প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৯

0
298

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৯
জাওয়াদ জামী জামী

” রিশা, নিশো, তোমরা কাল আমার সাথে গ্রামে যাবে? ” রায়হান আহমেদ ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন।

” তুমি আবার গ্রামে যাবে কেন? সাতদিন আগেই তো সেখান থেকে আসলে? তাছাড়া কালকে তোমার অফিস আছে। অফিস রেখে গ্রামে যেতে হবে? ” নায়লা আঞ্জুম স্বামীর কথা শুনে তেতে উঠে।

” অফিস আছে জন্যই কি গ্রামে যেতে পারবনা! আমি আমার গ্রামে, আমার বাড়িতে কবে যাব, কখন যাব সেটা কি তোমার কাছ থেকে শুনে তবে যাব? ”

” কেন শুনবেনা? তোমাকে অবশ্যই শুনতে হবে। তুমি শুনতে বাধ্য। আমি তোমার স্ত্রী। তোমার যেকোনো বিষয়ে আমি কথা বলতেই পারি। এবং জানার অধিকারও রাখি। ”

” তাহলে জেনে রাখ, কুহুর পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুইদিন আগেই। তাই কাল গ্রামে গিয়ে ওদেরকে নিয়ে আসব। এখন থেকে ওরা দুই ভাইবোন আমার সাথেই থাকবে। সৃজনকে রাজশাহীতে ভর্তি করিয়ে দেব। কুহুকেও এ্যাডমিশন কোচিং-এ ভর্তি করাব। ”

রায়হান আহমেদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম চমকে উঠে। তার রা’গ তরতর করে বেড়ে যায়। স্বামীর এমন বেপরোয়া আচরণ সে কিছুতেই মানতে পারছেনা। যে মানুষটা কিছুদিন আগ পর্যন্তও তার কথার বাহিরে যেতোনা, কিন্তু এখন সে যেন অন্য গ্রহের কোন মানুষে পরিনত হয়েছে! এখন সবকিছুতেই স্ত্রী’র বিরোধিতা করাই যেন তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে রা’গে’র সাথে কথা বলল।

” কিহ্! তুমি ওদের এখানে নিয়ে আসবে? ওদের কি বাড়িঘর নেই, যে আমার বাবার বাড়িতে এসে ভিখারির মত থাকতে হবে? ওদের বাড়িতে ওরা থাকুকনা নিজেরদের ইচ্ছেমত। একটা কথা শুনে রাখ, এ বাড়িতে ওদের কোন ঠাঁই হবেনা। এটা আমার বাবার বাড়ি। তাই এখানে আমি যা বলব তা-ই হবে। ”

” ঠিক আছে। ওরা আসবেনা এখানে। আমি একটা ফ্ল্যাট দেখে রেখেছি। কাল থেকে আমরা সেখানেই থাকব। আমি কয়েকজন লোক ঠিক করব। তারা আমাদের সব ফার্নিচার সেখানে পৌঁছে দেবে। তার আগে আমি ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে কথা বলব। ” ঠান্ডা মেজাজে বললেন রায়হান আহমেদ।

স্বামীর এহেন কথা শুনে আরও বেশি রাগ হয় নায়লা আঞ্জুমের। সে কিছুতেই চায়না শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে কেউ এখানে আসুক।

” এসব তুমি কি বলছ? আমার মা অসুস্থ। সে দিনরাত বিছানায় শুয়ে থাকে। একা একা নড়াচড়া করতে পারেনা। এই অবস্থায় তাকে রেখে আমি কোথাও যাবনা। আর না এই বাসায় বাহিরের কেউ আসবে। আর কোন ভিখারিরতো অবশ্যই ঠাঁই নেই এখানে। আমার মতামত আমি জানিয়ে দিয়েছি। এবার তুমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। ”

” তোমার মা অসুস্থ, সে বিছানায় দিনরাত কাটিয়ে দেয়, এটা দেখার দ্বায়িত্ব আমার নয়। তার আরও ছেলেমেয়ে আছে। তাই তার চিন্তা আমার না করলেও চলবে। তবে তার প্রতি আমার সমবেদনা আছে। আর ভিখারি কাদের বলছ তুমি? মনে রেখ ওরা আমার বংশধর। ভবিষ্যতে ওদের নিয়ে একটা কটুকথাও আমার সামনে বললে, তোমার অসুবিধা আছে। আমার যা সিদ্ধান্ত নেয়ার আমি ভেবেচিন্তেই নিয়েছি। তাই আমার ব্যাপারে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। ”

এবার নায়লা আঞ্জুম চুড়ান্ত পর্যায়ের অবাক হয়ে যায়। রায়হান আহমেদের ওর মা’য়ের প্রতি এমন মনোভাব দেখে সে কেঁদে উঠল। ও মানতেই পারছেনা, রায়হান ওর মা’কে তুচ্ছ করছে।

” তুমি আমার মা’কে কি বললে? আমার মা’য়ের প্রতি তোমার কোন দ্বায়িত্বই নেই? সে তোমার জন্য কি করেনি? সেই তুমিই আজ তাকে বোঝা মনে করছ! ” নায়লা আঞ্জুম কান্নার দমকে কথা বলতে পারছেনা।

” নিজের মা’য়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে? আমারও খারাপ লেগেছিল। গত তিনটা বছর আমি ছটফট করেছি, হাহাকার করেছি। সেগুলো তোমার চোখে কি কখনো পরেছিল? তোমার মন একটুও গলেছিল? তুমি আমার সাথে যেটা করেছ, আমি শুধু সেগুলোই তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। মন দিয়ে শোন, তোমার মা আমার জন্য কিছুই করেনি। সে যা করেছে নিজের সুবিধার জন্য করেছে। আমার জন্য যা করবার করেছিল আমার বড় ভাই। আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, ছোট-বড় সব আবদার পূরণ করেছে। মোটকথা বাবা-মা’য়ের সকল দ্বায়িত্ব পালন করেছিল আমার ভাই-ভাবী। কিন্তু তুমি আমার সেই ভাই-ভাবীকে অনেকবার অপমান করেছ, তাদের বিপদে আমাকে তাদের পাশে দাঁড়াতে দাওনি। ভাইয়ের মৃ’ত্যু’র পর আমার ভাবী ছেলেমেয়েকে নিয়ে কতই না কষ্ট করেছে, তবুও তোমার মন গলেনি। তবে আজ কেন তুমি কাঁদছ? তুমি আমার আপনজনদের সাথে যা যা করেছ, আমি শুধু সেগুলোই ফিরিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। তুমি যেমন নিজের সুবিধার জন্য বাবার বাড়িতে পরে আছ, আমিও ঠিক তেমনি আমার ভাতিজা-ভাতিজী কে আমার কাছে রাখব তাদের সুবিধার জন্য। ”

নায়লা আঞ্জুম রা’গে, ক্ষোভে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে রায়হান আহমেদের কথার কি উত্তর দেবে তা ভেবে পাচ্ছেনা। তবুও সে মুখ খুলল। মিনমিনিয়ে বল উঠল,

” তোমার কি হয়েছে? তুমি আজকাল আমার সাথে এমন আচরণ করছ কেন? তুমি তো আগে এমন ছিলেনা! এত কঠোর কেন হলে? ”

” তুমি আমাকে বাধ্য করেছে এত কঠোর হতে। তুমি যদি একটু মানিয়ে নিতে পারতে, আমার আপনজনদের প্রতি সদয় হতে, তবে আজকেই এই পরিস্থিতি কখনোই সৃষ্টি হতোনা। শোন নায়লা, নারীরা কোমল হৃদয়েই সুন্দর। কঠোরতা তাদের মানায়না। তবে তাদের প্রতিবাদী হতে দোষের কিছু নেই। তাই বলে কঠোরতার আবরনে নিজেদের ঢেকে যদি বলে আমরা প্রতিবাদী, তবে সেটা হবে বড় ধরনের ভুল। তুমি প্রতিবাদী হও, আমি তোমার পাশে আজীবন থাকব। কিন্তু নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কঠোর হবে এটাকে আমি আর কোনদিন প্রশ্রয় দেবনা। তোমার দেখাদেখি আমি নিজেরটা বুঝতে শিখে গেছি। এবার বল তুমি কি নতুন ফ্ল্যাটে যাবে নাকি আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে একাই সেখানে উঠব? তুমি চাইলে এখানেই থাকবে। মাস শেষে আমি তোমার খরচ পাঠিয়ে দেব। ”

নায়লা আঞ্জুম বুঝতে পারছে তার এখন আর স্বামীর কথা না শুনে কোনও উপায় নেই। সে নিজের সামান্য একটা ভুলে সবকিছু হারাতে চায়না। তারপরও সে নিজের দম্ভ বজায় রেখে বলল,

” তুমি এখানে ওদের নিয়ে আসলে সোসাইটিতে কত কথা হবে বুঝতে পারছ? সবাই বলবে, তোমার ভাই মৃ’ত্যু’র সময় সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যায়নি, তারা গরীব আরও অনেক কিছু বলবে। সেসব শুনলে আমার তো লজ্জা লাগবে। ”

” হু কেয়ারস? আমার গরীব কি ধনী সেটা সোসাইটির মানুষদের কাছে ব্যাখ্যা করতে যাবোনা। আর গরীবরা কি মানুষ নয়? এসব আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ সেটা বল। আমার এত কথা শোনার সময় নেই। বসে বসে তোমার হাই সোসাইটির মানুষদের মত অন্য কারও পরিবার নিয়ে ভাবতে গেলে আমার সময়ের অপচয় হবে। সময়ের মূল্য আমার কাছে অনেক। ”

নায়লা আঞ্জুম বুঝল ওর সামনে আর কোনও পথই খোলা নেই। রায়হান ওকে সব দিক দিয়েই আটকে দিয়েছে। মনের মধ্যে রা’গ পুষে রেখে নিজেকে রাজি করায়।

