প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৮

0
307

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৮
জাওয়াদ জামী জামী

পেরিয়ে গেছে দশদিন। কুহুর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ওর প্রথম পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। শাকিলা সুলতানা সেই যে এসেছেন, আর বাড়িতে যাননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যতদিন কুহুরা রাজশাহী না যায়, ততদিন তিনি এখানেই থাকবেন। তিনিই কুহু আর সৃজনের দেখাশোনা করছেন। বারেবারে সাহস জোগাচ্ছেন তার ভাতিজা-ভাতিজীকে। তাদের মনোবল বাড়াচ্ছেন।

কুহুও নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে, নিজের সব দুঃখ একপাশে রেখে সৃজনকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাইছে।

রায়হান আহমেদ এবং সাইদ আহমেদ দুইজনই কুহুদের খোঁজ-খবর রাখছেন। সাইদ আহমেদ স্ত্রী’র কথা অমান্য করেই কুহুদের বাজার করে দিয়েছেন। রায়হান আহমেদও কুহুকে কিছু টাকা দিয়ে গেছেন। তাই এই কয়দিন শাকিলা সুলতানার খাবার নিয়ে কোন চিন্তা করতে হয়নি।

আইরিনের মৃ’ত্যু’র পরদিন নায়লা আঞ্জুম সেই যে গেছে, আর একটিবারও কুহুদের কোন খোঁজ নেয়নি। বিষয়টা নিয়ে শাকিলা সুলতানা একটু চিন্তা করছেন। কয়দিন পর ছেলেমেয়েদুটো রাজশাহী যাবে, সেখানে গিয়ে যদি আবারও কষ্ট পায়, তবে তিনি কেমন করে সইবেন। নায়লা আঞ্জুম যে ওদের ভালোভাবে গ্রহন করবেনা, তা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। তিনিও যে নিরুপায়। তার যদি একটুও সামর্থ থাকত, তবে তিনি ছেলেমেয়েদুটোকে অন্য কোথাও পাঠাতেননা। নিজের কাছেই রেখে দিতেন। নিজের অপারগতার কথা ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে শাকিলা সুলতানার। নিজেকে বারংবার ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি।

শাকিলা সুলতানার কান্নার শব্দ শুনে ঘর থেকে দৌড়ে উঠানে আসল তার মেয়ে আতিয়া। সে চুপটি করে মা’য়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে, মা’কে জড়িয়ে ধরল। ও ভালোভাবেই জানে, ওর মা কেন কাঁদছে। মা’কে শান্তনা দেয়ার কোন ভাষাই ওর জানা নেই। নিজের ভবিষ্যতের চিন্তায় সে নিজেও উদগ্রীব। এরপর কি হতে চলেছে? এই চিন্তা মাথায় আসলেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। কবে যে ওর বড় ভাই পড়াশোনা শেষ করবে, আর কবে একটা চাকরি করবে। তার নিজেরও পড়াশোনা আছে। কিভাবে চলবে সবকিছু!

আতিয়া অনেক কষ্টে ওর মা’কে শান্ত করে। ভাগ্যিস কুহু পরীক্ষা দিতে গেছে। নইলে মেয়েটা বাড়িতে থাকলে আরেক দফা কান্নার রোল পরে যেত।

তাহমিদ ভার্সিটির পরীক্ষার কারনে বেশ কিছুদিন রাজশাহী যেতে পারেনি। এবং আগামী পনেরদিনও সেখানে যেতে পারবেনা। তবে ও নিয়মিত ওর নানিমার খোঁজ রাখে। সেই সাথে রায়হান আহমেদের কাছেও ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হতে গেলেই ড্রয়িংরুমে ওর বাবার সামনাসামনি হয়। ভদ্রলোক তার বড় ছেলের জন্যই অপেক্ষা করছেন।

” এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছ? তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। এস একসাথে খাব। ” রাশেদ কুরাইশি তাহমিদকে দেখেই বললেন।

তাহমিদ বাবার কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায়। কেউ যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করে, তবে সে ঠিকই ওর ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখতে পাবে।

” মিছেমিছিই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। নিজের শরীরে কষ্ট দিয়ে, একটা অযোগ্য ছেলের না খেয়ে বসে থাকা কি ঠিক হয়েছে? আপনার স্ত্রী এতে অসন্তুষ্ট হবেনা! ”

