Saturday, July 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 351



সুখেরও সন্ধানে পর্ব-২৭+২৮

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৭]

সাড়ে নয়টা বাজতেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল শ্রাবণ। ড্রয়িং রুমে পা ফেলতেই দেখা মিললো সোফায় বসে থাকা মায়ের। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,“খেতে দাও মা। একেবারে খেয়েদেয়ে তারপর ঘরে যাই।”

পুত্রের কথায় বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না শান্তা। ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,“পারবো না। ঘরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে নিজে নিয়ে খা।”

হঠাৎ মায়ের এমন আচরণে চমকায় সে। শুধায়, “তোমার আবার কী হলো?”

“কী হবে?”

“তাহলে এভাবে বললে কেন?”

“ভালো করেই তো বলেছি। কোনো নিয়ম-কানুনের বালাই নেই। বাহির থেকে এসেই মা খাবার দাও! ফ্রেশ হওয়ার আগে কোনো খাবার নেই, ঘরে যা।”

“তোমার গায়েও বাবার বাতাস লেগেছে মনে হচ্ছে?”

পুত্রের কথায় চোখ পাকিয়ে তাকালেন শান্তা। মায়ের চাহনিতে আর কথা বাড়ায় না শ্রাবণ। গুণগুণ আওয়াজে ঠোঁটের আগায় গান তুলে পা বাড়ায় নিজ কক্ষের দিকে। হাতঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে চলে গেলো পরনের পোশাক বদলাতে। তার কয়েক মিনিট অতিক্রম হতেই তোয়ালে হাতে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে।

সম্মুখে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো একজন শাড়ি পরিহিত রমণীকে। মেয়েটি দরজার দিকে সোজা হেঁটে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো শ্রাবণের। ললাটে সরু কয়েকটা ভাঁজের উৎপত্তি ঘটলো। পেছন অংশ দেখেই অতি সহজে যেনো চিনে ফেললো রমণীটিকে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,“নোভা!”

পা জোড়া থেমে গেলো অনুভার। পেছন ফিরে তাকাতেই মিলিত হলো দু জোড়া দৃষ্টির। শুকনো ঢোক গিললো শ্রাবণ। পল্লব ঝাপটালো বেশ কয়েকবার। ঠিক দেখছে তো সে? এ কী সত্যিই অনুভা? তার সম্মুখে অনুভা দাঁড়িয়ে আছে? কিন্তু এ কী করে সম্ভব?

এই মুহূর্তে নতুন বধূর ন্যায় স্বামীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে লজ্জায় অনুভার লাল নীল বর্ণ ধারণ করা উচিত তবে তা যেনো তার জন্য খাটলো না। ভেতরে ভেতরে সে ক্ষীপ্ত। বিরক্তির সহিত শুধালো,“হা করে তাকিয়ে আছো কেন? কখনো দেখোনি?”

“তুমি কী সত্যিই এখানে দাঁড়িয়ে আছো নোভা?”

“কই না তো, নিশ্চয়ই তুমি কল্পনা দেখছো।”–কথাটা বলেই নিরস মুখে বিছানায় এসে বসলো অনুভা। এতক্ষণ সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। সেখান থেকে শাশুড়ির কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দরজার দিকে এগোলেও এখন আর গেলো না।

পূর্বের স্থানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাবণ। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে যেনো কষ্ট হচ্ছে তার। অনুভা! ও এখানে এলো কোত্থেকে? আচ্ছা হুটহাট যেখানে সেখানে মেয়েটাকে দেখার অসুখ হলো নাকি তার? মাথা দুদিকে ঝাঁকিয়ে বিছানার আরেক পাশে বসে পড়ল শ্রাবণ। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তুমি এখানে কী করে নোভা? কখন এলে?”

“এইতো সাতটা সাড়ে সাতটা নাগাদ।”

“হঠাৎ এখানে এলে? কীভাবে কী?”

“তোমার নাকি একা থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে? তাই তোমার বাবা-মা গিয়ে ধরে বেঁধে নিয়ে এলো আমায়। সিরিয়াসলি শ্রাবণ! তুমি এতটা ঠোঁট কাটা স্বভাবের? বিয়ে করতে না করতেই বউ পাগল হয়ে গিয়েছো?”

মনে মনে হাসলো অনুভা। কিন্তু বাহিরে নিজেকে রাখলো যথেষ্ট গম্ভীর। শ্রাবণের ভাবভঙ্গি দেখে তার মনে কী চলছে তা তেমন বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বেচারা যে ঘোরের মধ্যে আছে তা খুব টের পেলো অনুভা। তাকে আরো ঘাবড়ে দিতে বলে উঠলো,“তা কোথায় ছিলে এতক্ষণ?গাড়ি তো তোমার গ্যারেজেই পড়ে আছে, তাহলে? নতুন কাউকে পেয়েছো নাকি? যার সঙ্গে এতক্ষণ টাইম স্পেন্ড করে এলে?”

থতমত খেয়ে গেলো শ্রাবণ। মিনমিনে স্বরে বললো,“কী বলো এসব? আমি তো লেকের কাছাকাছিই ছিলাম।”

“কার সঙ্গে?”

“বন্ধু।”

“সত্যিই বন্ধু নাকি বান্ধবী?”

“তুমি কী আমায় সন্দেহ করছো নোভা?”

“সন্দেহ করা উচিত নয় বলছো?”

“অবশ্যই নয়।”

নিরুত্তর রইলো অনুভা।প্রসঙ্গ বদলালো শ্রাবণ। ক্ষীণ স্বরে বললো,“বাবা-মা যে তোমাকে নিয়ে আসতে যাবে এ প্রসঙ্গে সত্যিই কিছু জানতাম না আমি। ওরা তোমায় জোর করে নিয়ে এসেছে তাই না? তুমি কী রাগ করেছো?”

পূর্ণ দৃষ্টিতে পাশে বসা ছেলেটির পানে তাকায় অনুভা। চোখেমুখে তার অপরাধবোধ বিরাজমান। শুধালো,“রাগলে কী করবে তুমি?”

“রাগ ভাঙাবো।”

“কীভাবে?”

“আদর করে।”

ভড়কে গেলো অনুভা। গম্ভীর মুখে কী করে এসব কথাবার্তা বলতে পারে এই ছেলেটা? দৃষ্টি সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিলো। অস্বস্তি জেঁকে ধরলো তাকে। যা খুব ভালো করেই খেয়াল করল শ্রাবণ। মনে মনে ভারি মজা পেলো। তখনি নিচ থেকে ডাক এলো শান্তার। গলা উঁচিয়ে ডাকছেন,“মেহু এই মেহু!”

“আসছি মা।”—-বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো শ্রাবণ। অনুভার পানে তাকিয়ে বলে গেলো,“মা ডাকছে। তুমি বসো, আমি আসছি।”

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আশেপাশে খুঁজতেই মাকে খাবার টেবিলের সামনে পেয়ে গেলো শ্রাবণ। পুত্রের জন্য খাবার বাড়ছেন শান্তা। তাকে আসতে দেখেই বললেন,“খিদে লেগেছে বলে তখন চেঁচামেচি করলি আর এখন ঘর থেকে বেরই হচ্ছিস না। ব্যাপার কী?”

“তোমরা আমায় না জানিয়েই নোভাকে আনতে চলে গেলে? এটা কী ঠিক করলে মা? জোর করে একটা মেয়েকে অপরিচিত পরিবেশে এনে ফেলা কী উচিত হলো?”

“বেশ করেছি এনেছি। ছেলের বউ থাকতে বাড়িতে একা একা বসে থাকবো কেন?”

“তাই বলে?”

কথার মধ্যিখানেই ছেলেকে থামিয়ে দিলেন শান্তা। ধমকের সুরে বলে উঠলেন,“চুপ থাক তুই। তোর বেশি সমস্যা হলে আমি আমার বউমাকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিবো।তারপর শাশুড়ি বউমা মিলে সারারাত বসে বসে গল্প করবো।”

মায়ের কথায় আঁতকে উঠলো শ্রাবণ।আমতা আমতা করে বললো,“অন্য ঘরে যাওয়ার প্রসঙ্গ কোত্থেকে আসছে? আমার বউ আমার সঙ্গেই থাকবে। তুমিও না মা।”

মুচকি হাসেন শান্তা। বলেন,“এবার খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।”

“দাঁড়াও ওকে ডেকে আনি।”

“আমি আমার বউমাকে খাইয়ে দাইয়েই ঘরে পাঠিয়েছি বুঝলি। এখন তুই খেলে আমি ঘুমাতে যাবো।”

আর কথা বাড়ালো না শ্রাবণ। চুপচাপ বসে পড়ল খেতে।

চাঁদের আলোয় আলোকিত চারিদিক। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনুভা। শ্রাবণের ঘরের এই বারান্দাটা একদম খোলামেলা। বিশাল বড়ো বারান্দার একপাশে সাড়িবদ্ধ কয়েকটা ফুলের গাছ। পরিবেশটা মনোযোগ সহকারে উপভোগে ব্যস্ত অনুভা। তখনি পেছন থেকে কেউ তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। পুরুষালী স্পর্শে কেঁপে উঠলো মেয়েটির দেহ। যা সহাস্যে টের পেলো শ্রাবণ। ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,“আয়হায় নোভা আমি তো তোমায় জড়িয়ে ধরলাম! এবার কী হবে?”

প্রত্যুত্তর করতে পারলো না অনুভা। কণ্ঠনালী তার কাঁপছে। মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে গেছে শব্দমালা। গোপনে, নিঃশব্দে হাসলো শ্রাবণ। হাতের বাঁধন শক্ত করল আরো। আলতো করে চুম্বন এঁকে দিলো স্ত্রীর উন্মুক্ত ঘাড়ে। সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে অনুভার। চটজলদি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে শ্রাবণের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর তার মুখোমুখি ফিরে কোমর ঠেকায় রেলিংয়ে। মুচকি হাসে শ্রাবণ। এগিয়ে গিয়ে রেলিংয়ের হাতলে দু হাত দুদিকে রেখে স্ত্রীকে ফের আবদ্ধ করে নিজের বাহুডোরে। তৎক্ষণাৎ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে অনুভা বলে ওঠে, “একদম অসভ্যতামি করার চেষ্টা করবে না।”

“কী করবে করলে?”

থতমত খেয়ে গেলো অনুভা। আমতা আমতা করে বললো,“কেন করবে? বিয়ে হতে না হতেই অসভ্যতামি করতে হবে কেন?”

“উহু ভুল বললে, বিয়ের আগে করলে তা অসভ্যতামি হতো কিন্তু আমি তো বিয়ের পর করছি তাই এটা হচ্ছে আদর, ভালোবাসা।”

এবারো দমে গেলো অনুভা। খুঁজতে লাগলো যুক্তি। গাঢ় দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শ্রাবণ। পিঠ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো খোলা। মৃদু বাতাসে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে তা। পরনে সবুজ রঙের কাতান শাড়ি। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল। কপালের বাম দিকে দুয়েকটা ছোটো ছোটো পিম্পল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন ধরে যত্ন নেয় না এই সুন্দর মুখশ্রীর। নারী যতই রূপবতী হোক না কেন, নিজের যত্ন না নিলে সেই রূপ কী আর ঝলকময় থাকে? বরং ভাটা পড়ে মলিনতায়।

শখের নারীর এত এত অপূর্ণতায়ও শ্রাবণের চোখ গিয়ে আটকালো মেয়েটির ডান গালের মাঝে ছোট্ট তিল খানার উপর। আচমকা সেখানে গাঢ় চুম্বন বসালো শ্রাবণ। তার এহেন কাণ্ডে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো অনুভা। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো এই অসভ্য ছেলেটির পানে। নিঃশব্দে হাসলো শ্রাবণ। কানের কাছে মুখ নিয়ে অভিযোগের সুরে বললো, “নিজের প্রতি এতটা অযত্ন কেন নোভা? এসব অযত্ন কিন্তু আর চলবে না। আগে যা হয়েছে হয়েছে। আমার কাছে এসব একদম চলবে না। ঠিক আছে?”

শুকনো ঢোক গিলে উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। অধরে হাসি রেখেই দুজনার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে নেয় শ্রাবণ। ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে কোমল স্বরে বলে,“ঘরে এসো। ঘুম পাচ্ছে।”
_______

ভোরের আলো ফোটেছে অনেকক্ষণ আগেই। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে সাতটা বাজতেই তৈরি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে ফ্ল্যাট থেকে বের হলো অর্থিকা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখা মিললো ফায়াজের। বাইকের উপর বসে মাথায় হেলমেট পড়ছে। তাকে পাশ কাটিয়ে গেইটের দিকে পা বাড়াতেই ভেসে এলো পুরুষালী কণ্ঠস্বর,“অফিসে যাচ্ছো নাকি অর্থিকা?”

থামলো অর্থিকা। অধরে সৌজন্য হাসি টেনে উত্তর দিলো,“হ্যাঁ। তুমি?”

“আমিও, এত সকালে তো সহজে রিক্সা পাওয়া যায় না তাহলে যাবে কী করে?”

“একটু হাঁটলেই পাওয়া যাবে।”

“এত কষ্ট করার কী প্রয়োজন? এসো, আজ আমি বরং তোমায় লিফট দেই।”

“তার প্রয়োজন নেই, আমি রিক্সা করেই চলে যেতে পারবো।”

“কেন আমার সঙ্গে গেলে কী খুব অসুবিধে হবে?”

অসুবিধে অবশ্যই হবে।পর পুরুষের বাইকে কিছুতেই উঠতে চায় না অর্থিকা। তবে মনের কথা মনের ভেতরে গোপন রেখেই বললো,“তেমন কিছু না। আসছি আমি।”

আর বিলম্ব না করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল সে। তার যাওয়ার পানে দৃষ্টি স্থির রেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাইকে স্টার্ট দিলো ফায়াজ। বাইকে কিছু সমস্যা হওয়ার কারণে তা গ্যারেজে দিয়ে এসেছিল সপ্তাহ খানেক আগে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেখান থেকে আর আনাই হচ্ছিল না। তবে গতকাল রাতে গিয়েই বাইকটা বাড়ি নিয়ে এসেছে ফায়াজ। বাইক ছাড়া যাতায়াতে যে খুব সমস্যা হয় তার।

সকালের নাস্তার পাট চুকিয়ে আবারো রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন শান্তা।অনুভা এসে দাঁড়ালো রান্নাঘরের দোরগোড়ায়। কিয়ৎক্ষণ শাশুড়িকে পর্যবেক্ষণ করে শুধালো,“এই সময়ে আবার রান্না করছেন যে মা?”

হাতের কাজ করতে করতেই শান্তা উত্তর দিলেন,“আজ বাড়িতে তোমার খালা শাশুড়ি আর তার পুরো পরিবার আসছে। প্রায় এক বছর পর তারা আসতে চলেছে এ বাড়িতে, একটু আয়োজন না করলে কী হয় মা?”

মৃদু হেসে শাশুড়ির পাশে এসে দাঁড়ায় অনুভা। কোমল স্বরে বলে,“কী করতে হবে বলুন। আমিও আপনাকে হেল্প করি।”

“করবে? করো তবে।”—সায় জানালেন শান্তা। মনে মনে বেশ তৃপ্তও হলেন বটে। যাক অবশেষে পুত্রবধূ তো পেলেন তিনি।

আজ ক্লাস না থাকায় বাড়িতেই রয়ে গেলো শ্রাবণ। নাস্তা সেরে ঘরে এসে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে সে। হানিফ শেখ পুত্রের কক্ষের সামনে এসে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলেন।সোজা হয়ে বসলো শ্রাবণ। অনুমতি দিতেই ভেতরে প্রবেশ করলেন হানিফ শেখ। সচরাচর পুত্রের ঘরে আসেন না তিনি। তাই উনাকে দেখে খানিকটা চমকালো শ্রাবণ।

হানিফ শেখ এসে বসলেন সিঙ্গেল সোফাটায়। সতর্ক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,“শুনেছিস বাড়িতে যে আজ তোর খালা আসবে?”

“কই না তো।”

“না শোনারই কথা, বাড়ির খোঁজ খবর তো আর রাখিস না। যাই হোক তোর খালা কিন্তু একা নয় বরং তার পুরো গোষ্ঠী সঙ্গে নিয়ে আসছে।”

“ওহ, তা হঠাৎ করে?”

“হঠাৎ না, প্লান করেই আসছে। তোর মা তো আবার ভাই-বোন অন্ত প্রাণ। তাই তার বোনের কাছে আগে ভাগেই সবকিছু বলে দেয়। তোর বিয়ের কথাটাও বলে দিয়েছে এমনকি তোর বউকে যে বাড়িতে নিয়ে এসেছে সেটাও রুবির বুদ্ধিতেই। যদিও ব্যাপারটা আমি গতকাল রাতে ধরতে পেরেছিলাম।”

শ্রাবণ নিরুত্তর। কথাটা শুনেই কিছু একটা ভাবতে বসেছে। হানিফ শেখ পুনরায় বললেন,“তোর মামা- খালাদের স্বভাব তো আবার ভালো না। অন্যের ভুল আর খুঁত টেনে টেনে বের করে সমালোচনা করা তাদের স্বভাব। তাই ওরা এলে বউমার সাথে সাথে থাকবি। আসছে যখন বলা তো যায় না কখন কী বলে কষ্ট দিয়ে ফেলে মেয়েটাকে।”

“আমারও ব্যাপারটা অতো সুবিধার মনে হচ্ছে না। নইলে যে সারা বছরেও ব্যস্ততার কারণে বোনকে দেখতে আসতে পারে না সে কিনা হুট করেই চলে আসবে? বৌ ভাতের সময় এলেই তো দেখতে পাবে বউকে তাই না?”

হানিফ শেখ এবার কণ্ঠ আরো নিচু করে বললেন,
“তোর মা তোর খালার জায়ের মেয়েকে পছন্দ হয়েছে বলেছিল না? ওই যে মেয়েটা? যাকে তোর সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল।”

“হ্যাঁ, সে আবার কী করল?”

“সে কিছুই করেনি।করেছে তোর খালা। তোর মায়ের ব্রেইন ওয়াশ করে নিজের জায়ের মেয়েকে তোর ঘাড়ে গছাতে চেয়েছে। তোর মাকে তো চিনিসই। বোন যা বলবে তাই বিশ্বাস করে নিবে। তাই ওরা এলেই অনুভা মাকে কিন্তু একা ওদের সামনে ছাড়বি না। কে জানে কখন কী হয়?”

“চিন্তা করো না। এইদিকটা আমি সামলে নিবো।”

“এটা জানাতেই এসেছিলাম। কী যেনো করছিলি কর, আমি যাই এক কাপ চা খেয়ে আসি।”

বলেই বসা থেকে উঠে গেলেন হানিফ শেখ। প্রস্থান করার জন্য কয়েক পা এগোতেই পিছু ডেকে প্রশ্ন করল শ্রাবণ,“সহু কবে ফিরবে বাবা? বলেছে কিছু?”

“জিজ্ঞেস করে নে।”

“ওর অনুপস্থিতিতে বিয়ে করে নিয়েছি বলে রাগ করে আছে। কল ধরছে না।”

নিঃশব্দে হেসে পুত্রের কক্ষ ত্যাগ করলেন হানিফ শেখ। এই দুই ভাইয়ের মধ্যে দুদিন পরপরই মান অভিমান লেগে থাকে। আবার হুট করেই একসঙ্গে মিলে যায় তারা। তবুও হানিফ শেখ খুশি। যেই যুগে ভাই ভাইয়ের মধ্যে সহজে মিলমেশ থাকে না সেখানে উনার ছেলে দুটো তো আলাদা। একেবারে ভাই অন্ত প্রাণ যেনো। সারাটা জীবন তারা এভাবে মিলেমিশে থাকলেই হলো।

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৮]

শাশুড়ির সঙ্গে দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করে ঘরে এলো অনুভা। আসার পথে নতুন শাড়ি আর গহনার বাক্স পুত্রবধূর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন শান্তা। ঘরে এসে বিছানার উপর বাক্সগুলো রেখে শাড়িটা নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করল অনুভা। সোফায় বসে স্ত্রীর সম্পূর্ণ কাজকর্ম আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করে আবারো মোবাইলের স্ক্রীনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল শ্রাবণ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গোসল সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো অনুভা। চুলে আধভেজা তোয়ালে জড়ানো। শাড়ির আঁচলটাও বেশ এলোমেলো তার। আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কুচি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়েটি। উন্মুক্ত ঘাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু পানি। ব্লাউজের কিছু অংশও ইতোমধ্যে ভিজে গেছে। কুচি ঠিক করে আয়নায় চোখ রাখতেই দৃষ্টিগোচর হলো শ্রাবণকে। একদৃষ্টিতে ছেলেটি তাকিয়ে আছে তার পানে। ঘোর লাগা দৃষ্টি। দৃষ্টির অর্থ আঁচ করতে পেরেই মিইয়ে গেলো অনুভা। রক্ত শূণ্য হয়ে উঠলো ওষ্ঠদ্বয়।জিভ দিয়ে ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“হা করে তাকিয়ে আছো কেন? আগে কখনো দেখোনি আমায়?”

নিঃশব্দে হাসলো শ্রাবণ। বসা থেকে উঠে এগিয়ে এলো স্ত্রীর অতি নিকটে।বাহু ধরে তাকে ঘুরিয়ে নিলো নিজের দিকে। নেশালো কণ্ঠে বললো,“দেখেছি তবে এমন রূপে আগে কখনো দেখা হয়নি। নিজেকে কন্ট্রোল করা তো রীতিমতো অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে নোভা। কী করি বলো তো?”

হৃদস্পন্দন যেনো বেড়ে গেলো অনুভার। গলা শুকিয়ে আসছে বারংবার। তার লাজে রাঙা মুখটি দেখে কোমর জড়িয়ে ধরলো শ্রাবণ। টেনে নিলো নিজের অতি নিকটে। মুখ ডুবালো উন্মুক্ত গলায়। শুষে নিলো বিন্দু বিন্দু পানি। শ্বাসরোধ হয়ে এলো অনুভার। খিচ মেরে বন্ধ করে নিলো নিজের আঁখি যুগল। স্ত্রীর মুখপানে চাইলো শ্রাবণ। অধর প্রশস্ত হলো। কী মোহনীয়ই না লাগছে মেয়েটিকে! নিজেকে জোরপূর্বক সামলে নিয়ে সরে এলো স্ত্রীর নিকট হতে। সৃষ্টি করল দুজনার মধ্যকার দূরত্ব।

ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাবণ। অনুভা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো সম্মুখে। তৎক্ষণাৎ মিলিত হলো দুজনার দৃষ্টি। শ্রাবণ শব্দ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,“তুমি তো ভারি লজ্জাবতী নারী নোভা! এমন করে লজ্জা পেলে কী চলবে? সঠিক সময়ে আমাদের বিয়ে হলে দেখা যেতো একটা বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে আরেকটা তোমার গর্ভে। ডাউনলোড হবে হবে ভাব। সেখানে বিয়ে হলো কিনা এই সেদিন। তার উপর রোমান্টিক মোমেন্টে এত লাজ আর কাঁপা কাঁপি! তোমাকে নিয়ে আমি আর পারি না মেয়ে।”

শেষের কথাটা আফসোসের সুরে বলে কাবাডের কাছে চলে গেলো শ্রাবণ। কাবাডের দরজা খুলে ড্রয়ার থেকে সাদা কাগজের একটি খাম বের করে আবারো এগিয়ে এলো অনুভার নিকট। খামটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো অনুভার। তার মুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে মুচকি হাসে শ্রাবণ। জিজ্ঞেস করে,“ধরছো না কেন?”

খামটি ধরলো অনুভা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খামটি দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কী আছে এতে?”

“তোমার দেনমোহরের টাকা। দেনমোহর পরিশোধ না করে স্ত্রীকে ছোঁয়া তো আবার বৈধ নয়। তাই পুরোটা পরিশোধ করে দিলাম। রোমান্সে আমি কোনো বাঁধা চাই না নোভা। ”—-বলেই পূর্বের স্থানে গিয়ে বসলো শ্রাবণ।

অনুভা এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই। তার বিষ্মিত মুখায়ব দেখে ভেতরে ভেতরে বেশ আনন্দ পেলো শ্রাবণ। তাড়া দিয়ে ফের বললো,“এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? সামান্য চুমুই তো খেলাম তার রিয়েকশন এখনো কাটেনি?বাকি স্টেপগুলো প্রয়োগ করতে গেলে যে তোমার কী হবে? যাও যাও দ্রুত চুল মুছে শুকিয়ে নাও। ঠাণ্ডা লেগে যাবে নইলে।”

লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে কি অবলীলায় একের পর এক লজ্জা নামক বাণ মেয়েটির দিকে ছুঁড়ে মারছে এই ছেলেটা! মুহূর্তেই খুব আফসোস হলো অনুভার। মনে মনে বললো,“হে রব আমায় কেন এর মতো একটু নির্লজ্জ বানালে না তুমি? নির্লজ্জ না হলে এর সঙ্গে তো সংসার করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে যাবে!”

কলিং বেল বাজার শব্দ হতেই হেল্পিং হ্যান্ড মেয়েটি সদর দরজা খুলে দিলো। বেশ কয়েক বছর এখানে কাজ করার দরুন দরজার অপরপাশের মানুষ গুলোকে চিনতে অতটা অসুবিধে হলো না তার। স্বামী, সন্তান, পুত্রবধূ এবং নাতি নাতনি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন রুবি। উনারা সকলে সোফায় বসতেই হানিফ শেখ এবং শান্তার আগমন ঘটলো সেখানে। রুবি এবং উনার স্বামী আকরাম হোসেন একসঙ্গে সালাম দিলেন তাদের। সালামের জবাব নিয়ে হানিফ শেখ এবং শান্তা বসলেন সম্মুখ সোফায়।

কথার মধ্যেই রুবি বলে উঠলেন,“শুনলাম শ্রাবণের নাকি বিয়ে দিয়েছেন দুলাভাই? বউও তো নাকি বাড়িতে তুলেছেন? এত কাণ্ড ঘটে গেলো অথচ আমাদের জানানোর প্রয়োজনই মনে করলেন না একবার? সে যাই হোক আপনারা আমাদের পর ভাবতে পারেন কিন্তু আমরা তো আর তা ভাবি না। তাই সবটা জানার পরেও আর বাড়িতে বসে থাকতে পারলাম না।”

হাসলেন হানিফ শেখ। বললেন,“আসলে কাউকেই জানানো হয়নি। তবে সৌহার্দ্য দেশে ফিরলেই ভাবছিলাম দুই ভাইয়ের বৌ ভাতের অনুষ্ঠানটা একেবারে সেরে ফেলতে। তখনি না হয় সবাইকে জানাতাম।”

উনার কথায় যেনো তেমন একটা পাত্তা দিলেন না রুবি। হানিফ শেখ পুনরায় বললেন,“তুমি তো সারা বছরই ব্যস্ত থাকো শালীকা তা ব্যস্ততা কমলো? ও মা আনিকাও দেখি এসেছে! তা তোমার স্বামী কোথায়?সে এলো না কেন?”

রুবির বড়ো মেয়ে আনিকা মৃদু হেসে উত্তর দিলো,“ওর কাজের অনেক চাপ খালু। তাই বাচ্চা দুটোকে নিয়ে আমিই মা-বাবার সঙ্গে চলে এলাম।”

“ওহ, তা ঠিক করেছো।”

এত সৌজন্য কথা বিরক্ত লাগছে রুবির নিকট। এবার শান্তার উদ্দেশ্যে বলেই বসলেন,“তা তোমার ছেলে আর ছেলের বউ কোথায় আপা? ডাকো তাদের। নতুন বউকে দেখার জন্যই তো এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এলাম আমরা।”

“দাঁড়া আমি নিয়ে আসি ওকে।”—বলেই পুত্রের কক্ষের দিকে ছুটলেন শান্তা।

অনুভার তৈরি হওয়া শেষ। এখন শুধু হাতে সোনার বালা দুটো পরছে। শ্রাবণ গেছে গোসল সারতে। বাড়িতে থাকলে সবসময়ই ছেলেটার গোসলের অনিয়ম হয়। আজও ব্যতীক্রম কিছু ঘটলো না। দরজায় নক করে শান্তা জিজ্ঞেস করলেন,“বউমা তৈরি হয়েছো?”

শাড়ির কুচি ধরে দ্রুত দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো অনুভা। নত স্বরে উত্তর দিলো,“জ্বি।”

গায়ে ধূসর রঙা শাড়ি। শরীরে সোনার গহনা। পুত্রবধূর এমন রূপ দেখে চমকালেন শান্তা। আনমনে বলে উঠলেন,“মাশাআল্লাহ!”

লজ্জায় আড়ষ্ট হলো অনুভা। নুইয়ে গেলো তার মাথা। মুচকি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন শান্তা। বললেন,“ছেলের আমার পছন্দ আছে। দু দুটো ছেলেই চাঁদ পছন্দ করে এনেছে। তা মেহু কোথায়?”

“মেহু কে?”

“শ্রাবণ।”

“ওহ, ও তো গোসল করছে।”

“আচ্ছা তুমি এসো আমার সাথে। তোমার খালা শাশুড়ি, খালু শ্বশুর নিচে অপেক্ষা করছে।”—বলেই অনুভার মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে নিজের সঙ্গে করে নিচে নিয়ে যেতে লাগলেন শান্তা।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই নিচে এসে পৌঁছালেন শাশুড়ি বৌমা। উৎসুক দৃষ্টিতে অপরিচিত মেয়েটির পানে তাকিয়ে আছেন রুবি। অধরে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে সামনের খালি সোফাটা দেখিয়ে বললেন,“এখানে বসো।”

শান্তা ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসলেন পাশে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জেরা করার ভঙিতে রুবি প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “নাম কী তোমার?”

“অনুভা।”

“আগে পরে কিছু নেই?”

“অনুভা হাসান।”

“কতদূর লেখাপড়া করেছো?”

“স্নাতক।”

“তা বাড়িতে কে কে আছে?”

“মা, বড়ো বোন।”

ভ্রু বাঁকালেন রুবি। কৌতূহল নিয়ে শুধালেন,“বড়ো বোনের কী বিয়ে হয়নি নাকি? শ্বশুর বাড়ি রেখে বাপের বাড়ি কী করে?”

“দুলাভাই মারা গেছেন তাই।”

“ওহ, তা শ্বশুর বাড়ির লোক রাখেনি তাই তো?”

মহিলার কণ্ঠে বিদ্রুপ খেলে গেলো। যা খুব ভালো করেই টের পেলো অনুভা। ভেতরে ভেতরে ক্রুদ্ধ হলো সে। নত মস্তক উঠিয়ে এবার সম্মুখ মহিলার মুখশ্রীর পানে দৃষ্টি স্থির করল। কৃত্রিম হেসে চাপা স্বরে বললো, “তা আমাদের পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেসব বলতে আগ্ৰহী নই।”

কথাটা শুনতেই উপস্থিত সকলে চমকায়। আঁধারে ছেয়ে যায় রুবির মুখশ্রী। খোঁচা মেরে বলেন,“বাহ আপা! তোর পুত্রবধূ দেখি ভালোই কথা বলতে জানে?”

হানিফ শেখ বিপরীতে বললেন,“যা যুগ পড়েছে কথা না জানলে হয় না। তা তুমি এতদূর বয়ে জেরা করতে এসেছো নাকি শালিকা?”—-বলেই শব্দ করে হাসলেন তিনি।

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন রুবি। বড়ো বোনের উদ্দেশ্যে বললেন,“দেখলে আপা? দেখলে? দুলাভাই কীভাবে আমায় খোঁচা মেরে কথা বললেন?”

“এ মা খোঁচা মারবো কেন? আমার শালিকা তুমি। শালিকার সঙ্গে একটু রসিকতা করতে পারবো না?”

দমে গেলেন রুবি। এদিকে শান্তা পড়লেন বিপাকে। কার পক্ষে কথা বলা উচিত তাই বুঝতে পারছেন না তিনি। পুনরায় অনুভার উদ্দেশ্যে রুবি প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“তা তোমার বাবা কী করে?”

“বাবা নেই মারা গেছেন।”

“ওহ, তা মরার আগে তো কিছু একটা করতেন নাকি না?”

“বাবা প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় কয়েক বছর পড়ে ছিলেন।”

“তাহলে সংসার চলতো কীভাবে? চাকরি বাকরি করতে নাকি?”

মহিলার প্রশ্নগুলো সুচের মতো শরীরে বিঁধছে অনুভার। প্রশ্নের ধাঁচগুলো বিরক্ত লাগছে তার নিকট। এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ভেবেই তো এতবার এড়িয়ে গিয়েছে শ্রাবণকে। অথচ আজ কিনা এসবের সম্মুখীনই হতে হচ্ছে তাকে? সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দেওয়ার জন্য ঠোঁট দুটো প্রশস্ত করল অনুভা কিন্তু পারলো না। তখনি সেখানে উপস্থিত হলো শ্রাবণ। মৃদু হেসে বললো,“আসসালামু আলাইকুম খালামণি, খালু।”

আকরাম হোসেন এবং রুবি জবাব নিলেন সালামের। অনুভার পাশের খালি জায়গাটায় আরাম করে বসে পড়ল শ্রাবণ। শুধালো,“তা হঠাৎ স্বপরিবারে চলে এলে যে? বিশেষ কোনো দিন নাকি আজ?”

আকরাম হোসেন হেসে বললেন,“তুই তো আমাদের না জানিয়েই বিয়ে করে নিলি কিন্তু আমরা তো আর মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারি না তাই চলে এলাম বউ দেখতে।”

খালার সঙ্গে সংসার করতে করতে খালুও যে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলতে শিখে গেছে তা খুব ভালো করেই আঁচ করতে পারলো শ্রাবণ। অধরের হাসিটা বহমান রেখেই বললো,“নিজের ভাই-ই উপস্থিত ছিলো না আবার তোমাদের জানাবো! এত সময় কোথায়?”

অপমানে থমথমে হয়ে গেলো স্বামী-স্ত্রীর মুখশ্রী। এর বিপরীতে বিদ্রুপ করেই রুবি বলে উঠলেন,“তা তোর বউ বিয়ের আগে চাকরি করতো নাকি?”

“হ্যাঁ করতো। কেন বলো তো?”

“চাকরি করা মেয়ে বিয়ে করেছিস! তা মা সংসারের কাজকর্ম কিছু জানো নাকি? চাকরি করা মেয়েরা তো আবার ঘরের কাজকর্মে ঢেকি হয়।”

“চাকরি করার যোগ্যতা ছিলো তাই করেছে। তাছাড়া বউ এনেছি কাজের লোক তো আর আনিনি।তোমার কথায় খোঁচা খোঁচা একটা ভাইব পাচ্ছি খালামণি!ব্যাপার কী? তুমি কী অসন্তুষ্ট কোনো কারণে?”

রাগে, অপমানে রীতিমতো এবার ভেতরটা কাঁপছে রুবির। বাহিরের একটা মেয়ের সামনে এভাবে কথা শুনতে হলো উনাকে?ইচ্ছে করল এখনি এখান থেকে চলে যেতে কিন্তু তা অসম্ভব।বরং এমন কাজে আরো অপমানিত হতে হবে উনাকে। শান্তা ছোটো বোনের উদ্দেশ্যে বললেন,“তুই রাগ করিস না রুবি। আমি তো সবার আগে তোকেই জানিয়েছি নাকি? তাছাড়া বউমা আমার কোনোদিক দিয়ে কম নয়। তুই রেগে আছিস তো তাই তোর এমন লাগছে। দেখতে দেখতে তোরও আমার মতোই বউমাকে একদম মনে ধরে যাবে।”

এটাই দেখার বাকি ছিলো! শেষমেশ কিনা নিজের বোনও ওই মেয়ের গুণকীর্তন গাইছে?ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় দগ্ধ হলেও বাহিরে কৃত্রিম হাসলেন তিনি। এক ফাঁকে পুত্রবধূকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন শান্তা। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে যে। সব গোছগাছ করে টেবিল সাজাতে হবে তো।
_________

দিনের আলো বিলীন হয়ে সন্ধ্যা নামলো ধরণীতে। রাত আটটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিট। রুবি আর তার পরিবার চলে গিয়েছে সন্ধ্যার নাস্তা সেরেই। বিছানায় এসে বসে আছে অনুভা। মিনিট দুয়েক আগে মায়ের সঙ্গে ফোনকলে কথা বলে সবার খোঁজখবর নিয়েছে সে।

শ্রাবণ এসে পাশে বসলো। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বললো,“খালামণির কথায় একদম মন খারাপ করো না নোভা। উনার কথার ধরণ একটু অমনই। তার উপর সবসময়ই আমাদেরকে উনি নিজ ছেলের দৃষ্টিতে দেখে এসেছেন তাই না জানিয়ে বিয়ে করায় একটু রেগে আছেন।”

হতাশার শ্বাস ফেললো অনুভা। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “সবে তো শুরু। দেখতে থাকো না, একে একে আত্মীয়-স্বজন আসবে আর এমন ভাবে ইন্টারভিউ নিতে থাকবে। কজনকে ঠিক কদিন সামলাবে তুমি?এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে জেনেই আমি বারবার এগোতে তোমায় নিষেধ করেছি কিন্তু তুমি তো নাছোড়বান্দা পুরুষ।”

তার ডান হাতের উপর নিজের বাম হাতটা রাখলো শ্রাবণ। ভরসার কণ্ঠে বললো,“যত জনকে প্রয়োজন তত জনকে থামিয়ে রাখবো। তোমার বাবার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার শুধু তোমাকে প্রয়োজন ছিলো আর আমি তোমাকে পেয়েও গেছি নোভা।”

“তোমার বাবা-মা জানেন সবকিছু?”

ইতস্ততবোধ করল শ্রাবণ। ললাটে সরু ভাঁজ পড়ল। কণ্ঠ নেমে গেলো খাদে। বললো,“বাবা জানে কিন্তু মা তেমন কিছুই জানে না। যেদিন বিয়ে হলো সেদিনই মা তোমায় প্রথম দেখেছিল আর নামও জেনেছিল।”

“তারপরেও তোমার বাবা রাজি হলো কী করে?”

“ঘটনাটা এত জটিল বানানোর কী আছে নোভা? পৃথিবীতে কেউই সাধু কিংবা দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নয়। প্রতিটি মানুষের ব্যাকগ্ৰাউন্ড ঘাটতে গেলে কিছু না কিছু খারাপ পাওয়া যাবে। এখন মূল কথা হচ্ছে এই খারাপের মধ্যে কারোরটা প্রকাশ পায় আবার কারোরটা পায় না। নিজের স্ত্রী সন্তানদের সুখ দিতে গিয়ে ভদ্রলোক না হয় অপরাধ করেই ফেলেছে। তার জন্য মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত শাস্তিও ভোগ করে গিয়েছে। মৃ’ত্যুর পরে কী হবে তা আল্লাহ জানেন। তোমরাও তো কম সাফার করোনি তাহলে? বাবাকে জানানো প্রয়োজন ছিলো বিদায় জানাতে হয়েছে। আর মা! মাকে জানাইনি। এই ব্যাপারটা আমার কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি বলেই জানাইনি।”

পূর্বের ন্যায় নিরব বসে রইলো অনুভা। শ্রাবণ তার বাহু ধরে নিজের পানে ঘুরালো তাকে। কপোলে আলতো করে হাত রেখে বললো,“আমাদের পরিচয়টা পারিবারিকভাবে নয় নোভা। বরং যখন আমাদের দুজন দুজনার দেখা হয়েছে পরিচয় হয়েছে তখন কেউ কারো পরিবার সম্পর্কে জানতাম না আমরা। তাহলে এখন যখন আমরা মিলিত হয়েছি তখন কেন এসব নিয়ে ভাববো? ভুলে যাও অতীত। অতীত নিয়ে ভেবে ভেবে কেউ কখনো বর্তমানে সুখী হতে পারে না।”

গাঢ় দৃষ্টিতে সম্মুখে বসা পুরুষটির চোখের পানে চেয়ে কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনলো অনুভা। তারপর আলতো করে তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বুঁজে নিলো চোখ। আনমনে বলে উঠলো,“হু।”

মোবাইলে কার্টুন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে তাঈম। রাতের খাবার খেয়ে মায়ের ঘরে এলো অর্থিকা। সুফিয়া তখন শুয়ে আছেন বিছানায়। ঘুমাননি এখনো। বড়ো মেয়ের উপস্থিতি টের পেতেই চোখ জোড়া মেলে তাকালেন। বিছানায় বসলো অর্থিকা। হাস্যজ্জ্বল মুখে শুধালো,“এখনো ঘুমাওনি?”

“না, ঘুম আসছে না।”

“ঘুমের ওষুধ খাওনি কেন?”

“ভালো লাগে না আর।”

“ভালো না লাগলে হবে? ঘুমের ওষুধ না খেলে তো তুমি ঘুমাতেই পারো না মা।”

উত্তর দিলেন না সুফিয়া।কিছুক্ষণ নিরব থেকে প্রসঙ্গ বদলে বললেন,“অনুর সঙ্গে কথা হলো। যা বুঝলাম মেয়েটা ভালোই আছে। তোদের বাবা তো ছোটো মেয়ের সংসার আর দেখে যেতে পারলো না। জানিস রোজ তোর বাবা আমার স্বপ্নে আসে। আমার কেন জানি মনে হয় সে একদম ভালো নেই। কতবার করে আমাকে ডাকলো। নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলো।”

অর্থিকা নিরবে শুনে সেসব কথা। কিন্তু বিপরীতে বলার মতো কোনো বাক্য খুঁজে পায় না।

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-২৫+২৬

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৫]

বসন্তের মৃদু ঠান্ডা হাওয়া। সন্ধ্যে নামার পরেও অন্তরীক্ষ জুড়ে পাখির বিচরণ আর কিচিরমিচির ধ্বনিতে মুখরিত চারিপাশ। লাল টুকটুকে বধূ রূপে নত মস্তকে বসে আছে অনুভা। তার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব রেখেই পাশে বসা শ্রাবণ। সম্মুখে পৌঢ় কাজী সাহেব কাগজপত্র গোছগাছ করতে ব্যস্ত। আসা যাওয়ার পথে পাশের ফ্ল্যাটের পরিবারটির সঙ্গেও দুয়েকবারের কথাবার্তায় ভালো একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে অর্থিকার। তাদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাই তারাও সেখানে উপস্থিত। সকলে উদগ্রীব হয়ে আছে সেই বিশেষ কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটির জন্য। সকলের মধ্যিখানে বসেই এক যুবতী মনে উথাল পাতাল ঢেউ বইছে। ঘর্মাক্ত হাতের তালুতে অন্য হাত ঘষে চঞ্চলা কিশোরীর ন্যায় ভেবে যাচ্ছে কতকিছু। আড়চোখে তার এসব কাণ্ড অবলোকন করে মনে মনে হাসছে শ্রাবণ। এই তো আর কয়েক মুহূর্ত। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পাশে বসা কাঙ্ক্ষিত রমণীটি শুধু তার, শুধুই তার। এই রমণীর উপর সকল অধিকার একমাত্র তার থাকবে।

ভেসে এলো কাজীর মোটা স্বর। ধ্যান ভঙ্গ হলো অনুভার। কর্ণে বেজে উঠলো প্রিয় নামটি,“শেখ মাহাথির শ্রাবণ।”

নামটা শুনতেই ভেতরটা কম্পিত হলো। থেমে গেলো হৃদক্রিয়া। পুনরায় কাজী সাহেব বলে উঠলেন,“বলুন মা কবুল।”

এই মুহূর্তে অনুভা টের পেলো তার গলা শুকিয়ে এসেছে। জিভের সাহায্যে শুকনো ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিলো। চঞ্চল হয়ে উঠলো তার চোখের মণি। অর্থিকা বোনের কাঁধে হাত রেখে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,“কবুল বল অনু।”

কণ্ঠনালী কম্পিত হলো অনুভার। বিলম্ব না করে চিত্ত চিরে বেরিয়ে এলো,“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

মুহূর্তেই সকলের অধর প্রশস্ত হলো। সমস্বরে সবাই বলে উঠলো,“আলহামদুলিল্লাহ।”

কাবিন নামায় স্বাক্ষর করা শেষ হতেই শুরু হলো মিষ্টিমুখ। বিয়ের কার্য সম্পাদন হতেই অনুভাকে নিয়ে ঘরে চলে এলো অর্থিকা। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে গেলো,“তুই বসে জিড়িয়ে নে। আমি আসছি।”

অর্থিকা চলে যেতেই ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা পানির বোতল থেকে বেশ কিছুটা পানি পান করে গলা ভিজিয়ে নিলো অনুভা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি স্থির করল আরশিতে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নিজেকে। তখনি দৃষ্টিগোচর হলো পরিচিত আরেক প্রতিবিম্বর। অনুভূতিরা চট করে শান্ত হলো। কয়েক কদম এগিয়ে ঠিক তার পেছনে এসে দাঁড়ালো শ্রাবণ। অধরে তার চমৎকার, প্রাপ্তির হাসি। সম্মুখে উল্টো ঘুরে দাঁড়ানো রমণীটির মাথা থেকে ঘোমটা টা চট করে ফেলে দিয়ে পকেট থেকে বের করল বেলী ফুলের মালা। এই মালাটি আনতেই তো তখন সে ছুটে গিয়েছিল নিচে। যত্ন করে তা গেঁথে দিলো স্ত্রীর খোঁপায়। নিষ্পল দৃষ্টিতে আরশির ভেতর দিয়েই পুরুষটির কর্মকাণ্ড দেখে গেলো অনুভা। তার বাহু দুটো ধরে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো শ্রাবণ। কানের ধারে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,“বলেছিলাম না তুমি শুধুই শ্রাবণের নোভা। কী মিললো তো?”

অস্বস্তি ঘিরে ধরলো মেয়েটিকে। তার অস্বস্তিকে আরো দ্বিগুন করে দিতে অপ্রত্যাশিত একটি কাজ করে বসলো শ্রাবণ। গাঢ় চুম্বন এঁকে দিলো অনুভার ললাটে। এই মুহূর্তে এসে অনুভার মনে হলো এই পুরুষটির জন্মই হয়েছে তাকে লজ্জায় ফেলার জন্য। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুজনার মধ্যকার দূরত্ব তৈরি করে নিলো শ্রাবণ। পূর্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো অনুভা। শুভ্র রঙের পাজামা পাঞ্জাবীতে তাকে চমৎকার লাগছে।

মুচকি হাসে শ্রাবণ। জিজ্ঞেস করে,“আমায় সুন্দর লাগছে তাই না?”

ভড়কে গেলো অনুভা। আমতা আমতা করে শুধালো,
“হ্যাঁ?”

“যেভাবে তাকিয়ে আছো তাই তো মনে হচ্ছে।”

তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় অনুভা। নিঃশব্দে হেঁটে বিছানার এককোণে বসে পড়ে। অভিযোগের সুরে বলে,“এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না? এটা কী ঠিক করেছো?”

শ্রাবণও তার দিকে মুখ করে একপাশে বসে। বাম হাতটি মুষ্টিবদ্ধ করে সেখানে থুতনি ঠেকিয়ে তার পানে তাকায়। বলে,“আমি নেইনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থি আপু। আর আমিও সুযোগটা শুধু লুফে নিলাম আরকি। তোমার উপরে ভরসা করে থাকলে কী আর জীবন চলবে? দেখা যেতো বিয়ে না করেই একসময় আমি বুড়ো হয়ে যেতাম। এর থেকে বিয়ে সেরে নেওয়াটাই কী ঠিক হলো না? এবার তুমি যা ইচ্ছে করো, আমার কী?”

কথার বিপরীতে তার পানে চোখ পাকিয়ে তাকালো অনুভা। তার এহেন দৃষ্টি লক্ষ্য করতেই থেমে গেলো শ্রাবণ। বিপরীতে উপহার দিলো মিষ্টি হাসি।
_______

রাতের অন্ধকার বিলীন হয়ে ধরণীতে আস্ফালন ঘটলো সূর্য রশ্মির। দিনের সূচনা হতেই রোজকার মতো শুরু হলো জনজীবনের ছোটাছুটি। নাস্তা সেরে অফিস ছুটলো অর্থিকা। তার পরপরই বের হলো অনুভাও। গতকাল রাতেই শ্রাবণ আর তার পরিবার ফিরে গেছে নিজ ঠিকানায়। যদিও শান্তার খুব ইচ্ছে ছিলো পুত্রবধূকে একবারে সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন কিন্তু শ্রাবণ তাতে বাঁধ সাধলো। সে কিছুতেই চায় না হুটহাট করে অনুভার উপর গোটা একটা সংসার আর সম্পর্ক চাপিয়ে দিতে।

অফিসে এসে চুপচাপ নিজের কেবিনে বসে পড়ল অনুভা। গতকাল কেন আসেনি এ বিষয়ে আজ কোনো জবাবদিহি করতে হলো না তাকে। নিজের মনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল কাজে।

দুপুর হতেই সুদূর কানাডা হতে কল এলো শ্রাবণের মোবাইলে। নাম্বারটা দেখেই ললাটে সরু কয়েকটা ভাঁজ পড়ল তার। কিছুটা সময় নিয়ে কলটা রিসিভ করতেই অপরপাশ হতে শুরু হলো ছোটো ভাইয়ের হাজারটা অভিযোগ। সৌহার্দ্য মুখ ফুলিয়ে বলতে লাগলো,“আমি মীর জাফর দেখিনি কিন্তু সামনে থেকে তোমাকে দেখেছি ভাইয়া। ভাই হয়ে ভাইয়ের সঙ্গে এমন বেঈমানি কী করে করতে পারলে বলো তো?”

শ্রাবণ গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,“কী করেছি আমি?”

বড়ো ভাইয়ের এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সৌহার্দ্য। তরতর করে বৃদ্ধি পেলো তার রাগের পারদ। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“এতটা নির্লজ্জ তুমি কী করে হতে পারলে ভাইয়া?আমায় না জানিয়ে তুমি বিয়ে করে নিলে অথচ এখন ন্যাকামি করে বলছো কী করেছি আমি? শ্যাম অন।”

“শুধু বিয়েই তো করেছি, সংসার তো আর করছি না তাই কথা একটু কম বল।”

“বিয়ে করেছো এটাই অনেক। তাও আবার না জানিয়ে। ভাই হয়ে ভাইকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না? ছিহ! মানবতা বলতে তো আর কিছুই রইলো না পৃথিবীতে। তোমার সঙ্গে কোনো কথা নেই আমার। আগামী দু দিন না না আগামী দুই সপ্তাহ কোনো কথাই বলবো না তোমার সঙ্গে। আল্লাহ হাফেজ।”

“পুরো কথা না শুনেই রেগে বোম….

এতটুকু বলেই থেমে গেলো শ্রাবণ। অপরপাশ হতে কল কাটার শব্দ হলো। কল কেটে দিয়েছে সৌহার্দ্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দিলো শ্রাবণ। বিয়ের বিষয়টা যে মা-ই ছোটো ভাইকে জানিয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই তার।
_______

অফিস শেষে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ফায়াজের সঙ্গে পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেলো অর্থিকার। এগিয়ে এসে তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো ফায়াজ। মুচকি হেসে শুধালো,“চাকরি করো নাকি?”

হাঁটতে হাঁটতেই অর্থিকার থেকে উত্তর এলো,“হ্যাঁ।”

“ছোটো বাচ্চা রেখে চাকরি করতে সমস্যা হয় না? আর তোমার হাজব্যান্ড? সে কিছু বলে না?”

সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্থিকা। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বলে,“চাকরিতে জয়েন করেছি মাসখানেক হলো। বাচ্চাকে দেখার জন্য লোক রাখা আছে তাছাড়া মাও আছে বাড়িতে।”

“ওহ, তা কী করে তোমার স্বামী? এখনো আলাপই তো করালে না।”

“সে থাকলে তো আলাপ করাবো।”

ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকায় ফায়াজ। কৌতূহলী কণ্ঠে শুধায়,“মানে?”

“আমার স্বামী এক বছর আগে মারা গেছে। মৃত মানুষের সঙ্গে কী করে তোমায় আলাপ করাবো?”

পথিমধ্যে পা জোড়া থমকে গেলো ফায়াজের। এমন একটি কথা যেনো মোটেই সে প্রত্যাশা করেনি। ততক্ষণে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে অর্থিকা। ফায়াজ দ্রুত এসে তার কদমের সঙ্গে কদম মেলালো। মিনমিনে স্বরে শুধালো,“কীভাবে মারা গেছেন?”

“দুর্ঘটনায়।”

“ওহ, বাচ্চাকে নিয়ে তবে তুমি একাই থাকো?”

“বললাম না মা আর বোন আছে সাথে। বাবাও মারা গেছেন কয়েক মাস আগে। এতদিন ছোটো বোনই সবদিক একা হাতে সামলেছে। কিন্তু আর কতদিন? ওরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে নাকি? তাই জোর করেই চাকরিতে জয়েন হলাম।”

মনটা মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেলো ফায়াজের। বিনা বাক্যে এগোতে লাগলো সামনের পথ ধরে। নিরবতা ভেঙে এবার অর্থিকা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তা তোমার কী খবর? বিয়ে সাদি করোনি? বাচ্চা কজন?”

“বউও নেই বাচ্চাকাচ্চাও নেই।”

“এমা কেন? বিয়ে করোনি?”

“করেছিলাম।”

“তাহলে?”

“বাবা-মায়ের জোরাজুরিতে পারিবারিকভাবেই বিয়েটা করেছিলাম কিন্তু যেখানে মনের মিল নেই সেখানে কী আর সম্পর্ক টিকে? সে মুক্তি চাইলো আমিও দিয়ে দিলাম মুক্তি।”

“পুরুষ মানুষ তাহলে নতুন করে আবার শুরু করলে না কেন?”

শব্দহীন হাসলো ফায়াজ। বললো,“চাইলেই কী সবাই নতুন করে শুরু করতে পারে? একই প্রশ্ন তো আমিও তোমায় করতে পারি। তবে তুমি কেন নতুন করে শুরু করলে না?”

অর্থিকার সহজ উত্তর,“তন্ময় যদি তোমার স্ত্রীর মতোই আমায় জীবিত অবস্থায় ছেড়ে যেতো তাহলে এতদিনে তার সকল স্মৃতিকে ভুলে গিয়ে আমি নতুন করে নিজের ভালো থাকা খুঁজে নিতাম। কিন্তু সে তো জীবিত অবস্থায় আমায় ছেড়ে যায়নি, বরং আমার হয়েই সে দুনিয়া ত্যাগ করেছে। সাথে রেখে গেছে আমাদের ভালোবাসার প্রতীক ছোট্ট ছেলেটাকে। তাহলে কেন আমি অন্য কাউকে জড়াবো নিজের জীবনে? এ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি তার ছিলাম আর মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্তও তার হয়েই থাকবো।”

কথাটা বলেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল অর্থিকা। সেখানেই থেমে গেলো ফায়াজ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ পানে তাকিয়ে রইলো। বিড়বিড় করে বললো,“সবাই তার নিজ জায়গা থেকে সুখী। শুধু আমার জীবনেই এত এত ধোঁয়াশা, শুরুতেই আমার ডাকে তুমি সাড়া দিলে আজ হয়তো আমাদের জীবনটাও অন্যরকম হতো অর্থি।”

নাহিয়ান যেনো ইদানিং খুব করে অনুভাকে এড়িয়ে চলে। আগে যেমন দেখা হলেই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসতো এখন তার বিপরীত। সম্মুখে পড়ে গেলেও সৌজন্য হেসে সুন্দর করে এড়িয়ে যায় তাকে। যা খুব ভালো করেই দৃষ্টিগোচর হয়েছে অনুভার।

আজ একটু আগেই বাড়িতে ফিরে এলো নাহিয়ান। বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটি।তাকে এসময় দরজার সম্মুখে দেখে মোটেও খুশি হলো না নাহিয়ান। ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়েই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,“কী ব্যাপার? ঘর থেকে বের হয়ে এলে কেন তুমি? তোমায় নিষেধ করেছি না একদম একা একা বিছানা থেকে নামবে না।”

মুখখানি মলিনতায় ছেয়ে গেলো তমার। মিনমিনে স্বরে বললো,“এমন করে বলছেন কেন? আপনি এলে কী আমি দরজা খুলে দিতে পারি না?”

স্ত্রীর মলিন মুখখানা দৃষ্টিগোচর হতেই মুচকি হাসলো নাহিয়ান। পেছন হতে জড়িয়ে ধরে সম্মুখে ধরলো আচারের প্যাকেট। আদুরে গলায় বললো,“কেন পারবে না? কিন্তু আমার বউয়ের গর্ভে যে নতুন একজন অতিথি আছে সে তো এমন দৌড় ঝাঁপে কষ্ট পাবে।”

“মাত্র দুই মাস চলছে আর এতেই আপনি যা শুরু করেছেন তাতে মানুষ পাগল বলবে আপনাকে।”

“বলুক তাতে আমার কী?”

মলিনতা দূর হয়ে হাসি ফোটে উঠলো তমার মুখশ্রীতে। আচারের প্যাকেট নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল ঘরে। প্রেগনেন্সির খবরটা গত সপ্তাহেই হাসপাতালে গিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে টের পেয়েছিল দম্পতি যুগল। আর তারপর থেকেই নাহিয়ানের বিভিন্ন আজগুবি যত্নে যেনো ক্লান্ত হয়ে উঠেছে তমা।

অফিস শেষে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বের হতেই তানিমের মুখোমুখি হতে হলো অনুভাকে। ভেতরটা অস্বস্তিতে ফেটে পড়ল তার। তবুও বাহির থেকে যথাসম্ভব নিজেকে ধাতস্থ রেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো সে। কিন্তু পারলো না। তানিম পিছু ডাকলো,“মিস.অনুভা!”

অনুভা দাঁড়ায়। পিছু ফিরে শুধায়,“জ্বি স্যার?”

“কোনো পারমিশন ছাড়াই হুটহাট অফিস বন্ধ করা কী ভালো দেখায়? অফিসটা তো আর কারো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, বলুন।”

“আসলে বাড়িতে একটু প্রবলেম ছিলো তাই আসতে পারিনি আর জানাতেও পারিনি। স্যরি স্যার।”

“স্যরি বললেই কী সবটা মিটে যাবে মিস.অনুভা?”

মৃদু হাসে অনুভা। দৃঢ় কণ্ঠে বলে,“মিস নয় স্যার মিসেস.অনুভা।”

ললাটে ভাঁজ পড়ে তানিমের। চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ। শুধায়,“কবে থেকে?”

“এইতো গতকাল রাত থেকে।”

“গতকাল রাত? মানে? বুঝলাম না কিছুই।”

“আ’ম ম্যারিড স্যার। তাই নামের আগে মিসেস হওয়াটাই স্বাভাবিক।”

কথাটা সম্পূর্ণ বুকে গিয়ে আঘাত হানলো তানিমের। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে তাণ্ডব চালালো একটি বাক্য,‘আ’ম ম্যারিড স্যার’। শুকনো ঢোক গিলে প্রশ্ন করল,“কবে হলো?”

“গতকাল রাতে।”

“হুট করে বিয়ের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে ফেললেন?”

“মানুষটা যদি নিজের শখের হয় তবে অতিব গুরুত্বপূর্ণ কাজও হুটহাট সেরে ফেলাটা কঠিন কিছু নয়।”

“শখের মানুষ! আগে থেকেই তবে?”

“হ্যাঁ, ধরুন সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে।”

“তাহলে এতদিন পর কেন?”

“আমিই চাইনি আমার এই কষ্টে ঘেরা অনিশ্চিত জীবনে তাকে জড়াতে কিন্তু সে যে নাছোড়বান্দা পুরুষ। কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। ভালো যখন বেসেছে সেহেতু ভালোবাসার মানুষটিকে নাকি তার চায়ই চাই। এরপরেও আমি আর কী করে তাকে ফিরিয়ে দেই? তাছাড়া আপুও সবটা জানতো তাই বিয়েটা হয়ে গেলো।”

যা বলবে ভেবে এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তা যেনো মুহূর্তেই মূল্যহীন হয়ে উঠলো তানিমের নিকট। এতকিছু জানার পরেও কী করে নিজের অনুভূতির কথা জানাবে সে? এক লহমায় তার অনুভূতিগুলো হয়ে গেলো মূল্যহীন। ভেতরের অহমিকার পারদ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে এক নারীর জন্য সেখানে জমা হয়েছিল কিছু সুন্দর অনুভূতি অথচ সেই নারীটি কিনা এখন অন্য কারো? ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে এলো তানিমের। ভেতরে ভেতরে হেরে যাওয়াটা কিছুতেই বাহিরে প্রকাশ হতে দিলো না। শুধালো,“কে সে মহান ব্যক্তি? যাকে ফ্রেন্ড বলে সম্বোধন করেছিলেন? যে অফিসের কাছে আপনার জন্য অপেক্ষারত থাকতো রোজ, সে?”

ভেতরে ভেতরে চমকালো অনুভা। লোকটিরও তবে শ্রাবণকে দৃষ্টিগোচর হয়েছে? অধরে হাসিটা বিদ্যমান রেখেই অনুভা উত্তর দিলো,“হ্যাঁ।”

মনে মনে ক্রোধের অনলে দগ্ধ হতে লাগলো তানিম। ইচ্ছে করল চিৎকার করে বলতে,“এসব মিথ্যে। এসব আমার ভ্রম। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে অনুভা তাই আপনি শুধুই আমার।”

কিন্তু কিছুতেই তা বলতে পারলো না তানিম। বিবেক তাকে আটকালো। কথাটা বললে যে তার অহমিকার প্রাসাদে আঘাত হানবে তাও জানান দিলো মস্তিষ্ক। অনুভা কোমল স্বরে বললো,“বাড়ি ফিরতে হবে।আসি স্যার। আসসালামু আলাইকুম।”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় তানিম। তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করে অনুভা।কিন্তু সেথায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয় তানিম। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মুষ্টিবদ্ধ হাতে গাড়ির সম্মুখে বসিয়ে দেয় শক্তপোক্ত ঘুষি। না কিছুতেই যেনো রাগ কমছে না তার। ছোটো থেকে যা পছন্দ হয়েছে তাই তো সে পেয়ে এসেছে তাহলে আজ কেন একটা নারীকে সে পেলো না নিজ জীবনে? একি মানা যায়?

চলবে ________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৬]

রাত দশটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বসন্ত ঋতু বিদায়ের সময় লগ্ন এসে গেছে। মৃদু ঠান্ডা বাতাসে গা ভাসিয়ে চায়ের কাপ হাতে ব্যালকনিতে বসে আছে অনুভা। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে আকাশপানে। তখনি নিঃশব্দে তার পাশে এসে চেয়ার পেতে বসলো অর্থিকা। বোনের উপস্থিতি টের পেয়েও নিরব রইলো অনুভা। নড়চড় হলো না তার চোখের মণি। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে গলা ঝাড়লো অর্থিকা। বললো,“কাল অফিসে গিয়ে রিজাইন দিয়ে আসবি।”

এবার নড়েচড়ে ওঠে অনুভা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বড়ো বোনের পানে। বাম ভ্রু উঁচিয়ে শুধায়,“কেন?”

“দুই বেলা অন্যের ঝাড়ি খেয়ে এত কষ্ট করার আর কোনো প্রয়োজন নেই তাই। তুই তো বলতি তোর বস খুব রাগী, অযথা সকলের সামনে বকাঝকা করে, অপমান করে।”

“আগে করতো তবে ইদানিং ধরে আর করে না। কিন্তু তোর হঠাৎ করে কেন মনে হলো যে চাকরিটা আমার ছেড়ে দেওয়া উচিত?”

“আগে যখন ওসব কারণে মন খারাপ করে থাকতি তখন আমার কিছুই করার ছিলো না। আমি ছিলাম নিরুপায় কিন্তু এখন তো আর তেমন পরিস্থিতিতে আমরা নেই। এখন আমিও চাকরি করছি। তাই তুই বরং চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে রেস্ট নে। পরে না হয় নতুন কোনো চাকরি খুঁজে নিবি।”

বিরক্ত হলো অনুভা। বললো,“বললাম আর চাকরি পেয়ে গেলাম এত সহজ? এই চাকরিটা পেয়েছিলাম নাহিয়ান ভাইয়ের সহযোগিতায়। আর তুইও কিন্তু চাকরি পেয়েছিস শ্রাবণের সহযোগিতায়। তাই আমি আর চাই না কারো সহযোগিতায় কিছু করতে।”

“খুঁজতে খুঁজতে ঠিক একসময় না একসময় পেয়ে যাবি। তাছাড়া এখন তুই বিবাহিত মেয়ে, কদিন পর সংসারে পা রাখবি তাহলে তোর এতকিছু নিয়ে ভাবার কী প্রয়োজন বল তো? এদিকটা আমি ঠিক সামলে নিবো। অনেক তো হলো দায়িত্ব নেওয়া, আমাদের নিয়ে ভাবা। এবার না হয় আমি সব দায়িত্ব নেই?”

“তুই একা সবদিক সামলাতে পারবি না আপু। নতুন চাকরি, বেতনই বা কত তোর?”

“আল্লাহ চাইলে অবশ্যই পারবো। ছোটো বোন হয়ে তুই এতদিন সব সামলাতে পারলে আমি কেন পারবো না?”

সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুভা। কাঠ কাঠ গলায় বলে,“কিন্তু আমি তো ছাড়ছি না চাকরিটা। বিয়ে যখন হয়েছে সংসারও করবো, চাকরিটাও করবো। আশা করি শ্রাবণেরও এতে কোনো সমস্যা হবে না কারণ ও সব জেনেই তো নিজ থেকে আমায় বিয়ে করেছে।”

দমলো না অর্থিকা। স্পষ্ট ভাষায় বলে উঠলো,“তুই কী কিছু বুঝিস না? নাকি না বোঝার ভান ধরে থাকিস বল তো? তোর চাকরি নিয়ে কারো কোনো আপত্তি নেই, আপত্তি হচ্ছে ওই অফিস নিয়ে। তোর মাথায় একবারও প্রশ্ন আসেনি, হঠাৎ করে কেন তোর ওই রগচটা বসের ব্যবহার কোমল হলো? কেন তোর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলো? কেন বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলো? আর কেনই বা বাবা-মাকে এখানে পাঠিয়ে দিলো বিয়ের জন্য?”

“আমি বুঝতে চাই না। কারো অনুভূতি সম্পর্কে বোঝার ইচ্ছে আমার নেই। কে আমায় ভালোবাসলো আর কে বাসলো না তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার কাছে আমার অনুভূতিটাই সব। আমি উনার অফিসে কাজ করি সেই সুবাধে মাস শেষে মাইনে পাই ব্যস এতটুকুই। এর বেশি জানার কোনো প্রয়োজন তো দেখছি না।”

এবার যেনো দমে গেলো অর্থিকা। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ছোটো বোনের পানে। কয়েক বছরের ব্যবধানে মেয়েটা কেমন বদলে গেলো? হয়ে গেলো কঠোর। পরিস্থিতি মানুষকে কতটাই না বদলে দেয়।

অফিস থেকে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে তানিম। আফসানা পরম মমতায় ছেলের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন।কিছুক্ষণ নিরবতার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“মন খারাপ?”

“না।”

“তাহলে?”

“অনুভার বিয়ে হয়ে গেছে মা।”

মোটেও চমকালেন না আফসানা। বিপরীতে বললেন,
“তো?”

বন্ধ চোখ জোড়া খুলে মায়ের পানে তাকায় তানিম। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে,“অথচ ওকে আমার ভালো লেগেছিল মা। সেক্ষেত্রে তাকে পাওয়ার কথাও তো আমার।”

“সে কোনো বস্তু বা পণ্য নয়, সে হচ্ছে একজন নারী।নারীকে পেতে হলে তার মন জয় করতে হয়। নারীকে অর্জন করতে হয়। যে তাকে পেয়েছে সে নিশ্চয়ই বিনা পরিশ্রমে তাকে পেয়ে যায়নি।”

নিরব হয়ে গেলো তানিম। ছেলের ভাবভঙ্গি দেখে মুচকি হাসলেন আফসানা। পুনরায় বললেন,“এক মাত্র ছেলে হওয়ায় যখন যা চেয়েছিস তাই আমরা তোকে দিয়েছি তাই বলে আস্ত একটা মানুষ চেয়ে বসলেই যে তাকেও পেয়ে যাবি এটা ভাবা নিতান্তই বোকামি বাবা। চাইলেই জীবনে সবকিছু পাওয়া যায় না। কিছু জিনিস না পাওয়ার আক্ষেপ মানুষের থাকতে হয়। মেয়েটার ভেতরে তোর জন্য কোনো অনুভূতি নেই।সে শুধু তোকে অফিসের বস হিসেবেই চেনে এবং তেমন দৃষ্টিতেই দেখে। এর বেশি কিছু নয়। স্রষ্টা তাকে তোর জন্য সৃষ্টি করেননি। তাকে যার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল সে তাকে নিজের করে পেয়ে গেছে। তাই ভুলে যা সেসব। আমার তানিম তো মোটেও এমন নয় যে একটা মেয়ের জন্য সে কষ্ট পাবে। তাই না?”

পূর্বের ন্যায় নিরব থাকে তানিম। তার ভেতরে যে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা কী টের পাচ্ছে মা?
________

সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো একটি। বোনের বিভিন্ন যুক্তি তর্কে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে চাকরিটা ছেড়েই দিলো অনুভা। আজ শুক্রবার। বিকেল হতে না হতেই বাড়িতে এসে প্রবেশ করল এক জোড়া দম্পতি। তাদের দেখতেই অধরে হাসি ফোটে উঠলো অর্থিকা এবং সুফিয়ার। সোফায় এসে বসতেই চা বিস্কুট ফলমূল এনে তাদের সামনে রাখলো মাজেদা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনারা যে আসবেন তা যেনো উপস্থিত সকলেই আগে থেকে জানতো। সুফিয়া কথা বলছেন হানিফ শেখ এবং শান্তার সঙ্গে।

চট করে ঘরে এসে অনুভার সম্মুখে দাঁড়ালো অর্থিকা। বিছানায় বসে তাঈমের সঙ্গে গল্প করছে অনুভা। বোনকে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখেই মাথা উঁচু করে তাকালো। প্রশ্ন করার আগেই অর্থিকা বলে উঠলো,“তোর শ্বশুর শাশুড়ি এসেছে। তৈরি হয়ে বসার ঘরে আয়।”

চমকায় অনুভা। প্রশ্ন করে,“হঠাৎ উনারা? এ সময়?”

“হ্যাঁ, তুই তৈরি হ তাড়াতাড়ি।”

“শ্রাবণও কী এসেছে?”

“না শুধু উনারা দুজন। এত প্রশ্ন না করে চুপচাপ আয় তো।”

বলেই তাঈমের হাত ধরে কক্ষ ত্যাগ করল অর্থিকা। বিপাকে পড়ে গেলো অনুভা। হুটহাট চলে আসার মতো মানুষ তো উনারা নন। তবে? এ সময় কেন এলো? অলসতা ঝেড়ে ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অনুভা। বাড়িতে পরিহিত কাপড় পরেই তো আর তাদের সামনে যাওয়া যায় না। তাই আলমারি খুলে বাহিরে পরার জন্য থ্রী পিছ নিয়ে তৈরি হতে চলে গেলো।

অর্থিকা এসেও বসলো সোফায়। তাঈমকে দেখতেই তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলেন শান্তা। মুচকি হেসে বললেন,“মাশাআল্লাহ। ও কী ওর বাবার চেহারা পেয়েছে নাকি?”

কিছুটা অপ্রস্তুত হলো অর্থিকা।কিন্তু তা বুঝতে দিলো না উনাদের। অধরে হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিলো,“হ্যাঁ।”

অপরিচিত নারীটির পানে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো তাঈম। বাচ্চা শান্তার খুবই পছন্দের। ছেলেরা যখন ছোটো ছিলো তখন সব কাজকর্ম ফেলে তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন শুধু তাদের পানে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেগুলো কত বড়োই না হয়ে গেলো! এমনকি বিয়েও করে নিলো।

তৈরি হয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে উপস্থিত হলো অনুভা। শ্বশুর শাশুড়িকে সালাম জানিয়ে কুশলাদি বিনিময় করল। শান্তা হাতের ইশারায় পুত্রবধূকে পাশে বসার ইঙ্গিত দিলেন। আহ্লাদী কণ্ঠে বললেন,“এই তো এসে গেছে আমার বউমা। তা কেমন আছো মা?”

“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আন্টি।”

মুহূর্তেই ললাটে ভাঁজ পড়ল শান্তার। কৌতূহলী কণ্ঠে শুধালেন,“কে আন্টি? কীসের আন্টি? মা বলো। কী হলো? বলো।”

ঘাবড়ে গেলো অনুভা। নিজের মায়ের পানে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। সুফিয়া চোখের ইশারায় মেয়েকে তাই করতে বললেন। মা-মেয়ের পুরো দৃশ্যটা দৃষ্টিগোচর হলো শান্তার।মৃদু হেসে বললেন,“হুটহাট আরেকজনকে মা ডাকা একটু কেমন জানি দেখায় তাই না? তাহলে আপাতত থাক, এখনি আমাকে তোমার মা ডাকতে হবে না। তুমি বরং আমায় শাশুড়ি মা বলেই ডেকো। যখন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে তখন না হয় শাশুড়িটা কেটে দিবে।”

ভদ্রমহিলার এত সুন্দর মনোভাবে ভেতর থেকে প্রশান্তি অনুভব করল অনুভা। মনে মনে ভাবলো, যেই পুরুষের মা এত সুন্দর অমায়িক একজন মানুষ। সেই পুরুষের এমন সুন্দর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কথার মাঝখানেই হানিফ শেখ বলে উঠলেন,“সে তোমাকে যা ইচ্ছে ডাকুক তবে আমায় কিন্তু তুমি এখন থেকেই বাবা বলে ডাকবে অনুভা মা। আর তা এখন থেকেই। এক বাবা হারিয়েছো তো কী হয়েছে? আজ থেকে আমি তোমার আরেকটা বাবা।”

এবারো প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়ালো অনুভা। জড়তায় কণ্ঠস্বর যেনো রোধ হলো তার। শান্তা বললেন,“আজ এখানে আমাদের আসার মূল কারণ হচ্ছে অনুভা মা। আমরা আমাদের পুত্রবধূকে নিজেদের সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি।”

অবাক হয় অনুভা। সুফিয়া বিচলিত কণ্ঠে বলেন,
“আপনাদের বাড়ির বউ আপনারা নিয়ে যেতেই পারেন। আমরা আর কী বলবো?”

ভেতরে ভেতরে শ্রাবণের উপর রাগ জমা হয় অনুভার। কী শুরু করল এই ছেলেটা? তার মতামত ছাড়াই হুটহাট এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস পাচ্ছে কোত্থেকে সে? অনুভা ইতস্তত করে বললো,“বিয়ে হওয়ার সপ্তাহখানেক হলো। আজই ও বাড়িতে? তাছাড়া বিয়েটা তো..”

কথার মধ্যিখানেই তাকে থামিয়ে দিয়ে হানিফ শেখ কোমল স্বরে বলতে লাগলেন,“বাড়িটা যে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে মা। ছোটো ছেলে ভীনদেশে। আর বড়োটা? সে তো নিজের চাকরি আর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে সর্বদা। খাওয়ার সময় ব্যতীত তাকে আর দেখা যায় না তেমন। বাড়িতে আমরা দুজন বয়স্ক মানুষ। এমন করে কী আর ভালো লাগে? শ্রাবণকে সেই কবে থেকেই বিয়ের চাপ দিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু সে ছেলে স্পষ্ট করে বলে দিলো, তোমায় ছাড়া নাকি আর কাউকেই সে বিয়ে করবে না। তখন ওর মা বললো, তোমার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে। তখন ছেলে আবার বলে, তুমি নাকি বিয়ের জন্য এখনি প্রস্তুত নও, যখন প্রস্তুত হবে তখনই তোমার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিবে। তখন আমাদের আর কী করার থাকে বলো তো?”

উপস্থিত সকলেই ভদ্রলোকের কথায় অবাক হয়। এই ছেলে বাবা-মায়ের সামনেও এতটা স্পষ্টভাষী? এভাবে কেউ সবটা বলে দিতে পারে? তবে অনুভা বোঝে এই পুরুষটির ভালোবাসা। পুরুষ যদি কোনো নারীকে সত্যিকারের ভালোবাসে তবে তার কথা তার বাবা-মায়ের সম্মুখে বলতে কখনোই সে দ্বিধাবোধ করে না। যার প্রমাণ স্বয়ং শ্রাবণ। হানিফ শেখ পুনরায় বলেন, “শ্রাবণ এ বিষয়ে জানে না। ওকে জানালে ও কিছুতেই রাজি হতো না। তোমার মতামত ছাড়া ও তোমার উপর কিছু চাপিয়ে দিতে চায় না। আমরাও কিন্তু চাই না। তবে অনেক আশা নিয়ে যে এখানে এসেছি মা। খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না। নতুন পরিবেশে তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। যখন ইচ্ছে তখনি মা, বোন আর এই মিষ্টি বাচ্চাকে দেখতে চলে আসতে পারবে। আমাদের তরফ থেকে কোনো মানা নেই।”

উনারা যে আজই অনুভাকে নিতে আসবেন তা অর্থিকা জানতো না। তাই সে বলে উঠলো,“বিয়েটা হয়তো পারিবারিকভাবেই হয়েছে তাই বলে এভাবে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়াটা কেমন দেখায় না? আপনাদেরও নিশ্চয়ই আত্মীয়-স্বজন, পাড়া- প্রতিবেশী আছে। তাই আমাদের যদি একটু সময় দিতেন আঙ্কেল তাহলে না হয় যতটা পারি একটা দিন একটু আয়োজন করে।”

হানিফ শেখ সৌজন্য হেসে বললেন,“তার কোনো প্রয়োজন নেই মা।বিয়ে হয়ে গেছে। এখন যা অনুষ্ঠানের আয়োজন করার তা আমরাই করবো। তোমাদের এ নিয়ে ভাবতে হবে না। আমরা আজই ওকে নিয়ে যেতে চাই। আপনাদের কোনো আপত্তি নেই তো আপা? অনুভা মা তোমার? তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? যদি থাকে তাহলে বলতে পারো, আমরা কিছু মনে করবো না।”—-শেষের কথাটা অনুভাকে উদ্দেশ্য করেই বললেন তিনি।

মা আর বোনকে ফেলে কিছুতেই অনুভা হুটহাট করে অন্য কোথাও যেতে চায় না। কী করে তাদের এভাবে ফেলে রেখে নিজে সুখের দিকে ধাবিত হবে? এ যে তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছু বলতে চাইলো অনুভা। উনারা কষ্ট পাক তবুও সে নিজের মতামত জানাবে কিন্তু সুফিয়া তখনি বলে উঠলেন,“ওর কোনো আপত্তি নেই। আপনারা নিয়ে যেতে পারেন।”

অর্থিকাও মায়ের সঙ্গে সম্মতি জানালো। আশানুরূপ উত্তর পেয়ে খুশি হয়ে গেলো দম্পত্তি যুগল। ব্যাগ গোছানোর জন্য সময় দেওয়া হলো তাকে। তাই নিরবে ঘরে চলে এলো অনুভা। তার পিছুপিছু অর্থিকাও এলো। বোনকে একান্তে পেয়েই রাগ ঝাড়ার প্রয়াস চালালো অনুভা। চাপা ক্ষোভে বললো,“সমস্যা কী তোর? হুটহাট আমারই অনুমতি ছাড়া আমার ব্যাপারে তুই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস কেন বল তো? সাপের পাঁচ পা দেখেছিস? চাকরিতে ঢুকে চোখে সর্ষে ফুল দেখছিস? হঠাৎ বিয়ে দিয়ে দিলি। এখন আবার শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিবি?”

ভাবলেশহীন ভাবে বিছানায় আয়েশ করে বসলো অর্থিকা। বললো,“তো কী তোর নড়বড়ে মতামতের জন্য অপেক্ষা করবো? তোর মতামত চাইতে গেলে সেই তো বলতি, আমি বিয়ে করবো না। তোমাদের ছেড়ে আমি যাবো না। কেন যাবি না? সংসার কী পৃথিবীতে আর মেয়েরা করে না? শ্রাবণের মতো স্বামী আর অমন শ্বশুর শাশুড়ি পেয়েছিস বলে শুকরিয়া আদায় কর।”

“আপু!”

“রাগ না দেখিয়ে তৈরি হ যা।”

প্রচন্ড রাগ হচ্ছে অনুভার। এ কাদের জন্য সে এতকিছু ভাবলো? যারা কিনা তার যাওয়ার জন্য এত সুন্দর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে? বিড়বিড় করে বলতে লাগলো অনুভা,“ঠিক আছে থাকবোই না এখানে। চলে যাবো। চলেই যাবো আমি। কাউকে দরকার নেই আমার।”

বলতে বলতে ব্যাগ গোছাতে লাগলো সে। বোনের রাগ দেখে নিঃশব্দে হাসলো অর্থিকা। আজ অনেক দিন বাদে মেয়েটিকে রাগতে দেখলো সে। দিনকে দিন পরিস্থিতির চাপে পড়ে কী কঠিন খোলসেই না আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবার যদি জীবনে তার সুখ আসে। যদি পারে এই শক্ত খোলস থেকে বেরিয়ে পুরোনো অনুভা রূপে ফিরে আসতে।

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-২৩+২৪

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৩]

সুফিয়া সালাম জানিয়ে তাদের সম্মুখে বসলেন। আজিজুল হক সৌজন্য হেসে নিজেদের পরিচয় জানাতেই ভেতরে ভেতরে বেশ চমকে উঠলেন তিনি। এত বড়ো ঘর থেকে সম্বন্ধ এসেছে মেয়ের জন্য! ভাবতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। মাজেদা এসে দিয়ে গেলো চা এবং বিস্কুট। আফসানা হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন,“মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি সেই কবে। সে ঘরে নাতি-নাতনিও আছে। এখন বাকি শুধু আমার এই একটামাত্র ছেলে। তারও বিয়ের বয়স হয়েছে। বাড়িতে একা একা কী ভালো লাগে বলুন তো?”

সুফিয়া জোরপূর্বক হেসে বললেন,“বিয়ের বয়সী ছেলে আছে ঘরে তাহলে তাকে বিয়ে করিয়ে দেওয়াই তো উত্তম।”

“এটাই তো আমি বলি। কিন্তু ছেলেকে এ বিষয়ে বললেই সে এড়িয়ে যায়। তারপর পরশু এসে আমায় জানালো তার নাকি একটা মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করলে তাকেই করবে। ছেলের যখন পছন্দ হয়েছেই তাহলে অন্য কোথাও মেয়ে খুঁজে সময় নষ্ট করতে যাবো কেন বলুন?”

কৃত্রিম হাসলেন সুফিয়া। আজিজুল হক বললেন,
“না জানিয়ে আসার জন্য দুঃখিত আপা। আমার স্ত্রীর তো আর তড়ই সইছিল না। তাই আজই আসতে হলো। অনুভার ছবি আমরা দেখেছি, আমাদেরও তাকে খুব পছন্দ হয়েছে। তাই আমরা চাইছি আজই বিয়ের কথাবার্তা একেবারে পাকাপোক্ত করে যেতে।”

প্রত্যুত্তরে কী বলবেন বুঝতে পারলেন না সুফিয়া। তবে তিনিও খুব করে চান নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটার বিয়ে দিতে। মরার আগে মেয়েটার সুখ নিজ চোখে দেখে যেতে। উনার নিরবতা দেখে আফসানা আশ্বস্ত করে বললেন,“আমরা সবকিছু জানি আপা। ওসব নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। বউ নয় বরং আমরা এক কাপড়ে একটা মেয়ে নিয়ে যেতে চাই বাড়িতে। আপনার মেয়েকে রাজরাণী করে রাখবো, কখনো কোনো কষ্ট হবে না তার। আমার ছেলেটা রাগী হলেও মনটা কিন্তু ওর খুব ভালো। খুব আশা নিয়ে এসেছি আপা। খালি হাতে ফেরাবেন না আমাদের।”

মহিলাটির কণ্ঠস্বর খুবই করুণ শুনালো। ভদ্রমহিলার চোখ জোড়ার পানে তাকিয়ে সুফিয়া খেয়াল করলেন ওই চোখে অদৃশ্য এক মায়া আছে। এত সুন্দর অক্ষি যুগলের মালিকের মনটাও নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর হবে! মনে মনে সুফিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন, যাই হয়ে যাক না কেন এখানেই এবার তিনি ছোটো কন্যাকে বিয়ে দিবেন। কারো ‘না’ শুনবেন না। তারও তো একটা জীবন আছে নাকি? তার উপর ওদের বাবা মারা গেছেন। অর্থিকাও এখন সুস্থ স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছে, চাকরি করছে। উনার অবস্থাও তেমন ভালো নয়। তাই মা হিসেবে ছোটো মেয়েটার জীবন সাজিয়ে দেওয়া তো উনার কর্তব্য।

দুজন নর নারী কাঙ্ক্ষিত উত্তরের অপেক্ষায় উনার মুখপানে চেয়ে আছেন। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিলেন সুফিয়া। অধর প্রশস্ত করলেন কিছু বলার উদ্দেশ্যে আর তখনি শব্দ হলো কলিং বেলের। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন সুফিয়া। মাজেদা দৌড়ালো দরজা খুলতে। মিনিট দুয়েক পরেই দু হাতে বাজারের থলে নিয়ে হাজির হলো অনুভা।

অপরিচিত দুজন মানুষকে সোফায় বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুটির কুঁচকে নিলো। ব্যাগ দুটো মাজেদার হাতে দিয়ে ফিসফিসিয়ে শুধালো,“উনারা কারা?”

মাজেদাও ঠিক একইভাবে ফিসফিস করে উত্তর দিলো,“আপনেরে দেখতে আইছে আপা। খালার মতিগতি দেইখা যা বুঝলাম ভিতরে ভিতরে খালায় কিন্তু রাজি। খুব তাড়াতাড়ি আপনের বিয়ার ঢোল বাজতে যাইতাছে গো আপা!”

কথাটা বলেই লাজুক হেসে প্রস্থান করল মাজেদা। ললাটে এখনো কয়েকটা ভাঁজ পড়ে আছে অনুভার। এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো অপরিচিত মানুষ দুজনকে। আফসানা এবং আজিজুল হক সমস্বরে জবাব নিলেন সালামের। ভদ্রতা বজায় রেখে অনুভা প্রশ্ন করল,“আপনারা? ঠিক চিনলাম না তো আপনাদের।”

আফসানা একপাশে সরে গিয়ে নিজের পাশেই কিছুটা জায়গা করে দিলেন তাকে বসার জন্য। হাত বাড়িয়ে ডেকে বললেন,“আমরা তানিমের বাবা-মা। এখানে এসে বসো তো মা।”

আশ্চর্য হয় অনুভা।তানিমের বাবা-মা! উনারা এখানে কেন? মায়ের বয়সী ভদ্রমহিলার ডাকে উনার পাশে গিয়ে বসলো অনুভা। প্রশ্ন করল,“আপনারা? হঠাৎ এখানে?”

এবারো হাসলেন আফসানা। বললেন,“তোমার জন্যই তো আসা।”

“আমার জন্য?”

উনাকে কিছু বলতে না দিয়েই সুফিয়া বলে উঠলেন,
“উনারা তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।”

চমকায় অনুভা। বিয়ের প্রস্তাব! গলা শুকিয়ে আসে মুহূর্তেই। শুকনো ঢোক গিলে শুধায়,“কার সাথে?”

আফসানা মুচকি হেসে উত্তর দেন,“তানিমের সাথে। তুমি তো আমাদের অফিসেই চাকরি করো তাই না?”

অপ্রস্তুত হয় অনুভা। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে,“আমার সঙ্গে স্যারের বিয়ে এটা কী করে হয় আন্টি? উনি আমার অফিসের বস আর আমি উনার একজন কর্মচারী।”

আফসানা ভদ্রমহিলা প্রাণবন্ত একজন নারী। স্বভাব সুলভ অধরে হাসি রেখেই বললেন,“কেন হয় না? চাইলেই হয়। আর আমরা তা চাইছি। তোমাকে আমাদের একমাত্র ছেলের পছন্দ হয়েছে। তুমি যদি চাও বিয়ের পরেও চাকরি করতে পারবে তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবুও না করো না মা। খুব আশা নিয়ে যে এসেছি। এই মাকে ফিরিয়ে দিও না।”

অনুভা অনুভব করল ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বরে কিছু একটা আছে। যার বিপরীতে কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না সে। এত সুন্দর আবেদনের পর মনে হয় না কেউ মুখের উপর না বলে দিতে পারবে। সবচেয়ে বেশি অবাক হচ্ছে এটা শুনে যে তানিমের তাকে পছন্দ! যেই লোকটা শুরু থেকেই তাকে বিভিন্ন ভাবে অপমান অপদস্থ করে আসছে সেই লোকটা তাকে বিয়ে করতে চায়? যদিও লোকটার ইদানিংকালের ব্যবহারে কিছু একটা টের পেয়েছিল অনুভা। তবুও বারবার ভাবনা সরিয়ে দিয়েছে মন মস্তিষ্ক থেকে।

ভেতরে অস্বস্তিবোধ করছে অনুভা। কীভাবে এদের না বলে দিবে বুঝতে পারছে না। মায়ের দিকে তাকিয়ে এটা অবশ্য বুঝতে পারলো যে মা এই প্রস্তাবে রাজি। রাজি থাকবে নাই বা কেন? তিনি তো কবে থেকেই চাইছিলেন মেয়েকে সুপাত্রে হস্তান্তর করতে। আজিজুল হক আর আফসানা চা খেতে খেতে সুফিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন কথাবার্তা বলছেন।

আবারো কলিং বেল বেজে উঠলো। মাজেদা দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললো,“মনে হয় বড়ো আপায় আইয়া পড়ছে।”

তার কথাই ঠিক হলো।ভেতরে প্রবেশ করল অর্থিকা। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সকলকে সালাম দিয়ে বসে পড়ল মায়ের পাশে। আফসানা হেসে প্রশ্ন করলেন,
“তুমি বুঝি অনুভার বড়ো বোন?”

“জ্বি, আপনারা?”

উনারা উনাদের পরিচয় দিতেই অর্থিকাও ঠিক ছোটো বোনের মতোই ভেতরে ভেতরে চমকালো। আড়চোখে দেখে নিলো তাকে। অনুভার চোখেমুখে ফোটে উঠেছে অসহায়ত্ব। সুফিয়া মেয়ের উদ্দেশ্যে তাদের আসার কারণটা বলে এবার তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,“আমার মেয়েটা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। আমিও চাই আমার মেয়েটা এবার অন্তত সুখের মুখ দেখুক। তাই আমার কোনো আপত্তি নেই আপনাদের প্রস্তাবে।”

বুক কেঁপে ওঠে অনুভার। মা তো উনাদের কথা দিয়ে দিচ্ছে! এবার কী হবে? বড়োদের মাঝখানে কিছু বলতেও পারছে না মেয়েটা। অসহায় দৃষ্টিতে বড়ো বোনের পানে তাকালো। অর্থিকা ইশারায় বোনকে আশ্বস্ত করে মায়ের উদ্দেশ্যে হেসে বললো,“অনু প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে। ওর অনুমতি না নিয়েই হুটহাট এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তো তুমি নিতে পারো না মা।”

বড়ো কন্যার দিকে ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকান সুফিয়া। বলেন,“ওর মতামত নিয়ে কী হবে? সেই তো বলবে তোমাদেরকে ছেড়ে আমি যাবো না।”

আজিজুল হক বললেন,“না না বিয়েটা যেহেতু ওর, সারাটা জীবন যখন ওকেই কাটাতে হবে তখন ওর সিদ্ধান্তটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

আফসানা আলতো করে অনুভার মাথায় হাত রেখে শুধালেন,“নির্দ্বিধায় তুমি তোমার মতামত জানাতে পারো মা। তুমি কী বিয়েতে রাজি?”

পুনরায় বড়ো বোনের পানে তাকায় অনুভা। অর্থিকা চোখ দিয়ে ইশারা করে বোনকে। যার অর্থ সহজেই বোধগম্য হয় অনুভার। সোজাসাপ্টা জবাবে বলে,
“তানিম স্যারকে আমি শুরু থেকেই অফিসের বস হিসেবে জেনে এসেছি। অফিসের কাজ ব্যতীত উনার সঙ্গে আমার তেমন কোনো পরিচয় নেই। সেক্ষেত্রে এ বিয়েতেও আমি সায় দিতে পারছি না, মাফ করবেন আমায়। এমন একটা সিচুয়েশনে যে কখনো পড়তে হবে তা ভাবতেও পারিনি।”

ভেতরে ভেতরে আহত হলেন আফসানা। বোঝানোর সুরে বললেন,“তাতে কী হয়েছে মা? পরিচয় নেই তো পরিচয় হয়ে যাবে। পারিবারিকভাবেই না হয় তোমাদের বিয়েটা হবে তারপর সংসার করতে গিয়ে দুজন দুজনাকে চেনাজানাও হয়ে যাবে। কত মানুষেরই তো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হচ্ছে যেখানে একজন আরেকজনকে আগে কখনো দেখেনি পর্যন্ত। তারা কী সংসার করছে না?”

এবার কী যুক্তি দিবে ভাবতে লাগলো অনুভা। কিন্তু তাকে আর ভাবতে না দিয়েই অর্থিকা ভদ্রতা বজায় রেখে বললো,“সবার ক্ষেত্রে এমনটা হয় না আন্টি। অফিসের বসের সঙ্গে বিয়েটা দৃষ্টিকটু দেখায়। অন্যান্য কর্মচারীরা ব্যাপারটা নিয়ে যে আড়ালে কথা বলবে তার কী গ্যারান্টি আছে? তাছাড়া আমার বোনের জন্য যোগ্য পাত্র আমি পেয়ে গেছি। তাকে আমি কথাও দিয়েছি অনুভার সঙ্গে তার বিয়ে দিবো। মা বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকেন তার সঙ্গে বিভিন্ন ঝোট ঝামেলা তো আছেই তাই বলা হয়ে ওঠেনি। আশা করি বুঝতে পারছেন আন্টি?”

তার কথায় অনুভা এবং সুফিয়া দুজনেই চমকালো। মনক্ষুণ্ণ হলেন আফসানা। আজিজুল হক ব্যাপারটাকে ভীষণ স্বাভাবিকভাবে নিলেন। বিয়ের বয়সী মেয়ে যখন বাড়িতে আছে বাড়ির কেউ না কেউ তার বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিবে এটাই স্বাভাবিক। আফসানা কিছুক্ষণ নিরব রইলেন। মেয়েটাকে উনার প্রথম দেখাতেই মনে ধরেছিল তার উপর ছেলের পছন্দ বলে কথা! তারপরেও কিছুটা আশা নিয়ে বললেন,“আরেকবার যদি ভেবে দেখতে? বিয়েটা তো এখনো হয়নি। তাছাড়া আমার ছেলেও তো কোনোদিক দিয়ে খারাপ নয়।”

অর্থিকা মিহি হেসে উত্তর দেয়,“খারাপ ভালোর কথা আসছে না আন্টি। বিয়েটা তো আর ছেলেখেলা নয়। একজনের পছন্দ দিয়ে কখনোই বিয়ের মতো সম্পর্ক হয় না। যাকে অনুভা এতদিন স্যারের সম্মান দিয়ে এসেছে তাকে তো আর হুট করেই স্বামীর স্থান দেওয়া যায় না। তাছাড়া ওরও নিজের পছন্দের মানুষ আছে। তাই আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত আন্টি।”

আশার আলো চট করেই নিভে গেলো আফসানার। আজিজুল হক নিরব রইলেন। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে তারা চলে যেতে চাইলেন কিন্তু অর্থিকা তাদের যেতে দিতে নারাজ হলো। যতোই হোক বোনের অফিসের বসের বাবা-মা বলে কথা! আপ্যায়ন না করলে কী আর হয়? একেবারে নাস্তা করিয়েই তারপর উনাদের যেতে দেওয়া হলো।

উনারা যেতেই সুফিয়া চেপে ধরলেন মেয়েকে। প্রশ্ন করলেন,“তুই কাকে বিয়ের কথা দিয়ে এসেছিস হ্যাঁ? এত ভালো সম্বন্ধটা হাতছাড়া হয়ে গেলো। তুই কজনকে চিনিস বল তো? আমাকে না জানিয়ে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়ার তুই কে?”

অর্থিকার সোজা উত্তর,“আমি ওর বড়ো বোন। তাই ওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার আছে। বড়ো ঘর হলেই যে বিয়ে দিতে হবে এমন কথা কোথায় আছে? যে বস নিজের ইমপ্লয়ীদের সম্মান দিতে জানে না সে আবার বউ পালবে কী করে? যত্তসব।”

“কিন্তু তুই কথা দিয়েছিস কাকে?”

“হয়তো চিনতেও পারো আবার নাও পারো তবে এটা জেনে রাখো অনু তাকে ভালোবাসে এবং ছেলেটাও অনুকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আমাদের জন্য ও ওর ভালোবাসাটা অনেক আগেই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে মা। নেহাৎ ছেলেটা ভালো তাই এখনো ওর অপেক্ষায় বসে আছে। আমি আমার ভালোবাসার মানুষ হারিয়েছি কিন্তু বোনকে কিছুতেই তার ভালোবাসা হারাতে দিবো না। অনুভার জন্য যদি যোগ্য কেউ থাকে তাহলে সে হচ্ছে শ্রাবণ।”

বলেই নিজ ঘরের দিকে পা বাড়ালো অর্থিকা। তার কথা শুনে সুফিয়া এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন পূর্বের স্থানে। দরজার আড়াল থেকে সমস্ত কথাই কর্ণগোচর হয়েছে অনুভার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে।

অর্থিকাও ফ্রেশ হয়ে এলো। তাঈম জেগে উঠেছে। বিছানায় একঝাঁক খেলনা নিয়ে খেলছে। মাকে দেখতে পেয়েই ভাঙা ভাঙা শব্দে নিজের মতো বলে যাচ্ছে কথা। অর্থিকা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে মুহূর্তেই একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো।

সবে সাড়ে সাতটা বাজে। শ্রাবণ এখনো বাড়ির বাহিরে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে ক্যাফেটেরিয়ায়। টেবিলের উপর রাখা মোবাইলটা বেজে উঠলো তৎক্ষণাৎ। স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করা ‘অর্থি আপু’ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা দেখে ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো তার। বন্ধুদেরকে ওয়াশরুমের বাহানা দিয়ে সেখান থেকে সরে গেলো মোবাইল হাতে। কল রিসিভ করে সালাম জানিয়ে প্রশ্ন করল,“সব ঠিক আছে তো আপু?”

সালামের জবাব নিলো অর্থিকা। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “না নেই। কিচ্ছু ঠিক নেই।”

“কেন? কী হয়েছে?”

“তুমি কী বিয়ের জন্য প্রস্তুত শ্রাবণ? অনুকে বিয়ে করতে পারবে?”

আচমকা এমন কথায় অবাক হয় শ্রাবণ। ভাবার জন্য সময় না নিয়েই উত্তর দেয়,“অবশ্যই প্রস্তুত। আমি তো কবে থেকেই ওকে বিয়ের কথা বলে যাচ্ছি কিন্তু ওই তো রাজি হচ্ছে না।”

“ওর কথা ছাড়ো, যদি আজকালের মধ্যে অনুকে বিয়ে করতে বলি তাহলে পারবে করতে?”

আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে শ্রাবণ শুধালো,“আজকে?”

“আজ রাতে যদি তোমার সমস্যা না থাকে তাহলে আজ রাতেই, আর সমস্যা থেকে থাকলে না হয় কাল। করবে বিয়ে?”

“নোভা রাজি?”

“রাজি কী রাজি না তা জানি না তবে ও তোমায় ভালোবাসে‌। এর থেকে বেশি কিছু জানার কী আর প্রয়োজন আছে?”

ওষ্ঠদ্বয়ের কার্ণিশ বর্ধিত হলো শ্রাবণের। শীতল কণ্ঠে বললো,“নাহ।”

“তা বাবা-মাকে নিয়ে আসছো তো? নাকি আপত্তি আছে?”

মুচকি হাসে শ্রাবণ। উত্তর দেয়,“না নেই। তবে এখন তো সাড়ে সাতটা বাজে আপু। বাবা-মাকে জানিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করতেও তো একটা সময়ের প্রয়োজন তাই না?”

অর্থিকাও হাসে। বলে,“আচ্ছা রাখি তবে। কাল দেখা হচ্ছে।”

“ইনশাআল্লাহ।”

মুচকি হাসে শ্রাবণ। কল কেটে দেয় অর্থিকা। পা বাড়ায় মায়ের ঘরের দিকে। মাকে তো জানাতে হবে সবকিছু তাই না? মোবাইল পকেটে ভরে বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসে শ্রাবণ।

অফিস শেষে বাড়ি ফিরে এসেছে তানিম। ভেতরে প্রবেশ করেই বাবা-মাকে ড্রয়িং রুমে পেয়ে গেলো। পুলকিত হয়ে উঠলো মন। বড়ো বড়ো কদম ফেলে সোফায় গিয়ে বসে পড়ল। মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“দেখেছো অনুভাকে? পছন্দ হয়েছে মা?”

ছেলের উৎসুক মুখশ্রী দেখতেই ভেতরে চাপা কষ্ট অনুভব করলেন আফসানা। মুখখানি উনার মলিন হলো। উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বোঝালেন হ্যাঁ। অধরে হাসি ফোটে উঠলো তানিমের। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,“বিয়েতে রাজি হয়েছে উনার মা? তারিখ ঠিক করে এসেছো?”

তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারলেন না আফসানা। ছেলের এই হাসিটা মা হয়ে কী করে বিলীন হয়ে যেতে দেখবেন তিনি? উত্তরের অপেক্ষায় মায়ের পানে তাকিয়ে আছে তানিম। আজিজুল হক গলা ঝেড়ে বললেন,“তার মা রাজি হলেও কনে এবং কনের বড়ো বোন রাজি নয়। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে একজনের সঙ্গে। আর খুব শীঘ্রই তার সঙ্গেই বিয়ে হবে।”

পিতার মুখ থেকে এমন কথা শুনে হাস্যজ্জ্বল মুখখানা মলিন হয়ে গেলো তানিমের। ক্ষত বিক্ষত হয়ে উঠলো হৃদয়। অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে আছে? মানে কী এর? কে সে? কার সঙ্গে বিয়ে? খুব রাগ হলো তানিমের। সেন্টার টেবিলের উপর রাখা রাজহংসী আকৃতির শো পিসটা ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে। পুত্রের এমন রাগ দেখে মুহূর্তেই চমকে ওঠেন কপোত কপোতী যুগল। গভীর শঙ্কায় নিমজ্জিত হয়ে ওঠে আফসানার মন।

বসা থেকে উঠে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো তানিম। বিড়বিড় করে বললো,“আজ পর্যন্ত যা যা আমার পছন্দ হয়েছে সবই আমি পেয়েছি। আপনাকে তো আমি ছাড়ছি না অনুভা।”
________

রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে সকলে এসে উপস্থিত হয়েছে খাবার টেবিলে। সবার পর নিজ চেয়ারে এসে বসলো শ্রাবণ। শান্তা ছেলের প্লেটে বেড়ে দিলেন খাবার। সৌহার্দ্য দিন পনেরো আগেই আবারো ফিরে গেছে কানাডা। টেবিলে এখন তিনজন। হানিফ শেখ নিজ প্লেটের পানে দৃষ্টি রেখে মনোযোগ সহকারে খাবার খাচ্ছেন। ভেতরে ভেতরে শ্রাবণের উত্তেজনা বিরাজ করছে। যতই বাবা-মায়ের সামনে বেফাঁস কথাবার্তা বলে ফেলুক না কেন এই মুহূর্তে নিজের বিয়ের কথা বলতে বেশ লজ্জা করছে তার। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে উপরে উপরে যথাসম্ভব স্বাভাবিক এবং গম্ভীর রাখলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বাবা-মায়ের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গেই শান্তা ছেলের মুখপানে তাকালেন কিন্তু হানিফ শেখের কোনো নড়চড় নেই।

হেরফের না করে শ্রাবণ স্পষ্ট ভাষায় বলে উঠলো,
“আমি বিয়ে করবো।”

কথাটা দুজনে তেমন আমলে নিলেন না। শ্রাবণ পুনরায় বললো,“কালকেই বিয়ে করবো।”

এবারের কথাটা কাজে দিলো। খাওয়া ছেড়ে পুত্রের পানে তাকালেন হানিফ শেখ। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মুখেই বিষ্ময়। শান্তা বললেন,“গতকাল না বললি সামনের শুক্রবার করবি? তাহলে?”

“শুক্রবার আসতে অনেক দেরি। তাই কালই বিয়ে করবো।”

হানিফ শেখ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“মগের মুল্লুক নাকি? কালকের মধ্যে কী করে বিয়ের আয়োজন করবো?”

“ঘরোয়াভাবে করবো। আমরা যাবো, কাজী ডাকবো, বিয়ে করবো তারপর চলে আসবো। ব্যস।”

“তাই বলে হুটহাট সিদ্ধান্ত নিবি? মেয়ের বাড়ির লোকের মতামতেরও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি?”

“ওর বড়ো বোনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের কোনো আপত্তি নেই। আর তোমাদেরও থাকার কথা নয়। বিয়ে করলে কালই করবো নইলে কখনো বিয়ের কথা বলবে না।”

ছেলের কথায় এক মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন হানিফ শেখ। উনার এই ছেলেগুলো এমন কেন?

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৪]

গতকাল বলে দেওয়ায় আজ সাত সকালেই বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে মাজেদা। আজকের দিনটা ছুটি নেওয়ার জন্য গতকাল রাতেই অফিসে মেইল করে দিয়েছে অর্থিকা। মাজেদাকে নিয়ে দ্রুত সকালের নাস্তা তৈরি করে খেয়ে নিলো সে। অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসলো অনুভা। রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরতেই তার সামনে এসে হাজির হলো অর্থিকা। শুধালো,“অফিসে যাবি নাকি?”

খেতে খেতেই সে উত্তর দিলো,“হুম, তুই যাবি না?”

“না, ছুটি নিয়েছি।”

“কেন?”

“দরকার আছে তাই। সাথে তুইও আজ যাচ্ছিস না।”

ললাটে ভাঁজ পড়ে অনুভার। জিজ্ঞেস করে,“কেন? গতকালকের ঘটনাটার জন্য যেতে নিষেধ করছিস? ওই সামান্য কারণে আমি অন্তত অফিস বন্ধ করতে পারবো না। চাকরির বাজার সম্পর্কে তো জানিসই আপু।”

চটজলদি টেবিলের উপর একটা ফর্দ রাখলো অর্থিকা। বললো,“অত কিছু জানি না। আজ আর তোর অফিসে যাওয়া হচ্ছে না। এই রইলো বাজারের ফর্দ। খাবারটা শেষ করে ফর্দ মিলিয়ে মিলিয়ে বাজার করে নিয়ে আয়। তুই তো আবার এই কাজে ভালোই পারদর্শী।”

বাম হাত দিয়ে ফর্দটা তুলে চোখের সামনে ধরলো অনুভা। লেখাগুলো পড়েই চমকে উঠলো। জিজ্ঞেস করল,“এতকিছু! কেউ আসছে নাকি বাড়িতে?”

“হ্যাঁ, এবার প্রশ্ন না করে তাড়াতাড়ি যা। তুই এলে রান্না বসাবো।”

“কে আসবে তা তো বললি না আপু।”

চোখ পাকিয়ে শাসন করার ভঙিতে ছোটো বোনের পানে তাকালো অর্থিকা। তার এহেন দৃষ্টিতে নিরব হয়ে গেলো অনুভা। রুটিটা শেষ করেই বাজারের ব্যাগ হাতে বের হলো বাড়ি থেকে। সে যেতেই মাজেদাকে নিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করতে নেমে পড়লো অর্থিকা। যদিও গতকালই তারা সবকিছু গুছিয়েছে কিন্তু আজ বিশেষ একটা দিন থাকায় কোনোদিকেই কোনো খুঁত রাখতে চাচ্ছে না সে।

শান্তার দিনটা আজকে ব্যস্তময়। ছেলের বিয়ে দেওয়া কী কম ঝক্কি ঝামেলা নাকি? যতই ঘরোয়াভাবে বিয়ে হোক না কেন খালি হাতে তো আর ছেলের জন্য বউ তুলতে পারেন না ঘরে। আলমারি থেকে বড়ো পুত্রবধূর জন্য গড়া গহনাগুলো বের করলেন তিনি। তার থেকে এক সেট গুছিয়ে নিলেন নিজের ব্যাগে। বাকিগুলো পুত্রবধূকে একেবারে বাড়ি এনে তারপর বুঝিয়ে দিবেন। হানিফ শেখ ঘরে এলেন। স্ত্রীকে বিছানায় বসে গহনা হাতাতে দেখে শুধালেন,
“প্রয়োজনীয় সব নিয়েছো তো?”

“হ্যাঁ নিয়েছি নিয়েছি। আচ্ছা রুবিকে আসতে বললে ভালো হতো না?”

“এখন কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আগে বিয়ে হোক তারপর না হয় জানিও।”

মন ভার হলো শান্তার। আফসোস করে বললেন, “ছেলেদের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিলো আমার কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। দু দুটো ছেলেই আগে থেকে মেয়ে পছন্দ করে রেখেছে। করে রেখেছে তো রেখেছে তার উপর বিয়েটাও কিনা এমনভাবে সবাইকে না জানিয়ে করবে?”

মুচকি হাসলেন হানিফ শেখ। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,“মন খারাপ করো না। বৌ-ভাত না হয় আমরা অনেক ধুমধাম করে করবো দেখে নিও।”
________

অনুভার চেয়ারটা আজ ফাঁকা। ফাঁকা চেয়ারের পানে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে ভীষণ রাগ হলো তানিমের। বিড়বিড় করে বললো,“গতকালের ওই ঘটনার জন্য আপনি আজ অফিসে এলেন না অনুভা? ঠিক আছে আমিও দেখে নিবো কতদিন আপনি না এসে পারেন। কতদিন আমায় এভাবে এড়িয়ে চলতে পারেন।”

পরক্ষণেই ভেতরে একটা হাহাকার টের পেলো তানিম। ইচ্ছে করল অনুভা নামক মেয়েটির সম্মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে,“আমায় বিয়ে করতে আপনি রাজি হলেন না কেন অনুভা? আমি কী আপনার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই? কেন যোগ্য নই? কোথায় কমতি আছে আমার? সবকিছু ভুলে গিয়ে একবার আমার হবেন অনুভা? খুব যত্ন করে ভালোবাসবো আপনায়।”

ভাবতে ভাবতেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তানিমের। নিজ চেয়ারে শরীর হেলিয়ে বন্ধ করে নিলো আঁখি যুগল।

বাজার থেকে বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে আছে অনুভা। তখনি ঘরে প্রবেশ করল অর্থিকা। হাতে তার একটা ছোটো বাটি। তাড়া দিয়ে বোনের উদ্দেশ্যে বললো,“এই এই তুই শুয়ে আছিস কেন এখন? দেখি ওঠ তো তাড়াতাড়ি।”

বিরক্তির সহিত উঠে বসলো অনুভা। ক্লান্ত স্বরে শুধালো,“কী?”

তার সম্মুখে বসলো অর্থিকা। বাটি থেকে ডাল বাটাটা নিয়ে চট করে অনুভার মুখে মাখতে মাখতে বললো, “ইস! চেহারার কী অবস্থা হয়েছে একবার দেখেছিস আয়নাতে? একটু যত্নও কী করতে পারিস না?”

নাকমুখ কুঁচকে নিলো অনুভা। জিজ্ঞেস করল,“কী এগুলো?”

“ডাল বাটা। মাখিয়ে দিয়ে যাচ্ছি, টানা আধ ঘণ্টা পর গিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলবি, বুঝেছিস?”

“তোর সমস্যা কী বল তো? হঠাৎ আমার রূপচর্চা নিয়ে পড়লি কেন? আমার কী বিয়ে লেগেছে নাকি?”

“হুম।”

“কী হুম?”

“আজ তোর বিয়ে।”

অবাক হলো অনুভা। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে শুধালো,
“মজা করছিস আপু?”

“না তো।”

“কার সাথে বিয়ে?”

“কার সাথে আবার? তোর প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে।”

আঁতকে উঠলো অনুভা। ভালো করে বড়ো বোনের মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করল। অর্থিকা যে মজা করছে না তা সে সুনিশ্চিত হলো। বাড়িতে রান্নাবান্নার যেই ধুম পড়েছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে আজ বাড়িতে বিশেষ কিছু আছে। অবিশ্বাস্য সুরে বললো,“শ্রাবণ!”

মুচকি হাসলো অর্থিকা। উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে বললো,“হুম, বেচারা আর কতদিন তোর মতো গবেটের জন্য অপেক্ষা করবে? তাই ভাবলাম আজ দুটোকে ধরে বেঁধে একেবারে বিয়ে দিয়ে দেই।”

রাগ হলো অনুভার। নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল লিস্টে যেতে যেতে বললো,“শ্রাবণ তোর মাথায় এসব ঢুকিয়েছে তাই না? দাঁড়া আজ ওর একদিন কী আমার একদিন।”

চটজলদি তার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিলো অর্থিকা। মুখ বাঁকিয়ে বললো,“যত কথা সব বাসর ঘরে গিয়ে বলবি। আপাতত এই মোবাইলটা আমার কাছেই রইলো। আর হ্যাঁ শ্রাবণ বিয়ের ব্যাপারে আমায় কিছু বলেনি। গতকাল রাতে আমিই তাকে জিজ্ঞেস করেছি তোকে বিয়ে করতে পারবে কিনা। আর ও রাজিও হয়ে গেলো তাই বলে দিয়েছি যাতে আজকের মধ্যে বাবা-মা নিয়ে চলে আসে বাড়িতে।”

“আমায় না জিজ্ঞেস করেই কেন এসব করতে গেলি আপু?”

চমকপ্রদ হাসলো অর্থিকা। পরম মমতায় হাত রাখলো ছোটো বোনের মাথায়। কোমল স্বরে বললো,“নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। শুধু তুই বুঝিস না। ছেলেটা তোকে খুব ভালোবাসে অনু। ওর চোখে আমি তোর জন্য ভালোবাসা দেখেছি, সম্মান দেখেছি। শ্রাবণ ছাড়া অন্য কেউ তোকে ভালোবাসতে পারলেও বুঝতে পারবে বলে মনে হয় না। ভালোবাসার থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বোঝাপড়া। তাই অমন একটা মানুষকে কখনোই দূরে ঠেলে দিতে নেই। বরং পরম আবেশে তাকে আগলে রাখতে হয়। হ্যাঁ আমি হয়তো তোকে না জানিয়েই হুট করে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছি কিন্তু এর পেছনে কারণ আছে। আশা করি তোর এতে কোনো আপত্তি নেই?”

চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো অনুভার। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো ‘না’।
________

সূর্য অস্ত গেছে পশ্চিমাকাশে। কিচিরমিচির শব্দ তুলে আকাশ পথে নিজেদের নীরে ফিরছে পাখির দল। লাল টুকটুকে চমৎকার একটি বেনারসি নিয়ে মেয়ের ঘরে উপস্থিত হলেন সুফিয়া। বেনারসিটি মূলত উনি নিজেই পছন্দ করে কিনেছিলেন বড়ো কন্যার জন্য। কিন্তু অর্থিকা সেই বেনারসি পরিধান করে কিছুতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না বলে সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছিল।বিয়েতে সে নিজ পছন্দসই একটি ল্যাহেঙ্গা পরেছিল।তখন মনে মনে বেশ আফসোস নিয়েই যত্ন করে শাড়িটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন সুফিয়া। ভেবেছিলেন বড়ো মেয়েকে না হয় শাড়িটা পরাতে পারেননি কিন্তু ছোটো মেয়ে তো আছে। তার বিয়েতেই না হয় শাড়িটা পরাবেন।

বিছানায় হতাশ হয়ে বসে আছে অনুভা। মাকে দেখতেই সে নড়েচড়ে উঠলো। সুফিয়া হাস্যজ্জ্বল মুখে বিছানায় এসে বসলেন মেয়ের সম্মুখে। শাড়িটা তুলে ধরে বললেন,“আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো এই শাড়িটা পরে আমার মেয়ে তার নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে। কিন্তু অর্থি তো এটা পরলোই না তাই ভেবেছিলাম তোর বিয়ের সময় না হয় তোকেই পরাবো কিন্তু বিয়ে করবো না করবো না বলে তুইও যা শুরু করেছিলি আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম যে আমার স্বপ্নটা হয়তো আর পূরণই হবে না। এই অসম্পূর্ণ ইচ্ছে নিয়েই হয়তো আমাকে মরে যেতে হবে। যাক অবশেষে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। তা পরবি এই শাড়িটা?”

আজ অনেকদিন বাদে মায়ের সেই কোমল গলাটা শুনতে পেলো অনুভা। চোখের কোটরে জমলো অশ্রু। উপরনিচ মাথা নাড়ালো। তৎক্ষণাৎ সুফিয়ার অধরে ফোটে উঠলো হাসির রেখা। আজ অনেকদিন বাদে ভদ্রমহিলার মলিন মুখখানায় হাসির দেখা মিললো। যা দু চোখ ভরে দেখে নিলো অনুভা। এই ছোট্ট একটা কারণে মা হাসলো! ভেবেই বিষ্মিত হলো। সুফিয়া আবদারের সুরে বললেন,“আমি পরিয়ে দেই?”

অনুভা জড়ানো গলায় উত্তর দিলো,“দাও।”

আশানুরূপ উত্তর পেয়ে পুলকিত হয়ে উঠলো সুফিয়ার মন। শাড়ির ভাঁজ খুললেন। তৎক্ষণাৎ কয়েকটা গহনার বাক্স দৃষ্টিগোচর হলো অনুভার। ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো তার। কৌতূহলী কণ্ঠে শুধালো,“এই বাক্সগুলোতে কী আছে মা?”

মেয়ের প্রশ্নে বাক্সের পানে তাকালেন সুফিয়া। একে একে বাক্স তিনটে খুলে বললেন,“কী আবার? গহনা।”

একটা বাক্সে গলার মোটা হার আর কানের এক জোড়া ঝুমকা। আরেকটাতে সোনার দুটো মোটা বালা। তৃতীয় ছোট্ট বাক্সে সোনার দুটো আংটি। এগুলো দেখতেই বিষ্ময় প্রগাঢ় হয় অনুভার। শুধায়, “এগুলো কোত্থেকে এলো মা? তুমি না সব গহনা বিক্রি করে দিয়েছিলে?”

মৃদু হাসলেন সুফিয়া। বললেন,“যেসব গহনা বিক্রি করে দিয়েছিলাম ওগুলো ছিলো আমার বিয়ে আর বৌ ভাতের গহনা। আর এগুলো আমি তোর জন্য গড়েছিলাম তাই আর হাত দেওয়ার সাহস পাইনি। শাড়ির সাথে এগুলোও তুলে রেখেছিলাম। অর্থির গুলো তো অর্থিকে বিয়ের সময়ই দিয়ে দিয়েছিলাম। তার সাথে তোর বাবাও নতুন নতুন অনেক গহনা গড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেসব তো আর ওর ননদেরা ফেরতই দিলো না।নিজেরাই আত্মসাৎ করল। অর্থির বিয়ের সময় তোর বাবা বলেছিল তোর বিয়ের সময়ও নাকি নতুন নতুন অনেক গহনা গড়িয়ে দিবে, বড়ো মেয়ের মতো ছোটো মেয়েকেও সোনা দিয়ে মুড়িয়ে তারপর শ্বশুর বাড়িতে পাঠাবে। কিন্তু তা তো আর হলো না তাই আর কী করার? এইটুকুই রাখ মা। আর পারলে মাফ করে দিস বাবাকে।”

বলেই আঁচলে চোখ মুছলেন সুফিয়া। মাকে জড়িয়ে ধরলো অনুভা। ভারি কণ্ঠে বললো,“তোমাদের প্রতি আমার কোনো রাগ ক্ষোভ নেই মা। তাহলে মাফ করার প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?”

প্রসন্ন হলেন সুফিয়া। নিজের থেকে মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,“হয়েছে, এবার তৈরি হতে হবে তো নাকি? ওদের তো আসার সময় হয়ে গেলো।”

লাজুক হাসলো অনুভা। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করল।

কালো রঙের গাড়িটা এসে থামলো নির্দিষ্ট বিল্ডিং এর সামনে। হানিফ শেখ এবং শান্তা নামলেন গাড়ি থেকে। তাদের পিছুপিছু নামলো শ্রাবণও। গাড়ির ডিকি থেকে ড্রাইভারের সাহায্যে নামানো হলো সঙ্গে আনা মিষ্টান্ন আর ফলমূলের প্যাকেট। ভেতরের দিকে হাঁটা ধরলেন হানিফ শেখ। উনার সঙ্গে ব্যাগ হাতে ড্রাইভার লোকটি। শান্তা হাঁটছেন ছেলের সঙ্গে। ফিসফিস করে বললেন,“আমার তো হার্টবিট বাড়ছে রে মেহু।”

“একদম মেহু মেহু বলে ডাকবে না মা।”

“আহা অভ্যাস হয়ে গেছে তো।”

“হোক অভ্যাস। তবুও ডাকবে না। আর ভেতরে তো একদমই নয়, আমার মান সম্মানের ব্যাপার।”

মুখ বাঁকালেন শান্তা। বললেন,“মান সম্মান! তোর আবার মান সম্মান আছে? বিয়ের দিন মাকে তৈরি বউ দেখাতে নিয়ে এসেছে।তার আবার মান সম্মান।”

কথাটা বলেই আগে আগে হাঁটতে লাগলেন শান্তা। একটা সিঁড়ি অতিক্রম করতেই মস্তিষ্কে কিছু একটা উঁকি দিলো শ্রাবণের। দাঁড়িয়ে পড়লো পথিমধ্যে। গলা উঁচিয়ে পিতার উদ্দেশ্যে বললো,“যাহ বাবা! আমি তো একটা জিনিস আনতে ভুলেই গিয়েছি।”

হানিফ শেখও থেমে পুত্রের পানে তাকালেন।জিজ্ঞেস করলেন,“কী আনতে আবার ভুলে গেলি? সবই তো নেওয়া হয়েছে।”

“আমার নেওয়া হয়নি। তোমরা ভেতরে যাও আমি ওই জিনিসটা নিয়ে আসছি।”—বলেই নিচে নামা ধরলো শ্রাবণ।

হানিফ শেখ পিছু ডেকে শুধালেন,“আরে কোন ফ্ল্যাট সেটাই তো আমরা জানি না।”

“চতুর্থ ফ্লোর, বাম দিকের দুই নম্বর ফ্ল্যাট।”—কথা শেষ করে চলে গেলো শ্রাবণ।

তার কথামতো স্ত্রীকে নিয়ে সেদিকেই পা বাড়ালেন হানিফ শেখ। নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী। হানিফ শেখ সৌজন্য হেসে বললেন,“আমরা শ্রাবণের বাবা-মা।”

মেয়েটি হেসে দরজার সম্মুখ থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললো,“আমি মেয়ের বড়ো বোন। ভেতরে আসুন।”

উনাদের নিয়ে সোফায় বসালো অর্থিকা। ডেকে আনলো মাকে। সুফিয়া এসেও বসলেন সোফায়। সালাম বিনিময় করলেন। মাজেদা এসে শরবত আর কিছু নাস্তা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে উনাদের আনা মিষ্টির প্যাকেটগুলো নিয়ে গেলো ভেতরে। একে অপরের সঙ্গে মুহূর্তেই পরিচয় পর্ব শুরু হলো। হবু পুত্রবধূকে দেখার জন্য মন উথাল পাতাল করছে শান্তার। আর না পেরে এবার বলেই বসলেন,“মেয়েকে আনুন না। ওকে দেখার জন্য তো আমার আর তড় সইছে না।”

স্ত্রীর এহেন কথায় অপ্রস্তত হলেন হানিফ শেখ। জোরপূর্বক হেসে বললেন,“কী বলবো বলুন তো? আমরাই হয়তো প্রথম বাবা-মা যারা কিনা বিয়ের দিন পুত্রবধূর সঙ্গে পরিচিত হবো, পুত্রবধূকে চোখের দেখা দেখতে পাবো। তাই শ্রাবণের মা একটু কৌতূহলী হয়ে আছে।”

উনাদের কথায় সুফিয়া চমকান। চমকিত কণ্ঠে শুধান, “সে কী! এর আগে আপনারা অনুকে দেখেননি? ফটো? কোনো ফটোও দেখেননি?”

শান্তা পাল্টা প্রশ্ন করেন,“মেয়ের নাম বুঝি অনু?”

চমকের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলো সুফিয়ার। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললেন,“আমার ছোটো মেয়ের নাম অনুভা হাসান। ডাকনাম অনু।”

“সুন্দর নাম। আমাদের ছেলেদের কথা আর কী বলবো? ছোটোটা প্রাণচ্ছল হলেও বড়োটা হয়েছে একেবারে বিপরীত। সহজে মুখ ফোটে কিছু বলতেই চায় না। এই যে বিয়ের জন্য যখন আমি মেয়ে দেখার চাপ দিলাম তখনই বললো, আমার বউ হিসেবে মেয়ে অলরেডি পছন্দই আছে মা। তারপর যখন ওর পছন্দের মেয়ে দেখতে চাইলাম তখন জানেন কী বলে? বলে যে, আহা মা এত আগে বউ দেখে কী করবে বলো তো? বিয়ের পর তো একেবারে তোমার কাছেই চলে আসবে তখন মনে ভরে দেখে নিও তাকে।”—বলেই শব্দহীন হাসলেন শান্তা।

সুফিয়া ভেতরে ভেতরে বেশ চমকেছেন। এ আবার কেমন দ্বারার ছেলে? প্রশ্ন করলেন,“ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি না যে কোথায় ও?”

হানিফ শেখ উত্তরে বললেন,“ও এসেছে, কী যেনো আনতে ভুলে গেছে সেটাই আনতে গিয়েছে। চলে আসবে।”

শান্তা এবার অশান্ত কণ্ঠে বললেন,“আপা মেয়েকে নিয়ে আসুন না।”

তখনি ড্রয়িং রুমে অনুভাকে নিয়ে হাজির হলো অর্থিকা। এনে বসালো সোফার এক স্থানে। হাতের তালু, পায়ের পাতা এতক্ষণে ঘেমে গেছে অনুভার। ভেতরে বয়ে যাচ্ছে ঝড়। কী অদ্ভুত অনুভূতি! জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো চুপচাপ। শান্তা একদৃষ্টে তার পানে তাকিয়ে থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে বসলো। থুতনিতে ধরে মুখ উঁচু করে আনমনে বলে উঠলো,“মাশাআল্লাহ কী স্নিগ্ধ!”

এ কথাটাই যেনো ছিলো অনুভার অস্বস্তি বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। লজ্জায় নুইয়ে গেলো সে। ফর্সা মুখশ্রীতে ছড়িয়ে গেলো রক্তিম আভা। তাও চোখে পড়ল শান্তার। প্রসন্ন হেসে বললেন,“আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে।”

বড়ো ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে দুটো মোটা সোনার বালা বের করলেন শান্তা। অনুভার হাত দুটো টেনে নিজের কোলে এনে পরাতে পরাতে বললেন,“এখন বুঝলাম কেন আমার খুঁতখুঁতে, গম্ভীর স্বভাবের ছেলেটা তোমার প্রেমেতে মজেছে।”

বাকরুদ্ধের ন্যায় বসে রইলো অনুভা। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার।মনে মনে অজস্র গালি দিচ্ছে শ্রাবণ নামক অসহ্য পুরুষটিকে। তার এমন পাগলামির কারণেই তো আজ অনুভাকে এমন বিপাকে পড়তে হলো।

নিজের কাজ সেরে এসে উপস্থিত হলো শ্রাবণ। দরজা খোলাই ছিলো। ভেতরে প্রবেশ করে নির্দিষ্ট মানুষের দিকে দৃষ্টি যেতেই ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো তার। লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিত এক রমনী বসে আছে মায়ের পাশে। রমনীর এই রূপের সঙ্গে অপরিচিত প্রেমিক পুরুষটি। এত বছরের পরিচয় এবং গোপন প্রণয়ে এই প্রথম মেয়েটির এমন রূপ দু চোখ ভরে দেখে নিলো শ্রাবণ। পুত্রকে দৃষ্টিগোচর হলো হানিফ শেখের। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,“এই তো শ্রাবণ এসে গেছে। দেখি এদিকে আয়।”

পিতার কণ্ঠস্বরে ধ্যান ভঙ্গ হলো শ্রাবণের। সুফিয়াকে সালাম জানিয়ে বসে পড়ল পিতার পাশে। ছেলেটাকে চিনতে তেমন অসুবিধে হলো না সুফিয়ার। কামরুল হাসান যেদিন মারা গেলেন সেদিনই তো এই ছেলেকে দেখেছিলেন উনি। এই ছেলেই তো উনাদের অনেক সাহায্য করেছে। তবে সেদিন একটা শোকের মধ্যে থেকে অতো ভালো করে দেখা হয়নি ছেলেটাকে। তবে আজ মন ভরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলেন তাকে। মনে মনে উচ্চারণ করলেন,“মাশাআল্লাহ।”

ছেলের উদ্দেশ্যে শান্তা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“তোর পছন্দ আছে রে মেহু, আমার কিন্তু বউমাকে খুব মনে ধরেছে।”

মনে মনে মায়ের উপর চরম ক্ষীপ্ত হলো শ্রাবণ। এতবার বলে দেওয়ার পরেও কিনা আবারো মা তাকে এই নামে ডাকলো? এখনো একবারের জন্যও শ্রাবণের মুখপানে তাকায়নি অনুভা। হবু শাশুড়ির এমন কথাতেই লজ্জার পর্দা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। সেই লাজুক মুখশ্রীটাও দেখে নিলো শ্রাবণ। জিভের ডগা দিয়ে ভিজিয়ে নিলো ওষ্ঠদ্বয়।

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-২১+২২

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২১]

কুয়াশার চাদরে মুড়ে আছে পুরো ধরিত্রী। শহরের রঙ বেরঙের বর্ণিল সাজে আর কোলাহলে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে রাতটা। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে জনজীবন। অফিস শেষে বাড়িতে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে সবে আরাম করে বসেছিল অনুভা। কিন্তু তার এই আরামটা যেনো কিছুতেই সহ্য হলো না অর্থিকার। পারভিনার উপর তাঈমের সকল দায়িত্ব দিয়ে ছোটো বোনকে বগল দাবা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল সে।

রিক্সা চলছে তার আপন গতিতে।উৎসুক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিক দেখতে ব্যস্ত অর্থিকা। শেষ যেদিন রাতের শহরটাকে সে দেখতে বের হয়েছিল তখন তার পাশে ছিলো স্বামী তন্ময়। আর তাঈম ছিলো তার গর্ভে। জীবনের চড়াই উতরাই পেরিয়ে অবশেষে বাস্তবতাটা মেনে নিতে পেরেছে মেয়েটা। জীবনে মানুষ আসে ভালোবাসা নিয়ে তারপর একটা সময় তারা চলেও যায়। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে চলে যায় আবার কেউ বা যায় অনিচ্ছাকৃত। তাই বলে কি সেই ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য সারাজীবন দুঃখের সাগরে ভেসে বেড়িয়ে ঘর বন্দী করে রাখতে হবে নিজেকে? মোটেও নয়। ভালোবাসার প্রধান ধাপই তো হচ্ছে নিজেকে ভালোবাসা। যে নিজেকে ভালোবাসে না সে আসলে ভালোবাসতেই জানে না।

বোনের এই নির্লিপ্ত ভাবসাব দেখে বিরক্ত হলো অনুভা। শুধালো,“আচ্ছা আপু সত্যি করে বল তো আমরা যাচ্ছি কোথায়?”

“নতুন বাসা খুঁজতে।”

“এভাবে রিক্সায় ঘুরে ঘুরে?”

“বাসার খোঁজ আমি পেয়েছি। আজ শুধু দেখতে যাবো। পছন্দ হলে সব কথাবার্তাও না হয় বলে আসবো।”

পূর্বের ন্যায় চুপ করে গেলো অনুভা। কথা আর বাড়ালো না। কয়েক মিনিট বাদে রিক্সা থামিয়ে নেমে পড়ল অর্থিকা। অনুভাও নামলো বোনের সাথে। ভাড়া দিয়ে হাঁটতে লাগলো তার পিছুপিছু।

কয়েক কদম হাঁটতেই পা জোড়া থামলো একটি মস্ত বড়ো বিল্ডিংয়ের সামনে। বাহিরে ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার টু-লেট ঝুলছে। অর্থিকার সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা। ফাঁকা ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখে পছন্দও হয়ে গেলো দু বোনের। একপর্যায়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথোপকথন সেরে সব ঠিকঠাক করে চলে এলো দুজনে। সামনের মাসের মাঝামাঝিতে গিয়েই উঠবে ওখানে।
_____________

রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় এসে কেবল শুয়েছে শ্রাবণ। তখনি ঘরে প্রবেশ করল সৌহার্দ্য। শরীরের ভারসাম্য ছেড়ে দিয়ে ভাইয়ের পাশাপাশি সেও শুয়ে পড়ল। তার উপস্থিতি টের পেতেই শ্রাবণ গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,“কী চাই এখানে?”

“তোকে চাই।”

সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো শ্রাবণের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে ছোটো ভাইয়ের পানে তাকালো। তার এহেন দৃষ্টি দেখতেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো সৌহার্দ্য। বললো, “বিয়ের পর তো আর চাইলেই আমরা দু ভাই একসঙ্গে শুতে পারবো না। বউরা তখন রাগ করবে। তাই আজ তোর সঙ্গে ঘুমাতে চলে এলাম।”

“মিথ্যে বলিস না। তোর মতলব একদম ভালো ঠেকছে না। নিজের ঘরে যা।”

শ্রাবণের সঙ্গে আরেকটু লেপ্টে গেলো সৌহার্দ্য। এক ফাঁকে চুমুও খেয়ে নিলো গালে। ছোটো ভাইয়ের এমন কাজে হতবাক, হতভম্ব শ্রাবণ। শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসলো। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললো,“এই এই সত্যি সত্যি তো দেখছি তোর মতলব ভালো না! নিশ্চয়ই এমন কিছু চাইতে এসেছিস যা আমি কখনোই তোকে দিবো না। তাই না?”

উঠে বসলো সৌহার্দ্য। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। শ্রাবণ বাম ভ্রু উঁচিয়ে ফের শুধায়,
“তাহলে?”

“দেখ ভাইয়া, প্রান্তির কথা আমি সবার আগে তোকে বলেছি তাই না?”

“হুম, বলেছিস।”

“প্রান্তির ছবিও দেখিয়েছিলাম।”

“হুম তবে আমি খেয়াল করে দেখিনি।”

“সেটা তোর ব্যাপার। গতকাল সামনাসামনিও তো দেখলি।”

“মেইন টপিকে আয়।”

“তাহলে তুই কেন ভাবীর কথা আমায় বলিসনি?”

“না বললে জানলি কী করে তোর ভাবী আছে?”

দমলো না সৌহার্দ্য। নাদান বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে বললো,“ছবিও তো দেখাসনি। দেখা না ভাইয়া একটা ছবি। কেমন দেখতে ভাবী? নাম কী তার? তোদের প্রেম কাহিনীটা অন্তত বল।”

“ছবি দেখে কাজ নেই। দেবর হচ্ছে মৃ’ত্যু সমতুল্য। তাই দূরে দূরে থাকবি বুঝলি? তাছাড়া তোদের মতো অসব লুতুপুতু প্রেম কাহিনী আমাদের মধ্যে নেই।”

মন ভার হলো সৌহার্দ্যের। বললো,“এভাবে বলতে পারলি ভাইয়া?”

“যা সত্যি তাই বললাম। বিয়ে হোক তারপর তো দেখতেই পারবি। এখন নিজের ঘরে যা।”

দমলো না সৌহার্দ্য। চট করে বালিশের পাশ থেকে তুলে নিলো বড়ো ভাইয়ের মোবাইল। শ্রাবণ নড়লো না। কিছু বললোও না। চুপচাপ দেখতে লাগলো তার কাণ্ড কারখানা। বিজয়ী হাসি হেসে মোবাইল অন করতেই মুখশ্রী থেকে হাসি বিলীন হলো সৌহার্দ্যের। মোবাইলটা লক করা।যথাস্থানে মোবাইল রেখে দিয়ে উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। দরজার দিকে অগ্ৰসর হতে হতে অভিমানী স্বরে বললো,“তুই সত্যিই একটা নেমকহারাম ভাইয়া। এভাবে ছোটো ভাইয়ের থেকে সবকিছু লুকিয়ে গেলি না? সবকিছু আমি মনে রেখে দিলাম। পই পই করে হিসেব রাখলাম।”

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। গলা উঁচিয়ে বিপরীতে বললো, “তুই যেই ভুলোমনা কাল সকাল পর্যন্ত মনে থাকবে কিনা সন্দেহ। এক কাজ কর, ঘরে গিয়েই ডায়েরিতে সব লিখে রাখ।”
__________

গতকাল রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি অনুভার।অফিসে বসে থাকলেও মন পড়ে আছে সেই বিছানায়। চোখ জ্বলছে ঘুমে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো বেশ কয়েকবার। লাঞ্চ টাইম আসতে এখনো ধের দেরি। এই মুহূর্তে এক কাপ কড়া লিকারের চা হলে মন্দ হতো না। অনন্ত ক্লান্তিটা তো দূর হতো।

ভাবনা থেকে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল অনুভা। তখনি টেবিলের ফাঁকা স্থানে কেউ চা ভর্তি একটি চায়ের কাপ এনে রাখলো। তৎক্ষণাৎ চমকে উঠলো সে। ঘাড় উঁচিয়ে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো আজগরকে। পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসলো লোকটি। বললো,“আপনে কাজে অমনোযোগী ম্যাডাম। তাই স্যার কইছে চা খাইয়া শরীর চাঙ্গা কইরা কাজে মন দিতে।”

কথাটা শেষ করে প্রস্থান করলেন আজগর। ভিতু হলো অনুভার মন। আশেপাশে তাকিয়ে এবার তাকালো সম্মুখে লাগানো সিসি ক্যামেরার পানে। খুব রাগ হলো নিজের উপর। জেনেবুঝে এই ভুলটা করল কী করে সে?কে জানে স্যার কী মনে করছেন? ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে চায়ের কাপে চুমুক বসালো অনুভা। সকল ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে মনোযোগ বসালো কাজে।

পুরো বিষয়টি খুব ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করল তানিম। মেয়েটির ভাবুক দৃষ্টি দেখতেই মুচকি হাসলো। বিড়বিড় করে বললো,“আপনি এমন কেন অনুভা? খুব অদ্ভুত এক নারী। নারীদের কী এমন অদ্ভুত আচরণে মানায়?”

পুরো একটা দিন পেরিয়ে রাত হলো। সকল কাজের অবসান ঘটিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে চেয়ার ছেড়ে টানটান হয়ে দাঁড়ালো অনুভা। বের হলো অফিস থেকে। সবসময়কার মতো একই স্থানে দেখা পেয়ে গেলো বড়ো আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির। হাত ভাঁজ করে গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। মুখশ্রীর ভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। সহাস্যে তার দিকে এগিয়ে গেলো অনুভা। আজও সপ্তাহ খানেক পর দুজনার দেখা হলো। কোনো ভণিতা ছাড়াই পুরুষটির উদ্দেশ্যে সে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “সবসময়ই সপ্তাহে একদিন আমাদের দেখা হয়। দেখা হওয়ার পর টানা সাতদিন তুমি আমার সামনে আসো না। কিন্তু আমি জানি রোজ তুমি আমায় দেখো, আমার খেয়াল রাখো। এবার প্রশ্নটা হচ্ছে এমন করে কী মজা পাও বলো তো?”

প্রশ্নটি করে থামলো অনুভা। উত্তরের আশায় বিপরীতে দাঁড়ানো পুরুষটির মুখশ্রীতে গাঢ় দৃষ্টি রেখে তাকিয়ে রইলো। চমৎকার হাসলো শ্রাবণ। উত্তরে বললো, “তোমাকে আমার অনুপস্থিতি সম্পর্কে ভাবাতে। তোমার মনে আমাকে এক নজর দেখার ব্যাকুলতা সৃষ্টি করতে।”

থামলো শ্রাবণ। সেকেন্ড দুয়েক বিরতি নিয়ে বাম ভ্রু উঁচিয়ে খানিকটা ঝুঁকলো অনুভার দিকে। প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তা আমার উদ্দেশ্যে কী আমি সফল হতে পারলাম? আমার নোভা রাণী কী আমায় মিস করেছে?”

অপ্রস্তুত হলো অনুভা। আশেপাশে অপ্রয়োজনে তাকালো। প্রসঙ্গ বদলাতে বললো,“আজকে অনেক ঠাণ্ডা পড়েছে তাই না?”

“তা তো অবশ্য পড়েছেই।এমন একটা আবহাওয়াতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় রোজ তোমায় খুব মিস করি। তুমি পাশে থাকলে হয়তো এই ঠাণ্ডার মধ্যে আমাকে কোলবালিশ ধরে শুয়ে থাকতে হতো না।”

ছেলেটার কথাবার্তা দিনদিন লাগাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রাগ হলো অনুভার। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“অসভ্য একটা।”

হাসিটা চওড়া হলো শ্রাবণের। বললো,“জানো?আমার ছোটো ভাই না তোমার উপর চরম ক্ষীপ্ত।”

কথাটা কর্ণপাত হতেই অবাক হলো অনুভা।ছেলেটার যে একটা ভাইও আছে সে বিষয়ে আজ প্রথমই জানলো সে। তার উপর সেই ভাই তার উপর কেন রাগ করবে? আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে শুধালো,“কেন? আমি আবার কী করলাম?”

“অবশ্যই করেছো। তোমার জন্যই তো ও ওর বউকে ঘরে তুলতে পারছে না।”

“আমার জন্য! আমি তো তোমার ভাইকে কখনো দেখলামই না। সেখানে ওর বউ কোত্থেকে এলো?”

“দেখোনি তো কী হয়েছে? ও একটা মেয়েকে ভালোবাসে। বাবা-মা ওদের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়েছে কিন্তু বিয়েটা আটকে আছে।”

“কেন আটকে আছে?”

“কেন আবার? বিবাহযোগ্য বড়ো ভাই রেখে ছোটো ভাইয়ের বিয়ে? আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী তো রীতিমতো কুটনৈতিক বৈঠক বসিয়ে দিবে।”

“তাহলে এখানে আমার উপর কেন ক্ষীপ্ত হলো? দোষ তো তোমার। তুমি বিয়ে করে নাও তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।”

এতক্ষণ যেনো এ কথাটা শোনার জন্যই ভেতরে ভেতরে ওৎ পেতে ছিলো শ্রাবণ। চট করে বললো,“অবশ্যই তোমার দোষ। আমি কী চাইছি না বিয়ে করতে? অবশ্যই চাইছি। বউ ছাড়া এত দীর্ঘ রাত কাটাতে আমার কষ্ট হয়। আমি তো সেই কবে থেকেই তোমাকে বলে যাচ্ছি আমায় বিয়ে করো নোভা, আমায় বিয়ে করো। কিন্তু তুমিই তো করছো না। সেক্ষেত্রে সব দোষ তোমার।”

ভেতরে ভেতরে অনুভূতিরা তাণ্ডব চালালেও বাহির থেকে নিজেকে কঠোর রাখলো অনুভা। বললো,
“তুমি এমন অধৈর্যশীলদের মতো কেন করছো বলো তো? আমাদের মধ্যে কিছু হতে পারে না। পরিবার যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে তাকেই বিয়ে করে সুখী হও।”

কথাটা মোটেও গুরুত্ব সহকারে কানে তুললো না শ্রাবণ। ভাবলেশহীন বললো,“আমাদের একে অপরের সুখ যে আমাদের দুজনার মধ্যেই নিহিত নোভা। অন্য কারোর সঙ্গেই যদি নিজেকে বাঁধতে পারতাম তাহলে এতকিছুর পরেও কী আর ফিরে আসতাম? তাছাড়া আমার মতো লয়্যাল ছেলে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে তুমি দ্বিতীয়টি আর খুঁজে পাবে না। বুঝলে?”

আহত দৃষ্টিতে তাকালো অনুভা। এই পুরুষটির জন্য আকাশসম অনুভূতির পাহাড় যে অনেক আগে থেকেই তার ভেতরে রয়েছে। বারবার তাকে ফিরিয়ে দিতেও ভীষণ কষ্ট হয় অনুভার। কিন্তু সব বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকতে হয় তাকে। ভবিষ্যৎ ভেবে ভিতু হয় তার মন। শ্রাবণের বাবা-মা তাদের সম্পর্কে সব জানার পর আদৌও কী তাকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিবেন?

তাকে ভাবনার অন্তর্জালে ডুবে যেতে দেখে গাড়ির দ্বার খুলে দিলো শ্রাবণ। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“উঠে বসো।”

ধ্যান ভঙ্গ হলো অনুভার। নিরবে উঠে বসলো গাড়িতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজ গতিতে চলতে শুরু করল গাড়ি। এতক্ষণ ধরে এই কপোত কপোতীকে দূর থেকেই খুব গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে গেলো এক জোড়া চোখ। রোষানলে ফেটে পড়ল তার সমস্ত দেহ। শক্ত কণ্ঠে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে আদেশ ছুঁড়লো,“স্টার্ট দাও।”

মালিকের এমন কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পূর্ব পরিচিত মাঝ বয়সী ড্রাইভার। শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত হাতে স্টেয়ারিং ঘুরালো।

সবসময়কার মতো দক্ষ হাতে গাড়ি চালাচ্ছে শ্রাবণ। পাশেই বসা অনুভা। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তুমি আপুকে চাকরির সন্ধান দিয়েছো?”

শ্রাবণের সোজাসাপ্টা জবাব,“হ্যাঁ।”

“এটা করার কী খুব প্রয়োজন ছিলো?”

“অবশ্যই ছিলো।”

“কেন? অতীত থেকে সবে আপু বেরিয়ে এসেছে। মুভ অন করেছে, তার মধ্যেই মাথার মধ্যে চাকরির ভূতটা ঢুকানোর কোনো প্রয়োজন তো আমি দেখছি না। তাছাড়া আমিই তো সবটা সামলাচ্ছিলাম।”

“চাকরির ভূত আমি ঢুকাইনি। উনি নিজেই হয়তো এ বিষয়ে ভেবেছেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি শুধু হেল্প করেছি ব্যস। তোমার উচিত উনার সিদ্ধান্তকে সম্মান করা। অন্যের উপর বোঝা হয়ে থাকার থেকে নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়া ভালো নয় কী?”

কথাটা মোটেও আশা করেনি অনুভা। আহত হলো তার মন। মিনমিনে স্বরে বললো,“আমার মা বোন এবং বোনের সন্তান আমার কাছে বোঝা নয়। তারা আমার আপনজন। তাদের দেখভাল করা আমার দায়িত্ব।”

“অমন ইঙ্গিতে কথাটা বলিনি নোভা। কষ্ট পেও না। চিরকাল কী কেউ থাকে এই পৃথিবীতে?আরেকজনের উপর নির্ভর হওয়ার থেকে নিজেরই একটা কিছু করা উচিত নয় কী? উনি তো ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তুমি যেভাবে জব করছো সেভাবেই করো। পরিবারের দায়িত্ব পালন করো। পাশাপাশি আপু যা করছেন তা উনাকে করতে দাও। এতে উনার উপকারই হবে।”

কথাটা মন দিয়ে শুনলো অনুভা। অনুধাবন করার চেষ্টা করল। কিছু সময়ের মধ্যে শ্রাবণের কথাটার অর্থ ধরেও ফেললো। তাই আর কথা বাড়ালো না। মেনে নিলো সবটা।

চলবে __________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২২]

কুয়াশার ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ এসে আলোকিত করে তুলেছে ধরণীকে। বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে প্রভাতটা উপভোগ করছে অনুভা। দেখতে দেখতে আরো একটি মাস কেটে গেলো। গতকালই পরিবার নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে দু বোন। এখনো পুরোপুরি ভাবে গোছগাছ করা হয়নি কিছুই। শুধু মায়ের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটাই গুছিয়ে উঠতে পেরেছে দুজনে।

আজ শুক্রবার। আজ আর বাজার করতে বের হয়নি অনুভা। অর্থিকা বাজারে যেতে নিষেধ করেছে তাকে। আজ অনেকদিন বাদে মেজাজটা বেশ ফুরফুরে অনুভার। মাথায় নেই কোনো চিন্তা, দেহে নেই ক্লান্তির ছাপ। এই মুহূর্তে বাবাকে খুব মনে পড়ছে তার। আচ্ছা বাবা কেমন আছে কবরে? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে হানা দিতেই মন ভার হয় অনুভার। চায়ের কাপ খালি হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। বারান্দা থেকে উঠে ঘরে ফিরে এলো সে। আগের ফ্ল্যাটের তুলনায় নতুন ফ্ল্যাটটা বেশ বড়ো আর খোলামেলা। ঘরগুলো জুড়েও শুধু আলোর খেলা।

সুফিয়া বিছানায় শুয়ে আছেন। আগের সেই তেজ এখন আর অবশিষ্ট নেই উনার মধ্যে। স্বামীর মৃ’ত্যুর পর প্রাণহীন নির্জীব হয়ে গেছেন ভদ্রমহিলা। কারো সঙ্গে তেমন কথা বলেন না আর।

তাঈম মেঝেতে বসে খেলনা নিয়ে খেলছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখ দিয়ে আওড়াচ্ছে অস্পষ্ট কিছু শব্দ। অনুভা এসে বসলো তার সম্মুখে। তাকে দেখতেই চঞ্চল হয়ে উঠলো তাঈম। হাতের খেলনা গাড়িটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“মা, মা, খেলু খেলু।”

মুচকি হাসলো অনুভা। খেলনা গাড়ি না নিয়ে নিজ কোলে বসালো তাঈমকে। গাল দুটো আলতো করে টিপে দিয়ে বললো,“মা না খালামণি বল।”

কথাটা কিছুতেই মনঃপুত হলো না ছোট্ট তাঈমের। গলা জড়িয়ে ধরে বললো,“মা আমা মা।”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো অনুভা। তার হাসির শব্দে ভেতর ঘর থেকে ছুটে এলো অর্থিকা। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে বোন আর ছেলেকে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে শুধালো,“কী হলো এভাবে হাসছিস কেন অনু?”

বোনের প্রশ্নে যেনো বেশ মজা পেলো অনুভা। অধরে হাসি রেখেই জবাব দিলো,“তোর ছেলে একটু একটু করে হাঁটতে শিখে গেছে কিন্তু এখনো আমাকে মা বলে ডাকা ভুলেনি। আমি বললাম মা না খালামণি বল কিন্তু ও কী বলে জানিস?”

ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হয় অর্থিকার। শুধায়,“কী?”

সরাসরি উত্তর দেয় না অনুভা। প্রমাণ দেখাতে হবে। তাই ফের তাঈমের পানে দৃষ্টি ফেলে শুধায়,“আমি তোমার কী হই বাবাটা?”

প্রশ্নের বিপরীতে সঙ্গে সঙ্গে অবুঝ বাচ্চাটির থেকে উত্তর এলো,“মা মা।”

আবারো হেসে উঠলো অনুভা। তাকে জড়িয়ে ধরলো বুকের সঙ্গে। আজ আর রাগলো না অর্থিকা। সেও হেসে দিলো ছোটো বোনের সঙ্গে। হাস্যজ্জ্বল মুখে বললো,“তোর মা হওয়ার তো খুব শখ দেখছি রে অনু! তোর এই শখটা পূরণের জন্যই এবার আমি তোকে বিয়ে দিয়ে দিবো।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই মেঝেতে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠলো। উঁকি দিয়ে স্ক্রীনে ভাসমান ‘শ্রাবণ’ নাম দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা দেখে মুচকি হাসলো অর্থিকা। ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,“ওই যে বিয়ের কথা বলতে না বলতেই বাচ্চার ভবিষ্যৎ বাপ কল দিয়ে দিলো। কী টাইমিং রে বাব্বাহ্!”

বড়ো বোনের কথাটা শ্রবণালী ভেদ করে মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই লজ্জায় ফর্সা গাল দুটোতে রক্তিম আভা ফোটে উঠলো অনুভার। তাঈমকে খেলনা দিয়ে মেঝেতে বসিয়ে রিসিভ করল কল। সবসময়কার মতো আজও তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বিপরীত পাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বর,
“তোমার তো দিনে দিনে খুব অবনতি হচ্ছে নোভা! রুটিন মাফিক আজ তোমার বাজার করার কথা ছিলো কিন্তু তুমি বাজার করতে এলে না।এটা কী ঠিক করলে? এই এই তুমি কী এখন আমাকে তোমার বাজার করার কেয়ার টেকার বানাতে চাইছো নাকি?”

একসঙ্গে এতগুলো কথা শোনার পর হতভম্ব হয়ে গেলো অনুভা। কিয়ৎ নিরব থেকে তার স্বরেই বললো,“তুমি তো আমার বডি গার্ড। বডি গার্ডের পদ ছেড়ে আবার কেয়ার টেকার হতে চাইছো?”

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। কিন্তু তা প্রকাশ করল না বরং পূর্বের ন্যায় গম্ভীর কণ্ঠেই বললো,“তুমি আমায় বডি গার্ড বলতে পারলে নোভা?”

“তো কী বলবো? যেভাবে সারাক্ষণ আমার খবরা খবর রাখো তাতে তো আমার এমনটাই মনে হয়।”

“জামাই না হয়েও জামাইয়ের মতো তোমায় আগলে রাখি আর তুমি কিনা আমার সম্পর্কে এমনটা ভাবলে? ছিহ্।”

নিঃশব্দে হাসলো অনুভা। এ যেনো সেই পুরোনো শ্রাবণ। সবকিছু বদলালেও এই ছেলেটার আচার ব্যবহার একটুও বদলায়নি। তার হাসি দেখতেই তাঈমও হেসে উঠলো। আদো আদো বুলি ছুঁড়লো,“মা মা আমা তাতে খেলু।”

পুরো কথাটাই স্পষ্ট শুনতে পেলো শ্রাবণ। প্রশ্ন করল,
“বাচ্চাটা কে? তাঈম?”

“হুম।”

“অর্থি আপু কী তোমার পাশেই?”

“না, আপু তার ঘরে।”

“তাহলে মা বলে কাকে ডাকে?”

“কাকে আবার? আমায় ডাকে।”

ললাটে ভাঁজ পড়ে শ্রাবণের। কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে কিছু একটা ভেবে উঠতেই হেসে ওঠে। বলে,
“বাহ নোভা! বিয়ের আগেই মা ডাক শোনা হয়ে গেছে তোমার? আমি তবে বাদ যাবো কেন? দাঁড়াও আমি বরং আমার ফটো পাঠাচ্ছি।”

ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায় অনুভার।শুধায়,“কেন?
তোমার ফটো দিয়ে আমি কী করবো?”

“কেন আবার?তাঈমকে দেখিয়ে বাবা ডাক শেখাবে, পরেরবার দেখা হলেই বাবা ডেকে আমার কোলে চলে আসবে ও।”

“অন্যের বাচ্চার থেকে বাবা ডাক শোনার এত শখ কেন হ্যাঁ? পারলে নিজে একটা পয়দা করে নাও।”

কথাটা মনঃপুত হলো শ্রাবণের। কণ্ঠে খেলে গেলো দুষ্টুমি। বললো,“এই জন্যই বলেছিলাম চলো বিয়ে করে নেই। তারপর না হয় বাচ্চা পয়দা করার কাজকর্ম শুরু করবো।”

ছেলেটার এমন লাগামহীন কথায় থতমত খেয়ে গেলো অনুভা। বেশ লজ্জাও পেলো। দাঁতে দাঁত চেপে ‘অসভ্য’ বলেই কেটে দিলো কল। এতক্ষণের আটকে রাখা হাসিটা এবার বাহ্যিকভাবে প্রকাশ পেলো শ্রাবণের। হাসতে হাসতে বিছানায় মোবাইল রেখে ঘর থেকে বের হলো সে।

টেবিলে বসে চপিং বোর্ডে তরকারি কাটছেন শান্তা।মায়ের পাশের চেয়ারটায় এসে বসলো শ্রাবণ। ছেলেকে দেখতেই মুখ বাঁকালেন শান্তা।আফসোসের সুরে বলতে লাগলেন,“কী কপাল আমার!যেই বয়সে ছেলের বউয়ের হাতের রান্না খাওয়ার কথা সেই বয়সে নিজে রান্না করে খেতে হচ্ছে। কী লাভ হলো দু দুটো ছেলের মা হয়ে? এর থেকে যদি মেয়ে হতো তাহলে অন্তত এতদিনে ডজন ডজন নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলতে পারতাম।”

মায়ের কথায় আড়ালে হাসলো শ্রাবণ। তবে সামনাসামনি গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“আজ শুক্রবার, তোমরা চাইলে কিন্তু আজ আমার বিয়েটা দিয়ে দিলেই পারতে মা। তাহলে অন্তত তোমার দুঃখ কষ্ট ঘুচতো।”

হাত থেমে গেলো শান্তার। পূর্ণ দৃষ্টিতে পুত্রের পানে তাকালেন। ডান ভ্রু টা উঁচিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে শুধালেন,“মেয়ে রাজি?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় শ্রাবণ। তৎক্ষণাৎ চোখেমুখে উৎসুক একটা ভাব ফোটে উঠলো শান্তার। আহ্লাদী কণ্ঠে পুনরায় শুধালেন,“দেখতে কেমন? সুন্দর?”

“কেন? সুন্দর না হলে বুঝি পুত্রবধূ হিসেবে মানবে না?”

“তা হবে কেন? আমার ছেলের পছন্দের উপর আমার পুরোপুরি ভরসা আছে। সে আমার অপছন্দ হবে এমন মেয়েকে কখনোই পছন্দ করতে পারে না।”

প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো শ্রাবণ। শান্তা বললেন,“তোর বাবাকে গিয়ে বলি তবে?”

“কী?”

“এই যে তুই বিয়ে করবি। তোর কোনো চিন্তা নেই। যা ব্যবস্থা করার আমি আর তোর বাবা মিলে করবো। দরকার পড়লে আজ রাতেই বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবো।”

এবারও চমৎকার হাসলো শ্রাবণ। মা যে তার বউ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারলো। বললো,“বাবাকে বলে দিয়েছি, বিয়ে করলে পরের শুক্রবারই করবো।”

মুখখানি মলিন হলো শান্তার। টেনে টেনে বললেন,
“আরো সাত দিন পর! বাঁচবো এ কদিন?”

“বাঁচবে না কেন? নাতি নাতনি নিয়ে খেলতে হবে না?”

মুচকি হাসলেন শান্তা। বললেন,“তা তো হবেই। যাক এত বছর অপেক্ষা করেছি আর সাতদিন অপেক্ষা করতে পারবো না? অবশ্যই পারবো।”
________

শীতকালে সন্ধ্যাটা খুব দ্রুতই নেমে পড়ে। তবে এখন বিকেল। আসরের নামাজ পড়ে ছাদে এসেছে অর্থিকা। দুপুরে তাঈমের কিছু কাপড় ছাদে দিয়ে গিয়েছিল শুকাতে, এখন সেগুলো নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এখানে আসা। কয়েকটা ফ্ল্যাটের মহিলারা একপাশে বসে গল্প করছে। অন্যপাশে চলছে বাচ্চাদের হইচই।

দ্রুত পদে কাপড়গুলো দড়ি থেকে নামিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে যাওয়ার পথেই পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো,“অর্থিকা!”

সিঁড়ির মাঝখানেই থেমে দাঁড়ায় অর্থিকা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হয়। দৃষ্টিগোচর হয় ছাদের দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুরুষকে। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করতেই অর্থিকার মনে হলো এই পুরুষটিকে সে চেনে। তার ভাবনার মধ্যেই এগিয়ে এলো লোকটি। বললো,“অনেকগুলো বছর বাদে দেখা হলো আমাদের তাই না?”

সৌজন্য হাসলো অর্থিকা। বললো,“হুম। তা তুমি এখানে? ছাদে তো চোখে পড়ল না। এখানেই থাকো নাকি?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় ফায়াজ। প্রশ্ন করে,“তোমরাই নতুন ভাড়াটিয়া তাই না?”

“হ্যাঁ।”

কথার প্রসঙ্গেই প্রশ্ন ছুঁড়ে ফায়াজ,“শুনেছিলাম বিয়ে করে নিয়েছিলে? তা ছেলে-মেয়ে কজন?”

“একটাই ছেলে, তা একদিন এসো না। একই বিল্ডিং এ থাকছি তার উপর পরিচিত। এখন তো আবার প্রতিবেশীও হয়ে গেলাম।”

প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো ফায়াজ। অর্থিকা তাড়া দেখিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বললো,“চায়ের দাওয়াত রইলো কিন্তু।”

“গ্ৰহণ করলাম তোমার দাওয়াত।”

ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে নিচে নেমে গেলো অর্থিকা।ফায়াজ এখনো সেদিক পানেই তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে বললো,“গ্ৰহণ করলাম তোমার দাওয়াত। নিয়তি যখন আবারো দুজনকে সম্মুখে দাঁড় করিয়েই দিলো তখন আমারও তো দেখা উচিত কার কপালে স্রষ্টা তোমায় লিখে রেখেছিলেন।”

কাপড় নিয়ে ভেতরে এসে দরজা লাগালো অর্থিকা। সোফার উপর কাপড়গুলো রেখে ডেকে আনলো অনুভাকে। তারপর দুজনে মিলে আবারো শুরু করল ঘর গোছানো। আজকের মধ্যেই সব কমপ্লিট করতে হবে। কাল থেকে যে অফিস শুরু। অর্থিকাও তো চাকরিতে জয়েন করেছে মাস খানেক হবে।
_______

একটি রাত কেটে নতুন আরেকটি দিনের সূচনা ঘটলো। তানিম বাড়িতে নেই। রোজকার রুটিন মাফিক অফিসে সে। পল্লবী ভবনে শোনা যাচ্ছে একজন নারী কণ্ঠস্বরের চেঁচামেচি। রোজিনাকে বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। কাজগুলো মনঃপুত না হওয়ায় খানিক বাদে বাদেই বিরক্ত হয়ে বলছেন,“এটা এভাবে করছিস কেন? এভাবে হবে না, ওভাবে কর।”

রোজিনা মেয়েটা পড়েছে মহা ঝামেলায়। মালকিনের কথামতো বারবার কাজের ধরণ বদলাচ্ছে সে। আজিজুল হক এসে উপস্থিত হলেন স্ত্রীর সম্মুখে। বললেন,“এভাবে না বলে কয়ে হুটহাট মেয়ে দেখতে যাওয়াটা কী ঠিক হবে? উনাদের তো আগে জানানো উচিত তাই না?”

স্বামীর কথাটা পছন্দ হলো না আফসানার। বললেন, “কাকে জানাবে? ছেলে তো বললোই মেয়ের পরিবার সম্পর্কে। আমরা যাবো ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে চলে আসবো।”

মন সায় দিলো না আজিজুল হকের। আমতা আমতা করে বললেন,“কিন্তু।”

“কোনো কিন্তু নয়, ছেলেটা নিজ থেকে এসে বিয়ে করতে চাইছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা দিয়ে দেওয়া উচিত। পরে আবার মত বদলে গেলে?”

স্ত্রীর কথায় সম্মতি জ্ঞাপন করলেন আজিজুল হক।

আজকে তানিমের মেজাজটা খুব ফুরফুরে। এই ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই দু দুটো মিটিং শেষ করে নিজ চেয়ারে এসে বসে আছে সে। সিসি ক্যামেরায় দৃষ্টি স্থির রেখে মুচকি হাসলো। তারপর আবারো সরিয়ে নিলো নিজ দৃষ্টি। টেবিলের উপর রাখা বেলটা বাজাতেই ছুটে এলেন আজগর। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তার উদ্দেশ্যে তানিম বলে উঠলো,“মিস.অনুভাকে পাঠিয়ে দিন।”

উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে যায় আজগর। অনুভার টেবিলের সামনে এসে আহত স্বরে প্রশ্ন করে,“আইচ্ছা ম্যাডাম আপনে দুইদিন পরপর এতো অন্যায় করেন ক্যান কন তো?”

মনোযোগ সহকারে কাজ করছিল অনুভা।আজগরের কথায় ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকায়। শুধায়,“আমি আবার কী করলাম?”

“তা আমি কী জানি? ঘাড়ের রগ কাটা স্যার আপনেরে আবার ডাকছে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানিমের কেবিনে পা বাড়ায় অনুভা। ভেতরে প্রবেশ করে অনুমতি নিয়ে। চোখেমুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তানিম প্রশ্ন ছুঁড়ে,“যেই কাজগুলো দিয়েছিলাম তা কমপ্লিট হয়েছে?”

“পুরোপুরি শেষ হয়নি স্যার, আর আধ ঘণ্টা সময় লাগবে।”

“ঠিক আছে, কাজটা শেষ হলে আজগরকে দিয়ে আমায় পাঠিয়ে দিবেন।”

“ওকে স্যার।”

“এরপর তো আপনার আজ আর কোনো কাজ নেই সম্ভবত। তাই চাইলে আপনি চলে যেতে পারেন। আপনার ছুটি।”

চমকায় অনুভা। কথাটা যেনো বিশ্বাস হলো না। তাই ফের শুধায়,“জ্বি স্যার? ছুটি?”

“হ্যাঁ, কেন কোনো আপত্তি আছে?”

“না স্যার। ধন্যবাদ আপনাকে।”

বলেই সেখান থেকে নিজ ডেস্কে চলে এলো অনুভা। তার হাস্যজ্জ্বল মুখখানা দেখতেই তানিমের গম্ভীর মুখখানাতেও ফোটে উঠলো হাসির রেখা।
________

পাশের ফ্ল্যাটের পৌঢ় ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা বলে নতুন একজন আয়া ঠিক করেছে অর্থিকা। বাড়িতে এখন সুফিয়া, তাঈম এবং সেই নতুন আয়া মাজেদা। কলিং বেল বাজার শব্দ কানে আসতেই ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে দরজা খুলে দিলো মাজেদা। অনুভা অফিসে যাওয়ার আগে কড়াকড়ি ভাবে বলে দিয়ে গেছে,“আমি কিংবা আপু ব্যতীত অন্য কেউ এলে কিন্তু একদম দরজা খুলবে না আর ভেতরেও ঢুকতে দিবে না। ঠিক আছে?”

দরজার সামনে দাঁড়ানো তিনজন অপরিচিত মানুষ দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো মাজেদা। কর্কশ কণ্ঠে বললো,“আপারা বাড়িত নাই। আইতে আইতে রাইত হইবো। কোনো দরকার হইলে তহন আইয়েন।”

আফসানা মৃদু হেসে কোমল গলায় বললেন,“তোমার আপাদের মাও কী বাড়িতে নেই?”

“খালার কথা কইতাছেন?”

না বোঝেও মাথা নাড়ালেন আফসানা। মাজেদার চোখেমুখে সন্দেহের ছাপ। প্রশ্ন করল,“আমনেরা কী লাগেন চাচীর?”

“কিছু হই না তবে তুমি আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়ে উনাকে ডেকে দিলে ভালো একটা সম্পর্ক হতে পারে।”

কথাটার অর্থ খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো মাজেদা। হেসে বললো,“আপনেরা ঘটক? ছুডু আপার লাইগ্গা সম্বন্ধ আনছেন?”

মেয়েটা চালাক চতুর যা খুব ভালো করেই টের পেলেন আফসানা। উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। তৎক্ষণাৎ দরজা ছেড়ে ভেতরে হাঁটা ধরলো মাজেদা।ড্রয়িং রুমের সোফা দেখিয়ে বললো,“আপনেরা বসেন আমি খালারে ডাইক্কা আনি।”

আজিজুল হক আর আফসানা বসলেন সোফায়। সাথে আসা ড্রাইভার ছেলেটা মিষ্টির প্যাকেটগুলো সেন্টার টেবিলের উপর রেখে চলে গেলো গাড়ির কাছে।

তাঈমকে নিজের পাশে ঘুম পাড়িয়ে রেখে নিজেও চোখ বন্ধ করে আছেন সুফিয়া। ভেতরে প্রবেশ করল মাজেদা। নিজ স্বরে বললো,“খালা ঘুমাইয়া গেছেন নাকি?”

সুফিয়া চোখ মেলে তাকালেন। বললেন,“না ঘুমাইনি। কিছু বলবে?”

“হ খালা। ছুডু আপার লাইগা সম্বন্ধ আইছে।”

কথাটা শুনতেই টনক নড়ে উঠলো সুফিয়ার। কিছুটা সময় নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলেন। প্রশ্ন করলেন,
“অনুর জন্য সম্বন্ধ এসেছে?”

“হ খালা। তাড়াতাড়ি চলেন। হেরা বসার ঘরে বইসা আছে।”

বড়ো আশ্চর্য হলেন সুফিয়া। এখানকার কাউকেই তো চেনেন না উনারা।সেখানে মেয়ের জন্য সম্বন্ধ কোত্থেকে এলো? কে নিয়ে এলো? এসব ভাবতে ভাবতেই ব্যথাযুক্ত পা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পরনের শাড়ি ঠিক করে ঘোমটা টেনে বাহিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। মাজেদাকে বলে গেলেন,“তাদের জন্য চা বিস্কিটের ব্যবস্থা করো।”

মাজেদা মাথা নাড়ালো।তার আগে কল দিলো অর্থিকার নাম্বারে। কথাটা তো দু বোনের একজনকে জানাতে হবে নাকি? যার জন্য সম্বন্ধ এসেছে তাকে জানানো উচিত হবে না তাই বড়ো বোনকেই কল বসালো মাজেদা।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-১৯+২০

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৯]

রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধরণীতে ঘটেছে শীতের তাণ্ডব। দুপুরের খানিক পরে গ্ৰাম থেকে রওনা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে অনুভাদের। ঘণ্টা খানেক আগেই তারা বাড়ি এসে পৌঁছেছে। যদিও চাচা-চাচীরা কিছুতেই আসতে দিতে চাইছিল না তাদের তবুও সেসব অনুরোধের তোয়াক্কা না করেই মাকে নিয়ে দুই বোন ফিরে এসেছে নিজেদের বর্তমান আবাসস্থলে।

এই শীতের রাতেই ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল সেরে সোফায় এসে বসলো অনুভা। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লেগেছে খিদে। গতকাল থেকে পেটে তেমন ভারি কিছু পড়েনি।বাবার মৃ’ত্যু শোকে খেতেও পারেনি ঠিকমতো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অনুভা। মস্তিষ্ক জানান দিলো ওদিকে মা আর বোনও যে তার মতোই অভুক্ত রয়েছে। তাদেরও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে?

ক্লান্ত দেহখানাকে টেনে নিয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করল অনুভা। রঙচটা ফ্রিজটা খুলে ভেতরে কী কী আছে দেখতে লাগলো। বেশি কিছু রান্না করার মতো শক্তি শরীরে আর অবশিষ্ট নেই। ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে চুলার ধারে রাখলো। ফেরার পথে সেই যে তাঈম ঘুমিয়েছে এখনো ভাঙেনি তার সেই ঘুম। ঘুম ভাঙলেই খিদের চোটে কান্না শুরু করে দিবে ছেলেটা। তাই গুঁড়ো দুধের প্যাকেটটা সর্বপ্রথম হাতে নিলো অনুভা। আগে দুধ আর সুজি জাল দিবে তারপর বাকি কাজ।

দুধ জাল দিয়ে তা ফিডারে ভরে সুজির পাতিল বসালো চুলায়। তখনি কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো অনুভার। এত রাতে কে এলো? কোমরে বাঁধা ওড়নাটা দিয়ে ভালো করে মাথা ঢেকে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। লুকিং হোলে চোখ রাখতেই দেখা মিললো অপরিচিত এক যুবকের। বিষ্মিত হলো অনুভা। ছেলেটির মুখশ্রী তার নিকট সম্পূর্ণ অচেনা। তাই দরজা খোলার আর সাহস হলো না। বাড়িতে তিন তিনটে মেয়ে তারা। নেই কোনো পুরুষ মানুষ। দরজা খোলা কিছুতেই যে উচিত হবে না তা বুঝে গেলো অনুভা। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে শুধালো,“কে আপনি? কাকে চাই?”

লোকটি ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো,“ম্যাডাম পার্সেল ছিলো একটা।”

“কীসের পার্সেল? কার পার্সেল?”

“অনুভা ম্যাডামের নামে পার্সেল।”

“কী আছে ওতে? আমি তো কোনো কিছু অর্ডার দেইনি। তাহলে কে পাঠিয়েছে?”

“কী আছে তাতো জানি না তবে স্যার আপনাকে দিতে বলেছেন।”

“কোন স্যার?”

যুবকটি প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললো,“ম্যাম আমার তাড়া আছে। পার্সেলটা একটু দ্রুত নিলে ভালো হতো।”

বিরক্ত হলো অনুভা। সাথে ভীষণ ভয়ও হলো।দিনকাল ভালো নয়। দরজা খোলাটা কী ঠিক হবে? দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতেই অপরপাশ থেকে আবারো ডাক এলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলো অনুভা। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“দরজার কাছে পার্সেল রেখে আপনি চলে যান। আমি পরে নিয়ে নিবো।”

যুবকটি আর দ্বিমত করল না। তার কথা অনুযায়ী সেখানেই প্যাকেট রেখে বিদায় নিলো। লুকিং হোলে পুরো দৃশ্যটা দেখে নিয়ে মিনিট চারেক অপেক্ষা করে তারপর দরজা খুললো অনুভা। একটা শপিং ব্যাগ দেখে ভারি অবাক হলো সে। চটজলদি ব্যাগ হাতে নিয়ে ভেতরে ঢুকে আটকে দিলো দরজা।

কী আছে ব্যাগে? কেই বা পাঠালো? মনের গহীনে অসংখ্য প্রশ্ন রেখে ব্যাগ খুলতেই মারাত্মক বিষ্ময়ে বসে পড়ল অনুভা। কয়েকটা খাবারের টিফিন বক্স। নিজেকে সামলে নিয়ে খাবার টেবিলের উপর নিয়ে সেগুলো রাখলো। একে একে বক্স খুলতেই দেখতে পেলো গরম গরম রুটি, দু পদের রান্না করা সবজি আর দেশি মুরগি ভুনা। সাথে পেলো একটি চিরকুট। তাতে স্পষ্ট বাক্যে লেখা,“এত রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রান্না করার কোনো প্রয়োজন নেই নোভা। মায়ের হাতের রান্না। মা খুব যত্ন করে রেঁধেছেন। আপু আর আন্টিকে নিয়ে খাবারগুলো খেয়ে ঘুমাতে যাও।”

খাবারগুলো যে শ্রাবণ পাঠিয়েছে তা বুঝতে আর বেগ পেতে হলো না তাকে। চোখ জোড়া ভিজে উঠলো মুহুর্তেই। ছেলেটাকে যত দেখছে ততোই সে অবাক হচ্ছে। মুগ্ধ তো অনেক আগেই হয়েছিল। আচ্ছা ছেলেটা এমন কেন? এতটা দায়িত্ববান একটা পুরুষ কী করে হতে পারে? দায়িত্বের মতো কোনো সম্পর্ক কী আদৌ তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে? কই এমন কিছু তো গড়ে ওঠেনি। তাহলে? না এগুলো তো দায়িত্ব নয় বরং এগুলো হচ্ছে ভালোবাসা। মোবাইল নিয়ে শ্রাবণের নাম্বারে ডায়াল করল অনুভা। কিন্তু রিসিভ হলো না। বাজতে বাজতে কেটে গেলো কল। পরপর তিনবার কল দেওয়ার পরেও সেই একই অবস্থা। তার মিনিট দুয়েক পর সেই নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এলো,“এমনিতেই ঊনত্রিশ বছর ধরে সিঙ্গেল তার উপর বউ ছাড়া এই কনকনে শীতের রাত। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে নোভা। তার সঙ্গে তোমার কল রিসিভ করে বকাঝকা শোনার কোনো ইচ্ছেই আপাতত আমার নেই। চুপচাপ খেয়ে ঘুমাতে যাও।”

ম্যাসেজটা পড়েই লজ্জা রাঙা হয়ে উঠলো অনুভার মুখশ্রী। ছেলেটা এসব কথাও বলতে জানে! ভাবতেই ভীষণ অবাক হলো। এই ছেলেটার জন্য জীবনে তাকে আর কতটা অবাক হতে হবে তার হিসেব যেনো অনুভার ভাবনা বহির্ভূত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবার বেড়ে মা আর বোনকে ডাকার জন্য পা বাড়ালো ঘরের দিকে। তখনি আগমন ঘটলো অর্থিকার। ছোটো বোনের উদ্দেশ্যে বললো,“শরীরটা খুব ব্যথা করছিল তাই একটু শুয়েছিলাম। কলিং বেল বাজার শব্দ পেলাম মনে হলো। কে এসেছে এত রাতে?”

“পার্সেল এসেছে।”

“কীসের পার্সেল?”

“কীসের আবার? খাবারের?”

ললাটে ভাঁজ পড়ে অর্থিকার। টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে খাবারগুলো দেখতেই বিষ্ময় খেলে যায় চোখেমুখে। অনুভা যে বাহির থেকে খাবার অর্ডার দিয়ে আনাবে না তা সে নিশ্চিত। তাহলে কে পাঠালো? এত রাতে বাড়ি পর্যন্ত এতগুলো খাবার পাঠানোর মতো আপন মানুষ বলতে তো কেউ নেই তাদের। তবে? প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কে পাঠিয়েছে এগুলো?”

দম ছাড়লো অনুভা। উত্তর দেওয়ার প্রয়াস চালাতেই সেই উত্তরের অপেক্ষা না করে অর্থিকা বাম ভ্রু উঁচিয়ে ফের শুধালো,“শ্রাবণ পাঠিয়েছে?”

বড়ো বোনের কথায় চমকায় অনুভা। সে জানলো কী করে এ কথা? আর শ্রাবণের নামটাই বা জানলো কী করে? বাবার মৃ’ত্যুর দিন একমাত্র শ্রাবণ এসেই তাদের এত উপকার করেছে। কিন্তু ও-ই যে শ্রাবণ তা তো জানার কথা নয় অর্থিকার। অনুভা তো তেমন কিছুই বলেনি বোনকে। তাহলে? কৌতূহল নিয়েই উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। আশানুরূপ উত্তর পেয়ে মুচকি হাসে অর্থিকা। বলে,“ছেলেটা কিন্তু তোকে ভীষণ ভালোবাসে রে অনু। এই যুগে এমন ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাওয়া বড়োই দুষ্কর ব্যাপার।”

বোনের কথাটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো অনুভা। মিনমিনে স্বরে বললো,“যাই মাকে ডেকে আনি। তুই বরং খাওয়া শুরু কর আপু। খাওয়া শেষে ফিডার আর সুজির বাটিটা নিয়ে যাস। তাঈমকে খাইয়ে দিস।”

ছোটো বোনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্থিকা। যাক ছোটো বোনটার জীবনে এবার অন্তত সুখ নামক পাখিটা তো আসতে চলেছে। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি যে আবারো নতুন রূপে ফিরে এসেছে তার জীবনে।
_______

সকাল হওয়ার পরেও চারিদিকে নেই কোনো রোদের তাপ। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে সূয্যি মামা। আজ যেনো এক কুয়াশাচ্ছন্ন দিন। অন্যদিনের মতো আজ সকালে নেই সুফিয়ার কোনো চিৎকার চেঁচামেচি। মায়ের দায়িত্ব বোন আর পারভিনার উপর ছেড়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো অনুভা। গন্তব্য অফিস। মনের ভেতরে তার হাজারো ভয় ডানা ঝাপটাচ্ছে। বিনা ছুটিতে কাউকে না জানিয়েই টানা চারদিন অফিস বন্ধ করেছে। চাকরিটা আদৌ কী আর থাকবে? তানিম যেমন ধাঁচের মানুষ তাতে যে চাকরিটা আর থাকবে না তা অনুভার খুব ভালো করেই জানা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে গলি পেরিয়ে মেইন রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলো অনুভা। যা হয় তা না হয় পরেই দেখা যাবে। খারাপ কিছু হলেও তা আর মেনে নিবে সে। তানিম তাকে সকলের সামনে অপমান করলে সে আর কোনো কৈফিয়তই দিবে না কাউকে। চুপচাপ চলে আসবে। সব সিদ্ধান্ত নিয়েই এগিয়ে গেলো সম্মুখে।

রাস্তায় জ্যাম না থাকায় অফিসে এসে পৌঁছাতে বেশি একটা সময় লাগলো না অনুভার। উদ্বিগ্ন, সঙ্কিত মন নিয়ে নিজের চেয়ারে বসে একটু জিরিয়ে নিলো। তাকে দেখতেই কলিগ নায়রা এগিয়ে এলো। চোখেমুখে তার হাজারটা প্রশ্নের ছাপ। মাথা নুইয়ে ফিসফিস করে শুধালো,“আরে আপা কতদিন পর আপনাকে দেখলাম! তা কোথায় ছিলেন এতদিন? অফিসে আসেননি কেন? ছুটিতে ছিলেন অথচ একবারও জানালেন না?”

একনাগাড়ে মেয়েটির এত প্রশ্নে হকচকিত হলো অনুভা। অফিসে যে এ ব্যাপার নিয়ে তানিম চিৎকার চেঁচামেচি করেনি তা মেয়েটির প্রশ্নেই বেশ ভালো ভাবে টের পেলো সে। এই শীতেও তার কপালে ঘাম জমেছে। বাম হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে ঘাম মুছে নিলো অনুভা। উত্তরে বললো,“আমার বাবা মারা গেছেন তাই আসতে পারিনি।”

কথাটা কর্ণপাত হতেই মুখখানি মলিন হলো নায়রার।
মিনমিনে স্বরে,“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন” পড়ে অনুভাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলো নিজ আসনে।সময় পেরোলো। এতক্ষণ ধরে অফিসে আসার পরেও আজ নাহিয়ানের সঙ্গে দেখা হলো না তার। ক’দিন না আসায় তার ভাগের কাজও জমে থাকার কথা কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কোনো কাজই জমে নেই। পিয়ন আজগর এসে উপস্থিত হলেন টেবিলের সম্মুখে। বললেন,“ম্যাডাম! স্যার আপনেরে যাইতে কইছে।”

চমকায় অনুভা। স্যার মানে তো তানিম! সে আবার কখন এলো?শুধালো,“স্যার কখন এলেন?কোনদিক দিয়ে এলেন? কই দেখলাম না তো?”

“আপনে আসার আগেই আইছে। এহন যান তাড়াতাড়ি।”

মাথা নাড়িয়ে তেড়ে আসা ঝড়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে তানিমের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো অনুভা। অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই মিলিত হলো একে অপরের দৃষ্টি। খানিকটা অপ্রস্তুত হলো অনুভা। সরিয়ে নিলো নিজ দৃষ্টি। তার এহেন কাণ্ডে মনে মনে হাসে তানিম। কিন্তু বাহিরটা গাম্ভীর্যের চাদরে মুড়িয়ে রেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“অফিসের তো কিছু নিয়ম-কানুন আছে মিস.অনুভা। তা কোনো ধরণের ইনফর্ম না করেই টানা চারদিন ধরে অফিসে আপনি অনুপস্থিত ছিলেন কেন?”

যে ছেলের কণ্ঠে সর্বদা রাগের আভাস পাওয়া যায় আজ সেই ছেলের এত স্বাভাবিক কণ্ঠে কৌতূহলী হয়ে ওঠে অনুভার মন। রয়েসয়ে উত্তর দেয়,“আমার বাবা মারা গেছেন। অমন একটা মুহূর্তে অতকিছু মাথায় আসা সম্ভব নয় স্যার। তাই আগে থেকে কিছু জানাতে পারিনি।”

তানিমের মুখখানা মলিন হলো। যদিও নাহিয়ানের থেকে অনুভার ঠিকানা নিয়ে সেদিনই তার খোঁজ নিয়েছিল তানিম। পুরো ঘটনাটা সম্পর্কে অবগত হতেই মেয়েটির জন্য খুব মায়া হলো। তবে সেসব সম্মুখে আর প্রকাশ করল না। কণ্ঠে নমনীয়তা এনে শুধালো,“তা কীভাবে মারা গেলেন উনি?”

“বলেছিলাম না স্যার বাবা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন? শরীরের অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছিল আর তারপরেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন।”

“ওহ, তা এই শোকের মধ্যে অফিসে আসতে গেলেন কেন? চাইলেই তো অফিসে ফোন করে আরো কয়েকদিনের ছুটি নিতে পারতেন।”

“তার আর প্রয়োজন নেই স্যার। বলার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”

মাথা নাড়ায় তানিম। অনুভাও অনুমতি নিয়ে চলে আসে নিজ কেবিনে।
_______

বিয়ে উপলক্ষে অফিস থেকে বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে নাহিয়ান। গতকালই পারিবারিক ভাবে তমা আর তার বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে। দুই পরিবারের আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে বিয়ে করে বউ নিয়ে রাতেই বাড়ি ফিরেছিল নাহিয়ান। তার জোরাজুরিতে তানিমও উপস্থিত ছিলো সেই বিয়েতে।

শুরুতে মেয়ের গায়ের রঙ নিয়ে কুলসুমের মনের ভেতরে খচখচ একটা ভাব থাকলেও ছেলে-মেয়ের বিভিন্ন যুক্তি তর্কের সামনে হার মেনে নিয়ে বিয়েটা অবশেষে মেনে নিয়েছেন তিনি। যে সংসার করবে তারই যদি সমস্যা না থাকে তাহলে উনারই বা আর কী বলার আছে?

সকাল থেকেই রান্নাঘরে ব্যস্ত তমা। শাশুড়িকে রান্নার কাজে হাতে হাতে সাহায্য করছে। এতে বেশ বিরক্ত হচ্ছেন কুলসুম। তিরিক্ষ মেজাজে বললেন,“এমন ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে কেন তুমি? তোমাকে বলেছি না ঘরে যাও।”

তমা মিনমিনে স্বরে বললো,“আমি একটু সাহায্য করলে সমস্যা কোথায় মা? আমিও তো এখন থেকে এ বাড়ির একজনই।”

“বিয়ে হতে না হতেই এত সাহায্য করতে বলেছে কে? ঘরে গিয়ে বসে থাকো। দুপুরের দিকে মানুষের আনাগোনায় নড়ার সময়টুকু পাবে না। ঘরে যাও।”

শেষের কথাটা একটু ধমকের সুরেই বলে উঠলেন কুলসুম। শাশুড়িকে আর বেশি রাগানোর সাহস পেলো না তমা। ছোটো ছোটো কদম ফেলে চলে এলো কক্ষে। নাহিয়ান বিছানায় আধ শোয়া। নববধূকে প্রবেশ করতে দেখেই উঠে বসলো সে। মুচকি হেসে শুধালো,“কী হলো চলে এলে যে? নিশ্চয়ই মা তাড়িয়ে দিয়েছে তাই না?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় তমা। গোমড়া মুখখানিতে ফোটে ওঠে মৃদু হাসি। বলে,“শুরুতে শাশুড়ি সম্পর্কে যা ধারণা করেছিলাম তার তো উল্টোটা ঘটছে।আমার শাশুড়ি মা কিন্তু খুব কেয়ারিং।”

“মা এমনই। মনটা খুব নরম উনার। শুরুতে তোমায় হয়তো একটু অপছন্দ হয়েছিল বটে, তবে দেখবে দিন যতো এগিয়ে যাবে ততোই সবার থেকে বেশি আপন তোমায় মা-ই করে নিবে আর ভালো ও বাসবে।”

বাড়িতে পা দেওয়ার আগ পর্যন্ত শাশুড়িকে নিয়ে তমার মনের মধ্যে বিভিন্ন আজেবাজে ভাবনা থাকলেও সেসব ভাবনার কিছুটা হলেও যেনো অবসান ঘটেছে এবার। চোখেমুখে ফোটে উঠেছে প্রশান্তির ছাপ। কিছু একটা ভাবনা মস্তিষ্কে আসতেই আবারো পূর্বের ন্যায় চুপসে গেলো তার মুখশ্রী। স্বামীর উদ্দেশ্যে অনুমতি চাইলো, “একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

“হুম করো।”

“মায়ের অমত থাকার পরেও কেন আপনি আমায় বিয়ে করলেন বলুন তো? এমন তো নয় যে আমরা পূর্ব পরিচিত। ইনফেক্ট আমরা একে অপরকে সেদিনের আগ পর্যন্ত চিনতামও না। তাহলে?”

“পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্রী পছন্দ হয়েছে তাই বিয়ে করে এনেছি। সহজ কথা। কেন তোমার কী আমায় পছন্দ হয়নি?”

“সেসব কিছু না। আপনাকে কেন পছন্দ হবে না? আপনি স্বামী হিসেবে সবদিক দিয়েই উপযুক্ত। কিন্তু আমায় পছন্দ হওয়ার কোনো কারণ তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না।”

“পছন্দ না হওয়ার কোনো কারণও তো খুঁজে পাচ্ছি না।”

“আমি শ্যামলা।”

“শ্যামলা মেয়েরা মায়াবতী। তাই তুমিও একটা মায়াবতী। আর কখনো নিজের গায়ের রঙ নিয়ে মন খারাপ কিংবা আফসোস করবে না বুঝলে?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় তমা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাহিয়ান। রূপবতীকে না হয় সে পায়নি কিন্তু মায়াবতীকে তো পেয়েছে। একজনকে চিরকাল একতরফাভাবে অতি গোপনে ভালোবেসে সারাজীবনের জন্য একাকিত্বকে সঙ্গী করে বাঁচা হচ্ছে একমাত্র বোকামি। কিন্তু নাহিয়ান তো বোকা নয়। সে আবারো ভালোবাসবে। তবে এবার একতরফা নয়। বরং এই ভালোবাসা হবে পবিত্র এবং দুজনার সম্মতিতে।

চলবে _______

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২০]

দেখতে দেখতে মাস পেরোলো। এক মাসের মধ্যে স্থান, কাল, মানুষগুলো না বদলালেও বদলেছে বিভিন্ন সম্পর্কের গতিবিধি। চতুর্থবারের মতো চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরলো অর্থিকা। ক্লান্ত দেহখানার ভারসাম্য সোফায় ফেলে বসতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো অনুভা। বসে পড়ল বড়ো বোনের মুখোমুখি। রাগত স্বরে বলে উঠলো,“নিষেধ করার পরেও আবার তুই ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলি আপু? তোর সমস্যাটা ঠিক কোথায় বলবি? আর ঠিক কতবার তোকে বললে এসব চাকরি বাকরি করার ভূত মাথা থেকে নামবে?”

সোজা হয়ে বসলো অর্থিকা। ভ্রু যুগল কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তোকে না সকালে অফিসে বের হতে দেখলাম? তাহলে এ সময় বাড়িতে কী করছিস তুই? আমার জানামতে তোর কঞ্জুস বস তো এমনি এমনি ছুটি দেওয়ার লোক নন।”

“শরীরটা ভালো লাগছিল না। যদিও শুরুতে ভেবেছিলাম ছুটিটা হয়তো উনি দিবেন না কিন্তু দিয়ে দিলেন।”

প্রত্যুত্তর করল না অর্থিকা। অনুভা ফের পূর্বের প্রসঙ্গ টেনে এনে বললো,“আজকের পর আর ওসব ইন্টারভিউ দিতে যাবি না তুই। সময়টা ছেলের পেছনে দে। বড়ো হচ্ছে ও। আমি তো এতদিন ধরে চালাচ্ছি সংসারটা তাহলে এখন আবার তোকে চাকরি করতে হবে কেন বল তো? বাবাও এখন আর নেই। বাবার চিকিৎসা ওষুধপত্রের জন্য যেই অর্থটা খরচ হতো সে টাকাটাও তো এখন মাস শেষে রয়ে যায়।”

অর্থিকা দ্বিমত পোষণ করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো, “অবশ্যই প্রয়োজন আছে। সারাজীবন কী এভাবেই চাকরি করে সংসার চালিয়ে মা-বোনের দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার ফন্দি এঁটেছিস নাকি? যদি এসব আজেবাজে ফন্দি এঁটে থাকিস তাহলে সেসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। বড়ো বোন হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব কর্তব্য আছে। এতদিন একটা ট্রমার মধ্যে ডুবে থাকার কারণে কিছু বলতে পারিনি তোকে তবে আমি নিজেকে এখন যথেষ্ট স্বাভাবিক করতে পেরেছি। এবার আমার সব দায়িত্ব পালনের সময় এসে গেছে।”

“কী দায়িত্ব শুনি?”

“আমি তোর বিয়ে দিবো।”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই আশ্চর্য হয় অনুভা। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলে,“এসব আজেবাজে চিন্তা কোত্থেকে তোর মাথায় উদয় হলো আপু?”

“আজেবাজে চিন্তা হবে কেন? এটাকে বলে সুচিন্তা। বয়স তো কম হলো না। আরো অপেক্ষা করলে দেখা যাবে ছেলের মায়েরা পুত্রবধূ হিসেবে তোকে পছন্দই করছে না। অসব ঝুঁকি কিন্তু আমি একদম নিতে পারবো না বলে দিলাম।”

মুখখানা মলিন হলো অনুভার। কণ্ঠে জমাট হলো শঙ্কা,ভয়। মিনমিনে স্বরে বললো,“আমি বিয়ে করতে চাই না আপু। চাই না নতুন কোনো সম্পর্কের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে। ভালোবাসতে যে খুব ভয় হয় আমার। কাউকে বেশি ভালোবাসলেই সে হারিয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষ হারানোর বেদনা যে খুবই নিকৃষ্ট আপু।”

ছোটো বোনের কাঁধে হাত রাখলো অর্থিকা।আশ্বস্তের সুরে বললো,“আমার এই অবস্থা দেখে ভালোবাসার প্রতি এত বিদ্বেষ জন্মেছে তোর তাই না? তুই তো আমায় বলেছিলি তন্ময় আমায় ছেড়ে যায়নি। তার হায়াত অতটুকুই ছিলো। তাহলে? তাহলে তোর কেন এত ভয়? ভালোবাসা ছাড়া একাকিত্বকে সঙ্গী করে মানুষ বাঁচতে পারে না অনু। প্রত্যেকেরই সুখ, দুঃখ ভাগ করার জন্য একজন মানুষের প্রয়োজন হয়। নিজেকে ভেঙেচুরে উপস্থাপন করার জন্য, জড়িয়ে ধরে সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়ার জন্য একজনকে প্রয়োজন হয়। আর সেই একজন হচ্ছে জীবনসঙ্গী। সেই জীবনসঙ্গী পেতে হলে তো বিয়ে করতে হবে তাই না?”

“তাহলে তোর কী‌ হবে? তুই কার কাছে নিজের সুখ, দুঃখ ভাগ করে নিবি?”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই হাসলো অর্থিকা। তার এই অবুঝ ছোট্ট বোনটা যে এত তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে গেছে, বোঝদার হয়ে গেছে ভেবেই ভেতরে ভেতরে প্রশান্তি অনুভব করল। অধরে হাসি রেখেই বললো, “আমি তো আর তোর মতো ভালোবেসেও ভয়ের চোটে তা নিজের ভেতরে গোপন করে রাখিনি অনু। বরং আমি মন প্রাণ উজাড় করে একজনকে ভালোবেসেছি। তার বিনিময়ে এর থেকেও বেশি পরিমাণ ভালোবাসা পেয়েছি। পেয়েছি সুন্দর একটা সংসার, পেয়েছি একজন সাদাসিধে স্বামী। আবার তার মাঝেই পেয়েছি একজন প্রেমিককে। পেয়েছি আমাদের ভালোবাসার জলজ্যান্ত প্রাণ আমাদের ছেলে তাঈমকে। আর কী চাই বল তো? শুরুতে হয়তো তন্ময়ের মৃ’ত্যুটা আমি মেনে নিতে পারিনি কিন্তু এখন আমি সবটাই মেনে নিয়েছি। ওর সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি আর তাঈমকে নিয়েই বাকি জীবনটা আমি পরম শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারবো। মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত ওই পুরুষকে ভালোবেসে যাবো।”

“তোকে অমন পরিস্থিতিতে সামলানোর জন্য না হয় আমরা ছিলাম কিন্তু আমাকেও ওই একই পরিস্থিতিতে পড়তে হলে? আমি যে মেনে নিতে পারবো না রে আপু। বাবা মারা যাওয়াতেও আমার অতটা কষ্ট হয়নি যতটা না কষ্ট হয়েছিল তোকে ওই পরিস্থিতিতে দগ্ধ হয়ে যাওয়া দেখতে। কারণ বাবা তো অনেক আগেই ভেতরে ভেতরে মরে গিয়েছে, দূরে সরে গিয়েছে আমাদের থেকে। শুধু তার দেহটাই অক্ষত ছিলো। কিন্তু!”

বাকি কথাটুকু আর শেষ করতে দিলো না অর্থিকা। বললো,“কেউ চিরকাল বেঁচে থাকে না। আর না কেউ এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে সুখ খোঁজে। এসব ভেবে কেউ সংসার সাজায় না। দুঃখের পরে যে সুখ আসে এ কথাটা মানিস তো?”

উপর নিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। অর্থিকা পুনরায় বলে,“তেমনি চিরকাল কিন্তু সুখও থাকে না। এই যে দেখ না, আমাদের জন্ম থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত সবটাই ছিলো সুখের চাদরে মোড়ানো। কিন্তু কী হলো? দমকা হাওয়ায় সেই সুখ থেকে আমরা ছিটকে পড়লাম দুঃখের সাগরে।দুঃখ পেতে পেতে যে আমরা শক্ত পাথরে রূপান্তরিত হয়ে গেছি। কিন্তু তার মধ্যেও মায়ের দুটো মেয়ে আছে। যাদের আঁকড়ে ধরে সামনের পথগুলো মা নির্ধিদ্বায় অতিক্রম করতে পারবে। তেমনি আমারও আছে। তুই আর মায়ের পাশাপাশি তাঈম আর ওর বাবার স্মৃতি আছে। কিন্তু তোর কী এমন কেউ আছে? নেই তো। তাই তোর উচিত নিজের জীবনকে একটা পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া। জীবনে একজনকে আঁকড়ে ধরা। পরে না হয় যা হওয়ার হলো। সব হারিয়ে গেলেও স্মৃতি কিন্তু হারায় না অনু।”

বোনের প্রতিটি কথাই সঠিক। মরতে তো সকলকেই হয় কিন্তু তাই বলে কী জীবন থেমে থাকে? তবুও উপরে উপরে কিছুতেই যেনো দমতে চাইলো না অনুভা। বিপরীতে বলতে লাগলো,“কিন্তু আপু!”

এবারো তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো অর্থিকা। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“মন থেকে একটা সত্যি কথা বল তো। তুই সত্যিই এ জীবনে কাউকে ভালোবাসিসনি? এখনো কী বাসিস না ভালো?”

প্রশ্নগুলো মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতেই চোখের অদৃষ্টে ভেসে উঠলো পরিচিত একটি মুখ। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো অনুভা। এই প্রশ্নটা শুনলেই ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। তার এই অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসলো অর্থিকা। একহাতে বোনকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“ভালোবাসাকে স্বীকার করতে শিখ। অনুভূতিগুলো বুকের ভেতর চেপে রেখে কষ্ট না পেয়ে প্রকাশ করতে শিখ। ভালোবাসার দহনে যে একা একা পুড়তে নেই। যদি পুড়তে হয় তবে ভালোবাসার মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে পুড়ে মর।”

ঘন পল্লব ঝাপটে বড়ো বোনের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো অনুভা। অর্থিকা তাকে রেখেই উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো নিজ কক্ষে। কিছু একটা মনে পড়তেই পথিমধ্যে থেমে গিয়ে পিছু ফিরে বললো,“বুঝলি অনু? চাকরিটা কিন্তু আমার হয়ে গেছে। আর এই চাকরিটা পাওয়ার সকল ক্রেডিট হচ্ছে শ্রাবণের।”

হকচকিয়ে উঠলো অনুভা। বসা থেকে দ্রুতপদে উঠে দাঁড়ালো। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“শ্রাবণের?”

“হুম, প্রথম তিনটে ইন্টারভিউর মধ্যে একটাতে বয়সের জন্য নেয়নি আর বাকি দুটোতে তো নামমাত্র ইন্টারভিউ নিয়েছিল। ভেতরে ভেতরে আগে থেকেই লোক তাদের ঠিক করা ছিলো। তারপর শ্রাবণই আমায় এখানে নিয়ে গেলো। ওর কোনো এক রিলেটিভ নাকি ওখানে চাকরি করে। এই জন্যই ঝামেলাহীন ভাবে ইন্টারভিউ দিয়ে টিকেও গেলাম।”

“তা ও কীভাবে তোর সঙ্গে যোগাযোগ করল?”

“কেন? মোবাইলে।”

“ফোন নাম্বার পেলো কোথায়?”

“তোকে বলবো কেন?”—-প্রশ্নটা করেই আপনমনে হনহনিয়ে প্রস্থান করল অর্থিকা।

অনুভা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো নিজ স্থানে। এখানেও শ্রাবণ! এই ছেলেটা কী কোনোমতেই তাকে আর ছাড়বে না?
________

শ্রাবণদের বাড়িতে আগমন ঘটেছে অতিথিদের।শেখ ম্যানসনের ড্রয়িং রুমে বসে আছে প্রান্তি আর তার বাবা-মাসহ ছোটো ভাই। সৌহার্দ্যও বসা ঠিক তারই মুখোমুখি সোফায়।

দুদিন আগে কাউকে কোনো কিছু না জানিয়েই দেশে ফিরে এসেছে সৌহার্দ্য। কোনো ভণিতা ছাড়াই এবার বাবা-মাকে জানিয়ে দিয়েছে নিজের পছন্দের কথা। বড়ো ছেলের বিয়েটা এখনো পর্যন্ত দিতে না পারায় মন খারাপ থাকলেও ছোটো ছেলে তো অন্তত বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এই ভেবেই মন খারাপ কিছুটা হলেও যেনো হ্রাস পেলো শান্তার। প্রান্তিও এবার আর বিয়ের ব্যাপারে অমত পোষণ করতে পারলো না। মাঝখানে কয়েক দিনের জন্য ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় প্রাণ তার যায় যায় অবস্থা ছিলো। তাই বাবা-মাকে বুঝিয়ে গতকালই এসে পৌঁছেছে দেশে। আর আজ সোজা সৌহার্দ্যের বাড়িতে।

প্রান্তির বাবা পলাশ মাহমুদ উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য নিজ দেশ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ভিন্ন দেশে। লেখাপড়া শেষে সেখানেই চাকরি নিয়ে থেকে যান তিনি। প্রান্তির মা মায়ার সঙ্গে উনার বিয়েটা হয়েছিল সম্পূর্ণ পারিবারিকভাবে। বিয়ের পর স্ত্রী সমেত আবারো তিনি পাড়ি জমান সেই বিদেশের মাটিতে। প্রান্তি এবং তার ভাইয়ের জন্মটাও ওখানেই।

খানিক সময়ের মধ্যেই হানিফ শেখের সঙ্গে পলাশ মাহমুদের বেশ ভাব জমে উঠলো। যতই হোক দুজনের পেশাই শিক্ষকতা কিনা! বেয়াইন হিসেবে মায়াকেও বেশ পছন্দ হয়েছে শান্তার। তাদের জমে ওঠা আলাপচারিতা দেখে সৌহার্দ্য আর প্রান্তি ইশারায় দুজন দুজনাকে আশ্বস্ত করে বললো,“বিয়েটা তো পুরোপুরি পাকা। এবার আর আটকায় কে আমাদের?”

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে যেতেই বিয়ের কথাবার্তাও পাকাপোক্ত হয়ে গেলো।হানিফ শেখ প্রস্তাব রাখলেন,
“আমি চাইছিলাম আপনারা যেহেতু দেশে এসেছেনই তাহলে আপাতত ঘরোয়া ভাবেই ওদের বিয়েটা দিয়ে দেই? ধুমধাম করে অনুষ্ঠান না হয় পরে করবো।”

পলাশ মাহমুদ প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“এখন হলেই সমস্যা কোথায়? আমাদের তো কোনো সমস্যা নেই।”

শান্তা মন খারাপ করে বললেন,“আর বলবেন না ভাই। আমার বড়ো ছেলেটারই তো এখনো বিয়ে হয়নি। বড়ো ছেলে রেখেই ছোটো ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলে আত্মীয় স্বজন পরিচিতরা তো হাজারটা প্রশ্ন ছুঁড়বে। তা তো বুঝেনই?”

পুরো ব্যাপারটাই উনারা বুঝলেন। মায়া বললেন,“তাও অবশ্য ঠিক। এসব দেশীয় আত্মীয় স্বজনদের মুখ আবার লাগামহীন। তা বড়ো ছেলে কোথায়? দেখলাম না তো ওকে।”

হানিফ শেখ উত্তর দিলেন,“ছেলে আমার ভার্সিটির লেকচারার। ভার্সিটিতেই গিয়েছে। তবে ওর ফেরার সময়ও প্রায় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।”

মায়া মৃদু হেসে বললেন,“তা বিয়ে থা করছে না কেন? আমার কাছে কিন্তু ভালো মেয়ের সন্ধান আছে। যেহেতু আত্মীয়তার সম্পর্ক করতেই যাচ্ছি তাই একসঙ্গে দুটোই না হয় করে ফেলি। কী বলেন?”

শান্তার চোখেমুখে উৎসাহিত একটা ভাব চলে এলো। কিন্তু তার মধ্যেই হানিফ শেখ ভদ্রতার সহিত বলে উঠলেন,“এখনকার ছেলে-মেয়েদের কী আর অতো কষ্ট করে পাত্র-পাত্রী খুঁজে বিয়ে দিতে হয়? সৌহার্দ্যের যেমন প্রান্তি মাকে পছন্দ তেমন আমার বড়ো ছেলে শ্রাবণেরও আগে থেকেই মেয়ে পছন্দ আছে।”

পলাশ মাহমুদ জিজ্ঞেস করলেন,“তাহলে বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?”

হানিফ শেখের সহজ উত্তর,“ছেলে অনুমতি দেয়নি তাই। তবে এ বছরেই বিয়েটা দিয়ে দিবো ভাবছি। আর তারপরেই না হয় সৌহার্দ্য আর প্রান্তির বিয়ের অনুষ্ঠান ধুমধাম করে করবো।”

সকলেই সায় জানালো এই প্রস্তাবে। বিকেলের দিকে বাড়িতে আগমন ঘটলো শ্রাবণের।
__________

বিছানায় অন্যমনস্ক হয়ে শুয়ে আছে অনুভা। তখনি ঘরে প্রবেশ করল অর্থিকা। বিছানায় এসে বসে প্রশ্ন করল,“কী রে কী করছিস?”

বোনের উপস্থিতি টের পেতেই শোয়া থেকে উঠে বসলো অনুভা। নিচু স্বরে উত্তর দিলো,“কিছু না।”

“আমি না একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি রে অনু।”

“কী সিদ্ধান্ত?”

“ভাবছি এই বাসাটা বদলে ফেলবো। এতদিন তোকে একা একা সব সামলাতে হতো তাই সবদিক কুলাতে না পেরে এই বাসাটা ভাড়া নিতে হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে এখানে সবদিক দিয়েই অসুবিধে। তার উপর মা সারাক্ষণ ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। হয়তো বাবার স্মৃতিচারণ করে। এভাবে তো আর চলতে পারে না বল। আমি যেহেতু এক সপ্তাহ পর চাকরিতে জয়েন করবো তাই এই সপ্তাহেই বাসা পাল্টে ফেলতে চাই। দুজনার অফিস থেকে কাছাকাছি দূরত্বেরই একটা খোলামেলা বাসা ভাড়া নিবো না হয়।”

“তোর যা ইচ্ছে।”

“আমার আবার কী ইচ্ছে রে? চল কালই বাসা দেখতে বের হই আমরা।”

“কাল আমার অফিস আছে।”

“তাতে কী? অফিস ছুটি হলে আমায় কল দিবি। তারপর না হয় দুজন একসঙ্গে দেখতে চলে যাবো।”

“ওই রাতের বেলায়?”

“তো কী হয়েছে? রাতের বেলাও বাসা দেখা যায় বুঝলি?”

না বুঝলেও চুপচাপ উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। বোনের কথায় সায় জানায়।

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-১৭+১৮

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৭]

ভোরের আলো কেবল ফোটতে শুরু করেছে। সে সময়ই হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এসে সর্বশক্তি দিয়ে ছোটো কন্যার কক্ষের দরজায় কড়া নাড়লেন সুফিয়া। চিৎকার করে ডাকলেন,“অনু! এই অনু! উঠ না তাড়াতাড়ি। দেখ না তোর বাবা ঘুম থেকে উঠছে না। আমি এত করে ডাকলাম কিন্তু কিছুতেই আমার কথা কানে নিলো না। ওই অনু!”

মায়ের আহাজারিতে ঘুম ভাঙলো অনুভার। ফজরের নামাজ পড়ে বিছানায় শুতেই চোখটা লেগে এসেছিল তার। দুলতে দুলতে দরজা খুলে দিতেই দৃষ্টিগোচর হলো মায়ের আতঙ্কিত মুখশ্রী। শুধালো,“কী হয়েছে? চিৎকার করছো কেন?”

অন্য কোনো সময় হলেও হয়তো এ কথাটায় রেগে যেতেন সুফিয়া, কিন্তু আজ তিনি রাগলেন না। সঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,“রোজ ভোরবেলাতেই তোর বাবার ঘুম ভেঙে যায় তবে আজ ভাঙেনি। আমি কতবার করে ডাকলাম কিন্তু উঠলোই না। আমার না খুব ভয় করছে অনু, তোর বাবার শরীরটা একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কী হলো বল তো?”

“শীত এসে গেছে,এমন সময় হাত-পা ঠাণ্ডা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক মা। আচ্ছা চলো দেখি।”

বাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালো অনুভা। তার পিছু নিলেন সুফিয়াও। এতক্ষণে অর্থিকার ঘুমটাও ভেঙে গেছে। খুব সাবধানে ঘুমন্ত তাঈমের পাশ থেকে উঠে এসে ঘর থেকে বের হলো সে।

ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই শায়িত বাবাকে দৃষ্টিগোচর হলো অনুভার। বিছানার একপাশে বসে আলতো করে বাবার মাথায় হাত রেখে কোমল স্বরে ডাকলো,“বাবা! ও বাবা! সকাল যে হয়ে গেছে এবার তো ঘুম থেকে ওঠো।”

এত ডাকাডাকির পরেও চোখ মেলে তাকালেন না কামরুল হাসান। মুখশ্রী উনার নিষ্প্রাণ ঠেকছে। দেহখানা বরফের মতো ঠাণ্ডা, পাথরের ন্যায় শক্ত। কিছু একটা আঁচ করতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো অনুভার। কাঁপা কাঁপা হাতে ডান হাতের অঙ্গুলি পিতার নাকের কাছে রাখলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠলো সে। কারণ শ্বাসক্রিয়া চলছে না। এবার অতি দ্রুত উনার বুকের উপর মাথা রাখলো। অবাক করা বিষয়, হৃদযন্ত্র ক্রিয়াও বন্ধ।

সুফিয়া মেয়ের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। মেয়ের মুখের আদল বদলে যেতে দেখেই শঙ্কা বৃদ্ধি পেলো উনার। বিচলিত কণ্ঠে শুধালেন,“কী হয়েছে তোর বাবার? উঠছে না কেন? ডাক্তার ডাক না।”

‘ডাক্তার’ শব্দটা মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল অনুভার। মায়ের কথায় যেনো সম্বিৎ ফিরে এলো সে। দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের কক্ষে এলো। বিছানার উপর রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল দিলো পরিচিত ডাক্তারের নাম্বারে। বিস্তারিত সব জানিয়ে আবারো ফিরে এলো পিতার কক্ষে। হৃদয় প্রাঙ্গন ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত হচ্ছে তার। শীতের মধ্যেও শরীর ঘেমেনেয়ে একাকার। কু ডাকছে মন। বিভিন্ন চিন্তায় ভার হয়ে এসেছে মস্তিষ্ক। সেসব কিছুতেই পাত্তা দিলো না অনুভা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় মগ্ন হয়ে পড়ল।

সুফিয়া নিষ্প্রাণ হয়ে বসে আছেন। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন স্বামীর পানে। অর্থিকা মাকে শক্ত করে ধরে বসে আছে চুপচাপ। তার মনেও শঙ্কা। এক শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেক শোক? মনে মনে রবের নিকট আকুল হয়ে প্রার্থনা করছে। স্বামীকে যে হারিয়েছে মেয়েটা পুরোপুরি ভাবে এখনো বছর কাটেনি। তার মধ্যে পিতাকে হারানোর বেদনা যে কিছুতেই সহ্য করা সম্ভব নয় তার পক্ষে।

ডাক্তার আসতে আসতে ঘণ্টা পেরোলো। ডা. মুস্তফা এর আগেও বেশ কয়েকবার এ বাড়িতে এসেছেন মূলত কামরুল হাসানের জন্যই। তাই বাড়িটা উনার খুব ভালো করেই চেনা। উনাকে নিয়ে ভেতরে এলো অনুভা। চেয়ার টেনে বসতে দিলো কামরুল হাসানের সম্মুখে। চোখে চশমা এঁটে নিষ্প্রাণ দেহখানার দিকে তাকালেন ডাক্তার। কিছু সময় নিয়ে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থামলেন তিনি। মুখশ্রী গম্ভীর। তর্জনী আঙুলের সাহায্যে নিজ কপাল ঘষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। অনেক আগেই উনি এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেছেন।উনি আর বেঁচে নেই, চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে মৃ’ত্যুর সময় অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে।কিছু টের পাননি আপনারা?”

পরিবেশটা মুহূর্তেই থমথমে হয়ে গেলো। তিনজন নারীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুজল। বাকহারা হয়ে গেলো সকলে। শুরুতে অনুভা যেই আশঙ্কাটা করেছিল তাই সত্যি হলো। কিয়ৎক্ষণ থেকে বিদায় নিলেন ডাক্তার।

এতক্ষণে বরফের মতো জমে গেছেন সুফিয়া। পাথরের মূর্তির ন্যায় একস্থানেই বসে আছেন। এক বিছানায় থেকেও কীভাবে স্বামীর মৃ’ত্যু যন্ত্রনা উপলব্ধি করতে পারলেন না তিনি? কেন ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরার মতো পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছিলেন?ভেতরে ভেতরে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করতে লাগলেন সুফিয়া।অর্থিকা পিতার লাশের সম্মুখে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তার মনে পড়ে এভাবে সে কেঁদেছিল এইতো মাস এগারো আগে। এই ছোট্ট জীবনে কেন এত দুঃখ? গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলো কেন এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় জীবন থেকে?

বাবার আয়ু যে ফুরিয়ে এসেছে তা সেদিন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেই বুঝতে পেরেছিল অনুভা।তবে আজ বাস্তবতা মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।বাবা যতই সমাজের কাছে অপরাধী থাকুক না কেন, মানুষ যতই তার বাবাকে মন্দ বলুক না কেন, নিঃসন্দেহে কামরুল হাসান একজন শ্রেষ্ঠ পিতা এবং শ্রেষ্ঠ স্বামী। বাবার সঙ্গে কাটানো অতীতের স্মৃতিগুলো অকপটে ভেসে ওঠে অনুভার দৃষ্টিতে। এতশত আত্মত্যাগ তো এই বাবা-মায়ের জন্যই ছিলো। সবকিছুর ঊর্ধ্বে ক্লান্ত দেহখানা ঠেলে বাড়ি ফেরার পর আপন মুখগুলো দেখলেই তো অনুভা ভুলে যেতো সকল দুঃখ কষ্ট। অথচ আজ কিনা তাদের মধ্য থেকে একজন এভাবে বিদায় নিলো পৃথিবী থেকে? বাবা নামক মানুষটি সব ছেড়েছুড়ে চলে গেলো? এতিম হয়ে গেলো সে?

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না অনুভা। শক্ত খোলসটা বেরিয়ে মুহূর্তেই হয়ে উঠলো পুরোনো অনুভা। চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। কামরুল হাসানের শক্তপোক্ত ডান হাতটা নিজের কপালের সঙ্গে ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগের সুরে বলে উঠলো,“কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলে বাবা? কেন? তুমি কখনোই আমার কাছে বোঝা ছিলে না বাবা। প্লিজ ফিরে এসো। আমি যে তোমায় খুব ভালোবাসি বাবা।”

মেয়েদের কান্নায় সম্বিৎ ফিরে পেলেন সুফিয়া। বসা থেকে অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন। স্বামীর প্রাণহীন দেহের পানে কিয়ৎ নিরব তাকিয়ে রইলেন। চামড়া কুঁচকে যাওয়া কাঁপা কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দিলেন স্বামীর প্রাণহীন দেহখানা। এই লোকটার সঙ্গে যখন বিয়ে হয় তখন সুফিয়ার বয়স কেবল পনেরো। তারপর দেখতে দেখতে একসঙ্গে চৌত্রিশটা বসন্ত কেটে গেলো। এই মুহূর্তে এসে তিনি বড়ো মেয়ের দুঃখটা খুব করে অনুভব করতে পারছেন। কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার চোখ দিয়ে এখন আর উনার পানি ঝরছে না। কিছু সময় এমনভাবেই অতিবাহিত হলো। শরীরের ভারসাম্য ছেড়ে দিলো সুফিয়ার। মাথা টনটন করে ঘুরছে। দৃষ্টির সম্মুখে সব অস্পষ্ট, ঘোলাটে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মেঝেতে পড়ে গেলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা গেলেন। শক্ত টাইলসে পড়ায় মাথার খানিকটা অংশ ফেটে গেলো।

অনুভা দৌড়ে এলো মায়ের কাছে। মায়ের মাথাটা নিজের কোলের উপর রেখে কপোলে হাত রেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলতে লাগলো,“মা, ও মা, কী হলো তোমার? বাবা যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, তুমি অন্তত যেও না। মা গো..”

অর্থিকাও মৃত পিতার নিকট হতে চলে এলো মায়ের কাছে। এমন অবস্থা দেখে দৌড়ে গিয়ে পানি এনে ছিটিয়ে দিলো মায়ের মুখশ্রীতে। কিন্তু জ্ঞান ফিরলো না সুফিয়ার। আজ যেনো দু বোনের কঠিন পরীক্ষার দিন। একদিকে পিতাকে হারানোর শোক অন্যদিকে মায়ের এমন করুন অবস্থা। কোথায় যাবে তারা? কী করবে? এমন একটা কঠিন সময়ে পাশে হয়তো বিশ্বস্ত কারো একজনের থাকা উচিত ছিলো।

বেলা বাড়তে লাগলো। পাশের ফ্ল্যাটের মহিলাকে ডেকে এনেছে অর্থিকা। উনি এবং অনুভা মিলে সুফিয়ার হাতে পায়ে তেল মালিশ করছে। ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিয়েছে এন্টিসেপটিক। দুজন পুরুষ এসে খাট থেকে কামরুল হাসানের লাশটা মেঝেতে নামিয়ে রেখেছেন। সুফিয়ার জ্ঞান ফিরলো আরো আধ ঘণ্টা পর। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই বিড়বিড় করে প্রলাপ বকতে লাগলেন তিনি। একটু পরপর মৃত স্বামীর লাশের পানে তাকিয়ে বিসর্জন দিতে লাগলেন অশ্রু। তাঈমের ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভাঙার পর থেকে সেও চিৎকার করে কাঁদছে। পারভিনা তাকে সামাল দিচ্ছে।

কী করবে কী করবে না দিক বেদিক ভুলে বসেছে অনুভা। এই শহরে তাদের আপন বলতে কেউই নেই। তবে কামরুল হাসান বেশ কয়েকবার মেয়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,“আমি মারা গেলে আমার কবরটা আমার বাবা-মায়ের কবরের পাশে দিস মা।”

এমন একটা সময় কী থেকে কী করবে কিছুই মাথায় আসছে না অনুভার। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলে গেছে তার। হাঁটু মুড়ে বসে আছে ঘরের এককোণে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পিতার নিথর দেহের পানে। মনে মনে রবের নিকট অভিযোগ জানাচ্ছে,“এতটা অসহায় কেন করে দিলে আমায়?”

এভাবেই বেলা বাড়ছে,এতক্ষণ পাশে বসা দুয়েকজন যারা ছিলো তারাও চলে গেলো নিজ নিজ কাজে। অনুভার খেয়াল হলো তার মোবাইল অনেকক্ষণ যাবত বাজছে। নাম্বার না দেখেই রিসিভ করে কানে ধরলো মোবাইল। অপরপাশ হতে ভেসে এলো গম্ভীর কণ্ঠস্বর,“কল ধরছিলে না কেন নোভা? আজ কী অফিস বন্ধ তোমার?”

কণ্ঠস্বরের মালিককে চিনতে বেগ পেতে হলো না অনুভার। পারলো না নিজেকে সামাল দিতে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো তৎক্ষণাৎ। চমকালো শ্রাবণ। শুধালো,
“তুমি কী কাঁদছো নোভা? কিছু হয়েছে তোমার? কী হয়েছে? বলো আমায়।”

“বাবা আর নেই।”—এতটুকু বলতেই যেনো দম বন্ধ হয়ে এলো অনুভার। বুক ভার হলো। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। অপরপাশ হতে হয়তো আরো কিছু বলা হলো কিন্তু সেসব অনুভার শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না। সে নিজের কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালালো। নিজে দুর্বল হয়ে পড়লে যে মা আর বোনও অনেক অসহায় হয়ে পড়বে।

চারিদিকে শোকের ছায়া। সুফিয়া নিজ ভারসাম্য ছেড়ে দিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন। অর্থিকাও সেই পূর্বের ন্যায় মাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কিছুক্ষণ বাদেই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করল এলোমেলো একজন পুরুষ। পায়ে কেডস, পরনে ট্রাউজার, পাতলা টি-শার্ট তার উপর ডেনিমের একটা জ্যাকেট। চুলগুলোও তার এলোমেলো। বোঝাই যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে ছুটে এসেছে সে। পুরো ঘরে দৃষ্টি ফিরিয়ে এককোণে বসে থাকতে দেখলো অনুভাকে। এই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কী অবস্থাই না হয়েছে মেয়েটার। গাঢ় স্বরে ডাকলো,“নোভা!”

তার ডাকে অনুভা, অর্থিকা দুজনেই তাকায়। পুরুষালী মুখখানা অচেনা ঠেকে অর্থিকার নিকট। এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে অনুভার সম্মুখে বসে শ্রাবণ। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে শুধায়,“কখন হলো এমনটা?”

“মনে হয় রাতে।”

চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে শ্রাবণের। আজ ভার্সিটিতে তার কোনো ক্লাস নেই। রোজকার মতো আজও অনুভার জন্য অপেক্ষা করছিল রাস্তায় কিন্তু তার কোনো সাক্ষাৎ না পেয়ে চিন্তিত হয় সে। একসময় বাধ্য হয়েই কল করে বসে। তখন অমন কথা শুনতেই একপ্রকার দৌড়ে বাকি পথটা এসে পৌঁছেছে ছেলেটা। কয়েক মিনিট বাদে পুনরায় অনুভার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“নিজেকে শক্ত করো নোভা। ভেঙে পড়লে চলবে না। উনি তো আগে থেকেই অনেক অসুস্থ ছিলেন। তবুও তোমাদের কষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। বাবা হারানোটা যে অনেক কষ্টের তা আমি বুঝতে পারছি।”

অনুভা নিরুত্তর। এখনো তার পূর্ণ দৃষ্টি পিতার নিথর দেহের পানে নিবদ্ধ। কোমল কণ্ঠে পুনরায় শ্রাবণ বললো,“মৃত দেহ বেশিক্ষণ এভাবে ফেলে রাখা উচিত নয় নোভা। আমি গোসল করানোর ব্যবস্থা করছি। কবর দেওয়ার কথা ভেবেছ? কোথায় কবর দিবে? গোরস্থানে নাকি গ্ৰামের বাড়িতে? গোরস্থানে হলে তার ব্যবস্থাও না হয় আমিই করছি।”

এবার এক ঝলক শ্রাবণের পানে তাকালো নোভা। চোখ জোড়া রক্তিম হয়ে আছে তার। ভেজা ভারি স্বরে বললো,“বাবা বলে গেছেন তাকে যাতে দাদা দাদীর কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়।”

“তো আত্মীয় স্বজনদের খবর দিয়েছো? বিশেষ করে তোমার চাচাদের?”

দুদিকে মাথা নাড়ায় অনুভা। শ্রাবণ ফের বলে,“জানাতে হবে তো। নাম্বার আছে?”

অনুভা কিছু বলার আগেই চটজলদি অর্থিকা বলে ওঠে,“কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই। ওই বেঈমানদের তো একদম নয়।”

অতি বিনয় নিয়ে শ্রাবণ বলে,“এমন একটা সময় রাগ পুষে রাখা অনুচিত আপু। উনাদের সবটা জানানো উচিত। ভাইয়ের মৃ’ত্যু সংবাদ শুনে অন্তত উনাদের মন গলবে। তাছাড়া জানাজা থেকে শুরু করে কবর পর্যন্ত পরিচিত কাউকে তো লাগবেই তাই না?”

মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনলো অর্থিকা। অপরিচিত ছেলেটার কথায় খুঁজে পেলো যুক্তি। শ্রাবণ এবার প্রশ্ন ছুঁড়লো,“নাম্বারটা?”

“উনাদের কারো নাম্বার আমাদের কাছে নেই।যেখানে যোগাযোগ নেই সেখানে নাম্বার?”

এবার কী বলবে, কী করা উচিত বুঝতে পারলো না শ্রাবণ। উঠে দাঁড়ালো। আপাতত গোসলের ব্যবস্থাটা করা উচিত। ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই শোনা গেলো সুফিয়ার কণ্ঠস্বর,“অর্থির বাবার মোবাইলে হয়তো আছে ওদের নাম্বার।”

উনার দিকে ফিরে চাইলো শ্রাবণ। ভদ্রমহিলার চোখেমুখে বেদনার ছাপ। কপালে সুক্ষ্ম ক্ষত যাতে জমাট বেঁধে আছে র’ক্ত। শুকিয়ে গেছে মুখখানা। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“উনার মোবাইলটা?”

প্রশ্নটি করে আশেপাশে চোখ বুলাতেই বালিশের কাছে দেখা মিললো একটি বাটন ফোনের। শ্রাবণ এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা হাতে নিলো। কল লিস্টে ঢুকে পেয়েও গেলো মেজো ভাই দিয়ে সেভ করা একটি নাম্বার। একবার দুবার বাজতে বাজতে তৃতীয়বারের মাথায় রিসিভ হলো কল। কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বিস্তারিত সবকিছু জানিয়ে দিয়ে ফোন কাটলো শ্রাবণ। বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। এবার নিজের পরিচিত কাউকে কল দিলো।
_______

গোসল শেষে মৃত দেহ রাখা হলো লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িটায়। জানাজা পড়ানো হবে একেবারে গ্ৰামে নিয়ে। ফোন পেয়েই সেজো চাচা আর চাচাতো ভাইয়েরা তখনি রওনা দিয়েছিল নিজ বাড়ি থেকে। তারা আসতে আসতে একেবারে বিকেল হয়ে গেছে। মাকে তৈরি করে নিজেও তৈরি হয়ে নিলো অনুভা। সারাদিন পর তাঈমকে কোলে তুলে নিলো অর্থিকা।

সেই যে এখানে এসেছে শ্রাবণ, তারপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি তার। এদিকের সবদিক একাই সামলেছে ছেলেটা। গ্ৰামে ফেরার জন্য গাড়িও ভাড়া করেছে। সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। অনুভার সেজো চাচা আতিউর এসে দাঁড়ালেন তার পাশে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধালেন,“তুমি সম্পর্কে হেগো কী লাগো কও তো?”

ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো শ্রাবণের। ঘাড় উঁচিয়ে তাকালো লোকটির পানে। আসার পর থেকেই লোকটি তার দিকে কেমন একদৃষ্টিতে যেনো বারবার পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল। আর এখন সরাসরি এমন একটা প্রশ্ন? গভীর দৃষ্টিতে শ্রাবণও লোকটিকে দেখে নিলো। এও বুঝে ফেললো লোকটা যে তেমন সুবিধার নয়। সুবিধার হলে কী আর নিজ ভাইয়ের সঙ্গে এভাবে বেঈমানি করতে পারতো? শ্রাবণ স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিলো,“হঠাৎ এই প্রশ্ন? কেন বলুন তো?”

“আসার পর থাইক্কাই দেখতাছি আগ বাড়াইয়া হেগোরে সাহায্য করতাছো,হুনলাম লাশের গোসলের ব্যবস্থাও নাকি তুমি করছো? ছোডো মাইয়ার লগে কোনো সম্পর্ক টম্পর্ক আছে নাকি?”

“প্রতিবেশী হিসেবে এতটুকু করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কাউকে সাহায্য করলেই যে তাদের সঙ্গে গভীর কোনো সম্পর্ক থাকতে হয় এ কথা কোত্থেকে শিখেছেন? ভাই মারা গেছে আপনার। কোথায় শোক পালন করবেন, কষ্ট পাবেন তা না করে কার সঙ্গে কার সম্পর্কে আছে, কে কাকে কেন সাহায্য করছে সেসব বিষয় নিয়ে পড়ে আছেন কেন বলুন তো? আপনার কী ভাইয়ের মৃ’ত্যুতে কষ্ট লাগছে না?”

নড়েচড়ে উঠলেন আতিকুর। মলিন হয়ে গেলো উনার মুখশ্রী। কথাটা খুব ভালো করেই গায়ে লেগেছে। নিরবে সরে দাঁড়ালেন শ্রাবণের পাশ থেকে।

কয়েক মিনিট বাদে ফ্ল্যাটে তালা ঝুলিয়ে নিচে নেমে এলো অনুভারা। গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে নিচে। শুকনো মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অনুভা। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শ্রাবণ। বললো,“আবারো বলছি নিজেকে শক্ত করো নোভা। জন্মালেই যে মানুষকে মরতে হয়। এটাই ভবিতব্য। ওখানে গিয়ে নিজের খেয়াল রেখো। সাথে মা-বোনের খেয়ালও কিন্তু রেখো।”

“হু।”

“তোমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না আমার কিন্তু তোমার চাচার নজর ভালো ঠেকলো না। আমি চাই না আমার জন্য তোমাদের কাউকে কথা শুনতে হোক। সমস্যা হলে আমায় জানিও। আর হ্যাঁ একদম মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখবে না। ঠিক আছে?”

“হু।”—-এবারো ছোট্ট করে উত্তর দিলো অনুভা। তাকে আর ঘাঁটালো না শ্রাবণ। একটা দুঃখ ঘুচতে না ঘুচতেই আরেকটা দুঃখ যেনো হুমড়ি দিয়ে জেঁকে ধরে এই পরিবারটাকে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একে একে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। তারপরেই ছেড়ে দিলো গাড়িগুলো। যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্তই সেই পথে তাকিয়ে রইলো শ্রাবণ। পরিশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মানুষের জীবন কত আশ্চর্য! দুনিয়াতে সুখের সন্ধান করতে করতে কখন যে মৃ’ত্যু হাতছানি দিয়ে ওঠে তাই টের পায় না কেউ।

চলবে ___________

(#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৮]

জানাজা শেষে কামরুল হাসানের মৃত দেহখানা আজীবনের জন্য কবরে রেখে বাড়ি ফিরে এলো সকলে। এতক্ষণ ধরে নিজেকে জোরপূর্বক বাহির থেকে সামলে নিয়ে অযু করে কোরআন পাঠ করল অনুভা। তাদের চাচাতো ভাইয়ের বউ তাঈমকে নিজ ঘরে নিয়ে গোসল করিয়ে একেবারে খাইয়ে দিয়েছে। সুফিয়া একটা বাক্যও আর কারো সঙ্গে বিনিময় করেননি। মূর্তির ন্যায় খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছেন। দৃষ্টি শূন্যে স্থির, ঠোঁট দুটো তরতর করে কাঁপছে। অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর কথাটা যেনো উনার উপর ফলে গেছে এক লহমায়। অর্থিকাও মাকে ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও নড়ছে না কোথাও। চুপচাপ বসে আছে মায়ের পাশে।

রাত হয়েছে অনেক। গতকাল যেই মানুষটি এই দুনিয়ার সকল সুবিধা ভোগ করেছিল। যে গত রাতটাও নরম বিছানায় শরীর এলিয়ে আরাম করে শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিল। আজ রাতটা সে আর এই দুনিয়ার বুকে নেই। আজ থেকে তাকে কাটাতে হবে ওই অন্ধকার কবরে। আজ থেকে ওইটাই যে তার ঘর।

বড়ো জা মরিয়ম খাবার হাতে ঘরে এলেন। অর্থিকার উদ্দেশ্যে আদেশের সুরে বললেন,“তোর ভাবী খাওন বাড়ছে। বইনরে লইয়া কিছু মুখে দে। এমনে না খাইয়া থাকলে শরীর কেমনে চলবো? মরা মানুষের লাইগ্গা অতো কানতে নাই।”

বিপরীতে কিছু বলার জন্য ঠোঁট নাড়াতেই মরিয়ম চোখ রাঙালেন। তাই আর কিছু বলতে পারলো না অর্থিকা। একবার মায়ের মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে স্থান ত্যাগ করল। তার প্রস্থানেই মরিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সুফিয়ার পানে তাকালেন পূর্ণ দৃষ্টিতে। দুজনার শেষ দেখা হয়েছিল এইতো বছর তিনেক আগে। তখন সুফিয়া নামক এই নারীটির চেহারা ছিলো উজ্জ্বল, শরীরে ছিলো দামি শাড়ি এবং দামি গহনা। অথচ সাড়ে তিন বছরের ব্যবধানে চেহারায় বসে গেছে বাধক্যের ছাপ। চোখের নিচে কালি জমেছে। পরনের শাড়িটাও কমদামি। কানে ছোট্ট সোনার দুল। উনার এই অবস্থা দেখে নিজেদের বড্ড অপরাধী মনে হতে লাগলো মরিয়মের।

খাবার মাখিয়ে এক লোকমা ছোটো জায়ের মুখের সামনে ধরলেন তিনি। নড়েচড়ে উঠলেন সুফিয়া। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মরিয়মের পানে। মরিয়মের চোখ জোড়াও ছলছল করছে। ভেজা গলায় বললেন, “পারলে মাফ কইরা দেইস তোর এই বোইনডারে। অমন একটা বিপদের সময় আমি তগো পাশে দাঁড়াইতে পারি নাই। এতগুলা বছর সংসার কইরাও কাছের মানুষরে চিনতে পারি নাই। তোর ভাসুরের লাইগ্গা তগো লগে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারি নাই। মাফ কইরা দেইস আমারে।”

কথার তালে তালে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুজল। উনার চোখে অশ্রু দেখে শক্ত খোলসে আবৃত হৃদয়টাও যেনো কেঁদে উঠতে চাইলো সুফিয়ার। চোখ ভরে এলো পানিতে। বউ হয়ে প্রথম যখন এ বাড়িতে পা রেখেছিলেন তিনি তখন এই নারীটিই মাতৃ স্নেহে আপন করে নিয়েছিলেন সুফিয়াকে। বড়ো বোনের মতো সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে গড়ে তুলেছিলেন আদর্শ স্ত্রী রূপে। এই মানুষটি যে নির্দোষ তা সুফিয়া জানেন কিন্তু ভাসুর ননদদের যে কখনোই তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না। তারা ঠকিয়েছে উনার স্বামী আর সন্তানদের। নিজেদের এই অবস্থার জন্য তারাও যে অধিক দায়ী।

তবে চোখের পানি মুছে নিলেন সুফিয়া। স্বামীর জন্য রবের নিকট দোয়া করলেন। তিলে তিলে অনেক গুলো দিন, মাস যে মানুষটা ভোগেছে। রোজ রোজ মেয়ের উপর বোঝা হয়ে থাকার দরুন আফসোস করে দৃষ্টি নত করেছে। সবই তো স্বচোক্ষে দেখেছেন সুফিয়া। তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃ’ত্যু নামক মুক্তি ধের ভালো।

জোরপূর্বক সুফিয়াকে কয়েক লোকমা খাইয়ে কক্ষ ত্যাগ করলেন মরিয়ম। সিদ্ধান্ত নিলেন আজ জায়ের সঙ্গেই রাতটা কাটাবেন তিনি।
______

দিন পেরিয়ে রাত, রাত পেরিয়ে নব্য দিনের সূচনা। অফিসে এসে আজও পরিচিত চেয়ারটা খালি দেখে তানিমের ফুরফুরে মেজাজটা তিরিক্ষ হয়ে উঠলো। নিজের কেবিনে ঢুকেই বসে পড়ল নির্ধারিত আসনে। বাম হাত দিয়ে আলগা করল গলার টাই। মোবাইল হাতে নিয়ে কল বসালো একটি নাম্বারে। তার মিনিট চারেক পর হাজির হলো নাহিয়ান। সালাম জানিয়ে শুধালো,“বলুন স্যার।”

“মিস.অনুভা কোথায়? গতকালও উনার চেয়ার খালি ছিলো এবং আজকেও খালি। অফিসে কোনো ধরণের ইনফর্ম না করেই এভাবে অফিস বন্ধ করা কী উচিত হচ্ছে উনার?”

ঘটনাটা নাহিয়ানও খেয়াল করেছে। মেয়েটা তো সহজে অফিস বন্ধ করে না। তাহলে? হলো কী? কোনো বিপদ ঘটেনি তো? তার এই নিরবতায় বেশ বিরক্ত হলো তানিম। বললো,“এভাবে চুপ করে থাকার জন্য তো তোমায় ডাকিনি নাহিয়ান। আমার এন্সার দাও।”

“আমি কীভাবে জানবো স্যার?”

“তোমার তো পরিচিত। না জানার তো কোনো কারণ দেখছি না আমি।”

“স্যরি স্যার। এ ব্যাপারে তো কিছু জানি না আমি। তাছাড়া ওর সঙ্গে অনেকদিন ধরে তেমন করে আমার কথাও হয়নি।”

আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে মন ভার হলো তানিমের। মেয়েটাকে দুদিন ধরে না দেখে ভেতরটা অস্থিরতায় ছেয়ে যাচ্ছে তার। তার সঙ্গে সমান তালে চিন্তাও হচ্ছে। কোনো বিপদ ঘটলো না তো? মেয়েটা যেই ভুলোমনা আর বেখেয়ালি, তার সঙ্গে বিপদ আপদ ঘটাও তো অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ভোরে মাকে নিয়ে বাবার কবরটা দেখে এলো অনুভা। সকালের নাস্তা সেরে বিছানায় বসতেই চাচাদের ডাক পড়ল বসার ঘরে। মাকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হতেই নজরে পড়ল চাচা-চাচী এবং চাচাতো ভাইদের।অর্থিকাও উপস্থিত আছে সেখানে।সোফার এককোণে মাকে বসিয়ে নিজেও বসে পড়ল অনুভা।

চাচাদের মুখগুলো কেমন থমথমে। নিরবতা ভেঙে বড়ো চাচা নতজানু হয়ে বললেন,“নতুন কইরা কী আর কমু? আশেপাশের মাইনষের কটু কথা হুইন্না আর শয়তানের ফাঁদে পইড়া ভুল একটা কাম কইরাই ফেলাইছি। তুমগো তাড়াইয়া দিছি। তুমগো পরিস্থিতি সম্পর্কে যদি একটাবার জানতাম! কামরুলের অমন অবস্থার কথাও তুমগো জানানো উচিত আছিল আমাগো। তাইলে আমরা অন্তত সাহায্য করতে পারতাম।”

চট করে মেজাজ খারাপ হলো অর্থিকার। রাগত স্বরে বললো,“ভুল নয় বরং আপনারা অন্যায় করেছেন। আমাদের বাবাকে আপনারা ঠকিয়েছেন। কম উপকার তো বাবা আপনাদের করেনি, তারপরেও বেঈমানের মতো সব ভুলে গিয়ে বিপদের সময় আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বাবাকে ঠকিয়ে সব সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিলেন। আর এখন বলছেন ভুল হয়েছে?”

আবারো পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেলো। সকলের মুখ চুপসে গেলো। মেজো চাচা বললেন,“তার শাস্তি তো আর কম পাই নাই আমরা। তোমরা যাওয়ার কয়দিন পরেই সেজোর মাইয়া বেলীরে শ্বশুর বাড়িত্তে বাজা উপাধি দিয়া তাড়াইয়া দিলো। আমার পোলা নাজমুলরে বিদেশে যাওনের লাইগ্গা যেই টাকা দিছিলাম, সেই টাকাডা লইয়াও দালালে পলাইয়া গেলো। বড়ো ভাইজানের এক কিডনি নষ্ট। সেজো ভাবীও বছর দুয়েক আগে পানিতে ডুইবা মইরা গেছে। আর কত শাস্তি পামু কও তো? আমরা আমগো ভুল বুঝতে পারছি। এবার তুমগো সম্পত্তি তোমরা বুইঝা লও। আবারো কইতাছি কামরুলের এই অবস্থার কথা জানলে আমরা কিন্তু ঠিক তুমগো পাশে দাঁড়াইতাম।”

সুফিয়া এখনো বেশ স্বাভাবিক হয়ে বসে আছেন। উনার এই স্বাভাবিক ব্যবহারটাই ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে অনুভাকে। সারাক্ষণ যে মা অল্পতেই বাড়ি মাথায় করে রাখেন সেই মা কিনা এত এত ঘটনার মধ্যে নিরব! এ বড়ো আশ্চর্যজনক ব্যাপার। মৌন ব্রত ভেঙে সুফিয়া এবার মুখ খুললেন। ঠাণ্ডা স্বরে বললেন,“আমার স্বামী যা অপরাধ করেছে তার শাস্তি সে দুনিয়াতেই ভোগ করে গেছে। তার সাথে সাথে আমার মেয়েরাও সেই শাস্তি ভোগ করছে। তাই বলে আপনাদের আমি কখনোই ক্ষমা করবো না। যা বিচার দেওয়ার তা রবের নিকট আমি দিয়ে দিয়েছি। তিনিই আপনাদের বিচার করবেন। একটা কথা জানেন কী? সব ভুলের ক্ষমা হয়না।সেদিন আপনারা যদি অমন করে না ঠকাতেন তাহলে আজ হয়তো আমাদের অবস্থা এতটা খারাপও হতো না। আমার স্বামীকে আফসোস নিয়ে বাঁচতে হতো না। আমার ছোটো মেয়েটাকে নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে গাধার মতো খাটতে হতো না। দোয়া করি আল্লাহ যাতে এর থেকেও খারাপ দিন আপনাদের দেখিয়ে তারপর মৃ’ত্যু দেয়।”

কথাগুলো বলা শেষ করতেই ভেতরটা হালকা হয়ে এলো সুফিয়ার। অনেক বছর ধরে যে ক্ষোভের দহনে পুড়ছিলেন তিনি। সময় নিয়ে তৎক্ষণাৎ স্থান ত্যাগ করলেন। ভাগ্নিদের উদ্দেশ্যে বড়ো চাচা মিনমিনে স্বরে বললেন,“আমগো উপর তোমাগো রাগ করাডা স্বাভাবিক মা। কম পাপ তো আর করি নাই জীবনে। শেষ বারের মতোন একটা সুযোগ দাও মা। নইলে মরার পর রবের সামনে দাঁড়ামু কেমনে কও তো? আর ফিইরা যাওয়ার দরকার নাই ওই অপরিচিত শহরে। এইহানেই তোমরা থাইক্কা যাও। তোমাগো বাবার সব সম্পত্তি আমি নিজ দায়িত্বে তোমাগো বুঝাইয়া দিমু। তোমাগো সব দায়িত্ব তোমাগো ভাইয়েগো।”

অর্থিকার ইচ্ছে হলো কড়া কিছু শুনিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তার সেই ইচ্ছেকে পূর্ণতা না দিয়ে অনুভা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“তার কোনো প্রয়োজন নেই চাচা। যখন দায়িত্ব নেওয়ার ছিলো তখন তো আর নিতে পারেননি বরং জীবন নামক গভীর সাগরের মাঝখানে ছেড়ে দিয়েছিলেন আমাদের। ওই মাঝপথ থেকে অনেক কষ্টে উঠে এসে আজ এই পর্যন্ত পৌঁছেছি। নিজের দায়িত্ব নেওয়া শিখেছি।আপনাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই এখন। আপনাদের মুখোমুখি হওয়ারও কোনো ইচ্ছে ছিলো না আমার। কিন্তু ওই যে বাবার শেষ ইচ্ছে ছিলো কবরটা যাতে তার বাবা-মায়ের কবরের পাশে দেওয়া হয়। তাই আসতে হলো। দয়া করে আমাদের নিয়ে আর কোনো চিন্তা করবেন না। আজই আমরা নিজেদের ঠিকানায় রওনা দিবো।”

কথাটা শেষ করে গটগট হেঁটে প্রস্থান করল অনুভা। অর্থিকাও তার পিছু নিলো‌। লোকগুলোর মুখ দেখেই অতীতের জঘন্য স্মৃতিগুলো চক্ষু পটে ভেসে উঠলো দু-বোনের।

বেশ কয়েকবার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটায় কল দিয়ে থামলো শ্রাবণ। বিপরীত পাশ হতে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে চিন্তিত হলো মন। সেই চিন্তার ছাপ ভাঁজ পড়া ললাটেও উদীয়মান হয়ে উঠলো। ইচ্ছে জাগলো ছুটে চলে যেতে অনুভার কাছে। কিন্তু ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে হলো তাকে। হাত-পা যে তার অদৃশ্য এক শিকলে বাঁধা। এই সময়টায় মেয়েটার পাশে ছায়ার মতো থাকতে না পারার কষ্টে ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ছারখার হয়ে যেতে লাগলো।

খানিকক্ষণ বাদে অনুভার কল এলো।কল কেটে দ্রুত ব্যাক করল শ্রাবণ। চিন্তিত, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুমি ঠিক আছো তো নোভা? কতগুলো কল দিলাম ধরলে না কেন? আন্টি, অর্থি আপু, তাঈম ওরা ঠিক আছে তো?”

“হুম সবাই ঠিক আছে।আসলে মোবাইলটা সাইলেন্ট অবস্থায় ঘরে রেখে গিয়েছিলাম তো তাই ধরতে পারিনি।”

চিন্তা কিছুটা হলেও এবার হ্রাস পেলো শ্রাবণের। কণ্ঠে নমনীয়তা এনে শুধালো,“খেয়েছো?”

“হুম।”

“ফিরতে কী দেরি হবে?”

“না আজকালের মধ্যেই চলে আসবো।”

“একা একা আসার প্রয়োজন নেই,পুরো লোকেশনটা পাঠিয়ে দিও আমি এসে নিয়ে যাবো তোমাদের।”

“আর কত সাহায্য করবে বলো তো?একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কারো উপর নির্ভর হতে চাই না আমি। সবাই মাঝপথে ফেলে চলে যায়। একা করে দিয়ে যায় আমাদের। বাকি পথটাও যে একাই চলতে হবে। তাই নতুন করে আর কাউকে প্রয়োজন নেই আমার।”—-
কথাটা বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলো অনুভার। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জলরাশি।

শ্রাবণের মুখশ্রী মলিন হয়। গাঢ় স্বরে বলে,“আমি তো ইহজন্মের জন্যই তোমার একাকিত্ব দূর করে দিতে চাই নোভা। তোমার জীবনের দুঃখ কষ্ট ঘুচিয়ে দিতে চাই। তোমার চলন্ত পথ বদলে দিতে চাই। একবার শুধু বিশ্বাস করে আমার হাতটা ধরো। কথা দিচ্ছি মৃ’ত্যু ব্যতীত তোমার ওই হাত ছাড়বো না আমি।”

আচমকা কেঁদে উঠলো অনুভা। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বললো,“এই মৃ’ত্যুটাই তো সব শ্রাবণ। এই মৃ’ত্যুটাই আমাদের একা করে দিয়ে যায়। এই মৃ’ত্যুর কারণে একে একে সবাই হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে।”

“প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃ’ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই বলে তুমি কাউকে ভালোবাসবে না? চিরকাল বুকের ভেতর এক সমুদ্র দুঃখ পুষে রেখে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিবে? একবার ভালোবেসে দেখো না নোভা।”

“ভয় করে, শেষে যদি আপুর মতো অবস্থা হয়? যদি ভালোবাসা নামক বিষ গলাধঃকরণ করলে মানসিক অসুখ নামক মৃ’ত্যু হয় আমার? তখন! তখন কী হবে?”

“প্রতিটি জিনিসের মন্দ দিক যেমন থাকে তেমন ভালো দিকও থাকে। এমনও তো হতে পারে তোমার ক্ষেত্রে উল্টো ঘটলো? বিষ নয় বরং ভালোবাসা নামক অমৃত সুধা পান করে তোমার সুখের অসুখ হলো। তখন?”

নিরব হয়ে গেলো অনুভা। কখনো তো এমন করে ভেবে দেখেনি সে। ভালোবাসা কী আদৌ অমৃত হতে পারে? ভালোবাসা কী পারে জীবন বদলে দিতে? এমন প্রমাণ তো কখনো পায়নি সে। তবে? এসব ভাবনাতেই মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে গেলো অনুভার। বিপরীত পাশ হতে আকুল আবেদনী কণ্ঠে শুধালো,“অনেক তো হলো ভালোবাসাকে ঘৃণা করা। এবার একটু ভালোবেসে ভালোবাসায় গা ভাসিয়ে দেখো না নোভা। তোমার ভালোবাসার তৃষ্ণায় যে একজন প্রেমিক পুরুষ তৃষ্ণার্ত হয়ে ছটফট করছে। একবার শুধু বিশ্বাস করে ভালোবেসে দেখো। কথা দিচ্ছি ঠকবে না। শ্রাবণের হাত ধরলে তুমি ঠকবে না।সুখের চাদরে মুড়িয়ে রাখবো তোমায়।”

কী সুন্দর আবদার! এই আবদারের বিপরীতে কী আদতে ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করা সম্ভব? যায় কী এমন স্নিগ্ধ পুরুষের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করা? হয়তো যায় না। অনুভা নামক কঠিন হৃদয়ের মেয়েটি হাজারবার চেয়েও পারলো না তা উপেক্ষা করতে। তবে অজস্র জড়তার কারণে সরাসরি সেই আবদার মঞ্জুরও করতে পারলো না। মৌন রইলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো তার।

ছোট্ট একটি শব্দ শোনার আশায় উতলা হয়ে বসে থাকা শ্রাবণ নামক পুরুষটি জিভ দিয়ে নিজের শুকনো ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে শুধালো,“এবারের উত্তরটা কী হ্যাঁ ধরে নিবো নোভা? বাসবে কী ভালো?”

এবারও উত্তর এলো না বিপরীত মুখী হতে। দুদিকে মিনিট দুয়েক নিরবতা চললো পাল্লা দিয়ে। শ্রাবণ আর কিছু বললো না। চাইলো না জোর করতে। সময় দিলো পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার। অনুভা মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,“রাখছি।”

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-১৪+১৫+১৬

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৪]

শরৎ ঋতু শেষের পথে। চারিদিকে শীত শীত একটা আমেজ। অফিস থেকে বের হওয়ার পর আজও তানিমের সঙ্গে দেখা হলো অনুভার।গত চারদিন ধরে অনিচ্ছাসত্বেও তানিমের গাড়িতে করেই বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে তাকে। মুখের উপর কড়া করে নাও বলতে পারে না মেয়েটা। পাছে চাকরি যাওয়ার ভয়ে। তবে ভদ্রতা বজায় রেখে একবার তানিমের উদ্দেশ্যে অনুভা বলেই দিয়েছিল,“রোজ রোজ কষ্ট করে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই স্যার। এমনিতে তো আমি একা একাই বাড়ি ফিরি।”

তানিমের তখন সোজাসাপ্টা জবাব,“আগে ফিরতেন বলে যে এখনো একা একা ফিরতে হবে তেমন কোনো কথা ছিলো নাকি মিস.অনুভা? এবার থেকে আপনাকে আমার সঙ্গেই ফিরতে হবে। তাতে যদি আপনার আপত্তি থাকে তারপরেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না।”

এরপর আর কিই বা বলার থাকে? অন্য কেউ হলে না হয় ত্যাড়ামো করা যেতো। কিন্তু বসের মুখে মুখে কি আর তর্ক করা যায়? তবে আজকাল অনুভার নিকট সবকিছুই বিরক্ত লাগে। আশেপাশে থাকা মানুষজনকেও বড্ড বিরক্ত লাগে। তবে এর মধ্যে একটা ব্যাপার খুব ভালো করেই খেয়াল করেছে অনুভা। সবাইকে তার নিকট বিরক্ত লাগলেও শ্রাবণ নামক পুরুষটির প্রতি তার নেই কোনো বিরক্তি। চাইলেও তার প্রতি রাগ আসে না। ছেলেটার মুখখানা দেখলেই যেনো দিন দুনিয়া ভুলে বসে থাকে মেয়েটা। এসব লক্ষণ ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় পর্বের শুরুর দিকেও ছিলো অনুভার ভেতরে।

হাস্যজ্জ্বল মুখে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তানিম। আজ ড্রাইভার নেই সঙ্গে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে তার মন মেজাজ আজ খুবই ভালো। দৃষ্টি অনুভার পানে স্থির। একঝাঁক বিরক্তি নিয়ে অনুভা এগোলো। তৎক্ষণাৎ তার মোবাইলটা ঝংকার তুলে বেজে উঠলো। দ্রুত ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে স্ক্রীনে তাকাতেই ভাসমান একটি নাম্বার দেখতে পেলো। তৎক্ষণাৎ আপনাআপনি ঠোঁটের কার্নিশে ফোটে উঠলো মৃদু হাসির রেখা। এই নাম্বারটি অনুভার খুবই পরিচিত। সেদিন রাতে এই নাম্বার থেকেই শ্রাবণের কল এসেছিল। এই নাম্বারের কল পেয়েই তো মাঝরাতে নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে অনুভা ছুটে গিয়েছিল নিচে। তারপর টানা তিনদিন কেটে গেলো অথচ শ্রাবণের দেখা মিললো না আর। একেবারে লাপাত্তা হয়ে গেলো ছেলেটি। যদিও পরিচয় পর্বের শুরু থেকেই এভাবে হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়া শ্রাবণের অভ্যাস।

বাজতে বাজতে কল কেটে যাওয়ার আগ মুহূর্তেই রিসিভ করে মোবাইল কানে ধরলো অনুভা। কিছু বলার পূর্বেই বিপরীতে পাশ হতে ভেসে এলো ভারি কণ্ঠস্বর,“অফিস রোডের অপজিটে দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে জং ধরে যাচ্ছে নোভা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার সামনে দেখতে চাই তোমাকে।”

কথাটা শেষ হতেই কেটে গেলো কল। অবাক হলো অনুভা। ছেলেটা কী তাকে আদেশ করল? ভাবতেই দম ছাড়লো সে। তাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো তানিম। শুধালো,“এনি প্রবলেম মিস.অনুভা?”

নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখলো অনুভা। সে জানে এই মুহূর্তে যদি শ্রাবণের ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে ছেলেটা রাগারাগী না করলেও অভিমান করবে। চরম অভিমান। হয়তো আরও দুই তিন সপ্তাহ সামনেই আসবে না। এমনটা অনুভা চায় না। সামনে যত যাই বলুক না কেন,সত্যি বলতে সে চায় না শ্রাবণ আবারো লম্বা একটা সময়ের জন্য তার চোখের আড়াল হোক। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিয়ে অনুভা বললো,“স্যরি স্যার। আমার ফ্রেন্ড ফোন করেছিল। ও আমার অপেক্ষায় বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাই আপনার সঙ্গে আজ যাওয়া হচ্ছে না।”

কথাটাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিলো তানিম। দায় সারা ভাবে বললো,“নো প্রবলেম। ফ্রেন্ড ডাকলে যেতে হয়। যান তবে।”

তার থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত চলে গেলো অনুভা। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে বসলো তানিম।

গাড়ির সম্মুখ অংশে বসে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে শ্রাবণ। এই রাস্তাটায় জনমানব খুব কম। আশেপাশে তেমন দোকান পাটও নেই। অফিস এড়িয়া বলেই হয়তো। গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো অনুভা। তার উপস্থিতি টের পেয়েও পূর্বের ন্যায় ঠাঁয় বসে রইলো শ্রাবণ। কিছু সময় নিরবতা পালন করল। তারপর হুট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। গাঢ় দৃষ্টি স্থির করল অনুভার অক্ষি যুগলে। ভড়কে গেলো অনুভা। এতক্ষণ তো সে শ্রাবণের পানেই তাকিয়ে ছিলো। চোখাচোখি হতেই খানিকটা লজ্জা পেলো।

নেশাতুর কণ্ঠে শ্রাবণ বলে উঠলো,“লজ্জা পেলে তোমায় দারুন লাগে নোভা। ইচ্ছে করে ওই চোখ, ওই ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে দিতে।”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই হতভম্ব হয়ে গেলো অনুভা। এমন দ্বারার কথাও এই পুরুষ বলতে পারে? হ্যাঁ পারে তো, না পারলে বললো কী করে? তার এই অবাকত্বের মধ্যেই আরো অবাক করে দিয়ে স্লান হাসে শ্রাবণ। কণ্ঠে গভীরতা ঢেলে বলে,“চলো না বিয়ে করে ফেলি। কথা দিচ্ছি, সকল কষ্ট দূর করে দিয়ে পৃথিবীর সব সুখ এনে দিবো তোমার দোরগোড়ায়।”

হতবিহ্বল চিত্তে তাকিয়ে থাকে অনুভা। এমন একটি কথা শ্রাবণের থেকে কখনোই সে প্রত্যাশা করেনি। কিছুক্ষণ হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে চেহারায় কঠোরত্ব এঁটে বললো,“মজা করছো আমার সঙ্গে? এটা তোমার কাছে মজা করার মতো সময় মনে হলো? তোমার কাছে মনে হলেও আমার কাছে কিন্তু সময়টা একদম মজা করার মতো নয়।”

“আমার অনুভূতি তোমার কাছে মজা মনে হয়? তুমি তো অবুঝ নও নোভা তাহলে অবুঝ হওয়ার ভান কেন করছো? কখনো সো কল্ড প্রেমিকদের মতো হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করিনি বলে, হাত ধরে হাঁটিনি বলে, ফোনকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রেমময় বাক্য শুনাইনি বলে কি আমি ভালোবাসতে জানি না?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুভা। কিয়ৎক্ষণ নিরব থাকে। মনে মনে সাজায় কথা। জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলে,“তুমিও তো অবুঝ নও শ্রাবণ। তারপরেও কীভাবে এমন একটা প্রস্তাব দিচ্ছো বলো তো? আমাদের অবস্থা আর আগের মতো নেই। আমি এখন একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। বিয়ে করে সুখে সংসার করার মতো অবস্থায় আমি নেই। পুরো একটা সংসারের দায়িত্ব আমার উপর। তাছাড়া তোমারও তো একটা পরিবার আছে। যা বোঝা যায় তুমি সম্রান্ত পরিবারের ছেলে। তোমার বাবা-মা যখন জানতে পারবে আমার পরিবারের কথা, আমার বাবা ঘুষ নিতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছে, জেল খেটেছে তখন কী তারা মুখ ফিরিয়েও তাকাবে আমার দিকে? সমাজ, আত্মীয় স্বজন বলেও তো একটা কথা আছে। যেখানে আমরাই আত্মীয়, স্বজন, পরিচিতদের সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না সেখানে তোমাদের কী অবস্থা হবে?”

দম ছাড়ে অনুভা। ফের বলে,“তুমি বুদ্ধিমান, শিক্ষিত ছেলে। সবকিছু জানার পরেও আবার ফিরে আসা উচিত হয়নি তোমার। উচিত হয়নি আমার মুখোমুখি হওয়া।”

শ্রাবণের মুখভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। বললো,“প্রথম বার যেদিন আমাদের দেখা হয়েছিল সেই দেখাটা ছিলো একদম আকষ্মিক আর কাকতালীয়। হয়তো ওইদিনই আমাদের শেষ দেখা হতে পারতো। কিন্তু তোমার কিছু বোকা বোকা কথা আর ভুল ধারণার কারণে দ্বিতীয়বার দেখাটা আমার পক্ষ থেকে ছিলো ইচ্ছাকৃত। তোমার ভুল ভাঙানোর জন্যই দ্বিতীয়বার তোমার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। আর তারপরেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। তোমার ওই চোখ, ঠোঁট, কথাবার্তা বারবার আমার মনে পড়তে লাগলো। অনেক চেষ্টা করেও আমি ভুলতে অক্ষম হলাম তোমায়। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে তার ঠিক এক সপ্তাহ পর আবারো দেখা করতে ছুটে এলাম। সেমিষ্টার পরীক্ষার কারণে তারপর আর আসা হলো না, দেখা হলো না আমাদের। পরীক্ষা শেষ হলো, ফলাফল দিলো তারপর আচানক তোমার কথা আবারো মনে পড়ে গেলো।ততদিনে তোমার কোচিংয়ের ক্লাস শেষ। কোন বিল্ডিংয়ের কততম ব্যাচে তুমি ছিলে তা আমার জানার বাহিরে ছিলো। তারপরেও সেদিন পুরোটা দিন ধরে সব কয়টা বিল্ডিংয়ে গিয়ে গিয়ে মানবিক বিভাগের হাজিরা খাতা ঘেঁটে তোমার নাম, ঠিকানা সবকিছু খুঁজে বের করেছি। সামনে তোমার পরীক্ষা ছিলো বলে তখন বিরক্ত করিনি। যখন যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট দিয়েছে সেখানকার ওয়েবসাইটে গিয়ে গিয়ে চেক করে দেখেছি।সবশেষে জবিতে গিয়ে তোমায় পাই। এই যে রোজ রোজ এতটা পথ পাড়ি দিয়ে, জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে তারপর তোমার সঙ্গে দেখা করতাম এগুলো কী তোমার কাছে নিছক মজা মনে হয়? মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার হলে, তিনটে বছর কোনো যোগাযোগ ছাড়া থাকার পরেও দেশে এসে খোঁজ খবর নিয়ে সবটা জানতে পারার পর তখনই সব ভুলে যেতাম। কিন্তু না দুটো মাস কোথায় কোথায় না খুঁজেছি তোমায়? অবশেষে পেয়েছি। তারপরেও ছায়ার মতো পেছন পেছন থেকেছি। বাড়ি থেকে যতক্ষণ না অফিস পর্যন্ত পৌঁছেছো আবার অফিস থেকে বাড়িতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত খেয়াল রেখেছি। কখনো হয়তো এসব কিছুই টের পাওনি। আর এখন তুমি আমায় বাস্তবতা, সমাজের ভয় দেখাচ্ছো? একটা কথা জানো কী? শ্রাবণ কারো ধার ধারে না। আমার নজরে পড়ার পর থেকেই তুমি শুধু শ্রাবণের নোভা। শুধুই শ্রাবণের।”

শেষের কথাটা বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে এলো শ্রাবণের। শুকনো ঢোক গিললো অনুভা। এসব কিছু এতদিন তার জানার বাহিরে ছিলো। সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস না করেও শ্রাবণ যে তার সম্পর্কে এতকিছু কী করে জানে এই প্রশ্নটাই কখনো মাথায় আসেনি। আসলেও হয়তো সামনাসামনি দেখা হলে তা জিজ্ঞেস করতে ভুলে যেতো। তবে সে এবার পুরোপুরি নিশ্চিত যে এই পুরুষ তাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে। কিন্তু সে যে অপারগ। শ্রাবণের ডাকে সারা দেওয়া তার জন্য নিষিদ্ধ। সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করে,“সেদিন দুর্ঘটনার সময় তুমি ওখানে উপস্থিত ছিলে তাই না? তুমিই ওই ওষুধগুলো পাঠিয়েছিলে আমার জন্য?”

বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শ্রাবণের।তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,“দেখলে? মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তুমি কতটা ভুলে গিয়েছো আমায়? আমার উপস্থিতি, আমার কণ্ঠস্বর পর্যন্ত তোমার কাছে অচেনা।”

“ভুল ভাবছো।”

“তাহলে ঠিকটা কী?”

“কিছু না, ভালো লাগছে না। বাড়ি চললাম। তুমিও নিজ বাড়িতে ফিরে যাও।”

কথাটা বলে সামনের দিকে এগোনোর জন্য উদ্যত হলো অনুভা। কিন্তু পারলো না। সামনে এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো শ্রাবণ। চোখেমুখে তার কাঠিন্য। কঠোর গলায় বললো,“তোমার কথায় তো শ্রাবণ চলবে না নোভা। বাড়ি পর্যন্ত তোমায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। এই দায়িত্ব কেড়ে নেওয়ার কোনো অধিকার তোমার নেই। আর না আছে তোমার ওই বসের।”

ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনুভা। বাঁকা হাসলো শ্রাবণ। অনুভার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,“তুমি শুধু আমার নোভা। তোমার দায়িত্ব নেওয়ার অধিকার শুধুই আমার। তোমার ভালো-মন্দও আমি বুঝবো। আমাদের মাঝখানে যদি অন্য কেউ চলে আসে তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম। তোমাকে অন্য কারো সঙ্গে দেখলে আমার সহ্য হয় না। এ কথা কবে বুঝবে বলো তো?”

ঠান্ডা কণ্ঠের হুমকি শুনতেই পুরো দেহ শীতল হয়ে উঠলো অনুভার। এমন একটা সময় এসে তার মনে হলো, ছেলেটা ভারি হিংসুটে। অনুভাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো শ্রাবণ। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“গাড়িতে উঠো। তোমায় পৌঁছে দিয়ে আমারও তো ফিরতে হবে।”

নড়চড় করল না অনুভা। নিজের কথাতেই সে অনড় থাকবে আজ। কিছুতেই শ্রাবণের সঙ্গে ফিরবে না। শ্রাবণ হয়তো বুঝতে পারলো তার মনোভাব তাই কণ্ঠে গাম্ভীর্য রেখেই বললো,“নিজ থেকে উঠবে নাকি আমায় জোরাজুরি করতে হবে? আমি জোরাজুরি করলে কিন্তু তোমার জন্য তা মোটেও ভালো হবে না নোভা।”

কথায় কথা বাড়ে। শ্রাবণের বিপরীতে গিয়ে এখান থেকে যাওয়া যে তার জন্য কষ্ট সাধ্য হয়ে যাবে তা বেশ বুঝতে পারলো অনুভা। হার মেনে নিয়ে চুপচাপ উঠে বসলো গাড়িতে।

নিঃশব্দে হাসলো শ্রাবণ। চালকের আসনে গিয়ে বসে স্টার্ট বসালো গাড়িতে। অনুভা সিদ্ধান্ত নিলো এই ছেলের সঙ্গে আর কথাই বলবে না সে। এই মুহূর্তে মৌন থাকবে। গাড়ি চলছে কিন্তু ধীর গতিতে। এই ধীর গতি খুবই বিরক্ত লাগে অনুভার নিকট। কথা বলবে না বলবে না ভেবেও একপ্রকার বাধ্য হয়েই বলে উঠলো, “সমস্যা কী তোমার? এভাবে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছো কেন?”

শ্রাবণের দৃষ্টি সম্মুখে। হতাশ কণ্ঠে উত্তর দিলো, “জীবনটাই তো ধীর গতিতে চলছে সেখানে গাড়ির গতি এমন হওয়া তো অস্বাভাবিক কিছু নয়।”

“হয় গাড়ির গতি বাড়াও নয়তো গাড়ি থামাও। আমি নেমে যাবো।”

“তোমার কথা আমি শুনবো না।”

“এমন করছো কেন?”

“বিয়ে করে নাও আমায়। তাহলে আর কিছুই করবো না।”

নিরব হয়ে গেলো অনুভা। দৃষ্টি নিবদ্ধ করল জানলার বাহিরে। তার এই নিরবতায় শ্রাবণ পুনরায় বলে উঠলো,
“বিয়ে করলেই যে সংসার করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আগে না হয় বিয়েটাই করে ফেলি চলো। সংসার তো পরেও করা যাবে তাই না?”

এবারো নিরুত্তর রইলো অনুভা। এই পুরুষকে যে বারংবার না করতে তার কষ্ট হয়। ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় হৃদয়। যথাসম্ভব নিজেকে শ্রাবণের সামনে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় মগ্ন হয়ে পড়ল সে। ততক্ষণে গাড়ির গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্দিষ্ট স্থানে এসে থেমে গেলো গাড়ি। তাড়াহুড়ো করে নেমে গেলো অনুভা। বিদায় না জানিয়েই হাঁটা ধরলো সামনের পথ ধরে।
_______

তানিম বাড়ি ফিরেছে ঘণ্টা খানেক পূর্বে। ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে। আফসানা এসে উপস্থিত হলেন প্রাণপ্রিয় পুত্রের ঘরে। রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন,“আমায় কী তোরা বাপ ছেলে একটু শান্তি দিবি না? ওদিকে বাপের হাজার হাজার হুকুম আর এদিকে ছেলে।”

“আমি কী তোমায় আসতে বলেছি?”

“তাহলে রোজিনাকে দিয়ে যে তোকে ডেকে পাঠালাম এলি না কেন? খাওয়া দাওয়া কী ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস নাকি?”

“খাওয়া দাওয়া কী ছাড়ার মতো কিছু? খিদে নেই তা তো বলেই দিয়েছি।”

ললাটে ভাঁজ পড়ল আফসানার। রোজিনা খাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। তার হাত থেকে ট্রে টা নিজ হাতে নিয়ে নিলেন আফসানা। তৎক্ষণাৎ কক্ষ থেকে চলে গেলো রোজিনা। আফসানা ভাত মেখে এক লোকমা তুলে ধরলেন পুত্রের মুখের সামনে। কড়া গলায় বললেন,“তোকে আমি জন্ম দিয়েছি। তাই তোর খিদে আছে কি নেই তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না, বুঝলি? এবার চুপচাপ খেয়ে নে।”

মায়ের কথার উল্টো পিঠে দ্বিমত পোষণ করতে পারলো না তানিম। কারো উপরে রেগে গেলেই সেই রাগটা খাবারের উপর দিয়ে প্রয়োগ করা তার সেই ছোটোবেলাকার বদ অভ্যাস। ছেলের এই বদ অভ্যাস সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবগত আফসানা। তাই যখনি তানিম খেতে চায় না তখনি উনি বুঝে যান যে ছেলে উনার রেগে আছে। তাই জোট ঝামেলা না করে তখন জোর করে নিজ হাতেই এভাবে খাইয়ে দেন ছেলেকে।

খাওয়ানো শেষ হতেই হাত ধুয়ে নিলেন আফসানা। যেতে যেতে বললেন,“এদের জ্বালায় আর বাঁচি না। বয়স তো কম হয়নি এখনো নাকি মাকে খাবার নিয়ে পিছুপিছু ঘুরতে হয়। এবার অন্তত বিয়ে করে বাড়িতে একটা বউ নিয়ে আয়। তারপর যত আধিখ্যেতা সব বউয়ের সামনে করিস।”

আরো অনেক কিছুই বলতে বলতে চলে গেলেন আফসানা। তানিমের মস্তিষ্কে গিয়ে শুধু আটকে রইলো দুটো শব্দ, ‘বিয়ে’ ‘বউ’।

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৫]

প্রতি মাসের নির্ধারিত একটা সময়ের জন্য অফিস থেকে ছুটি নেয় অনুভা। আজই তার সেই ছুটির দিন। এই দিনটিতে সে বাবাকে ডাক্তার দেখায়। তবে আজ বাবা-মা দুজনকেই সঙ্গে করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে অনুভা। সুফিয়ার ব্যথাটা ইদানিং খুব বেড়েছে। এই ব্যথা সহ্য করতে না পেরেই সারাক্ষণ সবার সঙ্গে খিটখিটে মেজাজ দেখান ভদ্রমহিলা। খারাপ আচরণ করেন। কখনো তো সাধারণ একটা বিষয়কেও বড়ো করে দেখেন। তবুও মুখ ফুটে নিজের অসুস্থতার কথা জানান না কাউকে। আড়াল রাখেন মেয়ের থেকে।

হুইল চেয়ারে করে কামরুল হাসানকে একটি কেবিনের ভেতরে নিয়ে গেছে নার্স। ওখানেই ডাক্তার এসে দেখবে উনাকে। এই সুযোগে মাকে নিয়ে অন্যদিকে আরেক বিশেষজ্ঞের কাছে ছুটলো অনুভা। মেয়ের এহেন কাণ্ডে প্রচন্ড ক্ষীপ্ত সুফিয়া। দাঁতে দাঁত চেপে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“এমনিতেই মাস শেষে টাকায় টানাটানি পড়ে। তার উপর আবার আমাকেও সঙ্গে করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছে। বোকাসোকা দুটো মেয়ে জন্ম দিয়েছি আমি।”

আড়চোখে মায়ের মুখভঙ্গি দেখে সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অনুভা। কয়েক মিনিট বাদেই তাদের সিরিয়াল এলো। ডাক্তার ভদ্রলোক কিছুক্ষণ কথা বলে কয়েকটা টেস্ট লিখে দিয়ে বললেন,“এই পরীক্ষাগুলো আজই করাবেন। রিপোর্ট হাতে পেতেই আমার কাছে আবার চলে আসবেন।”

প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়ালো অনুভা। সেখান থেকে এবার মাকে নিয়ে গেলো পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করাতে। ঘণ্টা খানেক সময় নিয়ে সব পরীক্ষা করিয়ে তারপর আবারো ছুটলো বাবার কাছে।

যেই ডাক্তারের চিকিৎসাধীন কামরুল হাসান, সেই ডাক্তার আলাদা ডেকে পাঠিয়েছে তাকে। উনার চেম্বারেই প্রবেশ করল অনুভা। অর্ধ বয়স্ক লোকটি হাতের ইশারায় চেয়ারে বসতে বললো অনুভাকে। মুখে উনার চিন্তার ছাপ। চশমাটা নাকের ডগায় নামানো। রয়েসয়ে হতাশ কণ্ঠে বললেন,“আমরা ডাক্তাররা রোগীর রোগ নির্ণয় করে সে অনুযায়ী তার চিকিৎসা করি, ওষুধ লিখে দেই। কিন্তু সুস্থ করার মালিক হচ্ছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। তবে নিজেরও তো নিজের শরীরের যত্ন নিতে হবে তাই না? বেঁচে থাকার পূর্ণ একটা ইচ্ছা থাকতে হবে। মি.কামরুলের শরীরে রোগের তো অভাব নেই। এমনিতেই ক্যান্সারের মতো বড়ো একটা অসুখ বাঁধিয়ে বসে আছেন তার উপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আরো কতকিছুই যুক্ত হয়েছে। উনার কন্ডিশন তেমন ভালো নয়। ঠিকমতো খাওয়া- দাওয়া করেন না। বাঁচার কোনো ইচ্ছেই উনার মধ্যে নেই। যতবার হাসপাতালে আসেন ততবারই শুধু জিজ্ঞেস করেন, ডাক্তার আর কতদিন এভাবে পার করতে হবে? মরার সময় কী এখনো আসেনি? মানুষ যেখানে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে সেখানে উনি নিজের মৃ’ত্যুর দিন গুনেন। কী আর বলবো? উনার মধ্যে কোনো ইম্প্রুভমেন্ট আমি দেখছি না। শুধু ওষুধ সেবন করলেই তো আর মানুষ সুস্থ হয়ে ওঠে না।”

শ্রবণালী পর্যন্ত কথাগুলো পৌঁছাতেই মস্তিষ্ক জ্বলজ্বল করে উঠলো অনুভার। কণ্ঠনালী তার কাঁপছে। ভেতরে এসি থাকার পরেও ললাটে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সংকীর্ণ স্বরে শুধালো,“আপনি কী বলতে চাইছেন বাবা আর বেশিদিন বাঁচবে না?”

সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। উনার নিরবতা দেখে যা বোঝার বুঝে গেলো অনুভা। পুরোনো ক্ষত জেগে উঠলো মুহুর্তে। বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েও না হয় সব দুঃখ কষ্ট মেনে নিয়েছিল মেয়েটা। কিন্তু তাদের মধ্যকার একজনই যদি না থাকে তাহলে এই কষ্ট, পরিশ্রম যে বৃথা যাবে। ডাক্তার হয়তো আরো কিছু বললেন কিন্তু তা যেনো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালোই না অনুভার। ছোটো ছোটো কদম ফেলে চলে গেলো বাবার কাছে।

গোরস্থানের একটি কবরের পাশে বসে আছে অর্থিকা। কবরের পাশে বাঁধাই করে লেখা আছে,‘তন্ময় খান’। প্রায়সই রাতের বেলা যখন বিভৎস স্বপ্নগুলো দেখতো মেয়েটা, তার পরেরদিনই ছুটে আসতো স্বামীর কবরের কাছে। তবে আজ অর্থিকা একা আসেনি। সঙ্গে এনেছে তাঈমকে। এই প্রথম বাবার কবরের কাছে এসেছে তাঈম। মা-খালার সান্নিধ্যে থাকলে কখনোই ছেলেটাকে কাঁদতে দেখা যায় না। আজও তাই, নিজের মতো করে মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ করছে। ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছে মায়ের মুখপানে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে স্বামীর কবরের পাশে বসে রইলো অর্থিকা। ছেলেকে দেখিয়ে দেখিয়ে বিড়বিড় করে কিছুক্ষণ আপনমনে কথা বললো তারপর উঠে গেলো সেখান থেকে। কখনো কী ভাবতে পেরেছিল প্রিয় মানুষটির সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য গোরস্থানের মতো একটি জায়গায় আসতে হবে তাকে?
_______

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই ফ্ল্যাটের দরজায় বাহির থেকে ঝুলন্ত তালা দেখে চমকায় সকলে। ক্লান্ত দেহগুলো যেনো আরো ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রাগে গজগজ করতে থাকেন সুফিয়া। কণ্ঠে অঢেল রাগ ঢেলে বলেন,“অর্থিটা এবার খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। ও কী জানে না আমরা যেকোনো মুহূর্তেই যে চলে আসবো? আজকের দিনটাও কাউকে শান্তি দিবে না মেয়েটা?”

অনুভা নিরব, বোনের উপর তারও এবার কিছুটা রাগ হচ্ছে। একটা মানুষকে প্রতিটা দিন কতভাবে বোঝানো যায়? কতভাবে তার পাশে থেকে ভরসা যোগানো যায়? হয়তো যায়, তবে সেই মানুষটা এতকিছুর পরেও যদি না বোঝে সবসময় নিজের পরিস্থিতির কথা ভাবে তাহলে বিরক্ত আর রাগ তো আসবেই।

কামরুল হাসান হুইল চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছেন। আশেপাশে উনার নেই কোনো খেয়াল। পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার সঙ্গে এর আগেও অনেকবার কথা হয়েছিল সুফিয়ার। মহিলাটি উনাদের আহ্বান করলেন তাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে যাতে আপাতত উনারা বসে। সুফিয়াও রাজি হলেন। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে তো আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার আগেই সেখানে চলে আসে অর্থিকা। সকলকে দেখতেই দৃষ্টি তার ভিতু হয়। কোলে ঘুমন্ত তাঈম। দ্রুত গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। অনুভাও আর দেরি করে না। হুইল চেয়ার ঠেলে বাবাকে নিয়ে সোজা ঘরে চলে যায়।

বিছানা গুছিয়ে ঠিকঠাক করে বাবাকে শুইয়ে দিয়ে বাহিরে আসতেই শুনতে পায় মায়ের তেজস্রী কণ্ঠস্বর। সকল রাগ এবার বড়ো মেয়ের উপর ঝাড়ছেন সুফিয়া। উনার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে তাঈমের। চিৎকার চেঁচামেচিতে সে অভ্যস্ত নয়। এমনটা এর আগে কখনোই এ বাড়িতে হয়নি।সুফিয়া দিক বেদিক চিন্তা না করে একদমে বলে যাচ্ছেন,“সারাজীবন শুধু নিজের কথাই ভেবে গেলি তাই না? পৃথিবীতে কী আর কোনো মানুষ মরে না? সবাই কী তোর মতো দিন দুনিয়া ভুলে নিজের স্বার্থ নিয়ে বসে থাকে নাকি? স্বামী মরেছে বছর হতে চলেছে অথচ মহারানীর শোক এখনো কাটেনি। এতদিন যা করেছিস সব সহ্য করেছি। কিন্তু আর নয়। এসব চলবে না এ বাড়িতে। ছোটো বোনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ। মেয়েটা নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে সারাদিন খেটেখুটে সংসার চালায়। সবার দায়িত্ব পালন করে।অথচ তুই? নিজেকে নিয়ে পড়ে থাকিস সারাক্ষণ। সবার কথা বাদই দিলাম। এতদিন তো নিজের সন্তানের দিকে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করিসনি। দয়া করে এবার একটু শান্তি দে আমাদের। এসব আর নিতে পারছি না আমরা।”

একপর্যায়ে কেঁদে উঠলো তাঈম। তার কান্না দেখেও থামলেন না সুফিয়া। অনুভা এগিয়ে এলো। বোনের কোল থেকে নিজের কোলে তুলে নিলো তাঈমকে। পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“নিজের রাগকে সংবরণ করো মা। বাইরে থেকে এসেছো, ঘরে যাও, বিশ্রাম নাও।” এবার বোনের উদ্দেশ্যে বললো,“মায়ের কথা ধরে মন খারাপ করে বসে থাকিস না। জানিস তো সবকিছু। ঘরে যা। আর হ্যাঁ হুটহাট করে বাড়ি থেকে বের হোস না। চিন্তা হয় আমাদের।”

নিজের কথাটুকু শেষ করে তাঈমের কান্না থামাতে থামাতে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো অনুভা। অর্থিকা শুধুই নিরব রইলো। নিরবে নিভৃতে সহ্য করে গেলো মায়ের বলা তিক্ত কথাগুলো।
_______

মাত্র কয়েকদিনেই সামিরা নামক মেয়েটির মুখশ্রী বিবর্ণ, অনুজ্জ্বল হয়ে গেছে। চোখের নিচে জমেছে কালো দাগ। মা মৌরি মেয়েকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। হঠাৎ করে মেয়ের আমূল পরিবর্তন উনাকে খুব ভাবাচ্ছে। স্বামী মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে। বড়ো ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা সংসার পেতেছে। এখন উনার শেষ সম্বল ছোটো ছেলে আর এই মেয়েটা।

বান্ধবীরা মাঝে দুদিন এসে গেছে বাড়িতে। তাদের সঙ্গে এই বিষয়ে বেশ কয়েকবার কথা বলেছেন মৌরি কিন্তু তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা নাকি কিছু জানে না।যা মৌরির নিকট একদম বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। রাতে তানভীর এসে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো বোনের সঙ্গে। ছোটো থেকেই বোনের ছোটো ছোটো সকল আবদারই পূরণ করে এসেছে সে। প্রথমে ভাইকে কিছু বলবে না বলবে বলেও একপর্যায়ে সব কথাই বলে দিলো সামিরা।

তানভীর চমকায়নি। বোনের হাবভাব দেখে আগেই কিছু একটা টের পেয়েছিল সে। তবে আজ সবটা জেনে বড়ো ভাই হিসেবে বোনকে বোঝানো তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সামিরাকে পাশে বসিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করল তানভীর। বাস্তবতা সম্পর্কে বোঝালো। হয়তো সামিরা ভাইয়ের কথা বুঝতেও পারলো। পরেরদিন যথা সময়ে ক্লাসে উপস্থিত হলো।।

সেদিনের পর শ্রাবণের দুটো ক্লাসেই সে অনুপস্থিত ছিলো। তবে আজ মনোযোগ সহকারে ক্লাস করেছে সামিরা। একটুও শ্রাবণের পানে তাকায়নি। এতে শ্রাবণও মনে মনে বেশ স্বস্তি অনুভব করল।

সৌহার্দ্যের ছুটি ফুরিয়ে এসেছে। আগামীকাল তার ফ্লাইট। শান্তা ছেলের হাতে হাতে গোছগাছ করতে সাহায্য করছেন। দুদিন ধরে নাড়ু, মোয়া বানিয়ে তিনটে বয়াম পরিপূর্ণ করেছেন তিনি। নাড়ু, মোয়া, বিভিন্ন পিঠা ছেলেটার খুবই পছন্দের। তার এই পছন্দটা অবশ্য গড়ে তুলেছিল তাদের দাদী। উনি বেঁচে থাকাকালীন নাতিদের জন্য গ্ৰাম থেকে নিয়ম করে এসব পাঠাতেন। শ্রাবণের এসব অপছন্দনীয় হলেও সৌহার্দ্যের নিকট এগুলোই যেনো অমৃত। শাশুড়ি মা’রা যাওয়ার পর থেকে নিজেই সবসময় এসব তৈরি করে ছেলের আবদার পূরণের চেষ্টা করেন শান্তা।
________

বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে ধরণীতে। মায়ের জোরাজুরিতে অফিস থেকে সোজা বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে নাহিয়ান। চোখেমুখে তার বিরক্তির ছাপ। পাশেই মা কুলসুম বসে হেসে হেসে কথা বলছেন মেয়ের বাবা-মায়ের সঙ্গে। কিছুক্ষণ বাদেই মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হলো তার ভাবী। বসালো পাত্র পক্ষের সম্মুখে।

ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে সেই কবে। এর আগেও অনেক মেয়েই ছেলের জন্য দেখেছিলেন কুলসুম। কিন্তু কোনো মেয়েই ছেলের মনে ধরে না। একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেন। তবে আজ ভাই বউয়ের কথায় এই মেয়েটিকে দেখতে এসেছেন তিনি। এতক্ষণ মুখশ্রীতে খুশি খুশি একটা ভাব থাকলেও এই মুহূর্তে হাস্যজ্জ্বল মুখখানা মলিন হয়ে গেলো কুলসুমের। মেয়েটির গায়ের রং বড্ড চাপা। আড়চোখে তাকালেন ভাই বউয়ের পানে। ভাই বউ সাবিনা ননদের হাবভাব দেখে পুরো বিষয়টাই ঠাহর করতে পারলেন। এখান থেকে বের হওয়ার পর যে উনার কপালে চরম দুঃখ আছে এও বেশ বুঝতে পারলেন। জোরপূর্বক হেসে মেয়ের বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,“ছবিতে তো মেয়েকে অনেক ফর্সা দেখেছিলাম। কিন্তু বাস্তবে তো! তা এডিট করা ছবি ছিলো বুঝি?”

পাত্রীর বাবা-মা অপ্রস্তত হলেন। পাত্রীর মুখের লাজুকতাও মুহূর্তেই বিলীন হলো। নাহিয়ান নিরবে তাদের হাবভাব দেখে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে পাত্রীর বাবা বলে উঠলেন,“আপনারা কিছু নিচ্ছেন না কেন? একটু মিষ্টিমুখ করুন।”

কথাটা কানে নিলেন না কুলসুম। এনাদের কথা এখন আর উনার কাছে একদম ভালো লাগছে না। একটা মাত্র ছেলে, তার জন্য কিনা এমন কালো মেয়ে বউ করে ঘরে তুলবেন? কথাটা ভাবতেই মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো কুলসুমের। বললেন,“আমরা কিছু খাবো না। আজ তাহলে উঠছি।”

“এত তাড়াতাড়ি? আমার মেয়েকে তো ভালো করে দেখলেনই না। কথাও বললেন না। ওকে কী আপনাদের পছন্দ হয়নি?”

গোপনে হতাশার শ্বাস ফেললেন কুলসুম। সরাসরি পছন্দ হয়নি এমন কথা বলাটা মোটেও শোভা পায় না। ইনিয়ে বিনিয়ে বললেন,“তেমন কিছু না ভাই। আমাদের একটু তাড়া আছে। বিয়ে বিষয়ক বাদ বাকি কথা না হয় ফোনেই জানিয়ে দিবো?”

যা বোঝার সকলেই বুঝে গেলো। পাত্রীর বাবা-মায়ের মুখে হতাশার ছাপ। বাধ্য হয়েই কুলসুমের বিপরীতে মাথা নাড়ালেন উনারা। পাত্রীর আসনে বসা মেয়েটি পূর্বের স্থানে জড়সড় হয়ে বসে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ বিয়ে যে হবে না তা সে সুনিশ্চিত। এমনকি এসব পরিস্থিতির সঙ্গেও সে পূর্ব পরিচিত।

নাহিয়ান এবার সোজা হয়ে বসলো। মৌনতা ভেঙে পাত্রীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,“আপনার নামটা যেনো কী?”

ছোট্ট সহজ একটা প্রশ্ন অথচ সকলেই বিষ্মিত হলো। মেয়েটি উত্তরে বললো,“শ্রেয়ানী তমা।”

“মাশাআল্লাহ সুন্দর নাম। তা কী করছেন? লেখাপড়া নাকি চাকরি?”

“লেখাপড়া চলমান, বি.এ তৃতীয় বর্ষে পড়ছি।”

“ভবিষ্যৎ নিয়ে কী পরিকল্পনা? শুধুই সংসার ধর্ম করা নাকি চাকরি বাকরি করারও ইচ্ছে আছে?”

“ইচ্ছে তো আছে একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার। স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকেরা যদি রাজি থাকে তাহলে আরকি।”

“বিয়েতে কী আপনার কোনো মত আছে? অর্থাৎ আমাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই তো?”

মেয়েটি চমকায়। এতক্ষণ দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ থাকলেও এবার মাথা তুলে তাকায় সে। কুলসুম চাপা কণ্ঠে ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,“এখানে তো প্রথমে আসতেই চাইছিলি না। তাহলে এখন কী হলো? এত কথা আসছে কোত্থেকে? মেয়ে কিন্তু আমার পছন্দ হয়নি বলে দিলাম।”

নাহিয়ান অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,“কেন পছন্দ হয়নি? গায়ের রঙের কারণে? গায়ের রঙে কিই বা আসে যায় মা? মানুষের আসল সৌন্দর্য তো থাকে অন্তরে, আচার-ব্যবহারে। আমার তো উনাকে কোনোদিক দিয়ে খারাপ মনে হচ্ছে না।”

“তার মানে?”—-কণ্ঠে কুলসুমের রাগ বিদ্যমান।

নাহিয়ানের সোজাসাপ্টা উত্তর,“বিয়ে যখন করাবেই তাহলে এত জায়গায় ঘুরে কী লাভ? করলে এখানেই করবো। উনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি উনাকেই বিয়ে করতে চাই।”

তমার বাবা-মায়ের মলিন মুখটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। ছেলের প্রতি মন ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলো কুলসুমের। তবে এখানে সবার সামনে কিছু বলতেও পারলেন না। অবশেষে ছেলেটা বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে এর বিপরীতে আর কিই বা বলার আছে উনার? দুই পক্ষের সম্মতিতে বিয়ের কথাবার্তা শেষমেশ পাকা হয়ে গেলো। আসার আগে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন কুলসুম। ভেবে রেখেছিলেন, মেয়ে যদি পছন্দ হয় তাহলে একেবারে আংটি পরিয়ে যাবেন। অগত্যা সঙ্গে আনা আংটিটা পরিয়ে দিলেন তমার আঙুলে।

রাতের খাবারের জন্য মেয়ের বাবা-মা জোরাজুরি করলেও কুলসুম তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে সেখান থেকে চলে এলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।

চলবে __________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৬]

বিকেল থেকেই আকাশে গুমোট ভাব। চারিদিকে কালো মেঘের ছড়াছড়ি। রাত হতেই প্রবল ধারায় বৃষ্টি নামলো ধরণীতে। তুমুল বর্ষনে ভিজিয়ে দিতে লাগলো শহর। রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় এসে সবে শুয়েছে নাহিয়ান। তখনি ঘরে উপস্থিত হলো ছোটো বোন নিধি। শ্বশুর বাড়ি থেকে গতকালই সে বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। আজ মা-ভাইয়ের সঙ্গে তারও পাত্রী দেখতে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু দুধের শিশুটি হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার আর যাওয়া হলো না।

বোনকে দেখতেই উঠে বসলো নাহিয়ান। ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে শুধালো,“এ সময় আমার ঘরে? কিছু বলবি?”

কোনো ভণিতা না করেই সোজাসাপ্টা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে নিধি বলে উঠলো,“মা তোমার উপর রেগে আছে ভাইয়া। যাকে বলে চরম রাগ।”

“খাওয়ার সময় মাকে টেবিলে না দেখতে পেয়েই তা বুঝতে পেরেছিলাম।”

“বোঝার পরেও এত কুল মুডে আছো কী করে?”

কোনোরূপ উত্তর দিলো না নাহিয়ান। নিধি বসলো ভাইয়ের পাশে। মুখ বিকৃত করে বললো,“হুট করে তোমার কী হয়েছে বলো তো? মায়ের জোরাজুরিতে মেয়ে দেখতে গিয়ে একেবারে মেয়ে পছন্দ করে বিয়ের কথাবার্তা বলে চলে এলে? আচ্ছা সবই না হয় মানলাম। কিন্তু তুমি ওই কালো মেয়ের মধ্যে কী এমন দেখলে বলো তো? তোমার সঙ্গে অমন কালো মেয়ে মানায়?”

“মেয়ে কালো নয় শ্যামলা। আর যদি কালো হয়েও থাকে তাতে সমস্যা কোথায়? গায়ের রঙ, চেহারা, উচ্চতা সব তো সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত, তাই না?”

“কথাটা আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে..”

কথার মাঝখানেই বোনকে থামিয়ে দিলো নাহিয়ান। মৃদু হেসে বললো,“একজনকে তো এতদিন ধরে ভালোবেসে এলামই। তার সৌন্দর্যের তো কোথাও কোনো কমতি ছিলো না। অথচ দেখ! ও জানতেই পারলো না ওকে একজন খুব করে চেয়েছে নিজের জীবনে। প্রতি মুহূর্তে তাকে স্মরণ করে ভালোবেসে গেছে। আমার চাওয়াটা একতরফাই রয়ে গেলো রে নিধি। সত্যি বলতে কি, সৌন্দর্যের কদর অনেক বেশি। সুন্দর মানুষদেরকে ভালোবাসার লোকের অভাব হয় না। তাদের খেয়াল রাখার মানুষেরও অভাব হয় না। আমার আগেই কেউ ওকে ভালোবেসেছে। নিজের পাশে আজীবনের জন্য চেয়েছে। সেও হয়তো সারা দিয়েছে সেই প্রেমিক পুরুষের ডাকে।”

বড়ো ভাইয়ের প্রতিটি শব্দেই কষ্টের ছাপ অনুভব করল নিধি। নরম হয়ে এলো তার মন। শুধালো,“তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না ভাইয়া? অনুভাকে ভুলে যাওয়ার জন্য এই বিয়েটা করতে চাইছো তাই তো?”

এবারও হাসলো নাহিয়ান। শাণিত কণ্ঠে বললো,
“মানুষ ভুলা যে অনেক কঠিন কাজ রে নিধি। যারা এই কঠিন কাজটা সম্ভব করতে পারে তারা হচ্ছে স্বার্থপর। কিন্তু তোর ভাই তো মোটেও স্বার্থপর নয়। অনুকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না। কখনো ভুলার চেষ্টাও করবো না। তাই বলে সারাজীবন যে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে মরবো এমন বোকাও আমি নই। আমার একটা মানুষ চাই। যাকে শুধু আমি ভালোবাসবো, বিভিন্ন ভাবে ভালোবাসবো। যাকে যত্ন করে আমি আমার বুকে আশ্রয় দিবো। আমার শুধু একটা মানুষ চাই, যাকে সবাই অবহেলা করলেও আমার ভালোবাসা পেয়ে সেই অবহেলা সে ভুলে যাবে। তার কাছে আমিই হবো সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রিয় একজন মানুষ।”

“তাই বলে ওই মেয়েকে? যার রূপ নেই?”

বোনের কথার বিপরীতে মুচকি হাসে নাহিয়ান। বলে,“হ্যাঁ, গায়ের রঙে আমার কিছুই আসে যায় না। আমার শুধু নিজের মানুষ চাই। ওকে নিজের জন্য বেছে নেওয়ার কারণ ওর ওই রূপ। যেই রূপ অন্যদের নিকট বিষাদের ন্যায় ঠেকলেও আমার কাছে হবে অমৃত সুধা।”

ভাইয়ের কথার অর্থ বুঝতে পেরেই লজ্জিত হলো নিধি। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে ত্যাগ করল কক্ষ। নাহিয়ান পূর্বের ন্যায় আবারো শুয়ে পড়ল বিছানায়। নরম বালিশে মাথা রেখে বুঁজে নিলো চোখ। বুকের ভেতর আস্তরণ গেড়ে থাকা দুঃখের পাহাড়টা এবার ক্ষয় হতে লাগলো একটু একটু করে। ভালোবাসলেই যে পেতে হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম কী আছে নাকি? ভালোবাসার মানুষকে না পেয়ে নিজের জীবনকে একাকিত্বের দিকে ঠেলে দেওয়ারও কোনো অর্থ নেই। ভালোবাসার থেকেও উর্ধ্বে নিজের ভালো থাকা।
________

খানিক বাদে বাদে আকাশে গুরুম গুরুম শব্দ হচ্ছে। দু ঘণ্টা আগেই বিদ্যুৎ চলে গিয়ে অন্ধকার করে দিয়েছে পুরো এলাকা। তিনটে ঘরে তিনটে মোম জ্বালানো। তাঈমকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে অর্থিকা।বাবা-মাও ঘুমের ওষুধ খেয়ে এতক্ষণে পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের রাজ্যে। তবে অনুভার চোখে ঘুম নেই। হাঁচি দিতে দিতেই তার অবস্থা নাজেহাল। বাড়িতে নেই কোনো ঠান্ডার ওষুধও। কবে যে শেষ হয়েছে সে খেয়ালও নেই মেয়েটার।

শ্রাবণের সঙ্গে দেখা হয়নি দুদিন হলো। তবে এসবে অনুভা অভ্যস্ত। সে জানে এই পুরুষটা খুব অদ্ভুত। হুটহাট নিখোঁজ হওয়া তার চিরাচরিত অভ্যাস। তবে অনুভা একটা বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত যে শ্রাবণ তাকে দূর থেকে ঠিকই পাহারা দেয়, মন ভরে দেখে নেয়। শুধু নিজেকে দেখানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে অনুভাকে। আজও তানিম অনুভাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন বাহানা দিয়ে একা একাই বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি চলে এসেছে অনুভা। এই বৃষ্টিতে ভেজার কারণেই তার প্রচন্ড ঠান্ডা লেগেছে। রাতে হয়তো জ্বরও আসতে পারে।

শত অসুস্থতার মধ্যেও শ্রাবণকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে তার। এই বিশেষ কারণটা অজানা নয়। তবে শ্রাবণ নামক স্নিগ্ধ পুরুষের ডাকে সাড়া দেওয়া যে অনুভার জন্য গুরুতর অপরাধ। সেই পরিস্থিতিটাই যে এখন আর নেই। অথচ একটা সময় এই পুরুষকে নিয়ে কত স্বপ্নই না দেখেছিল মেয়েটি। স্বপ্ন দেখেছিল সাজানো গোছানো একটা সংসারের।সেই স্বপ্ন হয়তো স্বপ্নই রয়ে যাবে। মানুষের সব স্বপ্ন কী আর পূরণ হয়?

মোবাইলের কল লিস্টের একটি নাম্বারে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে অনুভা। নাম্বারটা শ্রাবণের। খুব যত্ন সহকারে এই নাম্বারটা সেদিন রাতেই সে সেভ করে রেখে দিয়েছিল। কল দিবে কী দিবে না? বিষয়টি নিয়ে চরম দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর এবং মারাত্মক। ভাবতে ভাবতেই মোবাইলটা বিছানার অন্যপাশে রেখে মোম নিভিয়ে দিলো অনুভা। বন্ধ করে নিলো নেত্র যুগল।

তৎক্ষণাৎ ঝংকার তুলে বেজে উঠলো রিংটোন। সেই সাথে অন্ধকার বিলীন হয়ে ঘরে জ্বলে উঠলো মোবাইলের আলো। শোয়া অবস্থাতেই মোবাইল হাতে নিলো অনুভা। স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করা নাম্বারটা দেখে না চমকে আর পারলো না। কল রিসিভ করল সঙ্গে সঙ্গে। তখনি অপরপাশ থেকে ভেসে এলো সুপরিচিত কণ্ঠস্বর,“তোমাদের ওখানে কারেন্ট আছে?”

“না তো।”

“পুরো ঘর অন্ধকার?”

“হ্যাঁ।”

“বাহিরে অনেক বৃষ্টি পড়ছে, সাথে বাজও পড়ছে। ভয় করছে না তোমার?”

“ভয় করবে কেন? সবসময় তো একাই ঘুমিয়ে এসেছি।”

“তুমি তো দেখছি ভারি আনরোমান্টিক মেয়ে।”

“এর সঙ্গে রোমান্টিক আনরোমান্টিকের কী সম্পর্ক?”

“অবশ্যই সম্পর্ক আছে।কত স্বপ্ন দেখেছিলাম, আকাশে বাজ পড়লেই আমার বউ ভয় পেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরবে। আমি তাকে আগলে নিবো নিজের সাথে।অথচ তুমি আমার সব স্বপ্নকে কাঁচের টুকরোর ন্যায় ভেঙে দিলে নোভা। এর জন্য তোমাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।”

শ্রাবণের কণ্ঠে চাপা রাগ। অজান্তেই মুচকি হাসলো অনুভা। প্রশ্ন করল,“কী শাস্তি শুনি?”

“সুখের সমুদ্রে তোমাকে ডুবিয়ে রাখবো। এটাই হচ্ছে তোমার চরম শাস্তি।”

শব্দ করে হেসে উঠলো অনুভা। এটা আবার কেমন শাস্তি? এমন শাস্তির নাম তো আগে কখনো শুনেনি সে। শ্রাবণ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধালো,“আমার স্বপ্ন ভাঙার খুশিতে তুমি হাসছো? হাসি পাচ্ছে তোমার?”

হাসি থেমে গেলো অনুভার। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। বললো,“ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়েদের ওইসব বাজ পড়ার শব্দে ভয় পেয়ে ন্যাকামি করা সাজে না। তোমার বাবা-মা তোমাদের মতোই একটা পরিবার থেকে তোমার জন্য ভিতু সুন্দর বউ খুঁজে এনে দিবে, দেখো। তোমার স্বপ্ন একদম ভাঙবে না।”

অপরপাশে থমথমে নিরবতা।কয়েক মিনিট অতিক্রম হতেই শ্রাবণের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,“আমার শুধু নোভাকে চাই। আমার নোভার থেকে সুন্দর ফুল কী আর আছে? কই আমি তো আজ পর্যন্ত বিকল্প দেখিনি। আর দেখতে চাইও না।”

“দিনদিন তুমি অসহ্য হয়ে যাচ্ছো শ্রাবণ।”

“অথচ এই অসহ্য মানবটাই তোমার সুখ, তোমার ভবিতব্য।”

প্রত্যুত্তর করল না অনুভা। শ্রাবণের কথার বিপরীতে সঠিক উত্তর দেওয়া তার পক্ষে খুবই কঠিন একটি কাজ। তার এহেন নিরবতায় মুঠোফোনের বিপরীত পাশ হতে ভেসে এলো খালি গলার মৃদু তরঙ্গ ধ্বনি,

❝তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে….❞

মাঝপথেই থেমে গেলো গান। ততক্ষণে শ্রাবণের এই সুন্দর গুণের সঙ্গেও অতীব পরিচিত হয়ে উঠলো অনুভা। ছেলেটা গানও গাইতে পারে? এত সুন্দর কণ্ঠস্বর তার! কই আগে তো এ বিষয় সম্পর্কে টের পায়নি অনুভা। তাহলে? এই প্রতিভা তবে লুকিয়ে রেখেছিল কী? হয়তো তাই। কণ্ঠে মায়া ঢেলে শ্রাবণ বলে উঠলো,“গানটার এই তিনটে লাইন আমার খুব প্রিয়। তবে তোমার সুখ শুধুই আমার কাছে নোভা। তোমার সুখ আমি।আমি ব্যতীত অন্য কারো সঙ্গে যে তোমায় আমি কিছুতেই সুখী হতে দেখতে পারবো না নোভা। অন্য কারো সঙ্গে তোমায় আমি সুখী হতে দেবো না। বলবো না, সুখের সন্ধানে অন্য কোথাও যেতে। তুমি যেমন আমার হৃদয়মাঝে আছো ঠিক তেমনি ভাবে খুব শীঘ্রই তোমাকে প্রকাশ্যে আমার দেহের সঙ্গেও বেঁধে ফেলবো।”

শীতল একটা স্রোত ছুঁয়ে গেলো অনুভার পুরো দেহ জুড়ে। মুহূর্তেই টের পেলো তার খুব ঠান্ডা লাগছে। শরীরে ছড়িয়েছে উত্তাপ। আজ রাতে যে জ্বর আসবে তাও সে নিশ্চিত। কণ্ঠনালী থেকে হারিয়ে গেছে বাক্য। শ্রাবণ ফের বললো,“বৃষ্টিতে ভিজেছো। জ্বর আসতে পারে। নিজের শরীর নিয়ে হেলাফেলা অন্তত করো না। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। শুভ রাত্রি মেঘফুল।”

আর এক মুহূর্তও দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হলো দুই পাশের সংযোগ। এতকিছুর ভেতরেও প্রশান্তি অনুভব করল অনুভা।অতঃপর তার মনে হলো,“আমার জন্যও তবে কেউ আছে। আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য কেউ আছে। কেউ আছে সময় নিয়ে আমার যত্ন করার।”
_________

বাংলাদেশ থেকে গতকাল রাতেই কানাডা এসে পৌঁছেছে সৌহার্দ্য। দীর্ঘক্ষণ জার্নি করায় মাথাটা ভার হয়ে আছে এখনো। সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ হলো কিন্তু আজ আর নিয়মমাফিক হাঁটতে বের হওয়া হয়ে উঠলো না তার। ফ্রেশ হয়ে চোখ বন্ধ করে সোফায় বসে আছে সে। কিছুক্ষণ আগেই মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। ছেলের মাথা ব্যথার খবর পেতেই চিন্তিত হলেন শান্তা। উপদেশ দিলেন কড়া করে এক মগ চা বানিয়ে খেতে। এই মুহূর্তে চা অথবা কফি কিছুই বানানোর মনোবল পাচ্ছে না সৌহার্দ্য, তাই আধ ঘণ্টা ধরে ঝিম মেরে বসে আছে।

ডাবল রুমের মাঝারি অ্যাপার্টমেন্টটায় সে একাই থাকে। বন্ধু বান্ধবরা আগের মতো তেমন একটা আর বাড়ি এসে আড্ডা দেয় না। তাদের সঙ্গে যা দেখা হওয়ার তা ক্লাবেই হয়। কিন্তু হুট করেই কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। হেলিয়ে দেওয়া মাথাটা উঠিয়ে সোজা হয়ে বসলো সৌহার্দ্য। এমন সময় কে আসতে পারে এখানে? কারো আসার তো কথা নয়। তবে?

আরো দু-তিন বার বেজে উঠলো বেল। বিরক্তি নিয়ে হেলেদুলে গিয়ে দরজার সম্মুখে দাঁড়ালো সৌহার্দ্য। দরজা খুলতেই অপরপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো একটি মেয়েকে। ফর্সা মুখশ্রীতে তার জমে আছে স্পষ্ট রাগ। চোখের নিচ অল্পসল্প কালচে দাগ। মনে হয় কয়েক রাত নির্ঘুমে কাটিয়ে দিয়েছে মেয়েটি। বোচা নাকের ডগা লালাভ আভায় ছেয়ে। এ সময় এখানে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মেয়েটিকে দেখে খুব অবাক হলো সৌহার্দ্য। তার এই অবাকের ধার না ধেরে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল মেয়েটি।

দরজা আটকে নিজেও ভেতরে চলে এলো সৌহার্দ্য। শুধালো,“তুমি?”

“কেন আশা করোনি বুঝি?”

“না।”

“তা করবে কেন? দেশে ফিরে তো তোমার পাখা গজিয়েছে। আমায় ব্লক করলে কোন সাহসে?”

“রাগের মাথায় করে ফেলেছি, স্যরি।”

“রাগ যখন কমেছিল তখন কেন ব্লক খুলে কল দাওনি? কেন স্যরি বলোনি?”

“ব্লক তার পরেরদিনই খুলে দিয়েছি। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি।”

“কল দাওনি কেন?”

“আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে তাই আর কল দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।”

“তুমি বললেই হলো? সম্পর্কটাকে কী তোমার ছেলেখেলা মনে হয়?”—চিৎকার করে বলে উঠলো কথাটি।

সৌহার্দ্যেরও ভীষণ রাগ হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“লিসেন প্রান্তি, একদম আমার সঙ্গে গলা উঁচু করে কথা বলবে না। তোমার এই রাগ, চেঁচামেচি এতদিন সহ্য করেছি বলে এখনো যে সহ্য করবো তা কিন্তু ভাববে না।”

প্রিয় মানুষের এমন করে বদলানোয় বিষ্মিত হলো প্রান্তি। ঢপ করে বসে পড়ল সোফায়। বড়ো বড়ো কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রাগ সংবরণ করার প্রচেষ্টা করল সৌহার্দ্য। শান্ত কণ্ঠে বললো,“আমাদের এই সম্পর্কটাকে আমি শুরু থেকেই সিরিয়াস ভাবে নিয়েছিলাম।তোমার সকল রাগ, অভিমান, আবদার, আজেবাজে কথা সহ্য করে গেছি বারংবার। কিন্তু তুমি শুরুতে ঠিক থাকলেও দিনদিন অনেকটা বদলে গেছো প্রান্তি। তারপরেও আমি সব মেনে নিয়েছি। কিন্তু এতকিছুর পরেও সেদিন তুমি আমার মাকে নিয়ে ওইরকম কথা কীভাবে বলতে পারলে বলো তো? আমার মা থার্ড ক্লাস? আমার সঙ্গে রিলেশন করে ভুল করেছো তুমি?”

দুদিকে মাথা নাড়ালো প্রান্তি। চঞ্চল হয়ে উঠলো তার চোখের বাদামি মণি। বলতে চাইলো কিছু। কিন্তু পারলো না। সৌহার্দ্য ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে নিজেই পুনরায় বললো,“শুরুতেই আমি আমার মায়ের ব্যাপারে তোমায় জানিয়েছি, তুমি বলেছিলে তাতে তোমার কোনো সমস্যা হবে না। তাহলে এখন কেন সমস্যা হচ্ছে? সারাজীবন ওইসব প্রেমপ্রেম সম্পর্কে আমি থাকতে পারবো না। ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে বাবা-মা হজ্জে যাবে। সেখান থেকে আমি তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। তাই বিয়ের পর আমার ওয়াইফকে আমার মায়ের সঙ্গেই থাকতে হবে। সেখানে তুমি আমার মা নিয়ে অমন কথা বলো কী করে হ্যাঁ? আমার কাছে আমার মা-ই সব। যে আমার মাকে নিয়ে এমন নোংরা মনোভাব পোষণ করে তাকে আমি আমার জীবনে চাই না। আমাদের মধ্যকার সকল সম্পর্ক আপাতত শেষ।”

সৌহার্দ্যকে চমকে দিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো প্রান্তি। তার এহেন কাণ্ডে ভড়কে গেলো সৌহার্দ্য। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই প্রান্তি বলে উঠলো,“আমি ওসব বলতে চাইনি বিশ্বাস করো। তুমি তো জানো, মাঝে মাঝেই মাইগ্ৰেশনের ব্যথা উঠে আমার। ব্যথাটা সহ্য করতে না পেরেই বাজে আচরণ করে ফেলি।সেই মুহূর্তে অফিসের একটা প্রজেক্ট নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলাম। তার উপর তোমার কথাগুলো। সব মিলিয়ে মুখে যা এসেছে বলে ফেলেছি। তাই বলে তুমি এত বছরের সম্পর্ক শেষ করে দিবে? প্লিজ এমনটা করো না সৌহার্দ্য। খুব ভালোবাসি তোমায়। এ কটা দিন তোমায় ছাড়া খুব কষ্ট হয়েছে আমার।”

শুকনো ঢোক গিললো সৌহার্দ্য। মেয়েটার চোখের পানি কিছুতেই যেনো সহ্য হচ্ছে না তার। ভেতরটা নরম হয়ে এসেছে এতক্ষণে। কিন্তু বাহির থেকে নিজেকে যথাসম্ভব কঠোর রাখলো। ছোটো থেকে বাবা-মা যতই তাকে শাসন করুক না কেন তাদেরকে যে খুব ভালোবাসে সৌহার্দ্য। সেখানে সেদিনের সেই ব্যবহারটা কিছুতেই সে আশা করেনি। কঠোর কণ্ঠে বললো,
“মাইগ্ৰেশনের ব্যথা উঠেছে বলে তুমি আমার মাকে কটু কথা বলতে ছাড়োনি। ভবিষ্যতে কখনো যে মায়ের সামনে এমনটা করবে না তার কী গ্যারান্টি আছে? মা যদি কখনো এমন ব্যবহারের সম্মুখীন হয় তাহলে তিনি খুব কষ্ট পাবেন। হয়তো দেখা যাবে আমার সঙ্গে থাকবেনই না আর। তোমার তো আবার ব্যথা উঠলে কোনো বোধবুদ্ধিই থাকে না। যাই হোক এই ব্যাপারটা বেশিদূর না এগোনোই ভালো।তোমরা বিদেশি কালচারে বড়ো হওয়া মানুষ, এসব ছোটো খাটো রিলেশন ভাঙলে তেমন কিছু যায় আসবে না।”

কান্নার বেগ বৃদ্ধি পেলো প্রান্তির। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,“আমি তোমার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস সৌহার্দ্য। তোমাকে ছাড়া থাকাটা আমার কাছে অসম্ভব। যা এ কদিনে খুব ভালো করেই বুঝে গেছি আমি। বিশ্বাস করো তোমার মা আমার কাছে একজন সম্মানীয় নারী। কারণ তিনি তোমায় জন্ম দিয়েছেন। বড়ো করেছেন। তাকে কেন আমি অপমান করবো? সেদিন অনিচ্ছাকৃত একটা ভুল হয়ে গেছে। এমন ভুল আর কখনো হবে না। যদি কখনো হয়েও থাকে সেদিন না হয় তুমি আমায় ছেড়ে দিও। তখন আমি আর তোমায় কিছুই বলবো না প্রমিস।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো সৌহার্দ্য। প্রান্তি পুনরায় বললো,
“দয়া করে সম্পর্কটাকে আগের মতো করে নাও না। তুমি বললে আমি এখনি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি আছি। তবুও আমায় ছেড়ে দিও না।”

আলতো করে প্রান্তির হাতের উপর হাত রাখলো সৌহার্দ্য। শীতল কণ্ঠে বললো,“শান্ত হও।”

“আগে বলো মাফ করেছো আমায়?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় সৌহার্দ্য। সঙ্গে সঙ্গেই ক্রন্দনরত মুখশ্রীতেই ফোটে ওঠে একফালি হাসি।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-১২+১৩

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১২]

আজ অফিস থেকে সকল কর্মচারীকে স্যালারি দেওয়া হয়েছে। স্যালারির পুরো টাকাটাই একাউন্টে প্রবেশের ম্যাসেজ দেখে থ হয়ে গেলো অনুভা। স্যার না বলেছিলেন বেতন থেকে তিন হাজার টাকা কেটে রাখবেন? তাহলে পুরো টাকাটা কেন দিলেন? ইচ্ছেকৃত নাকি ভুলবশত? অফিসের সঙ্গে জড়িত এমন কিছুতে তো তানিমের কোনো ভুল হওয়ার কথা নয়। প্রতিটি কর্মচারীর কাছ থেকে কড়ায় গন্ডায় হিসাব নেয় সে। পরক্ষণেই অনুভার মনে পড়ল, হয়তো নাহিয়ান পরিস্থিতিটা সামলে নিয়েছে। মনে মনে নাহিয়ানের উপর আবারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল অনুভা। এই লোকটি কত সাহায্যই না করছে তাকে।

অফিস থেকে বের হয়ে নিচে নামতেই দেখা মিললো তানিমের। নিজ গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। আজ অফিস থেকে একটু আগেই নাহিয়ান বেরিয়ে গেছে। তানিমকে পাশ কাটিয়ে স্থান পরিত্যাগ করার জন্য সামনে পা বাড়ালো অনুভা। তৎক্ষণাৎ তানিম বলে ওঠলো,“কী ব্যাপার মিস. অনুভা? দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছেন যে?”

পথিমধ্যে অনুভার পা থামে। ভদ্রলোকের কণ্ঠের কঠোরত্ব টের পায়। পিছু ফিরে সৌজন্য হাসে। কিন্তু কী বলবে বুঝতে পারে না। গাড়ির পেছনের দ্বার খুলে দেয় তানিম। অনুভার পানে চেয়ে বলে,“নিন উঠুন। বাড়ি পর্যন্ত আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

“তার প্রয়োজন নেই স্যার। আমি যেতে পারবো।”

“আপনার মতামত তো জানতে চাইনি মিস.অনুভা। আপনি যে যেতেন পারবেন তা আমি জানি। রোজ তো জানই আজ না হয় আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।”

“আসলে স্যার…”

বাক্যাংশ শেষ হতে না দিয়েই হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় তানিম। কঠোর গলায় বলে,“না শুনতে আমি অভ্যস্ত নই অনুভা। উঠুন।”

ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলো অনুভা। বস হয় বলে কিছু বলতেও পারে না লোকটাকে। কিন্তু হুট করে এনার আচরণের পরিবর্তন দেখে বেশ চমকিত অনুভা। আর কথা না বাড়িয়ে নিরবে উঠে পড়ল গাড়িতে। তানিমও উঠে তার পাশের আসনে বসলো। চালকের আসনে বসে আছে তানিমের ব্যক্তিগত ড্রাইভার নয়ন। ছুটে চললো গাড়ি। কেমন এক ইতস্ততবোধ জেঁকে ধরলো অনুভাকে। কখনো কী সে কল্পনা করতে পেরেছিল যে এই রগচটা বসের গাড়ি করে তাকে বাড়ি ফিরতে হবে? ভেতরে শুরু হলো পিনপতন নিরবতা।

নিরবতা ভেঙে তানিম প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তা মিস.অনুভা কে কে আছে আপনার পরিবারে?”

তানিমের দিকে না ফিরেই অনুভা উত্তর দিলো, “বাবা-মা, বড়ো বোন আর তার নয় মাসের একটা বাচ্চা।”

“ওহ, তা বোনের হাজব্যান্ড কোথায়?”

“মারা গেছেন।”

মন ভার হলো তানিমের। কণ্ঠস্বর নরম হয়ে এলো। পুনরায় শুধালো,“কীভাবে মারা গেছেন উনি?”

“বাস দুর্ঘটনায়।”

“ওহ, তা আপনার বাবা কিছু করেন না?”

“বাবা প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় শায়িত তার সাথে ক্যান্সারের রোগী।”

“তার মানে আপনিই আপনার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি?”

“হ্যাঁ।”—অনুভার সহজ উত্তর। তাতে নেই কোনো কষ্টের ছাপ।

মেয়েটির কথা শুনে হুট করেই তানিম অনুভব করল তার কষ্ট হচ্ছে। মানব জীবন বড়োই অদ্ভুত। কারো জীবনে সুখ আর সুখ আবার কারো জীবনে শুধুই দুঃখ কষ্টতে ভরপুর। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই গাড়ি থামাতে বললো অনুভা। তার নির্দেশে দ্রুত গাড়ি থামালো চালক। তানিমের পানে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো তার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি। সৌজন্য হাসলো অনুভা। তার উদ্দেশ্যে বললো,“এখান থেকে আমার বাড়ি যেতে তিন-চার মিনিটের পথ। বাকি পথটুকু আমি একাই যেতে পারবো স্যার। পৌঁছে দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”

প্রত্যুত্তরে শুধুই মাথা নাড়ালো তানিম। অনুভা প্রস্থান করল। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার জন্য নয়নকে তাড়া দিলো তানিম।

বালিশের উপর উবু হয়ে শুয়ে কারো সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে সৌহার্দ্য। চোখেমুখে ফোটে উঠেছে তার অসহায়ত্ব। স্ক্রীনে ভাসছে একটি মেয়েলী মুখ। মেয়েটির চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি তার প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে ঝগড়া করছে। কিন্তু অপরপাশ হতে মনঃপুত উত্তর না পেয়ে রাগটা তার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনা কারণে প্রেমিকার এমন ঝগড়ায় এবার চরম বিরক্ত হলো সৌহার্দ্য। বাজখাঁই গলায় বললো,
“এবার একটু চুপ করবে প্রান্তি? জাস্ট অসহ্য লাগছে।”

তার এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো প্রান্তি নামক মেয়েটির রাগ নামক আগুনের লেলিহান শিখা বৃদ্ধি করার। শক্ত কণ্ঠে বললো,“অসহ্য লাগছে! আমায়? বিডিতে গিয়ে তো তোমার ভালোই উন্নতি হয়েছে দেখছি।”

“তোমার সমস্যা কী বলবে? সারাদিন পর একবার কল ধরার সময় পাও অথচ এই সময়টাও ঝগড়া করে কাটাতে হবে? কী এমন বললাম যে এত চটতে হবে তোমাকে?”

“আমার আবার কীসের সমস্যা? আমার তো কোনো সমস্যা নেই। সব সমস্যা তোমার। তুমি রীতিমতো আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছো।”

“চাপ কোথায় দিলাম? আমি কী বলেছি এখনি বিয়ে করো? আমি শুধু বলেছি আমার মা তোমায় দেখতে চাইছে।”

“কেন দেখতে চাইবে? আমি কারো সঙ্গে দেখা করতে পারবো না। আর না আমি এখন বিডিতে যাবো।”

“আহা বিডিতে আসতে কে বলেছে? এখন আমরা যেভাবে কথা বলি সেভাবেই মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। দিনের বেলায় না হয় তোমায় ভিডিও কল দিবো।”

প্রান্তির চোখেমুখে ফোটে উঠলো বিরক্তির ছাপ। বললো,“বাঙালি ছেলের সঙ্গে রিলেশনে জড়ানোটাই আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল হয়েছে। তোমরা সারাক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে থাকো কেন বলো তো? কই আমার মা তো তোমায় দেখতে চায়নি কখনো।তাহলে তোমার মা কেন দেখতে চাইবেন? থার্ড ক্লাস যত্তসব। রিলেশন হতে না হতেই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যায় এরা।”

প্রান্তির কথায় হতবাক হয়ে গেলো সৌহার্দ্য। তার মাকে নিয়ে মেয়েটার মনে এত বাজে বাজে চিন্তা উদয় হয়েছে?কই সম্পর্কের শুরুতে তো এমন ছিলো না প্রান্তি, তাহলে? আর না কখনো মেয়েটিকে এই সম্পর্কে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল সৌহার্দ্য। সে তো নিজ থেকেই এসেছিল তার কাছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৌহার্দ্য। স্ক্রীনে গাঢ় দৃষ্টি ফেলে শুধায়,“বাঙালি তো তুমিও। তাহলে বাঙালিদের নিয়ে এতো হীন চিন্তা কেন এলো তোমার মাথায়?”

প্রান্তি নিশ্চুপ। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় মগ্ন সে। সৌহার্দ্যের চোয়াল শক্ত হলো তার নিরবতায়। বললো,“রিলেশনটা নিয়ে তুমি আর খুশি নও তাই তো? আমাকে আর ভালো লাগে না তোমার? অথচ আমি তোমায় নিয়ে বাকিটা পথ, বাকিটা জীবন অতিক্রম করতে চেয়েছিলাম। ব্রেকআপ করতে চাও সেটা সরাসরি বলে দিলেই হতো।আমার মাকে থার্ড ক্লাস বলে হীন মানসিকতার প্রমাণ দিয়ে নিজেকে ছোটো করার কোনো প্রয়োজনই ছিলো না।”

চমকে গেলো প্রান্তি। অফিসের কিছু কাজে ইদানিং সে প্রচন্ড ডিস্টার্ভ। রাগের মাথায় কি বলতে কি বলে ফেলেছে নিজেই জানে না। তার এই নিরবতা দেখে সৌহার্দ্যের রাগও বৃদ্ধি পেলো। যদিও ছেলেটা সহজে রাগে না। নিজেকে ঠান্ডা, শান্ত রাখার অধিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তার আছে কিন্তু মায়ের অপমান কিছুতেই মেনে নেওয়ার ছেলে সে নয়। ফের কঠিন স্বরে বললো,“যাও ব্রেকআপ তোমার সঙ্গে। আর কখনো তোমায় বিরক্ত করা তো দূরে থাক আজকের পর থেকে তোমায় আমি চিনি না।”

কথাটা শেষ করেই কল কেটে মেয়েটিকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিলো সৌহার্দ্য। এই মুহূর্তে সবকিছু তার নিকট অসহ্য লাগছে। হুট করে প্রিয় মানুষের বদলে যাওয়াটা মেনে নেওয়াটা যেনো দুষ্কর। হাতের মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে। কানাডায় পড়তে গিয়ে প্রান্তি নামক মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয় সৌহার্দ্যের। একই ক্লাস একই ডিপার্টমেন্ট হওয়ায় রোজই দেখা হতো দুজনার। বাঙালি হওয়ায় আগ বাড়িয়েই সৌহার্দ্য বেশ কয়েকবার কথা বলেছিল তার সঙ্গে। তবে কথা বলার প্রধান কারণই ছিলো নোটস। সৌহার্দ্যের মনে পড়ে না লেখাপড়ার বাহিরে কবে সে কথা বলেছিল এই মেয়েটির সঙ্গে। শান্তা রোজ রোজ ছেলেকে কল করে বারবার মনে করিয়ে দিতেন,“শোন সহু, ওইসব বিদেশিনী মেয়ের প্রেমে কিন্তু একদম পড়বি না। বিদেশি মেয়েরা ভালো হয় না। আমি তোর জন্য একটা ধার্মিক মেয়ে খুঁজে এনে দিবো। ইহকালও শান্তি, পরকালও শান্তি।”

পরিচয়, বন্ধুত্বের বছর তিনেক পার হতেই সৌহার্দ্যের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে প্রান্তি। একসময় বন্ধু-বান্ধব সকলের সামনে নিজের মনের কথা সৌহার্দ্যকে জানিয়েও দেয়। দেয় রিলেশনশিপে যাওয়ার প্রস্তাব। সঙ্গে সঙ্গে তার সেই প্রস্তাব নাকোচও করে দিয়েছিল সৌহার্দ্য কিন্তু একটা সময় সে হার মেনে নেয়। কথায় কথায় পুত্রবধূ হিসেবে মায়ের কেমন মেয়ে পছন্দ, অপছন্দ তাও জানিয়ে দিয়েছিল তাকে। তা শুনে প্রান্তি বলেছিল,“শাশুড়ি মায়ের ছেলেকে পাওয়ার জন্য না হয় নিজেকে একটু পরিবর্তনই করে নিলাম।শাশুড়ি মায়ের মনের মতো বউমা হয়ে উঠলাম। এ আর কী এমন কঠিন কাজ?”

সেদিনের সেই মেয়েটির মধ্যে আজ কত বদল!আবারো প্রমাণিত হলো মানুষ বদলায়, মানুষের মন বদলায়।
________

রাত যত গভীর হচ্ছে ততোই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে শিউলি ফুলের সুবাস। এত‌ রাতেও ঘুম নেই শ্রাবণের চোখে। বিশাল ছাদটায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি গাছটাতে শুভ্র রঙা ফুল ফোটেছে। নরম বিছানা ছেড়ে অনেকক্ষণ ধরে ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সদ্য ফুটন্ত ফুলের পানে। গত শরতে যে গাছটি তার সবুজ পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সেই গাছটিতেই এই শরতে ফুলে ফুলে ভরা। কিছু একটা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই ঠোঁটের কার্নিশে চওড়া হাসি ফোটে উঠলো শ্রাবণের।

গাছ থেকে অজস্র ফুল পেড়ে বোঝাই করল পরিধেয় ট্রাউজারের পকেটে। তারপর নিঃশব্দে নেমে গেলো ছাদ থেকে। শব্দহীন কদম ফেলে ঘর থেকে গাড়ির চাবিটা এনে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।

সারাদিন কাজে ডুবে থাকায় বাড়ি ফিরতে হয় ক্লান্ত শরীর নিয়ে। ক্লান্ত শরীর বিছানায় ফেলতেই রাজ্যের ঘুম এসে আবেষ্টিত করে নেয় অনুভাকে। জীবনে এত অপূর্ণতা, দুঃখ, চিন্তা থাকার পরেও ঘুমের সঙ্গে যেনো মেয়েটার গোপন কোনো সন্ধি রয়েছে। বরাবরের মতো আজও সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাঈমকে এখন নিজের কাছেই রাখে অর্থিকা। যত্ন করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়,খাওয়ায় বাদ বাকি কাজও করে। দিন যত পার হচ্ছে ততোই মেয়েটা আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। তাই এখন অনুভার কাজটা একটু লাঘব হয়েছে।

কিন্তু অনুভার ঘুমটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারো নিকট হয়তো তার এই শান্তির ঘুমটা পছন্দ হলো না।মোবাইল বেজে উঠলো ঝংকার তুলে। পরপর কয়েকবার। চোখ আধ বোজা করে মেলে কল রিসিভ করল অনুভা। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে শুধালো,“হ্যালো কে?”

“আমি।”

“আমি? আমি কে?”

“শ্রাবণ।”

মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো অনুভার। ঘুমের নেশা কেটে গেলো মুহূর্তেই। কণ্ঠের সেই ঘুমঘুম ভাবটাও আর নেই। তার নিরবতায় অপরপাশ থেকে ভেসে এলো আকুল আবেদন,“আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি। আসবে একবার? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমায়।”

অবাক হলো অনুভা। ঘড়িতে ২টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। এত রাতে এই ছেলে নিচে দাঁড়িয়ে? দ্রুত কল কেটে মাথায় ভালো মতো ওড়না জড়িয়ে নিয়ে গায়ে জড়ালো একটা চাদর। রাতে বাড়ির মেইন গেইটে তালা দেওয়া থাকে কিন্তু প্রত্যেক ফ্ল্যাটেই একটা করে চাবি দিয়ে রেখেছে বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। ফ্ল্যাটের দরজা বাহির থেকে লক করে নিচে নামলো অনুভা। গেইটের তালা খুলে বের হতেই হলুদ লাইটের টিমটিম আলোয় স্পষ্ট ফোটে উঠলো পরিচিত, আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির মুখশ্রী।

হাত ভাঁজ করে সামনের বিল্ডিং এর দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। অনুভাকে দেখতে পেয়েই বহুল প্রতীক্ষিত হাসিটা বিস্তর লাভ করল তার অধরে। চমকিত মুখশ্রী দেখেই ভেতরে ভেতরে তৃপ্ত হলো। এগিয়ে এসে ছেলেটির সম্মুখে দাঁড়ালো অনুভা। কিন্তু তাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই শ্রাবণ বলে উঠলো,“চলো।”

“কোথায়? তার আগে বলো তুমি এত রাতে এখানে কেন?”

“আসা বারণ?”

“জানি না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো শ্রাবণ। উপায়ন্তর না পেয়ে অনুভাও দূরত্ব রেখে তার পিছুপিছু হাঁটতে লাগলো। গলি পার হয়ে উঠে এলো মেইন রাস্তায়। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা খুবই কম‌। হাঁটতে হাঁটতেই অনুভা প্রশ্ন করল,“যাচ্ছি কোথায় আমরা? এত রাতে ঘর বাড়ি ছেড়ে এখানে কী করছো?”

“কোথায় যাচ্ছি জানি না তবে তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই চলে এসেছি।”

“এতদিন পর হুটহাট কেন দেখতে ইচ্ছে করবে? মাঝখানে তিন বছরের মতো সময় যে একেবারে না দেখেই কাটিয়ে দিয়েছো, তখন কেন এসব দেখা দেখির শখ জাগেনি? হুট করে আবার কোত্থেকে না কোত্থেকে উদয় হয়ে ঢং দেখানো হচ্ছে?”—কণ্ঠে অনুভার ক্ষোভ ঝরে পড়ল।

কথাগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই পথিমধ্যে থেমে গেলো শ্রাবণ। অনুভার মুখশ্রীতে দৃষ্টি স্থির রেখে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো।তার এহেন দৃষ্টিতে ঘাবড়ে গেলো অনুভা। মনের গহীনে ঘিরে ধরলো অনুশোচনায়। রাগের মাথায় মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে কথাগুলো। শ্রাবণের মুখশ্রীতে পূর্বের হাসিটা এখনো বিদ্যমান। বাম ভ্রু উঁচিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কোত্থেকে না কোত্থেকে উদয় হয়েছি মানে? আমার অনুভূতি তোমার নিকট ঢং মনে হয় নোভা? স্বাভাবিক এবং ভালো আচরণ করছি বলে নিজের মনঃপুত যা ইচ্ছে ভেবে নিচ্ছো?”

“তুমি যা ভাবছো আমি আসলে….”

কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিলো শ্রাবণ। বললো,“বাহিরে যাওয়ার কথা তোমায় আমি আগেই জানিয়েছিলাম। এমনকি চিঠিতেও সবকিছু লিখেই গিয়েছিলাম। যোগাযোগ করার জন্য নাম্বারটা পর্যন্ত দিয়েছিলাম কিন্তু তুমি কোনো রেসপন্ড করোনি।। এখন আবার এটা বলো না চিঠিটা তুমি পাওনি। আমি জানি চিঠিটা তুমি পেয়েছিলে এবং পুরো চিঠিটাই মনোযোগ সহকারে পড়েছ। কতগুলো দিন তোমার একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছি তা কী তুমি জানো? জানলে নিশ্চয়ই এমনটা করতে পারতে না। অপেক্ষা করাটা যে কতটা কষ্টের তা শুধু তারাই জানে যারা অপেক্ষা করে। এতে অবশ্য তোমার উপর আমার চরম রাগ হওয়ার কথা ছিলো। রাগ হয়েছিলও বটে। খুব রাগ হয়েছিল তোমার প্রতি। ইচ্ছে করছিল ওখান থেকে এসেই তোমার নরম ফর্সা গাল দুটো একেবারে গরম করে দিতে।”

হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনুভা। দম ছাড়লো শ্রাবণ। ফের বললো,“যখন তোমার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারলাম তখন সেই পুষে রাখা রাগ গুলো এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। যার জীবনটাই এত এলোমেলো হয়ে গেলো তার উপর রাগ পুষে রেখেই বা কী লাভ?”

নরম হলো অনুভার মন। এই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় ঠেকছে নিজের কাছে। কণ্ঠে আবেগ ঢেলে বললো,“সব যখন জানতেই তাহলে আবার কেন এলে আমার জীবনে? তুমি বুদ্ধিমান পুরুষ। বুদ্ধিমান পুরুষদের এমন বড়ো বড়ো ভুল করা মানায় না শ্রাবণ। আমার সামনে আসা যে তোমার মোটেও উচিত হয়নি।”

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। পূর্বের ন্যায় আবারো হাঁটতে লাগলো সামনের পথ ধরে। বললো,“তোমারও উচিত হয়নি তোমার বসের গাড়িতে করে বাড়ি পর্যন্ত ফেরা। চাকরি করলেই যে অফিসের বসের গাড়িতে করে বাড়ি ফিরতে হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম তো নেই নোভা।”

পূর্বের ন্যায় হতবাক, হতভম্ব হলো অনুভা। শ্রাবণ কী করে জানলো এ কথা? থামলো শ্রাবণ। পেছনের দিকে এগিয়ে এলো। মেয়েটির প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি অবজ্ঞা করে পকেট থেকে বের করল সঙ্গে করে নিয়ে আসা ফুলগুলো। বাড়িয়ে দিলো অনুভার দিকে। অনুভা হাত দুটো উঁচু করে ধরলো তার সম্মুখে। গ্ৰহণ করল সেই ফুল। নাকের কাছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে পরম আবেশে শুঁকে নিলো সেই সুমিষ্ট ঘ্রান।

প্রেয়শীর মুখশ্রীতে তৃপ্তির রেখা দেখতেই চমৎকার হাসলো শ্রাবণ। নেশাতুর কণ্ঠে বললো,“তুমি স্নিগ্ধ ঠিক এই শুভ্র শিউলির মতো। তুমি সুন্দর এই শরৎ এর মতো। তুমি চঞ্চল বর্ষার মেঘমালা। তুমি শ্রাবণের প্রিয়তমা নোভা।”

পুরো দেহখানা ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠলো অনুভার। লোম কূপ জাগ্ৰত হলো। সতেজ হয়ে উঠলো ভগ্ন হৃদয়। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো শ্রাবণ। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,“আ’ম জেলাস নোভা। আই গেট জেলাস হয়েনএভার আই সি ইউ উইথ সামওয়ান এলস্।”

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৩]

বাকি রাতটা অনুভা নির্ঘুমে কাটালো। শ্রাবণ চলে যেতেই বাড়িতে ফিরে এসেছে সে। বালিশের উপর শ্রাবণের দেওয়া শিউলি ফুলগুলো রেখে অযু করে এসে ফজরের নামাজটা পড়ে নিলো। তারপর কোরআন তেলাওয়াত করে পা বাড়ালো রান্নাঘরে। অধিকাংশ সময় মা-বোনের সঙ্গে কাটাতে কাটাতে রান্নাটা খুব ভালো ভাবেই আয়ত্বে এনেছে অনুভা। সকালের নাস্তাটা তৈরি করে ফের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল সে।

বেলা বাড়লো।সাড়ে সাতটায় বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাবা-মায়ের মুখোমুখি হতে হলো শ্রাবণকে। পুত্রকে দেখতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন শান্তা। মুখশ্রীতে উনার চিন্তার ছাপ। এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে পুত্রের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,“এত ভোরবেলা কোথায় গিয়েছিলি? ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থেকে উঠে দেখি তুই ঘরে নেই। কোথায় ছিলি এতক্ষণ?”

“ঘুম আসছিল না মা তাই ছাদে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই আজান দিয়ে দিলো তখনি ওখান থেকে একেবারে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে মর্নিং ওয়াক করে ফিরলাম।”

পুত্রের কথা বিশ্বাস করে নিলেন শান্তা। চিন্তিত মুখখানা থেকে কেটে গেলো চিন্তার রেশ। বললেন,
“আচ্ছা ঘরে গিয়ে তবে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নাস্তা দিচ্ছি।”

মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে মাথা নাড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায় শ্রাবণ। মাকে সে মিথ্যে বলেনি। প্রতিটি কথাই সত্য শুধু অনুভার সঙ্গে দেখা করার কথাটাই ছিলো গোপনীয়।

ছোটো ছোটো কদম ফেলে সোফায় এসে বসলো সৌহার্দ্য। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। সকালের নাস্তা সেরে সময় মতো নিজ কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে শ্রাবণ।

গতকাল মেঝেতে মোবাইল ছুঁড়ে মারায় মোবাইলের স্ক্রীনের অবস্থা নাজেহাল। ভাঙা স্ক্রীনের পানে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্য। দূর থেকে ছেলেকে নিবিড়ভাবে বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন হানিফ শেখ। মুখোমুখি হয়ে সোফায় বসে পড়লেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“রাগ করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু হাতের সামনে যা পাবো তাই ছোড়াছুড়ি করবো এমন রাগ ভালো না। এমন ধরণের রাগে ক্ষণিকের জন্য আনন্দ পাওয়া গেলেও রাগ কমার পর আফসোস করতে হয়। নিজের পকেটের টাকা নষ্ট হয়। তাই আমি কখনোই রাগ করে জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করি না। সেখানে আমার ছেলে হয়ে তুই কী করে এমনটা করতে পারলি? কাজটা করা তোর মোটেও ঠিক হয়নি। অনুচিত কাজের জন্য তোর কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। তোর এই ভাঙাচোরা মোবাইল মেরামতের জন্য একটি পয়সাও আমি দিবো না। আর এটাই হচ্ছে তোর শাস্তি।”

দৃষ্টি নড়েচড়ে পিতার মুখশ্রীতে গিয়ে স্থির হলো সৌহার্দ্যের। ভাঙা মোবাইল আড়াল করল পেছনে। আমতা আমতা করে বললো,“রাগ করে কিংবা ইচ্ছে করে ফেলিনি বাবা। হাত থেকে ফসকে মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেছে।”

“তুই কী ভেবেছিস? মিথ্যে বললেই সুরসুর করে আমি তোকে টাকা বের করে দিবো? জিন্দিগিতেও না।”

“আমায় বিশ্বাস করলে না বাবা?”

“এই বয়স তো আমিও পার করে এসেছি। বিশ্বাস করি কী করে বল তো বাবা?”

ভ্রু বাঁকালো সৌহার্দ্য। চোখেমুখে তার সন্দেহ। প্রশ্ন করল,“তুমিও কী ভাঙচুর করতে নাকি?”

উপর নিচ মাথা নাড়ালেন হানিফ শেখ। পিতার থেকে আশানুরূপ উত্তর পেয়ে অতি উৎসাহিত হয়ে উঠলো সৌহার্দ্যের মুখখানা। তার এই অতি উৎসাহিত ভাব দেখে বুক ফোলালেন হানিফ শেখ। পুত্রের কাছে উপস্থাপন করতে লাগলেন নিজের অতীতের রাগের বশে করা ভাঙাচোরার গল্প। পিতার কাহিনী শুনে মুহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেলো সৌহার্দ্যের।

পেশায় হানিফ শেখ কলেজের একজন অধ্যক্ষ। এই তো বছর দেড়েক আগে রিটায়ার্ড করেছেন। অবসর সময়টা পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেই কেটে যায় উনার। কলেজে উনি সিংহ হলেও বাড়িতে যেনো একেবারে ভেজা বেড়াল।স্ত্রীর মতো ছেলেদের সঙ্গে অতোটা বন্ধুসুলভ মেলামেশা না থাকলেও খুব সহজেই যেনো ছেলেদের মন পড়ে ফেলতে পারেন ভদ্রলোক। কথার একপর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। বললেন,“বাবার ছায়াতলে যতদিন ছিলাম ততদিনই এই রাগ ক্ষোভ, ভাঙাচোরার বদ অভ্যাসগুলো ছিলো। বাবাও চলে গেলেন, নিজে উপার্জন করতে শিখলাম তখন আর রাগ হলেই ভাঙচুর করতে পারতাম না। রাগের মাথায় যাই করি না কেন খেসারত তো নিজেকেই দিতে হবে। ভাঙচুর আমি করলে টাকা তো আমারই যাবে।”

আফসোস করে কথাটা বলে পুত্রের পানে তাকালেন হানিফ শেখ। মুহূর্তেই আঁতকে উঠলেন। সৌহার্দ্যের অধরে দুষ্টু হাসির ছাপ। কণ্ঠে দুষ্টুমি এঁটে বললো,
“আমার তো বাবাও আছে বাবার টাকাও আছে। যাই তাহলে, নতুন একটা মোবাইল কিনে নিয়ে আসি।”

কথাটা বলতে বলতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সৌহার্দ্য। হাঁটা ধরলো পিতার কক্ষের দিকে। পেছন থেকে অসহায় কণ্ঠে হানিফ শেখ বলে উঠলেন,”ওই তো পেনশনের সামান্য কিছু টাকা পাই। সেই টাকাটায়ও তোর ভাগ বসাতে হবে বেয়াদব?”

সৌহার্দ্যের শ্রবণালী পর্যন্ত কথাটা পৌঁছেছে বলে মনে হলো না। ততক্ষণে সে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেছে। এক লহমায় মুখের ভাবধারা পরিবর্তন হলো হানিফ শেখের। শব্দহীন হেসে উঠলেন। মনে মনে বললেন,
“এসব মন খারাপের বয়স কবেই পার করে এসেছি। চুলে তো আর এমনি এমনি পাক ধরেনি।”
__________

সামিরা মেয়েটার হাবভাব ইদানিং খুব বিরক্ত ঠেকছে শ্রাবণের নিকট। সাথে এও সে বেশ বুঝতে পেরেছে যে সদ্য যৌবনে পা রাখা মেয়েটি তার উপর আবেগে মজেছে। শুরুর দিন থেকেই ক্লাসে সারাক্ষণ হা করে নিষ্পল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মাঝে একদিন পড়ার ফাঁকে একটা টপিক থেকে মেয়েটিকে প্রশ্নও করে বসেছিল শ্রাবণ। কিন্তু সেই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তরই দিতে পারেনি সামিরা।

শ্রাবণের ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্টেও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে সে। যা দেখেও শ্রাবণ এমন একটা ভান ধরে আছে যেনো এই প্রসঙ্গে কিছুই সে জানে না। তবে ব্যাপারটা এখন খুব ভাবাচ্ছে তাকে। এই বয়সী ছেলে-মেয়েরা খুব আবেগ প্রবণ হয়ে থাকে। আবেগের বশে ভুল কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করে না।তাই মেয়েটাকে বেশি দূর এগোতে দেওয়া উচিত হবে না।

তৃতীয় বর্ষের ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে এলো শ্রাবণ। একটু এগোতেই কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সামিরাকে। এভাবে রোজরোজ যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা যেনো সামিরার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আজ আর তাকে এড়িয়ে গেলো না শ্রাবণ। এগিয়ে গেলো তার দিকে। মৃদু হেসে শুধালো,
“কেমন আছো?”

এই প্রথম শ্রাবণের থেকে তুমি সম্বোধন শুনে অবাক হলো সামিরা। চোখেমুখে ফোটে উঠলো খুশি খুশি একটা আমেজ। শুরু থেকেই লোকটার থেকে আপনি সম্বোধনই শুনে এসেছে সে। তবে একটা ব্যাপার খুব ভালো করেই খেয়াল করেছে সামিরা।বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের আপনি আপনি করে সম্বোধন করে। ভাবনা বাদ দিয়ে প্রত্যুত্তর করল,“ভালো স্যার। আপনি?”

“আলহামদুলিল্লাহ। তা এখানে কী করছো? কারো জন্য অপেক্ষা করছিলে?”

যদিও অপেক্ষাটা শ্রাবণের জন্যই ছিলো তবুও তৎক্ষণাৎ সত্যটা বলতে পারলো না মেয়েটা। হুটহাট করে এমনটা বলাও তো সম্ভব নয়। যখন বিপরীত থেকে পাল্টা প্রশ্ন আসবে, কেন অপেক্ষা করছিলে? কী প্রয়োজন? তখন কী উত্তর দিবে সে? তাই চট করে মিথ্যে বললো,“ফ্রেন্ডের সঙ্গে এসেছিলাম স্যার। ও ওর বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেছে তাই আমি আরকি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।”

“ওহ, একা দাঁড়িয়ে থেকে আর কী করবে? চলো হাঁটতে থাকি। এমনিতেও দাঁড়িয়ে কথা বলাটা ভালো দেখায় না।”

দ্বিমত করল না সামিরা। এমন সুযোগ তো আর বারবার আসে না। হাঁটতে লাগলো শ্রাবণের সাথে সাথে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে কোনো ভণিতা ছাড়াই সরাসরি শ্রাবণ প্রশ্ন করল,
“তুমি কী আমায় পছন্দ করো সামিরা? স্টুডেন্ট হিসেবে প্রত্যেকেরই একজন পছন্দের টিচার থাকে কিন্তু তোমার চাল চলন দেখে কেন জানি আমার তা মনে হচ্ছে না। তোমার আচরণ বলছে তুমি মোটেও আমায় একজন টিচার হিসেবে পছন্দ করো না।”

কথাগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই ভড়কে গেলো সামিরা। সাথে সর্বাঙ্গে ঘিরে ধরলো লজ্জায়। এ কথা তো সে স্যারকে সরাসরি কখনো বলেনি, তাহলে? তাহলে স্যার জানলো কী করে? লজ্জায় দৃষ্টি নত হলো। পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার নিরবতায় সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেললো শ্রাবণ। মনে মনে কিছু কথা গুছিয়ে নিয়ে বললো,“ভার্সিটি লাইফ পার করে আসায় এসব অনুভূতি, চাহনি, দেখা করার অজুহাত সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবগত আমি।ডিপার্টমেন্টে এমন কতশত ছেলে-মেয়ে দেখলাম যারা কিনা টিচারের উপর ক্রাসড। কেউ কেউ তো প্রেমে একেবারে হাবুডুবু পর্যন্ত খেয়েছে। তোমার চালচলন শুরু থেকেই আমার নজরে পড়েছে। আমরা টিচাররা ক্লাসের যে স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে লেকচার দেই, সেখান থেকে কিন্তু ক্লাসের সব স্টুডেন্টকে খুব ভালো করেই দেখা যায়, বুঝলে?”

“কাউকে ভালোলাগা, ভালোবাসা কী অপরাধ স্যার?”

“অপরাধ হবে কেন? তবে একটা কথা জানো কী? ভালোবাসা কখনো হুটহাট করে হয় না। হুটহাট করে হয় ভালোলাগা। মানুষ হিসেবে মানুষকে ভালো লাগতেই পারে তবে সেই মানুষ সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে তাকে ভালোবাসাটা অপরাধ। তার পাশাপাশি মারাত্মক অন্যায়ও বটে।”

“আমি আপনার সম্পর্কে জানি স্যার। ভাইয়ার সঙ্গে তার ফেয়ারওয়েল সিরিমনিতে এসেছিলাম আমি। সেখানেই আপনাকে প্রথম দেখা। ভাইয়ার থেকে আপনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মূল কারণও আপনি।”

“এখন আমি তোমার শিক্ষক সামিরা। পিতা-মাতার পর শিক্ষকের স্থান, জানো তো নাকি? শিক্ষককে নিয়ে অতিরিক্ত কিছু ভাবা অন্যায় কাজ।”

“শিক্ষক ছাত্রীর কী বিয়ে হয় না স্যার? কতই তো হচ্ছে।”

মেয়েটাকে যে বিভিন্ন যুক্তি দিয়েও বোঝানো সম্ভব নয় তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো শ্রাবণ। তাই সময় নষ্ট করার চিন্তাভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলে মৃদু হেসে বললো,“তা অবশ্য ঠিক। বর্তমানে এসব ঘটনা অহরহ হচ্ছে। তবে তোমার এদিকে আর না এগোনোই ভালো। তোমার ম্যাম যে খুব হিংসুটে। এসব ব্যাপারে জানলে খুব রেগে যাবে আমার উপরে।”

চমকালো সামিরা। শুধালো,“ম্যাম?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় শ্রাবণ। পুনরায় সামিরা প্রশ্ন করে,“ম্যাম কোত্থেকে এলো স্যার? আপনি তো অবিবাহিত।”

“তাতে কী? সবসময় কী আর অবিবাহিত থাকবো নাকি? খুব শীঘ্রই বিবাহিত’র তকমা লেগে যাবে আমার গায়ে। অলরেডি আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আশা করি বুঝতে পারছো তুমি? তাই আমাদের মধ্যে একটাই সম্পর্ক তা হচ্ছে তুমি আমার ছাত্রী আর আমি তোমার শিক্ষক।”

কথাটা শেষ করে প্রস্থান করল শ্রাবণ। সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সামিরা। প্রতিটি কথা বিঁধে আছে কানে। ভেতরের কোথাও তৈরি হচ্ছে সুক্ষ্ম ক্ষত। সদ্য হৃদয় ভাঙার যন্ত্রনায় জ্বলে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ।
________

দুপুর হলেই তাঈম ঘুমিয়ে পড়ে। এটাই যেনো পরিণত হয়েছে তার অভ্যাসে। আজ টানা তিন মাস পর বাবার ঘরে পা রাখলো অর্থিকা। চোখ জোড়া বন্ধ করে শুয়ে আছেন কামরুল হাসান। ঘুমিয়েছেন কিনা এই মুহূর্তে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না। সুফিয়া কিছুক্ষণ আগেই নিজ হাতে স্বামীকে খাবার আর নির্ধারিত ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গিয়েছেন।

বিছানার একপাশে বসে একদৃষ্টে পিতার মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে অর্থিকা। এককালে এই ভদ্রলোক কী স্বাস্থ্যবানই না ছিলেন। দেহখানা ছিলো বলিষ্ঠ।চোখেমুখে ছিলো তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বের ছাপ। আর আজ তার কী অবস্থা! অতীতের মতো সেই দেহখানা আর নেই। হাড়গুলো ভেসে আছে মাংসপিণ্ডের উপর দিয়ে। কঙ্কালসার দেহ। মুখশ্রীতে অসহায় একটা ভাব। মাথায় টাক পড়েছে। অবশিষ্ট যা চুল আছে তাও আধপাকা। চেহারায় মলিনতার ছাপ। বাবার এই অবস্থা দেখলেই খুব কষ্ট হয় অর্থিকার। আজও তার ব্যতীক্রম হলো না। চোখের কোণে অশ্রু জমেছে। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ভারি দীর্ঘশ্বাস।

বিড়বিড় করে বললো,“ছোটো থেকে আমাদের যেই নীতিমালা শিখিয়েছিলে সেই একই নীতি যদি তুমিও মেনে চলতে, লোভ না করতে তাহলে হয়তো আজ আমাদের পরিবারটার এমন অবস্থা হতো না বাবা। আর না অনুকেও নিজের জীবনকে অবজ্ঞা করে, নিজের ভবিষ্যতকে জলাঞ্জলি দিয়ে এত কষ্ট করতে হতো।”

ধীর পায়ে পিতার কক্ষ ত্যাগ করে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ালো অর্থিকা। মেয়েকে দেখেই সুফিয়া বলে উঠলেন,“বেলা চলে যাচ্ছে, খাবি কখন?”

হাঁটা থামালো না অর্থিকা। যেতে যেতে উত্তর দিলো,
“সময় হলে খেয়ে নিবো।”

“তোর বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে?”

“না, বাবা ঘুমাচ্ছে।”

“যখন উঠবে তখন কথা বলে নিস তবে।”

“কী বলবো? বলার মতো তো কিছু নেই।”

নিশ্চুপ হয়ে গেলেন সুফিয়া। ততক্ষণে অর্থিকা ঘরে প্রবেশ করেছে।

রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সূর্যের তাপে জনজীবন বিপর্যস্ত। মাথার উপর ফ্যান ঘুরার পরেও গরমের চোটে ঘাম ঝরছে শরীর থেকে। উদাস দৃষ্টি মেলে বারান্দার গ্ৰিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে অর্থিকা। একসময় প্রকৃতি ছিলো তার অত্যন্ত প্রিয়। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে ভালোবাসতো মেয়েটি। দুঃখ হলে, অভিমান হলে তা ভুলতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতো বারান্দায়। কখনো সখনো দুয়েকজন বন্ধু নিয়ে চলে যেতো ঘুরে বেড়াতে। অথচ এখন সে প্রকৃতি থেকে লুকিয়ে থাকে। পড়ে থাকে ঘরের এক কোনায়। তিন বছরে যে তন্ময় নামক প্রেমিক পুরুষটির সঙ্গে অজস্র স্মৃতি জমে আছে তার।

অর্থিকার মনে পড়ে, রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে তার জন্য শুভ্র রঙের ফুল নিয়ে আসতো তন্ময়। শুভ্র রঙ শান্তির প্রতীক এই জন্যই হয়তো অর্থিকার প্রিয়’র তালিকায় ছিলো এই রঙ এবং এই রঙের ফুল। তন্ময় ছিলো ভুলোমনা একজন পুরুষ। মাঝেমধ্যে ফুল ছাড়াই ফিরে আসতো বাড়িতে। আবার কখনো বা শুভ্র বাদ দিয়ে নিয়ে আসতো র’ক্তবর্ণের গোলাপ কিংবা জবা। তখন অর্থিকার সেকি রাগ! সেকি রাগ!

তন্ময়ের মতে,নারী হচ্ছে ফুলের মতো পবিত্র। তাদের মনও ফুলের মতো কোমল। ফুলের পানে তাকালে যেমন সকল মন খারাপ এবং অভিমান ভালো হয়ে যায় ঠিক তেমনি স্ত্রীর ওই কোমল, নিষ্পাপ মুখখানায় তাকালে সকল ক্লান্তি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়।

তখন রেগেমেগে অর্থিকা গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো বারান্দায়। আর রইলো তন্ময়, সেও চলে আসতো বউয়ের পিছুপিছু। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বউয়ের রাগ ভাঙানোর জন্য কত কিছুই না বলে হাসাতো।এই মানুষটির উপর চাইলেও বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারতো না অর্থিকা।

পুরোনো স্মৃতিচারণ বাদ দিয়ে বিছানায় এসে বসলো সে। ঘুমন্ত ছেলের পানে মাতৃ স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক। চুমু খেলো কপালে। বিড়বিড় করে বললো,“বাবা নেই তো কী হয়েছে? তোর মা তো আছে। আমি বাঁচবো, প্রাণ খুলে হাসবো শুধুই আমার ছেলের জন্য। আমার তন্ময়ের রেখে যাওয়া স্মৃতি আর ওর এই অংশটুকুর জন্য হলেও আমি বাঁচবো।”

মুখশ্রীতে ফোটে উঠলো অকৃত্রিম হাসি কিন্তু চোখ দিয়ে যেনো গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রুজল।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-১০+১১

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১০]

বিয়ের আমেজ শেষ হতেই পরিবারসহ নিজেদের আবাসস্থলে ফিরে আসে অনুভা। কিন্তু তারপরেই তাদের জীবনে এক কালবৈশাখী ঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু। ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়ায় মাস খানেক আগেই নাকি চাকরি চলে গেছে কামরুল হাসানের। এতদিন মেয়েদের থেকে পুরোপুরি ভাবেই ঘটনাটা গোপন করেছেন তিনি। অনুভার যেনো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না তার বাবা এমন একটি অন্যায় কাজ করতে পারে। তবে এটা ঠিক বুঝতে পারছিল যে এই জন্যই তাড়াহুড়ো করে বড়ো বোনের বিয়েটা দেওয়া হয়েছিল।

চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে ঘটনাটা। খবরের কাগজেও ছাপা হয়েছে তা। সব প্রমাণ কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে। ঘটনাটা ঘটেছে অনেকদিন আগেই। তখন উনাকে সাময়িকভাবে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করার পরেও কোনো প্রমাণ ছিলো না হাতে। হুট করেই একটা ফুটেজ চলে যায় সাংবাদিকদের হাতে। তারা নিউজটিকে জনসমক্ষে আরো গভীরভাবে উপস্থাপনের জন্যই হয়তো এতদিন সময় নিয়েছিল। ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একজন লোক কয়েকটা টাকার বান্ডেল টেবিলের উপর রেখেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কামরুল হাসান এক এক করে টাকার বান্ডেলগুলো ঢুকালেন নিজ টেবিলের ড্রয়ারে।

লোকটাকে ধরা হলো। সে নিজ মুখে স্বীকার করল তার ছেলে খুনের মামলায় জেলবন্দি। মামলা কোর্টে উঠবে দুয়েক দিনের মধ্যেই। কামরুল হাসান বলেছিলেন টাকা দিলে নাকি তিনি চেষ্টা করবেন কেসটাকে ধামাচাপা দেওয়ার। তদন্ত করে জানা গেলো ঘুষ নেওয়ার মতো অপরাধ নাকি উনি এর আগেও বেশ কয়েকবার করেছেন। সব প্রমাণ উনার বিরুদ্ধে যাওয়ায় ডিপার্টমেন্ট থেকে ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ল। আজীবনের জন্য সাসপেন্ড করে দেওয়া হলো উনাকে। মামলাও হলো। কয়েকদিনের মধ্যেই কামরুল হাসানের ঠাঁয় হলো কারাগারে। যাদের নিকট এতদিন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন মুহূর্তেই তাদের নিকট পরিণত হলেন অসম্মানীয় একজন ব্যক্তি হিসেবে। গ্ৰাম থেকে ছুটে এলেন চাচারা। ভালো একজন উকিল ঠিক করা হলো। এসব কেসে উকিলের ফি অনেক। চাচারা নিজ ভান্ডার থেকে সেসব ফি দিয়ে ভাইকে ছাড়াতে নারাজ। এত এত ঝামেলার মধ্যে ভার্সিটির কথা ভুলেই গেলো অনুভা।

এত বছর ধরে একটু একটু করে টাকা সঞ্চয় করে আসা নিজের ফান্ডটা ভেঙে ফেললেন সুফিয়া। সব টাকা তুলে দিলেন মেজো ভাসুরের হাতে। সেই টাকা দিয়ে উকিল ঠিক করলেন উনি। তবে উকিল দিয়ে কেস লড়ানোর জন্য এই টাকাটা পর্যাপ্ত ছিলো না। জমানো যা টাকা আছে সব কামরুল হাসানের একাউন্টে। কিন্তু তিনি তো এখন জেলবন্দি। তখন ভাসুরদের নিকট ধার চাইলেন সুফিয়া,“আমার কাছে যা ছিলো সবই তো দিয়ে দিয়েছি। এখন বাকি টাকা কোথায় পাবো? আপনাদের ভাই হয় ও, আপনারা যদি বাকি টাকাটা দিয়ে সাহায্য করতেন? আমি কথা দিচ্ছি ও ছাড়া পেলেই সব টাকা আপনাদের পরিশোধ করে দিবো।”

বড়ো চাচা অপারগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,“আমার কাছে অতো টাকা পয়সা নাই। অতো টাকা পয়সা পামু কই?”

বাকি চাচারাও বড়ো চাচার সাথে সহমত পোষণ করলেন।অনুভা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখলো সবটা। অথচ এই বড়ো চাচার ছোটো কন্যার বিয়ের অর্ধেক খরচই বাবা দিয়েছিলেন। সেজো চাচা যখন বাইক এক্সিডেন্ট করল তখন বাবাই ভাই ভাই করে জান দেওয়ার অবস্থা। সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সব খরচ তিনিই বহন করেছিলেন। দুই ফুফুকেও কম সাহায্য করেনি। অথচ সেই ফুফুরা একবারের জন্যও দেখতে এলো না নিজের ভাইকে। বরং ফোনে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, ভাইয়ের কুকর্মের জন্য নাকি তারা শ্বশুর বাড়িতে মুখ দেখাতে পারছেন না।

সুফিয়ার বাপের বাড়ির অবস্থা যথার্থ উন্নত ছিলো। এক ভাই প্রবাসী, আরেক ভাই ব্যবসায়ী। তাদের থেকে সাহায্য চাইলেন তিনি। তারাও সাহায্য করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। সাথে কটু কথাও কম বলেননি উনাকে। সবাই ত্যাগ করতে পারলেও সুফিয়া কিছুতেই কামরুল হাসানকে ত্যাগ করতে পারলেন না। যতই হোক স্বামী তো! ঘরকুনো স্বভাবের এই নারীটিই একা একা বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া ওয়ারিশের দলিল বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। এতে ভাইরা ক্ষীপ্ত হয় একমাত্র বোনের উপর। নিরবেই ছিন্ন করে সকল সম্পর্ক।

তারমধ্যেই ভার্সিটি থেকে সেমিষ্টার পরীক্ষার নোটিশ আসে। বন্ধুদের থেকে নোট সংগ্ৰহ করে পারিবারিক এমন দুরাবস্থাতেই পরীক্ষায় বসে অনুভা। মা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন,“যত যাই হয়ে যাক লেখাপড়া থেকে দূরে সরিস না মা। এটাই তোর সম্বল। বাবা এখন বাড়িতে নেই তো কী হয়েছে? মা আছে। তোর মা সব সামলে নিবে।”

এমন একটা পরিস্থিতিতেও মায়ের থেকে এতটা আত্মবিশ্বাস পেয়ে অনুভা আবারো মনোযোগী হলো লেখাপড়ায়। গুরুত্ব সহকারে পরীক্ষা শেষ করার পরপরই দেখা হলো এক বান্ধবীর সঙ্গে। খামে ভরা একটা চিঠি এগিয়ে দিলো তার দিকে। বললো,“শ্রাবণ ভাই চিঠিটা দিয়েছে তোকে।”

“কবে দিলো?”

“তুই গ্ৰামে যাওয়ার চার পাঁচদিন পর। কিন্তু তোর সঙ্গে তো আমার দেখাই হচ্ছিল না তাই দিতেও পারিনি।”

চিঠিটা নিলো অনুভা। তাড়া দেখিয়ে বললো,
“ধন্যবাদ তোকে। বাড়ি ফিরতে হবে এখন। পরে কথা হবে।”

বিদায় নিয়ে চলে এলো অনুভা। বাড়ি ফিরে নিজ কক্ষে গিয়ে চিঠিটা পড়েই জানতে পারলো শ্রাবণ দেশে নেই। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য চলে গেছে বাহিরের দেশে। চিঠির শেষ অংশে বড়ো বড়ো সংখ্যায় তার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটাও দেওয়া। সেদিকে গভীর দৃষ্টি রেখেই বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। কথায় কথায় অনেক আগেই শ্রাবণের নিকট থেকে অনুভা জানতে পেরেছিল উচ্চশিক্ষার জন্য সে দেশের বাহিরে যেতে চায়। কাগজপত্র নাকি এতদিনে বাবা জমাও দিয়ে দিয়েছে। গ্ৰাজুয়েশনের সমাপ্তি আর ভিসা পাওয়ার অপেক্ষা শুধু। তাহলে সেদিন যখন দেখা হলো তখন কেন কিছু জানালো না শ্রাবণ? অনুভা কষ্ট পাবে বলে? হয়তো।

মোবাইল হাতে নিয়েও তা রেখে দিলো অনুভা। খুব করে ইচ্ছে জাগলো ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে নিজের কষ্টটা লাঘব করার কিন্তু নিজের ইচ্ছেটাকে গুরুত্ব দিলো না সে। নিজেদের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাবতেই লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেলো। এই মুহূর্তে স্বাভাবিক নেই অনুভা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বাবাকে যে বড্ড ভালোবাসে মেয়েটা। অন্যদের মতো শ্রাবণও যদি জেনে যায় তার বাবা ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা খেয়েছে, জেলবন্দী হয়েছে তখন কী হবে? অনুভাকে কেমন দৃষ্টিতে দেখবে সে? এসব ভাবতে ভাবতেই চিঠিটা অযত্নে ড্রয়ার বন্দী করল।

বাবার অপকর্ম ধরা পড়ায় শ্বশুর বাড়িতে অর্থিকার অবস্থাও নাজেহাল। উঠতে বসতে শুধু খোঁটা আর খোঁচা মারা কথা।তন্ময় মা মরা ছেলে। এক স্ত্রী মরতে না মরতেই বাবা আরেক বিয়ে করে সংসার পাতেন। ছোটো থেকেই বড়ো বোনেদের আদর যত্নে বড়ো হয়েছে তন্ময়। ছেলে-মেয়েরা দ্বিতীয় বিয়ে মানতে না পারায় নতুন বউ নিয়ে অন্যত্র গিয়ে নতুন করে সংসার পাতেন তন্ময়ের পিতা।তাই সংসারে একচ্ছত্র আধিপত্য তখন বোনেদের। যদিও তারা ছিলো বিবাহিত কিন্তু বাপের বাড়ির অধিকার যেনো কিছুতেই তারা ছাড়বে না। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় বাড়ির খবর কিছুই জানতো না তন্ময়। অর্থিকাও ভয়ে কিছু বলতো না তাকে।যদি বোনেদের নিয়ে বলা কথা বিশ্বাস না করে সে? যদি তাড়িয়ে দেয় তাকে? ততদিনে তন্ময়কে খুব ভালোবেসে ফেলেছে অর্থিকা। আট মাস ননদদের অত্যাচার সহ্য করে শ্বশুর বাড়িতে দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে ছিলো মেয়েটা। একবারই শুধু দেখতে আসতে পেরেছিল বাবা-মা, বোনকে। তাতেও অনেক কথা শোনায় ননদরা। স্পষ্ট করে বলে দেয়,“তোমার ওই জেল খাটা বাবা আর তার পরিবারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না তুমি। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হলে এ বাড়ি তোমাকে ছাড়তে হবে।”

এতকিছুর পরেও তারা দমেনি। একসময় তাদের দু চোখের বিষ হয়ে ওঠে অর্থিকা। পাশাপাশি আরেকটা বিয়ে করানোর জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে তন্ময়কে। বোনেদের অবদান তন্ময়ের জীবনে অনেক। তাদের মুখের উপর কথা বলা তার স্বভাব বহির্ভূত। তাদেরকে যেমন বাড়িতে আসতে নিষেধ করতে পারবে না ঠিক তেমনি নিজের স্ত্রীকেও সে ছেড়ে দিতে পারবে না। মেয়েটাকে যে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো তন্ময়। মনটাও দিয়ে দিয়েছিল অতি গোপনে। একসময় সকল লাজ লজ্জা ভুলে সরাসরি নিজে গিয়েই কামরুল হাসানের নিকট বিয়ের প্রস্তাবটাও দিয়ে দিয়েছিল।

ছেলেটির আচার ব্যবহারে মুগ্ধ হন কামরুল হাসান। লোক লাগিয়ে খোঁজ নেন ছেলেটির সম্পর্কে। তারপরই পাকাপোক্ত হয় বিয়ের কথাবার্তা। কিন্তু অমন এক পরিস্থিতিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হন তিনি। তাই অতিদ্রুত মেয়েকে পাত্রস্থ করেন।

বাধ্য হয়েই স্ত্রীকে নিয়ে অফিসের কাছাকাছি ভাড়া বাড়িতে ওঠে তন্ময়। অর্থিকার দুঃখের দিন ঘুচে। আবারো যোগাযোগ শুরু হয় পরিবারের সাথে। এমন একটা ঘটনার জন্যই তো তন্ময়ের প্রতি অর্থিকার ভালোবাসাটা আকাশচুম্বী। একটা নারী ঠিক কতটা ভাগ্যবতী হলে এমন স্বামী পায়? অথচ মেয়েটার কপালে বেশিদিন সেই সুখ সইলো না। সইলো না স্বামী সোহাগ।

ছয় মাস জেল খেটে জামিনে ছাড়া পান কামরুল হাসান। সকলের অগোচরে জমিয়ে রাখা টাকা থেকে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে স্ত্রীর সম্পত্তিটুকু ছাড়িয়ে আনেন। দলিল ফিরিয়ে দিলেন শ্যালকদের। সুফিয়া খুব চটে গেলেন স্বামীর উপর। স্ত্রীর রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে অমন অবস্থাতেও তিনি হেসে জানালেন,“দুনিয়ার মানুষগুলো খুব স্বার্থপর আর লোভী। এই যে দেখো না লোভ করতে গিয়ে আজ আমার কী অবস্থা? লোকের সামনে মুখ দেখানোর উপায়টুকু নেই। আত্মীয় স্বজন কেউ কারো নয়। এমনিতেই তো আমি সবার কাছে লোভী প্রমাণিত হলাম এখন আর তোমার ওই সম্পত্তিটুকুর জন্য তোমার ভাইদের চোখে আর খারাপ হতে চাই না। ওদের সঙ্গে অন্তত তোমার সম্পর্কটা ভালো থাকুক।”

স্বামীর বিপরীতে আর কথা বললেন না সুফিয়া। দিন যেতে লাগলো সাথে জীবনটাও ক্রমশ নরকে পরিণত হতে লাগলো। বাহিরে বের হওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ল। কামরুল হাসান নিজেকে গৃহবন্দী করলেন। সুফিয়া বাহিরে তো দূরে থাক, প্রতিবেশীদের কটু কথায় ছাদেও যেতে পারেন না। অনিয়মিত ক্লাস করায় ভার্সিটিতে অপরিচিত মুখ হয়ে উঠলো অনুভা। ওদিকে অতটা হেয় প্রতিপন্ন না হলেও এলাকায় বের হওয়া, প্রবেশ করা ছিলো তার জন্য একপ্রকার যুদ্ধ। সব বয়সীরাই তাকে দেখলে পথ আটকে আজেবাজে প্রশ্ন করতো। এসবের সঙ্গে অপরিচিত সে। মাকে জড়িয়ে যে কত কান্নাকাটি করেছে তার কোনো হিসেব নেই। কখনো কামরুল হাসান কান পেতে শুনেছেন মেয়ের কান্না। বারবার নিজেকে নিজের কাছেই ছোটো মনে হয়েছে উনার।

এভাবেই কয়েক মাস চললো। প্রতিবেশীদের কথা নামক বিষাক্ত ফলায় চূর্ণ বিচূর্ণ হতে লাগলো একটা পরিবার। সব শেষে কামরুল হাসান সিদ্ধান্ত নিলেন ফিরে যাবেন গ্ৰামে। তন্ময়ও সাহায্য করল এতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরেই পরিচিত কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘হলে’ উঠলো অনুভা।

কামরুল হাসানের পৈতৃক নিবাস ছিলো সিরাজগঞ্জ। গ্ৰামে বাপ-দাদার জমি জমার কোনো অভাব নেই। দাদার আমলের বিশাল বাড়ি।একমাত্র ছেলে হওয়ার দরুন যা উনার বাবা একাই পেয়েছিলেন সব। নিজেদের খেতের ধান,খেতের শাক-সবজি, পুকুরের মাছ সবদিক দিয়েই উচ্চবিত্ত পরিবার। উনারা ভাই- বোন ছিলেন ছয় জন। চার ভাই দুই বোন। কামরুল হাসান ছিলেন বাবা-মায়ের ষষ্ঠ সন্তান। ভাই- বোনদের সবার ছোটো। উনার যখন জন্ম হয় তখন বাবা আর সেই জোয়ান পুরুষটি নেই। অর্থাৎ শেষ বয়সের সন্তান তিনি। লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো ছিলেন কামরুল হাসান। লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস দেন। প্রথম চান্সে উত্তীর্ণ হয়ে একেবারে হয়ে যান পুলিশের এসপি। কয়েক মাস পর বদলি হয়ে যান খুলনায়। সরকারি চাকরি হওয়ায় এক জায়গায় এক বছরের বেশি সময় ধরে মনে হয় না টিকতে পেরেছেন তিনি। একসময় বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করে ঘরে তুলেন সুফিয়াকে।

সুফিয়া ছিলেন একজন সংসারী নারী। উনার চাওয়া পাওয়া ছিলো সীমিত। শক্ত হাতে সংসারটাকে সাজিয়ে নেন মন মতো। বছর ঘুরতেই তাদের কোল আলো করে আসে অর্থিকা। তার বছর পাঁচেক পর হয় অনুভা। দুই মেয়ে নিয়ে কামরুল হাসানের ছোটো সংসার। নেই কোনো অভাব অনটন। দুই বোন ছোটো থেকেই বড়ো হয়েছে অনেক আদরে। যখন যা আবদার করেছে তাই কামরুল হাসান মেয়েদের সামনে এনে হাজির করেছেন।

গ্ৰামে যাওয়াতে ভাই, ভাই বউরা তেমন খুশি হলো না। মাস খানেক থাকার পর সেখানেও অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন উনারা। এলাকার লোকেরা বাড়ি বয়ে এসে শুনিয়ে যেতো কথা। একদিন সকল ভাইয়েরা একত্র হলো। হয়তো আগেই তারা নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করে রেখেছিল। কামরুল হাসানের উদ্দেশ্যে সরাসরি বড়ো ভাই বলে ওঠেন,“তুই লোভে পইড়া খারাপ একটা কাম কইরা ফেলাইছোস। তোর লাইগ্গা তোর বউ পোলাপাইন ভুগতাছে। যতদিন বাঁচবো ততদিন এমনেই ভুগবো। বড়ো মাইয়ার কপাল ভালা তাই তার জামাই অহনও তারে তালাক দেয় নাই। ছোডো মাইয়াডারে কেডায়ই বা বিয়া করবো? আর যাই হোক ভালা বংশে ওরে বিয়া দেওয়া সম্ভব না। এহন কথা হইলো তোর লাইগ্গা তো আর আমরা ভুগতে পারমু না। গেরামে এমনিতেই মান সম্মান কিচ্ছু নাই। তার উপর তোরা এনে আসার পর আরো কথা শুনতে হইতাছে।আমগোও তো বউ পোলাপাইন আছে। মাইয়ারা শ্বশুর বাড়ি। ওগো যে কথা শুনতে হইবো না তার কোনো গ্যারান্টি আছে?”

এমন এক বিপর্যয়ে ভাইয়ের থেকে এমন কথা মোটেও প্রত্যাশা করেননি কামরুল হাসান। যদিও শুরুতে শুনেছিলেন স্ত্রীর নিকট থেকে সবটা। শুধালেন,“এখন কী করতে বলো তোমরা?”

মেজো ভাই বললেন,“এতদিন যেনে ছিলি হেনেই তোরা ফিরা যা।”

“বললেই তো আর ফিরে যাওয়া যায় না ভাইজান। তাছাড়া এমন কথা কী করে বলো তোমরা? এ বাড়িতে আমারও তো একটা ভাগ আছে। বাবার ছেলে হিসেবে আমিও তো সম্পত্তির ভাগীদার।”

মুহূর্তেই সকলের মুখের আদল বদলে গেলো। এক কথা দু কথা হতে হতে অবস্থা বদলে গেলো। ভাইদের চোখেমুখে ক্ষীপ্ততা। সেজো ভাই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,“কীসের ভাগীদার? তোর কোনো ভাগ নাই এইহানে। আব্বায় সব সম্পত্তি আমগো তিন ভাইয়ের নামে দিয়া গেছে। বোন গো তো বিয়ার সময় কম যৌতুক দেয় নাই। তাগো আর কোনো ভাগ নাই। তোরও নাই।”

বজ্রাসনের ন্যায় চমকালেন কামরুল হাসান। ভাইদের স্বরূপ দেখতে পেলেন নিজ চক্ষে। কথাটা যখন উনার বিশ্বাস হচ্ছিল না তখন ভাইরা উনাকে দলিল দেখায়। যাতে স্পষ্ট পিতার টিপসই দেওয়া। হয়তো অসুস্থ, অক্ষর জ্ঞানহীন পিতাকে তারাই ভুলিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিল। বোনদের থেকেও কোনো সাহায্য পাননি তখন। অথচ সবার ছোটো হওয়ার পরেও এই ভাই-বোনদের জন্য কত কিছুই না করেছেন তিনি। বিপদে এগিয়ে এসেছেন। তারাও তখন উনাকে এবং উনার পরিবারকে মাথায় তুলে রেখেছিল। তাহলে আজ কী হলো? বিপদের সময় কী সত্যিই কেউ পাশে থাকে না? থাকে নাই তো। যার প্রমাণ নিজের অসময়ে পেয়েছেন কামরুল হাসান। ‘লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু’ প্রবাদ বাক্যটা বাস্তব জীবনে যে ফলে গেছে ধের বুঝতে পারলেন তিনি। ফিরে এলেন আবারো নিজেদের ফ্ল্যাটে।

অর্থিকা স্বামীকে বাবা-মায়ের পরিস্থিতির কথা জানাতেই তন্ময় তাদের জন্য নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিলো। পুরোনো ফ্ল্যাটটা রয়ে গেলো তালা বন্ধ। নিজেকে পরিপূর্ণ ঘর বন্দী করে নিলেন কামরুল হাসান। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে উনার লজ্জা লাগে। একাকিত্বকে সঙ্গী করে ডিপ্রেশন নামক অসুখে ডুবে গেলেন। শেষে কিনা বেছে নিলেন আত্মহ’ত্যার পথ। ভাগ্য ভালো থাকায় সুফিয়া সময় মতো দেখে ফেলেছিলেন স্বামীর অমন কান্ড। প্রতিবেশীদের সাহায্যে নিয়ে উনাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। সেবারের মতো বেঁচে ফিরলেন তিনি তবে চিন্তায় চিন্তায় বড়ো ধরণের স্ট্রোক করে বসলেন। ডাক্তার নিষেধ করল চিন্তা করতে কিন্তু কেউ নিষেধ করলেই কী আর চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা যায়?

অনেকবার চেষ্টা করেছেন আত্মহ’ত্যার কিন্তু সকল চেষ্টাই বৃথা যাওয়ার পর হাল ছেড়ে দিলেন। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো অনুভা। ভারি কণ্ঠে বললো,“যা হওয়ার হয়ে গেছে বাবা। সব ভুলে যাও। তুমি যদি চলে যাও তাহলে আমার আর মায়ের কী হবে বলো তো? আমাদের জন্য হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে।”

মেয়ের কথায় সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন লোকটা। তারপর আর অমন জঘন্য কাজে পা বাড়াননি। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সবার জীবনে সুখ কী আর বেশিদিন থাকে? হাতে যে কটা টাকা ছিলো তা শেষ হয়ে গেলো। এভাবে ঘরে বসে থাকলে তো আর চলবে না। ভালো চাকরি যে পাবেন না তা তিনি নিশ্চিত। ছোটো খাটো যাই পান না কেন সংসারটা তো চলবে। তাই বেরিয়ে পড়েন চাকরির সন্ধানে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চাকরি তো পেলেনই না বরঞ্চ ফেরার পথে চলন্ত গাড়ির নিচে পড়ে ঘটিয়ে ফেললেন দুর্ঘটনা। তৎক্ষণাৎ পথচারীরা উনাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করালো। সঙ্গে পাওয়া মোবাইল দিয়ে বাড়িতে ফোন করে জানালো সকল ঘটনা।

আল্লাহর অশেষ রহমতে এবারও বেঁচে ফিরলেন কামরুল হাসান। তবে আজীবনের জন্য শরীরের অর্ধেকটা হয়ে গেলো প্যারালাইসড। অতঃপর স্বামীর চিকিৎসার জন্য শেষ সম্বল ফ্ল্যাটটাই বিক্রি করে দিলেন সুফিয়া। তন্ময় সাহায্য করতে চাইলেও নিলেন না তার কোনো সাহায্য। একপর্যায়ে দুলাভাইয়ের সাহায্যে একটা এনজিওর চাকরিতে জয়েন হয়ে পরিবারের খরচা এবং বাকি লেখাপড়াটাও চালিয়ে গেলো অনুভা।

চলবে ________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১১]

এনজিও থেকে পাওয়া বেতন দিয়ে সবদিক সামলিয়ে সংসার পরিচালনা করা অতোটাও সহজ ছিলো না। কিন্তু তারপরেও যে মা কীভাবে সংসারটা চালিয়েছে তা শুরুতে অনুভার অজানা থাকলেও একসময় জানতে পারে যে মা তার কিছু গহনা বিক্রি করে দিয়েছে। সে টাকা দিয়েই এতদিন ধরে সবটা সামলিয়ে আসছে। চাকরির পাশাপাশি মাস্টার্সে সবে ভর্তি হয়েছে অনুভা। দুদিন মাত্র ক্লাস করতে না করতেই তন্ময়ের মৃ’ত্যুর সংবাদ এলো। আবারো বিধ্বস্ত হয়ে গেলো সকলের মন। একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে চললো। দুঃখ যেনো তাদের আর ছাড়তেই চাইলো না। তন্ময় অনুভাকে ছোটো বোনের মতো স্নেহ করতো। অনুভারও ছিলো দুলাভাইয়ের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাবোধ এবং ভাই সমতুল্য ভালোবাসা। এমন একজন মানুষকে হারিয়ে সেও ভেঙে পড়ল মারাত্মকভাবে।

একদিকে বাবা-মা আরেকদিকে বোন আর তার সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া ছোট্ট শিশু। মৃ’ত্যুর দিন চারেক পার হতে না হতেই ননদেরা কিছুতেই শ্বশুরের ভিটেতে থাকতে দিলো না অর্থিকাকে। যারপনায় তার ঠাঁই হলো বাপের বাড়িতে। সেসময়ে মারাত্মকভাবে পরিবারে দেখা দিলো আর্থিক অনটন। ওখানেই ইতি ঘটলো অনুভার লেখাপড়ার।

সেবার হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। সুফিয়া ছুটে গেলেন ছাদ থেকে কাপড় আনতে। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময়ই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন সিঁড়ি থেকে। পা মচকে গেলো উনার। কপালটাও বেশি খানিকটা ফেটে গেলো। চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল অনুভা। বাড়ির নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে ইন্টারভিউ না দিয়েই ছুটে এসে মাকে নিয়ে হাসপাতালে যায় মেয়েটা। এক্সরে করে জানা যায় পায়ের হাড় ভেঙে গেছে সুফিয়ার। সেই চিকিৎসা করতে গিয়েই তো অবশিষ্ট অর্থটাও শেষ হয়ে গেলো। সাথে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আরো বিভিন্ন অসুখ বিসুখ তো ধরা পড়লোই। চাকরিটা তখন ভীষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ল অনুভার। তখনি চাকরির সন্ধান নিয়ে হাজির হলো নাহিয়ান। যার জন্য আজীবন লোকটার কাছে সে কৃতজ্ঞ থাকবে।

খরচ দিন দিন বেড়েই চলছিল। বাড়ি ওয়ালা তার মধ্যেই ভাড়া দু হাজার বাড়িয়ে দিলো। বাজারে দিনদিন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেড়ে চলেছে। তাই সুফিয়াই তৎক্ষণাৎ বাড়ি বদলানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মেয়েকে বলে কয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িটা বদলেও ফেলেন।

অতীতের কথা মনে পড়লেই যেমন আনন্দ ঘিরে ধরে তেমনি কিছু কিছু সময়কার ঘটনা অক্ষিপটে ভেসে উঠলেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। আজও ব্যতীক্রম হলো না অনুভার সঙ্গে। জীবনটা হয়তো এতটা কঠিন না হলেও পারতো। সুখ হারিয়ে দুঃখ না এলেও হয়তো হতো।

রাতের আঁধারে ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের পানি মুছে নিলো অনুভা। বারান্দা থেকে ফিরে এলো ঘরে। সিদ্ধান্ত নিলো আর অতীত নিয়ে সে ভাববে না। মেনে নিবে বর্তমানকে। যা ভাগ্যে আছে তাই না হয় হতে থাক।তাকে যে আরো কঠিন হতে হবে। চোখের পানি আর সুখ যে তার জন্য নয়। তবুও সে খুশি। রবের উপর বিশ্বাসী। আল্লাহ্ যা করেন মঙ্গলের জন্যই তো করেন।

বিছানায় শরীর এলিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো অনুভা। কাল আবারো রুটিন মাফিক অফিসে ছুটতে হবে তাকে। উঠতে হবে ভোরে। নরম বালিশে মাথা রাখতেই সকল গ্লানি ভুলে গিয়ে ডুবে গেলো তন্দ্রার অতল গহ্বরে।
________

ফজরের নামাজ শেষে হানিফ শেখ দুই পুত্রকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছেন। এই নিয়ে পরপর দুবার ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে চক্কর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সৌহার্দ্য। একটা বেঞ্চ দেখেই হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ল তাতে। হানিফ শেখ আর শ্রাবণের অবস্থাও একই কিন্তু বাপ-ছেলে কেউ কারো সামনে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করতে যেনো নারাজ।

বুক টানটান করে মুখে দাম্ভিকতা ফুটিয়ে ছোটো পুত্রের পাশে গিয়ে বসে পড়লেন হানিফ শেখ। কণ্ঠে অহমিকা এঁটে বললেন,“মাত্র এতটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলি? তোর বয়সে আমি থাকতে পুরো গ্ৰাম তিন- চারবার করে চষে বেড়াতাম। অবশ্য তোরা শহরের ছেলেপুলে তো আবার একটুতেই দুর্বল হয়ে যাস।”

“তা দাদু বেঁচে থাকলেই জানা যেতো। উনার ছেলের দৌড় কতটুকু ছিলো তা তো আর দাদার থেকে ভালো কেউ জানবে না।”—-বিদ্রুপ করে কথাটা বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো শ্রাবণ।

ভাইয়ের কথা কর্ণপাত হতেই শব্দ করে হেসে উঠলো সৌহার্দ্য। থতমত খেয়ে গেলেন হানিফ শেখ। বিড়বিড় করে বললেন,“ছেলে দুটো উচ্ছন্নে গেলো। বাবার প্রতি কোনো ভয় ডর নেই?”

খানিকক্ষণ বাদে দু হাতে করে দু কাপ চা নিয়ে উপস্থিত হলো শ্রাবণ। কাপ দুটো ভাই আর পিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,“বাড়ি যাচ্ছি আমি। খুব ক্লান্ত লাগছে।”

হানিফ শেখ এবং সৌহার্দ্য চায়ের কাপ দুটো গ্ৰহণ করতেই হনহনিয়ে প্রস্থান করল শ্রাবণ। চায়ের কাপে চুমুক বসালেন হানিফ শেখ। চোখা দৃষ্টিতে তাকালেন ছোটো পুত্রের পানে। পিতার এহেন চাহনিতে চুপসে গেলো সৌহার্দ্য। শুধালো,“কী দেখছো?”

“জীবনে তো আর বাবা-মাকে কম মিথ্যে কথা বলিসনি। জানিস তো বাবা-মাকে মিথ্যে বললে যে পাপ হয়? দুনিয়ার জীবনে পাপ করলে পরকালের জীবনে কিন্তু শান্তি পাওয়া যায় না। নিজের পাপের ভাগটা কমানোর জন্য চটপট করে এখন একটা সত্যি কথা বলে ফেলতো।”

“কী সত্যি?”

“তোর ভাই কার সঙ্গে প্রেম করে? মেয়েটা কে? বাড়ি কোথায়? বাবা কী করে?”

বিস্ফোরিত নেত্রে পিতার মুখশ্রীতে তাকিয়ে রয় সৌহার্দ্য। পুত্রের এমন চাহনিতে বিরক্তবোধ করলেন হানিফ শেখ। বললেন,“গরুর মতো তাকিয়ে আছিস কেন? নির্দ্বিধায় বন্ধু মনে করে আমায় সব বলতে পারিস। আমি হচ্ছি ডিজিটাল বাবা। কিচ্ছু বলবো না।”

“তোমায় বন্ধু মনে করবো! তোমায়? কাবি নেহি। ইম্পসিবল।”

“কেন? বন্ধু ভাবতে সমস্যা কোথায়?”

“মনে আছে ছোটো বেলায় বাড়ির পাশের বালুর মাঠে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ছক্কা মারলাম? এমন ছক্কাই মারলাম যে একেবারে মোতালেব চাচার জানালাটা ভেঙে গেলো? তখন তুমি কী বলেছিলে?বলেছিলে, বাবা তুই কী জানালাটা ভেঙেছিস? যদি ভেঙে থাকিস তাহলে সত্যিটা বলে ফেল। আমি কিছু বলবো না তোকে। তারপর কী করলে?”

“কী করেছি? সত্যিই তো কিছু করিনি।”

“মিথ্যে বলবে না বাবা।তুমি বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে সবটা বলে দিয়েছিলে আর তারপর মা আমার পিঠে কাঠের দু দুটো স্কেল ভেঙেছিল।”

হাস্যজ্জ্বল মুখখানা মলিন হয়ে গেলো হানিফ শেখের। আমতা আমতা করে উঠে দাঁড়ালেন বসা থেকে। সামনের পথে যেতে যেতে বললেন,“তোর মা যে তোকে মারবে আমি কী জানতাম নাকি? পুরোনো কথা মনে রাখতে নেই। বাড়ি চল।”

সৌহার্দ্যও বসা থেকে উঠে বাবার পিছুপিছু হাঁটতে লাগলো। অভিযোগের সুরে বললো,“কিন্তু তুমি তো মায়ের মারের হাত থেকেও রক্ষা করোনি।”

“আইসক্রিম খাবি?”

“সেদিন মাইর খেয়ে যখন আমি কাঁদছিলাম তখনও তুমি এ কথাটাই বলেছিলে।”

“আহা! পুরোনো কথা মনে রাখতে নেই। মায়ের হাতে মাইর খেয়েছিস বলেই তো আর কখনো অমন অঘটন ঘটাসনি। আর আমারও কাউকে জরিমানা দিতে হয়নি।”

বাপ-ছেলে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চললো বাড়ির পথে। বাহির থেকে এসেই সোজা নিজ কক্ষে প্রবেশ করেছে শ্রাবণ। ক্লান্ত দেহখানা নিয়ে ঢুকে পড়েছে বাথরুমে, গোসল করার উদ্দেশ্যে।

বেলা বাড়লো। ডাইনিং টেবিলে নাস্তা দিয়েছেন শান্তা। ভার্সিটির জন্য একেবারে তৈরি হয়ে টেবিলে এসে বসেছে শ্রাবণ। শান্তা ইতস্তত করতে করতে ছেলের উদ্দেশ্যে বলেই ফেললেন,“কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিলে হতো না মেহু?”

“এসব মেয়েদের নামে ডাকবে না তো। আর ছুটিই বা কেন নিবো?”

“ওই যে তোর রুবি খালার ননদের মেয়ের কথা বললাম না? তুই তো বিয়ে করবি না বলে নিষেধ করে দিলি তাই সৌহার্দ্যের জন্য ওকে দেখতে যাবো। ভাবছি বিয়ের কথাবার্তাও একেবারে পাকা করে আসবো।”

“এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন?”

“তাড়াহুড়ো করবো না? বিয়ের বয়সী মেয়ে তার উপর সুন্দরী। এসব মেয়ের বাবা-মায়ের পেছনে সারাক্ষণ ঘটক পড়ে থাকে। যদি অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে যায়? আমি তো এ হতে দিবো না।”

“শোনো মা, এসব ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। এখনকার যুগে ছেলে-মেয়েরা বাবা-মায়ের ভরসায় বসে থাকে না। কলেজ, ভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে নিজেরাই নিজেদের লাইফ পার্টনার ঠিক করে নেয়। তাছাড়া সৌহার্দ্য অলরেডি একজনকে পছন্দ করে। তোমরা অন্তত ওর উপর চাপ ক্রিয়েট করো না।”

হতভম্ব, হতবাক হয়ে গেলেন শান্তা। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,“কিহ! সহু প্রেম করে?”

মায়ের চিৎকারে দম ছাড়ে শ্রাবণ। বিরক্ত হওয়ার ভঙিতে বলে,“সিনক্রিয়েট করো না মা। আমার জানামতে বাবার সঙ্গেও তোমার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। ওদিকে নানা বাবাকে পছন্দ করতেন না তাই তুমি বাবার হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলে।পরে অবশ্য মান সম্মানের ভয়ে নানা আবারো তোমাদের বিয়েটা নতুন করে দিয়ে দেয়। তবে মন থেকে কিন্তু মেনে নেয়নি। ঘটনাটা আরো বত্রিশ বছর আগের। সেই তুমিই বত্রিশ বছর পরে কীভাবে ছেলেদের উপর নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে চাইছো?”

ছেলের কথায় মিইয়ে গেলেন শান্তা। কিছু সময় অতিক্রম হতেই ফের প্রশ্ন করলেন,“মেহু সত্যি করে বল তো তুইও কী প্রেম করিস?”

কোনো ভণিতা ছাড়াই খেতে খেতে শ্রাবণ উত্তর দিলো,“উহু প্রেম করি না। ওইসব প্রেমট্রেম আমার সঙ্গে যায় না। তবে মেয়ে পছন্দ আছে।”

“মেয়েটা কী জানে তুই ওকে পছন্দ করিস? আচ্ছা ওই মেয়েও কী তোকে পছন্দ করে?”

“মা হয়ে ছেলেকে এসব প্রশ্ন করা উচিত নয়।”

কথাটা শেষ করে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো শ্রাবণ। মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো বাড়ি থেকে।

শ্রাবণ যেতে না যেতেই টেবিলে একে একে উপস্থিত হয় হানিফ শেখ এবং সৌহার্দ্য। মাকে গোমড়া মুখ করে বসে থাকতে দেখে সৌহার্দ্য শুধায়,“তোমার আবার কী হয়েছে মা? মুখ ভার কেন?”

“মেহুরও বিয়ের জন্য মেয়ে পছন্দ আছে। শেষে কিনা মেহুও প্রেম করে!”

স্ত্রীর কথা শেষ হতেই হানিফ শেখ সবজান্তার মতো ভাব নিয়ে বললেন,“এ আর নতুন কী? খবরটা অতিব পুরোনো। মেয়েটার নাম, ঠিকানা যদি জানতে পারো তাহলে সেটাই হবে নতুন এবং টাটকা খবর।”

চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো শান্তার। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে স্বামীর পানে তাকালেন। শুধালেন,“তুমি জানতে ও প্রেম করে? কীভাবে জানলে? কবে জানলে?”

“ভার্সিটিতে পড়াকালীন মাস শেষে যখন ড্রাইভারকে দিয়ে আমার হাতে গাড়ির পেট্রোল খরচের বিশাল বড়ো একটা লিস্ট ধরিয়ে দিতো তখনি কিছু একটা আন্দাজ করেছিলাম। পরে ড্রাইভার ব্যাটাকে ধরে আরো কিছু তথ্য উদঘাটন করি। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত আমার পেট্রোল খরচা করে ওই মেয়ের সঙ্গেই ও দেখা করতে যেতো।”

“তাহলে তো অনেক বছর ধরে সম্পর্ক চলছে!”

“হুম তা তো চলছেই।”

বড়ো ভাইয়ের পেছনে বাবা-মায়ের গোয়েন্দাগিরি চালানোটা মোটেও পছন্দ হলো না সৌহার্দ্যের। বিরক্তির সহিত বললো,“আহা তোমরা থামো তো। অযথা ভাইয়ার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করে সময় নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন আছে? সময় হলে ভাইয়া নিজেই ভাবীকে নিয়ে এসে তোমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিবে। এখন শুধু রিলেক্স করো।”

সরু দৃষ্টিতে এবার ছোটো পুত্রের পানে তাকালেন শান্তা। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“তোর ভাইয়ের না হয় নিজের পছন্দের মানুষের সঙ্গে বাবা-মায়ের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় হয়নি। কিন্তু তোর তো সময় না হওয়ার কিছু দেখছি না। কার সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছিস?কে মেয়েটা? তাকে নিয়ে বাড়িতে আসিস তো দেখবো। আর হ্যাঁ বিদেশি কোনো মেয়েকে কিন্তু আমি পুত্রবধূ হিসেবে মানবো না বলে দিলাম। তারপরেও আমাকে যদি জোর করিস তাহলে তোর বাবাকে দিয়ে তোকে ত্যাজ্য পুত্র করে দিবো।”

কথা শেষ করে হনহনিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন শান্তা। অসহায় মুখ করে মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্য। হানিফ শেখ উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,“তোদের দুই ভাইকে নিয়ে আমি গর্বিত। বাবা যে পথে হেঁটেছে তোরাও দেখছি সেই পথেই হাঁটছিস! ক্যারি অন। আমার বাবা আমার পাশে না থাকলে কী হবে? আমি আছি তোদের পাশে।”
_________

অন্যান দিনের থেকে আজকে কাজের চাপটা একটু বেশিই। কলিগ নায়রার সঙ্গে ক্যান্টিনে এসে সবে বসেছে অনুভা। মেয়েটি অফিসে নতুন সাথে অনেক মিশুকও বটে। দুদিনেই নিজ দায়িত্বে ভাব করে নিয়েছে অনুভার সঙ্গে। আগের তুলনায় অতো কথা বলার অভ্যাস আর নেই অনুভার। নিরবে শুনে যাচ্ছে অপরপাশে বসা ব্যক্তির একনাগাড়ে বলা কথা গুলো। মাঝেমধ্যে সৌজন্য স্বরূপ হাসছে। খাওয়ার ইতি উতি ঘটিয়ে দুজনেই বের হতে নিলো ক্যান্টিন থেকে। তৎক্ষণাৎ তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো নাহিয়ান। চোখেমুখে তার বিষণ্ণতা। আগের সেই চমকপ্রদ হাসিটা আর নেই। একদিনের ব্যবধানে মুখশ্রী হয়ে উঠেছে অনুজ্জ্বল।

অনুভা সৌজন্য হাসলো। শুধালো,“কেমন আছেন ভাইয়া?”

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো নাহিয়ান। পাল্টা প্রশ্ন করল,
“ফ্রি আছো তুমি? দু মিনিট সময় হবে?”

সরাসরি না করতে পারলো না অনুভা। নায়রার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,“আপনি এগোন আপা, আমি উনার সঙ্গে কথা বলেই আসছি।”

নায়রা সায় দিলো তাতে। প্রস্থান করল কয়েক সেকেন্ডেই। ক্যান্টিনের ভেতরে ফাঁকা টেবিলে এসে বসলো নাহিয়ান। তার মুখোমুখি বসলো অনুভা। জিজ্ঞেস করল,“কী যেনো বলবেন ভাইয়া? এবার বলুন।”

হুট করে তো ডেকে নিয়ে এলো কথা বলার জন্য কিন্তু এবার কী বলবে? মস্তিষ্কে ঘুর্ণিপাক খাওয়া প্রশ্নগুলো সরাসরি জিজ্ঞেস করলে যদি রেগে যায় অনুভা? যদি ভুল বোঝে? বিভিন্ন ভাবনা ভাবতে ভাবতেই কয়েক মিনিট অতিক্রম হলো। অনুভা পুনরায় বললো,“কী হলো ভাইয়া? কী ভাবছেন? যা বলার নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।”

কিছুটা হলেও সাহস সঞ্চয় হলো নাহিয়ানের। সরাসরি প্রশ্ন করল,“ওই ছেলেটা কে অনু? তোমাদের মধ্যে কী কোনো সম্পর্ক আছে?”

ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো অনুভার। শুধালো,“কে? শ্রাবণ?”

“ওহ, ছেলেটার নাম তবে শ্রাবণ? তা কী সম্পর্ক তোমাদের মধ্যে? কতদিনের পরিচয়?”

“পরিচয় অনেক আগের। ধরুন পাঁচ-ছয় বছর তো হবে।”

শুকনো ঢোক গিললো নাহিয়ান। ভেতরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। উপরে উপরে নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে। কথাটা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে বারংবার। পাঁচ-ছয় বছর! সেখানে সে অনুভাকে চেনে মাত্র বছর দেড়েক হবে। তাও আবার কয়েক মাস কম ব্যস আছে তার মধ্যে। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “ও তোমায় ভালোবাসে তাই না?”

”জানি না।”

ললাটে ভাঁজ পড়ে নাহিয়ানের। ফের প্রশ্ন করে,“তুমি বাসো? এবারও অন্তত জানি না বলো না।”

কী উত্তর দিবে ভেবে পেলো না অনুভা। তবে হ্যাঁ একসময় শ্রাবণ নামক পুরুষটি তার জীবনের অর্ধেকটা জায়গা দখল করে ছিলো। এই পুরুষটিকে নিয়ে সে ভাবতো। তার দেখা পাওয়ার জন্য ছটফট করতো মন। একসময় নিশ্চিতও হতে পেরেছিল যে পুরুষটির প্রেমে পড়েছে সে। ভালোও হয়তো বেসেছিল কিন্তু সে সময়টায় জীবনে এক ঝড় বয়ে যায়। ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের সুন্দর সাজানো পরিবারটা তছনছ হয়ে যায়। দরিদ্রতার কড়াল গ্ৰাসে ভেঙে পড়ে। সব দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে অনুভার। তখন সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কাউকে একটা প্রয়োজন ছিলো পাশে কিন্তু কাউকেই পায়নি মেয়েটি।

দায়িত্বের ভারে একসময় তার মন, মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে যায় শ্রাবণ। তবে এমনি এমনি বের হয়নি বরং জোর করে শ্রাবণ নামক পুরুষটিকে নিজের সকল ভাবনা থেকে বের করে দিয়েছিল অনুভা। বারবার তার মুখশ্রী স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলেও তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। তবে এই মুহূর্তে নাহিয়ানের কথার বিপরীতে চট করে না বলতে পারলো না অনুভা। ভেতরে কোথাও শ্রাবণের জন্য এখনো কিছু একটা অনুভব করে সে।

তার নিরবতায় মলিন হাসলো নাহিয়ান। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বললো,“বেশি সময় নিয়ে ফেললাম তোমার। নিজের টেবিলে যাও। স্যারের চোখে পড়লে আবার বকা খেতে হবে।”

বলেই চলে গেলো নাহিয়ান। অনুভাও উঠে দাঁড়ালো। এ বিষয়ে আর বেশি একটা ভাবলো না। চলে গেলো নিজ টেবিলে।

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৮+৯

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৮]

পরিবারের ভীষণ আদরের মেয়ে হওয়ায় ছোটো থেকেই বেশ জেদি এবং স্পষ্টভাষী মেয়ে ছিলো অনুভা। তাই চোখের সামনে নিজের সঙ্গেই এমন একটি অন্যায় হতে দেখে রাগ হলো তার। হেল্পার লোকটি ভাড়া উঠিয়ে পেছন থেকে যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনি অনুভা তার উদ্দেশ্যে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“এখন না আপনি আমায় বলে গেলেন হাফ ভাড়ার নিয়ম নাকি বন্ধ হয়ে গেছে? তাহলে ওই ছেলেটার কাছ থেকে কেন পুরো ভাড়া না নিয়ে হাফ ভাড়াই নিলেন?”

লোকটির চোখেমুখে নেই কোনো অনুশোচনার ছাপ। তার সোজাসাপ্টা জবাব,“আপনার কাছে কৈফিয়ত দিমু ক্যান?”

“কৈফিয়ত দিবেন কেন মানে? অবশ্যই দিতে হবে। অন্যায় করবেন আর তা বললেই দোষ হয়ে যাবে? আইন মানবেন না আবার পক্ষপাতীত্ব করবেন?”

লোকটি রেগে গেলো। মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেলো তার ভাষা। শুরু হলো দুজনার মধ্যে তর্কাতর্কি। বাস ভর্তি এত এত লোক তারপরেও কেউ যেনো দেখেও দেখছে না কিছু। কেউই এগিয়ে এলো না প্রতিবাদের জন্য। এদিককার বাস হেল্পারগুলো খুব খারাপ হয়। এতদিন তা শুধু অনলাইন প্লার্টফর্মেই শুনে এসেছিল অনুভা। আজ তার প্রমাণও সামনাসামনি পেয়ে গেলো। এসব জঘন্য ভাষার সঙ্গে পূর্ব পরিচিত নয় মেয়েটি। একপর্যায়ে থেমে গেলো সে। থেমে গেলো তার কণ্ঠনালী। কিন্তু লোকটি যেনো কিছুতেই থামার নয়। পেছন থেকে কয়েকজন পাবলিক এবার কণ্ঠে বিরক্তি লেপ্টে হেল্পারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“এত কথা কীসের তোমার? এবার অন্তত থামো। বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গেও ঝামেলা করতে হবে তোমাদের? তোমরা পারোও বটে।”

লোকটি তৎক্ষণাৎ বিশ্রি একটা হাসি দিলো। মুখ বিকৃত করে বলে উঠলো,“এইডা বাচ্চা মাইয়া? এহন ধইরা রে***”

শেষের কথাটা ছিলো চরম নোংরা এবং বিশ্রি। যা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই হতভম্ব হয়ে যায় অনুভা। ঘৃণায় রি রি করে ওঠে পুরো দেহ। ইচ্ছে করে এখনি নেমে পড়তে বাস থেকে। অথচ তার পাশেই বসে ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ বয়সী নারী। তিনি চাইলেই উনার সামনে একজন নারীর অপমানিত হওয়া দেখে করতে পারতেন প্রতিবাদ। কিন্তু করলেন না। বরং না শোনার ভান ধরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন বাহিরের দিকে। ততক্ষণে হেল্পার লোকটি গিয়ে দাঁড়ালো দরজার সম্মুখে। ওখানে দাঁড়িয়েই কুদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনুভার পানে।

দৃষ্টিটা লক্ষ্য করতেই অনুভা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখলো নিজের কলেজ ব্যাগ।মাথায় হাত দিয়ে দেখে নিলো হিজাবটা ঠিক আছে কিনা।গাড়ি এসে থামলো ফার্মগেট। নামার সময় হয়েছে। সিট থেকে উঠে দাঁড়ালো অনুভা। লোকটি এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে এখনো সেই বিশ্রি হাসিটা। মুহূর্তেই সারা দেহে জেঁকে ধরলো ভয়। ইতোমধ্যে কয়েকজন নেমেও গেছে বাস থেকে। ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে দ্রুত নামার জন্য। দুরুদুরু বুকে বাস থেকে নিরাপদে নেমে গেলো অনুভা। লোকটি যে কিছু করেনি তাতে অবাকও হলো বেশ। সাথে মনে মনে রবের নিকট আদায় করল শুকরিয়া।

ভাবনার মধ্যেই পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ায় অনুভা।কারো চেঁচানোর শব্দে পিছু ফিরে তাকায় সে। সঙ্গে সঙ্গেই ভীষণ চমকে যায়।হেল্পার লোকটি পড়ে আছে রাস্তায়।বাস থেকে ছিটকে পড়ার কারণেই তার এমন আর্তনাদ। এমন শক্তপোক্ত লোকটা নিচে পড়ল কী করে? মাথায় প্রশ্নটা হানা দিতেই রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উপরে তাকায় অনুভা। দেখতে পায় একটি ছেলেকে। যে বাস থেকে নামছে। বাস থেকে নেমেই হেল্পারের কলার ধরে টেনে দাঁড় করায়। মুষ্টিবদ্ধ হাত খানা দিয়ে লাগিয়ে দেয় শক্তপোক্ত কয়েকটা ঘুষি। সঙ্গে সঙ্গে হেল্পারের ঠোঁট কেটে বের হতে লাগলো তরল তাজা র’ক্ত। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে রাস্তায়। গোল হয়ে সকলে দেখে যাচ্ছে ঘটনাটা। বাস থেকে নেমে এলো ড্রাইভার। ছেলেটাকে থামানোর উদ্দেশ্যে কর্কশ কণ্ঠে বলতে লাগলো,“ওরে এমনে মারতাছেন ক্যান?গরীব পাইয়া আমগো উপরে জুলুম করতাছেন মিয়া?”

যুবক ছেলেটার চোখেমুখে রাগ সুস্পষ্ট। ড্রাইভারের সামনেই হেল্পারকে আরো কয়েক ঘা বসিয়ে দিলো। তারপর রাগত স্বরে বললো,“গরীব! বাসের মধ্যে মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ভাষা প্রয়োগ করার সময় মনে থাকে না তোমরা গরীব? দুইদিন পরপর অপকর্ম ঘটানোর সময় এসব মনে থাকে না? কেউ প্রতিবাদ করতে আসলে সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য নাকে কেঁদে এসব বলো তাই না?”

ততক্ষণে কয়েকটা বাস থেমে গেছে। পরিচিত কয়েকজন এগিয়ে এলো। তাদের পোশাক আশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরাও ওই হেল্পার আর ড্রাইভারদের দলেরই লোক। তারা চড়াও হলো প্রতিবাদ করা যুবকটির উপর। এরপরেও যেনো ছেলেটা ছাড়ার পাত্র নয়। যুবক বয়সটাই এমন। এই বয়সে এদের রাগ থাকে বেশি, অন্যায়ের প্রতিবাদে তারাই দৃপ্ত ভূমিকা পালন করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঝামেলাটা বেশ বড়ো হয়ে গেলো। ভিড় ঠেলে হাতে হকি স্টিক নিয়ে যুবকটিকে সঙ্গ দিলো আরো কয়েকজন যুবক। সম্ভবত এরা যুবকটিকে চেনে। সবাই সমবয়সী। হয়তো বন্ধু হবে। হেল্পারের অবস্থা আধমরা। রাস্তার পাবলিক পুরো ঘটনাটা জানার পর তারাও যুবকদের পক্ষ নিলো। বোঝা গেলো এই হেল্পারদের দ্বারা তারাও অতিষ্ট। শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি নেই বলে বাধ্য হয়েই এসব বাসে চড়তে হয় তাদের। অনুভা বুঝতে পারলো তাকে হেনস্থা করার কারণেই যুবকটি মূলত ওই হেল্পারকে এভাবে পিটিয়েছে।

ভয় কেটে চোখেমুখে ফোটে উঠলো হাসির রেখা। সামনে এগোনোর জন্য ঘুরে পা বাড়াতেই অনুভব করল কেউ ছুটে এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। অনুভা তাকালো আগন্তুকের পানে। এবারো চমকালো। এতক্ষণ যেই যুবক তার জন্য মারপিট করল সেই এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটা হাপাচ্ছে। ফর্সা মুখশ্রীতে জমেছে ঘাম। এখনো চেহারায় তার রাগ বিদ্যমান।

দ্রুত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তার সম্মুখে ধরলো অনুভা। যুবকটি বিলম্ব না করে তা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। পাশেই একটা ফাঁকা স্থানে বসে এক দমে শেষ করল বোতলের অর্ধেক পানি। তারপর বোতলটি ফেরত দিয়ে বললো,“হাঁটতে থাকো।”

সরু দৃষ্টিতে তাকায় অনুভা। ধন্যবাদ দিবে ভেবেও আর না দিয়ে হাঁটা ধরে সামনে। ছেলেটাও তার সঙ্গী হয়। হাঁটতে হাঁটতে শুধায়,“নাম কী?”

উত্তর দেয় না অনুভা। অপরিচিত একজন ছেলেকে নাম বলা অনুচিত ঠেকে। তার ভাবভঙ্গি টের পেতেই যুবকটি ফের বলে,“আমি শেখ মাহাথির শ্রাবণ। ডাক নাম অবশ্য শ্রাবণ তবে তুমি চাইলে যেকোনো একটা নামে ডাকতেই পারো।”

এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে যুবকটির পানে তাকায় অনুভা। চেহারা সুরৎ মাশাআল্লাহ। পোশাক আশাকেও বোঝা যাচ্ছে ভালো পরিবারের ছেলে। কিছুক্ষণ আগে যেভাবে প্রতিবাদ করল এতেও বোঝাই যায় খারাপ কোনো মতলব যে তার নেই। শ্রাবণ পুনরায় প্রশ্ন করল,“থাকো কোথায়?”

এবার উত্তর না দিলেই যেনো নয়। মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো,“মিরপু্র।”

“তাহলে এখানে কী?”

“কোচিং এ যাচ্ছি।”

“কোচিং? এডমিশন কোচিং?”

“হুম।”

“কোন কোচিং সেন্টার?”

“ইউসিসি।”

“ওহ বেশ ভালো। আমিও ওদিকেই যাচ্ছি। চলো তাহলে একসঙ্গে যাওয়া যাক।”

হাঁটতে হাঁটতেই ছেলেটির পানে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় অনুভা। শুধায়,“আপনিও কী ওখানে কোচিং করেন?”

ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হয় শ্রাবণের। কেমন এক দৃষ্টিতে তাকায় অপরিচিত মেয়েটির পানে। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। অনুভূতি শূন্য চোখ জোড়া চিকচিক করে ওঠে অনুভার। চঞ্চল কণ্ঠে ফের শুধায়,“তার মানে তুমি আমার ব্যাচের? এবার এইচএসসি দিয়েছো তাই না?”

পথিমধ্যেই থমকে দাঁড়ায় শ্রাবণ। আপনি থেকে এক লাফে তুমিতে নেমে গিয়েছে মেয়েটা? আচ্ছা মেয়েটার আক্কেল জ্ঞান বলে কি কিছুই নেই? তাকে দেখে কি সদ্য এইচএসসি পাস যুবক মনে হয়?এবারও তার নিরবতায় উত্তরটা হ্যাঁ ধরে নিলো অনুভা। তাড়া দিয়ে বললো,“দাঁড়িয়ে আছো কেন? তাড়াতাড়ি চলো। ক্লাস শুরু হয়ে গেলে তো বকা খেতে হবে।”

সত্যিটা বলতে চেয়েও আর বললো না শ্রাবণ। হুট করেই মাথায় চেপে ধরলো দুষ্টু বুদ্ধি। মেয়েটার কথাতেই সায় দিয়ে তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। অনুভা প্রশ্ন করল,“তুমি কোন বিভাগের?”

“বিজ্ঞান। তুমি?”

“মানবিক।”

দুজনার মধ্যে আর কোনো কথা হলো না। কোচিং বিল্ডিং এর সামনে আসতেই বিদায় নিয়ে ভেতরে ঢুকতে নিলো অনুভা। তৎক্ষণাৎ তাকে পিছু ডাকলো শ্রাবণ,“শোনো মেয়ে।”

থামলো অনুভা। ছেলেটার চোখে চোখ রেখে বললো,
“অনুভা।”

ললাটে ভাঁজ পড়ে শ্রাবণের। অনুভা পুনরায় বলে,
“আমার নাম অনুভা হাসান।”

যা বলার জন্য ডাকলো তাই বলার জন্যই এবার উদ্যত হলো শ্রাবণ। কণ্ঠে গাম্ভীর্য এঁটে বললো,
“যানবহনে চলাকালীন আর কখনো এমন ঝামেলা বাঁধাবে না। এইসব ড্রাইভার, হেল্পাররা ভালো নয়। এদের অনেক বড়ো গ্যাং আছে। দেখলে না তখন কতগুলো এসে জড়ো হলো? একা একটা মেয়ে তার উপর মেয়ে দেখলেই পুরুষরা সুযোগ খোঁজে বুঝোই তো নাকি?”

“তো কী করবো? লোকটা তো পক্ষপাতীত্ব করল। ওই ছেলের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিলো আর আমার কাছ থেকে নিলো ফুল!”

“ওই ছেলে ভার্সিটির ছাত্র। ওর সঙ্গে এমনটা করলে পুরো ভার্সিটির পোলাপাইন এসে গাড়ি আটকে দিবে তাই সঠিক ভাড়াই নিয়েছে। শেষে কী বাজে কথা বললো তোমায়? কোনো ছেলেকে কী এসব বলতে পারতো? যখন নামছিলে তখনও তো বাজে ভাবে ছুঁতে চেয়েছিল।”

আঁতকে উঠলো অনুভা। লোকটার হাসি দেখে তার এমন কিছুই মনে হয়েছিল কিন্তু নিরাপদে নামতে পেরে সেসবে আর পাত্তা দেয়নি। এবার তার কাছে সবটা পরিস্কার হলো। শ্রাবণই তাহলে এ পরিস্থিতি থেকে তাকে রক্ষা করেছে? সব মিলিয়েই ওভাবে মেরেছে!চোখেমুখে মুহূর্তেই প্রকাশ পেলো কৃতজ্ঞতা। ছোট্ট করে বললো,“ধন্যবাদ তোমাকে।”

“এবার যাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিনের মতো চলে গেলো অনুভা। ভেবেছিল এটাই হয়তো তাদের প্রথম এবং শেষ দেখা কিন্তু তার ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গুণে গুণে একদিন পরই আবারো দেখা হলো দুজনার। বরং এটাই ছিলো তাদের সাক্ষাৎ এর সূচনা লগ্ন।

কোচিং থেকে বাড়ি ফিরে পুরো ঘটনাটাই বড়ো বোনকে জানায় অনুভা। ঘটনার বিবরণ শুনে অর্থিকা রেগে গেলেও পরক্ষণেই প্রতিবাদ করা ছেলেটার প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। একদিন বাদে আবারো ক্লাসের দিনক্ষণ চলে আসে। সেদিন আর কোনো ঝামেলাই পোহাতে হলো না অনুভাকে।

কোচিং ক্লাস শেষ হতে হতে তখন দুপুর। যহরের আজান কিছুক্ষণ আগেই পড়েছে। তখনও পুরোপুরি শীতকাল আসেনি। সূর্যের তাপ প্রখর। মাথার উপর ছাতা ধরে রোদ থেকে বাঁচার জন্য সামনের দিকে পা চালাচ্ছে অনুভা। তখনি কেউ পেছন থেকে ডেকে উঠলো,“নোভা!”

নামটা নিজস্ব না হলেও অনুভার নিকট মনে হলো এই সম্বোধনটা তার জন্যই। চলন্ত পা দুটো থেমে গেলো তার। পেছনে ঘুরার আর প্রয়োজন হলো না। ছেলেটি তার সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালো। ছেলেটিকে দেখে চিনতে তেমন একটা অসুবিধে হলো না অনুভার।এ তো শ্রাবণ! কোনো সামাজিকতা না দেখিয়েই তার হাত থেকে ছাতাটা কেড়ে নিলো শ্রাবণ। আশেপাশে তাকিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,“কী রোদ! ভাগ্যিস ছাতাটা নিয়ে এলে তুমি। নইলে আমার স্কিনটা আজ কালো করেই ছেড়ে দিতো এই সূর্যি মামা।”

চট করে রাগ হলো অনুভার। রাগলে স্বভাবসুলভ তার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতীক্রম ঘটলো না। রাগত স্বরে বললো,“তুমি আমার ছাতা নিলে কেন? দাও বলছি।”

“বললাম না রোদে দাঁড়িয়ে থাকলে আমার সুন্দর স্কিনটা কালো হয়ে যাবে।”

“তো আমার যে রোদ লাগছে। আমি বুঝি কালো হবো না?”

কয়েক সেকেন্ড ভাবলো শ্রাবণ। তারপর বললো,“তা অবশ্য ঠিক। চলো তবে দুজনে ভাগাভাগি করে নেই।”

“প্রয়োজন নেই।”

রাগ দেখিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো অনুভা। শ্রাবণও হাঁটতে লাগলো তার পাশাপাশি। জিজ্ঞেস করল,“আচ্ছা তোমার বাবা যেনো কী করে নোভা?”

“নোভা নয় আমার নাম অনুভা।”

“অনুভা? ওহ, সেদিন অতো খেয়াল করিনি। পরে মনে করতে গিয়ে মনে হয়েছিল তোমার নাম নোভা।”

“সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা তুমি কী একটু বলদ টাইপের মেয়ে?”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই চরম আশ্চর্য হলো অনুভা। বলদ তাও আবার সে? তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে শ্রাবণের পানে তাকালো। শ্রাবণের মুখশ্রীতে সিরিয়াসনেস। বললো,“পুলিশ অফিসারের মেয়ে হয়ে পথে ঘাটে ঝামেলা বাঁধিয়ে কিনা হয়রানির শিকার হয়ে চলে আসো? তখন যদি হেল্পারের সামনে জোর গলায় বলতে, আমার বাবা পুলিশ। আমি পুলিশের মেয়ে। তাহলে কী আর ওই লোকটা অসব বলার সাহস পেতো?”

টনক নড়ে উঠলো অনুভার। ঠিকই তো! তখন যদি এ কথাটা বলতো তাহলে তো আর এত ঝামেলা তাকে পোহাতেই হতো না।বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বুদ্ধিমতি হলেও ছোটো থেকেই অনুভার উপস্থিত বুদ্ধিটা কম। খানিকক্ষণ নিরব থেকে বললো,“মনে ছিলো না। তাই বলে যে আমি বলদ এমনটাও নয়। তা তুমি কী করে জানলে যে আমার বাবা পুলিশ?”

ক্লাস শেষে কামরুল হাসান থানার গাড়িতে করেই মেয়েকে নিতে এসেছিলেন। তখনি তাকে পুলিশের লোগো লাগানো গাড়িতে উঠতে দেখে এমন কিছুই আন্দাজ করেছিল শ্রাবণ। তবে এখনি প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না সে। শুধালো,
“আমাকে দেখে কী তোমার সদ্য এইচএসসি পাস করা যুবক মনে হয়?”

“তা অবশ্য হয় না। লেখাপড়ায় গ্যাপ গেছে নাকি তোমার?”

“উহু, কোনো গ্যাপই যায়নি। ব্রাইট স্টুডেন্ট আমি।”

“ওহ, তাহলে হয়তো দেরিতে স্কুলে ভর্তি হয়েছো তাই না? এটা কোনো ব্যাপারই না। কলেজে আমার ইয়ারের কত স্টুডেন্ট দেখলাম যারা আমার থেকেও বয়সে অনেক বড়ো।”

“তুমি আসলেই একটা বলদ।”

মুহূর্তেই রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো অনুভার। যদিও বোন তাকে প্রায়সই বলদ উপাধিটা দিয়ে থাকে তবুও এ কথাটা শুনলেই তার রাগ হয়। ঘোর প্রতিবাদ করে বললো,“দেখো আর একবারও কিন্তু এমন কথা বলবে না।”

“বলদকে বলদ বলবো না তো কী বলবো? শুরু থেকেই না জেনে আমায় নিজের ব্যাচমেট বানিয়ে দিলে? যাই হোক, শোনো মেয়ে জাবিতে কিন্তু মাস্ট এক্সাম দিবে এবং ভালো একটা প্রিপারেশনও নিবে। দোয়া করি তোমার যাতে জাবিতেই হয়ে যায়।”

“শুধু জাবিই কেন? সব জায়গায় তো ঢাবিকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।”

“কারণ জাবিতে তোমার জন্য আমি আছি। আমার ক্যাম্পাসেই কিন্তু তোমাকে দেখতে চাই নোভা খুকুমণি। তোমাকে আমি যত্ন সহকারে রোজ র্যাগ দিবো। ঠিক আছে?”

কথাটা শেষ করেই অনুভার হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দিয়ে শীষ বাজাতে বাজাতে প্রস্তান করল শ্রাবণ। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো অনুভা। ছেলেটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে পূর্বের স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। শ্রাবণের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো।

তার মানে ছেলেটা তার ব্যাচমেট নয়? ভার্সিটিতে পড়ুয়া সিনিয়র ভাই? এত সিনিয়র ভাইকে কিনা শুরু থেকেই ‘তুমি’ সম্বোধন করে এসেছে সে? নিজেকে সত্যি সত্যিই এবার বলদ বলে মনে হলো অনুভার। তখন অমন একটা পরিস্থিতিতে ছিলো তার উপর? আর কিছু ভাবতে পারলো না অনুভা। বাড়ির পথে যাওয়া ধরলো। তবে এই ঘটনাটা যে মোটেও আপুর কাছে বলা যাবে না তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো। আপু জানলে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে তা সে নিশ্চিত। ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজেকে আরো বলদ প্রমাণ করার কোনো মানেই হয় না।

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৯]

তারপর পুরো দুটো সপ্তাহ কেটে গেলো কিন্তু শ্রাবণের দেখা আর মিললো না। যেভাবে হঠাৎ করেই ছেলেটা উদয় হলো ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো। পথে যাতায়াতের সময়ও বারবার অনুভার আনমনা মন এদিক ওদিক খুঁজে ফিরেছে তাকে। অনুভা খুব করে চাইলো এই অদ্ভুত ছেলেটির সঙ্গে তার আবার দেখা হোক। স্রষ্টা তার এই চাওয়াটাও শুনলো। সেই একই স্থানে আবার দেখা হলো দুজনার। অনুভা খেয়াল করল দুজনার মধ্যে যতবার দেখা হয়েছে ঠিক ততবারই হুট করে কোত্থেকে যেনো উদয় হয়ে তাকে পিছু ডেকেছে শ্রাবণ। আর প্রথম দুবারই অবাক হয়েছে অনুভা। তবে এবার আর কোনো অবাক হয়নি সে। হয়েছে চরম রাগ।

পেছন থেকে ডাক পড়ল,“এই ঘুষখোরের মেয়ে!”

অনুভা থমকায়। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে পিছু ফিরে। তার পাশে এসে দাঁড়ায় শ্রাবণ। শুধায়,“প্রেম ট্রেম করো নাকি? কোথায় তোমার প্রেমিক মহাশয়?”

“কষ্মিনকালেও এ পথে পা বাড়াইনি তার আগে বলুন আপনি আমায় কী বলে ডাকলেন?”

“কই কী বলে ডাকলাম?”

“অবশ্যই ডেকেছেন। আপনি আমায় ঘুষখোরের মেয়ে বলে ডেকেছেন। এখন আবার তা অস্বীকার করছেন?”

শ্রাবণের চোখেমুখে ফোটে ওঠে দুষ্টুমির ছাপ। একটু ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলে,“তোমার বাবা পুলিশ না? তাহলে ভুল কী বললাম?”

“আমার বাবা পুলিশ বলেই কী ঘুষখোর?”

শ্রাবণের সহজ উত্তর,“হ্যাঁ।”

“এসব আজেবাজে ধারণা বাদ দিয়ে মনটা পরিস্কার করুন।”—অনুভার কণ্ঠে ভীষণ তেজ। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো ঝড়ের গতিতে।

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। তার হাঁটার সঙ্গী হলো।বললো,
“রাগলে মেয়ে মানুষদের অনেক সুন্দর লাগে।”

প্রত্যুত্তর করল না অনুভা। শ্রাবণ বুঝলো মেয়েটা তার সঙ্গে কথা না বলার ফন্দি এঁটেছে। বললো,“তুমি কী আমায় মিস করছিলে এ কদিন?”

কথাটায় কাজ দিলো। অনুভা ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“আজব তো! আপনাকে আমি মিস করবো কেন?”

“এই দাঁড়াও দাঁড়াও এতক্ষণ তো আমি খেয়ালই করিনি। তুমি আবার একলাফে আপনি ডাকে চলে এসেছ কেন?”

“কারণ আপনি আমার সিনিয়র।”

“সিনিয়রদের বুঝি আপনি বলে সম্বোধন করতে হয়?”

“হ্যাঁ।”

“এখন নিশ্চয়ই ভাইয়া বলেও ডাকবে? দোয়া করি আমাকে ভাইয়া বলে ডাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেনো তোমার মুখ খসে পড়ে।”

হাঁটার মধ্যে আবারো দাঁড়িয়ে পড়ল অনুভা। ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে শুধায়,“অভিশাপ দিচ্ছেন?”

“হুম দিলাম। তবে ভাইয়া বলে ডাকলেই কিন্তু অভিশাপটা লেগে যাবে।”

নিশ্চুপ অনুভা। হাস্যজ্জ্বল মুখখানা এবার গম্ভীর হলো শ্রাবণের। বললো,“শুরুতেই আপনি বলে সম্বোধন করলে না হয় মেনে নিতাম। কিন্তু তুমি থেকে আপনিতে নামা খুবই অন্যায় একটি কাজ। আমি অন্যায় সহ্য করতে পারি না। যারা অন্যায় করে তাদেরকে ওই হেল্পারের মতোই পেটাতে ইচ্ছে করে।”

“পেটানোর হুমকি দিচ্ছেন আমায়? আমায় পেটাবেন?”

“এমন করে বলছো কেন? পেটালে কী করবে? তোমার পুলিশ বাপকে গিয়ে নালিশ করবে?”

“দরকার হলে তাই করবো।”

“এটা করা একদম অনুচিত হবে।”

“কেন?”

“কারণ তোমার বাপ পুলিশ হলে আমার বাপ হচ্ছে র‍্যাব। তুমি তোমার পুলিশ বাবাকে আমার কথা বললে তোমার বাবা আমায় জেলে ভরতে চাইবেন। তখন আবার তাকে বাঁধা দিতে চলে আসবে আমার র‍্যাব বাবা। শুরু হবে পুলিশ আর র‍্যাবের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে শত্রুতা। তাদের মধ্যে শত্রুতা হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে থমকে দাঁড়াবে নোভা।”

“তাদের দ্বন্দ্বের সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কী সম্পর্ক?”

“অনেক সম্পর্ক আছে। তোমার এই ছোটো মাথায় তা ঢুকবে না। তার আগে কাল কী হয়েছে সেটা শুনো।”

“কী হয়েছে?”

“গতকাল নৈশ প্রহরে আমি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ঠিক সেই সময়টায় স্বপ্নে দেখলাম আমার নাতি- নাতনিরা কান্না করছে।”

“নাতি-নাতনি কোত্থেকে এলো? আপনি কী বিয়ে করেছেন?”

“আরে বলদ মেয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ নাতি- নাতনিরা।”

“আমাদের?”

“হুম।”

“তা কী বললো?”

“বললো, দাদা গো দাদীকে বলো যাতে তার পুলিশ বাপের কাছে তোমার নামে নালিশ না করে। নালিশ করলে তো তোমার বিয়ে হবে না। বিয়ে না হলে আমাদের বাবা-মায়েরাও পয়দা হবে না। তারা পয়দা না হলে আমাদের কী হবে? দেখেছো তাদের কী কষ্ট?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুভা। হাঁটতে হাঁটতে বলে,“ভালো গল্প বলতে পারেন তো আপনি? নিশ্চয়ই সাহিত্যের ছাত্র?”

“না তো।”

“তাহলে?”

“এইসব আগের যুগের আপনি আজ্ঞা বন্ধ করে পুরোনো ফর্মে ফিরে এসো। শুরুতে তুমি তুমি বলে যেভাবে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছিলে সেভাবেই তুমি করে বলো।”

“মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছি?”

“অসহ্য, ন্যাকা একটা মেয়ে।”

“তুমি অসহ্য, তুমি ন্যাকা।”—রাগান্বিত স্বরে কথাটা বলে থামলো অনুভা।

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। রয়েসয়ে বললো,“আমার সাবজেক্ট কেমিস্ট্রি। তুমি চাইলে কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা কেমিস্ট্রি হতেই পারে।”

“ভালো ফ্লাটিং করতে পারো তো!”

“উহু পারি না,তবে তোমার উপর এপ্লাই করে অভিজ্ঞ হবো ভাবছি।”

“সাভারের পোলাপাইন মিরপুর, ফার্মগেট দিয়ে কী করো? যাও সাভারে যাও,নিজের ভার্সিটির মেয়েদের সঙ্গে ফ্লাটিং করো গিয়ে।”

“আমি ধানমন্ডির ছেলে। মিরপুরে গিয়েছিলাম খালার বাড়িতে। কথা ছিলো সেদিন রাতটা থেকে পরেরদিন বাড়ি ফিরবো কিন্তু আমার মন টিকছিল না ওখানে তাই কাউকে না জানিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে উঠে পড়ি।”

“তাহলে ফার্মগেটে কী?”

“তোমাদের পাশের কোচিং সেন্টারে এডমিশনের জন্য কেমিস্ট্রি পড়াই। যদিও সেদিন আমার ক্লাস ছিলো না তবুও একটা প্রয়োজনে গিয়েছিলাম।”

“ওহ, তাহলে তো অনেক পরিশ্রম করতে হয় তোমাকে তাই না?”—অসহায় হয়ে গেলো অনুভার মুখশ্রী।

মৃদু হাসলো শ্রাবণ। বললো,“কীসের পরিশ্রম?সপ্তাহে একদিন ক্লাস। তার উপর এ বছর থেকেই শুরু করেছি। জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে বুঝলে মেয়ে?”

উপর নিচ মাথা নাড়ালো অনুভা। বাসে উঠার আগ পর্যন্ত কথা বলে তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।

সেদিনের পর থেকে আবারো নিরুদ্দেশ হলো শ্রাবণ। অনির্দিষ্ট কালের জন্য আবারো হারিয়ে গেলো ছেলেটা। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েটার ভেতরে জেগে ওঠা বিভিন্ন অনুভূতি নামক আগুন নিভে গেলো চট করে। ফেরার পথে কত যে ছেলেটার দেখা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে অনুভা তার কোনো হিসেব নেই। বারবার চেয়েছিল যাতে আবারো দেখা হয় তাদের কিন্তু হলো না। কোচিং এর ক্লাস শেষ হলো। সেখান থেকে দেওয়া হলো বিদায়। ভেতরে জ্বলন্ত ছোট্ট আশার আলো নিভে গেলো। অনুভা বুঝতে পারলো তাদের মধ্যে যে আর কখনোই দেখা হবে না।

হুট করেই একজন এলো তারপর প্রেমের উষ্ণতা ছড়িয়ে হারিয়ে গেলো অজানায়। ততদিনে এডমিশন নিয়ে মাথায় হাজারো চিন্তা অনুভার। সময় তার গতিতে চলতে লাগলো। দেখতে দেখতে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ হলো। ফলাফল দিলো। প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় না পেয়ে মনক্ষুণ্ণ হলো অনুভার। তবে তা সাময়িক। জবিতে মন মতো সাবজেক্ট পেয়ে সেখানেই ভর্তি হয়ে গেলো।

ভার্সিটির হাওয়া গায়ে লাগলো। মেয়েটা হয়ে উঠলো আগের থেকেও চঞ্চল। কিন্তু মেয়েটার চঞ্চলতা কারো নিকট সহ্য হলো না। তার সেই চঞ্চলতা প্রেম নামক অসুখে রূপান্তর করতে আবারো তার জীবনে চলে এলো সেই সুপুরুষ। ভার্সিটিতে পা রাখার মাস তিনেক পার হয়েছে তখন।নতুন নতুন অনেক বান্ধবী জুটেছে অনুভার। ক্লাস শেষে একেক জনের একেক গল্প শুনে হাসতে হাসতে বের হলো ভার্সিটির ভেতর থেকে। আশেপাশে কোনো খেয়াল নেই তার। অদূরে কেউ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে। দেখা শেষ হতেই ডাকলো,“নোভা!”

এই নামটা অনুভার চেনা। বিশেষ মানুষের দেওয়া সংক্ষিপ্ত একটি নাম। পুরোনো ভাবেই থেমে গেলো তার পা জোড়া। বান্ধবীরা অনেকটা পথ ততক্ষণে এগিয়ে গিয়েছে। পেছন ফিরতেই বিষ্ময়ে মুখশ্রীর আদল বদলে গেলো অনুভার। নিজের চোখকে তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। ঠিক দেখছে তো সে? সাদা একটি গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। চোখে সানগ্লাস, পায়ে সাদা কেস, পরনে হাফ প্যান্ট, কালো রঙের টি-শার্ট তার উপরে আবার সাদা একটা শার্ট যার বোতামগুলো খোলা। সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাবণ। উচ্চস্বরে বললো,“দেখা শেষ হলে দ্রুত কাছে এসো।”

হঠাৎ করেই যে আবারো এভাবে দেখা হবে দুজনার কষ্মিনকালেও তা ভাবতে পারেনি অনুভা। বাধ্য মেয়ের মতো এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ছেলেটার সম্মুখে। তার মনে যখন বিভিন্ন প্রশ্ন আর মান অভিমানের পাল্লা ওঠা-নামা করছিল ঠিক তখনি শ্রাবণ বলে উঠলো,“এটা তো কথা ছিলো না নোভা।জাবিতে না গিয়ে তুমি জবিতে কী করছো?”

“জাবিতে তো পরীক্ষাই দেইনি।”

“কেন দাওনি?”

“ফরমই তো তুলতে পারিনি। এইচএসসিতে আমার ইংরেজির পয়েন্ট খুবই খারাপ। টেনেটুনে পাস যাকে বলে। জাবির ফরম তুলতে তো ইংরেজিতে ভালো একটা পয়েন্ট লাগে।”

কয়েক সেকেন্ড কিছু ভাবলো শ্রাবণ। তারপর বললো,“ওহ, এটা তুমি আমায় আগে বলবে না? ওদিকে তোমাকে স্পেশাল ওয়েলকাম জানানোর জন্য তোমার অপেক্ষায় আমি বসে ছিলাম।”

“আগে কীভাবে বলবো? তোমার সঙ্গে কী আমার কোনো যোগাযোগ ছিলো? নাকি তোমার ফোন নাম্বার ছিলো?”

শ্রাবণ বাম ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,“নাম্বার লাগবে?”

ভড়কে গেলো অনুভা। খানিকটা লজ্জাও পেলো। কিন্তু সেই লজ্জাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শ্রাবণ বলে উঠলো,“তোমার লাগলেও আমি আমার নাম্বার তোমায় দিবো না।”

“কেন দিবে না?”

“আমার ইচ্ছে।”

“তা এতদিন পর কোত্থেকে উদয় হলে বলো তো? সেদিনের পর থেকে আর দেখাই পেলাম না তোমার।”

“আমায় খুঁজেছিলে নাকি?”

ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ভিতু হলো মন। উপরে উপরে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখলো অনুভা। হুটহাট কারো প্রতি আবেগী হয়ে অনুভূতি প্রকাশ করার মেয়ে সে নয়। দক্ষভাবে মিথ্যে বললো,“না তো। তোমায় খুঁজবো কেন? তা জানলে কী করে আমি যে এখানে আছি?”

“জানাটা কী কঠিন কোনো কাজ নাকি?তবে তোমার উপর আমি চরম ক্ষুব্ধ নোভা।”

“কেন?”

“জাবিতে পরীক্ষা না দেওয়ার ব্যাপারটা মানলাম কিন্তু জাবির ভাই ঢাবির কাছে কেন গেলে না?”

“গিয়েছিলাম কিন্তু ওখানেও এই ইংরেজিই বাঁধ সাধলো। এক মার্কের জন্য ইংরেজিতে ফেইল।”

“ইংরেজিতে নিশ্চয়ই প্রচন্ড দুর্বল তুমি?”

“হুম অনেক।”

“শুরুতে আমায় কেন জানালে না? তাহলে আমি তোমার স্পেশাল ক্লাস নিতাম।”

ছোটো ছোটো চোখ করে ভ্রু যুগল কুঁচকে শ্রাবণের পানে তাকিয়ে রইলো অনুভা। সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“তোমাকে আমার একদম সুবিধার মনে হচ্ছে না। সত্যি করে বলো তো কয়জনের এমন স্পেশাল ক্লাস নাও?”

“স্পেশাল তো দূরে থাক তবে নরমাল ভাবেও কারো ক্লাস নেই না। নিজে ক্লাস করেই কুল পাই না তার উপর অন্যের ক্লাস নেওয়ার সময় কোথায়? তবে কোচিং এ ক্লাস নিতে গিয়ে দেখলাম কয়েকটা মেয়ে সম্ভবত আমার উপর ফিদা হয়ে গেছে। কয়েক মাস ধরে জোঁকের মতো ম্যাসেঞ্জারের পেছনে লেগে থেকে প্রেম নিবেদন করছে।”

“স্বাভাবিক। এত সুন্দর স্যার থাকলে যে কেউই প্রেমে পড়বে। তবে আমার হচ্ছে কপাল পোড়া। জীবনে এত সুন্দর একটা স্যার-ই পেলাম না।”

ভ্রু নাচায় শ্রাবণ। অধরে দুষ্টু হাসি। ফিচেল কণ্ঠে বলে,“তুমি চাইলে কিন্তু আমি তোমার প্রেমের টিচার হতেই পারি।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো অনুভা। তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গ বদলে ফেললো শ্রাবণ। পুরোনো প্রসঙ্গ টেনে বললো,“ভেবেছিলাম পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ায় তোমায় বড়োসড়ো একটা ট্রিট দিবো। কিন্তু তোমার কাছে আসতে গিয়েই তো আমার বাবার অনেক গুলো পেট্রোল খরচ হয়ে গেলো। ভবিষ্যৎ এ আরো কত যে পেট্রোল খরচ হবে তার তো হিসেবই নেই। দেখা যাবে পেট্রোলের টাকা জোগান দিতে গিয়ে বাড়িঘর বেচে দেউলিয়া হয়ে গেছে আমার বাবা।”

মুচকি হাসলো অনুভা। কথাটার অর্থ সহজেই বুঝে গেলো। বললো,“রাবিতেও আমার হয়ে গিয়েছিল কিন্তু বাবা কিছুতেই অতদূরে যেতে দিলো না। তাই এখানেই সাবজেক্ট চয়েস দিয়েছিলাম আর মনমতো পেয়েও গেলাম।”

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। বললো,“তোমার ঘুষখোর পিতা মহোদয় এই একটা ভালো কাজ অন্তত করেছেন। যার কারণে উনার প্রতি আমি সন্তুষ্ট।”

“বাবাকে একদম ঘুষখোর বলবে না। আমি কিন্তু রেগে যাবো।”

“সত্যি কথা শুনতে তিতাই লাগে। তিতা কারো পছন্দ নয়।”

মুখ বাঁকালো অনুভা। সেদিনের পর থেকে তাদের সম্পর্কের গভীরতা যেনো বৃদ্ধি পেলো।এভাবেই পুরো দু দুটো বছর একসঙ্গে পথ চললো দুজন। দুজনার দেখা হতো অনিয়ম করে। শুরুর মতোই হুটহাট করে হারিয়ে যেতো শ্রাবণ। আবার হুট করেই কোত্থেকে উদয় হয়ে পিছু ডাকতো অনুভার। অন্যান্যদের মতো তখনও তাদের মধ্যে বিনিময় হয়নি ফোন নাম্বার। অথচ তখন সকলের হাতে হাতেই স্মার্ট ফোন। শুরু থেকেই অনুভার মনে হয়েছে এই পুরুষটা অদ্ভুত। খুবই অদ্ভুত। স্যোশাল মিডিয়ার যুগ থাকার পরেও একজন আরেকজনের ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ কোনো জায়গায় যুক্ত ছিলো না। একটা সময় এই অদ্ভুত ছেলেটার প্রেমে পড়ল অনুভা। যাকে বলে মারাত্মক প্রেম। তবে কখনোই প্রকাশ করা হলো না। দুই বছরে অনেক গুলো মাস, দিন পাড়ি দেওয়ার পরেও তাদের সম্পর্কের কোনো নাম হলো না। কিন্তু দুজনই দুজনার অনুভূতি বুঝতো। বুঝতো চোখের ভাষা।

এই দুই বছরে একবারের জন্যও কেউ কারো সীমা লঙ্ঘন করেনি। কেউ কারো আঙ্গুল স্পর্শ করেনি। বান্ধবীরাও যখন জিজ্ঞেস করতো, তোদের মধ্যে কী প্রেম চলছে? অনুভার উত্তর ছিলো, না। তখন আবারো প্রশ্ন আসতো, তাহলে চলছেটা কী? অনুভা জানতো না। আসলেই তাদের মধ্যে চলছেটা কী?

বছর ঘুরতেই বাড়িতে অর্থিকার বিয়ের কথাবার্তা উঠলো। বড়ো বোনের বিয়ে নিয়ে অনুভার অনেক পরিকল্পনা ছিলো। যা শ্রাবণের সঙ্গে দেখা হলেই উৎফুল্ল হয়ে তাকে জানাতো। তন্ময় ছেলেটা ছিলো খুবই ভদ্র, মিশুক এবং হাসিখুশি প্রকৃতির একজন পুরুষ।বাবা হয়তো তার ভেতরে আরো ভালো কোনো গুণ দেখেছিল। নয়তো কী আর নিজের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য এতো উতলা হয়ে ওঠেন? তবে এর ভেতরেই অনুভা লক্ষ্য করল বাবা-মায়ের যে কিছু একটা হয়েছে। তাদেরকে আগের মতো আর হাসি
খুশি দেখা যায় না। সবসময় চিন্তিত থাকে। মেয়েদের দেখলেই লুকোচুরি ভাব। অনুভা কিছু একটা আঁচ করে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল,“কোনো সমস্যা বাবা? তুমি কি অসুস্থ?তোমাকে ইদানিং কেমন যেনো লাগছে।”

প্রথমে কামরুল হাসান ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণেই জোরপূর্বক হেসে উত্তর দেন,“কী সমস্যা হবে?অফিসে কাজের চাপ বেশি, বুঝলি? তার উপর তোর বোনের বিয়ে। বিয়ের পর আমাদের ছেড়ে কত দূরে চলে যাবে অর্থি? ভেবেই তো আমার বুকটা কেঁপে উঠছে।”

বাবার কথায় নিজের মনটাও চট করে খারাপ হয়ে গেলো অনুভার। সত্যিই তো! বোন চলে গেলে যে খুব কষ্ট হবে তার। কি করে থাকবে তাকে ছাড়া?

মাস খানেকের মধ্যেই বিয়ের হইচই পড়ে গেলো বাড়িতে। চাচা জেঠাদের কথায় ঠিক হলো বিয়ে হবে গ্ৰামের বাড়িতে। মন খারাপ হলো অনুভার। তার মানে শ্রাবণের সঙ্গে দেখা হবে না অনেকদিন! ভাবনা গুলো মস্তিষ্কে হানা দিতেই ধক করে উঠলো তার বুক।

তারপরের দিনই ক্লাস মিস দিয়ে মনে সাহস নিয়ে এই মেয়েটাই একা একা চলে গিয়েছিল সেই সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। কিন্তু গিয়ে যেনো তার মাথায় হাত। চট করে মনে পড়ল যার জন্য এতদূর ছুটে আসা তার তো মাস চারেক আগেই গ্ৰাজুয়েশন শেষ হলো! মন খারাপ নিয়ে ফেরার জন্য পা বাড়াতেই সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটার সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেলো সে পথেই।

সেদিন শ্রাবণের মুখটা দেখে কি খুশিই না হয়েছিল অনুভা। প্রথমবারের মতো এই পুরুষটাকে সে চমকাতে দেখেছে। তার সামনে এসে সটান করে দাঁড়িয়ে চমকায়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল,“তুমি! এখানে কী করছো? কার সঙ্গে এসেছো এতদূর?”

ঠোঁট চেপে তখন হাসছিল অনুভা। কোনো ভণিতা ছাড়াই উত্তর দেয়,“আপুর বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে পনেরো দিনের জন্য পরিবারের সঙ্গে গ্ৰামে যাচ্ছি। পরশু দিন রওনা দিবো। তাই কাল দেখা হওয়ার কোনো চান্স নেই, গোছগাছ করতে হবে। আর আজও যে তুমি আসবে না তা আমি নিশ্চিত ছিলাম।”

“তাই বলে একা একা চলে এলে? পথে যদি কোনো বিপদ হতো?”

“হতো’র চিন্তা কবে করো তুমি? হয়নি তো। এখানে এসে আমার মনে পড়ল তোমার তো গ্ৰাজুয়েশন কমপ্লিট। কথাটা মনে পড়তেই মন খারাপ হলো। তোমার বলা প্রথমদিনের কথাটা মনে পড়ে গেলো। সত্যিই আমি একটা বলদ। সময়ের কথা সময়ে মনে না পড়ে অসময়ে মনে পড়ে।”

“ভাগ্যিস অসময়ে মনে পড়ে। তাই তো আমাদের পথ চলাটা দীর্ঘ হলো।”—-বলেই মুচকি হাসলো শ্রাবণ।

“তা তুমি এখানে এ সময়?”

“প্রয়োজনে এসেছিলাম।তোমার ভাগ্য ভালো আমার প্রয়োজনটা ছিলো তাই তো দেখা হলো।”

সেদিন অনেকক্ষণ দুজনে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ওইটাই জীবনের প্রথম আনন্দঘন দিন ছিলো অনুভার। সেদিনই তার জীবনে এতটা স্বাধীন ভাবে ঘুরতে পেরেছিল মেয়েটা। তারপর শ্রাবণ নিজ দায়িত্বে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায় অনুভাকে। যদিও সেদিন ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছিল। মায়ের থেকে অনেক বকাও খেতে হয়েছিল তাকে। তবে ভাগ্য ভালো ছিলো যে বাবা সেসময় বাড়িতে ছিলেন না। নইলে বাবার বকাও মিস যেতো না।

চলবে _______

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)