প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১০

0
290

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১০
জাওয়াদ জামী জামী

কুহুরা রাজশাহীতে আসলে ওদের কেউ স্বাগত জানালনা কিংবা কেউ এগিয়ে এসে মাথায় সহানুভূতির হাত রাখলনা। একজন পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়া এসে ওদেরকে একটা রুমে নিয়ে গেল। কুহু তার সাথে কথা বলে জানতে পারল, বৃদ্ধার নাম রাজিয়া।

রায়হান আহমেদ বাসায় এসেই আবার কোথাও বেরিয়ে গেছেন। রিশা, নিশো দুজনেই নিজেদের রুমে চলে গেছে। ওরা গ্রামে গিয়ে সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করেছে, তাই বাসায় এসেই ওরা ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে।

কুহু আর সৃজন রুমে চুপচাপ বসে আছে। ওরা এই বাসায় এসেছে তিন ঘন্টা আগে। এতক্ষণ পর্যন্ত নায়লা আঞ্জুমের সাথে ওদের দেখা হয়নি। ওরা বাড়ি থেকে আসার সময় বাড়িতে পালিত হাঁস, মুরগী, বাড়ির সবজিসহ বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। সেসব কুহু রাজিয়া খালার কাছেই দিয়েই। রাজিয়া খালা এতসব কিছু দেখে ভিষণ খুশি হয়েছে। এভাবে কতক্ষণ রুমে বসে থাকা যায়! কুহু একটু উসখুস করতে লাগল। মেজো চাচির সাথে এখনও কথা হয়নি। অথচ তার সাথে কথা বলা দরকার। ওর ভাবনার মাঝেই রাজিয়া খালা রুমে আসল।

” মা গো, তোম্গোর কি খিদা লাগছে? খাওন দিমু? ”

” না খালা, এখন খাবোনা। আচ্ছা খালা, মেজো চাচি কোথায়? তাকে দেখছিনা যে? আর চাচা সে কোথায়? ”

” নায়লা আপায় নিজের ঘরেই আছে। আর তোমার চাচায় এখনো বাড়িতে আসেনাই। হেয় মনে হয় অফিসেই গেছে। হেয় এমনিতেই প্রতিদিন রাইত কইরাই বাসায় আসে। তার নাকি অফিসে মেলা কাম থাকে। আমি কইতাছি কি মা, তোমরা এহন খাইয়া নেও। কতক্ষণ ধইরা না খাইয়া থাকবা? তোমার চাচা আইতে রাইত এগারোটার বেশি বাজব। আর তোমার চাচির কথা বাদ দেও। হের মনে কখন কি কয়, হেয় নিজেই জানেনা। তোমাদের কখন, কি দরকার হয়, তা সব আমারেই কইবা। ”

রাজিয়া খালার স্নেহমাখা কথা শুনে কুহুর বেশ ভালো লাগল। এখানে এসে একজনকে অন্তত পেয়েছে যে ওদের ভালোর জন্য চিন্তা করছে। আল্লাহর প্রতি মনে মনে হাজরো শুকরিয়া আদায় করল মেয়েটা।

বিশ দিন পেরিয়ে গেছে কুহুরা রাজশাহী এসেছে। এ কয়দিনে নায়লা আঞ্জুম ওদের ধারেকাছেও ঘেঁষেনি। আর না ওদের সাথে যোগাযোগ বলেছে। তবে বিষয়টা এখনো রায়হান আহমেদের কানে যায়নি। রায়হান আহমেদ কুহু সৃজনের কাছ থেকে প্রতিদিনই জানতে চায় নায়লা আঞ্জুম ওদের সাথে কিরূপ আচরণ করে। কিন্তু কুহু তাকে কখনোই জানায়না ওর চাচির ওদের প্রতি অবহেলার কথা। ও চায়না ওদের জন্য ওর চাচা-চাচির সম্পর্ক নষ্ট হোক। ওর চাচার জন্যই আজ ও ভালো কোচিং-এ ভর্তি হতে পেরেছে, সৃজন ভালো স্কুলে পড়ছে।

রাত এগারোটা বিশ। কুহু ওর চাচার জন্য অপেক্ষা করছে। ও এই বাসায় আসার পর থেকেই স্বেচ্ছায় দ্বায়িত্বটা পালন করে আসছে। চাচার জন্য অপেক্ষা করতে ওর মন্দ লাগেনা।

কুহু ড্রয়িংরুমে বই হাতে নিয়ে বসে আছে। রাজিয়া খালাকে ও জোড় করে শুতে পাঠিয়েছে। যেটা এই বাসায় আসার পর থেকেই করে আসছে। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে কুহু দরজার দিকে এগিয়ে যায়। হাসিমুখে দরজা খুলে সামনে তাকাতেই ও চমকে যায়।

তাহমিদ এই অসময়ে কুহুকে এখানে আশা করেনি। ও জানত কুহু এই বাসায় আছে। কিন্তু ও দরজা খুলতে আসবে সেটা তাহমিদ ভাবতে পারেনি।

” কি অবস্থা খালামণির শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়ার? তার তো আবার চমকানোর ব্যামো আছে। আজও কি সে আমাকে দেখে চমকে গেছে? ব্যামোর ঔষধ লাগবে নাকি? আমি আবার এই বিষয়ে পারদর্শী। কয়েকরকম ব্যামোর ঔষধ আমার কাছে আছে। তুমি শুধু ইশারা দেবে। দেখবে এই বান্দা তোমার সেবায় হাজির হয়ে গেছে। ” তাহমিদ দরজার একপাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে । দু হাত আড়াআড়িভাবে বুকের সাথে বেঁধে রেখেছে। ওর ঠোঁটে খেলা করছে দুষ্টুমির হাসি। ওর সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে।

এদিকে কুহু তাহমিদকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছে। সেই সাথে আরও অবাক হয়েছে তাহমিদের এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে। সেই রাতে বাড়ির উঠানে ও প্রথম তাহমিদকে দেখেছিল। তখনও কুহু জানতোনা লোকটা কে। পরদিন ফুপুর কাছ থেকে শুনেছিল ইনি মেজো চাচির বোনের ছেলে। সেইদিনই সকালেই উনি গ্রাম থেকে চলে গেছিলেন। তারপর আর তার সাথে কুহুর দেখা হয়নি। এতদিনে কুহু এই লোকটার কথা ভুলে গিয়েছিল। ও চোরা চোখে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখল, আশেপাশে কেউ নেই। হঠাৎই দমকা হাওয়ার তোড়ে কুহু নড়ে উঠল। এলোমেলো হয়ে গেলো ওর বাঁধনহারা কেশরাশি।

তাহমিদ লক্ষ্য করল মেয়েটার কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো লুটোপুটি করছে ওর পেলব শরীরে। শ্যামলা চেহারার মেয়েটার চোখেমুখে এই মুহুর্তে খেলা করছে বিস্ময়। সেই সাথে উঁকি দিচ্ছে লজ্জা।

” রমনী, আমাকে কি বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে? নাকি আগেই ঔষধ চাই? তবে জেনে রাখ, আপাতত তুমি ঔষধ সেবনের পর্যায়ে যাওনি। তুমি বর্তমানে প্রথম ধাপে অবস্থান করছ। এই ঔষধ সেবনের পূর্বে কয়েকটা ধাপ অতিক্রম করতে হবে তোমাকে। ”

কুহু তাহমিদের এহেন কথা শুনে অতিদ্রুত দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।

তাহমিদ কুহুকে সরে দাঁড়াতে দেখে বাসায় প্রবেশ করল।

রায়হান আহমেদ বাসায় আসলে কুহু খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে রাখল।

রায়হান আহমেদ খেতে আসলেন। একটু পর সেখানে আসল তাহমিদ। তাহমিদকে দেখে কুহু অস্বস্তিতে পরে যায়। কিন্তু তাহমিদের কোন হেলদোল নেই।

” আরে তাহমিদ যে , কেমন আছো? কখন এসেছ? ” রায়হান আহমেদ সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন।

” আমি খুব ভালো আছি, তালুকদার সাহেব। আপনার অবস্থা কি বলুন? কেমন যাচ্ছে দিনকাল? আপনার যমকে দেখছিনা যে? আর রাজিয়া খালাকেও তো দেখছিনা। আমার কি আজ খাওয়া হবেনা? ” তাহমিদের কথা শুনে বিষম খেলেন রায়হান আহমেদ। ভাতিজীর সামনে তাহমিদ তাকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।

” আমিও ভালো আছি। তোমার খালামণি ঘুমাচ্ছে। এসব কথা বাদ দাও। এসো একসাথে খেয়ে নিই। কুহু এখানে আসার পর থেকে রাতে সে-ই আমাকে খেতে দেয়। কুহু মা, এ হচ্ছে তাহমিদ। তোর চাচির বোনের ছেলে। আমাদের খেতে দে, মা। ”

কুহু নীরবে ওদেরকে খেতে দেয়। রায়হান আহমেদ ওকে অনেকবার খেতে বললেও ও খায়না। তারা খাওয়া শেষ করে নিজেদের রুমে গেলেই তবে কুহু খেয়ে নেয়।

ফজরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ বই নিয়ে বসে কুহু। একঘন্টা পড়ার পর চলে যায় রান্নাঘরে। ও এই বাসায় আসার পর থেকেই রাজিয়া খালাকে টুকটাক কাজে সাহায্য করে। যদিও এই বাসায় আরও তিনজন মেইড আছে, তবুও কুহু রাজিয়া খালাকে নিজ থেকেই কাজে সাহায্য করে।

কুহু কাজ সেড়ে খাবার নিয়ে যায় নায়লা আঞ্জুমের মায়ের রুমে। চিকেন স্যুপ, আর কিছু ফল তার সকালের নাস্তা।

” নানিমা, আপনার খাবার এসে গেছে। এবার ঝটপট খেয়ে নিন দেখি। ” কুহু টি টেবিলে খাবারের ট্রে রেখে, সিস্টারকে সাহায্য করে নানিমাকে তুলে বসাতে। তার সার্বক্ষনিক দেখাশোনার জন্য জন্য একটা নার্স রাখা হয়েছে।

নায়লা আঞ্জুমের মা ফাতিমা খানম কুহুকে দেখে হেসে উঠলেন। তিনি ডান হাত বাড়িয়ে কুহুকে নিজের কাছে ডাকলেন। কুহুও হাসিমুখে সেদিকে এগিয়ে যায়। এই কয়েকদিনে তার সাথে কুহুর বেশ শখ্যতা গড়ে উঠেছে। বৃদ্ধা জড়বস্তুর ন্যায় দিনরাত বিছানায় শুয়ে থাকেন। গত পাঁচ বছর আগে তার পুরো শরীর প্যারালাইসড হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে হারিয়েছেন বাকশক্তি। অনেক চিকিৎসার পর ছয়মাস আগে থেকে তিনি ডান হাত নাড়াতে পারছেন। কুহু এখানে আসার পরদিনই রাজিয়া খালার সাথে এই রুমে এসেছিল। তখন বিছানায় শোয়া বৃদ্ধাকে দেখে ওর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। এরপর থেকে ও নিয়মিত এই রুমে আসে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বৃদ্ধার সেবা করে। একা একা এটাসেটা গল্প করে বৃদ্ধার সাথে। এতে বৃদ্ধাও ভিষণ খুশি হয়েছেন। এতদিনে তিনি একজন সাথী পেয়েছেন।

” তাহমিদ বাবা, ও তাহমিদ বাবা? আর কত ঘুমাইবা? উইঠা পর। টেবিলে খাওন দিছি। ”

রাজিয়া খালার ডাকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল তাহমিদ।

” রাতে তোমাকে না দেখে আমার কত খারাপ লেগেছিল, সেটা কি তুমি জানো খালা? ” কোন সম্ভাষণ ছাড়াই জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” আমি কি জানি কাল তুমি আইবা? আমারে যদি আগে কইতে তবে আমি কি ঘুমাইতাম নাকি? কুহু আসনের পর থাইকা আমি দশটার মধ্যেই শুই। মাইয়াডা আমারে জাগবার দেয়না। এখন উঠ দেখি। আমি বিছানা গোছায় দিই। ”

তাহমিদ বিছানা থেকে নেমে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকল। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল রাজিয়া খালা চলে গেছে। রাতে আসার পর নানিমার সাথে দেখা করা হয়নি। তাই তাহমিদ প্রথমেই নানিমার কাছে যায়।

” নানিমা, আর একটু খেয়ে নিন। এতটুকু খেলে আপনার শরীর টিকবে? আপনাকে খুব তারাতারি সুস্থ হতে হবে। আপনি সুস্থ হলেই, আপনাকে নিয়ে আমি টি বাঁধে বেড়াতে যাব। এই শহরে আমি কার সাথে বেড়াতে যাব বলুন? আপনি ছাড়া আমার বেড়ানোর সাথী আর কে আছে? ”

তাহমিদ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় ভেতরের কেশবরণ কন্যার দিকে। এই সকালেও সে তার চুলগুলো খোলা রেখেছে। তার কোঁকড়া চুল যেন এঁকেবেঁকে নেমেছে নিচের দিকে। ফ্যানের বাতাসে ওরা এদিকসেদিক ছোটাছুটি করছে। মেয়েটার পড়নে হালকা কলাপাতা রংয়ের থ্রিপিস। নাকে জ্বলজ্বল করছে সাদা পাথরের ছোট্ট নাকফুল। কানের সাথে লেপ্টে আছে ছোট্ট একজোড়া দুল। হঠাৎই তাহমিদ অনুভব করল ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। পিপাসায় ওর বুক চৌচির হয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে আসছে ঠোঁটদ্বয়। জ্বিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল ও। অনেক চেষ্টা করছে রুমের ভেতর যাওয়ার। কিন্তু ওর পা জোড়া যেন মেঝের সাথে সেঁটে গেছে।

সিস্টার তাহমিদকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কথা বলে উঠল,

” স্যার, আপনি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন! ভেতরে আসুন। ”

সিস্টারের গলার আওয়াজে ঘোর কাটল তাহমিদের। ও মাথা চুলকে হেসে রুমে ঢুকল।

কুহু তাহমিদকে দেখে মাথা নিচু করে নানিমাকে খাইয়ে দিতে থাকল। তাহমিদ গিয়ে ওর নানিমার অপর পাশে বসে তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে