Friday, July 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 347



প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৩৯+৪০

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৯
জাওয়াদ জামী জামী

” এভাবে কি দেখছ! আমাকে কি আগে কখনো দেখনি? ” কহু তাহমিদের রুমে এসে আরেক দফা অবাক হয়ে তাহমিদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। কহুকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয় তাহমিদ।

” দেখছিনা, ভাবছি। ”

” কি ভাবছ! ”

” যে মানুষটা এত বড় বাড়ির ছেলে, রাজকীয় যার রুম, সে আমাদের গ্রামের বাড়ির এক সাদামাটা রুমে কিভাবে কাটিয়েছে! তার কি কোনও কষ্ট হয়নি! ”

” মেয়ে, তুমি কি তোমার মুখটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখবে? তোমাকে আগেই বলেছি, এটা আমার বাড়ি নয়। আর এই রুমের মালিকও আমি নই। তাই এসব আজেবাজে চিন্তা করে আয়ু কমানোর কোন মানেই হয়না। তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার অর্ডার দিয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেগুলো চলে আসবে। খেয়েদেয়ে জম্পেশ ঘুম দেবে। যাও ফ্রেশ হয়ে এস। ” তাহমিদ কুহুকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেয়।

কুহু ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখল তাহমিদ বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে। মনযোগ দিয়ে ফোন দেখছে। তাহমিদকে এই অবস্থায় দেখে ওকে বিরক্ত করার ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল কুহুর। এ ওয়াশরুমে গিয়ে দু হাতের আঁজলায় পানি নিয়ে এসে তাহমিদের শরীরে ছিটিয়ে দিল।

হঠাৎই শরীরে পানি পরতেই কুহু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। কুহুর দিকে তাকাতেই দেখল, মেয়েটার ঠোঁটের কোনে দুষ্টুমির হাসি।

” বউ দেখছি আমার সাথে দুষ্টুমি করতেও শিখে গেছে! অথচ আমি আমার বউটাকে নাদান বালিকা ভেবে, পারলে সারাদিন-রাত কোলে নিয়ে বসে থাকার চিন্তায় বিভোর থাকি! আর এই মেয়ে কিনা আমাকেই ঘোল খাওয়ানোতে পটু। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু খিলখিল করে হাসতে থাকে। ও তাহমিদের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারা দেখে মজা পাচ্ছে।

” তবে রে মেয়ে, আমাকে বিপর্যস্থ হতে দেখে মজা নিচ্ছ! ওয়েট, আমিও এখন মজা নিব। তার আগে তোমাকে বাথটাবে কিছুক্ষণ চুবিয়ে রাখব। ” তাহমিদ বিছানা থেকে নেমে কুহুকে ধরতে গেলেই মেয়েটা দৌড়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।

” আপনি আর এক ধাপ সামনে এগোলে আমি দরজা খুলে বাহিরে চলে যাব। সোজা আমার শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে গল্প করতে বসে যাব। গল্প করতে করতে সারারাত কাটিয়ে দেব। বিষয়টা খুব একটা খারাপ হবেনা তাইনা? ”

কুহুর হুমকিতে তাহমিদ মোটেও ভয় পায়না। তবে এই মুহুর্তে ওর মেয়েটাকে ধরতে হবে। তাই কায়দা করে কুহুর কথা শোনার ভান করল। একবার ওকে ধরতে পারলেই কেল্লাফতে। ওকে আর পায় কে।

” তুমি এইভাবে আমাকে হুমকি দিচ্ছ, বউ? আমার মত এমন ইনোসেন্ট জামাইকে তুমি এভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে পারনা। এটা অন্যায়। শুধু অন্যায়ই নয় মহাঅন্যায়। আর একজন পতিব্রতা রমনী হিসেবে এটা তোমার আচরণের পরিপন্থী হয়ে যায়। এই অসহায় মানুষটার ওপর তোমার কি একটুও দয়া হয়না? যদিও তুমি তোমার নামমাত্র শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে পাত্তা পাবেনা। তবুও তোমার কথা শুনে আমার কেমন যেন কষ্ট কষ্ট ফিল হচ্ছে। ” তাহমিদ কাঁদোকাঁদো গলায় বলল।

” হয়েছে আর অভিনয় করতে হবেনা। সাধে তো আর বলিনা, অভিনয়ের জন্য আপনি কয়েকটা অস্কার ডিজার্ভ করেন। এতে অস্কারও ধন্য হয়। অস্কারও আপনাকে মনেপ্রাণে কামনা করছে। ”

” তুমি আমাকে বিশ্বাস করলেনাতো, বউ! এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি। তাহমিদ ভাই, তুই সত্যিই হতভাগা। বউ তোকে বিশ্বাস করেনা। ” তাহমিদ কথা বলত বলতে গুটিগুটি পায়ে কুহুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কুহু সেটা বুঝতে পেরে দরজা খুলতে চাইলেই কেউ বাহির থেকে দরজায় নক করল।

” তাহমিদ , আব্বা, তুমি ফ্রি আছ? ” বাহিরে শাহানা আক্তারের গলা শুনতে পেয়েই কুহু থেমে যায়। ও দরজা খোলার অনুমতি নিতে তাকায় তাহমিদের দিকে।

তাহমিদ ইশারা করলে কুহু দরজা খুলে দেয়।

” ভেতরে এস, ফুপু। ”

” আব্বা, আজকে তুমি আর বউমা তোমার বাবার সাথে খাবে। রাশেদ তোমাদের কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে যেতে বলেছে। ” শাহানা আক্তার ভেতরে এসে বললেন।

” ফুপু, তুমি সবকিছুই জানো। তারপরও কেন এমন আবদার করছ! এমন আবদার কেন কর, যেটা আমি রাখতে পারবনা। আর আমি খাবার অর্ডার দিয়েছি। ডেলিভারি বয় রাস্তায় আছে। কয়ে মিনিটের মধ্যেই সে পৌঁছে যাবে। ”

” আব্বা, রাশেদের ইচ্ছে সে বউমাকে সাথে নিয়ে খাবে। এটা তার আবদার, আমার নয়। আসুক ডেলিভারি বয়। খাবার আমি রিসিভ করব। আমরা সবাই মিলে সেগুলো খাব। ” শাহানা আক্তার বায়না করলেন।

” আজ হঠাৎ তার এমন ইচ্ছের কারন কি? তার স্ত্রী-সন্তানেরা আছে। তাদের পাশে আমার স্ত্রী বেমানান। নাকি আমার স্ত্রী’ কে অপমান করতেই এই আয়োজন? ”

” তাহমিদ, তুমি রাশেদের প্রথম সন্তান। আজ তুমি নতুন বউ নিয়ে বাসায় এসেছ। সে কিন্তু বিনাবাক্যে বউমাকে মেনে নিয়েছে। বউমাকে দেখার পর থেকেই ওকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। ওর তো ইচ্ছে করতেই পারে বউমাকে সাথে নিয়ে খাবে। তুমি আর না করোনা, আব্বা। ”

” না গেলে হয়না, ফুপু ? তুমি তো জানো, কত বছর আমি তার সাথে খাইনা। ”

” আমার কথা শোন। আজকে রাতে একসাথে খাও। তুমি যদি দেখ, তোমাদের সামান্যতমও অসম্মান হচ্ছে, তবে আর খেওনা। আর তখন তুমি প্রতিবাদ করলেও আমি কিছুই বলবনা। আমার এই অনুরোধ রাখ, আব্বা ”

” তুমি আমাকে অনুরোধ নয়, আদেশ করবে, ফুপু। তোমার আদেশ মেনে আজ তোমার ভাইয়ের সাথেই খাব। তবে সে যেন আমাকে না খোঁ’চা’য়। তাকে বলে দিও। ”

” আমি এখনই রাশেদকে গিয়ে বলছি। তোমরা তারাতারি নিচে এস। বউমা , আমি গিয়ে তোমার শ্বশুরকে বলছি। তোমরা দেরি করোনা কেমন? আমার রান্নাও শেষের দিকে। ” শাহানা আক্তার হেসে রুম ত্যাগ করলেন।

আরও আধাঘন্টা পর তাহমিদ কুহুকে নিয়ে নিচে আসল। ততক্ষণে রাশেদ কুরাইশি ডাইনিং টেবিলে এসেছেন। তিনি একা বসে আছেন। চোখের সামনে ফোন নিয়ে মনযোগ সহকারে কিছু দেখছেন। অনেকদিন পর ডাইনিং এরিয়ায় এসে তাহমিদের সংকোচবোধ হচ্ছে। ও চুপচাপ একটা চেয়ার টেনে বসল। শাহানা আক্তার কুহুকে বসতে বললেই, রাশেদ কুরাইশি তাকালেন কুহুর দিকে। কুহু তাহমিদের পাশের চেয়ারে বসতে গেলেইস, রাশেদ কুরাইশির ডাকে ও থমকে দাঁড়ায়।

” বউমা, তুমি আমার পাশে এসে বস। ” রাশেদ কুরাইশি কুহুকে চেয়ার দেখিয়ে দিল কুহু সেখানে গিয়ে বসল।

তাহমিদ চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে রাশেদ কুরাইশির দিকে। ওর বাবা হঠাৎ কেন এমন নমনীয় আচরণ করছে, সেটা ওর বোধগম্য হচ্ছেনা।

শাহানা আক্তার এসে একে একে সবাইকে খাবার পরিবেশন করেছেন। তবে তাহমিদের বাঁধায় তাকে থামতে হল। তাকেও ওদের সাথে খেতে বসতে হল।

এভাবে সবার সাথে খেতে কুহুর বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। তবে রাশেদ কুরাইশির আচরণে ও মুগ্ধ। তিনি নিজ হাতে এটাসেটা কুহুর পাতে তুলে দিচ্ছেন। কুহু খেতে না চাইলেও তিনি জোর করে দিচ্ছেন।

শাহানা আক্তার খাওয়ার ফাঁকে তাহমিদের প্লেটে রুই মাছের মাথা তুলে দিতে গেলেই রাশেদ কুরাইশির কথায় তিনি থেমে যান।

” আপা, তুমি ওকে সর্ষে ইলিশ দাও। ও মাছের মাথা খেতে পারেনা। ও রুই মাছ অতটা পছন্দও করেনা। সর্ষে ইলিশ খাওয়া হলে, চিংড়ির মালাইকারি দিও। ” রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে শাহানা আক্তার হেসে তাহমিদের প্লেটে সর্ষে ইলিশ তুলে দিলেন।

তাহমিদ বাবার কথা শুনে বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। ওর পছন্দ-অপছন্দ ওর বাবা জানে! সে কিভাবে জানল, তাহমিদের সর্ষে ইলিশ পছন্দ? আবার চিংড়ির মালাইকারি কথা সে জানল কিভাবে!

হঠাৎই তাহমিদ অনুভব করল ওর চোখের পাতা ভিজে উঠেছে। যেই বাবা কখনো তার ছেলের ভালোমন্দ খেয়াল রাখেনি, সে-ই বাবাই আজ তার ছেলের পছন্দের কথা বলছে! তাহমিদ অতি সন্তর্পনে চোখ মুছে খাবারে মনযোগ দেয়।

” বাবা, আপনাকে একটু মালাইকারি দেই? আপনিতো শুধু করলা ভাজি দিয়েই খাচ্ছেন। ” কুহু সাহস করে রাশেদ কুরাইশিকে বলল।

” বউমা, আমার ডায়বেটিস আছে। তাই তিন বেলাই করলা খাই। ইচ্ছে থাকলেও এসব খেতে সাহস হয়না। ”

রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে কুহুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। ও মৃদুস্বরে বলল,

” একবেলা খেলে কিছুই হবেনা, বাবা। আমি আপনার প্লেটে অল্প একটু তুলে দিচ্ছি। আপনি খান। ” কুহু ওর শ্বশুরের প্লেটে চিংড়ির মালাইকারি তুলে দিলে রাশেদ কুরাইশি আগ্রহ নিয়ে খেতে থাকলেন।

কুহুরা বেশ কিছুক্ষণ হয় খেতে বসেছে। এরমধ্যে ডেইজি কুরাইশিকে সে কোথাও দেখেনি। ও বুঝতে পারছে ওরা খেতে এসেছে জন্যই বোধহয় সে এখানে আসেনি। বিষয়টা কুুহুর কাছে ভালো লাগলনা। নিজেকে কেমন উটকো ঝামেলা মনে হচ্ছে। তবে রাশেদ কুরাইশির আন্তরিকতায় কোন কৃত্রিমতা নেই। যেটা কুহুকে আকৃষ্ট করেছে।

” তুমি রান্না করতে পার, বউমা? ” খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন রাশেদ কুরাইশি।

” জ্বি, বাবা। সব রান্নাই মোটামুটি পারি। ”

” কালকে দুপুরে আমি বাসায় খাব। তুমি কালকে আপার সাথে রান্না করতে পারবে? আমি কিন্তু ভোজনরসিক। কিন্তু ডায়াবেটিস শরীরে আক্রমণ করার পর থেকে খাওয়াদাওয়া সব শিকেয় তুলেছি। কিন্তু তুমি যদি রান্না কর, তবে রিস্ক একটা নেয়াই যায়। ”

” ঠিক আছে বাবা, আমি রান্না করব। আপন শুধু বলুন কি কি খাবেন? ”

” আমি সবই খাই। তুমি তোমার পছন্দমত রান্না কর। তবে এই ভদ্রলোক কি খাবে সেটাও জিজ্ঞেস নিও। তার পছন্দের খাবারও রান্না কর। ” রাশেদ কুরাইশি তাহমিদকে ইংগিত করে বললেন।

” ধন্যবাদ। আমি কাল ভার্সিটি থেকে কোচিং-এ ক্লাস নিতে যাব। তাই দুপুরে বাসায় আসতে পারবনা। আপনিই বরং কবজি ডুবিয়ে খেয়েন। ”

” আমিতো খাবই। বউমা প্রথমবার আমার জন্য রান্না করবে। আমি প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই খাব। ”

শাহানা আক্তার বাবা-ছেলের কথপোকথন শুনে হাসলেন। তবে রাশেদ কুরাইশিকে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে তার খুব শান্তি লাগছে। তবে কি বাবা-ছেলের সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে?

বিঃদ্রঃ গত তিনদিন ধরে আম ভিষণ অসুস্থ। ফোনের দিকে তাকানোর অবস্থায় ছিলামনা। তাই লিখতেও পারিনি। তিনদিন থেকে স্লিপিং পিল খেয়ে বেঘোরে ঘুমিয়েছি। আজ একটু সুস্থ হওয়ায় এতটুকু লিখতে পেরেছি। আপনারা কষ্ট করে এতটুকুই পড়ুন। ভালোবাসা পাঠকমহলকে।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪০
জাওয়াদ জামী জামী

” ছেলে আর ছেলের বউকে সাথে নিয়ে ডিনার করে খুব শান্তি পেয়েছ তাই না? এখন কি মনে হচ্ছে, এতদিন এত সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছিলাম কেন? যতসব লো ক্লাস মেন্টালিটি। এক দেখাতেই ছেলের বউ তার আপন হয়ে গেছে। এখন আমি যেন আর কেউনা। ড্যাং ড্যাং করতে করতে ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে ডিনার করল। ঐ থার্ড ক্লাস মেয়ের সামনে নিজেকে দ্বায়িত্বশীল শ্বশুর হিসেবে পরিচিত করল। ” ডেইজি কুরাইশি রা’গে গজগজ করতে করতে কথাগুলো বলল।

স্ত্রী ‘র কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তিনি বলার জন্য কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছেননা। কি অবলীলায় তার স্ত্রী এসব বলছে, ভেবেই তিনি বিস্মিত হচ্ছেন। অথচ ডিনার করতে যাওয়ার আগে তিনি ডেইজি কুরাইশিকে তার সাথে যাওয়ার জন্য অনেক জোর করেছেন। কিন্তু সে তার কোন কথাই শোনেনি।

” কয়দিন পর দেখব আমার ছেলেমেয়েদের ফাঁকি দিয়ে সব প্রপার্টি ঐ অসভ্য, ছোটলোক ছেলেকে দিয়ে বসে আছে। এখন ছেলেই সব। আমার রায়ান আর জাহিয়া কিছুই নয়। সব ঐ অসভ্যটার অবদান। ” রাশেদ কুরাইশিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ডেইজি কুরাইশি তার কথা চালিয়ে যেতে থাকে।

এবার আর রাশেদ কুরাইশি চুপ করে থাকলেননা। তিনি রে’গে উঠলেন।

” তুমি চুপ করবে? আমার কাছে আমার তিন সন্তানই সমান। তাহমিদ রায়ান, জাহিয়ার থেকে আমার কাছে কোনও অংশেই কম নয়। আমার সব প্রপার্টি ওদেরকে সমান ভাগে ভাগ করে দেব। এই নিয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাইনা। ” রাশেদ কুরাইশি আর কথা না বাড়িয়ে একটা বই হাতে নিয়ে রকিং চেয়ারে বসলেন।

রুমে এসে কুহু মাথার ঘোমটা ফেলে দেয়। এতক্ষণ ঘোমটার আড়ালে থেকে ওর হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে। তাহমিদ রুমে এসে বেলকনির দরজার খুলে পর্দা সরিয়ে দেয়। পর্দা সরিয়ে দিতেই হু হু করে বাতাস রুমে ঢুকল। হঠাৎই ঠান্ডা বাতাসের পরশ পেতেই কুহু বাহিরে তাকায়। রাতের কৃত্রিম আলোয় উদ্ভাসিত এই বাড়ির এরিয়া। কৃত্রিম আলোরছটায় চাঁদের আলোর দেখা পাওয়া মুশকিল। তবুও ধীর পায়ে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়। একটু যদি চাঁদের আলোর পরশ শরীরে নেয়া যায়। কুহুকে বেলকনির দিকে যেতে দেখে তাহমিদও ওর পিছু পিছু যায়।
মেয়েটা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি দূর ছায়ালোকের দিকে। যেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারো তারকারাজি। গায়ে মেখেছে চাঁদের আলোর রূপালী ঝর্ণা।

তাহমিদ পেছনে দাঁড়িয়ে আচমকা জড়িয়ে ধরল কুহুর কোমড়। তাহমিদের স্পর্শে কুহু কেঁপে উঠল। তাহমিদ ধীরে ধীরে ওর হাত কুহুর উন্মুক্ত পেটের দিকে নিয়ে যায়। থুতুনি রাখে কুহুর খোলা কাঁধে। তাহমিদের দাড়ির ঘষাষ শিরশিরিয়ে উঠল কুহুর তনু। অসার হয়ে আসে ওর সর্বাঙ্গ। এদিকে পেট জুড়ে তাহমিদের ছোঁয়া ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। কুহু ঠোঁট কামড়ে সহ্য করছে তার একান্ত পুরুষের ভালোবাসার অত্যাচার। যে অত্যাচারে নেই কোনও দুঃখ, কষ্ট। তাহমিদের হাত এতক্ষণ কুহুর পেটে বিচরণ করছিল, এবার সে কুহুর খোলা কাঁধে ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে।
অনেকক্ষণ পর কুহুর হুঁশ হয় ওদেরকে এই অবস্থায় কেউ যদি দেখে! ও হুট করেই তাহমিদকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। কুহুর ধাক্কায় তাহমিদ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।

” এভাবে রোমাঞ্চের চৌদ্দটা না বাজালেই কি হচ্ছিলনা! নিষ্ঠুর রমনী। নিজেও ভালোবাসবেনা, আবার আমি ভালোবাসতে গেলেই দূরে সরিয়ে দেয়। আমার কপালে বউয়ের আদর নেই। ”

” ছিহ্ এসব কি বলছেন! আপনার দেখছি লজ্জা শরমের বালাই নেই। আশেপাশে কত বিল্ডিং। কেউ আমাদের এই অবস্থায় দেখলে কি ভাববে বলুনতো? ”

তাহমিদ কুহুর কথা পাত্তা না দিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। এরপর বেলকনির মেঝেতে পাতা বিছানায় ওকে নিয়ে বসল। তাহমিদ কুহুকে কোলে নিয়েই বসেছে। ওর নড়াচড়ার কোন উপায় রাখেনি।

” কেউ দেখলে দেখবে। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি আমার বউকে আদর করছি। এতে লজ্জার কিছুই নেই। এত কম কম আদর করলে দুই ডজন ছানাপোনা কেমন করে আসবে! ”

” কিহ্, দুই ডজন! আপনার মাথা ঠিক আছে? নাকি মেয়াদোত্তীর্ণ কিছু খেয়েছেন? ”

” বউ, তুমি ভালো করেই জানো আমি আজেবাজে কিছু খাইনা। তোমার বর একদম বিশুদ্ধ, নিষ্পাপ আর অসহায়। ”

” জানিনা আবার। ”

” কি জানো? ” তাহমিদ কুহুর গলায়, কাঁধে গাল ঘষে বলল।

” আপনি একদম খাঁটি মানুষ। ”

” গুড। একমাত্র জামাইয়ের জন্য সব সময়ই এমন ভালো ধারনা পোষণ করবে। এতে আমার ছানাপোনারাও তাদের বাবাকে বেশি বেশি ভালোবাসবে এবং বাবার ভক্ত হবে। তাদের সামনে বেশি বেশি আমার সুনাম করবে। ”

” হুম করব সুনাম। ”

” গুড। ”

” শুনুন। ”

” বলুন। ”

” বাবাকে আমার বেশ লেগেছে। তিনি আমাকে কত যত্ন করে খাওয়ালেন। আবার আপনারও খেয়াল রাখলেন। এতদিন আপনি শুধু শুধু তার ওপর রা’গ করেছেন। ”

” এক বেলাতেই পটে গেছ! কয়েকদিন এখানে থাক। তার স্বরূপ তোমার সামনে উন্মোচিত হোক। তারপর বল তিনি কেমন। আগে পটে গেলে মানুষ চেনার পর কষ্ট পাবেতো। আর আমি চাইনা তুমি কষ্ট পাও। ”

” আবারও? আপনি এমন কেন! কি হয় বাবার সাথে ভালো করে কথা বললে? ”

” কিছুই হয়না। তার সাথে ভালো করে কথা বললে আমি কি একটা সুস্থ শৈশব, কৈশোর কিংবা স্বাভাবিক যৌবন ফিরে পাব? ”

” জানি, সেসবের কিছুই পাবেননা। কিন্তু আপনার স্বাভাবিক কথাবার্তায় যে বাবা খুশি হবেন। আমি লক্ষ্য করেছি, বাবা আপনার সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজে বেড়ান। একজন বাবাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেননা। আমি জানি আপনার কাছে বিষয়টা অনেক কঠিন। তবুও একজন বাবাকে খুশি রাখতে এতটুকু করাইতো যায়। ”

” সারাজীবন শুধু অন্যকে খুশ করে যাব? তবে আমি কেন একটু খুশির স্বপ্ন দেখতে পারিনা? আমার চারপাশ কেন আঁধারে ছাওয়া? কি দোষ ছিল আমার? ”

” আপনার কোনই দোষ ছিলনা। আপনি দু’জনের মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েনে পিষ্ট হয়েছেন। যার প্রভাবে আপনার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত পথও কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে। আপনার চারপাশ আঁধারে ছাওয়া ঠিকই। কিন্তু আপনি নিজে একজন আলোর দিশারি। যার আপাদমস্তক আলোয় ঝলমল করে, ঝলমলে রোদ্দুরের ন্যায়। থাকুকনা তার চারপাশে আঁধার। সেই আঁধার কভু আপনাকে ছুঁতে পারবেনা। ঝলমলে রোদ্দুরের তেজোদ্দীপ্ত বর্ণচ্ছ্বটায় আঁধার কি তার পাখনা মেলতে পারে? ”

” তুমি সবটা জানোনা তাই এভাবে বলতে পারছ। ” তাহমিদ বিষাদ মাখা গলায় বলল।

” আমি সবই জানি। খালা একদিন আমাকে অনেককিছুই বলেছেন। আপনি জীবনে যা যা সহ্য করেছেন, তারপরও যে আপনি নিজেকে এভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, তা কয়জন পারে? আপনি অনেকের অনুপ্রেরণা হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ”

” কি ব্যাপার বউ, আজ আমার এত প্রশংসা করছ কেন? আমিতো দেখছি খুশিতে পা’গ’ল হয়ে যাব। বউয়ের প্রশংসা পেতে ভাগ্য লাগে। আজকে আমার ভাগ্য দেখছি সুপ্রসন্ন! ” তাহমিদ একটু হেসে ভরাট কন্ঠে বলল।

” চুপ করবেন? টিটকারি মা’র’ছেন কেন! আমি যা কিছু বলেছি, সবটাই সত্য। ” কুহু অভিমানে মুখ ফোলায়।

” আমি কখন বললাম, তুমি মিথ্যা বললে! আমিতো নিজের প্রশংসা শুনে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছি। আরেকটু প্রশংসা করলে প্লেন ছাড়াই অন্য মহাদেশে উড়াল দেব। ”

” আবার? আপনি সত্যিই একটা বদ লোক। ”

” এইতো সত্যি কথা বের হয়েছে। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই আরও কিছু শুনতে পাব। তাইতো বলি, বউ করবে জামাইকা প্রশংসা! বউ জাতির সৃষ্টিই হয়েছে জামাইয়ের পেছনে কাঠি নাড়তে। ”

” এই আপনি আমাকে এখনই ছাড়ুন। আপনার সাথে কোন কথা নেই। জীবনেও আপনার প্রশংসা করবনা। আপনি একটা যাচ্ছেতাই। আমি তার সাথে একটু সুখ-দুঃখের গল্প করতে চাইলাম, আর সে আমার সাথে মজা করে। আসলে সে চায়না, তার জীবনের গল্প আমার সাথে শেয়ার করতে। ” কুহু তাহমিদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও তাহমিদের শক্তির সাথে পেরে উঠেনা। বাধ্য হয়ে ওকে তাহমিদের কোলেই থাকতে হয়।

” যে ছেলে ছোট থেকেই বাবা-মা ‘র মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। নয় বছর বয়সে যাকে তার মা ফেলে রেখে অন্য কারও হাত ধরে চলে যায়, যার বাবা অন্য নারীতে মত্ত সেই ছেলের জীবন কি এতই সহজ? প্রতিনিয়ত তাকে মানুষের কটুকথা শুনতে হয়েছে। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর। ভ্যাগাবন্ডের ন্যায় এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। যার জীবন নানিমা আর রাজিয়া খালা নামক মানুষ দুটো ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব ছিলনা। তবে মাঝেমধ্যে শাহানা ফুপু এসে আদরে ভরিয়ে দিত। একটা সময় সে সংসার না করার পণ করে। কিন্তু একদিন হঠাৎই এক কান্নাভেজা চোখে সে আটকে যায়। আটকে যায় শ্যামাঙ্গীনি এক কিশোরীর মায়াময় মুখে। তার হৃদয়মাঝে আটকে থাকা ভালোবাসা উছলে পরে। সে বহু বছর পর জানতে পারল, তার ভেতরও ভালোবাসা বাস করছে। যে ভালোবাসার জোয়ারে সে সবকিছু ভাসাতে প্রস্তুত। সেইদিনই তার সকল পণ জলাঞ্জলি দিয়ে সেই কিশোরী কন্যাকে নিজের করে পেতে চায়। একটা সময় সে পেয়েও যায় তার কিশোরী কন্যাকে যতটা আপন করে পেলে দু’জনের মাঝে কোন লজ্জার বালাই থাকেনা, যতটা আপন করে পেলে দুনিয়াকে তুচ্ছ করতে ইচ্ছে করে। সেভাবেই সে পেয়েছে তাকে। আজ এই মধুর রজনীতে সেই কিশোরী কন্যা তার নিজস্ব পুরুষের কোলে বসে সেই কথাই শুনছে। আর কিছু শুনতে চাও আমার শ্যামাঙ্গীনি? ” তাহমিদের দরদ মাখানো কথা শুনে কুহু বিমোহিত নয়নে তাকায়।
তার কথাগুলো কুহুর বুকে আছড়ে পরল বাঁধভাঙা ঢেউয়ের ন্যায়। যে ঢেউয়ের তোড়ে কুহু যেকোন পরিস্থিতিতে ভাসতে রাজি। হারাতে রাজি মধুমাখা প্রেমহিল্লোলে। কোথায় থেকে একরাশ আবেগ এসে কুহুকে জড়িয়ে নেয়। সে-ও স্থান কাল ভুলে তাহমিদের গলা জড়িয়ে ধরে, তার পানে চায় নেশাক্ত চোখে। ওর ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে।

তাহমিদ হেসে তার রমনীর ঠোঁট ঠোঁট ডুবায়।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৩৭+৩৮

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী জামী

” অনেক বেলা হয়েছে, এবার তো আমাকে ছাড়ুন। চাচার বাসায় যাবেননা? এখন যদি না উঠি, তবে ঐ বাসায় যেতে দেরি হবে। ”

তাহমিদ কুহুকে জাপ্টে ধরে শুয়ে আছে। কুহু অনেকক্ষণ থেকে ওকে ছাড়তে ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে। কিন্তু তাহমিদের কানে কুহুর সেসব কথা পৌঁছলে তো। ও দিব্যি কুহুর গলায় মুখ গুঁজে ঘুম দিচ্ছে।

” উম বউ, এত কথা বলছ কেন? তুমিও চুপচাপ ঘুমাও, আর আমাকেও ঘুমাতে দাও। চাচা শ্বশুরের বাসায় যেতে দেরি হবে। ” তাহমিদ ঘুম জড়ানো গলায় বলল।

” আপনি ঘুমান। কে মানা করেছে। আমাকে ধরে রেখেছেন কেন! আমাকে ছাড়ুন। নাস্তা বানাতে হবেনা? ”

” শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত আছেনা। সেখানেই গিয়ে নাস্তা করব। আমার চাচা শ্বশুর বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি সকাল সকাল তার বাসায় যেতে বলেছেন। যেহেতু নাস্তা তৈরীর ঝামেলা নেই, সেহেতু আরও এক ঘন্টা ঘুমানোই যায়। ”

কুহু চোখ পাকিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার কোনও হেলদোল নেই। অনেক চেষ্টার পরও কুহু তাহমিদের হাতের বাঁধন ঢিলা করতে পারলনা। বাধ্য হয়ে ওকেও শুয়ে থাকতে হয়।

রায়হান আহমেদের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওদের এগারোটা বেজে যায়। ওদেরকে দেখেই রায়হান আহমেদ এগিয়ে আসলেন। তিনি সরাসরি তাহমিদে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসলেন। তাহমিদের খাবেন জন্য তিনি এখনও না খেয়ে আছেন।

বিকেলে কিছু সময়ের জন্য তাহমিদ বাহিরে যায়। ও কোথায় যাচ্ছে, সেটা কাউকেই জানায়না।

” নানিমা, তুমিও কি খালামনির মত আমাকে দোষী ভাব? আমিতো শুধু চেয়েছি তোমার মুখে হাসি ফোটাতে। মামাকে ছাড়া তুমি যে কতটা কষ্টে ছিলে, সেটা আর কারও চোখে না পরলে আমার চোখে পরেছে। কিন্তু কালকে যেটা হল, সেটার জন্যও কি আমিই দায়ী? ” তাহমিদ ফাতিমা খানমের হাত নিজের দু হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে করুণ স্বরে কাতরতার সাথে বলল।

তাহমিদের করুণ স্বর ফাতিমা খানমের বুকে আঘাত হানে। তিনি সজোরে মাথা নাড়িয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করলেন। তিনি একমাত্র সচল হাতটি বাড়িয়ে দিলেন নাতির দিকে। এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন তার প্রানপ্রিয় নাতিকে।

” বাপজান, তুমি রাইতে খাইয়া যাইবানা? ” রাজিয়া খালা জিজ্ঞেস করলেন।

তাহমিদ নানিমার সাথে অনেকটা সময় কাটিয়ে ড্রয়িংরুমে এসেছে। সেখানে সে মামা-মামীর সাথে কথা বলছে। তখনই রাজিয়া খালা এসে ওকে জিজ্ঞেস করলেন।

” না খালা, আজ এখানে খেতে পারবনা। আরেকদিন এসে তোমার হাতে খেয়ে যাব। তা তুমি কি রান্না কর, নাকি মামী করে? ”

” না তাহমিদ, এখনো আমি রান্নাঘরের দ্বায়িত্ব কাঁধে নিইনি। রাজিয়া আপা সবকিছুই সামলাচ্ছে। ” তাহমিদের মামী স্মৃতি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল।

” মামী, এতে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই। রাজিয়া খালা রান্নাবান্নায় পটু। তার হাতের রান্না খেলে অন্য খাবার মুখে তুলতে ইচ্ছে করেনা। আপাতত আপনি খালার রান্না খেয়ে রুচি বাড়ান। ”

” তুমি কিন্তু রাতে খেয়ে যেও। বউমাকেও সাথে নিয়ে আসতে। কালকে ওর সাথে গল্প করতেই পারলামনা। ”

” আজ খেতে পারবনা, মামী। আজকে আমরা চাচা শ্বশুরের বাসায় দাওয়াতে গিয়েছি। সেখান থেকেই এখানে এসেছি। রাতে সেখানেই খাব। ”

নায়লা আঞ্জুম তার বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হতেই তাহমিদের কথা তার কানে পৌঁছে যায়। সে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ায়। তাহমিদের কথা যেন কানে বি’ষে’র ন্যায় আছড়ে পরল। তার অনুপস্থিতিতে তারই বাসায় রায়হান আহমেদ মেলা বসিয়েছে সেকথা ভেবেই তার রা’গে শরীর চিরবির করছে। সে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, নিজের বাসায় ফিরে গেলেই এসবের প্রতিদান রায়হান আহমেদকে হাড়েহাড়ে টের পাইয়ে দেবে। সে ধুপধাপ পা ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

তাহমিদ নায়লা আঞ্জুমের দিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসল।

” বউ, শ্বশুর বাড়িতে যেতে চাও? তোমার দেখতে ইচ্ছে করেনা তোমার এই অসহায় জামাই কোথায় থাকে? ” কুহুকে জড়িয়ে ধরে বলল তাহমিদ। মেয়েটা কয়েকদিন পর আজ কোচিং-এ গিয়েছিল। কোচিং-এ আজ পরীক্ষা ছিল। কুহু সেই খাতাগুলোই দেখছিল। হঠাৎ তাহমিদ ওকে জড়িয়ে ধরায় প্রথমে চমকে উঠেছিল। পরে তাহমিদের গলা পেয়ে মৃদু হাসল মেয়েটা।

” কে বলছে আপনি অসহায়! আপনি যদি অসহায় হন, তবে আমি কি? সারাদিন যে আমাকে আঙুলে নাচাচ্ছেন, আর আমি অসহায় বালিকা নেচে যাচ্ছি। আমি কি অসহায় নই? ” কুহু ঠোঁট টিপে হাসল।

” আচ্ছা, আমি তোমাকে আঙ্গুলে নাচাই! সত্যিই! দেখেছ আমি কত বড় অসহায়, এই যে তুমি আমার নামে মিছেমিছিই অপবাদ দিলে, আর আমি বিনাবাক্যে মেনে নিলাম? সারাজীবন এমনটাই চলতে থাকবে। এরথেকে বড় অসহায় ব্যক্তি তুমি দুনিয়া খুঁজলেও পাবেনা। ” তাহমিদ চোখমুখ অসহায়ের ন্যায় করল।

কুহু ওর দিকে তাকিয়ে না হেসে পারলনা। মানুষটা ওপরে ওপরে নিজেকে যতটা কঠোর দেখায়, আদতেই সে তা নয়।

” সত্যিই কি আমাকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাবেন! আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা। কবে যাবেন ঢাকা? ”

” তুমি বললে এখনই যেতে পারি। ”

” দূর ইয়ার্কি করবেননাতো। সত্যি করে বলুন না কবে আমাকে নিয়ে ঢাকা যাবেন। ”

” বাব্বাহ্ শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য দেখছি তর সইছেনা। আগেই বলে রাখছি, সেখানে তোমাকে আপ্যায়ন করার জন্য কেউ কিন্তু থাকবেনা। ”

” আপ্যায়ন করা লাগবেনা। সেই আশাও করিনা। কিন্তু ভয় হয়, যদি তারা আমাকে মেনে না নেয় । একে-তো আপনি তাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছেন। তার ওপর আমি আমার শ্বাশুড়ির বোনের শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়। ”

” তাদের মেনে নেয়া না নেয়ায় আমার কিছুই আসে যায়না। সংসার করব আমি। তারা করবেনা। তাই আমার ভালো আমাকেই বুঝতে হবে। তুমি কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেখ। কাল দুপুরেই আমরা রওনা দেব। আমি ফুপুর সাথে কথা বলেছি, তিনি কয়েকদিন এখানেই থাকবেন। আসলে আমি সৃজনকে এখনই আমার বাবার বাড়িতে নিতে চাচ্ছিনা। সেখানে তোমাকে কিভাবে ট্রিট করা হবে, সেটা আমি জানলেও সৃজন কিন্তু জানেনা। তাই আপাতত ছেলেটাকে এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে চাই। ”

” আপনি এত কিছুর খেয়াল রাখেন কিভাবে! সব দিকে নজর রাখার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আপনার ভেতর রয়েছে, সেটা কি আপনি জানেন? আপনাকে যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই। ”

” মেয়ে, এভাবে দেখোনা। প্রেমে পরে যাবে। একবার আমার প্রেমে পরলে আজীবন আমাতেই আটকে থাকতে হবে। আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত বেঁচে থাকার কথা চিন্তাই করতে পারবেনা। ”

” আমি কি আপনার প্রেমে পরিনি বলতে চাচ্ছেন? আপনাতে আটকে যাইনি? ”

” তাই কি? কই আমিতো জানিনা। ”

” আবারও ইয়ার্কি করছেন! আমি আপনাতে আটকাইনি? আটকেছি বুঝলেন, ভিষণভাবে আটকে গেছি। আজ থেকে চারদিন আগেই স্থায়ীভাবে আপনাতেই আটকে গেছি। এতদিন মনে মনে আটকে ছিলাম। এখনতো দুনিয়াকে জানিয়ে আপনার বুকের মধ্যে আটকে গেছি। যেখান থেকে আমাকে সরানোর সাধ্য কারও নেই। সো এই নিয়ে কোন কথাই হবেনা। ”

কুহুর কথায়, চোখেমুখে কনফিডেন্স দেখে তাহমিদ অবাক হয়। এই মেয়েটা কত সহজে মনের গোপন কথা প্রকাশ করে দিল, ভেবেই ওর গর্ব হচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে ভালোবেসে ও ঠকেনি। এই মায়াবী কন্যা ওর জীবনে সুখের বার্তা নিয়ে এসেছে। ওকে ভাসাতে এসেছে প্রনয়ের সাগরে।

” এবার সরুন দেখি। আমাকে আবার গোছগাছ করতে হবে। প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি। তাই প্রস্তুতি নিতে সময় লাগবে। ” তাহমিদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় কুহু।

কুহুর আচমকা ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় পরে যায় তাহমিদ। মেয়েটা যে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে সেটা ও ভাবতেই পারছেনা।

” চারদিন হতে না হতেই নির্যাতন শুরু করেছ! এখনই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছ? আমার হাত-পা ভেঙে গেলে কিংবা মাথা ফেটে গেলে তোমার কি কোন কষ্টই হতোনা! নিষ্ঠুর বউ, হিটলারের নাতনি। অত্যাচারী রমনী। ” তাহমিদ ব্যথা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল।

” আর কিছু? একে তো পরেছেন বিছানায়, তার ওপর এমন ভাব করছেন, যেন কেউ আপনাকে দশতলা থেকে ফেলে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে! অভিনয় ভালোই জানেন দেখছি। অস্কার আপনাকে পেলে ধন্য হয়ে যাবে। ”

” হাহ্ ভাই তাহমিদ, ভবিষ্যতে তোর কপালে দুঃখ আছে বুঝলি? তুই তো বিয়ে করে বউ পাসনি, পেয়েছিস হিটলারের উৎকৃষ্ট বংশধর। যে তোকে উঠতে বসতে নাকানিচুাবানী খাওয়াবে। তার ডিকশনারিতে আদর বলে কোন ওয়ার্ড নেই। আছে শুধু অত্যাচার আর অত্যাচার। এভাবে চলতে থাকলে তোর বংশে লালবাতি জ্ব’ল’বে। তোর আর ফুটবল টিমের হওয়া হলোনা। এমন কাটখোট্টা বউয়ের ভয়েই তোকে আজীবন তটস্থ থাকতে হবে। ”

কুহু তাহমিদের কথায় কান না দিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। তবে ওর ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি তাহমিদের চোখ এড়ায়না।

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৮
জাওয়াদ জামী জামী

পরদিন দুপুরে ওরা বড় ফুপু আর সৃজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে।
কুহু আগে বেশ কয়েকবার ঢাকায় এসেছে। বেড়াতে এসেছে মাত্র তিনবার। তবে বাবাকে নিয়ে বেশি আসা হয়েছে। কয়টা বছর বাবাকো নিয়ে কতইনা টানাহ্যাঁচড়া করতে হয়েছে। এ হসপিটাল থেকে ঐ হসপিটাল করতে হয়েছে। সবকিছুই ও আর ওর মা সামলেছে। সেই দুঃসময়ে বড় ফুপু ছাড়া কেউই ওদের পাশে ছিলনা। শেষ পর্যন্ত বাবাও বাঁচলোনা। দুই ভাইবোনকে এতিম করে বাবা চলে গেল। আর মা তো ওদেরকে অনাথই করে গেল। ওর এমন একটা দিনও কাটেনা যেদিন বাবা-মা’ কে মনে পরেনা। সৃজনকে বুঝতে না দিয়ে গোপনে চোখের পানি ঝরায়। কখনোই কাউকে দেখতে দেয়না ওর গোপন বেদনা। কিন্তু আজ কিছুতেই চোখের পানি গোপন করতে পারলনা। সেই দুর্বিসহ দিনগুলি, আর বাবা-মা’ র কথা মনে হতেই ও হু হু করে কেঁদে উঠল।

আচমকা কুহুকে কাঁদতে দেখে তাহমিদ ভড়কে যায়। ও একহাতে কুহুকে আগলে নেয়। সেই সাথে মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে। ও কি কোনভাবে কুহুকে কষ্ট দিয়েছে!

” বউ, তুমি কাঁদছ কেন? তোমার কি কষ্ট হচ্ছে? কি হয়েছে আমাকে বল। আমি কি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি? ” তাহমিদ ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল।

তাহমিদকে এভাবে উদগ্রীব হতে দেখে কুহু ঝটপট চোখের পানি মুছে নেয়। ও যে স্থান, কাল ভুলে গিয়ে এভাবে কাঁদছিল ভাবতেই অপ্রস্তুত হয়ে গেছে।

” বাবা-মা’ র কথা মনে হচ্ছিল। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তাকে নিয়ে অনেকবার ঢাকা এসেছি। আমি আর মা কত কষ্ট করেছি জানেন? কোথায় যাব, কোথায় কি করব, কিছুই জানতামনা। কতজনকে যে জিজ্ঞেস করেছি, কতজনের হাতেপায়ে ধরেছি। সেসব কথাই মনে হচ্ছিল। ” কুহু তখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

তাহমিদ কুহুর কথার কি প্রত্তুত্যর করবে! কিছু কষ্টের কোন শান্তনা হয়না। বরং শান্তনাতেই সেই কষ্ট আরও বাড়ে। এই মেয়েটা সব হারিয়ে কিভাবে যে বেঁচে আছে, সেটা ভাবলেই হাঁসফাঁস শুরু হয় ওর। মনোবল কত দৃঢ় হলে এই পরিস্থিতিতে কোন মেয়ে নিজে লেখাপড়া চালিয়ে ভাইকেও পড়াতে পারে, সেটা কুহুকে না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস করতনা।

ওরা সন্ধ্যার পর পরই বাসায় পৌঁছে যায়। সিএনজি থেকে নেমে কুহু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদসম বাড়ির দিকে। এই বাড়ির ছেলে ওর স্বামী! কুহু অবাক হয়ে একবার তাহমিদের দিকে তাকায়, পরক্ষণেই আবার বাড়ির দিকে তাকায়। ওর সারাদিনের ক্লান্তি ততক্ষণে উধাও হয়েছে। তার বদলে চোখমুখে ফুটে উঠেছে প্রশ্নের রেখা।

” এভাবে আমার দিকে কি দেখছ! আমাকে কি আগে কখনো দেখনি? ” কুহুর তাকানোতে তাহমিদ অপ্রভিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” আপনি এই বাড়ির ছেলে! এত ধনী পরিবারের ছেলে হয়ে আমাকে বিয়ে করলেন কেন? ”

কুহুর প্রশ্নে তাহমিদ বিরক্ত হয়। ও কিছু না বলে কুহুর হাত ধরে গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল।

দারোয়ান তাহমিদের সাথে একটা মেয়েকে দেখে বোধহয় একটু অবাকই হয়েছে। তাহমিদও সেটা বুঝতে পেরে হাসল।

” চাচা, এই যে আপনার বউমা। প্রতিদিন বিয়ে কর, বিয়ে কর বলে আমার কানের পোকা নাড়িয়ে দিতেননা? তাই বিয়েটা করেই ফেললাম। এবার অন্তত আপনার মুখে প্রতিদিন বিয়ের কথা শুনতে হবেনা। ভালো করেছিনা? ”

” খুব ভালো করেছ, বাবা। দোয়া করি তোমরা সুখী হও। এবার আমার চিন্তা একটু কমল। তোমাকে শাসন করার জন্য কেউতো এসেছ। আমাদের কথা তো তুমি শুনতেই চাওনা। ”

কুহু এগিয়ে গিয়ে দারোয়ান চাচাকে সালাম দেয়।

” চাচা, রাশেদ কুরাইশি কি বাসায় আছে? সকাল থেকে তার মন মেজাজ ঠিক আছে তো? ”

” সকালে যখন স্যার বেরিয়ে যায়, তখন তাকে হাসিখুশিই দেখেছি। সন্ধ্যায় যখন বাসায় আসল তখনও ভালোই ছিল। তবে হঠাৎ করেই ছেলের বউকে দেখে সেটা তুমি আমি কেউই যেহেতু জানিনা, সেহেতু যেকোন পরিস্থিতিতে তুমি চুপচাপ থাকবে, কেমন? এবার ভেতরে যাও। ”
দারোয়ান চাচা হেসে জবাব দিল।

তাহমিদ কুহুর হাত ধরে সামনে এগিয়ে যায়।

” দারোয়ান চাচা আপনাকে বোধহয় খুব ভালোবাসে? ”

” হুম। সে আমার সব অপরাধের দোসর বলতে পার। ”

” কিহ্! আপনি অপরাধী নাকি? ”

” এই যে রাত-বিরেতে বাসায় আসলে সে ঘুম থেকে উঠে গেইট খুলে দেয়। মাঝেমাঝে আমার রুমের বেলকনির সামনে বড় মই রাখে, আমার ভেতরে যাওয়ার সুবিদার্থে। এবং এটা বছরের পর বছর ধরে করে আসছে। এখানে মূল অপরাধী আমি, আর সে আমার দোসর। অন্তত আমার কাছে এমনই মনে হয়। ”

কথা বলতে বলতে ওরা বাসার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশাল কাঠের দরজায় রাজকীয় নকশা আঁকা রয়েছে। দরজার একপাশে বড় করে লিখা আছে ‘ আশ্রয় ‘। কুহু লক্ষ্য করল, তাহমিদ একটু দম নিয়ে কলিংবেলে আঙুল ছোঁয়াল।

এতক্ষণে কুহুর হাতের তালু ঘামতে শুরু করেছে। ওর ভিষণ ভয় হচ্ছে। ভেতরে না জানি ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে।

বেশ খানিকক্ষণ পর খুলে যায় বিশাল দরজার খানিকটা অংশ। ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একজন মাঝ বয়সী নারী। যার মুখের আদল অনেকটাই রাজিয়া খালার সাথে মিলে যাচ্ছে। রাজিয়া খালার মত তার মুখেও মমতার ছাপ দেখতে পাচ্ছে কুহু।

” তাহমিদ, তুমি আসছ আব্বা! আস ভেতরে আস। তুমি আসবে সেটা কিন্তু জানাওনি। ”

তাহমিদ কুহুর হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করল।

ভেতরে পা রাখতেই কুহুর মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল। ও বিশাল ড্রয়িংরুমের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। ডুপ্লেক্স বাড়ির ছাদ থেকে ঝুলে রয়েছে বড়সর ঝাড়বাতি। বাসার ভেতরে পা রাখলেই যেটা সবার নজরে পরবে। ভিষন সাজানো-গোছানো ড্রয়িংরুম। নানান এ্যাক্টিক জিনিসপত্র শোভা পাচ্ছে ড্রয়িংরুম জুড়ে।

” কেমন আছো, ফুপু? আমি ব্যাস্ত ছিলাম। তাই তোমাকে ফোন দিইনি। ”

ভদ্রমহিলার এবার নজর যায় কুহুর দিকে। তাহমিদ মেয়েটার হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে দেখে তিনি একটু ভ্রুকুটি করলেন।

” আমি ভালো আছি, আব্বা। এই মেয়েটিকে তো চিনলামনা। তোমার পরিচিত? ”

” ও তোমার আব্বার বউ। দেখতো পছন্দ হয় কিনা। ফুপু তোমার ভাই কোথায়? তাকে দেখছিনা যে। ”

এবার ভদ্রমহিলা বড়সড় ধাক্কা খেলেন। তিনি চোখ বড় করে তাহমিদের দিকে তাকালেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেননা, তাহমিদ বিয়ে করেছে।

” তুমি সত্যিই বিয়ে করেছ! বাসায় কাউকে না জানিয়েই তুমি বিয়ে করেছ? রাশেদ শুনলে কি হবে বুঝতে পারছ? আব্বা, তুমি না এস্তোনিয়া গিয়েছিলে? সেখান থেকেই বউ নিয়ে এসেছ! ”

” আমি এস্তোনিয়া থেকে পাঁচদিন আগেই ফিরেছি। এই কয়দিন রাজশাহী ছিলাম। আর সেখান থেকেই বউ নিয়ে এসেছি। এবার বল তোমার ভাই কোথায়? ”

” রাশেদ, লাইব্রেরীতে আছে। ওকে ডাকব? ”

” দরকার নেই। তুমি বরং আমার বউকে দেখ। ভালো করে দেখে বল, তোমার আব্বার বউ কেমন হয়েছে। ”

কুহু ভদ্রমহিলাকে সালাম দিলে তিনি কুহুকে জড়িয়ে ধরলেন।

” কে এসেছে, শাহানা আপা? কার সাথে কথা বলছ? ”

হঠাৎই গুরুগম্ভীর আওয়াজ শুনে কুহু চমকে উঠে। ও মাথা নিচু করে রেখেছে। তাই দেখতে পাচ্ছেনা কে কথা বলল।

” তাহমিদ এসেছে, রাশেদ। ওর সাথেই কথা বলছি। ” মৃদুস্বরে বললেন শাহানা আক্তার।

” তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তা তোমার ভাতিজার সাথে কে এসেছে? নতুন বলে মনে হচ্ছে। ”

” এদিকে এস। তোমার বউমাকে দেখে যাও। তার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই। আমার ভাতিজা বড় হয়ে গেছে। সে বিয়ে করেছে। তুমি শ্বশুর হয়ে গেলে। ”

” হোয়াট? সে বিয়ে করেছে! কিন্তু আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি? ওর এতবড় সাহস! ”

এবার কুহুর ভয় হচ্ছে। ও মাথা তুলে তাকায় তাহমিদের দিকে। কিন্তু তাহমিদকে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে যায়।

” আহ, রাশেদ, উত্তেজিত হচ্ছ কেন? নতুন বউ বাড়িতে এসেছে। ওকে প্রথমদিনই ভয় পাইয়ে দিওনা। এদিকে এস। ” শাহানা আক্তার আবারও মৃদু গলায় বললেন। কুহু বুঝতে পারছে তিনিও বোধহয় ভয় পাচ্ছেন।

” শাহানা আপা, আপনার এমন দ্বিচারিতা নীতি বিরক্ত লাগে। আপনি রাশেদকেও হাতে রাখেন আবার ঐ ছেলেকেও হাতে রাখেন। আপনি দুইদিক থেকেই ফায়দা লুটতে চান। ” কোথায় থেকে ডেইজি কুরাইশি এসে ফোঁড়ন কাটল।

ডেইজি কুরাইশির কথা শোনামাত্রই শাহানা আক্তার মাথা নিচু করলেন।

” এই মেয়ে, তোমার বাসা কোথায়? কোথায় থেকে এস এর গলায় ঝুলে পরেছ? যেই দেখছ কুরাইশি বাড়ির ছেলে, তখনই টুপ করে ঝুলে পরেছ? দেখে তো মনে হচ্ছেনা কোন ভালো বাড়ির মেয়ে। ” ডেইজি কুরাইশি কুহুর সামনে এসে নাক সিটকিয়ে বলল।

” আপনি ভুলে যাবেননা, কার সম্পর্কে কথা বলছেন। ও আমার স্ত্রী। আর আমার স্ত্রী’র সম্পর্কে কিছু বলতে হলে অবশ্যই ভেবেচিন্তে বলবেন। এই প্রথমবার এবং শেষবার আপনাকে সাবধান করে দিলাম। ” তাহমিদের গলা শুনে কুহু চমকে যায়। তাহমিদকে এমনভাবে কথা বলতে ও আগে কখনোই শোনেনি।

” হোয়াট ননসেন্স, তুমি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ? তুমি বাসায় যে কাউকে ধরে এনে বউ বলে পরিচয় দেবে, আর আমি মেনে নেব? মনে রেখ এটা আমার বাড়ি। এখানে আমার ইচ্ছাতেই সব হয় এবং হবে। ”

” ওহ্ এতদিন জানতাম এটা রাশেদ কুরাইশির বাড়ি। তাহলে বোধহয় ভুল জানতাম। তো মিষ্টার কুরাইশি, বাড়িটা কি আপনার শ্বশুরের টাকায় বানানো হয়েছে? এখন কি এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে? ”

” তাহমিদ, তুমি চুপ করবে? একেতো হুট করে বিয়ে করে এনেছ, তারওপর এভাবে চোটপাটও করছ! তোমার বাবা এখনও বেঁচে আছে। তাকে না জানিয়ে বিয়ে করে তুমি কি ঠিক করেছ? আর তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনও বা কেমন, তারা পাত্রপক্ষের সাথে কথা না বলেই মেয়েকে বিয়ে দিল! ”

” বিয়ে করব আমি, বউ দরকার আমার, এখানে আপনার কাজ কি? শ্বশুর বাড়ির লোকজন দেখবে জামাই কি করে। জামাইয়ের বাবা কি করে সেটা জেনে তারা কি করবে? ”

এদের কথা শুনে কুহুর মনে হচ্ছে সে যেন অকুল পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাবা, মা, ছেলে কেউই কারও চাইতে কম যায়না, সেকথা ও হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে।

রাশেদ কুরাইশি বুঝলেন, ছেলের সাথে কথা বললেই কথা আরও বাড়বে। তাই তিনি তাহমিদকে কিছুই বললেননা। তিনি এগিয়ে এলেন কুহুর দিকে।

” এই মেয়ে, তোমার বাড়ি কোথায়? ”

” নাটোর। ”

” বাবা কি করে? কয় ভাইবোন তোমরা? ” ধমকে উঠলেন রাশেদ কুরাইশি।

” বাবা হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আমরা একভাই এক বোন। ”

” শিক্ষক ছিলেন! এখন আর শিক্ষকতা করেননা? ” রাশেদ কুরাইশি এবার যেন থমকালেন।

” বাবা বেঁচে নেই। ”

” ওহ্। তোমার ভাই কি করে? আর তোমার মা? সে কি জব করে? ”

” আমার ভাই ক্লাস ফাইভে পড়ে। মা-ও বেঁচে নেই। ”

কুহুর কথা শুনে রাশেদ কুরাইশির মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি কুহুকে কঠিন কিছু কথা শোনাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু ওর বাবা-মা বেঁচে নেই শুনেই তিনি থেমে গেলেন। এই বয়সে মেয়েটা বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়েছে ভেবেই তার বুক ভারি হয়ে আসে।

” তুমি কি পড়াশোনা কিছু জানো? ”

” এবার অনার্সে ভর্তি হয়েছি। ”

” কোন কলেজে? কোন সাবজেক্ট? ”

” রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে। ”

এবার রাশেদ কুরাইশি যেন সন্তুষ্ট হলেন।

” আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই, আমার বউ ভর্তি পরীক্ষায় টপ স্কোর করেছিল। এবং এইচএসসিতেও জেলায় টপার হয়েছিল। আর ওর নাম কুহু। যদি ডাকতে ইচ্ছে করে তবে নাম ধরে ডাকবেন। এই মেয়ে কোন ডাক নয়। ”

” শাহানা আপা, তুমি ওদের নাস্তার ব্যবস্থা কর। তোমার ভাতিজার সাথে কথা বলা মানে নিজের সম্মান নষ্ট করা। আর আমি সেটা করতে চাইনা।”

” ফুপু, আমি খাবার অর্ডার দিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। তুমি কষ্ট করে কিছু করতে যেওনা। ” তাহমিদ কুহুকে নিয়ে ওপরে যেতে যেতে বলল।

” ঢং দেখে গা জ্বা’ লা করে। থাকবে এই বাড়িতেই, কিন্তু এই বাড়ির খাবার গলায় দিতে চায়না। সব লোক দেখানো অভিনয়। ” ডেইজি কুরাইশির কথা শোনামাত্র দাঁড়িয়ে যায় তাহমিদ।

” আমি কি করব আর না করব, সেটা নিশ্চয়ই আপনার কাছ থেকে শুনে করবনা। এই বাড়িতে যতটুকু আপনার অধিকার আছে, তার থেকে বেশি অধিকার আমার আছে। নেহাৎই আমি অধিকার খাটাতে যাইনা। আমি অধিকার খাটালে আপনার চাপার জোর এতটা থাকতনা। এরপর থেকে কিছু বলার আগে দুইবার চিন্তা করবেন। আরেকটা কথা, ফুপু তার ভাইয়ের বাড়িতে থাকে। তার ভাইয়ের খায়। আপনার কিংবা আপনার বাবার খায়না সে। তাই তাকেও কথা বলার সময় হিসেব করে বলবেন। জানেনতো পঁচা শামুকেও পা কাটে? ”

তাহমিদ আর সেখানে দাঁড়ায়না। কুহুকে নিয়ে ওপরে চলে যায়।

চলবে…..

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৩৫+৩৬

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৫
জাওয়াদ জামী জামী

” তাহমিদ, তুমি এসব কি বলছ! কাল এই মেয়েকে তুমি বিয়ে করেছ! এজন্যই আমার বাসার মানুষদের এত রাখঢাক ছিল কালকে! কিন্তু তুমি এটা কিভাবে করতে পারলে? তারা নাহয় এই মেয়েকে তোমার ঘাড়ে গুছিয়ে দিয়েছে। তাই বলে তুমিও ওকে বিয়ে করে নিলে! তোমার রুচি এতটা জঘন্য হতে পারেনা। আমাদের লুকিয়ে তুমি এভাবে বিয়ে করতে পারোনা। তোমার বাবা-মা’কে না জানিয়ে তুমি এই থার্ড ক্লাস মেয়েকে বিয়ে করলে? ”

নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে রুমে উপস্থিত সকলে সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। কুহু মাথা নিচু করল তার কথা শুনে। ওর দুচোখে মুহূর্তেই শ্রাবনের মেঘ জমে।

রায়হান আহমেদ তার স্ত্রী’র দিকে আ’গু’ন চোখে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু নায়লা আঞ্জুম তার অগ্নি দৃষ্টিকে পরোয়া করলে তো।

” আমি নিজের রুচি নিয়ে কখনোই চিন্তিত নই। আমি চিন্তিত রায়হান আহমেদের রুচি নিয়ে। তার রুচি যদি নিচু পর্যায়ের নাই-ই হবে, তবে তোমাকে বিয়ে করতে পারতনা। আর রইল আমার বাবা-মা ‘ কে না জানানোর বিষয়। সেক্ষেত্রে তুমি আগে থেকেই অবগত আছ, আমি মিথিলা আরজুমান্দকে মা বলে স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করি। এবং রাশেদ কুরাইশি আমার শুধু নামমাত্র বাবা। তাই তাদের জানানোর প্রয়োজনবোধ করিনি। ”

” তাহমিদ, তুমি বেয়াদবির সীমা অতিক্রম করছ বলে দিলাম। কার সাথে কার তুলনা করছ তুমি? এই সামান্য মেয়ের সাথে আমার তুলনা করছ! একটা ফকিন্নি ঘরের মেয়ের জন্য নিজের খালামনির সাথে দুর্বব্যহার করছ? তোমার বউ হবার কোন যোগ্যতা আছে এর? কোথায় তোমার বাবার স্ট্যাটাস আর কোথায় এই ফকিন্নির মেয়ের স্ট্যাটাস! সে নাহয় বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াতেই পারে। তাই বলে তুমিও বামনকে কাছে টেনে নিবে! ”

নায়লা আঞ্জুমের কথা শেষ হওয়া মাত্রই রায়হান আহমেদ তার কাছে এসে সপাটে চড় বসালেন তার স্ত্রী’ র গালে। পরপর তিনি কয়েকটা থাপ্পড় মে’রে’ই তবে ক্ষান্ত দিলেন।

” তোমার সাহস তো কম নয়, তুমি আমার পরিবারকে আবার নিচু করছ? তোমার কথামত কুহু যদি ফকিন্নি ঘরের মেয়ে হয়, তবে আমিও সেই ঘরেই ছেলে। আমি সেই ঘরের ছেলে হয়ে যদি তোমাকে বিয়ে করতে পারি, তবে কুহুও পারে কোন ভালো ঘরে সংসার পাততে। কান খুলে শুনে রাখ আমি বা আমরা নিজেদের যোগ্যতায় এতদূর এসেছি। কারও দয়া আমাদের প্রয়োজন পরেনি। আমার আব্বা একজন শিক্ষক ছিলেন। আমার আম্মাও তোমার মা’য়ের থেকে কোন অংশে কম ছিলেননা। গরীব আমরা কোনকালেই ছিলামনা। তুমি ভালো করে ভেবে দেখতো, তোমার কি কুহুর সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা আছে? কিংবা আমার স্ত্রী হওয়ার কোনও যোগ্যতা তোমার আদৌ আছে? যেখানে আমার কলিগদের স্ত্রী একেকজন ডক্টর, প্রফেসর কিংবা ব্যাংকার। সেখানে তুমি আ বিগ জিরো। সারাজীবন বাপের অর্থ সম্পদের বড়াই করে গেছ। একবারও ভাবোনি বিয়ের পর মেয়েদের বাপের বাড়ি ফুটানি দেখালে চলেনা। কতদিন আর বড়াই করবে? এবার নিজের অবস্থান কি সেটা ভাব। ” রায়হান আহমেদের কথা শুনে রে’গে উঠল নায়লা আঞ্জুম।

” তুমি আবার আমার গায়ে হাত তুললে? তোমার সাহস দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। তোমার মত ছোট ঘরের মানুষদের ম্যানার্স জানা হয়ে গেছে আমার। কোন সাহসে তুমি আমাকে থাপ্পড় মারলে? আজ এর একটা বিহিত আমি করেই ছাড়ব। নিজে যেমন ছোট ঘর থেকে উঠে এসে জাতে উঠেছ, তেমনি ভাইয়ের এই কুশ্রী মেয়েকেও জাতে তুলতে চাইছ? তা আমি কখনোই হতে দেবনা। তোমাদের দু’জনকেই আমি জেলের ভাত খাওয়াব। চাকরির বড়াই দেখাও? নারী নির্যাতনের কেইস দিয়ে প্রথমে আমি তোমার চাকরি খাব। তখন দেখব কেমন করে বড়াই কর। এরপর ধরব এই মেয়েকে। ওর নামে ফ্রড কেইস করব। তোমাদেরকে আমি দেখে নিব। আমার বাবার বাড়িতে এসে আমাকেই অপমান করছ? ”

” কাকে ভয় দেখাচ্ছ তুমি? তুমি কেইস করবে আর আমি বসে থাকব? তোমার এতক্ষণের সব কথা আমি রেকর্ড করে রেখেছি। খুব তো উঁচু জাতের বড়াই দেখাও। তোমাকে এবার টেনে নিচে নামানোর সময় এসেছে। তোমাকে দেখিয়ে দেব কে কোন জাতে বিলং করেছে। তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে। আমার বাড়িতে তোমার কোন ঠাঁই নেই। অবশ্য তোমার সকল জিনিসপত্র নেয়ার জন্য শুধু ঐ বাসায় যেতে পারবে। কালই আমি ডিভোর্সের জন্য আবেদন করব। এবং সেই সাথে আমার ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে রাখার সব ব্যবস্থাই আমি করব। আমি দেখব, তুমি তোমার বাবার বাড়িতে কতদিন থাকতে পার। ” রায়হান আহমেদের রা’গে’র পারদ তরতর করে বাড়ছে।

” কি বললে! তুমি আমাকে ডিভোর্স দেবে? তবে শুনে রাখ, আমিও তোমার সংসার করতে চাইনা। আমি এই বাড়িতেই থাকব। এবং রিশা, নিশো আমার কাছেই থাকবে। রিশা, নিশো তোমরা আমার কাছে থাকবেতো? ”

নায়লা আঞ্জুম খেঁকিয়ে উঠে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে রায়হান আহমেদের সাথে। একসময় সে তার ছেলেমেয়ের কাছে জানতে চায় তারা কার সাথে থাকবে।

” সরি আম্মু, আমি বাবার সাথে থাকতে চাই। তোমার মত মা আমার প্রয়োজন নেই। যে মা’য়ের কাছে তার ইগো বড়, যে স্বামী, স্বামীর পরিবারকে আপন করতে পারেনা, সেই মা’কে আমার চাইনা। আর তুমি যে বারবার আমার দাদুর বংশকে ছোট বলছ, তোমাকে ঘৃণা করার জন্য এই একটা কারনই যথেষ্ট। জেনে রাখ, আমার বাবা যদি ছোট জাতের হয়, তবে আমি আর নিশো ও ছোট জাতেরই। কারন আমরাও বাবার সন্তান। ঐ বংশের র’ক্ত বইছে আমাদের শরীরে। বাবার ডি এন এ বহন করছি আমরা। তাই আমার মনে হয় এমন ছোট জাতের ডি এন এ নিয়ে তোমার মত উঁচু বংশের কারও সাথে না বাস করাই আমার জন্য মঙ্গল। কখন যে তুমিই আমাদের ছোট জাত বলে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেবে এই ভয়ই হয় সব সময়। বড় হওয়ার পর থেকেই তোমার মুখে এসব কথা শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে গেছে। এসব আর শুনতে চাইনা আমি। কুহুপু এই বাসায় আসার পর থেকেই তুমি তার সাথে দূর্বব্যহার করেছ। আপু কখনোই প্রতিবাদ করেনি। বাবাকে পর্যন্ত জানায়নি। আমিও নীরবে সব দেখে গেছি। ভেবেছি তুমি এক সময় মানিয়ে নিবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তুমি শোধরাবার মানুষ নও। নিশো যদি তোমার সাথে থাকতে চায় থাকবে। আমি তোমার সাথে থাকছিনা, এটাই ফাইনাল। ” রিশা ঘৃণাভরে বলল।

রিশার কথা শুনে এবার নায়লা আঞ্জুম থমকায়। সে কল্পনাই করতে পারেনি রিশা তাকে এতটা ঘৃণা করে।

” আমিও তোমার সাথে থাকবনা, আম্মু। তোমার এমন অহংকারী ভাব আমার ভালো লাগেনা। তুমি আমাদের গ্রামে যেতে দিতে চাওনা। কুহুপু, সৃজনের সাথে মিশতে দিতে চাওনা। এটা আমার ভালো লাগেনা। তাহমিদ ভাইয়া কুহুপুকে বিয়ে করলে তোমার সমস্যা কোথায়? তুমি কি ভাইয়াকে খাওয়াচ্ছ, পড়াচ্ছ? এছাড়া বারবার তুমি কুহুপুকে ফকিন্নির মেয়ে বল। আপু কি ফকিন্নির মেয়ে? আমার দাদুর অনেক সম্পত্তি আছে। বড় চাচ্চু অসুস্থতার জন্য তারা সব বিক্রি করেছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তারা গরীব নয়। আর আমার সাইদ চাচ্চুও গরীব নয়। তোমার এসব কথা শুনতে বিরক্ত লাগে। তুমি বাবার নামে কেইস করলে, আমি তোমার বিপক্ষে সাক্ষী দেব। তোমার বলা সব কথাই আদালতে বলব। ” এবার নিশো ও রিশার কথার সাথে সায় দেয়।

ছেলের মুখে এমন কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম স্তম্ভিত। সে ভাবতেই পারেনি তার ছেলেমেয়েরা তারই বিপক্ষে যাবে। তার মুখে কোন কথা জোগায়না। নির্বাক চেয়ে থাকল ছেলেমেয়ের মুখের দিকে।

কুহু রিশা, নিশোর কথা শুনে অবাক হয়ে গেছে। ওরা যে কুহুর জন্য ভাবে, সেটা ও চিন্তাই করতে পারেনি।

সৈকত আহমেদ এবং তার স্ত্রী ‘ও সব চুপচাপ শুনল।

তাহমিদ এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনছিল। এবার তার মুখ না খুললেই নয়। ও একটু হেসে এগিয়ে যায় নায়লা আঞ্জুমের দিকে।

” দেখলে, একটা ফকিন্নি ঘরের মেয়ের জন্য তোমার ছেলেমেয়েরাও তোমার বিপক্ষে কথা বলছে? কারন কি জানো? কারন, ওদের মধ্যে একতা আছে। একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা আছে। আর ওরাই সত্যিকারের মানুষ। আজ তোমার নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হচ্ছেনা? কেউ নেই তোমার পাশে। যে ছোট ভাইকে তার বউসহ এই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলে, এবার তাদেরই দয়ায় এই বাড়িতেই তাদের আশ্রিতা হয়ে থাকতে তোমাকে। এই বাড়ি অনেক আগেই নানাভাই তার ছেলের নামে দিয়েছিলেন। এখন যদি তোমার ভাই তোমাকে এখানে থাকতে না দেয়, তবে তুমি কোথায় যাবে? তাই আমি বলি কি, এমন জীবন গড়ে তোল, যেখানে সংসারে তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার জন্য চোখের পানি ফেলার মানুষের অভাব থাকবেনা। ”

নায়লা আঞ্জুম জানতনা এই বাড়ি তার বাবা নিজের ছেলেকে দিয়ে গেছেন। তাহমিদের মুখে শোনার পর সে চিৎকার করে উঠল।

” মিথ্যা বলছ তুমি। এই বাড়ি আমার। আমি আব্বাকে সব সময়ই বলতাম এই বাড়ি আমাকে লিখে দিতে। আব্বাও আমাকেই দিতে চেয়েছিল। এখন তুমি আমাকে কোনঠাসা করতে এমন চাল চালছ। আমি সব বুঝি। ”

” তোমাকে কোনঠাসা করে আমার কোনই লাভ নেই। নানাভাই যে তার ছেলেকে এই বাড়ি দিয়ে গেছেন, সেটা আর কেউ না জানুক, নানিমা জানে। তার ইচ্ছানুযায়ী নানাভাই মামাকে এই বাড়ি দিয়েছেন। তোমাদের তিন বোনের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমানে টাকা তিনি রেখেছেন। তার সব পেপার নানিমার কাছে গচ্ছিত আছে। ”

তাহমিদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম তার মায়ের কাছে ছুটে যায়।

” আম্মা, সত্যিই কি আব্বা সৈকতকে এই বাড়ি দিয়েছে? তুমি আজ মিথ্যা বলোনা। আব্বা আমাকে এভাবে ঠকালো কেন? আর তুমিই বা আমার সাথে বেইমানী কররে কেন? কি করিনি আমি তোমার জন্য? এতদিন আমি তোমার সেবা করেছি এই জন্য! ” নায়লা আঞ্জুম তার মা’কে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করছে। তার মাথায় এই কথা নেই যে, তার মা অসুস্থ। তার এমনভাবে ঝাঁকুনিতে বৃদ্ধার কষ্ট হতে পারে।

মেয়ের এমন কাজে অসুস্থ মা’য়ের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। তিনি কল্পনা করতে পারেননি, তার মেয়ে এতটা নিচ, এতটা লোভী। তিনি ভালো করেই জানতেন, তার মেয়ে এখানে থাকত শুধু নিজের স্বার্থে। আজ সেটা তার মেয়ে আজ প্রমান করে দিল। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

” ভুল বললে, খালামনি। তুমি নানিমার বিন্দুমাত্র সেবা করোনি। তাকে দেখার জন্য দুইজন নার্স থাকে সর্বদাই। সার্ভেন্ট থাকে, রাজিয়া খালা থাকে। তুমি নানিমার জন্য কিছুই করোনি। সে এখনও তার স্বামীর টাকায় খেয়েপড়ে বেঁচে আছে। ”

” তুমি চুপ কর বেইমান ছেলে। তুমিই আমার আব্বা-আম্মার মাথা খেয়েছ। তোমার জন্য আজ আমার এই অবস্থা। তুমিই আবার সৈকতকে ফিরিয়ে এনেছ। তুমি সব ইচ্ছে করে করেছ। তুমি চাওনি আমি এখানে থাকি। ”

এবার তাহমিদ সত্যি অবাক হয়ে গেছে। ওকে এভাবে দোষারোপ করতে দেখে একটু হাসিও পায়।

” তুমি মেয়ে হয়ে কখনো মা’য়ের মন বোঝার চেষ্টা করেছ? তোমার মা তার ছেলের জন্য দিনরাত তড়পাচ্ছিল, সেটা কি কখনো তোমার চোখে পরেছে? একটা ছেলে বছরের পর বছর, তার পরিবার বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকছে। এটা যে কত কষ্টের তা কি তুমি বোঝ? আমি শুধু নানিমার মুখের হাসি দেখতে, মামাকে তার পরিবার ফিরিয়ে দিতে এখানে এনেছি। ”

তাহমিদ কথা বলতে বলতে আলমারি খুলে একটা ফাইল বের করল। সে ফাইলটা সৈকত আহমেদের কাছে দেয়।

” মামা, তোমাদের প্রপার্টির পেপারস এখানে আছে। তুমি চলে যাওয়ার পর এটার কথা আমি জানতে পারি। তুমি না থাকায় কারও কাছেই এটা দেইনি। এবার তোমার প্রপার্টি তুমি বুঝে নাও, আর বোনদেরকেও বুঝিয়ে দাও। ”

সৈকত আহমেদ হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নেয়।

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৬
জাওয়াদ জামী জামী

” আপনি কি সত্যিই খালামনিকে ডিভোর্স দেবেন! বিষয়টা আরেকবার চিন্তা করে দেখলে হতোনা। আরেকটা সুযোগ তাকে দিতে পারেননা? লাস্ট একটা সুযোগ। ” তাহমিদ অনুনয় করে বলল রায়হান আহমেদকে।

ওরা দু’জন বাগানের এক কোনায় বসে কথা বলছে। নায়লা আঞ্জুমের সাথে কথা কাটাকাটির পর রায়হান আহমেদ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে সৈকত ও তার স্ত্রী স্মৃতি তাকে জোড় করে আটকে রেখেছে।

” তুমি কি আমাকে এতটাই বোকা আর নির্দয় মনে কর, তাহমিদ! আর যাইহোক নিজের সংসার নিজের হাতে নষ্ট করার মত মানুষ আমি নই। আমি শুধু নায়লাকে একটু শিক্ষা দিতে চাই। ওকে সংসারের মায়া বুঝতে হবে, দ্বায়িত্ব পালন করতে শিখতে হবে। এতদিন যা যা ভুল করেছি সেসব শুধরে নিতে চাই। আর সেই সাথে নায়লাকেও তার ভুলগুলো উপলব্ধি করাতে চাই। নায়লাকে তার ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাই। আমার সন্তানদের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে চাই। ”

রায়হান আহমেদের কথা শুনে তাহমিদ মৃদু হাসল। ওর পাশে বসে থাকা মানুষটা যে নিজের পরিবারের প্রতি সদয়, সেটা আরেকবার উপলব্ধি করল।

” আপনি আজ খালামনিকে নিজের সাথে নিয়ে যাবেননা। তাকে এখানেই রেখে যান। আর এই বিষয়ে মামা কিংবা মামীকে কিছুই বলার দরকার নেই। তাদেরকে আগে কিছু বললে, খালামনির আপ্যায়ন ঠিকঠাক হবেনা। তাকে আগে কিছুদিন বাবার বাড়িতে রাজকীয়ভাবে কাটাতে দিন। ”

” তুমি ঠিকই বলেছ। সৈকত যদি জানে, আমি নায়লাকে শিক্ষা দিতে এখানে রেখে যাচ্ছি, তবে তারা হয়তো নায়লার প্রতি নমনীয় হবে। কিন্তু আমি এটা হতে দেবনা। এমনকি এই কথাটা রিশা , নিশোকেও জানানো যাবেনা। এসব কথা এখন থাক। এক কাজ কর, আগামীকাল তুমি কুহু, আপা, সৃজনকে নিয়ে আমার বাসায় চলে এস। কাল সারাদিন তোমরা সেখানে আনন্দ কর। ”

” মেয়ে আর জামাইকে কেউ এভাবে দাওয়াত দেয়, সেটাতো জানতামনা! কোথায় বংশের একমাত্র জামাইকে ইনিয়েবিনিয়ে দাওয়াত করবেন। কিন্তু সেটা না করে মুখে নিমপাতা ঢেলে কথা বলছেন। এটাই বুঝি চাচা শ্বশুরের আসল রূপ! ”

তাহমিদের এমন অভিযোগ শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন রায়হান আহমেদ। তবে তাহমিদ যে তার সাথে মজা করেছে, এটা তিনি বুঝতে পারছেন।

” ভুল হয়ে গেছে, জামাইবাবা। তুমি আগামীকাল সকালে তোমার স্ত্রী, শালাবাবু আর ফুপু শ্বাশুড়িকে নিয়ে আমার বাসায় চলে এস। সারাদিন সেখানে খাওয়াদাওয়া কর, আনন্দ উল্লাস কর। তোমার পছন্দের খাবার রান্না করতে বলব আমার বড় বোনকে। তুমি কবজি ডুবিয়ে খেও। ” রায়হান আহমেদও ঠাট্টার ছলে বললেন।

” সাব্বাশ। এই না হলে শ্বশুর মশাই। তবে একটু বেশি করে বাজার করবেন। জামাইতো আর আপনার বাসায় খালি হাতে যাবেনা। ফল-মিষ্টি, ঠান্ডা, গরম কত কিছুই নিতে হবে। জামাই অনেক কিছু নিয়ে যাবে, কিন্তু শ্বশুর বাজার কম করল। বিষয়টা একটু দৃষ্টিকটু। ”

” জামাইকে আর কষ্ট করে ফল মিষ্টি নিতে হবেনা। শুধু তারা গেলেই চলবে। প্রয়োজনে আমি জামাইকে সাথে করে বাজারে নিয়ে গিয়ে, তার পছন্দমত বাজার করব। ভালো হবেনা? ”

” আমরা যে এত প্ল্যান করছি, আপনার স্ত্রী জানলে কি হবে বলুনতো? ভদ্রমহিলা শোকে যদি স্ট্রোক করে বসে! ” ভাবুক চেহারায় জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” তার কলিজা নরমাল মানুষের মত নয়। তার কৈ মাছের কলিজা। সহজে কিছু হবেনা। আমাদের তো কলিজা নয় যেন চায়না প্রোডাক্ট। ওয়ারেন্টি, গ্যারান্টি কিছুই নেই। সেক্ষেত্রে আমার বউয়ের কলিজায় দম আছে। আজ সতের বছর ধরে সংসার করছি, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়নি তার কলিজায় কোনও আঁচড় পরেছে। তাই তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। ভালো কথা মনে হয়েছে, তুমি কি তোমার বাবাকে বিয়ের কথা জানিয়েছ? ”

” নাহ্, এখোনো জানাইনি। ভাবছি কুহুকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েই তাকে সারপ্রাইজ দেব। আগেই তার ব্লাড প্রেশার বাড়াতে চাইনা। আমি সামনাসামনি দেখতে চাই, আমার বউ দেখে তার অবস্থা কেমন হয়। ”

” আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছে। সে যদি কুহুকে মেনে না নেয়? মেয়েটা জীবনে কম কষ্ট পায়নি। আমি আর ওকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবনা। ”

” কুহু আমার স্ত্রী। আর স্ত্রী’কে সকল দুঃখ-কষ্ট, অপমান, অসম্মানের হাত থেকে হেফাজত করার দ্বায়িত্ব তার স্বামীকেই পালন করতে হয়। এই বিষয়ে আশা করছি আমি আপনাকে নিরাশ করবনা। ”

” আমি জানি তুমি যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। তোমার ওপর এই বিশ্বাস আমার আছে। তাই একবাক্যে কুহুকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। আমি জানি তুমিই ওর উপযুক্ত। তো ঢাকা ফিরছ কবে? ”

” আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। কুহুর কোন অমর্যাদা হতে আমি দেবনা। তিনদিন পর কুহুকে নিয়ে ঢাকা যাব। ওকে ওর শ্বশুর বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে আসব। ”

দুপুর বেলা সবাই মিলে খেতে বসলে নায়লা আঞ্জুমকে ডাকতে যান রাজিয়া খালা। নায়লা আঞ্জুম তার পূর্বের রুমেই ছিল। রাজিয়া খালাকে দেখামাত্রই সে খেঁকিয়ে উঠল। সে সাফ জানিয়ে দেয়, কারও সাথে সে খাবেনা। রাজিয়া খালা সেকথা বাহিরে এসে জানালে নায়লা আঞ্জুমকে ছাড়াই সবাই খেয়ে নেয়।

রিশা, নিশো সকালের পর মায়ের কাছে ঘেঁষেনি। এখন আবার রাজিয়া খালার কাছে সব শুনে ওদের ভিষণ রা’গ হয়। রিশা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, ও আর মা’য়ের আশেপাশে যাবেনা।

সন্ধ্যার পরে সবাই বিদায় নেয়। তাহমিদ কুহুকে নিয়ে চলে যায়। আর রায়হান আহমেদ তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে চলে যান নিজের বাসায়। তিনি যাবার আগে তাহমিদকে আগামীকাল তার বাসায় যাওয়ার কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি এ-ও বললেন, তাহমিদ যেন বাসায় পৌঁছেই সোহানী পারভিন আর সৃজনকে তার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। তিনি সোহানী পারভিনের সাথে আগেই কথা বলেছেন। আগামীকাল তার বাসায় সোহানী পারভিন না থাকলে চলবেনা। তাহমিদ তার কথায় রাজি হয়।

বাসায় এসে তাহমিদ নিজে সোহানী পারভিন আর সৃজনকে রায়হান আহমেদের বাসায় পৌঁছে দেয়। সোহানী পারভিন তাহমিদকে খুব পছন্দ করেছেন। তিনি মন থেকে ওকে দোয়া করলেন।

কুহু বাসায় এসে দেখল ফুপু রাতের খাবার রান্না করেই রেখেছেন। ওকে আর কষ্ট করে রান্না করতে হলোনা।

নায়লা আঞ্জুম সেইযে সকালে রুমে ঢুকেছে, সারাদিন বের হয়নি। রাতে সবার খাওয়া শেষ হলেই তবে সে রুম থেকে বের হয়। রাজিয়া খালা তার জন্য খাবার টেবিলেই রেখেছেন। সে রুম থেকে বেরিয়ে খাবার খেয়ে আবার রুমে চলে যায়। দুপুরে স্মৃতি তাকে খাওয়ার জন্য রাজিয়া খালাকে ডাকতে পাঠালেও, রাতে তাকে কেউ-ই ডাকতে যায়নি। এই বিষয় নিয়েও নায়লা আঞ্জুম রে’গে আছে। এত বছরেও তার সাথে যা ঘটেনি, আজ তা-ই ঘটেছে। এ কথা যখনই তার মনে হচ্ছে, ততবারই সে সৈকত, স্মৃতি আর কুহুকে অভিশাপ দিচ্ছে। সেই সাথে তাহমিদকেও লাগাতার গালিগালাজ করেই যাচ্ছে। সে সব কিছুর জন্য তাহমিদকে একতরফা দায়ী করছে।

কুহু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়চোপড় আর জুয়েলারির দিকে। তাহমিদ সোহানী পারভিনকে রেখে আসার পথে কুহুর জন্য শাড়ি, থ্রিপিস, জুয়েলারি কিনে এনেছে।

” এসব কি করেছেন! গতকালই না কত শপিং করেছেন। আবার আজকে কেন? ”

” আমার একটা বউয়ের জন্য সামান্য কিছুই এনেছি। এতে তোমার এত কথা কেন? বিয়ের দুইদিন পূর্তি উপলক্ষ্যে সামান্য কেনাকাটা করেছি। দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটামাত্র বউ আমার। তার এতটুকু তো করতেই পারি। ”

” আজকে দুইদিন, তাহলে কালকে তো তিনদিন হবে। তিনদিন পূর্তি উপলক্ষ্যেও কি তবে কেনাকাটা করবেন? এরপর চারদিন, পাঁচদিন, এভাবে একমাস, পাঁচমাস, দশমাস। এভাবে চলতেই থাকবে? আর মানুষের বউ কয়টা হয় শুনি? ”

” ভালো আইডিয়া দিলে তো। আমার কাছে প্রতিদিনই স্পেশাল। তাই প্রতিদিনই এমন শপিং চলতেই থাকবে। যদিও আমাদের প্রতিবেশি আংকেলের তিনটা বউ। তবে সে কিন্তু তিন বউকেই সমান প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমার আপাতত একটা। তাই একটার জন্যই যথাসাধ্য করার চেষ্টা করছি, করব। ”

” আপাতত একটা মানে? আপনার কি আরও কয়েকটা বিয়ে করার ইচ্ছে আছে! ” কুহু সবিস্ময়ে জানতে চাইল।

” আপাতত সেরকম কোন ইচ্ছেই নেই। ইন ফিউচার বউ যদি কম কম ভালোবাসে তবে করতেই পারি। আমার মনে হয় কপালে আরেকটা বউয়ের আদর আছে। এই বউটা আমাকে একদমই ভালোবাসেনা। ” তাহমিদ ভয়ে ভয়ে বলল।

” কিহ্! আপনি আবার বিয়ে করবেন? আমি আপনাকে ভালোবাসিনা! ” কুহুর গলা ভয়ে কাঁপছে।

” এখন করব সেটা বলিনি তো। বলেছি ভবিষ্যৎ করতেও পারি। তোমাকে রাতে কতবার করে বললাম, একটা চুমু দাও। তুমি কি আমার কথা শুনেছ? আবার এখন বাহিরে এসে তোমাকে চুমু দিলাম, বিনিময়ে তুমি কি আমাকে কিছু দিয়েছ? আমারও তো আদর পেতে ইচ্ছে করে। এখন আমার সেই প্রাপ্য আদর যদি তুমি না দাও, তবে আমাকে বাধ্য হয়েই আরেকবার শুভ কাজ করতে হবে। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু কিছু বলার ভাষা হারিয়েছে। ওর বরটা যে একটা বেশরম সেটা বুঝতে ওর বাকি নেই। তাই ও তাহমিদের কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কাপড়চোপড় গোছাতে শুরু করল।

এদিকে তাহমিদ কুহুকে নিরুত্তর থাকতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসল। হঠাৎই ও এক ঝটকায় কুহুর হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল। পরক্ষণেই কুহুকে নিজের কাছে টেনে ওর অধরে অধর মিশিয়ে দেয়। অনেকক্ষণ পর তাহমিদের আক্রমন থেকে মুক্তি পেয়ে কুহু হাঁপাতে থাকে। কিন্তু তাহমিদ এখনও ওকে জাপ্টে ধরে রেখেছে। কুহু ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করলেও তাহমিদের মনে একটুও দয়া হয়না। বরং ও আরও শক্ত করে ধরে কুহুকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। ঘোর লাগা গলায় বলে,

” আমার বউ পাখিটা বুঝি রা ‘ গ করেছে? রাগলে তাকে ব্যাপক এ্যাট্রাকটিভ লাগে, সেটা কি সে জানে? মনে হয়, আস্ত একটা রসগোল্লা আমার সামনে এসে বলছে ‘ ভক্ষণ কর ‘। আমি আবার ভিষণ দয়ালু। তার এমন নিরব আবদার ফেলতে কষ্ট হয়। তাইতো সময়ে-অসময়ে তাকে রা’ গি ‘য়ে দিয়ে রসগোল্লা ভক্ষণের পায়তারা করি। ”

তাহমিদের এহেন নির্লজ্জ বাক্যে কুহু লজ্জায় মাথা নিচু করে। লজ্জায় আরক্তিম মুখে সে তাহমিদ আচমকা অত্যাচারের হাত থেকে নিস্তার পেতে চাইল। কিন্তু ওর যে নিস্তার নেই, তা বোধহয় এখনও বুঝতে পারেনি। ও এখন সম্পূর্ণরূপে তাহমিদের অধীনে। মোচড়ামুচড়ি করেও লাভ হলোনা। তাহমিদ ওকে জড়িয়ে নিল মধুমাখা ভালোবাসার চাদরে। যে ভালোবাসায় কোন খাঁদ নেই। যে ভালোবাসা পেলে কোন নারী কখনো ছেড়ে যাবেনা। একান্ত পুরুষের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকে হাজারও রমনী। কুহুও না চাইতেই আরেকবার পেতে চলেছে সেই ভালোবাসা।

চলেছে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৩৩+৩৪

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৩
জাওয়াদ জামী জামী

এই সকালে তাহমিদকে দেখে রায়হান আহমেদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। তিনি এত সকালে তাহমিদকে আশা করেননি। তাহমিদ সকাল ছয়টায় যখন তাকে ফোন দিয়ে বাসার সামনের কফিশপে ডেকেছে, তখনই তিনি চরমমাত্রায় বিস্মিত হয়েছেন। এত সকালে কফিশপ খোলা নেই তাই তারা কফিশপের পাশের চায়ের দোকানে বসেছে।

” তাহমিদ, তুমি এস্তোনিয়া থেকে কবে এসেছ! গত কয়েকদিন তোমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছি। কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ পেয়েছি। এই সকালে হঠাৎ করে আমাকে ডাকলে যে! কোন সমস্যা? ”

” অনেক সমস্যা। তো এই অধমকে মনে করার কারন কি! অধমকে তো আর আপনাদের কোনও কাজে লাগবেনা। এই অধম শুধু নামেই মানুষ। ”

” এভাবে বারবার নিজেকে অধম বলছ কেন! তুমি হলে গিয়ে খাঁটি সোনা। ”

” খাঁটি সোনা হলে, আপনার চোখ কানাডা প্রবাসীর দিকে পড়তনা। খাঁটি সোনাকেই আপন করে নিতে চাইতেন। আপনারা মনে করেন, পাত্র প্রবাসী হলেই সে যোগ্য, ভালো, সৎ ব্লা ব্লা। তাদের দশটা গার্লফ্রেন্ড থাকলেও তারা ভালো। এদিকে আমার মত হতভাগারা সারাজীবন গার্লফ্রেন্ডহীনতায় কাটিয়েও আপনাদের মন পাইনা। তাই চোখের সামনে উপযুক্ত ছেলেকে আপনাদের নজরে পরেনা। আপনারা মেয়েদের জন্য যদি প্রবাসী ছেলেই খুঁজবেন, তবে দেশের বাবা-মা’ দের জানিয়ে দিতেন তাদের ছেলেদের কষ্ট করে পড়াশোনা না করাতে। তাহলে আমার মত বেচারা ছেলেগুলো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত। তাদের সময়ে-অসময়ে এভাবে ছুটে আসতে হতোনা। নির্বিঘ্নে বিদেশে বসে নিজের কাজ করতে পারত। ”

তাহমিদের কথা শুনে রায়হান আহমেদ হা হয়ে গেছেন। সহসাই তার মুখে কোনও কথা জোগায়না। তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন তাহমিদের কথার মর্মার্থ। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি ধাতস্থ হয়ে মুখ খুললেন।

” তুমি কি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছ নাকি আমাকে থ্রেইড দিছ? ”

” যেটা মনে করবেন সেটাই। থ্রেইড যদি মনে করেন, তবে শুনে রাখুন, আমি আপনার ভাইয়ের মেয়েকে তুলে নিয়ে বিয়ে করব, যদি আপনারা রাজি না থাকেন। আর যদি প্রস্তাব মনে করেন, তবে আমি আপনার সেই মেয়েটিকে রানী করে নিজের ঘরে নিয়ে যাব আপনাদের সম্মতিতে। আমার প্রস্তাব আমি দিয়েছি এবং দুই ভাবেই দিয়েছি। এখন কোনভাবে আপনি রাজি হবেন সেটা আপনার ব্যাপার। ”

” এইভাবে কেউ কখনো বিয়ের প্রস্তাব দেয়, সেটা আমি বাপের জন্মেও দেখিনি! ”

” কি করব বলুন, আপনার মত একজন অভিজ্ঞ মানুষ যদি ঐ বাচ্চা মেয়েটার মনের কথা বুঝতে না পারেন, তবে আমাকে এমন উপায়ই অবলম্বন করতে হবে। বাপের জন্মে এমন প্রস্তাব দেখেননিতো কি হয়েছে! নিজের জন্মে দেখেন। যেকোন একজন্মে দেখলেই হল। দুই জন্মেরই শেষ ফলাফল একটাই ‘ বিয়ে ‘। ”

” তবে আর দেরি কেন? সব যখন ঠিক করেই ফেলেছ, তবে ডেইটও তুমিই ঠিক কর। ” রায়হান আহমেদ হেসে বললেন।

” আমি কি আপনার কথা সত্যি বলে ধরে নিব? সেই প্রবাসীর পরিবারকে কি বলবেনে? ”

” চোখের সামনে এমন যোগ্য প্রার্থী রেখে আমি দূর দেশে মেয়েকে পাঠাতে যাব কোন দুঃখে! যাকে অনেক বছর যাবৎ চিনে এসেছি, যার সাথে সুখ-দুঃখের গল্প করেছি। যে আমার ভাতিজীর জন্য এমন ঝুঁকি নিতে পারে, তাকে না করি কিভাবে! আর রইল আশিকের পরিবার। তাদেরকে আমি এক্ষুনি না করে দেব। কুহুর সুখের জন্য আমি সব করতে পারি। ”

” ওকে, তবে আপনার ভাইবোনকে ডেকে নিয়ে আসুন। আমার বউ তার চাচা-ফুপুর দোয়া নিয়েই নতুন জীবন শুরু করবে। চারঘন্টা সময় দিলাম আপনাকে। চারঘণ্টা পর আমার শ্বশুর জন্য হবার প্রস্তুত হোন। ”

মায়ার ফোন পেয়ে কুহু একটু অবাকই হয়েছে। সকাল সাড়ে সাতটায় মায়া ওকে কেন ফোন দিয়েছে! আর সেই মানুষটাই বা কোথায় হাওয়া হয়েছে! সে সেই যে বেরিয়ে গেল, এতক্ষণ হয়ে গেছে তবু তার দেখা নেই! কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়েই কুহু ফোন রিসিভ করলে মায়া ওকে জানালো, সে গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তার কথা শুনে কুহু গেইটে গিয়ে দারোয়ান চাচাকে গেইট খুলে দিতে বলল। মায়া হাসিমুখে ভেতরে এসে কুহুকে জড়িয়ে ধরল।

দুই ঘন্টা পর কুহু বসে বসে মায়ার কাজ দেখছে। সে কুহুকে জোড় করিয়ে গোসল করিয়ে নিয়েছে। এরপর ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেছে।

আর কিছুক্ষণ পর যখন রিশা, নিশো আসল তখন কুহু শুধু ভাবছে ওরা এখন কেন এসেছে?

সজলকে সাথে নিয়ে তাহমিদ যখন বাসায় আসল, তখন ওর হাতে একটা ন্যাপসাক। সজল কুহুকে দেখে মিটিমিটি হাসছে।

রাজিয়া খালাকে দেখে কুহু তাকে জড়িয়ে ধরল।এই মানুষটার জন্য আজ ও তাহমিদকে ফিরে পেয়েছে। খালার সাথে সৈকত আহমেদ তার স্ত্রী-সন্তানদের এসেছে। এত বছর পর নিজের বাড়িতে এসে যে বড় ভাগ্নের বিয়েতে থাকতে পারবে একথা সে কল্পনাই করতে পারেনি। সবাইকে দেখে ভালো লাগলেও একটা চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। চাচারা আর ফুপু যদি রাজি না হয়! কিন্তু ওর বুকের ওপর থেকে মস্ত একটা পাথর সরে গেলে, যখন দেখল বড় ফুপু, চাচা গ্রাম থেকে এসেছে। সাথে সিহা আর সাদমানও আছে। বড় ফুপু তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বাসায় এসেই সোহানী পারভিন কুহুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি মুখে কৃত্রিম রা’গ এনে বললেন,

” তাহমিদে কথা আমাকে বললে কি হত? আমরা কি তোর কথা শুনতামনা! আমরা তোকে সুখী দেখতে চাই। তোর সুখ আমাদের প্রথম চাওয়া। ”

ফুপুর কথা শুনে কুহু লজ্জায় মাথা নিচু করল৷

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কুহু নিজেকে দেখছে। পার্লার থেকে কয়েকজন এসে ওকে একঘন্টা ধরে সাজিয়েছে। এখন ও নিজেকে চিনতেই পারছেনা। ও কতবার মায়া আপুকে নিষেধ করেছে, সাজতে চায়না। কিন্তু মায়া সেকথা শুনলেতো।

গাঢ় বেগুনি রঙের বেনারসিতে ওকে যেন সদ্য প্রস্ফুটিত কুসুমের ন্যায় লাগছে। মানুষটা এত তারাতারি শপিং করছে ভাবতেই কুহুর মন প্রেমহিল্লোলে ছেয়ে যাচ্ছে। হালকা জুয়েলারিও কিনেছে মানুষটা। কুহুর পোশাকের সাথে মিল রেখে নিজের জন্যও শেরওয়ানি কিনেছে। অবশ্য সে কিনতে চায়নি, সজলের জোরাজুরিতে কিনতো হয়েছে।

অনেকটা ঘোরের মধ্যেই ‘ কুবল ‘ শব্দটি উচ্চারিত হলো কুহুর কন্ঠা থেকে। ও এখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা, আজকে ও অন্য কারো অর্ধাঙ্গীনি হলো! মানুষটা সকাল সকাল ওকে এতবড় সারপ্রাইজ দিবে তা ওর কল্পনায়ও ছিলনা।

বিকেলেই সাইদ আহমেদ ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রামে ফিরে যান। রাজিয়া খালাও সন্ধ্যায় ফিরে গেলেন। তবে সোহানী পারভিন থেকে গেলেন।

রায়হান আহমেদও রাতের খাবার পর রিশা, নিশোকে নিয়ে ফিরে গেলেন।

সৃজন ভাবতেই পারছেনা ওর আপুর সাথে তাহমিদের বিয়ে হয়েছে। তাহমিদ অল্পদিনেই তার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল। এবার তার সাথেই বোনের বিয়ে হতে দেখে ওর খুশির সীমা রইলনা। ও সারাক্ষণ তাহমিদের সাথে লেপ্টে রইল। তাহমিদ ওর জন্যও শপিং করেছে। সেই পোশাক পরেই ছেলেটা আনন্দ করেছে।

রাতে বাসায় ফেরার পূর্বেই মায়া কুহুকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিল। কুহু তাদেরকে থাকবার জন্য অনুরোধ করেছে, কিন্তু সকালে সজলের ক্লাস আছে জন্য তাদের যেতে হচ্ছে।

রাত বারোটা পঞ্চাশ। কুহু ব্যালকোনিতে বসে আছে। ভারি শাড়িতে ওর প্রান যাই যাই অবস্থা। আজকের আগে খুব একটা শাড়ি পরেনি মেয়েটা। সেজন্যই এত অস্বস্তি লাগছে। এদিকে রুমে যাওয়ার ও সাহস পাচ্ছেনা। সেখানে তাহমিদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সৃজনের রুমে ফুপু শুয়েছে। ও একবার ভাবছে ফুপুকে ডেকে তুলবে কিনা। পরক্ষনেই আবার ভাবছে সারাদিন ফুপু অনেক পরিশ্রম করেছে, এখন তাকে ডাক দেয়া ঠিক হবেনা। নানান চিন্তা করছে আর দাঁত দিয়ে নখ কাটছে মেয়েটা।

” এভাবে নখ কাটছ কেন! এখন থেকে মাথার একটা চুলও ফেলার আগে আমার হুকুম নিবে। আমি আমার নিঁখুত বউকে চাই। এত চিন্তা কিসের? কাল থেকে যখন চিন্তা করতে ইচ্ছে করবে, তখন আমাকে জিজ্ঞেস করে নিবে। আমি বললেই তবে চিন্তা করবে। ”

হঠাৎই তাহমিদের গলা শুনে কুহু চমকে উঠল।

” আ..আপনি! আপনি না ঘুমিয়ে ছিলেন! ”

” ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন জেগে গেছি। তুমি এতরাতে এখানে বসে আছ কেন? রুমে যাওয়ার ইচ্ছে নেই? মায়া তোমাকে কিছু শেখায়নি! ”

কুহু তাহমিদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই হাসি আসছেনা। কুহুকে নীরব থাকতে দেখে তাহমিদ আবারও বলে উঠল,

” আজকের রাতটা কি এখানেই কাটিয়ে দেবে ভাবছ। তবে কি ঐতিহাসিক এই বাসর বারান্দায় হবে? বারান্দায় হোক আর ছাদেই হোক, আমি রাজি। যেকোন এক জায়গায় হলেই হয়। আগেই বলেছি, আমি টাইম ফুল ফর্মে থাকি। তবে দেরি কেন, কাছে এস। ”

তাহমিদের কথা কানে যেতেই কুহু লাফিয়ে চেয়ার ছাড়ল।

” কি..কিসব ব..বলছেন! আমার ঘুম পেয়েছে। ” কুহু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল।

” তো! আমি কি বলেছি তোমাকে ঘুমাতে দেবনা! বেয়াদব মেয়ে, সকালেতো খুব কলিজার ওপর আছড়ে পরেছিলে। তখন সার্টিফিকেট বিহীন আপনজন ছিলে। কিন্তু তখন ভয় পাওনি। অথচ এখন যখন তুমি আমার সার্টিফিকেটধারী বউ, কোথায় এখন নির্ভয়ে কলিজার মধ্যে ঢুকে যাবে, সেটা না করে ভয়ে তো তো করে তোতলাচ্ছ? যা করার আমাকেই করতে হবে দেখছি। এত সাধনার বউ আমার, এত সাধের বাসর রাত আমাদের। এই সাধের রাত আমি বিনা কাজে কাটাতে রাজি নই। আমি আবার পরিশ্রমি জীব কিনা। ” কথাটা বলেই এক ঝটকায় তাহমিদ কুহুকে কোলে তুলে নেয়।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৪
জাওয়াদ জামী জামী

গভীর রাত। ধরাধাম ঘুমের কোলে নিজেকে সঁপেছে। ধরিত্রী নিঃশব্দে জানান দিচ্ছে তার বুক জুড়ে এখন বিভাবরী তার রাজত্ব কায়েম করেছে। সূচিত করেছে প্রেমময় ক্ষণের।

রাত, চাঁদ, জনমানব ঘুমে মগ্ন থাকলেও ঘুম নেই দুটি কপোত-কপোতির আঁখিদ্বয়ে। তারা প্রেম বিনিময়ে মত্ত। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ তারা দু’জন দু’জনার হয়েছে। এই রজনী কিছুতেই বৃথা যেতে পারেনা।

তাহমিদের উন্মুক্ত লোমশ বক্ষে মাথা রেখে তার প্রিয় মানুষটির প্রতিটি হৃৎস্পন্দন মনযোগ দিয়ে শুনছে কুহু। নির্দিষ্ট লয়ে দ্রিম দ্রিম শব্দ করে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তাহমিদ ওর চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটছে। আরেক হাতে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। যেন ছেড়ে দিলেই সে কোথাও হারিয়ে যাবে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। দু’জনেই চুপচাপ অনুভব করছে দু’জনকে। এভাবে কেটে গেছে অনেকক্ষন। কুহু এবার তাহমিদের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড়া পেতে উসখুস করছে। কুহুর এহেন কাজে ভ্রু কোঁচকায় তাহমিদ।

” এমন করে চিংড়ি মাছের মত তিড়িংতিড়িং করছ কেন! আমার বুকে থাকতে কি তোমার ভালো লাগছেনা? কত মেয়ে এই বুকে আসার জন্য পা’ গ’ ল হয়ে গেছে, কিন্তু আমি তাদের সুযোগ দেইনি। আর তুমি কিনা এমন সুযোগ পেয়েও তিড়িংতিড়িং করছ! আমার এই বুকের মর্ম তুমি এখনো বুঝলেনা, মেয়ে। তাহমিদের বুকে সবার স্থান হয়না। যে একবার এখানে স্থান পেয়েছে, আমি তাকে রাণী করে রাখতে চাই। তুমি দেখছি সেই সুযোগ পেয়েও হেলা করছ! ” তাহমিদের গলায় উষ্মা লুকিয়ে থাকলনা।

” আপনি কত শক্ত করে ধরে রেখেছেন, সেটা একবারও লক্ষ্য করেছেন! আমার পাঁজরের হাড় একটাও আস্ত নেই। ” কুহু মুখ কালো করে বলল।

” কে বলেছে তোমার পাঁজরের হাড় আস্ত নেই! এই যে দেখ দিব্যি তোমার পাঁজরের হাড় বিছানায় শুয়ে আছে। এই পাঁচ ফিট নয় ইঞ্চির মস্ত হাড় যদি তোমার চোখে না পরে, তবে আমার নিষ্পাপ অদৃশ্য মন তুমি না দেখেই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে দেখছি! তখন আমাকে মন বীনা বেঁচে থাকতে হবে! এটা আমি ভাবতেই পারছিনা। কি নিষ্ঠুর রমনী তুমি, বউ। ”

তাহমিদের মুখে ‘ বউ ‘ ডাক শুনে কুহুর শরীর শিথিল হয়ে যায়। ওর সমস্ত শরীরে সুখের শীতল মলয় এসে দোলা দিয়ে যায়। ঠোঁটের কোনে ফুটে ওঠে প্রাপ্তির হাসি। ও পেয়েছে, দূরে থাকা আপনজনকে আরও আপন করে পেয়েছে। যে ওর জীবনে এসেছে ধূমকেতু হয়ে। অপ্রাপ্তির বেদনাকে প্রাপ্তিতে পূর্ণ করেছে।

” একটা কথা জিজ্ঞেস করব? ” কুহু মিনমিন করে বলল।

” একটা কেন, একশোটা কর। চাইলে হাজারটাও করতে পার। তোমার সব কথা শোনার জন্য , সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এই অধম সব সময়ই প্রস্তুত আছে। ”

তাহমিদের আস্কারা পেয়ে কুহু হাসল। ও তাহমিদের লোমশ বুকে আঙ্গুল চালাতে চালাতে প্রশ্ন করল,

” আপনি ফোন সুইচড অফ করে রেখেছিলেন কেন? আমার ওপর খুব রা’গ হয়েছিল বুঝি? ”

” ফোন ইচ্ছে করে বন্ধ করিনি। হাত থেকে পরে ভেঙে গিয়েছিল। কাজের চাপে নতুন ফোন কিনতে দেরি হয়েছিল। এদিকে কোর্সের সময় শেষ হয়ে আসছে, অথচ তখনও একটা থিসিস জমা দিতে পারিনি। তাই ফোন কেনার কথা মাথা থেকে বের করে দিয়ে থিসিসে মনযোগ দিয়েছিলাম। তারপর থিসিস কমপ্লিট করে যখন ফোন কিনলাম এবং খালাকে ফোন দিলাম, তখন সব শুনে আমার পা’ গ’ ল পা’ গ’ ল লাগছিল। মুহূর্তেই ভুলে যাই আমি তোমার ওপর রে’ গে ছিলাম। যদিও সেটা রা’ গ ছিলনা। শুধু তোমাকে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখ, শেষ পর্যন্ত ভয়টা কে পেল? আমি এই অসহায়, অবুঝ বালকটি ভয়ের চোটে সময়ের দুইদিন আগেই সব থিসিস জমা দিয়ে উড়াল দিলাম। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু হেসে ফেলল। ওর মনের আকাশের সকল মেঘ কেটে, উঁকি দিল এক ফালি সূর্য।

” সরি। আমি আপনাকে বাসা বদল করার আগে জানাইনি। আমি জানতাম আপনি আমাকে কিছুতেই এখানে আসতে দিতেননা। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আর সেখানে থাকতে পারছিলামনা। আমি জানতাম আপনি কষ্ট পাবেন, রা’গ করবেন তবুও আমি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। ” কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

তাহমিদ কুহুর কান্না দেখে ওকে শক্ত করে বুকে জরিয়ে নেয়। চুমু দেয় ওর ললাটে , অধরে।

ঘুম ভাঙ্গতেই বহু কষ্টে তাহমিদের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল কুহু। দেয়াল ঘড়িতে চোখ পরতেই ওর মাথায় বা’জ পরল। সকাল নয়টা বেজে গেছে! লজ্জায় আপনাআপনি ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এখন ফুপুর সামনে যাবে কেমন করে! এতক্ষণ ওকে বাহিরে না বেড়োতে দেখে ফুপুই বা কি ভাববে।
এদিকে তাহমিদ ওকে আবারও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে।

” এবার আমাকে ছাড়ুন। নয়টা বেজে গেছে। আমি কিভাবে ফুপুর সামনে যাব। সবকিছু আপনার জন্যই হয়েছে। ”

কুহুর মুখে এমন কথা শুনে তাহমিদ উঠে বসল। ও কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কুহুর দিকে।

” এই মেয়ে বলে কি! আমি না আসলে তাকে অন্যের বউ হয়ে জীবন কাটাতে হত। আর সে-ই কিনা আমার ওপর অপবাদ দিচ্ছে! আমি কোথায় তাকে ভালোবেসে নিজের বুকে ঠাঁই দিলাম, বিয়ে করলাম, বাসর তা-ও তারই সম্মতিতে। কিন্তু বিয়ের পরদিন সকালেই আমাকে শুনতে হচ্ছে আমিই সবকিছুর জন্য দায়ী! তোমার জন্য ঐ প্রবাসীই ঠিক ছিল। করতে বিয়ের পর জামাই ছাড়া সংসার। তাহলে সকালে উঠতেও দেরি হতোনা, আর তোমাকে লজ্জাও পেতে হতোনা। অবশ্য তুমি ভুল কিছু বলনি। বিয়ের পর বউ কোথায় স্বামীর ঘরে গিয়ে বাসর করবে। সেটা না করে স্বামীই এসেছে বউয়ের কাছে। মেয়েরা আবার বাবার বাড়িতে লজ্জাবতীর রোল প্লে করে কিনা। শ্বশুর বাড়িতে জামাইয়ের সাথে দিনরাত এক রুমে থাকলেও লজ্জা লাগেনা। কিন্তু বাবার বাড়িতে সকাল নয়টা বাজলেই লজ্জায় নুইয়ে পরে। যদিও এটা তোমার বাবার বাড়ি নয়। তারপরও আমার কথাটা মিথ্যা নয়। ”

তাহমিদের খোঁ’চা মা’রা কথা শুনে কুহু কপাল চাপড়ায়। ও বুঝতে পারছে এখন তাহমিদের সাথে কথা বলতে গেলেই দেরি হয়ে যাবে। তাই ও কিছু না বলে বিছানা ছাড়ল। তাহমিদ কুহুর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারও শুয়ে পরল।

তাহমিদের ঘুম ভাঙ্গলো ফোনের শব্দে। সৈকত আহমেদ ওকে ফোন করে জানাল, হঠাৎই ফাতিমা খানম অসুস্থ হয়ে গেছেন। তাহমিদ ওর মামার ফোন পেয়ে আর দেরি করলনা। কুহুকে ডাকতে থাকে।
কুহু তখন সোহানী পারভিনের সাথে রান্নাঘরে কাজ করছিল। তাহমিদের ডাক শুনে ও রুমে আসলে তাহমিদ ওকে তৈরী হতে বলে নিজেও তৈরী হয়ে নেয়।

কুহু একটা রানী গোলাপি রঙের জর্জেট শাড়ি পড়েছে। ও নিজে শাড়ি পরতে জানেনা, তাই সোহানী পারভিন ওকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। পাশের রুম থেকে নিজের রুমে আসতেই তাহমিদের নজর যায় কুহুর দিকে। সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার রমনীর দিকে। এই শান্ত, স্নিগ্ধ মেয়েটিযে তার একান্তই নিজের সেকথা ভাবলেই ওর মন প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। তাহমিদ কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে কুহুকে বাহুডোরে বেঁধে নেয়। ঠোঁট ছোঁয়ায় মেয়েটার ললাটে, আঁখিতে এবং সবশেষে ওষ্ঠদ্বয়ে। তাহমিদের আচম্বিত ছোঁয়ায় শিউরে ওঠে কুহু। কেঁপে উঠল ওর শরীর।

অনেকদিন পরে এই বাড়ির ভেতরে এসে কুহু আবেগে ভেসে যায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই বাড়ির মায়ায় জড়িয়েছিল কুহু। একদিন এই বাড়িতে ওকে মাথা নিচু করে থাকতে হয়েছে। এই বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে বের হতে হয়েছে। কিংবা আজ এই বাড়িতেই কুহু স্বসম্মানে উপস্থিত হয়েছে। আজ ওকে কেউ আর অসম্মান করতে পারবেনা। কেউ অপমান করতে পারবেনা। কুহুকে দেখে রাজিয়া খালা দৌড়ে আসলেন। ওকে বুকে জরিয়ে নিয়ে আদর করলেন। খালার সাথে কথা বলে কুহু তাহমিদের সাথে নানিমার কাছে যায়। সেখানে সৈকত আহমেদ এবং তার স্ত্রী ও আছে। কুহু প্রথমে তাদের সাথে কথা বলে নানিমার কাছে গিয়ে বসল। ওকে দেখেই নানিমা শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। তাহমিদ নানিমার কাছে গিয়ে তাকে তুলে বসিয়ে দেয়।
নানিমা কুহুর হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিনি তার একমাত্র সচল হাত দিয়ে কুহুর হাতে বারবার চুমু খেতে থাকলেন।
কুহু লক্ষ্য করল নানিমা এই দুইমাসে বেশ শুকিয়ে গেছেন। তার চোখমুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে তিনি ভালো নেই। কুহু নানিমার কাছে কিছুক্ষণ বসে।

তাহমিদ গভীরভাবে লক্ষ্য করছে নানিমাকে। তার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়েছে। তাহমিদ বুঝতে পারছে নানিমা আর হয়তো বেশিদিন তাদের মাঝে থাকবেনা। কথাটা মনে আসতেই তাহমিদের মন হু হু করে উঠল। ওর মমতাহীন জীবনে এই নানিমা’ই ছিল ওর অবলম্বন। এই মানুষটাই ওকে আগলে রেখেছিলেন দুনিয়ার মানুষের কটুবাক্য থেকে। এই মুহুর্তে তাহমিদ আর কিছু ভাবতে পারছেনা। ওর ভিষণ কান্না পাচ্ছে। কান্না লুকাতে ও লুটিয়ে পরল নানিমার পায়ে। তার পা’ দুটি দু’হাতে জড়িয়ে চুপচাপ মুখ গুঁজে পরে রইল।

কুহু রান্নাঘরে এসে নানিমার জন্য স্যুপ বানাতে শুরু করল।

তাহমিদ নানিমার কোলে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে আছে। নানিমা তার এক হাত দিয়ে তাহমিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

কুহু রুমে আসলে তাহমিদ উঠে বসে ওকে বসবার সুযোগ দেয়।
কুহু কোন কথা না বলে নানিমাকে খাইয়ে দিতে থাকে।

” নানিমা, আমার বউ কেমন হয়েছে বললেনাতো? বউ বুঝি তোমার পছন্দ হয়নি। ”

তাহমিদের কথা শুনে নানিমা মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলেন কুহুকে তার খুব পছন্দ হয়েছে।

” আম্মা, তোমার কি হয়েছে? কেমন আছো তুমি? ”

হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে ব্যাগ্র গলায় জিজ্ঞেস করল নায়লা আঞ্জুম। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে সে আর রাগ করে থাকতে পারেনি। ছুটে এসেছে মা’কে দেখতে।

রুমে ঢুকে কুহুকে দেখে কপাল কুঁচকায় নায়লা আঞ্জুম। কুহুকে এই বেশে দেখে সে বেশ অবাক হয়েছে।

তাহমিদ নায়লা আঞ্জুমের দৃষ্টি বুঝতে পেরে হেসে উঠে বলল,

” খালামনি, এস আমার স্ত্রী’ র সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই। কুহু সম্পর্কে ইনি তোমার ছোট খালা শ্বাশুড়ি। তোমার গুরুজন। তাকে সালাম কর। চেয়ার এনে বসতে দাও। ”

তাহমিদ ব্যঙ্গ করে বলল। যা ঠিকিই বুঝতে পারছে নায়লা আঞ্জুম। সে স্তব্ধ হয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। তাহমিদের কথা বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৩১+৩২

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩১
জাওয়াদ জামী জামী

কুহু তাহমিদের সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু গত পনেরদিন থেকে তাহমিদের কোনও খবর নেই। এদিকে কুহু রাজিয়া খালার কাছ থেকে জানতে পেরেছে তাহমিদ এরইমধ্যে দুই দিন খালার কাছে ফোন দিয়েছে। এই কথা শোনার পর কুহু আরও ভেঙে পরেছে। সেই সাথে ভয়ও হচ্ছে। তবে কি সে কুহুর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে! এখন কুহুর নিজের ওপর রা’গ হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, কেন সে আগে তাকে নতুন ফ্ল্যাটে ওঠার আগে জানালনা। সে সবকিছু শোনার পর রা’গ করত, তারপর একসময় ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু এখন কুহু কিভাবে সবকিছু ঠিক করবে? কষ্টের তীব্রতায় কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তবে কি ওর না বলা ভালোবাসা সমূলেই বিনাশ হতে চলেছে! কুহু দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে তাহমিদকে ফোন করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই ওকে নিরাশ হতে হয়।

হঠাৎ করেই বড় ফুপুকে বাসায় দেখে কুহু অবাক হয়ে গেছে। সোহানী পারভিন সাইদ আহমেদের সাথে কুহুর কাছে এসেছেন। এতদিন তাদের ভাতিজা-ভাতিজী ছোট ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকায় তারা সেখানে যেতে পারেননি। কারন তারা জানতেন, নায়লা আঞ্জুম তাদের পছন্দ করেনা। সোহানী পারভিন অনেক জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন ওদের জন্য। এই দুঃসময়ে আপনজনদের কাছে পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল কুহু। সোহানী পারভিন পরম আদরে ভাইয়ের মেয়েকে বুকে জরিয়ে নিলেন।

সাইদ আহমেদ পরদিন সকালে বড় বোনকে কুহুদের কাছে রেখে গ্রামে ফিরে গেলেন। সোহানী পারভিন কয়েকদিন এখানে থাকবেন।

সেদিন বিকেলে রায়হান আহমেদ ছেলেমেয়েদের সাথে নিয়ে কুহুদের বাসায় আসলেন। মুহূর্তেই বাসাটা যেন চাঁদের হাটে পরিনত হয়েছে। কুহু গিয়ে পাশের ফ্ল্যাট থেকে দাদুকে নিয়ে এসেছে। বৃদ্ধাও আজকে ভীষণ খুশি হয়েছেন। তার ছেলেমেয়েও থাকার পরও তিনি সব আনন্দ থেকে বঞ্চিত। আজ তিনি এদের সাথে আনন্দ করে, নিজের অপূর্ন স্বপ্নকে পূরন করছেন।

চারদিন পর সোহানী পারভিন গ্রামে ফিরে গেলেন। সৃজন কুহু চেয়েছিল তাদের ফুপু আরও কয়েকটা দিন থেকে যাক। কিন্তু বাড়িতে কাজ পরে যাওয়ায় তাকে চলে যেতে হয়।

একদিন সন্ধ্যায় রায়হান আহমেদ কুহুর কাছে আসলেন। তিনি ওদের জন্য কিছু ফলমূল এনেছেন। সেগুলো কুহুর হাতে দিয়ে তিনি কুুহুর রুমে গিয়ে বসলেন।

” কুহু মা, আজকে একটা দরকারে তোর কাছে এসেছি। তুই মনযোগ দিয়ে আমার কথা শোন। ”

” কি হয়েছে চাচা? কিছু হয়েছে? ”

” তেমন কিছুই হয়নি, আবার অনেক কিছুই হয়েছে। যেহেতু ভাই-ভাবী বেঁচে নেই, এখন তোর অভিভাবক বলতে আমরা তিন ভাইবোনই আছি। তাই যে কথা তোকে ভাবীর বলা দরকার ছিল, সেই কথা আমাকে বলতে হচ্ছে। ”

কুহু চাচার কথার সারমর্ম বোঝার চেষ্টা করছে। এদিকে রায়হান আহমেদ একমনে কথা বলেই চলেছে,

” বুঝলি মা , মেয়েরা বড় হলে বাবা-মা’ র দুশ্চিন্তা হয়। তেমনি আজকাল আমাদেরও তোর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তুই সব ছেড়ে একা সৃজনকে নিয়ে থাকছিস। এটা আমাদেরকে আরও বেশি ভাবাচ্ছে। ”

” চাচা, তুমি কি বলতে চাইছ! আমি বুঝতে পারছিনা। আমাদের জন্য এত চিন্তা করতে হবেনা, চাচা। ” কুহু ভ্রকুটি করে বলল।

” মা রে, তুই বুঝবিনা আমাদের দুশ্চিন্তা। যতদিন তোকে একটা ভালো পরিবারে, একজন সৎ মানুষের হাতে তুলে দিতে না পারছি, ততদিন আমাদের স্বস্তি নেই। আর সেই ভালো পরিবার আর সৎ মানুষের সন্ধান আমরা পেয়েছি। ”

চাচার কথা শুনে কুহুর পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল। চাচা কার কথা বলছে? এবার ও কি করবে!

” তু..তুমি ক..কি বলছ, চাচা? ” কুহু মনে হচ্ছে যেকোন মুহূর্তে মাথা ঘুরে পরে যাবে। এসব কি শুনছে ও!

” আমি ঠিকই বলছি, মা। আমার কলিগের ভাইয়ের ছেলে আশিক। সে কানাডা থাকে। মন্ট্রিল ইউনিভার্সিটিতে পিএচডি করছে। আমার কলিগ একদিন তোকে কোচিং-এ দেখেছিল। তখনই তোকে পছন্দ করেছিল। সে-ই তার ভাতিজার সাথে তোর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি তখন তাকে কিছুই বলিনি। গোপনে ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলাম। এবং রেজাল্ট পজিটিভ। সবাই তাদের পরিবারকে ভালো বলেই আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু আমি তোর কাছে না জেনে তাদেরকে কিছুই বলতে পারছিনা। অবশ্য তোকে এখন কিছুই জানাতে হবেনা। তুই দুইদিন সময় নে। এরপর আমাকে জানাস। ”

কুহু চাচার কথার প্রত্তুত্যরে কিছুই বলতে পারলনা। ঠোঁট কামড়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করার বৃথা চেষ্টা করল।

রায়হান আহমেদ আরও কিছুক্ষণ সৃজন কুহুর সাথে গল্প করে বিদায় নিলেন।

পরদিন ফজরের নামাজের পর কুহু নাশতা তৈরী করছে। তখনই বড় ফুপুর ফোন আসল। কুহু মলিন হেসে ফুপুর সাথে কথা বলতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ কথা বলার পর, সোহানী পারভিন জানালেন তিনি ও সাইদ আহমেদ কুহুর বিয়ের ব্যাপারে ছোট ভাইয়ের সাথে একমত হয়েছেন। ছেলে ও তার পরিবার সম্পর্কে সবকিছু শোনার পর তারাও চান সেখানেই কুহুর বিয়ে হোক। এছাড়া সাইদ আহমেদ নিজে গিয়েছিলেন ছেলের গ্রামে। তিনিই সবকিছু শুনে এসেছেন।

এবার কুহু যেন অকুল পাথারে পরল। ওর শেষ ভরসাটুকুও কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। ও ভেবেছিল, বড় ফুপুকে বুঝিয়ে চাচাকে ওর বিয়ে নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাতে নিষেধ করবে। কিন্তু ও এখন দেখছে বড় ফুপু আর মেজো চাচাও ছোট চাচার সাথে বিয়েতে মত দিয়েছে!

কুহু দিশেহারা হয়ে গেছে। ও এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। চোখ দিয়ে আপনাআপনিই শ্রাবনের ধারার ন্যায় অশ্রু ঝরতে থাকল।

আরও তিনদিন কেটে গেছে। কুহু অনেকবার তাহমিদের কাছে ফোন দিয়েছে, কিন্তু ওকে এবারও হতাশ হতে হয়। বাধ্য হয়ে ও দাদুর কাছ থেকে ফোন নিয়ে, লাজলজ্জা ভুলে তাহমিদকে ফোন দেয়। কিন্তু এবার ফোন সুইচড অফ দেখায়। পরপর দুইদিন দাদুর ফোন দিয়ে তাহমিদকে ফোন দেয়, এবং দুইদিনই ফোন সুইচড অফ দেখায়।
কুহু এবার রাজিয়া খালাকে ফোন করে সবটা জানায়। খালা সব শুনে বললেন, তিনদিন থেকে তাহমিদ তার কাছেও ফোন দেয়নি। তিনিও তাহমিদের কোনও খোঁজ জানেননা।

পরবর্তী কয়েকদিন কুহু উন্মাদের মত আচরণ করেছে। এদিকে বড় ফুপু প্রতিদিনই ওকে ফোন দিয়ে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন। ওর মত আছে কিনা জানতে চেয়েছেন। কিন্তু কুহু কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থেকেছে। যেখানে তাহমিদেরই কোন খোঁজ নেই, সেখানে সে কিভাবে সবাইকে তার কথা বলবে! যদি তাহমিদ ওর সাথে যোগাযোগ করত, তবে ও অবশ্যই চাচা-ফুপুকে বিয়ে বন্ধ করতে বলত।
কিন্তু তাই বলে ও নিজের জীবনে তাহমিদ ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা করতে পারেনা।

সেদিন সন্ধ্যায় রায়হান আহমেদ আসলেন কুহুর সাথে কথা বলতে। কুহু নত মস্তকে বসে আছে। ও জানে চাচা কি বলতে চায়।

” মা, কি সিদ্ধান্ত নিলি? আশিকের বাবা আর অপেক্ষা করতে চাইছেননা। তিনি চাইছেন এখনই বিয়েটা পড়িয়ে রাখতে। আপাতত ফোনে বিয়ে হবে। আর তিন বছর পর আশিক দেশে আসলে বড় আয়োজন করে তারা পুত্রবধূকে ঘরে তুলবেন। এবার তোর ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। তবে আমরা করছি তুই আমাদের নিরাশ করবিনা। ”

” চাচা, আমি সৃজনকে ছেড়ে থাকতে পারবনা। আর সৃজুও সেটা পারবেনা। ও এখনও অনেক ছোট। নিজের ভালো এখনো বুঝতে শেখেনি। ওকে এই অবস্থায় একা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ”

” সৃজনের চিন্তা তোকে করতে হবেনা। আগামী তিন বছর তোরা এখানেই থাকবি। শুধু মাঝেমধ্যে আশিকের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বেড়িয়ে আসবি। তিন বছর পর আশিক তোকে আর সৃজনকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে। ”

ধীরে ধীরে যেন কুহুর সব পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে কি ও কোন অচেনা আগন্তুকের সাথে বাঁধা পরতে চলেছে!
যাকে কভু বলা হয়নি ‘ ভালোবাসি ‘ তবুও প্রতিনিয়ত যে ওকে বুঝিয়েছে ভালোবাসা না বললেও হয়ে যায়। মুখে বলতে হয়না। মনের সাথে মন মিলে গেলেই ভালোবাসা নীরবেই ধরা দেয়। তবে কি সেই মানুষটার সাথে বিচ্ছেদ আসন্ন!

পরদিন সকালেই সোহানী পারভিন রাজশাহী আসলেন। তাকে দেখে কুহু অবাক হয়ে গেছে। আজ ফুপুকে দেখে ওর মনে খুশির দোলা লাগলনা। মুখের ভেতর তিক্ত স্বাদ অনুভব করছে।
সোহানী পারভিন প্রতিটা কথায় কুহুকে বুঝিয়ে দিলেন তারা সবাই চাচ্ছে এখানেই কুহুর বিয়ে হোক। তিনি কুহুকে অনেক বোঝালেন। সেই সাথে তিনি আজ কুহুকে কোচিং-এ যেতে নিষেধ করে দিলেন। কারন আজ বিকেলে আশিকের বাবা-মা, দুই বোন কুহুকে দেখতে আসবে। সেরকম হলে আজকেই তারা বিয়ের দিন ঠিক করবেন।

এবার কুহু ফুপুর কোলে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সোহানী পারভিন ভাবলেন বাবা-মা হারা মেয়েটা মৃ’ত বাবা-মা’কে স্মরণ করেই কাঁদছে। তিনি নানানভাবে কুহুকে শান্তনা দিলেন। ওকে থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কুহু কিছুতেই কান্না থামায়না। ও যেন আজ নিজের সব কষ্টকে অশ্রুবিন্দুতেই উজার করে দিচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর কুহু ফোন নিয়ে লনে এসে দাঁড়ায়। ফোন করল রাজিয়া খালার কাছে। একটাবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চায়।

চলবে..

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩২
জাওয়াদ জামী জামী

” বাহ্ মামনির দেখছি দীঘল কালো চুল! আমার দুই মেয়ের কারও চুল এত বড় নয়। ” কুহুর হাঁটু সমান চুল দেখে আশিকের মা আয়িশা নার্গিস সবিস্ময়ে বললেন।

” কি আম্মু, তুমি এখানে পাত্রী দেখতে এসেও আমাদের দূর্নাম করবে! এটা কিন্তু ভারি অন্যায়। তোমার দুই মেয়ের চুল লম্বা না হলেও, তৃতীয় মেয়েরতো চুল লম্বা হবে। এটা নিয়েই আপাতত খুশি থাক। এখন আবার জিজ্ঞেস করোনা এই তৃতীয় মেয়ে আবার কে। ছেলের বউকে মেয়ের চোখে দেখলেই কিন্তু তুমি আরেকটা মেয়ের মা হয়ে যাবে। ” আশিকের বড় বোন তিশা হাসিমুখে বলল।

তিশার এমন আন্তরিক কথাবার্তা শুনে রুমে উপস্থিত সকলে ভিষণ খুশি হয়েছে। সোহানী পারভিন বুঝতে পারছেন কুহু এই পরিবারে বউ হয়ে গেলে সুখী হবে। এরা মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। রায়হান আহমেদ এবং সাইদ আহমেদের মুখেও হাসির রেশ। অবশেষে তাদের মেয়ে একটা ভালো পরিবারে যাবে, একথা ভাবতেই তাদের চোখ ভিজে উঠছে।

আশিকের পরিবার বিদায় নেয়ার আগে জানিয়ে যায়, কুুহুকে তাদের পছন্দ হয়েছে। তারা বাসায় গিয়ে ছেলের সাথে কথা বলে বিয়ের দিন ঠিক করবে। তবে সেটা আগামী সাতদিনের মধ্যেই হবে। তারা চাচ্ছেন যত তারাতারি সম্ভব কুহুকে ছেলের বউ করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে।

আশিকের পরিবার বিদায় নিলে কুহু ফোন নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়। ও কাঁদতে কাঁদতে রাজিয়া খালাকে ফোন দিয়ে সবটা জানায়। সব শুনে খালাও ভিষণ চিন্তিত হয়ে গেছেন। তিনি জানালেন, এখন পর্যন্ত তাহমিদ তাকে ফোন দেয়নি।

কুহু দিনরাত কান্নাকাটি করছে। সোহানী পারভিন গ্রামে ফিরে গেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বিয়ের আগেরদিন তিনি রাজশাহী আসবেন।

কুহু নিয়মিত ক্নাস নিচ্ছে। ওর ও ক্লাস শুরু হতে দেরি নেই। সৃজন মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। তবে ওর মনটা খুব ভালো নেই। বাবা-মা’ কে হারানোর পর এই বোনই ওকে আগলে রেখেছিল। এখন সেই বোনেরও বিয়ে হয়ে যাবে! ও যে বড্ড একা হয়ে যাবে। কিভাবে থাকবে সে বোনকে ছাড়া! যখনই ছেলেটার এসব কথা মনে হয়, তখনই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। কখনোই কুহুকে বুঝতে দেয়না।

রাজশাহী থেকে যাওয়ার পর আশিকের পরিবারের সবাই কুহুর সাথে ফোনে কথা বলেছে। আশিকের বড় বোন কুহুকে বলেছিল, আশিক ওর সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু কুহু তার প্রস্তাবকে সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। ওর আশিক নামক মানুষটার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে নেই। যে রমনীর হিয়ার মাঝে, প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে তার একান্ত পুরুষটির নাম সগৌরবে বিরাজ করছে, তার মন কিভাবে চাইবে এক অচেনা মানুষের সাথে বাক্যবিনিময় করতে!

কুহু প্রতিদিন তাহমিদের ফোনে ট্রাই করে, কিন্তু সে তাকে পেতে ব্যর্থ হয়েছে বারবারই। এদিকে আশিকের পরিবার থেকে জানিয়েছেন তারা আগামী শুক্রবার বর ছাড়াই বরযাত্রা নিয়ে হাজির হতে চায়। কুহু এবার সচকিত হয়ে বড় ফুপুর কাছে আঁইগুই করে জানায়, সে এখনই বিয়ে করবেনা। কিন্তু সোহানী পারভিন ওর কথায় পাত্তা দেননি। কারন তারা মন থেকে চান তাদের মেয়েটা সুখী হোক। কুহুর ইচ্ছে থাকলেও তাকে তাহমিদের কথা জানাতে পারলনা। কারন ও যেখানে তাহমিদের খোঁজই পাচ্ছেনা, সেখানে কিভাবে তার কথা জানাবে! এরপর সব লাজলজ্জা ভুলে রায়হান আহমেদকে জানায়, ও এখন বিয়ে করতে চায়না। কিন্তু রায়হান আহমেদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নানানভাবে বুঝালেন। তারা মন থেকে কুহুর ভালো চাইছেন।

কুহু অকুল পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছে। ও সত্যি কথা না পারছে কাউকে বলতে না পারছে সহ্য করতে। এদিকে আজ সোমবার। মাঝখানে আর তিনদিন সময় আছে। এরইমধ্যে যদি তাহমিদের সাথে যোগাযোগ করতে না পারে, তবে ওকে চিরদিনের জন্য অন্য কোন সংসারের অংশ হতে হবে।

সেদিন বিকেলে রাজিয়া খালা আসলেন কুহুর সাথে দেখা করতে। কুহু এই অবস্থায় খালাকে কাছে পেয়ে কিছুটা আশার আলো দেখল। ও খালার ফোন দিয়ে বারবার তাহমিদকে ট্রাই করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই ওকে হতাশ হতে হয়।

রাজিয়া খালা বুঝতে পারছেননা তাহমিদের কি হয়েছে। তার ফোন বন্ধ কেন! তিনি কুহুকে খুব করে বোঝালেন। তিনি বুঝতে পারছেননা এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত। তবুও তিনি কুহুকে চিন্তা করতে নিষেধ করলেন। এরপর সন্ধ্যায় তিনি কুহুর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মঙ্গলবারও পেরিয়ে যায়। কুহুর সব আশা যেন নিমেষেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ও আর নতুনকরে কিছুই ভাবতে পারছেনা। কয়েকদিন থেকে ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করতে পারেনি মেয়েটা। কান্নারা দলা পাকিয়ে বারবার হানা দিচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে এই কয়দিনে। শুকিয়েও গেছে বেশ কিছুটা। ফজরের আযান দিতেই বিছানা ছাড়ল সে। গত কয়েকদিন থেকে রাতে ঘুমাতে পারছেনা। তাই মাথা থেকে থেকেই ব্যথা করছে। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। গত রাতেই বড় ফুপু জানিয়েছেন তিনি আগামীকাল সকালেই আসবেন। তিনি কুহুকে কোচিং থেকে কয়েকদিন ছুটি নিতে বলেছিলেন। তিনি চাননি বিয়ের আগে মেয়েটা দৌড়াদৌড়ি করুক। কিন্তু কুহু ফুপুকে অনেক বুঝিয়ে আজ বুধবার পর্যন্ত ক্লাস নেয়ার অনুমতি নিয়েছে।

কিছুক্ষণ বিছানায় ঝিম মেরে বসে থেকে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। নামাজ আদায় করে, সকাল-দুপুরের খাবার তৈরি করতে হবে।

জায়নামাজ গুছিয়ে রাখতেই কলিংবেল বেজে উঠল। কুহু অবাক হয়ে কলিংবেলের আওয়াজ শুনছে। এই অসময়ে কে আসল! এ সময়তো কারও আসার কথা নয়! এবার একটু ভয় পায় মেয়েটা। এদিকে কলিং বেল বেজেই চলেছে। ও ধীর পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। পিপ হোলে চোখ রেখেও কাউকে দেখতে পায়না। আগন্তুক বোধহয় একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দোটানায় ভুগতে থাকে মেয়েটা। ওর এখন কি করা উচিত সেটা ভেবে পায়না। হঠাৎই মনে হল নিশ্চয়ই বিল্ডিংয়ের কেউ এসেছে। হয়তো জরুরী কোন দরকার আছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবে, বিল্ডিংয়ের কারও ওর কাছে কি দরকার থাকতে পারে? এবার ভয়ের চোরা স্রোত ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে। ভিষণ অসহায় বোধ হচ্ছে। এদিকে নিয়মিত বিরতিতে কলিং বেল বেজেই চলেছে।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সাহস করে দরজা খুলে দেয়। চিন্তা করে রেখেছে খারাপ কিছু হতে দেখলেই চিৎকার দেবে। দরজা খোলার সাথে সাথে ওর নিঃশ্বাস আটকে যায়। এতদিন পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে। সে দরজার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো উসকোখুসকো, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চোখদুটোয় রাজ্যের ক্লান্তি। গায়ে লেপ্টে থাকা টি-শার্ট কুঁচকে আছে। এত অসামঞ্জস্যতার মধ্যেও তার ঠোঁটের স্নিগ্ধ হাসি দেখে অশান্ত মন নিমেষেই শান্ত হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই মানুষটাও ওকে পরম ভালোবেসে বুকে জরিয়ে নেয়।

” এই মেয়ে, এভাবে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমার কলিজার ওপর হুমড়ি খেয়ে পরলে কেন! তোমার দুই মন ওজন আমার মত অসহায় মানুষ কিভাবে সামাল দেবে? ছাড়ো দেখি। আর এভাবে কেঁদেকেটেই বা কেন আমার বুক ভাসাচ্ছ ? ” মৃদু ভৎর্সনা খেলে যায় মানুষটির কন্ঠায়।

কুহু তার কথার উত্তর না দিয়ে কেঁদেই চলেছে। তাহমিদ আর কিছু না বলে মেয়েটাকে জড়িয়ে রাখে। যে আজ স্বেচ্ছায় ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাকে কেউ দেখে ফেলার ভয়ে দূরে ঠেলে দেয়ার মত বোকা সে নয়।

কুহুর কান্না কিছুতেই থামছেনা। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত যাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে, এই মুহূর্তে তাকে পাওয়ার আনন্দে কাঁদছে। আর হারানোর ভয়ে ওকে কাঁদতে হবেনা।

” কান্না না থামালে এই মুহুর্তে আমি চলে যাব। তোমার চোখের পানি দেখার জন্য আমি পা’গ’লে’র মত দেশে ছুটে আসিনি। ”

” আপনি খুব খারাপ। খুব নিষ্ঠুর। ”

” সেকথা আজ জানলে! ”

” আমার নম্বর ব্লক করেছিলেন কেন? ”

” মনের সুখে। খুব শান্তিতে ছিলাম কয়েকদিন। ”

” আপনি সত্যিই খুব খারাপ। ”

” নতুন কিছু বল। ”

” চাচারা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। ” কুহু ফুঁপিয়ে উঠল।

” কনগ্রেচুলেশন। তা সৌভাগ্যবানটি কে? ”

” আমি বিয়ে করবনা। ”

” কেন! তুমি কি এখনও নাদান বাচ্চা আছ, যে বিয়ে করবেনা? সময়মত বিয়ে হলে, আজ তিন বাচ্চার মা থাকতে। সুযোগ যখন এসেছে বিয়েটা করেই নাও। আমিও তোমার বাচ্চাদের মুখে মামা ডাক শুনে কলিজা জুড়াই। ”

” ভালোবাসি। ” তাহমিদের কথা পাত্তা না দিয়ে বলল কুহু।

” কাকে? বাচ্চাদের বাবাকে? ”

” উহু, বাচ্চাদের মামাকে। ”

” তাহলে সত্যিই বিয়েটা করছ! সংসার করবে বাচ্চাদের বাবার সাথে, আর ভালোবাসবে বাচ্চাদের মামাকে? বেয়াদব মেয়ে, ঠাঁটিয়ে কানের নিচে দেব। ছাড় আমাকে। সরে যাও আমার কলিজার ওপর থেকে। ”

” আমি বাচ্চাদের বাবাকেই ভালোবাসিতো। ” কথাটা বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটল কুহু। আবেগের বশে কি ভুলটাই না করল সে!

” তো আমার কলিজায় এমন হুমড়ি খেয়ে পরে আছ কেন? যাও বাচ্চাদের বাবার কাছেই যাও। তাকে গিয়ে সেকেন্ডে দশবার ভালোবাসি বল। এই দুইমাসে নিজের চরিত্রের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে! আমার মত অসহায় মানুষের কলিজায় চেপে বসেছে! মানুষজনের দেখে ফেলার ভয় করছেনা। ”

” সরি। এভাবে রাগবেননা। ভালোবাসি তো। ”

” আমি কি কখোনো বলেছি ‘ ভালোবাসি ‘? কখনো বলিনি বলবওনা। এবার ছাড়ো। তুমি তোমার ঐ আশিক বানায়া আপ্নেকে ভালোবাসি বল।” তাহমিদ মৃদু গলায় বলল।

” আমার বয়েই গেছে আপনাকে জড়িয়ে ধরতে। তিনি নিজেই আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। আবার ধমকায়ও আমাকেই। আর আমার যাকে ‘ভালোবাসি ‘ বলার তাকেই বলে দিয়েছি। কোন আশিক ফাশিককে আমি চিনিনা। ” কুহু তাহমিদের কাছ থেকে সরে আসতে চাইলেই, তাহমিদ দু’হাতে ওর কোমড় ধরে নিজের সাথে আরেকবার জড়িয়ে নেয়।

” তার কাছ থেকে কি কখনো ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা শুনেছ? না শুনেই এতদূর! ”

” কিছু না বলা কথা বুঝতে হলে কোনও শব্দের দরকার হয়না। শুধু বুঝে নিলেই কাজ হয়ে যায়। আমি অনেক আগেই সবটা বুঝে নিয়েছি। এখন আপনি অস্বীকার করলেও আমি কিছুতেই মানবনা। ”

” এই সাতসকালে আমাকে বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে? কাল সারাদিন খাওয়া হয়নি, গোসল হয়নি আবার রাতে ঘুমও হয়নি। তোমার কি একটু দয়া হবে, এই অসহায়ের ওপর?”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু চমকে উঠে তার মুখের দিকে তাকায়। তাহমিদের হাত ধরে ওকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে, তাহমিদ দু’হাতের আঁজলায় কুহুর মুখটা তুলে ধরল। গলায় রাজ্যের ভালোবাসা এনে বলল,

” এমন ভালোবাসা অস্বীকার করার সাধ্য কার? তোমার একজীবনের ভালোবাসা দূরে ঠেলার সাধ্য, আমার সাতজন্মেও হবেনা। তুমিই আমার ভালোবাসার সাতমহল। ‘ভালোবাসি’ মেয়ে অনেক ‘ ভালোবাসি ‘তোমাকে। এক অতলস্পর্শী ভালোবাসায় তোমাকে বেঁধে রাখতে চাই আজীবন। এতটা ভালোবাসতে চাই তোমাকে, যে ভালোবাসার তল খুঁজে পাবেনা হাজার জনমেও। হবে কি আমার? ”

তাহমিদের আবেগে জড়ানো কথা শুনে কুহুর দম বন্ধ হয়ে আসছে। ওর চোখ ছলছল করছে।
ওকে অবাক করে দিয়ে তাহমিদ আবারও কথা বলে।

” আমার কথা আমি বলে দিয়েছি। এখন সিদ্ধান্ত তোমার। তুমি যদি চাও তবে আমাকে বাচ্চাদের বাবা বানাতে পার। আর না চাইলে অগত্যা আমাকে মামা হয়েই নিজেকে শান্তনা দিতে হবে। তবুও কিছু একটা হতেই হবে। এতেই পুরুষ জনমের স্বার্থকতা। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু ফিক করে হেসে উঠল।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-২৯+৩০

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৯
জাওয়াদ জামী জামী

” চাচি, চলুন খেয়ে নিন। আপনি দুপুরেও খাননি। আবার এত রাত পর্যন্ত না খেয়ে আছেন। আপনার শরীর খারাপ করবে। ” কুহু ভয়ে ভয়ে নায়লা আঞ্জুমের রুমে এসে তাকে খেতে ডাকল।

” মজা নিচ্ছ? আমার অপমানে খুব শান্তি পেয়েছ? হাভাতের দল, লজ্জা করেনা আমার বাবার বাড়িতে থেকেই আমাকে জ্ঞান দিতে? বেরিয়ে যাও আমার রুম থেকে। ” খেঁকিয়ে উঠল নায়লা আঞ্জুম।

কুহু অশ্রুসজল চোখে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকল। তাহমিদ বাসায় নেই, চাচাও নেই। চাচাকে ফোন দিয়ে জানতে পারল, তিনি বাসা দেখছেন। তার ফিরতে দেরি হবে। রিশা আর নিশো দুপুরের ঘটনার পর থেকে মন খারাপ করে আছে। নায়লা আঞ্জুম খায়নি, সেজন্য কুহু আর রাজিয়া খালাও না খেয়ে আছে। ও রিশা, নিশোকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছুক্ষণ আগে খাইয়ে দিয়েছে।

” আমাকে গালি দেয়ার অনেক সুযোগ পাবেন, চাচি। কিন্তু এখন আপনার খাওয়া জরুরী। চাচাও বলেছে আপনাকে খেয়ে নিতে। ”

” তোমার চাচা আসলে তাকে বেশি করে খেতে দিও। আজ তার খুশির দিন। আমাকে অপদস্ত করতে পেরে সে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে। তাই তাকে আমার খাবারটুকুও দিও। সে খুশিতে খেয়ে নিবে। ”

কুহু বুঝল চাচির সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। এখানে থাকলেই ওকে আরও কথা শুনতে হবে। তাই আর ও রুমে দাঁড়ায়না। আজ রাতে ওর আর খাওয়া হবেনা।

রাত বারোটার কিছু আগে রায়হান আহমেদ বাসায় আসলেন। কুহু চাচাকে দেখে এগিয়ে এসে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে, তিনি জানান খেয়ে এসেছেন। তাই কুহু নিজের রুমে চলে যায়। এরপর ও আর রাজিয়া খালা মিলে তাহমিদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সাড়ে বারোটা নাগাদ খালা ঘুমিয়ে পরলে, কুহু অপেক্ষা করছে তাহমিদের জন্য।

একটার দিকে কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে কুহু দরজা খুলতে যায়।

” দশ মিনিট পর ছাদে এস। ” তাহমিদ সোজা রুমে চলে যায়। ও কুহুর প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করলনা।

কুহু কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ও ভেবে পায়না মানুষটা এমন কেন। মাঝেমধ্যে মনে হয় তাকে হয়তো কুহু চিনতে পেরেছে। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয় লোকটা অচেনা কেউ। আজও তার মন পড়া হয়ে উঠলনা কুহুর।

দশ মিনিট পর ছাদে এসে দাঁড়ায় কুহু। তাহমিদ রেলিংএ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুহু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ও কোন কথা খুঁজে পায়না।

” তোমার চাচির কি অবস্থা? মনে তো হয়না সে আজ খেয়েছে। আর নিশ্চয়ই তুমিও খাওনি? সে আবার নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা৷ মানুষ। ” তাহমিদের গলায় চাপা রাগ প্রকাশ পাচ্ছে।

” চাচি কিন্তু আপনার খালামনি হয়। আমার আগে থেকেও তার সাথে আপনার সম্পর্ক। ” কুহু মুখ ভার করে বলল।

” সেই সম্পর্ক চুকাতে পারলে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হতোনা। কিন্তু আমি হতভাগ্য একজন, এমন এক সম্পর্কের বেড়াজালে আটকা পরেছি, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোন পথ নেই। ” তাহমিদের চোখে টলমল করছে অশ্রুবিন্দু।

” রাতে খেয়েছেন কিছু? নাকি দেবদাস হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন? ”

” তোমাকে কে বলেছে আমি দেবদাস! আমি হলাম গিয়ে প্রেমিক পুরুষ। অল টাইম ফুল ফর্মে থাকি। আমাকে দেবদাস বলে দুনিয়ার প্রেমিক সকলকে কষ্ট দিওনা। প্রেমিকরা দেবদাস হতে নয়, প্রেমিকাদের হিয়ার অধিপতি হয়ে তাদের হৃদকোঠরে আধিপত্য করতে চায়। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু নীরবে হাসল। ও উসখুস করছে। তাহমিদকে কিছু বলতে চায়, কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছেনা। কথাগুলো কিভাবে বলবে সেটা ভাবতেই ওর ঘাম ছুটে যাচ্ছে।

” আজকে নানিমা অনেক খুশি হয়েছে। তিনি দুপুর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত একবারও তার ছেলেকে কাছ ছাড়া করেননি। নানিমার মুখ থেকে হাসি যেন সরছিলইনা। ”

” সবার মা তো আর আমার মা’য়ের মত নয়। নানিমা গত আট বছর ছেলের জন্য প্রতিনিয়ত কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু তারই মেয়ে হয়ে মিথিলা আরজুমান্দ উনিশ বছর যাবৎ ছেলেকে ভুলে ছিল। একই দুনিয়ায় কত রকম মানুষ। কতইনা তাদের রূপ-রং। কত তাদের ছলা কলা। ”

তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরল কয়েক ফোঁটা তরল। যার প্রতিটি বিন্দুতে লুকিয়ে রয়েছে শত শত হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস। চোখের পানি লুকাতে তাহমিদ উল্টো ঘুরল। কিন্তু তার আগেই কুহু দেখে নিয়েছে সেই অশ্রুকনাদের। তাহমিদের চোখের পানি ওর বুকের গহীনে আঘাত করল। খোলসের আবরনে ঢেকে রাখা মানুষটাকে দেখে ভেঙে পরছে ওর ধৈর্যের বাঁধ।

” আপনি কিন্তু এখনো আমার কথার উত্তর দেননি। নাকি আমার কথার জবাব দিতে আপনার ভালো লাগেনা। ” কুহু কপট রাগে বলল। ও তাহমিদের মন ভালো করার চেষ্টা করছে।

কুহুর কথা শুনে তাহমিদ ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ও মনে করতে পারছেনা কুহুর কোন কথার উত্তর দেয়নি। ও ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করছে। অনেকক্ষন ভাবার পরও বেচারা বুঝতেই পারলোনা ওর অপরাধ কোথায়। বাধ্য হয়েই কুহুকে জিজ্ঞেস করল,

” তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর দেইনি আমি! এক্সকিউজ মি, তুমি কি আমাকে আদৌ কোন প্রশ্ন করেছিলে! তুমি দেখছি দিনকে দিন বড্ড সেয়ানা হচ্ছ! শোন মেয়ে, আমার সাথে সেয়ানা গিরি করে পার পাবেনা। তুমি বুনো ওল হলে, আমি কিন্তু বাঘা তেঁতুল। ”

” অযথাই আমাকে অপবাদ দেবেননা। আমি আপনাকে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আপনি এখন পর্যন্ত উত্তর দেননি। ”

কুহুর গোমড়ামুখ দেখে তাহমিদ হাসল।

” সজলের বাসায় গিয়েছিলাম। মায়া না খেয়ে আসতেই দিলনা। শোন, যেকারনে তোমাকে ডেকেছি। আমি কালকেই ঢাকা ফিরছি। ঠিক দুইদিন পর আমি এস্তোনিয়া যাচ্ছি। সেখানকার তার্টু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা কোর্সের জন্য ডাক পেয়েছি। দুইমাস থাকতে হবে সেখানে।দুইমাস পর দেশে এসে তোমাকে সারপ্রাইজ দেব। ততদিন তুমি সাবধানে থেক। তালুকদার সাহেব খুব তারাতারি বাসা ঠিক করে ফেলবেন। আমিও তার সাথে গিয়ে কয়েকটা বাসা দেখেছি।”

” কালকেই চলে যাবেন! ”

” হুম। তবে তারাতারি ফিরব। এটা নিয়ে রুমে যাও। খালাও নিশ্চয়ই খায়নি। তাকে ঘুম থেকে তুলে, দু’জন একসাথে খেয়ে নিবে। এতক্ষণে খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে। গরম করে নিও। এখন রুমে যাও। অনেক রাত হয়ে গেছে। ” তাহমিদ কুহুর হাতে খাবারের প্যাকেট দিল।

কুহু হাত বাড়িয়ে প্যাকেট নিল। কিন্তু কোন কথা বললনা। ওর বুকটা ভারি হয়ে গেছে। মানুষটা আসতে কি না আসতেই চলে যাবে। অথচ কতদিন পর রাজশাহী এসেছে।

কুহু কিছু না বলে চুপচাপ নিচে চলে যায়।

পরদিন সকালে তাহমিদ ঢাকা রওনা দেয়। রায়হান আহমেদ অফিসে চলে গেছেন। সৈকত আহমেদ তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেশিরভাগ সময় ফাতিমা খানমের রুমে কাটাচ্ছে। অনেকদিন পর সে তার মা’কে ফিরে পেয়েছে। কিন্তু নায়লা আঞ্জুম রুম থেকে একবারও বের হয়নি। না সে তার ভাইয়ের সাথে কথা বলেছে , না তার স্ত্রী-সন্তানদের সাথে কথা বলেছে। সে বাসায় খায়নি। খাবার অর্ডার দিয়েছিল। সেই খাবারই সন্তানদের নিয়ে খেয়েছে। সৈকত আহমেদ তার সাথে কথা বলতে গেলেই, সে তার ভাইকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে কয়েকবার।

কুহু বিপদে পরেছে। ওকে দেখলেই নায়লা আঞ্জুম খেঁকিয়ে উঠছে। নানা ধরনের কথা বলছে। কুহু আর সহ্য করতে পারছেনা। গতরাতে সে তাহমিদকে জানাতে চেয়েছে, ও আলাদা বাসা নিতে চায়। কিন্তু তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর সাহস করে উঠতে পারেনি।

কুহু বিকেলে কোচিং-এ গিয়ে সেখানকার কয়েকজন শিক্ষককে আরেকবার করে একটা বাসা দেখার কথা বলে দেয়। তারাও জানায় কুহুর জন্য একটা নিরাপদ বাসা খুঁজে দেবে। তবে একজন শিক্ষিকা জানায়, তার ফুপুর বাসায় দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট ফাঁকা আছে। ফুপুর ছেলেমেয়েরা সবাই দেশের বাহিরে থাকে। বৃদ্ধা ছয়তলা বিল্ডিংয়ের নিচতলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। বাকি পাঁচতলা ভাড়া দেয়া হয়েছে। বৃদ্ধা কথা বলার কোন সঙ্গী পাননা। তার স্বামী কয়েক বছর আগে মা’রা গেছেন। তাই তিনি ফাঁকা দুই রুম ভাড়া দিয়ে গল্প করার একটা সঙ্গী চান। তিনি এ-ও বলেছেন, নামমাত্র টাকায় তিনি ফ্ল্যাটটা ভাড়া দেবেন। কুহু সব শুনে কোচিং শেষে সেই বাসায় গিয়ে বৃদ্ধার সাথে কথা বলেছে।

সন্ধ্যায় রায়হান আহমেদ বাসায় এসে জানালেন, তিনি একটা ফ্ল্যাট পছন্দ করেছেন। আগামীকাল থেকেই তারা ফ্ল্যাট গোছাতে শুরু করবেন। তিনি কুহুকে ডেকে সব গোছগাছ হরতে বললেন। এবার আর নায়লা আঞ্জুম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলনা। সে নিজের সমস্ত রাগ, জেদ ঢেলে দেয় কুহু৷ ওপরে।

” খুব বাড় বেড়েছে তোমার? আমার কাছ থেকে না শুনেই তুমি বাসা দেখেছ! এতবড় সাহস তুমি কোথায় থেকে পেয়েছ? তোমার নতুন বাসায় তুমিই যেও। আমি এই বাসা ছেড়ে কোথাও যাবনা। তোমার যেখানে খুশি তুমি সেখানে যাও। ”

” ঠিক আছে, তুমি না গেলে যেওনা। আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠব। তোমার অহংকার নিয়ে তুমি থাক। আমাদের জীবনে তোমার কোন প্রয়োজন নেই। কুহু মা, তুই গিয়ে গোছগাছ করে নে। এই মহিলাকে ছাড়াও আমাদের চলবে। ”

” হ্যাঁ, এখনতো ঐ হাভাতে, ফকিন্নিই তোমার সব। যেদিন থেকে তোমার ভাই ম’রে’ছে সেদিন থেকেই যেন ওরা তোমার আপন হয়ে গেছে। আর যখন তোমার ভাবি ম’র’ল তখন এই হাভাতে দুটো তোমার আপন হয়ে গেল? এখন এই হাভাতেদের ছাড়া তোমার চলছেইনা? কিসের এত দরদ? যার যেখানে স্থান, তাকে সেখানেই রাখতে হয়। তুমি পায়ের জুতাকে মাথায় তুলছ। ভুলে যেওনা আমি তোমার স্ত্রী। আমি চাইলেই নারী নির্যাতনের মামলা দিয়ে তোমাকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াতে পারি। তাই যা করার ভেবেচিন্তে করবে। ”

নায়লা আঞ্জুমের করা আজকের অপমান কুহু কিছুতেই সহ্য করতে পারলনা। ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। কিন্তু ও মুখ খোলার আগেই রায়হান আহমেদের গলা শুনতে পায়।

” খবরদার নায়লা, আমার ভাই-ভাবী কিংবা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোন কথা তুমি বলবেনা। তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা। তোমার মত স্ত্রী’কে আমার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে আমি তোমাকে ডিভোর্স দেব। তোমার…

রায়হান আহমেদ কথা শেষ করতে পারলেননা। তার আগেই কুহু কথা বলল।

” চিন্তা করবেননা চাচি, আমি কালকেই সৃজনকে নিয়ে এই বাসা থেকে বেরিয়ে যাব। এই হাভাতেদের মুখ আপনার আর দেখতে হবেনা। আপনি বরং মন দিয়ে সংসার করবেন। চাচা, তুমি আমাদের জন্য কেন নিজের সংসারে অশান্তি ডেকে নিয়ে আসছ! আমি আজই একটা বাসা দেখেছি। তবে কোন কথা দিইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কথা দিলেই ভালো হত। আমি এক্ষুনি বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলব। কাল সকালেই সৃজনকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব। ”

” কুহু মা, এসব তুই কি বলছিস? তুই কোথাও যাবিনা। তুই আমার সাথে আমাদের নতুন ফ্ল্যাটে উঠবি। দেখি কে তোকে আটকায়। ”

” না চাচা, তা আর হয়না। আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আর যাইহোক নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আমি তোমার সাথে নতুন বাসায় যাবনা । আমাদের বাবা-মা নেই বলে কি যে কেউ আমাদের পায়ে মাড়াবে? এটা আমি কখনোই হতে দেবনা। এছাড়াও অনেক আগেই আমি এখান থেকে বেরিয়ে যেতাম। শুধু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাটি কামড়ে পরে ছিলাম। কিন্তু আর নয়। আমি রাজশাহীতে থেকেই সৃজনকে পড়াশোনা করাব আর নিজেও পড়ব। চিন্তা করোনা, এখন দুইটা কোচিং-এ পড়াচ্ছি। সামনে অন্য কোথাও কাজ নিব। আর বাবার যে কয়টা টাকা আছে, সব মিলিয়ে আমাদের দুই ভাইবোনের ভালোই চলে যাবে। তুমি আর আমাদের আটকাবেনা প্লিজ। আমাদের জন্য দোয়া করবে। ” কুহু আর সেখানে দাঁড়ায়না। দৃঢ় পায়ে রুমের দিকে হেঁটে যায়।

এতক্ষণ রাজিয়া খালা রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। তিনি সৈকত আহমেদের ছেলের জন্য নুডলস বানিয়ে এনেছিলেন। সৈকত আহমেদের রুমে যাওয়ার সময় কথাগুলো তার কানে যায়।

কুহুর এমন সিদ্ধান্ত শুনে খালার চোখে পানি জমেছে। তিনি তাহমিদকে কি বলবেন? এখন যদি এসব কথা তাহমিদের কানে যায়, সে আবারও রাজশাহী ফিরে আসবে। তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দেবে। হয়তো তার আর বিদেশ যাওয়াই হবেনা। অনেক কিছু ভেবে খালা এখনই তাহমিদকে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নেন। তার আগে কুহুর সাথে আলোচনা করতে হবে।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী জামী

পরদিন সকালে কুহু সৃজনকে তৈরী হতে বলে নিজেও তৈরী হয়ে নেয়। রাজিয়া খালা ছলছল চোখে ওর কাজকর্ম দেখছে। রাতেই কুহু ওদের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেখেছিল এবং বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে রেখেছিল। ও বৃদ্ধাকে জানিয়েছিল, সকালেই ওরা বাসায় উঠবে।

” মাগো, না গেলে হয়না? তোমার চাচার বাড়িতেই যাইয়া থাইক। তুমি একা মাইয়া, ছোট ভাইরে নিয়া নতুন জায়গায় কেমনে থাকবা! আমার চিন্তা হইব গো, মা। ” রাজিয়া খালা ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।

” আমার যেতেই হবে, খালা। এবার ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। আজ যদি আমি না যাই, তবে আজীবন আমাকে পরাধীনতার শেকলে আটকে থাকতে হবে। আমি মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই, খালা। ”

” বাপজানরে আমি কি কমু? তুমি তো তারে জানোই। ”

এবার থমকায় কুহু। সত্যিইতো ও তাহমিদকে কি জবাব দেবে! আর সেই বা বিষয়টা কিভাবে নেবে? কিছুক্ষণ নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা। ততক্ষণে ওর আঁখিদ্বয় জলে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। ও চোখ মুছে ভাঙ্গা গলায় বলল,

” তাকে এখন কিছু জানানোর দরকার নেই, খালা। সে যেমন মানুষ, এসব শোনার পর দেখা যাবে, সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছে। আগে সে এস্তোনিয়া যাক। তারপর বল। ”

রাজিয়া খালা এই কুহুকে যেন চিনতে পারছেননা। মেয়েটা একরাতেই হঠাৎ করে কেমন অচেনা হয়ে গেছে! ওর চেহারায় প্রতিজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট। তার মুখে আর কোনও কথা জোগায়না।

আরও আধাঘন্টা পর সৃজনকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় কুহু। তার আগে অবশ্য নানিমা, চাচা, রিশা, নিশোর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। ওর এভাবে চলে যাওয়ার কথা শুনে রিশা কাঁদছিল। নানিমাও খুব কেঁদেছেন। সৃজন এখনও বুঝে উঠতে পারেনি ওর আপু হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল। কুহুও ছেলেটাকে কিছুই জানায়নি। রায়হান আহমেদের সাথে ওরা দুজন ওদের নতুন ঠিকানার পথে পা বাড়ায়।

দুরুদুরু বুকে, ভীতু পায়ে কুহু সৃজনকে নিয়ে এসে দাঁড়ায় নতুন বাসার সামনে। দারোয়ান প্রথমে ওদের ভেতরে যেতে দিতে চাচ্ছিলনা। ও বুদ্ধি করে বাড়ির মালিককে ডাকার কথা বলেছিল। পরে বাড়ির মালিক সেই বৃদ্ধা এসে ওদের ভেতরে নিয়ে যায়।

বৃদ্ধা ওদের দুই ভাইবোনের কাছে তিনটা ব্যাগ দেখে অবাক হয়ে গেছেন।

” তোমাদের আসবাব কই? কখন আসবে সেগুলো? ”

” দাদু, আমাদের এখন পর্যন্ত কোন আসবাব কেনা হয়নি। শুধু কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছি। ধীরে ধীরে প্রয়োজনিয় আসবাব কিনে নেব। ” প্রথমদিনই বৃদ্ধা তাকে দাদু ডাকতে বলেছিলেন। তাই কুহুও তাকে দাদু ডাকল।

বৃদ্ধা আগেই কুহুর কাছ থেকে জেনেছিলেন ওর বাবা-মা বেঁচে নেই। তাই তখনই ওর ওপর বৃদ্ধার মায়া জন্মেছিল। আজ আরেকবার ওদের দুই ভাইবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখ ভিজে উঠে।

” শোন মা, আপাতত কোন আসবাব কেনার দরকার নেই। আমার স্টোর রুমে তোমার প্রয়োজনিয় সকল কিছু পেয়ে যাবে। তুমি শুধু দেখিয়ে দাও কি কি লাগবে। আমি দারোয়ানকে বলে সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ”

” আন্টি, আপনি এসব কি বলছেন! আমার কিছু লাগবেনা। আমি ধীরে ধীরে সবকিছু কিনে নিতে পারব। ”

” সেটা পরে দেখা যাবে। আগে বাসাটা থাকার উপযোগী করে নাও। শোন, এসব আমি এমনিতেই তোমাদের জন্য করছিনা। এগুলোর বিনিময়ে আমাকে একটু সময় দিও তোমরা। এত বড় বিল্ডিংয়ে কত মানুষ বাস করে। কিন্তু কারও আমার কাছে এসে গল্প করার সময় হয়না। আমি বড্ড একা। ছেলেমেয়েরা কেউ কাছে নেই, স্বামী নেই। এই বয়সে নাতি-নাতনীদের নিয়ে আনন্দ করার বদলে আমি একা একা গুমরে ম’র’ছি। আমাকে দেয়ার মত সময় কারও নেই। ছেলেমেয়েরা টাকা দিয়ে, ভিডিও কলে কথা বলে নিজেদের দ্বায়িত্ব পালন করে। তারা বুঝতে চায়না আমি কতটা একা। ” বৃদ্ধা হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

বৃদ্ধার কান্না দেখে কুহুর চোখেও পানি জমেছে। ও ভাবছে, নিজ নিজ অবস্থান থেকে কেউই আসলে পরিপূর্ণ নয়। কোননা কোন কিছুর অভাব সকলকেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে।

রায়হান আহমেদ বৃদ্ধার একটু কাছে এগিয়ে গেলেন।

” খালাম্মা, আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়ে দুটো একেকটা রত্ন। ওরা সুযোগ পেলেই দেখবেন আপনাকে সঙ্গ দেবে। তবে এরা দু’জন বড্ড অসহায়। আজ তাদের কাছে চাচা থেকেও নেই। কতবড় দুর্ভাগা হলে কারও সাথে এমনটা ঘটতে পারে বলুন! আমিও এক অর্থে দূর্ভাগাই। এমন রত্নকে নিজের কাছে রাখতে পারলামনা। তাদের প্রতি কোনও দ্বায়িত্ব পালন করতে পারলামনা। ” রায়হান আহমেদের গলায় ক্ষোভ, হতাশা সুপ্ত থাকলনা।

” চাচা, এভাবে বলোনা। তুমি আমাদের জন্য যা করেছ, তা কোন বাবা-মা ‘ র থেকে একটুও কম নয়। তুমি এভাবে বললে আমার কষ্ট হয়। ” কুহু রায়হান আহমেদের হাত ধরে বলল।

বৃদ্ধা ওদের কথপোকথন শুনে বুঝতে পারছেন, তার ন্যায় এরাও কোন অপ্রাপ্তিতে ভুগছে। তিনি ম্লান হেসে কুহুর হাত ধরে টেনে ওকে নিজের কাছে নিলেন।

” তুমি দেখছি খুব দয়ালু একটা মেয়ে। তোমাকে আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। তুমি এবার শেফালির সাথে স্টোর রুমে যাও। কি কি প্রয়োজন সব ওকে দেখিয়ে দাও। দেখবে দুই ঘন্টার মধ্যে তোমার ফ্ল্যাটকে বসবাসযোগ্য করে দেব। ” তিনি শেফালি নামক কাজের মেয়েটির সাথে কুহুকে স্টোর রুমে পাঠিয়ে দিলেন।

রায়হান আহমেদ বৃদ্ধার ড্রয়িংরুমে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা বলছেন মাতৃসমা এই বৃদ্ধার সাথে। অনেকদিন পর কেউ তাকে এভাবে মায়ের মত স্নেহ করছেন। আজ হঠাৎ করেই তার মা’য়ের কথা ভিষণভাবে মনে পরছে।

কুহু স্টোর রুম থেকে বেরিয়ে আসলে বৃদ্ধা শিউলিকে দিয়ে সিকিউরিটিকে ডেকে পাঠালেন। সিকিউরিটি আসলে তাকে শেফালির সাথে পাঠিয়ে দিলেন স্টোর রুমে। সৃজনও তাদের পিছুপিছু স্টোর রুমে যায়।

কুহু সময় কাটানোর জন্য বৃদ্ধার সাথে কথা বলতে থাকে।

দুই ঘন্টার ভেতর কুহুর ফ্ল্যাটে প্রয়োজনিয় আসবাব সেট করে দেয় সিকিউরিটি, দারোয়ান আর মালি মিলে। বৃদ্ধার প্রতি কৃতজ্ঞতায় কুহুর মন ছেয়ে যায়। এভাবে যে নতুন কাউকে ভালোবাসা যায় আজ ও প্রথম দেখল।

রায়হান আহমেদের বিদায় নেয়ার সময় হয়েছে। তিনি কুহুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, কুহুর সাথেই বৃদ্ধার কাছে আসলেন।

” খালাম্মা, আমি এবার বের হব। আপনি আমার ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখে রাখবেন। আমরা ভাইবোনেরা ওদেরকে মাঝেমধ্যেই দেখতে আসব। এছাড়া আমার ছেলেমেয়েরাও আসবে। আর আসবে কুহুর একটা খালা। যিনি কুহুর কাছে মা’য়ের মতই। কুহু মা, তুই প্রতিদিন সময় করে এসে খালাম্মার সাথে গল্প করবি, কেমন? ”

কুহু চাচার কথার প্রত্যুত্তরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।

” কারা কারা ওদের কাছে আসবে সেটা সিকিউরিটির কাছে বলে দিয়ে যেও, বাবা। এখানকার নিয়ম খুব কড়া। আগে থেকেই বলে না রাখলে কাউকে ঢুকতে দেবেনা। ”

” চাচা, তোমরা সবাই আসবে, কিন্তু তাহমিদ ভাইয়া আসবেনা? সে তো মাঝেমধ্যে রাজশাহীতে আসে। ভাইয়া রাজশাহীতে আসবে, কিন্তু আমাদের কাছে আসবেনা? ভাইয়াকে না দেখলে আমার খুব খারাপ লাগবে। ” হঠাৎ করেই সৃজন বলে উঠল। ছেলেটার মন খারাপ হয়ে গেছে তাহমিদকে দেখবে না জন্য।

কুহু আহত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়। সৃজন উনাকে এত ভালোবাসে! কুহু ঠোঁট কামড়ে হাসল। আসলেই মানুষটা ভালোবাসার মতই। যাকে সব সময়ই ঘিরে থাকে একরাশ মুগ্ধতা আর স্নিগ্ধতা। এতক্ষণ ও তাহমিদকে দিব্যি ভুলে ছিল। হঠাৎই সৃজন তার কথা মনে করিয়ে দেয়ায়, কুহুর বুক ধুকপুক করছে। সে যখন জানবে ওরা বাড়ি ছেড়েছে, তখন সে কি প্রতিক্রিয়া দেবে? কিভাবে নেবে সে এই সবকিছু?

” আচ্ছা আব্বা, আমি তাহমিদের কথাও বলে যাব সিকিউরিটির কাছে। ও রাজশাহী আসলেই তোর সাথে দেখা করবে। আমি তাহমিদকেও বলে দেব। ” কুহুর ভাবনার মাঝেই কথা বললেন রায়হান আহমেদ।

আরও কিছুক্ষণ কথা বলে অশ্রুমাখা নয়নে বিদায় নিলেন রায়হান আহমেদ।

এদিকে দাদু কুহুকে বলেছেন, আগামী কয়েকদিন কুহুকে রান্না করতে হবেনা। এই কয়েকদিন ওরা দাদুর বাসাতেই খাবে। কুহু অনেক জোড়াজুড়ি করেও কোন লাভ হলোনা।

আরও তিনদিন পর কুহুর ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসল। কুহু তখন সবেমাত্র বই বন্ধ করে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছে। ও ফোন হাতে নিয়ে দেখল রাত এগারোটা দশ বাজে। অপরিচিত নম্বর তাও আবার এত রাত। তাই কুহু ফোন রিসিভ করলোনা। পরপর কয়েকবার ফোন বাজলেও কুহু রিসিভ করলনা।

টুং করে শব্দ হতেই কুহু ফোন হাতে নিয়ে দেখল একটা ম্যাসেজ এসেছে সেই অপরিচিত নম্বর থেকে। কুহু ম্যাসেজ ওপেন করে দেখল ছোট্ট করে লিখা আছে, ” ফোন রিসিভ কর। ” ব্যাস ও বুঝে যায় তাহমিদের ম্যাসেজ।

প্রায় সাথে সাথেই ফোন বেজে উঠল। কুহু দুরুদুরু বুকে ফোন রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। এতক্ষন তো ফোন রিসিভ করছিলেনা, এখন আবার জিজ্ঞেস করছ কেমন আছি! যাহোক আমি ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো? সৃজন কেমন আছে? কি করছে ও? ”

” আমরা সবাই ভালো আছি। সৃজন ঘুমিয়েছে। আপনি কি করছেন? ”

” আমি মাত্রই রুমে আসলাম। রাতে খেয়েছ? ”

” জ্বি খেয়েছি। আপনি? ”

” আরেকটু পর খাব। কোচিং-এ গিয়েছিলে? সব ঠিকঠাক আছে? ”

” জ্বি সব ঠিকঠাক আছে। ”

” অনেক রাত হয়েছে। আর জেগে থেকোনা। সকালেতো আবার কোচিং-এ ছুটবে। নিজেদের খেয়াল রেখ। আর হ্যাঁ, আমি প্রচুর ব্যস্ত থাকব। রেগুলার ফোন দিতে পারবনা। মাঝেমধ্যেফোন করব। নম্বরটা সেইভ করে রেখ। রাখছি। ” তাহমিদ তারাহুরো করেই ফোন রাখল। ওকে আবার বেড়োতে হবে। কয়েকদিন দৌড়ের ওপর থাকতে হবে।

সকাল থেকে রাজিয়া খালার মন ভালো নেই। চিন্তায় তার বুক শুকিয়ে আছে। তাহমিদ সকালে ফোন দিয়েছিল। যদিওবা কুহুর কথা কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। তবে তিনি জানেন এরপর ফোন করলে অবশ্যই সে তাকে কুহুর কথা জিজ্ঞেস করবে। তিনি কি উত্তর দেবেন? আর সত্যিটা বলার পর তাহমিদ কি করবে? খালা আর কিছু ভাবতে পারছেননা। আজকে তিনি কাজেও মন দিতে পারছেননা।

কয়েকদিন কুহুর বেশ ভালোই কেটেছে। সাতদিন ওরা দাদুর বাসাতেই খেয়েছে। কাজের ফাঁকে গিয়ে দাদুর সাথে গল্প করে আসে। দাদু আরও কয়েকদিন ওদের তার কাছে খাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কুহু রাজি হয়নি। ও দুইদিন আগে সংসারের টুকটাক জিনিসপত্র কিনে এনেছে। এরমধ্যে আর তাহমিদ ফোন দেয়নি। তবে কুহু জানে দুই-এক দিনের মধ্যেই সে ফোন দেবে। তাকে কিভাবে বলবে তারা ঐ বাসায় নেই, এই চিন্তাই এখন কুহুকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

রাজিয়া খালা রান্নাঘরে কাজ করছেন। তার পাশে আরও দুইজন মেয়ে যে যার কাজ করছে। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। তিনি ফোন হাতে নিয়ে বুঝলেন আরেকদিন তাহমিদ এই নম্বর দিয়েই ফোন দিয়েছিল। শুকনো মুখে তিনি ফোন রিসিভ করলেন।

” কেমন আছো, বাপজান? কি করতাছো এখন? ”

” আমি ভালো আছি, খালা। নানিমা কেমন আছে? বাসার সবাই ভালো আছে? আমি কিছুক্ষণ আগে রুমে এসেছি। এখন রেস্ট করছি। সারাদিন খুব খাটতে হয়। সেজন্যইতো তোমাদের সাথে কথা বলতে পারিনা। ”

” আমরা সবাই ভালো আছি, বাপজান। তুমি খাইছো? এখন তোমার ঐ দেশে কয়ডা বাজে? ”

” খেয়েই তবে রুমে এসেছি। এখন এখানে সন্ধ্যা সাতটা। কিন্তু তুমি কি করছ? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছেনা তুমি ঘুমিয়েছ। এখন বাংলাদেশে এগারোটা বাজছে। তুমি এখনও জেগে আছ কেন? ”

” বাপজান, আইজ বাসায় অনেক আত্মীয় আসছিল। সৈকত তার বউ পোলাপান নিয়া আসছে। তাই তাদেরকে দেখবার জন্য সবাই আসছিল। সবাই রাতের খাবার খাইয়াই গেছে। তাই আমরা এখনো জাইগা আছি। রান্নাঘর গোছগাছ কইরাই তবে ঘুমাইতে যাব।”

” খুব ঝামেলায় আছ দেখছি। আচ্ছা খালা, কুহু কই? ওকে ফোনটা দাও। এই সুযোগে ওর সাথেও কথা বলে নেই। ”

রাজিয়া খালার হাত থেমে গেছে। তিনি এখন কি উত্তর দেবেন। সেই সাথে শুকিয়ে এসেছে গলা। তার পাশে দুইজন মেয়ে এখনও কাজ করছে। তাই তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে করিডোরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাকে আজ সত্যিটা বলতেই হবে, এটা তিনি বুঝে গেছেন।

” বাপজান, তুমি এখন ঘুমাও। পরে কথা কইও কুহু মায়ের সাথে। ” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল খালা।

” আমি আগে ওর সাথে কথা বলে নিই। তারপর ঘুমাব। তুমি ওকে দাও। ”

” হেয় বাড়িতে নাই। ” এক নিঃশ্বাসে বললেন তিনি।

” কোথায় গেছে! ও গ্রাম থেকে কয়দিন আগেই না বেড়িয়ে এসেছে। এখন আবার কোথায় গেছে? ”

” বাপজান, তুমি মাথা ঠান্ডা কইরা আমার কথা শুনবা কও? আমারে কথা দেও। ”

” বল, খালা। আমি শুনছি। ” কাঠকাঠ গলায় বলল তাহমিদ।

” কুহু মা সৃজনরে নিয়া বাড়ি ছাইড়া ভাড়া বাড়িতে গেছে আজ আটদিন হয়। ” এরপর খালা একে একে সেদিনের সব ঘটনা খুলে বললেন।

সব শুনে তাহমিদ স্তব্ধ হয়ে গেছে। ওর অজান্তেই এত কিছু হয়ে গেছে, অথচ ওকে কেউই কিচ্ছু জানায়নি! অবশ্য ও এই কয়দিন রায়হান আহমেদের কাছে ফোন করেনি। তাই কিছু জানতেও পারেনি। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। সব কথাগুলো তাহমিদের কন্ঠায় এসে আটকে গেছে। সে এখন খালাকে কি বলবে! সেই সাথে এটাও অনুভব করছে, হুট করেই ওর রা’গ তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ও ফোন কেটে দেয়।

কুহু কেবলই বই রেখে শুয়েছে। সেই সময়ই ফোন বেজে উঠল। ও ভয়ে ভয়ে রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন ? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। তুমি এখন কোথায়? “কুহুর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন প্রয়োজনবোধ করলনা।

তাহমিদের গলা শুনে কুহু বুঝে গেছে সে সবটাই জেনে গেছে। এখন আর লুকোচুরির কোন সুযোগ নেই।

” আমি এখন সাহেব বাজার থাকি। ” মৃদু গলায় বলল মেয়েটা। এরপর কি প্রশ্ন আসবে সেই চিন্তায় ও চোখে অন্ধকার দেখছে।

” বাহ্। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে শিখেছ। খুব বড় হয়ে গেছ দেখছি! আজ মনে হচ্ছে তোমার সাথে মিথিলা আরজুমান্দের বড্ড মিল। সে-ও তার নিজের প্রয়োজনে সংসার ছেড়েছিল। আর তুমিও নিজের প্রয়োজনেই ঐ বাড়ি ছেড়েছ। অথচ আমাকে একটিবার জানানোর প্রয়োজনই মনে করনি! আর আমি কিনা এদিকে সর্বদাই তোমার চিন্তায় অস্থির থাকি। নতুন বাসায় খুব শান্তিতে আছ তাইনা? তবে থাক শান্তিতে। আমাকে যখন তোমার প্রয়োজনই নেই, তবে মিছেমিছি আমি কেন তোমার চিন্তা করব। তুমি যদি আমাকে ছাড়াই নিজের ভালোমন্দ বুঝতে পার, তবে আমি কেন তোমার জন্য ভালোর জন্য ভাবব? তুমি তোমার মতই থাক। ” তাহমিদ রা’ গ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।

” আপনি রা’গ করবেননা, প্লিজ। একটিবার আমার কথা শুনুন। আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। আমাক..

” কি শুনব হ্যাঁ? তুমি একবারও ভেবে দেখেছ, একা একটা মেয়ে সম্পূর্ণ আত্মীয় স্বজন ছাড়া, নতুন জায়গায় থাকতে গেলে, এতে কত সমস্যা হতে পারে? তোমার প্রটেকশনের জন্য সেখানে কেউই নেই। আল্লাহ না করুন, কোন বিপদ হলে কে এগিয়ে আসবে। এসব ভেবে দেখেছ? আরে দুনিয়াটা কত খারাপ সে সম্পর্কে কোন ধারনা আছে তোমার? তুমি একা একটা মেয়ে। লোকজন সুযোগ পেলেই যে তোমার ক্ষতি করতে চাইবেনা, সেটা তুমি বলতে পারবে? ” কুহুকে কথা বলতে না দিয়েই তাহমিদ কথা বলল।

তাহমিদের গলা শুনে কুহু বুঝতে পারছে সে ভিষণ রে’গে গেছে। এই মুহূর্তে কোন কথাই তাকে শান্ত করতে পারবেনা।

” আপনি একটু শান্ত হোন। আমার কথা একবার শুনুন। ” ভয়ে কুহুর শরীরের সাথে গলাও কাঁপছে।

” এই মুহূর্তে তোমার কোন কথা শোনার ইচ্ছেই আমার নেই। তুমি থাক তোমার মত। নিজের মত করে শান্তিতে দিন কাটাও। কেউ তোমাকে বাঁধা দিতে যাবেনা। ” তাহমিদ কথাগুলো বলেই ফোন কেটে দেয়।

পরমুহূর্তেই কুহু তাকে ফোন দিলে বিজি দেখায়। পরপর কয়েকবার ফোন দিয়েও তাকে পায়না। পুরো রাত কুহু তাহমিদকে ফোনে পায়না। সেই রাতে আর কুহুর ঘুম হলোনা। পরদিন সকালেও তাহমিদকে ফোনে পায়না। এভাবে পরপর কয়েকদিন ট্রাই করেও তাহমিদকে পায়না। এরইমধ্যে রাজিয়া খালার সাথে কথা বলে জানতে পারে তাহমিদ তাকে গতকাল ফোন দিয়েছিল। কুহু বুঝতে পারে তাহমিদ ওর নম্বর ব্লক লিষ্টে রেখেছে।

চলবে….

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-২৭+২৮

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৭
জাওয়াদ জামী জামী

” আমার হলদে পাখি । ” তাহমিদ আনমনেই বলে উঠল.
দেয়ালের গা বেয়ে বেড়ে উঠা হলুদ অলকানন্দা গাছের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুহু। গাছ ভর্তি হলুদ অলকানন্দার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যও অতটা মোহিত করতে পারলনা তাহমিদকে, ও যতটা মোহিত হয়েছে তার শ্যামাঙ্গীনির রূপে। কুহুর পরনে কাঁচা হলুদ রংয়ের থ্রি-পিস। তাহমিদ বিমোহিত নয়নে দেখছে তার চঞ্চলা পাখিকে। যার প্রনয়ে সে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায়। তার প্রনয়ের পরশ মাখতে চায় নিজের তনু-মনে। সেই প্রনয়কে নিজের অস্তিত্বে বেঁধে রাখতে চায় আজীবন।
কুহু দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। রায়হান আহমেদ সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।

অনেকদিন পর বাড়িটা যেন প্রান ফিরে পেয়েছে। সোহানী পারভিন ছোট ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের কাছে পেয়ে খুশিতে কেঁদে ফেললেন। রিশা, নিশো চুপটি মে’রে ফুপুর কাছে বসে থাকল।

সাইদ আহমেদের ছেলেমেয়ে সিহা আর সাদমানও এই বাড়িতে এসেছে। কুহুরা আসার পর থেকেই ওরা এখানে বেশি সময় কাটাচ্ছে। শিরিন আক্তার ওদের বাঁধা দিলেও, ওরা তার কোন নিষেধই মানছেনা। ওরা তাদের কুহুপু আর বড় ফুপুর আশেপাশেই থাকতে চায়।

গভীর রাত। ধরনীর বুকে আঁধার তার রাজত্ব শুরু করেছে। ধরনীও আঁধারকে শরীরে মেখে নিয়ে দিনকে ঘুম পারিয়েছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। কোথাও কোন শব্দ নেই। মাঝেমধ্যে রাতচোরা পাখি ডেকে উঠছে কোন গাছের শাখা-প্রশাখার আড়াল থেকে। থেকে থেকে ঝিঁঝিঁরা তারস্বরে গান শুনিয়ে রজনীকে শান্ত করছে।
অম্বরে রুপালী সুধাকর ধরনীকে সাজাতে তার আলোর পসরা উজার করে ঢেলে দিয়েছে।

তাহমিদ উঠানে পেতে রাখা মাদুরে সটান হয়ে শুয়ে উর্দ্ধাকাশে নিনির্মেষ তাকিয়ে দেখছে আলো-আঁধারির খেলা। থেকে থেকেই চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে এক টুকরো মেঘ। আবার পাগলা হাওয়ার দল হুট করেই মেঘেদের গায়ে আছড়ে পরে, তাদেরকে সরিয়ে দিচ্ছে। নিয়মিত বিরতিতে চাঁদ, মেঘ আর বাতাসের লুকোচুরি চলছে।

” নিন আপনার বিখ্যাত কালো কফি। ” হুট করেই কুহু এসে বসল তাহমিদের পাশে। ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে কফির পাত্র।

তাহমিদ যেন জানত কুহু উঠানে আসবেই। তাই ও কুহুর আগমনে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়না। শুধু মৃদু হেসে শোয়া থেকে উঠে বসল।

” কালো কফি! তোমাকে যতটা চুপচাপ মনে করতাম, ততটা চুপচাপ তুমি নও। বরং একটু বেশিই চঞ্চল। তো, কালো কফি শুধু আমার জন্যই এনেছ? তোমারটা কই? ”

” আমি এসব খাইনা। কি তেঁতো। এসব গরু-ছাগলের খাবার। আমি বাপু সাধারন মানুষ। ”

” মানে পরোক্ষভাবে তুমি আমাকে গরু-ছাগল বলছ! আজকেই শেষ। এরপর জীবনেও আর কফি পান করবনা। এতবড় অপমান মেনে নেয়া যায়না। ” কথা বলতে বলতে তাহমিদ পাশ থেকে ডার্ক চকলেট বক্স হাতে নিয়ে কুহুর দিকে বাড়িয়ে দেয়।

কুহু অসময়ে চকলেট দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছে।

” চকলেট কেন! আপনি কি চকলেট সাথে নিয়ে চলাফেরা করেন? ”

” উহু। একজনকে এখনও তার অর্জনের জন্য মিষ্টিমুখ করানো হয়নি। তাই এই সামান্য আয়োজন। সে যদি এই সামান্য উপহার গ্রহন করে তবে কৃতার্থ হই। ”

তাহমিদের কথার ধরনে কুহু হাসল। ডান হাত বাড়িয়ে চকলেটের বক্স নেয়।

” ধন্যবাদ। ”

” রাজশাহীতে কবে ফিরছ? ”

” চাচা যদি কালকে থেকে যায়, তবে পরশুদিন ফিরব। আপনি থাকবেননা? ”

” আমি সকালেই বেরিয়ে যাব। জরুরী কাজ আছে। ”

” ঢাকা ফিরে যাবেন? ” ম্লান গলায় বলল কুহু। চোখের কোনে চিকচিক করছে অশ্রু।

” নাহ্। চার-পাঁচদিন আছি। তারাতারি ফিরে যেও। পরশুদিন বেলা এগারোটার মধ্যে তোমাকে রাজশাহীতে দেখতে চাই। ”

তাহমিদের কথায় অধিকারবোধ স্পষ্ট। যা কুহুর কর্নকুহরে ঠিক পৌঁছে গেছে।

” চাচা যদি যেতে দেরি করে তখন আমি কি করব! আমিতো তাকে তারাতারি যাওয়ার কথা বলতে পারবনা। ”

” কোচিং বন্ধ আছে? নাকি ছেড়ে দিয়েছ? ” কুহুর কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই আসেনা, ছুটি নিয়েছি। ”

” কাল সারাদিন শান্তি করে ঘুরে বেড়াও। আত্মীয় স্বজনদের সাথে সময় কাটাও। ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে গেলে, আর সেসবের সুযোগ পাবেনা। ”

কুহু তাহমিদের কথা আপাতত শুনছেনা। ও তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা আগের থেকে একটু যেন শুকিয়ে গেছে। গায়ের রংটাও কেমন মলিন হয়ে গেছে। তবে নিজেকে পরিপাটি করে রাখায় পরিবর্তনটা খুব একটা ধরা যাচ্ছেনা। হঠাৎ করেই কুহুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। কি হয়েছে তার?

” আপনি কি অসুস্থ? ”

হঠাৎ অপ্রাসংঙ্গিক প্রশ্ন করায় তাহমিদ ভুরু কুঁচকে কুহুর দিকে তাকায়।

” হঠাৎ এমনটা মনে হলো কেন? যেখানে আমাকে দেখে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পরে, ইভেন বাসে আসার সময়ও একজন এ্যাড্রেস নিয়েছে। সেখানে তুমি আমাকে অসুস্থ বানিয়ে দিলে! তাহমিদ সব সময়ই ফিট থাকে বুঝলে? কোন অসুস্থতা তাকে ছুঁতে পারেনা। সত্যি বলতে কি জানো, সুন্দর মানুষদের কখনো অসুখ হয়না। ”

তাহমিদের এমন আবোলতাবোল উত্তর শুনে কুহু রে’গে যায়। মানুষটা এমন কেন!

” যদি অসুস্থই না হবেন, তবে চেহারা এমন শুকিয়ে গেছে কেন? নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করেননি? এবার সোজাসুজি উত্তর দেবেন। আমি কোন আবোলতাবোল উত্তর শুনতে রাজি নই। ”

” শুনেছি মেয়েদের সংসার করতে ইচ্ছে করলে, এমন অনেক জিনিসই আছে উল্টাপাল্টা দেখে। তাদের চোখে সংসারের স্বপ্ন এমনভাবে সেঁটে যায় যে সাধারণ জিনিসের মাঝেও খুঁত খুঁজে পায়। তোমার কি এখন সংসার করতে ইচ্ছে করছে? পাত্র দেখব? কেমন পাত্র পছন্দ? ”

” আবারও উল্টাপাল্টা বকছেন? আমি ঘরে গেলাম। আপনি এখানে একা একাই দেবদাসের মত শুয়ে থাকেন। ” কুহু বিরক্ত হয়ে গেছে।

” তো, আমি কোন রোমিও! আমিতো দেবদাসই। জীবনে কোন রং নেই। সাধ-আহ্লাদ নেই। একটা প্রেমিকা নেই, একটা বউ নেই। দুই গন্ডা ছেলেপুলে নেই। দুই-চারটা শালা-শালী নেই। একটা শ্বশুর বাড়ি নেই। আমি শুকিয়ে শুটকি হবনাতো কে হবে? বেঁচে আছি এই ঢের। জীবনে একটা বউয়ের বড্ড অভাব বুঝলে? বউ ছাড়া জীবনটা পানসে। একজন পুরুষের জীবনে বউই রং এনে দিতে পারে। কিন্তু আমার ভাগ্য দেখ। এই বয়সে এসেও বউয়ের জন্য হাহাকার করতে হয়। ”

তাহমিদের মুখভঙ্গি দেখে কুহু হাসতে থাকে।

” বউ ছাড়াই যখন এত বছর কাটিয়ে দিলেন। তবে এখন কেন বউয়ের জন্য হাহাকার করছেন? বাকিটা জীবন এইভাবেই কাটিয়ে দিন। স্বাধীনভাবে বউ শূন্য জীবন উপভোগ করুন। ”

” বউ শূন্য ব্যাক্তিরা কত যে অসহায় তা তুমি কিভাবে বুঝবে নিষ্ঠুর মেয়ে। বউ শূণ্য জীবন আমি কাটাবো কেন? এর থেকে বড় শাস্তি জীবনে আর দ্বিতীয়টি নেই। ঐটা আমার শত্রুর সাথেও যেন না ঘটে। বউয়ের উপকারিতা সম্পর্কে তোমাকে একটু ধারণা দেয়া দরকার। তবেই যদি তুমি বুঝতে পার। ”

” থাক, এত বুঝে আমার কাজ নেই। এখন ঘুমাতে যান। নাকি সারারাত মশাদের গান শোনার জন্য উঠানেই বসে থাকবেন? ”

” অন্য কেউ যদি আমার দুঃখের কথা না শোনে, তবে মশাদের গান শুনতে শুনতে নাহয় নিজের দুঃখের কথা শেয়ার করি। এখন মশারাই আমার বউ শূন্য জীবনের সঙ্গী। ” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তাহমিদ।

কুহুর এই মুহূর্তে আকাশপাতাল কাঁপিয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাড়িতে এখন সবাই আছে। ওর হাসির শব্দে কেউ যদি বাহিরে আসে, তবে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাই অনেক কষ্টে হাসি দমিয়ে রাখল।

” রুমে গিয়ে মশাদের সাথে সুখ-দুঃখের গল্প করবেন। প্রয়োজনে মশারী খুলে রাখবেন। এখন রুমে যান। অনেক রাত হয়েছে। আর বাহিরে থাকবেননা। ”

” হাহ্ তাহমিদ ভাই, তোর আসলেই পো’ড়া কপাল। কেউই তোর দুঃখ বোঝেনা। কি আর করার, যাই ভেতরেই যাই। ” কথার মাঝেই তাহমিদ পকেট হাতড়ে কিছু একটা বের করল। আচমকা চেপে ধরল কুহুর হাত। চোখের ইশারায় ওকে শান্ত থাকতে বলল।

কুহু দেখল তাহমিদ একটা ছোট প্যাকেট বের করেছে। মেয়েটা স্থির চোখে তাকিয়ে দেখছে সামনের মানুষটাকে। চাঁদের আলো তার মুখাবয়বে আছড়ে পরেছে। আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে তার সুন্দর মুখশ্রী। কুহু তাহমিদের মুখের প্রতিটি শিরা-উপশিরা মনযোগ দিয়ে দেখছে। হঠাৎই ওর চোখ পরল তাহমিদের ডানদিকের ভ্রুর নিচে। সেখানে একটা কা’টা দাগ স্পষ্ট। অথচ আগেও সেখানে কোন কা’টা দাগ দেখেনি কুহু। কি হয়েছিল তার? কুহু কেবলই জিজ্ঞেস করতেই মুখ খুলবে, ঠিক তখনই কুহু ওর পায়ে কোন কিছুর শীতল ছোঁয়া অনুভব করল। ভয়ে ভয়ে পায়ের দিকে তাকাতেই ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। তাহমিদ যত্ন করে ওর পায়ে নুপুর পরিয়ে দিচ্ছে!

কুহু নিনির্মেষ নেত্রে চেয়ে দেখছে সামনের মানুষটাকে। মানুষটা ওকে এত বোঝে কেন! কেন এভাবে আগলে রাখে! আর কেনইবা ওর কথা ভাবে!

” শ্যামাঙ্গীনি তার অনেক বড় অর্জনের জন্য আমার কাছ থেকে ছোট একটা উপহার ডিজার্ভ করে। তার প্রতিটা অর্জনেই কিছুনা কিছু উপহার তার জন্য বরাদ্দ থাকবে। সে যেন নির্দিধায়, নিঃসংকোচে আমার উপহার গ্রহন করে। ”

তাহমিদের কথার প্রত্যুত্তরে কি বলবে কুহু। এমন কথার প্রত্যুত্তর ওর জানা নেই৷ ও নীরব হেসে তাকিয়ে থাকে সুদর্শন যুবকের দিকে। কিন্তু আবারও ওর চোখ যায় ভ্রুর নিচে কা’টা দাগের দিকে। নিমেষেই ওর মুখ কালো হয়ে যায়।

” ভ্রুর নিচে কি হয়েছে? কা’টা দাগ কেন? আগেতো এটা ছিলনা। ”

কুহুর কথা শুনে তাহমিদ মুখ তুলে তাকায় মেয়েটার দিকে। ওর চোখমুখ বিস্ময় খেলে যায়।

” তুমি আমার চেহারার দিকে তাকিয়েছ! মাই গড! আমার কি সৌভাগ্য। তারমানে আমি নিশ্চয়ই সুদর্শন। তাই তোমার দয়া হয়েছে আমার প্রতি। ”

” খবরদার কথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেবেননা। কি হয়েছিল আপনার? সোজাসাপটা উত্তর দিন। “।

কুহুর কন্ঠে কিছু একটা ছিল, যা শুনে থমকায় তাহমিদ। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ভেতর থেকে উছলে পরা অনুভূতিদের সামাল দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল।

” মাস খানেক আগে ছোট্ট একটা এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। একটা সিএনজি ধাক্কা দিয়েছিল। রাস্তায় পরে গিয়েছিলাম। তখনই কিছু একটা লেগে কেটে গিয়েছিল। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুকের ভেতর ছলকে উঠে ব্যথারা। এতকিছু ঘটে গেছে তা-ও সে একবারও জানায়নি! এত চাপা কেন মানুষটা! সবাইকে ভালো রাখতে নিজেকে উজার করে। কিন্তু নিজের বেলায় কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। কেন এমন সে?

” কই আমাদের তো কিছুই জানাননি! খালাও নিশ্চয়ই জানেননা। এমন কেন আপনি? ” কুহুর গলা কাঁপছে।

” এই সামান্য বিষয়ে তোমাদের জানিয়ে কি নিজেই বিপদে পরতাম। খালাকে জানানোর সাথে সাথে সে কান্নাকাটি শুরু করত। আর তাকে শান্ত করতে আমাকেই রাজশাহী আসতে হত। নিজের কাজ ফেলে সেটা করা সম্ভব ছিলনা, তাই জানাইনি। ”

” আপনি ঘরে যান। অনেকক্ষণ ধরে বাহিরে আছি। কেউ দেখলে লজ্জায় পরে যাব। ” কুহু আর উঠানে থাকলনা। চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরে চলে গেল।

তাহমিদ বুঝতে পারছে কুহু বেশ রা’গ করেছে। তাই এমনভাবে উঠে চলে গেল। সে-ও ম্লান হেসে রুমের দিকে পা বাড়ায়।

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৮
জাওয়াদ জামী জামী

” নানিমা, সারপ্রাইজের জন্য তৈরী থাক। তোমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সারপ্রাইজ আসতে চলেছে। নানা ভাইও তোমাকে এমন সারপ্রাইজ কখনোই দেয়নি। ” তাহমিদ ফাতিমা খানমের ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদু গলায় বলল।

” বাপজান, তোমার নানা ভাই সারাজীবন চাকরি আর ছেলেমেয়েদের ভালো রাখবার জন্য খাইটা গেছে। তার কি সারপ্রাইজ দেওনের সুযোগ আছিল। ”

ফাতিমা খানম দু’জনের কথপোকথন শুনে হাসছেন। এই নাতিটিকে তিনি জীবনের অধিক ভালোবাসেন। ছোট থেকে কম কষ্ট পেয়ে বড় হয়নি ছেলেটা। তারপরও সে একজন আর্দশ মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছে। এই নাতিকে তিনি বরাবরই গর্ব করতেন। আর এখনো করেন।

” ছেলেমেয়েদের জন্য পরিশ্রম করে সে কি পেয়েছে? আর নানিমা’ই বা কি পাচ্ছে! মেয়েরা যে যার মত সংসার করছে। ছেলে থেকেও নেই। একটা মেয়েরও সময় নেই মায়ের কাছে দুদণ্ড বসার। মা’য়ের ভালোমন্দ খোঁজ নেয়ার। কি লাভ হয়েছে সম্পদের পাহাড় গড়ে? যাহোক এখন এসব কথা থাক। খালা, তুমি নানিমাকে তৈরী করে রেখ। আমার নানিমাকে আজ হিরোইন লাগা চাই। ”

” আম্মারে নাহয় তৈরী করাইলাম। কিন্তু এই বয়সে কি তারে হিরোইনের মত লাগব! তুমি এখন নিজের হিরোইনের না ভাইবা নানিরে নিয়া মাতছো কেন? শ্বশুর বাড়ি থাইকা বেড়ায় আইসা, সেখানকার গল্প শুনাইলানাতো। আমার কুহ মা কেমন আছে সেটাও কইলানা। ”

” আগে বউটাকে ঘরে তুলি, তারপর নাহয় শ্বশুর বাড়ির গল্প শোনাব। তোমার মায়ের দিক থেকে যখন গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গেছি, এবার আর দেরি করবনা৷ আজতো তোমার মা গ্রাম থেকে ফিরছে। তোমাদের জন্য নাকি সে কিসব নিয়ে আসবে। তার ফুপু বললেন, তিনি পিঠাপুলি পাঠাবেন তোমাদের জন্য। শোন তাকে বলো আজ যেন কোচিং-এ না যায়। আজকে ক্লাস না নিলেও তার চলবে। আমি বাহির থেকে এসে তাকে বাসায় দেখতে চাই। ”

” মা আসলে নাহয় তারে কইয়া দিমুনে। কিন্তু তুমি আবার কই যাইবা, বাপজান! কাইল গ্রাম থাইক আইসা সেই যে বাহিরে গেলা, আসলা কত রাইতে। আবার এখন কই যাইবা? কতদিন পর আসছো একটু আমাদের কাছে বসবানা। আর একটা শুইনা রাখ, বিয়া যখন করবাই, তখন দেরি করা চলবনা। যত তারাতারি পার বিয়া কইরা নিবা। ” রাজিয়া খালার গলায় অভিমান টের পায় তাহমিদ। সে স্মিথ হেসে খালাকে জড়িয়ে ধরল।

” খালা, আমি একটু কাজে যাচ্ছি। নানিমাকে সারপ্রাইজ দিতে হবে তো। ঘন্টা তিনেক পরই চলে আসব। তারপর তোমাদের সময় দেব। প্রমিজ করছি। আর দুইমাস পর তোমার বাপজান বিয়ে করছে, এটা মোটামুটি শিওর। এখন থেকে প্রস্তুতি নাও। নানিমা, তুমি কি বল? ”

তাহমিদের কথা শুনে বৃদ্ধা হাসলেন। তার সম্মতি বুঝতে বাকি থাকলনা তাহমিদের। কিন্তু রাজিয়া খালা তাহমিদের এই সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারলেননা। তিনি মুখ গোমড়া করে বললেন,

” বিয়া যখন করবাই, তখন এত দেরি করবা কেন? একটু আগে করলে কি হয়। ”

” খালা, সামনের সপ্তাহে আমি এস্তোনিয়া যাচ্ছি। সেখানের এক ভার্সিটিতে দেড়মাসের একটা কোর্স করতে। সেখান থেকে ফিরেই বিয়ের কাজ সারব। তবে তার আগে তোমার কথা বলতে হবে কুহুর অভিভাবকদের সাথে। যেহেতু আমার অভিভাবক তোমরা, সেহেতু কাজটা তোমাকেই করতে হবে। নানিনা সুস্থ থাকলে তোমাকে সাথে নিয়ে সে কাজটা করত। কিন্তু এখন তোমাকে একাই সব সামলাতে হবে। ”

তাহমিদের কথা শুনে রাজিয়া খালার ভ্রু কুঁচকে যায়।

” এসব কি কও, বাপজান! তোমার বিয়ার কথা কওনের জন্য তোমার খালারা আছে। তারা সব দেখব। এরমধ্যে আমারে জড়ানো ঠিক হইবনা। ”

” তুমিই আমার মা,বাবা আর খালা, যেটা মনে কর সেটাই। তাই আমার বিয়ের সকল ব্যপারে জড়ানোর অধিকার আমার আছে। আচ্ছা শোন, এই বিষয়ে পরে কথা হবে। আমি এখন বাহিরে যাচ্ছি। তোমার মা আসলে তাকে বাহিরে যেতে নিষেধ কর। আর শোন, আজকে নানিমাকে গোসল করিয়ে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যাবে। হুইলচেয়ার ঠিক আছে তো? ”

রাজিয়া খালা জানায়, হুইলচেয়ার ঠিক আছে। তাহমিদ আর রুমে থাকলনা। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

তাহমিদ বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর কুহুরা বাসায় প্রবেশ করল। রাজিয়া খালা ওদেরকে দেখে খুশিতে এগিয়ে আসলেন। খালার সাথে কুশল বিনিময় শেষে কুহু একটা বড় ব্যাগ খালার কাছে এগিয়ে দিল। খালা ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে চলে যান। কুহুও রুমে গিয়ে কাপড় পাল্টে নেয়।

বাসায় তখন নায়লা আঞ্জুম ছিলনা। রিশা মা’কে না পেয়ে ফোন করলে জানতে পারল সে শপিংয়ে গেছে।

কুহু ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে এসে দেখল খালা অবাক হয়ে ব্যাগ থেকে সবকিছু বের করছে।

” ও মা, তুমি এতকিছু আনছ! এত খাবার খাব কে! কত রকমের পিঠা আনছ। আবার মাংসও দেখতাছি। ”

” খালা, সব পিঠা আমি আর ফুপু মিলে বানিয়েছি। আমার কয়েকটা হাঁস, মুরগী প্রতিবেশি এক দাদির কাছে রেখে এসেছিলাম। কয়েকটা হাঁস-মুরগি থেকে অনেকগুলো হয়েছে। সেখান থেকেই কয়েকটা নিয়ে এসেছি। আজকে তুমি হাঁস আর মুরগী রান্না কর। আগামী কয়েকদিন এসব রান্না করে শেষ করবেন। আর পিঠা, পায়েস আপাতত ফ্রিজে রাখি। পরে সবাইকে দিলেই হবে। ”

” মাগো, তুমি আইজ কোচিং-এ যাইওনা। বাপজানে তোমারে যাইতে না করছে। তুমি বরং আমারে রান্নায় সাহায্য কর। ”

খালার কথা শুনে কুহু নিরবে হাসল। ও বাসায় ঢোকার পর কয়েকবার উঁকিঝুঁকি মেরে তাহমিদকে খোঁজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওকে দেখতে পায়নি। কুহু আর কিছু না বলে কাজে হাত লাগায়। হাতের কাজ শেষ হলে, কুহু নানিমার কাছে যায়। ও একটা বাটিতে পায়েস নিয়েছে।

ফাতিমা খানম নিমিলীত চোখে হুইলচেয়ারে বসে আছেন। কুহু তার কাছে গিয়ে তাকে ডাক দেয়।

” নানিমা, এইযে দেখুন আপনারর জন্য কি এনেছি। এবার লক্ষ্মী মেয়ের মত হা করুন দেখি। আমি কিন্তু পায়েস রান্না করেছি। খেয়ে বলতে হবে কেমন হয়েছে। ”

কুহুর কথা শুনে ফাতিমা খানম হাসলেন। কুহু তার মুখে এক চামচ পায়েস তুলে দেয়।

” আপনাকে আজ এখানে দেখে আমার কিযে ভালো লাগছে। এখন থেকে প্রতিদিন আপনাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসব। মাঝেমধ্যে বাহিরেও নিয়ে যাব। ” কথা বলতে বলতে নানিমাকে খাইয়ে দেয়। এরপর ও বেশ কিছুক্ষণ নানিমার সাথে গল্প করে, রান্নাঘরে যায়।

নায়লা আঞ্জুম বাসায় এসে ফাতিমা খানমকে ড্রয়িংরুমে দেখেই খেঁকিয়ে উঠল।

” রাজিয়া আপা, আম্মাকে এখানে এনেছে কে? কার হুকুমে আম্মাকে রুম থেকে বের করা হয়েছে? ”

” বাপজানে কইয়া গেছে। তার কথামতই আম্মারে এখানে নিয়া আসছি। ” রাজিয়া খালা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলেন।

” আমি যে সবাইকে বলে রেখেছি, আম্মাকে যেন রুম থেকে কোথাও বের করা না হয়। সেটাকি তোমার কানে যায়নি? এখন এই বাসায় কি হবে না হবে, সেটাওকি তাহমিদই বলে দেবে? ভুলে যেওনা এটা আমার বাবার বাড়ি, তাহমিদের বাবার বাড়ি নয়। ও এই বাড়িতে একজন অতিথি মাত্র। তাই ভালো হবে যদি আমার কথা মেনে চল। ”

রাজিয়া খালা নায়লা আঞ্জুমের কথা নিরবে শুনে গেলেন। কারন তিনি জানেন, এখন নায়লার সাথে কথা বলা মানেই ঝামেলা বাড়ানো। তাই তিনি নায়লা আঞ্জুমের কথায় পাত্তা দিয়ে চুপচাপ কাজ করতে থাকলেন। কিন্তু কুহু নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। নিজের খালামনি হয়ে সে এসব কি বলছে! সে কি আদৌও তাহমিদের খালামনি!

কুহু খালা আর দুইজন আপার সাথে মিলে রান্না শেষ করে রুমে গিয়ে গোসল সেড়ে বেরিয়ে আসে।

ফাতিমা খানম চোখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে যাচ্ছেন। আজ তার খুব ভালো লাগছে। কতদিন পর রুম থেকে বের করা হয়েছে তাকে।

চুল চিরুনি করা শেষ হতেই কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে কুহু প্রায় দৌড়েই রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এসময় তাহমিদ ছাড়া কেউই আসবেনা।

দরজা খুলে তাহমিদকে দেখে কুহুর মুখে হাসি ফুটল। তাহমিদ ওর হাসির জবাবে মৃদু হেসে ভেতরে প্রবেশ করল।
কুহু অবাক হয়ে দেখছে তাহমিদের সাথে থাকা মানুষগুলোকে। তাহমিদের সাথে দুইজন পুরুষ-নারী এসেছেন। তাদের সাথে দুইটা বাচ্চা। একটা বাচ্চা তাহমিদের কোলে, আরেকজন আগত পুরুষের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

তাহমিদ নানিমাকে দেখে তার কাছে এগিয়ে যায়। ওর কোলে থাকা বাচ্চাটাকে নানিমার কোলে দিয়ে, হাসিমুখে বলল,

” সারপ্রাইজ। এই যে তোমার নাতিকে তোমার কোলে দিলাম। এবার তোমার ছেলে আর ছেলের বউকে দেখ। ” তাহমিদ সরে দাঁড়ালে ফাতিমা খানম দেখলেন তার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।

এত বছর পর ছেলেকে দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারলেননা বৃদ্ধা। তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। হাউমাউ করে কিছু বলার চেষ্টা করছেন।

মা’কে কাঁদতে দেখে তার কাছে এগিয়ে আসলেন সৈকত আহমেদ। কত বছর পর তিনি তার মা’কে দেখছেন। শেষবার যখন তিনি তার মা’কে দেখেছিলেন তখনও তার মা সুস্থ ছিলেন। দিব্যি চলতে ফিরতে পারতেন। আজ চোখের সামনে এ কাকে দেখছেন তিনি! তার মা একটা জড়বস্তুর ন্যায় পরে আছেন হুইলচেয়ারে!

সৈকত আহমেদ দৌড়ে এসে মা’য়ের পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। তার কান্না দেখে বৃদ্ধার কোলে থাকা বাচ্চাটাও তারস্বরে কাঁদতে থাকে। তাহমিদ এসে বাচ্চাটিকে নানিমার কোল থেকে নিয়ে তার মা’য়ের কাছে দেয়।

ড্রয়িংরুম থেকে শোরগোল শুনে নায়লা আঞ্জুম রুম থেকে বেরিয়ে আসে। তার সাথে রায়হান আহমেদও বেরিয়ে এসেছেন। চোখের সামনে ছোট ভাইকে দেখে সে রাগে দিশেহারা হয়ে যায়।সৈকত আহমেদের সাথে তাহমিদকে দেখে, সে সাথে সাথে বুঝে যায় এটা তাহমিদেরই কাজ।

” তাহমিদ, তোমার এতবড় সাহস! তুমি কার হুকুমে এই বেইমানকে বাসায় নিয়ে এসেছে? তুমি দিনদিন তোমার সীমা পার করে যাচ্ছ। মনে রেখ তুমি এই বাড়ির একজন অতিথি মাত্র। তোমার সব মাতব্বরি, দ্বায়িত্বগিরি নিজের বাড়িতে দেখিও। একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে রাখ, এটা তোমার বাবার বাড়ি নয়। তুমি এক্ষুনি এদেরকে বাড়ি থেকে বের কর। ”

নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনেও ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ওর ঠোঁটে ব্যঙ্গ খেলা করছে।

” এই বাড়ি যেমন আমারও নয়, তেমনি তোমারও নয়। আমার মত তুমিও এই বাড়ির অতিথি। এই বাড়িতে কোন অতিথি বছরের পর বছর যাবৎ থাকছে জন্য বাড়ির মালিককে নিয়ে আসলাম। এতদিন অতিথি বাড়ির দেখাশোনা করেছে, এবার বাড়ির আসল মালিকের দেখাশোনা করার সময় এসেছে। বাড়ির মালিক তার অধিকার বলে নিজের আবাসস্থলে ফিরে এসেছে। নানিমা, তুমিও কি চাও তোমার ছেলে বেড়িয়ে যাক? তুমি চাইলেই তবে মামা এখানে থাকবে। ”

ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে বৃদ্ধা বুঝিয়ে দিলেন তিনি তার ছেলেকে বাড়িতে চান। তিনি একহাতেই ছেলেকে জাপ্টে ধরে রাখলেন।

” আশা করছি তুমি তোমার উত্তর পেয়ে গেছ? মামা তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখানেই থাকবে। কেউ যদি তাদের কিছু বলে তবে বিষয়টা কিন্তু খুবই খারাপ হয়ে যাবে। ” তাহমিদ আবারও বলল।

” তুমি চিন্তা করোনা, তাহমিদ। সৈকত তার অধিকার বলেই এখানে থাকবে। এবার আমাদের যাবার সময় হয়েছে। এতদিন আম্মাকে দেখার কেউ ছিলনা, সেই অযুহাতে এই বাসায় থেকেছি। এখন আম্মাকে দেখার জন্য তার ছেলে এসে গেছে। এবার আমরাও নতুন বাড়িতে শিফ্ট করব।”

রায়হান আহমেদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুমের চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম হলো। সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে।

” তুমি এসব কি বলছ! আমরা কোথায় যাব? এটা আমার আব্বার বাড়ি। আমি এই বাড়ি থেকে কোথাও যাবনা। ওরা যাবে এখান থেকে। ঐ ফকিন্নির মেয়ে কিছুতেই এই বাড়ির বউ হতে পারেনা। ওর কোন যোগ্যতাই নেই, এই বাড়ির বউ হওয়ার। ”

” তুমি যদি আর একটা কথা বল, তবে থাপড়িয়ে তোমার দাঁত ফেলে দেব। তাহমিদ যদি এই বাড়ির অতিথি হয়, তবে তুমি, তোমার ছেলেমেয়ে আর আমিও এই বাড়ির অতিথি। বিয়ের পর মেয়েদের আসল ঠিকানা হয় তার স্বামীর বাড়ি। কিন্তু সব সময়ই তুমি আমার বাড়ির চেয়ে বাবার বাড়িকে প্রাধান্য দিয়েছ। নিজের অহংকার বজায় রেখছ। তুমি যেমন আমার সংসারকে অশান্তিতে ভাসিয়েছ, তেমনি নিজের বাবার বাড়িতেও আ’গু’ন দিয়েছ। সৈকতের যাকে মনে ধরেছে তাকেই বিয়ে করেছে। ওর বউকে তুমি ফকিন্নির মেয়ে বলার কে? এই মেয়েটা নেহাৎই ভদ্র তাই এতক্ষণেও তোমাকে চুলের মুঠি ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়নি। তাই ভালো হয় যদি নিজের মুখ বন্ধ রাখ। এখন থেকেই মানসিকভাবে নিজের সংসারে যাওয়ার প্রস্তুতি নাও। আমি যত তারাতারি পারি একটা ফ্লাট দেখব। ”

রায়হান আহমেদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম নির্বাক চেয়ে থাকে।

” দুলাভাই, এসব কি বলছেন? আপনারা কোথাও যাবেননা। এতদিন আপনারাই আম্মাকে আগলে রেখেছেন। আমি তার কোনই খোঁজ নিইনি। আজ আমি আসাতে আপনারা চলে যাবেন, আমি এটা ভাবতেই পারছিনা। আপনারা কোথাও যাবেননা। আমরা একসাথেই এখানে থাকব। ” মা’য়ের কাছ থেকে উঠে এসে রায়হান আহমেদের পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল সৈকত আহমেদ।

” আমি আরও আগেই চলে যেতাম, সৈকত। শুধু আম্মার জন্যই এখানে থেকেছি। এখন আম্মার জন্য তোমরা আছ। এবারতো যেতেই হবে। এছাড়াও তোমার বোনকে সংসারের দায়-দ্বায়িত্ব বুঝতে হবে। সে এত বছর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেরিয়েছে। তার নজর সব সময়ই উপরের দিকে ছিল। এবার তাকে নিচের দিকে তাকাতেই হবে। সে সময় এসে গেছে। ”

কুহু এই মুহুর্তে কারও কোনও কথা শুনছেনা। ও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। কতশত গোপন কথা মানুষটা তার নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। সবার কথার আঘাত সহ্য করে অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে সে তৎপর। তাকে দেখে কে বুঝবে, এক জীবনে কত ঝড় ঝাপটা তাকে সইতে হয়েছে! সে চিরদুঃখী একজন।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-২৫+২৬

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৫
জাওয়াদ জামী জামী

” শুনলাম তুমি নাকি কোচিং-এ জয়েন করেছ? ” কুহু ড্রয়িংরুমে বই নিয়ে বসেছিল। তখনই নায়লা আঞ্জুম সেখানে এসে দাঁড়ায়।

কুহু চাচির আওয়াজ পেয়ে চোখ তুলে তাকায়। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে জবাব দেয়,

” জ্বি, চাচি। পরশু থেকে ক্লাস নিতে হবে। ”

” ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ। কখনো না কখনোতো নিজের রাস্তা দেখতেই হত। কতদিন আর এভাবে হাভাতের মত অন্যের ঘাড়ে পা দিয়ে চলবে! অবশ্য তোমাদের তো লাজলজ্জা নেই। দিনের পর দিন অন্যের বাড়িতে থেকেও বিবেকবোধ জাগ্রত হয়না। ”

নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে কুহুর বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। এত অপমানও ওর ভাগ্যে ছিল! চোখের কোনে জমে থাকা অবাধ্য অশ্রুকনারা ঝরে পরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু কুহু কোনক্রমেই ওর চোখের অশ্রুকনাদের ঝরতে দিতে চায়না। নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চায়না অন্যের সামনে। ও বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নায়লা আঞ্জুমের দিকে তাকিয়ে বলল,

” চিন্তা করবেননা চাচি, আমি খুব তারাতারি এখান থেকে বেরিয়ে যাব। আপনাকে আর কষ্ট দেবনা। ”

” সেটাই তোমার জন্য মঙ্গল হবে। অনেক সহ্য করেছি তোমাদের এই বাসায়, আর নয়। সকালে, সন্ধ্যায় তোমাদের দুই ভাইবোনের মুখ দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি। রায়হান আহমেদের কথা আর মানতে আর রাজি নই আমি। প্রয়োজনে তোমাদের সাথে তাকেও ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এখান থেকে বের করে দেব। আমার ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে রেখে তাকেও ছুঁড়ে ফেলে দেব। নিজের স্ত্রী-সন্তানদের থেকে তার ভাইয়ের ছেলেমেয়ে দর ওপর দরদ বেশি! দরকার নেই আমার এমন স্বামী। যে স্বামী একটাবারও চিনি করেনা এদের পড়াশোনা করাতে গিয়ে তার সংসারে টান পরছে। খরচ বাড়ছে। ঢং করে ভাইয়ের ছেলেকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে! সাধারণ একটা হাইস্কুলে ভর্তি করালে তার সম্মান যেত! আর এই ভিখারির দলও নাচতে নাচতে চাচার কথায় সায় দিয়েছে। ”

চাচির এমন ঘৃণায় ভরা কথা শুনে কুহু এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলনা। ও হু হু করে কেঁদে উঠল। কি দোষ ছিল ওদের? মৃ’ত মা’য়ের কথা রাখতেই চাচার কথায় এখানে এসেছিল। ও-তো চাচাকে নিষেধ করেছিল প্যারামাউন্ট স্কুলে সৃজনকে ভর্তি না করাতে। কিন্তু চাচা শুনলোনা।

রাজিয়া খালা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনলেন। তিনি আঁচলে চোখ মুছলেন। তাহমিদকে দেয়া কথা তিনি রাখতে পারলেননা। তিনি এই বাসায় অসহায় একজন কাজের মানুষ মাত্র।
রাজিয়া খালার সাথে আরেকজনও শুনল নায়লা আঞ্জুমের বিষবাক্য। সে হল এই বাসারই আরেকজন মেইড রেখা আক্তার। তার চোখেও পানি।

পরদিন থেকে শুরু হয় কুহুর কর্মজীবন। ও কোচিং-এ ক্লাস নিচ্ছে। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ক্লাসে পড়াতে থাকে। সেই সাথে নিজের লক্ষ্য পূরনের দিকে এগোতে থাকে একটু একটু করে। তাহমিদের পাঠানো সাজেশনগুলো ওর হাতে এসেছে। ও সেগুলো এমনভাবে পড়েছে যে মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। যদিও রুয়েটের জন্য সাজেশন ও অল্পই পড়েছে। ওর টার্গেট পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়। কারন ও জানে রুয়েটে চান্স হয়ে গেলে নিজের পড়াশোনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে হবে। কোচিং কিংবা টিউশনি তেমন একটা করতে পারবেনা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে গেলে পড়ার ফাঁকেও যথেষ্ট সময় পাবে কোচিং, টিউশনি করানোর। ওদের দুই ভাইবোনের পড়াশোনার জন্য অনেক টাকা দরকার। আর সেই টাকাগুলো আসবে কোচিং, টিউশনি থেকেই।

আরও একমাস পেরিয়ে গেছে। কুহু দুই কোচিং থেকেই বেতন পেয়েছে। ও এই সামান্য বেতন থেকেই রিশা, নিশোর জন্য পোশাক কিনেছে। খালার জন্যও একটা শাড়ি কিনেছে। তবে সৃজনের জন্য এখন কিছুই কেনেনি। ওকে বলেছে, সামনের মাসে বেতন পেয়ে কিনে দেবে।

এই একমাসে তাহমিদ ওকে দশদিন ফোন করেছে। পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলেনি সে। সে জানিয়েছে রাজশাহী আসতে তার আরও কিছুদিন দেরি হবে। কুহুর অ্যাডমিশনের দিনও এগিয়ে আসছে। তাই সে কুহুকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বারবার তাগিদ দেয়।

” চাচা, একটা কথা ছিল। ” রায়হান আহমেদ বাগানে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন। আজ শুক্রবার হওয়ায় তিনি বাসায় আছেন।

কুহুর গলা শুনে তিনি পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে বললেন,

” কি কথা বলবি, বলে ফেল। সব সময় এমন কুঁকড়ে থাকিস কেন, মা! আমি তোকে বলেছিনা, তোরা তোদের চাচার অধিকারে এখানে থাকছিস। রিশা আর নিশোর ন্যায় আমার টাকা, ভালোবাসায় তোদের সমান অধিকার আছে। মনে রাখবি তোর চাচা সামান্য কেউ নয়। ”

চাচার কথা শুনে কুহু একটু হাসল। চাচা যে ওদের সত্যিকারের ভালোবাসে তা কুহু বেশ বুঝতে পারে। তাই সে নায়লা আঞ্জুমের আচরণগুলো কখনোই চাচার কাছে তুলে ধরেনা। ও চায়না ওদের জন্য চাচার সংসারে অশান্তি হোক।

” চাচা, আমি এখানে যথেষ্ট ভালো আছি। তাই তোমাকে আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। আমি তোমার কাছে অন্য একটা দরকারে এসেছিলাম। ”

রায়হান আহমেদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন কুহুর দিকে।
কুহু চাচার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে আবারও কথা বলল,

” চাচা, অনেকদিন হয় রাজশাহী এসেছি। সেই কবেই চারমাস পেরিয়ে গেছে। কতদিন বাড়িতে যাইনি। কতদিন বাবা-মা’কে দেখিনি। সৃজনও বাড়িতে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। একবার আমাদের গ্রামে নিয়ে যাবে? ” কুহু ফুঁপিয়ে কাঁদছে। গত কয়েকদিন থেকে ও মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। বারবার বাবা-মা’ র কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। প্রতিনিয়ত চাচির করা অপমানে ওর মন ভঙ্গুর হয়েছে। হারাচ্ছে ধৈর্য্য। সেই সাথে প্রকট হচ্ছে এই বাড়ি থেকে দূরে যাওয়ার ইচ্ছে।

ভাতিজীর কান্না দেখে রায়হান আহমেদের চোখেও অশ্রু জমেছে। তিনি একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে কুহুর কাছে বসলেন। সস্নেহে হাত রাখলেন কুহুর মাথায়। কুহু তখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

” কাঁদিসনা, মা। তোদেরকে বাড়িতে নিয়ে যাব। কিন্তু জানিসইতো, আমি একরাতের বেশি সেখানে গিয়ে থাকতে পারবনা। এছাড়া বড় আপাও এখন বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারবেনা। দুলাভাই অসুস্থ। তার চিকিৎসা চলছে। আগে দুলাভাই সুস্থ হোক। তারপর গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবি। একা একা তোদের বাড়িতে রাখার রিস্ক আমি নেবনা। আর তাছাড়া অ্যাডমিশনের আগে তুই কোথাও যাস সেটা আমি চাইনা। অ্যাডমিশন ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে, আমি তোদের গ্রামে রেখে আসব। ”

কুহু চাচার কথা বুঝতে পারছে। তিনি মনেপ্রাণে চাইছেন কুহু ভার্সিটিতে চান্স পাক। তাই নিজের কষ্ট মনে রেখেই কুহু চাচার কথায় রাজি হল। আর কিছুদিন মাত্র। এই বাড়িতে থাকার মেয়াদ দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। ও কোচিং-এর কয়েকজন স্যারকে বলে রেখেছে একটা বাসা দেখার জন্য। একটু নিরাপদ বাসা পেলেই ও এই ছাড়বে।

গভীর রজনী। নিস্তব্ধ চারপাশ। মাথার ওপর ফ্যানের শব্দ বৈ কোন আওয়াজ নেই চারপাশে। রুমের একটিমাত্র জানালার কাঁচ খুলে রেখেছে কুহু। আকাশে রুপালী চাঁদ আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে ধরনীকে। খোলা জানালা পেরিয়ে এক চিলতে আলো এসে আলোকিত করেছে জানালার পাশটা।
জানালার বাহিরে চোখ যেতেই কুহুর বুকের ভেতর দামামা বাজতে শুরু করল। ওর বাহিরে যেতে ভিষণ ইচ্ছে করছে। চাঁদের আলো গায়ে মাখার সাধ জেগেছে। কিন্তু ও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দুইটা বিশ বাজছে। হাতে থাকা বই বন্ধ করে অপলক নেত্রে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আকাশ পানে। এত রাতে বাহিরে যাওয়া ঠিক হবেনা ভেবে আবার বই খুলতেই বেজে উঠল মোবাইল। নৈশব্দকে ভেদ করে ফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ রুমের ভেতর বজ্রের ন্যায় আছড়ে পরল। কুহু চমকে উঠে ফোন হাতে নিতেই দেখল তাহমিদের নাম জ্বলজ্বল করছে। ও মৃদু হেসে ফোন রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। এত রাত পর্যন্ত জেগে আছেন যে! ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। কাউকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করতে হয়, সে ভালো আছে কিনা। কিন্তু তুমি বেয়াদব মেয়ে আগেই আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছ? আর আমি সহজসরল মানুষ কিনা তোমার চিন্তা করছি! আজ আবারও প্রমানিত হল, দুনিয়ায় ভালো মানুষের মূল্য মেয়েরা দিতে জানেনা। ”

কুহু এতরাতে এসব কথা আশা করেনি। ও নিরাশ হয় তাহমিদের কথা শুনে।

” ভুল হয়ে গেছে। এমন ভুল আর হবেনা। আপনি কেমন আছেন? ” দাঁতে দাঁত পিষে বলল কুহু।

” এভাবে রেগে জিজ্ঞেস করছ কেন! ভালোভাবে জিজ্ঞেস করলেই তবে উত্তর পাবে। আর যাইহোক আমিতো আর মেয়াদোত্তীর্ণ পাতা সেবনকারী নই যে আমার সম্মান ঠুনকো হয়ে গেছে। সমাজে আমি সম্মানিত ব্যাক্তি বুঝলে? তাই তুমিও আমাকে সম্মান দেবে। ”

এবার কুহু সত্যিই রেগে যায়। এই মুহুর্তে তাহমিদ ওর সামনে থাকলে নিশ্চয়ই কুহু তার মাথা ফাটাত।

” জনাব স্যার, আপনি কেমন আছেন? আপনার শরীর ভালোতো? আর আজেবাজে মেয়াদোত্তীর্ণ পাতা সেবন করবেননা। এসব পাতা স্বাস্থ্যের জন্য হানি কারক। এসব পাতা সেবন করলে বুদ্ধি লোপ পায়। ” অনেক কষ্টে স্বর নরম করে বলল কুহু।

” কি বললে তুমি? তুমি আমাকে সরাসরি গঞ্জিকাসেবী উপাধি দিচ্ছ? ননসেন্স, তোমার এতবড় দুঃসাহস! খালি একবার তোমাকে সামনে পাই। এই মেয়ে, এতরাত পর্যন্ত জেগে আছ কেন? নিশ্চয়ই বাগানে যাওয়ার জন্য মন আঁকুপাঁকু করছে? ভুল করেও যদি রুম থেকে বেরিয়েছ, তবে আমি কালকেই রাজশাহী গিয়ে তোমার দুই পা ভেঙে ফেলব। ” কুহুর কথা শুনে তাহমিদ রে’গে উঠল। ও রা’গ’কে প্রশমিত করতেই কুহুকে ঝাড়ি দিচ্ছে।

এই মুহূর্তে কুহু তাহমিদকে মোটেও ভয় পাচ্ছেনা। কারন ও জানে তাহমিদ এসব মন থেকে বলছেনা। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতেই এসব বলছে। কুহু তাহমিদকে আর একটু রাগিয়ে দেয়ার লোভ কিছুতেই সংবরণ করতে পারলোনা। ও নীরব হেসে আরেকবার মুখ খুলল,

” আমি এই মুহূর্তে বাগানেই দাঁড়িয়ে আছি। কতবড় চাঁদ উঠেছে দেখেছেন? ভাবছি আজ সারারাত এখানেই বসে কাটাব। তার ওপর আবার উপরি পাওনা হিসেবে পাশের বিল্ডিংয়ের দোতলার বারান্দায় একজনকে দেখতে পাচ্ছি। তার সাথে ইশারায় গল্প করতে মন্দ লাগবেনা। ”

কুহু ফোন কানে চেপে চোখ বন্ধ করে তাহমিদের ঝাড়ি শোনার অপেক্ষা করছে।

তাহমিদ কুহুর কথায় শিওর হয়ে যায় ও রুমেই আছে। আর যত যাই হয়ে যাক না কেন, পাশের বিল্ডিংয়ের কাউকে এখন বারান্দায় দেখলে মেয়েটা যে বাগানে থাকবেনা, এটা তাহমিদ ভালো করেই জানে। ও বুঝতে পারল, মেয়েটা ওকে একটু নাচাতে চাইছে। তাহমিদও কম যায়না। তার শ্যামাঙ্গীনি যখন একটু নাচাতে চাইছে, তবে ওর এখন নাচতে দোষ কোথায়? আর নাচাতেই বা সমস্যা কি। ও মুখ দিয়ে নিঃস্বাস ছেড়ে বলল,

” ভালো করে দেখ, বারান্দার ভদ্রলোক ইয়াং নাকি ওল্ড। ওল্ড হলে জমবেনা। রাত জেগে চোখাচোখি, ইশারা করতে হলে ইয়াং গাইজের প্রয়োজন। এইযে যেমন ধর আমি এই মুহূ্র্তে একটা অষ্টাদশী রমনীর কোলে মাথা রেখে জোছনা বিলাস করছি। এর মজা কি আমি কোন বয়োবৃদ্ধা নারীতে পাব? তুমি চাইলে তাকে ডেকে বয়স জেনে নিতে পার। তারাতারি তার বয়স জেনে নাও। হারি আপ। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কোঠর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। কি বলছে এই লোকটা! সে অন্য নারীর কোলে মাথা রেখে জোছনা বিলাস করছে! বোকা মেয়েটা বুঝতেই পারলোনা, ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষটা ওর সাথে মজা করছে। হঠাৎই ওর কান্না পায়। কিন্তু ও প্রতিজ্ঞা করল কাঁদবেনা। নিজের দূর্বলতা কারো কাছে প্রকাশ করবেনা। ফোন কানে চেপে রেখে নিশ্চুপ থাকল।
এতটুকুতেই তাহমিদ যা বোঝার বুঝে গেছে।

” তার সাথে ইশারায় কথা বলা হলে আমাকে একটু সময় দেবে? আমার অষ্টাদশী রমনীও যে চাঁদের আলোয় মিশে গেছে। কেবল শ্যামাঙ্গীনি কথা বললেই কেবল সে আবার আবির্ভূত হবে। আবার তার কোলে মাথা রাখব আমি, তার বাহুডোরে নিজেকে সমর্পন করব। কাকতালীয়ভাবে আমার শ্যামাঙ্গীনির সাথে এই অষ্টাদশীর ভিষণ মিল খুঁজে পাই। ”

” আপনি আসলেই খুব খারাপ মানুষ। আপনার সাথে আর কথা নেই। বদের হাড্ডি একটা। ”

কুহু ফোন কেটে দিয়ে হাসল। ও তাহমিদের কথা শুনে বুঝতে পেরেছে,মানুষটা ওর সাথে মজা নিয়েছে।

কয়েক সেকেন্ড পর আবারও ফোন বেজে উঠল। কুহু দ্বিতীয়বার না ভেবেই রিসিভ করল।

” আমি এই রাতে মাটিতে শুয়ে আকাশের তারা গুনছি, আর তুমি আমাকে বদের হাড্ডি বললে! আমি জানতাম আজ তোমার মন বাগানে যেতে উস্কানি দেবে। তাই ভাবলাম তোমাকে সঙ্গ দেই। আর তুমি হিটলারের নাতনি কিনা আমাকে বদ বলছ! এখন থেকে দেখছি মেয়াদোত্তীর্ণ পাতাই সেবন করতে হবে, তা-ও যদি কারও কাছে ভালো হতে পারি। তাহমিদ তুই ভালো থাকতে চাইলে কি হবে, কেউ একজন তোর ভালো সহ্য করতে পারেনা। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। এই মুহূর্তে ওর মন থেকে সব দুশ্চিন্তা আর নায়লা আঞ্জুমের অপমানগুলো উবে গেছে।

তাহমিদ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে মুগ্ধ হয়ে কুহুর হাসি অনুভব করছে। মেয়েটার হাসির ঝংকারে ওর তনু-মন ভালোলাগায় ছেয়ে যায়।

” এভাবে হেসোনা শ্যামাঙ্গীনি। তোমার হাসিমাখা মুখ না দেখতে পেরে আমার হিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। সে আমার বুকের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। সে তোমার মাঝে নিজের আশ্রয় খুঁজে নিতে তৎপর হয়েছে। আমি এক অসহায় , নিঃস্ব মানুষ। যে তার শ্যামাঙ্গীকে নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে এই প্রেমপূর্ণ হিয়াকে জোর করে নিজের কাছে বেঁধে রেখেছিল। এখন যদি সে-ও উড়াল দেয় তবে আমি বাঁচব কি নিয়ে? আমার বাঁচা-ম’রা সব শ্যামাঙ্গীনির হাতে। ”

তাহমিদের কথা শোনামাত্রই কুহুর হাসি থেমে যায়। ওর আঁখি পূর্ণ হয় সুখের অশ্রুতে। সুখপাখি অবশেষে কি তার কাছে ধরা দিয়েছে! সে কি এবার পূর্ণ হতে চলেছে মানুষটার প্রেমের ছায়ায়?

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৬
জাওয়াদ জামী জামী

কোচিং-এ ঢোকার সময় ছোট চাচাকে দেখে অবাক হয়ে গেছে কুহু। সাইদ আহমেদ কোচিং-এর গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কুহু চাচাকে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলল। চাচার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” আসসালামু আলাইকুম, চাচা। তুমি এখানে? কেমন আছো তুমি? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আমি ভালো আছি, মা। তুই কেমন আছিস? আর সৃজন ওর কি খবর? ”

” আমরা ভালো আছি, চাচা। কিন্তু তুমি বাসায় না গিয়ে এখানে এসেছ কেন? চাচি, সাদমান আর সিহা কেমন আছে? ”

” ওরা সবাই ভালো আছে। আমি ব্যাংকের কাজে রাজশাহী এসেছিলাম। তারাতারি কাজ শেষ হওয়ায় ভাবলাম তোদের সাথে দেখা করে যাই। বাসায় গেলে দেরি হয়ে যাবে, তাই এখানেই আসলাম। ”

কুহু বুঝল ওর চাচা ঐ বাসায় যেতে চায়না। তাই এমন বাহানা দিচ্ছেন।

সাইদ আহমেদ বেশ কিছুক্ষণ কুহুর সাথে কথা বললেন। তিনি সৃজনের সাথে দেখা করতে ওর কোচিং-এ যাবেন। তারপর তিনি গ্রামে ফিরবেন। যাবার আগে তিনি কুহুর হাতে কয়েকটা প্যাকেট দিলেন। তিনি ছেলেমেয়েদের জন্য ফলমূল এনেছেন। কুহু হাসিমুখে প্যাকেটগুলো হাতে নেয়। এরপর তিনি কুহুকে টাকা দিতে গেলেই, কুহু নিমরাজি হয়ে মানা করে দেয়। কিন্তু সাইদ আহমেদ ভাতিজীর কোন কথাই শুনলেননা। তিনি জোর করে কুহুর হাতে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। তার গন্তব্য এখন সৃজনের কোচিং।

কুহু নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছে আবার নিজের পড়াশোনাও মন দিয়ে করছে। মাঝেমধ্যেই নায়লা আঞ্জুম ওকে দু-চার কথা শুনিয়ে দেয়। কুহু কোন প্রত্যুত্তর না করে নীরবে চোখ ঝরায়।

আরও কিছুদিন কেটে যায়। আর চারদিন পরই কুহুর অ্যাডমিশন। ও কোমড় বেঁধে পড়াশোনা করছে। খালা ওকে রান্নাঘরে যেতে দিচ্ছেনননা কয়েকদিন আগে থেকেই। তাই কুহু পড়াশোনার যথেষ্ট সময় পাচ্ছে। তাহমিদও নিয়মিত ওর সাথে ফোনে কথা বলছে। বড় ফুপু, ছোট চাচা প্রতিদিনই ফোন করে ওদের খোঁজ নেয়। কিন্তু কুহু আশ্চর্য হয়ে যায়, এতদিনে একবারও ছোট ফুপু ওদের কোনও খোঁজ নেয়নি! কুহু দু-একবার তাকে ফোন দিয়েছে, কিন্তু সে রিসিভ করেনি। কুহু ভাবে যখন ওর বাবা সুস্থ ছিল, ওদের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল, তখন ছোট ফুপু ঠিকই ওদের খোঁজ নিত। বাবাও তাকে দুহাত ভরে জিনিসপত্র দিত। ওদের দুই ভাইবোনকেও ছোট ফুপু কতকিছু দিত। আজ কুহু সম্পর্কের সমীকরণ বুঝতে শিখেছে। ও বুঝে গেছে, স্বার্থপরেরা সম্পর্ক বলতে শুধু টাকাকেই বুঝে। টাকা আর অর্থ সম্পদকেই তারা প্রাধান্য দেয়। তাদের কাছে টাকা, অর্থসম্পদই সম্পর্কের চাবিকাঠি। এসব ভাবলে কুহুর হাসি পায়। কত সহজে মানুষ তাদের আসল রূপ দেখিয়ে দেয়!

তাহমিদ বারবার কুহুকে অভয় দিচ্ছে। কুহু অ্যাডমিশন নিয়ে বেশ চিন্তায়ই আছে। তাহমিদের সান্তনা বাণী ওকে স্থিরতা এনে দিতে পারছেনা।

ফজরের নামাজ আদায় করে বই নিয়ে বসেছে কুহু। আজকে থেকে অ্যাডমিশন শুরু। চিন্তায় ওর বুক শুকিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পড়ে বই বন্ধ করে, বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। একটু ঘুমাতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু এখন ওর ঘুমালে চলবেনা। আবার বই হাতে নিতেই ওর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রীনে তাকিয়ে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল।

” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমার অবস্থা কি? বেশি চিন্তা হচ্ছে? ” তাহমিদ ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল।

” হুম। ”

” চিন্তার কিছুই নেই। দেখবে ভালোভাবে উৎরে যাবে। মনকে এখন চিন্তামুক্ত রাখ। প্রথমে এক কাপ কড়া লিকারের চা পান কর। তবে অবশ্যই খালি পেটে নয়। আগে হালকা কিছু খেয়ে নিবে। ভার্সিটিতে তুমি কি একা যাবে? নাকি তালুকদার সাহেব তোমার সাথে যাবে? ”

” চাচা যাবে আমার সাথে। ”

” এখন আর কোন কথা নয়। তুমি খালার কাছে যাও। আমি কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দেব। ”

তাহমিদ ফোন কাটতেই রাজিয়া খালা ট্রে-তে করে একটা সেদ্ধ ডিম, কয়েক টুকরা আপেল আর এক কাপ ধূমায়িত চা নিয়ে রুমে হাজির হলেন। খালার কান্ড দেখে কুহুর চোখ কপালে উঠল। এই মানুষটা ওর জন্য যা করছে তা নিজের আত্মীয়রাও করেনা। তিনি নিজের টাকা খরচ করে ডিম এনেছেন, দুধ কিনছেন। এসব শুধু তিনি কুহুর জন্য করছেন। কুহু এসব খেতে না চাইলেও তিনি প্রতিদিন এসব জোর করে কুহুকে খাওয়াচ্ছেন।

বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তাহমিদ আরেকবার ফোন করল। কুহু রিসিভ করতেই ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাহমিদ কথা বলল,

” টেনশন ফ্রি থাকবে। মনে রাখবে, আজ থেকে তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণের পথে পা বাড়াচ্ছ। আজকে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখবে তুমি। যা তোমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রথম ধাপের অর্জনই তোমাকে শেষ অব্দি নিয়ে যাবে। পৌঁছে দেবে সিঁড়ির শেষ ধাপে। যেখান থেকে তুমি অনায়াসেই তোমার স্বপ্নকে ছুঁতে পারবে। মনে থাকবে? ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর মনে সাহস সঞ্চার হয়। এই মানুষটা ওকে কতভাবে সাহস দিচ্ছে ভাবতেই ওর ভালো লাগছে। এমন একটা মানুষের স্বপ্ন দেখে সব মেয়েরাই।

” এই যে মেয়ে, কোথায় হারালে? ”

তাহমিদের ডাকে চমকে উঠে কুহু। চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। মৃদু হেসে কোমল স্বরে বলল,

” বাসায়ই আছি। কোথাও হারাইনি। আপনার কথা মাথায় রাখব। কোন টেনশন করবনা। ”

” গুড গার্ল। এবার বেরিয়ে পর। নইলে দেরি হয়ে যাবে। বেস্ট অফ লাক। ”

” ধন্যবাদ। ”

কুহু ফোন কেটে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

কুহু ড্রয়িংরুমে বসে অঝোরে কাঁদছে। ওর পাশে খালা হাসিমুখে বসে আছেন। রায়হান আহমেদ ফোনে ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলছেন। সাইদ আহমেদের সাথে কথা শেষ করে তিনি ফোন করলেন বড় বোনকে।

রিশা, সৃজন, নিশো কুহুর সামনের সোফায় বসে মনযোগ দিয়ে ওর কান্না দেখছে। সৃজন ভাবছে, আপু বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে তবুও কাঁদছে কেন! নিশোও একই কথা ভাবছে।

” মাগো, এবার কান্না থামা। এভাবে কাঁদলে চলবে? আজকে তোর আনন্দ করার সময়। কত কষ্ট করেছিস এতদিন। আজ আর কাঁদিসনা, মা। ” রায়হান আহমেদ সস্নেহে কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

” ও মা, এবার চোখ মুইছা লও। এম্নে কাঁন্দেনা। তুমি গিয়া তোমার নানিমারে খুশির সংবাদ দিয়া আসো। সে শুইনা খুব খুশি হইব। ”

” কুহুপু, তুমি কেমিস্ট্রিতে পড়বে! ওয়াও। কনগ্রেচুলেশনস আপু। তুমি পেরেছ। এবার কান্না থামিয়ে আমাদের নিয়ে বাহিরে চল। আজকে আমরা চার ভাইবোন মিলে ফুচকা খাব। তোমার কোন বারণই শুনবনা। এক্ষুণি চল। ”

রিশা কুহুকে টেনে তুলল। আজকে কুহু ওদেরকে না করলনা। তৈরী হয়ে ভাইবোনদের নিয়ে বাহিরে বেরিয়ে গেল।

কুহু অস্থির চিত্তে পায়চারী করছে। সৃজন ঘুমিয়েছে। খালাও নিচে বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। কুহু ওর হাতে থাকা ফোনের বারবার তাকাচ্ছে। আজ সারাদিন মানুষটা ওকে ফোন করেনি। কুহু তাকে কখনোই ফোন করেনা। সে কখন ক্লাসে থাকে কিংবা কাজে ব্যস্ত থাকে, তা কুহু কিছুই জানেনা। তাই ও তাহমিদকে ফোন করে বিরক্ত করেনা। কিন্তু আজকে কুহুর মন কোন বারণ মানছেনা। বারবার তাকে ফোন করতে ইচ্ছে করছে। মনকে বশ মানাতে না পেরে রাত এগারোটা দশে ও তাহমিদকে ফোন করল। কিন্তু ওর মন খারাপ করে দিয়ে দুইবার বাজতেই ফোন কেটে যায়।

অবশেষে কুহুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফোন বাজল রাত বারোটা পঁচিশে। কুহু তখনও ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিল। একবার ফোন বাজতেই কুহু রিসিভ করল। আর সাথে সাথেই ওকে তাহমিদের খোঁ’চা’র সম্মুখীন হতে হলো।

” কি ব্যাপার, ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলে নাকি! আজকাল বুঝি ফোনই তোমার ধ্যান জ্ঞান হয়েছে? নাকি আমার সাথে কথা বলার তর সইছিলনা? ”

কুহু আজ তাহমিদের কোন খোঁ’চা গায়ে মাখলনা। সে সরাসরি তাহমিদকে জিজ্ঞেস করল,

” আমার রেজাল্ট দিয়েছে। আপনি শুনেছেন? ”

” নাহ্। তুমি কি আমাকে বলেছ যে আমি শুনব। ” তাহমিদ অকপটে মিথ্যা বলল। অথচ ও আগেই কুহুর রেজাল্ট জেনেছে।

” আপনি সারাদিন ব্যস্ত থাকেন, তাই আমি ফোন দেইনি। আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি। ” কুহু ম্লান গলায় বলল।

” কনগ্রেচুলেশন, ফিউচার কেমিস্ট। তুমি সিঁড়ির প্রথম ধাপ পেরিয়ে দ্বিতীয় ধাপে সফলভাবে পদার্পন করেছ। আশা করব সামনে এভাবেই সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ দৃঢ় পদক্ষেপে পেরিয়ে যাবে। ”

” আপনি জানেন, আমি কেমিস্ট্রিতে চান্স পেয়েছি! তবে যে বললেন, জানেননা? ” কুহুর গলায় বিস্ময় খেলে যায়।

” আমি আরও অনেক কিছুই জানি। এখানেও তুমি সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছ। আরেকবার শুভকামনা রইল তোমার জন্য। ”

কুহু তাহমিদের কথা শুনে হাসল।

ভর্তির ঝামেলা মিটিয়ে কুহু চাচার কাছে বায়না করল গ্রামে যাওয়ার। রায়হান আহমেদও রাজি হলেন। তবে তিনি এখন গ্রামে যেতে পারবেননা। তাই নিজের গাড়িতে করে সৃজন আর কুহুকে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। তার আগে অবশ্য তিনি বড় বোনকে ফোন করে গ্রামে যেতে বলেছেন। সোহানী পারভিনের স্বামী আগের থেকে সুস্থ থাকায়, তিনিও ভাইয়ের ফোন পেয়ে দেরি না করে গ্রামে চলে যান।

গাড়ি থেকে নেমে কুহু তাকিয়ে থাকল তার অতি প্রিয় বাড়িটার দিকে। এই যে ওর প্রিয় অঙ্গন। যেখানে কেটেছে ওর শৈশব, কৈশোর। এখানেই একসময় রচিত হয়েছে কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি। এই প্রিয়াঙ্গনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে কত মায়া, ভালোবাসা। আজ কতদিন পর ও পা রাখছে ওর এই ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকা প্রিয়াঙ্গনে।

সোহানী পারভিন কুহুকে দেখে দৌড়ে আসলেন। জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন কুহুর চোখেমুখে। সৃজনও বাদ গেলনা।

তিনদিন গ্রামে কেটে যায়। সাইদ আহমেদ প্রতিদিন কুহুদের সাথে দেখা করেছেন। তিনি বাজার করে দিয়েছেন বোনের কাছে। শিরিন এই কয়দিনে একবারও এদিকে পা মাড়ায়নি। কুহু গিয়েছিল তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু শিরিন তেমন একটা আগ্রহ দেখায়নি। সে এক প্রকার অবহেলাই করেছে ওকে। তাই কুহুও আর তাকে বিরক্ত করতে ও বাড়িতে যায়নি।

প্রায় তিনমাসের বেশি সময় পর তাহমিদ রাজশাহী এসেছে। ও জানত কুহুরা গ্রামে গেছে। তাই বাসায় ওদেরকে না দেখে অবাক হয়না। ও বাসায় ঢুকে রাজিয়া খালার সাথে কথা বলে নিজের রুমে যায়।

” ভাইয়া, তুমি কখন এসেছ? ” রিশা স্কুল থেকে এসে তাহমিদকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” দুই ঘন্টা আগে এসেছি। তোর কি অবস্থা? পড়াশোনা কেমন চলছে? এসএসসি পরীক্ষার তো আর দেরি নেই। নিশো আসবে কখন? ”

” আমার পড়াশোনা ভালোই চলছে। নিশোর আসতে দেরি হবে। জানো ভাইয়া, আমরা কাল গ্রামে যাচ্ছি। সেখানে এবার গিয়ে দুইদিন থাকব। তুমি যখন এসেছ, এবার কিন্তু আমাদের সাথে তোমাকে গ্রামে যেতে হবে। তোমার কোন কথাই শুনবনা। ” তাহমিদ রিশার কথার উত্তর না দিয়ে নানিমার কাছে যায়।

পরদিন রায়হান আহমেদের জোড়াজুড়িতে তাহমিদকে তাদের সাথে গ্রামে যেতে হল। তাহমিদের মনটা আজ বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। কতদিন পর সে তার শ্যামাঙ্গীনিকে দেখবে। কতদিন ও মেয়েটার চোখের গভীরতায় হারায়না। মেয়েটার হাসির ঝংকারে হৃদয় ভেজায়না। আজ ওর বহুদিনের পিপাসিত নয়ন তৃষ্ণা মেটাবে তার শ্যামাঙ্গীনিকে দেখে। ওর শুকনো হিয়ায় এক পশলা বৃষ্টি নামবে তার শ্যামাঙ্গীনিকে দেখে।

গাড়ির শব্দ পেয়ে সৃজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কুহু ফুপুর সাথে রান্নাঘরে ছিল। সে-ও গাড়ির শব্দ পেয়ে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর সাথে সাথেই ও থমকে যায় সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে। কতদিন পর তাকে দেখছে। অফ হোয়াইট টি-শার্ট আর কালো জিন্স পরিহিত সুদর্শন যুবকটি ওর দিকেই নিনির্মেষ চেয়ে রয়েছে। তার চোখে একরাশ মুগ্ধতা। কিছুক্ষণের জন্য কুহুর হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। শরীর-মন জুড়ে দোলা দেয় মৃদুমন্দ মলয়। সুশীতল মলয়ে প্রনয়ের ঘ্রান স্পষ্ট।
ধুকপুক বুকে কুহু এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। সামনের মানুষটা নয়ন বিচরণ করছে ওর মুখাবয়বে। কুহুর ভয় হচ্ছে, এই বুঝি চাচার সামনে ধরা পরে যায়। কিন্তু ওর নয়নও যেন আজ বাঁধা মানছেনা। বারবার দেখতে চাচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষকে। যেন কতদিন ওর আঁখিদ্বয়ে তাকে না দেখার তৃষ্ণা।

চলবে….

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-২৩+২৪

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী জামী

” সাবধানে চলাফেরা করবে। রিক্সাওয়ালা চাচার সাথেই কেবল কোচিং-এ যাবে। কালকেই তোমার রেজাল্ট দেবে। চিন্তা করবেনা একদম। রেজাল্ট যেটা আসবে, সেটাই মেনে নিয়ে মন দিয়ে এ্যাডমিশনের প্রস্তুতি নেবে। ” তাহমিদ ড্রইংরুমে বসে কুহুর সাথে কথা বলছে। ওর পাশে খালাও বসে আছে। আর কিছুক্ষণ পরই তাহমিদ রওনা দেবে। আগেই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে।

” বাপজান, আজকে রাতটা থাইকা গেলেই পারতা। কুহু মা’য়ের রেজাল্ট কি হয় শুইনাই যাইতা? ”

” না খালা, কালকে এগারোটার মধ্যে আমাকে ভার্সিটিতে যেতে হবে। কযেকটা ইমারজেন্সি কাজ পরে গেছে। কয়েক জায়গায় এ্যাপ্লিকেশন করেছিলাম। সেসব জায়গা থেকে ডাক এসেছে। নয়তো কালকে থেকেই যেতাম। ”

” আচ্ছা, তোমার যেইটা ভালো মনে হয়, সেইটাই কইরো। তবে কাহ শেষ হইলে আইসা পরবা। দেরি করবানা কিন্তু। ”

” খালা, তোমার মা’কে দেখে রেখ। পড়াশোনায় যেন ফাঁকি দিতে না পারে, সেটা দেখবে। ”

তাহমিদ খালার সাথে কথা বলছে দেখে কুহু রুমে যায়। খালার সাথে তার কোন জরুরী কথা থাকতেই পারে। তাই ড্রয়িংরুমে থাকলনা মেয়েটা।

” খালা, এই টাকাগুলো রাখ। কুহুকে দিলে ও কিছুতেই নিবেনা। ওর, সৃজনের যেকোন প্রয়োজনে টাকাগুলো ওদের দিবে। নিজের প্রয়োজনেও খরচ করবে। ”

” বাপজান, আমার কাছে টাকা আছে। তোমার দেওন লাগবোনা। কুহু মা’য়ের টাকার দরকার পরলে আমি তাকে টাকা দিমুনে। ”

” তোমার টাকা যত্ন করে রেখে দাও। যখন কোন ইমারজেন্সি পরবে, তখন খরচ করো। এখন টাকাগুলো লুকিয়ে রাখ। কুহু যেন কিছুতেই দেখতে না পায়। আর শোন, নায়লা আঞ্জুমের কথা থেকে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রেখ। সে যেন কুহুকে কোন আজেবাজে কথা বলতে না পারে। ”

” তুমি এত চিন্তা কইরোনাতো, বাপজান। তারে যখন আমি মা ডাকছি, তখন তারে দেইখা রাখার দ্বায়িত্বও আমার। তোমার বাস কয়টায়? ”

” সাড়ে বারোটায়। আমি বারোটায় বের হব। আর দশ মিনিট আছি। তুমি একবার ওকে ডাকবে, খালা? ”

তাহমিদের কথা শুনে খালা কুহুকে ডাকলেন। কুহু ড্রয়িংরুমে আসতেই খালা রান্নাঘরে গেলেন কাজের ছুঁতোয়।

” সৃজনকে বাহিরে যেতে দিওনা। এই মহল্লার কয়েকজন উঠতি বয়সী ছেলে আছে, যারা খুবই খারাপ। ওদের সাথে যেন ও মিশতে না পারে। স্কুল, কোচিং ছাড়া ওকে বাহিরে থাকতে দিওনা। যদিও আমি ওকে বলে দিয়েছি। তারপরও তুমি একবার বল। ”

” ঠিক আছে। আমি ওকে বলে দেব। আপনি সাবধানে থাকবেন। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করবেন। কাজ না থাকলে অযথাই বাহিরে থাকবেননা। ” কুহু মৃদুস্বরে বলল।

তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে হাসল। মেয়েটা বরাবরের মত মাথা নিচু করে বসে আছে। তবে অন্যদিনের মত আজ মাথায় ওড়না নেই। ওর লম্বা কেশরাশি পিঠে লুটোপুটি করছে। পেলব আঁখিপল্লবে মাঝে মধ্যে এসে আছড়ে পরছে কিছু অবাধ্য ছন্নছাড়া মেঘবরণ কেশরাশি। মেয়েটা ওদেরকে মৃদু হাতে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু পরক্ষনেই ওরা আবারও হানা দিচ্ছে।

” একবার মুখ তুলে চাইবেনা? আড়াই মাস দেখবোনা ঐ স্নিগ্ধ মায়ায় জড়ানো মুখখানি। অন্তত দশটা মিনিট এই কুসুমের ন্যায় প্রস্ফুটিত মুখখানি দেখে নিজের তৃষ্ণা মেটাই। চোখের তারায় এঁকে নিই ঐ মুখাবয়বের প্রতিটা বিন্দু। যাতে আগামী আড়াই মাস নিজের মনকে লাগাম দিতে পারি। প্রবোধ দিতে পারি নিজের মনকে। ”

তাহমিদের আদুরে গলা শুনে কুহুর বুকের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ওর চোখের কোনে জমেছে বিরহের অশ্রু। সত্যিই মানুষটা অনেকদিন এমুখো হবেনা? ওর দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেবেনা? কিংবা সময়ে-অসময়ে ছুটে আসবেনা ওর বিপদে!

” তাকাবেনা আমার দিকে? অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়েই কি আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে! নাকি তুমি চাইছ আমি এখানে আর না আসি? ”

তাহমিদের এহেন কথায় কুহু এক ঝটকায় মাথা তুলে তাকায়। চোখ রাখে তাহমিদের চোখে। মেয়েটার চোখে টলমল করছে অশ্রকনারা। যে কোন মুহূর্তে তারা টুপ করে ঝরে পরবে।

তাহমিদ কিছুই না বলে তাকিয়ে থাকল ঐ কাজল দীঘির জলে। ও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে জলের অতল তলে। আজ কিছু অবাধ্য ইচ্ছেরা বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অনেক কষ্টে তাহমিদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। ও নিজের সামনে বসা মেয়েটার মন জিততে চায়।

” বারোটা বেজে গেছে। এবার আমাকে বেড়োতে হবে। তুমি সাবধানে থাকবে। কোন সমস্যা হলে খালাকে জানাবে। খালা, আমি বেড়োব। ”

তাহমিদের ডাক শুনে খালা বেরিয়ে আসলেন রান্নাঘর থেকে। চোখের জলে বিদায় দিলেন সন্তানসম তাহমিদকে।

কুহু দরজায় দাঁড়িয়ে তাহমিদের চলে যাওয়া দেখল। মানুষটা যেতে যতে কয়েকবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে।

পরদিন সকাল থেকেই কুহু মনমরা হয়ে আছে। আজকে ওর রেজাল্ট দেবে। সকালেই বড় ফুপু একবার ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। ছোট চাচাও ফোন দিয়েছেন। তারা বারবার কুহুকে সাহস জুগিয়েছেন। এমনকি রায়হান আহমেদও অফিসে যাওয়ার সময় কুহুকে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছেন। খালাও একটু পরপর কুহুকে এটাসেটা বলছেন। তিনি মেয়েটার মন ভালো করতে অনেক কিছুই করছেন।

তাহমিদ কিছুক্ষণ আগেই খালার সাথে কথা বলেছে। সে অনেক আগেই বাসায় পৌঁছেছে। বাসায় পৌঁছেই সে খালাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। তারপর দুইবার খালাকে ফোন করে কথা বলেছে। কিন্তু কুহুর সাথে একবারও কথা বলেনি।

ড্রয়িং রুমে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে কুহু। মেজো চাচা ফোন করে জানিয়েছেন তিনি রেজাল্ট শুনে বাসায় জানিয়ে দেবেন। রেজাল্ট আউট হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এখনো কুহুর কাছে রেজাল্ট আসেনি। ওর কাছে স্মার্ট ফোন নেই তাই অনলাইনে খবরও নিতে পারছেনা। রিশা স্কুলে গেছে। ওর ফোনও এখন নিতে পারবেনা। অবশ্য ও স্কুলে যাওয়ার সময় কুহুর কাছে ফোন দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কুহু নায়লা আঞ্জুমের কথা ভেবে রিশার কাছ ফোন নেয়নি।

অনেকক্ষণ পর রাজিয়া খালার ফোন বেজে উঠল। খালা কাজের ফাঁকেই ফোন রিসিভ করলেন। খালার কথা শুনে কুহু বুঝতে পারল তাহমিদ ফোন দিয়েছে।

” কুহু মা, বাপজান তোমার সাথে কথা বলবে। ধর কথা কও। ”

কুহু কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে কানে ঠেকায়।

” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। কাছে কেউ আছে? থাকলে তার কাছে টাকা দিয়ে দোকানে পাঠাও। আর পছন্দের মিষ্টি কিনে আনতে বল। এরপর পেট পুরে সেগুলো খাও। আমি রাজশাহী থাকলে মিষ্টি কেনার দ্বায়িত্ব আমিই নিতাম। এবং খেতামও আমিই। ”

তাহমিদের উদ্ভট কথা শুনে কুহুর চোখ কপালে উঠল। এই লোকটা সব সময়ই এমন হেয়ালি করে কথা বলে কেন!

” আমি মিষ্টি খাব কেন? মিষ্টি খেতে আমার ভালো লাগেনা। ”

” ভালো না লাগলেও খেতে হবে। শুধু আজকের জন্য। জেলার টপার বলে কথা! বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয়! এমন রেজাল্ট করলে মিষ্টির দোকান কাছে এসে বলবে, আমাদের খাচ্ছেননা কেন ম্যাম? ”

তাহমিদের কথা বলতে কুহুর মনে হচ্ছে ও মাথা ঘুরে পরে যাবে।

” আপনি সত্যি বলছেন? আমার রেজাল্ট আপনি জানতে পেরেছেন? কিন্তু কিভাবে? আমার রোল, রেজিষ্ট্রেশন নম্বর পেলেন কোথায় থেকে! ”

” শোন মেয়ে, আমি জীবনে খুব কমই মিথ্যা বলেছি। লাস্ট মিথ্যা বলেছি গত দুইদিন আগে। তা-ও তোমার জন্য। আর রইল তোমার রোল, রেজিষ্ট্রেশন নম্বর। সেটা আমি তুড়ি মেরে জোগাড় করেছি। এবার খালাকে, নানিমাকে গিয়ে রেজাল্ট জানিয়ে এস। আমি রাখছি। ”

তাহমিদ ফোন রাখলে কুহু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ও তাহমিদের কথা বিশ্বাস করবে কিনা সেটা ভেবে পাচ্ছেনা। ও ভালো করেই জানে তাহমিদ এই বিষয় নিয়ে ওর সাথে মজা করবেনা। কিন্তু ও এত ভালো রেজাল্ট করেছে সেটা ভাবতে পারছেনা।

ওর ভাবনার মাঝেই বেজে উঠল ফোন। কুহু দেখল মেজো চাচা ফোন দিয়েছে।

কুহু ফোন রিসিভ প্রথমেই চাচাকে সালাম দিল।

” কুহু মা, তুই একবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস। জেলায় টপার হয়েছিস। আর বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয়। আমরা সবাই তোর এই রেজাল্টে ভিষন খুশি হয়েছি। দোয়া করি জীবনে অনেক বড় হ, মা। ” রায়হান আহমেদ খুশিতে কেঁদে দিলেন।

আজ সারাদিন কুহুর ফোন রিসিভ করেই কাটল। বিকেলে কোচিং-এ গিয়ে রেজাল্টের কথা বলতেই সবাই খুশি হয়। সজল কোচিং-এ এসেছে কুহুর সাথে দেখা করতে। তার সাথে মায়াও আছে।

কুহু এখানে সজল আর মায়াকে আশা করেনি। ও ওদের দুজনকে একসাথে দেখে অবাক হয়ে গেছে। মায়া এসে জড়িয়ে ধরল কুহুকে।

” কনগ্রেচুলেশন কুহু। তোমার রেজাল্ট শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি। তোমাকে দেখে কিন্তু মোটেও বোঝা যায়না, তোমার মাথায় এত বুদ্ধি। এমনিতেই তাহমিদ তোমাকে ছুপা রুস্তম বলেনা। এই নাও তোমার জন্য চকলেট এনেছি। তুমি তো আবার মিষ্টি খাওনা। তাই কয়েকরকম চকলেট এনেছি। এগুলো খেতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? ”

কুহু মায়ার কথা শুনে বুঝল ওর মিষ্টি না খাওয়ার কথা নিশ্চয়ই তাহমিদ মায়া আপুকে বলেছে। অজান্তেই কুহুর ঠোঁটে খেলে যায় হাসির রেখা। লোকটা পারেও।

কুহু হাসিমুখে মায়ার কাছ থেকে চকলেটের প্যাকেট নিল।

পরদিন বিকেলে কোচিং-এ ক্লাস করছে কুহু। ক্লাসের মাঝেই ওর ফোন বেজে উঠল। কুহু ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল আননোন নম্বর। অচেনা নম্বর দেখে কুহু রিসিভ করলনা। পরপর দুইবার বাজল ফোন। কিন্তু ও রিসিভ করলনা।
কিছুক্ষণ পর টুং শব্দ করে ম্যাসেজ আসল। পরপর তিনটা ম্যাসেজ আসল। কুহু কৌতুহলবশত ম্যাসেজ ওপেন করল। সেই অচেনা নম্বর থেকেই ম্যাসেজ এসেছে। কুহু ভ্রু কুঁচকে ম্যাসেজগুলো পড়তে শুরু করল।

” এইযে মেয়ে, আমি একটা অসহায় মানুষ কতবার ফোন করলাম। কিন্তু তুমি ভীতু কুমারী রিসিভ করছনা। ”

” ফোন রিসিভ কর, মেয়ে। নইলে আমি রাতেই রাজশাহী এসে তোমার বারোটা বাজিয়ে দেব। ”

” এই বেয়াদব মেয়ে, ফোন রিসিভ কর। তোমার ভাগ্য ভালো আমি তোমার সামনে নেই। এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে ঠাঁটিয়ে থা’প্প’ড় মা’র’তে। ”

ম্যাসেজগুলো পড়তে পড়তেই কুহুর ঠোঁটে হাসি ফুটল। তাহমিদ যে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে এটা বুঝতে ওর বেগ পেতে হলোনা। তখনই আরেকবার ফোন বেজে উঠল। সেই নম্বর দেখে কুহু রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। শুকরিয়া চিনতে পারার জন্য। ”

কুহু উত্তর না দিয়ে হাসল।

” এবার টিচারকে বলে একটু বাহিরে যাও। দেখবে একটা পার্সেল নিয়ে বাহিরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। সোজা গিয়ে পার্সেলটা রিসিভ কর। ”

” পার্সেল! কিসের পার্সেল? ”

” কথা কম বল। আর বাহিরে যাও। এক সেকেন্ড দেরি করলে তোমার কপালে খারাবি আছে। ” কুহু তাহমিদের ধমকে ভয় না পেয়ে বসেই রইল।

” আগে বলুন কিসের পার্সেল। তবেই আমি বাহিরে যাব। ”

” তোমার বিয়ের দেনমোহর আছে। খুশি? এবার যাও। ”

ক্লাসের কয়েকজন কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। এমনকি স্যারও তাকিয়ে আছে। কুহু আর কথা না বাড়িয়ে স্যারকে বলে বাহিরে যায়।

ক্লাসে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে কুহু। এতবড় পার্সেল নিয়ে বাসায় যাওয়া অসম্ভব। চাচি দেখলে ওকে আস্ত রাখবেনা। প্যার্সেল খুলে দেখল প্রায় পঞ্চাশটা বই, থ্রি পিস আর সৃজনের জন্য টি-শার্ট, প্যান্ট। কুহু আর কিছু ভাবতে পারছেনা।

সমস্যার সমাধান দিল তাহমিদ। ও বইগুলো কোচিং-এ রেখে যেতে বলল। কাপড়গুলো ব্যাগে তুলতে বলে দিল। কুহু তাহমিদের কথামত কাজ করল। কোচিং-এ বই রাখতে কোনও সমস্যা হলোনা। কয়েকদিনে ও বইগুলো বাসায় নিয়ে যাবে।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৪
জাওয়াদ জামী জামী

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে কয়েকটা দিন। কুহু নিয়মিত কোচিং-এ যাচ্ছে, বাসায় মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। রিক্সাওয়ালা চাচা প্রতিদিন সময়মত এসে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে
আবার ক্লাস শেষ করে বাহিরে এসেই চাচাকে দেখতে পায়। প্রতিদিন ওকে নিয়ে যাওয়াআসা করলেও সে একদিনও কুহুর কাছ থেকে ভাড়া নেয়না। কুহু জোর করে ভাড়া দিতে চাইলে সে বলে, ” আপনার কাছে থেকে টাকা নেয়া বারন আছে, মা। আব্বা বিশ্বাস করে আপনাকে পৌঁছে দেওয়ার দ্বায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। আমি তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে চাই। ”
এই কথা শোনার পর কুহু আর কিছু বলতে পারেনা।

তাহমিদ প্রতিদিনই খালার কাছে ফোন দিয়ে কথা বলে। তবে কুহুর সাথে প্রতিদিন কথা বলেনা। দুই-তিন পর কুহুকে ফোন করে। তাও আবার রাত এগারোটার পর। ফোন করে সে পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলেনা। এতে অবশ্য কুহুর মোটেও খারাপ লাগেনা। কারন ও জানে, তাহমিদ নায়লা আঞ্জুমের জন্যই ওকে সব সময় ফোন করেনা। নায়লা আঞ্জুম জানতে পারলে বিষয়টা অনেক দূর গড়াবে।

কুহু প্রতিদিনের ন্যায় কোচিং-এ এসেছে। এখনো ক্লাস শুরু হয়নি।

” কুহু, একটু অফিসে এস। তোমার সাথে দরকারী কথা আছে। ” কোচিং-এর ফিজিক্সের টিচার এসে কুহুকে ডাকলেন।

কুহু স্যারের কথা শোনার জন্য অফিসে যায়।

” আসব স্যার? ” দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইল কুহু।

” এস। ”

কুহু ভেতরে আসলে স্যার আবারও কথা বললেন,

” কুহু, তুমি টিউশনির ব্যাপারে আমাকে বলেছিলে। আমি কয়েক জায়গায় কথা বলেছিলাম। কিন্তু তখন কেউই সাড়া দেয়নি। কিন্তু এখন তাদেরকে যখন তোমার রেজাল্টের কথা বললাম, তাদের মধ্যে কয়েকজন চেয়েছে তাদের ছেলেমেয়েদের তুমি পড়াও। এছাড়াও দুইটা কোচিং-ও চেয়েছে, তুমি তাদের সাথে কাজ কর। এজন্য অবশ্য তারা তোমার প্রাপ্য বেতন দিতে রাজি আছে। এখন তুমি কি করবে, সেটা ভেবে দেখ। ”

স্যারের কথা শুনে কুহু হাঁফ ছাড়ল। ও খুব করে চেয়েছিল যেন দুই-একটা টিউশনি পায়। এতে ওর সুবিধা হত।

” স্যার, আমি কালকেই আপনাকে জানাব। এই এলাকার ভেতর কোচিং কিংবা টিউশনি যাই হোকনা কেন আমি করব। ”

কুহু স্যারের কাছ থেকে কোচিং আর যেখানে ছাত্র পড়াতে হবে তার ডিটেইলস নেয়। এবার বাসায় গিয়ে খালা আর চাচার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা।

রায়হান আহমেদ রাতে বাসায় আসলে, রাতের খাবার পর কুহু তার সাথে কথা বলতে চায়।

” চাচা, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। ” রায়হান আহমেদ ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন। তখন সেখানে আসল।

” কি বলবি, মা? আমার কাছে এসে বস। তারপর তোর যা যা বলার বল। ”

কুহু ওর চাচার পাশে বসে চিন্তা করছে কিভাবে কথা শুরু করবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বুক ভরে শ্বাস নেয় মেয়েটা।

” চাচা, আমি কোচিং-এর স্যারকে টিউশনির কথা বলেছিলাম। তিনি আজকে বললেন, কয়েক জায়গায় কথা বলেছেন। এখন তুমি রাজি থাকলে আমি স্যারের সাথে কথা বলব। ”

কুহুর কথা শুনে রায়হান আহমেদ ওর দিকে কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বুঝতে চাইছেন কুহুর মনের কথা। কিন্তু তার সামনে বসে থাকা চাপা মেয়েটার মনের কথা বুঝতে তিনি অক্ষম হলেন। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

” তোর কি টিউশনি করা খুব জরুরী, মা? টিউশনি করতে গেলে অ্যাডমিশনের জন্য প্রস্তুতি নিবি কেমন করে? আমি চাইনা তুই এখন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনদিকে নজর দিস। এসবের জন্য অনেক সময় পরে আছে। ”

চাচার কথা শুনে কুহুর চোখে পানি আসল। চাচা যে ওর ভালো চায়, সেটা ওর বুঝতে বাকি থাকেনা। কিন্তু এই মুহুর্তে কুহুর একটা কাজ দরকার। চাচির চোখ রাঙ্গানি কিংবা অপমান, অসম্মান ওকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। একটা কাজ ওর ভিষণই দরকার। যাতে ওদের দুই ভাই-বোনের খরচ জোগাতে সমস্যা না হয়। তাই ও খুব সাবধানে মুখ খুলল। চাচার সামনে চাচির বিষয়ে মুখ খোলা যাবেনা।

” চাচা, আমি পড়াশোনাকে প্রায়োরিটি দিয়েই যা করার করতে চাই। টিউশনি কিংবা কোচিং-এ ক্লাস নিলে সকাল সাতটা থেকে মাগরিবের আগ পর্যন্তই নিতে হবে। রাতে আমি সম্পূর্ণ ফ্রি থাকব। রাতে পড়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পাব। আমি জানি চাচা, তুমি ছোট চাচা, ফুপু আমাদের জন্য চিন্তা কর। তোমাদের চাওয়া আমি অবশ্যই পূরণ করব। কিন্তু এই সুযোগে আমি নিজেকেও ঝালাই করে নিতে চাই। তুমি আর না করোনা, চাচা। ”

রায়হান আহমেদ বুঝলেন কুহু খুব করে চাচ্ছে কিছু একটা করতে। সেই সাথে তিনি এ-ও বুঝলেন মেয়েটা রোজগার করে তার কাঁধ থেকে বোঝা সরাতে চাইছে। এই বাসায় যে কুহু আর সৃজন প্রতিনিয়ত ভয়ে ভয়ে থাকে, সেটা তিনি বুঝতে পারেন। তিনি অনেকবার ওদেরকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। হঠাৎ করেই কষ্টে তার বুক ভারি হয়ে আসে। বড় ভাই-ভাবী বেঁচে থাকলে ছেলেমেয়ে দুটো এমন ভয়ে ভয়ে বাঁচতনা। ওরা নিজেদের মত করে স্বাধীনভাবে বাঁচত।

” আমি সম্মতি দিতে পারি এক শর্তে। পড়াশোনা ঠিক রেখে টিউশনি কিংবা কোচিং যা করার করবি। যদি আমি শুনি ওসব করতে যেয়ে তোর পড়াশোনায় সামান্যতমও সমস্যা হচ্ছে, তবে সাথে সাথেই তোকে সবকিছু থেকে ইস্তফা দিতে হবে। পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স তোকে পেতেই হবে। ”

চাচার কথায় কুহু প্রান ফিরে পেল। ও প্রানখুলে হেসে জবাব দিল,

” তুমি চিন্তা করোনা, চাচা। আমার কাছে পড়াশোনাই সব। লেখাপড়া করার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি আছি। আর পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স আমি পাবই। সেই বিশ্বাস আমার আছে। ”

রাতে খালাকে সবটা বললে তিনিও রাজি হয়ে যান। তবে রাতে তিনি তাহমিদকে জানাতে পারেননি বিষয়টা। পরদিন সকালে তাহমিদ ফোন দিলে তিনি তাহমিদকে সব জানান। তাহমিদ মনযোগ দিয়ে খালার সব কথা শোনে।

পরদিন কোচিং-এ গিয়ে কুহু স্যারের সাথে কথা বলল। ও সকাল সাতটায় একটা কোচিং-এ পড়াবে। সেখানে ক্লাস এইট থেকে ক্লাস টেনের শিক্ষার্থীদের অংক আর ইংরেজি ক্লাস নেবে। আর বাকি দিন ওর কোচিং-এর ফাঁকে আরেকটা কোচিং-এ ক্লাস নিবে। ও রাতে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন বাসায় আপাতত পড়াতে যাবেনা। এই দুইটা কোচিং থেকে ওদের দুই ভাই-বোনের চলার মত খরচ হয়ে যাবে। ও সামনের মাস থেকেই কোচিং-এ জয়েন করবে। এই মাসের আর তিনদিন আছে। এই তিনদিন ও ফ্রি থাকবে। তারপর আরেকবার নতুনভাবে শুরু হবে বেঁচে থাকার লড়াই।

রাত এগারোটা চল্লিশ। কুহু মনযোগ দিয়ে পড়ছে। সৃজন খাটে ঘুমাচ্ছে। ও আর খালা মেঝেতে বিছানা পেতে শোয়। খালাও ওর পাশে ঘুমিয়েছে। ফোনের শব্দে পড়ায় ব্যঘাত ঘটল। বই বন্ধ করে ফোন হাতে নিতেই দেখল স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে ‘ খোঁ’চা কুমার ‘ লেখাটা।
কুহু মৃদু হাসল। মানুষটা তিনদিন পর ফোন দিয়েছে। কুহু ফোন হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরের শেষ মাথায অবস্থিত ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে ফোন বাজতে বাজতে একবার কেটে গেছে। কুহু ধৈর্য্য সহকারে আরেকবার তাহমিদের ফোনের অপেক্ষা করছে। এবার ফোন বাজতেই কুহু রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। কেমন আছো? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন? ” কুহু উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।

” কি ঘটনা! তুমি বোধকরি আমার চিন্তায় শুকিয়ে গেছ? কন্ঠ এমন ব্যাকুল শোনায় কেন? Something is fishy? ”
এবার তাহমিদের কথা শুনে কুহুর মাথা ঘুরছে। ওর মন বলছে, এই মানুষটা কি সব সময়ই এমন খোঁ’চা দিয়ে কথা বলবে! একে থামাতেই হবে।

” একটা জরুরী কথা ছিল। আপনি কি শুনবেন? নাকি আমি ফোন কেটে দেব। ” কুহু সরাসরি হুমকি দেয় তাহমিদকে।

” জ্বি বলুন, শুনছি আপনার জরুরী কথা। অযথা ফোন কাটবেন কেন! আপনি ফোন কাটলে আমার বিরাট লস হয়ে যাবে। কারও মধু মাখানো গলা শুনতে পাবোনা। কাঁপা কাঁপা সেই গলায় কি যে নেশা সেটা কেবল আমিই জানি। আমার কান সেই গলার আওয়াজ না পেলে বধির হয়ে যাবে। ”

” আমি ফোন রাখছি। ” এবার কুহুর হুমকিতে কাজ হল।

” এই খবরদার ফোন রাখবেনা। নেহাৎ আমি অসহায় পুরুষ, তাই কারনে-অকারনে তোমার এমন হুমকি সহ্য করি। এই আমাকে অসহায় পেয়ে তুমি। বারেবারে সুযোগের সদ্ব্যবহার কর। ”

তাহমিদের মিইয়ে যাওয়া গলা শুনে কুহু হাসল। মানুষটাকে জব্দ করার উপায় পেয়েছে ও।

” আমি একটা কোচিং-এ জয়েন করছি আর তিনদন পরই। আসলে একটা নয় দুইটা কোচিং-এ সুযোগ পেয়েছি। ” কুহু উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল।

” কনগ্রেচুলেশন। তুমিও স্বাবলম্বী নারীর তালিকায় নাম লিখালে! কে বলেছে তালুকদার সাহেবের ভাতিজী অসহায়! তবে দুইটা কোচিং-এ ক্লাস নিয়ে পড়াশোনা ঠিকমত চালাতে পারবেতো? আশা করছি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ”

” দিনে আমি খুব একটা পড়িনা। দিনে ক্লাস নিয়ে রাতে পড়তে কোন সমস্যা হবেনা। শুধু এক জায়গায়ই পরীক্ষা দেব, তাই খুব একটা টেনশন করছিনা। ”

” সমস্যা না হলেই ভালো। পড়াশোনায় কোন ত্রুটি যেন না হয়। এক জায়গায় পরীক্ষা দেবে মানে? অ্যাডমিশন কোন কোন ভার্সিটিতে দিবে? ”

” শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশ নেব। ”

” কেন? অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কি দোষ করল? ”

” আমি যদি অন্য কোথাও চান্স পাই, তবে সৃজনকে এখানে রেখে আমাকে সেখানে থাকতে হবে। আমি সৃজনকে কোথাও একা রাখতে চাইনা। সে-ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। ”

এবার তাহমিদ কুহুর কথায় বিরক্ত হয়। কিন্তু ও কুহুকে বুঝতে দেয়না। ও নিজের বিরক্তি চেপে রেখে কথা বলল।

” কেন, রুয়েট কি দোষ করল? সেখানেও তো একটা সুযোগ নিতে পার। ”

” আমিতো রুয়েটের জন্য প্রস্তুতি নেইনি। শুধু পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ”

” আমি সাজেশন জোগাড় করেছি। এই কয়দিন ঝামেলার কারনে পাঠাতে পারিনি। কালকে পাঠিয়ে দেব। ডেলিভারিম্যান কোচিং-এ গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে। সাজেশনগুলো ফলো করলে আশা করি নিরাশ হবেনা। তবে রুয়েটের জন্যও একটু আধটু পড়াশোনা কর। যেখানে চান্স পাবে, সেখানেই ভর্তি হবে। ”

” আচ্ছা। আমি কালকেই স্যারের সাথে কথা বলব। স্যার যদি সাজেশন জোগাড় করে দিতে পারে, তবে ভালো হবে। ”

” আমি রুয়েটের সাজেশনও জোগাড় করেছি। তারপরও তোমার স্যারের সাথে কথা বলে দেখ। ”

কুহু তাহমিদের কথা শুনে নিরবে হাসল। মানুষটা দূরে গিয়েও ওর সাথে ছায়ার মত রয়ে গেছে
আগলে রাখছে কুহুকে।

” আপনি রাতে খেয়েছেন? কোথায় আছেন এখন? ”

” এখনও খাইনি। বর্তমানে একটা পার্কের ঘাসে শুয়ে আকাশের তারা গুনছি। দেখছি আকাশের গায়ে তারারা কেমন করে লেপ্টে থেকে, আকাশের ভালোবাসা নিজেদের শরীরে মেখে নিচ্ছে। বুঝলে মেয়ে, আকাশের সাথে তারাদের গভীর প্রনয় রয়েছে। ওরা একে-অপরকে ছাড়া শূন্য। যেমন আমি শূন্য এক শ্যাসাঙ্গীনিকে ছাড়া। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর হিয়ার মাঝে দোলা দেয় প্রশান্তির মৃদুমন্দ মলয়। মন বাগিচায় পাখনা মেলে উড়তে থাকে রংবেরংয়ের প্রজাপতি। ওর মন বলছে, তোর জীবনে সে এসেছে সুখের পরশ নিয়ে। তোর জীবনকে পরশপাথরের ছোঁয়ায় পাল্টে দেবে সে। তুই তার, তুই একান্তই তার। তুই তার শ্যামাঙ্গীনি।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-২১+২২

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২১
জাওয়াদ জামী জামী

মিথিলা আরজুমান্দ স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় একটা পাঁচতারকা হোটেলে উঠেছে। নাহিয়া ঘৃ’ণা’য় বাবা-মা’ র দিকে তাকাচ্ছেনা।

” নাহিয়া বেইবি ,তুমি এভাবে আমাদের দিক থেকে মুখ ঘুড়িয়ে রেখনা। আমি তোমাকে এভাবে দেখতে পারছিনা। কথা বল বেইবি। ” মিথিলা আরজুমান্দ মেয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে।

” শ্যাটআপ, মম। তোমার এমন কথা আমি জাস্ট নিতে পারছিনা। তোমার কথাকে আমার ন্যাকামো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তোমার সব অভিনয়। একটা কথা বলতো, এতদিন ধরে তুমি তোমার প্রথম সন্তানকে একদিনও মনে করনি? কি করে পেরেছ, তাকে না দেখে থাকতে! ” নাহিয়া মা’য়ের সঙ্গে ঘৃণাভরে কথা বলছে।

” আমার জীবনে তোমাদের মূল্য সবথেকে বেশি। তাই কারও কথা ভাবার সময় আমি পাইনি। তোমরাই আমার কাছে সব। আব্বার কথায় বিয়ে করেছিলাম রাশেদ কুরাইশিকে। তার অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তির কমতি ছিলনা। একসময় আমার কোলজুড়ে সন্তানও আসল। ও ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল। একসময় বুঝতে পারলাম, রাশেদ কুরাইশির মন সংসার থেকে উঠে গেছে। একদিন জানতে পারলাম, রাশেদ কুরাইশির তার সেক্রেটারির সাথে সম্পর্ক চলছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করায়, সে অস্বীকার করল। আমিও আর কথা বাড়াইনি। একদিন তাহমিদকে নিয়ে শপিংয়ে গিয়ে তোমার পাপার সাথে পরিচয়। সেই পরিচয় পরিনয়ে গড়াতে সময় লাগেনি। ধীরে ধীরে রাশেদ কুরাইশির সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে। একদিন সময় বুঝে কুরাইশি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি তোমার পাপার কাছে। এর দুইমাস পর চলে যাই সুইজারল্যান্ড। ”

” কি করে পেরেছ, সন্তানকে রেখে অন্য কারো হাত ধরে চলে যেতে? একবারও কি ঐ ভাইয়াটার চেহারা তোমার চোখে ভাসেনি? এখানে পাপাও সমান দোষী। সে চাইলেই পারত একটা সংসারকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে। কি করে পারলে! ”

” আমার কাছে তোমার পাপাই সব ছিল। আমার তখন অন্য কারো কথা ভাববার অবকাশ ছিলনা। এরপর আমার জীবনে তুমি আসলে। আমি আমার দুনিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পরলাম। তোমার পাপাও আমাকে অন্যকাউকে মনে করার সুযোগই দেয়নি। তাই তাহমিদকে আমার একটা দিনের জন্যও মনে পরেনি। আমি জানতাম ও সুখে আছে। ইভেন গতকাল পর্যন্তও আমি ওকে মনে করিনি। আমি তাহমিদের জন্য দেশে আসিনি, এসেছি তোমার নানুকে দেখতে। দেশে আসার আগে জানতে পেরেছি তাহমিদ রাজশাহীতে আছে। তখনই শুধু মনে হয়েছে ওকে আমি একবার দেখতে পাব। আশা করছি তোমার উত্তর পেয়ে গেছ। ”

নাহিয়া অবাক হয়ে মিথিলা আরজুমান্দদের দিকে তাকিয়ে আছে। ও ভাবছে, কোনও মা আদৌ কি সন্তানকে না দেখে থাকতে পারে! কতটা পাষাণ হলে মানুষ এমন করতে পারে!

” এখন যদি তোমার অন্য কাউকে ভালো লাগে, কিংবা পাপার অন্য কোন মেয়েকে পছন্দ হয়, তবে কি তোমরা আলাদা হয়ে যাবে? আমাদের কথা মনে করবেনা নিশ্চয়ই? ”

” এসব কি বলছ, সোনা? তুমি আমাদের প্রিন্সেস। আমাদের ভালোবাসার ফল। তোমাকে, মিশালকে ছেড়ে যাবার কথা আমরা কল্পনাই করতে পারিনা। শান্ত হও বেইবি। তুমি আমার কথা একটু বুঝতে চেষ্টা কর। এত হাইপার হলে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। ”

” আমি কিভাবে শান্ত হই, মম! তোমাদের করা অন্যায়ের কথা মনে হলেই আমার বুকে ঘৃণারা আছড়ে পরছে। বারবার ঐ ভাইয়াটার কান্না ভেজা চোখদুটো চোখে ভাসছে। একটা নয় বছরের ছেলে মা’কে ছাড়া কতটা অসহায় তার কথা শুনে আমি বুঝতে পারছি। আমি তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে, নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিনা। সে তাহলে কিভাবে জীবনের এতটাদিন কাটিয়েছে, ভাবলেই আমার কান্না পাচ্ছে। মা ছাড়া একটা সন্তান যে কতটা অসহায়, সেটা তুমি দুইদিনের জন্য বাহিরে গেলে আমি বুঝতে পারি। তবে আজ আমার মনে হচ্ছে, তুমি ভিষণই স্বার্থপর একজন মানুষ। নিজের সুখের জন্য সংসার ছেড়েছিলে, আবার নতুন সংসারে গিয়ে সেই পরিবারের সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। আমাদের সাথে দাদু বাড়ির সম্পর্ক রাখতে দাওনি। দেশে এসে দাদুর বাড়িতে না গিয়ে উঠেছিলে হোটেলে। আবার আজকেও সেটাই করলে। আর পাপাও তোমাকে অন্ধের মত সাপোর্ট দিয়ে গেছে। যাহোক আমি আর কথা বাড়াতে চাচ্ছিনা। তোমার নিজের জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তুমি নিতেই পার। আর আমিও পারি নিজেকে একটু ভালো রাখতে। তাই এখন থেকে সেই চেষ্টাই করব। আমি সুইজারল্যান্ড ফিরে হোস্টেলে উঠব। সেখান থেকেই পড়াশোনা করব। এবং এটাই ফাইনাল। ”

” নাহিয়া সোনা, তুমি এসব কি বলছ! আমরা তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবনা। তুমি আমাদের চোখের মনি। ” নাহিদ সারোয়ার মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।

” বাসায় থাকলেই তোমাদেরকে দেখতে হবে। আর যতবারই তোমাদের দেখব, ততবারই এক অসহায় সন্তানের হাহাকার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। যেটা আমি সহ্য করতে পারবনা। তাই আশা করছি তোমরা আমাকে কোন বাঁধা দেবেনা। ”

নাহিদ সারোয়ার এবং মিথিলা আরজুমান্দ দুজন দু’জনের দিকে তাকায়। তারা বুঝতে পারছে তাদের মেয়ে এই মুহুর্তে তাদের কোন কথা শুনবেনা। তাই তারা আপাতত চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। একবার সুইজারল্যান্ড যেতে পারলে তারা নিশ্চয়ই তাদের মেয়েকে বোঝাতে পারবে।

সকাল থেকে তাহমিদ রুম থেকে বের হয়নি। সকালে নাস্তা করবার জন্য রাজিয়া খালা কয়েকবার ওকে ডাকতে এসেছিলেন। কিন্তু তাহমিদ যায়নি।

বেলা এগারোটার দিকে খালা আরেকবার ওকে ডাকতে আসলেন।

” বাপজান, চল খাইবা। সবার খাওয়া শেষ। এখন তুমি খাইলেই আমরা খাইতে পারি। আর দেরি কইরোনা, বাপজান। ” খালার দরদ মাখা কথা শুনে তাহমিদ আর শুয়ে থাকতে পারলনা। ও উঠে বসল।

” খালা, তুমি যাও। আমি আসছি। টেবিলে তিনজনের খাবার দিও। তোমার সাথে সাথে নিশ্চয়ই সেই মেয়েও খায়নি? তোমরা দেখছি আমাকে ব্ল্যাকমেইলের ওপরই রাখবে। আমার সকাল হবে ব্ল্যাকমেইলের নাস্তা করে, রাত হবে ব্ল্যাকমেইলের ডিনার করে। ভাবা যায়! জীবনটাই ব্ল্যাকমেইলময়। ”

” আর কথা কইওনা। নিচে আস, আমি খাবার দিতাছি। খাওয়ার পর তোমার নানিমার কাছে যাইবা। হেয় কাইল থাকা খালি কানতাছে। ”

” আচ্ছা, খালা। ” তাহমিদ আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকল।

তাহমিদ খাবার টেবিলে আসলে কুহু গরম ভাতের প্লেট এগিয়ে দেয় ওর দিকে।

” খালা, তোমরা খাবেনা? জলদি এস। ”

” তুমি খাও, বাপজান। আমি হাতের কাজ কইরাই খাব। কুহু মা, তুমিও বাপজানের সাথে খাইয়া লও। ”

” না খালা, আমি আপনারই খাব। ”

তাহমিদ কিছু না বলে শুটকি ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে এক লোকমা ভাত কুহুর মুখের দিকে ধরে।
তাহমিদের এমন কাজে কুহু চরম বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।

” খাবে? নাকি আমি প্লেট রেখে উঠে যাব? সিদ্ধান্ত তোমার। ”

কুহু আঁড়চোখে তাকায় ড্রয়িংরুমের চারপাশে। সেখানে কাউকে না দেখে, একটু ইতস্তত করে খাবার মুখে নেয়।

রাজিয়া খালা দৃশ্যটা দেখে স্বস্তির হাসি হাসলেন।

কুহু এক লোকমা ভাত মুখে নিয়েই রান্নাঘরে চলে যায়। চুপচাপ খালার পেছনে সেঁধিয়ে থাকে। লোকটা বারবার ওকে লজ্জায় ফেলে দেয়। সে যেমন নিজের অনুভূতি লুকায়না, তেমনি কুহুর অনুভূতিও টেনে বের করতে ওস্তাদ।

” নানিমা, তুমি কালকের সব ঘটনা শুনেছ? তোমার বড় মেয়ে উনিশ বছর পর মাতৃত্বের দাবী নিয়ে এসেছে। অথচ যে একটা সময় আমাকে ছেড়ে যেতে দু’বার ভাবেনি। তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ, নানিমা? কষ্ট পেয়েছ তোমার মেয়ের সাথে খারাপ আচরণ করেছি জন্য? কষ্ট পেলে আমাকে জানিয়ে দিও, আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাব। ” তাহমিদের চোখের কোনে চিকচিক করছে দুঃখের অশ্রু। সে খাওয়া শেষ করেই নানিমার কাছে এসেছে।

তাহমিদের কথা শুনে বৃদ্ধা তার একমাত্র সচল হাতটি বাড়িয়ে দিলেন। তাহমিদ তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। এক হাত দিয়ে তাহমিদকে নিজের কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করছেন। তাহমিদ তার দিকে এগিয়ে গেলে তিনি একহাতে ওকে জড়িয়ে নিলেন।

কুহু কোচিং-এ যাবার সময় আশেপাশে তাহমিদকে দেখলনা। আজ সারাদিন মানুষটা বাসা থেকে বের হয়নি। সে এখনো রুমেই আছে। কুহুর বুক চিঁড়ে আপনাআপনি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। ও একনজর দোতলায় তাকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

কোচিং শেষ করে বেরিয়ে আসতেই, তাহমিদকে সামনের দোকানে বসে থাকতে দেখল কুহু। সে উদাস নয়নে সূদুরে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে কি হচ্ছে সেদিকে তার কোনও খেয়াল নেই। কুহু বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু তাহমিদ ওকে লক্ষ্যই করলনা। বাধ্য হয়ে কুহু মৃদু পায়ে এগিয়ে আসে।

তাহমিদের সামনে এসে দাঁড়ালেও সে কুহুকে লক্ষ্য করলনা। এবার কুহু অবাক হয়। মানুষটা সেই কখন থেকে কিছু একটা ভেবেই চলেছে। তার মন-মস্তিস্কে চিন্তার ঝড় বইছে, সেটা কুহু বুঝতে পারছে। কিন্তু ও কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? তাহমিদকে এবার ডাকতেই হবে। ও তাহমিদকে কিভাবে ডাকবে সেই চিন্তাই করছে।

” এই যে মহাশয়? কোথায় হারালেন? আমি অনেকক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। ” সাহস করে কুহু কথা বলল।

হঠাৎ কারো আওয়াজ পেয়ে চমকে তাকায় তাহমিদ। সামনে দাঁড়ানো কুহুকে দেখে স্মিথ হেসে উঠে দাঁড়ায়। একটা ফাঁকা রিক্সা ডেকে উঠে বসল।

আজও ও কুহুকে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছে। একটু ফাঁকামত জায়গা দেখে কুহুকে নিয়ে বসল। কুহু জড়োসড়ো হয়ে বসতেই, তাহমিদ ঘাসের ওপর সটান হয়ে শুয়ে পরল।

” আজকে শুধু বাদাম কিনেছি। প্যাকেট খুলে দেখ সবগুলো বাদাম ছিলে রেখেছি। তুমি চুপচাপ এগুলো খাও। এই সুযোগে আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। খবরদার আমাকে ডাকবেনা বলে দিলাম। আমাকে ডেকেছ তো ফেঁসেছ। তোমাকে ক্যাম্পাসে রেখে আমি বাসায় চলে যাব। সময় না কাটলে আমার ফোনে টিকটক দেখতে পার। ” কথাগুলো বলেই চোখ বুজল তাহমিদ। অবশ্য তার আগে নিজের ফোন পকেট থেকে বের করে কুহুর দিকে এগিয়ে দিয়েছে।

কুহু তাহমিদের এমন বেপেরোয়া কথা শুনে মুখ বাঁকায়। তাহমিদের চোখ বন্ধ দেখে ও কিছু বলার ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিয়ে বাদামের প্যাকেট খুলল।

মাগরিবের আজান দিয়েছে। কুহু এবার উসখুস করছে। আজ চাচি ওকে ছাড়বেনা। কিন্তু কুহু হঠাৎ করেই অনুভব করল আজ ও চাচিকে মোটেও ভয় পাচ্ছেনা। তাহমিদের দিকে চোখ পরতেই দেখল মানুষটা প্রশান্তিতে ঘুমাচ্ছে। তাই তাকে ডাকতে কুহুর মন সায় দিলনা। ও গত এক ঘন্টায় বাদামগুলো খেয়ে নিয়েছে। সেই সাথে একক আধিপত্য খাটাচ্ছে তাহমিদের ফোনে।

আরও পনের মিনিট পর তাহমিদের ঘুম ভাঙ্গলো। ও হাই তুলে উঠে বসল। সামনে বসা মেয়েটার দিকে তাকাতেই আপনাআপনি ঠোঁটের কোন প্রসারিত হল।

” বাসায় যাবেনা নাকি এখানেই সংসার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ? ”

তাহমিদের কথা শুনে বিরক্ত হয় কুহু। এ কেমনধারা কথা বলছে লোকটা! সে-ই আমাকে অপেক্ষা করতে বলে, উল্টো আমাকেই খোঁ’চা দিচ্ছে!

” তারাতারি বাসায় চলুন। আমি চাচিকে নিয়ে চিন্তা করছি। আজ আমার কপালে কি আছে আল্লাহই জানেন। ”

” তোমার কপালে আমার আদর বৈ কিছুই নেই। বুঝলে মেয়ে তোমার কপালে তাহমিদের রাজত্ব শুরু হয়েছে অনেকদিন আগেই। ”

” ছিহ্। অসভ্য লোক খালি আজেবাজে কথা বলে! ”

কুহুর কথা শুনে তাহমিদ নিরবে হাসল। ও কুহুর কথার উত্তর না দিয়েই সামনে হাঁটতে থাকে। কুহুও বাধ্য মেয়ের মত ওর পিছু নেয়।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী জামী

গত কয়েকদিনের ন্যায় আজ কুহু রিক্সায় জড়োসড়ো হয়ে বসলনা। তাহমিদ আজ ওর মধ্যে কোন জড়তা না দেখে গোপনে হাসল। তবে ও কুহুর পেছন দিয়ে রিক্সায় হাত রাখতে ভুললনা।

প্রায় আধাঘন্টা পর ওদের রিক্সা বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। কুহুর হঠাৎ করেই ভয় লাগতে শুরু করল। অন্যদিনের মত আজ তাহমিদ ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলনা। বাসার ভেতর ঢুকে কিসের সম্মুখীন হবে, সেটা ভাবতেই কুহুর গলা শুকিয়ে আসছে। ওর দু’পা যেন মাটির সাথে সেঁটে গিয়েছে।

” কি হলো, বাসায় না গিয়ে এখানে ল্যাম্পপোষ্টের মত দাঁড়িয়ে রইলে কেন? নাকি মহল্লার মানুষদের আলো দেয়ার সাধ জেগেছে? তবে তুমি থাক, আমি ভেতরে গেলাম। ” তাহমিদ কথাটা বলেই বাসার দিকে পা বাড়ায়।

তাহমিদের রুদ্রমূর্তি দেখে কুহুর কথা বাড়ানোর সাহস হয়না। ও তাহমিদের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। আর মনে মনে দোয়া-দরুদ পাঠ করতে থাকে।

বাসায় ঢুকতেই ড্রয়িংরুমে রায়হান আহমেদকে বসে থাকতে দেখল কুহু। তার পাশে নায়লা আঞ্জুমও বসে আছে।

কুহুকে তাহমিদের সাথে দেখে কুটিল চোখে তাকায় নায়লা আঞ্জুম। সে কুহুকে কঠিন কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু তার আগেই কথা বললেন রায়হান আহমেদ।

” কুহু মা, তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? আমি চিন্তায় পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছিলাম। ফোন নিয়ে যাসনি কেন? আর তাহমিদের সাথে কোথায় দেখা হয়েছে তোর? ” রায়হান আহমেদের গলায় নিখাঁদ উদ্বেগ।

” চাচা, আমি…. কুহু কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই তাহমিদ কথা বলল,

” তালুকদার সাহেব, ও কোচিং থেকে বেরিয়ে সম্ভবত রিক্সার অপেক্ষায় ছিল, আমিও তখন সেখান দিয়েই আসছিলাম। ওকে দেখে ভাবলাম, আমিও বাসায় যাচ্ছি, ওকেও নিয়ে যাই। তো আসার পথে আমার একটা কাজ পরে যায়। আর আমার কাজের জন্যই বাসায় আসতে দেরি হয়েছে। ”

কুহু হা করে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা অনায়াসে যা ইচ্ছে তাই বলল, কোন বিকার নেই তার চেহারায়!

” ওহ্ বুঝেছি। রুমে যা, মা। ভালোই হয়েছে তাহমিদের সাথে এসেছিস। তবে এরপর বাহিরে গেলে ফোন নিতে ভুলবিনা। ”

” ঠিক আছে, চাচা। ” কুহু আর সেখানে দাঁড়ায়না।

পরদিন সকালে শায়লা হাসান স্বামী-সন্তান নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। জয়কে বাসা থেকে বেড়োতে দেখে কুহু হাঁফ ছাড়ল। তবে যাওয়ার আগে জয় ওকে চোখের ইশারায় কিছু বলে গেল, যা কুহুর বোধগম্য হয়না। যেটা তাহমিদের নজর এড়ায়নি এবং ও জয় কি বলতে চেয়েছে, তা ঠিকই বুঝেছে।

সেদিন বিকেলে কোচিং থেকে বেরিয়ে কুহু বরাবরের মতো তাহমিদকে দেখতে পায়। আজকেও তাহমিদ কুহুকে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছে। আজও তাহমিদ বাদাম ছিলে রেখেছে। যা দেখে কুহু হাসল।

” যখন-তখন এভাবে হেসে আমাকে খু’ন করার মতলব এঁটেছ, মেয়ে! তুমি কি জানো তোমার হাসিতে আমি খেই হারিয়ে ফেলি? ওলট-পালট হয় আমার পুরো দুনিয়া? নাকি আমাকে ঘায়েল করতেই এই মোক্ষম অস্ত্রের ব্যবহার কর! ”

কুহু তাহমিদের কথা নীরবে শুনে যায়। ও কি উত্তর দেবে! এই মানুষটার সামনে আসলেই ওর সাথে কথারা বেইমানী করে। তারা ঘাপটি মেরে বসে থাকে কন্ঠায়। চেপে ধরে রাখে ওর কন্ঠ নালী।

কুহুকে নীরব থাকতে দেখে আবারও মুখ খুলল তাহমিদ।

” আজ রাতেই আমি ঢাকায় ফিরছি। আগামী আড়াইমাস এমুখো হতে পারবনা। এরইমধ্যে তোমার এডমিশনও হয়ে যাবে। এই কয়দিন তুমি রিক্সায় যাতায়াত করবে। আমি রিক্সা ঠিক করে রেখেছি। প্রতিদিন সময় মত রিক্সাওয়ালা চাচা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে, আবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাবে। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু ধাক্কা খেল।

” আজকেই চলে যাবেন! ”

” হুম। অনেকদিন ছুটি কাটালাম, আর কত? এত ছুটি কাটাতে গিয়ে চাকরিটা চলে গেলে, অভিভাবকরা কি তাদের মেয়েকে কোন বেকার ছেলের হাতে তুলে দেবে? এখনকার অভিভাবকদের আকাশসম চাহিদা। অল্পে তাদের মন ভরেনা। তারা মেয়ের জন্য ইলন মাস্কের মত পাত্র খোঁজে। তবে তাদের চেহারাও হতে হবে টম ক্রুজের মত। আবার তাদের আচরণও হতে ত্যালতেলে মোমের পুতুলের মত। কথায় কথায় গলে পরবে। আমারতো আবার এসব কিছুই নেই। আছে একটা সামান্য চাকরি। এটা চলে গেলে জীবনে কপালে বউ জুটবেনা। আজীবন আমাকে বউ হীনতায় কাটাতে হবে। আমি সারাজীবন একবেলা করে খেয়ে কাটতে রাজি আছি। কিন্তু বউ হীনতায় একদিনও কাটাতে রাজি নই। বউ হীন পুরুষ আর ঘাসহীন গরুর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ঘাস আর বউ, গরু আর পুরুষের পরিপূরক। এই দুটো ছাড়া গরু আর পুরুষ অচল। ”

এবার কুহুর মাথা বন বন করে ঘুরছে। এই লোক কোন কথাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে! একটা ছোট প্রশ্নের উত্তর সে কিভাবে প্যাঁচাচ্ছে এটা ভাবা যায়! আসলেই লোকটা ত্যাড়া।

” আমি বাসায় যাব। আজকে দেরি হলে চাচিকে দেয়ার মত কোনও উত্তর আমার কাছে নেই। ” কুহু উঠে দাঁড়িয়ে বলল।

” চুপ করে বস। আজকেও আমার সাথে বাসায় যাবে। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। ”

তাহমিদের চোখ রাঙ্গানি দেখে কুহু ধপ করে বসে পরল।

” কি বলবেন তারাতারি বলুন। ”

” এত তাড়াহুড়ো কিসের? আমি কি বলেছি মনে আছে তো? ”

কুহু বুঝতে না পেরে তাকায় সামনে বসে থাকা সুদর্শন যুবকটির দিকে।

” প্রতিদিন সময়মত গেইটের সামনে দাঁড়াবে, আজকে আমরা যে রিক্সায় যাব, সেই রিক্সাই তোমাকে নিতে যাবে। আসার সময়ও সেই রিক্সায়ই আসবে। রাস্তায় কারও সাথে কথা বলবেনা। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। আর নায়লা আঞ্জুমের কাছ থেকে যতটা দূরে থাকা যায় থাকবে। ”

তাহমিদের কথা শুনে চিন্তায় পরে যায় কুহু। ও প্রতিদিন অটোতে চলাফেরা করে। আর রিক্সার তুলনায় অটোর ভাড়া কম। প্রতিদিন রিক্সায় চলাফেরা করলে ওর ৬০-৭০ টাকা ভাড়া লাগবে। এত টাকা ও রিক্সা ভাড়ার জন্য খরচ করবে! যদিও চাচা প্রতিদিন ওকে টাকা দেয়। কিন্তু তাই বলে এত টাকা খরচ করতে ওর বিবেকে বাঁধবে। এমনিতেই চাচি ওদের টাকা দিকে দেখলে চোখ গরম করে তাকায়। কুহু এবার সত্যিই অকূল পাথারে পরল। ও তাহমিদকে কি বলবে?

কুহুকে নীরব থাকতে দেখে তাহমিদ যা বোঝার বুঝে নেয়।

” কি এত চিন্তা করছ? যা যা বললাম, সেগুলো মাথার ভেতর ভালোভাবে ঢুকিয়ে নাও। আমার কথার অন্যথা হলে তোমার কঠিন শাস্তি অবধারিত। আর এতদিনে আমাকে নিশ্চয়ই চিনেছ তুমি? ”

” হুম। ” কুহু ছোট্ট করে উত্তর দেয়। ওর মনের মধ্যে চিন্তার ঝড় বইছে।

আরও কিছুক্ষণ ওরা ক্যাম্পাসে বসল। কুহু চুপচাপ বসে আছে, আর তাহমিদ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন বহুকালের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। মেয়েটাকে এত দেখছে তবুও ওর মনের তৃষ্ণা, চোখের তৃষ্ণা কিছুই মিটছেনা। ওর বুকের ভেতর এখন থেকেই হাঁস-ফাঁস করছে। মেয়েটাকে এতদিন না দেখে থাকবে কিভাবে! এই মেয়েটা যে ওর বেঁচে থাকার খোরাক। ওর মরুর মত জীবনে এক পশলা শীতল বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে এই মেয়েটা। যে বৃষ্টির তোড়ে ছাপিয়ে গেছে হৃদয়ের দু কূল। বাঁধভাঙা ভালোবাসা এসে জমা হয়েছে হৃদয় অম্বরে।

কুহু অনুভব করছে তাহমিদ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর সমস্ত শরীর শিরশিরিয়ে উঠল। টুপ করেই ভালো লাগায় ছেয়ে যায় ওর পুরো সত্তা। আজকাল এই মানুষটার ধমকেও ভালোবাসা খুঁজে পায় কুহু। তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দকনা অমৃত ঢেলে দেয় কুহুর কর্নকুহরে। তার একটুখানি হাসিও কুহুর রাতের ঘুম কেড়ে নিতে যথেষ্ট। হঠাৎই কুহুর চোখজোড়া মানুষটাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে যায়। ও হাসিমুখে সামনে বসা পুরুষটির দিকে তাকাতেই থমকে যায়। সেই পুরুষটি ওকে নেশাক্ত চোখে দেখছে! দু’জনের চোখাচোখি হয় কয়েক মুহুর্তের জন্য। এই কয়েক মুহূর্ত সাক্ষী হয়ে রইল দু’জনের অব্যক্ত ভালোবাসার। নীরবে কথা হয় দুটি হিয়ার। দু’জনের প্রেমময় আঁখি জোড়ায় আরেকবার সৃষ্টি হয় প্রনয়ের পদ্মদিঘি।

কুহু লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। ওর লজ্জায় আরক্তিম চেহারা দেখে তাহমিদ প্রানখোলা হাসল।

” এই সামান্য চোখাচোখিতেই লজ্জায় রাঙা হচ্ছ রমনী! যেদিন আমার চোখজোড়া প্রেয়সীর সর্বাঙ্গে প্রেমের দংশন করবে, সেদিন কি সে সইতে পারবে? নাকি লজ্জায় সংজ্ঞা হারিয়ে আমার রোমাঞ্চের চৌদ্দটা বাজাবে! রমনী তুমি আজ আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলে। লজ্জায় সংজ্ঞা হারানো বউ পাহারা দিয়ে রাত কাটানোর কথা ভাবতেই আমার শরীরের প্রতিটি র’ক্তকনিকা ছলকে উঠছে। ”

তাহমিদের এমন নির্লজ্জ কথা শুনে কুহু আর বসে থাকতে পারলনা। ও এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে যায়। ওর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। আজ অব্দি কেউ ওকে এভাবে বলেনি। এই নিলাজ লোকটার সাথে আর কিছুক্ষণ থাকলে ও নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে।

” আমি বাসায় যাব। আপনি না গেলেও আমি একাই চলে যাব। ”

” আগে কাঁপা-কাঁপি বন্ধ কর, তারপর বাসায় যাও। নতুবা লোকজন তোমাকে এভাবে কাঁপতে দেখলে ভাববে, আমি তোমার সাথে কোন দুষ্টুমি করেছি। আদতেই যেটা আমি করিনি, সেই দোষ কেন নিজের কাঁধে নেব! যদি সামান্যও কিছু করতাম, তবে না হয় মানা যেত। করব নাকি কিছু? ”

ব্যাস, আর কুহুকে পায় কে। ও আর সেখানে দাঁড়ায়না। দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল।

তাহমিদও হেসে কুহুর পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। মেয়েটা যেভাবে টালমাটাল পায়ে হাঁটছে, যেকোন মুহূর্তে হোটচ খাবে। তাই ওর পেছনে থাকা তাহমিদের কাছে আবশ্যক মনে হল।

চলবে….