Thursday, August 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 12



মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১৪+১৫

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৪.
বাড়ি যাওয়ার পথে মৃন্ময়ীকে মিষ্টির দোকানের দিকে হাঁটতে দেখে প্রভাত জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“দোকানে।”
প্রভাত হেসে বলল,
“বিয়ে ভাঙার খুশিতে মিষ্টিমুখ করবে না কি?”
“জি না। আমার বাড়ির ছোটো সদস্য রাগ করেছে। মিষ্টি না খাওয়ালে তার রাগ ভাঙবে না।”
“মৃদুলার কথা বলছো? রাগ করেছে কার সাথে?”
“আমার আর মৃত্তিকার সাথে।”
“তোমরা বড়ো দুবোন মিলে আমার ছোটো শ্যালিকাকে এভাবে রাগাও তাহলে? কী ভদ্র আর মিষ্টি মেয়েটা!”
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল,
“একটা সত্যি কথা বলো তো। তোমার সাথে মৃদুলার এত ভালো সম্পর্ক হলো কবে থেকে?”
প্রভাত দাঁতে জিব কে’টে বলল,
“ছিঃ! কী যে বলো তুমি! তুমি ছাড়া আর কারো সাথে আমার সম্পর্ক থাকার কথাই না।”
“কথা ঘুরাবে না। আগেও অনেকবার মৃদুলার মুখে আমি তোমার কথা শুনেছি। ও তোমাকে ভালো চোখে দেখে। কিন্তু আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে সবসময় এড়িয়ে যায়। এখন আবার আমার বিয়ে আটকানোর জন্য ও নিজে থেকে তোমাকে সাহায্য করেছে। তুমিও ওকে এত ভালো মেয়ে ভাবো। এসব মোটেও একদিনের ব্যাপার নয়। মৃদুলা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। হুট করে ও যার-তার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে না।”
প্রভাত বলল,
“তোমার কী ধারণা? মৃদুলাকে আমি মিষ্টি খাইয়ে পটিয়ে আমার দলে নিয়ে নিয়েছি?”
মৃন্ময়ী মৃদু হেসে বলল,
“মৃদুলা বাচ্চা মেয়ে না যে তুমি ওকে কিছু খাইয়ে পটাবে। আমি নিশ্চিত তুমি ওকে তোমার কথায় ভুলিয়েছ। ওকে এমনকিছু বুঝিয়েছ যা শুনে ও তোমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে।”
“তোমার বোনটা তোমাকে খুবই ভালোবাসে।”
“হুম, ওর এই দুর্বলতাকেই তো তুমি কাজে লাগালে। এসব কবে থেকে চলছে বলো তো? এর আগে আর কী-কী খবর পাচার করেছে ও?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“আনফরচুনেটলি তোমার লক্ষ্মী বোনটার সাথে আমার কখনও ভালোভাবে কথাই হয়ে ওঠেনি।”
মৃন্ময়ী বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি মিথ্যা বলা বন্ধ করবে? দেখছ আমি বুঝে গেছি তোমাদের কাহিনি, তবু মিথ্যা বলেই চলেছ।”
“মিথ্যা কেন বলব? সত্যি কথাই বললাম। মৃদুলার সাথে আমার পরিচয় আছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত ও আমার সাথে দাঁড়িয়ে দুমিনিট কথা বলেনি। সামনে পড়লে কেমন আছি জিজ্ঞেস করেই চলে যায়। কতবার কিছু খাওয়াতে চেয়েছি, তা-ও দাঁড়ায়নি।”
মৃন্ময়ীর কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। বলল,
“বিশ্বাসযোগ্য কথা বলো প্রভাত। কথাবার্তা ছাড়াই একজন তোমাকে সাহায্য করতে যাবে? তা-ও আবার সেই একজনটা মৃদুলা।”
“আমি কি একবারও বলেছি মৃদুলা আমাকে সাহায্য করেছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“তুমি এখনও অস্বীকার করছো?”
“আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোমার বোনকেই জিজ্ঞেস কোরো আমার সাথে ও কখনও ভালোভাবে কথা বলেছে কি না।”
“তুমি সত্যি কথা বলছো না, আমার বোন বলবে? ও তো কথা পেটে চেপে রাখার বেলায় তোমার চেয়েও একধাপ এগিয়ে।”
“তা-ও তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো আমার কথা মিলে কি না।”
“হয়েছে, তোমাদের কথা মিলিয়ে মাথা খারাপ করার শখ নেই আমার। যার যা ইচ্ছা করো, আমার কী?”
“তুমি নিজেই তো যেচে মাথা খারাপ করার পাঁয়তারা করছো। যাইহোক, বাদ দাও। অনামিকার বিয়েতে দাওয়াত পেয়েছ?”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“হুম, গতরাতে ম্যাসেজ করেছিল।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? বিয়ের কথা বলল, দাওয়াত করল।”
“যাবে তো?”
“জানি না। সময় হবে না হয়তো।”
“সময় হবে না কেন? শুক্রবার বিয়ে। শুক্রবার তো আর তোমার ক্লাস করানোর প্যারা নেই।”
“ক্লাস করানো ছাড়া কি আমার আর কোনো কাজ থাকতে পারে না?”
“সে যে কাজই থাকুক। তুমি অজুহাত দেখিয়ে বাড়িতে বসে থাকবে না। বিয়েতে অবশ্যই যাবে। গেলে অনেকের সাথে দেখা-ও হবে।”
“দেখি, গেলে তো দেখবেই।”
“দেখি না, অবশ্যই যাবে।”
“এমনভাবে জোর দিয়ে বলছো যেন তোমার বোনের বিয়ে।”
“নিজের বোন না হোক, প্রতিবেশী বোন তো। তার ওপর বান্ধবী। দেখো, তুমি তোমার বান্ধবীর বিয়েতে না গেলে কিন্তু ও-ও তোমার বিয়েতে আসবে না। আর তোমার বিয়েতে আসবে না মানে আমাদের বিয়েতে আসবে না। এটা আমি মোটেও হতে দিবো না। আমি চাই ভবিষ্যতে আমাদের বিয়েতে সবাই উপস্থিত থাকুক। সবাই দেখুক পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি আমার বউ হতে চলেছে।”
“বিয়ের জন্য দেখছি তোমার পেটের ভাত হজম হয় না। এক কাজ কোরো। অনামিকার বিয়ের আসরেই বিয়ে সেরে ফেলে পেটের ভাত হজম করে নিয়ো।”
প্রভাত হেসে বলল,
“অনামিকার সাথে তুমিও বউ সাজলে বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি রাজি থাকলে এক কাজিতেই দুটো বিয়ে হয়ে যেতে পারে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“বিয়ে বাড়ির আনাচে-কানাচে সুন্দরী মেয়েদের অভাব থাকে না।”
“ভুলভাল মানুষকে বিয়ে করে পরে পেটের ভাত হজম হওয়ার বদলে বদহজম হয়ে যাবে। যেচে বদহজম করার ইচ্ছা আমার নেই। আমার একজনকেই লাগবে, সে মৃন্ময়ী ম্যাডাম।”

অনামিকা মৃন্ময়ীর স্কুল জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। এখনও তাদের মাঝে সম্পর্ক ভালো। প্রভাতের প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে অনামিকার সাথে তার-ও ভালো বন্ধুত্ব। অনামিকার বিয়ে ঠিক হওয়ার পরপরই সে মৃন্ময়ীকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল। বারবার করে বলে দিয়েছিল মৃন্ময়ী যেন কোনোভাবেই তার বিয়েতে অনুপস্থিত না থাকে। এদিকে মৃন্ময়ী পড়ে গেছে চিন্তায়। বিয়েতে গেলে বান্ধবী হিসেবে কিছু একটা উপহার তো দিতে হবে। মাসের মাঝামাঝি এসে সে কী করে অত টাকা খরচ করে ভালো উপহার কিনবে? টাকার চিন্তায় বিয়েতে যাওয়ার ইচ্ছা-ই মাটি হয়ে যাচ্ছে মৃন্ময়ীর। না গেলেও অনামিকা রাগ করবে। এখন যাবে কি যাবে না, সিদ্ধান্ত নিতেই সে দ্বিধায় ভুগছে। অনামিকার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়া তার জন্য সম্ভব হয়নি। অনামিকা অনেকবার বলেছিল, কিন্তু কোচিংয়ের কারণে সে যেতে পারেনি। তাছাড়া বিয়ের আগেরদিন এসেও যাওয়া নিয়ে সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। এখনও কোনো উপহার-ও কেনা হয়নি। মৃত্তিকা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল এক হাজার টাকা দিয়ে দেওয়ার জন্য। সে-ও শেষমেশ মনে-মনে এটাই ঠিক করেছিল। যাওয়া হলে টাকা-ই দিয়ে দিবে। এই মুহূর্তে অনুষ্ঠানে গিয়ে এক হাজার টাকা খরচ করাই তার জন্য অনেককিছু। এর বেশি খরচ করে উপহার কেনা তো অসম্ভব ব্যাপার। এরমধ্যে প্রভাত আবারও তাকে প্রশ্ন করে বসল অনামিকার বিয়েতে যাবে কি না। বিয়ের কথা শুনে হতেই সে মৃন্ময়ীকে এ প্রশ্ন করেই চলেছে। এতদিন মৃন্ময়ী নিজে দ্বিধায় ছিল বলে ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেনি। আজ বলল,
“গেলে তো কাল দেখতে পাবেই।”
প্রভাত বলল,
“অনামিকা এত করে বলল, এখনও তুমি এ কথা বলছো?”
“তুমি কি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওনি?”
“ওখান থেকেই এলাম।”
“অনুষ্ঠান শেষ?”
“শুরু হলে তো শেষ হবে। মেয়েদের সাজতে এত সময় লাগে? বাপরে! রাত নয়টা বেজে গেছে, তা-ও শুনি সাজ আরেকটু বাকি আছে। সাজ শেষ হবে, তারপর ফটোশুট হবে, তারপর হবে গায়ে হলুদ। বসে-বসে অত কাহিনি দেখার ধৈর্য আমার নেই। তাই চলে এসেছি। এরচেয়ে ভালো তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে যাব। গিয়ে এক প্লেট বিরিয়ানি খেয়ে ঘুমিয়ে যাব।”
“অনুষ্ঠানে থাকার চেয়ে বিরিয়ানি খাওয়া তোমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?”
“খাওয়ার জন্যই তো দাওয়াত দিয়েছে। খাওয়া ছাড়া আমার আর কাজ কী? আমি তো আর বান্ধবী না যে বসে-বসে ওকে সাজিয়ে দিবো। ভালো কথা, শোনো, আমাদের বিয়ের সময় কিন্তু তুমি সাজগোজের পেছনে এত সময় লাগাবে না। হালকা সাজেই তোমাকে দারুণ লাগে। আমার বউ আমার কাছে ভালো লাগলেই হয়, আর কারোর ভালো লাগার দরকার নেই। মনে থাকবে? অনামিকার মতো এমন কাজ মোটেও করবে না। আমি এত অপেক্ষা করতে পারব না।”
মৃন্ময়ী এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে বলল,
“অযথা বকবক না করে চুপ থাকো।”
“এসব মোটেও অযথা বকবক না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। বিয়ে তো একদিন করব-ই। এসব কথা আগে থেকে বলে রাখাই ভালো। মনে রেখো কিন্তু। যাইহোক, এখন বলো কাল শিওর যাচ্ছ তো?”
“তুমি আমার যাওয়া নিয়ে উঠেপড়ে লাগলে কেন? বলছি তো গেলেই জানতে পারবে।”
“এটা বললে কীভাবে হবে? আমাদের গিফট কিনতে হবে না? তুমি কি গিফটের কথা কিছু ভেবেছ?”
“না।”
“তাহলে? কাল যাওয়ার আগে তো গিফট কিনতে হবে। আমরা ছয়জন আছি। পাঁচজনের টাকা অলরেডি তুলে ফেলেছি। বাকি আছো শুধু তুমি।”
মৃন্ময়ী আবারও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। ছয়জন মিলে উপহার কেনার জন্য কত টাকা করে তুলেছে কে জানে? যদি এক হাজার টাকার বেশি হয়, তাহলে সে কী বলবে? প্রভাত এভাবে বললে তার কাছে টাকা দিবে না বলবেই বা কীভাবে? তবু সে জানতে চাইল,
“কী উপহার কিনবে?”
“ওরা কী কিনবে বলল, মনে নেই আমার। তুমি কি আমাদের সাথে দিবে? তাহলে পাঁচশো টাকা দিয়ে দিতে পারো আমার কাছে।”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“পাঁচশো টাকা! তোমরা পাঁচশো টাকা করে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“পাঁচশো টাকা করে তুলে কী কিনবে?”
“সে যা কিনে কিনুক ওরা। ছয়জন মিলে দিলে এর বেশি লাগবে না। তুমি কি এরচেয়ে বেশি দিতে চাও?”
“আমি বেশি দিতে যাব কেন?”
“তাহলে এত প্রশ্ন কোরো না। টাকা দিলে দিয়ে দাও। কাল সময়মতো চলে যাবে।”
এত অল্প টাকার কথা শুনে মৃন্ময়ী অবাক হলেও না করল না।‌ ব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকা বের করে প্রভাতের হাতে দিয়ে দিলো। টাকা নিয়ে প্রভাত বলল,
“ওদের বিয়েতে আমরা দুজন একসঙ্গে উপহার দিচ্ছি ঠিকই, ওদের সবাইকে বলে দিবো আমাদের বিয়েতে আলাদা উপহার দেওয়া বাধ্যতামূলক। নয়তো কাউকে দাওয়াত দেওয়া হবে না। নইলে আবার সবকটা আমাদের দুজনকে একসঙ্গে উপহার দিয়ে পার পেয়ে যেতে চাইবে। তা চলবে না।”


আজও জাহিদ দেরী করেছে। নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট পর উপস্থিত হয়েছে সে। মৃদুলা-ও গুণে-গুণে দশ মিনিট গাল ফুলিয়ে থেকে তবেই তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। অবশ্য দেরী হতে পারে বুঝে আগেভাগেই জাহিদ আসার আগে ফুল কিনে নিয়েছিল। নয়তো আজ তাকে দশ মিনিটের বদলে বিশ মিনিট শাস্তি মাথা পেতে নিতে হত। আজ তাদের ছুটির দিন। দুজন মিলে রিকশায় চড়ে যেদিকে খুশি ছুটে চলার দিন। বাকি দিনগুলো ব্যস্ততার মাঝে তাদের ঘোরাঘুরি হয় না। দেখা হয়, একটু পথ একসঙ্গে হাঁটা হয়, একটু কথাবার্তা, খাওয়া-দাওয়া করেই বাসায় ছুটতে হয়। এ কারণে শুক্রবারটা তাদের জন্য বিশেষ। এদিন কারোর কোনো ব্যস্ততা থাকে না, বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে না। সপ্তাহে শুক্রবার-ই মৃদুলা একটু সাজগোজ করে বেরোনোর চেষ্টা করে। সারা বিকাল তারা রিকশায় ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে-ঘুরতে নিজেদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত নিয়ে হাজারো গল্পের পসরা সাজায়। শান্তিতে খাওয়া-দাওয়া করে, ছবি তোলে। বাড়িতে জানে শুক্রবারে-ও মৃদুলার টিউশন থাকে। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়, আবার পুরোপুরি মিথ্যা-ও নয়। শুক্রবার তার টিউশন থাকে, তবে শুধু সন্ধ্যার পর একটি টিউশন। বিকালে তার একদম অবসর। ওই সময়টা জাহিদকে দেওয়ার জন্যই সে বাড়িতে মিথ্যা বলেছে। জাহিদ-ও তাই প্রত্যেক শুক্রবারে খুব করে চেষ্টা করে মৃদুলাকে খুশি রাখতে। মৃদুলার মন খারাপ হবে বা সে রেগে যাবে, এমন কথা বা কাজ সে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আজ তাদের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রভাত-মৃন্ময়ীর বিয়ে। কদিন ধরেই এই বিষয়টি নিয়ে তাদের কথা হচ্ছিল। আজ তাদের আলোচনা খুবই সিরিয়াস। প্রভাত জাহিদকে বলেছে যেভাবেই হোক মৃদুলা যেন তার মাকে বুঝানোর দায়িত্বটা নেয়। এই দায়িত্বটা তাকেই নিতে হবে। প্রভাত বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর যদি মৃন্ময়ীর মা তাকে দেখে ‘না’ করে দেয়, তাহলে ঝামেলা বাড়বে। মৃন্ময়ীকে তো সে নিজেই সামলে নিবে। কিন্তু তার মাকে তো সামলাতে পারবে না। জাহিদ বারবার করে মৃদুলাকে এ কথা বলায় মৃদুলা বলল,
“আমি পারব বলেছি তো। মা একটু ত্যাড়া মানুষ, তবে অবুঝ নয়। আপার বিয়ে-ই এখন তার সবচেয়ে বড়ো মাথাব্যথা। সে যখন বুঝতে পারবে প্রভাত ভাই আপাকে ভালো রাখার মতোই ছেলে, তখন আপার আগে সে-ই রাজি হয়ে যাবে।”
“তুমি আজ-ই বলে দেখো আন্টিকে।”
“বলব, বলব। আমি বলেছি যখন, তখন মাকে রাজি না করিয়ে আমি হাল ছাড়ছি না। আপনি আমাকে এত তাড়া দিয়েন না তো। বড়ো ভাইয়ের বিয়ের জন্য এত তাড়া দেখাচ্ছেন, নিজের বেলায় কতটুকু তাড়া থাকে দেখব।”
জাহিদ হেসে বলল,
“সময় আসুক, দেখবে। নিজের বেলায় আমি প্রভাত ভাইয়ের মতো এত অপেক্ষা করব না কি? গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেই একটা জব জয়েন করব। তারপর কোনোদিক না তাকিয়ে আগে তোমাকে বিয়ে করে নেব।”
“আচ্ছা, তারপর?”
“তারপর আবার কী? তারপর আমাদের সংসার হবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে।”
“গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার পরপরই আপনাকে বিয়ে করাতে চাইবে আপনার পরিবার?”
“চাইবে না মানে কী? বিয়ে আমার, বউ আমার, সংসার আমার, অন্য কেউ আপত্তি করবে কেন? আগে বিয়ে করব, তারপর যা হওয়ার হবে।”
“হুম, দেখব তখন এতো বড়ো-বড়ো কথা কতটুকু সত্যি হয়।”
“অবশ্যই দেখবে। দেখবে কী? সাক্ষী হবে। এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দাও।”
মৃদুলা মৃদু হেসে বলল,
“এখনই এত বেশি এক্সাইটেড হওয়ার দরকার নেই। সময়ের কথা কেউ বলতে পারে না। সময় কখন কোন পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়, তা হয়তো আমরা এখন কল্পনা-ও করতে পারছি না।”
জাহিদ অসন্তুষ্ট মুখে বলল,
“এভাবে বলছো কেন মৃদুলা? পরিস্থিতি যা-ই হোক, বিয়ে তো আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে করব না। তুমি কি এখনও আমাকে বিশ্বাস করতে পারোনি?”
“বিশ্বাস করব না কেন? আপনি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। অবশ্যই আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। কিন্তু বাস্তবতা বলেও তো একটা কথা আছে। আপনি যতই বলুন আমি-ই আপনার বউ হব। সময় আপনাকে দেখাবে বাস্তবতা মুখের কথার মতো এত সহজ নয়। ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্কে হাজারটা বাঁধা স্পষ্ট, তা আপনি চোখ খুললেই দেখতে পাবেন।”
“আমি জানি তুমি কী ভাবছো। ওসব নিয়ে ভেবো না মৃদুলা। আমার ওপর যখন বিশ্বাস আছে, তখন এটুকু বিষয়ে নিশ্চিত থাকো যে ভবিষ্যতে যে বাঁধা-ই আসুক, আমি তোমাকে ছাড়ব না। তোমার জন্য আমি পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে যেতে-ও প্রস্তুত।”
মৃদুলা একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে নিয়ে বলল,
“জীবনে অতটা খারাপ সময়-ও আমাদের না আসুক।”
জাহিদ তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“আসবে না। ভরসা রাখো।”

ওদিকে অনামিকার বিয়েতে গিয়ে প্রভাত মৃন্ময়ীর পিছু-ই ছাড়ছে না। মৃন্ময়ী এসে হতে সে তার পেছনেই পড়ে আছে। এই নিয়ে তার বন্ধুরা-ও খুব হাসাহাসি করেছে। তাতে তার কিছুই যায়-আসে না। মৃন্ময়ী রাগ করেও তাকে দূরে সরাতে পারেনি। অনামিকাকে বউ সাজে দেখার পর বন্ধুদের সাথে মৃন্ময়ী খুব প্রশংসা করছিল যে তাকে বউয়ের সাজে খুব সুন্দর লাগছে। তখন সুযোগ বুঝে প্রভাত বুদ্ধি খাটিয়ে চাপা স্বরে তাকে বলল,
“লাল রংটা ছাড়া কি অন্য কোনো রংয়ের শাড়ি পেল না ওরা?”
এ কথা শুনে মৃন্ময়ী তাকে পালটা প্রশ্ন করল,
“কেন, লাল রংয়ে কী সমস্যা?”
“কেমন টকটকে রং, চোখে লাগে।”
“কে বলল? নতুন বউদের লাল রংয়েই সবচেয়ে বেশি মানায়। টুকটুকে লাল রংয়ের শাড়ি পরলেই মনে হয় রাঙা বউ। কেমন একটা বিয়ে-বিয়ে ভাব আসে।”
“এত সাজার-ই বা কী দরকার? বিরক্ত লাগে না?”
“মেয়েরা বিয়েতে তাদের মনমতো সাজতে চায়। বিয়ে তো একদিনই হয়। এই একদিন নিয়ে অনেকেরই অনেক রকম ইচ্ছা থাকে, স্বপ্ন থাকে। তাদের জীবনের বিশেষ দিনে নিজেদের মনমতো সাজতে দেওয়া উচিত। তুমি ওসব বুঝবে না।”
“এখন বুঝে নিয়েছি। তা ম্যাডামের-ও কি তবে নিজের বিয়ের জন্য লাল শাড়ি পছন্দ?”
মৃন্ময়ী ইতস্তত করে বলল,
“তা কখন বললাম?”
“আর বলতে হবে না, বুঝে নিয়েছি।”
“তোমার স্বভাব-ই সবসময় বেশি-বেশি বোঝা।”
“অনামিকাকে আসলে লাল শাড়িতে সুন্দর-ই লাগছে। আমি তো কথাটা বললাম তোমার মনের কথা জানার জন্য।”
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই প্রভাত প্রশস্ত হেসে বলল,
“তুমি তো মুখ ফুটে বলবে না। আমাকে তো জানতে হবে বিয়েতে তুমি কোন রংয়ের শাড়ি পরতে চাও, কীভাবে সাজতে চাও।”
মৃন্ময়ী চাপা স্বরে বলল,
“চুপ থাকো। সবসময় মুখে এক কথা।”
প্রভাত বলল,
“এখন আর চুপ থাকার সময় নেই। তোমার বউ সাজার সময় ঘনিয়ে এল বলে ম্যাডাম।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৫.
সাজেদা বেগম রান্নার জন্য তরকারি কাটছেন। এক বালতি কাপড় একসঙ্গে ধুতে গিয়ে তার রান্নায় অনেক দেরী হয়ে গেছে। রান্নায় বেশি দেরী হলে তাড়াহুড়া লেগে যায়। তাড়াহুড়া করে কাজ করলেই সাজেদা বেগমের মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। মৃদুলা কলেজ থেকে ফিরে বুঝে উঠতে পারেনি মায়ের মেজাজ বিগড়ে আছে।‌ সে রান্নাঘরে এসেই মাকে জিজ্ঞেস করল,
“মা, কী করো?”
সাজেদা বেগম চড়া গলায় উত্তর দিলেন,
“নাচি, তুই দেখছিস না?”
মায়ের ত্যাড়া উত্তরেই মৃদুলা বাসার পরিবেশের অবস্থা বুঝে ফেলল। ধীর পায়ে চুলার কাছে গিয়ে সে নরম গলায় বলল,
“রান্নায় দেরী হয়ে গেছে দেখছি। কিছু করা লাগবে? কী করব বলো।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“ডাল চুলায় বসিয়ে আর উঠে দেখতেও পারিনি, তরকারি কাটতে বসেছি। দেখ কী অবস্থা।”
সঙ্গে-সঙ্গে মৃদুলা ডাল রান্নার কাজে হাত লাগাল। ডাল নাড়তে-নাড়তে সে মায়ের মেজাজ হালকা করার চেষ্টা করল। ভাব জমানোর জন্য বলল,
“মা, আমি ডালে হলুদ দিলেই রং কেমন গাঢ় হয়ে যায়। তোমার মতো ঠিকঠাক হয়-ই না।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“ডালকে তরকারি ভেবে চামচ ভর্তি হলুদ দিলে তো রং গাঢ় হবেই। তরকারির মতো ডালে অত বেশি হলুদ লাগে না। সামান্য পরিমাণে দিবি।”
“আচ্ছা।”
“টমেটো দে। ওই বাটির মধ্যে কেটে রেখেছি, দেখ।”
“আপু না তোমাকে বলেছিল ওর টমেটো টক খেতে ইচ্ছা করে?”
“খাওয়াব নে। কালোজিরা শেষ হয়ে গেছে অনেকদিন আগে।”
“আচ্ছা, আমি এনে দিবো নে।”

টুকটাক কথাবার্তার পর একসময় সাজেদা বেগম নিজেই বলে উঠলেন,
“ওই ব্যাপারটার কোনো খবর নিয়েছিলি?”
“কোন ব্যাপার?”
“ওই যে মৃন্ময়ী কাউকে পছন্দ করে কি না।”
এতক্ষণ ধরে মৃদুলা এই প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা-ই করছিল। মা নিজেই সুযোগ করে দেওয়ায় তার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। দ্রুত উত্তর দিলো,
“শুধু কি খবর নিয়েছি? ভূপৃষ্ঠ থেকে একদম তাজা খবর সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছি। বলেছিলাম না এ ব্যাপারে আমাকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারো?”
সাজেদা বেগম হাতের কাজ বন্ধ করে উৎসুক হয়ে উঠলেন। জানতে চাইলেন,
“কী খবর পেলি?”
“খবর একদম একশোতে একশো সত্য। আমি তোমাকে বলব। কিন্তু শর্ত হচ্ছে তুমি রেগে যেতে পারবে না। ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনতে হবে।”
“আচ্ছা শুনছি। তুই তাড়াতাড়ি বল তো।”
মৃদুলা দু’পা এগিয়ে গলার স্বর একটু নিচু করে বলল,
“তোমার কি ওই ছেলেটার কথা মনে আছে, আপা যার কথা বলেছিল?”
“কোন ছেলে?”
“আপার পেছন-পেছন যে ঘুরঘুর করত।”
“ও, হ্যাঁ। মৃন্ময়ীকে সবসময় বিরক্ত করত, ওই ছেলেটা?”
“হ্যাঁ, ওই ছেলেটাই। কিন্তু তোমার কথায় একটু ভুল আছে মা। ওই ছেলেটা আপাকে বিরক্ত করত না। পছন্দ করত, তাই পেছনে ঘুরত।”
“ওই একই তো।”
“উঁহু, এক না। পছন্দ করা এক ব্যাপার, আর বিরক্ত করা আরেক ব্যাপার।”
“তুই পাকামি করতে এসেছিস? মৃন্ময়ী নিজেই তো বলেছিল ছেলেটা ওকে বিরক্ত করে।”
“বলেছিল, কারণ আপা তখন ছেলেটাকে দেখলেই বিরক্ত হত। এই ব্যাপারটা একটু বুঝতে হবে তোমাকে। ছেলেটা কিন্তু আপার ক্লাসমেট ছিল। তখন সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আপা যখনই জানতে পেরেছিল ছেলেটা তাকে পছন্দ করে, তখন থেকেই সে ছেলেটার প্রতি বিরক্ত ছিল। এমনটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ আপা চাইত-ই না কেউ তাকে পছন্দ করুক, তাকে বিয়ে করতে চাক। ওই ছেলেটা আপাকে বিয়ে করতে চাইত বলেই আপা তার ওপর এত বিরক্ত ছিল। সে তো বিয়ে না করার পণ করে বসে আছে। কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইলে তার ছায়া তো তার বিরক্ত লাগবেই। তুমি তো জানোই তোমার মেয়ে কেমন।”
সাজেদা বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“হতে পারে। কিন্তু তুই এখনকার কথা রেখে আগের কথা ঘাঁটছিস কেন?”
“কারণ আছে বলেই ঘাঁটছি। বিরাট কারণ আছে।”
“তো বলছিস না কেন?”
“বলছি, বলছি। ধৈর্য ধরো। আমি যে কথাগুলো বলছি, তা কিন্তু অপ্রয়োজনীয় না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মন দিয়ে শোনো। তো আপা তখন যা-ই বলত, আমরা তার কথাই বিশ্বাস করে নিতাম। তাই না? কেন বিশ্বাস করতাম? কারণ আমরা তো ভেতরের খবর জানতাম না।”
“তাহলে তুই এখন জানলি কীভাবে?”
“তখন তো আপার মুখের কথা-ই সত্য ভেবে নিতাম। এখন খোঁজ নিয়েছি বলেই সত্যিটা জানতে পেরেছি। এখন আমার আফসোস হচ্ছে যে কেন তখন আমি খোঁজ নিলাম না, আর তোমাকে সত্যি কথা জানালাম না। তখন জানালে তুমি একজন বিশ্বাসযোগ্য মেয়ে জামাই পেতে পারতে।”
সাজেদা বেগমের কৌতুহল যেন বেড়েই চলেছে। তিনি আবারও প্রশ্ন করলেন,
“ছেলেটা কি আবারও ওর পেছনে ঘুরছে?”
“আবারও কী বলছো? ছেলেটা তো আজ পর্যন্ত আপার পিছু-ই ছাড়েনি।”
একথা শুনে সাজেদা বেগমের চোখ দুটো গোলাকার হয়ে গেল। চরম বিস্ময় নিয়ে তিনি বললেন,
“ছেলেটা এখনও মৃন্ময়ীর পেছন-পেছন ঘোরে?”
“হ্যাঁ, সেই থেকে এখন পর্যন্ত ছেলেটা আপার পিছু ছাড়েনি, শুধুমাত্র আপাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য। কোনো ছেলে যে আপার মতো ত্যাড়া মেয়ের জন্য এত ধৈর্য ধরে রাখতে পারে, তা আমার কল্পনাতে-ও ছিল না।”
“বলিস কী! মৃন্ময়ী তা-ও রাজি হলো না?”
“তোমার ঘাড়ত্যাড়া মেয়েকে আজ পর্যন্ত বিয়েতে রাজি করাতে পেরেছ? ওই ভাইয়াটা-ও পারেনি। তার জায়গায় আমি হলে কবে পিছু ছেড়ে দিতাম। সে এত ধৈর্য কোথায় পেয়েছে আল্লাহ্ জানে।”
সাজেদা বেগম জানতে চাইলেন,
“ছেলেটা কে রে? চিনিস তুই?”
“শুধু চিনি না, ছেলের সম্পর্কে সব খোঁজ নিয়েই এসেছি আমি। ছেলে খুবই ভালো।”
“কী কাজ করে?”
“কম্পিউটার অপারেটর। ইনকাম ভালো। পরিবার-ও ভালো। তোমার মেয়ে যদি একবার বিয়েতে রাজি হয়ে যেত, সুখ সুনিশ্চিত ছিল। আহারে! ভাইয়াটা আপাকে এত ভালোবাসে! অন্য কোনো মেয়ে হলে কবেই বিয়ে করে নিত। তোমার মেয়ে আসলেই একটা হৃদয়হীন।”
“এত ভালো ছেলে হলে এতদিন ধরে ওর পেছনে পড়ে আছে কেন? ভালো কোনো মেয়ে দেখে বিয়ে করতে পারল না?”
“ভালোবাসা মা, ভালোবাসা। ছেলেটা আপাকে সত্যি-সত্যি অনেক ভালোবাসে। নয়তো এ যুগে কে কার জন্য এত অপেক্ষা করে থাকে? এমন ছেলে সচরাচর তোমার চোখে পড়ে?”
সাজেদা বেগমকে খানিক চিন্তিত দেখাল। তিনি বললেন,
“মৃন্ময়ী তো সবসময় ছেলেটার বদনাম-ই করত। আমি তো জানতাম ছেলেটা খুব খারাপ। তো ও কি কিছু না জেনেই এত মিথ্যা কথা বলেছিল?”
“আহা মা! তোমার মেয়ে আবার কোন ছেলের প্রশংসা করে? বিয়ের ভয়ে তো বদনাম করবেই। তুমি তার কথা আর বিশ্বাস কোরো না তো। আর তোমার কি মনে হয় আমি মিথ্যা কথা বলছি? একদম হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি খবর জোগাড় করে এনেছি। বিশ্বাস না হলে তুমি নিজেও খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। আপার বন্ধু-বান্ধব সবাই এ বিষয়ে জানে। শুধু আমরা ঘরের মানুষ-ই জানতাম না।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“ছেলেটার কোনো ছবি দেখাতে পারবি?”
“পারব। দাঁড়াও, আমি ফোন নিয়ে আসছি।”

মৃদুলা এক দৌড়ে গিয়ে ফোন নিয়ে এল। তারপর প্রভাতের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকে তার ছবি বের করে মাকে দেখাল। সাজেদা বেগম ভালোভাবে ছবি দেখে বললেন,
“চেহারা তো ভালোই, খারাপ না।”
“হ্যাঁ, সবদিক থেকেই ভালো। সুপাত্র। আপার জন্য একজন পারফেক্ট। শুধু আপা-ই না বোঝার ভান ধরে থাকে। জানো? আপা কিন্তু এখন আর ছেলেটার ওপর বিরক্ত হয় না।”
“কীভাবে বুঝলি?”
“ছেলেটার সাথে আপার ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে। আপা আসলে বুঝতে পেরেছে ছেলেটা তাকে সত্যি-সত্যি ভালোবাসে। এ কারণেই তোমাকে বলেছিল ছেলেটা আর তাকে বিরক্ত করে না। অথচ বাইরে তারা ভালো বন্ধু।”
সাজেদা বেগম সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলেন,
“বন্ধু?”
মৃদুলা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“বন্ধু তো ওপরে-ওপরে। মনে-মনে এখন তোমার মেয়ে-ও ওই ছেলেকে পছন্দ করে। কিন্তু মুখ ফুটে স্বীকার করে না। স্বীকার করলে যদি বিয়ে করা লাগে, সেই ভয়ে।”
“স্বীকার না করলে তুই জানলি কীভাবে?”
“আমি বুঝে গেছি। হাবভাব দেখেই বুঝতে পেরেছি। তুমি এটা নিশ্চিত থাকো, আমার কোনো কথায় এতটুকুও ভেজাল নেই। আপা সত্যিই ওই ছেলেকে পছন্দ করে। ছেলেটাকে নিয়ে এখন তার কোনো সমস্যা নেই। তার আসল সমস্যাই হচ্ছি আমরা। আমাদের চিন্তা না থাকলে নিশ্চিতভাবে সে এতদিনে ওই ছেলেকে বিয়ে করে নিত।”
সাজেদা বেগমের চোখ-মুখে কৌতুহল সরে এখন চিন্তারা জায়গা করে নিয়েছে। তিনি বললেন,
“এতকিছু ঘটে গেছে তাহলে? এই মেয়ে দেখি নিজের সুস্থ চোখ-ও অন্ধ বানিয়ে বসে আছে। একে নিয়ে যে আমি কী করব!”
মৃদুলা বলল,
“করতে হবে মা, তোমাকেই সব করতে হবে। এখন তুমি ছাড়া এই সমস্যার সমাধান কেউ করতে পারবে না।”
“কী করব?”
“ওই ছেলের সাথেই আপার বিয়ে দিবে।”
সাজেদা বেগম তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“বিয়ে দিবো তোর ঘাড়ত্যাড়া আপাকে? এমনভাবে বলছিস যেন তোর আপা আমার কথায় ওঠে আর বসে। এতদিনে পেরেছি ওকে বিয়েতে রাজি করাতে?”
“আহা! তুমি বুঝতে পারছো না কেন? এতদিন না পারলেও এবার পারবে। কারণ এবারের পাত্র আপার পছন্দের মানুষ। একটু চাপ দিলেই রাজি করাতে পারবে। আমরা তো আছিই তোমার সাথে। তোমার চিন্তা কী?”
“আমার চিন্তা কী? চিন্তা তো ওর ত্যাড়ামি নিয়েই। নিজের ভালো পাগল-ও বোঝে, শুধু ও-ই বুঝল না।”
“বুঝবে মা, বুঝবে। এবার আমাদের আপাকে বুঝাতেই হবেই। আপাকে একটা সুখী জীবন দেওয়ার জন্য এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর আমরা পাব না। এবার আমাদের পারতেই হবে।”
সাজেদা বেগম সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“চেষ্টা-ই করতে পারব। শেষমেশ আবার হয়তো সেই একই ঘটনা ঘটবে। যাইহোক, ছেলেটার সাথে কি কোনোভাবে যোগাযোগ করা যায়? তুই খোঁজ-খবর নিয়েছিস কার থেকে?”
“আমার এক বন্ধুর থেকে। ওই ভাইয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক আছে তার। ভাইয়া না কি বলেছে সে আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চায়।”
সাজেদা বেগম বলে উঠলেন,
“সত্যি? কবে?”
“কবে পাঠাবে তা তো নিশ্চিত জানি না। তবে পাঠাবে যে, এটুকু নিশ্চিত থাকো।”
“ঠিক আছে, আমি আজই মৃন্ময়ীর সাথে কথা বলব। মাথামোটা মেয়ে একটা!”
“আজই কিছু বলার দরকার নেই। তাহলে আবার আপা কী না কী ভাবে। একটু অপেক্ষা করো। আগে বিয়ের প্রস্তাব আসুক। তারপর না হয় যা বলার বলবে।”
“তুই নিশ্চিত, প্রস্তাব পাঠাবে তো?”
“একশো ভাগ নিশ্চিত।”


আমাদের দেখা হয়েছিল এক আয়োজিত সন্ধ্যায়,
কনকনে শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে
তুমি এসেছিলে খুব আয়োজন করে।
প্রথম দর্শনে আমি তোমার মুখ জুড়ে
দেখেছিলাম কেবলই স্নিগ্ধতা,
ঘাসের ওপর জমে থাকা
এক ফোঁটা শিশির বিন্দুর মতো স্নিগ্ধতার
প্রেমে পড়েছিলাম আমি।
আমি সেদিন পরিচিত হয়েছিলাম প্রথম প্রেমের সবচেয়ে সুন্দর, শীতলতম অনুভূতির সাথে।
অথচ আমার তোমাকে খুঁটিয়ে দেখা হয়নি,
তোমার সাথে প্রেমালাপ হয়নি,
জানা হয়নি তোমার মন।
তবু, তবু আমি প্রেমে পড়েছিলাম!
লোকে জানলে হয়তো তামাশা করে বলত,
‘কয়েক মুহুর্তের সাক্ষাতে-ও বুঝি প্রেম হয়?
এ পাগলামি ছাড়া আর কী?’
পাগলামি বুঝি? হোক তবে!
তুমি বলতে আমার তো ওই পাগলামিটুকুই আছে।
হাত বাড়ালেই আমি তোমায় ছুঁতে পারি,
পা বাড়ালেই হাঁটতে পারি কদম মিলিয়ে।
অথচ, অথচ আমাদের দূরত্ব যেন দুই হাতের নয়,
দুই মাইলের নয়,
কয়েক যুগের, কয়েক শতাব্দীর।
সে দূরত্ব কবে যে কোকিলের কুহুতানের
আড়ালে মুখ লুকাল,
টেরই পেলাম না।
আমার হৃদয়ে বসন্তের সুর যে
এক মাঘের সাঁঝেই নাড়া দিয়েছিল,
কেবল তুমিই তা বুঝলে না, বুঝতে চাইলে না।
প্রিয় বাসন্তী,
তোমাকে দেখার পর আমার জীবনে আর
আলাদা করে বসন্ত আসেনি।
এখন ছয় ঋতু-ই আমার বসন্ত, তুমিময় বসন্ত।

প্রভাত স্বপ্ন দেখে তার মৃন্ময়ীময় বসন্ত কেবল পৃথিবীর বুক জুড়ে নয়, একদিন তার বুক জুড়ে-ও থাকবে। মৃন্ময়ীকে নিয়ে তার সংসার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন বোনা হয়ে গেছে। বাকি রয়ে গেছে সবচেয়ে বড়ো কাজটাই, যা সম্পন্ন না করা পর্যন্ত তার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হবে না। এখন তার একমাত্র লক্ষ্য শুধু মৃন্ময়ীকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়া। সে জানে এটা খুব সহজ হবে না। তবে এবার সে ভেবেচিন্তেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মৃন্ময়ীর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হলে আগে বাড়িতে বলতে হবে। কিন্তু সে এখনও বাড়িতে কিছু বলেনি। মৃন্ময়ীর সম্পর্কে বাড়ির কেউ এখনও কিছু জানে না। জানানোর মতো সম্পর্ক তার কারোর সাথেই নেই। এই পর্যন্ত অনেকবার বাড়ি থেকে তাকে বিয়ের তাগাদা দেওয়া হয়েছিল। সে তা কানে তোলেনি বলে কেউ জোর করে-ও এ বিষয়ে কিছু বলেনি। অথচ এবার তার নিজেরই বিয়ের কথা বলার দরকার পড়ছে। তবু সে নিজের মুখে কিছুই বলল না। অস্বস্তির কারণে বন্ধুকে দিয়ে খবর পাঠাল বাবার কাছে। তার বন্ধু গিয়ে যখন তার বাবাকে বলল প্রভাত তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, তখন তার বাবা নিজেই আবার তার কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। মেয়ের বিষয়ে জানতে চাইলেন। প্রভাত মৃন্ময়ীর ব্যাপারে সবটাই বলল। পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে তা-ও বলল। সব শুনে তার বাবার মুখে স্পষ্ট অসন্তোষ দেখা গেল। মুখেও বললেন পরিবার তার পছন্দ হয়নি। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে বিয়ের পরও মেয়ে বাপের বাড়ির দায়িত্ব কাঁধে বয়ে বেড়াবে কেন? প্রভাত বলল,
“ও পরিবারের বড়ো মেয়ে। সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই, তাই বাধ্য হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। বিয়ে করলে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না কেন? সমস্যা কোথায়?”
“বিয়ের পর বাপের বাড়ি নিয়ে পড়ে থাকলে নিজের সংসারে মন বসবে না।”
“কে বলেছে আপনাকে? ওকে কি আমার চেয়ে আপনি বেশি চেনেন? পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে বলে কি ও সংসার করার অধিকার রাখে না?”
“এত ঝামেলার কী দরকার? তুই এখনই বিয়ে করতে চাইলে আমরা মেয়ে দেখছি, বিয়ে করিস। এই মেয়ে বিয়ে করার দরকার নেই।”
একথা শুনেই প্রভাত রেগে গেল। শক্ত গলায় বলে দিলো,
“আপনাকে এতকিছু ভাবতে হবে না। আমি ওকে পছন্দ করি, বিয়ে করলে ওকেই করব। সংসার আমি করব, আমার সংসারের চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। দরকার পড়লে আমি ওকে আলাদা সংসার দিবো। তবু আপনার সংসারে রাখব না।”
এই নিয়ে বাবার সাথে তার বেশ কিছুক্ষণ তর্ক হলো। তার সৎ-মা রাহেলা বেগম অদূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। প্রভাত বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“এই লোককে বুঝান। নয়তো আপনারা চাইলেও আমি ওই মেয়েকে বিয়ে করব, না চাইলেও করব।”

মৃন্ময়ী লক্ষ্য করল আজ প্রভাত কথাবার্তা একটু কম বলছে। মুখে সবসময়ের স্বচ্ছ হাসিটা নেই। সে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার কি আজ কোনো কারণে মন খারাপ?”
“নাহ্,” প্রভাত অস্বীকার করল।
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমার তো মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ।”
প্রভাত হেসে বলল,
“তুমি তাহলে আমার মন-ও বুঝতে শিখে গেছো? বাহ্! আমার চেষ্টা তবে সফল হচ্ছে।”
“ফাজলামি কোরো না তো। বলো, বাড়িতে কিছু হয়েছে?”
“উঁহু।”
মৃন্ময়ী বুঝল প্রভাত কিছু বলবে না। তবু তার মন খারাপ থাকলে প্রভাত যেভাবে তাকে জেরা করতে থাকে, তা সে করতে পারল না। মনে-মনে নিজেকে ভীষণ অকর্মণ্য মনে হলো। ভাবল কীভাবে প্রভাতের মন ভালো করা যায়। প্রভাত তার মন ভালো করার জন্য কত চেষ্টা করে। অথচ সে কিছু বলতে-ও পারছে না। প্রভাত হঠাৎ কেমন মলিন কন্ঠে বলে উঠল,
“চলো এবার বিয়েটা করে নিই ম্যাডাম। আর বাঁধা দিয়ো না।”
হঠাৎ প্রভাতকে এভাবে কথা বলতে শুনে মৃন্ময়ী চুপ হয়ে গেল। প্রভাত থামল না, বলতেই থাকল,
“একটা সংসার ছাড়া আমি তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাই না। তোমার সাথে আমার জীবন জুড়ে যাওয়ার পরও আমি তোমার জীবনের কোনো সিদ্ধান্তে আপত্তি করব না। তোমাকে সমর্থন করার জন্য, তোমাকে খুশি রাখার জন্য যা করতে হয় আমি করব। এতদিনেও কি তুমি আমাকে বুঝতে পারছো না?”
মৃন্ময়ী এবারেও প্রত্যুত্তর করল না। প্রভাত বলল,
“কিছু বলছো না যে?”
মৃন্ময়ী মাথা নিচু করে হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“কী বলব? তোমায় এক কথা বলতে-বলতে আমি ক্লান্ত।”
“এক কথা আমি আর শুনতে চাচ্ছি না। এবার ভিন্ন কিছু বলো। নিজের মনকে আর কত বেঁধে রাখবে? মনকে একটু ছাড় দাও ম্যাডাম, আমি তাকে খুব যত্নে রাখব। কোনোদিন-ও অযত্ন করব না। তোমার পরিবার নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এ কথা তো তোমাকে হাজারবার বলেছি। তা-ও কেন তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো না?”
“পাগলামি কোরো না প্রভাত।”
“পাগলামি এতদিন করিনি মৃন্ময়ী, এখন করতে চাইছি। খুব শীঘ্রই আমি তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব।”
মৃন্ময়ী চমকে উঠে থমকে দাঁড়াল। চট করে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,
“মানে কী?”
প্রভাত শান্ত চোখে চেয়ে উত্তর দিলো,
“মানে খুব শীঘ্রই আমি তোমাকে আমার ঘরে নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। হতেও পারে তা এ সপ্তাহের মধ্যেই।”
মৃন্ময়ী উত্তেজিত হয়ে উঠল,
“তোমার মাথায় কী চলছে প্রভাত? এমন কিছু করতে যেয়ো না, প্লিজ।”
“তুমি প্লিজ আমাকে আর আটকিয়ো না।”
কথাটা একটু জোরে বলে ফেলল প্রভাত। সঙ্গে-সঙ্গেই আবার নিজেকে ধাতস্থ করে সে বলল,
“মৃন্ময়ী, আমার কথা শোনো। সারাজীবন তুমি এমন থাকতে পারবে না। তোমার মা তোমাকে নিয়ে কত চিন্তা করে, তা তো তুমি বোঝো। পরিবারের জন্য বিয়েতে তোমার আপত্তি, আমি বুঝি। কিন্তু আমি তো তোমাকে বারবার কথা দিয়েছি তোমার পরিবারকে আমি নিজের পরিবার বানিয়ে নেব। পরিবারের প্রতি তোমার দায়িত্ব, কর্তব্যে আমি কোনোদিন বাঁধা দিবো না। এমনকি আমার পরিবার থেকেও কোনোরকম বাঁধা আসতে দিবো না। এরপরও তোমার কিসের এত ভয়? দরকার পড়ে আমি নিজের মুখে স্বীকারোক্তি দিয়ে তারপর তোমাকে বিয়ে করব। বিয়ের পর আমার কথার এদিক-সেদিক হলে তুমি আমাকে শাস্তি দিয়ো। তবু আর আমাকে বাঁধা দিয়ো না। আমি আর তোমার আপত্তি শুনতে চাই না। কারণ আমি জানি তোমার মন কী চায়।”
“আমার মন কিছুই চায় না। তুমি এসব করতে যেয়ো না।”
মৃন্ময়ী কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু নিজের কথায় সে কোনো জোরই খুঁজে পেল না। নিজের কাছে নিজেকে চরম মিথ্যাবাদী মনে হলো। সত্যিই তার মন কিছু চায় না? প্রভাত নাছোড়বান্দা। সে স্পষ্ট ভাষায় বলল,
“মন কিছু চায় কি না তা বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর পর বুঝে নিয়ো। তখনও যদি তোমার অমত থাকে, তাহলে আমি বিশ্বাস করে নেব আমায় তুমি এক মুহুর্তের জন্যও ভালোবাসোনি।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১২+১৩

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১২.
প্রভাতকে জানানোর পর থেকে মৃত্তিকাকে বিরক্ত করা তো দূর, শফিক আর তার সামনে-ও আসছে না। মৃন্ময়ী প্রভাতকে জিজ্ঞেস করেছিল সে শফিককে কীভাবে আটকাল। প্রভাত হাসতে-হাসতে শুধু উত্তর দিয়েছে, “ওইটুকু পুঁচকে ছেলেকে শায়েস্তা করা কী এমন আহামরি কাজ? বেচারা ভয় পেয়েছে, আর বিরক্ত করবে না। এর বেশি জেনে তোমার কাজ নেই।” কিছুতেই প্রভাতের পেট থেকে সত্য কথাটা বের করা যায়নি। উলটো সে মৃন্ময়ীর কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলল। বলল,
“আমি তো তোমার সমস্যার সমাধান করে দিলাম, এবার তুমি আমার সমস্যার সমাধান করে দাও।”
মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“তোমার আবার কী সমস্যা?”
“আমার বউ নেই, এটাই সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। কবে আমার বউয়ের অভাব পূরণ করছো বলো।”
“যেদিন পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় হবে, সেদিন।”
প্রভাত হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বুঝেছি, এবার আমাকেই শক্ত একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। মিষ্টি কথা খরচ করে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই।”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে শুধাল,
“কী ব্যবস্থা নিবে, শুনি?”
“তা কি আমি তোমায় বলব? তুমি শুধু বউ সাজার প্রস্তুতি নাও, বাকিটা সময় বলে দিবে।”
মৃন্ময়ী মৃদু হাসল। প্রভাত সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল,
“হাসছো যে? তুমি কি বউ সাজার কথা শুনে খুশি হলে?”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, তোমার কনফিডেন্স দেখে।”
“কনফিডেন্স আমার সবসময়ই আছে। এবার শুধু কনফিডেন্সকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পালা।”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা, শুভকামনা রইল তোমার জন্য।”
প্রভাত হাসিমুখে বলল,
“লাভ ইউ।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকাল। তবে প্রভাতের হাসি-হাসি মুখে সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। প্রভাতের ঠোঁটের কোণ থেকে হাসির রেখা মুছল না। আজকাল মৃন্ময়ী তার সাথে অনেকটাই সহজ হয়েছে। আগের মতো হুটহাট রাগ দেখায় না। ব্যাপারটা প্রভাত ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে। পারিবারিক সমস্যার কারণে মন খারাপ হলেও মৃন্ময়ী এখন তা প্রভাতের কাছে বলতে দ্বিধা করে না। প্রভাত এতেই ভীষণ খুশি। মৃন্ময়ীর এই সহজ রূপটাই তো সে সবসময় দেখতে চেয়েছিল। অবশেষে সে কিছুটা হলেও সফল হলো। বাকি সাফল্যটুকু-ও সে যেকোনো মূল্যে জয় করে নিবে।

সবেই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে মৃন্ময়ী। ডানহাতে একটা নীল পলিথিন। মৃত্তিকার জন্য কিছু জলপাই কিনে নিয়ে এসেছে সে। এই সময় মৃত্তিকা আর মা নিশ্চয়ই কাঁথা সেলাই করছে। আজকাল রোজ বাড়ি ফিরেই সে দেখে মা আর মৃত্তিকা বাচ্চার জন্য ছোটো-ছোটো কাঁথা সেলাই করছে। দৃশ্যটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগে মৃন্ময়ীর। মৃত্তিকার সাথে মায়ের বেশ ভাব হয়েছে। এটা খুব দরকার ছিল। ভাবতে-ভাবতে মৃন্ময়ী ঘরে ঢুকতেই খানিক থমকাল। বসার ঘরে মায়ের সঙ্গে চার-পাঁচটা অপরিচিত মহিলা বসে গল্প করছে। মৃন্ময়ী তাদের কাউকেই চেনে না। অকস্মাৎ সে সালাম জানাতে-ও ভুলে গেল। সাজেদা বেগম তাকে দেখেই কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মহিলাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
“এই তো আমার মেয়ে চলে এসেছে।”
তারপর মৃন্ময়ীকে বললেন,
“সালাম দে, ওনারা তোর জন্যই এসেছে।”
অগত্যা মায়ের কথামতো মৃন্ময়ী সালাম জানাল। সাজেদা বেগম তড়িঘড়ি করে উঠে এসে তাকে ঠেলে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন,
“তাড়াতাড়ি গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে, জামাকাপড় পালটে আয়। ওনারা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন।”
মৃন্ময়ী বিস্ময় নিয়ে ঘরে ঢুকতে যেতেই আবার রান্নাঘরে শব্দ শুনে সেদিকে এগিয়ে গেল। মৃদুলাকে দেখল কড়াইতে কিছু ভাজছে। সে বলে উঠল,
“মৃদুলা, তুই আজ টিউশনে যাসনি?”
মৃদুলা উত্তর দিলো,
“মা যেতে দেয়নি।”
“কেন?”
মৃদুলা হেসে উঠে বলল,
“বাড়িতে এমন মারাত্মক ব্যাপার ঘটবে, আমি অনুপস্থিত থাকলে কী করে হবে?”
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
“কিসের মারাত্মক ব্যাপার? আর ওই মহিলারা কারা?”
মৃদুলা তাড়া দেখিয়ে বলল,
“তাদের আমি চিনব কী করে? এখনও তো আত্মীয়তা-ই হলো না। তুমি ঘরে যাও তো আপা। ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে আমার দেওয়া শাড়িটা নামিয়ে পরো। এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। আমার কাজে ডিস্টার্ব হচ্ছে। এই দেখো, তোমার সাথে কথা বলতে-বলতে কয়েকটা পিঠা বেশি ভেজে ফেলেছি। যাও, যাও।”
“আশ্চর্য!”

মৃন্ময়ী ঘরে গিয়ে দেখল তার ঘরে বসে মৃত্তিকা কাঁথা সেলাই করছে। তাকে দেখেই সে বলল,
“এতক্ষণে এলি তুই? সেই কখন থেকে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। কী এনেছিস রে?”
মৃন্ময়ী জলপাইয়ের প্যাকেটটা মৃত্তিকার কোলের ওপর রাখল। মৃত্তিকার হাসি-হাসি মুখ দেখে মনে হলো জলপাই পেয়ে সে খুশি হয়েছে। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে মৃন্ময়ী বলল,
“বাসায় কী হচ্ছে একটু বলবি আমাকে? ওই মহিলারা কোত্থেকে এসেছে?”
“কোত্থেকে এসেছে তা একমাত্র মা জানে। আমি শুধু এটুকু জানি যে তারা তোকে দেখতে এসেছে।”
“তা তো মায়ের তাড়া দেখেই আমি বুঝে গেছি। কিন্তু এদের আমাদের বাড়ির পথ দেখিয়ে দিলো কে?”
মৃত্তিকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
“জানি না। মা নিজেই সকালে আমাকে বলল। তারপর নিজেই সারাদিন আপ্যায়নের ব্যবস্থা করল। তোকে জানিয়ে দিই কি না, সেই ভয়ে তেমন কিছুই বলেনি আমাকে।”
“কী মুশকিল! মা কি বাচ্চা, বল? এতদিন তো এমন করেনি। হুট করে আবার তার মাথায় এসব বাচ্চামি জাগল কীভাবে?”
“মা-ই জানে। তুই দাঁড়িয়ে না থেকে জামাকাপড় পালটা, নয়তো মা এক্ষুনি এসে আবার তাড়া দিবে। আমাকে বারবার করে বলে দিয়েছে তোকে যেন সুন্দর করে সাজিয়ে দিই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তুই-ও কি মায়ের মতো পাগল হলি? জানিস না আমি এসব পছন্দ করি না?”
“আমি কী করব বল? মাকে এই কথা বল তুই, দেখ কেমন তেতে ওঠে। আমি একবার বলাতে আমাকে একশো ধমক দিয়েছে।”
মৃন্ময়ী বিরক্তিতে মুখে চ-সূচক শব্দ করে বলল,
“মা যে কী করে!”

বলতে-বলতেই সাজেদা বেগম দরজায় উপস্থিত হলেন। তাড়া দেখিয়ে মৃন্ময়ীকে বললেন,
“তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস? জামা-কাপড় পাল্টাচ্ছিস না কেন?”
মৃন্ময়ী মায়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
“এসবের মানে কী মা? তুমি আবার আমাকে না বলে এসব কাণ্ড শুরু করেছ? আমি বলেছি না এভাবে হুটহাট কাউকে বাড়ি আসতে বলবে না?”
“হুটহাট কোথায়? আমার সাথে কথা বলেই তো এসেছে।”
“তো তুমি আমাকে জানিয়েছ? আমাকে না জানিয়ে তুমি যাকে-তাকে আসতে বলো কেন? আমি তো তোমাকে বারবার বারণ করেছিলাম।”
সাজেদা বেগম তার কথা কানেই তুললেন না। উলটো বললেন,
“তাড়াতাড়ি কর, আমার যেন আর ডাকতে আসা না লাগে। এই মৃত্তিকা, ওকে রেডি করে দে।”

মৃত্তিকা কিছু বলতেও পারল না। সাজেদা বেগম তাড়া দিয়ে চলে গেলেন। মৃন্ময়ী মৃত্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মৃত্তিকা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
“আমি কী করব? আগে জানলে তো জানাতাম তোকে। এখন আর রাগ করিস না প্লিজ। মা কেমন তা তো জানিসই। মহিলারা যখন এসে বসে আছে, তাদের তো তাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সামনে যা।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি বিয়ে-ই যখন করব না, তখন সামনে যাব কেন? আশ্চর্য!”
“সামনে গেলেই তো তোকে বিয়ে দিয়ে দিবে না। ওনারা চলে যাওয়ার পর না হয় তুই মায়ের সাথে কথা বলিস। এখন তো বাইরের মানুষের সামনে কিছু বলতে পারবি না।”

মহাবিরক্তি নিয়েই শেষে মৃন্ময়ী ভালো জামা পরল। কিন্তু তাকে সাজানো গেল না। মৃদুলা সাজতে বলে উলটো বকা খেয়ে গেল। মহিলাদের সামনে গিয়ে মৃন্ময়ী ভদ্র আচরণ করলেও তার মনের মধ্যে বিরক্তি টগবগ করছিল। কারোর কোনো প্রশ্নের উত্তর তার দিতে ইচ্ছা করছিল না। তবু ভদ্রতার খাতিরে দিতে হলো। মায়ের প্রতি তার রীতিমতো রাগ উঠে গেল। মা তাকে নিয়ে মহিলাদের কাছে এমন মিষ্টি-মিষ্টি বুলি আওড়াচ্ছিলেন, যেন আজই তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। মৃন্ময়ী শুধু অপেক্ষায় ছিল কখন মহিলারা বিদায় হবেন। বিদায়ের সময় মহিলারা আবার বলেও গেলেন বাড়ি ফিরে তারা তাদের ছেলেকে পাঠানোর দিন বলে দিবেন। তাদের বিদায় জানিয়েই মৃন্ময়ী মাকে চেপে ধরল। জানতে চাইল এদের সে কোথা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। সাজেদা বেগম বললেন,
“আমি তুলে আনতে যাব কেন? তারাই আমাকে ধরেছিল, আপনার মেয়েকে দেখতে যাব। তাদের ছেলের খোঁজ-খবর নিয়ে শুনলাম ভালো ছেলে, তাই আসতে বলেছিলাম।”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“তুমি আবার ছেলের খোঁজ-খবরও নিয়েছ? মানে তুমি এতদূর এগিয়ে গেছ, অথচ আমাকেই জানানোর প্রয়োজন মনে করনি?”
“তোকে কী জানাব? জানালে তুই ‘না-না’ ছাড়া কিছু বলতি? আমার দায়িত্ব আমার মেয়েকে ভালো ছেলের হাতে তুলে দেওয়া, আমি তা-ই করছি।”
“তোমাকে এত দায়িত্ব পালন করতে হবে না মা। আমি হাজারবার তোমাকে বলেছি তুমি আর যা-ই করো, অন্তত আমার বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আমার কথা তুমি কেন শোনো না?”
সাজেদা বেগম রাগত মুখে বললেন,
“বিয়ে নিয়ে আমি মাথা ঘামাব না তো কে ঘামাবে? তুই যে কোন চিন্তা-ভাবনা করে বসে আছিস, তা কি আমি জানি না? আজীবন কি তুই এই বাড়ির খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি? নিজের দিকে তাকানো লাগবে না?”
“আমার চিন্তা আমি করি মা, তোমাকে করতে হবে না। আমি যেমন আছি ভালো আছি, এরচেয়ে আর ভালোর চিন্তা করার দরকার নেই।”
“কী ভালো আছিস তুই? এই তোর ভালোর নমুনা?”
“তোমরা আমাকে ছেড়ে দয়া করে নিজেদের ভালোর দিকে তাকাও।”
“আমাদের ভালো তোকে সারাজীবন অবিবাহিত থেকে দেখতে হবে না। এত বছর যথেষ্ট দেখেছিস। এখন নিজের কথা ভাব। এই মহিলারা তাদের ছেলে পাঠাবে। পছন্দ হলে আর সব ঠিকঠাক থাকলে এবার তোকে বিয়ে করতেই হবে। এবার আর আমি তোর কোনো কথাই শুনব না।”
সাজেদা বেগম একটু উঁচু গলায় কথাগুলো বলে চলে গেলেন। মৃন্ময়ী এত কথা বলল, তার কিছুই তিনি শোনার প্রয়োজনবোধ করলেন না। মৃত্তিকা আর মৃদুলা অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। মৃত্তিকা মিনমিনে গলায় বলল,
“বিয়েটা এবার কর আপা। এমন করিস না। বয়স পেরিয়ে গেলে আর কবে নিজের সংসার সাজাবি?”
মৃদুলা-ও বলল,
“হ্যাঁ আপা, আর না-না কোরো না। এবার বিয়েটা করেই নাও। তোমার একটা সংসার হলেই মা অনেকটা চিন্তামুক্ত হতে পারবে।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তোরা-ও দেখছি মায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এক সুরে কথা বলছিস। কর, সবাই মিলে আমার চিন্তা কর। নিজেদের চিন্তা আর করা লাগবে না। আমিও দেখব তোদের চিন্তা কে করে। আছি বলে তো মূল্য বুঝতে পারছিস না। বিদায় করে দেখ একবার, তখন বুঝবি বাস্তবতা কী।”
আপনমনে বকতে-বকতে মৃন্ময়ী ঘরে চলে গেল। মৃত্তিকা আর মৃদুলা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। মৃত্তিকা হতাশ গলায় বলল,
“একে বুঝানো আমার কাজ নয় বোন।”
মৃদুলা ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর আবার নিজের আত্মবিশ্বাসী সত্তা জাগিয়ে তুলে দৃঢ় গলায় বলল,
“নাহ্! হাল ছাড়লে চলবে না। এবার আপাকে রাজি করাতেই হবে। আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে।”
মৃত্তিকা জোরপূর্বক হেসে বলল,
“অল দ্যা বেস্ট।”


মৃন্ময়ী আজ ভীষণ চুপচাপ। প্রভাত বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলেও সে কেবল হুঁ-হা উত্তরে সাড়া দিয়েছে। প্রভাত কিছু পথ হাঁটার পর নরম গলায় প্রশ্ন করল,
“বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?”
মৃন্ময়ী এবার মুখ খুলল। তবে বেশ চড়া গলায় বলে উঠল,
“তোমার কেন মনে হয় সবসময় আমার বাসাতেই শুধু সমস্যা হয়? দুনিয়ার আর কোথাও কি কোনো সমস্যা নেই? না কি দুনিয়ার যত সমস্যা সব আমার বাসাতেই বাস করে?”
প্রভাত বলল,
“আমি জানি তো বাসায় সমস্যা হলে তোমার সবসময় মন খারাপ থাকে, তাই জিজ্ঞেস করলাম। তা যদি না হয় তবে দুনিয়ার অন্য কোথাও তোমার সমস্যা হলে তা-ই বলো, শুনি।”
মৃন্ময়ী আবারও চুপ হয়ে গেল। প্রভাত বারবার তার রাগে খোঁচা মে’রে বলল,
“কী হলো? বললে না? বলো।”
মৃন্ময়ী প্রত্যুত্তর করল না। প্রভাতের খোঁচাখুঁচিতে বিরক্ত হয়ে পুনরায় বলে উঠল,
“আহ্ প্রভাত! জ্বালিয়ো না তো।”
“আমি তোমাকে জ্বালাচ্ছি?”
“তো কী করছো?”
“প্রশ্ন করছি।”
“প্রশ্ন করবে না।”
“আচ্ছা, আর প্রশ্ন করছি না। তুমি কি খুব রেগে আছো?”
“আবারও প্রশ্ন করছো?”
“রাগের কারণটুকু শুধু জানতে চেয়েছি।”
মৃন্ময়ী আবারও কপালে ভাঁজ ফেলে গাল ফুলিয়ে রইল। প্রভাত তার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“তোমার রাগত চেহারা বাচ্চাদের মতো লাগছে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“বুড়ো বয়সে চেহারা বাচ্চাদের মতো লাগছে! চোখের ডাক্তার দেখাও।”
“আমার ডাক্তার তো তুমিই।”
মৃন্ময়ী চুপ। প্রভাত বলল,
“একটু দাঁড়াও, আমি ঝালমুড়ি নিয়ে আসি। ঝালমুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে।”
“তো খাও গিয়ে। আমি দাঁড়িয়ে কী করব?”
“দাঁড়াও না প্লিজ। যেয়ো না কিন্তু, হ্যাঁ? অপেক্ষা করো আমার জন্য।”

প্রভাত রাস্তার ওপারের ঝালমুড়ির দোকানে চলে গেল। যেতে-যেতে সে বারবার করে ফিরে তাকিয়ে দেখল মৃন্ময়ী চলে যাচ্ছে কি না। মৃন্ময়ী একবার ভেবেছিল চলে যাবে। প্রভাতের অমন বারবার ফিরে তাকানো দেখে আবার কী ভেবে দাঁড়িয়ে রইল, তবে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে। মৃন্ময়ী দাঁড়িয়ে আছে দেখে প্রভাত বেশ খুশি হয়েছে। দুই হাতে দুই প্যাকেট ঝালমুড়ি নিয়ে মৃন্ময়ীর কাছে ফিরে এসে একহাতের ঝালমুড়ি বাড়িয়ে ধরে বলল,
“নাও।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি খাব না। তোমার খেতে ইচ্ছা করেছে, তুমিই খাও।”
“আমি তো তোমার জন্য-ও এনেছি, নাও।”
“আমি তো খাব বলিনি। আনলে কেন?”
“খাবে না, তা-ও তো বলনি।”
“তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করনি।”
“আচ্ছা, আমারই ভুল। এখন খেয়ে নাও তো। আমি একা খেতে পারব না, নষ্ট হবে।”

মৃন্ময়ী ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে খেতে গিয়ে ঝালমুড়িতে মরিচের পরিমাণ দেখে চোখ বড়ো করে বলল,
“এত ঝাল!”
প্রভাত হেসে বলল,
“ঝালমুড়ি কি মিষ্টি হয়?”
“না, কিন্তু এত বেশি মরিচ দিয়ে আনলে কেন?”
“খেতে পারবে না?”
“পারব, কিন্তু পরে অনেক পানি খেতে হবে।”
“পানি এনে দিবো, সমস্যা নেই। খাও, খাও। এটুকু ঝাল তোমার রাগের কাছে কিচ্ছু না। ঝালমুড়ির ঝালের সাথে যদি তোমার মনের ভেতরের রাগের ঝাল বেরিয়ে আসে, তাহলে তো তোমারই উপকার। তাই না?”
মৃন্ময়ী চোখ পাকিয়ে তাকাতেই প্রভাত দাঁত বের করে হেসে বলল,
“মজা করেছি, স্যরি।”

মৃন্ময়ী ঝালমুড়ি খেতে-খেতে বেশ কয়েকবার প্রভাতের মুখের দিকে তাকাল। আজকাল প্রভাতের সাথে কোনো কথা শেয়ার করতে না পারলে তার ভালো লাগে না। মনখুলে যেকোনো কথা বলার এই একটাই তো জায়গা তার। আগে প্রভাত নিজেই তাকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে পেট থেকে কথা বের করত। আর এখন সে নিজেই কথা বলার জন্য ভেতর-ভেতর ছটফট করে। প্রভাত বুঝতে পারল তার মনোভাব। তারপর নিজেই বলল,
“কিছু বলতে চাইলে নির্দ্বিধায় বলে ফেলো, শুনছি।”
মৃন্ময়ী একটু অস্বস্তিতে ভুগছে। অন্যান্য সমস্যার মতো তো এই কথাটা না যে ঠাস করে বলে ফেলবে। প্রভাত চোখ ছোটো করে বলল,
“এখনও তুমি কথা বলতে দ্বিধাবোধ করো? এতদিনেও একটু সাহস হয়নি?”
“তা না। কথাটা একটু অন্যরকম।”
“কী রকম?”
মৃন্ময়ী এবার সাহস করে বলে ফেলল,
“বিকেলে আমাদের বাড়িতে কয়েকজন মহিলা এসেছিল।”
“কোন মহিলা?”
“আমি চিনি না, মা চেনে।”
প্রভাত যেন এক মুহুর্তেই ব্যাপারটা ধরে ফেলল। চোখ বড়ো করে সে বলে উঠল,
“বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল?”
মৃন্ময়ী মৃদু ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। প্রভাতের মুখটা হঠাৎ করেই খুব সিরিয়াস দেখাল। সে মৃন্ময়ীকে একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল,
“তোমার মা তাদের কোথায় পেল?”
“কী জানি! আগেও তো মা অনেকবার এমন করেছিল। আমি রাগ দেখানোর পর কিছুদিন বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু করেছে।”
“তোমাকে আগে থেকে কিছু জানায়নি?”
“না, স্কুল থেকে ফিরে দেখি মহিলারা বসে আছে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? মায়ের সাথে অযথা রাগ দেখিয়ে শেষে সামনে যেতে হয়েছে।”
“তুমি কি শাড়ি পরেছিলেন?”
“উঁহু।”
“সেজেছিলে?”
“নাহ্!”
“তারা কি তোমাকে পছন্দ করেছে বলে গেছে?”
মৃন্ময়ী হতাশ মুখে বলল,
“হুম।”
“আর কী বলে গেছে?”
“পাত্রকে পাঠাবে বলে গেছে।”
“তোমার মা রাজি?”
“মায়ের কথা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে?”
প্রভাত এবার কিছুটা জোরেই বলে উঠল,
“তার মানে তারা তোমাকে আবার দেখতে আসবে?”
“তা-ই তো মনে হচ্ছে।”
“তুমি কিছু বলনি?”
“মায়ের সাথে রেগে ছিলাম, তাই কিছু বলিনি তখন।”
প্রভাত হঠাৎ রেগে গেল। সে রাগত মুখে বলে উঠল,
“ছেলের ঠিকানা জেনে আমাকে জানিয়ো। তারপর ওর বিয়ে করার সাধ আমি মিটাচ্ছি।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে আমি বলেছি কিছু করতে?”
“তাহলে কি তুমি ওই ছেলেকে বিয়ে করবে?”
“আমি কখন বললাম ওই ছেলেকে আমি বিয়ে করব?”
“তাহলে?”
“প্রতিবারের মতোই না বলে দিবো। এভাবে মায়ের বাধ্য মেয়ের মতো বিয়ে করার হলে তো কবেই করে ফেলতাম। আমার কি সেই সুযোগ আছে?”
“সুযোগ অবশ্যই আছে। তবে সেটা শুধুই আমার বেলায়। তুমি বাধ্য মেয়ের মতো বিয়ে করলে করবে শুধুমাত্র আমাকে। আমি ছাড়া অন্য কেউ এই জায়গায় দাঁড়াতে চাইলে আমি তার ঠ্যাং ভেঙে রেখে দিবো।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ইশ্! কেমন গুণ্ডাদের মতো কথা বলছো।”
“অন্য কেউ আমার জায়গা নিতে চাইলে আমি গুণ্ডা-ই হব।”
মৃন্ময়ী মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,
“এমনভাবে বলছো, আমি যেন তোমাকে জায়গা দিয়ে বসে আছি।”
প্রভাত বলল,
“সে জায়গা তো আমার জন্যই বরাদ্দ আছে। খুব শীঘ্রই আমি আমার জায়গা দখল করে নেব। তুমিও বাঁধা দিতে পারবে না।”
“আমি বাঁধা দিতে পারব না? এমন বিশ্বাস তুমি কোথায় পেলে?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“তোমার পরিবর্তন থেকে।”
“কী পরিবর্তন?”
“তুমি কি নিজের পরিবর্তন বুঝতে পারো না? তা-ও আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? একমাস আগেও কি তুমি নিজে থেকে আমাকে কোনো কথা বলতে? এখন কিন্তু বলছো। এটা কি বিরাট ধরনের পরিবর্তন নয়? আমি জানি তুমি মুখে স্বীকার করবে না। না করলে কোরো না, সমস্যা নেই। আমি তোমার মন বুঝতে পারি।”
মৃন্ময়ী মিনমিনে গলায় বলল,
“খুব বোঝো তুমি।”
প্রভাত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“অবশ্যই বুঝি। আর এভাবে মন বুঝতে-বুঝতেই একদিন দেখবে আমি তোমার গোটা মনটাকেই দখল করে নিয়েছি। তখন মন জুড়ে শুধু প্রভাত ছাড়া কিছুই খুঁজে পাবে না। তোমার মনে রাগ তো দূর, মন খারাপকে-ও তখন আর আমি জায়গা দিবো না। আমি ছাড়া বাকি সবার ওপর, সবকিছুর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৩.
পাত্রপক্ষ থেকে খবর এসেছে পাত্রসহ তার বোন আর দুলাভাই মৃন্ময়ীকে দেখতে আসবে। তাদের পছন্দ হলে বিয়ের বিষয়ে কথা এগোবে। খবর শুনে মৃন্ময়ী সঙ্গে-সঙ্গে তার মাকে বলেছে তাদের আসতে নিষেধ করতে। কিন্তু সাজেদা বেগম তাতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন। মৃন্ময়ীর কথা কানে না তুলে সে তাদের আসতে বলে দিয়েছেন। সেই নিয়ে মা-মেয়ের মাঝে শুরু হয়েছে কথা কাটাকাটি। মৃন্ময়ী কিছুতেই আর পাত্রপক্ষের সামনে যেতে রাজি না। সাজেদা বেগম-ও নাছোড়বান্দা। মৃন্ময়ী কোনোভাবেই এবার সাজেদা বেগমকে বুঝাতে পারছে না। মৃত্তিকা আর মৃদুলাকে-ও বারবার করে বলেছিল তারা যেন মাকে বুঝায়। অথচ তারা বুঝাতে গেলেই সাজেদা বেগম রেগেমেগে সবাইকে চোখ রাঙানি দিয়ে বিদায় করে দেন। মায়ের রাগের সামনে তারা কোনো বোনই টিকতে পারে না। মৃদুলা তবু বকা খাওয়ার পর-ও মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল। সাজেদা বেগম উলটো তাকে বলে দিয়েছেন মৃন্ময়ীকে বুঝাতে। বোনকে তারা আর কত বছর এভাবে রাখবে? বোনের ভালোর জন্যই তো বিয়ের তাড়া দেওয়া। মৃদুলা মৃন্ময়ীর কাছে গিয়ে হতাশ গলায় বলল,
“তোমাদের দুই বিরোধী দলের গ্যাঞ্জামের মাঝে আমাকে আর ঢুকিয়ো না প্লিজ।”
মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“মা কী বলেছে?”
“কী আবার বলবে? সারাদিন ধরে যা বলে এসেছে তা-ই। মায়ের একটাই কথা, তোমাকে এবার সে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। তার কথায় কোনো নড়চড় হবে না।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল ,
“আমি বিয়ে না করলে সে আমাকে কীভাবে বিয়ে দিবে? আশ্চর্য! আমি কি বাচ্চা মেয়ে আছি যে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে?”
মৃদুলা ভাবুক মুখে মাথা নেড়ে বলল,
“হুম, কথা অবশ্য ঠিক। মা তোমাকে কী করে বিয়ে দিবে তা আমার জানা নেই। তবে তোমার দিক থেকে কীভাবে আটকানো যায়, তা জানা আছে।”
মৃন্ময়ী কৌতুহলী হয়ে উঠে বলল,
“সত্যি? কীভাবে রে?”
মৃদুলা ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হেসে বলল,
“বলব না।”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“না বললে আটকাব কীভাবে?”
“তা-ও বলব না।”
“আজব! তাহলে বললি কেন তুই জানিস?”
“তোমার আগ্রহ দেখলাম।”
“অসময়ে ফাজলামি করিস না মৃদুলা।”
“করছি না। মাথা খাটিয়ে একটু চিন্তা করো। তোমার মাথায় দেখছি বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুই নেই। সমাধান চোখের সামনে থাকলেও তুমি সমস্যা বয়ে বেড়াও।”
“চোখের সামনে কী সমাধান দেখিস তুই?”
“চোখে কালো চশমা পড়ে থাকলে দেখবে কীভাবে?”
“হেঁয়ালি না করে বললেই পারিস।”
“নিজে থেকে চিন্তা করো। আমার মাথা দিয়ে চিন্তা করলে তোমার মাথা আছে কোন কাজে?”
বলেই মৃদুলা চলে গেল। মৃন্ময়ীর বিরক্ত লাগল। মৃদুলাটা সবসময় এমন বুদ্ধিমতী সাজে। বুদ্ধি উপকারে না এলে তার এত বুদ্ধিমত্তা দেখে কী করবে সে?

সাজেদা বেগম কাঁথা সেলাই করবেন। কিন্তু রাতের বেলায় তিনি সুচের ক্ষুদ্র ফাঁকফোকর দিয়ে সুতা ঢুকাতে পারেন না। তাই মৃদুলাকে বারবার করে ডাকেন সুতা ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। আজ-ও মৃদুলা তার সুচে সুতা ঢুকিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পাশে বসে রইল। তারপর বলল,
“মা শোনো, বড়ো আপা এই ছেলেকে বিয়ে করবে না। তুমি শুধু-শুধু তাদের ডেকে এনে খরচ কোরো না।”
সাজেদা বেগম বিরক্ত চোখ তুলে বললেন,
“আবার তুই আমার কানের কাছে ভনভন করতে এসেছিস?”
“আমাকে তো তুমিই ডেকে আনলে।”
“আমি কাজে ডেকেছি, অকাজে না। তুই তোর কাজে যা, আবার ডাকলে আসিস।”
মৃদুলা এক চুল-ও নড়ল না। শক্ত হয়ে বসে বলল,
“মা, আমি ভালো কথাই বলছি। তুমি আমাদের কথা না শুনে রাগ দেখিয়ে লোকজনের পেছনে টাকা খরচ করবে, কিন্তু আপা তো ওই ছেলেকে বিয়ে করবে না। তাহলে লাভ কী এসব করে?”
“তোর আপা কোন ছেলেকে বিয়েটা করবে, বুঝা আমাকে। এই ছেলে আর ওই ছেলে আছে? ওই মেয়ে তো চিরকুমারী থাকার তালে আছে। তোরা বুঝবি কীভাবে?”
“আরে করবে-করবে। এখন কোনো ছেলেকে বিয়ে না করলেও, একদিন একজনকে ঠিকই বিয়ে করবে। তোমাকে এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না।”
“তা চিন্তা যে করব না, সেই একদিনটা ঠিক কবে আসবে মা? আমি ম’রলে? আর সেই একজনটাই বা কোন রাজপুত্র যার অপেক্ষায় বসে থেকে তোমার আপা বয়স বাড়াচ্ছে?”
মৃদুলা বলল,
“হতেও তো পারে আপার নিজের কোনো পছন্দ আছে, তাই এখন তোমার পছন্দে বিয়ে করতে চাইছে না।”
সাজেদা বেগম তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
“তোর আপা করবে ছেলে পছন্দ? তাহলে কি আর এত বছর ধরে বসে আছে?”
“এভাবে বলছো কেন? এখন তো কাউকে পছন্দ করতে-ও পারে।”
সাজেদা বেগম কেমন সন্দিহান দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে বললেন,
“তুই কি কোনো কথা লুকাচ্ছিস আমার থেকে?”
“আমি কী লুকাব?”
“তোর আপা কাকে পছন্দ করে?”
“তা আমি কী করে জানব? আমি তো শুধু সন্দেহ প্রকাশ করলাম। তুমি আমার কথা শোনো মা, আমি ভালো কথাই বলছি। ওই লোকদের আসতে বারণ করে দাও। আপা কোন ছেলেকে পছন্দ করে তার খোঁজ নিয়ে আমি তোমাকে জানাব। তারপর বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামিয়ো, কাজে লাগবে। যা কোনো কাজে আসবে না, তার পেছনে টাকা খুইয়ে কোনো লাভ নেই।”
সাজেদা বেগম রাগত স্বরে বললেন,
“ঘুরেফিরে এই কথা বলতেই আসিস? এই, তুই তোর রুমে যা। আমাকে আর কিছু বুঝাতে আসবি না। সেদিনের সেই বাচ্চা, তারা আসে আমাকে বুঝাতে। খুব বুঝদার হয়ে গেছে একেকজন।”
আরও একবার সাজেদা বেগমের বকা শুনতে হলো মৃদুলাকে। ঘরে গিমে মৃদুলা বিরক্ত মুখে বলল,
“মায়ের মাথায় আসলেই কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি নেই।”
মৃত্তিকা বলল,
“তোর মাথায় তো বুদ্ধির পাহাড়। তুই কেন কিছু করতে পারছিস না?”
“তোমার বড়ো আপা নিজেই এখন চুপ করে বসে আছে, দেখছো না?”
“কী আর করবে? মায়ের সাথে তো সারাদিন কম তর্ক করল না। এই রাত-বিরাতেও তর্ক করবে?”
“সে-ই, সে বিয়েও করবে না, মায়ের সাথেও পারবে না।”
“আরে ধুর! এসব আর নতুন কী? শেষমেশ গিয়ে তো আপার অসম্মতিতেই বিয়ে আটকে যাবে। তাকে কি মা জোর করে বিয়ে দিতে পারবে?”
“মা এবার কী ত্যাড়ামি করছে দেখছো না? শেষমেশ গিয়ে আবার কী না কী গণ্ডগোল বাঁধিয়ে বসে, তা কে জানে?”
“কী জানি! এদের ঝামেলা আমার মাথায় ধরে না।”
মৃদুলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বুদ্ধিমতী হয়ে-ও বিপদে আছি।”


সকাল-সকাল সাজেদা বেগমের মেজাজ বিগড়ে আছে। আজ বিকালে পাত্রপক্ষের আসার কথা ছিল। অথচ সকালবেলাই খবর এল তারা আসবে না। মৃন্ময়ীকে তারা তাদের ছেলের বউ বানাতে চান না। কারণ হিসেবে জানালেন মৃন্ময়ীর না কি কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। তারা বিয়ে করার চিন্তা-ভাবনাও করেছে। খুব শীঘ্রই পরিবারকে জানিয়ে তারা বিয়ে করবে। এ কথা না কি মৃন্ময়ীর প্রেমিক নিজে তাদের কল করে জানিয়েছে। মৃন্ময়ীর জন্য তাদের অযথা সময় নষ্ট করতে নিষেধ করেছে। খবর শুনে সাজেদা বেগম যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মৃন্ময়ীকে এ কথা জিজ্ঞেস করতেই সে অস্বীকার করল। সাজেদা বেগম নিজেও বিশ্বাস করেন মৃন্ময়ীর কোনো ছেলের সাথেই সম্পর্ক নেই। তাহলে এমন কথা বলল কে? অপরিচিত ছেলেটাকে না চিনলেও সে রাগে, দুঃখে সকাল থেকে ছেলেটাকে বকেই চলেছেন। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে মৃন্ময়ী নিজেও ভীষণ অবাক হয়েছে। যদিও পাত্রপক্ষের আগমনে বাঁধা পড়ায় মনে-মনে সে খুব স্বস্তি পাচ্ছে। কিন্তু মনের ভেতর প্রশ্ন রয়ে গেল কে এমনটা করল। যদিও এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে জটিল নয়। পৃথিবীতে একজন মানুষই আছে যে তার জন্য এমন অদ্ভুত কাণ্ড-ও ঘটাতে পারে। তখনই সে ফোন বের করে প্রভাতকে ম্যাসেজ করল,
“আজ বিকেলে যে পাত্রপক্ষ আসার কথা ছিল, তারা আসবে না জানিয়েছে।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রভাতের উত্তর এল,
“গুড নিউজ।”
“কেন আসবে না জানতে চাইবে না?”
“তা জেনে আমার কী হবে? আপদ বিদায় হয়েছে, এতেই আমি খুশি।”
তবু মৃন্ময়ী লিখল,
“আমার কোন প্রেমিক না কি তাদের কল করে আসতে বারণ করে দিয়েছে। বলেছে তার সাথে আমার সম্পর্ক আছে। কদিন পর আমরা বিয়ে-ও করব।”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“তোমার তো বিরাট উপকার হলো। তুমি খুশি হওনি।”
“হয়েছি, এসব আটকাতেই তো চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কোত্থেকে আমার এই আগন্তুক প্রেমিক দেখা দিলো, তা-ই তো বুঝতে পারছি না।”
“না বুঝলে নেই। এত বুঝে কী করবে? সমস্যার সমাধান হয়েছে, ব্যস, এবার খুশি থাকো।”
“তুমি আমার আগন্তুক প্রেমিকের কথা শুনে অবাক হলে না যে?”
“অবাক হওয়ার কী আছে?”
“এমনভাবে বলছো মনে হচ্ছে সে তোমার অতি পরিচিত কেউ।”
“কী যে বলো! কে না কে মজা করেছে। আমি চিনব কীভাবে?”
“তুমি চেনো না?”
“না।”
“তুমি নিজেকেই নিজে চেনো না? কী আশ্চর্য!”
“আমি তো তোমার আগন্তুক প্রেমিক নই, প্রকাশ্য প্রেমিক। তোমার হবু জামাই।”
“চালাকি কম করো। আমি খুব ভালোভাবেই জানি এই কাজ তুমি ছাড়া আর কেউ করেনি।”
“বাহ্! কী ভালো চিনো তুমি আমাকে! এরপরও বলবে তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”
“কথা ঘুরাবে না।”
“ঘুরাচ্ছি না, বলো কী জানতে চাও।”
“তোমাকে তো আমি তাদের পরিচয় দেইনি। তাহলে তুমি তাদের খুঁজে বের করলে কীভাবে? ফোন নাম্বার পেলে কোথায়?”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“এসব কোনো বিশাল ব্যাপার নয়। তোমার জন্য আমি তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর পরিচয়-ও খুঁজে বের করতে পারতাম।”
“চৌদ্দ গোষ্ঠীর কথা আমি জানতে চাইনি। যা জানতে চেয়েছি, তা বলো। নাম্বার পেয়েছ কার থেকে?”
“স্বপ্নে পেয়েছি। তোমার ওসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কাজ নেই। তুমি আমার বউ সাজার চিন্তা-ভাবনা করো।”

প্রভাতের হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্তায় মৃন্ময়ী বুঝল প্রভাত সত্যি কথা বলবে না। পাত্রপক্ষ আসার কথা তাদের ঘরের বাইরের মানুষ প্রভাত ছাড়া আর কেউই জানত না। তাহলে কি ঘরের কেউ প্রভাতকে সাহায্য করেছে? কে? মৃত্তিকা? হতেই পারে। মৃত্তিকা ওর প্রাক্তন স্বামীর সমস্যা-ও সমাধান করেছিল প্রভাতকে দিয়েই। তাহলে কি মৃন্ময়ীর অগোচরে এবার-ও সে সমাধান হিসেবে প্রভাতকেই বেছে নিয়েছে? জিজ্ঞেস করতে হবে। সে ছুটে গেল মৃত্তিকাকে জিজ্ঞেস করতে। অথচ জিজ্ঞেস করার পর মৃত্তিকা অবাক হয়ে বলল,
“আমি প্রভাত ভাইকে কোথায় পাব? তার সাথে তো আমার কোনো যোগাযোগ-ই নেই। আমি আরও মনে-মনে আফসোস করছিলাম তার সাথে যোগাযোগ নেই বলে।”
“সত্যিই তুই জানাসনি?”
“আরে না। তোর সঙ্গে মিথ্যা বলব কেন?”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“তাহলে কে?”
“তুই এসব নিয়ে এত চিন্তা করছিস কেন? তোর তো খুশি হওয়ার কথা। যে প্রভাত ভাইকে নাম্বার দিয়েছে, সে তোর কত বড়ো উপকার করেছে। আমার সাথে যোগাযোগ থাকলে তো আমি নিজেই তাকে জানিয়ে দিতাম।”

পরক্ষণেই মৃত্তিকা প্রশ্ন করল,
“এই আপা, মৃদুলা প্রভাত ভাইয়ের ব্যাপারে কতটুকু জানে?”
“ওকে তো আমি কখনও এসব নিয়ে কিছু বলিনি। কিন্তু ও যা চালাক! মাঝে-মাঝে কথাবার্তা শুনে মনে হয় ও সবই জানে। কীভাবে জানে তা আমি নিজেও জানি না। জিজ্ঞেস করলে শুধু হাসে, সত্যি কথা বলে না।”
মৃত্তিকা বলে উঠল,
“ওওও, তাহলে তুই ঘরে বিড়াল রেখে বাইরে খোঁজ করছিস কী করতে? তোর ঘরের বিড়াল-ই ইঁদুর খেয়ে ঘাপটি মে’রে বসে আছে, দেখ গিয়ে।”
“তুই কি মৃদুলাকে সন্দেহ করছিস?”
“তা নয়তো কী? ওই মেয়ের পেটে-পেটে যে কত বুদ্ধি, তা তুই ধরতে পারিসনি। গতকাল তোর থেকেও ওর বেশি তাড়া ছিল, কীভাবে পাত্রপক্ষের আসা আটকাবে তা নিয়ে। মাকে বুঝাতে গিয়ে কয়েকবার বকা-ও খেয়ে এসেছিল। তারপর হয়তো কাউকে না জানিয়ে প্রভাত ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেছে।”
এতক্ষণে মৃন্ময়ীর মাথা থেকে চিন্তার প্যাঁচ খুলল। সে মাথা দুলিয়ে বলল,
“হুম, তোর ধারণাই সঠিক। তাহলে মৃদুলা-ই একাজ করেছে।”
মৃত্তিকা হেসে উঠে মজা করে বলল,
“এক কেজি মিষ্টি কিনে এনে ওকে জিজ্ঞেস করতে যা। তোর এত বড়ো উপকার করল।”

ওদিকে মৃদুলাকে চেপে ধরেছেন সাজেদা বেগম। গত রাতেই মৃদুলা মৃন্ময়ীর পছন্দের ছেলের কথা বলে সন্দেহ প্রকাশ করল, আর আজই মৃন্ময়ীর কোন অপরিচিত প্রেমিকের আবির্ভাব হলো। এসবের মানে কী? মৃদুলা নিশ্চয়ই কিছু জানে, কিন্তু তাকে বলছে না। আজ তিনি ওর পেট থেকে সত্যি কথা বের করেই ছাড়বেন। মায়ের চাপে পড়ে মৃদুলা বলল,
“মা, আমি কি তোমাকে আমার মনের সন্দেহ জানিয়ে-ও ভুল করলাম? আমি কীভাবে জানব আপা সত্যিই কাউকে পছন্দ করে কি না? তুমি আপাকেই জিজ্ঞেস করো।”
“তোর আপা তো অস্বীকার-ই করছে‌।”
“আপা অস্বীকার করলে তুমি আমাকে ধরলে কী মনে করে?”
“তুই গত রাতেই বললি আর সকাল হতেই কোন ছেলে বিয়েতে বাঁধা দিলো, বুঝা আমাকে? এটা কি সন্দেহের বিষয় না? আমার তো মনে হচ্ছে ওই ছেলেকে তুই চিনিস।”
“আমি কী করে চিনব? আজব! আপা কি ওর ব্যক্তিগত কথা আমাকে বলে?”
সাজেদা বেগম নিজের কথায় অটল থেকে বললেন,
“আমি নিশ্চিত তুই ওই ছেলেকে চিনিস। আমি তোকে ভালোয়-ভালোয় জিজ্ঞেস করছি মৃদুলা, সত্যি কথা বল। এটা তোর আপার জন্যই ভালো। নইলে বাইরের মানুষ বদনাম ছড়াতে এক সেকেন্ড-ও ভাববে না।”
“আমি তো বলেছি আমি খোঁজ নিয়ে তোমাকে জানাব। বলেছি যখন, অবশ্যই জানাব। আজই আমি খোঁজ লাগাব। আপাতত আমি কিছুই জানি না মা। আমি নিজে না জানলে তোমাকে কার কথা বলব? তুমি অযথা আমার সাথে এখন চেঁচামেচি কোরো না।”
তবু সাজেদা বেগম মুখ বন্ধ করতে পারলেন না। একা-একা বকেই চললেন,
“তোরা সবাই আমার সাথে চালাকি করছিস তো? কর, কর। এখন তো বুঝতে চাইছিস না। আমি ম’রে গেলে বুঝবি আমি তোদের ভালো চেয়েছি, না খারাপ চেয়েছি। যার যা ইচ্ছা কর। আমি আর কাউকে নিয়েই মাথা ঘামাব না।”

মৃন্ময়ী আর মৃত্তিকা নিশ্চিত যে প্রভাতকে পাত্রপক্ষের ফোন নাম্বার মৃদুলা-ই দিয়েছে। অথচ তারা যখন মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করল, মৃদুলা তখন ঝুপ করে আকাশ থেকে পড়ার ভান ধরে বলে উঠল,
“তোমরা আমাকে সন্দেহ করছো? সিরিয়াসলি? ওই অপরিচিত ছেলে যে প্রভাত ভাই, তা-ই তো আমি মাত্র তোমাদের থেকে জানলাম। আচ্ছা আপা, প্রভাত ভাই জানল কী করে আজ তোমাকে দেখতে আসবে? এ খবর তো আমরা ছাড়া কেউ জানত না।”
মৃত্তিকা বলল,
“কথা ঘুরাবি না। সত্যি কথা স্বীকার করে নে। আমরা জানি তুই ছাড়া কেউ একাজ করেনি।”
মৃদুলা বলল,
“কী যে বলো আপু! আমার জীবনে তিনটা স্বপ্ন আছে। তৃতীয়টা হলো জামাইয়ের কাঁধে চড়ে সুইজারল্যান্ড ঘুরতে যাওয়া, দ্বিতীয়টা হলো গ্রাজুয়েশন শেষ করে ভালো একটা চাকরি করা, আর প্রথমটা হলো আপার বিয়ে খাওয়া। ভাবতে পারছো? আপার বিয়ে খাওয়া আমার প্রথম স্বপ্ন। আর সেই আমি কি না আপার বিয়ে ভাঙার কাজে সাহায্য করব? আমি কি পাগল? আমি আরও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কবে আমি আপার বিয়ে খাব, আর কবে আমার জীবনের প্রথম স্বপ্ন পূরণ হবে।”
মৃত্তিকা মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাদ দে আপা। বোমা মে’রেও তুই এই নাটকবাজের পেট থেকে সত্যি কথা বের করতে পারবি না। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য ওকে বরং পুরস্কৃত করিস।”
মৃন্ময়ী মৃদুলাকে শুধাল,
“সেরা অভিনেত্রী পুরষ্কার হিসেবে কী চায়?”
মৃদুলা মন খারাপের ভান ধরে বলল,
“তোমরা এভাবে আমাকে অপমান করছো আপা? আমার একটা কথা-ও তোমরা বিশ্বাস করছো না। এই তোমাদের ছোটো বোনের প্রতি ভালোবাসা?”
মৃত্তিকা বলল,
“আমরা সত্যবাদীকে বিশ্বাস করি, মিথ্যাবাদীকে না।”
“ঠিক আছে। আমাকে অবিশ্বাস করছো তো? করো। একদিন বুঝবে আমি কেমন বিশ্বাসী মানুষ। সেদিন বিশ্বাস করতে চাইলেও আমি তোমাদের কথা শুনব না।”
“কেন আপা? ততদিনে কি আপনার কান অকেজো হয়ে যাবে? ওওও, বুঝতে পেরেছি। সেইদিন আসতে-আসতে আপনি নিশ্চয়ই বুড়ি হয়ে যাবেন?”
মৃত্তিকার সাথে মৃন্ময়ী-ও হেসে ফেলল। মৃদুলা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলল,
“তোমাদের সাথে আমি আর কোনো কথাই বলব না। কেউ একদম আমাকে ডাকবে না আর। এখন থেকে আমি তোমাদের সাথে রেগে আছি।”
মৃত্তিকা আবারও মজা করে মৃন্ময়ীকে বলল,
“আপা, আমাদের বড়ো আপা তো রেগে আছেন। তার রাগ ভাঙানোর জন্য এক কেজি মিষ্টি ঘুষ নিয়ে আসিস কাল।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-১০+১১

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে-ইলোরা জাহান ঊর্মি

১০.
মৃত্তিকা প্রথম মাসের বেতন হাতে পেয়ে মায়ের জন্য একটা নতুন শাড়ি কিনেছে। মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কী লাগবে। মৃদুলা তার থেকে এক জোড়া জুতা নিয়েছে। আর মৃন্ময়ী কিছু নিতে রাজি না হওয়ায় মৃত্তিকা নিজেই তার জন্য একটা থ্রি-পিস কিনে এনেছে। নিজেই আবার দরজির দোকান থেকে বানিয়ে-ও নিয়ে এসেছে। জামা এনে সে প্রথমে মৃদুলাকে দেখিয়েছে। মৃদুলা বলেছে ভালো হয়েছে। মৃদুলা কী ভেবে তখন মৃত্তিকাকে বলল,
“আপু, তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
মৃত্তিকা বলল,
“বল।”
“কথা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তোমাকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।”
“আচ্ছা শুনছি, বল তুই।”
“বড়ো আপার বিষয়ে।”
“আপার বিষয়ে? কী কথা?”
“তুমি কি প্রভাত ভাইয়ের বিষয়ে জানো?”
প্রভাতের প্রসঙ্গ উঠতেই মৃত্তিকা বলে উঠল,
“ওই বদ লোকটা? জানিস সেদিন কী হয়েছে? আমি আর আপা যে ফুসকা খেতে গেলাম, ওই লোক-ও আমাদের সঙ্গে বসে ফুসকা খেয়েছে। আমাদের না বলে বিল-ও দিয়ে দিয়েছে। আমি তো জানতামই না ওই লোক এখনও আপার পেছনে ঘুরে বেড়ায়। সেদিন আমি এত অবাক হয়েছি, কী বলব! মানে আপা এতদিন যাবত একে কীভাবে সহ্য করেছে, কেন সহ্য করেছে আমার মাথায় ধরে না।”
মৃদুলা মৃদু হেসে বলল,
“এটাই তো আসল কথা আপু। আপা কেন প্রভাত ভাইকে এতদিন ধরে সহ্য করছে?”
মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তুই-ও জানিস উনি আপাকে বিরক্ত করে?”
“জানি। তবে তোমার জানায় ভুল আছে। উনি আপাকে বিরক্ত করে না, ভালোবাসে।”
“কী? ওই ফালতু ছেলে আবার ভালোবাসতে জানে? এতদিন ধরে আপাকে নরম পেয়ে বিরক্ত করছে, তুই তাকে ভালোবাসা বলছিস?”
“তোমার মতে প্রভাত ভাই আপাকে বিরক্ত করে?”
মৃত্তিকা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“অবশ্যই।”
“তুমি কীভাবে বুঝলে বিরক্ত করে?”
“আপা তাকে পছন্দ করে না, তবু সে আপার পেছনে ঘোরে জানিস না?”
“এটা তো সঠিক নয়। আচ্ছা তুমি আমাকে বলো, তুমি যতটুকু সময় প্রভাত ভাইকে আপার আশপাশে দেখেছ, ততটুকু সময় প্রভাত ভাই আপাকে কোনো বাজে কথা বলেছে?”
মৃত্তিকা ভাবুক মুখে মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক বাজে কথা না, তবে আমাকে শ্যালিকা বলে খেপিয়েছে।”
“সে তো দুষ্টুমি করেছে। আচ্ছা, আপার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করতে দেখেছ?”
“না।”
“সে কি দেখতে বখাটেদের মতো?”
“না, থাকে তো ভদ্রলোকের বেশ ধরে।”
“আপাকে কি তার ওপর খুব বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখেছ?”
“না।”
“তাহলে তুমি কীভাবে বুঝলে যে প্রভাত ভাই আপাকে বিরক্ত করে?”
মৃত্তিকা নিজের কথায় অনড় থেকে বলল,
“বিরক্ত না করলে এই লোক আপার পেছনে কেন ঘোরে? আপা কি তাকে পছন্দ করে?”
“এটাই কথা। আপা তাকে পছন্দ করে।”
মৃত্তিকা চোয়াল ঝুলিয়ে বলে উঠল,
“কী! আপা ওই লোককে পছন্দ করে? তুই কি পাগল হয়েছিস?”
“উঁহু, আমি ঠিকই আছি। আমি শুধু তোমার চোখের সামনে থেকে ভুলের পর্দাটা সরাতে চাইছি।”
মৃত্তিকা সন্দিহান কন্ঠে বলল,
“তুই কি প্রভাত ভাইয়ের হয়ে কথা বলছিস?”
মৃদুলা হেসে বলল,
“শোনো আপু, কোনো বখাটে ছেলেরা আমাদের আপার পেছনে ঘোরার মতো ধৈর্য রাখে না, এটা অন্তত আমি বিশ্বাস করি। আপা তো কাউকে পাত্তা-ই দেয় না, আর না কারোর প্রস্তাবে সাড়া দেয়, তাহলে কোন ছেলে জেনেশুনে তার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করবে? কেউই করবে না। কারণ সবাই জানে আপার কাছে আশা রেখে কোনো লাভ নেই। কিন্তু প্রভাত ভাই আলাদা। সে আপার বিষয়ে সবকিছু জানে, আপাকে খুব ভালোভাবে চেনে, তবু সে আপাকে ছাড়তে রাজি না। আপা কিন্তু তাকে কোনোরকম আশা দেয়নি, তবু সে আপার জন্য অপেক্ষা করে আছে। অদৃশ্য আশা নিয়ে সে দিনের পর দিন আপাকে ভালোবাসা নিবেদন করছে। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে একদিন আপা তাকে গ্রহণ করবে।”
মৃত্তিকা বলল,
“তার জন্য কি মেয়ের অভাব পড়েছে? আপার পেছনেই কেন পড়ে আছে?”
“সেটাই তো, তার জন্য মেয়ের অভাব নেই। সে চাইলেই খুব ভালো পরিবারের সুন্দরী কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু সে তা করছে না। করবে কী করে? তার মন তো পড়ে আছে আপার কাছে। তুমি তার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে না ভাবলে কখনোই বুঝতে পারবে না আপাকে সে কতটা ভালোবাসে।”
মৃত্তিকার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল। সে ভাবুক মুখে বলল,
“সত্যিই কি তাই?”
“হুম, একদম তাই। প্রভাত ভাই আপাকে খুব ভালোবাসে। সে আপাকে বিরক্ত করে না, ছায়ার মতো আপার পাশে থাকার চেষ্টা করে। আপার মন পাওয়ার জন্য রোজ চেষ্টা চালিয়ে যায়।”
“কিন্তু আপা?”
“আপা? আপার বিষয়টা ধরা খুব কঠিন কিছু না। তুমি একটু ভাবলেই বুঝে যাবে।”
মৃত্তিকা একটু চিন্তা করে বলল,
“আপা কি বিয়ের ভয়ে প্রভাত ভাইকে এড়িয়ে চলছে?”
“একদম ঠিক ধরেছ। আপা ভয় পায়। আপার ভয় আমাদের নিয়ে, এই সংসার নিয়ে। আমাদের এই সংসারের একমাত্র সম্বল সে। সে চলে গেলে এই সংসারের কী হবে, শুধুমাত্র এই চিন্তা করে আপা নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিচ্ছে। আমাদের জন্য সে তার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে পারছে না। প্রভাত ভাইকে সে অপছন্দ করে না। বরং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সে ঠিকই এতদিনে প্রভাত ভাইকে নিয়ে চিন্তা করত। তা-ও সে করতে পারছে না। সংসারের বাধ্যবাধকতা তাকে তার নিজস্ব জীবন থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে,” মৃত্তিকার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
“কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আপাকে তো নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। তার এখন নিজের সংসার সাজানোর সময়। আমাদের জন্য সে আজীবন এমন থাকতে পারবে না।”
“এটাই তাকে বুঝাতে হবে। তাকে তার জীবন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এবার অন্তত তার নিজস্ব একটা সংসার প্রয়োজন। নয়তো আজীবন আমরা আপার কাছে দোষী থাকব। আপা হয়তো মুখে কিছু বলে না, কিন্তু একটা নিজস্ব মানুষ, নিজস্ব সংসারের শখ তো তার-ও আছে।”
মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“ঠিক বলেছিস, আপাকে এই বিষয়ে বুঝানো দরকার। এখন তো আমি চাকরি করছি, তুই-ও টুকটাক নিজের খরচ চালাতে পারিস। এবার আপাকে আমাদের মুক্তি দেওয়া উচিত।”
“তুমি একটু আপার সাথে কথা বলো না আপু। আমি ছোটো মানুষ, আপার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি হয়। আপা-ও আমার সাথে মনখুলে কিছু বলবে না। তুমি বললে আপার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারবে।”
“ঠিক আছে, আমি কথা বলে দেখব। কিন্তু তোর মাথায় এত খবর এল কোত্থেকে?”
মৃদুলা মুচকি হেসে বলল,
“আমার স্পাই আছে।”
“কে?”
“বিবিসি নিউজের হেড।”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলল,
“ফাজিল।”


মৃত্তিকার থেকে নতুন জামা পেয়ে মৃন্ময়ী ভীষণ খুশি হয়েছে। তার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছে সে মৃত্তিকার পরিবর্তন দেখে। মৃত্তিকা সত্যিই বদলে গেছে। আগের মৃত্তিকা আর বর্তমান মৃত্তিকার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখনকার মৃত্তিকার চিন্তাধারা অন্যরকম। একদম যেমনটা মৃন্ময়ী সবসময় দেখতে চেয়েছিল। অবশেষে মৃন্ময়ীর একটা চিন্তা দূর হলো। যদিও তার পেছনে টাকা খরচ করার জন্য সে মৃত্তিকার ওপর কপট রাগ-ও দেখিয়েছে। বলেছে তার জন্য আর কিছু না কিনতে। মৃত্তিকার এখন নিজস্ব খরচ আছে। বেশি-বেশি পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন তার। মৃত্তিকা হেসে বলল,
“তুই আমার পেছনে যা খরচ করেছিস, তা তো আমি তোকে ফেরত দিতে পারব না। তোর কাছে না হয় আজীবন ঋণী থেকে যাব। আমার এটুকু খরচ যদি তোর অনেক মনে হয় তাহলে ভবিষ্যতে তুই আমার বাচ্চাকে দিয়ে শোধ করে দিস।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তোর বাচ্চাকে দিয়ে শোধ করতে যাব কেন? তোর বাচ্চা কি আমার পর হবে? আমি না দিলে ওকে কে দিবে? ও আসুক, তারপর দেখবি মৃদুলা-ও ওকে তোর চেয়ে বেশি দিবে। কত বছর পর এই পরিবারে নতুন সদস্য আসবে! একটা ছোট্ট বাচ্চা আমাদের হাতে বড়ো হবে। ভাবতেই আমার আনন্দ হচ্ছে। মৃদুলার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।”
মৃন্ময়ীর চোখেমুখে আনন্দ। মৃত্তিকা কেবল হেসেই চলল। সে মনেপ্রাণে শুধু চায় তার সন্তান যেন সবার ভালোবাসায় বেড়ে উঠতে পারে। আপাকে দিয়ে তার সেই বিশ্বাস আছে। নিজের পরিবার না পাক, তার সন্তান মাকে পাবে, মায়ের পরিবার পাবে। মায়ের পরিবার-ই হয়ে উঠবে তার পরিবার। কথায়-কথায় মৃত্তিকা বলল,
“আপা, তোকে একটা প্রশ্ন করব?”
“বল।”
“তোর নিজস্ব একটা সংসারের সাধ হয় না?”
মৃন্ময়ী খানিক থমকাল। বলল,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস?”
“প্রয়োজন আছে বলেই করছি। বল না, তোর কি সংসারের সাধ হয় না? এই দায়িত্বের জীবন থেকে বেরিয়ে নিজের একটা মানুষকে আঁকড়ে নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করে না?”
মৃন্ময়ী বলল,
“উত্তরটা তো তোর প্রশ্নেই আছে।”
“কী?”
“দায়িত্বের জীবন। দায়িত্বের জীবন থেকে বেরোনোর পথ কোথায়?”
“পথ কি তুই কোনোদিন খুঁজেছিস?”
“খুঁজে কী হবে? যা সম্ভব না, তার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করে তো লাভ নেই।”
“আর তোর নিজের সাধ-আহ্লাদ? জীবন নিয়ে কি তুই একটুও ভাববি না?”
“আমার অত সময় নেই। বাদ দে তো এসব কথা।”
মৃত্তিকা প্রসঙ্গ বাদ দিতে নারাজ। সে পুনরায় বলল,
“তোর এখন নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত আপা। অনেক হয়েছে দায়িত্ব পালন। দায়িত্বের ভারে তুই নিজের ভবিষ্যত অন্ধকার করতে পারিস না।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তা তুই আমার ভবিষ্যত আলোকিত করতে বলছিস কীভাবে?”
“তুই এবার বিয়েটা করে ফেল আপা। তোর একটা সাজানো সংসার হোক।”
“তারপর?”
“তারপর আবার কী? এই সংসারের অজুহাত দেখাবি তো? এই সংসারের জন্য তুই অনেক ত্যাগ করেছিস আপা। অনেক হয়েছে, আর না। আমরা এখন আর ছোটো নেই।”
“আচ্ছা? কতটা বড়ো হয়েছিস তোরা শুনি?”
“যথেষ্ট বড়ো হয়েছি। হয়তো তোর মতো করে সংসার সামলানোর মতো বড়ো হইনি, কিন্তু চেষ্টা করার মতো বড়ো তো হয়েছি। তোর অনুপস্থিতিতে আমি আর মৃদুলা আছি আপা। আমরা দুজনেই এখন উপার্জনক্ষম। দুজন মিলে ঠিক সবটা সামলে নিব। তুই প্লিজ এবার ছুটি নে।”
“তুই আমাকে ছুটি দিচ্ছিস মৃত্তিকা? একটা সংসার সামলানো তোর ভাবনার মতো এত সহজ না রে। নিজের কাঁধে দায়িত্ব পড়লে তা টের পাবি। মৃদুলার এখনও নিজের সম্পূর্ণ খরচ সামলানোর সামর্থ হয়নি। এখনই ও পড়াশোনার খরচ সামলালে হাত খরচে টানাটানি পড়ে যায়। আর সামনে তো ওর পড়াশোনার খরচ আরও বাড়বে। টিউশনের টাকায় ও কতটুকু সামলাবে? তোর এখন নিজের জন্য-ই কত খরচের প্রয়োজন। সামনে তোর বাচ্চার দায়িত্ব-ও নিতে হবে। তুই কী করে সংসারের খরচ সামলাবি? তারপর মায়ের ঔষধের খরচ? তা কী করে সামলাবি?”
মৃত্তিকা ক্ষণকাল চুপ থাকার পর অন্ধকার মুখে বলল,
“তুই তো আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছিস আপা।”
মৃন্ময়ী দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, আমি তোকে প্রকৃত সত্যিটা বুঝাতে চাইছি। তোরা আমাকে ছুটি দিতে চাইলেও এই সংসার আমায় ছুটি দিবে না। দায়িত্ব থেকে আমার মুক্তি নেই।”
“কিন্তু তোর ভবিষ্যত জীবনের কী হবে আপা?” ছলছল চোখে চেয়ে বলল মৃত্তিকা।
“আমার ভবিষ্যত জীবন? জানি না রে। আমার ভবিষ্যত আমি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কপালে যা আছে হবে।”
“কী হবে? কীভাবে হবে? তুই কি এই সংসারের দায়িত্ব পালন করেই জীবন কা’টিয়ে দিবি?”
“কপালে যদি তা-ই লেখা থাকে, তবে দিবো। বাবা তার এই সংসার আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছে রে বোন। আমি তার সেই সংসারের হাল মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার মতো স্বার্থপর হতে পারব না। বিশ্বাস কর, শত কষ্টের মাঝেও আমি তোদের নিয়ে অনেক ভালো আছি। কিন্তু তোদের ছেড়ে গিয়ে আমি কোনোদিন-ও ভালো থাকতে পারব না। অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাবে। যে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য আমি নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করে এসেছি, সেই সংসার মাঝনদীতে ডুবিয়ে দিয়ে আমি কীভাবে নিজের জন্য সুখের সংসার সাজাব বলতে পারিস? এমন দুঃসাহস তো আমার নেই রে বোন।”
মৃত্তিকা কেঁদে ফেলল। কাঁদতে-কাঁদতে বলল,
“সব আমার দোষ। আমার জন্য তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি যদি তোর মতো হতাম তাহলে আজ আমাদের এমন দুর্দিন দেখতে হত না। আমাকে তুই মাফ করে দিস আপা।”
মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে বাঁধা দিতে চাইল। মৃত্তিকা দাঁড়াল-ই না। দ্রুত তার সামনে থেকে সরে গেল। দরজার বাইরে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে ছিল মৃদুলা। মৃত্তিকা বেরোতেই সে বলে উঠল,
“প্রভাত ভাইয়ের কথা বললে না কেন?”
মৃত্তিকা নাক টেনে বলল,
“আপাকে এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই রে। আপা আমাদের কথা শুনবে না।”
“আপা তো তোমাকেই উলটো বুঝিয়ে দিলো।”
“আমাদের জীবনটা এমন কেন হলো রে মৃদুলা? আমরা কেউ কি একটু সুখের ভাগীদার না?”
মৃদুলা সশব্দে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“জানি না। তুমি কেঁদো না তো। কেঁদে কোনো ফায়দা নেই। ঘরে যাও।”


প্রভাতকে দেখে আজ মৃন্ময়ীর মনে-মনে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। গতকালের ঘটনা আর মৃত্তিকার কথা মিলিয়ে তার মনটাই বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। প্রভাত তার মুখোভাব লক্ষ্য করে শুধাল,
“মুখটা অমন করে রেখেছ কেন? কী হয়েছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“কিছু না।”
“পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা?”
মৃন্ময়ী না-বোধক মাথা নাড়ল। প্রভাত বলল,
“তাহলে?”
“বললাম তো কিছু না।”
“তোমার মুখ তো বলছে কিছু হয়েছে।”
“উঁহু, আমি ঠিক আছি।”
প্রভাত পালটা জবাবে বলল,
“তুমি ঠিক নেই। তোমার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারছি।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করে বসল,
“কেন বুঝতে পারো?”
“ভালোবাসি তাই।”
“তোমাকে এত বুঝতে হবে না।”
প্রভাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আর কত নিষেধাজ্ঞা জারি করবে?”
“জারি করেই বা লাভ কী হচ্ছে? তুমি তো এক ঘাড়ত্যাড়া।”
“সেটাই। লাভ নেই জেনেও এই এক কথা হাজারবার বলার কী দরকার?”
“তুমিও তো এক কথা লক্ষ বার বলো। তোমার কী দরকার?”
“আমার তো দরকার আছেই। আমি লক্ষ বার না বললে তোমাকে পাব কীভাবে?”