” হোয়াট ননসেন্স! রাশেদ, কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, সেকথা কি তোমার ছেলে ভুলে গেছে? সে নাহয় আমাকে সম্মান দেয়না, কিন্তু তাই বলে কি তোমাকেও অসম্মান করবে! তোমার ছেলে বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে কিন্তু মানুষের মত মানুষ হতে পারেনি। আর তুমি কিনা এই ছেলের জন্য তুমি অপেক্ষা করছ! একসাথে খেতে চাচ্ছ! তোমার উচিত একে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া। এই বাড়িতে বাস করার মত যোগ্যতা ওর এখনও হয়নি। এরা শুধু মানুষের সম্মান নিয়ে খেলতে পারে। মানুষকে সম্মান দিতে এরা জানেনা। ” ডেইজি কুরাইশি স্বামীকে উস্কে দিতে ভুলন করলনা।

” জ্বি, আমি মানুষ হতে পারিনি। আমি বেয়াদব, অসভ্য, বর্বর। ছোটবেলা থেকেই এসব শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই এসব এখন আমার ওপর কোন প্রভাব ফেলেনা। পারলে নতুন কিছু বলুন। ”

তাহমিদের ত্যাড়া কথা শুনে রেগে যান রাশেদ কুরাইশি।

” তাহমিদ, তুমি থামবে? তুমি যে এতটা বেয়াদব হয়েছ সেটা আমি কল্পনাই করতে পারিনি। একটা সামান্য কথাকে তুমি কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ! তুমি বেড়ে উঠেছ ঠিকই কিন্তু মানুষ হতে পারোনি। অবশ্য তোমার কাছ থেকে ভালো কিছু আশাও করা যায়না। দিনশেষে নিজের জাত ঠিকই চিনিয়ে দাও। নিজের কার্যকলাপ দিয়ে বারবার বুঝিয়ে দাও, তুমি দূষিত গর্ভে জন্মেছ। এক নোংরা মানুষের নাড়ি বন্ধনে আবদ্ধ ছিলে তুমি। আমার সকল প্রপার্টি থেকে তোমার নাম আমি পার্মানেন্টলি ছেটে দেব। ”

রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে তাহমিদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। রা’গে হাতের মুঠো পাকিয়েছে।
সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। রা’গ তরতর করে বেড়ে যেতেই ও কাছে থাকা টি টেবিলে লা’থি হাঁকায়। হাতের কাছে থাকা কাঁচের ফুলদানি আছাড় মা’র’ল। রা’গে’র চোটে জোরে শ্বাস ছাড়ছে।

” শুধু দূষিত গর্ভের দোষ দিচ্ছেন কেন? আপনারও তো দোষ কম ছিলনা। সাধু পুরুষ ছিলেননা আপনি। এখন আমি মুখ খুললে বাসার মেইডদের চোখেও নিচে নেমে যাবেন। মুখ দেখাতে পারবেননা কাউকে। তাই ভালো হয় আপনি এবং আপনার স্ত্রী দুজনেই মুখ বন্ধ রাখুন। আর কে চায় আপনার প্রপার্টি? আমি ঘৃণা করি আপনাকে। আমার জীবনটা আপনারা নষ্ট করে দিয়েছেন। আমার থেকে শৈশব, কৈশোর আপনারা কেড়ে নিয়েছেন। নিজেরা ভালো থাকতে গিয়ে আমাকে নরকে নিক্ষেপ করেছেন। নয় বছর বয়স থেকে আমি নিজের সাথে, সমাজের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। কখনো সেই খোঁজ রেখেছেন? জানতে চেয়েছেন আমি ভালো আছি কি না? এখন যখন আপনার পাশে আপনার স্ত্রী-সন্তান আছে, তবে আমাকে কেন ঘাঁটান? থাকতে দিননা আমাকে আমার মত। ” আর সেখানে দাঁড়ায়না তাহমিদ। গটগটিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

” দেখেছ কত বড় বেয়াদব! কিভাবে ভাঙ্গচুর করল! আবার তোমাকেও কথা শুনিয়ে গেল! এগুলো কি ওর নিজের টাকায় কেনা? আমার সাধের ফুলদানিটা ভেঙে ফেলল! কয়দিন পর দেখা যাবে আমাদের গায়েও হাত তুলেছে। আমি বলি কি ওকে বাসা থেকে বের করে দাও। ও এই বাসায় থাকলে আমরা কেউ ভালো থাকবনা। আমার ছেলেমেয়েদেরও ও ভালো থাকতে দেবেনা। রোজ রোজ এই অশান্তি ভালো লাগেনা। ” ডেইজি কুরাইশি চেষ্টা করছে তার স্বামীকে নিজের দিকে টানতে। সে চায় তাহমিদকে রাশেদ কুরাইশি বাড়ি থেকে বের করে দিক।

