Wednesday, August 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 11



ডাক পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0

ডাক
৩য় পর্ব (শেষ পর্ব)

তুশি কুঁকড়ে আছে ভয়ে। আমি গিয়ে তুশিকে কোলে তুলে‌ নিলাম। তুশি আমার কোলে উঠে কাঁপতে লাগলো।

আপু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’

আমি বললাম, ‘জানালায় ঐ মহিলা দুটোকে দেখেছিলো তুশি। তাই কাঁপছিলো।’

আপু জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই মহিলা দুটোকে আগে দেখেছিস?’

আমি বললাম, ‘না। তোদের ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটা মানুষকেই তো আমি চিনি।‌ কতোদিন ধরেই যাতায়াত করি তোদের ফ্ল্যাটে।

অথচ উনাদের দেখে একদমই চিনতে পারিনি এরা কারা। ঐদিন তোদের বাড়িতে ঢুকতেই ওদের একতলা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে দেখে সন্দেহ হয়েছিলো। কেমন একটা অশুভ ব্যাপার ছিলো দুজনের মধ্যে। তখনই ডাক দিয়েছিলাম দুজনকে।’

আপুর ফোনে ভাইয়ার কল তখনো চলছে। ফোনে ভাইয়ার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। ‘আমি পালিয়ে এসেছি পুষ্পা বাড়ি থেকে।‌ অনেক কষ্টে পালিয়েছি। এগুলা সব জান্নাবার কাজ, আমি জানি। পুষ্পা, তোমাকে আমি তখনই মানা করেছিলাম, তুমি শোনোনি। এখন আমি সেই শঙ্খবুড়ির কাছে যাবো। তুমি তুশিকে সাবধানে রাখ।’

ভাইয়ার কথা শুনে আপু হু হু করে কেঁদে দিলো।‌ আমার কাছ থেকে তুশিকে প্রায় কেড়ে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বুকে। ওর গালে কপালে চুমু খেতে লাগলো। তুশি মায়ের কোলে গিয়ে ভয় অনেকটা কাটিয়ে উঠলো। ছোট্ট একটা সাদা বিড়ালের মতো গুটিসুটি মে*রে রইলো মায়ের বুকে। আপু তুশিকে আঁকড়ে ধরলো, যেন এখনই হারিয়ে ফেলবে ওকে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে আপু?’

আপু চোখ মুছতে মুছতে বললো, ‘অনেক বড় পাপ করছ ফেলেছি রে। পাপের শাস্তি পাবো এখন।’

কিছুই বুঝলাম না আপুর কথায়। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’

আপু ছোট্ট পুতুলের মতো তুশিকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে বললো, ‘তুশি হওয়ার আগে, আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম বেবি নেওয়ার। কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। ডাক্তার দেখাচ্ছিলাম, টেস্টে জানা গেলো আমারই সমস্যা। এর কোনো চিকিৎসা নেই। বিদেশে গিয়েও খুব একটা লাভ হবে না। আমি সারাজীবন মা ডাক শুনতে পাবো না।

তোর দুলাভাইকে বলেছিলাম আরেকটা বিয়ে করতে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, ‘আমার জন্য যদি ইরানের রাণী শেহেরজাদকেও নিয়ে আসা হয়, তবুও তোমার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবো না।’

আমি জানতাম ওকে ছাড়া আমি কিংবা আমাকে ছাড়া ও বাঁচতে পারবে না। কিন্তু এক না একটা সময় তো আফসোস হবেই একটা ছোট্ট বাবুর জন্য, নিজের একটা সন্তানের জন্য। আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন শুধু কাঁদতাম আর উপরওয়ালাকে ডাকতাম। এরমধ্যেই একদিন শঙ্খবুড়ির খোঁজ পেলাম।

শঙ্খবুড়ি থাকে তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশে এক বস্তিতে। খুব নোংরা আর ছোট ঘরে থাকে ও। ওর সাথে সঙ্গী বলতে আছে একটা টিয়া পাখি। টিয়া পাখিটাই কেবল বুড়ির সাথে কথাবার্তা বলে। বুড়ি অর্ধেক পাগল, সবসময় বিড়বিড় করে কি বলে নিজেই নাকি বোঝে না।

এমন একটা বুড়ির কাছে আমাকে নিয়ে গেলো আমার কলেজের এক বান্ধবী। সে বললো, বুড়ির চেহারা দেখে ভুলিস না। এই বুড়ির অনেক ক্ষমতা। তুই যা চাবি, তাই তোকে এনে দিতে পারবে।

বুড়ির কাছে গেলাম। বুড়ি সেসময় একটু ভালো অবস্থায় ছিলো। আমাকে দেখে বললো, ‘তোকে আমার ভাল লাগছে। তোকে আমি সাহায্য করবো। কিন্তু তোর নিজের একটা ছাড় দেওয়া লাগবে।

আমি বললাম, ‘কি ছাড়?’

সে বললো, ‘তোর প্রথম বাচ্চা হবার কিছুদিন পর দ্বিতীয় বাচ্চা হবে। দ্বিতীয় বাচ্চা পেটে আসার সাথে সাথেই তোর প্রথম বাচ্চাকে নিতে জান্নাবা আসবে‌। ওদের কাছে তোদের প্রথম বাচ্চাটা দিয়ে দিবি।

আমি বললাম, ‘যদি‌ না দেই?’

বুড়ি বললো, ‘তাইলে দুটো বাচ্চাই মা*রা যাবে। এখন চিন্তা করে দেখ, একটা বাচ্চা হারিয়ে আরেকটা বাচ্চা নিবি, না সারাজীবন এরকম বাঁজাই‌ থেকে যাবি?’

আমি বললাম, ‘একটা বাচ্চা খুইয়ে আরেকটা বাচ্চা নিবো। অন্তত একটা বাচ্চা তো বেঁচে থাকবে আমার। আমি ওতেই খুশি।’
বুড়ি খিলখিল করে হেসে বললো, ‘ঠিক আছে। যা। বাসায় গিয়ে শুয়ে থাক। ঠিক সময়েই তোর বাচ্চা হবে।’

এর কয়দিন পরই তুশি এলো আমার কোলে।’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এসব কি বলে আপু? এরকম একটা কাজ সে কিভাবে করতে পারলো?

জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই একদিনও এসব কথা আমাদের বলিসনি কেন?’

‘ভেবেছিলাম পাগলা বুড়ি উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে। এরকম কিছু হবেনা। কিন্তু…’
‘আপু, তুই বেবি এক্সপেক্ট করছিস?’
আপু মাথা নিচু করে বললো, ‘হ্যাঁ। আজকে সকালেই টেস্টের রিপোর্ট এসেছে। পজিটিভ।’
‘এখন কি করবি তাহলে?’
‘শঙ্খবুড়ির কাছে যাবো। তার পা ধরে কান্নাকাটি করবো। আমার তুশির প্রাণভিক্ষা চাইবো। আমি শিওর তিনি একটা না একটা উপায় বের করতে পারবেন। তার অনেক ক্ষমতা।’

আপুর চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছে। তুশিকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে বলতে লাগলো, ‘তোমায় কোথাও যেতে দিবো না আম্মু। কোথাও যেতে দিবো না।’ মায়ের চোখের কান্না দেখে তুশিরও চোখ ভিজে আসছে। মা এবং মেয়ে, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, এমন মায়াবী দৃশ্য খুব কম দেখা যায়। আমার চোখও কেন জানি ভিজে আসলো। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো, এই মায়াবী দৃশ্য আমি আর কোনোদিন দেখতে পারবো না।

ভাইয়া ফোন করলো সেসময়। আপু ফোন ধরলো।

‘পুষ্পা। আমি শঙ্খবুড়ির বাসার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। বুড়ি মা*রা গেছে। তার টিয়া পাখিটাও নাই। দুজনের মাথা ধরেই কে যেন ছিঁ*ড়ে দুটুকরো করে দিয়েছে। আমি যতো তাড়াতাড়ি পারি বাসায় আসছি। তুমি তুশিকে সামলে রেখো।’

আপু ফোনটা রেখে দিয়ে চুপচাপ তুশিকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। তার চোখে পানির বাঁধ ভেঙেছে‌‌।
তুশি বললো, ‘আম্মু, এতো কান্না করো কেন তুমি?’
আপু তুশির কপালে চুমু খেয়ে বললো, ‘মা রে, তোর সব বিপদের কারণ আমি রে মা। আমাকে মাফ করে দিস।’

বাতাসে পোড়া কাঠের ঘ্রাণ। বারান্দার দরজাটা খুলে গেল। দুজন মহিলা এসে ঢুকলো ঘরে। সেই দুজন মহিলা, যাদের প্রথম সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখেছি। যারা এতোদিন দেখা দিচ্ছিলো আমাদের। জান্নাবা।

আপু ওদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘দোহাই তোমাদের। এতোটুকু বাচ্চা আমার। ওকে ছেড়ে দাও। আমাকে মাফ করে দাও। ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও না।’

মহিলা দুটো হাসলো। হাসতে হাসতে বললো, ‘কথা দেওয়া মানে কথা দেওয়া। তুমি আমাদের কথা দিয়েছিলে তোমার প্রথম বাচ্চাকে আমাদের কাছে দিয়ে দিবে। এখন সময় এসেছে ওকে আমাদের কাছে দিয়ে দেওয়ার। ওকে আমাদের হাতে তুলে দাও।’

তুশি মহিলা দুটোকে দেখে ভয়ে কুঁকড়ে আছে। ওকে দেখাচ্ছে ছোট্ট বাচ্চা একটা বিড়ালছানার মতো। আপু তুশিকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। কিছুতেই তুশিকে কাছ-ছাড়া করবে না।

মহিলা দুটো তুশির দিকে এগোচ্ছে।

আপুর ঘরের টেবিলের ওপর একটা ছুরি পড়েছিলো‌। মনে হয় ফল কাটার জন্য আনা হয়েছিলো। আমি ছুরিটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে বললাম, ‘খবরদার। আমার ভাগ্নির দিকে কেউ এক হাত বাড়ালে ওর সেই হাত কেটে আরেক হাতে ধরায় দিবো।’

আপু, আর জান্নাবা, সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।

আমার ছুরির ফলাটা চিকচিক করে উঠলো আলো পড়ে। জান্নাবা পিছিয়ে গেলো কেন যেন।

আপু বললো, ‘তুই কি বলিস এগুলা? পাগল হয়ে গেছিস?’

আমি বলি, ‘আপু, ঠিকই বলতেসি সব। তোর বাচ্চা দেওয়ার ক্ষমতা ওদের আছে? আছে কেবল একমাত্র ওপরওয়ালার। উনি চেয়েছেন বলেই তোর বেবি হয়েছে। এরা তোর বেবি দেওয়ার কে? বেবি হয়েছে আর মাঝখান থেকে ফায়দা লুটতে আসছে। দালালের বাচ্চা সব।’

আপু বললো, ‘তুই পাগল হয়ে গেছিস। এরা মানুষ না, বুঝতে পারছিস না। মানুষের মতো ধমকালে এরা ভয় পাবে না। উল্টো রেগে যাবে।’

আমি বললাম, ‘মানুষ না বুঝলাম, ওপরওয়ালার একটা সৃষ্টিই তো। আমি, তুই ওপরওয়ালার যেমন একটা সৃষ্টি, গরু ছাগল যেমন একটা সৃষ্টি, এরাও তেমনি একটা সৃষ্টি। গরু ছাগলকে দেখে তুই অকারণে ভয় পাস? এদের কেন ভয় পাবি?’

আপু বললো, ‘এদের অনেক ক্ষমতা…’
‘ক্ষমতা তো কি হয়েছে? এদের অনেক ক্ষমতা আছে, আর মানুষের কোনো ক্ষমতা নাই? মানুষের অনেক ক্ষমতা আপু। মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত এমনি এমনি বলা হয় না। মানুষের ক্ষমতার জন্যই এরা মানুষকে ভয় পায়, মানুষের সাথে লোকালয়ে থাকে না, বনে-জঙ্গলে গিয়ে থাকে। আমরা আমাদের এতো ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারি না, কারণ আমরা ভয় পাই। সব কিছুতেই আমাদের ভয়‌। কেউ নজর দিলো কিনা ভয়, কেউ বান মারলো কিনা ভয়। শরীর একটু খারাপ হলেই ভাবি জ্বীনের আছড়। বউয়ের সাথে একটু ঝগড়া হলেই ভাবি জ্বীনের আছড়। এসব ভয়ের জন্যই আমাদের মন দূর্বল থাকে আপু। মন একটু শক্ত কর, এরা তোর চুলটাও ছিঁড়তে পারবে না।’

জান্নাবা দুজন চিৎকার করে উঠলো, ‘ভুল করছিস, অনেক বড় ভুল করছিস। আমরা শঙ্খবুড়িকে শেষ করে দিয়ে এসেছি। তোকেও শেষ করে দিবো।’
আমি ছুরিটায় দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে ওদের দিকে আগাতে আগাতে বললাম, ‘আয়, কাছে আয়। দেখি কে কাকে শেষ করে।’

জান্নাবা পেছাতে পেছাতে বারান্দার বাইরে চলে গেলো। এরপর বারান্দার গ্রিল দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে মিলিয়ে গেলো বাতাসে। যাওয়ার সময় বলে গেলো, ‘ভুল করলি। খুব বড় ভুল করলি। আমরা আবার আসবো।’

আপু ভয়ে কাঁপতে লাগলো। বললো, ‘ওরা যদি আসে আবার? যদি আমাদের কোনো ক্ষতি করে?’

আমি বললাম, ‘ওরা কিছুই করতে পারবে না। আজ যে বেইজ্জতিটা হয়ে গেলো, এরপর আর ওরা এদিকে মুখ ফেরানোর কথাও চিন্তা করবে না। ওরা তো আর মানুষ‌ না। মানুষ ওদের চেয়েও খারাপ।’

আপু তুশিকে জড়িয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বললো, ‘তোমাকে আমি কোথাও যেতে দিবো‌ না আম্মু। আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে দিবো না।’
তুশি হাত দিয়ে ওর মায়ের কান্না মুছিয়ে দিলো। আমি চলে এলাম। আমারও খুব কান্না পাচ্ছে। সব কান্না সবাইকে দেখাতে হয় না।

***
তিন বছর পর। আপুর আরেকটা পুতুল হয়েছে। এটার নাম রাখা হয়েছে টুশি। তুশি আর টুশি দুটো মিলে আপুর বাসা মাতিয়ে রাখে। এই দৌড়াদৌড়ি করছে, এই মারা*মারি করছে, এই লাফালাফি করছে, এক সেকেন্ডও শান্তিতে বসে নাই দুজন।
আপু হাফাতে হাফাতে বলতে থাকে,’উফ রে, পিন্ডিটা জ্বালিয়ে খাচ্ছে দুটা। একটুও শান্তি দেয় না। দুই ঘন্টা যে শান্তিতে ঘুমাবো, সেই সুযোগটাও নাই‌। বিরক্ত করে মা*রলো আমাকে।’ বলতে বলতে আপুর চোখে কান্না ঝিকমিক করতে থাকে। আনন্দের কান্না। আপু পুতুল দুটোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। একটুও এদিক ওদিক যেতে দেয় না।

ভাইয়াও অফিস থেকে ফিরলে পুতুল দুটোকে নিয়েই মেতে থাকে। ওরাও বাবা বলতে অজ্ঞান, বাবা ফিরলে বাবার কাছে গিয়ে যে বসে থাকে, আর কাছ ছাড়া হয় না। একটা থাকে বাবার এক বগলের নিচে, আরেকটা থাকে অন্য বগলের নিচে।

ছুটির দিনে ভাইয়া আপু আর তার দুই মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যায়। পার্কে আপু আর ভাইয়া বসে থাকে, তাদের মেয়ে দুটো ছোট ছোট পায়ে তাদের ঘিরে ঘুরতে থাকে প্রজাপতির মতো। অদ্ভুত শান্তি শান্তি লাগে তাদের দেখতে।

আমি আগের মতোই আছি। তবে এখন মাঝে মাঝেই মাঝরাতে ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙলে দেখতে পাই, আমার বিছানার পাশের জানালায় দুজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি আমার বালিশের নিচে হাত রাখি‌‌। হাতে ছুরির ধাতব স্পর্শ পাই। তখন ওরা চলে যায়। আমি আবার মুচকি হেসে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি।

মাঝে মাঝে অবশ্য একটু ভয় লাগে। যদি কোনোদিন বালিশের নিচে ছুরি রাখতে ভুলে যাই? যদি সেদিন কেউ আসে আমার রুমে?
আমি ভাবতে চাই না ওসব। যখন হবে, তখন দেখা যাবে।

(শেষ)
সোয়েব বাশার

ডাক পর্ব-০২

0

ডাক
২য় পর্ব

আমি তুশিকে কোলে নিয়ে দৌড় দিলাম। ঝাড়া দৌড়।‌ এক দৌড়ে বিল্ডিংয়ের বাইরে।

আমাকে দেখে দারোয়ান অবাক হয়ে বললো, ‘দৌড়ান কেন স্যার?’
আমি বললাম, ‘পুলিশ ডাকেন, জলদি পুলিশ ডাকেন। আমাদের বাসায় কারা জানি ঢুকেছে।’

দারোয়ান বললো, ‘পুলিশ ডাকার আগে আমি একটু দেইখা আসি। কে এমনে ঢুকলো। আমি তো এতোক্ষণ বসা আছিলাম। একটা তেলাপোকাও তো ঢুকতে দেই নাই।’

দারোয়ান উপরে আমাদের বাড়ি গেলো। আমি নিচে তুশিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তুশির মুখটা শুকনো। ভয় পেয়েছে খুব।

পনেরো মিনিট পর দারোয়ান এলো। গিয়েছিলো সে চোখমুখ শক্ত করে। দেখে মনে হচ্ছিলো, চোর ছ্যাচ্ছর সব একাই পিটিয়ে বের করে নিয়ে আসবে।

অথচ যখন এলো, তখন তাকে দেখে আমিই ভয় পেয়ে গেলাম। পুরো লম্বা দৈত্যের মতো দেখতে লোকটা ভয়ে কাঁপছে। পাগলের মতো কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতেই বললো, ‘এই চাকরি করুম না। এই চাকরি করুম না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে।’

দারোয়ান আমার দিকে তাকালো। তারপর হাসলো। পাগলের মতো হাসলো। বললো, ‘আমি জ্বীন দেখসি স্যার। সত্যিকারের জ্বীন দেখসি। এমন ভয়ংকর জিনিস দুনিয়ার আর কেউ দেখে নাই।’

লোকটা বেরিয়ে চলে গেলো। তার আর দেখা পাওয়া গেলো না।

আমি তুশিকে নিয়ে বিল্ডিংয়ের নিচে বসে রইলাম। সন্ধ্যা পার হলো। আপু ফিরলো আগে। এসেই বললো, ‘তোরা এখানে কেন?’

আমি বললাম, ‘এখানে তোর জন্য বসেছিলাম। আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না এখানে। আমার সাথে এখনই আমাদের বাসায় চল। দুলাভাইকেও ফোন করে দে ওখানে যেতে। আমার ফোনটা উপরে রেখে এসেছি, ফোন করতে পারছি না।’

আপু বললো, ‘কি সব পাগলামি শুরু করলি।’

আমি বললাম, ‘চল আপু, চল। রাস্তায় সব বলবো তোকে।’

রিকশায় উঠতে উঠতে আপুর বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালাম। আপুদের ফ্ল্যাটটা অন্ধকার।‌ জানালা দিয়ে ওখানে কিছুই দেখা যায় না।

অথচ আমি দেখলাম।‌দুজন মহিলাকে দেখলাম। তারা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। জানালার দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে ওদের।

বাসায় ফিরতে ফিরতে আপুকে সব বললাম। সে বিশ্বাস করলো না। বললো ফাজলামি করছি। আমাকে অনেক বকলো তুশিকে ভয় দেখানোর জন্য। তুশি ভয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে।

আপু ফোন দিলো দুলাভাইকে। বললো যে সে আজ রাতে মায়ের বাসাতেই থাকবে। ভাইয়া যেন সোজা বাড়িতে চলে যায়। ফ্রিজে খাবার রাখা আছে, গরম করে খেয়ে নিবে। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘এটা কি বললি আপু। সত্যিই ঐ বাড়িতে থাকলে ভাইয়ার বিপদ হবে।’

আপু চোখ রাঙিয়ে বললো , ‘চোপ ফাজিল। তোর ফাজলামির জন্য আমার মায়ের বাসায় যাওয়া লাগছে। তোর দুলাভাইকেও এমনে বোকা বানাবো‌ নাকি। ও বাসাতেই যাক। বাসা খালি রাখা ঠিক হবে না।’

আপুকে কোনোভাবেই মানাতে পারলাম না।‌রাতে ভাইয়া ঐ বাসাতেই থাকবে।‌ একা। আমরা আমাদের বাসায়। আপু আর তুশি এক রুমে ঘুমাতে গেলো। আমি তাদের পাশের রুমে।

আমি রাতে জেগে রইলাম। খুব ভয় করছিলো। মনে হচ্ছিলো, এখনই ফোন বাজবে আপুর। আপু ফোন ধরবে।‌আর ওপাশ থেকে আসবে কোনো খারাপ খবর।

রাত তখন একটা বাজে। ফোনটা এলো।

আপু ধরলো ফোন।

আমি আপুদের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।‌

আপু কণ্ঠটা কেমন গম্ভীর শোনালো প্রথমে। তারপর ভয়, অদ্ভুত ভয় জাগলো তার কন্ঠে। আপু কান্না কান্না গলায় বললো, ‘কি দেখছো তুমি? কি দেখছো? বেরিয়ে যাও, এখনই বেরিয়ে যাও বাসা থেকে।’

আমি দরজা ঠকঠক করলাম। আপু খুললো দরজা। চোখ দুটো ভেজা। ভয়ে কাঁপছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’

আপু বললো, ‘তোর ভাইয়া শুয়ে ছিলো। ঘুম ভেঙ্গে দেখে, দুটো মানুষ সিলিঙে চারহাতপায়ে টিকটিকির মতো হেঁটে বেড়াচ্ছে।’

হঠাৎ চিৎকারের শব্দ। আপুর ফোনে। আপুর ফোনটা অন করা। ভাইয়া অন কলে ছিলেন। চিৎকারটা ভাইয়ার।

আমার তখন ভাইয়ার চিৎকারের দিকে মন নেই। আমার দৃষ্টি আপুদের বিছানায়। সেখানে তুশি বসে আছে। জানালার দিকে তাকিয়ে আছে সে।‌ জানালার ওপারে বারান্দা। বারান্দায় স্নিগ্ধ জোছনা। জোছনায় বারান্দার অনেকখানি আলোকিত হয়ে আছে।

সেই জোছনার ভয়ংকর আলোয় আমি দেখলাম, দুজন চাদর পরা মহিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে তুশির দিকে তাকিয়ে আছে। হাত নেড়ে ডাকছে তুশিকে।

চলবে

লেখা- সোয়েব বাশার

ডাক পর্ব-০১

0

#ডাক
১ম পর্ব
সোয়েব বাশার

দুজন অপরিচিত মহিলাকে দেখলাম বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে। দুজনের সারা শরীর কালো চাদরে ঢাকা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা কে? কোন বাসায় আসছেন?’

তারা আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো।

আমি জানি না, আমার কেন ভয় লেগেছিলো সেদিন। কেমন গা ছমছমে ভয়। ভয়ে আমার সারা গা কেঁপে উঠেছিলো।

আমি দারোয়ানকে গিয়ে বললাম, ‘দুইজন মহিলা উঠছিলো সিঁড়ি বেয়ে। উনারা কারা?’

দারোয়ান পানের পিক থু করে ফেলে বললো, ‘কি যে বলেন ভাইজান। সিঁড়ি দিয়ে উঠবো কেডা? লিফট তো চালু।’

আমিও দেখলাম, লিফট চালু। তাহলে সিঁড়ি বেয়ে তারা উঠছিলো কেন? দারোয়ানও বা তাদের দেখেনি কেন?

এই বাড়িটা আমার বোন-দুলাভাইয়ের।‌ভাইয়া এখানেই ফ্ল্যাট কিনেছেন। আদাবরে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। এই বাড়িতে ভাইয়া ভাবি ছাড়াও থাকে তুশি।

তুশি হলো আপুর চার বছরের পিচ্চিটা। একদম ছোট্ট পুতুলের মতো। ছোট ছোট পায়ে যখন ও ‘মামা, মামা’ বলে হাঁটে, মনে হয় চাঁদের একমুঠো আলো মাখা ছোট্ট একটা গোলুমোলু কিউট পুতুল হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওকে কোলে নিলে একটুও নামাতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় সারাক্ষণ ওকে আদর করি।

তুশির ইদানিং সমস্যা হচ্ছে।‌এইজন্যই ডেকেছে আপু। ও ইদানিং ভয় পায়। কাকে নাকি দেখে। রাতে একা থাকতে পারে না।‌ এইরুম থেকে ও রুমে যেতে পারে না ভয়ে। রাতে লাইট নেভাতে দেয় না। সারারাত লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে হয় আপা আর দুলাভাইকে।

আমি তুশির এই প্রবলেম সলভ করতে যে এখানে এসেছি, এমনটা না। এসেছি এই বাসায় ঘুরতে। কালকে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে, সামনে তেপান্তরের মাঠের মতো আদিগন্ত বিস্তৃত লম্বা ছুটি। কষিয়ে ছুটি কাটাবো। এই ছুটি কাটানোর প্ল্যানেই আপুর বাড়িতে আসা।

আপু সন্ধ্যায় আমাকে আর তুশিকে রেখে একটু শপিংয়ে গেলো। ভাইয়া অফিসে।‌বাসায় খালি আমি আর তুশি। আমি ড্রয়িংরুমে টিভি চালিয়ে বসে আছি। তুশি খেলছে। খেলতে খেলতে ও কেমন যেন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে, মামা?’