মৃন্ময়ী প্রত্যুত্তর করল না। চোখ জোড়া এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,
“তোমার শরীর কেমন?”
“ভালো। ভেবেছিলাম জ্বর-টর আসবে, কিন্তু আসেনি। অসুখ-ও বুঝে গেছে আমার সেবা করার মানুষ নেই।”
হাসল প্রভাত। মৃন্ময়ী বলল,
“তোমার মায়ের সাথে তোমার সম্পর্ক এতই খারাপ?”
“আমার কোনো মা নেই।”
মৃন্ময়ী দেখল প্রভাতের মুখের রং বদলে গেছে। তাই ওই প্রসঙ্গ আর সামনে টানল না। এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটল।‌ মৃন্ময়ী হঠাৎ ডাকল,
“প্রভাত?”
“হুঁ?” সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া দিলো প্রভাত।
“এতদিনে যদি আমি হ্যাঁ বলে দিতাম, তাহলে তুমি আমার জন্য কী করতে?”
“তুমি যা চাইতে তা-ই।”
“যেমন?”
“তোমার পরিবারের কথা বুঝাতে চাইছো তো? আমি জানি তুমি তোমার পরিবার ছাড়া আর কিছু চাইতে না। তাতে আমি কোনোদিনই আপত্তি করতাম না। তোমার পরিবারকে তুমি সাপোর্ট দিবে, সব জেনেবুঝে তাতে বাঁধা দেওয়ার মতো অত খারাপ মানুষ-ও আমি নই। আমি তো সবসময় বলি, তোমাকে পেয়ে গেলে আমি তোমাকে সাপোর্ট দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করব। তুমি যাতে খুশি থাকবে, ভালো থাকবে, আমি তা-ই করব।”
“কিন্তু আমি তো তোমাকে এমন সুযোগ দিয়ে খুশি করতে পারব না।”
প্রভাত মলিন হাসল। বলল,
“আমি অপেক্ষা করব।”
“আর কতদিন প্রভাত?”
“যতদিন না তুমি আমার নামে কবুল পড়ছো।”
“ভালোবাসায় জেদ চলে না।”
“উঁহু, ভালোবাসায় জেদ নয়, জোর চলে না। তাই তো আমি তোমাকে জোর করছি না। তবে জেদ আমি ছাড়ব না। ভালোবাসায় এটুকু জেদ না থাকলে ভালোবাসা জয় করব কীভাবে?”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“তোমার সঙ্গে তর্ক করাই আমার ভুল।”
প্রভাত দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“চিন্তা কোরো না। এখন তর্ক করতে হচ্ছে আমার ভালোবাসা জয়ের প্রয়োজনে। বিয়ের পর তর্ক করব না। তখন তোমার বিজয়-ই আমার বিজয়।”
মৃন্ময়ী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“দুঃস্বপ্ন দেখো।”
প্রভাত বলল,
“দুঃস্বপ্নে হলেও তো আমাকে বিয়ে করে নিতে পারো।”
একটা ধারালো দীর্ঘশ্বাস মৃন্ময়ী অতি সন্তর্পণে চেপে নিল। দুঃস্বপ্নে বিয়ে? কেন? এটা তো বাস্তব-ও হতে পারত। বাস্তবতায় রূপ নেওয়া স্বপ্ন দেখা-ও কি তার জন্য নিষিদ্ধ? তার ভাগ্যটা কি কোনোদিন তার অনুকূলে আসবে না?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১১.
সময় যেন কে’টে যায় চোখের পলকে। মৃত্তিকার প্রেগন্যান্সির তখন ছয় মাস চলছে। এরমধ্যে একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে সে তার প্রাক্তন স্বামীর সামনে পড়ে গেল। এতদিন পর হঠাৎ এভাবে দেখা হওয়ায় মৃত্তিকা একটু ভড়কে গেলেও সে নিজেকে সামলে নিল। না দেখার ভান করে চলে যাওয়া ধরল। কিন্তু শফিক তার পথরোধ করে দাঁড়ানোর ফলে সে দাঁড়াতে বাধ্য হলো। হুট করে এভাবে যেচে এসে সামনে দাঁড়ানোর মানে কী? মুখোভাব কঠিন করে মৃত্তিকা বলে উঠল,
“কী সমস্যা?”
শফিক হাসিমুখে বলল,
“অনেকদিন পর দেখা হলো। কেমন আছো মৃত্তিকা?”
লোকটার হাসি দেখে মৃত্তিকার মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। সে শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমি কেমন আছি তা দিয়ে আপনার কী প্রয়োজন?”
“কী যে বলো! আমি ছাড়া আর কার প্রয়োজন হবে? আমার-ই তো প্রয়োজন।”
“আমার কোনো প্রয়োজন নেই আপনার কাছে, সরুন।”
মৃত্তিকা পাশ কেটে চলে যেতে চাইল। শফিক যেতে দিলো না। আবারও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে উঠল,
“আহা! এত তাড়া কিসের? একটু কথা শুনে যাও না।”
মৃত্তিকা বলল,
“আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা শোনার মতো সম্পর্ক আপনার সাথে আমার আর নেই।”
“জানি, জানি। সম্পর্ক তো ভেঙেই গেছে। তখন তো আর জানতাম না সম্পর্ক ভাঙার পরও আবার নতুন কোনো সম্পর্ক জন্ম নিবে।”
মৃত্তিকার বুকের ভেতর হঠাৎ কামড় দিয়ে উঠল। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ করতে লাগল। তার বিস্ময় দেখে শফিক আবারও হাসল। মৃত্তিকার সন্দেহ জাগল শফিক খবরটা জেনে গেছে কি না। মৃত্তিকার পরনের বোরখা যথেষ্ঠ ঢিলেঢালা। কেউ দেখলে বুঝতে পারে না সে অন্তঃসত্ত্বা। তবু সে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“পথ ছাড়ুন, আমার দেরী হচ্ছে।”
শফিক বলল,
“দাঁড়াও, দাঁড়াও। এখনও তো আমার প্রশ্নের উত্তর-ই পেলাম না।”
“কী প্রশ্ন?”
“আমার বাচ্চার কথা তুমি আমাকে জানাওনি কেন?”

ব্যস! মৃত্তিকা যা সন্দেহ করেছিল, তা-ই হলো। খনিকের জন্য মৃত্তিকা একটু ভড়কে গেলেও নিজেকে সে সামলে নিল। উত্তরে বলল,
“কিসের বাচ্চা?”
“কিসের বাচ্চা? পেটে যে বাচ্চা নিয়ে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছ, সেই বাচ্চা। আমার বাচ্চা।”
“আমি আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসিনি। বলুন আপনারা বের করে দিয়েছেন। আর আপনাকে কে বলল আমি আপনার বাচ্চা নিয়ে এসেছি?”
“তুমি কি ভেবেছিলে, বাচ্চার খবর গোপন রাখলে আমি জানতে পারব না? হুহু, তুমি ডালে-ডালে চললে আমি চলি পাতায়-পাতায়। তোমার সব খবরই আমার জানা।”
মৃত্তিকা ধিক্কার জানিয়ে বলল,
“অপ্রোজনীয় ভেবে যাকে গলাধাক্কা দিয়ে জীবন থেকে বের করে দিয়েছেন, তার খবর রাখেন আপনি কোন প্রয়োজনে?”
“খবর না রাখলে কি এমন খুশির খবর জানতে পারতাম?”
“আপনার খুশি হওয়ার কারণ কী?”
“আমার সন্তান আসবে, আমি খুশি হব না?”
“না। এই বাচ্চা আপনার না। বর্তমানে ওর মায়ের কোনো স্বামী নেই, তাই ওর-ও কোনো বাবা নেই। মা ছাড়া ওর কেউ নেই।”
শফিক চোখ বড়ো করে বলল,
“আমাকে না জানিয়ে আমার বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, আর বলছিস বাচ্চা আমার না? তোর এত বড়ো সাহস হয় কী করে? কে দিয়েছে তোকে এমন সাহস?”
মৃত্তিকা শক্ত গলায় বলল,
“রাস্তার মাঝে একদম চেঁচামেচি করবেন না। বাচ্চা নিয়ে আপনার এত মাথাব্যথা কিসের? আমার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই, আমার বাচ্চার সাথেও নেই।”
“এই খবরদার, বাচ্চা নিয়ে কোনো বড়োগলা করবি না। এই বাচ্চা আমার। ভালোয়-ভালোয় বাচ্চা আমাকে দিয়ে দিবি।”
কথাটা শুনেই মৃত্তিকা অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। কঠিন মুখে রাগত স্বরে বলল,
“আমার বাচ্চা যাওয়ার সাহস আপনাকে কে দিয়েছে? বিয়ে করেছেন, নতুন বউ নিয়ে সংসার বেঁধেছেন, তার কাছে যান না। আমার বাচ্চার কী প্রয়োজন আপনার?”

এরপর শফিক খ্যাপা ষাঁড়ের মতো যা উত্তর দিলো, তাতে মৃত্তিকার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল তার বর্তমান বউ সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। ডক্টর বলেছে সে কোনোদিনও মা হতে পারবে না। এ কারণেই শফিক এখন তার বাচ্চার পেছনে পড়েছে। মৃত্তিকা কটাক্ষ করে বলল,
“খুব শখ করে বিয়ে করেছিলেন না? এখন বিয়ের শখ মিটে গেছে? ভেবেছিলেন অন্যায় করে পার পেয়ে যাবেন? এবার দেখুন, এটা আপনার বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি। আল্লাহ্ আপনাকে যোগ্য শাস্তি দিয়েছেন।”
শফিক ধমকে উঠে বলল,
“চুপ থাক। ফালতু কথা বলবি না। তোর ফালতু আলাপ শুনতে আসিনি আমি।”
মৃত্তিকা আঙুল তুলে বলল,
“আপনিও আমাকে তুই-তুকারি করবেন না। আপনি আমার কাছে এখন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার সাথে গলাবাজি করার কোনোরকম অধিকার আপনার নেই।”
শফিক হঠাৎ মৃত্তিকার আঙুলটা মুচড়ে ধরল। মৃত্তিকা ব্যথায় ককিয়ে উঠলেও সে ছাড়ল না। চোখ বড়ো করে কড়া গলায় বলল,
“খুব বাড় বেড়েছে তোর, না? আমার সাথে একদম সাহস দেখাতে আসবি না। তোকে আমার থেকে ভালো আর কেউ চেনে না। বাচ্চা তুই আমাকে দিতে না চাইলেও আমি ঠিক নিয়ে নেব। তুই শুধু জন্ম দে।”
আঙুলের ব্যথায় মৃত্তিকার চোখে পানি চলে এসেছে। তবু সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“দুঃস্বপ্ন দেখুন। আমি মরে গেলেও আমার বাচ্চা আপনার মতো অমানুষের হাতে দিবো না। আঃ! আঙুল ছাড়ুন। আমি কিন্তু এখন লোকজন ডাকব।”
“ডাক, দেখি তোর কোন বাবা আসে।”

কাকতালীয়ভাবে জাহিদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিল। দূর থেকে মৃত্তিকাকে দেখে সে চিনতে পেরেছিল। মৃদুলার ফেসবুক পোস্টে তার আপাদের অনেকবার দেখেছে সে। ঘটনার অস্বাভাবিকতা বুঝতে পেরেই সে দৌড়ে এগিয়ে এল। একদল ছেলেপেলেকে আড্ডা দিতে দেখে বুদ্ধি করে সে তাদের-ও ডেকে নিয়ে এল। হঠাৎ করে একদল ছেলে এসে ঘিরে ধরে নানান প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ায় শফিক বেশ ঘাবড়ে গেল। শফিকের হাত থেকে ছাড় পেয়েই মৃত্তিকা ছেলেগুলোকে বলল শফিক তার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। ফলস্বরূপ শফিক ছেলেগুলোর কাছে বেশ ঝাড়ি খেল। মৃত্তিকার কাছে মাফ-ও চাইতে হলো তাকে। শফিক বিদায় হওয়ার পর ছেলেগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে মৃত্তিকা-ও স্কুলের দিকে হাঁটা দিলো। জাহিদ তাকে ডেকে রিকশা নিয়ে দিলো। মৃত্তিকা রিকশা নিতে চায়নি। জাহিদ তার বারণ শুনল না। রিকশা ঠিক করে দিয়ে ভাড়াটা-ও সে দিয়ে দিয়েছে। মৃত্তিকা ভীষণ কৃতজ্ঞতা বোধ করল। মৃত্তিকাকে বিদায় দিয়েই জাহিদ মৃদুলাকে কল করল। ঘটিত খবরটা মৃদুলার কানে তুলে দিতে সে দেরী করল না। মৃত্তিকা হয়তো বাসায় ফিরে কাউকে জানাবেই না। কিন্তু ব্যাপারটা তার পরিবারের জানা জরুরী মনে করল সে। যদিও মৃত্তিকা তাকে চেনে না। মৃদুলাকে খবর দিলেও সে বুঝতে পারবে না খবরটা কে দিয়েছে।
মৃদুলা এমন খবর পেয়েই সঙ্গে-সঙ্গে মৃন্ময়ীকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে। তবে মাকে জানায়নি। মৃন্ময়ী তখন প্রথম ক্লাসে ঢুকেছিল। খবরটা শুনেই তার মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ল। সে ভালো করেই জানে শফিক ছেলেটা মোটেও সুবিধার না। এ কারণেই ছেলেটার সাথে মৃত্তিকার সম্পর্কে সে আপত্তি জানিয়েছিল। অথচ সেই ছেলেটাই শেষমেশ মৃত্তিকার জীবনে আতঙ্ক ছড়াতে লাগল। চিন্তায় মৃন্ময়ী সারাদিন ঠিকঠাক ক্লাস-ও নিতে পারল না। মৃত্তিকাকে কল করে তার খবর নিয়েছে সে। তবু তার মনের মধ্যে শুধু ওই ভয়টাই ঘুরে বেড়িয়েছে। আজ স্কুল ছুটির পর সে নিজেই উলটো পথে গেল মৃত্তিকাকে এগিয়ে আনতে। বলা তো যায় না, ফেরার পথে যদি ছেলেটা ওকে আবার বিরক্ত করে? ওদিকে প্রভাত এসে তাকে খুঁজে পেল না। পথিমধ্যে মৃত্তিকা বোনকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। আজকের ঘটনার পর তাকে মা-বোন সবাই ফোন করেছিল। এদের যে কে এই খবর দিলো বুঝতেই পারছে না সে। তবে মৃন্ময়ীকে দেখে তার অনেকটা শান্তি লাগছে। ছুটির পর স্কুল থেকে বেরিয়ে তার বারবার মনে হচ্ছিল শফিক আবারও পথ আটকাবে। মৃন্ময়ীকে পেয়ে তার সাহস বেড়ে গেছে। সে মৃন্ময়ীকে জিজ্ঞেস করল কে তাকে খবর দিয়েছে। মৃন্ময়ী নিজেও উত্তর দিতে পারল না। কারণ মৃদুলা তাকে স্পষ্টভাবে বলেনি সে কোত্থেকে এই খবর পেয়েছিল। তবে একদিনের নিরাপত্তায় মৃত্তিকার রক্ষা মিলল না। এরপরও শফিক তাকে বারবার জ্বালাতন করেছে। স্কুলে যাওয়ার সময়েই সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। মৃত্তিকা প্রতিবাদ করলেই নানান আজেবাজে কথা বলে। মানসম্মানের ভয়ে মৃত্তিকা রাস্তার মাঝে চিৎকার করতে পারে না। প্রথমদিকে ব্যাপারটা সে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। বাড়িতে সবাইকে বলেছিল শফিকের সাথে তার আর দেখা হয় না। কিন্তু একই ঘটনা যখন বারবার ঘটতে লাগল, তখন মৃত্তিকা অসহ্য হয়ে মৃন্ময়ীকে জানাল। মৃন্ময়ী শুনে অবাক হয়ে বলল,
“তুই এই কথা আমাকে আগে জানাসনি কেন?”
মৃত্তিকা বলল,
“তোদের দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইনি, তাই।”
“মানে কী? তোর কি বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে মৃত্তিকা? তুই কোন আক্কেলে এই রিস্ক নিয়েছিলি? ওই লোক যদি তোর কোনো ক্ষতি করে ফেলত?”
“কী করতাম বল? তোদের জানালেই কি তোরা ওর কিছু করতে পারতি?”
“আমাদের কথা বাদ দে। তুই কেন চুপচাপ সহ্য করেছিস? আশপাশের লোকজন ডাকতে পারতি। গণধোলাই না খেলে ও সোজা হবে না।”
মৃত্তিকা মাথানিচু করে বলল,
“ও মানুষ নেই আপা, অমানুষ হয়ে গেছে। মুখের ভাষা শুনলে তুই বুঝতে পারতি। বাচ্চা দিবো না বললেই আমাকে যা-তা বলে গালাগাল করেছে। লোকজন কীভাবে ডাকব? ওর মানসম্মান না থাকলেও আমার তো আছে। রাস্তার মাঝে ও কী করে বসে তার তো ঠিক নেই। যা হিংস্র পশুর মতো ব্যবহার!”
মৃন্ময়ী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“এখন তুই করতে বলছিস? থানায় মামলা করবি?”
মৃত্তিকা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“মামলা? মামলা করে কী হবে? আজ মামলা করব, কাল ও পুলিশকে টাকা খাইয়ে মামলা তুলে নিবে। তুই ওদের চিনিস না আপা।”
মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এবার বুঝতে পারছিস ওই ছেলে তোর চোখে কেমন ধুলা দিয়ে রেখেছিল?”
মৃত্তিকা মলিন মুখে বলল,
“বুঝতে পারছি, এখন আর বুঝেই কী হবে? যা হওয়ার ছিল, তা তো হয়েই গেছে। এখন কী করা যায় বল তো?”
মৃন্ময়ী ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। সমাধান তো একটা বের করতেই হবে। সমাধানের কথা ভাবতেই তার প্রথমে মাথায় এল প্রভাতের নাম। ব্যাপারটা প্রভাতকে জানালে কেমন হয়? প্রভাত হয়তো কিছু একটা করতে পারবে। আবার প্রভাতের কাছে সাহায্য চাইতেও কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। এদিকে তার মনের কথা মৃত্তিকা মুখেই বলে ফেলল। তার-ও প্রভাতের কথা-ই মাথায় এসেছে। সে বলে উঠল,
“প্রভাত ভাইকে বললে কেমন হয় আপা? উনি কিছু বললে হয়তো ভয় পাবে। তুই ওনাকে একবার বলে দেখবি?”
মৃন্ময়ী চিন্তিত মুখে বলল,
“আমি বলব?”
মৃত্তিকা অনুরোধ করে বলল,
“বল না আপা। তুই বললে উনি নিশ্চিত সাহায্য করবে।”
মৃন্ময়ী ভারী বিপাকে পড়ে গেল। এছাড়া আর কোনো উপায়ও তার মাথায় এল না। মৃত্তিকাকে সে আশ্বাস দিলো প্রভাতকে বলবে। পরদিন প্রভাতের সামনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার কেবল চিন্তা-ই হয়েছে। শেষমেশ প্রভাতের কাছে তাকে সাহায্য চাইতে হবে। প্রভাত মনে-মনে তার ওপর না হাসলেই হয়। প্রভাতকে কীভাবে বলবে তা নিয়ে সে চিন্তা করলেও, প্রভাত নিজেই তার জন্য ব্যাপারটা সহজ করে দিলো। প্রভাত তার মুখের অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে বসল,
“তুমি কি কোনো দুশ্চিন্তায় আছো? কদিন ধরে দেখছি একটু বেশি চুপচাপ হয়ে গেছো।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ওই, সমস্যা একটু চলছে।”
প্রভাত আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল,
“কী সমস্যা চলছে?”
“মৃত্তিকাকে নিয়ে সমস্যা।”
“মৃত্তিকা আবার কী করল?”
“কিছু করেনি, মৃত্তিকার-ই সমস্যা। ও যাকে বিয়ে করেছিল, ওই ছেলেটা ওকে খুব জ্বালাতন করছে।”
“ওই শফিক? কী করেছে ও?”
মৃন্ময়ী মৃত্তিকার ব্যাপারটা খুলে বলল। মনোযোগ দিয়ে সব শুনে প্রভাত বলল,
“ওই বাটপার এত বাড় বেড়েছে, তা তুমি আমাকে আগে জানাবে না?”
“আমি একদিনের কথাই জানতাম। রোজ যে বিরক্ত করে তা তো মৃত্তিকা আমাদের জানায়নি।”
“আচ্ছা, আমি আজই দেখব ব্যাপারটা। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না।”
মৃন্ময়ী কেবল মাথা দোলাল। প্রভাত তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আবারও তোমার মাথায় এক দুশ্চিন্তা ঢুকে গেল, না?”
মৃন্ময়ী বলল,
“দুশ্চিন্তার সাথেই তো আমার আজন্মের ভাব।”
“চা খাবে? চলো, বসে একটু চা খাও, ভালো লাগবে।”
“নাহ্, বাড়ি ফিরতে দেরী হবে। রাত বাড়লে মা চিন্তা করবে।”
“চা খেতে আর কতক্ষণ লাগবে। আমি তো আছি, পৌঁছে দিয়ে আসব। চলো।”
কেমন আশ্বাস দিয়ে কথাটা বলল প্রভাত। মৃন্ময়ী রাজি হতে চাইছিল না। প্রভাত বেশ কয়েকবার বলার পর আর সে তার কথা ফেলতেও পারল না। দুজন চলে গেল চা খেতে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মৃন্ময়ীর থেকে একহাত দূরে বসল প্রভাত। মৃন্ময়ী কোনো কথা বলছে না। তার নীরব দৃষ্টি চায়ের কাপেই নিবদ্ধ। প্রভাত নিজেই তাকে ডাকল,
“মৃন্ময়ী?”
“হুঁ?” দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে সাড়া দিলো মৃন্ময়ী।
প্রভাত বলল,
“চলো না এই দূরত্বটুকু কমিয়ে নিই। তোমার মন কি চায় না তোমারও একটা দুঃখ বিসর্জনের জায়গা হোক?”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার কোনো দুঃখ নেই।”
“কাকে কী বুঝাচ্ছ তুমি?”
“আমি জানি তুমি কী বলতে চাইছো। সুখ সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া যায়। দুঃখ কোনোদিন ভাগ করে নেওয়া যায় না প্রভাত। যার দুঃখ সে-ই টের পায়, সে-ই বোঝে। মুখে বললেও আমরা কেউ কারোর দুঃখ অনুভব করতে পারি না।”
প্রভাত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি পারব। তুমি আমার হলে আমি সব পারব।”
মৃন্ময়ী দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, কেউ কোনোদিন কারোর জায়গায় দাঁড়াতে পারে না।”
“আমি জানি আমি তোমার জায়গায় দাঁড়াতে পারব না, কিন্তু পাশে তো দাঁড়াতে পারব। আমি শুধু তোমার পাশে দাঁড়িয়ে তোমার হাতটা ধরতে চাই। যেদিন সেই মুহুর্তটা আসবে, সেদিন তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারবে মৃন্ময়ী। এখন হয়তো তোমার কাছে অসম্ভব ব্যাপার-ই মনে হবে।”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“এত কনফিডেন্স তুমি কোত্থেকে পাও বলো তো?”
প্রভাত মুচকি হেসে বলল,
“ভালোবাসা থেকে। তুমি তো আমাকে ভালবাসো না, তাই এখন বুঝতে পারছো না। যখন ভালোবাসবে, তখন বুঝবে।”
পরক্ষণেই আবার প্রভাত বলল,
“তোমাকে আমি একটা চমৎকার বুদ্ধি দিতে পারি।”
“কী বুদ্ধি?”
“তুমি চাইলে আমার মুখের কথার প্রমাণ লিখিতভাবে রেখে দিতে পারো। আমি কথা রাখতে না পারলে কঠিন শাস্তির কথা-ও উল্লেখ করতে পারো। আমি নির্দ্বিধায় তোমার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হব।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“তোমার মাথা পুরো গেছে।”
“উঁহু, আমার মাথা একদম ঠিকঠাক আছে। মজা ভেবো না, আমি সত্যি বলছি। তুমি চাইলে আমি তোমার সাথে এমন চুক্তি করতেও রাজি আছি। তবু যদি তুমি আমাকে বিশ্বাস করো, তাতে ক্ষতি কী?”
মৃন্ময়ী প্রশ্ন করল,
“আমি কি তোমাকে অবিশ্বাস করি?”
“করো না?”
“তাহলে এখন তোমার সাথে বসে চা খেতাম?”
প্রভাত বলে উঠল,
“তারমানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো। কিন্তু বিয়ের ভয়ে স্বীকার করো না, তাই তো?”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল,
“তা কখন বললাম আমি?”
প্রভাত হাসিমুখে বলল,
“তোমাকে বলতে হবে না, আমি এমনিতেই বুঝতে পারি। চিন্তা কোরো না, বিয়ে আমি তোমাকেই করব। তুমি আমাকে অপেক্ষা করালেও আমি এই অপেক্ষার আয়তন কমিয়ে নেব। এবার বিয়ের চেষ্টায় আমাকে নামতেই হবে। আচ্ছা, বিয়েতে তুমি কোন রংয়ের শাড়ি পরতে চাও বলো তো?”
মৃন্ময়ী বলল,
“পাগলের মতো বিলাপ না করে ওঠো। আমি এখানে সারারাত বসে তোমার বিলাপ শুনতে পারব না।”
প্রভাত হেসে বলল,
“পারবে, পারবে। আজ না পারলেও খুব শীঘ্রই পারবে। এবার না হয় তুমি একটুখানি অপেক্ষা করো।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৯

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৯.
এই পর্যন্ত প্রভাত অনেকবার মৃন্ময়ীকে সুন্দর কিছু উপহার দিবে ভেবে-ও দেওয়া হয়নি। সে জানে মৃন্ময়ী নিবে না। একবার অনলাইনে একটা শাড়ি প্রভাতের খুব পছন্দ হয়েছিল। তার ভীষণ ইচ্ছা হয়েছিল মৃন্ময়ীকে যদি এই শাড়িতে দেখতে পারত। মনের ইচ্ছা পূরণের আশায় শাড়ি বিক্রির পেইজ থেকে সে মৃন্ময়ীকে শাড়ি উপহার পাওয়ার বার্তা পাঠিয়েছিল। মৃন্ময়ী তার নাম শুনেই বারণ করে দিয়েছে। এরপর সে নিজে মৃন্ময়ীকে খুব অনুরোধ করেছিল যেন সে শাড়িটা নেয়। কিন্তু মৃন্ময়ী কোনোভাবেই রাজি করানো যায়নি। সেই থেকে সে মৃন্ময়ীকে উপহার দেওয়ার ইচ্ছা মনের মধ্যেই চাপা দিয়ে রাখে। অনেকদিন পর এবার আবার তার মনের চাপা ইচ্ছাটা হুট করেই জেগে উঠেছে। তা-ও তার বন্ধুর বউয়ের ফেসবুক পোস্ট দেখে। বন্ধু তার বউকে দারুণ একটা গহনার সেট গিফট করেছে। সেসব নিয়ে তার বউ ভীষণ খুশি হয়ে স্বামীকে ট্যাগ করে ফেসবুকে পোস্ট করেছে। স্বামীকে নিয়ে খুব আবেগপূর্ণ অনুভূতি প্রকাশ করেছে সে। সেই পোস্ট চোখে পড়ে যাওয়ার পর থেকেই প্রভাতের মন আঁকুপাঁকু করছিল। মৃন্ময়ীর সঙ্গে তার এমন সুন্দর মুহূর্ত কবে আসবে জানে না সে। তবু তার ভীষণ ইচ্ছা এমন কিছু মুহূর্ত তার জীবনে-ও আসুক। মৃন্ময়ী-ও তার ভালোবাসায় মুড়ানো উপহার সানন্দে গ্রহণ করুক। ভীষণ আবেগপূর্ণ অনুভূতি প্রকাশ না করুক, অন্তত সে উপহার পেয়ে একটুখানি হাসুক। এর বেশি কিছু প্রভাত আশা করে না। মনের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করে প্রভাত সেই গহনার সেট কিনেছে। আজ সেটা মৃন্ময়ীকে দেওয়ার জন্য নিয়ে-ও এসেছে। অধীর আগ্রহে সে মৃন্ময়ীর কোচিং থেকে বেরোনোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। মৃন্ময়ী কোচিং থেকে বেরোতেই সে হাসিমুখে এগিয়ে গেল। মৃন্ময়ী তাকে পাশ কা’টাতে গিয়েও আবার ফিরে তাকাল। সূক্ষ্ম চোখে প্রভাতের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“তুমি কি অসুস্থ?”
প্রভাত মাথা নেড়ে বলল,
“নাহ্। আজ অফিসে কাজের চাপ ছিল। মাথাটা একটু ধরেছে।”
“একটু ধরেছে? তোমার চোখ-মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে জ্বর-টর এসে গেছে।”
প্রভাত ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“তুমি কি আমার জন্য দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছো?”
মৃন্ময়ী হাঁটা দিয়ে বলল,
“কে তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছে? আমার কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? অসুস্থ মনে হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করেছি।”
প্রভাত তার পিছু নিয়ে বলল,
“আহা! লজ্জা পাওয়ার কী আছে? আমার জ্বর আসছে মনে হলে তুমি কপালে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারো। আমার স্বাস্থ্যের জন্য তুমি ছাড়া আর কে দুশ্চিন্তা করবে বলো?”
মৃন্ময়ী বিড়বিড় করে বলল,
“আমার বয়ে গেছে তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করতে।”
প্রভাত মিটমিট করে হাসছে। আজ অফিস শেষ হওয়ার আগে থেকেই মাথাটা ব্যথা করছে। সে টের পাচ্ছে চোখ দুটো একটু জ্বলছে। জ্বর এলেও আসতে পারে। যদিও এই মুহূর্তে সে অসুস্থতা নিয়ে মোটেও চিন্তিত না। এসব ছোটোখাটো অসুস্থতা সয়ে নেওয়ার অভ্যাস তার খুব আছে। প্রভাত বলল,
“আহা! নিজের মানুষকে নিয়ে সবাই-ই একটু-আধটু চিন্তা করে। এটা খুবই ভালো ব্যাপার। এতে লজ্জার কিছু নেই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“চুপ থাকো তো।”
“আচ্ছা, চুপ করলাম। এবার এটা নাও তো,” গহনার প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে বলল প্রভাত।
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করল,
“এটা কী?”
“নিয়ে দেখো।”
“না জেনে কী নিব?”
“যা-ই‌ হোক, তোমার জন্যই আনা। নাও।”
“লাগবে না আমার।”
“না দেখেই বলছো লাগবে না?”
“তো বলছো না কেন?”
“আগে নাও, নিজেই খুলে দেখতে পাবে,” প্যাকেটটা মৃন্ময়ীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল প্রভাত।
মৃন্ময়ী বলে উঠল,
“আমি তোমাকে আমার জন্য কিছু আনতে বারণ করেছিলাম না?”
“সে তো আমার সব কাজেই তোমার বারণ। একবার অন্তত বারণ ভাঙতে দাও।”
“না-না, ফেরত নাও এটা। আমার কিছু চাই না।”
“তুমি না চাইলেও আমি তোমাকে এটা দিতে চাই। কারণ এটা শুধু এবং শুধুমাত্রই তোমার জন্য আনা।”

মৃন্ময়ী কিছুতেই প্রভাতের দেওয়া জিনিস নিবে না। প্রভাত-ও ফেরত নিতে নারাজ। মৃন্ময়ী পড়ে গেল বিপাকে। প্রভাতের জোরাজুরিতে শেষমেশ সে রাস্তায় দাঁড়িয়েই প্যাকেট খুলল ভেতরে কী আছে দেখার জন্য। গহনাগুলো এত দারুণ যে মেয়েরা দেখলে তাদের পছন্দ হবেই। অথচ মৃন্ময়ীর মুখের অভিব্যক্তি প্রভাত বুঝতে পারল না। অবশ্য সে জানে তার দেওয়া উপহারে মৃন্ময়ীর আনন্দ দেখার আশা রাখা-ও তার জন্য একপ্রকার বোকামি। এই মেয়ে কখনোই মনের অনুভূতি প্রকাশ করবে না, আনন্দিত হলেও না। তবু প্রভাত ভীষণ উৎসুক হয়ে মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ী গহনাগুলো হাতে নিয়ে দেখল। এসবের দাম মোটেও কম নয়। অন্তত তার হাতের নাগালের দাম তো নয়-ই। মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“আমি তোমার এই উপহার নিতে পারব না প্রভাত। এসব তুমি ফিরিয়ে নাও।”
মৃন্ময়ী প্রভাতের হাতে প্যাকেটটা ফেরত দিতে চাইল। কিন্তু প্রভাত তার দুহাত পেছনে লুকিয়ে ফেলল। শুধাল,
“কেন নিতে পারবে না? আমি দিয়েছি বলে?”
“হ্যাঁ, ধরে নাও তা-ই।”
“মৃন্ময়ী, আমি এটা অনেক শখ করে তোমার জন্য কিনেছি।”
“কেন কিনেছ? আমি তো বলিনি আমার এসব চাই।”
“আমার মনে হয়েছে এটাতে তোমাকে খুব মানাবে, তাই কিনেছি।”
“তুমি ভুল করেছ। দেখো, আমি তোমার এমন কেউ নই যে, কোনো জিনিস দেখলেই তুই চট করে আমার জন্য কিনে নিয়ে আসবে, আর আমিও খুশিমনে তা নিয়ে নিব। তুমি বলতে পারো আমি এসব কেন নিব?”
প্রভাত অনুরোধের সুরে বলল,
“এভাবে আপত্তি কোরো না প্লিজ। তুমি বারণ করার পর থেকে আমি যখন-তখন তোমার জন্য কিছু কিনেছি, বলো? কিনিনি, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি তোমার আপত্তির কথা ভেবে কিছু কিনিনি। কিন্তু এবার আমি তোমাকে এটা না দিয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না, তাই কিনেছি। এটা গ্রহণ করো প্লিজ। এরপর আর কিছু কিনব না, দেখো। শুধু এটা ফিরিয়ে দিয়ো না। প্লিজ মৃন্ময়ী।”
মৃন্ময়ী নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল,
“আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে যা উপহার দিয়েছ, আমি নিয়েছি। তোমার খারাপ লাগবে ভেবে ফিরিয়ে দিইনি। তাই বলে তো তোমার অনুরোধ আমি সবসময় রাখতে পারি না প্রভাত। তুমিই বলো আমি তোমার টাকায় কেনা জিনিস কেন নিব? তুমিই বা কেন আমার পেছনে টাকা খরচ করবে?”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। কত টাকা খরচ করেছি, এটা না দেখে ভালোবাসাটা দেখো।”
“এটা তো আরও বড়ো সমস্যা। আমি যা দেখতে চাই না, তুমি আমাকে তা-ই দেখাতে চাও। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি না। আমাদের সম্পর্কটা-ও একদমই তেমন না।”
“আমি কিছু জানি না। আমি তোমার জন্য এটা এনেছি মানে এটা তোমাকেই নিতে হবে।”
“সবসময় সবকিছুতে জেদ চলে না প্রভাত। এইটুকু বুঝতে শেখো। আমি এসব কোনোভাবেই নিব না। তোমার অনুরোধ-ও আজ আমি রাখব না। প্লিজ তুমি এটা ফিরিয়ে নাও, ধরো।”

প্রভাত কিছুতেই হাত সামনে আনতে চাইল না। মৃন্ময়ী তার একহাত টেনে নিয়ে প্যাকেটটা জোর করে ফেরত দিয়েই ছাড়ল। প্রভাতের কোনো অনুরোধ-ই কাজে আসবে না বুঝতে পেরে সে অন্ধকার মুখে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি এটা নিবেই না?”
মৃন্ময়ী উত্তর দিলো,
“না।”
“সিরিয়াসলি বলছো?”
“অবশ্যই।”
প্রভাত পুনরায় বলল,
“তুমি না নিলে আমি কিন্তু অন্য কাউকে এটা দিবো না। শেষবারের মতো ভেবে দেখো।”
“ভাবাভাবির কিছু নেই। তুমি আর কখনও আমার জন্য কিছু কিনবে না, এটাই শেষ কথা।”
“আচ্ছা।”
সম্মতি জানিয়েই প্রভাত ডানে-বায়ে না তাকিয়ে, কোনোরকম দ্বিধা না করে প্যাকেটটা ছুঁড়ে মা’রল। প্যাকেটটা সোজা গিয়ে টুপ করে পড়ল রাস্তার ধারের দিঘির জলে। মৃন্ময়ী খনিকের জন্য হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রভাত এমন কাণ্ড করবে ভাবেনি সে। সচরাচর প্রভাত তার সঙ্গে রাগ দেখায় না। বাইরের মানুষের মুখে শোনা যায় প্রভাত যেমন বেপরোয়া, তেমনি রাগী। কিন্তু মৃন্ময়ী তার আচরণে এখনও তেমন কিছুই দেখেনি। মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলে উঠল,
“এটা কী করলে তুমি?”
“কাজে লাগবে না, তাই ফেলে দিলাম।”
“কেন ফেললে? আমি নিব না বলেই তুমি কেনা জিনিস এভাবে ফেলে দিবে?”
“অনলাইন থেকে কিনেছি। ফেরত নিবে না। ঘরে তো আমার বউ নেই যে ব্যবহার করবে। ফেলে রেখে কী হবে?”
“তো তুমি পানিতে কেন ফেললে? কেউ নেই বলেই তুমি টাকায় কেনা জিনিস ফেলে দিবে? আজব!”
“অপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখার জায়গা নেই আমার ঘরে। বাদ দাও। চলো, তোমার দেরী হচ্ছে।”
“আরে! এটা কেমন কথা? এত জেদি হলে এসব কাজ করো কেন? আশ্চর্য!”

রোজ প্রভাত মৃন্ময়ীর সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটে। আজ প্রভাত তার আগেই হাঁটা দিয়েছে। মৃন্ময়ী হা-হুতাশ করতে-করতে তার পেছনে হাঁটছে। অথচ প্রভাত এমন ভাব করছে যেন টাকায় কেনা জিনিস হারিয়ে তার একটুও খারাপ লাগছে না। সে কেবল একবার বলল,
“আফসোস বন্ধ করো। আমি তোমার সাথে রাগ করতে চাই না।”
“তোমার খারাপ লাগছে না?”
“না। পাথরের পেছনে ঘুরে-ঘুরে আমিও পাথর হয়ে গেছি। এখন আর কিছুতেই খারাপ লাগে না। আমি জানি অপেক্ষা ছাড়া আমার জন্য সবকিছু নিষিদ্ধ।”
আজ রাতের জন্য প্রভাতের এই কথাটা মৃন্ময়ীর মনে গেঁথে গেল। বাসায় ফিরেও সে এই কথাটা ভুলতে পারল না। প্রভাতের ভীষণ স্বাভাবিক অথচ অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখটা-ও সে মন থেকে সরাতে পারল না। মৃন্ময়ী ভেবে পায় না এমন বেপরোয়া একটা ছেলে এত ধৈর্য কীভাবে রাখে। এ তো তার চেয়েও বেশি ধৈর্যশীল। মৃন্ময়ী একবার ভাবল জিনিসটা নিলে আর সেটা এভাবে জলে যেত না। আবার ভাবল সে কেন নিবে? সে তো এসব করতে সবসময়ই বারণ করে। প্রভাত নিজেই তার বারণ শোনে না।


এই নিয়ে জাহিদ দশবার মৃদুলাকে কল করেছে। আগামীকাল মৃদুলার ইংরেজি পরীক্ষা। ইংরেজি পড়তে-পড়তে তার মাথার খুলি খুলে পড়ার অবস্থা। ইচ্ছা করেই মৃদুলা মোবাইল ফোন সাইলেন্ট করে ফেলে রেখেছে। জাহিদের বদঅভ্যাস তার জানা আছে। বারণ করলেও এই ছেলে শখানেক ফোন করবে। তারপর আবার নিজেই মেয়েদের মতো অভিমান করবে। গাল ফুলিয়ে বলবে, ‘এই তোমার ভালোবাসা?’ এমনই এক অদ্ভুত প্রজাতির প্রেমিক ছুটেছে তার কপালে। পড়ার মাঝে মৃদুলা কিছু সময়ের বিরতিতে ফোনটা হাতে নিতেই তার অদ্ভুত প্রজাতির প্রেমিকের বিশটা কল দেখতে পেল। পরপরই আবার কল এলে মৃদুলা রিসিভ করল। জাহিদ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
“এতগুলো কল করলাম, পাত্তাই দিলে না।”
মৃদুলা বলল,
“আপনাকে না আমার পড়ার সময় কল করতে বারণ করেছি? তবু করেছেন কেন? আবার বলছেন আমি পাত্তা দিইনি?”
“কী করব বলো? তুমি কল দিতে বারণ করলে তো আমি সেদিন তোমাকে আরও বেশি-বেশি মিস করি। তাই কল না করে থাকতে পারি না। তুমি তো আর আমাকে মিস করো না, তাই তোমার কষ্ট-ও হয় না আমাকে ছাড়া।”
“কাল আমার ইংরেজি পরীক্ষা। আপনার আজাইরা আলাপ শোনার সময় নেই।”
“দেখেছ, বলেছি না তুমি আমাকে একটুও মিস করো না?”
“আপনি একদম ঠিক বলেছেন। আপাতত আমি আপনাকে মিস করছি না। কারণ আপনাকে মিস করলে আমার কোনো কাজে আসবে না। আমি মিস করছি আমার ইংলিশ টিচারকে।”
জাহিদ অভিমানী সুরে বলল,
“তুমি আমাকে মিস করো না মেনে নিয়েছি। তাই বলে তুমি অন্য এক পুরুষকে মিস করবে? তুমি না বলো তুমি আমাকে ভালবাসো? এই তোমার ভালোবাসা মৃদুলা?”
“হ্যাঁ, আমার ভালোবাসা একটু অদ্ভুত। কারণ আমার যে একজন পুরুষ আছে, সে তার চেয়েও বেশি অদ্ভুত। এখন ফোন রাখুন। আমার অনেক পড়া বাকি।”
“শোনো না একটু।”
“বলুন।”
“আই লাভ ইউ।”
“আচ্ছা।”
মৃদুলার সঠিক উত্তর না পেয়ে জাহিদ পুনরায় বলল,
“আই মিস ইউ।”
“আচ্ছা।”
“তুমি আমাকে মিস করছো না?”
“না।”
“ঠিক আছে, তুমি তোমার ইংলিশ টিচারকেই মিস করো। তোমার ইংলিশ টিচারের মাথায় খুব দ্রুতই টাক হবে, দেখো। তখন টাকমাথা লোককে তুমি মিস করো কি না দেখব।”
মৃদুলা ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বলল,
“কিন্তু আমার ইংলিশ টিচার তো অলরেডি টাকমাথা।”
জাহিদ ব্যথিত গলায় বলল,
“তুমি আমাকে এভাবে ছ্যাঁকা দিতে পারো না জান।”
“হয়েছে, এখন আপনার নাটক বন্ধ করুন। আমি পরীক্ষায় ফেল করলে কিন্তু সব দোষ আপনার।”
“তুমি ফেল করলে তো বিয়ে করে সংসার সাজিয়ে ফেলতাম। কিন্তু তুমি তো ফেল করা পাবলিক-ই না।”
মৃদুলা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আপনি মনে-মনে চান আমি যেন ফেল করি?”
“আরে নাহ্! আমি তোমার খারাপ চাইতে পারি? পড়া শেষ করে কিন্তু আমাকে অবশ্যই নক করবে।”
“আচ্ছা, এখন রাখছি।”
জাহিদ বলে উঠল,
“আরেকটা কথা শোনো।”
“আবার কী?”
“তোমার আপার সাথে কি প্রভাত ভাইয়ের কোনো সমস্যা হয়েছে? কিছু জানো?”
“না তো। কেন, কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে তা তো আমিও ঠিক জানি না। প্রভাত ভাইয়ের খুব মন খারাপ দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, তা-ও কিছু বলল না। আড্ডা দিতে-ও রাজি হলো না, বাড়ি চলে গেল। আমার মনে হলো যে তোমার আপার সাথে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“ও, আচ্ছা আমি আপার সাথে কথা বলে দেখব।”
“আরে, তোমার জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমার ধারণা তো ভুল-ও হতে পারে।”
“আমি আপনার মতো গাধা না কি এসব কথা আপাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করব?”
“তাহলে?”
“ওসব আপনি বুঝবেন না। রাখছি, পরে কথা হবে।”

ফোন রেখে পুনরায় পড়তে বসে-ও মৃদুলার মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। সত্যিই কি আপার সাথে প্রভাত ভাইয়ের কোনো সমস্যা হয়েছে? প্রভাত ভাইয়ের মন খারাপ হলে আপার মন কেমন? একবার তো গিয়ে দেখতে হয়। বই-খাতা বন্ধ করে রেখে মৃদুলা চলল আপার কাছে। মৃন্ময়ী বিছানা ঠিক করছিল ঘুমানোর জন্য। মৃদুলা তার ঘরে উঁকি মে’রে মুখোভাব দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু সে মৃন্ময়ীর চোখে পড়ে গেল। মৃন্ময়ী জিজ্ঞেস করল,
“কী-রে মৃদুলা? পড়া রেখে এখানে কী করছিস?”
মৃদুলা হেসে বলল,
“এমনিতেই এসেছি। তুমি কী করছো?”
“ঘুমাব, তোর পড়া শেষ?”
“না, এখনও বাকি আছে। একটানা পড়ে মাথা ধরে গেছে, তাই হাঁটছি।”
“চা খাবি?”
“চা দুবার খেয়ে ফেলেছি। এতবার চা খেতে ভালো লাগে না।”
“ভেতরে আয়।”
“না, চলে যাচ্ছি। তোমার মন খারাপ কেন আপা?”
মৃন্ময়ী যেন চমকে উঠল। মৃদুলা কীভাবে বুঝল তার মন খারাপ? ধরা না দিয়ে সে পালটা প্রশ্ন করল,
“কে বলল আমার মন খারাপ?”
“তুমি কথা বলার সময় আমার মনে হলো তোমার মনটা একটু খারাপ। কী হয়েছে আপা?”
“আরে না, আমার মন ঠিক আছে।”
“কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো। আমি তোমাকে উত্তম সমাধান দিয়ে দিবো।”
মৃন্ময়ী হাসার চেষ্টা করে বলল,
“তোর পাকামি করতে হবে না। আমার মন ভালো আছে। তুই পড়তে যা।”
“ঠিক আছে। তুমি বলতে না চাইলে বোলো না। তবে কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে মন খারাপ না করে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি চললাম।”

মৃদুলা চলে গেল। মৃন্ময়ী বড়ো একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। মাঝে-মাঝে তার মনে হয় মৃদুলা তার মন পড়তে জানে। এই মেয়েটার সামনে মনোভাব লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। প্রভাতের কথাটা আবারও তার মনে পড়ে গেল। এই ছেলেটা কবে তাকে শান্তি দিবে? কী করবে সে একে নিয়ে? তার দৈনন্দিন জীবনে এমনিতেই সমস্যার শেষ নেই। উঠতে-বসতে তাকে যুদ্ধ করে চলতে হয়। তার সঙ্গে জুটল প্রভাতের জেদ। মৃন্ময়ী না পারে যাকে ফেলতে, না পারে গিলতে। কাঁটার মতো গলায় বিঁধে থেকে আরও যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে। কিসের আশায় অপেক্ষা করছে প্রভাত? এই অপেক্ষার সুফল তাকে কীভাবে দিবে মৃন্ময়ী? সংসার জীবনে পা রাখার সাহস কি মৃন্ময়ীর আদৌ হবে? পৃথিবীটা এত জটিল কেন তার জন্য?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৮

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৮.
পাঠাগারের কাজটা মৃত্তিকা খুব উপভোগ করছে। কোনো চাপ নেই, তাড়া নেই। সারাদিন বসে শান্তিতে কাজ করা যায়। অবসরে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে বই পড়ে, তখন তাদের সঙ্গে একটু আলাপ হয় তার। কোন-কোন শিক্ষার্থী বই নিয়ে যায় তাদের নাম ভালোভাবে তালিকা করে রাখে সে। তারা আবার সময়মতো বই ফেরত দিয়ে যায়। এছাড়া অঢেল সময় তার হাতে পড়ে থাকে। মৃত্তিকা তখন সেলফ থেকে বই বেছে নিয়ে পড়তে বসে। বই পড়ার অভ্যাস তার কোনোকালেই ছিল না। পাঠাগারের দায়িত্ব হাতে পাওয়ার পর অভ্যাসটা নতুন হয়েছে। সময় কা’টানোর জন্যই সে বই পড়া শুরু করেছে। ধীরে-ধীরে এখন সেটা অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। ব্যাপারটা তার কাছে মন্দ লাগছে না। সুযোগ পেলে আবার সে আশপাশে-ও ঘুরে আসে। স্কুলের সবাই তাকে খুব সম্মান করে। ছাত্র-ছাত্রীরা এমনভাবে ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকে যে তার মনে হয় সে শিক্ষকতা করছে। আজকাল মৃত্তিকার নিজেকে খুব মূল্যবান মনে হয়। সত্যিই মানুষ নিজেকে ভালোবাসলে নিজের মূল্য বুঝতে পারে। নিজের জন্য চেষ্টা করলে সফল হতে পারে। মৃত্তিকা-ও সফল হবে। চেষ্টা সে ছাড়বে না। সারাদিন স্কুলে থাকার ফলে আজকাল আর মায়ের আহাজারি-ও তাকে শুনতে হয় না। এটা তার অনেক বড়ো স্বস্তি। সে চায় না কোনোভাবেই তার ক্ষত কাঁচা হোক। দাঁতের নিচে ধৈর্য চেপে সে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছে। কে জানত নিয়তি তার জন্য এতটাও সহজ হবে না?
কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর থেকে মৃত্তিকার সময়গুলো বেশ ভালো কা’টলেও, হুট করেই ভালো সময়গুলো পড়ে গেল শঙ্কার মুখে। মৃত্তিকা প্রেগন্যান্ট। প্রথম থেকেই খবরটা সে জানত। কিন্তু ভয়ে কাউকে জানায়নি। স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। কেউই হয়তো চাইবে না বাবা ছাড়া তার সন্তান পৃথিবীতে আসুক। কিন্তু সে তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চায়। নিজের ভুলের জন্য সে একটা নিষ্পাপ প্রাণকে কষ্ট দিতে চায় না। বাবা নেই তো কী হয়েছে? সে-ই নিবে তার সন্তানের দায়িত্ব। এ কারণেই সে এতদিন মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু এসব ব্যাপার তো আর সবসময়ের জন্য চাপা দিয়ে রাখা যায় না। আজ হঠাৎ মৃত্তিকার শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। মৃন্ময়ী তাকে একপ্রকার জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। তখন সে বাধ্য হয়ে সত্যিটা স্বীকার করে নেয়। খবরটা শুনে হতে নতুন করে সাজেদা বেগমের আহাজারি শুরু হয়েছে। কেঁদেকেটে একাকার করেছেন তিনি। এই ভয়েই মৃত্তিকা এ কদিন মায়ের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থেকেছে। বলা তো যায় না, কখন কোন লক্ষণ মায়ের চোখে পড়ে যায়। সাজেদা বেগমের আহাজারি মৃত্তিকা শুনেও না শোনার ভান করে থাকে। তার মনে কেবল একটাই ভয় দানা বেঁধে আছে, মা যদি বাচ্চাটার জন্ম না চায়। যদিও সাজেদা বেগম এমন কিছু স্পষ্ট করে বলেননি। তবু তার কথাবার্তায় মৃত্তিকার এমনটাই মনে হচ্ছে। পরদিন মৃন্ময়ীর স্কুল ছুটির আগে-আগে মৃত্তিকা তার স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মৃত্তিকা স্কুল থেকে বেরিয়ে আজ প্রভাতের জায়গায় দেখতে পেল বোনকে। মৃত্তিকাকে তার স্কুলের সামনে দেখে সে অবাকই হলো। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মৃত্তিকা, তুই এখানে কেন?”
মৃত্তিকা বলল,
“তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
“তুই স্কুলে ছিলি না?”
“প্রিন্সিপাল স্যারকে বলে ছুটির আগে বেরিয়ে এসেছি।”
“কেন?”
“এমনি, চল আজ একসঙ্গে বাড়ি যাই।”
“আমার সঙ্গে বাড়ি ফেরার জন্য তুই উলটা পথে এসে দাঁড়িয়ে ছিলি? না কি অন্য কোনো প্রয়োজন আছে?”
“আহা! চল না। হাঁটতে-হাঁটতে কথা বলি।”
“দাঁড়া, গাড়ি নিই।”
মৃত্তিকা বাঁধা দিয়ে বলল,
“গাড়িতে যাব না। হেঁটে যাব, চল।”
“তোর হাঁটতে কষ্ট হবে না?”
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“আরে না। এখন আমি ঠিক আছি। আমার হাঁটতে কষ্ট হয় না। চল তুই।”
“আচ্ছা চল তাহলে। কষ্ট হলে বলিস কিন্তু।”
“আচ্ছা-আচ্ছা।”

মৃন্ময়ী প্রভাতের সন্ধানে চারপাশে চোখ বুলাতেই দেখল প্রভাত আজ ভদ্র ছেলের মতো দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্তিকাকে দেখেই হয়তো তার এই হঠাৎ ভদ্রতা জেগে উঠেছে। সে তাকাতেই প্রভাত হাসিমুখে হাত নাড়ল। মৃন্ময়ী তাকে না দেখার ভান করে মৃত্তিকার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল।
“তোর কাজ কেমন চলছে?”
মৃত্তিকা উত্তর দিলো,
“ভালো।”
“কোনো সমস্যা মনে হয়?”
“নাহ্।”
“মৃদুলা বলল বইয়ের মধ্যে বসে থেকে-থেকে তোর-ও না কি বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে?”
“হুম।”
মৃত্তিকার সংক্ষিপ্ত উত্তর পেয়ে মৃন্ময়ী তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“তুই কি কিছু চিন্তা করছিস?”
মৃত্তিকা কথা বলল না। মৃন্ময়ী পুনরায় প্রশ্ন করল,
“তোর মনে কী চলছে মৃত্তিকা?”
মৃত্তিকা হাত কচলাতে-কচলাতে বলল,
“আপা, আমি অনেককিছুই চিন্তা করছি। তুই কি আমার কিছু কথা শুনবি?”
“শুনব না কেন? বল না। দ্বিধা করিস না।”
“মাকে একটু বলবি আমার বাচ্চাটার ওপর অসন্তুষ্ট না হতে? মা না চাইলেও আমি এই বাচ্চা জন্ম দিবো।”
“তুই কীভাবে বুঝলি মা চায় না? মা কি তোকে এমন কিছু বলেছে?
“মায়ের কথাবার্তায় আমি বুঝতে পেরেছি। দেখ আপা, আমার জীবনে যা ঘটে গেছে, তাতে তো আমার বাচ্চাটার কোনো দোষ নেই। আমার ভুলের শাস্তি তো আমি ওকে দিতে পারি না। ও ওর বাবাকে না পেলেও, মাকে তো পাবে। ওর বাবা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি ওকে ছাড়ব না। আমি একাই ওর বাবা-মা হয়ে উঠব। আপা, আমার সন্তান আমার কোলে এলে আমি ওর জন্য যা করতে হয় করব। আরও মন দিয়ে কাজ করব। আমি নিজেই তোদের সবচেয়ে বড়ো বোঝা হয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার সন্তানের বোঝা আমি তোদের কারোর মাথায় দিবো না আপা। তুই একটু মাকে বুঝাস। আমার বাচ্চাটা সবে নিষ্পাপ, ছোট্ট একটা প্রাণ। ওর ক্ষতি করার কথা আমি ভাবতেও পারি না।”

মৃত্তিকার চোখ ভর্তি জল। মৃন্ময়ী বলল,
“আমি তোর অনুভূতি বুঝতে পারছি বোন। আমি জানি কোনো মা-ই নিজের সন্তানের ক্ষতি চায় না। আমাদের মা-ও তো একজন মা। তোর কেন মনে হয় সে একজন মা হয়ে তোর সন্তানের ক্ষতি চাইবে? সে-ও তো তোকে জন্ম দিয়েছে। মাকে তুই এত হৃদয়হীন ভাবিস?”
“তোর মনে হয় না মা আমার সন্তানের প্রতি অসন্তুষ্ট?”
“না। মা অসন্তুষ্ট তোর ভাগ্যের ওপর। মা তোর জীবন নিয়ে চিন্তিত। এতদিন শুধু তোর ভবিষ্যতের চিন্তা ছিল, এখন নতুন করে যোগ হয়েছে তোর বাচ্চার চিন্তা।”
মৃত্তিকা প্রশ্ন করল,
“মা আমার বাচ্চার জন্য চিন্তা করে?”
“মৃত্তিকা, আমাদের মা তার স্বামী হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছে। সে-ও জানে বাবা ছাড়া সন্তানদের জীবন কতটা কঠিন হয়। হতে পারে তুই মায়ের থেকে আলাদা। আমরা বড়ো হয়ে বাবাকে হারিয়েছি, আর তোর সন্তান জন্মের আগেই হারিয়েছে। আমাদের ভবিষ্যতের জন্য মা বাইরের জগতে পা রাখতে পারেনি, কিন্তু তুই পারিস। তুই তোর সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার সাহস রাখতে পারিস। তবু সে মা তো। দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। তুই তোর বাচ্চা জন্ম না হতেই তার জন্য এত চিন্তা করছিস। আর মা তো তোকে পেলে-পুষে এত বড়ো করেছে। জীবনটা তোর ভাবনার মতো এত সহজ নয় রে মৃত্তিকা। তবু আমি চাই তুই যেন তোর সন্তান নিয়ে সুন্দর জীবন কা’টাতে পারিস।”
মৃত্তিকা চিন্তিত মুখে বলল,
“আমি কি তবে মাকে ভুল বুঝলাম?”
মৃন্ময়ী হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তুই সবসময়ই মাকে ভুল বুঝিস মৃত্তিকা। দিন-দিন মা তোর চোখে ভিলেন হয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে তুই মায়ের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলিস তো। সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে না থেকে মায়ের কাছাকাছি থাকিস, তার সাথে গল্প করিস। দেখবি মা এতটা-ও কঠিন না। দূর থেকে তাকে কঠিন মনে হলেও তার ভেতরটা খুব নরম।”
মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমি চেষ্টা করব আপা।”
মৃন্ময়ী জানতে চাইল,
“তোর বর কি জানত তুই প্রেগন্যান্ট?”
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু। ও জানবে কীভাবে? আমিই তো জানতে পেরেছি ওই বাড়ি থেকে চলে আসার পর।”
“ও। এমন খবর লুকিয়ে রাখার কোনো দরকার ছিল না। তুই অযথাই মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছিলি।”
“এখন যখন তোরা জানিস, বাইরের মানুষকে জানানোর দরকার নেই। আমি চাই না খবরটা ওর কানে পৌঁছাক। আমার সন্তানের আসার খবর শোনার অধিকার-ও ও হারিয়েছে। বেঁচে থাকলে আমি আমার সন্তানকে ওর মুখ-ও দেখাব না।”
“ঠিক আছে, তোর যা ভালো মনে হয়।”

রাস্তার পাশে কতরকম খাবার বিক্রি হচ্ছে। মৃন্ময়ীর সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে মৃত্তিকার হঠাৎ তাদের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেল। বাবা তাদের দুবোনকে দুই হাতে করে বাজারে নিয়ে আসতেন। যে যা খেতে চাইত তা-ই কিনে দিতেন। মায়ের জন্য-ও কিছু না কিছু কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। বাবা চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেসব সময়গুলো-ও তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এখন আর যখন যা ইচ্ছা তা-ই কিনে খাওয়া হয় না। খেতে ইচ্ছা করলে-ও কাউকে বলা যায় না। তার আগে টাকার কথা ভাবতে হয়। মৃত্তিকা বলে উঠল,
“আপা, চল ফুসকা খাই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ফুসকা খাবি? চল।”
ফুসকার দোকানে তখন ছেলে-মেয়েদের ভিড়। সামনেই একদল ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ফুসকার জন্য। তারা দুবোন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সামনের ছেলেগুলো সরে যাওয়ার। ঠিক তখনই প্রভাত এসে মৃন্ময়ীর পাশে দাঁড়াল। গলা তুলে বলল,
“মামা, তিন প্লেট ফুসকা।”
তার কন্ঠ শুনে সামনের ছেলেগুলো ফিরে তাকিয়ে হাসিমুখে আলাপ জুড়ে দিলো। মৃন্ময়ীর মনে হলো এরা আলাপের চেয়ে বেশি আহ্লাদ করছে। একজন আবার অতিরিক্ত আহ্লাদ দেখিয়ে ফুসকাওয়ালাকে বলে বসল,
“এই মামা, আগে ভাই-ভাবিকে দাও।”
সঙ্গে-সঙ্গে মৃন্ময়ী চোখ বড়ো করে তাকিয়ে বলল,
“কে তোমার ভাবি?”
ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“রাগ করবেন না ভাবি। আপনি ভাইয়ের সাথে সময় কা’টান, আমরা না হয় পরে আসব ফুসকা খেতে।”
“আমি তোমার ভাইয়ের সাথে এসেছি যে সময় কা’টাব? আমরা দুবোন এসেছি, চোখে দেখতে পাওনি? আজাইরা চাটুকারিতা আমার সামনে থেকে সরে করো গিয়ে। আমাদের দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখার সময় নেই।”
তার কথাগুলো যেন ছেলেটার গায়েই লাগল না। বরং সে বাকিদের বলে উঠল,
“এই, ভাবির মাথা গরম হয়ে গেছে। চল, আমরা পরে আসব।”
ছেলেগুলো প্রভাতকে লম্বা সালাম ঠুকে সরে গেল। মৃত্তিকা হা করে তাকিয়ে শুধু কাহিনি দেখছিল। এবার সে মৃন্ময়ীর এক হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“কী-রে আপা? এই প্রভাত ভাই কি এখনও তোর পিছু ছাড়েনি? তুই না মাকে বলেছিলি পিছু ছেড়ে দিয়েছে?”
মৃন্ময়ী উত্তর না দিয়ে তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। কর্মচারী ছেলেটা তিন প্লেট ফুসকা দিয়ে গেল। তারা দুজন বেঞ্চে বসতেই পাশে এসে প্রভাত-ও বসে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্তিকা বলে উঠল,
“আপনি কি আর কোনো জায়গা চোখে দেখছেন না? আপার পাশে বসতে কে ডেকেছে আপনাকে?”
প্রভাত ভ্রুকুটি করে মৃন্ময়ীকে প্রশ্ন করল,
“ম্যাডামের পাশে আর কার বসার কথা?”
মৃন্ময়ীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মৃত্তিকা আবারও বলে উঠল,
“আপনি অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসুন।”
“ফুসকাওয়ালা মামা কি এই বেঞ্চটা ম্যাডামের নামে লিখে দিয়েছে?”
মৃত্তিকা এবার তেতে উঠে বলল,
“আপনি তো আসলেই ঘাড়ত্যাড়া প্রভাত ভাই। এখনও আপনি আপাকে এভাবে জ্বালান? আশ্চর্য! আমি তো ভাবতেই পারছি না আপনি এখনও আপার পেছনে পড়ে আছেন। একটা মানুষ কতক্ষণ একজনের জ্বালাতন সহ্য করতে পারে? বুঝেছি, আমার আপাকে অতিরিক্ত ভদ্র পেয়ে মাথায় উঠে গেছেন, না? এরপর আপনার বাবা আমার সামনে পড়ুক, আমি যদি আপনার এই কুকর্মের কথা না জানিয়েছি তাহলে-”
মৃত্তিকার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রভাত বলে উঠল,
“তাহলে তোমার নাম পালটে মৃত্তিকা থেকে মিষ্টি খা রাখা হবে। ঠিক আছে, আমি রাজি।”
মৃত্তিকা মৃন্ময়ীকে বলল,
“আপা, তুই এতদিন ধরে এই অসহ্য লোকটাকে কীভাবে সহ্য করেছিস? তুই এত ভীতু? ওনার বাবার কাছে নালিশ না জানিয়ে চুপচাপ সহ্য করে নিয়েছিস? কী অদ্ভুত কাণ্ড!”
মৃন্ময়ী বলল,
“আহা! প্লেট হাতে নিয়ে বসে আছিস কেন? চুপ করে খা না।”
“তুই নিজেও কিছু বলছিস না, আমাকেও বলতে দিবি না? এজন্যই তো এই লোক তোকে বোকা পেয়ে সুপারগ্লুর মতো লেগে আছে।”
প্রভাত ফুসকা চিবোতে-চিবোতে গলা তুলে বলল,
“মামা, তোমার ফুসকা খেয়ে আমার শ্যালিকার মাথা গরম হয়ে গেছে। আরেক প্লেট দিয়ো।”
“এই, কে আপনার শ্যালিকা? ফাজলামি পেয়েছেন?”
মৃত্তিকা তেড়ে উঠতে নিতেই মৃন্ময়ী তাকে ধরে বসিয়ে দিলো। বলল,
“তুই কি বাড়ি যাবি না? আগে ফুসকা শেষ কর তো।”
মৃত্তিকা বলল,
“তুই শুনলি না উনি কী বলল? আমি ওনার কোন জন্মের শ্যালিকা হই? ওনার মতো ছেলের সাথে জীবনে আমি আমার বোন বিয়ে দিবো? ফালতু লোক!”
“আচ্ছা হয়েছে। তুই আগে খা, আমি কথা বলছি ওর সাথে।”

মৃন্ময়ী প্রভাতের দিকে তাকাতেই সে হাসি প্রশস্ত করল। মৃন্ময়ী চাপা গলায় বলল,
“দয়া করে মৃত্তিকার সামনে পাগলামি কোরো না। ও গিয়ে বাড়িতে বললে মা আমাকে নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা করবে।”
প্রভাত-ও নিচু স্বরে বলল,
“তারমানে তুমি স্বীকার করছো আমি আসলে তোমার মায়ের দুশ্চিন্তার কারণ হওয়ার মতো মানুষ নই?”
“তুমি কি যাবে এখান থেকে?”
“যাব, আজ শ্যালিকার সাথেই সময় কা’টাও। আমি দুঃখবিলাস করতে-করতে চলে যাই। ফিরে আসা পর্যন্ত ভালো থেকো।”

প্রভাত বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে গেল। সে চলে যাওয়ার পর-ও মৃত্তিকা তাকে বিড়বিড় করে বকে চলল। মৃন্ময়ী বিল দিতে গিয়ে শুনল প্রভাত তাদেরটাসহ বিল দিয়ে দিয়েছে। মৃত্তিকা তাকে বলল,
“এরপর দেখা হলে তুই ওনাকে টাকা দিয়ে দিস। আগে জানলে বিল দিতেই দিতাম না। বিরক্তিকর লোক একটা।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আচ্ছা যাক, দিয়ে যখন চলেই গেছে, তখন তো আর কিছু করার নেই। দেখা হলে টাকা দিয়ে দিবো নে। চল ওঠ।”
মৃদুলা আর মায়ের জন্য-ও ফুসকা কিনে নিয়ে তারা দুজন বাড়ি ফিরেছে। তারা যখন বাড়ি ফিরেছে তখন সাজেদা বেগম নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে ঠেলেঠুলে পাঠাল মাকে ডেকে আনতে। মৃত্তিকা মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল মা শুয়ে আছেন, কিন্তু ঘুমাননি। সে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে ডাকল,
“মা?”
সাজেদা বেগম চোখ তুলে তাকিয়ে মৃত্তিকাকে দেখে শুধালেন,
“কী হয়েছে? মাত্র এলি?”
“হ্যাঁ। আপা-ও এসেছে। আপা ফুসকা এনেছে। এসে খাও।”
“ও আবার ওসব আনতে গেল কেন?”
“আমি আর আপা ফেরার সময় খেয়েছিলাম। তাই তোমার আর মৃদুলার জন্য-ও নিয়ে এসেছে।”
“তোরা একসঙ্গে এসেছিস?”
“হ্যাঁ।”
সাজেদা বেগম শোয়া থেকে উঠে বিছানা থেকে নামতে-নামতে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর শরীরের কী অবস্থা?”
“ভালো।”
“চেকআপ করিয়েছিস?”
“গতমাসে করেছিলাম।”
“এখন আবার করিয়ে নিস। তোদের তো কাজের বিষয়ে কোনো খেয়াল থাকে না। নিজের অযত্ন করে বাচ্চাটার ক্ষতি করবি। ভালো কথা কানে ঢুকলেই হলো।”
মৃত্তিকা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এমনভাবে কথা বলছে যেন সে কেবল বলার জন্যই বলছে। অথচ মৃত্তিকা এই প্রথম টের পেল মায়ের থমথমে কথার আড়ালের যত্ন। সে বলল,
“কাল-পরশু চেকআপ করিয়ে নিব আবার।”
মৃন্ময়ী প্যাকেট থেকে ফুসকা বের করে প্রস্তুত করে রাখছিল। সাজেদা বেগম এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“মৃদুলা এখনও আসেনি?”
“না।”
“ও আবার কখন আসবে? এসব খাবার-দাবার পরে আর ভালো লাগবে?”
“ও এখনই চলে আসবে। নাও, খাও তুমি।”
সাজেদা বেগম চেয়ারে বসে বললেন,
“তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কী করতে? স্কুল থেকে এসেছিস, ক্লান্ত লাগছে না? যা আগে হাত-মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হ।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“আমি যাচ্ছি। তুমি তোমার মেজো মেয়েকে বলো মা। কে নিজের অযত্ন করছে দেখছোই তো।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“করুক অযত্ন। যার-যার সন্তানের সুস্থতার দায়িত্ব তার-তার ওপর। মাথা আরেকজনের, ব্যথা কি হবে আমার?”
সুযোগ পেয়ে মৃন্ময়ী বলে উঠল,
“তোমার ব্যথা হয় না কে বলল? ও-ও তো তোমার সন্তান। মাথাব্যথা তো তোমার-ও আছে মা।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“কথা না বাড়িয়ে হাত-মুখ ধুতে যা।”
মৃন্ময়ী মৃদু হেসে মৃত্তিকাকে ইশারা করে ঘরে চলে গেল। মৃত্তিকা ঘরে যেতে নিয়ে-ও আবার কী ভেবে বলে বসল,
“মা, আজ রাতে খিচুড়ি রান্না করবে?”
সাজেদা বেগম উত্তর দিলেন,
“পেয়াজ নেই। মৃদুলাকে ফোন করে বল আসার সময় নিয়ে আসতে।”
“আচ্ছা।”
মৃত্তিকার কেন জানি হঠাৎ করেই মনটা ভীষণ হালকা লাগতে শুরু করল। মা বুঝি এমনই?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৭

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৭.
টিউশন থেকে বেরিয়ে মৃদুলা পনেরো মিনিট ধরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। পনেরো মিনিটে বোধহয় পনেরোটা গাড়ি তাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আপা যাইবেন? আপা, কই যাইবেন?’ অতিরিক্ত হিসেবে আবার পাশের দোকানদার-ও জিজ্ঞেস করেছে, ‘আপা কি কারো জন্য অপেক্ষা করতাছেন? এমন চরকার মতো ঘুরতাছেন ক্যান?’ মৃদুলা সবার কথার উত্তরেই কেবল দুপাশে মাথা নাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে তার বিরক্তি। জাহিদ এল তার অপেক্ষার সতেরো মিনিটের মাথায়। তা-ও খালি হাতে। মৃদুলা দূর থেকেই দেখতে পেল জাহিদ দৌড়ে তার দিকে আসছে। হাতে ফুল নেই। নিশ্চিতভাবে এখন এসে সামনে দাঁড়িয়েই বলবে, ‘গাড়ি পাইনি, ফুল কেনার সময় ছিল না।’ মৃদুলা রাগ করলেই বলবে, ‘কানে ধরব?’ এই ছেলেটা যে তার প্রেমিক, মাঝে-মাঝে মৃদুলার বিশ্বাস করতে-ও কষ্ট হয়। জাহিদ তার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে ঠিক বলে উঠল,
“সরি জান, অনেক দেরী হয়ে গেল। আসলে গাড়ি পাচ্ছিলাম না। তাই-”
মৃদুলা হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“থাক, এসব জানি আমি। আপনি আগে নিঃশ্বাস ছাড়েন।”
জাহিদ সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মৃদুলা হাতের পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পানি খান।”
বোতলের অর্ধেক অংশ পানি ছিল। জাহিদ ঢকঢক করে পুরোটা পানি গলাধঃকরণ করে ফেলল। তারপর খালি বোতলটা মৃদুলাকে ফেরত দিয়ে বলল,
“উফ্! শান্তি লাগছে। জোরে দৌড়ে এসে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।”
মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“আপনাকে দৌড়াতে কেন হয়েছে?”
“কেন আবার? তোমার কাছে আসার জন্য।”
“আমার কাছে আসতে আপনাকে দৌড়াতে কেন হবে? টিউশন আমি করি, না আপনি? পরপর দুটো টিউশন করে আমাকে কেন আবার আপনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? আমি কি হাতে অফুরন্ত সময় নিয়ে বসে থাকি?”
জাহিদ নিষ্পাপ মুখ করে বলল,
“রাগ করলে? রাগ কোরো না প্লিজ। এমন ভুল আর কখনও করব না, সরি।”
মৃদুলা রেগেমেগে বলল,
“রোজ-রোজই আপনি এ কথা বলেন। পটানোর আগে তো ঠিকই এক ঘন্টা আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন। তখন গাড়ি কোথায় পেতেন? এখন যেই না প্রেমিকা বানিয়ে ফেলেছেন, অমনি আপনার কপাল থেকে গাড়ি উঠে গেল?”
“এই কারণেই তো বাবাকে বাইক কিনে দিতে বলছি। আম্মু-ই তো রাজি হচ্ছে না। বাইক নিয়ে রাস্তায় বোরোলেই না কি অ্যাক্সিডেন্ট করে আমি ম’রে যাব।”
মৃদুলা মহাবিরক্ত হয়ে বলল,
“রাখুন আপনার বাইক। ইচ্ছা থাকলে ভ্যানগাড়িতে চড়ে-ও আগে আসা যায়। শুনুন, এরপর কিন্তু আমি এক মিনিট-ও অপেক্ষা করব না। আজ সতেরো মিনিট অপেক্ষা করিয়েছেন। আমার পরীক্ষার পড়া কি আপনি পড়ে দিবেন? আমি বাড়ি ফিরে পড়ব কখন?”
“আহা! পড়তে পারবে। এখন তো এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার আরও সময় নষ্ট হচ্ছে। চলো তো, হাঁটতে-হাঁটতে যত ইচ্ছা বকো।”

মৃদুলা ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটা দিলো। এই ছেলের সঙ্গে রাগ করাই বেকার। এর আছে গণ্ডারের চামড়া। কোনো কথাই গায়ে লাগে না। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এই ছেলে তার পেছনে লেগেছে। কতবার করে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। মৃদুলা তখন ভয়ে রাজি হয়নি। জাহিদের পারিবারিক অবস্থান তাদের চেয়ে অনেক ওপরে। এ কারণেই সে সবসময় জাহিদকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু নিজের অনুভূতি থেকে আর কদিন পালিয়ে বাঁচা যায়? মন তো সে হারিয়েই বসেছিল। এভাবে চলতে-চলতেই কীভাবে যেন পাজি ছেলেটা তাকে পটিয়ে ফেলল। এখন আর মৃদুলা পালানোর পথ-ও খুঁজে পায় না।
জাহিদ মৃদুলার সঙ্গে সমান তালে হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“তোমার জন্য একটা সুন্দর জিনিস এনেছি।”
জাহিদ দেরী করলেই সেদিন হাতে করে ফুল নিয়ে উপস্থিত হয়। আজ তার হাতে ফুল-ও নেই। কী সুন্দর জিনিস এনেছে বুঝতে পারল না মৃদুলা। তবু অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলল,
“লাগবে না সুন্দর জিনিস।”
“লাগবে না?”
“না।”
“শিওর?”

