Saturday, July 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 352



সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৬+৭

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৬]

প্রভাতের কিরণ ধরণীতে আস্ফালিত হতেই সজাগ হয়ে উঠলো জনজীবন। পল্লবী ভবনের সদস্যরা এসে উপস্থিত হয়েছে ডাইনিংয়ে। মুহূর্তেই সকল নিস্তব্ধতা ঘুচে শুরু হয়ে গেলো গুনগুন আওয়াজ। বাচ্চারা খাবার সম্মুখে রেখে মেতে উঠেছে একে অপরকে খোঁচাখুঁচি নামক দুষ্টুমিতে। রমণীরা খানিক বাদে বাদে হেসে উঠছে নিজেদের মধ্যকার কথার তালে তালে। টেবিলের কর্ণারের একটি চেয়ারে বসে পাউরুটিতে জেল মাখাতে ব্যস্ত তানিম। আশেপাশে বোম ব্লাস্ট হলেও যেনো তাতে কিছু যায় আসে না তার। আজ এক সপ্তাহ ধরে নিজের তিন সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে বড়ো বোন তিথি। তিথি এলেই বাড়ির পরিবেশটা একেবারে বদলে যায়। গুমোট ভাব কেটে শুরু হয় হইচই। তখনি সেখানে উপস্থিত হলেন গম্ভীর ধাঁচের লোক আজিজুল হক। উনাকে দেখতেই থেমে গেলো সব হট্টগোল। তৎক্ষণাৎ যে যার মতো হুঁশিয়ার হয়ে উঠলো।

স্ত্রী আফসানা সিদ্ধ ডিম ভর্তি একটি প্লেট এনে স্বামীর সম্মুখে রাখলেন। খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন আজিজুল হক। আড়চোখে তাকালেন পুত্রের পানে। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খুক খুক করে দুবার কাশলেন। তারপরেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলছে তোমার?”

মুখের রুটি শেষ করে পিতার মুখের পানে তাকায় তানিম। স্পষ্ট বাক্যে উত্তর দেয়,“চলছে ভালোই।”

নিশ্চিন্ত হন আজিজুল হক। খাওয়ায় মনোনিবেশ করেন। নিজের খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে তানিম। বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় অফিসের উদ্দেশ্যে। গাড়ি নিয়ে আগেই বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো নাহিয়ান। তানিমই তাকে আসতে বলে দিয়েছিল। কী একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ নাকি আছে তার জন্যে। মাঝপথে যেতেই থেমে গেলো গাড়ি। ল্যাপটপ আর একটা ফাইল হাতে নেমে গেলো নাহিয়ান। তারপর আবারো চলতে শুরু করল গাড়িটা। মিনিট পনের বাদে এসে থামলো অফিসের সামনে।

কম্পিউটারের সামনে বসে দ্রুত হাতে টাইপিং করছে অনুভা। তখনি ভেতরে প্রবেশ করল তানিম। কেউ তাকে সালাম জানালো আবার কেউ বললো,“গুড মর্নিং স্যার।”

সকলের জবাব নিয়েই করিডোর দিয়ে হেঁটে নিজ কেবিনে চলে গেলো সে। যাওয়ার আগে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গেলো অনুভার পানে। নতুন নতুন যখন মেয়েটা জয়েন করেছিল অফিসে তখন তাকে বিশেষ একটা খেয়াল করেনি তানিম। দুয়েকবার নজরে পড়লেও ঠিক অন্যান্য কর্মচারীর দৃষ্টিতেই দেখে এসেছিল তাকে। কিন্তু হুট করেই ঘটে গেলো এক অঘটন।

তখন সবে অফিসের ভেতরে পা রেখেছে তানিম। করিডোর দিয়ে হেঁটে নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়াতেই বিদঘুটে শব্দ শুনে থেমে যায় পথিমধ্যে। পিছু ফিরতেই দেখতে পায় ফাঁকা চেয়ার টেনে একটা মেয়ে বসেছে সবে। মূলত চেয়ারটা টানার ফলেই ঘর্ষণের শব্দ হয়েছে। ফাঁকা চেয়ারটা শুরুতেই তার নজরে আটকে ছিলো। ভেবেছিল, হয়তো টেবিলের কর্মচারী ছুটিতে আছে তাই এত মাথা ঘামায়নি তানিম। কিন্তু তৎক্ষণাৎ পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো তার সম্মুখে। তড়াক করে মেজাজ খারাপ হলো তানিমের। এসব অনিয়ম ছেলেটার মোটেও পছন্দ নয়। অফিসের ম্যানেজার থেকে শুরু করে দারোয়ানসহ প্রত্যেক কর্মচারী এ বিষয়ে অবগত। তাই কেউই কখনো ভুলক্রমেও দেরি করে আসে না। অফিসের সময়টা সর্বদা সতর্কিত থাকে সকলে।

এগিয়ে আসে তানিম।একহাত পকেটে গুঁজে আরেক হাত টেবিলের উপর রেখে শুধায়,“কয়টা বাজে?”

চেয়ার ছেড়ে দ্রুত পদে উঠে দাঁড়ায় অনুভা। প্রশ্নের আসল অর্থটা সহজেই বোধগম্য হয় তার। মিনমিনে স্বরে বলে,“আজ একটু দেরি হয়ে গেছে স্যার।”

“অফিস টাইম শুরু হয় সাড়ে আটটায়। আপনি এসেছেন নয়টা চল্লিশে। অর্থাৎ এক ঘণ্টা দশ মিনিট লেট হয়েছে আপনার। অথচ আপনি একটু বলছেন?”—-শেষের কথাটা একটু ধমকের সুরেই বলে উঠলো।

ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো অনুভার। স্বভাবসুলভ ভাবে সে ভিতু মেয়ে না হলেও চাকরিতে প্রবেশ করতেই যেনো সারাক্ষণ তাকে ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। যদি কোনো ভুলের কারণে চাকরিটা চলে যায়? কী হবে তখন? পরিবারকে যে রাস্তায় নামতে হবে! সারাক্ষণ মাথায় ঘুরঘুর করে এসব দুশ্চিন্তা।

বাকি কর্মচারীরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। এমন ভাব যেনো আশেপাশে কিছুই হচ্ছে না। কিংবা হলেও তা তারা টের পাচ্ছে না। হয়তো ভয়ে। অনুভা খেয়াল করে দেখেছে এই লোকটার ভয়ে সকলে তটস্থ। এর কারণটাও অবশ্য একসময় টের পেয়ে গিয়েছিল অনুভা।

কোনো উত্তর না পেয়ে রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তানিমের। প্রশ্ন করল,“বেতনের সময় এক টাকাও তো কম নিবেন না তাহলে কাজের বেলায় এতশত খামখেয়ালিপনা কেন?”

এবারও নিরব অনুভা।প্রত্যুত্তর করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অজান্তেই ভুল একটা হয়ে গেছে, তার উপর যদি ভুল কিছু বলে ফেলে?তখন কী চাকরিটা আদৌ থাকবে? তার এই নিরুত্তরপনা দেখে ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে তানিমের। যদিও ছেলেটার ধৈর্য্য এমনিতেই খুব কম। কথায় কথায় রাগ ঝেরে ফেলা তার অভ্যাস। বিপরীত মানুষটার পরিস্থিতি কিছুতেই বুঝতেই চায় না বা চেষ্টাও করে না।এবারও তাই হলো। রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
“লেট কেন হলো তার এক্সপ্লেইন দিন। ফাস্ট।”

সাহস সঞ্চয় করে কয়েক সেকেন্ড মৌন রইলো অনুভা। কণ্ঠে নমনীয়তা এনে উত্তর দিলো,“বাবু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হুট করে বমি হচ্ছিল, ওষুধ খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে।”

ভ্রু যুগল পরিপূর্ণ কুঁচকে গেলো তানিমের। সাথে বেশ কয়েকটা সরু ভাঁজ পড়ল ললাটে। কণ্ঠে বিষ্ময় নিয়ে শুধালো,“আপনি বিবাহিত?”

দুদিকে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বোঝালো অনুভা। পুরো চোখেমুখে বিষ্ময় ছাপিয়ে গেলো তানিমের। শুধালো,
“তাহলে বাবু এলো কোত্থেকে? বিয়ের আগেই কী?”

এতটুকু বলে থেমে গেলো তানিম। তার শেষ না হওয়া খারাপ ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটি বুঝতেও বেশি সময় লাগলো না অনুভার।নত মস্তক উঠিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালো তানিমের পানে। এমন নারী দৃষ্টিতে মুহূর্তেই ভড়কে গেলো তানিম। মেয়েটার দৃষ্টিতে দেখতে পেলো সীমাহীন রাগ। অনুভা কঠিন স্বরে উত্তর দিলো,“আমার বোনের বাচ্চা। বাবা-মা,বোন সবাই অসুস্থ তাই আমার উপরেই ওর সব দায়িত্ব। দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত স্যার। পরবর্তীতে আর কখনো এমনটা হবে না।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো অনুভা। এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য ছিলো একটাই। যাতে দ্বিতীয়বার তাকে আর কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না হয়।সেদিন আর কিছুই বলতে পারলো না তানিম। ওই তেজস্রী চাহনি তার কণ্ঠনালী থেকে বাক্যগুলো কেড়ে নিয়ে তাকে করে দিলো নির্বাক। হাতের ইশারায় বসতে বলে সেই ব্যাপারটাকে সেখানেই সমাপ্ত করে নিজের কেবিনে গিয়ে বসে পড়ে তানিম।

তারপর থেকে না চাইতেও মেয়েটা বারবার তার নজরে পড়ে। তানিম খেয়াল করে মেয়েটির কাজের ধরণ খুব ভালো। কোনো প্রজেক্ট দিলে খুব গুছিয়ে তা শেষ করে। মাঝে মাঝে ভুলও অবশ্য করতো। এই যেমন নতুন কোনো ফাইল দিলে দেখা যেতো অফিসেই ফেলে রেখে চলে গেছে। নয়তো কখনো সখনো বাড়িতে ফেলে রেখে চলে এসেছে অফিসে। এসব কারণে মেয়েটার প্রতি অনেক ক্ষোভও ছিলো তার। কাজের প্রতি অভিজ্ঞ বলে শুধু বের করে দিতে পারছিল না অফিস থেকে।তার পাশাপাশি প্রতিবারই ওর পক্ষে নাহিয়ানের অজস্র সাফাই গাওয়া।

নাহিয়ান ছেলেটা খুব ভালো। একেবারে তানিমের মনের মতো। প্রথম প্রথম অফিসের পি.এ হিসেবে তাকে সীমাবদ্ধ রাখলেও একসময় বানিয়ে নেয় এসিস্ট্যান্ট। ব্যক্তি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজসহ বিভিন্ন পরামর্শও তার কাছ থেকেই নেয় তানিম। তার সঙ্গে থাকতে থাকতে নাহিয়ানও যেনো স্যারের বলার আগেই অনেক কিছু বুঝে যায়।

অনুভার সেদিনের অপরাধটা ছিলো মারাত্মক। সেই মিটিংয়ের জন্য অনেকটা অপেক্ষা করতে হয়েছিল তানিমকে। প্রজেক্টের কাজ যদিও আগেই শেষ হয়েছিল তবুও সে অনুভাকে ফাইলটা চেক করার জন্যই মূলত দিয়েছিল। যাতে কোনো ভুল না থাকে। মেয়েটা ভুল ধরতে খুব এক্সপার্ট। কিন্তু সেদিনই সে আসলো না। ক্লাইন্টরা তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাদের প্রতি ক্ষোভ নিয়েই চলে যায় অফিস থেকে। সেই রাগটা যেনো কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছিল না তানিম। ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে সামনে পেলেই যা তা শুনিয়ে দিতে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের চেয়ার টেনে বসলো তানিম। পুরোনো কথাগুলো ভাবলেই তার হাসি পায়। কেন জানি এখন আর অনুভা নামক মেয়েটির উপর কোনো রাগই করতে পারে না সে। মেয়েটার জন্য ভেতরে অনুভূত হয় মায়া। সেদিন হয়তো রাগের মাথায় কাজ থেকে তাড়িয়েও দিতো অনুভাকে। কিন্তু নাহিয়ান এসে আটকায় তাকে।যতটুকু সম্ভব অনুভার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায়। তখনি মেয়েটির জন্য করুনা হয় তানিমের। সেদিন পুরোটা সময় ভেবে দেখে মেয়েটার অবস্থা।

প্রায়সই সিসি টিভিতে মনোযোগ সহকারে দেখে মেয়েটাকে। তবে ইচ্ছেকৃত নয় বরং অনিচ্ছাকৃত। নিজের এমন কাজে কখনো সখনো অবাকও হয়। আজও ব্যতীক্রম ঘটলো না। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে স্ক্রীনে। শুধু দেখে যাচ্ছে অনুভাকে। তবে অনিচ্ছাকৃত নয়, আজ ইচ্ছাকৃতভাবেই সে দেখছে। বাহ্যিক ভাবে কেউ দেখে বলতেই পারবে না এই মেয়েটির জীবনে এতশত ট্রাজেডিতে ভরা।

আচমকা ঠোঁটের কার্নিশে এক চিলতে হাসি ফোটে উঠলো তানিমের। হুট করেই তার মনে হলো মেয়েটি সুন্দর। বাস্তবিক অর্থে এই সুন্দর মেয়েটিকে তার ভালো লাগছে। যে সে ভালো নয় বরং অন্যরকম ভালো। আবার এও বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে নাহিয়ানের সঙ্গে অনুভা নামক মেয়েটির চলাফেরা, কথা বলা তার সহ্য হয় না। রাগ হয়। চরম রাগ।
______

আজ তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষ মিলিয়ে মোট দুটো ক্লাস ছিলো শ্রাবণের। ক্লাস শেষে নিজের টিচার্স রুমেই এতক্ষণ বসে ছিলো সে। দরজার কাছে আসতেই দেখতে পেলো একটা মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথা বলছে পিয়ন। মেয়েটার মুখখানা দেখতেই পরিচিত ঠেকলো তার নিকট কিন্তু নামটা আপাতত মনে পড়ছে না। এখানে হচ্ছেটা কী তা বোঝার জন্য সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটি অনুরোধের সুরে বলছে,“স্যারের সঙ্গে আমার কথা আছে। বলছি তো কথা বলেই চলে যাবো।”

পিয়ন লোকটাও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই মেয়েটিকে ভেতরে ঢুকতে দিবেন না।কর্কশ কণ্ঠে বললেন,“স্যার এহন বাহির হইবেন তাই কথা কওয়া যাইবো না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে নালিশ করমু গিয়া।”

“আপনি স্যারকে একবার বলে তো দেখুন।”

“কী বলমু? দেখা করার লাইগ্গা অনুমতিপত্র আছে? কই দেখান আগে।”

সামিরা অবাক হলো। স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আবার অনুমতিপত্রও লাগে? প্রথমদিন যে কথা বললো তখন তো লাগেনি।আজ কেন লাগবে? শুধালো,“অনুমতিপত্র লাগবে কেন? সেদিনও তো কথা বললাম তখন তো লাগেনি।”

পিয়ন লোকটার ললাটে ভাঁজ পড়ল। দৃষ্টিতে যোগ হলো সন্দেহ। পাল্টা প্রশ্ন করলেন,“অফিসরুমে গিয়া কথা কইছেন?”

“না, ক্লাস শেষে বলেছিলাম।”

“তাইলে আর কী? ক্লাসে কিংবা ক্লাস শেষে কথা কওয়া আর অফিস রুমে ঢুইক্কা কথা কওয়া কী এক নাকি? অফিস রুমে ঢুকতে হইলে আলাদা দরখাস্ত লাগে, অনুমতিপত্র লাগে এইডাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম। এহন যান এন থাইক্কা।”

সামিরার মুখখানায় মলিনতা ভর করল। ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই শ্রাবণ বেরিয়ে এলো বাহিরে। সবটা শোনার পরেও না শোনার ভান ধরে শুধালো,“কী হয়েছে এখানে? এতো হট্টগোল কীসের?”

পিয়ন চমকে উঠলো। আমতা আমতা করে বললো,
“তেমন কিছু না স্যার। ক্যাম্পাসে নতুন পোলাপাইন আইছে তাই নিয়ম কানুন না জাইনাই দেখা করতে আইছে। আমি বুঝাইয়া তাড়াইয়া দিছি।”

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতেই পথিমধ্যে থেমে গেলো সামিরা। পেছন ফিরে শ্রাবণকে বের হতে দেখেই চিকচিক করে উঠলো অক্ষি যুগল। বিলম্ব না করে দ্রুত হেঁটে এগিয়ে এসে বললো,“স্যার!”

ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো শ্রাবণ।পিয়ন আঁতকে উঠলো। বেয়াদব মেয়েটা আবার এসেছে? কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই শ্রাবণ উনাকে থামিয়ে দিয়ে সামিরার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,“কিছু বলবেন?”

উপর নিচ মাথা নাড়ালো সামিরা। পাল্টা প্রশ্ন করল,
“দুদিন ধরে আপনি ক্লাসে আসছেন না কেন স্যার?”

“ক্লাস ছিলো না তাই।”

উত্তরটি জানতেই থতমত খেয়ে গেলো সামিরা। নত স্বরে বললো,“ওহ, তাহলে আপনার নেক্সট ক্লাস আবার কবে স্যার?”

“ক্লাস রুটিন দেখেননি?”

“না স্যার।”

“এই প্রশ্ন করার জন্য এখানে এসেছেন?”

ইতস্ততবোধ করল সামিরা। ইচ্ছে করল নিজের গালে নিজ হাতে দুটো চড় মেরে দিতে। একটা বলতে এসে বলে ফেলেছে আরেকটা। মনে করার চেষ্টা করল, কী যেনো বলতে এসেছিল সে? না কিছুতেই মনে পড়ছে না। এই পিয়ন ব্যাটার জন্যই আসল কথাটা ভুলে বসে আছে। তার নিরুত্তর ভাব দেখে বিরক্ত হলো শ্রাবণ। তাড়া দেখিয়ে বললো,“আমার ক্লাস আবার কালকে। ক্লাস রুটিন সম্পর্কে সিনিয়রদের থেকে ভালো করে জেনে নিবেন। আর হুটহাট টিচার্স রুমে দেখা করতে আসবেন না। এটা ইউনিভার্সিটি, এখানে অনেক আলাদা আলাদা নিয়ম-কানুন আছে। যা সমস্যা হবে তা নোট করে রাখবেন। ক্লাসে গেলে তখন আমায় বলবেন উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।”

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গটগট হেঁটে প্রস্থান করল শ্রাবণ। হাস্যজ্জ্বল মুখখানা চুপসে গেলো সামিরার। এই মুহূর্তে খুব অপমানিত বোধ হচ্ছে তার। মিলি বারবার নিষেধ করেছিল এখানে আসতে কিন্তু তাদের কথা না শুনে আসাটা যে অনুচিত হয়েছে তা ধের বুঝতে পারছে মেয়েটা।
_______

সন্ধ্যার খানিক পর অফিসে প্রবেশ করল নাহিয়ান। সোজা ঢুকলো তানিমের কেবিনে। তানিম চেয়ারে বসে মোবাইলে কারো সঙ্গে কথা বলছে। চোখেমুখে কাঠিন্যতা। নাহিয়ানকে দেখতেই হাতের ইশারায় তাকে বসতে বললো। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর মোবাইলটা রাখলো টেবিলের উপর।

নাহিয়ান এগিয়ে দিলো একটা ফাইল। ফাইলটা নিজ হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখতে লাগলো তানিম। শুধালো,“একটা সাইন করাতে এতো দেরি হলো কেন?”

“কী করবো স্যার বলুন তো? গিয়ে দেখি উনি অফিসেই নেই। উনার পি.এ বললো, এসে পড়বে। এই এসে পড়বে বলতে বলতেই দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করালো। তারপর জানালো, উনার স্যার নাকি বিকেলের আগে আসবেন না। কী একটা কাজে আটকে গেছেন।”

“আমি তো উনার সঙ্গে আগেই কথা বলে রেখেছিলাম তারপরেও এমন করল? আর তুমিই বা চলে এলে না কেন?”

“এতদূর পর্যন্ত গেলাম, এতক্ষণ অপেক্ষা করলাম তাই ভাবলাম একেবারে সাইনটা করিয়েই নিয়ে যাই।”

ঠোঁটের কার্নিশে হাসি ফোটে উঠলো তানিমের। প্রশংসার সুরে বললো,“এই জন্যই তুমি আমার এতো প্রিয় নাহিয়ান। অনেক খেটেছো এবার বাড়ি যেতে পারো। আজ তোমার ছুটি।”

“ধন্যবাদ স্যার।”

স্লান হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে তানিমের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো নাহিয়ান। একটা প্রজেক্টের কাজ অনেকদিন ধরেই আটকে ছিলো উপর মহলের একটা সাইনের জন্য।যার দরুন অনেক কাগজপত্রও উপস্থাপন করেছিল তানিম। সেখান থেকেই আজ তাকে ডাকা হয়েছিল। যেহেতু কথাবার্তা আগেই সারা ছিলো তাই বাকি কাজটার দায়িত্ব দিয়ে নাহিয়ানকেই পাঠিয়ে দিয়েছিল তানিম।

অফিস শেষে নিজের টেবিলের সব গোছগাছ করে বের হলো অনুভা। অফিস থেকে কিছুটা পথ সামনে যেতেই দেখতে পেলো নাহিয়ানকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কলা খাচ্ছে সে। অনুভাকে দেখতেই এগিয়ে এলো। আরেকটা কলা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,“নাও কলা খাও।”

বাড়িয়ে দেওয়া কলাটা গ্ৰহণ করল না অনুভা। বিষ্মিত স্বরে প্রশ্ন করল,“আপনি তো অনেকক্ষণ আগেই অফিস থেকে বের হয়ে গিয়েছেন ভাইয়া। তাহলে এখনো বাড়ি ফিরেননি যে?”

আসল কথাটা চেপে গেলো নাহিয়ান। তার জন্যই যে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। সংক্ষিপ্তভাবে বললো,“এমনি। এখন তো বাসায় ফিরবে তাই না? চলো পৌঁছে দিয়ে আসি।”

প্রস্তাবটা নাকোচ করে দেওয়ার জন্য ঠোঁট দুটো প্রসারিত করতেই থেমে গেলো অনুভা। রাস্তার উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলো নাহিয়ান। আর অনুভা ছিলো তার বিপরীতে যার দরুন পুরো রাস্তাটা সহজেই তার দৃষ্টিগোচর হলো। পরিচিত একটা মুখ দেখতেই অদ্ভুত শিহরণে ছেয়ে গেলো হৃদয়খানা। তাকে থেমে যেতে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো নাহিয়ান। অনুভার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকালো। পরিচিত তেমন কিছুই তার চোখে পড়ল না তাই শুধালো,“কী দেখছো অনু?”

ধ্যান ভঙ্গ হলো অনুভার। ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। আজ এক সপ্তাহ পর আবার এই মানুষটির সঙ্গে দেখা হলো অনুভার। সেই যে সেদিন শুক্রবারে দেখা হলো তারপর আর ছেলেটি একবারের জন্যেও সামনে এলো না তার। তারপর কেটে গেলো এক সপ্তাহ। সামনে এসে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে প্রশ্ন করল শ্রাবণ,“এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো নোভা?”

নড়েচড়ে উঠলো অনুভা। নাহিয়ান ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করল,“আপনারা পরিচিত?”

“তার থেকেও বেশি।”—-কেমন এক রহস্যময়ী ভঙিতে কথাটা বলে উঠলো শ্রাবণ।

নাহিয়ানের চোখেমুখে ছেয়ে গেলো হাজারো প্রশ্ন। অনুভার দিকে দৃষ্টি ফেলে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু সেই সুযোগ আর তাকে দেওয়া হলো না। চট করে শীতল কণ্ঠে শ্রাবণ বলে উঠলো,“গাড়িতে গিয়ে বসো নোভা।”

এই কণ্ঠস্বরের বিপরীতে কড়া কিছু বলতে চেয়েও কেন যেনো কখনোই কিছু বলতে পারে না অনুভা। কোথাও একটা বাঁধা অনুভব করে। এই মুহূর্তে কী করা উচিত সে বুঝতে পারলো না।নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে কীভাবে না বলবে ভাবতে লাগলো। ভাবনার মধ্যেই ফের শোনা গেলো সেই কণ্ঠস্বর। কণ্ঠে মায়া ঢেলে বললো,“এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি কী আমাকে সারারাত এখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইছো নোভা? তাতে অবশ্য আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি পাশে থাকলে সারারাত কেন? সারাদিনও আমি নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো এখানে।”

হুট করে এমনভাবে কেন কথা বলছে ছেলেটা? মনে হাজারো প্রশ্ন রেখেই নাহিয়ানের থেকে বিদায় নিয়ে সামনে হাঁটা ধরলো অনুভা। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে অপরিচিত ছেলেটির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো নাহিয়ান,“কে হন আপনি ওর? কী সম্পর্ক আপনাদের মধ্যে?”

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। একটু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,“আপনি এতদিন ধরে যা হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন আমি ওর তা-ই হই।”

বিষ্ময়ে ছেয়ে গেলো নাহিয়ানের মুখশ্রী। কৌতূহলী কণ্ঠে বলে উঠলো,“মানে?”

চলবে _______

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৭]

শ্রাবণের হাস্যজ্জ্বল মুখখানা মুহূর্তেই হয়ে উঠলো গম্ভীর। একদৃষ্টিতে নাহিয়ানের পানে তাকিয়ে আছে সে। নাহিয়ানের দৃষ্টিও একইভাবে তার মুখশ্রীতে স্থির। উতলা হয়ে উঠেছে মন। পূর্বের কথাটার অর্থ বোঝার জন্য উদগ্ৰীব হয়ে আছে। নিরবতার অবসান ঘটিয়ে শ্রাবণ বলে উঠলো,“কেউ কী এমনি এমনি কাউকে সাহায্য করে মি.নাহিয়ান?”

হঠাৎ এই প্রশ্ন? মানেটা বুঝতে পারলো না নাহিয়ান। যা তার চোখেমুখে সুস্পষ্ট। শ্রাবণ তার মুখভঙ্গি দেখে তা সহজেই টের পেলো। পুনরায় বললো,“অনুভা আপনার উপর বরাবরই কৃতজ্ঞ। কারণ তার কঠিন দুর্দশার সময় এই চাকরির সন্ধানটা আপনিই তাকে দিয়েছিলেন। ও শুরু থেকেই আপনাকে বড়ো ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখে আসছে। সে অনুযায়ী আপনাকে সম্মানও করে। কিন্তু আপনি কী তাকে আদতে বোন হিসেবে ট্রিট করেন?”

ভড়কে গেলো নাহিয়ান। আমতা আমতা করে ফের বললো,“মানে?

“এত মানে মানে করছেন কেন? সত্যটা তো আপনিও জানেন আমিও জানি তাহলে এত নাটকীয়তার কী প্রয়োজন আছে মি.নাহিয়ান?”

সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে স্থির হয়ে দাঁড়ালো নাহিয়ান। ললাটে জমে থাকা ঘাম বাম হাত দিয়ে মুছে নিয়ে বললো,“সবটা জানেনই যখন তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেন? নাকি আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছেন? আপনি কে তা আমি জানি না। কীভাবে এসব জানলেন তাও জানি না তবে এটাই সত্যি যে আমি শুরু থেকেই অনুকে ভালোবাসি। অনু বুঝুক বা না বুঝুক তবুও আমি ওকে ভালোবাসি।”

মুখশ্রী কঠিন হয়ে উঠলো শ্রাবণের। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বললো,“আর বাসবেন না।”

চমকে গেলো নাহিয়ান। প্রশ্ন করল,“ভালোবাসবো না? এ আবার কেমন কথা?”

“কেমন কথা তা তো জানি না। তবে আজকের পর থেকে অনুভা নামক মেয়েটিকে আপনি আর ভালোবাসবেন না। পৃথিবীতে সবাইকে ভালোবাসার অধিকার থাকলেও অনুভাকে ভালোবাসার অধিকার আপনার নেই। অপাত্রে ভালোবাসা ঢালাটা যে সময় নষ্টের কাতারে পরে মি.নাহিয়ান। অনুভা নামক পথ আপনার জন্য নিষিদ্ধ, কাঁটার ন্যায় বিষাক্ত বিষ।”

“আমি না হয় কাঁটায় পা দিয়ে এই বিষটাই পান করতে চাই।”

কঠিন, গম্ভীর মুখখানায় হুট করেই সূর্যের ন্যায় ঝলকে উঠলো একফালি হাসি। যেই হাসিতে মিশে রয়েছে ভয়ানক কিছু। শ্রাবণ শীতল কণ্ঠে বললো,“তাহলে আপনার মৃ’ত্যু যে নিশ্চিত মি.নাহিয়ান। অনুভা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই আপনার মৃ’ত্যু সুনিশ্চিত।”–কথাটুকু বলেই নাহিয়ানকে রেখে গাড়ির কাছে চলে গেলো শ্রাবণ।

শ্রাবণের অপেক্ষায় এতক্ষণ ধরে গাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো অনুভা। শ্রাবণ গিয়ে গাড়ির দ্বার খুলে দিতেই ভেতরে গিয়ে বসলো সে। এরপর শ্রাবণ নিজেও ভেতরে ঢুকে সিট বেল্ট বেঁধে নিলো।

নাহিয়ান পথেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে ছেলেটার বলা কথাগুলো। তার চোখের সামনেই রাস্তার ধুলো উড়িয়ে চলে গেলো গাড়িটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলিয়ে গেলো অদৃষ্টে। নাহিয়ান হুট করেই অনুভব করল তার অনুভূতিতে মরীচিকা ধরে যাচ্ছে। এতদিনের ভালোবাসাটা হয়ে যাচ্ছে ফিকে। তাহলে সত্যিই কী সে অপাত্রে ভালোবাসা দান করল? লুকিয়ে লুকিয়ে একতরফা ভালোবেসে কী সত্যিই ভুল করল?

“মামা কই যাইবেন?”

হঠাৎ এমন ডাকে নড়েচড়ে উঠলো নাহিয়ান। দেখতে পেলো রাস্তার কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি রিক্সা। রিক্সাচালক উপর্যুক্ত প্রশ্নটি করে তার পানে চেয়ে আছে উত্তরের আশায়। নাহিয়ান উঠে বসলো তাতে। আনমনে বললো,“যেদিকে দুচোখ যায়।”

“এই রাইতের বেলা আমার লগে কী মজা করেন মামা?”

“মজা! এই মুহূর্তে আমার জীবনে এসব মজা টজা বলে কিছুই নেই। যতো চাইবে ভাড়া না হয় ততোই দিবো, এবার চলো।”

“যাইবেন কই? ঠিকানাডা তো কন।”

“বললাম না দুচোখ যেদিকে যায়।”

রিক্সা চালক আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। নিরবে চালাতে লাগলেন রিক্সা।

মনোযোগ সহকারে ড্রাইভ করছে শ্রাবণ। তার পাশে বসে হাঁসফাঁস করছে অনুভা। বলতে চাইছে কিছু কিন্তু কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। সামনের আয়না দিয়ে পুরোটাই খেয়াল করল শ্রাবণ।শুধালো,
“বলবে কিছু?”

“নাহিয়ান ভাইয়ার সামনে অমন করে কথা বলা তোমার উচিত হয়নি।”

“কেমন করে বলেছি? বকেছি তোমায়?”

“বকবে কেন? আসলে ওই যে অমন করে কথা বললে না? কে জানে উনি কী ভাবলেন আমাদের সম্পর্কে।”

“অন্যের ভাবনা দিয়েও তো দেখছি তোমার অনেক কিছু যায় আসে নোভা। শুধু আমার ভাবনা দিয়েই তোমার কিছু যায় আসে না।”—-কথায় তার তাচ্ছিল্য ভাব।

চট করেই বিষয়টা ধরে ফেললো অনুভা। মাঝে মাঝে এমন ত্যাড়া ধরণের কথা শুনলে খুব রাগ হয় তার। এবারও হলো। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এতদিন পর আমাদের আবার দেখা হচ্ছে কেন বলো তো? এটা কী সত্যিই কাকতালীয় ঘটনা? প্রথম সাক্ষাৎ এর মতোই কী কাকতালীয়?”

“যদি বলি ইচ্ছাকৃত?”—-শ্রাবণের সোজাসাপ্টা জবাব।

ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয় অনুভার। কণ্ঠে বিষ্ময় এনে শুধায়,“ইচ্ছাকৃত?”

চলন্ত গাড়িতে হঠাৎ করেই ব্রেক কষে শ্রাবণ। সিট বেল্ট খুলে অনুভার দিকে ঘুরে বসে। পাল্টা প্রশ্ন করে,
“আমাদের যে আবার দেখা হচ্ছে এতে কী তুমি খুশি নও?”

ভড়কে যায় অনুভা। হঠাৎ করে যে তাকে এমন একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তা কষ্মিনকালেও ভাবতে পারেনি সে। কী উত্তর দিবে এখন? প্রশ্নের উত্তরটা যে নিজের কাছেই তার অজানা। সত্যিই কী শ্রাবণ নামক অদ্ভুত পুরুষটির সঙ্গে পুনরায় দেখা হওয়ায় অখুশি সে? তার থেকে আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে চোয়াল শক্ত হলো শ্রাবণের। তিরিক্ষ মেজাজে বললো,
“খুশি নও তাই না? কেন খুশি নও? জীবনে কী বসন্ত এসেছে? কী হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন? এসেছে কী বসন্ত?”

একনাগাড়ে প্রশ্নগুলো করে থামলো শ্রাবণ। ঘাবড়ালো অনুভা। বুঝতে পারলো ছেলেটা রেগে গেছে। শুকনো ঢোক গিলে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে অস্পষ্ট আওয়াজে উত্তর দিলো,“নাহ।”

মুখের আদল বদলালো শ্রাবণের। ছোট্ট একটা শব্দে পুরো দেহ শীতলতায় ছেয়ে গেলো। কণ্ঠ হলো মোলায়েম। গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,“না আসাই ভালো। তোমার জীবনে বসন্ত আসা নিষিদ্ধ নোভা। তোমার জীবনে শুধু একটা ঋতুই আসবে আর তা হচ্ছে বর্ষাকাল। শ্রাবণের বর্ষাকাল। বর্ষার মেঘমালাকে তুমি দুচোখ ভরে দেখবে, ভালোবাসবে। বৃষ্টির জলে গা ভেজাবে। আর সেই বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় শ্রাবণ মিশে তোমাকে ছুঁয়ে দিবে। অনুভার জীবন হবে শুধুই শ্রাবণময়।”

নিষ্পল দৃষ্টিতে সামনে বসে থাকা সুদর্শন পুরুষটির পানে তাকিয়ে আছে অনুভা। অশান্ত মণি দ্বারা খুঁজে ফিরছে অপর চোখ থেকে কিছু। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে তাণ্ডব চালাচ্ছে বাক্যগুলো। শেষ বাক্যটি কণ্ঠনালীতে গিয়ে খুঁটি গেড়েছে,‘অনুভার জীবন হবে শুধুই শ্রাবণময়!’

ততক্ষণে পূর্বের ন্যায় আবারো গাড়ি চালানোতে মনোনিবেশ করেছে শ্রাবণ। অনুভা যে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো সে কিন্তু কিছুই বললো না। নিরবে দ্রুত গতিতে পাড়ি দিতে লাগলো পথ।

পূর্বের মতো সেই একই রাস্তায় গাড়ি থামালো শ্রাবণ। অনুভা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।বিদায় নেওয়ার কথা মনে রইলো না আজ। রোবটের ন্যায় হাঁটা ধরলো সামনের পথ ধরে।একসময় মিলিয়ে গেলো অন্ধকার গলির ভেতরে। তার চলে যাওয়া দেখেই মুচকি হাসলো শ্রাবণ। এবার নিজের বাড়ি ফেরার পালা।
_______

আজ বাড়ি ফিরেই সোজা নিজের ঘরে প্রবেশ করল অনুভা। পোশাক বদলে হাত-মুখ ধুয়ে ঘর থেকে বের হলো। উঁকি দিলো বোনের ঘরে। তাঈম ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। তার একপাশে একটা কোলবালিশ আর একটা পাশ বালিশ দিয়ে বাঁধ দেওয়া যাতে সে নিচে পড়ে না যায়। আরেক পাশে শোয়া অর্থিকা। ঘুমিয়ে আছে সে। শ্রাবণের কথায় তিনদিন আগেই তাকে ভালো একজন সাইক্রিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিল অনুভা। ঘণ্টা বেঁধে দুজন কী এমন কথা যে বলেছিল কে জানে? তারপর থেকেই হুট করে বদলে গেলো মেয়েটা। ছেলের প্রতি আগের থেকেও অনেক যত্নশীল হয়ে উঠলো। দুদিন ধরে তার কাছেই তো ঘুমায় তাঈম।

রাতের খাবার খেয়ে ড্রয়িং রুমের আলো নিভিয়ে ঘরে এসে দরজা লাগালো অনুভা। ঘরটায় ছোট্ট একটা ব্যালকনি আছে। আকারে সরু। ছোটো একটা টুল রেখে নির্দ্বিধায় বসা যায় সেখানে। ফ্ল্যাটের ঘরগুলোও অতো বড়ো নয়। ছোটোই বলা চলে। এত সস্তায় ভালো কিছু আশা করাটাও বোকামি। অনুভার খেয়াল হলো এই ঘরে আজ পাঁচ মাস ধরে থাকছে সে অথচ এই বারান্দাটায় দুদণ্ড এসে বসেছে বলে মনে হয় না তার। একটা টুল পেতে আজ এখানে বসলো অনুভা। বাহিরে জ্যোৎস্না রাত কিন্তু চাঁদটা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। সম্মুখেই বিশাল একটা বিল্ডিং। এই বিল্ডিং এর কারণে আকাশটাই পরিপূর্ণ দেখা যাচ্ছে না সেখানে চাঁদ তো দূরহ ব্যাপার।

তবুও বসে রইলো অনুভা।যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই আপনমনে দেখতে লাগলো। মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে রইলো তারকামণ্ডলীর পানে। অতীত ঘেঁটে করতে লাগলো স্মৃতিচারণ।

অনুভার ছোটোবেলাটা কেটেছে মূলত ভ্রমণের মতো। বাবা পুলিশ অফিসার থাকার দরুন প্রতি বছরই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদলি হতে হতো উনাকে। অর্থিকা আর অনুভাকেও বদলাতে হতো স্কুল। প্রথম প্রথম বন্ধুদের ছেড়ে আসতে কষ্ট হলেও একসময় এতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে অনুভা। দুই বোনের বয়সের পার্থক্য কেবল পাঁচ বছরের। বড়ো বোনই তখন হয়ে ওঠে অনুভার প্রিয় বান্ধবী। স্কুল থেকে ফিরে সারাদিনের জমে থাকা গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসতো অর্থিকার কাছে। অর্থিকাও মনোযোগ সহকারে শুনতো ছোটো বোনের কথা। সব গুরুত্বপূর্ণ কথাই দুই বোনের মধ্যে থাকতো সিক্রেটের মতো। ঝগড়া হলেও কখনো এ নিয়ে কেউ কারো নামে অভিযোগ জানাতো না মায়ের কাছে।

অর্থিকা তখন দ্বাদশে পড়ে আর অনুভা সবে সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছে। কামরুল হাসান সিলেটের একটা থানায় বছর দুয়েক পোস্টিং ছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে উনার আবার বদলি হয়ে যায় টাঙ্গাইলে। এদিকে অর্থিকার সামনে এইচএসসি পরীক্ষা।ওকে সঙ্গে করে নতুন জায়গায় পাড়ি দেওয়া যেমন সম্ভব নয় তেমনি একা রেখে যাওয়াটাও সম্ভব নয়। কী করবেন না করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না কামরুল হাসান। সবাইকে যে এখানে রেখে যাবেন তাতেও তো সমস্যা। সামনের বছর আবার অনুভার জেএসসি। এখানকার স্কুলেই আবারো ভর্তি করালে পরের বছরটাও পুরো পরিবারকে এখানেই থেকে যেতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে শেষে সিদ্ধান্ত হলো অর্থিকার পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত সুফিয়াই মেয়েকে নিয়ে থাকবেন এখানে। অনুভাকে নিয়ে কামরুল হাসান চলে যাবেন টাঙ্গাইল। ওখানকার একটা স্কুলেই ভর্তি করানো হবে তাকে।

তারপর আট আটটা মাস একে অপরকে ছেড়ে আলাদা থাকতে হয়েছে দুই বোনকে। রোজ ফোনে কথা হলেও অনুভার সে কি কান্না! বোনকে ছাড়া তার যেনো চলছেই না। অভিমানে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দেয়, সেবার বাঁধিয়ে ফেলে অসুখও। গা পুড়িয়ে তার জ্বর আসে। কামরুল হাসানের প্রাণ হচ্ছেন দুই মেয়ে। সবার ঊর্ধ্বে উনার কাছে উনার মেয়েরা তারপর বাকি সবকিছু। থানা বাদ দিয়ে মেয়ের শিয়রে বসে সারারাত মাথায় পানি ঢালেন। সকাল হতেই ছুটেন হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে। টানা এক সপ্তাহ জ্বরে ভোগে সেবারের মতো সুস্থ হয়ে ওঠে মেয়েটা। প্রাণ ফিরে পান কামরুল হাসান। ওই আটটা মাস অনুভার কাছে মনে হয়েছিল যেনো আট যুগ। অর্থিকার পরীক্ষা শেষ হতেই কামরুল হাসান আবারো যান সিলেটে। সবকিছু গোছগাছ করে বউ মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন নতুন বসত বাড়িতে।

দুই বোন আবার একত্র হয়। তারপরের দিনগুলো মোটামুটি ভালোই চলছিল তাদের। মাস পাঁচেক পর ঢাকার একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যায় অর্থিকা। ভার্সিটি টু টাঙ্গাইল যাতায়াত অসম্ভব হয়ে ওঠে তার জন্য। তারপর ওখানকারই একটা ‘হলে’ গিয়ে ওঠে সে। তখন অবশ্য কান্নাকাটি করে নিজের বেহাল দশা বানায়নি অনুভা। তার বোঝ হয়েছে, লেখাপড়া করে বড়ো কিছু হওয়ার জন্য যে বোনের যাওয়াটা প্রয়োজন তা বাবা খুব ভালো করেই বুঝিয়েছে তাকে। সাড়ে তিন বছর টাঙ্গাইল কাটিয়ে আবারো পোস্টিং হয় কামরুল হাসানের। তবে সেবার পোস্টিং তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই নিয়েছিলেন। পোস্টিং হয়ে চলে আসেন মিরপুরের একটি থানায়। থানার কাছাকাছিই কিনে নেন বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাট। ওখানকারই একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় অনুভাকে।অর্থিকাও তখন ‘হল’ ছেড়ে চলে আসে বাড়িতে। নিজের পরিবারের কাছে। তারপর বাড়ি থেকেই শুরু করে ভার্সিটিতে যাতায়াত।

আগের থেকে দুই বোনের সম্পর্কটার উন্নতি হয় অনেক। দেখতে দেখতে একটা একটা করে বছর কাটে। অনুভার এইচএসসি শেষ হয়।

অনার্স শেষ করে অর্থিকা ভর্তি হয় মাস্টার্সে। অনুভা এইচএসসি দিয়ে এডমিশনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ভর্তি হয় ফার্মগেটের ভালো একটা কোচিং সেন্টারের মেইন শাখায়।

অনুভার ক্লাস ছিলো একদিন পরপর। সবসময় বাস ধরেই মিরপুর টু ফার্মগেট যাওয়া আসা করতে হতো তাকে। প্রথম প্রথম অর্থিকা ছোটো বোনকে দিয়ে আসা নিয়ে আসা করলেও তারপরে রাস্তা চেনা হতেই অনুভা একা একাই যাতায়াত শুরু করে। কিন্তু হুট করেই একদিন মাঝ রাস্তায় বাসের মধ্যে ঘটে চরম বিপত্তি। যাকে বিপত্তি বললেও ভুল হবে। এককথায় হয়রানি।

ফার্মগেটের কাছাকাছি আসতেই হেল্পার ভাড়া উঠাতে শুরু করে যাত্রীদের নিকট হতে। অনুভা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বাড়িয়ে দিতেই বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নেয় হেল্পার লোকটা। কণ্ঠে বিরক্তি মিশিয়ে বলে,“এই রাস্তায় কী নতুন নাকি আপা?”

এহেন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় অনুভা। শুধায়,
“নাহ। কেন বলুন তো?”

“আপনে মিরপুর তে বাসে উঠছেন না? তাইলে হাফ ভাড়া দিলেন ক্যান?”

“স্টুডেন্টদের জন্য তো হাফ ভাড়াই নির্ধারিত। আমি তো একদিন পরপরই যাতায়াত করি তখন তো হাফ ভাড়াই দেই।”

“আপনে স্টুডেন্ট?”

“হুম। এই যে কলেজ ব্যাগ।”—কোলের উপর থাকা ব্যাগটা দেখিয়ে বললো অনুভা।

হেল্পার ছেলেটা দেখেও না দেখার ভান ধরে বললেন,
“এইসব ব্যাগ ট্যাগ দিয়া হইবো না। প্রমাণ দেন।”

ব্যাগ থেকে আইডি কার্ডটা বের করে ছেলেটার সামনে তুলে ধরলো অনুভা। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা সুর বদলে টাকাটা অনুভার কোলের উপর ফেলে দিলো। অন্য যাত্রী থেকে ভাড়া উঠাতে উঠাতে বললো,“ওই সব হাফ ভাড়া টাড়া এহন আর নাই আপা। পুরা ভাড়াই দিতে হইবো।”

“পরশুও তো বাস দিয়েই গেলাম। কই তখন তো শুনলাম না হাফ ভাড়া বন্ধ হয়ে গেছে?”

লোকটি এবার কর্কশ কণ্ঠে বললো,“দেখেন আপা হুদাই তর্ক করবেন না। টাকা পয়সা না থাকলে গাড়িতে উঠেন ক্যান?”

লোকটার কথায় বেশ অপমানিতবোধ করল অনুভা। বাস ভর্তি মানুষের সামনে এমন একটি কথা যেনো কিছুতেই নিতে পারলো না।চুপচাপ ব্যাগ থেকে বাকি টাকাটা বের করে পূর্বের টাকার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে দিলো ভাড়া। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেলো অন্য আরেকজন ছেলের থেকে হাফ ভাড়াই গ্ৰহণ করল হেল্পার লোকটি। দৃশ্যটি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চট করে মেজাজ গরম হয়ে গেলো অনুভার।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৪+৫

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৪]

সকাল সাড়ে নয়টা। নিজের চেয়ারে বসে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ফাইল চেক করছে অনুভা। তখনি অফিসে এসে পৌঁছালো তানিম। সকলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম জানালো। সালামের উত্তর নিয়ে নিজ কেবিনে গিয়ে প্রবেশ করল তানিম। আধ ঘণ্টা পার হতেই ভেতরে ডাক পড়ল অনুভার। টেবিল থেকে ফাইলগুলো নিয়ে তানিমের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো অনুভা। অনুমতি চাইলো,“আসবো স্যার?”

“আসুন।”

বড়ো বড়ো কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে ভেতরে ঢুকলো অনুভা। টেবিলের উপর তানিমের সম্মুখে রাখলো ফাইলগুলো। বললো,“ফাইলগুলো চেক করা শেষ স্যার। যা যা সমস্যা ছিলো সমাধান করে দিয়েছি।”

“ইম্প্রোভ হচ্ছে তবে? বেশ ভালো।”

“ডেকেছিলেন কেন স্যার?”

“ফাইলের জন্যই ডেকেছি। এবার আপনি যেতে পারেন।”

বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উল্টো ঘুরে দুয়েক কদম এগোতেই পেছন থেকে তানিম বেশ গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে ওঠে,“মিস.অনুভা।”

পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ায় অনুভা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। প্রত্যুত্তর করে,“জ্বি স্যার?”

“বাড়ি থেকে অফিসে যাতায়াতে কী আপনার খুব বেশি অসুবিধে হয়?”

“না তো স্যার। অফিস থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব তেমন বেশি নয়। অসুবিধে হবে কেন?”

ললাটে ভাঁজ পড়ে তানিমের। ভ্রু উঁচিয়ে ফের শুধায়,
“তাহলে নাহিয়ানের সঙ্গে কী আপনার অন্য কোনো সম্পর্ক আছে?”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই চোখেমুখে বিষ্ময় ছাপিয়ে ওঠে অনুভার। এ আবার কেমন প্রশ্ন? তার জানামতে অফিসে এসে নাহিয়ানের সঙ্গে এমন কোনো আচরণ সে করেনি যার কারণে স্যারের এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। উত্তরের আশায় ওৎঁ পেতে বসে আছে তানিম। বোঝার চেষ্টা করছে অনুভার ভাবভঙ্গি। হ্যাঁ শুনলেই যেনো শুরু করে দিবে ধ্বংসলীলা। কিছুটা সময় নিয়ে অনুভা পাল্টা প্রশ্ন করল,“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”

“আজকাল নাহিয়ান আপনাকে বাড়ি থেকে অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে আবার ফেরার সময়ও দেখি আপনার জন্য অপেক্ষা করে তাই আরকি জানতে চাইলাম। এ নিয়ে তো অফিসে একেকজনের একেক মত। কানে এলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। যতই হোক আমার অফিসের একজন কর্মচারী আপনি।”

চাপা ক্রোধে ফেটে পড়ল অনুভা। কঠিন স্বরে উত্তর দিলো,“উনি আমার পরিচিত স্যার। সেদিন পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল বিদায় আসার পথে আমাকেও উনি সঙ্গে করে অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন, ব্যস এতটুকুই।”

“সত্যি এতটুকুই? শুধুই কী পরিচিত?”

এই বস নামক লোকটিকে এমনিতেই অনুভার নিকট অসহ্য লাগে। অকারণেই সকলের সামনে অন্যকে ছোটো করে কথা বলতে, খারাপ আচরণ করতেও দুবার ভাবে না তানিম নামক পুরুষটি। তার উপর এখনকার ব্যবহার যেনো খুবই বিরক্তিকর লাগছে অনুভার। ইচ্ছে করছে মুখের উপরই কড়া করে বলে দিতে,“যার সঙ্গে ইচ্ছে তার সঙ্গেই আমি অফিসে আসবো। সে আমার যা ইচ্ছে লাগুক তাতে তোর কী?” নির্ঘাত চাকরি যাবে তাই মুখ ফোটে বলতে পারলো না কথাটা। মনের কথা মনের ভেতরে রেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“নাহিয়ান ভাই আমার বড়ো ভাইয়ের মতো। এই চাকরিটার সন্ধানও উনিই আমায় দিয়েছিলেন। তাই উনার সঙ্গে কথা বলা, আসা-যাওয়াটা স্বাভাবিক স্যার।”

তানিমের মুখভঙ্গি এবং কণ্ঠস্বর এবার যেনো বদলালো। কণ্ঠে নম্রতা এঁটে বললো “ওহ। আচ্ছা এবার তাহলে আপনি যান। আর হ্যাঁ আপনি চাইলে কিন্তু অফিসের গাড়ি ব্যবহার করতেই পারেন। ড্রাইভারকে না হয় আমি বলে দিবো আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কথা।”

“তার প্রয়োজন নেই স্যার। বলার জন্য ধন্যবাদ।”

আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে নিজ ডেস্কে চলে গেলো অনুভা। সে যেতেই তানিম মুচকি হাসলো। দৃষ্টি স্থির করল সামনে থাকা ল্যাপটপে।

বড়ো একটা ক্লাসরুমে বসে আছে নবীন শিক্ষার্থীরা। কারোর জন্য অপেক্ষা করছে তারা। আজ তাদের ভার্সিটি লাইফের দ্বিতীয় দিন। তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল কালো স্যুট বুট পরিহিত সুদর্শন একজন পুরুষ। টেবিলের উপর হাতের বইটা রেখে উচ্চ স্বরে বললো,“গুড মনিং স্টুডেন্ট।”

বিপরীতে সকলেই সম্মলিত কণ্ঠে বলে উঠলো,“গুড মর্নিং।”

শিক্ষার্থীদের উৎসুক ভাব দেখে ঠোঁটের কার্নিশে হাসি ফোটে উঠলো সম্মুখে দাঁড়ানো পুরুষটির। নিজের পরিচয় দেওয়ার উদ্দেশ্যে অধর নাড়িয়ে বিনয়ী কণ্ঠে বললো,“আমি শেখ মাহাথির শ্রাবণ। আজ থেকে আপনাদের কেমিস্ট্রি লেকচারার।”

আবারো শিক্ষাথীদের মধ্য থেকে হৈ হৈ শব্দ ভেসে এলো। পরিচয় পর্ব শেষ করে ক্লাস নেওয়া শুরু করল শ্রাবণ। কয়েক মিনিটেই ক্লাসরুম ভর্তি নব্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিলো। সহজ টপিক দিয়ে শুরু করল আজকের লেকচার।

কয়েক বেঞ্চ পেছনে বসা তিনজন তরুণীর দল। ক্লাসে তাদের নেই কোনো মনোযোগ। তিনজনের মধ্যেই চলছে ফিসফিসানি। দৃষ্টি স্থির সামনে দাঁড়িয়ে লেকচার দেওয়া শ্রাবণের পানে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তারা ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করছে। চোখেমুখে কাজ করছে আকর্ষণীয়তা। যা দৃষ্টি এড়ায়নি শ্রাবণের। আড়চোখে তাদের পানে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,“এটা প্রাইমারি স্কুল নয় যে ক্লাসের মধ্যেই নিজেদের ইচ্ছামতো কথা বলবেন আপনারা। আর না আপনারা অবুঝ শিশু যে দিক বেদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজেদের মতো চলবেন। আমার ক্লাসে পড়া বিষয়ক কথা ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ আমি এলাউ করবো না। তাই সবাই সাইলেন্ট।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই পুরো ক্লাসরুমে নিস্তব্ধতা ভর করল। মেয়ে তিনজন একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে নত করে নিলো মাথা। ক্লাস শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো শ্রাবণ। নিজের টিচার্স রুমের কাছাকাছি এসে পৌঁছাতেই পেছন থেকে এলো এক মেয়েলী কণ্ঠস্বরের ডাক,“স্যার! মাহাথির স্যার?”

পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে গেলো শ্রাবণ। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে পেছন ফিরে তাকালো।দেখতে পেলো ক্লাসের সেই তিনজন মেয়েকে। তাদের মধ্য থেকে এগিয়ে এলো একজন। চোখেমুখে তার আনন্দ চিকচিক করছে। এগিয়ে এসে আন্তরিকতা নিয়ে বললো,“স্যরি স্যার।”

“কেন?”

“তখন ক্লাসে বিরক্ত করার জন্য। আমি বুঝেছি আপনি যে আমাদের মিন করেই কথাটা বলেছেন।”

মেয়েটির কথায় বাম ভ্রু টা আরেকটু উঁচু হলো শ্রাবণের। মেয়েটি যে চতুর এবং তার সাথে অতি আন্তরিক তা বেশ বুঝতে পারলো সে। শান্ত কণ্ঠে বললো,“ইটস্ ওকে। পরবর্তীতে এমনটা যেনো আর না হয়।”

“জ্বি স্যার আর হবে না।”এতটুকু বলেই মেয়েটির অধরে হাসি ফোটে উঠলো। উৎসাহিত কণ্ঠে পুনরায় বললো,
“আমার নাম সামিরা। আমার ভাইয়া গত বছরই এই ইউনিভার্সিটি থেকে গ্ৰাজুয়েশন কমপ্লিট করে বের হয়েছে। ভাইয়ার মুখে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি স্যার। তাই আপনি যখন ক্লাসে ঢুকে নিজের পরিচয় দিলেন তখনি চমকে গেছিলাম তাই আরকি তখন।”

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। বললো,“বুঝেছি ব্যাপারটা। তা নাম কী আপনার ভাইয়ের?”

“সিয়াম।”

“ওহ, আচ্ছা এখন তবে ক্লাসে যান।”

মাথা নাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করল সামিরা। সিয়াম নামটা মোটেও চেনাচেনা ঠেকলো না শ্রাবণের নিকট। না চেনাটাই স্বাভাবিক। সেও এখানে জয়েন করেছে গত বছর। তার উপর একেকটা ইয়ারে এত এত শিক্ষার্থী। সবার মধ্য থেকে একজনকে মনে রাখা খুবই দুষ্কর ব্যাপার। সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে টিচার্স রুমে ঢুকে পড়ল সে।

মিলি এবং তোহা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সামিরা আসতেই দুজনে তাকে চেপে ধরলো। আগ্ৰহ নিয়ে শুধালো,“কী কথা বললি স্যারের সঙ্গে?”

“স্যরি বলেছি।”

“আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতি। আমরাও স্যরি বলতাম।”—-মুখ গোমড়া করে কথাটা বলে উঠলো তোহা।

বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নিলো সামিরা। বিপরীতে প্রশ্ন করল,“তোদের আবার স্যরি বলতে হবে কেন?”

মিলির চোখেমুখে ফোটে উঠলো লাজুকতা। ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,“স্যার কিন্তু হ্যান্ডসাম আছে দোস্ত। কত স্বপ্ন দেখেছি প্রেম করলে জীবনে একটা হ্যান্ডসাম স্যারের সঙ্গেই করবো। কিন্তু কী এক কপাল? স্কুলে পড়াকালীন সব কয়টা স্যার ছিলো বয়স্ক। কলেজে অবশ্য দুজন কম বয়স্ক স্যার ছিলো তবে দুজনই বিয়াইত্তা। আর হোম টিউটরের কথাই বা কী বলবো? আমায় এত্তগুলা পড়া দিয়ে সে সময়টায় ব্যাটা নিজের গফের সঙ্গে মোবাইলে লুতুপুতু করতো।”

মিলির কথায় সামিরা, তোহা দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ হাসার পর চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো সামিরার। শাসানোর সুরে বললো,“সে যাই হোক।মাহাথির স্যারের দিকে অন্তত আজেবাজে নজরে একদম তাকাবি না।”

“কেন কেন?”

“কারণ এদিকে যে অনেক আগেই আমার নজর পড়ে গেছে। ভাইয়ার মোবাইলে প্রথম উনার ছবি দেখেছিলাম আর তারপর ভাইয়ার থেকে উনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেই আমি উনার প্রেমে ভীষণ রকমের হাবুডুবু খাচ্ছি। এখানে এডমিশন নেওয়ার কারণও মূলত উনিই। আশা করি বুঝতে পারছিস সবটা?”

দুজনেই মাথা নাড়ালো অর্থাৎ তারা বুঝতে পেরেছে।
_______

লাঞ্চ টাইম হতেই ক্যান্টিনে এসে একটা টেবিলে বসেছে অনুভা। তখনি তার সামনের চেয়ারটা দখল করে নিলো নাহিয়ান। স্বভাবসুলভ ভাবে তার ঠোঁটের কার্নিশে বিস্তর হাসি। উৎসুক কণ্ঠে অনুভার নিকট প্রস্তাব রাখলো,
“চলো অনু, আজ একসঙ্গে লাঞ্চ করি।”

অনুভার চোখেমুখে সন্দেহ। জিজ্ঞেস করল,“রোজ তো স্যারের সঙ্গেই করেন তাহলে আজ এখানে? স্যার কোথায়?”

“স্যার নাকি এখন খাবেন না।দুদিন পর একটা মিটিং আছে না? সেটা নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করছেন।”

“ওহ।”

ক্যান্টিনের ছেলেটা ততক্ষণে খাবার নিয়ে হাজির হলো। অনুভার ভেতরে ইতস্ততবোধ কাজ করছে। কিছু বলার জন্য হাঁসফাঁস করছে মন। নিজের মনে কথাগুলো গুছিয়ে এবার বলেই বসলো,“একটা কথা ছিলো ভাইয়া।”

খেতে খেতেই নাহিয়ান প্রত্যুত্তর করল,“কী?”

“মানুষের ভাবনা না আজকাল খুব বাজে হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে কথা বলতে দেখলেই তাদের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক বানিয়ে দেয়। অথচ তাদের মধ্যে আসলে সম্পর্কটা যে কী সেটাই জানতে চায় না।”

“তা অবশ্য ঠিক বলেছো।”

“পরিবারের দুর্যোগে যখন আমার দিশেহারা অবস্থা। হন্যে হয়ে একটা ভালো চাকরি খুঁজতে ব্যস্ত আমি তখন আপনিই আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমার অবস্থা সম্পর্কে জেনে পাইয়ে দিয়েছিলেন এই চাকরিটা। সেকথা কী করে ভুলি বলুন তো? তখন থেকেই আপনাকে আমি নিজের বড়ো ভাইয়ের আসনে বসিয়েছি।আমার কোনো ভাই থাকলে হয়তো আজ সেও আপনার মতোই আমার এই উপকারটা করতো। কিন্তু অফিসের লোকজন যেনো তা মানতে নারাজ।ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে একটু কথা বললেই তাদের মধ্যে নোংরা সম্পর্ক বানিয়ে দিতে দুবার ভাবে না এরা।”

খাওয়া থেমে গেলো নাহিয়ানের। শুধালো,“হঠাৎ এসব কথা? কেউ কী কিছু বলেছে তোমায়? কে বলেছে? কী বলেছে? নাম বলো তার।”

অনুভা মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো,“স্যার বলেছেন।”

চমকালো নাহিয়ান। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে শুধালো, “স্যার!”

“আপনি আসার পথে দুদিন ধরে আমায় অফিসে নিয়ে এসেছেন সে কারণেই উনার সন্দেহ হয়েছে।”

“সন্দেহের কী আছে? অফিসে অন্য সবার সঙ্গে যেমন আচরণ করি তোমার সঙ্গেও তো ঠিক তেমন আচরণই করি। বাহিরের খবর উনিই বা জানলেন কী করে?”

“বললেন তো অফিসের ইমপ্লয়ীদের নাকি এ ব্যাপারে বলতে শুনেছেন।”

এবার ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক নিলো নাহিয়ান। দুষ্টু হেসে বললো,“ওদের ধারণাটা সত্যি করে দিলে কিন্তু মন্দ হয় না অনু।”

“মানে?”

“হেল্প করেছি বলেই যে আমাকে ভাই ভাবতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ওই যে সিনেমায় দেখো না, নায়ক এসে নায়িকাকে হেল্প করে তারপর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়‌। কিন্তু আমার তো প্রেমের সেই বয়সটা আর নেই। তাছাড়া তুমিও তো প্রেমট্রেম করবে না তাই চলো দুজনে একেবারে বিয়ে করে ফেলি।”

ভড়কে গেলো অনুভা। চোখেমুখে হানা দিলো স্পষ্ট ভয়। ঘাবড়ানোর সুরে জিজ্ঞেস করল,“এসব কী বলছেন ভাইয়া?”

অনুভার মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো নাহিয়ান। পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তুলতে বললো,“সিরিয়াস হয়ো না অনু। সবাই কীসব ভাবছে সেসব ভেবেই আমি তোমার সঙ্গে মজা করেছি।”

“ওহ।”

তৎক্ষণাৎ কথাটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে নিলো অনুভা। কোনোমতে খেয়ে স্থান ত্যাগ করল। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে মলিন হাসলো নাহিয়ান। কথাটা কী আদৌ সে মজার ছলে বলেছে? না তো। এই মেয়েটাকে যে শুরু থেকেই খুব পছন্দ করে সে।

অনুভারা প্রথমে যেই বাসায় ভাড়া থাকতো সেই একই বাসাতেই পাশাপাশি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতো নাহিয়ান আর তার পরিবার। তার মা ছিলো খুব মিশুক একজন মানুষ। সুফিয়ার সঙ্গেও অল্প সময়ের মধ্যেই করে নিয়েছিল ভাব। যার কারণে একজন আরেকজনের ফ্ল্যাটে আসা যাওয়া লেগেই থাকতো প্রায়সই। সেখান থেকেই নাহিয়ানের সঙ্গে অনুভার পরিচয়।

নাহিয়ান সবসময় কথা বলতে চাইলেও অনুভা ভদ্রতা সূচক দুয়েকটা কথা বলে এড়িয়ে চলতো তাকে। গল্পের ছলেই সুফিয়ার থেকে তাদের পরিবারের বর্তমান দুরাবস্থার কথা হয়তো জানতে পারেন নাহিয়ানের মা কুলসুম বেগম।

একটা দুর্ঘটনায় অর্ধেকটা শরীর প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় পড়ে যান কামরুল হাসান। তার মধ্যেই হঠাৎ করে বাঁধিয়ে ফেলেন ক্যান্সারের মতো একটি মারাত্মক ব্যাধি। অনুভাদের পরিবার যেনো পড়ে যায় এক অথৈ সাগরে। তাদের সঙ্গে এমন কেন ঘটলো তা নাহিয়ানের অজানা। মায়ের নিকট থেকে যতটা শুনেছে ততটুকুতে বুঝতে পেরেছে পরিবারটা ভালো নেই। শ্বশুরের এমন অবস্থায় শ্বশুরবাড়ির সকল দায়িত্ব তন্ময় নিতে চাইলেও কামরুল হাসান মেয়ে জামাইয়ের সাহায্য নিতে নারাজ ছিলেন। অনুভাও ছিলো বাবার সঙ্গে একমত।তখন বাবা-মায়ের দায়িত্ব এসে পড়ে তার উপর। তারপর শুরু হলো অনুভার চাকরি খোঁজাখুঁজি কিন্তু ভালো কোনো চাকরিই যেনো খুঁজে পাচ্ছিল না সে। ততদিনে অনার্সটাও কমপ্লিট হয়নি তার। অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলো। একসময় তন্ময় নিজেই পরিচিত একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা এনজিওতে চাকরি পাইয়ে দেয় শালীকাকে। যা বেতন পেতো তা দিয়েই কোনোমতে বাবার চিকিৎসাসহ, সংসারের সকল দায়িত্ব এবং নিজের লেখাপড়াটাও চালিয়ে নিতে লাগলো অনুভা। তার মাস আটেক পরেই তো তন্ময়ের সঙ্গে ঘটে সেই নির্মম দুর্ঘটনা। তখন সবে ফাইনাল পরীক্ষাটা দিয়েছে অনুভা। দুলাভাইয়ের মৃ’ত্যুর পর বোন আর বোনের সন্তানের দায়িত্বও এসে পড়ে মেয়েটার উপর।

কী করবে দিক বেদিক ভুলে বসে অনুভা।এক কথায় হয়ে ওঠে দিশেহারা। এনজিও থেকে যা বেতন পায় তা দিয়ে এতগুলো মানুষের ভরণ পোষণসহ বাদ বাকি খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে যেনো তখনি মাটি চাপা দিয়ে দিতে হয় মেয়েটার। পরিবারের একমাত্র ঢাল, ভরসা যে সে-ই। একটু একটু করে বিসিএসের জন্য যা প্রস্তুতি নিয়েছিল তাও ভুলে বসেছিল ততদিনে। এতো এতো জোট ঝামেলায় কী আদৌ সবদিক রক্ষা করা সম্ভব?

সুফিয়ার অবস্থাও তখন খারাপ হয়ে যায়। একদিকে বিধবা মেয়ে আর নাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা তার সঙ্গে অসুস্থ স্বামী তো আছেই। আরেকদিকে ছোটো মেয়ের জন্য চিন্তা। কী করে সবদিক সামাল দিবে মেয়েটা? চিন্তায় চিন্তায় শরীরে বাঁধিয়ে ফেলেন বিভিন্ন ব্যাধি। কুলসুম বেগম তখন বেশিরভাগ সময় পরে থাকতেন সুফিয়ার কাছে। বিভিন্ন ভাবে ভরসা দিতেন উনাকে। বোঝাতেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

প্রায়সই স্বামী এবং ছেলের সামনে এসব বিষয় নিয়ে আফসোসও করতেন কুলসুম। সেখান থেকেই অনুভাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয় নাহিয়ান। মেয়েটাকে তার শুরু থেকেই ভালো লাগতো। যেনোতেনো নয় বরং মারাত্মক ভালো লাগতো। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করেই সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো তাকে এক পলক দেখার জন্য। যখন তার এই দুরাবস্থার কথা জানতে পারে তখনই বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। অফিসে তখন নতুন কর্মচারীর খোঁজে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই অনুভাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য অফিসে নিয়ে আসে নাহিয়ান। যদিও নিজ যোগ্যতার মাধ্যমেই চাকরিটা পেয়েছিল অনুভা।
________

বিকেলের দিকে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরলো শ্রাবণ। নিজ কক্ষে প্রবেশ করতেই খানিক অবাক হলো। সৌহার্দ্য বসে আছে তার বিছানায়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণ ধরে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল সে। কয়েক সেকেন্ড ছোটো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আলমারির কাছে চলে গেলো শ্রাবণ। নিজের পোশাক বের করে তারপর প্রবেশ করল বাথরুমে। বেশ সময় নিয়ে পোশাক বদলে বেরিয়ে আসতেই পুনরায় মুখোমুখি হলো ভাইয়ের। সৌহার্দ্য কটাক্ষ করে বড়ো ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“তোমার পোশাক বদলাতে মেয়েদের মতো এত সময় লাগে কেন?”

“কী বলতে এসেছিস সেটা বল।”

“আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তুমি কী এটা ঠিক করলে ভাইয়া? তুমি জানতে না প্রান্তির কথা? তাহলে বাবা- মায়ের সামনে কাল কেন এসব বললে?”

“তুই কেন তাদের কানে আমার বিয়ের কথা ঢুকিয়েছিলি?”

থতমত খেয়ে গেলো সৌহার্দ্য। আমতা আমতা করে বললো,“তোমার বিয়ে না হলে তো আমার বিয়ের কথা কেউ ভাববেই না। আর কতকাল বউ ছাড়া এভাবে এতিম হয়ে বসে থাকবো বলো তো?”

“বড়ো ভাইয়ের সামনে এসব বলতে লজ্জা করে না?”

“নাহ করে না।”

“তোর উচিত ছিলো সমস্যাটা আমায় এসে জানানো। তাহলে আমি সমাধান করে দিতাম কিন্তু তুই বাবা- মায়ের কান ভাঙিয়েছিস। এবার নিজেরটা নিজে গিয়ে বুঝে নে। বাবা-মায়ের সামনে ভালো সাজা! আরো ভালো সেজে এবার বিয়েটাও করে নে।”

“সে যাই হোক। মা সকাল থেকে আমার পেছনে পড়ে আছে। বারবার বলছে, চল তোর রুবি খালার বাড়িতে। একবার মেয়েটাকে তো দেখ।”

“তো দেখে আয়।”

“কেন দেখবো? আমি কি বেঈমান নাকি? তাছাড়া প্রান্তি জানলে আমার নামে মামলা করে দিবে।”

সন্দেহ নিয়ে ভাইয়ের মুখশ্রীর পানে তাকালো শ্রাবণ। শুধালো,“মামলা করবে কেন? ওর সঙ্গে আজেবাজে কিছু করেছিস নাকি?”

“ছোটো ভাইকে এসব জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করে না তোমার?”

“ওহ, তার মানে কিছু করেছিস? দাঁড়া মাকে গিয়ে এখনি বলছি।”

আঁতকে উঠলো সৌহার্দ্য। বাঁধা দিয়ে বললো,“আরে কিচ্ছু করিনি। আমার কী মাথা নষ্ট নাকি?”

“তাহলে ঠিক আছে। এবার ঘর থেকে বের হ। আমি বিশ্রাম নিবো। সন্ধ্যায় বের হতে হবে।”

“কোথায় যাবে?”

“তোকে বলবো কেন?”

“সে না বলো কিন্তু আমার সমস্যার সমাধান তো করে দাও।”

“পারবো না।”—-বলেই ঘর থেকে সৌহার্দ্যকে টেনে বের করে দিয়ে দরজা আটকে দিলো শ্রাবণ।
________

অফিস আওয়ার শেষ হতেই ব্যাগ হাতে বের হতে যাবে অনুভা। তখনি তার পথ আটকে দাঁড়ায় তানিম। একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলে,“ফাইলটা রাখুন। ইমপোর্টেন্ট ফাইল। আশা করি সেদিনের ভুলটা এবার আর হবে না। যদি হয় তাহলে কিন্তু চাকরিটা আর থাকবে না বলে দিলাম।”

ফাইলটা হাতে নিলো অনুভা। শাণিত কণ্ঠে বললো,
“হবে না স্যার। এবার আর কোনো ভুল হবে না।”

“আচ্ছা যান তাহলে। ড্রাইভারকে আমি বলে দিয়েছি, বাড়ি পর্যন্ত আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

“বললাম তো স্যার, আমার বাড়ি বেশি দূরে নয়। আমি একাই যেতে পারবো। আল্লাহ্ হাফেজ।”

বিদায় নিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলো অনুভা। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখমুখ কুঁচকে নিলো তানিম। বিরক্তির সহিত বলে উঠলো,“ভাব বেশি।”

চলবে ________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৫]

আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ছুটির দিনে ফর্দ হাতে সাপ্তাহিক কাঁচা বাজার করতে বেরিয়ে পড়ে অনুভা। আজও তার ব্যতীক্রম ঘটলো না। সকাল সকাল বাজারের ব্যাগ হাতে চলে এসেছে বাজারে। বাবার এমন করুন অবস্থা হওয়ার পর থেকে এই কাজটাও নিজেকেই করতে হয় তার। শুরুর দিকে বাড়ির কেয়ারটেকারকে দিয়ে কাজটা করালেও লোকটার বাজার মোটেও পছন্দ হতো না সুফিয়ার। উনার মতে, লোকটা বাজারের অর্ধেক টাকা মেরে দিয়ে পঁচা শাক সবজি কিনে নিয়ে আসে। তাই বাধ্য হয়ে অনুভাকেই বাজার করতে হয়। বাজারের ফর্দ মিলিয়ে মিলিয়ে কাঁচা বাজার করা শেষ হতেই দুই হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে বের হতে লাগলো বাজার থেকে। এবার গন্তব্য মুদির দোকান।

হুট করে কেউ এসে একটা ব্যাগ ছিনিয়ে নিলো হাত থেকে। আঁতকে উঠলো অনুভা। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আগন্তুকের পানে তাকাতেই সহাস্যে মিলিয়ে গেলো ভয়। সামান্য আশ্চর্য হলো। ওষ্ঠদ্বয়ের কার্ণিশ বর্ধিত হলো। শুধালো,“তুমি?”

দ্বিতীয় ব্যাগটিও নিজের হাতে নিয়ে নিলো শ্রাবণ। চোখেমুখে তার গাম্ভীর্য। বুক টানটান করে আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে বললো,“তোমার শরীরে তো দেখছি অনেক শক্তি! তা কী খেয়ে এত শক্তিশালী হয়ে উঠলে নোভা?”

“তুমি এখানে কেন?”

“বাজারে মানুষ কেন আসে? অবশ্যই বাজার করতে এসেছি।”

“তোমার বাড়ির এলাকায় কী বাজার নেই? এতদূর এসেছো বাজার করতে?”

“বাজারটা কী তোমার ব্যক্তিগত সম্পদ নাকি যে বাড়ির এলাকা না হলে আসতেই পারবো না?”

“এমনটা কখন বললাম? ব্যাগ দুটো দাও।”

“এমনভাবে বলছো যেনো তোমার ব্যাগ নিয়ে আমি দৌড় দিয়ে পালাবো?”

নিরব হয়ে গেলো অনুভা। গাম্ভীর্যের মধ্যেই শ্রাবণের মুখশ্রীতে ফোটে উঠলো একফালি হাসি। মিহি স্বরে বললো,“মেয়ে মানুষের হাত থাকবে নরম তুলতুলে। যখন ছুঁয়ে দিবো তখনি কোমলতায় ছেঁয়ে যাবে শরীর ও মন। তাই আমি চাই না এসব ভারি কাজকর্ম করে তোমার হাত পাথরের ন্যায় শক্ত হোক।”

“এমন করে বলছো যেনো সবসময় তুমিই এই কাজটা করে দাও? রোজ শুক্রবারেই তো আমি বাজার করি।”

পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ালো শ্রাবণ। সন্দেহভাজন কণ্ঠে প্রশ্ন করল,“ব্যাগগুলোও কী তুমিই বহন করো?”

ভড়কে গেলো অনুভা। মনে করার চেষ্টা করল কিছু। মস্তিষ্কে বেশি চাপও প্রয়োগ করতে হলো না তার। সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে গেলো, প্রত্যেক শুক্রবার নিজে বাজার করলেও ব্যাগ তাকে বহন করতে হয় না। বাজার শেষে আগ বাড়িয়ে কোত্থেকে যেনো কোনো না কোনো লোক চলে আসে ব্যাগ বহন করার জন্য। অনুভা বাঁধা দিলেও তারা তার বাঁধা মানতে নারাজ। পারিশ্রমিক দিতে চাইলেও তা না নিয়েই চলে যেতো তারা। ঘটনাটা নিয়ে অতটা মাথা না ঘামালেও মনের গহীনে এখন ঠিক প্রশ্ন জাগলো, এই খবর শ্রাবণ জানলো কী করে?

পূর্বের ন্যায় আবারো সামনের দিকে হাঁটা ধরলো শ্রাবণ। তার পিছুপিছু অনুভাও হাঁটছে। বাজার পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই দেখা মিললো শ্রাবণের কালো গাড়িটার। গাড়িটা এখন সম্পূর্ণভাবে অনুভার পরিচিত। সেদিন রাতেই তো এ গাড়িতে করে তাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল শ্রাবণ। গাড়ির ডিকিতে বাজারের ব্যাগ গুলো রেখে অনুভার সামনে এসে দাঁড়ালো শ্রাবণ। হাত বাড়িয়ে বললো,“বাজারের ফর্দটা দাও।”

বিষ্মিত স্বরে অনুভা শুধালো,“তা দিয়ে তুমি কী করবে?”

“তুমি যা করছিলে তাই করবো। বেশি কথা আমার পছন্দ নয় তা তো জানোই। এবার ফর্দটা দাও।”

শ্রাবণের স্বভাব সম্পর্কিত ভালো ধারণাই আছে অনুভার। এর সঙ্গে এটাও জানে ছেলেটা বড্ড ঘাড় ত্যাড়া। কথা না বাড়িয়ে বাড়ানো হাতখানায় ফর্দটা তুলে দিলো। গাড়ির সামনের দ্বার খুলে অনুভার পানে গাঢ় দৃষ্টি রেখে শ্রাবণ বলে উঠলো,“লেখাপড়া ব্যতীত অন্য কোনো প্রশ্ন আমার মোটেও পছন্দ নয়। আমার অপছন্দনীয় কাজ করা মানুষও আমার পছন্দ নয়। নাও এবার গাড়িতে উঠে বসো। আমি আসছি।”

ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করে গাড়িতে উঠে বসলো অনুভা। সে যে এ নিয়েও হাজারটা প্রশ্ন করবে তা খুব ভালো করেই জানে শ্রাবণ। তাই আগে আগে এতগুলো লেকচার দিয়ে কায়দা করে মেয়েটাকে দমিয়ে রাখলো। দরজা লক করে সত্বর পায়ে চলে গেলো কোথাও। বিমূঢ় দৃষ্টি মেলে উদাস ভঙিতে বসে আছে অনুভা।

কয়েক মিনিট পার হতেই গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল শ্রাবণ। হাতে বেশ বড়োসড়ো একটা পলিথিন ব্যাগ। ব্যাগটা অনুভার কোলে দিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলো। অনুভা মিনমিনে স্বরে জিজ্ঞেস করল,“মোট কত হয়েছে?”

ড্রাইভ করতে করতেই পাল্টা প্রশ্ন এলো,“কী কত হয়েছে?”

“এগুলোর মোট দাম কত?”

প্রত্যুত্তর করল না শ্রাবণ। তার নিরুত্তর দেখে অনুভা ফের বললো,“না বললে টাকাটা দিবো কী করে?”

কেমন এক দৃষ্টিতে চাইলো শ্রাবণ। তার এমন চাহনির সঙ্গে পূর্ব পরিচিত নয় অনুভা। তবে ধের বুঝতে পারছে ছেলেটা যে চরম বিরক্ত হয়েছে এমন প্রশ্নে। কিন্তু কারো বিরক্তির ধার ধারলো না অনুভা। কণ্ঠে গাম্ভীর্য এঁটে বললো,“কী হলো বলছো না কেন?”

“এমন করছো যেনো তোমার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য আমি মরে যাচ্ছি? এই টাকা না পেলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে?”

“সেম কোয়েশ্চন তো আমিও করতে পারি।”

সশব্দে ভারি নিঃশ্বাস ত্যাগ করল শ্রাবণ। প্রসঙ্গ বদলে বললো,“অর্থিকা আপুর কী অবস্থা?”

“মোটামুটি ভালো।”

“তন্ময় ভাই মারা গেছে এটাই চরম সত্যি এবং বাস্তব।এভাবে তো চলতে পারে না। নিজের ছেলেটার প্রতি অন্তত উনার দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসা থাকা উচিত। বোন হিসেবে নিজের বোনের পাশে দাঁড়ানো তোমার কর্তব্য। সন্তান হিসেবে বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করাও তোমার কর্তব্য। তাই বলে একা একটা মেয়ের পক্ষে সবদিক সামলানো কী সম্ভব? নিজের দিকে একবার তাকিয়েছো?ভেবেছো নিজের কথা?”

চোখের দৃষ্টি নত হলো অনুভার। কোনো উত্তর নেই তার কাছে। আড়চোখে তাকে দেখে নিলো শ্রাবণ। পুনরায় বললো,“চোখের সামনে প্রিয় মানুষকে হারাতে দেখার যন্ত্রনা খুবই জঘন্য। উনি হয়তো এখনো মেনে নিতে পারেননি তন্ময় ভাইয়ের মৃ’ত্যুটা। আর কয়েক মাস অতিক্রম হলেই উনার মৃ’ত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়ে যাবে অথচ এখনো যদি আপু নিজেকে সামলে নিতে না পারে তাহলে উনার বড়ো কোনো ক্ষতি যে হয়ে যাবে না তার গ্যারান্টি কী কেউ দিতে পারবে? তাছাড়া বাচ্চাটারও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে তাই না? জন্মের পর বাবা হারিয়েছে এরপর মা হারালে?”

“আমার আর কী করার আছে? এই ট্রমা থেকে বের করে আনার জন্য কম চেষ্টা তো আর করছি না। সবসময় ঘরের এককোণে পড়ে থাকে। মাঝেমধ্যে কাউকে না বলে কয়েই চলে যায় দুলাভাইয়ের কবরের কাছে।”

“উনাকে ভালো একটা সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। এমন চলতে থাকলে পাগল হতে আর বেশি সময় লাগবে না।”

চকচকে দৃষ্টিতে শ্রাবণের পানে তাকালো অনুভা। এই কথাটা তো একবারও তার মাথায় আসেনি? না আসাটাই স্বাভাবিক। ছোট্ট মাথায় সবদিক চিন্তা করতে গেলে এমনটাই তো হবে। বাড়ির পথে এসে থেমে গেলো গাড়ি। অনুভা নেমে পড়ল। তার সাথে নামলো শ্রাবণও। ডিকি থেকে ব্যাগ দুটো নামিয়ে হাঁটা ধরলো সামনে।

পিছু ডাকলো অনুভা। চমকায়িত কণ্ঠে শুধালো,
“এই এই, তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“ছোটো মানুষ ভারি দুটো ব্যাগ নিয়ে গলি পার হয়ে সিঁড়ি ভেঙে ঘর পর্যন্ত যেতে পারবে না। পৌঁছে দিয়ে আসি।”

অনুভা বাঁধা দিয়ে বললো,“তার প্রয়োজন নেই।আমি পারবো যেতে।”

বাঁধা মোটেও মানলো না শ্রাবণ। তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,“চিন্তা নেই এতো তাড়াতাড়ি শ্বশুর বাড়িতে আমি ঢুকছি না।”

ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো অনুভার। পথিমধ্যে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। ততক্ষণে অনেকটা পথ হেঁটে সামনে এগিয়ে গেছে শ্রাবণ। টনক নড়লো অনুভার। দৌড়ে গিয়ে পা মেলালো শ্রাবণের সঙ্গে। বিষ্মিত স্বরে শুধালো,
“শ্বশুর! কে তোমার শ্বশুর?”

বিষ্ময়াভিভূত চাহনি শ্রাবণের। বিরক্তিতে আড়ষ্ট হলো। মেয়েটা কী কিছু বোঝে না? নাকি বোঝেও না বোঝার ভান করে থাকে? কঠিন স্বরে উত্তর দিলো,
“তোমার বাড়িওয়ালা।”

“বাড়িওয়ালার তো কোনো মেয়েই নেই।”

“তাহলে নিশ্চয়ই ছেলে আছে?”

“তা অবশ্য আছে।”

বলেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো অনুভা। টনক নড়ে উঠলো। কিছু একটা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই চিৎকার করে বলে উঠলো,“এই এই ছেলে আছে মানে? তুমি কী গে? আসতাগফিরুল্লাহ! গে হলে কবে থেকে?”

বিষ্ময়ে হতবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো শ্রাবণ। ছিহ্ কী বলে এই মেয়ে! কয়েক মুহূর্ত নিরব থেকে বললো,
“তোমার কথাবার্তা খুব বাজে হয়ে যাচ্ছে নোভা। আমি একজন মুসলিম পুরুষ। গে হতে যাবো কেন?”

“না মানে তুমিই তো জিজ্ঞেস করলে ছেলে আছে কিনা।”

সেসবে তোয়াক্কা করল না শ্রাবণ। অনুভার হাতে ব্যাগ দুটি ধরিয়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। তার আগে শাসিয়ে বলে গেলো,“এরপর আর যদি কখনো আমার সম্পর্কে বেফাঁস কথাবার্তা বলো তাহলে তোমার ওই মুখ খুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিবো।”

চুপসে গেলো অনুভা। পিছু ডেকে বললো “তুমি না বললে ঘর পর্যন্ত ব্যাগ দিয়ে আসবে?”

“তুমি কী বাচ্চা নাকি? নিজের কাজ নিজে করতে শিখো।”

“তুমিই তো বললে ছোটো মানুষ।”

“ভুল বলেছিলাম। ছোটো মানুষেরা এসব আবোল তাবোল কথা বলতে পারে না। আল্লাহ্ হাফেজ।”

অনুভাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো শ্রাবণ। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো অনুভা। ভুল জায়গায় কী ভুল কথা বলে ফেললো সে?হয়তো। কিন্তু শ্রাবণের কথা শুনে এই শব্দটাই তো তখন মাথায় এলো। অনুভা নিশ্চিত ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এই কথাটাই প্রথমে বলতো। আর কিছু না ভেবে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল সে।

শুক্রবারে পারভিনা কাজে আসে না।অনুভাও আসার জন্য কখনো জোরাজুরি করেনি।ফ্রেশ হয়ে তাঈমকে কোলে নিয়ে বোনের ঘরে পা বাড়ালো। জানালা ভেদ করে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে আছে অর্থিকা। ঠোঁট দুটো তার নড়ছে। আপনমনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে এক ধ্যানে। কী যেনো বলছে কাকে।

অনুভা এগোলো। বোনের বিপরীত মুখী হয়ে বসে পড়ল। তাঈম এক হাতে অনুভার ওড়না টেনে ধরে রেখে অপরহাতের বুড়ো আঙুল মুখে পুরে রেখেছে। ঘরে যে আরো দুটো প্রাণ উপস্থিত হয়েছে তা যেনো খেয়ালই করেনি অর্থিকা। বড়ো বোনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করল অনুভা। মন খারাপের ভান করে তাকালো তাঈমের পানে। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো সোজা করে। তারপর কিছুটা ঝুঁকলো তার উপর। দুঃখী দুঃখী কণ্ঠে বললো,“মা আদর করে না, কোলে নেয় না বলে আমার বাবাটার খুব মন খারাপ তাই না? থাক মন খারাপ করে আর কী করবে? মা তো তোমায় ভালোইবাসে না। মা না ভালোবাসুক তাতে কী? আমি তো আছি। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি।”

নড়েচড়ে উঠলো অর্থিকা। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো ছোটো বোনের পানে। তাঈম খিলখিলিয়ে হাসছে। আদো আদো কণ্ঠে বলে উঠছে,“মা মা মা….”

শব্দগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই ধক করে উঠলো অর্থিকার হৃদয়খানা। বিলম্ব না করে কোলে তুলে নিলো নিজ সন্তানকে। মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,“কী বললে? আরেকবার বলো।”

ড্যাবড্যাব দৃষ্টিতে মায়ের মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো তাঈম। মুখ দিয়ে পূর্বের ন্যায় বের হলো না কোনো শব্দ। অনুভা আফসোসের সুর তুলে বললো,“শেষে কিনা মাকে রেখে খালাকে মা বলে ডাকছে তোর ছেলে! এবার কী হবে আপু?”

“এটা তোর কাজ। তুই শিখিয়েছিস তাই না?”

“মা ডাক শিখিয়েছি কিন্তু আমাকে তো ডাকতে বলিনি।”

“তাহলে তোকে দেখলে কেন মা মা করে? আমার কাছে এসে চুপ থাকে কেন?”

“এটা নিজেকেই প্রশ্ন কর না। সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সারাক্ষণ একা একা বসে থাকিস।ওদিকে বাচ্চাটা বাবার আদর থেকে বঞ্ছিত হয়েছে এদিকে তুই কী করলি? স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভেবে গেলি এবং এখনো যাচ্ছিস। বাচ্চাটাকে ঠিকমতো কোলে নিস না, খাওয়াস না পর্যন্ত। মাঝে মধ্যে কী হয় কে জানে? তখন যা একটু কোলে তুলে নিস। আচ্ছা এভাবে বাচ্চা মানুষ করা যায়? বড়ো হয়ে যখন ও জানবে, ওর মা ওকে অবহেলা করেছে তখন কী প্রভাব পড়বে ওর উপর? তোকে আদৌ কী বসাতে পারবে মায়ের স্থানে?তখন আফসোস করতে হবে তোকে। এই সময়টা পুনরায় ফিরে পাওয়ার জন্য পাগল হতে হবে। বাবা-মা এবং তোকে যতটা আমি ভালোবাসি ঠিক ততোটাই ওকেও আমি ভালোবাসি। পেটে না ধরেও যেনো মা হয়ে উঠেছি। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। মা অসুস্থ, অসুস্থতা নিয়েই বাবার দেখভাল করতে হয় তাকে। বাহিরের মানুষের কাছে সারাক্ষণ বাচ্চাটা থাকে। জানিস ওকে নিয়ে আমার কতটা চিন্তা হয়? একটু পরপর শুধু সময় দেখি আর ভাবি কখন অফিস আওয়ার শেষ হবে আর আমি বাড়িতে আসবো। বারবার মাথায় প্রশ্ন জাগে তাঈম কাঁদছে না তো? ওর খিদে পায়নি তো?”

অর্থিকার চোখ চিকচিক করছে অশ্রুতে। বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো ছেলেকে।ভারি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে দম ছাড়লো অনুভা। তার গলাটাও ধরে এসেছে। পুনরায় বললো,“আবারো বলছি সত্যিটা মেনে নে আপু।মোভ অন কর। এভাবে কাঁদলে, নিজের অযত্ন করলে, বাবুর প্রতি অবহেলা করলে দুলাভাইয়ের আত্মা যে কষ্ট পাবে। তুই কী চাস দুলাভাই কষ্ট পাক?”

অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো অর্থিকার। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,“না না ও কষ্ট পাক আমি তা চাই না। ও কেন কষ্ট পাবে? ও ভালো থাকুক আমি শুধু অতটুকুই চাই।”

“শুধু চাইলেই তো আর হবে না।”

“আমি আর কাঁদবো না। বিশ্বাস কর আমি আর একটুও কাঁদবো না। খুব আদর করবো আমাদের ছেলেকে।”

বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অর্থিকা। বোনের মাথায় হাত রাখলো অনুভা।দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাঈমকে অর্থিকার কাছে রেখেই ত্যাগ করল কক্ষ। মায়ের কাছে যে সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে না তা নিশ্চিত সে। শুক্রবারে সুফিয়ার ছুটি।এদিন নিজ হাতেই রান্না করে অনুভা। তাই সোজা চলে গেলো রান্নাঘরে।
_________

অনেক বেলা করে বাড়ি ফিরলো শ্রাবণ। রান্নাঘর থেকে পুরো ড্রয়িং রুমটাই স্পষ্ট দেখা যায়। দুপুরের রান্না করছেন শান্তা। বড়ো ছেলেকে ঘরের দিকে যেতে দেখেই ডাকলেন তাকে।মায়ের ডাকে পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল শ্রাবণ।এগিয়ে এলো রান্নাঘরের কাছে।
জিজ্ঞেস করল,“কী বলবে? বলো।”

“সাত সকালে কোথায় যাওয়া হয়েছে শুনি?সকালের খাওয়া কী হয়েছে আদৌ?”

“বাহিরেই খেয়ে নিয়েছি।”

“কোথায় গিয়েছিলি?”

“বাজারে।”

ছেলের কথায় হাতের খুন্তি নাড়াচাড়া থেমে যায় শান্তার। বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি মেলে শুধান,“তুই আর বাজার! কই কখনো তো তোকে বাজারের ধারের কাছেও যেতে দেখলাম না তাহলে আজ গেলি যে? গেলি যখন তাহলে একা গেলি কেন? তোর বাবা তো সকালেই গেলো। তার সঙ্গেই যেতে পারতি।”

“বাবার সঙ্গে তো ড্রাইভার ছিলোই। আমার যাওয়ার কী প্রয়োজন তাহলে? তাছাড়া আগে যাইনি বলে যে এখনো যেতে পারবো না এমন তো কোনো কথা ছিলো না।”

“তা কোথায় তোর বাজার দেখা দেখি।”

“আনিনি। বাজারে গিয়ে মনে পড়ল বাবা তো অলরেডি বাজার করতে বেরিয়েই পড়েছে। তাহলে শুধু শুধু আমি বাজার করে আর কী করবো?”

সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে ছেলেকে আগাগোড়া ফের পর্যবেক্ষণ করলেন শান্তা। দম ছেড়ে বললেন “ওহ, আচ্ছা ঘরে যা তবে।”

সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ালো শ্রাবণ।

চলবে _______

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-২+৩

0

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০২]

মৃত স্বামীর লাশের খাটিয়ার সম্মুখে বসে আছে অর্থিকা। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। আগরবাতির গন্ধে মো মো করছে চারিদিক। বিশাল হল রুমের মাঝখানে সাদা কাফন গায়ে জড়িয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে শুয়ে আছে তন্ময়। ঘর থেকে ভেসে আসছে তাদের দুই মাস বয়সী ছেলের গগন বিধারক কান্নার শব্দ। সবার মতো ছোট্ট বাচ্চাটাও হয়তো টের পেয়ে গেছে যে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছে তার বাবা নামক মানুষটি। তাদেরকে অথৈ সাগরে ফেলে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। দুধের শিশুটির গায়ে অনাথ তকমা লাগিয়ে সকল দায়িত্ব থেকে নিয়েছে অব্যাহতি।

কয়েকজন বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এসে অর্থিকাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আফসোসের সুর তুলে বলতে লাগলেন,“আহারে! দুধের পোলাপাইন রাইখা এই অল্প বয়সে পোলাডায় মইরা গেলো! এহন একলা একটা মাইয়া মানুষ এই পোলাপাইন লইয়া কই যাইবো? কী হইবো ওগো?”

কোনো কথাই যেনো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না অর্থিকার। এক ধ্যানে নিষ্পল দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে মৃত স্বামীর প্রাণহীন মুখশ্রীতে। জানাজার সময় হয়ে এসেছে। তন্ময়ের দুলাভাই এবং চাচাতো ভাইয়েরা এগিয়ে এলো। একজন মিহি স্বরে বলে উঠলো,“ভাইকে এবার নিয়ে যেতে হবে। জানাজার সময় হয়েছে। জানাজা শেষে একেবারে দাফন।”

বাক্যগুলো চট করে মস্তিষ্কের নিউরনে আঘাত হানলো। নড়েচড়ে উঠলো অর্থিকা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বামীর নিষ্প্রাণ দেহের উপর। শুকিয়ে যাওয়া চোখ থেকে শুরুর মতো বইতে লাগলো তীব্র বর্ষন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলতে লাগলো,“আমার তন্ময়কে আমি কোথাও যেতে দিবো না। ও তো আমায় কথা দিয়েছিল ফিরে আসবে। বাবুকে কোলে নিবে। তাহলে কেন রাখলো না সেকথা? ও তন্ময় ওঠো না। ওই যে দেখো না আমাদের বাবু কান্না করছে। তোমাকে ছাড়া আমরা থাকবো কী করে? দয়া করে একবার চোখ মেলে তাকাও। এসব দুষ্টুমি কিন্তু আমার ভালো লাগছে না।তন্ময়….”

দৌড়ে এসে তাকে জাপটে ধরলো অনুভা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অশান্ত কণ্ঠে শুধালো,“আপু! এই আপু! কাঁদছিস কেন?”

“ওরা তন্ময়কে নিয়ে যাচ্ছে রে অনু। ওদের থামতে বল। আমি ওকে ছাড়া থাকবো কী করে?”

চিন্তিত হলো অনুভা। জগ থেকে পানি নিয়ে ছিটিয়ে দিলো বোনের চোখেমুখে।তৎক্ষণাৎ ঘুম ভেঙে গেলো অর্থিকার। আশেপাশে তাকিয়ে সবকিছু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল। দু হাতের আজলে বোনের মুখটা তুলে নিলো অনুভা। নম্র কণ্ঠে শুধালো,“আবারো দুলাভাইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিস তাই না?”

পূর্বের ন্যায় সশব্দে কেঁদে উঠলো অর্থিকা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,“কেন আমার সঙ্গেই এমনটা হলো বল না? তন্ময় বেঁচে থাকলে কী খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? মরলোই যখন আমাকে কেন রেখে গেলো? ও কী জানতো না যে ওকে ছাড়া থাকাটা আমার পক্ষে অসম্ভব?”

বোনের এই আহাজারি কষ্ট মোটেও সহ্য হয় না অনুভার।প্রতিবারের মতো এবারও তাকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“মৃ’ত্যু হচ্ছে একমাত্র সত্য। সকল প্রাণীকেই মৃ’ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়।আল্লাহ এটাই তোর ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন। দুলাভাইয়ের মৃ’ত্যুটা মেনে নে আপু। রোজ রাতে এমন পাগলামী করলে, যে চলে গিয়েছে সে কী আর ফিরে আসবে? আমরা আছি তো তোর পাশে। এখনো অনেকটা পথ বাকি। তোকে সুস্থ ভাবে বাঁচতে হবে। নিজের জন্য না হলেও তোদের সন্তানের জন্য বাঁচতে হবে।”

“তাঈম কোথায়? ওকে এনে দে না একটু।”

“ও তো ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা তুই বোস আমি নিয়ে আসছি।”

বড়ো বড়ো কদম ফেলে নিজের কক্ষে এলো অনুভা। দোলনায় থাকা ঘুমন্ত তাঈমের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর খুব সাবধানে তাকে কোলে তুলে নিলো যাতে ঘুমটা ভেঙে না যায়।তন্ময় মারা গিয়েছে ছয় মাস হতে চললো অথচ তার স্মৃতি এবং মৃ’ত্যুর ঘোর থেকে কিছুতেই যেনো বেরিয়ে আসতে পারছে না অর্থিকা। তাদের বিয়েটা পারিবারিকভাবে হলেও এই পুরুষটাকে অসম্ভব ভালোবাসতো সে। বিয়ের বছর তিনেক পরেই তাদের কোল আলো করে আসে তাঈম। অথচ হুট করেই একটা ঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দিলো সবকিছু। ভালোবাসার মানুষকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখে দিক বেদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো অর্থিকা নামক মেয়েটি। বাচ্চাটিকে কবে যে ঠিক করে কোলে নিয়েছে, কান্না থামিয়ে আদর করেছে, খাইয়ে দিয়েছে তা যেনো মনে করাই দুষ্কর।

বাবা বিছানা থেকে উঠে বসতে পারেন না। মায়ের কোমরে বাতের ব্যথা, পায়ের হাড়টাও ভেঙে গেছে। যতটুকু চলাফেরা করতে পারেন তাও অনেক কষ্ট করে। বাড়িতে ছুটা বুয়া রাখা। অফিস থেকে ফেরার আগ পর্যন্ত বাচ্চাকে দেখাশোনার সব দায়িত্ব সেই বুয়ার। অফিস থেকে ফিরে তাঈমকে সময় নিয়ে খাইয়ে, ঘুম পাড়াতে পাড়াতে যে কখন রাত পেরিয়ে যায় সেই খেয়ালই থাকে না অনুভার। মাঝেমধ্যে নিজেকে নিয়ে ভাবতে বসলেই খুব হাসি পায় তার। একটা সময় কী ছিলো আর আজ কী হলো। অল্প বয়সেই তার মাথায় হাজার হাজার দায়িত্ব। জন্ম না দিয়েই কখন যে ভেতরে ভেতরে তার মধ্যে তৈরি হয়ে গেলো মা নামক মাতৃত্বের সত্তা তা-ই অজানা।

তাঈমকে এনে অর্থিকার কোলে তুলে দিয়ে পাশে বসলো অনুভা। ছেলেকে পেয়েই বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো অর্থিকা। কয়েক মিনিট অতিক্রম হতেই সারা মুখে ভরিয়ে দিলো আদরমাখা চুম্বনে। ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলো,”ও জন্মানোর পর থেকে প্রায় রাতেই বিভিন্ন কারণে আমার ঘুম ভেঙে যেতো।ঘুম ভাঙলেই ওই মাঝরাতে তন্ময়কে জাগ্ৰত অবস্থায় ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখতাম। একদিন খুব আগ্ৰহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এতো কী দেখো বলো তো? ও উত্তরে বললো,জানো অর্থি আমার না অনেক শখ ছিলো আমাদের একটা মেয়ে হবে। যাকে আমি মা বলে ডাকবো। আমার তো মা নেই।মা কেমন হয় তাও তো জানি না। সেই ছোটো বেলায় মা মারা গিয়েছিল তাই চেহারাটাও তেমন একটা মনে নেই।”

দম ছাড়লো অর্থিকা। পুনরায় বললো,“তুমি কী তবে খুশি নও ওকে নিয়ে? প্রশ্নটা করার সময় আমার কণ্ঠনালী খুব কাঁপছিল। আমার ভয় হচ্ছিল ছেলেটাকে নিয়ে। ও কী তবে ওর বাবার অখুশির কারণ?কিন্তু আমার সকল ভয় আর সংশয় দূর করে দিয়ে তন্ময় হেসে উঠলো। উত্তর দিলো, অখুশি হবো কেন? ও তো আমাদের সন্তান। আমার আরেকটা বাবা। বড়ো আপা বলেছে ও নাকি দেখতে একেবারে আমার মতো হয়েছে। সত্যিই কী অর্থি ও আমার মতো হয়েছে? ওর প্রশ্নে সেদিনই আমি খেয়াল করে দেখলাম সত্যিই আমার ছেলেটা একেবারে তার বাবার মতো দেখতে হয়েছে।”

বলেই হো হো করে কেঁদে উঠলো অর্থিকা। এতক্ষণে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে তাঈম। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের পানে। অনুভা নিরব দর্শক হয়ে বোনের কষ্টকে চোখের পানির মাধ্যমে নির্বাসন দিতে দেখছে। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর বেদনা যে খুবই নিকৃষ্ট তার স্বাক্ষী হচ্ছে বারংবার।

অর্থিকার মনে পড়ে, অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিল তন্ময়। ফেরার আগের দিন রাতেও ভিডিও কলে কথা বলেছিল তার সঙ্গে। মন ভরে দেখেছিল নিজের ছেলেটাকে। বলেছিল,“তুমি আমায় খুব মিস করছো তাই না অর্থি? আমিও তোমায় খুব মিস করছি। বাবু না থাকলে তোমাকেও আমার সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম এখানে।দেশের ভেতরেই ছোটোখাটো একটা হানিমুন হয়ে যেতো।” এতটুকু কথায় কি লজ্জাটাই না পেয়েছিল মেয়েটা। যা অতদূর বসেও খুব ভালো করেই টের পেয়েছিল তন্ময়। মুচকি হেসে আশ্বস্ত করে ফের বলেছিল,“আমার জন্য চিন্তা করো না বউ। কথা দিচ্ছি, আগামী রাতটা আমাকে ছেড়ে তোমাদের আর থাকতে হবেনা। তখন তোমাদের পাশে রোজকার মতো আমি থাকবো। রাতে এসে একসঙ্গে ডিনার করবো।”

কিন্তু তন্ময় নিজের কথা রাখেনি। রাখতে পারেনি। সেদিনই যে তার মৃ’ত্যু অনিবার্য ছিলো। পরেরদিন ঠিকই সে ফিরলো তবে লাশ হয়ে। কাজ শেষে ভোর রাতেই বাসে করে রওনা দিয়েছিল তন্ময়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার বাসটা পথিমধ্যে এক্সিডেন্ট করে। বেশ কয়েকজন যাত্রী নিহত হয় যার মধ্যে তন্ময়ও ছিলো একজন। জানালার পাশে বসায় জানালার কাঁচ মাথায় ঢুকে নিকৃষ্ট মৃ’ত্যু হয় তার।

এসব মনে পড়লেই নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারে না অর্থিকা। বাবার উপর সে বরাবরই কৃতজ্ঞ। বাবার কারণেই সে এমন ভালো মন মানসিকতার একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছিল। বাবা নিজে পছন্দ করে যাচাই বাছাই করে তাকে তুলে দিয়েছিল তন্ময়ের হাতে। বিয়ের তিনটে বছর ছিলো তার কাছে স্বর্গীয়। মাঝে মাঝে ছোটো বোনের নিকট ফোন করে বলতো,“একটা মানুষের কপালে এতটাও সুখ থাকে রে অনু? এতো সুখ কেন রে আমার কপালে? এই মানুষটা আমায় এতো ভালোবাসে কেন অনু?”

কখনো সখনো কথা বলতে বলতে কেঁদে উঠতো। সুখের কান্না। আজ সেই সুখ আর নেই। সুখের অতল সাগরে তাকে ডুবিয়ে রাখা মানুষটাই যে আর নেই। শত ডাকলেও সে আর ফিরবে না। আজও অর্থিকা কাঁদে তবে দুঃখে। রোজ নিয়ম করে কাঁদে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় দুঃস্বপ্নে। রাতে খেতে পারে না।বারবার মনে পড়ে তন্ময়ের বলা সেই কথাটা,“রাতে ফিরে একসঙ্গে আমরা ডিনার করবো।”

“কেন সেই রাত এলো না? কেন?”

বলেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলো অর্থিকা। তার এই চিৎকারে ভয় পেয়ে গেলো কোলে থাকা তাঈম। সেও কেঁদে দিলো মায়ের সঙ্গে। এবার অনুভারও ভয় হলো। দ্রুত তাঈমকে নিয়ে নিলো নিজ কোলে। পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটতে লাগলো ঘর জুড়ে। ব্যস্ত হয়ে পড়ল কান্না থামাতে। তন্ময় বেঁচে থাকাকালীন স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা স্বচোক্ষে দেখেছে অনুভা। প্রায়সই বড়ো বোনকে খোঁচা দিয়ে বলে উঠতো,“দুলাভাই তো একেবারে বউ পাগলারে আপু!”

এ কথাতে কী রাগটাই না করতো অর্থিকা। আগুনের লাভার ন্যায় জ্বলে উঠতো। বলতো,“তুই কী বুঝবি এসবের? তুই তো একটা রোবট। যেদিন তোর এই রোবটময় জীবনে এমন একজন আসবে সেদিন ঠিক অনুভব করতে পারবি। ভালোবাসা কী, ভালোবাসা কাকে বলে।”

কথাটা মনে হতেই অনুভার মনে প্রশ্ন জাগে,“কেউ কী এসেছিল এই জীবনে? হয়তো এসেছিল। বেসেছিল কী ভালো? হয়তো বেসেছিল। আচ্ছা এখনো কী বাসে ভালো? নাকি সময়ের সাথে সাথে ভুলে গেছে আমায়?”

হৃদয় প্রাঙ্গন কম্পিত হলো। চোখ জোড়া বন্ধ করে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিড়বিড় করে বললো,“ভালোবাসা আগুনের লাভা। যাতে পা দিলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে হয়। ভালোবাসা হচ্ছে বিষ। যা গলাধঃকরণ করলে মৃ’ত্যু সুনিশ্চিত। যারা ভালোবেসেছে তারাই হয় পুড়েছে নয়তো মরেছে।”

বোনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাঈমকে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে লাগলো অনুভা। যেতে যেতে বলতে লাগলো,“নিজের বাচ্চার জন্য হলেও আপু মরতে পারবে না। আবার শান্তিতেও থাকতে পারবে না। তাকে পুড়তে হবে, পুড়ার যন্ত্রনা সহ্য করে নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বাঁচতে হবে। ভালোবাসা খুবই জঘন্য। ভালোবাসা গড়তে নয় বরং জানে শুধুই ধ্বংস করতে। মনোধ্বংসের মূলভিত্তিই যে ভালোবাসা।”
________

রোজকার ন্যায় আজও অনুভার ঘুম ভাঙলো বাচ্চার ক্রন্দনরত শব্দে। দেরিতে ঘুমানোয় মাথাটা ভার হয়ে আছে। কোনোমতে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে কোলে তুলে নিলো তাঈমকে। তাকে নিয়েই এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। শুনতে পেলো মায়ের ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর।কারো সঙ্গে যে তিনি রাগ নিয়ে কথা বলছেন তা সুস্পষ্ট। অনুভা মাথায় ওড়না টেনে সদর দরজার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো একজন বয়স্ক লোককে। মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এই সাত সকালে চেঁচামেচি করছো কেন?”

রাগ মিশ্রিত দৃষ্টিতে মেয়ের পানে তাকান সুফিয়া। কণ্ঠে তেজ এঁটে বলেন,“কেউ কী সাধে চেঁচায়? বাপের মতো সারাক্ষণ আমার চেঁচানোটাই দেখিস। এদিকে সংসারের পেছনে যে খেটে মরছি তা দেখতে পাস না?”

“সহজ প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে দাও। কী করেছে ইনি?”

“রোজ রোজ দুধে পানি মেশায়। দেখ তুই, আজকের দুধটাও একেবারে পাতলা। তাহলে দুধ খেয়ে লাভ কী বল? ডাক্তার তোর বাবাকে প্রতিদিন গরম দুধ খেতে বলেছে শরীরের পুষ্টির জন্য।এসব ভেজাল খেলে কী শরীরে আদৌ কোনো পুষ্টি হবে? এদিকে টাকা নেওয়ার বেলা পুরো টাকাটাই গুণে গুণে নেয় কিন্তু জিনিসের বেলা দেয় ভেজাল।”

“এনার কাছ থেকে দুধ নিও না তাহলেই তো হয়।”

“তাহলে কার কাছ থেকে নিবো? আমি তেমন কাউকে চিনি? তোকে কতবার করে বলেছি বাজার থেকে নিজে গিয়ে দেখে শুনে কিনে নিয়ে আয়। তা তো পারিস না।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো অনুভা। মায়ের থেকে দুধের পাতিল নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে জাল দিতে লাগলো। জাল দেওয়া হতেই কিছুটা ফিডারে ভরে ঠাণ্ডা পানিতে চুবিয়ে রাখলো। সারাদিন অফিস তারপর বাজার থেকে শুরু করে বাবা-মায়ের ওষুধ, ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল আবার মাসে নিয়ম করে তাদের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া সঙ্গে রোজকার রুটিনে একটা বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব। একা একটা অবিবাহিত মেয়ের পক্ষে কতটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়? মা যেনো কিছুতেই বোঝেন না তার পরিস্থিতি।বুঝতে চান না। অথচ তারও যে একটা জীবন আছে, তারও যে ক্লান্তি আছে, মন খারাপ আছে তা নিয়ে ভাবার কেউ নেই। সবার কথা ভাবতে গিয়ে নিজের কথাটাই যে ভাবা হয় না।

রোজকার মতো গোসল সেরে তাঈমকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো অনুভা। দুদিন ছুটি কাটিয়ে আজ কাজের মেয়ে পারভিনা চলে এসেছে। তার কোলে তাঈমকে দিয়ে নাস্তার টেবিলে বসে পড়ল অনুভা।সকালের নাস্তাটাও পারভিনাই তৈরি করেছে। নাস্তা করে অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হলো অনুভা।

তাদের বাড়িটা গলির একদম ভেতরের দিকে। রঙ ওঠা মলিন চার তলা বিল্ডিং। একেকটা ফ্লোরে দুটো করে ফ্ল্যাট। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এতগুলো মানুষের সংসার চালাতে গিয়ে যখন হিমশিম খেয়ে ওঠে অনুভা তখনি মায়ের বুদ্ধিতে বাধ্য হয়েই পূর্বের বাড়িটা তাকে বদলাতে হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজন পরিচিতর নিকট থেকে এই বাড়িটির সন্ধান পায় সে। সুযোগ সুবিধা কম থাকলেও আগের তুলনায় এখানকার ভাড়াটা যথেষ্ট সাধ্যের ভেতরে।

কিছুটা পথ হেঁটে মেইন রাস্তায় উঠতেই দেখতে পেলো পরিচিত একটি মুখ। তাকে দেখতে পেয়ে দাঁত কপাটি বের করে হাসলো লোকটি। অনুভার ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো। শুধালো,“নাহিয়ান ভাই! আপনি?”

এগিয়ে এলো নাহিয়ান। বিনীত সুরে বললো,“তোমার জন্যই এসেছি। জানো কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে?”

“আমার জন্য! কেন?”

“কেন আবার? এই যে পথে ঘাটে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হাতের অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছো। দুদিন পর যে ভেঙে ফেলবে না তার কী কোনো গ্যারান্টি আছে? তাই একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তোমাকে অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”

সৌজন্য হাসলো অনুভা। বললো,“তার কোনো প্রয়োজন ছিলো না ভাইয়া। তবে আজ যেহেতু এসেই পড়েছেন, চলুন তবে। লেইট হয়ে গেলে দেখা যাবে আবার বেতন কেটে নিবে।”

নাহিয়ান হাসলো। একটা সিএনজি দাঁড় করিয়ে অনুভাকে আগে ওঠার সুযোগ করে দিয়ে পরবর্তীতে নিজেও উঠে পড়ল তাতে। অফিসে সঠিক সময়ে পৌঁছেও গেলো দুজন। তারপর যে যার মতো বিদায় নিয়ে চলে গেলো নিজেদের কাজে।

নির্ঝঞ্ঝাটে অফিস টাইমটা পার হলো অনুভার। আজ একবারের জন্যও তাকে তানিমের মুখোমুখি হতে হয়নি। এমনকি লোকটা কোনো কাজের জন্যও তাকে ডাকেনি পর্যন্ত। এতে হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। লোকটার মুখোমুখি হওয়া মানে নিজের মান সম্মান নিজ হাতে বিসর্জন দেওয়া। অফিস ছুটি হতে হতে সাড়ে আটটা বেজে গেলো। নাহিয়ান যদিও তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু তার প্রস্তাব নাকোচ করে দিয়ে রোজকার মতো একা একাই বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো অনুভা।

চলবে _______

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৩]

“রাতেরবেলা শুনশান রাস্তায় একা একটা মেয়ে মানুষ! যদি কোনো বিপদ আপদ ঘটে? কী হবে তখন? বিশেষ করে যদি অ্যাটাক ফ্যাটাক হয়?”

বাক্যগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই নড়েচড়ে উঠলো অনুভা। পিছু ফিরতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো একটি কালো রঙের গাড়ি। ড্রাইভারের আসন থেকে কাঁচ নামানো জানালা দিয়ে মাথার অর্ধেকটা বের করে রেখেছে একজন পুরুষ। অন্ধকারে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না তার মুখটা।

রাস্তাটা মোটেও তেমন শুনশান নয়। ক্ষণে ক্ষণে দুয়েকটা গাড়ি চলছে। অনুভার কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে শব্দ করে খুলে গেলো গাড়ির দ্বার। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো লম্বা চওড়া একজন পুরুষ। বড়ো বড়ো কদম ফেলে সামনে এগিয়ে আসতেই গাড়ির সম্মুখের জ্বলন্ত হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট হলো পুরুষটির মুখশ্রী।

পুরুষটিকে দেখতেই বিষ্মিত হলো অনুভা। স্তম্ভিত নয়নে তাকিয়ে থাকলো তার মুখপানে। কী এক রুদ্ধদ্বার অবস্থা। এই মুহূর্তে কি অভিব্যক্তি প্রকাশ করা উচিত চট করে বুঝে উঠতে পারলো না। সেকেন্ডের জন্য থমকে গেছে হৃদয়। মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে এই সুপুরুষকে সে চিনে। খুব ভালো করেই চিনে। এও খেয়াল করল তার ভেতরে কৈশোরের সেই নিদারুণ ঝড় বইছে। সাথে তুমুল ভাবে চালাচ্ছে তাণ্ডব। একে অপরের চোখে চোখ রেখে পরিস্থিতি বুঝতে ব্যস্ত দুজনা। ব্যস্ত চোখের ভাষা বুঝতে। তখনি গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো সম্মুখে দাঁড়ানো পুরুষ। কণ্ঠনালী কম্পিত হলো অনুভার। শত কষ্টে চিত্ত চিরে বেরিয়ে এলো কৌতূহলী শব্দ,“শ্রাবণ!”

শান্ত মুখশ্রীতে এবার ফোটে উঠলো বিস্তৃত হাসি। বিপরীত ব্যক্তিটি বিদ্রুপ করে বলে উঠলো,“চিনতে পেরেছো তবে? তোমার হাবভাব দেখে তো আমি ভাবলাম আমায় হয়তো ভুলেই গেছো। এখন আর চিনতেই পারছো না।”

নিজেকে ধাতস্থ করতে কয়েক মিনিট সময় লাগলো অনুভার। খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে শ্রাবণ প্রশ্ন করল,“তা কী করছিলে এখানে?”

প্রশ্নটা স্বাভাবিক হলেও অনুভার নিকট এটাই যেনো অস্বাভাবিক ঠেকলো। মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো, “ওদিকে একটা কাজ ছিলো। সেখান থেকেই বাড়ি ফিরছিলাম কিন্তু মাঝরাস্তায় এসে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই নেমে যেতে হয়েছে।”

“এই রাতের বেলা কাজ! বাড়িতে কিছু বলবে না?”

অনুভা খেয়াল করল শ্রাবণের চোখেমুখে সন্দেহের ছাপ। তার সকল সন্দেহ দূর করার জন্য চঞ্চলা কণ্ঠে বললো,“কে কী বলবে? অফিস শেষে উল্টো পথে গিয়েছিলাম একটা প্রয়োজনে। তাছাড়া গাড়ি খারাপ না হলে তো এতক্ষণে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেও যেতাম।”

“আমি তো এমনি জিজ্ঞেস করলাম আর তুমি কিনা কৈফিয়ত দিয়ে দিলে? আগের মতোই আছো তবে।”

ভড়কে গেলো অনুভা। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে গাড়ির সামনের দ্বার খুলে দিলো শ্রাবণ।বললো,“উঠে এসো। পৌঁছে দেই।”

ইতস্ততবোধ করল অনুভা।গাড়িতে উঠতে সায় দিচ্ছে না মন। শ্রাবণ হয়তো টের পেলো তার অনুভূতি। স্লান হেসে জিজ্ঞেস করল,“ভয় পাচ্ছো? আমাকে? কই আগে তো কখনো পেতে না। তাহলে?”

উত্তর দিলো না অনুভা। গম্ভীর হয়ে এলো শ্রাবণের মুখশ্রী। শীতল কণ্ঠে বললো,“পৃথিবীতে আর কারো দ্বারা তোমার কোনো ক্ষতি হলেও শ্রাবণের দ্বারা যে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না তা আমার থেকেও তুমি খুব ভালো করেই জানো। নিজের মানুষের ক্ষতি কী কেউ করে নোভা?”

নোভা! সেই সম্বোধনীয় নাম। সেই দরদ মাখা কণ্ঠস্বর! মুহূর্তেই মন নরম হয়ে এলো অনুভার। মাথা নাড়িয়ে নিরবে গাড়িতে উঠে বসলো। তাচ্ছিল্য হাসলো শ্রাবণ। উঠে বসলো চালকের আসনে।চলতে লাগলো গাড়ি। অর্ধ নামানো কাঁচ ভেদ করে বাহিরের পরিবেশ দেখতে লাগলো অনুভা। ভেতরে সংকীর্ণতা, আতঙ্ক, জড়তা। কীসের এই আতঙ্ক? প্রশ্নের উত্তর নেই তার নিকট।ছেলেটির পাশে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে। উপরের আয়নায় ক্ষণে ক্ষণে পাশের যুবতী রমণীকে পরখ করে দেখছে শ্রাবণ। ঠোঁটের কার্ণিশে তার হাসির ফোয়ারা। সকল নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল,“তা মাস্টার্স কমপ্লিট করেছো?”

প্রশ্নটায় কিঞ্চিৎ লজ্জিত হলো অনুভা। দৃষ্টি বাহিরে রেখেই দুদিকে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো “না।”

“কেন? আমার জানামতে লেখাপড়ায় তো ভালোই ছিলে। পরিবার থেকেও ভালো সাপোর্ট ছিলো, তাহলে?”

“পরিস্থিতি অনেক কিছুই বদলে দেয়।অনার্স কমপ্লিট করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েও আর পড়া হয়নি।”

“বিয়েও তো করোনি তাহলে?”

চমকিত, বিষ্মিত দৃষ্টিতে শ্রাবণের পানে তাকায় অনুভা। সে জানলো কী করে যে অনুভা অবিবাহিত? তার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি আড়চোখে দেখে নিলো শ্রাবণ। সোজাসাপ্টা জবাব দিলো,“বিয়ে হলে নিশ্চয়ই এত রাত অবধি একা একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।”

চুপ রইলো অনুভা। শ্রাবণ ফের শুধালো,“তা কী করছো এখন? চাকরি?”

“হুম।”

“খুব ভালো।”

শ্রাবণের কণ্ঠের তাচ্ছিল্য ভাবটা খুব ভালো করেই টের পেলো অনুভা। প্রশ্ন করল,“এতদিন বাদে হঠাৎ করে আমাদের দেখা হলো? ব্যাপারটা কী কাকতালীয়?”

“তোমার কী মনে হয় ইচ্ছেকৃত? ইচ্ছেকৃত দেখা হওয়ার কোনো কাজ অথবা সুযোগ করে রেখেছিলে তুমি?”

ভড়কে গেলো অনুভা। প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করল,
“তা তুমি কী করছো? কোন প্রফেশন?”

“আপাতত একটা ভার্সিটির লেকচারার হিসেবে আছি।”

“আপাতত? পরবর্তীতে কী না থাকার পরিকল্পনা আছে নাকি?”

“দেখা যাক।”

“বিয়ে থা করেছো?”

“করা হয়নি।”

“কেন?”

প্রশ্নের বিপরীতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনুভার পানে চাইলো শ্রাবণ। তার সেই চাহনিতে ঘাবড়ে গেলো অনুভা। বুঝতে পারলো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেলেছে। মিহি স্বরে “স্যরি” বলে ফের দৃষ্টি ভিড়ালো জানলার বাহিরে। বিপরীত থেকে উত্তর এলো,“বউয়ের উপর যে অনেক দায়িত্ব। দায়িত্বের বেড়াজালে সে এতটাই আবদ্ধ যে আমাকে বিয়ে করার সময়টাই তার নেই।”

বিষ্ময়ের প্রকোভ পূর্বের থেকেও এবার বৃদ্ধি পেলো অনুভার দৃষ্টিতে। বউ! শ্রাবণের বউ! সে যে বললো বিয়ে করেনি তাহলে?পছন্দের কেউ আছে? পছন্দের নাকি একান্তই নিজের ভালোবাসার? গাড়ি থেমে গেলো। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে পুনরায় তাকালো শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ মুচকি হাসলো। বললো,“তোমার বাড়ির রাস্তায় এসে গেছি। গলিটা সরু তাই গাড়ি ভেতরে ঢুকবে না সম্ভবত।”

অনুভার মনে হলো আজ শুধুই তার চমকানোর পালা। শ্রাবণ নামক পুরুষটির মুখোমুখি সে যেদিন থেকে হয়েছে সেদিন থেকেই যেনো শুধু চমকাতে শিখেছে। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো অনুভা। ঘাড় নামিয়ে প্রশ্ন করল,“কথার তালে বাড়ির ঠিকানা জানাতেই তো ভুলে গেছিলাম। তাহলে তুমি জানলে কীভাবে আমার ঠিকানা?”

শ্রাবণের চোখেমুখে রহস্যের ছাপ। গাড়িতে স্টার্ট দিলো। বললো,“সবকিছু যে তুমি জানানোর পরেই আমি জানতে পারবো এমন ধরাবাঁধা নিয়ম কী ছিলো কখনো? রাত হয়েছে বাড়িতে যাও।”

কথা শেষ হতেই শাঁ শাঁ করে রাস্তা পরিত্যাগ করল গাড়িটি।মনে অজস্র প্রশ্ন নিয়েই গলি পার হয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা। কলিং বেল বাজাতেই আজও দরজা খুলে দিলেন সুফিয়া। পুলিশের ন্যায় জেরা করলেন,“আজ ফিরতে এতো দেরি হলো যে?”

মায়ের দিকে দুটো শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“এগুলো আনতে গিয়েছিলাম।”

মেয়ের হাত থেকে ব্যাগ দুটো নিজের হাতে নিতেই উনাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা। সুফিয়ার চোখেমুখে বিষ্ময়।ব্যাগ দুটো হাতড়ে ভেতরে পেলেন দুটো তাঁতের শাড়ি। মেয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“শাড়ি কার জন্য?”

“তোমার জন্য।”

“আমি কী তোর কাছে শাড়ি চেয়েছিলাম? দিনদিন সংসারের খরচ বাড়ছে এখন আবার অযথা খরচ করতে হবে কেন?”

“তুমি আবার নিজের জন্য কবে কী চেয়েছো? চাইতেই তো পারো না। তোমার যে বাড়িতে পরার মতো শাড়ি নেই, সেগুলো যে ছিঁড়ে গেছে তা আমায় না জানালেও আমার চোখ কিন্তু এড়ায়নি। ছেঁড়া শাড়ি ফেলে দিয়ে আপাতত এই দুটো পরতে থাকো। বেতন হাতে পেলে আরো দুটো না হয় কিনে দিবো।”

মেয়ের কথাগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই মনটা নরম হয়ে এলো সুফিয়ার। ভিজে উঠলো অক্ষি যুগল।টানাপোড়েনের সংসারে একজনের রোজগারে এতগুলো মানুষ চলা যে কি দুঃসাধ্য কাজ তা সুফিয়া খুব ভালো করেই বোঝেন। এও বোঝেন যে উনার মেয়েটা ভালো নেই। এইটুকু বয়সে বাবা-মা, বিধবা বোন আর তার সন্তানের মাথার উপর ঢাল হয়ে ভরসা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে নিজেই ডুবে গেছে চিন্তা আর দায়িত্বের অতল গহ্বরে। সব জেনে বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকতে হয় সুফিয়াকে। কারণ উনার হাত-পা বাঁধা। মেয়েটাই যে শেষ সম্বল। এই মেয়েটা না থাকলে কিংবা মেয়েটা এতদিন নিজের সুখের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লে যে উনাদের মুখ থুবড়ে পড়তে হতো। পরিবারটা ভেসে যেতো বানের জলে।

সারাদিন সকলের সঙ্গে খিটখিটে মেজাজ দেখালেও দিনশেষে আড়ালে চোখের পানি ফেলেন সুফিয়া। জায়নামাজে বসে রবের নিকট মেয়ের সুখের জন্য আকুল হয়ে দোয়া করেন।

ঘরে গিয়ে তাঈমকে দেখতে না পেয়েই ললাটে চিন্তার রেখা ফোটে উঠলো অনুভার। ঘর থেকে বের হতেই পাশের ঘর থেকে বোনের আহ্লাদী কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো। ঘরের সামনে গিয়ে উঁকি দিতেই চমকালো। তাঈমের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে অর্থিকা। মায়ের কথা না বুঝেও খিলখিল করে তাল মিলিয়ে হেসে যাচ্ছে বাচ্চাটা। অথচ তন্ময় মারা যাওয়ার পর থেকে দুধের ছেলেটাকে দু’চোখে দেখতে পারতো না অর্থিকা। বুকের দুধ খাওয়ানোও একসময় বন্ধ করে দেয়। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেই মেয়েটা কেঁদে দিতো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যেতো তার। বলতো, “ওকে দেখলেই আমার না তন্ময়ের কথা মনে পড়ে যায়। সাদা কাফনে জড়ানো তন্ময়ের লাশটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওকে দেখলে আমার কষ্ট বাড়ে। বেঁচে থাকার পরেও মৃ’ত্যু যন্ত্রনা আমায় তিলে তিলে ঘিরে ধরে।ওকে নিয়ে যা আমার সামনে থেকে। আমি ওকে সহ্য করতে পারছি না।”

খালা নাকি মায়ের মতো হয়। মায়ের পরে একমাত্র বড়ো বোন আর খালাই নাকি মায়ের মতো ভালোবাসতে পারে। কথাটা কতটুকু সত্য তা ধারণা না করা গেলেও অনুভা যেনো তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মা যখন সন্তানকে দূরে ঠেলে দিলো তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল অনুভা। মায়ের মতো যত্ন করে লালন পালন করছে। আট মাস বয়সী তাঈম এখনো কথা শিখতে না পারলেও তার ওই অ্যা অ্যা, মা মা শব্দ দিয়েই যেনো বারবার সে বুঝিয়ে দেয় অনুভা তার আরেক মা।

সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নিজ কক্ষে গেলো অনুভা। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে এই রাতের বেলায় গোসল সারলো। তারপর চলে এলো বাবার ঘরে। হাতে ব্যথা পাওয়ার পর বাবার সামনে আর আসা হয়নি। আজ হাতের ব্যান্ডেজ খুলে এসেছে। ব্যান্ডেজকৃত স্থানে লেপ্টে দিয়েছে মলম। বাবার এই এক সমস্যা, মেয়েকে নিয়ে বড্ড চিন্তা করেন। মেয়ে অসুস্থ হলেই নিজের উপর চাপিয়ে দেন সকল দোষ। মাঝেমধ্যে তো চোখের পানি ফেলে নিজের মৃ’ত্যু কামনা করতেও দ্বিতীয়বার ভাবেন না।

বিছানার ফাঁকা স্থানে এসে বসলো অনুভা। কামরুল হাসান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।মেয়ের উপস্থিতি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিতেই চোখ মেলে তাকালেন তিনি। হাস্যজ্জ্বল মুখে শুধালেন,“কখন ফিরলি?”

“আধ ঘণ্টা হবে।”

“ওহ।”

“শরীর কেমন আছে বাবা?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

“সারাক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকতে তোমার অনেক কষ্ট হয় তাই না বাবা?”

“কষ্ট তো হয় তবে শুয়ে থাকার জন্য নয় বরং তোর উপরে বোঝা হয়ে থাকার জন্য। আমি বাবা নামের কলঙ্ক তাই না রে মা? যে সময় কিনা নিজের মেয়েকে সৎ পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে তার জীবনে সুখ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার কথা সেই সময়টাতেই মেয়ের উপর এতগুলো মানুষের ভরণ পোষণের দায়িত্ব চাপিয়ে দিলাম। আমি অনেক ভুল করেছি মা। আমার লোভ করা যে উচিত হয়নি। নিজের নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া উচিত হয়নি।উচিত হয়নি তোর চাচা ফুফুদের উপর বিশ্বাস করা। তোর মায়ের কথা শুনলে হয়তো আজ এদিন দেখতে হতো না আমাকে। নিজ হাতে তোর জীবনটা নষ্ট করে দিচ্ছি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো অনুভা। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললো,
“আহা বাবা! সবসময় এসব বলে কী মজা পাও বলো তো? আজ যদি আমার জায়গায় তোমার কোনো ছেলে থাকতো তাহলে কী এড়িয়ে যেতে পারতো সকল দায়িত্ব?”

“তুই যতটা করছিস তোর জায়গায় ছেলে হলে কখনোই আমাদের জন্য এতটা করতো না। জীবনে কত দেখলাম।”

“এসব বলে আর কী লাভ? আফসোস করলে কী আর সেই সুদিন ফিরে আসবে? এসব ভেবে ভেবেই দিনদিন শরীরের অবস্থা উন্নতির বদলে আরো খারাপ হচ্ছে তোমার। ঘুমাও এবার।”

কথাটা বলেই দ্রুত বাবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো অনুভা। বেশিক্ষণ সামনে থাকলে হয়তো নিজেও দুর্বল হয়ে পড়তো।
________

গাড়ি পার্কিং করে বাড়িতে প্রবেশ করেছে শ্রাবণ। ভেসিংয়ে হাতটা ধুয়েই বসে পড়ল ডাইনিংয়ের চেয়ারে। ছেলের এসব ছোটো খাটো অনিয়ম দেখলেই মেজাজ খারাপ হয় পিতা হানিফ শেখের। শক্ত গলায় বললেন,
“বাহির থেকে এসেছো। ফ্রেশ হয়ে, পোশাক বদলে তারপর খেতে বোস।”

বাবার কথা শেষ হতে না হতেই ভাত মাখিয়ে এক লোকমা মুখে পুরে নিয়েছে শ্রাবণ। মুখের খাবার টুকু শেষ করে ব্যস্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তরে বললো,“উপরে যাবো তারপর আবার নিচে এসে খাবো? এতশত ঝামেলার দরকার কী? তাছাড়া আমার প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। একেবারে খেয়েদেয়ে তারপর ঘরে যাবো।”

ক্রুদ্ধ হলেন হানিফ শেখ। বিদ্রুপ করে বললেন,“তুই না শিক্ষক? একজন শিক্ষক হয়ে যদি নিজের মধ্যেই সঠিক শিক্ষা ধরে রাখতে না পারিস তাহলে ছেলে- মেয়েদের কী শেখাবি?”

“ছেলে-মেয়েরা যা শিক্ষা পাওয়ার পরিবার এবং স্কুল শিক্ষকদের কাছ থেকেই পেয়ে আসে। আমরা হচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমাদের কাজ ক্লাসে ঢুকে একেক দিন একেকটা টপিকসে লেকচার দেওয়া যা আমি খুব ভালো করেই দিতে পারি।”

“বেয়াদব।”—-বিড়বিড় করতে করতে নিজের খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন হানিফ শেখ।

পিতার কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে নিজের মতো খেতে লাগলো শ্রাবণ। খাওয়া শেষ করে এঁটো প্লেটে হাত ধুতেই নিরবতা ভেঙে মা শান্তা বলে উঠলেন,
“এই না বললি খুব খিদে পেয়েছে? তাহলে এত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ হলো কী করে? তেমন করে তো কিছুই খেলি না।”

“পেটে যতটুকু আঁটবে ততটুকুই তো খাবো মা।”

বসা থেকে ওঠার জন্য উদ্যত হতেই হানিফ শেখ পুনরায় ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,“তা বিয়ে সাদি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস নাকি?”

ভ্রু দ্বয় কুঁচকে নিলো শ্রাবণ। শুধালো,“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”

“তোর মতিগতি দেখে তো তাই মনে হলো। খাওয়ার সময় আর মর্নিং ওয়াকের সময় ছাড়া তো তোর টিকিটিও পাওয়া যায় না। বিয়ের বয়স হয়েছে সেই কবে। ভালো চাকরিও করছিস। ওদিকে সৌহার্দ্যের লেখাপড়াও শেষ। ওরও তো বিয়ের বয়স হয়েছে। ছুটি শেষ হলেই কয়েকদিন পর আবারো চলে যাবে দেশের বাহিরে। তোর জন্য তো আর ওর বিয়েটা আটকে রাখতে পারি না। তাছাড়া মানুষের হায়াৎ মউত সব আল্লাহর হাতে। কবে মরে যাই তা তো সঠিক জানি না তাই তোদের দুই ভাইকে বিয়ে দিয়ে আমি আর তোর মা মিলে সামনের বছরই হজ্জে যেতে চাইছি।”

আড়চোখে ছোটো ভাইয়ের পানে তাকালো শ্রাবণ। সৌহার্দ্যকে দেখে যেনো মনে হচ্ছে ভাঁজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। একেবারে বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান। কিন্তু এ ছেলেটারই যে পেটে পেটে শয়তানী তা শ্রাবণ ছাড়া কেউই জানে না। চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো মনোযোগ সহকারে খাবার খাচ্ছে সৌহার্দ্য। এমন ভাব আশেপাশের কোনো কথাই কর্ণগোচর হয়নি তার। বাবা যা সিদ্ধান্ত নিবে তাতেই সে রাজি।

গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো শ্রাবণ। পিতার উদ্দেশ্যে বললো,“আমার বিয়ে নিয়ে ভাবতে তো আগেই নিষেধ করে দিয়েছি তোমাদেরকে। হজ্জে যাবে ভালো কথা। ছেলের বিয়ে দিবে তাও ভালো কথা। আমার জন্য সৌহার্দ্য কেন আটকে থাকবে?ওর জন্য তোমরা বরং মেয়ে খোঁজা শুরু করে দাও। হজ্জে যাওয়ার আগে বিয়েটা ওর দিয়ে দাও।”

শান্তা ঘোর প্রতিবাদ করে বললেন,“সে কী কথা? বড়ো ভাই রেখে ছোটো ভাইয়ের বিয়ে? লোকে কী বলবে?”

“লোকে কিছুই বলবে না।”

“এমন করছিস কেন মেহু? বিয়ে তো মানুষকে করতেই হয় তাই না।”

“আমিও তো তাই বলি।”

চট করে আনন্দিত হয়ে গেলেন শান্তা। আহ্লাদী কণ্ঠে বললেন,“তাহলে রুবির সঙ্গে কথা বলি? রুবির ননদের মেয়েটা এবার ভার্সিটিতে পড়ছে। কয়েক মাস আগে বেড়াতে গেলাম না?তখন সেও এসেছিল। প্রথম দেখাতেই মেয়েটাকে আমার মনে ধরেছে।”

“তোমার মনে ধরলেই তো হবে না। সংসার যেহেতু আমায় করতে হবে সেহেতু মনেও আমারই ধরতে হবে।”

“মেয়ে অনেক সুন্দর। তোরও পছন্দ হবে।”

“হবে না, মন অনেক আগেই অন্য কাউকে দেওয়া হয়ে গেছে। ওই মেয়েকে তোমার অতিরিক্ত পছন্দ হলে ছোটো ছেলের বউ করে ঘরে নিয়ে এসো।”

বড়ো ভাইয়ের কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই আঁতকে উঠলো সৌহার্দ্য। টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো শ্রাবণ। সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে কিছু একটা মনে পড়তেই পিছু ফিরে ছোটো ভাইয়ের পানে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,“আমি না হয় বেয়াদব কিন্তু তোমাদের ছোটো ছেলে তো খুবই ভদ্র, বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান। বাধ্য সন্তানরা কখনো প্রেম করে না তাই আশা করি তুমি যাকে পছন্দ করবে ও তাকেই বিয়ে করবে মা।”

কথাটা বলা শেষ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে নিজের পথে পা বাড়ালো শ্রাবণ। তৎক্ষণাৎ গলায় খাবার আঁটকে গেলো সৌহার্দ্যের। উন্মাদের মতো কাশতে লাগলো। শান্তা ছেলের পিঠে চাপড় মারতে মারতে বিচলিত কণ্ঠে শুধালেন,“কী রে তোর আবার কী হলো?”

হানিফ শেখ ধমকের সুরে স্ত্রীর উদ্দেশ্য বললেন,
“প্রশ্ন পরে করো আগে পানি দাও ওকে।”

পুত্রের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন শান্তা। গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে গ্লাসের পুরো পানি শেষ করল সৌহার্দ্য। কাশির পরিমাণটা পূর্বের তুলনায় কমে এসেছে। এঁটো হাত ধুয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। কক্ষের দিকে অগ্রসর হতে হতে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,“আমার ঘুম পেয়েছে আমি ঘুমাতে গেলাম।”

ছেলের যাওয়ার পানে দুজনেই হা করে তাকিয়ে রইলেন। তাদের চাহনির মধ্যে একটাই প্রশ্ন,“হঠাৎ করে এর আবার কী হলো?”

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

সুখেরও সন্ধানে পর্ব-০১

0

#সূচনা_পর্ব
#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই

বিপরীত মুখী থেকে আগত বাইকের সংঘর্ষে পিচ ঢালা রাস্তার উপর উল্টে গেলো চলন্ত রিক্সাটি। সঙ্গে সঙ্গেই রিক্সা থেকে ছিটকে পড়ল অনুভা। বাম হাতের কব্জি ছিঁলে ফিনকি দিয়ে বের হতে লাগলো তরল তাজা র’ক্ত। মারাত্মক ব্যথায় অক্ষি যুগল থেকে বর্ষনের ন্যায় নিঃসৃত হচ্ছে অশ্রুজল। রিক্সা চালকের অবস্থাও মর্মান্তিক। আশেপাশের পথচারীরা দৌড়ে এলো ঘটনাস্থলে। শুরু হলো শোরগোল। আধ বোজা চোখে চাইলো অনুভা। ঘাড় উঁচিয়ে আবছা দৃষ্টিতে চারিদিকে একবার পর্যবেক্ষণ করে পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করে নিলো নিজ অক্ষি যুগল।হঠাৎ করেই শোনা গেলো আকুতি ভরা এক পুরুষালী কণ্ঠস্বর,“আপু উনাকে ধরে একটু সিএনজিতে উঠিয়ে দিন না। অনেক র’ক্তক্ষরণ হচ্ছে। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।”

যেই মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলা হলো সেই মেয়েটি এগোলো না সামনে। ভয়ে নিজ স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। তার নড়চড় না দেখে নিজ দায়িত্বে এগিয়ে আসতে লাগলো দুজন পুরুষ লোক। তাদের মধ্যকার একজন বলে উঠলো,“আমরা সাহায্য করছি। এই ধরুন তো উনাকে।”

পুরুষটি বাঁধ সাধলো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে লোক দুটোর উদ্দেশ্যে বললো,“আপনারা পুরুষ মানুষ। পুরুষ হয়ে অপরিচিত এক নারীকে ধরা কী আদৌ উচিত হবে? যেখানে আছেন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।”

থেমে গেলো লোক দুজন। পুরুষটির কথা শুনতেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী। হাঁটু গেঁড়ে বসলেন অনুভার সম্মুখে। বিচলিত কণ্ঠে বললেন,“আহারে কতটা কেটে গেছে! আমার হাত ধরে সাবধানে উঠুন দেখি।”

মহিলাটির সাহায্যে উঠে দাঁড়ালো অনুভা। ছিটকে পড়ায় হাঁটুতেও অনেকটা লেগেছে। হাঁটুর অংশের সালোয়ারটায় খানিকটা ছিঁড়ে গেছে। পরনের হলুদ জামা এবং হিজাবের সামনের অংশেও র’ক্তে মাখামাখি। তাকে নিয়ে মহিলাটি সিএনজির দিকে এগোতে নিলেই সেই পুরুষটি উনার হাতে ধরিয়ে দিলো একটি রুমাল। বললো,“রুমালটা উনার ক্ষত স্থানে চেপে ধরে রাখতে বলুন।”

কণ্ঠস্বরের মালিকের কথাটা এবারো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো অনুভার। মনে হলো কণ্ঠস্বরটির সঙ্গে সে পূর্ব পরিচিত। তবে মস্তিষ্ক চট করে কণ্ঠস্বরের মালিক কে হতে পারে তা ধরতে পারলো না। ঘোলাটে দৃষ্টিতে পুরুষটিকে দেখতে চেয়েও দেখতে পারলো না।ততক্ষণে তাকে উঠিয়ে দেওয়া হলো সিএনজিতে। মহিলাটিও কি মনে করে যেনো তার সঙ্গেই উঠে পড়ল। নিজ দায়িত্বে ক্ষত স্থানে চেপে ধরলো রুমালটি। শক্ত করে আরেক হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখলো বাহু।

নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছাতেই দুজন নার্স ধরাধরি করে একটি কেবিনে নিয়ে বসালো অনুভাকে। একজন ডাক্তার এসে ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। পূর্বের ব্যথাটা কিছুটা হলেও এবার যেনো লাঘব হলো অনুভার। তাকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে বলে চলে গেলেন ডাক্তার। ততক্ষণে সেই অপরিচিত ভদ্রমহিলাও বিদায় নিয়েছে। কিছু সময় অতিবাহিত হলো। হুট করে কিছু একটা মনে পড়তেই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো অনুভার। অশান্ত দৃষ্টিতে আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। তার এহেন ছটফটানি লক্ষ্য করে এগিয়ে এলেন একজন নার্স। প্রশ্ন করলেন,“কিছু খুঁজছেন আপনি?”

“আমার ভ্যানিটি ব্যাগ সাথে দুটো ফাইলও ছিলো।”

কেবিনের টেবিলের উপর থেকে একটা ব্যাগ এবং ফাইল দুটো এনে অনুভার হাতে তুলে দিলেন নার্সটি। বললেন “এই নিন। ব্যাগের ভেতরে সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিন।”

চটজলদি ব্যাগের ভেতরটা চেক করল অনুভা। সঙ্গে সঙ্গে খুঁজে পেলো মুঠোফোন। ফোনটা অন করতেই স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করা ভাসমান নাম্বার গুলোতে দৃষ্টি আটকালো তার। মুহূর্তেই কেঁপে উঠলো অন্তরাত্মা। অফিস থেকে প্রায় এগারোটা কল এসেছে। সাথে এসেছে বসের তিক্ত কিছু ম্যাসেজ।

ফাইলের পানে তাকাতেই অনুভা আঁতকে উঠলো। উপরের মোটা কাগজটার অবস্থা নাজেহাল। সাথে মনে পড়ল আজকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং ছিলো অফিসে। ফরেনার এক ক্লাইন্ট আসবেন। এই ফাইল দুটোর মধ্যকার একটাতেই তো ছিলো সেই মিটিংয়ের সকল বিষয় বস্তু। ললাট বেয়ে কপোলে এসে পড়ল সরু ঘাম। চাকরি হারানোর চিন্তায় মাথা ব্যথা হওয়ার উপক্রম। অশান্ত চোখ জোড়া দিয়ে বেখেয়ালি ভাবে আশেপাশে তাকাচ্ছে সে। তৎক্ষণাৎ কেউ একজন উপস্থিত হলো কেবিনে। তার সামনে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,“এই নিন আপু, আপনার ওষুধ।”

ধ্যান ভঙ্গ হলো অনুভার।মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য যৌবনে পা দেওয়া একজন যুবককে। ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত করে শুধালো,
“আপনি? কে আপনি?”

ছেলেটি কাঁচুমাচু মুখ করে উত্তর দিলো,“যেই বাইকের জন্য আপনার এই অবস্থা হলো সেই বাইকেরই চালক আমি। গতকালই বাবা নতুন বাইক কিনে দিয়েছে। অতশত চিন্তা না করে ফুল স্পীডে অন্য রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় টার্ন করতেই আপনাদের রিক্সার সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। স্যরি আপু। আমি বুঝতে পারিনি এত বড়ো একটা দুর্ঘটনা যে ঘটে যাবে।”

অনুভা খেয়াল করল তার থেকেও ছেলেটার অবস্থা খারাপ। কপালে ব্যান্ডেজ সাথে ডান হাতটাও গলায় ঝুলছে। অনুভা কিছুটা ইতস্তত করে বললো,“স্যরি বলার প্রয়োজন নেই। কেউ তো আর ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটায় না। আপনার অবস্থা তো আমার থেকেও করুণ। তা এই ওষুধের আবার কী দরকার ছিলো? আমি নিজেই তো কিনে নিতাম।”

“আমি কিনিনি আপু। একটা ভাইয়া এসে প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে বললেন আপনার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।”

“ভাইয়া? কোন ভাইয়া?”

“নাম তো জানা হয়নি। তবে দুর্ঘটনা স্থলে উনি ছিলেন। আমাকে তো উনিই হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন।”

বিপরীতে আর কোনো প্রশ্ন করল না অনুভা। চুপচাপ প্যাকেটটা গ্ৰহণ করল। ছেলেটি তার থেকে বিদায় নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে স্থান ত্যাগ করল। আর বিলম্ব না করে হাসপাতালের পাট চুকিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো অনুভা।এখন অফিসে যাওয়ার মতো অবস্থায় সে নেই। কাল যা হবে তা না হয় কালই দেখা যাবে।
______

চতুর্থ ফ্লোরের একটি ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে বাচ্চার গগন বিধারক চিৎকার। একজন পৌঢ় মহিলা দোলনার সম্মুখে বসে বাচ্চাটির কান্না থামাতে ব্যস্ত। ফিডারে করে দুধ এনে মুখের সামনে ধরার পরেও বাচ্চাটির কান্না যেনো কিছুতেই থামছে না। মহিলার চোখেমুখে অসহায়ত্ব। কীভাবে একে থামাবেন বুঝতে পারছেন না। ভেতর ঘর থেকে ভেসে আসছে অধৈর্য বয়স্ক পুরুষ কণ্ঠ,“কী হলো? নানাভাই কাঁদছে কেন? ওকে এ ঘরে নিয়ে এসো।”

মহিলা নিজ স্থান থেকেই উত্তর দিলেন,“ওর কান্না আমি থামাচ্ছি। তুমি ঘুমাও, এমনিতেই যে পাওয়ারের ওষুধ খেয়েছো।”

পূর্বের ন্যায় নিরবে বিছানায় শুয়ে রইলেন কামরুল হাসান। চোখেমুখে উনার স্পষ্ট ফোটে উঠেছে অক্ষমতা। তৎক্ষণাৎ বেজে উঠলো কলিং বেল। কলিং বেলের শব্দে সুফিয়ার মনে দেখা দিলো আশার আলো। ইচ্ছে করল এক ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিতে কিন্তু পায়ের ব্যথাটার কারণে পারলেন না ছুটে যেতে। বাচ্চাটিকে রেখেই ছোটো ছোটো কদমে কিছুটা সময় নিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দরজার অপরপাশের ব্যক্তিটিকে দেখতেই উনার মুখের আদল বদলে গেলো। কুঞ্চিত হলো ভ্রু দ্বয়। কালক্ষেপণ না করেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“একি! এই অসময়ে তুই? এত তাড়াতাড়ি অফিস ছুটি?”

ক্লান্ত এবং অসুস্থ দেহখানা নিয়ে সুফিয়াকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা। বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেতেই থমকে দাঁড়ালো। শুধালো,“তাঈম কাঁদছে না? ওর আবার কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছে কেন?”

প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে মায়ের পানে একবার তাকিয়ে তারপর দ্রুত পায়ে চলে গেলো দোলনার কাছে। দ্রুত তাঈম নামক বাচ্চাটিকে তুলে নিলো নিজ কোলে। পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে আহ্লাদী সুরে বললো,
“কাঁদে না, কাঁদে না, কাঁদে না বাবা আমার।”

পরিচিত কণ্ঠস্বর এবং স্পর্শ পেতেই কান্নার গতি হ্রাস পেলো শিশুটির। তাকে এবার পাঁজা কোলে নিলো অনুভা। কপালে, গালে, চোখে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। কাদু কাদু মুখ করে বললো,“কাঁদে কেন আমার বাবাটা? কী হয়েছে? নানু বকেছে?”

পুরোপুরি ভাবে কান্না থেমে গেলো ছোট্ট বাচ্চার। ড্যাবড্যাব দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো অনুভার পানে। আদো আদো কণ্ঠে উচ্চারণ করতে লাগলো,“মা, মা, মা।”

অনুভার অশান্ত, চিন্তিত মুখশ্রীতে ফোটে উঠলো এক চিলতে হাসি। সুফিয়া এগিয়ে এলেন। কোমরে হাত চেপে বসে পড়লেন সোফায়। দম ছেড়ে বললেন,
“অবশেষে থামলো উনার কান্না। কতক্ষণ ধরে যে কান্না করছিল! আমি কত চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই থামলো না।”

“এতো চেষ্টা করতে বলেছে কে? একটু কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করলেই তো কান্না থেমে যেতো।”

“তুই জানিস না আমার কোমরে আর পায়ে যে ব্যথা? নিজেই কত কষ্ট করে যা একটু হাঁটা চলা করি তার উপর ওকে কোলে নিয়ে নেচে নেচে কান্না থামানোর জো আছে?”

কথা বাড়ালো না অনুভা। বললো,“গোসলটাও তো করিয়েছ বলে মনে হয় না। যাই হোক পারলে ওর ফিডার আর সুজিটা দিয়ে যেও। খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবো।”

কথাটা বলা শেষ করে নিজ ঘরের দিকে পা বাড়ালো অনুভা। তখনি পেছন থেকে ডেকে ওঠেন সুফিয়া। এতক্ষণে মেয়ের অবস্থা উনার দৃষ্টিগোচর হলো। শুধালেন,“তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কী হয়েছে? এই জন্যই অফিস থেকে চলে এসেছিস?”

“তেমন কিছু না।পথে ছোটো খাটো একটা এক্সিডেন্ট ঘটেছে। চিন্তা করো না ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ বাবার কান পর্যন্ত যাতে কথাটা না পৌঁছায়।”

কথাটা শেষ হতে হতে ঘরে পৌঁছে গেলো অনুভা। দরজা ভিড়িয়ে বালিশ ঠিক করে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাঈমকে। খানিকক্ষণ বাদে একহাতে দুধ ভর্তি ফিডার আরেক হাতে সুজির বাটি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন সুফিয়া। মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,“তুই গিয়ে জামা-কাপড় বদলে আয়। আমি ওকে খাওয়াচ্ছি।”

মায়ের হাত থেকে সুজির বাটিটা নিজ হাতে নিয়ে নিলো অনুভা। যত্ন সহকারে তাঈমকে খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,“তার প্রয়োজন নেই। আমি আছি, বাকি সময়টা আমিই বুঝে নিবো কী করতে হবে আর কী করতে হবে না। তুমি বরং ঘরে যাও।”

কথাটা গায়ে লাগলো সুফিয়ার। যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “একেই বলে মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। এমন ভাব যেনো আমি ওর কিছুই হই না।”

সম্পূর্ণ কথাটা কর্ণগোচর হতেও বিপরীতে কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করল না অনুভা। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তাঈমকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। তারপর চলে গেলো নিজের পোশাক বদলাতে। যত যাই হোক না কেন, ছেলেটা ওর ছোঁয়া পেলেই একেবারে শান্ত হয়ে যায়।

স্ত্রীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখেই কামরুল হাসান উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন,“কে এসেছে? অর্থি? নানাভাইয়ের কান্না থেমেছে?”

“অনু এসেছে। ওই থামিয়েছে তাঈমের কান্না।”

“ও না অফিসে গেলো? যাওয়ার আগে বলেও তো গেলো কী নাকি একটা মিটিং ফিটিং আছে।”

“জানি না। বড়ো হয়েছে, এখন কী আর বাবা-মায়ের কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে? যা ইচ্ছে করুক গিয়ে।”

“তুমি সবসময়ই ভুল বোঝো মেয়েটাকে।”

“হ্যাঁ ও তো আমার সৎ মেয়ে যে ওকে ভুল বুঝবো সারাক্ষণ। মাঝেমধ্যে এমন করে কথা বলো যেনো আমি নই বরং তুমিই ওদের পেটে ধরেছো।”

বলেই মুখ বাঁকিয়ে উল্টো দিকে মুখ করে বসে রইলেন সুফিয়া। কামরুল হাসান নিরব রইলেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীর খিটখিটে স্বভাবটাও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।ভালো কথাকেও প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে অসহ্য করে তুলেন এই ভদ্রমহিলা। মাঝে মাঝে কামরুল হাসানের ইচ্ছে করে মেয়েকে বলতে,“তোর মাকে দয়া করে ভালো একটা ডাক্তার দেখা। এর ব্যবহার আমি আর নিতে পারছি না। আমার অসহ্য লাগছে সবকিছু।” কিন্তু বাধ্য হয়েই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে হয়। এই একটা মেয়ের উপর আর কতই বা সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া যায়? তাছাড়া স্ত্রীর এই অবস্থার মূল কারণও যে তিনি।

ফ্রেশ হয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে অনুভা। শরীরটা তার অবশ লাগছে। উত্তাপ ছড়িয়ে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। হাতের ব্যথাটা আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। খাবারের পর একটা ওষুধ আছে। কিন্তু পেটে ক্ষুধা থাকলেও খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার মধ্যে নেই। মাথায় অন্য চিন্তা,
“কাল অফিসে যাবো কী করে? স্যার যদি সবার সামনে আবারো অপমান করেন? চাকরি থেকে বের করে দিলে? কী হবে তখন?”

বিভিন্ন ভাবনা ভাবতে ভাবতে মাথাটা ভার হয়ে এলো অনুভার। মনে হয় জ্বর আসবে। ছোটো থেকেই তার এই একটা সমস্যা। শরীরে তীব্রতর কোনো আঘাত লাগলেই গা পুড়িয়ে জ্বর আসবে। নিজের শরীর নিয়ে আর হেলাফেলা না করে খাবার খেয়ে ওষুধ সেবনের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলো। নিজের জন্য তো নিজেকেই ভাবতে হবে।
_______

একটি কালো দিন পেরিয়ে নব্য দিনের সূচনা হলো। ভয়ার্ত মন নিয়ে অফিসের ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা। চোরা দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে সবাইকে পরখ করে নিলো। কেউই তার পানে একবারের জন্যও তাকাচ্ছে না। নিজ টেবিলে গিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগটা রাখতেই সামনে উপস্থিত হলেন বসের পিয়ন আজগর। পান খাওয়া দাঁত বের করে হেসে লম্বা একটা সালাম দিলেন। বললেন,“স্যার আপনারে যাইতে কইছে ম্যাডাম।”

সালামের জবাব নিলো অনুভা। বড়ো একটা ঝড় যে তার উপর আসতে চলেছে তা খুব ভালো করেই টের পেলো। সবার সামনে যদি স্যার চিৎকার চেঁচামেচি করে তখন কী হবে? লজ্জায় সকলকে মুখ দেখাবে কী করে অনুভা?চিন্তায় চিন্তায় ললাটে ঘাম জমেছে। আজগর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠলেন,“ম্যাডাম কী ভয় পাইতাছেন? ভয় পাইয়া আর কী করবেন? যা হওয়ার হইয়া গেছে। চলেন এইবার। দেরি কইরা গেলে স্যারে আরো রাইগা যাইবো।”

“আচ্ছা চলুন।”

“আপনে যান। আমার অন্য কাম আছে।”

বলেই পিঠ বাঁচিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন আজগর। শুকনো ঢোক গিলে বসের কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অনুভা। দরজায় নক করার পূর্বেই ভেতর থেকে ভেসে এলো এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর,“আসুন।”

অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। চেয়ারের উপর ফর্মাল পোশাকে বসে আছে একজন সুদর্শন পুরুষ। চোয়াল তার শক্ত। মুখশ্রীতে রাগ বিদ্যমান। লোকটির দিকে একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর সেই দৃষ্টি সরিয়ে মেঝেতে স্থির করল অনুভা। ভয় পেলে চলবে না। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে কিছু বলার জন্য ঠোঁট নাড়াতেই তাকে থামিয়ে দিলো তানিম। কণ্ঠে গাম্ভীর্য এঁটে বললো,“নো এক্সপ্লেইন।”

থতমত খেয়ে গেলো অনুভা। আপাতত চুপ করে থাকাকেই শ্রেয় মনে করল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো তানিম। বললো,“মিটিংটা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো জানতেন না আপনি? এই ডিলটা আমাদের কোম্পানির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাও কী জানতেন না আপনি? তাহলে এমন একটি জঘন্য কাজ করলেন কীভাবে? এমন অনভিজ্ঞ, অকাজের মানুষজনকে কী দেখে যে কাজে রাখা হলো তাই তো বুঝতে পারছি না।”

ধমকে নড়েচড়ে উঠলো অনুভা। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। তানিম এবার একাধিক প্রশ্ন ছুঁড়লো,“সত্যি করে বলুন তো, আমাদের বিরুদ্ধে কে আপনাকে হায়ার করেছে? আমাদের কোনো প্রতিযোগী কোম্পানি? নাম কী সেই কোম্পানির? কত টাকার বিনিময়ে তাদের হয়ে কাজ করছেন?”

বিস্ফোরিত নেত্রে সম্মুখে বসা লোকটির দিকে ফের তাকালো অনুভা। কম্পিত হলো হৃদয়। তার থেকে আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে আবারো চোখমুখ কঠিন হয়ে এলো তানিমের। দৃশ্যমান হলো ললাটের রগটা। শাসিয়ে বলে উঠলো,“ভালোয় ভালোয় সত্যটা বলবেন নাকি আমি পুলিশ ডাকবো?”

ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও বাহির থেকে নিজেকে যথেষ্ট সামলে নিলো অনুভা। বললো,“কেউ আমায় হায়ার করেনি স্যার। আমি তো সঠিক সময়েই অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। কিন্তু মাঝপথে আসতেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ি। যেই রিক্সাটিতে উঠেছিলাম সেই রিক্সাটা এক্সিডেন্ট করে। এই দেখুন আমার হাতে এখনো ব্যান্ডেজ।”

হাতের ব্যান্ডেজ করা স্থানটা তুলে ধরলো অনুভা। তানিম সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। অনুভা ফের বললো,“আমার কাছে প্রেসক্রিপশনও আছে স্যার। আপনি বললে ব্যাগ থেকে গিয়ে নিয়ে আসি? আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি। এই মিটিং নষ্ট করে আমার কী লাভ?”

“নিয়ে আসুন।”

“কী?”

“প্রেসক্রিপশন।”

অনুভা মাথা নেড়ে দ্রুত পায়ে নিজের টেবিলের দিকে অগ্ৰসর হলো। এমন কিছু হওয়ার আন্দাজ আগেই করেছিল সে, বিদায় সঙ্গে করে প্রেসক্রিপশনটাও নিয়ে এসেছে। ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করে পিছু ফিরতেই দেখতে পেলো দাঁড়িয়ে আছে তানিম। তার হাত থেকে একটানে নিয়ে নিলো প্রেসক্রিপশনটা। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই অনুভার। তার দৃষ্টি চারিদিকে ঘুরছে। ভয়টা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবার সামনেই যদি কড়া কিছু বলে অপমান করে বসে তানিম? আর যাই হোক লজ্জায় যে কারো সামনে উঁচু শিরে দাঁড়ানো যাবে না তা অনুভা পুরোপুরি ভাবে নিশ্চিত। এর আগেও বস নামক লোকটির থেকে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে। তবে এবারের ব্যাপারটা আগেরগুলোর তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত অন্যায় কাজ।

তানিম কড়া গলায় বলে উঠলো,“এসব অভিনয় তানিম এহসানের সামনে চলবে না। এবারের মতো মাফ করে দিলাম। এরপর এমন ভুল হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে চাকরি থেকে বের করে দিবো।”

তারপর নিজ এসিস্ট্যান্টের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বললো,“নাহিয়ান! উনার এই মাসের বেতন থেকে তিন হাজার টাকা কেটে রাখবে।”

কথাটা বলেই হনহনিয়ে স্থান ত্যাগ করল তানিম। অসহায় দৃষ্টিতে একবার অনুভার পানে তাকিয়ে নাহিয়ানও ছুটলো স্যারের পিছু। লজ্জায় মাথা নিচু করে চেয়ার টেনে বসে পড়ল অনুভা। তাকে এমন ভাবে অপদস্থ হতে দেখে সামনের টেবিলগুলোতে বসা কয়েকজন মুচকি মুচকি হাসছে। মেয়েটাকে বকা খেতে দেখে তাদের যেনো খুব আনন্দ হয়।

কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই অনুভার। তার মনে বাসা বেঁধেছে চিন্তারা। তিন হাজার টাকা আদৌতেও কী কম কিছু? তাদের মতো মধ্যবিত্তদের কাছে তো এই তিন হাজার টাকাই লাখ টাকার সমান। পুরো বেতন দিয়ে সংসারসহ এতগুলো মানুষের আলাদা আলাদা খরচ চালাতে গিয়েই তো হিমশিম খেয়ে যায় অনুভা। মাস শেষে হাতে একটা টাকাও অবশিষ্ট থাকে না। চলতে হয় ধার দেনা করে। সেখানে এবার আরো তিন হাজার টাকা কম?

চলবে_______

আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#১২তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক



আমি নির্বাক তাকিয়ে আছি ফৌজিয়ার চোখের দিকে। তার চোখ ভেজা জবজবে। গালে জলের ধারা।নাকে সর্দি জমেছে।
ফৌজিয়া কান্নাভেজা গলায় বললো,’ আমায় তুমি খারাপ মেয়ে ভাবছো তাই না তপু? ভাবছো আমিই তোমার ভাবীর সংসার নষ্ট করে দিয়েছি? এইসব কিছুর পেছনে আসল কালপ্রিট আমি এটাই ভাবছো তাই না তপু?’
চোখ মুছলো হাতের পিঠ দিয়ে ফৌজিয়া। তারপর বললো,’ আমি সংসার নষ্ট করিনি তোমার ভাবীর। সত্যি আমি এটা করিনি।’
এরপর এক অদ্ভুত কান্ড ঘটলো। সে ডাকলো হঠাৎ করে,’ অপি ভাবী, অপি ভাবী? এদিকে আসুন তো!’
আমায় অবাক করে দিয়ে ঠিক তখনই ওপাশের ঘরের দরজা খুলে অপি ভাবী এলো।অপি ভাবীকে এখনও দেখতে রোগা লাগছে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে একেবারে।
ফৌজিয়া বললো,’ ভাবী, ওদিকে বসুন।’
ভাবী আমার পাশেই বসলো।
এবার ফৌজিয়া বললো,’ আমি কি আপনার সংসার ভেঙেছি ভাবী? বা আমি আপনার সংসার ভাঙার জন্য কোন রকম দায়ী? ‘
অপি ভাবী তখনই কথা বললো না। সে কথা বললো খানিক পর।বললো,’ না। তুমি বরং আমায় ঠিক পথ দেখিয়েছো। আমি রাগে অন্ধ হয়ে নিজের গর্ভের সন্তানটিকে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলাম। তুমি তা করতে দেওনি।আমি সু*ইসাইড করার ডিসিশন নিয়েছিলাম।ওখান থেকেও ফিরিয়ে এনেছো তুমি। এরচে আরো বড় বিষয় হলো তুমি আমায় প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছো যে অপু কতোটা ভ*য়ংকর লোক! তুমি দেখিয়ে দিয়েছো অপুর সত্যিকারের রূপ।ওর আড়ালের চেহারা। ‘
আমি শুধু ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।কথা শুনছিলাম ওদের।
ফৌজিয়া এবার বললো,’ আরো কিছু শুনাই তোমায় তপু? গুরুত্বপূর্ণ কিছু।এইসব কিছু শুনলে বা দেখলে তুমি বুঝতে পারবে তোমার ভাই কতোটা ভয়ংকর লোক! তুমি বুঝতে পারবে সে অতোটা অমানুষ কিংবা সে আসলেই কোন মানুষ কি না! ‘
আমি শুনতে চাই, কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। চুপচাপ বসে রইলাম। ফৌজিয়া তার ল্যাপটপ নিয়ে এলো। টেবিলের উপর তা রেখে ফাইলে গিয়ে একটা ভিডিও চালু করলো।ভিডিও করা হয়েছে ফৌজিয়ার বাসাতেই।এই রুমেই। গোপন ক্যামেরা দিয়ে।তার মানে অপু ভাইয়ার কদিন ধরেই এই বাসায় যাতায়াত ছিল।
ফৌজিয়া বললো,’ ভিডিওতে যে কথাগুলো তোমার ভাইয়া বলছে তা তুমি মনোযোগ সহকারে শুনো।’
আমি ল্যাপটপের স্ক্রিনের আরো কাছাকাছি গিয়ে বসলাম।ভিডিওতে এই সোফার উপরেই ভাইয়া আর ফৌজিয়া কাছাকাছি বসে আছে। ফৌজিয়া ভাইয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে।আর সে ভাইয়াকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে।আর ভাইয়া সেসবের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
ফৌজিয়া ভাইয়াকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো,’ বিয়ে করবে কবে আমায় অপু?’
‘তুমি যখন চাও তখনই।’
ভাইয়া মৃদু হেসে উত্তর করলো।
ফৌজিয়া বললো,’ তোমার ঘরে যে একটা বউ আছে তাকে কি করবে? নাকি আমায় সতীনের ঘর করতে হবে আবার! ‘
ভাইয়া হা হা করে হেসে উঠলো। তারপর বললো,’ ওটা পুরনো জিনিস।ডেট এক্সফায়ারড।লাথি মেরে শালীকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিবো।’
বলে ভাইয়া ফৌজিয়াকে কাছে টানলো। তারপর বললো,’ কিভাবে কি করবো সব ডিসিশন নেয়া শেষ আমার।পুরো প্লট সাজিয়ে ফেলেছি আমি।টাকা পয়সা ছিটিয়ে দিয়ে লোক লস্কর ভাড়াও করে ফেলেছি।হা হা হা।’
ভাইয়া আবার হাসলো।
ফৌজিয়া বললো,’ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। সবকিছু ভেঙে বলো।’
ভাইয়া বললো ,’ আমার ফোনের মেমোরিতে অপির ন্যুড ছবি আছে।ভিডিও আছে। আমার ফোনটা আমি নিজেই কোথাও লুকিয়ে ফেলবো।’
ফৌজিয়া ভাইয়ার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো।বললো,’ ফোন লোকালে কি হবে? ‘
ভাইয়া হাসলো। হেসে বললো,’ মেয়ে মানুষের মাথা মোটা থাকে। তুমি ডাক্তার মানুষ।আমি ভেবেছিলাম তোমার মাথা অন্ততঃ মোটা না। কিন্তু এখন দেখছি তোমার মাথাও মোটা!’
ফৌজিয়া বললো,’ এসব ফালতু কথা রেখে কাজের কথা বলো। কিভাবে কি করবা তা বলো।’
ফৌজিয়া ভাইয়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
ভাইয়া উপর দিকে চোখ বাঁকিয়ে নিয়ে ফৌজিয়ার চোখের দিকে একবার তাকালো। তারপর বললো,’ আমি বাসায় সবার কাছেই বলবো আমার ফোন চুরি হয়ে গেছে। তারপর আরেকটা জঘন্য কাজ করবো।বুঝলে?’
বলে ভাইয়া আবার অট্টহাসি হাসলো।এই ভিডিওটা আর আমি দেখতে পারছিলাম না। ভীষণ বিচ্ছিরি লাগছিলো। ভাইয়ার চেহারাটা কেন জানি আর মানুষের চেহারা মনে হচ্ছিল না। তাকে মনে হচ্ছিল, একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে!
ফৌজিয়া বললো,’ সেই জঘন্য কাজটা কি অপু?’
ভাইয়া বললো,’ সব বলতে হবে? কিছু সিক্রেট থাক না।’
ফৌজিয়া মান দেখালো। ভাইয়ার থেকে সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,’ এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাও। আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে না। তোমার সঙ্গে আমার কিছুই নেই।যাও বলছি।’
ভাইয়া ফৌজিয়ার দিকে এগিয়ে এলো। তার হাত ধরে বললো,’ সরি ফৌজিয়া।আমি সব বলছি। তোমার কাছে এসব না বললে কার কাছে বলবো বলো? তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার? তোমার সঙ্গে আমার কোন গোপনীয়তা নাই।বুঝলা জানমণি!’
বলে ভাইয়া এক এক করে সব বলতে লাগলো। সে বললো,’ এক লোককে আমি পয়সা দিয়ে ভাড়া করবো। সে অপিকে ফোন করে বলবে, সেই আমার ফোন চুরি করেছে। তার হাতে এখন আমার ফোন। এই ফোনে অপির ন্যুড আছে, ভিডিও আছে।আর এসব সে ছড়িয়ে দিবে। তার কাছে যে অপির ছবি আছে এসব অপি বিশ্বাস করবে কিভাবে? অপি তো জানে না তার সবকিছু যে আমার কাছে আছে।
এই কাজ আমিই করবো।যেহেতু আমার ফোন আমিই লুকিয়ে রাখবো।এক সময় এটা বের করে হোয়াটসঅ্যাপে অপিকে কিছু ছবি আর ভিডিও পাঠিয়ে দিবো।অপি তখন ভাববে ওই চোর বা শয়তান লোকটাই এইগুলো তাকে পাঠিয়েছে। তার মানে ওই লোকের কথাই সত্য। তাছাড়া অপি তো এমনিতেও জানবেই আমার ফোন যে চুরি হয়ে গেছে।
তারপর ওই ভাড়াটে লোকটি বলবে, সে এইসব ছবি বা ভিডিও ছড়াবে না এক শর্তে।শর্ত হলো অপিকে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে।’
ফৌজিয়া ভাইয়ার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর বললো,’ তুমি তো দেখছি বিরাট একটা হারামি!’
ভাইয়া বিশ্রীভাবে একটা হাসি হাসলো। তারপর ফৌজিয়াকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে মিশিয়ে নিয়ে বললো,’ ফৌজিয়া, আমি যা চাই তা আদায় করি। তোমার চেয়ে কেউ এটা ভালো জানার কথা না।’
ফৌজিয়া সামান্য কেঁপে উঠলো। তবুও দেখলাম সে নিজেকে সংবরণ করলো। সামান্য হাসার চেষ্টা করে বললো,’ অপু, তো ওই লোকের সঙ্গে যদি অপি দেখা করে তবে তোমার কি লাভ বা এতে আমারই বা কি লাভ?’
ভাইয়া বললো,’ লাভ আছে। তখন আমি বাসায় থাকবো না। অফিসের কাজের নাম করে তোমায় নিয়ে সিলেটে চলে যাবো।আমরা ঘুরবো,দৌড়াবো। বেড়াবো।আর রাতভর একে অপরকে শুষে নিতে থাকবো।’
ভাইয়া আবার বিকৃত একটা হাসি দিলো।
ফৌজিয়া বললো,’ সেসব না হয় বুঝলাম, কিন্তু অপি যে দেখা করবে, এরপর কি হবে?’
ভাইয়া বললো,’ আমার ছোট ভাই তপু, হারামজাদাটা অপিকে বিরাট বিশ্বাস করে। আমার মাও বিশ্বাস করে। তাদের অবস্থা এমন যে, যেন অপি এই ঘরের বউ না, এই ঘরের মেয়ে।তো, আমি যখন বাসায় থাকবো না, এই সময় ফৌজিয়া তার মান সম্মান রক্ষা করতে, নিজের ছবি আর ভিডিও যেন ছড়িয়ে না যায় এই জন্য সে যেভাবেই হোক আমার ভাড়া করা লোকটার সঙ্গে দেখা করতে যাবে।আমি যাকে ভাড়া করেছি তাকে আগেই বলে রেখেছি সে যেন নিজে এসে সুযোগ মতো অপিকে আমাদের বাসার সামনে থেকে গাড়ি করে নিয়ে যায়। এমন ভাবে নিয়ে যাবে যেন বাসার কেউ না কেউ দেখে।যেন ওদের ভেতর সন্দেহের তীরটা ঢুকে যায়।আর তার শরীরের সবগুলো গহনা খুলে রেখে দিবে।পরে আমায় দিয়ে দিবে এগুলো।এতে সন্দেহ আরো শক্তিশালী হবে।আর এরপর যখন মা আর তপু অপিকে সন্দেহ করতে শুরু করবে, এই সুযোগে আমি একটা কাজ করবো। আমার ফোনে থাকা ওর সব ছবি, ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দিবো। তবেই তো খেলা চুকে গেল।তপু আর মা এরপর অপিকে নিজ থেকেই ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দিবে।এমন অসভ্য, নোংরা মেয়েকে তারা কিছুতেই আর সহ্য করবে না! আর তখন আমার আর তোমার পথ পরিষ্কার। তোমার আর আমার বিয়ে তখন আটকায় কে ফৌজিয়া?’
বলে ভাইয়া আবার বিকৃত এক হাসি হাসলো।
ফৌজিয়া এবার ভাইয়াকে বললো,’ আমি পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ দেখেছি, কিন্তু তোমার মতো খারাপ মানুষ আর একটিও দেখিনি অপু !’
ভাইয়া এবার ফৌজিয়ার কাঁধের উপর দিয়ে তার মুখটা নিলো। তারপর বললো,’ সেই যে ষোল বছর বয়সী তোমার শরীর পেয়েছিলাম, এরকম একটা শরীরের জন্য আমি পুরো দুনিয়া জ্বালিয়ে দিতে পারি ফৌজিয়া।আমি সব, সবকিছু করতে পারি।’
ফৌজিয়া বললো,’ ভুল বলেছো অপু।তুমি আমার শরীর পাওনি।জোর করে কেড়ে নিয়েছিলে।’
ভাইয়া কি যেন বলতে চাইলো, এরমধ্যেই ও ঘর থেকে কে যেন ডাকলো।কাজের মেয়ে হয়তো।বললো,’ আপা, আপা, মামা অজ্ঞান হয়ে গেছে।’

এইটুকু ভিডিওই ছিল।ভিডিও শেষ হলে ফৌজিয়া আবার কাঁদলো।বললো,’ বাবা, সেদিন সবকিছু শুনে ফেলেছিল।বাবা জেনে গিয়েছিল, বাবা মারা গিয়েছিল হার্ট ফেল করে সেদিনই।’
এরপর আবার সে আবার বলতে শুরু করলো।বললো,’আমার এসএসসির রেজাল্টের দিন, খুশি হয়ে তোমার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে মিষ্টি কিনে নিয়ে যখন তোমাদের বাসায় যাই, গিয়ে দেখি তুমি বা আন্টি তোমরা দুজনের কেউই বাসায় নাই। খালার বাসায় নাকি বেড়াতে গিয়েছিলে।অপু শুধু বাসায় ছিল। সে বললো, একটু বসতে।তোমরা নাকি আধ ঘন্টার মধ্যে এসে যাবে।গাড়িতেই আছো।আমি সেদিন বসলাম।আর সেদিনই পৃথিবীর নির্মমতম ঘটনাটি আমার সঙ্গে ঘটলো। কলঙ্কের কালো অমানিশা নেমে আসলো আমার পবিত্র, সুন্দর, ফুটফুটে জীবনে। তোমার ভাইয়া‌ নামের কুকুরটা সেদিন আমার উপর চড়াও হয়েছিল।আমি রেপড হই সেদিন তপু।আমি রেপড হই! এই যে চেইন, ছেঁড়া চেইন।যে চেইনের কথা তুমি বললে , মেলা থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল।তা চুরি হয়নি।আমি ওর কাছ থেকে ছুটতে গিয়ে ধস্তাধস্তির সময় এটা ছিঁড়ে গিয়েছিল।আর কিভাবে যেন আমার জামায় এঁটে যায় এটা।আমি এটা রেখে দিয়েছিলাম।যেন এই দিনটা কোনদিন না ভুলি।যেন, এই চেইন আমায় সব সময় প্রতিশোধ পরায়ণ করে তুলে।আমি আর কাউকে কিচ্ছু বলিনি এই বিষয়ে।আমি জানতাম, তখন যে দল ক্ষমতায় ছিল, তোমার ভাইয়া সেই দলের ভালো পর্যায়ের লিডার। বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব তার কথায় চলে। পুলিশের আইজিপির মেজো ভাইয়ের সঙ্গেও তোমার ভাইয়ার দহরমমহরম সম্পর্ক ছিল।আমি জানতাম, এসব নিয়ে কথা উঠলে, কিংবা মামলা দিলে তার কিছুই হবে না। বরং সারা দুনিয়ার লোক আমাকেই দোষারোপ করবে।যা ঘটেছে তা উল্টে যাবে। বরং আমার নামে একজন ভালো মানুষের মানহানির মামলা হবে।
তখন থেকেই আমি চুপচাপ হয়ে যাই একেবারে। নিজের পথে নিজে হাঁটতে থাকি। এরপর বড় হই।ডাক্তার হই। কিন্তু আমি কিছুই ভুলি না আর।আমি অপেক্ষা করি। শুধু সুযোগ খুঁজতে থাকি। তুমি মিথ্যে মামলায় ফেঁসে গিয়েছিলে এটা শুনে ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল আমার। এরপর যখন ফিরলে তখন তোমার সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব করি। বন্ধুত্ব করি এই জন্য যে, যদি এই সুযোগে হলেও তোমার ভাইয়ের কাছে যাওয়া যায়। এরপর সেই সুযোগ এলো।অপি ভাবী একদিন এলো এবরোশন করাতে।আর তোমার ফোনে বার বার ভাবীর ছবি দেখেছি বলে ভাবীকে খুব সহজেই চিনে ফেলি আমি। তারপর কি কি হয়েছে এর সব তুমি তো জানোই। ভাবীর থেকে অপুর নম্বর নিয়ে নেই আমি।আর আমি জানতাম সে কতোটা নারী লোভী।সুযোগটা কাজে লাগাই।আর খুব সহজেই সে আমার ফাঁদে পা ফেলে। এমনকি আমার প্রতি সে এতোটাই উদগ্রীব হয়ে উঠে যে আমার জন্য সে সব করতে পারে।আমায় তার সব দিয়ে দিতে পারে। এই সুযোগে তার মেমোরি থেকে সবগুলো ফাইল শেয়ার করেও নিয়ে নেই আমি।
এখন তুমি বলো আমি খারাপ মেয়ে কি না? আমি এইসব কিছু করেছি শুধু আমার সঙ্গে করা অ*নাচারের শাস্তি দেয়ার জন্য।এটা কি পাপ? তোমার কি মনে হয় তপু? ‘
আমার রাগে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বোধবুদ্ধি হারিয়ে যাচ্ছে যেন।কি করবো না করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।যাকে আমি ভাইয়া ডাকি, সে একজন ধ*র্ষক! ফৌজিয়ার বাবা তার জন্যই হার্ট ফেল করে মারা যায়! সে একটি মৃত্যুর কারণ! সে মহসিন ভাইয়ের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করার কারণ! সে অপি ভাবীর মতো একটা মাটির মানুষের জীবন নষ্ট করে দেয়ার কারণ!
আমার ইচ্ছে করছে, এই এক্ষুনি গিয়ে ওকে খু*ন করি নিজের হাতে। এক্ষুনি। নয়তো আমি শান্তি পাবো না। পাগল হয়ে যাবো আমি!
আমি ফৌজিয়াকে বললাম,’ ফৌজিয়া, তোমার পি*স্তলটা দিবে আমায়।আমি গিয়ে নিজের হাতে ওকে খু*ন করে আসি।প্লিজ দিবে!’
ফৌজিয়া বললো,’ উঁহু। আমার প্রতিশোধ শুধু আমিই নিবো। শুধু আমি।একা আমি।’
বলে সে আমায় বললো, তুমি আর অপি ভাবী ও ঘরে চলে যাও। কুইক।’
ডান পাশের ঘরটা দেখিয়ে দিলো আমাদের।আমরা গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওখান থেকে সব শোনা যায়।জানলা দিয়ে দেখা যায়। কিন্তু ফৌজিয়া বাইরে থেকে দরজাটা আটকে দিয়েছে।
এরপর দেখলাম ফৌজিয়া ভাইয়াকে ফোন করলো।বললো,’ অপু, এক্ষুনি আসো তো আমার বাসায়।কাজের মেয়ে আসেনি আজ। এখন এই মুহূর্তে তোমাকে আমার প্রয়োজন। ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন। আমার শরীর তোমায় চাইছে।বুঝলে! ‘
ভাইয়ার আসতে সময় লাগে চল্লিশ মিনিটের মতো। ভাইয়া এসে সোফায় বসে। ফৌজিয়া তখন দুটি রঙিন বোতল নিয়ে আসে।ব*দকা না অন্য জাতের ম*দ এটা দূর থেকে চেনা যাচ্ছে না। তাকে দেখা গেল গ্লাস ভরে ভরে ভাইয়াকে খাওয়াতে। ভাইয়া ঢকঢক করে গিলছে। এরপর ভাইয়াকে সে জড়িয়ে ধরে। সোফায় নিয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর মুহূর্তে সোফার ওপাশ থেকে রশি টেনে নিয়ে ভাইয়াকে বেঁধে ফেলে।এতোটা তরল গেলায় ভাইয়ার শরীর এমনিতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে তখন। এই জন্য খুব সহজেই এটা করতে পারে ফৌজিয়া। এরপর আমাদের চোখের সামনেই ক্ষীপ্র বাঘিনীর মতো চা*কুটা বের করে নিয়ে ভাইয়ার উপর হামলে পড়ে ফৌজিয়া। তারপর যা করার সে তা করে ফেলে এক মুহূর্তে।অপু নামের কুকুরটা তখন গগণবিদারী চিৎকার করতে শুরু করে। জীবন ভিক্ষা চাইতে থাকে। আকুতি মিনতি করতে থাকে। আহাজারি করতেই থাকে আর করতেই থাকে।জ*বেহ করা গরুর মতো লাফাতে থাকে। কিন্তু বাঁধা থাকায় অতোটাও নড়তে পারে না!
আমার কানে এসে এসব আকুতি মিনতি আর আহাজারি বাজে না কেন জানি।আমি কেবল তখন শুনতে পাই, একটা বুনো কুকুর, ঘেউ ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করছে।
আমি অপি ভাবীকে বলি, ভাবী শুনতে পাচ্ছো তুমি, একটা কুকুর কিভাবে ঘেউ ঘেউ করছে!’

ফৌজিয়া তখন অপু নামের কুকুরটার বুকের উপর পা রাখে। তারপর বলে,’ নারীরা দেবীর মতো। দেবীকে সম্মান দিলে, দেবীরা স্বর্গের সুখ দেয়। জীবন রাঙিয়ে দেয় ভালোবাসায় ‌।আর অসম্মান করলে নরকের যন্ত্রণায় পুড়িয়ে মারে কুত্তা!’

অপু চিৎকার করে কাঁদে। আহাজারি করে।
আর ফৌজিয়া এতো জোরে জোরে হাসতে থাকে যে তার হাসির শব্দে অপু নামক কুকুরটির আর্তনাদ কোথায় যেন বিলীন হয়ে যায়।

ফৌজিয়া অপুর বুকে গু*লিবিদ্ধ করে আরো আধ ঘন্টা পর। পরপর কয়েক রা*উন্ড গু*লি ছুঁড়ে। বিকট শব্দে যেন কান ফেটে যেতে চায়।আমি আর অপি ভাবী কানে আঙুল চেপে ধরি।আর জানলার স্বচ্ছ কাঁচের ওপারে দেখি ছটফট করতে করতে অপু নামের কুকুরটির মুখ থুবড়ে পড়া। ভয়ানক যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মৃ*ত্যু হয় একটি নোংরা কুকুরের। তার মৃ*ত্যুর মাধ্যমে কলঙ্ক এবং পাপ মুক্ত হয় আমার পরিবারের।

এরপর ফৌজিয়া এসে দরজা খুলে দেয়। সে কাঁদছে। আমি বললাম,’ কাঁদছো কেন ফৌজিয়া? তোমার তো ভীষণ আনন্দ হবার কথা? তুমি তোমার প্রতিশোধ নিতে পেরেছো? ‘
ফৌজিয়া আমায় জাপটে ধরলো। শক্ত করে। তারপর বললো,’ আনন্দে কাঁদছি আমি।তপু, আনন্দে কাঁদছি।আজ আমার সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন। সবচেয়ে বেশি খুশির দিন।এই পৃথিবীতে আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। আমার এইম ইন লাইফ এখন পরিপূর্ণ হয়েছে।’
এরপর ফৌজিয়া নিজেই ফোন করে দিলো থানায়।তার বাসার ঠিকানা বললো।বললো, এখানে একটা খু*ন হয়েছে।
পুলিশ আসতে সময় লাগলো খানিক। এরমধ্যে যা করার আমি তা করে ফেলেছি। ফৌজিয়ার মাথায় সামান্য আঘাত করতেই সে টাল মাটাল হয়ে দূরে ছিটকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই আমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। তারপর ওর হাত থেকে চকচকে কালো রঙের পি*স্তল আর চা*কু দুটোই কেড়ে নেই। তারপর বলি, ‘ খবরদার! বাড়াবাড়ি করলে এক্ষুনি ভবলীলা সাঙ্গ করে দিবো তোমার।অপি ভাবীর। চুপচাপ ওখানেই থাকো। যেভাবে আছো।’
ফৌজিয়া ভীষণ অবাক হয়েছে। নিজেকে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে আমার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইল শুধু।আর অপি ভাবী একেবারে দাঁড়ানো থেকে দেয়াল ঘেঁষে মুখ চেপে বসে পড়লো। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে অপি ভাবী।আর আমি হাসছি। শব্দ করে।হা হা হা করে হাসছি।
ফৌজিয়া রাগ অথবা ঘেন্নায় আমার দিকে একদলা থুথু ছিটিয়ে দিয়ে বললো,’ কুত্তার বাচ্চা।তোরা সবাই কুত্তার বাচ্চা।’
আমি আবারো হাসলাম।
ততোক্ষণে পুলিশ এসে গেছে। পুলিশ আসার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কাছে অ*স্ত্র জমা দিয়ে আমি আত্মসমর্পণ করলাম। এবং স্বীকারোক্তি দিলাম, বললাম, ‘আমার নিজের ভাইকে আমিই নির্মম ভাবে হ*ত্যা করেছি।’
অপি ভাবী গলা ছেড়ে কাঁদছে। বলছে, ‘ না না।ও মিথ্যে বলছে।ও মিথ্যে বলছে।’
ফৌজিয়া পাগলের মতো উঠে এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো।কান্নায় মরিয়া হয়ে উঠে বললো,’ না।ও কিচ্ছু করেনি।সব আমি করেছি। আল্লার কসম আমি করেছি।’
পুলিশের লোকেরা ওসব শুনলো না।তারা দেখলো আমার হাতেই মারণা*স্ত্র।সব প্রমাণাদি আমাকেই খু*নি চিহ্নিত করে।তারা আমার হাতেই কারার শেকল পরিয়ে দিলো। তারপর আমায় নিয়ে যেতে লাগলো গাড়ির দিকে।
অপি ভাবী দৌড়ে এগিয়ে আসতে লাগলো আমার কাছে। ফৌজিয়া আমায় ছাড়তে চায় না কিছুতেই। কাঁদে। আঁকড়ে ধরে রাখে। পাগলামি করছে বড়।
পুলিশের লোকেরা ওদের বাঁধা দিলো। আটকে দিলো। আমি যখন ওদের থেকে অনেকটা দূরে চলে এলাম একেবারে গাড়ির কাছে। এবার গাড়িতে উঠে যাবো।তখন পেছনে ওদের দিকে তাকিয়ে আমার গলার সবটুকু আওয়াজ দিয়ে বললাম-
” আমি জানি আমার হয়তো ফাঁ*সি হয়ে যাবে । হোক। এই যে কারার ফাঁ*সিতে আমার মৃ*ত্যু হবে। এই মৃ*ত্যু বড় আনন্দের ‌। নারীর স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে পারে কজন পুরুষ? ফৌজিয়া, অপি ভাবী, তোমরা সাক্ষী থেকো, প্রতিটা ঘরেই একদিন এমন করে একজন করে তপুর জন্ম হবে।আর এই তপুরাই এনে দিবে এ দেশে নারীর মুক্তির স্বাদ।তারাই উড়াবে নারীর বিজয়ের রঙিন নিশান। একদিন এদেশের নারীরাই গাইবে নারীর বিজয়ের গান।বিদায়, নারী! খোদা হাফেজ!'”

___সমাপ্ত___

আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-১১

0

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#১১তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক



একটা বিকট আওয়াজ হলো। পি*স্তল থেকে গু*লি ছুঁড়লে এরকম আওয়াজ হয়। কিন্তু প্রফেশনাল কি*লার যারা তাদের পি*স্তলে সাইলেন্সার লাগানো থাকে। তখন আর আওয়াজ হয় না। ফৌজিয়া তো আর প্রফেশনাল কি*লার না। সে হয়তো কয়দিনের জন্য এই পি*স্তল ভাড়া করেছে অথবা কিনেছে।তাই এইসব সম্পর্কে তার তেমন ধারণা না থাকারই কথা।
ফৌজিয়া যখন গু*লি করলো তখন পি*স্তলের সাউন্ড হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুকে হাত দিলাম। কোথায় বিঁধেছে বুলেট খুঁজে দেখছি।বুলেট যদি বুকে বিঁধে তবে তো ব্যথায় এতোক্ষণে মরে যাবার কথা। বুকের ক্ষত থেকে গলগল করে রক্ত বেরুবার কথা। কিন্তু এরকম তো কিছুই হচ্ছে না! অবাক করা কান্ড! এও কি সম্ভব যে বুলেট বুকে বিঁধে গেল আর কোন ক্ষত হলো না। রক্ত বেরুলো না।ব্যথা হলো না!
আমার দম আটকে আসছে। মৃত্যুর ভয়ে শরীর ঘেমে চুপসে গেছে। কিন্তু আমি তখনও চোখ খুলছি না। ভয়ে।চোখ খুললাম ফৌজিয়ার কন্ঠ শুনে। সে বললো,’ তপু, তোমার চোখ খুলো।’
আমি তার কথার সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুললাম না।চোখ খুললাম আরো খানিক পর। ভয়ে ভয়ে।
তারপর মিটিমিটি করে তাকাতেই দেখলাম ফৌজিয়া পি*স্তল হাতে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে পি*স্তলের বাট দিয়ে আমার মাথায় চাটি মেরে বললো,’ তোমার ডান পাশে তাকাও।’
আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম ডান পাশে। ওখানে একটা ডাউস সাইজের মূর্তি রাখা। কোন দেব- দেবীর মূর্তি না। দেব -দেবীর মূর্তি দেখলেই চেনা যায়। কিন্তু এটা কার আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কিন্তু কিছুটা পরিচিত মনে হচ্ছে এই চেহারা। ফৌজিয়া যে পি*স্তল আমার দিকে তাক করেছিল আর আমি ভেবেছিলাম সে আমায় গু*লি করবে এটা ভুল ভেবেছিলাম। সে আমায় গু*লি করেনি। সে গু*লি করেছে মূর্তিটাকে।মূর্তিটার বুক ফাঁকা হয়ে পেছন দিকে চলে গেছে বুলেট। মূর্তির বুকে ফাঁকা হয়ে যাওয়া জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকেই।
ফৌজিয়া তার মুখটা এবার আমার মুখের কাছে নিয়ে এলো এবার। একেবারে কাছে। তারপর ফিসফিস করে বললো,’ ভয় পেয়েছো তপু?’
আমি বললাম,’ না।ভয় পাবো কেন? ভয় পাওয়ার কি আছে? ভয় পাইনি একদম।’
ফৌজিয়া বললো,’ আচ্ছা। তাহলে একটা গু*লি করি তোমায়। তোমার বুকে। এই যে এখানে
কেমন? ‘
আমার বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে স্পর্শ করে বললো সে।
তারপর পি*স্তলের নলটা ওখানেই বুকের উপর ঠেকালো।আমি তখন থরথর করে কাঁপতে শুরু করলাম। আমার মুখ থেকে ভয়ে গোঁ গোঁ একটা আওয়াজ বেরুতে লাগলো। এছাড়া আর কিছু বলতে পারছিলাম না উচ্চারণ করে।
ফৌজিয়া হা হা হা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,’ এই তোমার সাহস তপু? চেক করে দেখো প্যান্ট ঠিক আছে কি না!’
ওর দিকে আর তাকাতে পারছি না। কিন্তু মনে মনে বলছি, আরেব্বাবা, এ কি মানুষ নাকি আজরাঈল!
ফৌজিয়া বললো,’ আচ্ছা তপু বল তো এই মূর্তিটার শিল্পী কে? মানে এটা কে বানিয়েছে?’
আমি বললাম,’ জানি না তো আমি। আমি কিভাবে বলবো?’
ফৌজিয়া এবার আমার সঙ্গে রাগ দেখালো। এবং জীবনে প্রথমবারের মতো সে আমার সঙ্গে নোংরা ভাষায় একটা কথা বললো।বললো,’ তুমি কোন বালটা জানো তাহলে তপু?’
এরপর ফৌজিয়া নিজ থেকেই বললো,’ সরি! মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বকা দিয়ে ফেলছি। এখন শুনো, এই মূর্তির শিল্পী আমিই।আমিই এটা দীর্ঘ সময় নিয়ে তৈরি করেছি।বড় যত্ন করে তৈরি করেছি।যেন নিখুঁত হয়। কিন্তু এই নিখুঁত আর নিজের তৈরি এই মূর্তিটার কাছে প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যায় আমি যাই।কেন যাই জানো?’
আমি বললাম,’ কেন যাও?’
ফৌজিয়া বললো,’ থুথু ফেলতে।রোজ দুইবার করে থুথু ফেলে আসি এর মুখে।’
আমি ফৌজিয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। কিছুই বুঝতে পারছি না। সে একটা এতো বড় মূর্তি তৈরি করেছে।আর রোজ এটার মুখের উপর সকাল -সন্ধ্যা দুইবার করে থুথু ছিটিয়ে আসে। কেন?
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’ মূর্তি তুমিই তৈরি করেছো, আবার তুমিই এর মুখে থুথু ফেলে আসো। কেন? কেন করো এটা?’
ফৌজিয়া বললো,’ এক কাজ করো। তুমি মূর্তিটার কাছে যাও আগে। একেবারে কাছে। মুখটার কাছে। গিয়ে দেখ তো চিনতে পারো কি না এটা কোন অশূরের মূর্তি! ‘
আমি বসা থেকে উঠে আস্তে আস্তে মূর্তিটার কাছে গেলাম। প্রথমে মোটেও বুঝতে পারছিলাম না।চেনা যাচ্ছিলো না। কিন্তু সময় নিয়ে যখন ভালো করে লক্ষ্য করলাম, তখনই বুঝতে পারলাম, এই অশূর আর কেউ না। আমার অপু ভাইয়া। এই মূর্তি অপু ভাইয়ার।
আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে আছি তখনও। মূর্তির কাছে।যেন আমি হঠাৎ করেই নড়তে ভুলে গেছি। চলতে ভুলে গেছি।যেন আমার সময় থমকে গেছে। ভাবনা, চিন্তা সব, সবকিছু থেমে গেছে।
ফৌজিয়াও হেঁটে হেঁটে এখানে এলো। তারপর তার পায়ের এক আঘাতে মূর্তিটাকে দূরে ছিটকে ফেললো। দূরে ছিটকে পড়ে গিয়ে মাটির মূর্তি ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। ফৌজিয়া এবার মূর্তির ভাঙাচোরা টুকরো গুলোর পাশে বসে একটা টুকরো তার হাতে নিলো। তারপর হাতের চাপে ভাঙা টুকরোটা একেবারে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফুঁ দিয়ে এর শুকনো ধুলো গুলো উড়িয়ে দিয়ে দু’ হাতে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’ তপু, আমি কোনদিন কাউকে হ*ত্যা করিনি। কোন প্রাণীকেই না।মশা তো ক্ষতিকর প্রাণী। কিন্তু একটা মশাও হ*ত্যা করিনি আমি।সত্যি বলছি। আল্লাহর কসম। এই যে তোমার অপি ভাবী আমার কাছে গিয়েছিলো তার গর্ভপাত করাতে। তোমার কি ধারনা, আমি তাকে এই কাজ করতে দিয়েছি? উঁহু। দেইনি। তোমার কাছে এমনিই মিথ্যে বলেছি। তার গর্ভে এখনও তার সন্তান আছে।আমি তাকে বুঝিয়েছি।আমি বলেছি, এই সন্তান শুধুই তোমার। তোমার পরিচয়েই এই সন্তান বড় হবে। বেড়ে উঠবে। এই সন্তানকে তুমি মানুষ করে গড়ে তুলবে।ও যদি ছেলে হয় তবে একে শেখাবে নারীদের সম্মান করতে। ওকে বলবে, নারীরা দেবীর মতো। দেবীদের অসম্মান করলে ধ্বংস হয়ে যেতে হয়! আর মেয়ে হলে ওকে একজন পৃথীলতা ওয়াদ্দেদার করে গড়ে তুলবে। বীরাঙ্গনা করে গড়ে তুলবে। যেন খারাপ পুরুষেরা ওকে দেখলেই ভয়ে শিউরে উঠে।অপি ভাবী বুঝেছে। সে আমার কথা মেনে নিয়েছে।
এখন তো বুঝলে আমার এইটুকু বয়সে আমি কোন অপরাধ করিনি। কোন হ*ত্যা টত্যা কিচ্ছু করিনি। কিন্তু আজ করবো। শুধুমাত্র একটি হ*ত্যা। একটি নি*র্মম হ*ত্যা। কিভাবে করবো জানো? ‘
ফৌজিয়ার কথা শুনে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে আমার।আমি ভীষণ তেষ্টায় কাশতে লাগলাম। ফৌজিয়া নিজেই ফ্রিজের কাছে গিয়ে একটা পানির বোতল নিয়ে এলো। তারপর তা আমার হাতে দিয়ে বললো,’ খাও।গলা ভেজাও।’
আমি বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে সবটুকু পানি শুষে নিলাম। তারপর বললাম,’ কিভাবে হ*ত্যা করবে? কিভাবে?’
ফৌজিয়া হাসলো।বললো,’ কিছু কিছু পুরুষ আছে যাদের বিশেষ অঙ্গটি তাদের অমানুষ বানিয়ে দেয়। অসামাজিক বানিয়ে দেয়।বন্য জানোয়ার বানিয়ে দেয়।আমি যাকে হ*ত্যা করবো,সেও এরকম একটা জানোয়ার।আমি সবার আগে তাকে ঘরের পিলারের সঙ্গে বেঁধে ফেলবো। তারপর জীবিত পুরুষটির ওই খারাপ অঙ্গটি কেটে ফেলবো। সে নিশ্চয় তখন ভয়ে চিৎকার করবে। আমার কাছে জীবন ভিক্ষা চাইবে। কাঁদবে। আকুতি মিনতি করবে।আমার তখন কি যে আনন্দ হবে তপু! তখন আমি আনন্দে চিৎকার করে গান গাইতে থাকবো। রবীন্দ্রনাথের গান। আমার সবচেয়ে প্রিয় গান –

” আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে
যাব না
যাব না গো, যাব না যে
থাকব পড়ে ঘরের মাঝে
যাব না গো, যাব না যে
থাকব পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায়
এই নিরালায় রব আপন কোণে
যাব না এই মাতাল সমীরণে। ”

বলে ফৌজিয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো টেবিলের কাছে। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলে আমায় চকচকে ঝকঝকে নতুন স্বচ্ছ চা*কুটি দেখালো। তারপর বললো,’ এই যে এটা দিয়ে।বুঝলে?’
এরপর এক অদ্ভুত ঘটনা করলো ফৌজিয়া। এই যে এতো রাগী ফৌজিয়া।এতো সাহসী ফৌজিয়া।যে খানিক আগেই মূর্তিটার বুক বিদীর্ণ করে ফেললো গু*লির আঘাতে। তারপর পায়ের আঘাতে খন্ড বিখন্ড করে দিলো মূর্তিটি। তারপর চা*কু দেখালো আমায়। এরপর এসব রেখে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো ফৌজিয়া। সে আমার পায়ের কাছে এসে বসলো।যেন আমি এক দেবতা আর সে পুজোর ফুল। তারপর আমার হাত দুটো মুঠো করে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,’ তপু, কোনদিন তোমায় বলা হয়ে উঠেনি। কোনদিন আমি বলতে পারিনি।সত্যি সত্যি আমি তোমায় ভালোবাসতাম। পাগলের মতো ভালোবাসতাম। ভালোবাসতাম বলেই তো দেখতে না, স্কুল জীবনে তোমার সঙ্গে কিভাবে ছায়ার মতো মিশে থাকতাম? দেখতে না, লজ্জা শরম সব ভুলে গিয়ে কিভাবে দিনের পর দিন তোমাদের বাসায় চলে যেতাম তোমার সঙ্গে! আচ্ছা তপু, ভালোবাসা কি বিরাট বড় পাপ নাকি? ভালোবাসলে কি নরক লাভের চেয়েও বড় কোন শাস্তি পেতে হয় এই পৃথিবীতে?


#চলবে

আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-১০

0

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#১০ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



আমি এর উত্তর কি দিবো? আমি কিভাবে জানবো ভাইয়ার চেইন কিভাবে তার কাছে এলো ? সে বলে দিলেই তো হয়।
আমি বললাম,’ ফৌজিয়া, এটা আমি কিভাবে বলবো বলো।এটা তো তোমার নিজের জানার কথা। তোমার কাছে যেহেতু চেইন তাহলে তুমিই জানো এটা কিভাবে তোমার হাতে এসেছে। তাহলে আমায় জিজ্ঞেস করছো কেন?’
ফৌজিয়া হাসলো।বললো,’ এমনিই জিজ্ঞেস করেছি। বাজিয়ে দেখলাম একটু তোমায়।’
আমি বললাম,’ এখন তুমিই বলো তোমার হাতে কিভাবে এটা এলো? আমি যতদূর জানি মেলা থেকে ভাইয়ার এই চেইন চুরি হয়ে গিয়েছিল।’
ফৌজিয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো এই কথা শোনার পর। সে খানিক হাসিহাসি মুখ নিয়ে বললো,’ কবেকার ঘটনা এটা? কতো বছর আগের বল তো? ‘
আমি বললাম,’ অতো কিছু কি আর মনে আছে নাকি!’
ফৌজিয়া বললো,’ তখন তুমি কোন ক্লাসে পড়তে এটা মনে আছে তোমার?’
আমি খানিক সময় ভাবলাম। তারপর বললাম,’ তখন তো ছুটির সময় ছিল। আমাদের এসএসসির রেজাল্ট পাবলিশের এক- দুদিন পরেই সম্ভবত ভাইয়ার চেইন চুরি হয়।’
ফৌজিয়া বললো,’ বাহ্। তুমি এখনও অসম্ভব রকমের মেধাবী। তোমার মেমোরাইজিং পাওয়ার অনেক বেশি স্ট্রং। এই জন্যই তোমার সঙ্গে কোনদিন আমি পড়াশোনায় কুলিয়ে উঠতে পারিনি তপু!’
বলে হাসলো ফৌজিয়া।
আমি বললাম,’ আচ্ছা ওসব বাদ দাও এখন।এর আগে তুমি এটা বলো কিভাবে তোমার কাছে ভাইয়ার চেইন এলো।’
ফৌজিয়া বললো,’ অবশ্যই বলবো।আজ সবকিছুই জানবে তুমি। কিন্তু তার আগে আরো কিছু কথা আছে তোমার সঙ্গে। আর কিছু জিনিস দেখাবারও আছে তোমায়।’
বলে চোখ টিপলো ফৌজিয়া।
আমি আজ ওকে একেবারেই নতুন করে আবিষ্কার করছি। তাকে আর মোটেও আমার চিরচেনা ফৌজিয়া মনে হচ্ছে না!
এরপর ফৌজিয়া হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা টেনে নিলো। তারপর চেয়ার থেকে উঠে এসে সোফায় সে আমার সঙ্গে মিশে বসলো। তারপর মোবাইলের গ্যালারিতে গিয়ে একটা ছবি বের করে আমায় দেখালো।ছবিটি সিলেটের লাক্কাতুরা চা- বাগানে তোলা।চা- বাগানে গিয়ে সে ছবি তুলেছে এটা আমি জানি। কিন্তু এই ছবি দেখে আমি চমকে উঠবো নাকি দম বন্ধ করে মরে যাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না!
ছবিতে ভাইয়া ফৌজিয়াকে জড়িয়ে ধরে আছে।ওই চা বাগানেই। একটা আকাশমণি গাছের নিচে তারা দাঁড়ানো।
আমি বললাম,’ এসব কি ফৌজিয়া?’
কথাটা রাগেই বলতে গেলাম। কিন্তু এর অর্ধেক বলতে পারলাম। বাকিটা বলার আগেই সে এক হাতে আমার মুখ চেপে ধরলো। তারপর বললো,’ এখন কোন প্রশ্ন করবে না আমায় তপু।আরো অনেক কিছুই দেখার বাকি আছে এখনও তোমার। শুধু দেখে যাও আপাতত।’
বলে সে গ্যালারি থেকে বের করে আরো একটি ছবি দেখালো। সেই ছবি দেখে আমার জিভ একেবারে তালুতে লেগে গেল। ফৌজিয়া আর অপু ভাইয়া শুয়ে আছে বিছানায়।তারা যে ঘরে শুয়ে আছে সেই ঘরের সব জিনিস পত্র, দেয়ালের কারুকাজ,লাইট,জানলা সবকিছুই দেখা যাচ্ছে ছবিতে।
এই ছবির ঘর আর বিছানার সঙ্গে আমার দেখা আরো কিছু ছবির ঘর আর বিছানার হুবহু মিল আছে। একটুও কম- বেশি নাই।
ফৌজিয়া বললো,’ ওয়েট।ছবি টবি ইডিট করা যায়।ছবি দেখিয়ে লাভ নাই তোমায়। এবার তোমায় একটা ভিডিও দেখাই।’
সে তার ফোনের ফাইলে ঢুকে একটা ভিডিও বের করলো। সেই ভিডিওতে অপু ভাইয়া ফৌজিয়ার পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। জড়িয়ে ধরে কি যেন বলছে। ফৌজিয়া আর ভাইয়া হাসাহাসিও করছে আবার। ভিডিওতে যে ঘর,ঘরের দেয়ালের রং, কারুকাজ , বিছানা, ঘরের অন্য সব আসবাবপত্র কিংবা লাইট, এর সবকিছুর সাথে অপি ভাবীর যে ভিডিও ছড়িয়েছে।ছবি ছড়িয়েছে। সেই ভিডিওর, ছবির ঘরের সঙ্গে হুবহু মিল। সোজা কথায় বলতে গেলে, একই ঘর, একই মানুষ। কিন্তু ভিন্ন দুটি নারী।
ততোক্ষণে আমার কাছে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।আমি বুঝতে পেরেছি অপু ভাইয়ার সঙ্গে ফৌজিয়ার গোপন এক সম্পর্ক ছিল ‌। এখনও আছে। এবং ভাবীর যে ভিডিও, ছবি ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনে, ওখানে ভাবীর সঙ্গে থাকা অস্পষ্ট পুরুষটিও আর কেউ নয়।সে‌ অপু ভাইয়াই।
তবে কি অপু ভাইয়া নিজেই এই ভিডিও ছড়িয়েছে? নাকি অন্য কেউ?
ভাইয়া কেন তার নিজের আত্মসম্মান নিজেই নষ্ট করবে! কোন পুরুষ কি তার নিজের স্ত্রীর নগ্ন ছবি, ভিডিও এভাবে ভাইরাল করে দেয়?
এটা কি আদৌও সম্ভব!
আচ্ছা ধরলাম ভাইয়াই এইসব কিছু ছড়িয়েছে। কিন্তু এখানে আরো একটা বিরাট প্রশ্ন আছে। ধাঁধা আছে।এটা হলো ভাবী যে পর পর দুদিন ফোন করলো কাউকে। অনুরোধ করলো তার ছবি বা ভিডিও গুলো যেন এভাবে না ছড়িয়ে দেয়।প্রয়োজনে যা চায় তাই দিবে। এমনকি একদিন ভাবী নিজেই ওদের কালো গাড়ি করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। রাতে ফিরলো।ফেরার পর দেখা গেলো তার হাতে,কানে, গলায় কোথাও কোন গহনা নেই। এর মানে কি?
এই এতো এতো প্রশ্ন, রহস্য যখন মাথায় এসে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখন ফৌজিয়া আরেকটি ছবি দেখিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিলো। ছবিতে সেই একই ঘর,একই দেয়াল, দেয়ালের কারুকার্য। ভাইয়াও ওখানে। কিন্তু এখানে তৃতীয় একজন নারীও আছে । ওই নারীর সঙ্গেও ভাইয়া খুব অন্তরঙ্গ অবস্থায় আছে। এই নারীটি আর কেউ নয়। মহসিন ভাইয়ের বউ তরু ভাবী।
আমি স্থবির হয়ে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই এতো দিন, এতোটা সময় ভাইয়াকে যা দেখে এসেছি, যা ভেবে এসেছি এর সবই তবে ভুল? ভ্রান্তি?
মহসিন ভাই, যে নাকি ভাইয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু।বিশ্বস্ত বন্ধু। অবশেষে তার সবচেয়ে দূর্বল জায়গায়ও আঘাত করেছে ভাইয়া!
এইসব কিছু বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। কিন্তু অবিশ্বাস করার মতোও তো কিছু না এসব।
ফৌজিয়া মিটিমিটি হাসছে। এবার এরকম মিটিমিটি হেসেই সে বললো,’ কি হলো তপু? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাই না? হা হা হা। তোমার ভাইয়ার নাম কি যেন? মোহতাসিম বিল্লাহ অপু। তোমার ভাবী মানে অপি ভাবী তাকে মানুষ মনে করতো না। তাকে মনে করতো কুকুর। দেখতে মানুষের মতোই কিন্তু আদতে সে এক কুকুর।ওই যে নীল রঙের ডায়েরিতে ইংরেজি সেন্টেন্সটা পড়োনি? অপি ভাবীর গর্ভে এই কুকুরের সন্তানই এসেছিল। অপি ভাবী যখন কনসিভ করলো এবং দু মাস পর সে পুরোপুরি কনফার্ম হলো যে সে কনসিভ করেছে, সেই দিনটি তার ভীষণ আনন্দ করবার দিন ছিল।আনন্দে চিৎকার করে, হৈ হুল্লোড় করে এই সংবাদ তোমার অপু ভাইয়াকে, তোমাকে, তোমার মাকে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে এই সংবাদ দিতে পারেনি।কারণ, এর ছ’ ঘন্টা আগেই তার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনটি ঘটে। সে আবিষ্কার করে তার বিশ্বস্ত স্বামী সে ছাড়াও অন্য নারীর কাছে যায়।অন্য নারীর সঙ্গেও মিশে। অন্য নারীর সঙ্গে শু’ই। সেদিন সকালে তোমার ভাইয়া ফোন লক না করেই তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে গিয়েছিল।আর অপি ভাবী কি মনে করে যেন তোমার ভাইয়ার ফোনের ফাইলে ঢুকে পড়লো।আর তখনই তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।সে দেখলো, যাকে সে এতো দিন নিজের ওমে রেখেছে, আদরে রেখেছে, সে এক কাল সাপ! সে ফাইল খুলেই দেখলো মহসিন ভাইয়ের বউ অর্থাৎ তরু ভাবীর সঙ্গে তোমার ভাইয়ার অন্তরঙ্গ ছবি, ভিডিও সবকিছু। ভাবী যখন এসব দেখছিলো, বাথরুম থেকে এসে তোমার ভাইয়া তা দেখে ফেলে। দেখে ফেলে যে ভাবী তার মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছে। এবং গোপন সবকিছুই দেখে ফেলেছে ততোক্ষণে।সেদিনই ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া হয় তোমার ভাইয়ার।ভাবীর সঙ্গে কথার কাটাকাটির এক পর্যায়ে তোমার ভাইয়া ভাবীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।ভাবী গিয়ে পড়ে খাটের কোনায়। তার চোখের উপর কপালের নিচ দিকে যে লম্বা দাগ। সেই দাগটা তখনই হয়েছিল। এরপর থেকেই তাদের সংসারে গোপন যু*দ্ধের শুরু হয়।
অপি ভাবী অনেক চেষ্টা করেছে এই যু*দ্ধের অবসান ঘটাতে।ঘরে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। সবকিছু স্বাভাবিক করতে। কিন্তু তোমার অপু ভাইয়া এই সন্ধি চায়নি। সে বরং অপি ভাবীকে ভয় দেখায়। সেই যে কবে অপি ভাবীকে নিয়ে রিসোর্টে গিয়েছিল তোমার ভাইয়া। বিয়ের কদিন পর। তখনই সে বুদ্ধি করে তোমার ভাবীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ভিডিও করে রেখেছিল। ছবি তুলেছিল। এটা করে রেখেছিল সুযোগ বুঝে যেন সে নিজেকে বাঁচাতে পারে। এরপর তার সেই দিন এলো।অপি ভাবী নিজে নিজে এই সমস্যা সমাধান করতে না পেরে যখন তোমার মায়ের কাছে সবকিছু খুলে বলতে চাইলো, তখনই তোমার ভাইয়া অপি ভাবীর
এইসব ছবি আর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার ভয় দেখাতে শুরু করলো। আর তখনই অপি ভাবী সিদ্ধান্ত নেয়, এই বাচ্চা সে কিছুতেই তার পেটে রাখবে না। সে ভাবলো, কুকুরের বাচ্চা তো কুকুরই হয়। মানুষ হয় না।আর বাচ্চা যে তার গর্ভে এসেছে এই কথাও কাউকে আর সে জানায়নি । এমনকি তোমার ভাইয়াকেও না। সে সরাসরি আসে আমার কাছে।এবরোশন করাবার কথা বলে।আমি তো আগে থেকেই অপি ভাবীকে চিনতাম। কিন্তু সে তো আমায় আর চেনে না। আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না। তার কাছে আমি বলি, গর্ভপাত করাতে হলে কজ বলতে হবে।হিস্টোরি না শুনে নিষ্পাপ একটা ভ্রুণকে কিছুতেই আমি হ*ত্যা করতে পারবো না! সে তখনই সবকিছু খুলে বলে। কিছুই গোপন করেনি।সব শুনে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠি।
জানো তপু, এমন একটা সুযোগের জন্য আমি তেরোটা বছর ধরে অপেক্ষা করছিলাম।তেরোটা বছর, কতো দীর্ঘ সময় তুমি বুঝো? অবশেষে অপি ভাবী আমার কাছে আসলো।আর আমার সেই চির আকাঙ্ক্ষিত অপেক্ষার অবসান ঘটালো।আর আমার জেতার সময় এলো। বিজয়ের সময় এলো! ‘
হা হা হা করে আবারও হাসলো ফৌজিয়া। তারপর তার বাঁ পাশের টেবিলের ড্রয়ারটা একটানে খুলে চকচকে কালো রঙের ছোট্ট পি*স্তলটি বের করে আনলো।আর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চটজলদি আমার দিকে পি*স্তলটি তাক করে ফেললো।
আমি মুহুর্তে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।আমি জানি আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। এরপরেই আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে দিবে প্রাণনাশী একটি বুলেট। কিন্তু আমায় মা*রতে চায় কেন ফৌজিয়া? ভাইয়ার পাপের শাস্তি সে আমায় দিবে কেন?

#চলবে

আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-০৯

0

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#৯ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ফৌজিয়ার বাসায় যেতে আধঘন্টা সময় লাগলো আমার। আমি গিয়ে দেখি সে বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। বসে থেকে গান শুনছে। রবীন্দ্রনাথের গান।

“আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে
যাব না
”যাব না গো, যাব না যে
থাকব পড়ে ঘরের মাঝে
যাব না গো, যাব না যে
থাকব পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায়
এই নিরালায় রব আপন কোণে
যাব না এই মাতাল সমীরণে।”

আমায় দেখে সে হাসলো।বললো,’ তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম তপু। অতো তাড়াতাড়ি এসে পড়বে ভাবিনি।
আসো।ঘরে যাই চলো।’
আমি ঘরে গিয়ে বসলাম। সোফায়।
তারপর বললাম,’ ফৌজিয়া, হঠাৎ কেন ডাকলে আমায়? ‘
ফৌজিয়া বললো,’ চা খাবে নাকি কফি? আচ্ছা থাক কিছুই খেতে হবে না।আমি জানি এখন কিচ্ছু খেতে পারবে না তুমি। এসব খেতে গেলে সেদিনের মতোই বমি করে সব ভাসিয়ে দিবে।’
এটা বলে ফৌজিয়া দুষ্টুমি ভরা হাসি হাসলো আমার দিকে তাকিয়ে।
আমি বললাম,’ আচ্ছা কিছু খেতে টেতে হবে না, আর বমিও করতে হবে না আমার। এখন তুমি বলো, কেন ডেকেছো আমায়। আমার সঙ্গে তোমার কি এমন ইমার্জেন্সি কাজ!’
ফৌজিয়ার চুল খোলা ছিল। সে পেছনে হাত দিয়ে চুল গুলো খোঁপা করে বেঁধে নিলো মুহূর্তে। তারপর বললো,’তোমাকে তো বলাই হয়নি অপি ভাবী তার বরের জায়গায় কার নাম লিখেছিলো। তাই না?’আসলে আমার নানান ব্যস্ততা ছিল।বিপদ-আপদ ছিল।তাই আর বলা হয়ে উঠেনি।এর জন্য আমি সরি!’
আমি উদগ্রীব হয়ে গেলাম সেই নাম শুনতে।আমি জানি, ফৌজিয়া এখন যে নাম বলবে সে-ই এখানকার মূল হোতা। সবকিছুর পেছনেই কলকাঠি সেই নাড়ছে।কি নাম তার? কি নাম?
আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,’ ফৌজিয়া, দোহাই লাগে আল্লার! তাড়াতাড়ি সেই নাম তুমি বলো আমায়।ওই কালপ্রিটটা আমাদের সুন্দর ফ্যামিলিটারে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে! ওরে খুঁজে বের করে আমি এমন শাস্তি দিবো ফৌজিয়া যে ও আর জীবনে কোনদিন কারোর ক্ষতি করার মতো কল্পনাও করতে পারবে না!’
ফৌজিয়া কথা বললো না। সে ছন্দের মতো পা ফেলে তার ঘরে রাখা আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। তারপর আলমারি খুলে ওখান থেকে একটা নীল রঙের ডায়েরি নামিয়ে আনলো। তারপর আমার সামনে এনে এর চারটে পাতা উল্টে দেখালো ওই নাম।আমি নাম দেখে অবাক হলাম।এটা আবার কোন ধরনের নাম?
ওখানে লিখা – ” A dog in the form of a human ”
আমি কিছুই বুঝতে না পেরে ফৌজিয়াকে বললাম,’ এটা কি দেখাচ্ছো? এরকম নাম কিভাবে হয় মানুষের? ‘
ফৌজিয়া হাসলো।বললো,’ হয়। কিছু মানুষের হাত পা সবই থাকে।এরা কথা বলে। বিয়ে করে।অফিস করে। মানুষের সঙ্গে চলে।খায়-দায় আর ঘুমায়ও। কিন্তু এরা সত্যিকারে কোন মানুষই না ।এবং এই ” A dog in the form of a human ” টা কে তুমি জানো?’
আমি বললাম,’ কে?’
ফৌজিয়া বললো,’ আমি এখনই বলবো না এই মানুষ নামের অমানুষটি কে।কি তার পরিচয়।এটা বলার আগে আরো কিছু জিনিস তোমায় দেখাতে চাই আমি।আর কিছু জিনিস শুনাতেও চাই।’
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। আমার সবটা শরীর থরথর করে কাঁপছে।আমি বললাম,’ ফৌজিয়া, তুমি কি আমায় নিয়ে খেলা খেলছো নাকি? তুমি আমায় বোকা পেয়েছো তাই না? তুমি জানো, তোমার এই গোপন গোপন খেলার জন্য,নামটা না বলার জন্য আমাদের কতো কতো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। গতকাল ভাইয়া মরতে বসেছিলো। মায়ের জন্য শুধু সে এখনো বেঁচে আছে। ‘
ফৌজিয়া হাসলো। শব্দ করে। এই প্রথম তার দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরে ভয় ধরে গেল। রাগে তার চোখ দুটো জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে আছে। চেহারার দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে, এ যেন অশূর বধ করতে আসা স্বর্গীয় কোন দেবী!
আমি কিছু বলার আগেই ফৌজিয়া বললো,’ আমি খেলছি? হা হা হা। তাহলে ঠিকই ধরেছো তুমি। এইসব কিছু খেলা আমিই খেলেছি। এখনও খেলছি।আমি। শুধু আমি।একা আমি। আমিই সেই আড়ালের শিকারী।আড়ালে লুকিয়ে থেকে কলকাঠি আমিই নাড়িয়েছি এতো দিন। কিন্তু খেলাটা এখনও শেষ হয়নি তপু।তপু, তুমি সিনেমা দেখো না? বাংলা সিনেমা? হিন্দি সিনেমা? ওসব সিনেমায় শেষের একটা সিন থাকে তাই না? ওখানে সব রহস্যের উন্মোচন হয়।সত্যের পক্ষে যে থাকে সে জিতে যায়।আর মিথ্যের পক্ষে যে থাকে সে পরাজিত হয়। তাই না? ‘
আমি কথা বললাম না। কথা বলতে পারছি না। আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে।
কথা বললো আবার ফৌজিয়াই। সে বললো,’ আড়ালে এতো দিন যে খেলা আমি খেলেছি এর শেষ আজকেই হবে।আজ রাতের মধ্যেই।’
আমি কিছু বলতে যাবো কিন্তু ফৌজিয়া কিছুই বলতে দিলো না আমায়।আমায় থামিয়ে দিয়ে সে বললো,’ আজ তুমি কোন কথাই বলবে না তপু।সব কথা আমি বলবো।আমি। শুধু আমি। একা আমি। ‘
বলে সে আলমারির কাছে গেল আবার। তারপর একটা সাদা ছোট্ট বাক্স নিয়ে এলো। আমার কাছে এসে সেই বাক্স খুলে একটা রূপার চেইন বের করলো ওখান থেকে।চেইনের নিচে একটা ইংরেজি অক্ষর। “A” । কিন্তু চেইনটা একদিকে ছেঁড়া।চেইনটা দেখে আমি চমকে উঠলাম।এটা আমি স্পষ্ট চিনতে পেরেছি।এটা আর কারোর না।এটা অপু ভাইয়ার। ভাইয়া তার ছাত্র জীবনে সব সময় গলায় চেইন পরতো। তারপর হঠাৎ করে একদিন সেই চেইন নাই।একরাতে আমরা খেতে বসেছি।আমি আর ভাইয়া।মা আমাদের পাতে ভাত -শালুন বেড়ে দিচ্ছেন। তখনই মা খেয়াল করলেন, ভাইয়ার গলায় চেইন নাই। কিন্তু তার গলায় কেটে যাওয়া লম্বা সরু একটা দাগ ভেসে আছে। তাকালে লাল টকটকে মাংস দেখা যায়।
মা বললেন,’ তোমার চেইন কোথায় অপু? ‘
ভাইয়া আমতা আমতা করে বললো,’ আছে।’
‘ কোথায় আছে?’
ভাইয়া বললো,’ ঘরে।’
মা বললেন,’ যাও নিয়ে আসো গিয়ে এখানে।’
ভাইয়া বিরক্ত হলো।বললো,’ এখন তো খাচ্ছি, এখনই কেন আনতে হবে? খাওয়ার পর আনলে হবে না তোমার?’
মা বললেন,’ না হবে না। এক্ষুনি আনতে হবে।’
ভাইয়া খানিক সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো,’ চেইনটা নাই!’
মা অবাক হলেন। বললেন,’ নাই মানে? চেইন কোথায় গেল? আর তোমার গলায় এই দাগ কিসের?’
ভাইয়া কিছু বলে না।চুপ করে আছে।’
মা ধমক দিলেন। বললেন,’ কিছু বলছো না কেন তুমি? চুপ হয়ে আছো কেন? ‘
ভাইয়া থতমত খেয়ে গেল যেন। তারপর বললো,’ চুরি হয়ে গেছে এটা। ওইদিন যে মেলা হলো।ভীড় ছিল খুব। ওখান থেকে কেউ একজন টেনে নিয়ে গেছে। আমি দেখতেই পাইনি কে নিলো।আর তখনই গলা কেটেছে।দাগ হয়েছে।’
মা সেদিন বলেছিলেন,’ দেশের চোর গুলোও এতো খারাপ হয়ে গেছে যে, একটা সামান্য রূপার চেইনের লোভও এরা সামলাতে পারে না! ‘

এবার আমি ভাবছি , সেদিন ভাইয়ার চেইন যদি মেলা থেকে চুরি হয়ে থাকে তবে তা ফৌজিয়ার কাছে এলো কি করে? নাকি ফৌজিয়াকেই ভাইয়া উপহার দিয়েছিলো এটা। তারপর মিথ্যে করে বললো চুরি হয়ে গেছে। আমাদের কাছে গোপন করেছিল। কিন্তু এখানে একটা বিরাট প্রশ্ন থেকেই যায়। আচ্ছা ভাইয়া যদি ফৌজিয়াকে এই চেইন নিজের থেকেই উপহার দেয় তবে তার গলায় এই দাগটা হয়েছিল কিভাবে?

ফৌজিয়া চেইনটা আমার হাতে দিয়ে বললো,’ এটা চিনতে পেরেছো তপু?’
আমি চিনতে পারলেও সত্যটা বললাম না। কেন বললাম না জানি না। আমি বললাম,’ না, চিনতে পারছি না তো।’
ফৌজিয়া হাসলো। আগের মতোই সেই ভয়ংকর এক হাসি হেসে সে বললো,’ তুমি অবশ্যই চিনতে পেরেছো তপু। কিন্তু মিথ্যে বলছো তুমি। এই চেইন তোমার অপু ভাইয়ার।ঠিক বলিনি আমি?’
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,’ হু।ঠিক বলেছো।’
কিন্তু হঠাৎ করেই ফৌজিয়াকে কেন আমার ভয় করছে আমি তা বুঝতে পারছি না। ভয়ে ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছি না তার সাথে। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, ফৌজিয়া সাধারণ কোনো মেয়ে নয়।যাকে আমি এই এতো দিন অতি সাধারণ, সাদামাটা একজন ডাক্তার ভাবতাম, ফৌজিয়া শুধু এইটুকু না। সে এরচেয়েও বেশি কিছু। এবং ভয়ংকর।আর অনেক বেশি চতুর।
ফৌজিয়া এবার আমার কাছে এলো। একেবারে কাছে।নাকের ডগায়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’তোমাকে একটা প্রশ্ন করি তপু? একটা ছোট্ট প্রশ্ন? ‘
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,’ হু।করো।’
এবার ফৌজিয়া আমার সামনে একটা চেয়ার টেনে আনলো। তারপর এক পায়ের উপর তার অন্য পা তুলে নিয়ে আরাম করে ওখানে বসলো। তারপর গলার আওয়াজ কমিয়ে অথচ ধারালো গলায় বললো,’ যেহেতু এই চেইনটা তোমার ভাইয়ের তাহলে এই চেইন আমার কাছে এলো কি করে তপু? ‘


#চলবে

আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-০৮

0

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#৮ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



দরজা খোলা গেল না কিছুতেই।সব চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মাকে দেখলাম জানলার দিকে দৌড়ে যেতে। ভাইয়ার ঘরে যে কাঁচের জানলা আছে তা আমার মোটেও খেয়াল ছিল না ।মা দৌড়ে গিয়ে সেই জানলায় দু’ হাতে একটানা আঘাত করতে লাগলেন।আমি গিয়ে দেখি মার দু’ হাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে ততোক্ষণে।হাতের কনুই বেয়ে সেই রক্ত টপটপ করে জমিনেও গড়িয়ে পড়ছে।জানলার গ্লাস ততোক্ষণে অনেকখানিই ভেঙে ফেলেছে মা। মায়ের ক্ষত বি*ক্ষত দুটি হাতের দিকে তাকিয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো।কষ্ট হচ্ছে আমার ভীষণ! আহারে অভাগী মা! মায়ের এতো দরদ হয় সন্তানের জন্য?
আমি তাড়াহুড়ো করে ভাঙা গ্লাসের ফাঁকা দিয়ে তাকাতে চাইলাম। আমার বুক এমনিতেই ধড়ফড় করছে।আমি ভয়ে চোখ মেলছি না, যদি দেখি ভাইয়া গলায় রশি দিয়ে ফেলেছে! যদি দেখি ভাইয়া আর নাই!
ভয়ে ভয়ে চোখের পাতা খুলতেই দেখি ভাইয়া সিলিং ফ্যানে রশি বেঁধে সেই রশিতেই তৈরি করা গোলকের ভেতর তার গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আর দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে তার শরীর প্রচন্ড রকম ঘামছে। সে থরথর করে কাঁপছে তখনও।আমি মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারছি না। জানালায় শক্ত গ্রীল দেয়া।এই গ্রীল গলে ভেতরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব না।
মা এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।রক্তে লাল টকটকে দুটো হাত এক করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে ভাঁজ করে সাজিয়ে সামনে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মা বললেন,’ আমি তোর মা, আমার কসম লাগে বাজান! তুই যদি ফাঁ*স নিস তবে সঙ্গে সঙ্গে আমিও নিবো। আল্লার কসম, আমিও নিবো।’
বলে মা সঙ্গে সঙ্গে তার শাড়ির আঁচল গলায় পেঁচিয়ে নিতে শুরু করলেন।আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না! আমাদের সুন্দর ঘরটা এভাবে নরক হয়ে উঠলো কিভাবে? এই যে এমন লকলকে দগদগে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন।আমি কিভাবে এই আগুন নিভৃত করবো।কোন তরলে নিভবে এ আগুন?
আমার জানা নাই!
অবশ্য মায়ের গলায় আঁচল পেঁচিয়ে নেওয়ায় ভাইয়া থমকে গেছে। সে তাড়াহুড়ো করে গলা থেকে রশি ছাড়িয়ে নিচে নেমে এলো। জানলার কাছে দৌড়ে এসে জানলার ভাঙা অংশ দিয়ে তার হাত দুটো বের করে দিয়ে মায়ের হাত দুটো টেনে ধরলো। তারপর কাঁদতে কাঁদতে সে বললো,’ না মা না। তুমি এটা করো না। আমি এটা মরে গিয়েও সহ্য করতে পারবো না!’
ভাইয়া এরপর দৌড়ে এসে দরজা খুললো।নিজেই বেরিয়ে এলো বাইরে।মা তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। আদর করলেন।চুমু খেলেন কপালে।গালে।যেমন করে ছোট্ট শিশুদের চুমু খায়, আদর করে মায়েরা।আর তার গালে চড়, থাপ্পর বসিয়ে দিতে দিতে বললেন,’ এতো বড় সাহস কে দিয়েছে তোকে? তুই মরতে চাস তাই না? কেন মরবি তুই বল।আমায় বল তুই? কার জন্য? কিসের জন্য?’
ভাইয়া বললো,’ অপি যা করলো এতো সবের পর এই জীবন রেখে কি লাভ মা? আমি মানুষকে কিভাবে এই মুখ দেখাবো?’
আমার মা অসম্ভব রকমের জ্ঞানী মহিলা।বাবা আমাদের দুই ভাইকে ছোট্ট ছোট্ট রেখে মারা গিয়েছিলেন। আমার দাদি ছিলেন অনেক বেশি বদমেজাজি মহিলা। মায়ের উপর তিনি নানাভাবে অ*ত্যাচার, অ*নাচার করতেন।সব সময়ই। মাকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। মায়ের তখন রূপ ছিল, বয়স ছিল। বিয়ে করার মতো অবস্থা ছিল।নানা তখনও বেঁচে আছেন। তাদের অর্থ বিত্ত কিংবা প্রভাব প্রতিপত্তি কোন কিছুর বিন্দুমাত্র অভাব ছিল না।নানা এবং মামারা চেয়েছিলেন মা বিয়ে করুন আবার। অনেক জায়গা থেকেই আলাপ এসেছিল।মা কিন্তু আমাদের দুই ভাইকে রেখে অন্য কোথাও বিয়ে করে ফেলেননি। তিনি তার সব শ্রম দিয়ে,মায়া মমতা আদর শাসন দিয়ে আমাদের বড় করে তুলেছেন। পড়াশোনা করিয়েছেন। একজন মা জ্ঞানী বলেই এতো সব কিছু সামলাতে পেরেছেন। কোনদিন পিতৃ হারাবার কষ্ট কি, যাতনা কি তা আমাদের বিন্দু পরিমাণ বুঝতে দেননি,!
মা ভাইয়ার একটা হাত ধরলেন। তারপর বললেন,’ তুই কি কোন অপরাধ করেছিস? এখানে কি তোর হাত আছে? এই ভিডিওতে, ছবিতে তুই আছিস?’
ভাইয়া বললো,’ না।নাই।’
মা বললেন,’ তাহলে? তাহলে তুই মানুষকে মুখ দেখাতে পারবি না কেন? তুই তো কোন অপরাধ করিসনি। অপরাধ করলে কথা ছিল। অপরাধ না করেও নিজেকেই নিজে এতো বড় শাস্তি তুই দিবি কেন?’
ভাইয়া বললো,’ অপি এটা কিভাবে করলো মা? তাকে কি আমি কম ভালোবেসে ছিলাম? তাকে কি আমি কম বিশ্বাস করেছিলাম? তুমি কম স্নেহ করতে তাকে? তপু কম শ্রদ্ধা করতো? তার জন্য আমরা কি না করেছি মা? এরপরেও কিভাবে সে এমন প্রতারণা করতে পারলো?’
মা ভাইয়ার কাছে বসলেন। তারপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’ আরে বোকা ছেলে, এটা নিয়ে এখন পড়ে থাকলে চলবে না। কিছুতেই থেমে যাওয়া যাবে না। মানুষ কিছু বলুক গিয়ে। লোকের কথায় কিচ্ছু যায় আসে না অপু! লোক আমাদের খাওয়ায় না, পরায় না।তো তাদের কথা কেন আমরা আমলে নিবো অপু? তোকে কি আরো কিছু বোঝাতে হবে আমার? তুই কি বোকা ছেলে নাকি বল?’
ভাইয়া এবার কিছুটা ধাতস্থ হলো বলে মনে হলো। সে বললো,’ অপিকে ঠিকই খুঁজে বের করবো।আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো কেন এমন করলো সে আমার সাথে। কি দোষ ছিল আমার? কেন এমন করলো সে?’
মা বললেন,’ বাদ দেও এসব অপু।যা হবার তা হয়ে গেছে। ভাগ্য বদলাবার ক্ষমতা তোমার আমার নাই।এটা আল্লার হাতে।এসব নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করার দরকার নাই।আর আজ যা করতে চেয়েছিলে ভবিষ্যতে যেন এরকম কিছু করা তো দূরের কথা , কল্পনায়ও যেন এসব না আনো! সাবধান! ‘
ভাইয়া মায়ের পা ধরে ক্ষমা চাইলো।বললো, তার বাকী জীবনে এমন কিছু ভুলেও সে করবে না!
মা তাকে ক্ষমা করলেন শেষ বারের মতোই।

এরপর সবকিছু ঠিক ভাবেই চলতে লাগলো। ভাইয়া আবার নিয়মিত অফিসে যাচ্ছে। সবকিছু সুন্দর ভাবে চলছে। শুধুমাত্র অপি ভাবী নাই।তার অনুপস্থিতি বড় কষ্ট দেয় আমায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে তার কথা মনে পড়লে ভীষণ ঘেন্নাও কাজ করে।কি নোংরা কাজগুলো করে গেল সে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
শুধুমাত্র তার জন্যই আমাদের সম্মান ধুলোয় মিশে গেল। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী এখন অনেকেই মিটিমিটি হাসে। কোনো ঘরে দুই জাঁ কিংবা ননদেরা একসঙ্গে শাকপাতা বাছতে গিয়ে কিংবা একে অপরের মাথায় নারিকেল তেল ঘষে দিতে গিয়েও তাদের গল্পের খোরাক হয় আমাদের ঘরের গল্প।অপি ভাবীর গল্প। চায়ের স্টল গুলোতে আগে সিনেমা চলতো। এখন অপি ভাবীর গল্প চলে। এসব গল্প বাড়িয়ে বলিয়ে বলা হয়। আমার নিজের কানেই এসেছে অনেক কিছু। তারা এটাকে এই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যে, অপি ভাবী কদিন পর পর তার পুরুষ বদলাতো।আর মাঝরাতে আমরা ঘুমিয়ে গেলে সেই পুরুষদের ঘরে নিয়ে আসতো।আরো কতো নোংরা নোংরা কথা যে তারা বলে!
শুধুমাত্র তার জন্যই এখন রাস্তায় বেরুলেও পরিচিত কেউ পেলে সহানুভূতি দেয়ার নাম করে চারটে কথা শুনিয়ে ছাড়ে! তখন আমারও ইচ্ছে করে, সত্যিই মরে যাই। ভাইয়া যে সেদিন মরতে চাইলো, তা এমনি এমনি না। নিজের স্ত্রী এমন করলে তখন কি মাথার ঠিক থাকে! ভাগ্যিস যে সে অপি ভাবীকে এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছে।অন্য কেউ হলে তো খু*ন করে ফেলতো!
নদীর একপাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসব ভাবছিলাম। আমার যখন ভীষণ মন খারাপ হয়। তখন এই নদীর কাছে আমি চলে আসি। এই নদীর নাম ব্রক্ষ্মপুত্র। কিন্তু আমি এর নাম দিয়েছি মায়াবী নদী।এর প্রতি আমার অনন্ত- অসীম মায়া। এখানে এসে নদীর পাড় ধরে একটু হাঁটাহাঁটি করি। নদীতে জল এখন একেবারেই কম। যেটুকু জল আছে তার সাথে যেন আকাশের রং এসে মিশে একাকার হয়ে থাকে সব সময়।কে বলবে জলের কোন রং হয় না! এই নদীর জলের রং এখন নীল।ঘন নীল। সেই নীল জলের বুকেই ভেসে বেড়াচ্ছে একদল পাতি হাঁস। মাঝেমধ্যে এক দুটো পানকৌড়ি ডুবছে, ভাসছে।এসব দেখে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু আজ মন কিছুতেই ভালো হচ্ছে না। নিজেকে কেমন অসহায় মনে হয় আমার। কেন জানি মনে হয় কারোর প্রতি আমি বা আমরা অবিচার করছি!
অপি ভাবীর কথা খুব মনে পড়ছে আমার। আমাদের মিষ্টি আর হাসিখুশি অপি ভাবী। আচ্ছা সে কেন এমন করলো হঠাৎ? কেন?
একটা মানুষ সম্পর্কে কোনদিন কিছুই জানি না। তার কোন খারাপ গুণ কোনদিন চোখে পড়েনি।আর হঠাৎ করেই কি না সে এতো কিছু ঘটিয়ে ফেললো! এও কি সম্ভব!

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বিকেল ফুরিয়ে গেছে মুহূর্তে। নদীর ওপারে যে মস্ত শিরিষ গাছ।সেই গাছের ডালপালার ফোঁকড় দিয়ে দেখা যাচ্ছে সিঁদূরের মতো লাল টকটকে সূর্যের হঠাৎ করেই মিলিয়ে যাওয়া।দূরের মসজিদ থেকে তখন ভেসে আসছে মাগরিবের আজান।আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এর ঠিক দখিনে হিন্দু পল্লী। ওখান থেকে কাঁসার আওয়াজ আসছে। ঘরের নারীরা নিশ্চয় এখন তুলসী তলায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে দিচ্ছে। এই যে এক সন্ধ্যা, দিন আর রাতের মিলন।এ এক অপার্থিব সময়।এ এক মধুর মোহন আর পবিত্র সময়।মিলনের চেয়ে কি পবিত্র কিছু আর আছে? আচ্ছা মিলনের সব দৃশ্যই কি এমন সুন্দর হয়?
পুরুষ- নারীরও?
আচ্ছা ভাইয়া আর অপি ভাবীরও কি এমন ছিল না? তারা কি তাদের ফুলশয্যায় শপথ করেনি কেউ কাউকে ছেড়ে না যাবার? আমৃত্যু একসঙ্গে থাকার? একে অপরের সঙ্গে প্রতারণা না করার? সুখে দুঃখে সব সময়ই একে অপরের পাশে থাকার?
কিন্তু এমন কেন করলো তারা? কেন?

খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম আমি।ভেজা ঘাসের উপর বসেই আবছা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য কাউকে এমন সব প্রশ্ন করে করে কোন উত্তর না পেয়ে চোখ ভেজাচ্ছিলাম নিজের।আর তখনই পকেটে থাকা ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। প্রথমবার ফোনে হাত নিলাম না। ভীষণ মন মরা আমার।ইচ্ছেই করছে না ফোন ধরতে এখন। কিন্তু দ্বিতীয় বারের মতো যখন ফোনে রিংটোন বাজতে লাগলো। তখন মনে হলো, কেউ জরুরি কল করেছে।পকেট থেকে ফোন হাতে নিয়ে অবাক হলাম। দীর্ঘদিন পর ফৌজিয়ার ফোন। ফৌজিয়া আবার হঠাৎ ফোন করলো কেন?
ফোন রিসিভ করতেই ফৌজিয়া বললো,’ তপু, তুমি কোথায় আছো? ‘
আমি বললাম,’ আছি এক জায়গায়।’
ফৌজিয়া এবার বললো,’ তুমি কি এক্ষুনি একটু আসতে পারবে? খুব ইমার্জেন্সি!’
আমি অবাক হলাম। আমার সঙ্গে এখন তার ইমার্জেন্সি কি আছে!
আমি বললাম,’ কোথায় আসবো?’
সে বললো,’ আমার বাসায় আসো।’

#চলবে

আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-০৭

0

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#৭ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মহসিন ভাই আমার মেসেজ এখনও সিন করেননি। তার সঙ্গে যে ফোন করে কথা বলবো এই শক্তি আমার শরীরে নাই। আমি ক্লান্ত শ্রান্ত আর বিধ্বস্ত হয়ে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রইলাম।
অবশ্য মহসিন ভাইয়ের সাথে যখন কথা হলো তখন কোন তথ্য তার কাছ থেকে পাওয়া গেল না। তিনি বললেন, এটা ফেসবুক, টেলিগ্রাম সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই পোস্ট করেছে। অনেক গুলো গ্রুপে, পেজে।এটা আসলে কে প্রথমে পোস্ট করেছে তা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।

আমার সবচেয়ে বেশি অবাক লাগছে একটা বিষয়ে, অপি ভাবী এই এতো দিন চুপচাপ কিভাবে রইলো? কোন কথাই বললো না সে এই বিষয় নিয়ে। ভাইয়াকে নিয়ে।আর আজ হঠাৎ করেই একেবারে বিদ্রোহ করে বাসা ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।আর তার চলে যাবার কয়েক ঘণ্টা পরেই তার এসব ছবি,ভিডিওর লিংক সব বের হয়ে গেল।এটা কিভাবে সম্ভব? এর মানে কি আমি ধরেই নিবো যে অপি ভাবী জানতো আগে থেকেই, আজ তার ছবিগুলো, এবং ভিডিও গুলো ছড়িয়ে পড়বে। তাহলে কি ভাবী যাদের অনুরোধ করেছিলো ছবিগুলো এবং ভিডিও গুলো পোস্ট না করতে তবে তারাই আজ এটি করেছে।তারা ভাবীর অনুরোধ রাখেনি। তবে যে ভাবী ওদের সঙ্গে কালো রঙের গাড়িতে করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। ভাবীর গহনা ঘাঁটি যা ছিল সব দিয়ে এলো,অথবা ওরা কেড়ে নিলো। এরপরেও কিভাবে ওরা ভাবীর সঙ্গে এমন করলো? বিনিময় নিয়েও কেন ওরা প্রতারণা করলো?
সে যায়হোক, আমার প্রশ্ন হলো ভাবীর সঙ্গে ভিডিওতে যে পুরুষ লোকটি এই লোকটি কে?যেই থাকুক না কেন পুরুষটি, সে ভয়াবহ রকমের চতুর। তাকে কোন ভাবেই চেনা যাচ্ছে না। কাউকে সন্দেহও করা যাচ্ছে না। এমনকি লোকটি কতোটা উঁচু, কতোটা সাস্থ্যবান, চেহারার অবয়ব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।ভাবী যে কোথাও ভয়ংকর রকম ভাবে ফেঁসে গিয়েছে এটা স্পষ্ট।

মজার বিষয় হলো এর পরদিন ভোর বেলায় ভাইয়া বাসায় ফিরলো। বাসায় ফিরে সে মায়ের পায়ের কাছে বসে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো।
মা বললেন,’ কোথায় ছিলি তুই?’
ভাইয়া সত্যি কথাই বললো।বললো,’ সিলেটে।’
‘সিলেটে কেন গিয়েছিলি?’
ভাইয়া আর মিথ্যে করে অফিসের কথা বললো না। সে বললো,’ ঘুরতে।’
‘ তাহলে বাসায় মিথ্যে বলে গেলি কেন? অফিসের কথা বললি কেন?’
ভাইয়া এবার মায়ের পা জড়িয়ে ধরে মায়ের কোলে মাথা গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো।আর কান্নাভেজা গলায় বলতে লাগলো,’ মা, আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে! আমার সব শেষ হয়ে গেছে।একটা সোনার সংসার, পুড়ে ছাই করে দিয়েছে অপি।দিনের পর দিন আমি এসব যন্ত্রণা, কষ্ট সব সহ্য করেছি। ঘরের কাউকে কিছুই বলিনি। ভেবেছিলাম একাই সব সমাধান করবো। কিন্তু আমি পারিনি মা।যে পতিতা, নষ্টা, তাকে ধর্মের জ্ঞান আর সামাজিকতার ভয় দেখিয়ে লাভ হয় না মা!’
ভাইয়া তখনও কাঁদছে। তার চোখ লাল হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে।
মা অপু ভাইয়ার মুখটা তার দু হাত দিয়ে উপরে তুললেন। তারপর বললেন,’ কি হয়েছিল বল তো আমায়!’
ভাইয়া বললো,’ অপি কারোর সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল মা।যার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তার কাছে অপির ভিডিও ছিল।এসব ভিডিও দিয়ে দিনের পর দিন ওই লোক আমায় হুমকি ধামকি দিতো।টাকা চাইতো।টাকা না দিলে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হু*মকি দিতো।আমি টাকা দিয়েছি।এটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন আমি জানলাম যার সঙ্গে অপির অবৈধ সম্পর্ক, তার সন্তানই অপির গর্ভে। তখনই আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে তখন গোপন এক কলহ শুরু হয়। তাকে আমি মারধোরও করি। সবার আড়ালে।আমি চাইনি তা কেউ জানুক।আর কেউ কষ্ট পাক এসব শুনে।আমি নিজে নিজেই সব কিছুর সমাধান করতে চেয়েছি। অপি শেষ পর্যন্ত হসপিটালে গিয়ে তার গর্ভের সন্তান অ্যাবোরেশোন করে এলো। এইসব কিছু আমি কিভাবে মেনে নিতাম বলো মা? কিভাবে? এর পরপরই আমি নিজেকে শান্ত করতে,একটু চিন্তামুক্ত থাকতে সিলেটে চলে যায়। ভাবলাম, ওখানে কদিন থেকে এলেই আমি শান্ত থাকতে পারবো।একটু ভালো থাকতে পারবো। কিন্তু ওখানে গিয়েও আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না।ওই লোক আমায় আবার ফোন করতে শুরু করে। আবার টাকা চাইতে শুরু করে। আবার হু*মকি দেয়।
বলে, টাকা না দিলে এসব ছবি,ভিডিও ছড়িয়ে দিবে। এরপরই আমি ফোন অফ করে ফেলি। আমি আর এসব নিতে পারছিলাম না।আমি বোঝে গিয়েছিলাম, সে কদিন পর পরই এভাবে আমার কাছে টাকা চাইবে।আর হু*মকি দিয়েই যাবে।অপিকে ওই লোক ইউজ করেছে শুধুমাত্র টাকা ইনকাম করতে।অপি বুঝতে পারেনি।অপি তার নিজের জীবন ধ্বং*স করলো, সাথে আমার জীবনটাও! ‘
ভাইয়া কেঁদেই যাচ্ছে।মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কোন কথা বলছেন না।
ভাইয়াই আবার কথা বললো। বললো,’ আমার ভাগ্যটা এতো খারাপ কেন মা ? বলো, আমার ভাগ্যটা এতো খারাপ কেন? এই যে সবাই আমার স্ত্রীর এসব ছবি দেখবে, ভিডিও দেখবে।আমি কিভাবে সমাজে মুখ দেখাবো মা? আমি মানুষদের কিভাবে এই মুখ দেখাবো? এরকম জীবন রাখার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো মা। এরকম জীবন রাখার কোন মানেই হয় না!’
মা ভাইয়াকে বার বার সান্তনা দিলেন।মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।আদর করে দিলেন। কিন্তু আমার কেন জানি এসব দেখে মনে মায়া জন্মের পরিবর্তে কেমন একটা ক্ষোভ জন্ম নিলো।

এই যে ভাইয়া এভাবে কাঁদলো। দুঃখ করলো।এসব দেখে, ভাইয়ার কথা শোনে মোটেও আমার মন গলেনি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে হয়তো কোন একটা কিন্তু আছে। নয়তো ভাবী অতো সব কিছু করলো, আর ভাইয়া এর সবকিছুই শুধু গোপনে সহ্য করেই গেল।এটা কি বিশ্বাস যোগ্য কথা?
আর ভাবী যে আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাবার সময় এভাবে কাঁদলো , গেট ডিঙিয়ে যাবার সময়ও চোখ মুছলো, এসব কি শুধু শুধু?
একটা ঘরের জন্য, ঘরের মানুষ গুলোর জন্য ভালোবাসা না থাকলে কি কেউ এমন করবে?

সন্ধ্যা সময় ভাইয়া বাজারে গেলো।ফেরার সময় দেখলাম তার হাতে একটা প্যাকেট।আমি বললাম,’ কি এনেছো ভাইয়া?’
ভাইয়া বললো,’ সুঁতো।’
আমি অবাক হলাম। বললাম,’ সুঁতো কেন? সুঁতো দিয়ে কি করবে?’
ভাইয়া বললো,’ কাল অফিস আছে। অফিসের কাজে লাগবে।’
আমি আর কিছু বললাম না। ভাইয়ার সঙ্গে এখন আর অতো কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কেন জানি ভাইয়াকে আর আমার সুবিধার লোক মনে হয় না। তাকে আমার অতোটা বিশ্বাসও হয় না। কেন জানি সব সময় তাকে আমার সন্দেহ হয়। কেন জানি মনে হয়, অপি ভাবীর কোন দোষ ছিল না।সব দোষ ভাইয়ার। এসবের জন্য একমাত্র ভাইয়াই দায়ী।

কিন্তু সে রাতেই আমার এই ভুল ধারণা বদলে গেল। তখন মাঝরাত। ফেসবুকে স্ক্রল করছি। তখনই দেখলাম নিউজফিডে ভাইয়ার স্ট্যাটাস।দুই মিনিট আগেই পোস্ট করেছে সে।লিখেছে ‘ এই জীবনের উপর আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। এমন কলঙ্কে অঙ্কিত কুৎসিত একটা জীবন রাখার কোন মানেই হয় না।আমি নিজের ইচ্ছায় আত্মহ*ত্যা করছি। এতে কেউ দায়ী নয়।’
ভাইয়ার পোস্ট দেখার পর দু’ চোখ অন্ধকার হয়ে এলো আমার। সন্ধ্যা সময় যে ভাইয়া মোটা সুঁতো কিনে এনেছিল প্যাকেটে করে তাহলে তা অফিসের কাজের জন্য আনেনি।এটা দিয়ে আত্মহ*ত্যা করতেই কিনে এনেছিল। আমার কাছে মিথ্যে বলেছিল। আমিও তখন বুঝতে পারিনি।ভাবতেও পারিনি ভাইয়া এমন একটা কাজ করে ফেলবে!
আমি কি করবো না করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। নিজের উপর নিজেরই ভীষণ রাগ লাগছে এখন। আমার আপন ভাই, রক্তের ভাই। তাকে কিভাবে আমি অবিশ্বাস করে ফেলেছিলাম!
কিভাবে ভাইয়ার চেয়ে অপি ভাবী আমার কাছে বিশ্বাসের পাত্রী হয়ে পড়েছিল! অথচ ভাইয়াকে অবিশ্বাস করার মতো প্রমাণ নাই বললেই চলে। কিন্তু অপি ভাবীকে অবিশ্বাস করার মতো অনেক গুলোই প্রমাণ আছে। এবং সবগুলো প্রমাণই অতি জ*ঘন্য!
আমি তাড়াহুড়ো করে মাকে ডেকে তুললাম।মা আর আমি দৌড়ে গেলাম ভাইয়ার দরজার কাছে। কিন্তু ভেতর থেকে ভাইয়ার দরজা আটকে রাখা।আমি আর মা চিৎকার করে ভাইয়াকে ডাকছি।মা কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতে ভাইয়াকে অনুরোধ করে বলছেন,’ বাবা, তুমি দরজাটা খুলো। লক্ষ্মী বাবা আমার! সোনা মানিক আমার! তুমি বেঁচে না থাকলে আমি বাঁচবো কিভাবে? কাকে নিয়ে বাঁচবো! ‘
কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ভাইয়া ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ করছে না।
আমি ভাইয়াকে ফোন দিচ্ছি। ফোন বন্ধ করে ফেলেছে। এরপর নিরুপায় হয়ে দরজায় আমার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছি। মাও আমার সঙ্গে দরজায় আঘাত করছেন তার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে।কিন্তু কোন ভাবেই আর দরজা খুলতে পারছি না আমরা। এখন কি হবে? আচ্ছা ভাইয়া কি তাহলে গ*লায় দড়ি দিয়ে ঝু*লে পড়েছে এতোক্ষণে ?

(চলবে)