” প্লিজ, একটু থামবে? নাকি আমিও বাসা থেকে বেরিয়ে যাব? তুমি তো দেখছি আ’গু’নে ঘি ঢালায় পারদর্শী! ” রাশেদ কুরাইশি এবার স্ত্রী’র ওপর রে’গে উঠলেন।

” মুখ সামলে কথা বল। আমাকে অবলা নারী ভাবলে তুমি ভুল করবে। বি’ষ’দাঁ’ত কি করে ভাঙতে হয় তা আমার জানা আছে। হোকনা সে তুমি কিংবা তোমার ছেলে। ডিজগাস্টিং। ” ডেইজি কুরাইশি সরাসরি রাশেদ কুরাইশিকে থ্রেড দিয়ে রুমের দিকে চলে যায়।

ভার্সিটি শেষে তাহমিদ কোচিংয়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে সোজা যায় টিএসসিতে। সন্ধ্যার পর নিয়মিতভাবে ওরা কয়েকজন বন্ধু মিলে টিএসসিতে আড্ডা দেয়। রাত এগারোটা পর্যন্ত চলে ওদের আড্ডা। এরপর যে যার বাসায় যায়।

কিন্তু তাহমিদ এখনই বাসায় যাবেনা। ওর ইচ্ছেও করেনা ঐ বাসার চৌকাঠ মাড়াতে। কিন্তু ও একজনের কাছে ওয়াদাবদ্ধ। তাই এতকিছুর পরও ওকে বাসায় যেতে হয়। ওর বন্ধুরা সবাই চলে গেলে, ও কিছুক্ষণ বসে থাকে সেখানে। সারাদিনের পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাই ও ঘাসের ওপর সটান হয়ে শুয়ে পরল। আশেপাশে এখনও মানুষজন আছে। কয়েকজনকে দেখা গেল সিগারেট ধরাতে। বাতাসে ভেসে আসা গন্ধে ও বুঝতে পারল, তারা নেশা করছে। ওদের দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পরে রইল। ওকে এখানকার সবাই চেনে। তাই দূর্ঘটনা ঘটার কোনও ভয় নেই।

রাত বারোটা দশ বাজতেই তাহমিদ উঠে বসল। প্রচন্ড পিপাসা পেয়েছে। ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে থাকা দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকে।

রাত দেড়টা। আজও ওর অপেক্ষায় কেউ জেগে নেই। আজ আর কলিংবেল বাজালোনা। সোজা হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় কাঁঠালচাঁপা গাছের নিচে।

কুহু একমনে পড়ছে। পিপাসা পেতেই টেবিলে ঢেকে রাখা গ্লাসের পানি পান করে ঘড়ির দিকে তাকায়। দেড়টা বেজে গেছে! হঠাৎ করেই ঘুম যেন চোখের পাতায় হানা দেয়। বই বন্ধ করে চেয়ার ছাড়ল। এরপর গিয়ে শুয়ে পরল সৃজনের পাশে।

রায়হান আহমেদ গ্রামে এসেছেন। তিনি বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন। শাকিলা সুলতানা ভাইকে দেখে ভিষণ খুশি হলেন। রায়হান আহমেদ সৃজনকে কাছে ডেকে নিয়ে বড় বোনের সাথে কথা বলছেন। কুহু তাদের দু’জনের কথা চুপচাপ শুনছে। গল্পের এক পর্যায়ে রায়হান আহমেদ কুহুকে জানান, ওর পরীক্ষার পরদিনই তিনি ওদের নিয়ে রাজশাহী যাবেন। এ্যাডমিশন এর জন্য কুহুকে কোচিং-এ ভর্তি করিয়ে দেবেন। এবং তিনি কোচিং-এ কথা বলে রেখেছেন। চাচা৷ কথা শুনে কুহুর ভিষণই ভয় হতে থাকে। ও রাজশাহীতে গেলে না জানি চাচি কিভাবে রিয়্যাক্ট করে! কিন্তু ওর মনের ভয় মনেই থেকে যায়। প্রকাশ করা আর হয়ে উঠেনা।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে