Saturday, July 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 350



আমি অর্ষা পর্ব-০৪

0

#আমি_অর্ষা
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#পর্ব_৪
আ আ আপনার বাসা টা কোথায় বলা যাবে?
_ওহ হো,আপনাকে তো আমার বাসা কোথায় সেটাই বলা হয়নি।
আমার বাসা হচ্ছে, মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে।
তার কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।

আমি স্তব্ধ হয়ে আছি।ভাবছি আর ভাবছি।

_কি হলো ধরবেন না হাত?

আমি ওকে বল্লাম,
_আপনি যা বলছেন,ভেবে বলছেন তো?
_আমি ভেবেই বলেছি।
_আপনি কত টুকু জানেন আমার সম্পর্কে?
_আমার কিছু জানার দরকার নেই।আমি তোমাকে দেখে ভালবেসেছি আর কিছু জানার দরকার নেই।
_আপনি আমার পরিবার সম্পর্কে জানেন না,আপনি আমার বাবা কি করেন তা জনেন না।
আমি ধনী না গরীব তা জানেন না।
কিছু না জেনেই আমাকে পছন্দ করে ফেললেন?
_আজব তো,আমি বিয়ে করবো তোমাকে।
তোমার বাবা কি করে,তোমরা ধনী না গরীব তা দিয়ে আমার কি কাজ।আমার ওসব জানতে হবেনা।
সরি তুমি বলে ফেললাম।
আমি কি তোমাকে তুমি করে বলতে পারি?
_জ্বী বলুন সমস্যা নেই।
_শোনো,আমি তোমাকে ভালবাসি।
আর কিছুই জানতে হবেনা আমার।
_শুনুন আমি কিন্তু গরীব ঘরের মেয়ে।এখনো কি আপনি অটল আপনার কথায়?
_হ্যাঁ।
_তাহলে আমার কথাও আপনি শুনুন।
আমি প্রেম ভালবাসায় বিশ্বাসী না।
তাই আমি যদি করি,একবারে বিয়ে করবো।
আপনি কি পারবেন তা করতে?
_অবশ্যই পারবো।
_তাহলে আপনি আপনার মত চলতে থাকুন।
আমি আমার মত চলতে থাকি।
যা হবার আমার পরীক্ষার পর হবে।

_আচ্ছা আমি রাজি।
_তাহলে আসছি।
আর একটা কথা,আপনি যে আমাকে ভালবাসেন।
বা আমাদের মধ্যে যে কথা হয়েছে।
এই কথা যেন শুধু আমাদের দুজনের মধ্যেই থাকে।
আমি চাইনা বিয়ের আগে কেউ কিছু জানুক কেমন?
কথা টা মাথায় রাখবেন।

_মনে থাকবে।
আর একটা কথা,আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকবো।

আমি একটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললাম।
কখনো কখনো অপেক্ষার ফল কিন্তু তিতাও হয়।
_আমার টা মিষ্টিই হবে।
_দেখা যাক।

এর মধ্যে অরণ্য আর শিলা আপু বাইরে চলে যায়।
শিলা আপু আমার সাথে দেখা করে গেলেও।
অরণ্য যাবার সময় দেখা করা তো দূর আমার ত্রিসীমানায় ও আসেনি।
বুঝলাম না সে কেন এমন করলো।

স্বাভাবিক ভাবেই চলছে আমার জীবন।
দেখতে দেখতে অনেক গুলো দিন চলে যায় সামনে আমার পরীক্ষা।

রুনা আমি প্রেমা মন দিয়ে পড়াশোনা করছি।
যাতে আমাদের পরীক্ষা টা ভালো হয়।
অনেক স্বপ্ন আমার পড়াশোনা নিয়ে।
আমার যে অনেক বড় হতে হবে।

একদিন হঠাৎ আন্টি এসে আমাকে বলেন,
জানো মা মন টা কেমন যেন করছে।
অরণ্য এবার বাইরে যাবার পর থেকে ঠিক মত কথাই বলেনা আমাদের সাথে।
কথা বল্লেও কেমন যেন মন মরা হয়ে থাকে।
কিছুই ভালো লাগছেনা মা।

আমি আন্টিকে স্বান্তনা দিয়ে বললাম,
আপনাদের জন্য খারাপ লাগেতো।
সেই জন্য মন মরা হয়ে থাকে।
আর কথা বললে হয়তো কান্না চলে আসে,তাই হয়তো কথা বলছেনা ঠিক মত।
কিছু দিন যাক।
ঠিক হয়ে যাবে।
_তাই হবে হয়তো।
আচ্ছা মা পড়ো তুমি।
আমি আসি।মন দিয়ে পড়বে।

_জ্বী আচ্ছা আন্টি।
আসবেন কিন্তু আবার।
_তুমিও যেও।

আন্টি চলে যান।
আমি মনে মনে ভাবতে থাকি,আসলেই কি অরণ্য এই জন্য এমন করছে?
নাকি অন্য কোন কারণ আছে?

যাকগে,এখন পড়াশোনায় মন দিতে হবে আমার।
অন্য কোথাও মন দিলে চলবেনা।

অবশেষে একে একে আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়।

এরপর একদিন আমি ছাদে কাপড় আনতে গেলে তুর্জ এসে আমাকে বলে,পরীক্ষাতো শেষ।
এবার কি আমাদের প্রেম টা হবে?

_আগেইতো বলেছি,প্রেম ভালবাসায় বিশ্বাসী না আমি।
_তাহলে চলো এবার বিয়ে করে ফেলি।
_ভেবে বলছেন?
_হুম বলছি।
কারণ আমার বউ পালার ক্ষমতা আমার আছে।
একটা জব করছি।
বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান।
আমার বাবার ও কম নেই।
তাই কি দরকার দেরি করার।
চলো তাহলে করে ফেলি বিয়ে।

_আচ্ছা বাসায় গিয়ে আয়োজন করুন তাহলে।
আপনার তো আমার পরিবার নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই।
আপনি তো আমাকে ভালবাসেন, তো বিয়েতে আমি আসলেই তো হয় শুধু তাইনা?

_বিয়ের কথা সত্যি বলছো?নাকি ফান করছো?
_ফান কেন করবো?
_দেখো,আমি মানছি তুমিই আমার প্রথম প্রায়োরিটি।
তবুও,বিয়ের মত বড় একটা বিষয় তোমার পরিবারের সাথে কথা বলা তো উচিৎ।
তারা আমাকে দেখবে।
আমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলবে।

_আমি যেখানে পছন্দ করবো তারা সেখানেই রাজি।
আমি বাসায় আপনার কথা বলবো।
আপনি বিয়ের আয়োজন করুন যদি চান।
আমি বিয়ের দিনই একবারে আপনার বাসায় উপস্থিত হবো,আমার বাবা মাকে নিয়ে।
আপনি রাজি?

_একদম রাজি।
তোমাকে এ কয়দিনে যতটুকু আমি চিনেছি বুঝেছি।
তুমি প্রতারণা করার মত মেয়ে না।
তুমি আমাকে ঠকাবা না এই বিশ্বাস আমার আছে।

_দেখুন,বিশ্বাস করা ভালো।
তবে অতিরিক্ত বিশ্বাস নয়।
তাহলে কিন্তু পস্তাতে হয়।

_হা হা হা।
এই মেয়ে দেখছি ভয় দেখায় আমায়।
_ভয় না।
সত্যি বললাম।
_আসলে কি জানো,তোমাকে দেখার পর থেকে আমি না পারি ঠিক মত খেতে,না পারি ঘুমাতে।
আমার মন শুধু তোমার কাছেই পড়ে থাকে।
তোমার সৌন্দর্য আমায় পাগল করে দিয়েছে।

তাই আমি চাই তোমার মন টাকেও বন্দি করতে।
আর সাথে তোমাকেও চিরদিনের মত বন্দি কর‍তে আমার জীবনে।
আমি তোমার জন্য পাগল ই হয়ে গেছি।
তোমার প্রেমে পাগল হয়ে গেছি।

আমি আমার বাবা মাকে বলে সামনের শুক্রবারই আমাদের বিয়ের আয়োজন করতেছি।

আমি মুচকি হাসলাম।
তুর্জ চলে যায়।

তুর্জ একদিনের জন্য বাসায় গিয়ে ওর বাবা মাকে বলে,ও একটা মেয়েকে ভালবাসে।
তারা যেন শুক্রবার বিয়ের আয়োজন করেন।
শুক্রবার দিন ও কনে কে নিয়ে বাসায় আসবে।
তারপর ই বিয়ে।

তার বাবা মা তাতে রাজি হননা।
কারণ কোন বাবা মা ই এমন করে রাজি হবার কথা না।

চেনা নেই জানা নেই,পরিচয় কি,বাড়ী কোথায়।
এসব না জেনে কোন অবিভাবকেরই রাজি হবার কথা না তার সন্তানের বিয়ের জন্য।

তুর্জর একই কথা।
আমি মেয়েকে চিনি।
তোমাদের তো চিনতে হবেনা।
আর যদি তোমরা এ বিয়েতে রাজি না হও তাহলে আমি আর জীবনে বিয়েই করবোনা।
আর না এ বাড়ীতে আসবো।

শেষমেস তার বাবা মা ছেলের কথায় রাজি হন।
কারণ এক মাত্র ছেলে।
যদিই সত্যি সত্যি বাড়ী ছেড়ে এক বারে চলে যায়।

এই জন্য তারা রাজি হন।

আর শুক্রবারে বিয়ের প্রস্তুতি নেন।
তাদের আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করেন শুক্রবার তাদের বাসায় আসার জন্য।
তাদের ছেলের বিয়ে উপলক্ষে।
মেয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন,বিয়ের দিন ই দেখতে পারবে।
অপেক্ষা করো।

তুর্জ আমার কাছে জানতে চায় আমার কেমন শাড়ি পছন্দ।
তাহলে ও সেরকম শাড়ি কিনবে।
আমি তাকে বলি,আমার কোন পছন্দ নেই।
তার যেমন ইচ্ছে সে যেন কিনে।

তুর্জ আমাকে বলে,

_আম্মু আব্বু কিন্তু আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করে ফেলেছেন।
শুক্রবার আমাদের বিয়ে।
এবার বলো আমি কি তোমার সাথে তোমাদের বাসায় গিয়ে তারপর তোমার বাবা মাকে আর তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো?

_নাহ।
_তাহলে?
_আমি বৃহষ্পতি বার রুনা আর প্রেমাকে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে যাবো।
আর শুক্রবার সকালে ওদের তিন জন আর বাবা মাকে নিয়ে আপনার বাসায় চলে আসবো।
আপনি শুধু ঠিকানা টা দিয়ে রাখুন আমায়।

_তুমি কি বাসায় জানিয়েছো আমার কথা?
আমাদের বিয়ের কথা?
_নাহ।
এখনো বলিনি।
বাসায় গিয়ে সামনাসামনি বলবো।
তারা আমার কথা ফেলতে পারবেন না।
_এতটা কনফিডেন্স?
_আমি আমার বাবা মাকে চিনি।
_দেখো কিন্তু,
কোন রকম কিছু হলে, আমি আমার আত্মীয় স্বজনদের সামনে বাবা মায়ের সামনে মুখ দেখাতে পারবোনা কিন্তু।

আমি তোমাতে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেছি,এতটাই পাগল হয়ে গেছি যে তুমি যা বলছো তাই করতেছি।
আমার সাথে প্রতারণা করোনা কিন্তু।

_হুম।
আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
_করো।
_আপনি আমার কি দেখে ভালবেসেছেন?
_বোকা মেয়ে।
আয়নায় নিজেকে কখনো দেখোনি?
তোমার মত এত সুন্দরী মেয়েকে কে না ভালবাসতে চাইবে?
_তাহলে আমি সুন্দর বলে আপনি আমাকে ভালবেসেছেন?
আমি যদি অসুন্দর হতাম?
ভালবাসতেন না তাইনা?
জানেন,সৌন্দর্য দেখে যারা ভালবাসে,তাদের ভালবাসা কিন্তু বেশি দিন থাকেনা।
মোহ কেটে গেলেই সব শেষ।

_যাও তো।কি সব বকবক করছো।
বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নাও।

চলে আসে বৃহষ্পতি বার।

আমি রুনা আর প্রেমাকে নিয়ে বাসায় চলে যাই।
কিন্তু ওদের আসল কারণ বলিনা কেন যাচ্ছি।
বলি যে,বাবা মায়ের জন্য মন টা কেমন করছে তাই যাচ্ছি।

ওদিকে তুর্জও বাসায় চলে যায়।

বৃহষ্পতিবার বাসায় পৌঁছানোর পর তুর্জ আমাকে ফোন দিয়ে বলে,

সব কিছু কত দ্রুত হয়ে যাচ্ছে তাইনা?
ভালো মত পৌঁছেছো?
রাস্তায় কোন সমস্যা হয়নিতো?

_না কোন সমস্যা হয়নি।
_বাবা মাকে জানিয়েছো?
_না।
_তাহলে?
_কাল একবারে বলবো।
_যদি না মানেন?
_একবারে আপনার বাসায় নিয়ে এসে সব বলবোতো।
তখন না মেনে কই যাবে?

_আচ্ছা তোমার বাবা কি খুব রাগী?
_কেন?
_না,এই যে এত লুকোচুরি করছো তাই মনে হচ্ছে।
মনে হচ্ছে তুমি তাকে খুব ভয় পাও।
_তেমন কিছুনা।
_তাহলে আমাকেও যে একটু পরিচয় করালে না।
_কাল তো করাচ্ছি ই।
_সকাল সকাল চলে এসো কিন্তু।
নাকি আমি নিতে আসবো?
_আমিই চলে আসবো।

পরের দিন শুক্রবার।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবা মাকে বলি,
আজ তোমাদের আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।
তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন,কোথায়?

আমি তাদের বলি,গেলেই বুঝতে পারবে।
তোমরা রেডি হয়ে নাও।
আমি রুনা আর প্রেমাকে বলে আসছি।

এরপর রুনা প্রেমা রেডি হয়ে আসে,আব্বু আম্মুও রেডি হয়ে যায়।
আমিও কোন রকম রেডি হয়ে নেই।

আর সবাইকে বলে নেই,আমি তোমাদের যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চুপচাপ সেখানে যাবে।
কোন রকম কোন প্রশ্ন করবেনা।

আমার বাবা মা খুব সহজ সরল তাই তারা আমার কথাতেই আচ্ছা বলেন।

আমি সবাইকে নিয়ে চলে যাই তুর্জদের বাসায়।

বাবা মা আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবেন,তখনই আমি তাদের বলি,

আগেই বলেছিলাম কোন প্রশ্ন না।আমার উপর তোমাদের বিশ্বাস আছে না?
_আছেতো মা,কিন্তু এখানে..
_কোন কথা না।
তোমরা দুজন আগে ভেতরে যাও।
আমি রুনা প্রেমা তোমাদের পেছনে আছি।

তুর্জদের বাসার সামনে তুর্জ আর ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছেন।
বাসায় অনেক মেহমান।

আমি রুনা প্রেমা মেইন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি একটা গাছের আড়ালে।

_অর্ষা,তুই আমাদের এখানে নিয়ে এলি কেন?
বলেছিনা কোন প্রশ্ন করবিনা।

চল আমার সাথে,

বাবা মা ধীরেধীরে তুর্জদের বাসার দিকে প্রবেশ করছেন।

বাবাকে দেখেই তুর্জর বাবা একটা হাসি দিয়ে বলেন,

_আপনারা এখানে?যাইহোক এসেছেন খুব ভালো করেছেন।
আসুন ভেতরে এসে বসুন।
_বাবা,উনারা কারা?
_কি আর বলবো,উনারা আমাদের পাশের এলাকার।ওই যে তোর যে বিয়ে ঠিক করেছিলাম।ওই মেয়ের বাবা আর মা।
তাদের মেয়ের সাথেই তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম।
কিন্তু তুই তো…
_ওহ ওই যে ওই জেলে পরিবার।
তোমার কি আমার বিয়েতে দাওয়াত দেয়ার জন্য মানুষ কম পড়ে গিয়েছিলো?
যে তোমার ওই জেলে পরিবারকে আমার বিয়েতে দাওয়াত দিতে হয়েছে?
(রাগের সাথে)

আমার বউ এর বাড়ীর লোকজন এসে যখন বলবে এরা কারা,
তখন কি পরিচয় দিবে তুমি?
আমার মান সম্মান কই থাকবে তখন?

দেখুন, আপনারা কিছু মনে করবেন না।
আজ আমার বিয়ে।
আমি চাইনা আমার বিয়েতে আপনারা এখানে উপস্থিত থাকেন।
তাই প্লিজ এখান থেকে চলে যান।

আর আপনারাও কেন বুঝেন না,
যে তেলে জলে কখনোই মিশ খায়না।
তবুও কেন চলে আসেন?
আপনারা যাবেন জেলে পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে।আমাদের সাথে নয়।

সেই মুহূর্তে আমি গিয়ে তুর্যর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেই।

আর তুর্য আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

চলবে..

আমি অর্ষা পর্ব-০৩

0

#আমি_অর্ষা
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#পর্ব_৩
আমি রুনার হাতে কাগজের টুকরোটা দিয়ে বললাম,পড়ে দেখ।
রুনা আর প্রেমা এক্সাইটেড হয়ে পড়তে লাগলো।
আর আমি ভাবতে লাগলাম,
কে দিলো এগুলো আমাকে।
আর কেনই বা দিলো।
মানুষ টা কে?

_কি ভাবছিস?
_কি আর ভাব্বো,ভাবছি কে দিলো এগুলো।
_সত্যিই জানিস না কে দিয়েছে?
_সত্যিই জানিনা।
_আচ্ছা চল,পরে দেখা যাবে কে দিয়েছে।
দেরি হয়ে যাচ্ছে।

এরপর আমরা কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেই।
তখনই নিচের ফ্ল্যাটের ছেলেটার সাথে দেখা।
আমাকে দেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমি দেখেও না দেখার ভান করে চলে আসছিলাম,
_হাই!কেমন আছেন?(রুনা)
_এই তো ভালো।
আপনারা?
_জ্বী ভালো আছি।
_কোথায় যাওয়া হচ্ছে তিন বান্ধবী মিলে?
_এইতো কলেজে যাচ্ছিলাম।
_আচ্ছা ভাইয়া আদিব কোথায়?(প্রেমা)
_ও তো একটু আগে বেরিয়ে গেছে।
_ওহ।
_অর্ষা!আপনি কথা বলছেন না যে?
_কি বলবো?
ওরা তো বলছেই।
চল তোরা দেরি হয়ে যাচ্ছে।
_আচ্ছা আসছি কেমন।আবার দেখা হবে,কথা হবে।(মুচকি হাসি দিয়ে,রুনা)
_আচ্ছা ঠিক আছে।

সেদিন ক্লাস শেষ করে আমরা চলে আসি।
প্রতিদিনের মত স্বাভাবিক ভাবেই চলছে আমার জীবন।
বাসায় এসে খাওয়াদাওয়া করে ফ্রী হয়ে বাবা মায়ের সাথে ফোনে কথা বলি।
প্রথমাদের পড়াই।
রাতে পড়াশোনা করে ঘুমিয়ে যাই।
এভাবেই চলছে।

একদিন শিলা আপু এসে দরজায় নক করেন।
দরজা খুলে দেখি আপু।
_আপু আসেন আসেন ভেতরে আসেন।
_কি ব্যাপার,তোমাদের তো আর দেখাই যায়না।
আসোনা কেন বাসায়?
_এইতো আপু একটু ব্যস্ত থাকি।
_আম্মুর মুখে তোমাদের অনেক প্রশংসা শুনেছি।
তোমরা নাকি আম্মুর অনেক খেয়াল রাখো।
তো এখন কেন আসোনা?

_আপু এখন তো আপনারা আছেন।
তাই আসিনা।

_আমরা আছি বলে আসা নিষেধ নাকি?
আসবে কেমন?

শিলা আপুর সাথে কথা বলতে বলতে অরণ্য আর তার মামাতো বোন প্রিয়াও চলে আসে।

_শিলা তুই এখানে,আর আমরা তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
আম্মু বল্লো এখানে আসছিস তাই চলে আসলাম।
_কিছু দরকার?
_নাহ,
_তাহলে এত খোঁজাখুঁজির কারণ?
_শোন,ভাবছি কি আমরা সবাই চল দূরে কোথাও ঘুরতে যাই।
_কোথায় যাবা?
_আরে চল কোন পার্কে টার্কে।
যাবে অর্ষা?
_যাবেনা মানে,আমরা সবাই যাবো।
(প্রেমা)
_হ্যাঁ ভাইয়া সবাই যাবো আমরা।
কত দিন হয় এখানে এসেছি।
কোথাও তো যাওয়াই হয়না।(রুনা)
_অর্ষা,
_জ্বী আপু।
_তাহলে সবাই রেডি হয়ে নাও।
একটু পরেই বের হই।
_আপনারাই যেতেন।
আমরা আবার কেন,
_কোন কথা না।
তোমরাও যাচ্ছো আমাদের সাথে।
যাও রেডি হয়ে নাও।
আমরা গিয়েও রেডি হই।

এরপর আমরা সবাই একটা পার্কে ঘুরতে যাই।
জায়গাটা অনেক সুন্দর।
সবাই যে যার মত ছবি তোলায় ব্যস্ত।
তা দেখে অরণ্য আমাকে এসে বলেন,

_তুমি ছবি তুলছো না যে?
_এমনি।
_এমনি কেন?ফোন দাও আমি ছবি তুলে দেই।আমি কিন্তু দারুণ ছবি তুলতে পারি।
_আমার তো ভালো ফোন নেই।তুলতে হবেনা ধন্যবাদ।
_ওহ এই কথা।
এক মিনিট।
দাঁড়াও দাঁড়াও,
সুন্দর করে দাঁড়াও একটু আমার ফোন দিয়ে তুলে দিচ্ছি।
যখন তোমার ভালো ফোন হবে,তখন না হয় নিয়ে নিও আমার থেকে।
_না না লাগবেনা।
_জেদ করোনা।
আজকের মুহূর্ত গুলো বন্দি হয়ে থাকুক মুঠোফোনে।

এই বলে অরণ্য আমার কিছু ছবি তুলেন।
আর বলেন,

_তুমি কি জানো?
তোমার চোখে অনেক মায়া?
_নাহ।
_তাহলে আজ থেকে জেনে রাখো।

আমি তার কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলি।

_আচ্ছা তুমি এত চুপচাপ থাকো কেন?
_এমনি।
_আমি বলার পরই ওরা আসতে চাইলো আর তুমি কিছু বললে না যে?
_দেখুন,আপনারা বড় লোক মানুষ,ধনী মানুষ।
আর আমি একটা গ্রামের সামান্য একজন জেলের মেয়ে।
আপনাদের সাথে ঘুরার মত সাহস হয় না আমার।
আপনাদের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতাও আমার নেই।
কোথায় আপনারা আর কোথায় আমি।

কিন্তু আংকেল আন্টি খুব ভালো মানুষ।
তাই আমাকে আপন করে নিয়েছেন।
আমি যে তাদের বাসায় ভাড়া থাকি।
সেটাও তারা আমাকে বুঝতে দেন না।
মনে হয় আমি তাদের ই কোন আত্মীয়।
আপন মানুষ।

_শোনো,আমি আর আমার বোন আমাদের বাবা মায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত।
তারা আমাদের সব সময় শিক্ষা দিয়েছেন।
মানুষ কে যেন আমরা মানুষ মনে করি।
সব পেশাকে যেন সম্মান করি।
কারণ তারা কষ্ট করে টাকা ইনকাম করে।
আর সৎ পেশায় কোন লজ্জা নেই।
সব কাজ ই সমান।
কাজ কখনো ছোট বড় হয়না।

তোমার আব্বু একজন জেলে।
উনি সৎ ভাবে টাকা উপার্জন করেন।এই ভেবে তোমার তো গর্ব করা উচিৎ।
যে আমার বাবা হালাল পথে হালাল ভাবে টাকা রোজগার করেন।
আর তোমাকে কত কষ্ট করে পড়াশোনা করাচ্ছেন।

এখানে যোগ্যতা অযোগ্যতার কি দেখলে তুমি,বুঝলাম না।
কখনো নিজেকে ছোট মনে করবেনা।
নিজের বাবার পেশাকে ছোট মনে করবেনা।বরং সম্মান দিবে।
কেমন?

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,
কত ভালো মন মানসিকতার মানুষ অরণ্য।
এমন কি তাদের পরিবারের প্রতিটা সদস্যই কত ভালো।

তখনই প্রিয়া অরণ্যকে ডাকে।
আর বলে,তার কিছু ছবি তুলে দিতে।
যত টুকু বোঝা যায়,
আমার মনে হয় প্রিয়া অরণ্য কে মনে মনে পছন্দ করে।
ওর চোখ দেখলেই বোঝা যায়।

যাইহোক,সেদিনের মত আমরা সবাই ঘুরাঘুরি করে বাসায় ফিরে যাই।
অনেক ভালো কাটে সময় গুলো।

কেটে যায় কয়েক টা দিন।

এর মধ্যে আদিব আর প্রেমার মধ্যে ভালবাসাবাসিও শুরু হয়ে যায়।
এরা ধুমসে ফোনে কথা বলে দিন রাত।ছাদে গিয়ে দেখাও করে।
ঝগড়া থেকে প্রেম।
ব্যাপার টা দারুণ কিন্তু।

এর মধ্যে আমার নামে প্রায়ই টুকটাক গিফট আসে কয়েক বার,

একবার ঝুমকা সহ একটা চিরকুট আসে।

আরেকবার বেলি ফুলের মালা সহ চিরকুট।

আজ আবার এসেছে নীল শাড়ির সাথে একটা চিরকুট।

এখানে লিখা,আজ বিকেলে শাড়ি টা পরে ছাদে এসো।

আমি অবাক হবার সাথে চিন্তায় পড়ে যাই।
কে আমাকে দিচ্ছে এগুলো।
আর না নিয়েও তো পারিনা।
কারণ আমি না নিলে অন্য কেউ দেখলে আবার সমস্যা।

যেই ভাবা সেই কাজ।
আজ জানতেই হবে কে এই ছেলে।
তাই আমি শাড়ীটা পরে ছাদে চলে যাই।

কিছু ক্ষণ পর আমি কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পাই।

পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি নিচের ফ্ল্যাটের ছেলেটা,

আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি,
আপনি?
আপনি এখানে?
_হ্যাঁ আমি।
অর্ষা দারুণ লাগছে আপনাকে।
অর্ষা আজ আর কোন ভনিতা নয়।
আমি আমার মনের সমস্ত অনুভূতি আজ প্রকাশ করতে চাই।

এই কথা বলে তিনি,
হাঁটু গেড়ে বসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
অর্ষা আমি তুর্জ আশরাফ।
মোঃতারেক আশরাফ এর এক মাত্র পুত্র। আমি আপনাকে ভালবাসি।
আমি আপনার হাত দুটো সারাজীবনের জন্য ধরতে চাই।
অনুগ্রহ করে আমার প্রস্তাবটি গ্রহণ করুন।
বাড়িয়ে দিন আপনার হাত।

উনার কথা শুনে আমি যেন ঘামতে শুরু করি।
আর তাকে জিজ্ঞেস করি,
আ আ আপনার বাসা টা কোথায় বলা যাবে?
_ওহ হো,আপনাকে তো আমার বাসা কোথায় সেটাই বলা হয়নি।
আমার বাসা হচ্ছে, মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে।

তার কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।

চলবে…

আমি অর্ষা পর্ব-০২

0

#আমি_অর্ষা
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#২য়_পর্ব
কলিং বেলের আওয়াজ আসলে আন্টি আমাকে বলেন,
_যাও তো মা দরজা টা খুলে দিয়ে এসো।
আমি গিয়ে দরজা টা খুলতেই আন্টি বলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠি।
আন্টি দৌড়ে আসেন।

এসে বলেন,কি হয়েছে মা?

তখনই আন্টির ছেলে তার মুখ থেকে ভয়ংকর মুখোশ টা সরায়।
আর বলে,সরি সরি সরি।

আন্টি হেসে দিয়ে বলে,ওহ ওই মুখোশ দেখে তুমি ভয় পেয়েছো?
এটা তো অরন্যর ছোট বেলার অভ্যাস।অরন্য সব সময় মুখোশ পড়ে সবাইকে ভয় দেখায়।
ওর বোন মানে শিলাকে, আমাকে,আর সব থেকে বেশি প্রিয়াকে।

_আমি তো ভেবেছি আম্মু তুমি কাজে ব্যস্ত থাকবে।
প্রিয়া এসেই দরজা টা খুলবে।তাইতো আরো..

সরি হ্যাঁ,আপনি কিছু মনে করবেন না।
_হুম ঠিক আছে।

তারপর আন্টি আংকেল এবং শিলা আপু বাসায় ঢুকেন।
আন্টিকে শিলা আপু আর তার ছেলে দুজনই জড়িয়ে ধরেন।

এই মুহূর্ত টা কত সুন্দর তা বলে বোঝানো যাবেনা।
প্রিয়া আপু এসেও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

তারপর আন্টি আমাকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

প্রথমার মা ভাবীর সাথে হাসি দিয়ে দুজন কথা বলেন।
এত ধনী হয়েও তাদের মনে বিন্দু মাত্র অহংকার নেই।

যেমন আংকেল আন্টি তেমন তাদের ছেলে মেয়ে।

আমি আন্টিকে বললাম,আমি এখন তাহলে আসি আন্টি।
পরে আবার আসবো।

আন্টি আমাকে খাওয়া দাওয়া করে আসতে বলেন।
আমি,
অন্য এক সময় এসে খাবো বলে চলে আসি।
আমার সাথে প্রথমার মা ভাবীও চলে আসেন।

সন্ধ্যায় আন্টি আমাদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দেন।

আমরা খাওয়া দাওয়া করে তিন বান্ধবী গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি।

এরপর ক্লাস, ছাত্রী পড়ানো,নিজের পড়াশোনা,বাসার কাজ কর্ম নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে যাই।

আন্টির ওখানেও আর যাইনা।
তার ছেলে মেয়ে এসেছে তাই আর যাইনা তেমন।
আগে আন্টি একা থাকতেন প্রায় সময়,তাই গিয়ে বসে থাকতাম মাঝেসাঝে।

আমরা যাই না বলে,আন্টি আসেন আমাদের খোঁজ খবর নিতে।
আর বলেন,

আগামী পরশুদিন শিলা আপুর জন্মদিন।
আমাদের সবার দাওয়াত তাদের বাসায়।
আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন তারা।
আর ভাড়াটিয়া সবাইকেই বলেছেন।
ধুমধাম করে জন্মদিন পালন করা হবে।

আমি কিছু বলার আগে আমার সাজনী বান্ধবী তো বলেই দিলো,আমরা অবশ্যই যাবো আন্টি।

আন্টি চলে যাবার পর আমি প্রেমাকে বললাম,
যাবি যে বললি দিবো কি আপুকে?
আর তারা এত ধনী মানুষ।
আমরা কিছু দিলে তাদের পছন্দ হবে?

ও বল্লো,
আরে চিন্তা করিস নাতো।
তিন বান্ধবী মিলে কিছু একটা কিনে দিবোনে।
আর বুঝিস না,কত্ত মজা হবে।
গান বাজনা হবে।
আমি তো সেই সাজ দিবো।

রুনা বলে উঠে,ইশ গান বাজনার জন্য আমি তো ঘুমাতেই পারবোনা।

_ধুর তুই আছিস তোর ঘুম নিয়ে।
দেখিস কত মজা হয়।
কিরে অর্ষা,তুই কিছু বল।

_কি বলবো,
_ধুর কিছু বলতে হবেনা তোর।

পরের দিন আমরা তিন বান্ধবী মিলে শিলা আপুর জন্য গিফ্ট কিনতে যাই।

শপিংমলে গিয়ে একটা একটা করে দেখছি কি দেয়া যায় আপুকে।
আমি আর রুনা এক পাশে,অপর পাশে প্রেমা।

কিছু ক্ষণ ঘুরাঘুরি করে প্রেমার চিল্লাচিল্লি শুনতে পাই।

দূরে তাকিয়ে দেখি কার সাথে যেন ঝগড়া করছে।

আমি আর রুনা দৌড়ে কাছে যাই।
যেতেই জিজ্ঞেস করি,

_আরে আরে কি হয়েছে?
এত চেঁচামেচি করছিস কেন?
_আর বলিস না,আমি এই গিফ্ট টা আপুর জন্য নিতে চাচ্ছি বলে ধরেছি।
আর সেও এটা ধরেছে।
ধরেছে যে ছাড়ছেই না।
আমি আগে ধরেছি এটা নিবো বলে।
উনি বলে উনি নাকি আগে ধরেছে।
_বিশ্বাস করুন আপু,আমিই এটা নিয়েছি।
কোত্থেকে এই মেয়ে এসে টানাটানি করছে আমাকে দিচ্ছেই না।
_আচ্ছা শোন প্রেমা,দিয়ে দে ভাইয়াকে এটা।
আমরা অন্য কিছু নিবোনে আপুর জন্য।
_ইশ তাকে কেন দিবো?
আমি নিয়েছি আমিই নিবো।
_না,আমি নিয়েছি আমিই নিবো এটা।

এই সময় নিচের ফ্ল্যাটের ছেলেটা এসে হাজির হয়।

_কিরে আদিব কি হয়েছে?
_আরে দেখ না দোস্ত।
আমি বাড়ীওয়ালা আংকেলের মেয়ের জন্য এটা নিতে চাচ্ছি।
এই মেয়ে এটা ছাড়ছেই না।
_আরে অর্ষা, আপনি এখানে?
_জ্বী,
_শপিং করতে এসেছেন।
_জ্বী।
_কি কেনাকাটা করলেন?
_কিছুই কিনিনি এখনো।
_কি নিতে এসেছেন?
_বাড়ীওয়ালা আংকেলের মেয়ের জন্য গিফট নিতে এসেছি।
_ওহ তাই?
আমরাও তো তাই নিতে এসেছি।
ওহ ওর সাথে আপনাদের কি দেখা হয়নি?
ও আমার বন্ধু আদিব।
নিচে আমার সাথে ও ই থাকে।
_ওহ তাই বুঝি।
না উনার সাথে এখনো দেখা হয়নি আমাদের।
_আদিব,দিয়ে দে ওটা।
তুই যার জন্য নিতে চাচ্ছিস,তার জন্যই নেয়া হচ্ছে।
তাছাড়া বাড়ীর মানুষের সাথে কিসের ঝগড়া।
আফটার অল,একই ছাদের নিচেই তো আমাদের বসবাস।

এই কথা শুনে প্রেমা সেটা ছেড়ে দেয়।
আর বলে চল অর্ষা আমরাই এটা ছেড়ে দিলাম।

_হুহ আমিও এটা আর নিবোনা দোস্ত।
চল যাই আমরা।

এভাবে আদিব আর প্রেমা দুজনই ওটা রেখে চলে যায়।
আমরাও অন্য একটা গিফট নিয়ে পরে বাসায় চলে আসি।

এরপর চলে আসে শিলা আপুর জন্মদিন।
প্রেমা রুনা আমি তিন জনই শাড়ি পরি।

প্রেমা আর রুনা আগেই আন্টির ওখানে চলে যায়।
আমি একটু লেইট করে প্রথমাদের পড়িয়ে তারপর যাই।

আমি শাড়ি পরে তেমন হাঁটতে পারিনা।
কোন রকম পরে সিঁড়ি দিয়ে যাচ্ছি আর সেই মুহূর্তে শাড়িতে পা বেঁধে পরে যেতে লাগছিলাম,আর তখনই কে যেন ঠিক নায়কের মত এসে আমাকে ধরে ফেলে।

তাকিয়ে দেখি বাড়ীওয়ালা আংকেলের ছেলে অরন্য।

হাসতে হাসতে আমাকে বলে,

_ভয় পান নি তো?
_নাহ
_শাড়ি পরে একটু সাবধানে হাঁটতে হয় বুঝলেন।
আমি যদি না থাকতাম,তখন তো পড়ে গিয়ে কোমড় টা ভাঙতেন।
ভাগ্যিস আমি সেভেন আপ আনতে নিচে যাচ্ছিলাম।
_হুম বুঝলাম
_যাইহোক শাড়িতে আপনাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
_থ্যাংক ইউ।
এবার হাত টা ছাঁড়ুন।
_ও হ্যাঁ,যান যান।
সাব্ধানে কিন্তু।
_জ্বী।

আমি আন্টির ওখানে চলে যাই।
সবাই মিলে অনেক আনন্দ করি।
নাচ গানের ও আয়োজন করা হয়।

প্রিয়া আর অরন্য জুটি বেঁধে নাচে।
সবাই মিলে নাচতে নাচতে প্রেমা আর আদিব ও নাচ শুরু করে দেয় কাপল হয়ে।
শিলা আপুও একা একা নাচছে।
শিলা আপুকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।
আমি আর রুনা সবার নাচ দেখতে থাকি।
সেই মুহূর্তে আদিবের বন্ধু এসে হাজির,মানে নিচের সেই ভাড়াটিয়া।
আমাকে ডাকছে,চলুন না আমরাও নাচি একটু।

_না।আমি যাবোনা।
রুনা বলে,
আমি আসি?
_হুম চলুন।

এরপর সবাই মিলে নাচতে থাকে।
আমি আর প্রথমার মা এক পাশে বসে দেখতে থাকি।

অরন্য আমাকে ইশারায় বলে,
তুমিও আসো।

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি,
নাহ।

এক সময় প্রথমা এসে আমাকে আর ওর মাকে জোর করে নাচতে নিয়ে যায়।

আমি আর ওর মা ওর হাত ধরে নাচতে থাকি।
সেই সময় নিচের ফ্ল্যাটের ছেলেটা নাচতে নাচতে রুনার হাত ছেড়ে আমার হাত ধরে।
আমি সবার মধ্যে তাকে আর কিছু বলতে পারিনা।

কিছু ক্ষণের মধ্যেই অরন্য আমার সামনে এসে বলে,

এই মেয়ে,আপনাকে..
নাহ তোমাকে আম্মু ডাকছে।
এই বলে সে আমাকে নিয়ে চলে আসে।

_কই?
আন্টি কোথায়?
_আন্টি ডাকেনি।
তোমার মুখ দেখে বুঝলাম তুমি ওই ছেলেটার সাথে আনইজি ফীল করছো তাই ডেকে নিয়ে আসলাম।
_ধন্যবাদ।
_আর শোনো,তুমি আমার অনেক ছোট তাই তোমাকে আমি তুমি করেই বলবো।
কেমন?
_জ্বী আচ্ছা।
_আচ্ছা যাও এবার।

সেদিনের মত প্রোগ্রাম শেষ হয়।
আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে,কেক কেটে,নাচ গান করে চলে আসি।

_আজ অনেক মজা হয়েছে তাইনারে?(প্রেমা)
_হুম অনেক।(রুনা)
_হুম দেখলাম তো দুই জন কিভাবে নাচলি। (আমি)
_কিরে প্রেমা!কালই তো এত ঝগড়া করলি অই আদিবের সাথে,আজ ই এত হাত ধরে নাচানাচি?(রুনা)
_ইশ তুই বুঝি বসে ছিলি?তুই যে ওর বন্ধুর সাথে নাচলি।
তুই না নেচে এসে ঘুমাতে পারলিনা।(প্রেমা)

_হয়েছে হয়েছে।
এখন ফ্রেশ হয়ে দুজনই ঘুমাতে চলেন।
সকালে ক্লাস আছে।

সকাল বেলা নাস্তা করে আমরা রুম থেকে বেরুবো,আর তখনই দেখি দরজার সামনে একটা কাগজের প্যাকেট।
প্রেমা ওটা হাতে নিতেই দেখে,

প্যাকেট টাতে অর্ষা লিখা।

প্রেমা মুচকি হেসে বলে,বাহ!
অর্ষার জন্য।
কে রে এটা?
_আমি তো জানিনা।

_এই নে খুলে দেখ,

আমি প্রেমার হাত থেকে প্যাকেট টা নিয়ে খুলে দেখি প্যাকেট টার ভেতরে এক মুঠো কাচের চুড়ি,আর একটা কাজল।
আর তার সাথে এক টুকরো কাগজ।

যেখানে লিখা,
কালো শাড়িতে তোমাকে পরীর মত লাগছিলো।
কাজলে আর চুড়িতে আরো সুন্দর লাগবে।
আচ্ছা,তুমি সাজোনা কেন?

রুনা বলে উঠলো,কি লিখারে?

আমি রুনার হাতে কাগজের টুকরোটা দিয়ে বললাম,পড়ে দেখ।
রুনা আর প্রেমা এক্সাইটেড হয়ে পড়তে লাগলো।

আর ভাবতে লাগলাম,
কে দিলো এগুলো আমাকে।
আর কেনই বা দিলো।
মানুষ টা কে?

চলবে…

আমি অর্ষা পর্ব-০১

0

#আমি_অর্ষা
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#১ম_পর্ব

আমার গায়ে হলুদের দিন আমার বিয়েটা ভেঙে যায়,শুধু মাত্র আমার বাবা জেলে বলে।তিনি নদী/পুকুরে মাছ ধরে তা আবার বাজারে নিয়ে বিক্রি করে টাকা উপার্জন করে আমাদের মুখে খাবার তুলে দেন বলে।ছেলে আমাদের পাশের এলাকারই।ছেলের বাবা মা আমাকে পছন্দ করেন তাদের ছেলের জন্য।
তারা আমার বাবার পেশাকে অসম্মান করেন নি।
বরং পছন্দ করেছিলেন আমাকে দেখে।ছেলের বাবা মায়ের আমার বাবার কাজে কোন আপত্তি ছিলোনা।
কারণ আমার বাবা একটা সৎ কর্ম করে খান।
চু রি ডা কা তি তো করেন না।

ছেলে বলেছিলো তার বাবা মায়ের পছন্দই তার পছন্দ।
তার বাবা মায়ের পছন্দর উপর নাকি তার পুরো বিশ্বাস আছে।
তাই সে আমাকে না দেখেই বিয়ের জন্য হ্যাঁ করে দিয়েছিলেন।
আমিও ছেলেকে দেখিনি।
আমার বাবা দেখেছেন তাতেই আমি সায় দিয়েছিলাম।
এর পর দুই পক্ষের মুরুব্বিরা বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেন।
দিন তারিখ পাকা হওয়ায় আমার বাবা সব কিছু কেনাকাটা করে ফেলেন।

কিন্তু যেদিন আমাদের গায়ে হলুদ।
সেদিনই আমার বাসায় খবর আসে।
ছেলে একটা চিঠি লিখে পালিয়ে গেছে।
চিঠিতে নাকি লিখা ছিলো,

“বাব্বু আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমার পক্ষে কোন জেলের মেয়েকে বিয়ে করা সম্ভব না।
আমার বন্ধুবান্ধব নিয়ে চলতে হয়।
ওদের আমি আমার বউ এর এই পরিচয় দিতে পারবোনা।
তাই আমি আবার শহরে ফিরে গেলাম।
আমাকে খুঁজবেন না।)

ছেলের বাবা মা ছেলেকে আগে জানাননি আমার আব্বু যে জেলে।
কারণ তারা ভেবেছিলেন,ছেলে যদি এই জন্য বিয়েতে অমত করে।

আর তাদের ওই একটা ভুলের জন্য এখন মাশুল গুনতে হচ্ছে আমার এবং আমার পরিবারের।

গ্রামে একটা বিয়ে ভেঙে যাওয়া মানে মেয়ে অ লক্ষী,অ পয়া।
সহজে আর সেই মেয়ের বিয়ের কাজ আসেনা।
মানুষ জন আগেপিছে দূর্নাম করতেই থাকে।

আমার পরিবারের আর আমার উপর দিয়ে এই একটা বছর যাবত কি যাচ্ছে তা শুধু আমি জানি।
আমি তো রাস্তায় বেরুলেই আমাকে দেখে লোকজন কানাকানি করে,ওই যে ওর না বিয়ে ভেঙে গেছে।
কিজানি,মেয়ের কোন দোষ আছে কে জানে।
ভালো মেয়েদের কি বিয়ে ভাঙে নাকি।

আমি সব কিছু শুনে চুপচাপ চলে আসি।
আম্মু বলেছেন,আমি যেন কারো কোন কথায় উত্তর না দেই।

আজ আমার এইচ এস সি এর রেজাল্ট দিয়েছে।
আমি খুব ভালো ভাবে পাশ করেছি।
আমার বাবা গরীব হতে পারেন।
কিন্তু আমাকে সে পড়াশোনা করিয়েছেন।
তার কথা প্রয়োজনে এক বেলা কম খাবো।
তবুও মেয়েকে পড়াশোনা শেখাবো।
ছেলের বাবা মা বলেছিলেন,তাদের তো টাকার অভাব নেই।
তারা বিয়ের পর আমাকে পড়াবেন।
তাই আমার বাবা সেখানে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন।
ভেবেছিলেন,মেয়ে ভালোও থাকবে।
আর পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পারবে।

কিন্তু কে জানতো,এই বিয়ের সিদ্ধান্তই যে আমাদের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে।

আমার রেজাল্ট দেয়ার পর আব্বুকে যখন জানাই।
আমার আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেন।

আমার মা ও আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন।

আমি দুজনের কান্না মুছে দিয়ে মা বাবার হাত ধরে বলি,

বাবা মা,
আমি যে ভালো ভাবে পাশ করেছি,তাতে কি তোমরা খুশি?
আমার বাবা আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,মারে অনেক খুশি।

তখন আমি তাদের বলি,
তাহলে আমি আজ তোমাদের কাছে কিছু চাইবো।

দুজনই বলে উঠেন,কি চাস মা বল।

আমি তখন তাদের বলি,

_আমি শহরে গিয়ে অনার্সে ভর্তি হতে চাই।
তোমরা আমাকে না করোনা।
আমি চাই আরো পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে।

_কিন্তু মা।
_বাবা তোমার অনেক কষ্ট হবে আমার পড়াশোনার টাকা জোগাড় করতে।
আর তোমরা চাওনা আমি তোমাদের থেকে অনেক দূরে থাকি।
তাইতো?
কিন্তু বাবা আমি চাই আমার নিজের একটা নাম হোক।
আমি অনেক বড় হতে চাই বাবা।
লোকে যাতে তোমাকে সম্মান দেয়।
আর বুঝতে পারে,চাইলে জেলের মেয়েও অনেক কিছু করতে পারে।
আর আমি সবাইকে বোঝাতে চাই,জেলেরাও মানুষ।
মাছ ধরা কোন খারাপ কাজ না।

আমার বাবা মা আমার কথা শুনে আমাকে অনুমতি দেন শহরে যাবার।

একটা সময় আমরা তিন বান্ধবী মিলে শহরে যাই।
গিয়ে একটা বাসা ভাড়া নেই তিন জন মিলে।
সময় মত অনার্সে ভর্তি হয়ে যাই।

আমি শহরে আসার সময় আমার বাবা আমাকে একটা বাটনফোন কিনে দেন।
যাতে আমি পাশের বাসার চাচীদের ফোনে কল করে বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে পারি।
আর আমার বাবা মা ও মাঝেমধ্যে তাদের ফোন থেকে কল দিয়ে আমার খবর নিতে পারেন।

তিন বান্ধবী খুব ভালো ভাবেই মানিয়ে নিতে শুরু করলাম শহুরে পরিবেশের সাথে।

আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকি,সে বাসায় ছোট্ট একটা পিচ্চি মেয়ে আছে।
ও আমাদের তিন জনকে বেশ পছন্দ করে।
বিশেষ করে আমাকে।

প্রায় সময়ই ওর মায়ের কাছে বায়না করে আমাদের কাছে আসবে।
ওর মা মাঝে মধ্যে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন।
একদিন ওর মা এসে আমাকে বলেন,
প্রথমা আমার কাছে পড়তে চায়।
আমি যেন ওকে পড়াই।
প্রথমা এবার ক্লাস টুতে পড়ে।
তিনি আরো বললেন,আমি যদি ওকে পড়াই তাহলে পাশের ফ্ল্যাটে ওর ক্লাসমেট আছে।ওকেও পড়াতে দিবে আমার কাছে।
আমি যদি দুজনকে পড়াই তাহলে তারা আমাকে মাসে ৩০০০ টাকা বেতন দিবেন।

আমার বান্ধবীরা বল্লো,রাজি হয়ে যা।
তিন হাজার টাকা কম না।

আমিও সুযোগ টা হাত ছাড়া করতে চাইলাম না।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রথমার মা বলে উঠে,
সামনের বছর বাড়িয়ে দিবো যদি পড়াও তুমি।

আমি বললাম,না না ঠিক আছে।
আমি পড়াবো।
এরপর থেকে আমি দুজনকে পড়ানো শুরু করি।

বাবা মাকে এই খবর টা দেয়ার পর তারা খুবই খুশি হন।

বাড়ীওয়ালা আংকেল আন্টি আমাদের সাথে খুব সুন্দর ব্যবহার করেন।
ভালো মন্দ রান্না করলে আমাদের জন্য দিয়ে পাঠান মাঝেমাঝে।

বাড়ীওয়ালা আংকেল আন্টির এক ছেলে এক মেয়ে।
তারা পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে থাকেন।

আংকেল আন্টি দুজনই থাকেন বাসায়।
তাই আন্টি মাঝেমাঝেই বলেন,তোমরা অবসর সময় আমার কাছে চলে আসবে।
আমরা সবাই মিলে গল্প করবো।

ভালোই কাটছে সময় গুলো।
ভেবেছিলাম শহরে আসবো।
কিভাবে এখানে নিজেকে মানিয়ে নিবো।
কিন্তু কোন রকম সমস্যা হয়নি।

প্রায়ই মা বাবার জন্য খারাপ লাগে।
কিন্তু কি আর করার।
আমাকে অনেক বড় যে হতে হবে।

দেখতে দেখতে এক মাস কেটে যায়।

একদিন আন্টি এসে আমাকে বলেন,আমি আর তোমার আংকেল তো দুদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছি।
বাসায় আবার নতুন ভাড়াটিয়া আসবে।
তুমি একটু ফ্ল্যাটের চাবিটা রাখতে পারবে?
ভাড়াটিয়া আসলে তাকে একটু চাবিটা দিলেই হবে।
আমি আচ্ছা বলে চাবিটা রেখে দেই।

আন্টি আংকেল বেড়াতে চলে যান।
পরের দিন সকালে কলিং বেলের আওয়াজ হচ্ছে।
আমার দুই বান্ধবীর একজনও দরজা খুলবেনা।
একজন বলছে,তুই ওঠ,আরেকজন বলছে তুই ওঠ।
আজ শুক্রবার সবাই আরামের ঘুম দিচ্ছিলাম।
অবশেষে আমি রুমের দরজা খুলি,
খুলে দেখি কালো শার্ট পরা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে।

দরজা খুলতেই তিনি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন।
আমি তাকে হালকা কাশি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

কে আপনি?
কাকে চান?

তিনি উত্তর দেন,না মানে ইয়ে।
_না মানে ইয়ে কি?
_আসলে আমি নিচে বাসা ভাড়া নিয়েছি।
ফ্ল্যাটের চাবিটা কি আপনাদের কাছে?
আন্টিকে কল দিয়েছিলাম।
আন্টিতো এই ফ্ল্যাটের কথাই বললেন।

_জ্বী।একটু দাঁড়ান আমি চাবি টা নিয়ে আসছি।

_জ্বী আচ্ছা।
_এই নিন চাবি।
_ধন্যবাদ।আপনার নাম টা তো জানা হলোনা।
আপনার নাম টা জানা যাবে?

_আমি অর্ষা।
_অর্ষা।অনেক সুন্দর নাম তো।
এতো সুন্দর নাম টা কে রেখেছে?
_আমার চাচাতো বোন।
আপুর নাম বর্ষা।তাই আমার নাম রেখেছে অর্ষা।

আর কিছু বলবেন?
_না।
আপাতত এটুকুই চলবে।
_তাহলে এবার আসুন।
_আচ্ছা, কোন দরকার হলে কিন্তু বিরক্ত করতে আসবো।
কিছু মনে করবেন না যেন।

এই কথা বলে ছেলেটা চলে যায়।

আমি ফ্রেশ হয়ে একটু নুডুলস রান্না করে নেই।

তারপর আমার মহারানী বান্ধবীরা ঘুম থেকে ওঠেন।

এদের একজন হচ্ছে রুনা।
যে নাকি ঘুমের রাণী।
যেখানে সেখানে যখন তখন শুলেই সে ঘুমিয়ে পড়ে।কোত্থেকে যে ওর চোখে এত ঘুম আসে।
একেক সময় তো ক্লাসে ক্লাস করতে করতেই ঘুমিয়ে যায়।
পরে আমরা ডেকে তুলি।

আরেকজন হচ্ছে সাজনী বুড়ি।
সে শুধু সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
সারাদিন রাত সাজের উপর থাকে সে।এমন কি বাসায় থাকলেও সে সেজেই থাকবে।
ওর নাম হচ্ছে প্রেমা।

আমরা তিনজন ছোট বেলার বান্ধবী।
এক সাথে আমাদের বড় হওয়া।একই এলাকায় বাড়ী।
এক সাথেই পড়াশোনা।
আমরা কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারিনা।
তাইতো এক সাথেই শহরে পড়তে এসেছি।
একই সাথে ভর্তি হয়েছি।

প্রেমা ফ্রেশ হয়ে সাজতে সাজতে আমাকে বলছে,
চলনা অর্ষা আজ আমরা কোথাও ঘুরতে যাই।
_না না না।
আমি তো কোথাও যাবোনা।
আমি খেয়েই এখন ঘুমাবো।
কত দিন পর একটা শুক্রবার পেয়েছি।
সারাদিন ঘুমাবো আমি আজ।(রুনা)

_তুই ঘুমা।
সারাদিন ঘুমা।
_আমিও যাবোনারে।
কাপড়চোপড় গুলো ধুয়ে দেই দেখি।
কাজ সেরে বাবা মাকে ফোন দিবো একটু।
কথা বলবো।
আজ মা বাবার জন্য মন টা কেমন যেন করছে।
_তাহলে কি আমি একা যাবো?
_না না একা যেতে হবেনা।সবে মাত্রই তো এসেছি আমরা।
সব কিছু কি চিনি নাকি ভালো মত?
একা গেলে যদি হারিয়ে যাস।
অন্য দিন যাবোনে।

_তাহলে কাজ টাজ সেরে রেডি থাকিস।
বিকেলে আমরা ছাদে গিয়ে ছবি তুলবো।
নাকি তাতেও তোদের সমস্যা? (প্রেমা)

_যদি ঘুম ভাঙে আমার তাহলে।(রুনা)
_আচ্ছা বাবা ঠিক আছে,তুলবোনে ছবি।

সারাদিনের কাজ কর্ম সেরে আমি বাবা মায়ের সাথে কথা বলে নেই।

বিকেলে ছাদে যাই শুকনো কাপড় গুলো আনতে।
যেই না দড়ি থেকে শুকনো ওড়না টান দিয়ে সরিয়েছি আর দেখি সকালের সেই ছেলেটা।

হঠাৎ দেখে আয়ায়ায়া বলে একটা চিৎকার দেই আমি।

আর সাথে সাথে ছেলেটা আমার মুখ চেপে ধরে।

আর বলে,

এই আমি আমি আমি।
এভাবে চিল্লালে মানুষ কি বলবে।
বাসার লোকজন তো সবাই চলে আসবে।

তারপর ছেলেটা আমার মুখ থেকে হাত সরায়।

আমি রেগে গিয়ে বলি,
আপনি ছাদে কি করেন?
আর আমার বান্ধবীর ওড়নার পেছনে কি?

_আরে বাবা আমিতো কাপড় মেলতে এসেছি।
এই দেখুন আমার ভেজা শার্ট।
_এই বিকেলে কেউ ভেজা কাপড় মেলে?
_কি করবো,রুম গোছাতে গোছাতে গোসল করতে দেরি হয়ে গেছে।
_ওহ আচ্ছা।
আচ্ছা ঠিক আছে যান আপনি।
_আপনারা কে কে থাকেন এক সাথে?
মানে কার সাথে থাকেন আপনি?

_আমরা তিন বান্ধবী থাকি।
_আপনারা পড়াশোনা করেন বুঝি?
পড়াশোনার জন্য এসেছেন?
_জ্বী।
বাসা কোথায় আপনাদের?
_এত কিছু জেনে আপনি কি করবেন?
_না এমনি।
আমিও আমার বন্ধুকে নিয়ে উঠেছি।
আমরা দুজনই জব আর পড়াশোনা করি।
_খুব ভালো।
_আচ্ছা আসবেন এক সময়।
আসছি।

এই বলে ছেলেটা চলে যায়।

আমিও শুকনো কাপড় নিয়ে রুমে চলে যাই।

পরে আবার ছাদে এসে তিন বান্ধবী মিলে ছবি তুলি।

এভাবে কয়েক দিন কেটে যায়।
বাড়ীওয়ালা আংকেল আন্টিও বাসায় চলে আসেন।
আর খুশি হয়ে আমাদের জানান,তিন দিন পর তাদের ছেলে মেয়ে দেশে আসবে কিছুদিনের ছুটিতে।

তারাতো মহা খুশি।

আংকেল আন্টির খুশি দেখে আমারো খুব ভালো লাগে।
আন্টি এই তিন দিনে তার ছেলে মেয়ের জন্য অনেক কিছুর আয়োজন করেন।
বিশেষ করে বিভিন্ন রকমের পিঠার।

আন্টির ভাইয়ের মেয়ে প্রিয়া বেড়াতে এসেছে।আন্টির ছেলে মেয়ে দেশে আসবে বলে।

আমি,প্রথমার আম্মু,আর আন্টির ভাতিজি আমরা সবাই মিলে আন্টিকে সাহায্য করি।
কারণ আন্টি একা মানুষ।
একা একা বেচারির কষ্ট হয়ে যায় বিভিন্ন পদ তৈরি করতে।
বোয়া খালার পা মচকে ফুলে গেছে বলে,দুদিন যাবত কাজে আসতে পারেন না।

আজ আন্টির ছেলে মেয়ে আসবে।
তাই আন্টি খুব এক্সাইটেড।
আংকেল গেছেন তাদের রিসিভ করতে।
আমি,আর প্রথমার মা ভাবী আন্টির টুকটাক কাজে সাহায্য করছি,কা টা কুটি করে দিচ্ছি।
আর আন্টি রান্না করছেন।
আন্টির ভাতিজি প্রিয়া ঘর গোছাচ্ছে।

ওমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ আসলে আন্টি আমাকে বলেন,

_যাও তো মা দরজা টা খুলে দিয়ে এসো।

আমি গিয়ে দরজা টা খুলতেই আন্টি বলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠি।

চলবে…

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৩৮ এবং শেষ পর্ব

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
#উপসংহার

সূর্য অস্ত গেছে অনেকক্ষণ আগে। মাগরিবের নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে চা বানাতে এসেছে অনুভা। দুটো কাপে চা ঢেলে সাথে কয়েকটা বিস্কুট ট্রেতে তুলে নিয়ে সে হাঁটা ধরলো কক্ষের দিকে। বোনের নিকট হতে বিদায় নিয়ে বিকেলের দিকেই বাড়িতে এসে পৌঁছেছে দুজন। সবিতাকে গতকালই দুদিনের ছুটি দিয়েছিল শ্রাবণ। তাই বাড়িতে আজ দুজন ব্যতীত কেউ না থাকায় ঘরের মধ্যেই মাগরিবের নামাজটা সে আদায় করে নিয়েছে। নামাজের এই সুন্দর অভ্যাসটা শ্রাবণ আর সৌহার্দ্যের গড়ে উঠেছে মূলত বাবার নিকট থেকে। হানিফ শেখের ছেলেবেলা কেটেছে গ্ৰামের বাড়িতে। বাড়ির কাছাকাছি মসজিদ হওয়ায় মা আজান হতেই ছেলেদের পাঞ্জাবী পাজামা পরিয়ে পাঠিয়ে দিতেন মসজিদে। স্কুল ডিঙিয়ে কলেজে উঠতেই সেই চিরচেনা অরণ্যে ঘেরা গ্ৰাম ছেড়ে তিনি চলে আসেন শহরে। সেই থেকেই শহরে উনার বসবাস। একে একে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তারপর চাকরিক্ষেত্র। একসময় এখানেই গড়ে তুলেন বসত ভিটা। এতকিছুর মধ্যেও তিনি নামাজটা ঠিকই জামায়াতে আদায় করতেন।

ছেলেরা যখন হাঁটতে শিখলো তখন নিজের দু হাত দিয়ে তাদের দুজনের হাতের আঙুল ধরে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন মসজিদে। আসা যাওয়ার পথে কতশত গল্প করতেন। যেই রবের কারণে অক্সিজেন নিয়ে এত সুন্দর পৃথিবীতে আমরা বেঁচে আছি, সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছি,যেই রব আমাদের সৃষ্টি করেছেন সেই রবকে ব্যস্ততা দেখালে কী হয়? সব কাজের থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজই তো রবের ইবাদত। সেই থেকে যত কাজ থাকুক কিংবা থাকুক ব্যস্ততা। শ্রাবণ আর সৌহার্দ্যও সময়মতো ঠিকই নামাজ আদায় করে নেয়।

চায়ের ট্রে নিয়ে অনুভা ঘরে প্রবেশ করতেই বিছানায় গা এলিয়ে শ্রাবণকে শুয়ে থাকতে দেখতে পেলো।একপাশে ট্রে রেখে নিজের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে বললো,“নাও চা খাও।”

শোয়া থেকে উঠে বসলো শ্রাবণ। মুষ্টিবদ্ধ হাতের উপর থুতনি ভর দিয়ে মিহি হাসলো। মাতাল কণ্ঠে বললো, “মাথাটা বড্ড ধরেছে নোভা। চা খেলে তো হবে না। এই মুহূর্তে কড়া কিছু চাই।”

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তার পানে তাকালো অনুভা। ছেলেটির মুখশ্রীতে উন্মাদনা। আঁখি যুগলে প্রগাঢ় নেশা। তার মতলব যে খুব একটা ভালো নয় তা চট করে বুঝে ফেললো অনুভা। পাংশুটে মুখ করে বললো, “কড়া কিছু?”

“হু হু।”

“কী শুনি?”

“তোমাকে চাই, তোমার ওই নরম ঠোঁট চাই। যার কাছে এসব চা নগণ্য।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো অনুভা। হুটহাট এসব নির্লজ্জ মার্কা কথায় এখন সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মুখ বাঁকিয়ে বললো,“চা খেলে খাও না খেলে নেই। পরে চা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে কিন্তু আমায় কিছু বলতে আসবে না।”

মুখশ্রীতে অসহায় একটা ভাব ফোটে উঠলো শ্রাবণের। চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে অভিযোগের সুরে বললো,“তুমি খুবই পাষাণ হৃদয়ের এক নির্দয়া প্রেমিকা বউ নোভা। একটু আদর করতে না পারার যন্ত্রনা তুমি বুঝতে চাও না। বারবার এই অসহায় পুরুষটিকে দুঃখ দাও।”

“চুমু খেতে দেইনি বলে তুমি দুঃখ পেয়েছো?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় শ্রাবণ। এবার আর মুখটাকে গম্ভীর করে রাখতে পারলো না অনুভা। হু হা করে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ হেসে অবশেষে হাসি থামাতে সক্ষম হলো। কাঁচুমাচু মুখ করে শ্রাবণ প্রশ্ন করল,“হাসার কী বললাম আমি? আমার অনুভূতি প্রকাশকে তোমার কাছে হাস্য রসাত্মক ব্যাপার মনে হলো?”

তার পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অনুভা। নড়েচড়ে উঠে আচমকা ছেলেটির অধরে অধর ছোঁয়ালো। শব্দ করেই চুম্বন এঁকে কয়েক সেকেন্ডে সরে এলো। তৈরি করে নিলো পূর্বের ন্যায় দূরত্ব। চমকালো শ্রাবণ। এই প্রথম তার শখের নারী নিজ থেকে তার এত নিকটে এসেছে। নিজ থেকে অধরে অধর ছুঁয়েছে। মুহূর্তেই যেনো এক অন্য রাজ্যে হারিয়ে গেলো পুরুষটি। ভেতরে ভেতরে জেগে উঠলো স্বামী সত্তা। এই মুহূর্তে নিজেকে সামলানোর সকল পথ যেনো বন্ধ হয়েছে। দুটো কাপ ট্রেতে পূর্বের মতো রেখে তা মেঝের একপাশে সরিয়ে রাখলো। হুট করে অনুভার বাহু ধরে টেনে তাকে নিজের অতি নিকটে নিয়ে এলো। শাড়ির আঁচল ফেলে দিয়ে হাত রাখলো উদরে। বাঁধা দিলো না অনুভা। নিরবেই যেনো সায় জানালো সে। এই পুরুষটিকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। তার কণ্ঠনালী হতে নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ তার ভালো লাগে। তার স্পর্শ তাকে ভুলিয়ে দেয় সকল অসুখ।
_________

ছোট্ট দুধের বাচ্চাটি চিৎকার করে কাঁদছে। তমা বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে বাচ্চার ক্রন্দন থামাতে। আজ শনিবার। তানিমকে বলে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে নাহিয়ান। ছেলেকে রেখে অফিসে যেতে তার ভালো লাগে না। সময় সহজে কাটে না। তানিম অবশ্য তার এই ছটফট ভাবটা বোঝে। তাই শুক্রবারের সাথে শনিবারটাও কখনো সখনো তার জন্য ছুটি মঞ্জুর করে দেয়। অফিসে অনিয়ম করায় ছেলের প্রতি কুলসুমের রাগের অন্ত নেই।

ছেলের কান্নার আওয়াজ পেতেই ঘরে এলো নাহিয়ান। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“আমার বাবা কাঁদছে কেন? কী হয়েছে?”

“বুঝতে পারছি না। ভেবেছিলাম খিদে পেয়েছে কিন্তু খাচ্ছেও না।”

“বিছানায় শুইয়ে দাও দেখি।”

স্বামীর কথামতো ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিলো তমা। নাহিয়ান গিয়ে বসলো বিছানায়। তার দিকে ঝুঁকে একটা ঝুনঝুনি বাজাতে বাজাতে চোখেমুখের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে লাগলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাচ্চাটির কান্না বন্ধ হলো। ছেলের কপালে চুমু খেলো নাহিয়ান। হাস্যজ্জ্বল মুখে স্ত্রীর উদ্দেশ্য বললো,“দেখলে তো আমার বাবার কান্না থেমে গেছে?”

মুচকি হেসে মাথা নাড়ায় তমা।

সবাইকে তাদের সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে উদাস মনে নিজ চেয়ারে বসে আছে তানিম। অল্পতেই রেগে যাওয়া পুরুষটির কী আজ মন খারাপ? বোঝা যাচ্ছে না। মায়ের কথায় নিজেকে সামলে নিতে পারলেও সেদিনের সেই অত্যন্ত সুখী এবং সুন্দর হাসির মেয়েটি তার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। বারবার আঁখি পটে ভেসে উঠছে অধরে বিস্তৃত চওড়া হাসিখানা। খুব ঈর্ষা জাগছে ওই পুরুষটির উপর যে ওই নারীকে নিজের করে পেয়েছে। যে পেরেছে ওই হাসিমুখের কারণ হতে।

আচ্ছা শ্রাবণ নামক পুরুষটি কী এমনি এমনিই অনুভা নামক স্নিগ্ধ মেয়েটিকে নিজের করে পেয়েছিল? মোটেও নয়। প্রিয় মানুষকে অতি সহজে কখনোই পাওয়া যায় না। প্রিয় মানুষকে জীবনে পেতে হলে অসাধ্য সাধন করতে হয়। শ্রাবণ তাই করেছে। নারীটির মন জিতেছে, এতকিছুর পরেও তাকে ছেড়ে যায়নি। এই নোংরা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে ঘর বেঁধেছে। আগলে রাখছে ভালোবাসা দিয়ে। যা তানিম পারেনি। সে একটু দেরিই করে ফেলেছিল মেয়েটির জীবনে আসতে।

চেয়ারে হেলান দিয়ে এসব ভাবনা ভাবার মধ্যেই তার কেবিনের দরজায় কেউ নক করল।মেয়েলী কণ্ঠস্বরে অনুমতি চাইলো,“আসবো?”

নিজেকে স্বাভাবিক করে মুখশ্রীতে গাম্ভীর্য এঁটে ঠিক হয়ে বসলো তানিম। বললো,“আসুন।”

তৎক্ষণাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল সাজিয়া। তাকে দেখতেই ভীষণ অবাক হলো তানিম। ততক্ষণে এসে তার সামনের চেয়ার দখল করে বসেছে সাজিয়া। টেবিলে রাখা পানি ভর্তি গ্লাসটি থেকে খেয়ে নিলো অর্ধেকটা পানি। পুরো ঘটনা মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করল তানিম। মেয়েটি তার পানে তাকাতেই সে একনাগাড়ে প্রশ্ন করল,“আপনি আমার অফিসে কী করছেন? কেন এসেছেন এখানে?”

সাজিয়ার সোজাসাপ্টা জবাব,“আপনার জন্যই তো এসেছি।”

“আমার জন্য?”

“হু, আপনার ওই শর্ত আমি মাথা পেতে গ্ৰহণ করে নিলাম স্যার। এমনিতেও জামাই ছাড়া আমার দিনকাল খুবই বিষণ্ণ কাটছে। ছেলে হিসেবে আপনি মন্দ নন। সমস্যা শুধু যখন তখন হুটহাট অযথা রেগে যান।”

অধর প্রশস্ত করে কিছু বলতে চাইলো তানিম কিন্তু তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে সাজিয়াই বলতে লাগলো, “তাতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি প্রচুর ড্রামা আর মুভি দেখি। সেখানেই দেখেছি জামাই রেগে গেলে কীভাবে রাগ ভাঙাতে হয়। অসব শিখে রেখেছি। অতো সুন্দর সুন্দর নায়করা যেই ফর্মুলাতে কুপোকাত হয়ে যায় সেই একই ফর্মুলাতে আপনার মতো চুনোপুঁটি পটবে না? উহু এমনটা তো হতেই পারে না। যাই হোক, চট করে তো বলে দিলেন বিয়ে এই সপ্তাহেই হবে অথচ বিয়ের কোনো তোড়জোড় নেই? এভাবে তো চলবে না, চলুন শপিং করতে যাবো।”

“শপিং? আমি?”

“আপনি নয়তো কে? একটা দেওরও তো নেই যে তাকে নিয়ে যাবো। যাই হোক, বিয়েতে আমি লাল টুকটুকে বেনারসি পরবো। বিয়ে হবে মসজিদে। অযথা খরচা করে লোক খাইয়ে লাভ আছে? বিপদের সময় এসব মানুষদের পাওয়া যায় না পাশে। তাই সেসব অর্থ না হয় গরীব মানুষদের দান করে দিবো। দারুন না বুদ্ধিটা?”

বুদ্ধিটা সত্যিই দারুন। মেয়েটির শেষের কথাগুলো মনে ধরেছে তানিমের। তাই উপরনিচ মাথা নাড়ায়। সাজিয়া উঠে দাঁড়ায়। তাড়া দিয়ে বলে,“নিন চলুন তবে। আর হ্যাঁ বাসরের জন্যও কিন্তু আলাদা ড্রেস কিনবো।”

“বাসরের জন্যও?”

“তো কী? আপনার জন্য স্পেশাল করে সাজতে হবে না? এমন সাজ সাজবো যে আপনি উল্টে পড়বেন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটির কথাতেই ভুলবশত সায় জানিয়ে দেয় তানিম। ড্রয়ার থেকে ওয়ালেট বের করে বেশি করে ক্যাশ সাথে নিয়ে বের হয় কেবিন থেকে।
__________

সকালেই নির্ধারিত সময়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে শ্রাবণ। এখন প্রায় দুপুরের শেষার্ধ। বিছানায় ক্লান্ত দেহখানা নিয়ে মলিন মুখ করে শুয়ে আছে অনুভা। শরীরটা আজ আর তার ভালো নেই। দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে আসতেই বমি করে সব উগ্রে দিয়েছে। বমি করতে করতে একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে জ্ঞান হারায় মেয়েটি। টাইলসযুক্ত শক্ত মেঝেতে পড়ে মাথার কিছুটা অংশ ফুলে গেছে। রক্ত জমাট বেঁধেছে সেথায়।

সবিতা একসময় তাকে ডাকতে ডাকতে উপরে এসে এমন অবস্থা দেখে ভড়কে যায়। ভিতু হয় তার মন। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে হাতেপায়ে তেল মালিশ করে একপর্যায়ে জ্ঞান ফেরাতে সক্ষম হয়। সবটা জিজ্ঞেস করতেই অনুভা তাকে জানায় সবকিছু। এরপর বেশ কয়েকবার শ্রাবণকে ফোন করার পরেও কলটা রিসিভ হয়নি। মোবাইল সুইচ অফ বলেছে বারংবার। তাই একপর্যায়ে সবিতাকে ফোন করতে বারণ করে দেয় অনুভা।

শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে তার। হুট করে এমনটা হওয়ায় থিতু হয়েছে মন। বমি বমি ভাবটা গতকাল থেকেই শুরু হয়েছে। সকালেও একবার হয়েছিল কিন্তু দুপুরের মতো অতটা নয়। তাহলে কী ফুড পয়জনিং হলো? আর কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করল না তার। বন্ধ করে নিলো নিজ আঁখি। একসময় পাড়ি দিলো ঘুমের রাজ্যে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হলো শ্রাবণের। ভার্সিটিতে ইদানিং তার খুব চাপ। সেমিষ্টার পরীক্ষা চলছে। তার উপর তার সাবজেক্টের পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। খাতাও পেয়ে গেছে হাতে। এখন সেগুলো চেক করতে হবে। কত ঝামেলা! দারোয়ানকে দিয়ে খাতাগুলো ভেতরে নিয়ে এলো শ্রাবণ। সোফায় রাখলো। পরে সেগুলো ঘরে নিয়ে যাবে। গলার টাই আলগা করতে করতে সবিতাকে প্রশ্ন করল,“নোভা কোথায়?দুপুরে খেয়েছে?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় সবিতা। তাকে সদর দরজা লাগানোর নির্দেশ দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোয় শ্রাবণ। তখনি পেছন থেকে সবিতা ডেকে ওঠে,“ভাইজান!”

পথিমধ্যে থেমে দাঁড়ায় শ্রাবণ। পেছন ফিরে শুধায়,
“কী?”

“ভাবী হঠাৎ কইরা অসুস্থ হইয়া পড়ছে। দুপুরে অনেকবার বমি করছে, অজ্ঞান হইয়া পইড়াও গেছিল। আপনেরে ফোন দিছিলাম কিন্তু তহন আপনের ফোন বন্ধ আছিল।”

চমকায় শ্রাবণ। দ্রুত পকেট হতে ফোনটা বের করে। পরীক্ষার হলে প্রবেশ করার আগে নিয়ম মাফিক মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিল সে। তারপর বিভিন্ন কারণে তা খোলার কথা ভুলেই গিয়েছে। দ্রুত বন্ধ মোবাইল খোলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো সে। কললিস্টে গিয়ে দেখে নিলো সত্যিই বেশ কয়েকটা কল এসেছিল।

ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো ঘুমন্ত স্ত্রীকে। সকালেই তো দেখে গেলো সুস্থ মেয়েটিকে অথচ এর মধ্যেই মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে, মলিনতায় আচ্ছাদিত হয়েছে। বিছানায় গিয়ে বসলো শ্রাবণ। আঘাতপ্রাপ্ত ক্ষত স্থানটি দেখে বুকটা মুচড়ে উঠলো। চুলের ভাঁজে হাত রেখে ডাকলো,“নোভা!”

কয়েক মিনিটেই ঘুম ভাঙলো অনুভার। সম্মুখে স্বামীকে বসে থাকতে দেখেই মলিন মুখে হাসির রেখা ফোটে উঠলো। ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। মিনমিনে স্বরে শ্রাবণ বললো,“স্যরি নোভা। আসলে আমি…”

তাকে আর কিছু বলতে দিলো না অনুভা। থামিয়ে দিয়ে বললো,“স্যরি বলার প্রয়োজন নেই। কর্মক্ষেত্রে যখন গিয়েছো ব্যস্ততা থাকাটাই স্বাভাবিক। অসুস্থতা তো আর বলে কয়ে আসে না।”

“সকালেও তো ঠিক ছিলে। তাহলে?”

“জানি না, মনে হয় ফুড পয়জনিং বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়েছে। অধিক বমির কারণে মাথাটা ঘুরে গেছে এই যা।”

কথাটায় মোটেও শ্রাবণের চিন্তা কমলো না। সে উঠে দাঁড়ালো। তাড়া দিয়ে বললো,“পরনের পোশাক বদলানোর প্রয়োজন নেই। এর উপরেই বোরকা পরে নাও। হসপিটালে যাবো আমরা।”

“এই সামান্য কারণে হসপিটালে কেন যাবো? কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমার এখন ভালো লাগছে না।”

“চুপ থাকো। এরপর বড়ো কিছু ঘটে গেলে? দ্রুত তৈরি হয়ে নাও।”

“তুমিও তো মাত্রই….”—–বাকিটা আর বলতে পারলো না অনুভা। শ্রাবণের রাগান্বিত দৃষ্টি দেখতেই চুপসে গেলো। ছেলেটি সহজে রাগে না। বিশেষ করে তার উপর তো একদম নয় কিন্তু আজ যেনো রেগেই গেলো।

ছোটো ছোটো কদম ফেলে অধিক সময় নিয়ে বোরকা আর হিজাব পরিধান করে নিলো অনুভা। তার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো শ্রাবণ। বাড়ির গাড়িতে সমস্যা হওয়ায় ড্রাইভার মেকানিক নিয়ে এসেছিল তা মেরামত করতে। শরীর কিছুটা ক্লান্ত থাকায় নিজে আর ড্রাইভ করল না শ্রাবণ। তবে বাহিরে সেই ক্লান্তি কিছুতেই সে প্রকাশ করল না।

হাসপাতালে পৌঁছে আগে স্ত্রীর ক্ষত স্থান ড্রেসিং করিয়ে তারপর ভালো একজন গাইনীর সঙ্গে কথা বললো শ্রাবণ। ভদ্রমহিলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতেই ইতস্তত কণ্ঠে অনুভা বলেই দিলো,“গতকাল থেকেই অস্থির অস্থির লাগছিল। সকাল থেকে বমি বমি ভাবটা শুরু হয়েছে আর সাথে মাথাটাও চক্কর দিচ্ছিল কিন্তু বুঝতে পারিনি এমনটা হবে।”

কথাটা শুনতেই ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফেটে পড়ল শ্রাবণ। মেয়েটি কিনা এসব জানালোই না তাকে? সচরাচর সে রাগে না। রাগলেও নিজের রাগ দমন খুব ভালো ভাবেই করতে পারে। বাহ্যিকভাবে রাগটাকে নিয়ন্ত্রনে রাখলো। সমস্যাগুলো শুনে একগাদা টেস্ট করাতে দিলেন ডাক্তার। টেস্ট করিয়ে তারপর আবার রিপোর্টগুলো নিয়ে উনাকে দেখাতে হবে।

অনুভার সঙ্গে একটা বাক্যও আর বিনিময় করল না শ্রাবণ। মেয়েটির উপর সে রেগে আছে। তার এই খামখেয়ালিপনাই রাগের মূল কারণ। তার উপর সারাদিনে এখনো একটুও নিজের বিশ্রাম নেওয়া হয়নি। দুপুরে খাওয়াটাও ঠিকমতো হয়নি। ওদিকে স্ত্রীর হঠাৎ কী হলো সে বিষয়ে চিন্তা। এত ঝোট ঝামেলা একটা মানুষের পক্ষে নেওয়া কী সম্ভব?

সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর রিপোর্ট হাতে পেতে আরো ঘন্টাখানেক হাসপাতালে বসে থাকতে হলো। শরীর এখনো গোলাচ্ছে অনুভার। মাথায় চিনচিনে ব্যথা করছে। তবুও ঠাঁয় বসে আছে। মুখ ফোটে কিছুই বলছে না শ্রাবণকে। তার আরো আধ ঘণ্টা পর ভেতরে তাদের ডাক পড়ল। শ্রাবণ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললো,“তুমি এখানে বসো। আমি কথা বলে আসছি।”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করে শ্রাবণ। রিপোর্টের ফাইলটা ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে দিতেই তিনি মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলেন সেসব কাগজ।

অনুভা বসেই আছে চুপচাপ।বিরক্ত লাগছে সবকিছু। নিজের উপর রাগ হচ্ছে। সকালে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে নিলেই তো এই ঝামেলায় আর তাকে পড়তে হতো না। কিছুক্ষণ বাদে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো শ্রাবণ। হাবভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। বললো,“এখানকার কাজ শেষ। প্রেসক্রিপশন মাফিক কিছু ওষুধ কিনে একেবারে বাড়ি ফিরবো।”

উঠে দাঁড়ালো অনুভা। তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,“কী ফুড পয়জনিং হয়েছে তাই না? আমি বলেছিলাম অযথা আসার প্রয়োজন নেই। সেই তো এলে? এতক্ষণ বাড়িতে একটু বিশ্রাম নিতে পারতে।”

অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে স্ত্রীর পানে তাকায় শ্রাবণ। তার এহেন দৃষ্টিতে হতচকিত হয়ে থেমে যায় অনুভা। জোরপূর্বক কৃত্রিম হেসে চুপচাপ চলতে থাকে।
_________

রাত সাড়ে দশটা। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই গোসল সেরে একেবারে রাতের খাবার খেয়ে শুয়েছে শ্রাবণ। টানা দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। মোবাইলে এলার্ম বাজছে। এলার্ম দিয়েই ঘুমিয়েছিল সে। অনেক কাজ পড়ে আছে। পুরো ঘরে চোখ বুলিয়েও কোথাও অনুভাকে দেখতে পেলো না। এত রাতে কোথায় গেলো মেয়েটি?

বাথরুমে চলে এলো শ্রাবণ। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে পুরোপুরি তন্দ্রা ভাবটা দূর করে বেরিয়ে এলো। তৎক্ষণাৎ দেখা পেয়ে গেলো অনুভার। সবেই সে ঘরে এসেছে। দরজা লাগিয়ে পেছন ফিরতেই স্বামীকে দেখে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,“ঘুম ভেঙেছে?”

উত্তর দিলো না শ্রাবণ। বিপরীতে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলে কেন?”

“সবিতা আপা চলে গেছেন তাই দরজা আটকে সব লাইট নিভিয়ে এলাম।”

“শরীর কী এখনো খুব খারাপ লাগছে? মাথা ঘোরানো, বমি বমি ভাবটা কেটেছে?”

“তখনকার মতো অতটা খারাপ এখন আর লাগছে না। তাছাড়া খাবারের পরপরই তো ওষুধ খেলাম।”

বিপরীতে কিছু বললো না শ্রাবণ। নিরবে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো বারান্দায়। তার এই গম্ভীর আচরণ কিছুতেই নিতে পারছে না অনুভা। পেছন পেছন সেও এসে দাঁড়ালো পাশে। কাঁচুমাচু মুখ করে নত স্বরে বললো,“তুমি কী আমার উপর খুব রেগে আছো শ্রাবণ? আমি অতকিছু ভেবে তোমার থেকে আড়াল করিনি ব্যাপারটা। এমনকি আমি তো বুঝতেও পারিনি….”

কথার মধ্যখানেই তার হাত ধরে হেঁচকা টানে নিজের সঙ্গে তাকে মিশিয়ে নিলো শ্রাবণ। পুরুষটির হৃদযন্ত্রের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে অনুভা। শরীর জুড়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো তার। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে শ্রাবণ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,“আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে তিনবার সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত হয়েছি, এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতি আমার ভেতরে তোলপাড় করেছে। প্রথমবার হচ্ছে, যখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম অনুভা নামক একটি মেয়েকে আমি ভালোবাসি। দ্বিতীয়বার, যখন তিন কবুলের মাধ্যমে হালাল ভাবে আজীবনের জন্য তোমায় নিজের করে আমি পেয়ে গেলাম। আর তৃতীয়বার হচ্ছে আজ, আজ আমার ভেতরে অন্য এক নাম না জানা অনুভূতি কাজ করছে নোভা। সেই অনুভূতি অদ্ভুত যা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আর চাইলেও আমি তোমায় তা দেখাতে পারবো না।”

অনুভা ধৈর্য্য সহকারে মনোযোগ দিয়ে তা শুনছে। কথাগুলো বলতে বলতে শ্রাবণের চোখ ভিজে উঠলো। গলার স্বর ভারী হলো। শুকনো ঢোক গিলে কিছুটা সময় নিলো। অতঃপর ফিসফিসিয়ে বললো,“প্রিয় নোভা, ভালোবাসি তোমায়। ভালোবাসি তোমার ওই গর্ভে আসা আমার ছোট্ট পবিত্র ফুলকে।”

হতচকিত, হতভম্ব হলো অনুভা। বাঁধন হতে মুক্ত হয়ে মাথা তুলে তাকালো শ্রাবণের পানে। দৃষ্টি নিবদ্ধ করল ওই পুরুষালি আঁখি যুগলের মধ্যে। আপনা আপনি নিজ ডান হাতটি তার পেটে চলে গেলো। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে ফের তাকাতেই তৃপ্ত হাসলো শ্রাবণ। সুগভীর বাক্যে বললো,“কংগ্ৰাচুলেশন মিসেস নোভা, ইউ আর প্রেগন্যান্ট।”

কী প্রতিক্রিয়া করা উচিত বুঝতে পারলো না অনুভা। তার শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে এলো। পূর্বের ন্যায় আশ্রয় নিলো প্রিয় পুরুষের বুকে। ভেজা স্বরে বললো,“সবাই পেয়েছে সুখের সন্ধান আর আমি পেয়েছি আস্ত একটা সুখ। তুমি আমার সুখ শ্রাবণ। অথচ এই সুখ আমার পাওয়ার কথা ছিলো না। তোমার মতো সুখ এবং শুদ্ধ পুরুষের ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে আমার এই বিশ্বের সবচেয়ে সুখী নারী মনে হচ্ছে। কেন আমি এত সুখী বলো তো?”

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অনুভা। তার চোখের পানিতে ভিজতে লাগলো শ্রাবণ নামক শুদ্ধ পুরুষটির পরনের শার্ট। কিন্তু সে এই মেয়েটিকে ছাড়লো না। বাঁধন আরো শক্ত হলো। এ কান্না যে সুখের কান্না। এ কান্না হারিয়েও প্রাপ্তির কান্না।

(~সমাপ্ত~)

[শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে গল্পটি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের। গল্পে হয়তো অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।]

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৩৭

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৭]

অপেক্ষা শব্দটি মানুষের সঙ্গে মানানসই হলেও সময়ের সাথে শব্দটি খুবই বেমানান। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, করতে পারে না।মানুষ আসে, মানুষ হারায় কিন্তু সময় তার নিজ গতিতে চলতে থাকে। ক্যালেন্ডারের সংখ্যা বদলায়। এই তো মাস দুয়েক আগে পুরোনো ফ্ল্যাট ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে অর্থিকা। তার ফ্ল্যাট বদলানোর খবর পেয়ে অনুভাও ছুটে এসেছিল। সবকিছু গোছগাছ করতে বড়ো বোনকে সে সাহায্য করেছে।

বাহিরে আজ পূর্ণিমা রাত। আকাশে রূপোর থালার ন্যায় বিশাল আকৃতির চাঁদ। তার সাথে বারান্দা হতে ভেসে আসছে ফুলের মিষ্টি গন্ধ। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে অনুভা। মন তার ভীষণ খারাপ। শান্তা এবং হানিফ শেখ বাড়িতে নেই তিনদিন হলো। উনারা গেছেন সৌহার্দ্যের কাছে। ওখানে মাস খানেক থেকে তারপর হজ্জ করে বাড়ি ফিরবেন। এটাই যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন পুত্র এবং পুত্রবধূকে। কয়েক মাসেই সংসার জীবনে এসে শাশুড়ির মধ্যে মাতৃত্বের স্বাদ খুঁজে পেয়েছিল অনুভা। এখন হুট করে উনারা চলে যাওয়ায় মনটা তার ভীষণ খারাপ।

নিচ থেকে ঘরে এসে প্রবেশ করল শ্রাবণ। আড়চোখে স্ত্রীকে দেখে নিয়ে বসে পড়ল সোফায়। ঘাড় উঁচিয়ে তার পানেই তাকালো অনুভা। মিলিত হলো দুজনার দৃষ্টি। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করল,“নোভা রাণীর মন খারাপ?”

অনুভা ছোট্ট করে উত্তর দিলো,“উহু।”

শব্দহীন হাসলো শ্রাবণ। উঠে এসে কাবাডের দরজা খুলে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করল,“শাড়ি নাকি থ্রী পিছ?

“মানে?”

“দুটোর মধ্যে কোনটা পরবে?”

“শাড়ি তো পরেই আছি তাহলে আবার কেন পরবো?”

“এভাবেই কী বাহিরে যাবে নাকি? উহু আমি তো এ হতে দিবো না। আমি ব্যতীত আমার বউকে খোলা চুলে অন্য কেউ কেন দেখবে?”

“এখন বাহিরে?”

“হুম, চলো ঘুরে আসি। যতোই হোক বউয়ের মন ভালো করার দায়িত্বটাও তো আমিই নিয়েছি তাই না?”

মুচকি হাসলো অনুভা। তাকে তাড়া দিয়ে নিজের পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো শ্রাবণ। তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতে তাদের আধ ঘণ্টা সময় লাগলো।

সময়টা এখন বর্ষাকাল। রাতের আকাশে নেই কোনো মেঘমালার দল। সকালেই ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। ভিজিয়ে দিয়ে গেছে শহরতলী। কংক্রিটের রাস্তা অনেক আগেই শুষে নিয়েছে বৃষ্টির পানি। তবুও রাস্তার আনাচে কানাচে দৃশ্যমান মাটি হয়ে আছে কর্দমাক্ত। গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বের করল শ্রাবণ। অনুভার গায়ে নীল গোলাপী রঙের মিশ্রণে সিল্কের শাড়ি। মাথায় নীল রঙের হিজাব। শাড়িটি অতি সাবধানে ধরে গাড়িতে উঠে বসলো সে। শ্রাবণও তৎক্ষণাৎ চালকের আসনে উঠে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে নয়টা ছুঁইছুঁই। একটি রেস্তোরাঁর কার্নিশের টেবিলে বসে আছে তানিম। চোখেমুখে ফোটে উঠেছে তার বিরক্তির ছাপ। একটু পরপর হাত ঘড়িতে সময় দেখছে আর বিড়বিড় করছে। আরো কিছু মিনিট পার হতেই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো সে। তখনি দ্রুত একটি মেয়ে এসে তার সম্মুখ চেয়ারে বসলো। অপরাধীর ন্যায় কোমল স্বরে বললো,“স্যরি স্যরি। আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। আসলে রাস্তায় এত জ্যাম ছিলো যে কী বলবো? জ্যামের কারণেই আরকি দেরিটা হলো। আপনি কী অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন?”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো মেয়েটি। তানিম ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,“মিস. সাজিয়া?”

মেয়েটি উপরনিচ মাথা নাড়ায়। এবার রাগত স্বরেই তানিম বলে উঠলো,“ঠিক পয়ত্রিশ মিনিট লেইট হয়েছে আপনার। আমার কী সময়ের কোনো দাম নেই? শুধু মায়ের কথায় অফিস শেষে এখানে এসে এতক্ষণ অপেক্ষা করেছি, নইলে।”

“ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়। চটছেন কেন? ধরুন আজ যদি আমার জায়গায় আপনি থাকতেন? আমি কী এভাবে রাগ করতে পারতাম? উহু মোটেও রাগ করতাম না হুহ।”

“আমি আপনার মতো কেয়ারলেস নই যে কাউকে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করাবো।”

“শাশুড়িমা তাহলে ঠিকই বলেছিল, তার ছেলে তো সত্যি সত্যিই একটা বদমেজাজি।”

“কে শাশুড়িমা?”

“কে আবার? আপনার মা।”

“আমার মা আপনার শাশুড়ি হলো কীভাবে?”

“বদমেজাজির পাশাপাশি তো আপনি দেখছি ভারি বোকা পুরুষ! আপনার সাথে আমার বিয়ে হলে তো আপনার মা আমার শাশুড়িই হবে তাই নয় কি?”

মেয়েটার এমন দ্বারা কথাবার্তা কিছুতেই পছন্দ হলো না তানিমের। সাথে মেয়েটার এমন সময়জ্ঞানহীন স্বভাবও না। গম্ভীর মুখে বলে উঠলো,“উহু বিয়ে হচ্ছে না। আপনাকে আমার একদম পছন্দ হয়নি।”

সাজিয়ার ললাটে ভাঁজ পড়ল। ব্যাগ থেকে ছোটো বিউটি আয়নাটা বের করে নিজের মুখশ্রীতে ভালো করে চোখ বুলিয়ে বললো,“না খারাপ তো লাগছে না। তাহলে পছন্দ না হওয়ার কারণ কী?”

“আপনার কী মনে হয় আপনাকে অপছন্দ হওয়ার কারণ আপনার রূপ?”

“অবশ্যই। আমি সুন্দরী একটি মেয়ে। পছন্দ হবে না কেন?”

“সৌন্দর্য ধুয়ে কী আমি পানি খাবো নাকি? আপনার বাচনভঙ্গিতে প্রচুর ন্যাকামি রয়েছে আর আমার এইসব ন্যাকামি একদম পছন্দ নয়। তার উপর আপনার সময়জ্ঞান বলে কিচ্ছু নেই।”

“মেয়েরা ন্যাকামি করবে না তো কে ন্যাকামি করবে? আপনি? আনরোমান্টিক পুরুষ। যাই হোক এসব আঁতলামি স্বভাব বাদ দিন। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।”

“আমার হয়নি।”

“কেন যে হয়নি জানি না ভেবেছেন নাকি?”

“কী জানেন?”

“এই যে এক মেয়েকে পছন্দ করে তার জন্য বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছিলেন কিন্তু মেয়েটি আপনায় রিজেক্ট করে দিয়ে তার প্রেমিককে বিয়ে করে নিয়েছে তাই তো?”

হতভম্ব হয়ে গেলো তানিম। এই মেয়ে এসব কথা কোত্থেকে জানলো? কে বলেছে তাকে? মা? মা কেন তার মান সম্মান এর কাছে নষ্ট করবে? তাহলে? ভীষণ রাগ হলো তানিমের। আর কথা বাড়াতে চাইলো না। এখান থেকে চলে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করল। তাই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো পরিচিত মুখশ্রীর। তৎক্ষণাৎ পূর্বের স্থানেই বসে পড়ল তানিম। তার এহেন কাণ্ডে ভ্রু কুঁচকে নিলো সাজিয়া। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“আপনার আবার কী হলো?”

উত্তর দিলো না তানিম। তার থেকে কয়েক টেবিল দূরত্বের একটি টেবিলে বসে আছে অনুভা। এই রেস্তোরাঁটা এখানকার বেশ নাম করা একটি রেস্তোরাঁ। বন্ধুদের সঙ্গে এর আগেও বেশ কয়েকবার এখানে এসেছিল শ্রাবণ। তাই আজ স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতেই প্লান করে নিয়েছিল যে আগে ডিনার করবে তারপর ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফিরবে।

মন খারাপটা মুহূর্তেই যেনো মিলিয়ে গেছে অনুভার। অধরে তার চমৎকার হাসি। শ্রাবণের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আশেপাশের সাজসজ্জা দেখতে ব্যস্ত সে। হঠাৎ সামনের দিকে দৃষ্টি যেতেই তানিমের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। ভেতরে ভেতরে কিছুটা চমকালেও উপরে উপরে বেশ স্বাভাবিক রইলো অনুভা। একটি মেয়ের সঙ্গে বসে আছে তানিম। তবে মেয়েটির মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসে আছে।

চোখ ছোটো ছোটো করে স্ত্রীর পানে তাকালো শ্রাবণ। বাম গালটা আলতো করে টিপে দিয়ে মিহি স্বরে বললো,“সামনে আমি থাকতে অন্যদিকে কী মেয়ে? জানো আমি ক্লাসে থাকাকালীন সবাই হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।”

মুচকি হাসলো অনুভা। দৃষ্টি সরিয়ে শ্রাবণের পানে তা স্থির করল। বললো,“এই কথা শুনতে শুনতে আমার কানটাই মনে হয় নষ্ট হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ তারা হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে তোমায় দেখে না বরং তোমার পড়া শুনে।”

“তাহলে আর কী? তুমি বরং আমায় শোনো।”

হাসিটা চওড়া হলো অনুভার। মুগ্ধ নয়নে তার পানেই তাকিয়ে রইলো শ্রাবণ। ততক্ষণে খাবার দিয়ে গেছে ওয়েটার। চামচ দিয়ে খাবার তুলে অনুভার মুখের সামনে ধরে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করল,“মন ভালো হয়েছে?”

খাবারটা মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে অনুভা উত্তর দিলো,“অর্ধেকটা।”

এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো শ্রাবণ। পুনরায় প্রশ্ন করল,“পুরোটা কখন ভালো হবে?”

“এখান থেকে বের হয়ে আরেকটু ঘুরলে।”

প্রত্যুত্তর করল না শ্রাবণ। অধরে হাসি রেখেই খেতে লাগলো। একদৃষ্টিতে তাদের দেখে গেলো তানিম। দেখে নিলো আজ অন্য এক অনুভাকে। এক প্রাণবন্ত হাস্যজ্জ্বল মেয়েকে। মনে মনে আওড়ালো, মেয়েটির হাসি সুন্দর।সাজিয়া তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে কণ্ঠে বিরক্তি ফুটিয়ে বললো,“এতক্ষণ তো ভালোই জ্ঞান দিচ্ছিলেন আমায়।তাহলে এখন কোথায় গেলো আপনার সেই জ্ঞান? আমার কথার জবাব না দিয়ে নিজের মতো বসে আছেন?”

তানিমের দৃষ্টি সরলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে এবার সামনে বসা অপরিচিত মেয়েটির পানে তাকালো সে। মেয়েটি দেখতে মন্দ নয়। মুখের গড়ন তার সুন্দর। পরনে বেগুনী রঙের শাড়ি। চুল‌ হাত খোঁপা করা। চোখে নিখুঁতভাবে কাজল দেওয়া। দু হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি।হুট করেই সিদ্ধান্ত বদলালো তানিম। শুকনো ঢোক গিলে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বলে উঠলো,“আপনার চুল সুন্দর। আমার বউয়ের সুন্দর চুল আমি ছাড়া আর কেউ দেখুক তা আমি চাই না। আপনার চোখটাও অসম্ভব সুন্দর। কাজলে যেনো মারাত্মক লাগে। আর বিয়ে হলে এই সপ্তাহেই হবে। শর্তে রাজি থাকলেই আমায় ফোন করবেন নয়তো ফোন করার প্রয়োজন নেই।”—কথাগুলো বলেই টেবিলের উপর একটা কার্ড রেখে বিল মিটিয়ে বড়ো বড়ো কদম ফেলে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেলো তানিম। যাওয়ার সময় আড়চোখে দেখে গেলো সেই সুখী দম্পতিকে।

সাজিয়া অবাক হলো ছেলেটির কাণ্ড কারখানা দেখে। এভাবে হুট করে কিনা তাকে একা রেখে চলে গেলো? এখন না বললো পছন্দ হয়নি? তাহলে আবার বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক করে ফেললো কেন? অদ্ভুত! কার্ডটি হাতে তুলে নিয়ে সেখান থেকে নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করল সাজিয়া। অর্ডার দিলো এক মগ কফি। এসেছেই যখন তাহলে কফি খেয়েই না হয় বাড়িতে ফেরা যাবে।

খাওয়া শেষে বিল মিটিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বের হলো শ্রাবণ। পথেই অনুভা বায়না ধরলো রিক্সায় করে শহর ঘুরবে সে। স্ত্রীর আবদার পূরণ না করার মতো পুরুষ শ্রাবণ নয় তাই গাড়িটি সঠিক স্থানে পার্ক করে একটা রিক্সা ঠিক করে ওঠে পড়ল তাতে। হুড নামানো থাকায় পেছন দিয়ে হাতটা নিয়ে অতি যত্ন সহকারে স্ত্রীর বাহুতে ধরে রাখলো শ্রাবণ। যাতে আঁকাবাঁকা পথে গিয়ে ঝাঁকি খেয়েও মেয়েটি পড়ে না যায়। তার এত যত্নশীলতায় তৃপ্তির হাসি ফোটে ওঠে অনুভার অধরে। এত ভালো একজন জীবনসঙ্গী তার ভাগ্যে লিখে রাখায় মনে মনে শোকরিয়া আদায় করে রবের। পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বড়ো বোনের প্রতি। সে তো বারবার বিভিন্ন শঙ্কায় এই পুরুষটিকে নিজের থেকে দূরে সরাতে চেয়েছে অথচ বড়ো বোন অমন উদ্যোগ নেওয়াতেই তো আজ সুখের সন্ধান পেয়েছে মেয়েটি। সব ক্ষততে লেপ্টে গেছে শ্রাবণ নামক শুদ্ধ পুরুষের ভালোবাসা।

আরো বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে অবশেষে বাড়ি ফিরলো দুজনে। পূর্বের দিনের তুলনায় আজকের দিনটা ছিলো অনুভার নিকট এক বিশেষ দিন।
_________

শ্বশুর শাশুড়ির আগমনে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে প্রান্তি। সৌহার্দ্য অফিসে। হানিফ শেখ অ্যাপার্টমেন্টের খোলামেলা বারান্দায় কফি নিয়ে বসে ইংরেজি পত্রিকা পড়ছেন। রান্নাঘরে ব্যস্ত শাশুড়ি-বউমা। দেশে থাকাকালীন সময়টা খুবই স্বল্প হওয়ায় শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি প্রান্তির। শাশুড়ি নামক মানুষটি তার কাছে শুধু শাশুড়ি হিসেবেই পরিচিত ছিলো।তবে এ কদিনে সম্পর্কের বিশেষ উন্নতি হয়েছে। রন্ধনে অদক্ষ মেয়েটি শাশুড়ির থেকে শিখে নিচ্ছে স্বামীর পছন্দনীয় বাঙালি সব রান্না।

সুপার শপ ঘুরে সকালের দিকেই খুঁজে খুঁজে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে শাশুড়ি আর বউমা মিলে। নাড়ু বানানোর জন্য নারকেল কোরাচ্ছেন শান্তা। উনার হাতের দিকে মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রান্তি। আজকের রেসিপি হচ্ছে নাড়ু, পাটিসাপটা আর পিঠেপুলি। এখানে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। ঠাণ্ডার মধ্যে পিঠে না হলে কী আর জমে? তার উপর পিঠা, নাড়ুসহ মিষ্টি জাতীয় সব ধরণের খাদ্যই সৌহার্দ্যের নিকট খুবই প্রিয়। প্রান্তি বললো,“এত কষ্ট করার কী প্রয়োজন মা? এর থেকে নারকেল ছোটো ছোটো করে কেটে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করলেই তো হয়ে যায়‌।”

পুত্রবধূর কথায় শব্দহীন হাসেন শান্তা। বলেন,“ব্লেন্ড করলে তো ভর্তা হয়ে যাবে। তাতে কোরোনো নারকেলের মজা তো পাওয়া যাবে না মা।”

“কিন্তু এটা অনেক কঠিন আর সময়ের ব্যাপার।”

“তা অবশ্য ঠিক কিন্তু ভালো কিছু পাওয়ার জন্য তো কঠিন কাজ করতেই হয় তাই নয় কি?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় প্রান্তি। শান্তা পুনরায় বলেন,
“প্রথম প্রথম একটু কঠিন লাগবেই। একবার শিখে গেলে দেখবে আর কঠিন লাগবে না। তাছাড়া সহুর আবার এসব খুব পছন্দের। এসব পেলে ওর আর কিছুই চাই না।”
__________

অন্যান্য দিনের থেকে শুক্রবারটা অনুভার প্রিয়। বিয়ের আগের শুক্রবার আর বিয়ের পরের শুক্রবারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে অনেক। বিয়ের আগের শুক্রবার মানে তার কাছে ছিলো সংসারের দায়িত্ব অথচ বিয়ের পরের শুক্রবারটা একেবারে ভিন্ন। এখন নেই তার কোনো চিন্তা। জীবনের নেই কোনো জটিলতা। সকাল থেকে শ্রাবণকে বিভিন্ন ভাবে রাজি করিয়ে আজ সে বোনের কাছে এসেছে। গত দুই সপ্তাহ হয় তাঈম কিংবা অর্থিকার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয় না অনুভার।

অর্থিকাকে আজ আর রান্না করতে হলো না। শ্রাবণ বাহির থেকে খাবার আনিয়েছে। দুপুরে সবাই একসঙ্গে গল্প করতে করতে খেয়ে উঠলো। খাওয়ার পর তাঈমকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে চলে গেলো শ্রাবণ। আসার সময় ছেলেটার জন্য অনেক খেলনা কিনে নিয়ে এসেছে। সেগুলোই তো তাকে দেখাতে হবে।

এঁটো প্লেটগুলো ধুয়ে নিচ্ছে অর্থিকা। অনুভা চাইলো বোনকে সাহায্য করতে কিন্তু অর্থিকা তাকে হাত লাগাতে দিলো না। পাশে দাঁড়িয়েই হাঁসফাস করছে অনুভা। ইতস্ততবোধ করছে কিছু বলতে। বোনের এমন অবস্থা দেখে আড়চোখে তাকিয়ে অর্থিকা শুধালো, “কিছু বলবি? এমন ইতস্তত করছিস কেন?”

বড়ো বোনের অনুমতি পেয়ে অনুভার কণ্ঠস্বর দৃঢ় হলো,“ফায়াজ ভাই তোকে সত্যিই খুব ভালোবাসে আপু।”

“তা তো আমি জানিই কিন্তু তুই জানলি কীভাবে?”

“বাড়ি বদলানোর সময় উনার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ওইটা ফায়াজ ভাইদেরই বাড়ি ছিলো।”

প্রত্যুত্তর করল না অর্থিকা। বড়ো বোনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার গালে আলতো করে হাত রেখে অনুভা বললো,“তোকে সে বিয়ে করতে চায়। তাঈমকে নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই। তার চোখে তোর জন্য আমি ভালোবাসা দেখেছি আপু। নতুন করে শুরু কর না সবটা। এতে তাঈম বাবার ছায়াতল পাবে, বাবার ভালোবাসা পাবে। আর তোর এই একাকিত্বটাও ঘুচবে।”

হাসলো অর্থিকা। যেই হাসিতে নেই কোনো বিষাদের ছাপ আর না আছে আনন্দ। বললো,“ভালোবাসা এক অদ্ভুত অনুভূতি। যারা ভালোবাসে তারা এই অনুভূতির মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। মানুষটি যদি সঠিক হয় তাহলে সেই মানুষটির স্মৃতি নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। পৃথিবীতে বাবা ছাড়া ছেলে-মেয়েরা কী বড়ো হচ্ছে না? স্বামীর অবর্তমানে কী নারীদের জীবিকা চলছে না? আমি বিবাহিতা নারী, হয়তো বিধবা তবে আমার সন্তানের পিতৃ পরিচয় রয়েছে। আমার সন্তানের বাবা মৃ’ত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে আর আমাদের সন্তানকে ভালোবেসে গেছে, নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছে। তার জায়গায় অন্য কাউকে স্থান দেই কী করে বল তো অনু? এ তো অসম্ভব। তুই আমায় বাস্তবতা বুঝিয়েছিস আর আমি বুঝেছি। তুই আমায় মুভ অন করে ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখিয়েছিস, আমিও তা শিখে গেছি। এবার অন্তত বলিস না আবার নতুন করে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সব নতুন করে শুরু করতে। জীবন মানেই শুধু বিয়ে নয়, সুখ মানেই বিয়ে নয়। আমি সম্মানের সাথেই এই পৃথিবীতে বাঁচবো। আমার সন্তান একদিন বড়ো হবে। আমিই ওর বাবা আর আমিই ওর মা। জীবন যেভাবে চলছে সেভাবেই না হয় চলুক। বিয়ের কথা আমি ভাবতে পারি না। এমন কথা শুনলে আমার কষ্ট বেড়ে যায়। আমি অসুখী হয়েও সুখী। আমার সুখ আমার স্বামীর স্মৃতি।”

নিরবে সব শুনলো অনুভা। কিন্তু বিপরীতে আর কিছুই বলতে পারলো না। অর্থিকার প্রতিটি কথাই যুক্তিযুক্ত। বিয়ে মানেই সব সমস্যার সমাধান নয়। ভবিষ্যতে কী হবে কী হতে চলেছে তা একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালাই তো জানেন।

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৩৫+৩৬

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৫]

কামরুল হাসানের কবরের পাশেই সুফিয়াকে কবর দেওয়া হলো। মায়ের লাশ নিয়ে সকলে বাড়ি ত্যাগ করতেই একেবারে নিরব হয়ে গেলো অনুভা। চোখের বর্ষন থেমে গেলো তার। হৃদয় হয়ে গেলো কঠোর। স্ত্রীকে অপরিচিত মানুষদের কাছে রেখেই শাশুড়ির কবরের কাছে গিয়েছিল শ্রাবণ। কবর দেওয়া হতেই সকলের সাথে বাড়ি ফিরে এলো সে। সদর দরজার সম্মুখে বড়ো চাচীর সাথে দেখা হতেই তিনি তাকে দেখিয়ে দিলেন অনুভার অবস্থানরত ঘরটি। তাই আর বিলম্ব না করে সেদিকেই পা বাড়ালো শ্রাবণ। তখনি তাকে মুখোমুখি হতে হলো সেজো চাচা আতিউরের সঙ্গে। লোকটি ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত করে বিদ্রুপের সুরে বললেন,“আমার সন্দেহই তাইলে ঠিক আছিল। কামরুলের মরার দিনই তোমারে দেইখা আমি বুঝছিলাম যে তোমার লগে অনুর সম্পর্ক আছে কিন্তু তুমি তো লগে লগেই তা অস্বীকার করছিলা। অথচ আইজ তোমার লগেই অনুর বিয়া হইলো।”

ভেতরে ভেতরে শ্রাবণ বেশ চিন্তিত এবং ব্যথিত। তবুও ভদ্রলোকের সম্মুখে অধরে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললো,“সম্পর্ক থাকলেই কী সবাইকে ঢাকঢোল পিটিয়ে জানাতে হবে নাকি? তাই বলার প্রয়োজন মনে করিনি।”

“তুমি অনেক চতুর পোলা।”

“তবে আপনাদের মতো অতটাও নই।”

“দেইখা তো তোমারে ভালা পরিবারের পোলাই মনে হয় তাইলে কী দেইখা এই মাইয়ারে বিয়া করলা কও তো? তাগো সব খবর জানো তো? নাকি সবকিছু গোপন রাইখাই হের মায় তোমার উপরে মাইয়ারে চাপাইয়া দিছে?”

“ভাইয়ের মেয়ের সুখ বুঝি সহ্য হচ্ছে না আপনার? তাই সংসার ভাঙার জন্য কানপড়া দিতে চলে এসেছেন?”

এমন একটি কথা যেনো মোটেই আশা করেননি লোকটি। তাই সঙ্গে সঙ্গে চুপসে গেলেন তিনি।মুখশ্রীতে নেমে এলো একঝাঁক তমিস্রা। শ্রাবণ পুনরায় বললো,“আমি সবকিছুই জানি। তাদের পরিবারের সাথে কী হয়েছে, আপনারা কী করেছেন সব জানি। সব জেনেই বিয়ে করেছি। আশা করি মনে আর কোনো সন্দেহ নেই?”

লোকটি দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে লোকটিকে পাশ কাটিয়ে চলে এলো শ্রাবণ। অনুভা বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে চুপচাপ। আজ পুরো এলোমেলো লাগছে মেয়েটিকে। ঘরে আসতেই হিজাবটা খুলে চাচী তার মাথার মধ্যিখানে ঠাণ্ডা তেল লাগিয়ে দিয়েছেন। শ্রাবণ এসে তার সম্মুখে বসলো। পরনের আধ খোলা ওড়নাটা ঠিক করে বুকে জড়িয়ে দিয়ে মুখশ্রীতে অসংখ্য চুমু খেলো। নিজ বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,“আমরা আজই বাড়ি ফিরবো নোভা।”

জোরপূর্বক তার বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার মুখের দিকে তাকালো অনুভা। ভাঙা স্বরে বললো, “মা ওখানে একা। আর আমরা চলে যাবো?”

“মা কোথায় একা? তোমার মায়ের কবরের পাশে তোমার বাবার কবর। তাহলে মা একা কোথায়? তুমি এভাবে কাঁদলে, কষ্ট পেলে অর্থি আপুকে কে সামলাবে বলো তো? এসে থেকে একবারও আপুর সঙ্গে কথা বলেছো? তাছাড়া তোমার মায়ের আত্মাও তো কষ্ট পাবে। বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করো নোভা। যাতে উনারা কবরের আজাব হতে পরিত্রাণ পান।জান্নাতবাসী হন।”

এতক্ষণ বাদে বড়ো বোনের কথা খেয়াল হলো অনুভার। বিছানা থেকে নেমে গেলো সে। শ্রাবণ প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এই মেয়ে যাচ্ছো কোথায়?”

“আপুর কাছে।”—-বলতে বলতেই দরজা দিয়ে কক্ষ হতে বেরিয়ে গেলো অনুভা। শ্রাবণ দেখলো তার যাওয়া কিন্তু বাঁধা দিলো না। এই মুহূর্তে দুই বোন একত্র হওয়া প্রয়োজন।

অর্থিকা পাশের ঘরেই। বড়ো চাচী তার পাশে বসা। অনুভা এসে ভেতরে প্রবেশ করল। বিছানায় এসে চুপচাপ সেও বসলো। তাকালো বড়ো বোনের নির্জীব মুখপানে। এই কষ্টের মধ্যেও শুকনো হাসলো অর্থিকা। হাত রাখলো ছোটো বোনের মাথায়।বললো,“প্রিয় মানুষকে হারিয়ে শোক কাটিয়ে উঠতে না পারা আমি আজ আর কাঁদছি না। অথচ কঠোর হৃদয়ের তুই আজ এতটা দুর্বল হয়ে গেলি রে অনু? মা যে আমাদের কাঁদতে নিষেধ করে গিয়েছে। কষ্ট পাস না। মায়ের জীবনে বাঁচার যতটা ইচ্ছে ছিলো সব ইচ্ছেই বাবা মারা যাওয়ার পর সব বাবার সাথে সাথেই মাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল রে। মা মুক্তি পেয়েছে। একেবারে বাবার কাছে চলে গিয়েছে। আমাদের কাঁদা যে উচিত নয় অনু। মা তো বাবার কাছে চলে গেলো কিন্তু আমি কবে তন্ময়ের কাছে যাবো বল তো? কবে আমার তাঈমটা বড়ো হবে? কবে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে শিখবে? তন্ময়, বাবা তারপর মাও আমায় ছেড়ে চলে গেলো। আমি ভালো নেই অনু আর কখনো হয়তো ভালো থাকতেও পারবো না। বাকি সবার মতো তুই অন্তত আমাকে ছেড়ে যাস না। তুই আর তাঈম ছাড়া যে আমার আর নিজস্ব কোনো মানুষ রইলো না।”

বোনের সংস্পর্শে এসে যেনো ভেতরটা আরো দুর্বল হয়ে পড়ল অনুভার। বুকে জড়িয়ে ধরলো বড়ো বোনকে। নাক টেনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে। বললো,“এভাবে বলিস না আপু। তোদের ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি। কোথাও না।”

অর্থিকার চোখ দিয়েও অনবরত গড়িয়ে পড়ছে পানি। কিন্তু তার কান্নার কোনো শব্দ নেই। গোটা একটা বছর কাঁদতে কাঁদতে যে সে ক্লান্ত।
________

দুপুরের দিকে অর্থিকা এবং অনুভাকে নিয়ে শেখ বাড়িতে এসে পৌঁছালো শ্রাবণ। বোনের শ্বশুরবাড়িতে থাকার কথা যেনো কিছুতেই ভাবতে পারছিল না অর্থিকা। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরেছে। কিন্তু ছোটো বোন আর বোন জামাতার বিভিন্ন কথায় শেষ পর্যন্ত তাকে রাজি হতেই হলো। তাছাড়া তাঈমও তো এখন শেখ বাড়িতেই রয়েছে। খালাকে পেলে তার আর কাউকে প্রয়োজন না হলেও অর্থিকার তো এখন ছেলেকে খুব প্রয়োজন।

শ্রাবণদের বাড়িটি ডুপ্লেক্স। তাই বাড়ির কক্ষের সংখ্যাও কম নয়। যার দরুন বেশিরভাগ কক্ষই খালি পড়ে থাকে। সকালেই সবিতাকে দিয়ে নিচ তলার একটি ঘর পরিষ্কার করিয়েছেন শান্তা। অনেকদিন ধরে ঘরটি বন্ধ থাকায় ধূলো জমেছে অনেক। ভেতরে প্রবেশ করতেই অর্থিকাকে নিজ মেয়ের মতোই সাদরে গ্ৰহণ করলেন শান্তা। তার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায় তাকে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে অনুভার উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলে গেলেন,“চুপচাপ ঘরে গিয়ে গোসল সারবে। সবিতাকে দিয়ে তোমাদের খাবার আমি ঘরেই পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিবে। কোনো অনিয়ম যেনো না হয় বলে দিলাম। আর হ্যাঁ অর্থিকা মায়ের জন্য আমি আছি। তাই বোনের জন্য তোমায় চিন্তা করতে হবে না।”

শাশুড়ির এমন কঠোর কণ্ঠস্বর হতে নিঃসৃত বাক্য শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো অনুভা। চুপচাপ উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো নিজেদের শোবার ঘরের দিকে। শ্রাবণ বাড়িতে প্রবেশ করে তার আগেই চলে গিয়েছিল উপরে।

ঘরে এসে হিজাবটা খুলে নিলো অনুভা।কাবাড থেকে বের করল পরনের জন্য শাড়ি। বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। গোসল করছে শ্রাবণ। কয়েক মিনিট সময় নিয়ে বের হয়ে এলো সে। সে বের হতেই তাকে পাশ কাটিয়ে নিরবে ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা।

অর্থিকাও সবে গোসল সেরে বের হয়েছে। শরীরটা তার ভীষণ হালকা লাগছে। তন্ময়ের মৃ’ত্যুর পর আজ প্রথম নিজের গায়ে শাড়ি জড়িয়েছে মেয়েটা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতেই হতাশার নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। বিছানায় বসা তাঈমের কাছে এগিয়ে গিয়ে হাত রাখলো মাথায়। তাঈম তাকালো মায়ের পানে। তোতলানো শব্দে জিজ্ঞেস করল,“নানু কুতায়?”

দুটো শব্দ যেনো বুকের ভেতর সুঁচের মতো গিয়ে বিধলো অর্থিকার। বললো,“নানু নেই। আকাশের তারা হয়ে গেছে নানু।”

এত এত ভারি কথা বোধগম্য হলো না তাঈমের। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো মায়ের মুখশ্রীতে। খাবারের ট্রে হাতে ভেতরে এলেন শান্তা। অর্থিকাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,“মাশাআল্লাহ তোমরা দু বোনই খুব সুন্দর। সব পোশাকেই দারুন মানিয়ে যায় তোমাদের।”

জোরপূর্বক হাসলো অর্থিকা। শান্তা পুনরায় বললেন,
“তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই মা। এমন ভয়াবহ শোক এর আগেও পার করে এসেছো। সবাই তো আর চিরকাল থাকে না। এই যে আমারও তো একসময় বাবা-মা ছিলো, ভাই-বোনেরা ছিলো। অথচ আজ বাবা-মা এই দুনিয়াতে নেই, ভাই-বোনেরা থেকেও না থাকার মতোই। সবাই নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তাই বলে কী আমি বছরের পর বছর কাটাচ্ছি না? আমার মা যখন মারা যায় তখন আমার ছোটো ছেলে আমার পেটে ছিলো। সে যাক গে, কান্নাকাটি আর একদম করবে না। আমি তো তোমার মায়েরই মতো তাই না? ছোটো বোনের শাশুড়ি ভেবে কিন্তু একদম পর মনে করবে না আমায় বুঝলে?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় অর্থিকা। ভারি কণ্ঠে বলে,
“শ্রাবণের হাতে অনুকে তুলে দিয়ে তবে ভুল করিনি আমি, কী বলেন আন্টি? মেয়েটা এত সুন্দর একটা পরিবার পেলো।আপনার মতো মা পেলো, আঙ্কেলের মতো বাবা পেলো।”

কথাটা শুনেই চট করে একটা আবদার করে বসলেন শান্তা,“তুমিও এখানে থেকে যাও না। ওখানে আর একা একা থেকে কী করবে? তার উপর অফিস করো। সারাদিন তো বাচ্চাটাকে একা থাকতে হবে। এর থেকে এখানে থেকে যাও। বউমাও খুশি হবে।”

প্রস্তাবটি পছন্দ হলো না অর্থিকার। কোমল স্বরে বললো,“এ হয় না আন্টি। দয়া করে এ কথাটা অনুর সামনে অন্তত বলবেন না। দেখা যাবে এ কথা শোনার পর থেকে আমাকে এখানে রাখার জন্য মেয়েটা উঠে পড়ে লাগবে কিন্তু আমি তো এমনটা চাই না। তাঈম বড়ো হচ্ছে তাই ভেবেছি ওকে ভালো একটা ডে কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিবো। অফিস থেকে ফেরার সময় আবার সঙ্গে করে না হয় নিয়ে আসবো।”

“সত্যিই কী হয় না?”

“আপনি, আপনারা খুবই ভালো মনের মানুষ আন্টি। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এত সহজে কথাটা বলতে পারতো না। তাই আপনার জন্য আমার সম্মানটা বড্ড বেড়ে গেলো। তবে সত্যিই এমনটা হয় না। জীবনে থেমে থাকলে তো আর হবে না। বরং অনেক এগিয়ে যেতে হবে। তাই যেভাবে জীবন চলছে চলতে থাকুক।”

“তাহলে কথা দাও প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও ছেলেকে নিয়ে এখানে আসবে।”

ভদ্রমহিলার এই আবদারটি চেয়েও নাকোচ করতে পারলো না অর্থিকা। মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। শান্তাও খুশি হয়ে গেলেন।

টানা আধ ঘণ্টা হলো অনুভা বাথরুমে গোসল করতে ঢুকেছে কিন্তু এখনো বের হওয়ার নাম নেই তার। স্ত্রীর চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে শ্রাবণ। এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো অনুভা। মুখোমুখি হলো স্বামীর। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“সমস্যা কী? টোকা দিচ্ছিলে কেন?”

শ্রাবণ চিন্তিত স্বরেই বললো,“এতক্ষণ লাগবে কেন গোসল সারতে? কত চিন্তা হচ্ছিল জানো?”

উত্তর দিলো না অনুভা। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় গেলো। ফিরে এলো মিনিট দুয়েক পরে। সবিতা অনেকক্ষণ আগেই খাবার দিয়ে গিয়েছে। শ্রাবণ ট্রে টা বিছানায় এনে দুজনের খাবারটা ঠিকভাবে রাখলো। অনুভা বিরক্ত হলো কিছুটা। বললো,“আমার খুব মাথা ধরেছে। এখন আর খাবো না। তুমি সোফায় যাও না। ওখানকার টেবিলের উপরে রেখে খাও।”

স্ত্রীর কথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না শ্রাবণ। চুপচাপ ভাত মাখাতে লাগলো। ততক্ষণে অনুভা এসে বসেছে বিছানার একপাশে। তখনি শ্রাবণ তার মুখের সামনে এক লোকমা তুলে ধরে বললো,“না খেয়ে কোনো শোয়া নেই। আমি খাইয়ে দিচ্ছি চুপচাপ মুখ খোলো, চিবাও আর গিলে ফেলো। বাড়তি কোনো কথা নয়।”

তার পানে চোখ রাঙিয়ে তাকালো অনুভা। কিন্তু বিশেষ কোনো কাজ হলো না। প্রথম লোকমাটা মুখের ভেতরে ঠুসেই দিলো শ্রাবণ। তাই বাধ্য হয়েই খেতে লাগলো সে। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই এঁটো প্লেট ট্রেতে তুলে নিচে চলে গেলো শ্রাবণ। আর বিলম্ব না করে বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়ল অনুভা। মাথাটা বড্ড ভার লাগছে তার। কান্নাকাটির ফলে শরীরটাও বেশ দুর্বল। শরীর হতে বের হচ্ছে উত্তপ্ততা। হয়তো জ্বর আসতে পারে।
________

রোজকার রুটিন মাফিক আজও বিকেলে হানিফ শেখ বের হয়েছেন বাহিরে। সন্ধ্যে হয়েছে অনেকক্ষণ আগে কিন্তু এখনো উনার ফেরার কোনো নাম গন্ধও নেই। সবিতাকে নিয়ে রোজকার মতো নাস্তা তৈরি করলেন শান্তা। অনুভা সেই যে দুপুরে ঘরে প্রবেশ করেছে তারপর আর নিচে নামেনি। অর্থিকাকে ডেকে ড্রয়িং নিয়ে এলেন তিনি। সেন্টার টেবিলের উপর রাখলেন বাহারি নাস্তা। সৌহার্দ্য এবং প্রান্তিও উপস্থিত হয়েছে সেখানে। খেতে খেতেই ছোটো খাটো একটা গল্পের আসর বসে গেলো সেখানে। বড়ো পুত্র এবং পুত্রবধূর জন্য আলাদা ভাবে ট্রে তে নাস্তা দিয়ে সবিতাকে বললেন তাদের ঘরে দিয়ে আসতে। তখনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো শ্রাবণ। পুত্রকে দেখতেই এগিয়ে গিয়ে শান্তা বলে উঠলেন,“এই তো মেহু এসে গেছে। তা বউমা কোথায়? দুপুরের পরে বেশি ঘুমালে তো শরীর খারাপ করবে।”

শ্রাবণ চিন্তিত মুখে উত্তর দিলো,“ঘুমের মধ্যেই ওর জ্বর এসেছে মা। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। পানি পট্টি দেওয়ার পরেও কিছুতেই জ্বর কমছে না। কী করি বলো তো মা?”

“সে কী কথা? জ্বর এসেছে আর তুই আমায় এখন জানাচ্ছিস?”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই বসা থেকে উঠে এলো অর্থিকা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,“মেয়েটা অতিরিক্ত চিন্তা করলে কিংবা সামান্য আঘাত পেলেই খুব জ্বর আসে। ওষুধ খাইয়েছো?”

“না, অনেক ডাকলাম কিন্তু উঠতেই চাইছে না।”

“আমায় একটু নিয়ে চলো না ওর কাছে।”

মাথা নাড়িয়ে আবারো নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়ালো শ্রাবণ। তার পিছুপিছু অর্থিকা আর শান্তাও গেলো। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে অনুভা। জ্বরে ঠোঁটগুলো তার তরতর করে কাঁপছে। অর্থিকা এসে ছোটো বোনের শিয়রে বসলো। হাত রাখলো কপালে এবং গলায়। শান্তা ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,“মাথায় পানি ঢালতে হবে। তুই নিচে যা। আমরা ওর মাথায় পানি ঢালছি।”

অসহায় মুখ করে শ্রাবণ তাকালো মায়ের পানে কিন্তু শান্তার চোখ রাঙানি দেখতেই চুপচাপ চলে গেলো কক্ষের বাহিরে।
_______

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাত যেনো গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। মাঝরাতে গিয়ে জ্বর নেমে গেলো অনুভার। শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। ঘুমটাও চট করে ভেঙে গেলো। বিরক্তের সহিত আড়মোড়া ভেঙে শরীরের কাঁথাটা ফেলে দিয়ে পাশ ফিরতেই ড্রিম লাইটের আলোতে দৃষ্টিগোচর হলো অর্ধ শোয়া শ্রাবণকে। কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে আছে সে। ঘুমিয়ে নাকি জেগে আছে বোঝা যাচ্ছে না তা। রাতের খাবারের সময় হতেই শান্তা চলে গিয়েছিলেন নিচে। ইচ্ছে থাকলেও অর্থিকা আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনি। স্ত্রীর জন্য শ্রাবণের মধ্যে ছটফটানি দেখে ভেতরে ভেতরে প্রসন্ন হয়ে সেও চলে গেছে।

এতটুকু জ্বরেই শরীরটা দুর্বল হয়ে গেছে অনুভার। সময় নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। হাত রাখলো স্বামীর চুলের ভাঁজে। মিহি স্বরে ডাকলো,“শ্রাবণ! এই শ্রাবণ! ঠিক করে শুয়ে ঘুমাও।”

বসে থাকতে থাকতে চোখটা লেগে এসেছিল শ্রাবণের। কারো ডাক আর গভীর স্পর্শেই জেগে উঠলো সে। চোখ মেলে উঠে বসলো। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো,“তুমি আবার উঠে বসলে কেন? জ্বর সেরেছে? দেখি।”

বলেই কপালে, গলায় হাত রেখে পরীক্ষা করল। নাহ পুরো শরীরের তাপমাত্রাই আগের তুলনায় স্বাভাবিক। বিছানা ছেড়ে ঘরের আলো জ্বেলে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার হতে থার্মোমিটার এনে আবারো ভালো করে তাকে পরীক্ষা করল। এবারও তাপমাত্রা স্বাভাবিক। ভেতরে ভেতরে শান্তি পেলো শ্রাবণ। বললো,“জ্বর নামলো তবে। শরীর দুর্বল লাগছে না খুব? দাঁড়াও আমি খাবার নিয়ে আসি। রাতে এত চেষ্টা করলাম কিন্তু তুমি তো খেলেই না।”—–বলেই আবারো উঠতে নিলো শ্রাবণ।

কিন্তু এবার আর তাকে উঠতে দিলো না অনুভা। হাত ধরে টেনে বসিয়ে রাখলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,“কোথাও যাবে না তুমি। এখন আমি কিছুই খাবো না।”

“সবে জ্বর সেরেছে নোভা। কিছু একটা খেয়ে তো ওষুধ খেতে হবে তাই না?”

“বললাম তো খাবো না। এর আগেও এমন জ্বর আমার অনেক এসেছে অথচ কেউ কখনো জানতেও পারেনি। তাই বলে কী মরে গিয়েছি?”

“এসব আবার কেমন কথা?আগে যা হয়েছে হয়েছে। আগের দিনের সঙ্গে এখনকার তুলনা একদম করবে না বুঝলে?”

“আপু আর তাঈম ওরা কোথায়?”

“আপু অনেকক্ষণ ছিলো এখানে, পরে আমিই পাঠিয়ে দিয়েছি ঘরে। এতক্ষণে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা।”

“তুমি খেয়েছো?”

“না।”

মাথা তুলে চাইলো অনুভা। অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে শুধালো,“এত রাত হয়ে গেছে অথচ খাওনি এখনো?”

“তুমিও তো খাওনি।”

“সিরিয়াসলি শ্রাবণ তোমার এসব কাণ্ড কারখানা দেখলে যে কেউ বলে দিবে তুমি যে একটা বউ পাগলা ছেলে। বয়স্ক মানুষ থাকলে এটাও বলবে যে নিশ্চয়ই ছেলেটার বউ তাকে কালোজাদু করেছে।”

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। বললো,“কালোজাদু না করলেও জাদু তো করেছোই নোভা। বিয়ের আগেই বলেছিলাম আমি যে বউ পাগলা হবো।”

তার বুকের মধ্যে মজার ছলে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে উঠে গেলো অনুভা। বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,“ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি। খিদে পেয়েছে খাবার নিয়ে এসো।”

স্ত্রীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে অধরে হাসি রেখেই ঘর থেকে বের হলো শ্রাবণ। গন্তব্য রান্নাঘর।

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৬]

বোনের শ্বশুরবাড়িতে দুদিন থেকেই ছেলেকে নিয়ে নিজ ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছে অর্থিকা। আসার আগে মাজেদাকে কল করে কাজে ফেরার কথাও জানিয়ে দিয়েছে। মায়ের ঘরটা খালি পড়ে আছে। ফ্ল্যাটের তিন তিনটে ঘরের মধ্যে দুটো ঘরই এখন ফাঁকা। মানুষ শূন্য। অথচ সময় ঠিকই তার গতিতে বয়ে চলেছে। কারো জন্য নেই তার কোনো অপেক্ষা। জানালা দিয়ে আকাশের পানে তাকায় অর্থিকা। ভাবে কতকিছু। দুনিয়ার পেছনে ছুটে, সুখের সন্ধান করে যেনো কোনো লাভ নেই। একসময় না একসময় ওই কবরটাই হবে আমাদের আপন। ওটাই হবে আমাদের গৃহশালা।

মোবাইল হাতে নিয়ে দ্রুত এক পরিচিত কলিগকে কল লাগালো অর্থিকা। কল রিসিভ হতেই কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,“কী খবর নামিরা আপা?”

“এই তো আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কী খবর? শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন?”

“চাইলেই কী আর শোক কাটিয়ে ওঠা যায় আপা?”

“তাও ঠিক। আপন মানুষদের চলে যাওয়ার মতো শোক কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।”

“তা একটা হেল্প করতে পারবেন আপা?”

“কী হেল্প? পারলে অবশ্যই চেষ্টা করবো।”

“আমার ডাবল রুমের ছোটো খাটো একটা ফ্ল্যাটের প্রয়োজন। যদি আপনার সন্ধানে থাকে আরকি।”

“এখন যেখানে থাকছেন ওখানে কোনো অসুবিধা নাকি?”

“এই ফ্ল্যাটটা তিন রুমের। বেশ বড়োও। এতগুলো রুমের ফ্ল্যাট দিয়ে আমি আর এখন কী করবো? অযথা বাড়তি খরচ। তার উপর আমাদের মা-ছেলের ছোট্ট একটা সংসার এখন। তাই দুটো রুমের হলেই হবে।”

“আপনি চাইলেই তো কারো সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকতে পারেন। একটা রুমই তো যথেষ্ট।”

“না আপা, আমার দু রুমের ফ্ল্যাটেরই প্রয়োজন ছিলো। একটা রুম দিয়ে কী হবে? রিলেটিভ এলে থাকবে কোথায়?”

“আচ্ছা, আচ্ছা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি খোঁজ নিয়ে দেখি আমাদের বিল্ডিংয়ের কোনো ফ্ল্যাট খালি আছে কিনা। যদি নাও থাকে তাহলে আপনার ভাইয়ের সঙ্গে না হয় কথা বলবো এই ব্যাপারে।”

“ধন্যবাদ আপা।”

“ধন্যবাদ তুলে রাখুন। আগে ফ্ল্যাটের সন্ধান পাই তারপর নতুন ফ্ল্যাটে নিয়ে কিন্তু চা খাওয়াতে হবে।”

“তা অবশ্যই।”—–বলেই কল কাটলো অর্থিকা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে চাইলেই এই বিল্ডিংয়ের দু তলায় শিফট হতে পারতো। সেখানেও ডাবল রুমের ফাঁকা একটা ফ্ল্যাট পড়ে আছে। কিন্তু এখানে আর সে থাকতে চায় না। চায় না ফায়াজের মুখোমুখি হতে। এতদিনে যে সে জেনে গেছে এটা ফায়াজদেরই বাড়ি। ফায়াজের বাবা এ বাড়ির বাড়িওয়ালা।

ফায়াজের ওই মলিন মুখ, অসহায়ত্ব, করুন স্বর তার কাছেও বড্ড খারাপ লাগে। কষ্ট হয় কিন্তু অর্থিকার জীবনে দ্বিতীয়বার বসন্ত আসার সুযোগ নেই। সে যে সত্যিকারের ভালোবেসেছিল। এক পুরুষে তীব্র থেকে তীব্রতর ভাবে আসক্ত হয়েছিল। মৃ’ত্যুর আগ মুহূর্তেও সেই পুরুষটির প্রণয়মাখা কণ্ঠস্বর শুনেছিল। সেখানে কী করে তাকে ভুলে গিয়ে নতুন করে অন্য পুরুষে আসক্ত হবে? সম্ভব নয়। তার দ্বারা এ সম্ভব নয়। তার জীবনে হারানোর আর কিছু নেই। কোনো চিন্তা নেই। কত নারীই তো আছে যারা সিঙ্গেল মাদার হয়ে একা হাতেই সন্তানকে বড়ো করছে। সেও পারবে। তাছাড়া ছোটো বোন তো আছেই। যে কিনা তার অবর্তমানে ঠিক তাঈমকে আগলে রাখবে। তাই অর্থিকার এই অনিশ্চিত জীবনে আর কোনো চিন্তা নেই। সব দুঃখ কষ্টকে সে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছে।
_______

সায়াহ্নের শেষার্ধ। নীল অম্বর ধারণ করেছে লাল হলুদ মিশ্রিত বর্ণ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে সেদিক পানে তাকিয়ে আছে অনুভা। তখনি পেছনে প্রিয় মানুষটির উপস্থিতি টের পেলো। নাসিকায় এসে বাড়ি খেলো মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ। টবে লাগানো গোলাপ গাছটিতে দুটো বড়ো বড়ো গোলাপ ফোটেছে। সেখান থেকেই একটি গোলাপ ছিঁড়ে প্রিয়তমার কানে গুঁজে দিলো শ্রাবণ। আলগোছে কপোলে চুমু খেয়ে মিহি স্বরে বললো, “আমার কথা ভাবছিলে বুঝি নোভা?”

মুচকি হাসে অনুভা। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ছেলেটির পানে। প্রশ্ন করে,“ছটফটে পাখি আজ এ সময় বাড়িতে যে? কী ব্যাপার?”

“সুন্দরী বউহীনা বাহিরে আর ভালো লাগে না।”

হাসিটা চওড়া হলো অনুভার। একদৃষ্টিতে স্ত্রীর পানে তাকিয়ে আছে শ্রাবণ। খোলা চুলগুলো উড়ছে। পরনে কমলা রঙের জর্জেট শাড়ি। তার এমন ঘোর লাগা দৃষ্টি দেখতেই ভ্রু নাচিয়ে অনুভা শুধালো,“কী দেখো?”

“তোমাকে।”

“বেশি দেখলে পরে আর ভালো লাগবে না। রুচি উঠে যাবে।”

“কিন্তু তুমি তো আমার রুচি নও মেঘফুল।”

“তাহলে?”

“তুমি আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা, অভ্যাস।”

অধরে হাসি রেখেই দৃষ্টি আবারো অম্বরে স্থির করল অনুভা। তার এই নিরবতা যেনো মোটেও পছন্দ হলো না শ্রাবণের। ডান বাহু শক্ত করে ধরে নিজের দিকে তাকে ঘুরালো। অনুভা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কী?”

উত্তর দিলো না শ্রাবণ। মৃদু হেসে আরেক হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজলো গলায়। চমকালো অনুভা। এই ছেলেটার হুটহাট প্রেমময়ী স্পর্শ তাকে লজ্জায় ফেলে দেয়।একঝাঁক জড়তা নিয়ে অগোছালো বাক্যে বললো,“করছো কী? ছাড়ো। সন্ধ্যে নেমেছে। আজান পড়ে যাবে।”

গাঢ় চুম্বন এঁকে গলার একপাশে জোরে কামড় বসিয়ে দিয়ে তাকে ছেড়ে দিলো শ্রাবণ। ব্যথায় আহ সূচক শব্দ করে উঠলো অনুভা। ক্রোধ নিয়ে বললো, “কী হলো এটা?”

“লাভ বাইট।”

“দিনদিন তুমি না!”

“কী আমি? এখন সন্ধ্যা না থাকলে দ্বিতীয় বাসরটা সেরেই ফেলতাম। ব্যাপার না, সারারাত তো পড়েই আছে।”—-কথাটা শেষ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো শ্রাবণ।

তার পিছু নিলো অনুভা। রাগত স্বরে বলতে লাগলো,
“খাটাস একটা। তোমার ভেতরে এতটা লুচ্চামি ছিলো তা আগে জানলে কখনোই।”

পথিমধ্যে থেমে গিয়ে পিছু ফিরে তাকালো শ্রাবণ। উৎসুক কণ্ঠে বললো,“কী করতে? বিয়ে করতে না বুঝি?”

“উহু জীবনেও না।”

“এত আদর যত্ন করি তাও নাকি মেয়ের ভালো লাগে না। এমন লয়্যাল, সুন্দর জামাই কজনের কপালে জোটে বলো তো?”

“আসছে লয়্যাল, তোমার ভেতরের খবর তো আমি জানি। বাহিরে যেই হাবাগোবা ভালো মানুষ সেজে থাকো কে তোমায় পছন্দ করবে?”

“তুমি জানো, ভার্সিটির মেয়েগুলো আমায় কতটা পছন্দ করে? ক্লাস নেওয়ার সময় হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। একবার তো একটা মেয়ে জোঁকের মতো পেছনে লেগে ছিলো। যদিও মেয়েটা দেখতে সুন্দর ছিলো, শুধু তোমায় ভালোবাসি বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রিজেক্ট করে দিয়েছি।”

চোখমুখ কুঁচকে তার পানে তাকিয়ে রইলো অনুভা। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে সে। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“কবেকার ঘটনা এটা?”

“গত বছরের, তখন আমি বিয়ের জন্য তোমার পিছুপিছু ঘুরছিলাম।”

কথা শেষ হতে না হতেই তার দিকে থুতু ছিটাতে লাগলো অনুভা। তার এহেন কাণ্ডে ভড়কে গেলো শ্রাবণ। চোখমুখ কুঁচকে বললো,“ছ্যাহ! কী করছো এসব? নাতী-নাতনীদের নোংরা দাদী।”

“মানুষের দৃষ্টি ভালো না। দেখা গেলো তাদের দৃষ্টির মাধ্যমেই তোমার উপর নজর লেগে গেলো। তখন কী হবে? এই সুন্দর রূপের তো বারোটা বেজে যাবে।”

“তাই বলে থুতু?”

“হুম ছোটো বেলায় আমাদের দুই বোনকে নানু দিয়ে দিতো। তা তুমি মুখটাকে অমন করে রেখেছো কেন? সুযোগ পেলে তো ঠিকই ঠোঁটের মধ্যে এসে…”

বাকি কথাটুকু আর শেষ করা হলো না অনুভার। শ্রাবণের অদ্ভুত চাহনি দেখতেই থেমে গেলো। বসা থেকে উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,“সত্যি কথার ভাত নেই দুনিয়াতে।”

হাসলো শ্রাবণ। পেছন থেকে বলে উঠলো,“ভাত নেই তো কী হয়েছে সত্যবাদী মহাশয়া? আমি তো আছি। ভাতের বদলে আমায় খাও।”

“অসভ্য।”—–বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো অনুভা। ছেলেটার উপর ভরসা নেই তার। কখন কী করে তাকে লজ্জায় ফেলে দেয় কে জানে?
__________

হাসপাতালের করিডোরে চিন্তিত ভঙিতে পাইচারি করছে নাহিয়ান। কুলসুম সেখানকার বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসে আছেন। উনার পাশে তমার বাবা-মাও বসা। অপেক্ষা আর চিন্তার প্রহর যেনো কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। একসময় মায়ের পাশের চেয়ারটা দখল করে বসে পড়ল নাহিয়ান। ছেলের মাথায় হাত রাখলেন কুলসুম। আশ্বস্ত করে বললেন,“আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। যা হবে ভালো হবে।”

মায়ের কথায় বুক থেকে যেনো চিন্তার ভার কিছুটা কমলো তার। সময় পেরোতে লাগলো। হঠাৎ করেই ও.টি থেকে ভেসে এলো সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া এক শিশুর ক্রন্দনরত ধ্বনি। তমার পিতা দু হাত উঁচু করে মোনাজাত ধরে বলে উঠলেন,“আলহামদুলিল্লাহ।”

তার কয়েক মিনিট বাদেই শুভ্র তোয়ালেতে প্যাঁচানো এক বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে এলো নার্স। কুলসুমের তাড়া খেয়ে দ্রুত হাত ধুয়ে এলো নাহিয়ান। নার্সের থেকে বাচ্চাটি নিয়ে ছেলের কোলে তুলে দিলেন কুলসুম। নির্নিমেষ বাচ্চাটির পানে তাকিয়ে রইলো নাহিয়ান। কী নিষ্পাপ তার মুখশ্রী! একদম মায়ের গায়ের রঙ এবং মায়াবী দুটো চোখ পেয়েছে শিশুটি। চোখ জোড়া ঘোলাটে হয়ে গেলো নাহিয়ানের। কুলসুম হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন,“তুই তো এক ছেলের বাপ হয়ে গেছিস রে!”

চোখে পানি রেখেই মায়ের কথায় হেসে উঠলো নাহিয়ান। কুলসুম পুনরায় বললেন,“একটা সময় ঠিক তোর এই জায়গাটায় তোর বাবা ছিলেন। আর এই শিশুটির জায়গায় ছিলি তুই। আহা সময় কত দ্রুত চলে যায়! সেই ছেলে বড়ো হয়ে এখন নিজেও বাবা হয়ে গেলো।”

মায়ের কথায় কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলো নাহিয়ান। শ্বশুরের কথা মোতাবেক আজান দিলো ছেলের কানে। তারপর চলে গেলো স্ত্রীর নিকট। ও.টি থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে তমাকে। জ্ঞানও ফিরে এসেছে। ছোটো ছোটো কদম ফেলে স্ত্রীর সম্মুখে এসে চেয়ার টেনে বসলো নাহিয়ান। তমা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“দেখেছেন আমাদের ছেলেকে?”

“হুম। দেখতে একদম তোমার মতো মায়াবী হয়েছে।”

মিহি হাসলো তমা। বললো,“ছেলে মানুষ মায়াবী হয় নাকি?”

“জানি না তবে ওকে আমার কাছে মায়াবীই মনে হয়েছে।”

পূর্বের হাসিটাই অধরে বজায় আছে তমার। তার বাম হাতটা মুঠো করে সেখানে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে নাহিয়ান বলে উঠলো,“ধন্যবাদ বউ। এতগুলো দিন মাস এত কষ্ট করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে পিতৃ সুখ দেওয়ার জন্য। খুব ভালোবাসি তোমায়। রবের নিকট অসংখ্য শোকরিয়া যে তোমার মতো চমৎকার এক নারীকে আমার সহধর্মিণী এবং সন্তানের মা হিসেবে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তিনি।”

চমৎকার হাসলো তমা। প্রসন্ন চিত্তে বললো,“আমিও রবের নিকট শোকরিয়া আদায় করি যে তিনি আপনার মতো ব্যক্তিত্ববান, যত্নশীল একজন পুরুষের সঙ্গে আমায় জুড়ে দিয়েছেন।”

অজান্তেই হেসে উঠলো নাহিয়ান। হাসির মধ্যেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দুয়েক ফোঁটা অশ্রুজল।
________

অনেক খোঁজ খবর নিয়ে অবশেষে একটা ডে কেয়ার সেন্টারে তাঈমকে ভর্তি করতে পারলো অর্থিকা। ছেলেকে নিয়ে চিন্তা যেনো কমলো তার। অফিসে যাওয়ার পথে সেখানে তাকে দিয়ে যায় আবার অফিস শেষে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। মা-ছেলের ছোট্ট সংসারটা সাচ্ছন্দ্যেই চলে যাচ্ছে।

রাত সাড়ে আটটা। চুলায় রান্না বসিয়ে ছেলেকে পড়তে বসিয়েছে অর্থিকা। ছোটো ছোটো হাতে বই উল্টে পাল্টে দেখছে তাঈম। বর্ণলিপির বইটি খুলে একটি অক্ষর দেখিয়ে তার উদ্দেশ্যে অর্থিকা জিজ্ঞেস করল,“বলো তো এটা কী?”

একবার মায়ের দিকে আরেকবার বইয়ের পানে তাকালো তাঈম। তোতলানো শব্দে উত্তর দিলো,
“সলেও।”

মুচকি হাসলো অর্থিকা। পরের অক্ষর দেখিয়ে ফের শুধালো,“এটা?”

“সলেও।”

এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো অর্থিকা। মায়ের হাসি দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তাঈম। একপর্যায়ে হাসি থামালো অর্থিকা। ছেলের মতো করেই তোতলিয়ে বললো,“সলেও না সলায়া।”

“সলায়া!”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় অর্থিকা।তখনি তার মোবাইলে কল আসে। স্ক্রীনে অনুভার নাম জ্বলজ্বল করছে। কল রিসিভ করতেই অনুভা বলে উঠলো, “হোয়াটসঅ্যাপে আয়। ভিডিও কল দিচ্ছি।”

কথাটা বলেই কল কাটলো সে। অর্থিকা দ্রুত ডাটা অন করল। মিনিট দুয়েক পর ভিডিও কল আসতেই রিসিভ করে সম্মুখে ধরলো। দেখতে পেলো বোনের রাগান্বিত মুখশ্রী। মেয়েটি রেগে থাকলে তার কপাল কুঁচকে থাকে, নাকের ডগায় ঘাম জমে। হাসার চেষ্টা করল অর্থিকা। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তুই কী কোনো কারণে রেগে আছিস অনু? নিশ্চয়ই শ্রাবণের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?”

“ঝগড়া তো ওর সাথে রোজই হয় কিন্তু ওর থেকে কাঙ্ক্ষিত কোনো রেসপন্স না পেয়ে শেষমেশ ঝগড়ার ইতি ঘটাতে হয়।”

“তাহলে রাগটা কার উপর শুনি?”

“তোর উপর।”

“আমার উপর? আমি কী করলাম?”

“তুই নাকি বাড়ি বদলে ফেলবি আবার? এমনকি মাজেদা আপাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিস? কেন? তাঈমকে কে দেখবে?”

“তাঈমকে একটা ডে কেয়ারে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। মাজেদাকে তো আমরা রেখেছিলাম বিশেষ করে ঘরের কাজকর্ম করা, মাকেসহ তাঈমকে দেখাশোনার জন্য। কিন্তু এখন তো আর মা নেই। তাঈম বড়ো হচ্ছে। আমি ওকে সময় দিতে পারি না তবে লেখাপড়া তো শিখতে হবে বল? তাই ডে কেয়ারে ভর্তি করেছি। ওখানেই আরো অনেক বাচ্চা আছে, বাচ্চাদের সুন্দর করে হাতের লেখা শেখানো হয় বেসিক লেখাপড়া শেখানো হয়। আর ফ্ল্যাট বদলে ফেলার কারণ হচ্ছে এখানে তিনটা রুম। মা নেই, তার উপর তুইও তো তোর শ্বশুরবাড়ি। তাই ভাবলাম বাড়ি বদলে ফেলে ডাবল রুমের ছোটো খাটো একটা ফ্ল্যাট নিতে। অযথা এত খরচের প্রয়োজন আছে?”

রাগ এবার কমলো অনুভার। মলিন স্বরে বললো,
“তোর খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাই না রে আপু?”

“দূর বোকা মেয়ে কষ্ট হবে কেন?”

“অনেক কারণেই হবে। যাই হোক কাল আমার একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। দোয়া করিস।”

ভ্রু কুঁচকে নিলো অর্থিকা। জিজ্ঞেস করল,“চাকরির ইন্টারভিউ! তুই চাকরি করবি?”

“হুম করবো, শ্রাবণকে বলেছি ওর কোনো আপত্তি নেই। ওর বাবা-মায়ের সঙ্গেও ও এ বিষয়ে কথা বলবে বলেছে।”

অর্থিকার চোখেমুখে যেনো কঠোরত্ব ছাপিয়ে গেলো। কড়া গলায় শাসনের সুরে বললো,“কোনো ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই তোর। বিয়ে হয়েছে এবার মন দিয়ে সংসার কর। চাকরি বাকরি, খাটাখাটুনি অনেক হয়েছে আর নয়।”

“চাকরি করলে সমস্যা কোথায়? আমার তো কোনো সমস্যা নেই। শ্রাবণেরও নেই।”

“শ্রাবণের যে নেই কে বলেছে? শ্রাবণ নিজে? এসব বাদ দিয়ে স্বামী নিয়ে ঘর সংসার কর, পুরোটা সময় তাদের দে। তোর চাকরি করার কী প্রয়োজন? এমন তো নয় যে শ্বশুর বাড়ি ভালো নয় কিংবা স্বামী ঠিকমতো হাতখরচ দিচ্ছে না ভরণপোষণ দিচ্ছে না।”

“কিন্তু আপু?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্থিকা। নরম স্বরে বলে,“আমি ভালো আছি অনু। যা বেতন পাই তা দিয়ে মা-ছেলের আরামসে দিন কেটে যাচ্ছে। তাই আমাকে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। এবার নিজেকে নিয়ে একটু ভাব।”

মন খারাপ হলো অনুভার। মুখ গোমড়া করে বসে রইলো ক্যামেরার সম্মুখে। বোনের মন খারাপ বুঝতে পেরেই মুচকি হাসলো অর্থিকা। বললো,“মন খারাপ কেন করছিস? তুই একা যদি বাবা-মা, আমি, তাঈমসহ পুরো সংসারটা চালাতে পারিস তাহলে আমি শুধু নিজের ছেলের খরচ চালাতে পারবো না?”

“আমি অমন করে ভেবে কিছু বলিনি।”

“আমি জানি। তুই আমার চিন্তা, কষ্ট কমাতে চাইছিস তাই তো? বিশ্বাস কর আমার আর কোনো চিন্তা নেই, কষ্ট নেই। বাবা-মা এখন আর নেই। আমরা এতিম। তোর একটা সুন্দর সংসার হয়েছে। আর রইলো বাকি তাঈম? ওর জন্য আমি আছি, তুই আছিস। কী আছিস না?”

উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে অনুভা উত্তর দেয়,“হু।”

অধরের হাসিটা চওড়া হয় অর্থিকার। তখনি তার হাত থেকে মোবাইলটা টেনে নেয় তাঈম। স্ক্রীনে অতি পরিচিত মুখটি দেখতেই তার চঞ্চলতা বৃদ্ধি পায়। তোতলানো এলোমেলো বাক্যে বলতে শুরু করে সারাদিনে তার করা কাজগুলো। অনুভা মনোযোগ দিয়ে শোনে সেসব কথা। মাঝেমধ্যে হেসে ওঠে।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৩৩+৩৪

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৩]

“বউমার বাবা একসময় পুলিশ ছিলেন? ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়ে চাকরি হারিয়েছিলেন?”

মায়ের কথায় মুখ তুলে তাকায় শ্রাবণ। দেখতে পায় শান্তার চোখেমুখে রাগের আভাস। শান্ত স্বরে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,“হ্যাঁ, তো?”

“আগে কেন বলিসনি এ কথা?”

“বলার মতো অতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি তাই।”

ছেলের কথায় আশ্চর্য হন শান্তা। বসে পড়েন বিছানায়। রাগত স্বরে বলেন,“এটা গুরুত্বপূর্ণ কথা নয়? আত্মীয় স্বজনেরা যখন এ কথা জানবে তখন আমাদের মান সম্মান কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে বুঝতে পারছিস?”

“তুমি জানালেই জানবে।”

“মেহু একদম মুখে মুখে কথা বলবি না বলে দিলাম। সবকিছু মেনে নেই বলে মায়ের সঙ্গে বেয়াদবি করার দুঃসাহসও দেখাবি না।”—বেশ চেঁচিয়েই কথাটা বলে উঠলেন শান্তা।

মা যখন হুটহাট রেগে যায় তখন এমন করেই কথা বলে যা শ্রাবণের অজানা নয়। মোবাইলটা রেখে পূর্ণ দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকায় সে। বলে,“আস্তে কথা বলো মা, নোভা শুনতে পাবে।”

“শুনলে শুনুক, এ কথা তো আর মিথ্যে নয়।”

“না মা, ওর শোনা উচিত নয়। উচিত নয় আমার মায়ের এমন ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। আমরা যেমন জানি আমাদের মা কোমল হৃদয়ের একজন নারী তেমন নোভাও এ কথাটাই জানে। শুরু থেকেই তোমার এ রূপের সঙ্গেই পরিচিত হয়ে আসছে। হঠাৎ করে আরেক রূপ দেখলে তার ভেতরে কী মনোভাব তৈরি হবে বলো তো? আর কিছু না হলেও তোমার জন্য তার মনে দূরত্বের সৃষ্টি হবে। আমি আমার মা কিংবা নোভা এই দুই নারীর কাউকেই ত্যাগ করতে পারবো না মা।”

রাগের পারদ গললো শান্তার। কণ্ঠ নিচু হলো। বললেন,“সব জেনেও অমন একটা মেয়েকে কেন বিয়ে করলি?”

“এসব ঘটনা ঘটার অনেক আগেই ও আমার জীবনে এসেছিল মা। ওকে আমি ভালোবেসেছি। আমি দেশ ছাড়ার পরই এসব ঘটনা ঘটে। যার জন্য লজ্জায় আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ পর্যন্ত রাখেনি মেয়েটা। দূরত্ব সৃষ্টি করে নিয়েছিল আমাদের মধ্যে। ওই দূরদেশে ওকে ছাড়া কতটা কষ্টে যে ছিলাম তা কেবল আমিই জানতাম মা। দেশে ফিরে রাতদিন এক করে ওকে খুঁজে বের করেছি। বারবার আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছি কিন্তু ও জানো আমায় কী বলেছিল? নিজের অনুভূতি, ভালোবাসা লুকিয়ে বলেছিল, এমনটা হয় না শ্রাবণ। তোমার বাবা-মা সবটা জানার পর আমাকে ভালোভাবে গ্ৰহণ করবেন না। আত্মীয় স্বজনেরা কটু কথা বলবে। এসব বোঝ জ্ঞান দিয়ে বারবার আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিল ও। কিন্তু আমি বড়ো মুখ করে ওকে বলেছি আমার বাবা-মা এমন নন। অন্যায় তোমার বাবা করেছে কিন্তু তোমরা না। কিন্তু ও মানেনি। ওর বড়ো বোন উদ্যোগ না নিলে হয়তো ওকে কিছুতেই আমি নিজের করে পেতাম না মা।”

বলেই থামে শ্রাবণ। পুনরায় বলে,“ও খুবই আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন নারী। ওর ব্যক্তিত্ব প্রখর। নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হবে, অপমানিত হতে হবে এমন স্থানগুলো সে এড়িয়ে চলে। তাই আশা করি এসব কথা কখনো ওর সামনে তুমি বলবে না। আমি ওকে নিজ দায়িত্বে এখানে নিয়ে এসেছি। তাই ওর সম্মানের দিকটাও আমারই দেখার বিষয়। বাবা সবটা জানে, তোমায় জানাইনি কারণ আমি ভেবেছিলাম আমার মায়ের এসবে কোনো সমস্যা হবে না। মায়ের উপর এতটুকু বিশ্বাস তো সন্তানের থাকেই তাই নয় কী মা?”

রাগটা এবার নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো শান্তার। হঠাৎ ফোনকলে রুবির থেকে এত নেতিবাচক কথা শুনে উনার রাগ হয়েছিল। তাই তো তৎক্ষণাৎ চলে আসেন পুত্রের কক্ষে। উনার নিরবতায় শ্রাবণ প্রশ্ন ছুঁড়ে,“এ কথা নিশ্চয়ই তোমায় খালামণি বলেছে তাই না?”

কাঁচুমাচু মুখ করে শান্তা উত্তর দিলেন,“হ্যাঁ, তখন অমন করে রুবি বললো যে।”

“তাই তোমার রাগ হয়েছে। আচ্ছা মা নিজের সংসারের কথা অন্য কাউকে বলার মধ্যে কী কোনো মহত্ত্ব আছে? মানছি খালামণি তোমার আপন ছোটো বোন কিন্তু তাই বলে তো চাইলেই সব বলা যায় না। তোমাদের দুজনার আলাদা আলাদা সংসার আছে। কই খালামণি তো তোমায় নিজেদের ব্যাপারে কিছু বলে না।”

“কে বলেছে রুবি কিছু বলে না? সব বলে।”

হাসে শ্রাবণ। বলে,“আনিকার স্বামীর সঙ্গে যে আনিকার ঝামেলা চলছে তা কী জানো? লিমনের বউয়ের সঙ্গে প্রায়সই খালামণির ঝগড়া হয় বাড়িতে তা কী জানো? খালুর যে চাকরি চলে গিয়েছিল সে কথা কী কখনো জানতে? পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে যে খালুদের ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব শুরু সেকথাই বা কী জানো?”

পুত্রের কথায় চমকান শান্তা। বলেন,“এতকিছু হয়েছে! কই রুবি তো আমায় জানালো না কিছু। তাছাড়া বৌ ভাতের অনুষ্ঠানেও তো সবার মধ্যে কী মিল দেখলাম।”

“স্বাভাবিক। কারণ সে তো আর তোমার মতো নয় যে নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা মানুষের সামনে প্রকাশ করে ছোটো হবে। নিজেদের মধ্যে একটা গোপনীয়তা থাকতে হয় মা। খালামণি নিজেদেরকে তোমার কাছে ছোটো করতে চায়নি বলেই জানায়নি। অথচ তুমি বোন অন্ত প্রাণ তাই সব বলে দাও বোনকে। বোন যদি তোমার ভালোই হতো তাহলে এ বয়সে এসে পুত্রবধূর সঙ্গে রোজ রোজ ঝগড়া করতো না। বোন তোমার ভালো চাইলে কখনোই নোভার বাবার নাম কৌশলে জেনে এত খোঁজ খবর নিয়ে তোমার কানে বিষ ঢালতো না। ভালো চাইলে জায়ের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা তোমার মাথায় ঢোকাতো না। যে মেয়ে দু দুবার প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়েছে সেই মেয়েকে কী করে বোনের ছেলের জন্য ঠিক করে বলো তো?”

“এসব কী বলছিস মেহু?”

সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রাবণ। বলে,“বাবা এমনি এমনি খালামণিকে অতো অপছন্দ করে না মা, বুঝলে? নইলে তোমার চাচাতো ভাই-বোনদের নিয়ে তো বাবার কোনো সমস্যা নেই। কারণ বাবা মানুষ চেনে। বৌ ভাতের অনুষ্ঠানের দিন দেখলে না কীভাবে নোভাকে এড়িয়ে গেলো খালামণি? কীভাবে প্রান্তির আশপাশ ঘুরঘুর করে ভাব জমাচ্ছিল? তুমি আমার মা সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধি তোমার বেশি। তাই বোনকে এতটা বিশ্বাস করো না। বিয়ের পর ভাই-বোন আর অতো আপন থাকে না। সবার আলাদা আলাদা সংসার হলে সম্পর্কগুলো আর আগের মতো থাকে না। এই যে আজ উনার কথায় যেভাবে তুমি রোষানলে ফেটে পড়লে সেভাবেই ভবিষ্যতেও যদি এমন করো তাহলে কিন্তু আমাদের এই সুন্দর সাজানো সংসারটা আর থাকবে না মা। ওরা পরের বাড়ির মেয়ে। হুট করে নতুন এক পরিবেশে এসেই সহজে সবাইকে আপন করে নিতে পারবে না। তোমারই তো উচিত তাদেরকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে নিজের মতো গড়ে তোলা। তুমিও তো এমন একটা সময় পার করে এসেছো। সবই তো জানো, বোঝো। তাছাড়া নোভার আচরণে কী কখনো এমন কিছু দেখেছো যার কারণে ওর প্রতি রাগ হয় তোমার?”

দুদিকে মাথা নাড়ান শান্তা। মনে মনে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হোন। নিরবে উঠে ত্যাগ করেন পুত্রের কক্ষ।

বাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। শ্রাবণের ফুফুরা ফিরে গেছে নিজেদের বাড়ি। রয়ে গেছে শুধু চাচা-চাচী আর চাচাতো ভাই-বোনেরা। তারাও বিকেলের দিকে রওনা দিবে নিজেদের আবাসস্থলে। দুপুরের রান্নার আয়োজন চলছে। ছোটো চাচী এবং চাচাতো জায়ের সঙ্গে হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে অনুভা। ফাঁকে ফাঁকে চলছে তাদের গল্প। যদিও অনুভা শুধু শুনেই যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে হা হু করছে, মুচকি মুচকি হাসছে।

বিছানায় আয়েশ করে বসে মোবাইল ঘাঁটছে প্রান্তি। সৌহার্দ্য গিয়েছিল একটু নিচে। ঘরে এসে স্ত্রীকে বসে থাকতে দেখেই জিজ্ঞেস করল,“এখানে এভাবে বসে আছো কেন?”

নড়েচড়ে উঠলো প্রান্তি। তাকালো স্বামীর পানে। হেসে বললো,“ওখানে ফিরে ওদের জন্য বড়োসড়ো একটা পার্টি না দিলে নাকি ওরা ছাড়বে না।”

“কাদের জন্য?”

“আরে ফ্রেন্ডসদের।”

“ওহ, আমার প্রশ্নের উত্তরটা তো দিলে না। এখানে বসে কী করছো? নিচে সবাই আছে ওদের কাছে যাও। নতুন বউ এভাবে ঘরে বসে থাকলে কী বলবে সকলে?”

মুখের আদল বদলে গেলো প্রান্তির। বিরক্তির সহিত বললো,“কাউকেই তো আমি চিনি না। কার সাথে কথা বলবো?”

“তোমাকে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে কে বলেছে? তুমি নিচে গেলে ওরাই তোমার সাথে কথা বলবে। তাছাড়া ভাবীও তো তোমার মতোই নতুন বউ, সে তো দিব্যি ঘরে বসে না থেকে রান্নাঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে।”

“সবাইকে দিয়ে সবটা হয় না।”

“ফ্যামিলি সম্পর্কে জেনেই বিয়ে করেছো আমায়। ব্রেকআপ করে ফেলার পরে কথা দিয়েছিলে‌ বিহেভিয়ার পুরো চেঞ্জ করে ফেলবে তাহলে এখন এমন করে কথা বলছো কেন?”

নিরুত্তর প্রান্তি। সৌহার্দ্য এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলো। স্ত্রীর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কোমল স্বরে বললো,“আমরা দুই ভাই। দুজনই বাবা-মায়ের গর্ব। দুজনেই যোগ্যতার দিক দিয়ে কেউ কারো থেকে কোনো অংশে কম নই। আবার দুজনই ভালোবেসে নিজেদের শখের নারীকে বিয়ে করেছি। তার মধ্যে তুমি যদি এভাবে অহংকারী মনোভাব নিয়ে চলাফেরা করো তাতে আমার বাবা-মা এ নিয়ে কিছু না বললেও আত্মীয় স্বজনেরা কিন্তু ঠিকই কথা বলবে। তাতে সবার সামনে আমি ছোটো হয়ে যাবো। নিজের পছন্দ এবং ভালোবাসার প্রতি প্রশ্ন উঠবে। তুমি কী এটাই চাও প্রান্তি?”

দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয় প্রান্তি। ভেতরে ভেতরে প্রশান্তি অনুভব করে সৌহার্দ্য। মেয়েটি এদিক দিয়ে ভালো আছে, তাকে বোঝালেই সবকিছু বুঝে ফেলে। সৌহার্দ্য পুনরায় বললো,“নিচে যাও। কারো কথায় একদম বিরক্তি প্রকাশ করবে না। আরেকটা কথা, ভাবী সম্পর্কে তোমার বড়ো তাই তাকে বড়ো বোনের মতো সম্মান দিয়ে কথা বলবে সবসময়। মনে রেখো আমার কাছে কিন্তু আমার পরিবার সবার উর্ধ্বে।”

এবারো স্বায় জানিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নিলো প্রান্তি। নিঃশব্দে বের হলো ঘর থেকে। সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেললো সৌহার্দ্য। মেয়েটা এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারলেই হলো এবার।

প্রান্তিকে নিচে উপস্থিত হতে দেখেই চাচাতো ভাই রুয়েলের স্ত্রী তুর তাকে টেনে নিয়ে বসালো সোফায়। সৌজন্য হাসলো প্রান্তি। নতুন বউকে দেখে বাকিরাও তাকে ঘিরে ধরলো। শুরু করল নিজেদের পরিচয় পর্ব। রান্নাঘর হতেই তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন শান্তা। গতকাল থেকে খাওয়ার সময় ব্যতীত ছোটো পুত্রবধূকে নিচে নামতে না দেখে বেশ চিন্তিত হয়েছিলেন তিনি। বারবার দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, ছেলে আদৌ সঠিক মেয়েকে নিজের জন্য বেছে নিয়েছে তো? মেয়েটি কী মিশুক নয়? পরিবার কী তার অপছন্দ?

মন থেকে যেনো সেই দ্বিধা এবার কাটলো উনার।
________

বেলা বাড়লো। তার সাথে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন হলো আবহাওয়ার। অফিসে কিছু প্রজেক্ট নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছে অর্থিকা। মোবাইলের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম্বার। কিন্তু মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় তার শব্দ কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না অর্থিকার। কিছু সময় গড়ালো। একজন নারী সহকর্মী বলে উঠলেন,“আপা আপনার মোবাইলটা বাজছে।”

বিরক্তিতে ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো অর্থিকার। গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় ফোন আসায় মনোযোগে যেনো ভাটা পড়ল। মোবাইল হাতে নিয়ে চেক করতেই দেখতে পেলো এটি মাজেদার নাম্বার। মেয়েটি এ সময় কেন কল দিচ্ছে এভাবে? বাড়িতে কিছু হলো কী? মা, তাঈম ঠিক আছে তো? হাজারটা উটকো চিন্তা ভাবনা নিয়েই কল ব্যাক করল অর্থিকা। রিসিভ হলো সঙ্গে সঙ্গে। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অপরপাশ হতে শঙ্কিত, বিচলিত নারী কণ্ঠে বলে উঠলো,“আপা গো আপনে কই? তাড়াতাড়ি বাড়িত আহেন।”

“আমি তো অফিসে মাজেদা। কার কী হয়েছে? তাঈম ঠিক আছে তো?”

“তাঈম বাজান ঠিক আছে কিন্তু চাচী তো ঠিক নাই আপা। দুপুরে খাওনের লাইগ্গা ডাকলাম কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ করল না। ভাবছি হয়তো ঘুমায়, বিকাল হইয়া গেছে এহনও উডার নাম নাই। অনেকক্ষণ ডাকলাম কিন্তু কিছুতেই উডলো না। চাচী তো এমনে কহনো ঘুমায় না। পরে শরীরে হাত দিয়া দেহি গো আপা বরফ হইয়া রইছে। আপনেরে অনেক ফোন করছি কিন্তু আপনে ধরেন নাই তাই আশেপাশের মাইনষে গো ডাইক্কা আনছি। হেরাই চাচীরে হাসপাতালে আইনা ভর্তি করছে। আপা গো আমার তো ডর লাগতাছে। আন্নে তাড়াতাড়ি আহেন আপা।”

মুহূর্তেই হতভম্ব হয়ে গেলো অর্থিকা। ইদানিং মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অনেকবার ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে চাইলেও সুফিয়া কিছুতেই রাজি হলেন না। মেয়েকে বিভিন্ন বোঝ দিয়ে আটকে দিলেন। ঘর থেকেও বের হন না তেমন। সারাক্ষণ মেঝের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করেন। আজ সকালেও তো মাকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় দেখে এসেছে অর্থিকা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। সেই মায়ের কী হয়ে গেলো এটুকু সময়ের মধ্যে? মাথা কাজ করছে না তার। শক্ত করে সম্মুখের টেবিলটা ধরলো সে। সহকর্মীরা তার অস্থিরতা দেখে এগিয়ে এলো। একজন শুধালো,“আপনি ঠিক আছেন তো? কিছু হয়েছে কী?”

কিয়ৎক্ষণ নিরব থাকে সে। সহকর্মীদের মধ্যকার একজন এগিয়ে দেয় পানির বোতল। পানি পান করে গলা ভেজায় অর্থিকা। বড়ো বড়ো কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,“আমার মা! আমার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাকে যেতে হবে ওখানে।”

সকলে চমকায়। তাদের মধ্য থেকে আরেকজন বলে ওঠে,“আপনি বরং হাসপাতালেই চলে যান। এদিকটা না হয় আমরা সামলে নিবো। ম্যামকে সবটা বুঝিয়ে বলবো। আশা করি উনি বুঝবেন।”

আর বিলম্ব করল না অর্থিকা। নিজের টেবিল হতে ভ্যানিটি ব্যাগটি নিয়ে বের হয়ে গেলো অফিস থেকে। পথে আবারো মাজেদাকে কল করে জেনে নিলো হাসপাতালের ঠিকানা।
_________

বিকেল পেরিয়ে ধরণীতে সন্ধ্যা নেমেছে। আত্মীয় স্বজনেরা চলে গেছে বিকেলেই। বাড়ি যেনো এখন পুরোপুরি নিস্তব্ধ। চা বানিয়ে সকলকে চা পরিবেশন করে ঘরে এলো অনুভা। শ্রাবণ বাড়ি নেই। ছেলেটার মন খুব ছটফটে। এক স্থানে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। যা অনুভা খুব ভালো করেই খেয়াল করেছে। শরীরটা বিছানার উপর সটান করে ছেড়ে দিলো সে। মাথা গুঁজলো বালিশে। সেই যে সকালে উঠেছে তারপর আর শোয়া হয়নি তার। যদিও শান্তা বারবার তাকে ঘরে এসে বিশ্রাম নিতে বলেছেন কিন্তু সে আসেনি। বাড়িতে অতিথি, তাদের মধ্যে নতুন বউ ঘরে এসে শুয়ে থাকলে লোকে কী বলবে? তাছাড়া শ্রাবণও তো ঘরেই ছিলো।

চোখ জোড়া বন্ধ করে নিতেই ঝংকার তুলে অনুভার মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রীনে মাজেদার নাম্বার দেখেই রিসিভ করে উঠে বসলো। প্রশ্ন করল,“আরে মাজেদা আপা যে! কেমন আছো?”

“আপা বাড়িতে আহেন আপনে।”

গলাটা কেমন ভারি শুনালো তার। প্রতিটি শব্দ যেনো তরঙ্গের মতো ঢেউ খেলে ছুটে এলো। মুখের হাসিহাসি ভাবটা সরে গেলো অনুভার। পুনরায় প্রশ্ন করল, “বাড়িতে আসবো? কারো কিছু হয়েছে মাজেদা আপা?”

শব্দ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটি। চমকালো অনুভা। বিচলিত হয়ে উঠলো তার মন। শুধালো,“কাঁদছো কেন মাজেদা আপা? কী হয়েছে? সবাই ঠিক আছে তো? কী হলো বলো।”

কিছু বলতে চাইলো মাজেদা কিন্তু পারলো না। তৎক্ষণাৎ কেউ তার হাত থেকে কেড়ে নিলো ফোন। অপরিচিত নারী কণ্ঠে একজন বললেন,“তুমি অনুভা? তোমার মা একটু অসুস্থ। বাড়িতে এসো তো।”

“কে আপনি? কী হয়েছে মায়ের?”

“আমি তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি। তুমি একটু তাড়াতাড়ি এসো মা।”—–বলেই কল কাটলেন ভদ্রমহিলা।

কিন্তু অনুভা যেনো অশান্ত হয়ে উঠলো। মায়ের কী হয়েছে? মাজেদা আপা কাঁদলো কেন? এসব প্রশ্ন মস্তিষ্কে হানা দিতেই মাথা ধরে এলো। দ্রুত শ্রাবণের নাম্বারে কল দিলো। কলটা বাজতে বাজতে কেটে গেলো। দ্বিতীয়বার কল দেওয়ার পর কেটে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে রিসিভ হলো তা। বিপরীত পাশ হতে ঠাট্টার ছলে শ্রাবণ বলে উঠলো,“একটু বাহিরে এলাম আর ওমনিতেই আমায় মিস করা শুরু করে দিলে নোভা রাণী?”

সেসব কথায় বিশেষ গুরুত্ব দিলো না অনুভা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,“আমি বাড়িতে যাবো শ্রাবণ। তুমি কোথায়? এখনি এসো।”

“বাড়িতে! এখন? এখন বাড়িতে কীভাবে যাবে নোভা? বাড়ির সকলের কথা মনে পড়ছে তাই না? আজ রাতটা বরং থাক কাল না হয় নিয়ে যাবো।”

“মাজেদা আপার কল এসেছিল, মা নাকি খুব অসুস্থ। আমি কিছু জানি না। এখনি আমাকে বাড়ি যেতে হবে। তুমি না পারলে আমি একা একাই চলে গেলাম।”

“একা একা একদম বের হবে না। তুমি তৈরি হও আমি এখনি আসছি।”—-বলেই কল কেটে বাড়ির দিকে ছুটলো শ্রাবণ।

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৪]

চারিদিকে নিস্তব্ধতার ছড়াছড়ি। সন্ধ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে শোক। সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে তৃতীয় তলায় পা রাখতেই অনুভা চমকালো। ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা। লোকমুখে গুণগুণ আওয়াজ। শঙ্কিত মন নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই বসার ঘরে দেখা মিললো প্রতিবেশী আন্টির। তিনি এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন অনুভার সম্মুখে। অনুভা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“আমার মা? মা কোথায়? মা কী খুব অসুস্থ? তাহলে আপু কোথায়? আপু কেন মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে না?”

ভদ্রমহিলা প্রত্যুত্তরে কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। উনার বলার অপেক্ষাও করল না অনুভা। চট করে চলে গেলো মায়ের ঘরে। তৎক্ষণাৎ পা দুটো তার থমকে গেলো। সাদা কাফন গায়ে জড়িয়ে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে সুফিয়াকে। অর্থিকা পাশেই খাটের পায়ার সঙ্গে হেলান দিয়ে নিরবে বসে আছে। চোখ জোড়ায় এখনো অশ্রুজল চিকচিক করছে। অনুভাকে দেখতেই মাজেদা শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, “আপা গো আপনে আইছেন? কিন্তু চাচী তো আর নাই আপা। আমগো ছাইড়া চইল্লা গেছে।”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো অনুভার। তাকালো মায়ের নিথর দেহের পানে। ঠোঁটের কার্নিশে উনার মৃদু হাসির রেখা। আগের থেকেও উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। চোখ দুটো বোঁজা। আর কিছুই খেয়াল করতে পারলো না অনুভা। শরীরের ভারসাম্য ধীরে ধীরে হ্রাস পেলো তার। সম্মুখের সকল কিছু আবছা হয়ে এলো। ফাঁকা হয়ে এলো মস্তিষ্ক, মূর্ছা গেলো সে। তৎক্ষণাৎ তাকে আগলে নিলো শ্রাবণ। গাড়ি পার্কিং করে এসে ভেতরে প্রবেশ করতেই স্ত্রীকে পড়ে যেতে দেখে চমকালো। গালে আলতো করে চাপড় মেরে ডাকলো,“নোভা! এই নোভা! কী হয়েছে তোমার?”

উত্তর এলো না কোনো। এগিয়ে এলেন দুজন মহিলা। বিচলিত কণ্ঠে বললেন,“এ কী উনি তো অজ্ঞান হয়ে গেছেন! উনাকে ঘরে নিয়ে চলুন।”

স্বম্বিৎ ফিরে পেলো শ্রাবণ। চটজলদি স্ত্রীকে তুলে নিলো পাঁজাকোলে। নিয়ে গেলো শোবার ঘরে। বিছানায় শুইয়ে দিতেই মহিলা দুজনের মধ্যকার একজন ছিটিয়ে দিতে লাগলেন চোখেমুখে পানি। আরেকজন বললেন,“হুট করে মায়ের মৃ’ত্যু সংবাদ শুনে সহ্য করতে পারেনি তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে। হাতে পায়ে তেল মালিশ করার জন্য আমি বরং কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ঠিক জ্ঞান ফিরে আসবে।”

মস্তিষ্কে মুহূর্তেই আঘাত হানলো বাক্যগুলো। স্ত্রীর পানে একপলক তাকিয়ে উপস্থিত মহিলাটিকে তার খেয়াল রাখার কথা বলে দ্রুত হেঁটে শাশুড়ির ঘরে চলে এলো শ্রাবণ। পুরো দৃশ্যটা দেখে বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো। একপল তাকালো অর্থিকার পানে। বাবার মৃ’ত্যুর সময় মেয়েটির মুখশ্রীর আদলে যেমন দুঃখ কষ্টে ছেয়ে ছিলো আজও ঠিক তেমনি তার অবস্থা। তাকে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেলো না শ্রাবণ। তাই মাজেদা মেয়েটির উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কখন হলো এমনটা? আর কীভাবেই বা হলো?”

মেয়েটি নাক টেনে বললো,“জানি না দুলাভাই। কয়দিন ধইরা চাচী খালি চুপচাপ থাহে। কিছু জিগাইলেও উত্তর দেয় না। আইজ সকালেও চাচীরে দেখলাম শুইয়া রইছে। খাওন দিয়া গেলাম খাইলো না। আমিও আর কিছু না কইয়া দুপুরের রান্না কইরা তাঈম বাজানরে গোসল করাইয়া খাওয়াইয়া ঘুম পাড়াইলাম। দুপুরের খাওনের সময় তিনবার ডাকলাম কিন্তু চাচী এইবারও উত্তর দিলো না। শরীর খারাপ করছে নাকি দেহার লাইগ্গা গা ছুঁইতেই দেহি বরফের মতো ঠাণ্ডা। তারপর পাশের ফেলাটের খালারে ডাইক্কা আনলাম। হেরাই হাসপাতালে লইয়া গেলো। হেইহানের ডাকতারে কইলো চাচী আর নাই।”

কথাটা বলে মুখে ওড়না গুঁজে আবারো কেঁদে উঠলো মাজেদা। ঘর থেকে বের হলো শ্রাবণ। ফোন দিলো বাবার নাম্বারে। কল রিসিভ হতেই সে বলে উঠলো, “বাবা নোভার মা মারা গেছেন।”

“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। কী বলিস! কখন?”

“সঠিক সময় তো বলতে পারছি না তবে যা অঘটন ঘটার আমরা আসার আগেই ঘটে গেছে।”

“বউমা কোথায়?”

“ঘটনাটা ও সহজে নিতে পারেনি। মায়ের মৃত দেহ দেখতেই জ্ঞান হারিয়েছে। এখন কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা।”

“তুই বউমার কাছে থাক। আমি তোর মাকে নিয়ে এখনি ওখানে আসছি।”—বলেই কল কাটলেন হানিফ শেখ। হন্তদন্ত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে এলেন স্ত্রীকে জানাতে।

সময় পেরোলো বেশ। জ্ঞান ফিরলো অনুভার।কয়েক মিনিট সময় লাগলো কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো স্মরণ করতে। শোয়া থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়াতে গেলেই তার বাম হাতটা টেনে ধরলো কেউ। সেদিক পানে তাকাতেই অনুভার দৃষ্টিগোচর হলো প্রিয় মুখখানা। হো হো করে কেঁদে উঠলো সে। বললো,“আমি মায়ের কাছে যাবো শ্রাবণ। মা কোথায়?”

এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রাবণ আর তাকে আটকাতে পারলো না। মস্তিষ্ক হতে শব্দরা উধাও হয়ে গেলো। তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে মায়ের ঘরে এলো অনুভা। খাটিয়ার সামনে বসে পড়ল। চোখের পানি বাঁধ মানছে না তার। মায়ের গালে হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে ডাকতে লাগলো,“মা! ও মা! চোখ খোলো না মা। সবাই এসব কী বলছে মা? বাবার মতো তুমি অন্তত আমাদের ছেড়ে যেও না। মাগো ও মা! চোখ খোলো মা। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। ছেড়ে যেও না আমাদের।”

কথাগুলো বলতে বলতেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো সদ্য মা হারা মেয়েটি। পিতার মৃ’ত্যুর থেকেও মায়ের মৃ’ত্যুতে তার শোকটা যেনো বড্ড বেশি। বাবা যে মৃ’ত্যুর দোরগোড়ায় অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছিল তা তো সে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুতও করে নিয়েছিল কিন্তু মা! মা কেন হুট করে চলে গেলো? হুট করে এভাবে ভালোবাসার মানুষেরা ছেড়েছুড়ে চলে গেলে কোনো মানুষ কী সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে পারে?

হুঁশ ফিরে এলো অর্থিকার। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো ছোটো বোনের পানে। মা হারানোর কষ্টটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তার চোখ দিয়েও আবারো নামতে লাগলো বর্ষন। নিরব বর্ষন। হাসপাতালে ডাক্তারের নিকট মায়ের মৃ’ত্যু সংবাদ শুনে কম তো কাঁদেনি মেয়েটা। বরং সেও জ্ঞান হারিয়েছিল। নার্সরা তখন ধরাধরি করে কেবিনে শুইয়ে তার চিকিৎসা করে জ্ঞান ফেরায়। প্রতিবেশী মানুষগুলো ভালো হওয়ায় একেবারে মৃত দেহের শেষ গোসল করিয়ে কাফনে মুড়িয়ে তারপর বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে তাকে।

স্ত্রীর ক্রন্দনরত দৃশ্য সহ্য হলো না শ্রাবণের। এগিয়ে গিয়ে তার পাশেই বসে পড়ল সে। শক্ত করে হেঁচকা টানে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো তার মাথা। ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,“এভাবে কাঁদে না নোভা। যার যাওয়ার সে তো চলেই যায় সবাইকে ছেড়ে। এভাবে কাঁদলে হবে বলো? শক্ত করো নিজেকে।”

কান্নার বেগ কমার বদলে শুধু বেড়েই চলেছে অনুভার। এতক্ষণে হেঁচকি উঠে গেছে। ভেজা গলায় বলতে লাগলো,“মা কেন চলে গেলো শ্রাবণ? কেন চলে গেলো? এখন কী হবে আমাদের? মাকে ফিরে আসতে বলো না। আচ্ছা মা কী কোনো কারণে অভিমান করেছে? কেন করেছে?”

আরো আজগুবি বিভিন্ন কথাই বলতে লাগলো মেয়েটি। চেষ্টা করেও তাকে থামাতে পারলো না শ্রাবণ। অপারগতা মেনে নিয়ে শক্ত করেই নিজের বক্ষের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলো প্রিয়তমাকে। সুখের সন্ধান পেতে না পেতেই দু বোনের জীবনে কেন এত কষ্ট এসে হানা দেয়? পাগলামো করতে করতেই পুনরায় জ্ঞান হারালো অনুভা। এবারো বিচলিত হয়ে উঠলো শ্রাবণ। পূর্বের স্থানেই শুইয়ে দিলো তাকে। একবার ভাবলো হাসপাতালে নিয়ে যাবে পরক্ষণেই ভাবলো,“জ্ঞান ফেরার পর যদি আবার মাকে দেখতে চায়? তখন?”

কী করবে বুঝতে পারলো না শ্রাবণ। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। এভাবে তো আর অসুস্থ স্ত্রীকে ঘরে রেখে দিতে পারে না। হানিফ শেখ এবং শান্তা এসে পৌঁছে গেছেন। বেয়াইনের লাশ দেখে পুত্রবধূর শিয়রে গিয়ে বসলেন শান্তা। মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে পুত্রের থেকে সবকিছু জেনে নিলেন। হানিফ শেখ তাড়া দিয়ে বললেন,“বউমার জন্য এখানে শ্রাবণ আছে। তুমি বরং অর্থিকা মায়ের কাছে যাও। মেয়েটি দেখলাম একা একা চুপচাপ বসে আছে। এই মুহূর্তে কাছে পিঠে ভরসার কেউ না থাকলে হয়?”

স্বামীর কথায় সায় জানালেন শান্তা। দ্রুত সেদিকে পা বাড়ালেন। যাওয়ার আগে পুত্রকে স্পষ্ট করে বলে গেলেন,“বউমার কাছ থেকে কিন্তু একটুও সরবি না মেহু। জ্ঞান ফিরলে সবটা আমায় জানাবি।”

এবারো অনুভার হাতে-পায়ে তেল মালিশ করা হলো। মুখে ছিটানো হলো পানি। কিন্তু বিশেষ কোনো কাজ হলো না। ঘরের বাহিরেই পায়চারি করছিলেন হানিফ শেখ। ভেতরের কথোপকথন শুনতে পেয়ে ছেলেকে ডেকে বললেন,“দেখ তোর কথামতো এ নিয়ে দু দুবার জ্ঞান হারিয়েছে বউমা। তাই আর এখানে ফেলে রাখা উচিত হবে না। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যা ওকে। নিচে ড্রাইভারসহ গাড়ি আছে। ওটায় করেই কাছের হাসপাতালটায় যা। আমি আর তোর মা তো আছি। সৌহার্দ্যকেও জানিয়ে দিয়েছি। ও এসে পড়বে এর মধ্যে। তুই যা।”

বাবার কথা এই মুহূর্তে সঠিক মনে হলো শ্রাবণের নিকট। তাই বিলম্ব না করে স্ত্রীকে ফের তুলে নিলো কোলে। জ্ঞানহীন অবস্থাতেই নিয়ে চললো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

শান্তা এসে বসলেন অর্থিকার পাশে। মাথায় হাত রাখলেন মাতৃ স্নেহে। ঘাড় ঘুরিয়ে ভদ্রমহিলার পানে তাকাতেই উনাকে চিনতে তেমন বেগ পেতে হলো না অর্থিকাকে। তাকে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন শান্তা। মা হারানোর বেদনা যে কতটা কষ্টের তা তো তিনি জানেন। এমন একটি সময় তো তিনিও পার করে এসেছেন। শান্তার মা যখন মারা যান তখন সৌহার্দ্য উনার পেটে। আহা এমন একটা আনন্দের সময় নিজের মাকে হারান ভদ্রমহিলা। কী নিদারুণ কষ্ট! খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন। শ্রাবণকেও কতদিন যে কোলে তুলে নেননি তাও হিসেবের বাহিরে। জা, শাশুড়িই তো তখন সবকিছু সামলেছে।

মেয়েটি শ্রাবণের থেকে বয়সে কিছুটা বড়ো হবে। তবুও তো মেয়ের মতোই। তার দুঃখে ব্যথিত হলেন শান্তা। বুকে টেনে নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন মাথায়। অনেকদিন বাদে পরম ভরসার একটি স্থান পেয়ে যেনো আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না অর্থিকা। কেঁদে উঠলো শব্দ করে।
________

ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে গভীর হতে লাগলো রাত। গ্ৰাম থেকে এসেছে দুজন চাচাতো ভাই আসিফ এবং সজিব। লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে করে আজও সেই চিরচেনা গ্ৰামে ছুটলো গাড়ি। তবে মৃতদেহ খানা আজ ভিন্ন। তাঈমকে অর্থিকার সঙ্গে ছাড়লেন না শান্তা। বাচ্চা ছেলে এত ধকল নিতে পারবে না। তাই তাকে বুঝিয়ে তাঈমকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। মাজেদা মেয়েটাও একা ছাড়লো না অর্থিকাকে। ফোনের মাধ্যমে কাজের স্থান হতে ছুটি নিয়ে সেও চললো অর্থিকার সাথেই গ্ৰামের বাড়িতে। র’ক্তের সম্পর্ক না থাকার পরেও অল্প কিছুদিনেই এই মানুষগুলো যে তার নিকট অতি আপন হয়ে উঠেছিল।

কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরেছে অনুভার। জ্ঞান ফিরতেই শুরু হলো তার কান্না আর চিৎকার চেঁচামেচি। বাবার কাছে ফোন দিয়ে বিস্তারিত সব জেনে নিয়ে স্ত্রীর নিকট এসে বসলো শ্রাবণ। তাকে দেখতেই বুকে হামলে পড়ল অনুভা। খামচে ধরলো পরনের শার্ট। অস্থির হয়ে বললো,“আমায় মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছো না কেন? কেন এমন করছো তোমরা? আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো।”

শ্রাবণ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,“নিয়ে যাবো তার আগে কথা দাও আমার কথা শুনবে, এভাবে কাঁদবে না।”

দম বন্ধ হয়ে আসছে অনুভার। মায়ের কাফনে জড়ানো মুখটা ভেসে উঠছে আঁখি পটে। কী করে থামাবে এই অশ্রুজল? তবুও মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে সায় জানিয়ে বললো,“উহু কাঁদবো না আমি। নিয়ে চলো।”

আর দেরি করল না শ্রাবণ। হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে অনুভাকে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসলো। ড্রাইভারকে ঠিকানা বলতেই ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিলো। ঠিকানাটা কর্ণগোচর হতেই স্বামীর পানে ভেজা চোখে তাকালো অনুভা। এই চাহনির অর্থদ্বার বুঝতে পারলো শ্রাবণ। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে কপালে, গালে ঠোঁটের উষ্ণ পরশ ছুঁইয়ে মৃদু আওয়াজে বললো, “তোমার বাবার পাশেই মাকে কবর দেওয়া হবে। চাচাতো ভাইয়েরা এসে মায়ের মৃতদেহ এবং আপুকে নিয়ে গেছে ওদের সাথে।”

একটু থেমে আবারো বললো,“হঠাৎ এমন একটি ঘটনা ঘটায় কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এভাবে কাঁদলে কী আর মাকে ফিরে পাওয়া যাবে নোভা? মানুষকে তো মরতে হয় তা তো তুমি জানো।”

“তাই বলে এভাবে কেন চলে যাবে? বাবা যাওয়ার আগেও আমরা সবাই সবকিছু টের পেয়েছি কিন্তু মা? আমাদের তো আর কেউ থাকলো না শ্রাবণ। পুরোপুরি ভাবে এতিম হয়ে গেলাম আমরা।”

সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলো না শ্রাবণ। নিরব রইলো। শুনতে থাকলো স্ত্রীর কান্না। অনুভব করতে লাগলো তার শরীরের কম্পন। মনে মনে শুধু প্রতিজ্ঞা করল,“এটাই তোমার শেষ কান্না নোভা। এরপর আর কখনো তোমার ওই চোখ দিয়ে দুঃখের অশ্রু গড়াতে আমি দিবো না।”

হানিফ শেখ, শান্তা এবং সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরে এসেছে অনেক আগেই। হাতমুখ ধুয়ে পরনের পোশাক বদলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শান্তা। সবিতার কাছে তাঈমকে রেখে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। পথে ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার উপর পেটে কিছু পড়েনি। বসার ঘরে আসতেই ছোটো পুত্রবধূকে সোফায় বসে থাকা অবস্থায় দেখতে পেলেন তিনি। তার পাশেই বসা জাগ্ৰত তাঈম। নিজ দায়িত্বে বাচ্চাটিকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে প্রান্তি। পুত্রবধূর এমন দায়িত্ব জ্ঞান দেখে ভেতরে ভেতরে প্রশান্তি অনুভব করলেন শান্তা।

শাশুড়িকে দৃষ্টিগোচর হতেই হাস্যজ্জ্বল মুখে প্রান্তি বলে উঠলো,“বাবুটা অনেক কিউট আর শান্ত। সেই যে বৌ ভাতের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম। এসেই অনুভা আপুর কোলে ঝাপিয়ে পড়েছিল।”

উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে এসে সোফায় বসেন শান্তা। আফসোসের সুর তুলে বলেন,“মেয়ে দুটোর উপর দিয়ে একটার পর একটা দখল যাচ্ছেই।তাছাড়া বড়ো বউমার জন্য এখন না হয় শ্রাবণ আছে, আমরা আছি কিন্তু অর্থিকা মেয়েটিকে সামলানোর জন্য তো কেউই নেই। এই অল্প বয়সেই বিধবা হলো, শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলোর আসল রূপ দেখলো তারপর বাবাকে হারালো এখন আবার মাও চলে গেলো। আমার না খুব কষ্ট হয় ওর জন্য।”

শাশুড়ির নিকট হতে সবটা শুনে প্রান্তিরও মন ভার হলো। তাঈমকে খাওয়ানো শেষ হতেই সবিতাকে ডেকে এঁটো প্লেটটা নিয়ে যেতে বললো । কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বলে উঠলো,“একটা কথা বলবো মা?”

“হুম বলো।”

“আন্টি মারা গেছেন। উনাদের দুই বোনের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। আপনার কথা অনুযায়ী যা বুঝলাম, আপুর বোন তো বর্তমানে একা। বেচারিকে সামলানোর জন্য সত্যিই কেউ নেই। তার উপর ছোটো বাচ্চা। আচ্ছা উনাকে যদি কিছুদিনের জন্য এখানে রাখা হয়, তাহলে কেমন হয়? একটা পরিবারের মধ্যে থাকলে শোকটা কাটিয়ে উঠতেও সুবিধা হবে। কী বলেন?”

পুত্রবধূর এহেন প্রস্তাবে চমকায়িত দৃষ্টিতে তার পানে তাকান শান্তা। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে মাথা নাড়িয়ে বলেন,“দারুন বলেছো তো। আমার মাথায় কেন এটা এলো না? তুমি বাচ্চাটাকে একটু দেখে রাখো আমি তোমার শ্বশুর মশাইকে জানিয়ে আসি কথাটা।”

বলেই হনহনিয়ে প্রস্থান করলেন শান্তা। যতোই হোক তিনিও তো একজন মা। অন্যের দুঃখে মায়ের মন সর্বদাই কাঁদে। প্রান্তি তাঈমের আঙুল ধরে দাঁড়ালো। বললো,“চলো ঘরে যাই।”

তাঈম তাকালো এই অপরিচিত রমণীটির পানে। মলিন স্বরে বললো,“মায়ের কাথে দাবো।”

তৎক্ষণাৎ তাকে কোলে তুলে নিলো প্রান্তি। ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,“হুম যাবো তো। মায়ের কাছেই যাবো। তার আগে আমরা খেলা করবো, গল্প করবো।”

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৩১+৩২

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩১]

চারদিনের মধ্যেই বৌ ভাতের সকল আয়োজন সম্পন্ন হলো। গ্ৰাম, শহরসহ বিভিন্ন জায়গা হতে আত্মীয় স্বজনেরা এসে উপস্থিত হলো শেখ বাড়িতে। বিশাল এক কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে সেখানেই অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন হানিফ শেখ। দুই পুত্রবধূকে মনমতো সাজালেন শান্তা। লকারে তুলে রাখা সব গহনা দিয়ে গা ভর্তি করে দিলেন।

স্ত্রীকে এমন ভারি সাজে দেখে দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেলো শ্রাবণের। হুট করেই মনে হলো তার এই ব্যক্তিগত নারীটি অসম্ভব সুন্দর।সব সজ্জায়-ই তাকে দারুন লাগে।

নিজের এবং মেয়ের পুরো শ্বশুরবাড়ির লোক সমেত অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হলেন রুবিও। ভদ্রমহিলা এসেই প্রান্তির সঙ্গে যেনো ভাব জমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনুভাকে দেখেও না দেখার ভান করে রইলেন পুরোটা সময়। অনুভা প্রাপ্ত বয়স্ক বোঝদার একজন নারী। মানুষের আচার-ব্যবহার, দৃষ্টি সবকিছুর অর্থদ্বার তার নিকট পরিষ্কার। তাই শ্রাবণের এই খালার মনোভাব দেখে সহজেই সে বুঝে গেলো উনার যে কোনো কারণে তাকে অপছন্দ। অপছন্দ হতেই পারে এটাই স্বাভাবিক। একজন মানুষ কখনোই সকলের মনের মতো হতে পারে না। তাই ব্যাপারটার প্রতি তেমন একটা গুরুত্ব দিলো না অনুভা।

অনুষ্ঠানে অর্থিকা এলো তাঈমকে নিয়ে। অথচ হানিফ শেখ এবং শ্রাবণ গিয়ে সকলকে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছে। সাথে বলে দিয়েছে মাজেদাকেও যাতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তা আর হলো না। সুফিয়ার চলাচল করতে অসুবিধে হয়। দিনে দিনে ভদ্রমহিলা একেবারে নিরব হয়ে গেছেন। নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখতেই পছন্দ করেন। তাই উনি বড়ো কন্যার সঙ্গে এখানে আর আসতে চাইলেন না। কড়াকড়িভাবে তাকে বলেও দিলেন,“অনুকে সত্যটা বলার প্রয়োজন নেই অর্থি। ওকে যা হোক কিছু একটা বলে বুঝিয়ে দিস। মেয়েটা অবুঝ। মায়ের জন্য চিন্তা করবে, কেঁদেকেটে ভাসাবে।”

তাই মাজেদাও আর এলো না। এ কদিনে সুফিয়ার প্রতি তার একটা টান জন্মে গেছে। এর আগেও অনেক বাড়িতেই সে কাজ করেছে কিন্তু এমন মাতৃ আচরণ কারো নিকট হতেই প্রাপ্ত হয়নি তাই হয়তো উনার প্রতি তার এত মায়া আর টান।

কাজিন শ্রেণীরা কমিউনিটি সেন্টার হতে খেয়ে দেয়ে বাড়িতে এসেছে অনেক আগেই। ফুল দিয়ে সজ্জিত করেছে বাসর ঘর দুটো। দুই ভাইয়ের একই দিনে বাসর ভাবা যায়!ব্যাপারটা নিয়ে সবাই খুবই উৎসুক। বাসর সাজানো শেষ হতেই সকলে মিলে একত্রে ফন্দি আঁটে কীভাবে তাদের থেকে আদায় করবে অর্থ। ফুফাতো, মামাতো, চাচাতো ভাই-বোন মিলে মোট ন খানা মাথা গোল হয়ে বসে আছে। টানা মিনিট দশেক ফন্দি এঁটে তারপর চেঁচিয়ে উঠলো সকলে।

পুত্রবধূদেরকে নিজেদের সঙ্গে করেই বাড়ি ফিরেছেন হানিফ শেখ এবং শান্তা। বাড়ি ফিরতেই তাদেরকে ঘিরে ধরলো সকলে। শ্রাবণ এবং সৌহার্দ্য এখনো ফেরেনি। দুজনে এক সঙ্গেই ফিরবে।

অনুভাকে আবারো নতুন করে সাজিয়ে এনে বসানো হলো তাদের শোবার ঘরে। ঘর দেখে আশ্চর্য হলো অনুভা। বিছানার মাঝখানে গোলাপের বদলে চন্দ্রমল্লিকা দিয়ে লাভ সেফ। তার মধ্যিখানে দুই জাতের শুভ্র বেলী ফুল। খাটের উঁচু পাটাতনে নাম না জানা কয়েক পদের ফুলের মেলা। ঘরটি আজ বড্ড অচেনা ঠেকছে তার নিকট। আসবাবপত্র সব পূর্বের থাকলেও ঘরটি সাজানোর কারণেই মূলত এই অচেনা রূপ।

কাজিন শ্রেণীর মধ্যে রূপা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে অনুভার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“বুঝলে ভাবী তোমার বাসর ঘর সাজানোর পুরো প্লান কিন্তু শ্রাবণ ভাইয়ের। এই যে দেখছো ফুলগুলো? এইসব ফুল কিন্তু ভাইয়া এনে দিয়েছে আর আমাদের সব দিক নির্দেশনাও ভাইয়াই দিয়েছে।”

চমকায় অনুভা। এতকিছুর মধ্যে এ দিকটাও কিনা ছেলেটির খেয়ালে ছিলো? অবন্তী বিরক্তির সহিত বলে,“সৌহার্দ্য ভাই শুধু প্রেমটাই যা করতে পারলো আসলে ব্যাটা একটা আনরোমান্টিক। ওর বাসর ঘরটা কিন্তু আমরা আমাদের আইডিয়াতেই সাজিয়েছি। সে তো তার বউ নিয়েই চরম ব্যস্ত ছিলো। এদিক ভাবার সময় কোথায়?”

অবন্তীর কথায় হো হো করে হেসে উঠলো বাকিরা। রূপা বিছানার মাঝখানটায় অনুভাকে সুন্দর করে বসিয়ে দিয়ে বললো,“বসে বসে এবার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করো ভাবী। আমাদের পাওনা টাকা না দিলে কিন্তু তোমার সোয়ামি এ ঘরের চৌকাঠেও পা রাখতে পারবে না বলে দিয়ে গেলাম। তাই আল্লাহকে ডাকো যাতে তার মনে দয়া মায়ায় ভরিয়ে দেয়।”

ননদের কথায় লাজুক হাসে অনুভা। অবন্তী তাড়া দিয়ে বলে,“এবার ছোটো ভাবীর কাছে চল। তাকে আর সৌহার্দ্য ভাইকে নিয়ে একটু মজা কুড়িয়ে আসি।”

সকলেই সায় জানালো তার কথায়। অনুভার নিকট হতে বিদায় নিয়ে চলে গেলো কক্ষ হতে। প্রান্তি বসে আছে সৌহার্দ্যের কক্ষের বিশাল খাটটির মাঝখানে। দু দলে বিভক্ত হওয়া কাজিনদের মধ্যে একদল তাকে বসিয়ে দিয়েছে এখানে। আরেকদলও অনুভার কাছ থেকে এখানে এসে হাজির হলো। খয়েরি রঙের ল্যাহেঙ্গায় বেশ সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। দেহে বাবা-মা এবং শ্বশুর শাশুড়ির দেওয়া অজস্র গহনা। লাজুক মুখ করে বসে আছে সে। অবন্তী আর রূপা এসে বসলো তার পাশে। উদ্দেশ্য একটাই সৌহার্দ্যকে জড়িয়ে তার সঙ্গে মজা নেওয়া।
_______

ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। দুই ভাই অবশেষে বাড়িতে ফিরলো। সিঁড়ির কাছে আসতেই তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো কাজিন শ্রেণী। দুই ভাই একে অপরের মুখপানে চাওয়াচাওয়ি করল। তাদের মধ্য হতে বয়সে বড়ো এবং বিবাহিত কাজিন রুয়েল ঠাট্টাশ্লেষ বলে উঠলো,“তোদের দু ভাইয়ের বয়সের পার্থক্য কত রে?”

ভ্রু কুঁচকে নিলো শ্রাবণ। উত্তর জানা প্রশ্ন এ আবার কেন করছে? ভেবেই ললাটে সরু ভাঁজ পড়ল। সৌহার্দ্য চটপট উত্তর দিলো,“ভাইয়া আমার থেকে তিন বছর পাঁচ মাস চৌদ্দ দিনের বড়ো। কেন বলো তো?”

নিরব বললো,“তাহলে শ্রাবণের আরো তিন বছর আগে বিয়ে করে বাসর করার কথা ছিলো অথচ শেষমেশ কিনা দুই ভাইয়ের একদিনেই বাসর! তোরা তো গিনেস বুকে নাম উঠাতে পারবি রে।”

তৎক্ষণাৎ সমস্বরে হেসে উঠলো সকলে। সৌহার্দ্য আফসোস করে বললো,“না রে নিরব ভাই। এমন ঘটনা আগেও অনেক ঘটেছে তবে তোরা আগে ভাগে বিয়ে না করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করলে হয়তো আজ আমাদের চার জনের বাসরই একদিনেই হতো। তাহলে গিনেস বুকে নাম উঠে গেলেও উঠতে পারতো।”

সৌহার্দ্যের কথায় দমে গেলো রুয়েল এবং নিরব। শ্রাবণ বিরক্তির সহিত বললো,“নাম তো তোর নিরব তাহলে নিরব না থেকে এত পটর পটর করিস কেন? আসল মতলবটা বলে ফেল। দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।”

অবন্তী খোঁচা দিয়ে বললো,“দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না নাকি বউকে ছাড়া ভালো লাগছে না?”

গম্ভীর মুখখানায় মুচকি হাসি ফোটে উঠলো শ্রাবণের। বললো,“দুটোই।”

অকপটে স্বীকারোক্তিতে আবারো হৈ হুল্লোড় সৃষ্টি হলো সকলের মধ্যে। কাজিন শ্রেণীর মধ্যে ছোটো থেকেই শ্রাবণ ছিলো ঘাড়ত্যাড়া এবং চাপা স্বভাবের একটি ছেলে। তার ভেতরের খবর বাহিরে আনা ছিলো যেনো দুঃসাধ্য একটি কাজ। তাদের মধ্যকার অনেক মেয়ে কাজিনই ছোটো থেকে লাইন মারতে চেয়েছিল শ্রাবণকে কিন্তু বরাবরই তাদের সুন্দর করে এড়িয়ে গিয়েছে শ্রাবণ। অথচ সেই ছেলেই কিনা একটা মেয়ের সাথে এত বছরের প্রণয়ের সম্পর্ক করে বিয়ে করে নিলো! আবার কী সুন্দর করে সকলের সামনে নিজের অভিব্যক্তি স্বীকারও করে নিচ্ছে! এতেই যেনো সকলে চরম অবাক।

অবন্তী বলে উঠলো,“সবাই শান্ত হ। কাজের কথায় আসি। শোন ভাইরা আমাদের। তোদের বাসরঘর আমরা অনেক কষ্টে সাজিয়েছি তাই আমাদের সাজানো ঘরে গিয়ে এমনি এমনি রোমান্স করা তো চলবে না।”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো,“কষ্ট করে প্রেম করে বিয়ে করলাম আমরা, বাসর সাজালি আমাদের টাকায় আবার বউকে সারাজীবন সহ্য করবো আমরা অথচ টাকা দিবো তোদের? কাভি নেহি। ভাইয়া এদের জোরে একটা ধমক দাও তো। আমি আছি তোমার পেছনে।”

মুহূর্তেই ক্ষেপে উঠলো সকলে।শুরু হলো বাগবিতণ্ডা। অতি কথা বিরক্ত লাগছে শ্রাবণের। তাই ওদের থামিয়ে দিয়ে শুধালো,“এমাউন্টটা বলে শান্তি পা এবং শান্তি দে।”

হাসি ফোটে উঠলো সকলের মুখে। রূপা সৌহার্দ্যকে ভেংচি কেটে শ্রাবণের উদ্দেশ্যে বললো,“দেখো ভাইয়ারা বেশি কোনো দাবি আমাদের নেই। শ্রাবণ ভাইয়ার বাসরঘর আলাদা এবং স্প্যাশালভাবে সাজানো প্লাস পুরোনো সাজ উঠিয়ে বড়ো ভাবীকে আবার নতুন করে সাজানোর জন্য শ্রাবণ ভাই দিবে পঁচিশ হাজার টাকা, আর সৌহার্দ্য ভাইয়ের জন্য অত খাটতে হয়নি বলে ও দিবে বিশ হাজার টাকা।”

অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো সৌহার্দ্যের। বুকের বা পাশে হাত রেখে বললো,“তোরা কী ডাকাত নাকিরে? একসাথে আমাদের দুই ভাইয়ের কাছ থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা ঝেঁপে দিবি? এই এই টাকা কী গাছে ধরে নাকি? দুই হাজার দিচ্ছি ভাগ বাটোয়ারা করে নিস।”

তেতে উঠলো রুয়েল। বললো,“এসব বলতে তোর লজ্জা করে না? বিদেশে হাই ফাই চাকরি করিস, মাস শেষে ডলার কামাস আর এখানে এসে এমন ছ্যাচড়ামি করছিস? মাত্র বিশ হাজারই তো চেয়েছে ছোটো বোনেরা। টাকার তো তোদের অভাব নেই।”

“নিজেরা ছ্যাচড়ামি করে আমাকে ছ্যাচড়া বানাচ্ছো? শ্যাম অন।”

শ্রাবণ কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললো,“আমার বাসরঘর প্লাস বউকে সাজানোর পুরো আইডিয়া আমার। পুরো শপিং মল ফুলের দোকান খুঁজে খুঁজে সবকিছু আমি এনে দিয়েছি তোদের। বাহির থেকে লোক আনিয়ে এসব করালে হাইস্ট দশ হাজার খরচ হতো। এর বেশি কিন্তু নয়। তবুও তোরা আমার ভাই- বোন তাই পনেরো হাজার দিতে রাজি আছি। এর থেকে একটা টাকাও বেশি দিবো না। এবার বাকিটা তোদের মর্জি। ভেবে দেখ।”

তাদের সামনে থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো সকলে। আলোচনা চললো কী করবে। নিবিড় ফিসফিস করে বললো,“শ্রাবণ যা ঘাড়ত্যাড়া আমি তো ভেবেছিলাম একটা টাকাও ওর থেকে আদায় করতে পারবো না। তারপরেও পনেরোতে রাজি হয়েছে এটাই হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। তাই চুপচাপ মেনে নে।”

নিবিড়ের কথায় সম্মতি জানালো সকলে। পুনরায় এসে দাঁড়ালো তাদের সম্মুখে। রূপা বললো,“ওকে তোমার কথায় রাজি আমরা। নগদ পনেরো হাজারই দাও তবে।”—–বলেই হাত বাড়ালো।

মুচকি হেসে পাঞ্জাবীর পকেট হতে চকচকে একটা হাজার টাকার বান্ডেল বের করে দিলো শ্রাবণ। সকলেই আবারো আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলো। সৌহার্দ্য কাঁচুমাচু মুখ করে বললো,“আমার থেকেও পাঁচ হাজার কম রাখলে হয় না?”

অবন্তী বললো,“শ্রাবণ ভাইয়ার মতো যুক্তি দেখা তারপর ভেবে দেখবো।”

কী যুক্তি দেখাবে ভাবতে লাগলো সৌহার্দ্য কিন্তু খুঁজে পেলো না কিছুই। বাধ্য হয়েই পকেট হতে সেও বের করল একটা বান্ডেল। রুয়েল গুনলো টাকাটা কিন্তু এখানে বিশ হাজারের বদলে আছে চৌদ্দ হাজার। রেগে গেলো তারা। প্রতিবাদ করে বললো,“এটা কিন্তু ঠিক নয় সৌহার্দ্য। বাকি ছয় হাজার দে বলছি।”

“আমার কাছে এটাই ছিলো। এর বেশি কিছু নেই। বাকিটা না হয় কাল দিবো?”

নিবিড় ঘোর প্রতিবাদ করে বললো,“উহু বাকির নাম ফাঁকি। টাকা ছাড়া বাসরঘরের চৌকাঠ মারানো নিষেধ।”

সকলের মুখ গুরু গম্ভীর। সৌহার্দ্য অসহায় মুখ করে বড়ো ভাইয়ের পানে তাকালো। বাচ্চাদের মতো পাঞ্জাবীর হাতা টেনে বললো,“ভাইয়া দিয়ে দাও না।”

বিরক্তির সহিত তার পানে তাকায় শ্রাবণ। সৌহার্দ্য ফের বলে,“প্রমিস শোধ করে দিবো।”

ভাইয়ের অসহায় মুখ দেখে না করতে পারে না শ্রাবণ। এমন ঝামেলায় পড়তে হবে ভেবে আগেই সে নিজের কাছে ভালো পরিমাণের ক্যাশ রেখে দিয়েছিল। তাই চুপচাপ দিয়ে দেয় তাদের টাকাটা। টাকা কে দিলো তা নিয়ে হলো না কারো মধ্যে কোনো মাথাব্যথা। টাকা নিয়ে দু ভাইকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রস্থান করল সকলে।

বাহিরের সমস্ত হইচই কর্ণগোচর হলো অনুভার। লজ্জায় পুরো দেহ তার কাঁপছে। ক্ষণে ক্ষণে শুকনো ঢোক গিলে চলেছে। এসি চলার পরেও হাত-পা ঘেমে নেয়ে একাকার। তাদের হৈ হুল্লোড় বন্ধ তার মানে শ্রাবণ আসছে!

ঘরে প্রবেশ করল সৌহার্দ্য। দরজা আটকে দিয়ে পাঞ্জাবীর হাতা গোটাতে গোটাতে এগিয়ে গিয়ে ঢপাস করে বসে পড়ল বিছানায় নববধূর সম্মুখে। দুই হাত দিয়ে ঘোমটা সরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,“মাশাআল্লাহ! অপূর্ব!”

লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো প্রান্তি। তার থুতনি ধরে মুখ উঁচু করল সৌহার্দ্য। ললাটে গভীর চুম্বন আঁকলো। চোখ বন্ধ করে নিলো মেয়েটি। খামচে ধরলো স্বামীর পাঞ্জাবী। সৌহার্দ্য হাসলো। ফিসফিস করে বললো,“প্রান্তি লজ্জা পেতেও জানে? কই জানতাম না তো।”

লজ্জার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলো প্রান্তির। দুষ্টু হাসলো সৌহার্দ্য। বললো,“লজ্জাবতীকে নির্লজ্জবতী করার ক্লাস শুরু করবো?”

কথার অর্থদ্বার বুঝতেই এবারো চুপ রইলো প্রান্তি।নিরবতাই যেনো সম্মতির লক্ষণ। সৌহার্দ্য হাসলো। সঙ্গে আনা উপহারটা স্ত্রীর হাতে দিয়েই আবারো চুম্বন আঁকলো অধরে।

এদিকে ঘড়ির কাঁটা এক ঘর হতে আরেক ঘরে স্থির হলো। সাড়ে বারোটা প্রায় বেজে গেছে অথচ এখনো ঘরে প্রবেশ করেনি শ্রাবণ। চিন্তিত হলো অনুভা। এতক্ষণে তো তার এসে পড়ার কথা তাহলে? কোথায় গেলো শ্রাবণ?

ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হলো বেশ কিছুটা। মোবাইল হাতে নিলো অনুভা।অন করতেই দৃষ্টিগোচর হলো ‘শ্রাবণ’ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটি থেকে গুণে গুণে এগারোটি মিসড কল। শঙ্কিত হয়ে উঠলো তার মন। মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় টের পায়নি কিছুই। কম্পিত হাতে দ্রুত কল লাগালো নাম্বারটিতে।রিসিভও হলো সঙ্গে সঙ্গে। যেনো চাতক পাখির ন্যায় তার অপেক্ষাতেই ছিলো এতক্ষণ। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে সুগভীর কণ্ঠে শ্রাবণ বলে উঠলো,“ঘর থেকে বের হয়ে হাতের ডানে হাঁটলেই সিঁড়ি পেয়ে যাবে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে এসো।”

এর বেশি একটা বাক্যও খরচা করল না শ্রাবণ।কেটে দিলো কল। বড়োই আশ্চর্য হলো অনুভা। এত রাতে ঘরে না এসে তাকে ছাদে কেন ডাকলো ছেলেটি? মাথা হতে দু পাট্টা খুলে বিছানায় রেখে দিলো অনুভা। পরনের অমায়িক কাজ করা শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে বের হলো ঘর থেকে।

নূপুরের রিনিঝিনিতে মুখোরিত হয়ে উঠলো চারিপাশ। ভয়ে, লজ্জায় কেঁপে উঠলো অনুভার মন। হঠাৎ কেউ দেখে ফেললে কী মনে করবে? হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলতে লাগলো সম্মুখ পথে। তবুও নূপুরের শব্দ হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো অনুভা। চারিপাশে চোখ বুলিয়ে অবশেষে দেখা মিললো শখের পুরুষের। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আকাশপানে মনোযোগী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। স্ত্রীর উপস্থিতি টের পেতেই সম্মোহনী স্বরে বললো,“দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসো।”

তাই করল অনুভা। আটকে দিলো ছাদের দরজা। ছোটো ছোটো কদমে এগিয়ে এসে সেও রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো পাশে। মিহি স্বরে শুধালো,“এত রাতে ছাদে ডাকলে কেন?”

আকাশ হতে দৃষ্টি সরিয়ে সেই দৃষ্টি স্ত্রীর পানে স্থির করল শ্রাবণ। সোনালী রঙের সুতোয় বোনা চোখ ধাঁধানো সুন্দর শাড়িটি যেনো সঠিক অঙ্গতেই স্থান পেয়েছে। শাড়িটি তাঁতি পাড়া থেকে মনমতো ডিজাইনে বানিয়ে এনেছিল শ্রাবণ। ইচ্ছে ছিলো যেদিন অনুভা নামক মেয়েটিকে সে জীবনে পেয়ে যাবে সেদিন তাকে মনের মতো সাজাবে। সাজাবে ফুলে ফুলে ফুলপরী। তাই হয়েছে, নিখুঁত ভাবে শাড়িটা পরানো হয়েছে তাকে। শরীরে বিভিন্ন জাতের ফুলের গহনা। মোটা করে কাজলটানা চোখ। ঠোঁটে লিপবাম। এর বেশি আর সাজ নেই। চুলগুলো খোঁপা করা কিন্তু তার উপর দিয়েই ছোটো ছোটো চুলগুলো বাতাসের তালে তালে এলোমেলো হয়ে উড়ছে।

এক অদৃশ্য ঘোরে আবদ্ধ হয়ে উঠলো শ্রাবণ। দৃষ্টিতে জমা হলো তীব্র প্রেমের নেশা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অনুভার কোমর। কোনো ধরণের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নিজ ঠোঁটের ভাঁজে আবদ্ধ করে নিলো রমণীর তুলতুলে নরম ঠোঁট। এহেন কাণ্ডে বিষ্মিত হলো অনুভা। কিছুই যেনো পূর্বে আঁচ করতে পারেনি সে। নিস্তেজ হয়ে এলো তার শরীর। বাঁধা দেওয়ার মতো সমস্ত শক্তি লোপ পেলো।

পূর্ণিমার চাঁদ। হলদে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে ধরণী। ছাদের টবে লাগানো কামিনী ফুলের সুবাস ছড়িয়েছে চারিদিকে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বইছে মৃদু বাতাস। দূর পথ হতে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ভাসছে। ভাসছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান। প্রেমময় একটি মুহূর্ত।

কিছু সময় অতিবাহিত হতেই শ্রাবণ তার ওষ্ঠদ্বয় ছেড়ে দিলো। নিতে লাগলো ভারি শ্বাস। অনুভার অবস্থাও এক। লজ্জায় বন্ধ চোখ মেলতে পারছে না কিছুতেই। এমন একটি কাণ্ড ঘটার পর কী করে সম্মুখ পুরুষটির চোখে চোখ রাখবে সে?

ধীরে ধীরে বাঁধন শক্ত হলো শ্রাবণের। শাড়ি ভেদ করে অনেক আগেই উন্মুক্ত উদরে হাত এসে প্রবেশ করেছে। মেয়েটির অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন, উত্তপ্ত শ্বাস- প্রশ্বাস খুব ভালো করেই টের পাচ্ছে। কিছু সময় কেটে গেলো। একরাশ লজ্জা নিয়েই পিটপিট করে তাকালো অনুভা। ফের দৃষ্টিগোচর হলো সেই মাদকতা মেশানো এক জোড়া দৃষ্টির। দৃষ্টিটি প্রকান্ড গাঢ় তার উপর। শরীরের ভারসাম্য যেনো ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে অনুভার। জড়িয়ে ধরলো পুরুষটিকে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুজল। বাঁধন শক্ত হয়ে এলো। ফুঁপিয়ে কান্না করার শব্দ ভেসে এলো শ্রাবণের কর্ণে। অথচ সে কিছুই বললো। বাঁধা দিলো না। এ কান্না যে দুঃখের নয়। এ কান্না হচ্ছে সুখের।

শ্রাবণ বলেছিল,‘আমি তোমায় সুখের অসুখে ডুবিয়ে রাখবো নোভা।’ সেই বাক্যটিই এই মুহূর্তে বারংবার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো অনুভার কানে। এই কী তবে সেই সুখ? ভালোবাসার প্রাপ্তি বুঝি এত সুখকর? গলা জড়িয়ে গেলো অনুভার। চোখের পানি নাকের পানি একত্রে হয়ে তা লেগে গেলো শ্রাবণের পাঞ্জাবীতে। আজ সকল জড়তা একপাশে সরিয়ে দিয়ে জড়ানো কণ্ঠেই অনুভা স্বীকার করে বসলো নিজের মনের গহীনে লুকায়িত সেই চির চিরায়ত সত্য কথাটা,“ভালোবাসি শ্রাবণ। অনেক ভালোবাসি তোমায়।”

শ্রাবণ হাসলো। যেই হাসির কোনো শব্দ নেই। এই হাসি প্রাপ্তির হাসি। তার মনটা নড়ে উঠলো। পুরুষালী কঠোর চোখ দিয়েও হলো দু ফোঁটা বর্ষন। যা দৃষ্টির অলক্ষ্যে থেকে গেলো সুখী রমণীর। মাথায় আলতো চুমু খেয়ে তাকে সপাৎ করে পাঁজাকোলে তুলে নিলো শ্রাবণ। ফিসফিসানো গাঢ় স্বরে প্রয়োগ করল সুগভীর বাক্য, “আঁধারিয়া রজনীর আঁধার সরিয়ে আলোকিত করা ওই চন্দ্রের চেয়েও সুন্দর আমার নোভা। কামিনী ফুলের গন্ধের চেয়েও মোহনীয় আমার নোভার দুটো ঠোঁট। শ্রাবণ নামক পুরুষটির উপরই শুধু নিহীত হোক নোভার সকল সুখ।”

লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো অনুভা। প্রিয়তমের পাঞ্জাবী খামচে ধরে প্রশস্ত বক্ষে গুঁজলো মুখ। কিন্তু ঘোর কাটলো না শ্রাবণের। তাকে কোলে নিয়েই নিচের দিকে যেতে যেতে ফিসফিসিয়েই আবদার করল,“আজ পুরোপুরিভাবে আমার হবে মেঘফুল? শত জড়তা, লজ্জার দেয়াল ভেঙেচুরে দিয়ে আমার হবে? তোমার পবিত্র দেহে আমার ভালোবাসার স্পর্শ আঁকতে দিবে?”

এত সুমধুর আবদার নাকোচ করতে পারলো না অনুভা। সেও চায় পুরোপুরিভাবে শ্রাবণের হতে। লাজুক স্বরে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,“হু।”

চলবে_________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩২]

আজকের দিনটি শুরু হলো হাজারটা অনিয়ম দিয়ে। শ্রাবণ, সৌহার্দ্য কেউই আজ সকাল সকাল হাঁটতে বের হলো না, খোলা আকাশের নিচে বসে তাদের চা খাওয়া হলো না, এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তারা।গোসল সেরে এসে বাসি ফুলগুলো পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়ল অনুভা। ভেজা চুল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। যার দরুন কোমরের কাছের শাড়ির অংশটি ভিজে লেপ্টে গেছে শরীরের সঙ্গে। ঘরদোর পরিষ্কার করে ময়লাগুলো একপাশে রেখে দিয়ে আয়নার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো সে। নিজের পানে নিজে তাকাতেই যেনো লজ্জাবোধ হচ্ছে মেয়েটার।

গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই বারবার কেঁপে উঠছে সর্বাঙ্গ। নিচে যেতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। ভেজা চুল দেখে কী মনে করবে সকলে? সকাল হয়ে গেছে অনেক আগে এতক্ষণ ধরে ঘরে বসে থাকাটাই বা কেমন দেখায়? লজ্জা ঠেলে আশেপাশে তাকালো অনুভা। ড্রেসিং টেবিলের উপর পেয়েও গেলো হেয়ার ড্রায়ার। তাই আর বিলম্ব না করে সুইচ অন করে চুল শুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখনি শব্দ হলো ওয়াশরুমের দরজার। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো বিছানা ফাঁকা। তার মানে শ্রাবণ উঠে গেছে!

সময় নিয়ে চুল শুকিয়ে বিছানা গোছাতে চলে এলো অনুভা। কাবাড খুলে নতুন বিছানার চাদর বের করে তা বিছাতে লাগলো। ওয়াশরুমের দরজা খুলে তখনি বেরিয়ে এলো শ্রাবণ। তোয়ালে দিয়ে ভেজা মাথা মুছতে মুছতে তাকালো স্ত্রীর পানে। বারান্দায় আধ ভেজা তোয়ালে মেলে দিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো স্ত্রীকে। অনুভা চমকালো। তার কাঁধে থুতনি ঘষে আহ্লাদী সুরে শ্রাবণ বললো,“স্বামীর ছোঁয়া পেতে না পেতেই দেখছি তোমার সৌন্দর্য বেড়ে গেছে নোভা! আমারটা কেন বাড়লো না? আমিও তো এই প্রথম বউকে আদর করলাম।”

হতভম্ব হয়ে গেলো অনুভা। কনুই দিয়ে গুঁতো মারলো তার পেটে। খানিকটা ব্যথা পেলো শ্রাবণ।তাকে ছেড়ে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ল। রাগত স্বরে অনুভা বলে উঠলো,“তুমি সত্যিই একটা অসভ্য। মুখে যা আসে তাই বলে দিবে?”

“আজব! আমি একটা লয়্যাল ছেলে, মনে যা আসবে তাই তো বউয়ের সামনে প্রকাশ করবো তাই না?”

“সরো এখান থেকে। বিছানা গোছাতে দাও।”

“না সরলে কী করবে?”

রাগ তরতর করে বৃদ্ধি পেলো অনুভার। বালিশটা শ্রাবণের দিকে ছুঁড়ে মেরে মাথায় ঘোমটা টেনে হাঁটা ধরলো দরজার দিকে। বললো,“নিজে গুছিয়ে নাও। সবটা সুন্দর করে গোছাবে বলে দিলাম।”

আলগোছে হাসলো শ্রাবণ। ততক্ষণে দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে অনুভা।সোফায় বসে চা খাচ্ছেন আর জা ননদদের সঙ্গে গল্প করছেন শান্তা। বড়ো পুত্রবধূকে দেখতেই প্রসন্ন হেসে শুধালেন,“ঘুম ভেঙেছে?”

এহেন প্রশ্নে সকলের সামনেই খানিকটা লজ্জা পেলো অনুভা। উপরনিচ মাথা নাড়ালো। শান্তা পুনরায় বললেন,“শ্রাবণ উঠেছে? উঠলে টেবিলে নাস্তা বেড়ে রাখা আছে, ওগুলো নিয়ে ঘরে চলে যাও। দুজনে একসঙ্গে গিয়ে খেয়ে নাও।”

আহত দৃষ্টিতে শাশুড়ির পানে তাকালো অনুভা। এই তো ছেলেটার লাগামহীন কথায় বিরক্ত হয়ে সে নিচে চলে এসেছিল।এখন কিনা আবার তার কাছেই যেতে হবে? দূর, দূর। তার করুন চাহনি আর দৃষ্টিগোচর হলো না শান্তার। তিনি তো গল্প করাতেই মনোযোগী হয়ে উঠলেন। তাই বাধ্য হয়েই খাবার নিয়ে পুনরায় ঘরে চলে গেলো অনুভা।

কিছুক্ষণ বাদে নিচে নেমে এলো প্রান্তি এবং সৌহার্দ্য। তারাও একসঙ্গেই নাস্তা করে নিলো।
_________

অর্থিকা এবং ফায়াজ একই ইউনিভার্সিটি এবং একই ব্যাচের স্টুডেন্ট। যদিও তাদের ডিপার্টমেন্ট ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা তবুও প্রথমে এই মেয়েটি ফায়াজের নজরে পড়েছিল নবীন বরণের দিন। তখন তারা দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। ক্যাম্পাসে আগমন ঘটেছে নতুন শিক্ষার্থীদের। নতুনদের ফুল দিয়ে ক্যাম্পাসে স্বাগত জানানোর দায়িত্ব এসে পড়েছিল তাদের উপর। বন্ধুদের বিভিন্ন কথাবার্তার উদ্বেগ পূর্ণ শক্তি সেদিন বের করে এনেছিল অর্থিকার প্রাণোচ্ছ্বল হাসিখুশি রূপটা। এই রূপেই তখন মুগ্ধ হয়েছিল সদ্য যৌবন অতিবাহিত করতে থাকা যুবকটি। সেদিন পুরোটা সময়ই সে মেয়েটির পানে নিষ্পল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।

তার এই প্রেমে পড়ার কাহিনীটা একসময় বন্ধুদের নজর এড়ায়না। তখন সবাই তাকে চেপে ধরে। সবার জোরাজুরিতে নিজের মনের গহীনে হুট করে আগমন ঘটা এক রমণীর প্রতি প্রেমের কথা তাদের জানিয়ে দেয় ফায়াজ। তারপর বন্ধু মহলে যেনো এটাই হয়ে ওঠে অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। সবার কথায় এবং ভরসায় ধীরে ধীরে সে ভাব জমায় অর্থিকার সাথে। শুরু হয় দুজনার বন্ধুত্ব। কিন্তু ফায়াজ আর বলতে পারে না নিজের মনের কথা। বলতে পারে না এই বন্ধুত্বের পিঠে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি গুলোর কথা।

এভাবেই শেষ হয় ভার্সিটি লাইফ। কয়েক মাস বাদে হুট করেই একজন বন্ধুর থেকে ফায়াজ জানতে পারে যে অর্থিকার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তখন কী কষ্টটাই না পেয়েছিল ছেলেটা। মধ্য রাতে দ্রুত গতিতে বাইক চালিয়ে হাজির হলো প্রিয়তমার বাড়ির সম্মুখে। একের পর এক কল দিয়ে ভঙ্গ করল অর্থিকার আরামদায়ক ঘুম। মোবাইল সাইলেন্ট করা না থাকায় ঘুম থেকে জেগে উঠলো অর্থিকা। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই শুনতে পেলো করুন কণ্ঠস্বর,“অর্থিকা!”

ঘুমের রেশ বিলীন হয় অর্থিকার। আশ্চর্য হয়ে শুধায়, “ফায়াজ?”

“নিচে আসবে অর্থিকা?”

“নিচে আসবো মানে?”

“হু, এসো না। আমি দাঁড়িয়ে আছি নিচে। প্লিজ একটিবার এসো।”

দৌড়ে বারান্দায় চলে আসে অর্থিকা। তার বারান্দা থেকে রাস্তাটা খুব ভালো করেই দেখা যায় তাই ফায়াজকে দৃষ্টিগোচর হতে আর বেশি সময় লাগে না অর্থিকার। শুধায়,“এত রাতে তুমি এখানে? হঠাৎ? পাগল টাগল হয়ে গেলে নাকি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ পাগলই হয়েছি। তুমি এসো।”

“বললেই তো আর এত রাতে নিচে আসা যায় না ফায়াজ। দরজা ভেতর থেকে লক করা। চাবি বাবা-মায়ের কাছে। তাদের দরজাও তো লক করা। কী বলবে ফোনে বললেই তো হতো অযথা মাঝরাতে আসার কী প্রয়োজন তাই তো বুঝলাম না।”

“অযথা নয় অর্থিকা, আমার অনেক কিছু বলার আছে তোমায়, যা ফোনে বলা সম্ভব নয়।”

“বাড়িতে যাও, বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলে কাল না হয় দেখা করো।”

“তোমার তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তাই কাল বলা যাবে না। যা বলার আজই বলতে হবে।”

“বিয়ের এখনো মাসখানেক দেরি আছে ফায়াজ।পাগলামো বাদ দিয়ে বাড়ি যাও।”

সেদিনের মতো শান্ত হয়ে ঠিকই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল ফায়াজ। কিন্তু কেউই আর রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারলো না। তার পরেরদিন বিকেলে দুজনে দেখা করল একটি ক্যাফেটেরিয়ায়। সম্মুখে বসেই অর্থিকা প্রশ্ন ছুঁড়েছিল,“কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা যে অত রাতে বাড়ির সামনে আসতে হলো তোমায়? নাও এখন বলা শুরু করো।”

কোনো ধরণের হেঁয়ালি ছাড়াই টেবিলের উপর রাখা অর্থিকার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো ফায়াজ। উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো,“আমি তোমায় ভালোবাসি অর্থিকা। খুব খুব ভালোবাসি। তোমাকে অন্যের হয়ে যাওয়াটা নিজ চোখে দেখতে পারবো না আমি। আমার যে খুব কষ্ট হবে অর্থিকা। আমি কষ্ট সহ্য করতে পারি না। দেখা গেলো এত বড়ো কষ্টে আমি মরেই গেলাম। তখন কী হবে? প্লিজ অর্থিকা বিয়েটা ভেঙে দাও। তুমি বিয়েটা ভেঙে দিলেই আমি আমার বাবা-মাকে নিয়ে তোমার জন্য বিয়ের প্রপোজাল পাঠাবো।”

কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো অর্থিকা। এমন কিছু শোনার জন্য যেনো সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। মেয়েদের নাকি এক অদৃশ্য ক্ষমতা আছে। কেউ তাদের লুকিয়ে লুকিয়ে পছন্দ করলেও তারা তা বুঝে ফেলে কিন্তু ফায়াজ নামক পুরুষটির সঙ্গে এত বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার পরেও কিছুই বুঝতে পারলো না অর্থিকা। কারণ বোঝার মতো এমন কোনো কাজই তো ফায়াজ করেনি। সে ভেবেছিল লেখাপড়া শেষে একটা চাকরি জুটিয়েই সবটা জানিয়ে দিবে অর্থিকাকে। অর্থিকা তার ডাকে সাড়া না দিলে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। তখন তো আর মেয়েটা না করতে পারবে না। কিন্তু সব যেনো এক নিমিষেই এলোমেলো হয়ে গেলো।

নিজেকে যথাসাধ্য সামলে নিয়ে তার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো অর্থিকা। প্রশ্ন করল,“কবে থেকে তোমার মনে এসব চলছে?”

“মনে এসব চলছে মানে?”

“না মানে কবে থেকে ভালোবাসো?”

“আমাদের বন্ধুত্ব শুরু হওয়ার আগে থেকে।”

“তাহলে এতদিন বলোনি কেন?”

দৃষ্টি নত করে নেয় ফায়াজ। বলে,“বেশ কয়েকবার বলতে চেয়েও বলতে পারিনি।”

“কেন?”

“ভয়ে, যদি আমায় এক্সেপ্ট না করো তাই।”

তাচ্ছিল্য হাসলো অর্থিকা। ফের প্রশ্ন করল,“তাহলে এখন কেন বলছো?”

“আমি তোমাকে হারাতে চাই না অর্থিকা।”

“এখন যে এক্সেপ্ট করবো শিওর হচ্ছো কী করে?”

“এক্সেপ্ট না করার তো কোনো কারণ দেখছি না। আমি ভালো চাকরি করি, আমার পরিবারও ভালো। তুমি শুধু এই বিয়েটা ভেঙে দাও। বাকি সব কিছু আমি ম্যানেজ করে নিবো। প্লিজ আমার হয়ে যাও অর্থিকা।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্থিকা। বলে,“এ সম্ভব নয় ফায়াজ। তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো। আমার বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন সপ্তাহ দুয়েক আগে। ছেলের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে তাকে আমার মনে ধরেছে আর আমিও বিয়েতে পুরোপুরিভাবে মত জানিয়ে দিয়েছি। ছাপাখানায় বিয়ের কার্ড ছাপাতে চলে গেছে। বিয়ের শপিংও অর্ধেকটা শেষ। মাঝপথে এসে এসব আর সম্ভব নয়। শুরু থেকেই স্রেফ তুমি আমার একজন ভালো বন্ধু ছিলে ব্যস এতটুকুই। তবে তোমার উচিত ছিলো নিজের মনের কথাটা আমায় জানিয়ে দেওয়া। তাহলে তো অন্তত নিজের দিক থেকে তুমি দায়সারা থাকতে পারতে। তোমার দিক থেকে তুমি সব চেষ্টা করেছো এ কথাটাও বলতে পারতে কিন্তু তুমি তা করোনি। এখন মাঝপথে এসে, ভালোবাসি তোমায় বিয়ে ভেঙে দাও বললেই তো হয় না ফায়াজ।”

“আমি মানছি আমি ভুল করেছি কিন্তু এখন তো বললাম। এখনো তো তোমার বিয়ে হয়নি তাই না?”

“বিয়ে হয়নি তবে হবে। এমন একটা জায়গা থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয় ফায়াজ। তাছাড়া সকল ভুলের সমাধান হয় না। তোমার ভালোবাসায় সাড়া দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভেবেছিলাম বিয়ের প্রথম কার্ডটা আমি তোমায় দিবো কিন্তু দেওয়া আর হলো না। এতে তোমার কষ্ট আরো বাড়বে। একতরফা ভালোবাসা ভুলে গিয়ে নিজের জীবন গুছিয়ে নিও। আশা করি ভালো একজন মানুষ তোমার জীবনে আসবে। আল্লাহ হাফেজ।”

এতটুকু বলেই বিদায় নিয়েছিল অর্থিকা। এরপর আর কারো সঙ্গে কারো দেখা হলো না। বাড়িতে শুরু হলো ফায়াজের পাগলামি। অর্থিকার বিয়ে হতেও আর মাসখানেক সময় লাগলো না। দিন পনেরো বাদেই হয়ে গেলো বিয়ে। সেদিন নিজেকে ঘরবন্দি করে ছিলো ছেলেটা। বেশ কয়েকবার শেষ করে দিতে চেয়েছিল নিজেকে। পুরুষ মানুষ শক্ত হৃদয়ের হয় কিন্তু তার হৃদয়টা যেনো ছিলো দুর্বল। পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায় বাবা-মা চিন্তিত হয় তাকে নিয়ে। বিভিন্ন ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় না। এভাবেই বছর গড়ায়। মায়ের হাহাকার এবং চোখের পানিতে একসময় সকল দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটে ছেলেটার। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে চাকরি বাকরিতে মনোনিবেশ করে। যদিও তার বাবার ছিলো অঢেল সম্পত্তি। ঢাকা শহরের মতো একটি জায়গায় নিজস্ব দালান। তার কয়েকদিন পরেই মায়ের কথায় মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে নেয় ফায়াজ কিন্তু বৈবাহিক জীবনে দেখা মিলে না শান্তির।

ফায়াজ নিজেকে যথেষ্ট বদল করে স্ত্রীর প্রাপ্যটা তাকে দিতে চেয়েছিল, চেষ্টা করেছিল স্ত্রীকে ভালোবাসার কিন্তু মেয়েটি যেনো দাম্ভিক স্বভাবের ছিলো। সংসারে প্রবেশের মাস দুয়েকের মধ্যেই পুরো সংসারটা নিজের আয়ত্তে আনতে চাইলো যার দরুন শুরু হলো মা স্ত্রীর বিভেদ। এতে একসময় অতিষ্ট হয়ে উঠলো ফায়াজ। ঘা সারানোর জন্য একজনকে জীবনে এনে ঘা যেনো দিনদিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একসময় মেয়েটি তো বলেই বসে,“তোমার কাছে দুটো অপশন আছে ফায়াজ, হয় তোমার বাবা-মাকে বেছে নিবে নয়তো আমাকে। তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে এক ছাদের তলায় আমি আর থাকতে রাজি নই। আমার আলাদা সংসার চাই।”

ফায়াজ স্ত্রীকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করল কিন্তু মেয়েটি বুঝলো না। ভয় দেখালো ডিভোর্সের, সাথে শ্বশুর-শাশুড়ির হুমকি ধামকি তো আছেই। এসব কিছু আর নিতে পারলো না সে আর না পারলো তার বাবা-মাকে ছাড়তে। তার ওই কঠিন বিপদের সময় তো এই বাবা-মা ই পাশে ছিলো। এই মেয়েকেও মূলত সে বিয়ে করেছিল মায়ের জেদের কারণে। বিভিন্ন বোঝ দিয়েও যখন কাজ হলো না তখন ডিভোর্সই বেছে নিলো ফায়াজ। যেই সম্পর্কে মানসিক শান্তি নেই সেই সম্পর্ক না থাকাটাই শ্রেয়।

সময়টা গোধূলির বিকেল। ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ফায়াজ এবং অর্থিকা। অফিসে একটা মিটিং ছিলো কিন্তু মিটিং ক্যান্সেল হওয়ায় দুপুরের দিকেই ছুটি পেয়ে যায় অর্থিকা। তাই আসরের নামাজ আদায় করে আজ সে ছাদে এসেছিল কাপড় নিতে আর তখনি দেখা হয়ে গেলো ফায়াজের সাথে। চেয়েও যেনো ছেলেটিকে উপেক্ষা করে চলে যেতে পারলো না অর্থিকা।

কিছুক্ষণ নিরবতার পর ফায়াজ নিজেই বলে উঠলো,“সবকিছু কী নতুন করে আবার শুরু করা যেতো না অর্থিকা?”

অর্থিকা হেসে উত্তর দিলো,“নতুন করেই তো শুরু করেছি।”

“এই শুরু করার কথা বলছি না।”

“তাহলে?”

“আমি তোমায় এখনো সেই আগের মতোই ভালোবাসি। তখন তোমায় পাইনি কিন্তু এখন তো আর কোনো বাঁধা নেই আমাদের মধ্যে। বিয়ে করবে আমায়? তোমার ছেলে নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। ও তো তোমারই অংশ। বাবার সকল দায়িত্ব ভালোবাসা সব দিয়ে ওকে বড়ো করবো।”

“এ হয় না ফায়াজ।”

“কেন হয় না? কতই তো হচ্ছে।”

“আমার পক্ষে নতুন করে সংসার বাঁধা সম্ভব নয়। আমার পুরো জগৎ জুড়ে শুধুই তন্ময়। ও ব্যতীত অন্য পুরুষের ঘ্রান আমি চাই না। চাই না কারো ভালোবাসা। ইহকালে যেমন আমি তন্ময়ের ছিলাম তেমন পরকালেও ওর হয়েই থাকতে চাই। দুনিয়াতে নতুন করে কারো সঙ্গে ঘর বাঁধলে কী এটা সম্ভব?”

“অর্থিকা!”—-ছেলেটির কণ্ঠস্বর করুন শোনালো।

সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে অর্থিকা বললো,“কিছু করার নেই ফায়াজ। এতটুকু স্বার্থপর তো হতেই হয় বলো। তন্ময় স্বামী হিসেবে চমৎকার একজন পুরুষ। সবাই প্রেমিক হতে পারলেও সবাই কিন্তু স্বামী হতে পারে না ফায়াজ। আমি তার মায়া, সম্মান, আগলে রাখা, ভালোবাসা এবং ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যের উপর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছি। এ বাঁধন থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র রাস্তা মৃ’ত্যু। আমার মৃ’ত্যু কবে হবে তা একমাত্র রবই জানেন। তাই এ ব্যাপারে আর কখনো কিছু বলো না। তোমার পুরোটা জীবন পড়ে আছে। নতুন করে কাউকে জীবনে জড়িয়ে সুখের সংসার করো।”

বলেই ছাদ থেকে নিচে নেমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো অর্থিকা। ফায়াজ পিছু থেকে বলে ওঠে,“তুমি আমার অনুভূতি নিয়ে একবারও ভাবলে না অর্থিকা। আমার অপরাধটা কোথায় ছিলো? কেন আমি বঞ্চিত হলাম তোমার ভালোবাসা থেকে?”

অর্থিকা পথিমধ্যে থেমে গেলো। পিছু ঘুরে চমৎকার হেসে বললো,“সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। তোমার ভুল ছিলো তুমি সময়ের কাজ সময়ে করতে পারোনি। তোমার ভুল ছিলো তুমি সঠিক সময়ে নিজের অনুভূতির কথা জানাতে পারোনি। সব ভুল তোমার এসব খামখেয়ালিপনার। যা চাইলেই তুমি আর শোধরাতে পারবে না।”

আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না অর্থিকা। চলে গেলো নিচে। আর সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো একজন হেরে যাওয়া পুরুষ। প্রেয়সীকে না পাওয়া ব্যর্থ প্রেমিক।

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-২৯+৩০

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৯]

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাস্তা তৈরি করে টেবিলে রাখলো অনুভা। শান্তা সবে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হয়েছেন। খাবার টেবিলের সম্মুখে এসে পুত্রবধূর কাণ্ড দেখেই অবাক হলেন তিনি। এগিয়ে এসে বিষ্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন,“এমা তুমি এর মধ্যেই নাস্তা তৈরি করে ফেলেছো?”

“হ্যাঁ।”

“সবিতা তো এখনো এলোই না। একা একা কেন এসব করতে গেলে বলো? আমিই তো ওকে সঙ্গে নিয়ে করে নিতাম সবটা।”

মিহি স্বরে উত্তর দিলো অনুভা,“ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তাই ভাবলাম করে ফেলি। এমনিতে আমি রান্নাবান্না করতে পারি মা। আপনি কী রাগ করলেন?”

মেয়েটির নমনীয়তা দেখে প্রসন্ন হন শান্তা। এগিয়ে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন,“রাগার মতো কিছু করেছো নাকি? যদি করেও থাকো তবুও কখনো রাগবো না। তোমার এই মায়াভরা মুখের দিকে তাকালে সহজে কারো রাগ আসবে বলে তো মনে হয় না।”

প্রত্যুত্তরে কী বলবে বুঝতে পারলো না অনুভা। তবে লজ্জা পেলো খানিকটা। রোজকার মতো আজও হানিফ শেখ এবং শ্রাবণ মিলে হাঁটতে বেরিয়েছে।

বেলা বাড়তেই বাপ-ছেলে বাড়িতে ফিরে এলো। নাস্তা সেরে একেবারে গোসল করে নিলো শ্রাবণ। আজ তার ক্লাস আছে। শার্ট ইন করে গলাতে টাই ঝুলাতেই নজরে পড়ল অনুভাকে। মিহি হেসে এগিয়ে গিয়ে সম্মুখে দাঁড়ালো তার। অনুভা ভ্রু কুঁচকায়। শুধায়,“কী?”

শ্রাবণ গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দেয়,“দাড়াঁও।”

বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় অনুভা। প্রশ্ন করে,“এবার?”

“নাও টাইটা বেঁধে দাও দ্রুত।”

“নিজে বেঁধে নাও।”

“বিয়ে করেছি কী নিজে বাঁধার জন্য নাকি? একটা দায়িত্ব আছে না তোমার?”

কথা বাড়ায় না অনুভা। নিরবে টাইটি বেঁধে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। কয়েক মিনিট সময় নিয়ে প্রচেষ্টায় সে সফলও হয়। টাই বাঁধা হতেই তার সামনে থেকে সরে আয়নার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায় শ্রাবণ। চুলে হাত দিয়ে তা ঠিক করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

নিরবতা ভাঙে অনুভা। নিচু স্বরে বলে,“একটা কথা ছিলো।”

নিজের কাজ করতে করতেই শ্রাবণ উত্তর দেয়,“হ্যাঁ বলো।”

“আসলে আমি চাইছিলাম আবার নতুন করে একটা জব করতে।”

হাত থেমে যায় শ্রাবণের। ঘাড় ঘুরিয়ে অনুভার পানে তাকায়। সেই দৃষ্টি দেখতেই অনুভা পুনরায় বলে ওঠে,
“আগের চাকরিটা এখানে আসার আগেই আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওখানে আর চাকরি করাটা আপুর পছন্দ নয়। তাই চাইছিলাম অন্য কোথাও যদি ট্রাই করি।”

তৎক্ষণাৎ শ্রাবণ কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তাকে বলতে না দিয়েই অনুভা বলে উঠলো,“আমি চাচ্ছি না আপুর উপর সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে নিজে ভালো থাকতে। আর না চাইছি কারো সাহায্য। আমি শুধু ওদের পাশে থাকতে চাই।”

বাঁধা দিতে পারলো না শ্রাবণ। মৃদু হেসে বললো, “তোমার যা ইচ্ছে তুমি করতে পারো নোভা। তোমার কোনো কিছুতেই আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না।”

“তোমার বাবা-মা? যদি উনাদের সঙ্গে একটু কথা বলে নিতে।”

“বাবার মনে হয় না এতে কোনো আপত্তি থাকবে তবে মা বললেও কিছু বলতে পারে। মাকে না হয় আমি বুঝিয়ে বলবো।”

প্রসন্ন হেসে ধন্যবাদ জানালো অনুভা। প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো শ্রাবণ। এগিয়ে এসে স্ত্রীর ললাটে চুম্বন এঁকে বিদায় নিয়ে বের হলো বাড়ি থেকে।

কাজের মেয়েটা এসেই ঘরদোর পরিষ্কার করতে লেগে পড়েছে। আজ কী রান্না করবেন স্বামীর থেকে সে পরামর্শ নিয়ে রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলেন শান্তা।

রোজকার মতো আজও বাড়িতে সুফিয়া, তাঈম, মাজেদা ব্যতীত আর কেউ নেই। কলিং বেল বাজার শব্দে ভেজা হাতটা পরনের জামার মধ্যে মুছেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো মাজেদা। দরজা খুলে দুজন পুরুষকে দেখে বেশ অবাক হলো। পুরুষ দুজনের বয়সের পার্থক্য অনেক। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আরেকজন প্রাপ্ত বয়স্ক। মাজেদা হেড়ে গলায় বললো, “আপা বাড়িত নাই। বেশি দরকার হইলে পরে আইয়েন। আর কম দরকার হইলে আমারে কন।”

বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটি বললেন,“আমি অর্থি আর অনুর বড়ো চাচা। ওগো মায় বাড়িত নাই? থাকলে ডাইকা দাও একটু। কথা আছে।”

লোকটির পানে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো মাজেদা। ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়ার সাহস হলো না। যদি লোকটা মিথ্যে বলে থাকে? তখন! কী হবে তখন? বললো,“আপনেরা এইহানেই দাঁড়ান আমি খালারে ডাইকা আনি।”

কথাটা বলেই দরজা ভিড়িয়ে সুফিয়াকে ডাকতে চলে গেলো মাজেদা। উনারা বাহিরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। বেশ কয়েক মিনিট বাদে দরজার সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন সুফিয়া।পরিচিত মানুষগুলোকে দেখে বড়োই আশ্চর্য হলেন তিনি। তাদের ভেতরে এসে বসার আমন্ত্রণ জানালেন।

বড়ো চাচা জোরপূর্বক হেসে জিজ্ঞেস করলেন,“কেমন আছো অর্থির মা? অর্থি আর অনু কই? অফিসে?”

সুফিয়া কঠোর ভঙিতে বললেন,“অর্থি অফিসে আর অনু তার শ্বশুর বাড়িতে।”

চমকান উপস্থিত দুজনেই। শুধান,“অনুর বিয়া হইলো কবে?”

“হয়েছে অনেকদিন আগেই তা আপনারা হঠাৎ কী মনে করে এখানে? ঠিকানাই বা পেলেন কীভাবে?”

সঙ্গে আসা মেজো চাচার ছেলে আসিফ উত্তর দিলো, “আসলে চাচী আগে যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন ওখানেই গিয়েছিলাম কিন্তু জানতে পারলাম আপনারা নাকি বাড়ি বদলে ফেলেছেন তারপরেই ওই পুরোনো বুয়ার সঙ্গে দেখা হলো। সে নাকি পাশের ফ্ল্যাটেই কাজ করে। তো ও-ই দিলো এই ঠিকানাটা।”

“তা আসার কারণ?”

আসিফকে ইশারায় কিছু বললেন বড়ো চাচা। সেই ইশারা বুঝতে পেরেই কাঁধে থাকা অফিস ব্যাগটি থেকে কয়েকটি টাকার বান্ডেল বের করল আসিফ। রাখলো সেন্টার টেবিলের উপরে। বড়ো চাচা নতজানু চিত্তে বললেন,“এই পাপের বোঝা লইয়া আর টিকতে পারতাছি না বৌমা। সম্পত্তি বুঝাইয়া দিতে চাইলাম কিন্তু তোমার মাইয়ারা তো আর ওয়ারিশ লইতে চায় না। রাগ করছে চাচাগো উপরে। হেগো রাগ করনডাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তো এই ভার লইয়া আর ভুগতে পারতাছি না। তাই তুমগো তিনজনের পাওনা সম্পত্তির টাকা তুমগো বুঝাইয়া দিতে আইলাম। ফিরাইয়া দিয়া আমগো পাপ আর বাড়াইয়ো না। এইগুলা সব তুমগো।”

বিমূঢ় দৃষ্টিতে টাকার বান্ডেলগুলোর পানে তাকিয়ে রইলেন সুফিয়া। এই টাকা, হ্যাঁ এই টাকাগুলোই তো সকল অশান্তির মূল। এই টাকার জন্য মানুষ অন্যায় করে, অপমান সহ্য করে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয় আরো কত কি।

উনার ভাবনার মধ্যেই বড়ো চাচা এবং আসিফ বিদায় নিয়ে প্রস্থান করল সেখান থেকে। সুফিয়া কিছু বলতে পারলেন না। এতদূর হতে আসা মানুষ দুজনকে চা বিস্কুট খাওয়ার কথা বলতে পারলেন না। উনারা চলে যেতেই মাজেদা গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে এলো। তখনও টাকাগুলো স্পর্শ করলেন না সুফিয়া। ঠাঁয় বসে রইলেন নিজ স্থানে। কতকিছুই না ভাবতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ করেই তিনি উপলব্ধি করলেন মানুষ তার কর্মফল দুনিয়াতে হলেও কিছুটা পেয়ে যায়। যা কামরুল হাসান পেয়ে গেছেন। আর উনাকেও মেয়েদের নিয়ে সেই কর্মফল ভোগ করতে হয়েছে শুধুমাত্র ওই অসৎ টাকায় জীবন যাপন করেছিলেন বলে। তবে কী কর্মফল ভোগার শাস্তি শেষ হয়ে এলো? ঘুচে গেলো সকল দুঃখ?
________

বিকেলটা পুরো শেখ বাড়ি একেবারে নিরব থাকে। হানিফ শেখের চা এবং বইয়ের নেশা। বিকেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে পছন্দের দোকানে গিয়ে চা খেয়ে তিনি যান লাইব্রেরিতে বই পড়তে। ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে শ্রাবণ কখনো বাড়ি ফিরে আবার কখনো বা কোনো বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে বের হয়। আজও তাই। শান্তা সোফায় বসে আছেন একা।কাজের মেয়েটিকে পাঠিয়েছেন অনুভাকে ডেকে নিয়ে আসতে।শাশুড়ির ডাকে মিনিট দুয়েক বাদেই ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হলো অনুভা। মিহি স্বরে শুধালো,“ডাকছিলেন মা?”

নিজের সম্মুখে রাখা একটি মোড়া দেখিয়ে শান্তা বললেন,“হ্যাঁ ডেকেছি। বসো এখানে। তা একা একা ঘরে কী করছিলে?”

এখানে বসতে বলছেন কেন উনি? বুঝতে পারলো না অনুভা। তবুও বাধ্য মেয়ের মতো বসলো সেথায়। উত্তর দিলো,“তেমন কিছু না।”

পাশে রাখা তেলের বাতিটি থেকে তেল নিয়ে তার মাথায় হাত রেখে শান্তা শাসনের ভঙিতে বললেন,“চুলে তেল দাও না কত বছর ধরে? এভাবে চুলের অযত্ন করলে তো জটা বুড়ি হতে বেশি সময় লাগবে না মা।”

লজ্জা পেলো অনুভা।ইতস্তত কণ্ঠে বললো,“ব্যস্ততার কারণে সময় হয়ে ওঠেনি কখনো তাছাড়া তেল দেওয়ার কথাও মনে পড়েনি।”

“সে যা হয়েছে হয়েছে, বিয়ের পর এসব অনিয়ম চলবে না। সর্বপ্রথম নিজের যত্ন তারপর বাদ বাকি কাজ। বুঝলে মেয়ে?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। শান্তা বিলি কেটে কেটে তার মাথায় তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন। কয়েক মিনিট নিরবতার পর অনুভা বলে উঠলো,“আপনার মধ্যে না শাশুড়ি শাশুড়ি ভাবটা নেই।”

হাত থেমে যায় শান্তার। ভ্রু যুগল কুঁচকে শুধান,“কী? শাশুড়ি ভাব নেই? তাহলে কী ভাব আছে শুনি?”

“মা মা ভাব। আপনাকে নিজের মা মনে হচ্ছে। শাশুড়িরা তো এমন হয় না, এমন হয় মায়েরা।”

অধরে হাসি ফোটে উঠলো শান্তার। মাথায় আলতো করে চাটি দিয়ে বললেন,“আমি তো তোমার মা-ই হই।”

অনুভা নিঃশব্দে হাসে। শান্তা আবারো মনোযোগ দেন তেল লাগানোতে। ফাঁকে ফাঁকে শাশুড়ি বউমার মধ্যে চলতে থাকে গল্প গুজব। তেল দেওয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়ায় অনুভা। শুধায়,“চা খাবেন মা?বানিয়ে আনবো?”

“আনবে? আনো তবে। নিজের হাতের চা খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে মুখে।”

হাসি মুখে চা বানাতে রান্নাঘরে চলে গেলো অনুভা। বাড়ির কলিং বেল বাজতেই দরজার কাছে এগিয়ে যান শান্তা। সদর দরজা খুলতেই চমকে ওঠেন সঙ্গে সঙ্গে। সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত গুজে। লাগেজ হাতে পাশেই দাঁড়িয়ে ড্রাইভার। মাকে দেখতেই মুচকি হেসে বললো,“হাই মা।”

বিষ্ময় ভরা কণ্ঠে শান্তা প্রশ্ন ছুঁড়েন,“তুই? এখন এখানে? আসবি যে সেকথা তো জানালি না।”

“তোমরা কী আমায় কিছু জানাও নাকি যে আমি তোমাদের জানাবো? সরো ভেতরে ঢুকি।”

দরজার সম্মুখ হতে সরে দাঁড়ালেন তিনি। সৌহার্দ্য ভেতরে প্রবেশ করল। ড্রাইভার লোকটিও লাগেজ গুলো ভেতরে দিয়ে চলে গেলেন। তখনি রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ হাতে ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হলো অনুভা। অপরিচিত একজন পুরুষকে দেখে খানিকটা হকচকিয়ে উঠলো। চায়ের ট্রে টা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে ভালো করে মাথায় টেনে নিলো ঘোমটা। সৌহার্দ্য প্রশস্ত হেসে উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তুমি আমার ভাবী?”

হঠাৎ এহেন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় অনুভা।অপরিচিত পুরুষটির পানে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। চেনা চেনা ঠেকে কিন্তু চিনতে পারে না। তার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরেই সৌহার্দ্য পুনরায় বললো,“আরে আমি সৌহার্দ্য। চিনলে না?”

দুদিকে মাথা নাড়ায় অনুভা। অধরের হাসিটা যেনো মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো সৌহার্দ্যের। রাগ হলো বড়ো ভাইয়ের উপর। যাকে বলে ভীষণ রাগ। নতুন ভাবীর কাছে তাকে নিয়ে কোনো গল্পই করেনি ভাইয়া? ছেলেটার নিভে যাওয়া হাসি দেখে কিছু একটা আঁচ করতে পারলো অনুভা। জোরপূর্বক হেসে বললো,
“শ্রাবণের ছোটো ভাই?”

পূর্বের হাসিটা আবারো মুখশ্রীতে ফিরে এলো সৌহার্দ্যের। বললো,“হ্যাঁ। ভাইয়া বলেনি আমার কথা?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। অর্থাৎ বলেছে। তৎক্ষণাৎ ভাইয়ের উপর থেকে সকল রাগ যেনো বিলীন হয়ে গেলো সৌহার্দ্যের। আগ্ৰহভরা লোচনে চেয়ে শুধালো,“কী কী বলেছে?”

শান্তা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলের কাণ্ড কারখানা দেখছিলেন এবার এগিয়ে এসে কড়া গলায় বললেন, “ঘরে গিয়ে বাহিরের পোশাক ছেড়ে তারপর আয়। খাবার বাড়ছি আমি। বিমানে কিনা কী খেয়েছিস তার তো ঠিক নেই। খাওয়া-দাওয়া শেষে ভাবীর সঙ্গে আলাপ হবে।”

মায়ের কথায় অত গুরুত্ব দিলো না সৌহার্দ্য। সোফায় বসে হাতে তুলে নিলো চায়ের কাপ। বড়ো করে চুমুক বসিয়ে তৃপ্তি সূচক শব্দ করল মুখ দিয়ে। প্রশংসা করে বললো,“ভালো চা বানাও তো ভাবী।”

শান্তা ফের রাগত স্বরে বললেন,“ভারি অধঃপতন হয়েছে দেখছি তোর! মেহুর মতো ফ্রেশ না হয়েই খেতে শুরু করে দিয়েছিস?”

“তুমি এমন করছো কেন মা? আগে ভাবীর সাথে কথা বলবো তারপর ঘরে গিয়ে একেবারে ফ্রেশ হয়ে একটা ঘুম দিবো। রাতে ঘুম হয়নি।”

অনুভা সৌজন্য হেসে বললো,“আগে বিশ্রাম নিন তারপর না হয় গল্প করা যাবে। আমি তো এখানেই আছি।”

“কী বলো ভাবী? আমি শুধু তোমার জন্য এতদূর থেকে ছুটে এলাম। বাই দ্য ওয়ে তুমি আমায় আপনি বলছো কেন? দেবরকে কে আপনি বলে? ভাইয়াকে তুমি বলবে অথচ ভাইয়ার ছোটো ভাইকে আপনি! ছ্যাহ। তুমি করে বলবে ঠিক আছে?”

এবারো উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। প্রসন্ন হাসে সৌহার্দ্য। চায়ের ট্রে টা নিয়ে উঠে যায়। নিজ কক্ষের দিকে যেতে যেতে বলে,“মাথাটা ধরেছে। চা ভর্তি দুটো কাপই আপাতত আমার প্রয়োজন। পরে কথা হবে ভাবী। টাটা।”

ছেলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে শান্তা বলেন,“এই ছেলে দুটোকে নিয়ে একদম পারি না। দুয়েকটা স্বভাব ব্যতীত বাকি সব দুই ভাইয়ের মধ্যে একেবারে মিল।”

শাশুড়ির চিন্তিত মুখ দেখে নিঃশব্দে হাসে অনুভা।
________

রোজকার মতো রাতে বাড়ি ফিরতেই মাজেদা দরজা খুলে দিলো। ভেতরে প্রবেশ করতেই মাকে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখতে পেলো অর্থিকা। মাজেদার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“মা এখানে বসা? কখন থেকে?”

“খালায় তো হেই দুপুর বেলা থাইক্কাই এনে বইয়া রইছে। আমনের চাচা আর চাচতো ভাই আইছিল। তারা যাওনের পর থাইক্কাই চাচী এনে বওয়া। আমি অনেক ডাকলাম কিন্তু আমার লগে কোনো কথাই কইলো না।”

চিন্তিত হলো অর্থিকা। চাচা এসেছিল বাড়িতে? কোন চাচা? কিই বা বলে গেলো মাকে? মায়ের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মাজেদার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,“তাঈম কোথায়?”

“ওয় তো সন্ধ্যা বেলায় খাইয়াই ঘুমায়।”

“আচ্ছা তুমি ওর কাছে যাও।”

তৎক্ষণাৎ চলে গেলো মাজেদা। অর্থিকা মায়ের মাথায় হাত রেখে ডাকলো,“মা! ও মা! মা গো!”

চোখ মেলে তাকালেন সুফিয়া। মেয়েকে দেখে সোজা হয়ে বসলেন। মায়ের বিমর্ষ রূপ দেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে অর্থিকা শুধালো,“কী হয়েছে তোমার? শুনলাম দুপুর থেকে নাকি এখানেই বসে আছো? কোন চাচা এসেছিল? কেন এসেছিল?”

টেবিলের নিচ থেকে টাকাগুলো মেয়ের সম্মুখে রাখলেন সুফিয়া। বললেন,“তোর বড়ো চাচা এসেছিল। টাকাগুলো দিয়ে গেলো।”

“কীসের টাকা এগুলো?”

“তোদের দু বোনের পাওনা টাকা।”

“তুমি নিলে কেন? এতদিন যখন তাদের সাহায্য ছাড়া চলতে পেরেছি বাকি জীবনটাও পারবো।”

গাঢ় দৃষ্টিতে মেয়ের পানে তাকান সুফিয়া। যেই দৃষ্টিতে রয়েছে শুধুই কঠোরতা। মায়ের এমন দৃষ্টির সঙ্গে পূর্ব পরিচিত নয় অর্থিকা। তাই চুপ রইলো উনার সামনে। উনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,“নিজের অধিকার একচুল পরিমাণের জন্যও ছাড়বি না অর্থি। এগুলো তোদের দুই বোনের ওয়ারিশের অর্থ। কারো দয়া নয়। নিজের ভাগেরটা নিজের কাছে রাখ আর অনুরটা অনুকে বুঝিয়ে দিস। আরেকটা কথা, তাঈম ছেলে। ওর ভবিষ্যৎ আছে। ওর নিজের বাবার সবকিছুর উপর ওর অধিকার আছে। ও যখন বড়ো হবে ওকে তোর ননদদের করা অন্যায়ের কথা জানাবি। ওকে ওর অধিকার বুঝে নিতে বলবি। কিচ্ছু ছাড়বি না, কিচ্ছু না। ওর বাবার কী কম আছে? ওর বাবার সব ওর, শুধুই ওর। মানুষের জীবনে মন্দ দিন আসে কেন জানিস? যাতে আশেপাশে থাকা মুখোশ পরিহিত মানুষগুলোর আসল রূপ চিনতে পারি সেই জন্য। দিনশেষে রব ছাড়া কেউ থাকে না পাশে। তাই কাউকে কখনো বিশ্বাস করবি না মা। দুই বোন মিলেমিশে থাকবি সবসময়। কেউ কারো উপর হিংসে করবি না। আমি যদি মারা যাই একদম কাঁদবি না, কষ্ট পাবি না। শুধু মাকে মাফ করে দিস, বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করে যাস।”

বুকটা কেঁপে উঠলো অর্থিকার। আজ যেনো তার সামনে বসে আছে অন্য একজন মানুষ। নিজেকে সামলাতে না পেরে মাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো অর্থিকা। কেঁদে উঠলো হো হো করে। সুফিয়া পাথরের মূর্তির ন্যায় চুপচাপ বসে মেয়ের কান্না শুনতে লাগলেন। কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলো না উনার মুখশ্রীতে। কী কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষ তিনি!

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩০]

আজ অর্থিকা অফিসে যায়নি। অসুস্থতার বাহানায় ছুটি নিয়েছে। গতকাল রাতেই ফোন করে ছোটো বোন আর বোন জামাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বাড়িতে।কড়াকড়িভাবে বলে দিয়েছে আজই আসতে হবে দুজনকে। সকাল সকাল মাজেদাকে সঙ্গে নিয়ে বাজার করে নিয়ে এসেছে অর্থিকা। বাড়িতে যেনো রান্নাবান্নার ধুম পড়েছে।

বারোটা নাগাদ বাড়িতে এসে পৌঁছায় শ্রাবণ এবং অনুভা। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় মাজেদা। তাদের দেখা পেয়েই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠে,“ছোডো আপা আর দুলাভাই আইসা পড়ছে!”

তার আনন্দময় চিৎকারে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু হাসলো অনুভা। প্রশ্ন করল,“কেমন আছো মাজেদা আপা?”

“ভালা আপা তবে আপনাগো দেইখা এখন আরো ভালা আছি।”—-বলেই দরজার সম্মুখ হতে সরে দাঁড়ালো মাজেদা।

অনুভা এবং শ্রাবণ ভেতরে প্রবেশ করল। সঙ্গে আনা মিষ্টান্ন, ফলমূল, বাচ্চাদের চকলেট চিপস এর প্যাকেটগুলো সেন্টার টেবিলে রাখলো। অর্থিকা এসে উপস্থিত হলো সেখানে। মৃদু হেসে তাকে সালাম দিলো শ্রাবণ। সালামের জবাব নিয়ে মিষ্টি হাসলো অর্থিকা। সুফিয়ার সঙ্গে দেখা করে আসতেই নিজের ঘরে তাকে বসতে বলে ঘর থেকে বের হলো অনুভা।

এখনো রান্না শেষ হয়নি। অর্থিকাও সেখানেই। ঘর থেকে তাঈমকে কোলে নিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলো অনুভা।চুলায় বসানো কড়াইয়ের পানে তাকিয়ে শুধালো,“হুট করে এত জরুরী তলব? বেশ তো মা- মেয়ে মিলে জোরজবরদস্তি করে আমায় শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিলি অথচ এখন ঠিকই মিস করছিস তাই না?”

খুন্তি নাড়ানো থামালো অর্থিকা। বললো,“কেন শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না বুঝি?”

“একদম না, জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলি তাহলে আসবো কেন?”

মুচকি হাসে অর্থিকা। রান্নাঘর থেকে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হয় অনুভা। যেতে যেতে তাঈমের উদ্দেশ্যে বলে,“চলো তোমায় খালুর কাছে দিয়ে আসি। ব্যাটাকে ইচ্ছেমতো জ্বালাতন করবে ঠিক আছে বাবা?”

তাঈম আদতে কিছু বুঝতে পারলো কিনা বোঝা গেলো না। শুধুই অনুভার গলা জড়িয়ে ধরে তার মুখের পানে তাকিয়ে রইলো। শ্রাবণ বসে বসে মোবাইল ঘাঁটছে। তখনি তার কোলে বসিয়ে দেওয়া হলো তাঈমকে। নড়েচড়ে উঠলো শ্রাবণ। ডান হাত ব্যারিকেটের মতো বাচ্চাটির পেছন দিয়ে ধরে রাখলো। অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে অনুভা বলে উঠলো,“নাও বসে বসে বাচ্চা সামলানো শিখো।”

মেয়েটির কথায় আপনাআপনি অধরে হাসির রেখা ফোটে ওঠে শ্রাবণের। ঠিকভাবে তাঈমকে নিজের কোলে বসিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে,“নোভা রাণী কী আমাকে বাবা বানাতে চাইছে নাকি? তা গতকাল রাতে বললেই তো হতো, বাসর টাসর একেবারে সেরে ফেলতাম।”

ভড়কে গেলো অনুভা। লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। আমতা আমতা করে বললো,“মুখে কিছু আটকায় না তোমার? নির্লজ্জ, অসভ্য।”

“তিনদিন ধরে বউয়ের সঙ্গে একঘরে থাকছি অথচ কোনো অসভ্যতামিই করলাম না তাহলে অসভ্য হলাম কী করে?”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই অনুভার নিকট মনে হলো তার কান দিয়ে হয়তো এবার আশ্চর্য জনক ভাবেই ধোঁয়া বের হবে। রাগে, লজ্জায় কক্ষ ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে যেতে যেতে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, “শিক্ষক মানুষের ন্যূনতম লজ্জাবোধ থাকা উচিত। যা তোমার মধ্যে নেই। হুটহাট বেফাঁস কথা বলে দেওয়া অসভ্য পুরুষ একটা।”

“শিক্ষকরা কী বাপ হচ্ছে না? তাছাড়া সাইন্সের ছাত্র ছিলাম বলে কথা বুঝোই তো।”

এ কথাটাও পুরোপুরি কর্ণগোচর হলো অনুভার। ফোঁস ফোঁস শব্দ করে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে স্থানটি পুরোপুরিভাবেই ত্যাগ করল সে।

হাসলো শ্রাবণ।পূর্ণ দৃষ্টিতে তাঈমের মুখপানে তাকালো। গাল দুটো আলতো করে টিপে দিয়ে ডাকলো,“তামু বাবা।”

তাঈম মুখ তুলে চাইলো অপরিচিত লোকটির পানে। এই মুখটা তার নিকট অপরিচিতই। বিয়ের দিনও দুজনার দেখা হয়নি। অর্থিকা তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। নইলে ছেলেটা জেগে থাকলেই অনুভার কোলে চড়ে বসে থাকতো। বাচ্চাটির দৃষ্টি দেখে মিষ্টি হাসলো শ্রাবণ। শুরু করল তার সঙ্গে ভাব জমানো।

রান্নাঘরে এসে উঁকি দিলো অনুভা। অর্থিকা সেখানে নেই। অগত্যা বড়ো বোনের কক্ষে প্রবেশ করল সে। এখানেও তাকে না পাওয়ায় এবার গেলো মায়ের ঘরে। সেখানেই পেয়ে গেলো বোনকে। বিছানায় মায়ের পাশে বসে আছে অর্থিকা। কথা বলছে দুজনে। অনুভা এসে শামিল হলো তাদের কথোপকথনে। তখনি দুটো টাকার বান্ডেল তার দিকে এগিয়ে দিলো অর্থিকা। টাকাগুলো দেখে চমকায় অনুভা। শুধায়,“এতগুলো টাকা! কোত্থেকে এলো?”

সুফিয়া উত্তর দেন,“তোর বড়ো চাচা আর আসিফ এসেছিল। ওরাই দিয়ে গেলো তোদের দু বোনের ওয়ারিশের টাকা আর আমার স্বামী স্বত্ব।”

“ওরা দিলো আর তুমি রেখে দিলে? এটা কী ঠিক হলো মা? এতদিনকার কষ্টটা বৃথা গেলো না তবে?”

“এটা তোদের পাওনা, ওরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে তাই দিয়ে গেছে। এতে তোর কষ্ট কেন বৃথা যাবে? বাবা-মায়ের জন্য যতটা কষ্ট করেছিস দেখবি আল্লাহ তার উত্তম প্রতিদান দান করবেন। সবসময় দোয়া করি আমার মেয়েরা যাতে সুখী হয়। তাই নিজের অধিকার বুঝে নে মা।”

এ ব্যাপারে কিছুক্ষণ নিরব রইলো অনুভা। তারপর বলে উঠলো,“আমার এসব চাই না মা। এখন তো আমার বিয়েই হয়ে গেছে তাই আমি আর এসব দিয়ে কী করবো? টাকাটা বরং আপুই রেখে দিক। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।”

সঙ্গে সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করল অর্থিকা। বললো,“কেন লাগবে না? অবশ্যই লাগবে। এটা তোর পাওনা। তাছাড়া আমি প্রথমে ভেবেছিলাম শ্রাবণের সামনেই কথাটা বলবো কিন্তু পরে ভাবলাম তুই যদি কিছু মনে করিস।”

মুচকি হাসলো অনুভা। প্রত্যুত্তরে বললো,“ওর সামনে বললেই কী না বললেই কী? ওর উত্তরটা আমার জানা। ও সরাসরিই বলে দিতো এসব নোভার লাগবে না আপু। নোভার দায়িত্ব আমার। ওর ইচ্ছা অনিচ্ছা পূরণের দায়িত্বও আমার। তাই আপনি রেখে দিন এগুলো।”

হতাশ কণ্ঠে অর্থিকা শুধালো,“নিবি না তবে?”

“না, এটা আমার তরফ থেকে আমার তাঈমের জন্য উপহার। ও তো আমারও ছেলে তাই না? ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা তো আমারও দায়িত্ব।”

আঁখি যুগল ভিজে উঠলো অর্থিকার। শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো ছোটো বোনকে। দু বোনের মিল মহব্বত দেখে সুফিয়া আড়ালে চোখের পানি মুছলেন আঁচলে। রবের নিকট মনে মনে দোয়া করলেন যাতে চিরকাল দু বোন এমন মিলেমিশেই থাকে। তাদের মধ্যকার ভালোবাসা, সম্মান যেনো অটুট থাকে।
________

সন্ধ্যা হতেই শ্বশুর বাড়ি থেকে স্ত্রীকে নিয়ে নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় শ্রাবণ। কিন্তু মাঝপথে এসেই থেমে যায় গাড়ি। অনুভা ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকায়। তার চাহনির অতো তোয়াক্কা না করে সিট বেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সে। ঘুরে এসে অনুভার পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে কোমল স্বরে বলে,“নেমে এসো।”

“কেন? এখানে আবার কী?”

“এত প্রশ্ন কেন করো বলো তো নোভা। আমি কী তোমায় এখানে রেখে চলে যাবো নাকি?”

“সেকথা বললাম কখন?”

“তাহলে নামছো না কেন?”

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল অনুভা। সে নামতেই গাড়ির দ্বার বন্ধ করে গাড়ি লক করল শ্রাবণ। আগে আগে হাঁটতে লাগলো বাম দিকের পথ ধরে। অনুভাও হাঁটছে তার পিছুপিছু। কয়েক মিনিট হাঁটার পর ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো,“যাচ্ছি কোথায়?”

“কোথাও না।”

“তাহলে হাঁটছি কেন?”

“এমনি, কেন? ভালো লাগছে না?”

প্রত্যুত্তর করল না অনুভা। আশেপাশে ভালো করে দেখতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে তারা ধানমন্ডি লেকের কাছাকাছি চলে এসেছে। চারিদিকে আলোতে আলোতে ঝলমল করছে। ক্ষণে ক্ষণে হেঁটে যাচ্ছে কতশত কপোত কপোতী। এই রাতের আঁধারে আশেপাশের আলোয় চকচক করছে লেকের পানি। এতটা মুগ্ধ হয়ে এর আগে কখনো রাতের শহর হেঁটে হেঁটে দেখা হয়নি অনুভার। হঠাৎ সে অনুভব করল তার হাতটা পরম আবেশে কেউ নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। আপনাআপনি অধরে হাসির রেখা ফোটে উঠলো তার। সম্মুখে চাইলো পুরুষটির পানে। শ্রাবণ তাকে টেনে নিজের পাশাপাশি নিয়ে এলো। পায়ে পা মিলিয়ে দুজনে হেঁটে চলেছে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে।

অনুভা ফিসফিসিয়ে শুধালো,“বাড়ি ফিরবে না?”

“এত তাড়া কীসের? দু তিনটে বাচ্চা রেখে এসেছো নাকি?”

“হুসস, সবসময় ফাজলামো মার্কা কথা।”

হাসে শ্রাবণ। বলে,“তাহলে ফেরার কথা জিজ্ঞেস করছো কেন বারবার? সময়টা উপভোগ করো। দেখো আজকের আকাশটা সুন্দর না অনেক?”

পূর্ণ দৃষ্টিতে আকাশ পানে তাকায় অনুভা। আকাশে অর্ধ খাওয়া চাঁদ। মেঘহীন পরিষ্কার আকাশটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা।সত্যিই রাতের আকাশটা অদ্ভুত সুন্দর। বললো,“হুম সুন্দর তবে শুধুই আজকের আকাশ নয় বরং আকাশ প্রতিদিনই সুন্দর দেখায়।”

“উহু আমার কাছে তো মনে হচ্ছে বিগত দিনের আকাশের চেয়ে আজকের আকাশটাই বেশি সুন্দর।”

“কেন কেন? আজকে কী বিশেষ কিছু?”

“হুম।”

“কী?”

গাঢ় দৃষ্টিতে স্ত্রীর পানে তাকায় শ্রাবণ। অনুভার উৎসুক দৃষ্টিও তার পানেই নিবদ্ধ। সেই দৃষ্টি দেখে মুচকি হেসে টেনে দেয় অনুভার গাল। বলে,“কারণ আজকে আমার পাশে আমার নোভা আছে। তাই আজকের রাত, আজকের ওই আকাশ আর সময়টা আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর এবং বিশেষ দিন।”

বুকের ভেতরে কৈশোরের সেই নিদারুণ অনুভূতি ছুঁয়ে যায় অনুভার। লাজুক হেসে সরিয়ে নেয় দৃষ্টি। পরনে আকাশী রঙের শাড়ি, মাথায় ম্যাচিং হিজাব, কাজল কালো চোখ। এতকিছুর মধ্যে এই হাসিটাই যেনো প্রয়োজনীয় ছিলো খুব। মন ভরে প্রিয়তমাকে দেখে নিলো শ্রাবণ।এক ফাঁকে দৃশ্যটি মোবাইলে করে নিলো ক্যামেরা বন্দি। টের পেয়ে গেলো অনুভা। বিচলিত কণ্ঠে বললো,“এই এই তুমি ছবি তুললে কেন হ্যাঁ?”

“আমার নাতি-নাতনিদের দাদীর ছবি আমি তুলেছি এতে কার কী শুনি?”

এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো অনুভা। মনে পড়ে গেলো সেই দেখা হওয়ার তৃতীয় দিনে শ্রাবণের বলা নাতি-নাতনি নিয়ে ঢপ মারা গল্পটা। হেসে বললো, “তুমি যে একটা মিথ্যুক তা কী জানো শ্রাবণ?”

“কী মিথ্যে বললাম? কখন বললাম?”

“তুমি আমায় বলেছিলে তোমার বাবা নাকি র‍্যাব কিন্তু তোমার বাবা তো কলেজের একজন অধ্যক্ষ ছিলেন।”

“তাহলে দেখো! তখন তোমার মাথায় কতটা গোবর ছিলো। নইলে ওই মজাটাকে কী তুমি সত্যিই ভেবে নিতে? তবে এটা অবশ্য ঠিক ছিলো, তখন আমার নাতি নাতনিদের দাদী হিসেবে আমি তোমায়ই সিলেক্ট করে রেখেছিলাম আর বানিয়েও নিলাম।”

“তা কোথায় তোমার সেই নাতি-নাতনি?”

“ফিউচারে বসে আছে। টাইম ট্রাভেল মেশিন থাকলে ঠিক দেখিয়ে নিয়ে আসতাম।”

মাঝেমধ্যে ছেলেটার এসব উদ্ভট কথা শুনলেই খুব হাসি পায় অনুভার। যৌবনের ভেতরে চাপা পড়ে থাকা সেই কৈশোরের চঞ্চলা তরুণী জাগ্ৰত হয়ে ওঠে।
________

বাহির থেকেই ডিনার সেরে বাড়ি ফিরলো দুজন। ড্রয়িং রুমে বসে হানিফ শেখ, শান্তা এবং সৌহার্দ্য মিলে কিছু একটা আলোচনা করছিল। অনুভা চলে গেলো ঘরে। আর শ্রাবণ ওখানে গিয়ে বসলো। প্রশ্ন করল,“কী নিয়ে কথা হচ্ছে?”

তিন জোড়া দৃষ্টি স্থির হলো শ্রাবণের পানে। হানিফ শেখ বললেন,“আমি আর দেরি করতে চাইছি না। সৌহার্দ্য এসে গেছে এবার তোদের দুই ভাইয়ের বৌ ভাতের অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলতে চাই।”

“তারিখ ঠিক করেছো?”

“প্রান্তির বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। এই সপ্তাহের মধ্যেই সেরে ফেলবো।”

“এই জন্য এত তাড়াতাড়ি?”

সৌহার্দ্য ভ্রু বাঁকিয়ে ঠেস দিয়ে বলে উঠলো,“বিয়ে করার সময় তো একটুও দেরি করোনি তাহলে বৌ ভাতের জন্য দেরি করতে হবে কেন? কোনো দেরি টেরি চলবে না। অনুষ্ঠান করলে এ সপ্তাহেই করতে হবে।”

“তড় সইছে না যেনো?”

“কেন তড় সইবে? বিয়ে করেছি সবাইকে জানাতে হবে না? নইলে তো পরে দেখা যাবে রাস্তা দিয়ে বউ নিয়ে হাঁটছি পাড়ার লোকেরা অন্যকিছু ভেবে কুটনৈতিক আলোচনা শুরু করে দিবে।”

“হয়েছে বুঝি সব, তোর যে কীসের জন্য তড় সইছে না সব বুঝি।”—–বলেই সিঁড়ির দিকে হাঁটা ধরলো শ্রাবণ।

সৌহার্দ্যও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বড়ো ভাইয়ের পিছুপিছু যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল,“কী বোঝো তুমি হে?”

“বউ ছাড়া একা একা ভালো লাগছে না তাই তো দ্রুত অনুষ্ঠানের নাম করে বউকে ঘরে তুলতে চাইছিস।”

থতমত খেয়ে গেলো সৌহার্দ্য। আমতা আমতা করে বড়ো গলায় বললো,“আর তুমি? তুমি যে বিয়ে করেই ভাবীকে নিয়ে সংসার করছো তার বেলা? নিজের বেলা ষোলো আনা তাই না?”

“বড়ো ভাই হই সম্মান দিয়ে কথা বল।”

“আমিও ছোটো ভাই হই আদর দিয়ে কথা বলো।”

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই বাঁকা দৃষ্টিতে ভাইয়ের পানে তাকায় শ্রাবণ। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে সৌহার্দ্যের গাল দুটো জোরে জোরে টেনে দিয়ে বলে,“ওলে আমার ভাইটা। আদর লাগবে তোমার তাই না? আসো আসো একটা চুমু দেই।”

বলেই নিজের মুখ এগিয়ে নিলো সৌহার্দ্যের দিকে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলো সৌহার্দ্য। আর্তনাদ করে বললো, “ব্যথা পাচ্ছি ছাড়ো। ও মা কিছু বলো না ভাইয়াকে।”

তাকে ছেড়ে দিলো শ্রাবণ। ঘাড় চেপে ধরে উপরে উঠতে উঠতে বিদ্রুপ করে বললো,“যখনি পারিস না তখনি বাবা-মাকে ডাকাডাকি তাই না? বাচ্চামি স্বভাব গেলো না আবার সে নাকি সংসার করবে।”

“হ্যাঁ সংসার ধর্ম শুধু তোমার জন্যই তৈরি হয়েছে।”

“আবার কথা? মুখের মধ্যে টেপ লাগিয়ে রাখবো।”

সোফায় বসেই হানিফ শেখ এবং শান্তা দেখে গেলেন ছেলেদের কর্মকাণ্ড। দুটো চোখের আড়াল হতেই একে অপরের পানে তাকিয়ে সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আসলেই দুটোর বাচ্চামি স্বভাব এখনো গেলো না। নইলে কী এখনো একটা আরেকটার পেছনে এভাবে লেগে থাকে?

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)