মৃদুলার জায়গায় অন্য মেয়ে হলে একটু দোনামনা করে অভিমানী সুরে বলত, জানি না। যাতে সুন্দর জিনিসটা দ্রুত তার হাতে এসে পড়ে। কিন্তু মৃদুলা তার বিপরীত। সে কপালে ভাঁজ ফেলে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি এত গাধা কেন? প্রেমিকার রাগ-ও ঠিকমতো ভাঙাতে জানেন না। আপনার প্রেমিক হয়ে চরম ভুল হয়েছে। আপনার হওয়া উচিত ছিল প্রেমিকা, আর আমার হওয়া উচিত ছিল প্রেমিক। আপনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতাম প্রেমিক কীভাবে হতে হয়।”
“তার মানে তুমি বলছো আমি এখনও প্রেমিক হতে পারিনি?”
“না।”
“সিরিয়াসলি?”
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট,” শক্ত গলায় বলল মৃদুলা।
জাহিদ ভাবুক মুখে শুধাল,
“তাহলে কীভাবে আমি প্রেমিক হয়ে উঠতে পারি মিস?”
“প্রেমিকাকে সতেরো মিনিট অপেক্ষা করিয়ে খালি হাতে এসেছেন কেন? ফুল কোথায়?”
জাহিদ দ্রুত পকেট থেকে বকুল ফুলের মালাটা বের করল। মৃদুলার সামনে মালা ঝুলিয়ে ধরে বলল,
“এই তো, ফুলের মালা এনেছি। এটা কি প্রেমিকা গ্রহণ করবে?”
মুখে উত্তর না দিয়ে মৃদুলা হাত বাড়িয়ে দিলো। জাহিদ তার হাতে মালাটা পরিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল,
“এখন কি আমি আপনার প্রেমিক হতে পেরেছি?”
মৃদুলা বলল,
“ভেবে দেখব।”
“তাড়াতাড়ি জানালে একটু সুবিধা হয়।”
“প্রেমিকদের এত তাড়া থাকবে কেন?”
“ওহ্ আচ্ছা! প্রেমিকদের তাড়া থাকা-ও নিষেধ? ঠিক আছে, আমার কোনো তাড়া নেই। আপনার যখন ইচ্ছা জানাবেন।”
মৃদুলার ঠোঁটের কোণে মিটমিটে হাসি। জাহিদ বলল,
“তোমার আপা রাগ করে আছে জানো?”
মৃদুলা অবাক হয়ে বলল,
“আপা রাগ করে আছে? কার সাথে?”
“কার সাথে তোমার আপা রাগ করতে পারে?”

প্রশ্নটা শুনে মৃদুলার খেয়াল হলো। জাহিদের মুখে তার আপার খবর মানেই তা প্রভাত ঘটিত ব্যাপার। বয়সে ছোটো হলেও জাহিদের সঙ্গে প্রভাতের একটা ভালো সম্পর্ক আছে। প্রতিবেশি হওয়ার সুবাদে ছোটোবেলা থেকেই জাহিদ প্রভাতের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। এ কারণে বাবা-মায়ের কত বকাঝকা যে সে শুনেছে, হিসাব নেই। বাবা-মা ভাবত প্রভাতের সঙ্গে মিশলেই সে খারাপ হয়ে যাবে। যদিও সে তেমনটা হয়নি। প্রভাতের সঙ্গে মিশলেও সে প্রভাতের মাঝে তেমন খারাপ কিছু দেখেনি। মানুষ একটু বেপরোয়া, দুষ্টু স্বভাবের হলেই কি সে খারাপ হয়? বুঝে আসে না জাহিদের। তাই প্রভাতের সঙ্গ সে এখনও বেশ উপভোগ করে। তার কাছেই রোজ প্রভাত-মৃন্ময়ীর সমস্ত খবর মৃদুলা পায়। আজ মৃন্ময়ীর রাগ করার বিষয়টি শুনে সে জাহিদকে বলল,
“প্রভাত ভাইকে সুন্দর কোনো বুদ্ধি দিবে, যাতে আপুর রাগ তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়।”
জাহিদ হেসে বলল,
“প্রভাত ভাইয়ের আমার বুদ্ধির প্রয়োজন আছে? সে নিজেই বুদ্ধির জাহাজ। পারলে আমরাই তার কাছে যাই সুন্দর বুদ্ধি নেওয়ার জন্য।”
মৃদুলা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“তোমার এই ফুল নিয়ে এসে প্রেমিকার রাগ ভাঙানোর বুদ্ধিটা-ও কি প্রভাত ভাইয়ের থেকে নেওয়া?”
জাহিদ দ্রুত গতিতে ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল,
“এই না-না-না। একদমই না।”
“অস্বীকার করে লাভ নেই। আমি বুঝে গেছি।”
জাহিদ হতাশ গলায় বলল,
“কিন্তু আমি তো অন্য বুদ্ধির কথা বুঝিয়েছি।”


আজ সারাদিন ধরে মৃন্ময়ীর মাথায় মৃত্তিকার কাজের কথাই ঘুরছে। যতই সে মৃত্তিকাকে বলুক এই কাজ না পেলে অন্য কাজ পাওয়া যাবে। অন্য কাজ পাওয়াটা তো আর মুখের কথা না। এই কাজটা না হলে সে মৃত্তিকার জন্য কী কাজ ঠিক করবে, এই ভাবনা-ই ঘুরছে তার মাথায়। একটার আশায় থেকে তো আর মাথা থেকে চিন্তা দূর করা যায় না। এদিকে গত তিনদিন ধরে প্রভাত তার রাগ ভাঙানোর জন্য কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে। সেদিনের ব্যাপারটা নিয়ে প্রভাতের ওপর তার রাগ হয়েছিল। কিন্তু তার রাগ কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দুদিন রাগ করে থাকলেও এখন সে ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। একে তার মাথায় চিন্তার শেষ নেই, এরমধ্যে ওসব মাথায় ঢুকিয়ে বসে থাকার সময় কোথায়? প্রভাত কি আর তা জানে? সে তো আজও আয়োজন করে এসেছে মৃন্ময়ীর রাগ ভাঙাতে। মৃন্ময়ী স্কুল থেকে বেরোনোর আগেই সে পথে দাঁড়িয়ে ছিল হাতে বড়ো একটা ফুলের তোড়া নিয়ে। গোলাপ ফুলের তোড়া। বাচ্চাদের অভিভাবকরা যাওয়ার পথে এ দৃশ্য দেখে খুব ফিসফিস করছে। এক বাচ্চা ফুল দেখে বায়না ধরল তার ফুল চাই। প্রভাতের কাছে সে ফুল চেয়ে বসল। তার মা তাকে জোর করে-ও সেখান থেকে সরাতে পারল না। প্রভাত হাঁটু মুড়ে বসে বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করল,
“নাম কী পিচ্চি?”
বাচ্চাটা উত্তরে বলল,
“ফুল দাও।”
প্রভাত বলল,
“নাম না বললে ফুল দিবো না।”
বাচ্চাটা এবার সুন্দরভাবে বলল,
“আমার নাম রাইসা।”
“রাইসা? তোমার নামটা তো খুব সুন্দর। তুমিও খুব সুন্দর।”
বাচ্চাটা আবারও হাত পেতে বলল,
“ফুল দাও।”
প্রভাত বলল,
“ফুল দিবো। আগে বলো তো এই ফুল কার মতো দেখতে?”
বাচ্চাটা বোকা চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
“জানি না।”
“জানো না?”
“না।”
“জানতে হবে।”
বাচ্চাটার বোধহয় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ফুল দাও।”
প্রভাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আহা! কাঁদে না। রাইসা না ভালো মেয়ে? রাইসাকে আমি ফুল দিবো তো। বলো তো তোমার কয়টা ফুল চাই?”
বাচ্চাটা দুটো আঙুল তুলে বলল,
“দুইটা।”
“তাহলে তো তোমাকে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আচ্ছা বলো তো, মৃন্ময়ী ম্যাম আমার কে হয়?”
বাচ্চাটা আবার দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
“জানি না।”
প্রভাত বলল,
“বউ হয়, বউ। এবার বলো তো কী হয়?”
বাচ্চাটা তাকে অনুসরণ করে বলল,
“বউ হয়।”
প্রভাত চমৎকার হেসে বাচ্চাটার গাল টিপে দিয়ে বলল,
“এই তো রাইসা কত্তকিছু জানে! কত্ত সুইট রাইসা! এই নাও তোমার ফুল। আর শোনো, এই ফুলটা তোমার মতো দেখতে, আর এটা মৃন্ময়ী ম্যামের মতো। আরেকটা তোমার গিফট, নাও-নাও।”
আনন্দে গদগদ হয়ে প্রভাত বাচ্চাটার হাতে দুইটার জায়গায় তিনটা ফুল দিয়ে দিলো। ফুল পেয়ে বাচ্চাটা-ও ভীষণ খুশি হলো। মিষ্টি হেসে সে প্রভাতকে ‘থ্যাংক ইউ আঙ্কেল’ বলতে-ও ভুলল না। গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে বিষয়টা মৃন্ময়ী দেখল ঠিকই, কিন্তু ধরা দিলো না। বাচ্চাদের সাথে-ও মানুষ এমন বাচ্চামি করে? প্রেমে পড়লে মানুষ কী আজব-আজব কাজ করে! রাইসা চলে যেতেই মৃন্ময়ী সামনে পা বাড়াল। প্রভাত তাকে দেখামাত্র ছুটে এল। ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে ধরে একগাল হেসে বলল,
“ম্যাডামের জন্য।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ধন্যবাদ, আমার ফুল লাগবে না।”
“কিন্তু আমি এটা তোমার জন্যই এনেছি। সেদিনের ব্যাপারটার জন্য সরি। আর রাগ করে থেকো না প্লিজ।”
“আমি তোমার ওপর রেগে নেই।”
“আমি জানি তুমি রেগে আছো। ফুলটা নাও না।”
“বলছি তো আমি রেগে নেই। আমি তোমার ওপর রাগ ধরে রাখার কে? আগ বাড়িয়ে বেশি ভেবো না প্রভাত।”
“ঠিক আছে, তাহলে এটা নাও। তাহলেই আমি বিশ্বাস করব তুমি আমার ওপর রেগে নেই।”
“আচ্ছা আমি এত বড়ো ফুলের তোড়া নিয়ে বাড়ি ফিরব কীভাবে? এই সামান্য ব্যাপারটা কি তুমি বোঝো না? শুধু-শুধু জেদ কোরো না।”
“ফুল নিয়ে বুঝি বাড়ি ফেরা যায় না?”
“যায়, কিন্তু এতগুলো ফুল দেখলে বাড়ির মানুষ কী ভাববে তার কোনো ঠিক আছে?”
প্রভাত ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো,
“কী আবার ভাববে? তোমাকে এতগুলো ফুল দেওয়ার মতো একজন ব্যক্তি-ই আছে। সে প্রভাত তরফদার। এই সামান্য কথাটা কে না জানে?”

ওদিকে মৃন্ময়ী বাড়িতে মাকে বলে রেখেছে এখন আর প্রভাত তাকে বিরক্ত করে না। মা তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে বলেই মিথ্যেটা বলতে হয়েছে। এতগুলো ফুল নিয়ে সে কোনোভাবেই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। আর যা-ই হোক, তার মা এতটাও বোকা না। প্রভাত-ও এক নাছোড়বান্দা। ফুল সে এনেছে মানে মৃন্ময়ীকে নিতেই হবে। নয়তো ফুল গিয়ে পড়বে সোজা রাস্তার ধারের দিঘিতে। ভেবেচিন্তে মৃন্ময়ী বলল,
“ঠিক আছে, আমি তোমার ফুল নিব। কিন্তু আমি এসব বাড়িতে নিতে পারব না। তোমার ফুল নিয়ে আমি অন্য কাউকে দিলে তোমার কোনো আপত্তি আছে?”
“ফুল গ্রহণ করলে এসব তোমার। তুমি অন্য কাউকে দিতে পারো, কিন্তু কোনো ছেলেকে না। তোমার প্রেমে পড়ে যাবে এমন কোনো ছেলে ছাড়া যে কাউকে দিতে পারো। চাইলে আমাকে-ও দিতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
মৃন্ময়ী ফুলের তোড়া নিল। এরপর সে পথে যে বাচ্চাকে দেখল, তার হাতেই একটা করে ফুল ধরিয়ে দিলো। অপ্রত্যাশিতভাবে অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে ফুল পেয়ে বাচ্চারা দারুণ খুশি হলো। তাদের খুশি দেখে মৃন্ময়ীর-ও মন ভালো হয়ে গেল। প্রভাত হাসিমুখে কেবল দেখে গেল। ব্যাপারটা তার কাছে মন্দ লাগছে না। মৃন্ময়ী যে আনন্দ পাচ্ছে, এতেই তার অনেককিছু পাওয়া হয়ে গেছে। সমস্ত ফুল ফুরিয়ে যাওয়ার পর প্রভাত বলে উঠল,
“আমাকে একটা-ও দিলে না। আমি তোমার এত অপ্রিয়?”
মৃন্ময়ী ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমিই তো বলেছিলে আমার ফুল আমি যে কাউকে দিতে পারব।”
“আমার কথা-ও বলেছিলাম।”
মৃন্ময়ী মুচকি হেসে বলল,
“তোমার জন্য ধন্যবাদ।”
“শুধুই ধন্যবাদ।”
“হ্যাঁ, শুধুই ধন্যবাদ।”
“ঠিক আছে। তোমার শুধুই ধন্যবাদের সাথে না নয় মনে-মনে আমি কিছু ভালোবাসা যোগ করে নিলাম।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমি ধন্যবাদ ছাড়া কিছু দিইনি।”
প্রভাত হেসে বলল,
“তুমি না দিলেও আমি ভেবে নিব।”


পাঠাগারের কাজটা শেষমেশ মৃত্তিকা-ই পেয়েছে। খবরটা স্কুল থেকে ফোন করে মৃত্তিকাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল থেকেই তাকে ডিউটিতে ডাকা হয়েছে। খবরটা পেয়ে খুশিতে মৃত্তিকার চোখে পানি চলে এল। তখনই সে ছুটল মৃন্ময়ীকে খবরটা দিতে। মৃন্ময়ী ঘরেই ছিল। মৃত্তিকা তাকে না ডেকেই সোজা ঘরে ঢুকে গেল। সে দেখল মৃন্ময়ী জামা সেলাই করছে। তাকে দেখে মৃন্ময়ী বলল,
“কী-রে? এভাবে ছুটে এলি যে? কী হয়েছে?”
মৃত্তিকা আসল কথা না বলে প্রশ্ন করল,
“কী করছিস আপা?”
“দেখছিস-ই তো কী করছি। জামাটা কদিন আগেই বানিয়েছিলাম। আজকালকার কাপড়ের যা অবস্থা! কদিন পরতেই টান লাগতেই কীভাবে ছিঁড়ে গেল দেখ। অল্প একটু ছিঁড়েছে, তাই ভাবলাম সেলাই করে আরও কয়েকদিন চালিয়ে দিই। ফেলে দিয়ে কী হবে? বাইরে তো আর পরব না।”
মৃত্তিকা জানে জামাটা কদিন আগে কেনা না। তাকে সাথে নিয়েই গতবছর মৃন্ময়ী জামাটা কিনেছিল। হয়তো সে ভুলে গেছে। কিন্তু মৃত্তিকা জামাটা দেখেই চিনতে পেরেছে। সব খরচ সামলে সম্ভব হলে মৃন্ময়ী নিজের জন্য কিছু কিনে। সম্ভবত বেতনের সবচেয়ে কম ভাগটাই তার নিজের খরচের জন্য অবশিষ্ট থাকে। মৃত্তিকা সেটা জানে, কিন্তু কোনোদিন-ও এ বিষয়ে সে ভ্রূক্ষেপ করেনি। আজ মৃত্তিকা বলল,
“বেতন পেলে এবার নিজের জন্য দুটো নতুন জামা কিনিস আপা।”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“কিনব।”
যদিও এটা তার মুখের কথা। খরচ সামলে উঠতে না পারলে সে এই মাসে-ও নতুন জামা কিনবে না। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে মৃত্তিকা আসল কথায় ফিরল। মুখে হাসি টেনে বলল,
“আপা, একটা সুসংবাদ আছে।”
মৃন্ময়ী চট করে মুখ তুলে বলে উঠল,
“তোর চাকরি হয়েছে?”
মৃত্তিকা অবাক হয়ে বলল,
“তুই বুঝলি কীভাবে?”
মৃন্ময়ী খুশিতে প্রশস্ত হেসে বলল,
“তারমানে সত্যিই তোর চাকরিটা হয়েছে? আলহামদুলিল্লাহ্, আলহামদুলিল্লাহ্। আমি তো কদিন ধরে শুধু এটাই ভাবছিলাম। এবার তাহলে স্বস্তি পেলাম। কবে থেকে ডিউটি করতে বলেছে?”
“কাল থেকেই।”
“তাহলে তো ভালোই হয়েছে। শোন, খুব মন দিয়ে কাজ করবি কিন্তু। অন্য কোনোদিকে মন দেওয়া যাবে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এ কদিনে তুই আমাকে হাজারবার বুঝিয়ে ফেলেছিস। আমি বাচ্চা না, বুঝি সব।”
“তোকে নিয়ে চিন্তা হয় বলেই তো বুঝাই। যা, মাকে খবরটা দিয়ে আয়।”
মৃত্তিকা কেমন চুপসে গেল। দ্বিধাভরা কন্ঠে বলল,
“তুই বল।”
“আমি বলব কেন? চাকরি কি আমার হয়েছে? তোর হয়েছে, তুই বলবি।”
“আমার কেমন যেন লাগছে। তুই বল না প্লিজ।”
“তুই এত বোকা কেন রে? এ কদিনে মা তোর চাকরির ব্যাপারে কতবার আমাকে প্রশ্ন করেছে জানিস? সে মনে-মনে তোর জন্য ঠিকই চিন্তা করে, তুই-ই বুঝিস না।”
“আয় না। তুই এলে কী সমস্যা?”
“আচ্ছা চল, আমিও যাচ্ছি। কিন্তু খবরটা তোর নিজের মুখেই বলতে হবে।”

মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে ধরে নিয়ে এল মায়ের কাছে। সাজেদা বেগম তখন রোদে শুকিয়ে আনা কাপড় গোছাচ্ছেন। মৃন্ময়ী এসে আনন্দিত গলায় বলে উঠল,
“মা, একটা আনন্দের খবর আছে।”
সাজেদা বেগম উৎসুক মুখে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,
“কী খবর?”
“আমি না, মৃত্তিকা বলবে। মৃত্তিকা, বল মাকে।”
মৃত্তিকার মুখের দিকে সাজেদা বেগম তাকিয়ে আছেন। মৃত্তিকা সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করতে না পেরে বলল,
“মা, আমার চাকরিটা হয়েছে।”
সাজেদা বেগম খুশি হয়েছেন কি না বুঝতে পারল না মৃত্তিকা। তিনি কেবল ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলেই আবার কাপড় গোছানো ধরলেন। মৃত্তিকা মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকাল। মৃন্ময়ী মাকে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি খুশি হওনি মা?”
সাজেদা বেগম বললেন,
“খুশি হব না কেন?”
মৃন্ময়ী মৃত্তিকাকে কনুইয়ের গুঁতা মে’রে ফিসফিসিয়ে বলল,
“খুশি হয়েছে। হেঁয়ালি করা এনার স্বভাব।”
মৃত্তিকা মৃদু হাসল। বোনের কথাটা সে বিশ্বাস করে নিল। মাকে সে কবেই বা বুঝতে পেরেছে?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৬

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৬.
মৃন্ময়ী খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছে তাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন পাঠাগার হয়েছে। পাঠাগারের দায়িত্ব পালনের জন্য লোক নেওয়া হবে। খবরটা পেয়ে মৃন্ময়ী দেরী না করে দ্রুত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করেছে। স্যার তাকে ভালোভাবেই চেনেন। রোজ সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে স্যারের সঙ্গে তার দেখা হয়। সে সালাম দিলেই স্যার হাসিমুখে তার খোঁজ-খবর নেন। মৃন্ময়ীর বোনের কথা শুনে তিনি বললেন মৃত্তিকার বিষয়ে তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন। আরও বললেন মৃত্তিকা যেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ নিয়ে একবার স্কুলে আসে। মৃন্ময়ী মনে-মনে খুব করে চাইছিল এই কাজটা যেন মৃত্তিকা পায়। তার জন্য এমন কাজ-ই দরকার। এরচেয়ে ভালো কাজ তার জন্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। মৃত্তিকা-ও শুনে মনেপ্রাণে চাইছিল সে যেন কাজটা পেয়ে যায়। এসএসসি আর এইচএসসির সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে সে মৃদুলাকে সঙ্গে করে স্কুলে-ও যায়। স্যার শুধু মৃত্তিকার কাগজপত্র চেক করে কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন। এরপর বলে দিয়েছেন মৃত্তিকার আগেও তিনজন কাগজপত্র জমা দিয়ে গেছে। সময়মতো তারা জানিয়ে দিবেন কাকে নেওয়া হবে। অবশ্য মৃন্ময়ী জানত বিষয়টা এত সহজ হবে না। এসব কাজ যে পর্যায়ের-ই হোক, মানুষের লাইন পড়বেই। মৃন্ময়ী তার স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে-ও এই বিষয়ে কথা বলে তাকে অনুরোধ করেছে সে যেন স্কুলে একটু কথা বলে দেখে। প্রিন্সিপাল স্যার তাকে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি কথা বলবেন। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মৃত্তিকার স্বামীর সাথে তার দেখা হয়ে গেল। স্বামীকে দেখেই সে থমকে দাঁড়াল ঠিকই, কিন্তু তার স্বামী যেন তাকে দেখলই না। বলাবাহুল্য দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল। মৃত্তিকার কলিজাটা মনে হলো ফুটা হয়ে গেল। বুকে একরাশ ব্যথা আর চোখে ছলছল জল নিয়ে মৃত্তিকা বাড়ি ফিরল। বাকি দিনটা কা’টল তার কেঁদে-কেঁদে। মৃন্ময়ী বাড়ি ফিরে মৃত্তিকার খবর নিতে গিয়ে দেখল তার বোনের এমন অবস্থা। অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারল স্বামীর অমন অপরিচিত আচরণে সে কষ্ট পেয়েছে। মৃন্ময়ী শুনে আবাক হলো। যে লোক দ্বিতীয় বউ ঘরে তুলে মৃত্তিকাকে বিদায় করে দিয়েছে, তার অপরিচিত আচরণ কি অস্বাভাবিক কিছু? মৃত্তিকার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না? কী আশ্চর্য! অথচ মৃত্তিকাকে এ কথা বলতেই সে আবারও বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলল। আহাজারি করে বলল,
“আমি তো ওকে ভালবেসেছি। ওর জন্য আমি নিজের পরিবার ছেড়েছিলাম। সংসারের হাজারটা ঝামেলার মাঝেও আমি শুধুমাত্র ওর জন্য টিকে ছিলাম। ওর সাথে আমার একটা বছরের সংসার, এত-এত স্মৃতি। আমি ওসব কী করে ভুলে যাব রে আপা?”
মৃন্ময়ী বলল,
“কষ্ট হলেও ভুলে থাকতে হবে বোন। নইলে যে তুই তোর জীবনে সামনে এগোতে পারবি না।”
“কী করে ভুলব আপা? ভালোবাসার মানুষকে মাথা থেকে মুছে ফেলা কি এত সহজ?”
“হতে পারে কঠিন। তার চেয়েও বেশি কঠিন তোর বর্তমান জীবন। এটাও তোকে বুঝতে হবে। তোর বর্তমান জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখ। তোর জীবনটা এখন সম্পূর্ণ অগোছালো। তোকেই তা গুছিয়ে নিতে হবে। পিছুটান নিয়ে তুই নতুন করে জীবন সাজাবি কীভাবে? পিছুটান রেখেই বা কী লাভ? কোনো লাভ নেই, বরং এতে তোর কষ্ট বাড়বে। তোর জীবনটা নিয়ে পুতুল খেলে যে জিতে গেছে, নতুন করে জীবন সাজিয়ে তাকে তুই হারিয়ে দে।”
“ওকে চোখের সামনে দেখলে যে আমি ভেঙে পড়ি আপা।”
“ভেঙে পড়া চলবে না। শক্ত হতে হবে। তোর সঙ্গে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার নিজেকে নিয়ে ভাব মৃত্তিকা। নিজেকে ভালোবাসতে শেখ। যারা ঠকিয়েছে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দে, তাদের ছাড়াও তুই একটা সুন্দর জীবন কা’টানোর সাধ্য রাখিস। দেখি, চোখ মোছ। এখন থেকে একদম কাঁদবি না। খারাপ মানুষদের জন্য নিজের মূল্যবান চোখের জল ঝরানোর কোনো মানেই হয় না। ওরা চোখের জল পাওয়ার-ও যোগ্য না,” মৃত্তিকার চোখের পানি মুছতে-মুছতে বলল মৃন্ময়ী।
মৃত্তিকা নাক টেনে বলল,
“আমি চেষ্টা করব আপা।”
“অবশ্যই চেষ্টা করবি। চেষ্টা করলে সব সম্ভব। এখন থেকে তোর লক্ষ্য শুধু একটাই, নিজের জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা। আর কোনোদিকে তুই তাকাবি না। দৃষ্টি রাখবি শুধু নিজের লক্ষ্যের ওপর। দেখবি, একদিন তোর জীবন এত সুন্দর হয়ে উঠবে, এত সুন্দর উঠবে যে খারাপ মানুষগুলো-ও তোকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকবে। মনে-মনে আফসোস করবে। তখন আর তুই তাদের দিকে ফিরে তাকানোর-ও প্রয়োজনবোধ করবি না।”
মৃত্তিকা বলল,
“আপা, তোর কথা শুনে আমার কেমন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।”
“কেমন অনুভূতি? মনে সাহস জাগছে না? সত্যি-সত্যি কিছু করে দেখাতে ইচ্ছা করছে না?”
মৃত্তিকা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল,
“ইচ্ছা করছে, খুব ইচ্ছা করছে। আমার সত্যিই এই অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়া দরকার। আমি সবকিছু পেছনে ফেলে সামনে এগোনোর চেষ্টা করতে চাই। নিজের জীবনকে উপভোগ করতে চাই।”
মৃন্ময়ীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। সে মাথা দুলিয়ে বলল,
“তুই পারবি। আমি তোকে সম্পূর্ণ সমর্থন করব। তোর এই রূপটা দেখার অনেক আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার। ফাইনালি আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো। আমার বোন সঠিকভাবে ভাবতে শিখল। শোন, তুই মন দিয়ে কাজ করবি। কাজের মাঝে থাকলে দেখবি আস্তে-আস্তে এমনি মাথা হালকা হয়ে যাবে। তারপরও কখনও মন খারাপ হলে তা মনে চেপে রাখবি না। আমি আছি, মৃদুলা আছে। আমাদের সঙ্গে শেয়ার করবি। সবার সঙ্গে সময় কা’টালে ভালো লাগবে।”
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“আপা, তুই এমনভাবে বলছিস যেন কাজটা আমি অলরেডি পেয়ে গেছি।”
মৃন্ময়ী আশা না হারিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,
“পাবি, পাবি। তুই-ই পাবি, দেখিস। আর এটা না পেলে কি দুনিয়াতে অন্য কোনো কাজ নেই? কিছু একটা ঠিক জোগাড় করে দিবো। আমার ওপর ভরসা রাখ। আমি তোকে হতাশায় ভুগতে দিবো না।”
মৃত্তিকা-ও দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“তোর ওপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে।”
“শুধু আমার ওপর না, নিজের ওপর-ও থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। মনোবল বাড়াতে হবে। নিজেকে বুঝাতে হবে তোকে দিয়ে সব সম্ভব, নিজের জন্য তুই সব করতে পারবি। কী-রে? পারবি না?”
মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে মাথা দুলিয়ে বলল,
“পারব আপা।”

টিউশন থেকে ফিরে মৃদুলা নিজের ঘরে ঢোকার পথে দুই বোনের কথোপকথন শুনে থেমে গিয়েছিল। মাঝখানে ঢুকে সে তাদের মনোযোগ নষ্ট করতে চায়নি। বিধায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথোপকথনের কিছু অংশ সে শুনতে পেয়েছে। বলা যায় ইচ্ছা করেই শুনেছে। মৃন্ময়ী ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে মৃদুলাকে দেখে শুধাল,
“কী-রে? তুই কখন এলি?”
“একটু আগেই। তোমাদের কথা বলতে দেখে মাঝখানে ঢুকিনি। আজকের ব্যাপারটা নিয়ে আপুর মন খারাপ, না?”
“হ্যাঁ। আমি তো বুঝিয়ে বললাম। শোন না, তুই-ও একটু বুঝাস ওকে। ওর কাছাকাছি যখন থাকবি, তখন ওকে সাহস যোগাবি। সামনে ওর অনেক পথ হাঁটতে হবে। ভাঙাচোরা মন নিয়ে বসে থেকে তো সেটা সম্ভব না।”
মৃদুলা তাকে আস্বস্ত করে বলল,
“ঠিক আছে, আমি যতটুকু পারি বুঝিয়ে বলব। তুমি চিন্তা কোরো না।”


মৃন্ময়ীর স্কুলে আজ একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান আছে। এতদিন ধরে মৃদুলা বোনকে তার কেনা নতুন শাড়িটা পরতে বলার উপলক্ষ খুঁজছিল। আজ কোনোমতে একটা ছোটোখাটো উপলক্ষ পেয়েই সে বোনকে চেপে ধরল শাড়ি পরানোর জন্য। কিন্তু মৃন্ময়ী নারাজ। সে কোনোমতেই শাড়ি পরবে না। মৃদুলা-ও কম যায় না। সে-ও জেদ ধরে বসল সে আজ বোনকে শাড়ি পরিয়েই ছাড়বে। মৃন্ময়ী এত করে বলল বড়ো কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সে অবশ্যই শাড়িটা পরবে, মৃদুলাকে কোনো কথাই শোনানো গেল না। সে মেয়ে জেদ ধরে বোনকে শাড়ি পরাতে রাজি করল। তারপর শাড়ি পরতে নিজেই সাহায্য করল। মৃন্ময়ী সাজগোজ খুব একটা করে না। করলেও যৎসামান্য। মৃদুলা তাকে হালকা সাজিয়ে-ও দিলো। মৃন্ময়ী বারবার শুধু বলছিল ‘বেশি সাজাস না, ভালো লাগবে না, আমার লজ্জা লাগে।’ অথচ সাজগোজ শেষে মৃদুলা তার দিকে তাকিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলল,
“তোমাকে দারুণ লাগছে আপা।”
মৃন্ময়ী আয়নায় নিজেকে দেখল। মৃদুলার ভাষায় তাকে‘দারুণ’ লাগছে কি না বুঝে উঠতে না পারলেও, নিজের কাছে তাকে সত্যিই একদম অন্যরকম মনে হলো। মৃদুলা তাকে জিজ্ঞেস করল,
“ভালো লাগছে না?”
মৃন্ময়ী কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলল,
“ভালো, কিন্তু সাজটা কি একটু বেশি হয়ে গেল?”
“এইটুকু সাজ বেশি? বলো কম হয়েছে।”
“আমার তো অভ্যাস নেই, তাই কেমন যেন লজ্জা লাগছে।”
“সব মেয়েরাই একটু হলেও সাজে। তোমার এত লজ্জার কী আছে?”
“তুই বুঝবি না। বাইরে বেরোলে মানুষ অদ্ভুতভাবে তাকাবে।”
“কোন মানুষ?”
“বাইরে কি মানুষের অভাব?”
“বাইরের মানুষের কথা বলছো, না প্রভাত ভাইয়ার?” ঠোঁট টিপে বলে উঠল মৃদুলা।
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কথায়-কথায় তুই ওকে টানিস কেন?”
“এছাড়া আর কাকে টানব? তুমি কি একজনকে পেছনে ঘুরিয়ে অন্য কাউকে টানতে চাও?”
“আমি ওকে পেছনে ঘুরাই? এসব কে বলেছে তোকে?”
“তুমি না ঘুরালেও সে ঘোরে, আমি সব খবর জানি।”
“এত খবর রাখিস কোত্থেকে তুই?”
মৃদুলা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
“আমার স্পাই আছে।”
“স্পাই আবার কে?”
“বিবিসি নিউজের হেড।”
মৃন্ময়ী আর মৃদুলার কথায় মাথা ঘামাল না। এই মেয়ে সত্য কথা তো বলেই না, অযথা রহস্য করে।

সারাদিন স্কুলে সুন্দর সময় কা’টলেও, ছুটির পর স্কুল থেকে বেরোতে মৃন্ময়ীর ভীষণ লজ্জা লাগতে শুরু করল। প্রভাত নিশ্চয়ই আজ তাকে নিয়ে কিছু না কিছু মন্তব্য করে তাকে লজ্জায় ফেলবে। গতবছরে-ও এমনটা হয়েছিল। স্কুল থেকে পিকনিকে নেওয়া হয়েছিল। বাকি ম্যামরা শাড়ি পরবে বলে তারা মৃন্ময়ীকে-ও শাড়ি পরতে রাজি করিয়েছিল। সেদিন প্রভাত তাকে দেখে এমন-এমন মন্তব্য করেছিল যে লজ্জায় পড়ে সে আর শাড়ি পরে স্কুলে আসেনি। অবশ্য তার দিক থেকে তার মন্তব্য সুন্দর-ই ছিল। মৃন্ময়ী নিজেই লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল। আজ স্কুল থেকে বেরিয়ে মনে পড়ল শাড়ি পরেও তার একটা-ও সিঙ্গেল ছবি তোলা হয়ে ওঠেনি। অনুষ্ঠানের মাঝে যা ছবি তোলা হয়েছে, সবগুলোই গ্রুপ ছবি। আশপাশে তাকিয়ে সে ফোন বের করে দুটো সেলফি তুলল। কিন্তু নিজের তোলা সেলফিতে সে সন্তুষ্ট হতে পারল না। স্কুল গেইট দিয়ে এক ম্যাম আর স্যার বেরোনোর সময় তাকে ছবি তুলতে দেখে এগিয়ে এল। স্যারের নাম ফুয়াদ। বয়সে তার চেয়ে একটু বড়ো। তবে লোকটা খুব মিশুক প্রকৃতির। মৃন্ময়ীকে খুব স্নেহ করে। ফুয়াদ স্যার সহাস্যে বললেন,
“ম্যাডাম, ছবি তুলতে ভুলে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই?”
মৃন্ময়ী কিছুটা লজ্জা পেয়ে ফোন নামিয়ে নিয়ে বলল,
“না স্যার, এমনি সেলফি তুললাম।”
“থাক, লজ্জা পেতে হবে না। আপনি যে এক বছরে একটা ছবি তোলা মানুষ, তা আমরা জানি। আপনার জন্য ছবি তুলতে ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। দিন, ছবি তুলে দিই।”
মৃন্ময়ী যেন আরও লজ্জায় পড়ে গেল। মাথা নেড়ে বলল,
“না-না স্যার। আমি আর ছবি তুলব না। ধন্যবাদ আপনাকে।”
ফুয়াদ স্যার তবু বারবার করে বললেন,
“আরে লজ্জা পাবেন না। দিন তুলে দিই। আমি কি অপরিচিত মানুষ?”
মৃন্ময়ী শেষে তার হাতে ফোন দিয়ে দিলো। এমনিতেই তার ফোনের ক্যামেরাটা-ও খুব একটা ভালো না, ফোনটা পুরোনো হয়ে গেছে যে। ফুয়াদ স্যারের হাতে ফোন দিয়ে মনে-মনে তার আরও লজ্জা লাগল। তবু ম্যামের কথায় সে ছবি তুলতে দাঁড়াল। ফুয়াদ স্যার বোধ হয় একটার বেশি ছবি তুলতে পারলেন না, কোত্থেকে প্রভাত এসে বলে বসল,
“আমার অনুপস্থিতিতে ছবি তোলার জন্য ধন্যবাদ স্যার। এবার আপনি ছুটি নিতে পারেন।”
ফুয়াদ স্যার অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। প্রভাত আর মৃন্ময়ীর ব্যাপারটা কারোরই অজানা নয়। ফুয়াদ স্যার একবার মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। বললেন,
“সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের আগমন। আমি তবে ছুটি নিলাম। আল্লাহ্ হাফেজ।”
এই বলে তিনি প্রভাতের হাতে ফোন দিয়ে ম্যামের সঙ্গে চলে গেলেন। তারা চলে যেতেই মৃন্ময়ী বিরক্ত চোখে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটা কী করলে তুমি?”
প্রভাত যেন কোনো দোষ-ই করেনি, এমনই ভাব করে উলটা প্রশ্ন করল,
“কী করলাম?”
“স্যার ছবি তুলছিল, তোমার এসে এভাবে বাঁধা দেওয়াটা কি খুব দরকার ছিল?”
“অবশ্যই দরকার ছিল, খুবই দরকার ছিল। আমি থাকতে তোমার ছবি অন্য কেউ তুলবে কেন? এটা তো শুধুমাত্র আমার দায়িত্ব।”
“তোমাকে আমি দায়িত্ব দিলাম কবে?’
“কোনো একদিন তো দিবেই। আপাতত প্রাকটিস করার চেষ্টা করছি। দেখি, সুন্দর করে দাঁড়াও তো, ছবি তুলি,” পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে মৃন্ময়ীর দিকে তাক করে বলল প্রভাত।
সঙ্গে-সঙ্গে মৃন্ময়ী এগিয়ে এসে বলল,
“আমার ছবি তোলা হয়ে গেছে। আমার ফোন দাও।”
প্রভাত মৃন্ময়ীর ফোনটা নিজের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। হাসিমুখে বলল,
“ছবি তুলতে না দিলে ফোন ফেরত পাবে না।”
“পুরোনো ফোন নিয়ে তোমার দুই টাকার-ও লাভ হবে না।”
“না হোক। আমি কি বিক্রি করতে নিব? ফোনটা আমার দরকার না হলেও তোমার তো দরকার আছেই, তাই না?”
“প্রভাত, ফাজলামি কোরো না তো। অনেকক্ষণ ধরে স্কুল ছুটি হয়েছে। সবাই চলে গেছে। ফোন দাও, বাসায় যাব।”
প্রভাত পুনরায় বলল,
“তোলো না দুটো ছবি। আমি ছবি তুলে দিলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?”
“আমার ইচ্ছা করছে না।”
“তোমার ইচ্ছা না করলে ফুয়াদ স্যার তুলল কীভাবে?”
মৃন্ময়ী হতাশ গলায় বলল,
“কী মুশকিল! সবকিছু নিয়ে তুমি এত বাড়াবাড়ি কেন করো?”
“আমার স্বভাব-ই এমন। যাও, দাঁড়াও। ছবি তুলেই ফোন ফেরত দিয়ে দিবো।”
মৃন্ময়ী হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, তোলো ছবি। তাড়াতাড়ি করবে।”
মৃন্ময়ী ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে খেয়াল করল প্রভাত তার নিজের ফোন তাক করে আছে। সে বাঁধা দিয়ে বলল,
“তোমার ফোনে তুলছ কেন?”
প্রভাত বলল,
“আমার ফোনে তোমার ছবি সুন্দর উঠবে তাই। আমি তোমাকে ছবি পাঠিয়ে দিবো, চিন্তা নেই।”
মৃন্ময়ী আর কথা বাড়াল না। প্রভাত ছবি তুলতে-তুলতে বলল,
“একটু হাসো না। মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি বুঝি তোমাকে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি।”

লজ্জা দূরে ঠেলে মৃন্ময়ী ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলল। প্রভাত-ও দুটো ছবির কথা বলে দশটা ছবি তুলে ফেলল। এরপর আর মৃন্ময়ীকে দাঁড় করিয়ে রাখা সম্ভব হলো না। বাড়ি ফেরার পথেই প্রভাত ছবিগুলো মৃন্ময়ীকে সেন্ড করে ফোন ফেরত দিয়ে দিলো। মৃন্ময়ী ফোনে ছবিগুলো দেখতে লাগল। প্রভাত সত্যিই সুন্দর ছবি তুলেছে। ছবিতে তাকে দারুণ লাগছে। ঠিক যেমনটি মৃদুলা বলেছিল। তার মুখোভাব লক্ষ্য করে প্রভাত শুধাল,
“ছবি কি ম্যাডামের পছন্দ হয়েছে?”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভালো ছবি।”
“শুধু ভালো নয়, বলো চমৎকার ছবি।”
প্রত্যুত্তরে মৃন্ময়ী বলে বসল,
“তোমার ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়ো।”
প্রভাত কপাল কুঁচকে ফেলে জিজ্ঞেস করল,
“কেন?”
“তোমার রাখার কী দরকার?”
“তোমার ছবি আমার দরকার নয় তো কি ফুয়াদ স্যারের দরকার?”
মৃন্ময়ী চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
“ফুয়াদ স্যার আবার তোমার কোন পাকা ধানে মই দিলো?”
প্রভাত সঙ্গে-সঙ্গে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
“তোমাকে কি কেউ বলেছে তোমাকে আজ দারুণ সুন্দর লাগছে?”
“বলেছে?”
“কে?”
মৃন্ময়ী বলে উঠল,
“যে-ই হোক, ফুয়াদ স্যার না।”
প্রভাত হেসে উঠে বলল,
“আমি তার কথা বলিওনি।”
“হ্যাঁ, একদমই বলনি।”
“শরবত খাবে?”
মৃন্ময়ী তাড়া দেখিয়ে বলল,
“উঁহু, বাড়ি ফিরতে হবে।”
“সে তো রোজই ফিরো। একদিন ভুল করে আমার বাড়ি ফিরে গেলে-ও তো পারো।”

মৃন্ময়ী প্রভাতের সামনে থেকে সরতে তাড়াহুড়া করে হাঁটতে যেয়ে বেখেয়ালে এক ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেল। ছেলেটা বোধহয় বদমেজাজি। ধাক্কা খেতেই কেমন খ্যাঁক-খ্যাঁক করে বলে উঠল,
“প্রেম-পিরিতির ঠেলায় কি অন্ধ হয়ে গেছেন? রাস্তায় চোখ খুলে হাঁটতে পারেন না?”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল,
“আশ্চর্য! আমি না হয় আপনাকে খেয়াল করিনি, আপনিও কি আমাকে খেয়াল করেননি? এমনভাবে কথা বলছেন কেন?”
ছেলেটা ত্যাড়া গলায় আবারও বলে উঠল,
“নিজে অন্ধের মতো হেঁটে আবার আমাকে বলেন? রাস্তাঘাটে প্রেম করা বন্ধ করুন, চোখ এমনিতেই খুলে যাবে। যত্তসব আজাইরা পাবলিক।”
সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাত এগিয়ে এসে ছেলেটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“কে আজাইরা পাবলিক? আবার বল তো কী বললি?”
ছেলেটা-ও প্রভাতের মুখের ওপর বলল,
“কী বলেছি শুনতে পাননি?”
প্রভাত ধমকে উঠে বলল,
“নিজের ভুল স্বীকার না করে আবার মুখে-মুখে কথা বলছিস? সমস্যা কী তোর?”
ছেলেটার বুকে হাত ঠেকিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ফেলল প্রভাত। ছেলেটা তাতে আরও তেতে উঠল। রেগেমেগে বলে উঠল,
“আপনার সমস্যা কী? রাস্তায়-রাস্তায় মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়ান, আবার মাস্তানি করতে এসেছেন? আপনাকে ভয় পায় কে?”
“এই, ছোটো ছোটোর মতো কথা বল। বেয়াদবি করবি তো ঘাড়ধাক্কা দিয়ে এলাকা থেকে বের করে দিবো?”
“আপনি এলাকার কে? চেয়ারম্যান, না মেম্বার? আমিও দেখি আপনি আমার সাথে কী করতে পারেন।”

তর্কাতর্কিতে ছেলেটা কয়েকটা গালি-ও দিয়ে ফেলল। শেষে রাগ সামলাতে না পেরে প্রভাত ছেলেটাকে দু-চারটা থাপ্পড় দিয়ে বসল। মৃন্ময়ী তর্ক তো থামাতেই পারল না, মা’র দেখে সে ভয় পেয়ে দ্রুত প্রভাতকে টেনে সরিয়ে দিলো। ছেলেটা তবু থামছেই না। মা’র খেয়ে সে পা’গলা কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ শুরু করেছে। তাদের মা’র দেখে সেখানে কয়েকজন ছেলেপেলে জড়ো হয়ে গেছে। প্রভাতকে তারা চেনে বলে ছেলেটাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাঁধা দিয়ে সরিয়ে নিল। মৃন্ময়ী প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি গায়ে হাত তুলতে গেলে কেন? এতে ছেলেটা আরও খেপেছে।”
প্রভাত ত্যাড়া গলায় বলল,
“খেপুক। ওর সাহস কী করে হয় বড়োদের সাথে এমন ব্যবহার করার? এটাই ওর জন্য উপযুক্ত শাস্তি। হাঁটুর বয়সী ছেলে হয়ে উলটা-পালটা কথা বলে, কত্ত বড়ো কলিজা।”
“ওর মানসিকতা খারাপ বলে খারাপ ব্যবহার করেছে। কিন্তু ওকে এসব কথা বলার সুযোগটা কে তৈরি করে দিয়েছে প্রভাত?”
প্রভাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“তুমি কি এখন এতে-ও আমার দোষ দিবে?”
“আমি দোষ না দিলেও লোকে আমাকে নিয়ে এমন মন্তব্য-ই করে। ছেলেটা সামনে করেছে, অন্যকেউ হয়তো পেছনে এই একই কথা বলে বেড়ায়। আমি তোমাকে এই কথাটা বারবার বলেছি, কিন্তু তুমি কোনোদিন-ও আমার কথা গ্রাহ্য করনি।”
প্রভাত বলল,
“আমি তো বারবার বলেছি লোকের কথায় আমার কিছু যায় আসে না।”
“তোমার এই বেপরোয়া স্বভাবটার জন্যই আমাকে আজ হাঁটুর বয়সী ছেলের মুখে অমন কথা শুনতে হয়েছে। এ-ও কি তুমি বুঝতে পারছো না? দয়া করে আমাকে একা ছাড়ো, আমার ভালো লাগছে না।”
কথাটা বলেই মৃন্ময়ী নিজের পথে হাঁটা দিলো। প্রচণ্ড রাগে চোখমুখের ভাব পালটে গেছে তার। প্রভাত চুপসানো মুখে একপা দু’পা করে হাঁটতে-হাঁটতে বিড়বিড় করল,
“জি ম্যাডাম। যত দোষ প্রভাত ঘোষ।‌ বাকি সব সাধু সন্ন্যাসী।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৫

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৫.
ঘুমাতে যাওয়ার আগে মৃন্ময়ী প্রভাতের দেওয়া গিফট বক্স খুলল। বক্সের ভেতর পেল দুমুঠো কাঁচের চুড়ি আর অনেকগুলো চিরকুট। গুনে দেখল সর্বমোট ছাব্বিশটি চিরকুট। মৃন্ময়ীর ছাব্বিশ তম জন্মদিন উপলক্ষে ছাব্বিশটি চিরকুট। মৃন্ময়ী পড়ে দেখল সবকটা চিরকুটে একবার হলেও ‘ভালোবাসি’ শব্দটা উল্লেখ আছে। এই শব্দ বাদ রেখে প্রভাত একটা চিরকুট-ও লেখেনি। মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে প্রত্যেকটা চিরকুট-ই প্রভাত খুব যত্ন সহকারে লিখেছে। কারণ একটা চিরকুটে-ও কোনো কা’টাছেঁড়া নেই, ভুল বানান নেই, আঁকাবাঁকা অক্ষর নেই। হাতের লেখা-ও গোছানো। সবমিলিয়ে প্রত্যেকটা চিরকুট-ই সুন্দর। কিন্তু চিরকুটগুলো পড়তে-পড়তে খুশি হওয়ার বদলে মৃন্ময়ীর আরও মন খারাপ হলো। নিজের পালিয়ে চলা মনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। একবার মনে হলো প্রভাতের প্রতি সে একটু বেশিই কঠিন হয়ে গেছে, আবার মনে হলো এছাড়া তার আর উপায় নেই। চিরকুটে প্রভাত অনেক কথা লিখেছে। মৃন্ময়ীকে নিয়ে তার প্রথমদিকের অনুভূতি থেকে শুরু করে বর্তমান অনুভূতি নিয়েও লিখেছে। বুঝাই যাচ্ছে তার অনুভূতির গভীরতা মৃন্ময়ীর ভাবনার বাইরে। একরাশ হতাশা নিয়ে মৃন্ময়ী চুড়ি আর চিরকুটগুলো আলমারিতে তুলে রাখল। ফোনের ডাটা অন করার সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাতের ম্যাসেজের নোটিফিকেশন এল। প্রভাত জানতে চেয়েছে উপহার পছন্দ হয়েছে কি না। মৃন্ময়ী সেই ম্যাসেজের উত্তর ভেবে পেল না। ফেসবুকে ঢুকতেই প্রভাতের পোস্ট সামনে পড়ল। প্রভাতের দুই লাইনের ইংরেজী স্ট্যাটাস।
‘No one can fix me except you.’

প্রভাতের বন্ধুরা সেই পোস্টের কমেন্ট বক্সে খোঁচা মে’রে অনেক কথা বলেছে, মজা করেছে। একজন তো সোজাসাপ্টা বলেই দিয়েছে, ‘ম্যাডাম তোমাকে চোখে দেখে না মামা। অতিদ্রুত ফুল পাওয়ারের চশমা কিনে দাও, নয়তো আজীবন পেছনে ঘুরেই ম’রতে হবে।’ মৃন্ময়ী কয়েক মিনিট সেই স্ট্যাটাসের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আবারও এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এসে ফোন রেখে দিলো। প্রভাতের ম্যাসেজের উত্তরটা-ও দেওয়া হলো না। কীইবা উত্তর দিবে সে? সে জানে ঠিক কোন উত্তরে প্রভাত খুশি হবে। কিন্তু প্রভাতকে সন্তুষ্ট করার মতো উত্তর দিতে তার যে অনেক দ্বিধা।

পরদিনই প্রভাত তাকে সর্বপ্রথম যেই প্রশ্নটি করল তা হচ্ছে ‘উপহার পছন্দ হয়েছে? জিজ্ঞেস করলাম, উত্তর দিলে না কেন?’
“ম্যাসেজ দেখিনি,” মিথ্যা বলল মৃন্ময়ী।
“ও। তাহলে এখন বলো পছন্দ হয়েছে কি না।”
মৃন্ময়ী ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে উত্তরে বলল,
“সুন্দর চুড়ি।”
“আর চিরকুটগুলো?”
“এত মনোযোগ দিয়ে কোনোদিন পরীক্ষার খাতায় লিখেছিলে?”
“এমনটা বলছো কেন?”
“তোমার চিরকুট দেখে মনে হলো এমন মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার খাতায় লিখলে ভালো রেজাল্ট পেতে পারতে।”
প্রভাত হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভান করে বলল,
“ধ্যাত! আমি যতটা মনোযোগী প্রেমিক, ততটাই অমনোযোগী ছাত্র। অমনোযোগী ছাত্র কী করে পরীক্ষার খাতায় মনোযোগ দিয়ে লিখবে? তোমার প্রেমে পড়েছি বলেই মনোযোগ দিয়ে তোমাকে চিরকুট লিখেছি। তোমার মতো করে পড়াশোনার প্রেমে পড়িনি বলেই মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার খাতায় লেখা হয়ে ওঠেনি।”
“কাজের বেলায় মনোযোগ থাকে না, মনোযোগ থাকে যত অকাজের বেলায়।”
“তা অবশ্য ভুল বলনি। তবু তোমার প্রতি যখন মনোযোগ আছেই, তখন আশার আলো-ও তো একটু থাকতেই পারে। তাই না? মনোযোগী হলে যেহেতু ভালো রেজাল্ট পাওয়া যায়। দেখি, আমিও কবে ভালো রেজাল্ট পাই।”
“ভালো রেজাল্ট কাজে আসে, অকাজে না।”
“আমার ভালোবাসাকে তুমি অকাজ বলছো?”
“অযথা সময় নষ্ট করাকে অকাজ বলব না তো কী বলব?”
প্রভাত অভিমানী সুরে বলল,
“ভালোবাসা গ্রহণ যখন করছো না, তখন আমার ভালোবাসাকে একটু সম্মান কিন্তু দেখানো উচিত তোমার। এত ধৈর্য নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি, দিন-দিন তোমাকে এত-এত ভালোবেসে ফেলছি, এসব মোটেও অকাজ হতে পারে না।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। তুমি খুবই কাজের কাজ করছো। তোমার সাথে তর্ক করে লাভ নেই আমার।”
প্রভাত প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“মৃত্তিকার ব্যাপারটা নিয়েই এতদিন তুমি খুব চিন্তিত ছিলে, তাই না?”
মৃন্ময়ী বলল,
“মনে তো হচ্ছে খবর নেওয়া হয়ে গেছে। তবু জিজ্ঞেস করছো কেন?”
“এমনি। দিন-দিন তোমার ওপর চাপ বাড়ছেই। জানি তোমার কষ্ট হয়। তবু আফসোস ছাড়া আমার কিছু করার থাকে না। তুমি আমাকে সেই সুযোগটাই দাও না,” কিছুটা মনমরা হয়ে বলল প্রভাত।
“তোমাকে সুযোগ দিলে আমার কষ্ট কমে যাবে, না তোমার আফসোস কমে যাবে? কোনটা?”
“হয়তো দুটোই। তুমি আমাকে সুযোগ দিলে সর্বপ্রথম আমি তোমার মাথার সমস্ত চাপ ভাগ করে নিব, তোমার মনের সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে দিবো, আমি হব তোমার সমর্থন, তোমার ভরসার জায়গা। যেকোনো মূল্যে আমি তোমাকে সুখী জীবন দিবোই মৃন্ময়ী। তোমার কাছে আমার এসব কথা আবেগ মনে হলেও, আমার কাছে এসব আমার নিজের কাছে করা প্রতিজ্ঞা। একবার তুমি আমাকে গ্রহণ করে দেখো, এ সব প্রতিজ্ঞা আমি রক্ষা করে দেখাব। আমি কাগজে-কলমে লিখে দিতে পারি, আমি প্রভাত তরফদার নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার পাশে থাকব এবং একমাত্র তোমাকেই ভালোবাসব।”

“খুব গরম লাগছে। শরবত খাবে?” বলেই মৃন্ময়ী জোরে হাঁটা দিলো।
প্রভাত বুঝল মৃন্ময়ী আবারও এড়িয়ে যাচ্ছে। মনে-মনে সে হাসল। মৃন্ময়ীর পেছনে ছুটে বলল,
“ম্যাডাম নিজে খাওয়াতে চাইলে আমি কিন্তু দুই গ্লাস খাব। রোদ মাথায় নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
মৃন্ময়ী বলে বসল,
“তিন গ্লাস খেয়ো তুমি।”
মৃন্ময়ী কথার কথা বললেও প্রভাত যে সত্যি-সত্যি পরপর তিন গ্লাস শরবত খেয়ে ফেলবে, ভাবেনি সে। প্রভাতের কথা এড়াতে সে শরবত খাওয়ার অযুহাত দেখিয়েছে। একা হলে সে শরবতের দোকানের আশপাশেও ঘেঁষত না। বাড়ি ফিরলেই মা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা শরবত বানিয়ে দেয়। খেলেই ক্লান্ত মনে তৃপ্তি আসে। এক গ্লাস শরবত কিনে টাকা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। তবু মৃন্ময়ী আজ এক গ্লাস শরবত খেল। স্বাদ ভালোই। সব মিলিয়ে চার গ্লাস শরবতের বিল তার জলে যাবে, এই ভেবে মনে-মনে নিজেকে বকল। শেষমেশ অবশ্য প্রভাত নিজেই তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সে টাকা বের করলেও প্রভাত কিছুতেই তাকে বিল দিতে দেয়নি। নিজেই দিয়ে দিয়েছে। ছেলের বুদ্ধি আছে।


মৃত্তিকার থেকে টাকা নিয়ে দরজির দোকান থেকে আজ জামা নিয়ে এসেছে মৃদুলা। বাড়ি ফিরে সে ভয়ে-ভয়ে মৃন্ময়ীকে ডাকল। মায়ের সামনে ব্যাগ থেকে জামা বের করে মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে বলল,
“জামা নিয়ে এসেছি।”
মৃন্ময়ী জামা নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে বলল,
“সুন্দর হয়েছে। এই রংয়ে তোকে মানাবে। সবারটাই এই রংয়ের?”
“হ্যাঁ।”
সাজেদা বেগম ঘটনা বুঝতে না পেরে এগিয়ে এসে শুধালেন,
“জামা কার?”
মৃদুলার আগে মৃন্ময়ী উত্তর দিলো,
“মৃদুলার।”
সাজেদা বেগম সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পারলেন কদিন আগে এই জামা কেনার কথাই বলেছিল তার মেয়ে। তিনি ভ্রুকুটি করে পুনরায় মৃদুলাকে বললেন,
“এই জামা তুই শেষমেশ কিনছিসই?”
মৃন্ময়ী বলল,
“থাক না মা। মেয়েরা সবাই একরকম জামা পরবে, ও পরতে না পারলে তো ওর খারাপ লাগবেই। তাছাড়া পরীক্ষার পর কে কোথায় ভর্তি হয় তার তো ঠিক নেই। একসঙ্গে একটু ভালো সময় কা’টাক ওরা।”
সাজেদা বেগম জানতে চাইলেন,
“কত টাকা লেগেছে?”
মৃদুলা মিনমিনে গলায় বলল,
“জামা বারোশো টাকা, বানাতে লেগেছে দুইশো টাকা।”
সাজেদা বেগম চোখ বড়ো করে বললেন,
“চৌদ্দশো টাকা খরচ করে ফেলেছিস এই জামার পেছনে! আর তুই যে গায়েই মাখছিস না। তুই কি তোর বোনদের জন্য টাকার গাছ লাগিয়েছিস?”
মায়ের কথা শুনে মৃন্ময়ী বলল,
“জামা বানাতে আমি টাকা দিইনি। ও আমার কাছে টাকা চায়নি।”
“তাহলে টাকা কোথায় পেল?”
“মৃত্তিকা দিয়েছে।”
মৃত্তিকার কথা শুনেই সাজেদা বেগমের কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি সন্দিহান কন্ঠে শুধালেন,
“মৃত্তিকা টাকা পেল কোথায়?”
“ওর কাছে ছিল, সেখান থেকেই দিয়েছিল।”
“ওর জামাইয়ের টাকা?”
“হবে হয়তো। ও আর টাকা কোথায় পাবে?”
এক মুহুর্তে সাজেদা বেগমের মুখোভাব পালটে গেল। রাগত মুখে তিনি মৃদুলাকে বললেন,
“তুই আমাকে জিজ্ঞেস না করে ওর থেকে টাকা চেয়েছিস কোন সাহসে?”
মৃদুলা নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
“আমি চাইনি, আপু নিজেই দিয়েছে।”
সাজেদা বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন,
“আপু চাইলেই তুই নিয়ে নিবি? তোর আপুর দুই টাকা রোজগার আছে? আজীবন আরেকজনের কলিজা ঠুকরে খাওয়া ওর স্বভাব। এই পর্যন্ত ওর ওই ছ্যাঁচড়া জামাইয়ের এক পয়সা আমরা খেয়েছি? তুই দেখিসনি, ওর জামাইয়ের টাকায় একটা ফল নিয়ে এলেও আমি তা ফেরত পাঠিয়েছি? দেখেছিস কি না? তুই কোন সাহসে ওর জামাইয়ের টাকায় জামা কিনলি? মৃন্ময়ী তোকে কোন জিনিসটা না দেয়? তুই মুখ ফুটে কিছু চাইলে কষ্ট হলেও ও কিনে এনে দেয়। কী-রে? দেয় না? একবার চাইতে বারণ করেছি বলেই তুই গিয়ে ওর কাছে হাত পাতলি? এই, তোর লাজ-শরম নেই? তোকে আমি এসবই শিখিয়েছি?”
মৃন্ময়ী বলল,
“মা, তুমি ওকে বকছো কেন? মৃত্তিকা যেচে দিয়েছে বলেই তো ও নিয়েছে। নইলে কি ও নিজে চাইতে যাওয়ার মতো মেয়ে? আমি জানলে তো আমি নিজেই ব্যবস্থা করে দিতাম।”
“ওকে যেচে দিলেই ও নিবে কেন? ওই ছ্যাঁচড়া ছেলের টাকা ও খরচ করল কোন সাহসে? আমার মান-সম্মান সব খেয়েছে, ওই ছেলের টাকা তো আমাকে হাতে ধরিয়ে দিলেও আমি নিতাম না। এই জামার জন্য ও আমার অবাধ্য হয়েছে না? মৃন্ময়ী তোকে আমি বলে দিচ্ছি, এখন থেকে ওর জামাকাপড়ের পেছনে তুই একটা টাকাও খরচ করতে পারবি না। আমিও দেখব ও কদিন ওর দুলাভাইয়ের টাকায় চলতে পারে। আমার সাথে চালাকি? ওকে আমি বুদ্ধিমতী ভাবতাম। আরেক গাধা ফিরে এসে ওর মাথার মধ্যেও গোবর ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমার সংসারে শান্তি আর দিবে না এরা।”
মায়ের চেঁচামেচি শুনে মৃত্তিকা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মায়ের এসব কথা শুনে আর সামনে এগোয়নি। মৃদুলাকে দেখল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার নতুন জামাটা মা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। মৃন্ময়ী সেটা তুলে মৃদুলার হাতে দিলো। মৃত্তিকা এগিয়ে এসে বলল,
“মৃদুলাকে কিছু বোলো না মা। ওর কোনো দোষ নেই। আমি নিজেই ওকে জোর করে টাকা দিয়েছি। তুমি শুনলে রাগ করবে বলেই ও তখন নিতে চায়নি। তোমার কিছু বলার থাকলে আমাকে বলো, ওকে ছাড়ো। দুদিন পর ওদের অনুষ্ঠান। এখন আবার জামা নিয়ে বকলে ওর মন ভেঙে যাবে।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“তোমাকে আর আমি কী বলব মা? তোমার সঙ্গে আর কলাগাছের সঙ্গে কথা বলার মাঝে তো কোনো তফাৎ নেই। তুমি এই সংসারে উপকারী কাজ না করতে জানলেও, বেছে-বেছে অপকারী কাজগুলো খুব ভালো করেই করতে জানো।”
“টাকাটা মৃদুলার দরকার ছিল, তাই দিয়েছিলাম।”
“টাকার দরকার ছিল, তোর জামাইয়ের টাকার তো দরকার ছিল না। যেদিন নিজের উপার্জন করার যোগ্যতা হবে, সেদিন এই সংসারে টাকা খরচ করিস।”
“সরি,” মিনমিনে গলায় কথাটা বলেই মৃত্তিকা মাথানিচু করে চলে গেল।
তবু যখন সাজেদা বেগমের রাগ কমছিল না, তখন মৃন্ময়ী জোর করে তাকে ঘরে নিয়ে গেল। একা বসে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করল। মৃদুলা জামা হাতে ঘরে গিয়ে দেখল মৃত্তিকা নিঃশব্দে কাঁদছে। মৃদুলাকে দেখে সে চোখের পানি মুছে ভেজা গলায় বলল,
“খারাপ মানুষদের করা ভালো কাজ-ও খারাপ হয়ে যায়, তাই না রে?”
মৃদুলা উত্তর দিলো না। চুপচাপ গিয়ে নতুন জামাটা আলমারিতে তুলে রাখল।

সেদিন রাতে মৃন্ময়ী ঘুমাতে যাওয়ার আগে মৃত্তিকা তার ঘরে এল। মৃন্ময়ী তাকে ডেকে বিছানায় বসাল। মৃত্তিকা নিজেই আগে কথা তুলল,
“এখনই ঘুমাবি?”
“হ্যাঁ। তুই কিছু বলবি?”
“তাহলে কাল বলব নে। তুই ঘুমা।”
“সমস্যা নেই, বল। তোর কি মন খারাপ?” মৃত্তিকার মুখোভাব লক্ষ্য করে শুধাল মৃন্ময়ী।
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“না। হঠাৎ করে মনে হলো তোকে একটা কথা বলে দেখি।”
“বল না।”
মৃত্তিকা একটু আমতা-আমতা করে বলল,
“আপা, তুই কি আমাকে একটা কাজ ঠিক করে দিতে পারবি?”
মৃন্ময়ীর মুখ দেখে মনে হলো সে অবাক হয়েছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফের শুধাল,
“কাজ? তুই কাজ করবি?”
“করতে তো চাইছি। কিন্তু আমি তো অনার্স শেষ করিনি। এইচএসসির সার্টিফিকেটে কোনো কাজ পেলে করব।”
“তুই কি সিরিয়াস?”
মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“হুম। কতকাল আর তোকে জ্বালাব? বিয়ের আগেও জ্বালিয়েছি, বিয়ের পর এসে-ও জ্বালাচ্ছি। আমার ওপর মায়ের রাগটা অস্বাভাবিক না, বুঝি আমি।”
“তুই কি মায়ের কথায় অভিমান করেছিস?”
“না রে। ওসব কথা আমার প্রাপ্য। অভিমান করব কোন সাহসে? ভাবলাম এখন তো বাড়িতেই বসে আছি, তারচেয়ে কোনো কাজ-টাজ করতে পারলে তো ভালো হয়। সময়-ও কে’টে যাবে, হাতখরচটা-ও পাওয়া যাবে।”
“কী কাজ করতে চাস তুই?”
“আমি তো এ বিষয়ে জানি না। সম্ভব হলে তুই একটু দেখ না কোথাও কোনো কাজ যদি পাস। তুই যা ঠিক করে দিবি তা-ই করব। আমার তো কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। তবু চেষ্টা করে দেখতে পারি। তুই কি পারবি খোঁজ নিতে? ভেবেছিলাম আমার বন্ধুদের বলব, পরে আবার ভাবলাম যাকে বলব সে-ই তো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবে।”
মৃন্ময়ী একটু ভেবে বলল,
“থাক, কাউকে বলার দরকার নেই। তুই যখন নিজে থেকে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিস, আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। পরিচিত যারা আছে, তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে হয়তো পাওয়া যাবে।”
“আচ্ছা, না পেলে-ও জানাস আমাকে।”
“পাওয়া যাবে, চিন্তা করিস না,” আশ্বস্ত করে বলল মৃন্ময়ী।
মৃত্তিকা কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারল না। মনে যে শত বাঁধা তার। মৃন্ময়ী তার মুখ দেখে প্রশ্ন করল,
“আর কিছু বলবি?”
মৃত্তিকা প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“না। আমি চলে যাচ্ছি, তুই ঘুমিয়ে পড়।”
“আচ্ছা যা। আমি দেখব ব্যাপারটা।”

মৃত্তিকা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মৃন্ময়ী দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে বিছানায় চলে গেল। আজ আবার প্রভাত ম্যাসেজ করেছে,
“আপনাদের কোচিংয়ে ভর্তি হতে খরচ কত ম্যাডাম? আমার মতো ছাত্র কি গ্রহণযোগ্য?”
উত্তরে মৃন্ময়ী লিখল,
“কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কি না জানি না। তবে তোমার মতো গোরু মার্কা ঢেউটিন ছাত্র আমার ক্লাসে গ্রহণযোগ্য নয়।”
সঙ্গে-সঙ্গে তার ম্যাসেজে প্রভাত স্যাড রিয়্যাক্ট দিয়ে লিখল,
“মুখের ওপর অপমান করে দিলে? ঠিক আছে, আমি তোমাদের কোচিংয়ে-ই ভর্তি হব। তারপর দেখব তুমি কীভাবে আমাকে ক্লাসে না নাও।”
মৃন্ময়ী আর উত্তর দিবে না ভেবেও আবার কী মনে করে প্রশ্ন করল,
“তুমি না মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়েছিলে?”
“একবার দিয়েছিলাম, তা-ও কলেজ থেকে স্যার ফোন করে খবর দিয়েছিল বলে। পরীক্ষায় বসে দেখি কোনো প্রশ্নই আমার পরিচিত না।”
“তুমি কি পড়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলে?”
“আরে নাহ্! পড়ব কখন? পরীক্ষা দিতে ডেকেছিল, তাই গিয়েছিলাম।”
“না পড়ে পরীক্ষা দিতে গেলে প্রশ্ন পরিচিত লাগবে কীভাবে? তারপর আর কোনো পরীক্ষা দাওনি?”
“নাহ্।”
“সেকি! তাহলে ভর্তি হয়েছিলে কেন?”
“আমার বাপের ঠেলাঠেলিতে আর আমার আবেগে ভর্তি হয়েছিলাম। একবার পরীক্ষায় বসার পর যখন বুঝলাম আমার পড়ার বয়স শেষ হয়ে গেছে, তখন থেকে ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি।”
“কী আশ্চর্য! তোমার পড়ার বয়স শেষ হয়েছে কে বলল তোমাকে?”
“এটা আবার কারো বলা লাগে? আমিই বুঝে গেছি। এখন হচ্ছে আমার বিয়ে-টিয়ে করে সংসার করার বয়স, বউ-বাচ্চা নিয়ে জীবন সাজানোর বয়স। বউয়ের মন পড়ার বয়সে কিসের বই পড়ে পরীক্ষায় বসব? আমি শুধু তোমার সম্মতির অপেক্ষায় আছি। তুমি সম্মতি জানালেই আমি বিয়ে করে জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষায় বসে পড়ব।”
এই ম্যাসেজ পড়ে মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। পরমুহূর্তে খেয়াল হতেই আবার মুখে গাম্ভীর্যতা টেনে লিখল,
“তোমার মতো এমন আজাইরা চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বসে থাকি না আমি।”
প্রভাত উত্তর দিলো,
“আহা! আমি জানি তো তুমি ভালো মেয়ে। আমি তো আর তোমার মতো ভালো ছেলে নই। আমি হচ্ছি ভালো প্রেমিক। তাই তুমি পড়ার পেছনে ছুটছো, আর আমি তোমার পেছনে। আচ্ছা, এভাবে ছুটতে-ছুটতে একদিন তুমি তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গে যদি আমিও আমার লক্ষ্য পৌঁছে যাই, ব্যাপারটা দারুণ হবে না? আই উইশ খুব শীঘ্রই এমন দিন আসুক। তুমি তোমার স্বপ্ন জয় করো, আর আমি তোমাকে।”

মৃন্ময়ী আজও এই ম্যাসেজের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রত্যুত্তর না করেই ফোন রেখে দিলো। স্বপ্ন জয়? সে তো অনেক কঠিন। মৃন্ময়ী নিজেও জানে না সে স্বপ্ন জয় করতে পারবে কি না। শেষমেশ তার এত চেষ্টা, এত কষ্ট সার্থক হবে কি না। তবু সে ছুটছে। প্রভাতের ধারণা তার মতো সে-ও স্বপ্ন জয় করতে ছুটছে। অবশ্য তার স্বপ্ন কেবলই মৃন্ময়ী। তুলনা করলে মৃন্ময়ীর লক্ষ্যে পৌঁছানো যেমন অনিশ্চিত, প্রভাতের-ও তাই। অথচ সে চাইলেই পেতে পারে সুনিশ্চিত সুখী জীবন। ছেলেটা সত্যি বেপরোয়া। তার ভাবনার চেয়েও বেশি বেপরোয়া।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৪

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৪.
মৃদুলা প্রাইভেটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মুখোভাবে স্পষ্ট যে জামা কিনতে না পারার বিষয়টি নিয়ে তার এখনও মন খারাপ। অনেকক্ষণ ধরে মৃত্তিকা তাকে কিছু বলার জন্য কাঁচুমাচু করছে। কিন্তু বলা-ই হচ্ছে না। মৃদুলা যখন হিজাব পরছিল, তখন মৃত্তিকা তাকে প্রশ্ন করে ফেলল,
“আপাকে টাকার কথা বলেছিলি?”
মৃদুলা থমথমে গলায় উত্তর দিলো,
“বলব না।”
“জিজ্ঞেস করে দেখতে পারতি না?”
“এই মাসে আপা অনেক খরচ করে ফেলেছে। এখন আমি টাকা নিলে তার নিজের হাত খরচের টাকা-ও হয়তো থাকবে না। তোমার মতো আপার গলায় ছু’রি ধরে টাকা আদায় করার স্বভাব আমার নেই। লাগবে না আমার জামা।”
মৃত্তিকা মন খারাপ করল না। পুনরায় শুধাল,
“তাহলে কী করবি? অন্য জামা পরেই যাবি?”
“তা-ও জানি না।”
“জামা কি তোরা পছন্দ করে রেখেছিস?”
“হুম।”
“দাম কত?”
“বারোশো টাকা।”
“কিনে আবার বানাতে দিতে হবে না?”
“কিনবই না, আবার বানাতে দিবো।”

মৃত্তিকা আর কথা বাড়াল না। আলমারি খুলে তার ব্যাগ থেকে বারোশো টাকা বের করে নিয়ে এল। মৃদুলার হিজাব পরা শেষ হতেই সে হঠাৎ বোনের হাতটা ধরে মুঠোয় টাকাটা গুঁজে দিলো। প্রথমে মৃদুলা চমকে উঠল। তারপর মুঠো খুলে টাকা দেখে সে অবাক চোখে তাকাল। প্রশ্ন করার আগেই মৃত্তিকা বলল,
“টাকাটা নে বোন। জামা নিয়ে আসিস।”
মৃদুলা প্রশ্ন করল,
“তুমি টাকা পেলে কোথায়?”
“আমার জমানো টাকা ছিল। এখন তো আমার লাগছে না, তুই নিয়ে কাজে লাগা।”
“তোমার জামাইয়ের টাকা না? আমি এই টাকা নিতে পারব না। পরে মা আমাকে যা-তা বলবে।”
মৃদুলা অসহায় মুখে বলল,
“এমন করিস না রে মৃদুলা। আমি জানি এখন তোর কেমন লাগছে। এমন অনেক অনুষ্ঠানে আমিও আপার থেকে টাকা নিয়েছিলাম। আপার কাছে টাকা আছে, না কি নেই, তা-ও আমি ভাবতাম না। আর তুই তো আমার চেয়ে কত বুদ্ধিমতী। তোর মতো সুন্দর মন আমার নেই। কিন্তু এটুকু বুঝার ক্ষমতা আছে যে, তোর সুন্দর মনটা হাসিমুখে কষ্ট গিলে নেয়। আমি কোনোদিনও নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবিনি। তোর প্রয়োজন নিয়েও মাথা ঘামাইনি। আজকাল তোকে দেখলে আমার নিজের প্রতি ধিক্কার আসে, জানিস? তুই এই টাকাটা নিলে আমি খুব খুশি হব। প্লিজ নে।”
মৃদুলা তবু আপত্তি জানিয়ে বলল,
“না-না আপা। এই টাকার জন্য না পরে আমাকে মায়ের কত বকা শুনতে হয়। তুমি বলেছ, এতেই আমি খুশি হয়েছি। তোমার টাকা তুমিই রেখে দাও, দরকার পড়লে খরচ করতে পারবে।”
“নে না রে। তুই তো আমার কাছে টাকা চাসনি। আমি নিজেই তোকে দিচ্ছি। মা কিছু বললে বলিস তুই নিতে চাসনি, আমিই তোকে জোর করে দিয়েছি। দরকার পড়লে আমিও মাকে বুঝিয়ে বলব। জামা কিনে ফেললে তো আর মা সেটা ফেরত দিতে পারবে না। তুই নিয়ে যা, আমার টাকা লাগবে না।”
মৃত্তিকা তারপরও একটু দোনামনা করল। মনে-মনে তার ভয় লাগছে। মা যদি বকাঝকা করে? আবার মৃত্তিকা এত করে বলার পর আর সে তাকে টাকা ফিরিয়ে-ও দিতে পারল না। শেষমেশ তাকে টাকা নিতেই হলো। ভাবল জামা কিনে আগেভাগেই মাকে জানাবে না। আগে বড়ো আপাকে জানিয়ে তারপর মাকে জানাবে। মৃত্তিকা আবার তাকে এ-ও বলে দিয়েছে যে, জামা এনে বাড়িতে না এনে যেন দরজির কাছে দিয়ে আসে। জামা বানানোর মজুরিটা-ও মৃত্তিকা দিয়ে দিবে। মৃদুলার বিস্ময় যেন কমতেই চাইছে না। এই কি তার ছোটো আপা, আজীবন যার নিজের স্বার্থ ছাড়া পরিবারের কাউকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না? যে আজীবন শুধু নিতেই জানত, সে দিতে শিখল কবে?


একহাতে কেক বক্স, আরেকহাতে গিফট বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাত। মৃন্ময়ীর আজ দেরী হচ্ছে কেন? তার হাত দুটো তো ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত হিসেবে আবার মশার কামড়-ও সহ্য করতে হচ্ছে। কামড়ে-কামড়ে পা দুটো শেষ করে দিলো। ইচ্ছে করছে মশার গলা চেপে ধরে কানের নিচে কয়েকটা চটকানা লাগিয়ে দিতে। অবশেষে যখন মৃন্ময়ীর দেখা মিলল, তখন প্রভাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে বলল,
“আজ তুমি এত দেরী করলে যে? এদিকে তোমার অনুপস্থিতিতে মশারা আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিল।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তোমার মশারা তোমার মতোই ঘাড়ত্যাড়া।”
“কী যে বলো! মশারা কেন আমার হতে যাবে? তুমি ছাড়া কেউ আমার না।”
“তোমার হাতে এসব কী?”
“ওহ্! এসব তোমার জন্য। শুভ জন্মদিন মৃন্ময়ী।”

প্রভাত হাসিমুখে কেক বক্সটা বাড়িয়ে ধরল। মৃন্ময়ী চরম অবাক হলো। আজ যে তার জন্মদিন তা হয়তো সে ছাড়া অন্য কারোরই মনে নেই। মনে থাকার কথাও না। আগে ফেসবুকে জন্মদিনের নোটিফিকেশন পেলে অনেকে পোস্টের মাধ্যমে তাকে শুভেচ্ছা জানাত। দুবছর ধরে মৃন্ময়ী জন্মতারিখ অনলি মি করে রেখেছে। কেন জানি তার এসব খুব একটা ভালো লাগে না। মায়ের তো কোনোকালেই কারোর জন্মতারিখ মনে থাকে না। মৃত্তিকা ফেসবুকে নোটিফিকেশন বন্ধ হওয়ার পর আর শুভেচ্ছা জানায়নি। মৃদুলার যেবার মনে থাকে, সেবার সে নিজের হাতে কার্ড বানিয়ে বোনকে শুভেচ্ছা জানায়। আর যেবার মনে না থাকে, পরবর্তীতে মনে পড়লে খুব আফসোস করে। প্রভাত-ই একমাত্র মানুষ যে দুবার ধরেই তার জন্মদিনে কেক, গিফটসহ শুভেচ্ছা জানাতে হাজির হয়। গত বছর সে প্রভাতের আনা উপহার গ্রহণ করেনি, কেক-ও ফিরিয়ে দিয়েছিল। তখন সে প্রভাতের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত ছিল। এবার আবার প্রভাত একই কাজ করল। মৃন্ময়ী বলল,
“ধন্যবাদ। কিন্তু তোমার এসব আনা উচিত হয়নি। গতবার তোমায় বারণ করেছিলাম তো, ভুলে গেছো?”
“তোমার ওসব বারণ প্রভাত তরফদার ভদ্র ছেলের মতো মেনে নিবে, এটা ভাবা-ও তোমার উচিত হয়নি। বেপরোয়া ছেলেরা এত বাধ্য হয় না। কিন্তু তুমি দয়া করে এবারেও অবাধ্যতা কোরো না। গতবার কেক নিয়ে বন্ধুদের দান করে দিয়েছিলাম, এবারে কিন্তু তা-ও করব না। আমি অত ভদ্র না।”
মৃন্ময়ী ঠিকঠাক উত্তর খুঁজে পেল না। চ-সূচক আওয়াজ করে বলল,
“কী মুশকিল! বুড়ো বয়সে তুমি এমন বাচ্চামি কেন করো?”
“কী মুশকিল! কারণটা বলতে-বলতে তো ‘ভালোবাসি’ শব্দটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার মনেই থাকছে না। এটা-ও কি আমার দোষ?”
“তুমি সত্যিই একটা অসম্ভব মানুষ। তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করাই আমার উচিত হয়নি।”
“করেই যখন ফেলেছ, এখন আরেকটু ভালো ব্যবহার করে কেকটা গ্রহণ করে আমায় ধন্য করো ম্যাডাম।”
“আমার এখন কেক খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খেয়ে ফেলো।”
“তা বললে তো হবে না ম্যাডাম। এক চিমটি হলেও খেতে হবে। নয়তো আজ আমি এই কেক নিয়ে তোমার বাসায় গিয়ে উঠব।”
মৃন্ময়ী হতাশ চোখে চাইল। এই ছেলেকে একদম বিশ্বাস নেই? সত্যি-সত্যি বাসায় গিয়ে উঠতে-ও এর কোনো দ্বিধা হবে না। দিশা না পেয়ে সে মনকে সান্ত্বনা দিলো, ‘কেকই তো! একটু খেলেই তো আর প্রেম হয়ে যাবে না।’ তারপর বলল,
“ঠিক আছে, দাও। কিন্তু আমি এক কামড়ের বেশি খেতে পারব না।”
প্রভাত দারুণ খুশিতে চমৎকার হাসিতে বলল,
“তোমার এক কামড়েই আমার কেক স্বার্থক। চলো কোথাও বসি।”

তারা একটা বন্ধ দোকানের সামনের টুলে বসল। প্রভাত বক্স খুলে প্লাস্টিকের ছু’রিটা মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে বলল,
“কাটো।”
নিজের সামনে প্রভাতকে এত খুশি মৃন্ময়ী এই প্রথম দেখল। কী উৎসুক চোখে সে মৃন্ময়ীর কেক কা’টার অপেক্ষা করছে! মৃন্ময়ী কেক কা’টল। সঙ্গে-সঙ্গে প্রভাত কেকের কা’টা টুকরোটা হাতে তুলে নিয়ে মৃন্ময়ীর মুখের কাছে ধরল। মৃন্ময়ী ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বুঝতে পেরে প্রভাত হাসিমুখে বলল,
“খাও না, আমি খুব খুশি হব। জাস্ট ওয়ান বাইট, প্লিজ।”
অস্বস্তি পেরিয়ে মৃন্ময়ী প্রভাতের হাত থেকে এক কামড় কেক খেল। বাকি কেকটুকু প্রভাত নিসঙ্কোচে নিজের মুখে পুরে নিল। বিষয়টা মৃন্ময়ী ঠিকঠাক খেয়াল না করার ভান করল। খেয়াল করলেই যত অস্বস্তি। প্রভাত আরেক টুকরো কেক বাড়িয়ে ধরে বলল,
“আরেকটু খাও না। কেকটা খুব মজা। এমনিতেও তো কে’টে ফেলেছো।”
মৃন্ময়ী ওই কেকটুকু-ও খেল। তারপর বলল,
“আমি এখন উঠছি।”
“আরেকটু খাও না।”
“আর পারব না।”
“তাহলে আরেকটু সময় বসো।”
প্রভাত পকেট থেকে টিস্যু প্যাকেট বের করে মৃন্ময়ীকে একটা টিস্যু দিলো। তারপর নিজের হাত মুছে নিয়ে পাশ থেকে গিফট বক্সটা তুলে বাড়িয়ে ধরল। মৃন্ময়ী এবার দ্বিধাভরা কন্ঠে বলল,
“কেক পর্যন্ত ঠিক আছে প্রভাত। আমি তোমাকে একেবারেই ফিরিয়ে দিইনি। কিন্তু উপহার আমি গ্রহণ করতে পারব না, সরি।”
“আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। ঠিক এই কারণেই আমি খুব মূল্যবান কিছু কিনিনি, বিশ্বাস করো। আমি পারতাম তোমার জন্য মূল্যবান উপহার কিনতে, তবু কিনিনি শুধুমাত্র তুমি গ্রহণ করবে না বলে। তুমি এই প্যাকেট খুলে দেখলেই বুঝতে পারবে, আমি একদমই মিথ্যা বলছি না। এর ভেতরে খুবই সামান্য উপহার আছে। তুমি এটা গ্রহণ করলে এই সামান্য উপহারটাই আমার কাছে অসামান্য মনে হবে।”
“প্রভাত, আমাকে জোর কোরো না প্লিজ।”
“জোর করছি না। তোমাকে কোনো কিছুতে জোর করার সাহস আমার নেই। আমি চাই আমার এই সামান্য উপহারটা তুমি গ্রহণ করো। প্রেমিক হিসেবে না হোক, অন্তত একজন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো। তুমি ফিরিয়ে দিলে এই উপহার অন্য কাউকে দেওয়া সম্ভব না, ফিরিয়ে দেওয়া-ও সম্ভব না। প্লিজ মৃন্ময়ী, সামান্য উপহারই তো। খোলার পর যদি তোমার মনে হয় আমি বিশাল কিছু কিনে ফেলেছি, তাহলে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো। আমি কিছুই মনে করব না।”
মৃন্ময়ী আবারও হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল। আজ কী যে হচ্ছে তার সাথে! আগের মতো প্রভাতের ওপর প্রচণ্ডভাবে বিরক্ত-ও সে হতে পারছে না। ছেলেটা এমনভাবে অনুনয়-বিনয় করে যে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। তবু তো সে শক্ত থাকার যথেষ্ট চেষ্টা করে। শেষমেশ উপহারটা-ও মৃন্ময়ীকে গ্রহণ করতে হলো। প্রভাতের খুশি যেন আর ধরে না। খুশিতে সে বাকি কেকটুকু এক বসাতে একাই খেয়ে ফেলল। তারপর মৃন্ময়ীকে বাড়ি অবধি-ও পৌঁছে দিয়ে এল। বাড়িতে ঢোকার আগে যখন মৃন্ময়ী ছোটো করে তাকে ধন্যবাদ জানাল, ঠিক তখন প্রভাতের মনে হলো আজকের দিনটা আসলেই একটু বেশিই বিশেষ। এমন দিন সে তার জীবনে বারবার ফিরে পেতে চায়।

উপহারসহ বাড়িতে ঢুকতেই মৃন্ময়ী মায়ের প্রশ্নের মুখে পড়ল। সাজেদা বেগম বক্সটা হাতে নিয়ে দেখতে-দেখতে জিজ্ঞেস করলেন,
“এটা কী রে?”
“উপহার।”
“কে দিলো?”
“এক বন্ধু,” উত্তরটা মিথ্যা হয়েও সত্য মনে হলো মৃন্ময়ীর।
সাজেদা বেগম পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“কোন বন্ধু?”
“তুমি চিনবে না। আমার সহপাঠী ছিল।”
“তা হঠাৎ তোকে উপহার দিলো যে?”
“দিতে ইচ্ছা করেছে তাই দিয়েছে।”
“তোর অনেক ভালো বন্ধু বুঝি?”
“ওই ভালোই।”
“ওওও। এটার ভেতরে কী আছে?”
“জানি না, খুললে বলতে পারব।”
“তাহলে খুলে দেখ।”
“খুলব নে মা। একটু জিরিয়ে নিই।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। ঠান্ডা শরবত খাবি? বানিয়ে দিবো?”
“বানাবে? বানাও তাহলে। গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।”

সাজেদা বেগম তখনই শরবত বানাতে চললেন। মৃন্ময়ী নিজের ঘরে ঢুকতেই তার পেছন-পেছন মৃদুলা-ও এল। ভেতরে ঢুকেই সে মৃন্ময়ীকে দুহাতে জাপটে ধরে বলল,
“হ্যাপি বার্থডে আপু।”
মৃন্ময়ী হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ বোন।”
মৃদুলা মৃন্ময়ীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“গিফটটা তোমায় প্রভাত ভাইয়া দিয়েছে, তাই না?”
মৃন্ময়ী অবাক চোখে তাকিয়ে জানতে চাইল,
“তুই জানলি কীভাবে?”
মৃদুলা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
“গণনা করে জেনেছি। দাঁড়াও, তোমার জন্য আমার তরফ থেকেও একটা ছোট্ট উপহার আছে।”
“কী উপহার?”
মৃদুলা এক ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। তাকে আলমারির ভেতরের জামাকাপড়ের নিচ থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করতে দেখে মৃত্তিকা প্রশ্ন করল,
“কী-রে? ওটা কী লুকিয়ে রেখেছিলি?”
মৃদুলা বলল,
“বড়ো আপুর বার্থডে গিফট।”
মৃত্তিকা একটু দ্বিধা নিয়ে জানতে চাইল,
“আজ আপার বার্থডে?”
“কেন? তুমি জানতে না?”
“মনে ছিল না।”
মৃদুলা উপহার নিয়ে ছুটল বড়ো বোনের কাছে। মৃত্তিকার হঠাৎ খুব খারাপ লাগল। নিজেকে প্রচণ্ডরকম স্বার্থপর মনে হলো। মা ঠিকই বলে, আপাকে সে কোনোকালেই বোঝেনি। বুঝতে চায়নি আর-কী। আচ্ছা, সে এখন খালি হাতে গিয়ে জন্মদিনের শুকনো একটা শুভেচ্ছা জানালে কি আপা খুশি হবে? না থাক, মৃদুলার মতো তো সে আপাকে ভালোবাসতেই পারে না। আজ হঠাৎ মিছে আবেগ দেখিয়ে কী হবে? তারচেয়ে বরং মৃদুলার সুন্দর শুভেচ্ছায় আপা খুশি থাকুক।

মৃদুলার উপহার খুলে মৃন্ময়ী অবাক হলো। এই মেয়ে তার জন্য দারুণ একটা শাড়ি কিনেছে। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে আবার চুড়ি আর কানের দুল-ও কিনেছে। মৃন্ময়ী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“এ তুই কী করেছিস মৃদুলা!”
মৃদুলা দাঁত বের করে হেসে বলল,
“তোমার ভাষায় অকাজ করে ফেলেছি, জানি। কিন্তু তুমি আমায় বকতে পারবে না। তুমিই সেদিন আমার জন্য পার্স কিনে এনে মাকে বলেছিলে মাঝে-মাঝে নিয়ম-কানুন ভেঙে পরিবারকে খুশি করতে ভালো লাগে। আমিও কিন্তু সেটাই করেছি।”
“তাই বলে তুই এত টাকা খরচ করবি? অল্প টাকায় কি উপহার দেওয়া যায় না?”
“আমার তোমাকে শাড়ি দেওয়ার শখ জেগেছিল, তাই শাড়িই কিনেছি। অন্যকিছু কিনলে মনে শান্তি পেতাম না।”
“এ মাসে নিশ্চয়ই হাত খরচে টানাটানি পড়ে গেছে?”
মৃদুলা হাসিমুখেই বলল,
“তা একটু পড়েছে। সমস্যা নেই, আগামী সপ্তাহেই আরেকটা টিউশনের টাকা পাব। এখন আমার গিফট তোমার পছন্দ হয়েছে কি না তা-ই বলো।”
মৃন্ময়ী মুচকি হেসে বলল,
“খুব পছন্দ হয়েছে। তোর পছন্দ কখনও খারাপ হয় না। কিন্তু এবারের মতো কিছু বললাম না, আর কখনও যেন এমন অকাজ করতে না দেখি।”
মৃদুলা বলল,
“তুমি খুশি হলে আমি এমন অকাজ বারবার করতে চাই। তারপর বকা শুনতে-ও আমার আপত্তি নেই।”
মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। বাড়িতে এই মেয়েটা আছে বলেই মাঝে-মাঝে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে সে হাসতে পারে। ভাগ্যিস সৃষ্টিকর্তা তার প্রতি এতটুকু দয়া করেছিলেন!

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০৩

0

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৩.
নতুন পার্স পেয়ে খুব খুশি হলেও মৃদুলা বেজার মুখে বলল,
“পার্স আমি নিজেই কিনতাম আপু। তুমি কেন কিনতে গেলে?”
“কেন, তোর পছন্দ হয়নি?”
“পছন্দ হয়েছে। তোমাকে না বলেছি আমার পেছনে অযথা খরচ না করতে?”
“দাম বেশি না তো। মাত্র আড়াইশো টাকা।”
“হোক, আড়াইশো টাকা তোমারই উপকারে আসত।”
মৃন্ময়ী হেসে মাকে ডেকে বলল,
“মা দেখো, তোমার মেয়ে খুব বড়ো হয়ে গেছে। এমনভাবে বলছে যেন তার জন্য খরচ করা আমার দণ্ডনীয় অপরাধ।”
সাজেদা বেগম বললেন,
“আমার মেয়ে ঠিকই বলে। যেটা কেনার সামর্থ ওর আছে, সেটা ও নিজেই কিনে নিবে। তোর এত বাড়তি খরচের কী দরকার? ওর যখন হাতে টাকা না থাকে, কিছু দরকার হলে তো ও নিজেই তোকে জানায়। দুজনেই কষ্ট করে টাকা রোজগার করিস। খরচ তেমনই ভেবেচিন্তে করা উচিত।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভেবেচিন্তে, মেপে-মেপে তো সবসময়ই খরচ করি মা। তবু কখনও-কখনও ভাবনাচিন্তার বাইরে গিয়ে তোমাদের জন্য কিছু করতে ইচ্ছা করে। এটা আমার কাছে অনেক আনন্দের। তোমাদের মুখের হাসিটাই তো আমার সবকিছু। তারজন্য মাঝে-মাঝে নিয়ম-কানুন ভাঙতে আমার কোনো আফসোস নেই।”
মৃদুলা মন খারাপী সুরে বলল,
“আমাদের ভালো রাখার তাগিদে তো তুমি নিজের জীবনটাকেই ব’লিদান দিয়ে দিচ্ছ আপু। আমরা তোমাকে ভুলিয়েই দিয়েছি তোমার-ও একটা জীবন আছে। তোমার-ও আমাদের মতো সবরকম চাহিদা আছে, হাসিখুশি থাকার ইচ্ছা আছে, একটা শান্তিপূর্ণ জীবনের আকাঙ্ক্ষা আছে। অথচ দায়িত্বের নামে আমরা তোমাকে টেনেহিঁচড়ে তোমার জীবন থেকে কতটা দূরে সরিয়ে এনেছি! আমরা খুবই স্বার্থপর, তাই না আপু?”

সাজেদা বেগম মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মৃদুলার কথায় যে মেয়েটার ক্লান্ত মনটায় মন খারাপের ছায়া পড়েছে, তা তিনি বেশ বুঝতে পারলেন। তাই তিনি মৃদুলাকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“তুই ওর কানের কাছে ভনভন না করে সর তো। ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দে। কী গরম পড়েছে দেখেছিস? মেয়েটা মাত্র বাইরে থেকে এসেছে না?”
“চলে যাচ্ছি, আমার পড়তে বসতে হবে,” বলে মৃদুলা উঠে পড়তেই মৃন্ময়ী তাকে পিছু ডাকল,
“শোন।”
“বলো আপু।”
মৃন্ময়ী তার ব্যাগ থেকে নতুন কেনা কানের দুলগুলো বের করে দিয়ে বলল,
“নে, কানের দুলের ডিজাইনটা পছন্দ হয়েছিল, তাই নিয়ে এসেছি।”
মৃদুলা হাতে নিয়ে দুই জোড়া দুল দেখে জিজ্ঞেস করল,
“একরকম দুই জোড়া দুল দিয়ে আমি কী করব?”
“মৃত্তিকাকে এক জোড়া দিয়ে আয়।”
মৃদুলা একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
“তুমি পারো-ও আপু!”

মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসে ছিল। মৃদুলা এসে তার হাতে এক জোড়া কানের দুল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“নাও, এটা তোমার।”
মৃত্তিকা কানের দুলটা নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে শুধাল,
“সুন্দর তো! তুই কিনেছিস?”
“উঁহু, বড়ো আপু আমার জন্য পার্স কিনতে গিয়েছিল। তখন এই দুলের ডিজাইন পছন্দ হয়েছে বলে তোমার আর আমার জন্য নিয়ে এসেছে।”
“ও, আসলেই সুন্দর।”
“আপু এখনও তোমাকে নিয়ে কত ভাবে! সত্যি, অবাক না হয়ে পারি না। তার জায়গায় আমি হলে হয়তো তোমার ছায়া-ও মাড়াতাম না। আপু একটা অদ্ভুত মানুষ!” কথাগুলো বলতে-বলতে মৃদুলা চলে গেল।

মৃত্তিকা প্রতিবাদ করল না। ইদানীং মা-বোনের কড়া কথার বিপরীতে তার আর প্রতিবাদ আসে না। তর্ক করার ইচ্ছা জাগে না। কথা-ও যেন সে খুব মেপে-মেপে বলছে। কী দরকার কথা বাড়িয়ে তর্কে জড়ানোর? তর্ক করার মতো কথাই তো আজ আর তার ঝুলিতে নেই। সম্পূর্ণ শূন্য ঝুলি নিয়ে সে এই সংসারে ফিরে এসেছে। এই সংসারে আগে তার ভিন্ন একটা জায়গা ছিল, অন্যরকম মনের জোর ছিল। সেই জায়গাটা-ও সে নিজের দোষে হারিয়েছে। তবু যখন তার শেষ আশ্রয়স্থল এই সংসারটাই, শেষ ভরসা বড়ো আপা-ই, তখন আর নিজেকে আগের জায়গায় কল্পনা করার অর্থ কী? আগের মৃত্তিকা আর আজকের মৃত্তিকার জীবনের মাঝে যে আকাশ-পাতাল ফারাক। আগের মৃত্তিকার জীবনে যে পরিবারের চেয়েও মূল্যবান একটা মানুষ ছিল, সে-ও আর তার নেই। মৃত্তিকা তার ফোনটার দিকে তাকাল। স্ক্রিনে তার আর তার স্বামীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভাসছে। ছবিটা তাদের বিয়ের দিনে তোলা। কী খুশি ছিল তারা সেদিন! পরমুহূর্তেই সে হাতের কানের দুলের দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে তার চোখ-মুখে অন্ধকার নেমে এল। বুক চিরে বেরিয়ে এল ধারালো দীর্ঘশ্বাস।


গরমে অতিষ্ঠ প্রভাত শার্টের ওপরের দিকের দুটো বোতাম খুলে হাঁটছে। একটু পরপরই সে শার্ট ঝাঁকিয়ে শরীরে হাওয়া দিচ্ছে আর আফসোসের সুরে বলছে,
“আহ্! সিঙ্গেল মানুষের এমন গরম লাগার মানে কী! বেয়াদব গরম কি জানে না সিঙ্গেল মানুষকে বাতাস করার কেউ নেই? মনে হচ্ছে এই গরমের থেকে বাঁচতে অতি শীঘ্র বিয়ে করতে হবে। বউ-ই এই বাড়াবাড়ি রকমের গরমের একমাত্র সমাধান।”
মৃন্ময়ীকে শুনিয়ে সে এত কথা বললেও মৃন্ময়ী যেন শুনেও শুনছে না। সে তার মতো হাঁটছে তো হাঁটছেই। প্রভাত মাথা কাত করে উঁকি দিয়ে তার মুখোভাব লক্ষ্য করে বলল,
“ও ম্যাডাম, একটু দয়া তো করতে পারো। না কি? বেচারা ছেলেটাকে আর কত কষ্ট দিবে? এই মাথাফাটা গরমে তোমার পেছনে ঘুরেঘুরে যদি মাথা ফেটে ম’রেটরে যাই, তখন তো আর কেঁদে-ও লাভ হবে না। এখন মানুষ আছি বলে তোমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন নিয়ে পেছনে ঘুরছি, ভূ’ত হলে তো তুমি আমাকে দেখলেই দৌড়ে পালাবে।”
মৃন্ময়ী বলল,
“ভূত হলে পছন্দমতো একটা পেতনি খুঁজে নিয়ো‌।”
“পেতনিটা তুমি হলে আমি এক কথায় রাজি আছি।”
“আমার ঠেকা পড়েনি তোমার সাথে ম’রার।”
প্রভাত অবাক কন্ঠে বলল,
“তারমানে তুমি চাও আমি একাই ম’রে যাই? আমি তোমাকে এত ভালোবাসি, আর তুমি আমার মৃ’ত্যু কামনা করছো? এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয় মৃন্ময়ী।”
“আমি কিছুই চাইছি না। তুমি নিজেই মুখের কথায় ম’রে যাচ্ছ, আবার মুখের কথায় ভূ’ত হয়ে যাচ্ছ।”
প্রভাত মন খারাপ করে বলল,
“কী করব? তুমি তো আমার দুঃখ বোঝো না। আমার সব দুঃখ বারবার পিষে ফেলে রেখে চলে যাও।”
“বললাম তো আমি কিছুই করি না। যা করার তুমি নিজেই করো। দুঃখের কথা বললে সেটাও তুমি নিজের ইচ্ছায় জুটিয়ে নাও।”
প্রভাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তা অবশ্য মিথ্যা বলনি। দোষ তো আমারই। আমি নিজেই তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভে চারটা বছর ধরে পেছনে পড়ে আছি। তুমি আমায় বিন্দুমাত্র আশা দাওনি। তবু আমি মৃন্ময়ী নামক আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটে চলেছি। আমি জানি না এই সব অনিশ্চয়তা পেরিয়ে আমি কবে তোমার হৃদয়ে পৌঁছাতে পারব। তবু আমি ধোঁয়াশার মতো আশা ছাড়ব না। আমি তোমাকে জয় করবই। হয় আমি তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধব, নয় আজীবনের মতো ঘরের আশা ত্যাগ করব।”
মৃন্ময়ী বলল,
“আমার কারণে তুমি ঘরের আশা ছাড়তে পারো না। যেহেতু আমি তোমাকে কোনোরকম আশা দিইনি, সেহেতু তুমি আমাকে আজন্মের দোষী-ও বানাতে পারো না।”
“নাহ্। আমি তো বলছি তুমি দোষী নও, দোষী আমি নিজেই। এটুকু দোষ না করলে কি আর অসম্ভব রকমের ভালোবাসা জয় করা যায়? দোষ যখন করেই ফেলেছি, চালিয়ে যাই না। জয়ী তো আমি একদিন হবই। আর দুর্ভাগ্যবশত হেরে গেলে, ঘর-টরের স্বপ্ন ওখানেই শেষ। তবে ভয় নেই, আমি কোনোদিনও তোমার দিকে আঙুল তুলব না। আমি জানি তুমি কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছো, কেন দিনের পর দিন প্রেম-ভালোবাসা এড়িয়ে চলছো। যেখানে আমি নিজেকে তোমার জায়গায় কল্পনা করতে-ও ভয় পাই, সেখানে তোমাকে দোষ দেওয়া তো অসম্ভব কাজ।”

মৃন্ময়ী কিছুক্ষণ নীরব রইল, প্রভাত-ও। তারপর মৃন্ময়ী নরম গলায় বলল,
“প্রভাত, জেনেবুঝে আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটে কী মজা পাচ্ছ? বয়স বাড়ছে, আর এমন বেপরোয়া হয়ো না।”
প্রভাত নিঃশব্দে হাসল। বলল,
“বেপরোয়া বলেই আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটছি। নয়তো বহু আগেই থেমে যেতাম।”
“এবার তো থামো। তুমি কি ক্লান্ত হও না?”
“থামার জন্য তো এতটা পথ হাঁটিনি। আর তোমার বেলায় আমার কোনো ক্লান্তি-ও নেই। যেদিন বুঝতে পেরেছিলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি, সেদিন থেকেই আমি আমার মনের সমস্ত ক্লান্তিদের ছুটি দিয়ে দিয়েছি। মৃন্ময়ী ম্যাডামকে জয় করার অভিযানে নেমেছি যে। এটুকু প্রস্তুতি তো নিতেই হত।”
“লাভ নেই প্রভাত। আমি তোমাকে বারবার বলেছি আমার পরিবারের বাইরে আমি এখন কিচ্ছু ভাবতে পারব না। আমার জীবন আমাকে সেই সুযোগ দিবে না।”
“আর যদি কোনোদিন সেই সুযোগ আসে, সেদিন কি তুমি আমাকে ভালবাসবে?”
“আসবে না।”
“যদি আসে?”
“অসম্ভব।”
“আচ্ছা, না আসুক। আমি শুধু তোমার মুখে সত্যি কথাটা জানতে চাই। সুযোগ এলে কি তুমি আমায় ভালবাসবে?”
“আমার জন্য ওসব কল্পনা ছাড়া কিছুই না।”
“বলো না। আমি একবার তোমার মনের কথা শুনতে চাই, শুধু একবার। মনে করো এটা কল্পনাই। তোমার সামনে সুযোগ এসেছে কাউকে ভালোবাসার। তুমি কী করবে? সেদিনও আমাকে এভাবেই ফিরিয়ে দিবে? না আমাকে গ্রহণ করে নিবে? না কি আমাকে অযোগ্য ভেবে অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে বসবে? বলো না প্লিজ।”

অবাক চোখে মৃন্ময়ী প্রভাতের ব্যাকুলতা দেখছে। যতই সে এই ছেলেটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুক, মাঝেমাঝে এমন কিছু মুহূর্তে ছেলেটার এসব ব্যাকুলতা দেখলে তার খারাপ লাগে। কোন সুখে এই ছেলে তাকে ভালোবাসল? কেন তার মনে মৃন্ময়ীর জন্যই এত পাগলামির সৃষ্টি হলো? সে তো অন্য কাউকে এমন পাগলের মতো ভালোবেসে একটা সুখী জীবন নিশ্চিত করতে পারত। তবে আর তাকে মৃন্ময়ীর অনিশ্চিত জীবনে প্রবেশ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে হত না। মৃন্ময়ী নিচু স্বরে বলল,
“আমি তোমাকে মিছে আশা দিতে পারব না।”
“তোমাকে আশা দিতে হবে না। তুমি মুখ দিয়ে শুধু এইটুকু বলো যে, কোনোদিন সুযোগ এলে তুমি আমাকেই ভালোবাসবে। ব্যস এটুকুই, আর কিচ্ছু বলতে হবে না তোমাকে। বাকিটা আমি নিজেই বুঝে নিব। প্লিজ মৃন্ময়ী।”
“তোমার নিজস্ব একটা জীবন আছে প্রভাত। আমি চাই না আমার জন্য তুমি তোমার জীবন থেকে সরে দাঁড়াও।”
“আর তুমি? তুমি কী করছো? তোমার কি নিজস্ব জীবন নেই? তা নিয়ে তো তোমার বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই। এটা কি নিজস্ব জীবন থেকে সরে যাওয়া নয়?”
“আমার আর তোমার জীবন এক নয়। তুমি তো জানো তোমার থেকে আমি সম্পূর্ণ আলাদা।”
“হোক আলাদা। তুমি শুধু আমার হয়ে যাও, আলাদাকেই আমি এক করে নিব।”
মৃন্ময়ী মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমার জন্য বিয়ে করা মানেই পরিবার ছাড়া। এই পরিবার ছাড়ার কথা আমি ভাবতেও পারব না।”
“আমি তো তোমাকে পরিবার ছাড়তে বলছি না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি কোনোদিনও তোমাকে তোমার পরিবার ছাড়তে বলব না। আমি শুধু চাইছি তুমি তোমার জীবনটা নিয়ে একটু ভাবো। তারপর তোমার-আমার জীবনে শুধু একটু পরিবর্তন আসবে। তোমার বাকি সব একইরকম থাকবে, আমি তোমাকে কিচ্ছু পরিবর্তন করতে বলব না। বিয়ে করলেই পরিবারের সাথে তোমার দূরত্ব তৈরি হবে, এমন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসো প্লিজ। আমি তো জানি তোমার পরিবারের তোমাকে কতটা দরকার। আমি তাতে কোনোদিনও আপত্তি করার সাহস দেখাব না। তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কী বুঝাতে চাইছি?”
“পারছি।”
“তাহলে কিছু তো বলো।”
“প্রভাত, মুখে অনেককিছুই বলা সম্ভব। চামড়ার মুখ তো, বলতে বাঁধে না। আর যদি হয় আবেগের কথা, তাহলে তো আরও আগে বাঁধে না। বাঁধে গিয়ে কোথায় জানো? যখন কথা রাখার সময় হয়। বাস্তবতার মুখোমুখি মানুষ তখনই হয়।”
“আমি ম’রে গেলেও আমার কথা ভাঙব না। তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিতে বললে আমি তা-ও করতে পারব।”
“মৃত্তিকার বর-ও হয়তো তাকে এমনভাবেই কথা দিয়েছিল। সে কি করেছে জানো? এত-এত ভালোবাসাসহ মৃত্তিকাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ওর নিজের হাতে সাজানো সংসারটা থেকে বের করে দিয়ে এখন নতুন বউ নিয়ে আনন্দ করছে।”
কথাটা শুনে প্রভাত ভীষণ অবাক হলো। মৃত্তিকার সাথে এমনটা হয়েছে, এই খবর তার জানা ছিল না। খবর নিতে হবে। আপাতত প্রভাত সে কথায় মাথা না ঘামিয়ে বলল,
“সব মানুষ তো এক হয় না। আমি খারাপ ছেলে হতে পারি, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে আমি খারাপ নই। তুমি একটা চিটারের সাথে আমার তুলনা করতে পারো না। আমি আর যা-ই করি, তোমার সঙ্গে চিট করব না।”
“আমি তুলনা করছি না, তোমাকে খারাপ-ও বলছি না। আমি শুধু বাস্তবতার বিষয়ে কথা বলছি। তুমি আমাকে যা বুঝাতে চাইছো, আমিও তারই প্রেক্ষাপট ধরে কথা বলছি।”
প্রভাত চরম হতাশ হয়ে বলল,
“তুমি আমাকে বুঝতে পারো না, না কি বুঝতে চাও না, তা-ই আমার বুঝে আসে না। এত ভালোবাসা চোখে দেখার পরও, এত সুযোগ সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও একটা মানুষ নিজের জীবন নিয়ে কীভাবে এতটা উদাসীন হয় মৃন্ময়ী?”
মৃন্ময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে উত্তর দিলো,
“মানুষটা আমি বলেই হয়তো।”


মৃদুলা আজ মৃত্তিকাকে ডাকাডাকি করে ঘর থেকে বের করেছে। মৃত্তিকা প্রয়োজন ছাড়া তেমন ঘর থেকে বেরোয় না। সে যে এই বাড়িতে আছে, তা-ই আজকাল বুঝা যায় না। অথচ আগে এ বাড়িতে তার কন্ঠস্বরই সবচেয়ে বেশি শোনা যেত। মৃদুলা আজ টিউশন থেকে ফেরার সময় ঝালমুড়ি কিনে এনেছে। বাড়ি ফিরে সে মা আর বোনকে ডেকে ঝালমুড়ি খেতে বসেছে। খেতে-খেতে মৃদুলা মাকে প্রশ্ন করল,
“মা, আপুর কাছে এখন টাকা চাইলে কি দিতে পারবে?”
সাজেদা বেগম বললেন,
“কেন? তোর টাকা লাগবে না কি?”
“ওই কিছু টাকা লাগত।”
“কিসের জন্য?”
“কলেজে।”
“কদিন আগে না টাকা দিলো?”
“ওই টাকা না।”
“তাহলে?”
মৃদুলা মিনমিনে গলায় বলল,
“আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান হবে। তারজন্য বান্ধবীরা সবাই একরকম জামা কিনবে।”
“তোর কাছে টাকা নেই?”
“যা আছে, তাতে হবে না।”
“তাহলে সবার সাথে পাল্লা দিয়ে জামা না কিনলে কী হয়? ঘরে কি তোর নতুন জামা নেই?”
মৃদুলা মুখে একরাশ অন্ধকার নামিয়ে বলল,
“সবাই একরকম জামা পরবে, তারমধ্যে আমি একা অন্যরকম জামা পরে যাব কীভাবে?”

সাজেদা বেগমের হঠাৎ কী হলো কে জানে? তিনি ধুম করে রেগে গেলেন। রাগত স্বরে বলে উঠলেন,
“না যেতে পারলে আমাকে বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে আন। আর কী করবি? আমার তো আর দুই টাকা রোজগার নেই যে বললেই দিয়ে দিবো। একজন দিন-রাত খেটে ম’রছে আর আমাদের টানছে। টানতে-টানতে তার দম ফুরানোর জোগাড় হচ্ছে, তা তোরা বুঝবি কী করে? তোরা তো তার কাছে হাত পাতলেই সব পেয়ে যাস। তারপর তার নিমক খেয়ে তার সাথেই নিমকহারামি করে পার পেয়ে যাস। আমার এই মেয়ে কি তোদের জন্য খাটতে-খাটতে ম’রে যেতে জন্মেছে রে? তোদের কাছে ওর কী এমন ঠেকা যে নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে তোদের সুখে রাখছে? তারপরও তোরা আমার মেয়েটার র’ক্ত পানি করা জীবনটার ওপর থুথু কেন ছিটাস? বলতে পারিস? কী পাপ করেছিল ও? কেন করিস তোরা এমন?”

কথা শেষ করার আগেই সাজেদা বেগম কেঁদে ফেলেছেন। মৃদুলা ব্যথাতুর মুখে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে আছে। সাজেদা বেগম উঠে সরে যেতেই মৃত্তিকা-ও উঠে পড়ল। সে উঠতেই মৃদুলা শক্ত মুখে বলে উঠল,
“শান্তি হয়েছ তুমি? তোমার কারণে মায়ের এসব কথা আমাকেও শুনতে হয়? আমি কী করেছি? আজব! তোমার দোষে আমিও কেন এসব কথা শুনব? আপু কি তোমার জন্য কম করেছে? আমার তো মনে হয় আপু আমার চেয়েও বেশি করেছে তোমার জন্য। তবু তুমি তাকে এত কষ্ট কী করে দাও? আল্লাহ্ কি তোমাকে মন বলতে কিছু দেয়নি আপা?”
মৃত্তিকা জবাব দিতে পারল না। মাথা নিচু করে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। সঙ্গে-সঙ্গে তার মুখের রং বদলে গেল। বিছানার কাছে গিয়ে সে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার কান্নার শব্দ দরজার ওপাশে বসা মৃদুলার কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। অনুশোচনায় দ’গ্ধ হৃদয়টা দেখল না কেউ। আবদ্ধ রুমের দেয়ালে-দেয়ালে কান্নার শব্দ ধাক্কা খেয়ে তার নিজের কানেই ফিরে এল। মৃত্তিকার যেন নিজের কান্নার শব্দটা-ও সহ্য হলো না। সে দুহাতে নিজের কান চেপে ধরল। সে আজীবন সন্ধি করে এল আনন্দের সাথে। হাসতে-হাসতে একটা জীবন কা’টিয়ে দিতে চাইল। অথচ কান্নারা হঠাৎ কেন তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে গেল? আশ্চর্য!

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।