Sunday, July 13, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 353



আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-০৬

0

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



আমি ভেবেছিলাম মার এই কঠিন রাগ কিংবা অভিমান অতো সহজে ভাঙবে না।মা সহজে বাসায় আসবেন না। ভাইয়া বাড়ি ফিরলে সে যদি গিয়ে মায়ের কাছে ক্ষমা চায়, অনুরোধ করে তবেই হয়তো মা ফিরবেন। কিন্তু আমায় চমকে দিয়ে পরদিন সকাল বেলায়ই মা বাসায় এসে উপস্থিত হলেন।মামার বাসায় তিনি যাননি।বড় খালার বাসা থেকে সরাসরি এসে পড়েছেন।
মা আসার পর মাকে সবকিছু খুলে বললাম। বিশেষ করে মহসিন ভাই যে বললো ভাইয়া ট্রেনিংয়ে বা অফিসের কোন কাজে কোথাও যায়নি। সে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে।আর আমাদের কাছে,মানে আমার কাছে বলে গিয়েছে সিলেট যাচ্ছে।এর সবকিছুই মাকে বললাম।
মা এই কথা শুনে চমকে উঠলেন। তিনি বিড়বিড় করে জপতে লাগলেন, আল্লাহ, আমি যা ভাবছি তা যেন না হয়। আল্লাহ আমার ছেলেকে নাফরমানদের অন্তর্ভুক্ত করো না তুমি!
মা আমায় কাছে ডাকলেন।আমি কাছে গেলে তিনি বললেন,’ তপু, তুমি এক্ষুনি অপুর অফিসে যাও।মহসিনের কথার উপর নির্ভর করে থাকলে হবে না। তুমি ওখানে গিয়ে ওর বসের কাছ থেকে, এবং অন্যদের থেকেও জানবে, আসলে তোমার ভাইয়া ছুটি নিয়ে গিয়েছে নাকি অফিসের কাজে গিয়েছে। এক্ষুনি যাও তুমি।দ্রুত।সব জানার চেষ্টা করবে।’
আমি বের হতে যাবো ঠিক তখনই ভাবী তার ঘর থেকে এক রকম দৌড়ে এলো। এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,’ তোকে অফিস যেতে হবে না তপু।অফিস গিয়ে কোন লাভ হবে না।লাভ হবে আমি যদি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই, তবেই।’
আমি চমকে উঠলাম ভাবীর কথা শুনে।আর মা চোখ বড় বড় করে তাকালেন ভাবীর দিকে। তাকিয়ে বললেন,’ কি বললে তুমি? ‘
অপি ভাবীর চোখ থেকে তখন টপটপ করে জল গড়িয়ে নামছে গালে। সে তার বা হাতের পিঠ দিয়ে তার গালে লেগে থাকা সেই জল মুছতে মুছতে ভেজা চুপসানো গলায় বললো,’ মা, আমি এখানে আর এক দণ্ডও থাকবো না।কেউ আমায় এখানে আর রাখতে পারবে না।কারোর অধিকার নাই আমায় এখানে আটকে রাখার!’
ভাবী রাগে কাঁপতে কাঁপতে এই কথাগুলো বললো।
মা আর আমি বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মা দূর্বল গলায় বললেন,’ আমি কি জানতে চাইনি তোমার কাছে , কি হয়েছে? কি হচ্ছে এই বিষয়ে? তুমি বলেছিলে কিছু আমায়? বলো বলেছিলে?’
অপি ভাবী রাগে তার গলার আওয়াজ আরো ধারালো করে বললো,’ না বলিনি। কেন বলিনি জানেন? ‘
মা বললেন,’ কেন?’
ভাবী তার কান্না,রাগ এইসব কিছু থামিয়ে হাসলো। অট্টহাসি। তাকে কেমন এলোমেলো দেখাচ্ছে এখন। তাকে একেবারেই অচেনা মনে হচ্ছে। এই যে এতো নম্র,ভদ্র আমাদের অপি ভাবী। এখন তাকে দেখলে মনে হবে ভদ্রতার ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে নাই! সে এক ছন্নছাড়া, ক্ষ্যাপাটে মেয়ে লোক।
ভাবী তার হাসি শেষ করে বললো ,’ কারণ আমি একটা নষ্ট মেয়ে। খারাপ মেয়ে। বুঝলেন? ‘
মা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।আমি মাথা নত করে রেখেছি। ভাবীর মুখ থেকে এমন সব কথা,তাও মার সামনে, মাকে উদ্দেশ্য করে বলা, এসব কখনোই আশা করিনি!
ভাবী বললো,’ আপনাদের অতো টেনশনের দরকার নাই। আপনাদের ছেলে যে দেশেই থাক না কেন, আমি আপনাদের বাড়ি থেকে চলে গেলে সে ঠিকই ফিরবে। কিন্তু আমি থাকলে আর কখনোই ফিরবে না।’
মা কিছু বললেন না আর। একেবারে চুপ হয়ে গেলেন।আমি বললাম,’ ভাবী, কি হয়েছে তুমি ভেঙে বলো প্লিজ। তুমি কিছু না বললে আমরা বুঝবো কি করে কি সমস্যা হয়েছে আর কিইবা এর সমাধান! ‘
ভাবী বললো,’ কিছুই আর বুঝতে হবে না তপু। কোন কিছুর আর সমাধান করতে হবে না তোর, তোদের।আমি আজ এক্ষুনি এই বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।চিরতরে চলে যাচ্ছি। ‘
বলে ভাবী এক কাপড়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।আমি তার হাত ধরে আটকাতে চাইলাম।মা গিয়ে সামনে দাঁড়ালেন। কিন্তু কিছুতেই আর কিছু হলো না। সে চলেই গেল।যাওয়ার সময় গেটটা যখন পেরুবে ঠিক তখন একবার পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আবার বা হাতের পিঠ দিয়ে তার চোখ মুছলো
তারপর হনহন করে হেঁটে চলে গেল।আমি তাড়াহুড়ো করে তার পেছন পেছন বেরুলাম।মাও বেরুলো। ততোক্ষণে ভাবী সিএনজি করে ওখান থেকে চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে ‌।

ভাবী চলে যাবার পর মা একেবারে মনমরা হয়ে গেলেন। তাকে ভীষণ দূর্বল দেখাচ্ছে। তিনি আমায় বললেন,’ আমি এরকম অসহায় কোনদিন হইনি রে তপু! আমার ঘরে এসব কি হচ্ছে! কেন এমন হচ্ছে! নিশ্চয় আমার ঘরের কেউ একজন ভয়াবহ কোন পাপ করেছে। কিন্তু কে করেছে এই কঠিন পাপ! এই পাপের আগুনেই আমার স্বর্গের ঘর আজ দাউ দাউ করে জ্বলছে!
মা কাঁদছেন। তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে গালের উপর। তিনি তার হাত দিয়ে কিংবা আঁচল দিয়ে সেই জল মুছছেন না।
আমি এই দৃশ্য মোটেও আর সহ্য করতে পারছি না। ভীষণ ভীষণ খারাপ লাগছে আমার। ইচ্ছে করছে আমিও চিৎকার করে কাঁদি। কিন্তু সবাই কি আর প্রকাশ্যে কাঁদতে পারে? আর সবাই পারলেও আমি পারি না! কিন্তু এই যে ভেতরের কান্না। ভেতরের ভাঙচুর।এ বড় কঠিন।এ বড় কষ্টের।যন্ত্রণার!

বিকেল বেলা ভাইয়ার অফিসে গেলাম। ভাইয়ার বস এবং তার অন্যান্য কলিগদের থেকে জানতে চাইলাম, ভাইয়া আসলে ছুটি নিয়েছে নাকি অফিসের কাজে গিয়েছে।তারা সবাই বললো, ছুটি নিয়েছে।এক সপ্তাহের জন্য ছুটি।
আজ ছুটির পাঁচদিন হয়েছে।আর দুদিন। এরপর তো নিশ্চয় ভাইয়া ফিরবে।অফিস তো করবে এসে।
কিন্তু ভাবী যে হঠাৎ করে এভাবে কেঁদে কেটে আর রাগ দেখিয়ে চলে গেল।যাবার সময় বললো, সে গেলেই সব সমাধান হয়ে যাবে। ভাইয়া বাড়ি ফিরবে। তাহলে কি ভাইয়ার পথের কাঁটাই ছিল অপি ভাবী? ভাবী চলে যাওয়া মানে ভাইয়ার পথের কাঁটা দূর হওয়া। আমি কি এটাই ধরে নিবো তবে?

রাত তখন এগারোটা বিশ মিনিট। শুয়ে আছি আমি। কদিন ধরে ফিকশন, ননফিকশন কোন ধরনের বই -ই ধরছি না আমি।দু মাস পর বই মেলা।এক প্রকাশক পেছনে লেগেছে খুব করে।একটা উপন্যাস লিখে দিতে। আমিও অনেক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম এ বছর একটা বই’বের করবো।বইয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলাম। ‘নারী ‘ । ভেবেছিলেন একটি সাহসী মেয়ের সব বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে জীবন জয়ের একটা উপন্যাস লিখবো।লিখাও শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। এরমধ্যেই তো সমস্যাটা শুরু হলো। ভাইয়া -ভাবীর মধ্যে ঝামেলা। মাঝখানে ফৌজিয়ার দেয়া উদ্ভট তথ্য।আর এখন তো একটার পর একটা জটিলতা সামনে আসছেই!
এসব ভাবছিলাম আর ভাবছিলাম। এরিমধ্যেই
মহসিন ভাই আমায় ফোন করলো।বললো,’ তপু, এসব কি হয়ে গেল রে ভাই!’
মহসিন ভাই খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্থ গলায় বললেন।
আমি বললাম,’ কি হয়েছে ভাই? ‘
মহসিন ভাই অবাক হলেন। বললেন,’ তুমি কিছুই জানো না? দেখোনি এখনও কিছু? ‘
আমিও অবাক হলাম। বললাম,’ না তো। আপনি ভেঙে বলুন।’
মহসিন ভাই বললেন,’ তোমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর কি এটিই যেটাতে আমি কল করেছি?’
আমি বললাম,’ জ্বি ভাই।’
উনি বললেন,’ অনলাইনে যাও তাহলে। এক্ষুনি। গিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ চেক করো।একটা লিংক দিচ্ছি দেখো। কিন্তু আমার এখনও এটা বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুতেই।মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি।অপি ভাবী এমন নোংরামি কিভাবে করতে পারলো! ছিঃ! ‘
আমি এখনও অনলাইনে যাইনি। কিন্তু আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কিসের লিংক দিয়েছেন মহসিন ভাই?

ওয়াইফাই কানেক্ট করে হোয়াটসঅ্যাপে গিয়েই দেখি মহসিন ভাই একটা লিংক পাঠিয়েছেন।ড্রাইভ লিংক।ড্রাইভে গিয়ে আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।ড্রাইভে অনেক গুলো ন্যুড ছবি, আর স্ক্যান্ডাল ভিডিও। ওখানে শুধুমাত্র অপি ভাবীকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।ভিডিওতে একজন পুরুষ লোকও আছে। কিন্তু পুরুষ লোকটির চেহারা দেখা যাচ্ছে না। চেহারা না দেখিয়েই এই ভিডিও করা হয়েছে। তবে এইসব ছবি কিংবা ভিডিও আমাদের বাসার বাইরে করা।মনে হচ্ছে কোন রিসোর্টে। সাধারণত বাসার রুম গুলো এমন হয় না কখনো!
আমার মাথা আর কাজ করছে না।মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা ঘুরে আমি লুটিয়ে পড়বো জমিনে। আমার শরীর ভীষণ রকম কাঁপছে।মনে হচ্ছে ভীষণ রকম ভূমিকম্প হচ্ছে।আর সবকিছু ভেঙে ছারখার হয়ে এক্ষুনি আমার মাথার উপর ভেঙে পড়বে। মহসিন ভাইকে যে একটা মেসেজ করবো,টাইপ করার এই শক্তিটুকু পর্যন্ত আমি পাচ্ছি না আঙুলে।
তবুও কষ্ট করে আমি মহসিন ভাইকে একটা মেসেজ করলাম। লিখলাম,’ আপনি এই লিংক কোথায় পেয়েছেন মহসিন ভাই?’


#চলবে

আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-০৫

0

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ফেসবুকের নিউজফিডে দেখা ছবিগুলো আর কারোর না।ফৌজিয়ার। ফৌজিয়া সিলেটের চা বাগানে গিয়েছে ঘুরতে। ওখান থেকে অনেক গুলো ছবি পোস্ট করেছে সে।আমি এটা দেখে যারপরনাই অবাক হলাম।অথচ কি সব ভাবছিলাম আমি। ভাবলাম, ফৌজিয়া তার ফোন অফ করে বাবার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে চাইছে।অথচ সে কি না নিজের শহর ছেড়ে ওই অতো দূরের এক শহরের পাশে চা বাগানে ঘুরতে গিয়েছে। আনন্দের জন্য। আবার ফেসবুকে ছবিও পোস্ট করেছে। বাহ্!
বাবা মারা যাওয়াতে মনে হচ্ছে তার ভীষণ আনন্দই হচ্ছে।
কিন্তু এর খানিক পরেই নিজের এমন ক্ষুদ্র মানসিকতার ক্ষীণ্নর চিন্তার জন্য নিজেই নিজের কাছে লজ্জিত হলাম।মনে মনে বললাম, ছিঃ ছিঃ! এসব কি ভাবছি আমি! একটা মানুষ,যার সবচেয়ে কাছের মানুষ অর্থাৎ তার বাবা মারা গিয়েছে।এটা আসলেই বিরাট শকড খাওয়া। কিন্তু সে যদি তার শোক কাটিয়ে উঠতে, নিজের মন টিক করতে দূরে কোথাও বেড়াতে যায়।এতে তো মন্দের কিছু নাই। এটা তো খুব ভালোকথা। সুন্দর বিষয় এটা।এটা নিয়ে আবার খারাপ কিছু ভাবার কি আছে?
এরপর আমার নিজের উপর নিজেরই এক ধরনের ঘেন্না হলো।মনে হলো, সে আমায় ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে, অনেক বড় হয়ে গিয়েছে বলে আমার ভীষণ হিংসে হয় তার প্রতি। সম্ভবত এই হিংসে থেকেই আমি ওকে নিয়ে এমন উলটপালট ভাবি।
কিন্তু আমার ভাবনা জুড়ে বেশিরভাগ সময়ই এই ফৌজিয়াই থাকে। স্কুলে পড়বার সময় ফৌজিয়ার সঙ্গে প্রথম প্রথম জেদ থাকলেও কিভাবে যেন তার সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল আমার। সেই আমার সঙ্গে নিজ থেকে মিশেছিল। এমনকি প্রায়ই সে আমার সঙ্গে স্কুল ছুটির পর আমাদের বাসায় আসতো। ভাইয়া তখন ত্রিশালের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে। ভাইয়া যখন ছুটি কাটাতে বাসায় আসতো তখন সে আমায় ইংরেজি পড়াতো। ফৌজিয়া তখন আমায় বলতো, তুমি একাই পড়বা কেন শুধু? আমিও পড়তে চাই ভাইয়ার কাছে। এরপর থেকে আমি আর ফৌজিয়া একসাথেই ভাইয়ার কাছে ইংরেজি পড়তাম। আমার কেন জানি মনে হতো, ফৌজিয়া তখন আমায় খুব পছন্দ করতো ‌। ভালো বাসতো আমায়। এই যে ঘন ঘন আমাদের বাসায় আসতো। এমনকি আমার সঙ্গে একসাথে পড়তে চাইতো।এর উদ্দেশ্যও আমার সঙ্গে একটু সময় কাটানো।আর কিছু না!
কিন্তু কলেজে উঠার পর কি হলো কে জানে। আমার সঙ্গে সে কথা বলাই বন্ধ করে দিলো। এরপর তো কতো কি ঘটে গেল আমার জীবনে। হঠাৎ করে আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু অপূর্বর খু*ন হওয়া। আমার উপর মামলা হওয়া। আমার পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো।এসব সমস্যা কাটিয়ে আসার পর দেখি ফৌজিয়া তখন সফল একজন মানুষ। ময়মনসিংহ শহরের প্রসিদ্ধ একজন ডাক্তার। আমার দেখায়, এতো অল্প বয়সে সেই সবচেয়ে জনপ্রিয় ডাক্তার।যার কাছে রোগীর উপচে পড়া ভীড় হয়।আর তার চিকিৎসা সেবাও খুব উন্নত। মানুষ তার চিকিৎসায় ভালো ফলাফল না পেলে তো আর এভাবে এসে তার চেম্বারে ভীড় করে থাকে না!
আমি কখনোই ভাবিনি ফৌজিয়ার সঙ্গে আমার আবার বন্ধুত্ব হবে। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমাদের।
কিন্তু এখন কি আর ফৌজিয়া আমায় নিয়ে এভাবে আগের মতো ভাববে? আমায় ভালোবাসবে?
কিছুতেই না।সে কোথায় আর আমি কোথায়? আমাদের দুজনের ব্যবধান এখন আকাশ -পাতাল!
হয়তো এতো দিনে তার নিজের একটা মানুষ হয়ে গেছে।সেও হয়তো বড় কোন ডাক্তার।অথবা বড় কোন চাকুরে। আমার মতো বেকার এক যুবক বড়জোর তার পি-এস হতে পারে।এর বেশি কিছু না! এরপরেও যে সে আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রেখেছে। আমার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলে।এও কি আমার জন্য কম কিছু!

এভাবে আরো দুদিন কেটে গেল। মায়ের সঙ্গে কথা হলো দুপুরে।মা বললো,’ কেমন আছো?’
আমি বললাম,’ ভালো আছি মা।’
মা জীবনে যা বলেননি তা আজ এই প্রথমবারের মতো বললেন। তাও রাগ দেখিয়ে। তিনি বললেন,’ তপু, আমি তোমার খালার বাসা থেকে আমার ভাইয়ের বাসায় চলে যাবো।বড় ভাইজানের বাসায় যাবো। কাল যাবো।’
আমি বললাম,’ হঠাৎ ওখানে কেন? কোন সমস্যা? কারোর অসুখ বিসুখ কি?’
মা বললেন ,’ না। এমন কিছুই না।’
আমি বললাম,’ তাহলে? ওখানে যাবে কেন? বাসায় আসবে কবে তুমি? আমার ভালো লাগছে না আর। তুমি না থাকলে ভালো লাগে না।সব শূন্য মনে হয়।’
মা আমায় সবচেয়ে বেশি চমকে দিয়ে বললেন,’ তপু, আমি আর কোনদিন তোমাদের বাসায় ফিরবো না।আমি আমার সবটা জীবন ভাইজানের বাসায় কাটিয়ে দিবো।আর ওখানে ভাইজান যদি আমার উপর অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন, আমাকে যদি সারা জীবন তার ওখানে রাখতে না চান, তবে কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো। তবুও বাসায় ফিরবো না আমি।’
আমার এতো খারাপ লাগছে এসব শুনে! মা কোনদিন এমন কথা বলেননি।কি হয়েছে এমন যে মা এভাবে এরকম শক্ত শক্ত কথা বলছেন!
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’ মা, কি হয়েছে বলো তো।কেন এমন কথা বলছো তুমি?’
মা হাসলেন যেন।এটা হাসি না ঠিক। তার নিজের প্রতি অবহেলার বহিঃপ্রকাশ।
আমি বললাম,’ মা বলো।প্লিজ বলো কেন এসব বলছো তুমি?’
মা বললেন,’ তপু, আমি কি কখনও মিথ্যে বলেছি তোমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে? কোনদিন এরকম হয়েছে? ‘
আমি বললাম,’ না। বলো নি।’
মা এবার বললেন,’ কখনো খামখেয়ালিপনা করেছি তোমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে?’
আমি বললাম,’ না।করোনি।’
মা সত্যি সত্যিই কখনো আমার সঙ্গে কিংবা ভাইয়া- ভাবীর সঙ্গে খামখেয়ালিপনা করেননি। মজা করেননি।রাগ অভিমান দেখাননি। তিনি আর দশটা মেয়ে লোকের চেয়ে ভিন্ন। ভীষণ রকম সৎ মানুষ তিনি। এবং এক কথার মানুষ তিনি। কোন কিছু নিয়ে কখনোই অতিরঞ্জিত করেননি তিনি কখনোই। কথা বলেন একেবারে মেপে মেপে। এবং যা বলেন তার সবই গুরুত্বপূর্ণ।সত্য। আচ্ছা তাহলে যে মা বললেন আর ফিরবেন না, এটা কি সত্যি সত্যিই তিনি করে ফেলবেন?
কিন্তু কেন? কেন এটা তিনি করবেন?
আমি আবার বললাম। বললাম,’ কি হয়েছে মা বলবে আমায়! দয়া করে বলো।
মা বললেন,’ এখন আর আমায় দিয়ে তোমাদের কোন প্রয়োজন নেই। এখন তোমরা অনেক বড় হয়ে গিয়েছো। আমার বড় ছেলে অপু আমায় না বলেই সিলেটে যায়। ট্রেনিং না কি যেন করতে।আর আমার কাছে কি অবলীলায় সে মিথ্যে বলে যায় রোজ রোজ। ফোন দিলেই বলে, সে অফিসেই যাচ্ছে নিয়মিত। কোথাও যায়নি। আর তুমি? তুমিও তো নিজের ভাইকেই সঙ্গ দিলে। তোমার ভাই বাসায় নাই। সিলেটে গিয়েছে।আর তুমি আমায় তা জানাওনি। তুমিও মিথ্যে বলেছো আমায়। তোমাদের থেকে আমার মন একেবারে উঠে গেছে।তোমরা তোমাদের মতোই থাকো। নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচো‌।’
মা ফোন কেটে দিলেন।আমি সঙ্গে সঙ্গেই আবার ডায়েল করলাম।মা ফোন বন্ধ করে ফেলেছেন।
এতো গুলো সমস্যা আমি কিভাবে সামাল দিবো বুঝতে পারি না। আমার মাথা কুলিয়ে উঠে না আর।

বিকেল বেলা ভাবী বললেন,’ ঘরে বাজার নাই।বাজার করতে হবে।’
আমি বললাম,’ কি কি লাগবে লিস্ট করে দেও।’
ভাবী লিস্ট করে দিলো। ভাবীর কাছ থেকে লিস্ট নেয়ার সময় ভাবীর মুখের দিকে তাকালাম আমি।এই কদিনেই ভাবীর চেহারা একেবারে কাহিল হয়ে গেছে। তাকে হঠাৎ করে দেখলে মনে হয়, এ তো আমাদের অতি সুন্দরী, ভীষণ মিষ্টি, আর সব সময় হাসিখুশি থাকা অপি ভাবী নয়।এ অন্য কেউ।যাকে আমি চিনি না।যাকে আমি জানি না।যাকে আমি আর কোনদিন দেখি নি!

তখন বাজারে আমি। মাছের আড়তের দিকে যাচ্ছি। তখনই দেখা হলো মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে। মহসিন ভাই হলেন ভাইয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আবার কলিগও। আমি মাছের আড়তের দিকে ঢুকছি আর তিনি মাছ কিনে বেরুচ্ছেন। তার দু হাত ভর্তি ব্যাগ।আমায় দেখেই তিনি বললেন,’ এই তপু, কেমন আছো তুমি?’
আমি হাসলাম মৃদু। বললাম,’ ভালো ভাইয়া। বাজার করতে এলাম।ঘরে বাজার নাই।’
মহসিন ভাইয়া বললেন,’ ও আচ্ছা। আচ্ছা অপু কোথায় রে? কোথায় গেল কিছুই জানি না।অফিস থেকে ছুটি নিলো এক সপ্তাহের জন্য।বললো জরুরি কাজে দূরে কোথাও যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে কিছু বলেনি। গতকাল ফোন করেছিলাম। ভাবলাম কথা বলি। কেমন আছে না আছে। কিন্তু ফোন বন্ধ ওর। তোমায় পেয়ে ভালোই হলো। তোমার কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাবে সে কোথায় আছে আর কোন সমস্যা কি না!’
আমার মাথায় যেন হঠাৎ এই এতো বড় আকাশটা ভেঙ্গে পড়লো।এসব কি বলছেন মহসিন ভাইয়া! ভাইয়া যে বললো অফিস থেকে তাকে সিলেটে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে তবে কি এটা মিথ্যা? তবে কি ভাইয়া সিলেটে যায়নি? আর যদি গিয়েও থাকে তবে কেন গেলো? আর তার নম্বর বন্ধ কেন? এমনকি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সবকিছু ডিএক্টিভেট করে রাখা কেন?

#চলবে

আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-০৪

0

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



গাড়িটা পেছনের দিকে ছুটে যেতেই আমার মাথায় একটা চক্কর দিয়ে উঠলো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভাবী বড় ধরনের কোনো একটা চক্রের হাতে আটকে গেছে কোন কারণে ‌। আবার মাঝেমধ্যে এও মনে হয়, চক্র ফক্র কিছু না এসব ‌।ভাবী অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ‌।আর সেই সম্পর্কের ফসল তার গর্ভে এসেছিল। ভাইয়া কোনো ভাবে হয়তো বিষয়টা আঁচ করেছিল। এই জন্যই হয়তো বা ভাইয়ার সঙ্গে ভাবীর সম্পর্ক অবনতির দিকে যাচ্ছে।আর ভাবী যেহেতু অন্য কাউকে মন দিয়ে বসেছে, তো এই সংসারে, এই ঘরে তার মন না বসায় তো স্বাভাবিক।আর তার নিজের বরকেই যদি তার আপন মনে না হয়, তাহলে বরের মা কিংবা ভাইকে তার আপন মনে হবে কিভাবে?

কালো চকচকে রঙের গাড়িটা মুহূর্তে চোখের আড়াল হয়ে গেল। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কি করবো? কিংবা আমার কি করা উচিৎ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছি ‌‌।এটা গল্প সিনেমা হলে সম্ভব হতো যে আমি দৌড়ে গিয়ে কিংবা একটা চলন্ত মোটরসাইকেল তার চালকের থেকে কেড়ে নিয়ে গাড়িটির পেছন পেছন ছুটে যেতাম। এবং ফলো করে দেখতাম, ওরা কি করে! কোথায় যায়।কিন্তু এটা তো গল্প সিনেমা নয়। বাস্তব।আর বাস্তবতা বড়ই কঠিন!

হঠাৎ করেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষটি মনে হলো আমার ‌। এবং এই প্রথম ভাবীর প্রতি প্রচন্ড ঘেন্না হচ্ছে আমার।ঘেন্নায় থুউক করে একদলা থুথু ফেললাম আমি মাটিতে।
রাগে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে।
বাসায় চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এখানে বসে থাকতে পারছি না আর। শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু বাসায় যাওয়াটা উচিৎ হবে না আমার।আমি চাই না ভাবী এসে দেখুক আমি আগে ভাগে বাসায় ফিরে এসেছি। বরং ভাবী যখনই ফিরবে, এর আরো ঘন্টাখানেক পর আমি বাসায় ফিরবো।এর আগে না। আপাতত ভাবী ফোন টোন করলে রিসিভ করবো না!
কিন্তু এখানে বসে কিছুতেই সময় কাটছে না আর।একা একা বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। আচ্ছা আমি কি একটু হাঁটাহাঁটি করবো?
একবার দাঁড়ালাম বসা থেকে। ভাবলাম নদীর পাড় ধরে একটু হেঁটে আসি। নদীর পাড়ে নানান বুনো ফুল ফোটেছে। নদীর জলে নিশ্চয় এখন একদল হাঁস হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে। নদীর পাড় ধরে হাঁটলে অনেক ভালো লাগবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, এটা কিছুতেই করা যাবে না।ভাবী যদি কোন ভাবে জেনে ফেলে যে আমি কোথাও যাইনি। আশেপাশেই ছিলাম। তখন সর্বনাশ হবে।খেলাটা হয়তো এখানেই থেমে যাবে। কিন্তু আমি এর সবটা না জেনে,এর রহস্য খুঁজে বের না করে কিছুতেই থামতে চাই না! কিছুতেই না!

হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে উঠলো আমার। ভাবলাম ভাবী ফোন করেছে। কিন্তু পকেট থেকে ফোন বের করে দেখি ভাবীর ফোন না।মা কল করেছেন।
ফোন রিসিভ করলাম সঙ্গে সঙ্গে।
মা ওপাশ থেকে বললেন,’ কি করো তপু?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম,’ শুয়ে আছি।গল্প পড়ি।’
মা বললেন,’ আচ্ছা ঠিক আছে।বউমা কি করে?’
আমি বললাম,’ ভাবী তার ঘরে।কি করে জানি না।’
মা মনমরা গলায় বললেন,’ আমার না কেমন যেন লাগছে! মন অশান্ত হয়ে আছে ভীষণ। ছটফট করছে শুধু। সাবধানে থেকো তোমরা। অপুকে ফোন দিয়েছিলাম।সে অফিসে।বলেছি, দেরি না করতে। সকাল সকাল অফিস করে চলে আসতে।’
আমি বললাম,’ অতো টেনশন করো কেন তুমি মা? এই জন্যই তোমার শরীর খারাপ লাগছে! হাসব্যান্ড -ওয়াইফের মধ্যে একটু আধটু ঝগড়া হতেই পারে।এটা কদিন থাকেও অনেক সময়।এটা তো তেমন কোন বিষয় না! সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মা বললেন,’ তুমি ছোট মানুষ তপু। তোমাদের পেটে রেখেছি আমি।আদর করে বড় করেছি। তুমি আমার কষ্ট, যন্ত্রণা বুঝবে না।আমি যে তোমার বড় খালার বাসায় হঠাৎ চলে এসেছি।যদিও তুমি বলেছো আসতে। তোমার এই বলায় কিন্তু আমি কোনদিন আসতাম না তোমার খালার বাড়ি। নিজের বাড়ি রেখে, সন্তানাদি রেখে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।আমি এখানে এসেছি মনের শান্তির জন্য।ঘরের ভেতর যে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যে গোপন এক দ্বন্ধ।এসব আমার সহ্য হচ্ছে না আর।তাই ওখান থেকে আড়ালে এসে থাকতে চেয়েছি কটা দিন। কিন্তু এখানে এসেও কোন লাভ হয়নি। আমার মন এখন আরো বিঁষিয়ে গেছে। কিন্তু বাসায় ফিরতেও আর সাহস হচ্ছে না।মন টানছে না।আমি এখানে বেশ কদিন থাকবো। তুমি সাবধানে থাকবে তপু। অপুকে নজরে রাখবে।বউমাকেও।আমি জানি বউমা উপরে যতোটা সরল, ভেতরে ততোটাই চতুর।আমি বলছি না সে মেয়ে হিসেবে মন্দ।এটা কোনদিন বলবোও না আমি।বউমা আসার পর থেকে আমি তাকে নিজের মেয়েই মনে করেছি।সে আমায় আদর দিয়ে, সান্নিধ্য দিয়ে,যত্ন দিয়ে আমার মেয়ে সন্তান না থাকার চাপা দুঃখটা গুছিয়ে দিয়েছিল।
সে যায়হোক, তোমার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।অপু আমার গর্ভের সন্তান।সেও মুখ ফুটে কিছু বলছে না।অপিকে যে আমি নিজের মেয়ে ভাবলাম।এতো সোহাগ- আদর দিলাম।সেও কোনদিন কিছু বললো না। আমি অপিকে বলেছিলাম, সব গোপন রাখলে সমস্যা কমে না।বাড়ে।অপিও আমার কথা শুনেনি।আচ্ছা এখন রাখি। ভালো লাগছে না আর কথা বলতে। সাবধানে থেকো তুমি।’
বলে মা ফোন কেটে দিলেন।
মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই মন ভীষণ ছটফট করছে। ভীষণ খারাপ লাগছে আমার।
শেষের কয়েকটি কথা বলার সময় মায়ের গলা ভিজে এসেছিল।আমি মায়ের থেকে বহু দূরে থাকার পরেও টের পেয়েছি মা কাঁদছেন।তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে গালের উপর।বুড়ো হাতের পিঠ দিয়ে এখন মা নিশ্চয় তার দুটি গাল মুছছেন। আহা বেচারি! মা হবার এই এক দুঃখ।তার নিজের সব সুখ শান্তি আরাম আয়েশের কথা ভুলে গিয়ে নিজের সন্তানের জন্য সব সময় উদগ্রীব থাকতে হয়। সন্তানের ভালো মন্দ নিয়েই সব সময় ভাবতে হয়।
কিভাবে এসবের সমাধান করবো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাইয়ার কাছে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবো নাকি আসলে তার আর ভাবীর মধ্যে কি ঘটছে?
অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম, এটা করা ঠিক হবে না। ভাইয়া অফিসের কাজে এক শহর ছেড়ে দূরে অন্য একটা শহরে গিয়েছে। তাকে কোন ভাবেই এই মুহূর্তে বিরক্ত করা উচিৎ হবে না!
যখন কোন সমাধান মাথায় আসছে না ঠিক তখন আবার ফৌজিয়ার কথা মনে পড়লো।
আঙ্কেল মারা গিয়েছেন দশ বারো দিন হয়েছে। এখন কি তাকে একটা ফোন করা যায়?
এছাড়া তো সমাধানের কোন পথও নাই আমার কাছে। ফৌজিয়ার কাছে বিরাট এক তথ্য আছে।সে জানে, অপি ভাবী ভাইয়ার নাম না বলে আর কার নাম বলেছিল সেদিন। আমার মন খুব করে বলছে, আমি যদি সেই নামটি জানতে পারি, আর খুঁজে বের করতে পারি লোকটিকে। তবেই এর সমাধান আমি খুঁজে বের করে ফেলবো।সব রহস্যের উদঘাটন তখন হয়ে যাবে।
ফোন করবো কি করবো না এরকম করতে করতে একটা সময় ফোন করেই ফেললাম।
কিন্তু বার বার ডায়েল করার পরেও তার ফোনে রিং হলো না।
ফোন বন্ধ। এখন আর তার প্রতি আমার কোন রকম রাগ হচ্ছে না। ফোন বন্ধ থাকতেই পারে। নিজের জন্মদাতা পিতা হলো বটবৃক্ষের মতো।বাবা না থাকলে সবকিছু অন্ধকার লাগে। ফৌজিয়া যেহেতু পরিচিত মানুষ, পেশায় নামিদামি ডাক্তার। হয়তো তার নম্বরে রোজ অনেক অনেক কল আসে।এসব থেকে আপাতত দূরে থাকতেই হয়তো সে ফোন বন্ধ করে রাখে। হয়তো সে এখনও তার বাবার হঠাৎ করে মৃত্যু বরণ করার শোকটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
মাগরিবের আজান পড়েছে তখন। এই সময় ভাবী ফোন করলো আমায়। পরপর অনেক বার। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই ফোন রিসিভ করলাম না। ফোন রিসিভ না করার সুন্দর একটা যুক্তি আছে।যুক্তিটা হলো, আমি ফোন রিসিভ করলেই ভাবী জিজ্ঞেস করবে আমি কতোদূর? তখন কি বলবো! এরচেয়ে ফোন রিসিভ না করাই ভালো।
কালো রঙের গাড়িটা ভাবীকে আবার নামিয়ে দিয়ে গেল মাগরিবের ঠিক বিশ মিনিট পর পর।‌ভাবী গাড়ি থেকে নেমে অতি সতর্কতা নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর ভেতর থেকে গেট আটকে দিলো।
আমি সামান্য দূরে বসে এসব কান্ড দেখে অসহায়ত্বের কিংবা ঘেন্নামাখা হাসিটা হাসলাম। তারপর বিড়বিড় করে বললাম, আড়াল থেকে কে নাড়ে এই কলকাঠি? কে? কে এই জঘন্য পিশাচ ?

বাসায় ফিরলাম এশার আজানের পর পর।ফিরে দেখি ভাবী রান্না করছে। এবং এই এতোদিন পর সে আমার সঙ্গে একটু সহজ হয়েছে। হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে আমি ভীষণ রকম অবাক হলাম। ভাবীর গায়ে কোন রকম অলংকার নাই।কান,নাক,হাত,গলা সব খালি।অথচ আজ সকালেও দেখেছি তার শরীরে সবগুলো গহনাই ছিল। তাহলে এখন এগুলো কোথায় গেল?
কিন্তু ভাবী যেন বুঝতে না পারে আমি তাকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি এই জন্য আর তার দিকে তাকালাম না। খাবার হলে খেয়ে আমার ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম।
এবং সে রাতেই ফেসবুকে স্ক্রল করার সময় সবচেয়ে বেশি অবাক হবার মতো ঘটনাটা ঘটলো। নিউজফিডে এই ছবিগুলো দেখে আমি একেবারে আঁতকে উঠলাম!


#চলবে

আঁড়ালে কে নাড়ে কলকাঁঠি পর্ব-০৩

0

#আঁড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঁঠি
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ফৌজিয়ার সঙ্গে কথা নাই অনেক দিন।ভাবী তার কাছে গিয়ে ভাইয়ার নাম না বলে স্বামীর নামের জায়গায় কার নাম বলেছিলো তা আর আমি ফোন করে জানিনি।ফৌজিয়াও জানায়নি। ফৌজিয়া রাগ করে আছে কি না আমার সঙ্গে কে জানে! না কি এই সমস্যায় সে নিজেকে আর জড়াতে চায়ছে না?
এসব ভেবেই তাকে ফোন করলাম।দু’ বার কল দেয়ার পর রিসিভ করলো।বললো,’ তপু, কিছু মনে করো না প্লিজ তোমায় পরে কল দেই?’
আমি বললাম,’ আচ্ছা ঠিক আছে।’
মেজাজ এবার সত্যি সত্যি খারাপ হলো। ফোন রেখে দিয়ে বসে রইলাম।
কিন্তু খানিক পরই আবার মন শান্ত হলো। ভাবলাম,মানুষের ব্যস্ততা তো থাকতেই পারে। সে একজন ডাক্তার। চেম্বারে রোগীর ভীড় থাকে সব সময়। আমার মতো তো আর সে বেকার বসে থাকে না যে কেউ ফোন করলেই কথা বলতে উদগ্রীব হয়ে পড়বে!
এসব বোঝা সত্ত্বেও রাগ লাগে। হয়তো বন্ধু বলেই এমনটা হয়। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয়, ফৌজিয়া সরাসরি কিছু না দেখালেও খুব চতুরতার সঙ্গে আমার সাথে এক রকমের একটা অহংকার দেখায়। এটা এই জন্য যে স্কুল কলেজ জীবনে সব সময় আমি শিক্ষকদের এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের প্রশংসায় ভেসেছি। সে কোন ভাবেই আমায় পেছন ফেলতে পারেনি। কিন্তু এখন তো সে অনেক বড়। অনেক বড় জায়গায় তার স্থান।এটা সে পরোক্ষভাবে হলেও আমায় বোঝাতে চায় হয়তো।
মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে ওর সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। কিন্তু কেন যে এটা বন্ধ করি না তা জানি না! বন্ধ করতে পারি না। কেমন দম বন্ধ লাগে।মনে হয় ওর সঙ্গে কথা না বললে, যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলে আমি থাকতেই পারবো না।

ফৌজিয়া ঠিক আধঘন্টা পরই কল করলো।বললো,’ বাবার শরীর খারাপ। হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলেন তিনি।সেন্স ফিরেছে। এখন একটু ভালো।’
আমি আবার লজ্জিত হলাম।কি সব ভাবছিলাম তার সম্পর্কে! আমি অনুতপ্ত হয়ে বললাম,’ ফৌজিয়া, এখন আঙ্কেলের সেবা করো। তার কাছে থাকো।আমি না হয় এরপর কথা বলবো।’
ফৌজিয়া বললো,’ সমস্যা নাই।কি অবস্থা বল তো তপু? কিছু বের করতে পারলা খুঁজে? ‘
আমি বললাম,’ কিছুই না। কিচ্ছু খুঁজে বের করতে পারিনি।’
ভাবীকে যে গতকাল বিকেলে কারোর সঙ্গে ফোনে এসব কথা বলতে দেখলাম তা আর প্রকাশ করলাম না।এটা ঘরের বিষয়। আমাদের প্রাইভেসি। ফৌজিয়া আমার যতো ভালো বন্ধুই হোক না কেন, সে ঘরের লোক না। বাইরের লোক। তার কাছে ঘরের ভেতরের কিছু না বলাই মঙ্গল।
ফৌজিয়া বললো,’ ডায়েরি দেখেছিলাম আমি।নাম বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। স্বামীর জায়গায় তোমার ভাবী লিখেছিল —‘
এইটুকু বলেই হুট করে কথা বন্ধ করে দিলো।নামটা আর শোনা হয়নি।বলে শেষ করতে পারেনি।আমি অনেকক্ষন এপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করলাম। কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না।এর খানিক পর আপনা আপনি ফোন কেটে গেল। এরপর বার কয়েক ডায়েল করেছি ওর ফোনে। রিসিভ করে না।
সমস্যা কি? নাকি ফৌজিয়া এই নাম বলতে চায় না? কেন বলতে চায় না? এর পেছনেও কি কোন রহস্য আছে?
আমার মাথা সত্যি সত্যি আর কাজ করে না!

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বিষণ্ণ হয়ে ছাদের উপর বসে আছি।ওপাশের ছাদে কিশোরী একটা মেয়ে রোজ আসে।গাছের টবে জল দেয়।দড়িতে নেড়ে দেয়া শুকনো কাপড় নিয়ে যেতে আসে। মজার বিষয় হলো, আমি যখন আসি ঠিক তখনই সে আসবে। আমার কেন জানি মনে হয় সে আমায় অনেক দিন ধরে ফলো করছে। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার সব রকম চেষ্টা সে করেছে। এমনকি তার গানের গলা যে ভালো, গানের এই গলা দিয়ে আমার প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছে একদিন ছাদে দাঁড়িয়ে।
” জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে ”
আজ খেয়াল করলাম শাড়ি পরেছে। সবুজ রঙের শাড়ি হয়তো। কিন্তু ওদিকে চোখ দিলাম না। বাচ্চা মেয়ে ‌।বড় জোর ক্লাস টেনে পড়ে।এর বেশি হবার কথাই না! ওদিকে চোখ দিয়ে লাভ নেই!
আমি ভাবছি অন্য কিছু নিয়ে।এর সমাধান কিভাবে করবো।
এরমধ্যে ফোন বের করলাম। ফেসবুকে ঢু মারলাম একটু। নিউজফিড ঘাঁটতে গিয়ে অবাক হলাম। আমাদের আরেক বন্ধু পোস্ট করেছে। ফৌজিয়ার বাবা মারা গিয়েছেন একটু আগেই।নিউজটা দেখে আমার শরীর কেমন কাঁপতে লাগলো।একটু আগেই তো ফৌজিয়া বললো, এখন ঠিক আছে।বাবা সুস্থ। কিন্তু এই খানিকটা সময়ের মধ্যেই এটা কি হয়ে গেল?
মানুষের জীবন এমন কেন? এতো ছোট্ট জীবন! কিন্তু এইটুকু এক জীবনে এতো এতো রহস্য! এতো এতো কানাঘলি জীবনের!

এর আরো চারদিন পর ভাবীকে দেখলাম আবার কল করতে। ভাইয়া তখন অফিসে।মা তার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছেন। ফিরবেন সন্ধ্যা বেলায়।আমি রুমে বসে জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি ‘ পড়ছি। তখনই চাপা গলায় কথা বলতে শুনলাম।ভাবী কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। কিন্তু এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না।আমি খুব সাবধানে ভাবীর ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর শুনতে পেলাম, ভাবী বলছে,’ আমি একটা মেয়ে মানুষ, শশুর বাড়ি থাকি। আপনি বললেই তো আর যখন তখন দেখা করতে পারি না। তবে আমি দেখা করবো। আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে এর জন্য। আমার শাশুড়ি কোথাও দু ‘চারদিনের জন্য বেড়াতে না গেলে বাসা থেকে বেরুনো আমার পক্ষে সম্ভব না।’
এরপর ওপাশ থেকে কি বলেছে কে জানে।ভাবী বললেন,’ আপনার টাকা আমি সাথে করেই নিয়ে আসবো।আমায় বিশ্বাস করুন প্লিজ! আমি আসবো। শিগগির আসবো।’
ভাবী কথা শেষ করার আগেই আমি অতি সাবধানে নিজের ঘরে চলে এলাম। এসে
বসে বসে লম্বা সময় ধরে ভাবলাম। ভাবলাম, আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ অপি ভাবী।যাকে নিজের বোনের মতোই আমি দেখি। তাকে নিয়ে খারাপ কিছু কিভাবে ভাববো? কিন্তু এই যে তার দুই দিনের ফোন কল।ভিডিও পোস্ট না করার জন্য অনুরোধ করা। বিনিময়ে যা ইচ্ছে তাই দিতে চাওয়া।মা বাসা থেকে কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য তার অপেক্ষা করা। এতো কিছুর পর সন্দেহের তীর টা তো ভাবীর দিকেও যায়। আচ্ছা তবে কি ভাবীই এসবের মূল? ভাইয়ার সঙ্গে তার এই যে মনোমালিন্যতা, অন্তর্গত কোন্দল, এসবের পেছনে কি ভাবীই দায়ী?
কিন্তু ভাবী আসলে কার সঙ্গে জড়িয়েছে?
খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। ভাবীর মতো এমন মিষ্টি মনের একটা মানুষ কেন এসবের মধ্যে জড়াতে গেল?
ভাবলাম, এইসব কিছুর রহস্য উদঘাটন করতে হলে আমাকেও কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে।আর এটা শুরু করবো মাকে দিয়েই।

মাকে এর পরদিনই বড় খালার বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।খালুরও অনেক দিন ধরে শরীর খারাপ।আমি বললাম,’ খালুকে তোমার দেখে আসা উচিৎ। কালকেই যাও। না গেলে এটা খারাপ হবে।সম্পর্ক নষ্ট হবে।’
মা প্রথমে না করলেন। বললেন,মনে শান্তি নাই। এখন যাবেন না।গেলেও আরো পরে যাবেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো পরদিন দুপুর বেলা তিনি বললেন,আমায় গাড়িতে তুলে দিয়ে আয়। গিয়ে কটা দিন থেকে আসি। আমার আসলেই যাওয়া উচিৎ। না গেলে খারাপ হবে!
দুপুর বেলা মাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে এলাম। ওখান থেকে ফেরার সময় মা বললেন,’ তপু, আমার শান্তির ঘরটাতে কিসের আগুন এসে লাগলো রে বাবা! কে লাগিয়েছে এই আগুন?’
মার চোখ দুটো ভিজে উঠলো জলে। তিনি তার বুড়িয়ে আসা নরম দুটি হাত দিয়ে আমার মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে দিলেন ‌। তারপর বললেন,’ যা। বাসায় চলে যা। সাবধানে থাকিস। খেয়াল রাখিস সবকিছু।’
মায়ের গাড়ি ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি বাসায় এসে পড়লাম। সে রাতেই ভাইয়া খাবার টেবিলে বসে আমায় বললো,’ তপু, আমি সিলেটে যাচ্ছি কাল।এক সপ্তাহ ওখানে থাকতে হবে।’
আমি বেশ অবাক হলাম। বললাম,’ কেন? কেন যাবে?’
ভাইয়া বললো,’ অফিসের কাজে। ওখানে একটা শাখা খুলেছে আমাদের অফিসের। নতুন যারা জয়েন করেছে ওদের ট্রেনিং করাতে হবে ওখানে গিয়ে।’
আমি এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম,’ ভাবীও যাবে?’
ভাইয়া মুখ মলিন করে উত্তর দিলো,’ নাহ ‌।’
ভাইয়া পরদিন সকাল বেলায়ই সিলেটের উদ্দেশ্যে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে গেল।যাবার সময় আমায় বলে গেল,’সাবধানে থাকিস। মাকে আগে ভাগে কিছু বলিনি।পরে বলিস তুই। এখন বললে মা টেনশন করবেন।’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
কিন্তু ভাবীর সঙ্গে তাকে কোন রকম কথা বলতেই দেখা গেল না।

এরপর দিন বাসায় শুধু আমি আর ভাবী।আর কেউ নেই। খুব ভালো একটা সুযোগ এসেছে।আমি সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইলাম।আর আমার চালটা চাললাম। ভাবীকে সকাল বেলা খাবার খেতে খেতে বললাম,’ ভাবী, একটা সমস্যা হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি বাসায় একা। কিভাবে যে বলি!’
ভাবী বললো,’ কি হয়েছে? বল। সমস্যা নাই।’
আমি বললাম,’ আমার এক বন্ধুর বাবা মারা গেছেন। কিশোরগঞ্জ ওদের বাড়ি।গ্রামে। কিন্তু না গেলেও হচ্ছে না।আমি গিয়ে জানাজা পড়ে এসে পড়বো। কিন্তু তোমাকে বাসায় একা রেখে কিভাবে যাই!’
ভাবী খানিক সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো,’ কেমন সময় লাগবে? রাতের মধ্যে ফিরবি না?’
আমি বললাম,’ দশটার মধ্যে ফিরবো ইনশাআল্লাহ!’
ভাবী বললো,’ আচ্ছা।যা তাহলে।দশটার মধ্যেই ফিরিস কিন্তু।আর ফিরতে দেরি হলে বা রাতে ফিরতে না পারলে আগে ভাগেই ফোন করে বলিস।’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
বলেই ভালো জামাটা পরে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু দূরে আর কোথাও গেলাম না। বাসার আশেপাশেই আড়াল থেকে নজর রাখতে লাগলাম বাসার দিকে। দেখতে লাগলাম বাসায় কেউ আসে নাকি ভাবী নিজেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায় কোথাও!

অপেক্ষা করছি লম্বা সময় ধরে।প্রায় তিন ঘন্টা। এখন আর ভালো লাগছে না। অসহ্য লাগছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভাবী আজ কোথায় বেরুবে না। কিংবা কেউ আসবেও না এখানে।আমি উঠে পড়তে চাইলাম এখান থেকে, ঠিক তখনই কলটা এলো। ভাবীর কল। ভাবী বললো,’ তুই পৌঁছেছিস গিয়ে?’
আমি বললাম,’ না ভাবী।গাড়ি পেতে সময় লেগেছে। এখনও রাস্তায়।আরো ঘন্টাখানেক লাগবে পৌঁছাতে।’
ভাবী বললো,’ আচ্ছা সাবধানে যা।রাখি।’
বলেই ফোন রাখলো। ফোন রাখার ঠিক দশ মিনিট পর কালো গাড়িটাকে এসে আমাদের বাসার গেটের সামনে দাঁড়াতে দেখলাম।আর মিনিট দুয়েকের মধ্যে গাড়ির একটা ডোর খুলে গেলো। তখনই গেট খুলে বেরিয়ে এলো ভাবী। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠে বসে পড়লো।ভাবী গাড়িতে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই ডোরটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা ঘুরিয়ে পেছনের রাস্তার দিকে নিয়ে চলে গেল।


#চলবে

আঁড়ালে কে নাড়ে কলকাঁঠি পর্ব-০২

0

#আঁড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঁঠি
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ফৌজিয়ার কথাটা আমি যেন ঠিক বুঝতে পারিনি।আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম,’ ফৌজিয়া কি বললে যেন তুমি?’
ফৌজিয়া আমার হাতটা ধরলো। তারপর বললো,’ ভেতরে চলো।মাথা কুল রাখো।’
আমি ওর থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,’ ফৌজিয়া, আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুমি কি করে এই সর্বনাশটা করলে আমাদের? ‘
কফিশপের ভেতরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসতে বসতে ফৌজিয়া বললো,’ অ্যাবরোশনের নেগেটিভিটি সম্পর্কে আমি তাকে বলেছি। তার কাছ থেকে কেস শুনতে চেষ্টা করেছি।বলেছি কেন এটা করতে চান তিনি। তিনি বললেন, এখনই তিনি প্রিপেয়ার না মা হতে।আরো নানান ঝামেলা আছে ফ্যামিলিগত।সব বলতে পারবেন না তিনি।’
আমার রাগে শরীর কাঁপছে থরথর করে।আমি বললাম,’ ফৌজিয়া, তুমি বাঁধা দিলে না কেন তাকে? কেন দিলে না বাঁধা?’
ফৌজিয়া এবার রাগ দেখালো। সে বললো,’ যে গর্ভধারণ করেছে সে যদি তার গর্ভ নষ্ট করে ফেলতে চায় তবে আমি কি করবো তপু? আমি একজন ডাক্তার। আর তোমার কাছে এই বিষয়ে কিছু বলাই আমার উচিৎ হয়নি! তোমার কাছে এটা বলাই আমার ভুল হয়েছে। এখন এটা নিয়ে কতো ঝামেলা হয় কে জানে! হয়তো এই ঝামেলায় এখন আমিও জড়িয়ে পড়বো! ‘
আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। ফৌজিয়া তো ভুল কিছু বলেনি।যার সন্তান সে যদি তার সন্তানকে পেটেই মেরে ফেলতে চায়, তার যদি কষ্ট না লাগে।দরদ না লাগে। তবে একজন ডাক্তারের আর কি বা করার আছে এখানে।এরপরেও ফৌজিয়া যে আমার সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করেছে এটাই তো অনেক বেশি!
আমি অনুতপ্ত হয়ে বললাম,’ ফৌজিয়া, সরি!’
ফৌজিয়া হাসার চেষ্টা করলো।বললো, ইটস্ ওকে।’
এরপর সে বললো,’ এসব বিষয়ে মাথা গরম করা যাবে না। তুমি জ্ঞানী ছেলে। তোমার সম্পর্কে আমি জানি। এই জন্যই তোমার সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করেছি আমি। তোমার ভাবী যে অ্যাবরোশন করিয়েছেন। বাচ্চা নষ্ট করেছেন। এটাকে আমার স্বাভাবিক মনে হয়নি। উনার কেমন যেন তাড়াহুড়ো ছিল! কেমন যেন অস্থির ছিলেন তিনি! তুমি ঠান্ডা মাথায় গোপনে এর কজটা বের করার চেষ্টা করবা।মাথা গরম করলে হিতে বিপরীত হবে পরে।’
আমার মাথা এবার সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। আচ্ছা, ভাবী এমন কাজটা কেন করবে?
আরো একটা সন্দেহের বিষয় আছে এখানে। ভাবীর যে তিন মাসের গর্ভ হয়েছে, এই বিষয়ে বাসার কেউ কিছুই জানে না। ভাবী এই এতো দিন এই বিষয়টা গোপন রাখলো কেন? এটা কি গোপন রাখার মতো বিষয়? মাকে বললো না, আমাকে বললো না। ভাইয়া কি জানে বিষয়টা? জানলে সে গোপন করে রাখলো কেন? আর তাদের মধ্যে ঝামেলাটা আসলে কি নিয়ে? এই যে রাতের কান্না, চোখের উপরের দাগ এরপর আবার গোপনে অ্যাবরোশন করে বাচ্চা নষ্ট করে ফেলা, এইসব কিছু কেন হচ্ছে? এর মূল কারণটা কি? ভাইয়া এখানে কতোটা দায়ী?
নিশ্চয় এর ভেতর ভয়াবহ রকমের কোন গড়বড় আছে। কিন্তু এটা কি? কি এই ভয়াবহ রকমের রহস্য? আমি কিভাবে এটা খুঁজে পাবো?এর জট খুলবো কিভাবে?
আমি নিজের মাথার চুল ধরে টানতে টানতে বললাম,’ ফৌজিয়া, আমি কিভাবে এসব খুঁজে বের করবো বলো? কিভাবে!’
ততোক্ষণে কফি এসেছে। ফৌজিয়া তার কাপে দু’ চুমুক দিয়েছে। কিন্তু আমার মোটেও কফি খেতে ইচ্ছে করছে না।আমি কাপটা খানিক দূরে সরিয়ে রাখলাম।
ফৌজিয়া আমার দিকে তাকালো। তারপর সময় নিয়ে বললো,’ ভাইয়া ভাবীর মধ্যে কোন রকম ঝগড়া ঝাটি বা ঝামেলা আছে কি? সাংসারিক কোন সমস্যা চোখে পড়েছে তোমার? বন্ডিং কেমন তাদের? স্ট্রং না উইক?’
নিজের ঘরের কথা বাইরে যাবে। কিংবা বাইরের কারোর কাছে ঘরের কথা বলবো আমি।তা কখনোই ভাবতেও পারিনি আমি।
আমি কিছু বলছি না।চুপ করে আছি।
ফৌজিয়া আবার বললো,’ তপু, আমায় কিছু বলতে হবে না।আমি তোমার ঘরের বিষয়ে নাক গলাতে চাই না। আমার কাছে ভাবীর অ্যাবরোশনের বিষয়টা এবং তার অতি গোপনীয়তা খুব দৃষ্টিকটু লেগেছিল।তাই তোমায় ফোন করে বিষয়টা বলা।’
আমি আরেকটু চমকালাম। বললাম,’ গোপনীয়তা মানে? বুঝিয়ে বলো আমায় ফৌজিয়া?’
সে বললো,’ ভাবীর নাম উম্মে নুসরাত অপি না?’
আমি বললাম,’ হুম।’
‘ভাইয়ার নাম অপু। মোহতাসিম বিল্লাহ অপু।তাই তো?’
আমি বললাম,’ হু।’
ফৌজিয়া এবার বললো ,’ ভাবী আমার কাছে তার নিজের নাম বলেছে শুধু অপি। কিন্তু স্বামীর নামের জায়গায় ভাইয়ার নাম বলেইনি।’
এবার আমি আরো বেশি চমকালাম।গা শিউরে উঠলো আমার।আমি বললাম,’ কার নাম বলেছে?’
ফৌজিয়া বললো,’ সে অন্য একটা নাম বলেছে। আমার না নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু চেম্বারের একটা ডায়েরিতে লিখা আছে এটা।পরে দেখে বলবো তোমায়।’
আমি ফৌজিয়ার দিকে তাকালাম। আমার চোখ কেমন জ্বালা করছে। মাথা ঘুরছে। পেটে কেমন পাক দিচ্ছে খানিক পর পর।বমি টমি হবে নাকি?
ফৌজিয়া আমার হাতটা ধরলো খপ করে। তারপর বললো,’ তপু তুমি ঠিক আছো?’
আমি বললাম,’ এখানে দম আটকে আসছে আমার।এখান থেকে বেরুতে হবে। এক্ষুনি।’
ফৌজিয়া আমায় নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কফিশপ থেকে বেরিয়ে এলো।আমরা এসে রাস্তার পাশে খোলা একটা জায়গায় ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসলাম। এই জায়গাটা সুন্দর। নিরিবিলি। আমার একটু আরাম লাগছে এখানে।
ফৌজিয়া বললো,’ ভেঙে পড়ো না তো তুমি। শক্ত থাকার চেষ্টা করো। এরচেয়ে বড় সমস্যাও কিন্তু তুমি মোকাবেলা করে এসেছো! তবে এটা নিয়ে এভাবে ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন?’
আমি আওয়াজ করে কিছু বললাম না তাকে। চুপ করে রইলাম। ফৌজিয়া বললো,’ উঠি তাহলে আজ। সাবধানে বাসায় যাও।আর অতো টেনশন করো না। সবকিছু সহজ হবে ইনশাআল্লাহ!’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
ফৌজিয়াকে একটা রিক্সা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় দিলাম। তারপর আমি আরো লম্বা সময় ধরে ওখানে বসে রইলাম। এই প্রচন্ড শীতের মধ্যেও আমার শরীর ঘামছে। এখানে হাওয়া আছে। প্রচন্ড শীত আছে। এখানে বসে থাকতে আমার খুব ভালো লাগছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীর সাংসারিক যে ঝঞ্জাট, এটা থেকে বহু দূরে আছি আমি।আর এই দূরে থাকাতেই যেন জগতের সব প্রশান্তি।

বাসায় ফিরতে আমার অনেক দেরি হয়ে গেল।রাত এগারোটা।মা বললেন,’ কোথায় ছিলি তুই?’
আমি বললাম,’ একটা কাজ ছিল। বাইরে গিয়েছিলাম একটু।’
‘ তোর ফোন রিসিভ করিসনি কেন? ‘
পরে মনে হলো ফোন সাইলেন্ট করা ছিল।এটা আর ঠিক করা হয়নি।
মা বললো,’ তোর ভাইয়া এখনও বাসায় ফিরেনি। সে তো সাধারণত এতো রাত করে না।আজ দেরি হচ্ছে কেন? কল দিলেও রিসিভ করে না।’
আমি বললাম,’ ভাবীকে জিজ্ঞেস করেছো? ভাবী কিছু জানে না?’
মা বললেন,’ তোর ভাবী ঘুমিয়ে গেছে। তার শরীর খারাপ ‌। তাকে আর ডেকে তুলিনি।’
আমি ভীষণ অবাক হচ্ছি।অপি ভাবী বিয়ে হয়ে আসার পর কোনদিন ভাইয়াকে রেখে একা ভাত খায়নি। ভাইয়া অফিস থেকে ফেরার আগে কখনোই ঘুমোতে যায়নি। এমনকি অসুখ থাকলেও না। কিন্তু এখন এসব কি হচ্ছে? এতো পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব? আর ভাইয়া? ভাইয়া কেন এতো লেট করছে আজ? আগে তো মিটিং থাকলেও ফোন করে বলতো মিটিং আছে। একটু দেরি হবে আসতে।আটটা বা নটা বাজবে। কিন্তু এই এগারোটা তো কোনদিন বাজেনি তার!
আমি ফোন বের করে ভাইয়াকে কল করলাম। ভাইয়ার ফোনের সুইচ অফ করা।এর আরো পনেরো মিনিট পর আবার ফোন করলাম। মোবাইলের সুইচ অফ করেই রাখা।কল দিলে বন্ধ বলে। ঘটনা কি!
মা চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন,’ তুই যা। তোর ভাইয়ার অফিসে যা। এক্ষুনি যা।’
আমি যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঠিক তখনই কলিং বেল বাজলো।আমি তাড়াহুড়ো করে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি ভাইয়া। ভাইয়া এসেছে।
আমি বললাম,’ এতো গুলো ফোন করা হলো রিসিভ করলে না কেন তুমি? ‘
ভাইয়া বললো,’ আর বলিস না। ফোন চুরি হয়ে গেছে। আমি থানায় গিয়েছিলাম।জিডি করে এসেছি।’
ততোক্ষণে মা এলেন এখানে। এসে বললেন,’ ফোন চুরি হয়ে গেছে এটা তুই অন্য ফোন দিয়ে কল করে বাড়িতে বলবি না? আমরা চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছি এদিকে!’
মা দেখি কেঁদে ফেলেছেন। তার চোখ ভেজা।গলা ভেজা।
ভাইয়া বললো,’ মা, আমি এটা নিয়ে খুব দৌড়ঝাঁপের মধ্যে ছিলাম। আমার ফোন করা উচিৎ ছিল। করতে পারিনি। সরি মা!’
রাতে ভাইয়া খাওয়া দাওয়া করেনি।মা জোর করেও খাওয়াতে পারেনি তাকে। তার মন ভীষণ খারাপ।মন খারাপ হতেই পারে। মোবাইলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থাকে। তাছাড়া তার মোবাইলের দামও অনেক বেশি।শখ করে কিনেছিল। খুব বেশিদিন হয়নি কিনেছে।শখের কিছু চুরি হয়ে গেলে ভীষণ খারাপ লাগারই কথা।
ভাইয়া রুমে গিয়ে দরজা আটকে শুয়ে পড়লো।

এরপর পরপর তিনদিন অফিস কামাই করেছে ভাইয়া। অফিসে যায়নি সে। কিন্তু বাসায় থেকেও যেন তারা নাই। ভাইয়া – ভাবীর মধ্যে কোন কথা হয় না। দুজনকে পাশাপাশি একসাথে সময় কাটাতেও দেখা যায় না।এ যেন এক ছাদের নিচে ভিন্ন দুই মানুষ, দুই মন।
তবে ভাবী আগের মতোই ঘরের কাজ করে। রান্নাবান্না করে।ঘর ঝাঁট দেয়।ভাত বেড়ে দেয়।মা কিংবা আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়। কিন্তু নিজ থেকে কিছু বলে না।সব সময় কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে। নিজেকে যেন একটু আড়াল করে রাখতে পারলেই বাঁচে। তার চেহারাও কেমন রোগা রোগা হয়ে এসেছে এই কদিনে। শরীর অনেকটাই শুকিয়েছে। চোখের নিচে কালসিটে দাগ জমেছে।
সবচেয়ে অবাক হবার মতো ঘটনাটা ঘটলো এর আরো সপ্তাহ খানিক পরে। তখন বিকেল। মা ঘরে নাই। পাশের বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন।আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু মশার কামড়ে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তখনই টের পেলাম ভাবী কারোর সঙ্গে কথা বলছে। তার ঘর থেকেই বলছে।ঘরের দরজা ভেজানো।আমি চুপিচুপি তার ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালাম।ভাবী টের পায়নি। সে তখনও কথা বলছে। ফোনে।
আমি এটুকু শুধু শুনতে পেলাম,’ আপনার পায়ে পড়ি, দয়া করে ভিডিও গুলো সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েন না । আপনি যা চান তাই করবো আমি।যা দিতে বলেন এর বিনিময়ে তাই দিবো আমি। তবুও আমার অতো বড় ক্ষতিটা আপনি করবেন না প্লিজ! ‘

#চলবে

আঁড়ালে কে নাড়ে কলকাঁঠি পর্ব-০১

0

#আঁড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঁঠি
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

একদিন বিকেলে তরকারি কুটার সময় মা হঠাৎ করেই ভাবীকে বললেন,’ তোমার চোখের উপর এই দাগটা কিসের বউমা? কিভাবে এই দাগ হয়েছে?’
ভাবী আমতা আমতা করে বললো,’ কই দাগ মা?’
এরপর হাত দিয়ে কপালের নিচ দিকে চোখের উপর দাগটায় হাত রেখে বললো,’ অহ্ এটা কিছু না।’
মা তখন কথা বাড়ালেন না। শুধু এটুকু বললেন,’ সবকথা লুকিয়ে রাখতে নেই বউমা।এতে সমস্যা বাড়ে।কমে না!’
ভাবী হাসার চেষ্টা করে বললো,’ আমি পড়ে গিয়েছিলাম মা। এছাড়া কিছুই না।’
মা অবাক হলেন। বললেন,’ কোথায় পড়ে গিয়েছিলে? কিভাবে?’
ভাবি তাড়াহুড়ো করে বললেন,’ বাথরুমে।’
মা আর কিছুই বললেন না।চুপ হয়ে গেলেন।ভাবীও চুপচাপ কাজ করলো।

এর আরো সপ্তাহ দুয়েক পরের ঘটনা।
রাত তখন দুটা বাজে। বাসায় চিকন রিনরিনে গলার একটা কান্না শুনে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় বসে ভালো ভাবে খেয়াল করলেই বুঝতে পারলাম কান্না আসছে ভাবীর ঘর থেকে।ভাবী কাঁদছে। কিন্তু সেই কান্নার গলা যেন বড় না হয়, বাইরের কেউ যেন না শুনে এই চেষ্টাও করছে ভাবী।এরিমধ্যে ভাইয়ার গলাও শোনা গেল। কিন্তু কি বলছে তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না।
আমি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে ভাইয়ার ঘরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। লম্বা সময় দাঁড়িয়ে রইলাম গিয়ে। তখন আর ভাবীর কান্নার গলা কিংবা ভাইয়ার গলা কিছুই আর শোনা গেল না।বড় অবাক হলাম আমি! আচ্ছা তারা কি বুঝে ফেলেছে এখানে এসে আমি দাঁড়িয়েছি যে?
আমি কিছুই বুঝতে পারি না। কিন্তু খুব মন খারাপ হয় আমার। আমাদের হাসিখুশি আর ভীষণ রকম চঞ্চল অপি ভাবী কদিন ধরেই কেমন যেন নিভে গিয়েছে দপ করে। সব সময় চুপচাপ থাকে।কাজ না থাকলে সারাক্ষণ নিজের ঘরেই বসে থাকে। দরজা ভেজিয়ে রাখে।অথচ বিয়ের এই তিন বছরের কোনদিন তাকে এভাবে দরজা ভেজিয়ে নিজের মতো চুপচাপ, মনমরা হয়ে থাকতে দেখা যায়নি। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেও আনন্দ পাওয়া যায় না।’হ্যা বা না’ এই দু’ কথার মধ্যেই ইদানিং সে কথা শেষ করে দেয়।
এছাড়া ওইদিন ভাবীর চোখের উপরে যে একটা দাগ, এই দাগ আমি দেখেছি। এই দাগটা শক্ত কিছুতে আঘাত পাওয়ার। বাথরুমে পড়ে গিয়ে চোখের উপর এভাবে দাগ হবে না নিশ্চয়! আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা দরজার চৌকাঠে অথবা টেবিলের কোনায় পড়ে গিয়ে এমন হয়েছে।

এই বিষয়ে পরদিন মার সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম আমি। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো মা আমার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে আগ্রহ দেখালেন না।আমি বিরক্ত হয়ে মাকে বললাম,’ মা, আমি কান্না শুনে আর ভাইয়ার গলা শুনে ওদের ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু —‘
আমি কথা শেষ করতে পারলাম না।এর আগেই মা আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালেন। তারপর বললেন,’ অন্যের গোপন বিষয় শুনতে তার ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নোংরামি এবং অসভ্যতা।আমি তোমার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করিনি তপু!’
আমি আরো কিছু বলতে চাইলে মা বললেন,’ এখন আমার সামনে থেকে যাও বলছি।আমায় বিরক্ত করবা না দয়া করে।’
রাগ আর অভিমান নিয়ে মায়ের কাছ থেকে চলে এলাম। এরপর ভাবলাম ভাইয়াকে একটু খেয়াল করবো। কোথায় যায় আর কি করে দেখবো।
কিন্তু খানিক পরেই নিজেই নিজের বোকামির কথা মনে করে হাসলাম। ভাইয়াকে কোথায় গিয়ে আমি ফলো করবো? ভাইয়ার সকাল আটটা – বিকেল ছটা পর্যন্ত অফিস। মাঝেমধ্যে মিটিং থাকে। বাসায় ফিরতে আরো দেরী হয়। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ সে।
কিন্তু ভাইয়া -ভাবীর সুখের সংসারে হঠাৎ করে এমন কি হলো যার কারণে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল? আমি কিছুই আর খুঁজে বের করতে পারি না!

এসব সাত- পাঁচ চিন্তায় যখন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো আমার ঠিক তখনই একটা ফোন এসে আমার মাথা আরো ভীষণ এলোমেলো করে দিলো।আমি দু’ চোখে তখন কেবল অন্ধকার দেখছিলাম।ফোনটা করলো হসপিটাল থেকে। আমার বান্ধবী ফৌজিয়া ফোন করেছে। ফৌজিয়া সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করেছে। এখন ময়মনসিংহের গ্রীণ লাইফে চেম্বার করেছে। এখানেই রোগী দেখতে বসে। সে ফোন করে বললো,’ পেশেন্টের প্রাইভেসি গোপন রাখা একজন ডাক্তারের ধর্ম, কিন্তু আমি একটা অপরাধ করে ফেলবো এখন।এটা না করেও পারছি না তপু। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে এটা কোনদিন প্রকাশ করবে না তুমি। কথা দিতে পারবে? ‘
আমি বললাম,’ আচ্ছা প্রকাশ করবো না। এখন বলো।’
ফৌজিয়া বললো,’ ফোনে কিছু বলবো না। তুমি শুধু আপাতত এইটুকুই জেনে রাখো, বিষয়টা তোমার ভাবীকে নিয়ে। এখন আর কিছুই বলবো না এই বিষয়ে। তুমি সন্ধ্যার পর আমার চেম্বারে আসো। আমি আটটার দিকে তোমার সঙ্গে বেরুবো।কফি খাবো।’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
ফোন রেখে দিলে আমি খানিকটা অবাক হলাম। ভাবীর সঙ্গে তো ফৌজিয়ার কোনদিন দেখাও হয়নি তাহলে ফৌজিয়া চিনলো কি করে ভাবীকে!
এরপর মনে হলো ফৌজিয়া অনেক অনেক বার ভাবীকে দেখেছে। ছবিতে।তাই ভাবীকে সে চিনতে পেরেছে। কিন্তু ভাবীর সম্পর্কে সে কি জানে? ভাবীর কি বড় ধরনের কোন অসুখ হয়েছে নাকি? কিছুই ভাবতে পারছি না আমি আর!

সন্ধ্যা হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বেরিয়ে গেলাম। আমার আর কিছুই ভালো লাগছে না। তাড়াহুড়ো করে সব শুনে ফেলতে আমার ইচ্ছে করছে ।

ফৌজিয়া আটটায় বের হতে পারলো না চেম্বার থেকে। শুক্রবার থাকায় রোগীর ঝামেলা বেশি। তাকে বের হতে হলো নটা বিশ মিনিটে। অবশ্য সে ফোন করে আমায় বলেছে, ‘ তপু, আরেকটু অপেক্ষা করো প্লিজ! রোগী বেশি। এদের রেখে চলে যাওয়াটা অমানবিক হবে। অনেক দূর দূরান্ত থেকে এইসব রোগীরা আসে!’
ফৌজিয়ার প্রতি কেমন জানি রাগ হচ্ছে আমার। ওর সঙ্গে স্কুল- কলেজে পড়াশোনা করেছি আমি। পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট হতাম সব সময়। ফৌজিয়া সেকেন্ড হতো। আমাকে টপকে যেতে সে সবরকম চেষ্টায় করেছে। কিন্তু স্কুল কলেজের কোথাও আর আমায় উতড়াতে পারেনি। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় হুট করেই আমার জীবন এলোমেলো হয়ে পড়ে। আমার কাছের এক বন্ধু খু*ন হয় এক রাতে। সেই খু*নের মামলায় আমায় ফাঁসানো হয়।এর জন্য দীর্ঘদিন আমি পলাতক ছিলাম। অবশ্য যখন সবকিছু ঠিক হলো। মূল আসামী ধরা পড়লো।আসামীদের সাজা হলো। আমার উপর থেকে মামলা সরানো হলো। ততোদিনে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টা পেরিয়ে গেছে। মেডিক্যালে পড়ার যে তীব্র ইচ্ছে কিংবা স্বপ্নটা আমার ছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে ততোদিনে। কিন্তু ফৌজিয়া।কি সুন্দর ভাগ্য তার! আচ্ছা আমিও তো ওর মতোই এমন ডাক্তার হতে পারতাম হয়তো। আমার এখানেও রোগীদের উপচে পড়া ভীড় থাকতো এভাবে।আর আমার বন্ধুরা এলে আমিও তাদের বলতে পারতাম, আরেকটু অপেক্ষা করো বন্ধু, আজকে রোগীর ভীষণ চাপ!
ঘড়িটা দেখলাম আমি।নয়টা বেজে গেছে।গাল দুটো কেমন ভিজে গেছে জলে।আমি কি তাহলে কাঁদছি? কাঁদছিই তো। আচ্ছা জীবন এমন কেন? আমি তো কারোর কোন ক্ষতি করিনি।জেনেও না।না জেনেও না। তবুও আমার ভাগ্য এমন কেন হলো? সবচেয়ে সুন্দর ইচ্ছে টা কেন আমার পূরণ হলো না!

ফৌজিয়া এলো নয়টা বিশ মিনিট বাজতেই। কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শে আমি চমকে উঠলাম। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি ফৌজিয়া।
ভাগ্যিস খানিক আগেই রুমাল দিয়ে দু চোখ মুছেছি। নয়তো সর্বনাশ হতো। ফৌজিয়া যদি দেখতো আমার চোখ ভর্তি জল।গাল দুটো ভেজা। চুপসানো। তখন কি হতো! কান্নার কারণ জানতে চাইলে কি বলতাম তাকে আমি?
ফৌজিয়া লজ্জিত হবার ভঙ্গিতে বললো,’ সরি তপু! লেট হয়ে গেছে। এখন চলো যাই।’
আমরা হসপিটালের বাইরে গিয়ে রিক্সায় উঠে বসলাম।
ফৌজিয়া বললো,’ ইদানিং লিখা লিখি কম করছো নাকি? ফেসবুকে পোস্ট করতে দেখি না যে!’
আমি বললাম,’ লিখতে আর ইচ্ছে করে না। ‘
ফৌজিয়া বললো,’ লিখতে হবে।এটা ছাড়া যাবে না। তুমি পয়সার জন্য লিখো না আমি জানি। তুমি যে টপিক নিয়ে লিখো এটা নিয়ে কজন পুরুষ লেখক লিখে? নারীদের তো আজকাল সবাই পুতুল ভাবতে পারলেই বাঁচে। তাদের নামে সব দোষ চাপিয়ে দিতে পারলেই যেন তারা স্বর্গে যেতে পারে।এতো সবের মধ্যে তুমি যে তাদের কথা লিখছো। তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলছো।এটা তো ছোট কিছু না তপু! ‘
আমি এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালাম না।আমি টপিক চেঞ্জ করে বললাম,’ ভাবীর কি হয়েছে তা বলো।কি জানো তার সম্পর্কে তুমি?’
রিক্সা থেকে তখন নেমেছি আমরা কেবল। রিক্সার ভাড়া চুকিয়ে আমরা যেই না কফিশপের দিকে পা ফেলবো ঠিক তখনই ফৌজিয়া কথাটা বললো। সে বললো,’ ভাবী গত সপ্তাহে আমার কাছে এসে অ্যাবরোশন করিয়ে গিয়েছেন। তার তিন মাসের প্রেগন্যান্সি ছিল।’

#চলবে

অবিবাহিত বউ পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0

#অবিবাহিত_বউ
#শেষ_পর্ব
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

তোহা শাড়ি পড়ে ভার্সিটিতে এসেছে। তবে আজকে ভার্সিটিতে ক্লাস করার কোনো উদ্দেশ্য নেই তার। নাহিদের সাথে শহরটা ঘুরে বেড়াবে। তোহার দিকে তাকিয়ে অরিন মিটিমিটি হাসছে। তোহা তা দেখে জিজ্ঞেস করল,
“হাসছিস কেন? আমাকে কী জোকারের মতো লাগছে?

অরিন এবার মুখের হাসিটা আরেকটু প্রসারিত করে বলল,
“জোকারের মতো লাগবে কেন? আমি তো তোর আর নাহিদ ভাইয়ার আগের ঝগড়া গুলোর কথা মনে করে হাসছিলাম।

অরিনের কথায় তোহা ও মুচকি হাসল। অরিন আবারো বলল,
“তোদের প্রথম যখন দেখা হলো তখন থেকেই ঝগড়া শুরু হয়েছিল। তুই তো নাহিদ ভাইয়াকে স’হ্যই করতে পারতিস না। আর এখন ভাইয়ার সাথে যাওয়ার জন্য শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছিস।

তোহা মুচকি হেসে বলল,
“কি করবো বল। ঠিক কখন, কীভাবে উনাকে ভালোবেসে ফেললাম বুঝতে পারছি না। হুট করেই যেন সব হয়ে গেল।

অরিন গেইটের ভেতরে তাকিয়ে দেখল নাহিদ আসছে। নাহিদের সাথে ফাহিম, রনি এমনকি রিয়া ও আছে। অরিন তোহাকে হালকা ধা’ক্কা দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“ওই যে তোর উনি আসছে।

“তোর উনি ” কথাটা কানে যেতেই তোহার মুখের ল’জ্জার আভা ফুটে উঠল। শরীরে ভালো লাগার শিহরণ বয়ে গেল। তোহা চোখ তুলে দেখল নাহিদ ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে।

নাহিদ তোহার সামনে দাঁড়িয়ে তোহার মুখের দিকে তাকাল। তোহা মাথা নিচু করে রেখেছে। নাহিদ জানে তোহা আজকে শাড়ি পড়ে আসবে। শাড়ি পড়ার কথাটা সেই বলেছিল কি-না। নাহিদ তোহার মুখের দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তোহা মাথা নিচু করে রাখলেও বুঝতে পারল কেউ একজন তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কে তাকিয়ে আছে এ ও তার অজানা নয়।

রিয়া তোহাকে শাড়ি পড়তে দেখে তোহার দিকে তাকিয়ে নাহিদের দিকে তাকাল। তোহার দিকে নাহিদ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজ মনে বলল,
“তোহার জায়গায় যদি আমি থাকতাম, তাহলে কি ভাইয়া আমাকে এভাবেই দেখতো?

কথাটা ম’স্তিষ্কে প্রভাব ফেলতেই নড়েচড়ে উঠলো রিয়া। নিজের ভাবনাকে ধি’ক্কার জানিয়ে বলল,
“কিসব ভাবছি আমি? না, না। আমার এসব ভাবা উচিত না। কিছুতেই না। নাহিদ ভাইয়া তোহাকে ভালোবাসে। আমি কি করে এসব ভাবছি? আল্লাহ আমার অবচেতন মনটা শান্ত, স্থি’র করে দাও।

রিয়া নাহিদের থেকে চোখ সরিয়ে নিল। মনে মনে স্থি’র করে নিল আর নাহিদের দিকে তাকাবে না। কিছুতেই না। চোখ যতই দেখার জন্য ছটফট করুক, মন যতই অবা’ধ্য হওয়ার চেষ্টা করুক সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে।

রিয়ার মতো করে রনিও নাহিদকে তোহার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিল। ফাহিমকে হালকা ধা’ক্কা দিয়ে চোখের ইশারায় নাহিদের দিকে তাকাতে বলল। ফাহিম নাহিদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আরে মামা চোখ নামা। এভাবে তাকালে তো নজর লেগে যাবে।

ফাহিমের কথার তোহা আরো ল’জ্জায় নুয়ে পড়ল। তা দেখে নাহিদ মুচকি হাসল। ফাহিমের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“এভাবে বলিস না বন্ধু। বউটা ল’জ্জা পাচ্ছে।

নাহিদের কথায় ফাহিম, রনি শব্দ করে হেসে উঠল। নাহিদের ঠোঁটের হাসিও প্রসারিত হলো। রিয়া চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। অরিন একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া আমার তো ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। আপনারা এবার বেরিয়ে পড়ুন।

অরিন কথায় নাহিদ জবাব দেওয়ার আগেই রনি বলে উঠল,
“যা, যা। তোরই তো সময়। বিয়ের আগেই বউ পেয়ে গেছিস।

নাহিদ হাসল। কোনো জবাব দিল না। তোহার পাশে দাঁড়িয়ে তোহার হাতটা ধরে বলল,
“চলো।

নাহিদ বাইক স্টা’র্ট দিল। তোহা নাহিদের বাইকে উঠে বসে নাহিদের কাঁধে হাত রাখল। এতক্ষণ নিজের চোখ দুটোকে সামলে রাখলেও এবার সামলাতে পারল না। অবশেষে নিজের সকল বাধা, নি’ষেধ অ’মান্য করে চোখ জোড়া নাহিদের মুখে আটকে গেল। নাহিদের উচ্ছ্বা’সিত হাসি মুখটা দেখে রিয়ার মুখেও হাসি ফুটল। নিজেই বলল,
“তোমার মুখটা আজীবন হাসিতে পরিপূর্ণ থাকুক।

রিয়ার কথাটা নাহিদের কানে পৌঁছাল না। সে ইতিমধ্যে তোহাকে নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল।
__________________

বাইকে নাহিদের পেছনে বসে নাহিদের ঘাড়ের দিকে তাকাল তোহা। নাহিদের ঘাড়ের ঠিক ডান দিকে কালো তিল দেখতে পেল। তোহা তার ডান হাতটা নাহিদের কাঁধ থেকে সরিয়ে ধীরে ধীরে নাহিদের ঘাড়ের তিলের উপর রাখলো। অমনি বাইকটা থেমে গেল। চমকে উঠল তোহা। বাইক কেন থামলো? তোহা এবারো হাতটা সরিয়ে নিল। নাহিদকে প্রশ্ন করল,
“বাইক থামালেন কেন?

নাহিদ তোহার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে বলল,
“বাইক থেকে নামো।

তোহা ঠোঁট উল্টে বাইক থেকে নেমে গেল। শাড়ির কুচি গুলো কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে। তোহা মাথা নিচু করে সেগুলো ঠিক করতে লাগলো। নাহিদ বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে তোহাকে কিছু না বলেই হাঁটতে লাগলো। তোহা কুচি ঠিক করে পাশে তাকিয়ে দেখলো নাহিদ নেই। অবাক হয়ে সামনের দিকে তাকাল। তখনই নাহিদকে রাস্তা পার হতে দেখল। আনমনে বলল,
“উনি আবার কোথায় যাচ্ছেন?

তোহা নাহিদের বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপতে লাগল। মিনিট পাঁচেক বাদে মাথায় কারো স্প’র্শ পেয়ে ঘাবড়ে গেল তোহা। তড়িগড়ি করে মাথা ঘুরাতে চাইলে পেছন থেকে পুরুষেয়ালী ক’ন্ঠে বলে উঠল,
“উফ, নড়ছো কেন? একটু ঠিক হয়ে বসো তো।

নাহিদের ক’ন্ঠ শুনে তোহা যেন প্রাণ ফিরে পেল। স্ব’স্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“আপনি? হুট করে চলে এলে চমকাবো না?

নাহিদ জবাব দিল না। হাতে থাকা বেলি ফুলের গজরাটা তোহার চুলের খোঁপায় যত্ন করে গুঁজে দিতে লাগলো। গজরাটা গুঁজে দিয়েই তোহার সামনে এসে হাসি মুখে বলল,
“এবার পারফেক্ট আছে।

তোহা বাম হাতটা খোঁপায় রাখতেই বুঝতে পারল নাহিদ খোঁপায় ফুলের গজরা লাগিয়ে দিয়েছে। তোহা মুচকি হেসে বলল,
“পারফেক্ট আছে? কীভাবে পারফেক্ট হলো? আমিই তো পারফেক্ট না। বিয়ের পর কিন্তু আপনার সাথে খুব ঝগড়া করবো।

তোহার কথায় নাহিদ হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে তোহার বাম গালে ডান হাতটা রেখে বলল,
“তাতে কি? তোমার সাথে ঝগড়া করতে খারাপ লাগে না। তাছাড়া ঝগড়া করলে ভালোবাসা বাড়ে। ঝগড়া করাতে আমার কোনো সমস্যা নেই।

নাহিদ কথাটা বলেই চোখ টিপ দিল। তা দেখে তোহা লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে ফেললো। নাহিদ তোহার দিকে তাকিয়ে নেশা’লো কন্ঠে বলল,
“এই বউ।

নাহিদের ডাকে তোহা চোখ বুজে ফেললো। ইশ, ডাকটা এতো মধুর কেন? তোহা মুচকি হেসে চোখ খুলে নাহিদের চোখের দিকে তাকাল। কিন্তু সেই সর্ব’নাশা চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। মুহুর্তের মধ্যেই চোখ নামিয়ে নিল। নাহিদ বলল,
“কি হলো। তাকাও।

নাহিদের কথায় তোহা আবারো নাহিদের চোখের দিকে তাকাল। বেশি আগের বারের মতোই বেশিক্ষণ তাকানোর সাধ্য হলো না। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে হাত দিয়ে মুখ ডেকে বলল,
“আপনি আর তাকাতে বলবেন না। আমার ল’জ্জা লাগছে।

তোহার কথার ধরনে নাহিদ হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বলল,
“আচ্ছা। আর তাকাতে বলবো না। এবার মুখ থেকে হাত নামাও।

তোহা হাত নামালো। তবে নাহিদের দিকে না তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় তোহার চোখ দুটো আটকে গেল। বুকের ভেতর শুরু হলো ভূমি’কম্প। এতক্ষণের লাজুক মুখটা মুহুর্তের মধ্যেই ভয়া’র্ত হয়ে গেল। তোহা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। নাহিদ তোহার ভয়া’র্ত মুখ দেখে অবাক হয়ে তোহার দৃষ্টি অনুসরণ করে রাস্তার দিকে তাকাল।

তখনই দেখতে পেল এক বৃদ্ধ লোক ব্যাগ হাতে রাস্তা পাড় হচ্ছে। আর কয়েক পা এগোলেই রাস্তা পাড় হয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু তিনি হাঁটতে পারছেন না। খুবই ধীর গতিতে হাঁটছে। এদিকে একটা বড় গাড়ি ধেয়ে আসছে। তোহা নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনাকে বাঁচাতে হবে।

তোহা আর এক সেকেন্ডের জন্য ও দাঁড়াল না। বৃদ্ধ লোকটাকে বাঁচাতে দৌড় লাগালো। তোহার কান্ডে নাহিদ স্ত’ব্ধ হয়ে গেল। আসন্ন বিপদের কথা ভাবতেই শরীর যেন অসাড় হয়ে আসলো। নাহিদ স্ত’ম্ভিত ফিরে পেতেই চেঁচিয়ে বলল,
“যেও না তোহা।

তোহা নাহিদের ডাক শুনল না। নাহিদ ও তোহার পেছনে দৌড়াতে লাগল। তোহা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ লোকটাকে ধা’ক্কা দিল। ধা’ক্কা খেয়ে লোকটা রাস্তার ওপাশে পড়ে যেতে নিলেই নাহিদ ধরে নিল। তোহার মুখে ফুটে উঠলো বিশ্বজয়ের হাসি।

তবে হাসিটা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হলো না। তার আগেই বিশাল আকারের দান’বীয় গাড়িটা তোহার শরীরটাকে পি’ষে ফেলল। নাহিদ ‘তোহা’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো।

রাস্তায় র’ক্তে রাঙানো তোহার মুখটা পড়ে থাকতে দেখেই নাহিদের বুকটা জ্ব’লে উঠল। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো নোনাজল। নাহিদ দৌড়ে গিয়ে তোহার মাথাটা কোলে নিয়ে বলল,
“এটা তুমি কেন করলে তোহা?

তোহা বহু ক’ষ্টে নাহিদের মুখের দিকে তাকাল। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করল,
“শুনুন। আব্বুকে বলে দিবেন আমি আব্বুকে ভীষণ ভালোবাসি।

কথাটা বলে থামলো তোহা। মৃ’ত্যু যে খুব নিকটে দাঁড়িয়ে আছে। নাহিদ ভেজা ক’ন্ঠে বলল,
“তোমার কিছু হবে না তোহা। আমি তোমার কিছু হতে দেব না বউ। হসপিটালে নিয়ে গেলে তুমি ঠিক হয়ে যাবে।

নাহিদের কথা তোহা নামলো না। শেষ বারের মতো নাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসি।

নাহিদের বুকের ভেতর রক্ত’ক্ষরণ শুরু হয়েছে। এইতো, একটু আগেই তো মেয়েটা কি সুন্দর ল’জ্জা পেল। কতো সুন্দর করে বলল ‘আমার ল’জ্জা লাগছে ‘। বিয়ের পর দুজন ঝগড়া করবে বলল। কিন্তু এখন? এখন সেই মেয়েটাই রাস্তায় পড়ে মৃ’ত্যুর সাথে লড়াই করছে।

তোহার চোখ দুটো ব’ন্ধ হয়ে আসছে দেখে নাহিদ বলল,
“চোখ বন্ধ করো না তোহা। প্লিজ তোহা তাকাও।

তোহা জোরে শ্বা’স নিয়ে তাকাল। নাহিদের গালে হাত রেখে বলল,
“প্রথমে আব্বু আমাদের মেনে নিল না। এখন নিয়তি। বুঝলেন, ভা’গ্যে আমাদের মিলন ছিলো না। আমি আপনার অবিবাহিত বউ হয়েই রয়ে গেলাম।

“তুমি আমার বউ হবে তোহা। তুমি আমারই হবে। তুমি কোথাও যাবে না।

তোহা নাহিদের কথা শুনলো কই? নাহিদকে একা করে পাড়ি দিল দূর আকাশে। এদিকে নাহিদ প্রলাপ করে চলেছে,
“এই বউ, বউ। তাকাও না এদিকে। এই বউ, তোমায় ডাকছি তো আমি।
________________

ট্রেনের মধ্যে বসে আছে নাহিদ। হাতে মোবাইল নিয়ে তোহার হাস্য’জ্জ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। নাহিদের ঠিক বরাবর সামনের সিটে রিয়া বসে আছে। নাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিন যে নাহিদের হাসি মুখটা দেখছিল তার পর থেকে এখনো নাহিদের মুখে হাসি দেখেনি। ভা’গ্যিস সেদিন অ’বাধ্য চোখটা নাহিদকে দেখে নিয়েছিল। তোহার মৃ’ত্যুর পর নাহিদ যেন হাসতে ভুলে গিয়েছে।

নাহিদ আর রিয়া দুজন নাহিদের মামার বাড়িতে যাচ্ছে। নাহিদ সব সময় মন মরা থাকে বিধায় নাহিদের আম্মু দুজনকে জোর করে পাঠিয়েছে। রিয়া আজও নাহিদকে মনের কথা জানায়নি। জানাবে কি করে? নাহিদ যে এখনো তোহাকে ভুলেনি।

নাহিদের পাশে একটা ছয়/সাত বছরের ছোট বাচ্চা ছেলে বসে আছে। মুখ তার অন’র্গল চলছে। নিজের মাকে বারবার একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। নাহিদকে অনেকক্ষণ ধরে মোবাইলে একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“আঙ্কেল এই মেয়েটা কে?

বাচ্চাটার কথায় নাহিদ চোখ তুলে বাচ্চাটার দিকে তাকাল। আবারো তোহার ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার অবিবাহিত বউ।

সমাপ্ত

অবিবাহিত বউ পর্ব-২৩

0

#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ২৩
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

বিকালে তোহার মোবাইলে অরিনের কল এলে তোহা কল রিসিভ করে কানে দেয়। ওপাশ থেকে অরিন উ’দ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“কিরে তোহা? আজকাল তো তোর কোনো খবরই পাচ্ছি না। ভার্সিটিতে ও যাচ্ছিস না। কোনো সমস্যা হয়েছে?

তোহা দীর্ঘ’শ্বাস ফেলল। সমস্যা? হ্যাঁ‌। সম’স্যাই তো। এটা তো তার জীবনে সবচেয়ে বড় সম’স্যা। এমন কঠিন সম’স্যার মুখোমুখি এর আগে কখনো হয়নি। তোহা মলিন ক’ন্ঠে বলল,
“কিছুনা।

তোহার মলিন কন্ঠ শুনে অরিন বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে তা বুঝতে পারল না। শীতল স্ব’রে বলল,
“কি হয়েছে তোহা? তুই আমার কাছে কথা লুকো’চ্ছিস? আমার কাছে? কি হয়েছে বল।

তোহা এবার মুখ খুলল। দুদিনের সম’স্ত ঘটনা বলে চুপ করে রইল। অরিন সব শুনে অবাক কন্ঠে বলল,
“আঙ্কেল তোর কথা শুনছে না? তুই কান্না করেছিস জেনেও মুখ বুজে স’হ্য করছে?

তোহা কোনো জবাব দিল না। চুপ করে থাকল। অরিন দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে আবারো বলল,
“আমি তো জানি আঙ্কেল তোকে অনেক ভালবাসে। এখন হয়তো রাগের কারনে মেনে নিতে চাইছে না। পরে ঠিকই মেনে নেবে। তুই ক’ষ্ট পাস না। যা হবে ভালোর জন্যই হবে। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করিস। আমি রাখছি, হ্যাঁ।
______________

রাতের বেলা তারেকুল খাবার টেবিলে খেতে এলো। তখনই উদাস মুখে সানজিদাকে বসে থাকতে দেখল। চেয়ারের কোথাও তোহার দেখা পেল না। তারেকুল গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তোহা কোথায়? তোহা খাবে না?

তারেকুলের প্রশ্নে সানজিদা যেন গ’র্জে উঠলেন। চোখ মুখ শক্ত করে চেঁচিয়ে বলল,
“তোহার কথা জেনে তুমি কি করবে? তোমার খাওয়া তুমি খাও। তোহা খেলো কি খেলো না তা জেনে তোমার কি? মেয়েটার দিকে তোমার খেয়াল আছে? সকালে যে এতো করে বলল মেয়েটা ক’ষ্ট পাচ্ছে তাতে তোমার জে’দের কি একটুও নড়চড় হয়েছে? তুমি তো তোমার আত্ম’সম্মান নিয়ে আছো।

সানজিদার কথায় তারেকুল হত’ভম্ব হয়ে গেল। বিয়ের পর এই প্রথম মুখের উপর চেঁচিয়ে কথা বলল সানজিদা। তারেকুল ধমক দিয়ে বলল,
“তুমি আমার সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছো?

তারেকুলের ধ’মকে সানজিদার ভাব’ভঙ্গির কি’ঞ্চিত ও হেরফের হলো না। সে আগের মতোই চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“চেঁচাবো না তোমার সাথে? তুমি কি চেঁচানোর মতো কাজ করছো না? কিসের আত্ম’সম্মান তোমার? হ্যাঁ, কিসের আত্ম’সম্মান? এই আত্ম’সম্মান দিয়ে তুমি কি করবে? মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে তখন তোমার আত্ম’সম্মান আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দেয় কি-না দেখব আমি। আমার কথাটা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে রেখো।

তারেকুল এবার নড়েচড়ে উঠলেন। সত্যি তো মেয়েটা যদি কোনো অঘ’টন ঘটিয়ে ফেলে। সানজিদা এবার দু’চোখ বন্ধ করে শ্বা’স ফেলল। নিজেকে শান্ত করে শীতল ক’ন্ঠে বলল,
“আচ্ছা, তোমার রাগটা কিসের বলো তো? নাহিদের জন্য তোমার সম্মান’হানি হয়েছে বলে? একবার ভেবে দেখো তো। নাহিদ দুয়েকটা কথা বলেছিল আর সেই কথাটা সত্য নাকি মি’থ্যে সেটা যাচাই না করেই সুমন তোমাকে তোহাকে কথা শুনালো। এখানে কি সুমনের কোনো দোষ নেই? সুমনের কি উচিত ছিল না নাহিদের কথাটা সত্যি না মি’থ্যে যাচাই করার?

তারেকুল চুপ করে থাকল। সানজিদার কথা গুলো যে মি’থ্যে নয় সেটা বুঝতে পারল। সানজিদা আবারো বলল,
“সুমন কিন্তু তোহার একটা কথাও শুনেনি। এতোদিন যেহেতু অপেক্ষা করতে পেরেছে তাহলে কয়েকটা কথা শুনলে কি এমন ক্ষ’তি হতো? নাহিদকে দেখো। তোমার কথা নি’শ্চুপে মেনে নিল। কোনো কথা বলল না। তোমার কথায় তোহার সাথে কথা বলা ব’ন্ধ করে দিল।

তারেকুল এবারো চুপ করে রইল। কোনো কথা বলল না। সানজিদার কথা গুলো যে সত্যি সেটা বুঝতে পারল। নিজের ভুলটা ও বুঝতে পারল। সানজিদা আবারো বলল,
“ওদের মেনে নাও। একবার যাও না তোহার কাছে। একবার তোহাকে গিয়ে ডাক দাও। মেয়েটা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমার থেকেও তোমায় বেশি ভালোবাসে। তোমার ডাক উ’পেক্ষা করতে পারবে না। একবার যাও না।

তারেকুল সানজিদার কথা শুনল। নি’শ্চুপে হেঁটে চলে গেল তোহার রুমের সামনে। তোহার রুমটা ভেতর থেকে আটকানো। তারেকুল দরজায় আঙুল দিয়ে ঠক ঠক করে শব্দ করল। তোহা ভেতরে বিছানায় শুয়ে ছিল। আম্মু এসেছে ভেবে বলল,
“তুমি চলে যাও আম্মু। আমায় ডাকবে না। আমি এখন খেতে যাব না।

তারেকুল হুট করে যেন কথা বলতে ভুলে গেলেন। “আমি” শব্দটাও তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। আবারো দরজায় টোকা দিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে ধা’তস্থ করে বলল,
“দরজাটা খুলো।

আব্বুর গলা পেয়ে তোহা ধরফরিয়ে উঠে বসল। আব্বু এসেছে ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে। কিন্তু নাহিদকে মেনে না নেওয়ায় কথাটা মনে পড়তেই মুখটা মলিন হয়ে গেল। তোহা বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে দিল। তারেকুল তোহার মলিন মুখটা দেখে ক’ষ্ট পেল। তোহা বিছানায় গিয়ে বসতেই তারেকুল বলে উঠল,
“আব্বু সরি মামনি।

তোহা অবাক দৃষ্টিতে তারেকুলের দিকে তাকাল। তোহার দৃষ্টি থেকে তারেকুল বলে উঠল,
“আব্বু তোমায় অনেক ক’ষ্ট দিয়েছে। তোমাকে প্রমিজ করছি আমি আর তোমায় ক’ষ্ট পেতে দিব না। আব্বু অনেক অনেক সরি মামনি।

তারেকুলের কথায় তোহার চোখ দুটো খুশিতে চিকচিক করে উঠল। বুকের ভেতরটায় সুখের ঢেউ বয়ে গেল। অবি’শ্বাস্য ক’ন্ঠে বলে উঠল,
“তুমি সত্যি বলছো আব্বু? তুমি আমায় আর ক’ষ্ট পেতে দিবে না? তুমি উনাকে মেনে নিবে?

তারেকুল মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। বিছানায় তোহার পাশে আয়েশ করে বসে বলল,
“দেখি ছেলেটার নাম্বার দে তো।

তোহা অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পরক্ষনেই নাহিদের নাম্বারটা গড়গড় করে বলে দিল। তারেকুল নিজের মোবাইল দিয়ে নাহিদের নাম্বারে কল দিল। নাহিদ কলটা রিসিভ করতেই কিছুটা গ’ম্ভীর গলায় বলে উঠল,
“এই ছেলে তোমার সাহস তো কম না। তুমি আমার মেয়েকে ক’ষ্ট দিচ্ছো।

নাহিদ ভ্রুঁ কুঁচকে ফেলল। অচেনা নাম্বার থেকে কেউ ফোন দিয়ে এমন কথা বলায় কিছুটা বি’ব্রত বোধ করল। শীতল স্ব’রে বলল,
“আপনার মেয়েকে আমি কেন ক’ষ্ট দেব? কে আপনার মেয়ে? আমি তো আপনাকেই চিনি না। আপনার মেয়েকে চিনব কি করে?

ফোনটা লাউড স্পিকারে থাকায় তোহা নাহিদের কথাগুলো শুনতে পেল। এবং নাহিদের কথায় মুখ টিপে হাসতে লাগল। তারেকুল বলল,
“এখন তো আমাকে চিনবেই না। আমি তোমাকে মেনে নিব না বলেছি কিন্তু আমার মেয়েকে ক’ষ্ট দিতে বলিনি। তুমি কোন সাহসে আমার মেয়েকে ক’ষ্ট দিচ্ছো।

নাহিদ এবার বুঝতে পারল তারেকুল কল দিয়েছে। তারেকুলের কথায় নাহিদ ভড়কে গেল। আমতা-আমতা করে বলল,
“আঙ্কেল আমি কি…..

নাহিদকে কথাটা শেষ করতে দিল না তারেকুল। তার আগেই বলে উঠল,
“আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা। আমি শুধু আমার মেয়েকে খুশি দেখতে চাই। আমার মেয়ের যদি একটু ও ক’ষ্ট হয় সব দায়ভার তোমার।

নাহিদ হেসে বলল,
“আপনার মেয়েকে আমি কখনো আমার কারণে ক’ষ্ট পেতে দেব না।
_____________

ঘড়িতে যখন বারোটা বাজলো ঠিক তখনই আগের মতোই তোহার ফোনটা বেজে উঠলো। তোহা ফোনটা হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে নাহিদ নেশা’লো কন্ঠে বলল,
“এই বউ।

তোহা আবেশে চোখ দুটো ব’ন্ধ করে ফেলল। ডাকটা একেবারে বুকের ভেতরে গিয়ে লেগেছে। তোহা মুচকি হেসে মুখ ভেং’চি দিয়ে বলল,
“এখন বউ বলতে আসছে। আমি যে এতো করে বললাম আব্বু ঠিক মেনে নেবে তখন তো কথা শুনলেন না। তখন ঠাস করে মুখের উপর কলটা কেটে দিলেন।

তোহার কথায় নাহিদ হেসে উঠল। ফিসফিসিয়ে বলল,
“সরি বউ।

“এতো বউ বউ করেন কেন? বিয়ে না করে বউ কেন বলবেন? বিয়ে করার পর বউ বলবেন।

“আরে তুমি বুঝ না কেন? এখন যেহেতু বিয়ে করিনি সেহেতু তুমি আমার অবিবাহিত বউ। বিয়ে করে ঘরে তুলে আনলে বিবাহিত বউ হবে। তো বউ তো বলাই যায়।

তোহা হাসলো। নাহিদ আবারো বলল,
“তোমাকে বিয়ে করে বুকে জড়িয়ে আমার শূন্য বুকটা পুর্ন করবো।

“আপনি জানেন আমার এই কয়টা দিন কেমন বিদ’ঘুটে লেগেছে। কতোটা যন্ত্র’ণায় ছটফট করতে হয়েছে। কিন্তু এখন, এখন আপনার সাথে কথা বলার সময় মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা আমি।

নাহিদ হাসল। যন্ত্র’ণা কি তার কম হয়েছিল? উহু, কম হয়নি। বরং তোহার থেকে বেশিই হয়েছিল। তোহা তো কান্না করতে পেরেছে, মুখ ফুটে বলতে পেরেছে ক’ষ্টের কথা। কিন্তু তার ক’ষ্টতা কেবল সে নিজেই উপ’লব্ধি করেছিল, খুব গোপনে নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন যেন সব ক’ষ্ট, সব যন্ত্র’ণার অবসান ঘটল। পৃথিবীটা যেন রঙিন হয়ে উঠল।

#চলবে

অবিবাহিত বউ পর্ব-২১+২২

0

#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ২১
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

সকালে তারেকুলের হুং’কার শুনে তোহার ঘুম ভে’ঙ্গে গেল। হুট করে এমন হুমকি, ধামকি শুনে ধরফরিয়ে উঠে বসল। চোখ কচলে ভাবতে লাগলো তারেকুলের এমন হুমকি দেওয়ার কারণ। কিন্তু কোনো কারণই খুঁজে পেল না। তোহা বি’স্মিত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পেটে কিছু না থাকায় পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তোহা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে থেমে গেল।

চোখের সামনে অনাকা’ঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে চমকে উঠল। চোখ দুটো বড়বড় করে তাকাল। সামনে থাকা মানুষটাকে সত্যি দেখছে তো, নাকি স্বপ্ন? তোহা তারেকুলের দিকে তাকিয়ে দেখল তারেকুলের চোখ, মুখ শক্ত। তারেকুলের পাশেই তোহার আম্মু সানজিদা ভীত ভ’ঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তোহা শুকনো ঢোক গিলল। মানুষটা এখানে এসেছে কেন? কি করবে এখন? কিছুই বুঝতে পারছে না।

তোহা ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। বুকটা ক্রমাগত উঠানামা করছে। একবার তারেকুলের দিকে তাকাল। তারেকুল নির্বি’কার ভ’ঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। তোহা সামনে থাকা মানুষটার দিকে তাকাতেই মানুষটা মুচকি হাসল। সেই হাসি দেখে তোহা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। আব্বু কি তাহলে এতক্ষণ উনাকে ধ’মক দিয়েছিল? তোহা দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে শীতল কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“আপনি এখানে কি করছেন?

তোহার প্রশ্নটা কর্ন’গোচর হতেই নাহিদ মুখ খোলার আগেই তারেকুল তাচ্ছি’ল্য করে বলল,
“এমন ভান করছো যেন তুমি কিছুই জানো না? তোমার আশকারা না পেলে এমনি এমনি এসেছে?

তোহা আ’হত দৃষ্টিতে তারেকুলের দিকে তাকাল। আব্বু হঠাৎ করে এতোটা কঠিন হয়ে গেল কেন? তোহা হতা’শার শ্বা’স ফেলল। তখনই নাহিদ বিনীত স্বরে তারেকুলের উদ্দেশ্যে বলল,
“আঙ্কেল তোহা সত্যিই কিছু জানে না। আমি যে এখানে আসবো তোহাকে জানিয়ে আসিনি। আপনি দয়া করে ওকে কিছু বলবেন না।

নাহিদের কথায় তারেকুল বি’দ্রুপ করে হাসল। নাহিদের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্ব’রে বলল,
“তুমি এখন আমাকে শিখাবে আমার মেয়েকে আমি কি বলবো না বলবো? এখন থেকেই নিজেকে ওর অভিভাবক মনে করছো?

তারেকুলের কথায় তোহা ল’জ্জায় দুচোখ বন্ধ করে ফেলল। হুট করে আব্বুর এতো পরিবর্তন মানতে পারছে না। আব্বু কি করে এতোটা পাল্টে গেল? নাহিদ তারেকুলকে বুঝাতে বলল,
“ছিঃ ছিঃ আঙ্কেল। আমি তা মনে করবো কেন? আমি ওর অভিভাবক হতে যাব কেন? আপনিই তো ওর সব। আঙ্কেল তোহা আপনাকে অনেক ভালোবাসে। আপনি শুধু শুধু ওকে ভুল বুঝছেন।

তারেকুল আবারো তাচ্ছি’ল্য করে হাসল। এক পলক তোহার দিকে তাকিয়ে আবারো নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে ভালোবাসে? আমাকে ভালোবাসলে আমাকে কেন মি’থ্যে কথা বলল? আমি তো বারবার ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর পছন্দের কেউ আছি কিনা। তখন কেন বলল না? কেন প্লেন করে বিয়ে ভে’ঙে আমার সম্মান’হানি করলো? আমাকে ভালোবাসে বলেই কি এমন করল?

তোহা তারেকুলের দিকে তাকিয়ে হতাশ ক’ন্ঠে বলল,
“আব্বু এভাবে বলো না। আমার সত্যি পছন্দের কেউ ছিল না।

“তাহলে এখন পছন্দের মানুষ কোথা থেকে এলো?

তোহা জবাব দিতে গেলে নাহিদ তোহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটু পানি নিয়ে আসো তো।

তোহা থেমে গিয়ে মাথা নাড়িয়ে নাহিদের কথামতো পানি আনতে গেল। মিনিট দুয়েক পর ফিরে এসে নাহিদের দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিল। নাহিদ গ্লাসটা হাতে নিয়ে তারেকুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আঙ্কেল পানিটা খেয়ে একটু শান্ত হোন। তারপর আমাদের কথা শুনবেন। আপনার মেয়েকে তো আপনি চিনেন। মেয়ের উপর একটু আ’স্থা রাখুন।

তারেকুল কিছুটা শান্ত হয়ে নাহিদের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটা পানি খেয়ে ফেলল। নাহিদ এবার শীতল কন্ঠে মাথা নিচু করে বলল,
“আঙ্কেল সেদিন আমরা প্লেন করে বিয়েটা ভে’ঙ্গে দেইনি। আমি জানতাম না ওদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। দুষ্টুমি করে তোহাকে বউ বলতেই ছেলেটা ভুল বুঝে বেরিয়ে গেল। আমাদের মাঝে তখন কোনো সম্পর্ক ছিল না। তোহা আপনাকে কোনো মিথ্যে কথা বলেনি। সম্পর্কটা শুরু হয়েছে অনেক পরে। আপনি শুধু শুধুই তোহাকে ভুল বুঝছেন।

তারেকুল নাহিদের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তবে তার রাগটা গিয়ে পড়ল নাহিদের উপর। নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সেদিন নাহলে মি’থ্যে বলেনি। কিন্তু যেই ছেলের জন্য আমার সম্মান’হানি হয়েছে সেই ছেলের সাথে কীভাবে সম্পর্কে গেল? ও ভাবলো কীভাবে আমি সেই ছেলেটাকে মেনে নিব? আমি তোমাকে কখনও মেনে নিব না। তাই তোহার তোমাকে ভুলে যেতে হবে।

তারেকুলের কথায় তোহা, নাহিদ চমকে উঠলো। নাহিদ যেন বাক’শক্তি হারিয়ে ফেলল। কি বলা উচিত, কি করা উচিত কিছুই বুঝতে পারলো না। তোহার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। এ কেমন সংকট? এক জনকে পেতে হলে আরেকজনকে হারাতে হবে। তোহা তারেকুলের কাছে গিয়ে তারেকুলের হাত ধরে বলল,
“প্লিজ আব্বু এভাবে বলো না। উনি তো ইচ্ছে করে তোমার সম্মান’হানি করতে চাননি। জাস্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে।

তারেকুল তোহার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নাহিদ তোহার দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। নাহিদের বুকটা ধক করে উঠল। বুকের ভেতর জ্বা’লা শুরু হয়েছে। এখন থেকে তোহাকে ভুলে থাকতে হবে। নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে মি’থ্যে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“আপনি যা বলবেন তাই হবে আঙ্কেল। আপনি না চাইলে সম্পর্ক রাখার কোনো মানেই হয় না। আপনার যখন আমার মেনে নিবেন না, আমি তোহার জীবনে থাকব না।

নাহিদ মুচকি হেসে তোহার দিকে এগিয়ে গেল। তোহা ছল’ছল দৃষ্টিতে তাকাল। নাহিদ তোহার মাথায় হাত রেখে মুখে মুচকি হাসি, বুকে য’ন্ত্রণা নিয়ে বলল,
“ভালো থেকো বউ।
_______________

ছাদের মধ্যে নাহিদ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো আকাশের দিকে স্থি’র। বুকের মধ্যে ক’ষ্ট, য’ন্ত্রণা। নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছাদের মধ্যে স্প’ষ্ট কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। কে-ই বা আসবে। হয়তো রিয়া এসেছে। রিয়ার নাহিদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নাহিদের দিকে কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে আছো যে? মন খারাপ?

নাহিদ পকেট থেকে ডান হাতটা বের করে রিয়ার বাড়িয়ে দেওয়া কফির কাপটা হাতে নিল। কফির কাপে ধীরে সু’স্থে চুমুক দিল। রিয়া প্রশ্নের উত্তরের আশায় নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইল। নাহিদ শীতল ক’ন্ঠে বলল,
“রিয়া তুই তো কাউকে ভালোবাসিস। তোর ভালোবাসার মানুষটা যদি তোর না হয় তাহলে কি করবি?

রিয়া নাহিদের কথায় চমকে উঠল। হুট করে নাহিদের এমন প্রশ্নের কারণ বুঝতে পারল না। তবে কি তোহা আর নাহিদ ভাইয়ার মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়েছে? রিয়া নি’রাশ ক’ন্ঠে বলল,
“আমার ভালোবাসার মানুষটা আমার হবে না ভাইয়া। সে অন্য কারো।

নাহিদ রিয়ার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রিয়ার মুখের দিকে তাকাল। আবছা আলোয় রিয়ার মুখটা দেখতে পেল। রিয়াকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“তোর ক’ষ্ট হয় না?

নাহিদের কথায় রিয়া হেসে উঠলো। নাহিদ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। রিয়া হাসি থামিয়ে বি’ষন্ন ক’ন্ঠে বলল,
“ভালোবাসা মানেই তো ক’ষ্ট, যন্ত্র’ণা।

রিয়া কথাটা বলে কিছুক্ষন চুপ করে রইল। তারপর আবারো বলে উঠল,
“ভালোবাসলেই যে পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। না পাওয়ায় মাঝেও শান্তি আছে, স্ব’স্তি আছে। ভালোবাসার মানুষটা হয়তো বাস্তবে আমার হবে না। তবে আমার স্বপ্নে কল্পনায় সে সবসময় আমার। যার উপর কারো আধি’পত্য নেই। কারো কোনো অধিকার নেই। যার উপর শুধু আমার অধিকার থাকবে।

নাহিদ রিয়াকে বলল,
“তোর ভালোবাসার মানুষটা কে? আমি একবার তাকে তোর কথা বলে দেখি।

রিয়া নাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনের সমস্ত প্রেম নিয়ে বলল,
“ধরো তুমি।

নাহিদ অবাক চোখে তাকাল। রিয়া নাহিদের মুখ দেখে বলল,
“আরে আমি সত্যি বলিনি। জাস্ট উদাহরণ দিচ্ছি। তুমি তো তোহাকে ভালোবাসো। এখন আমি যদি বলি আমি তোমায় ভালোবাসি তাহলে তুমি কি আমায় মেনে নিবে?

“ভালোবাসার অনুভূতিটা সবার জন্য আসে না। তোহার প্রতি আমার যেই ভালোবাসাটা সেটা আমি কখনো কাউকে দিতে পারবো না। ভালোবাসা জোর করে হয় না।

“তাইতো আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। তুমি বললেও সে আমায় ভালোবাসতে পারবে না। যাই হোক, রাত বাড়ছে। রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।

রিয়া চলে গেল। নাহিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর ভালোবাসার মানুষটা অন্য কাউকে ভালোবাসে বলে তোর হবে না। অথচ আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে ভালোবেসে ও আমার হবে না।

#চলবে

#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ২২
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

সময়টা যখন রাত বারোটায় গিয়ে পৌঁছাল তোহার তখন ছটফ’টানি বাড়তে লাগলো। সারাদিন প্র’চন্ড বিষন্ন’তায় দিন কাটলেও এখন আর স’হ্য হচ্ছে না। নাহিদের সাথে কথা বলার তৃ’ষ্ণায় ছট’ফট করতে লাগলো। তোহা বারবার মোবাইলটার দিকে তাকাল। কিন্তু নাহিদের কল আসার কোনো নামই নেই। তোহার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। আব্বুকে বুঝালেও কিছুতেই বুঝছে না। নাহিদকে উনি কোনো মতেই মেনে নিবে না। অবশেষে ব্য’র্থ হয়ে তোহা রুমের দরজা লাগিয়েছে। তারপর থেকে একবারের জন্যও রুমের বাহিরে পা রাখেনি। তোহা মোবাইলের সময় দেখল। ঘড়িতে ইতিমধ্যে বারোটা পাঁচ বেজে গেছে।

তোহা বুকের ভেতরের দহন সইতে না পেরে অবশেষে কল লাগলো নাহিদের নাম্বারে। রিং হতে হতে কলটা কেটে গেল। কিন্তু নাহিদ কল রিসিভ করল না। তোহা হতা’শ চোখে মোবাইলের দিকে তাকাল।

রিয়া চলে যাওয়ার পরও নাহিদ ছাদ থেকে নামেনি। একই ভ’ঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। নি’স্তব্ধ পরিবেশটা যখন মোবাইলে কল আসার শব্দে মুখরিত হলো ঠিক তখনই নাহিদের বুকটা ছ’লাৎ করে উঠলো। তবে কি তোহা কল দিয়েছে? নাহিদ দ্রুত পকেট থেকে মোবাইলটা হাতে নিল। মোবাইলের স্ক্রি’নে তোহার নাম্বারটা দেখেই ব’ক্ষ জুড়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। নাহিদ কলটা রিসিভ করতে গিয়ে থেমে গেল। কী হবে কলটা রিসিভ করে? তোহার প্রতি দূর্ব’লতা আরো প্র’বল হবে। কিন্তু তার তো তোহাকে ভুলে থাকার কথা।

নাহিদ মিইয়ে গেল। কলটা বাজতে বাজতে একসময় কেটে গেল। কিন্তু তোহা থেমে নেই। আবারো নাহিদকে কল দিল। তিনবার কল দেওয়ার সময় নাহিদ কলটা রিসিভ করল। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে তোহা কান্না’মিশ্রিত ক’ন্ঠে বলে উঠল,
“আপনি আব্বুর কথায় আমায় ভুলে যাবেন?

নাহিদ দুচোখ বন্ধ করে ফেলল। ভুলে যাবে? ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ? চাইলেই কি কাউকে ভুলে থাকা যায়? নাহিদ স্থি’ত হেসে বলল,
“ভুলে তো যাচ্ছি না। শুধু দূরে সরে যাচ্ছি।

তোহা ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। উনি কতো সুন্দর করে বলে ফেললেন ‘ভুলে তো যাচ্ছি না। শুধু দূরে সরে যাচ্ছি ‘। উনার কি কথাটা বলতে একটু বুক কাঁপল না? তোহা ভেজা ক’ন্ঠে বলল,
“ভুলে যাওয়া আর দূরে যাওয়া তো একই।

“উহু। ভুলে যাওয়া আর দূরে যাওয়া এক না। আমি তোমায় ভুলতে পারবো না। দূরে সরে যাচ্ছি বলে ভুলে যাচ্ছি এমনটা ভেবো না। দূরে সরে যেতে চাইলেও আমি তোমায় মনের মাঝে যতন করে গেঁথে রেখেছি।

তোহা দুচোখ বন্ধ করে কাতর স্বরে বলল,
“প্লিজ দূরে সরে যাবেন না। দূরে যাওয়ার জন্য তো ভালোবাসেননি। আপনি এখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছেন। আপনার সাথে কথা না বলে থাকতে পারি না আমি। আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? ক’ষ্ট হয় আমার?

তোহার কথায় নাহিদের বুকটা জ্ব’লে উঠল। ইচ্ছে করল তোহাকে দুহাতে জাপটে ধরে বুকের মাঝে মিশিয়ে নিতে। কিন্তু নাহিদ তা পারবে না। তোহার কাতর স্বরে বলা কথাটা শুনে পাল্টা প্রশ্ন করল,
“তোমার আব্বু্কে ক’ষ্ট দিতে ক’ষ্ট হবে না?

নাহিদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কোনো উত্তর খুঁজে পেল না তোহা। আব্বুর কথা না মেনে যদি নাহিদকে চায় তাহলে তো আব্বু ক’ষ্ট পাবে। আব্বুকে ক’ষ্ট দিয়ে কি ভালো থাকতে পারবে?

তোহা নিজের ভাবনা গুলোর উত্তর পেল না। তোহাকে চুপ থাকতে দেখে নাহিদ আবারো বলল,
“আমি তোমায় ভুলে যাচ্ছি না। তোমার আব্বু যদি আমায় মেনে নেয় তবে তুমি আমার হবে। কিন্তু তোমার আব্বু তো আমায় মেনে নিতে রাজি না। আমি যদি জানতাম সেদিনের করা দুষ্টু’মির জন্য তোমাকে হারাতে হবে তাহলে কখনোই এমন দু’ষ্টুমি করতাম না।

“সেদিন যদি দুষ্টুমিটা না করতেন তাহলে হয়তো আমি অন্য কারো হয়ে যেতাম। যদিও আমি বিয়েটা ভা’ঙ্গার চেষ্টা করতাম। তবে কতটুকু সফল হতাম জানিনা। সেদিন দুষ্টু’মি করেছিলেন বলেই এখন আমার ভালোবাসা পেয়েছেন।

নাহিদ মৃদু হেসে বি’ষন্ন গলায় বলল,
“ভালোবাসা পেয়ে কি হলো বলো? ভালোবাসার মানুষটাকেই তো হারাতে হচ্ছে।

তোহা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আপনি প্লিজ আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করবেন না। আব্বু আপনাকে ঠিক মেনে নিবে। আমি আপনার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবো না। শুধু একটু কথা বললেই হবে। কথা বলবেন তো?

“তোমার আব্বু যদি আমায় মেনে না নেয়? তোমার কথা অনুযায়ী আমি এখন তোমার সাথে কথা বললাম কিন্তু পরে যদি তোমার আব্বু আমায় মেনে না নেয় তখন তো কথা না বলে থাকতে হবে। কথা বলতে বলতে আরো মায়া বাড়বে, ভালোবাসা বাড়বে। তখন কথা না বললে ক’ষ্টটা আরো গভীর হবে।

নাহিদের কথাটা তোহা শুনলো না। জে’দ ধরে বসে রইল। সে কিছুতেই কথা না বলে থাকতে পারবে না। তাইতো দৃঢ় গলায় বলল,
“আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আপনি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করবেন না। আব্বুকে আমি রাজি করাবো। আমি যে করেই হোক আব্বুকে রাজি করাবো। আপনি শুধু কথা বলা বন্ধ করবেন না।

নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক’ষ্ট তো তারও কম হচ্ছে না। শুধু তোহার মতো সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। প্রকাশ করলেই তো তোহা আরো জে’দ ধরবে। নাহিদ শীতল ক’ন্ঠে বলল,
“তুমি অবুঝ না তোহা। একটু বোঝার চেষ্টা করো।

তোহা এবার কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“আপনি ও তো অবুঝ না। আপনি কেন আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করছেন না? আমি তো একটু কথা বলতেই চাইছি। বেশি কিছু চাইছি কি?

নাহিদ তোহার একনাগাড়ে বলা কথা গুলো শুনল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তুমি যদি তোমার আব্বুকে রাজি করাতে পারো তবেই আমি কথা বলবো। তার আগে না।

নাহিদ কথাটা বলে তোহাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কলটা কেটে দিল। সে তো এমনিই তোহার প্রতি দুর্বল। আর কতক্ষন এভাবে কঠোর হয়ে থাকা যেত? হয়তো আরেকটু পরে তোহার কথাই মেনে নিত। তাইতো কথা না বাড়িয়ে কলটা কেটে দিল।
_____________

সকালে ঘুম থেকে উঠে তোহা ওয়াশরুমে গেল। চোখ মুখ ধুয়ে রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের চেহারা দেখে নিজেই চমকে গেল। ইশ, কতো বিধ্ব’স্ত দেখাচ্ছে তাকে। চোখ মুখ যেন বসে গিয়েছে। এমন হবেই তো। দুটো দিন খাওয়ার সাথে কোনো যোগসূত্র নেই। সেই সাথে মনের অবস্থাও ভালো না। কান্না করেই সময় কেটেছে তার।

তোহা চুল গুলো আঁচড়ে নিল। রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। যে করেই হোক আব্বুকে রাজি করাতেই হবে। আব্বু তো তাকে ভালোবাসে। তাকে নিশ্চয়ই ক’ষ্ট পেতে দেবে না। তোহা নিচে নেমে দেখল তারেকুল খবরের কাগজ পড়ছেন। তোহা শুকনো ঢোক গিলে শীতল কন্ঠে ডাকল,
“আব্বু।

মেয়ের ডাকে তারেকুলের বুকটা জুড়িয়ে গেল। চোখ তুলে তোহার দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠলেন। একি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার? মেয়েটার চোখ মুখ যেন শুকিয়ে গিয়েছে। তারেকুল উ’দ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে?

তারেকুলের কথায় তোহা একছুটে তারেকুলের পাশে গিয়ে বসল। তারেকুলের দিকে তাকিয়ে ভেজা ক’ন্ঠে বলল,
“আমার ক’ষ্ট হচ্ছে আব্বু। তুমি দেখো, তোমার মামনি ক’ষ্ট পাচ্ছে।

তারেকুলের বুকটা মেয়ের কথায় কেঁপে উঠল। তার একমাত্র আদরের মেয়েটা ক’ষ্ট পাচ্ছে। তোহার ক’ষ্টের কারণটা ধরতে পেরে তারেকুল মুখে কা’ঠিন্যতা ফুটিয়ে তুলল। তোহা তারেকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আব্বু তুমি আমার ক’ষ্ট দূর করবে না? তোমার কথা মানতে উনি আমার সাথে কথা বলছে না। তুমি প্লিজ উনাকে মেনে নাও। আমি ক’ষ্ট স’হ্য করতে পারছি না আব্বু।

তোহার আহাজারি করে বলা কথাগুলোতে তারেকুলের মন গলল না। রেস্টুরেন্টের সামনে সেদিন সুমনের বলা কথাগুলো কানে বাজলো। তারেকুল সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,
“তুমি যা চাইছ তা কখনোই সম্ভব হবে না। আমি ওই ছেলেটাকে মেনে নিব না।

তারেকুল কথাটা বলে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। হনহন করে চলে গেল। তোহা ফ্যাল’ফ্যল দৃষ্টিতে তারেকুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। মনকে বোঝাতে পারছে না। আব্বু সত্যি চলে গেল? তোহা বি’ষন্ন গলায় বলল,
“আমার ক’ষ্ট হচ্ছে জেনেও তুমি চলে গেলে? তুমি এতটা নি’ষ্ঠুর কীভাবে হলে আব্বু?

#চলবে

অবিবাহিত বউ পর্ব-১৯+২০

0

#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ১৯
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

ঘড়িতে বারোটা বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট বাকি। অন্য দিনের মতো তোহা আজকে ঘুমিয়ে যায়নি। অপেক্ষা করছে নাহিদের কলের জন্য। রাত বারোটা মানেই যেন কিছু সুন্দর অনুভূতি, কিছু রঙিন মুহূর্ত। তোহার কাছে এই পাঁচ মিনিট পাঁচ বছরের মতো লাগছে। কিছুতেই যেন সময় ফুরাচ্ছে না। তোহা ছটফট করতে লাগলো। বারবার মোবাইলে সময় দেখতে লাগলো। কিন্তু পাঁচ মিনিট যে শেষ হচ্ছে না। তোহা সিদ্ধান্ত নিল আজকে নাহিদকে কড়া করে বকে দেবে। কেন সে এতো রাত করে কল দেয়? কেন রাত বারোটার সময়ই তাকে কল দিতে হয়? কোন জায়গায় লেখা আছে, রাত বারোটার সময় কল দিয়ে প্রেমিকার সাথে কথা বলতে হয়? এটা কি কোনো নিয়ম? শুধু শুধু কেন এতো দেরি করে কল দিবে?

তোহা আবারো মোবাইলে সময় দেখে নিল। বি’রক্ততে কপাল কুঁচকে তাকালো। সময়টাও কি তার সাথে খেলা করছে? ষাট সেকেন্ডে এক মিনিট হওয়ার জায়গায় কি একশ বিশ সেকেন্ডে এক মিনিট হচ্ছে নাকি? বারোটা বাজার এখনও দুই মিনিট বাকি আছে। তোহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো এই দুই মিনিট যেন খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যায়।

অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজার কয়েক সেকেন্ড পরই তোহার ফোনটা বেজে উঠল। সেই সাথে তোহার হৃৎ’পিণ্ডটা তড়িৎ গতিতে লাফাতে লাগলো। তোহা আর এক মুহূর্ত বিল’ম্ব করল না। কলটা রিসিভ করে কানে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অপর পাশ থেকে নাহিদ বলে উঠল,
“এই বউ?

নাহিদ এমন মন মাতানো ডাকে আবেশে তোহার চোখ দুটো ব’ন্ধ হয়ে গেল। ইশ, লোকটা এতো সুন্দর করে, এতো মিষ্টি করে ডাকে কেন? নাহিদ এতো দেরি করে কল দেয় দেখে এতক্ষণ মনে যতো বি’রক্তি ছিল সব যেন এক নিমেষেই কর্পূরের মতো উড়ে গেল। বুকের ভেতর শুরু হলো ভালোলাগার এক আ’শ্চর্য তা’ন্ডব। যা তোহাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার রাজ্য। যেখানে শুধু দুটো মানুষের আবির্ভাব রয়েছে। আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। কোনো প্রানী নেই। আছে কেবল নাহিদ আর তোহা, তোহা আর নাহিদ। তোহা নাহিদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলল,
“হুম।

তোহার সাড়া পেয়ে নাহিদ মুচকি হাসল। মেয়েটা আজকাল বউ বলায় রেগে যাচ্ছে না। অবলীলায় তার বউ বলে সম্বোধন করাকে সমর্থন করে যাচ্ছে। নাহিদ বলল,
“তুমি আজকে ঘুমাও নি?

“উহু। ঘুম কিছুতেই আসছে না। আমি কতো চেষ্টা করলাম একটু ঘুমানোর জন্য। কিন্তু ঘুম যে আসছেই না। বারবার কেবল আপনার কথা মনে পড়ছে। আপনি আমার এ-কি সর্ব’নাশ করলেন বলুন তো?

তোহার এমন সর্ব’নাশ করার জন্য নাহিদের একটুও খারাপ লাগলো না। একটুও অনুশোচনা হলো না। বরং ভেতর ভেতর ভালোলাগার সৃষ্টি হলো। নাহিদ মুচকি হেসে বলল,
” তুমি জানো, তোমার এমন সর্ব’নাশ করার জন্য আমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আমার একটুও খারাপ লাগছে না।

“কি আ’শ্চর্য! আপনার খারাপ লাগছে না? কেন খারাপ লাগবে না? আপনি জানেন আপনার একটা কলের জন্য আমি কতোটা ছটফট করি, কতোটা অ’স্থির অ’স্থির লাগে? আপনার মুখ থেকে বউ ডাক শুনতে শুনতে এখন আমার বউ সাজতে ইচ্ছে করে। কি অ’দ্ভুত! আপনি ভাবতে পারছেন? যেই আপনাকে স’হ্য করতে পারতাম না এখন সেই আপনার জন্য আমার এতো পরিবর্তন।

নাহিদ আবারো মুচকি হাসল। এমন সুন্দর প্রাপ্তির জন্য বুকটা ভরে উঠছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত সুখ তার নামে লেখা হয়ে গেছে। নাহিদ মৃদু হেসে বলল,
“ভালোবাসা বড় অ’দ্ভুত। তাইতো তোমার এমন পরিবর্তন। তোমার বউ সাজার ইচ্ছে খুব শীঘ্রই পূরন হবে। আমি তোমায় আমার ঘরের বউ করে নিয়ে আসবো।

তোহা মুচকি হাসল। আচমকাই বলে উঠল,
“শুনুন।

“বলো।

তোহা শ্বা’স ফেলল। সম’স্ত লাজ, ল’জ্জা, সংকোচ ভুলে আচমকাই বলে উঠল,
“ভালোবাসি।

আক’স্মিক তোহার এমন অভাবনীয় কথায় খুশিতে আত্ম’হারা হয়ে নাহিদ কোনো প্রতি’ক্রিয়া করা ভুলে গেল। নাহিদ কোনো কথা না বলায় ধীরে ধীরে তোহার ল’জ্জা লাগছে। ল’জ্জা যেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে। তোহা ফট করে কলটা কেটে দিল। নাহিদ সৎবিৎ ফিরে পেয়ে দেখল ইতিমধ্যে কল বি’ছিন্ন হয়ে গেছে। নাহিদ মুচকি হেসে বলল,
“ইশ, বউটা কি সুন্দর করে বলল।
_____________

ভার্সিটিতে গিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নাহিদকে খুঁজতে লাগল তোহা।‌ কিন্তু আশেপাশে কোথাও নাহিদের দেখা পাওয়া গেল না। তোহার ভ্রুঁ কুঁচকে এলো। গেল কোথায় লোকটা? তোহা দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। ক্লাসের সামনে বারান্দায় রিয়া দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। রিয়া তোহাকে দেখে মিষ্টি হাসল। রিয়াকে হাসতে দেখে তোহাও সৌজন্যতা রক্ষা’র্থে হাসলো। ক্লাসে ব্যাগ রেখে এসে তোহা দেখল রিয়া বারান্দা থেকে এক দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কৌতুহল বশত তোহাও নিচের দিকে তাকাল। ওমনি মাঠের মাঝখানে ফাহিম, রনি, নাহিদকে দেখতে পেল। নাহিদের মোবাইলে কিছু একটা করছে। কয়েক সেকেন্ড পরই ফোনটা কানে লাগালো। নাহিদ ফোনটা কানে লাগানোর সাথে সাথে তোহার ফোনটা বেজে উঠলো।

রিয়া তোহার কাছাকাছি থাকায় ফোন বেজে উঠার শব্দে চমকে পেছনে তাকাল। তোহার ফোনে কল এসেছে দেখে খুব সহজেই বুঝে গেল ফোনটা নাহিদ করেছে। তোহা মোবাইলের স্ক্রি’নে নাহিদের নাম্বার দেখে চোখ তুলে রিয়ার দিকে তাকাল। দুজনের চোখাচোখি হতেই রিয়া বলল,
“কলটা রিসিভ করো। হয়তো নাহিদ ভাইয়া কল করছে।

তোহা মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে কল রিসিভ করল। ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে নাহিদ উ’দ্বিগ্ন ক’ন্ঠে বলে উঠল,
“কোথায় তুমি? আজকে কি ভার্সিটিতে আসবে না?

তোহা মুচকি হেসে বলল,
“আমি তো ভার্সিটিতে এসে পড়েছি। বর্তমানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনাকে দেখছি।

তোহার কথা শুনে নাহিদ চট করে উপরে তাকাল। মুহুর্তের মধ্যেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। তোহা চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। তা দেখে নাহিদ বলল,
“তুমি এতো ল’জ্জা পাও কেন?

তোহা এক শব্দে উত্তর দিল,
“জানিনা।

“আচ্ছা। ক্লাস শেষে গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো।

তোহা ‘আচ্ছা’ বলে রেখে দিল। রিয়া গভীর দৃষ্টিতে তোহাকে পর্যবেক্ষন করল। নাহিদের সাথে কথা বলার সময় তোহা যখন ল’জ্জায় চোখ ঘুরিয়ে নিল, মুখের মধ্যে যখন খুশির উচ্ছাস দেখা গেল সবই খুব নিপুণ ভাবে পর্যবেক্ষন করল রিয়া।

রিয়ার গভীর চোখ দুটো যে তোহাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে তা তোহা বুঝতেই পারল না। রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাহিদকে সে পাবে না জানে। তবে ওদের কোনো ক্ষ’তি চায় না। রিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিধাতা, তুমি ওদের সুখী করো।
__________

ছুটির পর তোহা গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর নাহিদ বাইক নিয়ে তোহার সামনে এসে দাঁড়াল। মুচকি হেসে বলল,
“বাইকে উঠো।

তোহার ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে বলল,
“কেন? কোথায় যাবো আমরা?

“তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসবো।

তোহা আর কথা বাড়ালো না। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নাহিদের বাইকে উঠে বসল।

আজকে অফিস শেষে তারেকুল বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিল। হঠাৎ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল তোহার ভার্সিটি ছুটি হওয়ার সময় হয়ে আসছে। তারেকুল গাড়ি ঘুরালো। ভার্সিটি থেকে তোহাকে নিয়ে একেবারে বাসায় ফিরবেন বলে। কিন্তু ভার্সিটির কাছাকাছি আসতেই তারেকুলের চ’ক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। রেস্টুরেন্টের সেই ছেলেটার বাইকে উঠে বসেছে তোহা। তোহা যে বলেছিল ছেলেটার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সেই কথাগুলো কি মিথ্যা ছিল?

তারেকুল আর ভাবতে পারল না। তোহা তাকে মি’থ্যা কথা বলেছে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু নিজের চোখকে ও যে অবি’শ্বাস করতে পারছে না। নাহিদ বাইক স্টা’র্ট দিলে তারেকুল নাহিদের পিছু পিছু গেল। নাহিদ তোহাকে বাসায় নামিয়ে চলে গেলে তারেকুলের গাড়ি এসে বাসার সামনে থামল। তোহা তারেকুলকে দেখে চমকে উঠল। বুকের ভেতর অজানা ভয় তা’ন্ডব চালানো শুরু করেছে। আব্বু কি তবে আমাদের দেখে ফেলেছে?

#চলবে

#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ২০
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

তারেকুল গাড়ি থেকে নামল। ধীর পায়ে তোহার সামনে দাঁড়িয়ে তোহার দিকে স্থি’র, শান্ত, শীতল দৃষ্টিতে তাকাল। তারেকুলের চোখে কোনো কঠোরতা নেই, কোনো ক্ষি’প্রতা নেই। তবুও তোহা শিউরে উঠলো। শুকনো ঢোক গিলল। আব্বুর অমন শান্ত, শীতল দৃষ্টি তার কাছে ভালো ঠেকছে না। হৃৎ’পিণ্ড ভয়ের কারণে দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। কিন্তু কিসের এতো ভয়? কিসের এতো অস্থি’রতা? আব্বু তো শান্তই আছে।

তোহা নানা ভাবে নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু অবুঝ, অবাধ্য মন যে কথা মানে না। মন বলছে কিছু একটা হবে। তারেকুল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েই বলল,
“বাসায় যাও মামনি।

তোহা মাথা নিচু করে বাসার ভিতরে চলে গেল। তারেকুল ও তোহার সাথে সাথে গেল। বাসার ভিতরে গিয়ে তোহা যখন নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল তখনই তারেকুল ডেকে উঠল,
“দাঁড়াও তোহা।

তোহা দাঁড়িয়ে পড়ল। বুকটা কেঁপে উঠছে। উফ, প্রেমে এতো যন্ত্র’ণা কেন? এতো ভয় কেন? তোহা শুকনো ঢোক গিলে পেছন ফিরে তারেকুলের দিকে তাকাল। তারেকুল শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি তো তোমায় মিথ্যে বলতে শিখাইনি মামনি। তাহলে আমায় কেন মিথ্যে বললে?

তারেকুলের এমন কথায় তোহার বুকটা হু হু করে উঠল। মনের মাঝে যেই ভয়টা দানা বেঁধে ছিল শেষ পর্যন্ত সেই ভয়টাই সত্যি হলো। আব্বু আমায় ভুল বুঝল? তোহা ছল’ছল দৃষ্টিতে তারেকুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তোমায় মিথ্যে কথা বলিনি আব্বু।

তারেকুল ক্ষানি’কটা হাসল। তোহা দুচোখ দিয়ে আব্বুর তাচ্ছি’ল্যের হাসি দেখল। বুকের ভেতরে ইতিমধ্যে রক্ত’ক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে। বুকটা ছিঁড়ে যদি আব্বুকে দেখাতে পারতাম। তাহলে হয়তো আব্বু বিশ্বাস করত আমি সেই দিন কোনো মিথ্যে কথা বলিনি। তোহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

সেদিন নাহিদ যখন তোহাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছিল তারেকুল সেদিন নাহিদের মুখটা না দেখলেও আজকে সরাসরি নাহিদের মুখটা দেখে ফেলেছে। সেই সাথে নাহিদের বাইকটাকেও চিনে ফেলেছে। তারেকুল দুচোখ বন্ধ করে শ্বা’স ফেলে বলল,
“তুমি সেইদিন কার বাইকে করে এসেছিলে? ছেলেটা কি তোমার ক্লাসের ছিল?

তোহা সেদিনের মতো আজকে মি’থ্যে কথা বলতে পারল না। দুপাশে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বুঝালো। তারেকুল আবারো হেসে বলল,
“তারপরও বলছো তুমি আমায় মিথ্যে কথা বলো নি?

তোহা আহত দৃষ্টিতে তারেকুলের দিকে তাকাল। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কি করে বিশ্বাস করাবে আব্বুকে? উফ, বুকের ভেতর কতো য’ন্ত্রণা হচ্ছে। তারেকুল তোহার দিকে ছল’ছল দৃষ্টিতে তাকাল। এতো আদর করে, এতো যত্ন করে ছোট থেকে তিল তিল করে গড়ে তোলা মেয়েটা তাকে মিথ্যে কথা বলছে? এ যে স’হ্য হচ্ছে না। তারেকুল বুকে পাহাড় সমান য’ন্ত্রণা নিয়ে চলে গেল।

তোহা থম মেরে ফ্লোরে বসে পড়লো। দুচোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। তোহা তারেকুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বলল,
“আমি তোমায় একটা মিথ্যে কথাই বলেছি আব্বু। আর কোনো মিথ্যে কথা বলিনি।

তোহার বলা কথাটা তারেকুলের কানে পৌঁছাল না। সে ততক্ষণে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছে। তোহা কতক্ষন নির্বাক হয়ে একই জায়গায় বসে রইল। কি করবে, কি করে আব্বুর ভুল ভাঙাবে কিছুই মাথায় আসছে না। চোখের সামনে আব্বুর ছল’ছল চোখ জোড়া ভেসে উঠছে। তোহার চোখ জোড়া বারে বারে ভিজে উঠছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

কেন সেদিন ওই একটা মিথ্যে কথা বলেছিলাম? ওই একটা মিথ্যে, ওই একটা মিথ্যেই এভাবে কাল হলো? আব্বুর সামনে আমাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করে দিল? অথচ মানুষ কতো অবলীলায় হাজারো মি’থ্যে কথা বলে যাচ্ছে। কই, তাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে আমার বেলায় কেন ওই একটা মিথ্যেই আমার কাল হলো? বিধাতা কেন এতো নি’ষ্ঠুর হলো?

তোহা উঠে দাঁড়াল। দুহাত দিয়ে চোখে পানি গুলো মুছে ফেলল। না, এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। আব্বুর ভুল ভাঙাতে হবে। তোহা গুটি গুটি পায়ে তারেকুলের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারেকুলের রুমের দরজায় ধা’ক্কা দিয়ে কান্না’মিশ্রিত ক’ন্ঠে বলল,
“আব্বু দরজাটা খুলো। আমার কথাটা প্লিজ শোন। আমি তোমায় মি’থ্যে কথা বলিনি আব্বু। আমার কথাটা একটু শুনো।

তোহা নিরাশ হলো। আম্মু নিশ্চয়ই রুমে আছে। হয়তো বা আব্বুর চোখ রাঙানিতে দরজা খোলার সাহস পাচ্ছে না। তোহা বি’ষন্ন মনে রুমের দিকে পা বাড়ালো। শরীরটা ভীষণ ক্লা’ন্ত লাগছে। মন চাচ্ছে ছোট বেলার মতো চিৎকার করে কান্না করতে। কিন্তু বড় হয়ে গেলে যে চিৎকার করে কাঁদতে নেই।
_________

তোহা বিছানায় শুয়ে আছে। মনের মাঝে ছিটে ফোঁটা ও আনন্দ নেই। চোখে কোনো ঘুম নেই। অথচ তার তখন এগারোটা পাড় করে বারোর ঘরে পৌঁছাচ্ছে। তোহা নির্নি’মেষ শূন্যে তাকিয়ে আছে। সকালেই যা নাস্তা করেছিল। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত মুখে কিছু তুলে নি। তুলবে কি করে? মন যে কোনো কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। তোহার আম্মু কয়েকবার খাওয়ার জন্য ডাকতে আসলেও তোহা ডিরেক্ট মানা করে দিছে।

ঘড়িতে যখন কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজলো ঠিক তখনই নিস্ত’ব্ধ রুমে বিকট শব্দে তোহার মোবাইলটা বেজে উঠল। তোহা মোবাইলটা হাতে নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে নাহিদের নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইল। কল রিসিভ করার কোনো তাড়া দেখা গেল না মুখ মন্ডলে। তখনই ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। তোহা দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাখলো।

কয়েক সেকেন্ড পর মোবাইলটা আবারো বেজে উঠল। তোহা এবার আর দেরি করল না। মোবাইলটা বেজে উঠার সাথে সাথেই কল রিসিভ করে কানে দিল। ওপাশ থেকে হাস্যে’জ্জল ক’ন্ঠে নাহিদ বলে উঠল,
“ঘুমিয়ে পড়েছিলে বুঝি?

তোহা বি’দ্রুপ করে হাসল। ঘুম যে কিছুতেই চোখে ধরা দিচ্ছে না। তোহা দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে মলিন ক’ন্ঠে বলল,
“না, ঘুমাইনি।

তোহার এমন মলিন কন্ঠ শুনে নাহিদের ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে এলো। হুট করে এমন করে কথা বলার কারণ বুঝতে পারল না। উ’দ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে তোহা? তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন?

তোহা দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে এতো দিনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বলল। রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে ওই দিনের মি’থ্যে কথা বলাটা, আজকে তারেকুল দুজনকে একসাথে দেখা ফেলা সব কিছু বলল। বলতে বলতে তোহার চোখ দুটো আবারো ছল’ছল করে উঠল। কাতর স্বরে বলল,
“জানেন, আমি আব্বুকে খুব ভালোবাসি। আব্বু এমন ভুল বুঝে আছে দেখে আবার খুব ক’ষ্ট হচ্ছে। আমি কি করে আব্বুর ভুল ভা’ঙাবো?

সবকিছু শুনে নাহিদ স্ত’ব্ধ হয়ে গেল। তোহার ক’ন্ঠ শুনে ইতিমধ্যে বুঝে গেছে মেয়েটা তার আব্বুকে অনেক ভালোবাসে। এর মধ্যেই তোহার ফুঁপিয়ে উঠার শব্দ পেল। মেয়েটা কি তাহলে কাঁদছে? নাহিদ উ’দ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“এই তোহা কাঁদছো কেন? দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আব্বু তোমায় আগের মতোই বিশ্বাস করবে। এভাবে কাঁদে না বউ।

নাহিদের অমন আ’হ্লাদী কথায় তোহার কান্নার গতি কমার বদলে আরো বেড়ে গেল। তা শুনে নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আবারো বলে উঠল,
“আহা, কান্না থামাও। দেখো এভাবে কান্না করলে কোনো সমাধান হবে না। কান্না থামিয়ে কোনো সমাধান বের করার চেষ্টা করো।

নাহিদের কথায় তোহার কান্নার গতি কিছুটা কমে এলো। নাহিদ স্ব’স্তির শ্বা’স ফেলে বলল,
“সারাদিন খাবার খেয়েছো নাকি খাবারের কথা ভুলে এমন মনমরা হয়ে ছিলে?

খাবারের কথা শুনে তোহা নাহিদকে আগে থেকেই সাবধান করে বলল,
“আপনি আমাকে এখন একদম খাওয়ার কথা বলবেন না। আমি কিছুতেই খাব না।

তোহার কথায় নাহিদ মুচকি হাসল। মেয়েটা ধরেই নিয়েছে নাহিদ এখন তাকে খাওয়ার জন্য জোর করবে। তবে নাহিদ জোর করল না। তোহাকে বলল,
“ঠিক আছে খেতে হবে না। অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমাতে হবে। দেখি চোখ দুটো ব’ন্ধ করো তো দেখি।

নাহিদের কথামতো তোহা চোখ দুটো ব’ন্ধ করল। নাহিদ আবারো বলে উঠল,
“একদম চোখ খুলবে না। চুপ করে চোখ বন্ধ করে রাখবে। দেখবে ঘুম চলে আসবে।

তোহা নাহিদের কথা শুনল। কোনো কথা বলল না। নাহিদ কল না কেটে তোহার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে লাগলো। ধীরে ধীরে যখন তোহার নিঃশ্বাসের শব্দ ভারী হয়ে আসতে লাগলো নাহিদ তখন বুঝতে পারল তোহা ঘুমিয়ে গেছে। তবুও নিশ্চিত হতে ডাকল,
“বউ।

ঘুমের ঘোরে তোহার আনমনে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
“হুম।

তোহার কথায় নাহিদ হেসে উঠল। যখন বুঝল হাসির শব্দে তোহার ঘুম ভেঙ্গে যাবে তখনই কলটা কেটে দিল। হাসি থামিয়ে বলল,
“বউটা ব’ড্ড ভালো।

#চলবে