❝ নিজের চোখের সামনে আমার হাসবেন্ড আমার ছোট বোনকে বিয়ে করে এনেছে । শুনেছি, ইসলাম ধর্মে নিজের আপন বোনকে বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রী তালাক হয়ে যায়। তাহলে আমার এই অনাগত দুধের বাচ্চার কি হবে? নিজের বোনকে বাসায় রাখা যে আমার জন্য কাল হবে, তা আমি কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি! ❞
” জুনায়েদ নিমুকে বুকে টেনে নিয়ে দুম করে দরজা লাগিয়ে দিলো, আমার চোখের সামনে। চোখ দিয়ে টপাটপ দু’ফোটা চেখের পানি গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে । স্বামীর বুকে নিজের বোনকে এই অবস্থায় দেখে চোখ মানছিলো না। জুনায়েদকে কিছু জিজ্ঞেস করার শ্রবণ শক্তি হারিয়ে গেছে ইনিয়ার। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারছিলো না। মনে হচ্ছে বুকে কেউ পাথর চা’পা দিয়ে রেখেছে। পিটপিট করছে চোখের পাতা। পানি পড়ছে টুসটুস করে। বেশিকিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেলো। অনেকক্ষণ পর ইনিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেললো। ”
” আমার পেটে আমার বরের বাচ্চা একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলো। নয় মাসের অন্তসর্তা স্ত্রী তার। এই সময়ে এসব কিছু দেখবো কল্পনাও করিনি। বাবা – মা আমার ভালোর কথা ভেবে আমার বোনকে আমার বাড়িতে পাঠিয়েছিলো। কিন্তু ফলাফল যে এরকম হবে ভাবতেও পারেনি। কিছুদিন যাবত জুনায়েদকে মাঝরাতে আমার পাশে পাচ্ছিলাম না। হয়তো এই সময়ে তারা আমার অনোগোচরে অ’বৈ’ধ সম্পর্কে লিপ্ত হতো । মাথা কাজ করছে না কি করবো এখন আমি? আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে দূরে কোথাও যাব নাকি এসব দেখেও না দেখার ভান নিয়ে বসে থাকবো! কিন্তু আমার বাচ্চা পৃথিবীতে আসলে তাকে কি জবাব দিব? তার প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিবো,তাঁকে কিভাবে বলবো তোমার বাবা একটি ল’ম্প’ট। আমার দূরে যাওয়াই উচিত। আমি চাইনা আমার অনাগত সন্তান দুঃচরিত্রবানের ছত্রছায়ায় মানুষ হোক। যেইভাবা সেই কাজ, ইনিয়া আস্তে আস্তে উঠে এক কাপড়ে নিচে নেমে আসে। দারোয়ান ইনিয়াকে এই অবস্থায় নিচে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম? এই অবস্থায় এভাবে নিচে আসছেন স্যার জানে তো! আপনার কিছু লাগবে ম্যাডাম, দেন আমি নিয়ে আসি।
” আলম ভাই যার সংসার টাই ন’ষ্ট হয়ে গেছে তার কি লাগবে, না লাগবে এসব না ভাবলেও চলবে। আলম ভাই এই নেন একটা চিঠি, আপনি খুলবেন না। আপনার স্যার যখন আমায় খুঁজবে তখন তার হাতে দিয়েন। আমি মার্কেট যাচ্ছি, আল্লাহ হাফেজ! ”
” আলম ইনিয়ার কথাগুলো ঠিকমতো বুঝতে পারলো না। তাই দায়িত্বশীল হয়ে বললো ম্যাডাম এই অবস্থায় এভাবে নিচে আসা ঠিক হয়নি। কিছু লাগলে আমাকে ডাকতে পারতেন, আমি এনে দিতাম। কিন্তু নিচে যেহেতু চলে এসেছেন স্যারের গাড়িটা নিয়ে যান। দাড়ান আমি ড্রাইভারকে কল করি। ”
” ইনিয়া মুচকি হেসে বললো আপনার স্যারের কোনোকিছু ব্যবহার করতে পারবো না। আমি চাইনা আমার অনাগতের জীবনে তার ছোঁয়া লাগুক। আমি রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবো। ”
” এই অবস্থায় রিকশায় উঠতে পারবেন? রিকশায় উঠতে হলে অনেক উঁচুতে পা উঠাতে হবে। তারচেয়ে গাড়ি নিয়ে যান। ”
“ আলম চুপসে যায়। মাথা নেতিয়ে থাকে। ইনিয়া গেইট থেকে বের হয়, এরপরে আলমকে বলে গেইট টা লাগাতে। আলম বাধ্য কর্মচারীর মতো গেইট লাগিয়ে দেয়। ইনিয়া একটা রিকশা ডাক দেয়। খুবই সাবধানতার সহিত রিকশাতে উঠে বলে মামা আমাকে জা’হা’ন্না’ম থেকে নিয়ে চলুন যেদিকে দু চোখ যায়। ”
“ রিকশাওয়ালা মামা ইনিয়ার কথা ঠিক বুঝতে পারলো না। তাই ইনিয়াকে প্রশ্ন করলো কোথায় যাবেন ম্যাডাম? হসপিটালে চেক-আপ করাতে যাবেন নাকি? কিন্তু এই অবস্থায় এভাবে যাওয়া ঠিক নয় ম্যাডাম। আপনাকে দেখে যথেষ্ট বড়লোকের স্ত্রী মনে হচ্ছে , তাহলে ডক্টর কল করে ডাকলেই তো পারতেন? ”
” মামা আপনাকে এভাবে ভাবতে বলছে কে? অন্য নারীর কেয়ার নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আপনি আপনার স্ত্রীর দিকে এসব কেয়ারিং দৃষ্টিপাত রাখুন। ”
” কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন? কোথায় নিয়ে যাব আপনাকে? ”
” কিছুক্ষণ স্থির থাকলো ইনিয়া। এরপরে ইনিয়া ভেবেচিন্তে দেখলো ইনিয়ার তো আসলেই কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ইনিয়া আসলে কোথায় যাবে? এই অবস্থায় বাবার বাড়িতে যেতেও লজ্জা করছে ইনিয়ার। তাই ইনিয়া ভেবেচিন্তে ঠিক করলো সারাদিন রিকশা করে ঘোরবে। তারপরে ভেবে দেখবে আসলেই কোথায় যাওয়া উচিত ইনিয়ার। ইনিয়া রিকশাওয়ালা মামার হাতে হাজার টাকার একটি নোট দিয়ে বললো সাঝ নামার আগ পযর্ন্ত আমাকে নিয়ে এই শহরের অলি গলি ঘোড়বেন। ”
” ইনিয়ার এমন উত্তরে রিকশাওয়ালা খানিকটা ঘাবড়ে গেলো। তবুও কিছু না বলে রিকশা নিয়ে শহরের অলিগলি ঘোরা শুরু করলো। রিকশাওয়ালা মনেমনে আন্দাজ করে নিয়েছিলো হয়তো হাসবেন্ডের সঙ্গে ঝ’গ’ড়া করে এই মহিলা এভাবে বের হয়েছে। সাঝ নামলে রাগ কমবে তখন নিশ্চিত ঘরে ফিরবে। ”
” বিয়ের প্রথমদিনে কিচেনরুমে সবজি কাটতে যায় ইনিয়া। সবজি কাটার বেখেয়ালে হাত কেটে ফেলে ইনিয়া। ইনিয়া আউচ বলে চিৎকার করে। ইনিয়ার চিৎকারে জুনায়েদ দৌড়ে আসে কিচেনরুমে। ইনিয়ার আঙুল কেটে রক্ত পড়তে দেখে পা’গ’ল প্রায় হয়ে যায় জুনায়েদ । জুনায়েদ ইনিয়াকে পাঁজাকোলে করে নিয়ে দ্রুত নিচে আসে। গাড়ির সিটে বসায় ইনিয়াকে। ইনিয়া ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে প্রশ্ন করে…
” কি করছো জুনায়েদ ? ”
” তোমাকে কত করে বললাম কিচেনরুমে যেতে হবেনা। আমরা অর্ডার করে খেয়ে ফেলবো? কিন্তু তোমার জে’দে’র কারণে আজকে এই সিচুয়েশনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ? ”
” ইনিয়া মৃদু হেসে বলে পা’গ’ল হয়েছো তুমি। কতদিন অর্ডার করে খাবে? আমাকে বিয়ে করছো কেনো তাহলে? আমি যদি তোমাকে একটু রান্না করে না খাওয়াতে পারলাম? ”
” এই তোমার রান্নার চক্করে পড়ে আমার হৃদয় থেকে রক্তপাত হচ্ছে ! ”
” সামান্য কেটেছে। কিছুনা হবেনা ড্রেসিং করলে হয়ে যাবে। এরজন্য গাড়ি করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ”
” ডক্টরের কাছে। ”
” জুনায়েদ তুমি পাগল হয়েছো? এই সামান্য কাটার জন্য কেউ ডক্টরের কাছে যায়। ”
” কোনটা সামান্য কাটা? আমার হৃদয়ের রক্তপাত হচ্ছে। এটাকে সামান্য কাটা বলে উড়িয়ে দিবেনা। ”
” ইনিয়া জুনায়েদের চোখে ভালোবাসার ছটফট দেখে মূহুর্তেই নিজেকে নিয়ে নিজেই মনে মনে হাসে। ”
❝ ডক্টর! ডক্টর! ডক্টর! কোথায় আপনারা? আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হচ্ছে চিকিৎসা দরকার! ❞
নার্স এইভাবে জুনায়েদের ছটফট দেখে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে স্যার?
” জুনায়েদ কপাল ভাজ করে বলে ডক্টর কোথায় নার্স? আমার ডক্টরকে প্রয়োজন! ”
” জুনায়েদের চিৎকারে নার্স কানচেপে ধরে বলে ডক্টর ওইদিকে স্যার? ”
” জুনায়েদ ইনিয়ার হাত ধরে দ্রুত ডক্টরের কাছে যায়। ইনিয়া হাফিয়ে যায় জুনায়েদের এতো কেয়ারিং আচরণে। ”
” ইনিয়া জুনায়েদকে বলে কি হচ্ছে জুনায়েদ? এরকম করছো ক্যানো? আমার সেরকম কিছু হয়নি তো! ”
” তুমি চুপ থাকো। ”
❝ ডক্টর ফোনে কথা বলছে। সুমন ডক্টরের কাছে যেয়ে বলে আমার স্ত্রীর হাত কেটে গেছে ডক্টর। আমার হৃদয়ের রক্তপাত বন্ধ করুন দ্রুত। ❞
ডক্টর বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, কি সমস্যা আপনার দেখছেন না ফোনে কথা বলছি। সমস্যা হলে ইমার্জেন্সিতে যান। ডক্টর আবার ফোনে কথা বলা শুরু করে।
ডক্টরের এইরকম ব্যবহারে জুনায়েদ ডক্টরের কলার চেপে ধরে বলে, আপনি ডক্টর না আপনার কাজ হচ্ছে পেসেন্টকে সার্ভিস দেওয়া। পেসেন্ট আপনার দোরগোড়ায় আপনি ফোনে কথা বলছেন কোন আক্কেলে?
ইনিয়া পিছন থেকে জুনায়েদকে বলে জুনায়েদ ( করুণাময়ী স্বরে )
” জুনায়েদ ইনিয়াকে বলে তুমি চুপ থাকো। ”
” ডক্টর ফোন কেটে দেয়। এরপরে জুনায়েদকে বলে আসুন ইমার্জেন্সিতে।”
হঠাৎ রিকশাওয়ালার ডাকে ইনিয়ার ঘোড় কেটে যায়। ইনিয়া রিকশাওয়ালাকে বলে কি হয়েছে?
” ম্যাডাম সেই দুপুর থেকে আপনাকে নিয়ে শহরের প্রত্যক অলিগলি ঘোরলাম। সাঝ নেমে এসেছে প্রায়। এখনতো বলুন কোথায় যাবেন আপনি? ”
” ইনিয়া রিকশাওয়ালা মামাকে বলে আমারতো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই? কই যাব আমি। ”
” ধুর ম্যাডাম আপনি একজন মহিলা দেখে সম্মানের সহিত এতক্ষণ ছিলাম। তারমধ্য এরকম অসুস্থ দেখে ভেবেছিলাম স্যারের সঙ্গে অভিমান করে বের হয়েছেন বাসা থেকে। অভিমান কমলেই বাসা ফিরবেন। এখন আপনি এসব বললে আমি আপনাকে কোথায় নিয়ে যাব? দয়া করুন ম্যাডাম আমাকে। এইবার আপনি নেমে পড়ুন আমার রিকশা থেকে। আমাকে মুক্তি দেন। আমি কোনো ভেজাল কাঁধে নিতে চাইনা। ”
” ইনিয়া রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালাকে স্যরি বললো। এরপরে রিকশাওয়ালাকে বললো আপনি চলে যান মামা। ”
” রিকশাওয়ালা খানিকটা অবাক হলো। কিন্তু মনেমনে রিলিফ ফিল করে রিকশা টান দিয়ে নিজের বাড়ির দিকে পথ বাড়ালো। ”
” ইনিয়া ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়লো। মাথায় হাত রেখে কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সারা শহরজুড়ে অন্ধকার নেমে পড়লো। ”
অনেকক্ষণ যাবত ইনিয়া একজায়গায় বসে আছে। একদল লোক ইনিয়াকে ফলো করছে। ইনিয়া বুঝতে পারলো। ইনিয়া বুঝতে পেরে উঠে পড়লো সেখান থেকে। এরপরে হাটা শুরু করলো সামনের দিকে। পিছন থেকে কিছু তিনজন লোক ইনিয়াকে ধাওয়া শুরু করলো। ইনিয়া অসুস্থ অবস্থায় দৌড়াতে শুরু করলো। পা চলছে না ইনিয়ার। লোকগুলো ইনিয়ার কাছে এসে ইনিয়াকে ঘীড়ে ধরলো।
” ইনিয়া আমতাআমতা স্বরে বললো, কি চাই আপনাদের? ”
“লোকগুলোর মধ্যে একজন বলে উঠলো আপনাকে! ”
” স্যার, আজকেই ম্যামকে সি সেকশনে নিতে হবে। আপনি কাইন্ডলি ডক্টরের সাথে কথা বলুন। ”
তাহমিদ কেবলমাত্র ভার্সিটি থেকে হসপিটালে এসেছে। গত দুইদিন আগে থেকে কুহু এখানে এডমিট আছে। ওর শারিরীক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাহমিদ রিস্ক নিতে চায়নি। তাই আগেই কুহুকে ডক্টরের তত্ত্বাবধানে রেখেছে।
” আমি ডক্টরের সাথে কথা বলছি। তার আগে আমার স্ত্রী’র সাথে দেখা করে আসছি। ” তাহমিদ আর সেখানে দাঁড়ায়না। সরাসরি চলে যায় কেবিনে।
” ভাইয়া, এসেছ? তুমি ডক্টরের সাথে কথা বল। তিনি রাউন্ডে এসে ভাবিকে আজকেই সি সেকশনে নিতে চেয়েছেন। ” তাহমিদকে দেখে নাহিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসল।
” আমি এখনই যাব ডক্টরের কাছে। তোমরা কি লাঞ্চ করেছ? সৃজন কোথায়? ”
” ভাবিকে খাইয়ে দিয়ে আমি খেয়েছি। সৃজনকে বাসায় পাঠিয়েছি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসতে। ও কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ”
তাহমিদ কুহুর দিকে এগিয়ে যায়। মেয়েটা বেডে শুয়ে শুয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। সাড়ে আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটা নড়তে চড়তে পারেনা। শরীরে পানি এসেছে। ফুলে গেছে পুরো শরীর।
” খারাপতো একটু লাগছেই। খেতে পারিনি আজকে। নাহিয়া জোর করে একটু খাইয়ে দিয়েছে। তাতেই আমার হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে। ”
তাহমিদ রুমে তাকিয়ে দেখল নাহিয়া ভেতরে নেই। ওদের দু’জনকে একা কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে নাহিয়া বাহিরে গেছে।
” একটু খেতে হবেতো, বউ। নইলে তুমি আর আমার সোনামণিরা সুস্থ থাকবে কেমন করে? তুমি না খেলে ওরা যে উইক হয়ে যাবে। ”
” আমার না ভিষণ ভয় করছে। আমার যদি কিছু হয়ে যায়? তবে আপনি ওদের একা একা কিভাবে সামলাবেন? ” কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
কুহুর মুখে এমন কথা শুনে তাহমিদের বুক কেঁপে উঠল। ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তার প্রানপ্রিয় স্ত্রী’কে। ওর শরীর কাঁপছে। কুহুর মুখে এমন কথা ও মানতে পারছেনা।
” এভাবে বলতে নেই, বউ। তোমার কিছু হবেনা। তুমি নিজেকে শক্ত কর। মনোবল বাড়াও। তোমার কিছু হলে আমাদের কি হবে সেটা তুমি একবারও ভেবে দেখেছ? তুমি আমাদের জন্য হলেও নিজের মনকে শক্ত কর। তুমি জানোনা, আমার জীবনে তুমি কি। তুমি ছাড়া আমি শূন্য। আমরা শূন্য। ” তাহমিদ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল। ও এই মুহূর্তে নিজেকে দূর্বল করতে চায়না। ও চায়না ওর ভেতরে বহমান শংকার স্রোত কুহু দেখতে পাক।
কুহুকে শান্ত করে তাহমিদ যায় ডক্টরের কাছে।
এক ঘন্টা পর। তাহমিদ হসপিটালের করিডোরে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। রায়হান আহমেদ চেষ্টা করছেন ওকে শান্ত রাখতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই তাহমিদকে শান্ত করতে পারছেননা। নায়লা আঞ্জুমও চেষ্টা করছে তাহমিদের সাথে কথা বলার। কিন্তু তাহমিদ তার কথা কানেই তুলছেনা।
রিশা আর নাহিয়া তাহমিদের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, একটা মানুষ কিভাবে কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে!
সৃজন করিডোরের একপাশে চেয়ারে বসে আছে। ছেলটার চোখে পানি ছলছল করছে। বাবা-মা’কে হারানোর পর এই বোনটাই ওকে আগলে রেখেছে। আজ সেই বোনও অপারেশন থিয়েটারে নিজের জীবন বাঁচাতে যুদ্ধ করছে। নানান চিন্তা করতে করতে কয়েক বিন্দু অশ্রু ঝরে পরল সৃজনের দু-চোখ বেয়ে।
” তাহমিদ, এত অস্থির হয়োনা। একটু শান্ত হয়ে বস। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। কুহু আর তোমার সন্তানরা ঠিকঠাক থাকবে। ” রায়হান আহমেদ চেষ্টা করছেন তাহমিদকে শান্ত করতে।
” আমি শান্ত থাকতে পারছিনা, চাচা। ভেতরে মেয়েটার হয়তো অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি কত অসহায় স্বামী দেখেছেন? নিজের স্ত্রী’র পাশে তার কঠিন বিপদের সময় থাকতে পারছিনা। আজকের মত অসহায় নিজেকে আমার আর কখনোই লাগেনি। ”
” তুমি আল্লাহকে ডাক। দেখবে তিনি সব ঠিক করে দিবেন। ”
” চাচা, ডক্টর এতক্ষণ কি করছে? ইনি কি ডক্টর হিসেবে পারফেক্ট? আপনাদের কথায় কুহুকে আমি তার তত্বাবধানে রেখেছি। তিনি তো সব ঠিকঠাক করতে পারবেন? ”
তাহমিদকে পা’গ’লে’র ন্যায় করতে দেখে নায়লা আঞ্জুম তার দিকে এগিয়ে আসল।
” তাহমিদ, তুমি ডক্টরের ওপর নির্দিধায় ভরসা করতে পার। কুহুর জন্য আমরা দেশের নামকরা ডক্টরকে সিলেক্ট করেছি। তুমি দেখে নিও তিনি আমাদের নিরাশ করবেননা। তুমি শান্ত হয়ে একটু বস। ” নায়লা আঞ্জুম স্ব স্নেহে হাত রাখে তাহমিদের মাথায়। সাড়ে পাঁচ বছর আগের সেই নায়লা আঞ্জুমের সাথে আজকের নায়লা আঞ্জুমের আকাশপাতাল তফাৎ। মাথায় খালামনির পরশ পেয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল তাহমিদ।
” খালামনি, আমার কুহু আমার সন্তানেরা ঠিক আছে তো? ডক্টর এত দেরি করছে কেন? আমার ভিষণ ভয় হচ্ছে। ”
” কিছু হবেনা, বেটা। তোমার স্ত্রী-সন্তানেরা সহিসালামতে তোমার কাছে আসবে দেখে নিও। তুমি একটু ধৈর্য্য ধর। ”
তাদের কথার মাঝেই দুইজন সিস্টার দুইটা বেবিকে নিয়ে হাজির হয়। নায়লা আঞ্জুম তাদের দেখামাত্রই তাহমিদকে ইশারা করে। তাহমিদ সামনে তাকিয়ে দেখল তার কাঙ্ক্ষিত ধনেরা দু’জন সিস্টারের কোলে। ও একলাফে দাঁড়িয়ে যায়। ওর চোখে পরল দু’জন পুতুল পিটপিটিয়ে চেয়ে আছে। আবেগে দুফোঁটা নোনাজল গড়ায় তাহমিদের চোখ বেয়ে। আজকের মত সুখী তার নিজেকে আর কখনোই মনে হয়নি।
” তাহমিদ, আমার নাতি-নাতনিকে আমার কোলে দাও দেখি। দেখি ওরা কার মত হয়েছে। ” রাশেদ কুরাইশি নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলেননা। তিনি আনন্দে কেঁদে ফেললেন।
তাহমিদ নিজের কোলে থাকা কন্যাটিকে বাড়িয়ে দেয় বাবার দিকে। নায়লা আঞ্জুমের কোলে আছে তাহমিদের ছেলে।
কুহুকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। ওর শারিরীক অবস্থা খারাপ হওয়ায় ডক্টরকে এমন সিদ্ধান্ত হতে হয়েছে। তবে ডক্টর জানিয়েছেন, আগামী দুইদিনের মধ্যেই কুহু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।
” এই যে পুত্র-কন্যার বাবা, নতুন নতুন বাবা হয়ে কেমন বোধ করছ? সন্তানের মায়া কেমন সেটা বুঝতে পারছ? তাদের না দেখলে, কাছাকাছি না থাকলে কেমন লাগে সেটা বুঝতে পারছ? ”
বাবার কথা শুনে তাহমিদ মাথা নিচু করল। ওর মনে পরেনা কত বছর ও বাবাকে ডাকেনি। বাবার সাথে মন খুলে কথা বলেনি। নিজের দুঃখকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ও এতদিন বাবাকে কষ্ট দিয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। বাবাতো ভুল কিছু বলেনি! এই একদিনেই সন্তানদের ওপর মায়া জন্মেছে। ওদেরকে এক মুহূর্ত না দেখলে মনে হচ্ছে কতকাল বুঝি দেখেনি। ওদের কান্নার শব্দে বুকের ভেতর তোলপাড় করছে। অথচ ওর বাবা কত বছর ছেলের মুখে বাবা ডাক শুনতে পায়না! আজ নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। কিভাবে বাবার চোখে চোখ মেলাবে! অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে চাইল তাহমিদ।
” বাবা, এভাবে বলোনা। আমার দোষ আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। আমি বুঝতে পেরেছি একজন মানুষের জীবনে সন্তান কি। ” তাহমিদের গলা ভারি হয়ে আসল। ও আর কিছুই বলতে পারলনা।
ছেলের মুখে বাবা ডাক শুনে রাশেদ কুরাইশির খুশিতে পা’গ’ল হওয়ার দশা। তিনি ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। এক হাতে তিনি নাতনিকে ধরে রেখেছেন। আরেক হাতে ধরে রেখেছেন ছেলেকে। অনেক বছরের মান-অভিমানের পালা নিমেষেই দূর হয়ে যায়।
কেবিনে উপস্থিত সকলের চোখে পানি এসেছে বাবা-ছেলের মিলন দেখে।
শাহানা আক্তারও কাঁদছেন। এত বছর ধরে তিনি এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলেন।
নায়লা আঞ্জুম আজ শান্তি পেলেন। তার বোন, দুলাভাইয়ের ভুলের শাস্তি ছেলেটা এত বছর ধরে ভোগ করেছে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা’র ভালোবাসা বঞ্চিত ছেলেটা ধীরে ধীরে পরিনত হয়েছিল কঠিন হৃদয়ের ব্যাক্তিতে।
কুহুর কলিগরা দেখতে এসেছে তাহমিদের কলিজার টুকরাদের। হ্যাঁ, সেই কুহু আজ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা। সফলভাবে পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে যোগ দিয়েছিল সাতমাস আগে। কুহুকে কেবিনে দেয়া হয়েছে। সকল বাঁধা বিপত্তি কাটিয়ে মেয়েটা ফিরে এসেছে তার পরিবারের কাছে। সবার মধ্যে থেকেই বারবার ওর নজর যাচ্ছে তাহমিদের দিকে। মানুষটার কোলে রয়েছে তার ছেলে। সে পরম আদরে আগলে রেখেছে তার ছেলেকে। আজ কুহু তাহমিদের মুখে একজন সুখী মানুষের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। অজান্তেই ওর চোখের কোনে জমা হয় আনন্দাশ্রু।
” ডেইজি, তুমিও আমার সাথে চল। বউমাকে আর আমার নাতি-নাতনীদের দেখে আসবে। রায়ান, জাহিয়াকে বললাম ওদের দেখে আসার কথা। কিন্তু ওরা কি আমার কথা রাখতে জানে। তাদের নাকি সময় নেই! অথচ তোমার মেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে সিঙ্গাপুর বেড়াতে গেল! আর তোমার ছেলে বউকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গেল। আফসোস হয় মাঝেমধ্যে। এমন ছেলেমেয়েরও বাবা আমি! অথচ তাহমিদ, যাকে দিনের পর দিন অবহেলা করেছি, সে যতই অভিমান করে থাকুক, আমার কথা শোনার চেষ্টা করেছে। ”
” এখন তোমার বড় ছেলেই সব। সে ভালো, সে এটা, সেটা! আমার ছেলেমেয়েরা এখন খারাপ! ওদের যদি বেড়াতে যাওয়ার দরকার হয় তবে কি ওরা যাবেনা? ওদের একটা স্ট্যাটাস আছে। তোমার বড় ছেলের মত হাভাতে ঘরে বিয়ে হয়নি আমার ছেলেমেয়েদের। ওদেরকে নিজেদের স্ট্যাটাস বজায় রাখতে হয়। তোমার বড় ছেলের সেসবের বালাই আছে নাকি! আর তাছাড়া ঐ বেয়াদব ছেলের বেয়াদব বউকে দেখতে গিয়ে ওদের কি লাভ? গাঁইয়া মেয়ে কি গাঁইয়া জন্ম দিয়েছে, তাদের দেখবার জন্য তোমার আগ্রহ দেখে আমার রাগ হচ্ছে। তোমার যত ইচ্ছে তুমি তাদের দেখ। আমাদের এর ভেতর টানবেনা। ”
স্ত্রী’র এরূপ কথা শুনে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন রাশেদ কুরাইশি। তিনি কি বলবেন সেটা বুঝতে পারছেননা। তার কথা রাখতে তাহমিদ ডেইজিকে ফোন করেছে। ওর সন্তানদের দেখতে যেতে বলেছে। কিন্তু ডেইজি কুরাইশি তার অহংকার নিয়েই থাকল!
” ঠিক আছে, তোমার কোথাও যেতে হবেনা। আমি গর্বিত ঐ গাঁইয়া মেয়ের শ্বশুর হতে পেরে। তোমার শহুরে ছেলের বউতো জীবনে সম্মান করলনা। তাই ওদের কাছ থেকে সম্মান আশাও করিনা। আর রইল তোমার মেয়ের জামাই। সে তো আমার সম্পদের লোভে তোমার মেয়েকে বিয়ে করেছে। সে উঠতে-বসতে আমাদের হুজুর হুজুর করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যেদিন আমার এই সম্পদের পাহাড়ে ধ্বস নামবে, সেদিন তুমি তোমার মেয়ে জামাইয়ের আসল রূপ দেখতে পাবে। মনে রেখ, তোমার পাশে সেদিন কেউ যদি থাকে তবে তাহমিদই থাকবে। ” রাশেদ কুরাইশি আর কথা বাড়ালেননা। তিনি বেড়িয়ে গেলেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
” তাহমিদ, অনেক তো হল। এবার তোমার দুই বোনের বিয়ের ব্যবস্থা কর। তারা যেহেতু পাত্র পছন্দ করেই রেখেছে, তবে আর দেরি করে লাভ কি? এখন বউমাও সুস্থ আছে, আর আমাদের সোনামণিরাও এসে গেছে। ওরাও এবার দুই ফুপির বিয়েতে ভাগ বসাক। ” নায়লা আঞ্জুম নাতিকে আদর করে বলল। তার কথা শুনে কুহু হাসল। ওর সেই অহংকারী চাচি আজ তাকে ছেলের বউয়ের মর্যাদা দেয়। সংসারের নানান আলোচনা ওর সাথে করে। ওকে যথেষ্ট ভালোবাসে। আবার ওর ছেলেমেয়েদেরও চোখে হারাচ্ছে।
” ভাইয়া, আম্মু কিন্তু ঠিক বলেছে। আর কতদিন এভাবে বাবার বাড়িতে থাকব? এখন কোথায় স্বামীর সাথে দুনিয়া ঘুরে বেড়াব। কিন্তু তোমরা সেটা হতেই দিচ্ছনা। ” রিশাও নায়লা আঞ্জুমের সাথে তাল মেলাল।
” একটুতো লজ্জা কর। আমি তোর বড় ভাই। ভাইয়ের সামনে এভাবে নিজের বিয়ের কথা বলতে লজ্জা করছেনা? থাপ্পড় দিয়ে কান লাল করে দেব। ”
” ফরজ কাজের বেলায় কোন লজ্জা নেই, ভাইয়া। তুমি কালকেই আমার শ্বশুরকে ফোন দিয়ে সব ঠিক করতে বলবে। রিয়াদ তোমার ফোনের অপেক্ষায় দিন গুনছে। ” মেয়ের মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম লজ্জায় মাথা নিচু করলেন। তার তাহমিদও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিদের অবস্থা দেখে কুহু হেসে কুটিকুটি হয়।
” এক কাজ করুন, রিশার সাথে নাহিয়ার বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক করুন। সে ও তো পাত্র পছন্দ করেই রেখেছে। আমি কি ভুল কিছু বললাম, নাহিয়া? হলে একসাথে দুই বোনের বিয়েই হোক। ”
” নাহিয়া, তুমি কি ইশানকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছ? আপা-দুলাভাই কিন্তু তোমার সিদ্ধান্ত মানতে পারছেনা। তাদের একমাত্র মেয়ে তুমি। আর কোন বাবা-মা’ ই চাইবেনা তাদের একমাত্র মেয়ে কোন বিপত্নীক পুরুষকে বিয়ে করুক। আবার সেই পুরুষের এক বছরের মেয়েও আছে। ” নায়লা আঞ্জুম উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল। নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে সবাই একযোগে নাহিয়ার দিকে তাকায়। নাহিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখ খুলল।
” আমি এডাল্ট। নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার আছে। আর কিছুদিন পর মাস্টার্স কমপ্লিট করব। তাই আমি যা করছি ভেবেচিন্তেই করছি। এছাড়া আমি দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে চাই, দুনিয়ায় যেমন মিথিলা আরজুমান্দের মত মানুষ আছে, তেমনি নাহিয়ার মত মেয়েও আছে। মিথিলা আরজুমান্দরা নিজের সুখের জন্য সন্তানকে ছাড়তে যেমন দ্বিধা করেনা, তেমনি নাহিয়ার মত মেয়েরাও অন্যের সুখের কারন হতে দুইবার ভাবেনা। আর একটা মা হারা সন্তানকে বুকে তুলে নিতে নাহিয়া দুইবার ভাববেনা। বিয়ে যদি করতেই হয় তবে আমি ইশানকেই করব। এটাই ফাইনাল। ” নাহিয়ার কথায় এমন কিছু ছিল যে আর কেউ কোন কথা বলতে পারলনা।
তাহমিদ নায়লা আঞ্জুম আর রায়হান আহমেদের সাথে কথা বলে রিশা আর নাহিয়ার বিয়ের ব্যাপারে পাত্রপক্ষের সাথে কথা বলতে উদ্যত হয়।
কুহু বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ওর পাশে বসে নাহিয়া ফোনে ব্যস্ত। বাচ্চারাও ঘুমাচ্ছে। রিশা রিয়াদের সাথে কথা বলছে। নায়লা আঞ্জুম তাহমিদের বাসায় গেছে। সে ফ্রেশ হয়ে খাবার নিয়ে তারপর আসবে। তাহমিদ ফার্মেসিতে গেছে একটা মেডিসিন আনতে। নিচে যেতেই রাশেদ কুরাইশির সাথে ওর দেখা হয়। রাশেদ কুরাইশিও ছেলের সাথে ফার্মেসিতে গেলেন। প্রয়োজনীয় মেডিসিন কিনেই তারা একসাথে হসপিটালে প্রবেশ করল। এরপর সোজা চলে আসে কেবিনে।
বাচ্চাদের ঘুমাতে দেখে রাশেদ কুরাইশি নাহিয়া আর রিশার সাথে টুকটাক কথা বলতে থাকলেন। রিশা আর নাহিয়ার সাথে তার সম্পর্ক বেশ ভালো।
প্রায় অনেকক্ষণ পর কেবিনে আসল নায়লা আঞ্জুম। সে ভেতরে এসে রাশেদ কুরাইশিকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। সে একবার রাশেদ কুরাইশির দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই তাকায় দরজার দিকে। ত্র দৃষ্টি অনুসরণ করে রাশেদ কুরাইশিও দরজার দিকে তাকান। কিন্তু দরজায় দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে তার মুখের হাসি মুছে যায়।
মিথিলা আরজুমান্দও এই সময় এখানে রাশেদ কুরাইশিকে আশা করেনি।
তাহমিদ কুহুসহ সকলে হঠাৎ মিথিলা আরজুমান্দের আগমনে অবাক হয়েছে। মিথিলা আরজুমান্দ সব অনুশোচনা দূর করে ভেতরে প্রবেশ করল। সে।সরাসরি তাহমিদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাহমিদ মা’কে দেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল।
” আমি জানি আমার ওপর তোমার অনেক রা’গ আর অভিমান জমা হয়েছে। আমি সেসবের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে আসিনি। কারন আমি জানি ক্ষমা চাইলেও কোন লাভ হবেনা। আমি তোমার কাছে জরুরী দরকারে এসেছি। ”
” কেন এসেছেন? ” তাহমিদ ছোট্ট করে বলল।
” নাহিয়া যখন ইশানকে বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে, তাকে আর বাঁধা দেয়ার কোন কারণই দেখছিনা। ওর বাবাও রাজি হয়েছে। আমরা কিছুতেই চাইনা, মেয়েটা আমাদের থেকে দূরে চলে যাক। তুমি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা কর। যেহেতু ও তোমাকে বড় ভাই মানে। সেহেতু ওর বিয়ের সব দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে তোমাকেই। ” মিথিলা আরজুমান্দ কোন ভনিতা ছাড়াই বলল।
রাশেদ কুরাইশি কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলে তাহমিদ তাকে আটকায়।
” এখানেই থাক, বাবা। এখানে এমন কোন আলোচনা হচ্ছেনা যে তোমাকে বাহিরে যেতে হবে। ” ছেলের কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি রিশার কাছে গিয়ে বসলেন। তিনি মাথা নিচু করে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগলেন। তিনি ভাবছেন, তার একটা ভুল সিদ্ধান্তের দরুন কিভাবে একটা সংসার তছনছ হয়ে গেছে। মিথিলার দিকে তাকানোর সাহস তার আজ নেই।
অথচ দিনশেষে তিনি ছাড়া বাকি সকলেই সুখী হয়েছে।
” আমি আপনার ওপর রে’গে কিংবা অভিমান করে নেই। নিজের অতীত মেনে নিয়েছি আমি। আর বর্তমান নিয়ে সুখী আছি। এবং ভবিষ্যতেও সুখী থাকতেই চাই। নিজের সন্তানদের একটা সুসজ্জিত ভবিষ্যৎ দিতে চাই। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়েই আমি অতীতের সব ভুলতে পেরেছি। এসেই যখন পরেছেন, তখন আমার ছেলেমেয়েকে দোয়া করে যাবেন। আর নাহিয়াকে নিয়ে ভাববেননা। রিশার সাথে ওর বিয়ের ব্যবস্থাও করব। ”
মিথিলা আরজুমান্দ কি মনে করে ছেলের দু-হাত ধরে কেঁদে উঠল। এরপর সে বাচ্চাদের কাছে গিয়ে তাদের একে একে কোলে নেয়। কুহুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে, শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। তার সাথে নায়লা আঞ্জুমও যায়।
মিথিলা আরজুমান্দ চলে যেতেই রুমের দমবন্ধ পরিবেশ ঘুচে যায়। কিছুক্ষণ পর রাশেদ কুরাইশিও বেরিয়ে যান।
তাহমিদের মাথায় দ্বায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে সবাই। কুহুকে হসপিটাল থেকে নিয়ে যাওয়ার পরই, রিশা, নাহিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিষয়টা সহজ হবেনা। ওকে কিছুদিন রাজশাহী, ঢাকা দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
” কি ভাবছেন এত? আমাদের দিকেও তো একবার তাকান। আপনার প্রিন্সেস কেমন ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আছে দেখুন। ” কুহুর কথা শুনে তাহমিদ ওর মেয়ের দিকে তাকায়। মেয়েটা তখন চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। তাহমিদ হেসে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। ততক্ষণে কেবিন থেকে সবাই বেরিয়ে গেছে।
” আমার চিন্তা অন্য কোথাও থাকলেও আমার মন, দৃষ্টি সব সময় তোমাদের দিকেই থাকে। তোমরা আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। ” কুহুর কপালে চুমু দিয়ে বলল তাহমিদ।
” মা’কে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার বাচ্চারা তাদের দাদা-দাদীর দোয়া পেয়েছে, এটা ভাবতেই ভালো লাগছে। এবার নাহিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করুন। মেয়েটা ইশানকে খুব ভালোবাসে। ”
” আগে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠ। আগামী একমাস কেউ চাইলেও আমি সেদিকে নজর দেবনা। আমার কাছে আগে তোমার সুস্থতা, পরে অন্যকিছু। ”
” আপনি এত ভালো কেন! এত ভালোবাসেন কেন আমাকে? আপনার মত পুরুষ সকল নারীই চায়। আপনি আমার পরম আরাধ্যের পুরুষ। জীবনে অনেক সওয়াব করলেই তবে আপনার মত মানুষ পাওয়া যায়। ” আবেগে বুজে আসে কুহুর গলা।
” তুমি ভালোবাসার মতই একজন। তোমার মত মেয়েকে ভালোনাবেসে কি পারা যায়! কয়জন পুরুষের কপালে তোমার মত নারী জোটে। জেনে রেখ, তোমাকে ভালোবাসার কোন কারন থাকতে নেই। তোমাকে কারনে-অকারনেই ভালোবাসা যায়। এমনি থেক আজীবন। আমার পাশে থেকে অনুপ্রেরনার কারন হও। আদর্শ মা হয়ে সমাজের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াও। দেখবে ভালোবাসা তোমার পায়ে লুটোপুটি খাবে। ”
” শুধু একটা আফসোস থেকে গেল। ছোট চাচি আমাদের মানতে পারলনা। চাচা কালকে আসবে। কিন্তু চাচি আসবেনা। তার এত কিসের রা’গ এটাই বুঝলামনা। ”
” চাচির চিন্তা বাদ দিয়ে আমার চিন্তা কর। তোমার ভালোবাসাবীনা আমার জীবন কিভাবে কাটছে সেটা কি একবারও ভেবেছ? এখন রুমে কেউ নেই ফটাফট কয়েকটা চুমু দাওতো। তুমি কি জানো, তোমার আদরহীনতায় আমার কলিজা বেরিয়ে আসতে চাইছে? তারাতারি কয়েকটা চুমু দিয়ে আমার কলিজা ঠান্ডা কর। ” তাহমিদ কুহুর দিকে গাল এগিয়ে দেয়। কুহুও দরজার দিকে তাকিয়ে টুপ করে তাহমিদের গালে চুমু দেয়। আর তখনই কেঁদে উঠল ছেলেমেয়ে দুটো। তাহমিদ অসহায় মুখে কুহুর দিকে তাকায়।
” এরা কি আমার ভালোবাসার বিপক্ষে এখন থেকেই অবস্থান নিয়েছে! মানবোনা বউ এসব মানবনা। প্রয়োজনে ওদের ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কবার। তবুও তোমার মত রসকষহীন হতে দিবনা। ওরা আমার মত প্রেমিক পুরুষ হবে। ”
কুহু তাহমিদের দিকে তাকিয়ে সুখের হাসি হাসল। সে হাসির প্রতিটি কনায় জড়িয়ে আছে পরিতৃপ্তি। যে মানুষটা ওকে ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করেছে। যার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার কথা ও কল্পনাই করতে পারেনা।
” বাবা, আপনি ভেতরে এসে বসুন। সকালে কি বাসা থেকে খেয়ে বেরিয়েছেন? আপনি রুমে চলুন। সেখানে কিছুক্ষণ রেস্ট নিন। ততক্ষণে আমি খাবার নিয়ে আসছি। ” রাশেদ কুরাইশিকে স্বাভাবিক করতে কুহু ঠোঁটের কোনে জোর করে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল।
নাহিয়া কুহুর কথা শুনে অবাক হয়ে গেছে। ও তো জানে কুহুর বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। তবে ইনাকে কুহু বাবা বলছে কেন!
” বউমা, তুমি এত অস্থির হয়োনা। আমার ক্ষুধা নেই। আমি শুধু তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। এখান থেকে সরাসরি অফিসে যাব। তুমি ভালো আছ, মা? আমার ছেলেটা ভালো আছে? ”
রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে নাহিয়া বুঝতে পারল ইনিই তাহমিদের বাবা। বিষয়টা জানার সাথে সাথেই ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে নাহিয়ার ভিষন লজ্জা লাগলো। ভদ্রলোক না জানি ওর সম্পর্কে কি না কি ভাবছে। তাই ও ড্রয়িংরুমে আর দাঁড়ায়না। রুমের দিকে পা বাড়ায়।
” এই যে, মামনি ? তুমি কোথায় যাচ্ছ? এস তোমার সাথে পরিচিত হই। ” রাশেদ কুরাইশি নাহিয়াকে চলে যেতে দেখে কি মনে করে ডাক দিলেন।
নাহিয়া ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ায়। ওর ঠোঁটে মলিন হাসির রেশ। ও কিভাবে মানুষটার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবে? ওর যতই খারাপ লাগুক, ভদ্রলোকের সাথে ওকে কথা বলতেই হবে।
” জ্বি, আংকেল। ” নাহিয়ার কন্ঠা থেকে আর কোন শব্দ বেরোলোনা।
রাশেদ কুরাইশিও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে অতীতের হাজারো স্মৃতি। এই মুহূর্তে তার মিথিলাকে ভিষণ মনে পরছে। মনে পরছে সেই ছোট্ট তাহমিদের কথা। একটা সময় কতইনা সুখের ছিল তাদের সংসার! কিন্তু তিনি নিজ হাতে সব ধ্বংস করেছেন।
কুহু রাশেদ কুরাইশিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে তার মনে অবস্থা বুঝতে পারছে। সে নীরবে হাত রাখল রাশেদ কুরাইশির বাহুতে। কুহুর স্পর্শ পেয়ে ধ্যান ভাঙ্গল রাশেদ কুরাইশির। তিনি বুঝলেন চোখের কোনে পানি জমেছে। সযতনে তিনি মুছলেন চক্ষুদ্বয়।
” তোমার মা-বাবা কেমন আছে, মামনি? তারা দেশে আসেনি? ” ফ্যাসফেসে গলায় তিনি নাহিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন।
” তারা ভালো থাকার জন্যইতো সব ছেড়েছিল, আংকেল। আর যারা একবার অতীতকে পায়ে ঠেলতে পারে, তারা কি কখনো খারাপ থাকে? ”
নাহিয়ার কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি বুঝলেন মেয়েটা নিশ্চয়ই মায়ের অতীত নিয়ে খুশি নয়। তিনি ভালোভাবে নাহিয়ার মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটার চেহারায় বড্ড মায়া। তিনি ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই দেখলেন, মেয়েটার ঠোঁট থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। ওর দীঘির ন্যায় আঁখিদুটি টলটলে জলে পরিপূর্ণ। মেয়েটার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল বক্ষের গভীর থেকে। মেয়েটার দুঃখ তার হৃদয় ছুঁয়েছে।
” তুমি কিসে পড়ছ, মামুনি? কবে এসেছ দেশে? ”
” আগামী বছর ভার্সিটিতে ভর্তি হব। আমি গতকালই দেশে এসেছি আংকেল। ” নাহিয়া কেন যেন স্বাভাবিক হতে পারছেনা।
” তোমাদের দেশেতো অনেক বড় বড় ইউনিভার্সিটি আছে। কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাও? ”
” ভাইয়া যে ভার্সিটির টিচার সেই ভার্সিটিতে পড়তে চাই। ”
নাহিয়ার হেয়ালিপূর্ন কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি প্রশ্নোবোধক চোখে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি নাহিয়ার কথার অর্থ বুঝতে পারেননি। কুহুও রাশেদ কুরাইশির ন্যায় অবাক হয়ে গেছে। কি বলতে চাইছে মেয়েটা?
নাহিয়া রাশেদ কুরাইশির দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বুঝতে পারে। এই মুহূর্তে ভদ্রলোকের চেহারা দেখার মত হয়েছে। তিনি যে ওর কথার মানে কিছুই বুঝতে পারেননি, সেটা নাহিয়া বেশ বুঝেছে। তাই ও হেসে আবারও মুখ খুলল।
” আমি তাহমিদ ভাইয়ার ভার্সিটিতে পড়ার কথা বলছি, আংকেল। আমি হাইস্কুল শেষ করে দেশে আসতে চাই। আর এখানেই পড়াশোনা করতে চাই। এই সুযোগে ভাইয়ার সংস্পর্শে এসে, নিজেকে তার মত করে গড়ে তুলতে চাই। ”
এবার রাশেদ কুরাইশি সত্যিই বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। একটা মেয়ে হঠাৎ করেই দেশে এসে তাহমিদের সংস্পর্শে নিজেকে গড়ে তুলতে চাইছে! অথচ তিনি এর আগে কখনোই মেয়েটার সম্পর্কে শোনেননি। কিংবা তাহমিদের কাছ থেকে জানতে পারেননি মেয়েটার কথা। যদিওবা তাহমিদ কখনোই তাকে এসব কথা বলতনা। কিন্তু শাহানা আক্তারকে ঠিকই বলত। আর শাহানা আক্তারের মাধ্যমে কথাটা ঠিকই তার কানে পৌঁছাত।
” তুমি সত্যি বলছ, মামুনি! তুমি দেশে এসে পড়াশোনা করতে চাও? তোমার বাবা-মা এই সিদ্ধান্ত মানবে! ”
” ভার্সিটিতে ভর্তি হবার আগেই আমি এডাল্ট হয়ে যাব। তখন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে কোন সমস্যা হবেনা। তাই অন্য কেউ আমার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার আগে অবশ্যই দুইবার ভাববে। তাই এই বিষয় নিয়ে আমার কোন চিন্তার কিছু দেখিনা। ”
” তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয়, মামনি। আমি তোমাকে দেখে সত্যিই অভিভূত হয়ে গেছি। ”
” আংকেল, আপনি একবারও কিন্তু আমাকে আপনার বাসায় যেতে বললেননা। আমরা এতক্ষণ গল্প করার সুবাদে এইটুকু ফর্মালিটি আপনার কাছ থেকে আশা করতেই পারি। ” নাহিয়া রাশেদ কুরাইশিকে কথাটা বলেই কুহুর দিকে তাকিয়ে ওকে চোখ মারল। নাহিয়ার এমন কাজে কুহু হতভম্ব হয়ে গেছে।
রাশেদ কুরাইশিও নাহিয়ার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেছেন। মেয়েটা যে সুযোগ বুঝে তাকে জব্দ করেছে এটা স্বীকার করতেই হবে।
” সত্যিই তুমি আমার বাসায় যেতে চাও! সেখানের অভিজ্ঞতা যে তোমার কাছে সুখকর হবেনা, এটার গ্যারান্টি আমি দিতে পারি। আর একজন আমার অতিথি হিসেবে তোমার সম্মান রক্ষা করার দ্বায়িত্ব আমার। সেজন্যই আমার বাসায় যেতে বলিনি তোমাকে। ”
” বুঝলেন আংকেল, আমি বড্ড লোভী একটা মেয়ে। তাই সুখকর অভিজ্ঞতার কোন প্রয়োজন নেই আমার। আমি শুধু সেই মানুষটাকে দেখতে চাই, যার জন্য ভাইয়ার শৈশব মধুর হয়নি। কিংবা তার কৈশোর নষ্ট করেছে যে, আঘাতে জর্জরিত করেছে যে, তাকে দেখার বড় সাধ হয়। এতদিন ভাইয়ার পুরো জীবন নষ্টকারীদের সাথে জীবনের অনেকটা বছর কাটিয়ে এসে আবার তার শৈশব-কৈশোর নষ্টকারীকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ”
” তাহলে তোমার সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দু-চোখ ভরে দেখে নাও। তারও কিন্তু তাহমিদের জীবন নষ্ট করার পেছনে যথেষ্ট অবদান আছে। ” রাশেদ কুরাইশি হাসিমুখে বললেন।
” পাপ করে মন ক্ষমা চাইলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও ক্ষমা করে দেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে, আপনি নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। আর যে ব্যাক্তি তার সকল ঘৃণিত কৃতকর্মের জন্য লজ্জা পায়, তাকে ক্ষমা করে দেয়া মনুষ্যত্বের লক্ষ্যণ। এটা একান্তই আমার মত। তাই অপরাধীর খাতা থেকে আপনার নাম কেটে দেয়া যেতেই পারে। ” নাহিয়ার কথা শুনে রাশেদ কুরাইশির মন নিমেষেই ভালো হয়ে যায়। তিনি মেয়েটাকে মন থেকেই ভালোবেসে ফেলেছেন। মেয়েটা স্পষ্টবাদী, তার মনের মধ্যে কোন প্যাঁচ নেই। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মেয়েটিকে ভালোনাবেসে থাকাই যায়না।
” কবে যেতে চাচ্ছ আমার বাসায়? তোমার বিখ্যাত ভাইয়া তোমাকে কিন্তু সে বাসায় নিয়ে যাবেনা। তোমাকে হয় আমার সাথে যেতে হবে, নয়তো একা যেতে হবে। ”
” আমি একাি যাব। আপনার অনুমতি যখন পেয়ে গেছি, তখন যেকোন একদিন হুট করেই সেখানে পৌঁছে যাব। ”
কুহু চুপচাপ দাঁড়িয়ে দুজনের গল্প শুনছে। কি সুন্দর তারা দু’জন কথা বলছে! অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে রান্নাঘরে পা বাড়ায়।
তাহমিদ বাসায় এসে দেখল নাহিয়া আর রাশেদ কুরাইশি হেসে হেসে গল্প করছে। ওদের সাথে সৃজনও আছে।
কুহু তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বুঝল বেচারা কম অবাক হয়নি। সে ইশারায় তাহমিদকে চুপ থাকতে বলল। তাহমিদ কুহুর কথা মেনে চুপচাপ রুমে চলে যায়।
রাতে খাবার পর রাশেদ কুরাইশি বাসায় গেলেন। আজ তিনি অফিসে যাননি। সারাটাদিন ছেলেমেয়েদের সাথে আড্ডা দিয়ে গল্প করে কাটিয়েছেন।
রাশেদ কুরাইশি চলে যেতেই তাহমিদ কুহুকে নিয়ে রুমে আসল।
” তোমার শ্বশুর আজও কেন এসেছিল? আর নাহিয়ার সাথে তার কিসের এত কথা? ”
” আপনি এভাবে বলছেন কেন! তিনি আমার শ্বশুর ঠিক আছে। তবে তার আগে তিনি আপনার বাবা। তাকে বাবা বলবেন এখন থেকে। আর ছেলের বাসায় বাবা এসেছে এখানে এত প্রশ্ন কিসের? ”
” বউ, তুমি আমাকে ঘোল খাওয়ানোর চেষ্টা করোনা। তোমার এই স্বামীটি কিন্তু কম ঘোরেল নয়। আমাকে ঘোল খাওয়াতে গিয়ে, নিজেই কখন খেয়ে বসে থাকবে, সেটা টেরও পাবেনা। ”
” বিয়ের আগে থেকেই আমি ঘোল খেয়ে অভ্যস্ত। আপনি সময়ে-অসময়ে আমাকে ঘোল খাইয়েছেন। তাই এখন আর ঘোল খেতে ভয় পাইনা। ”
কুহুর কথা শেষ হতে না হতেই, তাহমিদ ওকে টেনে নিজের বুকে জরিয়ে নেয়। তার অধরে অধর মিশিয়ে দেয় চোখের পলকেই।
” ঘোল খাওয়াতে পেরেছি জন্যই আজ তুমি আমার হয়েছ। আমার ভালোবাসায় নিজেকে সঁপে দিয়েছ। এটা কি ঘোলের ক্রেডিট নয়? ” কুহুর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল তাহমিদ।
তাহমিদের হাঁটুতে বসে তার দু’হাতের শক্ত বাঁধনে বন্দীনি কুহু তাকিয়ে আছে তার একান্ত পুরুষের ঠোঁটে। তার কালচে খয়েরী পুরুষ্ট ঠোঁট সব সময়ই কুহুকে এক অমোঘ আকর্ষনে টানে, তা কি সে জানে? দু’জনের কপাল এখনো একে-অপরের সাথে আলিঙ্গনরত।
চলবে…
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫৬
জাওয়াদ জামী জামী
” ম্যাম, আপনার সাথে একজন দেখা করতে চাচ্ছে। আমি অনেকবার নিষেধ করেছি কিন্তু সে কিছুতেই শুনতে চাচ্ছেনা। ” ডেইজি কুরাইশি স্বামী-সন্তানদের সাথে লাঞ্চ করছে। ঠিক তখনই কেয়ারটেকার এসে বলল।
” কে এসেছে, রুবেল? তুমি তাকে চেন? ” ডেইজি কুরাইশি জিজ্ঞেস করল।
” না ম্যাম, চিনিনা। অল্প বয়সী মেয়ে। তার পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই বলল, আপনার কাছে সে নিজের পরিচয় দেবে। ” ডেইজি কুরাইশির প্রশ্নের জবাবে বলল রুবেল।
” ওকে। তাকে ওয়েটিংরুমে বসতে দাও। আমাদের লাঞ্চ হলে পাঠিয়ে দিও। ” ডেইজি কুরাইশি খাবারে মনযোগ দেয়।
কেয়ারটেকার বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
রাশেদ কুরাইশি মনে মনে আন্দাজ করেছে মেয়েটি কে হতে পারে। তিনি ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজনা বোধ করছেন। একটু পরে কি হতে পারে ভেবেই তার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে।
” আমি তোমাকে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছেনা। কে তুমি? কি চাও আমার কাছে? ” ডেইজি কুরাইশি তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।
” আপনি আমাকে চিনবেননা। আমিও আপনাকে চিনিনা। তাই ভাবলাম, যখন কেউই কাউকে চিনিনা, তবে সেক্ষেত্রে পরিচিত হতে অসুবিধা কোথায়। তাই আপনার সাথে পরিচিত হতে আসলাম। আমি নাহিয়া সারোয়ার। এসেছি সুইজারল্যান্ড থেকে। মিথিলা আরজুমান্দের মেয়ে আমি। ” নাহিয়ার কথা শুনে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত। শুধু রাশেদ কুরাইশি নির্বিকার রয়েছেন। তিনি শুধু শেষটা দেখার অপেক্ষায় আছেন।
” হোয়াট! তুমি সেই চরিত্রহীনার মেয়ে! তোমার সাহস তো কম নয়, আমার বাসায় এসে এমন বুক ফুলিয়ে কথা বলছ? সেই বেয়াদব মহিলা কি তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে? তার মতলব কি? সে কি আবার ফিরে আসতে চায়? তাই তোমাকে প্রতিনীধি হিসেবে পাঠিয়েছে? ”
” আমার মা যদি চরিত্রহীনা হয়। তবে আপনিও কিন্তু তাই। একজন পুরুষের স্ত্রী, সংসার, সন্তান থাকা অবস্থায়ই আপনি কিন্তু তার সাথে পরকীয়ায় জড়িয়েছিলেন। আপনার জন্যই আমার মা নিজের পথ বেছে নিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আপনারা সমান দোষী। আপনি আংকেলের জীবনে আসার পরই, আমার মা নতুন জীবন খুঁজে নিয়েছে। এবার আশা করি আপনার গলার জোর কমবে? ” নাহিয়া কথাগুলো বলেই এদিক ওদিক তাকিয়ে বাড়িটা দেখায় মনযোগ দিল।
রায়ান ফুঁসে উঠে নাহিয়ার দিকে তেড়ে আসতেই রাশেদ কুরাইশি ওকে ধরে ফেললেন। রাশেদ কুরাইশির চোখের দিকে তাকিয়ে রায়ান থেমে যায়।
এদিকে জাহিয়াও রাশেদ কুরাইশির চোখমুখ দেখে ভয় পেয়ে গেছে। ওরা আজ পর্যন্ত ওদের বাবাকে এমন গম্ভীর রূপে দেখেনি।
” তোমার এতবড় সাহস, আমার বাসায় এসে আমাকেই অপমান করছ? একেই বলে লজ্জাহীন মা’য়ের লজ্জাহীন মেয়ে। বেরিয়ে যাও এখুনই আমার বাসা থেকে। ”
” আমি নিজেকে কখনোই লজ্জাহীন মনে করিনা। বরং এই মুহূর্তে আপনাকেই আমার লজ্জাহীন মনে হচ্ছে। আমি এসেছি আপনার সাথে পরিচিত হতে, আর আপনি আমাকে তখন থেকেই অপমান করে যাচ্ছেন। একটা সংসার নষ্টের কারিগর হয়ে, আপনিই আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলছেন। আর এমনভাবে আমার বাড়ি, আমার বাড়ি করছেন, যেন বাড়িটা আপনার বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন! কিন্তু আমার জানামতে, আপনি আংকেলের সেক্রেটারি ছিলেন। কোন ধনী বাড়ির মেয়ে কখনো সেক্রেটারির জব করবেনা৷ তাই ধরে নিচ্ছি বাড়িটা আংকেলেরই।”
” রাশেদ, তোমার সামনে এই মেয়েটা আমাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করছে, আর তুমি চুপচাপ দেখছ? আমি তোমার স্ত্রী। অন্যের অপমান থেকে আমাকে রক্ষা করার দ্বায়িত্ব তোমার।”
” মেয়েটা তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে। কিন্তু তুমি ওর পরিচয় পাওয়ার পর থেকেই, ওর সাথে দুর্ব্যবহার করছ। এতে আমি করতে পারি? ”
” বাই এনি চান্স, তুমি কি ওকে চেন? ওকে দেখেও তুমি এমন স্বাভাবিক আছ কেন? এক মিনিট, তোমার আদরের ছেলে আবার ওকে নিয়ে আসেনি তো? ও নিজে যখন কোন ফায়দা লুটতে পারেনি, তখন এই মেয়েকে এনেছে। একে দিয়েই নিজের কার্যসিদ্ধি করতে চাচ্ছে? ”
” সবাইকে নিজের মত মনে করোনা, ডেইজি। আমার প্রপার্টির ওপর তাহমিদের বিন্দুমাত্র লোভ নেই। আর ও এমন কোন ঘৃণ্য কাজ কখনোই করবেনা। এটা তুমি নিশ্চিত থাকতে পার। ”
” আপনারা ঝগড়া পরেও করতে পারবেন। আমি যা দেখতে এসেছিলাম, দেখে নিয়েছি। এবং জেনেছি, আপনার মত মা যেখানে থাকবে সেখানে তাহমিদের মত মানুষকে কষ্ট পেতেই হবে। এবং এটাই স্বাভাবিক। আরেকটা কথা শুনে রাখুন, এখানে আমি নিজের ইচ্ছেতেই এসেছি। আপনাকে দেখার সাধ আজ আমার পূরন হয়েছে। আসছি এখন। ভালো থাকবেন। ” নাহিয়া আর সেখানে দাঁড়ায়না। কয়েকজনের চিল চক্ষু উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।
রাশেদ কুরাইশিও ডেইজির রা’গকে পাত্তা না দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ান।
” বউ, এভাবে মনযোগ দিয়ে কি দেখছ? তোমার আশেপাশে আমি ছাড়া কোন সুদর্শন পুরুষ আমার চোখে পরছেনা। চোখের সামনে আস্ত একটা সুপুরুষ থাকতে তোমার নজর অন্য দিকে, এটা কি আদৌও মানা যায়! ” কুহু বেলকনির গ্রিল ধরে সামনের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাহমিদ রুমে বসে ভার্সিটির কাজ করছিল, তাই কুহু ওকে বিরক্ত না করে এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। সুজন রাজশাহী ফিরে গেছে, নাহিয়াও সুইজারল্যান্ড ফিরে গেছে। তাই ওর একা একা রুমে থাকতে বিরক্ত লাগছিল। সেজন্যই এখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎই তাহমিদ এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তাহমিদের স্পর্শে কুহু কেঁপে উঠল। মানুষটা যতবারই ওকে জড়িয়ে ধরে, ততবারই মনে হয় এই প্রথমবার তাহমিদ ওকে জড়িয়ে ধরেছে। এই মানুষটার ছোঁয়া পেতে ও হাজারবার জন্ম নিতে পারে দুনিয়ায়।
” আমি মোটেও অন্য কোন পুরুষকে দেখছিনা। আমিতো সামনের বেলকনিতে থাকা ঐ পিচ্চিটাকে দেখছিলাম। দেখুন কত আদুরে ঐ পিচ্চিটা। এমন একটা বাবু বাসায় থাকলে আর কি লাগে। বাসা মাতিয়ে রাখার জন্য এমন একটা আদুরে সোনাই যথেষ্ট। ”
” এমন একটা আদুরে সোনা আসতে আরও পাঁচ বছর লাগবে। তাই পাঁচ বছরের আগে এসব চিন্তা ভুলেও মন এবং মস্তিষ্কে আনবেনা। ” কুহুর কাঁধে থুতুনি রেখে বলল তাহমিদ।
” এমন করে বলেন কেন! আগেই একটা গুলুমুলু সোনা আসলে ক্ষতি কি! ”
” ক্ষতির কিছুই নেই। বরং তুমি ফাঁকিবাজি করবে। গুলুমুলু সোনা আসলে তুমি পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি করবে। আগে পড়াশোনা শেষ কর, তারপর একটা নয় দুই-তিনটা গুলুমুলু সোনা আসবে। যদি আরও বেশি চাও আমি তাতেই রাজি হব। ইচ্ছে পোষন করবে তুমি, এবং দ্বায়িত্ব পালন করব আমি। মনে রেখ, এই বিষয়ে আমি উদারহৃদয়ের জামাই। ” তাহমিদের কথার ধরনে কুহু হেসে উঠল। এই লোকটার মুখে কোন কিছুই আটকায়না।
” এই আপনি চুপ করবেন? একেতো আমার মন ভেঙে দিচ্ছেন তারওপর মজা করতেও ছাড়ছেননা! আর কিসব কথা বলছেন! একটুতো লজ্জা করেন। ”
” বউয়ের কাছে লজ্জা কি! নাকি তুমি চাও আমি লজ্জায় সারাদিন মুখ লুকিয়ে রাখি? আর সত্যি কথা বলতে লজ্জা নেই। তারপরও যদি তুমি চাও আমি লজ্জা পাই, তবে আজ থেকে মিথ্যা লজ্জা পাওয়ার ভান ধরব। বউয়ের সাথে কথা বলতে গেলে লজ্জা পাব, তার সাথে খেতে বসলে লজ্জা পাব, এমনকি তাকে আদর করতে গেলেও লজ্জা পাব। তখন মানতে পারবেতো? ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু এবার তার পেটে চিমটি কে’টে হাসল।
” আপনি কি জানেন, আপনি দিনদিন উচ্চমাপের নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছেন? আগেতো এমন ছিলেননা। ”
” তোমার কাছে নির্লজ্জ উপাধি পেয়েও শান্তি আছে, বউ। যাকে ভালোবাসা যায়, তার কাছ থেকে পাওয়া নির্লজ্জ উপাধিও মনে প্রশান্তি আনে। আর যেখানে তুমি নামক পুরো মানুষটাই আমার প্রশান্তির কারন। তাই সেখানে তোমার মুখে নির্লজ্জ ডাকটাও আমাকে প্রশান্তি দেয়। তোমাকে আরও বেশি ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করে। ”
তাহমিদের কথার উত্তর না দিয়ে কুহু ওর বুকে নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দেয়। তাহমিদও ওকে পরম আদরে আগলে নেয় বুকের মাঝে।
তিনদিন সৃজনকে নিয়ে পুরো ঢাকা চষে বেড়িয়েছে তাহমিদ। সাথে অবশ্য কুহুও ছিল। ও ভার্সিটি থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছিল। ছুটির অপব্যবহার মোটেও করেনি। এবার কুহু বেশিদিন ঢাকা থাকতে পারবেনা। সৃজনের ক্লাস শুরু হবে। তাই তারাতারিই ওদের যেতে হবে।
সন্ধ্যায় রুমে বসে তাহমিদ আর সৃজন আড্ডা দিচ্ছিল। কুহু ব্যস্ত রান্নাঘরে। কলিং বেলের শব্দে তাহমিদ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এই অসময়ে কে আসতে পারে! কুহুও রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
দরজা খুলে তাহমিদ রা’গে এদিকওদিক তাকায়। কুহু তাহমিদের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে, সে রে’গে গেছে। বাহিরে কে দাঁড়িয়ে আছে! কুহু কৌতুহলবশত সামনে এগিয়ে আসে। দরজার বাহিরে দাঁড়ানো আগন্তুককে দেখে ওর ভয় হয়। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে মাত্রই দেশে এসেছে। তার হাতে শোভা পাচ্ছে ধূসর রংয়ের ন্যাপসাক। মেয়েটা ভয়ে ভয়ে তাকায় তাহমিদের দিকে। তাহমিদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে প্রানপনে চেষ্টা করছে নিজের রা’গ সামাল দেয়ার।
” আমি কি ভেতরে আসতে পারি? ” মৃদু গলায় বলল আগন্তুক।
তাহমিদের কোনও উত্তর না পেয়ে সে উত্তরের আশায় কুহুর দিকে তাকায়।
” ভেতরে এস, নাহিয়া। ” কুহুর কথা শুনে তাহমিদ ঝট করে চোখ তুলে তাকায় কুহুর দিকে। কুহু তাকে ইশারায় শান্ত থাকতে বলে।
তাহমিদ সরে দাঁড়ালে কুহু নাহিয়ার হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে আসে।
ড্রয়িং রুমের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে নাহিয়া পুরো বাসায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। তাহমিদ নিজের রুমে চলে গেছে।
” আমি কি এখানে এসে ভুল করেছি, ভাবি? ” নাহিয়া কান্না চেপে বলল।
” মোটেও ভুল করনি। তুমি দেশে এসেছ কবে? ”
” যদি ভুলই না করি। তবে কেন ভাইয়া আমাকে দেখেই রে’গে গেল! আবার রুমেও চলে গেল। আমার মা’য়ের করা অন্যায়ের শাস্তি ভাইয়া আমাকে দিতে চায়? কিন্তু আমিতো তার কাছে বোনের দাবী নিয়ে এসেছি। ” এবার নাহিয়া চোখের পানি আটকাতে পারলনা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তাই কুহুর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলনা।
কুহু ওর কাছে এগিয়ে এসে, ওর হাতের মুঠোয় নাহিয়ার হাতদুটো নিল। নিজে চুপচাপ থেকে নাহিয়াকে কাঁদতে দিল। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছে, অনেক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সে।
” তোমার ভাইয়া তোমার ওপর কখনোই রা’গ’তে পারেনা। তার রা’গ শুধু তার কালো অতীতের ওপর। তোমার মত স্বাভাবিক জীবন পায়নি সে। এ পর্যন্ত আসতে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ”
নাহিয়া মুখ তুলে তাকায় কুহুর দিকে। মেয়েটা কত অনায়াসেই তার স্বামীর পক্ষে কথা বলছে! কত সহজেই তার স্বামীর সেই কালো অতীত মেনে নিয়েছে। নাহিয়া ভালো করে কুহুকে লক্ষ্য করল। সে স্পষ্ট দেখল, তার সামনে বসা তরুণীকে। এক বছর আগে যখন তাকে প্রথম দেখেছিল, তখন এই মেয়েটিকে একটা সাধারণ কিশোরী বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে আজ সে তরুণীতে পরিনত হয়েছে। তার চেহারার সুখী ভাব কারও নজর এড়াতে পারবেনা। তার শরীরের খাঁজে খাঁজে পরিপূর্ণ রমনীর চিহ্ন। এই মেয়েটার দিকে একবার তাকালে সহসাই চোখ ফেরানো দায়।
” ভাইয়া আমার সাথে কথা বলবেনা, ভাবি? আমি তার সাথে কথা বলতেই এতদূর এসেছি। ”
” কেন কথা বলবেনা? তুমি ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা করে নাও। এরপর তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলো। এস আমার সাথে। ” কুহু নাহিয়ার হাত ধরে তাকে সৃজন যে রুমে থাকে সেখানে নিয়ে যায়। ওকে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সৃজনও রুমে ছিলনা। সে তাহমিদের সাথে আছে। কুহু প্রথমে রান্নাঘরে গিয়ে নাস্তা রেডি করে, ট্রেতে নাস্তা সাজিয়ে নাহিয়ার জন্য নিয়ে যায়। এরপর সে নাস্তা নিয়ে তাহমিদের কাছে যায়। সৃজন তাহমিদের পাশে চুপচাপ বসে আছে। সে তাহমিদের মনোভাব বুঝতে পারছে। কিন্তু তাকে শান্তনা দেয়ার সাধ্য ওর নেই। কুহু রুমে আসলে সৃজন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে যায়। ও চাইছে, কুহু তাহমিদের সাথে কথা বলুক। তাই ওদেরকে কথা বলার সুযোগ করে দিতেই ও বাহিরে গেছে।
তাহমিদ পা ঝুলিয়ে খাটে বসে আছে। দুই হাত দিয়ে বিছানার দুই পাশ আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কুহু ধীরে ধীরে গিয়ে বসল তাহমিদের পাশে। হাত রাখল তাহমিদের কপোলে।
” এভাবে মন খারাপ করে থাকবেননা। আপনার শুকনো মুখ দেখলে আমার বুকের পাঁজর ভেঙে যায়। আমি জানি আপনার দুঃখের কোন তল নেই। তবুও জীবনের একটা সময় সবাইকে এই দুঃখ-কষ্টের সামনাসামনি হতে হয়। দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে হয় দুনিয়ায় টিকে থাকতে। আপনি পেরেছেন, সব বাঁধা পেরিয়ে সমাজের বুকে নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। সেই আপনাকে এমন রূপে মানায়না। ” কুহুর কথা শুনে তাহমিদ কান্নায় ভেঙে পরে।
কুহু তাহমিদকে শক্ত করে ধরে রাখল। বেশ কিছুক্ষণ পর তাহমিদ স্বাভাবিক হয়।
” আমার সাথেই কেন সব সময় এমন হয় বলতে পার? যে কালো অতীত থেকে আমি বেরিয়ে আসতে চাই, সেই অতীতই কেন বারবার আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে? অতীত কেন বারবার আমার জীবনে ফিরে আসে? তবে কি এর থেকে আমার মুক্তি নেই! ”
” আজ শেষবারের মত একবার সেই অতীতের একটা অংশের মুখোমুখি হয়ে দেখেন। আমি কথা দিচ্ছি এরপর আপনার জীবনে কালো অতীতের ছায়া পরতে দেবনা। মেয়েটা অনেক দূর থেকে বড় আশা নিয়ে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। সে কি বলতে চায় সেটা একবার শুনুন। আপনার যদি মনে হয় সে অহেতুক কিছু বলছে, তবে শুনবেননা। এরপর আর কখনোই আপনাকে আমি নাহিয়া কিংবা তার পরিবার রিলেটেড কোন অনুরোধ করবনা। ”
তাহমিদ কিছুক্ষণ কুহুর দিকে তাকিয়ে থাকল৷ এরপর ওর ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
” মনে থাকে যেন শেষবারের মত। শুধু তোমার কথার মান রাখতে আমাকে রাজি হতে হচ্ছে। ”
” আপনি নিজেকে শক্ত করুন। আর ঐ রুমে চলুন নাহিয়ার সাথে কথা বলবেন। মনে রাখবেন, পুরো দুনিয়াও যদি আপনার বিপক্ষে যায়, তখনও আমি আপনার পাশে থাকব। ” কুহু তাহমিদের বাহু জড়িয়ে ধরল।
” হুম, চল। তুমি সবটা সময় আমার পাশে থাকবে। ”
” আমার থাকাটা নাহিয়ার পছন্দ না-ও হতে পারে। ও যদি আমার সামনে আপনার সাথে কিছু বলতে না চায়? শুনুন আমি রান্নাঘরেইই থাকব। আপনি রুমে গিয়ে নাহিয়ার সাথে কথা বলবেন। এবার চলুন। ” কুহু তাহমিদের হাত ধরে তাকে নিয়ে নাহিয়ার কাছে চলল।
” এই যে তোমার ভাইয়াকে নিয়ে এসেছি। তোমরা কথা বল। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। রাতের খাবার বানাই। ”
” তুমিও থাকোনা, ভাবি। তোমার সামনে কথা বলতে আমার কোন আপত্তি নেই। ”
” আমি এখানে থেকে তোমাদের গল্প শুনলে রান্না করবে কে শুনি? নাকি তুমিও বাকিসব ননদীনিরদের মত ভাবির খুঁত ধরতে চাও? ” কুহু হাসিমুখে কথা বলল।
” মাফ চাই, ভাবি । তুমি রান্না কর গিয়ে। আমি বাকিসব ননদীনিদের মত হতে চাইনা। ”
কুহু হাসিমুখে বেরিয়ে যায়। আসলে ও চায়না কথা বলার সময় ওদের দু’জনের মাঝে কোন জড়তা থাকুক। কুহু থাকলে নাহিয়া হয়তোবা মন খুলে কথা বলতে পারবেনা।
রুম জুড়ে নিরবচ্ছিন্ন নিরবতা বিরাজ করছে। তাহমিদও কিছু বলছেনা। আবার নাহিয়াও মনে মনে কথা সাজাচ্ছে। এতদিন যেসব কথা মনে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিল, সেগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেছে। তারপরও ওকে কিছু বলতেই হবে। নতুনভাবে কথাগুলোকে সাজাতে হবে।
” ভাইয়া, প্রথমেই আমি সরি বলছি। এভাবে হুটহাট তোমার বাসায় আসা আমার উচিত হয়নি। ”
তাহমিদ নাহিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে চুপ থাকল। নাহিয়া বুঝল যা বলার ওকেই বলতে হবে। অপরপক্ষ থেকে কোনরূপ উৎসাহ সে পাবেনা।
” আমি সবকিছুর জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। যেহেতু আমার মা তোমার সাথে অন্যায় করেছে এবং সেজন্য তার বিন্দুমাত্রও অনুশোচনা নেই, সেই মা’য়ের সন্তান হিসেবে আমার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আমি স্বীকার করছি, তোমার শৈশব কৈশোর তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবনা। তবে তোমার ভবিষ্যতের দিনগুলি হয়তো মসৃণ করতে সহায়তা করতে পারব। ”
তাহমিদ চমকে তাকায় নাহিয়ার দিকে। এই মেয়ে বলছে কি!
” তোমার কথা বুঝলামনা। কিভাবে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাও, আর কেনইবা চাও! হতো আর আমার মত পরিবার হারাওনি। শৈশব কৈশোর হারাওনি। তুমি তো বাবা-মা’র রাজকন্যা হয়ে বেড়ে উঠেছ। নাকি তোমার মা তোমাকে পাঠিয়েছে আমাকে আরেকবার আঘাত দিতে? ”
” আমি মিথিলা আরজুমান্দকে মা বলে মনে করিনা। তাদের বাড়ি ছেড়েছি বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাওয়ার পরই। যে মা একটা ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারে, আর যাইহোক তাকে মা বলতে আমার ঘৃণা হয়। ”
” কেন এসেছ? ”
” তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে। হাজার হলেও মিথিলা আরজুমান্দ আমাকে জন্ম দিয়েছে। সব দায় এড়ালেও, এই দায় কিছুতেই এড়াতে পারবনা। তাই মেয়ে হওয়ার দায় এড়াতেই তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তুমি তাকে ক্ষমা করে দিও। আর প্রায়শ্চিত্ত এটাই, আমি তাকে মা হিসেবে অস্বীকার করেছি। একজন মা’য়ের জীবনে এর থেকে বড় আঘাত কখনোই হয়না। সে তোমার জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিয়েছে, বিনিময়ে আমি তার কাছ থেকে তার একমাত্র মেয়েকে কেড়ে নিয়েছি। ”
” কিন্তু কেন? তুমি আমার জন্য কেন এতবড় পদক্ষেপ নিতে চাও?” তাহমিদের গলায় অবিশ্বাস লুকিয়ে থাকলনা।
” পদক্ষেপ নিতে চাইনা, নিয়েছি। একজন সন্তান হিসেবে তার সেই ঘৃণিত কাজের পক্ষ আমি কিছুতেই নিতে পারবনা। অপরাধী সব সময়ই ক্ষমার অযোগ্য হয়, হোকনা সে বাবা কিংবা মা। ”
তাহমিদ চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে নাহিয়ার দিকে। ওর কথা তাহমিদের বোধগম্য হচ্ছেনা।
বিঃদ্রঃ আগামীকাল আমার ননদকে সি সেকশনে নিবে। এই কয়দিন ওকে ক্লিনিকেই থাকতে হয়েছে ডক্টরের তত্ত্বাবধানে। সব ঠিকঠাক থাকলে কাল সন্ধ্যায় আসতে চলেছে টুইন বেবি। আপনারা অনেকেই ইনবক্সে নক দিয়ে আমার ননদের অবস্থা জানতে চেয়েছেন। আমি ব্যস্ততার দরুন রিপ্লাই দিতে পারিনি। আমি কাল থেকে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে যাব। হয়তো কয়েকদিন নিয়মিত লিখা হয়ে উঠবেনা। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
চলবে…
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫৪
জাওয়াদ জামী জামী
” জার্নি করে এসেছ, নিশ্চয়ই তুমি টায়ার্ড। এখন কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। এরপর সবাই একসাথে খাব। ” তাহমিদ নাহিয়ার সামনে থেকে পালানোর পথ খুঁজছে। ও কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই নাহিয়া খপ করে ধরে ফেলল তাহমিদের হাত।
” আমার কথা এখনও শেষ হয়নি, ভাইয়া। আমি কয়েকদিন পর সুইজারল্যান্ড ফিরে যাচ্ছি ঠিকই, তবে সেখানের পড়াশোনার পার্ট চুকিয়ে এখানেই কোন একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হব। এবং হোস্টেলে থাকব। এবং তুমিই সব ব্যবস্থা করে দেবে। ”
” হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলে কেন! জন্ম থেকেই দেশের বাহিরে কাটিয়েছ, হুট করে দেশে এসে মানিয়ে নিতে পারবে? তোমার বাবা-মা সেটা মেনে নেবে! ” তাহমিদের কন্ঠে নিখাঁদ বিস্ময়।
” আগেই বলেছি, আমি তাদের সাথে থাকিনা। এমনকি তাদের সাথে একই দেশে থাকতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। এছাড়া আমি এ্যাডাল্ট, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নিজের আছে। আর আমি নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাব। তাই তাদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছিনা। এবার বল তুমি আমার পাশে থাকবে কিনা? ”
তাহমিদ নাহিয়ার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মেয়েটার কথার জোর দেখে তাহমিদ কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায়না। তবে মেয়েটা যে সত্যিই ওকে আপন ভেবেছে এটা বলার অপেক্ষাই রাখেনা।
” পরেরটা পরে দেখা যাবে। এখন তুমি ওঠ। চলো খেয়ে নিই। ”
” না। তুমি আগে আমাকে কথা দাও। আমি তোমার ওপর ভরসা করেই দেশে এসেছি। আমি দাদুর বাড়িতে না গিয়ে তোমার কাছে এসেছি। ” নাহিয়ার জোড়াজুড়িতে তাহমিদ দোটানায় পরে যায়। সে নাহিয়ার কথার কি জবাব দেবে!
” ঠিক আছে, তোমার যখন খুশি তখনই দেশে এস। আমি তোমার পাশে থাকব। ”
নাহিয়াকে আর পায় কে। ও তাহমিদের কথা শুনে এক লাফে উঠে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরল।
” ধন্যবাদ, ভাইয়া। এতদিন একটা বড় ভাইয়ের অভাব ছিল। আজকে সেই অভাবও আর রইলনা। আজ তুমি সত্যিকারের ভাইয়ের কাজ করলে। ” নাহিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
তাহমিদও ওকে জড়িয়ে ধরল। এই মেয়েটা একদিনের দেখায়ই যে ওকে এভাবে আপন করে নিবে, সেটা ওর ধারনায়ই ছিলনা! যেখানে বছরের পর বছর রায়ান, জাহিয়ার সাথে কাটিয়েও ওরা তাহমিদকে ভাইয়ের মর্যাদা কখনোই দেয়নি, সেখানে একদিনের পরিচয়ে এই মেয়েটা ওকে এতটা আপন ভেবেছে, সেটা তাহমিদের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। অথচ তাহমিদ ছোট্ট রায়ান আর জাহিয়াকে সব সময়ই নিজের ভাইবোন ভেবে এসেছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ওরা তাহমিদকে পছন্দ করে উঠতে পারেনি। অবশ্য এসবের পেছনে ডেইজি কুরাইশির পরোক্ষ ইন্ধন ছিল। যেটা তাহমিদ সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পেরেছে। একটা সময় পরে তাহমিদও আর রায়ান, জাহিয়ার জন্য ভালোবাসা রাখেনি। সময়ের সাথে সাথে ওদের প্রতি ভালোবাসাও ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু আজ চোখের সামনে এই মেয়েটাকে দেখে , তাকে ছোট বোন ভেবে আরেকবার ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। হয়তো জাহিয়ার শূন্যস্থান পূরণ করতেই নাহিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে।
” ভাবি, আমি যখন তোমাকে প্রথম দেখি, তখন বোধহয় তুমি ভাইয়ার বউ হওনি তাইনা? ” রাতে এক বিছানায় শুয়ে নাহিয়া কুহুকে জিজ্ঞেস করল। নাহিয়া আর কুহু একসাথে শুয়েছে। আর সৃজন শুয়েছে তাহমিদের সাথে। নাহিয়া যে কয়দিন দেশে আছে, সে কয়দিনের বেশিরভাগ সময়ই তাহমিদের বাসায়ই থাকবে। এরপর ও যাবে দাদুর বাসায়।
” তুমি কিভাবে জানলে? রিশার কাছ থেকে শুনেছ নাকি? ” কুহু শান্ত গলায় জবাব দেয়।
” নাহ্। রিশার কাছ থেকে শুধু তোমাদের বাসার ঠিকানা নিয়েছি। রিশাকে ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই ও বলেছে, তুমি ভাইয়ার বউ। তোমরা নানুর বাসায় আর থাকোনা এমনকি ঢাকায়ও আলাদা বাসা নিয়েছ। প্রত্যেকেরই ব্যাক্তিগত কিছু বিষয় থাকে যা সবার শুনতে নেই। তাই আমি তোমাদের বিষয়ে রিশাকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। তবে যেদিন প্রথম তোমাকে দেখলাম, সেদিন তুমি নিতান্তই সাধারন এক তরুণী ছিলে। যে সবেমাত্রই কিশোরীর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলে। তোমার মধ্যে তখনও কারও স্ত্রী হবার কোন চিহ্নই ছিলনা। ”
কুহু নাহিয়ার কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। এই মেয়েটা স্বল্প সময়ের মধ্যে কতকিছু লক্ষ্য করেছে!
” তোমরা সেদিন রাজশাহী থেকে চলে যাবার অনেক পরেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। তবে তোমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পর্কে জানতে পেরে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। অতটুকু সময়ের মধ্যে তুমি আমাকেও পরখ করেছ! ”
” আমি ঐ বাসার প্রত্যেককেই কমবেশি পরখ করেছিলাম। সেদিন তোমাকে আর রাজিয়া খালা নামক সেই মহিলাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছিলাম। তাই তোমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। তারপর যখন মঞ্চে ভাইয়ার আবির্ভাব ঘটল, তার সব কথা শুনে, তার চোখের পানি দেখে আমার সকল বিশ্বাস টলে গেল। সেদিন থেকেই বাবা-মা’ র প্রতি ঘৃণা জন্মেছে৷ দিনের পর দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি। ভাইয়ার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করেছি। বুঝতে পেরেছি তাহমিদ নামক মানুষটার চলার পথ মসৃন ছিলনা। তাই জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হয়নি। বেরিয়ে আসতে পেরেছি বাবা-মা নামক স্বার্থপরদের ছায়া থেকে। ”
কুহু অবাক হয়ে শুনছে নাহিয়ার কথা। মেয়েটা অল্প বয়সেই অনেক কিছু বুঝে গেছে। দেখেছে মুখোশের আড়ালে মানুষের আসল চেহারা। স্বার্থপর বাবা-মা ‘ র সাথে থেকেও সে হয়নি তাদের মত। তার মন হয়েছে আকাশের মত বিশাল। সে গড়ে উঠেছে খাঁটি মানুষ হয়ে। যে মেয়ে তার বাবা-মা ‘র নিকৃষ্ট অতীত জেনে যে তাহমিদকে ভাইয়ের মর্যাদা দিয়েছে, সেই সাহসী মেয়ের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে কুহুর।
” তোমাকে শান্তনা কিংবা সহমর্মিতা জানালে তোমাকে অপমান করা হবে। একটাই দোয়া করি, তোমার মত সন্তান যেন বাংলার প্রতিটি ঘরে জন্ম নেয়। ”
নাহিয়া কুহুর কথার উত্তর না দিয়ে কুহুর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল।
সকালে তাহমিদ ভার্সিটিতে চলে গেলে কুহু, নাহিয়া আর সৃজন মিলে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়৷ এরপর কুহু সোজা রান্নাঘরে যায়। কুহু রান্না করছে আর নাহিয়া মনযোগ দিয়ে কুহুর রান্না দেখছে। মাঝেমধ্যে নাহিয়া কুহুকে টুকটাক কাজ করে দিচ্ছে। নাহিয়া কুহুকে ওর হাইস্কুলের গল্প শোনাচ্ছে। ওদের গল্পের মাঝেই বেজে উঠল কলিং বেল। কুহু দরজা খুলতে চাইলেই নাহিয়া ওকে নিষেধ করে নিজে খুলতে যায়।
রাশেদ কুরাইশি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে একটু থমকান। এই মেয়েটাকে তিনি কখনোই দেখেননি। কে এই মেয়ে? পরক্ষনেই তিনি ভাবলেন, এটা হয়তো তাহমিদের মামার বাড়ির দিকের কেউ। কিংবা কুহুর কোন আত্মীয়।
” কাকে চাচ্ছেন? ” রাশেদ কুরাইশিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাহিয়া জিজ্ঞেস করল।
” কুহু মা বাসায় আছে? আর তাহমিদ সে কোথায়? ”
রাশেদ কুরাইশির কথার ভঙ্গিতে নাহিয়া বুঝল ইনি তাহমিদ, কুহুর পরিচিত কেউ। তাই সে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।
” ভেতরে আসুন। ভাইয়া ভার্সিটিত গেছে। ভাবি বাসায়ই আছে। ”
এই সময় রাশেদ কুরাইশিকে বাসায় দেখে কুহুর ভয় হচ্ছে। তিনি যদি নাহিয়ার পরিচয় জানতে চান, তবে ও কি উত্তর দেবে?
রাশেদ কুরাইশি নাহিয়ার কথা শুনে বুঝে নিলেন, মেয়েটি নিশ্চয়ই তাহমিদের কোন খালামনির মেয়ে। তিনি হাসিমুখে এগিয়ে গেলেন নাহিয়ার দিকে। তিনি ধরেই নিয়েছেন মেয়েটা নায়লা আঞ্জুম অথবা শায়লা হাসানের মেয়ে হবে।
” তোমার নাম কি, মা? তোমার আম্মুর নাম কি? ”
” আমি নাহিয়া সারোয়ার । মিথিলা আরজুমান্দ আমার আম্মু। আপনি কে আংকেল? ” নাহিয়া রাশেদ কুরাইশির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল নাহিয়াকে।
নাহিয়ার কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি দুই পা পিছিয়ে যান। আহত চোখে তাকিয়ে থাকেন নাহিয়ার দিকে। বহু বছর আগে যদি তিনি মিথিলা আরজুমান্দে অবহেলা না করতেন, তবে সে এখন তার সংসার করত। এই মেয়েটা তার সন্তান হতে পারত। পরক্ষণেই রাশেদ কুরাইশির মনে একরাশ অভিমান এসে হানা দেয়। তবে কি মিলিথার সাথে তাহমিদের যোগাযোগ আছে? মিথিলার মেয়ে এখানে আছে, তার মানে তাহমিদ মিথিলাকে মেনে নিয়েছে! তবে কি তাহমিদও মিথিলার মত তাকে ছেড়ে সুইজারল্যান্ড চলে যাবে! তাহমিদ কি আরেকবার তার পর হয়ে যাবে? কুহুর মত ছেলের বউকেও শেষ পর্যন্ত হারাতে হবে!
কুহু রাশেদ কুরাইশির দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের কোনে পানির অস্তিত্ব কুহুর অগোচরে থাকেনা। ও যেন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে।
জয় মাটিতে শুয়ে গোঙ্গাচ্ছে সেই সাথে ছটফট করছে। ওর নাক-মুখ দিয়ে র’ক্ত ঝরছে। কপাল ফে’টে গেছে। র’ক্তে ওর পুরো শরীর জবজব করছে। মা’রে’র চোটে ওর পুরো শরীরে ব্যথারা রাজত্ব শুরু করেছে। ওর মুখাবয়ব ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। দুই হাতে পেট চেপে ধরে ব্যথা কমানোর বৃথা চেষ্টা করছে।
” আর কুনজর দিবি আমার পাখির দিকে? এক মিনিট, তোর কুনজর দেয়ার সকল রাস্তা আমি বন্ধ করে দেব। প্রথমে তোর চোখদুটো উপড়ে ফেলব। এরপর কা’ট’ব তোর জিহ্বা। যাতে কাউকে আমার কথা বলতে না পারিস। আর আমার পাখির প্রতি কোন খারাপ কথা তোর এই জিহ্বা না ছুঁয়ে বের হতে পারে। ” তাহমিদ জয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ওর চুল হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল।
জয় নিভুনিভু চোখে তাহমিদের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু চোখ দুটো প্রায় বন্ধ থাকায় পুরোপুরি তাহমিদের চেহারা দেখতে পেলনা।মুখ খুলতেই মুখের ভেতরে র’ক্তে’র স্বাদ পেল।
” তোকে আমি এক বিন্দুও বিশ্বাস করিনা। তুই হইলি চরম লেভেলের বেয়াদব। তোকে বিশ্বাস করা আর কালসা’পকে বিশ্বাস করা একই কথা। আজ তোকে আমি কোনভাবেই ছাড়বনা। ” তাহমিদের চোখ দিয়ে যেন আ’গু’ন ঝরছে।
জয় কোনমতে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে তাহমিদের পা জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওর চোখের পানি র’ক্তে’র সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
জয়ের দিকে তাকিয়ে তাহমিদের দয়া হল। এই ছেলেটা ছোটবেলায় ওর পিছে ঘুরঘুর করত। প্রশ্নবানে জর্জরিত করত তাহমিদকে। বড় হওয়ার সাথে সাথে ওর স্বভাব-চরিত্র পাল্টে যায়। ধীরে ধীরে বাজে ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে শুরু করে। মাদকাসক্ত হয়ে পরে। সেই সাথে নারীদের প্রতি আসক্তি বেড়ে যায়। জয় যতই নষ্ট হোকনা কেন তাহমিদের মনের কোনে কোথাও ওর জন্য ভালোবাসা আছে। যতই হোক একটা সময় তাহমিদ ওকে সত্যিই ভালোবাসত।
” ঠিক আছে, আজ তোকে ছেড়ে দিলাম। তবে ভুল করেও যদি এসব কথা কাউকে বলেছিস, তবে সেদিন তোর প্রতি সামান্যতম দয়াও আমি দেখাবনা। তোকে সাথে সাথে খু’ন করব। আমার হাত থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবেনা। এমনকি তোর কোটিপতি বাবাও না। ”
তাহমিদের ইশারা পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো জয়কে নিয়ে গাড়িতে তুলল। এরপর ওকে নিয়ে তাহমিদের নির্দেশিত জায়গায় রওনা দিল।
নায়লা আঞ্জুম মেজো বোনের ফোন পেয়ে উদগ্রীব হয়ে বেরিয়ে যায়। কুহু জিজ্ঞেস করায় শুধু বলল, জয় অসুস্থ। ও মেডিকেলে আছে। নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে কুহু একটু অবাকই হয়। কালকেই যে জলজ্যান্ত অসভ্য ছেলেটা ওর সাথে অসভ্যতামি করেছিল, আজকে সে হঠাৎ অসুস্থ হল কেমন করে! ও তারাতারি তাহমিদের কাছে গিয়ে তাকে সংবাদটা দিতে চাইল। রুমে এসে দেখল তাহমিদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে রাত প্রায় দুইটার দিকে বাসায় এসেছিল৷ এতরাত পর্যন্ত কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিয়েছিল, সজলের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। কুহু আর কোন প্রশ্ন করেনি।
” এই যে শুনছেন? উঠুননা, আর কত ঘুমাবেন! ”
” কি হলো বউ, এভাবে আমার সাধের ঘুম ভাঙ্গাচ্ছ কেন! আরেকটু ঘুমাতে দাও। ” তাহমিদ ঘুম জড়ানো গলায় কথা বলে, সাথে সাথেই আবার ঘুমিয়ে পরে।
” জয় ভাইয়া অসুস্থ। সে মেডিকেলে অ্যাডমিট আছে। আপনি গিয়ে তাকে দেখে আসুন। চাচিও চিন্তা করতে করতে বেড়িয়ে গেল। ”
” জয় যেখানে খুশি সেখানে থাকুক। ওর জন্য তোমার এত চিন্তা কেন! যার যেখানে স্থান, সে সেখানেই থাকবে। তাই ওর জন্য তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। ওর কর্মের ফল ও ভোগ করছে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু ধন্দে পরে যায়। তাহমিদের কথা শুনে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে জয়ের বিষয়ে সে কিছু জানে।
” ঘটনা কি বলুনতো? জয় ভাইয়ার কথা শুনে আপনি এমন নিউট্রাল আছেন কেন! আবার আপনার কথার ধরনও আমার ভালো লাগছেনা। সত্যি করে বলুন ঘটনা কি। ”
” জয়কে আমিই উদোম ক্যালানি দিয়েছি। ও আমার হলদে পাখিকে ফ্ল্যার্ট করবে, আর আমি ওকে হুজুর হুজুর করব! তাই অল্পস্বল্প থেরাপি দিয়েছি মাত্র । ”
তাহমিদের কথা শোনামাত্রই কুহু ধপ করে বিছানায় বসে পরল। একটা মানুষ কি পরিমান নির্দয় হলে আরেকজনকে মা’রা’র পরে এমন নিস্পৃহ থাকতে পারে! আবার তাকে মা’রা’র কথা এমন ঠান্ডা মাথায় বলতে পারে! তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে কুহু আরেক দফা ঝটকা খায়। সেই মানুষটা ভোলাভালা মুখ করে চোখ বন্ধ করে আছে। যেন সে গভীর ঘুমে মগ্ন। এই চেহারা দেখে কে বলবে, এই মানুষটা এত জেলাস!
কুহু আর কোনও কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ তাহমিদের পাশে বসে থাকল। ও রুম থেকে বেরোনোর কথা ভুলে গেছে। ওর মনে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, যদি সবাই জানে জয়ের এমন পরিস্থিতির জন্য তাহমিদ দায়ী তবে কি হবে? আর বিষয়টার সাথে কুহুও জড়িত আছে, তবে কি ঘটতে পারে ওর সাথে! ভয়ে কুহুর হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। আসন্ন বিপদের কথা মাথায় আসতেই ওর শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এভাবে আর বসে থাকতে পারলনা মেয়েটা। বসে থাকার মত শক্তি ওর নেই। তাই চুপটি করে শুয়ে পরল তাহমিদের পাশে। ও শোয়ার সাথে সাথেই তাহমিদ ওকে নিজের কাছে টেনে নিল। তাহমিদের এমন কাজে কুহু চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে। কিন্তু আগের মতই তাহমিদ চোখ বন্ধ করে আছে। তাহমিদকে এই অবস্থায় দেখে একটা ভাবনাই কুহুর মাথায় খেলে যায়, এই মানুষটা ওকে এত ভালোবাসে কেন?
জয়কে নিয়ে সেদিন বিকেলেই ওর মা ঢাকায় যায়। সেখানে থেকেই সে জয়ের চিকিৎসা করাবে। প্রয়োজনে ইন্ডিয়া অথবা সিঙ্গাপুর নিবে। জয়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তবে গতবারের মত এবার হাত-পা ভাঙেনি। কিন্তু ইন্টারনাল প্রবলেম হয়েছে। এদিকে জয়কে অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। ওর সাথে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেই সে উত্তর দিচ্ছে এ্যাকসিডেন্ট করেছে। কিন্তু কিভাবে কি হয়েছে সেটা বলছেনা। দুপুরে তাহমিদ জয়কে দেখতে গিয়েছিল। ওকে দেখামাত্রই জয় ভয়ে কুঁকড়ে যায়। ঘুমিয়ে পরার ভান করে। যা তাহমিদ ঠিকই বুঝতে পেরেছে।
আরও তিনদিন রাজশাহী কাটিয়ে তাহমিদ ঢাকায় ফিরে। কুহুর পরীক্ষা চলছে। ওর পরীক্ষা শেষ হলেই তবে সৃজনকে নিয়ে ও ঢাকা যাবে। ওদের সাথে কুহুর বড় ফুপুও যাবেন। তাহমিদ ঢাকা যাওয়ার আগে তাকে রাজি করিয়েছে। তিনিও তাহমিদের কথা ফেলতে পারেননি। তবে তিনি বলেছেন, তিনি তিনদিনের বেশি ঢাকা থাকতে পারবেননা।
কুহুর বড় ফুপুও গ্রামে ফিরে গেছেন। তার মেয়ের বিয়ের সম্মন্ধ এসেছে। তাহমিদই পাত্রের খোঁজ দিয়েছে। পাত্র একটা বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। ছেলের স্যালারি খারাপ নয়। এছাড়াও তাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো। ছেলের বাবার গ্রামে অনেক সম্পত্তি আছে। তাহমিদের কাছ থেকে সব শুনে তারা এই সম্মন্ধ এগোতে রাজি হয়েছে। কুহুর ফুপু ঢাকা থেকে আসলেই তারা মেয়েকে দেখতে আসবে। এই কয়দিনের মধ্যেই তাকে সব কিছুর জোগাড় করতে হবে। যদিও তাহমিদ বলেছে, সে-ই সব ব্যবস্থা করবে। তবে এতে তার মন সায় দিচ্ছেনা। বিয়ের পর থেকেই তাহমিদ তার পরিবারের জন্য অনেক কিছু করছে। তিনি আর ছেলেটাকে এসবের ঝামেলায় জড়াতে চাইছেননা।
পরীক্ষা শেষে কুহু সৃজন আর ফুপুকে নিয়ে ঢাকা
যায়। ফুপু তার কথামত তিনদিন পরই বাড়িতে ফিরে যান। সৃজন থেকে যায় বোনের নতুন সংসারে।
চলবে…
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫২
জাওয়াদ জামী জামী
পনের দিন পর তাহমিদ কুহুর বড় ফুপুকে জানাল, পাত্রপক্ষ তিনদিন পরই আতিয়াকে দেখতে যাবে। কুহুর ফুপু চাইছেন কুহু আর তাহমিদ যেন সেখানে থাকে। তাহমিদ ওর ফুপু শ্বাশুড়ির অনুরোধ ফেলতে পারলনা। তাহমিদ তাকে জানিয়ে দিল, দুইদিন পরই ওরা গ্রামে যাবে।
বিশ দিন পর তাহমিদ কুহুদের নিয়ে রাজশাহী ফিরল। সেইদিনই আবার ওরা বড় ফুপুর বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়। ওদের সাথে রায়হান আহমেদের পরিবারও যাচ্ছে। নায়লা আঞ্জুমের ইচ্ছেতেই তারা সেখানে যাচ্ছে।
ফুপুর বাড়িতে গিয়ে কুহুরা দেখল সাইদ আহমেদও এসেছেন। তবে তার স্ত্রী-সন্তানেরা আসেনি।
নায়লা আঞ্জুম এই প্রথমবার ননদের বাড়িতে এসেছে। তাকে দেখে বাড়ির সকলে অবাক হয়ে গেছে। শাকিলা সুলতানা ভাইয়ের বউকে দেখে সত্যিই বিস্মিত হয়েছেন। রায়হান আহমেদ আসার সময় অনেকরকম বাজার করে এনেছেন। মেহমানদের জন্য তার বোনের আর নতুন করে কিছু কিনতে হবেনা। তাহমিদও অনেক কিছুই এনেছে। সাইদ আহমেদও বাদ যাননি।
পরদিন দুপুরে মেহমান আসলে তাহমিদ, রায়হান আহমেদ আর সাইদ আহমেদ মিলে তাদের তদারকি করছে। মেয়েরা রান্নাঘরে ব্যস্ত।
আতিয়াকে দেখেই পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে যায়। তারা সাথে সাথেই বিয়ের কথা তোলে। এবং চায় আজই বিয়ে হোক। ছেলের বাবার অনুরোধে সেদিন বিকেলেই বিয়ের কাজ সারতে হয়। যেহেতু শাকিলা সুলতানা আগেই ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন তাই তিনিও দ্বিমত করেননি। হুট করেই বিয়ে হয় আতিয়ার। সন্ধ্যার আগেই পাত্রপক্ষ বিদায় নেয়। একমাত্র মেয়েকে বিদায় দিয়ে কান্নায় ভেঙে পরলেন শাকিলা সুলতানা। নায়লা আঞ্জুম আর কুহু মিলে তাকে শান্তনা দেয়।
ফুপুর বাড়িতে তিনদিন কাটিয়ে ওরা সবাই রাজশাহী ফিরল। পরদিন বিকেলেই তাহমদি ঢাকা ফিরে যায়। ও আগামী একমাস রাজশাহী আসতে পারবেনা। একমাস পরীক্ষা চলবে, এই একমাস ও কোথাও বেড়োতে পারবেনা। সৃজনেরও পরীক্ষা শুরু হবে, তাই কুহুর ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও তাহমিদের সাথে ঢাকা যেতে পারলনা। তবে সৃজনের পরীক্ষা শেষ হলেই ওরা ঢাকা যাবে।
কুহু এই একমাস ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন ভার্সিটিতে গেল। প্রতিটা ক্লাস মনযোগ দিয়ে করল। ল্যাবও মিস দেয়নি। প্রতি শুক্রবার রায়হান আহমেদের বাসায় গিয়েছে। নায়লা আঞ্জুমের সাথে ওর একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নায়লা আঞ্জুমের ইচ্ছেতে ওরা এক শুক্রবারে গ্রামে গিয়ে সারাদিন কাটিয়ে আসল। কুহু এতদিন যেমন জীবন চেয়েছে, তা ও পেয়ে গেছে। চাচারা সেই আগেরমত ভালোবাসে ওদের দুই ভাইবোনকে। নায়লা আঞ্জুমও তার দ্বায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছে। যদিও শিরিন আক্তার এখনও ওদেরকে পছন্দ করেনা। অবশ্য এতে কুহুর কোনও দুঃখ নেই। এতজন মানুষের ভালোবাসা পেয়ে একজনের ভালোবাসা না পাওয়ায় কোনও আফসোস নেই ওদের।
সৃজনের পরীক্ষা শেষ হতেই পরদিন ওরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ওরা যে ঢাকা যাচ্ছে সে কথা তাহমিদকে জানায়নি। ওরা দুপুর সাড়ে বারোটায় বাসায় পৌঁছে। ওর কাছে এক্সট্রা চাবি থাকায় বাসায় ঢুকতে সমস্যা হয়না। কুহু ফ্রেশ হওয়ার পর দেখল বাসায় খাবার কিছুই নেই। ও বুঝতে পারছে তাহমিদ না খেয়েই ভার্সিটি গেছে। ও রাজশাহী থেকে আসার সময় কিছু খাবার নিয়ে এসেছে, সৃজন সেগুলো খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে। আর কুহু পুরো ফ্ল্যাট পরিষ্কার করে তারপর রান্না করতে গেছে। রান্না করতে করতে শাহানা আক্তারকে ফোন দিয়ে জানতে পারল, তিনি এখন রাশেদ কুরাইশির বাসায় আছেন। সাতদিনের মধ্যে তিনি এখানে আসতে পারবেননা। ডেইজি কুরাইশি হঠাৎই অসুস্থ হয়ে গেছে। তাই তাকে কিছুদিন সেখানে থাকতে হবে।
রাত নয়টায় তাহমিদ বাসায় আসল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই ওকে অবাক হতে হয়। পুরো বাসা আলোকিত হয়ে আছে। কিন্তু সে-তো বাসার সব লাইটই বন্ধ করেই গিয়েছিল! দরজা খোলার শব্দ পেয়ে কুহু রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবার তাহমিদ আরেক দফা অবাক হয়। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে একমাসের অতৃপ্ত আঁখিদ্বয়ে যেন তৃপ্তির ছোঁয়া লাগে। আবেশে ছেয়ে যায় তনু-মন। উচ্ছ্বসিত হিয়া আহলাদীত হয়ে বলে ওঠে, তোর হৃদয়েশ্বরী এসেছে। যাকে কল্পনা করে তোর দিবারাত্রি কেটেছে সে আজ তোর আঁখির সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে প্রানভরে দেখে তোর এতদিনের তৃষ্ণা মেটা। হৃদয়কে সিক্ত কর তার হাসির পরশে।
তাহমিদকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে কুহু তার দিকে এগিয়ে যায়। ওর একটু চিন্তা হচ্ছে। তাহমিদ ওকে দেখে তো বিরক্ত হয়নি!
” আমার পাখিটা এভাবে আমাকে সারপ্রাইজ দেবে আমি সেটা কল্পনাই করতে পারিনি! আমার হলদে পাখির কি জন্মই হয়েছে তার প্রেমিক জামাইকে চমকে দিতে? ” তাহমিদের কথায় কুহু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ও কিছু বলতে গেলেই লক্ষ্য করল তাহমিদ নিজের বাহুডোরে ওকে বেঁধে নিয়েছে।
” শুধু জড়িয়ে ধরার সুযোগ খোঁজেন? দয়া করে ছাড়ুন। সৃজন রুমে আছে। ও দেখলে লজ্জায় পরে যাব। ” কুহু তাহমিদের থেকে ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করছে।
” শালাবাবু দেখলে দেখবে। আমি ওর বোনকেই জড়িয়ে ধরেছি। অন্যের বোনকে ধরিনি। কিন্তু তুমি নিষ্ঠুর রমনী, এতদিন পর একমাত্র জামাইকে চোখের সামনে দেখেও এমন উদাসীনতা দেখাতে পারছ! কোথায় দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে, সেটা না করে আমার হাত থেকে ছাড়া পেতে চাচ্ছ? ব্যাড, ভেরি ব্যাড। কিন্তু তোমার নিস্তার নেই মোটেও। ”
” আমি যদি নির্লজ্জ হয়েও থাকি,তবে সেটা আমার বউয়ের কাছে। এতে আমার গর্ব হয়। যে পুরুষ তার বউয়ের কাছে নির্লজ্জ হতে পারেনা, তবে সে পুরুষই নয়। এই বিষয়ে আমি একশোতে একশো। বউয়ের কাছে বিয়ের আগে থেকেই নির্লজ্জ তকমা পেয়েছি। পুরুষ হিসেবে আমি স্বার্থক। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দিনদিন এই মানুষটার নির্লজ্জতার সীমা পেরোতে দেখে ওর ভয় হচ্ছে। কোনদিন না বাহিরের মানুষের সামনেই ওকে লজ্জায় ফেলে দেয়।
” কইরে শালাবাবু, কই গেলি তুই? তোর অভাগা দুলাভাই সেই কখন থেকে বাসায় এসে দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে তোর খেয়ালই নেই! দুলাভাই হিসেবে আমি পারফেক্ট হলেও শালা হিসেবে তুই জিরো। ” কুহুকে ছেড়ে দিয়ে তাহমিদ আরেকবার কথা বলল।
তাহমিদের গলা পেয়ে সৃজন বাহিরে আসল।
” ভাইয়া, আমি জানি তুমি দুলাভাই হিসেবে পারফেক্ট। নিয়ম করে প্রতিদিন একবার করে এই কথা ফোনে শুনতে শুনতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই প্রথম কাউকে নিজের ঢাক নিজেকে পেটাতে দেখলাম। ” সৃজনের কথা শুনে কুহু খিলখিল করে হাসতে থাকে।
এদিকে তাহমিদ ওদের দুই ভাইবোনের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এই একরত্তি ছেলেটা যে ওকে ঘোল খাওয়াবে সেটা বেচারা বুঝতেই পারেনি।
” দুই ভাইবোন একজোট হয়েছিস দেখছি! ওক্কে, আমারও দিন আসবে। তখন তোদের দুই ভাইবোনকে আমি সবুজ পাতার নির্যাস খাওয়াব। ”
সৃজন এগিয়ে এসে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরল। ওর ঠোঁটে তখনও তাহমিদকে হারিয়ে দেয়ার খুশিতে হাসি লেগে আছে।
রাতে তিনজন মিলে গল্প করতে করতে খাবার খেল। এরপর অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে তবে ঘুমাতে গেল।
” আসসালামু আলাইকুম বাবা। কেমন আছেন? আমি কিন্তু জানতাম আপনি আজ সকালেই আসবেন। ভেতরে আসুন। ”
রাশেদ কুরাইশি কুহুর সালামের উত্তর দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন।
” ছেলের মনোভাব যে একমাত্র মা-ই বুঝতে পারে সেটা তুমি আরেকবার প্রমান করলে, মা। এই যে দেখ, তোমার ছেলে তোমার পছন্দের বাজার করে এনেছে। সেই সাথে ঐ উজবুকের পছন্দেরও মাছ এনেছি। তুমি মজা করে রান্না কর দেখি। ”
তাহমিদ রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার কথা শুনে বিরক্ত হয়। মানুষটা ওকে সব সময়ই উজবুক বলে ডাকে যা ওর পছন্দ নয়।
রাশেদ কুরাইশি ছেলের বাসায় আসতে চেয়েও পারেননি। তাকে ব্যবসার কাজে দেশের বাহিরে যেতে হয়েছে। সাতদিনের আগে তিনি ফিরতে পারবেননা।
কুহু মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। তাহমিদও কেমিস্ট্রির শিক্ষক হওয়ায় কুহুকে সব দেখিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া ওর বন্ধু সজলের মাধ্যমে কুহুর ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকের সাথে কথা বলে ল্যাবের বিষয়ে জেনে নিয়েছে। এবং নিজের ভার্সিটির ল্যাবে কুহুর কয়েকদিন যাওয়ার জন্য পারমিশন নিয়েছে। এছাড়াও কুহু ওর ফ্রেন্ডদের মাধ্যমে ক্লাসের খুঁটিনাটি জেনে নিচ্ছে। যদিও এসবে টুকটাক সমস্যা থেকেই যায়। কিন্তু কুহু আপাতত এতেই সন্তুষ্ট।
এদিকে তাহমিদ বুঝতে পারছে এভাবে করলে কুহুর রেজাল্ট হয়তো খুব ভালো হবেনা। তাই ও কুহুকে রাজশাহী রেখে আসতে চেয়েছে কয়েকবার। কিন্তু কুহু রাজি হয়নি। ও এখন ঢাকা থেকে যেতে চাচ্ছেনা। শাহানা ফুপু না আসা পর্যন্ত তাহমিদকে বাসায় একা থাকতে হবে। তার খাওয়াদাওয়া ঠিকমত হবেনা। এসব কারনেই কুহু যেতে চাইছেনা। তবে ও তাহমিদকে কথা দিয়েছে, মন দিয়ে পড়াশোনা করবে।
শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে তাহমিদ কাঁচাবাজার নিয়ে বাসায় এসেই আবারও বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। এবং প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরে। কুহু রান্নাঘরে কাজ করতে ব্যস্ত। সব কাজ শেষ করে কুহু তাহমিদকে ডেকে তোলে। তাহমিদ সকালে খায়নি জন্য কুহুও না খেয়েই সব কাজ শেষ করেছে। তাহমিদ উঠলে দু’জনে একসাথে খেতে বসেছে। ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। তাহমিদ উঠতে চাইলেই কুহু ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই দরজা খুলতে যায়।
দরজা খুলে দরজার ওপারের দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে তাহমিদ যেন খানিকটা বিরক্ত হয়। ও সামান্যতম তোয়াক্কাও করলনা সামনের মানুষটিকে দেখে।
” এভাবে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? সরে দাঁড়াও, আর আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও। তোমাকে দেখতে আজ এখানে আসিনি। ” রাশেদ কুরাইশি তাহমিদের কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিয়ে নিজে ভেতরে ঢুকলেন। তার পেছন পেছন দুইজন হাত ভর্তি বাজার নিয়ে ভেতরে ঢুকল।
কুহু শ্বশুরকে আসতে দেখে খাবারের প্লেট সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়। মেঝেতে একটা মাদুরে খাবার সাজানো দেখে রাশেদ কুরাইশির মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি যেখানে তিনবেলা লাখ টাকার ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খান, সেখানে তার ছেলে আর ছেলের বউ মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাচ্ছে! সাথে সাথেই তার মনে হয়, হায়রে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস!
” বাবা, আপনি! ” কুহু শ্বশুরকে দেখে অবাক হয়ে গেছে।
” এই তোমরা বাজারগুলো বউমাকে দাও। ” রাশেদ কুরাইশির নির্দেশ পেয়ে লোক দুটো বাজার রেখে বাহিরে চলে যায়।
” বউমা, এখানে তোমার, আমার আর ঐ উজবুকের পছন্দের মাছ-মাংস আছে। তুমি মজা করে রান্না কর দেখি। অনেকদিন ধরে তোমার হাতের রান্না খাইনা। ” লোক দুটো চলে যেতেই রাশেদ কুরাইশি পুনরায় বললেন।
” আপনি বসুনতো, বাবা। আগে আমাদের সাথে বসে খেয়ে নিন। তারপর আপনার পছন্দমত সব রান্না করব। ”
রাশেদ কুরাইশি ছেলের বউয়ের কথামত মুখহাত ধুয়ে এসে মাদুরে বসল। তাহমিদ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। সে রাশেদ কুরাইশির এহেন কাজে তব্দা খেয়ে গেছে।
” তুমি কি আমাদের সাথে খাবে? নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে? বউমা, খেতে দাও দেখি। আজকে খাওয়ার সময় পাইনি। ”
কুহু আর দেরি না করে প্লেটে দুইটা পরোটা, ডিম ভাজা, আলুভাজা তুলে রাশেদ কুরাইশির হাতে দেয়। কুহু তাহমিদকে ডাকলে সে-ও এসে বসে।
খাওয়া শেষ করে কুহু সকালের সব খাবার ফ্রিজে তুলে রাখে। এরপর রাশেদ কুরাইশির নিয়ে আসা বাজার ব্যাগ থেকে বের করে সেগুলোর প্রসেসিং শুরু করল।
রাশেদ কুরাইশি রান্নাঘরে বসে কুহুকে কাজে সাহায্য করছে। তাহমিদ ড্রয়িংরুমের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সব কান্ডকারখানা দেখছে আর অবাক হচ্ছে। যেই বাবা আজ পর্যন্ত নিজের বাসার রান্নাঘরে ঢোকেনি সেই মানুষ এখানে এসে রান্নাঘরে কুহুকে সাহায্য করছে! বিষয়টা তাহমিদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন।
কুহু জোর করে রাশেদ কুরাইশিকে ড্রয়িংরুমে পাঠিয়ে দেয়। যদিও তিনি আসতে চাইছিলেননা কিন্তু কুহু তার আপত্তি কিছুতেই শুনলনা।
রাশেদ কুরাইশি ড্রয়িংরুমে আসলে তাহমিদ তার দিকে চেয়ার এগিয়ে দেয়।
” বাসাটা খারাপ নয়। একে একে সব রকম ফার্নিচারও কিনতে হবে। কবে কিনবে সেগুলো? ফার্নিচার ছাড়া বাসা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ” রাশেদ কুরাইশি চেয়ারে বসেই তাহমিদকে জিজ্ঞেস করলেন।
” প্রতিমাসেই একটা একটা করে কিনে নিব। আমারতো আপনার মত অঢেল টাকা, সম্পত্তি নেই যে তুড়ি মে’রে সব কিনব। ”
” বলছি কি, এভাবে বাসা থেকে দূরে না থাকলে কি হয়না? বাসায় থাকলে অন্তত জানতে পারি তুমি ঠিক আছো, সুস্থ আছো। এখানে কিছুদিন কাটালে ঠিক আছে। এবার বাসায় ফিরে চল। ”
” আমি এখানেই ঠিক আছি। আশা করব আর কখনোই আপনার বাসায় যাওয়ার কথা বলবেননা। ”
রাশেদ কুরাইশি বুঝলেন তার এই ত্যাড়া ছেলের সাথে এভাবে কথা বলে কোন লাভ নেই।
রাতে খেয়েই তবে রাশেদ কুরাইশি বাসায় ফিরলেন। তিনি তৃপ্তি সহকারে খেয়েছেন। কুহুকে বলেছেন, প্রতি সপ্তাহে তিনি এখানে আসবেন। কুহুও সানন্দে রাজি হয়।
একমাস পর কুহু তাহমিদের সাথে রাজশাহী আসে। আর চারদিন পর থেকে ওর পরীক্ষা শুরু। রাজশাহী এসে প্রথমেই ওরা নানিমাকে দেখতে যায়ন। আজকাল নানিমা বেশি অসুস্থ হয়ে গেছেন। তিনি বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটান। এমনকি জেগে থাকলেও কাউকে চিনতে পারেননা। কিছুদিন থেকে খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন।
তাহমিদ নানিমার কাছে তার ধরে সারাটা সময় বসে রইল। ও বেশ বুঝতে পারছে নানিমা আর বেশিদিন ওদের মাঝে থাকবেনা। কথাটা ভাবতেই তাহমিদের বুকের ভেতর ফাঁকা হয়ে যায়। বিষন্নতা ওকে ঘিরে ধরল। এই মানুষটাই এক সময় ওর বেঁচে থাকার কারন ছিল। এই মানুষটাই ওকে সাহস জুগিয়েছে। দুনিয়ার মানুষের বাঁকা দৃষ্টি, অপমান থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছে। আজ সেই মানুষটার আয়ু প্রতি সেকেন্ডে কমে আসছে। তাহমিদ হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওর অতিপ্রিয় নানিমা আর থাকবেনা এটা ও মানতে পারছেনা। কিভাবে থাকবে সে এই মানুষটাকে ছেড়ে।
কুহু নিরবে সবকিছু দেখছে। ও একটিবারের জন্যও তাহমিদকে শান্তনা দিতে যায়নি। কিছু কিছু কষ্টের শান্তনা কখনোই হয়না। ওর মুখের সামান্য শান্তনার বিনিময়ে তাহমিদের মন কখনোই ভালো হবেনা, এটা ও ভালো করেই জানে। কাঁদুক না মানুষটা। এতে যদি তার কষ্ট একটু লাঘব হয়। প্রায় দুই ঘন্টা পর কুহুকে নিয়ে তাহমিদ বাসায় ফিরল।
পরদিন সকালে কুহুর বড় ফুপু গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কুহুও ভার্সিটিতে যায়। তাহমিদ ওকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে সোজা নানিমার কাছে যায়। কুহু বাসায় না ফেরা পর্যন্ত ও নানিমার কাছেই থাকবে।
তাহমিদ বাসায আসলে রাজিয়া খালা তার দিকে হাসিমুখে এগিয়ে যান। তাহমিদ তাকে জড়িয়ে ধরে। রাজিয়া খালা তাহমিদের সাথে ফাতিমা খানমের কাছে যান। সেখানেই তিনি গত একমাসের সব গল্প তাহমিদকে শোনাতে শুরু করলেন।
তিনদিন পর তাহমিদ ঢাকা ফিরে যায়। কুহুরও পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ওর পরীক্ষা খুব একটা ভালো না হলেও খারাপ হচ্ছেনা। ও দুই-এক দিন পর পরই নানিমাকে দেখে যায়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে তাহমিদ রাজশাহী এসেছে। কুহুর পরীক্ষা তিনদিন পর। তাহমিদ বাসায় এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে কুহুকে তৈরী হতে বলল। ওরা এখন নানিমার কাছে যাবে। কুহু তৈরী হতে গেলে তাহমিদ নায়লা আঞ্জুমকে ফোন করে জানায, সে নানিমাকে দেখতে যাবে। নায়লা আঞ্জুমও জানায়, এই সুযোগে সে-ও যাবে তার মা’কে দেখতে।
নানিমার অবস্থা সে-ই আগের মতই। নায়লা আঞ্জুম মা’য়ের পাশে গিয়ে বসল। সে তার মা’য়ের মাথা, চোখমুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে তার চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছে। এই বাসায় এত বছর থেকে সে মা’য়ের মমতা সম্পর্কে উদাসীন ছিল। কিন্তু এখান থেকে যাবার পরই সে বুঝতে পেরেছে মা নামক মানুষটি কত আদরের, মমতার। সে প্রতি মুহূর্তে তার মা’কে মিস করে। এত বছর তার প্রতি উদাসীনতার জন্য নিজেকে দোষারোপ করে। সে এখন নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। প্রতি মোনাজাতেই সে মা’য়ের সুস্থতার জন্য দোয়া করে। সপ্তাহের তিনদিন সে মা’কে দেখতে আসে। ঘন্টার পর ঘন্টা সে মা’য়ের পাশে বসে থাকে। তার চোখমুখে হাত বুলায়।
তাহমিদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নায়লা আঞ্জুমের দিকে। সে পরম মমতায় তার মায়ের মুখে হাত বুলাচ্ছে। হঠাৎই তাহমিদের বুকের ভেতর উথলে ওঠে। ওর মা’য়ের কি একবারও ওর কথা মনে হয়না? একবারও কি তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করেনা! মা’য়ের আদর কতদিন সে শরীরে মাখেনি। মায়ের শাসনে কখনো নিজেকে শুদ্ধ করা হয়নি। কত বছর হয় মা’য়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানো হয়নি। তাহমিদ জানে এটা কখনোই হয়ে উঠবেনা। বাকিটা জীবন ওকে মা’য়ের আদর,শাসন ছাড়াই কাটাতে হবে।
” তাহমিদ, দেখতো আম্মা এমন করছে কেন? কি হয়েছে আম্মার? ” নায়লা আঞ্জুমের উদগ্রীব গলা শুনে তাহমিদের চিন্তা ভঙ্গ হয়। ও নানিমার দিকে তাকায়।
ফাতিমা খানম চোখ খুলেছেন। তার ঘোলাটে চোখ কাউকে খুঁজে চলেছে। তাহমিদ নানিমার দিকে ঝুঁকে তাকে মৃদু গলায় ডাক দেয়।
” নানিমা, কি হয়েছে তোমার? খুব কষ্ট হচ্ছে? ”
বৃদ্ধা যেন তার আদরের নাতির কথা শুনতে পেলেন। তিনি একহাত বাড়িয়ে দিলেন তাহমিদের দিকে। তাহমিদ নানিমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতেই তিনি উঠে বসার চেষ্টা করলেন। তাহমিদ একটু অবাক হয়ে তাকে তুলে বসাতে চাইলেও সেটা করতে পারলনা। তাকে পুনরায় শুইয়ে দিল। বৃদ্ধা তাহমিদের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছেন।
” আম্মা, ও আম্মা, কি হয়েছে তোমার? আমার দিকে তাকাও, আম্মা। ” নায়লা আঞ্জুম কাঁপা কাঁপা গলায় মা’কে ডাকল। এবার বৃদ্ধা তার মেয়ের দিকে তাকালেন। হঠাৎই যেন এক চিলতে হাসি ছুঁয়ে দেয় বৃদ্ধার ঠোঁটের কোন।
ততক্ষণে সৈকত ও তার স্ত্রী রুমে এসেছে। বৃদ্ধা একে একে সকলের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরান তাহমিদের দিকে। তিনি তাহমিদের হাত নিজের দিকে টেনে নিয়ে ছোট্ট করে চুমু দেন। এরপর হঠাৎই তার হেঁচকি উঠে। তারপর ধীরেসুস্থে তিনি চোখ বন্ধ করলেন। তখনও তার ঠোঁটে হাসির রেখা স্পষ্ট।
চলবে…
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫০
জাওয়াদ জামী জামী
কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে তাহমিদ। গত তিনদিন ধরে সে নিশ্চুপ। নানিমার এভাবে চলে যাওয়া সে মানতেই পারছেনা। যখনই নানিমার কথা মনে হচ্ছে, তখনই ওর দুনিয়া ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কুহু এই তিনদিন চুপচাপ তাহমিদের পাশে বসে থেকেছে। কখনো ওর মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়েছে। কুহুর ছোঁয়া পেতেই তাহমিদ বারবার কেঁদে উঠেছে। তাহমিদকে কাঁদতে দেখলেই কুহু ওকে জড়িয়ে ধরেছে, কখনো শান্তনা দিয়েছে আবার কখনোবা তাকে কাঁদতে দিয়েছে। ওরা গত তিনদিন থেকে নায়লা আঞ্জুমের বাসায় আছে। তাহমিদকে ভেঙে পরতে দেখে রায়হান আহমেদ ওদেরকে ঐ বাসায় যেতে দেননি।
নায়লা আঞ্জুমও ভেঙে পরেছে। সে মা’য়ের কথা ভেবে একটু পরপরই কাঁদছে।
নানিমার মৃ’ত্যু’র খবর পেয়েই কুহুর বড় ফুপু এসেছেন। তিনিই বাসার যাবতীয় কাজকর্ম করছেন। নায়লা আঞ্জুমের খেয়াল রাখছেন। ফুপু আসাতে কুহুও যেন স্বস্তি পেয়েছে। ও তাহমিদকে সামলাতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে গেছে। তারউপর নায়লা আঞ্জুমকে সামলানো ওর পক্ষে সম্ভব ছিলনা।
কুহু গিয়ে তাহমিদের পাশে বসল। হাত রাখল ওর মাথায়। কুহুর স্পর্শ পেয়ে তাহমিদ চোখ খুলল। ওর চোখজোড়া লাল হয়ে আছে।
” এবার উঠুন, চোখমুখে পানি দিয়ে একটু খেয়ে নিন। এভাবে না খেয়ে থাকলে আপনি অসুস্থ হয়ে যাবেন। ”
” আমার যে ক্ষুধা পাচ্ছেনা। সমস্ত শরীর কেমন অসার হয়ে আছে। বারবার মনে হচ্ছে, আমার একটা অঙ্গহানি হয়েছে। আমার বুকের পাঁজর বুঝি ভেঙে গেছে। ”
কুহু সযতনে তাহমিদের গালে হাত রাখল। ছোট্ট করে চুমু দেয় তার একান্ত পুরুষের কপালে। কোমল কন্ঠে বলল,
” এভাবে বলতে নেই। আপনি এভাবে ভেঙে পরলে আমার কি হবে! আপনার কান্না আমি সইতে পারছিনা। আপনাকে এভাবে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। এভাবে কান্নাকাটি না করে, নানিমার জন্য দোয়া করুন। আমি দেখেছি তিনি আপনাকে অনেক ভালোবাসতেন। তার ভালোবাসার প্রতিদানে আপনি নানিমার জন্য বেশি বেশি দোয়া করুন। এতে তিনি শান্তি পাবেন। ”
কুহুর কথা শুনে তাহমিদের মনে যেন শান্তির পরশ লাগে। ও কুহুর কোলে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকে। কুহুও চুপটি করে বসে বসে তাহমিদের চুলে আঙুল চালায়।
শায়লা হাসান জয়কে সাথে নিয়ে নায়লা আঞ্জুমের বাসায় এসেছে। সে কুহুর দিকে যতবার তাকাচ্ছে, ততবারই তার ভ্রু কুঁচকে আসছে। কুহুকে সে সব সময়ই ছোটলোকের চোখে দেখেছে। তার কাছে কুহু এবং তার পরিবার ছোটলোক বৈ কিছুই নয়। কুহু শায়লা হাসানের মনোভাব ঠিকই বুঝতে পারছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর শায়লা হাসানের চাহনিকে পাত্তা দেয়ার ইচ্ছা নেই মোটেও। তাই ও শায়লা হাসানকে সযতনে এড়িয়ে যায়। এদিকে জয় নির্লজ্জের মত কুহুর চারপাশে ঘুরঘুর করছে। বিষয়টা তাহমিদও লক্ষ্য করেছে। ও যতবারই কুহুর আশপাশে জয়কে দেখছে, ততবারই ও রা’গে ফেটে পরছে। কুহুও জয়ের এমন ছ্যাঁচড়ামো দেখে বিরক্ত হয়ে গেছে। ও জয়ের থেকে যতই দূরে থাকছে, জয় ততই ওর কাছে আসার চেষ্টা করছে। আবার মাঝেমধ্যে ইশারায় কিছু বলছে যা কুহু বুঝতে পারছেনা। কুহু ভাবছে, তাহমিদ যদি এসব জানতে পারে, তবে সে জয়ের অবস্থা খারাপ করে দেবে। কিন্তু বেচারি জানেইনা, জয়ের এমন বেহায়াপনা ঠিকই তাহমিদের নজরে পরেছে।
” কোকিল পাখি, তুমি এভাবে আমার সাথে লুকোচুরি করছ কেন? আমি আগে তোমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলাম। কিন্তু এখনতো আমাদের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। এখন আমরা চাইলেই কথা বলতে পারি। এমনকি হাসিঠাট্টা কিংবা ইয়ার্কিও করতে পারি। এখন আমি তোমার দেবর। জানোতো বরের থেকেও দেবরের সাথে ভাবীদের সম্পর্ক মধুর হয়। এবং দেবরের অধিকারও বেশি হয়। তাই মাঝেমধ্যে একটু মধুর ভুল করাই যেতে পারে। ”
জয়ের কথা শুনে রা’গে কুহুর শরীর রি রি করছে। জয়ের ইংগিত বুঝতে কুহুর মোটেও কষ্ট হয়না। ওর ইচ্ছে করছে জয়ের গালে সপাটে থা’প্প’ড় মা’র’তে। কিন্তু ও এখন চাচার বাসায় আছে। তাই অনেক কষ্টে নিজের ইচ্ছেকে সংবরণ করল। তবে ও জয়কে শাসাতে ভুল করলনা।
” মুখ সামলে কথা বলুন। আপনি ভুলে যাবেননা, আমি আপনার বড় ভাইয়ের বউ। সে যদি জানতে পারে, আপনি আমার সাথে অসভ্যতা করেছেন, তবে কিন্তু আপনাকে ছাড়বেনা। এই মুহূর্তে যদি আপনি অন্য কোথাও থাকতেন, তবে থা’প্প’ড় দিয়ে আপনার দাঁত ফেলে দিতাম। এমন নির্লজ্জতা অন্য কোথাও দেখান গিয়ে। ” কুহু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের রুমে যায়। ও ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখতে পেত পাশেই করিডরে তাহমিদ দাঁড়িয়ে ছিল।
রাত দশটা বিশ। জয় টি বাঁধে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওর সাথে তিনজন ছেলে আছে। যারা জয়ের পরিচিত। ও রাজশাহী আসলেই এদের সাথে আড্ডা দেয়। জয় কেবলই বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিয়েছে। ঠিক তখনই ওর ঘাড়ে কারও স্পর্শ টের পায়। কেউ একজন পেছন থেকে ওর কাঁধে হাত রেখেছে। জয় বিরক্ত হয়ে হাতটা সরিয়ে দিলে, পরক্ষনেই আবার কাঁধে হাতের অস্তিত্ব টের পায়।
এবার জয় রে’গে একটা বাজে গালি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
” কে বে? এভাবে বিরক্ত করছিস কেন? ভোগে যাওয়ার সাধ জেগেছে নাকি? শা’লা মাদারটোস্ট। ” জয় পেছনে তাকাতেই ভয়ে জমে যায়। ও দেখল আট থেকে দশজন দশাসই চেহারার মানুষ হাতে হকিস্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতেকের মুখ মুখোশে ঢাকা।
জয়ের সাথে থাকা তিনজনও চমকে গেছে। সেই দশজন ছেলের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এসে জয়ের তিনজন বন্ধুকে এখান থেকে চলে যেতে বলল। তারা প্রথমে চোটপাট করলেও সেই মুখোশধারী ছেলেটার হুমকিতে সেখানে থাকার সাহস হারায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা জয়কে
রেখে চলে যায়।
এবার জয় সত্যিই ভয় পায়। তার গত এক বছর আগের সেই রাতের কথা মনে হয়। আজও কি সেবারের মতই কিছু ঘটতে যাচ্ছে! ও এবার ছেলেগুলোর হাত-পায়ে ধরতে থাকে। তবে সেই ছেলেরদল ওর অনুরোধ পাত্তা না দিয়ে জয়কে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গাড়িতে তোলে।
প্রায় বিশ মিনিট পর গাড়ি থেমে যায়। ওরা গাড়ি থেকে নেমে জয়কে নিয়ে একটা সুনশান জায়গায় আসল। এরপর সবাই জয়কে ঘিরে দাঁড়ালে দীর্ঘদেহী একজন এগিয়ে এসে দাঁড়ায় জয়ের মুখোমুখি। এক ঝটকায় খুলে ফেলে তার মুখোশ।
সামনে দাঁড়ানো তাহমিদকে দেখে জয় ভিষণ অবাক হয়। বোধহয় একটু খুশিও হয়। ও ভাবছে, তাহমিদ বুঝি ওর সাথে প্রাঙ্ক করছে।
” ভাইয়া, তুমি! এসব কি! এভাবে মজা করার কোনও মানে হয়? ”
” কে মজা করছে তোর সাথে! তোর সাথে মজা করার মুড বা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই। ”
” মজাই যদি না করবে, তবে আমাকে এখানে, এভাবে নিয়ে এসেছ কেন? ”
” তোকে সাইজ করতে। খুব বেড়ে গেছিস। তাই তোকে একটু সাইজ না করলেই নয়। আবারও তুই আমার সম্পদে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করছিস। ”
” কি বলছ, ভাইয়া! তোমার সম্পদে আমি হাত দিতে যাব কেন? আমার বাবার কি সম্পদ কম আছে নাকি! ”
” আমার কাছে যে সম্পদ আছে, সেই সম্পদ তোর বাপ-দাদার চৌদ্দ গোষ্ঠীতে নেই। তাই সেদিকে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছুই নয়। ”
” ভাইয়া, এমন হেয়ালি করোনা। বাসায় ফিরতে হবে। বেশ রাত হয়েছে। ”
” কুহুকে দুপুরে কি যেন বলেছিলি? মধুর ভুল করতে ইচ্ছে করছে? বরের থেকে দেবরের সাথে ভাবীদের সম্পর্ক মধুর হয়? আমার বউকে এমন কথা বলার সাহস তোর কিভাবে হয়! ”
হঠাৎই তাহমিদকে প্রসঙ্গ পাল্টাতে দেখে জয় থতমত খেয়ে গেছে। তাহমিদ এই সময়ে এমন কথা বলতে পারে সেটা ওর ধারনায়ই ছিলনা।
” ভা..ভাইয়া, আমিতো কোকিল পাখির সাথে মজা করেছি। আ…” জয় কথা শেষ করতে পারলনা। তাহমিদের প্রকান্ড থাপ্পড় খেয়ে ও চোখে আঁধার দেখে।
” কুহু শুধু আমার। ও আমার কোকিল। আমার হলদে পাখি। তোকে সেবার খু’ন না করে শোধরানোর সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই শোধরাবার মানুষ নয়। এক বছর পরে এসেও তুই আবার কুহুর দিকে নজর দিয়েছিস। যে কুহুর জন্য আমি দুনিয়ার সাথে লড়াই করতে পারি, সেই কুহুর দিকে তুই আরেকবার চোখ তুলে তাকিয়েছিস। তাহমিদের কাছে তোর অন্যায়ের বারবার ক্ষমা নেই। সেবারও তুই কুহুর দিকে কুদৃষ্টি দেয়ার অপরাধে মা’র খেয়েছিলি। এবারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। ”
জয় তাহমিদের কথা শুনে শুকনো ঢোক গিলল। তাহমিদ যে মিথ্যা বলছেনা, সেটা তার চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে গতবারের বিষয়টা ওর কাছে ক্লিয়ার হয়ে যায়। সেবার ওর করুন অবস্থার পেছনে যে তাহমিদেরি হাত ছিল, সেটা ভাবতেই ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। আজ আবার কি হতে চলেছে ওর সাথে!
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। প্রিয় পাঠকমহল, আগামী পাঁচ-সাতদিন আমি নিয়মিত গল্প দিতে পারবনা। সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমার ছোট ননদের বেবি হবে। ওকে সি সেকশনে নিতে হবে। আমি একমাত্র ভাবী হবার সুবাদে তার সকল দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে। সে কারনে হয়তো ঠিকঠাক লিখতে পারবনা। দোয়া করবেন যেন সবটা ঠিকমত সামলাতে পারি।
তাহমিদ বেরিয়ে গেলে রাশেদ কুরাইশি আরেকবার সেই বয়স্ক মেইডের কাছে যান। তাকে মনে জমে থাকা কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। মেইডও সব প্রশ্নেরই সত্যি উত্তর দেয়। এরপর তিনি ফোন করলেন শাহানা আক্তারকে। তাকেও কয়েকটা প্রশ্ন করলেন।
রাশেদ কুরাইশি রুমে এসে দেখলেন তাদের ফ্যামিলি ডক্টর ডেইজি কুরাইশির চিকিৎসা করছেন। ডেইজি কুরাইশি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছেনা সে ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে।
বিছানার পাশে রায়ান, জাহিয়া বিরসবদনে বসে আছে। ডক্টর মনোযোগ দিয়ে ডেইজি কুরাইশির চিকিৎসা করছেন। রাশেদ কুরাইশিকে দেখে তিনি মৃদু হাসলেন।
” ডক্টর, ডেইজির শারিরীক অবস্থা এখন কেমন? ”
” দেখুন মিস্টার কুরাইশি, আজ যেটা ম্যাডামের সাথে ঘটেছে, খুব ভালো কিছু ঘটেনি। আর মিনিট খানেক গেলেই তার মৃ’ত্যু হতে পারত। তবে আমি ঠিকঠাকমতই ম্যাডামের চিকিৎসা করেছি, ইভেন এখনও করছি। এখন তিনি আগের থেকে কিছুটা ভালো আছেন। আশা করছি রাতের মধ্যেই তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ”
” আপনি কি আর কিছুক্ষণ এখানে থাকবেন? নাকি এখনই চলে যাবেন? ”
” এখন এখানে আমার কোন কাজ নেই। আমি আমার চিকিৎসা দিয়েছি, কেউ একজন প্রেসক্রিপশন নিয়ে গিয়ে ঔষধ এনেছে। এখন ম্যাডামের পর্যাপ্ত ঘুম দরকার। কাল সকালে একবার এসে দেখে যাব। ”
ডক্টর বেরিয়ে গেলে, রাশেদ কুরাইশি ডিভানে গিয়ে বসলেন।
” পাপা, তুমি তোমার বড় ছেলেকে এমনিতেই ছেড়ে দিলে? এতবড় অন্যায়ের পরও সে পার পেয়ে যাবে? তুমি না মাম্মার হাজবেন্ড! তবে মাম্মার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেনা কেন? ” জাহিয়া আক্রোশের সাথে জিজ্ঞেস করল।
” ডেইজি যেমন আমার স্ত্রী, তেমনি তাহমিদও আমার সন্তান। আমার প্রথম সন্তান। যার মুখে আমি প্রথমবার বাবা ডাক শুনেছি। আজ যদি তোমার মাম্মার সাথে কোন অন্যায় হয়, তবে তার জন্য দায়ী তোমার মাম্মাই। বউমা তার সাতেপাঁচে থাকেনা। তবুও তোমার মাম্মা তাকে কারনে-অকারনে অপমান করেছে। আজ তার জন্যই এতকিছু ঘটেছে। ” রাশেদ কুরাইশি কাটকাট জবাব দিলেন।
রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে ডেইজি কুরাইশি চোখ বড় করে তাকায়। সে বিশ্বাসই করতে পারছেনা, তার স্বামী আজ তার ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে। আজ যদি সে সুস্থ থাকত, তবে অবশ্যই রাশেদ কুরাইশির এই কথাগুলোর জবাব দিত।
” কি বলছ পাপা! এতকিছুর পরও তুমি মাম্মাকেই দোষী করছ? তুমি কি আসলেই মাম্মার হাজবেন্ড? ” রায়ান হতভম্ব হয়ে গেছে।
” আমি আসলেই তোমার মাম্মার হাজবেন্ড। তবে আজ সবকিছু শোনার পর এই পরিচয় দিতে ঘৃণা হচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে, তাকে বিয়ে করা আমার জীবনের বড় ভুল ছিল। সে আমার জীবনে না আসলে, আমার সংসারটা বরবাদ হতোনা। আমার ছেলেটা সব থাকার পরও নিঃস্ব হতোনা। তোমার মাম্মা আমার জীবনে এসেছে আমাকে শেষ করতে। যেদিন থেকে তার সাথে আমার জীবন জড়িয়েছি, সেদিন থেকেই আমার আব্বা-আম্মার সাথে আমার দূরত্ব বেড়েছে। তারা আমাকে ঘৃণা করেছে। মিথিলা সংসার ছেড়েছে। তোমার মাম্মা আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার প্রাপ্তির খাতায় শুধু শূন্য যোগ হয়েছে। ” রাশেদ কুরাইশি ভগ্ন গলায় বললেন।
ডেইজি কুরাইশি সব শুনে উঠে বসল। সে রা’গে ফুঁসছে। কিন্তু শরীরে তিল পরিমান শক্তি না থাকায় কিছু বলতে পারছেনা।
” পাপা, তুমি আমাদের সামনে মাম্মাকে এভাবে ইনসাল্ট করতে পারনা। সেই অধিকার তোমার নেই। তোমার ঐ ইডিয়ট ছেলের জন্য তুমি মাম্মাকে ইনসাল্ট করছ? তবে একটা কথা শুনে রাখ, তুমি মাম্মার পাশে না থাকলেও আমরা তার পাশে আছি। তবে আজ হঠাৎ করে, ঐ ইডিয়টের জন্য তোমার দরদ দেখে আমরা অবাক হচ্ছি। ”
” মুখ সামলে কথা বল। তাহমিদ ইডিয়ট নয়। ও হলো খাঁটি সোনা। বরং তোমরাই ইডিয়ট। ও ছোট থেকেই নিজের পরিশ্রম, মেধায় এতদূর এসেছে। যেখানে ওর পাশে বাবা-মা কেউই ছিলনা। কিন্তু তোমরা? তোমাদের কাছে সবাই থাকার পরও পেরেছ ভালো কিছু করতে? আমার টাকা দিয়ে বছর বছর সার্টিফিকেট কিনছ, আমার টাকায় বিলাসিতা করছ। একা একা কিছু করার যোগ্যতা আছে তোমাদের? কিন্তু তাহমিদের এই পর্যন্ত আসতে কাউকে লাগেনি। এখন ভালো করে চিন্তা করে দেখ, কে আসলে সত্যিকারের ইডিয়ট। ”
রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে রায়ান, জাহিয়া দুজনেরই মুখ কালো হয়ে গেছে। ওরা তাদের বাবার কথার যুৎসই জবাব খুঁজছে।
” পাপা, প্লিজ। এবার থাম। আজ তুমি বেশি বেশি করছ, সেটা কি তোমার একবারও মনে হচ্ছেনা? আমরা তোমার ঐ ইডিয়ট ছেলের নামে কোন গুনগান শুনতে এখানে বসে নেই। আমরা তার করা অন্যায়ের শাস্তি চাই। তাকে তুমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে এই মুহূর্তে বের করে দিবে। তুমি যদি এটা করতে পার, তবে আমরাই এটা করব। এই বাসায় ওর আর কোন জায়গা নেই। ”
” সাট-আপ। তাহমিদকে বাসা থেকে বের করে দেয়ার তুমি কে? মনে রেখ, তুমিও আমার বাসায় থাক। আমার প্রপার্টিতে তোমার আর জাহিয়ার যেমন অধিকার আছে, তেমনই তাহমিদেরও অধিকার আছে। এই বাড়ি যতটুকু তোমার, ততটুকু তাহমিদেরও। তবে তোমার সাথে ওর পার্থক্য কোথায় জানো? তুমি একটা স্বার্থপর, লোভী। আর ও নির্লোভ। সেজন্যই বোধহয় নিজ থেকে সব অধিকার ছেড়ে, এই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। তবে ও যেখানেই যাক না কেন, সময়মত ওর প্রপার্টি ওকে বুঝিয়ে দেব।”
” না পাপা, তুমি এটা করতে পারনা। তুমি ওকে কিছুই দিতে পারবেনা। এটা আমরা হতে দেবনা। তোমার প্রপার্টির অংশীদার শুধু আমরাই। প্রয়োজনে ওকে খু’ন করব। তবুও ওকে কিছুই দিতে দেবনা। ”
রায়ানের কথা শুনে রাশেদ কুরাইশির কপাল আপনাআপনিই কুঁচকে আসে। তার ছেলে এসব কি বলছে! এতটা লোভ বাসা বেঁধেছে ওর মন-মস্তিষ্কে!
” ভুলেও একাজ করতে যেওনা। আমি আমার সব প্রপার্টির উইল করে রেখেছি। আমার এবং তাহমিদের অস্বাভাবিক মৃ’ত্যু হলে সব প্রপার্টি, ব্যাংক-ব্যালেন্স ট্রাস্টের কাছে চলে যাবে। তোমরা শুধু মাস শেষে ভরণপোষণের জন্য কিছু টাকা পাবে। এবার তুমি ভেবে দেখ তোমাদের জন্য কোনটা ভালো হবে? স্বেচ্ছায় আমার প্রপার্টির ন্যায্য ভাগ নিবে, নাকি মাস শেষে কিছু টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে, আর নাকি বাকিটা জীবন গরাদের পেছনে কাটাবে? ” রায়ানকে থামাতে রাশেদ কুরাইশি মিথ্যা বললেন। তিনি যদি তার প্রপার্টি ট্রাস্টে দেয়ার কথা না বলতেন, তবে রায়ান হয়তো সত্যি সত্যি তাহমিদের কোন ক্ষতি করে দেবে। তিনি কখনোই চাননা, তার এক সন্তান আরেক সন্তানের খু’নি হোক৷ তিনি ডিভানে বসেই সিদ্ধান্ত নিলেন, এই জীবনে তাহমিদ যা যা পায়নি, তার সবগুলোই ফিরিয়ে দেবেন । হয়তো তিনি এটা করতে পারবেননা, তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?
রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে রুমে উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। তারা কখনো ভাবতেও পারেনি তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিবেন। রায়ানের এতদিনের সব পরিকল্পনা এভাবে ভেস্তে যেতে দেখে, সে নিজেও কম অবাক হয়নি। ও বুঝতে পারছে বাবা যেটা বলেছে, সেটাই করবে।
তাহমিদ কুহুকে নিয়ে একটা হোটেলে উঠেছে। ও আগামী তিনদিনের জন্য রুম বুকিং দেয়। তিনদিনের মধ্যে বাসা না পেলে প্রয়োজনে আরও কয়েকদিন এখানেই থাকবে।
এভাবে বাড়ি ছাড়ায় কুহুর মন খারাপ হয়ে গেছে। ওর বারবার মনে হচ্ছে সবকিছুর জন্য সে-ই দায়ী। সে যদি ডেইজি কুরাইশির মুখে মুখে তর্ক না করত, তবে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতোনা।
” কি ভাবছ, বউ? আমাকেও সঙ্গে নাও। তোমার ভাবনার সঙ্গে নিজের ভাবনার মিলন ঘটাই। ”
কুহুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল তাহমিদ।
” ভাবনার সঙ্গী আবার করা যায় নাকি! আপনিও না। শুধু আবোলতাবোল কথা বলেন। ”
” আমার মত করে একবার ভালোবাসতে শেখ, তবেই বুঝবে ভাবনার সঙ্গী হয় কিনা। তখন দেখবে শুধু ভাবনার নয়, স্বপ্নেরও সঙ্গী হয়। ”
কুহু তাহমিদের কথার উত্তর না দিয়ে ওর বুকে নিজের শরীর এলিয়ে দেয়। তাহমিদ শক্ত হাতে তার রমনীকে নিজের মাঝে জড়িয়ে রাখে।
চলবে.….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪৮
জাওয়াদ জামী জামী
দুই দিন পর সকালে তাহমিদ কুহুকে নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠল। ওর ভার্সিটির কাছাকাছি হওয়ায় ভাড়া বেশি হলেও ফ্ল্যাটটা হাতছাড়া করলনা। তাহমিদ ফ্ল্যাটে ওঠার আগেই কয়েকটি ফার্নিচারের অর্ডার দিয়েছে। সেগুলো সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছানোর কথা আছে। কিছুক্ষণ পর তাহমিদ কুহুকে নিয়ে টুকটাক জিনিসপত্র কেনার উদ্দেশ্যে বের হয়। ওরা দুপুর পর্যন্ত গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে।
বাসা গোছগাছ করতে কুহুর দুইদিন লেগে যায়। এদিকে ওর রাজশাহী ফেরার সময়ও হয়ে গেছে। তবে তাহমিদের মনোভাব ও বুঝতে পারছে। বেচারা খুব করে চাচ্ছে, কুহু যেন আর কয়েকটা দিন এখানে থেকে যায়। কিন্তু কুহু নিরুপায়। ওর পরীক্ষা সামনে মাসে। অথচ এখানে আসার সময় শুধু একটা বই-ই নিয়ে এসেছে। আবার তাহমিদের দিকে তাকালে ওর নিজেরও এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করেনা। এখন ও কি করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা।
তাহমিদ বেশ রাত করেই বাসায় ফিরছে। ও ভার্সিটির ক্লাস শেষে কোচিং-এ ক্লাস নিয়ে তবেই বাসায় আসে। সারাদিন কুহুকে একাই থাকতে হয়। তাহমিদ শাহানা ফুপুকে এখানে আসার জন্য কয়েকবার ফোন করেছে। তবে তিনি এখন চিটাগং তার এক ভাগ্নীর বাসায় আছেন। তিনি জানিয়েছেন, আগামী একমাস তিনি ঢাকা আসতে পারবেননা। কারন তার ভাগ্নীর বেবি হয়েছে। আর সে ভিষণ অসুস্থ। তাই তাকে দেখাশোনার জন্য আপাতত শাহানা আক্তারকে সেখানেই থাকতে হবে। তাহমিদ আর কোন কথা বাড়ায়নি। তবে সে শাহানা আক্তারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এরপর থেকে তার অন্য কোথাও থাকা চলবেনা। শাহানা আক্তারও তাহমিদের কথা মেনে নিয়েছেন।
দরজা খুলেই ক্লান্ত তাহমিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুহুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। মানুষটা ওকে ভালো রাখতেই কত পরিশ্রম করছে। ওর পাশাপাশি সৃজনের যাবতীয় খরচ সে-ই দিচ্ছে। এছাড়াও বড় ফুপুর কাছে প্রতিমাসে কিছু টাকা পাঠায়। রাজিয়া খালাকেও কিছুনা কিছু সাহায্য করে। একটা মানুষের পক্ষে এটাই অনেক কিছু। যদিওবা রাজিয়া খালা, কুহুর বড় ফুপু তাহমিদের কাছ থেকে কিছুই নিতে চাননা। কিন্তু নাছোড়বান্দা তাহমিদের কাছে তাদের যুক্তি টিকলে তো! পরিশ্রান্ত তাহমিদকে দেখে কুহু দ্রুতই একটা সিদ্ধান্ত নেয়। ও পরীক্ষার আগের দিন রাজশাহী যাবে। সৃজনকে ফোন দিয়ে ওর সব বইগুলো কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিতে বলবে। তার আগে কথা বলতে হবে বড় ফুপুর সাথে। আগামী একমাস ফুপুকে রাজশাহী থাকতে রাজি করাতে হবে। ও কিছুতেই এই মানুষটাকে ছেড়ে থাকতে পারবেনা। তার কাছাকাছি থাকার জন্য দুনিয়া সুদ্ধ মানুষের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত আছে। যদিও সেটার কোনই দরকার পরবেনা।
” যতটা মিস করলে তার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। লোকলজ্জার ভয়কে দূরে ঠেলে দিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পরতে ইচ্ছে করে। তার আদরীনি হয়ে তারই বুকে অনন্তকাল থাকতে ইচ্ছে করে। চুপটি করে তার ভালোবাসার পরশ শরীরে মাখতে আজন্মের সাধ জাগে। ”
কুহুর জবাব শুনে তাহমিদের ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটল। শরীর থেকে নিমেষেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। সে অনেক আগেই বুঝে গেছে, তার ভালোবাসার পোষা পাখিটিও তাকে অনেক ভালোবাসে। আজ আরেকবার নতুনভাবে বুঝতে পারল, এ যে শুধু তারই পাখি। যাকে পোষ মানাতে কোন খাঁচার প্রয়োজন হয়নি। শুধু ভালোবাসা পেয়েই সে তাহমিদের একান্ত আপন হয়ে উঠেছে।
কুহুর ফোন পেয়ে ওর বড় ফুপু দুইদিনের মধ্যেই রাজশাহী আসলেন। সৃজনও কুহুর কয়েকটা বই কুরিয়ারে পার্সেল করেছে। এবার কুহু নিশ্চিন্তে একটা মাস কাটাতে পারবে। কুহুর কাজকর্ম তাহমিদ মনে মনে ভিষণ খুশি হয়। মেয়েটা যে ওর কাছে থাকার জন্য এত আয়োজন করেছে, ভাবলেই ওর কুহুকে দিনরাত বুকে জরিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে।
তাহমিদ বড় ফুপুর সাথে কথা বলে, তাকে আগামী একমাসের খরচ পাঠিয়ে দিয়েছে। বাড়ি ভাড়াও পাঠিয়েছে। আগামী একমাস সৃজন আর আর ফুপুর যাতে কোন কষ্ট না হয়, তার সব ব্যবস্থাই করেছে।
রাতে তাহমিদের বুকে মাথা রেখে কুহু মনযোগ দিয়ে পড়ছিল। আর তাহমিদ ফোনে ব্যস্ত আছে। হঠাৎই কুহুর ফোনের শব্দে ওদের দু’জনেরই মনোযোগ ছিন্ন হয়। কুহু ফোন হাতে নিয়েই দেখল রাশেদ কুরাইশির নম্বর। ও আঁড়চোখে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে ফোন নিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। ততক্ষণে তাহমিদের চোখেও পরেছে কে ফোন দিয়েছে।
” আসসালামু আলাইকুম, বাবা। আপনি কেমন আছেন? ”
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আমি ভালো আছি, মা
তুমি কেমন আছো? আমার উজবুক ছেলেটা ভালো আছেতো? ” রাশেদ কুরাইশির তার ছেলের প্রতি সম্ভাষণ শুনে কুহু হেসে উঠল।
” আজকাল তারাতারিই বাসায় ফেরার চেষ্টা করি। আর তারাতারি খেয়েও নিই। তোমাকে একটা প্রশ্ন করব, মা? ” রাশেদ কুরাইশি ইতস্তত করছেন।
” আপনি এভাবে বলবেননা। মনে যা প্রশ্ন আসবে সরাসরিই বলবেন, বাবা। ”
” কোথায় বাসা নিয়েছ? আমাকে ঠিকানা দেয়া যাবে? ” রাশেদ কুরাইশি শুধু শুনেছেন ওরা নতুন বাসায় উঠেছে। কিন্তু সাহস করে বাসার ঠিকানা জানতে চাননি। তবে আজ তিনি না জিজ্ঞেস করে পারলেননা।
” আপনার ছেলের বাসার ঠিকানা জানার অধিকার আপনার আছে, বাবা। আমরা বসুন্ধরায় বাসা নিয়েছি। আপনি সময় করে আসবেন। ” এরপর কুহু বাসার এ্যাড্রেস জানিয়ে দিল।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর কুহু রুমে প্রবেশ করল।
তাহমিদ রুমে থেকেই কুহুর কথা শুনতে পাচ্ছিল।
” আসুন সম্মানিতা গুপ্তচর, ভেতরে আসুন। আপনি কি জানেন রাজরাজাদের সময় আপনার জন্ম হলে, উচ্চ মাপের একজন গুপ্তচর হতে পারতেন আপনি? ” তাহমিদের কথা শুনে কুহু আকাশ থেকে পরল!
” কিসব সর্বনাশা কথা বলছেন! আমি রাজরাজাদের যুগে জন্ম নিতে যাব কেন! আর সেই সময় আমার জন্ম হলে, আপনাকে কিভাবে পেতাম? আপনি নিশ্চয়ই রাজসভার ভাঁড় হতেননা। তাই এসব কুচিন্তা বাদ দিয়ে বলুন, আমি গুপ্তচর কিভাবে হলাম? ”
” যে মেয়ে একই সাথে দুইজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাকে কি বলা যায়? সে আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে তার শ্বশুরের সাফাই গায়। আর শ্বশুরের কাছে মিষ্টিস্বরে ঘরের কথা জানায়, জামাইয়ের দুর্নাম করে। তাকে কি বলে? ফাজিল মেয়ে। তুমি শুধু গুপ্তচর নয়, প্রধান গুপ্তচর হওয়ার যোগ্যতা রাখ। ”
” মোটেও আমি আপনার দূর্নাম করিনি। এভাবে আমাকে অপবাদ দেবেননা। ”
” বাবা, আপনি জানেনইতো আপনার ছেলে কেমন। তার আকাশ ছোঁয়া রা’গের কাছে আমি পাত্তা পাই বলুন, তাকে কিছু বলার সাহস আমার নেই। এসব কথা বুঝি দূর্নাম নয়! ” তাহমিদ চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করল।
” কারও অনুপস্থিতিতে তার নামে উল্টাপাল্টা কিছু বলিলে তাহাকে দূর্ণাম বলে। আমি আপনার উপস্থিতিতেই আপনার বাবাকে, আপনার মনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে জানিয়েছি। তাই ইহাকে কোনভাবেই দূর্নাম বলা চলিবেনা। ইহা খাঁটি সত্য কথা। আর আমি মোটেও মিথ্যা কিছু বলিনাই। বুঝিয়াছেন জনাব? ” কুহু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল।
তাহমিদ কুহুর অভিনয় দেখে হেসে উঠল। এরপর আচমকাই ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল।
” আমাকে কুপোকাত করার সকল অস্ত্রই দেখছি আমার রানীর কাছে মজুদ আছে! সে ভালো করেই জানে তার ওপর রা’গ আমি কোনকালেই করতে পারবনা। তাই সে-ও সুযোগের স্বদ্যবহার করতে পিছপা হয়না! ”
” একে বলে যার অস্ত্রে তাকেই কাৎ করা। আপনার সাথে বাস করে, আপনাকেই চিনবনা এটা কি করে হয়! এখনতো আমি নিজের থেকে আপনাকে ভালো চিনি। তাই আপনাকে কপোকাত করতে আমাকে বেগ পেতে হয়না। ”
” তুমি যেমন আমাকে কপোকাত করার সকল টেকনিক আয়ত্ত করেছ, ঠিক তেমনি তোমাকে কপোকাত করার নিঞ্জা টেকনিক আমার হাতের মুঠোয় আছে। আমি ভালো করেই জানি, আমার পাখিটা কিসে কুপোকাত হতে ভালোবাসে। আর আমিও আমার পাখির ভালোবাসাকে সব সময়ই প্রাধান্য দিয়ে তাকে কুপোকাত করতে প্রস্তুত। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু ঠোঁট কামড়ে হাসল। তাহমিদের ইঙ্গিত বুঝতে ওর মোটেও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ও সহজেই ধরা দিতে চায়না। এই মানুষটাকে নাকানিচুবানি খাওয়াতে কুহুর খারাপ লাগেনা।
এদিকে তাহমিদের হাতের বাঁধন একটু একটু করে শক্ত হচ্ছে। কুহুও সুযোগের অপেক্ষায় আছে তাকে ফাঁদে দেয়ার। ও এক হাতে নিজের ফোন নিয়েছে তাহমিদের অগোচরেই।
তাহমিদ কুহুর গলায় মুখ গুঁজে দিতেই ওর ফোন বেজে উঠল। বেচারা চমকে বিছানা হাতড়ে ফোন সামনে এনে রা’গী চোখে কুহুর দিকে তাকায়। ততক্ষণে ওর হাত ফসকে কুহু বেরিয়ে গেছে।
” আমার নিষ্ঠুর বউ, এভাবে আমার রোমাঞ্চে বাঁধা দেয়ার অপরাধে তোমার শাস্তি দ্বিগুণ করা হল। ফলশ্রুতিতে কাল আমি ভার্সিটিতে যাচ্ছিনা। তোমার শাস্তি আগামী দুইদিন অব্যাহত থাকবে। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহু খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। তাহমিদও বিছানা ছেড়ে ওকে ধরতে যায়।
ডেইজি কুরাইশি বিভিন্নভাবে কুহুকে অপমান করছে। তবুও কুহু মুখে কুলু পেতে আছে। ওর একটা সত্তা বলছে প্রতিবাদ করতে। কিন্তু অপর সত্তা পরক্ষনেই বলছে, নিশ্চুপ থাকতে। দ্বিতীয় সত্তা ওকে বারবার বলছে, এই বাসায় ও কয়েকদিনের অতিথি হয়েই আসে মাত্র। এই কয়েকদিনের জন্য কারও সাথে বিবাদে জড়িয়ে কি লাভ? এছাড়াও ডেইজি কুরাইশিও তাহমিদের নিজের মা নয়। যেখানে তাহমিদই ডেইজি কুরাইশিকে পাত্তা দেয়না, সেখানে তাকে কথা শোনাতে কুহুর ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু মাঝেমধ্যে ডেইজি কুরাইশি একটু বেশিই করে ফেলে। কুহুর তখন রা’গ হলেও চুপচাপ সব সহ্য করে। কিন্তু আজকে দুপুরে কুহু চুপ থাকতে পারেনি। ডেইজি কুরাইশির কটুকথার বিপক্ষে ও প্রতিবাদ করেছে। আর তাতেই ডেইজি কুরাইশি রে’গে আ’গু’ন হয়ে যায়। সে দাঁতে দাঁত পিষে কুহুর দিকে অ’গ্নি দৃষ্টি হেনে নিজের রুমে যায়।
” রুনু, রান্না হয়েছে? নাকি গল্প করেই দিন পার করে দিচ্ছিস? ফাঁকিবাজের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে নিজেও ফাঁকিবাজি শিখছিস? তবে জেনে রাখ, এর ফল মোটেও ভালো হবেনা। ”
” রান্না শেষ, ম্যাম। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সার্ভ করব। ”
” আমরা টেবিলে আসলে তুই থাকবি। এই মেয়েটা যেন না থাকে। ও থাকলে রায়ান, জাহিয়া বিরক্ত হয়। আসলেই তো একটা অসভ্য, জংলীর সামনে বসে কেউ কি শান্তিমত খেতে পারে! কিন্তু এই জংলী মেয়ে সেই কথা বুঝলে তো। সে এসব বুঝবে কেমন করে! সে-তো শ্বশুরের মনোরঞ্জন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিভাবে শ্বশুরকে হাতের মুঠোয় আনবে সেই চিন্তাই করে দিনরাত। ”
ডেইজি কুরাইশির কথা শুনে কুহুর মাথায় যেস দপ করে আ’গু’ন জ্ব’লে উঠল। রাশেদ কুরাইশিকে ও নিজের বাবার মত মনে করে। অথচ ডেইজি কুরাইশি তাকে নিয়ে এসব কি বলছে! ও এবার আর চুপ থাকতে পারলনা। মুখ খুলতেই হল।
” আপনি যা বলছেন ভেবেচিন্তে বলছেন তো? আপনার হাসবেন্ড আমার শ্বশুর। যিনি আমার বাবার সমতুল্য। আজ সেই পিতৃসম শ্বশুরকে নিয়ে আপনি যে কথাটা বললেন, এটা কি শোভনীয়? আমি নাহয় অসভ্য জংলী। কিন্তু আপনার কথা শুনে আপনাকেতো মোটেও সভ্য বলে মনে হচ্ছেনা। এখনতো আপনাকে পারিবারিক শিক্ষা বিবর্জিত জীব বৈ আর কিছুই লাগছেনা। আপনার থেকে অন্তত আমার পারিবারিক শিক্ষা উঁচু স্তরের বলে মনে হচ্ছে। আমার বয়েই গেছে আপনাদের খাবার সময় এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমি শুধু বাবার জন্য এখানে থাকি। আপনার দু’জন উজবুক মার্কা ছেলেমেয়েকে দেখলেই আমার হাসি পায়। তাদেরকে আপনিই ইচ্ছেমত গেলান। ”
কুহুর কথা শুনে রুনু অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখে। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দুইজন মেইড মুচকি মুচকি হাসছে।
ডেইজি কুরাইশি এমন অপমান মেনে নিতে পারলনা। সে কুহুর দিকে তেড়ে আসল।
” তোমার এত বড় সাহস, আমাকে অপমান করছ? তুমি কি জানো কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ? আমি চাইলেই এই মুহুর্তে তোমাকে মাটিতে পিষে ফেলতে পারি। দুই পয়সার মেয়ে আসছে আমাকে জ্ঞান দিতে। ”
” হোকনা দুই পয়সা, তাও তো আমার দাম আছে। আপনাকে তো আমি গোনার মধ্যেই ধরিনা। মূল্য হিসেব করতে গেলে, আপনার মূল্য জিরো। স্বামী এটা আছে, সেটা আছে ফুটানি দেখানো ছাড়া আরতো কিছুই করতে পারেননা। আর কি যেন বললেন? আমাকে মাটিতে পিষে ফেলবেন! তেমনটা করলে আমার জামাই আপনাকে ছেড়ে দেবে! আমার মনে হয়, আপনার কথা শোনামাত্রই সে আপনাকে ভস্ম করতে চাইবে। আর সেই কাজ করলে তবে সে আপনাকে কি করবে, কথাটা ভাবতেই ভয় করছে আমার। ”
” তুমি আমাকে থ্রেড দিচ্ছ! মনে করছ, তোমার হুমকিতে আমি ভয় পেয়ে রুমে গিয়ে দরজা দিয়ে বসে থাকব? স্বামীর বড়াই করছ! তবে শুনে রাখ, আমি ইচ্ছে করলেই চরিত্রহীনার ঐ ছেলেকে বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি। তাই এত আকাশে উড়তে যেওনা। কখন যে ধপ করে মাটিতে পরে হাত-পা ভাঙবে সেটা বুঝতেই পারবেনা। ” ডেইজি কুরাইশির চোখে যেন আ’গু’ন জ্ব’ল’ছে।
” আমার স্বামীটাই বড়াই করার মত। এমন স্বামী কয়জনের ভাগ্যে জোটে বলুন? কয়জন মেয়ে তার স্বামীর জীবন প্রথম নারী হতে পারে? যেমনটা আমি হয়েছি? আপনি এসবের মধ্যে নিজেকে জড়াবেননা। আপনিতো আর আপনার স্বামীর জীবনে প্রথম নারী নন। তাই এই সুখ বোঝার ক্ষমতাও আপনার নেই। সেই হিসেবে আপনি পুরোপুরি ব্যর্থ। আর ব্যর্থদের প্রধান হাতিয়ার ধারালো জিহ্বা। আপনি আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন কি! সে-ই এখানে থাকতে চায়না। ভুলে যাবেননা, সে একজন স্বাবলম্বী পুরুষ। তাই এই ভয় আমাকে দেখাতে আসবেননা। ”
ডেইজি কুরাইশি ভাবতেই পারেনি এই দুইদিনের মেয়ে তাকে চরমভাবে অপমান করবে। এই বাড়ির মালিক হবার সুবাদে যেখানে সবাই তাকে ভয় পায়, মেনে চলে সেখানে এই মেয়ের ঔদ্ধত্য সে কিছুতেই মানতে পারছেনা। সে এই মেয়েকে যতটা বোকা ভেবেছিল, ততটা বোকা যে সে নয়, সেটা ভেবেই নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। প্রথমেই যদি এই মেয়ের স্বরূপ বুঝতে পারত, তবে শুরুতেই এর একটা ব্যবস্থা করত। তবে এখন আর এতকিছু ভাবার সময় নেই। এখনই মেয়েটার মুখ বন্ধ করতে হবে।
” বেয়াদব মেয়ে, তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি! আজ রাশেদ আসুক। তোমার মুখোশ যদি আমি তার সামনে না খুলে দেই তবে আমার নামও ডেইজি নয়। ফকিরের মেয়ের গলাবাজি দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! এতদিন শুনেছি,’ ফাঁকা কলসি বাজে বেশি ‘। আজ সেই কথার প্রমান পেলাম। ফকিরের মেয়ের আর কিছু না থাকুক, গলায় জোর আছে।”
ডেইজি কুরাইশির এমন কথা শুনে এবার কুহুও রে’গে উঠল। এতক্ষণ সে ধীরে ধীরে কথা বলেছে ডেইজি কুরাইশির সাথে। তবে এখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলোনা। এবার সে একটু বেশিই প্রতিক্রিয়া দেখাল।
” আপনাকে আগেই বলেছি, আমার সাথে হিসেব করে কথা বলবেন। ফকিরের মেয়ে কে সেটা তার ব্যবহারেই প্রকাশ পায়। ইনফ্যাক্ট আমি মনে করি একজন ফকিরের মেয়ের যে সম্মান আছে, সেটা আপনার নেই। ফকিরের মেয়েরাও অন্তত কারও ঘর ভাঙ্গার আগে বোধহয় দুইবার ভাবে। ”
ডেইজি কুরাইশি তেড়ে এসে কুহুকে থা’প্প’ড় মারল। ঘটনার আকস্মিকতায় কুহু হকচকিয়ে গেছে। ও গালে হাত দিয়ে হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। ওকে নিরব থাকতে দেখে ডেইজি কুরাইশি আরেকটু সাহস পায়। সে ভেবে নেয়, তার থা’প্প’ড়ে কুহু ভয় পেয়েছে। সে এবার কুহুর দুই হাত নিজের ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে, বাম হাত দিয়ে কুহুর গালে সপাটে থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়। এবারও কুহু নিশ্চুপ। সে এবার দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে ভয় খেলা করছে।
ডেইজি কুরাইশি কুহুর দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকিয়েই জমে যায়। সেখানে তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ রা’গে লাল হয়ে গেছে। ডেইজি কুরাইশি নিজের জায়গা থেকে দাঁড়িয়েই দেখতে পাচ্ছে, তাহমিদ রা’গে দাঁত পিষছে। তাহমিদের এমস রূপ দেখে ডেইজি কুরাইশি ভয় পেয়ে গেছে। সে ঝট করে কুহুর হাত ছেড়ে দেয়।
কুহুও এই অসময়ে তাহমিদকে দেখে অবাক হয়েছে। ঘটনা যে এতদূর গড়াবে তা ও ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। সে তো শুধু ডেইজি কুরাইশির অপমানজনক কথার প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাহমিদ এই সময় বাসায় কেন! কি হবে এখন? ডেইজি কুরাইশির হাতে প্রথম থাপ্পড় খেয়ে ও হতভম্ব হয়ে গেছিল, সেই সাথে লজ্জাও ওকে গ্রাস করেছিল। এতগুলো মেইডের সামনে থা’প্প’ড় হজম করা সহজ ব্যপার নয়। কিন্তু এবার ওর ভয় হচ্ছে। তাহমিদের মুখ দেখে ওর কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে।
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪৬
জাওয়াদ জামী জামী
তাহমিদ কখন যে তার হাতে থাকা ব্যাগ ফেলে দিয়েছে সেটা ও বলতেই পারবেনা। সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই ও আশেপাশে যা পাচ্ছে তাতেই লাথি হাঁকাচ্ছে। একসময় দেখা গেল সে ডেইজি কুরাইশির সামনে আসার আগেই ড্রয়িংরুমের দফারফা করে দিয়েছে। তাহমিদের এমন রূপ দেখে কুহু চমকে গেছে। ডেইজি কুরাইশি ভীতু চোখে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বেশ বুঝতে পারছে, আজ তার নিস্তার নেই।
তাহমিদ ডেইজি কুরাইশির সামনে এসে সরাসরি তার গলা চেপে ধরল। এই মুহূর্তে সে কি করছে সেটা তার মাথায় নেই।
” আপনার এতবড় সাহস, আমার কুহুকে থা’প্প’ড় দিয়েছেন? যে ফুলকে আমি সব সময়ই আগলে রাখি। যাকে ভালোবাসতে গেলেও আমি চিন্তা করি, সে যদি ব্যথা পায় । আর আপনি আমার সেই ফুলকে আঘাত করেছেন! খুব খারাপ করেছেন আপনি। এখন যদি আমি আপনাকে মে’রে পুঁতে দেই, তবে কারও ক্ষমতা হবেনা আপনার বডি খুঁজে বের করার। আমি চাইলেই আপনার স্বামীকেও রাস্তায় নামাতে পারি। আপনার ছেলেমেয়েরা শুধু দেখে যাবে। কিছুই করার সাহস ওদের কোনদিনও হবেনা। ”
তাহমিদের হাত ধীরে ধীরে চেপে বসছে ডেইজি কুরাইশির গলায়। ডেইজির দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে একটুখানি অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাঁস করছে। মাথায় ভিষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। তার চোখের তারায় কোনও আলোর অস্তিত্ব নেই। ধীরে ধীরে অসার হয়ে আসছে তার শরীর। এক পর্যায়ে সে শরীর ছেড়ে দেয়। একটুখানি অক্সিজেনের জন্য ছটফট করলেও তাহমিদের শক্ত হাত থেকে মুক্তি পায়না।
ডেইজি কুরাইশির শোচনীয় অবস্থা দেখে কুহু ভয় পায়। ও দ্রুত পায়ে তাহমিদের সামনে গিয়ে ডেইজির গলা থেকে তার হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে ।
বাসার সব মেইডরা চোখ বড় করে তাহমিদের কর্মকাণ্ড দেখছে। তাদের চেয়ে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। কারন তারা তাহমিদের রা’গ সম্পর্কে ভালোভাবেই জানে।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে রায়ান, জাহিয়া নিরবে সবকিছু দেখছে। মায়ের জন্য তাদের কষ্ট হলেও, আপাতত নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করাই তাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। কারন তাহমিদের সামনে ওরা টিকতে পারবেনা কিছুতেই।
” তাহমিদ, তুমি কি করছ? ডেইজিকে মা’র’তে চাইছ কেন? ছেড়ে দাও ওকে। ” কোথায় থেকে যেন রাশেদ কুরাইশি এসে তাহমিদকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন।
রাশেদ কুরাইশির ধাক্কা খেয়ে তাহমিদ ডেইজিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ও ছিটকে কয়েক হাত পেছনে চলে যায়।
তাহমিদের হাত থেকে ছাড়া পেতেই ডেইজি কুরাইশি ঢলে পরে মেঝেতে। রাশেদ কুরাইশি এগিয়ে যান স্ত্রী’র কাছে। ততক্ষণে ডেইজি কুরাইশি জ্ঞান হারিয়েছে।
ডেইজি কুরাইশি মেঝেতে পরতেই মেইডরা ছুটে আসে। তারা ধরাধরি করে ডেইজিকে তার রুমে নিয়ে যায়। রায়ান ইতোমধ্যে ওদের ফ্যামিলি ডক্টরকে ফোন দিয়েছে।
তাহমিদ নিজেকে সামলে নিয়ে এদিকওদিক তাকায়। এরপর শুরু করল ধ্বংসযজ্ঞ। হাতের কাছে যা পাচ্ছে ভেঙ্গেচুরে একাকার করছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই ড্রয়িংরুম একটা আসবাবপত্রের আস্তাকুঁড়ে পরিনত হয়। এতক্ষণ রাশেদ কুরাইশি চেয়ে দেখছিলেন তাহমিদের এই ধ্বংসযজ্ঞ। তিনি আজ যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। তাহমিদের এমন রূপ দেখে তিনি যারপরনাই হতাশ হয়েছেন। তিনি তাহমিদকে থামাতে তার দিকে এগিয়ে যেতে চাইলেই, একজন বয়স্ক মেইড তাকে বাঁধা দেয়। এরপর সেই মেইড তাকে একে একে সব খুলে বলল।
সব শুনে রাশেদ কুরাইশির স্ত্রী’র ওপর ঘৃণা হচ্ছে। বাবা-মেয়ের পবিত্র সম্পর্ককে আজ ডেইজি কুরাইশি কলংকিত করেছে। তার এই মুহূর্তে স্ত্রী’র মুখ দেখতে ইচ্ছে করছেনা।
এদিকে তাহমিদ সবকিছু লণ্ডভণ্ড করেও শান্তি পাচ্ছেনা। সে এবার হাতে একটা চেয়ারের ভাঙ্গা হাতল নিয়ে ড্রয়িংরুমে দেয়াল জুড়ে থাকা অ্যাকুরিয়ামে সজোড়ে বারি দেয়। নিমেষেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় অ্যাকুরিয়াম। ঝনঝন শব্দে ভেঙে পরল কাঁচ। পানিতে ভেসে যায় ড্রয়িংরুমের মেঝে। অনেকগুলো লাল, নীল রঙের মাছ মেঝেতে খাবি খাচ্ছে। ছোট ছোট কচ্ছপের দল পালাতে চাইছে। তারাও যেন হঠাৎ করেই মুক্তির স্বাদ পেয়েছে।
কুহু এসব দেখে ভয় পায়। এখনই যদি তাহমিদকে না থামানো যায়, তবে সে নিশ্চয়ই আরও খারাপ কিছু ঘটাবে। ভাবনাটা মনে আসতেই কুহু পড়িমরি করে তাহমিদের কাছে ছুটে যায়। হুট করেই জড়িয়ে ধরে তার খ্যাপা স্বামীটিকে। সে এই মুহূর্তে স্থানকাল, পাত্র ভুলে বসেছে। ওর মাথায়ই নেই এখানে ওর শ্বশুর দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ কুরাইশি কুহুর দিকে তাকিয়ে হেসে অতি সন্তর্পনে ড্রয়িংরুম ছাড়লেন।
তবে যেতে যেতে তিনি শুনতে পেলেন, তাহমিদ কুহুকে বাড়ি ছাড়ার কথা বলছে।
তাহমিদ রুমে এসেও শান্ত হতে পারছেনা। কুহু তাকে বিছানায় জোর করে বসিয়ে দিয়ে তার বুকে মাথা রেখেছে। তাহমিদও বাধ্য হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেছে।
” আর সময় নষ্ট করোনা। তোমার কাপড়চোপড় গুছিয়ে নাও। আমাকেও সব গোছগাছ করতে হবে। এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকবনা। যে বাড়িতে আমার স্ত্রী’র সম্মান নেই, সেই বাড়িতে আমি থাকবনা। ” তাহমিদ হাঁপাচ্ছে।
” যাবতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নিশ্চয়ই চলে যাব। কিন্তু তার আগে আপনি একটু শান্ত হোন। এমনভাবে কেউ রা’গ করে? যদি উনার কিছু হয়ে যেত, তবে আপনার কি হত, সেই সম্পর্কে কোন ধারনা আছে আপনার? আমার কি হত বলতে পারেন? ”
” তোমাকে ঐ মহিলা অপমান করবে আর আমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখব? এতটাই স্তৈন আমাকে তোমার মনে হয়? ঐ মহিলার জন্য আজ আমার এত দুর্দশা। সে বাবার জীবনে আসার পরই এই সংসারে ভাঙ্গন ধরেছে। মা আমার থেকে দূরে চলে গেছে। আজ আবার সেই মহিলাই তোমার শরীরে হাত তুলেছে, এটা আমি কেমন করে মেনে নেই! তাকে খু’ন করতে পারলে শান্তি পেতাম।”
” না, মোটেও তেমনটা করবেননা। একদিন তারা তাদের কর্মফল ভোগ করবে। আপনাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তিও পাবে। কিন্তু আপনি আর কখনোই নিজ থেকে তাদের আঘাত করবেননা। আমাকে কথা দিন? আপনি একবারও ভেবে দেখেছেন, তাদের সবকিছু আছে। কিন্তু আমার আপনি ছাড়া আর কে আছে? তাদের আঘাত করার বিনিময়ে আমি আপনাকে হারাতে চাইনা। ” কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
” বউ, তুমি কেঁদনা। আমি কথা দিলাম এরপর কাউকে আঘাত করবনা। কিন্তু কেউ যদি তোমাকে অপমান, অসম্মান করে তবে তাকে ছেড়েও কথা বলবনা। এবার উঠে সবকিছু গুছিয়ে নাও। সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে। রাতটুকু হোটেলে কাটিয়ে, কালকে ফ্ল্যাট খুঁজে বের করতে হবে যেকোন উপায়েই। ”
” সত্যিই এই বাড়ি ছাড়বেন? ”
” কেন তোমার কি এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছেনা? তুমি থাকতে চাইছ এখানে! ”
তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে কুহু ভয় পায়। তার চোখমুখ আবার র’ক্তবর্ণ ধারন করেছে।
” ন..না। আমিও এখানে থাকতে চাইনা। আমি এখনই সব গুছিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু বাসা পাওয়ার সাথে সাথে শাহানা ফুপুকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে আপনাকে। নতুন বাসায় আমি তাকে চাই। ”
” হুম। ” তাহমিদ ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে বিছানা থেকে উঠে আলমারির কাছে যায়।
গোছগাছ শেষ করে কুহু তৈরী হয়ে নেয়। ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে যাবে। তাহমিদ শেষবারের মত আলমারি, ড্রেসিংটেবিলের সব ড্রয়ার চেইক করছে। ভালোভাবে দেখে নিচ্ছে কিছু ছেড়ে রেখে যাচ্ছে কিনা। কারন ও জানে আজকের পর এই বাড়ির ছায়া ও মাড়াবেনা।দরজায় শব্দ হতেই তাহমিদ মুখ তুলে তাকায়।
” বউমা, তোমাদের সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আমি কি ভেতরে আসব? ”
রাশেদ কুরাইশির গলা পেয়ে কুহু গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
” আসুন, বাবা। ”
” তোমরা সত্যিই চলে যাচ্ছ, মা! ” রাশেদ কুরাইশি মেঝেতে কয়েকটা ব্যাগ দেখে কুহুকে প্রশ্ন করলেন।
” জ্বি, বাবা। ” কুহু ইতস্ততভাবে জবাব দেয়।
” তাহমিদ, না গেলেই কি নয়? ”
” কত বছর পর আপনি এই রুমে এসেছেন, সেটা কি আপনার মনে আছে? ” তাহমিদ বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
ছেলের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাননা রাশেদ কুরাইশি। তার শুধু মনে হয়, আসলেই তো, এই রুমে কত বছর আসিনা আমি! তার ছেলেটা সেই ছোট থেকে একা একা থেকেছে এখানে। একা একা বেড়ে উঠেছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি তিনি একটাবারের জন্যও এই রুমে আসার প্রয়োজনবোধ করেননি।
” আমারই ভুল ছিল। যা কিছু ঘটেছে, সবকিছুর জন্যই দায়ী আমি। আজ স্বীকার করতে কোন অসুবিধা নেই। তোমরা যেওনা। আম্মার মৃ’ত্যু’র পর বউমা আমার মা হয়ে এসেছে। বউমা যে কয়দিন এখানে থাকে, আমি খুব ভালো থাকি সে কয়দিন। ” রাশেদ কুরাইশির চোখে পানি।
” আপনি যে স্বার্থপর তা আরেকবার প্রমান হয়ে গেল। আমি আমার স্ত্রী’ র নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সব ছাড়তে চাইছি। আর এই মুহূর্তেও আপনি নিজের কথা চিন্তা করছেন! এত স্বার্থপর হতে পারেন কিভাবে? একটুও চক্ষু লজ্জা নেই আপনার? আপনি যেমন সারাজীবন নিজের ভালো বুঝে এসেছেন, তেমনি আমাকেও আমার ভালোটাই বুঝতে হবে। এবং আমি সেটাই করার চেষ্টা করছি। ”
” আমি হাতজোড় করছি। তোমরা যেওনা। ”
” আপনার কোন কথা রাখতে আমি বাধ্য নই। সেদিন যদি নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করতেন, তবে আজ আপনাকে হাতজোড় করতে হতোনা। যদি আমার কথা একটুও চিন্তা করতেন তবে ঐ ভদ্রমহিলার জন্য আমার মা’কে অবহেলা করতে পারতেননা। আমি অনেক আগেই এখান থেকে চলে যেতাম। শুধু দাদুকে কথা দিয়েছিলাম, যাইহোক না কেন এখানেই থেকে যাব। তাই এতদিন অনেক অপমানের পরও এখানেই ছিলাম। এমনকি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী যখন দিনের পর দিন আমাকে টর্চার করেছে তা-ও এখানেই থেকেছি। ঐ ভদ্রমহিলা যখন আমাকে মা’র’ত তখন দাদু এগিয়ে আসত আমাকে রক্ষা করতে। তখন দাদুকেও সে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করত। সেসব কি আপনারা জানা আছে? এতকিছুর পরও আমি দাদুর কথা রাখতেই নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে এখানেই থেকেছি। কিন্তু আর নয়। এবার আমার নিজের পথ খোঁজার সময় এসেছে। ”
তাহমিদ রাশেদ কুরাইশিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দুই হাতে ব্যাগ তুলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ওর ইশারা পেয়ে কুহুও রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বেড়োনোর আগে ও শ্বশুরকে সালাম দেয়।
তাহমিদ গেটে এসে কেয়ারটেকারকে বলে রুম থেকে সব ব্যাগ নিয়ে আসতে।
নিজের রুমে গিয়ে নায়লা আঞ্জুম কিছুক্ষণ থম মে’রে বসে থাকে। ম্মৃতির করা অপমান সে কিছুতেই ভুলতে পারছেনা। রায়হান আহমেদও তাকে কখনোই এভাবে বলেনি। কিংবা শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলোও ওকে কখনো কটু কথা বলেনি। অথচ সে নিজেই তাদেরকে বিভিন্নভাবে অপমান করেছে। কিন্তু তারা কখনোই নায়লা আঞ্জুমের সাথে খারাপ আচরণ করেনি। বরং সব সময়ই তাকে ভয় কিংবা সমীহা করেছে। অথচ তার আদরের ভাইয়ের সামনেই ভাইয়ের স্ত্রী এভাবে তাকে অপমান করেছে, কিন্তু তার ভাই কোনও প্রতিবাদ করলনা! কিন্তু সে তো ভাইকে সত্যিই ভালোবাসে। ছোট থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। একটামাত্র ভাই হওয়ায় ওর জন্য কি করেনি তারা তিন বোন! তবে কি তার আদরের ভাই সব ভুলে গেছে? সে কি ভুলে গেছ, সে তার তিন বোনের প্রাণ ছিল! অনেককিছুর হিসেব-নিকেশ নায়লা আঞ্জুম এক লহমায় কষল। সে আজ হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে মেয়েরা রাজকন্যা হয় তার বাবার কাছে। তার রানী হয়ে থাকে তার স্বামীর কাছে। হোকনা সেই বাবা কিংবা স্বামী গরীব, নিঃস্ব কিংবা অসহায়। তাদের ভালোবাসা থাকে অফুরন্ত। শ্বশুর বাড়িতে তাদের যতটুকু সম্মান কিংবা গুরুত্ব থাকে, সেটা ভাই কিংবা তাদের বউদের কাছে থাকেনা। নায়লা আঞ্জুম চোখের পানি মুছে জীবনের কঠিনতম এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। আজ তার কাছে স্পষ্ট কারা তাকে ভালোবাসে, সম্মান করে।
তখনও স্মৃতি ড্রয়িংরুমে চিৎকার করেই চলেছে। আজ সে তার হিতাহিতজ্ঞান হারিয়েছে। কোন কথাই তার মুখে আটকাচ্ছেনা।
” কতবড় সাহস, আমার বাবা-মা’ কে ফকিন্নি বলে! আজ মন চাচ্ছে তোমার বোনকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাসা থেকে বের করে দিই। নিজে একটা ফকিন্নি জন্য এখানে বসত গড়েছে। তার স্বামীও যে সুবিধার নয়, সেটা আমার বোঝা উচিত ছিল। সেয়ানাগিরি করেই বউকে এখানে ফেলে রেখেছে। এখন তো মনে হচ্ছে এসব তার চাল ছিল। শ্বশুরের সম্পত্তি বাগাতেই এত আয়োজন করেছে সে। নিজে কিছু না বলে বউকে দিয়ে এসব করাচ্ছে। মতলববাজ সেও কম নয়। আর তার ছেলেমেয়েদেরকেও দেখ, তারা এই বাসায় আসবে, ধেই ধেই করে নাচবে কিন্তু মা’কে সাথে নেয়ার কথা বলবেনা! ”
সৈকত আহমেদ চুপচাপ তার স্ত্রী’র কথা শুনছে। কোন উচ্চবাচ্য সে করছেনা।
রায়হান আহমেদ কেবলই তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে গাড়ি থেকে নেমেছেন। ঠিক তখনই বাসার এক মেইডের সাথে দেখা হয়। রায়হান আহমেদ তাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলে, সে কথার ফাঁকেই সকালের ঘটনা তার কাছে প্রকাশ করে। কারন আজ স্মৃতির কথাগুলো তারমত বাড়ির অন্য মেইডদেরও খারাপ লেগেছ। তারা নায়লাকে নিয়ে এসব কথায় অভ্যস্ত। কিন্তু আজ স্মৃতি নায়লার সাথে সাথে তার স্বামী-সন্তানদের নিয়েও বলেছে, যেটা কারও ভালো লাগেনি। তার মুখে সব শুনে রায়হান আহমেদের মুখটা ছোট হয়ে যায়। রিশা, নিশোরও চোখে পানি এসেছে। হাজার খারাপ হলেও নায়লা আঞ্জুম তাদের মা। আর বাবা-মা’য়ের অপমান কোন সন্তানই সহ্য করতে পারেনা।
কুহু সৃজনকে নিয়ে গেইট পাড় হতেই বাগানে চাচাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ও লক্ষ্য করল রিশা বারবার চোখ মুছছে। কুহু দ্রুত পা চালিয়ে রিশার কাছে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? কিন্তু রিশা কোন জবাব দেয়না। তখন সেই মেইড কুহুকে একে একে সব কথা বলল। সবটা শুনে কুহুর মনও খারাপ হয়ে যায়। ও রায়হান আজাদ দিকে তাকাতেই দেখল ওর চাচারও চোখে পানি। এই মুহুর্তে ওর কি করা উচিত তা বুঝতে পারছেনা।
রায়হান আহমেদ নিজেকে ধাতস্থ করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলেন। অগত্যা কুহুও সৃজনকে নিয়ে তাদের পিছু নেয়।
অন্যদিনের মত আজ কেউই এই বাসায় হৈহল্লা করলনা। সবাই কেমন চুপচাপ আছে। রায়হান আহমেদ স্মৃতি আর সৈকতের সাথে কথা বলে শ্বাশুড়ির কাছে গেলেন। কুহু, সৃজন আর রিশা নিশোও তাই করল।
নায়লা আঞ্জুম স্বামী-সন্তানদের দেখে হাঁফ ছাড়ল। সে তার রুম থেকে বেরিয়ে তার মা’য়ের কাছে যায়। সেখানে সবাই বসে ছিল। নায়লা আঞ্জুম কারও দিকে না তাকিয়ে মা’য়ের পাশে গিয়ে বসে। মা’য়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গালে ঠেকায়। সেভাবেই কিছুক্ষণ বসে থাকে।
নায়লা আঞ্জুমকে রুমে আসতে দেখে রায়হান আহমেদ সেখান থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলেন।
” আম্মা, আমি আজ এই বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। এখানে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। হয়তো কোনদিন আমার কোন প্রয়োজন ছিলইনা। আমিই শুধু মিছেমিছি সবকিছু আঁকড়ে ধরে ছিলাম। ঘুনাক্ষরেও বুঝিনি, আমি কারও প্রিয়জন নই। স্বামীর সবকিছু থাকা স্বত্বেও এখানে থেকেছি। ছোটবেলা থেকেই আব্বার ন্যাওটা ছিলাম। এই বাড়িকে হৃদয়ের একটা অংশ বলে মনে করেছি। তাই বিয়ের পরও শ্বশুর বাড়ি যাইনি। এমনকি স্বামীকেও এখানে এসে থাকতে বাধ্য করেছি। এত বছর যে এখানে আছি, আমরা কিন্তু নিজেদেরটাই খেয়েছি। এটা তুমি ভালো করেই জান। সৈকতের কত শখ তোমার জামাই পূরণ করেছে, সেটা আর কেউ না জানুক আমি জানি। প্রতিমাসেই সৈকতের হাতে নির্দিষ্ট একটা এ্যামাউন্ট দিত রায়হান। ওকে নিজের খরচে বিদেশে ঘুরতে পাঠিয়েছে। আজ যখন স্মৃতি আমাকে কথা শোনাচ্ছিল, সেই সৈকতও চুপচাপ ওর বউয়ের কথা শুনছিল। আজ স্মৃতির আমাকে বলা কথা শুনে যতটানা কষ্ট পেয়েছি, তার থেকেও বেশি কষ্ট হয়েছে রায়হানের নামে কথাগুলো বলায়। আমি একজন স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে, পূত্রবধূ হিসেবে খারাপ হতে পারি। কিন্তু আমার স্বামীকে ঠিকই ভালোবাসি। তাই স্বামীকে অপমানিত হওয়ার আর কোন সুযোগই দিতে চাইনা। ”
মেয়ের কথাগুলো শুনে ফাতিমা খানম কেঁদে উঠলেন। সন্তান যতই অন্যায় করুক, বাবা-মা তাদের ওপর সাময়িক অভিমান করে থাকে ঠিকই। কিন্তু তাকে একেবারে দূরে ঠেলে দেয়না।
ফাতিমা খানমের চোখ বেয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরতে থাকে। নায়লা আঞ্জুম মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। এরপর আবারও বলতে থাকে।
” আম্মা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি মাঝেমধ্যে এসে তোমাকে দেখে যাব। তবে আগামী চার-পাঁচ দিন তোমার কাছে আসতে পারবনা। আমাকে আরও কয়েকজনের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এই কয়দিন আমি নিজেকে শুদ্ধ করতে চেষ্টা করব। তারপর এসে তোমাকে দেখে যাব। তোমার পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়ে আসব। ”
আরও কিছুক্ষণ মা’য়ের সাথে কাটিয়ে নায়লা আঞ্জুম রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
রায়হান আহমেদের মুখে আজ কোন কথা নেই। রিশা, নিশোও চুপচাপ বসে আছে।
রাজিয়া খালা করুণ চোখে তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে। আজ স্মৃতির কথায় তিনিও কষ্ট পেয়েছেন। এই বাসায় এত বছর থাকার সুবাদে তিনি জানেন, রায়হান আহমেদ কি কি করেছেন এদের জন্য। আজ স্মৃতি তাকেও ছাড়লনা।
কুহু এক পা দু পা করে খালার কাছে যায়। খালা ওকে দেখে হাসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার মুখে হাসি ফুটলনা।
” খালা, আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। চাচার মুখের দিকে তাকাতে পারছিনা। রিশা কাঁদছে। আজ এই মুহুর্তে উনার অভাববোধ করছি। ”
” এত চিন্তা কইরোনা গো, মা। আল্লাহ সব ঠিক কইরা দিবেন। তুমি গিয়া রায়হান ভাইয়ের কাছে বস। তার সাথে গল্প কর। দেখবা তার মন ভালো হইয়া যাব। এইবার বাপজান আসলে আমি তারে সব কমুনে। যা করার সেই করব। ”
কুহু কিছু বলতে গেলেই কলিং বেল বেজে উঠল। একজন মেইড গিয়ে দরজা খুলে দিলে অচেনা কয়েকজন প্রবেশ করল বাসায়। তাদেরকে দেখে স্মৃতি হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায়। কুহু বুঝল এরাই আজকের মেহমান।
স্মৃতি রায়হান আহমেদের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারা কিছুক্ষণ ড্রয়িংরুমে বসে রায়হান আহমেদের সঙ্গে কথা বলে। এরপর স্মৃতি সবাইকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
সৈকত আহমেদ রায়হান আহমেদের সাথে টুকটাক কথা বলছে। রায়হান আহমেদ শুধু চুপচাপ শুনে যাচ্ছেন। কিছু বলছেননা।
নায়লা আঞ্জুমকে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে রায়হান আহমেদ সেদিকে তাকালেন। নায়লা আঞ্জুমের হাতে বড় ব্যাগ দেখে তিনি কপাল কুঁচকালেন।
” এভাবে কি দেখছ! বাসায় যাবেনা? অনেকক্ষণ হয় এখানে এসেছ, এবারতো যেতে হবে নাকি? ” নায়লা আঞ্জুম এগিয়ে এসে রায়হান আহমেদেকে বলল।
” এসব কি বলছ, ছোট আপা? এখন দুলাভাই কোথায় যাবে! আর তুমিইবা কোথায় যাচ্ছ? দুলাভাই, রিশা, নিশো এখন পর্যন্ত কিছুই মুখে দেয়নি। ”
” আমরা নিজের বাসায় যাব। আমার মনে হয় ওরা সকালে খেয়েই এসেছে। আমাদের জন্য তোমার এত চিন্তা করতে হবেনা। বাসায় গিয়ে আমি রান্না করব। তুমি পারলে তোমার স্ত্রীকে একটু ডেকে দাও। ওর কাছ থেকে বিদায় নেই। রাজিয়া আপা, আমি চলে যাচ্ছি বুঝলে? তুমি আম্মাকে দেখে রেখ। আর মাঝেমধ্যে আমার বাসায় গিয়ে বেরিয়ে এস। ”
নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে রায়হান আহমেদের বিস্ময়ের সীমা রইলনা। তিনি তার স্ত্রীকে দেখছেন, কত নির্বিকার সে কথাগুলো বলল!
” কি কও, নায়লা! তুমি এখনই যাইবা? রান্না শেষ, খাইয়া তারপর যাও। বাচ্চাদের পছন্দের খাবার রানছি। ”
” আপা, আমার ছেলেমেয়েরা বাবার বাড়িতে তাদের পছন্দের খাবারই খায়। আজ ওদের না খেলেও চলবে। তবে তোমার যদি ওদের খাওয়ানোর একান্তই ইচ্ছে হয়, তবে তুমি আমার বাসায় গিয়ে ওদের পছন্দের খাবার রান্না করে দিও। তুমি এক কাজ কর স্মৃতিকে ডেকে নিয়ে আস। আর রুমে আমার আরও তিনটা ব্যাগ আছে, সেগুলো কাউকে বের করে আমাদের গাড়িতে রাখতে বল। ”
রাজিয়া খালা বুঝলেন আজ নায়লা আঞ্জুম কোন কথাই শুনবেননা। তিনি নায়লার সিদ্ধান্তে মন থেকে খুশি হলেন। হাসিমুখে ডাকতে গেলেন স্মৃতিকে।
কুহু এতক্ষণ সব শুনছিল। চাচির সিদ্ধান্তে সে-ও খুশি হয়।
” কুহু, তুমিও চল আমাদের সাথে। আজ না-হয় চাচার বাড়িতে গিয়ে চাচির হাতের রান্নাই খাবে। যদিও তোমার রাজিয়া খালার মত এত ভালো রান্না আমি করিনা। তবে চলার মত করতে পারব। আর দেরি করোনা, চলে এস। রিশা, নিশো তোমার মামার কাছে বিদায় নাও। ”
স্মৃতি ড্রয়িংরুমে আসলে নায়লা তার দিকে তাকিয়ে হাসল।
” আমরা চলে যাচ্ছি। তবে মাঝেমধ্যে আম্মাকে দেখতে আসব। এবং তখন বেলকনির দরজা দিয়ে আম্মার কাছে আসব। আম্মা যে কয়দিন বেঁচে আছে সে কয়দিন আমাকে আসতেই হবে। তবে তখন এই ড্রয়িংরুমে আমাদের পা পরবেনা। আশা করব আম্মার কোন অযত্ন হবেনা। আর সৈকত, এই যে আম্মার ব্যাংকের পেপারস। এখানে আমি নমিনি আছি। আব্বা আম্মাকে ত্রিশ লক্ষ টাকা দিয়েছিল, তার সব টাকাই এখনও আছে। আম্মার চিকিৎসায় সেসব টাকা খরচ করিনি। মানে আমার মতলববাজ স্বামী খরচ করতে দেয়নি। আম্মার চিকিৎসার সব খরচ সে-ই বহন করেছে। সৈকত, তুমি সময় করে একদিন ব্যাংকে যেও, আমি তোমাকে নমিনি করতে পারি কিনা দেখব। ”
” ছোট আপা, তুমি আমাকে তুমি করে বলছ কেন? তুমি না আমাকে তুই বলতে! আর নমিনি তুমিই থাক, আমার এসবের দরকার নেই। আব্বা আমাকে যথেষ্ট দিয়ে গেছে। ”
” তুই তাকেই বলা যায়, যে আপন হয়। যখন তোমার পেছনে রায়হান আহমেদ লাখ লাখ টাকা খরচ করেছে, তখন আমি আপন ছিলাম। আমার এখন একটাই কাজ আম্মার টাকার নমিনি পাল্টানো। সে তুমি চাও বা না চাও। ”
নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে সৈকত আহমেদ মাথা নিচু করল।
” কুহু, সৃজন তোমরা চল। রিশা নিশো তোমরাও সবার কাছ থেকে বিদাও নাও। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। রায়হান এবার যেতে হবে। ”
রায়হান আহমেদ স্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আজকে তার সামনে অন্যরকম এক নায়লা দাঁড়িয়ে আছে।
কুহু চাচির কথা অমান্য করলনা। কারন এটাই ওর কাছে ঠিক মনে হয়েছে। এই বাড়ির মেয়েই তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে, তার কাছে যাওয়াই উচিত, এটা কুহু মনে করছে। এই বাড়ির সাথে কুহুর থেকে নায়লা আঞ্জুমের সম্পর্কই ঘনিষ্ঠ।
একে একে সবাই বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল।
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪৪
জাওয়াদ জামী জামী
নায়লা আঞ্জুম বাসায় ঢুকেই রান্নার জোগাড় করতে শুরু করল। কুহুও তার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সাহায্য করল। এরপর রান্না শেষ হলে সবাইকে খেতে ডাকল।
কুহুরা সেদিন বাসায় ফিরতে চাইলেও নায়লা আঞ্জুম ওদের যেতে দিলনা। রাতটুকু সেখানে কাটিয়ে পরদিন সকালে নাস্তা করেই তবে ওদের ছেড়ে দেয় নায়লা আঞ্জুম।
নায়লা আঞ্জুমের এমন পরিবর্তনে সবাই খুশি হয়। কুহু তাহমিদকে ফোনে সবটা জানালে সে-ও ভিষণ অবাক হয়। সেই সাথে খুশিও হয়।
প্রতি বৃহস্পতিবার তাহমিদ রাজশাহী আসে। আজও সে রাজশাহী আসবে। কুহু তাহমিদের পছন্দের খাবার রান্না করেছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সে কখন আসবে।
” আমার বউকে দেখছি আগের থেকেও বেশি এট্রাকটিভ লাগছে! ঘটনা কি? তাহমিদের অপেক্ষাই কি তাকে এমন আকর্ষনিয় করে তুলেছে? মন্দ নয়। এমন বউ ক’জনের ভাগ্যে জোটে! ”
কুহু দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেছে। কোন সম্ভাষণে না যেয়েই সে এমন উদ্ভট কথা বলতে শুরু করেছে!
” ছিহ্ এসব কি কথা! ভেতরে আসুন। আপনার দেখছি আক্কেল জ্ঞান কিছুই নেই। আশেপাশে কতজন যাতায়াত করছে। তারা যদি এসব কথা শোনে, তবে কি ভাববে বলুনতো? ” কুহু তাহমিদের হাত ধরে টেনে বাসায় ঢোকায়।
” যার ইচ্ছে হয় সে শুনুক। আমি আমার বউয়ের সাথে কথা বলছি। পাশের বাড়ির ভাবির সাথে ফ্লার্ট করছিনা। যদিও পাশের বাড়ির ভাবিদের বিষয়টাই আলাদা। তাদের সাথে কথা বলে আলাদা আনন্দ পাওয়া যায়। ”
” কিহ্! আপনার দেখছি চরিত্র বলে কিছুই নেই। অথচ সবার সামনে কেমন ফেরেশতা সেজে থাকেন! ” কুহু গাল ফুলিয়ে রুমে যেতে চাইতেই তাহমিদ ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।
” সুন্দরী এভাবে দূরে যেওনা। শেষে দেখবে তোমার বিরহে পাশের বাড়ির ভাবিদের কাছেই আশ্রয় নিয়েছি। বিষয়টা কি খুব ভালো হবে? তোমার একটামাত্র জামাই থাকবে তোমার বাহুডোরে। কিন্তু তুমি সেই চেষ্টা না করে তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ! নিষ্ঠুর রমনী। ” কথা বলতে বলতেই তাহমিদ টুপ করে কুহুর গালে চুমু দেয়।
” আপনি দেখছি দিনকে দিন চরম নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছেন! বাসায় সৃজন আছে। ও যদি এভাবে আমাদের দেখে তাহলে কি ভাববে? ”
তাহমিদ কুহুর কথা পাত্তা না দিয়ে ওকে পরপর কয়েকটা চুমু দেয়।
” শালাবাবু, কোথায় তুমি? নতুন বউয়ের মত রুমে মুখ লুকিয়ে বসে আছ কেন! বিয়ে করার শখ জেগেছে নাকি? তাহলে সরাসরি আমাকে বলতে পার। ”
তাহমিদের কথা শুনে রুম থেকে বেরিয়ে আসে সৃজন।
” ভাইয়া, এসব কি বলছ তুমি? আমি ছোট বাচ্চাই আছি। বিয়ে করতে এখনও অনেক দেরি আছে। ”
সৃজনের কথা শুনে তাহমিদ হা হা করে হেসে উঠল।
শুক্রবার সকালে নায়লা আঞ্জুমের ফোন পেয়ে তাহমিদ অবাকই হয়। আরও বেশি অবাক হয়, যখন শুনল ছোট খালামনি ওদের দাওয়াত দিচ্ছে।
সেদিন সকালেই তাহমিদ কুহু আর সৃজনকে নিয়ে রায়হান আহমেদের বাসায় যায়। নায়লা আঞ্জুমের অনুরোধে সেখানে সারাদিন কাটিয়ে রাতে বাসায় ফিরে। তবে বিকেলে তাহমিদ সবাইকে নিয়ে নানিমাকে দেখতে যায়।
নায়লা আঞ্জুম তার কথা রেখেছে। সে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেলকনির দরজা দিয়ে মা’য়ের কাছে যায়।
তাহমিদ কুহুকে নিয়ে সরাসরি বাসায় গিয়ে মামির সাথে কথা বলে। এরপর সে নানিমার কাছে যায়।
স্মৃতি শ্বাশুড়ির রুমে গিয়ে নায়লা আঞ্জুমকে বাসার ভেতরে যেতে বললে, নায়লা আঞ্জুম রাজি হয়না। সে অনেকক্ষণ মা’য়ের পাশে বসে থাকে। এরপর তাহমিদকে নিয়ে বেরিয়ে যায় নিজের বাসার উদ্দেশ্যে।
দুইদিন পর তাহমিদ কুহুকে নিয়ে ঢাকায় ফিরল। এবার সে কুহুকে ঢাকায় নিতে চায়নি। কিন্তু রাশেদ কুরাইশি বারবার কুহুকে নিয়ে যেতে বলেছেন। বাবার কথা ফেলতে পারেনি তাহমিদ। তাই সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কুহুকে নিয়ে ঢাকায় যায়। এবার ওরা সৃজনকে রায়হান আহমেদের বাসায় রেখে এসেছে।
প্রতিবারের মত এবারও কেউ এই বাসায় কুহুকে মন থেকে গ্রহন করলনা। ডেইজি কুরাইশি এবারও কুহুকে দেখে মুখ কালো করল। তাতে অবশ্য কুহুর কিছুই যায় আসেনা। কারন এই ছয়মাসে ও ভালো করেই বুঝে গেছে ঐ মহিলা বদলানোর নয়। তাই কুহু মনে মনে তাকে গুরুত্ব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাশেদ কুরাইশি বাসায় এসে কুহুকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে গেলেন। কুহুকে জড়িয়ে ধরলেন পরম মমতায়।
” এতদিন পর তুমি আসলে, বউমা? গত একমাস আমার কথা তোমার মনে হয়নি? একবারও মনে হয়নি তোমার এক বাবা তার মেয়ের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে? ” রাশেদ কুরাইশির হৃদয় নিংড়ান কথা শুনে কুহু আপ্লুত হয়ে গেছে। এই বয়োবৃদ্ধ যে তাকে মন থেকে ভালোবাসে এটা কুহু এই বাসায় আসার পরই বুঝতে পেরেছে।
আজ আরও একবার তার কথা শুনে কুহুর মনে একটা কথাই গেঁথে যায়, এক বাবাকে হারিয়ে ও আরেক বাবাকে পেয়েছে। যে বাবা ওকে মেয়ের মত আগলে রাখতে চান সর্বদাই।
” আপনাকে ভোলার মত দুঃসাহস আমার নেই, বাবা। আমি প্রতি সপ্তাহেই এখানে আসতে চাই। কিন্তু আপনার ছেলে আমাকে নিয়ে আসতে চায়না। ” মুখ ফসকে কুহু সত্যি কথাই বলল।
” তুমি ওর কোনও বারণ শুনবেনা। ও তো চাইবেই তোমাকে এই বাড়ি থেকে দূরে রাখতে। কিন্তু এটা হতে দেয়া যাবেনা। তোমার যখন ঢাকা আসতে ইচ্ছে করবে, তখন শুধু আমাকে একবার জানাবে। তোমার এখানে ব্যবস্থা আমি করব। মনে থাকবে? ”
শ্বশুরের কথায় কুহু হেসে মাথা নাড়ায়।
ডেইজি কুরাইশি রাশেদ কুরাইশির এমন আদিখ্যেতা কিছুতেই মানতে পারছেনা। সে এই বাড়িতে নিজের আধিপত্য ব্যতিত আর কারও আধিপত্য মানতে নারাজ। কিন্তু দিনকে দিন কুহুকে এই বাড়িতে জেঁকে বসতে দেখে সে একটু ভয়ই পায়। শুধু বারেবার মনে হতে থাকে, এই বুঝি তার রাজত্ব শেষ হতে চলল। সে নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়া করে মনে মনে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। আর যাইহোক, এই বাড়ির রাশ তাকেই ধরে রাখতে হবে। সেই সাথে রাশেদ কুরাইশির লাগামও একটু টেনে ধরতে হবে। তাকে হাত ফসকে বেড়োতে দেয়া ঠিক হবেনা।
পরদিন সকালে তাহমিদ ভার্সিটিতে গেলে কুহু রান্নাঘরে এসে রুনু নামক এক মেইডকে সাথে নিয়ে দুপুরের খাবার প্রস্তুত করছে। রান্নাঘরে আরও দুইজন মেইড এটাসেটা করছে। শাহানা আক্তার তার এক বোনের বাসায় গেছেন। তাই কুহু আজ নিজের ইচ্ছেতেই খাবার তৈরী করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারন ও জানে ডেইজি কুরাইশি ওকে কখনোই বলবেনা, কি রান্না করতে হবে।
” রুনু, আজ দুপুরে কি রান্না হবে সেটা কি জানিস? ” হঠাৎই ডেইজি কুরাইশি রান্নাঘরে এসে রুনুকে জিজ্ঞেস করল।
” আজকে স্যারের পছন্দের খাবার রান্না করতে চাচ্ছে ভাবী। আপনি কি খাবেন বলুন, ম্যাম। আমি সেগুলো তৈরী করব। ” রুনু মৃদুস্বরে বলল।
” আমার ছেলেমেয়েও তো এই বাসায় থাকে নাকি? তারা কি না খেয়ে থাকবে! নাকি নিজ বাড়িতেই তারা পরবাসী জীবন কাটাচ্ছে? তাদের কি পছন্দের খাবার খেতে ইচ্ছে করেনা। শোন রুনু, তোর স্যারের পাশাপাশি আমার রায়ান, জাহিয়ার জন্যও ওদের পছন্দের খাবার বানাবি। আর সবাই ভুলে গেলেও তুই মনে রাখিস ওরা রাশেদ কুরাইশির সন্তান। এই বাড়িতে ওদের পছন্দের খাবার প্রয়োজনে এক হাজারবার রান্না করবি তোরা। অন্য কারও কথায় প্রাধান্য দিয়ে আমার ছেলেমেয়েকে কখনোই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবিনা। মনে রাখবি তারাই রাশেদ কুরাইশির যোগ্য সন্তান। অন্য কেউ এখন পর্যন্ত রাশেদ কুরাইশির কাছে পাত্তা পায়নি। যতটা গুরুত্ব সে রায়ান জাহিয়াকে দিয়েছে। ”
” জ্বি ম্যাম, মনে থাকবে। রায়ান স্যার, জাহিয়া ম্যামের জন্য তাদের পছন্দের ডিস তৈরী করে ফেলব। আপনি কি খাবেন? ”
” আমার জন্য ফ্রুট স্যালাড আর মিক্সড ভেজিটেবল করবি। ”
ডেইজি কুরাইশি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলে কুহু হাঁফ ছাড়ল। ও স্পস্টই বুঝতে পারছে ডেইজি কুরাইশি কথাগুলো ওকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে। এই ভদ্রমহিলাকে সে এজন্যই ভয় পায়। সে যে কাউকে আঘাত দিতে সিদ্ধহস্ত। তার চালচলন, কথায় বড়লোকিভাব স্পষ্ট। যা সহজেই যে কারও নজরে পরে যায়। সে নিজেকে জাহির করার কোনও সুযোগই ছাড়তে চায়না। সুযোগ পেলেই যে কাউকে হেয় করতে পিছপা হয়না।
রাত বারোটা পঁচিশ। তাহমিদ তখনও কুহুকে নিয়ে বেলকনিতে বসে আছে। কুহু তাহমিদের কোলে বসে বুকে মাথা রেখেছে। ও মনযোগ দিয়ে তাহমিদের প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ শুনছে। তাহমিদের বুকের প্রতিটি স্পন্দন ওর শরীরে শিহরণ জাগাচ্ছে। নির্দিষ্ট তালে অনবরত বেজেই চলেছে তারা। হৃৎস্পন্দনের সাথে সাথে তাহমিদের বুকের ওঠানামা গভীরভাবে অনুভব করছে কুহু।
” বউ, এভাবেই বেলকনিতে রাত পার করার চিন্তা করছ নাকি। আমার কিন্তু তেমন ইচ্ছে মোটেও নেই। বউয়ের বুকে মাথা না রাখলে আমার ঘুম আসেনা সেটা আগেই বলে রাখছি। ” তাহমিদ ঘোর লাগা গলায় বলল।
” এত বছরও কি বউয়ের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়েছেন! তা আপনার সে বউটি কোথায়? ” তাহমিদের কথার প্রত্তুত্যরে কুহু দুষ্টুমি করে বলল।
” কে বলেছে আমি এত বছর ঘুমিয়ে রাত পার করেছি? সারারাত নিজের জীবনের হিসাবনিকাশ মিলানোর চেষ্টা করেছি। ফজরের নামাজের পর কিছুক্ষণ ঘুমাতাম। যেহেতু রাতে ঘুমাইনি, সেহেতু তখন ঘুমানোর জন্য বউয়ের বুকের প্রয়োজন পরেনি। এখন এত বছর পর যখন একটা বউ পেয়েছি, তখন তার বুকে ঘুমানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে আমি রাজি নই। ”
কুহু মুখ তুলে তাহমিদের দিকে চাইল। ছেলেটা ওর দিকেই নোশাক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের তারায় ভালোবাসার হাতছানি। কুহ বুঝতে পারছে তাহমিদের এই ভালোবাসায় সাড়া না দিয়ে কোন উপায় নেই
পরদিন সকালে তাহমিদ ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। কুহুকে গতরাতের মত আজ সকালেও রাশেদ কুরাইশির সাথে নাস্তা করতে হয়। ডেইজি কুরাইশিকে সকাল থেকে কুহু ড্রয়িংরুমের আশেপাশে দেখতে পায়না।
নাস্তা শেষে রাশেদ কুরাইশি কিছুক্ষণ কুহুর সাথে গল্প করে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান।
” বউমা, আসব? ” কুহু রুমে বসে তাহমিদের বুকশেলফ থেকে মাইকেল কলেনির একটা বই নিয়ে পড়ছিল। ওর ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার নেশা। বাবা মাঝেমধ্যেই ওকে নানান জনরার বই কিনে দিত। কুহুও সেসব বই উৎফুল্ল হয়ে পড়ত। পড়ার মাঝেই শাহানা আক্তারের আওয়াজ পেয়ে কুহু বই বন্ধ করে।
” ফুপু, ভেতরে আসুন। ”
” কি করছিলে, বউমা? বিরক্ত করলাম নাতো? ”
” একা একা সময় কাটছিলনা, ফুপু। আপনি এসে ভালোই করেছেন। এবার আপনার সাথে মন খুলে গল্প করব। ”
কুহুর কথা শুনে শাহানা আক্তার হেসে কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
” শ্বশুর বাড়ি কেমন লাগছে, বউমা? ”
শাহানা আক্তারের এমন প্রশ্নে কুহু একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
” এখনো বুঝতে পারছিনা, ফুপু। শুধু আমার ভালো লাগায় কিছুই হবেনা। একটা বাড়িতে বসবাস করতে গেলে, সেই বাড়ির প্রত্যেকেরই সহযোগিতামূলক মনোভাব ভিষণ জরুরি। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি বাবা আর আপনি আমাকে মন থেকে গ্রহন করেছেন। কিন্তু এটা ভালো না মন্দ সেটা এখনও বোধগম্য হচ্ছেনা। ” কুহু মৃদু গলায় বলল।
” ভালো না মন্দ, একথা বলছ কেন, মা! ”
” গতরাত থেকে আমার শ্বাশুড়িকে একবারও দেখলামনা। বাবার আমাকে মেনে নেয়ার বিষয়টি তিনি হয়তো ভালোভাবে নেননি। এর প্রভাব যদি বাবার ওপর পরে, তবে বিষয়টা কি মন্দ নয়? আবার হয়তোবা আপনাকেও এর মাশুল দিতে হতে পারে। গতকাল আমার শ্বাশুড়িকে যতটুকু দেখেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে তিনি প্রতিশোধপরায়ন। আমার ভয়টা এখানেই। ”
” বাব্বাহ্ আমার বউমা দেখছি ভিষণই বুদ্ধিমতি! সে এক বেলাতেই সবকিছু বুঝে গেছে। আমার ছেলেটা তাহলে মানুষ বাছতে ভুল করেনি। তবে শোন মা, প্রত্যেক পরিবারেই কোননা কোন সমস্যা, ঝামেলা থাকবেই। তার ভেতরেই নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। এবং সুযোগ পেলেই পুরোনো নিয়মকানুন কিংবা পুরোনো মন মানসিকতা একটু একটু করে বদলাতে হয়। আর রইল রা’গ, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিশোধ, অভিমান সেগুলোও সংসার জীবনে থাকবেই। বুদ্ধিমানরা এগুলো নিয়ে উচ্চবাচ্য না করে চোখকান খোলা রেখে এগুলোর মোকাবিলা করে। প্রথম প্রথম অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা, আঘাত, প্রতিরোধ অনেককিছুই আসবে। কিন্তু সব পরিস্থিতিতেই মানুষকে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হয়। এক সময় দেখবে এসব কোন কিছুরই আর অস্তিত্ব থাকেনা। তখন সংসার জীবন হয়ে ওঠে এক টুকরো স্বর্গ। ”
” আপনার কথার অর্থ আমি বুঝতে পেরেছি, ফুপু। আপনার আজকের কথাগুলো আমার আজীবন মনে থাকবে। ”
” নতুন বউকে দেখে আমি কি দিই বলতো? তোমার ফুপু শ্বাশুড়ি একজন আশ্রিতা। তোমাকে কিছু দিলে সেটা তাহমিদ কিংবা রাশেদের টাকায়ই দেয়া হবে। ”
” কিছুই দিতে হবেনা, ফুপু। শুধু আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ”
” কিছু দেবনা মানে! আমার আব্বার বউকে আমি কিছু না দিয়ে পারি? টাকা নেই তো কি হয়েছে এই আংটিতো আছে। এটা আমার মায়ের দেয়া। তাই এক মায়ের দেয়া জিনিস আরেক মা’কে তো দিতেই পারি। ” শাহানা আক্তার কথার মাঝখানেই কুহুর আঙুলে একটা আংটি পরিয়ে দিলেন। আচমকা এমন কাজ করায় কুহু বাঁধা দেয়ার কোনও সুযোগই পায়না।
” ফুপু, এটা কি করছেন! আপনার মা’য়ের স্মৃতি এভাবে নষ্ট করবেননা।”
” নষ্ট কাকে বলছ শুনি? বললামইতো এক মা’য়ের জিনিস আরেক মা’কে দিলাম। এটা নিয়ে আর কোন কথাই হবেনা। তুমি শুধু এটাকে আগলে রেখ। আমার শূন্য জীবনে মা’য়ের এই শেষ স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরেই বেঁচে ছিলাম। ”
কুহু কোন কিছু না বলে শুধু শাহানা আক্তারের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।
” জানো বউমা, এক সময় আমার সব ছিল। বাবার বাড়িতে রাজকন্যার ন্যায় বড় হয়েছি। এস এস সি পাশ করার পর আব্বা ভালো পরিবারে বিয়ে দেয়। সেখানেও সুখের কমতি ছিলনা। বিয়েতে আব্বা দু হাত ভরে জিনিসপত্র দিয়েছিল। কত যে গহনা ছিল তা আমিই জানতামনা। সব শ্বাশুড়ির তত্বাবধানে থাকত।তাতে আমার কোন আপত্তিই ছিলনা। দুই বছর পর ছেলের মা হলাম। ছেলের বয়স যখন দেড়মাস, তখন একদিন জানতে পারলাম আমার স্বামী অন্য কারও প্রেমে মজেছে। খুব কান্নাকাটি করেছি। শ্বশুর শ্বাশুড়ির পায়ে পরেছি তাদের ছেলেকে যেন বোঝায়। স্বামীর পায়ে পরেছি, যেন সেই মেয়েকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু তারা কেউই আমার কথা শোনেনি। পরে জেনেছিলাম, সেই মেয়ে নাকি অনেক ধনী পরিবারের। আমার আব্বার থেকেও চারগুণ বেশি ধনী। তাই আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি ছেলেকে কিছুই বলেনি। বরং উস্কে দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে। এক সময় আমার ওপর শুরু হলো অত্যাচার। কত মা’র খেয়েছি জানো? দিনের পর দিন খেতে দেয়নি। যখন আব্বার কানে এসব কথা গেল, আব্বা আমার কাছে ছুটে যায়। আব্বাকেও সে কি অপমান। আমি সেই দিনটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারিনা। আব্বার অপরাধ ছিল, আমার শ্বশুরের কাছে তার ছেলের নামে বিচার দেয়ার। আব্বা সব অপমান হজম করে আমাকে তার সাথে নিতে চাইলে, আমি মানা করে দিলাম। আমার অসহায় আব্বা সেই অপমান সইতে পারলনা। তিনদিন পর আমার চিন্তায়, নিজের অপমানের জ্বা’লা’য় স্ট্রোক করল। দুইদিন পরেই সে আমাদের ছেড়ে চলে যায়। এভাবেই চলতে থাকে। দুই বছর পর আমার স্বামী সেই মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসল। সেদিনই জানতে পারলাম সে দেড় বছর আগেই বিয়ে করেছিল। সেদিন অনেক কাঁদলাম, অশান্তি করলাম। কিন্তু কোন ফলই পেলামনা। ঐ বাড়িতে কাজের মেয়ের মত পরে রইলাম। হঠাৎ করেই একদিন ছেলেটার অসুখ করল। সে কি অসুখ! জ্বর ছাড়েনা কিছুতেই। পরপর তিন দিন জ্বর রইল। ওদেরকে অনেক অনুরোধ করলাম ছেলেটার চিকিৎসা করাতে। কিন্তু কেউই আমার কথা আমলে নিলনা। বাধ্য হয়ে শ্বাশুড়ির কাছে আমার আব্বার দেয়া গহনা চাইলাম। সেগুলো বিক্রি করে আমার খোকনের চিকিৎসা করাব। কিন্তু শ্বাশুড়ি অস্বীকার করল, সে বলল, আমার আব্বা আমাকে কোন গহনাই দেয়নি৷ আমি যেন অকুল পাথারে হাবুডুবু খেতে থাকলাম। গলার চেইন, আর কানের দুল বেঁচে খোকনের চিকিৎসা করলাম। কিন্তু পনের দিন পর খোকনও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। রা’গে, দুঃখে, ক্ষোভে ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাবার বাড়িতে যেতেই আমাকে দেখে ভাই-ভাবী মুখ বেজার করল। ততদিনে মা-ও আর বেঁচে নেই। শুরু হল আমার আশ্রিতার জীবন। আজ এখানে তো কাল ওখানে। অবশ্য তাহমিদ চায়, আমি যেন এখানেই থাকি। কিন্তু আমি কেমন করে থাকি বল। যার নিজের ভাইয়েরাই দ্বায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চায়, সেখানে ফুপাত ভাইয়ের বাড়িতে থাকা কি বেমানান নয়? ” শাহানা আক্তার অঝোরে কাঁদছেন। কুহুও কাঁদছে তার কথা শুনে। শাহানা আক্তারের কষ্টের কাছে নিজের কষ্টকে নেহাৎই শিশু মনে হচ্ছে। একেক মানুষের একেক কষ্ট। আজ কুহু উপলব্ধি করল, দুনিয়ায় কেউই সুখী নয়। কেউই পরিপূর্ণ নয়। একই দুঃখ বিভিন্নভাবে মানুষের মাঝে ফিরে আসে। পৃথিবীর বুকে দুঃখ নামক একটা জিনিসই হাজারো রূপে বিরাজমান।
কুহু কান্না থামিয়ে শাহানা আক্তারের চোখের পানি মুছে দেয়।
” ফুপু, কে বলেছে আপনার খোকন নেই! যাকে আপনি আব্বা বলে ডাকেন, সে-ই আপনার খোকন। আপনি এরপর থেকে কোথাও যাবেননা। আপনার আব্বার কাছেই থাকবেন। আপনার সব দায়-দায়িত্ব এখন থেকে তার। ”
শাহানা আক্তার কুহুর কথার কোনও উত্তরই দিতে পারলেননা। তিনি অঝোরে কাঁদতেই থাকলেন।
চলবে…
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪২
জাওয়াদ জামী জামী
ঢাকায় সাতদিন কাটিয়ে কুহু তাহমিদের সাথে রাজশাহী এসেছে। ওরা রাজশাহীতে আসার পরদিনই কুহুর বড় ফুপু গ্রামে ফিরে গেলেন।
কুহুর ক্লাস শুরু হয়েছে। ও নিয়মিত ক্লাস করছে। এবং কোচিং এ -ও ক্লাস নিচ্ছে। তবে তাহমিদের হস্তক্ষেপে ও একটা কোচিং-এ যেতে পারে। তা-ও আবার বিকেলে। সেখানে ওকে দুইটা ক্লাস নিতে হয়। তাহমিদ চায়না কুহু পড়াশোনার বাহিরে বেশি পরিশ্রম করুক। ওর একটাই চাওয়া কুহু যেন লেখাপড়া করে জীবনে বড় কিছু হতে পারে।
তাহমিদ নিয়মিত রাজশাহীতে যাতায়াত করে। যে দুইটা দিন রাজশাহীতে কাটায়, সেই দুইটা দিনই যেন কুহুর কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়। ও যেমন কুহুকে ভালোবাসায় আগলে রাখে। তেমনি সৃজনকে ছোট ভাইয়ের মতই ভালোবাসা দেয়। এবং সেই সাথে সৃজনের সকল দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
কুহুর কাছে তাহমিদ একজন আদর্শ স্বামী। এবং সে সন্তান হিসেবেও মোটেই খারাপ নয়। শুধু পারিপার্শ্বিকতার কারনেই ও কঠোর হতে চায়।
ওদের বিয়ের ছয়মাস পেরিয়ে গেছে। কুহু প্রতি সপ্তাহেই তাহমিদের সাথে নানিমাকে দেখতে যায়। নানিমা আগের থেকে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে গেছেন। তিনি যেকোন মুহূর্তে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। তাই কুহু সপ্তাহে দুইদিন করেও তাকে দেখতে যায়। তিনি এখন কাউকেই চিনতে পারেননা। শুধু মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।
নায়লা আঞ্জুম গত ছয়মাস ধরে বাবার বাড়িতে আছে। রায়হান আহমেদ তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে তার বাসায় যেন নায়লা আঞ্জুম পা না রাখে। এমনকি তিনি তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই বাসায় আসলেও নায়লা আঞ্জুমের সাথে কথা বলেননা। এটা তাকে যতটা না কষ্ট দেয়, তার থেকেও বেশি কষ্ট দেয় রিশা, নিশো তার সাথে কথা না বলায়। সে অনেকবার তার ছেলেমেয়েদের সাথে যোগাযোগ বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ওরা কেউই তাদের মা’য়ের ওপর সদয় হয়নি। এদিকে নায়লা আঞ্জুম এই বাসায় আর থাকতে চাইছেনা। এই সংসার এখন পুরোদমে সৈকতের স্ত্রী স্মৃতির দখলে। তার আদেশ নিষেধেই সংসার চালিত হয়। এটা নায়লা আঞ্জুম মেনে নিতে পারেনা। কিন্তু তার করার কিছুই নেই।
সকাল থেকেই স্মৃতি ব্যস্ত হয়ে আছে। আজকে তার বাবার বাড়ি থেকে মেহমান আসবে। তার বাবা-মা, ভাই-বোনসহ আরও কয়েকজন আসবে। সেজন্য আজ বাসায় আজ নানান আয়োজন করা হয়েছে। কি নেই রান্নার আইটেমে? সেসব দেখেই নায়লা আঞ্জুম ভেতরে ভেতরে জ্ব’ল’ছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা৷ কারন এই ছয়মাসে সে বুঝতে পেরেছে, তাই ভাইয়ের বউকে যতটা নিরীহ দেখা যায়, আদতেই সে তা নয়। সে চুপচাপ থাকে ঠিকই কিন্তু মাঝেমধ্যে যেভাবে ফুঁসে ওঠে সেটা অবাক করে নায়লা আঞ্জুমকে।
” রাজিয়া আপা, আপনি শুধু রান্না করবেন। বাকি কাজ অন্যরা করবে। আপনি রান্নাঘরে বসে থেকে তাদের কাজ তদারকি করবেন। ওরা সব জোগাড় করে দিলেই তবে আপনি রান্না করবেন। ” স্মৃতি রান্নাঘরে এসে রাজিয়া খালাকে বলল।
” তুমি এত চিন্তা করবানা কইলাম। আমি যা করার করমুনে। তোমার শরিলডা উম্ সেই ভালোনা। এই শরলে কোন চাপ তোমার নেওনের দরকার নাই। তুমি সোফায় বসে বসে আমাদের কাজ দেখ। ”
রাজিয়া খালার সাথে স্মৃতির সম্পর্কটা বেশ ভালো। স্মৃতি আগে থেকেই রাজিয়ার সম্পর্কে জানত। তাই সে খুব তারাতারিই খালাকে আপন করে নিতে পেরেছে। সে তার ননদদের থেকেও রাজিয়া খালাকে বেশি আদর করে। আপন মনে করে। তার মতে, তার ননদরা একেকটা বড় মাপের বেয়াদব। যারা মানুষকে সম্মান দিতে জানেনা।
রাজিয়া খালাও স্মৃতির আচরণে সন্তুষ্ট। সে এই বাসায় আসার পর সবাইকে আপন করে নিয়েছে। শ্বাশুড়ির সেবা করছে মন দিয়ে। এখন রাজিয়া খালার অনেকটাই ছুটি মিলেছে। তবে মেয়েটা দুই মাসের প্রেগন্যান্ট হওয়ায় একটু অসুস্থ হয়ে গেছে। তারপরও শ্বাশুড়ির সেবা সে মন দিয়েই করছে।
স্মৃতি ড্রয়িংরুমে বসেই কুহুকে ফোন করল। সে আগেই কুহুকে আজকের দিনের জন্য ইনভাইট করেছিল। যদিওবা কুহুকে সকাল সকাল আসতে বলেছিল। তবে কুহু জানিয়েছে একটা ক্লাস করেই সে এই বাসায় আসবে।
কুহু সবেমাত্র ভার্সিটি থেকে বাসায় এসেছে। তখনই ওর ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল ওর মামীশাশুড়ী ফোন দিয়েছে।
বাসায় এত আয়োজন দেখে নায়লা আঞ্জুম আর কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলনা। তার ভাই শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের নিয়ে মেতে থাকবে এটা সে মানতেই পারছেনা। তার নিজের হাতে গড়া এত বছরের এই সংসার তার ভাইয়ের বউ নিজের দখলে নিয়েছে, এটা সে মানবে না।
সৈকত আহমেদ দেশে এসে ব্যবসা শুরু করেছে। সে তার অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসা একজনের তত্বাবধানে রেখে, এখন দেশেই ব্যবসা শুরু করেছে। আজ বাসায় মেহমান আসবে জন্য সে অফিসে যায়নি।
সৈকত তার মেয়েকে কোলে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে স্ত্রী র পাশে বসল। মেয়ের সাথে খুনসুটির পাশাপাশি স্ত্রী র সাথে টুকটাক কথা বলছে। ঠিক তখনই নায়লা আঞ্জুম তার ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়।
” সৈকত, তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। ”
” কি বলবে বল। ”
” তুই এসব কি শুরু করেছিস? মাসের পনেরদিনই তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন এই বাসায় এসে পরে থাকে কেন? তাদের কি মিনিমাম চক্ষু লজ্জাটুকুও নেই! মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে কেউ যে এভাবে আসে, তোর শ্বশুর শ্বাশুড়িকে না দেখলে জানতামনা। আসলে তারা তো আজীবন কুঁড়ে ঘরে থেকেছে, এমন রাজপ্রাসাদ চোখে দেখেনি। তাই এমন ফকিন্নির মত আচরণ করে। তুই ওদেরকে মানা করে দিবি। তারা যেন এত ঘনঘন এখানে না আসে। তাদের সোসাইটি না থাকতে পারে, আমাদেরকে তো সোসাইটি মেইনটেইন করতে হয়। ”
নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে সৈকত আহমেদ রা’গে ফেটে পরছে। একই দশা হয়েছে স্মৃতিরও। এবার সে মুখ বন্ধ রাখতে পারলনা। অনেক সহ্য করেছে। আর নয়।
” মুখ সামলে কথা বলুন, ছোট আপা। আপনি এ পর্যন্ত অনেক কথাই বলেছেন। আমি চুপচাপ সহ্য করেছি। এখন দেখছি কথা বলতে বলতে আপনার মুখ বড় হয়ে গেছে। আমি আমার স্বামীর বাড়িতে আমার বাবা-মা আত্নীয় স্বজনদের আসতে বলেছি। আপনার স্বামীর বাড়িতে কাউকে নিয়ে যাইনি। কিংবা আপনার স্বামীর টাকায় আমার আত্মীয় স্বজনদের খাওয়াইনা। যে মেয়ের নিজের চক্ষু লজ্জা নেই, সে আবার অন্যের চক্ষু লজ্জা নিয়ে মাথা ঘামায় কেমন করে! যে মেয়ে নিজের সংসার ফেলে ছয়মাস ধরে ভাইয়ের বাড়িতে পরে আছে, আর যাইহোক তার মুখে চক্ষু লজ্জা কথাটা শোভা পায়না। যে মেয়ে নিজে শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন, তার মুখে এত বড়বড় কথা মানায়না। আমার বাবার বাড়ির আত্মীয়রা আপনার মা’কে দেখতে আসবে। তারা পাত পেরে খেতে আসবেনা। কিন্তু মেয়ে হিসেবে তাদের আপ্যায়ন করার দ্বায়িত্ব আমার। আপনি এসবের কি বুঝবেন? নিজের মা’য়ের শরীরে একদিনও তো হাত দিয়ে ধরে দেখেননি। কিংবা একবেলা মুখে তুলে খাইয়ে দেননি। আপনি ভালোবাসা জিনিসটা বুঝবেননা। আপনি বুঝেন নিজের স্বার্থ। কিসের অহংকার করেন? স্বামী তো ছয়মাস আগেই আপনাকে এখানে ছেড়ে গেছে। যেই মেয়েকে তার স্বামী ত্যাগ করেছে, তার মুখে এত বড়বড় কথা মানায়না। নিজের যদি এক তিল পরিমানও সম্মান থাকত তবে ভাইয়ের বাড়িতে থেকে, তারই খেয়ে পরে তার স্ত্রীকেই এসব কথা বলতেননা। আজকে শেষ বারের মত আপনাকে বলছি ভালোভাবে শুনে রাখেন, এরপর কখনো এই ধরনের কথা বললে, আপনার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেব। ”
আজ সৈকত আহমেদও নীরবে সবটা শুনে গেল। সে তার স্ত্রী র কথা কোনই প্রতিবাদ করলনা।
স্মৃতির এমন আক্রমনাত্বক কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম যেন জমে গেছে। সে স্মৃতির কথার প্রত্যুত্তর করতে ভুলে গেছে। আজ পর্যন্ত বাহিরের কেউ তাকে এভাবে বলেনি, এটা তার বারবার মনে হচ্ছে। স্মৃতির মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বুঝতে পারল সে পুনরায় মুখ খোলা মাত্রই স্মৃতি তাকে আরও কিছু কঠিন কথা বলতে ছাড়বেনা। তাই সে চুপচাপ সবকিছু হজম করে।
এদিকে স্মৃতির রা’গ কিছুতেই কমছেনা। সে হাতের কাছে থাকা একটা শো পিস মেঝেতে ছুঁড়ে মা’র’ল।
” স্মৃতি, এমন পা’গ’লা’মি করছে কেন! তোমার শরীর ভালো নেই, সেটা কি তুমি জানোনা? রিলাক্স, আমি রাজিয়া আপাকে জুস দিতে বলছি। তুমি জুস খেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবে, কেমন? ” সৈকত আহমেদ তার স্ত্রীকে নরম গলায় বলল।
” জুস তোমার বোনকে খাওয়াও। তুমি ছাড়া তাকে খাওয়ানোর এখন কেউ নেই। সে কত বড় ফকিন্নি দেখেছ? তোমার বাসায় থাকছে, তোমারই খাচ্ছে পরছে কিংবা অন্যকে ফকিন্নি বলে! আমার তো মনে হয়, তার থেকে বড় ফকিন্নি এই দেশে আর দুইটা নেই। আমার বাবা-মা এখানে তোমার মা’কে দেখতে আসে। তারা এখানে দিনের পর দিন পরে থাকেনা। কিন্তু সে ঠিকই ছ্যাঁচড়ার মত এখানেই থাকছে। আবার গলাবাজিও করছে। ”
এবার নায়লা আঞ্জুম আর সহ্য করতে পারলনা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এত অপমান কিছুতেই সহ্য করা যায়না।