সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৩৫+৩৬

0
325

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৫]

কামরুল হাসানের কবরের পাশেই সুফিয়াকে কবর দেওয়া হলো। মায়ের লাশ নিয়ে সকলে বাড়ি ত্যাগ করতেই একেবারে নিরব হয়ে গেলো অনুভা। চোখের বর্ষন থেমে গেলো তার। হৃদয় হয়ে গেলো কঠোর। স্ত্রীকে অপরিচিত মানুষদের কাছে রেখেই শাশুড়ির কবরের কাছে গিয়েছিল শ্রাবণ। কবর দেওয়া হতেই সকলের সাথে বাড়ি ফিরে এলো সে। সদর দরজার সম্মুখে বড়ো চাচীর সাথে দেখা হতেই তিনি তাকে দেখিয়ে দিলেন অনুভার অবস্থানরত ঘরটি। তাই আর বিলম্ব না করে সেদিকেই পা বাড়ালো শ্রাবণ। তখনি তাকে মুখোমুখি হতে হলো সেজো চাচা আতিউরের সঙ্গে। লোকটি ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত করে বিদ্রুপের সুরে বললেন,“আমার সন্দেহই তাইলে ঠিক আছিল। কামরুলের মরার দিনই তোমারে দেইখা আমি বুঝছিলাম যে তোমার লগে অনুর সম্পর্ক আছে কিন্তু তুমি তো লগে লগেই তা অস্বীকার করছিলা। অথচ আইজ তোমার লগেই অনুর বিয়া হইলো।”

ভেতরে ভেতরে শ্রাবণ বেশ চিন্তিত এবং ব্যথিত। তবুও ভদ্রলোকের সম্মুখে অধরে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললো,“সম্পর্ক থাকলেই কী সবাইকে ঢাকঢোল পিটিয়ে জানাতে হবে নাকি? তাই বলার প্রয়োজন মনে করিনি।”

“তুমি অনেক চতুর পোলা।”

“তবে আপনাদের মতো অতটাও নই।”

“দেইখা তো তোমারে ভালা পরিবারের পোলাই মনে হয় তাইলে কী দেইখা এই মাইয়ারে বিয়া করলা কও তো? তাগো সব খবর জানো তো? নাকি সবকিছু গোপন রাইখাই হের মায় তোমার উপরে মাইয়ারে চাপাইয়া দিছে?”

“ভাইয়ের মেয়ের সুখ বুঝি সহ্য হচ্ছে না আপনার? তাই সংসার ভাঙার জন্য কানপড়া দিতে চলে এসেছেন?”

এমন একটি কথা যেনো মোটেই আশা করেননি লোকটি। তাই সঙ্গে সঙ্গে চুপসে গেলেন তিনি।মুখশ্রীতে নেমে এলো একঝাঁক তমিস্রা। শ্রাবণ পুনরায় বললো,“আমি সবকিছুই জানি। তাদের পরিবারের সাথে কী হয়েছে, আপনারা কী করেছেন সব জানি। সব জেনেই বিয়ে করেছি। আশা করি মনে আর কোনো সন্দেহ নেই?”

লোকটি দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে লোকটিকে পাশ কাটিয়ে চলে এলো শ্রাবণ। অনুভা বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে চুপচাপ। আজ পুরো এলোমেলো লাগছে মেয়েটিকে। ঘরে আসতেই হিজাবটা খুলে চাচী তার মাথার মধ্যিখানে ঠাণ্ডা তেল লাগিয়ে দিয়েছেন। শ্রাবণ এসে তার সম্মুখে বসলো। পরনের আধ খোলা ওড়নাটা ঠিক করে বুকে জড়িয়ে দিয়ে মুখশ্রীতে অসংখ্য চুমু খেলো। নিজ বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,“আমরা আজই বাড়ি ফিরবো নোভা।”

জোরপূর্বক তার বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার মুখের দিকে তাকালো অনুভা। ভাঙা স্বরে বললো, “মা ওখানে একা। আর আমরা চলে যাবো?”

“মা কোথায় একা? তোমার মায়ের কবরের পাশে তোমার বাবার কবর। তাহলে মা একা কোথায়? তুমি এভাবে কাঁদলে, কষ্ট পেলে অর্থি আপুকে কে সামলাবে বলো তো? এসে থেকে একবারও আপুর সঙ্গে কথা বলেছো? তাছাড়া তোমার মায়ের আত্মাও তো কষ্ট পাবে। বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করো নোভা। যাতে উনারা কবরের আজাব হতে পরিত্রাণ পান।জান্নাতবাসী হন।”

এতক্ষণ বাদে বড়ো বোনের কথা খেয়াল হলো অনুভার। বিছানা থেকে নেমে গেলো সে। শ্রাবণ প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এই মেয়ে যাচ্ছো কোথায়?”

“আপুর কাছে।”—-বলতে বলতেই দরজা দিয়ে কক্ষ হতে বেরিয়ে গেলো অনুভা। শ্রাবণ দেখলো তার যাওয়া কিন্তু বাঁধা দিলো না। এই মুহূর্তে দুই বোন একত্র হওয়া প্রয়োজন।

অর্থিকা পাশের ঘরেই। বড়ো চাচী তার পাশে বসা। অনুভা এসে ভেতরে প্রবেশ করল। বিছানায় এসে চুপচাপ সেও বসলো। তাকালো বড়ো বোনের নির্জীব মুখপানে। এই কষ্টের মধ্যেও শুকনো হাসলো অর্থিকা। হাত রাখলো ছোটো বোনের মাথায়।বললো,“প্রিয় মানুষকে হারিয়ে শোক কাটিয়ে উঠতে না পারা আমি আজ আর কাঁদছি না। অথচ কঠোর হৃদয়ের তুই আজ এতটা দুর্বল হয়ে গেলি রে অনু? মা যে আমাদের কাঁদতে নিষেধ করে গিয়েছে। কষ্ট পাস না। মায়ের জীবনে বাঁচার যতটা ইচ্ছে ছিলো সব ইচ্ছেই বাবা মারা যাওয়ার পর সব বাবার সাথে সাথেই মাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল রে। মা মুক্তি পেয়েছে। একেবারে বাবার কাছে চলে গিয়েছে। আমাদের কাঁদা যে উচিত নয় অনু। মা তো বাবার কাছে চলে গেলো কিন্তু আমি কবে তন্ময়ের কাছে যাবো বল তো? কবে আমার তাঈমটা বড়ো হবে? কবে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে শিখবে? তন্ময়, বাবা তারপর মাও আমায় ছেড়ে চলে গেলো। আমি ভালো নেই অনু আর কখনো হয়তো ভালো থাকতেও পারবো না। বাকি সবার মতো তুই অন্তত আমাকে ছেড়ে যাস না। তুই আর তাঈম ছাড়া যে আমার আর নিজস্ব কোনো মানুষ রইলো না।”

বোনের সংস্পর্শে এসে যেনো ভেতরটা আরো দুর্বল হয়ে পড়ল অনুভার। বুকে জড়িয়ে ধরলো বড়ো বোনকে। নাক টেনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে। বললো,“এভাবে বলিস না আপু। তোদের ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি। কোথাও না।”

অর্থিকার চোখ দিয়েও অনবরত গড়িয়ে পড়ছে পানি। কিন্তু তার কান্নার কোনো শব্দ নেই। গোটা একটা বছর কাঁদতে কাঁদতে যে সে ক্লান্ত।
________

দুপুরের দিকে অর্থিকা এবং অনুভাকে নিয়ে শেখ বাড়িতে এসে পৌঁছালো শ্রাবণ। বোনের শ্বশুরবাড়িতে থাকার কথা যেনো কিছুতেই ভাবতে পারছিল না অর্থিকা। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরেছে। কিন্তু ছোটো বোন আর বোন জামাতার বিভিন্ন কথায় শেষ পর্যন্ত তাকে রাজি হতেই হলো। তাছাড়া তাঈমও তো এখন শেখ বাড়িতেই রয়েছে। খালাকে পেলে তার আর কাউকে প্রয়োজন না হলেও অর্থিকার তো এখন ছেলেকে খুব প্রয়োজন।

শ্রাবণদের বাড়িটি ডুপ্লেক্স। তাই বাড়ির কক্ষের সংখ্যাও কম নয়। যার দরুন বেশিরভাগ কক্ষই খালি পড়ে থাকে। সকালেই সবিতাকে দিয়ে নিচ তলার একটি ঘর পরিষ্কার করিয়েছেন শান্তা। অনেকদিন ধরে ঘরটি বন্ধ থাকায় ধূলো জমেছে অনেক। ভেতরে প্রবেশ করতেই অর্থিকাকে নিজ মেয়ের মতোই সাদরে গ্ৰহণ করলেন শান্তা। তার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায় তাকে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে অনুভার উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলে গেলেন,“চুপচাপ ঘরে গিয়ে গোসল সারবে। সবিতাকে দিয়ে তোমাদের খাবার আমি ঘরেই পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিবে। কোনো অনিয়ম যেনো না হয় বলে দিলাম। আর হ্যাঁ অর্থিকা মায়ের জন্য আমি আছি। তাই বোনের জন্য তোমায় চিন্তা করতে হবে না।”

শাশুড়ির এমন কঠোর কণ্ঠস্বর হতে নিঃসৃত বাক্য শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো অনুভা। চুপচাপ উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো নিজেদের শোবার ঘরের দিকে। শ্রাবণ বাড়িতে প্রবেশ করে তার আগেই চলে গিয়েছিল উপরে।

ঘরে এসে হিজাবটা খুলে নিলো অনুভা।কাবাড থেকে বের করল পরনের জন্য শাড়ি। বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। গোসল করছে শ্রাবণ। কয়েক মিনিট সময় নিয়ে বের হয়ে এলো সে। সে বের হতেই তাকে পাশ কাটিয়ে নিরবে ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা।

অর্থিকাও সবে গোসল সেরে বের হয়েছে। শরীরটা তার ভীষণ হালকা লাগছে। তন্ময়ের মৃ’ত্যুর পর আজ প্রথম নিজের গায়ে শাড়ি জড়িয়েছে মেয়েটা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতেই হতাশার নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। বিছানায় বসা তাঈমের কাছে এগিয়ে গিয়ে হাত রাখলো মাথায়। তাঈম তাকালো মায়ের পানে। তোতলানো শব্দে জিজ্ঞেস করল,“নানু কুতায়?”

দুটো শব্দ যেনো বুকের ভেতর সুঁচের মতো গিয়ে বিধলো অর্থিকার। বললো,“নানু নেই। আকাশের তারা হয়ে গেছে নানু।”

এত এত ভারি কথা বোধগম্য হলো না তাঈমের। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো মায়ের মুখশ্রীতে। খাবারের ট্রে হাতে ভেতরে এলেন শান্তা। অর্থিকাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,“মাশাআল্লাহ তোমরা দু বোনই খুব সুন্দর। সব পোশাকেই দারুন মানিয়ে যায় তোমাদের।”

জোরপূর্বক হাসলো অর্থিকা। শান্তা পুনরায় বললেন,
“তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই মা। এমন ভয়াবহ শোক এর আগেও পার করে এসেছো। সবাই তো আর চিরকাল থাকে না। এই যে আমারও তো একসময় বাবা-মা ছিলো, ভাই-বোনেরা ছিলো। অথচ আজ বাবা-মা এই দুনিয়াতে নেই, ভাই-বোনেরা থেকেও না থাকার মতোই। সবাই নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তাই বলে কী আমি বছরের পর বছর কাটাচ্ছি না? আমার মা যখন মারা যায় তখন আমার ছোটো ছেলে আমার পেটে ছিলো। সে যাক গে, কান্নাকাটি আর একদম করবে না। আমি তো তোমার মায়েরই মতো তাই না? ছোটো বোনের শাশুড়ি ভেবে কিন্তু একদম পর মনে করবে না আমায় বুঝলে?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় অর্থিকা। ভারি কণ্ঠে বলে,
“শ্রাবণের হাতে অনুকে তুলে দিয়ে তবে ভুল করিনি আমি, কী বলেন আন্টি? মেয়েটা এত সুন্দর একটা পরিবার পেলো।আপনার মতো মা পেলো, আঙ্কেলের মতো বাবা পেলো।”

কথাটা শুনেই চট করে একটা আবদার করে বসলেন শান্তা,“তুমিও এখানে থেকে যাও না। ওখানে আর একা একা থেকে কী করবে? তার উপর অফিস করো। সারাদিন তো বাচ্চাটাকে একা থাকতে হবে। এর থেকে এখানে থেকে যাও। বউমাও খুশি হবে।”

প্রস্তাবটি পছন্দ হলো না অর্থিকার। কোমল স্বরে বললো,“এ হয় না আন্টি। দয়া করে এ কথাটা অনুর সামনে অন্তত বলবেন না। দেখা যাবে এ কথা শোনার পর থেকে আমাকে এখানে রাখার জন্য মেয়েটা উঠে পড়ে লাগবে কিন্তু আমি তো এমনটা চাই না। তাঈম বড়ো হচ্ছে তাই ভেবেছি ওকে ভালো একটা ডে কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিবো। অফিস থেকে ফেরার সময় আবার সঙ্গে করে না হয় নিয়ে আসবো।”

“সত্যিই কী হয় না?”

“আপনি, আপনারা খুবই ভালো মনের মানুষ আন্টি। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এত সহজে কথাটা বলতে পারতো না। তাই আপনার জন্য আমার সম্মানটা বড্ড বেড়ে গেলো। তবে সত্যিই এমনটা হয় না। জীবনে থেমে থাকলে তো আর হবে না। বরং অনেক এগিয়ে যেতে হবে। তাই যেভাবে জীবন চলছে চলতে থাকুক।”

“তাহলে কথা দাও প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও ছেলেকে নিয়ে এখানে আসবে।”

ভদ্রমহিলার এই আবদারটি চেয়েও নাকোচ করতে পারলো না অর্থিকা। মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। শান্তাও খুশি হয়ে গেলেন।

টানা আধ ঘণ্টা হলো অনুভা বাথরুমে গোসল করতে ঢুকেছে কিন্তু এখনো বের হওয়ার নাম নেই তার। স্ত্রীর চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে শ্রাবণ। এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো অনুভা। মুখোমুখি হলো স্বামীর। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“সমস্যা কী? টোকা দিচ্ছিলে কেন?”

শ্রাবণ চিন্তিত স্বরেই বললো,“এতক্ষণ লাগবে কেন গোসল সারতে? কত চিন্তা হচ্ছিল জানো?”

উত্তর দিলো না অনুভা। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় গেলো। ফিরে এলো মিনিট দুয়েক পরে। সবিতা অনেকক্ষণ আগেই খাবার দিয়ে গিয়েছে। শ্রাবণ ট্রে টা বিছানায় এনে দুজনের খাবারটা ঠিকভাবে রাখলো। অনুভা বিরক্ত হলো কিছুটা। বললো,“আমার খুব মাথা ধরেছে। এখন আর খাবো না। তুমি সোফায় যাও না। ওখানকার টেবিলের উপরে রেখে খাও।”

স্ত্রীর কথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না শ্রাবণ। চুপচাপ ভাত মাখাতে লাগলো। ততক্ষণে অনুভা এসে বসেছে বিছানার একপাশে। তখনি শ্রাবণ তার মুখের সামনে এক লোকমা তুলে ধরে বললো,“না খেয়ে কোনো শোয়া নেই। আমি খাইয়ে দিচ্ছি চুপচাপ মুখ খোলো, চিবাও আর গিলে ফেলো। বাড়তি কোনো কথা নয়।”

তার পানে চোখ রাঙিয়ে তাকালো অনুভা। কিন্তু বিশেষ কোনো কাজ হলো না। প্রথম লোকমাটা মুখের ভেতরে ঠুসেই দিলো শ্রাবণ। তাই বাধ্য হয়েই খেতে লাগলো সে। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই এঁটো প্লেট ট্রেতে তুলে নিচে চলে গেলো শ্রাবণ। আর বিলম্ব না করে বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়ল অনুভা। মাথাটা বড্ড ভার লাগছে তার। কান্নাকাটির ফলে শরীরটাও বেশ দুর্বল। শরীর হতে বের হচ্ছে উত্তপ্ততা। হয়তো জ্বর আসতে পারে।
________

রোজকার রুটিন মাফিক আজও বিকেলে হানিফ শেখ বের হয়েছেন বাহিরে। সন্ধ্যে হয়েছে অনেকক্ষণ আগে কিন্তু এখনো উনার ফেরার কোনো নাম গন্ধও নেই। সবিতাকে নিয়ে রোজকার মতো নাস্তা তৈরি করলেন শান্তা। অনুভা সেই যে দুপুরে ঘরে প্রবেশ করেছে তারপর আর নিচে নামেনি। অর্থিকাকে ডেকে ড্রয়িং নিয়ে এলেন তিনি। সেন্টার টেবিলের উপর রাখলেন বাহারি নাস্তা। সৌহার্দ্য এবং প্রান্তিও উপস্থিত হয়েছে সেখানে। খেতে খেতেই ছোটো খাটো একটা গল্পের আসর বসে গেলো সেখানে। বড়ো পুত্র এবং পুত্রবধূর জন্য আলাদা ভাবে ট্রে তে নাস্তা দিয়ে সবিতাকে বললেন তাদের ঘরে দিয়ে আসতে। তখনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো শ্রাবণ। পুত্রকে দেখতেই এগিয়ে গিয়ে শান্তা বলে উঠলেন,“এই তো মেহু এসে গেছে। তা বউমা কোথায়? দুপুরের পরে বেশি ঘুমালে তো শরীর খারাপ করবে।”

শ্রাবণ চিন্তিত মুখে উত্তর দিলো,“ঘুমের মধ্যেই ওর জ্বর এসেছে মা। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। পানি পট্টি দেওয়ার পরেও কিছুতেই জ্বর কমছে না। কী করি বলো তো মা?”

“সে কী কথা? জ্বর এসেছে আর তুই আমায় এখন জানাচ্ছিস?”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই বসা থেকে উঠে এলো অর্থিকা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,“মেয়েটা অতিরিক্ত চিন্তা করলে কিংবা সামান্য আঘাত পেলেই খুব জ্বর আসে। ওষুধ খাইয়েছো?”

“না, অনেক ডাকলাম কিন্তু উঠতেই চাইছে না।”

“আমায় একটু নিয়ে চলো না ওর কাছে।”

মাথা নাড়িয়ে আবারো নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়ালো শ্রাবণ। তার পিছুপিছু অর্থিকা আর শান্তাও গেলো। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে অনুভা। জ্বরে ঠোঁটগুলো তার তরতর করে কাঁপছে। অর্থিকা এসে ছোটো বোনের শিয়রে বসলো। হাত রাখলো কপালে এবং গলায়। শান্তা ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,“মাথায় পানি ঢালতে হবে। তুই নিচে যা। আমরা ওর মাথায় পানি ঢালছি।”

অসহায় মুখ করে শ্রাবণ তাকালো মায়ের পানে কিন্তু শান্তার চোখ রাঙানি দেখতেই চুপচাপ চলে গেলো কক্ষের বাহিরে।
_______

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাত যেনো গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। মাঝরাতে গিয়ে জ্বর নেমে গেলো অনুভার। শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। ঘুমটাও চট করে ভেঙে গেলো। বিরক্তের সহিত আড়মোড়া ভেঙে শরীরের কাঁথাটা ফেলে দিয়ে পাশ ফিরতেই ড্রিম লাইটের আলোতে দৃষ্টিগোচর হলো অর্ধ শোয়া শ্রাবণকে। কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে আছে সে। ঘুমিয়ে নাকি জেগে আছে বোঝা যাচ্ছে না তা। রাতের খাবারের সময় হতেই শান্তা চলে গিয়েছিলেন নিচে। ইচ্ছে থাকলেও অর্থিকা আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনি। স্ত্রীর জন্য শ্রাবণের মধ্যে ছটফটানি দেখে ভেতরে ভেতরে প্রসন্ন হয়ে সেও চলে গেছে।

এতটুকু জ্বরেই শরীরটা দুর্বল হয়ে গেছে অনুভার। সময় নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। হাত রাখলো স্বামীর চুলের ভাঁজে। মিহি স্বরে ডাকলো,“শ্রাবণ! এই শ্রাবণ! ঠিক করে শুয়ে ঘুমাও।”

বসে থাকতে থাকতে চোখটা লেগে এসেছিল শ্রাবণের। কারো ডাক আর গভীর স্পর্শেই জেগে উঠলো সে। চোখ মেলে উঠে বসলো। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো,“তুমি আবার উঠে বসলে কেন? জ্বর সেরেছে? দেখি।”

বলেই কপালে, গলায় হাত রেখে পরীক্ষা করল। নাহ পুরো শরীরের তাপমাত্রাই আগের তুলনায় স্বাভাবিক। বিছানা ছেড়ে ঘরের আলো জ্বেলে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার হতে থার্মোমিটার এনে আবারো ভালো করে তাকে পরীক্ষা করল। এবারও তাপমাত্রা স্বাভাবিক। ভেতরে ভেতরে শান্তি পেলো শ্রাবণ। বললো,“জ্বর নামলো তবে। শরীর দুর্বল লাগছে না খুব? দাঁড়াও আমি খাবার নিয়ে আসি। রাতে এত চেষ্টা করলাম কিন্তু তুমি তো খেলেই না।”—–বলেই আবারো উঠতে নিলো শ্রাবণ।

কিন্তু এবার আর তাকে উঠতে দিলো না অনুভা। হাত ধরে টেনে বসিয়ে রাখলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,“কোথাও যাবে না তুমি। এখন আমি কিছুই খাবো না।”

“সবে জ্বর সেরেছে নোভা। কিছু একটা খেয়ে তো ওষুধ খেতে হবে তাই না?”

“বললাম তো খাবো না। এর আগেও এমন জ্বর আমার অনেক এসেছে অথচ কেউ কখনো জানতেও পারেনি। তাই বলে কী মরে গিয়েছি?”

“এসব আবার কেমন কথা?আগে যা হয়েছে হয়েছে। আগের দিনের সঙ্গে এখনকার তুলনা একদম করবে না বুঝলে?”

“আপু আর তাঈম ওরা কোথায়?”

“আপু অনেকক্ষণ ছিলো এখানে, পরে আমিই পাঠিয়ে দিয়েছি ঘরে। এতক্ষণে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা।”

“তুমি খেয়েছো?”

“না।”

মাথা তুলে চাইলো অনুভা। অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে শুধালো,“এত রাত হয়ে গেছে অথচ খাওনি এখনো?”

“তুমিও তো খাওনি।”

“সিরিয়াসলি শ্রাবণ তোমার এসব কাণ্ড কারখানা দেখলে যে কেউ বলে দিবে তুমি যে একটা বউ পাগলা ছেলে। বয়স্ক মানুষ থাকলে এটাও বলবে যে নিশ্চয়ই ছেলেটার বউ তাকে কালোজাদু করেছে।”

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। বললো,“কালোজাদু না করলেও জাদু তো করেছোই নোভা। বিয়ের আগেই বলেছিলাম আমি যে বউ পাগলা হবো।”

তার বুকের মধ্যে মজার ছলে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে উঠে গেলো অনুভা। বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,“ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি। খিদে পেয়েছে খাবার নিয়ে এসো।”

স্ত্রীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে অধরে হাসি রেখেই ঘর থেকে বের হলো শ্রাবণ। গন্তব্য রান্নাঘর।

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৬]

বোনের শ্বশুরবাড়িতে দুদিন থেকেই ছেলেকে নিয়ে নিজ ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছে অর্থিকা। আসার আগে মাজেদাকে কল করে কাজে ফেরার কথাও জানিয়ে দিয়েছে। মায়ের ঘরটা খালি পড়ে আছে। ফ্ল্যাটের তিন তিনটে ঘরের মধ্যে দুটো ঘরই এখন ফাঁকা। মানুষ শূন্য। অথচ সময় ঠিকই তার গতিতে বয়ে চলেছে। কারো জন্য নেই তার কোনো অপেক্ষা। জানালা দিয়ে আকাশের পানে তাকায় অর্থিকা। ভাবে কতকিছু। দুনিয়ার পেছনে ছুটে, সুখের সন্ধান করে যেনো কোনো লাভ নেই। একসময় না একসময় ওই কবরটাই হবে আমাদের আপন। ওটাই হবে আমাদের গৃহশালা।

মোবাইল হাতে নিয়ে দ্রুত এক পরিচিত কলিগকে কল লাগালো অর্থিকা। কল রিসিভ হতেই কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,“কী খবর নামিরা আপা?”

“এই তো আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কী খবর? শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন?”

“চাইলেই কী আর শোক কাটিয়ে ওঠা যায় আপা?”

“তাও ঠিক। আপন মানুষদের চলে যাওয়ার মতো শোক কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।”

“তা একটা হেল্প করতে পারবেন আপা?”

“কী হেল্প? পারলে অবশ্যই চেষ্টা করবো।”

“আমার ডাবল রুমের ছোটো খাটো একটা ফ্ল্যাটের প্রয়োজন। যদি আপনার সন্ধানে থাকে আরকি।”

“এখন যেখানে থাকছেন ওখানে কোনো অসুবিধা নাকি?”

“এই ফ্ল্যাটটা তিন রুমের। বেশ বড়োও। এতগুলো রুমের ফ্ল্যাট দিয়ে আমি আর এখন কী করবো? অযথা বাড়তি খরচ। তার উপর আমাদের মা-ছেলের ছোট্ট একটা সংসার এখন। তাই দুটো রুমের হলেই হবে।”

“আপনি চাইলেই তো কারো সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকতে পারেন। একটা রুমই তো যথেষ্ট।”

“না আপা, আমার দু রুমের ফ্ল্যাটেরই প্রয়োজন ছিলো। একটা রুম দিয়ে কী হবে? রিলেটিভ এলে থাকবে কোথায়?”

“আচ্ছা, আচ্ছা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি খোঁজ নিয়ে দেখি আমাদের বিল্ডিংয়ের কোনো ফ্ল্যাট খালি আছে কিনা। যদি নাও থাকে তাহলে আপনার ভাইয়ের সঙ্গে না হয় কথা বলবো এই ব্যাপারে।”

“ধন্যবাদ আপা।”

“ধন্যবাদ তুলে রাখুন। আগে ফ্ল্যাটের সন্ধান পাই তারপর নতুন ফ্ল্যাটে নিয়ে কিন্তু চা খাওয়াতে হবে।”

“তা অবশ্যই।”—–বলেই কল কাটলো অর্থিকা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে চাইলেই এই বিল্ডিংয়ের দু তলায় শিফট হতে পারতো। সেখানেও ডাবল রুমের ফাঁকা একটা ফ্ল্যাট পড়ে আছে। কিন্তু এখানে আর সে থাকতে চায় না। চায় না ফায়াজের মুখোমুখি হতে। এতদিনে যে সে জেনে গেছে এটা ফায়াজদেরই বাড়ি। ফায়াজের বাবা এ বাড়ির বাড়িওয়ালা।

ফায়াজের ওই মলিন মুখ, অসহায়ত্ব, করুন স্বর তার কাছেও বড্ড খারাপ লাগে। কষ্ট হয় কিন্তু অর্থিকার জীবনে দ্বিতীয়বার বসন্ত আসার সুযোগ নেই। সে যে সত্যিকারের ভালোবেসেছিল। এক পুরুষে তীব্র থেকে তীব্রতর ভাবে আসক্ত হয়েছিল। মৃ’ত্যুর আগ মুহূর্তেও সেই পুরুষটির প্রণয়মাখা কণ্ঠস্বর শুনেছিল। সেখানে কী করে তাকে ভুলে গিয়ে নতুন করে অন্য পুরুষে আসক্ত হবে? সম্ভব নয়। তার দ্বারা এ সম্ভব নয়। তার জীবনে হারানোর আর কিছু নেই। কোনো চিন্তা নেই। কত নারীই তো আছে যারা সিঙ্গেল মাদার হয়ে একা হাতেই সন্তানকে বড়ো করছে। সেও পারবে। তাছাড়া ছোটো বোন তো আছেই। যে কিনা তার অবর্তমানে ঠিক তাঈমকে আগলে রাখবে। তাই অর্থিকার এই অনিশ্চিত জীবনে আর কোনো চিন্তা নেই। সব দুঃখ কষ্টকে সে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছে।
_______

সায়াহ্নের শেষার্ধ। নীল অম্বর ধারণ করেছে লাল হলুদ মিশ্রিত বর্ণ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে সেদিক পানে তাকিয়ে আছে অনুভা। তখনি পেছনে প্রিয় মানুষটির উপস্থিতি টের পেলো। নাসিকায় এসে বাড়ি খেলো মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ। টবে লাগানো গোলাপ গাছটিতে দুটো বড়ো বড়ো গোলাপ ফোটেছে। সেখান থেকেই একটি গোলাপ ছিঁড়ে প্রিয়তমার কানে গুঁজে দিলো শ্রাবণ। আলগোছে কপোলে চুমু খেয়ে মিহি স্বরে বললো, “আমার কথা ভাবছিলে বুঝি নোভা?”

মুচকি হাসে অনুভা। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ছেলেটির পানে। প্রশ্ন করে,“ছটফটে পাখি আজ এ সময় বাড়িতে যে? কী ব্যাপার?”

“সুন্দরী বউহীনা বাহিরে আর ভালো লাগে না।”

হাসিটা চওড়া হলো অনুভার। একদৃষ্টিতে স্ত্রীর পানে তাকিয়ে আছে শ্রাবণ। খোলা চুলগুলো উড়ছে। পরনে কমলা রঙের জর্জেট শাড়ি। তার এমন ঘোর লাগা দৃষ্টি দেখতেই ভ্রু নাচিয়ে অনুভা শুধালো,“কী দেখো?”

“তোমাকে।”

“বেশি দেখলে পরে আর ভালো লাগবে না। রুচি উঠে যাবে।”

“কিন্তু তুমি তো আমার রুচি নও মেঘফুল।”

“তাহলে?”

“তুমি আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা, অভ্যাস।”

অধরে হাসি রেখেই দৃষ্টি আবারো অম্বরে স্থির করল অনুভা। তার এই নিরবতা যেনো মোটেও পছন্দ হলো না শ্রাবণের। ডান বাহু শক্ত করে ধরে নিজের দিকে তাকে ঘুরালো। অনুভা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কী?”

উত্তর দিলো না শ্রাবণ। মৃদু হেসে আরেক হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজলো গলায়। চমকালো অনুভা। এই ছেলেটার হুটহাট প্রেমময়ী স্পর্শ তাকে লজ্জায় ফেলে দেয়।একঝাঁক জড়তা নিয়ে অগোছালো বাক্যে বললো,“করছো কী? ছাড়ো। সন্ধ্যে নেমেছে। আজান পড়ে যাবে।”

গাঢ় চুম্বন এঁকে গলার একপাশে জোরে কামড় বসিয়ে দিয়ে তাকে ছেড়ে দিলো শ্রাবণ। ব্যথায় আহ সূচক শব্দ করে উঠলো অনুভা। ক্রোধ নিয়ে বললো, “কী হলো এটা?”

“লাভ বাইট।”

“দিনদিন তুমি না!”

“কী আমি? এখন সন্ধ্যা না থাকলে দ্বিতীয় বাসরটা সেরেই ফেলতাম। ব্যাপার না, সারারাত তো পড়েই আছে।”—-কথাটা শেষ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো শ্রাবণ।

তার পিছু নিলো অনুভা। রাগত স্বরে বলতে লাগলো,
“খাটাস একটা। তোমার ভেতরে এতটা লুচ্চামি ছিলো তা আগে জানলে কখনোই।”

পথিমধ্যে থেমে গিয়ে পিছু ফিরে তাকালো শ্রাবণ। উৎসুক কণ্ঠে বললো,“কী করতে? বিয়ে করতে না বুঝি?”

“উহু জীবনেও না।”

“এত আদর যত্ন করি তাও নাকি মেয়ের ভালো লাগে না। এমন লয়্যাল, সুন্দর জামাই কজনের কপালে জোটে বলো তো?”

“আসছে লয়্যাল, তোমার ভেতরের খবর তো আমি জানি। বাহিরে যেই হাবাগোবা ভালো মানুষ সেজে থাকো কে তোমায় পছন্দ করবে?”

“তুমি জানো, ভার্সিটির মেয়েগুলো আমায় কতটা পছন্দ করে? ক্লাস নেওয়ার সময় হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। একবার তো একটা মেয়ে জোঁকের মতো পেছনে লেগে ছিলো। যদিও মেয়েটা দেখতে সুন্দর ছিলো, শুধু তোমায় ভালোবাসি বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রিজেক্ট করে দিয়েছি।”

চোখমুখ কুঁচকে তার পানে তাকিয়ে রইলো অনুভা। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে সে। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“কবেকার ঘটনা এটা?”

“গত বছরের, তখন আমি বিয়ের জন্য তোমার পিছুপিছু ঘুরছিলাম।”

কথা শেষ হতে না হতেই তার দিকে থুতু ছিটাতে লাগলো অনুভা। তার এহেন কাণ্ডে ভড়কে গেলো শ্রাবণ। চোখমুখ কুঁচকে বললো,“ছ্যাহ! কী করছো এসব? নাতী-নাতনীদের নোংরা দাদী।”

“মানুষের দৃষ্টি ভালো না। দেখা গেলো তাদের দৃষ্টির মাধ্যমেই তোমার উপর নজর লেগে গেলো। তখন কী হবে? এই সুন্দর রূপের তো বারোটা বেজে যাবে।”

“তাই বলে থুতু?”

“হুম ছোটো বেলায় আমাদের দুই বোনকে নানু দিয়ে দিতো। তা তুমি মুখটাকে অমন করে রেখেছো কেন? সুযোগ পেলে তো ঠিকই ঠোঁটের মধ্যে এসে…”

বাকি কথাটুকু আর শেষ করা হলো না অনুভার। শ্রাবণের অদ্ভুত চাহনি দেখতেই থেমে গেলো। বসা থেকে উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,“সত্যি কথার ভাত নেই দুনিয়াতে।”

হাসলো শ্রাবণ। পেছন থেকে বলে উঠলো,“ভাত নেই তো কী হয়েছে সত্যবাদী মহাশয়া? আমি তো আছি। ভাতের বদলে আমায় খাও।”

“অসভ্য।”—–বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো অনুভা। ছেলেটার উপর ভরসা নেই তার। কখন কী করে তাকে লজ্জায় ফেলে দেয় কে জানে?
__________

হাসপাতালের করিডোরে চিন্তিত ভঙিতে পাইচারি করছে নাহিয়ান। কুলসুম সেখানকার বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসে আছেন। উনার পাশে তমার বাবা-মাও বসা। অপেক্ষা আর চিন্তার প্রহর যেনো কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। একসময় মায়ের পাশের চেয়ারটা দখল করে বসে পড়ল নাহিয়ান। ছেলের মাথায় হাত রাখলেন কুলসুম। আশ্বস্ত করে বললেন,“আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। যা হবে ভালো হবে।”

মায়ের কথায় বুক থেকে যেনো চিন্তার ভার কিছুটা কমলো তার। সময় পেরোতে লাগলো। হঠাৎ করেই ও.টি থেকে ভেসে এলো সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া এক শিশুর ক্রন্দনরত ধ্বনি। তমার পিতা দু হাত উঁচু করে মোনাজাত ধরে বলে উঠলেন,“আলহামদুলিল্লাহ।”

তার কয়েক মিনিট বাদেই শুভ্র তোয়ালেতে প্যাঁচানো এক বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে এলো নার্স। কুলসুমের তাড়া খেয়ে দ্রুত হাত ধুয়ে এলো নাহিয়ান। নার্সের থেকে বাচ্চাটি নিয়ে ছেলের কোলে তুলে দিলেন কুলসুম। নির্নিমেষ বাচ্চাটির পানে তাকিয়ে রইলো নাহিয়ান। কী নিষ্পাপ তার মুখশ্রী! একদম মায়ের গায়ের রঙ এবং মায়াবী দুটো চোখ পেয়েছে শিশুটি। চোখ জোড়া ঘোলাটে হয়ে গেলো নাহিয়ানের। কুলসুম হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন,“তুই তো এক ছেলের বাপ হয়ে গেছিস রে!”

চোখে পানি রেখেই মায়ের কথায় হেসে উঠলো নাহিয়ান। কুলসুম পুনরায় বললেন,“একটা সময় ঠিক তোর এই জায়গাটায় তোর বাবা ছিলেন। আর এই শিশুটির জায়গায় ছিলি তুই। আহা সময় কত দ্রুত চলে যায়! সেই ছেলে বড়ো হয়ে এখন নিজেও বাবা হয়ে গেলো।”

মায়ের কথায় কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলো নাহিয়ান। শ্বশুরের কথা মোতাবেক আজান দিলো ছেলের কানে। তারপর চলে গেলো স্ত্রীর নিকট। ও.টি থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে তমাকে। জ্ঞানও ফিরে এসেছে। ছোটো ছোটো কদম ফেলে স্ত্রীর সম্মুখে এসে চেয়ার টেনে বসলো নাহিয়ান। তমা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“দেখেছেন আমাদের ছেলেকে?”

“হুম। দেখতে একদম তোমার মতো মায়াবী হয়েছে।”

মিহি হাসলো তমা। বললো,“ছেলে মানুষ মায়াবী হয় নাকি?”

“জানি না তবে ওকে আমার কাছে মায়াবীই মনে হয়েছে।”

পূর্বের হাসিটাই অধরে বজায় আছে তমার। তার বাম হাতটা মুঠো করে সেখানে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে নাহিয়ান বলে উঠলো,“ধন্যবাদ বউ। এতগুলো দিন মাস এত কষ্ট করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে পিতৃ সুখ দেওয়ার জন্য। খুব ভালোবাসি তোমায়। রবের নিকট অসংখ্য শোকরিয়া যে তোমার মতো চমৎকার এক নারীকে আমার সহধর্মিণী এবং সন্তানের মা হিসেবে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তিনি।”

চমৎকার হাসলো তমা। প্রসন্ন চিত্তে বললো,“আমিও রবের নিকট শোকরিয়া আদায় করি যে তিনি আপনার মতো ব্যক্তিত্ববান, যত্নশীল একজন পুরুষের সঙ্গে আমায় জুড়ে দিয়েছেন।”

অজান্তেই হেসে উঠলো নাহিয়ান। হাসির মধ্যেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দুয়েক ফোঁটা অশ্রুজল।
________

অনেক খোঁজ খবর নিয়ে অবশেষে একটা ডে কেয়ার সেন্টারে তাঈমকে ভর্তি করতে পারলো অর্থিকা। ছেলেকে নিয়ে চিন্তা যেনো কমলো তার। অফিসে যাওয়ার পথে সেখানে তাকে দিয়ে যায় আবার অফিস শেষে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। মা-ছেলের ছোট্ট সংসারটা সাচ্ছন্দ্যেই চলে যাচ্ছে।

রাত সাড়ে আটটা। চুলায় রান্না বসিয়ে ছেলেকে পড়তে বসিয়েছে অর্থিকা। ছোটো ছোটো হাতে বই উল্টে পাল্টে দেখছে তাঈম। বর্ণলিপির বইটি খুলে একটি অক্ষর দেখিয়ে তার উদ্দেশ্যে অর্থিকা জিজ্ঞেস করল,“বলো তো এটা কী?”

একবার মায়ের দিকে আরেকবার বইয়ের পানে তাকালো তাঈম। তোতলানো শব্দে উত্তর দিলো,
“সলেও।”

মুচকি হাসলো অর্থিকা। পরের অক্ষর দেখিয়ে ফের শুধালো,“এটা?”

“সলেও।”

এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো অর্থিকা। মায়ের হাসি দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তাঈম। একপর্যায়ে হাসি থামালো অর্থিকা। ছেলের মতো করেই তোতলিয়ে বললো,“সলেও না সলায়া।”

“সলায়া!”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় অর্থিকা।তখনি তার মোবাইলে কল আসে। স্ক্রীনে অনুভার নাম জ্বলজ্বল করছে। কল রিসিভ করতেই অনুভা বলে উঠলো, “হোয়াটসঅ্যাপে আয়। ভিডিও কল দিচ্ছি।”

কথাটা বলেই কল কাটলো সে। অর্থিকা দ্রুত ডাটা অন করল। মিনিট দুয়েক পর ভিডিও কল আসতেই রিসিভ করে সম্মুখে ধরলো। দেখতে পেলো বোনের রাগান্বিত মুখশ্রী। মেয়েটি রেগে থাকলে তার কপাল কুঁচকে থাকে, নাকের ডগায় ঘাম জমে। হাসার চেষ্টা করল অর্থিকা। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তুই কী কোনো কারণে রেগে আছিস অনু? নিশ্চয়ই শ্রাবণের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?”

“ঝগড়া তো ওর সাথে রোজই হয় কিন্তু ওর থেকে কাঙ্ক্ষিত কোনো রেসপন্স না পেয়ে শেষমেশ ঝগড়ার ইতি ঘটাতে হয়।”

“তাহলে রাগটা কার উপর শুনি?”

“তোর উপর।”

“আমার উপর? আমি কী করলাম?”

“তুই নাকি বাড়ি বদলে ফেলবি আবার? এমনকি মাজেদা আপাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিস? কেন? তাঈমকে কে দেখবে?”

“তাঈমকে একটা ডে কেয়ারে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। মাজেদাকে তো আমরা রেখেছিলাম বিশেষ করে ঘরের কাজকর্ম করা, মাকেসহ তাঈমকে দেখাশোনার জন্য। কিন্তু এখন তো আর মা নেই। তাঈম বড়ো হচ্ছে। আমি ওকে সময় দিতে পারি না তবে লেখাপড়া তো শিখতে হবে বল? তাই ডে কেয়ারে ভর্তি করেছি। ওখানেই আরো অনেক বাচ্চা আছে, বাচ্চাদের সুন্দর করে হাতের লেখা শেখানো হয় বেসিক লেখাপড়া শেখানো হয়। আর ফ্ল্যাট বদলে ফেলার কারণ হচ্ছে এখানে তিনটা রুম। মা নেই, তার উপর তুইও তো তোর শ্বশুরবাড়ি। তাই ভাবলাম বাড়ি বদলে ফেলে ডাবল রুমের ছোটো খাটো একটা ফ্ল্যাট নিতে। অযথা এত খরচের প্রয়োজন আছে?”

রাগ এবার কমলো অনুভার। মলিন স্বরে বললো,
“তোর খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাই না রে আপু?”

“দূর বোকা মেয়ে কষ্ট হবে কেন?”

“অনেক কারণেই হবে। যাই হোক কাল আমার একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। দোয়া করিস।”

ভ্রু কুঁচকে নিলো অর্থিকা। জিজ্ঞেস করল,“চাকরির ইন্টারভিউ! তুই চাকরি করবি?”

“হুম করবো, শ্রাবণকে বলেছি ওর কোনো আপত্তি নেই। ওর বাবা-মায়ের সঙ্গেও ও এ বিষয়ে কথা বলবে বলেছে।”

অর্থিকার চোখেমুখে যেনো কঠোরত্ব ছাপিয়ে গেলো। কড়া গলায় শাসনের সুরে বললো,“কোনো ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই তোর। বিয়ে হয়েছে এবার মন দিয়ে সংসার কর। চাকরি বাকরি, খাটাখাটুনি অনেক হয়েছে আর নয়।”

“চাকরি করলে সমস্যা কোথায়? আমার তো কোনো সমস্যা নেই। শ্রাবণেরও নেই।”

“শ্রাবণের যে নেই কে বলেছে? শ্রাবণ নিজে? এসব বাদ দিয়ে স্বামী নিয়ে ঘর সংসার কর, পুরোটা সময় তাদের দে। তোর চাকরি করার কী প্রয়োজন? এমন তো নয় যে শ্বশুর বাড়ি ভালো নয় কিংবা স্বামী ঠিকমতো হাতখরচ দিচ্ছে না ভরণপোষণ দিচ্ছে না।”

“কিন্তু আপু?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্থিকা। নরম স্বরে বলে,“আমি ভালো আছি অনু। যা বেতন পাই তা দিয়ে মা-ছেলের আরামসে দিন কেটে যাচ্ছে। তাই আমাকে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। এবার নিজেকে নিয়ে একটু ভাব।”

মন খারাপ হলো অনুভার। মুখ গোমড়া করে বসে রইলো ক্যামেরার সম্মুখে। বোনের মন খারাপ বুঝতে পেরেই মুচকি হাসলো অর্থিকা। বললো,“মন খারাপ কেন করছিস? তুই একা যদি বাবা-মা, আমি, তাঈমসহ পুরো সংসারটা চালাতে পারিস তাহলে আমি শুধু নিজের ছেলের খরচ চালাতে পারবো না?”

“আমি অমন করে ভেবে কিছু বলিনি।”

“আমি জানি। তুই আমার চিন্তা, কষ্ট কমাতে চাইছিস তাই তো? বিশ্বাস কর আমার আর কোনো চিন্তা নেই, কষ্ট নেই। বাবা-মা এখন আর নেই। আমরা এতিম। তোর একটা সুন্দর সংসার হয়েছে। আর রইলো বাকি তাঈম? ওর জন্য আমি আছি, তুই আছিস। কী আছিস না?”

উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে অনুভা উত্তর দেয়,“হু।”

অধরের হাসিটা চওড়া হয় অর্থিকার। তখনি তার হাত থেকে মোবাইলটা টেনে নেয় তাঈম। স্ক্রীনে অতি পরিচিত মুখটি দেখতেই তার চঞ্চলতা বৃদ্ধি পায়। তোতলানো এলোমেলো বাক্যে বলতে শুরু করে সারাদিনে তার করা কাজগুলো। অনুভা মনোযোগ দিয়ে শোনে সেসব কথা। মাঝেমধ্যে হেসে ওঠে।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে