Thursday, June 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 295



এক টুকরো আলো পর্ব-১৯+২০

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

আজ ঘরের পরিবেশ গুমোট। বাড়ি ফেরার পর থেকে একবারও কথা বলেনি হুরাইন। তাসিন দুশ্চিন্তায় পড়লো। আজ আবার কী নিয়ে রেগে আছে? সকালের ব্যাপার নিয়ে? রাতের খাবারেও কথা হয়নি। ঘরে এসে দেখলো চুপচাপ বিছানা করছে হুরাইন। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,“রেগে আছ কেন? সকালের জন্য সরি।”

হুরাইন কিছু বলল না। ছাড়ানোর চেষ্টাও করলো না। চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। তাসিন বুঝলো মান ভাঙেনি। তাই তার ভালোবাসার গভীরতা আরেকটু বাড়লো। পুরো প্রতিক্রিয়াহীন হুরাইন। যেন কোনো রোবট দাঁড়িয়ে আছে। বাঁধাও দিচ্ছে না। সরে গেল তাসিন। নিভু নিভু স্বরে শুধালো,
“তোমার কি আমার স্পর্শ খা*রা*প লাগছে?”

হুরাইন বিছানা গোছানো শেষ করে দম ফেললো। এবার স্বাভাবিক গলায় বলল,“বসুন। আপনার সাথে কিছু কথা আছে।”

তাসিন বসলো।
“বলো।”

তাসিনের চোখে চোখ রাখলো হুরাইন। গভীরভাবে তার চোখজোড়া পড়তে চেষ্টা করলো। বলল,“আমি যা যা জিজ্ঞেস করবো, সত্য জবাব দেবেন।”

তাসিন বুঝতে পারলো না হুরাইন কোন প্রসঙ্গে কথা বলতে চায়। তবুও সে আশ্বস্ত করলো সত্য বলবে। হুরাইন বলল,“আপনার কি বিয়ের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল?”

এবার শব্দ করে হেসে ফেললো তাসিন। রগঢ় করে বলল,“তুমি দেখি খুব জেলাস।”

হুরাইন উত্তেজিত হয়ে বলল,“জেলাস কেন হবো? সে কি আপনার স্ত্রী? যদি হালাল হতো, তাহলে জেলাস শব্দটা মানা তো। আমার বরং ঘৃ*ণা হচ্ছে।”

তাসিন বিস্মিত হয়ে হুরাইনের রাগ দেখলো। চোখের সাদা অংশ লাল। ফর্সা ত্বক লাল হয়ে আছে। তাসিন তাকে শান্ত করার জন্য দু’হাতে তাকে আগলে নিলো।
“শান্ত হও। আমার বিয়ের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল না।”

হুরাইন বাঁধন থেকে সরে এসে বলল,“আমি আবারও বলছি, মিথ্যা বলবেন না।”

“সত্য বলছি। আচ্ছা তোমার মাথায় বাচ্চা মেয়েদের মত এসব কে ঢুকিয়েছে?”

হুরাইন তেজী গলায় বলল,“আমার বিবেক, আমার বয়স কোনো দিক থেকে আমি ছোটো নই। আমি যা জানতে চাইছি তার জবাব দেবেন।”

তাসিন অপলক তেজী হুরাইনকে দেখে নিয়ে মৃদু হেসে বলল,“স্বামীর কাছে কৈফিয়ত চাইছো?”

হুরাইন আরও কঠিন হয়ে বলল,“আপনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি আমি আপনার স্ত্রী। তাই আপনার সম্পর্কে সব জানার অধিকার আমার আছে। আমি ভালোবেসে যেমন আগলে নিতে জানি, তেমনি কঠিনও হতে জানি।”

তাসিনের ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয়ে গেল। এখন আর তার ঠোঁটে বিন্দুমাত্র হাসি নেই। হুরাইনের এমন রূপের সাথে সে খুব একটা পরিচিত নয়। সে প্রায়ই রাগ করে থাকে। তবে এবারের মতো কঠিন কখনো তাকে দেখা যায়নি। তাসিন বলল,“আচ্ছা আর কী জানতে চাও?”

“ফাবিহা আপুর সাথে আপনার কী সম্পর্ক ছিল?”

“ফাবিহার সাথে আমার কোনোকালেই সম্পর্ক ছিল না। তবে ওর সাথে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। সেটা আমার সম্মতিতে। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার কৌতুহল মাত্র। ফাবিহার সাথে বিয়ে হয়ে গেলে আর তোমার চিন্তা মাথায় আসবে না। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। যত দিন যাচ্ছিলো, আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি তোমার প্রতি। ফাবিহার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র মনের টা*ন ছিলো না।”

“আপনি নিজের সমস্যার সমাধান করতে একটা মেয়েকে কেন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবেন? এই সাহস, এই অধিকার কে দিল আপনাকে? ফাবিহা আপু দিয়েছিলেন?”

তাসিন দৃষ্টি নামিয়ে বলল,“আমি অনুতপ্ত হুরাইন। মাও এই ব্যাপারে আমার সাথে রেগে ছিলেন। তুমি প্লিজ আমাদের বর্তমান, ভবিষ্যতে ওসব কথা টে*নে এনো না!”

হুরাইন মলিন হেসে বলল,“এখন সবটা স্পষ্ট যে কেন আপনার মা আর বোন আমাকে পছন্দ করেন না। আমি তাঁদের সাথে যতোই মিশতে চেষ্টা করি, তাঁরা আমাকে আ*ঘা*ত করতে চান। ঠিক আছে, ওটা আপনার অতীত ছিল। বিয়ের পূর্বের বিষয় নিয়ে কথা বললেও সেটা এখন সমাধান হবে না। তবে আপনার দ্বারা এমন কিছু হয়েছে, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। বাদ দিলাম ওসব।”

একটু থেমে বলল,“কিন্তু বিয়ের পরবর্তী জীবন নিয়ে আমি আপনাকে একবিন্দু ছাড় দেব না।”

ভ্রু কুঁচকে গেল তাসিনের।
“আশ্চর্য! আর কী করলাম আমি?”

“আপনার মেয়ে বান্ধবী আছে নিশ্চয়ই! তাঁদের সাথে চলাফেরাও হচ্ছে নিয়মিত।”

তাসিন এবার চুপ করে গেল।
“কী হলো? জবাব দিন।”

তাসিন অস্বস্তি নিয়ে বলল,“বন্ধুবান্ধবের সাথে একসাথে চলাফেরা করেছি। এখন চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারছি না। একটু বুঝার চেষ্টা করো। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”

“পরিবর্তন আজ হোক, আগামীকাল নয়। এভাবে চলতে থাকলে মৃ*ত্যু এসে দরজায় কড়া নাড়বে অথচ আগামীকাল আর আসবে না।”

“আচ্ছা আমি কীভাবে এড়িয়ে চলবো বলো?”

হাসলো হুরাইন। তার ঠোঁটের কোনে লুকিয়ে আছে স্পষ্ট উপহাস।
“আপনি নিশ্চয়ই ছোটো বাচ্চা নন! আপনি বিয়ে করেছেন। সবাইকে বলবেন ‘আমি বিবাহিত, দ্বীনের পথে চলতে চাই‘।
তাঁরা যদি আপনাকে দ্বীন পালনে বাঁধা দেয় তবে ওসব বন্ধু পরিহার করুন।”

তাসিন চাপা রাগ দেখিয়ে বলল,“তুমি কী বলছো বুঝতে পারছো? বন্ধু মানে বুঝো তুমি? তাদের আমি ছেড়ে দেব?”

হুরাইন দ্বিগুণ রেগে বলল,“আপনি কি ভেবেছেন? আপনার বিয়ের পূর্বে সকল অন্যায়, হা*রা*ম কাজ মেনে নিয়েছি বলে এখনো সবটা মেনে নেব? তখন আপনার সাথে আমার জীবন জড়িত ছিল না। তাই আমার করার কিছুই ছিল না। কিন্তু আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি এখনো সকল বেহা*য়া*পনা, অশ্লী*লতা সহ্য করবো তবে ভুল ভাবছেন। ইসলাম স্বামীকে মান্য করতে বলেছে, স্বামীর বে*হা*য়া*প*না নয়। যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতি ভালোবাসা আসে না, ভীতি আসে না। কয়েক বছর চলা বন্ধুত্বের প্রতি এত টা*ন? যারা আপনাকে ইসলামের পথে নয়, হারামের দিকে টে*নে নিয়ে যায়, তাঁরা আপনার বন্ধু নয়, শ*ত্রু।”

“হুরাইন। নিজের মুখ সংযত করো।”
ঘরে দুজনের চাপা স্বরে রাগারাগি, ঝগড়াঝাটি চলছে। বাকি সব ঘুমে বিভোর।
হুরাইন বলল,“স্ত্রী ঘরে রেখে বাইরে পরনারীর সাথে মেলামেশাকে কী বলবো? পুণ্যের কাজ?”

তাসিন চোখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে বলল,“আমার রাগ আর বাড়িয়ে দিও না হুরাইন।”

হুরাইন আর কথা বললো না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো। তার অনেকক্ষণ ধরে কোমর, তলপেটে ব্যথা হচ্ছে।
তাসিন ওখানেই বসে রইলো। জীবনকে যতটা সহজ ভেবেছিল, তা ততটা সহজ নয়। তার মাথার ভেতর হাজারও টেনশন। সে কোনোদিকই ছাড়তে পারছে না। স্ত্রীর কথামতো চলতে চাইছে, নিজেকে পরিবর্তন করতে চাইছে, বাইরে গেলে মানুষের কটাক্ষ, বিদ্রুপ এড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারছে না। কিছু মানুষের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে, তাদের কাছ থেকে ছুটে আসা যাচ্ছে না। হুরাইনের কথাগুলো তীক্ষ্ণ তীরের মতো গেঁথেছে মনে। একটা স্বাভাবিক চলাফেরাকে কীভাবে সে বেহা*য়া*পনা বলতে পারলো! মেয়ে বন্ধুতো তার একার নয়। সে তো তাঁদের সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে না। তাহলে কীসের এতো ভয় হুরাইনের?

হুরাইন জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। তার চোখে ঘুম নেই। পেট ব্যথা তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করার চেষ্টা করছে। তাসিন গভীর ঘুমে। তার দিকে ফিরলো হুরাইন। পলকহীন তাকিয়ে রইলো। সে মনেপ্রাণে চাইলো আল্লাহ তাসিনকে আর এই পরিবারের মানুষগুলোকে হিদায়াত দিক। চোখমুখ কুঁচকে ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সে। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো।

আজ আর তাহাজ্জুদ পড়তে ওঠেনি হুরাইন। ঘুম এসেছিল শেষ রাতে। তাই টের পায়নি। জেগে গেল আজানের শব্দে। আজান হলেই তার আর ঘুম হয় না। তাসিনকে ডাকলো নামাজ পড়ার জন্য।
তাসিন উঠলো না। হুরাইনের ডাকাডাকিতে সে সাড়া দেয়নি। পেটে ব্যথা এখনো আছে। তবুও জায়নামাজ গুছিয়ে উঠে গেল। বেরিয়ে দেখলো সাজেদা রান্নাঘরে। সে বলল,“আমি করে নিচ্ছি আম্মা। আপনি যান।”

সাজেদা ভারী গলায় বললেন,“তুমি যখন ছিলে না, তখন আমি এই সংসারটা একা হাতে চালিয়েছি।”

“তখন করেছেন। এখন আপনার রেস্ট করার সময়।”

“যাও এখন থেকে।”

হুরাইন বুঝতে পারলো না সে কী কাজ করবে! হাতের কাছে করার মত কোনো কাজও নেই। এদিকে সাজেদাও গম্ভীর হয়ে কথা বলছেন।
সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ না যেতেই সাজেদার বকাবকি শুরু হয়ে গেল। এই বয়সে এসে ওনাকে কাজ করতে হচ্ছে। হুরাইন এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে তো কাজ করতেই চেয়েছিল। তখনও রেগে গেলেন আর কাজ না করে ওনার কথা মান্য করছে বলেও রাগ দেখাচ্ছেন।
তাসিনের অফিসের সময় হয়ে এলেও হুরাইন ডাকলো না। ঘড়িতে যখন আর দশমিনিট বাকি। তখন ঘুম ভাঙলো তার। বিয়ের আগে মা বা নিশি ডেকে দিতো। বিয়েরপর হুরাইন ডেকে দিতো। আজ তাকে ডাকা হলো না। সময় দেখে সে কয়েকবার চেঁচিয়ে হুরাইনকে ডাকলো। তারপরই ওয়াশরুমে ছুটলো। হুরাইন ঘরে এলো ধীরেসুস্থে।
তাসিন বেরিয়ে নিজের কোনোকিছুই আজ গোছানো পেল না। জামাকাপড় বের করা নেই, আয়রন করা নেই। অন্যদিন সবকিছু তৈরি রাখে হুরাইন। তাকে দেখে রাগী স্বরে বলল,“আমার অফিসের সময় হয়েছে, ডাকোনি কেন? আমার কিছুই গোছানো নেই কেন?”

হুরাইন শান্ত স্বরে বলল,“আমি আপনাকে ফজরে ডেকেছিলাম। আপনি ওঠেননি। সেটা আমার দোষ নয়।
আর বাকি রইলো আপনার সব গুছিয়ে রাখা। যে ব্যক্তি ফজর পড়া জরুরি মনে করে না, আমিও তাঁর সব গুছিয়ে রাখা জরুরি মনে করিনি।”

সময় চলে যাচ্ছে। তীব্র রাগ হলেও দ্রুত একটা শার্ট নিয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল তাসিন। কথা বাড়ানোর সময় নেই। এমনিতেই দেরি হয়ে গেল। বসকে হাজারটা জবাবদিহি করতে হবে। কথা শোনাতে কার্পণ্য করেন না বস। আজ আর আয়রন করা শার্ট পরা হয়নি। এলোমেলো হয়ে বেরিয়ে গেল। হুরাইন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শরীর বারবার ভেঙে আসতে চায়। বারবার মনে হয় এটা কিছুতেই তার জীবন হতে পারে না। সে এমন জীবনের স্বপ্ন দেখেনি।

★★★

ফুফাতো ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শাবাব নিজেও এলো। মেয়ে দেখার পূর্বেই মেয়ের বাবা শাবাবকে দেখে ফিরোজ আলমকে জিজ্ঞেস করলেন,“ও পাত্রের কী হয়?”

ফিরোজ আলম হেসে বলল,“পাত্রের মামাতো ভাই। আমার একমাত্র ছেলে।”

আতাউর রহমান সাথে সাথে বলে দিলেন।
“দুঃখিত আমি মেয়ে বিয়ে দেব না!”

শাবাব দুর্বোধ্য হাসলো। ফিরোজ আলম সহ সকলে অবাক হয়ে তাকালেন। কারণ জানতে চাইলে শাবাবের কীর্তিকলাপের বিবরণ দিলেন আতাউর রহমান। ফিরোজ আলম যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছেন না। শাবাবের দিকে তাকাতেই শাবাব বলল,“ওনার মেয়ে আমার সাথে প্রেম করেছে। কিন্তু বিয়ে করবে না।”

“মিথ্যা কথা। তুমি আমার মেয়েকে উত্যক্ত করেছো। যার জন্য আমরা থা*না*য় যেতে বাধ্য হয়েছিলাম।”
প্রতিবাদ করলেন আতাউর রহমান। ফিরোজ আলমের বোন তো কিছুতেই আর মেয়ে দেখবেন না। তিনি এই মেয়েকে আর বউ বানাবেন না। ভাইকে রেখেই তিনি ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ফিরোজ আলম মাথানিচু করে বেরিয়ে এলেন। শাবাব বেরিয়ে আসতেই তাকে রাস্তায় রেখে চ*ড় মা*র*লে*ন দুটো। আজ তিনি খুব আ*ঘা*ত পেয়েছেন। মুখটা ছোটো হয়ে গিয়েছে।
শাবাবের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন।

আজ আবার দেখতে এসে ফিরে গিয়েছে ছেলেপক্ষ। এটাও জানাজানি হয়ে গেল। ফাবিহা হয়ে উঠলো উপহাসের পাত্রী। সকলের ধারণা মেয়েটার আর বিয়ে হবে না।

#চলবে……

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

ফাবিহা এসে বাবার পাশে বসলো। ছোটো করে বলল,“আমাকে ফুফুর বাসায় দিয়ে আসো বাবা। ক’দিন থেকে আসি।”

আতাউর রহমানও ভাবলেন মেয়ে ঘুরে আসলে হয়তো মনটা ভালো হবে। তাই মেয়েকে বললেন,“জামাকাপড় গুছিয়ে নে।”

ফাবিহা উঠে গেল। জামাকাপড় গুছিয়ে নিলো। তিক্ত স্মৃতিগুলোকে এখানেই মাটিচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলো। চাইলেই কি আর স্মৃতি ভোলা যায়? তবুও মানুষের কত চেষ্টা।
ফাবিহাকে নিয়ে পরদিনই চট্টগ্রামের গাড়ি ধরলেন তার বাবা-মা। একেবারে বোনের বাসায় পৌঁছে দিয়ে সেদিন তাঁরাও ওখানে রইলেন। পরদিন আবার চলে আসলেন দু’জন। বাড়িতে তালা ছিল। প্রতিবেশীদের অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন কোথায় গিয়েছেন। আতাউর রহমান স্ত্রীকে চুপ থাকতে বলে দিলেন। এই মানুষগুলো তাঁর মেয়ের শান্তি নষ্ট করেছে, ক*টু কথা বলেছে। এখন আবার নতুন কোনো কথা তুলবে। ফাবিহার মাও শক্ত রইলেন। সন্তানের বেলায় সব বাবা-মা-ই কেমন শক্ত হয়ে যান। ফাবিহা যে ফুফুর বাড়ি গিয়েছে এই সংবাদ কেউ জানে না।

এক সপ্তাহ কেটে গেল। ফাবিহার কোনো খোঁজ নেই। ফরহাদকে ফোন দিলেই সে জানায় “আসেনি ক্যাম্পাসে।”

শাবাব চিন্তিত হলো। কিছু হয়েছে নাকি? আশঙ্কা থেকে ফরহাদকে বলল,“একটু ওর বাসায় খোঁজ নিয়ে দেখ। কোনো সমস্যা হয়েছে কি না জানা আমাকে।”

“ঠিক আছে ভাই।”

কল কেটে ভাবনায় বসলো শাবাব। ফাবিহা এখন একেবারে প্রতিক্রিয়াহীন। কোনো প্রতিবাদ করছে না। এখন কেন যেন মেয়েটাকে শা*স্তি দিয়ে মজা পায় না।
আসলেই কি প্রতিবাদ করছে না? তার নিরবতাই যে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবাদ। এটা শাবাব বুঝে উঠতে পারেনি।
বাবার কাছে গিয়ে অফিসের একটা ব্যাপার নিয়ে কথা তুললো। ফিরোজ আলম কাঠকাঠ গলায় বলে দিলেন,“আমার ব্যবসায় আর কারো বসার দরকার নেই। আমি আগে সামলাতে পেরেছি, এখনো পারবো।”

“বাবা।”
শাবাবকে থামিয়ে দিলেন ফিরোজ আলম। রুষ্ট কন্ঠে বললেন,“ভেবেছিলাম ভালো হয়ে গিয়েছিস। আমি ভুল ছিলাম। যতটা খা*রা*প তোকে ভেবেছিলাম, তারচেয়ে বেশি খা*রা*প তুই। তোর মায়ের জন্য পারছি না। নয়তো বাড়ি থেকেই বের করে দিতাম।”

শাবাব মাথা নিচু করে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাবা না করলেও ব্যাবসা নিয়ে সে মাথা ঘামালো। এভাবে আরো একটি সপ্তাহ পার হলো। ফরহাদ খবর জানালো ফাবিহা বাড়িতে নেই। কোথায় আছে কেউ বলতে পারছে না। কারো কাছেই মুখ খুলছেন না ফাবিহার বাবা-মা। শাবাবের ভালো লাগছে না। অস্থিরতা তাকে তাড়া করছে। অপরাধবোধ না কি এত সহজে ফাবিহা হেরে গিয়েও জিতে যাওয়া শাবাবকে শান্তি দিচ্ছে না, তা বুঝা গেল না।

ফাবিহার ফুফু কল দিলেন। ভাইয়ের বউ আর ভাইয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বললেন। ফাবিহাও মা-বাবার সাথে কথা বলেছে। এবার ফোন নিয়ে সরে গেলেন ফাবিহার ফুফু। আতাউর রহমানরা স্বামী-স্ত্রী এখনো কলে আছেন। ফাবিহার ফুফু বললেন,“তোদের সাথে একটু আলাপ করার ছিল।”

আতাউর রহমান বললেন,“বল।”

“আমাদের এখানে তো কেউ কিছু জানে না ফাবিহার কথা। আমার ননাস এসেছিলেন। ফাবিহাকে পছন্দ হয়েছে ওনার। এ নিয়ে কথাও তুলেছিলেন। আমি বলেছি আমার ভাই-ভাবির সাথে কথা বলে দেখি।”

ফাবিহার মা-বাবা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তারপর আতাউর রহমান গলা ঝেড়ে বললেন,“তোর ননাস। তাহলে তো সব খবর তোর জানা।”

“জি ভাইয়া। আমার ননাসের কথা বলে লাভ নেই। বউদের সাথে খ্যাটখ্যাট করা স্বভাব আছে। তবে ছেলে ভালো। তাছাড়া ছেলে চাকরি করে যেখানে, সেটা বাসা থেকে দূরে আছে। সপ্তাহে বাড়ি আসে। খাওয়াদাওয়ার কষ্ট। তাই বিয়ে হলে ফাবিহাকে সাথেই রাখবে মনে হয়। সমস্যা একটা আছে।”

“কী?”

“ছেলের বয়স একটু বেশি আর খাটো।”

ফাবিহার মা নাকচ করলেন। তিনি বলেই দিলেন,“আমার মেয়ে তো ঘর ভেঙে যাচ্ছে না। সবকিছু বাদ দিলেও বয়সের কথা বলি। ছেলের সাথে ছেলের বয়সে খাপ খাবে এমন মেয়ে দেখা উচিত। আমার মেয়ের মাত্র অনার্স করছে। আরো কয়েক বছর পরও ফাবিহাকে লাগবে যুবতী আর ছেলেকে মধ্যবয়স্ক ধরা হবে। তখন মেয়ের মন উঠে যাবে। সংসারে মন দেবে না। আমরা যদি এখন এসব না আটকাই পরে দোষ মেয়ের হবে না, আমাদের হবে।”

“ভাবি সবদিক তো পাওয়া যায় না। এতকিছু বিবেচনা করলে বিয়ে দেবে কীভাবে? এলাকায় যা বদনাম ছড়িয়েছে মেয়ে এত সহজে বিয়ে দিতে পারবে? পারলেও ভালো ঘর পাবে? তাছাড়া ছেলের বয়স বেশি হলে সেই ছেলেরা বুঝদার হয় বেশি।”

“আমিও বলছি না সবদিক পাবো। আর ছেলে বুঝদার হবে এটা আমরা জানি, আমরা মানি। মেয়ে তো মানবে না। মন থেকে মানিয়ে নিতে না পারলে ভবিষ্যতে কিছু একটা ঘটালে তার দায়ভার কে নেবে? মেয়ের মন যে অন্যদিকে যাবে না তার নিশ্চয়তা কী?”

“তোমরা আগে এখানে এসে দেখে যাও। ফাবিহার সাথে কথা বলে দেখো সে কী বলে। তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নিও। ফাবিহা না চাইলে তো আর কিছু করার নেই।”

আতাউর রহমানও সায় দিলেন। বললেন,“আগে আমরা ফাবিহার সাথে কথা বলে দেখি।”

ফাবিহার মা মানতে চাইছেন না। আতাউর রহমান বোনের সাথে কথা শেষ করে স্ত্রীকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন,“তুমিই তো বললে মন থেকে মানতে না পারলে ভবিষ্যতে অঘটন ঘটবে। আগে আমরা কথা বলে দেখি। দেখো, সুযোগ কিন্তু বারবার আসে না। বিয়ে না দিলে কিছুদিন পর ফাবিহা আবার আসবে এখানে। মানুষ ওকে খোঁ*চা*বে। ভালো সম্বন্ধ আসলেও কিছু মানুষ তাঁদের কানভারী করে রাস্তা থেকে বিদায় দেবে।
মেয়ে এবার শক্ত থেকেছে বলে কি সবসময় শক্ত থাকতে পারবে? আ*ঘা*ত আ*ঘা*তে সবাই শক্ত হয় না। বেশিরভাগই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আমি বলছি না এখনেই বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। আগে যাচাই-বাছাই করো। মেয়ের মন বুঝার চেষ্টা করো। চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”

ফাবিহার মা থমথমে গলায় বললেন,“যেখানে আমার মন বলছে আমার মেয়ে মানিয়ে নিতে পারবে না, সেখানে আমি যাচাই-বাছাই করতে যাওয়ার প্রয়োজন দেখি না।”

“তুমি বেশি অবুঝ হচ্ছো। আমরা আগে দেখে আসি।”

ফাবিহার মা আর কথা বাড়ালেন না। তবে তিনি মনে মনে ঠিক করে ফেললেন মেয়েকে তিনি কিছুতেই বিয়ে দেবেন না।
দুদিন পর আবার স্বামী-স্ত্রী চট্রগ্রাম গেলেন।
ফাবিহার ছোটো ছোটো ফুফাতো ভাইরা দোকান দিয়েছে। দুজন মিলে পাঁচশো টাকার জিনিসপত্র তুলেছে। জোরজবরদস্তি করে প্রথম ক্রেতা বানালো ফাবিহাকে। ফাবিহা বলল,“আমি কিছুই কিনবো না।”

জোর করে তার মুখে একটা চকলেট ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,“দাও, টাকা দাও।”

হতভম্ব হয়ে গেল ফাবিহা। চকলেট খেয়ে এবার বলল,“তাহলে আরেকটা চকলেট দাও।”

আরেকটা চকলেট নিলো ফাবিহা। দশ টাকা বাড়িয়ে দিতেই ছোটো ফুফাতো ভাই বলল,“আরো দুই টাকা।”

ফাবিহা ভ্রু কুঁচকে বলল,“কীসের দুই টাকা? দুইটা চকলেট দশ টাকা।”

“না, আমরা একটা চকলেট ছয় টাকা বিক্রি করি। নয়তো লাভ হবে কীভাবে?”

ফাবিহা চোখ বড়ো করে বলল,“প্রথমত জবরদস্তি করে ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করেছো। আবার দু’নম্বরি শুরু করেছো?”

“এতকিছু বুঝি না। দুই টাকা দাও।”

ফাবিহার ফুফা মুখ টিপে হাসছেন। ফাবিহা ফুফার দিকে তাকাতেই ফুফা বললেন,“দুই টাকা মাফ করে দাও।”

“না, যদি বলা হয় এক পয়সা মাফ করো। মাফ করতে পারবো না। প্রয়োজনে একবেলা ভাত খাওয়াবো। ব্যাবসার সাথে কোনো আপোষ করা হচ্ছে না।”

ফাবিহা ভেংচি কেটে বলল,“আমিও দুই টাকা দিচ্ছি না।”

ফুফা পকেট থেকে দশ টাকার নোট দিলেন ছেলেদের দিকে। ফাবিহা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,“এটা কিন্তু দু’নম্বর ব্যাবসায়িদের প্রমোট করা হলো ফুফা।”

ফুফাতো ভাই বলল,“যাও দুই টাকা মাফ করে দিলাম।”

“আম্মাজান।”
ডাক শুনে পেছন ঘুরলো ফাবিহা। বাবা মাকে দেখে ছুটে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। তাঁদের অপেক্ষাতেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাঁরা আসবে ফাবিহা জানে। কিন্তু কেন আসবে তা জানে না।

রাতে ফাবিহার কাছে এসে বসলেন বাবা-মা। প্রথমে ভিন্নভাবে কথা শুরু করলেও কথার মোড় ঘুরলো ধীরে ধীরে। আতাউর রহমান সবকিছু বলে ফাবিহার দিকে তাকালেন। মাথানিচু করে রইল ফাবিহা। ফাবিহার মা আগ বাড়িয়ে বললেন,“আমি জানি তোর পছন্দ হয়নি। না হলে বল আমরা বিয়ে দেব না।”

আতাউর রহমান বিরক্ত চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। ফাবিহাকে বললেন,“তোর মতামত জানতে চাইছি।”

কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছেন, কী সুবিধা-অসুবিধা সব বললেন আতাউর রহমান। ফাবিহা নিচু গলায় উদাস হয়ে বলল,“তোমরা যা ভালো মনে করো। আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মানসিকতা এখন আমার নেই।”

আতাউর রহমান মেয়ের কথা শুনে খুশি হলেন। স্বামী-স্ত্রী উঠে গেলেও দুজনের মাঝে ঠোকাঠুকি লেগে গেল। পরদিন ফাবিহার ফুফুর ননাসের পরিবার আসলো। তাঁরাও বিকেলে চলে গেলেন আর ফাবিহার বাবা-মাও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ফাবিহা আরো কিছুদিন থাকুক।

বাড়ি আসার দুদিন পরই চমকিত হলেন ফাবিহার বাবা-মা। শাবাব তাঁদের বাড়িতে। এসেই ফাবিহার খবর জানতে চাইল। সে কোথায়?
আতাউর রহমান সোজাসাপটা জবাব দিলেন,“বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।”

শাবাব কপাল কুঁচকে পরক্ষণেই মৃদু হেসে বলল,“বিয়ে দিলেন আর কেউ জানলো না?”

“কেউ যাতে না জানে, আমার মেয়ের বিয়ে ভাঙতে না পারে সেজন্যই লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছি।”

আপনা-আপনি শাবাবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। চাপা রাগ দেখিয়ে বলল,“ওর শশুর বাড়ি কোথায়?”

“তোমাকে কেন বলবো?”

“বলতে হবে না।” বলে শাবাব বেরিয়ে গেল। রাস্তায় নামতেই এক টুকরো ইটের সাথে হোঁচট খেল। রাগ চেপে গেল আরো। লা*ত্থি মা*র*লো ইটের টুকরোয়।

★★★

হুরাইন আর তাসিনের সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তাসিন সব ঠিক করতে চাইলেও হুরাইন ঠিক করার চেষ্টা করছে না। সেদিন তাসিন নরম হয়ে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলো, বুঝানোর চেষ্টা করলো। হুরাইন ভাবলো তাসিন তার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। সে নিজের কাপড়ে হাত দিয়ে আঁচল ফেলতে গিয়ে বলল,“আপনাকে বাঁধা দেয়ার শক্তি বা অধিকার কোনোটাই আল্লাহ আমাকে দেননি। আপনি আপনার অধিকার নিতে পারেন।
তবে সত্যি বলছি আমি আপনাকে এখন আর মন থেকে গ্রহণ করতে পারছি না।”

থমকে গেল তাসিন। তার প্রচণ্ড রাগ হলো সাথে কষ্ট পেল। প্রথমত ঘনিষ্ঠ হওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না। যা তার রাগ বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত তাকে মন থেকে মানতে না পারার ব্যাপারটা পীড়া দিচ্ছে তাকে। রাগ আর কষ্ট থেকেই হুরাইনকে আর বুঝানোর চেষ্টা করেনি সে। যেভাবে চলছে চলুক। দুজনের মাঝে প্রয়োজন ছাড়া কথাও হচ্ছে না।

আজ তাসিনের ভাই বাড়ি ফিরেছে। ভাইয়ের বিয়ের সময় তার পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার পর বন্ধুদের সাথে ট্যুর দিয়েছে। তারপর আবার ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই আর বাড়ি আসা হয়নি। এখন বাড়ি এসেছে।

তামিম বাড়ি আসায় হুরাইন এখন ঘর ছেড়ে বের হয় না। ভালোভাবে দেখেশুনে রান্নার কাজকর্ম সারতে আসে। তাও যত জলদি করা যায় সে ঘরে চলে আসে। হুরাইনের মাঝে এই পরিবর্তন দেখে সাজেদা খ্যাঁক করে উঠেছেন। দুদিন যাবত কাজ নিয়ে চো*রা*চু*রি দেখছেন তিনি। ঘরে বসে থাকে সারাদিন। তামিম তো গতরাতে বলে ফেললো,“ভাবি কি আমার বাড়ি আসা পছন্দ করছে না? দেখাও করলো না কথাও বললো না।”

বউ অসুস্থ বলে সাজেদা সব ধামাচাপা দিলেন। আজ রান্না করতে এসে কথা দিয়ে হুরাইনের টুঁটি চেপে ধরলেন। হুরাইন বলল,“আম্মা তিনি আমার দেবর। আমি কীভাবে তাঁর সামনে যাই? সেজন্যই দ্রুত কাজকর্ম সেরে ঘরে ঢুকে যাই।”

“দেবর তো কী হয়েছে? সে তোমার স্বামীর ছোটো ভাই। তোমারও ছোটো ভাই। একটু কথা বললে তো আর জাত যাবে না। নাকি তুমি আমার ছেলের বাড়ি আসা পছন্দ করছো না।”

“এটা ওনার বাবার বাড়ি। আমি কেন ওনার আসা নিয়ে ঝা*মে*লা করবো আম্মা? আমরা ছোটো ভাই বলে সামনে গেলেও ইসলামে তা জায়েজ নেই।”

সাজেদা যেন অবুঝ নারী হয়ে গেলেন। তিনি একরোখা ভাবে বললেন,“আজ ঘরে যাওয়া চলবে না। সবাইকে দাঁড়িয়ে খাবার দেবে তুমি।”

হুরাইন কথা বলল না। সে চুপচাপ কাজ করে গেল। দুপুরে সকলে খাবার টেবিলে। তাসিন অফিসে আছে। হুরাইন নিচে নামছে না। সাজেদা কয়েকবার গলা ছেড়ে ডাকলেন। হুরাইন সাড়া দিচ্ছে না। তার দরজা বন্ধ। সে জায়নামাজে পড়ে আছে। সকল ফিতনা থেকে সে মুক্তি চাইলো। নামাজ বন্ধ দিচ্ছে না। সাজেদা কতক্ষণ চিল্লাফাল্লা করে দরজা বন্ধ দেখে গজগজ করতে করতে নিজেই খাবার বেড়ে দিলেন সবাইকে। তামিম তো আর এতদিন বাড়ি ছিল না। সে কিছুই জানে না। ভাবলো ঘরে হয়তো ভাবির সাথে সবার ঝামেলা চলছে। সে বিরক্ত হয়ে বলল,“এসব কী হচ্ছে ঘরে?”

তাসিনের বাবা এতক্ষণ চুপচাপ স্ত্রীর কাণ্ডকারখানা দেখে গেলেও এবার মুখ খুললেন।
“তোমরা তো কিছুই মানো না। মেয়েটাকে কেন তার দ্বীন পালনে বাঁধা দিচ্ছো? সে সঠিক কাজই করছে।”

সাজেদা এবার হুরাইনকে ছেড়ে স্বামীর উপর চড়াও হলেন। তাসিনের বাবা চুপ করে শুনে গেলেন। কথা বলে তর্কে জড়ানোর মত বোকামি তিনি করলেন না।

তাসিন বাড়িতে ঢুকার পরই তাকে আগলে ধরলেন সাজেদা। হুরাইন কী কী করেছে সব জানালেন। তাসিন কাউকে কিছু না বলে দরজার সামনে এসে নক করলো।
“দরজা খুলে দাও।”

তাসিনের গলা শুনে হুরাইন দরজা খুলে দিল। অফিসের পোশাক পরিবর্তন করে ফ্রেশ হয়ে শান্ত হয়ে বসলো তাসিন। ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,“বাসায় কী হয়েছে?”

হুরাইন স্বাভাবিক গলায় বলল,“আপনার ভাইয়ের সামনে যাইনি কেন, সেটা নিয়েই আম্মা রেগে আছেন।”

তাসিন ওভাবেই বলল,“গিয়ে ওকে খাবারটা দিয়ে চলে আসলেই পারতে। ও তোমার ছোটো ভাইয়ের মত।”

হুরাইন রেগে গিয়ে বলল,“আপনি কোন ব্যাপারে সিরিয়াস বলতে পারেন? নিজে পরিবর্তন হবেন না, আমাকেও বহাল থাকতে দিচ্ছেন না। ছোটো ভাই মনে করলেই তো হলো না। তাঁর সাথে আমার দেখা দেয়া জায়েজ নেই। তিনি নন-মাহরাম পুরুষ আমার জন্য। দেবর মৃ*ত্যু সমতুল্য।”

তাসিন বলল,“আচ্ছা আমরা যেটার ভয় পাচ্ছি, ও কিন্তু তেমন না। তোমার দিকে নজর দেওয়ার মতো কাজ ও করবে না৷ তাছাড়া সেই সাহস ওর নেই। ও জানে আমি ওকে কী করতে পারি।”

হুরাইনের আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও বলল,“ফিতনার জন্য স্বাভাবিক একটা চোখের দৃষ্টিই যথেষ্ট। দ্বিতীয়বার তাকানোর কুমন্ত্রণা শ*য়*তা*ন দিয়ে দেবে। সামান্য আমার স্বর যদি আপনার মনে অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে, আমাকে নিয়ে ভাবতে আপনাকে বাধ্য করতে পারে তাহলে দৃষ্টি কেন নয়?”

তাসিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এতো ধরাবাঁধা নিয়মে তো তারা বড়ো হয়নি। সে নিজের ভুল অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে। কেবল নামাজ পড়লেই যে তাকে প্রকৃত মুসলিম, প্রকৃত দ্বীনদার বলে না। প্রতিনিয়ত সে চেষ্টা করেও নিজের কাছে প্রতারিত হয়। শ*য়*তা*ন বলে ওঠে,“আল্লাহ ক্ষমাশীল। তুই পা*প করে ক্ষমা চাইলে তিনি মাফ করে দেবেন। আবার পা*প করবি আবার মাফ চাইবি। আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমা করবেন।”
তখন সে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আপনা-আপনি কেউ যেন তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। একজন মা*তা*ল যেমন ম*দ খেয়ে বেহুশ হয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায়, সেও তেমনি নিয়ন্ত্রণ হারায়। পরে অনুতপ্ত হয়। আমি কেন করলাম এটা? আবারও সে নিয়ন্ত্রণ হারায়। হুঁশ আসতে আবারও অনুতপ্ত হয়। এরজন্য দরকার শক্ত ইমান।

রাতে হুরাইন ঘুমিয়ে গেলেও তাসিনের ঘুম আসছে না। সে অপলক তাকিয়ে আছে হুরাইনের দিকে। কতশত চিন্তা তার মাথায় ভর করছে। দশটার আগেই তার শশুর ফোন করে মেয়েকে নিতে আসতে চান বলে দিল। তাসিন প্রথমে না করলেও পরে হার মানলো। হুরাইন অনেকদিন হলো বেড়াতে যায় না। তাই শশুরকে আর না করলো না। হুরাইন কাল যাবে। অথচ তাসিনের এখন থেকেই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হুরাইনের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে সে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো।

কথা অনুযায়ী জনাব আজাদ মেয়ের শশুর বাড়ি আসলেন মেয়েকে নিতে। তাসিন আগেই মা-বাবাকে বলে রেখেছে হুরাইনকে যেতে দিতে।
তাসিন অফিসে, হুরাইন চলে গেল তার বাবার সাথে। যাওয়ার আগে একবার কল দিয়ে বলল,“আমি বাবার সাথে যাচ্ছি।”

#চলবে…

এক টুকরো আলো পর্ব-১৭+১৮

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

কাঁধের দিকে জামা ছিঁড়ে বক্ষবন্ধনীর ফিতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একজন খিকখিক করে হেসে বলল,“দেখ দেখ কালো রঙের।”
কথা শেষ করেই ফিতা ধরে টা*ন দিয়ে পরপরই ছেড়ে দিল। রাবার জাতীয় জিনিস হওয়ায় তীব্র ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো। ফাবিহা অনবরত কেঁদে হাতজোড় করে বলছে,“আমি কী ক্ষ*তি করেছি তোমাদের? দোহাই লাগে আমাকে ছেড়ে দাও!”

অনেকেই হয়তো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। হয়তো মনে পড়ে গেল আমার মেয়েটাও তো রাস্তায় একা চলাফেরা করে। দোষ যারই হয়ে থাকুক ,আগে মেয়েটিকে রক্ষা করা জরুরি। দুজন মধ্যবয়সী পুরুষ এগিয়ে এসে ধমকে উঠলেন,“কী হচ্ছে কী এখানে? মেয়েটিকে ছাড়ো। বে*য়া*দ*ব ছেলে।”

সুমনের এক বন্ধু বলে উঠলো,“এখান থেকে যান। বীর সাজতে আসবেন না। বাড়াবাড়ি করলে জান নিয়ে ফিরতে পারবেন না।”

লোক দুটো দমে গেলেন না। এখনো মনুষ্যত্ব বেঁচে আছে। ছেলেটির গালে এক চ*ড় বসিয়ে দিলেন সাহস করে। এরপর আরো কয়েকজন এগিয়ে এলো। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কিছু যুবক। যেই লোকটি সুমনের বন্ধুর গালে থা*প্প*ড় দিয়েছেন, তিনি হাঁক ছেড়ে বললেন,“না দেখার মতো চলে যাচ্ছো। যখন তোমাদের বোন হেনস্তা হয়, তখন পাশ দিয়ে নির্বিকারে হেঁটে যাওয়া মানুষদের গা*লি দাও। কেন তাঁরা তোমার বোনকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না? তোমরাই সেই নির্বিকারে হেঁটে যাওয়া ছেলে। লজ্জা হওয়া উচিত তোমাদের। একই মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া মেয়েটাই কেবল তোমার বোন নয়। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া, ইভটিজিং, ধ*র্ষ*ণে*র শিকার হওয়া মেয়েটাও তোমার বোন। তোমার না হলেও কারো না কারো বোন।”

লজ্জা পেয়ে ছেলেগুলো এবার এগিয়ে এলো। সুমনের ছেলেগুলোকে ঘিরে ধরে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল। ফাবিহা শরীরে ওড়না মুড়িয়ে কাঁপছে আর চোখের পানি ফেলছে। কত বড়ো বিপদ থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছে। এখন একা বাড়ি যাওয়ার মতো শক্তি তার নেই। সুমন এতজনের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। হয়তো এরা পুলিশ ডাকবে। তাই ছেলেপুলে নিয়ে কেটে পড়লো। একে একে স্থান ফাঁকা হতে থাকলো। দাঁড়িয়ে রইলেন বাবার বয়সি সেই লোকটি। যিনি চ*ড় দিয়েছিলেন। ফাবিহাকে কাঁপতে দেখে তিনি নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“বাসায় যেতে পারবেন, মামনী?”

ফাবিহা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,“আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ আঙ্কেল। আমার জন্য আরেকটু কষ্ট করতে পারবেন? আমি একা বাড়ি যাওয়ার শক্তি পাচ্ছি না। একটা গাড়ি ঠিক করে দেবেন!”

লোকটি কথা না বলে একটা ট্যাক্সি ডেকে নিলেন। ফাবিহাকে তুলে দিয়ে নিজেও সাথে চড়ে বসলেন। অবাক হলো ফাবিহা। তার চোখে তা স্পষ্ট। লোকটি মৃদু হেসে বললেন,“আপনি মানসিকভাবে এখন দুর্বল। আপনাকে পৌঁছে দেওয়া আমার কর্তব্য।”

ফাবিহা ঢুকরে কেঁদে উঠে বলল,“আপনার এই ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না আঙ্কেল।”

“না কেঁদে শক্ত হওয়া জরুরি।”

ফাবিহাকে তার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল লোকটি। ফাবিহা বলল,“ভেতরে আসুন আঙ্কেল।”

লোকটি চমৎকার হেসে বললেন,“ বাড়ি চিনে গিয়েছি। অন্যদিন আসবো।”

“প্লিজ আঙ্কেল!”

ফাবিহার অনুরোধে লোকটি ভেতরে এলেন। সবটা শুনে ফাবিহার বাবা অস্থির হয়ে পড়লেন। অসুস্থ হওয়ার লক্ষণ। বিচলিত দেখাচ্ছে ফাবিহার মাকেও। বেশি সময় বসলেন না লোকটি। ফাবিহার বাবার সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করে শুধু চা নিয়ে উঠে গেলেন। ফাবিহার বাবা যে মেয়ের জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছেন, ভালো পাত্র খুঁজছেন সেটাও আলাপের এক পর্যায়ে বলে ফেললেন।

ফাবিহা ভেতর থেকে একেবারে ভেঙে গিয়েছে। তার এখন আর কিছুই ভালোলাগছে না। যে পর্যন্ত না কেউ তার পরিস্থিতিতে পড়ছে, কেউ ভেতরকার কষ্ট অনুভব করতে পারবে না। জীবন একঘেয়ে লাগছে। একটা ঘটনা ঘটার পর সেটা এক কান দুই কান করে ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয় না। এলাকার কারো হয়তো নজরে পড়েছে। সে পুরো এলাকা ঘটনাটি ছড়িয়ে দিয়েছে। অথচ যখন মেয়েটির সাহায্য প্রয়োজন, তখন এগিয়ে আসলো না।

অধিকাংশ লোকজনই এখন কানাকানি করে ফাবিহাকে নিয়ে। মেয়েটার নিশ্চয়ই চরিত্রে দোষ আছে, নয়তো খালাতো ভাই জানাশোনা মানুষের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও ছেলেটা কেন বিয়ে করলো না? দুবার বিয়ে ভেঙেছে। এখন ছেলেগুলোর সাথে দেখা গিয়েছে। নিশ্চয়ই কিছু করেছে, নয়তো ছেলেরা একটা মেয়েকে হেনস্তা করার এতো সাহস পায় কোথায়?
রাস্তাঘাটে বের হলেই লোকের কথায় আতাউর রহমান অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। ওনার বুক ব্যথাটা বেড়ে গেল। ফাবিহা বাবার কাছে গেল না। একমনে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো।

★★★

শাবাব অনবরত হেঁচে যাচ্ছে। সুরাইয়া ছোটো বাচ্চার মতো করে ছেলেকে ট্রিট করছেন। শাবাব মাকে দেখে আর করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে। মাকে কিছু বললেও তিনি শুনবেন না। বরং কেঁদে ভাসাবেন। মা কষ্ট পাক সে চায় না। তাই চুপচাপ মায়ের কাছ থেকে যত্ন নিচ্ছে। গোসলের পরপর একটা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে দিয়েছেন ভালো করে। ওটা রেখে আরেকটা শুকনো তোয়ালে নিলেন। শাবাব বলল,“চুলে আর পানি নেই তো মা।”

“তুই চুপ থাক। চুলে পানি থেকে তুই আরো অসুস্থ হয়ে যাবি। তোকে একটা লক্ষ্মী মেয়ে দেখে বিয়ে করাবো। যে আমার মতো তোর যত্ন নেবে।”

শাবাব হেসে ফেললো মায়ের কথা শুনে। হাসি বহাল রেখেই বলল,“আমি তো বিয়েই করবো না।”

সুরাইয়ার হাত থেমে গেল। জহুরি নজর ফেলে বললেন,“একবার না তোর বাবার সামনে বলেছিস বিয়ে করবি? মেয়ে আর মেয়ের বাবা রাজি না কিন্তু তুই রাজি। ওই মেয়ের ঠিকানা দে। দেখি আমার সোনার টুকরো ছেলেকে কে বিয়ে করতে না করে।”

শাবাব কেশে উঠলো। মা যদি সোনার টুকরো ছেলের বাইরের কু*কী*র্তি*র কথা শোনেন। ছেলে কয়টা প্রেম করে বেড়িয়েছে যদি জানেন তবে জায়গায় স্ট্রোক করবেন। সুরাইয়া শাবাবের সাড়া না পেয়ে আবারও চুল মুছতে মুছতে বললেন,“কীরে বল মেয়েটার ঠিকানা।”

শাবাব বলল,“ওটা তো বাবাকে রাগানোর জন্য বলেছি।”

সুরাইয়া বললেন,“যাইহোক, তোর পছন্দ না থাকলেও তোকে বিয়ে করতে হবে। একটা ভালো মেয়ে এনে দেব তোকে।”

শাবাব বলল,“সবাই তাদের ছেলের জন্য টুকটুকে পরী আনতে চায় আর তুমি শুধু ভালো মেয়ে আনতে চাইছো!”

“মেয়ে রূপবতী হয়ে লাভ কী যদি ভালো না হয়? যদি দু’জনের মাঝে সুখশান্তি না থাকে তবে সেই বিয়ের লাভ কোথায়?”

শাবাব করুণ চাহনি দিয়ে বলল,“হয়েছে তো মোছা।”

সুরাইয়া ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। আহ্লাদ করে বললেন,“তোকে আমার এখনো সেই ছোট্ট শাবাবই মনে হয়। একটুও বড়ো হোসনি।”

শাবাব বিড়বিড় করল,“সঠিক বয়সে বিয়ে করলে অন্তত দুটো বাচ্চার বাপ থাকতাম।”

সুরাইয়া শুনতে পেলেন না ছেলের কথা। শাবাবও এমনভাবে বলেছে যেন মায়ের কানে না পৌঁছে।
সুরাইয়া গেলেন ছেলের জন্য খাবার আনতে। ফিরোজ আলম তখন বাড়ি ফিরলেন। শাবাব আজ অসুস্থ। তিনি আগে ছেলেকে দেখতে তার ঘরে গেলেন। সুরাইয়াও খাবার নিয়ে শাবাবের ঘরে এসে ফিরোজ আলমকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,“তোমার আজ এতো দেরি হলো যে?”

ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ফিরোজ আলম বললেন,“আর বলো না! রাস্তাঘাটে আজকাল কোনো মেয়ে নিরাপদ নয়। শাবাবের ভার্সিটি থেকে কিছুটা দূরে একটা মেয়েকে কয়েকজন ছেলে হেনস্তা করলো। আমরা বাঁধা না দিলে মেয়েটা আজ ধ*র্ষ*ণে*র শিকার হতে পারতো। মেয়েটিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতেই দেরি হলো।”

শাবাব ভ্রু কুঁচকে বলল,“আমাদের ভার্সিটির কাছে?”

“হ্যাঁ।”

“ওহ্। মা খাবার টেবিলে নিয়ে যাও। বাবা এসে গিয়েছে, সবাই একসাথে খাবে।”

সুরাইয়া তাই করলেন। বাবা-মায়ের সাথে খাবার খেয়ে উপরে উঠে একটা সিগারেট নিয়ে দু-ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরলো। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ করে লাইটার অন করে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো উন্মুক্ত বাতাসে। ফোন হাতে ফরহাদকে কল দিল। ভার্সিটির সামনে এতবড়ো গ্যাঞ্জাম লাগলো আর সে জানে না? ফরহাদ কল ধরলো।
“আসসালামু আলাইকুম ভাই।”

“আজ ভার্সিটির সামনে কী হয়েছে রে?”
শাবাবের সোজাসাপটা প্রশ্ন শুনে ফরহাদ বলল,“সুমন আর তার ছেলেরা ফাবিহা মেয়েটাকে বা*জে*ভা*বে হেনস্তা করেছে।”

দপদপিয়ে উঠলো রাগ। চোয়াল শক্ত তার।
“তোরা কোথায় ছিলি হা*রা*ম*জা*দা?”

চমকে উঠলো ফরহাদ। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,“ভাই আমরা কী করবো? সুমনও আপনার শ*ত্রু আর ফাবিহা মেয়েটাও।”

“আমার শ*ত্রু হলেই কি তাকে এভাবে সুমনের হাতে ছেড়ে দেব? আমি প্রেম করে বেড়িয়েছি কিন্তু মেয়েদের ভো*গ করার কথা মাথায় ঢুকাইনি। সুমনের ইতিহাস তোর নিজেরই জানা। মেয়েটাকে ছেড়ে দেবে না ও। কতদিন থেকে এসব চলছে?”

“ভাই মেয়েটা আপনার শ*ত্রু। আপনি কেন এতো উত্তেজিত হচ্ছেন?”

শাবাব শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত রেখে বলল,“শ*ত্রু বলেই এতোকিছু করছি। ও আমার শ*ত্রু। তাই ওকে শাস্তি দেওয়ার অধিকারও আমার। সুমন কোথায় আছে খবর নে। আমি আসছি।”

ফরহাদের কথা শোনার আগেই কল কেটে দিল শাবাব। রাগে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। তার সাথে শ*ত্রু থেকেই ও ফাবিহার ক্ষ*তি করতে চাইছে। ওর এক্সদেরও হেনস্তা করেছে। তবে এতোটা নয়। ফাবিহার পেছনে বেশি ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে বলে হয়তো ভেবে নিয়েছে শাবাবের মনে ফাবিহার জন্য সফট কর্নার আছে। সেজন্যই ফাবিহার ক্ষ*তি করতে এভাবে উঠেপড়ে লেগেছে।

★★★

তাসিন আলসে ভঙ্গিতে ঘরেই নামাজে দাঁড়ালো। হুরাইন অনেকক্ষণ ধরে কানের কাছে মৌমাছির মতো ভোঁ ভোঁ করছিল। মসজিদে গিয়ে জামাত ধরার সময় নেই। তাই ঘরেই দাঁড়ালো। এতক্ষণ ফোন ঘাটছিল সে।
নামাজে দাঁড়িয়ে সূরা ভুলে যাচ্ছে। মাথায় নানারকম চিন্তাভাবনা আসছে। তাদের কোম্পানির নতুন প্রজেক্ট নিয়ে মাথায় ভাবনা আসছে। কানে গানের সুর ধ্বনিত হচ্ছে। সিজদায় গেল। চোখে একটু আগে ফোনে দেখা বিভিন্ন অন্তরঙ্গ দৃশ্য ভাসছে। বারবার চোখ বন্ধ করছে। তবুও এসব যাচ্ছে না।
চোখের জি*না খুব ভয়*ঙ্কর। নামাজে দাঁড়ালেও তা চোখে ভাসে। আমরা ফোনে অনেকিছুই দেখি। যা আমাদের কাছে স্বাভাবিক, বিনোদন মাত্র। অথচ এসব চোখের জি*না।
কোনোভাবে নামাজ আদায় করলো তাসিন। হুরাইন চা নিয়ে আসলো। তাসিনের দিকে বাড়িয়ে দিল মিষ্টি হেসে। সে যথেষ্ট স্বাভাবিক থেকে ধৈর্যধারণ করার চেষ্টা করছে। লড়তে চাইছে। এ বাড়ির কোনো কিছুই বাবার বাড়ির কারো সাথে শেয়ার করছে না।
তার স্বামী, শাশুড়ি, ননদ হয়তো পরিবর্তন হয়ে যাবেন। কিন্তু সে যে তাদের দো*ষ সবার কাছে বলে বেড়াবে, তার রেশ থেকে যাবে। তাদের পরিবর্তন হলেও কেউ তাদের ভালোচোখে দেখবে না। তাতে হুরাইনের নিজেরই খারাপ লাগবে। সে আশাবাদী সবাই একদিন পরিবর্তন হবে। আল্লাহর উপর সে সবসময়ই ভরসা করে।
যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কারো পরামর্শের প্রয়োজন পড়ছে, ততক্ষণ কিছুই বলবে না কাউকে। লড়াইটা তার একার।

#চলবে…….

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

রাতের খাবার তৈরি করতে করতে জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তি পাবার আশায় সুমধুর সুরে সূরা মূলক পাঠ করছিল হুরাইন। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন সাজেদা। শুনতে খা*রা*প লাগছে না। বরং অন্তরে শান্তি অনুভব করছেন। তাঁরই পেছনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছে তাসিন। তার স্ত্রীকে আল্লাহ যেন সব রকম গুণ দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত সূরা মূলক পাঠ করছিল হুরাইন, ততক্ষণ পর্যন্ত মা – ছেলে নড়চড় করলেন না। সে পিছু ফিরতেই সাজেদা থতমত খেয়ে গেলেন। দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন।

এখন গভীর রাত। ঘুম ভেঙে গেল হুরাইনের। সে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে। তাসিন আর তার মাঝে অজানা এক দূরত্ব এসে তাদের আলাদা করে দিয়েছে। দু’পাশ থেকে দুজনের এক হওয়ার হাহাকার। ডিম লাইটের আলোয় তাসিনের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাঁপা হাত এগিয়ে নিয়ে ওর মুখটা ছুঁয়ে দিল। বিড়বিড় করে বলল,“আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন আপনাকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।”

তাসিন নড়েচড়ে উঠলো। হুরাইনের হাত মুখ থেকে সরিয়ে ঘুমের ঘোরে হাতটি জড়িয়ে ধরলো। হুরাইন কিছুক্ষণ স্থির বসে রইল। অপর হাত বাড়িয়ে সময় দেখলো। এখনো তিনটা বাজতে সাত মিনিট বাকি। তাসিনের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো সাবধানে। তারপর ওজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নিলো। ফজরের আজান পর্যন্ত তার নিঃশব্দে কান্নাকাটি চললো তার আল্লাহর কাছে। আজান হতেই তাসিনকে ডাকতে এলো। সে উঠতে খুব দেরি করে। হুরাইন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো।
“শুনছেন? ফজরের আজান হয়েছে।”

তাসিন “হুম” বলেই চুপ হয়ে গেল। হুরাইন আবারও ডাকলো, আবারও ডাকলো। তাসিন ‘উঠছি’ বলে আবারও ঘুমে তলিয়ে গেল। এটা নিত্যদিনের কাজ। হুরাইন আক্ষেপ করে কীসের দুঃখ তার? স্বামী তাকে জ্বালাতন করে? মা*র*ধ*র, গা*লা*গা*লি করে? না, নিঃসন্দেহে সে একজন ভালো স্বামী। শাশুড়ি, ননদ তাকে অপছন্দ করলেও সারাদিন পেছনে লেগে থাকে না। তবে কীসে তার দুঃখ?
এই পরিবারে সব আছে। তবে দ্বীন নেই। সকলের অন্তর কালো ছায়ায় ঢেকে আছে। এটাই যে তার বড়ো দুঃখ। কেন এই মানুষগুলো আখিরাত চিনে না?
হুরাইন গ্লাস থেকে পানি নিয়ে ছিটিয়ে দিলো তাসিনের চোখেমুখে। লাফ দিয়ে উঠলো সে। ঘুম ভেঙে বিরক্তি গলায় বলল,“পানি মা*র*লে কেন? আমি তো উঠতাম।”

হুরাইন হাসলো না। কঠিন মুখভঙ্গিতে বলল,“সেটা প্রতিদিনই দেখি। আচ্ছা আপনার কি আমার সাথে থাকার ইচ্ছে নেই? কেন এতো অবহেলা করছেন সবকিছু। আমার কথা বাদ দিন, নিজের প্রতি মায়া হয় না? কোথায় ডুবে আছেন? একবার চোখ মেলে দেখুন। যতদিন না আপনি মন থেকে আগ্রহী হবেন, আমি কেন কেউ আপনাকে পরিবর্তন করতে পারবে না।”

তাসিন আলসে ভঙ্গিতে বলল,“এতো কঠিন কথা কেন বলছো?”

হুরাইন হতাশ চোখে তাকায়। তারপরই তাসিনকে ঠে*লে দিয়ে বলে,“যান ওজু করে আসুন।”

তাসিন পরিষ্কার হয়ে ওজু করে বের হলো। নামাজ পড়ে এসে বিছানায় শুতে গেলেই হুরাইন বাঁধা দিল।
“এখন ঘুমাবেন না। চা খান। তারপর কাজ করুন। সকালবেলা কাজে বরকত হয়। মস্তিষ্ক সচল থাকে।”

তাসিন বিরক্ত হয়।
“হুরাইন কেন এমন করছো? রাতে দেরি করে ঘুমিয়েছি। এখন ঘুমাতে দাও।”

হুরাইন বলল,“আপনাকে তো কেউ বলেনি রাত জাগতে। আপনি তো ফোনে ব্যস্ত ছিলেন।”

“তুমি দিনদিন কঠোর হয়ে যাচ্ছো হুরাইন।”

“আমি কঠোর হচ্ছি না। আমি শুধু সত্যটাই বলছি।”

“আচ্ছা, এখন ঘুমাতে দাও প্লিজ!”
তাসিন শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মাঝে ঘুমিয়েও পড়লো। হুরাইন কিছুই বললো না। পা চলছে না। সে জোর করে পা টেনে রান্নাঘরে ঢুকলো। সকলের জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রাখলো। সময় দেখে তাসিনকে ডাকতে গেল।
“আপনার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে, উঠুন।”

প্রথমবারেই জেগে গেল তাসিন। হুরাইনের ঠোঁটে আফসোসের হাসি। ফজরের নামাজের জন্য মুয়াজ্জিন ডাকেন, স্ত্রী বারবার ডাকে। ওঠার কোনো তাড়া নেই। অথচ অফিস যাওয়ার তাড়া ঠিকই আছে। বলল,“অফিসের বসকে এতো ভয়? অথচ যে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তাঁকে ভয় নেই। নাস্তা করতে আসুন।”

হুরাইন বেরিয়ে গেলেও তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো তাসিন। গভীর ভাবে হুরাইনের কথাটি নড়াচড়া করলো। তারপর কী ভেবে যেন উঠে পড়লো। নাস্তা করে আবার ঘরে ফিরে তৈরি হয়ে নিলো অফিসের জন্য। নিশি এসে পাশে দাঁড়ালো। গলায় একটা ওড়না ঝুলানো।
“ভাইয়া আমাকেও নামিয়ে দিও।”

“চল।”

হুরাইন বলল,“বোরকা পরলে দেখতে সুন্দর লাগে আপু।”

নিশি কথা বললো না। তার চোখমুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে চরম বিরক্ত। তাসিন বলল,“ও বড়ো হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তাসিনের মানসিকতা দেখে আশ্চর্য হয় হুরাইন। একটা কলেজে পড়ুয়া মেয়ে আর কত বড়ো হলে তাকে বড়ো বলা হবে?
“স্ত্রী ছোটো হোক বা বড়ো, তার ক্ষেত্রেই পর্দা ফরজ। আর বোনের ক্ষেত্রে কোনো গুনাহ নেই বলছেন? একজন বেপর্দা নারীর জন্য চারজন পুরুষ জাহা**ন্নামী হবে জানেন তো? তার মধ্যে বড়ো ভাই একজন।”

নিশি ছ্যাৎ করে উঠলো।
“দেখুন ভাবি, এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আমি মানছি আমি আপনার মতো পর্দানশীন নই। কিন্তু অশালীন চলাফেরাও করি না। জিন্স, টপ পরে ঘুরি না।”

“নিজের ভালো নিজে না বুঝলে কার সাধ্যি আপনাকে বুঝানোর?”

তাসিন এবার বলল,“তোকে তো আমাদের বিয়ের আগে একটা বোরকা কিনে দিয়েছিলাম। ওটা তো পরতে পারিস।”

“ওটা আমি একজনকে দান করে দিয়েছি।”

“তাহলে মাথায় কাপড় দিয়ে নে। আজ আরেকটা বোরকা কিনে দেব।”

“তোমার আমাকে নামিয়ে দিতে হবে না। আমি একাই যাচ্ছি।”

নিশি ভাইয়ের সাথে রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে যেতেই তাসিন নরম স্বরে বলল,“এভাবে না বলে একটু বুঝিয়ে বললেই পারতে।”

হুরাইন কথার জবাব দিলো না। মাঝেমাঝে সে নিজের প্রতিই বিরক্ত হয়ে যায়।
তাসিন বেরিয়ে গেল বোনের পিছু পিছু।

হুরাইনের প্রতি ক্ষো*ভ*টা রয়ে গিয়েছে নিশির। বাড়ি ফেরার পর থেকেই নানা ভাবে হুরাইনকে কথা শোনানের চেষ্টা করছে। হুরাইন জবাব দিচ্ছে না কিছুরই। এক পর্যায়ে নিশি বলল,“ফাবিহা আপু আমার ভাবি হলে কত ভালো হতো। অথবা ভাইয়ার বান্ধবীদের মধ্যে কেউ একজন হতে পারতো। ভাইয়ার প্রতা*রণা*র কারণেই সবটা এলোমেলো হয়ে গেল।”

এবার মস্তিষ্কে চাপ পড়লো হুরাইনের। কৌতুহলী স্বরে জানতে চাইলো,“মানে? তোমার ভাইয়ার বান্ধবী ছিল? আর ফাবিহা আপু, কিছু বুঝলাম না।”

“বান্ধবী ছিল না, এখনো আছে। আর ফাবিহা আপুর সাথে ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তাদের মধ্যে সবটা ঠিকঠাক ছিল। তারপর সে আপনার রূপে মজে বিয়েটা ভেঙে দিল। মন ভাঙলো ফাবিহা আপুর। মেয়েটা কতো কান্নাকাটি করেছে।”

উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে হুরাইন। তার এসব মানতে কষ্ট হচ্ছে। প্রশ্ন করলো,“এসবের সত্যতা কতটুকু?”

“বিয়েতে আমার মায়ের পক্ষের কাউকে দেখেছেন? দেখেননি। এই কারণেই কেউ রাগ করে আসেনি। ফাবিহা আপু লুকিয়ে এসেছিল কেবল আপনাকে দেখতে। কোন রূপবতীর মোহে পড়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করলো সেটা দেখতে এসেছে। আর পুরোপুরি বিশ্বাসের জন্য মাকে জিজ্ঞেস করুন তারপর নিজের স্বামীকেই জিজ্ঞেস করে নেবেন।”

হুরাইন অপেক্ষায় রইল। আজকের অপেক্ষা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। যতক্ষণ পর্যন্ত না তাসিনের মুখের স্বীকারোক্তি পাচ্ছে, ততক্ষণ সে শান্ত হতে পারবে না।

দুপুরে খাবার র নামাজের বিরতি দেওয়া হলো। যদি দুই-একজন নামাজ বিরতি মানলেও সকলেই খাবার বিরতি হিসেবেই সময় নষ্ট করে। তাসিন বিরতি পেয়ে নামাজ পড়ে নিলো। একজন কলিগ বললেন,“তাসিন সাহেব তো হুজুর হয়ে গেলেন। মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ।”

আরেকজন বললেন,“কতদিনের জন্য এই পরিবর্তন।”
ভদ্রতারও প্রয়োজন মনে করলেন না। হেসে ফেললেন তিনি। তাসিন বলল,“এমনভাবে বলছেন কেন ভাই? পরিবর্তন হতো ক্ষতি কী?”

চলে যেতে নিতেই শুনতে পেল “এমন অনেককেই দেখেছি। ক’দিন হুজুর হয়ে যায়। পরে আবার শ*য়*তা*নে*র লেবাস ধরে।”

“আরে ভাই, এসব মানুষের এটেনশন পাওয়ার কৌশল। গান-বাজনা, মেয়ে বান্ধবী, মেয়ে কলিগ সবার সাথে গদগদ সম্পর্ক রাখছে। আবার হুজুর সাজতে এসেছে।”

রাগ হচ্ছে তাসিনের। যতবার সে নিজেকে পরিবর্তন করতে চায়, ততবারই সে হেরে যায়। শ*য়*তা*ন ধোকা দেয়, এই আশেপাশের মানুষগুলো বিদ্রুপ করে। নিজের নফসের সাথে যুদ্ধ করা সহজ নয়।

★★★

শাবাব বাড়ি ফিরতেই সুরাইয়া আঁতকে উঠলেন। ছেলের চেহারার এ-কি হাল! চোখে আগুনের ফুলকি। শরীরের কিছু জায়গায় আ*ঘা*তে*র চিহ্ন। এসব নতুন নয় সুরাইয়ার কাছে। ছেলের এসবের রেকর্ড আছে। প্রায়শই মা*রা*মা*রি করে বাড়ি ফেরে। তিনি বিচলিত হয়ে বললেন,“আব্বা আবার কোথায় মা*রা*মা*রি করেছো?”

কথা বলতে বলতে সুরাইয়ার চোখে পানি এসে ভীড় জমালো। শাবাব গম্ভীর মুখে বলল,“হাত-পা ব্যথা করছে। ভেতরে ঢুকতে দাও।”

সুরাইয়া সরে দাঁড়াতেই শাবাব নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল। সুরাইয়া কাঁদতে কাঁদতে ছেলের মাথার কাছে এসে বসলেন। বিলাপ করছেন বসে বসে। শাবাব চোখ বন্ধ করে নিলো। সুমনের সাথে আজ প্রচুর মা*রা*মা*রি হয়েছে। সেদিন সুমনের খোঁজ পায়নি বলে বেঁচে গিয়েছে। আজ সুযোগ বুঝে ক্ষো*ভ মিটিয়ে মে*রে*ছে তাকে। নিজেও মা*র খেয়েছে। তবে সুমনের অবস্থা করুণ। হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। এখনো রাগ কমছে না তার। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।

ফাবিহা সারাদিন বাড়িতে বসে থাকে। তার দিকে তাকালেই তার মায়ের কান্না আসে। তিনি মেয়ের আড়ালে গিয়ে কান্নাকাটি করেন। কেন মেয়েটার জীবন এলোমেলো হয়ে গেল?
আতাউর রহমান ফাবিহাকে বললেন, “তৈরি হয়ে নে। আমরা থা*না*য় যাবো।”

ফাবিহা নড়ে না। জায়গায় স্থির বসে থাকে। তার মন এখন কোনো কিছুতেই সায় দেয় না। আতাউর রহমান তাড়া দেন। ফাবিহা বলে,“কী হবে বাবা? ওরা ছাড়া পেয়ে আরও হিং*স্র হয়ে উঠবে। ওদের থানা পুলিশের রেকর্ড আছে।”

“তাই বলে চুপ করে থাকবো?”

ফাবিহা কথা বলে না। আতাউর রহমান বললেন,“তোর ফুফুর কাছে কিছুদিন থেকে আয়।”

“ভালোলাগে না বাবা।”

“ঘুরে আয়, দেখবি ভালোলাগবে। বাবা কাল সকালে দিয়ে আসবো।”

মাও বললেন, “যা, ঘুরে আয়।”

“ঠিক আছে।”
ছোটো করে জবাব দিলো ফাবিহা। আতাউর রহমান মেয়েকে বোনের কাছে দিয়ে থাকার জায়গা পরিবর্তন করার কথা পরিকল্পনা করে নিলেন। এখান থেকে চলে যাবেন। এই শহরে ওনার মেয়ে ভালো থাকবে না।

এর মাঝে বাড়িতে মেহমান এলো। ফাবিহাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া লোকটি, ফিরোজ আলম। তিনি এসেছেন একটি সুখবর নিয়ে। ফাবিহার জন্য সমন্ধ নিয়ে এসেছেন ওনার বোনের ছেলের জন্য। সুযোগ্য ছেলে। সংসারে ঝুট ঝামেলা নেই। বিয়ের পর ছেলে নিজের কাছে বউকে বিদেশ নিয়ে যাবে। আতাউর রহমান সবটা শুনে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তিনি ভাবেননি ফিরোজ আলম সমন্ধ নিয়ে আসবেন। সেদিন তো দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আনমনে মেয়ের বিয়ের কথা বলে ফেলেছেন।

ফাবিহার ফুফুর বাড়ি যাওয়া ক্যান্সেল হয়ে গেল। আগে পাত্রপক্ষ এসে দেখে যাক। তারপর মেয়ে ঘুরে আসবে।

ফিরোজ আলম রাতে বাড়ি এসে খাবার টেবিলে কথা তুললেন। সেদিনের মেয়েটির বাবার কাছে রোমাইজার ছেলের জন্য তিনি প্রস্তাব রেখেছেন। রোমাইজার সাথে কথা বলেই ছেলেকে নিয়ে মেয়ে দেখতে যাবেন। টেবিলে শাবাবও উপস্থিত ছিলো। খেতে খেতেই বলল,“কোন মেয়ে?”

“তুই যেদিন অসুস্থ ছিলি, সেদিন বাড়ি এসে যে মেয়েটার কথা বলেছিলাম তার কথাই বলছি।”

ভ্রু কুঁচকে গেল শাবাবের।
“মানে কী? নয়নের জন্য ওই মেয়েকে কেন তোমার উপযুক্ত মনে হলো?”

“তুই তো দেখিসনি। দেখলে এই কথা বলতি না।”

শাবাব বিড়বিড় করে বলল,“আমার আগে তুমি দেখোনি। ওর বিয়ে তো আমি হতেই দেব না। আমিও দেখি তুমি কীভাবে আমার শ*ত্রু*কে ভাগ্নের বউ বানাও।”

সুরাইয়া বললেন,“কিছু বলছিস?”

“হ্যাঁ। মাছ দাও।”

#চলবে……

এক টুকরো আলো পর্ব-১৫+১৬

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

হুরাইন রান্নাঘরে কাজ করছে। সাজেদাও নিজের মত করে সাহায্য করেন তাকে। মাঝেমাঝেই বলেন,“তোমার কাজ আমার পছন্দ না। আমার মত করতে না জানলে করার দরকার নেই। আমি নিজেই করে নেব।”

হুরাইনের মন খারাপ হয় না৷ তারও অবশ্য কারণ আছে। কাজকর্মে অন্যরা তার প্রশংসা করলেও মা ওকে প্রায়ই বলতেন,“তোর কাজকর্ম আমার পছন্দ হয় না৷ আমার কাজ আমিই করবো।”

একটা নারী ২০-৩০ বছর একটা সংসারের দায়িত্ব নিলে, একাহাতে একভাবে সবটা গুছিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলে হঠাৎ নিজের হাতের কাজ অন্যকেউ অন্যভাবে করলে স্বাভাবিক তার পছন্দ হবে না। তাই হুরাইন মন খারাপ না করে বলে,“আমাকেও আপনার মত শিখিয়ে দিন আম্মা।”

সাজেদা আড়চোখে তাকান। কিছু না বলে নিজের মত কাজ করে যান। হুরাইন মনোযোগ দিয়ে দেখে সাজেদার কাজের ধরণ ধরে রাখার চেষ্টা করে। সাজেদা বসে সবজি কাটছেন। একটু দূরে চুলার কাছে হুরাইন। হঠাৎ কী যেন এসে হুরাইনের গায়ে পড়লো। চমকে উঠে গা ঝেড়ে নিচে তাকাতেই পায়ের কাছে সাপ দেখে অস্পষ্ট স্বরে “আম্মা, আম্মা, আম্মা” বলে সাজেদার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। এমন ছুটে এসে পেছনে দাঁড়িয়ে হুরাইনকে বিড়বিড় করে ওনাকে ধরতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“কী হয়েছে?”

“আউজু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খলাক।”
বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে যাচ্ছে সে। সাপ, বি*ষা*ক্ত পোকামাক, হিং*স্র প্রাণীর আক্র*মণ থেকে বাঁচার ক্দোয়া এটি। সাজেদার নজরে পড়লো সাপটি। তিনিও চমকে গেলেন। এটাকে মা*র*তে হবে। হুরাইনকে নিয়ে রান্নারঘর থেকে বের হতে গিয়ে তাসিনকে ডাকলেন। দু’জন বেরিয়ে দেখে তাসিন রান্নাঘরের বাইরে। ঠোঁট টিপে হাসছে। সাজেদা আতঙ্কিত স্বরে বললেন,“রান্নাঘরে সাপ। কোথা থেকে এলো জানিনা। ওটাকে তাড়ানোর ব্যবস্থা কর।”

তাসিন হাসতে হাসতে বলল,“সাপটি কি নড়াচড়া করছিল?”

“এতকিছু আমি খেয়াল করেছি? তাড়াতাড়ি ওটা তাড়া।”

তাসিন রান্নাঘরে ঢুকে সাপ হাতে নিয়ে বের হলো। সাজেদা কিছু বলতে যাবেন, তাসিন ওটা মায়ের হাতে দিয়ে দিল। তিনি সাপটি ছুঁড়ে মে*রে পিছিয়ে গেলেন দ্রুত। কপট রাগ দেখাতে গিয়েও ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলেন ওটা নড়াচড়া করছে না। হুরাইনও খেয়াল করলো। তাসিন বলল,“এটা আর্টিফিশিয়াল সাপ।”

স্বস্তির শ্বাস ফেললেও ছেলেকে থাপ্পড় দিয়ে বললেন,“জা*নো*য়া*র, এত ফাজলামি কেউ করে?”

তাসিন হেসেই চলল। সে জানে তার মা-বোন সাপে ভয় পায়। কোনো দিকে না তাকিয়ে ছুট লাগায়। তবে হুরাইনও যে ভয় পায়, তা আজ দেখে নিলো।
হুরাইন শাশুড়ির উদ্দেশ্যে মিনমিন করে বলল,“সন্তানকে এসব বলা উচিত নয় আম্মা। বাঙালি মায়েরা বিরক্ত হলেই সন্তানকে জা*নো*য়া*র, কু*ত্তা*র বাচ্চা, অ*জা*তে*র বাচ্চা ইত্যাদি গা*লি*গা*লা*জ করে থাকেন। এগুলো ঠিক না। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাদেরকে কোনো পশুর সাথে তুলনা করা, গা*লি দেওয়া হা*রা*ম। আল্লাহ না*রা*জ হন।”

সাজেদা বিরক্তি ফোটিয়ে বললেন,“আমি কি সত্যি বলছি নাকি? এটা তো কথার কথা বলে ফেলি। আর আমার ছেলে-মেয়ে জানে এসব আমি মন থেকে বলি না। এসেছো থেকে তুমি আমার হাজারটা খুঁত ধরছো। মনে হচ্ছে আমি না, তুমি আমার শাশুড়ি।”

হুরাইন আরও নিচু স্বরে বলল,“ক্ষমা করবেন আম্মা। আপনার খুঁত ধরার উদ্দেশ্য আমার নেই। কোনো মা-ই সন্তানের অমঙ্গল চান না, মন থেকে কিছু বলেন না। এসব বলে থাকেন বিরক্তি কিংবা রাগের মাথায়। শুধু সন্তান কেন? কাউকেই গা*লা*গা*ল দেওয়া উচিত নয়।”

তাসিন বলল,“আচ্ছা বাদ দাও।”

সাজেদা থমথমে অবস্থায় আবার রান্নাঘরে ঢুকলেন৷ পিছু পিছু হুরাইন গেল।

ঘুমাচ্ছে তাসিন। আজ অফিস থেকে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীর ক্লান্ত। মাগরিবের আজান পড়েছে। হুরাইন তাকে ডেকে দিল। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। এখন ওঠার ইচ্ছেশক্তি বিন্দুমাত্র নেই। সে শুয়েই রইলো। দুই মিনিট পরই উঠে যাবো এমন একটা ভাব হলেও গভীর ঘুমের ভারে পাঁচ মিনিট অতিক্রম হয়ে গেল। হুরাইন আবার ডাকলো। তাসিনের মনে হলো সে এক সেকেন্ড আগে চোখ বুজেছে। বিশ্বাস করলো না হুরাইনের কথা। এবার হুরাইন গলায়, ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিল। তারপর বুকে। মাথা তুলে দেখে তাসিন ঘুম ঘুম চোখে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। হুরাইনের চোখে চোখ পড়তেই ধীর গলায় শুধালো,“কী করছো?”

হুরাইন নিষ্পাপ চেহারা বানিয়ে বলল,“আপনি তো উঠছিলেন না।”

তাসিন ক্ষণ সময় তাকিয়ে থেকে উঠে যেতে যেতে বলল,“নামাজ পড়ে আসি। তোমার শাস্তির ব্যবস্থা পরে করছি।”

ভেংচি কাটলো হুরাইন। তাসিন চোখ সরু করে বলল,“আমি আসলেই দেখা যাবে। দেখি তুমি কতটুকু সুড়সুড়ি সহ্য করতে পারো।”

হুরাইন বলল,“অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি অজু করে ছুটুন মসজিদে।”

সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন। তাসিন মাঝেমাঝে কাজের চাপ বেশি থাকলে বাসাতেও কিছু কাজ এগিয়ে রাখে। আজও ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে। হুরাইন এক কাপ চা নিয়ে এলো। মিষ্টি সুরে বলল,“আপনার চা।”

কথা বলল না তাসিন। তার চোখ এবং হাত ল্যাপটপে। কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে গাল ফুলিয়ে হাতের নিচ দিয়ে তাসিনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো হুরাইন। এবারেও পাত্তা পাচ্ছে না। তাসিনের একহাত টে*নে নিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলে ছোটো ছোটো কামড় বসালো। এক হাতে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে বলে এবার মনোযোগ দিয়ে হুরাইনের কর্মকাণ্ড পরোখ করলো। ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,“এমন বিড়ালের মত আচরণ করছো কেন? তুমি কি বিড়াল?”

হুরাইন ডবডবে চোখে তাকিয়ে বলল,“আপনি জেনেও ঢং করছেন?”

তাসিন দু-কাঁধ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“কী জানি আমি?”

এবার কেঁদে ফেলবে হুরাইন। মৃদু রাগ ঝেড়ে বলল,“আপনি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন না কেন?”

তাসিন ভাবলেশহীন বলল,“কারণ আমি যেতে পারবো না। আমার ছুটি নেই। তোমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে আমার। ভয়ঙ্কর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছ।”

“ওহ আচ্ছা, শুধু অভ্যাস?” গাল ফোলালো হুরাইন।

তাসিন কাছ ঘনিয়ে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে নিলো। হুরাইনের অনাবৃত কপালে চুমু খেয়ে গভীর স্বরে বলল,“অভ্যাস থেকেই ভালোবাসা।”

হুরাইন অনুনয় করে বলল,“প্লিজ যেতে দিন না!”

তাসিন গম্ভীর হয়ে ঠেলে উঠিয়ে দিল হুরাইনকে। গমগমে স্বরে বলল,“তোমার যেতে ইচ্ছে হলে যাও। আমাকে জানানোর দরকার নেই।”

খুব কষ্ট পেল হুরাইন। স্বামীর কথা অমান্য করে এক পাও বের হতে পারবে না সে। এদিকে বাবা-মায়ের কথাও খুব মনে পড়ছে। মন খারাপ করে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপ হাতে বেরিয়ে গেল। তাসিন সাথে সাথেই ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
হুরাইন রাতের খাবারেরও প্রয়োজন ছাড়া কথা বললো না। ঘরে এসেও হু, হা তে জবাব দিয়েছে।
ঘুমাতে গিয়ে তাসিন যখন বুকে টেনে নিলো, তখনও সে প্রতিক্রিয়াহীন। চুপচাপ লেপ্টে রইলো বুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে তাসিন বলল,“কেউ চাইলে কিন্তু শুক্রবার যেতে পারে। সকালে নিয়ে যাবো, বিকেলে আবার আমার সাথে চলে আসবে।”

সাথে সাথে মাথা তুললো হুরাইন। এতক্ষণ মলিনতায় ঢেকে থাকা মুখে হাসি ফোটে। তীব্র উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,“সত্যি? নিয়ে যাবেন আমাকে? আপনি কিন্তু বলে ফেলেছেন। এখন মত পরিবর্তন করতে পারবেন না।”

তাসিনের কপাল ভাঁজ পড়ল। বলল,“তুমি না আমার উপর রেগে ছিলে?”

হুরাইন অবাক হয়ে বলল,“আমি কখন রেগে ছিলাম? শুধু একটু কৌশল অবলম্বন করে দেখলাম কেমন কাজে লাগে। তাই কথা কমিয়ে দিয়েছি।”

তাসিন চোখ বড়ো করলো ঈষৎ।
“তুমি খুব চালাক মেয়ে।”

খিলখিল করে হেসে ফেললো হুরাইন। তাসিন অপলক তাকিয়ে থেকে বিবশ কন্ঠে বলল,“এভাবে আর কারো সামনে হেসো না।”

হুরাইন হাসি থামিয়ে বলল,“আমি তো কারো সামনে যাই না।”

তাসিন তাকে আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল,“যেতে হবে না। তুমি কেবল তাসিনের ভালোবাসা।”

হুরাইন শুধালো, “আর আপনি?”

তাসিন চুপ করে হুরাইনের উৎকণ্ঠা দেখলো। অতঃপর বলল,“কেউ যদি আমায় ভালোবাসে স্বীকার করে নেয়, তবে আমি তার ভালোবাসা। কিন্তু আফসোস কেউ আমাকে এখনো ভালোবাসেনি।”

হুরাইন বলতে পারলো না কিছুই। সে লজ্জা পেয়ে মুখ লুকিয়ে ফেললো। তাসিন বলল,“যাকে লজ্জা পাচ্ছো, তার বুকে মুখ লুকিয়ে লজ্জা নিবারণ করার সাইন্স বুঝলাম না।”

হুরাইন মুখ গুঁজে রেখেই বলল,“এত সাইন্স বুঝার দরকার নেই।”

★★★

দুদিন বেশ আনন্দেই সময় কাটলো ফাবিহার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে ভার্সিটি আসা-যাওয়া করেছে। আজ আবার নতুন ঝা*মে*লা সৃষ্টি হলো। কিছু ছেলেপুলে অ*শা*লী*ন ভাষায় কথাবার্তা বলছে। ফাবিহাকে দেখে ডেকে উঠে বলল,“ শাবাবের মা*ল না? তোমার নাগর তো নাকি কোন মেয়ের পেছনে পড়ে হা*জ*তে আছে। তোমায়ও ছেড়ে দিল নাকি? শা*লা*রে মনে হয় তুমিও সন্তুষ্ট করতে পারোনি। খেয়ে ছেড়ে দিল। আহারে! আমাদেরও খাওয়ার সুযোগ দাও।”

ফাবিহার চোখে জ্বলন্ত আগুন। চোয়াল শক্ত করে বলল,“আ*জে*বা*জে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। শাবাবের মা*ল মানে কী? আমার সাথে তার সম্পর্ক ছিল কখনো? খেতে চান, না?
কু*লা*ঙ্গা*র।”

হো হো করে হেসে উঠলো ছেলেগুলো। তাদের লিডার আবার বলল,“ওর সাথে তো মজা মাস্তি করেছো। এখন আমরা করতে চাইলেই দো*ষ?”

ফাবিহা এতগুলো ছেলেকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। তবুও তার রাগ তার বিবেককে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। সে কথাগুলো এড়িয়ে যেতে পারছে না।
পাল্টা জবাবে বলল,“ বিশেষ মুহূর্তে দোয়া পড়তে ভুলে গিয়ে তোদের মতো কু*লা*ঙ্গা*র, শ*য়*তা*নে*র জন্ম। এভাবে বলতে চাইনি। তবুও বলছি, তোরা এসবের যোগ্য।”

রাগে হনহনিয়ে চলে গেল সে। ছেলেগুলো মাছি তাড়ানোর মতো করে বসে রইলো। শাবাবের সাথে বনাবনি নেই তাদের। শাবাবের সাথে সম্পর্ক থাকা যতগুলো মেয়েকে ওরা চিনে, সবাইকেই এমনভাবে হেনস্তা করেছে। এই পর্যন্ত একটা মেয়েও প্রতিবাদ করেনি। তবে এই মেয়েটা তেজী। একে নিয়ে মজা নেওয়া যাবে বেশ।

ফাবিহা বাড়ি ফিরে রাগ ঠান্ডা হতেই নিজের শেষ কথায় অনুতপ্ত হলো। বাবা-মায়ের তো দোষ নেই। নিজের কর্মের কারণেই এরা কথা শোনে। তার উচিত হয়নি এত বড়ো কথা বলা। সব শাবাবের দো*ষ। তার কারণে হয়েছে এতকিছু। ওর কারণেই তাকে অশা*লীন ভাষায় কথা বলতে পেরেছে ছেলেগুলো। ইচ্ছে করছে হাতুড়ি দিয়ে পি*টি*য়ে শাবাবের মাথা ফাটিয়ে ফেলতে। জে*লে গিয়েও তাকে শান্তি দিল না।

শাবাব জে*লে থেকেও বেহায়া ঠোঁটে হাসছে। রগঢ় করে বলল,“জানেমান চলো তোমাকে তোমার শশুর বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে আসি।”

ফাবিহা গিয়েছিল আজকের ছেলেগুলোর ব্যাপারে কথা বলতে। সে রাগ ধরে রাখতে না পেরে ঠা*স*ঠা*স করে দুটো চড় বসিয়ে দিল শাবাবের গালে।

হঠাৎ কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ফাবিহার। মামাতো বোন মালিহা তার সাথে ঘুমিয়েছে। সে ঘুম থেকে উঠে কাঁদছে। ফাবিহা কপাল কুঁচকে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,“কাঁদছিস কেন?”

মালিহা গালে হাত রেখে তেতে উঠে বলল,“আমার গালে ঠা*স*ঠা*স করে দুটো চ*ড় বসিয়ে এখন জিজ্ঞেস করছো কাঁদছি কেন?”

ফাবিহার হুশ এলো। সে তো শাবাবকে চ*ড় মে*রে*ছে। এতরাতে শাবাব আসবেই বা কোথা থেকে? সেও বা কীজন্য শাবাবের সাথে দেখা করতে যাবে? তারমানে মালিহাকেই ঘুমের ঘোরে চড় মে*রে*ছে। দু-হাতে মাথার চুল ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“আমি তোমায় খু*ন করবো শাবাব। ঘুমের ঘোরেও তুমি আমার সাথে ঝামেলা বাঁধাচ্ছো।”

মালিহা কান্না বন্ধ করে কৌতুহলী স্বরে বলল,“শাবাব কে আপু? তোমার বয়ফ্রেন্ড? জানো কী হয়েছে? আমি না দেখে ফোনে একজনের সাথে প্রেম করলাম। কন্ঠ কী মধুর। তার সাথে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে আমি প্রাণপনে দৌড়ে ফেরত এসেছি। কারণ যার সাথে আমি প্রেম করেছি, তার আমার চেয়েও বড়ো মেয়ে আছে।”

ফাবিহা হাসবে না কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। নবম শ্রেণিতে পড়েই এই মেয়ে প্রেম করে দেখাও করে এলো। সে তো একজনকে পছন্দ করে আটকে গিয়েছে। যখন মনে অনুভূতির জন্ম নিলো। সে যত্ন করে অনুভূতি লালন করছিল। তখনই সব শেষ। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফাবিহা। মালিহাকে ঘুমাতে বলে সেও ঘুমিয়ে গেল।

শাবাবকে ছাড়িয়ে আনলেন ফিরোজ আলম। ছেলে আগের তুলনায় গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। আগে কথায় কথায় মজা ওড়ানো শাবাব এখন সারাদিনই গম্ভীর থাকে। ফিরোজ আলম কথা শোনাতে কম শোনাননি। বলে দিয়েছেন এবার আর কোনো ঘটনা ঘটালে তিনি নিজেই ওকে পু*লি*শে দিয়ে আসবেন।
বাসা থেকে বের হচ্ছে না শাবাব। সারাদিন কী যেন ভাবে। আজ সোজা বাবা-মায়ের ঘরের দরজায় এসে অনুমতি চাইলো,“আসবো?”

ফিরোজ আলম চমকালেন। ছেলে জীবনে কোনোদিন অনুমতি চেয়েছে কি না ওনার মনে নেই৷ তাহলে আজ ঘরে ঢুকতে কীসের অনুমতি চাইছে। এত ভদ্রত জ্ঞান আছে না কি এই ছেলের? না কি সুবুদ্ধি হয়েছে? তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,“আয়।”

শাবাব ঘরে ঢুকলেও বসলো না। শক্তমুখে বলল,“আমি কাল থেকে তোমার সাথে অফিস যাবো। তুমি আমায় কাজ শেখাবে।”

ফিরোজ আলম, সুরাইয়া দুজনই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তাঁরা অবাকতা কাটিয়ে ওঠার পূর্বেই লম্বা কদম ফেলে বেরিয়ে গেল শাবাব।
ফিরোজ আলম বিস্মিত হলেও মনে মনে খুশি হলেন। ছেলে তাহলে সুপথে আসতে চাইছে। এরচেয়ে খুশির সংবাদ আর কী হতে পারে?

শাবাব ভদ্র পোষাকে ভদ্রভাবে বাবার সাথে অফিসে পা রাখলো। ফিরোজ আলম সকলের সাথে ছেলেকে পরিচয় করিয়ে নিজের সাথে ভেতরে নিয়ে গেলেন। শাবাব আশেপাশে তাকিয়ে সব পরোখ করেছে। কিছু মেয়ে স্টাফ শাবাবকে দেখে ফিসফিস করছে।
“কী হ্যান্ডসাম, দেখেছিস? এর সাথে লাইন মারতে পারলে ছক্কা। জোশ হাজবেন্ড উইথ মানি।”
মেয়েদের দৃষ্টি চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না শাবাবের। অন্য সময় হলে সেও সুযোগে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করতো। এখন এদের সবাইকে বি*ষা*ক্ত লাগে। সে সম্পূর্ণ ইগনোর করে গেল।

#চলবে……

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

এক মাস সব ঠিকঠাক চললেও ইদানীং তাসিনের মাঝে পরিবর্তন লক্ষ করছে হুরাইন। পূর্বে যতটা আগ্রহের সাথে দ্বীন পালনে উৎসাহী ছিল, এখন ততটাই অনাগ্রহ দেখায়। এ বাড়ির একজন ছাড়া আর কারো মাঝে পরিবর্তন নেই। মানুষটি তার শশুর। নিশি তার কথা শুনতেই পারে না। তাসিন কেবল স্বামীর দায়িত্বই পালন করে। দ্বীন পালনে তার কোনো আগ্রহ নেই। আগে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করলেও এখন ফজর ছুটে যায়। দুপুরে জোহর ছুটে যায়। হুরাইন কিছু বললে তাকে নানান যুক্তি দেখায়।
এখন আর হুরাইন নিজেও দ্বীন পালন করে তৃপ্তি পায় না। নামাজে সেজদায় পড়ে থাকলেও অন্তর অতৃপ্ত থেকে যায়। নিজেকে সে হারিয়ে ফেলছে যেন। দুনিয়ার মানুষগুলোর মন রক্ষা করতে গিয়ে তার কোনো কোনো রাতে জিকির ছুটে যায়। ফজর এবং এশার সালাতের পর রোজ কোরআন তেলাওয়াত করা মেয়েটা কোনো কোনো দিন কোরআন পড়ার সময় পায় না।
অশান্ত মন নিয়ে মোনাজাতে কেঁদে ভাসায় হুরাইন। তার অন্তর শীতল হয় না। সে শান্তি পায় না। এক মাসে তার এত পরিবর্তন। তার ভয় হয় সে নিজের দ্বীন ধরে রাখতে পারবে তো? কেননা শয়তান সর্বদা মানুষকে ওয়াসওয়াসা দিয়ে থাকে। ঘরদোর পরিষ্কার রাখতে পরিবারের সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। একজন সারাজীবন পরিষ্কার করেই গেল, বাকি লোকজন বারবার অপরিষ্কার করতেই থাকলে এক সময় পরিষ্কার করা ব্যক্তিও অপরিষ্কার হয়ে পড়ে। তেমনি দ্বীন পালনে অনাগ্রহী পরিবারে নিজের ইমান, দ্বীন নিয়ে টিকে থাকার লড়াই বড্ডো কঠিন। তাঁদের মাঝে বসবাস করে এক সময় তাঁদের মতো জীবনযাপনে না অভ্যস্ত হয়ে যায়! আজ বাবার সিদ্ধান্তকে দোষারোপ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কেন তিনি তাকে এই কঠিন যুদ্ধে ঠেলে দিলেন? একজন দ্বীনি ছেলের দারস্থ করলে আজ তার জীবনটাও সহজ হয়ে উঠতে পারতো।

একজন নারী না কি একজন পুরুষের জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারে। হুরাইন সব রকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ।
“নিশ্চয়ই তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে তুমি হিদায়াত দিতে পারবে না। বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন। আর হিদায়াতপ্রাপ্তদের ব্যাপারে তিনি ভালো জানেন।”
সূরা আল-কাসাস। আয়াত ৫৬।

কার জন্য সে এখানে এসেছে। কাকে সঠিক পথ দেখাতে? না কি পথ দেখাতে এসে নিজের পথ ভুলে যেতে এসেছে! অনেকক্ষণ সময় নিয়ে নামাজ আদায় করে হুরাইন। সাজেদা ডাকেন চা দেওয়ার জন্য। নামাজে থাকায় উঠতে দেরি হয়। চা নিয়ে যেতেই সাজেদা ঝাঁঝালো স্বরে বলেন,“এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”

“নামাজ পড়ছিলাম আম্মা।”

“এতক্ষণ লাগে নামাজ পড়তে? না কি নমাজ পড়তে গিয়ে ঘুমাও।”

হুরাইন বলল,“আমি পাঁচ মিনিটে সাত রাকাত নামাজ শেষ করতে পারি না আম্মা। সূরা শুদ্ধ এবং ধীরে পাঠ করলে সময় লাগে।”

“তুমি বলতে চাও তুমিই শুদ্ধ করে পড়ো? আর কেউ শুদ্ধ করে পড়ে না? আমরা পড়ি না?”

হুরাইন নিচু স্বরে বলল,“আমি সেটা বলিনি আম্মা।”

“এই মিনমিন করে কথা বলবে না। যাঁরা হাঁকডাক ছেড়ে কথা বলে, তাঁদের অন্তর পরিষ্কার। এমন মিনমিন কথা বলা মহিলারা হয় মিচকে শয়তান।”

মনে আঘাত পেলো হুরাইন। কন্ঠ নারীর পর্দা। আর পর্দাকে উনি কীসের সাথে তুলনা করছেন? আহত চোখে তাকিয়ে বলল,“এভাবে বলবেন না আম্মা। কন্ঠেরও পর্দা আছে।”

“যাঁরা জানে বেশি, তাঁরাই গুনাহ করে বেশি। আমরা জানিও না, গুনাহও কম করি।”
ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে কত সহজে এমন একটা কথা স্পর্ধার সাথে বলে ফেললেন সাজেদা। হুরাইন বলল,“আমাদের গুনাহের শেষ নেই আম্মা। স্বাভাবিক একটা কথাতেও আমরা কীভাবে গুনাহ কুড়িয়ে নিচ্ছি বুঝতেই পারছি না।”

“পাশের বাসার তমালের বউ গিয়ে স্বামীর গলায় উঠেছে। শশুর-শাশুড়ির সাথে থাকতে তাদের গলায় কাঁটা বিঁধে। তুমিও এমন করিও। তাসিনকে বলিও দূরে একটা চাকরি নিতে। তারপর তুমিও ওর ঘাড়ে গিয়ে উঠিও।”

হুরাইন বলল,“আম্মা আপনার কেন এত অপছন্দ আমাকে? আর শরিয়া অনুযায়ী একজন পুরুষ বাবা-মায়ের জন্য নয়, নিজের জন্য বিয়ে করে। স্ত্রীর সকল চাহিদা পূরণ করা স্বামীর দায়িত্ব। তাই স্বামী দূরে থাকলে, স্ত্রী যদি স্বামীর সাথে থাকার ইচ্ছে পোষণ করে, তবে স্বামী তাকে নিয়ে যেতে বাধ্য।”

সাজেদা রেগে বললেন,“মনগড়া কথা বানিয়ে, নিজেদের পক্ষে রায় দেওয়ার চেষ্টা করছো? শশুর-শাশুড়ির সেবা না করতে পারলেই বেঁচে যাও তোমরা।”

“শশুর-শাশুড়ির সেবা করা সাওয়াবের কাজ। তাছাড়া এসব আমার কথা নয় আম্মা।”

বাঙালি নারীদের মধ্যে অধিকাংশ আছেন যাঁরা রেফারেন্স বুঝেন না। পূর্বে তাঁরা সঠিক-ভুল কী শিখে এসেছেন সেটা বিশ্বাস করেই বসে থাকেন। তাঁরা প্রায়শই ক্ষোভের বশে একটা কথা বলে থাকেন। আজ রাগে অন্ধ হয়ে সাজেদাও বলে ফেললেন।
“আগে কে জাহান্নামে যাবে? হুজুররা।”

হুরাইন সবকিছু অপাত্রে দান করছে। ওদিকে জোর আওয়াজে সাউন্ড বক্সে “ টাইম ট্র্যাভেলার” গান চালিয়ে দিয়েছে নিশি। হুরাইন ওর ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল,“আপুকে নামাজ পড়তে বলবেন আম্মা।”

সাজেদা বললেন,“আমার কী? ওর জবাবদিহি ও করবে। আমি তো নামাজ পড়তে বলি। না পড়লে আল্লাহ আমাকে কেন ধরবে?”

আফসোস হচ্ছে হুরাইনের। কেমন বলা বলেন তিনি? ফজরে ডাকেন না। মেয়ে পড়ে রাত করে ঘুমিয়েছে, থাক ঘুমাক৷ মাঝেমাঝে আসরের নামাজের সময় বলে থাকেন,“নামাজ পড়তে যা।”

দুই-একবার বলার পরও মেয়ের হেলদোল না দেখে তিনিও আর কিছু বলেন না। মাঝেমাঝে বলে থাকেন থাক বিয়ের পর পড়বে। যখন আমাদের মতো হবে, তখন পড়বে। অথচ যৌবনকালের ইবাদাত আল্লাহর প্রিয়। যেখানে মৃত্যুর ভরসা নেই, সেখানে যৌবনের ইবাদাত বাদ দিয়ে মধ্য বয়সে গিয়ে ইবাদাত করার স্বপ্ন কীভাবে একজন মুসলিম দেখে? হুরাইন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“আপনার মেয়ে অবিবাহিত। তার সমস্ত পাপের দায়ভার অনেকটাই আপনার, তার বাবার, তার ভাইদের। তাই তাকে ফেরানোর চেষ্টা করুন।”

হুরাইন চলে গেল। সাজদা তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলেন। হুরাইন গিয়ে নামাজের বিছানায় বসে পড়লো। মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে সকলের হিদায়াত প্রার্থনা করলো সাথে নিজের ধৈর্য শক্তি।

★★★

ফাবিহা শান্তিতে দিন পার করতে পারছে না। আগে ছিল শাবাব। এখন তার প্রতিপক্ষ দলের ছেলেরা। এরা শাবাবের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে। খুবই উগ্র আচরণ তাদের। রাস্তায় ওড়না ধরে টা*না*টা*নি করে। আজকাল মানুষ কাউকে হেনস্তা হতে দেখে মজা নেয়। কেউ কেউ ভয়ে এগিয়ে আসে না। বাড়ি থেকে বের হতেও ইচ্ছে করে না। পড়াশোনায় মন বসে না। তার পরীক্ষা চলছে। তিন সাবজেক্ট পরীক্ষা শেষ হলো। তিনটাই খা*রা*প হলো। একা গুমরে কাঁদে সে। পড়তে বসতে পারে না। মনে শুধু আতঙ্ক ভর করে। বাইরে যেটুকু সাহস দেখায় ওটা ঘরে এলেই হারিয়ে যায়। ভয়ে আছেন ফাবিহার বাবা-মাও। তাঁরাও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। বাবা গোপনে তার জন্য পাত্র দেখাও শুরু করেছেন। তা খুব করে টের পেল ফাবিহা।

পরীক্ষা থাকায় বের হতে হলো তাকে। চুলে চিরুনি চালায়নি। একটা ওড়না পেঁচিয়ে বেরিয়ে গেল। পরীক্ষার হলে সকলের কলম চলছে। ফাবিহা অধিকাংশ প্রশ্ন কমন পেয়েও লিখতে পারছে না। হাত চলছে না। ইচ্ছে করছে কোথায়ও চলে যেতে। যেখানে তাকে কেউ চিনবে না। সে বেঞ্চে মাথা এলিয়ে দিলো। ঠকঠক শব্দ পেয়ে ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসলো। স্যার বললেন,“এটা পরীক্ষার হল। সোজা হয়ে পরীক্ষা দিন।”

ফাবিহার মনে পড়লো তিনটা সাবজেক্ট সে ভালো পরীক্ষা দেয়নি৷ এভাবে চললে তো হবে না। মনের বিরুদ্ধে কলম চালানো শুরু করলো। হাত না চলায় লেখা ভীষণ বাজে হলো।

ফরহাদ দেখতে পেল ফাবিহা কেমন নিস্তেজ ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। সে ফোন বের করলো।

শাবাব বাবার সাথে সভ্য ছেলের মতো অফিস যাচ্ছে। বিনয়ী আচরণও লক্ষ করা যাচ্ছে তার মাঝে। বুঝা যাচ্ছে তার মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ফিরোজ আলম শুকরিয়া আদায় করেন। সুরাইয়া ছেলে বলতে পাগল। এখন আরো আদরে মুড়িয়ে রাখছেন।

ফাবিহাকে দেখতে এলো পাত্রপক্ষ। মা-বাবা খুব করে বুঝালেন। তার বাবা অসুস্থ মানুষ। মাথার উপর বাবা ছাড়া আর কারো হাত নেই। বাবার কিছু হয়ে গেলে তাদের মা -মেয়ের কী হবে? তাছাড়া ব*খা*টে*দে*র কবল থেকেও রক্ষা পাবে সে। ফাবিহা বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিলো। তার আর ভালোলাগছে না এসব। সেও সবকিছু থেকে মুক্তি চায়।
পাত্রের সাথে ছাদে দাঁড়িয়ে রইল সে।
ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো,“আপনার কেমন জীবনসঙ্গী পছন্দ?”

ফাবিহা মৃদু হেসে বলল,“যেমন চাই, তেমন কি বললেই পাওয়া যায়?”

“বলতে তো ক্ষতি নেই। আমারও জানা উচিত আপনার চাওয়া-পাওয়া। নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি আমরা।”

ফাবিহা বলল,“সিগারেট খাওয়া আমার পছন্দ নয়। পাস্ট অধিকাংশ মানুষেরই থাকে। তবে একজনের বেশি আমি আশা করি না। তাহলে মানতে খুব কষ্ট হয়ে যাবে।”

ছেলেটি মুচকি হেসে বলল,“স্বস্তি পেলাম। আমি সিগারেট ছুঁয়েও দেখি না। আর আমার জীবনে মা ছাড়া আপনিই প্রথম নারী।”

ফাবিহা মনে মনে আওড়ালো,“অথচ আমার জীবনে প্রথম পুরুষ আপনি নন।”

পাত্রপক্ষ পজিটিভ সাইন দিয়ে গেলেন। বুঝা গেল ফাবিহাকে খুব পছন্দ হয়েছে। হবেনাই বা কেন? ভারি মিষ্টি মেয়ে। ছেলে চেয়ে নম্বরও নিয়ে গেল ফাবিহার। কথাটা বাবা-মা দু’পক্ষের আত্মীয়স্বজনের মাঝেই জানাজানি হয়ে গেল।
বিপত্তি ঘটলো দুদিন পর। মায়ের চোখমুখ শুকনো। দুই ঘন্টা যাবত থমথমে দেখাচ্ছে তাঁকে। ফাবিহা কারণ জিজ্ঞেস করে বসলো।

“ছেলেপক্ষ না করে দিয়েছে।” অতঃপর রাগ ঝেড়ে বললেন,“আমার মেয়ে কম কীসে? বরং ছেলের তুলনায় আমার মেয়ে সবদিক থেকে উপরে আছে। তারপরও ছেলের মায়ের দাপট বেশি। আমি এরচেয়ে ভালো ঘরে মেয়ে বিয়ে দেব।”

ফাবিহা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,“কারণ জানিয়েছে?”

“না।”

কথা বাড়ালো না সে। বিকেলে তার নামে পার্সেল এলো। অথচ ফাবিহা কিছু অর্ডার করেনি। পার্সেল রিসিভ করার পর ভেবেচিন্তে খুলে ফেললো। ভেতরে একটা কাগজ ছাড়া আর কিছুই নেই। ফাবিহা কাগজ খুলে চোখ বুলিয়ে নিলো।
“একটা বিয়ে ভেঙেছি। যতবার প্রপোজাল আসবে, ততবার ভাঙবো। আমিও বিয়ে করবো না, কাউকে বিয়ে করতে দেব না।”

হুমকি আর হ্যান্ড রাইটিং দেখে ফাবিহা বুঝে গেল এটা কার কাজ। সে রাগ করবে কি- না বুঝে উঠতে পারলো না। আপাতত অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে রইলো।

বিয়ের খবরটা যেভাবে সবার মাঝে ছড়িয়েছি, একইভাবে বিয়ে ভাঙার খবরটাও সবার মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছে। পরপর দুবদর বিয়ে ভাঙা নিয়ে মানুষ নানান মন্তব্যে মেতে উঠেছে।

পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে রাস্তায় শাবাবের প্রতিপক্ষ সুমনের দল সামনে পড়লো। বিশ্রী হেসে তারা তাদের মতো নোং*রা মন্তব্য করতে লাগলো। অন্যদিন ওড়নার আঁচল ধরে টানলেও আজ একেবারে ওড়নার দুই-মাথা ধরে টানলো। গলায় ফাঁ*স লাগার মতো নিঃশ্বাস আটকে আসলো ফাবিহার। দু’হাতে সামনের দিকে ওড়না টেনে ধরে রেখেছে। বাবা বলেছেন এদেরও ব্যবস্থা নেবেন। আজ ধৈর্যের সীমা লঙ্ঘন হলো। প্রথমে ওড়না ছাড়ালো। তারপর ঠাটিয়ে ওড়না ধরা ছেলেটির গাল লাল করে দিল। শাবাব চুপ থাকলেও এরা হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করে উঠলো। খামছে ধরলো জামার কাঁধ। ভয় ঝেঁকে ধরলো ফাবিহাকে। সম্মানহানীর ভয়, মৃত্যুর ভয়। মনে মনে আল্লাহকে ডাকলো। তাকে এই বিপদ থেকে যেন রক্ষা করেন তিনি।

#চলবে….

এক টুকরো আলো পর্ব-১৩+১৪

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

আজ মন ভালো আছে ফাবিহার। তবে এই ভালো বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। শাবাব নামক যুবকটি ফাবিহার জীবনের অ*শা*ন্তি ডেকে আনতে যথেষ্ট। যেমন এখন পথিমধ্যে তাকে আটকে রেখে ফুরফুরে মেজাজের কুলখানি বানিয়ে দিয়েছে। রোজকার মতো পরিপাটি হয়ে বেশ ভাব নিয়ে সামনে দাঁড়ালো শাবাব। ফাবিহার শক্ত মুখে তাকিয়ে সুখ মিশ্রিত হাসি টা*ন*লো ঠোঁটে। কৌতুক গলাতেও গভীরতা। কেমন টা*না সুরে বলল,“জানেমান।”

ফাবিহা চোখ বুজে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠান্ডা মাথায় বলল,“তুমি তো আমায় ভালোবাসেো না, এটা তোমার আচরণে স্পষ্ট। তাহলে আমাকে এভাবে হে*ন*স্তা করার কারণটা কী? আমি সত্যিই বিরক্ত।”

শাবাব খুব মনোযোগ দিয়ে ফাবিহার কথা বলার ভঙ্গিমা পরোখ করলো। যেমনটা একজন প্রেমিক করে থাকে। প্রেমিকার হাসি থেকে কথা বলার স্টাইলটুকু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। শাবাবের জবাব না পেয়ে তার গতিবিধি ফাবিহাও লক্ষ করলো। এমন হ্যাংলামো দেখে একটু জোর গলায় বলল,“স্পষ্ট করে বলো কেন এসব করছো? তোমার চাওয়া কী?”

শাবাব এবার আর রসিকতায় গেল না। কথা বলতে গিয়ে অপমানে তার গালের হাঁড় শক্ত হয়ে এলো। দৃষ্টি ভীষণ ধারালো।
“তুমি আমায় রিজেক্ট করেছো। এবার আমি তোমাকে রিজেক্ট করবো। এটাই আমার চাওয়া।”

ফাবিহার খুব হাসি পেল। তাচ্ছিল্যের হাসি। সে নিজেকে দমিয়ে না রেখে হেসেও ফেললো। বলল,“তোমার পেছনে ঘুরতে যাচ্ছে কে? তুমি আমায় রিজেক্ট করবে? আমি তো তোমায় আগেই রিজেক্ট করে দিয়েছি।”

শাবাবের রাগ যেন আরও উত্তপ্ত হলো। ক্রোধের আগুনে হিসহিসিয়ে বলল,“আমায় রিজেক্ট করার একটা কারণ দেখাও। হ্যান্ডসাম, অর্থ কোনদিক থেকে আমি অযোগ্য?”

ফাবিহা এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে আফসোসের সুর তুললো। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শাবাবের যোগ্যতার ঘাটতি। বলল,“তুমি একটা চ*রি*ত্র*হী*ন। এখানটায় তুমি অযোগ্য। তুমি বাপের পয়সায় চলো, এখানটায় তুমি অযোগ্য। তুমি মানুষকে সম্মান দিতে জানো না, এখানটায় তুমি অযোগ্য।
কতটা প্রেম করতে পারলে সেটাকেই যোগ্যতা ভেবে তুমি যে অহং*কার দেখাচ্ছো? সেটা কোনো যোগ্যতা নয়। এটা তোমার চ*রি*ত্রে*র দোষ। মেয়ে*বাজ তুমি।
আর সবার আগে মানুষ হও। তুমি একটা অ*মা*নু*ষ। অন্তত ছোটো বাচ্চা থেকে বৃদ্ধকে পর্যন্ত তার প্রাপ্য সম্মান দিতে শেখো। তারপর নিজের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।”

সবকিছু ছাপিয়ে চ*রি*ত্র*হী*ন শব্দটা তীরের মতো আ*ঘা*ত করলো শাবাবকে। চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে গেল রাগে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“এতদিন আমি মজা করলেও এবার আমি সিরিয়াসলি বলছি। আমি যদি চ*রি*ত্র*হী*ন হয়ে থাকি, তাহলে এই চরিত্র**হীনকেই তোমার বিয়ে করতে হবে। প্রয়োজনে আমাকে যা যা করতে হয় করবো।”

ফাবিহা যেন মজা পেল। রঙ্গ করে হাসলেও তার কথা ঠান্ডা মাথায় নিশানা বরাবর তীর ছোড়ার মতো। বলল,“শয্যাসঙ্গী দরকার তোমার। তুমি কতোটা কা*মু*ক, চ*রি*ত্র*হী*ন তা আবার প্রমাণ করে দিলে। সমাজের ভয়েই কি বৈধতা অবলম্বন করতে চাইছো? তোমার তো এতটুকু আত্মসম্মান, ইজ্জত নেই। চাইলেই রাতের আঁধারে অন্ধকার গলিতে যেতে পারো। তোমারও খায়েশ মিটবে আর তোমার ললিতাদেরও ইনকাম হবে।”

নিজের চরিত্রের এতবড়ো দোষ হজম হলো না শাবাবের। সে একটা অভদ্র, অসভ্য ছেলে, গার্লফ্রেন্ড চেঞ্জ করা তার অভ্যাস হলেও সে কখনো অন্ধকার গলিতে যাওয়া কিংবা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ফূর্তি করার কথা ভাবেনি। আজ চরমভাবে অপমানিত হলো ফাবিহার কাছে। বরাবরই সে একরোখা, বেপরোয়া ছেলে। এই অসম্মান সে ভুলবে না। ফাবিহাকে অবশ্যই তার স্পর্ধার সমান বড়ো মাসুল দিতে হবে। টকটকে চোখ স্থির থাকলেও স্থির থাকেনি হাত দুটো। সোজা ফাবিহার টুঁটি চে*পে ধ*র*লো।
“আল্লাহর কসম আমি তোর জীবন জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বো।”

দম বন্ধ হয়ে চোখ দুটো কোটর ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দু’হাতে গলা থেকে শাবাবের হাত সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো ফাবিহা। যখন তার শরীরটা নেতিয়ে পড়তে চাইলো তখন শাবাব নিজ থেকেই ছেড়ে দিল। ফাবিহা ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। এক্ষুনি তার ম*র*ণ হতে পারতো। আঙ্গুল তুলে তাকে আরো একবার শাসিয়ে নিলো শাবাব।
“প্রস্তুত থাকবি।”

ফাবিহা আপাতত জান শ্বাস নিতে ব্যস্ত। শাবাব তাকে পথে রেখেই চলে গেল। আজ আর শরীর কুলাতে চাইলো না। শরীরে খানিকটা ভয় ঢুকেছে। থরথর করে কাঁপছে হাত-পা। তার সাথে প্রতিযোগিতা করে লাফিয়ে চলেছে হৃৎপিণ্ড। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। হেনস্তা হতে হতে অতিষ্ঠ হয়ে মনের সম্পূর্ণ ক্ষোভ মিটিয়ে নিয়েছে সে। তার জায়গায় অন্যকোনো মেয়ে থাকলে নিশ্চয়ই এটাই করতো। বাড়ি ফিরে গেল ফাবিহা। আর কত চুপ করে বসে থাকবে? বাবাকে জানাবে না বলেও জানিয়ে দিল আজকের ঘটনা। সোজা বাবার হাত ধরে পৌঁছে গেল থানায়। সহ্যের সীমা আর কত হলে এসবের সমাপ্তি ঘটবে?

★★★

ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আয়াত শেষ করে কুরআন বন্ধ করে তাকালো। তাসিনকে দেখে মিষ্টি করে হেসে সব গুছিয়ে উঠে পড়লো। হুরাইন সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও আজ আর তাকে জড়িয়ে ধরলো না তাসিন। নিজের বিবেক তাকে বাঁধা দিচ্ছে। অবাক হলো হুরাইন। অন্যদিন জোর করে হলেও বাইরে থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরতো তাসিন। অথচ আজ সামনে পেয়েও নির্লিপ্ত। হয়তো শরীর অসুস্থ। নিচু স্বরে বলল,“আমি খাবার আনছি। আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন।”

তাসিন নিজের জড়তাকে গম্ভীরতার মাঝে গুলিয়ে ফেললো। গমগমে স্বরে বলল,“বন্ধুদের সাথে খেয়ে এসেছি।”

মুখ ভার করলো হুরাইন। ছোট্ট করে বলল,“আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।”

“তুমি খেয়ে নাও।”

হুরাইন চুপচাপ এসে খেয়ে নিলো। মনে অনীহা থাকলেও পেটে ক্ষুধা। তাই কথা বাড়ালো না। খাওয়া শেষ করে তাসিনের পাশে শুয়ে পড়লো। অনেকক্ষণ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে তাকে নিজের দিকে টে*নে নিলো তাসিন। চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,“এবার তোমার গল্প শুনবো। বলো আজ সারাদিন কী কী করলে?”

ছোট্ট এক টুকরো ভালোবাসায় হুরাইনের মন খারাপ উবে গেল। সে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাসিনকে সারাদিনের গল্প শোনাচ্ছে। তাসিন আগ্রহ নিয়ে শুনছে কম, হুরাইনকে দেখছে বেশি। তার তুলনায় মেয়েটা নিতান্ত ছোটো। তবে মস্তিষ্ক পরিপক্ক। বুঝদার নারী হওয়ার চেষ্টা করে সবসময়। কথা বলতে বলতে এক সময় কন্ঠনালিতে অধরের উষ্ণ চুম্বন অনুভব করে শিউরে ওঠে হুরাইন। রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে গভীরতা বাড়লো ভালোবাসার।
রাতে যে অনুশোচনা ছিল তাসিনের মাঝে। ভোরের আলো ফোটার পরই হয়তো সে সব ভুলে বসেছে।

কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বের হলো নিশি। তার মুখে সাজসজ্জা। একটা থ্রিপিস পরনে। ওড়না গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। হুরাইন মৃদু স্বরে বলল,“আপু এভাবে বের হওয়া ঠিক নয়।”

নিশি হুরাইনের কথায় বিশেষ মাথা ঘামালো না। স্বাভাবিক গলায় বলল,“আমি এভাবে চলতে অভ্যস্ত। আপনি যেমন আমার চলাফেরায় অভ্যস্ত নন, তেমনি আমিও আপনার মতো চলাফেরায় অভ্যস্ত নই ভাবি।”

“নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী আপু?”

নিশি রাগান্বিত স্বরে বলল,“দেখুন, আপনি ভাইয়ার স্ত্রী। তার যেকোনো ব্যাপারে নাক গলাবেন তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। সেটা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু প্লিজ আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না। নিজের স্বাধীনতায় অন্যের হস্তক্ষেপ আমার পছন্দ নয়।”

হুরাইন কেবল একটা কথাই বলল,“নিজের মূল্য বুঝুন আপু। আপনি অমূল্য রত্ন।”

নিশি বিরক্তিতে মুখ গুঁজে বেরিয়ে গেল।
তার গমনপথে চেয়ে তার হেদায়েত প্রার্থনা করলো হুরাইন।

#চলবে….

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

বিয়ের পর থেকে দুজনের কোথায়ও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। তাসিন আজ অফিস শেষে প্রস্তুতি নিয়েই বাসায় এলো। হুরাইনকে ঘরে না পেয়ে খুঁজে দেখলো। সে সাজেদার ঘরে বসে আছে। যদিও সাজেদা এখনো হুরাইনকে মেনে নেননি, তবুও সে নাছোড়বান্দার মত শাশুড়ির মন জয় করতে উঠেপড়ে লেগেছে। আগ বাড়িয়ে শাশুড়ির সব কাজ করে দিচ্ছে। বিকেলে অবসর সময়ে গল্প করার চেষ্টা করে। সাজেদার ঘরে এসে বসে থাকে। তাসিন মায়ের ঘরের দরজায় এসে হালকা কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো। সাজেদা আর হুরাইন ফিরে তাকাতেই সে ঘরে ঢুকে মায়ের পাশে বসলো। হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,“শরীর কেমন আছে মা?”

থমথমে গলায় জবাব এলো,“ভালো।”

হুরাইনকে চোখের ইশারায় বলল,“ঘরে যাও। আমি আসছি।”

হুরাইন যেন বুজেও বুঝলো না। না বুঝার ভান করে সেও ইশারায় শুধালো,“কী?”

তাসিন ফের বুঝালো,“ঘরে যাও।”

ইশারায় স্বামী-স্ত্রীর কথপোকথন সাজেদার চোখ এড়ালো না। প্রেমালাপ ধরে নিলেন তিনি। চোখ ঘুরিয়ে অপর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

হুরাইন ঘরে যাচ্ছে না দেখে সরু চোখে তাকালো তাসিন। হুরাইন মিটিমিটি হেসে বসে রইল। এবার শান্ত একটা দৃষ্টি দিলো তাসিন। যার অর্থ কাছে পেলে বুঝিয়ে দেব। হুরাইন ঢোক গিলে উঠে পড়লো। সাথে সাথেই কেটে পড়লো ঘর থেকে দুর্বোধ্য হাসলো। পরপর সাজেদা বেগমের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে বলল,“হুরাইনকে নিয়ে একটু বেরোবো মা। ফিরতে সন্ধ্যার পর হতে পারে।”

সাজেদার অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে গেল। কঠিন মুখে শুধালেন,“কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

“একটু ঘুরেফিরে চলে আসবো।”

কটাক্ষোর বান ছুঁড়ে দিলেন সাজেদা।
“হুজুর পরিবারের মেয়ে ঘুরতে যাওয়ার নাম মুখে নেয় কীভাবে?”

তাসিন শান্ত স্বরে বলল,“কে বলেছে তাদের ঘুরতে যেতে মানা? তাছাড়া সে তো পরপুরুষের সাথে যাচ্ছে না মা। আমি তার স্বামী।”

“তোরা নিজেরা নিজেদের মর্জির মালিক। আমাকে বলার কোনো দরকার আছে? যা ইচ্ছে কর।”

“রাগ করছো কেন মা?”

“আমার রাগে কি তোর কখনো এসে-যায়? বিয়ে যেহেতু নিজের মর্জিমাফিক করতে পেরেছিস, বাকিসবও নিজের মর্জিমাফিক করতে পারবি।”

“আমরা বের হবো একটু পর।” বলেই মায়ের ঘর থেকে বিদায় নিলো তাসিন। সাজেদা বেগম আরো ফুঁসে উঠেছেন। তিনি ভাবতে পারেননি তাসিন ওনার কথা অমান্য করে বের হবে স্ত্রীকে নিয়ে। রাগে ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস ফেলছেন।
তাসিন ঘরে ঢুকতেই হুরাইন সিটিয়ে গেল ভয়ে। একবার ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই। তাসিন তার দিকে তাকিয়ে থেকে কদম ফেলে এগিয়ে আসছে। পিছিয়ে যাচ্ছে হুরাইন। তার চোখের চাহনি সুযোগ খুঁজছে পালাবার। এগিয়ে এসে খপ করে হুরাইনের হাত ধরে তাকে বুকের কাছে টে*নে নিয়ে দুষ্টু হাসলো। হুরাইন ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,“আর করবো না।”

“করবে, আর আমি রোজ তোমায় শাস্তি দেব। আজকের শাস্তি রাতের জন্য তোলা রইলো।”
একটু থেমে হুরাইনের নাকে টোকা দিয়ে বলল,“তৈরি হও। আমরা আজ বের হবো।”

হুরাইন খুশি হলো ভীষণ। তবুও ইতস্তত করে বলল,“আম্মাকে জিজ্ঞেস করেছেন?”

তাসিন বলল,“তুমি আম্মার স্ত্রী নও। আমার স্ত্রী। তাই আমার অনুমতি তোমার জন্য যথেষ্ট। আমি আম্মার ছেলে। তাই আম্মাকে জবাবদিহি করার দায়িত্ব আমার। যাও তৈরি হও।”

হুরাইন ঝটপট বোরকায় আবৃত করে নিলো নিজেকে। নিকাব পরিধান করে মোজা হাতে নিলো। তার হাত থেকে মোজা দুটো টে*নে নিয়ে নিলো তাসিন। কোমল হাত ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে মোজা পরিয়ে দিলো৷
ছোটো ছোটো যত্নেগুলো হৃদয় শীতল করে দেয় হুরাইনের। সে বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকে তার অর্ধাঙ্গের মুখপানে। তাসিন চমৎকার হেসে বলল,“এখন বের হবো। তাই এমন চাহনি দিয়ে লাভ নেই।”

হুরাইন লজ্জা পেয়ে মাথানিচু করে নিলো। সে তো কেবল মুগ্ধতা প্রকাশ করেছে। অথচ দুষ্ট পুরুষ কত কী ভেবে বসে আছে! হুরাইনের অবস্থা দেখে হেসে ফেললো তাসিন। হাত টে*নে বেরিয়ে গিয়ে মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়ালো।
“মা আমরা আসছি।”

সাজেদা কথা বললেন না। চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। হুরাইনও ছোট্ট করে বলল,“আসছি আম্মা।”
দুজন ঘুরাঘুরি করে একটা রেস্তোরাঁয় বসে খাবার খেয়ে নিলো। নিকাব খুললো না হুরাইন। নিকাবের নিচ দিয়েই খেয়ে নিলো। তাসিন তাকে যত দেখে, সে মুগ্ধ হয়। অথচ সে কিছুতেই দুনিয়াবি মায়া ত্যাগ করতে পারছে না। যতবার সে নিজের পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে, ততবারই মস্তিষ্ক তাকে সব ভুলিয়ে দেয়। কোনো একটা অন্ধকারে হারিয়ে যায়। দুনিয়ার চাকচিক্য তাকে আলো দেখিয়ে চুম্বকের মতো টানে।
আগের ফোনে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। একটা নতুন ফোন কেনা জরুরি। হুরাইনকে নিয়ে আসায় অগত্যা তাকে সাথে নিয়েই ফোন কিনতে গেল। কয়েকটা জায়গায় ভীড় দেখে অন্য জায়গায় এসে ফোন দেখলো। হুরাইনকে ফোনের রং দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“দেখো তো এটা কেমন লাগে?”

হুরাইন বলল,“এটার রং ভালোলাগছে না। কালোটা সুন্দর।”
এতটা নিচু ছিল তার স্বর। তাসিন পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল বিদায় শুনতে পেল। সে চোখ ছোটো করে বলল,“এটাই সুন্দর৷ এটা নেব।”

তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো হুরাইন। নিকাবের পাতলা আবরণে উপর দিয়েও তা নজর এড়ালো না তাসিনের। সে কেশে ছেলেটাকে বলল,“ভাই কালোটাই দিন।”

বেঁকে বসলো হুরাইন। তাসিনের শার্ট খামচে ধরে তাকে নিজের দিকে ফেরালো। তাসিন ইশারায় বলল, “কী?”

থমথমে গলায় বলল,“আপনি যেটা পছন্দ করেছেন ওটাই কিনুন।”

“না, তোমার পছন্দ করাটাই সুন্দর।”

“না আপনি ওটাই কিনুন।”

“না এটাই সুন্দর।”

দুজনের কথাবার্তা কারো কানে পৌঁছাচ্ছে না। উপস্থিত মানুষ দেখলে বোঝা যায় স্বাভাবিক কোনো কথা হচ্ছে দুজনের মাঝে। হুরাইনের অভিব্যক্তি বুঝার উপায় নেই। সে পুরোটাই আবৃত। অনেকক্ষণ দুজনের কথা কাটাকাটির পর হুরাইনের পছন্দ করা ফোনটাই কিনলো তাসিন।

বেরিয়ে আসার সময় হুরাইন চাপা রাগ ঝেড়ে বলল,“বেঁচে গেলেন। যদি আমার পছন্দের ফোনটা না কিনতেন? তবে..

“জানি, সবার দৃষ্টিতে না পড়ার ভয়ে ঘরে জায়গা দিলেও বিছানায় জায়গা দিতে না। আমি নিজের ভালো বুঝি।”
হুরাইনের কথা সম্পন্ন করতে না দিয়ে উক্ত কথাটি বলল তাসিন।
হুরাইন পূর্বের কন্ঠে স্থির থেকে বলল,“আপনি কী বলতে চান? আমি অত্যা*চারী?”

তাসিন সব দোষ মাথা পেতে নিলো।
“আমি অত্যা*চারী রাজা।”

ঝগড়ায় জিতে গিয়ে নিকাবের আড়ালে মুখ টিপে হাসলো হুরাইন। তাসিন বিড়বিড় করে বলল,“ঝগড়াতেও দেখছি পারদর্শী।”

“কিছু বললেন?”

“হুঁ? হ্যাঁ, বলছিলাম সংসারে শান্তি চাইলে বউয়ের কথায় সম্মতি দিন। শান্তিতে সংসার করুন। সংসার জীবনে উন্নতির চাবিকাঠি হলো স্ত্রীর পরামর্শে চলা।”

★★★

শাবাব দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাইরে থাকে। দুপুরে খেয়ে মাঝেমধ্যে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। আজও খেয়ে শুয়ে পড়লো। সে যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন দরজায় বেল বাজলো। সুরাইয়া দরজা খুলে পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। সহজ-সরল মানুষ নিজের দরজায় পুলিশ দেখলেই ভয় পেয়ে যায়। তিনি ভীত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,“আপনারা?”

“মিস্টার রাফিদ শাবাব বাসায় আছেন?”

কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠলো সুরাইয়ার। তোতলানো স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“কী করেছে শাবাব?”

“ওনাকে ডাকুন। ওনার নামে ওয়ারেন্ট আছে।”

সুরাইয়া হাহুতাশ করে কেঁদে ফেললেন। এসব পরিস্থিতিতে কীভাবে কথা বলতে হয় তিনি জানেন না। ভয়ে হাত জোড় করে বললেন,“আপনারা চলে যান। আমার ছেলে কিছু করেনি।”

“প্লিজ ওনাকে ডাকুন।”

কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে ঘুম পাতলা হয়ে এলো শাবাবের। এবার কান খাঁড়া করে শুনে বুঝতে পারলো মায়ের স্বর। ধড়ফড়িয়ে ঘুম ছেড়ে উঠলো সে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে দরজার সামনে মা আর পুলিশ দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল তার। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,“আপনারা হঠাৎ?”

সুরাইয়া শাবাবকে আড়াল করে বললেন,“তুই সরে যা শাবাব। আব্বা আমার, যা এখান থেকে।”

পুলিশের মধ্যে থেকে একজন বললেন,“আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে। আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।”

“কীসের ওয়ারেন্ট? কী করেছি আমি?”

“ একটি মেয়েকে ইভটি*জিং আর মে*রে ফেলার চেষ্টা করায় আপনার নামে ওয়ারেন্ট এসেছে।”

শাবাবের মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো। বুঝে গেল কে করেছে এসব। সে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,“আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।”

খালি গায়ে শোয়ার অভ্যাস শাবাবের। শোয়া থেকে উঠেই চলে এসেছে। ঘরে গিয়ে শার্ট পরতে পরতে বেরিয়ে আসতেই সুরাইয়া ঝাপটে ধরলেন শাবাবকে। বাঁধ ভাঙা কান্নায় গলার স্বর বদলে গেল।
“আব্বা, আব্বা তুই কোথাও যাবি না।”

শাবাব মাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। এক হাতে মাকে জড়িয়ে বলল,“আমি চলে আসবো মা। ওনাদের সাথে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হবে। তুমি কান্নাকাটি কোরো না। আমি যাবো আর আসবো।”

সুরাইয়া শার্ট খামচে ধরে রাখলেন শাবাবের। শাবাব মাকে ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল পুলিশের সাথে। সুরাইয়া উপায়ন্তর না পেয়ে নিচে ধপ করে বসে পড়লেন। তেরো বছরের তুলি এসে মালকিনের পাশে বসলো। বলল,“আম্মা, খালুরে খবর দেন। কান্নাকাটি না কইরা খালুরে জানাইলে, তিনি ভাইজানরে নিয়া আইতে পারবো।”

সুরাইয়ার যেন হুশ এলো। তিনি মোবাইলের জন্য উঠে পড়তেই তুলি ফোন বাড়িয়ে দিল। সুরাইয়া কল দিয়ে যাচ্ছেন সমানে। রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে কোনো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
“শাবাবের বাবা।”

শাবাবের বাবার পিলে চমকে উঠলো। আচানক স্ত্রীর কণ্ঠ শুনে ভয় পেয়ে গেলেন। আতঙ্কিত স্বরে বললেন,“কী হয়েছে শাবাবের মা। তুমি ঠিক আছো? শাবাব ঠিক আছে?”

“শাবাব ঠিক নেই। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। আমার কলিজার টুকরারে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে।”
আহাজারি করে কেঁদে কেঁদে বললেন সুরাইয়া।

ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠস্বর শোনা গেল,“কীহ্!”

★★

ফিরোজ আলম বাড়ি এসে আগে বিস্তারিত জানতে চাইলেন। সুরাইয়া কিছুই গুছিয়ে বলতে পারছেন না। তুলির কাছে যতটুকু শুনেছে তাতে ছেলের জন্য এতক্ষণ যে দুশ্চিন্তা কাজ করছিল, তা ক্রোধে পরিণত হয়েছে। ছেলে তাঁর অগোচরে এত নিচে নেমে গিয়েছে? অসভ্য খেতাব তো আগেই পেয়েছে। তারচেয়েও নীচ কাজ করবে তিনি ভাবতে পারেননি। ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য না হলেও কিছু হলেও সত্য। তিনি সুরাইয়াকে সাফসাফ জানিয়ে দিলেন,“তোমার ছেলেকে আমি ছাড়িয়ে আনতে পারবো না। সে অন্যায় করেছে, শাস্তি প্রাপ্য। আমার সম্মান তো সে রোজই ডুবাচ্ছে। বাকিটুকু ডুবতে দেব না আমি।”

সুরাইয়া শত আহাজারি করেও কিছু করতে পারলেন না। তাঁর আকুতিও আজ ফিরোজ আলমকে টলাতে পারছে না। তিনি অফিসে ফিরে গেলেন। রাত আটটা বেজে গেল। সুরাইয়ার শরীর অসাড় হয়ে আসছে। চোখে সব কিছু ঝাপসা দেখছেন। এরপরই সব অন্ধকার হয়ে গেল। তুলি ফোন হাতে নিয়ে কল দিল ফিরোজ আলমকে। সুরাইয়ার অবস্থা জানাতেই তিনি আবার ছুটে বাসায় এলেন। স্ত্রীর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে চলেছেন। ছেলের জন্য ওনার মন পুড়ছে না, এমন নয়। একমাত্র ছেলে, তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা রয়েছে ফিরোজ আলমের মনে। কিন্তু ছেলেকে আর প্রশ্রয় দিতে চান না। দুদিন জে*লে থেকে শিক্ষা হোক এটাই চেয়েছিলেন তিনি। এখন মনে হচ্ছে বসে থাকা যাবে না। সুরাইয়া আবার যেকোনো সময় অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
সুরাইয়ার জ্ঞান ফেরার পর তুলিকে ওনার পাশে রেখে থা*না*র উদ্দেশ্যে বের হলেন ফিরোজ আলম।

শাবাবকে একপলক দেখে নিলেন। ছেলের চোখে কোনো অনুশোচনা, লজ্জা নেই। বরং ক্রো*ধে*র আগুন খেলা করছে। চোয়াল শক্ত হয়ে হাড় স্পষ্ট হয়ে আছে।
ফিরোজ আলম কোনোভাবে কোনো গতি করতে পারলেন না। বুঝা গেল আরেকটু ঘোরাঘুরি করতে হবে এই বে*য়া*দ*ব, অপদার্থ, অকর্মার ঢেঁকির জন্য। এই ছেলে যেমন তাঁকে পিতৃত্বের স্বাদ দিয়েছে, তেমনই এখন জীবনটা ভাজা ভাজা করে দিচ্ছে।

#চলবে….

এক টুকরো আলো পর্ব-১১+১২

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১১
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

দু’দিন হলো হুরাইন ফিরেছে তাসিনের সাথে। সাজেদা থমথমে গলায় টুকটাক কথার জবাব দেন। তবে খোঁচাতে বেশি পছন্দ করেন। যেসব ওনার ধাতে নেই, তেমন ব্যবহারও আজকাল করে বসছেন। তাসিন ঘরে থাকার পরও এ কাজ ও কাজের বাহানায় ডেকে নিয়ে আসেন হুরাইনকে। নিশি নিজের মত সময় কাটায়। সেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না।
তাসিন বাইরে থেকে এসে জামাকাপড় ছেড়ে নিলো। হাতে হাতে সবটা এগিয়ে দিচ্ছে হুরাইন। তাসিন জিজ্ঞেস করল, “খেয়েছো?”

“না।”

হুরাইনের জবাবে প্রশস্ত হাসলো সে। হুরাইনের নাক টিপে দিয়ে বলল,“খিদে পেলে অপেক্ষা করতে হবে না। খেয়ে নেবে।”

“আপনি তাড়াতাড়ি ফিরবেন। তাহলে আমারও আর আগ বাড়িয়ে খিদে পাবে না।”
নিচু স্বরে জবাব দিল হুরাইন। তাসিন বাধ্য স্বামীর মতো মাথা নাড়লো। দুজন একসাথে খেয়ে ঘরে আসতেই হুরাইনের দিকে একটা বাক্স এগিয়ে দিল। ভ্রু কুঁচকে বাক্সটি উল্টেপাল্টে দেখতেই তাসিন বলল,“খুলে দেখো পছন্দ হয়েছে কিনা? সবার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে।”

হুরাইন ফোন দেখে অবাক হলো। তার কোনো ফোন ছিল না। প্রয়োজনে মা বা ভাবির ফোন ব্যবহার করেছে। তাই ফোনের সেটিংস সম্পর্কে তার তেমন ধারণা নেই। বাক্স খুলে তাসিন সবকিছু ঠিক করে দিয়ে শুয়ে পড়লো। কপালের উপর এক হাত রেখে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাঝখানে এক হাত দূরত্ব। হুরাইন চোখ বন্ধ করলো না। তাকিয়ে রইলো তাসিনের মুখপানে। কিছু একটার অপেক্ষা করছে সে। অথচ তাসিন নির্বিকারভাবে শুয়ে আছে। হয়তো ঘুমিয়েও গিয়েছে। মন খারাপ করে রইল হুরাইন। ক্ষণ সময় পর তাসিন হেসে ফেলে বলল,“এভাবে চোখ দিয়ে গিলে না নিয়ে বুকে এলেই পারো। আমি জানি আমি খুব এ্যাটাকট্রিভ।”

হুরাইন নড়চড় করলো না। মুহূর্তেই চোখের পাতা বন্ধ করে নিলো। যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাসিন চোখ সরু করে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ এক টা*নে তাকে কাছে নিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে রগঢ় করে বলল,“সত্যি রাগ করেছো না-কি আদর-টাদর পাওয়ার বাহানা?”

লজ্জা পেয়ে স্বর উঁচু হয়ে গেল হুরাইনের। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ঝাড়ির সুরে বলল,“ধ্যাৎ, সরুন তো।”

তাসিনের চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেল সে। চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঢোক গিলল হুরাইন। স্বর একেবারে ক্ষীণ করে বলল,“স…

বাকিটুকু বলার পূর্বে পুরো ঘরটা যেন কেঁপে উঠলো। হুরাইনকে চমকে দিয়ে শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো তাসিন। হতভম্ব হয়ে গেল হুরাইন। সে ভেবেছিল উঁচু গলায় কথা বলায় তাসিন রেগে গিয়েছিল। আচানক তার চোখে পানি চলে এলো। এবার তাসিন নিজেই হতভম্ব হয়ে গেল। সে তো ধমক-টমক দেয়নি। চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল,“আমি কী করলাম?”

তাসিনের অফিস যাওয়া-আসা হচ্ছে। সকালে বের হওয়ার পূর্বে হুরাইনের ডাক পড়ে। তারপর একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মাকে বলে তবেই বের হয়। সবটা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেছেন সাজেদা। যেহেতু হুরাইনকে তিনি পুত্রবধূ রূপে মানতে পারেননি, তাই মাথায় একটা কথা গেঁথে গিয়েছে। মাত্র কয়েকদিনেই ছেলে ওনার পর হয়ে গিয়েছে। আগে খাওয়া শেষ করে মাকে বলে তারপর বের হতো। এখন খাওয়া শেষ করে আগে বউকে ডাকে। একটুখানি ক্ষোভ জন্মালো মনে। হুরাইন তরকারি কা*টা*কু*টি করছে। সাজেদা পাশে দাঁড়িয়ে কাজের ছলে একথা- ওকথা বলে হুরাইনকে বুঝিয়ে দিচ্ছে বাড়ির বড়ো বউ হিসেবে বাপের বাড়ি থেকে ফার্নিচার এনে ঘর সাজানো, স্বামীকে গাড়ি উপহার দেওয়া স্ত্রীর কর্তব্য। হুরাইন সবটা বুঝেও চুপচাপ শুনে রইল। না বুঝার ভান করে শাশুড়ির সাথে কথা বাড়িয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। দুই-তিন দিন যাবত এসব নিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে কথা শোনাচ্ছেন। সাজেদা যদিও লো*ভী নারী নন, তবুও হুরাইনকে এসব বলে অশান্তি দেওয়াই ওনার মূল উদ্দেশ্য।
যেহেতু হুরাইন কিছুই বুঝতে চেষ্টা করছে না, তাই সাজেদা আজ সরাসরি বললেন,“তুমি তো পরিবারের ছোটো মেয়ে। সবার আদরের। কই সেরকম কিছু তো নজরে পড়ছে না।”

সাজেদা কথা শেষ করে আড়চোখে হুরাইনকে দেখে নিচ্ছেন। মাথায় ভালোভাবে আঁচল টেনে কাজ করছে মেয়েটা। আশ্চর্য কাপড়টা যেন মাথা থেকে সরছেই না! এমন সোনার টুকরা বউ কে না চায়? ছেলের কারণেই বউকে তিনি মেনে নিতে পারছেন না। নিজের বাপের দিকের লোকজনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। তাহলে এই মেয়েকে মেনে নেবেন কীভাবে?

হুরাইন মৃদু স্বরে বলল,“কী করলে বুঝা যাবে আমার বাবা-মা, পরিবার আমাকে ভালোবাসেন?”

সাজেদা তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,“মানুষ ছোটো মেয়েদের ভালোবেসে শশুর বাড়িতে টুকটাক জিনিসপত্র দেয়। জামাইকে গাড়িটাড়ি উপহার দেয়। এসব তো দূরের ব্যাপার আমার ছেলে বিয়েতেই কোনো সোনার জিনিস উপহার পেল না। একজন রিকশা চালকের মেয়ের জামাইও সোনা উপহার পায়। আর আমার ছেলেটা যেখানে নিজেই সোনার টুকরা।”

হুরাইন মৃদু হেসে জবাব দিল,“ঠিকই তো আম্মা। আপনার ছেলে নিজে যেখানে সোনার টুকরা, সেখানে সামান্য সোনা দেওয়া তাঁকে অপমান করার সমান নয় কি?”

সাজেদা তেতে উঠলেন। নিজের কথায় ফেঁসে গিয়ে বললেন,“না দেওয়ার জন্য এখন কতশত যুক্তি বের করবে। এসব আমার জানা আছে।”

হুরাইন কাজ না থামিয়ে বলল,“আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসুল (সা:) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রিয়জনকে আগুনের কড়া বা আংটি পরানো পছন্দ করে, সে যেন তাকে সোনার কড়া বা আংটি পড়ায়। (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৪০১, বাংলা মিশকাত হা/৪২০৫)

আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা:) এক লোকের হাতে সোনার একটি আংটি দেখলেন। তিনি তা খুলে নিয়ে নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন, “তোমাদের কোন ব্যক্তি আগুনের টুকরো হাতে রাখতে চাইলে এই আংটি হাতে রাখতে পারে।” (মুসলিম, আলবানী, আদাবুয যুফাফ ২১৫ পৃষ্ঠা)।

সাজেদা থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন। ঘন্টা না পেরোতেই আবারও অন্যান্য উপহারের জন্য বলতে লাগলেন।
হুরাইন বলল,“আম্মা আপনারা কি যৌতুক নিতে চান? তাহলে আমি আব্বুকে বলবো যৌতুক পাঠাতে।”

খ্যাঁক করে সাজেদা জবাব দিলেন।
“যৌতুক চেয়েছি আমরা? আমাদের এত নিচু মানসিকতা নেই। উপহার আর যৌতুক কি এক হলো?”

হুরাইন চুপ করে রইল। এই মুহূর্তে সে যতই বুঝাতে যাক না কেন, হিতে বিপরীত হবে। সাজেদা ভেবে বসবেন সে তর্ক করছে। বিকেলে আবারও ইনিয়েবিনিয়ে এসব কথা তুলতেই হুরাইন নিজের ফোন নিয়ে শাশুড়ির পাশে বসলো। বলল,“আম্মা আপনার চুলে তেল দিয়ে দিই, আসুন।”

“লাগবে না তোমার তেল দেওয়া।”

হুরাইন বারণ শুনলো না। সাজেদা স্বেচ্ছায় তেল দিতে দেবেন না সে বুঝে গিয়েছে। তাই জোর করে তেল নিয়ে সাজেদার পেছনে বসলো। এদিকে ইউটিউবে ঢুকে ওয়াজ চালিয়ে দিয়েছে। ওয়াজের মূল বিষয়বস্তু যৌতুক। কীভাবে আধুনিকভাবে টেকনিক করে মানুষ যৌতুক আদায় করছে। আর নাম দিচ্ছে উপহার। এর ভয়াবহতা সম্পর্কেও বলা হচ্ছে। সাজেদার শরীর দিয়ে আগুন ঝরছে। এই মেয়ে তো বড্ডো ধড়িবাজ। কী সুন্দর ওয়াজ চালিয়ে তাকে জবাব দিচ্ছে। তিনি শক্ত হয়ে বসে রইলেন। মুখ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। পেছনে বসে ঠোঁট টিপে হেসে চলেছে হুরাইন। তারও তর্ক করা হলো না। এদিকে শাশুড়িও বুঝে গেলেন। ব্যাপারটা “সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না।” টাইপ হয়ে গেল।
তেল দেওয়া শেষ করে ঘরে এসে নিজের কাজে নিজেই কিছুক্ষণ প্রাণ খুলে হেসে নিলো হুরাইন। পুরো ওয়াজ শেষ করে তবেই উঠেছে সে৷ সাজেদা একটু কথাও আর মুখ দিয়ে বের করেননি। শক্ত হয়ে একইভাবে বসেছিলেন।

★★★

তীব্র যন্ত্রণায় দিন কাটছে ফাবিহার। বাড়ি এলে তাসিনের কথা মনে পড়ে আর ক্যাম্পাসে গেলে শাবাবের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। আজ আর একদমই ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না। সে শুয়ে রইলো। মা এসে ডাকাডাকি করে গেলেন। ফাবিহা জানিয়ে দিল সে আজ ক্লাসে যাবে না। এখন যেন ডাকাডাকি না করে। বাবার কথা মনে পড়লো তার। মানুষটা তার জন্য অধিক দুশ্চিন্তা করেন। তার সাথে সাথে তার বাবাকেও দৌড়ের উপর রাখছে শাবাব। বাবা কেমন অস্থির হয়ে পড়েন। বয়স হয়েছে। পূর্বের মতো শারিরীক আর মানসিক শক্তি কোনোটাই নেই। তাকে নিয়ে চিন্তা করে কালও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি এমনিতেই হার্ট রোগী। ফাবিহা সিদ্ধান্ত নিলো বাবাকে আর কিছু জানাবে না। সে শাবাবের সাথে সমঝোতায় এসে সবটা মিটমাট করার চিন্তাভাবনা করলো।

ফাবিহা দুদিন ক্লাসে গেল না। ফোন বেজে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। শব্দ পেয়ে ঘরে এসে নম্বর দেখলো। অপরিচিত নম্বর দেখে প্রথমেই রিসিভ করলো না। মাথা খাটানোর চেষ্টা করলো এটা তাদের কারো নম্বর কিনা? তেমন কারো কথাই মনে পড়ছে না। ফাবিহা ফোন তুলে সালাম দিল। ওপাশ থেকে সালামের জবাব এলো না। ভেসে এলো ধমকের সুর।
“এ্যাই জানেমান ক্যাম্পাসে আসছো না কেন? আমার শশুর কি অক্কা পেয়েছে? তুমি শোক পালন করছো? আমি তো মেয়ের জামাই। আমাকে খবর দেওয়া তোমার উচিত ছিল।”

কথার ধরণ শুনে ফাবিহা বুঝে গেল এই ল*ম্প*ট শাবাব। তার বাবাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। মুখ দিয়ে আর সুশীল ভাষা বের হলো না। প্রচন্ড উগ্রকণ্ঠে বলল,“কু***** তোর বাপের কথা বলতে পারিস না? আমার বাবাকে নিয়ে আর যদি উল্টাপাল্টা কথা বলিস, তো এক কো*পে তোর মাথা আলাদা করে দেব। এরপর জে*লে যাবো। অ*স*ভ্য, অ*জা*তকু*জা*তের বংশধর।”

ফাবিহার শরীর কাঁপছে রাগে। তার চোখে পানি চিকচিক করছে। বাবা তার প্রাণ। আর সেই বাবাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র কথা সে সহ্য করবে না। এতবড়ো কথা তো নয়ই।
শাবাব বেহায়ার মত হো হো করে হেসে বলল,“এত রাগ? আগে বলো ক্যাম্পাসে আসছো না কেন? আমাকে ভ*য় পাচ্ছো?”

“তোকে ভয় পাওয়ার কী আছে? কেন নিজের অপকর্ম দিয়ে পরিবারকে গা*লি শোনাতে চাচ্ছিস? তোর লজ্জা-শরম নেই?”

শাবাব ধমকে উঠলো,“আহ্ জানেমান। তুই-তুকারি করবে না।”

“তুই যেটার যোগ্য তোকে সেটাই বলবো। তুই-তুকারি করলে কী করবি?”

“আজীবনের জন্য মুখটাই বন্ধ করে দেব জান।”
এবার শাবাবরের স্বর কঠিন শোনাল। যেন ফাবিহাকে সামনে পেলে এক্ষুনি টুঁটি চে*পে ধরে মে*রে ফেলতো। ফাবিহা ফোঁসফোঁস করে বলল,“তোর ওই নোং*রা মুখে আমাকে জান ডাকবি না।”

“আজীবন আমার মুখ থেকেই তোমায় জান শুনতে হবে জানেমান। কাল সোজা ভার্সিটি আসবে। নয়তো….

“নয়তো কী?”

“তোমার বাসায় চলে যাব। হাঙ্গামা করলে আশেপাশের মানুষ যখন কানাকানি করবে, তখন আমার শশুর-শাশুড়ি ঠিক থাকবেন কি-না সেটাই দেখার বিষয়। সেদিন একটু খানি দৌড়ঝাঁপ করেই শশুর আমার হাঁপিয়ে গিয়েছেন। ভেবে দেখো তুমি কী করবে?”

ফাবিহা অতিষ্ঠ হয়ে বলল,“কী চাও তুমি? কেন আমার আর আমার পরিবারের সাথে এমন করছো?”

“এসব করবো না আমি। তোমার বাবা-মা শান্তিতে থাকবে। একটা শর্ত আছে।”

ফাবিহা হার মানার ভঙ্গিতে বলল,“কী শর্ত?”

“আমি যতদিন চাইবো, ঠিক ততদিন তুমি আমার সাথে প্রেম করবে। আমার ইন্টারেস্ট হারিয়ে গেলেই তোমার মুক্তি মিলবে।”

আতঙ্কে মৃদু চিৎকার দিল ফাবিহা।
“অসম্ভব।”

শাবাব হেসে বলল,“তাহলে এসব চলতে থাকবে সবসময়। জেনে খুশি হবে যে, আমি তোমার বিয়েও হতে দেব না আর নিজেও তোমায় বিয়ে করবো না। যতবার পাত্রপক্ষ আসবে, ততবারই তারা জানবে তুমি আমার বউ।”

ফাবিহা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“তোমার মত কুলা**ঙ্গার জন্ম দিয়ে তোমার মা কতটা আফসোস করছেন সেটা দেখার খুব ইচ্ছে আমার।”

“তাহলে বের হও। আমি আসছি তোমাকে নিতে। তোমার ইচ্ছেও পূরণ হবে সাথে শশুর বাড়িও ঘুরে দেখবে।”

ফাবিহা অতিষ্ঠ হয়ে বলল,“আল্লাহ তোর বিচার করুক। তুই ম*র*তে পারিস না শয়*তান?”

“শয়তান ম*র*লে তোমার মত ভালো মানুষদের কাতুকুতু দিবে কে?”

এবার কল কেটে বিছানায় ফোন ছুঁড়ে মা*র*লো ফাবিহা। নিজের চুল নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
শাবাব ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটে স্পষ্ট হাসির রেশ। ভীষণ কষ্টে হাসি কন্ট্রোল করছে সে।

#চলবে…..

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

ঘন অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া শহরে মিঠে আলোর ছোঁয়া। রাত্রি বোধ করা যায় বারো এর ঘর পেরেয়েছে। এখনো জেগে আছে দুজন মানুষ। কলিংবেলের শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছতেই ত্রস্ত পায়ে ছুটে গেলেন মধ্যবয়সী নারী সুরাইয়া। পেছন ফিরলে হয়তো স্বামীর রোষপূর্ণ দৃষ্টি দেখতে পেতেন। সুরাইয়া দরজা খুলে দিতেই কাঙ্ক্ষিত চেহারা ভেসে উঠলো। চিন্তামুক্ত হলেন তিনি। শাবাব মায়ের সাথে হেসে কথা বলে ভেতরে ঢুকতে গিয়েও ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল বাবাকে দেখে। সুরাইয়া ছেলেকে ঠেলে বললেন,“হাতমুখ ধুয়ে আয়। খাবার দিচ্ছি।”

ফিরোজ আলমের চোখের চাহনি কঠিন। দরাজ গলায় বললেন,“বাড়ি না ফিরলেই হতো। এতরাত পর্যন্ত যেখানে কাটিয়েছিস সেখানেই বাকি রাত পার করে দিতে পারতি।”

সুরাইয়া বিরক্তমাখা গলায় বললেন,“আহা! এমন করছো কেন? ছেলেটা মাত্র বাইরে থেকে এসেছে।”

“বাইরে থেকে এসেছো তো কী হয়েছে? কাজ করে তো আসেনি। আনন্দ ফূর্তি করে এসেছে। বসে বসে আমার অন্ন ধ্বংস করা ছাড়া আর তো কোনো কাজ নেই।”

শাবাব বাবার কটাক্ষ স্বরের বিপরীতে তীব্র প্রতিবাদ জানালো। দমে না গিয়ে বলল,“খাবো না তোমার খাবার। বারবার এসব খোঁটা ভালোলাগে না।”

মেজাজ চড়ে ছিল ছেলের উপর। এবার আরেকটু ক্ষেপে গেলেন ফিরোজ আলম। বললেন,
“কতবার আর একই কথা বলবি? না নিজে চাকরিবাকরি কিছু করছিস আর না আমার সাথে থেকে ব্যাবসার হিসাব বুঝে নিচ্ছিস। আমি তো এখনই সব ঘাড়ে নিতে বলিনি। যতদিন আমি বেঁচে আছি তোর চিন্তা করার দরকার নেই। কিন্তু সবটা বুঝে তো নিবি। সেটাও করছিস না। তাছাড়া চাকরির কথা বলছিই বা কেন? রেজাল্টের নমুনা দেখলে কেউই চাকরি দেবে না।”

নাক উঁচু শাবাবের অহংকার যেন মুহূর্তেই ঝনঝন করে ভেঙে চূর্ণ হলো। নিজের অপমান সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। আর রেজাল্ট, পড়াশোনা দিয়ে কী হবে? কতজন পড়াশোনা করে কিছু করতে পেরেছে? ৯০ শতাংশ মানুষই শিক্ষিত বেকার। তার বাবার টাকা থাকতে সে কেন শুধু শুধু মেধা খাটাতে যাবে? বাবাকে শুনিয়ে দিল কিছু কথা।
“পড়াশোনা, ভালো রেজাল্ট দিয়ে কতজন তোমার মতো টাকা কামিয়েছে? ছোটোবেলায় আমার বাবা স্কুল চু*রি করেছে। আমি সাধু-সন্ন্যাসী হবো এটা ভাবাও আমার বাবার নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ।”

বাবার ছোটোবেলার কথা মনে করিয়ে দিতে পেরে শাবাব মনে মনে নিজেকে বীর ঘোষণা করলো। ভেবেছিল বাবাকে বুঝি টেক্কা দিতে পেরেছে! ফিরোজ আলম বললেন,“আমি স্কুল পলাতক ছাত্র হয়ে যা করেছি, তুই শুধু এর এক তৃতীয়াংশ করে দেখা।”

শাবাব বলল,“যার বাপের এতকিছু আছে তার আবার কিছু করার কী দরকার? মা ভাত দাও।”

ফিরোজ আলম চরম হতাশ এই ছেলেকে নিয়ে। সাথে আশ্চর্য সুরে বললেন,“একটু আগে না বললি আমার খাবার খাবি না? এখন খাবার দিতে বলছিস কোন মুখে?”

শাবাবের স্বাভাবিক জবাব।
“আমি তো তোমার খাবার খাবো না বলেছি। মাকে তো আমার খাবার দিতে বলেছি।”

সুরাইয়া চোখ রাঙিয়ে বলল,“শাবাব, চুপচাপ হাতমুখ ধুয়ে আয়। বাবার সাথে এভাবে ত*র্ক করা ভালো না।”

শাবাব এবার চুপ করে চলে গেল নিজের ঘরে। ফিরোজ আলম স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,“আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল তোমার কথায় ছেলেকে প্রশ্রয় দেওয়া। বিয়ের এক যুগ পর জন্ম নেওয়া সন্তান তার মাঝে একমাত্র সনৃতান বলে ওকে অতিরিক্ত মাথায় তুলে ফেলেছি। এখন না পারছি মাথা থেকে সোজা পথে নামাতে আর না পারছি একেবারে আঁচড়ে ফেলতে।
এক সন্তান হিসেবে ওর প্রতি অতিরিক্ত আবেগি হয়ে শাসনের কথাই ভুলে গিয়েছি। সন্তানের আদরের পাশাপাশি শাসনও প্রয়োজন।
তুমি ওর অন্যায় আবদার গুলোকেও প্রশ্রয় দিয়েছো।”

সুরাইয়া বললেন,“আমার অনেক সাধনার ছেলে। তাছাড়া ছেলেমানুষ, এখন এসব আড্ডাবাজি করবেই। বিয়ের পর দায়িত্ব কাঁধে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“তুমি এখনো প্রশ্রয় দিচ্ছো। যে ছেলে ২৭ বছরেও ঠিক হতে পারলো না, সে বিয়ে করেই ঠিক হয়ে যাবে? দায়িত্ব কাঁধে নেবে বলছো? বরং আমাদের মাথায় ঝামেলা তুলে দিয়ে সে নির্বিকার ঘুরেফিরে বেড়াবে। স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবে না, ইচ্ছে মতো সব করবে। তখন ঝামেলা ওর ঘাড়ে নয়, আমাদের ঘাড়ে আসবে। তাছাড়া এই বাউন্ডুলে ছেলের হাতে কে মেয়ে দেবে? দিনদিন হচ্ছে একটা অ*স*ভ্য।”

শাবাব বাবার কথা কিছুটা শুনেছে। বিয়ের কথা শুনতে পেয়ে সে চেয়ার টেনে বসে বলল,“ভালো কথা মনে করেছো। আমাকে বিয়ে করিয়ে দাও।”

“তোকে ঘর থেকে বের করবো আমি।”

সুরাইয়া গদগদ কন্ঠে বললেন,“আব্বা মেয়ে পছন্দ হয়েছে? ঠিকানা দে। আমরা গিয়ে সব পাকা করে আসি।”

শাবাব মুখের খাবার গিলে পানি পান করলো। তারপর ধীর গলায় বলল,“মেয়ে রাজি না। মেয়ের বাপও রাজি না। শুধু আমি রাজি।”

ফিরোজ আলমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এক্ষুনি হামলে পড়ে ঠা*স*ঠা*স করে গালে দুটো দিয়ে বসবেন। ফোঁসফোঁস করে উঠছেন তিনি। শাবাব বলল,“বাবা এমন অজগর সাপের মত ফোঁসফোঁস করছো কেন?”

এবার আর গালটা নিরাপদ রইলো না। পরপর কয়েকটা চ*ড় পড়ে তব্দা খেয়ে গেল শাবাব। বাবা-মা কোনোদিন তার গায়ে হাত তোলেনি। আজ প্রথম বাবা তাকে মে*রে*ছে। খাবার ছেড়ে উঠে গেল সে। সুরাইয়া ছেলেকে আটকানোর চেষ্টা করলেন। না পেরে কান্নাকাটি করে ফিরোজ আলমকে দোষারোপ করলেন।
“তুমি আমার ছেলেকে কেন মে*রে*ছো? কে তোমার কানে বি*ষ ঢেলেছে? তুমি ওকে ইদানীং সহ্যই করতে পারো না।”

ফিরোজ আলম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,“আমার তো এতদিনে চোখ খুলেছে। আফসোস আরো আগে কেন চোখ খুললো না?
তুমি এখনো অন্ধের মতো ছেলেকে তুলুতুলু করো। ভবিষ্যতে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না। যে ছেলে এখন আদর দিয়ে বে*য়া*দ*ব বানাচ্ছো সেই তোমার আশাভঙ্গ করবে। যে ছেলেকে সামান্য চ*ড় দেওয়ায় তুমি কান্নাকাটি করছো, সেই ছেলের দেওয়া ব্যথাতেই তুমি একসময় কাঁদবে। ঠিকানা হবে বৃদ্ধাশ্রম। আমার জীবনে আফসোস থেকে যাবে। না পারলাম ছেলেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আর না পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। তোমার পাশাপাশি সমান দোষী আমিও। আমার চোখ খুলে গেছে। দয়া করে নিজের চোখ দুটো খুলে আশেপাশে তাকাও।”

সুরাইয়া স্বামীর কথায় পাত্তা দিলেন না। মুখ ঝামটি দিয়ে ঘরে চলে গেলেন। খাবারদাবার ওভাবেই পড়ে রইল টেবিলে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফিরোজ আলম খাবার সব গুছিয়ে রাখলেন। সুরাইয়ার প্যাঁচ কম। যা তিনি বুঝেছেন, সেটাই সই। অন্যকেউ হাজার ব্যাখা করে ভালোমন্দ বুঝালেও বুঝেন না তিনি। সংসার আলাদা হওয়ার পর ফিরোজ আলম আশঙ্কায় থাকতেন। সুরাইয়া সবটা গুছিয়ে নিতে পারবেন কিনা! দেখা গেল একটা জিনিস ঘরে নিজেদের আজ প্রয়োজন। কেউ এসে চেয়ে বসলে কোনোকিছু না ভেবে তাঁকে ওই জিনিসটা দিয়ে দেন।
ঘুমাতে গিয়েও শান্তিতে দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না তিনি। সুরাইয়া ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদেই যাচ্ছেন। এখন কিছু বললে এই কান্না ফজরের পরও থামবে না। পুরোটা রাত এভাবেই কাটবে। কানে বালিশ চাপা দিয়ে পড়ে রইলেন।

শাবাব পরদিন সকালে উঠে নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেল।
আজ আর অপেক্ষা করতে হলো না। পথেই মুখোমুখি হলো ফাবিহার।

★★★

বন্ধুদের আড্ডায় বসলো তাসিন। কত কত ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধু। পূর্ব থেকে এমনভাবে মিশেছে যে এখন চাইলেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। যতটুকু পারা যায় হুঁ, হা উত্তর দিচ্ছে সে। একজন বলল,“তাসিন কি কোনো কারণে রেগে আছো? দেখছি আমাদের সাথে কথা বলছো না।”

“না, তেমনটা নয়।”

অপরজন বলল,“আমার মনে হচ্ছে রেগে নেই। সুন্দরী বউ পেয়ে আমাদের এড়িয়ে চলতে চাইছে।”

তাসিন বলল,“তোমরা ভুল বুঝো না। আসলে আমাদের এভাবে চলাফেরা উচিত না।”

কয়েকজন মুখ টিপে হাসলো। কয়েকজন সরাসরি হেসে বিদ্রুপ করে বলল,“হুজুরনি বিয়ে করে তুইও দেখছি হুজুর হয়ে গিয়েছিস। চিল ভাই। আমরা সবাই ভাই-বোনের মতো। আমাদের কারো প্রতি কারো ওইরকম কোনো আকর্ষণ নেই। তাহলে কেন অযথা চিন্তা করছিস?”

তাসিন জানে এই যুক্তি সম্পূর্ণ দুর্বল। তবুও তার মন বারবার বন্ধুদের কথায় সায় দিতে চাইছে।
কতটা দুর্ভাগা মনুষ্য জাতি আমরা।
আমরা জানি যা করছি পা*প করছি। তবুও আমাদের মস্তিষ্ক খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে নিজের পা*প*কেও পুণ্য প্রমাণ করছে। নিজেকে বুঝিয়ে থাকি আমার অন্তর তো পরিষ্কার। আমার তো ইমান ঠিক আছে।
অথচ আমরা টেরই পাই না অন্তর কতটা অসুস্থ, ময়লা হয়ে গিয়েছে আমাদের। জানি কিন্তু মানি না।
তাসিনও তার ব্যতিক্রম নয়। চাইলে মুহূর্তের মাঝেই নিজেকে পরিবর্তন করা যায় না। জেনারেলে পড়ুয়া, আধুনিক সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে চলা মানুষের হিদায়াত প্রাপ্ত হওয়া খুব সহজ কথা নয়। তাসিন বন্ধুদের আড্ডায় মজে গেল। ভুলে গেল স্ত্রীকে দেওয়া কথা।
সকলের সাথে হাসিঠাট্টায় হারিয়ে গেল।

রাতে বাড়ি ফিরে হুরাইনকে দেখতে না পেয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। দরজার কাছে যেতেই গুণগুণ শব্দে মধুর কন্ঠস্বরে কিছু শুনতে পেল। সামনে এগিয়ে যেতেই আরও স্পষ্ট হলো কুরআন তেলাওয়াতের মধুর কণ্ঠ। তাসিনের চোখ কান, দুটোই জুড়িয়ে গেল। হুরাইনের চেহারার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল সে। মনে পড়ে গেল সেই বন্ধুদের আড্ডার কথা। অনুশোচনা হচ্ছে। তবে এমন এক পর্যায়ে সে ঝুলে আছে, যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া দুষ্কর।

#চলবে…….

রি-চেইক করা হয়নি।

এক টুকরো আলো পর্ব-১০

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

“আমার হৃদয়ের খুব কাছে, যাকে ভেবে আমার বুক তড়পায়, যার জন্য আমি অপেক্ষা জমাই, তার প্রতি এই ব্যাকুল অনুভূতির কী নাম দেবে তুমি?
ভালোবাসা না কি ভালো থাকা?”

গভীর শ্বাসে টান পড়ে। থেমে যায় ভারী পড়া নিঃশ্বাসের শব্দ। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে ঘর জুড়ে। দখিনা জানালা দিয়ে ধেয়ে আসে মৃদু শীতল বাতাস। অপ্রত্যাশিত জবাবে অন্তর রঙিন হয়ে ওঠে হুরাইনের। আনন্দে সলজ্জ হাসে। তাসিন শুধালো, “তুমি ভালোবাসো?”

হুরাইনের চোখে সত্যের ঝিলিক। অকপটে ঠোঁটের ডগায় প্রস্তুত করে শব্দ।
“গতকাল থেকে আমি আপনার প্রতি বিশেষ এক ধরনের টা*ন অনুভব করি। ইনশাআল্লাহ সেটা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে শীঘ্রই।”

তাসিন দূরত্ব কমায়। নাকে টে*নে নেয় মিষ্টি খুশবু। হুরাইনের শরীর থেকে আতরের সুবাস ভেসে আসছে। চুলে মুখ গুঁজে দিয়ে তাসিন জিজ্ঞেস করল,“এত সুগন্ধি কেন?”

কুঁকড়ে যাওয়া শরীরে, মৃদু কন্ঠস্বর,“আপনার জন্য।”

কথা না বাড়িয়ে হাসলো তাসিন। চট করে হুরাইনের মস্তিষ্কে কিছু প্রশ্ন উঁকি দিল। উত্তর তার জানা। কেবল স্পষ্ট হতে চাইছে সে। ঘুরে বসল তাসিনের মুখোমুখি। মুখে নববধূর ছাপ স্পষ্ট। খাড়া নাকের বাঁ পাশে ছোট্ট সোনার নাকফুল জ্বলজ্বল করছে। বলল,“আপনার মা কি আমার উপর নারাজ?”

জবাব না দিয়ে চেয়ে রইল তাসিন। ক্ষণ সময় অপেক্ষা করিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কেন মনে হলো?”

হুরাইন ইতস্তত করে বলল,“কাল থেকে ওনাকে দেখিনি। আমি যখন সকালে দেখা করতে গেলাম। মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। বাবার সাথে এ বাড়ি আসার পূর্বে আবারও দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি কথা বলেননি আমার সাথে।”

তাসিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হুরাইনের দু’হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,“মা তোমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু ওনার মনোবাসনা অন্যকিছু ছিল। আমি নিজের পছন্দে বিয়ে করেছি বলে নারাজ। এটা সাময়িক ব্যাপার। তুমি এসব নিয়ে চিন্তা কোরো না। আমি চাই আমার পরিবারের সকলেই তোমার কাছ থেকে শিখুক। তুমি হয়ে ওঠো একজন আদর্শ শিক্ষক। সেদিকেই ফোকাস করবে তুমি।”

হুরাইন মাথা দোলায়। মনে মনে আওড়ায়,“এই হাত দুটো ধরে রাখুন ভরসায়।”

তাহাজ্জুদ পড়তে উঠে পড়ল হুরাইন। রোজ এই সময় তার ঘুম ভাঙে। তাসিনকে কয়েকবার ডাকার পরও সে সাড়া দিল না। আর ডাকলো না সে। একদিনেই কারো মাঝে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তবে আল্লাহ চাইলে সেকেন্ডেই সব সম্ভব। তাহাজ্জুদ পড়ে অপেক্ষায় রইল ফজরের। মুয়াজ্জিনের ডাক ভেসে আসছে চারদিক থেকে। ধীরে ধীরে বাড়ির পরিবেশ গরম হয়ে উঠলো। সকলেই জেগে গিয়েছেন। বাদ নেই হুসাইনের ছেলে তারশীদ। সেও রোজ বাবা-দাদার সাথে ফজর পড়তে মসজিদে যায়। হুরাইন জায়নামাজ ছেড়ে তাসিনের মাথার পাশে এসে বসল। ধীর আওয়াজে ডাকলো,“শুনছেন? ফজরের আজান হয়েছে। নামাজ পড়তে উঠুন।”

এমন নরম সুরে তাসিনের ঘুম ভাঙার পরিবর্তে আরও গাঢ় হচ্ছে। মনে হচ্ছে কে যেন মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমিয়ে থাকার আহবান জানাচ্ছে। আরেকটু আরাম করে পাশ ফিরে গেল সে। হুরাইন ফের ডাকলো। এক সময় তার স্বর বড়ো হলো। তাসিনের কানে গিয়ে স্পষ্ট পৌঁছচ্ছে। তার মস্তিষ্ক জাগ্রত হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছে হুরাইন তাকে ফজরের সালাতের আহ্বান জানাচ্ছে। উঠছি উঠছি করেও গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। তার গায়ে হাত রেখে মৃদু ধাক্কা দিল হুরাইন। বলল,“আপনি না আমায় দায়িত্ব দিয়েছিলেন দুজনকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার? আপনি নাকি আমাকে সাহায্য করবেন! কোথায় গেল আপনার কথার মূল্য?”

তাসিন ঘুম জড়ানো গলায় বলল,“অল্প কিছুক্ষণ। উঠে যাচ্ছি।”

“আব্বু, ভাইয়া, তারশীদ সকলেই মসজিদে চলে যাচ্ছে।”

“আমি ঘরে পড়ে নেব।”

এবারে হুরাইনের স্বর কঠিন হলো।
“না। আপনি এক্ষুনি সবার সাথে মসজিদে যাবেন। একটা সাত বছরের বাচ্চা যদি আরামের ঘুম ত্যাগ করতে পারে, আপনি কেন পারবেন না? উঠে পড়ুন। হাত-পা ঝেড়ে ফেলে ওজু করে নিন।”

এবার তাসিনের ঘুম ছুটে গেল। এক লাফে বিছানা ছাড়তেই এতক্ষণের আদুরে ঘুম উবে গেল। এখন সতেজ লাগছে। তাসিন ওজু করে নিতেই তার পাঞ্জাবি, টুপি এগিয়ে দিল হুরাইন। একটু আগের কঠিন মুখশ্রীতে এখন কেবল কোমলতা। এক টুকরো নুর জ্বলজ্বল করছে। তাসিন পা বাড়িয়ে বের হলো। হুরাইন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।

★★★

শাবাবের পরিবার সম্পর্কে আতাউর রহমান খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলেন। জানতে পারলেন বাবা বেশ প্রভাবশালী। একমাত্র পুত্র। বিবাহিত জীবনের তেরো বছর পর একমাত্র সন্তানের জন্ম। বাবা-মায়ের আদরের পুত্র জেনে আতাউর রহমান যা বুঝার বুঝে গেলেন। এর পরিবারকে জানিয়ে খুব একটা লাভ হবে না। হয়তো বা টাকা দিয়ে আতাউর রহমানকে মুখ বন্ধ রাখতে বলবেন। কী করতে হবে তিনি মনস্থির করে ফেললেন। টাকা ছিটলেই আজকাল অনেককিছু পাওয়া যায়। কিছু ছেলেপুলে হায়ার করলেন শাবাবকে মে*রে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার জন্য। তিনি মেয়েকে ভার্সিটি পাঠিয়ে ফোন লাগালেন সেই ছেলেদের লিডারের কাছে।
“হ্যাঁ, হাত-পা ভেঙে দিয়েছ? কয়েকমাস অন্তত আমার মেয়ে শান্তিতে থাকবে আর ওই বেয়া*দবটা শিক্ষা পাবে।”

ওপাশ থেকে অট্টহাসি ভেসে এলো। চমকে উঠলেন আতাউর রহমান। তিনি বললেন,“এ্যাই হাসছ কেন? যে কাজে পাঠিয়েছি সেটা করেছ?”

“আমি শাবাব বলছি শশুর আব্বা। আপনার মেয়ের জামাই। আমার ছেলেদেরকেই আমাকে মা*রা*র জন্য পাঠিয়েছেন? বলি কি শশুর আব্বা একটু ঘিলু খাটিয়ে কাজ করুন।”

খ্যাঁক করে উঠলেন আতাউর রহমান।
“এ্যাই, এ্যাই অ*স*ভ্য ছেলে। কী বলতে চাও তুমি? আমার ঘিলু নেই, না?”

শাবাব কটাক্ষ করে বলল,“আছে নাকি? বাপ-মেয়ে দুটোই ঘিলু ছাড়া। ঘিলু থাকলে তো মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিতেন।”

দাঁতে দাঁত চাপলেন আতাউর রহমান। “তোমাকে সামনে পেলে..

মুখের কথা টে*নে নিল শাবাব। রগঢ় করে বলল,“বাড়ি নিয়ে জামাই আদর করতেন, তাইনা? অবশ্য শশুর হিসেবে আপনি পারফেক্ট। আপনার মেয়ে নিয়ে লড়াইটা বেশ জমবে। আই লাভ ইউ শশুর আব্বা। ইশ! আপনার মেয়েকে এখনো আই লাভ ইউ বলা হয়নি। যাই গিয়ে বলে আসি।”

“এ্যাই বয়া*দব একদম ফোন কাটবি না। আমার মেয়ের কাছে যাবি না তুই। ছিঃ কী নির্লজ্জ! আমাকে আই লাভ ইউ বলা হচ্ছে?”

আতাউর রহমানের নাক-মুখ লাল হয়ে গেল। ভারি লজ্জার ব্যাপার। শাবাব খট করে কল কেটে দিয়ে কুটিল হাসল। বিড়বিড় করে বলল,“এবার দেখুন শশুর আব্বা, কীভাবে আপনাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাই। শরীরে তেল-চর্বি বেড়ে গিয়েছে। দৌড়ঝাঁপ করলে শরীর ফিট থাকবে। কৃতজ্ঞতা জানান আমাকে।”

ছেলেগুলোর দিকে ফোন ছুঁড়ে দিয়ে সামনে পা বাড়ালো শাবাব। তার গন্তব্য ফাবিহা। হাত ঘড়িতে সময় দেখল সে। চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে নবাবী স্টাইলে হাঁটছে। চেহারা, চলাফেরার স্টাইল, উচ্চতা বিচার করলে একজন হ্যান্ডসাম পুরুষ। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। ক্ষমতাও তার কম নয়। বাবার একমাত্র ছেলে। টাকাপয়সা তো সব তারই। আড়ালে-আবডালে জুনিয়র মেয়েরা ঠিকই আড়চোখে দেখে তাকে। তাতে যেন শাবাব দাম্ভিক হয়ে ওঠে। কী কম আছে তার? একটা মেয়ে কেন তাকে এড়িয়ে চলবে?

ফাবিহার ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইল শাবাব। ক্যাম্পাসের গেট পেরিয়ে বেরুতেই শাবাবকে দেখে থমকে গেল ফাবিহা। অজানা ভয় মনে ভেতর বাসা বাঁধলো। বাবা তো বললেন আজকের পর থেকে সে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে। শাবাব নামক কোনো কালো ছায়া আর থাকবে না। ফাবিহা ধীরে ধীরে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলো৷ ডেকে উঠলো শাবাব।
“আরে জানেমান কোথায় যাচ্ছো? আমি তোমার অপেক্ষায় শুকিয়ে যাচ্ছি।”

ফাবিহা কথা বাড়াতে চাইলো না। চুপ থাকাই শ্রেয়। শাবাব এগিয়ে এসে খপ করে ফাবিহার হাত চেপে ধরে বলল,“চলো চলো জানেমান। শশুর আব্বা বলেছেন তোমাকে আই লাভ ইউ বলতে। তুমি নাকি গতকাল কেঁদেকেটে পুকুর বানিয়েছ? আশ্চর্য সামান্য আই লাভ ইউ শোনার জন্য কেউ এমন করে?”

ফাবিহা হতভম্ব হয়ে গেল। কী আবোল-তাবোল বলছে এই ছেলে? হাত মোচড়ানো শুরু করে দিয়ে বলল,“দেখ, পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট কোরো না। হাত ছাড়ো আমার।”

“আচ্ছা, তাহলে আমার সাথে চলো।”

“তোমার সাথে যাবো মানে? কোথায় যাবো আমি?”

“তোমার শশুর বাড়ি যাবে, চলো। বিয়ের আগে সবটা দেখতে হবে না?”

হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিল ফাবিহা। তেজী কন্ঠে বলল,“কখনো না। তুমি যদি পৃথিবীতে শেষ পুরুষ হয়ে থাকো, তবুও আমি তোমায় বিয়ে করবো না। ল*ম্প*ট একটা।”

শাবাব চুপ করে রইল। তার চোখে কাতরতা। ফাবিহার হাত দুটো আবারও মুঠোবন্দি করে আকুতি করে বলল,“তোমাকে পেলে আমি ভালো হয়ে যাব ফাবিহা। বিশ্বাস করো।”

ফাবিহা তাকালো শাবাবের চোখে। কোথাও মিথ্যের ছিঁটেফোঁটাও নেই। তবুও ফাবিহার মন গললো না। কেবল নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,“যেতে দাও আমায়। তুমি আমার সামনে না এলেই খুশি হবো।”

শাবাব হো হো করে হেসে ফেললো। ভারি চমকালো ফাবিহা। মুহূর্তেই রং বদল হয়ে গেল। শাবাব ঠোঁট চোখা করে আফসোস সূচক শব্দ করলো। তার চোখে-মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। ফাবিহাকে একটু হলেও বোকা বানাতে পারল। মন না গলুক কিঞ্চিৎ হলেও মেয়েটার মনকে ভাবতে বাধ্য করেছে। শাবাব ভর্ৎসনা করে বলল,“আজ দ্বিধায় ছিলে বিশ্বাস করবে কি করবে না। কাল – পরশু তো আমাকে বিয়েই করে ফেলবে।”

আতাউর রহমান এদিকেই ছুটে আসছেন। হাঁপিয়ে গিয়েছেন তিনি। ঘনঘন শ্বাস টা*ন*ছে*ন। ফাবিহা উৎকণ্ঠিত হলো।
“বাবা কী হয়েছে তোমার?”

শাবাব হাঁক ছাড়লো। পাশের দোকানদারকে বলল,“টিটু একটা ঠান্ডা পানি দে তো।”

টিটু ঠান্ডা পানি নিয়ে ছুটে এলো। শাবাব বোতলের ক্যাপ খুলে আতাউর রহমানের সামনে দিয়ে ঢকঢক করে গিলে নিলো সব পানি। তৃষ্ণা মিটিয়ে চমৎকার হেসে বলল,“আপনি হাঁপিয়ে গিয়েছেন শশুর আব্বা। আপনার কষ্ট কি আমার সহ্য হয়? তাই পানি পান করে তৃষ্ণা মেটালাম।”

আতাউর রহমান হতভম্ব। পাশ থেকে ফাবিহা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে ভেবেছিল পানি বুঝি তার বাবার জন্য। শাবাব ফাবিহার দৃষ্টি দেখে সামান্য ঘাড় উঁচু করে বলল,“যা বাবাহ, আমি কী করলাম?”

ফাবিহা মুখ শক্ত করে বলল,“তুমি একটা হৃদয়হীন, অ*মা*নু*ষ।”

শাবাব ভাবলেশহীন। কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,“ওহ্ তোমাকে তো আই লাভ ইউ বলা হলো না। শশুর আব্বা আপনি এসেছেন ভালো করেছেন। আপনাকে সাক্ষী রেখে আমি আপনার মেয়েকে বলছি আই লাভ ইউ জানেমান।”

#চলবে…..

এক টুকরো আলো পর্ব-০৯

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_০৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

ফাবিহা বাবার সঙ্গে ক্যাম্পাসে যাচ্ছে। তিনি বাড়ি আসার পরই স্ত্রীর কাছে মেয়ের ব্যাপারে জানতে পারলেন। বাইকের পেছনে মেয়েকে নিয়ে সড়কে উঠে জিজ্ঞেস করলেন,“মন খারাপ?”

ফাবিহা অন্যমনস্ক ছিল। বাবার কথা শুনতে পেল না। বাবা একটু জোর দিয়ে ডাকলেন,“ফাবিহা!”

“হুঁ?”

রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে বাবার কথায় প্রত্যুত্তর করল ফাবিহা। বাবা ফের জিজ্ঞেস করলেন,“মন খারাপ?”

“মন খারাপ কেন হবে বাবা?”
ফাবিহা হয়তো বাবার প্রশ্নের গভীরতা বুঝতে পারেনি। তিনি তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললেন,“তাসিন আর তোমার খালা-খালু যা করেছে। ভুলে যাও মা। ভেবে নাও তোমার জন্য তাসিন উত্তম কেউ নয়৷ তোমার জন্য যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, সে এখনো আসেনি তোমার জীবনে। সঠিক সময়ে তার আগমন ঘটবে।”

ফাবিহা মনে মনে বলল,“যাকে আমার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, তার প্রতি কেন আমার মনে অনুভূতি সৃষ্টি হলো?”
মুখে কিছু না বলে নিরব রইল। ফাবিহার বাবাও আর মেয়েকে ঘাঁটাতে চাইলেন না। মেয়েকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে তিনি বাবার দায়িত্ব পালন করলেও তাসিন আর তার পরিবারের প্রতি তীব্র ক্ষোভ জমা রয়েছে। একজন বাবা কখনোই মেয়ের অপমান মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের কাছে সর্বাধিক প্রিয় তাঁদের কন্যা।

ক্যাম্পাসে এসে আর খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। শাবাব ফাবিহার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো। ঠোঁটে একটা সিগারেট চেপে মাত্রই লাইটার অন করল। ঘুরে দাঁড়াতেই তার পিরিতের রানীকে দেখে ঠোঁট বাঁকা করল। সাথে মধ্যবয়সী লোক দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল তার। চেহারায় অনেকটা মিল দেখে শাবাব হুট করে শব্দ করে হেসে ফেললো। পাপা কি পারি পাপাকে নিয়ে এসেছে তাকে থ্রে*ট দেওয়ার জন্য। ফরহাদ সামনে তাকিয়ে বলল,“ভাই আপনার শিকার আসতেছে। সাথে দেখি কারে নিয়া আইছে।”

“আমার শশুর বাবাজানকে নিয়ে এসেছে। বিয়েটা এবার করেই ফেলতে হবে ফরহাদ। আজ থেকে ভাবি ডাকবি সবসময়।”

ফরহাদ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল শাবাবের মুখপানে। শাবাব ভাইয়ের মুখে বিয়ের কথা মানায় না। এই মেয়েটিকে তো একদমই না। গার্লফ্রেন্ডদের বিয়ের কথা তিনি কখনো মাথাতেই নেননি, মুখে নেওয়া দূরের ব্যাপার। দুমাস না পেরোতেই ব্রেকআপ। আর এই মেয়ের সাথে তো প্রেমের সম্পর্কও নেই। যা আছে কেবল অপমান আর শত্রুতার। শাবাবের মুখভঙ্গি দেখে বুঝার উপায় নেই সে সিরিয়াস না-কি ঠাট্টা করছে! ফাবিহার বাবা আতাউর রহমান শাবাবের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। চোখমুখ গম্ভীর। শাবাব ভদ্রতা করেও সিগারেট ফেলল না। সে যা নয়, তা দেখাতে চায় না। ভুস ভুস করে ধোঁয়া ছেড়ে দিল মুক্ত আকাশে। নাক,মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করার দৃশ্য দেখে আতাউর রহমান চোখ কুঁচকে নিলেন। ফাবিহা নির্লিপ্ত। তার মাঝে কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। সে শাবাবের আচরণের সাথে একটু হলেও পরিচিত৷ তাই এই গুরুতর অপরাধ দেখেও তার চোখে বিস্ময় খেলেনি। সে স্বাভাবিক। আতাউর রহমান দরাজ গলা শুধালেন,“তুমি না-কি আমার মেয়েকে বিরক্ত কর?”

শাবাব ফাবিহার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হেসে বলল,“করি তো।
কীভাবে বিরক্ত করি, বলনি জানেমান?”

শাবাবের ধূর্ত হাসি দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো মন। নাকের পাটা ফোলে ওঠে। বাবার সামনে চুপ রইল সে। কেবল চোখের চাহনি দিয়েই ভস্ম করতে চাইলো শাবাবকে।
অভদ্র শাবাব বুকের বাঁ পাশে হাত চেপে নিজেকে অনুভূতি প্রবণ দেখাল। মেকি আসক্তি কন্ঠে ঢেলে দিয়ে বলল,“ইশ্ জানেমান! এমন চাহনি দিলে ম*রে যাব তো।”

আতাউর রহমানের মেজাজ তুঙ্গে। তিনি ভদ্রভাবে ছেলেটাকে বুঝিয়ে বিষয়টা শেষ করতে চাইলেন। এখন দেখতে পাচ্ছেন বে*য়া*দ*ব ছেলে উনাকে সামনে রেখেই মেয়েকে বা*জে ইঙ্গিতে কথাবার্তা বলে। তিনি তিরিক্ষি গলায় বললেন,“অ*স*ভ্য ছেলে। আমি তোমার বাবা-মায়ের কাছে যাব। যথাযথ বিচার না পেলে তোমাকে মে*রে হাত-পা ভেঙে দিতেও আমার সময় লাগবে না।”

শাবাব বেহায়া ঠোঁটে হাসল। তার কথা, তার হাসি তার নির্লজ্জতার প্রমাণ। বলল,“আমি অ*স*ভ্য না হলে তো নানা হতে পারবেন না শশুর আব্বা।”

শাবাবের নিষ্পাপ চাহনি। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হল ফাবিহার৷ বাবার সামনে লজ্জায় তার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে। আতাউর রহমান উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। উনি নিজেই যেখানে লজ্জা পাচ্ছেন, সেখানে মেয়ের পরিস্থিতি বিবেচনা করে আরো ফুঁসে উঠলেন। ঠা*স করে শাবাবের গালে চ*ড় বসিয়ে দিলেন। শাবাবের মাঝে হেলদোল দেখা গেল না। সে নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি। অথচ রাগে থরথর করে কাঁপছেন আতাউর রহমান। মেয়েকে নিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে৷ এই বে*য়া*দ*ব ছেলে আবারও কোনো কথার অ*স*ভ্য কথাবার্তা বলে মেয়েটাকে লজ্জায় ফেলে দেবে।

ফরহাদ এগিয়ে এসে গর্জে উঠল। হুমকি দিল আতাউর রহমানকে। “এ্যাই।”

ফরহাদকে থামিয়ে দিল শাবাব। উপকার হল না। ফরহাদের গালেও পড়ল একটা চ*ড়। গালে হাত দিয়ে হতভম্বের মত একবার শাবাব একবার আতাউর রহমানের দিকে তাকিয়ে রইল সে। মেয়ের হাত ধরে প্রস্থান করলেন আতাউর রহমান। শাবাব পিছু ডেকে বলল,“এক মিনিট শশুর আব্বা। আপনার মেয়ের সাথে আমার ব্যক্তিগত কথাবার্তা আছে। বুঝেনই তো প্রাইভেসি ব্যাপার-স্যাপার।”

আতাউর রহমান চলে ক্যাম্পাসের ভেতর হাঁটা দিলেন। বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছে সব কিছু। অধ্যক্ষের কানে কথাগুলো তোলা প্রয়োজন। ফাবিহাকে নিয়ে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে পা বাড়াতে নিতেই ফাবিহা জিজ্ঞেস করল,“কোথায় যাচ্ছো বাবা?”

“আসো আমার সাথে।”

ফাবিহা বাবার মনোভাব বুঝতে পেরে চট করে বলে ফেলল,“ও এখন আর এই ভার্সিটির ছাত্র নয়। প্রাক্তন ছাত্র।”

থেমে গেলেন আতাউর রহমান। তিনি সরাসরি এই ছেলের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবেন। মেয়েকে ক্লাসে দিয়ে তিনি বেরিয়ে যেতে গিয়েও শাবাবকে পূর্বের জায়গায় দেখলেন। থেমে একবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে পা বাড়ালেন। শাবাব বলল,“চলুন শশুর আব্বা নাস্তা করবেন আমার সাথে। প্রথমবার মেয়ে জামাইয়ের সাথে দেখা করলেন। খালি মুখে চলে যাবেন?”

দ্বিতীয়বার আর মুখ খুললেন না আতাউর রহমান। সোজা হেঁটে চলে গেলেন।
ফরহাদ পাশ থেকে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল,“ভাই আপনি কি সত্যি সত্যি এই মেয়েকে মানে ভাবিকে বিয়ে করবেন?”

“ভাবি পছন্দ হয়েছে তোর?”

“ভাই সত্যি বলব?”

“বল।”

“এই মেয়ে ওয়াইফ মেটারিয়াল না। আপনার বউ হবে শান্ত, ভদ্র, লাজুক, পানির মতো। আপনি যে পাত্রে রাখবেন, সেই পাত্রের আকার ধারণ করবে। তাছাড়া আপনি যে বিয়েশাদি নিয়ে সিরিয়াস হবেন, তা ভেবেই আমি ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি।”

“আমি কোনো কালেই সিরিয়াস ছিলাম না আর না এখন সিরিয়াস আছি।”

“তবে?”
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ফরহাদ। শাবাবের ঠোঁটে রহস্যময় হাসির বেড়াজালে আটকে রইল দৃষ্টি।
★★★

হুরাইন তার বাবার বাড়ির সকলের সাথে চলে গেল। তাসিনকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেল জনাব আজাদ। বিড়বিড় করল তাসিন।
“আপনি না বললেও আমি আমার বউকে নিতে চলে যেতাম।”

হাসিমুখে শশুরের নিমন্ত্রণ গ্রহন করল সে। হুরাইন চলে গেলেও সে সিদ্ধান্ত নিল বাড়ির দিকটা সামলে তারপর যাবে। বাবা একা হাতে সব সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাবেন। হুরাইন চলে যাওয়ার পরই সাজেদা নিজের মত করে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তাসিন এখনো খাবার খায়নি। শশুর জোর করলেও সে বসেনি। কারণ তার মা না খেয়ে আছে। সাজেদা জেদ ধরে খাবার পর্যন্ত মুখে তুললেন না। বাড়ির পরিবেশ ঠান্ডা হতেই তাসিন মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
“মা।”

সাজেদা সাড়া দিলেন না। নিজের জন্য খাবার তৈরিতে ব্যস্ত তিনি। তাসিন মায়ের হাত চেপে ধরে বলল,“এত খাবার তৈরি করার পরও কেন তুমি আলাদা খাবার বানাচ্ছো?”

সাজেদা হাত ঝাড়া দিয়ে বললেন,“সর। এসব আদিখ্যেতা আমার সাথে দেখাবি না। যা চেয়েছিস, করে নিয়েছিস। আমাকে আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের কাছে ছোটো করেছিস। আর কী চাই?”

অসহায় চোখে তাকালো তাসিন। নরম কন্ঠে বলল,“মা যেখানে ফাবিহা মেনে নিয়েছে, সেখানে তুমি আর খালা কেন বুঝতে চেষ্টা করছ না? আমি যদি ফাবিহাকে বিয়ে করতাম, তার সাথে সহজ হতে না পারলে কি সে কষ্ট পেত না? তখন তো প্রতিকারের উপায়ও থাকত না। এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে দু’জনই আলাদা হওয়ার রাস্তা বেছে নিতাম। তাতে কী লাভ হত? আমাকে হয়তো কেউ কিছু বলত না। কিন্তু ফাবিহার দিকে সকলেই আঙ্গুল তুলতো।”

“তুই যে এখানে নিজের স্বার্থে কথা বলছিস, সেটা আমি বুঝতে পারছি না?”

তাসিন মায়ের কথা সমর্থন করে বলল,“আমি আমার স্বার্থ ছাড়া কথা বলছি না। অবশ্য আমার স্বার্থ আছে এখানে। সাথে জড়িয়ে আছে ফাবিহার ভালো।”

সাজেদা একমনে খাবার তৈরি করছেন। তাসিন হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,“আমি এখনো খাইনি মা।”

সাজেদার হাত থেমে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। শত হলেও মায়ের মন। অন্যদের জন্য রুক্ষ হলেও সন্তানের প্রতি সকলের হৃদয়ে স্থান আলাদা। ছেলেকে বুঝতে না দিয়ে আবারও হাত চালিয়ে বললেন,“যার জন্য এত আয়োজন, সে তো দিব্যি খেয়েদেয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেছে। স্বামীর খাওয়ার খোঁজ নেয়নি বুঝি?”

মা যে কথার তীক্ষ্ণ বানে তাসিনকে কুপোকাত করার চেষ্টা করছেন সেটা স্পষ্ট টের পেল তাসিন। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“আর রাগ করে থেক না মা।”

সাজেদা গমগমে গলায় বললেন,“খেতে বসো গিয়ে।”

নিঃশব্দে হাসলো তাসিন। মায়ের রাগ একটু হলেও কমেছে। সে স্বস্তির শ্বাস নিল।

শশুর বাড়ির আঙিনায় পা রাখল তাসিন। এ নিয়ে পঞ্চমবার শশুর এলো সে। জামাই হিসেবে এবারই প্রথম। তার আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখছে না কেউ। তবু তাসিনের সবকিছুতে একটা কমতি মনে হচ্ছে। আর সেটা তার বিবি। রাতের খাবারে শশুর আর বড়ো শালকের সাথেই বসল সে। স্ত্রীকে ছাড়া দুঃখী মন নিয়ে খেতে বসল। তাকে চমকে দিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল হুরাইন। বাবা, ভাই, স্বামী তিনজনকেই বেড়ে খাওয়ানোর দায়িত্ব পড়ল তার উপর। সকলের পাতে যত্ন করে খাবার বেড়ে দিয়ে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে রইল সে। তাসিন করুণ চোখে তাকালো। সারাজীবন তো বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। এখন তো তার পাশে দাঁড়াতে পারে। হুসাইন বলল,“তুই বসে পড়।”

“আমি পরে সবার সাথে খাব। মা, ভাবি, আপুরা বসে আছেন।”

“ঠিক আছে।”

জনাব আজাদ বললেন,“জামাইয়ের পাতে গোস্ত দিন আম্মু।”

তাসিন নম্র স্বরে বলল,“আর লাগবে না। পরে লাগলে নেওয়া যাবে।”
মনে মনে বলল,“গোস্ত লাগবে না। আমার বউকে দিয়ে দিন। আমি চলে যাই।”

হুরাইন ঘুরে ঘুরে তিনজনেরই তদারকি করছে। নিজ উদ্বেগে সকলের পাতে খাবার দিচ্ছে। জনাব আজাদ মেয়ে জামাইয়ের দৃষ্টি লক্ষ করে মেয়েকে বললেন,“আপনি ভেতরে গিয়ে খেয়ে নিন আম্মু। বাকিটা আমি সামলে নেব। খেয়ে বিছানা ঠিক করে নিন।”

হুরাইন স্বাভাবিকভাবে কথাটি কানে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। তাসিন মনে মনে শশুরের প্রতি কৃতজ্ঞ হলো। জনাব আজাদ আরেকবার তাসিনের দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,“একটু ভাত দেব?”

তাসিন বাঁধ সাধলো। তার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। মন পড়ে রইল বিবির কাছে।

হুরাইন খাওয়া শেষ করে তাসিনকে নিয়ে গেল তার ঘরে। নিচু স্বরে বলল,“আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি একটু পর আসছি।”

খপ করে তার হাত চেপে ধরল তাসিন। বলল,“পুরোদিনে মাত্র কাছে পেয়েছি তোমায়। এখন কোথাও যেতে হবে না।”

হুরাইন লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল। থুতনি গিয়ে ঠেকলো বুকে। মিনমিন করে বলল,“মা, আপুরা বসে আছেন। না গেলে কী ভাববেন?”

“বিয়ে তাঁদেরও হয়েছে হুরাইন। তাঁদের সকলের উচিত স্বামীকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকা। আর কেউ ভাবলে ভাবতে পারে তোমার স্বামী তোমায় অত্যধিক মাত্রায় মহব্বত করে।”

পুলকিত নজর হুরাইনের। সে প্রশ্ন করল,“সত্যি মহব্বত করেন আমায়?”

তাসিন চট করেই জবাব দিতে পারল না। ক্ষণ সময় চুপ রইল।

#চলবে…….

এক টুকরো আলো পর্ব-০৮

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_০৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

এখন পর্যন্ত শাশুড়ির দেখা পেল না হুরাইন। চারদিক থেকে তাকে ঘিরে রেখেছে প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন। মেয়েদের ভীড় ঠেলে একজন পুরুষ স্ত্রীকে ডাকতে চলে এলেন এ ঘরে। এসেই যেহেতু পড়েছেন, কৌশলে একবার তাসিনের বউ দেখে নিলে মন্দ হয় না। আফসোস উঁকিঝুঁকি দিয়েও তিনি দেখতে পেলেন না নববধূর মুখশ্রী। পুরুষ কন্ঠ কর্ণগোচর হওয়া মাত্র তড়িৎ মুখ আড়াল করে ঘুরে বসে হুরাইন। তার বুকে তীব্র কম্পন হচ্ছে। নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। হুরাইনের অন্তরে ভয়। ওই অজ্ঞাত ব্যক্তি কি তাকে দেখে নিয়েছে? দেখলেও বা কতটুকু? ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেই পুরুষ কন্ঠ। পূর্বের মত ঘুরে বসতেই কেউ কেউ বুঝে নিলেন হুরাইনের ভয়। কেউ সরু গলায় বললেন,“কী গো মেয়ে? আমাদের দেখে এমন মুখ ঘুরিয়ে বসেছো কেন? শুনলাম পর্দাশীল মেয়েদের মন স্বচ্ছ। অথচ তোমার মন দেখি অহংকারে ভরা। আমরা কি বিধর্মী নাকি? আমাদের দিকে তাকালে কি তোমার ইজ্জত যাবে?”

বৃদ্ধার কথা শুনে হুরাইন নিজের অন্তর পরিষ্কার প্রমাণ করতেই তড়িঘড়ি সাফাই দিল।
ক্ষীণ স্বরে বলল,“আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না। একজন পুরুষ মানুষ এই ঘরে প্রবেশ করেছিলেন। ওনার সাথে দেখা দেওয়া আমাদের সবার জন্য জায়েয নয়।”

বৃদ্ধার চোখমুখের আকার বড়ো হয়ে গেল। হাহুতাশ করে বললেন,
“তাসিনের মা তাসিনের জন্য কী ধরে এনেছে! এখনো বিয়ের গন্ধ যায়নি। অথচ শশুর বাড়ি পা রেখেই মুখে মুখে জবাব দেয়। এই মেয়ে সংসারে অশান্তি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।”

পাশেই বৃদ্ধার মেয়ে ছিলেন।
“তুমি থামবে মা?”
অতঃপর হুরাইনের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,“বয়স হয়েছে। সেকেলে মানুষ। তাই না বুঝে ধর্ম টেনেও কথা বলে ফেলেছে। কিছু মনে কোরো না।”

হুরাইন বলল,“আমি কিছু মনে করিনি।”

বৃদ্ধা খেঁকিয়ে উঠলেন। মেয়েকে বললেন,
“ওঠ এখান থেকে।”

রাত বাড়তেই ভিড়ভাট্টা কমে গেল। মাগরিবের নামাজ আদায় করলেও এশা এখনো আদায় করতে পারেনি হুরাইন। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে কিছু খুঁজতেই ফুফু শাশুড়ি এসে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলেন,“কী খোঁজা হচ্ছে?”

“আপনাকেই। ওজু করবো।”

হুরাইন ফুফু শাশুড়ির সাথে গিয়ে ওজু করে নামাজ আদায় করে নিল। সকলের রাতের খাবার শেষ হওয়ার পর তিনজন বাকি রইলো। তাসিন, হুরাইন আর তাসিনের ফুফু। হুরাইনকে নিয়ে খেতে বসিয়ে দিলেন ফুফু। জড়োসড়ো হয়ে একবার চারপাশে নজর বুলানোর চেষ্টা করলো হুরাইন। ফুফু শাশুড়ি ছাড়া পরিবারের আর কেউ তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেনি। তার না-কি একটা ননদ আছে! কই তাকেও যে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। হুরাইন যখন আপন ভাবনায় মত্ত, তখন পাশে চেয়ার টানার শব্দ হলো।
আরো অনেকগুলো চেয়ার থাকতেও তাসিন এসে হুরাইনের পাশের চোয়ার টেনে বসলো। নড়াচড়া করলো না হুরাইন। শক্ত হয়ে বসে রইলো। তার বুক কাঁপছে দুরুদুরু। একটা সম্পর্কে জড়িয়ে তো পড়েছে। কিন্তু মানুষটা কেমন হবে সেই ভয় তাকে কাবু করে নিয়েছে। ফুফু নিজেও খেতে বসলেন। হুরাইন খাচ্ছে কম,খাবার নড়াচড়া করছে বেশি। তেমন কিছুই নিলো না পাতে। তাসিন বেশ খানিকক্ষণ যাবত লক্ষ করে বলল,“খাচ্ছো না কেন? আমরা মুরগীর বাচ্চা পালি না।”

কথাগুলো বলার সময় তাসিনের ঠোঁটে হাসি ছিল না। ওর চেহারা ছিল স্বাভাবিক। ফুফু মৃদু হেসে বললেন,“জায়গা বদলেছে, বাবা-মা ছেড়ে এসেছে। তাই এমন হচ্ছে। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”

হুরাইন উশখুশ করছে। তার দৃষ্টি এলোমেলো। কিছু বলতে চাইছে সে। তাসিন তার দিকে তাকাতেই সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। তাসিন ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,“কিছু বলবে?”

দুদিকে মাথা দুলিয়ে না জানালো। ফুফু জিজ্ঞেস করলেন,“কোনো সমস্যা?”

“আমি আর খাব না।” অস্ফুট স্বরে কথাখানা বলতেই তাসিনের কপালে ভাঁজ পড়ে চোখ দুটো ছোটো হয়ে এলো। তীক্ষ্ণ চাপ দিল মস্তিষ্ক। ফুফুকে বলছে অথচ তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে! তাসিন বাঁধা দিল না। হুরাইন উঠে পড়লো। পেটে খিদে থাকলেও গলা দিয়ে নামছে না। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে।

★★
হালকা-পাতলা ফুল দিয়ে তাসিনের ঘর সাজানো হয়েছে। বিছানার মাঝখানে মাথায় কাপড় টেনে দৃষ্টি নিচু করে বসে আছে হুরাইন। তাসিন ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিল। শরীরে একখানা নীল সুতি শাড়ি। মুখে কোনো কৃত্রিম সাজ নেই। ছোট্ট নাকফুলটা ঝিলিক দিয়ে উঠছে। নীল শাড়িতে একটুকরো সাদামেঘ যেন উঁকি দিচ্ছে। তাসিনের হুঁশ উবে গেল। তার ঘরে উঠে এসেছে নীলপদ্ম। এ তো চোখের তৃষ্ণা। মনের তৃষ্ণা মেটাতে হলে যে অন্তর ছুঁয়ে দিতে হবে। তাসিন মৃদু স্বরে শুধালো, “তুমি কি আমাকে ভয় পাও?”

হুরাইনের নিরব রইল। সব সময় নিশ্চুপ থাকা মানে সম্মতির লক্ষণ নয়। কখনো কখনো জড়তা মুখ চেপে ধরে। তাসিনের দৃষ্টি এক মুহুর্তের জন্য সরলো না। বলল,“ভয় পাও?”

“নতুন জীবনটা নিয়েই আমার ভয়।”
হুরাইনের কম্পিত স্বর। তাসিন প্রত্যুত্তর করলো না। আল্লাহ তায়ালার নিকট শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো তাসিন। আহবান করলো হুরাইনকে। নরম স্বরে বলল,
“আমি পা*পী। পেছন দিকে ঘুরে তাকাতে চাই না। তোমার সাথে আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তোমার৷ তার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আমি।”

হুরাইন অবাক চোখে তাকালো। তাসিন ফের বলল,“আমার জন্য তোমার চোখে ভয় দেখতে চাই না। তোমার জীবন নিয়ে আশঙ্কা দেখতে চাই না। মৃত্যুর পর অব্দি তোমার সাথে থাকতে চাই।”

হুরাইনের ভয় অনেকটাই কেটে গেল। তাদের বাড়ির পরিবেশ আর এই বাড়ির পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাড়িতে কখনো তেমনভাবে তাদের মাথা থেকে কাপড় সরে না। অথচ এখানে এমন অনেক নারীকে নজরে পড়েছে। যাঁরা খোলা চুলে হেঁটে বেড়িয়েছে। হুরাইন ধীর পায়ে তাসিনের পাশের জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওজু সে পূর্বেই করে নিয়েছে। বুকের ভেতর দিয়ে একটা শীতল ঢেউ অনুভব করলো তাসিন। একই সাথে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নিলো। বিছানায় পা টানটান করে শুলো তাসিন। পাশ ফিরে হুরাইনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,“পাশে এসো।”

জড়োসড়ো হয়ে এগিয়ে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল হুরাইন। তার ভীষণ লজ্জা করছে। একজন অপরিচিত মানুষ এক মুহূর্তের মাঝে তার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। আচ্ছা সে-কি এই মানুষটাকে মহব্বত করবে? পবিত্র বন্ধনে নাকি আল্লাহর রহমত,বরকত, ভালোবাসা থাকে অঢেল! চোখ বুজে অনুভব করলো একটি উষ্ণ হাত এসে তার শরীর ছুঁয়েছে। আলিঙ্গনে নিজের দিকে টে*নে নিয়ে যাচ্ছে। হুরাইন ঝট করে খুলে ফেললো চোখের পাতা। ভড়কে গেল ভীষণ। তাসিনকে তার দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখল। তাসিনের চোখে ঘোর। বিপরীত মানবীর প্রতি আকর্ষণ। ক্রমশ তাদের মাঝের দূরত্ব কমলো। ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো হুরাইনের ঘাড়ের কাছে।

★★★

গতদিনের মত আজও অনেকে এসে হুরাইনকে দেখে যাচ্ছে। কাল তার মাঝে ভীতি থাকলেও আজ চোখমুখ উজ্জ্বল। সকালেই ফুফু শাশুড়ি পরিচয় করিয়ে দিলেন হুরাইনের একমাত্র ননদ নিশির সাথে। মেয়েটি খুব একটা কথা বললো না। ভাবি নিয়ে তেমন উল্লাস নেই তার। হুরাইনের মনে হলো বেশ মেপেঝেপে কথা বলে। দুপুর হওয়ার পূর্বে একটি মেয়ে নিয়ে হুরাইনের কাছে ছুটে এলো নিশি। সালাম দিল হুরাইন। মেয়ে মানুষটি বয়সে তার তুলনায় বড়ো হবেন৷ এক কথায় রূপবতী নারী। হুরাইন তাঁর দৃষ্টিতে থতমত খেল। কেমন গভীর দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন। নিশি বলল,“উনি আপনার ননদ হয়। আমার কাজিন, ফাবিহা আপু।”

মিষ্টি করে হাসলো হুরাইন৷ ফাবিহা আরো ঘোরের মাঝে ডুবে গেল। এবার বুঝলো এই নারীর সাথে প্রতিযোগিতা করা, যুদ্ধে নামার যোগ্যতা তার নেই। গুণের কথা পূর্বেই শোনা হয়েছে। আজ তার লাবণ্যময়ী রূপও দেখা হয়ে গেল। ফাবিহা নিজেকে স্বাভাবিক করে জোরপূর্বক মৃদু হাসলো। বলল,“আপনাকে দেখার আগে ভেবেছিলাম আপনি সৌভাগ্যবতী বলেই তাসিন ভাইকে জীবনসঙ্গী রূপে পেয়েছেন৷ এখানে এসে আপনার সম্পর্কে জেনে আপনাকে দেখে আমার ধারণা পরিবর্তন হলো। আপনি নন, তাসিন ভাই সৌভাগ্যবান পুরুষ। আপনার মত স্ত্রী কতজন পুরুষের ভাগ্যে জোটে?”

সামনের আপুটিকে ভালোলাগছে হুরাইনের। বলল,“আমাকে তুমি সম্বোধন করবেন আপু। আমার ভালোলাগবে।”

ফাবিহা বুকের কষ্ট চেপে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। বলল,“তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে। তোমার সংসার জীবনে শান্তির বৃষ্টি হোক। আবারও আমাদের দেখা হবে। আজ তাড়া আছে। আসছি।”

হুরাইন বলল, “এখনই চলে যাচ্ছেন আপু? আপনাকে কাল থেকেও দেখলাম না। আর এখনই বিদায় নিচ্ছেন?”

“ওই যে বললাম, তাড়া আছে। আসছি।”

ফাবিহা চলে যেতেই হুরাইনের মন খারাপ হয়ে গেল।
ফাবিহা বাড়ি পথে রওনা দিয়েছে। তাসিনকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে গেল। তার সুখের জীবনে কাঁটা হয়ে থাকতে চায় না ফাবিহা। ওই মেয়েটাও নিশ্চয়ই তার মত রঙিন স্বপ্ন নিয়ে এসেছে। তার সংসারের অশান্তির কারণ কী করে হয় ফাবিহা?

সকালে বাবার সাথে কাজে হাত লাগিয়ে আর বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেনি তাসিন। হুরাইনের আশেপাশে সারাক্ষণ কেউ না কেউ বসা রইল। এখন বসে আছে তাসিনের ফুফাতো বোনের মেয়ে। সে অপলক হুরাইনের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইলো। হুরাইন যতবার তার দিকে তাকিয়েছে, ততবারই তাকে একইভাবে দেখতে পেল। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,“তাকিয়ে আছো কেন বুড়ী?”

“আপনার ঠোঁট আমার ভালোলাগে।”

তাসিন ভেতরে ঢুকে মেয়েটিকে বলল,“একটু বাইরে যাও তো আম্মু।”

বাচ্চা মেয়েটি চলে গেল এক ছুটে। তাসিন গলা ঝেড়ে গভীর স্বরে বলল,“আমারও ভালোলাগে।”

হুরাইনের প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি পড়ে দুষ্টুমি ফুটিয়ে তুললো চোখেমুখে। ধীর স্বর বলল,“ঠোঁট।”

লজ্জা পেয়ে পিছু ঘুরে গেল হুরাইন। বিড়বিড় করে বলল,“খুব বাজে।”

#চলবে……

এক টুকরো আলো পর্ব-০৭

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_০৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

শান্তিপ্রিয় মানুষ হওয়ায় কখনো স্ত্রীর সাথে তর্কে যান না তাসিনের বাবা। কিন্তু আজ আর কোন অন্যায় মেনে নিলেন না৷ কড়া গলায় বলে দিলেন।
“তোমার এসব বাহানা চলবে না। আমার কথাই শেষ কথা। আর কিছু শুনতে চাই না আমি।”

সাজেদা রাগে ফেটে পড়লেন। তাসিন দেখলো যে মা খালাকে কিছুই জানায়নি। সে সরাসরি ফাবিহাকে কল দিল। ফোন তুললো না ফাবিহা। পরপর কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গেল।

ফাবিহা বাড়ি পৌঁছাতেই তার মা আঁতকে উঠলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন মেয়েকে। ফাবিহাকে ধরে আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,“এই অবস্থা কেন তোর? কী হয়েছে?”

ফাবিহা ঝিমিয়ে ঘরে ঢুকলো। মৃদু স্বরে বলল,“আগে আমায় ভেতরে যেতে দাও৷ ক্লান্ত আমি। মা ফাবিহাকে ধরে নিয়ে বসিয়ে দিলেন৷ মায়ের মন। দ্রুত পানি দিয়ে অস্থির স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“এবার বল, কী হয়েছে?”

ফাবিহা ধীর গলায় শাবাবের কথা বলল মাকে। তীব্র আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
“ওই হারামজাদার এত বড়ো সাহস! কার মেয়ের সাথে বাজে ব্যবহার করেছে ও জানে না। তোর বাবা আসুক একবার। এর একটা বিহিত করেই ছাড়বো। তুই এতদিন কেন বললি না? খুব বড়ো হয়ে গিয়েছিস, না?”

ফাবিহা চুপ করে রইলো। ভেতরে ভেতরে সেও তীব্র রাগ পুষে রেখেছে। ফোন হাতে নিয়ে তাসিনের কল দেখে মন ভালো হয়ে গেল। শাবাবের চিন্তা একপাশে রেখে ফোন হাতে ঘরের দিকে উঠে গেল। মা জিজ্ঞেস করলেন,“কোথায় যাচ্ছিস?”

“ঘুমাবো৷ আমাকে ডেকো না।”

“যা, বিশ্রাম নে।”

ফাবিহা নিজের ঘরে এসে কল ব্যাক করলো তাসিনকে। তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করিয়েই তাসিন ফোন তুললো।
“কেমন আছিস?”

“খুব ভালো।” ফাবিহার নরম স্বর।

তাসিন গম্ভীর স্বরে বলল,“তোর সাথে আমার কথা আছে। ফ্রি আছিস?”

“হ্যাঁ, বল।”

তাসিন কোন প্রকার ভনিতা না করেই বলে ফেললো,“আমি একজনকে পছন্দ করি। আর তাকেই বিয়ে করতে চাই। আমাদের ঘরে বিয়ের আলোচনাও চলছে। তোকে আমি সবসময় নিশির মতোই ছোটো বোনের নজরে দেখে এসেছি।”

ফাবিহা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তার শব্দ স্বল্পতা দেখা দিল। বুক কাঁপছে তার। তাসিন নিশ্চিয়ই তার সাথে মজা করছে। ফাবিহা হাসার চেষ্টা করে তোতলানো স্বরে বলল,“ত তুমি মজা করছো, তাইনা?”

তাসিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“না। আমি সত্যি বলছি। আমি যাকে পছন্দ করি, তার নাম হুরাইন। মা কিছুতেই খালাকে ব্যাপারটা জানাতে পারছিলেন না। জানাতে চাচ্ছেন না। তিনি চান আমি যেন তোকে বিয়ে করি৷ কিন্তু মনের টান যেখানে শূন্য, সেখানে সারাজীবন সংসারের সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামি। আমার কথা কি বুঝতে পারছিস? তুই খালাকে একটু বুঝিয়ে নিস। আর আ’ম সরি। আমার দো*ষে*ই ব্যাপারটা এতদূর গড়ালো।”

“আমাকে কে বোঝাবে?” ফাবিহার ব্যথাতুর চোখজোড়া এই কথা বললেও মুখে বলতে পারলো না। তার গলা ধরে আসছে। দ্রুত কথা শেষ করতে চাইল সে। তাই তড়িঘড়ি করে জবাব দিল,“আমি বোঝাবো মাকে। তুমি চিন্তা কোরো না।”

তাসিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,“থ্যংকিউ।”
কল কেটে দিতেই ফাবিহার আটকে রাখা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো। কত সহজেই সবটা বলে দিল। একটা সরি তে কি আর মনের ক্ষ*ত সারিয়ে তোলা যায়? কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেললো সে৷ গোপন চিৎকারে কাঁদলো তার মন। যার আওয়াজ কারো কান পর্যন্ত গেল না৷ যাকে মন দিয়ে এসেছে, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, সেই মানুষটাই আজ তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ফাবিহা ক্রন্দনরত গলায় চাপা আর্তনাদ করে বলল,“আপনার মনে আমায় একটুখানি জায়গা দিলে কী হতো তাসিন ভাই?”

তাসিন – হুরাইনের বিয়ের কথা দ্রুত এগোচ্ছে। যেহেতু বিয়ের কথা পাকা, তাই শুধু শুধু ছেলেমেয়ের মনে আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে লাভ কী? সাজেদা জেদ করে কারো সাথেই কথা বলছেন না। নিশিও মনোক্ষুণ্ণ। তাসিনের বাবা মেহমানের লিস্ট করার সময় সাজেদা সাফসাফ বলে দিলেন উনার বাবার দিকের কোন লোক বিয়েতে আসবে না। তাঁদের যেন গোনায় না ধরা হয়। তাসিনের বাবা চুপচাপ লিস্ট তৈরি করে গেলেন। তিনি নিজে গিয়ে বিয়েতে দাওয়াত দিয়ে আসবেন। উনার দায়িত্ব উনি পালন করবেন। তাঁরা আসুক, না আসুক সম্পূর্ণ তাঁদের ইচ্ছে।

ফাবিহা নিজেকে ধাতস্থ করে সন্ধ্যায় ঘর থেকে বের হলো। চোখমুখের ফোলা ভাব এখনো স্পষ্ট। মুখে পানি দিয়ে মায়ের কাছে গেল। তিনি চিন্তিত স্বরে বললেন,“তোর চোখমুখ এমন ফুলে আছে কেন?”

“মাথাব্যথা করছে মা।”

“সে কি। আমাকে ডাকিসনি কেন? আমি মলম লাগিয়ে দিতাম।”

“এখন আর লাগবে না। শোন না।” বলেই ফাবিহা ইতস্তত করে উঠলো।

“কিছু বলবি? বল না।”

“তুমি আগে বল কোন রিয়েক্ট করবে না৷ আগে ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করবে।”

“ঠিক আছে।”

ফাবিহা ভয়ে ভয়ে তাসিনের কথা মাকে জানালো। শান্ত থাকবেন বলেও ফাবিহার মা শান্ত থাকতে পারলেন না। স্বাভাবিক, কোন মা-ই নিজের মেয়ের অপমান, মন ভাঙার আর্তনাদ মেনে নেবেন না। ঝড়ের পূর্বের পরিবেশ বেশ থমথমে। তিনি বললেন,“এসব আ*জে*বা*জে কথা কে বলেছে তোকে?”

“এসব আ*জে*বা*জে কথা নয়।” রুদ্ধশ্বাসে কথা খানা বলতে গিয়ে এক ফোঁটা অবাধ্য আোখের জল গড়িয়ে পড়লো ফাবিহার।
মায়ের মাথায় যেন বর্জ্রপাত হলো। চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
“কী পেয়েছে আমার মেয়েকে? আমার মেয়ে খেলার পুতুল? আমার ফোন কই?”

ফাবিহা ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল,“মা ঝামেলা কোরো না।”

“এই জন্যই তোর চোখমুখ ফোলা? কেঁদেছিস তুই।”

ফাবিহা ক্রমাগত মাথা নেড়ে অস্বীকার করলো সে কাঁদেনি। তার মা ফোন হাতে নিয়ে কল দিলেন সাজেদার নম্বরে। থামাতে পারলো না ফাবিহা। সাজেদার সাথে তর্কাতর্কি শুরু হলো। সাজেদা ওপাশ থেকে হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মিথ্যা, বানোয়াট মনে হলো ফাবিহার মায়ের কাছে। রাগে শরীর থরথর করে কাঁপছে।
সাজেদা বোনকে বোঝাতে অক্ষম। তিনি তো মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন ফাবিহাকে বউ করে নিতে। ছেলে যদি না শোনে তাহলে উনারই বা কী করার আছে? সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়েও নিলেন তিনি। ছেলের মুখের দিকেও তাকাচ্ছেন না। আর কী করতে পারেন?

গেটের দিকে মুখ করে বাইকের উপর বসে রইলো শাবাব। ফাবিহা গেট দিয়ে প্রবেশ করেছে।মনে হচ্ছে প্রাণহীন দেহটা হেঁটে আসছে। চোখেমুখে অন্যদিনের মতো উজ্জ্বলতা নেই আজ। নেই কোন তেজ। ভ্রু কুঁচকে গেল শাবাবের। বিড়বিড় করে বলল,“এর আবার কী হলো? একটা চ*ড় খেয়ে এই অবস্থা?”

তার সামনে দিয়ে ফাবিহা হেঁটে চলে গেল। ফরহাদ বলল,“ভাই, মাইয়া দেখি চুপসে গেছে। যে চ*ড়*টা দিছেন ভাই, আমি নিজেই ভয় পাই গেছি।”

শাবাব ফরহাদের কথায় প্রত্যুত্তর না করে তীক্ষ্ণ চোখে ফাবিহার ক্লাসের দিকে তাকিয়ে রইলো। ক্লাস শেষে বের হয়ে গেল ফাবিহা। ক্যাম্পাসের বিপরীতে তার বাসা। সামনে এগিয়ে যেতেই গতকালের মতো পথ রোধ করে দাঁড়ালো শাবাব। সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করে বিদ্রুপ করে বলল,“প্রেমিক ছ্যাকা দিয়েছে পরমা সুন্দরী? কেঁদেছ কেন? আমার কাছে এসে দেখ, আমি ছ্যাকা দেব না। সত্যি বলছি।”

ফাবিহা শক্ত মুখে বলল,“আপনার সাথে আমি কোন কথা বলতে চাই না। পথ থেকে সরে দাঁড়ান।”

“সত্যি বলছি। তোমার প্রেমিকের চেয়েও বেশি ভালোবাসবো তোমায়৷ ছ্যাকাটাও তারচেয়ে বড়ো দেব।”
শেষ কথাটা ফিসফিসিয়ে বলেই শব্দ করে হেসে ফেললো শাবাব। অপমানে শরীর রিরি করে উঠছে। দাঁতে দাঁত চেপে একটা কথাই উচ্ছারণ করলো ফাবিহা।
“ল*ম্প*ট কোথাকার।”

পাশ কাটিয়ে যেতে যেতেই শুনতে পেল শাবাবের স্বর। “গালে মলম লাগিয়ে নিও পরমা সুন্দরী। দেখতে ভালোলাগছে না।”

ফাবিহা দাঁড়িয়ে পড়লো। পিছু ঘুরে করুণ গলায় বলল,“আমার পিছু ছাড়বেন কবে?”

শাবাবের চাহনি পরিবর্তন হলো। কোমল হলো চেহারার আদল। এবার বুঝি রহম করবে মেয়েটার উপর! পরক্ষণে মুখ ফুটে বলল,
“আমার সাথে প্রেম করো। তখন আর পিছু করবো না। ছ্যাকা দেব।”

শাবাবের ঠোঁটে ফিচেল হাসি।
ফাবিহা নিজের কাজে নিজেকে দোষারোপ করলো। সে কেন এই বেয়া*দব ছেলেটার সাথে কথা বলতে গেল? এ সোজা হওয়ার মতো ছেলে নয়৷ রাস্তা পার হওয়ার আগে সামনে দিয়ে একটা ট্রাক গেল। যদি লম্প*টটাকে পি*ষে মা*র*তে পারতো, তবে ক্ষো*ভ মিটে যেত।

তাসিন -হুরাইনের বিয়েতে তাসিনের মায়ের পক্ষের কোন লোকজন এলো না। বরপক্ষ থেকে খুবই কম লোকজন গেল হুরাইনের বাড়ি। মসজিদে অবস্থানরত সকলে অপেক্ষায় আছে। স্বল্প পরিমাণ দেনমোহর ধার্য করে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল। জনাব আজাদ জামাতা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। হুরাইনের এক অজানা অনুভূতি হচ্ছে। সে নিজেকেই বুঝে উঠতে পারছে না। বুক ধুকপুক করছে তার। তাসিন মুখিয়ে আছে তার প্রিয় বিবি সাহেবাকে এক নজর দেখার জন্য। আজ তারা একে অপরের জন্য হালাল। আর লুকোচুরি করে দেখতে হবে না। খুব কাছ থেকে দেখতে পারবে, চাইলেই একটুখানি ছুঁয়ে দিতে পারবে।

পুরো পর্দার সহিত বিদায় দেওয়া হলো হুরাইনকে। প্রিয় বাবা-মা, প্রিয় পরিবার ছেড়ে যেতে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। নিকাবের ভেতর তার গাল ভিজে একাকার। চোখজোড়া এখনো জলে টইটম্বুর। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। হুরাইনের কান্নার মাঝেই একটি শক্তপোক্ত হাত তার হাত ছুঁয়ে দিল। কেঁপে উঠলো হুরাইন। কান্না থেমে গেল তার। তাসিন কেমন বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল। ছোটো স্বরে শুধালো, “পানি খাবে?”

হুরাইন জমে বসে রইলো। নড়াচড়া করতে পারলো না। তাসিন তার জড়তা দেখে বলল,“বিবি তুমি আমার। ভয় নেই। পানি দেব?”

হুরাইন মাথা নেড়ে না জানালো। আড় চোখে একবার সামনে ড্রাইভারের দিকে তাকাতে গিয়েও মাথানিচু করে ফেললো। তাসিন বলল,“উনাকে নামতে বলি। তুমি পানি খাও।”

এবারেও না সূচক মাথা নাড়লো হুরাইন।
নতুন বউ নিয়ে গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। সাজেদা বের হয়ে এলেন না। হুরাইনের ফুফু শাশুড়ীরা আগ বাড়িয়ে সব করছেন। মান রক্ষা করতে হবে যে। যিনি হুরাইনকে দেখছেন, তিনিই মাশাআল্লাহ বলে থামছেন। এভাবে এতগুলো দৃষ্টির কবলে পড়ে অস্বস্তি বাড়লো হুরাইনের। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। চুপচাপ সবটা মেনে নিতে হলো।

নিশি ফোন করলো ফাবিহাকে। জানালো তাসিন বউ নিয়ে এসেছে। সাথে রাগ, বিরক্তি দুটোই প্রকাশ করলো৷
“বড়ো ভাইয়ের বিয়ে, অথচ আমি একমাত্র বোন হয়ে বিয়েতে যেতে পারলাম না। বিয়ে নাকি কোন শোকের মাঝে আছি বুঝতে পারছি না। কোন হৈ-হুল্লোড় নেই৷ তুমি আমার ভাবি হলে কত ভালো হতো।”

ফাবিহা নিজের কান্না চেপে বলল,“আল্লাহ যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন৷ মা ডাকছে আমায়। পরে কথা বলবো।”

“শোন না। তুমি আসবে কাল?”

“চেষ্টা করবো।”
বলে কল কেটে দিল ফাবিহা। তার কিচ্ছু ভালোলাগছে না। হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে নিজেকে আঘাত করার চেষ্টা করলো। টেনে সব চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। রাগ গিয়ে এবার চুলের উপর পড়লো। পরক্ষণে হাঁটু গুটিয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদলো। দেখতে ইচ্ছে করলো সেই সৌভাগ্যবতীকে। যে দেখা না দিয়েও তাকে পরাজিত করে তাসিনকে জিতে নিয়েছে। এক সময় কাঁদতে কাঁদতে শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠলো। থম ধরে পড়ে রইলো ফাবিহা। এখন আর চোখের পাতা মেলে ধরতে ইচ্ছে করছে না।

#চলবে…

এক টুকরো আলো পর্ব-০৬

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_০৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

হুরাইনের মা স্বামীর দিকে পানির গ্লাসটি বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“আপনি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?”

জনাব আজাদ স্ত্রীকে পাশে বসতে ইশারা করলেন। বসতেই মুচকি হেসে বললেন,“কী মনে হয় তোমার? কেমন সিদ্ধান্ত নিলে আমার আম্মুকে দেখার অনুমতি দিয়েছি?”

হুরাইনের মা উশখুশ করে বললেন,“কিন্তু।”

“ভরসা আছে আমার উপর?”

স্ত্রীর চোখের চাহনিতেই জবাব পেয়ে ঠোঁট আরও প্রশস্ত করলেন। বললেন,“ভরসা করলে এত দুশ্চিন্তা কেন? আমি দেখেছি ছেলেটার আগ্রহ। ছেলের বাবার সাথেও কথা হয়েছে আমার।
আমার চিন্তাভাবনা ভিন্ন কিছু। যদি ওই পরিবারে গিয়ে পরিবারের মানুষগুলোকে সামান্যতম পরিবর্তন করা যায়! যাঁদের আগ্রহ থাকে না, তাঁদের পরিবর্তন করা কঠিন। আল্লাহ যাকে চান হেদায়েত দিতে পারেন। উসিলা যদি আমার মেয়ে হয়। যদি সামান্যতম পরিবর্তন আসে, চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”

“কীভাবে পারবে আমার মেয়ে?”

“তুমি কি ভুলে গিয়েছ, তোমার পুত্র বধূও কিন্তু ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেয়ে। আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে তার মাঝে যে পরিবর্তন এসেছে, কেউ দেখলে বলতে বাধ্য এই মেয়ে ছোটো থেকেই দ্বীনি শিক্ষায় বেড়ে উঠেছে।”

“আমাদের দল ভারী। সেজন্য বউমার মাঝে পরিবর্তন এসেছে। একা একজন আমাদের ভেতরে এসে নিজেকে পরিবর্তন করতে পেরেছে। আমার মেয়েও একা। ওই ছেলের পরিবার শক্তিশালী। যদি মেয়ে ওখানে থেকে তাঁদের মতো চলাফেরায় নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলে?”

জনাব আজাদ দৃঢ়তার সাথে বললেন,“ইনশাআল্লাহ আমার মেয়ে পারবে। আমি ছেলের বাবা আর ছেলেকে শর্ত দিয়েছি। সবটা মজবুত করে তবেই এগোচ্ছি।”

“কেমন শর্ত?” হুরাইনের মায়ের উৎসুক কন্ঠস্বর।

“ঘটনা কিছুটা এমন ছিল, আমি তাসিন আবিদ আর তাঁর বাবার কাছে শর্ত রেখেছি।
আমার মেয়ের পর্দার খেলাপ হবে এমন কিছু যে ঘটবে না তার নিশ্চয়তা দিতে পারবেন?

ছেলের বাবা বললেন,‘আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে যেন শুধু পর্দা নয়, অন্য কোন অসুবিধা না হয় আপনার মেয়ের।’

বললাম,“যদি খেলাপ হয়ে যায়?”

ছেলেটি দৃঢ়তার সাথে বলে উঠলো,‘এমন কিছু দেখলে আপনার মেয়েকে আপনি নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারেন। কিংবা যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেন।’

কথা শেষ করে হাসলেন জনাব আজাদ। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,“কী বল, এমন একটা মানুষকে সুযোগ দেওয়া নাকি তাঁকে দ্বীনি পথে টেনে আনতে আমাদের এত বড়ো সুযোগ হাত ছাড়া না করা উচিত হবে? পরামর্শ দাও কোনটা করলে ভালো হবে?”

হুরাইনের মা নিচু স্বরে বললেন,“আপনি যা ভালো মনে করেন। সবসময় ছেলেমেয়ের ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত তাঁদের কল্যাণ বয়ে এনেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবারও আল্লাহ তায়ালা সেটাই করবেন। আর উপর থেকে যদি এখানেই আমার মেয়ের জুড়ি লিখা থাকে, তাহলে আমরা কিছুই করতে পারব না।”

জনাব আজাদ বললেন,“আমি এখনো সম্পূর্ণ কথা দেইনি তাঁদের। আগে আমার আম্মুর মতামত প্রয়োজন। তাঁকে জিজ্ঞেস কোরো। তার সম্মতি থাকলে তবেই আমি চূড়ান্ত কথায় এগিয়ে যাব।”

“জি।”

হুরাইনের ঘরে প্রবেশ করল তার ভাবি। মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করল,“সকলেই সম্মত আছে। আম্মা আমাকে পাঠিয়েছেন তোমার মতামত নিতে। তুমি না বললে এই সম্বন্ধ এগোবে না। আমি তাঁদের গিয়ে কী বলব?”

হুরাইন বলল,“আব্বু কী চাইছেন?”

“তিনি চাইছেন তুমি ওই পরিবারের পরিবর্তনের কারণ হও। আলো হয়ে যাও ওই সংসারে।”

হুরাইন কোন চিন্তাভাবনা ছাড়াই বাবার সিদ্ধান্তকে সম্মান দিয়ে রাজি হয়ে গেল। লজ্জালু হেসে বলল,“আব্বু যা করবেন, সেটা নিঃসন্দেহে আমার ভালো ভেবে করবেন। আমার অমত নেই।”

“আলহামদুলিল্লাহ।” বলেই মিটিমিটি হাসলো ভাবি। বলল,“আমার আর সকাল সকাল আরাম করে চা খাওয়া হবে না। এই চা টা এবার অন্যকেউ খাবে।”

হুরাইন লজ্জায় অতিষ্ঠ হয়ে চোখমুখ খিঁচিয়ে বলল,“যাও তো ভাবি। নয়তো আমি বেরিয়ে যাব।”

ভাবি হাসতে হাসতে বলল,“যাচ্ছি, যাচ্ছি। এত লজ্জা পেতে হবে না। বরের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।”

হুরাইনের মনে উঁকি দিল হাজারও কল্পনা। একবার চোখ বুজে স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্টা করল। কানে এখনো বেজে উঠছে সেই স্বর। হুরাইন অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করল,“আমি কীভাবে মনে দাগ লাগিয়েছি? আমি তো কিছুই করিনি।”

হুরাইনের বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই তাসিনকে সতেজ দেখাচ্ছে। খোশমেজাজে সবার সাথে কথা বলছে। সাজেদা দ্বিধাদ্বন্দে আছেন৷ কী করা উচিত তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। হুরাইনের ব্যাপারে কঠিন হতে গিয়েও পারছেন না। আবার ফাবিহার জন্যও মনটা জ্বলে যাচ্ছে।

ঘড়ির কাঁটা রাত্রি তিনটার ঘরে। তাসিনের চোখে ঘুম নেই। তার মন – মস্তিষ্কে রাজ করছে হুরাইন নামক এক মানবী। যতবার চোখের পাতা এক করতে চেষ্টা করে, ততবারই ওই মানবী এসে ধরা দেয়। কেমন ভুবন ভোলানো হাসি হেসে মায়া বাড়িয়ে ছুটে চলে যায়। চট করে চোখ খুলে ফেলে তাসিন। বিছানায় যাওয়ার পর থেকে অনেকবার তার সাথে এমন হয়েছে। তাই এখন আর ঘুমানোর চেষ্টা না করেই উঠে পড়ল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে যান্ত্রিক শহরটাকে দেখছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে হরিদ্রাভ আলো ছড়ানো ল্যাম্পপোস্ট। চট করে মাথায় কিছু খেলে যেতেই তাসিন ঘরে ফিরে এলো। এক টুকরো কাগজ নিয়ে কলম ঘষে চলল।
কী যেন লিখে যত্ন করে ভাঁজ করলো। তার চোখ হাসছে, ঠোঁট হাসছে। অন্তরটাও হেসে উঠছে পাওয়ার আনন্দে।
এবার বিছানায় গিয়ে জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করল।

কিছুদিন ধরেই ফাবিহাকে ক্যাম্পাসে দেখা যাচ্ছে না। শাবাব প্রতিদিন খোঁজ করে একই খবর পায়। ফরহাদ বলল,“ভাই মেয়েটা বোধহয় ভয় পেয়েছে। সেজন্যই ভার্সিটিতে আসছে না। দুদিন কথা বলে যখনই মেয়েদের অনুভূতি জন্মেছে আপনার প্রতি, আপনি সেই আগুন সুন্দরীদের ছেড়ে দিয়েছেন। আর এই মেয়ের পেছনে এখনো পড়ে আছেন? ছেড়ে দিন। এমনিতেই ভয় পেয়ে গিয়েছে।”

শাবাবের দৃষ্টি সামনের দিকে। ঠিক কীসের দিকে তাকিয়ে আছে বোঝা যাচ্ছে না। সে ক্রুর হেসে বলল,“এত সহজে ভয় পেলে কি চলবে? আমাকে দু-দুবার চড় মে*রে*ছে। এবার চুমু দেবে। সেই ব্যবস্থা করছি।”

“কীভাবে ভাই?”

“শুধু দেখে যা।”

তখনই গেট দিয়ে প্রবেশ করতে দেখা গেল ফাবিহাকে। ফরহাদ ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,“ভাই, ভাই আপনার শিকার। গেটের দিকে তাকান।”

শাবাবের চোখ ফরহাদের আগেই গেটে পড়েছে। ফাবিহা এদিক-ওদিক সাবধানী চোখে দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে ক্লাসের দিকে। হঠাৎ শাবাবের চোখে চোখ পড়ল। চোখমুখ শক্ত দেখালো তার। শাবাব বেহায়ার মতো হাসছে।
তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে ফাবিহা ঠোঁট নাড়িয়ে তাকে গালাগাল দিচ্ছে।

ক্লাস করে বিনা বাঁধায় গেট পেরোতে পেরে ফাবিহা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
রিকশা নিয়ে অর্ধেক রাস্তা যেতেই রিকশাচালক থেমে গেলেন। কারণ জিজ্ঞেস করতে যাবে, সামনে তাকিয়ে থেমে গেল সে। শাবাব তার বি*দ*ঘু*টে হাসি ঠোঁটে টেনে রেখেছে। ফাবিহা তেজী কন্ঠে বলল,“পথ আটকে রেখেছেন কেন?”

ফরহাদ বলে উঠল,“ভাইয়ের স্পেশাল ক্লাস আছে আপনার সাথে। নামুন।”

ঘৃণায় চোখ ঘুরিয়ে নিল ফাবিহা। রাগে দাঁতে দাঁত লেগে আসছে। পায়ের দিকে ইশারা করে বলল,“জুতা দেখেছিস? চামচার চল। রাস্তায় যখন ধরে জুতা পেটা করব, তখন বুঝতে পারবি মেয়েদের হ্যারাস করার শা*স্তি কী জিনিস।”

শাবাব খপ করে ফাবিহার হাত ধরে টে*নে*হিঁ*চ*ড়ে নামিয়ে ফেললো তাকে। হিং*স্র বাঘের মতো গর্জন করে বলল,“এ্যাই, চামচা কাকে বলছো? প্রথমত আমার গায়ে হাত তুলে মস্ত বড়ো ভুল করলে। আবার আমার ভাইদের চামচা বলছ?”

ফাবিহা দমে না গিয়ে দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল,“একশবার চামচা বলব, হাজারবার বলব চামচা। কী করবি তুই? টাকা ছিটালে তোর মতো আরও কত কুকুর এসে হাজির হয়ে যাবে। তোকে লা*শ বানিয়ে দিয়ে যাবে। রাস্তার কু*ত্তা।”

সজোরে ফাবিহার গালে চ*ড় পড়ল। ছিঁটকে মুখ থুবড়ে পড়ল রাস্তায়। শাবাবের শরীর দিয়ে আগুন ঝরছে। রক্তিম চোখজোড়া দেখে ভয় পেল ফাবিহা। শাবাব কঠোর স্বরে বলল,“আজ স্পর্ধা দেখেয়েছিস আর যেন কোনদিন এমন স্পর্ধা না দেখি। এতদিন কিছু বলিনি। তারমানে এই নয় যে আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে গা*লি দিবি। লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি তোকে। এরপর জানে মে*রে ফেলবো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মা*র*ব। আজকের মতো কেউ ছুটে আসবে না। সবাই তামাশা দেখবে।”

ফাবিহা খেয়াল করল সকলেই তামাশা দেখছে। কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে না।
শাবাব প্রস্থান করল। ফরহাদ ভীষণ চমকেছে। সে এর আগে শাবাবের এমন রূপ দেখেনি। সামান্য একটা সম্বোধনে এতটা হিং*স্র হয়ে উঠেছে! তার সাথে বাকি ছেলেগুলোও স্তব্ধ। ফাবিহা এতদিন বাড়িতে জানায়নি। বাবা শহরের বাইরে। মাকে জানালে দুশ্চিন্তা ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না। বরং তিনি আরও ভয় পেয়ে তাকে বের হতেই দেবেন না। রাস্তার ঘষা লেগে দু-এক জায়গায় চামড়া উঠে গিয়েছে। গালটা জ্বলে যাচ্ছে, টনটনে ব্যথায় কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তার। আজ তো মা জানবেনই।

তাসিন অপেক্ষায় ছিল কখন মাদ্রাসার গেট দিয়ে বের হবে হুরাইন। তার দেখা পেয়ে মাদ্রাসার একটি ছোটো মেয়েকে ডাক দিল। মেয়েটি প্রথমে এগোতে চাইছিল না। পরক্ষণে কী মনে করে এগিয়ে আসতেই তাসিন ইশারায় হুরাইনকে দেখিয়ে দিল। বলল,“ওই যে আপুটাকে দেখছ? তাকে এই কাগজটা দেবে ঠিক আছে?”

“হুরাইন আপুকে?”

“বাহ্! তুমি চেন তাকে?”

“হ্যাঁ চিনি তো।”

“তাহলে এটা দিয়ে এসো।”

মেয়েটি চলে গেল কাগজ হাতে। হুরাইনের বোরকা টেনে ধরে ডাকল,“আপু!”

পাশ ফিরতেই হাতে মাঝে একটা কাগজ গুঁজে দিল মেয়েটি। হুরাইন জিজ্ঞেস করলো,“কে দিল এটা?”

তাসিনের দিকে ইশারা করে বলল,“ওই যে, উনি তোমাকে দিতে বলেছেন।”

হুরাইন সেদিকে তাকাতেই তাসিনের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। সে দৃষ্টি নিচু করে কগজটি মুঠো করে ধরল। ছোট্ট মেয়েটি বিদায় নিতেই হুরাইনের একজন বান্ধবী বলে উঠল,“কাগজটা খুলে দেখ, কী লিখা আছে।”

হুরাইন কাগজটি ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল,“প্রয়োজন নেই।”

“বুঝেছি, আমাদের সামনে খোলা যাবে না। ব্যক্তিগত চিঠি কি-না!”

হুরাইন লজ্জা পেয়ে ধমকে উঠলো বান্ধবীকে।
“বেশি কথা বলিস।”

পাশ থেকে দুজনই মিটমিটি হাসছে।
হুরাইন কাগজটির কথা ভুলল না। খাবার খেয়ে দ্রুত দরজা আটকে দিল। ব্যাগ থেকে ওই সাদা কাগজটি বের করতেই কালো কালিতে কিছু শব্দ মিলে কয়েকটি বাক্য দেখতে পেল।
“দিনরাত শুধু আপানাকে ভাবছি। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। দ্রুত আমায় হালাল করে নিন। আমি পবিত্র ছোঁয়ার অপেক্ষায়….।”

থমকে গেল হুরাইন। সাথে ছুঁয়ে গেল একরাশ লজ্জা। সে কি এই চিঠির জবাব দেবে? দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তা মনের মাঝে মাটিচাপা দিল। চিঠির জবাব দিয়ে আর নিজের লজ্জা বাড়াতে চায় না।

সাজেদা এখনো কাউকে কিছুই জানাননি। বরং জনাব আজাদ সম্মতির কথা জানাতেই তিনি তাসিনের বাবাকে বলে দিলেন “আমি অনুষ্ঠান করে লোকজন খাইয়ে ছেলের বিয়ে দেব৷ চুপ চুপ করে বিয়ে দিতে পারব না। আর উনাকে জানিয়ে দাও আমাদের শ-পাঁচেক মেহমান খাওয়াতে হবে।”

বিস্মিত হয়ে গেলেন তাসিনের বাবা। তিনি বললেন,“তুমি বুঝতে পারছো তো কী বলছো? তোমার বাড়ি তুমি মেহমান খাওয়াও সেটা তো উনাদের সমস্যা না। কিন্তু এভাবে উনাদের চাপ দেওয়ার কী মানে? তোমার কী মনে হয় উনারা মানবেন? শরিয়া সম্মত বিয়ে মানে একগাদা লোক খাওয়ানো, হাসি-তামাসা করা নয়।”

“তাহলে জেনে-বুঝে কেন আমাদের পরিবারে মেয়ে পাঠাতে চাইছে? যদি এত সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে না করে দিক। আমি ফাবিহাকে নিয়ে আসবো বউ করে।”

তাসিনের বাবা বুঝে গেলেন এসব সাজেদার ইচ্ছাকৃত কাজ।

#চলবে……