তুশি কিছু বলে না। ভীতু বিড়ালের মতো আমার কাছে এসে জড়োসড়ো হয়ে থাকে।

আমি কান পাতি।

কেমন একটা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

অদ্ভুত একটা শব্দ।

মানুষের ডাকের শব্দ।

শব্দটা আসছে সামনের রুমটা থেকে।‌রুমটা অন্ধকার। ভীষণ অন্ধকার।

তুশি আমার কোলে উঠে বসে। আমাকে জাপটে ধরে। ফিসফিস করে বলে, ‘ভয় লাগছে মামা। আমার ভয় লাগছে।’

আমি অন্ধকার রুমটার দিকে ভালো করে তাকাই। কিছুই দেখা যায় না।‌এসময়ই হঠাৎ বাজ পড়ে কাছাকাছি কোথাও।

বিদ্যুৎ চমকের আলোতে রুমটা হঠাৎ আলোকিত হয়ে যায়। আর আমি যা দেখি, আমার পুরো শরীর ভয়ে কাঁপতে থাকে।

আমি দেখি সকালের সেই মহিলা দুটো রুমের মধ্যে। অদ্ভুত ভাবে হাসছে তারা। হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছে। তাদের ডাকের শব্দও শুনতে পারি আমি।

তারা ডাকতে থাকে, ‘আয়, তুশি আয়।’

ভয়ে আমার শরীর কাঁপতে থাকে। আর তারা হাত নেড়ে ডাকতেই থাকে, ডাকতেই থাকে।

‘আয় তুশি। আয়।’

(চলবে)

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৪৮

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪৮
নয়না জিয়ানের বাহুতে আবদ্ধ। নয়নার চোখ দুটো কাপড়ে বাঁধা। হৃদপিণ্ড বেসামাল, খামচে ধরে আছে জিয়ানের পাঞ্জাবি।
“জিয়ান নয়নার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,ডিয়ার বাটার মাশরুম। এতোটুকু ছোঁয়ায় হাওয়াই মিঠার মতো মিলিয়ে যেও না। তোমার জীবনের সবচেয়ে স্বরণীয় দিনের জন্য প্রস্তুতি নাও প্রাণ।”

নয়না এখনো জিয়ানের পাঞ্জিবর কলার শক্ত করে ধরে আছে।

জিয়ান নয়নার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,”ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসা যায়। স্পর্শে ব্যাকুলতা ছড়িয়ে মিশে যেতে হয় একে অপরের পাজরে। অপূর্ণ থেকে পূর্ন হওয়া যায়, মিশে যাওয়া যায় একে অপরের মাঝে,লোকে জানবে, তুমি আমি দুটি দেহ, একটি প্রাণ৷ কবুল বললেই অপরিচিত নারীকে অর্ধাঙ্গিনী রুপে পাওয়া যায়। তবে সে নারীর ভালোবাসায় উন্মাদ হওয়া যায় জানা ছিলো না৷ তুমি আমার সব শূন্যতার প্রিয় পূর্নতা।”

“নয়না ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে চাইলো৷ তার আগেই ঠোঁট দুটো দখল করে নিলো অপর দু’টি ঠোঁট। নয়না কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো৷ খামচে ধরলো জিয়ানের পিঠ।

পেছন থেকে অনিকেত বলে,”ভাই আমরা অবিবাহিত একটু দয়া কর আমাদের উপর। তোদের যা করার আমরা সরলে করিস।”
“জিয়ান নয়নার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে সরে আসলো কিছুটা। অনিকেতকে উদ্দেশ্য করে বলে,”শা’লা কয়েক মিনিট চোখ বন্ধ করে রাখতে পারলি না!মনমত কিসটা করতেও পারলাম না৷”
“বৌ তোরই, ফুরিয়ে যাচ্ছে না। সারাজীবন মনভরে যা খাওয়ার খেয়ে নিস। খাওয়ার আগে খেয়াল রাখিস আগে পিছে কেউ আছে নাকি। যেখানে সেখানে খেতে হয় না৷”
“নয়না মনে মনে বলে,এই লোকটা এতো ঠোঁট কাটা! লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই। এভাবে কেউ সবার সামনে বলে!অসভ্য,নির্লজ্জ,বেকুব প্লেন ড্রাইভার।”

জিয়ান বলল,”মনে মনে বকছো কেন! যত যায়ই বলো আমি কিন্তু তোমারই, তাই বকে টকে লাভ তেমন নাই সহ্য সারাজীবন করতেই হবে নো অপশন।”
জিয়ান নয়নার হাত ধরে নিয়ে আসে। আস্তে আস্তে নয়নার চোখ খুলে দেয়৷ নয়নার দৃষ্টি তখন আকাশে, সুন্দর করে লেখা, প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী শুভ জন্মদিন। লেখাটা মিলিয়ে যায় কয়েক মূহুর্তে। এরপরই নয়নার উপর বর্ষিত হতে থাকে নানা রকম সুগন্ধি ফুল৷ সবাই একসাথে উইশ করছে,হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার সুনয়না। হেলিকপ্টার থেকে বর্ষিত হচ্ছিলো ফুলের পাপড়িগুলো৷ এরপর উপর থেকে লাল আর সাদা রঙের বেলুন৷ নয়নার চোখেমুখে বিস্ময় আনন্দ দু’টো প্রকাশ পাচ্ছে।
“জিয়ান বলল,হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার বাটার মাশরুম। বেচে থাকার প্রার্থনায় তোমার সাথে বৃদ্ধ হতে চাই প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।নয়নার খালি হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্য আবদ্ধ করে নেয়। এরপর অপর হাত দিয়ে নিজের পাঞ্জাবির পকেটে থেকে বের করে আনে, লাল রঙের রেশমি কাঁচের চুড়ি।

“নয়না অবাক নেত্রে তাকিয়ে আছে জিয়ানের দিকে। মানুষটা তাকে কত যত্ন নিয়েই ভালোবাসে! পরম যত্ন নয়নার শুন্য হাত ভরে উঠলো লাল কাঁচের চুড়িতে৷ হাত ছাড়তেই চুড়ি ঝুনঝুন করে উঠলো।”
“জিয়ান বলল,তোমার হাত এই চুড়ির সৌন্দর্য বর্ধন করে দিয়েছে।”
” নাজিব চৌধুরী, মিতা বেগম ওনারাও এসেছেন৷ যদিও কিছুটা দেরিতে ডেকে এনেছে ওনাদের। তবুও দু’জনেই বেশ খুশি হলো।সবাই মিলে একত্রিত হয়ে কেক কাটলো৷ নয়না সর্বপ্রথম কেকের পিসটা নিয়ে মিতা বেগমের মুখে তুলে দিলো৷ এরপর নাজিম সাহেবকে খাইয়ে দিয়ে কেকের পিসটা রেখে দিলো।”

সবাই বেশ আনন্দিত। তবে মেহনুরের মন যেনো আমাবস্যারাত। বেশি সময় সবাই থাকলো না৷ সবাই চলে গেলো যে যার মত।

“অনিকেত জিয়ানের, কানের কাছে মুখ এনে বলে,ভাই আমার তাল হারিয়ে ফেলিস না৷ নয়ত সেবারের মত ভাবি জ্ঞান হারাবে আর তুই এবারও ফুলকোর্স কম্পিলিট করতে পারবি না। একটু রয়ে সয়ে খাইস ভাই। জিনিস তোরই সারাজীবন খেতে পারবি।”
“শা’লা ইতর তুই যাবি নাকি সায়নাকে ফোন করে ডেকে আনবো?”
” যাচ্ছি। তবে এবার কিন্তু ইনকম্পিলিট রাখিস না।”

জিয়ান ছাদের দরজা বন্ধ করে নয়নাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নয়নার চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো। শুষে নিতে থাকলো নয়নার চুলের মাতাল করা ঘ্রাণ৷
“নয়না চোখ বন্ধ করে ডাক্তারের কথাগুলো স্বরণ করলো,তুমি বর্তমান উপভোগ করো অতীত কে বর্তমানে আসার সুযোগ না দিয়ে৷ যদি বর্তমান আর অতীত একসাথে আসতে চায় একটু শ্বাস নাও ট্রাই করো বর্তমানকে অনুভব করার। মৃদু স্বরে বলল, চুলে কি তেলের বদলে আফিম ব্যবহার করো নাকিগো!কেমন মাতাল হয়ে যাচ্ছি। জিয়ান ধীরে ধীরে নয়নার কাঁধ থেকে চুলগুলো সরিয়ে নয়নার ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দেয়।

“নয়না কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে দু”হাতে শাড়ি খামচে ধরে। নয়নার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,এতোটুকুতেই জমে গেলে এই পুরো আমি টাকে কি করে সামলাবে বাটার মাশরুম !”

“নয়নার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। নিশ্বাসের শব্দ ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
“পরপর কয়েবার জিয়ান নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের উষ্ণতা অনুভব করালো নয়নার ঘাড়ে৷”
” নয়না ঘুরে জিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো,কোমল কন্ঠে,বলল,আমার কেমন জেনো লাগছে।”
“জিয়ান পরম আদরে জড়িয়ে নিলো নয়নাকে নিজের বক্ষপিঞ্জরে, আদুরে স্বরে বলল,কেমন লাগছে বাটার মাশরুম? এই অনুভূতি এক্সপ্লেইন করতে পারবে?”
“নয়নার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি টের পাচ্ছে জিয়ান৷ বলো না জান কেমন লাগছে তোমার?”

“নয়না জিয়ান পাঞ্জাবি ভেদ করে নখ বসিয়ে দিলো জিয়ানের পিঠে,মৃদু কন্ঠে বলল,জানিনা তুমি আমাকে কোন ঘোরে নিয়ে যাচ্ছো!মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাচ্ছি তোমার স্পর্শে।”

“জিয়ান নিজের জমিয়ে রাখা কন্ট্রোল হারিয়ে বসলো, নয়নার মুখ থেকে তুমি ডাক শুনো৷ হুট করে নয়নার ঠোঁট ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো গভীর ভাবে।”
“নয়না পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।সে যেনো হারিয়ে যাচ্ছে নিজের মধ্য থেকে৷ ইচ্ছে করছে জিয়ানের ভেতর নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলতে।”
“প্রায় পাঁচ মিনিট পর নয়নার ঠোঁট জোড়া মুক্ত হলো জিয়ানের ঠোঁট থেকে৷ নয়না জোড়ে জোড়ে নিঃস্বাস নিচ্ছে। একমন সুখকর অদ্ভুত অনুভূতি!
“জিয়ান নিজেও শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,ডিয়ার বাটার মাশরুম আজকে তোমাতে ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে।জানিনা কতক্ষণ নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখতে পারবো। তুমি বুঝতে পারছো আমি বলছি? আমার ভেতরের পুরুষসত্তা তীব্রতা ধারণ করছে সুইটহার্ট। তোমার কোন সমস্যা হোক আমি চাইনা৷ তোমার কষ্ট হলে বলে দিও রাঙাবৌ। আমি সারাজীবন অপেক্ষা করবো তবুও তোমার অমতে তোমার সাথে ঘনিষ্ঠ হবো না জান৷”

“নয়না এসবের মানে বুঝে। নয়নার গাল দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো,শরীরে বয়ে যেতে লাগলো অন্য রকম এক শিহরণ।”

” জিয়ান নয়নার চোখে হাত রেখে বলে,এই পূর্নিমা রাত তুমি আমি জোছনাস্নাত করবো। দেহের মিলন না আমি তোমার সাথে আমার আত্মার মিলন ঘটাতে চাই প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী। তুমি বাঁধা দিওনা আজ সব বাঁধা ছিন্ন করে আসো একে অপরকে শপে দেই৷ এই সময়টুকুতে ভুলে যাও সব৷ আমার ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে উন্মাদ হও আমার সাথে। চলো হারিয়ে যাই উন্মাদনায়।”
“কাঁপা কাঁপা কন্ঠে নয়না সুধালো, কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“তোমাকে ভালোবাসার সমুদ্রে ভাসিয়ে নিতে নিয়ে যাচ্ছি বাটার মাশরুম। প্লিজ তুমি করে বলো জান৷ তুমিময় ভালোবাসায় সিক্ত হতে চাই৷ আমি তোমার কন্ঠে আদুরে স্বরে তুমি সম্বোধন শুনতে চাই সখী।”

“জিয়ান সুইমিংপুলের কাছে এসে নয়নার চোখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে নিলো৷ চারপাশে লাল,নীল, সবুজ, হলুদ নারা রঙের লাইটিং পুরো পুল জুড়ে লাল গোলাপের পাপড়ি। মাঝখানে হলুদ গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা, শুভ জন্মদিন প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।”

“নয়নার ছোট হৃদয় জুড়ে রঙিন প্রজাপতি উড়তে লাগলো৷ মনে হচ্ছিলো সে যেনো কোন অষ্টাদশী কন্যা। জিয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,ভালোবাসি তোমাকে৷ একটু বেশিই ভালোবাসি। আমি কি সত্যি তোমার! আমার নিজের এই ভাগ্য যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না!”

“জিয়ান কল্পনাও করেনি নয়না তার এতো কাছে এসে এভাবে তাকে প্রপোজ করে বসবে৷ জিয়ান দু’হাতে নয়নাকে নিজের বক্ষে জড়িয়ে নিয়ে বলে,তোমার প্লেন ড্রাইভার তোমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে বাটার মাশরুম। আমার বাটার মাশরুম একান্ত ব্যাক্তিগত সুরভিত ফুল তুমি, যার মাতাল করা ঘ্রানে আমি সব সময় আসক্ত থাকতে চাই। ভালোবাসি, ভালোবাসি। ভালোবাসায় মোড়ানো আমার ছোট বাটার মাশরুম।”

“নয়না জিয়ানকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো৷ তার যেনো ইচ্ছে করছে জিয়ানের ভেতরে নিজেকে আড়াল করে ফেলতে৷”

“জিয়ান নয়নাকে ঘুরিয়ে সামনে এনে নয়নার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে পুলে জাম্প মারলো। পানির শীতলতা যেনো আরো উত্তাপ জড়িয়ে দিলো দু’জন কপোত-কপোতীর দেহ-মন জুড়ে। গোলাপের সুভাষ আর প্রিয়তমার সান্নিধ্যে পাগল করে তুলেছে জিয়ানকে৷”
অবশেষে আজকের পূর্নিমার রাত আর এই শীতল বাতাস সাক্ষী হতে যাচ্ছে দু’জন কপোত-কপোতীর পবিত্র মিলনের।
#চলবে

আলতো বাঁধন পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#আলতো_বাঁধন(ছোটগল্প)
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ২(অন্তিম)

ছাদ থেকে নিচে নেমে অনুভব এক কোণার সোফায় গিয়ে বসে পড়লো। ঘরে উচ্ছ্বসিত কোলাহল,একরকম উৎসবমুখর পরিবেশ। মনে হচ্ছিল, সব কিছু বুঝি চূড়ান্ত।
কোনো কথা না বলে মোবাইলটা বের করে স্ক্রলিং শুরু করল অনুভব। চোখ হয়তো স্ক্রিনে, কিন্তু মন আর কান কথোপকথনের দিকে।
কিছু সময়ের ভেতরই পুরো পরিবেশটা উপলব্ধি করতে পারল সে।
পাশে এসে বসল ছোটবোন নিহি। চাপা হাসি ঠোঁটের কোণে।
অনুভব নিচু গলায় বলল,
“এখনো এদের প্যাচাল শেষ হলো না? বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়নি?”

নিহি ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে বলল,
“উফ ভাইয়া, তুই তো এখনো একেবারে রসকসহীন রয়ে গেলি! এখানে কাহিনী উল্টে গেছে রে!”

ভ্রু কুঁচকে অনুভব তাকাল,
“মানে?”

রিহি তখন ফিসফিস করে পুরো কাহিনী খুলে বলল। কানে কথাগুলো পৌঁছাতেই, অনুভব চোখ তুলে তাকাল ঘরের দিকটায়। বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল। তার মানে, ছাদে পিছনের সাইট দেখা সেই মেয়েটাই প্রথমে পাত্রী ছিল!
হঠাৎ করেই তার বুকের ভেতর কিছু একটা খচখচ করে উঠল। নিজের উপর বিরক্তি ভর করল। কেন সে চলে এলো? কেন ছাদের সেই মুহূর্তে কিছু বলল না, কিছু করল না?

ঘরভর্তি মানুষের হাসি তার কানে কাঁটার মতো বাজলো। কী অবলীলায় সবাই বদল মেনে নিল!
আর সেই মেয়েটার পরিবারও? তাদের পরিবারেরই একজনের চোখের জল কি এদের কারও চোখে পড়ে না?
সবার দিকে তাকিয়ে, অনুভব প্রথমবারের মতো গভীর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তার মনে হলো, কেউ একজন নীরবে কান্না করছে,আর পুরো পৃথিবী উদাসীন হয়ে হাসছে। এমনকি তার কাছের মানুষগুলোও!

“কিরে, এভাবে চুপচাপ বসে আছো কেন, অনুভব ভাই?”
নরম কণ্ঠে পেছন থেকে বলল আরিশ।

অনুভব ধীর চোখে তার দিকে তাকাল। গলায় কোনো উত্তাপ না রেখেই বলল,
“তুই এটা ঠিক করিস নি।”

আরিশ থমকালো।
“মানে?”

অনুভব এবার সোজাসুজি চোখে চোখ রেখে বলল,
— “তা তুই ভালোই বুঝতে পারছিস।”

আরিশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “অনুভব ভাই, তুমি অন্তত এই কথাটা আর বলো না। জানি তুমি আমাদের সবার চেয়ে আলাদা। কিন্তু এভাবে মুখের ওপর এমন কথা বলে মন খারাপ করে দিও না।”

— “যেটা সত্যি, সেটাই তো বলছি।”

— “ওই মেয়েটার সাথে আমার কিছুতেই মানাবে? তুমি সত্যি করে বলো তো।”

অনুভব এবার কণ্ঠে একটু শীতল রাগ ঢেলে বলল,
— “রঙই কি সব সৌন্দর্য?”

— “হ্যাঁ, অবশ্যই। এখন আবার তুমি উল্টো ব্যাখ্যা কোরো না প্লিজ।”

— “মনের সৌন্দর্য তোরা কবে দেখবি রে, আরিশ?কবে আরেকজনের মনের কষ্টটা বুঝবি তোরা?”

অনুভব উঠে দাঁড়াতেই সবার দৃষ্টি তার দিকে পড়লো।
সে পা বাড়াতেই পেছন থেকে আরিশের গলা শোনা গেল,
— “কই যাচ্ছ তুমি?”

— “আমি আর এখানে থাকতে পারছি না, আরিশ। বাড়ি ফিরবো।”

আরিশ উঠে এলো, গলায় একরাশ অনুরোধ নিয়ে বলল,
— “না, আমরা ভাবছি আজই সব পাকাপাকি করে ফেলবো। তুমি না থাকলে—আমার এই বিশেষ দিনে, তা কি হয়?”

অনুভব এক ঝটকায় ঘুরে তাকালো। কণ্ঠে ব্যঙ্গ মিশিয়ে শুধালো,
— “এই বাণীগুলো না বললেই ভালো হতো। পাত্রী দেখতে এসে শালিকা যার পছন্দ হয়ে যায়, তার মুখে এমন ‘সত্যি কথা’ শুনে হজমের ওষুধ ঠিক হজম হচ্ছে না।”

— “অনুভব ভাই…”

— “তোর এই তথাকথিত শুভদিনে, আমার উপস্থিতি মুখ দুটোই অশুভ হয়ে উঠুক—এটা আমি চাই না। তোরই খারাপ লাগবে পরে, বুঝে নিস।”

আরিশ থমকে দাঁড়ায়। একটু থেমে কাঁপা গলায় বলল,
— “তুমি এমন বলতে পারলে! তাহলে তুমি আমাকে কোনোদিন ভাই ভাবোনি। শুধু একটা চাচাতো সম্পর্কই মেনে দায়িত্ব পালনে এসেছো তাহলে, তার বাইরে আর কিছু না?”

অনুভব এবার একটু নরম হলো, কিন্তু কণ্ঠে ক্লান্তি ও রাগের দাগ স্পষ্ট,
— “ভেবেছি বলেই তো উঠে যাচ্ছি। কেউ না থাকলে এখনই তোকে দুটো থাপ্পড় দিতাম, জানিস। যাই।”

এই বলে সে ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

উঠানে এসে পৌঁছতেই তার চোখ টানল ছাদের কোণায়।
সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে, একা। চুলগুলো এলোমেলো হাওয়ায় ওড়ে, মুখ অস্পষ্ট হলেও অনুভবের চোখে স্পষ্ট একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে- একটা মেয়ে, যার চোখে ছিল অসম্মান, যার পাশে ছিল না কেউ, আর যার কান্না ছিল শুধুই নিজের জন্য।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে মনে মনে বলল,
“আমার পরিবারের জন্য… তোমাকে হেনস্থার মুখে পড়তে হলো। ক্ষমা করে দিও।”

কিন্তু অনুভব বেশিদূর এগোতে পারলো না। দরজার কাছে পৌঁছাতেই আরিশ এসে পথ আটকে দাঁড়াল। চোখেমুখে কোনো অভিমান,অদৃশ্য অনুরোধ। অনুভব থেমে দাঁড়ালো—কোলেপিঠে করে মানুষ করা সেই ছোটভাইয়ের এমন শুভদিনে এভাবে চুপচাপ চলে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? সে বুঝে গেল, ইচ্ছে না থাকলেও, আজকের এই ঘটনায় সে নিজেও একটুকরো অন্যায়ের অংশ হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে আন্টির ডাকে যখন রিমি নিচে নামলো, তখন তার চোখে এখনও কান্নার দাগ। তবুও সে মুখে একরাশ হাসি এনে নিচে নামলো।
ভেবেছিল, আজ সে ছাদেই থাকবে, নিজেকে আড়ালে রাখবে।
কিন্তু এক সময় মনে হলো, এই আনন্দের দিনে বোনের পাশে না থেকে সে কি করে পারবে?এই সম্পর্কটা শুধুই এক বিয়ের নয়,এটা ভালোবাসার, যত্নের, বন্ধনের।
রিমি নিজেকে বোঝালো-দুঃখ এখন দূরে রাখতে হবে।
আজ যদি ছোটবোনের জায়গায় সে থাকতো, তবে রিমি-ই কি আগলে রাখতো না সবকিছু?
নিজের মনেই সে উত্তর পেল—
হ্যাঁ, অবশ্যই রাখতো। একজন অভিভাবকের মতো, বুক চিতিয়ে পাশে দাঁড়াতো। তাহলে আজ কেন সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে?

এই ভাঙা হৃদয়ের ভেতরের সঙ্গে এক খণ্ড দায়িত্ববোধ মিশে রিমিকে আবারো টেনে আনলো, সবার মাঝে। কারণ কিছু সম্পর্ক কাঁটার মতো নয়, যারা কাঁটা ছুঁয়ে বুঝিয়ে দেয়-ভালোবাসা শুধু নিজের জন্য নয়, কিছু কিছু আপনজনের জন্যও!
অনুভব মাকে নিয়ে একটু আড়ালে সরে এল। ভিড়ভাট্টা, লোকজনের হাসি-ঠাট্টা থেকে দূরে—শুধু মা আর ছেলে।

সে ধীর গলায় বলল,
“মা, এগুলো ঠিক হচ্ছে না।”

আমেনা বেগম একবারে ছেলের চোখের দিকে তাকালেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমি কী করবো বল? ওদের বাবা-মা যদি এমন সিদ্ধান্তে সায় দেয়, আমি কি গিয়ে কিছু বলতে পারি? তাছাড়া আরিশ তো আমার কাছেও নিজের ছেলের মতোই। তোদের মধ্যে কখনো পার্থক্য করিনি। কিন্তু এখন আমি কিছু বললে সেটা উল্টোভাবে নেবে।”

অনুভব নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল। মায়ের বলা কথাগুলো এতটা নির্মমভাবে সত্য।

“কিন্তু জানিস” আমেনা বেগম একটু থেমে যোগ করল,
“ওই বড়ো মেয়েটা না, ভীষণ শান্ত। একটুও উচ্চবাচ্য না করে মেনে নিল সব। তার চেহারাটা… কেমন এক ধরনের মায়া মাখানো! অথচ আমাদেরই লোকজন শুধু রঙ দেখে রায় দিচ্ছে।”

অনুভব হঠাৎ হেসে ফেলল, মায়ের দিকে তাকিয়ে একমুঠো স্নেহ ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার পছন্দ হয়েছে?”

আমেনা বেগম একটু হেসে বলছিলেন, “হ্যাঁ, ভীষণ।”
কিন্তু হঠাৎ থেমে গেলেন, চোখে প্রশ্ন ভেসে উঠলো।
“তুই এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

অনুভব গভীরভাবে মায়ের চোখে চোখ রাখল।
তারপর একটিমাত্র বাক্যে উত্তর দিল—
“আমি বিয়ে করবো।”

আমেনা বেগমের মুখে বিস্ময়ের পর খুশির ঝলক দেখা গেল। অবশেষে, তার ছেলে নিজের ইচ্ছেতে বিয়ের কথা বলছে! কিন্তু পরমুহূর্তেই চোখে ভাঁজ পড়ল চিন্তার, একটু গম্ভীর গলায় বললেন,
“এই কথার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির কী সম্পর্ক? আমি তো কিছুই বুঝলাম না।”

অনুভব মুচকি হেসে মাকে ঠাট্টার সুরে বলল,
“তোমার সাদামাটা মাথায় যেটা আসছে, সেটাই ধরো মা।”

মায়ের চোখে বিস্ময় আরও গাঢ় হয়।
“মানে? মানে… তুই ওই মেয়েটাকে করবি? কিন্তু… এটা তো দেখতে ভালো লাগবে না। ভাইয়ের জন্য যাকে দেখে এলি, পরে তাকেই করবি?”

মায়ের কণ্ঠে স্বাভাবিক দ্বিধা। খুশির মাঝে এক টুকরো সমাজের ভয়।
অনুভব এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
“ওরা যেটা করেছে, সেটার চেয়ে আমি অনেক ভালো কিছুই করছি মা। অন্তত কাউকে হেয় করছি না, কেউ অপমানিত বোধ করবেও না। তোমার বরং আমার উপর গর্ব করা উচিত।”

আমেনা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।
“তোকে নিয়ে আমি সবসময়ই গর্ব করি। কিন্তু একটা কথা বল, তুই কি শুধুই মায়া থেকে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস?”

অনুভব একটু থেমে, স্থির গলায় বলল,
“ভালোবাসার প্রথম ধাপটাই তো মায়া, মা। আমি সেই মায়া থেকেই সংসার শুরু করতে চাই। ধাপে ধাপে ভালোবাসাটাও তৈরি হয়ে যাবে।”

মা ছেলের মুখে এক অপূর্ব স্থিরতা দেখলেন। চোখে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের দীপ্তি নিয়ে বললেন,
“আমি রাজি।”

অনুভব মুচকি হেসে মাথা ঝুঁকাল। তারপর চুপিচুপি তাকাল ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে—রিমির দিকে।
তার এলোমেলো চুলে সন্ধ্যার বাতাস খেলা করছে।
সে নিজের মনে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আই প্রমিস, তুমি অনেক ভালো থাকবে। রত্নের কদর সবাই জানে না, কিন্তু আমি জানি—তোমার বোন যদি হয় সোনা, তবে তুমি তার চেয়ে ১০গুণ এগিয়ে একটা রত্ন। করুণার মাঝেই হোক আমাদের ভালোবাসার সূচনা।”

ভিড়ের মাঝেও সেই মুহূর্তটা নিঃশব্দ, অথচ সবচেয়ে গভীর ছিল,যেখানে সম্মান আর অনুভব মিশে এক আশ্চর্য সাহসে রূপ নিল ভালোবাসা। আর একটা সুন্দর সম্পর্কের সূচনা।

#সমাপ্ত
(এটা এটুকুই থাক। থিমটা দিয়ে কয়েকদিন সময় নিয়ে আবারও আসবে গল্প। এরপর থেকে শুরু হবে পরবর্তী পর্ব, সম্পূর্ণ নতুনরূপে, এটা জাস্ট এমনিতে আগের অংশটুকুই । এটা ছোটগল্প হিসেবে ভেবে নিতে পারেন। আবার পরের গল্পের শুরুর দিকও ভাবতে পারেন।)

আলতো বাঁধন পর্ব-০১

0

#আলতো_বাঁধন
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১

বড়ো বোনকে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ ছোট বোনকে পছন্দের কথা জানাতেই রিমির গাল গড়িয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এটা আজকে নতুন নয়, এ নিয়ে সতেরোবার। সতেরোটি সম্বন্ধ এসেছিল—সব ফিরে গেছে। কারণ একটাই,সে কালো।
“আসলে আমরা ছোট মেয়েটাকেই বেশি পছন্দ করলাম। তাকেই পুত্রবধূ হিসেবে নিয়ে যেতে চাই।”

দ্বিতীয়বার একই শব্দগুলো যেন অদৃশ্য তীর হয়ে বিঁধলো রিমির বুকের গভীরে। রিমি তাকালো না কারো দিকে। মনের গহীন থেকে একটা চাপা নিঃশব্দ শ্বাস বেরিয়ে এলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোঁটা অশ্রু। খুব চেনা এই অনুভূতি। নতুন নয় একটুও।
এইবারের সম্বন্ধটার কাছ থেকেও রিমি বেশি-কিছু আশা করেনি। সে জানতো এমন কিছুই হবে কিন্তু পাত্র ভীষণ ভালো, সরকারি চাকুরীজীবি তাই রিমির বাবার জোর-জবরদস্তির উপর হেরে গিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে এসেছিল। তাও আগেরই মতো ফল পেলো। তবে এবারের ফল একটু ভিন্ন।

রিমি ড্রয়ইং রুমের সবার মাঝখানে থেকে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল, “আমি একটু আসছি।”
তারপর নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
বাড়ির পরিসর ছোট, নিজের ঘরটাও আজ মেহমানদের দখলে। একটুকু নিঃসঙ্গ হবার, একফালি কাঁদার জায়গাটুকুও যেন কেড়ে নিয়েছে ভাগ্য।
ছাদ ছিল রিমির শেষ আশ্রয়। সেই পুরোনো রেলিং আর চেনা আকাশটাই আজ যেন একমাত্র সাক্ষী তার ভাঙাচোরা মনের।
উঠেই এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। প্রথমে ঠোঁট কাঁপলো, তারপর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। পরক্ষণেই এক বুক কান্না চেপে ধরে ডুকরে উঠল—হঠাৎ করেই, বিনা শব্দে, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা ব্যথাটা নিজেই মুখ খুঁজে নিয়েছে।
আজ তো তার কাঁদার কথা ছিল না। আজকের দিনটা যে বাবা খুব আশা নিয়ে শুরু করেছিলেন।
যখন বাবার মুখে শুনেছিল,
“ছেলেটা খুব ভালো রে রিমি, সরকারি চাকরি করে। এইবার হয়তো তোর ভাগ্য ফিরবে।”
বাবা যখন খুশি খুশি মনে সম্বন্ধটা রিমির সামনে এসে বলেছিল তখন বাবার উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে সে না বলতে পারলো না। শেষবারের মতো আবারো অপমান হবে জেনেও সম্বন্ধের সামনে যেতে রাজি হয়েছিল।
নিচের ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে আসছে প্রাণখোলা হাসির শব্দ। শব্দগুলো যেন রিমির বুকের গভীরে ঢুকে বিষ ছড়াচ্ছে। হাসির সাথে তাল মিলিয়ে যেন তার কান্নার বেগও বাড়ছে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে।
সে তো এসব দৃশ্যের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই।
তবুও আজ কেন এমন কান্না পাচ্ছে তার?
কেন এই অজানা ভার বুকের ওপরে চেপে বসেছে?

——-

ছাদের এক কোণে, ধরা ছোঁয়ার বাইরের একান্ত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল অনুভব। হাতে ধরা সিগারেটটার ধোয়ার আবরণে নিজেকে আড়াল করে নিচ্ছে সে।
এইসব পাত্রপক্ষের আনাগোনা, মেয়ে দেখা, পছন্দ অপছন্দ—সবই অনুভবের চোখে বড্ড নিচু মানসিকতার পরিচয়। তার কাছে এসব কিছুই একরকম পণ্য বাছাইয়ের মতো মনে হয়—যেখানে মেয়ের মুখের হাসি, চোখের জলের কোনো দাম থাকে না।
সবাই মিলে একসাথে হুট করে হাজির হয়ে মেয়ের পরিবারকে অস্বস্তিতে ফেলা, তাকে যেন অপমানিত করে ফেলে ভেতর থেকে। সে জানে,আজ সে নিজেও সেই একই অন্যায়ের অংশ।
সে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো চারপাশে। এই বাড়িতে পা রাখার পর থেকেই তাদের উদ্দেশ্যে করা এতসব আয়োজন দেখে অস্বস্তিতে ভুগছে সে। তাই তো আসার সাথে সাথে নিজেকে জায়গা দিতে সোজা ছাদে চলে এসেছে।
এইসব লোকজন, আত্মীয়স্বজনের ঠেলাঠেলি, বাহারি পোশাকে হাসিমুখে সাজানো মেয়ে দেখা,সবই তার কাছে বিরক্তির এক প্রবল উৎস। তবুও আজ কেন যেন নিজেকে মানানো যায়নি। হয়ত অভিমানে ছোট ভাইয়ের অভিমানে মোড়ানো কথাটার জন্যই আর না করতে পারেনি সে।
“তুমি না গেলে আমার দিনটাই মাটি হয়ে যাবে ভাই!”
—সেই কণ্ঠের আবদার ফেলতে পারেনি অনুভব। যায় হোক না কেন,সে বুঝতে পারছে—আজ তার আসাটা ছিল একটা ভুল। একেবারে চরম ভুল।

——-

রিমি নিজেকে থামাতে চাইল। বারবার আপনমনেই আওড়ালো,এই কান্না অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন।
কিন্তু কান্না থামে না, বরং আরও বেশি তীব্র হয়ে ফিরে আসে যেন। হঠাৎই মনে হলো—এই কান্নার পেছনে কি অন্য কোনো কারণ লুকিয়ে আছে? নাহয়, এরূপ পরিস্থিতিতে তো সে অভ্যস্ত ছিল! তবু কেন আজ ব্যতিক্রম হচ্ছে!
পাত্র তো এসেছিল তাকে দেখতে… এখন সে হয়তো ছোটবোনের সঙ্গে বিয়ের কথা বলছে। তার জন্যই কি কান্নার বেগ বাড়ছে! এই ভেবেই তার বুকটা ধক করে উঠল।
তাহলে কি সে… সে তার ছোটবোনকে হিংসা করছে?
ভাবনাটা মাথায় আসতেই রিমি চমকে উঠল। আপন বোন! যার জন্য সবসময় নিজের চেয়ে ভালো কিছু চেয়েছে–তার প্রতি এমন ভাবনা!
নিজেকেই ধিক্কার দিল সে।
“ছি রিমি! এ কী ভাবছিস তুই!”
নিজেকে বুঝ দিতে চাইল—ছোটবোন তো রূপে, গুণে, আচরণে তার চেয়ে অনেক এগিয়ে। ওর এমন একটা পরিবারে বিয়ে হওয়া মানেই তো স্বপ্নপূরণ। এই তো, রিমি সবসময় চেয়েছিল ছোটবোনটা যেন ভালো ঘরে যায়, সুখী হয়।
বাবার আনা শখের প্রস্তাবটা তাকে দিয়ে পূরণ নাহলেও তার রূপবতী ছোট আদরের বোনকে দিয়ে পূরণ হচ্ছে, এই তো সুখ! নিজের এই দ্বন্দ্বময় ভাবনার মাঝে এই ভেবে একটুখানি প্রশান্তির আশ্রয় খুঁজে পায় রিমি।
ড্রয়ইং রুম থেকে আরো একবার হাসির আওয়াজ এলো।হয়ত-বা মা ছোট বোনের সাথে বিয়ের কথা পাকা-পোক্ত করে ফেলেছে। আর করবে না বা কেন! এতো ভালো একটা পরিবার, ছেলে- মেয়ের বিয়ের জন্য সাধারণত সবাই এমনই তো পরিবার খুঁজে। তবু খারাপ লাগলো এই ভেবে যে,রিমি ওখান থেকে চলে আসাতে কারো কিছু যাই আসেনি। তবু সে এতসবের মাঝে ছোটবোনের ভালো ঘরে বিয়ের কথা হওয়াতে প্রশান্তি খুঁজে নিল।

——

অনুভব সিগারেট শেষ করে শেষ অংশটা পা দিয়ে পিষে ফেলল। এই জিনিসটা সে নিজের উপর ক্ষোভ হলে খায়।হাতেগুনা একদম। যদিও পরিবারের কেউ তার এই বিষয়টা জানে না।
অনুভব আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো। ছাদটা ছোট হলেও পরিপাটি। বাঁদিকে টিনের কিনারে সারি দিয়ে রাখা কয়েকটা ফুলের টব—মালতী, জবা, আর এক কোণে একটা অচেনা গাছ। কার হাতের ছোঁয়ায় এত যত্নে গড়া এই সবুজের সারি?
অনুভবের চোখে ভেসে উঠলো এক অদেখা মায়া-মাখা মুখ। যে করেছে সে নিশ্চই খুব যত্ন করে গাছগুলোকে। যে গাছকে যত্ন করে, সে নিশ্চই ভালো মনের। অনুভবের ইচ্ছে আছে, তার খোলামেলা বারান্দায় একদিন কেউ একজন এসে এভাবে গাছ দিয়ে সতেজ বাতাস করে দিবে। পরমুহূর্তে নিজের ভাবনার অদ্ভুততায় আবারও মুচকি হেসে নিল অনুভব। কাজ না থাকলে যা হয়! এখন কোনো কাজ নেই তাই গাছগুলোর পেছনের মালকিনের কথাও তার মাথায় আসছে।

সিগারেটের প্যাকেটটা পকেটে গুঁজে ঘুরে দাঁড়ালো অনুভব। নেমে যাবার জন্য পা বাড়িয়েই ছিল, ঠিক তখনই এক টানা হেঁচকির শব্দ তার কানে এলো। অস্পষ্ট, ভাঙা ভাঙা কান্নার মতো—যেমনটা হয় অনেকক্ষণ ধরে কেউ নিজেকে চেপে ধরে রাখার পর হঠাৎ ভেঙে পড়লে।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখে পড়লো—ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। এলোমেলো শাড়ির আঁচল বাতাসে ওড়ছে, মুখটা আড়ালে, কিন্তু কাঁধের কাঁপনে কান্না লুকানো যাচ্ছে না।
অনুভব থমকে গেল। ছাদে ওঠার সময় তো এমন কাউকে দেখেনি সে। হয়ত তখন মেয়েটি দেয়ালের পাশে বসে ছিল, অথবা সেও তার মতোই ভিড় এড়িয়ে এক কোণে গা ঢাকা দিয়েছিল।
এক পা এগিয়ে আবার থেমে গেল অনুভব। আপনমনেই বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“কেন যাব আমি? ওর কান্না থামানোর দায়িত্ব তো আমার না। যার মন চাই কাঁদুক, মরুক—আমার কী!”

অন্য কেউ হলে হয়তো দৌড়ে গিয়ে বলত,
“কাঁদছেন কেন আপনি?”
কিংবা পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ একটা সান্ত্বনার হাত রাখত কাঁধে। কিন্তু অনুভব দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠল,
“ওর কান্নার পেছনের কারণ জানার দরকার তো আমার নেই।”
তার এই নিষ্ঠুর প্রশ্নটাই হয়ত তার পরিবারকে বারবার বলে উঠতে বাধ্য করে—
“তুই একটা পাথর।”

সে জানে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা এই কাঁদতে থাকা মেয়েটির কান্না আজ হয়ত কাউকে স্পর্শ করছে না। নয়তো নিচ থেকে এমন হাসির আওয়াজ ভেসে আসতো না। পাষান হৃদয়ের অনুভব চলে আসতে নিলেও থেমে গেল। একটা ক্ষীণ অনুভব তাকে ছুঁয়ে গেল—সে পিছু ফিরে আরেকবার তাকালো। তবুও সে এগিয়ে গেল না। কোনো প্রশ্ন না করে, কোনো উত্তর না খুঁজে অনুভব সামনে ফিরে সিঁড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।
পায়ের ধাপে ধাপে তার ভেতরে যেন একটা অচেনা অপরাধবোধ জমে উঠলো, তবুও মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ানোর মতো মন গললো না তার। এভাবে ছাদে কেউ অসহায়ের মতো কাঁদল, আর অনুভব শুধু দূর থেকে দেখে ফিরে গেল—নিজের মতো করেই, নির্লিপ্ত, নিঃসঙ্গ, আর একফোঁটা হালকা হাওয়া হয়ে।

চলবে।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-২১ এবং শেষ পর্ব

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২১.
মৃত্তিকাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছেন সাজেদা বেগম আর মৃদুলা। প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে তার‌। মৃন্ময়ীকে কল করে খবর দিয়েছেন। প্রভাত আর মৃন্ময়ী তাদের কল পাওয়ামাত্র রেডি হয়ে হসপিটালে ছুটে এসেছে। বেচারি মৃত্তিকার অবস্থা শোচনীয়। গতকাল পর্যন্ত-ও সে নরমাল ডেলিভারির আশায় ছিল। ডক্টর-ও তাকে তেমন আশ্বাস-ই দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তার অবস্থা থেকে ডক্টর-ই বললেন আজকের মধ্যে সিজারিয়ান ডেলিভারি করতে হবে। নয়তো বাচ্চার ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এ কথা শুনে মৃত্তিকার মাথায় যেন বাজ পড়ল। ডেলিভারির জন্য সে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তা সিজারিয়ান ডেলিভারির জন্য যথেষ্ট নয়। সাজেদা বেগম এবং মৃত্তিকার জন্য তো এত টাকা দেওয়া অসম্ভব। একমাত্র ভরসা তাদের মৃন্ময়ীর মুখেই। মা যখন ভরসার চোখ দুটো তার দিকে তুলে ধরল, মৃন্ময়ী অন্ধকার মুখে বলল,
“আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তা দিলেও তো হবে না মা।”
সাজেদা বেগম দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ে বললেন,
“এত করেও শেষমেশ এসে বাচ্চাটাকে আমরা হারাব?”
মৃদুলা বলল,
“এসব বোলো না মা। আপু, কিছু একটা উপায় খুঁজে বের করা যায় না?”
মৃন্ময়ী ভাবুক মুখে বলল,
“তা তো করতেই হবে।”
“আমাদের কাছে যা টাকা আছে, তা একসঙ্গে করে রাখি। বাকি টাকাটা কারো কাছ থেকে ধার নেওয়া গেলে ভালো হয়। পরে না হয় আমরা সবাই মিলে শোধ করে দিবো।”
“আমি দেখছি কী করা যায়। তোরা চিন্তা করিস না।”

মৃন্ময়ী কেবিনের বাইরে সরে গিয়ে দ্রুত ভাবতে শুরু করল কার-কার কাছ থেকে টাকা চাওয়া যায়। আগে বিপদে পড়লে অনেকের কাছেই টাকা চাওয়া যেত। এখন তা সবাই সহজভাবে দেখবে না। বরং তার স্বামী থাকতে অন্যদের কাছে টাকা ধার চাওয়ার বিষয়টা নির্ঘাত সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মৃন্ময়ী বেছে-বেছে বিশ্বাসযোগ্য দু-এক জন মানুষকে কল করার সিদ্ধান্ত নিতেই তার সামনে প্রভাত উপস্থিত হলো। প্রভাত তার চিন্তাগ্রস্থ মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে প্রশ্ন করল,
“তোমাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর তুমি এখানে কী করছো?”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার একটা কল করতে হবে। তুমি ভেতরে যাও, আমি আসছি।”
“আমি ভেতর থেকেই এসেছি। ডক্টরের সাথে কথা বললাম। সিজারিয়ান ডেলিভারি ছাড়া উপায় নেই। আমি বলেছি যেটা ভালো হয়, সেটাই করতে। মৃত্তিকা আর বাচ্চা সুস্থ থাকলেই হয়। আমরা সিদ্ধান্ত জানালেই ওনারা ডেলিভারির টাইম জানিয়ে দিবেন। টাকা-পয়সার কথা-ও আমি জেনে এসেছি। তাড়াতাড়ি চলো।”
“তুমি যাও, আমি আসছি।”
“কেন? কাকে কল করবে তুমি?”
“করব একজনকে।”
“কোনো সমস্যা?”
“না।”
প্রভাত চলে যেতে গিয়েও আবার থেমে গেল। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি টাকা নিয়ে চিন্তিত?”
মৃন্ময়ী বলল,
“হ্যাঁ, একটু চিন্তা তো হচ্ছেই।”
“কেন?”
“আমার আর মৃদুলার কাছে দিয়ে দিয়েছি। আরও কিছু টাকা লাগবে।”
“আচ্ছা, বাকি টাকা কার কাছে চাইলে?”
“চাইনি এখনও। জোগাড় হয়ে যাবে। তুমি ওদের কাছে যাও।”
প্রভাত কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে মৃন্ময়ীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। মৃন্ময়ী শুধাল,
“কী? তাকিয়ে আছো কেন?”
“তুমি কি আদৌ আমাকে নিজের পরিবার ভাবতে পেরেছ মৃন্ময়ী?”
“এ আবার কেমন কথা?”
“আমাকে সামনে রেখে তুমি অন্য মানুষের কাছে টাকা ধার চাওয়া ধরেছে, এটা কেমন কথা?”
“ব্যাপারটা তেমন নয়। আমি-”
তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রভাত বলল,
“যেমন ব্যাপার-ই হোক। কারোর কাছ থেকে টাকা ধার চাইবে না। চলো।”
“আরে আমার কথা তো শোনো।”
“কথা বাড়ি ফিরে শুনব।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। তাকে কেবিনের সামনে পৌঁছে দিয়ে সে শুধু বলল,
“মৃদুলাকে নিয়ে গিয়ে ডক্টরের সাথে কথা বলো। আমি টাকা তুলে নিয়ে আসছি।”

কথাটা বলেই সে প্রস্থান করল। মৃন্ময়ীকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। মৃদুলা এগিয়ে এসে বলল,
“ভাইয়া কি রাগ করেছে?”
“অন্য মানুষের কাছে টাকা ধার চাওয়ার কথা শুনে অসন্তুষ্ট হয়েছে।”
“এখন কোথায় গেল?”
“টাকা তুলতে।”
“ভাইয়াকে না বলে আগেই টাকা ধার চাওয়া উচিত হয়নি। কথাটা তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল আমার।”
“টাকা চাইনি। ও যেমনটা ভাবছে, আমি তো তা ভেবে টাকা ধার করার কথা ভাবিনি। ও তো কম করে না আমার পরিবার নিয়ে। তবু বারবার আমি ওর টাকা নিই কী করে বল? কিছু টাকা ধার করলে কি আমি পরে শোধ করে দিতে পারতাম না? ওর জন্যই তো এখন আমার আগের মতো টানাপোড়েন নেই। ওকে তা কে বুঝাতে?”
মৃদুলা বলল,
“বুঝাতে হবে না। তোমার থেকে ভাইয়া ভালোই বোঝে। তুমি তাকে অসন্তুষ্ট কোরো না আর।”

মৃত্তিকার ডেলিভারির পুরো টাকাটাই শেষে প্রভাত দিয়েছে। রাত দুইটায় মৃত্তিকা একজন কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে। তারা দুজনেই সুস্থ আছে। প্রভাত আর মৃন্ময়ী রাতে হসপিটালেই থেকে গেছে। রাতের খাবার রাহেলা বেগম রান্না করে প্রভাতের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সকালে মৃত্তিকাকে অপারেশন রুম থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। সকালের খাবারটা-ও প্রভাত বাইরে থেকে কিনে নিয়ে এসেছে। প্রভাত যখন মৃত্তিকাকে দেখতে গেল, সে তখন দুচোখে টলমল জল নিয়ে প্রভাতের দিকে তাকাল। কন্ঠে কৃতজ্ঞতা মেখে বলল,
“আপনার কাছে আমি ঋণী থাকব ভাইয়া। আপনি না থাকলে এই বিপদের দিনে আমার বোনদের না জানি কত ভোগান্তি পোহাতে হত। আমি সুস্থ হয়ে চাকরি কনটিনিউ করার পর আমি আপনার পাওনা শোধ করে দিবো। আপনার এই উপকার আমি আজীবন মনে রাখব।”
প্রভাত বলল,
“এসব বলে আমাকে পর করে দিয়ো না মৃত্তিকা। আমি বলেছি না তোমরা যেমন মৃন্ময়ীর পরিবার, তেমনি আমার-ও পরিবার? ওর পরিবারের গুরুত্ব আমার কাছে কোনো অংশে কম নয়। আমাকে পরিবারের একজন ভাবলে ঋণ শব্দটা আর কখনও মুখে আনবে না। আপনজনদের কাছে আবার ঋণ কিসের? তোমার বাচ্চা-ও এখন থেকে আমাদের পরিবার। তুমি নিজেই যদি আমাকে পরিবার না ভাবো, তোমার বাচ্চা ভাববে কীভাবে?”
মৃত্তিকা বলল,
“না-না ভাইয়া। আমরা কখনোই আপনাকে পর ভাবি না। আপনি সবসময় আমাদের পরিবার হয়ে পাশে থেকেছেন। আমার বাচ্চার তো ভাগ্য ভালো যে ও আপনার মতো পরিবার পেয়েছে।”
পাশ থেকে মৃদুলা বলল,
“আমাকে খালামনি হিসেবে পাওয়া-ও তোমার বাচ্চার সৌভাগ্য, হুহ্!”
মৃত্তিকা হেসে বলল,
“তা দেখব খালামনি কেমন যত্ন করে।”
“দেখো, দেখো। বাড়ি চলো, তারপর তোমাকেই আমি শেখাব কীভাবে বাচ্চার যত্ন নিতে হয়।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“যাক, তাহলে তো বাচ্চা নিয়ে আমার আর কোনো চিন্তা নেই।”

মৃন্ময়ীর স্কুলে যেতে হবে বলে, প্রভাতের সঙ্গেই তাকে ফিরে যেতে হলো। তার অবশ্য চিন্তা হচ্ছিল মা-বোনদের নিয়ে। মৃদুলা আর মা বলল তাদের সমস্যা হবে না। মৃন্ময়ী যেন ক্লাস শেষ করে আসে। প্রভাত মৃন্ময়ীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই অফিসে চলে যাবে। বাইকে বসে প্রভাতকে চুপচাপ দেখে মৃন্ময়ী নরম গলায় প্রশ্ন করল,
“এই, তুমি কি আমার সাথে রেগে আছো?”
প্রভাত ছোটো করে জবাব দিলো,
“উঁহু।”
“মিথ্যা বলছো।”
“মিথ্যা বলব কেন?”
“তুমি টাকার বিষয়টা নিয়ে আমার সাথে রেগে আছো। তাই না?”
“তুমি ভালো করেই জানো আমি তোমার সাথে রাগ করি না।”
“তাহলে কি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছ?”
“বাদ দাও, যা গেছে তো গেছে।”
মৃন্ময়ী বাদ দিলো না। প্রভাতের পেটের কাছের শার্টটা আরও একটু চেপে ধরে বলল,
“সরি গো। আমি বুঝতে পারিনি তুমি এত অসন্তুষ্ট হবে। আসলে আমি ব্যাপারটা তেমনভাবে ভাবিনি।”
“তাহলে কেমনভাবে ভেবেছিলে?”
“আমি ভেবেছিলাম তুমি তো এইমাসে অলরেডি অনেক খরচ করে ফেলেছ। এটা যদি আমি সামলাতে পারি।”
“সব খরচ আর এক না। তুমি নিজে ব্যাপারটা সামলাতে চেয়েছ, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি তা করতেই পারো। কিন্তু অন্য কারো থেকে টাকা ধার নিয়ে কেন? ধার মানুষ কখন নেয়? যখন নিজেদের হাতে কোনো উপায় না থাকে। তোমার তো আমি ছিলাম। আমি তোমার নিজের মানুষ না। তুমি নিজের মানুষ রেখে অন্যদের কাছে কেন সাহায্য চাইবে?”
মৃন্ময়ী চুপ হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে সে সত্যিই ভুল করে ফেলেছে। প্রভাত পুনরায় বলল,
“ভবিষ্যতে আর এমনটা কোরো না মৃন্ময়ী। তোমার যখন সবচেয়ে বেশি সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, তখন আমি অধিকারের অভাবে যখন-তখন তোমার পাশে দাঁড়াতে পারিনি। এখনও যদি তুমি আমাকে সুযোগ না দাও, আমি সত্যিই ভীষণ কষ্ট পাব। তোমাকে সাহায্য করতে না পারার মতো বড়ো ব্যর্থতা আমার জীবনে দ্বিতীয়টি নেই।”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“আর করব না, প্রমিস। প্লিজ তুমি আমার সাথে রাগ কোরো না।”
প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“রাগ করিনি। তুমি চা খাবে?”
“না, এখন চা খেলে দুজনেরই দেরী হয়ে যাবে।”


টিউশন থেকে ফিরেই মৃদুলা ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিয়েছে। মৃত্তিকা চেঁচিয়ে ডেকে বলছে,
“হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়। তোর জন্য আমিও না খেয়ে বসে আছি। বাবু জেগে গেলে খেতে পারব না।”
মৃদুলা দুর্বল কন্ঠে উত্তর দিলো,
“আমার অনেক ক্লান্ত লাগছে আপু। একটু জিরিয়ে নিই। তোমার বেশি ক্ষুধা পেলে খেয়ে নাও।”
“তাহলে আমি এতক্ষণ তোর জন্য বসে ছিলাম কেন? তোর বিশ্রাম শেষ হলে ডাকিস আমাকে।”
“আচ্ছা।”
ফোনটা হাতে নিয়ে মৃদুলা ফেসবুকে ঢুকল। মৃত্তিকার মেয়ের সঙ্গে আজ সে দারুণ কিছু ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। এখন নিউজফিডে ঢুকেই দেখল অনেক রিয়্যাক্ট, কমেন্ট পড়েছে। নোটিফিকেশন চেক করতেই মৃদুলা চমকে উঠে বসে পড়ল। তার পোস্টে জাহিদের রিয়্যাক্ট! কী করে? চলে যাওয়ার পর জাহিদ তো আর এই আইডিতে অ্যাক্টিভ হয়নি। পরক্ষণেই সে খেয়াল করল জাহিদ তাকে ম্যাসেজ-ও দিয়েছে। অবিশ্বাস্য লাগল মৃদুলার। কাঁপা হাতে সে ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে দেখল অনেক বড়ো ম্যাসেজ। জাহিদ লিখেছে,
“কেমন আছো মৃদুলা? আমি খুব আশা করি তুমি ভালো থাকো। জানি আমি তোমাকে কেমন আঘাত করেছি। তবু আমি আশা রাখি তুমি ভালো থাকো। এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করার সাধ্য যে আমার নেই। এখানে আসার পর তোমার একটু খোঁজ নেওয়ার জন্য আমি প্রভাত ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ভাই বোধহয় আমার সাথে যোগাযোগ করতে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে কিছু সময়ের জন্য এই আইডি অ্যাক্টিভ করলাম। তুমি হয়তো ভেবেছ আমি তোমার সঙ্গে চিট করেছি। সে তুমি ভাবতেই পারো। সত্যিই তো, আমি তোমার বিশ্বাস রাখতে পারিনি, তোয়ায় ঠকিয়েছি। কিন্তু জানো, আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম মাকে মানানোর। জীবনে প্রথমবার আমি তোমার জন্য মায়ের হাত-পা ধরে অনুরোধ করেছিলাম। তবু আমি ব্যর্থ হয়েছি। মৃদুলা, তোমাকে ভালোবাসার দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি। আর তোমাকে হারানো আমার জীবনের সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা। অমি জানি না এই তিক্ততা কাটিয়ে উঠতে আমার ঠিক কত যুগ লাগবে। তবু বলব, তুমি আমাকে ভুলে যেয়ো। আমি তোমার স্মৃতিতে বাঁচার যোগ্যতা রাখি না। আমি চাই তুমি আমাকে ঘৃণা করো। আমাকে ঘৃণা করে হলেও তুমি আবার প্রেমে পড়ো। জীবনে একজন সঠিক মানুষকে বেছে নিয়ো যে কোনোদিন তোমার বিশ্বাস ভাঙবে না। মাঝপথে তোমার হাত ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাবে না। তার সঙ্গে তুমি খুশি থেকো। তোমার ওই চাঁদমুখে দুঃখ শোভা পায় না। তোমার প্রাপ্য একটি সুন্দর, সুখী জীবন। আমার হয়তো আর কোনোদিন দেশে ফেরা হবে না। ফিরলেও হয়তো আর তোমার মুখোমুখি হব না। তাই আর তোমাকে মিছে সান্ত্বনা দিতে চাই না। তোমাকে এই ম্যাসেজের উত্তর দিতে হবে না। আমি এই আইডি নষ্ট না করলেও আজকের পর আর এটা আমার কাজে আসবে না। যদি কোনোদিন সম্ভব হয়, এই অপরাধীকে ক্ষমা কোরো। সবসময় ভালো থেকো মৃদুলা।”

আশপাশে কেউ না থাকলে এই মুহূর্তে হয়তো মৃদুলা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদত। কিন্তু তার ম্যাসেজ পড়া শেষ হওয়ার আগেই মৃত্তিকা আবারও তাকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছে। মৃদুলার আর কাঁদা হলো না। বুকের ভেতর জমাট বাঁধা কষ্টগুলো উগড়ে ফেলা হলো না। একবার ভাবল খেতে যাবে না। মৃত্তিকা এতক্ষণ পর্যন্ত না খেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করেছে ভেবে আবার না-ও করতে পারল না। গলাভর্তি কান্না গিলে নিয়ে সে ভাত খেতে গেল। পেট পুরে ভাত খাওয়ার পর না হয় সে কাঁদবে। সারারাত কাঁদবে। এতগুলো দিন যত কান্না সে জমিয়ে রেখেছে, আজ সমস্ত কান্নাকে সে একেবারে মুক্তি দিয়ে দিবে। আজকের পর যে তাকে নতুনভাবে বাঁচতে হবে। নতুন মানুষের জন্য হৃদয়ে নতুন জায়গা তৈরি করতে হবে। এমনটাই তো হওয়ার ছিল।


বারান্দায় কিছু ফুলগাছ লাগিয়েছে মৃন্ময়ী। গাছগুলো অবশ্য প্রভাত এনে দিয়েছে। হঠাৎ করে তার খুব ফুলগাছের শখ হয়েছিল। প্রভাতকে বলার পরদিনই সে কিছু চারাগাছ নিয়ে হাজির হয়েছে। সেগুলো টবে লাগাতে-ও মৃন্ময়ীকে সাহায্য করেছে। মৃন্ময়ী রোজ দুবেলা করে গাছের যত্ন নেয়। সকালে নামাজ আদায় করার পর একবার, বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আরেকবার। রাতেও সে বারান্দায় বসে ফুলগাছ দেখে আর তাদের বড়ো হওয়ার অপেক্ষা করে। সে মনে-মনে কল্পনা করে গাছগুলো বড়ো হয়ে ফুল দেওয়ার পর তার বারান্দাটা কেমন দেখাবে। বারান্দা জুড়ে নানান রঙের ফুলে অবশ্যই সুন্দর দেখাবে। আচ্ছা, মৃত্তিকার মতো তার কোল জুড়ে-ও যদি ফুলের মতো একটা ফুটফুটে বাচ্চা আসে, সে-ও নিশ্চয়ই তার ঘর সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিবে? ইদানীং প্রভাত খুব বাচ্চাদের গল্প করছে। মৃত্তিকার বাচ্চাকে যতবার দেখে আসছে, ততবারই বাড়ি ফিরে মৃন্ময়ীকে বলছে তার ঘরে আরও একজন সদস্য দরকার। মৃন্ময়ী নিজেও এখন বিষয়টা নিয়ে ভাবছে। এখন তার চাকরি-বাকরির ঝামেলা মিটে গেছে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে সে। চাকরিটা পাওয়ার পর আগের স্কুল, কোচিং দুটোই ছেড়ে দিয়েছে। টাকা-পয়সা নিয়েও তার দুশ্চিন্তা নেই। প্রভাত তার বেতন নিয়ে মাথা ঘামায় না। নিজের ইচ্ছামতো সে খরচ করে। মায়ের ঔষধের খরচ প্রভাত যেচে নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে। এখন তার পরিবারে প্রয়োজনীয় খরচ দেওয়ার পরও তার হাতে টাকা অবশিষ্ট থাকে। মৃত্তিকার খরচ সে নিজেই চালাতে পারে। আর তার বাচ্চা তো বড়ো হচ্ছে সবার দায়িত্ব। প্রথমদিকে মৃত্তিকা নিজেও ভাবতে পারেনি তার বাচ্চা এতগুলো মানুষের পরিবার হয়ে উঠবে। তারা তাকে পরিবারের অভাব টেরই পেতে দেয় না। মৃন্ময়ীর চিন্তা এখন শুধু মৃদুলার জন্য। মেয়েটা পড়াশোনা শেষ না করা পর্যন্ত তার দিকটা মৃন্ময়ীকেই দেখতে হবে।

“কী আকাশ-কুসুম ভাবছেন ম্যাডাম?”
প্রভাতের ডাকে মৃন্ময়ীর ভাবনায় ছেদ পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল,
“কিছু না।”
“অবশ্যই কিছু ভাবছিলে। নয়তো আমার উপস্থিতি টের পেলে না কেন?”
“কতকিছুই ভাবছিলাম।”
“তা ম্যাডামের ভাবনায় কি এই অধমের ঠাঁই হয়েছিল?” মৃন্ময়ীকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে শুধাল প্রভাত।
মৃন্ময়ী ওপর-নিচে মাথা দুলিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
“হুমমম।”
“কী ভাবা হচ্ছিল আমাকে নিয়ে?”
“ভাবছিলাম কোন ভালো কাজের উপহারস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা আমার পোড়া কপালে একজনকে লিখে দিয়েছিলেন।”
প্রভাত কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“পোড়া কপালে?”
মৃন্ময়ী মৃদু হেসে দুহাতে প্রভাতের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“একজন মলম লাগিয়ে সারিয়ে নিয়েছে।”
প্রভাত নিচু স্বরে বলল,
“কেউ কি আমার প্রশংসা করছে।”
“তোমার প্রশংসা কে করছে? আমি তো আমার বরের কথা বলছি।”
“ওওও…আপনার বর আপনাকে এত ভালোবাসে?”
“অবশ্যই।”
“বাহ্! ভীষণ গর্বিত দেখছি। তা আপনি আপনার বরকে কতটুকু ভালোবাসেন?”
“তার মতো করে হয়তো ভালোবাসতে পারি না। তবে অনেক ভালোবাসি।”
“অনেক?”
“হ্যাঁ, অনেক।”
“তাহলে তো আপনার বরকে ভাগ্যবান বলা যায়।”
“উঁহু, ভাগ্যবতী তো আমি। তাকে জীবনে না পেলে হয়তো আমি একজন প্রকৃত প্রেমিককে হারাতাম। ভেতর থেকে কোনোদিন অনুভব করতে পারতাম না পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ আছে যার কাছে আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমার দুঃখে সে দুঃখ পায়, আমার আনন্দে সে আনন্দিত হয়। সে আমার জীবনের জাদুকর। সে নিজেও জানে না আমার টানাহেঁচড়ার জীবনটাকে সে কতটা বদলে দিয়েছে। আমাকে সে আগাগোড়া সুখী মানুষ বানিয়ে দিয়েছে।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“এই সুখ তোমার পাওনা ছিল ম্যাডাম। আর তোমাকে বিয়ে না করলে আমার ভাগ্য বদলাত কী করে? এদিক থেকে আমি নিজেই তো ভাগ্যবান। তুমি আমায় সংসারের মায়ায় না বাঁধলে হয়তো আজীবনই আমি ভবঘুরে, বেপরোয়া প্রভাত তরফদার থেকে যেতাম। নয়তো কেউ কি কোনোদিন ভেবেছিল আমার মতো মানুষ একদিন বাধ্য স্বামীতে পরিণত হবে?”
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে বলল,
“তুমি বাধ্য স্বামী?”
“অবশ্যই। তোমার তাতে কোনো সন্দেহ আছে?”
“না-না, তুমি তো খুব বাধ্য স্বামী। আমার কথায় ওঠো, বসো, খাও, ঘুমাও, সব করো। একদম বউভক্ত স্বামী।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“আমি যে খাস বউভক্ত, তাতে অন্তত তোমার সন্দেহ থাকা উচিত নয়। নয়তো আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না কেন?”
মৃন্ময়ী প্রভাতের বাহুতে চিমটি কে’টে বলল,
“তুমি তো এক নির্লজ্জ, একটাদিন-ও তোমার জন্য শান্তিতে বাবার বাড়ি থাকতে পারি না। ঢেংঢেং করে পেছন-পেছন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে হাজির হও।”
“আমি আজীবন এমন নির্লজ্জ-ই থাকতে চাই। আমার বউকে আমি ছাড়ব কেন? এমনিতেই জীবনের কতগুলো সময় নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি আমায় পাত্তা না দিয়ে আরও সময় নষ্ট করেছ। আমার অবশ্যই উচিত জীবনের বাকি সময়ের পুরোটা তোমার সঙ্গে কা’টানো। এতেও কি তোমার আপত্তি আছে?”
“আমার আপত্তি থাকলে কি তুমি আমার কথা শুনবে?”
“অবশ্যই না। এমন আপত্তি আমি মোটেও অ্যালাউ করব না। তুমি আমার বউ, সবসময় আমার কাছাকাছি থাকবে। এতে আমাদের ভালোবাসা আরও-আরও-আরও বাড়বে। এতে তোমার আপত্তি থাকা কি উচিত?”
মৃন্ময়ী দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“একদমই না।”
প্রভাত তার নাক টিপে দিয়ে বলল,
“এইতো আমার লক্ষ্মী বউ বুঝতে পেরেছে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ফাজিল একটা। সরো, আমার ঘুম পাচ্ছে।”
প্রভাত তাকে আটকে রেখে আদুরে গলায় বলল,
“শোনো না।”
“শুনছিই তো, বলো।”
“মৃত্তিকার বাবুটা আজ কী করেছে জানো? আমি গিয়ে কোলে নেওয়ার পর একহাতে আমার শার্ট মুঠোয় শক্ত করে যে ধরেছিল, মৃত্তিকা-ও ছাড়াতে পারছিল না। আমার যে কী ভালো লাগছিল তখন!”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“আদর পেয়ে-পেয়ে ও নিশ্চয়ই তোমাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে।”
“হুম। এই, আমাদের-ও ওর মতো একটা বাবু থাকলে অমন কিউট-কিউট আচরণ করবে, তাই না?”
“সব বাচ্চারাই অমন কিউট আচরণ করে।”
“সব বাচ্চাদেরটা তো আমরা সবসময় দেখতে পারি না। ঘরে থাকলে তো চব্বিশ ঘন্টা দেখতে পারব, আদর করতে পারব।”
“সে-ই, কথার মাঝে একশোটা প্যাঁচ না দিয়ে সোজাসুজি বললেই হয়।”
“আমি তো সবসময় বলি, তুমিই তো এখনও পরিষ্কারভাবে কিছু বলছো না।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা, তোমার ছেলে চাই, না মেয়ে চাই?”
“আল্লাহ্ যা দিবে তাতেই আলহামদুলিল্লাহ্। আল্লাহর পরিকল্পনার চেয়ে তো আমার চাওয়া বড়ো না।”
“ভেরি গুড। তাহলে তোমার ছেলে-মেয়ের নাম খোঁজা শুরু করো।”
প্রভাত চোখ দুটো গোলাকার করে বলে উঠল,
“সত্যি?”
“হুম।”
“তুমি সিরিয়াস?”
“অবশ্যই।”
খুশিতে প্রভাত মৃন্ময়ীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,,
“থ্যাংক ইউ বউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ। আমি প্রচণ্ড খুশি।”
“খুশিতে আমাকেই মে’রে ফেলো না।”
প্রভাত হাতের বাঁধন আলগা করে বলল,
“সরি, বেশি এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম।”
“কিন্তু আমি চিন্তায় আছি আল্লাহ্ আমাদের সন্তান দিলে ওকে সময় দিবো কীভাবে? আমি তো সারাদিন থাকি স্কুলে।”
প্রভাত বলল,
“তাতে কী? তোমার সাথে যারা চাকরি করে, তাদের বুঝি বাচ্চা নেই? আমি আছি তো।”
“তোমার-ও তো কাজের ব্যস্ততা।”
“বাড়িতে মা আছে না? সে দেখবে। একটু বড়ো হলে তখন তুমি-আমি দুজনেই সঙ্গে রাখতে পারব। ওসব নিয়ে ভেবো না তো। সবাই মিলে ঠিক সামলে নেওয়া যাবে।”
“আর যদি হয় তোমার মতো বেপরোয়া?”
“হলেই সমস্যা কোথায়? তুমি সামলে নিতে পারবে।”
“কীভাবে?”
“আমাকে সামলাতে পারলে বাচ্চাকে পারবে না কেন?”
মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। বলল,
“দারুণ উদাহরণ।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“একটা পরিপূর্ণ পরিবার পাওয়ার পর আমার জীবনে আর কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকবে না ম্যাডাম। ওপরওয়ালার কাছে আমি সবসময় তোমাকে চেয়েছি, তিনি আমার জীবনে তোমাকেই জুড়ে দিয়েছেন। এরপর তোমার ছোট্ট একটা অংশ যেদিন আমাকে বাবা বলে ডাকবে, ব্যস, এ পৃথিবীতে আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে। এক জীবনে সুখী হতে এরচেয়ে বেশি কিছু আর আমার চাই না।”

~সমাপ্ত~

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-২০

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২০.
শুক্রবার। মৃদুলার জন্য বিশেষ দিন। বরাবরের মতো সে নিজেকে সাজিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। তারপর থেকে সে টানা আধঘন্টা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। জাহিদের অপেক্ষায়? নাহ্! এখন আর তাকে কারো জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে বিরক্তি আসে না। বারবার রাস্তার দিকে তাকাতে হয় না। সে জানে তার অপেক্ষা থেমে গেছে। তবু কোন ব্যর্থ আশায় তার মন বারবার এভাবে ছুটে আসে, জানে না সে। আধঘন্টা পর কোত্থেকে এক বাইক এসে থামল তার সামনে। মৃদুলা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল। হেলমেট খুলে প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“কী? এখনও চিনতে পারনি?”
কপালের ভাঁজ মিলিয়ে নিয়ে মৃদুলা বলল,
“ভাইয়া, আপনি কোত্থেকে এলেন?”
“মহাকাশ থেকে টপকে এলাম। কারণ কোনো এক এলিয়েন আমার কানে-কানে খবর দিলো আমার ছোটোবোন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বিরহবিলাস করছে।”
মৃদুলা হেসে বলল,
“ধুর! আপনি বাইক কিনলেন কবে?”
“কিনলাম গতকাল। তোমার আপাকে নিয়ে মাঝে-মাঝে আকাশে ওড়ার জন্য।”
“বাহ্! আপনার বাইক-ও আকাশপথে চলে?”
“তোমার আপা সাথে থাকলে আমি নিজেই তো আকাশপথে চলি, বাইক কেন নয়?”
“আচ্ছা, বুঝলাম। কোথায় যাচ্ছিলেন?”
“যাচ্ছিলাম না, তোমার খোঁজেই এলাম।”
“হঠাৎ আমার খোঁজ কেন?”
প্রভাত কপাল কুঁচকে বলল,
“কেন? আমি কি তোমার খোঁজ নিতে পারি না? বোনদের খোঁজ নেওয়া বারণ?”
“না, এমনিতেই বললাম।”
প্রভাত গাড়িটা পার্ক করে রেখে বলল,
“চলো, কিছু খাই। বেশিক্ষণ বসব না আমি।”
“এখন আমার খেতে ইচ্ছা করছে না।”
“তাহলে আমি খাই, তুমি দেখো। এসো।”

প্রভাত মৃদুলাকে নিয়ে পাশের ছোটো রেস্ট্রন্টে বসল। হালকা কিছু খাবার অর্ডার দিলো। মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“আপার কী খবর?”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“আপার খবর জানতে না চেয়ে আমার খবর জানতে চাও। তোমার আপা সবসময়-ই বিন্দাস আছে। চব্বিশ ঘন্টা আমাকে শাসনের মধ্যে রাখছে। বিয়ে করে ঘরে বউ না, অভিভাবক তুলেছি আমি।”
মৃদুলা হেসে বলল,
“এত তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন?”
“আরে নাহ্! কী বলছো? আমি ধৈর্য হারাব কেন? ধৈর্য হারানোর কথা তো তোমার আপার, আমার মতো মানুষকে ও সামলাচ্ছে। ও যেখানে ধৈর্য হারাচ্ছে না, আমি হারাব কোন সাহসে? এত কষ্ট করে বিয়ে করেছি কি ধৈর্য হারানোর জন্য?”
“হুম, তা ঠিক। লাস্টবার বাড়ি এসে আপা মায়ের থেকে আপনার পছন্দের পিঠা বানানো শিখে গিয়েছিল। বানিয়ে খাইয়েছে আপনাকে?”
প্রভাত চোখ বড়ো করে বলে উঠল,
“বলো কী! সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
প্রভাত অত্যধিক খুশি হয়ে বলল,
“খাওয়াবে হয়তো সময় পেলে। খবরটা দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার আপা যেদিন আমাকে ওই পিঠা বানিয়ে খাওয়াবে, সেদিন অবশ্যই তাকে আমি বিশেষ পুরষ্কার দিবো।”
“তাহলে তো আমি ভুল করে ফেললাম। আপা হয়তো আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। আমি তার বারোটা বাজিয়ে দিলাম। যাহ্!”
“ব্যাপার নাহ্। তোমার আপাকে আমি বলব না আমি জেনে গেছি।”
“তাহলে ঠিক আছে।”
একটু চুপ থেকে প্রভাত প্রশ্ন করে বসল,
“তুমি কি সত্যিই মুভ অন করতে পেরেছ মৃদুলা?”
মৃদুলা মৃদু হেসে শুধাল,
“এখনও সন্দেহ আছে?”
“আছে বলেই তো জানতে চাইছি।”
“কেন? আমি কি আপনার সাথে কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলছি?”
“কথা ঘুরিয়ো না। সোজাসাপ্টা উত্তর দাও।”
“ধুর! এসব কোনো বিষয় হলো? মুভ অন করতে পারব না কেন? অবশ্যই পেরেছি।”
প্রভাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“সত্যিই কি পেরেছ?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আজ কার জন্য বেরিয়েছ?”
“টিউশন ছিল।”
“আমি জানি শুক্রবার তোমার টিউশন নেই।”
“সন্ধ্যায় আছে। ছুটির দিন একটু ঘোরাফেরা করার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়েছি।”
প্রভাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“অন্যকে মিথ্যা বুঝানো গেলেও, নিজেকে বুঝানো যায় না মৃদুলা। তুমি জানো জাহিদ আসবে না। তবু কোন আশায় ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকো?”
মৃদুলার মুখটা নিমেষেই কেমন মলিন হয়ে গেল। এদিক-ওদিক এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে সে বলল,
“আমি কারোর আশায় বাঁচি না।”
“এ কথা অন্তত আমাকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা কোরো না। তোমাদের সম্পর্কে আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আমি জানি তোমার পরিস্থিতি।”
মৃদুলা মিইয়ে পড়া স্বরে বলল,
“জেনে কী হবে ভাইয়া? কিছু তো আর পরিবর্তন হবে না।”
“জানি কিছু পরিবর্তন হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে না পারলেও নিজেকে তো পরিবর্তন করতে হবে। এক জায়গায় আটকে থেকে তুমি কখনোই জীবনযাপন করে শান্তি পাবে না।”
“এটাই তো ও চেয়েছিল, আমার জীবন থেকে যেন সমস্ত শান্তি হারিয়ে যায়।”
“তোমাকেই এটা পরিবর্তন করতে হবে। তোমার বয়সটা নিতান্তই কম। আল্লাহ্ বাঁচিয়ে রাখলে গোটা একটা জীবন পড়ে আছে তোমার সামনে। তোমার জীবনের জন্য তোমাকেই ভাবতে হবে। মনে রাখবে, এটা তোমার জীবন। তোমার মূল্যবান জীবনকে নষ্ট করার অধিকার পৃথিবীর কোনো মানুষের নেই। তারজন্য আগে নিজের জীবনের মূল্য নিজেকে বুঝতে হবে। নিজের জীবনের মূল্য বুঝার পর দেখবে তুমি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া সৃষ্টিকর্তা কার কপালে কী লিখে রাখেন বলা যায় না। হতেও পারে তোমার জন্য তিনি আরও ভালো কাউকে ঠিক করে রেখেছেন। তাই ভুল মানুষকে আগেভাগেই সরিয়ে দিয়েছেন। আমার মতে ভালোই হয়েছে ভুল মানুষটা তোমার জীবন থেকে দ্রুত সরে গেছে। আরও কয়েক বছর থেকে গেলে তোমার জন্য মুভ অন করা আরও কষ্টকর হয়ে যেত। তাই বলছি ধৈর্য ধরো। ভাগ্য মেনে নাও।”
মৃদুলা বলল,
“আমি সবই বুঝি। আপনি এত চিন্তা করবেন না ভাইয়া। আমাকে আরেকটু একটু সময় দিন। জীবনের প্রতি অবিচার করার মতো মানসিকতা অন্তত আমার নেই।”
“আমি জানি তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। সবই বোঝো। তবু আমার যতটুকু বলা প্রয়োজন মনে হয় বলি। আমি চাই তুমি যেন এসব কা’টিয়ে উঠতে পারো।”
মৃদুলা মাথা নেড়ে বলল,
“পারব। ধন্যবাদ ভাইয়া।”
“কেন?”
“আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য।”
প্রভাত বলল,
“তুমি আমার জন্য যা করেছ, তার কাছে এসব কিছুই না।”
মৃদুলা হাসল। বলল,
“আমি আপনার জন্য কিছুই করিনি। যা কিছু করেছি আমার আপার জন্য। আমি জানতাম আমার আপা লাকি হবে।”
প্রভাত ভাব নিয়ে বলল,
“ইনডিরেক্টলি আমার-ই প্রশংসা করলে।”

খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে প্রভাত নানান কথায় মৃদুলাকে হাসানোর চেষ্টা করল। মেয়েটার জন্য তার খারাপ লাগে। মৃন্ময়ীর সাথে তার বিয়ের ঠিক দুদিন আগে হঠাৎ জাহিদ তার কাছে এসেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সবসময়ের মতো তার সাথে চা খেয়েছিল। বাড়ি ফেরার আগমুহূর্তে সে বলে বসেছিল পরদিন সন্ধ্যায় তার ফ্লাইট। সে ইউরোপ যাচ্ছে। জাহিদের বাবা ইউরোপ থাকেন। গত দুই বছর ধরে তিনি স্ত্রী-সন্তানকে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। পরিবার নিয়ে যাওয়ার পর দেশে আসার আর ইচ্ছা ছিল না তার। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে জাহিদ আপত্তি জানিয়েছিল। তার আপত্তি ধোপে টিকবে না বুঝে পড়াশোনার অযুহাতে মাকে আটকে রেখেছিল। কিন্তু তার মা-ও অপেক্ষায় ছিলেন কবে তার পড়াশোনা শেষ হবে। জাহিদ তখন বলেছিল পড়াশোনা শেষ করে সে ভেবে দেখবে। কিন্তু পড়াশোনা শেষে দেশে থেকে যাওয়ার মতো আর কোনো পোক্ত অযুহাত তার কাছে ছিল না। তবু সে বাবা-মাকে বুঝানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। লাভ হয়নি। কেউই তাকে সমর্থন করেনি। বাধ্য হয়ে সে মায়ের কাছে মৃদুলার কথা জানিয়েছিল। মৃদুলার পরিচয় শুনে বাবা-মা কেউই কোনোরূপ আগ্রহ দেখায়নি। উলটা তার মা দেশ ছাড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। জাহিদ বরাবরই মা ভক্ত ছেলে। মা চলে গেলে তার এদেশে থাকার কোনো উপায় ছিল না। একবার গেলে যে আর সে ফিরবে না। মৃদুলাকে সে মন উজাড় করে ভালোবেসেছিল। তার হৃদয়ের অনেকটা অংশ জুড়ে মৃদুলা ছিল। মেয়েটাকে ঠকানোর কথা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারত না। অথচ ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়ে তাকে বিশ্বাসঘাতক সাজতে হয়েছিল। পরিবারের জন্য নেওয়া মাত্র একটা সিদ্ধান্তের কারণে মৃদুলার সমস্ত বিশ্বাস গুড়িয়ে দিয়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ছেলেটা সেদিন ছিঁচকাদুনে মেয়েদের মতো কেঁদেছিল। প্রভাতের দুহাত চেপে ধরে অনুরোধ করেছিল মৃদুলাকে যেন তার চলে যাওয়ার আগে খবরটা না দেওয়া হয়। আরও বলেছিল বিশ্বাস ভাঙার জন্য মৃদুলা যেন তাকে ক্ষমা না করে। সে ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য। প্রভাতের কেবল শোনা এবং দেখা ছাড়া আর কিছুই করার সাধ্য ছিল না। সে জানত জাহিদ নিরুপায়। তবু সেদিনের পর থেকে সে জাহিদের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখেনি। তার অভিযোগ ছিল একটাই। ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে বুঝেও জাহিদ কেন পরিবারের থেকে লুকিয়ে মৃদুলার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়েছিল? অনুভূতির জন্য এতটাও অন্ধ হওয়া ঠিক নয়, যা ভবিষ্যতে কাল হয়ে দাঁড়াবে। বিয়ের পর প্রভাত যখন মৃন্ময়ীর বাড়ি গিয়েছিল, তখন মৃদুলার মানসিক অবস্থা সে লক্ষ্য করেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে সে মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। তবু প্রভাত আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়নি। মৃদুলা নিজেই একদিন তার কাছে এসেছিল জাহিদের খবর জানতে। সেদিন আর সে কিছু লুকায়নি। জাহিদের প্রস্থানের খবরটা শোনার পর শক্তপোক্ত মেয়েটা তার সামনে চোখের পানি না ফেললেও, কতটা আঘাত পেয়েছিল, তা তার মুখ দেখেই প্রভাত বুঝতে পেরেছিল। সেই থেকেই সে মাঝে-মাঝে মৃদুলার খোঁজ-খবর নেয়। কারণ প্রভাত-ই একমাত্র ব্যক্তি, যে মৃদুলার মানসিক অবস্থার বিষয়ে অবগত। মৃদুলার অনুরোধে সে মৃন্ময়ীকে-ও এসব বিষয় জানায়নি। সে আশা রাখে মৃদুলা ঠিক এই পরিস্থিতি কা’টিয়ে উঠতে পারবে। তবেই সে চিন্তামুক্ত হবে।


মৃন্ময়ী আজকাল রোজ খাবারের টেবিলের চিত্র পরিবর্তনের চেষ্টা করে। বরাবরের মতো টেবিলে খাবার দিয়ে রাহেলা বেগমকে সরে যেতে দেয় না। নিজে তাকে খাবার বেড়ে দিয়ে খেতে বসায়। প্রভাতকে-ও সে টেবিল ছাড়তে দেয় না। রোজ তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে পালটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। মৃন্ময়ীর মুখে রাহেলা বেগমের জীবনকাহিনি শোনার পর থেকে অবশ্য তার আচরণে ধীরে-ধীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। এখন আর রাহেলা বেগমের প্রতি তার খুব একটা ঘৃণা বোধ হয় না। কিন্তু মৃন্ময়ী যে রাহেলা বেগমকে মা ডাকার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে, এটা তার জন্য জটিল। মায়ের জায়গায় অন্য কাউকে বসানোর কথা সে ভাবতেই পারে না। এ কথা শুনলেই মৃন্ময়ী বলে,
“মায়ের জায়গায় বসাতে হবে কেন? তোমার মা তোমার মনে যে জায়গায় আছে, সে জায়গাতেই থাকবে। সে জায়গা তো আর কেউ দখল করতে পারবে না। তাই বলে যে তুমি আরেকজনকে মা ডাকতে পারবে না, এমন তো কোনো নিয়ম নেই। তুমি তার সন্তান নও, তবু সে তোমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করে। আর সে তোমার মা নয় বলে তুমি তাকে মায়ের মতো ভালোবাসতে পারবে না? একজন মাকে এভাবে কষ্ট দিয়ো না প্রভাত। এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি তো তোমার আছে। তবু কেন আমার এত বুঝাতে হচ্ছে?”
প্রভাত চুপ হয়ে যায়। তারপর আকাশ-পাতাল ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়ে। মৃন্ময়ী হাল ছাড়ে না। প্রভাতকে পালটাতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আজ তারা মার্কেটে গিয়েছিল কিছু কেনাকাটা করতে। দরকারি কেনাকাটা করে প্রভাত মৃন্ময়ীর জন্য একটা শাড়ি-ও কিনেছে। শাড়িটা না কি মৃন্ময়ীর উপহার। গতকাল সে প্রভাতের পছন্দের পিঠা বানিয়ে খাইয়েছিল, তাই। সেই সুযোগে মৃন্ময়ী তাকে দিয়ে রাহেলা বেগমের জন্য-ও একটা শাড়ি কিনিয়েছে। বাড়ি ফিরে আবার প্রভাতকেই ঠেলে পাঠিয়েছে রাহেলা বেগমকে শাড়ি দিয়ে আসতে। প্রভাত বারবার বলছিল মৃন্ময়ীকে যেতে। কিন্তু মৃন্ময়ী তাকে দিয়েই শাড়ি দেওয়াবে। এদিকে অস্বস্তিতেই প্রভাতের পা বারবার থেমে যায়। মৃন্ময়ী আবার তাকে পেছন থেকে তাড়া দেয়। রাহেলা বেগম তখন ডাইনিংয়ে বসে লাউশাক কে’টে রাখছিলেন আগামীকালের রান্নার জন্য। প্রভাতকে আসতে দেখে তিনি মাথা তুলে তাকালেন। প্রভাত তখন ইতস্তত ভঙ্গিতে শাড়ির প্যাকেটটা এগিয়ে ধরল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। রাহেলা বেগম প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালেন,
“কী এটা?”
প্রভাত শুধু বলল,
“নিন।”
রাহেলা বেগম মনে প্রশ্ন নিয়েই প্যাকেটটা নিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাত চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই মৃন্ময়ী এসে তার পথরোধ করে দাঁড়াল। ততক্ষণে রাহেলা বেগম প্যাকেট খুলে বুঝেও গেছেন ভেতরে কী আছে। রাহেলা বেগম হঠাৎ চোখেমুখে একপ্রকার উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করে ফেললেন,
“তুমি এনেছ বাবা?”
প্রভাতের আগে মৃন্ময়ী দ্রুত মাথা দুলিয়ে বলে উঠল,
“জি আম্মা। আমার জন্য আর আপনার জন্য কিনেছে।”
প্রভাত মিনমিনে গলায় বলল,
“মৃন্ময়ী পছন্দ করেছে।”
রাহেলা বেগম হাসিমুখে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ্ বাবা, সুন্দর শাড়ি।”
রাহেলা বেগম হাসছেন, অথচ তার চোখ ছলছল করছে। প্রভাত সে হাসিমুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে দ্রুত প্রস্থান করল। প্রভাত যেতেই মৃন্ময়ী খুশিমনে প্রশ্ন করল,
“আম্মা, আপনি খুশি হয়েছেন?”
রাহেলা বেগম আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“অনেক খুশি হয়েছি মা। আমার ছেলে এই প্রথম আমার জন্য শাড়ি কিনে এনেছে। আমি খুশি না হয়ে পারি?”
“শাড়িটা পছন্দ করে দিয়েছি কিন্তু আমি। আপনার ছেলের পছন্দ একদম ভালো না।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“আমি তো বলব আমার ছেলের পছন্দ একশোতে একশো। নয়তো তোমার মতো এমন বউ আনল কী করে?”
মৃন্ময়ী লজ্জা পেয়ে বলল,
“আমি তো শাড়ি পছন্দের কথা বললাম।”

মৃন্ময়ী আনন্দিত মনে ঘরে ফিরতেই প্রভাত টিপ্পনি কে’টে বলে উঠল,
“একজনকে বলতে শুনলাম আমার পছন্দ না কি ভালো না। সে কি নিজের রূপ নিয়ে সন্দিহান?”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে ফেলে বলল,
“আরেকজন তাহলে আড়ি পেতে আমার আর আম্মার কথা শুনেছে?”
প্রভাত বলল,
“আড়ি কে পেতেছে? ঘর থেকেই শোনা যাচ্ছিল।”
“ঘর থেকে মোটেও শোনা যাচ্ছিল না। আড়ি পেতেছিলে, তা-ই বলো।”
“নিজের ঘরে আড়ি কে পাতে? দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, তাই কানে চলে এসেছে।”
“হয়েছে, আর নাটক করতে হবে না।”
প্রভাত দুই হাতে মৃন্ময়ীর গাল টিপে দিয়ে বলল,
“তা আমার নায়িকার রূপ নিয়ে এত সন্দেহ কেন শুনি?”
মৃন্ময়ী তার হাতে মৃদু চড় মে’রে বলল,
“আমি শাড়ির কথা বলছিলাম।”
“ওওও, আর তোমার শাশুড়ি কী বলল?”
“আমার শাশুড়ি কী? তোমার মা বলো।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর দুই হাত মুঠোবন্দী করে সবগুলো আঙুল তার আঙুলের ভাঁজে বন্দী করে নিল। তারপর বলল,
“এবার বলো তো আমার পছন্দ কেমন?”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি ছাড়া সব বাজে।”
“তুমি ছাড়া সব বাজে?”
“হুম।”
“সবের মধ্যে তুমি পড় না?”
“না।”
“কে বলেছে?”
“তোমার মা।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর ঠোঁটে, কপালে চুমু এঁকে দিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“এটা-ও আমার পছন্দ।”
মৃন্ময়ী কোনোমতে হাসি আটকে বলল,
“বাজে।”
প্রভাত ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
“শিওর?”
“উফ্! হাত ছাড়ো তো। তোমার ফাজলামি দেখার সময় নেই। আমার কাজ আছে।”
“এই রাতে বেচারা বরকে ঘরে ফেলে রেখে তোমার আর কাজ কী?”
“খাওয়ার পর যে থালা-বাসন রেখে দিয়েছি, ওগুলো কি জিন-পরী এসে ধুয়ে দিবে?”
“আমি থাকতে তোমার আবার জিন-পরী লাগে? চলো আজ আমি তোমার জিন হয়ে যাই।”
“তোমার কাজের নামে অকাজ বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। তুমি আমার হাত ছাড়ো, তাহলেই হবে।”
মৃন্ময়ী হাত মোচড়াতেই প্রভাত তার আঙুলগুলো মুক্ত করে দিলো। ছাড়া পেয়ে মৃন্ময়ী হাত ঝাড়া দিয়ে বলল,
“উফ্! আঙুলগুলো একদম ব্যথা বানিয়ে দিয়েছ।”
“সরি বউ।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর দুহাতের আঙুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। তার চুলগুলো ঠিক করে দিতে-দিতে ফিসফিস করে বলল,
“তাড়াতাড়ি ফিরে এসো ম্যাডাম। অপেক্ষা করিয়ে বুকব্যথা বাড়িয়ো না।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১৮+১৯

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৮.
মৃন্ময়ীর বিয়ে। আয়োজন ছোট্ট। কিন্তু আনন্দ উপচে পড়া। মৃত্তিকা-মৃদুলা এত খুশি! তাদের এত বেশি খুশি শেষ কবে দেখেছিল মনে নেই মৃন্ময়ীর। সাজেদা বেগম আজ পুরোদস্তুর ব্যস্ত। মৃন্ময়ীর কাছে আসার সময় পাচ্ছেন না। পূর্বের কথামতো মৃত্তিকা-ই মৃন্ময়ীকে বউ সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে। মৃদুলা-ও মায়ের সাথে কাজে ব্যস্ত। কাজের ফাঁকে সে এসে মৃন্ময়ীর সাজগোজ দেখে যাচ্ছে। মৃত্তিকাকে সাহায্য করছে মৃন্ময়ীর দুই বান্ধবী। মৃন্ময়ী বারবার করে বলছে,
“বেশি সাজাবি না, আমাকে ভূতের মতো লাগবে।”
অনামিকা বলল,
“আরে লাগবে না। আমার বিয়েতে আমি সাজিনি? আমাকে কি ভূতের মতো লেগেছিল?”
“তোর অভ্যাস আছে, আমার তো নেই।”
“চিন্তা করিস না। আমার মতো তোকে ভারি সাজ দিচ্ছে না। তোর হবু বর এসে হতে আমাকে ম্যাসেজে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে আমার মতো যেন তোকে না সাজাই।”
মৃন্ময়ীর আরেক বান্ধবী প্রিয়া দুষ্টুমি করে বলল,
“তার তো তর সইছে না বউকে দেখার জন্য, তাই অল্পতে সাজ শেষ করতে বলছে।”

বান্ধবীর মুখে এ কথা শুনে মৃন্ময়ীর লজ্জা লাগল। প্রিয়া তাকে আরও লজ্জায় ফেলে দেওয়ার পাঁয়তারা করে বলল,
“প্রভাতের নতুন বউ দেখছি লজ্জা পাচ্ছে। বেচারাকে এত ঘুরিয়ে লাভ কী হলো বল তো? সেই তো এখন তার জন্যই বউ সাজছিস।”
অনামিকা বলল,
“ঘুরিয়েছে বলেই তো বুঝতে পেরেছে আমাদের প্রভাত খাঁটি প্রেমিক। সঙ্গে-সঙ্গে পাত্তা দিয়ে দিলে তো বুঝতে পারত না তার মনে কী আছে।”
মৃত্তিকা হেসে বলল,
“একদম ঠিক বলেছ আপু। রাজি হতে এতটা সময় নিয়েছে বলেই আপু প্রভাত ভাইয়ার খাঁটি প্রেম বুঝতে পেরেছে। আমরাও এখন তাকে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করতে পারছি।”
অনামিকা হাসিমুখে বলল,
“চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রভাতকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারো। আমরা জানি ও কেমন ছেলে। মৃন্ময়ী-ই একমাত্র মেয়ে, যার প্রতি ও শুরু থেকে এত লয়াল। মৃন্ময়ীকে যে ও আজীবনে-ও কষ্ট দিবে না, এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকো।”
প্রিয়া বলল,
“এক কথায় বলা যায় আমাদের মৃন্ময়ী ভাগ্যবতী।”
মৃত্তিকা বলল,
“তা-ই যেন হয় আপু। আমার আপার ভাগ্যের পরিবর্তন দেখার বড়ো সাধ আমার মায়ের। আমার আপা যেন বাকি জীবন একটা সুখী সংসার পায়।”

মৃদুলা সেখানে উপস্থিত হয়ে বাকি কথা না শুনলেও, মৃত্তিকার শেষ কথাটা শুনতে পেল। সঙ্গে-সঙ্গে সে বলে উঠল,
“আমার আপাকে যেচে বিয়ে করতে এসেছে মানে তাকে সুখী রাখতেই হবে। নচেৎ আমি নিজ দায়িত্বে দুলাভাইয়ের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাব। আমি আমার আপার মতো অত ভদ্র মানুষ নই।”
মৃত্তিকা তাকে চোখের ইশারায় একটু ধমকে দিলো। অনামিকা শব্দ তুলে হেসে বলল,
“বেচারা প্রভাত যদি জানত বিয়ের আগেই ওর শ্যালিকা ওকে হুমকি দিচ্ছে।”
প্রিয়া বলল,
“ওর জন্য এমন শ্যালিকা-ই ঠিক আছে।”

মৃন্ময়ীকে সাজানো শেষ করে মৃত্তিকা বলল,
“দেখো তো সবাই সাজ ঠিকঠাক আছে কি না?”
মৃত্তিকা বলল,
“ঠিক আছে। এর বেশি সাজানোর দরকার নেই। এতেই আপাকে সুন্দর লাগছে।”
প্রিয়া দুষ্টুমি করে বলল,
“আরে সবাই দেখে কী করবে? একজন দেখলেই হবে। আজ মৃন্ময়ীকে যা মারাত্মক লাগছে, ওই একজন দেখে জ্ঞান না হারালেই হয়।”
মৃন্ময়ী তাকে খোঁচা মেরে মিনমিনে গলায় বলল,
“আর বাজে বকিস না তো।”
প্রিয়া বলল,
“এখন আমার কথা বাজে বকবক-ই মনে হবে। তোমার জামাই যখন হা করে তাকিয়ে থাকবে, তখন বুঝবে আমার কথায় কোনো ভেজাল নেই। এখন প্রভাতের নাম শুনেই লজ্জা লাগছে তো? দুদিন পর দেখব এই লজ্জা কোথায় থাকে।”

প্রভাত-মৃন্ময়ীর বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর যখন তাদের পাশাপাশি বসানো হলো, মৃন্ময়ী তখন লাজুক বধূ হয়ে ঘোমটা টেনে বসে রইল। তা-ও প্রভাত সুযোগ বুঝে ফিসফিসিয়ে বলে বসল,
“আজ তোমায় মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে বউ।”

বউ! ডাকটা শুনেই যেন মৃন্ময়ীর হৃদস্পন্দন এক মুহুর্তের জন্য দ্বিগুণ বেড়ে গেল। লজ্জায় সে মুখ তুলে তাকাল না। যে মুখে সে এই অবধি ‘ম্যাডাম’ ডাক শুনেই অভ্যস্ত, আজ সে মুখ তাকে ‘বউ’ ডাকছে। ভাবা যায়! আজ প্রথমবারের মতো সে কীভাবে প্রভাতের মুখোমুখি হবে, তা নিয়ে সে এখনই চিন্তায় পড়ে গেছে। শুরুটা তার জন্য নিশ্চয়ই সহজ হবে না।

মৃদুলা বারবার বলে রেখেছিল মৃন্ময়ীর বিদায়ে সে একদম কাঁদবে না। কাঁদবে কেন? আজীবনের জন্য তো সে বোনকে বিদায় জানাচ্ছে না। বোনের জীবনের এই সুদিনটি দেখার জন্য সে কত অপেক্ষা করে ছিল। অপেক্ষায় ছিল একজন সুপাত্র এসে কবে তার আপার জীবনটা রাঙিয়ে তুলবে। তার সকল অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। আজ সে হাসিমুখে বোনকে বিদায় জানাবে, সাময়িক বিদায়। সে যতবারই এ কথা বলেছিল, মৃত্তিকা খুব হেসে বলেছিল, ‘সময় আসুক, দেখব কত হাসতে পারিস।’ শেষমেশ গিয়ে মৃত্তিকার কথাই সত্যি হলো। মৃন্ময়ীর বিদায় মুহূর্তে মা যখন তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, নিমেষেই মৃদুলার সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। কাঁদবে না বলে সে নিজেই সবার চেয়ে বেশি কাঁদল। মৃন্ময়ীকে নিয়ে পাত্রপক্ষ বিদায় নেওয়ার পরও তার কান্না থামল না। তখন মৃত্তিকা-ই তাকে শান্ত করতে এগিয়ে এল।


প্রভাতের বাড়িতে প্রথমদিনেই মৃন্ময়ী অবাক হয়ে প্রভাতের সৎ মায়ের কাণ্ড দেখছে। রাহেলা বেগম নিজের কাজের ফাঁকে বারবার এসে তার খোঁজ নিচ্ছে, তার কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করছে। বিয়ের চাপে ঠিকঠাক খেতে পেরেছে কি না ভেবে নিজ হাতে মৃন্ময়ীর জন্য খাবার-ও বয়ে এনেছে। মৃন্ময়ী খেতে চায়নি বলে সে নিজেই জোর করে কিছু খাবার খাইয়ে দিয়েছে। খাবার খাইয়ে চলে যাওয়ার আগে সে বারবার করে মৃন্ময়ীকে বলে গিয়েছে যেকোনো প্রয়োজন যেন তাকে বলে। মৃন্ময়ী কেবল মনের ভেতর বিস্ময় চেপে রাখল। বাড়ি এসে হতে মৃন্ময়ীর চারপাশে মহিলাদের আনাগোনা প্রভাতকে বিরক্ত করে তুলেছে। অবশেষে রাতে যখন তার সুযোগ মিলল, ঘরে ঢুকে মৃন্ময়ীর পাশে বসেই সে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“উফ্! অবশেষে মুক্তি মিলল। বিয়ে করলাম আমি, অথচ মানুষজনের জন্য আমি নিজেই আমার বউয়ের কাছে আসার সুযোগ পাচ্ছি না। এ কেমন অবিচার!”
পরক্ষণেই মৃন্ময়ীর নতমুখের দিকে উঁকি মে’রে তাকিয়ে বলল,
“ম্যাডাম দেখি এখনও লাজুক বধূ হয়ে আছেন। কী ব্যাপার? বর পছন্দ হয়নি?”
মৃন্ময়ী তখন লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। মুখ তুলে তাকানোর অবস্থায়-ও নেই সে। এতদিন যাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে, আজ তার চোখে চোখ রাখবে কী করে? প্রভাত হেসে বলল,
“এত লজ্জা পেতে হবে না। আমরা তো আর অপরিচিত কেউ নই। আমি তোমার বন্ধু ছিলাম না? কত কথা বলেছো তুমি আমার সাথে। সেভাবে একটু কথা বলো তো। অপরিচিতদের মতো মুখ নুইয়ে রেখো না। দেখি, তাকাও। তোমার বর এদিকে বসে।”

তা-ও মৃন্ময়ী মুখ তুলে তাকাল না। চুপচাপ বসে নখ খুঁটছে সে। প্রভাত আরও একটু এগিয়ে তার গা ঘেঁষে বসল। মৃন্ময়ীর সামনে নিজের দুহাত পেতে ধরে বলল,
“তোমার হাতটা দিবে ম্যাডাম?”
মৃন্ময়ী সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া দিতে পারল না। প্রভাতের হাতের দিকে তাকিয়ে নিজের হাতে হাত চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল সে। প্রভাত তাকে তাড়া দিলো না, অপেক্ষা করল। সময় নিয়ে মৃন্ময়ী নিজের ডান হাতটা তুলে দিলো প্রভাতের হাতে। প্রভাত সে হাতটা অতি যত্নে মুঠোবন্দী করে নিল। বলল,
“এই হাতটা ধরার জন্য আমি অনেক অপেক্ষায় ছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল একদিন আমার জীবনে এই দিনটি আসবে। ফাইনালি আমার অপেক্ষা শেষ হলো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর আমি এই হাত ছাড়ছি না ম্যাডাম।”

প্রভাত অনেক কথাই বলল। মৃন্ময়ী কেবল চুপ করে শুনে গেল। প্রভাত আজ একটুও মজা করছে না। তবে মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে প্রভাত নানান কথায় তার মনোভাব সহজ করতে চাইছে। তার লজ্জা ভাঙানোর চেষ্টা করছে। প্রভাত মৃন্ময়ীকে একটা উপহার দিলো। সেই উপহার পেয়ে মৃন্ময়ী যারপরনাই অবাক হলো। কয়েক মাস আগে প্রভাতের তাকে যে গহনা সেট উপহার দিয়েছিল, সে ফিরিয়ে দেওয়াতে যার স্থান হয়েছিল রাস্তার ধারের দিঘির জলে, সেই গহনাগুলোই আজ প্রভাত তাকে উপহার দিয়েছে। মৃন্ময়ী হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। নাহ্, চিনতে তার একদম ভুল হয়নি। এগুলো সেই গহনাগুলোই। মৃন্ময়ী দুচোখে বিস্ময় নিয়ে প্রভাতের দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাল। প্রভাত মুচকি হাসছে। সে বুঝতে পেরেছে মৃন্ময়ীর মনে কী প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। মৃন্ময়ী প্রশ্ন করার আগেই সে প্রশ্ন করল,
“কী ম্যাডাম? চেনা-চেনা লাগছে?”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“হুঁ, এগুলো ওই গহনাগুলোই না? কিন্তু তুমি তো ওগুলো পানিতে ফেলে দিয়েছিলে।”
“তোমার স্বামী তোমার জন্য ডুবুরি দিয়ে এই অতি মূল্যবান গহনা উদ্ধার করে এনেছে।”

মৃন্ময়ীর কপালে ভাঁজ পড়ল। প্রভাতের ফাজলামি তার বিশ্বাস হয়নি। প্রভাত হেসে বলল,
“আবার কিনেছিলাম।”
“আবার কেন কিনেছিলে?”
“আগেরগুলো পানিতে ফেলে দিয়ে দুদিন পর মনে হয়েছিল কাজটা একদম ঠিক হয়নি। রেখে দিলে পরে তোমাকেই দিতে পারতাম। তাই আবার কিনে রেখেছিলাম।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আবার কেনার দরকার ছিল না।”
“তোমার দরকার না থাকলেও, আমার বউয়ের জন্য আমার দরকার ছিল।”

মৃন্ময়ী মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করল,
“আমার প্রতি তোমার হাসি আসছে না প্রভাত?”
প্রভাত পালটা প্রশ্ন করল,
“হাসি? কেন?”
“বিয়ে করব না বলেও সেই তোমাকেই বিয়ে করলাম যে।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“ওহ্! এই কারণে? নাহ্, আমার হাসি আসছে না। তবে আনন্দ আসছে।”
“হাসি আসছে না?”
“উঁহু। কারণ আমি জানি আগের ওসব কথা তোমার মুখের ছিল। মনে তো আমার জন্য ঠিকই অনুভূতি ছিল, কিন্তু বুঝতে দাওনি। আজো কি মনের কথা লুকিয়ে রাখতে চাও? না কি শোনার সৌভাগ্য হবে আমার?”
মৃন্ময়ী লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। প্রভাত হেসে বলল,
“থাক, লজ্জা পেতে হবে না। একটু সহজ হলে তুমি নিজেই সব বলে দিবে। অবশ্য তুমি না বললেও বুঝে নেওয়ার দৈব শক্তি আছে আমার।”
তারপর প্রভাত মৃন্ময়ীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“আমার আজ সত্যিই ভীষণ আনন্দ হচ্ছে মৃন্ময়ী। আজ আমার শুধুই আনন্দের দিন। আমি তোমাকে পেয়েছি। এরচেয়ে বড়ো পাওয়া আর আমার জীবনে দ্বিতীয়টি নেই। শোনো, আজ থেকে আমি তোমার পরিবার, তোমার নিজের মানুষ। তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। তোমার যেকোনো সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, সবকিছু আমার সাথে শেয়ার করবে। সবকিছু মনে চেপে রেখে নিজের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে না। আমি এটা একদম বরদাস্ত করব না। আজ থেকে তোমার সমস্ত সমস্যা আমার‌। আজ এই মুহূর্ত থেকে সবসময় আমি তোমার মুখে হাসি দেখতে চাই। বাকি জীবন আমি সুখী মৃন্ময়ীর সাথে কা’টাতে চাই। শুনতে পেয়েছ আমার কথা? আজীবন তোমাকে সুখে রাখার জন্য যা করতে হয় আমি করব। কোনো পরিস্থিতিতে আমি তোমায় একা ছাড়ব না। এখন থেকে তুমি একজন নও, দুজন। তুমি আমি, আমি তুমি। মনে থাকবে?”

মৃন্ময়ী মুখে উত্তর না দিয়ে মাথাটা মৃদু দোলাল। প্রভাত ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখল মৃন্ময়ীর চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াতেই সে চট করে মুছে নিচ্ছে। প্রভাত তার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল,
“কাঁদছো কেন? আমি কি তোমাকে বকেছি, না কড়া কথা শুনিয়েছি? দেখি, কান্না বন্ধ করো। বিদায়ের সময় যথেষ্ট কেঁদেছ। মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে জোর করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসছি। নতুন বউটাকে আর কাঁদতে দেখতে চাই না।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর চোখের পানি মুছে দিলো। আহ্লাদ পেয়ে মৃন্ময়ীর কান্না থামার বদলে বেড়ে গেল। প্রভাত ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল,
“কী হলো? আরে! কান্নাকাটির কী হলো আবার?”
মৃন্ময়ী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। প্রভাতের এক হাত চেপে ধরে সে ভেজা গলায় বলল,
“সরি প্রভাত। আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি।”
“তোমাকে কে বলেছে আমি কষ্ট পেয়েছি? আমি তো কেবল অপেক্ষা করেছি। তোমায় নিয়ে একসঙ্গে হাসার জন্য অপেক্ষা করেছি। হাসো তো একটু বউ। হাসো, হাসো। কতদিন তোমার হাসি দেখি না!”
মৃন্ময়ী হাসল না। ব্যথিত গলায় বলল,
“আমি ক্লান্ত প্রভাত।”
এতটুকু একটা কথায় যেন আকাশ সমান ব্যথা লুকিয়ে ছিল। সে ব্যথা গিয়ে লাগল প্রভাতের বুকের ভেতরটায়। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে অতি আদরে মৃন্ময়ীর কপালে চুমু খেল। তারপর তাকে যত্ন সহকারে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে রাখল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি জানি এতটা বছর তোমার ওপর দিয়ে কেমন চাপ গিয়েছে। প্রতিটা দিন তুমি কীভাবে বেঁচে ছিলে, আমি সব জানি। আর নয় ম্যাডাম। আজ এখানেই তোমার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-ক্লান্তি বিসর্জন দাও। আমি আর তোমায় পুরোনো জীবনে ফিরতে দিবো না। আজ থেকে আমি তোমায় নিয়ে নতুন জীবনে যাত্রা শুরু করলাম। জীবনের সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা আমি তোমায় উপহার দিবো। আমার হৃদয়ে যতটুকু ভালোবাসা জমা আছে, সবটাই তোমার, কখনও এক চুলও ছাড় দিয়ো না।”


মৃন্ময়ীর বিয়েতে জাহিদ আসেনি। অথচ তার দাওয়াত ছিল দুই পক্ষ থেকেই। দুদিন আগেও সে মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কোন পক্ষে থাকা উচিত। মৃদুলা বলেছিল তার যেদিকে ইচ্ছা থাকতে পারে। যে পক্ষেই থাকুক, অনুষ্ঠান তো একই বাড়িতেই হবে। প্রভাতের কথামতো বরযাত্রী এসেছিল গোটা কয়েক মানুষ। তারমধ্যে জাহিদকে দেখতে না পেয়ে মৃদুলা ভেবেছিল জাহিদ হয়তো তার অতিথি হয়েই আসবে। কিন্তু জাহিদ আসেনি। নিজের ব্যস্ততার মাঝেও মৃদুলা তাকে কয়েকবার কল করেছিল। কলটা-ও রিসিভ করেনি। মৃদুলা আশা করেছিল রাতে আবার কল করে জাহিদের না আসার কারণ জেনে নিবে। কিন্তু জাহিদ রাতে-ও কল রিসিভ করল না। মৃদুলা এখন পড়ে গেছে চিন্তায়। জাহিদ কখনও এমন করে না। মৃদুলা কল দিয়েছে, আর সে ইচ্ছাকৃত কল এড়িয়ে গেছে, এমন আজ পর্যন্ত হয়নি। উলটা কল ঘুরাতে দেরি হলে সে দুঃখ প্রকাশ করে। তবে আজ তার কী হলো? কোনো সমস্যায় পড়েনি তো? না কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে? চিন্তায় মৃদুলার দুচোখের ঘুম উড়ে গেছে। অথচ তার সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা এখন একটু বিশ্রাম চাইছে। জাহিদের খোঁজ নেওয়ার কোনো উপায় সে খুঁজে পাচ্ছে না। একমাত্র উপায় ছিল প্রভাত। কিন্তু এত রাতে সে প্রভাতকে-ও বিরক্ত করতে পারবে না। মৃত্তিকা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তারা আজ আপার ঘরে ঘুমাতে এসেছে। মৃদুলা চুপচাপ বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বসার ঘরে আলো জ্বলছে। মৃদুলা নিজেই ওই ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে গিয়েছিল। মৃদুলা এগিয়ে গিয়ে দেখল তার মা এই ঘরে আছে। চুপচাপ বসে আছে। মৃদুলা মাকে ডেকে বলল,
“এখানে কী করছো মা? ঘুমাওনি কেন?”
সাজেদা বেগম তাকে দেখে বললেন,
“ঘুম আসছিল না, তাই বসে আছি। তুই ঘুমাসনি কেন?”
“আমারও ঘুম আসছে না।”
মৃদুলা মায়ের পাশে বসল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল মুখটা কেমন উদাসীন দেখাচ্ছে। মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“আপার জন্য চিন্তা করছো মা?”
সাজেদা বেগম চিন্তিত মুখে বললেন,
“আমার মেয়েটা কি সত্যিই সুখ পাবে রে মৃদুলা?”
মৃদুলা বলল,
“পাবে মা, পাবে। এখনও তুমি ভরসা পাচ্ছ না?”
“ভরসা তো করতে চাইছি, ছেলেটা তো ভরসা করার মতোই মনে হয়। তবু মন থেকে খটকা দূর হচ্ছে না।”
“কটা দিন যাক, নিজের চোখে আপার সুখ দেখলে তোমার মনের খটকা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। এত চিন্তা কোরো না। আপা ভালোই থাকবে। ঘুমাতে যাও, সারাদিন অনেক খাটাখাটুনি করেছ।”
সাজেদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ভালো লাগছে না। মেয়েটাকে আর ঘরে হাঁটাচলা করতে দেখব না, ভাবলেই ঘরটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে।”
মৃদুলার মনের কথাই যেন মা বলে দিলো। এখন থেকে আপাকে আর রোজ চোখের সামনে দেখবে না, ছুঁতে পারবে না ভাবলে তারও কষ্ট লাগছে। সাজেদা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“যাই, শুই গিয়ে। তুই ঘুমাবি না?”
“যাচ্ছি।”
‘যাচ্ছি’ বলেও মৃদুলা উঠল না। মা চলে যাওয়ার পরও সে এক জায়গাতেই ঠাঁয় বসে রইল। জাহিদের নাম্বারে আবারও দুবার কল দিলো। এবারে কল-ই ঢুকল না। নাম্বার বন্ধ বলছে। মৃদুলার হঠাৎ চোখ দুটো জ্বলে উঠল। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। আপার অজুহাতে কিছুটা সময় সে কেঁদেও নিল। কেউ দেখল না তার কান্না।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৯.
বিয়ের পর থেকে মৃন্ময়ী রোজ প্রভাতের সঙ্গে তার মায়ের ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করেছে। অথচ প্রভাত তার সঙ্গে কথা-ই বাড়াতে চায় না। প্রসঙ্গ তুললেই এড়িয়ে যায়। মৃন্ময়ীকে অনুরোধ করে তার সঙ্গে ওই মহিলাকে নিয়ে কথা না বলার জন্য। মৃন্ময়ী হাল ছাড়ে না। এ কদিনে সে স্পষ্ট বুঝে গেছে তাদের মা-ছেলের মধ্যকার সমস্যা গভীর। এটা মোটেও সৎ-মায়ের হিংসাত্মক ঘটনা নয়। কারণ রাহেলা বেগমকে সে যতটুকু দেখেছে, চিনেছে, তাতে তার মনে হয়েছে এই মহিলা একদমই হিংসুটে বা খারাপ মনের মানুষ না। প্রভাতের জন্য তিনি যথেষ্ট মায়া করেন। মৃন্ময়ীর সঙ্গে তার আচার-ব্যবহার এমন যে, মৃন্ময়ীর কখনও মনেই হয়নি এই মহিলা তার সৎ শাশুড়ি। মৃন্ময়ী খুব চেষ্টা করছে এই ভালো মানুষটির সাথে প্রভাতে সম্পর্কের জটিলতার আসল কারণ জানার। এতদিনে সে যতটুকু লক্ষ্য করেছে, তাতে তার মনে হয়েছে সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি প্রভাতের মাঝেই। সে তার মায়ের ধারেকাছেও ঘেঁষে না, যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে। অন্যদিকে রহিমা বেগম বেছে-বেছে প্রভাতের পছন্দের খাবারটা রান্না করার চেষ্টা করেন। প্রভাত ঠিকঠাক খাচ্ছে কি না, তা নিয়েও তার ভাবনার শেষ নেই। খাবার নিয়ে মৃন্ময়ীর সঙ্গেও মহিলা এখন খুব তোড়জোড় করেন। মৃন্ময়ী কোনো খাবার খাবে না বললেও তাকে শোনানো যায় না। তার একটাই কথা, মৃন্ময়ী বয়সের তুলনায় খাবার কম খায়। তার স্বাস্থ্যের জন্য এতটুকু খাবার যথেষ্ট নয়। খাবার নিয়ে মৃন্ময়ীর সাথে এত জোরাজুরি তার মা-ও কখনও করতে পারেনি। কারণ তার ব্যস্ত জীবনে আরামসে বসে খাবার খাওয়া খুব কমই হয়েছে। ফলস্বরূপ তাড়াহুড়ায় দিন-দিন তার খাবারের পরিমাণ-ও কমে গিয়েছে। মৃন্ময়ী মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে যে করে হোক প্রভাতকে চেপে ধরে তার পেট থেকে সত্য কথা বের করবে, আর নয়তো রাহেলা বেগমকেই জিজ্ঞেস করবে। ভেবেচিন্তে আগে সে রাহেলা বেগমের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করল। তাই ছুটির দিনে যখন প্রভাত বাড়ির বাইরে গেল, সেই সুযোগ সে কাজে লাগাল। রান্নাঘরে রাহেলা বেগমের সাথে হাতে-হাতে কাজ করতে-করতে কথা গুছিয়ে নিল। তারপর এ-কথা, ও-কথার মাঝে প্রভাতের প্রসঙ্গ টেনে বলল,
“আম্মা, কিছু মনে না করলে প্রভাতের ব্যাপারে দুটো কথা জিজ্ঞেস করব?”
রাহেলা বেগম মৃদু হেসে বললেন,
“কিছু মনে করব কেন? প্রভাতকে নিয়ে তুমি প্রশ্ন করতেই পারো।”
“প্রশ্নটা আসলে আপনার সাথে প্রভাতের সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে। তাই ভাবছি আপনি আবার কিছু মনে করেন কি না।”
“কী জানতে চাও, বলো।”
রাহেলা বেগমের মাঝে কোনো জড়তা নেই দেখে মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“প্রভাত কেন আপনার কাছ থেকে দূরে সরে থাকে? আমি যতটুকু দেখেছি, আপনি ওকে যথেষ্ট ভালোবাসেন। তবু এই দূরত্ব কেন? সমস্যাটা আসলে কী বা কার? আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কি আমাকে একটু সত্যিটা বুঝিয়ে বলবেন?”
রাহেলা বেগম বললেন,
“একসঙ্গে থেকে এসব দেখতে তোমার ভালো লাগছে না নিশ্চয়ই?”
মৃন্ময়ী ওপর-নিচে মাথা দোলাল। রাহেলা বেগম বললেন,
“বুঝেছি। এসব আমাদের এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। তুমি পরিবারে নতুন বলে তোমার চোখে লেগেছে। আমাদের সম্পর্ক সবসময়ই এমন।”
“কেন?”
“জানতে যখন চেয়েছ, তোমাকে প্রথম থেকেই খুলে বলি, শোনো।”

মৃন্ময়ী কৌতুহল নিয়ে রাহেলা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাহেলা বেগমের মুখটা হঠাৎ কেমন রং বদলে নিয়েছে। হয়তো দুঃখবোধ থেকে। তিনি বলতে শুরু করলেন,
“আমার প্রথম বিয়ে হয়েছিল খুব কম বয়সে। তখন ঠিকমতো সংসারের কাজ-ও জানতাম না। তবু পরিবারে ভাই-বোন বেশি ছিল, আর বাপের রোজগার কম ছিল বলে বাবা-মা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। যার সাথে বিয়ে হয়েছিল, সে ছিল আমার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী। তারা তিন ভাই ছিল। তিন ভাইয়ের পরিবার একসঙ্গেই থাকত। যৌথ পরিবার ছিল। খুব বড়ো পরিবার। একে তো ঠিকঠাক কাজ জানতাম না, তার ওপর এতগুলো মানুষের রান্নাবান্নার সব কাজ আমাকে দিয়ে করানো হত। তারপর কাপড় ধোয়া, ঘরদোর পরিষ্কার করা। কোনো কারণে কাজ করতে না চাইলে আমার শাশুড়ি যা নয় তা বলে গালাগাল করত। আর তার ছেলে তো কোনোদিন আমার কথা শোনার-ও প্রয়োজন মনে করত না। মা-ভাবিদের মুখে নালিশ শোনামাত্রই গায়ে হাত তুলত। এজন্য শরীর খারাপ হলেও কাউকে বলতে পারতাম না। একা-একা কান্নাকাটি করে আবার কাজে লেগে পড়তাম। কাঁদতে দেখলেও বলত প্রতিবেশীদের কাছে তাদের বদনাম ছড়ানোর জন্য নাটক করি। মায়ের সঙ্গে অনেকবার কেঁদেছিলাম। মায়ের তো আর কিছু করার ছিল না। তার নিজের সংসার-ই চলত ঠেলাগাড়ির মতো। বাবা বলত বয়স কম বলে আমার সহ্যশক্তি কম। সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে। অথচ আমি যে কী সহ্য করেছিলাম, তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। তাই দাঁতে দাঁত চেপে সব যন্ত্রণা সহ্য করে শ্বশুরবাড়িতেই পড়ে ছিলাম। কিন্তু একদিন চুরির অপবাদ দিয়ে তারা আমাকে এমনভাবে মারল-”
“কিসের চুরির?” কথার মাঝে বাঁধ সেধে প্রশ্ন করল মৃন্ময়ী।
“টাকা চুরির। আমার প্রাক্তন স্বামী টাকা রেখেছিল তার মায়ের কাছে। আমি জানতাম-ও না সেই টাকা উনি কোথায় রেখেছিলেন। দুদিন পরেই শুনি টাকা গায়েব। টাকা না কি রেখেছিলেন বিছানার নিচে। বিছানা গোছাতাম তো আমি, দোষ এসে পড়ল আমার ওপর। আমার কথা কেউই বিশ্বাস করেনি। স্বামী বিশ্বাস না করলে আর কাকেই বা বিশ্বাস করাতাম? সে তার মা-ভাবিদের কথা শুনেই আমাকে মারধর করে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। শরীরে মারের দাগ নিয়ে প্রমাণসহ যখন বাবার ঘরে উঠেছিলাম, তখন আমার বাবা আমাকে বিশ্বাস করেছিল। তারপর একমাস কেটে গেলেও আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আমার কোনো খোঁজ নেয়নি, ফিরিয়ে নেওয়া তো দূর। আমারও আর ওই সংসারে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। তারপর আমার বাবা লোকজন ধরে তালাকের ব্যবস্থা করে আমাকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তি কি আর এত সহজে মিলে? তখনই আমার শরীরে আরও একটা প্রাণের উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর জানতে পেরেছিলাম আমার পেটে দুই মাসের বাচ্চা।”
কথাটা বলেই রাহেলা বেগম থেমে গেলেন। বোধহয় পুরোনো ব্যথাগুলো নতুন করে তিনি অনুভব করতে পারলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“বাচ্চার কথা জানার পর আমার মা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। তাই তালাকের সিদ্ধান্ত থেকে পিছাতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সন্তানের জন্য হলেও সংসার নামক নরকে আবার ফিরে যাব। বাবার ঘরে আমি একা মানুষ-ই বাড়তি বোঝা ছিলাম। তার ওপর একটা বাচ্চার দায়িত্ব আমি কাকে দিতাম? আমার বাবা আমাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে। অথচ সে বাড়িতে যাওয়ার পর আমাদের ঘরের ভেতর পা-ও রাখতে দেয়নি আমার শাশুড়ি। আমার সঙ্গে আমার বাবাকে যা-তা বলে গালাগাল করেছিলেন। বাবা আমার পেটের সন্তানের কথা বলার পর মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে। তখন তাদের ছেলে বাড়ি ছিল না। আমি বলেছিলাম তাদের ছেলেকে খবর দিতে। সন্তানের খবর জানার পর আমাকে রাখবে কি না, তা আমার সন্তানের বাবার কথার ওপর নির্ভর করে। তারা তাদের ছেলেকে খবর দিয়ে বাড়ি এনেছিলেন। ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আর বাবা বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমার শরীর খারাপ লাগছিল। তবু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এই আশায় যে, সন্তানের খবর শোনার পর ওর বাবার মন যদি একটু গলে। অথচ আমার প্রাক্তন স্বামী বাড়ি ফিরে আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তার মা ব্যঙ্গ করে আমার সন্তানের কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে সে নিজের সন্তানকে অস্বীকার করেছিল। তার কথা শুনে আমার দুনিয়া নড়ে উঠেছিল। আমি শরীরের শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। তবু তার হাতে-পায়ে ধরে অনেক অনুনয় বিনয় করেছিলাম যেন আমার সন্তানকে সে ফিরিয়ে না দেয়। আমি নিজের প্রতি হওয়া সব অন্যায় মেনে নিলেও সন্তানের প্রতি এই অবিচার মানতে পারছিলাম না। সন্তানের জন্য আমি সেদিন আমার শাশুড়ির পা পর্যন্ত ধরেছিলাম। আমার বাবা বয়সে বড়ো হয়েও মেয়ে জামাইয়ের হাতে ধরে বহু অনুরোধ করেছিলেন। তবু তারা আমাকে রাখেনি। নিজেদের রক্তের সন্তানসহ তারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। পিতৃপরিচয়হীন সন্তান নিয়ে আমার কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। এত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি বিছানা থেকেই উঠতে পারিনি।”

মৃন্ময়ী ব্যথিত দৃষ্টি মেলে রাহেলা বেগমের যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে চেয়ে আছে। মনে-মনে সে ওই জঘন্যতম মানুষগুলোর প্রতি ভীষণ ঘৃণা অনুভব করছে, যারা একটা বাচ্চার প্রতিও একফোঁটা মায়া দেখায়নি। যে লোকটা নিজের সন্তানকে অস্বীকার করেছে, তাকে কাপুরুষ বলে গালাগাল দিতে ইচ্ছা করছে। মুখ ফুটে সে রাহেলা বেগমকে কিছু বলে সান্ত্বনা-ও দিতে পারছে না। কেমন অস্বস্তি লাগছে। অথচ রাহেলা বেগম কী নির্দ্বিধায় তাকে নিজের জীবনের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে শোনাচ্ছেন। যেন সে তার পুত্রবধূ না, সমবয়সী বান্ধবী। রাহেলা বেগম মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বাচ্চাটার কী হলো, কোথায় আছে জানার কৌতুহল জেগেছে, না?”
মৃন্ময়ী ধীর গতিতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। রাহেলা বেগমের ঠোঁটের কোণে এক ফালি তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে উঠেও মিলিয়ে গেল। সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন,
“অসুস্থ হয়ে আমি যখন বিছানায় পড়ে ছিলাম, তখনই আমার স্বামী আমাকে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমার অবস্থা তখন আরও খারাপ হয়ে পড়েছিল। আমার মা আমাকে নাকে-কানে বুঝিয়ে বলেছিলেন বাচ্চাটা না রাখতে। বাচ্চা রাখলে আমার আর বাচ্চার, দুজনের ভবিষ্যত-ই নষ্ট হবে। এক বাচ্চা নিয়ে আমাকে আরেক ঘরে পাঠাতে কষ্ট হবে। আমি রাজি হইনি। যা-ই হোক, নিজের শরীরের অংশকে কে এভাবে মেরে ফেলতে চায়? বাবা শুনে বলেছিল বাচ্চাকে যদি আমি নিজের টাকায় চালাতে পারি, তবেই যেন রাখি। আমি কোথায় টাকা পাব? উপার্জন করার ক্ষমতা তো আমার ছিল না। জীবনে ঘরের বাইরের জগত দেখিনি। বাইরের মানুষের সাথে মিশিনি। একা আমি কীভাবে দুটো জীবন সামলাব? নদীর মাঝখানে পড়ার পরও ছোট্ট একটা প্রাণকে মারার সাহস আমার হচ্ছিল না। সন্তান নিয়ে কীভাবে জীবন-যাপন করব, সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা না থাকলেও বাবা-মাকে আমি অনেক অনুরোধ করেছিলাম বাচ্চাটাকে রাখার জন্য। কিন্তু আমি কারোর মন গলাতে পারিনি। অসুস্থ অবস্থায় মা আমাকে ধরে-বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন আমি গলা ফাটিয়ে এত কেঁদেছিলাম, আমার আজন্ম মনে থাকবে। অমন কান্না হয়তো আমি পুরো জীবনেও কাঁদিনি। একইসঙ্গে সংসার হারিয়ে, বাচ্চা হারিয়ে আমি কেমন পাগল-পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক হতে আমার প্রায় দুই মাস লেগে গিয়েছিল।”

রাহেলা বেগম মোটেও কাঁদছেন না। এত পুরোনো ব্যথা তার বহু আগেই সয়ে গেছে। এখন আর কান্না আসে না। তবে বুকের ভেতরটা জমাট বেঁধে থাকে। জমাট বাঁধা কষ্টটুকু হালকা করতেই হয়তো তিনি আবারও কিছু সময় চুপ রইলেন। মৃন্ময়ী অনুভূতিশূন্য গলায় মৃদু স্বরে জানতে চাইল,
“তারপর কী হয়েছিল?”
রাহেলা বেগম বললেন,
“ছাড়াছাড়ির পর শুধু দশ মাস বাবার বাড়িতে ছিলাম। দশ মাসেই আমার বাবা-মায়ের কাছে আমি বোঝা হয়ে উঠেছিলাম। দশ মাসে আমার বাবা আমার জন্য বিশ বার ঘটক ধরেছিলেন। দশ মাস পর এক ঘটক প্রভাতের বাবার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে গিয়েছিল। ভালো পরিবার, পয়সা দেখে বাবা জেদ ধরে বসেছিলেন এখানেই আমার বিয়ে দিবেন। আমার ইচ্ছা বা মতামতের কোনো গুরুত্ব ছিল না। অভাবের সংসারে বাড়তি বোঝা হয়ে ছিলাম। বাবা-মা বোঝা হালকা করতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। বয়স কম ছিল, বুঝ-ও কম ছিল; তবু নিজের নিয়তি মেনে নিয়েছিলাম। এছাড়া তো আর আমার কিছু করার ছিল না। পড়াশোনা যতটুকু জানি, তাতে নাম লেখার চেয়ে বেশি কিছু করা যেত না। যাইহোক, প্রভাতের বাবার কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। ঘরোয়াভাবে বিয়ে করে আমাকে এনেছিলেন। বিয়ের আগে শুনেছিলাম তার একটা ছেলে আছে। কিন্তু জানতাম না ছেলে কতটুকু। এ বাড়িতে আসার পর প্রভাতকে দেখেছিলাম। ওর বয়স তখন পনেরো বছর। আমি নিজেই ছিলাম অল্পবয়সী, তার ওপর এক সন্তানহারা মা। আমার জন্য তখন পনেরো বছর বয়সী ছেলেকে সন্তানের স্নেহ দেওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই প্রভাত আমার কাছ থেকে দূরে থাকত। প্রথমদিকে আমার-ও ওকে ডাকতে অস্বস্তি হত। তাই নিজেও ওকে এড়িয়ে চলতাম। তখন আমার শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন। একটা কথা না বললেই নয় মা, এক শাশুড়ি আমাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল ঠিকই, পরবর্তীতে যে আমি মায়ের মতো শাশুড়ি পাব, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রভাতের দাদি আমাকে খুব ভালো জানতেন। কোনোদিন আমার সঙ্গে একটু রেগেও কথা বলেননি। বরং খুব বুঝিয়ে কথা বলতেন। তিনিই আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন প্রভাতকে যেন আমি এড়িয়ে না চলি। নিজের মাকে হারানোর পর থেকে প্রভাত একটু চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আমিও যদি ওকে দূরে ঠেলে রাখি, তাহলে ও পরিবারের সঙ্গে থেকেও একা হয়ে পড়বে। তার ওপর ওর বাবার সঙ্গে ওর খুব একটা ভাব ছিল না। ও না কি মায়ের পাগল ছিল। ওর বাবা-ও আমাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। আস্তে-আস্তে আমি বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলাম। প্রভাত সত্যিই পরিবারের সঙ্গে থেকেও নিজেকে আলাদা করে রাখত। অথচ ওর বয়সটা একা কাটানোর মতো ছিল না। ওকে দেখে আমার তখন খারাপ লাগত। কপালপোড়া আমি এই পরিবারে বউ হয়ে আসার পর আমার জীবনটাই বদলে গিয়েছিল। এই পরিবারে আমি যে সম্মান আর ভালোবাসা পেয়েছিলাম, তা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। অথচ প্রভাত এই পরিবারের ছেলে হয়েও কারোর ভালোবাসা ওর মন ছুঁতে পারত না। ব্যাপারটা খারাপ লাগার মতোই ছিল। তারপর থেকে আমি ওকে কাছে ডাকতাম, ওর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু ততদিনে প্রভাত যেন আমাকে নিজের শত্রু ভেবে নিয়েছিল। আমি ডাকলেও ও সাড়া দিত না। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে কথা বলত না। ওর দাদি এত করে বুঝিয়ে বলত আমাকে ‘মা’ বলে ডাকতে, ও তা মানতেই পারত না। বুঝাতে-বুঝাতে বিরক্ত হয়ে ওর বাবা কয়েকদিন ওকে মারতে-ও গিয়েছিলেন, তবু ওকে কোনোভাবেই মানানো যায়নি। উলটো ওর বাবাকে-ও ও পর ভাবতে শুরু করেছিল। এই যে দেখছো না ওর বাবার সঙ্গে ওর কেমন নীরব দূরত্ব, এসবের সূচনা তখন থেকেই। ওর একটাই কথা, ওর মা নেই। নিজের মা ছাড়া অন্য কাউকে ও মা বলে ডাকবে না। যদিও তখন আমার খুব একটা খারাপ লাগত না। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম আমি আর কোনোদিন মা হতে পারব না, তারপর থেকেই খারাপ লাগাটা অনুভব করতে পেরেছিলাম। নিজের কোনো সন্তান ছিল না, যাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতে চাইতাম, সে আমাকে মায়ের জায়গা দিতেই নারাজ ছিল। কষ্টটা তখন থেকেই বুকের ভেতর জমাট বেঁধে ছিল। ভেবেছিলাম প্রভাত বড়ো হলে হয়তো বুঝতে পারবে আমি ওর শত্রু নই। তখন হয়তো আমাকে মা ডাকবে। কিন্তু আমার কপালে আর সেই সোনার দিন দেখা হয়ে ওঠেনি। আজ পর্যন্ত-ও প্রভাতের মুখে মা ডাক শোনার ভাগ্য আমার হয়নি। এক ছাদের নিচে থাকি ঠিকই, খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ও আমার সঙ্গে কথাও বলতে চায় না। ওকে টেবিলে খাবার দিয়ে আমার উঠে যেতে হয়। আমার সামনে বসে খেতেও ওর আপত্তি।”

ব্যাপারটা ধরতে পেরে মৃন্ময়ী শুধাল,
“এই কারণেই প্রভাতের খাওয়া শেষ হলে আপনি খেতে বসেন?”
রাহেলা বেগম মাথা ঝাঁকালেন, অর্থাৎ হ্যাঁ। মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“তাই বলে প্রভাত এত বছরেও বুঝবে না? আমি ভাবতাম ও একটু পাগলাটে স্বভাবের হলেও চিন্তাধারার দিক থেকে অন্যরকম। এবার বুঝতে পারছি, কেন ও সবসময় আপনার প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলেই এড়িয়ে যায়।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“থাক মা, তুমি এসব নিয়ে ওর সাথে কথা বলতে যেয়ো না। শুধু-শুধু রেগে যাবে। আমি এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কখনও তো এসব কথা কারো সাথে বলি না। আজ তুমি জিজ্ঞেস করেছ বলে বললাম। নইলে আমার মনের কথা মনেই থাকত।”
“আমি তো আপনার ঘরের মানুষ আম্মা। এখন থেকে আপনি আমার সাথে সব কথা বলবেন। কোনো কথা মনে চেপে রাখবেন না।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“বলব মা, বলব। আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমার মতো একটা মেয়ে ঘরের বউ হয়ে আসুক। আমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। বিশ্বাস করো, আমার শ্বাশুড়ির কাছে আমি যেমন মেয়ের মতো ছিলাম, তুমিও আমার কাছে আমার মেয়ের মতোই থাকবে। আল্লাহর কাছে লাখ-লাখ শুকরিয়া, তিনি আমার ছেলের কপালে এত ভালো মেয়ে জুটিয়ে দিয়েছেন।”
মৃন্ময়ী হাসিমুখে বলল,
“দোয়া করবেন আম্মা, আমি যেন আজীবন আপনাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারি। আর আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি প্রভাতকে বুঝাব। ওকে বুঝতে হবে একজন মাকে ও দূরে সরিয়ে রাখছে। যেচে মায়ের স্নেহ, মমতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখনও না বুঝলে আর কবে বুঝবে? ওকে বুঝতেই হবে।”
রাহেলা বেগম চিন্তিত মুখে বারণ করে বললেন,
“না-না মা, এসবের কোনো দরকার নেই। তুমি বলেছ, এটাই আমার কাছে অনেক। আমার কারণে পরে ও তোমার সাথে রাগ করবে।”
মৃন্ময়ী তাকে আস্বস্ত করে বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমার সাথে ও রাগ করবে না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি আপনার কাছে আপনার সন্তান ফিরিয়ে দিবো। আপনি শুধু আমাকে দোআ করবেন।”


কোচিং থেকে বেরিয়েই রোজকার মতো প্রভাতের হাসিমুখটা চোখে পড়ল মৃন্ময়ীর। তাকে দেখামাত্রই প্রভাত এগিয়ে এসে তার ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। প্রশ্ন করল,
“টায়ার্ড?”
দুদিকে মাথা নেড়ে মৃন্ময়ী বলল,
“টায়ার্ড তো তোমার হওয়ার কথা। এত করে বললাম তাড়াহুড়া করে অফিস থেকে এসে আমাকে নিয়ে যেতে হবে না। এটুকু রাস্তা আমি একাই যেতে পারব। তুমি শুনছোই না।”
“বিয়ের আগে যে বিকেলে একবার স্কুল গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতাম, রাতে আবার কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম?”
“তখন তো আর আমি তোমার বউ ছিলাম না। আর এখন যেখানেই থাকি, সেই তোমার ঘরেই ফিরে যেতে হবে। এরপরও তোমার কী দরকার এত দৌড়ঝাঁপ করার?”
“তোমার কথায় আমি বিকালে স্কুল গেইটে যাওয়া বাদ দিয়েছি। সারাদিন অফিস করে রাতে তোমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরি, তা-ও বারণ করছো?”
“তোমার ভালোর জন্যই তো বলছি।”
“আমার ভালোর কথা ভাবলে তোমার উচিত আমাকে ডেকে তোমার কাছে আনা। তোমাকে নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফেরা থেকে শুরু করে সকালে ঘুম থেকে ওঠা পর্যন্তই তো আমি তোমাকে কাছে পাই। কত অল্প সময়! তোমার উচিত চব্বিশ ঘন্টা আমার কাছে থাকা।”
“তাহলে বরং এক কাজ করি। আমার চাকরি-বাকরি সব ছেড়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোমার অফিসে গিয়ে বসে থাকি। তুমি আমার চেহারা দেখে-দেখে কাজ করো। কেমন হয়?”
প্রভাত চমৎকৃত হয়ে বলল,
“খুবই ভালো হয়। এরচেয়ে ভালো মাস্টার্সের সার্টিফিকেটটা তুলেই তুমি আমার অফিসে জয়েন হয়ে যেয়ো।”
“অ্যাহ্! আমার ইচ্ছা শিক্ষকতা করা, আমি গিয়ে বসে থাকব তোমার অফিসে? বললেই হলো?”
“তাহলে তো আর আমার দৌড়ঝাঁপ করতে হত না। একসঙ্গে কাজ করতে পারতাম। সারাদিন তোমাকে চোখের সামনে পেতাম।”
মৃন্ময়ী বলল,
“সারাদিন চোখের সামনে থাকি না বলেই তো মনের ছটফটানি টের পাও। দেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। এটাই ভালো।”
“কাজ শেষে একসঙ্গে বাড়িও ফিরতে পারতাম।”
“একসঙ্গে বাড়ি ফেরা কি খুব জরুরী?”
“অবশ্যই। অফিস থেকে বেরিয়ে আমি কতক্ষণে বউয়ের মুখ দেখব, সেই তাড়ায় থাকি। আগেভাগে বাড়ি গিয়ে বসে থাকার চেয়ে কোচিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঢের ভালো। আর নিজের ভালোর জন্য রাত-বিরাতে তোমাকে একা বাড়ি ফিরতে দিবো, আমি কি এতটাই আহাম্মক?”
“আমার বাড়ি কোচিং থেকে দূরে বলে বিয়ের আগে তোমার চিন্তা ছিল। এখন তো তোমার বাড়ি কাছেই, এটুকু পথ যেতে আমার বিপদ হবে না।”
“আমি রিস্ক নেব কেন? আমার বউয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব অবশ্যই আমার। তুমি হাজারবার বারণ করলেও আমি আসব।”
মৃন্ময়ী হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা এসো। তোমাকে বারণ করাও ভুল।”
“বললাম চাইলে কোচিং ছেড়ে দিতে পারো, তা তো শুনছো না।”
“আগে একটা প্রোপার চাকরি পাই, তারপর ছেড়ে দিবো।”
প্রভাত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“তোমার ইচ্ছা। মাকে কল করেছিলে?”
মৃন্ময়ী দাঁতে জিব কে’টে কপাল চাপড়ে বলল,
“ক্লাসের চাপে একদম ভুলে গেছি। বাড়ি ফিরে কথা বলব নে।”
“আমি কল করার পর তো বলল তার মেয়ে না কি দিন-দিন তাকে ভুলেই যাচ্ছে।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“ওসব তো মায়ের অভিমানী কথা। তাছাড়া মায়ের এখন মেয়ের চেয়ে মেয়ের জামাইয়ের প্রতি দরদ বেশি।”
“হ্যাঁ, জামাই খোঁজ নেয় বলে তোমার নিতে হবে না।”
“হবে না কখন বললাম? নিই তো। মাঝে-মাঝে দেরী হয়ে যায়। মা কী বলল?”
“সে তো নিজের রোগ-শোক লুকিয়ে কথা বলে। মৃত্তিকা বলল মায়ের ডায়াবিটিস এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আছে। সুযোগ বুঝে গিয়ে দেখে এসো। দেখি, কাল-পরশু গিয়ে আমি ঔষধ কিনে দিয়ে আসব।”
“আমি যাওয়ার সময় ঔষধ কিনে নিয়ে যেতে পারব।”
“আমি নিয়ে গেলে তোমার কী সমস্যা?”
“সমস্যা নেই।”
“তাহলে?”
মৃন্ময়ী প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“কী কথা?”
“একটু দাঁড়াও। পরে বাড়ি ফিরি।”
মৃন্ময়ীর সঙ্গে প্রভাত-ও থামল। কৌতুহল নিয়ে সে মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“এখানে দাঁড়িয়ে কী কথা বলতে হবে? বাড়ি ফিরে বলতে পারবে না?”
“না, এখনই বলতে চাই। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা।”
“বলো তাহলে।”
“তুমি কেন তোমার মাকে এখনও পর্যন্ত মা বলে ডাকো না?”
প্রশ্ন শুনেই প্রভাত পা চালিয়ে বলল,
“বাড়ি চলো। আমার ক্ষুধা পেয়েছে।”
মৃন্ময়ী নড়ল না। এক জায়গাতেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। প্রভাত ফিরে তাকিয়ে বলল,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার কথা না শোনা পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়ব না।”
“কী মুশকিল! রাত বাড়ছে তো মৃন্ময়ী।”
“বাড়ুক। তুমি চলে যাও, তারপর আমাকে ভূতে ধরুক।”
প্রভাত দু’পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এসব তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা?”
“হ্যাঁ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। কারণ তুমি ইচ্ছা করে মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছ। আম্মা তোমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। কিন্তু তুমি তা চোখে দেখেও দেখো না। কেন প্রভাত? তুমি জানো আম্মা মনে-মনে কত কষ্ট পান?”
প্রভাত সশব্দে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি তোমাকে বারবার বলেছি এসব নিয়ে না ঘাঁটতে। তবু তুমি কেন সবসময় এই প্রসঙ্গ-ই টানো?”
মৃন্ময়ী বেজার মুখে বলল,
“তুমি আমার সাথে রাগ করছো?”
প্রভাত হোঁচট খেয়ে বলল,
“রাগ কখন করলাম?”
“এই তো মাত্রই করলে।”
“রাগ করিনি।”
“তাহলে বিরক্ত তো হয়েছ।”
“না।”
“বললেই হলো? তুমি তাহলে আজকাল আমার ওপর বিরক্ত হতে শুরু করেছ?”
প্রভাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“না রে বাবা, থুক্কু, বউ। তুমি হঠাৎ কেন বাচ্চামি করছো? অদ্ভুত!”
“তাহলে তুমি আমার কথা শুনছো না কেন?”
প্রভাত এগিয়ে এসে মৃন্ময়ীর হাত ধরে বলল,
“এমন অদ্ভুত আচরণ কোরো না ম্যাডাম। বাড়ি চলো প্লিজ।”
মৃন্ময়ী বলল,
“একটু বসে আমার দুটো কথা শোনার ধৈর্য তোমার নেই? আম্মার প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইছি বলে? তুমি কখনও তাকে বুঝতে চেয়েছ? জানো তার মনে কত দুঃখ? আজীবন সে কত কষ্ট ভোগ করে তোমাদের সংসারে এসেছিল? তোমাকে সে এত ভালোবাসে, তবু তুমি কোন কারণে এখনও তাকে এড়িয়ে চলো? তার সাথে আমার কথা হয়েছে। সে তার মনে চেপে রাখা সব কথা আমাকে বলেছে, যার এক অংশ-ও তুমি জানো না। তুমি শুধু নিজেকে মায়ের ভালোবাসা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছো না, একজন মাকে-ও সন্তানের ভালোবাসা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছো। কেন প্রভাত?”
“আমার মা বহু আগেই মরে গেছে। চলো।”
“তুমি কি চাও ভবিষ্যতে তোমার সন্তান নিজের বাবার আর দাদির সম্পর্কের জটিলতা দেখুক? তুমি এমন করলে তোমার সন্তান তোমার কাছ থেকে কি শিখবে, বলবে আমাকে?”
প্রভাত অনুরোধের সুরে বলল,
“এসব বাদ দাও না প্লিজ।”
“উঁহু, আজ তোমাকে এসব বিষয় ক্লিয়ার করতেই হবে। নইলে আমি এখান থেকে নড়ব না।”
“কেন এমন করছো?”
মৃন্ময়ী প্রভাতের হাত চেপে ধরে মুখ ফুলিয়ে ডাকল,
“প্রভাত-”

এরপর আর প্রভাত কথা বাড়াতে পারল না। মৃন্ময়ী গাল ফুলিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। এ চাহনি এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। এমন সাধ্য সে কোনোদিন পেতে-ও চায় না। শেষমেশ প্রভাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বলো, শুনছি।”
মৃন্ময়ী খুশি হয়ে বলল,
“চলো বসি।”
“বসতে হবে?”
“হ্যাঁ। চা-ও খাব।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর হাতটা মুঠোয় নিয়েই হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“হঠাৎ এমন ত্যাড়ামি কোত্থেকে শিখলে?”
একগাল হেসে মৃন্ময়ী বলল,
“হঠাৎ কোথায়? এক ত্যাড়া মানুষ যতদিন ধরে আমার পিছু নিয়েছে, ততদিন ধরেই তো হাতে-কলমে ত্যাড়ামি শিখে আসছি।”
প্রভাত হেসে ফেলল। বলল,
“আচ্ছা, সুযোগ বুঝে খোঁচা মারা হচ্ছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“একদমই না। আমি তো কেবল সত্য কথা বললাম। একদম ভেজালহীন সত্য কথা।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১৬+১৭

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৬.
আহমদ তরফদার মৃন্ময়ীর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। মৃন্ময়ীর মায়ের সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন। মৃন্ময়ীকে দেখতে যাওয়ার কথা বলেছেন। মৃন্ময়ীর মা এবারেও মৃন্ময়ীকে না জানিয়ে পাত্রপক্ষকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে দিয়েছেন। প্রভাত ভাবেনি বাবা এত সহজে রাজি হয়ে যাবে। সে ভেবেই নিয়েছিল ব্যাপারটা নিয়ে বাড়িতে আরও কদিন যুদ্ধবিগ্রহ চলবে। কিন্তু তার উলটোটা হওয়ায় সে একটু অবাকই হয়েছে। আহমদ তরফদার এত সোজা মানুষ না। কী ভেবে হঠাৎ নিজে থেকেই রাজি হয়ে গেলেন জানা নেই প্রভাতের। তবু ঝামেলা না বাড়ায় সে মনে-মনে খুশি হয়েছে। অধীর আগ্রহে সে অপেক্ষা করছে পাত্র হয়ে মৃন্ময়ীকে দেখতে যাওয়ার। তার চেয়েও বড়ো অপেক্ষা বর সেজে যাওয়ার। যদিও তার জন্য তাকে আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে। প্রস্তাব পাঠানোর পর আবার মৃন্ময়ী তাকে কী কথাবার্তা বলে, তা-ও শুনতে হবে। এই মেয়েটার ত্যাড়ামিই এখন তার সবচেয়ে বড়ো দুশ্চিন্তার কারণ। বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আর সাজেদা বেগম প্রভাতের পরিবারকে আসতে বলে দিয়েছেন, এই খবর মৃন্ময়ীকে প্রথমে দিলো মৃদুলা। খবর শুনে মৃন্ময়ী কিছু মুহূর্তের জন্য পুরোপুরি আহাম্মক বনে গেল। এবার আর সে মাকে জিজ্ঞেস করতে ছুটে গেল না। সবার আগে জিজ্ঞেস করল প্রভাতকে। আজ সে প্রভাতকে সরাসরি কল করে বসল। অন্য সময় হলে প্রভাত অবাক হত। আজ কাল পেয়ে অবাক হলো না। রিসিভ করে হাসিমুখে কথা বলল,
“ম্যাডাম আজকাল আমাকে এত বেশি মিস করছেন?”
মৃন্ময়ী সে কথার উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল,
“এটা কি করলে প্রভাত?”
“কী করলাম?” না বুঝার ভান করে শুধাল প্রভাত।
“তুমি জানো না তুমি কী করেছ?”
“ওহ্! বিয়ের কথা বলছো?”
“তুমি আমাকে জানিয়ে এটা কেন করলে?”
“না জানিয়ে কোথায়? তোমাকেই তো সবার আগে জানিয়েছিলাম। সেদিন যে বললাম, মনে নেই তোমার?”
“তাই বলে এতদূর? মায়ের সাথে কখন যোগাযোগ করলে, কখন বাড়ি আসার কথাবার্তা হলো, কোনোকিছু আমাকে জানিয়েছ তুমি?”
“জানালে কী হত?’
“কী হত মানে? এত বড়ো একটা ব্যাপার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?”
“জানালে বাঁধা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে?”
এবার আর মৃন্ময়ী উত্তর দিতে পারল না। সত্যিই তো। বাঁধা দেওয়া ছাড়া আর কীইবা বলত সে? প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“সত্য কথা শুনে চুপ হয়ে গেলে তো? এজন্যই তোমাকে জানাইনি। বাঁধা তো আমি তোমাকে দিতেই দিবো না।”
“এটা কেমন কাজ প্রভাত? তুমিও দেখি আমার মায়ের মতো আচরণ করছো।”
“শাশুড়ির আদরের হবু জামাই তো, তাই।”
“একটা সত্যি কথা বলো তো। মাকে তুমি কীভাবে পটালে?”
“আমার ভালোবাসার শক্তি দিয়ে।”
“ফাজলামি কোরো না, সিরিয়াসলি বলো।”
“একসঙ্গে এতকিছু জেনে কী করবে? একটু অপেক্ষা করো। বিয়ের পর তো সবসময় আমাকে কাছেই পাবে। তখন একান্তে বসে সব প্রশ্নের উত্তর জেনে নিয়ো।”
প্রভাত সবকিছুতে এত ত্যাড়া কথা বলে! অথচ মৃন্ময়ীর কাছে বর্তমান পরিস্থিতি খুবই সিরিয়াস। প্রভাত এমন ত্যাড়া কথা বললে কীভাবে হবে?


মায়ের সাথে মৃন্ময়ীর কথা হয়েছে। বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই মা যেভাবে তাকে কড়া গলায় কথা শুনালেন! সাথে এ-ও বললেন, এই প্রভাতকে পছন্দ করার কারণেই না কি এতদিন তার কোনো ছেলেকে পছন্দ হয়নি। মৃন্ময়ী অস্বীকার করলেও মা তার কথা মানতে নারাজ। ওদিকে প্রভাত-ও নাছোড়বান্দা। যতবার তার সাথে দেখা হয়েছে, ততবারই সে বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে পিছাতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। মৃন্ময়ীর কোনো অজুহাত-ই সে কানে তুলছে না। তার এক কথা, ‘হয় এবার তোমাকে বিয়ে করব, নয় আজন্মের মতো বিয়ের‌ নাম ভুলব।’ মৃন্ময়ী না পারছে কাউকে কিছু বুঝাতে, না পারছে নিজেকে বুঝাতে। অথচ এসব ক্যাচাল চলতে-চলতেই প্রভাতের প্রতিক্ষার দিন ফুরিয়ে এল। আগামীকাল তারা মৃন্ময়ীকে দেখতে আসবে। ঘরে বসে মৃন্ময়ী এসব নিয়েই আকাশ-পাতাল চিন্তা করছিল। তার চিন্তা-ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটাল মৃত্তিকা আর মৃদুলা। তারা দুজন হঠাৎ রুমে এসে উপস্থিত হলো। মৃত্তিকা বিছানায় বসতে-বসতে জিজ্ঞেস করল,
“কী করছিস আপা?”
মৃন্ময়ী দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“তোরা না ঘুমিয়ে এখানে কী করছিস?”
মৃদুলা বলল,
“আমরা তোমার সাথে গল্প করতে আসতে পারি না?”
“তা পারবি না কেন? বোস।”
মৃদুলা বসল। মৃত্তিকা শুধাল,
“কালকের বিষয়ে কী ভাবলি আপা?”
মৃন্ময়ী বলল,
“এই তোদের গল্পের বিষয়?”
মৃদুলা তার একহাত ধরে বলল,
“আহা আপা! রাগ কোরো না। কালকের বিষয়টা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সাথে একটু কথাবার্তা বলো না ওই বিষয়ে।”
“কী আর বলব বল? মা আমার কোনো কথা কানে তুলছে?”
“মায়ের কথা আপাতত বাদ দাও। সে তো আজীবনই এমন। তুমি আমাদের সাথে কথা বলো।”
মৃত্তিকা বলল,
“হ্যাঁ আপা, আমরা তোর সব কথা শুনতে চাই। তোর মনে যা চলছে বল আমাদের সাথে।”
মৃন্ময়ী মলিন মুখে বলল,
“আমার মনে যা চলছে সবটাই কনফিউশন রে।”
“কিসের কনফিউশন? তুই কি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিস?”
“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
মৃদুলা বলল,
“হয়তো স্বাভাবিক। তবু একটা মানুষ এত করে বুঝানোর পরও তোমার কনফিউশন কীভাবে থাকে আপা? এত কনফিউশন নিয়ে কি জীবন চলে?”
মৃন্ময়ী তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার জায়গায় থাকলে বুঝতি রে মৃদুলা, একটা মেয়ে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে থাকলে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতেও সাহস পায় না, কনফিউশনে ভোগে। নইলে একটা সুখী জীবন কি আমার-ও প্রাপ্য ছিল না, বল?”
মৃত্তিকা বলল,
“প্রাপ্য বলেই তো আমরা তোর সাথে কথা বলতে চাইছি আপা। তোর মনে আমাদের নিয়ে কনফিউশন চলছে তো? প্লিজ তুই এই কনফিউশন থেকে বেরিয়ে আয়।”
“কীভাবে? কীভাবে বেরোতে বলছিস তোরা আমাকে? বিয়ে করে? বিয়ে করলেই আমার কনফিউশন কে’টে যাবে?”
“বিয়ে করলে তোর কনফিউশন কাটবে না। তোকে কনফিউশন কাটিয়ে বিয়ে করতে হবে। যতদিন তুই মনের ভেতর কনফিউশন রাখবি, ততদিন তুই বিয়ের কথাও ভাবতে পারবি না।”
“কার ভরসায় আমি কনফিউশন কাটাব রে? কে আছে আমাদের? বাবা তো নেই।”

কথাটা বলতে গিয়ে মৃন্ময়ীর গলা ধরে গেল, চোখ ভর্তি জল চলে এল। মৃত্তিকা তার হাত চেপে ধরে বলল,
“আপা, কার জীবনের দৈর্ঘ্য কতটুকু তা আমরা কেউ জানি না। আজ আমরা এই পরিস্থিতিতে আছি। আল্লাহ্ চাইলে ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে। আমরা আজীবন এমন থাকব না। সবার জীবন পালটাবে। তোর জীবন-ও পালটাবে। জীবনের শেষ অবধি তুই একা কাটাতে পারবি না, এটা তোর নিজের প্রতি করা সবচেয়ে বড়ো অন্যায় হবে। অন্তত একজন মানুষকে আকড়ে ধরে বাকি জীবনের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একসঙ্গে জীবনযাপন করার জন্য হলেও তোকে বিয়ে করতে হবে। কারোর পছন্দে তোকে বিয়ে করতে হবে না। তোর যাকে নিজের জন্য সঠিক মনে হবে, যার সাথে তোর একটা শান্তিপূর্ণ জীবনের সম্ভাবনা দেখবি, তাকেই বিয়ে করবি।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তুইও তো নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলি মৃত্তিকা। শেষ পর্যন্ত শান্তি রয়েছে?”
“রয়নি, কারণ আমি ভুল মানুষকে পছন্দ করেছিলাম। আমি জানি তুই আমার মতো সেই ভুল করবি না। প্রভাত ভাই তোর জন্য কতটুকু সঠিক, তা তো আমাদের চেয়েও তোর মন ভালো জানে। তাই না, বল? তোর কি মনে হয়, প্রভাত ভাই আর শফিক এক পাল্লার মানুষ?”
মৃন্ময়ী ডানে-বায়ে মাথা দোলাল। মৃত্তিকা আবারও শুধাল,
“এতদিনে প্রভাত ভাইকে যতটুকু চিনেছিস তাতে কি ওনাকে বিশ্বাসযোগ্য মানুষ মনে হয়?”
মৃন্ময়ী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। মৃত্তিকা বলল,
“সত্যি করে বল।”
“মিথ্যা কোথায় বললাম? লোকের কাছে ও মানুষ যেমনই হোক, যারা ওকে কাছ থেকে চিনে তারাই শুধু জানে ওর মনটা আসলেই ভালো।”
“তারমানে তুই ওনাকে বিশ্বাস করিস?”
মৃন্ময়ী একটু ইতস্তত করে উত্তর দিলো,
“ওই… করি। অবিশ্বাস করার তো কারণ নেই।”
“তবু তো করছিস।”
“কোথায়?”
“এই যে নিজের জীবনের ক্ষেত্রে। ওনার প্রতি বিশ্বাস থাকলে তোর এত কনফিউশনে ভোগার প্রশ্নই আসত না।”
মৃন্ময়ী আবারও প্রত্যুত্তর হারাল। মৃদুলা বলল,
“আচ্ছা আপা, তোমার কি মনে হয় প্রভাত ভাই তোমাকে সত্যি-সত্যি ভালোবাসে?”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো,
“হুম।”
“তুমি তাকে ভালোবাসো?”
“মৃদুলা, বেশি পেকে গেছিস। নিজের কাজে যা।”
মৃন্ময়ীর কপট রাগ দেখে মৃদুলা হেসে বলল,
“দেখেছ? তুমিও তবে প্রভাত ভাইকে ভালোবাসো। কিন্তু স্বীকার করতে চাও না।”
মৃত্তিকা বলল,
“সে তোকে ভালোবাসে, তুইও তাকে ভালোবাসিস। দুজনের ভালোবাসা-ই সত্যি। একজন আরেকজনকে বুঝতে পারিস। তোরা একে অপরের জন্য পারফেক্ট। এর বেশি আর কী চাই? ভরসা রাখ আপা, উনি তোকে হতাশ করবেন না।”
মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি জানি রে। ওকে নিয়ে আমার তেমন ভয় নেই। আমি জানি ও আমাকে ভালো-ই রাখতে চায়। কথা দিয়ে তা ভাঙার মানুষ ও না। ও আমাকে এ-ও বলেছে যে, আমার পরিবারকে ও নিজের পরিবার ভাববে। আমার কোনো সিদ্ধান্তে, কোনো কাজে বাঁধা দিবে না। তবু বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবন তো এক হয় না।”
মৃদুলা বলল,
“প্রভাত ভাই যখন কথা দিয়েছে, তখন সব ঠিকঠাক থাকবে আপা। দেখো, আপুর ডেলিভারির পর তো আবার সে কাজে যাবে। দরকার হলে আমিও টিউশন বাড়িয়ে নেব। আমাদের জীবন চলে যাবে আপা।”

মৃত্তিকা-ও গলা মিলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আপা, তুই আর এসব নিয়ে ভাবিস না। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, আমি মাকে আর মৃদুলাকে দেখে রাখব। প্রভাত ভাইকে যতটুকু চিনেছি, তাতে আমার-ও মনে হয় না সে তার কথা ভাঙবে। প্লিজ আপা, তুই এবার শুধু নিজেকে নিয়ে ভাব। আমরা স্বার্থপরের মতো আর তোকে ধরে রাখতে চাই না। মা তোকে নিয়ে দিন-রাত দুশ্চিন্তা করে। তার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে দেখ। সে শুধু তোর একটা সুন্দর, সুখী সংসার দেখতে চায়।”
মৃদুলা অনুরোধের সুরে বলল,
“প্লিজ আপা, এবার আর ‘না’ কোরো না। প্রভাত ভাইয়ের মতো মানুষ হারালে এমন মানুষ আবার তোমার জীবনে আসবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। মা এবার অনেক আশা নিয়ে আছে।”
মৃন্ময়ী কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করল না। তার মাথা কেমন ফাঁকা লাগছে। মনটা এত বেশি আবেগী হয়ে উঠেছে যে চোখ দুটো বারবার ভিজিয়ে দিচ্ছে। এ কেমন কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়ল সে?


প্রভাতসহ তার বাবা, মা আর চাচি এসেছে মৃন্ময়ীর বাড়িতে। মৃন্ময়ীর মা তাদের খুশিমনে আপ্যায়ন করছেন। মৃদুলা সব কাজে মাকে সাহায্য করছে। মৃত্তিকা চেপে ধরেছে মৃন্ময়ীকে। মৃন্ময়ী সাজগোজ করতে নারাজ ছিল। মৃত্তিকা তাকে শাড়ি পরিয়ে হালকা সাজিয়ে ছেড়েছে। তাকে ভীষণ আনন্দিত দেখাচ্ছে। মৃন্ময়ী খেয়াল করে বলল,
“তুই এত খুশি কেন?”
মৃত্তিকা বলল,
“খুশি হব না? আমার বড়ো আপার বিয়ে বলে কথা! কত্ত অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।”
“এখনও সামনেই গেলাম না, বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।”
“সামনে গেলেই তো বিয়ে ফাইনাল।”
“তোকে বলেছে?”
মৃত্তিকা হাসিমুখে বলল,
“আড়াল থেকে তাদের কথাবার্তা শুনেই বুঝেছি।”
“কী বুঝেছিস?”
“এই যে তারা মূলত তোকে পুত্রবধূ করার পাকাপোক্ত পরিকল্পনা নিয়েই দেখতে এসেছে। শোন আপা, তোর বিয়ের দিন-ও কিন্তু আমি-ই তোকে সাজিয়ে দিবো। তোকে বউ সাজানোর খুব শখ আমার।”
“কেন?”
“জানি না। শুধু জানি আমার মন শান্তি পাবে।”
মৃন্ময়ী হাসল। সময় দেখতে ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে ভেসে থাকা প্রভাতের ম্যাসেজ চোখে পড়ল। আরও দশ মিনিট আগে সে লিখেছে,
“কত সাজছো ম্যাডাম? তোমাকে না বলেছিলাম সাজগোজের পেছনে বেশি সময় নষ্ট করবে না? তুমি আজ মুখে এক থাবা কালি মেখে এলেও আমি তোমাকে বউ বানিয়ে ছাড়ব। তাড়াতাড়ি এসো না। বসে থাকতে-থাকতে আমার কোমর ব্যথা হয়ে গেল। হার্টটাকে-ও আর সামলানো যাচ্ছে না। দ্রুত দেখা দিয়ে আমাকে বাঁচাও প্লিজ।”

পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে মৃন্ময়ী লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারল না। পাত্রের জায়গায় প্রভাত বসে বলেই হয়তো তার লজ্জা এবার আকাশ ছুঁয়েছে। অন্যান্যবার পাত্রপক্ষের মহিলারা যেভাবে তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নানান প্রশ্ন করেছিল, এবার মৃন্ময়ীর সাথে তেমনটা হলো না। হাতেগোনা কয়েকটা প্রশ্ন করল প্রভাতের মা-চাচি। মৃন্ময়ী বুঝতে পারল তারা আগে থেকে সবকিছু জেনেই এসেছেন, বিধায় অত প্রশ্নের ঝঞ্ঝাটে যাচ্ছেন না। একটা ব্যাপার না চাইতেও মৃন্ময়ীর নজরে পড়ল। তা হচ্ছে প্রভাতের মায়ের আচরণ। মহিলা হাসিমুখে খুব সুন্দরভাবে কথা বলছেন। মায়ের কাছে প্রভাতের-ও খুব প্রশংসা করছেন। কিন্তু প্রভাত যে বলেছিল তার মা তাকে ছেলে মনে করে না? মায়ের প্রতি তার যা অভিযোগ, তাতে মৃন্ময়ী ভেবেই নিয়েছিল মহিলা হয়তো ভীষণ খারাপ ধরনের। কথাবার্তা কটু, আচরণ অসহ্যকর। অথচ এখন মনে হচ্ছে তার কল্পনা পুরোটাই ভুল। মহিলা তো সম্পূর্ণ-ই তার বিপরীত ধরনের মানুষ। কিন্তু মহিলা কি সত্যিই এমন? না কি এটা কেবলই লোকদেখানো ভালোমানুষী? প্রভাত-ই বা তাকে মিথ্যা বলবে কেন? মৃন্ময়ী কেমন কনফিউশনে পড়ে গেল। বিয়ে-টিয়ের চিন্তা-ভাবনা রেখে তার সম্পূর্ণ মনোযোগ গিয়ে বসে আছে মহিলার দিকে। কৌতুহলবশত লজ্জা ডিঙিয়ে সে একবার মাথা তুলে তাকাল কেবল মহিলার মুখটা দেখার জন্য। দেখতেও সে যথেষ্ট সুশ্রী। হাসি-হাসি মুখ। বয়সটা হয়তো মৃন্ময়ীর মায়ের চেয়েও কম। এই মহিলা প্রভাতের সৎ-মা, তা-ই আর মৃন্ময়ীর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করল না। কী আশ্চর্য ব্যাপার!

মূর্তির মতো চুপটি করে বসে থাকতে মৃন্ময়ীর ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। ভাগ্যিস তাকে বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখা হয়নি। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পরেই তাকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। সে ভেতরে চলে আসার পর মায়ের সাথে পাত্রপক্ষের আলোচনা বসল। মৃদুলা আর মৃত্তিকা আড়াল থেকে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে সেই আলোচনা শোনার জন্য। মৃন্ময়ী ধরেই নিয়েছিল এবারেও মা একই কাজ করবে। তাকে কোনোকিছু জিজ্ঞেস না করেই পাত্রপক্ষকে আশা দিয়ে বসবে। কিন্তু মৃত্তিকা আর মৃদুলা এসে খবর দিলো মা এবার তেমনটা করেইনি। বরং সে বলে দিয়েছে মেয়ের সাথে কথা বলে তাদের জানাবেন। প্রভাতের মা না কি এ-ও বলেছিলেন যে, তারা চাইলে আজ-ই নিজেদের মধ্যে স্বল্প আয়োজনে বিয়ের কাজ সেরে ফেলবেন। তাদের না আছে কোনোরকম দাবিদাওয়া, না চান বড়ো আয়োজন। তবু সাজেদা বেগম একটু সময় চেয়েছেন। তাড়াহুড়া করে তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে চান না। মৃন্ময়ী বেশ বুঝতে পারল মৃদুলা আগেভাগে মাকে সব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রভাতের বিষয়টা-ও যে মাকে এই মেয়ে-ই বুঝিয়েছে, এ-ও মৃন্ময়ী ঢের বুঝতে পেরেছে। এবার তিনজন জোট বেঁধে একসঙ্গে কোমর বেঁধে নেমেছে তাকে বিদায় করার জন্য।


পরদিন স্কুল ছুটির পর মৃন্ময়ী রাস্তায় বেরোনোর সাহস পেল না। ভয়ে নয়, লজ্জায়। রাস্তায় বেরোলেই প্রভাতের মুখোমুখি হতে হবে যে! গতকালের ঘটনার পর মৃন্ময়ী প্রভাতের মুখোমুখি হতেই চাইছে না। ওই ছেলের মুখ যা লাগাম ছাড়া, দেখা হলেই কী না কী বলে দিবে! কিন্তু ছুটির পর মৃন্ময়ী কতক্ষণ-ই বা বসে থাকতে পারবে? ইতোমধ্যে ক্লাসরুমগুলোতে তালা পড়ে গেছে। টিচার্স রুমে-ও এক্ষুনি তালা পড়বে। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে মৃন্ময়ী স্কুল থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে-সঙ্গে যম তার সামনে উপস্থিত হলো। অবশ্য যম মহাশয় আগে থেকেই অপেক্ষারত ছিল। মৃন্ময়ীকে দেখেই সে প্রশ্ন করল,
“এত দেরী করে বেরোলে যে?”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
ছোটো করে উত্তর দিয়েই মৃন্ময়ী নিজের মনে হাঁটা দিলো। প্রভাত তার সাথে হাঁটতে-হাঁটতে তার মুখোভাব লক্ষ্য করল। তারপর প্রশ্ন করল,
“তুমি কি আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছ? ম্যাডাম? কথা বলছো না যে?”
মৃন্ময়ী গম্ভীর মুখে বলল,
“কিছু বলার নেই।”
“বিয়ের ব্যাপারেও না?”
“আমার কথা শোনার প্রয়োজন আছে তোমাদের?”
“অবশ্যই আছে, যদি তোমার কথা শোনার মতো হয়।”
“আমার কথা তো শোনার মতোই না। তোমাদের সব কথা শোনার মতো।”
“উঁহু, এখনই এত ঝগড়া করলে হবে? বিয়ের পরের জন্য কিছু বাকি রাখো।”
“তোমাকে কে বিয়ে করবে?”
“অবশ্যই তুমি। বিয়ের জন্য সবাই প্রস্তুত হয়ে আছে, এখনও কনফিউজড থাকলে চলবে?”
“আমরা সময় চেয়েছি, এখনও মতামত জানাইনি।”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“আমি জানি তো তোমার মনের মতামত। মুখে যতই ‘বিয়ে করব না, করব না’ করো, মনে-মনে যে আমার বউ সাজার স্বপ্ন বুনছো, তা আর অস্বীকার করে লাভ নেই। আমি সব জানি।”
“তুমি তো সবজান্তা শমসের।”
“শুধু তোমার জন্য।”

ব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে মৃন্ময়ী প্রভাতের দিকে বাড়িয়ে ধরল। প্রভাত ভ্রু কুঁচকে বলল,
“বিয়ে ভাঙার জন্য হবু বরকে ঘুষ দিচ্ছ না কি? তাহলে পাঁচ কোটি টাকা দিলেও আমি রাজি নই, দুঃখিত। আমার ভালোবাসার মূল্য এত কম নয়।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল,
“তোমাকে ঘুষ কে দিচ্ছে? এটা তোমার পাওনা টাকা।”
“পাওনা টাকা! কিন্তু তুমি আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছ বলে তো আমার মনে পড়ে না,” মনে করার চেষ্টা করে বলল প্রভাত।
“নাও, তারপর মনে করিয়ে দিচ্ছি।”
“উঁহু, আগে বলো কিসের টাকা।”
“নাও আগে।”
“না জেনে নিচ্ছি না।”
“অনামিকার বিয়েতে গিফট কেনার টাকা আমার থেকে কম নিয়েছিলে কেন?”
“কে বলল কম নিয়েছি?”
“কে বলেছে, সেটা বিষয় নয়। তুমি যে আমাকে মিথ্যা বলে টাকা কম নিয়েছিলে, এটা তো সত্যি।”
“না।”
“প্রভাত, আমি জানি তুমি এটা করেছ। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে এত কম টাকায় কী গিফট কিনেছ তোমরা। তখনই আমার ওদের কাউকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। গতকাল রাসেলের সাথে কথায়-কথায় অনামিকার বিয়ের প্রসঙ্গ না উঠলে তো জানাই হত না।”
প্রভাত বলল,
“রাসেল বলেছে তাহলে? ওকে তো আমি-”
তার কথায় বাঁধা দিয়ে মৃন্ময়ী বলল,
“প্রভাত, আমি জানি তুমি আমার জন্য অনেক ভাবো। তাই বলে আমি সবসময় তোমার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা চাই না। কষ্ট করে হলেও আমি নিজের প্রচেষ্টায় এই অবধি এসেছি।”
“আমি জানি তুমি কারোর থেকেই আর্থিক সহায়তা চাও না। আমি এ-ও জানি তখন তোমার টানাপোড়েন চলছিল, কারণ মাসের মাঝামাঝি সময়ে তোমার হাতে অত টাকা থাকার কথা নয়। তাই আমি তোমার ওপর চাপ ফেলতে চাইনি। দয়া করে বিষয়টা খারাপ চোখে দেখো না।”
“খারাপ চোখে দেখছি না। সাহায্য করেছ, সেজন্য ধন্যবাদ। এখন আমার হাতে টাকা আছে, তাই ফেরত দিচ্ছি।”
“আমি ফেরত নিতে চাই না।”
“কেন? নাও প্লিজ। আমি ঋণী থাকতে চাই না।”
“সব মানুষকে ঋণী করে রাখা যায় না। তুমিও আমার কাছে তেমন। যেদিন তুমি আজীবনের জন্য আমার হাত ধরবে, সেদিন থেকে বাকি জীবন আমি নিজেই তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব।”

প্রভাত নারাজ। মৃন্ময়ী কোনোভাবেই টাকাটা তাকে ফেরত দিতে পারল না। ঘুরেফিরে প্রভাত সেই বিয়ের প্রসঙ্গেই ফিরে গেল,
“শোনো, দ্রুত মতামত জানিয়ো। এতদিন আমি কীভাবে অপেক্ষা করেছি জানি না। গতকাল তোমার বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকে আমার আর অপেক্ষা ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তোমাকে না পেলে আমি এবার পাগল হয়ে যাব।”
মৃন্ময়ী‌ টিপ্পনী কে’টে বলল,
“তুমিই না কদিন আগে বলেছিলে আমার জন্য আজীবন অপেক্ষা করতে তোমার আপত্তি নেই? আমাকে না পেলেও তুমি আমাকে ছাড়বে না? তাহলে হঠাৎ করে টিনেজারদের মতো আবেগী হয়ে উঠলে কীভাবে?”
“জানি না। এখন আমি শুধু জানি তুমি আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসবে, নয়তো আমি সত্যি-সত্যি পাগল হয়ে যাব।”
“ঠিক আছে। আমি তাহলে আজই পাগলা গারদে আলাপ করে রাখছি।”
প্রভাত গোমড়া মুখে বলল,
“তোমাকে ভালোবেসে আমি একটা ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি। আর তুমি আমাকে পাগলা গারদে পাঠাতে চাইছো?”
“আমি কোথায় চাইছি? চাইছ তো তুমি। আমি শুধু তোমার চাওয়াটা পূরণ করতে চাইছি।”
“এতদিন ধরে যা চাইছি, তা তো পূরণ করার নাম নিলে না। এখন হুট করে যখন পাগলা গারদের কথা বললাম, অমনি তোমার চাওয়া পূরণের ইচ্ছা জেগে উঠল?”
“ভুল কী বললাম? এখন তো তোমার ঘর আছে, পরিবার আছে। পাগল হওয়ার পর তো তুমি সব ভুলে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরবে। তাই আমি তোমার জন্য একটা নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে চাইছি।”
প্রভাত তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“ঘর? পরিবার? ওসব তো আমার থেকেও নেই ম্যাডাম। তোমার কাছে সবসময়ই তো আমার এটুকু চাওয়া-ই ছিল। ছোট্ট একটা ঘর, মিষ্টি একটা পরিবার, একটু যত্ন, ভালোবাসা আর ঘরভরা সুখ। এর বেশি কিছু আমার চাই না, বিশ্বাস করো। তুমি শুধু আমার এটুকু চাওয়া পূরণ করে দিয়ো, আমি এক জীবন তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব।”

এসব কথার প্রেক্ষিতে মৃন্ময়ী আমতা-আমতা করে বলল,
“তোমাকে একটা প্রশ্ন করার ছিল।”
“বলো।”
“আচ্ছা, তোমার মা কি সত্যিই এত খারাপ? গতকাল তাকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে আমার কেন জানি মনে হয়েছে সে এতটাও খারাপ না। আবার তোমার কথার সাথেও কিছু মিল পাচ্ছি না। তাই গতকাল থেকে আমার মনে প্রশ্নটা উঁকি মারছে।”
প্রভাত তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“মুখে মিষ্টি ঝরলেই সবার মন মিষ্টি হয় না।”
মৃন্ময়ী আবারও কনফিউশনে পড়ল। সত্যিই কি এত মিষ্টি আচরণের মানুষটার মন বিষাক্ত? মৃন্ময়ীর মানতে ইচ্ছা করছে না। যদিও জগতের নিয়ম-ই এমন। মানুষের মুখ আর মনের মিল খুঁজে পাওয়া ভার। ঠিক যেন বিষে ভরা সুদর্শন ফুল। দেখতে ভীষণই আকর্ষণীয়, ছুঁয়ে দিলেই আলগোছে বিষ ছড়িয়ে দেয়।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৭.
মৃন্ময়ীর মায়ের সাথে আহমদ তরফদারের কথা হয়েছে। আহমদ তরফদার নিজেই কল করেছিলেন তাদের মতামত জানার জন্য। মৃন্ময়ীর মা জানিয়েছেন তার মেয়ের আপত্তি নেই। এবার বিয়ের কথা এগোনো যায়। আহমদ তরফদার বেশি দেরী করতে চাননি। তিনি জানিয়েছেন আগামী সপ্তাহেই বিয়ের তারিখ ঠিক করবেন। মৃন্ময়ীর মা তাকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। একসঙ্গে বসেই বিয়ের পাকা কথা বলা দরকার। আহমদ তরফদার নিজেও এমনটাই চাইছিলেন। তবে তিনি সঙ্গে করে কাউকে নিবেন না। প্রভাত তাকে বলে দিয়েছে বিয়ের পাকা কথা বলতে বাবার সাথে শুধু সে নিজেই যাবে। অন্য কাউকে পাঠিয়ে সে মৃন্ময়ীর পরিবারের ওপর চাপ ফেলতে চায় না। তাছাড়া বিয়ের আয়োজনের ব্যাপারেও খোলামেলা আলোচনা খুব জরুরী। তাকে ছাড়া সেটা ঠিকঠাক হবে না। আহমদ তরফদার আত্মীয়-স্বজন কাউকে সঙ্গে নিতে না পারায় মনে-মনে অসন্তুষ্ট-ই হয়েছেন। তবু তাকে ছেলের কথা মেনে নিয়ে একা যেতে হলো বিয়ের পাকা কথা বলতে। দুজন এলেও সাজেদা বেগম যথাযথভাবে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছেন। সাজেদা বেগমের ভাই, ভাবি-ও উপস্থিত ছিলেন। তবু কথাবার্তা বলার সময়ে প্রভাত সাজেদা বেগমকে অনুরোধ করলেন মৃন্ময়ীকে ডাকার জন্য। সে চায় আলোচনায় মৃন্ময়ী নিজে উপস্থিত থাকুক। এই সংসারে বাবার অবর্তমানে যেহেতু হাল তার হাতেই, সেহেতু তার মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছেলের এমন কথা শুনে আহমদ তরফদার তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাজেদা বেগমের ভাই ইতস্তত করে বললেন,
“সমস্যা নেই বাবা। আমরা আছি তো অভিভাবক হিসেবে। আমাদের সাথেই সব কথা বলতে পারো। আমাদের মেয়ের তাতে আপত্তি নেই।”
প্রভাত বলল,
“আপত্তি যেন না থাকে সেজন্যই তার এখানে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত যদি তার মতের বিপরীতে চলে যায়, তাহলে সেটা ভালো হবে না। কারণ তার পরিবারের দিক থেকে যেকোনো সিদ্ধান্ত তার-ই নেওয়া উচিত। দয়া করে তাকে ডাকুন, তারপর আমরা কথাবার্তা শুরু করি। আপনারা দ্বিধাবোধ করবেন না। আমি নিজেই চাইছি আপনাদের মেয়ে সব কথা শুনুক আর নিজের মতামত-ও জানাক। তাহলে আমাদের দু’পক্ষের জন্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে।”

প্রভাত বারবার এক কথা বলায় সাজেদা বেগম মৃন্ময়ীকে ডাকলেন। মৃন্ময়ী ভীষণ চিন্তিত ছিল কথাবার্তা বলে আবার কী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তার মা। বিশেষ করে বিয়ের আয়োজন নিয়েই তার যত দুশ্চিন্তা। বিয়েতে বেশি খরচ করার সাধ্য তাদের নেই। আত্মীয়-স্বজন দাওয়াত করে খাওয়াতে এত টাকা কীভাবে ম্যাসেজ করবে, সেই চিন্তায়-ই তার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। বিয়ের আলোচনায় বসেছেও সে দুরুদুরু বুকে। যদি দুই পক্ষের কথায় না মেলে? নিজস্ব মতামত জানানোর জন্য মৃন্ময়ীকে ডাকা হলেও, মৃন্ময়ীর তেমন কিছু বলার প্রয়োজন-ই পড়েনি। প্রভাত যেন তার মন পড়তে পারে, এমনভাবেই সমস্ত আলোচনায় তাকে কেবল বাঁচানোর চেষ্টা-ই করল। তাদের কোনো দাবিদাওয়া নেই, তা তারা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। বাকি ছিল অনুষ্ঠানের আয়োজনের ব্যাপারটা। প্রভাত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলো সে বড়ো আয়োজন চায় না। এমনকি তার পক্ষ থেকে গাড়ি ভর্তি মানুষ নিয়েও সে বিয়ে করতে আসতে নারাজ। হাতেগোনা কয়েকজন নিয়ে আসবে সে। আয়োজন হবে সাদামাটা। তার এসব কথা শুনে আহমদ তরফদারের মুখ কালো হয়ে যায়। বিষয়টি লক্ষ্য করে সাজেদা বেগম সৌজন্যতার খাতিরে বললেন,
“তা কী করে হয় বাবা? আত্মীয়-স্বজন রেখে বিয়ের মতো বড়ো ব্যাপার একা-একা সারা যায়?”
প্রভাত বলল,
“আত্মীয়-স্বজন রেখে করব না আন্টি। আমার আত্মীয়-স্বজনের জন্য যা আয়োজন দরকার, আমার বাড়িতেই করব। সবাইকে সাথে নিয়ে যে বিয়ে করতে আসতে হবে, এমন তো কোনো মাথার দিব্যি নেই। আর আপনাদের যদি মনে হয় আপনাদের আত্মীয়-স্বজন ডাকা দরকার, তাহলে অবশ্যই ডাকবেন। তাতে তো আর আমি বারণ করতে পারি না। তবে আমি চাই না আমাদের বিয়ের জন্য আপনাদের ওপর কোনোরকম চাপ পড়ুক। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ের সমস্ত খরচ আমি নিজেই বহন করব। আপনাদের কাউকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে না।”
আহমদ তরফদার ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে বুঝার জন্য জিজ্ঞেস করলেন,
“সমস্ত খরচ বলতে কোন খরচ?”
“বিয়ের আয়োজনের খরচ। মৃন্ময়ীর বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি তার দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি যেহেতু বেঁচে নেই, আমি মনে করি বিয়ের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার-ও কেউ নেই। আর আমি অবশ্যই মৃন্ময়ীর ওপর চাপ ফেলতে চাই না। তাই বিয়ের আয়োজনের দায়িত্বটা আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। আমি আশা করব আমার সিদ্ধান্তে কারোর আপত্তি না থাকুক।”
আহমদ তরফদার মৃন্ময়ীদের সামনে কিছু বলতে পারলেন না, তাই দাঁত চেপে বসে রইলেন। মৃন্ময়ী নিজেও কিছু বলতে পারছে না। তার কেমন মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। প্রভাতের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ হচ্ছে। আবার ভেতর-ভেতর অস্বস্তি-ও হচ্ছে। পাছে প্রভাতের পরিবার না সিদ্ধান্তটা খারাপভাবে নেয়। তার বাবাকে-ও খুব একটা সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে না। নিরবতা-ই তার অসন্তুষ্টির লক্ষণ। মৃন্ময়ীর মামা কানের লতি চুলকে বললেন,
“না-না, আমাদের দিকের আয়োজন নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমরা ম্যানেজ করে নেব। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না।”
প্রভাত মৃদু হেসে বলল,
“বিয়েটা তো আমিই করছি মামা। আপনারা আপনাদের মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবেন, এটা তো আয়োজনের চেয়েও অনেক বড়ো ব্যাপার। আপনাদের মাথার ওপর চাপ প্রয়োগ করে, মনে দুঃখ দিয়ে আমি আপনাদের মেয়েকে কেড়ে নিতে চাই না। এতে ও নিজে-ও মানসিক অশান্তিতে থাকবে। আমি চাই সবাই মন থেকে হাসিখুশি থাকুক। হাসিমুখে আমাদের বিয়েতে উপস্থিত থাকুক। দেখুন, আমার দিক থেকে এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই। আমি প্রস্তুতি নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দয়া করে আপনারা আপত্তি করবেন না।”

দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা করেও কেউ প্রভাতকে তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারল না। মুখ ফুটে বলেছে মানে বিয়ের খরচ সে-ই বহন করবে। আহমদ তরফদার চক্ষু লজ্জায় শেষে মিনমিনে গলায় সম্মতি জানালেন। এরপর আর সাজেদা বেগমের আপত্তি থাকার কারণ রইল না। সবার মতামত মিলে যাওয়ার পর তারা বিয়ের তারিখটা-ও ঠিক করে ফেললেন। আহমদ তরফদার নিজেই বললেন আগামী শুক্রবার বিয়ের দিন নির্ধারণ করা হোক। কেউ তাতে আপত্তি জানায়নি।

মৃন্ময়ীর পরিবারের সামনে আহমদ তরফদার ছেলের সব সিদ্ধান্ত মুখ বুজে মেনে নিলেও, তিনি মুখ খুললেন বাড়ি পৌঁছানোর পর। বাড়ি ফিরেই তিনি চেপে রাখা রাগটুকু ঝাড়তে শুরু করলেন। উঁচু গলায় প্রভাতকে শুনিয়ে-শুনিয়ে স্ত্রীর কাছে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরলেন। সঙ্গে প্রভাতের সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করতে-ও ছাড়লেন না। প্রভাত জানত বাড়ি ফিরলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবেই। বাবাকে থামানোর জন্য সে জামা-কাপড় ছেড়ে এসে সোজাসাপ্টা জানতে চাইল,
“আমার সিদ্ধান্তে আপনার সমস্যা কোথায়?”
আহমদ তরফদার তিক্ত স্বরে বললেন,
“সমস্যা কোথায়? তুই কোন পরিবারে বিয়ে করতে গেছিস যে বিয়ের খরচ-ও তোকেই দিতে হবে? মানুষজন শুনলে হাসবে।”
“মানুষজন হাসবে, না কাঁদবে, তা দিয়ে আমার তো কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষজনকে আপনি শুনাতে যাবেন কেন?”
“এসব কথা আবার চাপা থাকে? ভালো পরিবারের অভাব নেই, সব রেখে তার চোখ পড়েছে এমন পরিবারে, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কজন লোক খাওয়ানোর মুরোদ-ও যাদের নেই।”
প্রভাত কপাল কুঁচকে বলল,
“ওই পরিবারের আসল দায়িত্ব নেওয়ার মানুষটাই নেই, তা কি আপনি দেখছেন না? মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য কি তারা এখন কিডনি বিক্রি করবে? আপনি তা-ই চাইছেন?”
আহমদ তরফদার চিৎকার করে বলে উঠলেন,
“যোগ্যতা না থাকলে ভালো ফ্যামিলিতে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার এত শখ কেন? তোর মাথা-ও কি খেয়েছে তারা? বিয়ের কথাবার্তা বলতে একা আমাকে নিয়ে গেছিস। কী করতে নিয়েছিস? চেহারা দেখাতে? আমার কোনো মতামত জানার প্রয়োজন পড়েছে তোর? তোর বিয়ের সিদ্ধান্ত তুই একাই নিয়ে নিয়েছিস। এখন আবার বিয়েতে-ও কাউকে নিবি না বলে এসেছিস। আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে আমি একা-একা সেরে আসব? এই, আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারব রে? কী শুরু করেছিস তুই? ফাজলামি পেয়েছিস?”
প্রভাত নিজেও রাগত মুখে বলে উঠল,
“আমার যাকে পছন্দ, আমি তাকেই বিয়ে করব। ফ্যামিলির দিকে তাকিয়ে আমি কী করব? তাকে নিয়ে সংসার আমি করব, জীবন আমি কাটাব। আপনি ফাজলামির কী দেখলেন? আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে নিয়ে বিয়ে করতে যাব না বলে আপনার এত দুঃখ? আমার মা মরার পর কদিন আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠী এসে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছে? কে আমাকে ডেকে একবেলা ভালো-মন্দ খাওয়াতে চেয়েছে? উলটা আমার বাড়ি এসে পেটভরে খেয়ে গেছে। খাওয়ালেই তাদের কাছে আপনি ভালো। আপনার এত ভালো সাজার শখ জাগলে আপনি নিজেই গোরু কেটে আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীর খাওয়ান, আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আপনার স্বার্থপর গোষ্ঠীকে পেটপূজা করাতে নিয়ে যাব না। আমার অত ভালো সাজার শখ নেই কারোর কাছে। তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা-ও আমার নেই।”
পরক্ষণেই তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওনাকে ভালোমানুষী বন্ধ করতে বলুন। খাইয়ে-খাইয়ে মানুষের সামনে ভালো হতে যায়। তাকে কে খাওয়ায়? জীবনে তো আমাকে আপনারা ভালো থাকতে দিলেন না। এবার অন্তত আমাকে মুক্তি দিন। আমার ভালো থাকার পথ আমি বেছে নিয়েছি। এতেও যদি কেউ বাঁধা দেন, এই বাড়ি ছাড়তে আমি এক মুহুর্ত-ও ভাবব না। আমার মা-ও নেই, এ বাড়িতে আমার কোনো পিছুটান-ও নেই।”

আহমদ তরফদার আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন। প্রভাত আর তার কথা শোনার অপেক্ষা করল না। হনহনিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল। রাহেলা বেগম বিরক্ত মুখে বললেন,
“আপনি থামুন তো। কী চেঁচামেচি শুরু করেছেন? আমার মাথা ধরে যাচ্ছে আপনার চেঁচামেচি শুনে।”
আহমদ তরফদার নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। একইভাবে বলে উঠলেন,
“আমি থামব কীভাবে? দেখছো না আমার জন্মের ছেলে আমার মুখে চুনকালি মাখতে চাইছে? ইচ্ছা করে সবার কাছে আমাকে ছোটো করতে চাইছে?”
“আপনি নিজেই নিজেকে ছোটো করছেন।”
“তুমিও ওর সুরে কথা বলছো?”
“তো কী করব? ছেলেটা নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে সুখে থাকতে চাইছে, থাকুক না। আপনি কেন এত আপত্তি করছেন? মেয়েটা তো খারাপ না, যথেষ্ট ভালো। মেয়েটার পরিবার নিয়ে এত কথা বলেন কেন? বাবা ছাড়া মেয়েটা কত কষ্টে পরিবারকে টেনে চলেছে, ওদের যন্ত্রণা তো আমরা দূর থেকে বুঝতে পারি না। বাবা থাকলে তো আর ওদের অবস্থা এমন থাকত না।”
“তো কী দরকার ওই মেয়েকে বিয়ে করার? মেয়ের কী অভাব এদেশে?”
“দেশে মেয়ের অভাব না, দেশ ভর্তি মেয়ে আছে। কিন্তু সব মেয়েদের সাথে আপনার ছেলে ভালো থাকবে না। কারণ ওর ভালো থাকার মন্ত্র লুকিয়ে আছে শুধুমাত্র একজনের প্রতিই, সে মৃন্ময়ী, যাকে ও মন থেকে ভালোবেসেছে। আমরা বাঁচব আর কদিন? একটামাত্র সন্তান আমাদের, ওর একটা সুখী জীবন-ই তো আমাদের একমাত্র চাওয়া। যার সাথে ও ভালো থাকতে পারবে, আমাদের তো উচিত ওর জন্য তাকেই নিয়ে আসা। ওদের সুখী সংসার দেখে যেতে পারলে আমাদের জীবনে আর কোনো আফসোস থাকবে না। নিশ্চিন্তে বিদায় নিতে পারব।”
আহমদ তরফদারের রাগে একটুখানি ভাঙন ধরল। তবু তিনি রাগটা ধরে রাখার চেষ্টা করে বললেন,
“সবই তো মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই পণ্ডিত শেষমেশ কী বলে এল, শুনলে না? বরযাত্রী-ও সে ঠিকঠাক নিবে না। আত্মীয়-স্বজনের সামনে আমার মান-সম্মান মাটি করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।”
রাহেলা বেগম বললেন,
“আচ্ছা, ও ভুল কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে? জানেন তো মেয়েটার পরিবারের কী অবস্থা। ওদের কথা ভেবেই প্রভাত বেশি লোকজন না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর আপনার আত্মীয়-স্বজন কি আপনি বৌ-ভাতে দাওয়াত করে খাওয়াতে পারবেন না? বরযাত্রী হিসেবেই নিতে হবে?”
“আমার বাড়ি আর ওই বাড়ি কি এক হলো?”
“না হয় নেই। সবকিছুতে যেচে অপমান বোধ করতে যাবেন না তো। প্রভাত যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। ও সবকিছু ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
“জানতাম তুমি এবারেও ওই ফাজিরটার হয়ে কথা বলবে। তোমাকে কোনো কথা বলা-ই বেকার। সরো তো, আজাইরা সময় নষ্ট। আমার ঘরে আমি ছাড়া সব পণ্ডিতের বাস। কোনো কিছুতেই আমাকে দরকার হয় না।”
আহমদ তরফদার একা-একা বকবক করতে-করতে ঘরে চলে গেলেন। রাহেলা বেগম গলা তুলে বললেন,
“সবসময় আত্মীয়-স্বজন, আত্মীয়-স্বজন করে গলা শুকিয়ে ফেলবেন না তো। তাদের জন্য আপনার-ই মন কাঁদে। আল্লাহ্ না করুন, আপনার দুটো পয়সা কমে গেলে দেখবেন তারা আপনার মুখ-ও দেখতে চাইবে না। ছেলে উচিত কথা বলেছে বলে গায়ে লাগে? ওসব মানুষদের এভাবেই বলা উচিত। সব স্বার্থপরের দল।”


বাবার সাথে ঝামেলা হলেই প্রভাতের মনটা সহজে ভালো হয় না। সবকিছু বিরক্ত লাগে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। মন ভালো করার জন্য সে বন্ধুদের ডেকে দীর্ঘ সময় আড্ডা দেয়, ঘুরাঘুরি করে। কিন্তু আজ তার সেই সময়টুকু-ও নেই। অফিসে কিছু কাজ বাকি পড়ে ছিল। সন্ধ্যাটা তার কাজ করেই কা’টাতে হলো। অফিস ছুটি হয় বিকালেই। প্রভাত এক অলস প্রাণী, যে কাজ জমিয়ে রেখে-রেখে মাঝেমধ্যে নাইট ডিউটি-ও করে। তাদের অফিসে নাইট ডিউটিতে খুব কম মানুষ-ই থাকে। প্রভাতের মন ভালো থাকলে সে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে পারে। নইলে সন্ধ্যাতেই বিদায় নেয়। আজ তার নাইট ডিউটিতে থাকার ইচ্ছা নেই। তাই বিকালেই বিদায় নিয়েছে। মৃন্ময়ীর স্কুলের বাইরে এসে কিছুক্ষণ হলো দাঁড়িয়েছে সে। আজ এটুকু সময়কেই খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। স্কুল ছুটি হতেই বাচ্চারা হুড়মুড়িয়ে গেট দিয়ে বেরোনো ধরল। প্রভাতের অপেক্ষমান চোখ জোড়া খুঁজে চলেছে মৃন্ময়ীর মুখ। মৃন্ময়ী বেরিয়ে এল দুজন শিক্ষকের সাথে কথা বলতে-বলতে। তার মুখে হাসি। হয়তো মন ভালো। প্রভাতকে দেখে মৃন্ময়ীর সাথের শিক্ষক দুজন চাপা স্বরে কী ঠাট্টা কর চলে গেল, প্রভাত শুনতে পেল না। মৃন্ময়ী এলোমেলো দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এল। প্রভাত জানতে চাইল,
“ম্যাডামের মন ভালো?”
মৃন্ময়ী পথ চলতে-চলতে বলল,
“ভালো।”
“ফুয়াদ স্যারের সাথে যেভাবে মিষ্টি হেসে কথা বলছিলে, দেখেই বুঝেছি মন ভালো।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আরেকজন স্যার-ও তো ছিল, চোখে পড়ল শুধু ফুয়াদ স্যার?”
“সে তো বিবাহিত, আরেকজনের হবু বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার চান্স নেই।”
“ফুয়াদ স্যারের-ও গার্লফ্রেন্ড আছে।”
“ওহ্! তাহলে ঠিক আছে।”

মৃন্ময়ী আরও একবার কপাল কুঁচকে তাকাল। বদলে প্রভাত তাকে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। সে হাসিতে মৃন্ময়ীর কী হলো কে জানে? হুট করেই তার বুকের ভেতর কম্পন ধরে গেল, মৃদুমন্দ বাতাসের মতো। শীতল বাতাস। ভেতরের শীতলতার ছোঁয়া যেন বাইরে এসে তার হাত-পা ঠাণ্ডা করে দিলো। লজ্জায় রাঙিয়ে দিলো সুন্দর মুখখানা। এ যেন এক নতুন অনুভূতি। মৃন্ময়ী সে অনুভূতি ধামাচাপা দিতেই প্রভাতের দিকে আর ফিরে না তাকানোর পরিকল্পনা করল। প্রভাত তাকে মৃদু স্বরে ডাকল,
“ম্যাডাম?”
মৃন্ময়ী চোখ না তুলেই সাড়া দিলো,
“হুঁ?”
“হাওয়াই মিঠাই খাবে?”
“উঁহু।”
“লজ্জা পেয়ো না, লজ্জা পেয়ো না। দুদিন বাদে তো এসবের জন্য সেই আমার কাছেই আবদার করবে।”
“আমি বাচ্চা না।”
“ভালোবাসার মানুষের কাছে থাকলে সবাই বাচ্চামি করে। যখন থেকে আমার কাছে থাকবে, তখন বুঝবে। একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।”
প্রভাত এক দৌড়ে গিয়ে চার প্যাকেট হাওয়াই মিঠাই কিনে আনল। এক প্যাকেটে ছোটো বল আকৃতির নয়টা হাওয়াই মিঠাই। মৃন্ময়ীর হাতে তিনটা প্যাকেট দিয়ে প্রভাত একটা প্যাকেট খুলল। মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“এতগুলো কেন?”
“বাড়ি গিয়ে আমার শ্যালিকাদের নিয়ে খাবে।”
প্রভাত প্যাকেট খুলে সেটাও মৃন্ময়ীর আরেক হাতে ধরিয়ে দিলো। মৃন্ময়ী প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে নিজের দুহাতের দিকে তাকাল। দুই হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিলে সে খাবে কোন হাত দিয়ে। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই প্রভাত খোলা প্যাকেট রেখে বাকি প্যাকেটগুলো নিজের হাতে ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“খাও।”
মৃন্ময়ী একটা হাওয়াই মিঠাই বের করে প্রভাতের দিকে বাড়িয়ে ধরল। প্রভাত হাসিমুখে সেটা হাতে নিয়েই মুখে পুড়ে দিলো। মৃন্ময়ী তাকে আরও একটা সাধল, সে আর নিল না। খেতে-খেতে মৃন্ময়ী অনেকবার প্রভাতকে বিয়ের প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতে চাইল। কিন্তু লজ্জায় প্রসঙ্গ তুলতেই পারল না। প্রভাত তার মনের কথা বুঝতে পারল কি না কে জানে? সে নিজেই বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরল। মৃন্ময়ীকে প্রশ্ন করল,
“বিয়েতে তোমার আলাদা কোনো ইচ্ছা আছে ম্যাডাম?”
প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“কিসের ইচ্ছা?”
“থাকে না অনেক মেয়েদের নিজের বিয়েতে এটা-সেটা করার কত ইচ্ছা? তোমার তেমন কোনো ইচ্ছা থাকলে আমাকে জানাও প্লিজ।”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“নেই।”
“সত্যি? লজ্জা পেয়ে আবার মিথ্যা বোলো না। আমি চাই না বিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে তোমার কোনো আফসোস থেকে যাক। তোমার যেকোনো ইচ্ছা আমি পূরণ করার চেষ্টা করব। বলো কী চাও।”
মৃন্ময়ী প্যাকেট থেকে আরেকটা হাওয়াই মিঠাই বের করতে-করতে বলল,
“একটা শান্তিপূর্ণ বিয়ে ছাড়া আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। বিয়ে নিয়ে সেভাবে কখনও ভাবিনি, তাই হয়তো আলাদা কোনো ইচ্ছা-ও জন্মায়নি।”
প্রভাত বলল,
“এখন থেকে ভাববে। বিয়ের আগে তোমার মনে যদি নতুন কোনো ইচ্ছা-ও জন্মায়, তুমি অবশ্যই আমাকে জানাবে। ঠিক আছে?”
মৃন্ময়ী কেবল মাথা দোলাল, সে জানাবে। যদিও তার মনে হয় না তার আলাদা কোনো ইচ্ছা জাগবে। আয়োজন করে যে তার বিয়ে হবে, এটাই তো অনেক। এর বেশি আর কী চাইবে সে? প্রভাত আবার প্রশ্ন করল,
“তুমি কি পার্লারে সাজতে চাও, না বাড়িতে?”
মৃন্ময়ী উত্তর দিলো,
“বাড়িতে।”
“বাড়িতে কেউ সাজিয়ে দিবে, না পার্লারের লোক আনতে হবে?”
“মৃত্তিকা সাজাবে বলেছে।”
“তাহলে ঠিক আছে। পার্লারের মেয়েগুলো কী ভূত সাজিয়ে দেয়, ওসবের দরকার নেই। সাধারণ সাজেই তোমায় সুন্দর মানায়। মৃত্তিকাকে বলে দিয়ো বিয়ের দিন যদি আমার বউকে সুন্দর করে সাজাতে পারে, তাহলে তার জন্য বিশেষ পুরষ্কার আছে। যদিও আমার বউ এমনিতেই সুন্দর।”

কিছুক্ষণ কাচুমাচু করার পর মৃন্ময়ী মৃদু স্বরে বলল,
“আজ তুমি সবার সামনে যা সিদ্ধান্ত জানালে, তা কি তোমার একার সিদ্ধান্ত ছিল?”
প্রভাত হেসে বলল,
“বিয়ে করব আমি, সিদ্ধান্ত আর কার থাকবে?”
“তোমার বাবা-মায়ের সাথে আগে আলোচনা করনি?”
“উঁহু।”
“কেন?”
“তোমার কী মনে হয়? আগে থেকে জানালে এত সহজে আমার সঙ্গে গিয়ে বিয়ের পাকা কথা বলে আসত? হাজারটা আপত্তি জানিয়ে আমার মাথা খারাপ করে ছাড়ত।”
“তবু তারা তোমার অভিভাবক। বিয়ের মতো বড়ো ব্যাপারে অভিভাবকের সাথে আলোচনা সবার আগে জরুরী।”
“জরুরী, তা আমিও জানি। কিন্তু আমার অভিভাবকের সাথে বোঝাপড়া করা তোমার ভাবনার মতো এত সহজ নয়। আমি যা করেছি, ভেবেচিন্তেই করেছি। ওসব তুমি এখন বুঝবে না। যখন আমার সঙ্গে জীবনযাপন শুরু করবে, তখন বুঝতে পারবে।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“এখন কি তারা তোমার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়নি?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“তারা আজীবনই আমার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট-ই হয়। ওসব আমার কাছে কোনো ব্যাপার না। তারা সন্তুষ্ট হলেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না, অসন্তুষ্ট হলেও না। তাছাড়া আমি কারোর প্রতি নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিইনি। আমার নিজের যতটুকু সামর্থ আছে, তার জোরেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই কারোর আপত্তিতে আমার কিছু যায় আসে না।”
মৃন্ময়ী বলল,
“সবকিছুতেই বেপরোয়া তুমি।”
প্রভাত নিচু স্বরে বলল,
“বেপরোয়া ছেলেটাকেই শেষমেশ বিয়ে করতে চলেছেন ম্যাডাম?”
“তোমরা জোট বেঁধে আমাকে ফাঁসিয়েছ, নয়তো কে তোমায় বিয়ে করত?”
প্রভাত কপাল কুঁচকে বলল,
“এখনও গা বাঁচিয়ে কথা বলছেন ম্যাডাম? খুব বুদ্ধিমতী আপনি।”
মৃন্ময়ী প্রত্যুত্তর করল না। প্রভাত পুনরায় বলল,
“ঠিক আছে, এখন মনের কথা লুকানোর চেষ্টা করছেন করুন। বিয়ের পর যখন আপনার মন সম্পূর্ণ দখলে নিয়ে নেব, তখন দেখব আর কত লুকিয়ে রাখতে পারেন।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।