সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৩৩+৩৪

0
294

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৩]

“বউমার বাবা একসময় পুলিশ ছিলেন? ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়ে চাকরি হারিয়েছিলেন?”

মায়ের কথায় মুখ তুলে তাকায় শ্রাবণ। দেখতে পায় শান্তার চোখেমুখে রাগের আভাস। শান্ত স্বরে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,“হ্যাঁ, তো?”

“আগে কেন বলিসনি এ কথা?”

“বলার মতো অতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি তাই।”

ছেলের কথায় আশ্চর্য হন শান্তা। বসে পড়েন বিছানায়। রাগত স্বরে বলেন,“এটা গুরুত্বপূর্ণ কথা নয়? আত্মীয় স্বজনেরা যখন এ কথা জানবে তখন আমাদের মান সম্মান কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে বুঝতে পারছিস?”

“তুমি জানালেই জানবে।”

“মেহু একদম মুখে মুখে কথা বলবি না বলে দিলাম। সবকিছু মেনে নেই বলে মায়ের সঙ্গে বেয়াদবি করার দুঃসাহসও দেখাবি না।”—বেশ চেঁচিয়েই কথাটা বলে উঠলেন শান্তা।

মা যখন হুটহাট রেগে যায় তখন এমন করেই কথা বলে যা শ্রাবণের অজানা নয়। মোবাইলটা রেখে পূর্ণ দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকায় সে। বলে,“আস্তে কথা বলো মা, নোভা শুনতে পাবে।”

“শুনলে শুনুক, এ কথা তো আর মিথ্যে নয়।”

“না মা, ওর শোনা উচিত নয়। উচিত নয় আমার মায়ের এমন ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। আমরা যেমন জানি আমাদের মা কোমল হৃদয়ের একজন নারী তেমন নোভাও এ কথাটাই জানে। শুরু থেকেই তোমার এ রূপের সঙ্গেই পরিচিত হয়ে আসছে। হঠাৎ করে আরেক রূপ দেখলে তার ভেতরে কী মনোভাব তৈরি হবে বলো তো? আর কিছু না হলেও তোমার জন্য তার মনে দূরত্বের সৃষ্টি হবে। আমি আমার মা কিংবা নোভা এই দুই নারীর কাউকেই ত্যাগ করতে পারবো না মা।”

রাগের পারদ গললো শান্তার। কণ্ঠ নিচু হলো। বললেন,“সব জেনেও অমন একটা মেয়েকে কেন বিয়ে করলি?”

“এসব ঘটনা ঘটার অনেক আগেই ও আমার জীবনে এসেছিল মা। ওকে আমি ভালোবেসেছি। আমি দেশ ছাড়ার পরই এসব ঘটনা ঘটে। যার জন্য লজ্জায় আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ পর্যন্ত রাখেনি মেয়েটা। দূরত্ব সৃষ্টি করে নিয়েছিল আমাদের মধ্যে। ওই দূরদেশে ওকে ছাড়া কতটা কষ্টে যে ছিলাম তা কেবল আমিই জানতাম মা। দেশে ফিরে রাতদিন এক করে ওকে খুঁজে বের করেছি। বারবার আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছি কিন্তু ও জানো আমায় কী বলেছিল? নিজের অনুভূতি, ভালোবাসা লুকিয়ে বলেছিল, এমনটা হয় না শ্রাবণ। তোমার বাবা-মা সবটা জানার পর আমাকে ভালোভাবে গ্ৰহণ করবেন না। আত্মীয় স্বজনেরা কটু কথা বলবে। এসব বোঝ জ্ঞান দিয়ে বারবার আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিল ও। কিন্তু আমি বড়ো মুখ করে ওকে বলেছি আমার বাবা-মা এমন নন। অন্যায় তোমার বাবা করেছে কিন্তু তোমরা না। কিন্তু ও মানেনি। ওর বড়ো বোন উদ্যোগ না নিলে হয়তো ওকে কিছুতেই আমি নিজের করে পেতাম না মা।”

বলেই থামে শ্রাবণ। পুনরায় বলে,“ও খুবই আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন নারী। ওর ব্যক্তিত্ব প্রখর। নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হবে, অপমানিত হতে হবে এমন স্থানগুলো সে এড়িয়ে চলে। তাই আশা করি এসব কথা কখনো ওর সামনে তুমি বলবে না। আমি ওকে নিজ দায়িত্বে এখানে নিয়ে এসেছি। তাই ওর সম্মানের দিকটাও আমারই দেখার বিষয়। বাবা সবটা জানে, তোমায় জানাইনি কারণ আমি ভেবেছিলাম আমার মায়ের এসবে কোনো সমস্যা হবে না। মায়ের উপর এতটুকু বিশ্বাস তো সন্তানের থাকেই তাই নয় কী মা?”

রাগটা এবার নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো শান্তার। হঠাৎ ফোনকলে রুবির থেকে এত নেতিবাচক কথা শুনে উনার রাগ হয়েছিল। তাই তো তৎক্ষণাৎ চলে আসেন পুত্রের কক্ষে। উনার নিরবতায় শ্রাবণ প্রশ্ন ছুঁড়ে,“এ কথা নিশ্চয়ই তোমায় খালামণি বলেছে তাই না?”

কাঁচুমাচু মুখ করে শান্তা উত্তর দিলেন,“হ্যাঁ, তখন অমন করে রুবি বললো যে।”

“তাই তোমার রাগ হয়েছে। আচ্ছা মা নিজের সংসারের কথা অন্য কাউকে বলার মধ্যে কী কোনো মহত্ত্ব আছে? মানছি খালামণি তোমার আপন ছোটো বোন কিন্তু তাই বলে তো চাইলেই সব বলা যায় না। তোমাদের দুজনার আলাদা আলাদা সংসার আছে। কই খালামণি তো তোমায় নিজেদের ব্যাপারে কিছু বলে না।”

“কে বলেছে রুবি কিছু বলে না? সব বলে।”

হাসে শ্রাবণ। বলে,“আনিকার স্বামীর সঙ্গে যে আনিকার ঝামেলা চলছে তা কী জানো? লিমনের বউয়ের সঙ্গে প্রায়সই খালামণির ঝগড়া হয় বাড়িতে তা কী জানো? খালুর যে চাকরি চলে গিয়েছিল সে কথা কী কখনো জানতে? পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে যে খালুদের ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব শুরু সেকথাই বা কী জানো?”

পুত্রের কথায় চমকান শান্তা। বলেন,“এতকিছু হয়েছে! কই রুবি তো আমায় জানালো না কিছু। তাছাড়া বৌ ভাতের অনুষ্ঠানেও তো সবার মধ্যে কী মিল দেখলাম।”

“স্বাভাবিক। কারণ সে তো আর তোমার মতো নয় যে নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা মানুষের সামনে প্রকাশ করে ছোটো হবে। নিজেদের মধ্যে একটা গোপনীয়তা থাকতে হয় মা। খালামণি নিজেদেরকে তোমার কাছে ছোটো করতে চায়নি বলেই জানায়নি। অথচ তুমি বোন অন্ত প্রাণ তাই সব বলে দাও বোনকে। বোন যদি তোমার ভালোই হতো তাহলে এ বয়সে এসে পুত্রবধূর সঙ্গে রোজ রোজ ঝগড়া করতো না। বোন তোমার ভালো চাইলে কখনোই নোভার বাবার নাম কৌশলে জেনে এত খোঁজ খবর নিয়ে তোমার কানে বিষ ঢালতো না। ভালো চাইলে জায়ের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা তোমার মাথায় ঢোকাতো না। যে মেয়ে দু দুবার প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়েছে সেই মেয়েকে কী করে বোনের ছেলের জন্য ঠিক করে বলো তো?”

“এসব কী বলছিস মেহু?”

সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রাবণ। বলে,“বাবা এমনি এমনি খালামণিকে অতো অপছন্দ করে না মা, বুঝলে? নইলে তোমার চাচাতো ভাই-বোনদের নিয়ে তো বাবার কোনো সমস্যা নেই। কারণ বাবা মানুষ চেনে। বৌ ভাতের অনুষ্ঠানের দিন দেখলে না কীভাবে নোভাকে এড়িয়ে গেলো খালামণি? কীভাবে প্রান্তির আশপাশ ঘুরঘুর করে ভাব জমাচ্ছিল? তুমি আমার মা সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধি তোমার বেশি। তাই বোনকে এতটা বিশ্বাস করো না। বিয়ের পর ভাই-বোন আর অতো আপন থাকে না। সবার আলাদা আলাদা সংসার হলে সম্পর্কগুলো আর আগের মতো থাকে না। এই যে আজ উনার কথায় যেভাবে তুমি রোষানলে ফেটে পড়লে সেভাবেই ভবিষ্যতেও যদি এমন করো তাহলে কিন্তু আমাদের এই সুন্দর সাজানো সংসারটা আর থাকবে না মা। ওরা পরের বাড়ির মেয়ে। হুট করে নতুন এক পরিবেশে এসেই সহজে সবাইকে আপন করে নিতে পারবে না। তোমারই তো উচিত তাদেরকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে নিজের মতো গড়ে তোলা। তুমিও তো এমন একটা সময় পার করে এসেছো। সবই তো জানো, বোঝো। তাছাড়া নোভার আচরণে কী কখনো এমন কিছু দেখেছো যার কারণে ওর প্রতি রাগ হয় তোমার?”

দুদিকে মাথা নাড়ান শান্তা। মনে মনে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হোন। নিরবে উঠে ত্যাগ করেন পুত্রের কক্ষ।

বাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। শ্রাবণের ফুফুরা ফিরে গেছে নিজেদের বাড়ি। রয়ে গেছে শুধু চাচা-চাচী আর চাচাতো ভাই-বোনেরা। তারাও বিকেলের দিকে রওনা দিবে নিজেদের আবাসস্থলে। দুপুরের রান্নার আয়োজন চলছে। ছোটো চাচী এবং চাচাতো জায়ের সঙ্গে হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে অনুভা। ফাঁকে ফাঁকে চলছে তাদের গল্প। যদিও অনুভা শুধু শুনেই যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে হা হু করছে, মুচকি মুচকি হাসছে।

বিছানায় আয়েশ করে বসে মোবাইল ঘাঁটছে প্রান্তি। সৌহার্দ্য গিয়েছিল একটু নিচে। ঘরে এসে স্ত্রীকে বসে থাকতে দেখেই জিজ্ঞেস করল,“এখানে এভাবে বসে আছো কেন?”

নড়েচড়ে উঠলো প্রান্তি। তাকালো স্বামীর পানে। হেসে বললো,“ওখানে ফিরে ওদের জন্য বড়োসড়ো একটা পার্টি না দিলে নাকি ওরা ছাড়বে না।”

“কাদের জন্য?”

“আরে ফ্রেন্ডসদের।”

“ওহ, আমার প্রশ্নের উত্তরটা তো দিলে না। এখানে বসে কী করছো? নিচে সবাই আছে ওদের কাছে যাও। নতুন বউ এভাবে ঘরে বসে থাকলে কী বলবে সকলে?”

মুখের আদল বদলে গেলো প্রান্তির। বিরক্তির সহিত বললো,“কাউকেই তো আমি চিনি না। কার সাথে কথা বলবো?”

“তোমাকে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে কে বলেছে? তুমি নিচে গেলে ওরাই তোমার সাথে কথা বলবে। তাছাড়া ভাবীও তো তোমার মতোই নতুন বউ, সে তো দিব্যি ঘরে বসে না থেকে রান্নাঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে।”

“সবাইকে দিয়ে সবটা হয় না।”

“ফ্যামিলি সম্পর্কে জেনেই বিয়ে করেছো আমায়। ব্রেকআপ করে ফেলার পরে কথা দিয়েছিলে‌ বিহেভিয়ার পুরো চেঞ্জ করে ফেলবে তাহলে এখন এমন করে কথা বলছো কেন?”

নিরুত্তর প্রান্তি। সৌহার্দ্য এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলো। স্ত্রীর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কোমল স্বরে বললো,“আমরা দুই ভাই। দুজনই বাবা-মায়ের গর্ব। দুজনেই যোগ্যতার দিক দিয়ে কেউ কারো থেকে কোনো অংশে কম নই। আবার দুজনই ভালোবেসে নিজেদের শখের নারীকে বিয়ে করেছি। তার মধ্যে তুমি যদি এভাবে অহংকারী মনোভাব নিয়ে চলাফেরা করো তাতে আমার বাবা-মা এ নিয়ে কিছু না বললেও আত্মীয় স্বজনেরা কিন্তু ঠিকই কথা বলবে। তাতে সবার সামনে আমি ছোটো হয়ে যাবো। নিজের পছন্দ এবং ভালোবাসার প্রতি প্রশ্ন উঠবে। তুমি কী এটাই চাও প্রান্তি?”

দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয় প্রান্তি। ভেতরে ভেতরে প্রশান্তি অনুভব করে সৌহার্দ্য। মেয়েটি এদিক দিয়ে ভালো আছে, তাকে বোঝালেই সবকিছু বুঝে ফেলে। সৌহার্দ্য পুনরায় বললো,“নিচে যাও। কারো কথায় একদম বিরক্তি প্রকাশ করবে না। আরেকটা কথা, ভাবী সম্পর্কে তোমার বড়ো তাই তাকে বড়ো বোনের মতো সম্মান দিয়ে কথা বলবে সবসময়। মনে রেখো আমার কাছে কিন্তু আমার পরিবার সবার উর্ধ্বে।”

এবারো স্বায় জানিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নিলো প্রান্তি। নিঃশব্দে বের হলো ঘর থেকে। সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেললো সৌহার্দ্য। মেয়েটা এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারলেই হলো এবার।

প্রান্তিকে নিচে উপস্থিত হতে দেখেই চাচাতো ভাই রুয়েলের স্ত্রী তুর তাকে টেনে নিয়ে বসালো সোফায়। সৌজন্য হাসলো প্রান্তি। নতুন বউকে দেখে বাকিরাও তাকে ঘিরে ধরলো। শুরু করল নিজেদের পরিচয় পর্ব। রান্নাঘর হতেই তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন শান্তা। গতকাল থেকে খাওয়ার সময় ব্যতীত ছোটো পুত্রবধূকে নিচে নামতে না দেখে বেশ চিন্তিত হয়েছিলেন তিনি। বারবার দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, ছেলে আদৌ সঠিক মেয়েকে নিজের জন্য বেছে নিয়েছে তো? মেয়েটি কী মিশুক নয়? পরিবার কী তার অপছন্দ?

মন থেকে যেনো সেই দ্বিধা এবার কাটলো উনার।
________

বেলা বাড়লো। তার সাথে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন হলো আবহাওয়ার। অফিসে কিছু প্রজেক্ট নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছে অর্থিকা। মোবাইলের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম্বার। কিন্তু মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় তার শব্দ কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না অর্থিকার। কিছু সময় গড়ালো। একজন নারী সহকর্মী বলে উঠলেন,“আপা আপনার মোবাইলটা বাজছে।”

বিরক্তিতে ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো অর্থিকার। গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় ফোন আসায় মনোযোগে যেনো ভাটা পড়ল। মোবাইল হাতে নিয়ে চেক করতেই দেখতে পেলো এটি মাজেদার নাম্বার। মেয়েটি এ সময় কেন কল দিচ্ছে এভাবে? বাড়িতে কিছু হলো কী? মা, তাঈম ঠিক আছে তো? হাজারটা উটকো চিন্তা ভাবনা নিয়েই কল ব্যাক করল অর্থিকা। রিসিভ হলো সঙ্গে সঙ্গে। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অপরপাশ হতে শঙ্কিত, বিচলিত নারী কণ্ঠে বলে উঠলো,“আপা গো আপনে কই? তাড়াতাড়ি বাড়িত আহেন।”

“আমি তো অফিসে মাজেদা। কার কী হয়েছে? তাঈম ঠিক আছে তো?”

“তাঈম বাজান ঠিক আছে কিন্তু চাচী তো ঠিক নাই আপা। দুপুরে খাওনের লাইগ্গা ডাকলাম কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ করল না। ভাবছি হয়তো ঘুমায়, বিকাল হইয়া গেছে এহনও উডার নাম নাই। অনেকক্ষণ ডাকলাম কিন্তু কিছুতেই উডলো না। চাচী তো এমনে কহনো ঘুমায় না। পরে শরীরে হাত দিয়া দেহি গো আপা বরফ হইয়া রইছে। আপনেরে অনেক ফোন করছি কিন্তু আপনে ধরেন নাই তাই আশেপাশের মাইনষে গো ডাইক্কা আনছি। হেরাই চাচীরে হাসপাতালে আইনা ভর্তি করছে। আপা গো আমার তো ডর লাগতাছে। আন্নে তাড়াতাড়ি আহেন আপা।”

মুহূর্তেই হতভম্ব হয়ে গেলো অর্থিকা। ইদানিং মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অনেকবার ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে চাইলেও সুফিয়া কিছুতেই রাজি হলেন না। মেয়েকে বিভিন্ন বোঝ দিয়ে আটকে দিলেন। ঘর থেকেও বের হন না তেমন। সারাক্ষণ মেঝের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করেন। আজ সকালেও তো মাকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় দেখে এসেছে অর্থিকা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। সেই মায়ের কী হয়ে গেলো এটুকু সময়ের মধ্যে? মাথা কাজ করছে না তার। শক্ত করে সম্মুখের টেবিলটা ধরলো সে। সহকর্মীরা তার অস্থিরতা দেখে এগিয়ে এলো। একজন শুধালো,“আপনি ঠিক আছেন তো? কিছু হয়েছে কী?”

কিয়ৎক্ষণ নিরব থাকে সে। সহকর্মীদের মধ্যকার একজন এগিয়ে দেয় পানির বোতল। পানি পান করে গলা ভেজায় অর্থিকা। বড়ো বড়ো কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,“আমার মা! আমার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাকে যেতে হবে ওখানে।”

সকলে চমকায়। তাদের মধ্য থেকে আরেকজন বলে ওঠে,“আপনি বরং হাসপাতালেই চলে যান। এদিকটা না হয় আমরা সামলে নিবো। ম্যামকে সবটা বুঝিয়ে বলবো। আশা করি উনি বুঝবেন।”

আর বিলম্ব করল না অর্থিকা। নিজের টেবিল হতে ভ্যানিটি ব্যাগটি নিয়ে বের হয়ে গেলো অফিস থেকে। পথে আবারো মাজেদাকে কল করে জেনে নিলো হাসপাতালের ঠিকানা।
_________

বিকেল পেরিয়ে ধরণীতে সন্ধ্যা নেমেছে। আত্মীয় স্বজনেরা চলে গেছে বিকেলেই। বাড়ি যেনো এখন পুরোপুরি নিস্তব্ধ। চা বানিয়ে সকলকে চা পরিবেশন করে ঘরে এলো অনুভা। শ্রাবণ বাড়ি নেই। ছেলেটার মন খুব ছটফটে। এক স্থানে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। যা অনুভা খুব ভালো করেই খেয়াল করেছে। শরীরটা বিছানার উপর সটান করে ছেড়ে দিলো সে। মাথা গুঁজলো বালিশে। সেই যে সকালে উঠেছে তারপর আর শোয়া হয়নি তার। যদিও শান্তা বারবার তাকে ঘরে এসে বিশ্রাম নিতে বলেছেন কিন্তু সে আসেনি। বাড়িতে অতিথি, তাদের মধ্যে নতুন বউ ঘরে এসে শুয়ে থাকলে লোকে কী বলবে? তাছাড়া শ্রাবণও তো ঘরেই ছিলো।

চোখ জোড়া বন্ধ করে নিতেই ঝংকার তুলে অনুভার মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রীনে মাজেদার নাম্বার দেখেই রিসিভ করে উঠে বসলো। প্রশ্ন করল,“আরে মাজেদা আপা যে! কেমন আছো?”

“আপা বাড়িতে আহেন আপনে।”

গলাটা কেমন ভারি শুনালো তার। প্রতিটি শব্দ যেনো তরঙ্গের মতো ঢেউ খেলে ছুটে এলো। মুখের হাসিহাসি ভাবটা সরে গেলো অনুভার। পুনরায় প্রশ্ন করল, “বাড়িতে আসবো? কারো কিছু হয়েছে মাজেদা আপা?”

শব্দ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটি। চমকালো অনুভা। বিচলিত হয়ে উঠলো তার মন। শুধালো,“কাঁদছো কেন মাজেদা আপা? কী হয়েছে? সবাই ঠিক আছে তো? কী হলো বলো।”

কিছু বলতে চাইলো মাজেদা কিন্তু পারলো না। তৎক্ষণাৎ কেউ তার হাত থেকে কেড়ে নিলো ফোন। অপরিচিত নারী কণ্ঠে একজন বললেন,“তুমি অনুভা? তোমার মা একটু অসুস্থ। বাড়িতে এসো তো।”

“কে আপনি? কী হয়েছে মায়ের?”

“আমি তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি। তুমি একটু তাড়াতাড়ি এসো মা।”—–বলেই কল কাটলেন ভদ্রমহিলা।

কিন্তু অনুভা যেনো অশান্ত হয়ে উঠলো। মায়ের কী হয়েছে? মাজেদা আপা কাঁদলো কেন? এসব প্রশ্ন মস্তিষ্কে হানা দিতেই মাথা ধরে এলো। দ্রুত শ্রাবণের নাম্বারে কল দিলো। কলটা বাজতে বাজতে কেটে গেলো। দ্বিতীয়বার কল দেওয়ার পর কেটে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে রিসিভ হলো তা। বিপরীত পাশ হতে ঠাট্টার ছলে শ্রাবণ বলে উঠলো,“একটু বাহিরে এলাম আর ওমনিতেই আমায় মিস করা শুরু করে দিলে নোভা রাণী?”

সেসব কথায় বিশেষ গুরুত্ব দিলো না অনুভা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,“আমি বাড়িতে যাবো শ্রাবণ। তুমি কোথায়? এখনি এসো।”

“বাড়িতে! এখন? এখন বাড়িতে কীভাবে যাবে নোভা? বাড়ির সকলের কথা মনে পড়ছে তাই না? আজ রাতটা বরং থাক কাল না হয় নিয়ে যাবো।”

“মাজেদা আপার কল এসেছিল, মা নাকি খুব অসুস্থ। আমি কিছু জানি না। এখনি আমাকে বাড়ি যেতে হবে। তুমি না পারলে আমি একা একাই চলে গেলাম।”

“একা একা একদম বের হবে না। তুমি তৈরি হও আমি এখনি আসছি।”—-বলেই কল কেটে বাড়ির দিকে ছুটলো শ্রাবণ।

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৪]

চারিদিকে নিস্তব্ধতার ছড়াছড়ি। সন্ধ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে শোক। সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে তৃতীয় তলায় পা রাখতেই অনুভা চমকালো। ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা। লোকমুখে গুণগুণ আওয়াজ। শঙ্কিত মন নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই বসার ঘরে দেখা মিললো প্রতিবেশী আন্টির। তিনি এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন অনুভার সম্মুখে। অনুভা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“আমার মা? মা কোথায়? মা কী খুব অসুস্থ? তাহলে আপু কোথায়? আপু কেন মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে না?”

ভদ্রমহিলা প্রত্যুত্তরে কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। উনার বলার অপেক্ষাও করল না অনুভা। চট করে চলে গেলো মায়ের ঘরে। তৎক্ষণাৎ পা দুটো তার থমকে গেলো। সাদা কাফন গায়ে জড়িয়ে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে সুফিয়াকে। অর্থিকা পাশেই খাটের পায়ার সঙ্গে হেলান দিয়ে নিরবে বসে আছে। চোখ জোড়ায় এখনো অশ্রুজল চিকচিক করছে। অনুভাকে দেখতেই মাজেদা শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, “আপা গো আপনে আইছেন? কিন্তু চাচী তো আর নাই আপা। আমগো ছাইড়া চইল্লা গেছে।”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো অনুভার। তাকালো মায়ের নিথর দেহের পানে। ঠোঁটের কার্নিশে উনার মৃদু হাসির রেখা। আগের থেকেও উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। চোখ দুটো বোঁজা। আর কিছুই খেয়াল করতে পারলো না অনুভা। শরীরের ভারসাম্য ধীরে ধীরে হ্রাস পেলো তার। সম্মুখের সকল কিছু আবছা হয়ে এলো। ফাঁকা হয়ে এলো মস্তিষ্ক, মূর্ছা গেলো সে। তৎক্ষণাৎ তাকে আগলে নিলো শ্রাবণ। গাড়ি পার্কিং করে এসে ভেতরে প্রবেশ করতেই স্ত্রীকে পড়ে যেতে দেখে চমকালো। গালে আলতো করে চাপড় মেরে ডাকলো,“নোভা! এই নোভা! কী হয়েছে তোমার?”

উত্তর এলো না কোনো। এগিয়ে এলেন দুজন মহিলা। বিচলিত কণ্ঠে বললেন,“এ কী উনি তো অজ্ঞান হয়ে গেছেন! উনাকে ঘরে নিয়ে চলুন।”

স্বম্বিৎ ফিরে পেলো শ্রাবণ। চটজলদি স্ত্রীকে তুলে নিলো পাঁজাকোলে। নিয়ে গেলো শোবার ঘরে। বিছানায় শুইয়ে দিতেই মহিলা দুজনের মধ্যকার একজন ছিটিয়ে দিতে লাগলেন চোখেমুখে পানি। আরেকজন বললেন,“হুট করে মায়ের মৃ’ত্যু সংবাদ শুনে সহ্য করতে পারেনি তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে। হাতে পায়ে তেল মালিশ করার জন্য আমি বরং কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ঠিক জ্ঞান ফিরে আসবে।”

মস্তিষ্কে মুহূর্তেই আঘাত হানলো বাক্যগুলো। স্ত্রীর পানে একপলক তাকিয়ে উপস্থিত মহিলাটিকে তার খেয়াল রাখার কথা বলে দ্রুত হেঁটে শাশুড়ির ঘরে চলে এলো শ্রাবণ। পুরো দৃশ্যটা দেখে বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো। একপল তাকালো অর্থিকার পানে। বাবার মৃ’ত্যুর সময় মেয়েটির মুখশ্রীর আদলে যেমন দুঃখ কষ্টে ছেয়ে ছিলো আজও ঠিক তেমনি তার অবস্থা। তাকে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেলো না শ্রাবণ। তাই মাজেদা মেয়েটির উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কখন হলো এমনটা? আর কীভাবেই বা হলো?”

মেয়েটি নাক টেনে বললো,“জানি না দুলাভাই। কয়দিন ধইরা চাচী খালি চুপচাপ থাহে। কিছু জিগাইলেও উত্তর দেয় না। আইজ সকালেও চাচীরে দেখলাম শুইয়া রইছে। খাওন দিয়া গেলাম খাইলো না। আমিও আর কিছু না কইয়া দুপুরের রান্না কইরা তাঈম বাজানরে গোসল করাইয়া খাওয়াইয়া ঘুম পাড়াইলাম। দুপুরের খাওনের সময় তিনবার ডাকলাম কিন্তু চাচী এইবারও উত্তর দিলো না। শরীর খারাপ করছে নাকি দেহার লাইগ্গা গা ছুঁইতেই দেহি বরফের মতো ঠাণ্ডা। তারপর পাশের ফেলাটের খালারে ডাইক্কা আনলাম। হেরাই হাসপাতালে লইয়া গেলো। হেইহানের ডাকতারে কইলো চাচী আর নাই।”

কথাটা বলে মুখে ওড়না গুঁজে আবারো কেঁদে উঠলো মাজেদা। ঘর থেকে বের হলো শ্রাবণ। ফোন দিলো বাবার নাম্বারে। কল রিসিভ হতেই সে বলে উঠলো, “বাবা নোভার মা মারা গেছেন।”

“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। কী বলিস! কখন?”

“সঠিক সময় তো বলতে পারছি না তবে যা অঘটন ঘটার আমরা আসার আগেই ঘটে গেছে।”

“বউমা কোথায়?”

“ঘটনাটা ও সহজে নিতে পারেনি। মায়ের মৃত দেহ দেখতেই জ্ঞান হারিয়েছে। এখন কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা।”

“তুই বউমার কাছে থাক। আমি তোর মাকে নিয়ে এখনি ওখানে আসছি।”—বলেই কল কাটলেন হানিফ শেখ। হন্তদন্ত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে এলেন স্ত্রীকে জানাতে।

সময় পেরোলো বেশ। জ্ঞান ফিরলো অনুভার।কয়েক মিনিট সময় লাগলো কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো স্মরণ করতে। শোয়া থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়াতে গেলেই তার বাম হাতটা টেনে ধরলো কেউ। সেদিক পানে তাকাতেই অনুভার দৃষ্টিগোচর হলো প্রিয় মুখখানা। হো হো করে কেঁদে উঠলো সে। বললো,“আমি মায়ের কাছে যাবো শ্রাবণ। মা কোথায়?”

এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রাবণ আর তাকে আটকাতে পারলো না। মস্তিষ্ক হতে শব্দরা উধাও হয়ে গেলো। তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে মায়ের ঘরে এলো অনুভা। খাটিয়ার সামনে বসে পড়ল। চোখের পানি বাঁধ মানছে না তার। মায়ের গালে হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে ডাকতে লাগলো,“মা! ও মা! চোখ খোলো না মা। সবাই এসব কী বলছে মা? বাবার মতো তুমি অন্তত আমাদের ছেড়ে যেও না। মাগো ও মা! চোখ খোলো মা। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। ছেড়ে যেও না আমাদের।”

কথাগুলো বলতে বলতেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো সদ্য মা হারা মেয়েটি। পিতার মৃ’ত্যুর থেকেও মায়ের মৃ’ত্যুতে তার শোকটা যেনো বড্ড বেশি। বাবা যে মৃ’ত্যুর দোরগোড়ায় অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছিল তা তো সে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুতও করে নিয়েছিল কিন্তু মা! মা কেন হুট করে চলে গেলো? হুট করে এভাবে ভালোবাসার মানুষেরা ছেড়েছুড়ে চলে গেলে কোনো মানুষ কী সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে পারে?

হুঁশ ফিরে এলো অর্থিকার। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো ছোটো বোনের পানে। মা হারানোর কষ্টটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তার চোখ দিয়েও আবারো নামতে লাগলো বর্ষন। নিরব বর্ষন। হাসপাতালে ডাক্তারের নিকট মায়ের মৃ’ত্যু সংবাদ শুনে কম তো কাঁদেনি মেয়েটা। বরং সেও জ্ঞান হারিয়েছিল। নার্সরা তখন ধরাধরি করে কেবিনে শুইয়ে তার চিকিৎসা করে জ্ঞান ফেরায়। প্রতিবেশী মানুষগুলো ভালো হওয়ায় একেবারে মৃত দেহের শেষ গোসল করিয়ে কাফনে মুড়িয়ে তারপর বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে তাকে।

স্ত্রীর ক্রন্দনরত দৃশ্য সহ্য হলো না শ্রাবণের। এগিয়ে গিয়ে তার পাশেই বসে পড়ল সে। শক্ত করে হেঁচকা টানে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো তার মাথা। ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,“এভাবে কাঁদে না নোভা। যার যাওয়ার সে তো চলেই যায় সবাইকে ছেড়ে। এভাবে কাঁদলে হবে বলো? শক্ত করো নিজেকে।”

কান্নার বেগ কমার বদলে শুধু বেড়েই চলেছে অনুভার। এতক্ষণে হেঁচকি উঠে গেছে। ভেজা গলায় বলতে লাগলো,“মা কেন চলে গেলো শ্রাবণ? কেন চলে গেলো? এখন কী হবে আমাদের? মাকে ফিরে আসতে বলো না। আচ্ছা মা কী কোনো কারণে অভিমান করেছে? কেন করেছে?”

আরো আজগুবি বিভিন্ন কথাই বলতে লাগলো মেয়েটি। চেষ্টা করেও তাকে থামাতে পারলো না শ্রাবণ। অপারগতা মেনে নিয়ে শক্ত করেই নিজের বক্ষের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলো প্রিয়তমাকে। সুখের সন্ধান পেতে না পেতেই দু বোনের জীবনে কেন এত কষ্ট এসে হানা দেয়? পাগলামো করতে করতেই পুনরায় জ্ঞান হারালো অনুভা। এবারো বিচলিত হয়ে উঠলো শ্রাবণ। পূর্বের স্থানেই শুইয়ে দিলো তাকে। একবার ভাবলো হাসপাতালে নিয়ে যাবে পরক্ষণেই ভাবলো,“জ্ঞান ফেরার পর যদি আবার মাকে দেখতে চায়? তখন?”

কী করবে বুঝতে পারলো না শ্রাবণ। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। এভাবে তো আর অসুস্থ স্ত্রীকে ঘরে রেখে দিতে পারে না। হানিফ শেখ এবং শান্তা এসে পৌঁছে গেছেন। বেয়াইনের লাশ দেখে পুত্রবধূর শিয়রে গিয়ে বসলেন শান্তা। মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে পুত্রের থেকে সবকিছু জেনে নিলেন। হানিফ শেখ তাড়া দিয়ে বললেন,“বউমার জন্য এখানে শ্রাবণ আছে। তুমি বরং অর্থিকা মায়ের কাছে যাও। মেয়েটি দেখলাম একা একা চুপচাপ বসে আছে। এই মুহূর্তে কাছে পিঠে ভরসার কেউ না থাকলে হয়?”

স্বামীর কথায় সায় জানালেন শান্তা। দ্রুত সেদিকে পা বাড়ালেন। যাওয়ার আগে পুত্রকে স্পষ্ট করে বলে গেলেন,“বউমার কাছ থেকে কিন্তু একটুও সরবি না মেহু। জ্ঞান ফিরলে সবটা আমায় জানাবি।”

এবারো অনুভার হাতে-পায়ে তেল মালিশ করা হলো। মুখে ছিটানো হলো পানি। কিন্তু বিশেষ কোনো কাজ হলো না। ঘরের বাহিরেই পায়চারি করছিলেন হানিফ শেখ। ভেতরের কথোপকথন শুনতে পেয়ে ছেলেকে ডেকে বললেন,“দেখ তোর কথামতো এ নিয়ে দু দুবার জ্ঞান হারিয়েছে বউমা। তাই আর এখানে ফেলে রাখা উচিত হবে না। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যা ওকে। নিচে ড্রাইভারসহ গাড়ি আছে। ওটায় করেই কাছের হাসপাতালটায় যা। আমি আর তোর মা তো আছি। সৌহার্দ্যকেও জানিয়ে দিয়েছি। ও এসে পড়বে এর মধ্যে। তুই যা।”

বাবার কথা এই মুহূর্তে সঠিক মনে হলো শ্রাবণের নিকট। তাই বিলম্ব না করে স্ত্রীকে ফের তুলে নিলো কোলে। জ্ঞানহীন অবস্থাতেই নিয়ে চললো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

শান্তা এসে বসলেন অর্থিকার পাশে। মাথায় হাত রাখলেন মাতৃ স্নেহে। ঘাড় ঘুরিয়ে ভদ্রমহিলার পানে তাকাতেই উনাকে চিনতে তেমন বেগ পেতে হলো না অর্থিকাকে। তাকে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন শান্তা। মা হারানোর বেদনা যে কতটা কষ্টের তা তো তিনি জানেন। এমন একটি সময় তো তিনিও পার করে এসেছেন। শান্তার মা যখন মারা যান তখন সৌহার্দ্য উনার পেটে। আহা এমন একটা আনন্দের সময় নিজের মাকে হারান ভদ্রমহিলা। কী নিদারুণ কষ্ট! খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন। শ্রাবণকেও কতদিন যে কোলে তুলে নেননি তাও হিসেবের বাহিরে। জা, শাশুড়িই তো তখন সবকিছু সামলেছে।

মেয়েটি শ্রাবণের থেকে বয়সে কিছুটা বড়ো হবে। তবুও তো মেয়ের মতোই। তার দুঃখে ব্যথিত হলেন শান্তা। বুকে টেনে নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন মাথায়। অনেকদিন বাদে পরম ভরসার একটি স্থান পেয়ে যেনো আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না অর্থিকা। কেঁদে উঠলো শব্দ করে।
________

ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে গভীর হতে লাগলো রাত। গ্ৰাম থেকে এসেছে দুজন চাচাতো ভাই আসিফ এবং সজিব। লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে করে আজও সেই চিরচেনা গ্ৰামে ছুটলো গাড়ি। তবে মৃতদেহ খানা আজ ভিন্ন। তাঈমকে অর্থিকার সঙ্গে ছাড়লেন না শান্তা। বাচ্চা ছেলে এত ধকল নিতে পারবে না। তাই তাকে বুঝিয়ে তাঈমকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। মাজেদা মেয়েটাও একা ছাড়লো না অর্থিকাকে। ফোনের মাধ্যমে কাজের স্থান হতে ছুটি নিয়ে সেও চললো অর্থিকার সাথেই গ্ৰামের বাড়িতে। র’ক্তের সম্পর্ক না থাকার পরেও অল্প কিছুদিনেই এই মানুষগুলো যে তার নিকট অতি আপন হয়ে উঠেছিল।

কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরেছে অনুভার। জ্ঞান ফিরতেই শুরু হলো তার কান্না আর চিৎকার চেঁচামেচি। বাবার কাছে ফোন দিয়ে বিস্তারিত সব জেনে নিয়ে স্ত্রীর নিকট এসে বসলো শ্রাবণ। তাকে দেখতেই বুকে হামলে পড়ল অনুভা। খামচে ধরলো পরনের শার্ট। অস্থির হয়ে বললো,“আমায় মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছো না কেন? কেন এমন করছো তোমরা? আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো।”

শ্রাবণ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,“নিয়ে যাবো তার আগে কথা দাও আমার কথা শুনবে, এভাবে কাঁদবে না।”

দম বন্ধ হয়ে আসছে অনুভার। মায়ের কাফনে জড়ানো মুখটা ভেসে উঠছে আঁখি পটে। কী করে থামাবে এই অশ্রুজল? তবুও মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে সায় জানিয়ে বললো,“উহু কাঁদবো না আমি। নিয়ে চলো।”

আর দেরি করল না শ্রাবণ। হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে অনুভাকে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসলো। ড্রাইভারকে ঠিকানা বলতেই ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিলো। ঠিকানাটা কর্ণগোচর হতেই স্বামীর পানে ভেজা চোখে তাকালো অনুভা। এই চাহনির অর্থদ্বার বুঝতে পারলো শ্রাবণ। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে কপালে, গালে ঠোঁটের উষ্ণ পরশ ছুঁইয়ে মৃদু আওয়াজে বললো, “তোমার বাবার পাশেই মাকে কবর দেওয়া হবে। চাচাতো ভাইয়েরা এসে মায়ের মৃতদেহ এবং আপুকে নিয়ে গেছে ওদের সাথে।”

একটু থেমে আবারো বললো,“হঠাৎ এমন একটি ঘটনা ঘটায় কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এভাবে কাঁদলে কী আর মাকে ফিরে পাওয়া যাবে নোভা? মানুষকে তো মরতে হয় তা তো তুমি জানো।”

“তাই বলে এভাবে কেন চলে যাবে? বাবা যাওয়ার আগেও আমরা সবাই সবকিছু টের পেয়েছি কিন্তু মা? আমাদের তো আর কেউ থাকলো না শ্রাবণ। পুরোপুরি ভাবে এতিম হয়ে গেলাম আমরা।”

সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলো না শ্রাবণ। নিরব রইলো। শুনতে থাকলো স্ত্রীর কান্না। অনুভব করতে লাগলো তার শরীরের কম্পন। মনে মনে শুধু প্রতিজ্ঞা করল,“এটাই তোমার শেষ কান্না নোভা। এরপর আর কখনো তোমার ওই চোখ দিয়ে দুঃখের অশ্রু গড়াতে আমি দিবো না।”

হানিফ শেখ, শান্তা এবং সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরে এসেছে অনেক আগেই। হাতমুখ ধুয়ে পরনের পোশাক বদলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শান্তা। সবিতার কাছে তাঈমকে রেখে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। পথে ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার উপর পেটে কিছু পড়েনি। বসার ঘরে আসতেই ছোটো পুত্রবধূকে সোফায় বসে থাকা অবস্থায় দেখতে পেলেন তিনি। তার পাশেই বসা জাগ্ৰত তাঈম। নিজ দায়িত্বে বাচ্চাটিকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে প্রান্তি। পুত্রবধূর এমন দায়িত্ব জ্ঞান দেখে ভেতরে ভেতরে প্রশান্তি অনুভব করলেন শান্তা।

শাশুড়িকে দৃষ্টিগোচর হতেই হাস্যজ্জ্বল মুখে প্রান্তি বলে উঠলো,“বাবুটা অনেক কিউট আর শান্ত। সেই যে বৌ ভাতের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম। এসেই অনুভা আপুর কোলে ঝাপিয়ে পড়েছিল।”

উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে এসে সোফায় বসেন শান্তা। আফসোসের সুর তুলে বলেন,“মেয়ে দুটোর উপর দিয়ে একটার পর একটা দখল যাচ্ছেই।তাছাড়া বড়ো বউমার জন্য এখন না হয় শ্রাবণ আছে, আমরা আছি কিন্তু অর্থিকা মেয়েটিকে সামলানোর জন্য তো কেউই নেই। এই অল্প বয়সেই বিধবা হলো, শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলোর আসল রূপ দেখলো তারপর বাবাকে হারালো এখন আবার মাও চলে গেলো। আমার না খুব কষ্ট হয় ওর জন্য।”

শাশুড়ির নিকট হতে সবটা শুনে প্রান্তিরও মন ভার হলো। তাঈমকে খাওয়ানো শেষ হতেই সবিতাকে ডেকে এঁটো প্লেটটা নিয়ে যেতে বললো । কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বলে উঠলো,“একটা কথা বলবো মা?”

“হুম বলো।”

“আন্টি মারা গেছেন। উনাদের দুই বোনের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। আপনার কথা অনুযায়ী যা বুঝলাম, আপুর বোন তো বর্তমানে একা। বেচারিকে সামলানোর জন্য সত্যিই কেউ নেই। তার উপর ছোটো বাচ্চা। আচ্ছা উনাকে যদি কিছুদিনের জন্য এখানে রাখা হয়, তাহলে কেমন হয়? একটা পরিবারের মধ্যে থাকলে শোকটা কাটিয়ে উঠতেও সুবিধা হবে। কী বলেন?”

পুত্রবধূর এহেন প্রস্তাবে চমকায়িত দৃষ্টিতে তার পানে তাকান শান্তা। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে মাথা নাড়িয়ে বলেন,“দারুন বলেছো তো। আমার মাথায় কেন এটা এলো না? তুমি বাচ্চাটাকে একটু দেখে রাখো আমি তোমার শ্বশুর মশাইকে জানিয়ে আসি কথাটা।”

বলেই হনহনিয়ে প্রস্থান করলেন শান্তা। যতোই হোক তিনিও তো একজন মা। অন্যের দুঃখে মায়ের মন সর্বদাই কাঁদে। প্রান্তি তাঈমের আঙুল ধরে দাঁড়ালো। বললো,“চলো ঘরে যাই।”

তাঈম তাকালো এই অপরিচিত রমণীটির পানে। মলিন স্বরে বললো,“মায়ের কাথে দাবো।”

তৎক্ষণাৎ তাকে কোলে তুলে নিলো প্রান্তি। ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,“হুম যাবো তো। মায়ের কাছেই যাবো। তার আগে আমরা খেলা করবো, গল্প করবো।”

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে