সুখেরও সন্ধানে পর্ব-৪+৫

0
304

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৪]

সকাল সাড়ে নয়টা। নিজের চেয়ারে বসে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ফাইল চেক করছে অনুভা। তখনি অফিসে এসে পৌঁছালো তানিম। সকলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম জানালো। সালামের উত্তর নিয়ে নিজ কেবিনে গিয়ে প্রবেশ করল তানিম। আধ ঘণ্টা পার হতেই ভেতরে ডাক পড়ল অনুভার। টেবিল থেকে ফাইলগুলো নিয়ে তানিমের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো অনুভা। অনুমতি চাইলো,“আসবো স্যার?”

“আসুন।”

বড়ো বড়ো কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে ভেতরে ঢুকলো অনুভা। টেবিলের উপর তানিমের সম্মুখে রাখলো ফাইলগুলো। বললো,“ফাইলগুলো চেক করা শেষ স্যার। যা যা সমস্যা ছিলো সমাধান করে দিয়েছি।”

“ইম্প্রোভ হচ্ছে তবে? বেশ ভালো।”

“ডেকেছিলেন কেন স্যার?”

“ফাইলের জন্যই ডেকেছি। এবার আপনি যেতে পারেন।”

বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উল্টো ঘুরে দুয়েক কদম এগোতেই পেছন থেকে তানিম বেশ গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে ওঠে,“মিস.অনুভা।”

পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ায় অনুভা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। প্রত্যুত্তর করে,“জ্বি স্যার?”

“বাড়ি থেকে অফিসে যাতায়াতে কী আপনার খুব বেশি অসুবিধে হয়?”

“না তো স্যার। অফিস থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব তেমন বেশি নয়। অসুবিধে হবে কেন?”

ললাটে ভাঁজ পড়ে তানিমের। ভ্রু উঁচিয়ে ফের শুধায়,
“তাহলে নাহিয়ানের সঙ্গে কী আপনার অন্য কোনো সম্পর্ক আছে?”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই চোখেমুখে বিষ্ময় ছাপিয়ে ওঠে অনুভার। এ আবার কেমন প্রশ্ন? তার জানামতে অফিসে এসে নাহিয়ানের সঙ্গে এমন কোনো আচরণ সে করেনি যার কারণে স্যারের এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। উত্তরের আশায় ওৎঁ পেতে বসে আছে তানিম। বোঝার চেষ্টা করছে অনুভার ভাবভঙ্গি। হ্যাঁ শুনলেই যেনো শুরু করে দিবে ধ্বংসলীলা। কিছুটা সময় নিয়ে অনুভা পাল্টা প্রশ্ন করল,“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”

“আজকাল নাহিয়ান আপনাকে বাড়ি থেকে অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে আবার ফেরার সময়ও দেখি আপনার জন্য অপেক্ষা করে তাই আরকি জানতে চাইলাম। এ নিয়ে তো অফিসে একেকজনের একেক মত। কানে এলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। যতই হোক আমার অফিসের একজন কর্মচারী আপনি।”

চাপা ক্রোধে ফেটে পড়ল অনুভা। কঠিন স্বরে উত্তর দিলো,“উনি আমার পরিচিত স্যার। সেদিন পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল বিদায় আসার পথে আমাকেও উনি সঙ্গে করে অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন, ব্যস এতটুকুই।”

“সত্যি এতটুকুই? শুধুই কী পরিচিত?”

এই বস নামক লোকটিকে এমনিতেই অনুভার নিকট অসহ্য লাগে। অকারণেই সকলের সামনে অন্যকে ছোটো করে কথা বলতে, খারাপ আচরণ করতেও দুবার ভাবে না তানিম নামক পুরুষটি। তার উপর এখনকার ব্যবহার যেনো খুবই বিরক্তিকর লাগছে অনুভার। ইচ্ছে করছে মুখের উপরই কড়া করে বলে দিতে,“যার সঙ্গে ইচ্ছে তার সঙ্গেই আমি অফিসে আসবো। সে আমার যা ইচ্ছে লাগুক তাতে তোর কী?” নির্ঘাত চাকরি যাবে তাই মুখ ফোটে বলতে পারলো না কথাটা। মনের কথা মনের ভেতরে রেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“নাহিয়ান ভাই আমার বড়ো ভাইয়ের মতো। এই চাকরিটার সন্ধানও উনিই আমায় দিয়েছিলেন। তাই উনার সঙ্গে কথা বলা, আসা-যাওয়াটা স্বাভাবিক স্যার।”

তানিমের মুখভঙ্গি এবং কণ্ঠস্বর এবার যেনো বদলালো। কণ্ঠে নম্রতা এঁটে বললো “ওহ। আচ্ছা এবার তাহলে আপনি যান। আর হ্যাঁ আপনি চাইলে কিন্তু অফিসের গাড়ি ব্যবহার করতেই পারেন। ড্রাইভারকে না হয় আমি বলে দিবো আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কথা।”

“তার প্রয়োজন নেই স্যার। বলার জন্য ধন্যবাদ।”

আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে নিজ ডেস্কে চলে গেলো অনুভা। সে যেতেই তানিম মুচকি হাসলো। দৃষ্টি স্থির করল সামনে থাকা ল্যাপটপে।

বড়ো একটা ক্লাসরুমে বসে আছে নবীন শিক্ষার্থীরা। কারোর জন্য অপেক্ষা করছে তারা। আজ তাদের ভার্সিটি লাইফের দ্বিতীয় দিন। তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল কালো স্যুট বুট পরিহিত সুদর্শন একজন পুরুষ। টেবিলের উপর হাতের বইটা রেখে উচ্চ স্বরে বললো,“গুড মনিং স্টুডেন্ট।”

বিপরীতে সকলেই সম্মলিত কণ্ঠে বলে উঠলো,“গুড মর্নিং।”

শিক্ষার্থীদের উৎসুক ভাব দেখে ঠোঁটের কার্নিশে হাসি ফোটে উঠলো সম্মুখে দাঁড়ানো পুরুষটির। নিজের পরিচয় দেওয়ার উদ্দেশ্যে অধর নাড়িয়ে বিনয়ী কণ্ঠে বললো,“আমি শেখ মাহাথির শ্রাবণ। আজ থেকে আপনাদের কেমিস্ট্রি লেকচারার।”

আবারো শিক্ষাথীদের মধ্য থেকে হৈ হৈ শব্দ ভেসে এলো। পরিচয় পর্ব শেষ করে ক্লাস নেওয়া শুরু করল শ্রাবণ। কয়েক মিনিটেই ক্লাসরুম ভর্তি নব্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিলো। সহজ টপিক দিয়ে শুরু করল আজকের লেকচার।

কয়েক বেঞ্চ পেছনে বসা তিনজন তরুণীর দল। ক্লাসে তাদের নেই কোনো মনোযোগ। তিনজনের মধ্যেই চলছে ফিসফিসানি। দৃষ্টি স্থির সামনে দাঁড়িয়ে লেকচার দেওয়া শ্রাবণের পানে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তারা ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করছে। চোখেমুখে কাজ করছে আকর্ষণীয়তা। যা দৃষ্টি এড়ায়নি শ্রাবণের। আড়চোখে তাদের পানে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,“এটা প্রাইমারি স্কুল নয় যে ক্লাসের মধ্যেই নিজেদের ইচ্ছামতো কথা বলবেন আপনারা। আর না আপনারা অবুঝ শিশু যে দিক বেদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজেদের মতো চলবেন। আমার ক্লাসে পড়া বিষয়ক কথা ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ আমি এলাউ করবো না। তাই সবাই সাইলেন্ট।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই পুরো ক্লাসরুমে নিস্তব্ধতা ভর করল। মেয়ে তিনজন একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে নত করে নিলো মাথা। ক্লাস শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো শ্রাবণ। নিজের টিচার্স রুমের কাছাকাছি এসে পৌঁছাতেই পেছন থেকে এলো এক মেয়েলী কণ্ঠস্বরের ডাক,“স্যার! মাহাথির স্যার?”

পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে গেলো শ্রাবণ। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে পেছন ফিরে তাকালো।দেখতে পেলো ক্লাসের সেই তিনজন মেয়েকে। তাদের মধ্য থেকে এগিয়ে এলো একজন। চোখেমুখে তার আনন্দ চিকচিক করছে। এগিয়ে এসে আন্তরিকতা নিয়ে বললো,“স্যরি স্যার।”

“কেন?”

“তখন ক্লাসে বিরক্ত করার জন্য। আমি বুঝেছি আপনি যে আমাদের মিন করেই কথাটা বলেছেন।”

মেয়েটির কথায় বাম ভ্রু টা আরেকটু উঁচু হলো শ্রাবণের। মেয়েটি যে চতুর এবং তার সাথে অতি আন্তরিক তা বেশ বুঝতে পারলো সে। শান্ত কণ্ঠে বললো,“ইটস্ ওকে। পরবর্তীতে এমনটা যেনো আর না হয়।”

“জ্বি স্যার আর হবে না।”এতটুকু বলেই মেয়েটির অধরে হাসি ফোটে উঠলো। উৎসাহিত কণ্ঠে পুনরায় বললো,
“আমার নাম সামিরা। আমার ভাইয়া গত বছরই এই ইউনিভার্সিটি থেকে গ্ৰাজুয়েশন কমপ্লিট করে বের হয়েছে। ভাইয়ার মুখে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি স্যার। তাই আপনি যখন ক্লাসে ঢুকে নিজের পরিচয় দিলেন তখনি চমকে গেছিলাম তাই আরকি তখন।”

মুচকি হাসলো শ্রাবণ। বললো,“বুঝেছি ব্যাপারটা। তা নাম কী আপনার ভাইয়ের?”

“সিয়াম।”

“ওহ, আচ্ছা এখন তবে ক্লাসে যান।”

মাথা নাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করল সামিরা। সিয়াম নামটা মোটেও চেনাচেনা ঠেকলো না শ্রাবণের নিকট। না চেনাটাই স্বাভাবিক। সেও এখানে জয়েন করেছে গত বছর। তার উপর একেকটা ইয়ারে এত এত শিক্ষার্থী। সবার মধ্য থেকে একজনকে মনে রাখা খুবই দুষ্কর ব্যাপার। সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে টিচার্স রুমে ঢুকে পড়ল সে।

মিলি এবং তোহা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সামিরা আসতেই দুজনে তাকে চেপে ধরলো। আগ্ৰহ নিয়ে শুধালো,“কী কথা বললি স্যারের সঙ্গে?”

“স্যরি বলেছি।”

“আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতি। আমরাও স্যরি বলতাম।”—-মুখ গোমড়া করে কথাটা বলে উঠলো তোহা।

বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নিলো সামিরা। বিপরীতে প্রশ্ন করল,“তোদের আবার স্যরি বলতে হবে কেন?”

মিলির চোখেমুখে ফোটে উঠলো লাজুকতা। ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,“স্যার কিন্তু হ্যান্ডসাম আছে দোস্ত। কত স্বপ্ন দেখেছি প্রেম করলে জীবনে একটা হ্যান্ডসাম স্যারের সঙ্গেই করবো। কিন্তু কী এক কপাল? স্কুলে পড়াকালীন সব কয়টা স্যার ছিলো বয়স্ক। কলেজে অবশ্য দুজন কম বয়স্ক স্যার ছিলো তবে দুজনই বিয়াইত্তা। আর হোম টিউটরের কথাই বা কী বলবো? আমায় এত্তগুলা পড়া দিয়ে সে সময়টায় ব্যাটা নিজের গফের সঙ্গে মোবাইলে লুতুপুতু করতো।”

মিলির কথায় সামিরা, তোহা দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ হাসার পর চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো সামিরার। শাসানোর সুরে বললো,“সে যাই হোক।মাহাথির স্যারের দিকে অন্তত আজেবাজে নজরে একদম তাকাবি না।”

“কেন কেন?”

“কারণ এদিকে যে অনেক আগেই আমার নজর পড়ে গেছে। ভাইয়ার মোবাইলে প্রথম উনার ছবি দেখেছিলাম আর তারপর ভাইয়ার থেকে উনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেই আমি উনার প্রেমে ভীষণ রকমের হাবুডুবু খাচ্ছি। এখানে এডমিশন নেওয়ার কারণও মূলত উনিই। আশা করি বুঝতে পারছিস সবটা?”

দুজনেই মাথা নাড়ালো অর্থাৎ তারা বুঝতে পেরেছে।
_______

লাঞ্চ টাইম হতেই ক্যান্টিনে এসে একটা টেবিলে বসেছে অনুভা। তখনি তার সামনের চেয়ারটা দখল করে নিলো নাহিয়ান। স্বভাবসুলভ ভাবে তার ঠোঁটের কার্নিশে বিস্তর হাসি। উৎসুক কণ্ঠে অনুভার নিকট প্রস্তাব রাখলো,
“চলো অনু, আজ একসঙ্গে লাঞ্চ করি।”

অনুভার চোখেমুখে সন্দেহ। জিজ্ঞেস করল,“রোজ তো স্যারের সঙ্গেই করেন তাহলে আজ এখানে? স্যার কোথায়?”

“স্যার নাকি এখন খাবেন না।দুদিন পর একটা মিটিং আছে না? সেটা নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করছেন।”

“ওহ।”

ক্যান্টিনের ছেলেটা ততক্ষণে খাবার নিয়ে হাজির হলো। অনুভার ভেতরে ইতস্ততবোধ কাজ করছে। কিছু বলার জন্য হাঁসফাঁস করছে মন। নিজের মনে কথাগুলো গুছিয়ে এবার বলেই বসলো,“একটা কথা ছিলো ভাইয়া।”

খেতে খেতেই নাহিয়ান প্রত্যুত্তর করল,“কী?”

“মানুষের ভাবনা না আজকাল খুব বাজে হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে কথা বলতে দেখলেই তাদের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক বানিয়ে দেয়। অথচ তাদের মধ্যে আসলে সম্পর্কটা যে কী সেটাই জানতে চায় না।”

“তা অবশ্য ঠিক বলেছো।”

“পরিবারের দুর্যোগে যখন আমার দিশেহারা অবস্থা। হন্যে হয়ে একটা ভালো চাকরি খুঁজতে ব্যস্ত আমি তখন আপনিই আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমার অবস্থা সম্পর্কে জেনে পাইয়ে দিয়েছিলেন এই চাকরিটা। সেকথা কী করে ভুলি বলুন তো? তখন থেকেই আপনাকে আমি নিজের বড়ো ভাইয়ের আসনে বসিয়েছি।আমার কোনো ভাই থাকলে হয়তো আজ সেও আপনার মতোই আমার এই উপকারটা করতো। কিন্তু অফিসের লোকজন যেনো তা মানতে নারাজ।ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে একটু কথা বললেই তাদের মধ্যে নোংরা সম্পর্ক বানিয়ে দিতে দুবার ভাবে না এরা।”

খাওয়া থেমে গেলো নাহিয়ানের। শুধালো,“হঠাৎ এসব কথা? কেউ কী কিছু বলেছে তোমায়? কে বলেছে? কী বলেছে? নাম বলো তার।”

অনুভা মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো,“স্যার বলেছেন।”

চমকালো নাহিয়ান। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে শুধালো, “স্যার!”

“আপনি আসার পথে দুদিন ধরে আমায় অফিসে নিয়ে এসেছেন সে কারণেই উনার সন্দেহ হয়েছে।”

“সন্দেহের কী আছে? অফিসে অন্য সবার সঙ্গে যেমন আচরণ করি তোমার সঙ্গেও তো ঠিক তেমন আচরণই করি। বাহিরের খবর উনিই বা জানলেন কী করে?”

“বললেন তো অফিসের ইমপ্লয়ীদের নাকি এ ব্যাপারে বলতে শুনেছেন।”

এবার ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক নিলো নাহিয়ান। দুষ্টু হেসে বললো,“ওদের ধারণাটা সত্যি করে দিলে কিন্তু মন্দ হয় না অনু।”

“মানে?”

“হেল্প করেছি বলেই যে আমাকে ভাই ভাবতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ওই যে সিনেমায় দেখো না, নায়ক এসে নায়িকাকে হেল্প করে তারপর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়‌। কিন্তু আমার তো প্রেমের সেই বয়সটা আর নেই। তাছাড়া তুমিও তো প্রেমট্রেম করবে না তাই চলো দুজনে একেবারে বিয়ে করে ফেলি।”

ভড়কে গেলো অনুভা। চোখেমুখে হানা দিলো স্পষ্ট ভয়। ঘাবড়ানোর সুরে জিজ্ঞেস করল,“এসব কী বলছেন ভাইয়া?”

অনুভার মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো নাহিয়ান। পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তুলতে বললো,“সিরিয়াস হয়ো না অনু। সবাই কীসব ভাবছে সেসব ভেবেই আমি তোমার সঙ্গে মজা করেছি।”

“ওহ।”

তৎক্ষণাৎ কথাটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে নিলো অনুভা। কোনোমতে খেয়ে স্থান ত্যাগ করল। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে মলিন হাসলো নাহিয়ান। কথাটা কী আদৌ সে মজার ছলে বলেছে? না তো। এই মেয়েটাকে যে শুরু থেকেই খুব পছন্দ করে সে।

অনুভারা প্রথমে যেই বাসায় ভাড়া থাকতো সেই একই বাসাতেই পাশাপাশি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতো নাহিয়ান আর তার পরিবার। তার মা ছিলো খুব মিশুক একজন মানুষ। সুফিয়ার সঙ্গেও অল্প সময়ের মধ্যেই করে নিয়েছিল ভাব। যার কারণে একজন আরেকজনের ফ্ল্যাটে আসা যাওয়া লেগেই থাকতো প্রায়সই। সেখান থেকেই নাহিয়ানের সঙ্গে অনুভার পরিচয়।

নাহিয়ান সবসময় কথা বলতে চাইলেও অনুভা ভদ্রতা সূচক দুয়েকটা কথা বলে এড়িয়ে চলতো তাকে। গল্পের ছলেই সুফিয়ার থেকে তাদের পরিবারের বর্তমান দুরাবস্থার কথা হয়তো জানতে পারেন নাহিয়ানের মা কুলসুম বেগম।

একটা দুর্ঘটনায় অর্ধেকটা শরীর প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় পড়ে যান কামরুল হাসান। তার মধ্যেই হঠাৎ করে বাঁধিয়ে ফেলেন ক্যান্সারের মতো একটি মারাত্মক ব্যাধি। অনুভাদের পরিবার যেনো পড়ে যায় এক অথৈ সাগরে। তাদের সঙ্গে এমন কেন ঘটলো তা নাহিয়ানের অজানা। মায়ের নিকট থেকে যতটা শুনেছে ততটুকুতে বুঝতে পেরেছে পরিবারটা ভালো নেই। শ্বশুরের এমন অবস্থায় শ্বশুরবাড়ির সকল দায়িত্ব তন্ময় নিতে চাইলেও কামরুল হাসান মেয়ে জামাইয়ের সাহায্য নিতে নারাজ ছিলেন। অনুভাও ছিলো বাবার সঙ্গে একমত।তখন বাবা-মায়ের দায়িত্ব এসে পড়ে তার উপর। তারপর শুরু হলো অনুভার চাকরি খোঁজাখুঁজি কিন্তু ভালো কোনো চাকরিই যেনো খুঁজে পাচ্ছিল না সে। ততদিনে অনার্সটাও কমপ্লিট হয়নি তার। অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলো। একসময় তন্ময় নিজেই পরিচিত একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা এনজিওতে চাকরি পাইয়ে দেয় শালীকাকে। যা বেতন পেতো তা দিয়েই কোনোমতে বাবার চিকিৎসাসহ, সংসারের সকল দায়িত্ব এবং নিজের লেখাপড়াটাও চালিয়ে নিতে লাগলো অনুভা। তার মাস আটেক পরেই তো তন্ময়ের সঙ্গে ঘটে সেই নির্মম দুর্ঘটনা। তখন সবে ফাইনাল পরীক্ষাটা দিয়েছে অনুভা। দুলাভাইয়ের মৃ’ত্যুর পর বোন আর বোনের সন্তানের দায়িত্বও এসে পড়ে মেয়েটার উপর।

কী করবে দিক বেদিক ভুলে বসে অনুভা।এক কথায় হয়ে ওঠে দিশেহারা। এনজিও থেকে যা বেতন পায় তা দিয়ে এতগুলো মানুষের ভরণ পোষণসহ বাদ বাকি খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে যেনো তখনি মাটি চাপা দিয়ে দিতে হয় মেয়েটার। পরিবারের একমাত্র ঢাল, ভরসা যে সে-ই। একটু একটু করে বিসিএসের জন্য যা প্রস্তুতি নিয়েছিল তাও ভুলে বসেছিল ততদিনে। এতো এতো জোট ঝামেলায় কী আদৌ সবদিক রক্ষা করা সম্ভব?

সুফিয়ার অবস্থাও তখন খারাপ হয়ে যায়। একদিকে বিধবা মেয়ে আর নাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা তার সঙ্গে অসুস্থ স্বামী তো আছেই। আরেকদিকে ছোটো মেয়ের জন্য চিন্তা। কী করে সবদিক সামাল দিবে মেয়েটা? চিন্তায় চিন্তায় শরীরে বাঁধিয়ে ফেলেন বিভিন্ন ব্যাধি। কুলসুম বেগম তখন বেশিরভাগ সময় পরে থাকতেন সুফিয়ার কাছে। বিভিন্ন ভাবে ভরসা দিতেন উনাকে। বোঝাতেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

প্রায়সই স্বামী এবং ছেলের সামনে এসব বিষয় নিয়ে আফসোসও করতেন কুলসুম। সেখান থেকেই অনুভাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয় নাহিয়ান। মেয়েটাকে তার শুরু থেকেই ভালো লাগতো। যেনোতেনো নয় বরং মারাত্মক ভালো লাগতো। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করেই সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো তাকে এক পলক দেখার জন্য। যখন তার এই দুরাবস্থার কথা জানতে পারে তখনই বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। অফিসে তখন নতুন কর্মচারীর খোঁজে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই অনুভাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য অফিসে নিয়ে আসে নাহিয়ান। যদিও নিজ যোগ্যতার মাধ্যমেই চাকরিটা পেয়েছিল অনুভা।
________

বিকেলের দিকে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরলো শ্রাবণ। নিজ কক্ষে প্রবেশ করতেই খানিক অবাক হলো। সৌহার্দ্য বসে আছে তার বিছানায়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণ ধরে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল সে। কয়েক সেকেন্ড ছোটো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আলমারির কাছে চলে গেলো শ্রাবণ। নিজের পোশাক বের করে তারপর প্রবেশ করল বাথরুমে। বেশ সময় নিয়ে পোশাক বদলে বেরিয়ে আসতেই পুনরায় মুখোমুখি হলো ভাইয়ের। সৌহার্দ্য কটাক্ষ করে বড়ো ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“তোমার পোশাক বদলাতে মেয়েদের মতো এত সময় লাগে কেন?”

“কী বলতে এসেছিস সেটা বল।”

“আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তুমি কী এটা ঠিক করলে ভাইয়া? তুমি জানতে না প্রান্তির কথা? তাহলে বাবা- মায়ের সামনে কাল কেন এসব বললে?”

“তুই কেন তাদের কানে আমার বিয়ের কথা ঢুকিয়েছিলি?”

থতমত খেয়ে গেলো সৌহার্দ্য। আমতা আমতা করে বললো,“তোমার বিয়ে না হলে তো আমার বিয়ের কথা কেউ ভাববেই না। আর কতকাল বউ ছাড়া এভাবে এতিম হয়ে বসে থাকবো বলো তো?”

“বড়ো ভাইয়ের সামনে এসব বলতে লজ্জা করে না?”

“নাহ করে না।”

“তোর উচিত ছিলো সমস্যাটা আমায় এসে জানানো। তাহলে আমি সমাধান করে দিতাম কিন্তু তুই বাবা- মায়ের কান ভাঙিয়েছিস। এবার নিজেরটা নিজে গিয়ে বুঝে নে। বাবা-মায়ের সামনে ভালো সাজা! আরো ভালো সেজে এবার বিয়েটাও করে নে।”

“সে যাই হোক। মা সকাল থেকে আমার পেছনে পড়ে আছে। বারবার বলছে, চল তোর রুবি খালার বাড়িতে। একবার মেয়েটাকে তো দেখ।”

“তো দেখে আয়।”

“কেন দেখবো? আমি কি বেঈমান নাকি? তাছাড়া প্রান্তি জানলে আমার নামে মামলা করে দিবে।”

সন্দেহ নিয়ে ভাইয়ের মুখশ্রীর পানে তাকালো শ্রাবণ। শুধালো,“মামলা করবে কেন? ওর সঙ্গে আজেবাজে কিছু করেছিস নাকি?”

“ছোটো ভাইকে এসব জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করে না তোমার?”

“ওহ, তার মানে কিছু করেছিস? দাঁড়া মাকে গিয়ে এখনি বলছি।”

আঁতকে উঠলো সৌহার্দ্য। বাঁধা দিয়ে বললো,“আরে কিচ্ছু করিনি। আমার কী মাথা নষ্ট নাকি?”

“তাহলে ঠিক আছে। এবার ঘর থেকে বের হ। আমি বিশ্রাম নিবো। সন্ধ্যায় বের হতে হবে।”

“কোথায় যাবে?”

“তোকে বলবো কেন?”

“সে না বলো কিন্তু আমার সমস্যার সমাধান তো করে দাও।”

“পারবো না।”—-বলেই ঘর থেকে সৌহার্দ্যকে টেনে বের করে দিয়ে দরজা আটকে দিলো শ্রাবণ।
________

অফিস আওয়ার শেষ হতেই ব্যাগ হাতে বের হতে যাবে অনুভা। তখনি তার পথ আটকে দাঁড়ায় তানিম। একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলে,“ফাইলটা রাখুন। ইমপোর্টেন্ট ফাইল। আশা করি সেদিনের ভুলটা এবার আর হবে না। যদি হয় তাহলে কিন্তু চাকরিটা আর থাকবে না বলে দিলাম।”

ফাইলটা হাতে নিলো অনুভা। শাণিত কণ্ঠে বললো,
“হবে না স্যার। এবার আর কোনো ভুল হবে না।”

“আচ্ছা যান তাহলে। ড্রাইভারকে আমি বলে দিয়েছি, বাড়ি পর্যন্ত আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

“বললাম তো স্যার, আমার বাড়ি বেশি দূরে নয়। আমি একাই যেতে পারবো। আল্লাহ্ হাফেজ।”

বিদায় নিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলো অনুভা। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখমুখ কুঁচকে নিলো তানিম। বিরক্তির সহিত বলে উঠলো,“ভাব বেশি।”

চলবে ________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৫]

আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ছুটির দিনে ফর্দ হাতে সাপ্তাহিক কাঁচা বাজার করতে বেরিয়ে পড়ে অনুভা। আজও তার ব্যতীক্রম ঘটলো না। সকাল সকাল বাজারের ব্যাগ হাতে চলে এসেছে বাজারে। বাবার এমন করুন অবস্থা হওয়ার পর থেকে এই কাজটাও নিজেকেই করতে হয় তার। শুরুর দিকে বাড়ির কেয়ারটেকারকে দিয়ে কাজটা করালেও লোকটার বাজার মোটেও পছন্দ হতো না সুফিয়ার। উনার মতে, লোকটা বাজারের অর্ধেক টাকা মেরে দিয়ে পঁচা শাক সবজি কিনে নিয়ে আসে। তাই বাধ্য হয়ে অনুভাকেই বাজার করতে হয়। বাজারের ফর্দ মিলিয়ে মিলিয়ে কাঁচা বাজার করা শেষ হতেই দুই হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে বের হতে লাগলো বাজার থেকে। এবার গন্তব্য মুদির দোকান।

হুট করে কেউ এসে একটা ব্যাগ ছিনিয়ে নিলো হাত থেকে। আঁতকে উঠলো অনুভা। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আগন্তুকের পানে তাকাতেই সহাস্যে মিলিয়ে গেলো ভয়। সামান্য আশ্চর্য হলো। ওষ্ঠদ্বয়ের কার্ণিশ বর্ধিত হলো। শুধালো,“তুমি?”

দ্বিতীয় ব্যাগটিও নিজের হাতে নিয়ে নিলো শ্রাবণ। চোখেমুখে তার গাম্ভীর্য। বুক টানটান করে আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে বললো,“তোমার শরীরে তো দেখছি অনেক শক্তি! তা কী খেয়ে এত শক্তিশালী হয়ে উঠলে নোভা?”

“তুমি এখানে কেন?”

“বাজারে মানুষ কেন আসে? অবশ্যই বাজার করতে এসেছি।”

“তোমার বাড়ির এলাকায় কী বাজার নেই? এতদূর এসেছো বাজার করতে?”

“বাজারটা কী তোমার ব্যক্তিগত সম্পদ নাকি যে বাড়ির এলাকা না হলে আসতেই পারবো না?”

“এমনটা কখন বললাম? ব্যাগ দুটো দাও।”

“এমনভাবে বলছো যেনো তোমার ব্যাগ নিয়ে আমি দৌড় দিয়ে পালাবো?”

নিরব হয়ে গেলো অনুভা। গাম্ভীর্যের মধ্যেই শ্রাবণের মুখশ্রীতে ফোটে উঠলো একফালি হাসি। মিহি স্বরে বললো,“মেয়ে মানুষের হাত থাকবে নরম তুলতুলে। যখন ছুঁয়ে দিবো তখনি কোমলতায় ছেঁয়ে যাবে শরীর ও মন। তাই আমি চাই না এসব ভারি কাজকর্ম করে তোমার হাত পাথরের ন্যায় শক্ত হোক।”

“এমন করে বলছো যেনো সবসময় তুমিই এই কাজটা করে দাও? রোজ শুক্রবারেই তো আমি বাজার করি।”

পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ালো শ্রাবণ। সন্দেহভাজন কণ্ঠে প্রশ্ন করল,“ব্যাগগুলোও কী তুমিই বহন করো?”

ভড়কে গেলো অনুভা। মনে করার চেষ্টা করল কিছু। মস্তিষ্কে বেশি চাপও প্রয়োগ করতে হলো না তার। সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে গেলো, প্রত্যেক শুক্রবার নিজে বাজার করলেও ব্যাগ তাকে বহন করতে হয় না। বাজার শেষে আগ বাড়িয়ে কোত্থেকে যেনো কোনো না কোনো লোক চলে আসে ব্যাগ বহন করার জন্য। অনুভা বাঁধা দিলেও তারা তার বাঁধা মানতে নারাজ। পারিশ্রমিক দিতে চাইলেও তা না নিয়েই চলে যেতো তারা। ঘটনাটা নিয়ে অতটা মাথা না ঘামালেও মনের গহীনে এখন ঠিক প্রশ্ন জাগলো, এই খবর শ্রাবণ জানলো কী করে?

পূর্বের ন্যায় আবারো সামনের দিকে হাঁটা ধরলো শ্রাবণ। তার পিছুপিছু অনুভাও হাঁটছে। বাজার পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই দেখা মিললো শ্রাবণের কালো গাড়িটার। গাড়িটা এখন সম্পূর্ণভাবে অনুভার পরিচিত। সেদিন রাতেই তো এ গাড়িতে করে তাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল শ্রাবণ। গাড়ির ডিকিতে বাজারের ব্যাগ গুলো রেখে অনুভার সামনে এসে দাঁড়ালো শ্রাবণ। হাত বাড়িয়ে বললো,“বাজারের ফর্দটা দাও।”

বিষ্মিত স্বরে অনুভা শুধালো,“তা দিয়ে তুমি কী করবে?”

“তুমি যা করছিলে তাই করবো। বেশি কথা আমার পছন্দ নয় তা তো জানোই। এবার ফর্দটা দাও।”

শ্রাবণের স্বভাব সম্পর্কিত ভালো ধারণাই আছে অনুভার। এর সঙ্গে এটাও জানে ছেলেটা বড্ড ঘাড় ত্যাড়া। কথা না বাড়িয়ে বাড়ানো হাতখানায় ফর্দটা তুলে দিলো। গাড়ির সামনের দ্বার খুলে অনুভার পানে গাঢ় দৃষ্টি রেখে শ্রাবণ বলে উঠলো,“লেখাপড়া ব্যতীত অন্য কোনো প্রশ্ন আমার মোটেও পছন্দ নয়। আমার অপছন্দনীয় কাজ করা মানুষও আমার পছন্দ নয়। নাও এবার গাড়িতে উঠে বসো। আমি আসছি।”

ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করে গাড়িতে উঠে বসলো অনুভা। সে যে এ নিয়েও হাজারটা প্রশ্ন করবে তা খুব ভালো করেই জানে শ্রাবণ। তাই আগে আগে এতগুলো লেকচার দিয়ে কায়দা করে মেয়েটাকে দমিয়ে রাখলো। দরজা লক করে সত্বর পায়ে চলে গেলো কোথাও। বিমূঢ় দৃষ্টি মেলে উদাস ভঙিতে বসে আছে অনুভা।

কয়েক মিনিট পার হতেই গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল শ্রাবণ। হাতে বেশ বড়োসড়ো একটা পলিথিন ব্যাগ। ব্যাগটা অনুভার কোলে দিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলো। অনুভা মিনমিনে স্বরে জিজ্ঞেস করল,“মোট কত হয়েছে?”

ড্রাইভ করতে করতেই পাল্টা প্রশ্ন এলো,“কী কত হয়েছে?”

“এগুলোর মোট দাম কত?”

প্রত্যুত্তর করল না শ্রাবণ। তার নিরুত্তর দেখে অনুভা ফের বললো,“না বললে টাকাটা দিবো কী করে?”

কেমন এক দৃষ্টিতে চাইলো শ্রাবণ। তার এমন চাহনির সঙ্গে পূর্ব পরিচিত নয় অনুভা। তবে ধের বুঝতে পারছে ছেলেটা যে চরম বিরক্ত হয়েছে এমন প্রশ্নে। কিন্তু কারো বিরক্তির ধার ধারলো না অনুভা। কণ্ঠে গাম্ভীর্য এঁটে বললো,“কী হলো বলছো না কেন?”

“এমন করছো যেনো তোমার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য আমি মরে যাচ্ছি? এই টাকা না পেলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে?”

“সেম কোয়েশ্চন তো আমিও করতে পারি।”

সশব্দে ভারি নিঃশ্বাস ত্যাগ করল শ্রাবণ। প্রসঙ্গ বদলে বললো,“অর্থিকা আপুর কী অবস্থা?”

“মোটামুটি ভালো।”

“তন্ময় ভাই মারা গেছে এটাই চরম সত্যি এবং বাস্তব।এভাবে তো চলতে পারে না। নিজের ছেলেটার প্রতি অন্তত উনার দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসা থাকা উচিত। বোন হিসেবে নিজের বোনের পাশে দাঁড়ানো তোমার কর্তব্য। সন্তান হিসেবে বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করাও তোমার কর্তব্য। তাই বলে একা একটা মেয়ের পক্ষে সবদিক সামলানো কী সম্ভব? নিজের দিকে একবার তাকিয়েছো?ভেবেছো নিজের কথা?”

চোখের দৃষ্টি নত হলো অনুভার। কোনো উত্তর নেই তার কাছে। আড়চোখে তাকে দেখে নিলো শ্রাবণ। পুনরায় বললো,“চোখের সামনে প্রিয় মানুষকে হারাতে দেখার যন্ত্রনা খুবই জঘন্য। উনি হয়তো এখনো মেনে নিতে পারেননি তন্ময় ভাইয়ের মৃ’ত্যুটা। আর কয়েক মাস অতিক্রম হলেই উনার মৃ’ত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়ে যাবে অথচ এখনো যদি আপু নিজেকে সামলে নিতে না পারে তাহলে উনার বড়ো কোনো ক্ষতি যে হয়ে যাবে না তার গ্যারান্টি কী কেউ দিতে পারবে? তাছাড়া বাচ্চাটারও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে তাই না? জন্মের পর বাবা হারিয়েছে এরপর মা হারালে?”

“আমার আর কী করার আছে? এই ট্রমা থেকে বের করে আনার জন্য কম চেষ্টা তো আর করছি না। সবসময় ঘরের এককোণে পড়ে থাকে। মাঝেমধ্যে কাউকে না বলে কয়েই চলে যায় দুলাভাইয়ের কবরের কাছে।”

“উনাকে ভালো একটা সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। এমন চলতে থাকলে পাগল হতে আর বেশি সময় লাগবে না।”

চকচকে দৃষ্টিতে শ্রাবণের পানে তাকালো অনুভা। এই কথাটা তো একবারও তার মাথায় আসেনি? না আসাটাই স্বাভাবিক। ছোট্ট মাথায় সবদিক চিন্তা করতে গেলে এমনটাই তো হবে। বাড়ির পথে এসে থেমে গেলো গাড়ি। অনুভা নেমে পড়ল। তার সাথে নামলো শ্রাবণও। ডিকি থেকে ব্যাগ দুটো নামিয়ে হাঁটা ধরলো সামনে।

পিছু ডাকলো অনুভা। চমকায়িত কণ্ঠে শুধালো,
“এই এই, তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“ছোটো মানুষ ভারি দুটো ব্যাগ নিয়ে গলি পার হয়ে সিঁড়ি ভেঙে ঘর পর্যন্ত যেতে পারবে না। পৌঁছে দিয়ে আসি।”

অনুভা বাঁধা দিয়ে বললো,“তার প্রয়োজন নেই।আমি পারবো যেতে।”

বাঁধা মোটেও মানলো না শ্রাবণ। তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,“চিন্তা নেই এতো তাড়াতাড়ি শ্বশুর বাড়িতে আমি ঢুকছি না।”

ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো অনুভার। পথিমধ্যে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। ততক্ষণে অনেকটা পথ হেঁটে সামনে এগিয়ে গেছে শ্রাবণ। টনক নড়লো অনুভার। দৌড়ে গিয়ে পা মেলালো শ্রাবণের সঙ্গে। বিষ্মিত স্বরে শুধালো,
“শ্বশুর! কে তোমার শ্বশুর?”

বিষ্ময়াভিভূত চাহনি শ্রাবণের। বিরক্তিতে আড়ষ্ট হলো। মেয়েটা কী কিছু বোঝে না? নাকি বোঝেও না বোঝার ভান করে থাকে? কঠিন স্বরে উত্তর দিলো,
“তোমার বাড়িওয়ালা।”

“বাড়িওয়ালার তো কোনো মেয়েই নেই।”

“তাহলে নিশ্চয়ই ছেলে আছে?”

“তা অবশ্য আছে।”

বলেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো অনুভা। টনক নড়ে উঠলো। কিছু একটা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই চিৎকার করে বলে উঠলো,“এই এই ছেলে আছে মানে? তুমি কী গে? আসতাগফিরুল্লাহ! গে হলে কবে থেকে?”

বিষ্ময়ে হতবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো শ্রাবণ। ছিহ্ কী বলে এই মেয়ে! কয়েক মুহূর্ত নিরব থেকে বললো,
“তোমার কথাবার্তা খুব বাজে হয়ে যাচ্ছে নোভা। আমি একজন মুসলিম পুরুষ। গে হতে যাবো কেন?”

“না মানে তুমিই তো জিজ্ঞেস করলে ছেলে আছে কিনা।”

সেসবে তোয়াক্কা করল না শ্রাবণ। অনুভার হাতে ব্যাগ দুটি ধরিয়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। তার আগে শাসিয়ে বলে গেলো,“এরপর আর যদি কখনো আমার সম্পর্কে বেফাঁস কথাবার্তা বলো তাহলে তোমার ওই মুখ খুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিবো।”

চুপসে গেলো অনুভা। পিছু ডেকে বললো “তুমি না বললে ঘর পর্যন্ত ব্যাগ দিয়ে আসবে?”

“তুমি কী বাচ্চা নাকি? নিজের কাজ নিজে করতে শিখো।”

“তুমিই তো বললে ছোটো মানুষ।”

“ভুল বলেছিলাম। ছোটো মানুষেরা এসব আবোল তাবোল কথা বলতে পারে না। আল্লাহ্ হাফেজ।”

অনুভাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো শ্রাবণ। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো অনুভা। ভুল জায়গায় কী ভুল কথা বলে ফেললো সে?হয়তো। কিন্তু শ্রাবণের কথা শুনে এই শব্দটাই তো তখন মাথায় এলো। অনুভা নিশ্চিত ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এই কথাটাই প্রথমে বলতো। আর কিছু না ভেবে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল সে।

শুক্রবারে পারভিনা কাজে আসে না।অনুভাও আসার জন্য কখনো জোরাজুরি করেনি।ফ্রেশ হয়ে তাঈমকে কোলে নিয়ে বোনের ঘরে পা বাড়ালো। জানালা ভেদ করে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে আছে অর্থিকা। ঠোঁট দুটো তার নড়ছে। আপনমনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে এক ধ্যানে। কী যেনো বলছে কাকে।

অনুভা এগোলো। বোনের বিপরীত মুখী হয়ে বসে পড়ল। তাঈম এক হাতে অনুভার ওড়না টেনে ধরে রেখে অপরহাতের বুড়ো আঙুল মুখে পুরে রেখেছে। ঘরে যে আরো দুটো প্রাণ উপস্থিত হয়েছে তা যেনো খেয়ালই করেনি অর্থিকা। বড়ো বোনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করল অনুভা। মন খারাপের ভান করে তাকালো তাঈমের পানে। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো সোজা করে। তারপর কিছুটা ঝুঁকলো তার উপর। দুঃখী দুঃখী কণ্ঠে বললো,“মা আদর করে না, কোলে নেয় না বলে আমার বাবাটার খুব মন খারাপ তাই না? থাক মন খারাপ করে আর কী করবে? মা তো তোমায় ভালোইবাসে না। মা না ভালোবাসুক তাতে কী? আমি তো আছি। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি।”

নড়েচড়ে উঠলো অর্থিকা। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো ছোটো বোনের পানে। তাঈম খিলখিলিয়ে হাসছে। আদো আদো কণ্ঠে বলে উঠছে,“মা মা মা….”

শব্দগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই ধক করে উঠলো অর্থিকার হৃদয়খানা। বিলম্ব না করে কোলে তুলে নিলো নিজ সন্তানকে। মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,“কী বললে? আরেকবার বলো।”

ড্যাবড্যাব দৃষ্টিতে মায়ের মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো তাঈম। মুখ দিয়ে পূর্বের ন্যায় বের হলো না কোনো শব্দ। অনুভা আফসোসের সুর তুলে বললো,“শেষে কিনা মাকে রেখে খালাকে মা বলে ডাকছে তোর ছেলে! এবার কী হবে আপু?”

“এটা তোর কাজ। তুই শিখিয়েছিস তাই না?”

“মা ডাক শিখিয়েছি কিন্তু আমাকে তো ডাকতে বলিনি।”

“তাহলে তোকে দেখলে কেন মা মা করে? আমার কাছে এসে চুপ থাকে কেন?”

“এটা নিজেকেই প্রশ্ন কর না। সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সারাক্ষণ একা একা বসে থাকিস।ওদিকে বাচ্চাটা বাবার আদর থেকে বঞ্ছিত হয়েছে এদিকে তুই কী করলি? স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভেবে গেলি এবং এখনো যাচ্ছিস। বাচ্চাটাকে ঠিকমতো কোলে নিস না, খাওয়াস না পর্যন্ত। মাঝে মধ্যে কী হয় কে জানে? তখন যা একটু কোলে তুলে নিস। আচ্ছা এভাবে বাচ্চা মানুষ করা যায়? বড়ো হয়ে যখন ও জানবে, ওর মা ওকে অবহেলা করেছে তখন কী প্রভাব পড়বে ওর উপর? তোকে আদৌ কী বসাতে পারবে মায়ের স্থানে?তখন আফসোস করতে হবে তোকে। এই সময়টা পুনরায় ফিরে পাওয়ার জন্য পাগল হতে হবে। বাবা-মা এবং তোকে যতটা আমি ভালোবাসি ঠিক ততোটাই ওকেও আমি ভালোবাসি। পেটে না ধরেও যেনো মা হয়ে উঠেছি। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। মা অসুস্থ, অসুস্থতা নিয়েই বাবার দেখভাল করতে হয় তাকে। বাহিরের মানুষের কাছে সারাক্ষণ বাচ্চাটা থাকে। জানিস ওকে নিয়ে আমার কতটা চিন্তা হয়? একটু পরপর শুধু সময় দেখি আর ভাবি কখন অফিস আওয়ার শেষ হবে আর আমি বাড়িতে আসবো। বারবার মাথায় প্রশ্ন জাগে তাঈম কাঁদছে না তো? ওর খিদে পায়নি তো?”

অর্থিকার চোখ চিকচিক করছে অশ্রুতে। বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো ছেলেকে।ভারি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে দম ছাড়লো অনুভা। তার গলাটাও ধরে এসেছে। পুনরায় বললো,“আবারো বলছি সত্যিটা মেনে নে আপু।মোভ অন কর। এভাবে কাঁদলে, নিজের অযত্ন করলে, বাবুর প্রতি অবহেলা করলে দুলাভাইয়ের আত্মা যে কষ্ট পাবে। তুই কী চাস দুলাভাই কষ্ট পাক?”

অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো অর্থিকার। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,“না না ও কষ্ট পাক আমি তা চাই না। ও কেন কষ্ট পাবে? ও ভালো থাকুক আমি শুধু অতটুকুই চাই।”

“শুধু চাইলেই তো আর হবে না।”

“আমি আর কাঁদবো না। বিশ্বাস কর আমি আর একটুও কাঁদবো না। খুব আদর করবো আমাদের ছেলেকে।”

বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অর্থিকা। বোনের মাথায় হাত রাখলো অনুভা।দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাঈমকে অর্থিকার কাছে রেখেই ত্যাগ করল কক্ষ। মায়ের কাছে যে সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে না তা নিশ্চিত সে। শুক্রবারে সুফিয়ার ছুটি।এদিন নিজ হাতেই রান্না করে অনুভা। তাই সোজা চলে গেলো রান্নাঘরে।
_________

অনেক বেলা করে বাড়ি ফিরলো শ্রাবণ। রান্নাঘর থেকে পুরো ড্রয়িং রুমটাই স্পষ্ট দেখা যায়। দুপুরের রান্না করছেন শান্তা। বড়ো ছেলেকে ঘরের দিকে যেতে দেখেই ডাকলেন তাকে।মায়ের ডাকে পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল শ্রাবণ।এগিয়ে এলো রান্নাঘরের কাছে।
জিজ্ঞেস করল,“কী বলবে? বলো।”

“সাত সকালে কোথায় যাওয়া হয়েছে শুনি?সকালের খাওয়া কী হয়েছে আদৌ?”

“বাহিরেই খেয়ে নিয়েছি।”

“কোথায় গিয়েছিলি?”

“বাজারে।”

ছেলের কথায় হাতের খুন্তি নাড়াচাড়া থেমে যায় শান্তার। বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি মেলে শুধান,“তুই আর বাজার! কই কখনো তো তোকে বাজারের ধারের কাছেও যেতে দেখলাম না তাহলে আজ গেলি যে? গেলি যখন তাহলে একা গেলি কেন? তোর বাবা তো সকালেই গেলো। তার সঙ্গেই যেতে পারতি।”

“বাবার সঙ্গে তো ড্রাইভার ছিলোই। আমার যাওয়ার কী প্রয়োজন তাহলে? তাছাড়া আগে যাইনি বলে যে এখনো যেতে পারবো না এমন তো কোনো কথা ছিলো না।”

“তা কোথায় তোর বাজার দেখা দেখি।”

“আনিনি। বাজারে গিয়ে মনে পড়ল বাবা তো অলরেডি বাজার করতে বেরিয়েই পড়েছে। তাহলে শুধু শুধু আমি বাজার করে আর কী করবো?”

সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে ছেলেকে আগাগোড়া ফের পর্যবেক্ষণ করলেন শান্তা। দম ছেড়ে বললেন “ওহ, আচ্ছা ঘরে যা তবে।”

সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ালো শ্রাবণ।

চলবে _______

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে