Friday, July 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 348



প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১৯+২০

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী জামী

পরদিন সকালে নাস্তার পর তাহমিদ বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। শুক্রবার হওয়ায় আজ রায়হান আহমেদ বাসায় আছেন। তিনিও তাহমিদের সাথে যেতে চাইলে, তাহমিদ তাকে সাথে নেয়না। সে কোন বন্ধুর সাথে রাজশাহীর বাহিরে যাবে। ওর ফিরতে বিকেল কিংবা সন্ধ্যা হবে। তাই রায়হান আহমেদকে মানা করে দেয়। তবে তাহমিদ তাকে জানায়, রাতে সে রায়হান আহমেদের সাথে ঘুরতে বের হবে। রায়হান আহমেদও সহাস্যে তাহমিদের সিদ্ধান্ত মেনে নেন।

বেলা এগারোটা নাগাদ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে রাজিয়া খালা দরজা খুলে দেন। দরজার বাহিরে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে তার হাত-পা কাঁপতে থাকে। ততক্ষণে নায়লা আঞ্জুম ও শায়লা হাসান ড্রয়িংরুমে এসেছে। দরজার অপরপাশে দাঁড়ানো মানুষকে দেখে তারা প্রায় দৌড়ে যায় সেখানে। জড়িয়ে ধরে স্বামী-সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাস্যোজ্জ্বল মহিলাকে।

রাজিয়া খালা পিছিয়ে চলে এসেছেন রান্নাঘরে। তার সর্বশরীর কাঁপছে। কোন কাজ করার শক্তি তার হাতে কিংবা শরীরে নেই। এক পর্যায়ে তিনি মাথা ঘুরে পরে যান। কুহু আর দুইজন মেইডের সাহায্য নিয়ে খালাকে নিয়ে রুমে যায়। তার মাথায় পানি ঢেলে তাকে সুস্থ করে। কিন্তু তিনি সুস্থ হওয়ার পর থেকেই মুখে কুলু পেতে বসে রয়েছেন। কুহু খালার হঠাৎ কি হয়েছে, তা অনেকবার জানতেও চেয়েও কোন উত্তর পায়নি।

অনেকক্ষণ এভাবে খালা স্বাভাবিক হয়ে রান্নাঘরে আসলেন। কিন্তু তার মুখ থমথমে হয়ে আছে।

” কুহুপু, এদিকে এস, আমার কাজিনের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই। এরা হচ্চে আমার কাজিন নাহিয়া আর মিশাল। ওরা সুইজারল্যান্ড থেকে এসেছে। ” রিশা উচ্ছ্বসিত হয়ে কুহুর সাথে ওর কাজিনদের পরিচয় করে দেয়। এবারই ওরা প্রথমবার দেশে এসেছে।
কুহুও ওদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে। কুহু লক্ষ্য করল মেয়েটার বয়স পনেরোর আশেপাশে। আর ছেলেটার বয়স সম্ভবত দশ বছর।

এরইমধ্যে রায়হান আহমেদ ড্রয়িংরুমে আসলে, কুহু দেখল ওর চাচা মনমরা হয়ে বসে আছেন। তার মুখে কোন হাসি নেই। তিনি একনজর কুহুর দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। কোন কিছু বললেননা তার ভাতিজীকে। অথচ ছুটির দিনে তিনি যতবারই ড্রয়িংরুমে আসেন, ততবারই কুহুর সাথে কথা বলেন। আজ তার ব্যতিক্রম দেখে কুহু কপালে চিন্তার ভাঁজ পরেছে। ও বুঝতে পারছেনা খালা আর চাচার কি হয়েছে!

বিকেল পাঁচটা পঁয়ত্রিশ। কুহু রুমে বসে পড়ছে। সৃজন নিশোর সাথে বাগানে খেলছে। সেখানে রিশা, নাহিয়া আর মিশালও আছে।

ড্রয়িংরুমে নায়লা আঞ্জুম, শায়লা হাসান বসে অতিথিদের সাথে গল্প করছিল। সেখানে রায়হান আহমেদ এবং খালেদ হাসানও রয়েছেন। তাদের সামনে হরেকরকমের নাস্তা।

” ভাইয়া, তুমি এসেছ? ভেতরে গিয়ে দেখ আমাদের বাসায় মেহমান এসেছে। ”

কুহু রুম থেকে নিশোর কথা শুনে বুঝতে পারে তাহমিদ এসেছে। রুমের জানালা খোলা থাকায় ওদের সব কথাই শুনতে পাচ্ছে কুহু। এ বই বন্ধ করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাসায় কে এসেছে, কিংবা আসেনি সেই বিষয়ে ওর বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই।

তাহমিদ নিশোর কথা শুনে ওর দিকে তাকায়। নিশোর পাশে দাঁড়ানো ছেলেমেয়ে দুটোকে চিনতে পারলনা। শরীর ক্লান্ত থাকায় তাহমিদ কোন বাড়ায়না। ঢুকে পরে বাসায়।

কুহু তাহমিদকে ভেতরে আসতে দেখেই রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। সে এখন নিশ্চয়ই তার বিখ্যাত ব্ল্যাক টি চাইবে।

” আপা, এই যে তাহমিদ এসে গেছে। দেখ তোমার ছেলে কত বড় হয়ে গেছে। ” ভেতরে ঢুকেই নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে তাহমিদ সামনে তাকায়। সোফায় বসে থাকা মানুষটিকে দেখে ওর মাথায় আ’গু’ন ধরে গেছে। চোখদুটো র’ক্তবর্ণ হয়ে গেছে। কপালের দুইপাশের শিরা দপদপ করছে।

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে মুখে হাত দিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছেন রাজিয়া খালা। তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

” তাহমিদ, কেমন আছ বেটা? কত বড় হয়ে গেছ তুমি! আমাকে চিনতে পেরেছ? ” সোফা ছেড়ে উঠে এসে ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করল মিথিলা আরজুমান্দ। সে তাহমিদের গালে হাত রেখেছে।

” ডোন্ট টাচ মি। আপনার সাহস তো কম নয়, আমাকে স্পর্শ করেছেন! আমাকে স্পর্শ করার আপনি কে? হতে পারেন আপনি এই বাড়ির মেয়ে, কিন্তু আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ”

তাহমিদের চিৎকার শুনে দুই পা পিছিয়ে যায় মিথিলা আরজুমান্দ। তার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে।

” তাহমিদ, তুমি এভাবে আপার সাথে কথা বলছ কেন? তুমি কি ভুলে গেছ, সে তোমার মা? একজন সন্তান হয়ে মা’য়ের সাথে এভাবে কথা বলতে তোমার বিবেকে বাঁধছেনা? ছিহ্ তাহমিদ ছিহ্। ” নায়লা আঞ্জুম খেঁকিয়ে উঠল।

” বিবেকবোধ তোমার আছে! কিংবা তোমাদের আছে? যদি থাকত তবে এই মহিলাকে তোমরা বাসায় ঢুকতে দিতেনা। তোমরা আজ প্রমান করে দিলে তোমরা সবাই বিবেকবর্জিত জীব। হতে পারে এই মহিলা তোমাদের বোন। কিন্তু সে কখনোই আমার মা নয়। কোন মা নিজের সুখের জন্য তার নয় বছরের সন্তানকে ফেলে, অন্য কারো হাত ধরে চলে যেতে পারেনা। সে তোমাদের বোন হলেও, কখনো সে আমার মা হয়ে উঠতে পারেনি। ” রাগে তাহমিদ কাঁপছে। ও দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

কুহু স্তব্ধ হয়ে গেছে। একি শুনছে ও!
রাজিয়া খালা কাঁদছেন।

” বেটা, তুমি এভাবে বলছ কেন! আমি তোমার মা। তোমাকে দেখার জন্য আমি এতদূর ছুটে এসেছি। তুমি…… ।
মিথিলা আরজুমান্দ কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই তাহমিদের হুংকারে তাকে থামতে হয়।

” জাস্ট শাট-আপ। আমি আগেই বলেছি, আপনি আমার কেউ নন। আপনি আমাকে দেখতে মোটেও আসেননি। আপনি এসেছেন এখানকার সবাইকে নিজের সুখের সংসার দেখাতে। আমাকে যদি এতই ভালোবাসতেন তবে ফেলে রেখে যেতে পারতেননা। একটাবারও আপনি ভাবেননি, আপনি চলে যাবার পর আমার কি হতে পারে। যে ছেলে একা ঘুমাতে ভয় পেত, অন্ধকারে ভয় পেত, আপনি চলে যাবার পর সেই ছেলের প্রতিটা রাত কেমন কেটেছে, সেটা যদি জানতেন তবে আপনি নিজের মুখ কখনোই তাকে দেখাতেননা। সমাজের চোখে তাকে প্রতিনিয়ত কতটা হেয় হতে হয়েছে, সেটা যদি আপনি জানতেন তবে আজ নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে আসতেননা। আজ এত বছর পর হঠাৎ করে ভালোবাসা দেখাতে হাজির হয়েছেন কেন? কেন নিজেকে মা বলে দাবী করছেন? আমার মা এই যে রাজিয়া খালা। যিনি আমাকে আগলে রেখেছেন আজ অব্দি। ”

তাহমিদ রাজিয়া খালাকে টেনে মিথিলা আরজুমান্দের সামনে নিয়ে আসল। ও কাউকে বলতে না দিয়ে নিজেই বলে চলেছে।

” জানেনতো, আপনি যাবার পর বাবা আমাকে পর করে দিয়েছে। সে আমাকে ঘৃ’ণা করতে শুরু করে। এরপর সে আরেকটা বিয়ে করল। সৎমায়ের হাত ধরে আরেকবার নরক দর্শন করলাম আমি। উঠতে বসতে বাবা আর সৎমা মিলে অপমান করতে শুরু করল। যদি দাদু না থাকত আমি বোধহয় শেষ হয়ে যেতাম। সে আমাকে সব কটু কথা থেকে রক্ষা করেছে। আমার যখন আপনাকে সবথেকে বেশি দরকার ছিল, তখন আপনি আমার পাশে ছিলেননা। ক্লাসের সবাই যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের মা’কে নিয়ে আসত, তখন আমি দূরে থেকে তাদেরকে দেখতাম। যখন প্রতি পরীক্ষায় টপার হতাম, তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার জন্য আপনি ছিলেননা। আপনার অভাবে আমার জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। আমি ছন্নছাড়া হয়ে এদিকসেদিক ঘুরতে থাকলাম। এতকিছুর পর আজ আপনি এসেছেন মাতৃত্বের দাবী নিয়ে! শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়না। আপনি জন্ম দিয়েও আমার মা হতে পারেননি, যেমনটা হয়েছে রাজিয়া খালা। আমার পুরোনো ক্ষ’তে আঘাত করতে কেন আবার আসলেন? কেন আসলেন? কেন? কেন? কেন আসলেন? ” তাহমিদ উন্মাদের মত করছে। ও দুই হাত দিয়ে নিজের চুল টানছে। চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছে।

তাহমিদের এরূপ আচরনে সবাই ভয় পেয়ে গেছে। কুহু অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেলে এরূপ আচরন করতে তা কুহু অনুধাবন করতে পারছে। তাহমিদের কষ্ট দেখে ওর বুকের ভেতর হাহাকার করছে।

রাজিয়া খালা তাহমিদকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। তিনি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।

” ও বাপজান, তুমি ইকটু শান্ত হও। এম্নে কাঁন্দেনা, বাপ। তোমারে এইভাবে দেখবার পারতাছিনা আমি। ও বাপ, তুমি শান্ত হও। ” রাজিয়া খালা তাহমিদের মাথায়, চোখেমুখে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

” এরা সবাই খারাপ, খালা। এরা একজোট হয়ে ঐ মহিলাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এরা কেউ আমাকে পছন্দ করেনা, এটা আমি ভালো করেই জানতাম। কিন্তু নানিমার টানে এদের অবহেলা উপেক্ষা করে আমি এখানে আসতাম। আজ এরা এদের রূপ দেখিয়েই দিল। একজন আমার সুখ কেড়ে নিয়ে নিজের সংসার সাজিয়েছে। গত উনিশ বছর ধরে আমি আমি সেই দহনে নিঃশেষ হচ্ছি। আজ আবার এরা নতুনভাবে আমার সেই দহনে অনলের প্রলেপ দিয়েছে। এখন বাকিটা জীবন আমি বাঁচব কি নিয়ে? দুনিয়াটা এত নিষ্ঠুর কেন, খালা? নাকি দুনিয়ার সব নিষ্ঠুরতা শুধু আমার জন্যই বরাদ্দ! ” তাহমিদ রাজিয়া খালার হাত ছাড়িয়ে ওপরে যেতে চাইলে, খালা ওকে আটকায়।

” কই যাও, বাপ? তুমি এখানে বস, আমি তোমার জন্য শরবত নিয়া আসতাছি। ”

” আমি চলে যাব, খালা। এই বাড়ি থেকে চিরতরে চলে যাব। এখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে আমি পা’গ’ল হয়ে যাব। ” তাহমিদ চোখ মুছে বলল। এরপর ও সোজা নিজের রুমে চলে গেল।

ড্রয়িংরুমের সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিথিলা আরজুমান্দ ভাবতেই পারেনি, তাহমিদের মনে তার জন্য এত ঘৃ’ণা জমেছে। সে হতভম্ব হয়ে তার মেয়ে নাহিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। বাসার ভেতরের চিৎকার শুনে ওরা বাগান থেকে ভেতরে এসে সবকিছু শুনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
রিশা এতকিছু জানতনা। সে-ও সবার মত হতবাক।

রাজিয়া খালা দৌড়ে ওপরে চলে আসে। তাহমিদ ব্যাগে ওর কাপড় তুলছিল। রাজিয়া খালা এসে ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নেয়।

” ও বাপজান, তুমি এভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিওনা। তুমি কোথাও যাইবানা। ”

” খালা, তুমি আমাকে আটকিওনা প্লিজ। আমি এখানে থাকলে খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলব। ” তাহমিদ খালার কাছ থেকে ব্যাগ নেয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করছে।

” বাপজান, তুমি চইলা গেলে কুহু মা’য়ের কি হইব ? তুমি ছাড়া তারে নিরাপত্তা কে দিব? এতিম মাইয়াডার ভবিষ্যৎ কি হইব? তুমি না তাকে ভালোবাস। তাইলে তারে ফেইলা রাইখা যাইবা কেম্নে! ” এবার তাহমিদের হাত থেমে যায়। ও এতক্ষণ কুহুর কথা ভুলেই গিয়েছিল।

ও ধপ করে বিছানায় বসে পরল। দুহাত দিয়ে খামচে ধরল নিজের চুল। এ কোন পরীক্ষা উপনীত হয়েছে ওর সামনে?

বিঃদ্রঃ গত তিনদিন থেকে আমি অসুস্থ। এর ওপর বাসায় মেহমান। মেহমানদারী করে, অসুস্থ শরীর নিয়ে এতটুকুই লিখতে পেরেছি। আপনারা কেউ মনঃক্ষুণ্ন হবেননা।

চলবে…….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২০
জাওয়াদ জামী জামী

রিশা এতক্ষণ অবাক চোখে মিথিলা আরজুমান্দকে দেখছে। ও এতদিন অনেক কিছুই জানতনা, যেগুলো আজ জেনে গেছে। ও জানত ওর বড় খালামনি দেশের বাহিরে থাকে। স্বামীর সাথে তার বাকি দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড থাকে। কিন্তু ও ঘুনাক্ষরেও জানতনা, ওর বড় খালামনি তাহমিদকে এভাবে ফেলে রেখে গেছে! নায়লা আঞ্জুম সব সময় ওদের বলেছে, মিথিলা আরজুমান্দ স্বামী-সন্তান নিয়ে সুইজারল্যান্ড থাকে। ও ভেবেছিল, বড় খালামনি এভাবে চলে যাওয়ায় তাহমিদ তার মা’য়ের ওপর রাগ করেছে। কিন্তু আজ ও এসব কি শুনল! হঠাৎই ওর মন বিদ্রোহ করে বসল। ড্রয়িংরুমে বসে থাকা ওর মা, খালামনিদের অসহ্য লাগতে শুরু করল। বিশেষ করে মিথিলা আরজুমান্দকে।

” ছিহ্ খালামনি, তুমি এমন কাজ কিভাবে করেছিলে? তোমার একবারও ভাইয়ার কথা মনে হয়নি! তোমার জন্য ভাইয়া এত কষ্ট পাচ্ছে। একজন মা হয়ে তুমি এমন কাজ করলে কিভাবে? ” রিশা আবেগের বশে কথাগুলো বলল।

মিথিলা আরজুমান্দ রিশার দিকে আহত চোখে তাকায়।

” রিশা, তোমার এতবড় সাহস, তুমি বড় আপার সাথে এভাবে কথা বলছ? বেয়াদব মেয়ে, আদবকায়দা ভুলে গেছ? ” নায়লা আঞ্জুম খেঁকিয়ে উঠল।

” রিশা, তুমি আমার সাথে এস। আমরা রুমে যাই। এখানের সার্কাস দেখতে মোটেও ভালো লাগছেনা। যারা তাহমিদের মত ছেলের মূল্য দিতে জানেনা, তারা আবার মানুষের পর্যায়ে পরে নাকি! ” রায়হান আহমেদ স্ত্রী’র কথায় পাত্তা না দিয়ে, রিশাকে বললেন।

” আমি এখন রুমে যাবনা, বাবা। আমি ভাইয়ার কাছে যাব। এই দুঃসময়ে ভাইয়ার কাছে থাকা জরুরী। ”

” চল, আমরা দুজনেই তাহমিদের কাছে যাই। ” রায়হান আহমেদ মেয়েকে নিয়ে পা বাড়ালেন দোতলায়।

” দাঁড়াও, রায়হান। আমিও যাব তোমাদের সাথে। এখানকার অসুস্থ পরিবেশে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ” খালেদ হাসানও তাহমিদের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।

রায়হান আহমেদের সাথে নিশোও দোতলায় যায়।

মিথিলা আরজুমান্দ লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। স্বামী- ছেলেমেয়েদের সামনে তাকে এভাবে লজ্জায় পরতে হবে, তা সে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি।

মিথিলা আরজুমান্দের স্বামী নাহিদ সারোয়ার চোখ গরম করে স্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে এত বছর পর প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে জানলে, সে কখনোই এখানে আসতনা।

নাহিয়া আর মিশাল অবাক চোখে ওদের মা’কে দেখছে। ওদের মা’য়ের এরূপ জঘন্য অতীত আছে সেটা ওরা ভাবতেই পারছেনা। এর জন্যও ওদের বাবাও যে দায়ী সেটা কিছুতেই ওরা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেনা। তাহমিদের কান্না ভেজা চোখ, অসহায় মুখ নাহিয়ার চোখের সামনে ভাসছে।

” ছিহ্ মম, তুমি এতটা জঘন্য! আমি জাস্ট ভাবতে পারছিনা। নিজের সুখের জন্য তুমি একটা পরিবার ভেঙে দিয়েছ! তুমি একটাবারও তোমার ছেলের কথা চিন্তা করোনি? এখনতো আমার মনে হচ্ছে, তোমার প্রয়োজনে তুমি আমাদেরও ছেড়ে যেতে পার। আই জাস্ট হেইট ইউ। এ্যান্ড সেইম অন ইউ, মম। ”

” নাহিয়া, মাই বেইবি, তুমি এভাবে বলোনা। তুমি আমার কলিজা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আমার কিউটি বেইবি। ” মিথিলা আরজুমান্দ ব্যগ্র কন্ঠে বলতে থাকে।

” ভালোবাসা মাই ফুট। আমার মনে হয় তুমি কাউকে ভালোবাসতে জানোনা। তুমি শুধু নিজেকেই ভালোবাসতে জানো। যদি কাউকে ভালোবাসতে তবে ঐ ভাইয়াটাকে কষ্ট দিতে না। তার ক্রন্দনরত মুখটা দেখে আমার নিজের প্রতি ঘৃ’ণা হচ্ছে। আর পাপা, তুমিও কম যাওনা। একটা সংসার ভাঙার চিন্তা তুমি কিভাবে করতে পারলে? তুমি একবারও ঐ ভাইয়ার দিকটা ভাবতে পারনি! ”

” নাহিয়া সোনা, রিল্যাক্স। এত হাইপার হয়োনা, সোনা। এসো আমরা বসে কথা বলি। তুমি আমার কথা মন দিয়ে শোন, তাহলেই সব বুঝতে পারবে। ” নাহিদ সারোয়ার তার মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।

” নো পাপা, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হেয়ার এনিথিং রাইট নাও। বোথ অফ ইউ আর কালপ্রিট। আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক টু সুইজারল্যান্ড রাইট নাও। তোমরা যদি না যাও, তবে আমি একাই চলে যেতে পারব। ”

নাহিদ সারোয়ার বুঝতে পারছে তার মেয়ে এখন কোন কথা শোনার অবস্থায় নেই। পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেছে। সে মিথিলা আরজুমান্দের দিকে তাকিয়ে বলল,

” মিথিলা, রেডি হয়ে নাও। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হব। নাহিয়া সোনা তুমিও রেডি হয়। আর মিশাল তুমিও। ”

মিথিলা আরজুমান্দ মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পরল। এতদিন পর তাকে অতীতের তিক্ত পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে হবে তা সে ভাবতেই পারেনি।

তাহমিদ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকল। এরপর উঠে আবার ব্যাগ হাতে নিল।

” খালা, আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাব ঠিকই, কিন্তু এখনই রাজশাহী ছাড়ছিনা। জয় রাজশাহী থেকে গেলেই তবে আমিও ঢাকা ফিরব। তুমি এই কয়টা দিন একটু সামলে নিও। বাসার বাহিরে কুহুর সকল বিষয় আমি দেখব, সে আমি যেখানেই থাকিনা কেন। ” থমথমে গলায় বলল তাহমিদ।

” আমি তোমার মত কইরা পরিস্থিতি সামলাইতে পারবনা, বাপজান। এতিম মাইয়াডা তুমি না থাকলে ভাইসা যাইব। রায়হান ভাই যতই চেষ্টা করুক, নায়লার হাত থাইকা তারে তুমিই পারবা রক্ষা করতে। তুমি এই বাড়ি ছাইড়না। তুমি চইলা গেলে তোমার নানিমা ম’ই’রা যাইব। হেই মানুষটা তোমার মুখ চাইয়া, আর তার পোলাডারে দেখবার লাইগাই বাঁইচা আছে। তুমি এইভাবে যাইওনা, বাপজান। ” রাজিয়া খালা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।

তাহমিদ নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। এদিকে রাজিয়া খালার কান্না ওর বুকের ভেতর তোলপাড় করছে। এই মানুষটার চোখের পানি ও সইতে পারেনা।

” ভাইয়া, তুমি সত্যিই চলে যাবে? যেওনা, ভাইয়া। তুমি চলে গেলে আমরা একা হয়ে যাব। ” রিশা দৌড়ে এসে তাহমিদের হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিল।

তাহমিদ সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় ওর দুই খালু রুমে এসে দাঁড়িয়েছেন।

” তাহমিদ, তুমি এভাবে হুটহাট কোন সিদ্ধান্ত নিওনা। রা’গ কখনো কারো ভালো করতে পারেনা। তুমি যা সিদ্ধান্ত নেয়ার ঠান্ডা মাথায় নিও। ” রায়হান আহমেদ সস্নেহে বললেন। খালেদ হাসান মাথা নাড়িয়ে রায়হান আহমেদের কথায় সায় দিলেন।

নিশোও এসে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরল। সকলের এমন আকুতি হেলায় ঠেলতে পারলনা।

” ঠিক আছে। আমি কোথাও যাচ্ছিনা। তবে ঐ ভদ্রমহিলা যতক্ষণ এই বাসায় আছে, ততক্ষণ আমি এখানে থাকছিনা। সে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে, তুমি আমাকে জানিয়ে দিও, খালা। ”
তাহমিদ আর এক সেকেন্ডও রুমে দাঁড়ালনা। দৃঢ় পায়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

ড্রয়িংরুমের সকলে তাহমিদকে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তাহমিদ তাদের দিকে একবারও না তাকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

মিথিলা আরজুমান্দ ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে! কত সুদর্শন হয়েছে সে! কিন্তু একটিবারও তার ছেলে তাকে মা বলে ডাকলনা, এই আফসোস তার আজীবন থেকে যাবে।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর মিথিলা আরজুমান্দ স্বামী-সন্তানদের নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সাথে করে নিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস আর ছেলের ঘৃ’ণা।

রাত তিনটা দশ। তাহমিদ এখনো বাসায় ফেরেনি। রাজিয়া খালা তাকে ফোন করে মিথিলা আরজুমান্দ চলে গেছে সেইটা জানিয়েছেন। কিন্তু তাহমিদের বাসায় ফেরার নাম নেই। কুহু আর খালা অস্থির চিত্তে ড্রয়িংরুমে বসে তাহমিদের অপেক্ষা করছে। খালা কয়েকবার ওকে ফোন করলেও তাহমিদ আর ফোন রিসিভ করেনি।

আরও দশ মিনিট পর কলিং বেল বাজলে কুহু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ওর মধ্যে এই মুহূর্তে ভয়ের কোনও অস্তিত্ব নেই। তাহমিদকে দেখবার জন্য ওর মন কেমন করছে। বিকেলে মানুষটার চুপসানো মুখ দেখে ওর ভিষণই কষ্ট হচ্ছিল।

দরজা খুলে দিতেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তাহমিদকে দেখে কুহুর বুকের ভেতর তোলপাড় হতে থাকে। মানুষটা এক নজর কুহুর দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করেছে। এই কয়েক সেকেন্ডেই কুহু তাহমিদের লাল চোখদুটো দেখতে পেয়েছে। চুলগুলো উসকোখুসকো, গায়ে থাকা টি-শার্টে ধুলোবালি লেগে আছে। প্যান্টেও তাই। কুহু একপাশে সরে দাঁড়ালে তাহমিদ ভেতরে ঢুকে সোজা ওপরে যেতে চাইলে খালা ওকে ডাক দেয়।

” বাপজান, তুমি মুখহাত ধুইয়া আস, আমি খাবার গরম করতাছি। ”

” আমি খাবনা, খালা। ”

” আমি আর কুহু মা’য় তোমার জন্য অপেক্ষা করতাছি। আমরাও খাই নাই। তারে অনেক বইলাও আমি খাওয়াইতে পারিনি। সে আমার কথা শুনলইনা। তার একটাই কথা, তুমি না খাইলে সে-ও খাবেনা। ”

তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

” তোমার সাথে সাথে দেখছি এই মেয়েটাও আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শিখে গেছে! মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার মোক্ষম হাতিয়ার তার কাছে আছে। সে ভালো করেই জানে দুনিয়ার সবাইকে ইগনোর করলেও, আমি তাকে ইগনোর করতে পারবনা। এই মেয়ে ক্রিয়ার বিপরীত ক্রিয়ায় বিশ্বাসী। সে প্রতিক্রিয়া দেখতে ভালোবাসে। তাই সে না খেয়ে আছে এত রাত রাত পর্যন্ত। আর আমিও অসহায় মানুষ সর্বদাই তার ফাঁদে পা দিতে একপায়ে রাজী। খাবার গরম কর আমি দশ মিনিটেই আসছি। ”

কুহু তাহমিদের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ও ভিষণ লজ্জা পেয়েছে। কেন যে খালা ঐ খোঁ’চা কুমারের সামনে কথাটা বলতে গেল!

তবে তাহমিদকে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে দেখে খালা ও কুহু দুজনেই হাঁফ ছাড়ল।

চলবে….

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১৭+১৮

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী জামী

” তাহমিদ, তুমি বোধহয় বেশ কয়েকদিন ছুটি নিয়েছ? এক কাজ কর, আমাদের সাথে খুলনা চল। আমার বাসার রাস্তা তুমি বোধহয় ভুলেই গেছ। ” শায়লা হাসানের স্বামী খালেদ হাসান তাহমিদকে বললেন। ভদ্রলোক ছেলের খবর শোনামাত্রই খুলনা থেকে রওনা দিয়েছিলেন।

” আমি আর চার-পাঁচ দিন রাজশাহীতে আছি। যে কয়দিন ছুটি পেয়েছি, সে কয়দিন নানিমার সাথে কাটাতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব। ”

খালেদ হাসান তাহমিদের পিঠ চাপড়ে দিলেন। তিনি মনে মনে তাহমিদকে বেশ পছন্দ করেন।

” ঠিক আছে ইয়াংম্যান। তুমি সময় করেই না-হয় খুলনা থেকে বেরিয়ে এস। আসলে সত্যি বলতে কি, আমি তোমাকে যতই দেখি, ততই মুগ্ধ হই। কি কর্মস্পৃহা তোমার! সেই সাথে অদম্য ইচ্ছাশক্তি। এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমনটা খুব একটা দেখা যায়না। আমার ছেলেকেই দেখ, তাকে আমরা মানুষ করতে পারলামনা। একটা মানুষের মধ্যে যত খারাপ গুণ থাকলে তার পিতামাতাকে সমাজের কাছে হেয় হতে হয়, তার সব গুণই ওর মধ্যে আছে। অথচ ওকে কোন সুযোগসুবিধা দিইনি! না করেছে মন দিয়ে পড়াশোনা, না ধরেছে আমার ব্যবসার হাল। এইযে আজ হাত-পা ভেঙে বিছানায় শুয়ে আছে, এটা হয়তো ওর কোন পাপেরই ফল। শাসন করেও কোন কাজ হলোনা। আর নিজের সন্তান জন্য ফেলেও দিতে পারিনা। ” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন খালেদ হাসান।

তাহমিদের হঠাৎই খারাপ লাগছে। ওর জন্যই আজ জয়ের এই অবস্থা। আর ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছে এই মানুষটা। এক অসহায় পিতার দীর্ঘশ্বাস ওকে পো’ড়া’তে লাগল। মাথা নিচু করে ও নিজেকে প্রবোধ দেয়। জয় নিজের কৃতকর্মের ফল পেয়েছে। ও যা করেছে তার জন্য এউ শাস্তিটুকু ওর পাওনা ছিল।

” তুমি এসব কি শুরু করলে? আমার ছেলেটা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে, আর তুমি ওকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলছ? কেমন বাবা তুমি? কি করেছে আমার ছেলে? এই বয়সের ছেলেমেয়েরা একটুআধটু দুষ্টুমি করেই থাকে। তাই বলে তুমি আমার ছেলেকে যাচ্ছেতাই বলতে পারনা। ” স্বামীর কথা শুনে খেঁকিয়ে উঠল শায়লা হাসান।

তাহমিদ শায়লা হাসানের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকল।

” আমি যা বলেছি ভেবেচিন্তেই বলেছি। এবং এক বিন্দুও ভুল বলিনি। জয়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী তুমি। তুমি নিজে না করেছ ছেলেকে শাসন, আর না করতে দিয়েছ আমাকে। কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সে সম্পর্কে ওকে কোন ধারনাই দাওনি তুমি। ছোটবেলা থেকেই ওকে নিজের মত করে গড়ে তুলেছ। আজ তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাকে। আমার আব্বার তিলে তিলে গড়ে তোলা রাজত্বের ভীতে কুঠার চালিয়েছ তুমি। ছেলেকে বানিয়েছ উশৃংখল, বেয়াদব আর স্বেচ্ছাচারী। তোমার জন্য আমার পরিবারে ভাঙ্গন ধরেছে। আমার ভাইবোনেরা আজ আমাকে ঘৃণা করে। সব কিছুর মূলে তুমি। তুমি তাদের থেকে আমার ছেলেকে দূরে রেখছ সব সময়ই। তবে আমি শঙ্কিত তোমার শেষ পরিণতি কি হবে এই ভেবে। ”

” হোয়াট ননসেন্স? মুখ সামলে কথা বল। তোমার ঐ রাবনের গোষ্ঠীর সাথে থাকিনা জন্য আমি খারাপ? আমার কি নিজের মত করে বাঁচার অধিকার নেই? তোমার বোনেরা এসে সংসারে মাতব্বরি করবে আর সেটা আমাকে মেনে নিতে হবে! আমি পারবনা মানতে। আর রইল আমার ছেলের বিষয়। আমার ছেলেকে আমি কার সাথে মিশতে দেব, কার সাথে দেবনা এটা আমিই বুঝব। এসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা না করলেও চলবে। ”

” খালামনি, চুপ করবে তুমি? কি শুরু করেছ এসব! মনে রেখ এটা তোমার বাবার বাড়ি। আর এই ভদ্রলোক তার শ্বশুর বাড়িতে এসেছেন। এটা তার বাড়ির ড্রয়িংরুম নয় যে তুমি তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলবে। তুমি নিজে যেখানে বাবার বাড়িতে এসে মাতব্বরি কর, সেখানে তার বোনেরা করলে দোষ কোথায়? এত রিয়্যাক্ট করছ কেন! তার ছেলে অসুস্থ। টাকা খরচ হচ্ছে তার। সে চিন্তা করছে। সেজন্য সে রিয়্যাক্ট করতেই পারে। তার সাথে তোমার এই আচরণ শোভা পায়না। ”

তাহমিদের কথা শুনে শায়লা হাসান চুপ করে যায়। কারণ সে ভালো করেই জানে, সে এখন একটা কথাও বললে তাহমিদের কাছে হেনস্তা হতে হবে।

এতক্ষণ কুহু রান্নাঘর থেকে সবই শুনছিল। ও ভীতু চোখে তাহমিদকে দেখছে। এই লোকটাকে দেখে সবাই এত ভয় পায় কেন তার আংশিক উত্তর আজ ও পেয়ে গেছে।

রাতে তাহমিদের কাছে বাচ্চারা পড়তে বসেছে। তাহমিদ একে একে সবার প্রবলেম সলভ জরে দিচ্ছে। সৃজন আর নিশো ঠিকঠাক পড়লেও রুশা মাঝেমধ্যেই ফাঁকিবাজি করছে। সেজন্য তাহমিদ ওকে ঠুসঠাস করে বসিয়েও দিচ্ছে। কাঠের স্কেলের বারি খেয়ে রিশা কিছুক্ষণ পড়ছে ঠিকই, সেই মা’রে’র মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে তারপরই শুরু করছে ফাঁকিবাজি।

” রিশা, তুই যদি পনের মিনিটের মধ্যে এই পাঁচটা অংক করে না দিস, তবে আজ তোকে সারা রাত আমি ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রাখব। সেই সাথে স্কেলের বারি ফ্রি থাকবে। নিশো, তোর খাতা দেখি। সৃজন, তুমি অংকগুলো শেষ করেছ? ” তাহমিদের কথা শুনে রিশা মুখ কাঁচুমাচু করে লিখতে থাকে।

নিশো খাতা এগিয়ে দিলে তাহমিদ সেটা দেখে, সৃজনের খাতায় নজর দেয়। নিশো টুকটাক ভুল করলেও সৃজন কোন ভুল করেনি। অনেকক্ষণ ধরেই তাহমিদ লক্ষ্য করছে, সৃজন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।

” সৃজন, তুমি কিছু বলতে চাও? ”

” একটা কথা ছিল, ভাইয়া। বললে তুমি রাগ করবে নাতো? ”

” কি কথা বল শুনি। ”

” তুমি রিশাপু আর নিশোকে তুই বল কিন্তু আমাকে তুমি বল। এটাই বলতে চাচ্ছিলাম। ”

” তোমাকে তুই বললে খুশি হবে? ”

সৃজন মাথা নাড়ায়।

তাহমিদ স্মিথ হেসে সৃজনের চুল এলোমেলো করে দেয়।

রাতে সৃজন রুমে আসলে কুহু প্যাকেটটা ওর হাতে ধরিয়ে দেয়। সৃজন প্যাকেট খুলে টি-শার্ট আর প্যান্ট দেখে খুশিতে কেঁদে দেয়। কতদিন হয়ে গেছে ও নতুন কাপড় পায়নি। এখানে আসার পর চাচা কিনে দিতে চেয়েছে অনেকবারই। কিন্তু চাচির ভয়ে ও প্রতিবারই না করে দিয়েছে।

কুহু ভাইয়ের আনন্দ দেখে নিজেও কেঁদে ফেলল।

” আপু, এই প্যাকেটে কি আছে? ” অপর প্যাকেট দেখাল সৃজন।

” জানিনা এতে কি আছে। আগে দেখে নেই। ”

কুহু প্যাকেট খুলে অবাক হয়ে গেছে। সেখানে দুইটা থ্রী-পিস। একটা হালকা কলাপাতা রংয়ের আরেকটা রানী গোলাপি রংয়ের। দুইটা থ্রী-পিসই সুতির। এবং পুরোটাতেই সুতার কাজ। কুহু অবাক হয়ে থ্রী-পিস দুটো হাতে নিয়ে বসে আছে। তাহমিদ সৃজনকে কিনে দিয়েছে এটা না হয় মানা যায়। কিন্তু তাই বলে ওকে কেন কিনে দিতে গেল!

” আপু, দেখতো এটা কিসের কাগজ? প্যাকেটের ভেতর ভাঁজ করা ছিল। ” কুহু দেখল সৃজন এক টুকরা কাগজ হাতে নিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

কহু কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলতেই আরেকবার চমকে যায়। কাগজে গোটা অক্ষরে কিছু লিখা আছে।

” শোন মেয়ে, আমি যদি দেখি তুমি থ্রী-পিসগুলো ফেলে রেখছ, তবে তোমার সব কাপড় আমি আ’গু’নে পু’ড়ি’য়ে ছাই করব। আর সেই ছাই দিয়ে দাঁত মাজব। ”

তাহমিদের এমন প্রচ্ছন্ন হুমকিতে কুহু ঘাবড়ে গেছে। এই লোকটা কি ওকে এখন লিখেও হুমকি দিতে শুরু করেছে! আজব লোক।

কুহু সযতনে থ্রী-পিস দুটো আলমারিতে রেখে দেয়। সুযোগ বুঝে এগুলো ও টেইলার্সে নিয়ে যাবে। নয়তো দেখা যাবে ঐ আধপাগল লোকটা সত্যি সত্যিই ওর সব কাপড়চোপড়ে আ’গু’ন ধরিয়ে দিয়েছে।

কুহু নানিমাকে রাতের খাবার খাইয়ে দিতে এসেছে। ওকে দেখেই বৃদ্ধা হেসে উঠলেন। এক হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডেকে নিলেন কুহুকে। কুহু তার কাছে যেতেই তিনি একহাতে মেয়েটাকে বুকে জরিয়ে নিলেন। কুহু লক্ষ্য করেছে, আজকাল নানিমা ওকে একটু বেশিই আদর করছেন।

কুহু নানিমাকে খাইয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ তার সাথে গল্প করে রান্নাঘরে যায়। খালা আরেকজন মেইডকে সাথে নিয়ে টেবিলে খাবার দিচ্ছেন। কুহুও তাকে সাহায্য করতে কাজে হাত লাগায়।

রাত বারোটা বিশ। কুহু মেঝেতে বিছানা পেতে সেখানে পড়ছে । খালা কয়েকদিন থেকেই ওর সাথে ঘুমাচ্ছে। সৃজনের দিকে তাকালে দেখতে পায় সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। খালাও তাই। এদিকে কুহুর আর পড়তে ইচ্ছে করছেনা। তাই উঠে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরল। জানালার কাঁচ ভেদ করে চাঁদের রুপালি আলোয় রুম উদ্ভাসিত হয়েছে। কুহু শুয়ে থেকেই জানালার দিকে তাকায়। ও ভেতর থেকেই বুঝতে পারছে আজকে পূর্নিমার রাত। ওর মন আনচান করে উঠল। গ্রামে থাকতে প্রতি পূর্নিমার রাতেই ও বাবা-মা’ র সাথে উঠানে বিছানা পেতে শুতো। বাবা অসুস্থ অবস্থায়ও ওদের নিয়ে পূর্ণিমা রাতে উঠাতে বসত। কতরকম গল্প শোনাত বাবা। আজ বাবা নেই, মা নেই। গ্রামের সেই বাড়িটা ঠিকই আছে। কিন্তু পূর্নিমা রাত দেখার মত সেখানে আর কেউ নেই। অঝোরে কুহুর চোখ দিয়ে অশ্রুবৃষ্টি ঝরতে থাকে। বাবা-মা’ র শূন্যতা আরেকবার উপলব্ধি করল ও। আজ বাবা-মা বেঁচে থাকলে ওদের এমন উদ্বাস্তুদের মত জীবন কাটাতে হতোনা। অনেকক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর কুহু কি মনে করে রুমের দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

ছাদের দরজা খোলা দেখে কুহু চিন্তায় পরে যায়। আজকে ও একবারও ছাদে আসেনি। তবে শেষে যে ছাদে এসেছে, সে দরজা না লাগিয়ে রেখেই চলে গেছে! নাহ্ কালকে খালাকে বলতে হবে।

আজ কুহু নির্ভয়ে ছাদে এসেছে। কারন ও জানে আপাতত জয় এখন বিছানায়। আর ঐ লাফাঙ্গা ছাড়া ওকে কেউ বিরক্তও করবেনা।

ছাদে পা রাখতেই শীতল মলয় এসে ছুঁয়ে দেয় কুহুর সর্বাঙ্গ। ও অন্যদিকে না তাকিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। থালার মত চাঁদ নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে ধরনীকে করেছে গরবিনী। চাঁদের দিকে তাকিয়েই এক পা দু পা করে ও এগিয়ে যায় রেলিঙের দিকে। রেলিঙের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে অম্বর পানে চেয়ে।

এত রাতে কুহুকে ছাদে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ। মেয়ের তো সাহস কম নয়! এত রাতে ছাদে এসেছে!

তাহমিদ কিছুক্ষণ আগেই ছাদে এসেছে। ও উত্তর দিকে কয়েকটা গাছের আড়ালে চেয়ারে বসে ছিল। চাঁদের আলো থাকায় ও লাইট জ্বালায়নি। কুহু দাঁড়িয়েছে দক্ষিণের রেলিং ঘেঁষে। মেয়েটাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর ভালো লাগছেনা।

” তাকে একটু বিরক্ত করতে না পারলে যে আমার শান্তি লাগছেনা। তাহমিদ, ভাব কিভাবে ওকে বিরক্ত করা যায়। কিন্তু দেখিস তোকে দেখে সে যেন চিৎকার না দেয়। সেটা করলে তোর ইজ্জতের দফারফা হয়ে যাবে। ” তাহমিদ বিরবিরিয়ে নিজের সাথেই কথা বলছে। হঠাৎই কিছু একটা মনে আসতেই তাহমিদ হেসে ফেলল।

” কাঁটা লাগা….

কুহু এত রাতে গানের আওয়াজ পেয়ে চমকে এদিকওদিক তাকায়। হঠাৎ দেখল উত্তরদিকে থাকা গাছগুলোর পেছন থেকে আলো আসছে। ও ভয় পেয়ে গেছে। এত রাতে কে এখানে!

” ভয় পেয়োনা, চন্দ্রাবতী। আমি এখানে। কোন ভূতটুত নই। ”

তাহমিদের গলা পেয়ে কুহু আরও ভড়কে যায়। এই লোকটা ওকে একেক সময়ে একেক নামে ডাকে।

তাহমিদ হাই তুলতে তুলতে কুহুর সামনে এসে দাঁড়ায়।

” এত রাতে ছাদে কি? পেত্নীদের সাথে কনফারেন্স আছে নাকি? তা ওদের সাথে কোন ভাষায় কথা বল? ওরা কি তোমাকে সম্মান দেয়? ”

এতগুলো উদ্ভব প্রশ্ন শুনে কুহুর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।

” আমি পেত্নীদের সাথে কনফারেন্স করব কেন! আমিতো পূর্নিমায় ভিজতে ছাদে এসেছি। কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন? মামদো ভূতের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন বুঝি? ” কথাটা বলেই কুহু দুই হাতে মুখ চেপে ধরল। কি বলে ফেলল এই লোকটাকে!

তাহমিদ কুহুর এমন অবস্থা দেখে মনে মনে হাসল।

” উঁহু, আমি কারও সাথে সাক্ষাৎ করতে আসিনি। ভাগ্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে, আমার পূর্ণিমার সাথে সাক্ষাৎ করাতে। ”

কুহু কিছু না বলে রেলিঙের দিকে চলে যায়। এই লোকটার সাথে কথা বলতে চায়না ও। লোকটা কখন কি বলবে তার কোন ঠিক নেই।

” দশ মিনিট সময় দিলাম। এরমধ্যে যত খুশি পূর্ণিমা দেখে নাও। এরপর রুমে চলে যাবে। ”

” আমি মাত্রই এলাম। আর আপনি আমাকে দশ মিনিট সময় দিচ্ছেন! ”

” আপাতত দশ মিনিটেই নিজের হিয়াকে প্রবোধ দাও। ভবিষ্যতে আমি তোমার সারা রাত পূর্ণিমা দেখবার ব্যবস্থা করে দেব। সেদিন লুকিয়ে ছাদে আসতে হবেনা। অধিকার নিয়ে আসবে। নিজের অধিকার বলে বাড়ির প্রতিটা কোনায় তোমার পদচারণা থাকবে। ”

কুহু তাহমিদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলনা। ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী জামী

বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে আকাশপাতাল চিন্তায় মত্ত কুহু। ও বারবার তাহমিদের এহেন আচরণের কারন খুঁজে চলেছে। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়েই তাহমিদের এমন অধিকারবোধ দেখে কুহু বিস্মিত। যদিও পরিচয়টা শুধু তেমনভাবেও হয়নি। কিন্তু কুহু এটা বুঝতে পেরেছে লোকটা মন্দ নয়। একটা মেয়েকে মাঝরাতে একা পেয়েও যে দুরত্ব বজায় রাখে, আর যাই হোক সে কখোনো খারাপ হতে পারেনা। কিন্তু কুহু ভয় পাচ্ছে, যদি চাচির চোখে এসব পরে যায়, তখন কি হবে! কিন্তু ও নিজেই কেন তাহমিদকে এড়িয়ে চলতে পারছেনা? হাজারো ভাবনার মাঝেই কুহু একসময় ঘুমিয়ে পরল। ওর আর উত্তর খুঁজে পাওয়া হলোনা।

পরদিন সকালে ড্রয়িংরুমে এসে কুহু বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। পুরো ড্রয়িংরুমের ফার্নিচার কয়েকজন মিলে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। একপাশে নতুন ফার্নিচার রাখা হয়েছে। জানালা-দরজায় নতুন পর্দা লাগানো হয়েছে। ও একনজর চোখ বুলিয়ে রান্নাঘরে যায়।

তাহমিদও নিচে এসে অবাক হয়ে গেছে। হঠাৎ এমনভাবে বাসা সাজানোর কোন কারন খুঁজে পায়না ও। খালাকে জিজ্ঞেস করেও কিছুই জানতে পারলনা।

খাবার টেবিলে আসলে কুহু ওকে নাস্তা এগিয়ে দেয়। আজকে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় সবাই যে যার মত নাস্তা করে নিয়েছে।

” খালা, তোমরা খেয়েছ? ”

” আমি খাইছি, বাপজান। কিন্তু কুহু মা খায়নি। তার নাকি সকালে খাইতে ইচ্ছে করেনা। অনেকবার কইলাম, তবুও সে খাইলনা। ”

” তার খাওয়া লাগবেনা। আমার মনে হয় সে সন্যাসীনি। আর সন্যাসীদের না খেলেও চলে। আলো-বাতাসেই তাদের পেট ভরে যায়। তাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ, আলো-বাতাস খেয়েছে কিনা। যদি না খেয়ে থাকে তবে তার জন্য আমি সেসবের ব্যবস্থা করব। এতটুকু উপকারতো আমি করতেই পারি। ”

” আবার শুরু হয়ে গেছে খোঁ’চা দেয়া! কুহু, কেন যে তুই এই লোকটাকে নাস্তা দিতে গেলি? তুই জানিসনা, এইটা খোঁ’চা কুমার? সে খোঁ’চা দেয়া ছাড়া কিছুই বলতে পারেনা। তুই আসলেই একটা গর্দভ। ” কুহু আনমনে নিজেকেই গালি দিচ্ছে।

” গালি দেয়া শেষ হলে বসে নাস্তা করে নাও। সময় তোমার জন্য বসে নেই। ”

” আমার ক্ষুধা নেই। ” কুহু মনে মনে ভাবে, এই মানুষ বুঝল কেমন করে ও গালি দিচ্ছে!

” খালা, এই মেয়ে যেন আগামী তিনদিন খেতে না পায়। ও না খেয়ে নিজের চাচার পয়সা বাঁচাক। ”

তাহমিদের কথা শুনে রা’গে কুহুর পিত্তি জ্ব’লে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে তাহমিদকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু বরাবরের মতো কথারা কন্ঠায় এসে আটকে গেছে। তারপরও মুখ খুলল ও। কঠিন কথা না হোক, অনন্ত হালকা করে হলেও দুইটা কথা শোনাতে পারলে আপাতত শান্তি পাবে।

” তিনদিন না খেয়ে থাকতে পারব। এটা তেমন কিছুই নয়। একটু কষ্ট হলেও সহ্য করে নেব। ”

কুহুর কথা শুনে আপনাআপনিই তাহমিদের কপাল কুঁচকে আসে। ও মেয়েটাকে যতটা সরল ভেবেছিল, আদতেই যে মেয়েটা সেটা নয়, তা বুঝতে তাহমিদের দেরি হয়না। একে একটু শায়েস্তা না করলেই নয়।

” খালা, জয় যে কয়দিন এখানে আছে, সে কয়দিন তোমার এই ত্যাড়া মা তার সেবা করবে। আমি সিস্টারকে বলে দেব। ওকে এখনই জয়ের রুমে পাঠাও। জয়কে খাওয়ানো, ঔষধ খাওয়ানো, ওর যাবতীয় কাজ যেন এই মেয়ে করে। আমি খালামনিকে বলে দিচ্ছি। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুকের ভেতর ধক করে উঠল। এই লোক বলে কি! ঐ উজবুকের সামনে গেলেই নির্ঘাত সে অসভ্যতা করবে। তার হাত-পা ভাঙ্গলে কি হবে! মুখ তো ঠিকই আছে। কুহু আর কিছু ভাবতে পারলনা। চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পরল। সামনে থাকা প্লেট নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে একটা পরোটা তুলে নেয়।

কুহুর কাজ দেখে তাহমিদ মৃদু হেসে খেতে থাকল। সোজা কথায় কাজ না হলে, মাঝেমধ্যে একটু ছলনার আশ্রয় নিলে ক্ষতি কি। ছলনা থেকে যদি ভালো কিছু হয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছলনাই শ্রেয়।

কুহু ধীরে ধীরে খাচ্ছে। ওর খেতেই ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু সামনে বসে থাকা যমের ভয়ে কষ্ট করে খেতে হচ্ছে।

তাহমিদের খাওয়া হয়ে গেলে সে উঠে যায়। এরপর কুহুরও খাওয়া শেষ হয়।

কুহু খাওয়া শেষ করে নানিমার কাছে যায়। অভিযোগের ঝুড়ি নিয়ে বসে বৃদ্ধার কাছে। তার নাতির নামে বিচার দেয়।

” নানিমা, আপনার ঐ নাতিটা ভিষণ খারাপ। শুধু শুধু আমাকে ভয় দেখায়। আমার ক্ষুধা না লাগলে কি করব, বলুনতো? তাকে দেখতে যতই নিস্পাপ লাগুকনা কেন, আদতেই সে বদের হাড্ডি। বাবুর মেজাজ সব সময়ই গরম থাকে। যাকে বলে মিলিটারির মেজাজ। এই মেজাজ নিয়ে শিক্ষকতা করে কেমন করে! ছাত্রছাত্রীদের না জানি কত নাকানিচুবানি খাওয়ায়! বেচারা স্টুডেন্টসদের জন্য আমার করুণা হচ্ছে। অনেক পাপ করলেই তবে এমন শিক্ষক কারও ভাগ্যে জোটে। গোমড়ামুখোটাকে একদিনও হাসতে দেখলামনা। যেটা সবাই দেখতে চায়। কিন্তু কারো ভাগ্যে সেটা দেখা হয়না। অথচ তার ধমক কেউ শুনতে না চাইলেও ফ্রিতে সবাই সেটা পেয়ে যায়। ”

কুহু লক্ষ্য করল নানিমা এক হাত দিয়ে কিছু একটা ইশারা করছে। সে বারবার রুমের ব্যালকনির দিকে ইশারা করছে।
নানিমা কি দেখাচ্ছেন! কুহু কৌতুহলী হয়ে ব্যালকনির দিকে যায়। সেখানে হাসিমুখে বসে থাকা তাহমিদকে দেখে ওর পিলে চমকে গেছে। তাহমিদ ব্যঙ্গ হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

” আল্লাহরে! ভুল জায়গায় ঠিক কথা বলে ফেলেছি। কুহুরে, তুই আসলেই উচ্চ মাপের গা’ধী। ” কোনমতে কথাটা বলেই কুহু দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

কুহু চলে যেতেই তাহমিদ হো হো করে হেসে উঠল। ও খাবার পর নানিমার কাছে এসেছিল। তখনই একটা ফোন আসায় ব্যালকোনিতে যায়। তার কিছুক্ষণ পর রুমে কুহু আসে। আর তারপরই বেচারি ফেঁসে যায়।

তাহমিদ নানিমার কাছে এসে বসল। ও তখনো হেসেই চলেছে। আচ্ছা জব্দ করেছে ও মেয়েটাকে।

” বুঝলে নানিমা, আমার পাখিটা কিন্তু বেশ দুষ্টু। শুধু ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়াল দেয়। বেশতো অভিযোগ করছিল। হঠাৎ করে ব্যালকনিতে গেল কেন! নিশ্চয়ই তুমি ইশারা করেছিলে? মোটেও ঠিক করনি। এই সুযোগে ওর মনের সব কথা আমি জেনে নিতাম। যেগুলো ও আমার জন্য মনেই জমা রেখেছে। ”

তাহমিদের কথা শুনে নানিমাও হাসল।

” ভালো কথা, নানিমা। বাসায় আজ সাজ সাজ রব কেন? কি হতে চলেছে? তোমার দুই মেয়ে বাসা নতুন করে সাজিয়েছে। ”

বৃদ্ধা হাত নাড়িয়ে বললেন, তিনি কিছুই জানেননা।

বিকেলে কোচিং থেকে বের হতেই কুহু দেখল তাহমিদ কোচিংয়ের সামনে দোকানে বসে আছে। তাহমিদ কুহর দিকেই তাকিয়ে আছে। কুহু সেটা দেখেই চোখ নামায়।

” বাব্বাহ্, আজ ভদ্রলোক দোকানে কেন! ” নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করল কুহু।

তাহমিদ কুহুকে দেখে উঠে এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। কেউ কোন কথা বলছেনা। কুহু ভয় পাচ্ছে সকালের ঘটনার জন্য। না জানি বদ লোকটা কখন কি বলে বসে।

কিন্তু কুহুকে অবাক করে দিয়ে তাহমিদ চুপ থাকে। ও চুপচাপ হাঁটছে। ওর পাশাপাশি হাঁটছে কুহু। যেন নীরবতাই ওদের দুজনের পথ নির্দেশ করছে। একজন আগে থেকে ঠিক করা গন্তব্যে হাঁটছে। তার পাশে অপরজন কোন দ্বিধা ছাড়াই হেঁটে চলেছে।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর তাহমিদ রিক্সা নিল। কুহু আরেকবার অবাক হয়। ও চিন্তা করছে, রিক্সাই যখন নিবে, তখন আবার হাঁটলো কেন? কিন্তু মেয়েটাতো জানেনা, তাহমিদের খুব ইচ্ছে ছিল ওর পাশাপাশি হাঁটার। হাঁটার ফাঁকে আলতোকরে ওর হাত ছুঁয়ে দেয়ার তীব্র বাসনা জন্মেছে তাহমিদের মনে।

তাহমিদ রিক্সাওয়াকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বলল। কুহু কোন প্রশ্ন করলনা। তাহমিদের সিদ্ধান্তকে মনে মনে সায় দিল। প্রতিবারের মত তাহমিদ কুহুর পেছন দিয়ে হাত নিয়েছে। তবে আজ কুহুর ভেতর তেমন একটা জড়তা নেই।

ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে তাহমিদ বাদাম, পপকর্ন আর চকলেট নিল। কুহু এবারও চুপচাপ দেখে গেল।

ক্যাম্পাসের ভেতর এসে ফাঁকা জায়গা দেখে বসল তাহমিদ। ওর দেখাদেখি কুহুও বসল।

বাদামের প্যাকেট কুহুর দিকে বাড়িয়ে দিলে কুহু আপত্তি জানায়।

” বাদাম খেতে ভালো লাগেনা। ”

” কেন! ”

” ছিলতে বিরক্ত লাগে, তাই। ”

তাহমিদ কিছু না বলে কয়েকটা বাদাম ছিলে কুহুর দিকে এগিয়ে দেয়। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কুহু তাহমিদের দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে চোখাচোখি হয় দুজনের। কুহু এখন পর্যন্ত ভালোভাবে তাহমিদের দিকে তাকায়নি। আজ হঠাৎই তাহমিদকে কাছ থেকে লক্ষ্য করল।

সরোবরের স্বচ্ছ পানির মত তার টলটলে চোখজোড়ায় বড্ড মায়া মেশানো। টিকোলো নাক, পুরুষ্টু কালচে খয়েরী ঠোঁট। চওড়া কপাল। কাঁচা হলুদের ন্যায় গাত্রবর্ণের তাহমিদকে সুপুরুষ বলাই যায়। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়েই কুহু চোখ নামিয়ে নিল। হঠাৎই সামনে বসা এই যুবকটিকে ওর কাছে বেশ আকর্ষনিয় মনে হচ্ছে।

কুহুকে মাথা নিচু করতে দেখে হাসল তাহমিদ। এতদিন পর মেয়েটা ওর দিকে সরাসরি তাকিয়েছে, ভাবতেই ভালো লাগছে।

” চোখ নামিয়ে নিলে যে? আমাকেও নাহয় দেখতে দিতে তোমার কাজল দীঘির ন্যায় গভীর চোখজোড়া। আমি আরেকবার ডুবতাম তোমার আঁখিপল্লবের ঝলকানিতে। ”

কুহু এবার বেশ লজ্জা পায়। ওর শ্যামলা চেহারায় লালচে আভা ফুটে উঠল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে লজ্জা নিরারণের মিছেই চেষ্টা করল। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে, তাহমিদ ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

তাহমিদ হঠাৎই হো হো করে হেসে উঠল। ওর হাসিতে প্রকম্পিত হল চারপাশ। বিকেলের আবছা আলোর রোশনাই ঝরে পরল ধরনীতে। আশেপাশের কয়েকজন মেয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তাহমিদের দিকে। এই সুযোগে কুহু আরেকবার তাকালো হাস্যরত মানুষটার দিকে। এই প্রথম লক্ষ্য করল তাহমিদের গজ দাঁতটি। কুহু মুগ্ধ হয়ে দেখছে মানুষটার হাসি। কাউকে হাসলে এত চমৎকার লাগে, এটা আজই প্রথম উপলব্ধি করল।

চলবে….

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১৫+১৬

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৫
জাওয়াদ জামী জামী

” নানিমা, তারাতারি খেয়ে নিন। আজকে আমি চিংড়ির মালাইকারি করেছি। খেয়ে আমাকে ইশারায় বলুন কেমন হয়েছে। ” কুহু ফাতিমা খানমকে খাইয়ে দিচ্ছে আর কথা বলছে।

ফাতিমা খানম তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছেন। তার চোখেমুখে তৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ দেখে কুহুর বেশ ভালো লাগছে।

” নানিমা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। অনুমতি দেবেন? ” কুহু নানিমার অনুমতির অপেক্ষায় তার দিকে তাকিয়ে আছে।

ফাতিমা খানম মাথা ঝাঁকিয়ে অনুমতি দিলেন।

” আপনার ঐ হ্যাংলা, ছ্যাঁচড়া নাতি আর কতদিন থাকবে বলুনতো? নির্লজ্জ, বেহায়া লোক একটা। আমার সাথে শুধু অসভ্যতামি করার তালেই থাকে। তাকে দেখলে মনে হয় কোন গহীন জঙ্গল থেকে শেকল পরা উজবুক উদয় হয়েছে। ” বৃদ্ধা ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে আছেন কুহুর দিকে।

এদিকে কুহু বৃদ্ধাকে খাওয়াচ্ছে আর কথা বলছে।

” আপনার দুই নাতিই চিজ মাইরি। একজন ছ্যাঁচড়া, আর আরেকজন খোঁ’চা কুমার। এই যে আমি কত যত্ন করে চিংড়ির মালাইকারি রান্না করলাম। আর সে কিনা আমাকে বলে টেস্ট করে দেখতে! আমি যদি লবন দিয়ে তরকারি তিতা করে ফেলি! আমি কি ইচ্ছে করে তরকারি নষ্ট করব, বলুন? আবার আমাকে গা’ধা, গা’ধী বলে ডেকেছে। কথায় কথায় আমাকে ধমকায়। যার নিজের স্বভাব শাখামৃগের ন্যায়, আর সে কিনা আমাকে গা’ধা বলে! আমি নেহাৎ ভদ্র মেয়ে তাই ঐ খোঁ’চা কুমারকে কিছু বলিনা। তাই বলে কিন্তু ঐ ছ্যাঁচড়া, লালমুখো হ’নু’মা’ন’কে ছেড়ে কথা বলবনা। সে আমাকে বলে তার সাথে ডেটিংএ যেতে! ”

কুহুর কথা শুনে ফাতিমা খানম চমকে তাকান। কুহু যে শেষের কথাগুলো যে জয়কে উদ্দেশ্য করে বলেছে, সেটা তার বুঝতে বাকি থাকেনা।

তাহমিদ রা’গে হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। জয়ের সাহস দেখে ও অবাক হয়ে গেছে। এতক্ষণ ও দরজার বাহিরে হেলান দিয়ে কুহুকে পাহারা দিচ্ছিল। ও যখন দেখল কুহু খাবার নিয়ে নানিমার কাছে যাচ্ছে, তার কিছুক্ষণ পরই ও এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। জয় এখন বাসায় আছে। কুহুকে এই রুমে দেখলেই ও নিশ্চয়ই এসে মেয়েটাকে বিরক্ত করবে। তাই নিজের অস্তিত্ব কুহুকে বুঝতে না দিতে চুপচাপ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এদিকে কুহু নানিমাকে খাওয়ানোর সময় কথাগুলো বলছিল।

তাহমিদ উঁকি দিয়ে দেখল নানিমার খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। এবার মেয়েটাকে জব্দ করাই যায়।

” নানিমা, তোমার এই টেপরেকর্ডার সময়ে-অসময়ে এভাবে বাজে কেন বলত? তার মুখ যদি এভাবে মেশিনগানের মত চলতে থাকে, তবে যে কোন সময় সার্কিট ডাউন হয়ে যেতে পারেনা কি? তাকে দেখলে মনে হয়, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেনা। কিন্তু এখন দেখছি, ভাজা মাছ উল্টে না খেয়ে সরাসরি চিবিয়ে খায়। আমাক যেন কি উপাধি দিয়েছে? ও হ্যাঁ, শাখামৃগ আর খোঁ’চা কুমার। এই টেপরেকর্ডার তোমার মাথার উকুন বাছতে হবে নাকি? শাখামৃগ কিন্তু এই কাজটা খুব ভালো পারে। তবে নড়াচড়া করা চলবেনা মোটেও। একটু নড়েছ তো ফ্রিতে মিলবে কা’ম’ড় আর আঁ’চ’ড়। লাগবে নাকি কা’ম’ড়? ” তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে বাম চোখ টিপল।

হঠাৎ রুমে তাহমিদের আগমনে কুহু চমকে গেছে। তারপর আবার ওর উল্টাপাল্টা কথা শুনে বেশ ভড়কে যায়। দ্রুত হাতে নানিমার মুখ মুছে দেয়। ও বেশ বুঝতে পারছে, তাহমিদের কাছে ও আচ্ছামত ধরা খেয়েছে।

” নানিমা, আমি এখন যাই। ” ও রুম থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে।

” কোথায় যাচ্ছ, ভদ্র মেয়ে! খোঁ’চা কুমারের খোঁ’চা শরীরে না মেখেই পালাই পালাই করছ কেন? আগে তার খোঁ’চায় নিজেকে জর্জরিত কর। তারপর যাও। ”

কুহু আপাতত তাহমিদের কথা শোনার মুডে নেই। ও রুম থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে। তাই কোনদিকে না তাকিয়ে হুড়মুড় করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

কুহুর এভাবে পালানো দেখে তাহমিদ হো হো করে হেসে উঠল।

” কি বুঝলে, নানিমা? ভীতু মেয়ে। ওকে জ্বা’লি’য়ে মজা আছে। তবে জয় ওর সাথে বাড়াবাড়ি করছে। ওকে থেরাপিতে দিতেই হবে। আমার কাছে ওর লাঠি থেরাপি পাওনা হয়েছে। দুই একেই ওর পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে। ওর কতবড় সাহস আমার শখের নারীর দিকে নজর দেয়! ঐ ভীতু হরিণীর ভীতু চোখ, কম্পমান ঠোঁট, ওর ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া, ভয়ে চুপসানো মুখ শুধুই আমি দেখব। আমি ওর হাজার রূপে মুগ্ধ হতে চাই। এমনকি ওর সাথে ফ্লার্টও আমিই করব। কিন্তু মাঝখানে জয় এসে আমার সব স্বপ্ন ভেস্তে দিচ্ছে। আমার সব অধিকারগুলো ও কেড়ে নিচ্ছে। ”

ফাতিমা খানম এক দৃষ্টিতে তার নাতির দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটার চোখের দ্যুতি তার নজর এড়ায়নি। ঐ স্বচ্ছ চোখের ভাষা তিনি পড়ত পারছেন। কুহুর কথা বলার সময় ছেলেটার চোখেমুখের আলাদা উজ্জ্বলতাও তার দৃষ্টি কেড়েছে। ছেলেটা সত্যি কুহুকে ভালোবাসে। তারও কুহুকে বেশ পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা যেমন নম্র, শান্ত তেমনি মিষ্টভাষী। তার নাতির সাথে কুহুকে বেশ মানাবে। তার আজ হঠাৎ করেই আর কিছুদিন বাঁচার সাধ জাগল। এতদিনে ছেলেটা মত পাল্টেছে। কাউকে কাছে পেতে চাইছে। তিনি নিজের তার নাতির প্রাপ্তির খাতা পূর্ণ দেখতে চান। এই নাতি তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। নিজের সন্তানদের থেকেও প্রিয় এই ছেলেটা। এই ছেলের সুখ দেখে ম’র’তে পারলে, তার সব চাওয়া পূর্ণ হবে। তিনি মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকলেন।

তাহমিদ ওর নানিমার মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে। বৃদ্ধা মাঝেমধ্যে হাত নাড়িয়ে কিছু বলতে চাইছেন। তাহমিদ সেটা দেখে হাসল।

” ধৈর্য্য ধর, নানিমা। আগে সে বুঝুক আমি তাকে কতটা ভালোবাসি। তারপর সে আমার ভালোবাসায় ধরা দিক। তাকে আগে বুঝতে হবে আমার ভালোবাসার গভীরতা। আমি ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসা আদায়ে বিশ্বাসী। যে ভালোবাসার মাঝে কোন খাঁদ থাকবেনা, সে ভালোবাসা আমি দিতে চাই আবার নিতেও চাই। ”

বৃদ্ধার চোখে খুশিতে পানি এসেছে। তিনি নাতির মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।

কুহু তাহমিদের কাছ থেকে লুকিয়ে আছে। ও তাহমিদের সামনে পরতে চায়না। আর না শুনতে চায় লোকটার খোঁ’চা মা’রা কথা। সেদিন রাত, পরদিন সকাল, দুপুর তাহমিদের কাছ থেকে লুকিয়ে রইল। বিকেলে যথারীতি কোচিং-এ গেছে। এরমধ্যে জয় ওকে বিরক্ত করার চেষ্টা করেছে কিন্তু রাজিয়া খালার হস্তক্ষেপে ওকে থেমে যেতে হয়।

কোচিং থেকে বেরিয়ে অটোরিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে কুহু। এমন সময় কোথায় থেকে ওর সামনে উদয় হয় তাহমিদ। ও রিক্সায় এসেছে।

” উঠে পর, ভদ্র মেয়ে। ”

” আমি একাই যেতে পারব। ” কুহু গোমড়ামুখে উত্তর দেয়।

” ওহ্ বুঝেছি। তোমার জয়ের সাথে যাওয়ার সাধ জেগেছে। ওকে, আরেকটু সামনে যাও। ওকে পেয়ে যাবে। এরপর দু’জন একসাথে রিক্সা বিলাস কর। এমনিতেই তোমার পাশে ওকে ভালো মানায়। ”

জয়ের কথা শুনে কুহু ভয় পেয়ে গেছে। ও আর কোন কথা বাড়ায়না। রিক্সায় উঠে বসল। জয়ের সামনে পরার থেকে এই মানুষটার সাথে যাওয়া নিরাপদ।

রিক্সা উল্টাদিকে ঘুরতে দেখেই কুহুর পিলে চমকে যায়। বাসার রাস্তা তো এদিকে নয়!

” একি! কোথায় যাচ্ছেন! বাসাতো এদিকে নয়? রিক্সা পেছনে ঘোরাতে বলুন। আমি বাসায় যাব।”

” কথা না বলে চুপচাপ বসে থাক। ”

” আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ”

” বিক্রি করে দিতে। ”

” কিহ্! মামা, রিক্সা থামান। আমি নেমে যাব। ” কুহু এবার উপায় না দেখে রিক্সাওয়ালার শরণাপন্ন হয়।

” তোমার মামাকেসহ রিক্সা আমি ভাড়া করেছি, তাই তোমার মামা শুধু আমার কথাই শুনবে। তাই চুপচাপ কোন কথা না বলে বসে থাক। অযথা চিৎকার করে গলা ব্যথা করার প্রয়োজন নেই। ”

তাহমিদের এহেন কথা শুনে কুহু এবার ভয় পেয়ে গেছে। ও আকুতি নিজেকে তাহমিদের দিকে তাকায়। কিন্তু তাহমিদকে নির্বিকার বসে থাকতে দেখে ভয়ের মাত্রা বেড়ে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ পর রিক্সা এসে একটা দোতলা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়ায়। তাহমিদ ভাড়া মিটিয়ে কুহুকে নামতে বললে কুহু গাঁট হয়ে বসে রয়।

” আপনি যান। আমি এই রিক্সাতেই বাসায় যাব। ”

” ওহ্ বুঝেছি, আমার কোলে উঠতে ইচ্ছে করছে। আগে বললেই পারতে। মামা, একটু সাইড দিন আর আমার দিকে নজর রাখুন। ম্যামকে কোলে নিই। এই কাজে আমার আবার অভিজ্ঞতা নেই। আপনার ভাগ্নীর ওজন সম্পর্কেও আমার ধারনা নেই। পরে যেতে লাগলে ধরবেন, কেমন? ” তাহমিদ শার্টের হাতা গুটিয়ে এগিয়ে যায় কুহুর দিকে। কুহু তাহমিদকে এগোতে দেখে এক লাফে রিক্সা থেমে নেমে যায়।

” চলুন, আমি হেঁটেই যাচ্ছি। ”

তাহমিদ কুহুর চুপসানো মুখ দেখে মজা পায়। রিক্সাওয়ালাও ওদের কান্ড দেখে হেসে ফেলে।

দোতলায় এসে কলিংবেল বাজিয়ে অপেক্ষা করছে ওরা। কুহু এতক্ষণে লক্ষ্য করল তাহমিদের হাতে তিনটা প্যাকেট।

দরজা খুলে তাহমিদকে দেখে অবাক হয়ে গেছে সজল। তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছে ওর সাথে অচেনা একটা মেয়েকে দেখে।

” দোস্ত তুই! আমাকে চমকে দিয়েছিস কিন্তু । আয় ভেতরে আয়। ” সজল দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।

তাহমিদের পেছন পেছন কুহুও ভেতরে ঢোকে।
তাহমিদ সজলের হাতে প্যাকেটগুলো ধরিয়ে দিতেই সজল খেঁকিয়ে উঠল।

” শা’লা, এসব কি নিয়ে এসেছিস? তোর জিনিস তুইই নিয়ে যাস। রাতে বসে বসে খাবি। এতে তোর খাওয়ার খরচ কমবে। আমার সাথে তোর ফর্মালিটির সম্পর্ক তাইনা? শা’লা ঘাড়ত্যাড়া পাব্লিক। ”

” নতুন একটা মানুষের সামনে আমাকে এভাবে বলিসনা। এই মেয়ে এমনিতেই আমাকে ইজ্জত দেয়না। এখন তোর কথা শুনে আমাকে আর জীবনেও দাম দেবেনা। একে দেখতে যতই বোকাসোকা লাগুকনা কেন, আদতে এই মেয়ে কিন্তু তা নয়। ”

এবার সজল একটু শান্ত হয়। কুহুর দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করল।

” তা এই বাচ্চা মেয়েকে কোথায় থেকে ধরে এসেছিস? আজকাল অন্যকোন ব্যবসাও শুরু করেছিস নাকি! কই আমিতো জানতামনা। ”

” তুই চুপ করবি নাকি আমি বেরিয়ে যাব? শোন এই বাচ্চা মেয়ে তালুকদার সাহেবের ভাতিজী। তবে এ দেখতে যতই বাচ্চামত হোকনা কেন মেয়ে কিন্তু সেয়ানা। ”

এবার কুহুর চরম রা’গ হয়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

” আপনি যতই যাই বলুন না কেন, মেয়েটা কিন্তু কিউট আছে। তোমার নাম কি কিউটি? ” সজলের বউ মায়া এসে দাঁড়ায় ওদের মাঝে।

” আমার নাম কুহু। ”

” বাহ্ সুন্দর নাম। দাঁড়িয়ে আছ কেন বস। আর ওদের কথায় কান দিওনা। ওরা এমনই। তাহমিদ ভাই, আপনি মানুষ কিন্তু সুবিধার নন। কালকে আমি কতগুলো রান্না করলাম কিন্তু আপনি আসলেননা। আর আজ সাথে করে এই কিউটিকে নিয়ে আসলেন কিন্তু খবর দিলেননা। ”

” তোমার এই কিউটিকে নিয়ে আসব জন্যই কাল আসিনি। তোমার খাবার নিয়ে এত টেনশন করতে হবেনা। শুধু চা খাওয়ালেই চলবে। দুপুরে পেটপুরে খেয়েছি। তাই এখন অন্যকিছু না খেলেও চলবে। ”

” দুপুরে কি খেয়েছিস, দোস্ত? আগে কখনোই শুনিনি তুই পেটপুরে খাস। ” সজলের চোখে সন্দেহ। যে ছেলে মেয়েদের আশেপাশে ভিড়েনা হঠাৎ সেই ছেলে একটা বাচ্চা মেয়েকে সাথে করে ওর বাসায় এসেছে। বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে সজলকে।

” বিফ বিরিয়ানি, ভাত, রোস্ট, ইলিশের দোপেঁয়াজা সবই খেয়েছি। এখন কি তোর এসব খেতে ইচ্ছে করছে? তবে অফ যা। তোকে কিছুই দেয়া হবেনা। এই যে ভদ্র মেয়ে? এটাকে দেখ। এটা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের মাস্টার। ভালো করে চিনে রাখ। তুই একে চিনে রাখ, মাস্টার। তোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যই এ কোচিং করছে। ”

এবার সজল কুহুর সাথে কথা বলতে শুরু করে। কুহুও কিছুক্ষণ পর থেকে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মায়াকে ওর ভিষণ পছন্দ হয়েছে। সেই সাথে সজলকেও। ওরা বেশ মিশুক।

মায়া সজল ওদের রাতো খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি করলেও ওরা থাকলনা। কারন তাহমিদ জানে কুহুর ফিরতে দেরি হলে ওর খালা কি করতে পারে। তবে ওকে কথা দিতে হল আরেকদিন কুহুকে নিয়ে আসতে হবে।

বাসায় ফেরার পথে কুহু কোন কথা বললনা। চুপচাপ রাস্তার চারপাশ দেখতে থাকল।

তাহমিদ গতকালের মত আজকেও রিক্সার পেছনে হাত রেখে বসেছে। বিষয়টা খেয়াল করে কুহু আনমনে হেসে ফেলল।

” মামা, রাজশাহীতে কোন পা’গ’লা গারদ আছে? থাকলে রিক্সা সেদিকে নিন। আমার পাশে বসা মেয়েটা একা একা হাসছে। এর ভাবগতিক সুবিধার লাগছেনা। ” রিক্সাওয়ালা তাহমিদের ইয়ার্কি বুঝতে পেরে জোরে হাসল।

কুহু কটমটিয়ে তাহমিদের দিকে তাকাতেই, তাহমিদ বুকের বাঁ পাশ চেপে ধরে পরে যাওয়ার ভান করল।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৬
জাওয়াদ জামী জামী

রাত এগারোটা। জয় কানে হেডফোন গুঁজে, গান শুনতে শুনতে বাসায় ফিরছিল। বাসা থেকে কিছুটা দূরে ফাঁকা একটা জায়গায় হঠাৎই একজনের সাথে ধাক্কা লাগল।

” কি রে মামুর ব্যাটা, ধাক্কা দিলি কেন বে? ”

” সরি ব্রো, আমি বুঝতে পারিনি। ” কান থেকে হেডফোন খুলে বলল জয়।

” চুপ শা’লা। আগে বল ধাক্কা দিলি কেন? ” ছেলেটা তেড়ে আসল জয়ের দিকে।

জয় কিছু বুঝে উঠার আগেই আরও চারজন ছেলে সেখানে হাজির হয়। তারা একজোট হয়ে জয়ের সাথে ঝগড়া শুরু করে। একপর্যায়ে একটা ছেলে জয়কে থা’প্প’ড় দেয়। জয়ও তেড়ে গিয়ে সেই ছেলেকে থা’প্প’ড় দেয়। সেই সাথে আজেবাজে গালিও দেয়। এতে ছেলেরা রে’গে গিয়ে জয়কে থা’প্প’ড় মা’র’তে থাকে।

পাঁচজনের সাথে একা পেরে উঠলনা জয়। ও নেতিয়ে গেছে। হঠাৎই পেছন থেকে একটা শক্তপোক্ত হাত ওকে পেঁচিয়ে ধরল। পিঠমোড়া করে বাঁধল ওকে। এরপর চোখও বেঁধে দেয়। হঠাৎই জয় অনুভব করল ও রাস্তায় হুটোপুটি খাচ্ছে। ওর বাম গাল, কান অসার হয়ে গেছে। এবার জয় ভয় পেয়ে গেছে। ও কোন অনুভূতি ব্যক্ত করার আগেই কেউ ওর পায়ে হকিস্টিক দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। পাঁচজন ছেলে তখন নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে রাস্তায় অসহায়ের মত পরে থাকা জয়কে। ওর মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে আসছে। মা’রে’র কারনে ওর জ্ঞান প্রায় লুপ্ত হয়েছে। তবে পুরোপুরি জ্ঞান হারানোর আগে কারও কয়েকটা তেজদ্বীপ্ত বাক্য ওর কুর্নকুহরে প্রবেশ করল। ওর কানে কথাগুলো পৌঁছালেও মস্তিষ্ক ধরতে পারলনা গলাটা কার। সেই ব্যক্তি বেদম পেটাচ্ছে আর বলছে,

” তুই কার সম্পদে হাত দিয়েছিস, একবারও ভেবে দেখেছিস? আমার সম্পদে হাত বাড়ানো দূরের কথা, কেউ চোখ তুলে তাকালে আমি সেই চোখ উপড়ে ফেলব। আমার জিনিস দেখার অধিকার শুধু আমারই আছে। তুই নরকের কীট নরকেই থাকবি। সেটা না করে, আমার সম্পর্কের মাঝে থার্ড পারসন হতে এসেই অকালে হাত-পা ভাঙতে হচ্ছে। এটা ফার্ষ্ট এ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং। এরপর তোর ছোঁকছোঁক স্বভাব দেখলেই মাটিতে পুঁতে দেব। কেউ কিচ্ছুটি টের পাবেনা। ”

পুরো কথা শোনার আগেই জয় জ্ঞান হারায়।

রাত একটা পঁচিশে শায়লা হাসান তাহমিদের রুমের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।

তাহমিদ দরজা খুলে চোখ কচলে তাকায়।

” তাহমিদ, আমাকে নিজেকে মেডিকেলে চল। তারাতারি রেডি হয়ে নাও। ” শায়লা হাসানের ব্যাকুল গলায় বলল।

” কেন খালামনি! এই রাতে মেডিকেলে যাবে কেন? কি হয়েছে তোমার? ”

” আমি ঠিক আছি। জয়ের নাকি কিছু হয়েছে। ওর ফোন থেকে একজন আমাকে ফোন দিয়ে জানাল, জয়কে নাকি মেডিকেলে এডমিট করা হয়েছে। এখন কথা বলার সময় নেই। তুমি রেডি হয়ে এস। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলেছি। ”

তাহমিদ একটা হাই তুলে হেলতে দুলতে ওয়াশরুমে ঢুকে, চোখমুখে পানি ছিটিয়ে বেরিয়ে আসল।

শায়লা হাসান ছেলেকে দেখা মাত্রই কেঁদে উঠল। ভাঙ্গা ডান হাত আর বাম পা নিয়ে বেডে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে জয়। ওর পুরো শরীরে মা’রে’র কালসিটে দাগ দেখে শিউরে উঠেছে শায়লা হাসান ও নায়লা আঞ্জুম।

বেডের একপাশে নির্বিকারচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। ওর পাশে রায়হান আহমেদ দাঁড়িয়ে ঘন ঘন হাই তুলছেন।

শায়লা হাসান তোড়জোড় করছে জয়কে এখান থেকে নিয়ে যেতে। সে তার ছেলেকে ভালো কোন ক্লিনিকে এডমিট করতে চায়। সে ইতোমধ্যে ফোনে বেশ কয়েক জায়গায় কথা বলেছে।

” তাহমিদ, এসব কি! মেডিকেলে কি মানুষের চিকিৎসা হয়না? জয়কে একটা রাত এখানে রাখলে কি হবে। কাল সকালেই না-হয় কোন ক্লিনিকে নিত। আমি এখানে আসতেই চাইনি। শুধু তোমার খালার খ্যাঁচখ্যাঁচানির জন্য আসলাম। এমনিতেই এই জয়কে আমার পছন্দ হয়না। কেমন একটা লাফাঙ্গা টাইপের ছেলে। ”

” আপনাকে চাচাশ্বশুর বানাতে সে তৎপর হয়ে গেছে। এটা আপনি জানার পর কি প্রতিক্রিয়া দেখান, সেটা দেখার বড় সাধ হচ্ছে। ” বিরবিরিয়ে বলল তাহমিদ।

” কিছু বললে? ”

” হুম? বললাম, সবই কর্মফল। ”

রায়হান আহমেদ এই বিষয়ে কথা বলার আগ্রহবোধ করলেননা। তিনি বাহিরে গিয়ে সিগারেট ধরালেন।

রাত তিনটা নাগাদ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেন রাজিয়া খালা। তিনি জয়কে দেখে আৎকে উঠেছেন। ওকে স্ট্রেচারে করে বাসায় নিয়ে এসেছে! কুহু একপাশ থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখল। জয়ের এই অবস্থা দেখে ওর খারাপ লাগলেও, ওর ইচ্ছে করছেনা জয়ের কাছে যেতে। তাই ও নিজের রুমে চলে যায়। তাহমিদ আঁড়চোখে কুহুকে দেখে মৃদু হাসল।

সকাল থেকে শায়লা হাসান ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছেলের দেখাশোনা করছে। দুইজন ডক্টর এসেছে জয়ের চেক-আপ করেছে। শায়লা হাসান চাচ্ছে ছেলেকে নিয়ে যত তারাতারি সম্ভব খুলনা ফিরে যেতে। জয়ের বাবা খালেদ হাসান ছেলেকে চিকিৎসা করাতে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবেন। তিনি ইতোমধ্যেই সব ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন। এটা তিনি খুলনা থেকে ফোনেই জানিয়েছেন।
কুহু অবাক হয়ে এদের কাজকর্ম দেখছে। তবে এখন পর্যন্ত ও জয়ের আশেপাশে যায়নি। আর ওর সেখানে যাওয়ার মোটেও ইচ্ছে সেই।

সেদিন শায়লা হাসানের খুলনা যাওয়া হলোনা। ডক্টর তিন-চার দিন জয়কে কোথাও নিতে বারণ করেছেন। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী পাঁচদিন তারা রাজশাহীতেই থাকবে।

কুহু সকালে খালাকে যতটা সম্ভব কাজে সাহায্য করেছে। নানিমাকে খাইয়ে দিয়েছে। তারপর টুকিটাকি কাজ সেড়ে ও বেরিয়ে পরে কোচিং-এর উদ্দেশ্যে। একসাথে দুইটা কোচিং করে বাসাটা আসবে।
আজকে বাসা থেকে বেরিয়ে কুহু একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আজকে জয়ের ভয় ওকে তাড়া করছেনা। কিন্তু ছেলেটার জন্য ওর সত্যিই খারাপ লাগছে। কুহু একটা মানুষকে যতই অপছন্দ করুক, তাই বলে তার খারাপ চাইতে ও কখনোই পারেনা। সেই শিক্ষা ও পায়নি।
আজ আশেপাশে তাহমিদকেও দেখলনা। কুহু জানতেই পারেনি, তাহমিদ আরও আগে বাসা থেকে বেরিয়েছে।

কোচিং শেষ করে রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই কোথায় থেকে তাহমিদ এসে হাজির। আজও সে রিক্সা নিয়ে এসেছে। কুহু তাহমিদকে দেখে চোখ ছোট করে তাকায়।

” এভাবে তাকিয়ে না থেকে রিক্সায় উঠো। তোমার জন্য মামার সময় বসে থাকবেনা। ” বরাবরের মতোই খোঁ’চা দিল তাহমিদ।

কুহুর খুব করে ইচ্ছে করলো লোকটাকে বলতে, ও তার সাথে যাবেনা। সেই সাথে কয়েকটা কথাও শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু ওর সব কথা কন্ঠায় এসে আটকে গেল। কুহু ভেবে পায়না জয়কে কিছু বলার সময় ওর তো এমন হয়না! কিন্তু এই লোকের সামনে আসলেই কথারা কেন এভাবে বেইমানী করে?

” চিন্তাবতী, রিক্সায় উঠেও তো চিন্তা করা যায়? তুমি রিক্সায় উঠে যত খুশি চিন্তা কর। ”

কুহু কিছু না বলে রিক্সায় চড়ে বসে। ও গতদিনের মতই জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। তাহমিদও ওর থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। কিন্তু ওর হাত ঠিকই পেছনে রেখেছে, যাতে কুহু ব্যথা না পায়।

আজও উল্টোদিকে রিক্সা যেতে দেখে কুহু কিছু একটা ভেবে তাহমিদের দিকে তাকায়।

” আজও কি আমাকে বিক্রি করতে নিয়ে যাবেন? ”

হঠাৎ কুহুর এমন কথা শুনে তাহমিদ ভড়কে যায়। পরক্ষনেই ওর গতকালের বলা কথাগুলো মনে হয়। সে-ও কম যায়না। কুহুকে খোঁ’চা দেয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।

” হুম। কালকের মত তিড়িংতিড়িং করছনা যে? ভয় কি তবে কেটে গেছে! ”

” যা পাবেন তার আধাআধি ভাগ হবে কিন্তু। অর্ধেক আপনার, অর্ধেক আমার। ”

তাহমিদ এবার ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ও কুহুর কথার মানে বুঝতে পারেনি। তাই সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চায় কুহুর দিকে।

কুহু সেটা বুঝতে পেরে অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে রেখে বলে,

” ঐ যে আমাকে বিক্রির টাকার আধাআধি ভাগের কথা বললাম। ”

তাহমিদ কুহুর এমন কথা শুনে রে’গে উঠল।

” ফাজিল মেয়ে, কতবড় সাহস আমার কাছ থেকে টাকার ভাগ চায়। আগে বুঝতে শিখ, আমার টাকা মানেই তোমার টাকা। তারপর ভাগ চাইবে। না বুঝেই অযথা লাফালাফি আমি পছন্দ করিনা। চুপচাপ বসে থাক। নইলে এক ধাক্কা দিয়ে রিক্সা থেকে ফেলে দেব। ”

তাহমিদের প্রচ্ছন্ন হুমকি শুনে কুহু সত্যিই ভয় পায়। ও আর কোন কথা না বলে বসে থাকে। রিক্সা গিয়ে থামল একটা মার্কেটের সামনে। কুহু ভাবছে, তাহমিদ ওকে এখানে কেন নিয়ে আসল!
কিন্তু ও তাহমিদকে প্রশ্ন করার সাহস পায়না। বাধ্য হয়ে ওকে তাহমিদের পিছুপিছু যেতে হয়।

” তোমার চাচাতো ভাই-বোনের জন্য ড্রেস সিলেক্ট কর। বিশেষ করে রিশার জন্য। ও কিসব জামাকাপড় পড়ে, সেসবের নাম আমার জানা নেই। ওর সাইজ অনুযায়ী দুইটা ড্রেস সিলেক্ট কর। এরপর নিশোর জন্য দেখবে। ”

কুহু তাহমিদের কথামত দুইটা ড্রেস সিলেক্ট করল। নিশোর জন্যও করল। এরপর তাহমিদের ধমক হজম করে সৃজনের জন্য টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পছন্দ করল। এরপর ওকে নিয়ে তাহমিদ মার্কেটের বাহিরে একটা রেস্টুরেন্টে বসল।

” কি খাবে, অর্ডার দাও। ”

” আমি কিছু খাবোনা। বাসায় যাব। ”

” তুমি না খেলেও আমি খাব। আর তুমি চুপচাপ বসে থেকে দেখবে। আমার খাওয়া শেষ হলেই তবে তুমি বাসায় যেতে পারবে। ”

কুহু আর কিছু না বলে মুখ গোমড়া করে বসে থাকল।

তাহমিদ খাবার অর্ডার দিয়ে, কুহুকে রেস্টুরেন্টে রেখে কোথাও বেরিয়ে যায়। কুহু বিরসবদনে বসে বসে চারপাশ পর্যবেক্ষন করতে থাকল।

প্রায় বিশ মিনিট পর তাহমিদ হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসল। এরইমধ্যে খাবার আসলে নীরবে দুইজন খেয়ে নেয়। কুহু একটু আঁইগুঁই করলে, তাহমিদের ধমক খেয়ে চুপসে যায়।

কুহুর আজ ভিষণ ভয় করছে। আজকে বাসায় আসতে একটু বেশিই দেরি হয়েছে। চাচি ওকে কি বলবে সেটা ভেবেই ওর হাত-পা কাঁপছে। তাহমিদ ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে কোথাও চলে গেছে। যাবার আগে ওর কাছ থেকে সব প্যাকেট নিজের কাছে নিয়ে, শুধু দুইটা প্যাকেট কুহুকে দেয়। কুহু দেখল একটাতে সৃজনের জন্য কেনা পোশাক। অপরটাতে কি আছে তা সে জানেনা। তাহমিদকে প্রশ্ন করেও লাভ হলোনা। ও শুধু বলল, এটা কাউকে না দেখাতে। রুমে গিয়ে যেন প্যাকেট খোলে। কুহু আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে বাসায় প্রবেশ করল।

ড্রয়িংরুমে ঢুকে নায়লা আঞ্জুমকে আঁড়চোখে খুঁজল কুহু। কিন্তু তাকে কোথাও দেখতে পেলনা। ও হাঁফ ছাড়ল। এক দৌড়ে চলে যায় নিজের রুমে।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১৩+১৪

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৩
জাওয়াদ জামী জামী

” হেই হট বিউটি, কোথায় যাও? ” কুহু সবেমাত্র বাসা থেকে বেরিয়েছে, ঠিক তখনই ওর সামনে এসে দাঁড়ায় জয়।

কুহু জয়কে দেখে মনে মনে ভিষণ বিরক্ত হয়। ওর ঠোঁটের আগায় একটা গালিও চলে এসেছিল। কিন্তু নিজেকে সামলায়। ও কিছু বললে সেটা যদি চাচির কানে যায়, তবে বাসায় একটা অপ্রিয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই দাঁত দাঁত পিষে জবাব দেয়,

” সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। আর ভবিষ্যতে এমনভাবে হুটহাট করে আমার আশেপাশে আসবেননা। আমার এসব পছন্দ নয়। ”

” আহ্ রা’গ করছ কেন, কোকিল পাখি? আমিতো শুধুমাত্র তোমাকে সঙ্গ দিতে চেয়েছি। চল কোথায় যাবে। আমি তোমাকে পৌঁছে দিই। এরপর দু’জন সারা বিকেল একসাথে ঘুরব। তোমার পছন্দের খাবার খাওয়াব, শপিং করে দেব। তুমি যা চাইবে তা-ই দেব। ” জয় চোখ টিপে বলল।

” আমাকে কি আপনি রাস্তার মেয়ে মনে করেছেন ? আপনি লোভ দেখালেন আর আমি নাচতে নাচতে আপনার সাথে চলে গেলাম! এমনটা ভাবলে আপনি ভুল করবেন। এখন সামনে থেকে সরুন। ” কুহু জয়কে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে জয় আবারও ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।

” রা’গ’লে তোমাকে চুড়ান্ত পর্যায়ের হট লাগে দেখছি! যেন অ’গ্নি’স্ফু’লি’ঙ্গ তোমার চেহারায় ঝলকাছে। তোমার ঐ আ’গু’নে আমি ঝাঁপ দিতে চাই সুন্দরী। তোমাকে একান্তে পেতে চাই। ”

জয়ের এরূপ নির্লজ্জতা দেখে কুহু আশ্চর্য হয়ে গেছে। একটা মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে এভাবে কোন মেয়েকে প্রপোজ করতে পারে! কুহু বুঝল এর সাথে যতই কথা বলবে, এ ততই কথা বাড়াবে। তাই প্রায় জয়কে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মেইন গেট পেরিয়ে রাস্তায় পা রাখে। কিন্তু জয় ওর পিছু ছাড়েনা।

কুহু রাস্তায় এসে রিক্সার খোঁজ করছে। কিন্তু আশেপাশে একটা রিক্সাও ওর চোখে পরলনা। বাধ্য হয়ে ও হাঁটতে থাকে। ও ভয় পাচ্ছে জয় যদি আবারও ওর পেছনে আসে।

” হেই বেইবি, এভাবে চলে যাচ্ছ কেন? একটু কথা বল আমার সাথে। তোমাকে দেখার পর তোমার আশেপাশে না থাকলে আমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গরা বিদ্রোহ করে। এই মুহূর্তেও সবাই বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছে। ওদের বিদ্রোহ একমাত্র তুমিই থামাতে পার। ”

এবার কুহু ভয় পায়। রাস্তায় এই লোকটা কোন সিনক্রিয়েট করবে না তো! কুহু জোড়ে পা চালাতে শুরু করল। কিন্তু ওর ভয় বাড়িয়ে দিয়ে জয় ওর পাশে এসে হাঁটতে শুরু করল।

” আপনি এভাবে আমার পেছনে পরে আছেন কেন? আমি কি ক্ষতি করেছি আপনার? প্লিজ আপনি এখান থেকে যান। ” অনুনয় ঝরে পরল মেয়েটির কন্ঠায়।

” আমার ডেটিংএ গেলে তোমার প্রবলেম কোথায়! তুমি কি জানো আজ পর্যন্ত কোন মেয়েই আমার এই অফার ফিরিয়ে দেয়নি? মেয়েরা জয়ের সঙ্গ পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকে। জয়ের একটু ছোঁয়া ওদেরকে বিশ্বজয়ের তৃপ্তি দেয়। ” জয়ের চোখ ঘুরতে বেড়াচ্ছ কুহুর শরীরের আনাচকানাচে। ওর দৃষ্টি দেখে কুহু শিউরে ওঠে।

” আমি ঐরকম কোন মেয়ে নই। সব মেয়েকে আপনি তাদের কাতারে ফেলবেননা। ”

” ঐরকম মেয়ে নও, কিন্তু হতে দোষ কি? মজা তুমিও নাও, আর আমাকেও নিতে দাও। বিনিময়ে তোমাকে টাকা দিয়ে ভরিয়ে দেব। চল কোথাও গিয়ে একান্তে সময় কাটাই। ” জয় কুহুর হাত ধরতে গেলেই, কেও ওর হাত আটকে দেয়।

কুহু ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। এদিকে রাস্তায় কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে। কুহুর ভয় হচ্ছে এসব কথা চাচির কানে গেলে সে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দেবে।

” কি রে জয়, এই মাঝ রাস্তায় বাচ্চা মেয়েটার সাথে কি করছিস? ”

পরিচিত কারও গলা শুনে কুহু সাহস ফিরে পায়। ও জয়ের অপর পাশে তাকাতেই চমকে উঠে।
এই মানুষটা আজ রাজশাহীতে কেন!

এদিকে জয়ও অবাক হয়ে ওর পাশে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে।

” তাহমিদ ভাইয়া, তুমি! তুমি না তিনদিন আগেই ঢাকায় গিয়েছিলে? আজ আবার হঠাৎ রাজশাহী আসলে যে? তোমার ভার্সিটি এখনও খোলা আছে। কিন্তু তুমি এখানে কেন? ”

” শুনলাম তোরা এসেছিস। তাই ছুটি নিয়ে চলে আসলাম। এমনিতেই অনেক ছুটি পাওনা আছে। তাই ভাবলাম এই সুযোগে সেগুলো কাজে লাগাই। তুই আমার কথার উত্তর দিলিনা যে? এই মাঝ রাস্তায় বাচ্চা মেয়েটার সাথে কি করছিস? ও এমন কুঁকড়ে আছে কেন? ” তাহমিদ দৃঢ় গলায় জানতে চাইল।

” ওর সাথে আমার ব্যাক্তিগত কাজ আছে। সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তোমার হাতে ব্যাগ দেখছি। তারমানে বাসায় যাওনি। আগে বাসায় যাও, রেস্ট নাও। তারপর তোমার সাথে কথা বলব। আর ও মোটেও বাচ্চা মেয়ে নয়। ”

” তুই ছাব্বিশ বছরের একটা দামড়া হয়ে এসব বুঝিসনা ! মেয়েটার বয়স আটারো কি উনিশ। মনে হয় উনিশ এখনো হয়নি। তোর সাথে ওর বয়সের পার্থক্য কত জানিস? তোর বয়সের কাছে নেহাৎ ও বাচ্চা। আর নিজের চেহারার কি হাল করেছিস! দেখে তো মনে হচ্ছে তুই সদরঘাটের ব’খা’টে। কানে দুল পরেছিস, হাতে কতগুলো ব্রেসলেট, আবার গলায়ও শেকল ঝুলিয়েছিস! এক কাজ করবি আমার সাথে জেন্টস পার্লারে গিয়ে নাক ফুটো করবি। আমি মোটা দেখে রিং কিনে দেব। প্যান্টের জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া কেন! মনে হচ্ছে তোর পোশাককে কেউ রেইপ করে ছেড়ে দিয়েছে। এই তোর বাবা তোর এই উদ্ভট বেশভূষা দেখে কিছু বলেনা? ”

কুহু তাহমিদের কথা বলতে বেশ মজা পাচ্ছে। লোকটা এই ছ্যাঁচড়াকে আচ্ছা জব্দ করছে।

” ভাইয়া, তুমি এসব কি বলছ? এটা ফ্যাশন বুঝলে। তুমি শুধু লেখাপড়াই শিখেছ। মর্ডান হতে পারোনি। ”

” আমি লেখাপড়া করেছি মর্ডান হতে নয়, সমাজের সেবক হতে। কিন্তু তুই লেখাপড়াকেও রেইপ করেছিস। তোর সবখানে এত রেইপ করার স্বভাব কেন বলতো? আমার মনে হয় তোর জন্ম রেইপ লগ্নে। তুই যা কিছু করিসনা কেন, যেখানে যাসনা কেন সবখানেই রেইপ থেকেই যায়। ”

” ভাইয়া, তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছ। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে আজেবাজে কথা বলছ। এটা মোটেও ঠিক নয়। ” এবার গর্জে উঠল জয়।

” অপমানবোধ তোর আছে! আমিতো ভেবেছিলাম তুই অপমানেরও রেইপ করেছিস। যাহোক এবার অন্তত নিশ্চিত হলাম, একটা জায়গায় অন্তত রেইপ রেহাই পেয়েছে তোর কাছ থেকে। ”

জয় ভিষণ অপ্রস্তুত হচ্ছে তাহমিদের এহেন কথায়। কুহুর সামনে ও এভাবে চরম অপমানিত হবে সেটা ভাবতেই পারেনি। কুহুকে কিছু একটা বলে বুঝ দিতে গিয়ে, বাম পাশে তাকিয়ে দেখল বামপাশটা ফাঁকা। ওদের কথার ফাঁকে মেয়েটা কখন যেন উধাও হয়ে গেছে! এবার নিজের রা’গ’কে বশে রাখতে পারলনা জয়। খেঁকিয়ে উঠল তাহমিদের ওপর।

” তোমার জন্যই পাখি উড়াল দিল। কেবল একটু পটাতে গেলাম, আর তুমি কাবাবে হাড্ডি হয়ে হাজির হলে। আবার নতুন করে মিশন শুরু করতে হবে। তুমি পুরাই ফালতু। ”

জয়ের কথা শুনে দপ করে জ্ব’লে উঠল তাহমিদের চোখজোড়া। কপালের একপাশের শিরা তিরতির করে কাঁপছে। দু’হাত মুঠোবদ্ধ করে কঠিন চোখে তাকায় জয়ের দিকে। তাহমিদের লাল চোখ দেখে জয় ভয়ে ফাঁকা ঢোক গিলল।
বেশ খানিকক্ষণ পর তাহমিদ স্বাভাবিক হয়ে হাত দেয় জয়ের শার্টের কলারে। নিঁখাদ হয়ে থাকা কলার আরও একবার আলতো হাতে ঠিক করে দেয়।

” আমি যে কি সেটা তুই আজও জানিসনা। আমাকে তুই এখনো চিনতে পারিসনি। এত বছর যাবৎ আমার যে রূপ তুই দেখেছিস, সেটা পুরোটাই মুখোশ। আর যাই হোক মুখোশে ঢাকা মানুষের ওপরের রূপটাই শুধু দেখা যায়। তাদের ভেতরে যে কি বা কারা বাস করছে, তা কেবল তারাই জানে। বুদ্ধিমানরা কখনোই কারও ওপরের রূপ দেখে কোন কমপ্লিমেন্ট করেনা। আর আমি চাইওনা আমার রূপ কেউ দেখে ফেলুক। একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে রাখ, যেটা আমার সেটা একান্তই আমার। আমার জিনিসের ভাগ হতে কখনোই দেবনা। ” তাহমিদ জয়ের কলার থেকে হাত সরিয়ে একটা রিক্সা ডাকল।

জয় নিখাঁদ বিস্ময়ে তাহমিদের চলে যাওয়া দেখল। ও তাহমিদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি।

তাহমিদকে এই সময় বাসায় দেখে নায়লা আঞ্জুম কপাল কুঁচকে তাকায়। তাহমিদ তার দৃষ্টিকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

রাজিয়া খালা টেবিলে খাবার সাজিয়ে তাহমিদের অপেক্ষা করছেন। তাহমিদ আসলে তিনি তাকে নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিলেন।

জয়ের মা শায়লা হাসান তাহমিদকে দেখে অবাক হয়ে গেছে।

” তাহমিদ, তুমি কখন এসেছ! তুমি তো আমাকে সারপ্রাইজ দিলে! কেমন আছো তুমি? ”

” আমি ভালো আছি, খালামনি। তুমি কেমন আছো? কালকে রাজিয়া খালার কাছে জানতে পারলাম তুমি এসেছ। তাই ছুটি নিয়ে আমিও চলে এলাম। অনেকদিন তোমাদের দেখিনা। ” নির্বিকারচিত্তে বলল তাহমিদ।

রাজিয়া খালা তাহমিদের কথা শুনে হা করে তাকিয়ে থাকেন। তিনি মনে মনে ভাবছেন, মানুষ এত নিখুঁতভাবে মিথ্যা কি করে বলতে পারে!
এই ছেলে নাকি ওর খালামনিকে দেখতে রাজশাহী এসেছে!

” তাহমিদ বাজান, তুমি তারাতারি খাইয়া নেওতো। তোমার খাওয়া হইলে আমারে আবার রাতের খাওন করতে হবে। তুমিও নাকি সাহেব বাজার যাইবা? তারাতারি কর। ” রাজিয়া খালা মিছেই তাড়া লাগালেন।

তাহমিদ কিছু না বলে দ্রুতই খেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ও রাজিয়া খালার ইঙ্গিত ঠিকই বুঝতে পেরেছে।

কুহু কোচিং শেষে ক্লাস রুমে বসে চিন্তা করছে। বাসায় যেতে ওর ভয় করছে। জয় ছেলেটা যে মোটেও ভালো নয় এটা কুহু ভালোই বুঝতে পেরেছে। ঐ ছেলের থেকে দূরে থাকতে হবে। ওকে কাছে ঘেঁষতে দেয়া যাবেনা।

” এই যে চিন্তা রানী, কি এত চিন্তা করছ? আজ কি বাসায় যাবেনা? নাকি আমাকে অপেক্ষা করানোর ধান্দা খুঁজে বেড়াও! ”

কারও গলা পেয়ে চমকে উঠল কুহু। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে তাহমিদ দাঁড়িয়ে।

” আপনি! আপনি এখানে কেন? ”

” হুম আমি। কেন? জয়কে আশা করছিলে বুঝি? ডাকব ওকে? ”

” একদমই না। ঐ অসভ্য লোকটাকে কখনোই ডাকবেননা। ”

” এভাবে দেবদাসীর মত বসে আছ কেন? বাসায় যাবেনা? ”

” হুম যাব। ”

” চল। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমার আরেক জায়গায় যেতে হবে। ”

” আপনার সাথে যাব কেন! আমি একাই যেতে পারব। ”

” আমি কি বলেছি, তুমি একা যেতে পারবেনা? আমি শুধু তোমার রাস্তাটুকু নিরাপদ রাখতে চাইছিলাম। তুমিই যখন কন্টকাকীর্ণপথ চাও, তবে আমার কিসের দায় পরেছে তোমার পথের কাঁটা সরানোর। যত খুশি তুমি হাঁটো কন্টকাকীর্ণ পথে। ” তাহমিদ কোচিং থেকে বেরিয়ে আসে।

কুহু বাহিরে এসে দেখল তাহমিদ একটা রিক্সা দাঁড় করিয়ে কথা বলছে। কুহু সোজা গিয়ে রিক্সায় বসল। তাহমিদ প্রথমে একটু ভ্যাবাচেকা খেলেও পরক্ষনেই মৃদু হেসে রিক্সায় উঠে বসে।

কুহু বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে বসেছে। ও গত দুই দিনে তাহমিদকে দেখে বুঝেছে, মানুষটার কথায় হেয়ালি থাকলেও সে জয়ের মত অসভ্য ধরনের নয়।

রাস্তা এবড়োথেবড়ো হওয়ায় রিক্সায় ভালোই ঝাঁকুনি লাগছে। কুহু জড়োসড়ো হয়ে বসায়, রিক্সার ধারে বারি খাচ্ছে ওর কোমড়, কনুই। কিন্তু ওর করার কিছুই নেই। সামনে আরও এবড়োথেবড়ো রাস্তা দেখে কুহুর ভয় হতে থাকে। এবার নিশ্চয়ই ওর কোমড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে। এতদিন অটোতে যাতায়াত করেছে। পাশে কেউ না কেউ থেকেছে। তাতে একটু জড়তা থাকলেও, আজকে একটু বেশিই জড়তা কাজ করছে। কুহু কোন কিছু চিন্তা না করেই রিক্সার হুডের পাশটা শক্ত করে ধরে রাখল।

কিছুক্ষণ পর রিক্সায় ঝাঁকুনি লাগলেও, কুহু অনুভব করল, ওর কোমড় কিংবা কনুই কোথাও ব্যাথা লাগলনা। একটু অনুসন্ধান করতেই বুঝতে পারল, তাহমিদ ওর হাত কুহুর পেছনে দিয়ে রিক্সার হুডের একপাশে ধরে রেখেছে। এ কারনেই ওর ব্যথা লাগেনি!
কুহু অবাক বিস্ময়ে তাহমিদের দিকে তাকায়। সেটাও কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তাহমিদ সামনে তাকিয়ে আছে। যেন মনযোগ দিয়ে রাস্তার গাড়িঘোড়া দেখছে।

কুহুর এই প্রথমবার মনে হল, লোকটার কথা যতই তিতা হোকনা কেন, তার দ্বায়িত্ববোধ মন্দ নয়।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৪
জাওয়াদ জামী জামী

পুরোটা পথ কুহু গুটিসুটি মে’রে বসে রইল। তাহমিদও পূর্বের ন্যায় পেছনে হাত রেখে কুহুকে নিরাপদ রাখতে তৎপর।

শেষ বিকেল। উর্ধ্ব অম্বরে লালাভ দিবাকর আঁধারের কোলে ঢলে পড়বার আয়োজনে মত্ত। ঘন সবুজ বৃক্ষরাজির শাখে-প্রশাখে ঝাঁকে ঝাঁকে বিহঙ্গের কলতানে চারপাশ মুখরিত। কুহু মুখ তুলে বিহঙ্গের দলকে দেখার বৃথাই চেষ্টা করল।

এক প্রেমিক পুরুষের হিয়া এই র’ক্ত রাঙ্গা বিকেলে সদ্য ফোটা হিজলের ন্যায় প্রস্ফুটিত হলো। সে আঁড়চোখে থেকে থেকেই দেখে চলেছে তার হৃদয়হরণীকে। তার চোখের তৃষ্ণা কিছুতেই মিটছেনা। সে গত দুইমাসের বেশি সময় ধরে নিজের সাথে বোঝাপড়া করে ক্লান্ত। দূরত্বের অনলে সে জ্বলছে। অপেক্ষার প্রহর আজ তার বুকে জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসেছে। তবে তাহমিদ তার শ্যামাঙ্গীনিকে পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় কাটাতে পারে। সে যতই কষ্ট হোকনা কেন। সে কোন সামান্যতম ভুলের জন্যও তার শ্যামাঙ্গীনিকে হারাতে চায়না। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সূদুরে তাকায় তাহমিদ।

বাসার সামনে রিক্সা এসে দাঁড়ালে কুহুকে নামতে বলল তাহমিদ। কুহু রিক্সা থেকে নেমে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রিক্সাওয়ার সামনে বাড়িয়ে দিতেই তাহমিদ ওর দিকে কটমটিয়ে তাকায়।

” তোমার টাকা দিয়ে তুমি কয়েক হালি হাঁসের ডিম কিনে খেও, গা’ধা মেয়ে। তাতে যদি একটু বুদ্ধি খোলে। টাকা নিয়ে চুপচাপ ভেতরে যাও। ”

তাহমিদের ধমক খেয়ে কুহু সুড়সুড় করে ভেতরে প্রবেশ করল। ওকে ভেতরে যেতে দেখে তাহমিদ রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা ঘোরাতে বলল।

বাসায় ঢুকতেই রাজিয়া খালা কুহুকে জরুরীভাবে নিজের কাছে ডাকলেন। কুহু পোশাক পাল্টে খালার কাছে যায়।

” খালা, এত জরুরী তলব কেন? কি হয়েছে? ”

” মাগো, তুমি একটু চিংড়ির মালাইকারী কইরা দিবা? তাহমিদ বাপজান মেলা বাজার কইরা আনছে। সেইগুলান সামাল দিতেই আমার সইন্ধ্যা হইয়া যাইব। বাপে আমার চিংড়ির মালাইকারী পছন্দ করে। দেখ কতগুলা চিংড়ি আনছে! এই টাটকা মাছগুলান যদি না রাইন্ধা তুইলা রাখি, সেইডা কি ভালো দেখায়? ”

খালার কথা শুনে কুহু বেশ অবাক হয়েছে।

” উনি বাজার করেছেন কেন, খালা! ফ্রিজে মাছ-মাংস সবইতো আছে। ” কুহু সবিস্ময়ে জানতে চাইল।

” বাপজানে প্রতি সপ্তাহেই বাজর করে। সে রাজশাহী নাইমাই বাজারে যায়। একগাদা বাজার হাতে নিয়া তবেই বাসায় ঢোকে। খালি গত তিনদিন আগে যে আইছিল তখন বাজার নিয়া আসেনি। সেই বাজার পরেরদিন করছিল। আর আইজকা খাইয়া সোজা বাজারে গেছিল। ”

” কিন্তু তিনি বাজার করবেন কেন? ”

” তুমি তারে চেননা, মা। সে কারও দয়া নিবার চায়না। কিংবা এইখানে প্রতি সপ্তাহে আসার জন্য, থাকার জন্য কোন কথা হোক তা সে চায়না। তাই এইখানে আসলে বাজার করে। সে প্রতি সপ্তাহে এই বাসায় একটু শান্তির জন্য আসে। এছাড়া তার নানিমা অসুস্থ। সে আবার নানিমার ভক্ত। নানিমারে না দেইখা সে থাববার পারেনা। আম্মায় বিছানা নেয়ার পর থাইকা পোলাডা খুব কষ্ট পাইতাছে। ”

কুহু খালার কথা শুনে খুব অবাক হয়। ততক্ষণে খালা ওর দিকে চিংড়ির পাত্র এগিয়ে দিয়েছেন। কুহু আর কোন কথা না বলে চিংড়িগুলো কা’ট’তে শুরু করে।

” বেইবি, কখন এসেছ তুমি! তোমার জন্য চিন্তা করতে করতে আমার হার্ট শুকিয়ে গেছে। সে প্রতি মিনিটে মাত্র দশবার বিট করছে। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তুমিই পারো আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। তারাতারি এসে একটা কিসি দিয়ে আমার হার্টকে স্বাভাবিক করে দাও। ”

এতক্ষণ কুহু দিব্যি জয়কে ভুলে ছিল। হঠাৎ করেই ওর সামনে জয় এসে কথা বলাতে মেয়েটা ভয়ে কেঁপে উঠল। ও দ্রুতই রাজিয়া খালার আড়ালে গিয়ে লুকায়। একহাতে ধরে রেখেছে খালার বাহু।

রাজিয়া খালা জয়ের এরূপ কথায় রা’গ করলেও ওপরে ওপরে শান্ত থাকলেন। তবে তিনি কুহুকে রক্ষা করতে ভুল করলেননা।

” জয় বাবা, তুমি এইখানে ক্যা? কি লাগব কও, আর নিজের ঘরে যাও। আমি তোমার ঘরে নিয়া আসতাছি। ”

” খালা, আমার যেটা লাগবে সেটা তুমি দিতে পারবেনা। তোমার আড়ালে দাঁড়ানো ঐ হটি কুইনই পারবে আমার সব সমস্যার সমাধান করতে। তুমি ওকে আমার রুমে পাঠিয়ে দাও। ” জয় জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল।

” জয় বাবা, তুমি এখনই এইখান থাইকা যাইবা। নইলে আমি কিন্তু তোমার আম্মারে এখনই ডাক দিমু। সাথে তোমার খালামনিরেও ডাকমু। ”

খালার কথায় এবার কাজ হয়। তার কথা শুনে জয় একটু থমকে যায়। সে আর কিছু না বলে কুহুর দিকে অগ্নী দৃষ্টি হেনে প্রস্থান করল।

জয় চলে যেতেই কুহু খালার পেছন থেকে বেরিয়ে আসে।

” শোন মাইয়া, দুনিয়াডা খুব একটা সহজ জায়গা নয় কইলাম। এখানে টিক্কা থাকতে হইলে তোমারে শক্ত হইতে হইব। অল্পতেই এমন কুঁকড়ে গেলে হইব? তোমার বাপ-মা কেউই নাই। নিজের ছোট ভাইডার দ্বায়িত্ব এখন তোমার উপর। নিজের পাশাপাশি তারেও মানুষ করনের দ্বায়িত্ব তোমার। সেই তুমিই যদি এত অল্পেই ভয়ে পিছায় যাও, তাইলে লড়াই করবা কেম্নে? নিজের মনোবল বাড়াও, মাইয়া। কে তোমার ভালো চায়, আর কে ক্ষতি করবার চায়, প্রথমেই তাগোরে চিনতে শিখ। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখ। তুমি লেখাপড়া জানো। ভবিষ্যতে আরও ম্যালা পড়াশোনা করবা। নিজের জীবনকে নিজেই গড়তে পারবা। তাইলে এত ভয় কিসের? আল্লাহর উপর ভরসা আর নিজের প্রতি আত্নবিশ্বাস থাকলে তোমারে উপরে আগায় যাইতে ঠ্যাকায় কার সাধ্যি? ”

কুহু অবাক হয়ে খালার কথা শুনছিল। এক অশিক্ষিত বয়োবৃদ্ধা তাকে এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল! সত্যিই কি ও শক্তিহীনা! নিজের দ্বায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ নয়? সেই সাথে আরেকটা কথা মনে হতেই ওর বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এটা জয়ের নানার বাড়ি। আর সে এই বাড়ির নাতি হিসেবে যখন খুশি তখন এখানে আসবে। আর সে এখানে আসলেই কুহুর সাথে অসভ্যতা করবে। কতদিন ও জয়ের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে? আর কিন্তু ভাবতে পারছেনা কুহু। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। আজ আরেকবার বাবা-মা’ র শুণ্যতা ও হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে।

” দোস্ত, চল বাসায় যাই। মায়া অলরেডি তোর জন্য রান্না শুরু করে দিয়েছে। তুই না গেলে ও মন খারাপ করবে। ”

সজল অনুনয় করছে। কিন্তু তাহমিদ ওর সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ও আপাতত সজলের কথা কানে না নিয়ে ক্যাম্পাসের বৃক্ষদ্বয়ের আড়ালে সূর্যের লুকোচুরি দেখতে ব্যস্ত। কিন্তু সজলের সেদিকে খেয়ালই নেই। ও তাহমিদকে নিজের বাসায় নেয়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান করছেই।

” ধুর শা’ লা, তোর কাছে এসেছি একটু রিল্যাক্স করতে। কিন্তু তুই দেখছি আমাকে আরও বেশি প্যারা দিচ্ছিস! বললামইতো আজকে তোর বাসায় যাবনা। কিন্তু তুই আমার কথা না শুনে মায়াকে ফোন করলি। আজকে আমার ভাগের খাবারও তুইই খাস। এতে তোর বউয়ের কষ্ট একটু লাঘব হবে। ”

সজল কিছু বলতে চাইলেই চারপাশে মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনি শুনতেই চুপ করে যায়। দুই বন্ধু মনযোগ দিয়ে আজান শুনছে।

” বাপজান, তুমি এত দেরি কইরা আসলা? এদিকে চিংড়ির মালাইকারি ঠান্ডা হইয়া গেছে। বাজার করবা ঠিকই কিন্তু একবারও গরম গরম খাইবানা। ”

” আরিব্বাহ খালা, তুমি আজকেই মালাইকারি করে ফেলেছ! খালা, তুমি গ্রেট। ” চেয়ার টেনে বসে গ্লাসে পানি ঢালছে তাহমিদ। তিন ঢোকে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করল।

” বাপজান, আমি আইজকা রান্ধিনাই। আইজকা কুহু মা’য়ে রান্ধছে। ”

খালার কথা শুনে তাহমিদ বাম ভ্রু উচু করে কুহুর দিকে তাকায়। মেয়েটা তখন ডালে ফোড়ন দিতে ব্যস্ত। ওর অন্য দিকে তাকানোর সময় নেই। ড্রয়িংরুমে রিশা, নিশো, সৃজন হৈ-হুল্লোড় করেছে। তাহমিদ ওদেরকে দেখে মৃদু হেসে খালার সাথে কথা বলতে শুরু করল,

” খালা, আমাকে দিবা? মানে চিংড়ির মালাইকারি। একটু টেস্ট করে দেখতাম কেমন রান্না করে তোমার গা’ধী মা। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর রা’গ হয়। লোকটা বিকেলেও একবার ওকে গা’ধা বলেছে। কুহু ভেবে পায়না লোকটা কেন ওকে কারনে-অকারনে খোঁ’চা দেয়। ওপরে ওপরে লোকটাকে যতটা ভালো মনে হয়, ততটা ভালো সে নয়।

” এই নেও বাপজান, তোমার মালাইকারি। খাইয়া কও কুহু মা’য়ে কেমন রান্ধছে। ” রাজিয়া খালা তাহমিদের দিকে একটা বাটি এগিয়ে দেন।

তাহমিদ বাটি থেকে একটা চিংড়ি নিয়ে মুখে তুলতে গিয়েই থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে খালার দিকে তাকায়

” খালা, তোমার মা’কে আগে খেতে বল। সে যদি হিংসা করে এতে কিছু মিশিয়ে দেয়? কিংবা দেখা গেল লবন দিয়ে তিতা করে রেখেছে। আমি বাপু আমার জিহ্বার স্বাদ নষ্ট করতে চাইনা। বরং সে-ই আগে খেয়ে এটার টেস্ট ঠিক আছে কিনা বলে দিক। তারপর নাহয় আমি খাব। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু চরমমাত্রায় অবাক হয়ে খালার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। ও মনে মনে তাহমিকদে হাজারটা গালি দিচ্ছে।

” কতবড় বদ হলে একটা মানুষ এভাবে কথা বলতে পারে! তার সাথে আমার কোন জন্মের শত্রুতা আছে, যে সে আমাকে এভাবে খোঁ’চা দিচ্ছে? অসহ্য লোক একটা। শাখামৃগ, মুখপোড়া হনুমান। ” কুহু বিরবিরিয়ে তাহমিদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে।

” খালা, তাকে ওয়াজ করা বাদ দিয়ে এখানে আসতে বল। সে ওয়াজ পরেও করতে পারবে। মুখের সামনে লোভনীয় খাবার রেখে বসে থাকা কত যে কষ্টের সেটা শুধু আমিই জানি। ”

” খালা, উনাকে বলে দিন আমি এখন কিছুই খাবনা। প্রয়োজনে আপনি খেয়ে তাকে বলুন সব ঠিক আছে কিনা। ” কুহু গলা চড়িয়ে বলল।

” পা’গ’ল নাকি! খালা, যে রান্না করেছে, সে-ই আগে টেস্ট করবে। কেউ যদি আমার কথা না শোনে, তবে কিন্তু আমি তাকে জোড় করে খাওয়াব। এটাই ফাইনাল। ”

” ও মা কুহু, একটা খাইয়া দেখনা। বাপজানের কথা শুন। ”

রাজিয়া খালার জোড়াজুড়িতে কুহু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসল ডাইনিং টেবিলের কাছে। তাহমিদের সামনে থেকে বাটি নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে একটা চিংড়ি হাতে তুলে নেয়। চিংড়িটা মুখে দেয়ার আগে একবার তাকালো ড্রয়িংরুমে বসে থাকা সৃজনের দিকে।

কোনরকম চিংড়িটা খেয়ে রান্নাঘরে যায় কুহু।

” খালা, উনাকে বলুন তরকারিতে লবন পরিমান মতই হয়েছে। তিনি নির্দিধায় খেতে পারবেন। ”

কুহুর কথা শুনে তাহমিদ স্মিথ হেসে ডাক দেয় রিশা, নিশো আর সৃজনকে।

” খালা, বাটিতে আরও কয়েকটা চিংড়ি দাও। আমার ব্যাটেলিয়নরা টেস্ট করলেই তবে আমি খাব। ”

ওরা তিনজন ডাইনিং টেবিলের কাছে আসতেই খালা ওদের সামনে মালাইকারির বাটি রাখল।

কুহু আরও একবার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সামনের সুদর্শন মানুষটার দিকে। এই মানুষটাকে চেনা বড় দায়। এই মনে হয় সে চুড়ান্তমাত্রার অসভ্য, তো পরক্ষণেই মনে হয় এটা তার আসল রূপ নয়। সে আসলে নিজেকে যেমনভাবে উপস্থাপন করে তেমনটা সে মোটেও নয়।

চলবে…..

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১১+১২

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১১
জাওয়াদ জামী জামী

” নানিমা, এই যে গত আট বছর ধরে একটামাত্র ছেলেকে দেখোনি, তোমার কষ্ট হয়না? তোমার কত আদরের ছেলে ছিল সে। কেন তাকে যেতে দিলে? মেয়েদের কথা শুনে, ছেলেকে পর করে দিলে! আজ কোনও মেয়ে কি তোমাকে দেখছে? তুমি তোমার স্বামীর বাড়িতে আছ, তার টাকায়ই তোমার চিকিৎসা চলছে। তবে সেদিন কেন মেয়েদের কথা শুনতে গেলে! আমার বলতে খারাপ লাগছে, তবুও বলতে হচ্ছে, তুমি সারাজীবন মরিচীকার পেছনে ছুটেছ। নিজেও যেমন সম্পর্কের মূল্য দিতে পারোনি, ছেলেমেয়েদেরও তেমনভাবে গড়ে তুলেছ। কি পেলে এসব করে? ছেলেমেয়েরাও আজ তোমাকে বোঝা মনে করে। ” তাহমিদ ফাতিমা খানমের হাত ধরে রেখে করুণ স্বরে বলল।

বাকহীনা ফাতিমা খানম কোন কথা বলতে না পারলেও, তার দুচোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরতে থাকে। তিনি হাতের ইশারায় তাহমিদকে কিছু বলছেন। তাহমিদ মনোযোগ দিয়ে তার ইশারা বোঝার চেষ্টা করছে।

বৃদ্ধা বেশ কিছুক্ষণ হাত নেড়ে ক্ষান্ত হন। কিন্তু তার কান্না থামলনা। তাহমিদও বুঝতে পারছে ওর নানিমা কি বলতে চায়।

” নানিমা, আমি মামার সাথে যোগাযোগ করব। তাকে দেশে আসার কথা বলব। কিন্তু তারা দেশে আসলে তোমার মেয়েরা যদি তাদেরকে কিছু বলে, সেদিন কিন্তু আমি তোমার মেয়েদের ছেড়ে কথা বলবনা। ”

বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা হাতে তাহমিদের হাত চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন।

কুহু ফাতিমা খানমকে খাইয়ে দিয়েই রান্নাঘরে চলে এসেছে। রাজিয়া খালার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করতে থাকে।

রায়হান আহমেদ ডাইনিং টেবিলে এসে তাহমিদের খোঁজ করলেন। ততক্ষনে নায়লা আঞ্জুমও চলে এসেছে। সে কুহুকে দেখেও না দেখার ভান করে চেয়ার টেনে বসল।

” কুহু মা, সৃজন কোথায়? ওকে ডাক। ”

রায়হান আহমেদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুমের মন বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। সে তার স্বামীর নিজের ভাতিজা-ভাতিজীর ওপর এমন আদিখ্যেতা সইতে পারছেনা।

” কুহুপু, সৃজন কই? ওকে তারাতারি ডাক। ” নিশো চেয়ারে বসতে বসতে বলল।

” কুহুপু, তুমি আমাদের সাথে বসবেনা? এসো আজ একসাথে খাই। ” রিশা হাসিমুখে বলল।

” তুমি খাও, রিশা। আমি পরে খাব। সকালে আমি খেতে পারিনা। ”

রাজিয়া খালা সৃজনকে ডাক দিলে সৃজন কুহুর পাশে এসে দাঁড়ায়। নিশো সৃজনকে নিজের পাশের চেয়ারে বসাল।

” কেমন আছো, খালামণি? রিশা, নিশো তোরা কেমন আছিস? ”

” তুমি কখন এসেছ, তাহমিদ! ” নায়লা আঞ্জুম বিস্মিত।

” গতরাতে এসেছি। তা তোমাদের দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ” কুহুর দিকে তাকিয়ে নায়লা আঞ্জুমকে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” ভাইয়া, আগে আমাদের সাথে কথা বল। পরে আম্মুর সাথে গল্প করবে। তুমি কতদিন পর আসলে! আজকে নাস্তা করেই আমাকে পড়া দেখিয়ে দেবে। তোমার মত করে কেউই পড়ায়না। ” নিশোর গলায় অভিযোগ খেলা করছে।

তাহমিদ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

” আগে খেয়ে নে। তারপর বই নিয়ে আসবি। ”

” ভাইয়া, তুমি কুহুপুকে চেন? আর সৃজনকে? ওরা কিন্তু এখন আমাদের সাথেই থাকে। এই সৃজন, তুই ভাইয়ার সাথে কথা বলছিসনা কেন? তুই জানিস আমার ভাইয়া কত ভালো পড়ায়? ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে তার স্টুডেন্টরা তার ওপর ফিদা। ভার্সিটির মোষ্ট হ্যান্ডু টিচার ভাইয়া। আমি ঠিক বলেছিনা, ভাইয়া? ” রিশা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে তাকায় তাহমিদের দিকে।

” এই ফাজিল মেয়ে, তুই চুপ করবি? এত বকবক করিস কেন? পড়াশোনা রেখে শুধু চাপাবাজী করা? এতদিন পড়াশোনা কেমন করেছিস, তা একটু পরেই দেখছি। একটা করে ভুল করবি, একটা করে স্কেলের ঘা পড়বে পিঠে। ”

তাহমিদের ধমকে রিশা মুখ কাঁচুমাচু করে এদিকওদিক তাকায়।

” সৃজন, তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়ছ? এখানে কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছ? ঠিকমত পড়াশোনা করছ তো? কোন টিচারের কাছে পড়ছ? ” এবার সৃজনকে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি, ভাইয়া। কলেজিয়েট স্কুলে চাচা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। স্কুলেরই এক স্যারের কাছে পড়ি। ”

” গুড। আমি প্রতি সপ্তাহে দুইদিন এখানে এসে থাকি। আমি আসলে রিশা, নিশো আমার কাছে পড়া দেখিয়ে নেয়। তুমিও ওদের সাথে বই নিয়ে চলে আসবে। আর এখানে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছেনাতো? সমস্যা হলে আমার খালামণিকে বলবে। যখন যেটা প্রয়োজন হবে সব তাকেই বলবে। ” তাহমিদ আড়চোখে তাকায় নায়লা আঞ্জুমের দিকে।

তাহমিদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুমের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। যা তাহমিদের নজর এড়ায়নি।

টুকটাক কথা বলতে বলতে ওরা খেতে থাকে।
খাওয়া শেষ করে রিশা, নিশো, সৃজন বই নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে তাহমিদের কাছে পড়া দেখিয়ে নেয়।

রাজিয়া খালা টেবিল পরিষ্কার করে রান্নাঘরে বসেই কুহুকে নিয়ে খেয়ে নেয়। যদিওবা কুহু খেতে চায়নি, কিন্তু খালার জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে ওকে খেতে হয়। এবং এটা গত বিশদিন যাবৎ প্রতিদিন সকালেই হয়ে আসছে। অন্যদিন তারা ডাইনিং টেবিলেই বসে। কিন্তু আজ তাহমিদ ড্রয়িংরুমে থাকায় কুহু রান্নাঘরে খাওয়ার বায়না ধরলে, খালা তাতে সায় দেয়। খাওয়ার পর কুহু কোচিং-এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। তাহমিদ আঁড়চোখে কুহুর চলে যাওয়া দেখে, রিশাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, কুহু সাহেব বাজারে অবস্থিত একটা কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে। ও চালাকি করে কোচিং-এর নামও জেনে নিল।

” মেজো চাচি, আপনার চা এখানেই নিয়ে আসব নাকি ড্রয়িং রুমে গিয়ে খাবেন? ” কুহুর প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায় নায়লা আঞ্জুম। তার ঠোঁটের কোনে ঝুলছে তাচ্ছিল্যের হাসি।

” গুড, নিজের পজিশন ঠিকই বুঝে নিয়েছ তাহলে। মন দিয়ে সব কাজ করবে। এখানে থাকছ জন্যেই নিজেকে এই বাড়ির মালিক ভাবতে যেওনা। সব সময়ই একটা কথা মাথায় রাখবে, তোমরা দুই ভাইবোন এই বাড়িতে আশ্রিত। আমার দয়ায় এখানে থাকতে পারছ। তাই একটু কৃতজ্ঞতা তোমাদের কাছ থেকে আশা করতেই পারি। আর সেই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আশা করব তোমার চাচাকে কিছুই জানাবেনা। ”

” না চাচি, কাউকেই কিছু জানাবোনা। আমরা খুব ভালো করেই জানি, এখানে আমরা আশ্রিত। তাই এই বাড়িতে নিজের বাড়ি ভাবার কোন প্রশ্নই আসেনা। তবে আশা করছি বেশিদিন এখানে আমাদের থাকতে হবেনা। তিনমাসের মধ্যে কিংবা এ্যাডমিশনের পর কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। আপনার ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকার ইচ্ছেও আমার নেই। আপনার চা কি এখানেই নিয়ে আসব? ”

কুহুর সোজাসাপটা উত্তর শুনে নায়লা আঞ্জুম কপাল কুঁচকে তাকায়। ঠোঁট ভেংচে হেসে উঠল।

” এখানেই নিয়ে এস। আজ তোমার কনফিডেন্স দেখে একটা প্রবাদই মনে আসছে, ছাল নাই কু’ত্তা’র বা’ঘা নাম। মুরোদ থাকলে তো আর এখানে এসে পরে থাকতেনা। সেই আবার গলা উঁচিয়ে কথা বলে! ”

কুহু বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে চাচির সাথে বিতন্ডায় জড়ানো ঠিক হবেনা। কিন্তু নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে ওর চোখে পানি এসেছে ঠিকই। তার তিক্ত কথার বাণ কুহুর বুকে আঘাত করেছে।

ঘোর অমানিশা। আকাশ সেজেছে আঁধারের ঝালোর নিয়ে। গায়ে মেখেছে অমাবস্যার প্রলেপ। মৃদুমন্দ হাওয়া ছুঁয়ে দিচ্ছে বিটপীদের শাখা-প্রশাখা। হাওয়ার তোড়ে যেন দুলছে ধরাধাম। আশেপাশে কোথাও একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে ঝিঁঝিঁদের দল। কয়েকটা রাতচোরা পাখি উড়ে গেল মেঘেদের গা ছুঁয়ে দিয়ে। ইট-পাথরের এই রাজ্যে পাখিদের কদাচিৎ দর্শন পাওয়া যায়।

কুহু মুখ তুলে উর্ধ্বাকাশে চাইল। ঘন আঁধারে ছাওয়া অম্বরে পাখির দলকে দেখার বৃথাই চেষ্টা করল সে। ওর কানে শুধু বাজল একঝাঁক পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি।
হাওয়ায় দুলছে ওর কৃষ্ণবরণ কেশরাশি। আজি এ কৃঞ্চকালো রজনীতে উন্মুক্ত অন্তরীক্ষ তলে এক শ্যামাঙ্গীনি অষ্টাদশী কন্যার ডাগর আঁখিতে জমা হয়েছে এক সরোবর অশ্রুরাশি। তার আঁখিতে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। কেন ওরা আজ অবহেলিত? কেন পরিজনদের নিকট ওরা বোঝা? বারবার খুঁজে চলেছে প্রশ্নগুলোর উত্তর।

” এত রাতে তুমি বাহিরে কি করছ! তোমার ভয় করছেনা? ”

কারও গলা শুনে চমকে উঠে কুহু। পাশে তাকিয়ে দেখল তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদকে দেখে আপনাআপনিই ওর মাথা নিচু হয়ে যায়। কন্ঠায় এসে মুখনিঃসৃত বাণী আটকে গেছে।

” কি ব্যাপার? এমন সাইলেন্ট মোডে কনভার্ট হলে কেন? শোন মেয়ে, সাইলেন্ট মোড আমার ভিষণ অপছন্দের। চাইলে ভাইব্রেট মোডেও যেতে পারো, কিন্তু আমার সামনে আসলে সাইলেন্ট মোড সাইডে রাখবে। এবার ভায়োলেন্ট মোডে আসো জলদি। ” কুহুর মুখের তুড়ি বাজিয়ে বলল তাহমিদ।

” ঘুম আসছিলনা, তাই বাগানে এসেছিলাম। ” অস্ফুট স্বরে বলল কুহু।

” বাগানে কি ঘুমের ঔষধের বীজ পুঁতে রাখা আছে! বীজ থেকে কি চারাগাছ জন্মায়? কতবড় হয় সেই গাছ? ফুল-ফল কিছু ধরে সেই গাছে? ফুলের সুবাস আছে? ফল কি মিষ্টি হয়? ঘুম গাছের ফুল দিয়ে কি বাসর সাজানো যায়? ”

” কিহ্! ”

কুহুর মুখে আর কোন কথা জোগায়না। ওর মনে কেবল একটা কথাই বাজছে, সামনে দাঁড়ানো এই লোক বিরাট মাপের ত্যাঁদর। এর আশেপাশে থাকলেই শুধু খোঁ’চা হজম করতে হবে। তাই ও বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

” আমি চিন্তা করে দেখলাম, ঘুম গাছের ফুল দিয়ে বাসর সাজালে আমার লস হয়ে যাবে। তাই সেই প্ল্যান ক্যান্সেল। বউকে ভালোবেসে ঘুম পাড়াতে হয়। বউ জাতী হয় ভালোবাসায় কাবু। তাদের ভালো……

তাহমিদ কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই কুহু হুড়মুড়িয়ে বাসার ভেতর ঢুকে গেছে।

তাহমিদ গমনরত কুহুর পানে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল।

চলবে।

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী জামী

কুহুু দৌড়ে রুমে দরজা লাগিয়ে দিয়ে, বিছানায় গিয়ে বসল। ও ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেছে। সেই সাথে শরীরে হালকা কাঁপুনির অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। তাহমিদ ওর সাথে কেন এমন আচরণ করছে, তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছেনা কুহুর। এর আগে মাত্র একবার তাহমিদের সাথে কুহুর দেখা হয়েছে। সেটাও কোন সুখকর পরিস্থিতিতে হয়নি। মায়ের মৃ’ত্যু’র পর শোকে আচ্ছন্ন কুহু একরাতে তাহমিদকে প্রথম দেখেছিল উঠানে পাতা চেয়ারে বসে থাকতে। পরদিন সকালেই সে গ্রাম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর পেরিয়েছে দুই মাস। এর ভেতর আর দেখা হয়নি তার সাথে। কিন্তু গতরাতে বাসায় এসেই কুহুকে দেখেই কেমন হেয়ালি কথাবার্তা শুরু করেছিল সে। কুহু কালকেও না পেরেছে তাহমিদের কথার মানে বুঝতে। আর আজও না পারছে তার কথার অর্থ বের করতে।
অবশ্য তাহমিদের কথার মানে বোঝার কোনও ইচ্ছেও নেই ওর। ও ভয় পাচ্ছে মেজো চাচিকে। চাচি যদি জেনে যায় বিষয়টা? তবে নিশ্চয়ই কুহুকে কথা শোনাতে ছাড়বেনা!

