Wednesday, June 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 11



মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৬

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৬.
মৃন্ময়ী খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছে তাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন পাঠাগার হয়েছে। পাঠাগারের দায়িত্ব পালনের জন্য লোক নেওয়া হবে। খবরটা পেয়ে মৃন্ময়ী দেরী না করে দ্রুত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করেছে। স্যার তাকে ভালোভাবেই চেনেন। রোজ সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে স্যারের সঙ্গে তার দেখা হয়। সে সালাম দিলেই স্যার হাসিমুখে তার খোঁজ-খবর নেন। মৃন্ময়ীর বোনের কথা শুনে তিনি বললেন মৃত্তিকার বিষয়ে তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন। আরও বললেন মৃত্তিকা যেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ নিয়ে একবার স্কুলে আসে। মৃন্ময়ী মনে-মনে খুব করে চাইছিল এই কাজটা যেন মৃত্তিকা পায়। তার জন্য এমন কাজ-ই দরকার। এরচেয়ে ভালো কাজ তার জন্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। মৃত্তিকা-ও শুনে মনেপ্রাণে চাইছিল সে যেন কাজটা পেয়ে যায়। এসএসসি আর এইচএসসির সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে সে মৃদুলাকে সঙ্গে করে স্কুলে-ও যায়। স্যার শুধু মৃত্তিকার কাগজপত্র চেক করে কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন। এরপর বলে দিয়েছেন মৃত্তিকার আগেও তিনজন কাগজপত্র জমা দিয়ে গেছে। সময়মতো তারা জানিয়ে দিবেন কাকে নেওয়া হবে। অবশ্য মৃন্ময়ী জানত বিষয়টা এত সহজ হবে না। এসব কাজ যে পর্যায়ের-ই হোক, মানুষের লাইন পড়বেই। মৃন্ময়ী তার স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে-ও এই বিষয়ে কথা বলে তাকে অনুরোধ করেছে সে যেন স্কুলে একটু কথা বলে দেখে। প্রিন্সিপাল স্যার তাকে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি কথা বলবেন। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মৃত্তিকার স্বামীর সাথে তার দেখা হয়ে গেল। স্বামীকে দেখেই সে থমকে দাঁড়াল ঠিকই, কিন্তু তার স্বামী যেন তাকে দেখলই না। বলাবাহুল্য দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল। মৃত্তিকার কলিজাটা মনে হলো ফুটা হয়ে গেল। বুকে একরাশ ব্যথা আর চোখে ছলছল জল নিয়ে মৃত্তিকা বাড়ি ফিরল। বাকি দিনটা কা’টল তার কেঁদে-কেঁদে। মৃন্ময়ী বাড়ি ফিরে মৃত্তিকার খবর নিতে গিয়ে দেখল তার বোনের এমন অবস্থা। অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারল স্বামীর অমন অপরিচিত আচরণে সে কষ্ট পেয়েছে। মৃন্ময়ী শুনে আবাক হলো। যে লোক দ্বিতীয় বউ ঘরে তুলে মৃত্তিকাকে বিদায় করে দিয়েছে, তার অপরিচিত আচরণ কি অস্বাভাবিক কিছু? মৃত্তিকার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না? কী আশ্চর্য! অথচ মৃত্তিকাকে এ কথা বলতেই সে আবারও বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলল। আহাজারি করে বলল,
“আমি তো ওকে ভালবেসেছি। ওর জন্য আমি নিজের পরিবার ছেড়েছিলাম। সংসারের হাজারটা ঝামেলার মাঝেও আমি শুধুমাত্র ওর জন্য টিকে ছিলাম। ওর সাথে আমার একটা বছরের সংসার, এত-এত স্মৃতি। আমি ওসব কী করে ভুলে যাব রে আপা?”
মৃন্ময়ী বলল,
“কষ্ট হলেও ভুলে থাকতে হবে বোন। নইলে যে তুই তোর জীবনে সামনে এগোতে পারবি না।”
“কী করে ভুলব আপা? ভালোবাসার মানুষকে মাথা থেকে মুছে ফেলা কি এত সহজ?”
“হতে পারে কঠিন। তার চেয়েও বেশি কঠিন তোর বর্তমান জীবন। এটাও তোকে বুঝতে হবে। তোর বর্তমান জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখ। তোর জীবনটা এখন সম্পূর্ণ অগোছালো। তোকেই তা গুছিয়ে নিতে হবে। পিছুটান নিয়ে তুই নতুন করে জীবন সাজাবি কীভাবে? পিছুটান রেখেই বা কী লাভ? কোনো লাভ নেই, বরং এতে তোর কষ্ট বাড়বে। তোর জীবনটা নিয়ে পুতুল খেলে যে জিতে গেছে, নতুন করে জীবন সাজিয়ে তাকে তুই হারিয়ে দে।”
“ওকে চোখের সামনে দেখলে যে আমি ভেঙে পড়ি আপা।”
“ভেঙে পড়া চলবে না। শক্ত হতে হবে। তোর সঙ্গে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার নিজেকে নিয়ে ভাব মৃত্তিকা। নিজেকে ভালোবাসতে শেখ। যারা ঠকিয়েছে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দে, তাদের ছাড়াও তুই একটা সুন্দর জীবন কা’টানোর সাধ্য রাখিস। দেখি, চোখ মোছ। এখন থেকে একদম কাঁদবি না। খারাপ মানুষদের জন্য নিজের মূল্যবান চোখের জল ঝরানোর কোনো মানেই হয় না। ওরা চোখের জল পাওয়ার-ও যোগ্য না,” মৃত্তিকার চোখের পানি মুছতে-মুছতে বলল মৃন্ময়ী।
মৃত্তিকা নাক টেনে বলল,
“আমি চেষ্টা করব আপা।”
“অবশ্যই চেষ্টা করবি। চেষ্টা করলে সব সম্ভব। এখন থেকে তোর লক্ষ্য শুধু একটাই, নিজের জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা। আর কোনোদিকে তুই তাকাবি না। দৃষ্টি রাখবি শুধু নিজের লক্ষ্যের ওপর। দেখবি, একদিন তোর জীবন এত সুন্দর হয়ে উঠবে, এত সুন্দর উঠবে যে খারাপ মানুষগুলো-ও তোকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকবে। মনে-মনে আফসোস করবে। তখন আর তুই তাদের দিকে ফিরে তাকানোর-ও প্রয়োজনবোধ করবি না।”
মৃত্তিকা বলল,
“আপা, তোর কথা শুনে আমার কেমন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।”
“কেমন অনুভূতি? মনে সাহস জাগছে না? সত্যি-সত্যি কিছু করে দেখাতে ইচ্ছা করছে না?”
মৃত্তিকা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল,
“ইচ্ছা করছে, খুব ইচ্ছা করছে। আমার সত্যিই এই অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়া দরকার। আমি সবকিছু পেছনে ফেলে সামনে এগোনোর চেষ্টা করতে চাই। নিজের জীবনকে উপভোগ করতে চাই।”
মৃন্ময়ীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। সে মাথা দুলিয়ে বলল,
“তুই পারবি। আমি তোকে সম্পূর্ণ সমর্থন করব। তোর এই রূপটা দেখার অনেক আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার। ফাইনালি আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো। আমার বোন সঠিকভাবে ভাবতে শিখল। শোন, তুই মন দিয়ে কাজ করবি। কাজের মাঝে থাকলে দেখবি আস্তে-আস্তে এমনি মাথা হালকা হয়ে যাবে। তারপরও কখনও মন খারাপ হলে তা মনে চেপে রাখবি না। আমি আছি, মৃদুলা আছে। আমাদের সঙ্গে শেয়ার করবি। সবার সঙ্গে সময় কা’টালে ভালো লাগবে।”
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“আপা, তুই এমনভাবে বলছিস যেন কাজটা আমি অলরেডি পেয়ে গেছি।”
মৃন্ময়ী আশা না হারিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,
“পাবি, পাবি। তুই-ই পাবি, দেখিস। আর এটা না পেলে কি দুনিয়াতে অন্য কোনো কাজ নেই? কিছু একটা ঠিক জোগাড় করে দিবো। আমার ওপর ভরসা রাখ। আমি তোকে হতাশায় ভুগতে দিবো না।”
মৃত্তিকা-ও দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“তোর ওপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে।”
“শুধু আমার ওপর না, নিজের ওপর-ও থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। মনোবল বাড়াতে হবে। নিজেকে বুঝাতে হবে তোকে দিয়ে সব সম্ভব, নিজের জন্য তুই সব করতে পারবি। কী-রে? পারবি না?”
মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে মাথা দুলিয়ে বলল,
“পারব আপা।”

টিউশন থেকে ফিরে মৃদুলা নিজের ঘরে ঢোকার পথে দুই বোনের কথোপকথন শুনে থেমে গিয়েছিল। মাঝখানে ঢুকে সে তাদের মনোযোগ নষ্ট করতে চায়নি। বিধায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথোপকথনের কিছু অংশ সে শুনতে পেয়েছে। বলা যায় ইচ্ছা করেই শুনেছে। মৃন্ময়ী ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে মৃদুলাকে দেখে শুধাল,
“কী-রে? তুই কখন এলি?”
“একটু আগেই। তোমাদের কথা বলতে দেখে মাঝখানে ঢুকিনি। আজকের ব্যাপারটা নিয়ে আপুর মন খারাপ, না?”
“হ্যাঁ। আমি তো বুঝিয়ে বললাম। শোন না, তুই-ও একটু বুঝাস ওকে। ওর কাছাকাছি যখন থাকবি, তখন ওকে সাহস যোগাবি। সামনে ওর অনেক পথ হাঁটতে হবে। ভাঙাচোরা মন নিয়ে বসে থেকে তো সেটা সম্ভব না।”
মৃদুলা তাকে আস্বস্ত করে বলল,
“ঠিক আছে, আমি যতটুকু পারি বুঝিয়ে বলব। তুমি চিন্তা কোরো না।”


মৃন্ময়ীর স্কুলে আজ একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান আছে। এতদিন ধরে মৃদুলা বোনকে তার কেনা নতুন শাড়িটা পরতে বলার উপলক্ষ খুঁজছিল। আজ কোনোমতে একটা ছোটোখাটো উপলক্ষ পেয়েই সে বোনকে চেপে ধরল শাড়ি পরানোর জন্য। কিন্তু মৃন্ময়ী নারাজ। সে কোনোমতেই শাড়ি পরবে না। মৃদুলা-ও কম যায় না। সে-ও জেদ ধরে বসল সে আজ বোনকে শাড়ি পরিয়েই ছাড়বে। মৃন্ময়ী এত করে বলল বড়ো কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সে অবশ্যই শাড়িটা পরবে, মৃদুলাকে কোনো কথাই শোনানো গেল না। সে মেয়ে জেদ ধরে বোনকে শাড়ি পরাতে রাজি করল। তারপর শাড়ি পরতে নিজেই সাহায্য করল। মৃন্ময়ী সাজগোজ খুব একটা করে না। করলেও যৎসামান্য। মৃদুলা তাকে হালকা সাজিয়ে-ও দিলো। মৃন্ময়ী বারবার শুধু বলছিল ‘বেশি সাজাস না, ভালো লাগবে না, আমার লজ্জা লাগে।’ অথচ সাজগোজ শেষে মৃদুলা তার দিকে তাকিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলল,
“তোমাকে দারুণ লাগছে আপা।”
মৃন্ময়ী আয়নায় নিজেকে দেখল। মৃদুলার ভাষায় তাকে‘দারুণ’ লাগছে কি না বুঝে উঠতে না পারলেও, নিজের কাছে তাকে সত্যিই একদম অন্যরকম মনে হলো। মৃদুলা তাকে জিজ্ঞেস করল,
“ভালো লাগছে না?”
মৃন্ময়ী কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলল,
“ভালো, কিন্তু সাজটা কি একটু বেশি হয়ে গেল?”
“এইটুকু সাজ বেশি? বলো কম হয়েছে।”
“আমার তো অভ্যাস নেই, তাই কেমন যেন লজ্জা লাগছে।”
“সব মেয়েরাই একটু হলেও সাজে। তোমার এত লজ্জার কী আছে?”
“তুই বুঝবি না। বাইরে বেরোলে মানুষ অদ্ভুতভাবে তাকাবে।”
“কোন মানুষ?”
“বাইরে কি মানুষের অভাব?”
“বাইরের মানুষের কথা বলছো, না প্রভাত ভাইয়ার?” ঠোঁট টিপে বলে উঠল মৃদুলা।
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কথায়-কথায় তুই ওকে টানিস কেন?”
“এছাড়া আর কাকে টানব? তুমি কি একজনকে পেছনে ঘুরিয়ে অন্য কাউকে টানতে চাও?”
“আমি ওকে পেছনে ঘুরাই? এসব কে বলেছে তোকে?”
“তুমি না ঘুরালেও সে ঘোরে, আমি সব খবর জানি।”
“এত খবর রাখিস কোত্থেকে তুই?”
মৃদুলা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
“আমার স্পাই আছে।”
“স্পাই আবার কে?”
“বিবিসি নিউজের হেড।”
মৃন্ময়ী আর মৃদুলার কথায় মাথা ঘামাল না। এই মেয়ে সত্য কথা তো বলেই না, অযথা রহস্য করে।

সারাদিন স্কুলে সুন্দর সময় কা’টলেও, ছুটির পর স্কুল থেকে বেরোতে মৃন্ময়ীর ভীষণ লজ্জা লাগতে শুরু করল। প্রভাত নিশ্চয়ই আজ তাকে নিয়ে কিছু না কিছু মন্তব্য করে তাকে লজ্জায় ফেলবে। গতবছরে-ও এমনটা হয়েছিল। স্কুল থেকে পিকনিকে নেওয়া হয়েছিল। বাকি ম্যামরা শাড়ি পরবে বলে তারা মৃন্ময়ীকে-ও শাড়ি পরতে রাজি করিয়েছিল। সেদিন প্রভাত তাকে দেখে এমন-এমন মন্তব্য করেছিল যে লজ্জায় পড়ে সে আর শাড়ি পরে স্কুলে আসেনি। অবশ্য তার দিক থেকে তার মন্তব্য সুন্দর-ই ছিল। মৃন্ময়ী নিজেই লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল। আজ স্কুল থেকে বেরিয়ে মনে পড়ল শাড়ি পরেও তার একটা-ও সিঙ্গেল ছবি তোলা হয়ে ওঠেনি। অনুষ্ঠানের মাঝে যা ছবি তোলা হয়েছে, সবগুলোই গ্রুপ ছবি। আশপাশে তাকিয়ে সে ফোন বের করে দুটো সেলফি তুলল। কিন্তু নিজের তোলা সেলফিতে সে সন্তুষ্ট হতে পারল না। স্কুল গেইট দিয়ে এক ম্যাম আর স্যার বেরোনোর সময় তাকে ছবি তুলতে দেখে এগিয়ে এল। স্যারের নাম ফুয়াদ। বয়সে তার চেয়ে একটু বড়ো। তবে লোকটা খুব মিশুক প্রকৃতির। মৃন্ময়ীকে খুব স্নেহ করে। ফুয়াদ স্যার সহাস্যে বললেন,
“ম্যাডাম, ছবি তুলতে ভুলে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই?”
মৃন্ময়ী কিছুটা লজ্জা পেয়ে ফোন নামিয়ে নিয়ে বলল,
“না স্যার, এমনি সেলফি তুললাম।”
“থাক, লজ্জা পেতে হবে না। আপনি যে এক বছরে একটা ছবি তোলা মানুষ, তা আমরা জানি। আপনার জন্য ছবি তুলতে ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। দিন, ছবি তুলে দিই।”
মৃন্ময়ী যেন আরও লজ্জায় পড়ে গেল। মাথা নেড়ে বলল,
“না-না স্যার। আমি আর ছবি তুলব না। ধন্যবাদ আপনাকে।”
ফুয়াদ স্যার তবু বারবার করে বললেন,
“আরে লজ্জা পাবেন না। দিন তুলে দিই। আমি কি অপরিচিত মানুষ?”
মৃন্ময়ী শেষে তার হাতে ফোন দিয়ে দিলো। এমনিতেই তার ফোনের ক্যামেরাটা-ও খুব একটা ভালো না, ফোনটা পুরোনো হয়ে গেছে যে। ফুয়াদ স্যারের হাতে ফোন দিয়ে মনে-মনে তার আরও লজ্জা লাগল। তবু ম্যামের কথায় সে ছবি তুলতে দাঁড়াল। ফুয়াদ স্যার বোধ হয় একটার বেশি ছবি তুলতে পারলেন না, কোত্থেকে প্রভাত এসে বলে বসল,
“আমার অনুপস্থিতিতে ছবি তোলার জন্য ধন্যবাদ স্যার। এবার আপনি ছুটি নিতে পারেন।”
ফুয়াদ স্যার অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। প্রভাত আর মৃন্ময়ীর ব্যাপারটা কারোরই অজানা নয়। ফুয়াদ স্যার একবার মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। বললেন,
“সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের আগমন। আমি তবে ছুটি নিলাম। আল্লাহ্ হাফেজ।”
এই বলে তিনি প্রভাতের হাতে ফোন দিয়ে ম্যামের সঙ্গে চলে গেলেন। তারা চলে যেতেই মৃন্ময়ী বিরক্ত চোখে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটা কী করলে তুমি?”
প্রভাত যেন কোনো দোষ-ই করেনি, এমনই ভাব করে উলটা প্রশ্ন করল,
“কী করলাম?”
“স্যার ছবি তুলছিল, তোমার এসে এভাবে বাঁধা দেওয়াটা কি খুব দরকার ছিল?”
“অবশ্যই দরকার ছিল, খুবই দরকার ছিল। আমি থাকতে তোমার ছবি অন্য কেউ তুলবে কেন? এটা তো শুধুমাত্র আমার দায়িত্ব।”
“তোমাকে আমি দায়িত্ব দিলাম কবে?’
“কোনো একদিন তো দিবেই। আপাতত প্রাকটিস করার চেষ্টা করছি। দেখি, সুন্দর করে দাঁড়াও তো, ছবি তুলি,” পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে মৃন্ময়ীর দিকে তাক করে বলল প্রভাত।
সঙ্গে-সঙ্গে মৃন্ময়ী এগিয়ে এসে বলল,
“আমার ছবি তোলা হয়ে গেছে। আমার ফোন দাও।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর ফোনটা নিজের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। হাসিমুখে বলল,
“ছবি তুলতে না দিলে ফোন ফেরত পাবে না।”
“পুরোনো ফোন নিয়ে তোমার দুই টাকার-ও লাভ হবে না।”
“না হোক। আমি কি বিক্রি করতে নিব? ফোনটা আমার দরকার না হলেও তোমার তো দরকার আছেই, তাই না?”
“প্রভাত, ফাজলামি কোরো না তো। অনেকক্ষণ ধরে স্কুল ছুটি হয়েছে। সবাই চলে গেছে। ফোন দাও, বাসায় যাব।”
প্রভাত পুনরায় বলল,
“তোলো না দুটো ছবি। আমি ছবি তুলে দিলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?”
“আমার ইচ্ছা করছে না।”
“তোমার ইচ্ছা না করলে ফুয়াদ স্যার তুলল কীভাবে?”
মৃন্ময়ী হতাশ গলায় বলল,
“কী মুশকিল! সবকিছু নিয়ে তুমি এত বাড়াবাড়ি কেন করো?”
“আমার স্বভাব-ই এমন। যাও, দাঁড়াও। ছবি তুলেই ফোন ফেরত দিয়ে দিবো।”
মৃন্ময়ী হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, তোলো ছবি। তাড়াতাড়ি করবে।”
মৃন্ময়ী ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে খেয়াল করল প্রভাত তার নিজের ফোন তাক করে আছে। সে বাঁধা দিয়ে বলল,
“তোমার ফোনে তুলছ কেন?”
প্রভাত বলল,
“আমার ফোনে তোমার ছবি সুন্দর উঠবে তাই। আমি তোমাকে ছবি পাঠিয়ে দিবো, চিন্তা নেই।”
মৃন্ময়ী আর কথা বাড়াল না। প্রভাত ছবি তুলতে-তুলতে বলল,
“একটু হাসো না। মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি বুঝি তোমাকে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি।”

লজ্জা দূরে ঠেলে মৃন্ময়ী ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলল। প্রভাত-ও দুটো ছবির কথা বলে দশটা ছবি তুলে ফেলল। এরপর আর মৃন্ময়ীকে দাঁড় করিয়ে রাখা সম্ভব হলো না। বাড়ি ফেরার পথেই প্রভাত ছবিগুলো মৃন্ময়ীকে সেন্ড করে ফোন ফেরত দিয়ে দিলো। মৃন্ময়ী ফোনে ছবিগুলো দেখতে লাগল। প্রভাত সত্যিই সুন্দর ছবি তুলেছে। ছবিতে তাকে দারুণ লাগছে। ঠিক যেমনটি মৃদুলা বলেছিল। তার মুখোভাব লক্ষ্য করে প্রভাত শুধাল,
“ছবি কি ম্যাডামের পছন্দ হয়েছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভালো ছবি।”
“শুধু ভালো নয়, বলো চমৎকার ছবি।”
প্রত্যুত্তরে মৃন্ময়ী বলে বসল,
“তোমার ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়ো।”
প্রভাত কপাল কুঁচকে ফেলে জিজ্ঞেস করল,
“কেন?”
“তোমার রাখার কী দরকার?”
“তোমার ছবি আমার দরকার নয় তো কি ফুয়াদ স্যারের দরকার?”
মৃন্ময়ী চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
“ফুয়াদ স্যার আবার তোমার কোন পাকা ধানে মই দিলো?”
প্রভাত সঙ্গে-সঙ্গে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
“তোমাকে কি কেউ বলেছে তোমাকে আজ দারুণ সুন্দর লাগছে?”
“বলেছে?”
“কে?”
মৃন্ময়ী বলে উঠল,
“যে-ই হোক, ফুয়াদ স্যার না।”
প্রভাত হেসে উঠে বলল,
“আমি তার কথা বলিওনি।”
“হ্যাঁ, একদমই বলনি।”
“শরবত খাবে?”
মৃন্ময়ী তাড়া দেখিয়ে বলল,
“উঁহু, বাড়ি ফিরতে হবে।”
“সে তো রোজই ফিরো। একদিন ভুল করে আমার বাড়ি ফিরে গেলে-ও তো পারো।”

মৃন্ময়ী প্রভাতের সামনে থেকে সরতে তাড়াহুড়া করে হাঁটতে যেয়ে বেখেয়ালে এক ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেল। ছেলেটা বোধহয় বদমেজাজি। ধাক্কা খেতেই কেমন খ্যাঁক-খ্যাঁক করে বলে উঠল,
“প্রেম-পিরিতির ঠেলায় কি অন্ধ হয়ে গেছেন? রাস্তায় চোখ খুলে হাঁটতে পারেন না?”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“আশ্চর্য! আমি না হয় আপনাকে খেয়াল করিনি, আপনিও কি আমাকে খেয়াল করেননি? এমনভাবে কথা বলছেন কেন?”
ছেলেটা ত্যাড়া গলায় আবারও বলে উঠল,
“নিজে অন্ধের মতো হেঁটে আবার আমাকে বলেন? রাস্তাঘাটে প্রেম করা বন্ধ করুন, চোখ এমনিতেই খুলে যাবে। যত্তসব আজাইরা পাবলিক।”
সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাত এগিয়ে এসে ছেলেটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“কে আজাইরা পাবলিক? আবার বল তো কী বললি?”
ছেলেটা-ও প্রভাতের মুখের ওপর বলল,
“কী বলেছি শুনতে পাননি?”
প্রভাত ধমকে উঠে বলল,
“নিজের ভুল স্বীকার না করে আবার মুখে-মুখে কথা বলছিস? সমস্যা কী তোর?”
ছেলেটার বুকে হাত ঠেকিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ফেলল প্রভাত। ছেলেটা তাতে আরও তেতে উঠল। রেগেমেগে বলে উঠল,
“আপনার সমস্যা কী? রাস্তায়-রাস্তায় মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়ান, আবার মাস্তানি করতে এসেছেন? আপনাকে ভয় পায় কে?”
“এই, ছোটো ছোটোর মতো কথা বল। বেয়াদবি করবি তো ঘাড়ধাক্কা দিয়ে এলাকা থেকে বের করে দিবো?”
“আপনি এলাকার কে? চেয়ারম্যান, না মেম্বার? আমিও দেখি আপনি আমার সাথে কী করতে পারেন।”

তর্কাতর্কিতে ছেলেটা কয়েকটা গালি-ও দিয়ে ফেলল। শেষে রাগ সামলাতে না পেরে প্রভাত ছেলেটাকে দু-চারটা থাপ্পড় দিয়ে বসল। মৃন্ময়ী তর্ক তো থামাতেই পারল না, মা’র দেখে সে ভয় পেয়ে দ্রুত প্রভাতকে টেনে সরিয়ে দিলো। ছেলেটা তবু থামছেই না। মা’র খেয়ে সে পা’গলা কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ শুরু করেছে। তাদের মা’র দেখে সেখানে কয়েকজন ছেলেপেলে জড়ো হয়ে গেছে। প্রভাতকে তারা চেনে বলে ছেলেটাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাঁধা দিয়ে সরিয়ে নিল। মৃন্ময়ী প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি গায়ে হাত তুলতে গেলে কেন? এতে ছেলেটা আরও খেপেছে।”
প্রভাত ত্যাড়া গলায় বলল,
“খেপুক। ওর সাহস কী করে হয় বড়োদের সাথে এমন ব্যবহার করার? এটাই ওর জন্য উপযুক্ত শাস্তি। হাঁটুর বয়সী ছেলে হয়ে উলটা-পালটা কথা বলে, কত্ত বড়ো কলিজা।”
“ওর মানসিকতা খারাপ বলে খারাপ ব্যবহার করেছে। কিন্তু ওকে এসব কথা বলার সুযোগটা কে তৈরি করে দিয়েছে প্রভাত?”
প্রভাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“তুমি কি এখন এতে-ও আমার দোষ দিবে?”
“আমি দোষ না দিলেও লোকে আমাকে নিয়ে এমন মন্তব্য-ই করে। ছেলেটা সামনে করেছে, অন্যকেউ হয়তো পেছনে এই একই কথা বলে বেড়ায়। আমি তোমাকে এই কথাটা বারবার বলেছি, কিন্তু তুমি কোনোদিন-ও আমার কথা গ্রাহ্য করনি।”
প্রভাত বলল,
“আমি তো বারবার বলেছি লোকের কথায় আমার কিছু যায় আসে না।”
“তোমার এই বেপরোয়া স্বভাবটার জন্যই আমাকে আজ হাঁটুর বয়সী ছেলের মুখে অমন কথা শুনতে হয়েছে। এ-ও কি তুমি বুঝতে পারছো না? দয়া করে আমাকে একা ছাড়ো, আমার ভালো লাগছে না।”
কথাটা বলেই মৃন্ময়ী নিজের পথে হাঁটা দিলো। প্রচণ্ড রাগে চোখমুখের ভাব পালটে গেছে তার। প্রভাত চুপসানো মুখে একপা দু’পা করে হাঁটতে-হাঁটতে বিড়বিড় করল,
“জি ম্যাডাম। যত দোষ প্রভাত ঘোষ।‌ বাকি সব সাধু সন্ন্যাসী।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৫

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৫.
ঘুমাতে যাওয়ার আগে মৃন্ময়ী প্রভাতের দেওয়া গিফট বক্স খুলল। বক্সের ভেতর পেল দুমুঠো কাঁচের চুড়ি আর অনেকগুলো চিরকুট। গুনে দেখল সর্বমোট ছাব্বিশটি চিরকুট। মৃন্ময়ীর ছাব্বিশ তম জন্মদিন উপলক্ষে ছাব্বিশটি চিরকুট। মৃন্ময়ী পড়ে দেখল সবকটা চিরকুটে একবার হলেও ‘ভালোবাসি’ শব্দটা উল্লেখ আছে। এই শব্দ বাদ রেখে প্রভাত একটা চিরকুট-ও লেখেনি। মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে প্রত্যেকটা চিরকুট-ই প্রভাত খুব যত্ন সহকারে লিখেছে। কারণ একটা চিরকুটে-ও কোনো কা’টাছেঁড়া নেই, ভুল বানান নেই, আঁকাবাঁকা অক্ষর নেই। হাতের লেখা-ও গোছানো। সবমিলিয়ে প্রত্যেকটা চিরকুট-ই সুন্দর। কিন্তু চিরকুটগুলো পড়তে-পড়তে খুশি হওয়ার বদলে মৃন্ময়ীর আরও মন খারাপ হলো। নিজের পালিয়ে চলা মনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। একবার মনে হলো প্রভাতের প্রতি সে একটু বেশিই কঠিন হয়ে গেছে, আবার মনে হলো এছাড়া তার আর উপায় নেই। চিরকুটে প্রভাত অনেক কথা লিখেছে। মৃন্ময়ীকে নিয়ে তার প্রথমদিকের অনুভূতি থেকে শুরু করে বর্তমান অনুভূতি নিয়েও লিখেছে। বুঝাই যাচ্ছে তার অনুভূতির গভীরতা মৃন্ময়ীর ভাবনার বাইরে। একরাশ হতাশা নিয়ে মৃন্ময়ী চুড়ি আর চিরকুটগুলো আলমারিতে তুলে রাখল। ফোনের ডাটা অন করার সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাতের ম্যাসেজের নোটিফিকেশন এল। প্রভাত জানতে চেয়েছে উপহার পছন্দ হয়েছে কি না। মৃন্ময়ী সেই ম্যাসেজের উত্তর ভেবে পেল না। ফেসবুকে ঢুকতেই প্রভাতের পোস্ট সামনে পড়ল। প্রভাতের দুই লাইনের ইংরেজী স্ট্যাটাস।
‘No one can fix me except you.’

প্রভাতের বন্ধুরা সেই পোস্টের কমেন্ট বক্সে খোঁচা মে’রে অনেক কথা বলেছে, মজা করেছে। একজন তো সোজাসাপ্টা বলেই দিয়েছে, ‘ম্যাডাম তোমাকে চোখে দেখে না মামা। অতিদ্রুত ফুল পাওয়ারের চশমা কিনে দাও, নয়তো আজীবন পেছনে ঘুরেই ম’রতে হবে।’ মৃন্ময়ী কয়েক মিনিট সেই স্ট্যাটাসের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আবারও এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এসে ফোন রেখে দিলো। প্রভাতের ম্যাসেজের উত্তরটা-ও দেওয়া হলো না। কীইবা উত্তর দিবে সে? সে জানে ঠিক কোন উত্তরে প্রভাত খুশি হবে। কিন্তু প্রভাতকে সন্তুষ্ট করার মতো উত্তর দিতে তার যে অনেক দ্বিধা।

পরদিনই প্রভাত তাকে সর্বপ্রথম যেই প্রশ্নটি করল তা হচ্ছে ‘উপহার পছন্দ হয়েছে? জিজ্ঞেস করলাম, উত্তর দিলে না কেন?’
“ম্যাসেজ দেখিনি,” মিথ্যা বলল মৃন্ময়ী।
“ও। তাহলে এখন বলো পছন্দ হয়েছে কি না।”
মৃন্ময়ী ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে উত্তরে বলল,
“সুন্দর চুড়ি।”
“আর চিরকুটগুলো?”
“এত মনোযোগ দিয়ে কোনোদিন পরীক্ষার খাতায় লিখেছিলে?”
“এমনটা বলছো কেন?”
“তোমার চিরকুট দেখে মনে হলো এমন মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার খাতায় লিখলে ভালো রেজাল্ট পেতে পারতে।”
প্রভাত হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভান করে বলল,
“ধ্যাত! আমি যতটা মনোযোগী প্রেমিক, ততটাই অমনোযোগী ছাত্র। অমনোযোগী ছাত্র কী করে পরীক্ষার খাতায় মনোযোগ দিয়ে লিখবে? তোমার প্রেমে পড়েছি বলেই মনোযোগ দিয়ে তোমাকে চিরকুট লিখেছি। তোমার মতো করে পড়াশোনার প্রেমে পড়িনি বলেই মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার খাতায় লেখা হয়ে ওঠেনি।”
“কাজের বেলায় মনোযোগ থাকে না, মনোযোগ থাকে যত অকাজের বেলায়।”
“তা অবশ্য ভুল বলনি। তবু তোমার প্রতি যখন মনোযোগ আছেই, তখন আশার আলো-ও তো একটু থাকতেই পারে। তাই না? মনোযোগী হলে যেহেতু ভালো রেজাল্ট পাওয়া যায়। দেখি, আমিও কবে ভালো রেজাল্ট পাই।”
“ভালো রেজাল্ট কাজে আসে, অকাজে না।”
“আমার ভালোবাসাকে তুমি অকাজ বলছো?”
“অযথা সময় নষ্ট করাকে অকাজ বলব না তো কী বলব?”
প্রভাত অভিমানী সুরে বলল,
“ভালোবাসা গ্রহণ যখন করছো না, তখন আমার ভালোবাসাকে একটু সম্মান কিন্তু দেখানো উচিত তোমার। এত ধৈর্য নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি, দিন-দিন তোমাকে এত-এত ভালোবেসে ফেলছি, এসব মোটেও অকাজ হতে পারে না।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। তুমি খুবই কাজের কাজ করছো। তোমার সাথে তর্ক করে লাভ নেই আমার।”
প্রভাত প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“মৃত্তিকার ব্যাপারটা নিয়েই এতদিন তুমি খুব চিন্তিত ছিলে, তাই না?”
মৃন্ময়ী বলল,
“মনে তো হচ্ছে খবর নেওয়া হয়ে গেছে। তবু জিজ্ঞেস করছো কেন?”
“এমনি। দিন-দিন তোমার ওপর চাপ বাড়ছেই। জানি তোমার কষ্ট হয়। তবু আফসোস ছাড়া আমার কিছু করার থাকে না। তুমি আমাকে সেই সুযোগটাই দাও না,” কিছুটা মনমরা হয়ে বলল প্রভাত।
“তোমাকে সুযোগ দিলে আমার কষ্ট কমে যাবে, না তোমার আফসোস কমে যাবে? কোনটা?”
“হয়তো দুটোই। তুমি আমাকে সুযোগ দিলে সর্বপ্রথম আমি তোমার মাথার সমস্ত চাপ ভাগ করে নিব, তোমার মনের সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে দিবো, আমি হব তোমার সমর্থন, তোমার ভরসার জায়গা। যেকোনো মূল্যে আমি তোমাকে সুখী জীবন দিবোই মৃন্ময়ী। তোমার কাছে আমার এসব কথা আবেগ মনে হলেও, আমার কাছে এসব আমার নিজের কাছে করা প্রতিজ্ঞা। একবার তুমি আমাকে গ্রহণ করে দেখো, এ সব প্রতিজ্ঞা আমি রক্ষা করে দেখাব। আমি কাগজে-কলমে লিখে দিতে পারি, আমি প্রভাত তরফদার নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার পাশে থাকব এবং একমাত্র তোমাকেই ভালোবাসব।”

“খুব গরম লাগছে। শরবত খাবে?” বলেই মৃন্ময়ী জোরে হাঁটা দিলো।
প্রভাত বুঝল মৃন্ময়ী আবারও এড়িয়ে যাচ্ছে। মনে-মনে সে হাসল। মৃন্ময়ীর পেছনে ছুটে বলল,
“ম্যাডাম নিজে খাওয়াতে চাইলে আমি কিন্তু দুই গ্লাস খাব। রোদ মাথায় নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
মৃন্ময়ী বলে বসল,
“তিন গ্লাস খেয়ো তুমি।”
মৃন্ময়ী কথার কথা বললেও প্রভাত যে সত্যি-সত্যি পরপর তিন গ্লাস শরবত খেয়ে ফেলবে, ভাবেনি সে। প্রভাতের কথা এড়াতে সে শরবত খাওয়ার অযুহাত দেখিয়েছে। একা হলে সে শরবতের দোকানের আশপাশেও ঘেঁষত না। বাড়ি ফিরলেই মা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা শরবত বানিয়ে দেয়। খেলেই ক্লান্ত মনে তৃপ্তি আসে। এক গ্লাস শরবত কিনে টাকা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। তবু মৃন্ময়ী আজ এক গ্লাস শরবত খেল। স্বাদ ভালোই। সব মিলিয়ে চার গ্লাস শরবতের বিল তার জলে যাবে, এই ভেবে মনে-মনে নিজেকে বকল। শেষমেশ অবশ্য প্রভাত নিজেই তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সে টাকা বের করলেও প্রভাত কিছুতেই তাকে বিল দিতে দেয়নি। নিজেই দিয়ে দিয়েছে। ছেলের বুদ্ধি আছে।


মৃত্তিকার থেকে টাকা নিয়ে দরজির দোকান থেকে আজ জামা নিয়ে এসেছে মৃদুলা। বাড়ি ফিরে সে ভয়ে-ভয়ে মৃন্ময়ীকে ডাকল। মায়ের সামনে ব্যাগ থেকে জামা বের করে মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে বলল,
“জামা নিয়ে এসেছি।”
মৃন্ময়ী জামা নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে বলল,
“সুন্দর হয়েছে। এই রংয়ে তোকে মানাবে। সবারটাই এই রংয়ের?”
“হ্যাঁ।”
সাজেদা বেগম ঘটনা বুঝতে না পেরে এগিয়ে এসে শুধালেন,
“জামা কার?”
মৃদুলার আগে মৃন্ময়ী উত্তর দিলো,
“মৃদুলার।”
সাজেদা বেগম সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পারলেন কদিন আগে এই জামা কেনার কথাই বলেছিল তার মেয়ে। তিনি ভ্রুকুটি করে পুনরায় মৃদুলাকে বললেন,
“এই জামা তুই শেষমেশ কিনছিসই?”
মৃন্ময়ী বলল,
“থাক না মা। মেয়েরা সবাই একরকম জামা পরবে, ও পরতে না পারলে তো ওর খারাপ লাগবেই। তাছাড়া পরীক্ষার পর কে কোথায় ভর্তি হয় তার তো ঠিক নেই। একসঙ্গে একটু ভালো সময় কা’টাক ওরা।”
সাজেদা বেগম জানতে চাইলেন,
“কত টাকা লেগেছে?”
মৃদুলা মিনমিনে গলায় বলল,
“জামা বারোশো টাকা, বানাতে লেগেছে দুইশো টাকা।”
সাজেদা বেগম চোখ বড়ো করে বললেন,
“চৌদ্দশো টাকা খরচ করে ফেলেছিস এই জামার পেছনে! আর তুই যে গায়েই মাখছিস না। তুই কি তোর বোনদের জন্য টাকার গাছ লাগিয়েছিস?”
মায়ের কথা শুনে মৃন্ময়ী বলল,
“জামা বানাতে আমি টাকা দিইনি। ও আমার কাছে টাকা চায়নি।”
“তাহলে টাকা কোথায় পেল?”
“মৃত্তিকা দিয়েছে।”
মৃত্তিকার কথা শুনেই সাজেদা বেগমের কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি সন্দিহান কন্ঠে শুধালেন,
“মৃত্তিকা টাকা পেল কোথায়?”
“ওর কাছে ছিল, সেখান থেকেই দিয়েছিল।”
“ওর জামাইয়ের টাকা?”
“হবে হয়তো। ও আর টাকা কোথায় পাবে?”
এক মুহুর্তে সাজেদা বেগমের মুখোভাব পালটে গেল। রাগত মুখে তিনি মৃদুলাকে বললেন,
“তুই আমাকে জিজ্ঞেস না করে ওর থেকে টাকা চেয়েছিস কোন সাহসে?”
মৃদুলা নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
“আমি চাইনি, আপু নিজেই দিয়েছে।”
সাজেদা বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন,
“আপু চাইলেই তুই নিয়ে নিবি? তোর আপুর দুই টাকা রোজগার আছে? আজীবন আরেকজনের কলিজা ঠুকরে খাওয়া ওর স্বভাব। এই পর্যন্ত ওর ওই ছ্যাঁচড়া জামাইয়ের এক পয়সা আমরা খেয়েছি? তুই দেখিসনি, ওর জামাইয়ের টাকায় একটা ফল নিয়ে এলেও আমি তা ফেরত পাঠিয়েছি? দেখেছিস কি না? তুই কোন সাহসে ওর জামাইয়ের টাকায় জামা কিনলি? মৃন্ময়ী তোকে কোন জিনিসটা না দেয়? তুই মুখ ফুটে কিছু চাইলে কষ্ট হলেও ও কিনে এনে দেয়। কী-রে? দেয় না? একবার চাইতে বারণ করেছি বলেই তুই গিয়ে ওর কাছে হাত পাতলি? এই, তোর লাজ-শরম নেই? তোকে আমি এসবই শিখিয়েছি?”
মৃন্ময়ী বলল,
“মা, তুমি ওকে বকছো কেন? মৃত্তিকা যেচে দিয়েছে বলেই তো ও নিয়েছে। নইলে কি ও নিজে চাইতে যাওয়ার মতো মেয়ে? আমি জানলে তো আমি নিজেই ব্যবস্থা করে দিতাম।”
“ওকে যেচে দিলেই ও নিবে কেন? ওই ছ্যাঁচড়া ছেলের টাকা ও খরচ করল কোন সাহসে? আমার মান-সম্মান সব খেয়েছে, ওই ছেলের টাকা তো আমাকে হাতে ধরিয়ে দিলেও আমি নিতাম না। এই জামার জন্য ও আমার অবাধ্য হয়েছে না? মৃন্ময়ী তোকে আমি বলে দিচ্ছি, এখন থেকে ওর জামাকাপড়ের পেছনে তুই একটা টাকাও খরচ করতে পারবি না। আমিও দেখব ও কদিন ওর দুলাভাইয়ের টাকায় চলতে পারে। আমার সাথে চালাকি? ওকে আমি বুদ্ধিমতী ভাবতাম। আরেক গাধা ফিরে এসে ওর মাথার মধ্যেও গোবর ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমার সংসারে শান্তি আর দিবে না এরা।”
মায়ের চেঁচামেচি শুনে মৃত্তিকা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মায়ের এসব কথা শুনে আর সামনে এগোয়নি। মৃদুলাকে দেখল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার নতুন জামাটা মা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। মৃন্ময়ী সেটা তুলে মৃদুলার হাতে দিলো। মৃত্তিকা এগিয়ে এসে বলল,
“মৃদুলাকে কিছু বোলো না মা। ওর কোনো দোষ নেই। আমি নিজেই ওকে জোর করে টাকা দিয়েছি। তুমি শুনলে রাগ করবে বলেই ও তখন নিতে চায়নি। তোমার কিছু বলার থাকলে আমাকে বলো, ওকে ছাড়ো। দুদিন পর ওদের অনুষ্ঠান। এখন আবার জামা নিয়ে বকলে ওর মন ভেঙে যাবে।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“তোমাকে আর আমি কী বলব মা? তোমার সঙ্গে আর কলাগাছের সঙ্গে কথা বলার মাঝে তো কোনো তফাৎ নেই। তুমি এই সংসারে উপকারী কাজ না করতে জানলেও, বেছে-বেছে অপকারী কাজগুলো খুব ভালো করেই করতে জানো।”
“টাকাটা মৃদুলার দরকার ছিল, তাই দিয়েছিলাম।”
“টাকার দরকার ছিল, তোর জামাইয়ের টাকার তো দরকার ছিল না। যেদিন নিজের উপার্জন করার যোগ্যতা হবে, সেদিন এই সংসারে টাকা খরচ করিস।”
“সরি,” মিনমিনে গলায় কথাটা বলেই মৃত্তিকা মাথানিচু করে চলে গেল।
তবু যখন সাজেদা বেগমের রাগ কমছিল না, তখন মৃন্ময়ী জোর করে তাকে ঘরে নিয়ে গেল। একা বসে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করল। মৃদুলা জামা হাতে ঘরে গিয়ে দেখল মৃত্তিকা নিঃশব্দে কাঁদছে। মৃদুলাকে দেখে সে চোখের পানি মুছে ভেজা গলায় বলল,
“খারাপ মানুষদের করা ভালো কাজ-ও খারাপ হয়ে যায়, তাই না রে?”
মৃদুলা উত্তর দিলো না। চুপচাপ গিয়ে নতুন জামাটা আলমারিতে তুলে রাখল।

সেদিন রাতে মৃন্ময়ী ঘুমাতে যাওয়ার আগে মৃত্তিকা তার ঘরে এল। মৃন্ময়ী তাকে ডেকে বিছানায় বসাল। মৃত্তিকা নিজেই আগে কথা তুলল,
“এখনই ঘুমাবি?”
“হ্যাঁ। তুই কিছু বলবি?”
“তাহলে কাল বলব নে। তুই ঘুমা।”
“সমস্যা নেই, বল। তোর কি মন খারাপ?” মৃত্তিকার মুখোভাব লক্ষ্য করে শুধাল মৃন্ময়ী।
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“না। হঠাৎ করে মনে হলো তোকে একটা কথা বলে দেখি।”
“বল না।”
মৃত্তিকা একটু আমতা-আমতা করে বলল,
“আপা, তুই কি আমাকে একটা কাজ ঠিক করে দিতে পারবি?”
মৃন্ময়ীর মুখ দেখে মনে হলো সে অবাক হয়েছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফের শুধাল,
“কাজ? তুই কাজ করবি?”
“করতে তো চাইছি। কিন্তু আমি তো অনার্স শেষ করিনি। এইচএসসির সার্টিফিকেটে কোনো কাজ পেলে করব।”
“তুই কি সিরিয়াস?”
মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“হুম। কতকাল আর তোকে জ্বালাব? বিয়ের আগেও জ্বালিয়েছি, বিয়ের পর এসে-ও জ্বালাচ্ছি। আমার ওপর মায়ের রাগটা অস্বাভাবিক না, বুঝি আমি।”
“তুই কি মায়ের কথায় অভিমান করেছিস?”
“না রে। ওসব কথা আমার প্রাপ্য। অভিমান করব কোন সাহসে? ভাবলাম এখন তো বাড়িতেই বসে আছি, তারচেয়ে কোনো কাজ-টাজ করতে পারলে তো ভালো হয়। সময়-ও কে’টে যাবে, হাতখরচটা-ও পাওয়া যাবে।”
“কী কাজ করতে চাস তুই?”
“আমি তো এ বিষয়ে জানি না। সম্ভব হলে তুই একটু দেখ না কোথাও কোনো কাজ যদি পাস। তুই যা ঠিক করে দিবি তা-ই করব। আমার তো কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। তবু চেষ্টা করে দেখতে পারি। তুই কি পারবি খোঁজ নিতে? ভেবেছিলাম আমার বন্ধুদের বলব, পরে আবার ভাবলাম যাকে বলব সে-ই তো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবে।”
মৃন্ময়ী একটু ভেবে বলল,
“থাক, কাউকে বলার দরকার নেই। তুই যখন নিজে থেকে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিস, আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। পরিচিত যারা আছে, তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে হয়তো পাওয়া যাবে।”
“আচ্ছা, না পেলে-ও জানাস আমাকে।”
“পাওয়া যাবে, চিন্তা করিস না,” আশ্বস্ত করে বলল মৃন্ময়ী।
মৃত্তিকা কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারল না। মনে যে শত বাঁধা তার। মৃন্ময়ী তার মুখ দেখে প্রশ্ন করল,
“আর কিছু বলবি?”
মৃত্তিকা প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“না। আমি চলে যাচ্ছি, তুই ঘুমিয়ে পড়।”
“আচ্ছা যা। আমি দেখব ব্যাপারটা।”

মৃত্তিকা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মৃন্ময়ী দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে বিছানায় চলে গেল। আজ আবার প্রভাত ম্যাসেজ করেছে,
“আপনাদের কোচিংয়ে ভর্তি হতে খরচ কত ম্যাডাম? আমার মতো ছাত্র কি গ্রহণযোগ্য?”
উত্তরে মৃন্ময়ী লিখল,
“কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কি না জানি না। তবে তোমার মতো গোরু মার্কা ঢেউটিন ছাত্র আমার ক্লাসে গ্রহণযোগ্য নয়।”
সঙ্গে-সঙ্গে তার ম্যাসেজে প্রভাত স্যাড রিয়্যাক্ট দিয়ে লিখল,
“মুখের ওপর অপমান করে দিলে? ঠিক আছে, আমি তোমাদের কোচিংয়ে-ই ভর্তি হব। তারপর দেখব তুমি কীভাবে আমাকে ক্লাসে না নাও।”
মৃন্ময়ী আর উত্তর দিবে না ভেবেও আবার কী মনে করে প্রশ্ন করল,
“তুমি না মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়েছিলে?”
“একবার দিয়েছিলাম, তা-ও কলেজ থেকে স্যার ফোন করে খবর দিয়েছিল বলে। পরীক্ষায় বসে দেখি কোনো প্রশ্নই আমার পরিচিত না।”
“তুমি কি পড়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলে?”
“আরে নাহ্! পড়ব কখন? পরীক্ষা দিতে ডেকেছিল, তাই গিয়েছিলাম।”
“না পড়ে পরীক্ষা দিতে গেলে প্রশ্ন পরিচিত লাগবে কীভাবে? তারপর আর কোনো পরীক্ষা দাওনি?”
“নাহ্।”
“সেকি! তাহলে ভর্তি হয়েছিলে কেন?”
“আমার বাপের ঠেলাঠেলিতে আর আমার আবেগে ভর্তি হয়েছিলাম। একবার পরীক্ষায় বসার পর যখন বুঝলাম আমার পড়ার বয়স শেষ হয়ে গেছে, তখন থেকে ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি।”
“কী আশ্চর্য! তোমার পড়ার বয়স শেষ হয়েছে কে বলল তোমাকে?”
“এটা আবার কারো বলা লাগে? আমিই বুঝে গেছি। এখন হচ্ছে আমার বিয়ে-টিয়ে করে সংসার করার বয়স, বউ-বাচ্চা নিয়ে জীবন সাজানোর বয়স। বউয়ের মন পড়ার বয়সে কিসের বই পড়ে পরীক্ষায় বসব? আমি শুধু তোমার সম্মতির অপেক্ষায় আছি। তুমি সম্মতি জানালেই আমি বিয়ে করে জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষায় বসে পড়ব।”
এই ম্যাসেজ পড়ে মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। পরমুহূর্তে খেয়াল হতেই আবার মুখে গাম্ভীর্যতা টেনে লিখল,
“তোমার মতো এমন আজাইরা চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বসে থাকি না আমি।”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“আহা! আমি জানি তো তুমি ভালো মেয়ে। আমি তো আর তোমার মতো ভালো ছেলে নই। আমি হচ্ছি ভালো প্রেমিক। তাই তুমি পড়ার পেছনে ছুটছো, আর আমি তোমার পেছনে। আচ্ছা, এভাবে ছুটতে-ছুটতে একদিন তুমি তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গে যদি আমিও আমার লক্ষ্য পৌঁছে যাই, ব্যাপারটা দারুণ হবে না? আই উইশ খুব শীঘ্রই এমন দিন আসুক। তুমি তোমার স্বপ্ন জয় করো, আর আমি তোমাকে।”

মৃন্ময়ী আজও এই ম্যাসেজের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রত্যুত্তর না করেই ফোন রেখে দিলো। স্বপ্ন জয়? সে তো অনেক কঠিন। মৃন্ময়ী নিজেও জানে না সে স্বপ্ন জয় করতে পারবে কি না। শেষমেশ তার এত চেষ্টা, এত কষ্ট সার্থক হবে কি না। তবু সে ছুটছে। প্রভাতের ধারণা তার মতো সে-ও স্বপ্ন জয় করতে ছুটছে। অবশ্য তার স্বপ্ন কেবলই মৃন্ময়ী। তুলনা করলে মৃন্ময়ীর লক্ষ্যে পৌঁছানো যেমন অনিশ্চিত, প্রভাতের-ও তাই। অথচ সে চাইলেই পেতে পারে সুনিশ্চিত সুখী জীবন। ছেলেটা সত্যি বেপরোয়া। তার ভাবনার চেয়েও বেশি বেপরোয়া।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৪

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৪.
মৃদুলা প্রাইভেটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মুখোভাবে স্পষ্ট যে জামা কিনতে না পারার বিষয়টি নিয়ে তার এখনও মন খারাপ। অনেকক্ষণ ধরে মৃত্তিকা তাকে কিছু বলার জন্য কাঁচুমাচু করছে। কিন্তু বলা-ই হচ্ছে না। মৃদুলা যখন হিজাব পরছিল, তখন মৃত্তিকা তাকে প্রশ্ন করে ফেলল,
“আপাকে টাকার কথা বলেছিলি?”
মৃদুলা থমথমে গলায় উত্তর দিলো,
“বলব না।”
“জিজ্ঞেস করে দেখতে পারতি না?”
“এই মাসে আপা অনেক খরচ করে ফেলেছে। এখন আমি টাকা নিলে তার নিজের হাত খরচের টাকা-ও হয়তো থাকবে না। তোমার মতো আপার গলায় ছু’রি ধরে টাকা আদায় করার স্বভাব আমার নেই। লাগবে না আমার জামা।”
মৃত্তিকা মন খারাপ করল না। পুনরায় শুধাল,
“তাহলে কী করবি? অন্য জামা পরেই যাবি?”
“তা-ও জানি না।”
“জামা কি তোরা পছন্দ করে রেখেছিস?”
“হুম।”
“দাম কত?”
“বারোশো টাকা।”
“কিনে আবার বানাতে দিতে হবে না?”
“কিনবই না, আবার বানাতে দিবো।”

মৃত্তিকা আর কথা বাড়াল না। আলমারি খুলে তার ব্যাগ থেকে বারোশো টাকা বের করে নিয়ে এল। মৃদুলার হিজাব পরা শেষ হতেই সে হঠাৎ বোনের হাতটা ধরে মুঠোয় টাকাটা গুঁজে দিলো। প্রথমে মৃদুলা চমকে উঠল। তারপর মুঠো খুলে টাকা দেখে সে অবাক চোখে তাকাল। প্রশ্ন করার আগেই মৃত্তিকা বলল,
“টাকাটা নে বোন। জামা নিয়ে আসিস।”
মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“তুমি টাকা পেলে কোথায়?”
“আমার জমানো টাকা ছিল। এখন তো আমার লাগছে না, তুই নিয়ে কাজে লাগা।”
“তোমার জামাইয়ের টাকা না? আমি এই টাকা নিতে পারব না। পরে মা আমাকে যা-তা বলবে।”
মৃদুলা অসহায় মুখে বলল,
“এমন করিস না রে মৃদুলা। আমি জানি এখন তোর কেমন লাগছে। এমন অনেক অনুষ্ঠানে আমিও আপার থেকে টাকা নিয়েছিলাম। আপার কাছে টাকা আছে, না কি নেই, তা-ও আমি ভাবতাম না। আর তুই তো আমার চেয়ে কত বুদ্ধিমতী। তোর মতো সুন্দর মন আমার নেই। কিন্তু এটুকু বুঝার ক্ষমতা আছে যে, তোর সুন্দর মনটা হাসিমুখে কষ্ট গিলে নেয়। আমি কোনোদিনও নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবিনি। তোর প্রয়োজন নিয়েও মাথা ঘামাইনি। আজকাল তোকে দেখলে আমার নিজের প্রতি ধিক্কার আসে, জানিস? তুই এই টাকাটা নিলে আমি খুব খুশি হব। প্লিজ নে।”
মৃদুলা তবু আপত্তি জানিয়ে বলল,
“না-না আপা। এই টাকার জন্য না পরে আমাকে মায়ের কত বকা শুনতে হয়। তুমি বলেছ, এতেই আমি খুশি হয়েছি। তোমার টাকা তুমিই রেখে দাও, দরকার পড়লে খরচ করতে পারবে।”
“নে না রে। তুই তো আমার কাছে টাকা চাসনি। আমি নিজেই তোকে দিচ্ছি। মা কিছু বললে বলিস তুই নিতে চাসনি, আমিই তোকে জোর করে দিয়েছি। দরকার পড়লে আমিও মাকে বুঝিয়ে বলব। জামা কিনে ফেললে তো আর মা সেটা ফেরত দিতে পারবে না। তুই নিয়ে যা, আমার টাকা লাগবে না।”
মৃত্তিকা তারপরও একটু দোনামনা করল। মনে-মনে তার ভয় লাগছে। মা যদি বকাঝকা করে? আবার মৃত্তিকা এত করে বলার পর আর সে তাকে টাকা ফিরিয়ে-ও দিতে পারল না। শেষমেশ তাকে টাকা নিতেই হলো। ভাবল জামা কিনে আগেভাগেই মাকে জানাবে না। আগে বড়ো আপাকে জানিয়ে তারপর মাকে জানাবে। মৃত্তিকা আবার তাকে এ-ও বলে দিয়েছে যে, জামা এনে বাড়িতে না এনে যেন দরজির কাছে দিয়ে আসে। জামা বানানোর মজুরিটা-ও মৃত্তিকা দিয়ে দিবে। মৃদুলার বিস্ময় যেন কমতেই চাইছে না। এই কি তার ছোটো আপা, আজীবন যার নিজের স্বার্থ ছাড়া পরিবারের কাউকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না? যে আজীবন শুধু নিতেই জানত, সে দিতে শিখল কবে?


একহাতে কেক বক্স, আরেকহাতে গিফট বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাত। মৃন্ময়ীর আজ দেরী হচ্ছে কেন? তার হাত দুটো তো ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত হিসেবে আবার মশার কামড়-ও সহ্য করতে হচ্ছে। কামড়ে-কামড়ে পা দুটো শেষ করে দিলো। ইচ্ছে করছে মশার গলা চেপে ধরে কানের নিচে কয়েকটা চটকানা লাগিয়ে দিতে। অবশেষে যখন মৃন্ময়ীর দেখা মিলল, তখন প্রভাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে বলল,
“আজ তুমি এত দেরী করলে যে? এদিকে তোমার অনুপস্থিতিতে মশারা আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিল।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তোমার মশারা তোমার মতোই ঘাড়ত্যাড়া।”
“কী যে বলো! মশারা কেন আমার হতে যাবে? তুমি ছাড়া কেউ আমার না।”
“তোমার হাতে এসব কী?”
“ওহ্! এসব তোমার জন্য। শুভ জন্মদিন মৃন্ময়ী।”

প্রভাত হাসিমুখে কেক বক্সটা বাড়িয়ে ধরল। মৃন্ময়ী চরম অবাক হলো। আজ যে তার জন্মদিন তা হয়তো সে ছাড়া অন্য কারোরই মনে নেই। মনে থাকার কথাও না। আগে ফেসবুকে জন্মদিনের নোটিফিকেশন পেলে অনেকে পোস্টের মাধ্যমে তাকে শুভেচ্ছা জানাত। দুবছর ধরে মৃন্ময়ী জন্মতারিখ অনলি মি করে রেখেছে। কেন জানি তার এসব খুব একটা ভালো লাগে না। মায়ের তো কোনোকালেই কারোর জন্মতারিখ মনে থাকে না। মৃত্তিকা ফেসবুকে নোটিফিকেশন বন্ধ হওয়ার পর আর শুভেচ্ছা জানায়নি। মৃদুলার যেবার মনে থাকে, সেবার সে নিজের হাতে কার্ড বানিয়ে বোনকে শুভেচ্ছা জানায়। আর যেবার মনে না থাকে, পরবর্তীতে মনে পড়লে খুব আফসোস করে। প্রভাত-ই একমাত্র মানুষ যে দুবার ধরেই তার জন্মদিনে কেক, গিফটসহ শুভেচ্ছা জানাতে হাজির হয়। গত বছর সে প্রভাতের আনা উপহার গ্রহণ করেনি, কেক-ও ফিরিয়ে দিয়েছিল। তখন সে প্রভাতের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত ছিল। এবার আবার প্রভাত একই কাজ করল। মৃন্ময়ী বলল,
“ধন্যবাদ। কিন্তু তোমার এসব আনা উচিত হয়নি। গতবার তোমায় বারণ করেছিলাম তো, ভুলে গেছো?”
“তোমার ওসব বারণ প্রভাত তরফদার ভদ্র ছেলের মতো মেনে নিবে, এটা ভাবা-ও তোমার উচিত হয়নি। বেপরোয়া ছেলেরা এত বাধ্য হয় না। কিন্তু তুমি দয়া করে এবারেও অবাধ্যতা কোরো না। গতবার কেক নিয়ে বন্ধুদের দান করে দিয়েছিলাম, এবারে কিন্তু তা-ও করব না। আমি অত ভদ্র না।”
মৃন্ময়ী ঠিকঠাক উত্তর খুঁজে পেল না। চ-সূচক আওয়াজ করে বলল,
“কী মুশকিল! বুড়ো বয়সে তুমি এমন বাচ্চামি কেন করো?”
“কী মুশকিল! কারণটা বলতে-বলতে তো ‘ভালোবাসি’ শব্দটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার মনেই থাকছে না। এটা-ও কি আমার দোষ?”
“তুমি সত্যিই একটা অসম্ভব মানুষ। তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করাই আমার উচিত হয়নি।”
“করেই যখন ফেলেছ, এখন আরেকটু ভালো ব্যবহার করে কেকটা গ্রহণ করে আমায় ধন্য করো ম্যাডাম।”
“আমার এখন কেক খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খেয়ে ফেলো।”
“তা বললে তো হবে না ম্যাডাম। এক চিমটি হলেও খেতে হবে। নয়তো আজ আমি এই কেক নিয়ে তোমার বাসায় গিয়ে উঠব।”
মৃন্ময়ী হতাশ চোখে চাইল। এই ছেলেকে একদম বিশ্বাস নেই? সত্যি-সত্যি বাসায় গিয়ে উঠতে-ও এর কোনো দ্বিধা হবে না। দিশা না পেয়ে সে মনকে সান্ত্বনা দিলো, ‘কেকই তো! একটু খেলেই তো আর প্রেম হয়ে যাবে না।’ তারপর বলল,
“ঠিক আছে, দাও। কিন্তু আমি এক কামড়ের বেশি খেতে পারব না।”
প্রভাত দারুণ খুশিতে চমৎকার হাসিতে বলল,
“তোমার এক কামড়েই আমার কেক স্বার্থক। চলো কোথাও বসি।”

তারা একটা বন্ধ দোকানের সামনের টুলে বসল। প্রভাত বক্স খুলে প্লাস্টিকের ছু’রিটা মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে বলল,
“কাটো।”
নিজের সামনে প্রভাতকে এত খুশি মৃন্ময়ী এই প্রথম দেখল। কী উৎসুক চোখে সে মৃন্ময়ীর কেক কা’টার অপেক্ষা করছে! মৃন্ময়ী কেক কা’টল। সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাত কেকের কা’টা টুকরোটা হাতে তুলে নিয়ে মৃন্ময়ীর মুখের কাছে ধরল। মৃন্ময়ী ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বুঝতে পেরে প্রভাত হাসিমুখে বলল,
“খাও না, আমি খুব খুশি হব। জাস্ট ওয়ান বাইট, প্লিজ।”
অস্বস্তি পেরিয়ে মৃন্ময়ী প্রভাতের হাত থেকে এক কামড় কেক খেল। বাকি কেকটুকু প্রভাত নিসঙ্কোচে নিজের মুখে পুরে নিল। বিষয়টা মৃন্ময়ী ঠিকঠাক খেয়াল না করার ভান করল। খেয়াল করলেই যত অস্বস্তি। প্রভাত আরেক টুকরো কেক বাড়িয়ে ধরে বলল,
“আরেকটু খাও না। কেকটা খুব মজা। এমনিতেও তো কে’টে ফেলেছো।”
মৃন্ময়ী ওই কেকটুকু-ও খেল। তারপর বলল,
“আমি এখন উঠছি।”
“আরেকটু খাও না।”
“আর পারব না।”
“তাহলে আরেকটু সময় বসো।”
প্রভাত পকেট থেকে টিস্যু প্যাকেট বের করে মৃন্ময়ীকে একটা টিস্যু দিলো। তারপর নিজের হাত মুছে নিয়ে পাশ থেকে গিফট বক্সটা তুলে বাড়িয়ে ধরল। মৃন্ময়ী এবার দ্বিধাভরা কন্ঠে বলল,
“কেক পর্যন্ত ঠিক আছে প্রভাত। আমি তোমাকে একেবারেই ফিরিয়ে দিইনি। কিন্তু উপহার আমি গ্রহণ করতে পারব না, সরি।”
“আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। ঠিক এই কারণেই আমি খুব মূল্যবান কিছু কিনিনি, বিশ্বাস করো। আমি পারতাম তোমার জন্য মূল্যবান উপহার কিনতে, তবু কিনিনি শুধুমাত্র তুমি গ্রহণ করবে না বলে। তুমি এই প্যাকেট খুলে দেখলেই বুঝতে পারবে, আমি একদমই মিথ্যা বলছি না। এর ভেতরে খুবই সামান্য উপহার আছে। তুমি এটা গ্রহণ করলে এই সামান্য উপহারটাই আমার কাছে অসামান্য মনে হবে।”
“প্রভাত, আমাকে জোর কোরো না প্লিজ।”
“জোর করছি না। তোমাকে কোনো কিছুতে জোর করার সাহস আমার নেই। আমি চাই আমার এই সামান্য উপহারটা তুমি গ্রহণ করো। প্রেমিক হিসেবে না হোক, অন্তত একজন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো। তুমি ফিরিয়ে দিলে এই উপহার অন্য কাউকে দেওয়া সম্ভব না, ফিরিয়ে দেওয়া-ও সম্ভব না। প্লিজ মৃন্ময়ী, সামান্য উপহারই তো। খোলার পর যদি তোমার মনে হয় আমি বিশাল কিছু কিনে ফেলেছি, তাহলে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো। আমি কিছুই মনে করব না।”
মৃন্ময়ী আবারও হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল। আজ কী যে হচ্ছে তার সাথে! আগের মতো প্রভাতের ওপর প্রচণ্ডভাবে বিরক্ত-ও সে হতে পারছে না। ছেলেটা এমনভাবে অনুনয়-বিনয় করে যে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। তবু তো সে শক্ত থাকার যথেষ্ট চেষ্টা করে। শেষমেশ উপহারটা-ও মৃন্ময়ীকে গ্রহণ করতে হলো। প্রভাতের খুশি যেন আর ধরে না। খুশিতে সে বাকি কেকটুকু এক বসাতে একাই খেয়ে ফেলল। তারপর মৃন্ময়ীকে বাড়ি অবধি-ও পৌঁছে দিয়ে এল। বাড়িতে ঢোকার আগে যখন মৃন্ময়ী ছোটো করে তাকে ধন্যবাদ জানাল, ঠিক তখন প্রভাতের মনে হলো আজকের দিনটা আসলেই একটু বেশিই বিশেষ। এমন দিন সে তার জীবনে বারবার ফিরে পেতে চায়।

উপহারসহ বাড়িতে ঢুকতেই মৃন্ময়ী মায়ের প্রশ্নের মুখে পড়ল। সাজেদা বেগম বক্সটা হাতে নিয়ে দেখতে-দেখতে জিজ্ঞেস করলেন,
“এটা কী রে?”
“উপহার।”
“কে দিলো?”
“এক বন্ধু,” উত্তরটা মিথ্যা হয়েও সত্য মনে হলো মৃন্ময়ীর।
সাজেদা বেগম পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“কোন বন্ধু?”
“তুমি চিনবে না। আমার সহপাঠী ছিল।”
“তা হঠাৎ তোকে উপহার দিলো যে?”
“দিতে ইচ্ছা করেছে তাই দিয়েছে।”
“তোর অনেক ভালো বন্ধু বুঝি?”
“ওই ভালোই।”
“ওওও। এটার ভেতরে কী আছে?”
“জানি না, খুললে বলতে পারব।”
“তাহলে খুলে দেখ।”
“খুলব নে মা। একটু জিরিয়ে নিই।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। ঠান্ডা শরবত খাবি? বানিয়ে দিবো?”
“বানাবে? বানাও তাহলে। গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।”

সাজেদা বেগম তখনই শরবত বানাতে চললেন। মৃন্ময়ী নিজের ঘরে ঢুকতেই তার পেছন-পেছন মৃদুলা-ও এল। ভেতরে ঢুকেই সে মৃন্ময়ীকে দুহাতে জাপটে ধরে বলল,
“হ্যাপি বার্থডে আপু।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ বোন।”
মৃদুলা মৃন্ময়ীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“গিফটটা তোমায় প্রভাত ভাইয়া দিয়েছে, তাই না?”
মৃন্ময়ী অবাক চোখে তাকিয়ে জানতে চাইল,
“তুই জানলি কীভাবে?”
মৃদুলা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
“গণনা করে জেনেছি। দাঁড়াও, তোমার জন্য আমার তরফ থেকেও একটা ছোট্ট উপহার আছে।”
“কী উপহার?”
মৃদুলা এক ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। তাকে আলমারির ভেতরের জামাকাপড়ের নিচ থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করতে দেখে মৃত্তিকা প্রশ্ন করল,
“কী-রে? ওটা কী লুকিয়ে রেখেছিলি?”
মৃদুলা বলল,
“বড়ো আপুর বার্থডে গিফট।”
মৃত্তিকা একটু দ্বিধা নিয়ে জানতে চাইল,
“আজ আপার বার্থডে?”
“কেন? তুমি জানতে না?”
“মনে ছিল না।”
মৃদুলা উপহার নিয়ে ছুটল বড়ো বোনের কাছে। মৃত্তিকার হঠাৎ খুব খারাপ লাগল। নিজেকে প্রচণ্ডরকম স্বার্থপর মনে হলো। মা ঠিকই বলে, আপাকে সে কোনোকালেই বোঝেনি। বুঝতে চায়নি আর-কী। আচ্ছা, সে এখন খালি হাতে গিয়ে জন্মদিনের শুকনো একটা শুভেচ্ছা জানালে কি আপা খুশি হবে? না থাক, মৃদুলার মতো তো সে আপাকে ভালোবাসতেই পারে না। আজ হঠাৎ মিছে আবেগ দেখিয়ে কী হবে? তারচেয়ে বরং মৃদুলার সুন্দর শুভেচ্ছায় আপা খুশি থাকুক।

মৃদুলার উপহার খুলে মৃন্ময়ী অবাক হলো। এই মেয়ে তার জন্য দারুণ একটা শাড়ি কিনেছে। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে আবার চুড়ি আর কানের দুল-ও কিনেছে। মৃন্ময়ী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“এ তুই কী করেছিস মৃদুলা!”
মৃদুলা দাঁত বের করে হেসে বলল,
“তোমার ভাষায় অকাজ করে ফেলেছি, জানি। কিন্তু তুমি আমায় বকতে পারবে না। তুমিই সেদিন আমার জন্য পার্স কিনে এনে মাকে বলেছিলে মাঝে-মাঝে নিয়ম-কানুন ভেঙে পরিবারকে খুশি করতে ভালো লাগে। আমিও কিন্তু সেটাই করেছি।”
“তাই বলে তুই এত টাকা খরচ করবি? অল্প টাকায় কি উপহার দেওয়া যায় না?”
“আমার তোমাকে শাড়ি দেওয়ার শখ জেগেছিল, তাই শাড়িই কিনেছি। অন্যকিছু কিনলে মনে শান্তি পেতাম না।”
“এ মাসে নিশ্চয়ই হাত খরচে টানাটানি পড়ে গেছে?”
মৃদুলা হাসিমুখেই বলল,
“তা একটু পড়েছে। সমস্যা নেই, আগামী সপ্তাহেই আরেকটা টিউশনের টাকা পাব। এখন আমার গিফট তোমার পছন্দ হয়েছে কি না তা-ই বলো।”
মৃন্ময়ী মুচকি হেসে বলল,
“খুব পছন্দ হয়েছে। তোর পছন্দ কখনও খারাপ হয় না। কিন্তু এবারের মতো কিছু বললাম না, আর কখনও যেন এমন অকাজ করতে না দেখি।”
মৃদুলা বলল,
“তুমি খুশি হলে আমি এমন অকাজ বারবার করতে চাই। তারপর বকা শুনতে-ও আমার আপত্তি নেই।”
মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। বাড়িতে এই মেয়েটা আছে বলেই মাঝে-মাঝে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে সে হাসতে পারে। ভাগ্যিস সৃষ্টিকর্তা তার প্রতি এতটুকু দয়া করেছিলেন!

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৩

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৩.
নতুন পার্স পেয়ে খুব খুশি হলেও মৃদুলা বেজার মুখে বলল,
“পার্স আমি নিজেই কিনতাম আপু। তুমি কেন কিনতে গেলে?”
“কেন, তোর পছন্দ হয়নি?”
“পছন্দ হয়েছে। তোমাকে না বলেছি আমার পেছনে অযথা খরচ না করতে?”
“দাম বেশি না তো। মাত্র আড়াইশো টাকা।”
“হোক, আড়াইশো টাকা তোমারই উপকারে আসত।”
মৃন্ময়ী হেসে মাকে ডেকে বলল,
“মা দেখো, তোমার মেয়ে খুব বড়ো হয়ে গেছে। এমনভাবে বলছে যেন তার জন্য খরচ করা আমার দণ্ডনীয় অপরাধ।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“আমার মেয়ে ঠিকই বলে। যেটা কেনার সামর্থ ওর আছে, সেটা ও নিজেই কিনে নিবে। তোর এত বাড়তি খরচের কী দরকার? ওর যখন হাতে টাকা না থাকে, কিছু দরকার হলে তো ও নিজেই তোকে জানায়। দুজনেই কষ্ট করে টাকা রোজগার করিস। খরচ তেমনই ভেবেচিন্তে করা উচিত।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভেবেচিন্তে, মেপে-মেপে তো সবসময়ই খরচ করি মা। তবু কখনও-কখনও ভাবনাচিন্তার বাইরে গিয়ে তোমাদের জন্য কিছু করতে ইচ্ছা করে। এটা আমার কাছে অনেক আনন্দের। তোমাদের মুখের হাসিটাই তো আমার সবকিছু। তারজন্য মাঝে-মাঝে নিয়ম-কানুন ভাঙতে আমার কোনো আফসোস নেই।”
মৃদুলা মন খারাপী সুরে বলল,
“আমাদের ভালো রাখার তাগিদে তো তুমি নিজের জীবনটাকেই ব’লিদান দিয়ে দিচ্ছ আপু। আমরা তোমাকে ভুলিয়েই দিয়েছি তোমার-ও একটা জীবন আছে। তোমার-ও আমাদের মতো সবরকম চাহিদা আছে, হাসিখুশি থাকার ইচ্ছা আছে, একটা শান্তিপূর্ণ জীবনের আকাঙ্ক্ষা আছে। অথচ দায়িত্বের নামে আমরা তোমাকে টেনেহিঁচড়ে তোমার জীবন থেকে কতটা দূরে সরিয়ে এনেছি! আমরা খুবই স্বার্থপর, তাই না আপু?”

সাজেদা বেগম মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মৃদুলার কথায় যে মেয়েটার ক্লান্ত মনটায় মন খারাপের ছায়া পড়েছে, তা তিনি বেশ বুঝতে পারলেন। তাই তিনি মৃদুলাকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“তুই ওর কানের কাছে ভনভন না করে সর তো। ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দে। কী গরম পড়েছে দেখেছিস? মেয়েটা মাত্র বাইরে থেকে এসেছে না?”
“চলে যাচ্ছি, আমার পড়তে বসতে হবে,” বলে মৃদুলা উঠে পড়তেই মৃন্ময়ী তাকে পিছু ডাকল,
“শোন।”
“বলো আপু।”
মৃন্ময়ী তার ব্যাগ থেকে নতুন কেনা কানের দুলগুলো বের করে দিয়ে বলল,
“নে, কানের দুলের ডিজাইনটা পছন্দ হয়েছিল, তাই নিয়ে এসেছি।”
মৃদুলা হাতে নিয়ে দুই জোড়া দুল দেখে জিজ্ঞেস করল,
“একরকম দুই জোড়া দুল দিয়ে আমি কী করব?”
“মৃত্তিকাকে এক জোড়া দিয়ে আয়।”
মৃদুলা একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
“তুমি পারো-ও আপু!”

মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসে ছিল। মৃদুলা এসে তার হাতে এক জোড়া কানের দুল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“নাও, এটা তোমার।”
মৃত্তিকা কানের দুলটা নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে শুধাল,
“সুন্দর তো! তুই কিনেছিস?”
“উঁহু, বড়ো আপু আমার জন্য পার্স কিনতে গিয়েছিল। তখন এই দুলের ডিজাইন পছন্দ হয়েছে বলে তোমার আর আমার জন্য নিয়ে এসেছে।”
“ও, আসলেই সুন্দর।”
“আপু এখনও তোমাকে নিয়ে কত ভাবে! সত্যি, অবাক না হয়ে পারি না। তার জায়গায় আমি হলে হয়তো তোমার ছায়া-ও মাড়াতাম না। আপু একটা অদ্ভুত মানুষ!” কথাগুলো বলতে-বলতে মৃদুলা চলে গেল।

মৃত্তিকা প্রতিবাদ করল না। ইদানীং মা-বোনের কড়া কথার বিপরীতে তার আর প্রতিবাদ আসে না। তর্ক করার ইচ্ছা জাগে না। কথা-ও যেন সে খুব মেপে-মেপে বলছে। কী দরকার কথা বাড়িয়ে তর্কে জড়ানোর? তর্ক করার মতো কথাই তো আজ আর তার ঝুলিতে নেই। সম্পূর্ণ শূন্য ঝুলি নিয়ে সে এই সংসারে ফিরে এসেছে। এই সংসারে আগে তার ভিন্ন একটা জায়গা ছিল, অন্যরকম মনের জোর ছিল। সেই জায়গাটা-ও সে নিজের দোষে হারিয়েছে। তবু যখন তার শেষ আশ্রয়স্থল এই সংসারটাই, শেষ ভরসা বড়ো আপা-ই, তখন আর নিজেকে আগের জায়গায় কল্পনা করার অর্থ কী? আগের মৃত্তিকা আর আজকের মৃত্তিকার জীবনের মাঝে যে আকাশ-পাতাল ফারাক। আগের মৃত্তিকার জীবনে যে পরিবারের চেয়েও মূল্যবান একটা মানুষ ছিল, সে-ও আর তার নেই। মৃত্তিকা তার ফোনটার দিকে তাকাল। স্ক্রিনে তার আর তার স্বামীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভাসছে। ছবিটা তাদের বিয়ের দিনে তোলা। কী খুশি ছিল তারা সেদিন! পরমুহূর্তেই সে হাতের কানের দুলের দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে তার চোখ-মুখে অন্ধকার নেমে এল। বুক চিরে বেরিয়ে এল ধারালো দীর্ঘশ্বাস।


গরমে অতিষ্ঠ প্রভাত শার্টের ওপরের দিকের দুটো বোতাম খুলে হাঁটছে। একটু পরপরই সে শার্ট ঝাঁকিয়ে শরীরে হাওয়া দিচ্ছে আর আফসোসের সুরে বলছে,
“আহ্! সিঙ্গেল মানুষের এমন গরম লাগার মানে কী! বেয়াদব গরম কি জানে না সিঙ্গেল মানুষকে বাতাস করার কেউ নেই? মনে হচ্ছে এই গরমের থেকে বাঁচতে অতি শীঘ্র বিয়ে করতে হবে। বউ-ই এই বাড়াবাড়ি রকমের গরমের একমাত্র সমাধান।”
মৃন্ময়ীকে শুনিয়ে সে এত কথা বললেও মৃন্ময়ী যেন শুনেও শুনছে না। সে তার মতো হাঁটছে তো হাঁটছেই। প্রভাত মাথা কাত করে উঁকি দিয়ে তার মুখোভাব লক্ষ্য করে বলল,
“ও ম্যাডাম, একটু দয়া তো করতে পারো। না কি? বেচারা ছেলেটাকে আর কত কষ্ট দিবে? এই মাথাফাটা গরমে তোমার পেছনে ঘুরেঘুরে যদি মাথা ফেটে ম’রেটরে যাই, তখন তো আর কেঁদে-ও লাভ হবে না। এখন মানুষ আছি বলে তোমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন নিয়ে পেছনে ঘুরছি, ভূ’ত হলে তো তুমি আমাকে দেখলেই দৌড়ে পালাবে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভূত হলে পছন্দমতো একটা পেতনি খুঁজে নিয়ো‌।”
“পেতনিটা তুমি হলে আমি এক কথায় রাজি আছি।”
“আমার ঠেকা পড়েনি তোমার সাথে ম’রার।”
প্রভাত অবাক কন্ঠে বলল,
“তারমানে তুমি চাও আমি একাই ম’রে যাই? আমি তোমাকে এত ভালোবাসি, আর তুমি আমার মৃ’ত্যু কামনা করছো? এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয় মৃন্ময়ী।”
“আমি কিছুই চাইছি না। তুমি নিজেই মুখের কথায় ম’রে যাচ্ছ, আবার মুখের কথায় ভূ’ত হয়ে যাচ্ছ।”
প্রভাত মন খারাপ করে বলল,
“কী করব? তুমি তো আমার দুঃখ বোঝো না। আমার সব দুঃখ বারবার পিষে ফেলে রেখে চলে যাও।”
“বললাম তো আমি কিছুই করি না। যা করার তুমি নিজেই করো। দুঃখের কথা বললে সেটাও তুমি নিজের ইচ্ছায় জুটিয়ে নাও।”
প্রভাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তা অবশ্য মিথ্যা বলনি। দোষ তো আমারই। আমি নিজেই তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভে চারটা বছর ধরে পেছনে পড়ে আছি। তুমি আমায় বিন্দুমাত্র আশা দাওনি। তবু আমি মৃন্ময়ী নামক আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটে চলেছি। আমি জানি না এই সব অনিশ্চয়তা পেরিয়ে আমি কবে তোমার হৃদয়ে পৌঁছাতে পারব। তবু আমি ধোঁয়াশার মতো আশা ছাড়ব না। আমি তোমাকে জয় করবই। হয় আমি তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধব, নয় আজীবনের মতো ঘরের আশা ত্যাগ করব।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার কারণে তুমি ঘরের আশা ছাড়তে পারো না। যেহেতু আমি তোমাকে কোনোরকম আশা দিইনি, সেহেতু তুমি আমাকে আজন্মের দোষী-ও বানাতে পারো না।”
“নাহ্। আমি তো বলছি তুমি দোষী নও, দোষী আমি নিজেই। এটুকু দোষ না করলে কি আর অসম্ভব রকমের ভালোবাসা জয় করা যায়? দোষ যখন করেই ফেলেছি, চালিয়ে যাই না। জয়ী তো আমি একদিন হবই। আর দুর্ভাগ্যবশত হেরে গেলে, ঘর-টরের স্বপ্ন ওখানেই শেষ। তবে ভয় নেই, আমি কোনোদিনও তোমার দিকে আঙুল তুলব না। আমি জানি তুমি কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছো, কেন দিনের পর দিন প্রেম-ভালোবাসা এড়িয়ে চলছো। যেখানে আমি নিজেকে তোমার জায়গায় কল্পনা করতে-ও ভয় পাই, সেখানে তোমাকে দোষ দেওয়া তো অসম্ভব কাজ।”

মৃন্ময়ী কিছুক্ষণ নীরব রইল, প্রভাত-ও। তারপর মৃন্ময়ী নরম গলায় বলল,
“প্রভাত, জেনেবুঝে আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটে কী মজা পাচ্ছ? বয়স বাড়ছে, আর এমন বেপরোয়া হয়ো না।”
প্রভাত নিঃশব্দে হাসল। বলল,
“বেপরোয়া বলেই আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটছি। নয়তো বহু আগেই থেমে যেতাম।”
“এবার তো থামো। তুমি কি ক্লান্ত হও না?”
“থামার জন্য তো এতটা পথ হাঁটিনি। আর তোমার বেলায় আমার কোনো ক্লান্তি-ও নেই। যেদিন বুঝতে পেরেছিলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি, সেদিন থেকেই আমি আমার মনের সমস্ত ক্লান্তিদের ছুটি দিয়ে দিয়েছি। মৃন্ময়ী ম্যাডামকে জয় করার অভিযানে নেমেছি যে। এটুকু প্রস্তুতি তো নিতেই হত।”
“লাভ নেই প্রভাত। আমি তোমাকে বারবার বলেছি আমার পরিবারের বাইরে আমি এখন কিচ্ছু ভাবতে পারব না। আমার জীবন আমাকে সেই সুযোগ দিবে না।”
“আর যদি কোনোদিন সেই সুযোগ আসে, সেদিন কি তুমি আমাকে ভালবাসবে?”
“আসবে না।”
“যদি আসে?”
“অসম্ভব।”
“আচ্ছা, না আসুক। আমি শুধু তোমার মুখে সত্যি কথাটা জানতে চাই। সুযোগ এলে কি তুমি আমায় ভালবাসবে?”
“আমার জন্য ওসব কল্পনা ছাড়া কিছুই না।”
“বলো না। আমি একবার তোমার মনের কথা শুনতে চাই, শুধু একবার। মনে করো এটা কল্পনাই। তোমার সামনে সুযোগ এসেছে কাউকে ভালোবাসার। তুমি কী করবে? সেদিনও আমাকে এভাবেই ফিরিয়ে দিবে? না আমাকে গ্রহণ করে নিবে? না কি আমাকে অযোগ্য ভেবে অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে বসবে? বলো না প্লিজ।”

অবাক চোখে মৃন্ময়ী প্রভাতের ব্যাকুলতা দেখছে। যতই সে এই ছেলেটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুক, মাঝেমাঝে এমন কিছু মুহূর্তে ছেলেটার এসব ব্যাকুলতা দেখলে তার খারাপ লাগে। কোন সুখে এই ছেলে তাকে ভালোবাসল? কেন তার মনে মৃন্ময়ীর জন্যই এত পাগলামির সৃষ্টি হলো? সে তো অন্য কাউকে এমন পাগলের মতো ভালোবেসে একটা সুখী জীবন নিশ্চিত করতে পারত। তবে আর তাকে মৃন্ময়ীর অনিশ্চিত জীবনে প্রবেশ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে হত না। মৃন্ময়ী নিচু স্বরে বলল,
“আমি তোমাকে মিছে আশা দিতে পারব না।”
“তোমাকে আশা দিতে হবে না। তুমি মুখ দিয়ে শুধু এইটুকু বলো যে, কোনোদিন সুযোগ এলে তুমি আমাকেই ভালোবাসবে। ব্যস এটুকুই, আর কিচ্ছু বলতে হবে না তোমাকে। বাকিটা আমি নিজেই বুঝে নিব। প্লিজ মৃন্ময়ী।”
“তোমার নিজস্ব একটা জীবন আছে প্রভাত। আমি চাই না আমার জন্য তুমি তোমার জীবন থেকে সরে দাঁড়াও।”
“আর তুমি? তুমি কী করছো? তোমার কি নিজস্ব জীবন নেই? তা নিয়ে তো তোমার বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই। এটা কি নিজস্ব জীবন থেকে সরে যাওয়া নয়?”
“আমার আর তোমার জীবন এক নয়। তুমি তো জানো তোমার থেকে আমি সম্পূর্ণ আলাদা।”
“হোক আলাদা। তুমি শুধু আমার হয়ে যাও, আলাদাকেই আমি এক করে নিব।”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমার জন্য বিয়ে করা মানেই পরিবার ছাড়া। এই পরিবার ছাড়ার কথা আমি ভাবতেও পারব না।”
“আমি তো তোমাকে পরিবার ছাড়তে বলছি না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি কোনোদিনও তোমাকে তোমার পরিবার ছাড়তে বলব না। আমি শুধু চাইছি তুমি তোমার জীবনটা নিয়ে একটু ভাবো। তারপর তোমার-আমার জীবনে শুধু একটু পরিবর্তন আসবে। তোমার বাকি সব একইরকম থাকবে, আমি তোমাকে কিচ্ছু পরিবর্তন করতে বলব না। বিয়ে করলেই পরিবারের সাথে তোমার দূরত্ব তৈরি হবে, এমন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসো প্লিজ। আমি তো জানি তোমার পরিবারের তোমাকে কতটা দরকার। আমি তাতে কোনোদিনও আপত্তি করার সাহস দেখাব না। তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কী বুঝাতে চাইছি?”
“পারছি।”
“তাহলে কিছু তো বলো।”
“প্রভাত, মুখে অনেককিছুই বলা সম্ভব। চামড়ার মুখ তো, বলতে বাঁধে না। আর যদি হয় আবেগের কথা, তাহলে তো আরও আগে বাঁধে না। বাঁধে গিয়ে কোথায় জানো? যখন কথা রাখার সময় হয়। বাস্তবতার মুখোমুখি মানুষ তখনই হয়।”
“আমি ম’রে গেলেও আমার কথা ভাঙব না। তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিতে বললে আমি তা-ও করতে পারব।”
“মৃত্তিকার বর-ও হয়তো তাকে এমনভাবেই কথা দিয়েছিল। সে কি করেছে জানো? এত-এত ভালোবাসাসহ মৃত্তিকাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ওর নিজের হাতে সাজানো সংসারটা থেকে বের করে দিয়ে এখন নতুন বউ নিয়ে আনন্দ করছে।”
কথাটা শুনে প্রভাত ভীষণ অবাক হলো। মৃত্তিকার সাথে এমনটা হয়েছে, এই খবর তার জানা ছিল না। খবর নিতে হবে। আপাতত প্রভাত সে কথায় মাথা না ঘামিয়ে বলল,
“সব মানুষ তো এক হয় না। আমি খারাপ ছেলে হতে পারি, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে আমি খারাপ নই। তুমি একটা চিটারের সাথে আমার তুলনা করতে পারো না। আমি আর যা-ই করি, তোমার সঙ্গে চিট করব না।”
“আমি তুলনা করছি না, তোমাকে খারাপ-ও বলছি না। আমি শুধু বাস্তবতার বিষয়ে কথা বলছি। তুমি আমাকে যা বুঝাতে চাইছো, আমিও তারই প্রেক্ষাপট ধরে কথা বলছি।”
প্রভাত চরম হতাশ হয়ে বলল,
“তুমি আমাকে বুঝতে পারো না, না কি বুঝতে চাও না, তা-ই আমার বুঝে আসে না। এত ভালোবাসা চোখে দেখার পরও, এত সুযোগ সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও একটা মানুষ নিজের জীবন নিয়ে কীভাবে এতটা উদাসীন হয় মৃন্ময়ী?”
মৃন্ময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে উত্তর দিলো,
“মানুষটা আমি বলেই হয়তো।”


মৃদুলা আজ মৃত্তিকাকে ডাকাডাকি করে ঘর থেকে বের করেছে। মৃত্তিকা প্রয়োজন ছাড়া তেমন ঘর থেকে বেরোয় না। সে যে এই বাড়িতে আছে, তা-ই আজকাল বুঝা যায় না। অথচ আগে এ বাড়িতে তার কন্ঠস্বরই সবচেয়ে বেশি শোনা যেত। মৃদুলা আজ টিউশন থেকে ফেরার সময় ঝালমুড়ি কিনে এনেছে। বাড়ি ফিরে সে মা আর বোনকে ডেকে ঝালমুড়ি খেতে বসেছে। খেতে-খেতে মৃদুলা মাকে প্রশ্ন করল,
“মা, আপুর কাছে এখন টাকা চাইলে কি দিতে পারবে?”
সাজেদা বেগম বললেন,
“কেন? তোর টাকা লাগবে না কি?”
“ওই কিছু টাকা লাগত।”
“কিসের জন্য?”
“কলেজে।”
“কদিন আগে না টাকা দিলো?”
“ওই টাকা না।”
“তাহলে?”
মৃদুলা মিনমিনে গলায় বলল,
“আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান হবে। তারজন্য বান্ধবীরা সবাই একরকম জামা কিনবে।”
“তোর কাছে টাকা নেই?”
“যা আছে, তাতে হবে না।”
“তাহলে সবার সাথে পাল্লা দিয়ে জামা না কিনলে কী হয়? ঘরে কি তোর নতুন জামা নেই?”
মৃদুলা মুখে একরাশ অন্ধকার নামিয়ে বলল,
“সবাই একরকম জামা পরবে, তারমধ্যে আমি একা অন্যরকম জামা পরে যাব কীভাবে?”

সাজেদা বেগমের হঠাৎ কী হলো কে জানে? তিনি ধুম করে রেগে গেলেন। রাগত স্বরে বলে উঠলেন,
“না যেতে পারলে আমাকে বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে আন। আর কী করবি? আমার তো আর দুই টাকা রোজগার নেই যে বললেই দিয়ে দিবো। একজন দিন-রাত খেটে ম’রছে আর আমাদের টানছে। টানতে-টানতে তার দম ফুরানোর জোগাড় হচ্ছে, তা তোরা বুঝবি কী করে? তোরা তো তার কাছে হাত পাতলেই সব পেয়ে যাস। তারপর তার নিমক খেয়ে তার সাথেই নিমকহারামি করে পার পেয়ে যাস। আমার এই মেয়ে কি তোদের জন্য খাটতে-খাটতে ম’রে যেতে জন্মেছে রে? তোদের কাছে ওর কী এমন ঠেকা যে নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে তোদের সুখে রাখছে? তারপরও তোরা আমার মেয়েটার র’ক্ত পানি করা জীবনটার ওপর থুথু কেন ছিটাস? বলতে পারিস? কী পাপ করেছিল ও? কেন করিস তোরা এমন?”

কথা শেষ করার আগেই সাজেদা বেগম কেঁদে ফেলেছেন। মৃদুলা ব্যথাতুর মুখে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে আছে। সাজেদা বেগম উঠে সরে যেতেই মৃত্তিকা-ও উঠে পড়ল। সে উঠতেই মৃদুলা শক্ত মুখে বলে উঠল,
“শান্তি হয়েছ তুমি? তোমার কারণে মায়ের এসব কথা আমাকেও শুনতে হয়? আমি কী করেছি? আজব! তোমার দোষে আমিও কেন এসব কথা শুনব? আপু কি তোমার জন্য কম করেছে? আমার তো মনে হয় আপু আমার চেয়েও বেশি করেছে তোমার জন্য। তবু তুমি তাকে এত কষ্ট কী করে দাও? আল্লাহ্ কি তোমাকে মন বলতে কিছু দেয়নি আপা?”
মৃত্তিকা জবাব দিতে পারল না। মাথা নিচু করে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। সঙ্গে-সঙ্গে তার মুখের রং বদলে গেল। বিছানার কাছে গিয়ে সে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার কান্নার শব্দ দরজার ওপাশে বসা মৃদুলার কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। অনুশোচনায় দ’গ্ধ হৃদয়টা দেখল না কেউ। আবদ্ধ রুমের দেয়ালে-দেয়ালে কান্নার শব্দ ধাক্কা খেয়ে তার নিজের কানেই ফিরে এল। মৃত্তিকার যেন নিজের কান্নার শব্দটা-ও সহ্য হলো না। সে দুহাতে নিজের কান চেপে ধরল। সে আজীবন সন্ধি করে এল আনন্দের সাথে। হাসতে-হাসতে একটা জীবন কা’টিয়ে দিতে চাইল। অথচ কান্নারা হঠাৎ কেন তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে গেল? আশ্চর্য!

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০২

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২.
মৃত্তিকা মৃন্ময়ীর সামনে এল সকালে। গতকাল এসে হতে সে অভুক্ত। রাতে মৃদুলা তাকে খেতে ডেকেছিল। কিন্তু তার খাওয়ার ইচ্ছা ছিল না বলে খায়নি। সকালে ঘুম ভাঙতেই পেটের মধ্যে ক্ষুধার জ্বালাতন শুরু হয়ে গেছে। এখন আর কিছু না খেয়ে থাকা সম্ভব নয়। এতটা সময় না খেয়ে থাকার অভ্যাস নেই তার। হাত-মুখ ধুয়েই সে রান্নাঘরে হাজির হলো। সাজেদা বেগম তখন সবে নাশতা বানানো শেষ করেছেন। মৃত্তিকাকে দেখে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন,
“রুটি-ভাজি করেছি। নিয়ে খা।”
মৃত্তিকা প্রত্যুত্তর না করে চুপচাপ প্লেটে রুটি-ভাজি নিয়ে চলে এল। টেবিলের কাছে এসে দেখল মৃন্ময়ী বসে রুটি খাচ্ছে। রান্নাঘরে যাওয়ার সময় সে মৃন্ময়ীকে খেয়াল করেনি। মৃন্ময়ী স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে খেতে বসেছে। মৃত্তিকা আসতেই সে বলল,
“বোস, কাল রাত থেকে না কি কিছু খাসনি? তোর শরীর ভালো?”
মৃত্তিকা চেয়ার টেনে বসে বলল,
“ভালো।”

শরীর ভালো থাকলেও যে মন ভালো নেই, সেটা তার মলিন মুখটাই বলে দিচ্ছে। মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে বোনের মনের অবস্থা ভালো না। এই মুহূর্তে সে কীভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। মৃত্তিকা রাগ, বিরক্তি তাদের দুবোনের চেয়ে বেশি। কারো কথা পছন্দ না হলে সে খুব বিরক্ত হয়। আচ্ছা, কোন কথা দিয়ে শুরু করলে আজ মৃত্তিকা বিরক্ত হবে না? এটা তো তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মৃন্ময়ীকে চুপ দেখে মৃত্তিকা নিজেই বলল,
“আপা কি খুব শক খেয়েছিস?”
মৃন্ময়ী কথাটার কারণ বুঝেও জানতে চাইল,
“শক খাব কেন?”
“এই যে তোদের জ্বালাতে চলে এলাম।”
মৃত্তিকার ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি। তাচ্ছিল্যটা আসছে তার কপালের প্রতি। মৃন্ময়ীর কেন জানি খারাপ লাগল। মৃত্তিকাকে আরও একটু সময় দিতে ইচ্ছা করল। কাঁচা ক্ষত খুঁচিয়ে র’ক্তাক্ত করতে তার দ্বিধা হচ্ছে। যদিও সকালে মা তাকে বারবার করে বলে দিয়েছে মৃত্তিকার পেট থেকে কথা বের করতে। সে সত্যিই আর ফিরবে কি না জানতে। মৃত্তিকা খেতে-খেতে বলল,
“কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে করতে পারিস, সমস্যা নেই। তোর ঘাড়ে যখন আবার ফিরে এসেছি, সবকিছু জানার অধিকার তো তোর আছেই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তোর যখন মন ভালো হবে তখন তুই বলিস।”
“এখন আর মন নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এসে যখন পড়েছি, তোদের কাছে সবটা পরিষ্কার থাকাই ভালো।”
এই পর্যায়ে মৃন্ময়ী নড়েচড়ে বসে প্রশ্ন করল,
“তুই কি একেবারেই চলে এসেছিস? না কি প্রতিবারের মতো রাগ কমলে চলে যাবি?”
“যাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই।”
“কেন? এবার কী সমস্যা হয়েছে তোদের?”
“সমস্যা তো একটার পর একটা চলছিলই। পুরো পরিবার জোট বেঁধে নেমেছিল আমাকে সংসার থেকে ছাঁটাই করার জন্য। স্বামীর জন্য তবু সবার সাথে যুদ্ধ করে টিকে ছিলাম। শেষমেশ সেই মানুষ নিজেই আমাকে সংসার থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো।”
“অনেকদিন ধরে তোদের ঝগড়াবিবাদ চলছিল, তা তো জানি। এবার এমন কি হলো যে তোকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো, আর তুইও চলে এলি?”
“ওরা যে কিছু একটা ঘটাবে তা আমার কয়েকদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল। কয়েকদিন ধরে আমার ডাইনি শাশুড়িটা সবসময় ছেলের সাথে ফুসুরফুসুর করছিল। আমাকে দেখলেই তারা চুপ। আর আমার সঙ্গে-ও খারাপ ব্যবহার আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার জামাই আমার সাথে দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিল। আমার পাশে ঘুমাত না, ঠিকমতো কথা বলত না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই ধমকে উঠত। দুদিন আগে তারা সবাই মিলে আমার নানা শ্বশুরকে দেখতে গিয়েছিল, তার অবস্থা না কি খুব খারাপ ছিল। আমাকে একা বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। তখন তো আর বুঝিনি তারা আমার সংসার ভাঙার হাতিয়ার আনতে গেছে।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল,
“হাতিয়ার মানে?”
“সতিন, সতিন। তারা গতকাল সকালে নতুন ছেলের বউ নিয়ে বাড়িতে উঠেছে। আমার জামাইকে এত করে জিজ্ঞেস করলাম সে আমার সাথে এমন কেন করেছে, সে এমন ভাব করল যেন আমি তার কেউ না। তারা সবাই ব্যস্ত নতুন বউ নিয়ে। আমি যেন কীটপতঙ্গ, কেউ চোখেই দেখে না। রাগ করে আমি যখন চেঁচামেচি শুরু করেছি, তখন তারা সুযোগ বুঝে বলে দিয়েছে তারা তাদের পছন্দমতো ছেলের বউ এনেছে। সহ্য না হলে আমি যেন আমার বাপের বাড়ি চলে আসি। আমার জামাই তো বলেই দিয়েছে সে আমাকে তালাক দিয়ে দিবে। আমি ওখানে থাকলে সে আর আমাকে স্ত্রীর জায়গা দিবে না। এই আর-কী। কথায়-কথায় গায়ে হাত-ও তুলল। তারপর দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিলো। তাই আমিও চলে এলাম। যার জন্য ওই বাড়িতে পড়ে ছিলাম, তার কাছেই যদি জায়গা না পাই, থেকে আর কী হবে? থাকুক তারা তাদের নতুন বউ নিয়ে। আমি তো শান্তি দিইনি। নতুন বউ যদি তাদের শান্তি দেয়।”

মৃন্ময়ী হতভম্ব হয়ে গেল। ঘরে বউ রেখে আবার নতুন বউ এনেছে? তা-ও প্রথম বউয়ের অজান্তে? আশ্চর্য! মানুষ এমন বিশ্রী কাজ কীভাবে করতে পারে? সে অবাক কন্ঠে বলল,
“সংসারে ঝগড়া-বিবাদ তবু মানা যায়। কিন্তু ও তোর সাথে এমন একটা কাজ কীভাবে করতে পারল? ও তো নিজের পছন্দেই তোকে বিয়ে করেছিল।”
“তখন পছন্দের ছিলাম তাই বিয়ে করেছিল। এখন অপছন্দের হয়ে গেছি, তাই ছেড়ে দিয়েছে। আমার কপালে আসলে এটাই হওয়ার ছিল। মা বলেছিল না আমার এই আবেগী বিয়ে বেশিদিন টিকবে না? শেষপর্যন্ত মায়ের কথাই সত্যি হলো।”
“তা তো মা তোর ওপর রাগ করে বলত। কোনো মা কি চায় মেয়ের সংসার ভেঙে যাক? তখন এ কথা বলত, এখন দেখ তুই চলে এসেছিস বলে মা কত দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।”
মৃত্তিকা আবারও হেসে বলল,
“মা দুশ্চিন্তায় পড়েছে তোকে নিয়ে রে আপা। তোর ঘাড়ে বসে আবারও লাফালাফি শুরু করি কি না, সেই ভয় পাচ্ছে।”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“মা তোর-আমার সবার চিন্তাই করে রে। শুধু মুখে প্রকাশ করে না বলে আমরা তার খিটখিটে মেজাজটাই সত্যি ভেবে নিই।”
মৃত্তিকা ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“যাক, এখন এসব কথা রাখ। তোর স্কুলে যেতে দেরী হয়ে যাবে। ওঠ-ওঠ।”
মৃন্ময়ী দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যিই তার দেরী হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাত ধুয়ে এক গ্লাস পানি পান করল সে। এঁটো প্লেট ধরতেই মৃত্তিকা বলল,
“আমি ধুয়ে রাখব নে। তুই যা।”
অবাক করার মতো কথা। মৃত্তিকার মুখে এমন কথা কোনোদিন শুনেছে বলে মৃন্ময়ীর মনে পড়ে না। সে খাবার খেয়ে নিজের এঁটো প্লেট-ও ফেলে রেখে উঠে যাওয়া মেয়ে। কিন্তু মৃন্ময়ীর এখন অবাক হওয়ার সময়-ও হাতে নেই।‌ উঁচু গলায় মাকে বলেই সে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল।


বেতন হাতে পেয়ে আজ মৃন্ময়ী কোচিং থেকে বেরিয়ে সোজা মার্কেটে চলে এসেছে। অনেকদিন ধরে সে লক্ষ্য করছে মৃদুলার হাতের পার্সটা পুরোনো হয়ে গেছে। মেয়েটা নতুন পার্স না কিনে সেটা নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃন্ময়ী বোনের জন্য একটা পার্স কিনল। নতুন এক ডিজাইনের কানের দুল মৃন্ময়ীর খুব পছন্দ হলো। তার থেকে সে দুই জোড়া কানের দুল কিনে নিল। মায়ের জন্য ঔষধ কিনতে যাওয়ার সময় হঠাৎ মৃন্ময়ীর চোখ আটকে গেল পাশের জুয়েলারি দোকানে। মৃত্তিকার বর দোকানে ঢুকছে, অর্থাৎ প্রাক্তন বর। সঙ্গের মেয়েটা নিশ্চয়ই তার নতুন বউ? নিমেষেই মৃন্ময়ীর মেজাজ বিগড়ে গেল। ইচ্ছা করল ছুটে গিয়ে বাটপারটার কলার ধরে কানের নিচে কষে কয়েকটা থাপ্পড় মা’রতে। এক বউয়ের সঙ্গে বাটপারি করে এখন আরেকজন নিয়ে ঘুরে-ঘুরে জুয়েলারি কেনা হচ্ছে? মনের তীব্র ইচ্ছাটা মনে চেপে মৃন্ময়ী ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে দ্রুত বাড়ির পথে হাঁটা দিলো। প্রভাত তার পেছনেই ছিল। হঠাৎ করে মৃন্ময়ীকে তাড়াহুড়া করে হাঁটতে দেখে সে দৌড়ে তার কাছাকাছি চলে গেল। মৃন্ময়ীকে ডেকে বলল,
“ম্যাডাম, হঠাৎ গতি বেড়ে গেল যে? আজ আবার কিসের তাড়া?”
মৃন্ময়ী দ্রুত পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে গম্ভীর মুখে বলল,
“আমার পিছু নিয়ো না প্রভাত। চলে যাও।”
প্রভাত সে কথা গায়ে না মেখে বলল,
“তা তো তুমি রোজই বলো। নতুন কী?”
“রোজ বললেও তুমি শোনো না, আজ একবার শোনো প্লিজ। আমার পেছনে এসো না।”
মৃন্ময়ীর অন্যরকম কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে প্রভাত প্রশ্ন করল,
“তুমি কি রেগে আছো?”
“না।”
“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি রেগে আছো। একটু আগেও না তোমায় স্বাভাবিক দেখলাম? হঠাৎ কী হলো?”
“কিছু হয়নি। তুমি চুপ করো।”
প্রভাত মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, কিছু তো একটা হয়েছে। আমাকে বলো না কী হয়েছে।”
মৃন্ময়ী হঠাৎ থেমে গিয়ে রেগেমেগে বলে উঠল,
“বলছি তো কিছু হয়নি? তারপরও এত নাক গলাচ্ছ কেন তুমি? আমি একটু একা হাঁটতে চাইছি। সেই স্পেসটুকু-ও কি তুমি আমায় দিবে না?”
“তোমাকে একা ছাড়ার মতো স্পেস আমি দিতে চাই না।”
মৃন্ময়ী গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“তোমার সাথে আমি কথা বাড়াতে চাই না। দয়া করে এখানেই থেমে যাও, আর এসো না। কারোর সঙ্গ আমার ভালো লাগছে না। চলে যাও।”
তবু প্রভাত ত্যাড়া সুরে বলল,
“যদি না যাই?”
মৃন্ময়ী এবার উত্তর না দিয়ে রাগত চোখে চেয়ে রইল। প্রভাত বলল,
“আচ্ছা, আমি বুঝতে পারছি না কদিন ধরে তোমার কী হয়েছে। কদিন ধরেই খেয়াল করছি তোমার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। বাসায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“আমার সমস্যা জানার বিশেষ কোনো প্রয়োজনীয়তা তোমার নেই। আমি যাচ্ছি, আমার পিছু নিবে না।”
প্রভাত মন খারাপ করে বলল,
“এমন করছো কেন? আমি চুপচাপ চলি না, কথা বলে তোমাকে বিরক্ত করব না।”
“হাসিয়ো না। তুমি যেদিন চুপচাপ থাকতে পারবে, সেদিন আমি এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করব।”
“তাহলে আমি তোমাকে হাসাতেই চাই।”
“প্রভাত, তুমি কেন বুঝতে চাইছো না আমার একটু স্পেস দরকার? তুমি না আমার সহপাঠী?”
“আচ্ছা দাঁড়াও, রিকশা নিয়ে দিই।”
“আমি রিকশায় যাব না, হেঁটে যাব।”
“তুমিও তো এখন জেদ করছো। রাত বাড়ছে দেখেছ? রাস্তাঘাটে যদি একা ভয় পাও?”
“তুমি পিছু নেওয়ার বহু আগে থেকে আমি একা চলাফেরা করছি। আমাকে নিয়ে অযথা ভেবো না। নিজের কাজে যাও।”
প্রভাত আবারও ত্যাড়া সুরে বলল,
“তোমাকে নিয়ে অবশ্যই আমি ভাবব। একা যেতে চাইলে রিকশায় ওঠো, নয়তো আমার সাথেই চলো।”

মৃন্ময়ী মুখে চ-সূচক শব্দ তুলে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে রইল। প্রভাত একটা রিকশা ডেকে তাকে উঠতে বলল। উপায়ান্তর না দেখে মৃন্ময়ী রিকশায় উঠে বসল। প্রভাত তার কথা না শুনে গাড়ি ভাড়াটা-ও দিয়ে দিলো। রিকশা চোখের আড়ালে চলে গেল। প্রভাত কিছুক্ষণ চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। পকেট থেকে ফোন বের করে বন্ধু সাঈদকে ফোন করে শুধাল,
“কোথায় আছিস রে?”
“বাড়িতে।”
“বাজারে আয়, চা খাই।”
সাঈদ সহাস্যে কৌতুক করে বলল,
“কীরে মামা? এই সময় তো বারবার ফোন দিলেও তোমার পাত্তা মিলে না। আজকে কি ম্যাডামের দেখা পাওনি?”
“পাব না কেন?”
“তাহলে? যাসনি তার পেছনে?”
“না।”
“ম্যাডাম কি আজ ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ানি মা’রছে?”
“ফালতু কথা রাখ। বাজারে আয় তাড়াতাড়ি।”
“আচ্ছা আসছি। অপেক্ষা কর।”
ফোন রেখে প্রভাত উলটো পথে হাঁটা ধরল। আপনমনে বিড়বিড় করে বলল,
“রোজই তো এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসি। আজ গেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে চা, নাশতা খেতে চাইতাম না ম্যাডাম।”

মৃন্ময়ীকে ভালোবাসাটা প্রভাতের জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনার একটি। সেই স্কুলজীবন থেকেই সে মৃন্ময়ীকে চেনে। কিন্তু কখনও ভাবেনি সে একদিন ওই ভদ্র-সভ্য মেয়েটাকে ভালোবাসবে। ছাত্রজীবনে প্রভাত বেশ কয়েকবার কয়েকটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু কাউকেই ঠিক ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি। প্রেমে তো মানুষ অসংখ্যবার পড়ে। সব প্রেমেই কি আর ভালোবাসা হয়? প্রভাত-ও প্রেমে পড়েছিল। কলেজে ভর্তির পর পরপর দুটো মেয়ের সঙ্গেই অল্প কিছুদিনের সম্পর্ক-ও হয়েছিল তার। দুটোই আবেগে ভেসে গিয়েছিল। না মেয়েগুলো তাকে ভালোবেসেছিল, না সে তাদের ভালোবেসেছিল। প্রেম করার ইচ্ছা জেগেছিল তাই প্রেম করেছিল। অনেক মেয়েরা তো তাকেই পাত্তাই দেয়নি। এই কাজটা করেছিল সব ভালো মেয়েগুলো। ভালো মেয়েরা তার মতো বেপরোয়া স্বভাবের ছেলেকে পাত্তা দিবে না, এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনার্সে ওঠার পর-ও সে এক মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই মেয়ে কয়েকদিন পরেই বিয়ে করে জামাইয়ের বাইকের পেছনে বসে কলেজে উপস্থিত হয়েছিল। প্রভাত টের পেয়েছিল তার লাভ লাইফ পুরোটাই লসে পরিপূর্ণ। তাই প্রেম থেকে সে একপ্রকার সরেই দাঁড়িয়েছিল। মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছিল সে আর কোনো মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করবে না। ঠিক সেই সময় আচমকা একদিন সে মৃন্ময়ীর প্রেমে পড়ে গেল। একদম মেঘশূন্য হঠাৎ বৃষ্টির মতোই তার হৃদয়ে ঝমঝমিয়ে প্রেমের বৃষ্টি নেমে এসেছিল। তখন ছিল মাঘ মাসের ভরপুর শীতকাল। সেদিন ঠান্ডাটা একটু বেশিই পড়েছিল। সাঁঝের বেলায় প্রভাত বন্ধুদের আড্ডা থেকে বিদায় নিয়েছিল বাড়ি গিয়ে কম্বলের নিচে আশ্রয় নেওয়ার আশায়। একা পথ চলতে-চলতে হঠাৎ করেই সে বাচ্চাদের কোচিং সেন্টারের সামনে এক মেয়েকে দেখতে পেয়েছিল। কনকনে শীতের মধ্যে মেয়েটা সোয়েটার হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে বসে ছিল। প্রভাত কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে মৃন্ময়ীকে দেখতে পেয়েছিল। মৃন্ময়ীর চোখ ভর্তি জল ছিল, মুখে ছিল তীব্র বিষাদের ছায়া। কেঁদেকেটে চোখ লাল করে ফেলেছিল মেয়েটা। প্রভাতকে দেখেই সে দ্রুত চোখ মুছে নিয়েছিল। প্রভাত তার পাশে গিয়ে বসেছিল। তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কিসের কষ্ট, সে কেন একা বসে কাঁদছে। মৃন্ময়ী তাকে বলতে চায়নি। কিন্তু প্রভাত জেদ ধরে বসেছিল। মৃন্ময়ীর কান্নার কারণ না জেনে সে কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। সে খুব করে জিজ্ঞেস করায় মৃন্ময়ী-ও সেদিন নিজের মন হালকা করার প্রয়োজন বোধ করেছিল। তাই সে প্রভাতের সঙ্গে অনেক কথা বলেছিল। প্রভাতকে শুনিয়েছিল তার দায়িত্বের গল্প। সংসার নামক এক যুদ্ধক্ষেত্রের গল্প। যেখানে সে প্রতিনিয়ত অভাব-অনটন, শোক-অসুখ আর সীমাহীন দায়িত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে। তবু তার এ দায়িত্ব শেষ হবার নয়। বরং দিনেদিনে বেড়েই চলেছে। বাবা তার কাঁধে নিজের সংসারের ভার চাপিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন যে। প্রভাত শুধু অবাক হয়ে মৃন্ময়ীর অশ্রুভেজা মুখের দিকে চেয়ে ছিল। এত সুন্দর, কোমল মেয়েটা যে মনে এত দুঃখ চেপে রেখেছিল, তা হয়তো কেউই জানত না। প্রভাতের যত কষ্ট ছিল তার মনমতো একটা পরিবারের অভাবে। কিন্তু টাকা-পয়সার অভাব তার কোনোকালেই ছিল না। বাবার কাছ থেকে সে ঠিকই প্রয়োজনীয় সবকিছু আদায় করে নিত। অথচ মৃন্ময়ীর সুন্দর একটা পরিবার থাকা সত্ত্বেও তার কষ্ট ছিল প্রভাতের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। একটা সংসারের দায়িত্ব কীভাবে সামলায় মেয়েটা? তার ওপর ওই মুহূর্তে মৃন্ময়ীর মায়ের ডায়বেটিস খুব বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছোটো বোনের স্কুলের বকেয়া পরিশোধ করে তার হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। সব শুনে সেদিন প্রভাত জোর করে তার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছিল। মৃন্ময়ী নিতে না চাইলে সে বলেছিল ধার হিসেবে নিতে। মৃন্ময়ী ধার হিসেবেই নিয়েছিল। এক সপ্তাহের মাথায় আবার পরিশোধ-ও করে দিয়েছিল। প্রভাতের হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল মৃন্ময়ী তার পাওনা টাকা ফেরত দিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তারচেয়েও খুব বড়ো কিছু চুরি করে নিয়েছে। ব্যস, নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রভাত আরও একবার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সেই সাথে সে এ-ও বুঝতে পারছিল যে, এবারের প্রেম মোটেও বাকিগুলোর মতো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ মৃন্ময়ী-ও ভালো মেয়েদের কাতারেই। প্রেম বিনিময় করলে নির্ঘাত প্রত্যাখ্যান করে দিবে। প্রভাত প্রেম বিনিময় করেনি। সেই থেকে সে মৃন্ময়ীকে আড়াল থেকেই দেখে গিয়েছিল। সুযোগ পেলেই মৃন্ময়ীর বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করত। মৃন্ময়ী-ও ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল। তার সাথে বন্ধুর মতোই আচরণ করেছিল। সময় যত গড়াচ্ছিল, প্রভাত তত বুঝতে পারছিল এটাই তার প্রথম দীর্ঘস্থায়ী প্রেম। মৃন্ময়ী-ই প্রথম মেয়ে যার প্রতি তার বিরক্তি আসে না, বিতৃষ্ণা আসে না, অধৈর্য আসে না; বরং দিনেদিনে প্রেম বাড়ে। একেক দিন সে নতুন করে মৃন্ময়ীর প্রেমে পড়ে, মুগ্ধ হয়। কিন্তু সে কোনোভাবেই নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছিল না। প্রভাত তরফদার, যে কি না একের পর এক মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করেছিল, সে একদিন মৃন্ময়ীর সামনে সাহস হারিয়ে বসেছিল। ব্যাপারটা নিয়ে তার বন্ধুরা খুব মজা করত, সবসময় হাসিঠাট্টা করত। কিন্তু প্রভাত সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল মৃন্ময়ীকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। এই ভালোবাসা সে কোনোভাবেই হারাতে চায় না। মৃন্ময়ীর মুখে হাসি ফোটানোর, তাকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার, একটা সুখী সংসার উপহার দেওয়ার স্বপ্ন তার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। টানা দেড় বছর প্রভাত আড়াল থেকে মৃন্ময়ীকে ভালোবেসেছিল। তারপর যখন দেখেছিল মৃন্ময়ীর এই জীবন পরিবর্তন হবার নয়, তখন সে ভাবনা বদল করেছিল। মৃন্ময়ীর সংসার-ই তার সবকিছু, দায়িত্ব পালন-ই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। নিজস্ব জীবন নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সেই মাথাব্যথাটাই প্রভাত তার মাথায় ঢুকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যাকে সে এতটা সময় ধরে ভালোবেসে এসেছে, সে যদি নিজের সংসার জীবন নিয়েই না ভাবে, তাহলে প্রভাতের এত স্বপ্ন কী করে পূরণ হবে? সে তো মৃন্ময়ীর সঙ্গে সংসার বাঁধার স্বপ্ন নিয়েই তার পেছনে পড়ে ছিল। মৃন্ময়ীর পর যে আর কোনো মেয়ের প্রেমে পড়া হয়ে ওঠেনি তার। ভেবেচিন্তে তখন প্রভাত মৃন্ময়ীকে মনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল। নিজের মনের সম্পূর্ণ সত্য অনুভূতি সে মৃন্ময়ীকে শুনিয়েছিল। মৃন্ময়ী সেদিন খুব শক খেয়েছিল। হয়তো সে কখনও কল্পনা-ও করেনি যে প্রভাত তাকে ভালোবাসবে। স্বাভাবিকভাবেই মৃন্ময়ী তার সাথে সম্পর্কে জড়াতে নারাজ ছিল। প্রভাত অবশ্য এর বেশি কিছু আশা-ও করেনি। সে জানত মৃন্ময়ী রাজি হবে না। তাই বলে তো আর সে সরে যেতে পারে না। তাকে লেগে থাকতে হবে। মৃন্ময়ীর মন সে জয় করেই ছাড়বে। সেই থেকে প্রভাত মৃন্ময়ীর পেছনে পড়েছিল। পড়েছিল তো পড়েছিল, আজও মৃন্ময়ী তার হাত ধরে তুলে নেয়নি। সংসার জীবনে পা বাড়ানোর দুঃসাহস মৃন্ময়ীর নেই। কারণটা যে একমাত্র তার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, এটা প্রভাত খুব ভালোভাবেই জানে। তবু সে আশা ছাড়ার পাত্র নয়। সে অপেক্ষায় আছে, একদিন মৃন্ময়ী নিজের দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে তার কাছে আসবে। দুহাত ভরে তার ভালোবাসা গ্রহণ করে নিবে। সেদিন যত দূরেই হোক, প্রভাত অপেক্ষা করবে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০১

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১.
“তোর জামাই না কি তুই বলতে পাগল? তাহলে এক বছরের মাথায় তালাক দেওয়ার জন্য কপাল ঠুকে ম’রে কীভাবে? খুব তো বড়ো গলা করে বলেছিলি ওই ছেলে তোকে আমাদের চেয়েও বেশি সুখে রাখবে। সুখ এমন বাড়া-ই বেড়েছিল যে চার-পাঁচটা ব্যাগ ভরে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো?”

মায়ের মুখে এমন কটুক্তি শুনে-ও ঠোঁটকাটা মৃত্তিকা তর্কে জড়াতে পারছে না। সময়টা এক বছর আগে হলে তার মুখ কোনোমতেই বন্ধ থাকত না। ঠিকই মুখের ওপর জবাব দিয়ে দিত। কিন্তু আজ সে জবাব দেওয়ার মতো মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরেনি। শ্বশুরবাড়ি থেকে ব্যাগপত্র বগলদাবা করে একেবারে বাবার বাড়ি চলে এসেছে। ব্যাগের আকার আর সংখ্যা দেখেই বুঝা যাচ্ছে শশুরবাড়িতে ফেরার আর কোনো নিশ্চয়তা নেই। ব্যাগপত্রের যা অবস্থা, ভুল করে কোনোকিছু ফেলে রেখে এসেছে বলেও মনে হচ্ছে না। মা সাজেদা বেগম আহাজারি শুরু করেছেন মেয়ে এসে হতে। মৃত্তিকা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল,
“মা, এখানেও কি একটু শান্তিতে থাকতে দিবে না আমায়? নাওয়া, খাওয়া, ঘুম কবে ঠিকমতো করেছি, তা আমি নিজেই ভুলে গেছি। তোমার আমাকে যা বলার পরে বোলো। দয়া করে এখন আপাতত মুখটা বন্ধ রাখো।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“যা মা, শান্তি কর এখন তুই। আমাকে তো তুই কম শান্তি দিসনি। যা, যা। বড়ো বোনের রোজগার আছে, ছোটো বোনের রোজগার আছে, তুই কি আর অশান্তিতে থাকবি?”

মৃত্তিকা মায়ের কথায় কান না দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। সাজেদা বেগম কপালে এক হাত ঠেকিয়ে কিছু সময় চুপচাপ বসে রইলেন। তার দুচোখ জলে ভরে উঠেছে। টেবিলের ওপর থেকে ছোটো বাটন ফোনটা নিয়ে কল করলেন বড়ো মেয়ে মৃন্ময়ীকে। মৃন্ময়ী স্কুলের বাচ্চাদের শেষ ক্লাস করিয়ে মাত্রই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়েছে। মায়ের ফোন পেয়ে ভাবল বাড়িতে কিছু লাগবে। রিসিভ করার পর সাজেদা বেগম ধরা গলায় আহাজারি করে বলে উঠলেন,
“তোর বোনের সংসারের স্বাদ মিটে গেছে রে। তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। দেখ ব্যাগপত্র গুছিয়ে শশুরবাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছে।”

মৃন্ময়ী একটু হোঁচট খেলেও খুব বেশি অবাক হলো না। এমন কিছু যে হবে, তা সে পূর্বেই আঁচ করেছিল। সে শান্ত গলায় জানতে চাইল,
“ও নিজের ইচ্ছায় চলে এসেছে, না কি ওনারা পাঠিয়ে দিয়েছে?”
“এবার ও নিজের ইচ্ছাতেই এসেছে। আগেরবার যাওয়ার সময় বলেছিলাম না, ওই সংসারের ভাত ওর কপালে নেই? দেখলি? মাস না পেরোতে নিজেই আবার চলে এল। এই সংসারে ওকে বসিয়ে কে খাওয়াতে পারবে বুঝা আমাকে।”
“মা, আমি বাড়ি ফিরে কথা বলছি তোমার সাথে। এখন রাখো।”
“আচ্ছা, আয় তাড়াতাড়ি। এসে ওর সাথে কথা বল ভালোভাবে। আমার সাথে তো জীবনেও খোলাখুলি কোনো কথা বলে না।”
“আচ্ছা, আমি আসছি। তুমি আগেই ওর সাথে রাগারাগী কোরো না।”


বোনকে নিয়ে ভাবতে-ভাবতে পথ চলছে মৃন্ময়ী। সে দ্রুত পা চালাতে চাইলেও তার পা চলতে চাইছে না। দুশ্চিন্তায় শরীরের শক্তি নিভু-নিভু করছে। তার বোনটা বিয়ের আগে থেকে এই পর্যন্ত তাদের কম দুশ্চিন্তা দেয়নি। তাদের বাবা নেই আজ চারটা বছর। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে গোটা একটা সংসারের ভার তার মাথায় এসে পড়েছে। সংসারের রোজকার খাবারের জোগান, চারজনের পোশাকের জোগান, দুই বোনের পড়াশোনার খরচ জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। ছোটো বোন মৃদুলা বরাবরই তার কষ্ট বোঝে। তাই তো বোনের কাঁধ থেকে একটুখানি ভার কমানোর প্রচেষ্টায় সে ক্লাস টেন থেকেই টিউশন শুরু করেছিল। এখন তার কলেজ জীবন-ও শেষের পথে। তবে আগের থেকে এখন তার ছাত্র-ছাত্রী বাড়ার সাথে উপার্জন-ও বেড়েছে। টিউশন থেকে প্রাপ্ত মাসিক বেতন সে কোনোভাবেই অপ্রয়োজনে ব্যয় করে না। নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর চেষ্টা করে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে সে বড়ো বোনের কাছ থেকে টাকাও চায় না। তবে মৃন্ময়ী বোঝে টিউশনের টাকায় কলেজের বেতন পরিশোধ করে, নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার পর মেয়েটার সারা মাসের হাত খরচে টানাটানি পড়ে। তাই সে প্রতি মাসেই মৃদুলাকে কিছু হাত খরচ দেয়। এই বোনটার প্রতি মৃন্ময়ী খুব কৃতজ্ঞতা বোধ করে। কিন্তু মৃত্তিকা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত তার পড়াশোনার খরচ মৃন্ময়ীকেই বহন করতে হয়েছে। তার ওপর সামর্থের তুলনায় মেয়েটার চাহিদা বেশি ছিল। সাজগোজের প্রতি তার খুব ঝোঁক ছিল। নতুন পোশাকের সাথে একেক সময় একেক সাজের সামগ্রী কেনার জন্য মৃন্ময়ীকে সে পাগল করে ফেলত। অনার্সে ভর্তি হওয়ার পরপরই পার্শ্ববর্তী এলাকার এক ছেলের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ছেলেটাকে তার পরিবারের সবাই চিনত। এটাও জানত ছেলেটা কোনো দিক থেকেই সুপাত্র না। তাদের সম্পর্কের খবর জানার পর ওই সবাই তাকে অনেক বারণ করেছিল যেন ওই ছেলের সাথে সম্পর্ক না রাখে। কিন্তু বারবার সাবধান করার পরও সে কারোর কথা কানে না তুলে দিনদিন ওই ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। এই নিয়ে সাজেদা বেগম অধৈর্য হয়ে শেষমেশ মেয়ের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছিলেন। জেদি মৃত্তিকা তাতে নিজের ভুল বুঝার বদলে উলটো আরও বড়ো ভুলের পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল। সুযোগ বুঝে ব্যাগপত্র বগলদাবা করে সেই ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিল সে। তবু যদি বিবাহিত জীবনে কিঞ্চিত সুখ মিলত! শশুরবাড়ির লোকজন তাদের একমাত্র আদরের ছেলের জন্য মৃত্তিকাকে ঘরে তোলে ঠিকই, কিন্তু কোনোদিনই পুত্রবধূর জায়গা দেয়নি। প্রতিটি মানুষের থেকে সে শুধু অবহেলা আর মুখ ঝামটা পেয়েছে। তার জন্য অবশ্য তার নিজের ব্যক্তিত্বের একাংশ-ও দায়ী ছিল। টেনেটুনে সংসার জীবনের এক বছর গড়াতেই স্বামীর চোখেও সে বি’ষে পরিণত হয়। স্বামী তার পড়াশোনা চালাতেও অস্বীকার করে বসে। তারপর থেকেই শুরু হয় তাদের নিত্যদিনের ঝামেলা। কদিন পরপরই সে শশুরবাড়ি থেকে ঝগড়াবিবাদ করে বাবার বাড়ি এসে আশ্রয় নেয়। এভাবে চলতে-চলতেই আজ তার শশুরবাড়ি থেকে একেবারে ফিরে আসা। মৃন্ময়ী জানে না এরপর কী হবে। সামনের দিনগুলো সে কীভাবে সামাল দিবে। ছোটো বোনটার এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। সামনে সে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পদার্পণ করবে। মেয়েটার খুব ইচ্ছা ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। যদিও সে মৃন্ময়ীকে কখনও সেভাবে বলেনি খরচের ভয়ে। তবে মৃন্ময়ীর-ও ইচ্ছা ছোটো বোনটাকে মোটামুটি একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর। মেয়েটা পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো। সে চায় মেয়েটার এত মেধা, এত প্রচেষ্টা একদিন সফলতার মুখ দেখুক। নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতে তার খরচ আরও বাড়বে। এই মুহূর্তে আবার মৃত্তিকার খরচ সে কীভাবে জোগান দিবে?

বোনের ভাবনায় মগ্ন মৃন্ময়ী ভুলেই গিয়েছিল তার নিত্যদিনের উটকো ঝামেলার কথা। হুট করে চোখের সামনে প্রভাতের রোজকার হাসিমুখটা ধরা দিতেই ক্ষণিকের জন্য সে হকচকিয়ে গেল, কিন্তু পা থামাল না। অতিদ্রুত নিজেকে সামলে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। পাশ কে’টে সে চলে যাওয়ার আগেই প্রভাত পিছু নিল। সে-ও মৃন্ময়ীর সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে আর জিজ্ঞেস করছে,
“ম্যাডামের আজ এত তাড়া কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
মৃন্ময়ী কোনোরূপ প্রত্যুত্তর তো করলই না, বরং তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে প্রভাতকে খেয়ালই করছে না। প্রভাতের মনে সন্দেহ জাগল মৃন্ময়ী নিশ্চয়ই কোনো সমস্যায় পড়েছে। নয়তো গত দেড় বছরে-ও প্রভাত তাকে রাস্তায় এত দ্রুত গতিতে হাঁটতে দেখেনি। সে সবসময়ই খুব ভদ্রভাবে চলাফেরা করে। স্বভাবে কোনো চঞ্চলতা চোখে পড়ে না। প্রভাত পুনরায় প্রশ্ন করল,
“এত তাড়া কেন? ম্যাডাম কি কোনো সমস্যায় পড়েছো?”
এ পর্যায়ে মৃন্ময়ী থমকে দাঁড়াল। বরাবরের মতোই শান্ত দৃষ্টি মেলে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সমস্যায় পড়লেও তোমাকে বললে আমার সমস্যার সমাধান হবে না। তাই অযথা প্রশ্ন কোরো না। আর আজ আমার তাড়া আছে দেখছো তো। আজ অন্তত পিছু ছাড়ো, প্লিজ।”
প্রভাত বলল,
“ঠিক আছে, আর কোনো প্রশ্ন করছি না। মুখ বন্ধ করে হাঁটছি শুধু।”
মৃন্ময়ী চরম বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,
“একটা দিন কি তুমি আমায় একা চলতে দিবে না প্রভাত?”
“আজ কোনো কথা বলব না। চুপচাপ শুধু হাঁটব।”
“প্রভাত প্লিজ। দেখছো তো আমি তাড়াহুড়া করে হাঁটছি। তোমাকে এভাবে আমার পেছনে ছুটতে দেখলে এলাকার লোকজন কী বলবে?”
প্রভাত বরাবরের মতোই বেপরোয়াভাবে বলল,
“লোকজনের কথার তোয়াক্কা প্রভাত করে না ম্যাডাম।”
“তুমি না করলেও আমি করি। কারণ আমি একটা মেয়ে। লোকজন বাজে মন্তব্যটা আগে আমার দিকেই ছুঁড়ে দিবে। তুমি তাদের চোখে পড়বে না। আর কতবার বললে বুঝবে তুমি?”

প্রভাতের মুখ দেখে মনে হলো সে একটু অসন্তুষ্ট হয়েছে। মুখ ভার করে সে বলল,
“দেড় বছর ধরে তোমার এই এক কথা শুনতে-শুনতেই পেছনে ঘুরছি। এলাকার লোকজন তোমাকে খুব ভালো করেই চেনে। এ-ও খুব ভালোভাবেই জানে যে, প্রভাত তরফদার নিজেই মৃন্ময়ী ম্যাডামের পেছনে পাগলা কুকুরের মতো ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ম্যাডাম তাকে পাত্তা দেয় না। তারা খারাপ বললেও আমাকেই বলে, তোমাকে না। জেনেবুঝে বারবার এলাকার লোকজনের দোহাই কেন দাও ম্যাডাম?”
মৃন্ময়ী ততক্ষণে তাকে পেছনে ফেলে দূরে চলে গেছে। একে তো মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তার পাহাড়, তারমধ্যে প্রভাত নামক উটকো ঝামেলাটা তার বিরক্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।


বাড়ি ফিরে মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে দেখতে পেল না। মৃদুলা এ সময় পড়াতে যায়। মা সাজেদা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, হয়তো তার-ই অপেক্ষায়। সে ঘরে ঢুকতেই শক্ত মুখে বলে উঠলেন,
“এসেছিস? যা দেখে আয় তোদের রাজরানি এসেছে। এসে হতে দরজা আটকে বসে আছে। ডেকে দেখ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে কি না। জিজ্ঞেস কর রাজমহল ছেড়ে এখানে এসেছে কেন।”

মৃন্ময়ী কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে ক্লান্ত মুখে বলল,
“মাথা গরম কোরো না মা। এসেছে যখন, তখন তো সারাদিনই দরজা আটকে বসে থাকবে না। বেরোলে আমি কথা বলব। তুমি শান্ত হয়ে বসো।”
সাজেদা বেগম ভারী নিঃশ্বাস ফেলে শুধালেন,
“তুই নিজে কি শান্ত আছিস?”
“আমি তো শান্তই আছি মা। তোমার কল পেয়ে ছুটির পর কত তাড়াহুড়া করে বাড়ি ফিরেছি জানো? তবু তো আমি তোমার মতো এত উত্তেজিত হইনি।”
“তুই পারিস, আমি পারি না মা।”
অত দ্রুত হেঁটে এসে মৃন্ময়ীর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে ঢকঢক করে পরপর দুই গ্লাস পানি পান করল। তা দেখে সাজেদা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। সন্দিহান কন্ঠে শুধালেন,
“আজও হেঁটে এসেছিস?”
মৃন্ময়ী মুখে হাসি টেনে বলল,
“কী করব বলো? আমি রাস্তায় বেরোলেই সব রিকশা হাওয়া হয়ে যায়। রিকশার জন্য যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, ততক্ষণে আমি হেঁটে-ই বাড়ি চলে আসতে পারি।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“তুই রিকশা পাস না, না কি রিকশা তোকে পায় না, তা কি আমি বুঝি না ভাবিস? রিকশা খুঁজলে তো তুই পাবি। মোটে বিশটা টাকা ভাড়া। দশ টাকা বাঁচিয়ে কি তুই সংসার উদ্ধার করে ফেলবি?”

মৃন্ময়ী কেবল হাসল। বিশ টাকায় সংসার উদ্ধার? হ্যাঁ, তাই তো করছে সে। এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসারে খাবারের জোগান দিতে রোজকার যাতায়াত ভাড়া থেকে বাঁচিয়ে আনা ওই বিশটা টাকাই তার কাছে অনেক মূল্যবান। স্কুল, কোচিং দুই জায়গা থেকেই মাস শেষে বেতন আসে। সেই বেতন দিয়ে পুরো একটা মাস তাদের খুব হিসাব করে চলতে হয়। আজকাল আবার খরচ কিছু বেড়েছে। মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ডায়বেটিস আগের চেয়ে বেড়েছে। তার জন্য প্রতি মাসে ঔষধ কেনা লাগছে। মৃন্ময়ী ঘরে গিয়ে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। পরক্ষণেই আবার উঠে বসল। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। তাড়াহুড়া করে হেঁটে আসায় তার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। পরনের কাপড় থেকে ঘামের দুর্গন্ধ আসছে। গোসল করা দরকার। সকালবেলায় একবার সে গোসল করে স্কুলে গিয়েছিল। তবু এই মুহূর্তে আরেকবার গোসল না করে থাকা যাচ্ছে না। মৃন্ময়ী বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ঠান্ডা পানিতে গোসল করল। গোসল সেরে বেরিয়ে দেখল মৃদুলা চলে এসেছে। চেয়ারে বসে সে মৃত্তিকার বাড়ি ফেরা নিয়ে মায়ের আহাজারি শুনছে। তাকে দেখেই মৃদুলা হাসিমুখে বলল,
“আপু, এদিকে এসো। এই দেখো কী এনেছি।”
“কী এনেছিস?”

কৌতূহল নিয়ে মৃন্ময়ী এগিয়ে গিয়ে দেখল টেবিলের ওপর নীল রংয়ের পলিথিন ব্যাগ। মৃদুলা ব্যাগের মুখ খুলে লিচু দেখতে পেল। লিচু কিনে এনেছে মেয়েটা। মৃন্ময়ীর বুঝতে বাকি রইল না তার বোন লিচু কেন এনেছে। দুদিন আগে কথায়-কথায় সে বলে ফেলেছিল এবারের সিজনে তাদের একদিন-ও লিচু খাওয়া হয়নি। এ মাসে বেতন পেলে সে কিনে আনবে। তার আগেই মৃদুলা নিয়ে হাজির। মৃন্ময়ী বলল,
“তুই আবার লিচু কিনতে গেলি কেন? আমি বলেছিলাম না বেতন পাওয়ার পর কিনে আনব?”
মৃদুলা বলল,
“তাতে কী? আজ আমি একটা টিউশনের বেতন পেয়েছি, তাই নিয়ে এলাম। আমি তো আর তোমার মতো বাজার-টাজার করে দিতে পারি না। টুকটাক কিছু কিনি, তাতে-ও এত আপত্তি করো কেন?”
“আমি তো সেজন্য বলি না বোন। তোর টাকা তো তোর নিজেরই কাজে লাগে। এভাবে খরচ করলে তোরই ক্ষতি।”
“এটুকু খরচে আমার বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে না আপু। আগে খাও তো। বসো এখানে। দাও, আমি কাপড় মেলে দিয়ে আসছি।”

মৃন্ময়ীর হাত থেকে মৃদুলা ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে চলে গেল। মৃন্ময়ী আর কথা বাড়াল না। মেয়েটা এমনই। টিউশনের বেতন পেলেই টুকটাক কিছু না কিনে সে বাড়ি ফিরতে পারে না। মাঝে-মাঝে আবার দুই-এক রকম খুচরা বাজার নিয়েও হাজির হয়। মৃন্ময়ী বারণ করলেও সে কানে তোলে না। মৃন্ময়ী ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে লিচুর খোসা ছাড়াতে-ছাড়াতে মাকে শুধাল,
“মৃত্তিকা একবারও বেরোয়নি?”
সাজেদা বেগম উত্তর দিলেন,
“একবার বেরিয়েছিল পানি খাওয়ার জন্য। পানি খেয়ে ঘুমাবে বলে আবার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়েছে। তোর সামনে বেরোনোর মুখ না থাকলে বেরোবে কীভাবে? ডেকে দেখ।”
“না থাক। এখন হয়তো মন-মেজাজ ভালো নেই। রাতে কোচিং থেকে ফিরে কথা বলব।”
“তখন আবার দেখবি ঘুমের ভং ধরে পড়ে আছে।”
“আহা মা! সবে তো এলো। প্রতিদিনই কি ও ঘুমিয়ে কা’টাবে? সকালে হলেও তো আমার সাথে দেখা হবে। আজ কিছু বোলো না। কিছু সময়ের জন্য ওকে একা ছেড়ে দাও। মৃদুলাকে আজ আমার ঘরে ঘুমাতে বোলো। ও একটু শান্ত হোক, তারপর কথা বলা যাবে।”


কোচিং থেকে বেরিয়ে মৃন্ময়ী আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। নাহ্, প্রভাতকে দেখা যাচ্ছে না। যদিও সে নিশ্চিত মাঝপথে হলেও ওই ছেলে তার সুদর্শন চেহারা দেখাতে হাজির হবেই। তবু আপাতত সে আপনমনে হাঁটা ধরল। ছেলেটা বড্ড ঘাড়ত্যাড়া। কিছুতেই কথা শুনানো যায় না। রেগে কথা বললেও এক কানে তুলে অপর কান দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দেয়। সেই মাধ্যমিক থেকে প্রভাতকে সে শুধুমাত্রই সহপাঠী হিসেবে চিনত। তখন থেকেই প্রভাত খুব ডানপিটে স্বভাবের। ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছাত্র ছিল সে। স্কুলের শিক্ষকরা-ও তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ট ছিলেন। সপ্তাহের আগায়-মাথায় স্কুলে তার বাবার ডাক পড়ত। এলাকার লোকজনের অভিযোগ তো ছিল নিত্যদিনের। তবু প্রভাতের দুষ্টুমি এক ফোঁটাও কমত না। প্রভাত যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন হঠাৎ তার মা ব্রেইন স্ট্রোক করে মা’রা যান। মৃন্ময়ীর স্পষ্ট মনে আছে, মায়ের মৃত্যুর পর কিছুদিনের জন্য তারা এক অন্য প্রভাতকে দেখতে পেয়েছিল। দুষ্টুমি বন্ধ, দৌড়ঝাঁপ বন্ধ, অকারণ অট্টহাসি বন্ধ। শোনা গিয়েছিল দুষ্টু প্রভাত মাকে খুব ভালোবাসত। মা ছিল তার একমাত্র ছায়া। বাবার শাসন খুব একটা পায়নি সে। তাই মায়ের শোক কা’টিয়ে ওঠার পরেই প্রভাতের দুষ্টুমি দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল। একবার তো দুষ্টুমির সূত্রে এক দূর্ঘটনা ঘটিয়ে বাবার হাতে বেদম মা’র খেয়েছিল। তার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। দুষ্টু প্রভাতকে আজ পর্যন্ত সেই মহিলা ভালো চোখে দেখতে পারেননি। ফলস্বরূপ প্রভাত নিজেও মহিলাকে মায়ের জায়গা দেয়নি। সবাই ভেবেই নিয়েছিল এই দুষ্টু প্রভাতের পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটবে কলেজের ত্রিসীমানায় পা রাখতেই। যদিও সবাইকে অবাক করে দিয়ে পড়াশোনার চেয়ে বেশি দুষ্টুমি করে-করেই প্রভাত কোনোমতে এইচএসসি পাস করে আবার অনার্সে-ও ভর্তি হয়েছিল। বন্ধুরা যখন একে-একে কাজকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল, তখন হয়তো তার-ও কিছু শুভ বোধদয় হয়েছিল। কম্পিউটারের কাজের বিষয়ে তার বেশ জানাশোনা ছিল। অন্য কোনো কাজে আগ্রহ জন্মায়নি বলে সে কম্পিউটারকেই বেছে নিয়েছিল। কম্পিউটারের দোকানে পার্ট টাইম কাজ করতে-করতে ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল সে। অনার্স শেষ করে এখন সে মোটামুটি ভালো একটা কোম্পানিতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করছে। বয়স বাড়ার সাথে আগের মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি কিছুটা কমলেও এখনও সে সবার কাছে দুষ্টু প্রভাত-ই রয়ে গেছে। কারণ সুযোগ পেলে বাঁদরামি সে এখনও করে। এলাকার লোকজন তো তাকে কোনোদিন ভদ্রবেশে দেখার আশাই ছেড়ে দিয়েছে। আগাগোড়াই যে ছেলে লাগাম ছাড়া, সে ভালো হবে কীভাবে? বরং তাদের ভাবনায় প্রভাতের সঙ্গ যে ছেলে পাবে, সে-ই বেপরোয়া হবে।

মৃন্ময়ীর ধারণা একশো ভাগ সত্য প্রমাণ করে দিয়ে প্রভাত রাস্তার মোড়েই দেখা দিলো। মৃন্ময়ীকে দেখেই সে উজ্জ্বল হাসিতে মনের প্রশান্তি প্রকাশ করল। বরাবরের মতোই মৃন্ময়ী তাকে দেখেও থামল না। প্রভাত নিজেই তার পিছু নিল। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,
“ম্যাডামের কি সমস্যার সমাধান হয়েছে?”
মৃন্ময়ী তাকেই পালটা প্রশ্ন করল,
“কিসের সমস্যা?”
“বিকালে যে খুব তাড়া দেখিয়ে বাড়ি ফিরলে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম তা তো আর বললে না।”
“আপাতত তোমার চেয়ে বড়ো সমস্যা আমার জীবনে আর একটাও নেই।”
“সত্যিই কি?”
“সন্দেহের কোনো কারণ নেই নিশ্চয়ই?”
“অবশ্যই আছে। ভেবে দেখো, আমি তোমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলে তুমি আমাকে উপড়ে ফেলার জন্য চাকরিবাকরি ছেড়ে দিতে পারো, যেন আমি আর তোমার পেছনে ঘুরতে না পারি। কিন্তু তুমি সেটা করবে না। কেন করবে না? কারণ এরচেয়েও বড়ো সমস্যা তোমার জীবনে আছে। যা সামলাতে হলে তোমার এই চাকরিবাকরি-ও প্রয়োজন। আর তোমার চাকরিবাকরি প্রয়োজন মানেই আমাকে তুমি উপড়ে ফেলতে পারবে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে আমিও তোমার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াব, বিশেষ প্রয়োজন।”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“আমি কি বলেছি তোমাকে আমার প্রয়োজন? আমি যে সবসময় তোমাকে বলি আমার পেছন ছাড়ো, শোনো না কেন তুমি?”
“তোমায় ভালোবাসি যে, বোঝো না কেন তুমি?”
মৃন্ময়ী হতাশ গলায় বলল,
আমি তো বারবার তোমাকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি যে আমি তোমার সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাই না।”
“চাইবে, চাইবে। আমি যেহেতু চাই, তুমিও একদিন চাইবে।”
“তোমার এত শখ থাকলে এখন থেকে গার্লস স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো। ওখানে মেয়ের অভাব নেই। পছন্দমতো কারো পেছনে এভাবে ঘুরঘুর করে শখ মিটিয়ে নাও। তবু আমাকে ছাড়ো। তোমার শখ মিটানোর শখ আমার নেই।”
তবু প্রভাত দৃঢ় গলায় বলল,
“ওসব গার্লস আমার চাই না। আমার শুধু মৃন্ময়ী ম্যাডাম হলেই চলবে।”
মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত দুটো একসঙ্গে জড়ো করে বলল,
“মাফ দাও, রোজ-রোজ এক কথা আর ভালো লাগে না।”
“চলো বিয়ে করে ফেলি, ভালো লাগবে।”
মৃন্ময়ী গম্ভীর মুখে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি বোঝো না আমি তোমার সাথে রাগ করি? তোমার কি মানসম্মানে-ও লাগে না?”
প্রভাত শব্দ তুলে হেসে বলল,
“আমার আবার মানসম্মান আছে কবে থেকে? তোমার পেছনে ঘুরেঘুরে এমনিতেই সবার চোখে বেহায়া হয়ে গেছি। আরেকটু ধৈর্য্য ধরে তোমাকে পেয়ে গেলেই মানসম্মান রক্ষা করা শিখে নিব।”
“বাচ্চাদের মতো কথা বোলো না তো। ছাব্বিশে দাঁড়িয়েও আঠারো বছরের যুবকের মতো আচরণ করো কীভাবে তুমি? লজ্জা লাগে না?”
“অত লজ্জা কোলে নিয়ে বসে থাকলে কি তোমায় ঘরে তুলতে পারব? এজন্যই তো বলি, দুজনেই বুড়িয়ে যাচ্ছি, চলো বিয়ে করে ফেলি। তারপর আমার আচরণ তুমি নিজেই পালটে দিতে পারবে। ভেবে দেখো, বিরাট চান্স কিন্তু। মিস করে গেলে তোমারই ক্ষতি। পৃথিবী জুড়ে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও তুমি আর এমন প্রেমিক পুরুষ পাবে না।”
“দরকার-ও নেই আমার। বকবক বন্ধ করে নিজের পথে হাঁটো।”
“তোমার সঙ্গে হেঁটে-হেঁটেও যে পথ ফুরাতে চায় না, সে পথে আমি একা হাঁটতে চাই না ম্যাডাম।”
“ঠিক আছে, তবে আমি নিজেই সে পথ ধরছি।”

বলেই মৃন্ময়ী বিকালের মতো আবারও দ্রুত গতিতে পা চালাল। প্রভাত তার পেছনে ছুটল না, স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে চলল। সে মৃন্ময়ীকে চেনে। তার জ্বালাতনে অতিষ্ট মৃন্ময়ী সবসময়ই তার সঙ্গে একটু-আধটু রাগ দেখায়, বকাঝকা করে। কিন্তু সে যখন পারিবারিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায়, তখনই তার মেজাজ একটু অন্যরকম থাকে। রাগের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রভাত নিশ্চিত তার মনে আজ-ও কিছু চলছে। মেয়েটা এত চাপা স্বভাবের! দেড় বছর ধরে পেছনে ঘুরেও সে এই মেয়েটার মনের কথা বুঝতে পারে না। তবু তার চেষ্টায় কোনো কমতি নেই। যেভাবে চলছে চলতে থাকুক না। একদিন হয়তো মেয়েটা-ও তাকে বুঝবে। মেয়েটা তাকে বুঝে গেলেই মেয়েটাকে বুঝা-ও তার জন্য সহজ হবে। চেষ্টা সে চালিয়ে যাবেই। চেষ্টা করতে তো আর টাকা-পয়সা লাগে না? লাগে শুধু একটু ধৈর্য। মৃন্ময়ীর মনের গহীনে পৌঁছাতে যতটুকু পথ তাকে হাঁটতে হয়, সে হাঁটবে। এটুকু ধৈর্য তার আছে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৪৭

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪৭
নয়না ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে৷ তার হলুদ গোলাপ পছন্দ ভিষণ রকমের পছন্দ। আচ্ছা না বলতেই সে বুঝলো কি করে! ওই প্লেন ড্রাইভারও কি আমাকে ভালোবাসে?বলেই নয়না দু’হাতে মুখ ঢাকলো৷ নয়না মনে মনে আওড়ালো ভালো যখন বাসেন তখন মুখে বললে কি হয়!ইশশ এই পাইলট মহাশয় এতো কিউট কেন? আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে, ফুলগুলো বৃত্তের মত তার চারো সাইডে রেখে নয়না মাঝখানে শুয়ে পরলো। গোলাপের ঘ্রাণ আর প্রিয় মানুষের ভালোবাসা অনুভব করছে নয়না। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি ছড়িয়ে পরছে নয়নার দেহমন জুড়ে! যে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না!
নয়না বেডের উপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে৷ তার দৃষ্টি স্থীর চলন্ত পাখার দিকে। মনের মধ্যে কেমন যেনো করছে। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে নয়নার৷ ভয়ে কপালে ঘাম জমেছে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে বার্থডে আর রেজাল্ট একি দিনে হতে হলো! হাসফাস লাগছে নয়নার৷ দ্রুত বেড ছেড়ে উঠলো। ওড়না গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বের হতেই মিতা বেগমের সাথে দেখা হলো৷
“মিতা বেগম বলে, সুনয়না কিছু লাগবে তোমার আম্মু?”
“নয়নার লম্বা চুলগুলো ওড়না গলিয়ে বাহির হয়ে আছে।”
“মিতা বেগম নয়নাকে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। নয়নার মাথাভর্তি রেশমি চুলগুলো তার ভিষণ পছন্দ হলো৷ তোমাকে তো দেখে শুনে আনতে পারিনি তবুও তুমি আমাদের মনের মত হয়েছো আলহামদুলিল্লাহ । মনে হয় শত জনমের সম্পর্ক তোমার সাথে আমাদের।”
‘মেহনুর মিতা বেগমের রুমে এসে এই দৃশ্য দেখে মনে মনে রেগে গেলো। মেয়েটাকে সবাই এতো প্রায়োরিটি কেন দেয়! নিজের ঠোঁটে মেকি হাসি টেনে বলল,আম্মি আমাদের রেজার বৌ কি একদম পরীর মতো৷ কিউট একটা বাচ্চা পরী।”
“ঠিক বলেছিস৷ ওর চুলগুলো দেখ?রুপাঞ্জেলের মত। ঘন সিল্কি,লম্বা, মসৃণ। আমার রেজা একদম লক্ষী একটা পরীবৌ পেয়েছে যেমন দেখতে মিষ্টি তেমনি মধুর মত ব্যবহার৷”
“মেহনূর বলল একদম ঠিম বলেছো। আর কতক্ষণ লাগবে তোমাদের আম্মি? আমার তোমার সাথে কথা ছিলো৷”
“কি কথা বলে ফেল। সুনয়নাতো আমাদেরই মানুষ ওর থেকে লুকানোর কিছু নেই৷”
“নয়না বলল,আম্মু আমি একটু ঘুমাবো। তোমরা কথা বলো৷ নয়না রুম থেকে বের হয়ে আসলো৷ জিয়ানের সাথে এখনো নয়নার একবারও দেখা হয়নি৷ কই গেলো লোকটা? নয়না নিচে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিলো৷ হঠাৎ গানের আওয়াজ পেয়ে নয়না স্থীর হলো।”

“জাহিন গিটারে সুর তুলে,গাইছে এলোকেশী কন্যারে তুই সদ্য ফোটা ফুল,তোরে দেখিয়া আমার মন হইলো ব্যাকুল।
তুই হাসলে যেনো মুক্ত ঝড়ে, তুই তাকালে ফোটে ফুল, এলোকেশী কন্যারে তুই সদ্য ফোটা ফুল৷”
“নয়না উঁকি দিতে যেয়ে সরে গেলো। জাহিনকে তার বিশেষ পছন্দ হয়নি। নয়না রুমে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে বারোটা সতেরো বাজে। নয়না বারান্দায় যেয়ে বসলো,মনে মনে বলে,কারো মনে নেই আমার বার্থডের কথা! রেজাল্ট দিলে তো সবাই ঠিক কল করে করে পাগল করে ফেলবে এখন একটা বার্থডে উইশ করতে পারছে না!”
“নয়না ফোনটা বেজে উঠলো, তুষির কল দেখে নয়না খুশি হয়ে গেলো৷ নিশ্চয়ই উইশ করবে।উৎসাহ নিয়ে কল রিসিভ করলো৷”
“কিরে কি করছিস! তোর টেনশন হচ্ছে না! আমার তো টেনশনে ঘুম আসছে না। পেটের ভেতর গুড়গুড় করছে।”
“তুই কি এসব বলার জন্য কল করেছিস তুষি?”
“হ্যা টেনশনে ঘুম আসছিলো না। তাই ভাবলাম তোর খোঁজ নেই৷”
” আর কিছু বলবি?”
“নাহহ আর কি বলবো৷ ওহহ হ্যা মনে পড়েছে৷”
“বল”
“দুলাব্রো কই?”
“নয়না খট করে কল কেটে দিলো। রাগ হচ্ছে তার৷”
নয়না রুমে এসে সোফায় শুয়ে আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে ঝিমাচ্ছে।
“এমন সময় কেউ দরজায় নক করে বলে,আসতে পারি?”
“কন্ঠ শুনে মনে হলো জিয়ান৷ তবুও বেড থেকে ওড়না নিয়ে, উঁকি দিয়ে বলে,আপনি কি জাহিন?”
“নাহহ জাহিন না আপনার বর।”
“নয়না দ্রুত দরজা বন্ধ করে বলে,আপনার ভাই রুমে নেই সে না আসলে এখানে আসবেন না। এইটুকু ম্যানারস নেই নাকি!”
“জাহিন বলল,মজা করছিলাম ওকে গুডনাইট প্রিটিগার্ল।”
“জাহিনকে দেখলেই নয়নার রাগ হয়। নয়না আবার এসে শুয়ে মোবাইল হাতে নিলো। রাত দেড়টা বাজে এখনো কোন খোঁজ নেই লোকটার! বৌ রেখে কোন বেডা মানুষ এমন টো টো করে রাত বিরতে! আবার কথায় কথায় বলে,বাসর সেরে ফেলবো। যাহহ এই জন্মে তোর বাসর করার শখ মিটবে না বদদোয়া দিলাম প্লেন ড্রাইভারের বাচ্চা।”

নয়না মোবাইল নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো তার আইডির নাম, সিরাত চৌধুরী। নয়না ঘেটে ঘেটে জিয়ানের আইডি খুঁজে বের করলো।লক করা৷ প্রোফাইল। নয়না রেগে বলে,প্লেন ড্রাইভারের ভাব তো কম না! খোমাটা একটু সুন্দর বলে,প্রোফাইল লক করে রাখবে! তাহলে হ্যান্ডসাম হয়ে লাভটা কি!হ্যান্ডসাম ছেলে প্রোফাইল পাবলিক করে রাখবে মেয়েরা ক্রাশ খাবে। লাবি’ডাবি কমেন্ট করবে,ইনবক্সে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। প্লেন ড্রাইভার আসলে মাথা মোটা৷ নয়ত এতো সুদর্শন হয়ে প্রোফাইল লক রাখে গাধা ছাড়া কেউ! নয়না উঠে এসে কাভার্ড খুললো সেদিন জিয়ান তার জন্য অনেকগুলো শাড়ি অর্ডার করেছে নয়না সেগুলো বের করে আনলো। সব ঘেটে ঘেটে দেখছে,লাল পাড় সাদা জমিন সুন্দর এই জামদানী শাড়িতে নয়নার দৃষ্টি স্থীর হলো। শাড়ীর সাথে লাল কালার ম্যাচিং রেডিমেড ব্লাউজ। নয়না ফোন হাতে নিয়ে জিয়ানকে কল করলো৷
“ওপাশ থেকে রিসিভ হলো৷ নয়না বলল,আপনি কই?”
“বাটার মাশরুম খুব বেশি মিস করছো বুঝি আমাকে?”
“মোটেই না৷ আপনি না আসলে আমি ঘুমাবো।”
“ঘুমিয়ে পরো লিলিপুট আজ আমি ফিরবো না৷”
“নয়না কল কেটে দিলো৷ এখন তার শাড়ি পরার নেশা জেগেছে তাই কথা না বাড়িয়ে শাড়িটা পরে নিলো৷ লম্বা চুলগুলো খোলা রেখে কানে গুঁজে নিলো দু’টো হলুদ গোলাপ। লাল রঙের লিপস্টিক লাগালো,ঠোঁটে। নিজেকে নিজে আয়নায় দেখে নয়না নিজের মুখ ডেকে বলে, তোমার কোন অধিকার নেই এতো সুন্দর হওয়ার! উফফ নিজেই না নিজেকে নজর দিয়ে বসি। নয়নার ইচ্ছে করছে নাচতে। এতো সুন্দর লাগছে তাকে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দেড়টা ছাড়িয়ে গেছে। হঠাৎ চোখ গেলো সোফার উপর পরে থাকা জিয়ানের ব্লেজারের উপর। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যেয়ে তুলি নিলো ব্লেজার। নাক ডুবিয়ে দিলো ব্লেজারে। কেমন মাতাল করা একটা ঘ্রাণ। ইশশ কারো শরীরের ঘ্রাণেও বুঝি মাদকতা থাকে! নয়না ব্লেজারে চুমু খেয়ে বলে,আপনি কি জানেন আমার এই ছোট হৃদয়ে আপনার ভালোবাসার অঙ্কুর গজিয়েছে। তারা কেমন ডাল-পালা ছড়িয়ে আপনার প্রতি আমাকে দূর্বল করে দিচ্ছে! জানেন তো কম বয়সের প্রেম মারাত্মক ভয়ংকর। অসম প্রেম যা নিজেকে ভুলিয়ে দেয় তবুও ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে পারে না। নয়না আনমনে জড়িয়ে নিলো জিয়ানের ব্লেজার। অদ্ভুত অনুভূতিরা ঘিরে ধরেছে তাকে।হৃদয় জুড়ে বয়ে যাচ্ছে শীতল প্রবাহ স্নায়ু জুড়ে ছড়িয়ে পরছে প্রিয় পুরুষের স্পর্শের মাদকতা। ইশশ কাউকে স্পর্শ না করেও এতো গভীর ভাবে অনুভব করা যায়! আজকের এই মূহুর্ত না আসলে হয়ত নয়না বুঝতো না৷ হৃদযন্ত্র ধীরে ধীরে কেমন বেসামাল হচ্ছে। নয়না চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো পরম আবেশে। দ্রুত চোখ খুলে ব্লেজার ছুড়ে ফেললো বেডে। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,একেমন সুখকর দমবন্ধ মুগ্ধতার মোহজালে ঘেরা অনুভূতি!শাড়ি খামচে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। শরীর জুড়ে বয়ে চলেছে অদ্ভুত শিহরন, হৃদয় জুড়ে বইছে ভালোবাসার মোহমায়া।

🌿

জিয়ান বাসায় এসেছে ঘন্টা খানেক আগে। বাসায় এসে তার প্রিয়তমার জন্য বার্থডে সারপ্রাইজ প্ল্যান করছে,তাদের ছাদে সুইমিংপুল আছে একপাশে আরেক পাশে সুন্দর বসার জায়গা বেশ সাজানো পরিপাটি ছাদটা।
“পুরো সুইমিংপুলের পানির উপরে,লাল আর হলুদ গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। মাঝখানে লেখা শুভ জন্মদিন ডিয়ার বাটার মাশরুম। জিয়ানের সাথে অনিকেত আর একজন ডেকোরেশনের লোক সব কিছু গুছিয়ে দিচ্ছে৷ কাজ শেষ হতেই। জিয়ান বলল,অনি এবার যাহহ তোর কাজটা করে আয়। উইশটা আবার চেঞ্জ করলো জিয়ান৷

🌿

নীলাঞ্জনা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে দূরের আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা চাঁদের দিকে।মনে মনে বলে,আজকের চাঁদটা এতো সুন্দর কেনো!নীলাঞ্জনার মনে পড়লো জিয়ানের বলা একটা কথা, ” পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর তার অর্ধেকটা জুড়ে নারী। নারী ছাড়া সৌন্দর্য তার পূর্নতা মেলে ধরতে পারে না। কোন এক পূর্নিমা রাতে পূর্ন চাঁদকে দেখাবো আমার পাশে তারচেয়ে উজ্জ্বল চাঁদ আছে৷ তখন মোবাইলের অপরপাশ থেকে এমন কথা শুনে নীলাঞ্জনা বলেছিল, এতো বেহুদা কথা কোথায় পাও তুমি! তুমি এতো,বোরিং কেন রেজা! আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এরচেয়ে সুন্দর কথা হয়ত নেই। চোখের অশ্রু মুছে নিয়ে বলে,আমি তোমাকে ডিজার্ভ করি না। তাই তোমাকে অবহেলায় হারিয়েছি। যে প্রেম আমি চেয়েছিলাম সেই কলুষিত প্রেমিক তুমি ছিলে না। তাই আমি তোমার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে কলুষিত মানুষের প্রেমে পরে ছিলাম। তার প্রেমে পড়ে মনে হয়েছিলো আমি এমন প্রেম চাইছিলাম৷ অথচ সে শুধু আমার দেহের বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রেমে মত্ত ছিলো। আমি তোমাকে হারিয়েছি আমি জীবনের সব সুখ হারিয়েছি। আমি কি করবো এই সন্তানের?একা একা কিভাবে সামলাবো তাকে! কাউকে ঠকিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না৷ তোমাকে ঠকাতে যেয়ে নিজের জীবন ধ্বংস হয়ে গেলো। তুমি ভালো আছো আমি ভালো নেই রেজা৷ একবারও কি আমার কথা তোমার মনে পরে না! একটুও তোমার মন পোড়ে না আমার জন্য! এটা যে আমি মেনে নিতে পারছিনা খুব কষ্ট হচ্ছে আমার খুব বেশি। তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারলে হয়ত এই কষ্টের ভার সামান্য কমতো।
তুমি আমাকে ভুলে যেয়ে ভালো আছে এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। কেনো পারছি না বলতে পারবে রেজ!
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৪৬

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪৬

জিয়ান নয়নার হাতটা ধরে বলে, “তুমি শুধু আমার, আমি কোন কিছুর বিনিময়ে তোমাকে হারাতে পারবো না৷”
“এতো ইমোশনাল হতে হবে না।এসব আমি নাটক সিনেমা দেখে শিখেছি হু।”
“আরেহহহ নায়িকা সুনয়না চৌধুরী অটোগ্রাফ প্লিজ৷”
“সুনয়না চৌধুরী যাকে তাকে অটোগ্রাফ দেয়না।”
“ম্যাডাম আপনি অটোগ্রাফ না দিলে আমার ভবিষ্যতে বাচ্চারা বলবে ছিহহহ বাবা সামান্য একটা অটোগ্রাফ ও নিতে পারোনি!”
“তেল মারা বন্ধ করুন। কেক, একটা ফুলের বুকে আর কি পছন্দ করে অনিকেত ভাইয়া৷”
“ও তোমার কোন জন্মের ভাই?”
“যে জন্মে আপনি আমার হ্যাসবেন্ড সেই জন্মের।”
“জিয়ান আড়চোখে চেয়ে দেখে নয়না হলুদ গোলাপগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে৷ জিয়ান দোকানি কে বলল,মামা এখানে কয় পিস ইয়োলো গোলাপ আছে?”
“সাতশ বা ছয়শ হবে। আপনার কতগুলো লাগবে স্যার?”
“সবগুলো দিয়ে দিন মামা।”

নয়না একটা গাজরা নিয়ে হাতে বাঁধার চেষ্টা করছিলো কিন্তু সে ব্যর্থ হচ্ছে বাঁধতে।

“জিয়ান নয়নার হাত ধরে গাজরাটা বেঁধে দিলো৷ নয়নার হাত ধরে রেখে বলে,বেলিফুল কি জানে তার সৌন্দর্য বর্ধন করছে কারো প্রিয়তমা! সে কি জানে তার শুভ্রতাকে হার মানাচ্ছে কারো মুচকি হাসি! হতাম যদি বেলিফুলের মালা তোমার গলাজুড়ে জড়িয়ে থকতাম সারাবেলা।”

“নয়না মৃদু স্বরে বলে,আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন মিস্টার রোমিও এটা আপনার বাসা না। আর বেলিফুলের গাজরা হাতে থাকে গলায় না৷”

“জিয়ান নয়নার হাত ছেড়ে বলে, শোনো বৌ পুরুষ মানুষ প্রেমে পড়লে ভুলভাল বকবে ইট’স নরমাল, বোঝেনা বৌ আমরা আমি তার প্রেমে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি। এই তুমি শাড়ি পরে বের হওনি কেন! তুমি শাড়ি পরে বের হলে আমি তোমার কুচি ঠিক করে দিতাম। তোমার শাড়ীর আঁচলে আমার হাত বেঁধে সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম। সবাই ভাবতো বৌ পাগল জামাই। কেউ কেউ ভাবতো এমন জামাই কই পাওয়া যায়?”
“দোকানদার ফুল বেঁধে দিয়ে বলে,সাহেব কি নতুন বিয়ে করছেন? আপনাকে আর ম্যাডামকে দারুণ মানিয়েছে। মনে হচ্ছে মানিকজোড়া৷ সব সময় ভালা থাহেন৷ আগের দিনে এমনই বিয়া হইতো জামাইয়ের তন বৌয়ের বয়সের পার্থক্য কম থাকতো।”
“জিয়ান হেসে বলে হ্যা মামা নতুন বিয়ে হইছে,তবে বৌ আমার বোঝে কম চিল্লায় বেশি। বাচ্চা মানুষ তো তবে আক্কেল ম্যালা ভালা আছে।”
“বৌ জ্বালাইবোই। আপনাগো চাচি আমারে কি কম জ্বালায়! তবুও হের ভালোবাসা অসীম আমি জানি৷ আমি না খাইলে খাইতো না৷ যত রাইতে দোকান বন্ধ করি যাইয়া দেখমু আমার লাইগা বইসা আছে। বুড়ির লগে দুইডা কথা কইলেই পরাণডা ঠান্ডা হইয়া যায়।”
“জিয়ান টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে বলে,বাকি টাকা দিয়ে চাচিরে একটা শাড়ি কিনা দিয়েন৷ দোয়া কইরেন আমাদের জন্য।”
“নয়না জিয়ানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে জিঙ্গেসু দৃষ্টিতে।
“এই যে এভাবে তাকালে কিন্তু ভরা রাস্তায় চুমুটুমু খেয়ে বসবো।”
“রিকশায় আমি বসবো নাকি ফুল বসবে?”
“তুমি তো নিজেই একটা জ্যান্ত ফুল। ফুলের মাঝে জ্যান্ত ফুলকে দারুণ লাগবে।”
“এতোগুলা ফুল কেনো কিনেছেন!”
“ভাবছি এসব নিয়ে সোজা বাসায় যাবো৷ বাসরটা সেরেই ফেলবো আজ। তাজা গোলাপের সুবাস সাথে সদ্য ফোটা জীবন্ত ফুলের নেশায় বুদ হবো,মাতাল হবো তার ভালোবাসায়।”
“আজেবাজে কথা বন্ধ করেন আমরা কিন্তু অনিকেত ভাইয়ার বার্থডেতে যাচ্ছি। দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করেন, ভুলে যাবেননা ফুলে কিন্তু কাটাও থাকে।”
“ফুলের কোমল স্পর্শ আর মাতাল করা ঘ্রাণ সহ্য করার জন্য কাটার আঘাত সহ্য করা কোন ব্যাপারনা জান৷”
“চুপ করুন। সময় যাচ্ছে না হচ্ছে!”
” সবকিছু কিনে নিয়ে অনিকেতের বাসার উদ্যেশে রওনা দিলো দু’জনে।”

🌿

কলিংবেলের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে অনিকেত দরজা খুলল,সামনে থাকা রমনিকে দেখে চশমা ঠিক করে বলে,আপনি এখানেও?
“জলে স্থলে,জঙ্গলে যেখানে থাকবেন আমাকে পাবেন।”
“কেনো এসেছেন?”
“আহাগো সখের নাগরের ভাব দেখলে বাঁচিনা৷ আজকে আমার একমাত্র সখের বেডার বার্থডে আসবো না! তোমার জন্য পুরো ঢাকার শহর ঘুরে দোলনচাঁপা ফুল নিয়ে আসলাম কই জড়িয়ে ধরে দুইচারটা চুমু খাবা তা’না আবার জেরা করছো! সরো সাইডে চাপো।”
“দেখুন মিস সায়না এসব একদম ঠিক হচ্ছে না।”
“সায়না সোফায় বসে চারপাশ ভালোভাবে লক্ষ্য করে বলে,আরেহহহ বাহহহ বিয়ের পর তো আরামে থাকতে পারবো৷ তুমি আমি আর আমাদের ভালোবাসার সংসার৷”
” শোন।”
“শোনাও আমি তো তোমাকেই শুনতে চাই।”
” কেন করছেন এমন?”
“আমি তো করবো না যা করার তুমি করবে। মেয়েরা কিছু করে নাকি লজ্জা লাগে না বুঝি!তোমার বাসার কিচেন কোনদিকে?”
“কিচেনে কি?”
“আজ দেড় ঘন্টা ব্যয় করে তোমার জন্য রান্না শিখেছি বিফ তেহারি রান্না করবো।”
“আমার বাসায় কিচেন নেই। আমি বাহির থেকে খাবার অর্ডার করি।”
” ওভেন আছে?”
“সায়না ওভেন খুঁজে পেলো। সাইড ব্যগ থেকে একটা বক্স বের করলো তেহারী প্লেটে ঢেলে গরম করতে দিলো ওভেনে। শাড়ীর আঁচল কোমড়ে গুঁজে রাখা। পিঠ জুড়ে খোলা চুলগুলো বারংবার দোলখাচ্ছে অনিকেত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে নব বিবাহিতা কোন রমনী। তার এতোদিনের স্বপ্ন যেনো বাস্তবে এসে ধরা দিয়েছে।”
“সায়না তেহারির প্লেট নিয়ে এসে বলে,লুকিয়ে দেখতে মজা তাই না।”
“আমি আপনাকে দেখছিলাম না আমি তো দেখছিলাম আমার ওভেন।”
“আমি কখন বললাম তুমি আমাকে দেখছো! রান্না ঘরে কে? আমি তো গুঁড়োদুধ খাইনি। এমন হয়ে গেলো না ব্যাপারটা?”
“চাইছো টা কি?”
” তোমার বৌ হতে চাইছি।”
“আবার কলিং বেল বেজে উঠলো।”
” অনিকেত দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলে দেখে জিয়ান আর নয়না। অনিকেত হতবুদ্ধি হয়ে যায়। এখন সে কি করবে! তুই এসেছিস ভাবিকে নিয়ে?”
“হ্যা এসেছি। এখন কি বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি ভেতরে আসতে দিবি?”
“আয়। অনিকেত সরে যেতেই দেখে নাহিদও এসেছে সাথে। রুমে ঢুকেই সবাই একত্রে বলে উঠলো হ্যাপি বার্থডে ডাক্তার সাহেব।”
“অনিকেতের চক্ষু টলমল করছে। এই মানুষ দু’টো সেই কলেজ লাইফ থেকে তাকে কখনো ফিল করতে দেয়নি সে অনাথ! সব সময় আগলে রেখেছে নিজের ভাইয়ের মত।”
” অনিকেত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,নাহিদ্দা ভাবি কই?”
“ভাবি এখন তোদের চাচ্চু বানানোর কাজে ব্যস্ত৷”
” নয়না সাইডে যেয়ে দাঁড়ালো।
“অনিকেত যেয়ে বলে,ভাবি আজকে তো আপনি আমাদের চিফ গেস্ট। প্লিজ আপনার আসন গ্রহন করুন।”
“সায়না কিচেন থেকে চানাচুর, বিস্কুট, ফল ট্রে তে করে সাজিয়ে নিয়ে এসে বলে,ডিয়ার দেবরগন আপনাদের ভাবির তরফ থেকে সামান্য খাতির যত্ন গ্রহণ করুন৷”
“জিয়ান হেসে বলে,বাহহ আমার আলাভোলা বন্ধুটাকে ফাঁসাচ্ছিস?”
” নাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে,এটা তোর বোন না?”
“জিয়ান হেসে বলে,আগে বোন ছিলো এখন ভাবি হয়ে গেছে।”
ওরা দু’জন হেসে উঠলো৷
“অনিকেত চোখের চশমা ঠিক করে বলে,আপনি এখানে এসেছেন কেনো? বললাম না, আসতে না।”
“নাহিদ বলল,চুপ কর শা’লা ফ্রীতে বৌ পাচ্ছিস চুপচাপ গ্রহণ করে নে। এরকম বৌ এতো সহজে পাওয়া যায় না।”
সবাই মিলে খাবার খেতে খেতে আড্ডা দিলো। এরপর কেক দুটো কাটা হলো কেক নিয়ে মজা হলো। অনিকেত বলল,”সব ঠিক থাকলে লাবিবও এখানে থাকতো আজ৷ কেনো যে নিজেকে ধ্বংস করলো ও!”
“জিয়ান বলল,আমি কখনো ভাবিনি আমার সাথে লাবিব গাদ্দারি করবে! তোরা আমার কাছে কিভাবে আড়াল করলি এতো বড় কথাটা! তবে ওরে তো আমার ট্রিট দেয়া উচিৎ ওর জন্য এতো সুইট কিউট একটা বৌ পেলাম।”
“নয়না লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে নখ খুটছে। মনে মনে বলে,এই লোকটার কোন লজ্জা টজ্জা নেই অসভ্য লোক একটা।”
“নাহিদ বলল,লাবিব তো জেলে নারী নির্যাতন মামলা খেয়েছে। তবে যাই বলিস নীলাঞ্জনা মেয়েটারও দোষ ছিলো৷ ছেলেদের মেয়েরা সুযোগ না দিলে তারা কোন মেয়ের কাছে ঘেঁষেতে পারে না।”
“অনিকেত বলল,দু’টোই একি কোয়ালিটির বাদ দে ওদের কথা। চল মুভি দেখে আসি সবাই মিলে।”
“বৌটাকে বাসায় রেখে আমরা তিনজন বের হবো। ব্যাচালার লাইফের মজা নেবো একটা দিন।”
“অনিকেত বলল,ডাক্তার অপর্ণা ঘোষ নিউরোলজিস্ট ওনাকে আসতে বলেছি। এসে পরবে কিছুক্ষণের মধ্যে। ভাবির মস্তিষ্ক থেকে তোর প্রতি ভয়টাকে বিদায় করতে হবে তো? নয়ত এজন্মে চাচ্চু হতে পারবো না৷”
“নয়না লজ্জায় এখন মিয়ে যাচ্ছে।”
“জিয়ান বলল,এই যে সায়না ভাবি আমার বৌটাকে নিয়ে আপনাদের বেডরুমে চলে যান।”
“ওরা দুজন রুমে এসে বসলো,সায়না বলল,বয়স কত তোমার?”
“আর একদিন পর সতেরো হবে।”
“তোমার কি সমস্যা আমাকে বলতে পারো। আমি শুধু অনিকেতের হবু বৌ না তোমার আদরের ননদিনী ও।”
“নয়না সে-সব কথা এখন মনে করতে চাইছে না৷ এমননা এখন জিয়ানের স্পর্শ তার খারাপ লাগে কিন্তু হঠাৎ কি যে হয়ে যায় লোকটা কাছে আসলে!”
“সায়না নয়নার কাঁধে হাত রেখে বলে,ইতস্তত না হয়ে বলে,ফেলো।সমস্যা না বললে সমাধান পাবে কই?”
” নয়না বেডসিট খামচে ধরে বলা শুরু করলো,চোখ বন্ধ করে সবটা বলে ফেললো গল গল করে,কপালে জমা হয়েছে বিন্দু বিন্দুঘাম।”
“সায়না নয়নাকে বলল,স্বাভাবিক হও নয়না৷ আমি জানি হুট করে তোমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা তুমি কেনো! কোন মেয়েই মেনে নিতে পারবে না। কিন্তু এখন তো তোমাকে সামনে আগাতে হবে ওই রাতটাকে ভুলে যেয়ে। জিয়ান খুব ভালো ছেলে কিন্তু রাগ কন্ট্রোল করতে পারেনি হয়ত। আমি জানি কাজটা অন্যায় করেছে। আচ্ছা ওইরাতে সবটা হয়েছে তোমাদের মধ্যে?”
” নয়না এসব বুঝে তবুও একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরেছে তাকে।”
“এমন সময় ডাক্তার অপর্ণা ঘোষ আসলো৷ নয়নার সাথে একান্তে কথা বলল,কিছু পরামর্শ দিলো সাথে তিনটা মেডিসিন দিলো।”

🌿

জাহিন ফাঁকা রুমে একটা চেয়ারের উপর পায় তুলে বসে আছে চোখ বন্ধ করে,তার কানে ভেসে আসছে তার বাবার কথাগুলো,তোকে দিয়ে কিছু হবে না৷ তুই কোন কাজের যোগ্য না। অপদার্থ একটা। জাহিন কপালে আঙ্গুল ঘষছে। এমন সময় ফোনটা স্ব শব্দে বেজে উঠলো৷ বিরক্ত নিয়ে চোখ খুলে দেখে অন্তরের কল,রিসিভ করে বলে,”কিরে শালা ডিস্টার্ব করার আর সময় পেলিনা!”

“অন্তর কাতর কন্ঠে বলে,রিতু সুইসাইড করেছে৷ প্লিজ স্কয়ার হসপিটালে চলে আয় দ্রুত।”
“জাহিন সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। রুমটা লক করে ছুটে বের হলো৷”
“মেহনুর হাত ধরে বলে এভাবে কোথায় যাচ্ছো?”
“জাহিন এক ঝটকায় হাত সরিয়ে বলে,জাহান্নামে যাচ্ছি তুই যাবি তাহলে আয়।জাহিন ততক্ষণে গেট ক্রস করেছে৷”
“মেহনুর কান্নার নাটক করে মিতা বেগমকে বলল,তোমার ছেলে আমাকে অসম্মান করেছে এবাড়িতে আমি আর থাকবো না।”
#চলবে

Dark Mystery পর্ব-১১

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_11
#Sabrina_Summa

দীর্ঘ চারদিন পর ক্যাম্পাসে আসলো সুপ্তি। নিমিষেই এ খবর চলে গেলো মাহিরের কানে।

আজও সুপ্তি বকা খাচ্ছে স্যারের কাছে। এভস্যান্ট থাকার জন্য।
তাকে বসানোর একটু পরই ক্লাসে প্রবেশ করলো মাহির।
মাহিরকে দেখে স্যার বলে উঠলো, ” আরে আরে তাশরিফ যে! ”
মাহির : সরি স্যার। বাট আমার একজনকে লাগবে। ( উকি ঝুকি দিয়ে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করে)
স্যার : কাকে?
মাহির : সুপ্তিকে৷
স্যার : সুপ্তি নামে কেউ আছো? স্ট্যান্ড আপ কুইকলি।
কেউ দাঁড়ালো না। সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
সুপ্তি নিজের নাম শুনে হেড ডাউন করে বসে আছে। আর সুশমিতা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
এরই মাঝে স্যার নামের লিস্টটা ভালো করে দেখে বললো, ” সুপ্তি নামে কেউ নেই। ”
মাহির ভ্রু কুচকে বললো, ” তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি ভুল ইনফরমেশন নিয়ে এসেছি! ”
স্যার : না তাশরিফ। আমি তা মিন করি নি।
মাহির : ওয়েট, আমিই খুঁজছি।
সানগ্লাসটা খুলে টি-শার্টের সাথে ঝুলিয়ে বেঞ্চের দিকে আগালো মাহির।
সুপ্তি বসে আছে ক্লাসের মিডেলের বেঞ্চের দিকে। লুকিয়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা তার৷ কিন্তু সুশমিতা কৌতুহল আটকাতে না পেরে অবাক হয়ে বলে উঠলো, ” সুপ্তি, তোকে তাশরিফ চৌধুরি খুঁজছে? ”
সুপ্তি : আরে চুপ থাক এখন। পরে বলবো কাহিনি।
বলতে গিয়ে খেয়াল করলো পুরো ক্লাস তার দিকে তাকিয়ে আছে ৷
মূলত মাহিরের উপস্থিতিতে একটা কানাগোষা চলতেও তা খুবই ধীরে। এক প্রকার বলা চলে পুরো ক্লাস নিরব। আর সুশমিতা অবাক হয়ে সুপ্তি নামটা একটু জোরেই বলে ফেলেছিল। ফলস্বরূপ সকলের দৃষ্টি এখন সুপ্তির দিকে।
সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাহিরও সে জায়গায় দ্রুত গেল। তারপর নিজের কোমরে হাত রেখে বললো, ” চলো৷ ”
স্যার বলে উঠলো, ” স্ট্যান্ড আপ। ”
সুপ্তি খুবই অস্বস্থিকর পরিবেশে পড়ে গেছে। তাও উঠে দাঁড়ালো।
সুপ্তিকে দেখেই স্যার বলে উঠলো, ” ও তো রিশিতা খানম। ”
মাহির : হ্যাঁ। ডাকনাম সুপ্তি। ভুলেই গিয়েছিলাম।
স্যার : কি করেছে ও?
মাহির : কিছুই না। আমার ফ্রেন্ড ও। নিয়ে যাচ্ছি। মাইন্ড করবেন না।
বলা শেষ করে সুপ্তিকে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। সুপ্তিও বাধ্য মেয়ের মতো হাটাঁ করলো। এখানে কিছু বলে আর সিন ক্রিয়েট করতে চাই না সে। মাহিরও সুপ্তির পিছে পিছে হাঁটা শুরু করলো।
পুরো ক্লাস তাদের যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে।
একটা মেয়ে বললো, ” এই ছেলেটা এত হ্যান্ডসাম কেন! ”
মেয়েটার পাশেরজন মেয়েটার কথায় তাল মিলিয়ে বললো, ” এই সুপ্তিকে তো আমি চিনতামই না। যদি আমি ওই সুপ্তির জায়গায় থাকতে পারতাম।।

মাহির সুপ্তিকে ৩১৯ নাম্বার কক্ষ অর্থাৎ মাহিরের প্রশিক্ষণ কক্ষে নিয়ে গেলো। রুমের ভিতরে প্রবেশ করার আগে পর্যন্ত দুইজনই চুপ ছিল। নিরবতা ভেঙে মাহিরই বললো, ” এই নাটকের কি দরকার ছিল? ”
সুপ্তি একটা চেয়ারে বসে বললো, ” আপনার এই নাটকের কি দরকার ছিল? ”
মাহির : নিজেকে চিনো না নাকি!
সুপ্তি : কেন আনলেন সেটা বলেন।
মাহির : কতদিন ধরে দেখি না বলো তো!
সুপ্তি বিরক্ত হয়ে বললো, ” আপনার কি মেয়ের অভাব পড়লো নাকি? ”
মাহির আর কি বলবে! সে সুপ্তিকে একবার দেখার জন্য এতটা উৎফুল্ল কেন সেটাই তো বুঝতে পারছে না। তার মাঝে এ মেয়ে তো আছেই সবসময় তাকে প্লে বয় প্রমাণ করার জন্য!
মাহির : কোথায় ছিলে এতদিন?
সুপ্তি : বলেছি তো অসুস্থ ছিলাম।
মাহির : এতটাই যে একবারও ভার্সিটিতে এলে না!
সুপ্তি : আপনার কি মনে হয় আমি ইচ্ছে করে ভার্সিটি অফ দিবো সামনে এক্সাম থাকা সত্ত্বেও!
মাহির : তিন বছরও তো দিয়েছো!
” আমি কি ইচ্ছে করে দিয়েছি । কাজে ব্যস্ত থাকলে কি করবো! ” ( মনে মনে )
মাহির : পড়ছো তো কঠিন বিষয় রাজনীতি নিয়ে। ফেল করলে কি করবে?
” সেটা তো আমারো চিন্তা। কোটি কোটি টাকা থাকা সত্ত্বেও আমাকে অসহায় অবলা নারী হয়ে থাকতে হবে। আমি তো ব্যবসার ‘ব’ ও বুঝি না। শুধু বুঝি রাজনীতি । কিন্তু আমি ভোটে দাঁড়ালে তো কেউ ভোটই দিবে না। কারণ সবাই চিনে মিস সিক্রেটকে সুপ্তিকে নয়। এগুলো ছাড়া এত রিচ দেখানো সম্ভবও না। “( মনে মনে )
মাহির : মনে মনে উত্তর না দিয়ে সরাসরিই তো দিতে পারো যাতে আমি শুনতে পারি।
সুপ্তি : আচ্ছা একটা গল্প শুনবেন।
মাহির : হুম বলো৷
সুপ্তি : একছিল মাফিয়া কুইন। তার ছিলো অনেক টাকা।…
মাহির কথার মাঝখানে বললো, ” মাফিয়া। অবৈধ টাকা তো থাকবেই। ”
সুপ্তি : আরে চুপ থাকেন। আমাকে বলতে দেন। কথার মাঝখানে কথা বলবেন না।
মাহির মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
সুপ্তি : তবে কেউ তার পরিচয় জানতো না। রাতের বেলায় ছিল মাফিয়া কুইন এবং দিনের বেলায় সাধারণ মানুষ। এতটাই সাধারণ যে তার চলার মতো টাকায় নেই। কোটি টাকা থাকা সত্ত্বেও দিনের বেলায় তা ব্যবহার করতে পারতো না। কারণ একটাই কেউ তো তার পরিচয় জানে না। হঠাৎ করে ধনী হয়ে গেলে মানুষ অবৈধ টাকা বলবে না! কিন্তু তার টাকা তো অবৈধ নই। তাকে জেলেও দিতে পারে। তখন তার পরিচয় তো মানুষের সামনে চলে আসবে। সে তো এটা হতে দিবে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো দিনের বেলায় ভিক্ষা করবে।…”
মাহির আবারো কথার মাঝে কথা বললো, ” তাহলে বড়লোক কাউকে বিয়ে করলেই হয়! ”
সুপ্তির বলতে ইচ্ছে করলো, ” তুই করবি বিয়ে এক ফকিরকে! ” কিন্তু বললো না। শুধু চোখ রাঙ্গিয়ে তাকালো। তাতেই চুপ হয়ে গেল মাহির৷
সুপ্তি : আমরা এই ঘটনায় মাফিয়া কুইনকে কি বলতে পারি! সে হলো কোটিপতি ফকির।

” আর সেটা হলাম আমি। ” ( মনে মনে )
মাহিরের কাছে গল্পটা তেমন ইন্টারেস্টিং লাগলো না। তবুও কিছু বললো না।
সুপ্তি : আজ আসি।
মাহির : পরে যাও। আগে এক রাউন্ড ফাইট করে যাও৷
সুপ্তি : আজ না।
মাহির : কেন ভয় পেলে?
সুপ্তি : না। তবে আমি সুস্থ নই। আজকে তোমার জিতার চান্স ৭০% ।
মাহির : এত কনফিডেন্স। যে ৩০% নিয়ে নিলে।
সুপ্তি : হ্যাঁ। আজ আসি।
বলেই উঠে দাঁড়ালো।
মাহির : কাল কখন দেখা হচ্ছে?
সুপ্তি : ক্লাস শেষে। ক্যাম্পাসে।
বলা শেষ করে চলে গেলো। ক্লাসে গিয়ে সুশমিতাকে সব বললো ৷
সুশমিতার মনে হচ্ছে মাহির সুপ্তিকে ভালোবাসে । তবে সুপ্তির ধারণা কোনো প্লে বয় কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারে না। আর যদি বাসে তবে সেটা তারই লাভ।।।

#চলবে.,.

Dark Mystery পর্ব-১০

0

#Dark_Mystery ( কালো রহস্য )
#Part_10
#Sabrina_Summa

মাহফুজ চৌধুরী ও তার বডিগার্ড চলে যেতেই একজন ডক্টর দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, ” ম্যা আই কাম ইন ম্যাম। ”
মিস সিক্রেট ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো, ” এসো। ”
ডক্টর ভিতরে এসে বললো, ” ম্যাম, আমি খুবই খুশি হয়েছি আপনার ট্রিটমেন্ট করতে পেরে। বাট ম্যাম, আপনার এ অবস্থা কেন? ”
মিস সিক্রেট : গুলি লেগেছে দেখতেই তো পাচ্ছো।
ডক্টর : ম্যাম, চিনেও না চিনার ভান করবেন?
মিস সিক্রেট : নাম্বার ১১। তোমার উচিৎ নই আমার অর কারো সামনে আসা ওয়িদআউট মাস্ক এ্যান্ট হুডি। ( রেগে )
ডক্টর : আমি জানতাম আপনি চিনেছেন ইনফ্যাক্ট আমাদের সকলের ইনফরমেশন আছে আপনার কাছে। তবে মাস্ক খুললে প্রবলেমটা কোথায়?
মিস সিক্রেট : এত টাস্ট করো না আমায়।
ডক্টর : কেন ম্যাম, ধোঁকা দিবেন?
মিস সিক্রেট চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই নাম্বার ১১ একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রেগে বললো, ” ম্যাম, একবার শুধু পারমিশন দেন। যে আপনাকে শুট করেছে তাকে মাটিতে পুতে ফেলা পর্যন্ত দায়িত্ব আমার। ”
মিস সিক্রেট তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ” আমাকে তো চিনো! আমি মারতে চাইলে ও বাঁচতে পারতো না।
তবে ওকে আমি মারতে পারবো না। ( শেষেরটুকু শান্তভাবে)
“কেননা ও মাহফুজ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে। যে আমাকে হেল্প করেছিল আমার আপুর খুনিকে মারতে। তার বিনিময়ে শুধু চেয়েছিল নিজের পরিবারের সেইফটি। কীভাবে মারি বলো তো! ”
“ম্যাম, কেন মারতে পারবেন না? ” নাম্বার ১১ এর প্রশ্নে হুশ ফিরলো মিস সিক্রেটের ৷
নিজেকে সামলে বললো, ” এমনিই কিছু পার্সোনাল ইস্যু আছে। ”
নাম্বার ১১ আর জানতে চাইলো না। কেউ যখন পার্সোনাল শব্দটা ব্যবহার করে তখন প্রশ্ন করাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। তাই নাম্বার ১১ চুপ থাকাটাই বেস্ট মনে করলো।
নিরবতা ভেঙে মিস সিক্রেটই বললো, ” আমি খুব প্রাউড ফিল করছি যে আমার টিমে একজন ডক্টরও আছে। ”
ডক্টর : থ্যাংক ইউ, ম্যাম।
মিস সিক্রেট : আচ্ছা আমি রিলিস কবে পাবো?
ডক্টর : ১ সপ্তাহের আগে তো না। আর যদি ৩/৪ দিনের মাঝে পেয়েও যান তবুও ঠিক করে হাঁটতে পারবেন না। প্রচুর পেইন করবে।
মিস সিক্রেট : ওকে। এখন তুমি যাও৷ আমি রেস্ট নিবো।
ডক্টর : ওকে, ম্যাম।
ডক্টর চলে যেতেই মিস সিক্রেট অরপে সুপ্তি মাস্ক ও হুডি খুলে বিড়বিড় করে বললো, ” ১ সপ্তাহ কেন! ২/৩ দিনও আমার এখানে থাকা অনেক ট্রাফ। এর জন্য দায়ী শুধু তুমি মাহির চৌধুরী অরপে তাশরিফ। এর মাশুল তোমাকে দিতেই হবে। ভেবেছিলাম বন্ধুত্ব করে তোমাকে ঠিক করবো। তবে এখন আমি তোমাকে নিয়ে খেলবো।
ওয়েট ফর মি.,.!”

নিজের সাথে কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে গেছে সে নিজেও জানে না। তার ঘুম ভাঙলো সুশমিতার কলে। সুপ্তি কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে বলে উঠলো, ” দোস্ত রাগ আছিস?”
সুপ্তি : কেন রে?
সুশমিতা : সেদিন গিয়ে দেখলাম তুই নেই। ভাবলাম আমার লেট হচ্ছে দেখে তুই রাগ করে চলে গেছিস।
সুপ্তি : না। আমাকে আরেকজন পিক করেছিল।
সুশমিতা : ভালোই তো। তোকে পিক করা মানুষের অভাব নেই!
সুপ্তি : পরে কাহিনি বলবো নি। আগে বল রবিবারে ক্যাম্পাসে এলি না কেন?
সুশমিতা : আরে আগে তুই বল। তুই আজ এলি না কেন?
সুপ্তি : অসুস্থ।
সুশমিতা : আমারো সেইম ক্যাস ছিল। তোর কি হয়ছে?
সুপ্তি : এই একটু ঠান্ডা জ্বর।
সুশমিতা : এড্রেস বল। আমি আসছি।
সুপ্তি : আমি বাসায় নেই।
সুশমিতা : তাহলে কোথায়, হসপিটালে?
সুপ্তি : আরে না। আত্মীয় বাড়ি। আচ্ছা দোস্ত রাখি এখন ৷
বলেই কল কেটে দিলো। না হয় সুশমিতা আরো হাজারটা প্রশ্ন করতো।
১ সপ্তাহও হয় নি তাদের পরিচয় হয়েছে । তবে দুইজন খুবই ক্লোজ হয়ে গেছে। মনে হয় দুই বোন।
সুপ্তি নিজের মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো, ” হসপিটাল আমার আত্মীয় বাড়ি হলো কীভাবে! হোয়াট ইভার, আমার টিমের সদস্য থাকে এখানে। সরি আমার না মিস সিক্রেটের । সো আত্মীয় বাড়ি তো হলোই ।।
( গল্পটি ভালো লাগলে “ক্ষুদে লেখিকা.,.” পেইজটি ফলো করবেন প্লিজ। )

মাঝে তিনটে দিন কেটে গেলো। এই তিন দিনে মাহফুজ চৌধুরী দুইবার দেখা করতে এসেছিল। মিস সিক্রেটের টিমের সদস্যরাও এসেছিল। সবথেকে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো মাহিরও এসেছিল। তবে সেটা নিজ ইচ্ছায় নয় বাধ্য হয়ে।।
মিস সিক্রেট ও সুপ্তি উভয়কেই কল করে জ্বালিয়ে মারছে সকলে। প্রথম দিন মিস সিক্রেটের মনে হয়েছিল সে এসব থেকে অবসর নিয়েছে। কিন্তু পরের দুইদিন ফোনের উপর ফোন করায় অতিষ্ঠ সে।
মিস সিক্রেটের হসপিটালের ভর্তির খবর মিডিয়া পর্যন্ত যায় নি। মূলত মিস সিক্রেট যেতে দেই নি। শুধু শুধু একটা এক্সটা ঝামেলা। আর তাছাড়াও এতে মাহির ফেঁসে যেতো। যা আপাতত সে চাই না।।

#চলবে.,.