” ঠিক আছে, ওরা এখানেই আসুক। থাকুক এই বাসায়। তবে ওদেরকে আমি যেই রুমে থাকতে দেব ওদেরকে সেখানেই থাকতে হবে। আমার ইচ্ছের বাহিরে কিছু করা যাবেনা। ”

” তোমার ইচ্ছের বাহিরে কিছুই ওরা করবেনা। ওদের বাবা-মা ওদেরকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়ে বড় করেছে। আর নিজের পছন্দমত রুমে ওদের থাকতে দেবে, তারমানে এই নয় যে ওরা মেইডের রুমে থাকবে। ওরা এই বাসায় আমার খরচে থাকবে। ওরা যেই রুমে থাকবে তার ভাড়া আমি তোমাকে দিয়ে দেব। আমি কিন্তু আমার ভাতিজা-ভাতিজীকে তোমার টাকায় কিংবা তোমার বাবার টাকায় খাওয়াবোনা। তাই ভুল করেও ওদের যে সে রুমে থাকার ব্যবস্থা করোনা। ”

” আমি ওদের ভালো রুমই দেব। আর রুমের জন্য তোমাকে ভাড়া দিতে হবেনা। ” মুখ কালো করে বলল নায়লা আঞ্জুম।

” যাতে ভবিষ্যতে তুমি ওদের খোঁ’টা দিতে পার? সে ভুল আমি করবনা। জীবনে অনেক ভুল করেছি। আর নয়। ”

এতক্ষণ রিশা আর নিশো বাবা-মা’র কথা শুনছিল। রায়হান আহমেদও ভুলে গিয়েছিলেন রুমে তার ছেলেমেয়েরাও আছে। রিশা বরাবরই ওর মায়ের ওপর বিরক্ত। ও বাবা ভক্ত মেয়ে। সেই সাথে ও দাদুর পরিবারের সবাইকে ভালোবাসে। তাই কুহুদের আসার কথা শুনে ভিষণই খুশি হয় মেয়েটা।
নিশো ও বোনের মতই বাবার আত্মীয় স্বজনদের ভালোবাসে। কিন্তু সব সময় মায়ের সাথে থেকে কিছুটা নাক উঁচু স্বভাবের হয়েছে ও। সবকিছুতেই খুঁত ধরার স্বভাব ও মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। কিন্তু আজকে বাবা-মা’র কথপোকথন শুনে ও বাবার পক্ষই নেয়।

” কুহু মা, সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়েছিস তো? এখন রাজশাহী গেলে হয়তো তিন-চার মাসের আগে গ্রামে আসতে পারবিনা। তাই প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে নে, মা। ” শাকিলা সুলতানা কুহুকে একটু পরপর মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

” ফুপু, আমি তোমাকে ছেড়ে সেখানে গিয়ে কেমন করে থাকব? এখানে থাকলে তোমাকে তবুও দেখতে পেতাম। কিন্তু রাজশাহীতে তো তুমি যাবেনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, ফুপু। ”

” পা’গ’লী মেয়ে, আমাকে দেখার আশা করতে গেলে তোদের পড়াশোনা ঠিকমত হবেনা। তাছাড়া আমি সব সময় তো এখানে থাকতে পারবনা। আমি নিজের বাড়িতে গেলে তোরা একা হয়ে যাবি। এটা আমার জন্য কতটা চিন্তার সেটা তুই জানিস? তোরা রাজশাহী গিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া কর, মানুষের মত মানুষ হ, বাবা-মা ‘ র স্বপ্ন পূরণ কর। মেজো চাচির সাথে ভালো ব্যবহার করবি কেমন? অভিযোগ করার কোন সুযোগ তাকে দিবিনা। গ্রামে আসার আগে আমাকে জানিয়ে দিস, আমি আসব। ” শাকিলা সুলতানা আর কিছু বলতে পারলেননা। তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসল। কুহুও ফুপুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।

তাহমিদ গত কিছুদিন যাবৎ ঠিকঠাক বাসায় আসতে পারছেনা। সেই সকাল আটটায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, বাসায় ফিরে রাত দেড়টা থেকে দুইটার দিকে। ওর জন্য কেউই অপেক্ষা করেনা। কেউ ওকে জিজ্ঞেস করেনা কেমন আছে। বেশিরভাগ সময় ও বাসায় খায়না। গত তিন বছর যাবৎ ও একবেলাও বাসায় খায়নি। অবশ্য এটা নিয়ে কারো তেমন একটা মাথাব্যথা দেখা যায়না। যেমনটা কেউ আজও দেখালনা। সকার আটটা বাজতেই ও নিচে আসল। ড্রয়িংরুমে ওর বাবা বসে ছিল। বাবার পাশে ওর ছোট বোন আরিশাও বসে আছে। তাহমিদ ওদেরকে দেখেও না দেখার ভান করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। রাশেদ কুরাইশি রা’গী চোখে ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে