণ আনন্দিত দেখাচ্ছে। মৃন্ময়ী খেয়াল করে বলল,
“তুই এত খুশি কেন?”
মৃত্তিকা বলল,
“খুশি হব না? আমার বড়ো আপার বিয়ে বলে কথা! কত্ত অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।”
“এখনও সামনেই গেলাম না, বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।”
“সামনে গেলেই তো বিয়ে ফাইনাল।”
“তোকে বলেছে?”
মৃত্তিকা হাসিমুখে বলল,
“আড়াল থেকে তাদের কথাবার্তা শুনেই বুঝেছি।”
“কী বুঝেছিস?”
“এই যে তারা মূলত তোকে পুত্রবধূ করার পাকাপোক্ত পরিকল্পনা নিয়েই দেখতে এসেছে। শোন আপা, তোর বিয়ের দিন-ও কিন্তু আমি-ই তোকে সাজিয়ে দিবো। তোকে বউ সাজানোর খুব শখ আমার।”
“কেন?”
“জানি না। শুধু জানি আমার মন শান্তি পাবে।”
মৃন্ময়ী হাসল। সময় দেখতে ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে ভেসে থাকা প্রভাতের ম্যাসেজ চোখে পড়ল। আরও দশ মিনিট আগে সে লিখেছে,
“কত সাজছো ম্যাডাম? তোমাকে না বলেছিলাম সাজগোজের পেছনে বেশি সময় নষ্ট করবে না? তুমি আজ মুখে এক থাবা কালি মেখে এলেও আমি তোমাকে বউ বানিয়ে ছাড়ব। তাড়াতাড়ি এসো না। বসে থাকতে-থাকতে আমার কোমর ব্যথা হয়ে গেল। হার্টটাকে-ও আর সামলানো যাচ্ছে না। দ্রুত দেখা দিয়ে আমাকে বাঁচাও প্লিজ।”

পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে মৃন্ময়ী লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারল না। পাত্রের জায়গায় প্রভাত বসে বলেই হয়তো তার লজ্জা এবার আকাশ ছুঁয়েছে। অন্যান্যবার পাত্রপক্ষের মহিলারা যেভাবে তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নানান প্রশ্ন করেছিল, এবার মৃন্ময়ীর সাথে তেমনটা হলো না। হাতেগোনা কয়েকটা প্রশ্ন করল প্রভাতের মা-চাচি। মৃন্ময়ী বুঝতে পারল তারা আগে থেকে সবকিছু জেনেই এসেছেন, বিধায় অত প্রশ্নের ঝঞ্ঝাটে যাচ্ছেন না। একটা ব্যাপার না চাইতেও মৃন্ময়ীর নজরে পড়ল। তা হচ্ছে প্রভাতের মায়ের আচরণ। মহিলা হাসিমুখে খুব সুন্দরভাবে কথা বলছেন। মায়ের কাছে প্রভাতের-ও খুব প্রশংসা করছেন। কিন্তু প্রভাত যে বলেছিল তার মা তাকে ছেলে মনে করে না? মায়ের প্রতি তার যা অভিযোগ, তাতে মৃন্ময়ী ভেবেই নিয়েছিল মহিলা হয়তো ভীষণ খারাপ ধরনের। কথাবার্তা কটু, আচরণ অসহ্যকর। অথচ এখন মনে হচ্ছে তার কল্পনা পুরোটাই ভুল। মহিলা তো সম্পূর্ণ-ই তার বিপরীত ধরনের মানুষ। কিন্তু মহিলা কি সত্যিই এমন? না কি এটা কেবলই লোকদেখানো ভালোমানুষী? প্রভাত-ই বা তাকে মিথ্যা বলবে কেন? মৃন্ময়ী কেমন কনফিউশনে পড়ে গেল। বিয়ে-টিয়ের চিন্তা-ভাবনা রেখে তার সম্পূর্ণ মনোযোগ গিয়ে বসে আছে মহিলার দিকে। কৌতুহলবশত লজ্জা ডিঙিয়ে সে একবার মাথা তুলে তাকাল কেবল মহিলার মুখটা দেখার জন্য। দেখতেও সে যথেষ্ট সুশ্রী। হাসি-হাসি মুখ। বয়সটা হয়তো মৃন্ময়ীর মায়ের চেয়েও কম। এই মহিলা প্রভাতের সৎ-মা, তা-ই আর মৃন্ময়ীর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করল না। কী আশ্চর্য ব্যাপার!

মূর্তির মতো চুপটি করে বসে থাকতে মৃন্ময়ীর ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। ভাগ্যিস তাকে বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখা হয়নি। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পরেই তাকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। সে ভেতরে চলে আসার পর মায়ের সাথে পাত্রপক্ষের আলোচনা বসল। মৃদুলা আর মৃত্তিকা আড়াল থেকে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে সেই আলোচনা শোনার জন্য। মৃন্ময়ী ধরেই নিয়েছিল এবারেও মা একই কাজ করবে। তাকে কোনোকিছু জিজ্ঞেস না করেই পাত্রপক্ষকে আশা দিয়ে বসবে। কিন্তু মৃত্তিকা আর মৃদুলা এসে খবর দিলো মা এবার তেমনটা করেইনি। বরং সে বলে দিয়েছে মেয়ের সাথে কথা বলে তাদের জানাবেন। প্রভাতের মা না কি এ-ও বলেছিলেন যে, তারা চাইলে আজ-ই নিজেদের মধ্যে স্বল্প আয়োজনে বিয়ের কাজ সেরে ফেলবেন। তাদের না আছে কোনোরকম দাবিদাওয়া, না চান বড়ো আয়োজন। তবু সাজেদা বেগম একটু সময় চেয়েছেন। তাড়াহুড়া করে তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে চান না। মৃন্ময়ী বেশ বুঝতে পারল মৃদুলা আগেভাগে মাকে সব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রভাতের বিষয়টা-ও যে মাকে এই মেয়ে-ই বুঝিয়েছে, এ-ও মৃন্ময়ী ঢের বুঝতে পেরেছে। এবার তিনজন জোট বেঁধে একসঙ্গে কোমর বেঁধে নেমেছে তাকে বিদায় করার জন্য।


পরদিন স্কুল ছুটির পর মৃন্ময়ী রাস্তায় বেরোনোর সাহস পেল না। ভয়ে নয়, লজ্জায়। রাস্তায় বেরোলেই প্রভাতের মুখোমুখি হতে হবে যে! গতকালের ঘটনার পর মৃন্ময়ী প্রভাতের মুখোমুখি হতেই চাইছে না। ওই ছেলের মুখ যা লাগাম ছাড়া, দেখা হলেই কী না কী বলে দিবে! কিন্তু ছুটির পর মৃন্ময়ী কতক্ষণ-ই বা বসে থাকতে পারবে? ইতোমধ্যে ক্লাসরুমগুলোতে তালা পড়ে গেছে। টিচার্স রুমে-ও এক্ষুনি তালা পড়বে। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে মৃন্ময়ী স্কুল থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে-সঙ্গে যম তার সামনে উপস্থিত হলো। অবশ্য যম মহাশয় আগে থেকেই অপেক্ষারত ছিল। মৃন্ময়ীকে দেখেই সে প্রশ্ন করল,
“এত দেরী করে বেরোলে যে?”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
ছোটো করে উত্তর দিয়েই মৃন্ময়ী নিজের মনে হাঁটা দিলো। প্রভাত তার সাথে হাঁটতে-হাঁটতে তার মুখোভাব লক্ষ্য করল। তারপর প্রশ্ন করল,
“তুমি কি আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছ? ম্যাডাম? কথা বলছো না যে?”
মৃন্ময়ী গম্ভীর মুখে বলল,
“কিছু বলার নেই।”
“বিয়ের ব্যাপারেও না?”
“আমার কথা শোনার প্রয়োজন আছে তোমাদের?”
“অবশ্যই আছে, যদি তোমার কথা শোনার মতো হয়।”
“আমার কথা তো শোনার মতোই না। তোমাদের সব কথা শোনার মতো।”
“উঁহু, এখনই এত ঝগড়া করলে হবে? বিয়ের পরের জন্য কিছু বাকি রাখো।”
“তোমাকে কে বিয়ে করবে?”
“অবশ্যই তুমি। বিয়ের জন্য সবাই প্রস্তুত হয়ে আছে, এখনও কনফিউজড থাকলে চলবে?”
“আমরা সময় চেয়েছি, এখনও মতামত জানাইনি।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“আমি জানি তো তোমার মনের মতামত। মুখে যতই ‘বিয়ে করব না, করব না’ করো, মনে-মনে যে আমার বউ সাজার স্বপ্ন বুনছো, তা আর অস্বীকার করে লাভ নেই। আমি সব জানি।”
“তুমি তো সবজান্তা শমসের।”
“শুধু তোমার জন্য।”

ব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে মৃন্ময়ী প্রভাতের দিকে বাড়িয়ে ধরল। প্রভাত ভ্রু কুঁচকে বলল,
“বিয়ে ভাঙার জন্য হবু বরকে ঘুষ দিচ্ছ না কি? তাহলে পাঁচ কোটি টাকা দিলেও আমি রাজি নই, দুঃখিত। আমার ভালোবাসার মূল্য এত কম নয়।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল,
“তোমাকে ঘুষ কে দিচ্ছে? এটা তোমার পাওনা টাকা।”
“পাওনা টাকা! কিন্তু তুমি আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছ বলে তো আমার মনে পড়ে না,” মনে করার চেষ্টা করে বলল প্রভাত।
“নাও, তারপর মনে করিয়ে দিচ্ছি।”
“উঁহু, আগে বলো কিসের টাকা।”
“নাও আগে।”
“না জেনে নিচ্ছি না।”
“অনামিকার বিয়েতে গিফট কেনার টাকা আমার থেকে কম নিয়েছিলে কেন?”
“কে বলল কম নিয়েছি?”
“কে বলেছে, সেটা বিষয় নয়। তুমি যে আমাকে মিথ্যা বলে টাকা কম নিয়েছিলে, এটা তো সত্যি।”
“না।”
“প্রভাত, আমি জানি তুমি এটা করেছ। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে এত কম টাকায় কী গিফট কিনেছ তোমরা। তখনই আমার ওদের কাউকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। গতকাল রাসেলের সাথে কথায়-কথায় অনামিকার বিয়ের প্রসঙ্গ না উঠলে তো জানাই হত না।”
প্রভাত বলল,
“রাসেল বলেছে তাহলে? ওকে তো আমি-”
তার কথায় বাঁধা দিয়ে মৃন্ময়ী বলল,
“প্রভাত, আমি জানি তুমি আমার জন্য অনেক ভাবো। তাই বলে আমি সবসময় তোমার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা চাই না। কষ্ট করে হলেও আমি নিজের প্রচেষ্টায় এই অবধি এসেছি।”
“আমি জানি তুমি কারোর থেকেই আর্থিক সহায়তা চাও না। আমি এ-ও জানি তখন তোমার টানাপোড়েন চলছিল, কারণ মাসের মাঝামাঝি সময়ে তোমার হাতে অত টাকা থাকার কথা নয়। তাই আমি তোমার ওপর চাপ ফেলতে চাইনি। দয়া করে বিষয়টা খারাপ চোখে দেখো না।”
“খারাপ চোখে দেখছি না। সাহায্য করেছ, সেজন্য ধন্যবাদ। এখন আমার হাতে টাকা আছে, তাই ফেরত দিচ্ছি।”
“আমি ফেরত নিতে চাই না।”
“কেন? নাও প্লিজ। আমি ঋণী থাকতে চাই না।”
“সব মানুষকে ঋণী করে রাখা যায় না। তুমিও আমার কাছে তেমন। যেদিন তুমি আজীবনের জন্য আমার হাত ধরবে, সেদিন থেকে বাকি জীবন আমি নিজেই তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব।”

প্রভাত নারাজ। মৃন্ময়ী কোনোভাবেই টাকাটা তাকে ফেরত দিতে পারল না। ঘুরেফিরে প্রভাত সেই বিয়ের প্রসঙ্গেই ফিরে গেল,
“শোনো, দ্রুত মতামত জানিয়ো। এতদিন আমি কীভাবে অপেক্ষা করেছি জানি না। গতকাল তোমার বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকে আমার আর অপেক্ষা ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তোমাকে না পেলে আমি এবার পাগল হয়ে যাব।”
মৃন্ময়ী‌ টিপ্পনী কে’টে বলল,
“তুমিই না কদিন আগে বলেছিলে আমার জন্য আজীবন অপেক্ষা করতে তোমার আপত্তি নেই? আমাকে না পেলেও তুমি আমাকে ছাড়বে না? তাহলে হঠাৎ করে টিনেজারদের মতো আবেগী হয়ে উঠলে কীভাবে?”
“জানি না। এখন আমি শুধু জানি তুমি আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসবে, নয়তো আমি সত্যি-সত্যি পাগল হয়ে যাব।”
“ঠিক আছে। আমি তাহলে আজই পাগলা গারদে আলাপ করে রাখছি।”
প্রভাত গোমড়া মুখে বলল,
“তোমাকে ভালোবেসে আমি একটা ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি। আর তুমি আমাকে পাগলা গারদে পাঠাতে চাইছো?”
“আমি কোথায় চাইছি? চাইছ তো তুমি। আমি শুধু তোমার চাওয়াটা পূরণ করতে চাইছি।”
“এতদিন ধরে যা চাইছি, তা তো পূরণ করার নাম নিলে না। এখন হুট করে যখন পাগলা গারদের কথা বললাম, অমনি তোমার চাওয়া পূরণের ইচ্ছা জেগে উঠল?”
“ভুল কী বললাম? এখন তো তোমার ঘর আছে, পরিবার আছে। পাগল হওয়ার পর তো তুমি সব ভুলে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরবে। তাই আমি তোমার জন্য একটা নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে চাইছি।”
প্রভাত তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“ঘর? পরিবার? ওসব তো আমার থেকেও নেই ম্যাডাম। তোমার কাছে সবসময়ই তো আমার এটুকু চাওয়া-ই ছিল। ছোট্ট একটা ঘর, মিষ্টি একটা পরিবার, একটু যত্ন, ভালোবাসা আর ঘরভরা সুখ। এর বেশি কিছু আমার চাই না, বিশ্বাস করো। তুমি শুধু আমার এটুকু চাওয়া পূরণ করে দিয়ো, আমি এক জীবন তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব।”

এসব কথার প্রেক্ষিতে মৃন্ময়ী আমতা-আমতা করে বলল,
“তোমাকে একটা প্রশ্ন করার ছিল।”
“বলো।”
“আচ্ছা, তোমার মা কি সত্যিই এত খারাপ? গতকাল তাকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে আমার কেন জানি মনে হয়েছে সে এতটাও খারাপ না। আবার তোমার কথার সাথেও কিছু মিল পাচ্ছি না। তাই গতকাল থেকে আমার মনে প্রশ্নটা উঁকি মারছে।”
প্রভাত তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“মুখে মিষ্টি ঝরলেই সবার মন মিষ্টি হয় না।”
মৃন্ময়ী আবারও কনফিউশনে পড়ল। সত্যিই কি এত মিষ্টি আচরণের মানুষটার মন বিষাক্ত? মৃন্ময়ীর মানতে ইচ্ছা করছে না। যদিও জগতের নিয়ম-ই এমন। মানুষের মুখ আর মনের মিল খুঁজে পাওয়া ভার। ঠিক যেন বিষে ভরা সুদর্শন ফুল। দেখতে ভীষণই আকর্ষণীয়, ছুঁয়ে দিলেই আলগোছে বিষ ছড়িয়ে দেয়।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৭.
মৃন্ময়ীর মায়ের সাথে আহমদ তরফদারের কথা হয়েছে। আহমদ তরফদার নিজেই কল করেছিলেন তাদের মতামত জানার জন্য। মৃন্ময়ীর মা জানিয়েছেন তার মেয়ের আপত্তি নেই। এবার বিয়ের কথা এগোনো যায়। আহমদ তরফদার বেশি দেরী করতে চাননি। তিনি জানিয়েছেন আগামী সপ্তাহেই বিয়ের তারিখ ঠিক করবেন। মৃন্ময়ীর মা তাকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। একসঙ্গে বসেই বিয়ের পাকা কথা বলা দরকার। আহমদ তরফদার নিজেও এমনটাই চাইছিলেন। তবে তিনি সঙ্গে করে কাউকে নিবেন না। প্রভাত তাকে বলে দিয়েছে বিয়ের পাকা কথা বলতে বাবার সাথে শুধু সে নিজেই যাবে। অন্য কাউকে পাঠিয়ে সে মৃন্ময়ীর পরিবারের ওপর চাপ ফেলতে চায় না। তাছাড়া বিয়ের আয়োজনের ব্যাপারেও খোলামেলা আলোচনা খুব জরুরী। তাকে ছাড়া সেটা ঠিকঠাক হবে না। আহমদ তরফদার আত্মীয়-স্বজন কাউকে সঙ্গে নিতে না পারায় মনে-মনে অসন্তুষ্ট-ই হয়েছেন। তবু তাকে ছেলের কথা মেনে নিয়ে একা যেতে হলো বিয়ের পাকা কথা বলতে। দুজন এলেও সাজেদা বেগম যথাযথভাবে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছেন। সাজেদা বেগমের ভাই, ভাবি-ও উপস্থিত ছিলেন। তবু কথাবার্তা বলার সময়ে প্রভাত সাজেদা বেগমকে অনুরোধ করলেন মৃন্ময়ীকে ডাকার জন্য। সে চায় আলোচনায় মৃন্ময়ী নিজে উপস্থিত থাকুক। এই সংসারে বাবার অবর্তমানে যেহেতু হাল তার হাতেই, সেহেতু তার মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছেলের এমন কথা শুনে আহমদ তরফদার তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাজেদা বেগমের ভাই ইতস্তত করে বললেন,
“সমস্যা নেই বাবা। আমরা আছি তো অভিভাবক হিসেবে। আমাদের সাথেই সব কথা বলতে পারো। আমাদের মেয়ের তাতে আপত্তি নেই।”
প্রভাত বলল,
“আপত্তি যেন না থাকে সেজন্যই তার এখানে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত যদি তার মতের বিপরীতে চলে যায়, তাহলে সেটা ভালো হবে না। কারণ তার পরিবারের দিক থেকে যেকোনো সিদ্ধান্ত তার-ই নেওয়া উচিত। দয়া করে তাকে ডাকুন, তারপর আমরা কথাবার্তা শুরু করি। আপনারা দ্বিধাবোধ করবেন না। আমি নিজেই চাইছি আপনাদের মেয়ে সব কথা শুনুক আর নিজের মতামত-ও জানাক। তাহলে আমাদের দু’পক্ষের জন্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে।”

প্রভাত বারবার এক কথা বলায় সাজেদা বেগম মৃন্ময়ীকে ডাকলেন। মৃন্ময়ী ভীষণ চিন্তিত ছিল কথাবার্তা বলে আবার কী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তার মা। বিশেষ করে বিয়ের আয়োজন নিয়েই তার যত দুশ্চিন্তা। বিয়েতে বেশি খরচ করার সাধ্য তাদের নেই। আত্মীয়-স্বজন দাওয়াত করে খাওয়াতে এত টাকা কীভাবে ম্যাসেজ করবে, সেই চিন্তায়-ই তার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। বিয়ের আলোচনায় বসেছেও সে দুরুদুরু বুকে। যদি দুই পক্ষের কথায় না মেলে? নিজস্ব মতামত জানানোর জন্য মৃন্ময়ীকে ডাকা হলেও, মৃন্ময়ীর তেমন কিছু বলার প্রয়োজন-ই পড়েনি। প্রভাত যেন তার মন পড়তে পারে, এমনভাবেই সমস্ত আলোচনায় তাকে কেবল বাঁচানোর চেষ্টা-ই করল। তাদের কোনো দাবিদাওয়া নেই, তা তারা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। বাকি ছিল অনুষ্ঠানের আয়োজনের ব্যাপারটা। প্রভাত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলো সে বড়ো আয়োজন চায় না। এমনকি তার পক্ষ থেকে গাড়ি ভর্তি মানুষ নিয়েও সে বিয়ে করতে আসতে নারাজ। হাতেগোনা কয়েকজন নিয়ে আসবে সে। আয়োজন হবে সাদামাটা। তার এসব কথা শুনে আহমদ তরফদারের মুখ কালো হয়ে যায়। বিষয়টি লক্ষ্য করে সাজেদা বেগম সৌজন্যতার খাতিরে বললেন,
“তা কী করে হয় বাবা? আত্মীয়-স্বজন রেখে বিয়ের মতো বড়ো ব্যাপার একা-একা সারা যায়?”
প্রভাত বলল,
“আত্মীয়-স্বজন রেখে করব না আন্টি। আমার আত্মীয়-স্বজনের জন্য যা আয়োজন দরকার, আমার বাড়িতেই করব। সবাইকে সাথে নিয়ে যে বিয়ে করতে আসতে হবে, এমন তো কোনো মাথার দিব্যি নেই। আর আপনাদের যদি মনে হয় আপনাদের আত্মীয়-স্বজন ডাকা দরকার, তাহলে অবশ্যই ডাকবেন। তাতে তো আর আমি বারণ করতে পারি না। তবে আমি চাই না আমাদের বিয়ের জন্য আপনাদের ওপর কোনোরকম চাপ পড়ুক। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ের সমস্ত খরচ আমি নিজেই বহন করব। আপনাদের কাউকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে না।”
আহমদ তরফদার ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে বুঝার জন্য জিজ্ঞেস করলেন,
“সমস্ত খরচ বলতে কোন খরচ?”
“বিয়ের আয়োজনের খরচ। মৃন্ময়ীর বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি তার দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি যেহেতু বেঁচে নেই, আমি মনে করি বিয়ের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার-ও কেউ নেই। আর আমি অবশ্যই মৃন্ময়ীর ওপর চাপ ফেলতে চাই না। তাই বিয়ের আয়োজনের দায়িত্বটা আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। আমি আশা করব আমার সিদ্ধান্তে কারোর আপত্তি না থাকুক।”
আহমদ তরফদার মৃন্ময়ীদের সামনে কিছু বলতে পারলেন না, তাই দাঁত চেপে বসে রইলেন। মৃন্ময়ী নিজেও কিছু বলতে পারছে না। তার কেমন মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। প্রভাতের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ হচ্ছে। আবার ভেতর-ভেতর অস্বস্তি-ও হচ্ছে। পাছে প্রভাতের পরিবার না সিদ্ধান্তটা খারাপভাবে নেয়। তার বাবাকে-ও খুব একটা সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে না। নিরবতা-ই তার অসন্তুষ্টির লক্ষণ। মৃন্ময়ীর মামা কানের লতি চুলকে বললেন,
“না-না, আমাদের দিকের আয়োজন নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমরা ম্যানেজ করে নেব। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না।”
প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“বিয়েটা তো আমিই করছি মামা। আপনারা আপনাদের মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবেন, এটা তো আয়োজনের চেয়েও অনেক বড়ো ব্যাপার। আপনাদের মাথার ওপর চাপ প্রয়োগ করে, মনে দুঃখ দিয়ে আমি আপনাদের মেয়েকে কেড়ে নিতে চাই না। এতে ও নিজে-ও মানসিক অশান্তিতে থাকবে। আমি চাই সবাই মন থেকে হাসিখুশি থাকুক। হাসিমুখে আমাদের বিয়েতে উপস্থিত থাকুক। দেখুন, আমার দিক থেকে এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই। আমি প্রস্তুতি নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দয়া করে আপনারা আপত্তি করবেন না।”

দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা করেও কেউ প্রভাতকে তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারল না। মুখ ফুটে বলেছে মানে বিয়ের খরচ সে-ই বহন করবে। আহমদ তরফদার চক্ষু লজ্জায় শেষে মিনমিনে গলায় সম্মতি জানালেন। এরপর আর সাজেদা বেগমের আপত্তি থাকার কারণ রইল না। সবার মতামত মিলে যাওয়ার পর তারা বিয়ের তারিখটা-ও ঠিক করে ফেললেন। আহমদ তরফদার নিজেই বললেন আগামী শুক্রবার বিয়ের দিন নির্ধারণ করা হোক। কেউ তাতে আপত্তি জানায়নি।

মৃন্ময়ীর পরিবারের সামনে আহমদ তরফদার ছেলের সব সিদ্ধান্ত মুখ বুজে মেনে নিলেও, তিনি মুখ খুললেন বাড়ি পৌঁছানোর পর। বাড়ি ফিরেই তিনি চেপে রাখা রাগটুকু ঝাড়তে শুরু করলেন। উঁচু গলায় প্রভাতকে শুনিয়ে-শুনিয়ে স্ত্রীর কাছে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরলেন। সঙ্গে প্রভাতের সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করতে-ও ছাড়লেন না। প্রভাত জানত বাড়ি ফিরলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবেই। বাবাকে থামানোর জন্য সে জামা-কাপড় ছেড়ে এসে সোজাসাপ্টা জানতে চাইল,
“আমার সিদ্ধান্তে আপনার সমস্যা কোথায়?”
আহমদ তরফদার তিক্ত স্বরে বললেন,
“সমস্যা কোথায়? তুই কোন পরিবারে বিয়ে করতে গেছিস যে বিয়ের খরচ-ও তোকেই দিতে হবে? মানুষজন শুনলে হাসবে।”
“মানুষজন হাসবে, না কাঁদবে, তা দিয়ে আমার তো কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষজনকে আপনি শুনাতে যাবেন কেন?”
“এসব কথা আবার চাপা থাকে? ভালো পরিবারের অভাব নেই, সব রেখে তার চোখ পড়েছে এমন পরিবারে, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কজন লোক খাওয়ানোর মুরোদ-ও যাদের নেই।”
প্রভাত কপাল কুঁচকে বলল,
“ওই পরিবারের আসল দায়িত্ব নেওয়ার মানুষটাই নেই, তা কি আপনি দেখছেন না? মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য কি তারা এখন কিডনি বিক্রি করবে? আপনি তা-ই চাইছেন?”
আহমদ তরফদার চিৎকার করে বলে উঠলেন,
“যোগ্যতা না থাকলে ভালো ফ্যামিলিতে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার এত শখ কেন? তোর মাথা-ও কি খেয়েছে তারা? বিয়ের কথাবার্তা বলতে একা আমাকে নিয়ে গেছিস। কী করতে নিয়েছিস? চেহারা দেখাতে? আমার কোনো মতামত জানার প্রয়োজন পড়েছে তোর? তোর বিয়ের সিদ্ধান্ত তুই একাই নিয়ে নিয়েছিস। এখন আবার বিয়েতে-ও কাউকে নিবি না বলে এসেছিস। আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে আমি একা-একা সেরে আসব? এই, আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারব রে? কী শুরু করেছিস তুই? ফাজলামি পেয়েছিস?”
প্রভাত নিজেও রাগত মুখে বলে উঠল,
“আমার যাকে পছন্দ, আমি তাকেই বিয়ে করব। ফ্যামিলির দিকে তাকিয়ে আমি কী করব? তাকে নিয়ে সংসার আমি করব, জীবন আমি কাটাব। আপনি ফাজলামির কী দেখলেন? আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে নিয়ে বিয়ে করতে যাব না বলে আপনার এত দুঃখ? আমার মা মরার পর কদিন আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠী এসে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছে? কে আমাকে ডেকে একবেলা ভালো-মন্দ খাওয়াতে চেয়েছে? উলটা আমার বাড়ি এসে পেটভরে খেয়ে গেছে। খাওয়ালেই তাদের কাছে আপনি ভালো। আপনার এত ভালো সাজার শখ জাগলে আপনি নিজেই গোরু কেটে আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীর খাওয়ান, আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আপনার স্বার্থপর গোষ্ঠীকে পেটপূজা করাতে নিয়ে যাব না। আমার অত ভালো সাজার শখ নেই কারোর কাছে। তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা-ও আমার নেই।”
পরক্ষণেই তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওনাকে ভালোমানুষী বন্ধ করতে বলুন। খাইয়ে-খাইয়ে মানুষের সামনে ভালো হতে যায়। তাকে কে খাওয়ায়? জীবনে তো আমাকে আপনারা ভালো থাকতে দিলেন না। এবার অন্তত আমাকে মুক্তি দিন। আমার ভালো থাকার পথ আমি বেছে নিয়েছি। এতেও যদি কেউ বাঁধা দেন, এই বাড়ি ছাড়তে আমি এক মুহুর্ত-ও ভাবব না। আমার মা-ও নেই, এ বাড়িতে আমার কোনো পিছুটান-ও নেই।”

আহমদ তরফদার আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন। প্রভাত আর তার কথা শোনার অপেক্ষা করল না। হনহনিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল। রাহেলা বেগম বিরক্ত মুখে বললেন,
“আপনি থামুন তো। কী চেঁচামেচি শুরু করেছেন? আমার মাথা ধরে যাচ্ছে আপনার চেঁচামেচি শুনে।”
আহমদ তরফদার নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। একইভাবে বলে উঠলেন,
“আমি থামব কীভাবে? দেখছো না আমার জন্মের ছেলে আমার মুখে চুনকালি মাখতে চাইছে? ইচ্ছা করে সবার কাছে আমাকে ছোটো করতে চাইছে?”
“আপনি নিজেই নিজেকে ছোটো করছেন।”
“তুমিও ওর সুরে কথা বলছো?”
“তো কী করব? ছেলেটা নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে সুখে থাকতে চাইছে, থাকুক না। আপনি কেন এত আপত্তি করছেন? মেয়েটা তো খারাপ না, যথেষ্ট ভালো। মেয়েটার পরিবার নিয়ে এত কথা বলেন কেন? বাবা ছাড়া মেয়েটা কত কষ্টে পরিবারকে টেনে চলেছে, ওদের যন্ত্রণা তো আমরা দূর থেকে বুঝতে পারি না। বাবা থাকলে তো আর ওদের অবস্থা এমন থাকত না।”
“তো কী দরকার ওই মেয়েকে বিয়ে করার? মেয়ের কী অভাব এদেশে?”
“দেশে মেয়ের অভাব না, দেশ ভর্তি মেয়ে আছে। কিন্তু সব মেয়েদের সাথে আপনার ছেলে ভালো থাকবে না। কারণ ওর ভালো থাকার মন্ত্র লুকিয়ে আছে শুধুমাত্র একজনের প্রতিই, সে মৃন্ময়ী, যাকে ও মন থেকে ভালোবেসেছে। আমরা বাঁচব আর কদিন? একটামাত্র সন্তান আমাদের, ওর একটা সুখী জীবন-ই তো আমাদের একমাত্র চাওয়া। যার সাথে ও ভালো থাকতে পারবে, আমাদের তো উচিত ওর জন্য তাকেই নিয়ে আসা। ওদের সুখী সংসার দেখে যেতে পারলে আমাদের জীবনে আর কোনো আফসোস থাকবে না। নিশ্চিন্তে বিদায় নিতে পারব।”
আহমদ তরফদারের রাগে একটুখানি ভাঙন ধরল। তবু তিনি রাগটা ধরে রাখার চেষ্টা করে বললেন,
“সবই তো মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই পণ্ডিত শেষমেশ কী বলে এল, শুনলে না? বরযাত্রী-ও সে ঠিকঠাক নিবে না। আত্মীয়-স্বজনের সামনে আমার মান-সম্মান মাটি করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“আচ্ছা, ও ভুল কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে? জানেন তো মেয়েটার পরিবারের কী অবস্থা। ওদের কথা ভেবেই প্রভাত বেশি লোকজন না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর আপনার আত্মীয়-স্বজন কি আপনি বৌ-ভাতে দাওয়াত করে খাওয়াতে পারবেন না? বরযাত্রী হিসেবেই নিতে হবে?”
“আমার বাড়ি আর ওই বাড়ি কি এক হলো?”
“না হয় নেই। সবকিছুতে যেচে অপমান বোধ করতে যাবেন না তো। প্রভাত যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। ও সবকিছু ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
“জানতাম তুমি এবারেও ওই ফাজিরটার হয়ে কথা বলবে। তোমাকে কোনো কথা বলা-ই বেকার। সরো তো, আজাইরা সময় নষ্ট। আমার ঘরে আমি ছাড়া সব পণ্ডিতের বাস। কোনো কিছুতেই আমাকে দরকার হয় না।”
আহমদ তরফদার একা-একা বকবক করতে-করতে ঘরে চলে গেলেন। রাহেলা বেগম গলা তুলে বললেন,
“সবসময় আত্মীয়-স্বজন, আত্মীয়-স্বজন করে গলা শুকিয়ে ফেলবেন না তো। তাদের জন্য আপনার-ই মন কাঁদে। আল্লাহ্ না করুন, আপনার দুটো পয়সা কমে গেলে দেখবেন তারা আপনার মুখ-ও দেখতে চাইবে না। ছেলে উচিত কথা বলেছে বলে গায়ে লাগে? ওসব মানুষদের এভাবেই বলা উচিত। সব স্বার্থপরের দল।”


বাবার সাথে ঝামেলা হলেই প্রভাতের মনটা সহজে ভালো হয় না। সবকিছু বিরক্ত লাগে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। মন ভালো করার জন্য সে বন্ধুদের ডেকে দীর্ঘ সময় আড্ডা দেয়, ঘুরাঘুরি করে। কিন্তু আজ তার সেই সময়টুকু-ও নেই। অফিসে কিছু কাজ বাকি পড়ে ছিল। সন্ধ্যাটা তার কাজ করেই কা’টাতে হলো। অফিস ছুটি হয় বিকালেই। প্রভাত এক অলস প্রাণী, যে কাজ জমিয়ে রেখে-রেখে মাঝেমধ্যে নাইট ডিউটি-ও করে। তাদের অফিসে নাইট ডিউটিতে খুব কম মানুষ-ই থাকে। প্রভাতের মন ভালো থাকলে সে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে পারে। নইলে সন্ধ্যাতেই বিদায় নেয়। আজ তার নাইট ডিউটিতে থাকার ইচ্ছা নেই। তাই বিকালেই বিদায় নিয়েছে। মৃন্ময়ীর স্কুলের বাইরে এসে কিছুক্ষণ হলো দাঁড়িয়েছে সে। আজ এটুকু সময়কেই খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। স্কুল ছুটি হতেই বাচ্চারা হুড়মুড়িয়ে গেট দিয়ে বেরোনো ধরল। প্রভাতের অপেক্ষমান চোখ জোড়া খুঁজে চলেছে মৃন্ময়ীর মুখ। মৃন্ময়ী বেরিয়ে এল দুজন শিক্ষকের সাথে কথা বলতে-বলতে। তার মুখে হাসি। হয়তো মন ভালো। প্রভাতকে দেখে মৃন্ময়ীর সাথের শিক্ষক দুজন চাপা স্বরে কী ঠাট্টা কর চলে গেল, প্রভাত শুনতে পেল না। মৃন্ময়ী এলোমেলো দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এল। প্রভাত জানতে চাইল,
“ম্যাডামের মন ভালো?”
মৃন্ময়ী পথ চলতে-চলতে বলল,
“ভালো।”
“ফুয়াদ স্যারের সাথে যেভাবে মিষ্টি হেসে কথা বলছিলে, দেখেই বুঝেছি মন ভালো।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আরেকজন স্যার-ও তো ছিল, চোখে পড়ল শুধু ফুয়াদ স্যার?”
“সে তো বিবাহিত, আরেকজনের হবু বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার চান্স নেই।”
“ফুয়াদ স্যারের-ও গার্লফ্রেন্ড আছে।”
“ওহ্! তাহলে ঠিক আছে।”

মৃন্ময়ী আরও একবার কপাল কুঁচকে তাকাল। বদলে প্রভাত তাকে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। সে হাসিতে মৃন্ময়ীর কী হলো কে জানে? হুট করেই তার বুকের ভেতর কম্পন ধরে গেল, মৃদুমন্দ বাতাসের মতো। শীতল বাতাস। ভেতরের শীতলতার ছোঁয়া যেন বাইরে এসে তার হাত-পা ঠাণ্ডা করে দিলো। লজ্জায় রাঙিয়ে দিলো সুন্দর মুখখানা। এ যেন এক নতুন অনুভূতি। মৃন্ময়ী সে অনুভূতি ধামাচাপা দিতেই প্রভাতের দিকে আর ফিরে না তাকানোর পরিকল্পনা করল। প্রভাত তাকে মৃদু স্বরে ডাকল,
“ম্যাডাম?”
মৃন্ময়ী চোখ না তুলেই সাড়া দিলো,
“হুঁ?”
“হাওয়াই মিঠাই খাবে?”
“উঁহু।”
“লজ্জা পেয়ো না, লজ্জা পেয়ো না। দুদিন বাদে তো এসবের জন্য সেই আমার কাছেই আবদার করবে।”
“আমি বাচ্চা না।”
“ভালোবাসার মানুষের কাছে থাকলে সবাই বাচ্চামি করে। যখন থেকে আমার কাছে থাকবে, তখন বুঝবে। একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।”
প্রভাত এক দৌড়ে গিয়ে চার প্যাকেট হাওয়াই মিঠাই কিনে আনল। এক প্যাকেটে ছোটো বল আকৃতির নয়টা হাওয়াই মিঠাই। মৃন্ময়ীর হাতে তিনটা প্যাকেট দিয়ে প্রভাত একটা প্যাকেট খুলল। মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“এতগুলো কেন?”
“বাড়ি গিয়ে আমার শ্যালিকাদের নিয়ে খাবে।”
প্রভাত প্যাকেট খুলে সেটাও মৃন্ময়ীর আরেক হাতে ধরিয়ে দিলো। মৃন্ময়ী প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে নিজের দুহাতের দিকে তাকাল। দুই হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিলে সে খাবে কোন হাত দিয়ে। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই প্রভাত খোলা প্যাকেট রেখে বাকি প্যাকেটগুলো নিজের হাতে ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“খাও।”
মৃন্ময়ী একটা হাওয়াই মিঠাই বের করে প্রভাতের দিকে বাড়িয়ে ধরল। প্রভাত হাসিমুখে সেটা হাতে নিয়েই মুখে পুড়ে দিলো। মৃন্ময়ী তাকে আরও একটা সাধল, সে আর নিল না। খেতে-খেতে মৃন্ময়ী অনেকবার প্রভাতকে বিয়ের প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতে চাইল। কিন্তু লজ্জায় প্রসঙ্গ তুলতেই পারল না। প্রভাত তার মনের কথা বুঝতে পারল কি না কে জানে? সে নিজেই বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরল। মৃন্ময়ীকে প্রশ্ন করল,
“বিয়েতে তোমার আলাদা কোনো ইচ্ছা আছে ম্যাডাম?”
প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“কিসের ইচ্ছা?”
“থাকে না অনেক মেয়েদের নিজের বিয়েতে এটা-সেটা করার কত ইচ্ছা? তোমার তেমন কোনো ইচ্ছা থাকলে আমাকে জানাও প্লিজ।”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“নেই।”
“সত্যি? লজ্জা পেয়ে আবার মিথ্যা বোলো না। আমি চাই না বিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে তোমার কোনো আফসোস থেকে যাক। তোমার যেকোনো ইচ্ছা আমি পূরণ করার চেষ্টা করব। বলো কী চাও।”
মৃন্ময়ী প্যাকেট থেকে আরেকটা হাওয়াই মিঠাই বের করতে-করতে বলল,
“একটা শান্তিপূর্ণ বিয়ে ছাড়া আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। বিয়ে নিয়ে সেভাবে কখনও ভাবিনি, তাই হয়তো আলাদা কোনো ইচ্ছা-ও জন্মায়নি।”
প্রভাত বলল,
“এখন থেকে ভাববে। বিয়ের আগে তোমার মনে যদি নতুন কোনো ইচ্ছা-ও জন্মায়, তুমি অবশ্যই আমাকে জানাবে। ঠিক আছে?”
মৃন্ময়ী কেবল মাথা দোলাল, সে জানাবে। যদিও তার মনে হয় না তার আলাদা কোনো ইচ্ছা জাগবে। আয়োজন করে যে তার বিয়ে হবে, এটাই তো অনেক। এর বেশি আর কী চাইবে সে? প্রভাত আবার প্রশ্ন করল,
“তুমি কি পার্লারে সাজতে চাও, না বাড়িতে?”
মৃন্ময়ী উত্তর দিলো,
“বাড়িতে।”
“বাড়িতে কেউ সাজিয়ে দিবে, না পার্লারের লোক আনতে হবে?”
“মৃত্তিকা সাজাবে বলেছে।”
“তাহলে ঠিক আছে। পার্লারের মেয়েগুলো কী ভূত সাজিয়ে দেয়, ওসবের দরকার নেই। সাধারণ সাজেই তোমায় সুন্দর মানায়। মৃত্তিকাকে বলে দিয়ো বিয়ের দিন যদি আমার বউকে সুন্দর করে সাজাতে পারে, তাহলে তার জন্য বিশেষ পুরষ্কার আছে। যদিও আমার বউ এমনিতেই সুন্দর।”

কিছুক্ষণ কাচুমাচু করার পর মৃন্ময়ী মৃদু স্বরে বলল,
“আজ তুমি সবার সামনে যা সিদ্ধান্ত জানালে, তা কি তোমার একার সিদ্ধান্ত ছিল?”
প্রভাত হেসে বলল,
“বিয়ে করব আমি, সিদ্ধান্ত আর কার থাকবে?”
“তোমার বাবা-মায়ের সাথে আগে আলোচনা করনি?”
“উঁহু।”
“কেন?”
“তোমার কী মনে হয়? আগে থেকে জানালে এত সহজে আমার সঙ্গে গিয়ে বিয়ের পাকা কথা বলে আসত? হাজারটা আপত্তি জানিয়ে আমার মাথা খারাপ করে ছাড়ত।”
“তবু তারা তোমার অভিভাবক। বিয়ের মতো বড়ো ব্যাপারে অভিভাবকের সাথে আলোচনা সবার আগে জরুরী।”
“জরুরী, তা আমিও জানি। কিন্তু আমার অভিভাবকের সাথে বোঝাপড়া করা তোমার ভাবনার মতো এত সহজ নয়। আমি যা করেছি, ভেবেচিন্তেই করেছি। ওসব তুমি এখন বুঝবে না। যখন আমার সঙ্গে জীবনযাপন শুরু করবে, তখন বুঝতে পারবে।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“এখন কি তারা তোমার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়নি?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“তারা আজীবনই আমার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট-ই হয়। ওসব আমার কাছে কোনো ব্যাপার না। তারা সন্তুষ্ট হলেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না, অসন্তুষ্ট হলেও না। তাছাড়া আমি কারোর প্রতি নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিইনি। আমার নিজের যতটুকু সামর্থ আছে, তার জোরেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই কারোর আপত্তিতে আমার কিছু যায় আসে না।”
মৃন্ময়ী বলল,
“সবকিছুতেই বেপরোয়া তুমি।”
প্রভাত নিচু স্বরে বলল,
“বেপরোয়া ছেলেটাকেই শেষমেশ বিয়ে করতে চলেছেন ম্যাডাম?”
“তোমরা জোট বেঁধে আমাকে ফাঁসিয়েছ, নয়তো কে তোমায় বিয়ে করত?”
প্রভাত কপাল কুঁচকে বলল,
“এখনও গা বাঁচিয়ে কথা বলছেন ম্যাডাম? খুব বুদ্ধিমতী আপনি।”
মৃন্ময়ী প্রত্যুত্তর করল না। প্রভাত পুনরায় বলল,
“ঠিক আছে, এখন মনের কথা লুকানোর চেষ্টা করছেন করুন। বিয়ের পর যখন আপনার মন সম্পূর্ণ দখলে নিয়ে নেব, তখন দেখব আর কত লুকিয়ে রাখতে পারেন।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১৪+১৫

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৪.
বাড়ি যাওয়ার পথে মৃন্ময়ীকে মিষ্টির দোকানের দিকে হাঁটতে দেখে প্রভাত জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“দোকানে।”
প্রভাত হেসে বলল,
“বিয়ে ভাঙার খুশিতে মিষ্টিমুখ করবে না কি?”
“জি না। আমার বাড়ির ছোটো সদস্য রাগ করেছে। মিষ্টি না খাওয়ালে তার রাগ ভাঙবে না।”
“মৃদুলার কথা বলছো? রাগ করেছে কার সাথে?”
“আমার আর মৃত্তিকার সাথে।”
“তোমরা বড়ো দুবোন মিলে আমার ছোটো শ্যালিকাকে এভাবে রাগাও তাহলে? কী ভদ্র আর মিষ্টি মেয়েটা!”
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল,
“একটা সত্যি কথা বলো তো। তোমার সাথে মৃদুলার এত ভালো সম্পর্ক হলো কবে থেকে?”
প্রভাত দাঁতে জিব কে’টে বলল,
“ছিঃ! কী যে বলো তুমি! তুমি ছাড়া আর কারো সাথে আমার সম্পর্ক থাকার কথাই না।”
“কথা ঘুরাবে না। আগেও অনেকবার মৃদুলার মুখে আমি তোমার কথা শুনেছি। ও তোমাকে ভালো চোখে দেখে। কিন্তু আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে সবসময় এড়িয়ে যায়। এখন আবার আমার বিয়ে আটকানোর জন্য ও নিজে থেকে তোমাকে সাহায্য করেছে। তুমিও ওকে এত ভালো মেয়ে ভাবো। এসব মোটেও একদিনের ব্যাপার নয়। মৃদুলা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। হুট করে ও যার-তার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে না।”
প্রভাত বলল,
“তোমার কী ধারণা? মৃদুলাকে আমি মিষ্টি খাইয়ে পটিয়ে আমার দলে নিয়ে নিয়েছি?”
মৃন্ময়ী মৃদু হেসে বলল,
“মৃদুলা বাচ্চা মেয়ে না যে তুমি ওকে কিছু খাইয়ে পটাবে। আমি নিশ্চিত তুমি ওকে তোমার কথায় ভুলিয়েছ। ওকে এমনকিছু বুঝিয়েছ যা শুনে ও তোমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে।”
“তোমার বোনটা তোমাকে খুবই ভালোবাসে।”
“হুম, ওর এই দুর্বলতাকেই তো তুমি কাজে লাগালে। এসব কবে থেকে চলছে বলো তো? এর আগে আর কী-কী খবর পাচার করেছে ও?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“আনফরচুনেটলি তোমার লক্ষ্মী বোনটার সাথে আমার কখনও ভালোভাবে কথাই হয়ে ওঠেনি।”
মৃন্ময়ী বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি মিথ্যা বলা বন্ধ করবে? দেখছ আমি বুঝে গেছি তোমাদের কাহিনি, তবু মিথ্যা বলেই চলেছ।”
“মিথ্যা কেন বলব? সত্যি কথাই বললাম। মৃদুলার সাথে আমার পরিচয় আছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত ও আমার সাথে দাঁড়িয়ে দুমিনিট কথা বলেনি। সামনে পড়লে কেমন আছি জিজ্ঞেস করেই চলে যায়। কতবার কিছু খাওয়াতে চেয়েছি, তা-ও দাঁড়ায়নি।”
মৃন্ময়ীর কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। বলল,
“বিশ্বাসযোগ্য কথা বলো প্রভাত। কথাবার্তা ছাড়াই একজন তোমাকে সাহায্য করতে যাবে? তা-ও আবার সেই একজনটা মৃদুলা।”
“আমি কি একবারও বলেছি মৃদুলা আমাকে সাহায্য করেছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“তুমি এখনও অস্বীকার করছো?”
“আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোমার বোনকেই জিজ্ঞেস কোরো আমার সাথে ও কখনও ভালোভাবে কথা বলেছে কি না।”
“তুমি সত্যি কথা বলছো না, আমার বোন বলবে? ও তো কথা পেটে চেপে রাখার বেলায় তোমার চেয়েও একধাপ এগিয়ে।”
“তা-ও তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো আমার কথা মিলে কি না।”
“হয়েছে, তোমাদের কথা মিলিয়ে মাথা খারাপ করার শখ নেই আমার। যার যা ইচ্ছা করো, আমার কী?”
“তুমি নিজেই তো যেচে মাথা খারাপ করার পাঁয়তারা করছো। যাইহোক, বাদ দাও। অনামিকার বিয়েতে দাওয়াত পেয়েছ?”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“হুম, গতরাতে ম্যাসেজ করেছিল।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? বিয়ের কথা বলল, দাওয়াত করল।”
“যাবে তো?”
“জানি না। সময় হবে না হয়তো।”
“সময় হবে না কেন? শুক্রবার বিয়ে। শুক্রবার তো আর তোমার ক্লাস করানোর প্যারা নেই।”
“ক্লাস করানো ছাড়া কি আমার আর কোনো কাজ থাকতে পারে না?”
“সে যে কাজই থাকুক। তুমি অজুহাত দেখিয়ে বাড়িতে বসে থাকবে না। বিয়েতে অবশ্যই যাবে। গেলে অনেকের সাথে দেখা-ও হবে।”
“দেখি, গেলে তো দেখবেই।”
“দেখি না, অবশ্যই যাবে।”
“এমনভাবে জোর দিয়ে বলছো যেন তোমার বোনের বিয়ে।”
“নিজের বোন না হোক, প্রতিবেশী বোন তো। তার ওপর বান্ধবী। দেখো, তুমি তোমার বান্ধবীর বিয়েতে না গেলে কিন্তু ও-ও তোমার বিয়েতে আসবে না। আর তোমার বিয়েতে আসবে না মানে আমাদের বিয়েতে আসবে না। এটা আমি মোটেও হতে দিবো না। আমি চাই ভবিষ্যতে আমাদের বিয়েতে সবাই উপস্থিত থাকুক। সবাই দেখুক পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি আমার বউ হতে চলেছে।”
“বিয়ের জন্য দেখছি তোমার পেটের ভাত হজম হয় না। এক কাজ কোরো। অনামিকার বিয়ের আসরেই বিয়ে সেরে ফেলে পেটের ভাত হজম করে নিয়ো।”
প্রভাত হেসে বলল,
“অনামিকার সাথে তুমিও বউ সাজলে বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি রাজি থাকলে এক কাজিতেই দুটো বিয়ে হয়ে যেতে পারে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“বিয়ে বাড়ির আনাচে-কানাচে সুন্দরী মেয়েদের অভাব থাকে না।”
“ভুলভাল মানুষকে বিয়ে করে পরে পেটের ভাত হজম হওয়ার বদলে বদহজম হয়ে যাবে। যেচে বদহজম করার ইচ্ছা আমার নেই। আমার একজনকেই লাগবে, সে মৃন্ময়ী ম্যাডাম।”

অনামিকা মৃন্ময়ীর স্কুল জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। এখনও তাদের মাঝে সম্পর্ক ভালো। প্রভাতের প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে অনামিকার সাথে তার-ও ভালো বন্ধুত্ব। অনামিকার বিয়ে ঠিক হওয়ার পরপরই সে মৃন্ময়ীকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল। বারবার করে বলে দিয়েছিল মৃন্ময়ী যেন কোনোভাবেই তার বিয়েতে অনুপস্থিত না থাকে। এদিকে মৃন্ময়ী পড়ে গেছে চিন্তায়। বিয়েতে গেলে বান্ধবী হিসেবে কিছু একটা উপহার তো দিতে হবে। মাসের মাঝামাঝি এসে সে কী করে অত টাকা খরচ করে ভালো উপহার কিনবে? টাকার চিন্তায় বিয়েতে যাওয়ার ইচ্ছা-ই মাটি হয়ে যাচ্ছে মৃন্ময়ীর। না গেলেও অনামিকা রাগ করবে। এখন যাবে কি যাবে না, সিদ্ধান্ত নিতেই সে দ্বিধায় ভুগছে। অনামিকার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়া তার জন্য সম্ভব হয়নি। অনামিকা অনেকবার বলেছিল, কিন্তু কোচিংয়ের কারণে সে যেতে পারেনি। তাছাড়া বিয়ের আগেরদিন এসেও যাওয়া নিয়ে সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। এখনও কোনো উপহার-ও কেনা হয়নি। মৃত্তিকা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল এক হাজার টাকা দিয়ে দেওয়ার জন্য। সে-ও শেষমেশ মনে-মনে এটাই ঠিক করেছিল। যাওয়া হলে টাকা-ই দিয়ে দিবে। এই মুহূর্তে অনুষ্ঠানে গিয়ে এক হাজার টাকা খরচ করাই তার জন্য অনেককিছু। এর বেশি খরচ করে উপহার কেনা তো অসম্ভব ব্যাপার। এরমধ্যে প্রভাত আবারও তাকে প্রশ্ন করে বসল অনামিকার বিয়েতে যাবে কি না। বিয়ের কথা শুনে হতেই সে মৃন্ময়ীকে এ প্রশ্ন করেই চলেছে। এতদিন মৃন্ময়ী নিজে দ্বিধায় ছিল বলে ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেনি। আজ বলল,
“গেলে তো কাল দেখতে পাবেই।”
প্রভাত বলল,
“অনামিকা এত করে বলল, এখনও তুমি এ কথা বলছো?”
“তুমি কি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওনি?”
“ওখান থেকেই এলাম।”
“অনুষ্ঠান শেষ?”
“শুরু হলে তো শেষ হবে। মেয়েদের সাজতে এত সময় লাগে? বাপরে! রাত নয়টা বেজে গেছে, তা-ও শুনি সাজ আরেকটু বাকি আছে। সাজ শেষ হবে, তারপর ফটোশুট হবে, তারপর হবে গায়ে হলুদ। বসে-বসে অত কাহিনি দেখার ধৈর্য আমার নেই। তাই চলে এসেছি। এরচেয়ে ভালো তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে যাব। গিয়ে এক প্লেট বিরিয়ানি খেয়ে ঘুমিয়ে যাব।”
“অনুষ্ঠানে থাকার চেয়ে বিরিয়ানি খাওয়া তোমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?”
“খাওয়ার জন্যই তো দাওয়াত দিয়েছে। খাওয়া ছাড়া আমার আর কাজ কী? আমি তো আর বান্ধবী না যে বসে-বসে ওকে সাজিয়ে দিবো। ভালো কথা, শোনো, আমাদের বিয়ের সময় কিন্তু তুমি সাজগোজের পেছনে এত সময় লাগাবে না। হালকা সাজেই তোমাকে দারুণ লাগে। আমার বউ আমার কাছে ভালো লাগলেই হয়, আর কারোর ভালো লাগার দরকার নেই। মনে থাকবে? অনামিকার মতো এমন কাজ মোটেও করবে না। আমি এত অপেক্ষা করতে পারব না।”
মৃন্ময়ী এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে বলল,
“অযথা বকবক না করে চুপ থাকো।”
“এসব মোটেও অযথা বকবক না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। বিয়ে তো একদিন করব-ই। এসব কথা আগে থেকে বলে রাখাই ভালো। মনে রেখো কিন্তু। যাইহোক, এখন বলো কাল শিওর যাচ্ছ তো?”
“তুমি আমার যাওয়া নিয়ে উঠেপড়ে লাগলে কেন? বলছি তো গেলেই জানতে পারবে।”
“এটা বললে কীভাবে হবে? আমাদের গিফট কিনতে হবে না? তুমি কি গিফটের কথা কিছু ভেবেছ?”
“না।”
“তাহলে? কাল যাওয়ার আগে তো গিফট কিনতে হবে। আমরা ছয়জন আছি। পাঁচজনের টাকা অলরেডি তুলে ফেলেছি। বাকি আছো শুধু তুমি।”
মৃন্ময়ী আবারও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। ছয়জন মিলে উপহার কেনার জন্য কত টাকা করে তুলেছে কে জানে? যদি এক হাজার টাকার বেশি হয়, তাহলে সে কী বলবে? প্রভাত এভাবে বললে তার কাছে টাকা দিবে না বলবেই বা কীভাবে? তবু সে জানতে চাইল,
“কী উপহার কিনবে?”
“ওরা কী কিনবে বলল, মনে নেই আমার। তুমি কি আমাদের সাথে দিবে? তাহলে পাঁচশো টাকা দিয়ে দিতে পারো আমার কাছে।”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“পাঁচশো টাকা! তোমরা পাঁচশো টাকা করে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“পাঁচশো টাকা করে তুলে কী কিনবে?”
“সে যা কিনে কিনুক ওরা। ছয়জন মিলে দিলে এর বেশি লাগবে না। তুমি কি এরচেয়ে বেশি দিতে চাও?”
“আমি বেশি দিতে যাব কেন?”
“তাহলে এত প্রশ্ন কোরো না। টাকা দিলে দিয়ে দাও। কাল সময়মতো চলে যাবে।”
এত অল্প টাকার কথা শুনে মৃন্ময়ী অবাক হলেও না করল না।‌ ব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকা বের করে প্রভাতের হাতে দিয়ে দিলো। টাকা নিয়ে প্রভাত বলল,
“ওদের বিয়েতে আমরা দুজন একসঙ্গে উপহার দিচ্ছি ঠিকই, ওদের সবাইকে বলে দিবো আমাদের বিয়েতে আলাদা উপহার দেওয়া বাধ্যতামূলক। নয়তো কাউকে দাওয়াত দেওয়া হবে না। নইলে আবার সবকটা আমাদের দুজনকে একসঙ্গে উপহার দিয়ে পার পেয়ে যেতে চাইবে। তা চলবে না।”


আজও জাহিদ দেরী করেছে। নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট পর উপস্থিত হয়েছে সে। মৃদুলা-ও গুণে-গুণে দশ মিনিট গাল ফুলিয়ে থেকে তবেই তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। অবশ্য দেরী হতে পারে বুঝে আগেভাগেই জাহিদ আসার আগে ফুল কিনে নিয়েছিল। নয়তো আজ তাকে দশ মিনিটের বদলে বিশ মিনিট শাস্তি মাথা পেতে নিতে হত। আজ তাদের ছুটির দিন। দুজন মিলে রিকশায় চড়ে যেদিকে খুশি ছুটে চলার দিন। বাকি দিনগুলো ব্যস্ততার মাঝে তাদের ঘোরাঘুরি হয় না। দেখা হয়, একটু পথ একসঙ্গে হাঁটা হয়, একটু কথাবার্তা, খাওয়া-দাওয়া করেই বাসায় ছুটতে হয়। এ কারণে শুক্রবারটা তাদের জন্য বিশেষ। এদিন কারোর কোনো ব্যস্ততা থাকে না, বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে না। সপ্তাহে শুক্রবার-ই মৃদুলা একটু সাজগোজ করে বেরোনোর চেষ্টা করে। সারা বিকাল তারা রিকশায় ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে-ঘুরতে নিজেদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত নিয়ে হাজারো গল্পের পসরা সাজায়। শান্তিতে খাওয়া-দাওয়া করে, ছবি তোলে। বাড়িতে জানে শুক্রবারে-ও মৃদুলার টিউশন থাকে। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়, আবার পুরোপুরি মিথ্যা-ও নয়। শুক্রবার তার টিউশন থাকে, তবে শুধু সন্ধ্যার পর একটি টিউশন। বিকালে তার একদম অবসর। ওই সময়টা জাহিদকে দেওয়ার জন্যই সে বাড়িতে মিথ্যা বলেছে। জাহিদ-ও তাই প্রত্যেক শুক্রবারে খুব করে চেষ্টা করে মৃদুলাকে খুশি রাখতে। মৃদুলার মন খারাপ হবে বা সে রেগে যাবে, এমন কথা বা কাজ সে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আজ তাদের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রভাত-মৃন্ময়ীর বিয়ে। কদিন ধরেই এই বিষয়টি নিয়ে তাদের কথা হচ্ছিল। আজ তাদের আলোচনা খুবই সিরিয়াস। প্রভাত জাহিদকে বলেছে যেভাবেই হোক মৃদুলা যেন তার মাকে বুঝানোর দায়িত্বটা নেয়। এই দায়িত্বটা তাকেই নিতে হবে। প্রভাত বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর যদি মৃন্ময়ীর মা তাকে দেখে ‘না’ করে দেয়, তাহলে ঝামেলা বাড়বে। মৃন্ময়ীকে তো সে নিজেই সামলে নিবে। কিন্তু তার মাকে তো সামলাতে পারবে না। জাহিদ বারবার করে মৃদুলাকে এ কথা বলায় মৃদুলা বলল,
“আমি পারব বলেছি তো। মা একটু ত্যাড়া মানুষ, তবে অবুঝ নয়। আপার বিয়ে-ই এখন তার সবচেয়ে বড়ো মাথাব্যথা। সে যখন বুঝতে পারবে প্রভাত ভাই আপাকে ভালো রাখার মতোই ছেলে, তখন আপার আগে সে-ই রাজি হয়ে যাবে।”
“তুমি আজ-ই বলে দেখো আন্টিকে।”
“বলব, বলব। আমি বলেছি যখন, তখন মাকে রাজি না করিয়ে আমি হাল ছাড়ছি না। আপনি আমাকে এত তাড়া দিয়েন না তো। বড়ো ভাইয়ের বিয়ের জন্য এত তাড়া দেখাচ্ছেন, নিজের বেলায় কতটুকু তাড়া থাকে দেখব।”
জাহিদ হেসে বলল,
“সময় আসুক, দেখবে। নিজের বেলায় আমি প্রভাত ভাইয়ের মতো এত অপেক্ষা করব না কি? গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেই একটা জব জয়েন করব। তারপর কোনোদিক না তাকিয়ে আগে তোমাকে বিয়ে করে নেব।”
“আচ্ছা, তারপর?”
“তারপর আবার কী? তারপর আমাদের সংসার হবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে।”
“গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার পরপরই আপনাকে বিয়ে করাতে চাইবে আপনার পরিবার?”
“চাইবে না মানে কী? বিয়ে আমার, বউ আমার, সংসার আমার, অন্য কেউ আপত্তি করবে কেন? আগে বিয়ে করব, তারপর যা হওয়ার হবে।”
“হুম, দেখব তখন এতো বড়ো-বড়ো কথা কতটুকু সত্যি হয়।”
“অবশ্যই দেখবে। দেখবে কী? সাক্ষী হবে। এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দাও।”
মৃদুলা মৃদু হেসে বলল,
“এখনই এত বেশি এক্সাইটেড হওয়ার দরকার নেই। সময়ের কথা কেউ বলতে পারে না। সময় কখন কোন পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়, তা হয়তো আমরা এখন কল্পনা-ও করতে পারছি না।”
জাহিদ অসন্তুষ্ট মুখে বলল,
“এভাবে বলছো কেন মৃদুলা? পরিস্থিতি যা-ই হোক, বিয়ে তো আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে করব না। তুমি কি এখনও আমাকে বিশ্বাস করতে পারোনি?”
“বিশ্বাস করব না কেন? আপনি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। অবশ্যই আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। কিন্তু বাস্তবতা বলেও তো একটা কথা আছে। আপনি যতই বলুন আমি-ই আপনার বউ হব। সময় আপনাকে দেখাবে বাস্তবতা মুখের কথার মতো এত সহজ নয়। ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্কে হাজারটা বাঁধা স্পষ্ট, তা আপনি চোখ খুললেই দেখতে পাবেন।”
“আমি জানি তুমি কী ভাবছো। ওসব নিয়ে ভেবো না মৃদুলা। আমার ওপর যখন বিশ্বাস আছে, তখন এটুকু বিষয়ে নিশ্চিত থাকো যে ভবিষ্যতে যে বাঁধা-ই আসুক, আমি তোমাকে ছাড়ব না। তোমার জন্য আমি পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে যেতে-ও প্রস্তুত।”
মৃদুলা একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে নিয়ে বলল,
“জীবনে অতটা খারাপ সময়-ও আমাদের না আসুক।”
জাহিদ তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“আসবে না। ভরসা রাখো।”

ওদিকে অনামিকার বিয়েতে গিয়ে প্রভাত মৃন্ময়ীর পিছু-ই ছাড়ছে না। মৃন্ময়ী এসে হতে সে তার পেছনেই পড়ে আছে। এই নিয়ে তার বন্ধুরা-ও খুব হাসাহাসি করেছে। তাতে তার কিছুই যায়-আসে না। মৃন্ময়ী রাগ করেও তাকে দূরে সরাতে পারেনি। অনামিকাকে বউ সাজে দেখার পর বন্ধুদের সাথে মৃন্ময়ী খুব প্রশংসা করছিল যে তাকে বউয়ের সাজে খুব সুন্দর লাগছে। তখন সুযোগ বুঝে প্রভাত বুদ্ধি খাটিয়ে চাপা স্বরে তাকে বলল,
“লাল রংটা ছাড়া কি অন্য কোনো রংয়ের শাড়ি পেল না ওরা?”
এ কথা শুনে মৃন্ময়ী তাকে পালটা প্রশ্ন করল,
“কেন, লাল রংয়ে কী সমস্যা?”
“কেমন টকটকে রং, চোখে লাগে।”
“কে বলল? নতুন বউদের লাল রংয়েই সবচেয়ে বেশি মানায়। টুকটুকে লাল রংয়ের শাড়ি পরলেই মনে হয় রাঙা বউ। কেমন একটা বিয়ে-বিয়ে ভাব আসে।”
“এত সাজার-ই বা কী দরকার? বিরক্ত লাগে না?”
“মেয়েরা বিয়েতে তাদের মনমতো সাজতে চায়। বিয়ে তো একদিনই হয়। এই একদিন নিয়ে অনেকেরই অনেক রকম ইচ্ছা থাকে, স্বপ্ন থাকে। তাদের জীবনের বিশেষ দিনে নিজেদের মনমতো সাজতে দেওয়া উচিত। তুমি ওসব বুঝবে না।”
“এখন বুঝে নিয়েছি। তা ম্যাডামের-ও কি তবে নিজের বিয়ের জন্য লাল শাড়ি পছন্দ?”
মৃন্ময়ী ইতস্তত করে বলল,
“তা কখন বললাম?”
“আর বলতে হবে না, বুঝে নিয়েছি।”
“তোমার স্বভাব-ই সবসময় বেশি-বেশি বোঝা।”
“অনামিকাকে আসলে লাল শাড়িতে সুন্দর-ই লাগছে। আমি তো কথাটা বললাম তোমার মনের কথা জানার জন্য।”
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই প্রভাত প্রশস্ত হেসে বলল,
“তুমি তো মুখ ফুটে বলবে না। আমাকে তো জানতে হবে বিয়েতে তুমি কোন রংয়ের শাড়ি পরতে চাও, কীভাবে সাজতে চাও।”
মৃন্ময়ী চাপা স্বরে বলল,
“চুপ থাকো। সবসময় মুখে এক কথা।”
প্রভাত বলল,
“এখন আর চুপ থাকার সময় নেই। তোমার বউ সাজার সময় ঘনিয়ে এল বলে ম্যাডাম।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৫.
সাজেদা বেগম রান্নার জন্য তরকারি কাটছেন। এক বালতি কাপড় একসঙ্গে ধুতে গিয়ে তার রান্নায় অনেক দেরী হয়ে গেছে। রান্নায় বেশি দেরী হলে তাড়াহুড়া লেগে যায়। তাড়াহুড়া করে কাজ করলেই সাজেদা বেগমের মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। মৃদুলা কলেজ থেকে ফিরে বুঝে উঠতে পারেনি মায়ের মেজাজ বিগড়ে আছে।‌ সে রান্নাঘরে এসেই মাকে জিজ্ঞেস করল,
“মা, কী করো?”
সাজেদা বেগম চড়া গলায় উত্তর দিলেন,
“নাচি, তুই দেখছিস না?”
মায়ের ত্যাড়া উত্তরেই মৃদুলা বাসার পরিবেশের অবস্থা বুঝে ফেলল। ধীর পায়ে চুলার কাছে গিয়ে সে নরম গলায় বলল,
“রান্নায় দেরী হয়ে গেছে দেখছি। কিছু করা লাগবে? কী করব বলো।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“ডাল চুলায় বসিয়ে আর উঠে দেখতেও পারিনি, তরকারি কাটতে বসেছি। দেখ কী অবস্থা।”
সঙ্গে-সঙ্গে মৃদুলা ডাল রান্নার কাজে হাত লাগাল। ডাল নাড়তে-নাড়তে সে মায়ের মেজাজ হালকা করার চেষ্টা করল। ভাব জমানোর জন্য বলল,
“মা, আমি ডালে হলুদ দিলেই রং কেমন গাঢ় হয়ে যায়। তোমার মতো ঠিকঠাক হয়-ই না।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“ডালকে তরকারি ভেবে চামচ ভর্তি হলুদ দিলে তো রং গাঢ় হবেই। তরকারির মতো ডালে অত বেশি হলুদ লাগে না। সামান্য পরিমাণে দিবি।”
“আচ্ছা।”
“টমেটো দে। ওই বাটির মধ্যে কেটে রেখেছি, দেখ।”
“আপু না তোমাকে বলেছিল ওর টমেটো টক খেতে ইচ্ছা করে?”
“খাওয়াব নে। কালোজিরা শেষ হয়ে গেছে অনেকদিন আগে।”
“আচ্ছা, আমি এনে দিবো নে।”

টুকটাক কথাবার্তার পর একসময় সাজেদা বেগম নিজেই বলে উঠলেন,
“ওই ব্যাপারটার কোনো খবর নিয়েছিলি?”
“কোন ব্যাপার?”
“ওই যে মৃন্ময়ী কাউকে পছন্দ করে কি না।”
এতক্ষণ ধরে মৃদুলা এই প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা-ই করছিল। মা নিজেই সুযোগ করে দেওয়ায় তার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। দ্রুত উত্তর দিলো,
“শুধু কি খবর নিয়েছি? ভূপৃষ্ঠ থেকে একদম তাজা খবর সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছি। বলেছিলাম না এ ব্যাপারে আমাকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারো?”
সাজেদা বেগম হাতের কাজ বন্ধ করে উৎসুক হয়ে উঠলেন। জানতে চাইলেন,
“কী খবর পেলি?”
“খবর একদম একশোতে একশো সত্য। আমি তোমাকে বলব। কিন্তু শর্ত হচ্ছে তুমি রেগে যেতে পারবে না। ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনতে হবে।”
“আচ্ছা শুনছি। তুই তাড়াতাড়ি বল তো।”
মৃদুলা দু’পা এগিয়ে গলার স্বর একটু নিচু করে বলল,
“তোমার কি ওই ছেলেটার কথা মনে আছে, আপা যার কথা বলেছিল?”
“কোন ছেলে?”
“আপার পেছন-পেছন যে ঘুরঘুর করত।”
“ও, হ্যাঁ। মৃন্ময়ীকে সবসময় বিরক্ত করত, ওই ছেলেটা?”
“হ্যাঁ, ওই ছেলেটাই। কিন্তু তোমার কথায় একটু ভুল আছে মা। ওই ছেলেটা আপাকে বিরক্ত করত না। পছন্দ করত, তাই পেছনে ঘুরত।”
“ওই একই তো।”
“উঁহু, এক না। পছন্দ করা এক ব্যাপার, আর বিরক্ত করা আরেক ব্যাপার।”
“তুই পাকামি করতে এসেছিস? মৃন্ময়ী নিজেই তো বলেছিল ছেলেটা ওকে বিরক্ত করে।”
“বলেছিল, কারণ আপা তখন ছেলেটাকে দেখলেই বিরক্ত হত। এই ব্যাপারটা একটু বুঝতে হবে তোমাকে। ছেলেটা কিন্তু আপার ক্লাসমেট ছিল। তখন সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আপা যখনই জানতে পেরেছিল ছেলেটা তাকে পছন্দ করে, তখন থেকেই সে ছেলেটার প্রতি বিরক্ত ছিল। এমনটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ আপা চাইত-ই না কেউ তাকে পছন্দ করুক, তাকে বিয়ে করতে চাক। ওই ছেলেটা আপাকে বিয়ে করতে চাইত বলেই আপা তার ওপর এত বিরক্ত ছিল। সে তো বিয়ে না করার পণ করে বসে আছে। কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইলে তার ছায়া তো তার বিরক্ত লাগবেই। তুমি তো জানোই তোমার মেয়ে কেমন।”
সাজেদা বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“হতে পারে। কিন্তু তুই এখনকার কথা রেখে আগের কথা ঘাঁটছিস কেন?”
“কারণ আছে বলেই ঘাঁটছি। বিরাট কারণ আছে।”
“তো বলছিস না কেন?”
“বলছি, বলছি। ধৈর্য ধরো। আমি যে কথাগুলো বলছি, তা কিন্তু অপ্রয়োজনীয় না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মন দিয়ে শোনো। তো আপা তখন যা-ই বলত, আমরা তার কথাই বিশ্বাস করে নিতাম। তাই না? কেন বিশ্বাস করতাম? কারণ আমরা তো ভেতরের খবর জানতাম না।”
“তাহলে তুই এখন জানলি কীভাবে?”
“তখন তো আপার মুখের কথা-ই সত্য ভেবে নিতাম। এখন খোঁজ নিয়েছি বলেই সত্যিটা জানতে পেরেছি। এখন আমার আফসোস হচ্ছে যে কেন তখন আমি খোঁজ নিলাম না, আর তোমাকে সত্যি কথা জানালাম না। তখন জানালে তুমি একজন বিশ্বাসযোগ্য মেয়ে জামাই পেতে পারতে।”
সাজেদা বেগমের কৌতুহল যেন বেড়েই চলেছে। তিনি আবারও প্রশ্ন করলেন,
“ছেলেটা কি আবারও ওর পেছনে ঘুরছে?”
“আবারও কী বলছো? ছেলেটা তো আজ পর্যন্ত আপার পিছু-ই ছাড়েনি।”
একথা শুনে সাজেদা বেগমের চোখ দুটো গোলাকার হয়ে গেল। চরম বিস্ময় নিয়ে তিনি বললেন,
“ছেলেটা এখনও মৃন্ময়ীর পেছন-পেছন ঘোরে?”
“হ্যাঁ, সেই থেকে এখন পর্যন্ত ছেলেটা আপার পিছু ছাড়েনি, শুধুমাত্র আপাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য। কোনো ছেলে যে আপার মতো ত্যাড়া মেয়ের জন্য এত ধৈর্য ধরে রাখতে পারে, তা আমার কল্পনাতে-ও ছিল না।”
“বলিস কী! মৃন্ময়ী তা-ও রাজি হলো না?”
“তোমার ঘাড়ত্যাড়া মেয়েকে আজ পর্যন্ত বিয়েতে রাজি করাতে পেরেছ? ওই ভাইয়াটা-ও পারেনি। তার জায়গায় আমি হলে কবে পিছু ছেড়ে দিতাম। সে এত ধৈর্য কোথায় পেয়েছে আল্লাহ্ জানে।”
সাজেদা বেগম জানতে চাইলেন,
“ছেলেটা কে রে? চিনিস তুই?”
“শুধু চিনি না, ছেলের সম্পর্কে সব খোঁজ নিয়েই এসেছি আমি। ছেলে খুবই ভালো।”
“কী কাজ করে?”
“কম্পিউটার অপারেটর। ইনকাম ভালো। পরিবার-ও ভালো। তোমার মেয়ে যদি একবার বিয়েতে রাজি হয়ে যেত, সুখ সুনিশ্চিত ছিল। আহারে! ভাইয়াটা আপাকে এত ভালোবাসে! অন্য কোনো মেয়ে হলে কবেই বিয়ে করে নিত। তোমার মেয়ে আসলেই একটা হৃদয়হীন।”
“এত ভালো ছেলে হলে এতদিন ধরে ওর পেছনে পড়ে আছে কেন? ভালো কোনো মেয়ে দেখে বিয়ে করতে পারল না?”
“ভালোবাসা মা, ভালোবাসা। ছেলেটা আপাকে সত্যি-সত্যি অনেক ভালোবাসে। নয়তো এ যুগে কে কার জন্য এত অপেক্ষা করে থাকে? এমন ছেলে সচরাচর তোমার চোখে পড়ে?”
সাজেদা বেগমকে খানিক চিন্তিত দেখাল। তিনি বললেন,
“মৃন্ময়ী তো সবসময় ছেলেটার বদনাম-ই করত। আমি তো জানতাম ছেলেটা খুব খারাপ। তো ও কি কিছু না জেনেই এত মিথ্যা কথা বলেছিল?”
“আহা মা! তোমার মেয়ে আবার কোন ছেলের প্রশংসা করে? বিয়ের ভয়ে তো বদনাম করবেই। তুমি তার কথা আর বিশ্বাস কোরো না তো। আর তোমার কি মনে হয় আমি মিথ্যা কথা বলছি? একদম হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি খবর জোগাড় করে এনেছি। বিশ্বাস না হলে তুমি নিজেও খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। আপার বন্ধু-বান্ধব সবাই এ বিষয়ে জানে। শুধু আমরা ঘরের মানুষ-ই জানতাম না।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“ছেলেটার কোনো ছবি দেখাতে পারবি?”
“পারব। দাঁড়াও, আমি ফোন নিয়ে আসছি।”

মৃদুলা এক দৌড়ে গিয়ে ফোন নিয়ে এল। তারপর প্রভাতের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকে তার ছবি বের করে মাকে দেখাল। সাজেদা বেগম ভালোভাবে ছবি দেখে বললেন,
“চেহারা তো ভালোই, খারাপ না।”
“হ্যাঁ, সবদিক থেকেই ভালো। সুপাত্র। আপার জন্য একজন পারফেক্ট। শুধু আপা-ই না বোঝার ভান ধরে থাকে। জানো? আপা কিন্তু এখন আর ছেলেটার ওপর বিরক্ত হয় না।”
“কীভাবে বুঝলি?”
“ছেলেটার সাথে আপার ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে। আপা আসলে বুঝতে পেরেছে ছেলেটা তাকে সত্যি-সত্যি ভালোবাসে। এ কারণেই তোমাকে বলেছিল ছেলেটা আর তাকে বিরক্ত করে না। অথচ বাইরে তারা ভালো বন্ধু।”
সাজেদা বেগম সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলেন,
“বন্ধু?”
মৃদুলা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“বন্ধু তো ওপরে-ওপরে। মনে-মনে এখন তোমার মেয়ে-ও ওই ছেলেকে পছন্দ করে। কিন্তু মুখ ফুটে স্বীকার করে না। স্বীকার করলে যদি বিয়ে করা লাগে, সেই ভয়ে।”
“স্বীকার না করলে তুই জানলি কীভাবে?”
“আমি বুঝে গেছি। হাবভাব দেখেই বুঝতে পেরেছি। তুমি এটা নিশ্চিত থাকো, আমার কোনো কথায় এতটুকুও ভেজাল নেই। আপা সত্যিই ওই ছেলেকে পছন্দ করে। ছেলেটাকে নিয়ে এখন তার কোনো সমস্যা নেই। তার আসল সমস্যাই হচ্ছি আমরা। আমাদের চিন্তা না থাকলে নিশ্চিতভাবে সে এতদিনে ওই ছেলেকে বিয়ে করে নিত।”
সাজেদা বেগমের চোখ-মুখে কৌতুহল সরে এখন চিন্তারা জায়গা করে নিয়েছে। তিনি বললেন,
“এতকিছু ঘটে গেছে তাহলে? এই মেয়ে দেখি নিজের সুস্থ চোখ-ও অন্ধ বানিয়ে বসে আছে। একে নিয়ে যে আমি কী করব!”
মৃদুলা বলল,
“করতে হবে মা, তোমাকেই সব করতে হবে। এখন তুমি ছাড়া এই সমস্যার সমাধান কেউ করতে পারবে না।”
“কী করব?”
“ওই ছেলের সাথেই আপার বিয়ে দিবে।”
সাজেদা বেগম তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“বিয়ে দিবো তোর ঘাড়ত্যাড়া আপাকে? এমনভাবে বলছিস যেন তোর আপা আমার কথায় ওঠে আর বসে। এতদিনে পেরেছি ওকে বিয়েতে রাজি করাতে?”
“আহা! তুমি বুঝতে পারছো না কেন? এতদিন না পারলেও এবার পারবে। কারণ এবারের পাত্র আপার পছন্দের মানুষ। একটু চাপ দিলেই রাজি করাতে পারবে। আমরা তো আছিই তোমার সাথে। তোমার চিন্তা কী?”
“আমার চিন্তা কী? চিন্তা তো ওর ত্যাড়ামি নিয়েই। নিজের ভালো পাগল-ও বোঝে, শুধু ও-ই বুঝল না।”
“বুঝবে মা, বুঝবে। এবার আমাদের আপাকে বুঝাতেই হবেই। আপাকে একটা সুখী জীবন দেওয়ার জন্য এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর আমরা পাব না। এবার আমাদের পারতেই হবে।”
সাজেদা বেগম সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“চেষ্টা-ই করতে পারব। শেষমেশ আবার হয়তো সেই একই ঘটনা ঘটবে। যাইহোক, ছেলেটার সাথে কি কোনোভাবে যোগাযোগ করা যায়? তুই খোঁজ-খবর নিয়েছিস কার থেকে?”
“আমার এক বন্ধুর থেকে। ওই ভাইয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক আছে তার। ভাইয়া না কি বলেছে সে আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চায়।”
সাজেদা বেগম বলে উঠলেন,
“সত্যি? কবে?”
“কবে পাঠাবে তা তো নিশ্চিত জানি না। তবে পাঠাবে যে, এটুকু নিশ্চিত থাকো।”
“ঠিক আছে, আমি আজই মৃন্ময়ীর সাথে কথা বলব। মাথামোটা মেয়ে একটা!”
“আজই কিছু বলার দরকার নেই। তাহলে আবার আপা কী না কী ভাবে। একটু অপেক্ষা করো। আগে বিয়ের প্রস্তাব আসুক। তারপর না হয় যা বলার বলবে।”
“তুই নিশ্চিত, প্রস্তাব পাঠাবে তো?”
“একশো ভাগ নিশ্চিত।”


আমাদের দেখা হয়েছিল এক আয়োজিত সন্ধ্যায়,
কনকনে শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে
তুমি এসেছিলে খুব আয়োজন করে।
প্রথম দর্শনে আমি তোমার মুখ জুড়ে
দেখেছিলাম কেবলই স্নিগ্ধতা,
ঘাসের ওপর জমে থাকা
এক ফোঁটা শিশির বিন্দুর মতো স্নিগ্ধতার
প্রেমে পড়েছিলাম আমি।
আমি সেদিন পরিচিত হয়েছিলাম প্রথম প্রেমের সবচেয়ে সুন্দর, শীতলতম অনুভূতির সাথে।
অথচ আমার তোমাকে খুঁটিয়ে দেখা হয়নি,
তোমার সাথে প্রেমালাপ হয়নি,
জানা হয়নি তোমার মন।
তবু, তবু আমি প্রেমে পড়েছিলাম!
লোকে জানলে হয়তো তামাশা করে বলত,
‘কয়েক মুহুর্তের সাক্ষাতে-ও বুঝি প্রেম হয়?
এ পাগলামি ছাড়া আর কী?’
পাগলামি বুঝি? হোক তবে!
তুমি বলতে আমার তো ওই পাগলামিটুকুই আছে।
হাত বাড়ালেই আমি তোমায় ছুঁতে পারি,
পা বাড়ালেই হাঁটতে পারি কদম মিলিয়ে।
অথচ, অথচ আমাদের দূরত্ব যেন দুই হাতের নয়,
দুই মাইলের নয়,
কয়েক যুগের, কয়েক শতাব্দীর।
সে দূরত্ব কবে যে কোকিলের কুহুতানের
আড়ালে মুখ লুকাল,
টেরই পেলাম না।
আমার হৃদয়ে বসন্তের সুর যে
এক মাঘের সাঁঝেই নাড়া দিয়েছিল,
কেবল তুমিই তা বুঝলে না, বুঝতে চাইলে না।
প্রিয় বাসন্তী,
তোমাকে দেখার পর আমার জীবনে আর
আলাদা করে বসন্ত আসেনি।
এখন ছয় ঋতু-ই আমার বসন্ত, তুমিময় বসন্ত।

প্রভাত স্বপ্ন দেখে তার মৃন্ময়ীময় বসন্ত কেবল পৃথিবীর বুক জুড়ে নয়, একদিন তার বুক জুড়ে-ও থাকবে। মৃন্ময়ীকে নিয়ে তার সংসার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন বোনা হয়ে গেছে। বাকি রয়ে গেছে সবচেয়ে বড়ো কাজটাই, যা সম্পন্ন না করা পর্যন্ত তার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হবে না। এখন তার একমাত্র লক্ষ্য শুধু মৃন্ময়ীকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়া। সে জানে এটা খুব সহজ হবে না। তবে এবার সে ভেবেচিন্তেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মৃন্ময়ীর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হলে আগে বাড়িতে বলতে হবে। কিন্তু সে এখনও বাড়িতে কিছু বলেনি। মৃন্ময়ীর সম্পর্কে বাড়ির কেউ এখনও কিছু জানে না। জানানোর মতো সম্পর্ক তার কারোর সাথেই নেই। এই পর্যন্ত অনেকবার বাড়ি থেকে তাকে বিয়ের তাগাদা দেওয়া হয়েছিল। সে তা কানে তোলেনি বলে কেউ জোর করে-ও এ বিষয়ে কিছু বলেনি। অথচ এবার তার নিজেরই বিয়ের কথা বলার দরকার পড়ছে। তবু সে নিজের মুখে কিছুই বলল না। অস্বস্তির কারণে বন্ধুকে দিয়ে খবর পাঠাল বাবার কাছে। তার বন্ধু গিয়ে যখন তার বাবাকে বলল প্রভাত তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, তখন তার বাবা নিজেই আবার তার কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। মেয়ের বিষয়ে জানতে চাইলেন। প্রভাত মৃন্ময়ীর ব্যাপারে সবটাই বলল। পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে তা-ও বলল। সব শুনে তার বাবার মুখে স্পষ্ট অসন্তোষ দেখা গেল। মুখেও বললেন পরিবার তার পছন্দ হয়নি। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে বিয়ের পরও মেয়ে বাপের বাড়ির দায়িত্ব কাঁধে বয়ে বেড়াবে কেন? প্রভাত বলল,
“ও পরিবারের বড়ো মেয়ে। সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই, তাই বাধ্য হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। বিয়ে করলে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না কেন? সমস্যা কোথায়?”
“বিয়ের পর বাপের বাড়ি নিয়ে পড়ে থাকলে নিজের সংসারে মন বসবে না।”
“কে বলেছে আপনাকে? ওকে কি আমার চেয়ে আপনি বেশি চেনেন? পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে বলে কি ও সংসার করার অধিকার রাখে না?”
“এত ঝামেলার কী দরকার? তুই এখনই বিয়ে করতে চাইলে আমরা মেয়ে দেখছি, বিয়ে করিস। এই মেয়ে বিয়ে করার দরকার নেই।”
একথা শুনেই প্রভাত রেগে গেল। শক্ত গলায় বলে দিলো,
“আপনাকে এতকিছু ভাবতে হবে না। আমি ওকে পছন্দ করি, বিয়ে করলে ওকেই করব। সংসার আমি করব, আমার সংসারের চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। দরকার পড়লে আমি ওকে আলাদা সংসার দিবো। তবু আপনার সংসারে রাখব না।”
এই নিয়ে বাবার সাথে তার বেশ কিছুক্ষণ তর্ক হলো। তার সৎ-মা রাহেলা বেগম অদূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। প্রভাত বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“এই লোককে বুঝান। নয়তো আপনারা চাইলেও আমি ওই মেয়েকে বিয়ে করব, না চাইলেও করব।”

মৃন্ময়ী লক্ষ্য করল আজ প্রভাত কথাবার্তা একটু কম বলছে। মুখে সবসময়ের স্বচ্ছ হাসিটা নেই। সে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার কি আজ কোনো কারণে মন খারাপ?”
“নাহ্,” প্রভাত অস্বীকার করল।
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমার তো মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ।”
প্রভাত হেসে বলল,
“তুমি তাহলে আমার মন-ও বুঝতে শিখে গেছো? বাহ্! আমার চেষ্টা তবে সফল হচ্ছে।”
“ফাজলামি কোরো না তো। বলো, বাড়িতে কিছু হয়েছে?”
“উঁহু।”
মৃন্ময়ী বুঝল প্রভাত কিছু বলবে না। তবু তার মন খারাপ থাকলে প্রভাত যেভাবে তাকে জেরা করতে থাকে, তা সে করতে পারল না। মনে-মনে নিজেকে ভীষণ অকর্মণ্য মনে হলো। ভাবল কীভাবে প্রভাতের মন ভালো করা যায়। প্রভাত তার মন ভালো করার জন্য কত চেষ্টা করে। অথচ সে কিছু বলতে-ও পারছে না। প্রভাত হঠাৎ কেমন মলিন কন্ঠে বলে উঠল,
“চলো এবার বিয়েটা করে নিই ম্যাডাম। আর বাঁধা দিয়ো না।”
হঠাৎ প্রভাতকে এভাবে কথা বলতে শুনে মৃন্ময়ী চুপ হয়ে গেল। প্রভাত থামল না, বলতেই থাকল,
“একটা সংসার ছাড়া আমি তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাই না। তোমার সাথে আমার জীবন জুড়ে যাওয়ার পরও আমি তোমার জীবনের কোনো সিদ্ধান্তে আপত্তি করব না। তোমাকে সমর্থন করার জন্য, তোমাকে খুশি রাখার জন্য যা করতে হয় আমি করব। এতদিনেও কি তুমি আমাকে বুঝতে পারছো না?”
মৃন্ময়ী এবারেও প্রত্যুত্তর করল না। প্রভাত বলল,
“কিছু বলছো না যে?”
মৃন্ময়ী মাথা নিচু করে হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“কী বলব? তোমায় এক কথা বলতে-বলতে আমি ক্লান্ত।”
“এক কথা আমি আর শুনতে চাচ্ছি না। এবার ভিন্ন কিছু বলো। নিজের মনকে আর কত বেঁধে রাখবে? মনকে একটু ছাড় দাও ম্যাডাম, আমি তাকে খুব যত্নে রাখব। কোনোদিন-ও অযত্ন করব না। তোমার পরিবার নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এ কথা তো তোমাকে হাজারবার বলেছি। তা-ও কেন তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো না?”
“পাগলামি কোরো না প্রভাত।”
“পাগলামি এতদিন করিনি মৃন্ময়ী, এখন করতে চাইছি। খুব শীঘ্রই আমি তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব।”
মৃন্ময়ী চমকে উঠে থমকে দাঁড়াল। চট করে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,
“মানে কী?”
প্রভাত শান্ত চোখে চেয়ে উত্তর দিলো,
“মানে খুব শীঘ্রই আমি তোমাকে আমার ঘরে নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। হতেও পারে তা এ সপ্তাহের মধ্যেই।”
মৃন্ময়ী উত্তেজিত হয়ে উঠল,
“তোমার মাথায় কী চলছে প্রভাত? এমন কিছু করতে যেয়ো না, প্লিজ।”
“তুমি প্লিজ আমাকে আর আটকিয়ো না।”
কথাটা একটু জোরে বলে ফেলল প্রভাত। সঙ্গে-সঙ্গেই আবার নিজেকে ধাতস্থ করে সে বলল,
“মৃন্ময়ী, আমার কথা শোনো। সারাজীবন তুমি এমন থাকতে পারবে না। তোমার মা তোমাকে নিয়ে কত চিন্তা করে, তা তো তুমি বোঝো। পরিবারের জন্য বিয়েতে তোমার আপত্তি, আমি বুঝি। কিন্তু আমি তো তোমাকে বারবার কথা দিয়েছি তোমার পরিবারকে আমি নিজের পরিবার বানিয়ে নেব। পরিবারের প্রতি তোমার দায়িত্ব, কর্তব্যে আমি কোনোদিন বাঁধা দিবো না। এমনকি আমার পরিবার থেকেও কোনোরকম বাঁধা আসতে দিবো না। এরপরও তোমার কিসের এত ভয়? দরকার পড়ে আমি নিজের মুখে স্বীকারোক্তি দিয়ে তারপর তোমাকে বিয়ে করব। বিয়ের পর আমার কথার এদিক-সেদিক হলে তুমি আমাকে শাস্তি দিয়ো। তবু আর আমাকে বাঁধা দিয়ো না। আমি আর তোমার আপত্তি শুনতে চাই না। কারণ আমি জানি তোমার মন কী চায়।”
“আমার মন কিছুই চায় না। তুমি এসব করতে যেয়ো না।”
মৃন্ময়ী কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু নিজের কথায় সে কোনো জোরই খুঁজে পেল না। নিজের কাছে নিজেকে চরম মিথ্যাবাদী মনে হলো। সত্যিই তার মন কিছু চায় না? প্রভাত নাছোড়বান্দা। সে স্পষ্ট ভাষায় বলল,
“মন কিছু চায় কি না তা বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর পর বুঝে নিয়ো। তখনও যদি তোমার অমত থাকে, তাহলে আমি বিশ্বাস করে নেব আমায় তুমি এক মুহুর্তের জন্যও ভালোবাসোনি।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১২+১৩

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১২.
প্রভাতকে জানানোর পর থেকে মৃত্তিকাকে বিরক্ত করা তো দূর, শফিক আর তার সামনে-ও আসছে না। মৃন্ময়ী প্রভাতকে জিজ্ঞেস করেছিল সে শফিককে কীভাবে আটকাল। প্রভাত হাসতে-হাসতে শুধু উত্তর দিয়েছে, “ওইটুকু পুঁচকে ছেলেকে শায়েস্তা করা কী এমন আহামরি কাজ? বেচারা ভয় পেয়েছে, আর বিরক্ত করবে না। এর বেশি জেনে তোমার কাজ নেই।” কিছুতেই প্রভাতের পেট থেকে সত্য কথাটা বের করা যায়নি। উলটো সে মৃন্ময়ীর কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলল। বলল,
“আমি তো তোমার সমস্যার সমাধান করে দিলাম, এবার তুমি আমার সমস্যার সমাধান করে দাও।”
মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“তোমার আবার কী সমস্যা?”
“আমার বউ নেই, এটাই সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। কবে আমার বউয়ের অভাব পূরণ করছো বলো।”
“যেদিন পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় হবে, সেদিন।”
প্রভাত হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বুঝেছি, এবার আমাকেই শক্ত একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। মিষ্টি কথা খরচ করে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই।”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে শুধাল,
“কী ব্যবস্থা নিবে, শুনি?”
“তা কি আমি তোমায় বলব? তুমি শুধু বউ সাজার প্রস্তুতি নাও, বাকিটা সময় বলে দিবে।”
মৃন্ময়ী মৃদু হাসল। প্রভাত সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল,
“হাসছো যে? তুমি কি বউ সাজার কথা শুনে খুশি হলে?”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, তোমার কনফিডেন্স দেখে।”
“কনফিডেন্স আমার সবসময়ই আছে। এবার শুধু কনফিডেন্সকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পালা।”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা, শুভকামনা রইল তোমার জন্য।”
প্রভাত হাসিমুখে বলল,
“লাভ ইউ।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকাল। তবে প্রভাতের হাসি-হাসি মুখে সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। প্রভাতের ঠোঁটের কোণ থেকে হাসির রেখা মুছল না। আজকাল মৃন্ময়ী তার সাথে অনেকটাই সহজ হয়েছে। আগের মতো হুটহাট রাগ দেখায় না। ব্যাপারটা প্রভাত ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে। পারিবারিক সমস্যার কারণে মন খারাপ হলেও মৃন্ময়ী এখন তা প্রভাতের কাছে বলতে দ্বিধা করে না। প্রভাত এতেই ভীষণ খুশি। মৃন্ময়ীর এই সহজ রূপটাই তো সে সবসময় দেখতে চেয়েছিল। অবশেষে সে কিছুটা হলেও সফল হলো। বাকি সাফল্যটুকু-ও সে যেকোনো মূল্যে জয় করে নিবে।

সবেই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে মৃন্ময়ী। ডানহাতে একটা নীল পলিথিন। মৃত্তিকার জন্য কিছু জলপাই কিনে নিয়ে এসেছে সে। এই সময় মৃত্তিকা আর মা নিশ্চয়ই কাঁথা সেলাই করছে। আজকাল রোজ বাড়ি ফিরেই সে দেখে মা আর মৃত্তিকা বাচ্চার জন্য ছোটো-ছোটো কাঁথা সেলাই করছে। দৃশ্যটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগে মৃন্ময়ীর। মৃত্তিকার সাথে মায়ের বেশ ভাব হয়েছে। এটা খুব দরকার ছিল। ভাবতে-ভাবতে মৃন্ময়ী ঘরে ঢুকতেই খানিক থমকাল। বসার ঘরে মায়ের সঙ্গে চার-পাঁচটা অপরিচিত মহিলা বসে গল্প করছে। মৃন্ময়ী তাদের কাউকেই চেনে না। অকস্মাৎ সে সালাম জানাতে-ও ভুলে গেল। সাজেদা বেগম তাকে দেখেই কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মহিলাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
“এই তো আমার মেয়ে চলে এসেছে।”
তারপর মৃন্ময়ীকে বললেন,
“সালাম দে, ওনারা তোর জন্যই এসেছে।”
অগত্যা মায়ের কথামতো মৃন্ময়ী সালাম জানাল। সাজেদা বেগম তড়িঘড়ি করে উঠে এসে তাকে ঠেলে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন,
“তাড়াতাড়ি গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে, জামাকাপড় পালটে আয়। ওনারা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন।”
মৃন্ময়ী বিস্ময় নিয়ে ঘরে ঢুকতে যেতেই আবার রান্নাঘরে শব্দ শুনে সেদিকে এগিয়ে গেল। মৃদুলাকে দেখল কড়াইতে কিছু ভাজছে। সে বলে উঠল,
“মৃদুলা, তুই আজ টিউশনে যাসনি?”
মৃদুলা উত্তর দিলো,
“মা যেতে দেয়নি।”
“কেন?”
মৃদুলা হেসে উঠে বলল,
“বাড়িতে এমন মারাত্মক ব্যাপার ঘটবে, আমি অনুপস্থিত থাকলে কী করে হবে?”
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
“কিসের মারাত্মক ব্যাপার? আর ওই মহিলারা কারা?”
মৃদুলা তাড়া দেখিয়ে বলল,
“তাদের আমি চিনব কী করে? এখনও তো আত্মীয়তা-ই হলো না। তুমি ঘরে যাও তো আপা। ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে আমার দেওয়া শাড়িটা নামিয়ে পরো। এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। আমার কাজে ডিস্টার্ব হচ্ছে। এই দেখো, তোমার সাথে কথা বলতে-বলতে কয়েকটা পিঠা বেশি ভেজে ফেলেছি। যাও, যাও।”
“আশ্চর্য!”

মৃন্ময়ী ঘরে গিয়ে দেখল তার ঘরে বসে মৃত্তিকা কাঁথা সেলাই করছে। তাকে দেখেই সে বলল,
“এতক্ষণে এলি তুই? সেই কখন থেকে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। কী এনেছিস রে?”
মৃন্ময়ী জলপাইয়ের প্যাকেটটা মৃত্তিকার কোলের ওপর রাখল। মৃত্তিকার হাসি-হাসি মুখ দেখে মনে হলো জলপাই পেয়ে সে খুশি হয়েছে। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে মৃন্ময়ী বলল,
“বাসায় কী হচ্ছে একটু বলবি আমাকে? ওই মহিলারা কোত্থেকে এসেছে?”
“কোত্থেকে এসেছে তা একমাত্র মা জানে। আমি শুধু এটুকু জানি যে তারা তোকে দেখতে এসেছে।”
“তা তো মায়ের তাড়া দেখেই আমি বুঝে গেছি। কিন্তু এদের আমাদের বাড়ির পথ দেখিয়ে দিলো কে?”
মৃত্তিকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
“জানি না। মা নিজেই সকালে আমাকে বলল। তারপর নিজেই সারাদিন আপ্যায়নের ব্যবস্থা করল। তোকে জানিয়ে দিই কি না, সেই ভয়ে তেমন কিছুই বলেনি আমাকে।”
“কী মুশকিল! মা কি বাচ্চা, বল? এতদিন তো এমন করেনি। হুট করে আবার তার মাথায় এসব বাচ্চামি জাগল কীভাবে?”
“মা-ই জানে। তুই দাঁড়িয়ে না থেকে জামাকাপড় পালটা, নয়তো মা এক্ষুনি এসে আবার তাড়া দিবে। আমাকে বারবার করে বলে দিয়েছে তোকে যেন সুন্দর করে সাজিয়ে দিই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তুই-ও কি মায়ের মতো পাগল হলি? জানিস না আমি এসব পছন্দ করি না?”
“আমি কী করব বল? মাকে এই কথা বল তুই, দেখ কেমন তেতে ওঠে। আমি একবার বলাতে আমাকে একশো ধমক দিয়েছে।”
মৃন্ময়ী বিরক্তিতে মুখে চ-সূচক শব্দ করে বলল,
“মা যে কী করে!”

বলতে-বলতেই সাজেদা বেগম দরজায় উপস্থিত হলেন। তাড়া দেখিয়ে মৃন্ময়ীকে বললেন,
“তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস? জামা-কাপড় পাল্টাচ্ছিস না কেন?”
মৃন্ময়ী মায়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
“এসবের মানে কী মা? তুমি আবার আমাকে না বলে এসব কাণ্ড শুরু করেছ? আমি বলেছি না এভাবে হুটহাট কাউকে বাড়ি আসতে বলবে না?”
“হুটহাট কোথায়? আমার সাথে কথা বলেই তো এসেছে।”
“তো তুমি আমাকে জানিয়েছ? আমাকে না জানিয়ে তুমি যাকে-তাকে আসতে বলো কেন? আমি তো তোমাকে বারবার বারণ করেছিলাম।”
সাজেদা বেগম তার কথা কানেই তুললেন না। উলটো বললেন,
“তাড়াতাড়ি কর, আমার যেন আর ডাকতে আসা না লাগে। এই মৃত্তিকা, ওকে রেডি করে দে।”

মৃত্তিকা কিছু বলতেও পারল না। সাজেদা বেগম তাড়া দিয়ে চলে গেলেন। মৃন্ময়ী মৃত্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মৃত্তিকা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
“আমি কী করব? আগে জানলে তো জানাতাম তোকে। এখন আর রাগ করিস না প্লিজ। মা কেমন তা তো জানিসই। মহিলারা যখন এসে বসে আছে, তাদের তো তাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সামনে যা।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি বিয়ে-ই যখন করব না, তখন সামনে যাব কেন? আশ্চর্য!”
“সামনে গেলেই তো তোকে বিয়ে দিয়ে দিবে না। ওনারা চলে যাওয়ার পর না হয় তুই মায়ের সাথে কথা বলিস। এখন তো বাইরের মানুষের সামনে কিছু বলতে পারবি না।”

মহাবিরক্তি নিয়েই শেষে মৃন্ময়ী ভালো জামা পরল। কিন্তু তাকে সাজানো গেল না। মৃদুলা সাজতে বলে উলটো বকা খেয়ে গেল। মহিলাদের সামনে গিয়ে মৃন্ময়ী ভদ্র আচরণ করলেও তার মনের মধ্যে বিরক্তি টগবগ করছিল। কারোর কোনো প্রশ্নের উত্তর তার দিতে ইচ্ছা করছিল না। তবু ভদ্রতার খাতিরে দিতে হলো। মায়ের প্রতি তার রীতিমতো রাগ উঠে গেল। মা তাকে নিয়ে মহিলাদের কাছে এমন মিষ্টি-মিষ্টি বুলি আওড়াচ্ছিলেন, যেন আজই তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। মৃন্ময়ী শুধু অপেক্ষায় ছিল কখন মহিলারা বিদায় হবেন। বিদায়ের সময় মহিলারা আবার বলেও গেলেন বাড়ি ফিরে তারা তাদের ছেলেকে পাঠানোর দিন বলে দিবেন। তাদের বিদায় জানিয়েই মৃন্ময়ী মাকে চেপে ধরল। জানতে চাইল এদের সে কোথা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। সাজেদা বেগম বললেন,
“আমি তুলে আনতে যাব কেন? তারাই আমাকে ধরেছিল, আপনার মেয়েকে দেখতে যাব। তাদের ছেলের খোঁজ-খবর নিয়ে শুনলাম ভালো ছেলে, তাই আসতে বলেছিলাম।”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“তুমি আবার ছেলের খোঁজ-খবরও নিয়েছ? মানে তুমি এতদূর এগিয়ে গেছ, অথচ আমাকেই জানানোর প্রয়োজন মনে করনি?”
“তোকে কী জানাব? জানালে তুই ‘না-না’ ছাড়া কিছু বলতি? আমার দায়িত্ব আমার মেয়েকে ভালো ছেলের হাতে তুলে দেওয়া, আমি তা-ই করছি।”
“তোমাকে এত দায়িত্ব পালন করতে হবে না মা। আমি হাজারবার তোমাকে বলেছি তুমি আর যা-ই করো, অন্তত আমার বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আমার কথা তুমি কেন শোনো না?”
সাজেদা বেগম রাগত মুখে বললেন,
“বিয়ে নিয়ে আমি মাথা ঘামাব না তো কে ঘামাবে? তুই যে কোন চিন্তা-ভাবনা করে বসে আছিস, তা কি আমি জানি না? আজীবন কি তুই এই বাড়ির খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি? নিজের দিকে তাকানো লাগবে না?”
“আমার চিন্তা আমি করি মা, তোমাকে করতে হবে না। আমি যেমন আছি ভালো আছি, এরচেয়ে আর ভালোর চিন্তা করার দরকার নেই।”
“কী ভালো আছিস তুই? এই তোর ভালোর নমুনা?”
“তোমরা আমাকে ছেড়ে দয়া করে নিজেদের ভালোর দিকে তাকাও।”
“আমাদের ভালো তোকে সারাজীবন অবিবাহিত থেকে দেখতে হবে না। এত বছর যথেষ্ট দেখেছিস। এখন নিজের কথা ভাব। এই মহিলারা তাদের ছেলে পাঠাবে। পছন্দ হলে আর সব ঠিকঠাক থাকলে এবার তোকে বিয়ে করতেই হবে। এবার আর আমি তোর কোনো কথাই শুনব না।”
সাজেদা বেগম একটু উঁচু গলায় কথাগুলো বলে চলে গেলেন। মৃন্ময়ী এত কথা বলল, তার কিছুই তিনি শোনার প্রয়োজনবোধ করলেন না। মৃত্তিকা আর মৃদুলা অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। মৃত্তিকা মিনমিনে গলায় বলল,
“বিয়েটা এবার কর আপা। এমন করিস না। বয়স পেরিয়ে গেলে আর কবে নিজের সংসার সাজাবি?”
মৃদুলা-ও বলল,
“হ্যাঁ আপা, আর না-না কোরো না। এবার বিয়েটা করেই নাও। তোমার একটা সংসার হলেই মা অনেকটা চিন্তামুক্ত হতে পারবে।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তোরা-ও দেখছি মায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এক সুরে কথা বলছিস। কর, সবাই মিলে আমার চিন্তা কর। নিজেদের চিন্তা আর করা লাগবে না। আমিও দেখব তোদের চিন্তা কে করে। আছি বলে তো মূল্য বুঝতে পারছিস না। বিদায় করে দেখ একবার, তখন বুঝবি বাস্তবতা কী।”
আপনমনে বকতে-বকতে মৃন্ময়ী ঘরে চলে গেল। মৃত্তিকা আর মৃদুলা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। মৃত্তিকা হতাশ গলায় বলল,
“একে বুঝানো আমার কাজ নয় বোন।”
মৃদুলা ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর আবার নিজের আত্মবিশ্বাসী সত্তা জাগিয়ে তুলে দৃঢ় গলায় বলল,
“নাহ্! হাল ছাড়লে চলবে না। এবার আপাকে রাজি করাতেই হবে। আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে।”
মৃত্তিকা জোরপূর্বক হেসে বলল,
“অল দ্যা বেস্ট।”


মৃন্ময়ী আজ ভীষণ চুপচাপ। প্রভাত বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলেও সে কেবল হুঁ-হা উত্তরে সাড়া দিয়েছে। প্রভাত কিছু পথ হাঁটার পর নরম গলায় প্রশ্ন করল,
“বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?”
মৃন্ময়ী এবার মুখ খুলল। তবে বেশ চড়া গলায় বলে উঠল,
“তোমার কেন মনে হয় সবসময় আমার বাসাতেই শুধু সমস্যা হয়? দুনিয়ার আর কোথাও কি কোনো সমস্যা নেই? না কি দুনিয়ার যত সমস্যা সব আমার বাসাতেই বাস করে?”
প্রভাত বলল,
“আমি জানি তো বাসায় সমস্যা হলে তোমার সবসময় মন খারাপ থাকে, তাই জিজ্ঞেস করলাম। তা যদি না হয় তবে দুনিয়ার অন্য কোথাও তোমার সমস্যা হলে তা-ই বলো, শুনি।”
মৃন্ময়ী আবারও চুপ হয়ে গেল। প্রভাত বারবার তার রাগে খোঁচা মে’রে বলল,
“কী হলো? বললে না? বলো।”
মৃন্ময়ী প্রত্যুত্তর করল না। প্রভাতের খোঁচাখুঁচিতে বিরক্ত হয়ে পুনরায় বলে উঠল,
“আহ্ প্রভাত! জ্বালিয়ো না তো।”
“আমি তোমাকে জ্বালাচ্ছি?”
“তো কী করছো?”
“প্রশ্ন করছি।”
“প্রশ্ন করবে না।”
“আচ্ছা, আর প্রশ্ন করছি না। তুমি কি খুব রেগে আছো?”
“আবারও প্রশ্ন করছো?”
“রাগের কারণটুকু শুধু জানতে চেয়েছি।”
মৃন্ময়ী আবারও কপালে ভাঁজ ফেলে গাল ফুলিয়ে রইল। প্রভাত তার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“তোমার রাগত চেহারা বাচ্চাদের মতো লাগছে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“বুড়ো বয়সে চেহারা বাচ্চাদের মতো লাগছে! চোখের ডাক্তার দেখাও।”
“আমার ডাক্তার তো তুমিই।”
মৃন্ময়ী চুপ। প্রভাত বলল,
“একটু দাঁড়াও, আমি ঝালমুড়ি নিয়ে আসি। ঝালমুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে।”
“তো খাও গিয়ে। আমি দাঁড়িয়ে কী করব?”
“দাঁড়াও না প্লিজ। যেয়ো না কিন্তু, হ্যাঁ? অপেক্ষা করো আমার জন্য।”

প্রভাত রাস্তার ওপারের ঝালমুড়ির দোকানে চলে গেল। যেতে-যেতে সে বারবার করে ফিরে তাকিয়ে দেখল মৃন্ময়ী চলে যাচ্ছে কি না। মৃন্ময়ী একবার ভেবেছিল চলে যাবে। প্রভাতের অমন বারবার ফিরে তাকানো দেখে আবার কী ভেবে দাঁড়িয়ে রইল, তবে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে। মৃন্ময়ী দাঁড়িয়ে আছে দেখে প্রভাত বেশ খুশি হয়েছে। দুই হাতে দুই প্যাকেট ঝালমুড়ি নিয়ে মৃন্ময়ীর কাছে ফিরে এসে একহাতের ঝালমুড়ি বাড়িয়ে ধরে বলল,
“নাও।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি খাব না। তোমার খেতে ইচ্ছা করেছে, তুমিই খাও।”
“আমি তো তোমার জন্য-ও এনেছি, নাও।”
“আমি তো খাব বলিনি। আনলে কেন?”
“খাবে না, তা-ও তো বলনি।”
“তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করনি।”
“আচ্ছা, আমারই ভুল। এখন খেয়ে নাও তো। আমি একা খেতে পারব না, নষ্ট হবে।”

মৃন্ময়ী ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে খেতে গিয়ে ঝালমুড়িতে মরিচের পরিমাণ দেখে চোখ বড়ো করে বলল,
“এত ঝাল!”
প্রভাত হেসে বলল,
“ঝালমুড়ি কি মিষ্টি হয়?”
“না, কিন্তু এত বেশি মরিচ দিয়ে আনলে কেন?”
“খেতে পারবে না?”
“পারব, কিন্তু পরে অনেক পানি খেতে হবে।”
“পানি এনে দিবো, সমস্যা নেই। খাও, খাও। এটুকু ঝাল তোমার রাগের কাছে কিচ্ছু না। ঝালমুড়ির ঝালের সাথে যদি তোমার মনের ভেতরের রাগের ঝাল বেরিয়ে আসে, তাহলে তো তোমারই উপকার। তাই না?”
মৃন্ময়ী চোখ পাকিয়ে তাকাতেই প্রভাত দাঁত বের করে হেসে বলল,
“মজা করেছি, স্যরি।”

মৃন্ময়ী ঝালমুড়ি খেতে-খেতে বেশ কয়েকবার প্রভাতের মুখের দিকে তাকাল। আজকাল প্রভাতের সাথে কোনো কথা শেয়ার করতে না পারলে তার ভালো লাগে না। মনখুলে যেকোনো কথা বলার এই একটাই তো জায়গা তার। আগে প্রভাত নিজেই তাকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে পেট থেকে কথা বের করত। আর এখন সে নিজেই কথা বলার জন্য ভেতর-ভেতর ছটফট করে। প্রভাত বুঝতে পারল তার মনোভাব। তারপর নিজেই বলল,
“কিছু বলতে চাইলে নির্দ্বিধায় বলে ফেলো, শুনছি।”
মৃন্ময়ী একটু অস্বস্তিতে ভুগছে। অন্যান্য সমস্যার মতো তো এই কথাটা না যে ঠাস করে বলে ফেলবে। প্রভাত চোখ ছোটো করে বলল,
“এখনও তুমি কথা বলতে দ্বিধাবোধ করো? এতদিনেও একটু সাহস হয়নি?”
“তা না। কথাটা একটু অন্যরকম।”
“কী রকম?”
মৃন্ময়ী এবার সাহস করে বলে ফেলল,
“বিকেলে আমাদের বাড়িতে কয়েকজন মহিলা এসেছিল।”
“কোন মহিলা?”
“আমি চিনি না, মা চেনে।”
প্রভাত যেন এক মুহুর্তেই ব্যাপারটা ধরে ফেলল। চোখ বড়ো করে সে বলে উঠল,
“বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল?”
মৃন্ময়ী মৃদু ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। প্রভাতের মুখটা হঠাৎ করেই খুব সিরিয়াস দেখাল। সে মৃন্ময়ীকে একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল,
“তোমার মা তাদের কোথায় পেল?”
“কী জানি! আগেও তো মা অনেকবার এমন করেছিল। আমি রাগ দেখানোর পর কিছুদিন বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু করেছে।”
“তোমাকে আগে থেকে কিছু জানায়নি?”
“না, স্কুল থেকে ফিরে দেখি মহিলারা বসে আছে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? মায়ের সাথে অযথা রাগ দেখিয়ে শেষে সামনে যেতে হয়েছে।”
“তুমি কি শাড়ি পরেছিলেন?”
“উঁহু।”
“সেজেছিলে?”
“নাহ্!”
“তারা কি তোমাকে পছন্দ করেছে বলে গেছে?”
মৃন্ময়ী হতাশ মুখে বলল,
“হুম।”
“আর কী বলে গেছে?”
“পাত্রকে পাঠাবে বলে গেছে।”
“তোমার মা রাজি?”
“মায়ের কথা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে?”
প্রভাত এবার কিছুটা জোরেই বলে উঠল,
“তার মানে তারা তোমাকে আবার দেখতে আসবে?”
“তা-ই তো মনে হচ্ছে।”
“তুমি কিছু বলনি?”
“মায়ের সাথে রেগে ছিলাম, তাই কিছু বলিনি তখন।”
প্রভাত হঠাৎ রেগে গেল। সে রাগত মুখে বলে উঠল,
“ছেলের ঠিকানা জেনে আমাকে জানিয়ো। তারপর ওর বিয়ে করার সাধ আমি মিটাচ্ছি।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে আমি বলেছি কিছু করতে?”
“তাহলে কি তুমি ওই ছেলেকে বিয়ে করবে?”
“আমি কখন বললাম ওই ছেলেকে আমি বিয়ে করব?”
“তাহলে?”
“প্রতিবারের মতোই না বলে দিবো। এভাবে মায়ের বাধ্য মেয়ের মতো বিয়ে করার হলে তো কবেই করে ফেলতাম। আমার কি সেই সুযোগ আছে?”
“সুযোগ অবশ্যই আছে। তবে সেটা শুধুই আমার বেলায়। তুমি বাধ্য মেয়ের মতো বিয়ে করলে করবে শুধুমাত্র আমাকে। আমি ছাড়া অন্য কেউ এই জায়গায় দাঁড়াতে চাইলে আমি তার ঠ্যাং ভেঙে রেখে দিবো।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ইশ্! কেমন গুণ্ডাদের মতো কথা বলছো।”
“অন্য কেউ আমার জায়গা নিতে চাইলে আমি গুণ্ডা-ই হব।”
মৃন্ময়ী মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,
“এমনভাবে বলছো, আমি যেন তোমাকে জায়গা দিয়ে বসে আছি।”
প্রভাত বলল,
“সে জায়গা তো আমার জন্যই বরাদ্দ আছে। খুব শীঘ্রই আমি আমার জায়গা দখল করে নেব। তুমিও বাঁধা দিতে পারবে না।”
“আমি বাঁধা দিতে পারব না? এমন বিশ্বাস তুমি কোথায় পেলে?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“তোমার পরিবর্তন থেকে।”
“কী পরিবর্তন?”
“তুমি কি নিজের পরিবর্তন বুঝতে পারো না? তা-ও আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? একমাস আগেও কি তুমি নিজে থেকে আমাকে কোনো কথা বলতে? এখন কিন্তু বলছো। এটা কি বিরাট ধরনের পরিবর্তন নয়? আমি জানি তুমি মুখে স্বীকার করবে না। না করলে কোরো না, সমস্যা নেই। আমি তোমার মন বুঝতে পারি।”
মৃন্ময়ী মিনমিনে গলায় বলল,
“খুব বোঝো তুমি।”
প্রভাত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“অবশ্যই বুঝি। আর এভাবে মন বুঝতে-বুঝতেই একদিন দেখবে আমি তোমার গোটা মনটাকেই দখল করে নিয়েছি। তখন মন জুড়ে শুধু প্রভাত ছাড়া কিছুই খুঁজে পাবে না। তোমার মনে রাগ তো দূর, মন খারাপকে-ও তখন আর আমি জায়গা দিবো না। আমি ছাড়া বাকি সবার ওপর, সবকিছুর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৩.
পাত্রপক্ষ থেকে খবর এসেছে পাত্রসহ তার বোন আর দুলাভাই মৃন্ময়ীকে দেখতে আসবে। তাদের পছন্দ হলে বিয়ের বিষয়ে কথা এগোবে। খবর শুনে মৃন্ময়ী সঙ্গে-সঙ্গে তার মাকে বলেছে তাদের আসতে নিষেধ করতে। কিন্তু সাজেদা বেগম তাতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন। মৃন্ময়ীর কথা কানে না তুলে সে তাদের আসতে বলে দিয়েছেন। সেই নিয়ে মা-মেয়ের মাঝে শুরু হয়েছে কথা কাটাকাটি। মৃন্ময়ী কিছুতেই আর পাত্রপক্ষের সামনে যেতে রাজি না। সাজেদা বেগম-ও নাছোড়বান্দা। মৃন্ময়ী কোনোভাবেই এবার সাজেদা বেগমকে বুঝাতে পারছে না। মৃত্তিকা আর মৃদুলাকে-ও বারবার করে বলেছিল তারা যেন মাকে বুঝায়। অথচ তারা বুঝাতে গেলেই সাজেদা বেগম রেগেমেগে সবাইকে চোখ রাঙানি দিয়ে বিদায় করে দেন। মায়ের রাগের সামনে তারা কোনো বোনই টিকতে পারে না। মৃদুলা তবু বকা খাওয়ার পর-ও মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল। সাজেদা বেগম উলটো তাকে বলে দিয়েছেন মৃন্ময়ীকে বুঝাতে। বোনকে তারা আর কত বছর এভাবে রাখবে? বোনের ভালোর জন্যই তো বিয়ের তাড়া দেওয়া। মৃদুলা মৃন্ময়ীর কাছে গিয়ে হতাশ গলায় বলল,
“তোমাদের দুই বিরোধী দলের গ্যাঞ্জামের মাঝে আমাকে আর ঢুকিয়ো না প্লিজ।”
মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“মা কী বলেছে?”
“কী আবার বলবে? সারাদিন ধরে যা বলে এসেছে তা-ই। মায়ের একটাই কথা, তোমাকে এবার সে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। তার কথায় কোনো নড়চড় হবে না।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল ,
“আমি বিয়ে না করলে সে আমাকে কীভাবে বিয়ে দিবে? আশ্চর্য! আমি কি বাচ্চা মেয়ে আছি যে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে?”
মৃদুলা ভাবুক মুখে মাথা নেড়ে বলল,
“হুম, কথা অবশ্য ঠিক। মা তোমাকে কী করে বিয়ে দিবে তা আমার জানা নেই। তবে তোমার দিক থেকে কীভাবে আটকানো যায়, তা জানা আছে।”
মৃন্ময়ী কৌতুহলী হয়ে উঠে বলল,
“সত্যি? কীভাবে রে?”
মৃদুলা ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হেসে বলল,
“বলব না।”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“না বললে আটকাব কীভাবে?”
“তা-ও বলব না।”
“আজব! তাহলে বললি কেন তুই জানিস?”
“তোমার আগ্রহ দেখলাম।”
“অসময়ে ফাজলামি করিস না মৃদুলা।”
“করছি না। মাথা খাটিয়ে একটু চিন্তা করো। তোমার মাথায় দেখছি বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুই নেই। সমাধান চোখের সামনে থাকলেও তুমি সমস্যা বয়ে বেড়াও।”
“চোখের সামনে কী সমাধান দেখিস তুই?”
“চোখে কালো চশমা পড়ে থাকলে দেখবে কীভাবে?”
“হেঁয়ালি না করে বললেই পারিস।”
“নিজে থেকে চিন্তা করো। আমার মাথা দিয়ে চিন্তা করলে তোমার মাথা আছে কোন কাজে?”
বলেই মৃদুলা চলে গেল। মৃন্ময়ীর বিরক্ত লাগল। মৃদুলাটা সবসময় এমন বুদ্ধিমতী সাজে। বুদ্ধি উপকারে না এলে তার এত বুদ্ধিমত্তা দেখে কী করবে সে?

সাজেদা বেগম কাঁথা সেলাই করবেন। কিন্তু রাতের বেলায় তিনি সুচের ক্ষুদ্র ফাঁকফোকর দিয়ে সুতা ঢুকাতে পারেন না। তাই মৃদুলাকে বারবার করে ডাকেন সুতা ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। আজ-ও মৃদুলা তার সুচে সুতা ঢুকিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পাশে বসে রইল। তারপর বলল,
“মা শোনো, বড়ো আপা এই ছেলেকে বিয়ে করবে না। তুমি শুধু-শুধু তাদের ডেকে এনে খরচ কোরো না।”
সাজেদা বেগম বিরক্ত চোখ তুলে বললেন,
“আবার তুই আমার কানের কাছে ভনভন করতে এসেছিস?”
“আমাকে তো তুমিই ডেকে আনলে।”
“আমি কাজে ডেকেছি, অকাজে না। তুই তোর কাজে যা, আবার ডাকলে আসিস।”
মৃদুলা এক চুল-ও নড়ল না। শক্ত হয়ে বসে বলল,
“মা, আমি ভালো কথাই বলছি। তুমি আমাদের কথা না শুনে রাগ দেখিয়ে লোকজনের পেছনে টাকা খরচ করবে, কিন্তু আপা তো ওই ছেলেকে বিয়ে করবে না। তাহলে লাভ কী এসব করে?”
“তোর আপা কোন ছেলেকে বিয়েটা করবে, বুঝা আমাকে। এই ছেলে আর ওই ছেলে আছে? ওই মেয়ে তো চিরকুমারী থাকার তালে আছে। তোরা বুঝবি কীভাবে?”
“আরে করবে-করবে। এখন কোনো ছেলেকে বিয়ে না করলেও, একদিন একজনকে ঠিকই বিয়ে করবে। তোমাকে এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না।”
“তা চিন্তা যে করব না, সেই একদিনটা ঠিক কবে আসবে মা? আমি ম’রলে? আর সেই একজনটাই বা কোন রাজপুত্র যার অপেক্ষায় বসে থেকে তোমার আপা বয়স বাড়াচ্ছে?”
মৃদুলা বলল,
“হতেও তো পারে আপার নিজের কোনো পছন্দ আছে, তাই এখন তোমার পছন্দে বিয়ে করতে চাইছে না।”
সাজেদা বেগম তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
“তোর আপা করবে ছেলে পছন্দ? তাহলে কি আর এত বছর ধরে বসে আছে?”
“এভাবে বলছো কেন? এখন তো কাউকে পছন্দ করতে-ও পারে।”
সাজেদা বেগম কেমন সন্দিহান দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে বললেন,
“তুই কি কোনো কথা লুকাচ্ছিস আমার থেকে?”
“আমি কী লুকাব?”
“তোর আপা কাকে পছন্দ করে?”
“তা আমি কী করে জানব? আমি তো শুধু সন্দেহ প্রকাশ করলাম। তুমি আমার কথা শোনো মা, আমি ভালো কথাই বলছি। ওই লোকদের আসতে বারণ করে দাও। আপা কোন ছেলেকে পছন্দ করে তার খোঁজ নিয়ে আমি তোমাকে জানাব। তারপর বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামিয়ো, কাজে লাগবে। যা কোনো কাজে আসবে না, তার পেছনে টাকা খুইয়ে কোনো লাভ নেই।”
সাজেদা বেগম রাগত স্বরে বললেন,
“ঘুরেফিরে এই কথা বলতেই আসিস? এই, তুই তোর রুমে যা। আমাকে আর কিছু বুঝাতে আসবি না। সেদিনের সেই বাচ্চা, তারা আসে আমাকে বুঝাতে। খুব বুঝদার হয়ে গেছে একেকজন।”
আরও একবার সাজেদা বেগমের বকা শুনতে হলো মৃদুলাকে। ঘরে গিমে মৃদুলা বিরক্ত মুখে বলল,
“মায়ের মাথায় আসলেই কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি নেই।”
মৃত্তিকা বলল,
“তোর মাথায় তো বুদ্ধির পাহাড়। তুই কেন কিছু করতে পারছিস না?”
“তোমার বড়ো আপা নিজেই এখন চুপ করে বসে আছে, দেখছো না?”
“কী আর করবে? মায়ের সাথে তো সারাদিন কম তর্ক করল না। এই রাত-বিরাতেও তর্ক করবে?”
“সে-ই, সে বিয়েও করবে না, মায়ের সাথেও পারবে না।”
“আরে ধুর! এসব আর নতুন কী? শেষমেশ গিয়ে তো আপার অসম্মতিতেই বিয়ে আটকে যাবে। তাকে কি মা জোর করে বিয়ে দিতে পারবে?”
“মা এবার কী ত্যাড়ামি করছে দেখছো না? শেষমেশ গিয়ে আবার কী না কী গণ্ডগোল বাঁধিয়ে বসে, তা কে জানে?”
“কী জানি! এদের ঝামেলা আমার মাথায় ধরে না।”
মৃদুলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বুদ্ধিমতী হয়ে-ও বিপদে আছি।”


সকাল-সকাল সাজেদা বেগমের মেজাজ বিগড়ে আছে। আজ বিকালে পাত্রপক্ষের আসার কথা ছিল। অথচ সকালবেলাই খবর এল তারা আসবে না। মৃন্ময়ীকে তারা তাদের ছেলের বউ বানাতে চান না। কারণ হিসেবে জানালেন মৃন্ময়ীর না কি কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। তারা বিয়ে করার চিন্তা-ভাবনাও করেছে। খুব শীঘ্রই পরিবারকে জানিয়ে তারা বিয়ে করবে। এ কথা না কি মৃন্ময়ীর প্রেমিক নিজে তাদের কল করে জানিয়েছে। মৃন্ময়ীর জন্য তাদের অযথা সময় নষ্ট করতে নিষেধ করেছে। খবর শুনে সাজেদা বেগম যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মৃন্ময়ীকে এ কথা জিজ্ঞেস করতেই সে অস্বীকার করল। সাজেদা বেগম নিজেও বিশ্বাস করেন মৃন্ময়ীর কোনো ছেলের সাথেই সম্পর্ক নেই। তাহলে এমন কথা বলল কে? অপরিচিত ছেলেটাকে না চিনলেও সে রাগে, দুঃখে সকাল থেকে ছেলেটাকে বকেই চলেছেন। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে মৃন্ময়ী নিজেও ভীষণ অবাক হয়েছে। যদিও পাত্রপক্ষের আগমনে বাঁধা পড়ায় মনে-মনে সে খুব স্বস্তি পাচ্ছে। কিন্তু মনের ভেতর প্রশ্ন রয়ে গেল কে এমনটা করল। যদিও এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে জটিল নয়। পৃথিবীতে একজন মানুষই আছে যে তার জন্য এমন অদ্ভুত কাণ্ড-ও ঘটাতে পারে। তখনই সে ফোন বের করে প্রভাতকে ম্যাসেজ করল,
“আজ বিকেলে যে পাত্রপক্ষ আসার কথা ছিল, তারা আসবে না জানিয়েছে।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রভাতের উত্তর এল,
“গুড নিউজ।”
“কেন আসবে না জানতে চাইবে না?”
“তা জেনে আমার কী হবে? আপদ বিদায় হয়েছে, এতেই আমি খুশি।”
তবু মৃন্ময়ী লিখল,
“আমার কোন প্রেমিক না কি তাদের কল করে আসতে বারণ করে দিয়েছে। বলেছে তার সাথে আমার সম্পর্ক আছে। কদিন পর আমরা বিয়ে-ও করব।”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“তোমার তো বিরাট উপকার হলো। তুমি খুশি হওনি।”
“হয়েছি, এসব আটকাতেই তো চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কোত্থেকে আমার এই আগন্তুক প্রেমিক দেখা দিলো, তা-ই তো বুঝতে পারছি না।”
“না বুঝলে নেই। এত বুঝে কী করবে? সমস্যার সমাধান হয়েছে, ব্যস, এবার খুশি থাকো।”
“তুমি আমার আগন্তুক প্রেমিকের কথা শুনে অবাক হলে না যে?”
“অবাক হওয়ার কী আছে?”
“এমনভাবে বলছো মনে হচ্ছে সে তোমার অতি পরিচিত কেউ।”
“কী যে বলো! কে না কে মজা করেছে। আমি চিনব কীভাবে?”
“তুমি চেনো না?”
“না।”
“তুমি নিজেকেই নিজে চেনো না? কী আশ্চর্য!”
“আমি তো তোমার আগন্তুক প্রেমিক নই, প্রকাশ্য প্রেমিক। তোমার হবু জামাই।”
“চালাকি কম করো। আমি খুব ভালোভাবেই জানি এই কাজ তুমি ছাড়া আর কেউ করেনি।”
“বাহ্! কী ভালো চিনো তুমি আমাকে! এরপরও বলবে তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”
“কথা ঘুরাবে না।”
“ঘুরাচ্ছি না, বলো কী জানতে চাও।”
“তোমাকে তো আমি তাদের পরিচয় দেইনি। তাহলে তুমি তাদের খুঁজে বের করলে কীভাবে? ফোন নাম্বার পেলে কোথায়?”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“এসব কোনো বিশাল ব্যাপার নয়। তোমার জন্য আমি তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর পরিচয়-ও খুঁজে বের করতে পারতাম।”
“চৌদ্দ গোষ্ঠীর কথা আমি জানতে চাইনি। যা জানতে চেয়েছি, তা বলো। নাম্বার পেয়েছ কার থেকে?”
“স্বপ্নে পেয়েছি। তোমার ওসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কাজ নেই। তুমি আমার বউ সাজার চিন্তা-ভাবনা করো।”

প্রভাতের হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্তায় মৃন্ময়ী বুঝল প্রভাত সত্যি কথা বলবে না। পাত্রপক্ষ আসার কথা তাদের ঘরের বাইরের মানুষ প্রভাত ছাড়া আর কেউই জানত না। তাহলে কি ঘরের কেউ প্রভাতকে সাহায্য করেছে? কে? মৃত্তিকা? হতেই পারে। মৃত্তিকা ওর প্রাক্তন স্বামীর সমস্যা-ও সমাধান করেছিল প্রভাতকে দিয়েই। তাহলে কি মৃন্ময়ীর অগোচরে এবার-ও সে সমাধান হিসেবে প্রভাতকেই বেছে নিয়েছে? জিজ্ঞেস করতে হবে। সে ছুটে গেল মৃত্তিকাকে জিজ্ঞেস করতে। অথচ জিজ্ঞেস করার পর মৃত্তিকা অবাক হয়ে বলল,
“আমি প্রভাত ভাইকে কোথায় পাব? তার সাথে তো আমার কোনো যোগাযোগ-ই নেই। আমি আরও মনে-মনে আফসোস করছিলাম তার সাথে যোগাযোগ নেই বলে।”
“সত্যিই তুই জানাসনি?”
“আরে না। তোর সঙ্গে মিথ্যা বলব কেন?”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“তাহলে কে?”
“তুই এসব নিয়ে এত চিন্তা করছিস কেন? তোর তো খুশি হওয়ার কথা। যে প্রভাত ভাইকে নাম্বার দিয়েছে, সে তোর কত বড়ো উপকার করেছে। আমার সাথে যোগাযোগ থাকলে তো আমি নিজেই তাকে জানিয়ে দিতাম।”

পরক্ষণেই মৃত্তিকা প্রশ্ন করল,
“এই আপা, মৃদুলা প্রভাত ভাইয়ের ব্যাপারে কতটুকু জানে?”
“ওকে তো আমি কখনও এসব নিয়ে কিছু বলিনি। কিন্তু ও যা চালাক! মাঝে-মাঝে কথাবার্তা শুনে মনে হয় ও সবই জানে। কীভাবে জানে তা আমি নিজেও জানি না। জিজ্ঞেস করলে শুধু হাসে, সত্যি কথা বলে না।”
মৃত্তিকা বলে উঠল,
“ওওও, তাহলে তুই ঘরে বিড়াল রেখে বাইরে খোঁজ করছিস কী করতে? তোর ঘরের বিড়াল-ই ইঁদুর খেয়ে ঘাপটি মে’রে বসে আছে, দেখ গিয়ে।”
“তুই কি মৃদুলাকে সন্দেহ করছিস?”
“তা নয়তো কী? ওই মেয়ের পেটে-পেটে যে কত বুদ্ধি, তা তুই ধরতে পারিসনি। গতকাল তোর থেকেও ওর বেশি তাড়া ছিল, কীভাবে পাত্রপক্ষের আসা আটকাবে তা নিয়ে। মাকে বুঝাতে গিয়ে কয়েকবার বকা-ও খেয়ে এসেছিল। তারপর হয়তো কাউকে না জানিয়ে প্রভাত ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেছে।”
এতক্ষণে মৃন্ময়ীর মাথা থেকে চিন্তার প্যাঁচ খুলল। সে মাথা দুলিয়ে বলল,
“হুম, তোর ধারণাই সঠিক। তাহলে মৃদুলা-ই একাজ করেছে।”
মৃত্তিকা হেসে উঠে মজা করে বলল,
“এক কেজি মিষ্টি কিনে এনে ওকে জিজ্ঞেস করতে যা। তোর এত বড়ো উপকার করল।”

ওদিকে মৃদুলাকে চেপে ধরেছেন সাজেদা বেগম। গত রাতেই মৃদুলা মৃন্ময়ীর পছন্দের ছেলের কথা বলে সন্দেহ প্রকাশ করল, আর আজই মৃন্ময়ীর কোন অপরিচিত প্রেমিকের আবির্ভাব হলো। এসবের মানে কী? মৃদুলা নিশ্চয়ই কিছু জানে, কিন্তু তাকে বলছে না। আজ তিনি ওর পেট থেকে সত্যি কথা বের করেই ছাড়বেন। মায়ের চাপে পড়ে মৃদুলা বলল,
“মা, আমি কি তোমাকে আমার মনের সন্দেহ জানিয়ে-ও ভুল করলাম? আমি কীভাবে জানব আপা সত্যিই কাউকে পছন্দ করে কি না? তুমি আপাকেই জিজ্ঞেস করো।”
“তোর আপা তো অস্বীকার-ই করছে‌।”
“আপা অস্বীকার করলে তুমি আমাকে ধরলে কী মনে করে?”
“তুই গত রাতেই বললি আর সকাল হতেই কোন ছেলে বিয়েতে বাঁধা দিলো, বুঝা আমাকে? এটা কি সন্দেহের বিষয় না? আমার তো মনে হচ্ছে ওই ছেলেকে তুই চিনিস।”
“আমি কী করে চিনব? আজব! আপা কি ওর ব্যক্তিগত কথা আমাকে বলে?”
সাজেদা বেগম নিজের কথায় অটল থেকে বললেন,
“আমি নিশ্চিত তুই ওই ছেলেকে চিনিস। আমি তোকে ভালোয়-ভালোয় জিজ্ঞেস করছি মৃদুলা, সত্যি কথা বল। এটা তোর আপার জন্যই ভালো। নইলে বাইরের মানুষ বদনাম ছড়াতে এক সেকেন্ড-ও ভাববে না।”
“আমি তো বলেছি আমি খোঁজ নিয়ে তোমাকে জানাব। বলেছি যখন, অবশ্যই জানাব। আজই আমি খোঁজ লাগাব। আপাতত আমি কিছুই জানি না মা। আমি নিজে না জানলে তোমাকে কার কথা বলব? তুমি অযথা আমার সাথে এখন চেঁচামেচি কোরো না।”
তবু সাজেদা বেগম মুখ বন্ধ করতে পারলেন না। একা-একা বকেই চললেন,
“তোরা সবাই আমার সাথে চালাকি করছিস তো? কর, কর। এখন তো বুঝতে চাইছিস না। আমি ম’রে গেলে বুঝবি আমি তোদের ভালো চেয়েছি, না খারাপ চেয়েছি। যার যা ইচ্ছা কর। আমি আর কাউকে নিয়েই মাথা ঘামাব না।”

মৃন্ময়ী আর মৃত্তিকা নিশ্চিত যে প্রভাতকে পাত্রপক্ষের ফোন নাম্বার মৃদুলা-ই দিয়েছে। অথচ তারা যখন মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করল, মৃদুলা তখন ঝুপ করে আকাশ থেকে পড়ার ভান ধরে বলে উঠল,
“তোমরা আমাকে সন্দেহ করছো? সিরিয়াসলি? ওই অপরিচিত ছেলে যে প্রভাত ভাই, তা-ই তো আমি মাত্র তোমাদের থেকে জানলাম। আচ্ছা আপা, প্রভাত ভাই জানল কী করে আজ তোমাকে দেখতে আসবে? এ খবর তো আমরা ছাড়া কেউ জানত না।”
মৃত্তিকা বলল,
“কথা ঘুরাবি না। সত্যি কথা স্বীকার করে নে। আমরা জানি তুই ছাড়া কেউ একাজ করেনি।”
মৃদুলা বলল,
“কী যে বলো আপু! আমার জীবনে তিনটা স্বপ্ন আছে। তৃতীয়টা হলো জামাইয়ের কাঁধে চড়ে সুইজারল্যান্ড ঘুরতে যাওয়া, দ্বিতীয়টা হলো গ্রাজুয়েশন শেষ করে ভালো একটা চাকরি করা, আর প্রথমটা হলো আপার বিয়ে খাওয়া। ভাবতে পারছো? আপার বিয়ে খাওয়া আমার প্রথম স্বপ্ন। আর সেই আমি কি না আপার বিয়ে ভাঙার কাজে সাহায্য করব? আমি কি পাগল? আমি আরও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কবে আমি আপার বিয়ে খাব, আর কবে আমার জীবনের প্রথম স্বপ্ন পূরণ হবে।”
মৃত্তিকা মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাদ দে আপা। বোমা মে’রেও তুই এই নাটকবাজের পেট থেকে সত্যি কথা বের করতে পারবি না। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য ওকে বরং পুরস্কৃত করিস।”
মৃন্ময়ী মৃদুলাকে শুধাল,
“সেরা অভিনেত্রী পুরষ্কার হিসেবে কী চায়?”
মৃদুলা মন খারাপের ভান ধরে বলল,
“তোমরা এভাবে আমাকে অপমান করছো আপা? আমার একটা কথা-ও তোমরা বিশ্বাস করছো না। এই তোমাদের ছোটো বোনের প্রতি ভালোবাসা?”
মৃত্তিকা বলল,
“আমরা সত্যবাদীকে বিশ্বাস করি, মিথ্যাবাদীকে না।”
“ঠিক আছে। আমাকে অবিশ্বাস করছো তো? করো। একদিন বুঝবে আমি কেমন বিশ্বাসী মানুষ। সেদিন বিশ্বাস করতে চাইলেও আমি তোমাদের কথা শুনব না।”
“কেন আপা? ততদিনে কি আপনার কান অকেজো হয়ে যাবে? ওওও, বুঝতে পেরেছি। সেইদিন আসতে-আসতে আপনি নিশ্চয়ই বুড়ি হয়ে যাবেন?”
মৃত্তিকার সাথে মৃন্ময়ী-ও হেসে ফেলল। মৃদুলা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলল,
“তোমাদের সাথে আমি আর কোনো কথাই বলব না। কেউ একদম আমাকে ডাকবে না আর। এখন থেকে আমি তোমাদের সাথে রেগে আছি।”
মৃত্তিকা আবারও মজা করে মৃন্ময়ীকে বলল,
“আপা, আমাদের বড়ো আপা তো রেগে আছেন। তার রাগ ভাঙানোর জন্য এক কেজি মিষ্টি ঘুষ নিয়ে আসিস কাল।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১০+১১

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে-ইলোরা জাহান ঊর্মি

১০.
মৃত্তিকা প্রথম মাসের বেতন হাতে পেয়ে মায়ের জন্য একটা নতুন শাড়ি কিনেছে। মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কী লাগবে। মৃদুলা তার থেকে এক জোড়া জুতা নিয়েছে। আর মৃন্ময়ী কিছু নিতে রাজি না হওয়ায় মৃত্তিকা নিজেই তার জন্য একটা থ্রি-পিস কিনে এনেছে। নিজেই আবার দরজির দোকান থেকে বানিয়ে-ও নিয়ে এসেছে। জামা এনে সে প্রথমে মৃদুলাকে দেখিয়েছে। মৃদুলা বলেছে ভালো হয়েছে। মৃদুলা কী ভেবে তখন মৃত্তিকাকে বলল,
“আপু, তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
মৃত্তিকা বলল,
“বল।”
“কথা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তোমাকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।”
“আচ্ছা শুনছি, বল তুই।”
“বড়ো আপার বিষয়ে।”
“আপার বিষয়ে? কী কথা?”
“তুমি কি প্রভাত ভাইয়ের বিষয়ে জানো?”
প্রভাতের প্রসঙ্গ উঠতেই মৃত্তিকা বলে উঠল,
“ওই বদ লোকটা? জানিস সেদিন কী হয়েছে? আমি আর আপা যে ফুসকা খেতে গেলাম, ওই লোক-ও আমাদের সঙ্গে বসে ফুসকা খেয়েছে। আমাদের না বলে বিল-ও দিয়ে দিয়েছে। আমি তো জানতামই না ওই লোক এখনও আপার পেছনে ঘুরে বেড়ায়। সেদিন আমি এত অবাক হয়েছি, কী বলব! মানে আপা এতদিন যাবত একে কীভাবে সহ্য করেছে, কেন সহ্য করেছে আমার মাথায় ধরে না।”
মৃদুলা মৃদু হেসে বলল,
“এটাই তো আসল কথা আপু। আপা কেন প্রভাত ভাইকে এতদিন ধরে সহ্য করছে?”
মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তুই-ও জানিস উনি আপাকে বিরক্ত করে?”
“জানি। তবে তোমার জানায় ভুল আছে। উনি আপাকে বিরক্ত করে না, ভালোবাসে।”
“কী? ওই ফালতু ছেলে আবার ভালোবাসতে জানে? এতদিন ধরে আপাকে নরম পেয়ে বিরক্ত করছে, তুই তাকে ভালোবাসা বলছিস?”
“তোমার মতে প্রভাত ভাই আপাকে বিরক্ত করে?”
মৃত্তিকা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“অবশ্যই।”
“তুমি কীভাবে বুঝলে বিরক্ত করে?”
“আপা তাকে পছন্দ করে না, তবু সে আপার পেছনে ঘোরে জানিস না?”
“এটা তো সঠিক নয়। আচ্ছা তুমি আমাকে বলো, তুমি যতটুকু সময় প্রভাত ভাইকে আপার আশপাশে দেখেছ, ততটুকু সময় প্রভাত ভাই আপাকে কোনো বাজে কথা বলেছে?”
মৃত্তিকা ভাবুক মুখে মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক বাজে কথা না, তবে আমাকে শ্যালিকা বলে খেপিয়েছে।”
“সে তো দুষ্টুমি করেছে। আচ্ছা, আপার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করতে দেখেছ?”
“না।”
“সে কি দেখতে বখাটেদের মতো?”
“না, থাকে তো ভদ্রলোকের বেশ ধরে।”
“আপাকে কি তার ওপর খুব বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখেছ?”
“না।”
“তাহলে তুমি কীভাবে বুঝলে যে প্রভাত ভাই আপাকে বিরক্ত করে?”
মৃত্তিকা নিজের কথায় অনড় থেকে বলল,
“বিরক্ত না করলে এই লোক আপার পেছনে কেন ঘোরে? আপা কি তাকে পছন্দ করে?”
“এটাই কথা। আপা তাকে পছন্দ করে।”
মৃত্তিকা চোয়াল ঝুলিয়ে বলে উঠল,
“কী! আপা ওই লোককে পছন্দ করে? তুই কি পাগল হয়েছিস?”
“উঁহু, আমি ঠিকই আছি। আমি শুধু তোমার চোখের সামনে থেকে ভুলের পর্দাটা সরাতে চাইছি।”
মৃত্তিকা সন্দিহান কন্ঠে বলল,
“তুই কি প্রভাত ভাইয়ের হয়ে কথা বলছিস?”
মৃদুলা হেসে বলল,
“শোনো আপু, কোনো বখাটে ছেলেরা আমাদের আপার পেছনে ঘোরার মতো ধৈর্য রাখে না, এটা অন্তত আমি বিশ্বাস করি। আপা তো কাউকে পাত্তা-ই দেয় না, আর না কারোর প্রস্তাবে সাড়া দেয়, তাহলে কোন ছেলে জেনেশুনে তার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করবে? কেউই করবে না। কারণ সবাই জানে আপার কাছে আশা রেখে কোনো লাভ নেই। কিন্তু প্রভাত ভাই আলাদা। সে আপার বিষয়ে সবকিছু জানে, আপাকে খুব ভালোভাবে চেনে, তবু সে আপাকে ছাড়তে রাজি না। আপা কিন্তু তাকে কোনোরকম আশা দেয়নি, তবু সে আপার জন্য অপেক্ষা করে আছে। অদৃশ্য আশা নিয়ে সে দিনের পর দিন আপাকে ভালোবাসা নিবেদন করছে। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে একদিন আপা তাকে গ্রহণ করবে।”
মৃত্তিকা বলল,
“তার জন্য কি মেয়ের অভাব পড়েছে? আপার পেছনেই কেন পড়ে আছে?”
“সেটাই তো, তার জন্য মেয়ের অভাব নেই। সে চাইলেই খুব ভালো পরিবারের সুন্দরী কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু সে তা করছে না। করবে কী করে? তার মন তো পড়ে আছে আপার কাছে। তুমি তার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে না ভাবলে কখনোই বুঝতে পারবে না আপাকে সে কতটা ভালোবাসে।”
মৃত্তিকার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল। সে ভাবুক মুখে বলল,
“সত্যিই কি তাই?”
“হুম, একদম তাই। প্রভাত ভাই আপাকে খুব ভালোবাসে। সে আপাকে বিরক্ত করে না, ছায়ার মতো আপার পাশে থাকার চেষ্টা করে। আপার মন পাওয়ার জন্য রোজ চেষ্টা চালিয়ে যায়।”
“কিন্তু আপা?”
“আপা? আপার বিষয়টা ধরা খুব কঠিন কিছু না। তুমি একটু ভাবলেই বুঝে যাবে।”
মৃত্তিকা একটু চিন্তা করে বলল,
“আপা কি বিয়ের ভয়ে প্রভাত ভাইকে এড়িয়ে চলছে?”
“একদম ঠিক ধরেছ। আপা ভয় পায়। আপার ভয় আমাদের নিয়ে, এই সংসার নিয়ে। আমাদের এই সংসারের একমাত্র সম্বল সে। সে চলে গেলে এই সংসারের কী হবে, শুধুমাত্র এই চিন্তা করে আপা নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিচ্ছে। আমাদের জন্য সে তার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে পারছে না। প্রভাত ভাইকে সে অপছন্দ করে না। বরং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সে ঠিকই এতদিনে প্রভাত ভাইকে নিয়ে চিন্তা করত। তা-ও সে করতে পারছে না। সংসারের বাধ্যবাধকতা তাকে তার নিজস্ব জীবন থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে,” মৃত্তিকার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
“কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আপাকে তো নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। তার এখন নিজের সংসার সাজানোর সময়। আমাদের জন্য সে আজীবন এমন থাকতে পারবে না।”
“এটাই তাকে বুঝাতে হবে। তাকে তার জীবন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এবার অন্তত তার নিজস্ব একটা সংসার প্রয়োজন। নয়তো আজীবন আমরা আপার কাছে দোষী থাকব। আপা হয়তো মুখে কিছু বলে না, কিন্তু একটা নিজস্ব মানুষ, নিজস্ব সংসারের শখ তো তার-ও আছে।”
মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“ঠিক বলেছিস, আপাকে এই বিষয়ে বুঝানো দরকার। এখন তো আমি চাকরি করছি, তুই-ও টুকটাক নিজের খরচ চালাতে পারিস। এবার আপাকে আমাদের মুক্তি দেওয়া উচিত।”
“তুমি একটু আপার সাথে কথা বলো না আপু। আমি ছোটো মানুষ, আপার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি হয়। আপা-ও আমার সাথে মনখুলে কিছু বলবে না। তুমি বললে আপার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারবে।”
“ঠিক আছে, আমি কথা বলে দেখব। কিন্তু তোর মাথায় এত খবর এল কোত্থেকে?”
মৃদুলা মুচকি হেসে বলল,
“আমার স্পাই আছে।”
“কে?”
“বিবিসি নিউজের হেড।”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলল,
“ফাজিল।”


মৃত্তিকার থেকে নতুন জামা পেয়ে মৃন্ময়ী ভীষণ খুশি হয়েছে। তার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছে সে মৃত্তিকার পরিবর্তন দেখে। মৃত্তিকা সত্যিই বদলে গেছে। আগের মৃত্তিকা আর বর্তমান মৃত্তিকার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখনকার মৃত্তিকার চিন্তাধারা অন্যরকম। একদম যেমনটা মৃন্ময়ী সবসময় দেখতে চেয়েছিল। অবশেষে মৃন্ময়ীর একটা চিন্তা দূর হলো। যদিও তার পেছনে টাকা খরচ করার জন্য সে মৃত্তিকার ওপর কপট রাগ-ও দেখিয়েছে। বলেছে তার জন্য আর কিছু না কিনতে। মৃত্তিকার এখন নিজস্ব খরচ আছে। বেশি-বেশি পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন তার। মৃত্তিকা হেসে বলল,
“তুই আমার পেছনে যা খরচ করেছিস, তা তো আমি তোকে ফেরত দিতে পারব না। তোর কাছে না হয় আজীবন ঋণী থেকে যাব। আমার এটুকু খরচ যদি তোর অনেক মনে হয় তাহলে ভবিষ্যতে তুই আমার বাচ্চাকে দিয়ে শোধ করে দিস।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তোর বাচ্চাকে দিয়ে শোধ করতে যাব কেন? তোর বাচ্চা কি আমার পর হবে? আমি না দিলে ওকে কে দিবে? ও আসুক, তারপর দেখবি মৃদুলা-ও ওকে তোর চেয়ে বেশি দিবে। কত বছর পর এই পরিবারে নতুন সদস্য আসবে! একটা ছোট্ট বাচ্চা আমাদের হাতে বড়ো হবে। ভাবতেই আমার আনন্দ হচ্ছে। মৃদুলার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।”
মৃন্ময়ীর চোখেমুখে আনন্দ। মৃত্তিকা কেবল হেসেই চলল। সে মনেপ্রাণে শুধু চায় তার সন্তান যেন সবার ভালোবাসায় বেড়ে উঠতে পারে। আপাকে দিয়ে তার সেই বিশ্বাস আছে। নিজের পরিবার না পাক, তার সন্তান মাকে পাবে, মায়ের পরিবার পাবে। মায়ের পরিবার-ই হয়ে উঠবে তার পরিবার। কথায়-কথায় মৃত্তিকা বলল,
“আপা, তোকে একটা প্রশ্ন করব?”
“বল।”
“তোর নিজস্ব একটা সংসারের সাধ হয় না?”
মৃন্ময়ী খানিক থমকাল। বলল,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস?”
“প্রয়োজন আছে বলেই করছি। বল না, তোর কি সংসারের সাধ হয় না? এই দায়িত্বের জীবন থেকে বেরিয়ে নিজের একটা মানুষকে আঁকড়ে নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করে না?”
মৃন্ময়ী বলল,
“উত্তরটা তো তোর প্রশ্নেই আছে।”
“কী?”
“দায়িত্বের জীবন। দায়িত্বের জীবন থেকে বেরোনোর পথ কোথায়?”
“পথ কি তুই কোনোদিন খুঁজেছিস?”
“খুঁজে কী হবে? যা সম্ভব না, তার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করে তো লাভ নেই।”
“আর তোর নিজের সাধ-আহ্লাদ? জীবন নিয়ে কি তুই একটুও ভাববি না?”
“আমার অত সময় নেই। বাদ দে তো এসব কথা।”
মৃত্তিকা প্রসঙ্গ বাদ দিতে নারাজ। সে পুনরায় বলল,
“তোর এখন নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত আপা। অনেক হয়েছে দায়িত্ব পালন। দায়িত্বের ভারে তুই নিজের ভবিষ্যত অন্ধকার করতে পারিস না।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তা তুই আমার ভবিষ্যত আলোকিত করতে বলছিস কীভাবে?”
“তুই এবার বিয়েটা করে ফেল আপা। তোর একটা সাজানো সংসার হোক।”
“তারপর?”
“তারপর আবার কী? এই সংসারের অজুহাত দেখাবি তো? এই সংসারের জন্য তুই অনেক ত্যাগ করেছিস আপা। অনেক হয়েছে, আর না। আমরা এখন আর ছোটো নেই।”
“আচ্ছা? কতটা বড়ো হয়েছিস তোরা শুনি?”
“যথেষ্ট বড়ো হয়েছি। হয়তো তোর মতো করে সংসার সামলানোর মতো বড়ো হইনি, কিন্তু চেষ্টা করার মতো বড়ো তো হয়েছি। তোর অনুপস্থিতিতে আমি আর মৃদুলা আছি আপা। আমরা দুজনেই এখন উপার্জনক্ষম। দুজন মিলে ঠিক সবটা সামলে নিব। তুই প্লিজ এবার ছুটি নে।”
“তুই আমাকে ছুটি দিচ্ছিস মৃত্তিকা? একটা সংসার সামলানো তোর ভাবনার মতো এত সহজ না রে। নিজের কাঁধে দায়িত্ব পড়লে তা টের পাবি। মৃদুলার এখনও নিজের সম্পূর্ণ খরচ সামলানোর সামর্থ হয়নি। এখনই ও পড়াশোনার খরচ সামলালে হাত খরচে টানাটানি পড়ে যায়। আর সামনে তো ওর পড়াশোনার খরচ আরও বাড়বে। টিউশনের টাকায় ও কতটুকু সামলাবে? তোর এখন নিজের জন্য-ই কত খরচের প্রয়োজন। সামনে তোর বাচ্চার দায়িত্ব-ও নিতে হবে। তুই কী করে সংসারের খরচ সামলাবি? তারপর মায়ের ঔষধের খরচ? তা কী করে সামলাবি?”
মৃত্তিকা ক্ষণকাল চুপ থাকার পর অন্ধকার মুখে বলল,
“তুই তো আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছিস আপা।”
মৃন্ময়ী দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, আমি তোকে প্রকৃত সত্যিটা বুঝাতে চাইছি। তোরা আমাকে ছুটি দিতে চাইলেও এই সংসার আমায় ছুটি দিবে না। দায়িত্ব থেকে আমার মুক্তি নেই।”
“কিন্তু তোর ভবিষ্যত জীবনের কী হবে আপা?” ছলছল চোখে চেয়ে বলল মৃত্তিকা।
“আমার ভবিষ্যত জীবন? জানি না রে। আমার ভবিষ্যত আমি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কপালে যা আছে হবে।”
“কী হবে? কীভাবে হবে? তুই কি এই সংসারের দায়িত্ব পালন করেই জীবন কা’টিয়ে দিবি?”
“কপালে যদি তা-ই লেখা থাকে, তবে দিবো। বাবা তার এই সংসার আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছে রে বোন। আমি তার সেই সংসারের হাল মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার মতো স্বার্থপর হতে পারব না। বিশ্বাস কর, শত কষ্টের মাঝেও আমি তোদের নিয়ে অনেক ভালো আছি। কিন্তু তোদের ছেড়ে গিয়ে আমি কোনোদিন-ও ভালো থাকতে পারব না। অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাবে। যে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য আমি নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করে এসেছি, সেই সংসার মাঝনদীতে ডুবিয়ে দিয়ে আমি কীভাবে নিজের জন্য সুখের সংসার সাজাব বলতে পারিস? এমন দুঃসাহস তো আমার নেই রে বোন।”
মৃত্তিকা কেঁদে ফেলল। কাঁদতে-কাঁদতে বলল,
“সব আমার দোষ। আমার জন্য তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি যদি তোর মতো হতাম তাহলে আজ আমাদের এমন দুর্দিন দেখতে হত না। আমাকে তুই মাফ করে দিস আপা।”
মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে বাঁধা দিতে চাইল। মৃত্তিকা দাঁড়াল-ই না। দ্রুত তার সামনে থেকে সরে গেল। দরজার বাইরে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে ছিল মৃদুলা। মৃত্তিকা বেরোতেই সে বলে উঠল,
“প্রভাত ভাইয়ের কথা বললে না কেন?”
মৃত্তিকা নাক টেনে বলল,
“আপাকে এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই রে। আপা আমাদের কথা শুনবে না।”
“আপা তো তোমাকেই উলটো বুঝিয়ে দিলো।”
“আমাদের জীবনটা এমন কেন হলো রে মৃদুলা? আমরা কেউ কি একটু সুখের ভাগীদার না?”
মৃদুলা সশব্দে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“জানি না। তুমি কেঁদো না তো। কেঁদে কোনো ফায়দা নেই। ঘরে যাও।”


প্রভাতকে দেখে আজ মৃন্ময়ীর মনে-মনে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। গতকালের ঘটনা আর মৃত্তিকার কথা মিলিয়ে তার মনটাই বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। প্রভাত তার মুখোভাব লক্ষ্য করে শুধাল,
“মুখটা অমন করে রেখেছ কেন? কী হয়েছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“কিছু না।”
“পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা?”
মৃন্ময়ী না-বোধক মাথা নাড়ল। প্রভাত বলল,
“তাহলে?”
“বললাম তো কিছু না।”
“তোমার মুখ তো বলছে কিছু হয়েছে।”
“উঁহু, আমি ঠিক আছি।”
প্রভাত পালটা জবাবে বলল,
“তুমি ঠিক নেই। তোমার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারছি।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করে বসল,
“কেন বুঝতে পারো?”
“ভালোবাসি তাই।”
“তোমাকে এত বুঝতে হবে না।”
প্রভাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আর কত নিষেধাজ্ঞা জারি করবে?”
“জারি করেই বা লাভ কী হচ্ছে? তুমি তো এক ঘাড়ত্যাড়া।”
“সেটাই। লাভ নেই জেনেও এই এক কথা হাজারবার বলার কী দরকার?”
“তুমিও তো এক কথা লক্ষ বার বলো। তোমার কী দরকার?”
“আমার তো দরকার আছেই। আমি লক্ষ বার না বললে তোমাকে পাব কীভাবে?”

মৃন্ময়ী প্রত্যুত্তর করল না। চোখ জোড়া এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,
“তোমার শরীর কেমন?”
“ভালো। ভেবেছিলাম জ্বর-টর আসবে, কিন্তু আসেনি। অসুখ-ও বুঝে গেছে আমার সেবা করার মানুষ নেই।”
হাসল প্রভাত। মৃন্ময়ী বলল,
“তোমার মায়ের সাথে তোমার সম্পর্ক এতই খারাপ?”
“আমার কোনো মা নেই।”
মৃন্ময়ী দেখল প্রভাতের মুখের রং বদলে গেছে। তাই ওই প্রসঙ্গ আর সামনে টানল না। এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটল।‌ মৃন্ময়ী হঠাৎ ডাকল,
“প্রভাত?”
“হুঁ?” সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া দিলো প্রভাত।
“এতদিনে যদি আমি হ্যাঁ বলে দিতাম, তাহলে তুমি আমার জন্য কী করতে?”
“তুমি যা চাইতে তা-ই।”
“যেমন?”
“তোমার পরিবারের কথা বুঝাতে চাইছো তো? আমি জানি তুমি তোমার পরিবার ছাড়া আর কিছু চাইতে না। তাতে আমি কোনোদিনই আপত্তি করতাম না। তোমার পরিবারকে তুমি সাপোর্ট দিবে, সব জেনেবুঝে তাতে বাঁধা দেওয়ার মতো অত খারাপ মানুষ-ও আমি নই। আমি তো সবসময় বলি, তোমাকে পেয়ে গেলে আমি তোমাকে সাপোর্ট দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করব। তুমি যাতে খুশি থাকবে, ভালো থাকবে, আমি তা-ই করব।”
“কিন্তু আমি তো তোমাকে এমন সুযোগ দিয়ে খুশি করতে পারব না।”
প্রভাত মলিন হাসল। বলল,
“আমি অপেক্ষা করব।”
“আর কতদিন প্রভাত?”
“যতদিন না তুমি আমার নামে কবুল পড়ছো।”
“ভালোবাসায় জেদ চলে না।”
“উঁহু, ভালোবাসায় জেদ নয়, জোর চলে না। তাই তো আমি তোমাকে জোর করছি না। তবে জেদ আমি ছাড়ব না। ভালোবাসায় এটুকু জেদ না থাকলে ভালোবাসা জয় করব কীভাবে?”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“তোমার সঙ্গে তর্ক করাই আমার ভুল।”
প্রভাত দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“চিন্তা কোরো না। এখন তর্ক করতে হচ্ছে আমার ভালোবাসা জয়ের প্রয়োজনে। বিয়ের পর তর্ক করব না। তখন তোমার বিজয়-ই আমার বিজয়।”
মৃন্ময়ী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“দুঃস্বপ্ন দেখো।”
প্রভাত বলল,
“দুঃস্বপ্নে হলেও তো আমাকে বিয়ে করে নিতে পারো।”
একটা ধারালো দীর্ঘশ্বাস মৃন্ময়ী অতি সন্তর্পণে চেপে নিল। দুঃস্বপ্নে বিয়ে? কেন? এটা তো বাস্তব-ও হতে পারত। বাস্তবতায় রূপ নেওয়া স্বপ্ন দেখা-ও কি তার জন্য নিষিদ্ধ? তার ভাগ্যটা কি কোনোদিন তার অনুকূলে আসবে না?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১১.
সময় যেন কে’টে যায় চোখের পলকে। মৃত্তিকার প্রেগন্যান্সির তখন ছয় মাস চলছে। এরমধ্যে একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে সে তার প্রাক্তন স্বামীর সামনে পড়ে গেল। এতদিন পর হঠাৎ এভাবে দেখা হওয়ায় মৃত্তিকা একটু ভড়কে গেলেও সে নিজেকে সামলে নিল। না দেখার ভান করে চলে যাওয়া ধরল। কিন্তু শফিক তার পথরোধ করে দাঁড়ানোর ফলে সে দাঁড়াতে বাধ্য হলো। হুট করে এভাবে যেচে এসে সামনে দাঁড়ানোর মানে কী? মুখোভাব কঠিন করে মৃত্তিকা বলে উঠল,
“কী সমস্যা?”
শফিক হাসিমুখে বলল,
“অনেকদিন পর দেখা হলো। কেমন আছো মৃত্তিকা?”
লোকটার হাসি দেখে মৃত্তিকার মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। সে শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমি কেমন আছি তা দিয়ে আপনার কী প্রয়োজন?”
“কী যে বলো! আমি ছাড়া আর কার প্রয়োজন হবে? আমার-ই তো প্রয়োজন।”
“আমার কোনো প্রয়োজন নেই আপনার কাছে, সরুন।”
মৃত্তিকা পাশ কেটে চলে যেতে চাইল। শফিক যেতে দিলো না। আবারও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে উঠল,
“আহা! এত তাড়া কিসের? একটু কথা শুনে যাও না।”
মৃত্তিকা বলল,
“আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা শোনার মতো সম্পর্ক আপনার সাথে আমার আর নেই।”
“জানি, জানি। সম্পর্ক তো ভেঙেই গেছে। তখন তো আর জানতাম না সম্পর্ক ভাঙার পরও আবার নতুন কোনো সম্পর্ক জন্ম নিবে।”
মৃত্তিকার বুকের ভেতর হঠাৎ কামড় দিয়ে উঠল। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ করতে লাগল। তার বিস্ময় দেখে শফিক আবারও হাসল। মৃত্তিকার সন্দেহ জাগল শফিক খবরটা জেনে গেছে কি না। মৃত্তিকার পরনের বোরখা যথেষ্ঠ ঢিলেঢালা। কেউ দেখলে বুঝতে পারে না সে অন্তঃসত্ত্বা। তবু সে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“পথ ছাড়ুন, আমার দেরী হচ্ছে।”
শফিক বলল,
“দাঁড়াও, দাঁড়াও। এখনও তো আমার প্রশ্নের উত্তর-ই পেলাম না।”
“কী প্রশ্ন?”
“আমার বাচ্চার কথা তুমি আমাকে জানাওনি কেন?”

ব্যস! মৃত্তিকা যা সন্দেহ করেছিল, তা-ই হলো। খনিকের জন্য মৃত্তিকা একটু ভড়কে গেলেও নিজেকে সে সামলে নিল। উত্তরে বলল,
“কিসের বাচ্চা?”
“কিসের বাচ্চা? পেটে যে বাচ্চা নিয়ে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছ, সেই বাচ্চা। আমার বাচ্চা।”
“আমি আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসিনি। বলুন আপনারা বের করে দিয়েছেন। আর আপনাকে কে বলল আমি আপনার বাচ্চা নিয়ে এসেছি?”
“তুমি কি ভেবেছিলে, বাচ্চার খবর গোপন রাখলে আমি জানতে পারব না? হুহু, তুমি ডালে-ডালে চললে আমি চলি পাতায়-পাতায়। তোমার সব খবরই আমার জানা।”
মৃত্তিকা ধিক্কার জানিয়ে বলল,
“অপ্রোজনীয় ভেবে যাকে গলাধাক্কা দিয়ে জীবন থেকে বের করে দিয়েছেন, তার খবর রাখেন আপনি কোন প্রয়োজনে?”
“খবর না রাখলে কি এমন খুশির খবর জানতে পারতাম?”
“আপনার খুশি হওয়ার কারণ কী?”
“আমার সন্তান আসবে, আমি খুশি হব না?”
“না। এই বাচ্চা আপনার না। বর্তমানে ওর মায়ের কোনো স্বামী নেই, তাই ওর-ও কোনো বাবা নেই। মা ছাড়া ওর কেউ নেই।”
শফিক চোখ বড়ো করে বলল,
“আমাকে না জানিয়ে আমার বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, আর বলছিস বাচ্চা আমার না? তোর এত বড়ো সাহস হয় কী করে? কে দিয়েছে তোকে এমন সাহস?”
মৃত্তিকা শক্ত গলায় বলল,
“রাস্তার মাঝে একদম চেঁচামেচি করবেন না। বাচ্চা নিয়ে আপনার এত মাথাব্যথা কিসের? আমার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই, আমার বাচ্চার সাথেও নেই।”
“এই খবরদার, বাচ্চা নিয়ে কোনো বড়োগলা করবি না। এই বাচ্চা আমার। ভালোয়-ভালোয় বাচ্চা আমাকে দিয়ে দিবি।”
কথাটা শুনেই মৃত্তিকা অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। কঠিন মুখে রাগত স্বরে বলল,
“আমার বাচ্চা যাওয়ার সাহস আপনাকে কে দিয়েছে? বিয়ে করেছেন, নতুন বউ নিয়ে সংসার বেঁধেছেন, তার কাছে যান না। আমার বাচ্চার কী প্রয়োজন আপনার?”

এরপর শফিক খ্যাপা ষাঁড়ের মতো যা উত্তর দিলো, তাতে মৃত্তিকার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল তার বর্তমান বউ সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। ডক্টর বলেছে সে কোনোদিনও মা হতে পারবে না। এ কারণেই শফিক এখন তার বাচ্চার পেছনে পড়েছে। মৃত্তিকা কটাক্ষ করে বলল,
“খুব শখ করে বিয়ে করেছিলেন না? এখন বিয়ের শখ মিটে গেছে? ভেবেছিলেন অন্যায় করে পার পেয়ে যাবেন? এবার দেখুন, এটা আপনার বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি। আল্লাহ্ আপনাকে যোগ্য শাস্তি দিয়েছেন।”
শফিক ধমকে উঠে বলল,
“চুপ থাক। ফালতু কথা বলবি না। তোর ফালতু আলাপ শুনতে আসিনি আমি।”
মৃত্তিকা আঙুল তুলে বলল,
“আপনিও আমাকে তুই-তুকারি করবেন না। আপনি আমার কাছে এখন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার সাথে গলাবাজি করার কোনোরকম অধিকার আপনার নেই।”
শফিক হঠাৎ মৃত্তিকার আঙুলটা মুচড়ে ধরল। মৃত্তিকা ব্যথায় ককিয়ে উঠলেও সে ছাড়ল না। চোখ বড়ো করে কড়া গলায় বলল,
“খুব বাড় বেড়েছে তোর, না? আমার সাথে একদম সাহস দেখাতে আসবি না। তোকে আমার থেকে ভালো আর কেউ চেনে না। বাচ্চা তুই আমাকে দিতে না চাইলেও আমি ঠিক নিয়ে নেব। তুই শুধু জন্ম দে।”
আঙুলের ব্যথায় মৃত্তিকার চোখে পানি চলে এসেছে। তবু সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“দুঃস্বপ্ন দেখুন। আমি মরে গেলেও আমার বাচ্চা আপনার মতো অমানুষের হাতে দিবো না। আঃ! আঙুল ছাড়ুন। আমি কিন্তু এখন লোকজন ডাকব।”
“ডাক, দেখি তোর কোন বাবা আসে।”

কাকতালীয়ভাবে জাহিদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিল। দূর থেকে মৃত্তিকাকে দেখে সে চিনতে পেরেছিল। মৃদুলার ফেসবুক পোস্টে তার আপাদের অনেকবার দেখেছে সে। ঘটনার অস্বাভাবিকতা বুঝতে পেরেই সে দৌড়ে এগিয়ে এল। একদল ছেলেপেলেকে আড্ডা দিতে দেখে বুদ্ধি করে সে তাদের-ও ডেকে নিয়ে এল। হঠাৎ করে একদল ছেলে এসে ঘিরে ধরে নানান প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ায় শফিক বেশ ঘাবড়ে গেল। শফিকের হাত থেকে ছাড় পেয়েই মৃত্তিকা ছেলেগুলোকে বলল শফিক তার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। ফলস্বরূপ শফিক ছেলেগুলোর কাছে বেশ ঝাড়ি খেল। মৃত্তিকার কাছে মাফ-ও চাইতে হলো তাকে। শফিক বিদায় হওয়ার পর ছেলেগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে মৃত্তিকা-ও স্কুলের দিকে হাঁটা দিলো। জাহিদ তাকে ডেকে রিকশা নিয়ে দিলো। মৃত্তিকা রিকশা নিতে চায়নি। জাহিদ তার বারণ শুনল না। রিকশা ঠিক করে দিয়ে ভাড়াটা-ও সে দিয়ে দিয়েছে। মৃত্তিকা ভীষণ কৃতজ্ঞতা বোধ করল। মৃত্তিকাকে বিদায় দিয়েই জাহিদ মৃদুলাকে কল করল। ঘটিত খবরটা মৃদুলার কানে তুলে দিতে সে দেরী করল না। মৃত্তিকা হয়তো বাসায় ফিরে কাউকে জানাবেই না। কিন্তু ব্যাপারটা তার পরিবারের জানা জরুরী মনে করল সে। যদিও মৃত্তিকা তাকে চেনে না। মৃদুলাকে খবর দিলেও সে বুঝতে পারবে না খবরটা কে দিয়েছে।
মৃদুলা এমন খবর পেয়েই সঙ্গে-সঙ্গে মৃন্ময়ীকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে। তবে মাকে জানায়নি। মৃন্ময়ী তখন প্রথম ক্লাসে ঢুকেছিল। খবরটা শুনেই তার মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ল। সে ভালো করেই জানে শফিক ছেলেটা মোটেও সুবিধার না। এ কারণেই ছেলেটার সাথে মৃত্তিকার সম্পর্কে সে আপত্তি জানিয়েছিল। অথচ সেই ছেলেটাই শেষমেশ মৃত্তিকার জীবনে আতঙ্ক ছড়াতে লাগল। চিন্তায় মৃন্ময়ী সারাদিন ঠিকঠাক ক্লাস-ও নিতে পারল না। মৃত্তিকাকে কল করে তার খবর নিয়েছে সে। তবু তার মনের মধ্যে শুধু ওই ভয়টাই ঘুরে বেড়িয়েছে। আজ স্কুল ছুটির পর সে নিজেই উলটো পথে গেল মৃত্তিকাকে এগিয়ে আনতে। বলা তো যায় না, ফেরার পথে যদি ছেলেটা ওকে আবার বিরক্ত করে? ওদিকে প্রভাত এসে তাকে খুঁজে পেল না। পথিমধ্যে মৃত্তিকা বোনকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। আজকের ঘটনার পর তাকে মা-বোন সবাই ফোন করেছিল। এদের যে কে এই খবর দিলো বুঝতেই পারছে না সে। তবে মৃন্ময়ীকে দেখে তার অনেকটা শান্তি লাগছে। ছুটির পর স্কুল থেকে বেরিয়ে তার বারবার মনে হচ্ছিল শফিক আবারও পথ আটকাবে। মৃন্ময়ীকে পেয়ে তার সাহস বেড়ে গেছে। সে মৃন্ময়ীকে জিজ্ঞেস করল কে তাকে খবর দিয়েছে। মৃন্ময়ী নিজেও উত্তর দিতে পারল না। কারণ মৃদুলা তাকে স্পষ্টভাবে বলেনি সে কোত্থেকে এই খবর পেয়েছিল। তবে একদিনের নিরাপত্তায় মৃত্তিকার রক্ষা মিলল না। এরপরও শফিক তাকে বারবার জ্বালাতন করেছে। স্কুলে যাওয়ার সময়েই সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। মৃত্তিকা প্রতিবাদ করলেই নানান আজেবাজে কথা বলে। মানসম্মানের ভয়ে মৃত্তিকা রাস্তার মাঝে চিৎকার করতে পারে না। প্রথমদিকে ব্যাপারটা সে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। বাড়িতে সবাইকে বলেছিল শফিকের সাথে তার আর দেখা হয় না। কিন্তু একই ঘটনা যখন বারবার ঘটতে লাগল, তখন মৃত্তিকা অসহ্য হয়ে মৃন্ময়ীকে জানাল। মৃন্ময়ী শুনে অবাক হয়ে বলল,
“তুই এই কথা আমাকে আগে জানাসনি কেন?”
মৃত্তিকা বলল,
“তোদের দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইনি, তাই।”
“মানে কী? তোর কি বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে মৃত্তিকা? তুই কোন আক্কেলে এই রিস্ক নিয়েছিলি? ওই লোক যদি তোর কোনো ক্ষতি করে ফেলত?”
“কী করতাম বল? তোদের জানালেই কি তোরা ওর কিছু করতে পারতি?”
“আমাদের কথা বাদ দে। তুই কেন চুপচাপ সহ্য করেছিস? আশপাশের লোকজন ডাকতে পারতি। গণধোলাই না খেলে ও সোজা হবে না।”
মৃত্তিকা মাথানিচু করে বলল,
“ও মানুষ নেই আপা, অমানুষ হয়ে গেছে। মুখের ভাষা শুনলে তুই বুঝতে পারতি। বাচ্চা দিবো না বললেই আমাকে যা-তা বলে গালাগাল করেছে। লোকজন কীভাবে ডাকব? ওর মানসম্মান না থাকলেও আমার তো আছে। রাস্তার মাঝে ও কী করে বসে তার তো ঠিক নেই। যা হিংস্র পশুর মতো ব্যবহার!”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“এখন তুই করতে বলছিস? থানায় মামলা করবি?”
মৃত্তিকা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“মামলা? মামলা করে কী হবে? আজ মামলা করব, কাল ও পুলিশকে টাকা খাইয়ে মামলা তুলে নিবে। তুই ওদের চিনিস না আপা।”
মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এবার বুঝতে পারছিস ওই ছেলে তোর চোখে কেমন ধুলা দিয়ে রেখেছিল?”
মৃত্তিকা মলিন মুখে বলল,
“বুঝতে পারছি, এখন আর বুঝেই কী হবে? যা হওয়ার ছিল, তা তো হয়েই গেছে। এখন কী করা যায় বল তো?”
মৃন্ময়ী ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। সমাধান তো একটা বের করতেই হবে। সমাধানের কথা ভাবতেই তার প্রথমে মাথায় এল প্রভাতের নাম। ব্যাপারটা প্রভাতকে জানালে কেমন হয়? প্রভাত হয়তো কিছু একটা করতে পারবে। আবার প্রভাতের কাছে সাহায্য চাইতেও কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। এদিকে তার মনের কথা মৃত্তিকা মুখেই বলে ফেলল। তার-ও প্রভাতের কথা-ই মাথায় এসেছে। সে বলে উঠল,
“প্রভাত ভাইকে বললে কেমন হয় আপা? উনি কিছু বললে হয়তো ভয় পাবে। তুই ওনাকে একবার বলে দেখবি?”
মৃন্ময়ী চিন্তিত মুখে বলল,
“আমি বলব?”
মৃত্তিকা অনুরোধ করে বলল,
“বল না আপা। তুই বললে উনি নিশ্চিত সাহায্য করবে।”
মৃন্ময়ী ভারী বিপাকে পড়ে গেল। এছাড়া আর কোনো উপায়ও তার মাথায় এল না। মৃত্তিকাকে সে আশ্বাস দিলো প্রভাতকে বলবে। পরদিন প্রভাতের সামনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার কেবল চিন্তা-ই হয়েছে। শেষমেশ প্রভাতের কাছে তাকে সাহায্য চাইতে হবে। প্রভাত মনে-মনে তার ওপর না হাসলেই হয়। প্রভাতকে কীভাবে বলবে তা নিয়ে সে চিন্তা করলেও, প্রভাত নিজেই তার জন্য ব্যাপারটা সহজ করে দিলো। প্রভাত তার মুখের অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে বসল,
“তুমি কি কোনো দুশ্চিন্তায় আছো? কদিন ধরে দেখছি একটু বেশি চুপচাপ হয়ে গেছো।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ওই, সমস্যা একটু চলছে।”
প্রভাত আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল,
“কী সমস্যা চলছে?”
“মৃত্তিকাকে নিয়ে সমস্যা।”
“মৃত্তিকা আবার কী করল?”
“কিছু করেনি, মৃত্তিকার-ই সমস্যা। ও যাকে বিয়ে করেছিল, ওই ছেলেটা ওকে খুব জ্বালাতন করছে।”
“ওই শফিক? কী করেছে ও?”
মৃন্ময়ী মৃত্তিকার ব্যাপারটা খুলে বলল। মনোযোগ দিয়ে সব শুনে প্রভাত বলল,
“ওই বাটপার এত বাড় বেড়েছে, তা তুমি আমাকে আগে জানাবে না?”
“আমি একদিনের কথাই জানতাম। রোজ যে বিরক্ত করে তা তো মৃত্তিকা আমাদের জানায়নি।”
“আচ্ছা, আমি আজই দেখব ব্যাপারটা। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না।”
মৃন্ময়ী কেবল মাথা দোলাল। প্রভাত তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আবারও তোমার মাথায় এক দুশ্চিন্তা ঢুকে গেল, না?”
মৃন্ময়ী বলল,
“দুশ্চিন্তার সাথেই তো আমার আজন্মের ভাব।”
“চা খাবে? চলো, বসে একটু চা খাও, ভালো লাগবে।”
“নাহ্, বাড়ি ফিরতে দেরী হবে। রাত বাড়লে মা চিন্তা করবে।”
“চা খেতে আর কতক্ষণ লাগবে। আমি তো আছি, পৌঁছে দিয়ে আসব। চলো।”
কেমন আশ্বাস দিয়ে কথাটা বলল প্রভাত। মৃন্ময়ী রাজি হতে চাইছিল না। প্রভাত বেশ কয়েকবার বলার পর আর সে তার কথা ফেলতেও পারল না। দুজন চলে গেল চা খেতে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মৃন্ময়ীর থেকে একহাত দূরে বসল প্রভাত। মৃন্ময়ী কোনো কথা বলছে না। তার নীরব দৃষ্টি চায়ের কাপেই নিবদ্ধ। প্রভাত নিজেই তাকে ডাকল,
“মৃন্ময়ী?”
“হুঁ?” দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে সাড়া দিলো মৃন্ময়ী।
প্রভাত বলল,
“চলো না এই দূরত্বটুকু কমিয়ে নিই। তোমার মন কি চায় না তোমারও একটা দুঃখ বিসর্জনের জায়গা হোক?”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার কোনো দুঃখ নেই।”
“কাকে কী বুঝাচ্ছ তুমি?”
“আমি জানি তুমি কী বলতে চাইছো। সুখ সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া যায়। দুঃখ কোনোদিন ভাগ করে নেওয়া যায় না প্রভাত। যার দুঃখ সে-ই টের পায়, সে-ই বোঝে। মুখে বললেও আমরা কেউ কারোর দুঃখ অনুভব করতে পারি না।”
প্রভাত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি পারব। তুমি আমার হলে আমি সব পারব।”
মৃন্ময়ী দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, কেউ কোনোদিন কারোর জায়গায় দাঁড়াতে পারে না।”
“আমি জানি আমি তোমার জায়গায় দাঁড়াতে পারব না, কিন্তু পাশে তো দাঁড়াতে পারব। আমি শুধু তোমার পাশে দাঁড়িয়ে তোমার হাতটা ধরতে চাই। যেদিন সেই মুহুর্তটা আসবে, সেদিন তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারবে মৃন্ময়ী। এখন হয়তো তোমার কাছে অসম্ভব ব্যাপার-ই মনে হবে।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“এত কনফিডেন্স তুমি কোত্থেকে পাও বলো তো?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“ভালোবাসা থেকে। তুমি তো আমাকে ভালবাসো না, তাই এখন বুঝতে পারছো না। যখন ভালোবাসবে, তখন বুঝবে।”
পরক্ষণেই আবার প্রভাত বলল,
“তোমাকে আমি একটা চমৎকার বুদ্ধি দিতে পারি।”
“কী বুদ্ধি?”
“তুমি চাইলে আমার মুখের কথার প্রমাণ লিখিতভাবে রেখে দিতে পারো। আমি কথা রাখতে না পারলে কঠিন শাস্তির কথা-ও উল্লেখ করতে পারো। আমি নির্দ্বিধায় তোমার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হব।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“তোমার মাথা পুরো গেছে।”
“উঁহু, আমার মাথা একদম ঠিকঠাক আছে। মজা ভেবো না, আমি সত্যি বলছি। তুমি চাইলে আমি তোমার সাথে এমন চুক্তি করতেও রাজি আছি। তবু যদি তুমি আমাকে বিশ্বাস করো, তাতে ক্ষতি কী?”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“আমি কি তোমাকে অবিশ্বাস করি?”
“করো না?”
“তাহলে এখন তোমার সাথে বসে চা খেতাম?”
প্রভাত বলে উঠল,
“তারমানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো। কিন্তু বিয়ের ভয়ে স্বীকার করো না, তাই তো?”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল,
“তা কখন বললাম আমি?”
প্রভাত হাসিমুখে বলল,
“তোমাকে বলতে হবে না, আমি এমনিতেই বুঝতে পারি। চিন্তা কোরো না, বিয়ে আমি তোমাকেই করব। তুমি আমাকে অপেক্ষা করালেও আমি এই অপেক্ষার আয়তন কমিয়ে নেব। এবার বিয়ের চেষ্টায় আমাকে নামতেই হবে। আচ্ছা, বিয়েতে তুমি কোন রংয়ের শাড়ি পরতে চাও বলো তো?”
মৃন্ময়ী বলল,
“পাগলের মতো বিলাপ না করে ওঠো। আমি এখানে সারারাত বসে তোমার বিলাপ শুনতে পারব না।”
প্রভাত হেসে বলল,
“পারবে, পারবে। আজ না পারলেও খুব শীঘ্রই পারবে। এবার না হয় তুমি একটুখানি অপেক্ষা করো।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৯

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৯.
এই পর্যন্ত প্রভাত অনেকবার মৃন্ময়ীকে সুন্দর কিছু উপহার দিবে ভেবে-ও দেওয়া হয়নি। সে জানে মৃন্ময়ী নিবে না। একবার অনলাইনে একটা শাড়ি প্রভাতের খুব পছন্দ হয়েছিল। তার ভীষণ ইচ্ছা হয়েছিল মৃন্ময়ীকে যদি এই শাড়িতে দেখতে পারত। মনের ইচ্ছা পূরণের আশায় শাড়ি বিক্রির পেইজ থেকে সে মৃন্ময়ীকে শাড়ি উপহার পাওয়ার বার্তা পাঠিয়েছিল। মৃন্ময়ী তার নাম শুনেই বারণ করে দিয়েছে। এরপর সে নিজে মৃন্ময়ীকে খুব অনুরোধ করেছিল যেন সে শাড়িটা নেয়। কিন্তু মৃন্ময়ী কোনোভাবেই রাজি করানো যায়নি। সেই থেকে সে মৃন্ময়ীকে উপহার দেওয়ার ইচ্ছা মনের মধ্যেই চাপা দিয়ে রাখে। অনেকদিন পর এবার আবার তার মনের চাপা ইচ্ছাটা হুট করেই জেগে উঠেছে। তা-ও তার বন্ধুর বউয়ের ফেসবুক পোস্ট দেখে। বন্ধু তার বউকে দারুণ একটা গহনার সেট গিফট করেছে। সেসব নিয়ে তার বউ ভীষণ খুশি হয়ে স্বামীকে ট্যাগ করে ফেসবুকে পোস্ট করেছে। স্বামীকে নিয়ে খুব আবেগপূর্ণ অনুভূতি প্রকাশ করেছে সে। সেই পোস্ট চোখে পড়ে যাওয়ার পর থেকেই প্রভাতের মন আঁকুপাঁকু করছিল। মৃন্ময়ীর সঙ্গে তার এমন সুন্দর মুহূর্ত কবে আসবে জানে না সে। তবু তার ভীষণ ইচ্ছা এমন কিছু মুহূর্ত তার জীবনে-ও আসুক। মৃন্ময়ী-ও তার ভালোবাসায় মুড়ানো উপহার সানন্দে গ্রহণ করুক। ভীষণ আবেগপূর্ণ অনুভূতি প্রকাশ না করুক, অন্তত সে উপহার পেয়ে একটুখানি হাসুক। এর বেশি কিছু প্রভাত আশা করে না। মনের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করে প্রভাত সেই গহনার সেট কিনেছে। আজ সেটা মৃন্ময়ীকে দেওয়ার জন্য নিয়ে-ও এসেছে। অধীর আগ্রহে সে মৃন্ময়ীর কোচিং থেকে বেরোনোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। মৃন্ময়ী কোচিং থেকে বেরোতেই সে হাসিমুখে এগিয়ে গেল। মৃন্ময়ী তাকে পাশ কা’টাতে গিয়েও আবার ফিরে তাকাল। সূক্ষ্ম চোখে প্রভাতের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“তুমি কি অসুস্থ?”
প্রভাত মাথা নেড়ে বলল,
“নাহ্। আজ অফিসে কাজের চাপ ছিল। মাথাটা একটু ধরেছে।”
“একটু ধরেছে? তোমার চোখ-মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে জ্বর-টর এসে গেছে।”
প্রভাত ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“তুমি কি আমার জন্য দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছো?”
মৃন্ময়ী হাঁটা দিয়ে বলল,
“কে তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছে? আমার কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? অসুস্থ মনে হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করেছি।”
প্রভাত তার পিছু নিয়ে বলল,
“আহা! লজ্জা পাওয়ার কী আছে? আমার জ্বর আসছে মনে হলে তুমি কপালে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারো। আমার স্বাস্থ্যের জন্য তুমি ছাড়া আর কে দুশ্চিন্তা করবে বলো?”
মৃন্ময়ী বিড়বিড় করে বলল,
“আমার বয়ে গেছে তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করতে।”
প্রভাত মিটমিট করে হাসছে। আজ অফিস শেষ হওয়ার আগে থেকেই মাথাটা ব্যথা করছে। সে টের পাচ্ছে চোখ দুটো একটু জ্বলছে। জ্বর এলেও আসতে পারে। যদিও এই মুহূর্তে সে অসুস্থতা নিয়ে মোটেও চিন্তিত না। এসব ছোটোখাটো অসুস্থতা সয়ে নেওয়ার অভ্যাস তার খুব আছে। প্রভাত বলল,
“আহা! নিজের মানুষকে নিয়ে সবাই-ই একটু-আধটু চিন্তা করে। এটা খুবই ভালো ব্যাপার। এতে লজ্জার কিছু নেই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“চুপ থাকো তো।”
“আচ্ছা, চুপ করলাম। এবার এটা নাও তো,” গহনার প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে বলল প্রভাত।
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করল,
“এটা কী?”
“নিয়ে দেখো।”
“না জেনে কী নিব?”
“যা-ই‌ হোক, তোমার জন্যই আনা। নাও।”
“লাগবে না আমার।”
“না দেখেই বলছো লাগবে না?”
“তো বলছো না কেন?”
“আগে নাও, নিজেই খুলে দেখতে পাবে,” প্যাকেটটা মৃন্ময়ীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল প্রভাত।
মৃন্ময়ী বলে উঠল,
“আমি তোমাকে আমার জন্য কিছু আনতে বারণ করেছিলাম না?”
“সে তো আমার সব কাজেই তোমার বারণ। একবার অন্তত বারণ ভাঙতে দাও।”
“না-না, ফেরত নাও এটা। আমার কিছু চাই না।”
“তুমি না চাইলেও আমি তোমাকে এটা দিতে চাই। কারণ এটা শুধু এবং শুধুমাত্রই তোমার জন্য আনা।”

মৃন্ময়ী কিছুতেই প্রভাতের দেওয়া জিনিস নিবে না। প্রভাত-ও ফেরত নিতে নারাজ। মৃন্ময়ী পড়ে গেল বিপাকে। প্রভাতের জোরাজুরিতে শেষমেশ সে রাস্তায় দাঁড়িয়েই প্যাকেট খুলল ভেতরে কী আছে দেখার জন্য। গহনাগুলো এত দারুণ যে মেয়েরা দেখলে তাদের পছন্দ হবেই। অথচ মৃন্ময়ীর মুখের অভিব্যক্তি প্রভাত বুঝতে পারল না। অবশ্য সে জানে তার দেওয়া উপহারে মৃন্ময়ীর আনন্দ দেখার আশা রাখা-ও তার জন্য একপ্রকার বোকামি। এই মেয়ে কখনোই মনের অনুভূতি প্রকাশ করবে না, আনন্দিত হলেও না। তবু প্রভাত ভীষণ উৎসুক হয়ে মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ী গহনাগুলো হাতে নিয়ে দেখল। এসবের দাম মোটেও কম নয়। অন্তত তার হাতের নাগালের দাম তো নয়-ই। মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“আমি তোমার এই উপহার নিতে পারব না প্রভাত। এসব তুমি ফিরিয়ে নাও।”
মৃন্ময়ী প্রভাতের হাতে প্যাকেটটা ফেরত দিতে চাইল। কিন্তু প্রভাত তার দুহাত পেছনে লুকিয়ে ফেলল। শুধাল,
“কেন নিতে পারবে না? আমি দিয়েছি বলে?”
“হ্যাঁ, ধরে নাও তা-ই।”
“মৃন্ময়ী, আমি এটা অনেক শখ করে তোমার জন্য কিনেছি।”
“কেন কিনেছ? আমি তো বলিনি আমার এসব চাই।”
“আমার মনে হয়েছে এটাতে তোমাকে খুব মানাবে, তাই কিনেছি।”
“তুমি ভুল করেছ। দেখো, আমি তোমার এমন কেউ নই যে, কোনো জিনিস দেখলেই তুই চট করে আমার জন্য কিনে নিয়ে আসবে, আর আমিও খুশিমনে তা নিয়ে নিব। তুমি বলতে পারো আমি এসব কেন নিব?”
প্রভাত অনুরোধের সুরে বলল,
“এভাবে আপত্তি কোরো না প্লিজ। তুমি বারণ করার পর থেকে আমি যখন-তখন তোমার জন্য কিছু কিনেছি, বলো? কিনিনি, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি তোমার আপত্তির কথা ভেবে কিছু কিনিনি। কিন্তু এবার আমি তোমাকে এটা না দিয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না, তাই কিনেছি। এটা গ্রহণ করো প্লিজ। এরপর আর কিছু কিনব না, দেখো। শুধু এটা ফিরিয়ে দিয়ো না। প্লিজ মৃন্ময়ী।”
মৃন্ময়ী নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল,
“আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে যা উপহার দিয়েছ, আমি নিয়েছি। তোমার খারাপ লাগবে ভেবে ফিরিয়ে দিইনি। তাই বলে তো তোমার অনুরোধ আমি সবসময় রাখতে পারি না প্রভাত। তুমিই বলো আমি তোমার টাকায় কেনা জিনিস কেন নিব? তুমিই বা কেন আমার পেছনে টাকা খরচ করবে?”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। কত টাকা খরচ করেছি, এটা না দেখে ভালোবাসাটা দেখো।”
“এটা তো আরও বড়ো সমস্যা। আমি যা দেখতে চাই না, তুমি আমাকে তা-ই দেখাতে চাও। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি না। আমাদের সম্পর্কটা-ও একদমই তেমন না।”
“আমি কিছু জানি না। আমি তোমার জন্য এটা এনেছি মানে এটা তোমাকেই নিতে হবে।”
“সবসময় সবকিছুতে জেদ চলে না প্রভাত। এইটুকু বুঝতে শেখো। আমি এসব কোনোভাবেই নিব না। তোমার অনুরোধ-ও আজ আমি রাখব না। প্লিজ তুমি এটা ফিরিয়ে নাও, ধরো।”

প্রভাত কিছুতেই হাত সামনে আনতে চাইল না। মৃন্ময়ী তার একহাত টেনে নিয়ে প্যাকেটটা জোর করে ফেরত দিয়েই ছাড়ল। প্রভাতের কোনো অনুরোধ-ই কাজে আসবে না বুঝতে পেরে সে অন্ধকার মুখে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি এটা নিবেই না?”
মৃন্ময়ী উত্তর দিলো,
“না।”
“সিরিয়াসলি বলছো?”
“অবশ্যই।”
প্রভাত পুনরায় বলল,
“তুমি না নিলে আমি কিন্তু অন্য কাউকে এটা দিবো না। শেষবারের মতো ভেবে দেখো।”
“ভাবাভাবির কিছু নেই। তুমি আর কখনও আমার জন্য কিছু কিনবে না, এটাই শেষ কথা।”
“আচ্ছা।”
সম্মতি জানিয়েই প্রভাত ডানে-বায়ে না তাকিয়ে, কোনোরকম দ্বিধা না করে প্যাকেটটা ছুঁড়ে মা’রল। প্যাকেটটা সোজা গিয়ে টুপ করে পড়ল রাস্তার ধারের দিঘির জলে। মৃন্ময়ী খনিকের জন্য হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রভাত এমন কাণ্ড করবে ভাবেনি সে। সচরাচর প্রভাত তার সঙ্গে রাগ দেখায় না। বাইরের মানুষের মুখে শোনা যায় প্রভাত যেমন বেপরোয়া, তেমনি রাগী। কিন্তু মৃন্ময়ী তার আচরণে এখনও তেমন কিছুই দেখেনি। মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলে উঠল,
“এটা কী করলে তুমি?”
“কাজে লাগবে না, তাই ফেলে দিলাম।”
“কেন ফেললে? আমি নিব না বলেই তুমি কেনা জিনিস এভাবে ফেলে দিবে?”
“অনলাইন থেকে কিনেছি। ফেরত নিবে না। ঘরে তো আমার বউ নেই যে ব্যবহার করবে। ফেলে রেখে কী হবে?”
“তো তুমি পানিতে কেন ফেললে? কেউ নেই বলেই তুমি টাকায় কেনা জিনিস ফেলে দিবে? আজব!”
“অপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখার জায়গা নেই আমার ঘরে। বাদ দাও। চলো, তোমার দেরী হচ্ছে।”
“আরে! এটা কেমন কথা? এত জেদি হলে এসব কাজ করো কেন? আশ্চর্য!”

রোজ প্রভাত মৃন্ময়ীর সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটে। আজ প্রভাত তার আগেই হাঁটা দিয়েছে। মৃন্ময়ী হা-হুতাশ করতে-করতে তার পেছনে হাঁটছে। অথচ প্রভাত এমন ভাব করছে যেন টাকায় কেনা জিনিস হারিয়ে তার একটুও খারাপ লাগছে না। সে কেবল একবার বলল,
“আফসোস বন্ধ করো। আমি তোমার সাথে রাগ করতে চাই না।”
“তোমার খারাপ লাগছে না?”
“না। পাথরের পেছনে ঘুরে-ঘুরে আমিও পাথর হয়ে গেছি। এখন আর কিছুতেই খারাপ লাগে না। আমি জানি অপেক্ষা ছাড়া আমার জন্য সবকিছু নিষিদ্ধ।”
আজ রাতের জন্য প্রভাতের এই কথাটা মৃন্ময়ীর মনে গেঁথে গেল। বাসায় ফিরেও সে এই কথাটা ভুলতে পারল না। প্রভাতের ভীষণ স্বাভাবিক অথচ অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখটা-ও সে মন থেকে সরাতে পারল না। মৃন্ময়ী ভেবে পায় না এমন বেপরোয়া একটা ছেলে এত ধৈর্য কীভাবে রাখে। এ তো তার চেয়েও বেশি ধৈর্যশীল। মৃন্ময়ী একবার ভাবল জিনিসটা নিলে আর সেটা এভাবে জলে যেত না। আবার ভাবল সে কেন নিবে? সে তো এসব করতে সবসময়ই বারণ করে। প্রভাত নিজেই তার বারণ শোনে না।


এই নিয়ে জাহিদ দশবার মৃদুলাকে কল করেছে। আগামীকাল মৃদুলার ইংরেজি পরীক্ষা। ইংরেজি পড়তে-পড়তে তার মাথার খুলি খুলে পড়ার অবস্থা। ইচ্ছা করেই মৃদুলা মোবাইল ফোন সাইলেন্ট করে ফেলে রেখেছে। জাহিদের বদঅভ্যাস তার জানা আছে। বারণ করলেও এই ছেলে শখানেক ফোন করবে। তারপর আবার নিজেই মেয়েদের মতো অভিমান করবে। গাল ফুলিয়ে বলবে, ‘এই তোমার ভালোবাসা?’ এমনই এক অদ্ভুত প্রজাতির প্রেমিক ছুটেছে তার কপালে। পড়ার মাঝে মৃদুলা কিছু সময়ের বিরতিতে ফোনটা হাতে নিতেই তার অদ্ভুত প্রজাতির প্রেমিকের বিশটা কল দেখতে পেল। পরপরই আবার কল এলে মৃদুলা রিসিভ করল। জাহিদ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
“এতগুলো কল করলাম, পাত্তাই দিলে না।”
মৃদুলা বলল,
“আপনাকে না আমার পড়ার সময় কল করতে বারণ করেছি? তবু করেছেন কেন? আবার বলছেন আমি পাত্তা দিইনি?”
“কী করব বলো? তুমি কল দিতে বারণ করলে তো আমি সেদিন তোমাকে আরও বেশি-বেশি মিস করি। তাই কল না করে থাকতে পারি না। তুমি তো আর আমাকে মিস করো না, তাই তোমার কষ্ট-ও হয় না আমাকে ছাড়া।”
“কাল আমার ইংরেজি পরীক্ষা। আপনার আজাইরা আলাপ শোনার সময় নেই।”
“দেখেছ, বলেছি না তুমি আমাকে একটুও মিস করো না?”
“আপনি একদম ঠিক বলেছেন। আপাতত আমি আপনাকে মিস করছি না। কারণ আপনাকে মিস করলে আমার কোনো কাজে আসবে না। আমি মিস করছি আমার ইংলিশ টিচারকে।”
জাহিদ অভিমানী সুরে বলল,
“তুমি আমাকে মিস করো না মেনে নিয়েছি। তাই বলে তুমি অন্য এক পুরুষকে মিস করবে? তুমি না বলো তুমি আমাকে ভালবাসো? এই তোমার ভালোবাসা মৃদুলা?”
“হ্যাঁ, আমার ভালোবাসা একটু অদ্ভুত। কারণ আমার যে একজন পুরুষ আছে, সে তার চেয়েও বেশি অদ্ভুত। এখন ফোন রাখুন। আমার অনেক পড়া বাকি।”
“শোনো না একটু।”
“বলুন।”
“আই লাভ ইউ।”
“আচ্ছা।”
মৃদুলার সঠিক উত্তর না পেয়ে জাহিদ পুনরায় বলল,
“আই মিস ইউ।”
“আচ্ছা।”
“তুমি আমাকে মিস করছো না?”
“না।”
“ঠিক আছে, তুমি তোমার ইংলিশ টিচারকেই মিস করো। তোমার ইংলিশ টিচারের মাথায় খুব দ্রুতই টাক হবে, দেখো। তখন টাকমাথা লোককে তুমি মিস করো কি না দেখব।”
মৃদুলা ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বলল,
“কিন্তু আমার ইংলিশ টিচার তো অলরেডি টাকমাথা।”
জাহিদ ব্যথিত গলায় বলল,
“তুমি আমাকে এভাবে ছ্যাঁকা দিতে পারো না জান।”
“হয়েছে, এখন আপনার নাটক বন্ধ করুন। আমি পরীক্ষায় ফেল করলে কিন্তু সব দোষ আপনার।”
“তুমি ফেল করলে তো বিয়ে করে সংসার সাজিয়ে ফেলতাম। কিন্তু তুমি তো ফেল করা পাবলিক-ই না।”
মৃদুলা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আপনি মনে-মনে চান আমি যেন ফেল করি?”
“আরে নাহ্! আমি তোমার খারাপ চাইতে পারি? পড়া শেষ করে কিন্তু আমাকে অবশ্যই নক করবে।”
“আচ্ছা, এখন রাখছি।”
জাহিদ বলে উঠল,
“আরেকটা কথা শোনো।”
“আবার কী?”
“তোমার আপার সাথে কি প্রভাত ভাইয়ের কোনো সমস্যা হয়েছে? কিছু জানো?”
“না তো। কেন, কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে তা তো আমিও ঠিক জানি না। প্রভাত ভাইয়ের খুব মন খারাপ দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, তা-ও কিছু বলল না। আড্ডা দিতে-ও রাজি হলো না, বাড়ি চলে গেল। আমার মনে হলো যে তোমার আপার সাথে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“ও, আচ্ছা আমি আপার সাথে কথা বলে দেখব।”
“আরে, তোমার জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমার ধারণা তো ভুল-ও হতে পারে।”
“আমি আপনার মতো গাধা না কি এসব কথা আপাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করব?”
“তাহলে?”
“ওসব আপনি বুঝবেন না। রাখছি, পরে কথা হবে।”

ফোন রেখে পুনরায় পড়তে বসে-ও মৃদুলার মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। সত্যিই কি আপার সাথে প্রভাত ভাইয়ের কোনো সমস্যা হয়েছে? প্রভাত ভাইয়ের মন খারাপ হলে আপার মন কেমন? একবার তো গিয়ে দেখতে হয়। বই-খাতা বন্ধ করে রেখে মৃদুলা চলল আপার কাছে। মৃন্ময়ী বিছানা ঠিক করছিল ঘুমানোর জন্য। মৃদুলা তার ঘরে উঁকি মে’রে মুখোভাব দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু সে মৃন্ময়ীর চোখে পড়ে গেল। মৃন্ময়ী জিজ্ঞেস করল,
“কী-রে মৃদুলা? পড়া রেখে এখানে কী করছিস?”
মৃদুলা হেসে বলল,
“এমনিতেই এসেছি। তুমি কী করছো?”
“ঘুমাব, তোর পড়া শেষ?”
“না, এখনও বাকি আছে। একটানা পড়ে মাথা ধরে গেছে, তাই হাঁটছি।”
“চা খাবি?”
“চা দুবার খেয়ে ফেলেছি। এতবার চা খেতে ভালো লাগে না।”
“ভেতরে আয়।”
“না, চলে যাচ্ছি। তোমার মন খারাপ কেন আপা?”
মৃন্ময়ী যেন চমকে উঠল। মৃদুলা কীভাবে বুঝল তার মন খারাপ? ধরা না দিয়ে সে পালটা প্রশ্ন করল,
“কে বলল আমার মন খারাপ?”
“তুমি কথা বলার সময় আমার মনে হলো তোমার মনটা একটু খারাপ। কী হয়েছে আপা?”
“আরে না, আমার মন ঠিক আছে।”
“কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো। আমি তোমাকে উত্তম সমাধান দিয়ে দিবো।”
মৃন্ময়ী হাসার চেষ্টা করে বলল,
“তোর পাকামি করতে হবে না। আমার মন ভালো আছে। তুই পড়তে যা।”
“ঠিক আছে। তুমি বলতে না চাইলে বোলো না। তবে কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে মন খারাপ না করে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি চললাম।”

মৃদুলা চলে গেল। মৃন্ময়ী বড়ো একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। মাঝে-মাঝে তার মনে হয় মৃদুলা তার মন পড়তে জানে। এই মেয়েটার সামনে মনোভাব লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। প্রভাতের কথাটা আবারও তার মনে পড়ে গেল। এই ছেলেটা কবে তাকে শান্তি দিবে? কী করবে সে একে নিয়ে? তার দৈনন্দিন জীবনে এমনিতেই সমস্যার শেষ নেই। উঠতে-বসতে তাকে যুদ্ধ করে চলতে হয়। তার সঙ্গে জুটল প্রভাতের জেদ। মৃন্ময়ী না পারে যাকে ফেলতে, না পারে গিলতে। কাঁটার মতো গলায় বিঁধে থেকে আরও যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে। কিসের আশায় অপেক্ষা করছে প্রভাত? এই অপেক্ষার সুফল তাকে কীভাবে দিবে মৃন্ময়ী? সংসার জীবনে পা রাখার সাহস কি মৃন্ময়ীর আদৌ হবে? পৃথিবীটা এত জটিল কেন তার জন্য?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৮

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৮.
পাঠাগারের কাজটা মৃত্তিকা খুব উপভোগ করছে। কোনো চাপ নেই, তাড়া নেই। সারাদিন বসে শান্তিতে কাজ করা যায়। অবসরে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে বই পড়ে, তখন তাদের সঙ্গে একটু আলাপ হয় তার। কোন-কোন শিক্ষার্থী বই নিয়ে যায় তাদের নাম ভালোভাবে তালিকা করে রাখে সে। তারা আবার সময়মতো বই ফেরত দিয়ে যায়। এছাড়া অঢেল সময় তার হাতে পড়ে থাকে। মৃত্তিকা তখন সেলফ থেকে বই বেছে নিয়ে পড়তে বসে। বই পড়ার অভ্যাস তার কোনোকালেই ছিল না। পাঠাগারের দায়িত্ব হাতে পাওয়ার পর অভ্যাসটা নতুন হয়েছে। সময় কা’টানোর জন্যই সে বই পড়া শুরু করেছে। ধীরে-ধীরে এখন সেটা অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। ব্যাপারটা তার কাছে মন্দ লাগছে না। সুযোগ পেলে আবার সে আশপাশে-ও ঘুরে আসে। স্কুলের সবাই তাকে খুব সম্মান করে। ছাত্র-ছাত্রীরা এমনভাবে ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকে যে তার মনে হয় সে শিক্ষকতা করছে। আজকাল মৃত্তিকার নিজেকে খুব মূল্যবান মনে হয়। সত্যিই মানুষ নিজেকে ভালোবাসলে নিজের মূল্য বুঝতে পারে। নিজের জন্য চেষ্টা করলে সফল হতে পারে। মৃত্তিকা-ও সফল হবে। চেষ্টা সে ছাড়বে না। সারাদিন স্কুলে থাকার ফলে আজকাল আর মায়ের আহাজারি-ও তাকে শুনতে হয় না। এটা তার অনেক বড়ো স্বস্তি। সে চায় না কোনোভাবেই তার ক্ষত কাঁচা হোক। দাঁতের নিচে ধৈর্য চেপে সে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছে। কে জানত নিয়তি তার জন্য এতটাও সহজ হবে না?
কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর থেকে মৃত্তিকার সময়গুলো বেশ ভালো কা’টলেও, হুট করেই ভালো সময়গুলো পড়ে গেল শঙ্কার মুখে। মৃত্তিকা প্রেগন্যান্ট। প্রথম থেকেই খবরটা সে জানত। কিন্তু ভয়ে কাউকে জানায়নি। স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। কেউই হয়তো চাইবে না বাবা ছাড়া তার সন্তান পৃথিবীতে আসুক। কিন্তু সে তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চায়। নিজের ভুলের জন্য সে একটা নিষ্পাপ প্রাণকে কষ্ট দিতে চায় না। বাবা নেই তো কী হয়েছে? সে-ই নিবে তার সন্তানের দায়িত্ব। এ কারণেই সে এতদিন মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু এসব ব্যাপার তো আর সবসময়ের জন্য চাপা দিয়ে রাখা যায় না। আজ হঠাৎ মৃত্তিকার শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। মৃন্ময়ী তাকে একপ্রকার জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। তখন সে বাধ্য হয়ে সত্যিটা স্বীকার করে নেয়। খবরটা শুনে হতে নতুন করে সাজেদা বেগমের আহাজারি শুরু হয়েছে। কেঁদেকেটে একাকার করেছেন তিনি। এই ভয়েই মৃত্তিকা এ কদিন মায়ের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থেকেছে। বলা তো যায় না, কখন কোন লক্ষণ মায়ের চোখে পড়ে যায়। সাজেদা বেগমের আহাজারি মৃত্তিকা শুনেও না শোনার ভান করে থাকে। তার মনে কেবল একটাই ভয় দানা বেঁধে আছে, মা যদি বাচ্চাটার জন্ম না চায়। যদিও সাজেদা বেগম এমন কিছু স্পষ্ট করে বলেননি। তবু তার কথাবার্তায় মৃত্তিকার এমনটাই মনে হচ্ছে। পরদিন মৃন্ময়ীর স্কুল ছুটির আগে-আগে মৃত্তিকা তার স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মৃত্তিকা স্কুল থেকে বেরিয়ে আজ প্রভাতের জায়গায় দেখতে পেল বোনকে। মৃত্তিকাকে তার স্কুলের সামনে দেখে সে অবাকই হলো। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মৃত্তিকা, তুই এখানে কেন?”
মৃত্তিকা বলল,
“তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
“তুই স্কুলে ছিলি না?”
“প্রিন্সিপাল স্যারকে বলে ছুটির আগে বেরিয়ে এসেছি।”
“কেন?”
“এমনি, চল আজ একসঙ্গে বাড়ি যাই।”
“আমার সঙ্গে বাড়ি ফেরার জন্য তুই উলটা পথে এসে দাঁড়িয়ে ছিলি? না কি অন্য কোনো প্রয়োজন আছে?”
“আহা! চল না। হাঁটতে-হাঁটতে কথা বলি।”
“দাঁড়া, গাড়ি নিই।”
মৃত্তিকা বাঁধা দিয়ে বলল,
“গাড়িতে যাব না। হেঁটে যাব, চল।”
“তোর হাঁটতে কষ্ট হবে না?”
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“আরে না। এখন আমি ঠিক আছি। আমার হাঁটতে কষ্ট হয় না। চল তুই।”
“আচ্ছা চল তাহলে। কষ্ট হলে বলিস কিন্তু।”
“আচ্ছা-আচ্ছা।”

মৃন্ময়ী প্রভাতের সন্ধানে চারপাশে চোখ বুলাতেই দেখল প্রভাত আজ ভদ্র ছেলের মতো দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্তিকাকে দেখেই হয়তো তার এই হঠাৎ ভদ্রতা জেগে উঠেছে। সে তাকাতেই প্রভাত হাসিমুখে হাত নাড়ল। মৃন্ময়ী তাকে না দেখার ভান করে মৃত্তিকার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল।
“তোর কাজ কেমন চলছে?”
মৃত্তিকা উত্তর দিলো,
“ভালো।”
“কোনো সমস্যা মনে হয়?”
“নাহ্।”
“মৃদুলা বলল বইয়ের মধ্যে বসে থেকে-থেকে তোর-ও না কি বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে?”
“হুম।”
মৃত্তিকার সংক্ষিপ্ত উত্তর পেয়ে মৃন্ময়ী তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“তুই কি কিছু চিন্তা করছিস?”
মৃত্তিকা কথা বলল না। মৃন্ময়ী পুনরায় প্রশ্ন করল,
“তোর মনে কী চলছে মৃত্তিকা?”
মৃত্তিকা হাত কচলাতে-কচলাতে বলল,
“আপা, আমি অনেককিছুই চিন্তা করছি। তুই কি আমার কিছু কথা শুনবি?”
“শুনব না কেন? বল না। দ্বিধা করিস না।”
“মাকে একটু বলবি আমার বাচ্চাটার ওপর অসন্তুষ্ট না হতে? মা না চাইলেও আমি এই বাচ্চা জন্ম দিবো।”
“তুই কীভাবে বুঝলি মা চায় না? মা কি তোকে এমন কিছু বলেছে?
“মায়ের কথাবার্তায় আমি বুঝতে পেরেছি। দেখ আপা, আমার জীবনে যা ঘটে গেছে, তাতে তো আমার বাচ্চাটার কোনো দোষ নেই। আমার ভুলের শাস্তি তো আমি ওকে দিতে পারি না। ও ওর বাবাকে না পেলেও, মাকে তো পাবে। ওর বাবা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি ওকে ছাড়ব না। আমি একাই ওর বাবা-মা হয়ে উঠব। আপা, আমার সন্তান আমার কোলে এলে আমি ওর জন্য যা করতে হয় করব। আরও মন দিয়ে কাজ করব। আমি নিজেই তোদের সবচেয়ে বড়ো বোঝা হয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার সন্তানের বোঝা আমি তোদের কারোর মাথায় দিবো না আপা। তুই একটু মাকে বুঝাস। আমার বাচ্চাটা সবে নিষ্পাপ, ছোট্ট একটা প্রাণ। ওর ক্ষতি করার কথা আমি ভাবতেও পারি না।”

মৃত্তিকার চোখ ভর্তি জল। মৃন্ময়ী বলল,
“আমি তোর অনুভূতি বুঝতে পারছি বোন। আমি জানি কোনো মা-ই নিজের সন্তানের ক্ষতি চায় না। আমাদের মা-ও তো একজন মা। তোর কেন মনে হয় সে একজন মা হয়ে তোর সন্তানের ক্ষতি চাইবে? সে-ও তো তোকে জন্ম দিয়েছে। মাকে তুই এত হৃদয়হীন ভাবিস?”
“তোর মনে হয় না মা আমার সন্তানের প্রতি অসন্তুষ্ট?”
“না। মা অসন্তুষ্ট তোর ভাগ্যের ওপর। মা তোর জীবন নিয়ে চিন্তিত। এতদিন শুধু তোর ভবিষ্যতের চিন্তা ছিল, এখন নতুন করে যোগ হয়েছে তোর বাচ্চার চিন্তা।”
মৃত্তিকা প্রশ্ন করল,
“মা আমার বাচ্চার জন্য চিন্তা করে?”
“মৃত্তিকা, আমাদের মা তার স্বামী হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছে। সে-ও জানে বাবা ছাড়া সন্তানদের জীবন কতটা কঠিন হয়। হতে পারে তুই মায়ের থেকে আলাদা। আমরা বড়ো হয়ে বাবাকে হারিয়েছি, আর তোর সন্তান জন্মের আগেই হারিয়েছে। আমাদের ভবিষ্যতের জন্য মা বাইরের জগতে পা রাখতে পারেনি, কিন্তু তুই পারিস। তুই তোর সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার সাহস রাখতে পারিস। তবু সে মা তো। দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। তুই তোর বাচ্চা জন্ম না হতেই তার জন্য এত চিন্তা করছিস। আর মা তো তোকে পেলে-পুষে এত বড়ো করেছে। জীবনটা তোর ভাবনার মতো এত সহজ নয় রে মৃত্তিকা। তবু আমি চাই তুই যেন তোর সন্তান নিয়ে সুন্দর জীবন কা’টাতে পারিস।”
মৃত্তিকা চিন্তিত মুখে বলল,
“আমি কি তবে মাকে ভুল বুঝলাম?”
মৃন্ময়ী হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তুই সবসময়ই মাকে ভুল বুঝিস মৃত্তিকা। দিন-দিন মা তোর চোখে ভিলেন হয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে তুই মায়ের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলিস তো। সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে না থেকে মায়ের কাছাকাছি থাকিস, তার সাথে গল্প করিস। দেখবি মা এতটা-ও কঠিন না। দূর থেকে তাকে কঠিন মনে হলেও তার ভেতরটা খুব নরম।”
মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমি চেষ্টা করব আপা।”
মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“তোর বর কি জানত তুই প্রেগন্যান্ট?”
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু। ও জানবে কীভাবে? আমিই তো জানতে পেরেছি ওই বাড়ি থেকে চলে আসার পর।”
“ও। এমন খবর লুকিয়ে রাখার কোনো দরকার ছিল না। তুই অযথাই মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছিলি।”
“এখন যখন তোরা জানিস, বাইরের মানুষকে জানানোর দরকার নেই। আমি চাই না খবরটা ওর কানে পৌঁছাক। আমার সন্তানের আসার খবর শোনার অধিকার-ও ও হারিয়েছে। বেঁচে থাকলে আমি আমার সন্তানকে ওর মুখ-ও দেখাব না।”
“ঠিক আছে, তোর যা ভালো মনে হয়।”

রাস্তার পাশে কতরকম খাবার বিক্রি হচ্ছে। মৃন্ময়ীর সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে মৃত্তিকার হঠাৎ তাদের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেল। বাবা তাদের দুবোনকে দুই হাতে করে বাজারে নিয়ে আসতেন। যে যা খেতে চাইত তা-ই কিনে দিতেন। মায়ের জন্য-ও কিছু না কিছু কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। বাবা চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেসব সময়গুলো-ও তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এখন আর যখন যা ইচ্ছা তা-ই কিনে খাওয়া হয় না। খেতে ইচ্ছা করলে-ও কাউকে বলা যায় না। তার আগে টাকার কথা ভাবতে হয়। মৃত্তিকা বলে উঠল,
“আপা, চল ফুসকা খাই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ফুসকা খাবি? চল।”
ফুসকার দোকানে তখন ছেলে-মেয়েদের ভিড়। সামনেই একদল ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ফুসকার জন্য। তারা দুবোন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সামনের ছেলেগুলো সরে যাওয়ার। ঠিক তখনই প্রভাত এসে মৃন্ময়ীর পাশে দাঁড়াল। গলা তুলে বলল,
“মামা, তিন প্লেট ফুসকা।”
তার কন্ঠ শুনে সামনের ছেলেগুলো ফিরে তাকিয়ে হাসিমুখে আলাপ জুড়ে দিলো। মৃন্ময়ীর মনে হলো এরা আলাপের চেয়ে বেশি আহ্লাদ করছে। একজন আবার অতিরিক্ত আহ্লাদ দেখিয়ে ফুসকাওয়ালাকে বলে বসল,
“এই মামা, আগে ভাই-ভাবিকে দাও।”
সঙ্গে-সঙ্গে মৃন্ময়ী চোখ বড়ো করে তাকিয়ে বলল,
“কে তোমার ভাবি?”
ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“রাগ করবেন না ভাবি। আপনি ভাইয়ের সাথে সময় কা’টান, আমরা না হয় পরে আসব ফুসকা খেতে।”
“আমি তোমার ভাইয়ের সাথে এসেছি যে সময় কা’টাব? আমরা দুবোন এসেছি, চোখে দেখতে পাওনি? আজাইরা চাটুকারিতা আমার সামনে থেকে সরে করো গিয়ে। আমাদের দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখার সময় নেই।”
তার কথাগুলো যেন ছেলেটার গায়েই লাগল না। বরং সে বাকিদের বলে উঠল,
“এই, ভাবির মাথা গরম হয়ে গেছে। চল, আমরা পরে আসব।”
ছেলেগুলো প্রভাতকে লম্বা সালাম ঠুকে সরে গেল। মৃত্তিকা হা করে তাকিয়ে শুধু কাহিনি দেখছিল। এবার সে মৃন্ময়ীর এক হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“কী-রে আপা? এই প্রভাত ভাই কি এখনও তোর পিছু ছাড়েনি? তুই না মাকে বলেছিলি পিছু ছেড়ে দিয়েছে?”
মৃন্ময়ী উত্তর না দিয়ে তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। কর্মচারী ছেলেটা তিন প্লেট ফুসকা দিয়ে গেল। তারা দুজন বেঞ্চে বসতেই পাশে এসে প্রভাত-ও বসে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্তিকা বলে উঠল,
“আপনি কি আর কোনো জায়গা চোখে দেখছেন না? আপার পাশে বসতে কে ডেকেছে আপনাকে?”
প্রভাত ভ্রুকুটি করে মৃন্ময়ীকে প্রশ্ন করল,
“ম্যাডামের পাশে আর কার বসার কথা?”
মৃন্ময়ীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মৃত্তিকা আবারও বলে উঠল,
“আপনি অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসুন।”
“ফুসকাওয়ালা মামা কি এই বেঞ্চটা ম্যাডামের নামে লিখে দিয়েছে?”
মৃত্তিকা এবার তেতে উঠে বলল,
“আপনি তো আসলেই ঘাড়ত্যাড়া প্রভাত ভাই। এখনও আপনি আপাকে এভাবে জ্বালান? আশ্চর্য! আমি তো ভাবতেই পারছি না আপনি এখনও আপার পেছনে পড়ে আছেন। একটা মানুষ কতক্ষণ একজনের জ্বালাতন সহ্য করতে পারে? বুঝেছি, আমার আপাকে অতিরিক্ত ভদ্র পেয়ে মাথায় উঠে গেছেন, না? এরপর আপনার বাবা আমার সামনে পড়ুক, আমি যদি আপনার এই কুকর্মের কথা না জানিয়েছি তাহলে-”
মৃত্তিকার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রভাত বলে উঠল,
“তাহলে তোমার নাম পালটে মৃত্তিকা থেকে মিষ্টি খা রাখা হবে। ঠিক আছে, আমি রাজি।”
মৃত্তিকা মৃন্ময়ীকে বলল,
“আপা, তুই এতদিন ধরে এই অসহ্য লোকটাকে কীভাবে সহ্য করেছিস? তুই এত ভীতু? ওনার বাবার কাছে নালিশ না জানিয়ে চুপচাপ সহ্য করে নিয়েছিস? কী অদ্ভুত কাণ্ড!”
মৃন্ময়ী বলল,
“আহা! প্লেট হাতে নিয়ে বসে আছিস কেন? চুপ করে খা না।”
“তুই নিজেও কিছু বলছিস না, আমাকেও বলতে দিবি না? এজন্যই তো এই লোক তোকে বোকা পেয়ে সুপারগ্লুর মতো লেগে আছে।”
প্রভাত ফুসকা চিবোতে-চিবোতে গলা তুলে বলল,
“মামা, তোমার ফুসকা খেয়ে আমার শ্যালিকার মাথা গরম হয়ে গেছে। আরেক প্লেট দিয়ো।”
“এই, কে আপনার শ্যালিকা? ফাজলামি পেয়েছেন?”
মৃত্তিকা তেড়ে উঠতে নিতেই মৃন্ময়ী তাকে ধরে বসিয়ে দিলো। বলল,
“তুই কি বাড়ি যাবি না? আগে ফুসকা শেষ কর তো।”
মৃত্তিকা বলল,
“তুই শুনলি না উনি কী বলল? আমি ওনার কোন জন্মের শ্যালিকা হই? ওনার মতো ছেলের সাথে জীবনে আমি আমার বোন বিয়ে দিবো? ফালতু লোক!”
“আচ্ছা হয়েছে। তুই আগে খা, আমি কথা বলছি ওর সাথে।”

মৃন্ময়ী প্রভাতের দিকে তাকাতেই সে হাসি প্রশস্ত করল। মৃন্ময়ী চাপা গলায় বলল,
“দয়া করে মৃত্তিকার সামনে পাগলামি কোরো না। ও গিয়ে বাড়িতে বললে মা আমাকে নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা করবে।”
প্রভাত-ও নিচু স্বরে বলল,
“তারমানে তুমি স্বীকার করছো আমি আসলে তোমার মায়ের দুশ্চিন্তার কারণ হওয়ার মতো মানুষ নই?”
“তুমি কি যাবে এখান থেকে?”
“যাব, আজ শ্যালিকার সাথেই সময় কা’টাও। আমি দুঃখবিলাস করতে-করতে চলে যাই। ফিরে আসা পর্যন্ত ভালো থেকো।”

প্রভাত বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে গেল। সে চলে যাওয়ার পর-ও মৃত্তিকা তাকে বিড়বিড় করে বকে চলল। মৃন্ময়ী বিল দিতে গিয়ে শুনল প্রভাত তাদেরটাসহ বিল দিয়ে দিয়েছে। মৃত্তিকা তাকে বলল,
“এরপর দেখা হলে তুই ওনাকে টাকা দিয়ে দিস। আগে জানলে বিল দিতেই দিতাম না। বিরক্তিকর লোক একটা।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আচ্ছা যাক, দিয়ে যখন চলেই গেছে, তখন তো আর কিছু করার নেই। দেখা হলে টাকা দিয়ে দিবো নে। চল ওঠ।”
মৃদুলা আর মায়ের জন্য-ও ফুসকা কিনে নিয়ে তারা দুজন বাড়ি ফিরেছে। তারা যখন বাড়ি ফিরেছে তখন সাজেদা বেগম নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে ঠেলেঠুলে পাঠাল মাকে ডেকে আনতে। মৃত্তিকা মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল মা শুয়ে আছেন, কিন্তু ঘুমাননি। সে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে ডাকল,
“মা?”
সাজেদা বেগম চোখ তুলে তাকিয়ে মৃত্তিকাকে দেখে শুধালেন,
“কী হয়েছে? মাত্র এলি?”
“হ্যাঁ। আপা-ও এসেছে। আপা ফুসকা এনেছে। এসে খাও।”
“ও আবার ওসব আনতে গেল কেন?”
“আমি আর আপা ফেরার সময় খেয়েছিলাম। তাই তোমার আর মৃদুলার জন্য-ও নিয়ে এসেছে।”
“তোরা একসঙ্গে এসেছিস?”
“হ্যাঁ।”
সাজেদা বেগম শোয়া থেকে উঠে বিছানা থেকে নামতে-নামতে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর শরীরের কী অবস্থা?”
“ভালো।”
“চেকআপ করিয়েছিস?”
“গতমাসে করেছিলাম।”
“এখন আবার করিয়ে নিস। তোদের তো কাজের বিষয়ে কোনো খেয়াল থাকে না। নিজের অযত্ন করে বাচ্চাটার ক্ষতি করবি। ভালো কথা কানে ঢুকলেই হলো।”
মৃত্তিকা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এমনভাবে কথা বলছে যেন সে কেবল বলার জন্যই বলছে। অথচ মৃত্তিকা এই প্রথম টের পেল মায়ের থমথমে কথার আড়ালের যত্ন। সে বলল,
“কাল-পরশু চেকআপ করিয়ে নিব আবার।”
মৃন্ময়ী প্যাকেট থেকে ফুসকা বের করে প্রস্তুত করে রাখছিল। সাজেদা বেগম এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“মৃদুলা এখনও আসেনি?”
“না।”
“ও আবার কখন আসবে? এসব খাবার-দাবার পরে আর ভালো লাগবে?”
“ও এখনই চলে আসবে। নাও, খাও তুমি।”
সাজেদা বেগম চেয়ারে বসে বললেন,
“তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কী করতে? স্কুল থেকে এসেছিস, ক্লান্ত লাগছে না? যা আগে হাত-মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হ।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“আমি যাচ্ছি। তুমি তোমার মেজো মেয়েকে বলো মা। কে নিজের অযত্ন করছে দেখছোই তো।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“করুক অযত্ন। যার-যার সন্তানের সুস্থতার দায়িত্ব তার-তার ওপর। মাথা আরেকজনের, ব্যথা কি হবে আমার?”
সুযোগ পেয়ে মৃন্ময়ী বলে উঠল,
“তোমার ব্যথা হয় না কে বলল? ও-ও তো তোমার সন্তান। মাথাব্যথা তো তোমার-ও আছে মা।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“কথা না বাড়িয়ে হাত-মুখ ধুতে যা।”
মৃন্ময়ী মৃদু হেসে মৃত্তিকাকে ইশারা করে ঘরে চলে গেল। মৃত্তিকা ঘরে যেতে নিয়ে-ও আবার কী ভেবে বলে বসল,
“মা, আজ রাতে খিচুড়ি রান্না করবে?”
সাজেদা বেগম উত্তর দিলেন,
“পেয়াজ নেই। মৃদুলাকে ফোন করে বল আসার সময় নিয়ে আসতে।”
“আচ্ছা।”
মৃত্তিকার কেন জানি হঠাৎ করেই মনটা ভীষণ হালকা লাগতে শুরু করল। মা বুঝি এমনই?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৭

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৭.
টিউশন থেকে বেরিয়ে মৃদুলা পনেরো মিনিট ধরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। পনেরো মিনিটে বোধহয় পনেরোটা গাড়ি তাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আপা যাইবেন? আপা, কই যাইবেন?’ অতিরিক্ত হিসেবে আবার পাশের দোকানদার-ও জিজ্ঞেস করেছে, ‘আপা কি কারো জন্য অপেক্ষা করতাছেন? এমন চরকার মতো ঘুরতাছেন ক্যান?’ মৃদুলা সবার কথার উত্তরেই কেবল দুপাশে মাথা নাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে তার বিরক্তি। জাহিদ এল তার অপেক্ষার সতেরো মিনিটের মাথায়। তা-ও খালি হাতে। মৃদুলা দূর থেকেই দেখতে পেল জাহিদ দৌড়ে তার দিকে আসছে। হাতে ফুল নেই। নিশ্চিতভাবে এখন এসে সামনে দাঁড়িয়েই বলবে, ‘গাড়ি পাইনি, ফুল কেনার সময় ছিল না।’ মৃদুলা রাগ করলেই বলবে, ‘কানে ধরব?’ এই ছেলেটা যে তার প্রেমিক, মাঝে-মাঝে মৃদুলার বিশ্বাস করতে-ও কষ্ট হয়। জাহিদ তার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে ঠিক বলে উঠল,
“সরি জান, অনেক দেরী হয়ে গেল। আসলে গাড়ি পাচ্ছিলাম না। তাই-”
মৃদুলা হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“থাক, এসব জানি আমি। আপনি আগে নিঃশ্বাস ছাড়েন।”
জাহিদ সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মৃদুলা হাতের পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পানি খান।”
বোতলের অর্ধেক অংশ পানি ছিল। জাহিদ ঢকঢক করে পুরোটা পানি গলাধঃকরণ করে ফেলল। তারপর খালি বোতলটা মৃদুলাকে ফেরত দিয়ে বলল,
“উফ্! শান্তি লাগছে। জোরে দৌড়ে এসে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।”
মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“আপনাকে দৌড়াতে কেন হয়েছে?”
“কেন আবার? তোমার কাছে আসার জন্য।”
“আমার কাছে আসতে আপনাকে দৌড়াতে কেন হবে? টিউশন আমি করি, না আপনি? পরপর দুটো টিউশন করে আমাকে কেন আবার আপনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? আমি কি হাতে অফুরন্ত সময় নিয়ে বসে থাকি?”
জাহিদ নিষ্পাপ মুখ করে বলল,
“রাগ করলে? রাগ কোরো না প্লিজ। এমন ভুল আর কখনও করব না, সরি।”
মৃদুলা রেগেমেগে বলল,
“রোজ-রোজই আপনি এ কথা বলেন। পটানোর আগে তো ঠিকই এক ঘন্টা আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন। তখন গাড়ি কোথায় পেতেন? এখন যেই না প্রেমিকা বানিয়ে ফেলেছেন, অমনি আপনার কপাল থেকে গাড়ি উঠে গেল?”
“এই কারণেই তো বাবাকে বাইক কিনে দিতে বলছি। আম্মু-ই তো রাজি হচ্ছে না। বাইক নিয়ে রাস্তায় বোরোলেই না কি অ্যাক্সিডেন্ট করে আমি ম’রে যাব।”
মৃদুলা মহাবিরক্ত হয়ে বলল,
“রাখুন আপনার বাইক। ইচ্ছা থাকলে ভ্যানগাড়িতে চড়ে-ও আগে আসা যায়। শুনুন, এরপর কিন্তু আমি এক মিনিট-ও অপেক্ষা করব না। আজ সতেরো মিনিট অপেক্ষা করিয়েছেন। আমার পরীক্ষার পড়া কি আপনি পড়ে দিবেন? আমি বাড়ি ফিরে পড়ব কখন?”
“আহা! পড়তে পারবে। এখন তো এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার আরও সময় নষ্ট হচ্ছে। চলো তো, হাঁটতে-হাঁটতে যত ইচ্ছা বকো।”

মৃদুলা ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটা দিলো। এই ছেলের সঙ্গে রাগ করাই বেকার। এর আছে গণ্ডারের চামড়া। কোনো কথাই গায়ে লাগে না। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এই ছেলে তার পেছনে লেগেছে। কতবার করে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। মৃদুলা তখন ভয়ে রাজি হয়নি। জাহিদের পারিবারিক অবস্থান তাদের চেয়ে অনেক ওপরে। এ কারণেই সে সবসময় জাহিদকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু নিজের অনুভূতি থেকে আর কদিন পালিয়ে বাঁচা যায়? মন তো সে হারিয়েই বসেছিল। এভাবে চলতে-চলতেই কীভাবে যেন পাজি ছেলেটা তাকে পটিয়ে ফেলল। এখন আর মৃদুলা পালানোর পথ-ও খুঁজে পায় না।
জাহিদ মৃদুলার সঙ্গে সমান তালে হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“তোমার জন্য একটা সুন্দর জিনিস এনেছি।”
জাহিদ দেরী করলেই সেদিন হাতে করে ফুল নিয়ে উপস্থিত হয়। আজ তার হাতে ফুল-ও নেই। কী সুন্দর জিনিস এনেছে বুঝতে পারল না মৃদুলা। তবু অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলল,
“লাগবে না সুন্দর জিনিস।”
“লাগবে না?”
“না।”
“শিওর?”

মৃদুলার জায়গায় অন্য মেয়ে হলে একটু দোনামনা করে অভিমানী সুরে বলত, জানি না। যাতে সুন্দর জিনিসটা দ্রুত তার হাতে এসে পড়ে। কিন্তু মৃদুলা তার বিপরীত। সে কপালে ভাঁজ ফেলে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি এত গাধা কেন? প্রেমিকার রাগ-ও ঠিকমতো ভাঙাতে জানেন না। আপনার প্রেমিক হয়ে চরম ভুল হয়েছে। আপনার হওয়া উচিত ছিল প্রেমিকা, আর আমার হওয়া উচিত ছিল প্রেমিক। আপনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতাম প্রেমিক কীভাবে হতে হয়।”
“তার মানে তুমি বলছো আমি এখনও প্রেমিক হতে পারিনি?”
“না।”
“সিরিয়াসলি?”
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট,” শক্ত গলায় বলল মৃদুলা।
জাহিদ ভাবুক মুখে শুধাল,
“তাহলে কীভাবে আমি প্রেমিক হয়ে উঠতে পারি মিস?”
“প্রেমিকাকে সতেরো মিনিট অপেক্ষা করিয়ে খালি হাতে এসেছেন কেন? ফুল কোথায়?”
জাহিদ দ্রুত পকেট থেকে বকুল ফুলের মালাটা বের করল। মৃদুলার সামনে মালা ঝুলিয়ে ধরে বলল,
“এই তো, ফুলের মালা এনেছি। এটা কি প্রেমিকা গ্রহণ করবে?”
মুখে উত্তর না দিয়ে মৃদুলা হাত বাড়িয়ে দিলো। জাহিদ তার হাতে মালাটা পরিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল,
“এখন কি আমি আপনার প্রেমিক হতে পেরেছি?”
মৃদুলা বলল,
“ভেবে দেখব।”
“তাড়াতাড়ি জানালে একটু সুবিধা হয়।”
“প্রেমিকদের এত তাড়া থাকবে কেন?”
“ওহ্ আচ্ছা! প্রেমিকদের তাড়া থাকা-ও নিষেধ? ঠিক আছে, আমার কোনো তাড়া নেই। আপনার যখন ইচ্ছা জানাবেন।”
মৃদুলার ঠোঁটের কোণে মিটমিটে হাসি। জাহিদ বলল,
“তোমার আপা রাগ করে আছে জানো?”
মৃদুলা অবাক হয়ে বলল,
“আপা রাগ করে আছে? কার সাথে?”
“কার সাথে তোমার আপা রাগ করতে পারে?”

প্রশ্নটা শুনে মৃদুলার খেয়াল হলো। জাহিদের মুখে তার আপার খবর মানেই তা প্রভাত ঘটিত ব্যাপার। বয়সে ছোটো হলেও জাহিদের সঙ্গে প্রভাতের একটা ভালো সম্পর্ক আছে। প্রতিবেশি হওয়ার সুবাদে ছোটোবেলা থেকেই জাহিদ প্রভাতের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। এ কারণে বাবা-মায়ের কত বকাঝকা যে সে শুনেছে, হিসাব নেই। বাবা-মা ভাবত প্রভাতের সঙ্গে মিশলেই সে খারাপ হয়ে যাবে। যদিও সে তেমনটা হয়নি। প্রভাতের সঙ্গে মিশলেও সে প্রভাতের মাঝে তেমন খারাপ কিছু দেখেনি। মানুষ একটু বেপরোয়া, দুষ্টু স্বভাবের হলেই কি সে খারাপ হয়? বুঝে আসে না জাহিদের। তাই প্রভাতের সঙ্গ সে এখনও বেশ উপভোগ করে। তার কাছেই রোজ প্রভাত-মৃন্ময়ীর সমস্ত খবর মৃদুলা পায়। আজ মৃন্ময়ীর রাগ করার বিষয়টি শুনে সে জাহিদকে বলল,
“প্রভাত ভাইকে সুন্দর কোনো বুদ্ধি দিবে, যাতে আপুর রাগ তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়।”
জাহিদ হেসে বলল,
“প্রভাত ভাইয়ের আমার বুদ্ধির প্রয়োজন আছে? সে নিজেই বুদ্ধির জাহাজ। পারলে আমরাই তার কাছে যাই সুন্দর বুদ্ধি নেওয়ার জন্য।”
মৃদুলা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“তোমার এই ফুল নিয়ে এসে প্রেমিকার রাগ ভাঙানোর বুদ্ধিটা-ও কি প্রভাত ভাইয়ের থেকে নেওয়া?”
জাহিদ দ্রুত গতিতে ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল,
“এই না-না-না। একদমই না।”
“অস্বীকার করে লাভ নেই। আমি বুঝে গেছি।”
জাহিদ হতাশ গলায় বলল,
“কিন্তু আমি তো অন্য বুদ্ধির কথা বুঝিয়েছি।”


আজ সারাদিন ধরে মৃন্ময়ীর মাথায় মৃত্তিকার কাজের কথাই ঘুরছে। যতই সে মৃত্তিকাকে বলুক এই কাজ না পেলে অন্য কাজ পাওয়া যাবে। অন্য কাজ পাওয়াটা তো আর মুখের কথা না। এই কাজটা না হলে সে মৃত্তিকার জন্য কী কাজ ঠিক করবে, এই ভাবনা-ই ঘুরছে তার মাথায়। একটার আশায় থেকে তো আর মাথা থেকে চিন্তা দূর করা যায় না। এদিকে গত তিনদিন ধরে প্রভাত তার রাগ ভাঙানোর জন্য কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে। সেদিনের ব্যাপারটা নিয়ে প্রভাতের ওপর তার রাগ হয়েছিল। কিন্তু তার রাগ কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দুদিন রাগ করে থাকলেও এখন সে ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। একে তার মাথায় চিন্তার শেষ নেই, এরমধ্যে ওসব মাথায় ঢুকিয়ে বসে থাকার সময় কোথায়? প্রভাত কি আর তা জানে? সে তো আজও আয়োজন করে এসেছে মৃন্ময়ীর রাগ ভাঙাতে। মৃন্ময়ী স্কুল থেকে বেরোনোর আগেই সে পথে দাঁড়িয়ে ছিল হাতে বড়ো একটা ফুলের তোড়া নিয়ে। গোলাপ ফুলের তোড়া। বাচ্চাদের অভিভাবকরা যাওয়ার পথে এ দৃশ্য দেখে খুব ফিসফিস করছে। এক বাচ্চা ফুল দেখে বায়না ধরল তার ফুল চাই। প্রভাতের কাছে সে ফুল চেয়ে বসল। তার মা তাকে জোর করে-ও সেখান থেকে সরাতে পারল না। প্রভাত হাঁটু মুড়ে বসে বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করল,
“নাম কী পিচ্চি?”
বাচ্চাটা উত্তরে বলল,
“ফুল দাও।”
প্রভাত বলল,
“নাম না বললে ফুল দিবো না।”
বাচ্চাটা এবার সুন্দরভাবে বলল,
“আমার নাম রাইসা।”
“রাইসা? তোমার নামটা তো খুব সুন্দর। তুমিও খুব সুন্দর।”
বাচ্চাটা আবারও হাত পেতে বলল,
“ফুল দাও।”
প্রভাত বলল,
“ফুল দিবো। আগে বলো তো এই ফুল কার মতো দেখতে?”
বাচ্চাটা বোকা চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
“জানি না।”
“জানো না?”
“না।”
“জানতে হবে।”
বাচ্চাটার বোধহয় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ফুল দাও।”
প্রভাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আহা! কাঁদে না। রাইসা না ভালো মেয়ে? রাইসাকে আমি ফুল দিবো তো। বলো তো তোমার কয়টা ফুল চাই?”
বাচ্চাটা দুটো আঙুল তুলে বলল,
“দুইটা।”
“তাহলে তো তোমাকে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আচ্ছা বলো তো, মৃন্ময়ী ম্যাম আমার কে হয়?”
বাচ্চাটা আবার দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“জানি না।”
প্রভাত বলল,
“বউ হয়, বউ। এবার বলো তো কী হয়?”
বাচ্চাটা তাকে অনুসরণ করে বলল,
“বউ হয়।”
প্রভাত চমৎকার হেসে বাচ্চাটার গাল টিপে দিয়ে বলল,
“এই তো রাইসা কত্তকিছু জানে! কত্ত সুইট রাইসা! এই নাও তোমার ফুল। আর শোনো, এই ফুলটা তোমার মতো দেখতে, আর এটা মৃন্ময়ী ম্যামের মতো। আরেকটা তোমার গিফট, নাও-নাও।”
আনন্দে গদগদ হয়ে প্রভাত বাচ্চাটার হাতে দুইটার জায়গায় তিনটা ফুল দিয়ে দিলো। ফুল পেয়ে বাচ্চাটা-ও ভীষণ খুশি হলো। মিষ্টি হেসে সে প্রভাতকে ‘থ্যাংক ইউ আঙ্কেল’ বলতে-ও ভুলল না। গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে বিষয়টা মৃন্ময়ী দেখল ঠিকই, কিন্তু ধরা দিলো না। বাচ্চাদের সাথে-ও মানুষ এমন বাচ্চামি করে? প্রেমে পড়লে মানুষ কী আজব-আজব কাজ করে! রাইসা চলে যেতেই মৃন্ময়ী সামনে পা বাড়াল। প্রভাত তাকে দেখামাত্র ছুটে এল। ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে ধরে একগাল হেসে বলল,
“ম্যাডামের জন্য।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ধন্যবাদ, আমার ফুল লাগবে না।”
“কিন্তু আমি এটা তোমার জন্যই এনেছি। সেদিনের ব্যাপারটার জন্য সরি। আর রাগ করে থেকো না প্লিজ।”
“আমি তোমার ওপর রেগে নেই।”
“আমি জানি তুমি রেগে আছো। ফুলটা নাও না।”
“বলছি তো আমি রেগে নেই। আমি তোমার ওপর রাগ ধরে রাখার কে? আগ বাড়িয়ে বেশি ভেবো না প্রভাত।”
“ঠিক আছে, তাহলে এটা নাও। তাহলেই আমি বিশ্বাস করব তুমি আমার ওপর রেগে নেই।”
“আচ্ছা আমি এত বড়ো ফুলের তোড়া নিয়ে বাড়ি ফিরব কীভাবে? এই সামান্য ব্যাপারটা কি তুমি বোঝো না? শুধু-শুধু জেদ কোরো না।”
“ফুল নিয়ে বুঝি বাড়ি ফেরা যায় না?”
“যায়, কিন্তু এতগুলো ফুল দেখলে বাড়ির মানুষ কী ভাববে তার কোনো ঠিক আছে?”
প্রভাত ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো,
“কী আবার ভাববে? তোমাকে এতগুলো ফুল দেওয়ার মতো একজন ব্যক্তি-ই আছে। সে প্রভাত তরফদার। এই সামান্য কথাটা কে না জানে?”

ওদিকে মৃন্ময়ী বাড়িতে মাকে বলে রেখেছে এখন আর প্রভাত তাকে বিরক্ত করে না। মা তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে বলেই মিথ্যেটা বলতে হয়েছে। এতগুলো ফুল নিয়ে সে কোনোভাবেই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। আর যা-ই হোক, তার মা এতটাও বোকা না। প্রভাত-ও এক নাছোড়বান্দা। ফুল সে এনেছে মানে মৃন্ময়ীকে নিতেই হবে। নয়তো ফুল গিয়ে পড়বে সোজা রাস্তার ধারের দিঘিতে। ভেবেচিন্তে মৃন্ময়ী বলল,
“ঠিক আছে, আমি তোমার ফুল নিব। কিন্তু আমি এসব বাড়িতে নিতে পারব না। তোমার ফুল নিয়ে আমি অন্য কাউকে দিলে তোমার কোনো আপত্তি আছে?”
“ফুল গ্রহণ করলে এসব তোমার। তুমি অন্য কাউকে দিতে পারো, কিন্তু কোনো ছেলেকে না। তোমার প্রেমে পড়ে যাবে এমন কোনো ছেলে ছাড়া যে কাউকে দিতে পারো। চাইলে আমাকে-ও দিতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
মৃন্ময়ী ফুলের তোড়া নিল। এরপর সে পথে যে বাচ্চাকে দেখল, তার হাতেই একটা করে ফুল ধরিয়ে দিলো। অপ্রত্যাশিতভাবে অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে ফুল পেয়ে বাচ্চারা দারুণ খুশি হলো। তাদের খুশি দেখে মৃন্ময়ীর-ও মন ভালো হয়ে গেল। প্রভাত হাসিমুখে কেবল দেখে গেল। ব্যাপারটা তার কাছে মন্দ লাগছে না। মৃন্ময়ী যে আনন্দ পাচ্ছে, এতেই তার অনেককিছু পাওয়া হয়ে গেছে। সমস্ত ফুল ফুরিয়ে যাওয়ার পর প্রভাত বলে উঠল,
“আমাকে একটা-ও দিলে না। আমি তোমার এত অপ্রিয়?”
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমিই তো বলেছিলে আমার ফুল আমি যে কাউকে দিতে পারব।”
“আমার কথা-ও বলেছিলাম।”
মৃন্ময়ী মুচকি হেসে বলল,
“তোমার জন্য ধন্যবাদ।”
“শুধুই ধন্যবাদ।”
“হ্যাঁ, শুধুই ধন্যবাদ।”
“ঠিক আছে। তোমার শুধুই ধন্যবাদের সাথে না নয় মনে-মনে আমি কিছু ভালোবাসা যোগ করে নিলাম।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি ধন্যবাদ ছাড়া কিছু দিইনি।”
প্রভাত হেসে বলল,
“তুমি না দিলেও আমি ভেবে নিব।”


পাঠাগারের কাজটা শেষমেশ মৃত্তিকা-ই পেয়েছে। খবরটা স্কুল থেকে ফোন করে মৃত্তিকাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল থেকেই তাকে ডিউটিতে ডাকা হয়েছে। খবরটা পেয়ে খুশিতে মৃত্তিকার চোখে পানি চলে এল। তখনই সে ছুটল মৃন্ময়ীকে খবরটা দিতে। মৃন্ময়ী ঘরেই ছিল। মৃত্তিকা তাকে না ডেকেই সোজা ঘরে ঢুকে গেল। সে দেখল মৃন্ময়ী জামা সেলাই করছে। তাকে দেখে মৃন্ময়ী বলল,
“কী-রে? এভাবে ছুটে এলি যে? কী হয়েছে?”
মৃত্তিকা আসল কথা না বলে প্রশ্ন করল,
“কী করছিস আপা?”
“দেখছিস-ই তো কী করছি। জামাটা কদিন আগেই বানিয়েছিলাম। আজকালকার কাপড়ের যা অবস্থা! কদিন পরতেই টান লাগতেই কীভাবে ছিঁড়ে গেল দেখ। অল্প একটু ছিঁড়েছে, তাই ভাবলাম সেলাই করে আরও কয়েকদিন চালিয়ে দিই। ফেলে দিয়ে কী হবে? বাইরে তো আর পরব না।”
মৃত্তিকা জানে জামাটা কদিন আগে কেনা না। তাকে সাথে নিয়েই গতবছর মৃন্ময়ী জামাটা কিনেছিল। হয়তো সে ভুলে গেছে। কিন্তু মৃত্তিকা জামাটা দেখেই চিনতে পেরেছে। সব খরচ সামলে সম্ভব হলে মৃন্ময়ী নিজের জন্য কিছু কিনে। সম্ভবত বেতনের সবচেয়ে কম ভাগটাই তার নিজের খরচের জন্য অবশিষ্ট থাকে। মৃত্তিকা সেটা জানে, কিন্তু কোনোদিন-ও এ বিষয়ে সে ভ্রূক্ষেপ করেনি। আজ মৃত্তিকা বলল,
“বেতন পেলে এবার নিজের জন্য দুটো নতুন জামা কিনিস আপা।”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“কিনব।”
যদিও এটা তার মুখের কথা। খরচ সামলে উঠতে না পারলে সে এই মাসে-ও নতুন জামা কিনবে না। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে মৃত্তিকা আসল কথায় ফিরল। মুখে হাসি টেনে বলল,
“আপা, একটা সুসংবাদ আছে।”
মৃন্ময়ী চট করে মুখ তুলে বলে উঠল,
“তোর চাকরি হয়েছে?”
মৃত্তিকা অবাক হয়ে বলল,
“তুই বুঝলি কীভাবে?”
মৃন্ময়ী খুশিতে প্রশস্ত হেসে বলল,
“তারমানে সত্যিই তোর চাকরিটা হয়েছে? আলহামদুলিল্লাহ্, আলহামদুলিল্লাহ্। আমি তো কদিন ধরে শুধু এটাই ভাবছিলাম। এবার তাহলে স্বস্তি পেলাম। কবে থেকে ডিউটি করতে বলেছে?”
“কাল থেকেই।”
“তাহলে তো ভালোই হয়েছে। শোন, খুব মন দিয়ে কাজ করবি কিন্তু। অন্য কোনোদিকে মন দেওয়া যাবে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এ কদিনে তুই আমাকে হাজারবার বুঝিয়ে ফেলেছিস। আমি বাচ্চা না, বুঝি সব।”
“তোকে নিয়ে চিন্তা হয় বলেই তো বুঝাই। যা, মাকে খবরটা দিয়ে আয়।”
মৃত্তিকা কেমন চুপসে গেল। দ্বিধাভরা কন্ঠে বলল,
“তুই বল।”
“আমি বলব কেন? চাকরি কি আমার হয়েছে? তোর হয়েছে, তুই বলবি।”
“আমার কেমন যেন লাগছে। তুই বল না প্লিজ।”
“তুই এত বোকা কেন রে? এ কদিনে মা তোর চাকরির ব্যাপারে কতবার আমাকে প্রশ্ন করেছে জানিস? সে মনে-মনে তোর জন্য ঠিকই চিন্তা করে, তুই-ই বুঝিস না।”
“আয় না। তুই এলে কী সমস্যা?”
“আচ্ছা চল, আমিও যাচ্ছি। কিন্তু খবরটা তোর নিজের মুখেই বলতে হবে।”

মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে ধরে নিয়ে এল মায়ের কাছে। সাজেদা বেগম তখন রোদে শুকিয়ে আনা কাপড় গোছাচ্ছেন। মৃন্ময়ী এসে আনন্দিত গলায় বলে উঠল,
“মা, একটা আনন্দের খবর আছে।”
সাজেদা বেগম উৎসুক মুখে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,
“কী খবর?”
“আমি না, মৃত্তিকা বলবে। মৃত্তিকা, বল মাকে।”
মৃত্তিকার মুখের দিকে সাজেদা বেগম তাকিয়ে আছেন। মৃত্তিকা সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করতে না পেরে বলল,
“মা, আমার চাকরিটা হয়েছে।”
সাজেদা বেগম খুশি হয়েছেন কি না বুঝতে পারল না মৃত্তিকা। তিনি কেবল ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলেই আবার কাপড় গোছানো ধরলেন। মৃত্তিকা মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকাল। মৃন্ময়ী মাকে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি খুশি হওনি মা?”
সাজেদা বেগম বললেন,
“খুশি হব না কেন?”
মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে কনুইয়ের গুঁতা মে’রে ফিসফিসিয়ে বলল,
“খুশি হয়েছে। হেঁয়ালি করা এনার স্বভাব।”
মৃত্তিকা মৃদু হাসল। বোনের কথাটা সে বিশ্বাস করে নিল। মাকে সে কবেই বা বুঝতে পেরেছে?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।