পরদিন সকালে কুহু আর তাহমিদের সামনে যায়না। তাহমিদ খেতে আসলে কুহু নিজের রুমে গিয়ে ঘামটি মে’রে বসে থাকল।

তাহমিদ খেতে বসে এদিকওদিক তাকিয়ে কুহুকে খোঁজার বৃথাই চেষ্টা করল। কিন্তু কুহুকে না দেখতে পেয়ে হতাশ হয়ে খাওয়া শেষ করে রিশা,নিশো, সৃজনকে পড়তে বসায়।

সেইদিন কুহু আর তাহমিদের সামনে আসলনা।তাহমিদ রাত দশটায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ও তখনও চারপাশে তাকিয়ে কুহুকে খুঁজল। কিন্তু যে একবার নিজ থেকে আড়ালে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে বৃথাই খোঁজার চেষ্টা করা বোকামি বৈ কিছুই নয়।
তাহমিদ মনমরা হয়ে বিদায় নেয় সকলের কাছ থেকে। ও যাবার সময় বারবার পেছন ফিরে তাকায়, যদি একটি বার তার রাতজাগা তারাকে দেখতে পেত। কিন্তু ওর আশা অপূর্ণই থেকে যায়। ওর স্বপ্ন অংকুরিত হতে পারলনা। বিরস বদনে, অলস পায়ে ত্যাগ করল, তার প্রিয় অংগন।

” মাগো, তুমি কাইল সারাদিন রুম থাইকা বাইর হইলানা ক্যা? কি হইছিল, মা? ” রাজিয়া খালা মলিন গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

” তেমন কিছু না, খালা। শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল, তাই বের হইনি। ” কুহু অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলল। ওর খুব খারাপ লাগছিল মাতৃসমা এই বৃদ্ধাকে মিথ্যা বলতে।

কুহুর কথা শুনে খালা একটু হাসলেন। তিনি কোমল চোখে তাকালেন কুহুর পানে।

” মাগো, এই জীবনে স্বামী-সন্তান নিয়া সংসার করবার পারিনি। সন্তান হইলনা জন্য স্বামী আরেকটা বিয়া করল। এক বছর পর সতীনের পেটে সন্তান জন্মালো। তার তখন থাইকাই আমার নরকদর্শন শুরু হইছে। স্বামী, সতীন মিল্লা কি অত্যাচারডাই না করত। অত্যাচার সইবার না পাইরা একদিন স্বামীর ঘর ছাড়লাম। বাপের বাড়িতে গেলাম। কিন্তু ভাইয়ের বউয়েরা আমাকে সেই বাড়িতে থাকপার দিলনা। বাপের ঘরও ছাড়লাম। ট্রেনে চাইপা গেলাম ঢাকা। সেখানে কাজ করলাম কত জায়গায়। একদিন রাস্তায় দেখা হইল তাহমিদ বাবার নানার লগে। হেয় আমার দুঃখের কথা শুইনা নিজের সাথে এইখানে নিয়া আসল। আর তখন থাইকাই আমি এই বাসায় আছি। এখানে আইসা আমি তাহমিদ বাবারে পাইলাম। আমি তার মা হইয়া উঠলাম। আর সে হইল আমার সন্তান। আমার বহু বছরের আক্ষেপ ঘুচল তাহমিদ বাবারে পাইয়া। জন্ম না দিয়াও আমি তার মা হইলাম। ”

কুহু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে দাঁড়ানো মমতাময়ী খালার দিকে। তার মনে কত কষ্ট সে পুষে রেখেছে, অথচ তার মুখ দেখলে সেটা বোঝা যায়না।

এদিকে রাজিয়া খালা একমনে বলেই চলেছেন,

” তারপর জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই দেখলাম। সংসারের ভাঙ্গন দেখলাম, লোভ, হিংসা দেখলাম। এতকিছুর পরও আমি তাহমিদ বাবার মা-ই থাইকা গেলাম। রিশা, নিশো ওরাও আমারে খুব ভালোবাসে। ওদেরকে নিজ হাতে মানুষ করলাম। আবার তুমি আসলা আমার কাছে। তোমারে পাইয়া আরেকবার আমার মা হওয়ার দুঃখ ঘুচল। তুমি আমারে আপন কইরা নিলা। আমিও ভালোবাসলাম তোমারে। আসলে তুমি মাইয়াডাই এমন। তোমারে ভালো না বাইসা থাকাই যায়না। এখন আবার তোমারে ভালোবাসার সাথে সাথে নতুন দ্বায়িত্বও কাঁধে পরছে। তোমারে ভালো রাখার দ্বায়িত্ব, তোমার নিরাপদ রাখার দ্বায়িত্ব। তাই কই কি মা, আমার কাছে মিথ্যা কইওনা। মা মনে কইরা আমারে সব খুইলা কইবা, কেমন? ”

কুহু খালার কথা শুনে ধন্দে পরে যায়। ও খালার বলা শেষের কথাগুলোর মানে বুঝতে পারছেনা। খালা ওকে কি বোঝাতে চাইল? চিন্তারা মাথায় জট পাকাচ্ছে। কিন্তু ওর চিন্তা পাখনা মেলার আগেই নায়লা আঞ্জুম রাজিয়া খালাকে ডাক দেয়। খালা বাহিরে গেলে কুহুও চিন্তায় ক্ষান্ত দেয়।

দুইদিন পর কোচিং থেকে বাসায় এসে কুহুর চক্ষু চড়ক গাছে রুপান্তরিত হয়। বাসায় বেশ কয়েকজন নতুন মানুষকে দেখে ও গুটিয়ে যায়। একজন মধ্যবয়সী নারীর সাথে মেজো চাচি হেসে হেসে কথা বলছে।

কুহু কোন কথা না বলে ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই কথা বলল সেই মধ্যবয়সী মহিলা।

” নায়লা, এটাই কি তোর সেই হাভাতে ভাসুরের মেয়ে? ভাতের অভাবে নিজের বাড়িতে না থেকে অন্যের ঘাড়ে বসে বসে খাচ্ছে! আসলে গ্রামের মানুষদের লজ্জাশরম সব সময়ই একটু কম থাকে। ”

ভদ্রমহিলার কথা কানে যেতেই কুহু লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। থমকে গেছে ও। মাটির সাথে যেন সেঁটে গিয়েছে ওর দুই পা। চক্ষু গহবরে ঠাঁই নিল অশ্রুকনারা। তারা জানান দেয়, আমরা অতিসত্তর আসছি। ঠোঁট কা’ম’ড়ে চেষ্টা করছে অশ্রুবিন্দুদের পতন ঠেকানোর।

” হুম ছোট আপা, এ-ই সে। তবে বেশি কিছু বলোনা। রিশার বাবা জানলে আমাদের অসুবিধা আছে। এই মেয়েটাকে দেখতে যেমন সাধাসিধা মনে হয়, বাস্তবে তার উল্টো। দেখবে ইনিয়েবিনিয়ে চাচার কাছে আমাদের নামে বিচার দেবে। তুমি সত্যিই বলেছ, গ্রামের মিসকিনদের লজ্জাশরম কমই হয়। ”

এবার কুহুর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু বিন্দুরা ঝরে পরল। যেন ওরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কার আগে কে ঝরতে পারে।

রাজিয়া খালা রান্নাঘর থেকে সবকিছুই শুনলেন। তার চোখেও পানি জমেছে। ড্রয়িংরুম আর রান্নাঘরের মাঝখানে পাথরের স্ল্যাবের ব্যবধান থাকায়, রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমের সব কথাবার্তাই শোনা যায়। একটা এতিম মেয়েকে কেউ যে এভাবে বলতে পারে, সেটা তার কল্পনাই ছিলনা। তার মন অনেক কিছু বলতে চাইলেও, সে যে এই বাসার কাজের মেয়ে। সেজন্য নিজের ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে কাজে লেগে যান।

কুহু রুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ওর এই মুহুর্তে এই বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা একপর্যায়ে ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। কিন্তু পরক্ষণেই চাচার কথা মনে হতেই কাপড়চোপড় ব্যাগ থেকে বের করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখল। ও ভালো করেই জানে, চাচার কানে আজকের কথাগুলো গেলে, চাচা ওদেরকে ছাড়বেনা। কুহু চায়না ওর কারনে চাচার সংসারে অশান্তি হোক। তাই শত অপমানেও ওর নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। ধীরে ধীরে নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে হবে। একটা কাজ জোগাড় করে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। তবে তার আগে চাচাকে বোঝাতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, কুহু আর ছোটটি নেই। পরিস্থিতি ওকে বদলে দিয়েছে। সে এখন নিজের সাথে সাথে ভাইয়েরও খেয়াল রাখতে পারে। ভাইয়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে সক্ষম সে।

কুহুর সম্বিৎ ফিরে খালার ডাকে। খালা কোন কথা না বলে কুহুকে জড়িয়ে ধরলেন। খালার একটু আদরের ছোঁয়া পেতেই কুহুর নিলাজ মন হু হু করে উঠল। আবারও কাঁদতে শুরু করল মেয়েটা।

রাজিয়া খালা অনেকক্ষণ কুহুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। কুহু শান্ত হলেই তবে ওকে নিয়ে রান্নাঘরে গেলেন তিনি।

” হেই রাজিয়া খালা, তোমার সাথে এই পরীটা কে? উঁহু পরী নয়, এটাতো ব্ল্যাক ডায়মন্ড! তা এই ব্ল্যাক বিউটি কে? ” রান্নাঘরের ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে ডক ডক করে পানি পেটে চালান দিয়ে বলল জয়। সে নীরবে কুহুকে পরখ করতে ব্যস্ত। জয় নামক ছেলেটার চোখ কুহুর সর্বশরীরে বিরাজ করছে।

কুহু ছেলেটাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখেই জড়সড় হয়ে কাজ করছিল। তখনই ছেলেটি রাজিয়া খালার সাথে কথা বলল। তাকে জিজ্ঞেস করল কুহুর কথা।

” ও কুহু। রিশার বড় চাচার মেয়ে। ” রাজিয়া খালার জয়ের কথা বলার ধরন পছন্দ হয়না। তাই তিনি আর কথা বাড়ালেননা।

” কু….হু। মানে কোকিলের ডাক। ভেরি গুড। তাকে একটু কথা বলতে বলবে, খালা? তার গলা দিয়ে কোকিলের স্বর বের হয় কিনা একটু দেখতাম। এই যে হট বিউটি? একটু কথা বলোনা? ” চোখ টিপে বলল জয়।

কুহু জয় নামক ছেলেটার কথা শুনে ওড়না দিয়ে শরীর ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিয়ে রাজিয়া খালার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়।

” জয় বাবা, তোমার কাম শেষ হইলে এখান থাইকা যাওগা। আমরা কাম করতাছি। রান্দোন ঠিক সময়ে না হইলে তোমার মা খ্যাচখ্যাচ করব।তখন তারে তো তোমার এই কথাগুলান কইতে পারমুনা। ”

রাজিয়া খালার হুমকিতে কাজ হলো। জয় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

সেইদিন জয় কারনে-অকারণেই কুহুর আশেপাশে আঠার মত চিপকে রইল। ও কুহুর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কুহু তাকে পাত্তা না দিয়ে রাজিয়া খালার সাথেই রইল। ও খালার কাছ থেকে জেনেছে জয় ওর চাচির ছোট বোনের ছেলে। তাই সে ভয়ে আরও গুটিয়ে যায়।

” হেই ডুড, আজকে নানুর বাসায় এসে একটা হট আইটেম দেখলাম। এবার রাজশাহীর ট্রিপটা আমার জন্য লাকি। আগে এখানে এসে বোর হতাম। এখন থেকে সেটা আর হতে হবেনা। মেয়েটাকে পটাতে পারলে মন্দ হবেনা। এটলিষ্ট রাজশাহীতে একটা বেড পার্টনার তো মিলবে। ”

অপার পাশ থেকে কিছু একটা শুনে জয় জোড়ে হেসে উঠল। ওর চোখ চকচক করছে। ঠোঁট দিয়ে ভেজায় নিজের ঠোঁট।

এতক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে সবটাই শুনল কেউ একজন। জয়ের কথা শেষ হতেই সে অতি সন্তপর্ণে সেখান থেকে সড়ে যায়।

রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ। কুহু পড়ছে । সৃজন ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই। এমন সময় দরজায় টোকার শব্দ শুনে কুহুর বুক ধক করে উঠল। এই রাতে কে এসেছে!

দরজার অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো ব্যক্তি যেন কুহৃর মনের কথা শুনতে পেল। তার গলা শুনেই কুহুর ভয় নিমেষেই উবে যায়।

” কুহু মা, দরজা খুইল্যা দেও। আমি রাজিয়া খালা। ”

কুহু দরজা খুলেই দেখল খালা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।

” খালা, আপনি এত রাতে? ”

” আইজ তোমার লগে শুইতে আইলাম। আমারে শুইতে নিবা? ”

” কেন নিবনা, খালা! আসেন ভেতরে আসেন। কিন্তু বিছানায় তো তিনজন শোয়া যাবেনা। এক কাজ করি সৃজন খাটে ঘুমাক। আমরা দুইজন মেঝেতে বিছানা করে ঘুমাই। ”

” তুমিও সৃজন বাবার লগে বিছানায় শোও। আমি নিচে শুই। ”

” আপনি এটা কি বলছেন! আপনি মুরব্বি হয়ে একা নিচে শোবেন, আর আমি ওপরে শোব! এটা কিছুতেই হয়না। আমিও আপনার সাথে নিচে শোব। আপনি আমাকে গল্প শোনাবেন। কতদিন গল্প শুনিনা। আগে বাবা নিয়ম করে গল্প শোনাত। কিন্তু সে অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই আর গল্প শোনা হয়নি। ” কুহুর চোখ চিকচিক করছে। চোখে পানি স্পষ্ট।

রাজিয়া খালা কিছু না বলে বিছানা করে কুহুকে নিয়ে শুয়ে পরল। আজ সে কুহুকে অনেক গল্প শোনাবে।

চলবে….

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১০

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১০
জাওয়াদ জামী জামী

কুহুরা রাজশাহীতে আসলে ওদের কেউ স্বাগত জানালনা কিংবা কেউ এগিয়ে এসে মাথায় সহানুভূতির হাত রাখলনা। একজন পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়া এসে ওদেরকে একটা রুমে নিয়ে গেল। কুহু তার সাথে কথা বলে জানতে পারল, বৃদ্ধার নাম রাজিয়া।

রায়হান আহমেদ বাসায় এসেই আবার কোথাও বেরিয়ে গেছেন। রিশা, নিশো দুজনেই নিজেদের রুমে চলে গেছে। ওরা গ্রামে গিয়ে সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করেছে, তাই বাসায় এসেই ওরা ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে।

কুহু আর সৃজন রুমে চুপচাপ বসে আছে। ওরা এই বাসায় এসেছে তিন ঘন্টা আগে। এতক্ষণ পর্যন্ত নায়লা আঞ্জুমের সাথে ওদের দেখা হয়নি। ওরা বাড়ি থেকে আসার সময় বাড়িতে পালিত হাঁস, মুরগী, বাড়ির সবজিসহ বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। সেসব কুহু রাজিয়া খালার কাছেই দিয়েই। রাজিয়া খালা এতসব কিছু দেখে ভিষণ খুশি হয়েছে। এভাবে কতক্ষণ রুমে বসে থাকা যায়! কুহু একটু উসখুস করতে লাগল। মেজো চাচির সাথে এখনও কথা হয়নি। অথচ তার সাথে কথা বলা দরকার। ওর ভাবনার মাঝেই রাজিয়া খালা রুমে আসল।

” মা গো, তোম্গোর কি খিদা লাগছে? খাওন দিমু? ”

” না খালা, এখন খাবোনা। আচ্ছা খালা, মেজো চাচি কোথায়? তাকে দেখছিনা যে? আর চাচা সে কোথায়? ”

” নায়লা আপায় নিজের ঘরেই আছে। আর তোমার চাচায় এখনো বাড়িতে আসেনাই। হেয় মনে হয় অফিসেই গেছে। হেয় এমনিতেই প্রতিদিন রাইত কইরাই বাসায় আসে। তার নাকি অফিসে মেলা কাম থাকে। আমি কইতাছি কি মা, তোমরা এহন খাইয়া নেও। কতক্ষণ ধইরা না খাইয়া থাকবা? তোমার চাচা আইতে রাইত এগারোটার বেশি বাজব। আর তোমার চাচির কথা বাদ দেও। হের মনে কখন কি কয়, হেয় নিজেই জানেনা। তোমাদের কখন, কি দরকার হয়, তা সব আমারেই কইবা। ”

রাজিয়া খালার স্নেহমাখা কথা শুনে কুহুর বেশ ভালো লাগল। এখানে এসে একজনকে অন্তত পেয়েছে যে ওদের ভালোর জন্য চিন্তা করছে। আল্লাহর প্রতি মনে মনে হাজরো শুকরিয়া আদায় করল মেয়েটা।

বিশ দিন পেরিয়ে গেছে কুহুরা রাজশাহী এসেছে। এ কয়দিনে নায়লা আঞ্জুম ওদের ধারেকাছেও ঘেঁষেনি। আর না ওদের সাথে যোগাযোগ বলেছে। তবে বিষয়টা এখনো রায়হান আহমেদের কানে যায়নি। রায়হান আহমেদ কুহু সৃজনের কাছ থেকে প্রতিদিনই জানতে চায় নায়লা আঞ্জুম ওদের সাথে কিরূপ আচরণ করে। কিন্তু কুহু তাকে কখনোই জানায়না ওর চাচির ওদের প্রতি অবহেলার কথা। ও চায়না ওদের জন্য ওর চাচা-চাচির সম্পর্ক নষ্ট হোক। ওর চাচার জন্যই আজ ও ভালো কোচিং-এ ভর্তি হতে পেরেছে, সৃজন ভালো স্কুলে পড়ছে।

রাত এগারোটা বিশ। কুহু ওর চাচার জন্য অপেক্ষা করছে। ও এই বাসায় আসার পর থেকেই স্বেচ্ছায় দ্বায়িত্বটা পালন করে আসছে। চাচার জন্য অপেক্ষা করতে ওর মন্দ লাগেনা।

কুহু ড্রয়িংরুমে বই হাতে নিয়ে বসে আছে। রাজিয়া খালাকে ও জোড় করে শুতে পাঠিয়েছে। যেটা এই বাসায় আসার পর থেকেই করে আসছে। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে কুহু দরজার দিকে এগিয়ে যায়। হাসিমুখে দরজা খুলে সামনে তাকাতেই ও চমকে যায়।

তাহমিদ এই অসময়ে কুহুকে এখানে আশা করেনি। ও জানত কুহু এই বাসায় আছে। কিন্তু ও দরজা খুলতে আসবে সেটা তাহমিদ ভাবতে পারেনি।

” কি অবস্থা খালামণির শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়ার? তার তো আবার চমকানোর ব্যামো আছে। আজও কি সে আমাকে দেখে চমকে গেছে? ব্যামোর ঔষধ লাগবে নাকি? আমি আবার এই বিষয়ে পারদর্শী। কয়েকরকম ব্যামোর ঔষধ আমার কাছে আছে। তুমি শুধু ইশারা দেবে। দেখবে এই বান্দা তোমার সেবায় হাজির হয়ে গেছে। ” তাহমিদ দরজার একপাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে । দু হাত আড়াআড়িভাবে বুকের সাথে বেঁধে রেখেছে। ওর ঠোঁটে খেলা করছে দুষ্টুমির হাসি। ওর সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে।

এদিকে কুহু তাহমিদকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছে। সেই সাথে আরও অবাক হয়েছে তাহমিদের এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে। সেই রাতে বাড়ির উঠানে ও প্রথম তাহমিদকে দেখেছিল। তখনও কুহু জানতোনা লোকটা কে। পরদিন ফুপুর কাছ থেকে শুনেছিল ইনি মেজো চাচির বোনের ছেলে। সেইদিনই সকালেই উনি গ্রাম থেকে চলে গেছিলেন। তারপর আর তার সাথে কুহুর দেখা হয়নি। এতদিনে কুহু এই লোকটার কথা ভুলে গিয়েছিল। ও চোরা চোখে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখল, আশেপাশে কেউ নেই। হঠাৎই দমকা হাওয়ার তোড়ে কুহু নড়ে উঠল। এলোমেলো হয়ে গেলো ওর বাঁধনহারা কেশরাশি।

তাহমিদ লক্ষ্য করল মেয়েটার কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো লুটোপুটি করছে ওর পেলব শরীরে। শ্যামলা চেহারার মেয়েটার চোখেমুখে এই মুহুর্তে খেলা করছে বিস্ময়। সেই সাথে উঁকি দিচ্ছে লজ্জা।

” রমনী, আমাকে কি বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে? নাকি আগেই ঔষধ চাই? তবে জেনে রাখ, আপাতত তুমি ঔষধ সেবনের পর্যায়ে যাওনি। তুমি বর্তমানে প্রথম ধাপে অবস্থান করছ। এই ঔষধ সেবনের পূর্বে কয়েকটা ধাপ অতিক্রম করতে হবে তোমাকে। ”

কুহু তাহমিদের এহেন কথা শুনে অতিদ্রুত দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।

তাহমিদ কুহুকে সরে দাঁড়াতে দেখে বাসায় প্রবেশ করল।

রায়হান আহমেদ বাসায় আসলে কুহু খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে রাখল।

রায়হান আহমেদ খেতে আসলেন। একটু পর সেখানে আসল তাহমিদ। তাহমিদকে দেখে কুহু অস্বস্তিতে পরে যায়। কিন্তু তাহমিদের কোন হেলদোল নেই।

” আরে তাহমিদ যে , কেমন আছো? কখন এসেছ? ” রায়হান আহমেদ সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন।

” আমি খুব ভালো আছি, তালুকদার সাহেব। আপনার অবস্থা কি বলুন? কেমন যাচ্ছে দিনকাল? আপনার যমকে দেখছিনা যে? আর রাজিয়া খালাকেও তো দেখছিনা। আমার কি আজ খাওয়া হবেনা? ” তাহমিদের কথা শুনে বিষম খেলেন রায়হান আহমেদ। ভাতিজীর সামনে তাহমিদ তাকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।

” আমিও ভালো আছি। তোমার খালামণি ঘুমাচ্ছে। এসব কথা বাদ দাও। এসো একসাথে খেয়ে নিই। কুহু এখানে আসার পর থেকে রাতে সে-ই আমাকে খেতে দেয়। কুহু মা, এ হচ্ছে তাহমিদ। তোর চাচির বোনের ছেলে। আমাদের খেতে দে, মা। ”

কুহু নীরবে ওদেরকে খেতে দেয়। রায়হান আহমেদ ওকে অনেকবার খেতে বললেও ও খায়না। তারা খাওয়া শেষ করে নিজেদের রুমে গেলেই তবে কুহু খেয়ে নেয়।

ফজরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ বই নিয়ে বসে কুহু। একঘন্টা পড়ার পর চলে যায় রান্নাঘরে। ও এই বাসায় আসার পর থেকেই রাজিয়া খালাকে টুকটাক কাজে সাহায্য করে। যদিও এই বাসায় আরও তিনজন মেইড আছে, তবুও কুহু রাজিয়া খালাকে নিজ থেকেই কাজে সাহায্য করে।

কুহু কাজ সেড়ে খাবার নিয়ে যায় নায়লা আঞ্জুমের মায়ের রুমে। চিকেন স্যুপ, আর কিছু ফল তার সকালের নাস্তা।

” নানিমা, আপনার খাবার এসে গেছে। এবার ঝটপট খেয়ে নিন দেখি। ” কুহু টি টেবিলে খাবারের ট্রে রেখে, সিস্টারকে সাহায্য করে নানিমাকে তুলে বসাতে। তার সার্বক্ষনিক দেখাশোনার জন্য জন্য একটা নার্স রাখা হয়েছে।

নায়লা আঞ্জুমের মা ফাতিমা খানম কুহুকে দেখে হেসে উঠলেন। তিনি ডান হাত বাড়িয়ে কুহুকে নিজের কাছে ডাকলেন। কুহুও হাসিমুখে সেদিকে এগিয়ে যায়। এই কয়েকদিনে তার সাথে কুহুর বেশ শখ্যতা গড়ে উঠেছে। বৃদ্ধা জড়বস্তুর ন্যায় দিনরাত বিছানায় শুয়ে থাকেন। গত পাঁচ বছর আগে তার পুরো শরীর প্যারালাইসড হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে হারিয়েছেন বাকশক্তি। অনেক চিকিৎসার পর ছয়মাস আগে থেকে তিনি ডান হাত নাড়াতে পারছেন। কুহু এখানে আসার পরদিনই রাজিয়া খালার সাথে এই রুমে এসেছিল। তখন বিছানায় শোয়া বৃদ্ধাকে দেখে ওর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। এরপর থেকে ও নিয়মিত এই রুমে আসে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বৃদ্ধার সেবা করে। একা একা এটাসেটা গল্প করে বৃদ্ধার সাথে। এতে বৃদ্ধাও ভিষণ খুশি হয়েছেন। এতদিনে তিনি একজন সাথী পেয়েছেন।

” তাহমিদ বাবা, ও তাহমিদ বাবা? আর কত ঘুমাইবা? উইঠা পর। টেবিলে খাওন দিছি। ”

রাজিয়া খালার ডাকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল তাহমিদ।

” রাতে তোমাকে না দেখে আমার কত খারাপ লেগেছিল, সেটা কি তুমি জানো খালা? ” কোন সম্ভাষণ ছাড়াই জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” আমি কি জানি কাল তুমি আইবা? আমারে যদি আগে কইতে তবে আমি কি ঘুমাইতাম নাকি? কুহু আসনের পর থাইকা আমি দশটার মধ্যেই শুই। মাইয়াডা আমারে জাগবার দেয়না। এখন উঠ দেখি। আমি বিছানা গোছায় দিই। ”

তাহমিদ বিছানা থেকে নেমে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকল। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল রাজিয়া খালা চলে গেছে। রাতে আসার পর নানিমার সাথে দেখা করা হয়নি। তাই তাহমিদ প্রথমেই নানিমার কাছে যায়।

” নানিমা, আর একটু খেয়ে নিন। এতটুকু খেলে আপনার শরীর টিকবে? আপনাকে খুব তারাতারি সুস্থ হতে হবে। আপনি সুস্থ হলেই, আপনাকে নিয়ে আমি টি বাঁধে বেড়াতে যাব। এই শহরে আমি কার সাথে বেড়াতে যাব বলুন? আপনি ছাড়া আমার বেড়ানোর সাথী আর কে আছে? ”

তাহমিদ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় ভেতরের কেশবরণ কন্যার দিকে। এই সকালেও সে তার চুলগুলো খোলা রেখেছে। তার কোঁকড়া চুল যেন এঁকেবেঁকে নেমেছে নিচের দিকে। ফ্যানের বাতাসে ওরা এদিকসেদিক ছোটাছুটি করছে। মেয়েটার পড়নে হালকা কলাপাতা রংয়ের থ্রিপিস। নাকে জ্বলজ্বল করছে সাদা পাথরের ছোট্ট নাকফুল। কানের সাথে লেপ্টে আছে ছোট্ট একজোড়া দুল। হঠাৎই তাহমিদ অনুভব করল ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। পিপাসায় ওর বুক চৌচির হয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে আসছে ঠোঁটদ্বয়। জ্বিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল ও। অনেক চেষ্টা করছে রুমের ভেতর যাওয়ার। কিন্তু ওর পা জোড়া যেন মেঝের সাথে সেঁটে গেছে।

সিস্টার তাহমিদকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কথা বলে উঠল,

” স্যার, আপনি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন! ভেতরে আসুন। ”

সিস্টারের গলার আওয়াজে ঘোর কাটল তাহমিদের। ও মাথা চুলকে হেসে রুমে ঢুকল।

কুহু তাহমিদকে দেখে মাথা নিচু করে নানিমাকে খাইয়ে দিতে থাকল। তাহমিদ গিয়ে ওর নানিমার অপর পাশে বসে তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৯

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৯
জাওয়াদ জামী জামী

” রিশা, নিশো, তোমরা কাল আমার সাথে গ্রামে যাবে? ” রায়হান আহমেদ ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন।

” তুমি আবার গ্রামে যাবে কেন? সাতদিন আগেই তো সেখান থেকে আসলে? তাছাড়া কালকে তোমার অফিস আছে। অফিস রেখে গ্রামে যেতে হবে? ” নায়লা আঞ্জুম স্বামীর কথা শুনে তেতে উঠে।

” অফিস আছে জন্যই কি গ্রামে যেতে পারবনা! আমি আমার গ্রামে, আমার বাড়িতে কবে যাব, কখন যাব সেটা কি তোমার কাছ থেকে শুনে তবে যাব? ”

” কেন শুনবেনা? তোমাকে অবশ্যই শুনতে হবে। তুমি শুনতে বাধ্য। আমি তোমার স্ত্রী। তোমার যেকোনো বিষয়ে আমি কথা বলতেই পারি। এবং জানার অধিকারও রাখি। ”

” তাহলে জেনে রাখ, কুহুর পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুইদিন আগেই। তাই কাল গ্রামে গিয়ে ওদেরকে নিয়ে আসব। এখন থেকে ওরা দুই ভাইবোন আমার সাথেই থাকবে। সৃজনকে রাজশাহীতে ভর্তি করিয়ে দেব। কুহুকেও এ্যাডমিশন কোচিং-এ ভর্তি করাব। ”

রায়হান আহমেদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম চমকে উঠে। তার রা’গ তরতর করে বেড়ে যায়। স্বামীর এমন বেপরোয়া আচরণ সে কিছুতেই মানতে পারছেনা। যে মানুষটা কিছুদিন আগ পর্যন্তও তার কথার বাহিরে যেতোনা, কিন্তু এখন সে যেন অন্য গ্রহের কোন মানুষে পরিনত হয়েছে! এখন সবকিছুতেই স্ত্রী’র বিরোধিতা করাই যেন তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে রা’গে’র সাথে কথা বলল।

” কিহ্! তুমি ওদের এখানে নিয়ে আসবে? ওদের কি বাড়িঘর নেই, যে আমার বাবার বাড়িতে এসে ভিখারির মত থাকতে হবে? ওদের বাড়িতে ওরা থাকুকনা নিজেরদের ইচ্ছেমত। একটা কথা শুনে রাখ, এ বাড়িতে ওদের কোন ঠাঁই হবেনা। এটা আমার বাবার বাড়ি। তাই এখানে আমি যা বলব তা-ই হবে। ”

” ঠিক আছে। ওরা আসবেনা এখানে। আমি একটা ফ্ল্যাট দেখে রেখেছি। কাল থেকে আমরা সেখানেই থাকব। আমি কয়েকজন লোক ঠিক করব। তারা আমাদের সব ফার্নিচার সেখানে পৌঁছে দেবে। তার আগে আমি ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে কথা বলব। ” ঠান্ডা মেজাজে বললেন রায়হান আহমেদ।

স্বামীর এহেন কথা শুনে আরও বেশি রাগ হয় নায়লা আঞ্জুমের। সে কিছুতেই চায়না শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে কেউ এখানে আসুক।

” এসব তুমি কি বলছ? আমার মা অসুস্থ। সে দিনরাত বিছানায় শুয়ে থাকে। একা একা নড়াচড়া করতে পারেনা। এই অবস্থায় তাকে রেখে আমি কোথাও যাবনা। আর না এই বাসায় বাহিরের কেউ আসবে। আর কোন ভিখারিরতো অবশ্যই ঠাঁই নেই এখানে। আমার মতামত আমি জানিয়ে দিয়েছি। এবার তুমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। ”

” তোমার মা অসুস্থ, সে বিছানায় দিনরাত কাটিয়ে দেয়, এটা দেখার দ্বায়িত্ব আমার নয়। তার আরও ছেলেমেয়ে আছে। তাই তার চিন্তা আমার না করলেও চলবে। তবে তার প্রতি আমার সমবেদনা আছে। আর ভিখারি কাদের বলছ তুমি? মনে রেখ ওরা আমার বংশধর। ভবিষ্যতে ওদের নিয়ে একটা কটুকথাও আমার সামনে বললে, তোমার অসুবিধা আছে। আমার যা সিদ্ধান্ত নেয়ার আমি ভেবেচিন্তেই নিয়েছি। তাই আমার ব্যাপারে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। ”

এবার নায়লা আঞ্জুম চুড়ান্ত পর্যায়ের অবাক হয়ে যায়। রায়হান আহমেদের ওর মা’য়ের প্রতি এমন মনোভাব দেখে সে কেঁদে উঠল। ও মানতেই পারছেনা, রায়হান ওর মা’কে তুচ্ছ করছে।

” তুমি আমার মা’কে কি বললে? আমার মা’য়ের প্রতি তোমার কোন দ্বায়িত্বই নেই? সে তোমার জন্য কি করেনি? সেই তুমিই আজ তাকে বোঝা মনে করছ! ” নায়লা আঞ্জুম কান্নার দমকে কথা বলতে পারছেনা।

” নিজের মা’য়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে? আমারও খারাপ লেগেছিল। গত তিনটা বছর আমি ছটফট করেছি, হাহাকার করেছি। সেগুলো তোমার চোখে কি কখনো পরেছিল? তোমার মন একটুও গলেছিল? তুমি আমার সাথে যেটা করেছ, আমি শুধু সেগুলোই তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। মন দিয়ে শোন, তোমার মা আমার জন্য কিছুই করেনি। সে যা করেছে নিজের সুবিধার জন্য করেছে। আমার জন্য যা করবার করেছিল আমার বড় ভাই। আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, ছোট-বড় সব আবদার পূরণ করেছে। মোটকথা বাবা-মা’য়ের সকল দ্বায়িত্ব পালন করেছিল আমার ভাই-ভাবী। কিন্তু তুমি আমার সেই ভাই-ভাবীকে অনেকবার অপমান করেছ, তাদের বিপদে আমাকে তাদের পাশে দাঁড়াতে দাওনি। ভাইয়ের মৃ’ত্যু’র পর আমার ভাবী ছেলেমেয়েকে নিয়ে কতই না কষ্ট করেছে, তবুও তোমার মন গলেনি। তবে আজ কেন তুমি কাঁদছ? তুমি আমার আপনজনদের সাথে যা যা করেছ, আমি শুধু সেগুলোই ফিরিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। তুমি যেমন নিজের সুবিধার জন্য বাবার বাড়িতে পরে আছ, আমিও ঠিক তেমনি আমার ভাতিজা-ভাতিজী কে আমার কাছে রাখব তাদের সুবিধার জন্য। ”

নায়লা আঞ্জুম রা’গে, ক্ষোভে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে রায়হান আহমেদের কথার কি উত্তর দেবে তা ভেবে পাচ্ছেনা। তবুও সে মুখ খুলল। মিনমিনিয়ে বল উঠল,

” তোমার কি হয়েছে? তুমি আজকাল আমার সাথে এমন আচরণ করছ কেন? তুমি তো আগে এমন ছিলেনা! এত কঠোর কেন হলে? ”

” তুমি আমাকে বাধ্য করেছে এত কঠোর হতে। তুমি যদি একটু মানিয়ে নিতে পারতে, আমার আপনজনদের প্রতি সদয় হতে, তবে আজকেই এই পরিস্থিতি কখনোই সৃষ্টি হতোনা। শোন নায়লা, নারীরা কোমল হৃদয়েই সুন্দর। কঠোরতা তাদের মানায়না। তবে তাদের প্রতিবাদী হতে দোষের কিছু নেই। তাই বলে কঠোরতার আবরনে নিজেদের ঢেকে যদি বলে আমরা প্রতিবাদী, তবে সেটা হবে বড় ধরনের ভুল। তুমি প্রতিবাদী হও, আমি তোমার পাশে আজীবন থাকব। কিন্তু নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কঠোর হবে এটাকে আমি আর কোনদিন প্রশ্রয় দেবনা। তোমার দেখাদেখি আমি নিজেরটা বুঝতে শিখে গেছি। এবার বল তুমি কি নতুন ফ্ল্যাটে যাবে নাকি আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে একাই সেখানে উঠব? তুমি চাইলে এখানেই থাকবে। মাস শেষে আমি তোমার খরচ পাঠিয়ে দেব। ”

নায়লা আঞ্জুম বুঝতে পারছে তার এখন আর স্বামীর কথা না শুনে কোনও উপায় নেই। সে নিজের সামান্য একটা ভুলে সবকিছু হারাতে চায়না। তারপরও সে নিজের দম্ভ বজায় রেখে বলল,

” তুমি এখানে ওদের নিয়ে আসলে সোসাইটিতে কত কথা হবে বুঝতে পারছ? সবাই বলবে, তোমার ভাই মৃ’ত্যু’র সময় সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যায়নি, তারা গরীব আরও অনেক কিছু বলবে। সেসব শুনলে আমার তো লজ্জা লাগবে। ”

” হু কেয়ারস? আমার গরীব কি ধনী সেটা সোসাইটির মানুষদের কাছে ব্যাখ্যা করতে যাবোনা। আর গরীবরা কি মানুষ নয়? এসব আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ সেটা বল। আমার এত কথা শোনার সময় নেই। বসে বসে তোমার হাই সোসাইটির মানুষদের মত অন্য কারও পরিবার নিয়ে ভাবতে গেলে আমার সময়ের অপচয় হবে। সময়ের মূল্য আমার কাছে অনেক। ”

নায়লা আঞ্জুম বুঝল ওর সামনে আর কোনও পথই খোলা নেই। রায়হান ওকে সব দিক দিয়েই আটকে দিয়েছে। মনের মধ্যে রা’গ পুষে রেখে নিজেকে রাজি করায়।

” ঠিক আছে, ওরা এখানেই আসুক। থাকুক এই বাসায়। তবে ওদেরকে আমি যেই রুমে থাকতে দেব ওদেরকে সেখানেই থাকতে হবে। আমার ইচ্ছের বাহিরে কিছু করা যাবেনা। ”

” তোমার ইচ্ছের বাহিরে কিছুই ওরা করবেনা। ওদের বাবা-মা ওদেরকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়ে বড় করেছে। আর নিজের পছন্দমত রুমে ওদের থাকতে দেবে, তারমানে এই নয় যে ওরা মেইডের রুমে থাকবে। ওরা এই বাসায় আমার খরচে থাকবে। ওরা যেই রুমে থাকবে তার ভাড়া আমি তোমাকে দিয়ে দেব। আমি কিন্তু আমার ভাতিজা-ভাতিজীকে তোমার টাকায় কিংবা তোমার বাবার টাকায় খাওয়াবোনা। তাই ভুল করেও ওদের যে সে রুমে থাকার ব্যবস্থা করোনা। ”

” আমি ওদের ভালো রুমই দেব। আর রুমের জন্য তোমাকে ভাড়া দিতে হবেনা। ” মুখ কালো করে বলল নায়লা আঞ্জুম।

” যাতে ভবিষ্যতে তুমি ওদের খোঁ’টা দিতে পার? সে ভুল আমি করবনা। জীবনে অনেক ভুল করেছি। আর নয়। ”

এতক্ষণ রিশা আর নিশো বাবা-মা’র কথা শুনছিল। রায়হান আহমেদও ভুলে গিয়েছিলেন রুমে তার ছেলেমেয়েরাও আছে। রিশা বরাবরই ওর মায়ের ওপর বিরক্ত। ও বাবা ভক্ত মেয়ে। সেই সাথে ও দাদুর পরিবারের সবাইকে ভালোবাসে। তাই কুহুদের আসার কথা শুনে ভিষণই খুশি হয় মেয়েটা।
নিশো ও বোনের মতই বাবার আত্মীয় স্বজনদের ভালোবাসে। কিন্তু সব সময় মায়ের সাথে থেকে কিছুটা নাক উঁচু স্বভাবের হয়েছে ও। সবকিছুতেই খুঁত ধরার স্বভাব ও মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। কিন্তু আজকে বাবা-মা’র কথপোকথন শুনে ও বাবার পক্ষই নেয়।

” কুহু মা, সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়েছিস তো? এখন রাজশাহী গেলে হয়তো তিন-চার মাসের আগে গ্রামে আসতে পারবিনা। তাই প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে নে, মা। ” শাকিলা সুলতানা কুহুকে একটু পরপর মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

” ফুপু, আমি তোমাকে ছেড়ে সেখানে গিয়ে কেমন করে থাকব? এখানে থাকলে তোমাকে তবুও দেখতে পেতাম। কিন্তু রাজশাহীতে তো তুমি যাবেনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, ফুপু। ”

” পা’গ’লী মেয়ে, আমাকে দেখার আশা করতে গেলে তোদের পড়াশোনা ঠিকমত হবেনা। তাছাড়া আমি সব সময় তো এখানে থাকতে পারবনা। আমি নিজের বাড়িতে গেলে তোরা একা হয়ে যাবি। এটা আমার জন্য কতটা চিন্তার সেটা তুই জানিস? তোরা রাজশাহী গিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া কর, মানুষের মত মানুষ হ, বাবা-মা ‘ র স্বপ্ন পূরণ কর। মেজো চাচির সাথে ভালো ব্যবহার করবি কেমন? অভিযোগ করার কোন সুযোগ তাকে দিবিনা। গ্রামে আসার আগে আমাকে জানিয়ে দিস, আমি আসব। ” শাকিলা সুলতানা আর কিছু বলতে পারলেননা। তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসল। কুহুও ফুপুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।

তাহমিদ গত কিছুদিন যাবৎ ঠিকঠাক বাসায় আসতে পারছেনা। সেই সকাল আটটায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, বাসায় ফিরে রাত দেড়টা থেকে দুইটার দিকে। ওর জন্য কেউই অপেক্ষা করেনা। কেউ ওকে জিজ্ঞেস করেনা কেমন আছে। বেশিরভাগ সময় ও বাসায় খায়না। গত তিন বছর যাবৎ ও একবেলাও বাসায় খায়নি। অবশ্য এটা নিয়ে কারো তেমন একটা মাথাব্যথা দেখা যায়না। যেমনটা কেউ আজও দেখালনা। সকার আটটা বাজতেই ও নিচে আসল। ড্রয়িংরুমে ওর বাবা বসে ছিল। বাবার পাশে ওর ছোট বোন আরিশাও বসে আছে। তাহমিদ ওদেরকে দেখেও না দেখার ভান করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। রাশেদ কুরাইশি রা’গী চোখে ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৮

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৮
জাওয়াদ জামী জামী

পেরিয়ে গেছে দশদিন। কুহুর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ওর প্রথম পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। শাকিলা সুলতানা সেই যে এসেছেন, আর বাড়িতে যাননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যতদিন কুহুরা রাজশাহী না যায়, ততদিন তিনি এখানেই থাকবেন। তিনিই কুহু আর সৃজনের দেখাশোনা করছেন। বারেবারে সাহস জোগাচ্ছেন তার ভাতিজা-ভাতিজীকে। তাদের মনোবল বাড়াচ্ছেন।

কুহুও নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে, নিজের সব দুঃখ একপাশে রেখে সৃজনকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাইছে।

রায়হান আহমেদ এবং সাইদ আহমেদ দুইজনই কুহুদের খোঁজ-খবর রাখছেন। সাইদ আহমেদ স্ত্রী’র কথা অমান্য করেই কুহুদের বাজার করে দিয়েছেন। রায়হান আহমেদও কুহুকে কিছু টাকা দিয়ে গেছেন। তাই এই কয়দিন শাকিলা সুলতানার খাবার নিয়ে কোন চিন্তা করতে হয়নি।

আইরিনের মৃ’ত্যু’র পরদিন নায়লা আঞ্জুম সেই যে গেছে, আর একটিবারও কুহুদের কোন খোঁজ নেয়নি। বিষয়টা নিয়ে শাকিলা সুলতানা একটু চিন্তা করছেন। কয়দিন পর ছেলেমেয়েদুটো রাজশাহী যাবে, সেখানে গিয়ে যদি আবারও কষ্ট পায়, তবে তিনি কেমন করে সইবেন। নায়লা আঞ্জুম যে ওদের ভালোভাবে গ্রহন করবেনা, তা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। তিনিও যে নিরুপায়। তার যদি একটুও সামর্থ থাকত, তবে তিনি ছেলেমেয়েদুটোকে অন্য কোথাও পাঠাতেননা। নিজের কাছেই রেখে দিতেন। নিজের অপারগতার কথা ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে শাকিলা সুলতানার। নিজেকে বারংবার ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি।

শাকিলা সুলতানার কান্নার শব্দ শুনে ঘর থেকে দৌড়ে উঠানে আসল তার মেয়ে আতিয়া। সে চুপটি করে মা’য়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে, মা’কে জড়িয়ে ধরল। ও ভালোভাবেই জানে, ওর মা কেন কাঁদছে। মা’কে শান্তনা দেয়ার কোন ভাষাই ওর জানা নেই। নিজের ভবিষ্যতের চিন্তায় সে নিজেও উদগ্রীব। এরপর কি হতে চলেছে? এই চিন্তা মাথায় আসলেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। কবে যে ওর বড় ভাই পড়াশোনা শেষ করবে, আর কবে একটা চাকরি করবে। তার নিজেরও পড়াশোনা আছে। কিভাবে চলবে সবকিছু!

আতিয়া অনেক কষ্টে ওর মা’কে শান্ত করে। ভাগ্যিস কুহু পরীক্ষা দিতে গেছে। নইলে মেয়েটা বাড়িতে থাকলে আরেক দফা কান্নার রোল পরে যেত।

তাহমিদ ভার্সিটির পরীক্ষার কারনে বেশ কিছুদিন রাজশাহী যেতে পারেনি। এবং আগামী পনেরদিনও সেখানে যেতে পারবেনা। তবে ও নিয়মিত ওর নানিমার খোঁজ রাখে। সেই সাথে রায়হান আহমেদের কাছেও ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হতে গেলেই ড্রয়িংরুমে ওর বাবার সামনাসামনি হয়। ভদ্রলোক তার বড় ছেলের জন্যই অপেক্ষা করছেন।

” এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছ? তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। এস একসাথে খাব। ” রাশেদ কুরাইশি তাহমিদকে দেখেই বললেন।

তাহমিদ বাবার কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায়। কেউ যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করে, তবে সে ঠিকই ওর ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখতে পাবে।

” মিছেমিছিই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। নিজের শরীরে কষ্ট দিয়ে, একটা অযোগ্য ছেলের না খেয়ে বসে থাকা কি ঠিক হয়েছে? আপনার স্ত্রী এতে অসন্তুষ্ট হবেনা! ”

” হোয়াট ননসেন্স! রাশেদ, কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, সেকথা কি তোমার ছেলে ভুলে গেছে? সে নাহয় আমাকে সম্মান দেয়না, কিন্তু তাই বলে কি তোমাকেও অসম্মান করবে! তোমার ছেলে বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে কিন্তু মানুষের মত মানুষ হতে পারেনি। আর তুমি কিনা এই ছেলের জন্য তুমি অপেক্ষা করছ! একসাথে খেতে চাচ্ছ! তোমার উচিত একে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া। এই বাড়িতে বাস করার মত যোগ্যতা ওর এখনও হয়নি। এরা শুধু মানুষের সম্মান নিয়ে খেলতে পারে। মানুষকে সম্মান দিতে এরা জানেনা। ” ডেইজি কুরাইশি স্বামীকে উস্কে দিতে ভুলন করলনা।

” জ্বি, আমি মানুষ হতে পারিনি। আমি বেয়াদব, অসভ্য, বর্বর। ছোটবেলা থেকেই এসব শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই এসব এখন আমার ওপর কোন প্রভাব ফেলেনা। পারলে নতুন কিছু বলুন। ”

তাহমিদের ত্যাড়া কথা শুনে রেগে যান রাশেদ কুরাইশি।

” তাহমিদ, তুমি থামবে? তুমি যে এতটা বেয়াদব হয়েছ সেটা আমি কল্পনাই করতে পারিনি। একটা সামান্য কথাকে তুমি কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ! তুমি বেড়ে উঠেছ ঠিকই কিন্তু মানুষ হতে পারোনি। অবশ্য তোমার কাছ থেকে ভালো কিছু আশাও করা যায়না। দিনশেষে নিজের জাত ঠিকই চিনিয়ে দাও। নিজের কার্যকলাপ দিয়ে বারবার বুঝিয়ে দাও, তুমি দূষিত গর্ভে জন্মেছ। এক নোংরা মানুষের নাড়ি বন্ধনে আবদ্ধ ছিলে তুমি। আমার সকল প্রপার্টি থেকে তোমার নাম আমি পার্মানেন্টলি ছেটে দেব। ”

রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে তাহমিদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। রা’গে হাতের মুঠো পাকিয়েছে।
সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। রা’গ তরতর করে বেড়ে যেতেই ও কাছে থাকা টি টেবিলে লা’থি হাঁকায়। হাতের কাছে থাকা কাঁচের ফুলদানি আছাড় মা’র’ল। রা’গে’র চোটে জোরে শ্বাস ছাড়ছে।

” শুধু দূষিত গর্ভের দোষ দিচ্ছেন কেন? আপনারও তো দোষ কম ছিলনা। সাধু পুরুষ ছিলেননা আপনি। এখন আমি মুখ খুললে বাসার মেইডদের চোখেও নিচে নেমে যাবেন। মুখ দেখাতে পারবেননা কাউকে। তাই ভালো হয় আপনি এবং আপনার স্ত্রী দুজনেই মুখ বন্ধ রাখুন। আর কে চায় আপনার প্রপার্টি? আমি ঘৃণা করি আপনাকে। আমার জীবনটা আপনারা নষ্ট করে দিয়েছেন। আমার থেকে শৈশব, কৈশোর আপনারা কেড়ে নিয়েছেন। নিজেরা ভালো থাকতে গিয়ে আমাকে নরকে নিক্ষেপ করেছেন। নয় বছর বয়স থেকে আমি নিজের সাথে, সমাজের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। কখনো সেই খোঁজ রেখেছেন? জানতে চেয়েছেন আমি ভালো আছি কি না? এখন যখন আপনার পাশে আপনার স্ত্রী-সন্তান আছে, তবে আমাকে কেন ঘাঁটান? থাকতে দিননা আমাকে আমার মত। ” আর সেখানে দাঁড়ায়না তাহমিদ। গটগটিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

” দেখেছ কত বড় বেয়াদব! কিভাবে ভাঙ্গচুর করল! আবার তোমাকেও কথা শুনিয়ে গেল! এগুলো কি ওর নিজের টাকায় কেনা? আমার সাধের ফুলদানিটা ভেঙে ফেলল! কয়দিন পর দেখা যাবে আমাদের গায়েও হাত তুলেছে। আমি বলি কি ওকে বাসা থেকে বের করে দাও। ও এই বাসায় থাকলে আমরা কেউ ভালো থাকবনা। আমার ছেলেমেয়েদেরও ও ভালো থাকতে দেবেনা। রোজ রোজ এই অশান্তি ভালো লাগেনা। ” ডেইজি কুরাইশি চেষ্টা করছে তার স্বামীকে নিজের দিকে টানতে। সে চায় তাহমিদকে রাশেদ কুরাইশি বাড়ি থেকে বের করে দিক।

” প্লিজ, একটু থামবে? নাকি আমিও বাসা থেকে বেরিয়ে যাব? তুমি তো দেখছি আ’গু’নে ঘি ঢালায় পারদর্শী! ” রাশেদ কুরাইশি এবার স্ত্রী’র ওপর রে’গে উঠলেন।

” মুখ সামলে কথা বল। আমাকে অবলা নারী ভাবলে তুমি ভুল করবে। বি’ষ’দাঁ’ত কি করে ভাঙতে হয় তা আমার জানা আছে। হোকনা সে তুমি কিংবা তোমার ছেলে। ডিজগাস্টিং। ” ডেইজি কুরাইশি সরাসরি রাশেদ কুরাইশিকে থ্রেড দিয়ে রুমের দিকে চলে যায়।

ভার্সিটি শেষে তাহমিদ কোচিংয়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে সোজা যায় টিএসসিতে। সন্ধ্যার পর নিয়মিতভাবে ওরা কয়েকজন বন্ধু মিলে টিএসসিতে আড্ডা দেয়। রাত এগারোটা পর্যন্ত চলে ওদের আড্ডা। এরপর যে যার বাসায় যায়।

কিন্তু তাহমিদ এখনই বাসায় যাবেনা। ওর ইচ্ছেও করেনা ঐ বাসার চৌকাঠ মাড়াতে। কিন্তু ও একজনের কাছে ওয়াদাবদ্ধ। তাই এতকিছুর পরও ওকে বাসায় যেতে হয়। ওর বন্ধুরা সবাই চলে গেলে, ও কিছুক্ষণ বসে থাকে সেখানে। সারাদিনের পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাই ও ঘাসের ওপর সটান হয়ে শুয়ে পরল। আশেপাশে এখনও মানুষজন আছে। কয়েকজনকে দেখা গেল সিগারেট ধরাতে। বাতাসে ভেসে আসা গন্ধে ও বুঝতে পারল, তারা নেশা করছে। ওদের দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পরে রইল। ওকে এখানকার সবাই চেনে। তাই দূর্ঘটনা ঘটার কোনও ভয় নেই।

রাত বারোটা দশ বাজতেই তাহমিদ উঠে বসল। প্রচন্ড পিপাসা পেয়েছে। ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে থাকা দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকে।

রাত দেড়টা। আজও ওর অপেক্ষায় কেউ জেগে নেই। আজ আর কলিংবেল বাজালোনা। সোজা হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় কাঁঠালচাঁপা গাছের নিচে।

কুহু একমনে পড়ছে। পিপাসা পেতেই টেবিলে ঢেকে রাখা গ্লাসের পানি পান করে ঘড়ির দিকে তাকায়। দেড়টা বেজে গেছে! হঠাৎ করেই ঘুম যেন চোখের পাতায় হানা দেয়। বই বন্ধ করে চেয়ার ছাড়ল। এরপর গিয়ে শুয়ে পরল সৃজনের পাশে।

রায়হান আহমেদ গ্রামে এসেছেন। তিনি বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন। শাকিলা সুলতানা ভাইকে দেখে ভিষণ খুশি হলেন। রায়হান আহমেদ সৃজনকে কাছে ডেকে নিয়ে বড় বোনের সাথে কথা বলছেন। কুহু তাদের দু’জনের কথা চুপচাপ শুনছে। গল্পের এক পর্যায়ে রায়হান আহমেদ কুহুকে জানান, ওর পরীক্ষার পরদিনই তিনি ওদের নিয়ে রাজশাহী যাবেন। এ্যাডমিশন এর জন্য কুহুকে কোচিং-এ ভর্তি করিয়ে দেবেন। এবং তিনি কোচিং-এ কথা বলে রেখেছেন। চাচা৷ কথা শুনে কুহুর ভিষণই ভয় হতে থাকে। ও রাজশাহীতে গেলে না জানি চাচি কিভাবে রিয়্যাক্ট করে! কিন্তু ওর মনের ভয় মনেই থেকে যায়। প্রকাশ করা আর হয়ে উঠেনা।

চলবে….

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৭

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৭
জাওয়াদ জামী জামী

বাড়ির গেইট পেরিয়ে উঠানে পা রাখল তাহমিদ। ও দুই হাতে রায়হান আহমেদকে ধরে রেখেছে।
বাড়ির উঠানে মানুষজন গিজগিজ করছে। উঠানের পূর্ব দিকে আম গাছের ছায়াতলে সামিয়ানা টাঙানো। সেখানে খাটিয়া রাখা হয়েছে।
খাটিয়া ঘিরে কয়েকজন মেয়ে কুরআন তিলাওয়াত করছে। এখানে সেখানে বসে কয়েকজন কাঁদছে।

রায়হান আহমেদকে দেখে এগিয়ে এলো দুইজন। তাহমিদ এখানকার কাউকেই চেনেনা, তাই বাধ্য হয়ে সেই অপরিচিত দুইজনের কাছেই সোপর্দ করল রায়হান আহমেদকে।
সেই দুই ব্যক্তি রায়হান আহমেদকে ধরে খাটিয়ার দিকে নিয়ে যায়। কেউ একজন এসে তাহমিদকে চেয়ার দিলে, তাহমিদ সেখানে বসল।

নায়লা আঞ্জুম বিরক্ত নিয়ে খাটিয়ার কাছে যায়। তার বরাবরই এসব ভালো লাগেনা। বিশেষ করে শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে একটু দূরেই থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে সে। এখানকার কে বাঁচল কে ম’র’ল, তাতে তার কোন যায় আসেনা। তাই আইরিন পারভিনের মৃ’ত্যু’ও তার অন্তরে দাগ কা’ট’তে পারলনা। সে কপালে বিরক্তির ভাঁজ নিয়ে খাটিয়ায় রাখা লা’শে’র দিকে তাকিয়ে রইল।

কুহু কাঁদতে কাঁদতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে। ওকে কেউ সামলাতে পারছেনা। সৃজন সেই কখন থেকে মা’য়ের পাশে বসে আছে। কখনো সে ডুকরে কেঁদে উঠছে, আবার কখনওবা মা’কে করুণ স্বরে ডাকছে। কিন্তু মা ওর কথা শুনলে তো।

চারপাশে কান্নার শব্দে বাড়ির বাতাস ভারি হয়ে গেছে। তাহমিদের বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে। ও খাটিয়ার পাশে বসা ছেলেটির কান্না দেখেই বুঝতে পারছে, ছেলেটি রায়হান আহমেদের ভাতিজা। ছোট্ট ছেলেটির কান্না ও সহ্য করতে পারছেনা। বারবার ছেলেটির মাঝে নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছে।

চেয়ারে বসে নানান চিন্তা করছে তাহমিদ। ভাবছে এই ছেলেটা আর তার বোনের কি হবে। ওরা কয়েক মাসের ব্যবধানে বাবা-মা দুজনকেই হারাল! ভাগ্য কতটা নির্মম হলে মানুষের সাথে এমনটা ঘটে।

কারও কান্নার শব্দ শুনে সেদিকে তাকায় তাহমিদ। দুইজন মধ্যবয়সী নারী একটা কিশোরী মেয়েকে ধরে নিয়ে আসছে। উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারার কিশোরীর চোখ দুটো ফুলে আছে, দু-চোখ বেয়ে ঝরছে নোনাজল। কান্নার দমকে নাকের পাতা ফুলে ফুলে উঠছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সামান্য শক্তিও অবশিষ্ট নেই সেই কিশোরীর। হাঁটতে গেলেই পা দুলে উঠছে।
হ্যালা, পাতলা মেয়েটির উচ্চতাও কম নয়। হালকা সবুজ রংয়ের থ্রিপিস তার পরনে। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছে।
কান্নারত মেয়েটিকে সামনে আসতে দেখেই আপনা-আপনি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায় তাহমিদ।

নায়লা আঞ্জুম কিছুতেই গ্রামে থাকতে চাইছেনা। সে চাচ্ছে যত তারাতারি সম্ভব ও রাজশাহী ফিরে যাবে। কিন্তু রায়হান আহমেদের একটাই কথা সে অন্তত দুইটা দিন গ্রামে থাকবে। তার ছেলেমেয়েরাও এটাই চায়। আইরিন পারভিনকে দাফন করে বাড়িতে আসলেই নায়লা আঞ্জুম স্বামীকে বলল, সে রাজশাহী ফিরে যাবে। আর তখনই দুজনের বিতন্ডা বেঁধে যায়। তাহমিদ ওর খালার এমন স্বার্থপরতা দেখে ভিষণ রে’গে যায়। কিন্তু বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা থাকায় সে কিছু বলতে পারছেনা।

নায়লা আঞ্জুমের চেঁচামেচি শুনে কয়েকজন আত্মীয় ফিসফাস করছে। তাহমিদ সেটা ইশারায় রায়হান আহমেদকে বলে দেয়।
রায়হান আহমেদ রা’গে নায়লা আঞ্জুমকে হিড়হিড় করে টেনে একটা রুমে নিয়ে যায়।

” তোমার সমস্যা কি, নায়লা? একটা দিন এখানে থাকতে তোমার সমস্যা কোথায়? ” রায়হান আহমেদ রে’গে গেছেন।

” আমার সমস্যা কিছুই না। কিন্তু তোমার আদিখ্যেতা বেশি। যখন তোমার বড় ভাই মা’ রা গেল, তখনও তো এত আদিখ্যেতা করনি। তবে এখন কেন করছ? ”

” সেদিন ভুল করেছি বলে, আজও সেই একই ভুল করতে চাইনা। কান খুলে শুনে রাখ, আমি আগামী তিনদিন এখানেই থাকব। আমার ছেলেমেয়েরাও আমার সাথেই থাকবে। তোমার ভালো না লাগলে কাল সকালে চলে যাবে। তবে আজকে রাত তোমার এখানেই কাটাতে হবে। এটাই ফাইনাল। ”

” তুমি আমাকে অর্ডার দিচ্ছ? হাউ ডেয়ার ইউ? আমি তোমার নির্দেশ মেনে চলব! তুমি ভুলে যেওনা আমি কে। তাই আমাকে অর্ডার করার সাহস করোনা। ”

নায়লা আঞ্জুম কথা পুরোটা শেষ না করতেই রায়হান আহমেদের হাতে সপাটে থা’প্প’ড় খেয়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে।

” তুমি ভুলে যেওনা আমি কে। আমি যদি অযোগ্য কেউ হতাম, তোমার বাবা নিশ্চয়ই আমার সাথে তোমার বিয়ে দিতনা। একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে রাখ, আমার পরিচয়েই তোমার পরিচয়। বাবার পরিচয়ে বোকারা নিজের পরিচিতি বাড়ায়। আমি এই মুহূর্তে আর একটাও কথা বলতে চাচ্ছিনা। তুমি আজ এখানে থাকবে এটাই ফাইনাল। এরপরও যদি একটা কথা বল, তবে এর পরিনতি খুব খারাপ হবে। আজকে আমার মন, মাথা সব খারাপ হয়ে আছে। ”

রায়হান আহমেদের গলায় এমন কিছু ছিল যা শুনে নায়লা আঞ্জুম ঘাবড়ে গেছে। তাই সে আর কোন কথা বাড়ায়না। রা’গে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বিছানায় গিয়ে বসল।

রায়হান আহমেদ উঠানে গিয়ে তাহমিদের পাশে বসল। তাহমিদ লক্ষ্য করল রায়হান আহমেদের মুখ শুকিয়ে গেছে। ও কিছু একটা বলতে গেলেই সেখানে উপস্থিত হয় সাইদ আহমেদ। সে-ও একটা চেয়ার টেনে বসল। দুই ভাইয়ের কারও মুখেই কোন কথা নেই। নিস্তব্ধতা যেন সবাইকে গ্রাস করেছে। এভাবে বসে থাকতে তাহমিদেরও অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু আপাতত ওর কিছুই করার নেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মুখ খুলল সাইদ আহমেদ।

” মেজো ভাই, কুহুর পরীক্ষার আর আটদিন আছে। এই অবস্থায় মেয়েটা কিভাবে পরীক্ষা দেবে! ওদের চিন্তায় আমার নিজেকে কেমন পা’গ’ল পা’গ’ল লাগছে।”

” কুহুকে বোঝাতে হবে। ওর পাশে ছায়া হয়ে আমাদেরকেই থাকতে হবে। ওদেরকে বোঝাতে হবে সকল প্রয়োজন, বিপদ-আপদে আমরা ওদের পাশে থাকব। আমি ভাবছি, পরীক্ষার পর কুহু, সৃজনকে আমার কাছে নিয়ে রাখব। সেখানেই এ্যাডমিশনের প্রস্তুতি নিবে। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুই ওদের খেয়াল রাখিস। ”

দুই ভাইয়ের কথার মাঝে তাহমিদ থাকতে চাইলনা। তাই ও চেয়ার ছাড়ল। কিন্তু রায়হান আহমেদ ওকে অন্য কোথাও যেতে দিলনা। তাদের দুই ভাইয়ের আলোচনার সঙ্গী করল তাহমিদকে।

রাতে খাবার পর তাহমিদকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে সাইদ আহমেদ। তাহমিদের সাথে পরিচিত হবার পর ওর ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে গেছে সে। তাই দুজনের বন্ধুত্ব হতে দেরি লাগেনি।
তাই যখন সাইদ আহমেদ তাহমিদকে বাহিরে যাওয়ার কথা বলেছে, তাহমিদও না করেনি।

বাহিরে থেকে বাড়িতে এসে ঢুকতেই তাহমিদের চোখ যায় বারান্দায় মাদুরে বসে থাকা কুহুর দিকে। মেয়েটার দুইপাশে কয়েকজন মহিলা বসে আছে। রায়হান আহমেদও সেখানে বসে আছে। সে সৃজনকে জড়িয়ে রেখেছে। তাহমিদ বুঝল তারা সবাই দুই ভাইবোনকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। মেয়েটা কোন কথা না বলে চুপচাপ শুনছে।
তাহমিদের হঠাৎই অযাচিত তৃষ্ণা পেয়ে বসল। ও এই বাড়িতে আসবার পর থেকে কুহুর গলা শোনেনি। এই মুহূর্তে ওর কুহুর কথা শুনতে সাধ জাগছে। কিন্তু ও ভালোভাবেই জানে পরিবারের লোকজনের মাঝে গিয়ে কারও কথা শোনা শোভনীয় নয়। তাই সে সাইদ আহমেদকে ফোনে কথা বলার বাহানা দিয়ে বাহিরে যায়।

শাকিলা সুলতানা, সোহানী পারভিন, রায়হান আহমেদ আর সাইদ আহমেদ মিলে কুহু আর সৃজনকে অনেকভাবে বুঝায়। সেখানেই ভাইবোনের সামনে রায়হান আহমেদ জানায়, কুহুর পরীক্ষা শেষ হলেই সে ওদেরকে রাজশাহী নিয়ে যাবে। সৃজনকে সেখানেই ভর্তি করিয়ে দিবে।ভাইয়ের এমন সিদ্ধান্তে শাকিলা সুলতানা বেশ খুশি হয়েছেন। আবার সোহানী পারভিন এবং সাইদ আহমেদও অমত করেনা। সবার ইচ্ছের কথা জানতে পেরে কুহুও সায় দেয়। ওর এই মুহূর্তে আর কিছুই করার নেই। আজকে চাচাদের এভাবে কাছে পেয়ে ও অনেকটাই ভরসা পেয়েছে।

রাতে তাহমিদ রায়হান আহমেদের সাথে এক রুমে শুয়েছে। নায়লা আঞ্জুম তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে এক রুমে শুয়েছে। রায়হান আহমেদ অনেক রাত পর্যন্ত তাহমিদের সাথে গল্প করল। এরপর সে ঘুমিয়ে গেলেও তাহমিদ জেগেই রইল। বেশ কিছুক্ষণ ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে। কিন্তু তবুও ঘুম আসেনা। এদিকে রাত তিনটা বেজে গেছে। কিন্তু ঘুম আসার কোনও লক্ষ্মণই নেই। তাই ও ফোন রেখে বাহিরে এসে দাঁড়ায়। উঠানের একপাশে কয়েকটা চেয়ার দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়।

আকাশে থালার মত চাঁদ রুপালি আলো ছড়াচ্ছে। দূরে কোথাও রাতজাগা পাখি তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে উঠল। ঝিঁঝিঁর ডাকে কানে তালা লাগার জোগাড়। সুশীতল হাওয়া এসে থেকে থেকে ছুঁয়ে দিচ্ছে শরীর।
তাহমিদ এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। এমন নিস্তব্দ রাত, এই চাঁদ, সবাই ওর রাত জাগার সাথী। জীবনের কতশত রাত যে ও আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে তা কেবল সে-ই জানে। এই রাত, এই চাঁদের মত তাহমিদও একা।

কোন কিছুর শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে তাহমিদের। শব্দের উৎসের দিকে তাকাতেই দেখল সেই শ্যামবরণ কিশোরী গুটিসুটি মে’রে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে একইসাথে খেলা করছে ভয় এবং কৌতুহল।

” রিল্যাক্স, আমি তাহমিদ। রায়হান আহমেদ আমার খালু। আমি তার সাথেই এসেছি। ” তাহমিদ বুঝতে পারছে কুহু ওকে চেনেনা। তাই ও আগেভাগেই নিজের পরিচয় দেয়।

তাহমিদের কথা শুনেও কুহুর ভয় কাটলনা। ও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল।
তাহমিদ লক্ষ্য করল কুহু কাঁপছে। বেশি কথা বললে মেয়েটা নির্ঘাত চিৎকার দেবে। আর ও এই কাজটা করলে নিজের মানসম্মান কিছুই থাকবেনা। আর এই একটা চিৎকারে ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে এটাও বুঝতে পারছে। তাই তাহমিদ ভেতরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

” আপনি ভয় পাবেননা। আমি রুমে যাচ্ছি। ”

তাহমিদ সেখানে না দাঁড়িয়ে কুহুকে পাশ কাটিয়ে রুমের দিকে চলে যায়। তবে ও দরজা না লাগিয়ে একটা চেয়ারে বসে কুহুর দিকে নজর রাখে। এত রাতে মেয়েটাকে বাহিরে দেখে তাহমিদও ঘাবড়ে গেছে। আসলে ও একটু ভয় পাচ্ছে। মা’য়ের শোকে মেয়েটা না কিছু একটা করে বসে। তাই ও অতি সংগোপনে নজর রাখে কুহুর দিকে।

তাহমিদ ভেতরে যেতেই কুহু উঠানে নেমে সোজা কলপাড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর অযু করে বেরিয়ে আসে। আজ ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করবে।

কুহু রুমে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে তাহমিদ। ওর দুচোখের পাতা ভারি হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই ঘুম যেন দু-চোখে তাদের রাজত্ব শুরু করেছে। যেন বহুকালের নির্ঘুম চোখ আজ একটু শান্তি চাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে না ঘুমালে ও বাঁচবেনা।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৬

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৬
জাওয়াদ জামী জামী

পরীক্ষার আর মাত্র দশদিন বাকি। কুহু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। ওর বড় ফুপু নিজের মেয়েকে নিয়ে কুহুদের বাড়িতে আছেন। কুহুর পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এখানেই থাকবেন। শাকিলা সুলতানা মন থেকেই তার ভাইদের ভালোবাসেন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন কুহুর পরিবারকে। কুহু, সৃজন তার কাছে নিজের সন্তানদের মতই।

এইচএসসি পাশ করার পর তার বিয়ের সম্মন্ধ আসে। ছেলে উচ্চশিক্ষিত, ভালো চাকরি করে, ভালো পরিবার দেখে আর অমত করেনি তার বাবা আর বড় ভাই। বিয়ের পর তিন বছর সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু কোন এক কারনে চাকরিচ্যুত হয় শাকিলার স্বামী আসাদ আলম। এরপর থেকে শুরু হয় তার উচ্ছনে যাওয়া। নেশা করা শুরু করে দেয়, শুরু করে জুয়া খেলা। একে একে বাপের সম্পত্তি বিক্রি করে নিজের চাহিদা পূরন করেছে। স্ত্রী-সন্তানদের দিকে তাকানোর সময় তার নেই। বাবার বাড়িতে এসব কথা জানাজানি হওয়ার পর কুহুর বাবা তালুকদার কায়সার ইনাম বোনের সকল দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। আইরিন পারভিন স্বামীকে কোন বাঁধা দেননি। বরং তিনি উৎসাহ জুগিয়েছেন। শাকিলা সুলতানার ছেলে মেয়ের পড়াশোনার সকল খরচ কুহুর বাবা দিতেন। শাকিলা সুলতানার ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। আর মেয়ে আগামীবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। তার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি বেশ কিছুদিন আগেই মা রা গেছে। তাই তিনি ভাইয়ের বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে নিশ্চিতভাবে থাকতে পারছেন। তার স্বামী কখন কোথায় থাকে তার কোনও ঠিক নেই। এমনকি তিনি নিজেও স্বামীর ওপর বিরক্ত হয়ে গেছেন। এক কথায় স্বামীকে কোনরূপ পরোয়াই করেননা তিনি। যে বাবা তার সন্তানদের প্রতি দ্বায়িত্ব পালনে উদাসীন এমন মানুষকে তিনি ঘৃ’ণা’ই করেন বলা যায়।

বড় ফুপু আসার পর কুহুকে কোন কাজই করতে হচ্ছেনা। ও শুধু পড়াশোনা করছে আর কয়েকটা ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে দিন পার করছে।

সে রাতে শাকিলা সুলতানা পুঁটি মাছের ঝোল আর পুঁইশাক চচ্চড়ি করেছেন। প্রতিবেশি এক চাচা মাছগুলো দিয়ে গেছে। সবাই একসাথে বসে রাতের খাবার খেয়ে যে যার ঘরে চলে যায়।

কুহু আর সৃজন ওর মায়ের কাছেই ঘুমায়। বাবা মা রা যাওয়ার পর কুহু ওর মা’কে একা ঘুমাতে দেয়না। আর সৃজন আগে থেকেই কুহুর কাছে ঘুমাত। তাই বাবা মা রা যাওয়ার পর দুই ভাইবোনই মায়ের কাছেই ঘুমায়।

কুহু পড়ার টেবিলে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। সৃজন মা’য়ের কাছে শুয়ে আছে।
আইরিন পারভিন মন দিয়ে কিছু একটা ভাবছেন। আজকাল রাতে তিনি ঘুমাত পারেননা।
শরীর সব সময়ই অবসন্ন থাকে। থেকে থেকেই মাথায় চক্কর দেয়। তিনি কিছুতেই স্বস্তি পাননা। মনটা সব সময়ই ক্যু ডাকে।

” কুহু, এদিকে একবার আয় দেখি। ”

মায়ের ডাক শুনে কুহু বিছানার দিকে এগিয়ে যায়।

” তোমার শরীর খারাপ লাগছে, মা? কোথায় খারাপ লাগছে, আমাকে বল। ” কুহু উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।

” আমি ভালো আছি। তোকে এত অস্থির হতে হবেনা। তোদের দুই ভাইবোনকে কয়েকটা কথা বলব। ”

কুহু কোন কথা না বলে মা’য়ের দিকে প্রশ্নবোধক চোখে চেয়ে থাকে।

” কুহু মা , আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। জীবন এখন আমাদের সাথে কঠিন খেলা খেলছে। কতদিন এভাবে আমাদের চলতে হবে তার কোনও ঠিক নেই। তবে পরিস্থিতি যা-ই হোকনা কেন তুই কখনো ভেঙে পড়বিনা। ছোট ভাইকে লেখাপড়া শেখাস। সব সময়ই ভাইয়ের পাশে ছায়া হয়ে থাকিস। ওকে আগলে রাখিস। মনে রাখবি তোর ভালো তোকেই বুঝতে হবে। এই কঠিন বিপদে যখন তোদের পাশে কেউই ছিলনা, হয়তো ভবিষ্যতেও কেউ থাকবেনা। তাই বলে ভেঙে পরবিনা, নিরাশ হবিনা। ধৈর্য্য ধরবি। মনে রাখবি সকল প্রাপ্তির মূলেই রয়েছে ধৈর্য্য। মানুষকে শ্রদ্ধা করবি। হোকনা সে অচেনা কিংবা শত্রু। যদি কখনো কোন বিপদ আসে চাচাদের সাথে যোগাযোগ করবি। মনে কোন হিংসা না রেখে তাদেরকে সব খুলে বলবি। আর যাই হয়ে যাকনা কেন, তারা তোদের ফেলে দেবেনা। কখনো অহংকার করবিনা। সবচেয়ে বড় শত্রুকেও ক্ষমা করে দিবি। মানুষকে ভালোবাসবি। দেখবি অন্যরাও তোকে ভালোবাসা দেবে। ”

মায়ের এমন এলোমেলো কথা শুনে কুহুর বুক ধক করে উঠল। মা হঠাৎই এসব কথা বলছে কেন, তা কুহু ভেবে পাচ্ছেনা।

” মা, তুমি এসব কি বলছ! কেনইবা বলছ? তুমি চুপচাপ শুয়ে পর, আর কথা বলোনা। ”

” আমাকে কথা বলতে দে, মা। সৃজন বাপ, তুমি তোমার আপুর কথা মেনে চলবে। তুমি এখন ছোট আছ, তাই নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা তোমার হয়নি। তাই সব সময় আপুর পাশেই থাকবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। তোমার দুই চাচার থেকেও বড় চাকরি করবে। মানুষের মত মানুষ হয়ে সমাজকে দেখিয়ে দেবে। চাচা, ফুপুদের কখনোই অসম্মান করবেনা। জীবনে অনেক বড় হতে হবে। কিন্তু তাই বলে তোমরা কেউই অসৎ উপায় অবলম্বন করবেনা। বুঝতে পেরেছ, বাপ? ”

ছোট্ট সৃজন মায়ের কথার মর্মার্থ না বুঝেই মাথা নাড়ায়। আইরিন পারভিন ছেলেকে বুকে জরিয়ে নিয়ে চুমু দেয় ওর কপালে, চোখে, নাকে।

কুহু মা’য়ের দিকে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছে। আজকে মা’য়ের আচরণ ওর কাছে অসংলগ্ন লাগছে। মা’য়ের চোখমুখও কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কুহু মা’য়ের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে তার মুখে হাত রাখল। ছুঁয়ে দিল মায়ের সমস্ত মুখ। তিনটা বছর থেকে ওর মা’য়ের দিন-রাত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছে। বাবার চিকিৎসা করাতে করাতে নিঃশেষ হয়ে গেল। তবুও হাল ছাড়েনি কিংবা ধৈর্য্যহারা হয়নি। মায়ের চোখের নিচে কালি জমেছে। ফর্সা শরীরে যেন কেউ আঁধার লেপে দিয়েছে। আজ হঠাৎই কুহু আবিষ্কার করল, ওর মা যেন অনেক দূরের কেউ। মা’য়ের চোখেমুখে শুধুই উৎকন্ঠা ভেসে বেড়াচ্ছে।

” মা, তুমি এভাবে বলোনা। আমি পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি করব। তখন আমরা অনেক ভালো থাকব, তুমি দেখে নিও। আর সৃজনকে তো আমি দেশের বাহিরে থেকে পড়াশোনা করাবো। বাবার স্বপ্ন ছিল, সৃজনকে অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজে পড়াবে। আমি বাবার স্বপ্ন যেকোন উপায়ে পূরণ করব, তুমি দেখে নিও। আজকে যেমন আমরা অভাবের সাথে যুদ্ধ করছি, একদিন দেশের অন্য অভাবীদের আমরা সাহায্য করব। ”

আইরিন পারভিন মেয়েকেও জড়িয়ে নিলেন বুকের ভেতর।

” শোন মা, ব্যাংকে আমার এ্যাকাউন্টে বোধহয় পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। প্রয়োজন পরলে ছোট চাচাকে বলে টাকাগুলো তুলে নিস। কালকে একবার তোর মামাদের কাছে ফোন দেব। আব্বার সম্পত্তির ভাগ আমিও পাই। এতদিন আমার সেগুলোর প্রয়োজন ছিলনা। কিন্তু এখন প্রয়োজন। আমার ভাগ আমি তাদের থেকে বুঝে নিব। এতে আমাদের অনেক উপকার হবে। ”

” মামারা বাবা মা রা যাওয়ার পর থেকে আমাদের কোন খোঁজ নেয়নি, মা। তাদের কাছ থেকে সম্পত্তির ভাগ চাওয়া কি ঠিক হবে? ”

” ঐ সম্পত্তিতে আমারও হক আছে। জমিজমা অল্প কিছু হলে আমি ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আমি প্রায় বিশ বিঘার মত জমি পাব। এতগুলো জমির ভাগ ছেড়ে দেব, তুই বল? জমি বিক্রি করে টাকা পেলে তোদের পড়াশোনা ঠিকমত করাতে পারতাম। আর অভাবও থাকতোনা। কাল সকালে উঠেই তোর বড় মামার সাথে কথা বলব। এরপর আর দুইজনের সাথেও কথা বলব। ”

” তুমি যেটা ভালো মনে কর সেটাই করো, মা। ”

” আমার কাছে একটু শুবি, মা? তোরা দুই ভাইবোন আমার দুই পাশে শুয়ে থাক। আমি তোদের প্রানভরে দেখি। আজ রাতের পড়া কাল সকালে পড়িস। ”

কুহু মা’য়ের কথা রাখতে মা’য়ের পাশে শুয়ে পরল। ছেলেমেয়েকে দুইপাশে নিয়ে শুয়ে রইলেন আইরিন পারভিন। তিনি সৃজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এক সময় সৃজন ঘুমিয়ে পরল। কুহু তখনও জেগে আছে। ও এক দৃষ্টিতে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে আছে। থেকে থেকেই ওর বুকের ভেতর আনচান করে উঠছে। কেন এমনটা হচ্ছে ও বুঝতে পারছেনা।

” কুহু, তোর জীবনে যতই ঝড় আসুকনা কেন পড়াশোনা ছাড়বিনা, মা। সৃজনকেও পড়াবি। মনে রাখিস, অভাব-অনটন ঘুচাতে , সামাজিক মর্যাদা পেতে, মানুষের কাছে সম্মান পেতে হলে পড়াশোনার বিকল্প নেই। তোর বাবার স্বপ্ন পূরণ করিস। নামাজ ছাড়বিনা কখনো। বাবার জন্য দোয়া করবি। ”

কুহু মাথা নেড়ে মা’য়ের কথায় সায় দেয়। এরপর তারাও ঘুমিয়ে পরে।

ফজরের আযান কানে আসতেই কুহুর ঘুম ভেঙে যায়। ও আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। পাশে তাকালেই আপনাআপনিই কপাল কুঁচকে আসে। ওর মা এখনো ঘুমাচ্ছে। অথচ কুহু গত তিন বছরে ওর মা’কে এই সময় ঘুমাতে দেখেনি। তাহাজ্জুদ নামাজের পর থেকেই সে জায়নামাজে বসে থেকেছে। কখনো দোয়া-দরুদ পাঠ করেছে, আবার কখনোবা কুরআন তিলাওয়াত করেছে। আজকের বিষয়টা কুহুর কাছে আশ্চর্যজনক মনে হয়। ও মৃদু গলায় মা’কে কয়েকবার ডাকল। কিন্তু আইরিন পারভিন কোন সাড়া দেয়না। বাধ্য হয়ে কুহু মা’য়ের শরীরে হাত দিয়ে পুনরায় ডাকতে থাকে। কিন্তু এবারও কোন সাড়া পায়না। কুহু এবার লক্ষ্য করল ওর মা’য়ের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে, আর সেই সাথে শক্তও হয়ে গেছে। কুহু ভয় পেয়ে যায়। সাথে সাথে মনে হয় বাবার কথা। বাবার মৃ’ত্যু’র পরও তো তার শরীর এমন ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে গিয়েছিল! কুহু আর কিছুই ভাবতে পারছেনা। হাঁচড়েপাঁচড়ে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে দরজার কাছে আসে। দরজা খুলেই চিৎকার করে ফুপুকে ডাকতে থাকে।

কুহুর চিৎকার শুনে সৃজনের ঘুম ভেঙে গেছে। ও মা’কে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিল। কুহুর চিৎকার শুনে ও মা’য়ের শরীর থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে বসল।

শাকিলা সুলতানা কুহুর চিৎকার শুনে প্রায় দৌড়েই এদিকে আসলেন। তিনি দেখতে পেলেন কুহু ওর মা’কে জোড়ে জোড়ে ঝাঁকিয়ে ডাকছে। কিন্তু কুহুর সকল আকুতি উপেক্ষা করে নিশ্চুপ থাকলেন আইরিন পারভিন।

শাকিলা সুলতানা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। তিনি ভাবতেই পারছেননা, তার ভাবি আর দুনিয়ায় নেই। তার চোখের তারায় বারেবার ভেসে উঠছে ভাবির হাস্যজ্জ্বল মুখ। কুহু মা’য়ের বুকের ওপর কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেছে। সৃজনও মা’কে জড়িয়ে কাঁদছে।

শাকিলা সুলতানার মেয়ে আতিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় সাইদ আহমেদের বাড়িতে।

সাইদ আহমেদ আতিয়ার মুখে আইরিন পারভিনের মৃ’ত্যু’র খবর শুনে ছুটে আসে সেখানে। সে-ও শাকিলা সুলতানার ন্যায় হতভম্ব হয়ে গেছে। এক সময় এই কষ্ট সইতে না পেরে মাথা ঘুরে পরে যায়।

শিরিন আক্তারও সবার মতই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে-ও মানতে পারছেনা তার বড় জায়ের এমন অপ্রত্যাশিত মৃ’ত্যু।

আতিয়া ওর মেজো মামার কাছে ফোন দিয়ে সবটা জানালে, রায়হান আহমেদও ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। এরপর হঠাৎই আর্তনাদ করে কাঁদতে থাকে।

রায়হান আহমেদের কান্নার শব্দ শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল নায়লা আঞ্জুম।
সে তার এত বছরের বিবাহিত জীবনে তার স্বামীকে কাঁদতে দেখেনি।
রায়হান আহমেদের কান্নার শব্দ শুনে বাসার সব মেইড এসে দাঁড়িয়েছে তাদের দরজার সামনে।

শনিবার হওয়ায় সেদিন তাহমিদ রাজশাহীতেই ছিল। সে সচরাচর ফজরের নামাজ আদায় করে আবার ঘুমায়। গতরাতে ঘুমাতে দেরি হওয়ায় ভোরে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙ্গলে সোজা ওয়াশরুমে যায়। অজু করে বেরিয়ে আসতেই নিচ থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ পায়। এই ভোরে কার কি হয়েছে, সেটা দেখতেই পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়।

রায়হানকে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় তাহমিদ। নায়লা আঞ্জুম কিছুতেই তার স্বামীকে শান্ত করতে পারছেনা। রায়হান আহমেদের ছেলেমেয়েও বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে অসহায় চোখে বাবার কান্না দেখছে।

তাহমিদ রুমের ভেতর গিয়ে রায়হান আহমেদের পাশে বসে। হাত রাখে তার কাঁধে। তাহমিদকে দেখেই ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে রায়হান আহমেদ।

রাজশাহী থেকে গ্রামে আসতে দেড় ঘন্টা সময় লাগল রায়হান আহমেদের। সে পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। পুরো রাস্তাই তাহমিদ তাকে ধরে রেখেছে।

নায়লা আঞ্জুমও বিরক্তি নিয়ে তার স্বামীর কান্না দেখছে। সে ভেবে পাচ্ছেনা রায়হান ভাবির জন্য কেন এত কাঁদছে!

কায়সার ইনামের বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালে, তাহমিদ রায়হান আহমেদকে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল।

চলবে….