“জি, মা-বাবা আর ছোটো একটা ভাই আর একটা বোন।”
তাসিনের ধীর গলায় জবাব শুনে জনাব আজাদ গম্ভীর মুখে বললেন,“আপনার বাবা-মা এই প্রস্তাবে সম্মত?”
ক্ষণকাল চুপ থেকে ভারী কন্ঠে তাসিন বলল,“না।”
জনাব আজাদ যথেষ্ট ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন,“বাবা-মায়ের অনুমতি ব্যতীত বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলেন?”
“বিয়ে আর সংসারটা যেহেতু আমার হবে, সেখানে আমার পছন্দ জরুরি। বাবা-মায়ের নয়। পুরো জীবন আমি কাটাবো। আমার বাবা-মা নয়।”
কিছুটা হাসলেন জনাব আজাদ। তা বেশিক্ষণ স্থায়ী না হয়ে মিলিয়ে গেল। বললেন,“বিয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই পাত্র-পাত্রীর পছন্দ সবার উর্ধ্বে। তবে সেখানে বাবা-মায়ের সম্মতিও প্রয়োজনীয় একটা বিষয়।”
তাসিন মাথা নিচু করে জবাব দিল,“জি। বাবা-মাকে মানিয়ে নেব আমি।”
“জোরপূর্বক?”
“মানানোর দায়িত্বটা আমার।”
“আমার মেয়েকে বিয়ে করার মতো কী কী যোগ্যতা আপনার মাঝে আছে?”
তাসিন এবার মাথা তুলে তাকালো। বলল,“কী কী যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন? ঘাটতি থাকলে আমি তা পূরণ করে নেব।”
“আমার কন্যার জন্য তার উপযুক্ত পাত্র চাই। যার মাঝে দ্বীনি শিক্ষা থাকবে। স্ত্রীর পর্দার হেফাজত করার মতো দৃঢ় মানসিকতা থাকবে।”
“এটুকু?”
জনাব আজাদ ঠোঁট এলিয়ে মুচকি হাসলেন।
“এটুকু যোগ্যতা আগে অর্জন করে দেখান।”
“তবে কি আপনার মেয়েকে আমার সাথে বিবাহ দেবেন?”
তাসিনের উৎসুক দৃষ্টি।
জনাব আজাদ বললেন,“আমার মেয়েকে দেখেছেন আপনি?”
“না।”
তাসিনের সরল জবাবে খানিকটা অবাক হলেও সেটা চেপে গেলেন তিনি। বললেন,“তবে কীভাবে আপনি বিয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন?”
“আমি বিয়ের জন্য উপযুক্ত। আর আপনার মেয়েকে না দেখেই বিবাহের প্রস্তাব দেওয়ার কারণ আমি জানি না। আপনারাই তো বলেন রূপ, সম্পদ দেখে নয়, দ্বীনদারিত্ব দেখে বিবাহ করা উচিত।”
“আপনি যখন নিজের মাঝে আমার বলা যোগ্যতাগুলো ধারণ করতে পারবেন, তখন আবার আসবেন। শুধু আপনার পছন্দেই বিয়ে হবে না। এখানে আমার মেয়ের সম্মতি আপনার সম্মতির চেয়ে কোন অংশে কম নয়।”
তাসিন চিন্তায় পড়ে গেল। আচ্ছা হুরাইন কি তাকে পছন্দ করবে? চিন্তিত মুখ নিয়ে উঠতে যেতেই জনাব আজাদ আবার বললেন,“পরেরবার আপনার পরিবার নিয়ে আসবেন, একা নয়।”
তাসিন একা একা হাঁটছে। হুরাইনকে বিয়ে করার জন্য তার সবচেয়ে কঠিন ধাপ হলো বাবা-মাকে রাজি করানো। বাকি যে দুটো বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, সে দুটো বিষয় তেমন জটিল নয়। তাসিনের ধারণা নামাজ পড়ায় ইরেগুলার থেকে রেগুলার হওয়াই হচ্ছে দ্বীনদারিত্ব। আর হুরাইনের পর্দার হেফাজতের বিষয়টা সে সহজেই করে ফেলতে পারবে। সামান্যই তো ব্যাপার। অথচ এই সামান্য ব্যাপারে কী গভীরতা, সে আঁচ করতে পারলো না। সে ভাবতেও পারলো না নিজের কথাকে কাজে বাস্তবায়ন করা কতটা কঠিন।
আগামী দিন থেকে তার জীবন হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে শুরু হবে।
অথচ নতুন ভোরের প্রথম নামাজটাই পড়া হলো না ঘুমের কবলে পড়ে।
তাসিন সকালের নাস্তার পর বাবার ঘরে গেল। গম্ভীর স্বরে বলল,“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে বাবা।”
“কেমন কথা?”
“আমি মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি ফাবিহাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না। আমি যাকে পছন্দ করি, তার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠিয়েছি।”
তাসিনের বাবার বিস্ময়ে চোখ দুটো কোটর ছাড়িয়ে বের হয়ে আসার উপক্রম। ছেলে এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছে? তাদের ছাড়াই প্রস্তাব পাঠাচ্ছে নিজের জন্য! তিনি থমথমে গলায় বললেন,“বেশ তো। আমাদের জানাচ্ছ কেন?”
“তোমাদের সম্মতি প্রয়োজন।”
“আমাদের সম্মতির গুরুত্ব আছে তোমার কাছে?”
বাবার কথায় সূক্ষ্ম খোঁচা টের পেল তাসিন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“আমি বুঝতে পারছি ফাবিহার বিষয়টা নিয়ে তোমরা অসন্তুষ্ট আমার উপর। কিন্তু আমার মন যেখানে টানছে না, সেখানে আমি কীভাবে হ্যাঁ করবো? একজন আমার স্ত্রী হওয়া স্বত্তেও আরেকজন আমার মস্তিষ্কে গেঁথে থাকবে বাবা। আমাকে বোঝার চেষ্টা কর।”
“এটাই তোমার শেষ কথা?”
তাসিন কঠিন গলায় বলল,“হ্যাঁ। তোমরা সম্মত না হলে আমি ওই মেয়েকে বিয়ে করবো না। তবে ফাবিহাকে যে বিয়ে করব এটা ভেবেও ভুল কোরো না। দূরে কোথাও চলে যাব আমি।”
তাসিনের বাবা বারবার ছেলের কাজে বিস্মিত হচ্ছেন। তাসিন ঠিক তার মায়ের মতো জেদি। যেটা বলে, সেটা করে তবেই ক্ষান্ত হয়। ছেলে বেরিয়ে যাওয়ার পরই স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পা বাড়ালেন তিনি। সাজেদাকে বললেন,“একবার ঘরে এসো দ্রুত।”
সাজেদা বসেই ছিলেন। স্বামীর সাথে উঠে ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“ছেলের সাথে কী কথা হল?”
তাসিনের বাবা শান্ত গলায় বললেন,“তুমি বরং বড়ো আপাকে না করে দাও। শুধু শুধু মা ছেলে জেদ করে কেন মেয়েটার জীবন নষ্ট করবে? তোমরা মা ছেলে দুজনই জেদি। তাসিনও নিজের জেদ বজায় রাখতে ফাবিহাকে কখনো বিয়ে করবে না। জোর করে করিয়ে দিলেও কেউ শান্তিতে থাকবে না। তাসিন দূরে দূরে থাকবে। মেয়েটাকে এভাবে ঝুলিয়ে রেখে বলি না দিয়ে তুমি না করে দাও। ছেলে যেহেতু অন্যত্র পছন্দ করে ফেলেছে, ওখানে যাওয়া উচিত তোমার।”
সাজেদার শান্ত চোখজোড়ায় হিংস্রতা। বাজখাঁই গলায় বললেন,“তোমার ছেলের আগে বলে দেওয়া উচিত ছিল পছন্দের কথা। আমি সবাইকে কোন মুখে না করবো? বড়ো মুখ করে প্রস্তাবটাও আমিই রেখেছিলাম। ছেলেও তখন সম্মতি দিয়েছে।”
তাসিনের বাবা শান্ত প্রকৃতির মানুষ। স্ত্রী যতটা রাগী, তিনি ততটাই শান্ত থাকতে পছন্দ করেন। সারাদিন কানের কাছে পড়ে এটা-ওটা বললেও চুপ করে থাকেন। তিনি বললেন,“যেটা হয়ে গেছে, সেটা তো আর বদলানো যাবে না।”
“বদলাতে কে বলেছে তোমার ছেলেকে? মাসুল দিক।”
“সে নাহয় অ*প*রা*ধী, তাই মাসুল দেবে। তাহলে নির্দোষ মেয়েটা কীসের মাসুল দেবে? আমি আবারও বলছি সাজেদা, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ।”
সাজেদা খানিকটা নরম হয়ে এলেন ফাবিহার কথা ভেবে। কিন্তু বোনকেই বা কীভাবে না করবেন? তাসিনের বাবা বললেন,“কী ভাবছ?”
সাজেদা স্বামীর চোখে চোখ মিলিয়ে বললেন,“ঠিক আছে। আমি যাব মেয়েটাকে দেখতে। যদি ফাবিহার চেয়ে রূপে-গুণে সামান্য ত্রুটিও খুঁজে পাই, তবে ফাবিহাকেই তোমার ছেলের বিয়ে করতে হবে। নয়তো আমি এই বাড়ি ছাড়ব। এটাই আমার শেষ কথা।”
তাসিনের বাবা হতাশ গলায় বললেন,“মা-ছেলে দুজনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে? যাও। ছোটো ছেলে তো বাড়িতে থাকে না। আমিও মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।”
খ্যাঁক করে উঠলেন সাজেদা।
“আমি যাওয়ার সময় কি আমার মেয়েকে রেখে যাব? তাকে সাথে নিয়েই যাব।”
শান্তি বজায় রাখতে স্ত্রীর সাথে আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন তাসিনের বাবা। ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছেন সাজেদা। ফাবিহার মতো সুন্দরী মেয়ে তাঁর ছেলে আর দুটো পাবে না। বাহ্যিক দিক বাদ দিলেও একজন সুন্দর মনের অধিকারিনী ফাবিহা। ছেলের মাথায় কেন অন্য মেয়ের ভূত চাপলো?
মা হুরাইনকে দেখতে যেতে রাজি হয়েছে শুনে খুশি হলো তাসিন। দেখতে যেতে যেহেতু রাজি হয়েছে, বিয়েতেও রাজি হবেন। জনাব আজাদকে খবর দিয়ে তাসিন তার পরিবার নিয়ে হুরাইনকে দেখতে গেল। পরিবার বলতে বাবা-মা আর নিশি।
সাজেদা থমথমে চোখমুখ নিয়ে বসে আছেন। একজন সুন্দরী নারী এসে উনাকে আর নিশিকে মেহমান খানা থেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। চারদিকে চোখ বুলিয়ে বাড়িটা দেখছেন। ভেতর ঘরেও প্রতিটি নারী নিজেদের মুড়িয়ে রেখেছে। মাথার কাপড় পর্যন্ত সরছে না। সবার অমায়িক ব্যবহারে সাজেদা বেগমের মন খানিকটা গলতে চাইলেও নিজের জেদের কাছে তিনি হার মানবেন না। শক্ত রইলেন। পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখাল হুরাইনের বড়ো বোন জান্নাত। নিশি আর সাজেদা বেগম অবাক হচ্ছেন হুরাইনের মায়ের রূপ দেখে। দেখে বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই এতগুলো সন্তানের মা তিনি। মনে হচ্ছে বয়স তাঁর পঁয়ত্রিশের ঘর পেরিয়েছে মাত্র। এখনো চামড়ার রং উজ্জ্বল। কেমন চকচকে ভাব। মহিলার হাসি দেখলেও চোখ আঁটকে যায়। বাড়ির বউটা আবার চোখ ধাঁধানো সুন্দরী নয়। গায়ের রংটাও বেশ চাপা। তবে ব্যবহার অমায়িক। মানুষগুলোকে ভালোলাগলেও এ জায়গায় নিশির বেশিক্ষণ ভালোলাগলো না। সে স্বাধীন পাখি। এই বন্দি খাঁচা তার পছন্দ হয়নি। সে ভাবে কীভাবে এরা নিজেদের বন্দি করে রাখে? দম বন্ধ হয়ে যায় না? সে বোরকা পরে না৷ আজ বাধ্য হয়েই বোরকা পরে এসেছে। ভাইয়া বোরকা এনে দিয়েছে। সাজেদা বেগমের তর সইছে না। যে নারী এতটা সৌন্দর্যের অধিকারী, বাকি মেয়েগুলোও পরির মতো। সেই নারীর ছোটো মেয়ে না-জানি কতটা রূপবতী হবে?
অবশেষে হুরাইনের দেখা মিলল। নিজের অজান্তে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন সাজেদা। নিশিও তাকিয়ে রইলো। এখানে আসার আগে ভেবেছিল মেয়ে বুঝি দেখতে তেমন ভালো না। এখন দেখছে তার ধারণা ভুল।
হুরাইনের মায়ের রূপই বেশি নজর কেঁড়েছে সাজেদার। এই নারী এখন এমন রূপবতী, তবে যৌবনে কেমন ছিলেন? হুরাইনের দিকে তাকিয়ে ধারণা করে বসলেন তাসিন আগেই মেয়েটিকে দেখেছে। দেখেশুনেই ছেলে পাগল হয়েছে। মেয়ের মাঝে কোন খুঁত খুঁজে পেলেন না। রূপে, চলাফেরায়। যদিও আচরণ সম্পর্কে এখনই কোন রিপোর্ট দিতে পারছেন না। তিনি ফাবিহাকে বউ করে রাখতে উঠেপড়ে লাগলেন যেন। এবার গুণে খুঁত ধরবেন। এতেও ভালোভাবে পাশ করে গেল হুরাইন। ঘরের কাজও সে জানে। লজ্জায় মুখ নিচু করে রেখেছে। সামনে কারো দিকেই তাকাতে পারছে না। সাজেদা কোন খুঁত ধরতে না পেরে আশাহত হলেন।
জনাব আজাদ আর তাসিনের বাবার সম্মতিতে বিবাহের উদ্দেশ্যে তাসিন আর হুরাইন একে অপরকে দেখার অনুমতি দেওয়া হলো।
তাসিন প্রবল আগ্রহে অস্থির হয়ে উঠেছে। তার একটাই ভয়। হুরাইন তাকে পছন্দ করবে তো?
হুরাইনকে দেখে চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল তাসিনের। হৃদয় তোলপাড় করা স্রোতে ভেসে গেল সে। মুখ ছাড়া তার আপাদমস্তক ঢাকা। তবুও যেন চোখ ঝলসে যাচ্ছে তার। শব্দভান্ডার ফুরিয়ে গেল। এই সৌন্দর্যের কোন উপমা খুঁজে পেল না। সাদা চামড়া নয়, এ আসলেই রূপমঞ্জরি। হুরাইন জড়োসড়ো হয়ে বসলো। একপাশে তার বৃদ্ধা দাদি। সূর্যের তাপের মতো প্রখর হয়ে এলো তার লজ্জা। কিছুতেই যেন সে স্থির হতে পারছে না।
তাসিন যেন হুরাইনের দাদীকে লক্ষই করলো না। বিবশ কন্ঠে বলল,“আপনি আমার মনে যে দাগ সৃষ্টি করেছেন, সেই দাগ মুছে দেওয়ার দায়ভার আপনার। এসে শুভ্রতা ছড়িয়ে দিন আমার অন্তরে। আল্লাহর কসম করে বলছি, আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোন নারী এই দাগ দূর করতে পারবে না। আমার হৃদয়ের রানী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি আপনাকে। গ্রহণ করুন আমায়!”
শরীর শিরশির করে উঠলো হুরাইনের। এবার লজ্জা, সংকোচ ভুলে একবার মুখ তুলে চাইতেই থমকালো সে। অপরিচিত হয়েও পরিচিত মুখ। হুরাইনের বিস্মিত ভাব বেশিক্ষণ রইলো না। সে মাথা নিচু করে থুতনি বুকে ঠেকিয়ে ফেললো। তাসিন চোখ না সরিয়ে বেহায়ার মতো তাকিয়ে রইলো। বলল,“আমার ব্যাপারে কিছু জানার আছে? থাকলে প্রশ্ন করতে পারেন। আপনার কাছে স্বচ্ছ থাকতে চাই আমি।”
হুরাইন পাশ থেকে বিছানার চাদর খামচে ধরে মাথা নাড়াল। তার কিছুই জানার নেই। এখানে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। দ্রুত কথা শেষ করে উঠতে চায় সে। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করল,“আমার ব্যাপারে কিছু জানার আছে আপনার?”
তাসিন লহু স্বরে বলল,“পুরো আপনিটাকেই জানার ইচ্ছে আমার। তার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে। শুধু আপনার একটা হ্যাঁ, না এর উপর নির্ভর করছে সবটা। অপেক্ষাতে আমি অভ্যস্ত নই। তবুও আমি অপেক্ষা করব, কেবল আপনার জন্য হুরাইন।”
“আব্বু-আম্মু আর ভাইয়ার পছন্দই আমার পছন্দ।” মিনমিন করে বলেই ছুটে চলে গেল হুরাইন। তার মনে একটা বড়ো প্রশ্ন জাগছে। আব্বু কেন তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন? সে কি মানিয়ে নিতে পারবে? কী চলছে আব্বুর মনে?
ফাবিহা ধীরে পা চালালো। দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে অদ্ভুত অনুভূতি। তাসিনের কথা বলার প্রসঙ্গ কী হতে পারে সেটা ভেবেই অস্থির সে৷ তাসিন সামনে চেয়ারে ইশারা করলো।
“বোস্।”
ফাবিহা বলল,“তুমি বলো। আমি শুনছি।”
“পড়াশোনা কেমন চলছে?”
মাথা দোলালো ফাবিহা।
“ভালো।”
“কোন সমস্যা হয় না তো?”
ফাবিহা চেপে গেল শাবাবের কথা। বলল,“না সব ঠিক আছে।”
এবার মূল কথায় আসতে চাইছে তাসিন। মনে মনে কথাগুলো ঠিক গুছিয়ে নিলেও ফাবিহার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারলো না। সব গোছানো কথা এলোমেলো হয়ে গেল। মেয়েটার চোখমুখে স্বপ্নের উজ্জ্বল বাতি। তাই সিদ্ধান্ত নিলো মাকে দিয়েই বলাবে। ছোটো স্বরে ফাবিহাকে বলল,“যা।”
ফাবিহা মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে এলো। দরজার বাইরে এসেই কয়েকটা বকা দিল তাসিনকে। সে ভেবেছিল সিরিয়াস কিছু কিংবা প্রেমালাপ করতে ডেকেছে। অথচ সে কিনা পড়াশোনার খোঁজ করে চলে যেতে বলছে?
নিশি দুষ্টু হেসে বলল,“কী করলে দুজনে এতক্ষণ?”
ফাবিহার চোখমুখ শক্ত। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“প্রেমালাপ করেছি। এমন প্রেম বাক্য আমার ইহজীবনে শুনিনি। এই নিরামিষের সাথে সংসার কী করে হবে?”
নিশি অবাক হওয়ার ভান করে বলল,“সে কি গো ভাবি। তবে কি আমার আর জীবনে ফুফি হওয়া হবে না? এখন দেখছি স্বপ্নে ভাতিজা-ভাতিজিকে কোলে নিতে হবে। বাস্তবে সম্ভব না।”
তেড়ে এলো ফাবিহা। “এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
হাসতে লাগলো নিশি। বিকেলে ফাবিহা মায়ের সাথে চলে গেল। যদিও তার থাকার ইচ্ছে ছিল প্রকট। কিন্তু মায়ের সামনে মুখ খুলে বলতেও লজ্জা। খালা আর নিশি অনেকবার চেষ্টা করেছেন। মা কিছুতেই রেখে যাবেন না ফাবিহাকে। বিয়ের আগে এই বাড়িতে রাত কাটানো যাবে না বলে তার উপর ১৪৪ ধারা জারি করলেন।
ফাবিহা চলে যেতেই মা তাসিনের ঘরে এলেন। সে ল্যাপটপে আঙ্গুল চালাচ্ছে। ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেলেও মাথা তুললো না। মা কিছুটা রাগ নিয়ে বললেন,“এভাবে ঘরে ঢুকে থাকার মানে কী তাসিন? তোর খালা এসেছেন, তার সাথে কথা বলবি বের হবি। তা না করে ঘরে পড়ে আছিস। আগে তো খালার সাথে জমিয়ে কথা বলতিস৷ এখন এমন অসামাজিক কেন হয়ে যাচ্ছিস?”
তাসিনের মনে হলো এখনই উপযুক্ত সময়। মাকে হুরাইনের কথাটা বলে দেবে। নিজেকে ধাতস্থ করে গম্ভীর স্বরে বলল,“বাবা কোথায়?”
“আমি তোকে কী জিজ্ঞেস করেছি?”
“আমার কথাটা বাবারও শোনা জরুরি।”
“কী এমন বলবি যে তোর বাবাকেও প্রয়োজন? আমি কি যথেষ্ট নই?”
তাসিন ল্যাপটপ বন্ধ করে মাকে পাশে বসিয়ে দিল। বলল,“দুজনই আমার অবিভাবক। আমি একটা ভুল করে ফেলেছি মা। তাই দুজনকেই খুঁজছি।”
মা চোখ কুঁচকে নিলেন। বয়সের সাথে সাথে চামড়ার ভাঁজটাও গাঢ় হলো। দৃষ্টি প্রখর হলো। তীক্ষ্ণ স্বরে শুধালেন,“কী ভুল করেছিস?”
তপ্ত শ্বাস ছাড়লো তাসিন। নত হয়ে বলল,“খালাকে না করে দাও। আমি ফাবিহাকে বিয়ে করতে পারবো না।”
বিস্ফোরিত নেত্রে তাকালেন তাসিনের মা৷ মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,“কী?”
ধীরে ধীরে উত্তেজিত হতে দেখা গেল তাঁকে।
“কেন বিয়ে করতে পারবি না ফাবিহাকে? ওর কমতি কী আছে? লম্বা, ফর্সা, সুন্দরী, পড়ালেখা জানা, সংসারী, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার দক্ষতা। কোনটার অভাব আছে?”
তাসিন মায়ের দিকে তাকালো। চোখে চোখ রাখার সাহস পাচ্ছে না। বলল,“যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা নয়। আমি এমন একজনকে জীবনে চাই যার নিজেকে হেফাজতে রাখার ক্ষমতা আছে। যে সূক্ষ্ম নজর থেকেও নিজেকে হেফাজতে রাখতে জানে।”
মা শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“কে সেই জাদুকরী? যে আমার ছেলের মাথা আগেই খেয়ে নিয়েছে?”
“মা কেউ আমায় জাদু করেনি। সে নিজেও জানে না আমি তাকে পছন্দ করি।”
“এখন মায়ের কাছে ওই মেয়ের সাফাই গাইতে শুরু করেছিস? সত্যি করে বল তো, এসব ওই মেয়ে শেখাচ্ছে না তো তোকে? তুই তো এমন ছেলে নয়।”
এবার তাসিন কিছুটা রাগী স্বরে বলল,“কতবার বললাম হুরাইন কিছুই জানে না। মা না জেনে কারো ব্যাপারে মন্তব্য করা উচিত নয়।”
“ আচ্ছা হুরাইন?”
কিছুটা টে*নে বললে মা। অতঃপর বললেন।
“করলাম না ওই মেয়েকে নিয়ে মন্তব্য। তুই যখন ওই জাদুকরীতেই আটকে আছিস, তখন আমার মেয়েটাকে কেন এভাবে অপমান করলি? ফাবিহাকে বিয়েতে হ্যাঁ কেন বললি?”
“মা আমি তখন দ্বিধায় ছিলাম। সেজন্য আমি অনুতপ্ত। এখনো বিরাট কিছু হয়ে যায়নি। বিয়ের দিনও বিয়ে ভেঙে যায়।”
“তুই শুনে রাখ। ফাবিহাকে বিয়ে না করে ওই মেয়ে ঘরে তোলার স্বপ্ন এখানেই মাটি দিবি। নয়তো যা করার বাড়ির বাইরে গিয়ে করবি। আমি তোকে আর চিনি না।”
ধুপধাপ পা ফেলে চলে যাচ্ছেন মা। ফ্লোরে সজোরে শব্দ হচ্ছে। যা কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে। একটা ফুলদানি নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারলো গাসিন। তবুও রাগ কমছে না। ফোঁসফোঁস করে বেড়েই যাচ্ছে। সে তো মানুষ। মানুষের দ্বারা কি ভুল হয় না?
তাসিনের মা ঘরে আটকে রাখলেন নিজেকে। মেজাজ খুব খা*রা*প হয়ে আছে। বোনকে কথা দিয়ে ফেলেছেন তিনি। এখন চোখ মেলাবেন কী করে? তাসিন যদি আগেই বলে দিত তার পছন্দ আছে তবে বোনকে কথা দিতেন না। ওই মেয়েকে বউ করতেও সমস্যা ছিল না। এখন বোন হয়তো স্বামীর চাপে পড়ে সম্পর্কটাও নষ্ট করে দিতে পারে। শুধু বোন নয়, বাবা-মা, ভাই বাকি বোনেরা সবার চোখে নিচু হবেন তিনি। সবচেয়ে বড়ো কথা একটা মানুষকে সুখের সপ্ন দেখিয়ে তার স্বপ্নগুলো কীভাবে চুরমার করে দেবেন তিনি? ফাবিহা যে তাসিনকে পছন্দ করে সেটা মেয়েটার চোখেমুখে স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনিও নিরুপায়। সবদিক বিবেচনা করলে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। যেকোন একদিক ছাড়তে হবে। ছেলের ভুলটাকে ধরে রাখলেন তিনি। মনে মনে জেদ চেপে গেল, এই বাড়ির বউ ফাবিহাই হবে।
বাড়িতে থাকা সকলেই তাসিনের ব্যাপারটি নিয়ে অবগত হয়ে গেল। না চাইতেও তাসিন আর তাঁদের তিনজনেের মাঝখানে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেল। তাসিনও মায়ের মতোই জেদি। সেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলো। মা-ছেলে কেউই স্যাক্রিফাইস করতে রাজি নয়।
সকলকে অগ্রাহ্য করে আবারো হুরাইনের পেছনে ছুটলো তাসিন। মাদ্রাসা থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য সিএনজি খোঁজ করছে তিন বান্ধবী। তিন সিট ফাঁকা কোন সিএনজি পাচ্ছে না। তাসিন দূরে দাঁড়িয়ে সবটা লক্ষ করেছে। একটা সিএনজিতে পেছনের সিটে একজন মেয়ে। তাসিন এগিয়ে গিয়ে সিএনজি থামিয়ে দিল। মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,“আপু আপনাকে আরেকটা সিএনজি ঠিক করে দিচ্ছি। আমার পেছনের তিনটা সিট লাগবে। অনেকক্ষণ ধরেই খোঁজ করছি। পাচ্ছি না।”
মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলল,“আমি কী করবো? আপনি অন্য সিএনজি দেখুন।”
“প্লিজ আপু!”
কী যেন ভেবে মেয়েটি নেমে পড়লো। আরেকটা সিএনজি নিয়ে চলে গেল। তাসিন তিনজন বোরকা পরা রমনীর দিকে আঙ্গুল তাক করে ড্রাইভারকে বলল,“উনাদের তিনজনকে পৌঁছে দেবেন।”
গরমে বোরকার ভেতরটা ভিজে একাকার। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। নিকাবের আড়ালে গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। একজন তাদের দিকে আঙ্গুলের ইশারায় কিছু দেখিয়ে দিচ্ছে। হুরাইনের চোখ আটকে গেল। তার যষ্ঠ ইন্দ্রীয় জানান দিচ্ছে পুরুষটিকে সে দেখেছে। সেদিন কুকুর তাড়িয়ে তাকে বাড়ি যেতে সাহায্য করেছে। এক পলকের দেখায় ঝট করে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো হুরাইন। সেই সিএনজিটা তাদের সামনে এসেই দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলেন ড্রাইভার, “কই যাইবেন?”
“বটতলা।”
“উঠেন।”
তিনজনে উঠে গেল। হুরাইনের মনের ভেতর অন্য চিন্তাভাবনা ঢুকে গেল। তার মাথায় ঘুরছে সেই পুরুষটির কথা। নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে নিজেই ভীষণ অবাক। পর পুরুষকে নিয়ে সে কেন ভাবছে?
দুদিন পরের কথা। মাদ্রাসা থেকে ফিরে চমকে গেল হুরাইন। তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। এই খবরটা তাকে জানালো ভাবি। সাথে এটাও জানালো পাত্র পূর্বে এই বাড়িতে এসেছে। হুরাইন ভেবে পেল না কে হতে পারে? ফুফু একবার ছেলের জন্য হুরাইনের হাত চাইলেন৷ বড়ো চাচাও নিজের ছেলের জন্য হুরাইনকে চাইলেন। ভাইকে দিলে বোন অসন্তুষ্ট আর বোনকে দিলে ভাই অসন্তুষ্ট হবে। সেজন্য জনাব আজাদ দুজনকেই এক জায়গায় নিয়ে বসলেন। সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন ব্যাপারটা। বললেন,“আমি চাই না আমাদের সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হোক। তোমরা দুজনই হুরাইনকে নিজের মেয়ের মতো ভালবাসো। কারো মনে কষ্ট দিতে চাই না আমি। ঘরে ঘরে আত্মীয় না পাতানোই ভালো।”
এ নিয়ে অবশ্য চাচা আর ফুফু কিছুদিন মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন। এখন সবটা আগের মতোই স্বাভাবিক। তাহলে এবার কে এসেছে? ভাবি বারবার এসে জ্বালিয়ে মারছে হুরাইনকে। লজ্জায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো সে। তাই ঘরের দোর দিয়ে বসে আছে।
মেহমান খানায় জনাব আজাদের সামনে বসে আছে তাসিন। না, তার পাশে পরিবারের কেউ নেই। একাই এসেছে সে। জনাব আজাদকে গম্ভীর দেখাচ্ছে। প্রস্তাবটা সেই পাঠিয়েছিল। জনাব আজাদ প্রস্তাব পেয়ে সরাসরি তাসিনকেই ডাকলেন।
★★
ভার্সিটি থেকে বেরুতেই ফাবিহার পথ রোধ করে দাঁড়ালো শাবাব। আগাগোড়া একবার পরোখ করে হাসলো। ফাবিহা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো। এই তাকানো স্বাভাবিক নয়। চোখমুখ শক্ত করে বলল,“পথ ছাড়ুন।”
“তোমাকে এগিয়ে দিতে এসেছি সুন্দরী।” বলেই ঠোঁট কামড়ে হাসলো শাবাব। ঘৃ*ণা*য় অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো ফাবিহা। পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই আজ আবার ফাবিহার হাত চেপে ধরলো। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে ফাবিহা। পেরে না উঠে সেও গতদিনের মতো শাবাবের গালে আরেকটা চ*ড় বসালো। আজ শাবাবকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। চেহারায় রাগ নেই। বোঝা যাচ্ছে শান্ত মাথায় খেলতে এসেছে। ঝট করে ফাবিহার হাতের পিঠে পরপর দুটো চু*মু বসিয়ে দিল। অতঃপর ক্রুর হেসে বলল,
“দুটো চ*ড়ে*র বিনিময়ে দুটো চুমু। যদি আবারও আমার ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে চাও, তবে তোমার জন্য আমার দুয়ার উন্মুক্ত।”
ফাবিহা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। রাগে, লজ্জায় চোখে পানি এসে পড়েছে। কেবল গড়িয়ে পড়া বাকি। দ্রুত চোখ মুছে ছুটে চলে গেল৷ শাবাব চুমু দেওয়ার পরই হাত ছেড়ে দিয়েছে। ফাবিহা আর জবাব দিল না। সে জানে এখন জবাব দেওয়া মানে নিজের সম্মানে হাত দেওয়া। তবে এই চুপ থাকাটা চুপ থাকা নয়। এর দাম শাবাবকে দিতেই হবে। বিড়বিড় করে বলল,“ তোমাকে আমি দেখে নেব প্লেবয় শাবাব।”
শাবাব পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,“হেই, কিছুদিনের জন্য আমার হয়ে যাও লিটল গার্ল।”
চারিদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। জায়নামাজ গুছিয়ে উঠানে হাঁটতে বের হলো হুরাইন। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে রান্নাঘরে ঢুকলো। সবার জন্য চা করে বের হতেই ভাবির সাথে দেখা হলো। মিষ্টি হেসে ভাবির দিকে এক কাপ চা বাড়িয়ে ধরলো।
ভাবি খুশি হয়ে হাস্যজ্জ্বল চেহারায় হাত বাড়িয়ে চা নিলো। দুষ্টুমি করে বলল,“এমন ননদিনীর বিয়ে হয়ে গেলে আমার খুব আফসোস হবে। প্রতিদিন আরাম করে চা খাওয়াটা মিস হয়ে যাবে যে!”
“ওই তো আর মাত্র একটা বছর। তারপর তো।”
ঠোঁট টিপে হাসছে ভাবি।
“এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে ভাবি।”
লজ্জা পেয়ে রাগ দেখালো হুরাইন।
ভাবি আরেকটু রাগানোর জন্য বলল,“তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলবো?”
“ভাবি।”
দ্রুত পা চালিয়ে চায়ের ট্রে হাতে চলে গেল হুরাইন। বাড়ির সকলের হাতে এক কাপ করে চা দিয়ে শেষে বাবা-মায়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় নক করতেই বাবা বললেন,“আসুন মা।”
জনাব আজাদ জানেন বাইরে হুরাইন দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন সকালে এই সময়টাতে চা নিয়ে এসে দাঁড়ায়। ভেতরে ঢুকে বাবা-মা দুজনকে চা দিয়ে নিজের জন্য এক কাপ নিয়ে বসলো। বাবা জিজ্ঞেস করলেন,“পড়াশোনা কেমন চলে? মাদ্রাসায় কোন সমস্যা হয়?”
“না আব্বু, সব ঠিকঠাক। পড়াশোনাও ভালো চলছে আলহামদুলিল্লাহ।”
চা শেষ করতে করতে বাবা-মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলে বেরিয়ে এলো হুরাইন।
মাদ্রাসার জন্য তৈরি হয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। বান্ধবীদের জন্য অপেক্ষা করছে। তিনজনই চললো সামনের মোড়ে৷ সেখানে সবসময় সিএনজি পাওয়া যায়। একটা সিএনজি ঠিক করে বাজারের উপর এসে নামলো তারা। এখান থেকে মাদ্রাসা একটু ভেতরে। ওটুকু পথ হেঁটেই যেতে হয়। হুরাইন চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে।
চা দোকানের ভেতর থেকে একজোড়া দৃষ্টি তার উপর পড়ে আছে। আধাঘন্টা পূর্বে এখানে এসে বসেছে তাসিন। একটা কালো বোরকা পরা ছাত্রীকে যেতে দেখলেই বুক ধ্বক করে উঠতো। এই বুঝি হুরাইন চলে যাচ্ছে। কিন্তু না,কাছাকাছি এগিয়ে এলে ভুল প্রমাণিত হয়। এবার আর ভুল হলো না। হুরাইন সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একবারও আশেপাশে তাকাচ্ছে না। তাসিন নিমেষহীন তাকিয়ে রইলো। একটিবার তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতো মেয়েটা। দৃষ্টি সীমানা পেরিয়ে যেতেই বেরিয়ে পড়লো তাসিন। আজ তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য বের হতে দেখে মা নানা রকম প্রশ্ন করছিলেন। এখন থেকে এই সময়েই বের হতে হবে বলে এসেছে তাসিন। এখান থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে গাড়ি ধরলো।
আজও একটা লাভ লেটার পেয়েছে ফাবিহা। কাগজের ভাঁজ খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে লাভ লেটারটি পড়লো সে। বাংলা ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী কিনা। বেশ কয়েকটি বানান মার্ক করে সামনের ছেলেটিকে বলল,“তোমার ভাইকে বলে দিও বাংলা বানানটা শিখে নিতে।”
ছেলেটি মাথা নিচু করে রইলো। ফাবিহা প্রস্থান করতেই বিড়বিড় করে বলল,“ভাই কীভাবে এই নাক উঁচু মেয়েটিকে পছন্দ করেছে?”
শাবাবের সাথে দেখা হয়ে গেল ফাবিহার। শাবাব বলল,“চিঠির জবাব?”
ফাবিহা সংকোচহীন গলায় বলল,“আপনার চামচার কাছে জবাব দিয়ে এসেছি।”
দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে এলো শাবাবের। ধমকে উঠলো ফাবিহাকে।
“শাটআপ। ও আমার চামচা নয়। ছোটো ভাইয়ের মতো।”
ফাবিহা বিদ্রুপ করে হাসলো। দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করলো না। ঝট করে হাত চেপে ধরলো শাবাব। চোখ জ্বলে উঠলো ফাবিহার। মাথা গরম হয়ে গেল তার। শাবাবের গালে চড় বসিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করলো,“অ*স*ভ্য। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বে*হা*য়া*প*না করা হচ্ছে। ”
শাবাবের চোখে জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। অপ*মানে র*ক্ত টগবগ করে উঠলো। গালে হাত বুলিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে শাসিয়ে উঠলো ফাবিহাকে।
“আমি তোমাকে দেখে নেব। নিজের পায়ে কুড়াল মে*রে*ছো।”
ফাবিহা কোন কিছুর পরোয়া না করে বেরিয়ে গেল গেট দিয়ে। বলতে হয় মেয়েটার সাহস আছে৷ কেবল তাসিনকে দেখলেই তাকে লজ্জারা ঘিরে ধরে। প্রচন্ড নির্লজ্জ মেয়েরাও যাকে ভালোবাসে, তার চোখে দৃষ্টি মেলাতে গিয়ে লজ্জা পায়। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। এটাই হয়তো ভালোবাসার ক্ষমতা।
তাসিনের পরিবারে একেবারে খোলা মনের। আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে অভ্যস্ত। ছেলে তার হবু বউ নিয়ে ঘুরতে যাবে, এগুলো স্বাভাবিক বলেই গণ্য হয়। তাসিন খাওয়া শেষ করলো চুপচাপ। শেষে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে মায়ের দিকে না তাকিয়েই বলল,“আপাতত বিয়ের ব্যাপারটা বন্ধ রাখ মা। এখনই বিয়ের ব্যাপারে ভাবছি না আমি।”
মা বললেন,“আশ্চর্য! এখন বিয়ে করবি না কখন করবি? বুড়ো হলে? চাকরি করছিস। একটা হ্যান্ডসাম স্যালারি পাচ্ছিস। তাহলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”
“আমার কিছু ব্যক্তিগত মতামত নিশ্চিয়ই থাকতে পারে।”
মা শান্ত হলেন। বললেন,“সেটা কেন থাকবে না। আচ্ছা এখন বিয়ে না করলি। সেটা তোরা দুজনে কথা বলে নিস নিজেদের মধ্যে। যখন ইচ্ছে হবে তখন দু’জন আমাদের জানিয়ে দিবি।”
তাসিন কথা বাড়ালো না। কারণ তার মন এখনো দ্বিধাদ্বন্দে আছে। নিজের কাছে নিজেকে ক্লিয়ার করাটা জরুরি।
★★
আজ দুই বান্ধবীর একজনও মাদ্রাসায় যাবে না। একাই যেতে হচ্ছে হুরাইনকে। না গেলেও শাস্তি পেতে হবে। একা যেতে কেমন অস্বস্তি লাগে। সাথে বান্ধবীরা থাকলে যেমন একটা বল পাওয়া যায়, একা হলে সেটা পাওয়া যায় না। একা গিয়ে একা একাই ফিরছে সে। সিএনজি থেকে নেমে কিছুটা ভেতরের দিকে তাদের বাড়ি। হাঁটতে গিয়ে সামনে দুটো কুকুর দেখলো। তার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে৷ ভয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভেতরে আল্লাহর নাম জপছে হুরাইন। সামনে পা চলছে না। চোখ বুঁজে এক পা বাড়াতে গিয়ে টের পেল কুকুর দুটো তার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের আওয়াজ বেড়ে গিয়েছে। এক পা দু-পা করে রাস্তার পাশে গিয়ে একটি পুকুরের কিনারায় চলে গেল। কুকুর দুটো ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে। বুকের ভেতর ত্রাস চলছে। আল্লাহ আল্লাহ করে প্রস্তুতি নিচ্ছে হুরাইন। কুকুরের কামড় নিশ্চিত মনে করে চোখ বন্ধ করতেই মানুষের স্বর শুনতে পেল। সাহস পেয়ে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো একজন যুবক কুকুর দুটোকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। ঝট করে মাথা নিচু করে নিলো হুরাইন। পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে। তাসিন কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। হুরাইনের এই তাকানোটা তার ভেতরে ঝড় তুলে দিলো। অথচ সে নিকাবের উপরের পাতলা আবারণের জন্য ঠিকঠাক মেয়েটির চোখের সৌন্দর্যও দেখতে পেল না। তবুও তার চোখে প্রশান্তি ঢেউ খেলছে।
মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো তাসিন। যাই হয়ে যাক না কেন, সে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। বাসায় জানিয়ে দেবে হুরাইনের কথা। শুধু শুধু ফাবিহাকে আশা দেখিয়ে লাভ নেই। মেয়েটার দোষ নেই। দোষটা তার। হুরাইনকে নিজের কৌতুহল ভেবে সে মাকে বিয়েতে হ্যাঁ বলেছে। ভেবেছিল বিয়েটা হয়ে গেল হয়তো তার কৌতুহল মিটে যাবে। এখন কৌতুহল মিটে নি। বরং বেড়ে গেল। তাসিন গভীর স্বরে বলল,“মৃ*ত্যু*র আগ পর্যন্ত তোমাকে জানতে চাওয়ার তৃষ্ণা বেড়ে গেল হুরাইন। কিন্তু তার জন্য যে তোমাকে নিজের জন্য হালাল করা জরুরি।”
ফাবিহা সেজেগুজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো। মনে প্রজাপতি ডানা মেলেছে। আজ দেখতে পাবে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে। বিয়ের কথা ওঠার পর থেকে তাসিন কেমন পর পর আচরণ করছে। নাকি অস্বস্তিতে কথা বলতে চাইছে না! সে না-হয় তাসিনকে পছন্দ করতো বলে বিয়ের কথা ওঠায় মনে মনে আরো লাড্ডু ফুটেছে। নিজের মনে সবটা ভাবছে ফাবিহা। মায়ের সাথে বের হলো সে। খালার বাড়ি এসে বাধ্য মেয়ের মতো খালার হাতে হাতে কাজ গুছিয়ে দিচ্ছে। তাসিনের মা যতই না করছেন, ফাবিহা শুনছে না। মনে মনে বেশ সন্তুষ্ট তিনি। ছেলে বউ হিসেবে ফাবিহা সোনার হরিণ। সংসারী মেয়ে। তাসিনের বোন নিশি সোফার উপর পা তুলে বসে মিটিমিটি হাসছে। ফাবিহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নিশি হাসতে হাসতে বলল,“তোমাকে বউ বউ লাগছে। ভাবি ডাকতে ইচ্ছে করছে।”
ফাবিহা আশেপাশে তাকালো। তাসিনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ঠোঁট টিপে হেসে ফিসফিস করে বলল,“তোর ভাবি ডাক শোনার জন্য আমি মুখিয়ে আছি। যত ইচ্ছে ডাক। তবে অন্যদের সামনে ডাকবি না। আমি কিন্তু লজ্জা পাব।”
নিশি হাসি আটকানোর চেষ্টা করে বলল,“তুমি আবার লজ্জাও পাও।”
“একদম ভাবির সাথে মশকরা করবি না। তোর ভাইকে বলে একদম হাত খরচা বন্ধ করে দেব।”
“বউ না হতেই কেমন বাঙালি ভাবিদের মতো আমার পেছনে লেগে যাচ্ছো। বলি আমিও কিন্তু ভালো ননদিনী নই। একেবারে যখন কা*ল*না*গি*নী*র মতো ছোবল দেব, তখন হাড়ে হাড়ে টের পাবে।”
“আমি অবশ্যই বাঙালি বউ, তাহলে বাঙালি ভাবি হবো না তো কী হবো?”
দুজনের হাসি-তামাশার মাঝে তাসিন এসে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিতেই লজ্জায় মিইয়ে গেল ফাবিহা।
“আমার ঘরে আয় ফাবিহা।”
বলেই গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল তাসিন। ফাবিহা কী করবে বুঝতে পারছে না। তার হাত-পা কেমন কাঁপছে। আগে আর এখনকার সম্পর্ক এক নয়। পুরোনো সম্পর্ক হলে তাসিন বলার পরপরই ফাবিহা তার ঘরে গিয়ে উঠতো। এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছে। নিশি রগড় করে বলল,“যাও যাও। ভাই তোমাকে প্রেম করার জন্য ডাকছে।”
জনাব আজাদের এ*ক্সি*ডে*ন্ট এর সপ্তাহ পেরিয়েছে। তাসিনের মতামতের উপর ভিত্তি করে মা জিজ্ঞেস করলেন,“ফাবিহাকে তোর কেমন লাগে?”
“কেমন লাগবে আবার? ফাবিহাকে ফাবিহার মতোই লাগে। ওকে তো আর ফারজানার মতো লাগবে না।”
মা কিছুটা বিরক্ত হলেন। মুখ কুঁচকে ‘চ’ শব্দ করে বললেন,“আমি তোকে সেটা বলিনি। জানতে চাইছি ফাবিহা আমাদের ঘরের বউ হলে কেমন মানাবে?”
“বউ?” বলে হাত থেমে গেল তাসিনের। কাজ বাদ দিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকালো মায়ের মুখপানে। মা মৃদু হেসে বললেন,“ফাবিহাকে আমার বেশ পছন্দ। তোর খালার সাথেও আমি কথা বলেছি। এখন তুই বললেই তোর খালা তোর খালুর সাথেও আলাপ করবে।”
বউ বলে হাত থেমে গেলেও হৃদয় থামেনি। বরং এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তাসিন এক অজানা ঘোরে হারিয়ে গেল। সে সেরোয়ানি, মাথায় পাগড়ি পরে বসে আছে। তার পাশেই লাল টুকটুকে শাড়িতে একহাত ঘোমটা টেনে বসে আছে তার নববধূ। তাসিনের বড্ডো তাড়া। কবুল বলার পর থেকেই সে মুখিয়ে আছে তার হৃদয়ের রাণীকে এক পলক দেখার জন্য। বদ্ধ ঘরে স্ত্রীর ঘোমটা সরিয়ে দিল তাসিন। চোখের সামনে বোরকায় আবৃত সেই মানবী এসে ধরা দিল। মুখ দেখতে পেল না সে। দেখবে কীভাবে? সে তো বাস্তবে কখনো সেই কন্ঠস্বরের অধিকারিনীর মুখ দেখেনি। যতটুকু দেখেছে, কল্পনায়ও ততটুকুই ধরা দিচ্ছে। মায়ের ছোঁয়ায় ধ্যান ভঙ্গ হলো। এতক্ষণ মায়ের কোন কথাই শুনতে পায়নি তাসিন। মা বললেন,“কীরে কিছু বল।”
তাসিন লম্বা শ্বাস ফেললো। সে এসব কেন ভাবছে? বিয়ে পর্যন্ত চলে গিয়েছে। অথচ বউ হিসেবে তার ফাবিহাকে কল্পনা করার কথা ছিল। সে খুব ভালোভাবেই জানে জনাব আজাদ কখনোই এমন পরিবারে এমন ছেলের কাছে মেয়ে দেবেন না। তাঁরা তাঁদের মতোই কোন এক পরিবারে মেয়েকে দেবেন। তাসিন মাকে বলে দিল,“তোমাদের যা ভালোলাগে কর। ”
মা তাসিনের কাছ থেকে এক প্রকার অনুমতি পেতেই খুশিমনে ছুটে গেলেন৷ দ্রুত আলোচনা চললো বিয়ের। যেহেতু মেয়ে, ছেলে সব নিজেদের মধ্যেই, সেহেতু দেখাদেখির পর্ব বাদ পড়লো। তবে রীতি অনুযায়ী বিয়ের কথাবার্তা মেয়ের বাড়িতে হবে।
নিশি ছুটে এলো ভাইয়ের ঘরে। কপালে হাত রেখে চোখ বুঁজে শুয়ে আছে তাসিন। নিশি এক বুক উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,“ভাইয়া, ভাইয়া কাল আমরা ফাবিহা আপুকে দেখতে যাবো। ওখানেই পাকা কথা হবে।”
তাসিনের কপালে ভাঁজ পড়লো৷
“ওকে আবার দেখতে যাওয়ার কী আছে?”
“এটা বললে তো হবে না। তোমাকেও কাল যেতে হবে। মাকে তো তাই বলতে শুনলাম।”
তাসিনের মন টানছে না কিছুতেই। তবুও কিছু একটা থেকে পালিয়ে বাঁচতেই সে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো বিয়ে হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তাসিন নিজের মনকে বোঝাতে চাইছে এটা কেবল তার কৌতুহল। আর কিছু নয়। মেয়েটিকে বাকি মেয়েদের মতো বোরকা ছাড়া দেখলে এমনটা হতো না। বরং স্বাভাবিক মনে হতো। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি শুধু তার নয়, প্রতিটি মানুষেরই আগ্রহ থাকে। ছোটো বেলায় মা যেসব করতে নিষেধ করতো, তাসিন আগ্রহ নিয়ে সেসবই করতো। এখনো তার সাথে সেটাই ঘটছে।
ফাবিহার বাড়িতে সকলে উপস্থিত। তাসিনের মা ফাবিহাকে পাশে বসিয়ে রেখে থুতনিতে হাত রেখে নয়ন ভরে দেখছেন। ফাবিহাকে এক দেখায় যেকেউ নির্দ্বিধায় আগুন সুন্দরী বলে ফেলবে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। মেয়েটিও ভীষণ ভালো। চেহারা থেকে লজ্জা সরছেই না। তাসিনকে তার ভালোলাগতো। বিয়ের কথা আলোচনার পর থেকেই সেই ভালোলাগা ভালোবাসার বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। সকলে চলে এলেও তাসিন এখনো এলো না। দুপুরে খাওয়ার সময় হয়ে এলো। মা কল দিলেন৷
“কোথায় তুই তাসিন? এখনো আসছিস না কেন?”
“আমি গিয়ে কী করবো মা? কাজে আছি।”
“এতকিছু বুঝি না৷ অসামাজিকের মতো কাজকর্ম করবি না। তাড়াতাড়ি আয়।”
মা ঝাড়ি দিয়ে কল কেটে দিলেন৷ হতাশ হয়ে তাসিনকে ফাবিহাদের বাড়ির পথ ধরতে হলো। তাসিনকে পেয়ে সকলেই খুশি হলো। নানার বাড়ির লোকজনও উপস্থিত আছে। ফাবিহা আর তাসিনকে কেন্দ্র করে সকলেই হাসি মজা করছে। তাসিন খেয়াল করলো ফাবিহা কেমন লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে। অথচ তার বিশেষ কোন অনুভূতি হচ্ছে না। যতবার ফাবিহাকে স্ত্রী রূপে কল্পনা করতে যায়, ততবারই ওই বোরকায় আবৃত কুচকুচে কালো অবয়বটা মানসপটে ভেসে ওঠে। নিজের উপরই রাগ উঠে যায় তার।
বিকেলের পূর্বেই বেরুতে নিচ্ছিল তাসিন। সামনে পড়লো ফাবিহা। তাসিনকে দেখে মুচকি হেসে সামনে পা বাড়িয়ে চলে যেতে নিতেই তাসিন ডেকে উঠলো।
“ফাবিহা।”
ফাবিহা দাঁড়িয়ে পড়লো। তার বুকে দ্রিমদ্রিম হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। এই বুঝি তাসিন তাকে বলবে ‘ছাদে যাবে?’
তাসিন এমন কিছুই বলল না। সে বলল,“তোর কাউকে পছন্দ আছে?”
তুই? তুই শুনেই মনটা বিষিয়ে উঠলো ফাবিহার। দুদিন পর যে বউ হবে, তাকে কেউ তুই ডাকে? আগে যতই কাজিন হিসেবে তুই ডাকুক, এখন তো তুমি বলতে পারে। সে মাথা নেড়ে বলল,“আমার কাউকে পছন্দ নেই।”
তারপরই ছুটে পালিয়ে গেল। তাসিন টের পেল মেয়েটা লজ্জা পেয়ে পালিয়েছে। অথচ সে লজ্জা পাওয়ার মতো কিছুই বলেনি।
★★
মাদ্রাসায় থেকে বাড়ি ফিরছে হুরাইন। ঝাঁকে ঝাঁকে কালো বোরকায় আবৃত ছোটো থেকে বড়ো মেয়েরা বের হচ্ছে গেট দিয়ে। সিএনজিতে বসা ছিল তাসিন। তিনজন মেয়ে এসে দাঁড়ালো পাশে। একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করলো,“বটতলা যাবেন?”
ড্রাইভার বললেন,“উইঠা বসেন।”
তাসিনকে কিছু বলতে হয়নি। সে পেছনের সিট ছেড়ে সামনে ড্রাইভারের সাথে গিয়ে বসে পড়েছে। সিএনজির ভেতরটা নিরব। হঠাৎ নিরবতা ভঙ্গ করে একটি কন্ঠ শোনা গেল,“তোর আব্বুর এখন কী অবস্থা হুরাইন?”
নিস্তব্ধতার মাঝে সেই স্বর স্পষ্ট হয়ে কর্ণকুহরে ঠেকলো।
“ভালো। ব্যান্ডেজ খুলবে আরো দশ-বারোদিন পর।”
তাসিনের ভেতর অস্থিরতা শুরু হলো। সে যদি ভুল না করে থাকে, তবে এটাই সেই কন্ঠস্বর। যা তাকে এমন উন্মাদ করে দিতে বাধ্য করেছে। কাজ-কর্ম, খাওয়াদাওয়া কোনটাই আজকাল ঠিকঠাক হয় না। তাসিন চোখ বুঁজে লম্বা শ্বাস টা*ন*লো। আবারো নিরবতা নামলো। হুট করেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেললো সে। বটতলার পরের স্ট্যান্ডে তার নামার কথা। সে ঠিক বটতলায় গিয়ে নেমে গেল। মেয়ে তিনটি ভাড়া মিটিয়ে রাস্তার পাশ ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তাসিন পুরোপুরি নিশ্চিত হতে সাবধানে পিছু নিলো মেয়েগুলোর। জনাব আজাদের বাড়ির সামনে এসেই একজন থেমে গেল। মাথা আর হাত নাড়িয়ে বাকি দুজনকে কী যেন বলে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। তাসিন নিশ্চিত হলো। এটাই সেই, এটাই সেই রমনী। সেদিন একপলক পেছন থেকে দেখলেও আজ পুরোপুরিভাবে মনে গেঁথে নিয়েছে। দেখলেই চিনে ফেলবে। চোখদুটো পর্যন্ত নিকাবের উপরে পাতলা আরেকটি আবরণ দ্বারা ঢেকে রাখা। নিজেকে এভাবে রক্ষা করছে কার জন্য? কেবল একটি পুরুষের জন্য? তবে সে পুরুষ কতটা ভাগ্যবান?
তাসিন লক্ষ করল সে মেয়েটিকে অনুসরণ করে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে৷ নিজেই নিজের কাণ্ডে স্তব্ধ হয়ে গেল।
ফিরে এলো সে। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসলো। তার শরীর এখানে হলেও মন পড়ে রয়েছে সেই মেয়েটির কাছে। পাশেরজন কী নাম বলে সম্বোধন করেছিল? মস্তিষ্কে দুবার চাপ দিয়ে মনে মনে আওড়ালো “হুরাইন।”
তাসিনকে উদাস হয়ে কিছু ভাবতে দেখে নিরব ওর পিঠে চাপড় মে*রে বলল,“কই হারাই গেলি? কয়েকদিন থেকেই দেখছি তুই কেমন আনমনা হয়ে কিছু নিয়ে ভাবিস। ঘরে কোন ঝামেলা?”
তাসিন কোনরূপ দ্বিধা না করেই বলে ফেললো,“আমি একটি মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছি।”
নিরব কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে থেকে খুশিতে আটখানা হয়ে গেল।
“আরে শা*লা। এটা তো খুশির খবর। তা ভাবিটা কে?”
“আমি কখনো দেখিনি তাকে?”
তাসিনের কথা শুনে নিরব রেগে গিয়ে বলল,“শা*লা ফাজলামো হচ্ছে?”
“আমি সিরিয়াস।”
তাসিনের চোখমুখ বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা বলছে না। নিরব নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,“দেখিসনি, তাহলে পছন্দ করেছিস কীভাবে?”
তাসিন ঘটনা খুলে বলতেই মাথায় হাত পড়লো নিরবের। বলে উঠলো,“এটা অসম্ভব ব্যাপার। আমাদের আর ওই মেয়ের লাইফস্টাইলে প্রচুর পার্থক্য। এসব পছন্দ-টছন্দ বাদ দে।”
তারপরই কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,“তোর না ফাবিহার সাথে বিয়ে ঠিক? তাছাড়া তোর কথা শুনে মনে হলো ফাবিহা তোকে অনেক পছন্দ করে। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফাবিহাকে বিয়ে করে নে। দেখবি ওই মেয়ের ভূত মাথা থেকে নেমে যাবে।”
তাসিন করুন স্বরে বলল,“আমার ভাবনায় শুধু ওই মেয়েটিই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ অনুভূতি আরো তীব্র হলো। বারবার কানে সেই কন্ঠ ভেসে আসছে। আজ আর আমার ঘুম হবে না।”
নিরব অবাক চোখে তাকালো৷ তাসিনকে কখনো এমন আচরণ করতে দেখেনি সে। কেমন দিশেহারা লাগছে।
নিরব নরম সুরে বলল,“শান্ত হয়ে বোস।
আমার কথা শোন্। তুই মেয়েটিকে দেখিসনি। এমনও হতে পারে, দেখলে হয়তো তোর মন পাল্টে যাবে। তাছাড়া তুই শুধু পছন্দ করিস মেয়েটিকে।”
“বিয়ে করে নিলো ভালোবাসা হয়ে যাবে, তাই না?”
তাসিন প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে আছে।
নিরব আজ পরপর স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার মুখে কোন কথা নেই। তাসিন স্বেচ্ছায় নিজের অ*শা*ন্তি ডেকে আনছে। না, মেয়েটিকে তো পাবেই না। উপরন্তু ফাবিহার মন ভেঙে যাবে, পরিবারের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে।
একটা চিকন শ্রুতিমধুর স্বর শুনে হৃদয় ছলকে ওঠে তাসিনের। এক মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ অজ্ঞাত সেই কন্ঠস্বরের অধিকািনীর মুখখানা দেখার জন্য মন ছটফট করে ওঠে তার। তবে চোখ তুলে তাকানো অসম্ভব। এটা অপরাধ। একটা পর্দাশীল নারীকে এভাবে দেখা তাঁকে অসম্মান করার সমান। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রেখে মাথানিচু করে বসে রইলো তাসিন।
মেয়েটি কোনদিকে লক্ষ না করে ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। কাঁধে ব্যাগ। পুরো শরীর কালো বোরকায় আবৃত।
“আব্বু? আপনার কোথায় কষ্ট হচ্ছে আব্বু?”
মেয়েটির বাবা নরম স্বরে মেয়েকে আদেশ করলেন,“ভেতরে যান আম্মু।”
মেয়েটি বাবার বুক থেকে মাথা তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বাবা ইশারায় আবারো ভেতরে যেতে বললেন। মেয়েটি বাবার আদেশ মেনে পেছন ঘুরতেই মেহমান খানায় সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষকে বসে থাকতে দেখে আঁতকে ওঠে। চোখ জোড়ায় ভীতি৷ নিকাব ফেলে ছুটে চলে যায় ভেতর ঘরে। এতক্ষণ মাথানিচু করে বসে ছিল তাসিন। এবার মাথা তুলে অস্বস্তি নিয়ে বলল,“উঠি তবে।”
তাসিনের ধারণা উনার মেয়েকে তাসিন দেখার চেষ্টা করেছে, এমনটাই ভাবছেন জনাব আজাদ। এটা ভেবেই তার অস্বস্তি বাড়লো।
কিন্তু তাসিনকে ভুল প্রমাণ করে জনাব আজাদ অনুরোধ করে বললেন,“আজ দাওয়াত গ্রহণ করুন। দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে তারপর যান।”
তাসিন অত্যন্ত নম্র গলায় বলল,“আমার কিছু কাজ আছে। পথে দুর্ঘটনা না ঘটলে আমি এখানে থাকতাম না। বেয়াদবি নেবেন না। আমাকে উঠতে হবে।”
জনাব আজাদ হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে বিদায় জানালেন তাকে। তাসিন মাথানিচু করে বেরিয়ে গেল। বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় উঠতেই তার প্রলম্বিত শ্বাস বেরিয়ে এলো। একটা মেয়ের কন্ঠস্বর এভাবে তার ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ রোজ সে কত মেয়ের স্বর শুনে অভ্যস্ত। রাস্তায় চলার পথেও কত নারী কন্ঠ কান ভেদ করে। কিন্তু এভাবে ভেতরটা নাড়িয়ে দিতে পারেনি। আমাদের নিষিদ্ধ জিনিসের উপর বরাবরই আগ্রহ বেশি। মেয়েটিকে দেখা সহজ কথা নয়। তাসিনের জন্য সে নারী নিষিদ্ধ। পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করে সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারলে তবেই দেখতে পাবে। তাসিন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো সব৷ কিন্তু কানে এখনো সেই শ্রুতিমধুর স্বর ভেসে আসছে।
রাস্তায় একটা গাড়ি এ*ক্সি*ডে*ন্টে দুজন লোক আ*হ*ত হন। সেই মুহূর্তে উনাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জরুরি ছিল। আহতদের মধ্যে একজন ছিলেন জনাব আজাদ। ধার্মিক লোক তিনি। শরীরে লম্বা আলখেল্লা, মাথায় পাগড়ি, মুখভর্তি দাড়ি। একটা পা ভেঙেছে উনার। শরীরের আরো কিছু জায়গায় ব্যথা পেয়েছেন। হাসপাতাল থেকে জনাব আজাদকে নিয়ে উনারই বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে তাসিন। বাড়ির উঠানে একটা কাকপক্ষীও নেই। একজন মহিলার স্বরও শোনা যাচ্ছে না। সবকিছু নিস্তব্ধ। তাসিন অবাক হলো না। ধার্মিক পরিবারের মানুষজনের জীবনযাপন নিয়ে কিঞ্চিৎ হলেও ধারণা আছে তার। জনাব আজাদ তাকে ছোটো একটা ঘর দেখিয়ে বললেন,“আমাকে এই ঘরে নিয়ে যাও।”
তাসিন সেটাই করলো। ছোটো একটা ছেলে তাদের দেখেই ছুটে বড়ো দালানটির ভেতর চলে গেল। তার মুখে বুলি উড়ছে,“দাদু এসেছে, দাদু এসেছে।”
তাসিন উঠতে নিলেই জনাব আজাদ বললেন,“বসুন বাবা। একটু পর যাবেন।”
তাসিন বসলো৷ কিছুক্ষণ পর সেই বাচ্চা ছেলের হাতে একটা নাস্তার ট্রে ধরিয়ে দেওয়া হলো। ছোটো ছোটো হাতে ধীর পায়ে ট্রে এনে রাখলো তাসিনের সামনে৷ জনাব আজাদ ইশারা করে বললেন,“নাস্তা করুন।”
তাসিন বিব্রত হয়ে বলল,“এসব..
জনাব আজাদ মৃদু হেসে বললেন,“সামান্য কিছু জিনিস। নিলে আমি খুশি হবো।”
তাসিন উপায়ন্তর না দেখে এক টুকরো ফল তুলে নিলো। জনাব আজাদের পরিবারকে তাসিন নিজ থেকেই কল দিয়ে জানিয়েছে দুর্ঘ*ট*নার খবর। জনাব আজাদ ছেলেকে ফোন করে জানাতে বলেছিলেন। ছেলে এই মুহূর্তে অনেক দূরে আছে। তবুও সে বাবার কথা শুনে ছুটছে কাজ ফেলে। সাথে বাড়িতে ফোন করে মা-বোন, স্ত্রীকে জানিয়ে দিল। তাসিনকে খুব অনুরোধ করে বলল,“আমার বাবাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিলে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। দয়া করে আমার অনুরোধটা রাখুন!”
তাসিন ফোন রেখে জনাব আজাদকে নিয়ে উনার বাড়ি চলে আসলো। এক টুকরো ফল খাওয়ার পরই কোথা থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এলো এক নারী। পুরো শরীর কালো বোরকায় মোড়ানো। পেছন দিক থেকেই এক পলক দেখেছে সে। মুখ দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। সাথে সাথেই দৃষ্টি নত করে ফেলেছিল। নারীটি এসেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিয়েছে।
কথাগুলো ভেবে এখনো সেই নারীর জন্য ছটফট অনুভব করছে তাসিন।
বাড়ি ফিরে না খেয়েই একটা ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করলো। ঘুম হলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাবনা অনুযায়ী বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল সে।
তাসিন চলে যেতেই মেহমান খানায় একে একে স্ত্রী, কন্যারা এসে ভীড় জমালো। সকলের চোখে পানি। প্রিয়জনের ব্যথায় ব্যথিত তাঁরা। জনাব আজাদ সান্ত্বনা দিলেন মেয়েদের।
“এর চেয়ে বড়ো কিছু ঘটতে পারতো। আমার মৃ*ত্যুও হতে পারতো। আল্লাহ যে আমাকে সহিসালামতে বাড়ি পৌঁছানোর তাওফিক দিয়েছেন, তাতে তোমাদের শুকরিয়া আদায় করা উচিত।”
সকলকে খানিকটা শান্ত দেখা গেল। জনাব আজাদের চোখ কাউকে খুঁজে যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে না দেখতে পেয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,“আমার আম্মু কোথায়?”
স্ত্রী নরম স্বরে বললেন,“কান্নাকাটি করছে।”
“ডেকে দাও।”
হুরাইনকে ডেকে আনা হলো। ভয়ে ভয়ে পা ফেলছে সে। বাবাকে সে ভয় পায় না। অত্যাধিক ভালোবাসে। তার ভয়ের একমাত্র কারণ বাবার অসম্মান। কোন কিছু খেয়াল না করেই একজন পুরুষের সামনে বাবার কাছে ছুটে এসেছে। জনাব আজাদ মেয়ের ভীত সন্ত্রস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে কাছে ডাকলেন। কেঁদে ফেললো হুরাইন।
“আমাকে ক্ষমা করুন আব্বু। আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল।”
মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বাবা বললেন,“শান্ত হন আম্মু। এরপর থেকে সাবধানে চলবেন। এখন কান্না বন্ধ করুন।”
হুরাইন হেঁচকি তুলে কাঁদছে। জনাব আজাদ বড় মেয়ে জান্নাতকে ইশারা করলেন হুরাইনকে ভেতরে নিয়ে যেতে।
ছেলে হোসাইন গাড়ি থেকে নেমেই বাবার কাছে ছুটে এলো। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বাবার হাত-পা চেক করছে৷ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বললেন,“আমি আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছি। চিন্তা করবেন না।”
জনাব আজাদ ছেলে-মেয়েদের আপনি সম্বোধন করেন। অথচ এই আপনি সম্বোধনেও রয়েছে অপার স্নেহ, মমতা। হোসাইন কাতর চোখে তাকিয়ে রইলো বাবার দিকে। আস্তে ধরে মেহমান খানা থেকে ভেতরের দালানে নিয়ে গেল বাবাকে। সেই দালানে বাইরের পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ। তাদের জন্য মেহমান খানায় বসা এবং শোয়ার ব্যবস্থা করা আছে।
খাবার খেয়ে উঠে গেল হুরাইন। আজ দেরিতে খাওয়া হয়েছে তার। আসরের সালাত আদায় করে জানালার ধারে বসলো। বাড়ির বাইরে থেকে লক্ষ করলে ভেতরের এই দালানটা দেখা যায় না। একটু ভেতরের দিকেই স্থাপন করা হয়েছে। তাই কোন পুরুষের দৃষ্টিতে পড়ার ভয় নেই। তবুও হুরাইনের অন্তরে ভীতি। কীভাবে সে এত বড়ো একটা ভুল করে বসলো। সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে আরো একবার ভয়ে শিউরে উঠলো সে। লোকটি তার স্বর শুনে ফেলেছে। চেহারাও হয়তো দেখে ফেলেছে!
ঘুম ভাঙলো তাসিনের। বেশ লম্বা ঘুম। সে নিত্যদিনের মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার মস্তিষ্কে আর সেই নারী এলো না।
পরদিন সকালে খাবার টেবিলে বাবা-মা আবারো তার বিয়ের কথা তুললেন। আশ্চর্য জনক ভাবে তাসিনের সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল। কানে সুরেলা ঠেকলো সেই চিকন স্বর। মেয়েটি কি বিবাহিত? নিজের ভাবনা দেখে নিজেই বিস্মিত হয় তাসিন। সে তো সব ভুলেই বসেছিল। এমন তো সে ছিল না। একজন নারীর সামান্য স্বর যে তাকে এভাবে যন্ত্রণায় ফেলবে সে এটা বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। এসব কিছু মনের ভণ্ডামি ভেবে নিজেকে শক্ত করতে চাইলো। বাবা-মাকে অনুমতি দিয়ে দিল তার জন্য মেয়ে দেখতে। যদি একটুখানি স্বস্তি মিলে! বাবা-মা উভয়ই খুশি হলেন। প্রথমদিকে তাঁরা নিজেরাই চাননি ছেলে দ্রুত বিয়ে করুক। আগে ছেলের একটা শক্ত অবস্থান চেয়েছেন। এখন সেই অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে তাসিন। এবার ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিতে পারলেই যেন দায়িত্ব কিছুটা কমে যাবে। তাসিনের মা বোনের মেয়েকে ছেলের জন্য পছন্দ করে রেখেছেন। আজই বোনের সাথে কথা বলবেন।
তাসিন বাবা-মাকে অনুমতি তো দিয়ে দিল। কিন্তু কিছুতেই মনে শান্তি পাচ্ছে না। তাই আধখাওয়া অবস্থায় উঠে পড়লো।
#আমার_তুমি
#পর্ব_১৯[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ]
#জান্নাত_সুলতানা
তিন্নি একটা হাল্কা মিষ্টি কালার শাড়ী পড়ে রেডি হচ্ছে।
শাড়ী টা পড়িয়ে দিয়েছে ওর সাথে যে মেয়ে টা থাকে সে।
ওর কোনো শাড়ী নেই।কিন্তু কাল রাত দশ টা বাজে কবির খাঁন ফোন করে বলেছে কাল তিন টার দিকে একটা রেস্টুরেন্টে -এ দেখা করতে।
এটা শোনার পর তিন্নি থম মেরে ছিল।
ও ভাব ছিল হয়তো কবির ভুল করে ফোন দিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু তিন্নি কে আরেক দফা অবাক করে কবির দ্বিতীয় বার তিন্নি কে গম্ভীর কণ্ঠে আদেশের স্বরে বলে ছিল।
দেখা করতে আসার সময় যেনো সুন্দর করে শাড়ী পড়ে আসে।
তিন্নি কিছু না বুঝতে পার ছিল না কিছু মুখ দিয়ে প্রশ্ন করার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিল।
তবে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অনেক কষ্ট বলে ছিল স্যার আপনি হয়তো নাম্বার ভুল করে আমাকে কল দিয়ে ফেলেছেন।
কিন্তু কবির তিন্নির কথা পাত্তা না দিয়ে বরং আদেশের স্বরে আবারও বলে ছিল যা বলেছে তাই যেনো করে।
আর ঠিক টাইমে যেনে যথা স্থানে পৌঁছে যায়।
তিন্নি কে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দিয়ে ছিল।
আর এদিকে তিন্নি আর সারা রাত ঘুমুতে পারে নি।
শুধু ভেবেছে এই বুঝি স্যার ফোন দিবে আর বলবে সরি তিন্নি ভুল করে তোমার নাম্বারে কল দিয়ে ফেলেছি।
কিন্তু না তিন্নি সারা রাত জেগে থেকেও তেমন কিছু ঘটে নি।
তিন্নি শেষ রাতের দিকে একটু ঘুমিয়ে ছিল।
আর সকালে উঠে দুই টা টিউশনি যে গুলো বিকেলে করায় সে গুলো সকালে করিয়ে বাসায় এসে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে বেড়িয়ে এলো হোস্টেল হতে।
বেশি সাজে নি হাল্কা গোলাপি রঙের লিপস্টিক আর কানে এক জোড়া ইয়ার রিং।
আর বাম হাতে একটা ঘড়ি যে টা সব সময় পড়ে থাকে।
টিউশন করায় বিধায় এটার খুব করে প্রয়োজন পরে।
তিন্নি একটা রিকশা নিয়ে কবিরের বলা লোকেশন পৌঁছে যায়।
কিন্তু সময় তখন তিন টার বেশি সময় বাজে।তিন্নি রিকশার ভাড়া মিটিয়ে রেস্টুরেন্টে এর ভেতরে যেতে লাগলো।
রেস্টুরেন্টে টা বেশ নামি দামী সেটা ডেকোরেশন দেখে বোঝা যাচ্ছে।
আর এটার ভেতরেও সব মানুষ বড় বড় লোক।
সবার ড্রেসআপ দেখে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তিন্নি আঁড়চোখে সব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে নিলো।
আর পুরোপুরি সামনে দৃষ্টি যেতেই দেখলো কবির স্যার একটা সাইডে একটা মাঝের টেবিলে বসে আছে।
সাথে আরও একজন আছে কিন্তু পেছন থেকে সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
কবির ওর বাবার সাথে কথা বলছিল।
কিন্তু হঠাৎ দেখেলো তিন্নি ওদের থেকে কিছু টা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
কবির সে দিকে একবার তাকিয়ে ওর বাবা কে কিছু বলে উঠে এগিয়ে আসে তিন্নির নিকট তিন্নি সালাম দেয়।
ও ভীষণ নার্ভাস এসি আছে নয়তো ওর ঘাম হয়তো এতোক্ষণে টুপ করে গড়িয়ে পড়তো নিচে।
কবির তিন্নি কে পরক করে নিলো অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে সালামের জবাব দিয়ে ওর সাথে আসতে বলে।
ওরা এগিয়ে গিয়ে ওই টেবিল টায় বসে পড়ে।
তিন্নি কালাম খাঁন কে চিনে না তবে স্যার এর সাথে ছিল বিধায় কালাম খাঁন কেও সালাম দেয়।
কালাম খাঁন লম্বা চওড়া হেসে সালামের উত্তর দেয়।
আর মনে মনে এটাও ভেবে নিলো ছেলের পছন্দ আছে বটে।
যদিও তিন্নির গায়ের রঙ ততটা ফর্শা নয়।
কিন্তু তবে সুন্দর বলাই চলে।
আর চেহারা টায় ভীষণ মায়াবী।
লম্বা টাও ঠিক ঠাক মোদ্দা কথা ছেলের সাথে তার সুন্দর মানাবে যাকে এক কথা বলে পারফেক্ট।
কালাম খাঁন এর ভাবনার মাঝেই কবির ওয়াটার ডেকে খাবার অর্ডার দেয়।
তার পর তিন্নি কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে
-“আমার বাবা।
বাবা ওর কথায় কাল বলেছিলাম।
শেষে এর টা কালাম খাঁন এর দিকে তাকিয়ে ওনাকে উদ্দেশ্য করে বলে।
তিনি তিন্নির নাম জিজ্ঞেস করে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে থাকে।
তিনি জানে তিন্নি এতিম তাই বাবা মার কথা আর জিজ্ঞেস করে না।
আর তিন্নি ভাবছে। সাথে মনে অনেক প্রশ্ন তাকে কেন এভাবে এখানে ডাকা হয়েছে?
আর স্যার কেন তার বাবা-র সাথে এভাবে পরিচয় করাচ্ছে?
সবার কথা আর আড্ডার মাঝেই খাবার দাবার শেষ করে।
কালাম খাঁন খাওয়া শেষ টিসু তে হাত মুছে উঠে দাঁড়িয়ে কবির কে উদ্দেশ্য করে বলল
-“আমার পছন্দ হয়েছে।
আমাদের বাড়ি চলে এসো তাড়াতাড়ি করে।
এই বাবা টা তোমার জন্য অপেক্ষা করবে।”
শেষ এর কথা গুলো তিন্নি কে উদ্দেশ্য করে বলে।
অতঃপর কাউ কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি চলে গেলো রেস্টুরেন্টে হতে।
তিন্নি তখনো সে দিকে অবুঝ চোখে তাকিয়ে।
যা দেখে কবির হাসে।
মেয়ে টা হয়তো কিছুই বুঝতে পারছে না।
অবশ্য বোঝার মতো কিছু করেও নি।
কবির গলা ঝেড়ে তিন্নির মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করে।
সফলও হয়।
তিন্নি তাকালো একবার কবিরের দিকে।
পর পর-ই মাথা নুইয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই কবির বলে উঠে
-“তুমি আমার ছাত্রী আমি তোমার শিক্ষক।
কিন্তু এটা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই।
তোমার আছে?”
তিন্নির সেকেন্ড এর মতো সময় লাগে কথা গুলোর মানে বুঝতে।
তবে শেষ এর কথা গুলো তিন্নি স্পষ্ট হলো কবির তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে।
ওর কি বলা উচিত ও বুঝতে পারে না।
রাজি হবে?নাকি সময় চাইবে?
তিন্নির ভাবনার মাঝেই কবির গম্ভীর কণ্ঠে আবারও শোনা গেলো
-“আজেবাজে চিন্তার প্রয়োজন নেই।
পজিটিভ ভাবো নেগেটিভ না।
আর বাবা খুব শীগগির হোস্টেল যাবে।
পরীক্ষার আগে আমাদের বাসায় চলে আসবে।”
তিন্নি এবারও কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না।
তবে ওর মন খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে সাদনান ভাই কে একবার এসব বলা প্রয়োজন।
-“মাইশা,,,,
-“আমি সব সামলে নেবো।”
তিন্নির কথা সব টা না শুনেই কবির বলে উঠে।
তিন্নি আর কিছু বলে না।
————-
প্রিয়তা সাদনানের পাশে বসে খাচ্ছে।
একটু আগেই সাদনান অনেক গুলো চিপস চকলেট আরও অনেক কিছু কিনে দিয়েছে।
ওরা কোথায় যাচ্ছে প্রিয়তা জানে না।
জানবে কি করে সে তো জিজ্ঞেস করে নি।
সে নিশ্চিত মনে মনে বসে খেয়ে যাচ্ছে।
ভাব টা এমন সাদনান যদি তাকে জাহান্নামেও নিয়ে যায় সে চোখ বন্ধ করে সাদনানের সাথে যাবে।
সাদনান একটু পর পর দেখছে তার ছোট জান কে।
তারা আজ বাড়ি যাবে না।
নিজেদের একটা ফ্ল্যাট কিনেছে বছর দুই এক আগে আজ রাত সেখানেই থাকবে তারা সকালে বাড়ি ফিরবে।
এটা সে সালেহা বেগম কে কল করে জানিয়ে দিয়েছে।
মিনিট বিশ এক পর সাদনানের গাড়ি টা এসে একটা বাড়ির সামনে থামে।
সাদনান পার্কিং এড়িয়া গাড়ি টা পার্ক করে প্রিয়তা কে নিয়ে লিফটে করে সোজা চার তলায় পৌঁছে যায়।
সাদনান রুমে গিয়ে প্রিয়তা কে ফ্রেশ হতে বলে নিজে ফোন হাতে দারোয়ান কে ফোন করে খাবার নিয়ে আসার কথা বলে দেয়।
সাদনান ফোনে কথা শেষ করে ব্যালকনি হতে রুমে এসে দেখলো প্রিয়তা এখনো স্কুল ড্রেস পড়েই দাঁড়িয়ে আছে।
সাদনান এর বিষয় টা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
সে তো ভুলে গিয়ে ছিল ওর নিজের কাপড় এ বাসায় থাকলেও প্রিয়তার নেই।
কিন্তু এখন কিছু করারও নেই।
আশে পাশে দোকান আছে তবে কাপড়ের দোকান নেই।
এটা একটু নিরিবিলি প্রাকৃতির জায়গা।
সাদনান এসব ভেবে ওয়ারড্রব এর ড্রয়ার খোলে সেখান থেকে ওর একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জির প্রিয়তার হাতে দেয়।
প্রিয়তা এতোক্ষণ সাদনান কে পর্যবেক্ষণ করছিল।
কিন্তু সাদনান কে ওর হাতে এসব কাপড় দিতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে
-“এটা পড়তে হবে?”
-“কিছু করার নেই।
তাছাড়া আমি তো অন্য কেউ তো আর নেই।”
মাহাদের দিনগুলো ভালো যাচ্ছে না। বাচ্চাটা মারা যাবার পর বেশ অসুস্থ মাহিয়া। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় নি এখনো। কোর্টে মাহতাবের কেস চলছে। অনেক চেষ্টা করেও তার জামিন করাতে পারে নি। পরিবারিক সংকটে পরে পিষ্ট সে। দিনশেষে তবুও যেটুকু সান্ত্বনা, স্বস্তি পাবার কথা সেটুকুও মেলে না তার। প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখখানি দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে। মনে হয় সেই দুঃস্বপ্নের সন্ধ্যার কথা। মনে পড়ে সিঁড়ির গোড়ায় নিথর হয়ে পরে থাকা রক্তাত মাহিয়ার মুখ। খুব ক্লান্ত স্বরে শুধায়,
— “এমনটা কেন করলে অনু?”
প্রশ্ন নয়, আক্ষেপ। আফসোস। বাড়ির কেউ আসল সত্যটা না জানলেও মাহাদ সব জানে। মাহিয়ার ঘটনাটা কোনো অ্যাকসিডেন্ট নয়। বরং তা পূর্বপরিকল্পিত। করিডোরে তেল ঢেলেছিল অনু। পরে সেটা মুছেও ফেলেছিল নিজেকে বাঁচাতে। কিন্তু সেদিন রাতে পায়ে লাগা কিছু লাগার চিটচিটে অনুভূতি; আর নিজের শয়নকক্ষের কোণায় রাখার খালি তেলের বোতল দেখেই সবটা পরিষ্কার হয়ে যায় ওর কাছে। ওকে জিজ্ঞেস করে সবটা জানতে, কিন্তু অনু উত্তর দেয় না। যদিও উত্তরটা জানার প্রয়োজন ওর একেবারই নেই!
অনু কেন এমন করেছে মাহাদ তা জানে। জানে বলেই আর কাউকে কিছু জানায় না সে। চুপচাপ সব গোপন করে ফেলে। কারণ, অনুর শাস্তিটা সে নিজেই দিতে চায়!
___
নির্ধারিত দিনে খুব ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল চারুর। ঢাকা থেকে বরযাত্রী এসে হাজির হলো বিয়ের দিন সকালে। সারাদিন থাকলো।
হৈ-চৈ হলো। বিয়ে পড়িয়ে রাতেই ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু কেউ ছাড়লেন না। নব দম্পতির বাসর অরুণা ম্যানশনেই হলো। পরদিন সকালেই নব পরিণীতাকে নিখিল আকাশপথে উড়িয়ে নিয়ে গেল নিজের বাসায়!
নতুন সংসারে বেশ সুখেই দিন কাটতে লাগলো। স্বামী, শাশুড়ি নিয়ে ঝঞ্ঝাটহীন নিরিবিলি সংসার। চারু সত্যিই খুব সুখী হলো। সেই সুখ দেখে লোকে যখন ঈর্ষা করে, হিংসায় জ্বলে গিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে ওকে নিয়ে, তখন হয় তো একটু দুঃখ পায় বেচারী। কিন্তু সেই দুঃখটা কখনোই স্থায়ী হতে দেয় না তার প্রিয়তম, নিখিল নওশাদ! কারণ সে যে কথা দিয়েছিল, চারুকে কোনদিন দুঃখী হতে দেবে না। কথা দিয়ে কথা না রাখা যায়?
চারুর খুশিতে বাড়ির সকলেই খুশি। মেয়েকে ভালো পাত্রের নিকট সোপর্দ করতে পেরে তাদের বুক থেকে যেমন পাথর নেমে গেছে। ভীষণ আনন্দিত তারা। কিন্তু এক দুশ্চিন্তার অবসান ঘটলেও, অন্য দুশ্চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তাদের ভেতর। সেই চিন্তা অনুকে নিয়ে। মেয়েটার সংসারজীবন খুব একটা সুখের যাচ্ছে না। ডেলিভারির সময়ও এগিয়ে আসছে। কি যে হয়, চিন্তায় আছেন সবাই!
____
ভালোবাসার মানুষের দেয়া উপহারের চেয়ে বড় উপহার যেমন আর কিছু হয় না; তেমনই ভালোবাসার মানুষের দেয়া শাস্তির চেয়েও বড় কিছু হয় না! অনুকে মাহাদ ঠিক সেই শাস্তিই দিয়েছে।
একই ছাদের নিচে, একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়েও ওদের মধ্যে থাকে যোজন যোজন দূরত্ব। অনু কাছে আসবার চেষ্টা করলেও মাহাদ এড়িয়ে যায়। ঠিকমত কথা অবধি বলে না!
সারাদিন সকলের সামনে ভালো থাকার অভিনয় করে যায় অনু, সবাইকে দেখায় ওরা কতো সুখী দম্পতি! অথচ বাস্তবতা ভিন্ন—
অনু যে অপরাধটা করেছে তার আসলে ক্ষমা হয় না। কেউ কাউকে হিংসে করতেই পারে। কিন্তু সেই ঈর্ষার মাত্রা কতখানি হলে একজন মানুষ অন্যজনকে খুlন করে ফেলবার মত জঘণ্য কাজ করে ফেলতে পারে; সেটা ভেবেই আশ্চর্য হয় মাহাদ। অনুর রাগ, জেদ ঈর্ষা কতখানি প্রবল ছিল ভেবেই হতাশ হয়! করুণা হয় নিজের প্রতি, কি করে এমন একজনকে সে ভালোবেসেছিল?
মাহিয়াকে মেরে ফেলবার যে বিশ্রী প্রচেষ্টাটা অনু করেছিল সেটা আর কেউ জানে না। একমাত্র সাক্ষী মাহাদ। যে নিজে ঘটনা প্রত্যক্ষ না করলেও শতভাগ নিশ্চিত অনুই দোষী। কেস করবার মতো জটিল একটা ইস্যু হলেও এ নিয়ে থানা-পুলিশ অবধি যায় নি কেউ। নেহাৎ এক্সিডেন্ট বলে ছেড়ে দিয়েছে সব। সবার নিশ্চলতা দেখে চিরকাল ন্যায়ের পক্ষে থাকা মাহাদও আর কিছু বলে নি। শতহোক, বাড়ির বৌকে পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে কেই আর চায়!
অনুকে অবশ্য অন্যভাবে শাস্তি দিতে পারতো সে। চাইলেই ডিভোর্স দিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু শেষমেষ তা না করে নি মাহাদ। ওদের একটা বাচ্চা আছে। বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে বাচ্চাটার উপর কোনো খারাপ প্রভাব পড়ুক সেটা ও চায় নি। তাই যেমন-তেমন করে হলেও সংসারটা টিকেছে অনুর। কিন্তু এই সংসারের কোনোই যে দাম নেই, তা ভালো করেই জানে অনু!
দেখতে দেখতেই কেটে গেছে প্রায় ছ’ মাস। দীর্ঘদিন ধরে চলমান কেসের রায় হয়েছে অবশেষে। মাহতাবের সাজা হয়েছে। দু বছরের হাজতবাস সহ নগদ অর্থ দণ্ড। মাহতাব বর্তমানে কারাগারেই আছে। চাকরি চলে গিয়েছে, ভেঙে গিয়েছে তার সুখের সংসার। হাসপাতাল থেকে আর ফিরে আসে নি মাহিয়া। চলে গিয়েছে নিজের বাড়িতে; পরিবারের কাছে। এ বাড়ির সঙ্গে সবরকমের সম্পর্ক চ্যুত করে!
ডিভোর্স লেটারও পাঠিয়ে দিয়েছে যথাসময়ে।
অনুও শাস্তি পেয়েছে তার কর্মের জন্য। রাষ্ট্রীয় কোনো আইনের আওতায় নয়, তার সৃষ্টিকর্তার দেয়া আইনের অধীনে। যে মানুষটিকে সে ভালোবেসেছিল, একসাথে জীবন পার করবার পবিত্র স্বপ্ন দেখেছিল, সেই মানুষটিকে তার তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন তিনি। পাশে থেকেও যেন নেই মাহাদ। উফ্, কি যন্ত্রণা! সঙ্গে আছে নিদারুণ অপরাধবোধ, আত্মগ্লানি। অনু অস্থির হয়ে উঠলো সবকিছু নিয়ে। সৃষ্টিকর্তার দরবারে মাথা ঠুকতে লাগলো নিজের কষ্ট লাঘবের জন্য। সে অনুতপ্ত, ভীষণ ভাবে! এখন যেন তার প্রতি সদয় হন তিনি।
হয় তো সত্যি সত্যিই তার প্রতি সদয় হলেন সৃষ্টিকর্তা। দোয়া কবুল হলো তার। বেশিদিন এই কষ্ট তার বইতে হলো না। অনেকটা সময় ধরে চলা এই মানসিক চাপের ভার তুলে নিয়ে, তাকে ইহজীবনের যাবতীয় সমস্যা থেকে মুক্তি দিলেন তাকে। ভারসাম্যহীন অনুলেখার স্থান এখন পাবনা মানসিক হাসপাতালে!
পরিশিষ্ট:
শুক্রবারের দিন। ব্যালকনিতে একা দাড়িয়ে আছে চারু। দৃষ্টি দূরের বড় বড় ভবনের উপর বুলিয়ে যাচ্ছে একাধারে। পাশেই রেলিংয়ের উপর চায়ের কাপ রাখা। আগুন গরম কাপখানি থেকে ধোঁয়া উঠছে হু হু করে!
পুরো ফ্ল্যাটটা আজ ফাঁকা। গতকাল ছোট জা’র বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন নাজিয়া নিলুফার। চারুকে একা ফেলে যেতেন না, তবে আজ শুক্রবার; নিখিল বাসায় থাকবে বলেই গেছেন। বিয়ের পর নবদম্পতিদের একটু স্পেস দিতে হয়। সুযোগ দিতে হয়, একসঙ্গে থাকার। তাতে ভালোবাসা বাড়ে, বোঝাপড়া সুন্দর হয়!
এমনিতেই বিয়ের পর অফিস থেকে কোনো ছুটি পায় নি নিখিল। চারুকে নিয়ে সেই যে এসে ফ্ল্যাটে তুলেছে, তারপর আর কোথাও যাওয়া হয় নি। গৎবাঁধা জীবনে আটকা পড়েছে দু’জনে। মাঝে মাঝে উনি তাও ঠেলেঠুলে বাইরে পাঠাতে চান দু’টোকে কিন্তু কাজের বাহানা দিয়ে বাবুরা আর যান না! এবার তাই বুদ্ধিমতী নাজিয়া ছেলে আর ছেলের বৌকে একেলা সময় কাটাতে ছেড়ে গেছেন। বলে গেছেন, পাঁচ ছ’ দিনের আগে উনি ফিরবেন না!
নিখিলের অবশ্য তাতে দ্বিমত ছিল বেশ। মা কেন এতদিন দূরে থাকবে? এই নিয়ে বেশ রাগারাগিও করেছে জননীর সঙ্গে, কিন্তু নাজিয়ার জেদের কাছে হার মেনেছে। বাধ্য হয়েছে ছোট চাচীর বাড়িতে রেখে আসতে। কলিং বেলের আওয়াজে ভাবনার সুতো ছিঁড়লো চারুর। কাপটা ওভাবে রেখেই সে ত্বরিৎ পায়ে ছুটলো দরজা খুলে দিতে, তার প্রাণনাথ এসেছে যে!
দরজা খুলতেই নিখিলের ঘামে ভেজা ক্লান্ত মুখখানি চোখে পড়লো। স্ত্রীকে দেখেই যে মুখখানিতে অমায়িক হাসি ফুটে উঠলো,
— “অপেক্ষায় ছিলে?”
চারু ততোক্ষণে ওর দু’ হাত থেকে বাজারের ব্যাগ দু’টো হস্তগত করে ফেলেছে। সেগুলিকে রান্নাঘরে স্থানান্তর করতে করতে জানালো,
— “করবো না? স্বামীর জন্যই তো সব অপেক্ষা স্ত্রীদের!”
নিখিল পুনরায় হাসলো। ধীর পায়ে হেঁটে ঘরে এলো। এসেই তার নজর আটকে গেল বিছানায় থাকা কাপড়ের কুণ্ডলীর দিকে। হাসিমুখে এগিয়ে এলো সে। কাপড়ের ওই পোটলার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে, সুন্দর এক ঘুমন্ত মুখশ্রী। ভীষণ মায়াময়, কোমল সে ছোট্ট মুখখানি!
একদম চারুর মতো দেখতে। যদিও সে চারুর গর্ভজাত নয়। তবুও একই জিন তো! অনুলেখার বাচ্চা মেয়েটা। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে, তার সন্তানের দায়িত্বটা চারুর উপরেই দিয়ে দিয়েছে মাহাদ। চারুর কোল পূর্ণ হয়েছে, মেহেরিমাও পেয়েছে তার মা!
— “এ কি? এখনো হাত-মুখ ধুতে যান নি? যান!”
চারু তাড়া দিলে ও ফের হাসলো। বাচ্চাটার দিকে চেয়ে বললো,
— “কখন ঘুমিয়েছে, মেহেরিমা? উঠবে না? তোলো তো, একটু আদর করি।”
— “এই— একদম না! সারারাত, সারাদিন জ্বালিয়ে একটু আগে ঘুমিয়েছে। ঘণ্টাও হয় নি। এখনই তুলবেন না।”
দৌড়ে এলো চারু।
— “আচ্ছা , তুলবো না। তোমার এতো টেনশন নিতে হবে না।”
নিখিল হেসে ওর নাক টেনে দিলো। তারপর সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল হাত-মুখ ধুতে। কাঁচা বাজার মানেই তো ভীষণ নোংরা একটা জায়গা। কতো হরেক রকমের মানুষজনের আনাগোনা, কতো হরেক রকমের আনাজ-সদাই! ঠিকমত পরিচ্ছন্ন তো হতেই হবে। বাড়িতে যখন ছোট্ট একটা শিশু আছে, তখন তো এটা আরো বেশি জরুরি!
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে চায়ের কাপ হাতে চারুকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো নিখিল। একহাতে তোয়ালেটা স্ত্রীর হাতে দিয়ে, অন্য হাতে কাপটা তুলে নিতে নিতে বললো,
— “একা বোর হচ্ছিলে? আমি জলদিই আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু জানোই তো বাজার! একটু দেখে-শুনে না কিনলে ঠকতে হয়।”
— “সমস্যা নেই। আমি বোর হই নি। ব্যালকনিতে দাড়িয়ে ছিলাম। আকাশ দেখছিলাম। আজকের আকাশটা খুব সুন্দর, জানেন?”
হঠাৎ খুব উচ্ছ্বসিত মনে হলো ওকে। কাপে চুমুক বসিয়ে নিখিল বললো,
— “তাই নাকি? দেখি তো!”
কয়েক পা এগোলো সেদিকে। এসে সেখানটায় দাড়ালো, যেখানটায় চারু একটু আগে দাড়িয়ে ছিল। কাপটা রাখলো ওর কাপের পাশে। আড়চোখে তাকালো স্ত্রীর দিকে। চারু তখন ব্যালকনির তারে ভেজা তোয়ালেটা নাড়তে ব্যস্ত দেখে সুকৌশলে কাপ বদলে ফেললো। নিজের কাপটা চারুর জায়গায় রেখে, ওর কাপটা তুলে চুমুক বসালো। তৃপ্তিসূচক শব্দ করে বললো,
— “চা’টা ভালো হয়েছে, বৌ।”
চারু হাসলো প্রশংসা শুনে। বললো,
— “রোজই এই কথা বলেন।”
— “বিশ্বাস করছ না তো? তোমার চা কিন্তু আসলেই খুব ভালো হয়! ঠিক আমার পছন্দের মতো।”
— “শুনে ধন্য হলাম জনাব!”
চারু হেসে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু চট করে ওর হাতটা ধরে ফেললো নিখিল। নরম করপুটে দুষ্টুমি করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। চারু বিস্মিত হয়ে তাকাতেই চোখটিপে দিলো। অতঃপর হ্যাঁচকা টানে ওকে এনে ফেললো বুকের উপর।
লাজে রাঙা হলো চারুলতা জাফরিন,
— “কি করছেন?”
— “ভালোবাসছি!”
ফিসফিস করে বলা সেই কথাটা শরীরে কি আশ্চর্য শিহরণ জাগিয়ে দিলো ওর। শিরশির করে করলো সারা গা। দম আটকে দাড়িয়ে রইলো। নিখিল হাসলো। একহাতে থুতনি ধরে সুকোমল মুখখানি উঁচু করলো, অন্যহাতটা কপোলে ঠেকালো। আবেশে চোখ বুঁজে ফেললো চারু। পরপরই ললাটে এক ঊষ্ণ স্পর্শের অস্তিত্ব টের পেল। পরম যত্নে ওকে চুমু দিচ্ছে নিখিল।
চোখ বন্ধ করে রেখেই সবটা অনুভব করলো চারু। সন্ধ্যা নেমে যাওয়া নিসর্গের মৃদু সমীরণ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের। আহা, কি শীতালু ছোঁয়া! কি আদুরে! দূরে কোথায় যেন বাজছে,
“এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু
কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন
মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু~”
রাতে বাসায় ফিরেই কেন যেন নিখিলের মনে হতে লাগলো পরিবেশ কেমন থমথমে। অদ্ভুত একটা গুমোট ভাব চারপাশে। কলিং বেল টিপে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। শেষটায় নাজিয়ার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চাবি দিয়ে সে নিজেই দরজা খুললো। তার ব্যাগের কোণে একটা অতিরিক্ত চাবি থাকেই সর্বদা। প্রয়োজনে যেন কাজে লাগাযতে পারে।
ভেতরে ঢুকেই অবাক হলো নিখিল। ঘন তমসায় নিমজ্জিত পুরো ফ্ল্যাট। অন্যান্য দিন এ-সময় ফিরলে বসার ঘর থেকে টেলিভিশনের শব্দ শোনা যায়, নাজিয়া হাসিমুখে ছেলের দিকে তাকান। কথা বলেন। আজ কোনো আওয়াজ নেই। নাজিয়াও নেই সেখানে।
নিখিল ধীর পায়ে হেঁটে মায়ের কক্ষের সামনে এলো। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। নিখিল শান্ত গলায় ডাকলো,
— “আম্মি!”
উত্তর এলো কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে,
— “ফ্রেশ হও গিয়ে।”
কি আশ্চর্য শীতল সে সুর। নিখিলের গা ছমছম করে উঠলো অজানা শঙ্কায়। কোনোমতে বললো,
— “তুমি কি অসুস্থ? ঘরদোর সব অন্ধকার করে রেখেছ যে—”
— “এমনই। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। খাবার দিচ্ছি।”
নিখিল তবুও গেল না। কি যেন ভেবে দাড়িয়েই থাকলো। সেটাও কি করে যেন টের পেলেন নাজিয়া। গলা উঁচিয়ে বললেন,
— “কি হলো? যাচ্ছো না কেন?”
— “যাচ্ছি!”
বহুদিন পর মায়ের রাগ দেখে এবার সত্যিই খুব আশ্চর্য লাগলো ওর। মা সহজে রাগেন না, আজ হঠাৎ? তীব্র ভয়ে বুকে কামড় পড়লো ওর! মা কিছু আঁচ করেছে নাকি?
ফ্রেশ হয়ে এসে নিখিল আবিষ্কার করলো খাবার ঘরে বসে থাকা তার মাকে। ছেলের প্লেট সাজিয়ে তিনি বসে আছেন। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। রোজ তারা দু’ জন একসঙ্গে খেতে বসে। আজ ব্যতিক্রম কেন? নিখিল প্রশ্ন করতেই নাজিয়ার গম্ভীর প্রত্যুত্তর,
‘খেয়েছি। তুমি খাও!’
নিখিল আরও অবাক হলো। রোজ সে বলেও নাজিয়াকে আগে খাওয়াতে পারে না, আজ সেখানে—
প্রায়শই অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়ে যায় ওর। তখনও ছেলের জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করেন তিনি। নিখিল এই নিয়ে কতো রাগ করেছে ইয়াত্তা নেই। কিন্তু তবুও নাজিয়ার সিদ্ধান্ত বদলায় নি। আজ হঠাৎ!
যাই হোক, নিখিল নীরবে খাওয়া শেষ করলো। পুরো সময়টাই নাজিয়া তার পাশে রইলো কিন্তু একটা কথাও বললো না। প্লেট ধুয়ে নিখিল চলে যেতে লাগলো ঘুমোতে; তবুও নাজিয়ার হেলদোল নেই। তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাচ্ছেন!
অধৈর্য হয়ে উঠলো নিখিল। ঘুরে এসে মা’র ধরে টানলো। কাতর গলায় বললো,
— “কি হয়েছে আম্মি? এমন করছ কেন? ও আম্মি?”
নাজিয়া যেন ভারী বিরক্ত হলেন এতে,
— “কি করেছি? সর তো, ঘুমাবো আমি। জ্বালাস্ না!”
— “আম্মিইই! প্লিইজ! কি হয়েছে আমাকে বলো? আমি বুঝতে পারছি কিছু একটা ঠিক নেই। কিন্তু—”
— “অর্ধেক যেহেতু বুঝেছিস, সেহেতু বাকিটাও বুঝে নে। আর আমাকে ছাড়। বিরক্ত লাগছে আমার!”
হাত ছাড়িয়ে চলে গেলেন নাজিয়া। নিখিল হাজার ডেকেও ফেরাতে পারলো না!
মায়ের নীরব এই অভিমান চললো পরদিন বিকেল পর্যন্ত। এই পুরোটা সময় উনি খুব অদ্ভুত আচরণ করলেন। কথা বললেন না ঠিক করে। সবকিছুতেই থাকলেন নির্লিপ্ত। নিখিল কিন্তু থামলো না। ওর অসম্ভব জোরাজুরির ঠেলায়ই শেষ অবধি নাজিয়া মুখ খুলতে বাধ্য হলেন। তীব্র অভিমানে বললেন,
— “তুই আমাকে এতো পর ভাবিস কেন, নিখিল? আমি কি তোকে পেটে ধরি নি? ছোট থেকে পেলেপুষে এতোবড় করি নি? তবে কেন আমার থেকে কথা লুকাস তুই? কেন সবকিছু আড়াল করিস আমার থেকে?”
নিখিল একমুহূর্ত হতভম্ব হয়ে রইলো। সম্বিৎ ফিরতেই উদ্বেল নিয়ে বললো,
— “কি লুকিয়েছি আমি? কি—”
— “একদম ঢং করবি না, বলে দিলাম। আমি খুব ভালো করেই জানি, চারুকে নিয়ে তুই কিছু আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছিস। ব্যাপারটা আমি ওর কাছেই শুনতে পারতাম কিন্তু শুনি নি। কেন জানিস? কারণ আমি চাই নি, চারুর কাছে আমাদের মা-ছেলের কথাটা প্রকাশ পাক। ওর কাছে ছোট হতে চাই নি আমি। অপেক্ষা করেছি, কাল রাতে – আজ সারাদিনে— অথচ তুই? এখনও সবটা লুকিয়েই যাচ্ছিস!”
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো নিখিল। হতাশ হয়ে বললো,
— “তুমি সবটা জেনেই গেলে?”
— “জানতে আর দিচ্ছিস কই! সবই তো লুকিয়ে যাচ্ছিস!”
রাগে মুখ ফিরিয়ে নিলেন নাজিয়া।
নিখিল বুঝলো। মায়ের রাগের কারণটা ভালোই পরিষ্কার হয়েছে এতক্ষণে। এজন্যই তবে এতো রাগ!
লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সে বললো,
— “বলো, কি জানতে চাও? আমি বলছি।”
— “শুরু থেকে বল্। আবার বলছি, কিচ্ছু লুকোবি না! একটা শব্দও না!”
ক্ষ্যান্ত দিলো নিখিল। হাত উঁচিয়ে পরাজয় স্বীকার করে বললো,
— “আচ্ছা, আচ্ছা। বলছি।”
— “হু, বল্।”
— “চারুর আগে একটা বিয়ে হয়েছিল, আম্মি। ছয় মাসের সংসার ছিল। সেই সম্পর্কের ইতি টানার পর থেকে গত আড়াই বছর ধরে চারু বাবার বাড়িতেই থাকে।”
নিঃস্তব্ধ ঘরটায় বিস্ফোরণ ঘটলো যেন! বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়েই উঠলেন নাজিয়া,
— “কীহ্!”
— “হ্যাঁ, আম্মি। চারু ডিভোর্সী। এটা শুনবার পর তুমি যদি ওকে মেনে নিতে চাও, সেই ভয়েই আমি সবটা লুকিয়েছি তোমার কাছ থেকে। কিন্তু বিশ্বাস করো, চারু খুব ভালো মেয়ে। তুমি তো মিশেছ ওর সঙ্গে। আমার চেয়ে ওর তোমার সঙ্গে বেশি সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ওকে তো তুমি চেনো!”
যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলো নিখিল। আকুতি জানিয়ে মায়ের হাত চেপে ধরলো। সহসা নাজিয়া কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। কেমন নিষ্প্রাণ, নিষ্প্রভ কণ্ঠে শুধালেন,
— “ওর ডিভোর্স কেন হলো?”
— “বনিবনা হয় নি। ছেলেটা ভালো ছিল না। ফালতু—”
বলতে বলতেই মায়ের চোখের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল নাজিয়ার কঠিন মুখখানি। তিনি তীব্র রোষের সহিত ধমকে উঠলেন তিনি,
— “আবার কথা লুকোচ্ছিস!”
— “চারুর কখনো বাচ্চা হবে না, মা। শি ইজ অ্যান ইনফার্টেইল উম্যান।”
বলেই দু’ হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লো। নাজিয়ার বিস্ময়ের পারদ বাড়লো। নিশ্চল পাথরের মত বসে রইলেন তিনি। ঠিক যেন মূর্তি!
কিয়ৎক্ষণ পর হঠাৎ নিখিলকে উত্তেজিত দেখালো। অস্থির চিত্তে সে মায়ের হাত ধরে ঝাঁকালো,
— “আমি সবকিছুই মেনে নিয়েছি, আম্মি। তুমিও প্লিজ মেনে নাও। অমত করো না। চারুকে আমি কথা দিয়েছি। ওকে ভালোবাসি আমি! প্লিজ!”
যান্ত্রিক শোনালো তাঁর কণ্ঠটা,
— “সবকিছু জেনে শুনেও?”
— “হ্যাঁ, মা। সবকিছু জেনেই আমি ভালোবেসেছি ওকে। প্লিজ, এই বিয়েতে তুমি রাজি হও। তুমি মত না দিলে তো আমি ওকে বিয়ে করতে পারবো না। আমার কথা মিথ্যে হয়ে যাবে। তোমার ছেলে মিথ্যেবাদী প্রমাণিত হবে, আম্মি!”
— “কিন্তু ও যে বন্ধ্যা? ওকে বিয়ে করলে তুই যে কোনদিন বাবা হতে পারবি না, বাপ! এই সত্য তুই কি করে—”
তাকে আর বলতে দিলো না নিখিল। আচানক ওর ভেতর থেকে সব দ্বিধার দেয়াল অদৃশ্য হয়ে গেল। সুস্পষ্ট, সুদৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করলো সে তার অভিমত,
— “আমি ওকে ভালোবাসি, আম্মি। এরচেয়ে বড় সত্য আমার কাছে নেই!”
নাজিয়া বিমর্ষ মুখে মাথা নাড়লেন। সায় দিয়ে বললেন,
— “ঠিক আছে। তোর যা ইচ্ছা। তোরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো!”
খুশিতে জ্বলজ্বলে হলো ওর চেহারা। প্রবল আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরলো সে।
___
চলতি মাস শেষের দিকে। এসময় নিখিল ছুটি নিতে পারবে না। সবার সঙ্গে কথা বলে তাই ঠিক হলো, পরবর্তী মাসের দুই তারিখে নিখিলরা তাদের দু’ একজন নিকটাত্মীয় সহ আংটি বদল করিয়ে আসবে চারুর।
দেখতে দেখতেই দিনগুলো কেটে গেল। নির্ধারিত দিনে আংটি বদল হয়ে গেল চারু-নিখিলের। সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো সবকিছু। বিয়ের দিন ঠিক হলো এর পনেরোদিন পর। খবরটা শুনবার পর থেকেই লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না চারু। ইসস , এতো লজ্জা কেন লাগছে?
সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের পর আজ ওরা এ বাড়িতেই থেকে গেছে। আশেপাশে কোথাও তো নিখিলদের আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। নিখিলরাও সবাই ঢাকাতেই সেটেল। তাই রাতটা অরুণা ম্যানশনেই থাকতে হলো। যদিও ওরা চেয়েছিল হোটেলে উঠতে; কিন্তু রাজি হন নি আজমীর রাজা। তারা থাকতে তাদের মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষজন হোটেলে কেন উঠবে!
ওদিকে নিখিল সাহেব অধৈর্য হয়ে বসে! বারংবার কল দিয়ে যাচ্ছে চারুকে; তার প্রিয়তমাকে; হবু স্ত্রীকে! টেক্সট দিচ্ছে; ডাকছে ছাদে যেতে। চারু লজ্জায় উত্তর পাঠাতে পারছে না। ছাদে যাওয়া তো বহুৎ দূর কি বাত্!
সে জানে কিছু বললেই নিখিল শুরু করে দেবে বদমাইশি। উল্টোপাল্টা বলে বলে ওকে লজ্জার চূড়ান্তে পৌঁছে দেবে! যা লাগামছাড়া হয়েছে সে আজকাল! না বাবা, চারু আজ কারো কলই তুলবে না। কারো টেক্সটের রিপ্লাই লিখবে না!
ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিলো চারু। কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো দ্রুতই। ঘুমের মাঝে সে একটা স্বপ্নও দেখলো। ঝলমলে সুন্দর এক স্বর্ণালী সন্ধ্যায় তার আর নিখিলের বিয়ের দৃশ্য। ভারী সুন্দর সেই স্বপ্ন; অথচ ঘুমের মাঝেই চারুর ভয়ে বুক কাঁপতে লাগলো। শরীর ঘামে ভিজে গেল। দেখলো, শরীরে লাল টুকটুকে বেনারসি নিয়ে বসে থাকা স্বপ্নের চারুর সামনে কাজী এসে হাজির হয়েছেন। তার বাড়িয়ে দেয়া রেজিস্ট্রি খাতায় সই করতে বলা হয়েছে ওকে। চারু কলম তুলেছে সাক্ষর করতে, অথচ কি আশ্চর্য! কলমটা থেকে কালি বেরোচ্ছে না। চারু কম্পিত হস্তে কাগজের উপরে ঘষতে লাগলো সেটাকে, হঠাৎ কালো কলম থেকে বেরোল লাল রং। ফিনিক দিয়ে একগাদা রং বেরোল, বেরোতেই লাগলো অবিরাম। দেখতে দেখতেই রক্তের মতো লাল সে তরলে ভেসে গেল ওর বিয়ের রেজিস্ট্রি কাগজখানা!
চারুর সই করা আর হলো না!
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_৩২
মাসখানেক ধরে বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগছে মাহতাব। রোজ সকালে অফিসে যাচ্ছে গভীর রাত করে ফিরছে। আবার কোনো কোনো দিন হুট করে বলছে, অফিস যাবে না; কিংবা সকালে গিয়েই দুপুর হতে না হতেই বাড়ি ফিরে আসছে। মেজাজ সারাক্ষণ থাকছে খিটখিটে। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবার উপায় নেই। ভুলবশত কিছু বলে ফেললেও শুরু করছে চিৎকার চেঁচামেচি। সমস্যাটা আসলে কি কেউ বুঝতে পারছে না!
খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম করছে। এর দরুণ ক’দিন আগেই পোহাতে হলো। মারাত্মক জন্ডিস হয়েছিল বেচারার। প্রায় দশ-পনেরো দিন একদম বেড রেস্টে ছিল। পুরো পরিবারের সবাই মিলে তখন ওর সেবা করেছে। নিজে গর্ভবতী হয়ে মাহিয়া নিজে হাতে ওর সব করেছে। কতো যত্ন, কতো আদর! অথচ এতকিছুর মধ্যেও বেচারা কিছুতেই স্বস্তি পেল না। কঠিন মর্মবেদনায় কাটতে লাগলো তার দুর্বিষহ দিন!
_______
ইদানিং নিজেকে খুব একা একা লাগে সৌভিকের। বহুদিন হলো পরিবার ছেড়ে এই দূর পরবাসের বাসিন্দা হয়েছে সে। একা থাকার অভ্যাসটা হওয়ার কথা অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এতদিনেও যেন তা হয়ে ওঠে নি। সারাদিন অফিসের কাজ, কাজের ফাঁকে ভাইয়ের মতো বন্ধুর সাথে কাটত সময়। উইকেন্ডে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে হ্যাং আউটে যাওয়া, হুটহাট পাওয়া ছুটিতে ট্যুর দেয়া — বিন্দাস ব্যাচেলর লাইফটা নিয়ে ভীষণ খুশিই ছিল সৌভিক। কিন্তু আস্তে আস্তে ওর আনন্দগুলো ফিকে হয়ে যেতে লাগলো। বন্ধুবান্ধবদের অধিকাংশই বিয়ে করে সংসারী হয়ে গেল। আগের মত প্রত্যেক ছুটিতে টিএসসিতে আড্ডা জমানো, মাসে মাসে গেট টুগেদার করা, হৈচৈ করে ট্যুরে যাওয়া, বন্ধ হয়ে গেল। নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই। কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়ে বিদেশ অবধি চলে গেল!
সবাই সব পেল, সংসার, একটা নিজস্ব মানুষ, ভালো চাকরী, ভালো জীবন ব্যবস্থা — কিন্তু কি পেল সৌভিক? প্রায়শই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খায়। তার আসলে কি আছে? না আছে প্রেমিকা, না আছে বৌ। নিজের কথাগুলো বলবার, নিজের সময়গুলো কাটানোর সঙ্গী যেন কেউই নেই ওর কাছে। আগে নিখিল ছিল। কিন্তু আজকাল সেও যেন নেই। চারুর সঙ্গে প্রেম হবার পর থেকেই ওর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল। নিখিলও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আংটি বদলের পর সেই ব্যস্ততা যেন বহু গুণে বেড়েছে ওর। বিয়ের প্রস্তুতি, শপিং ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কাজ তার। এখন আর রোজ সৌভিকের সঙ্গে আড্ডা দেবার মতো পর্যাপ্ত সময় কই?
সৌভিক অবুঝ নয়। জানে সব, বোঝেও। জগতে কেউ কারো নয়। বন্ধু-বান্ধব সে যতোই কাছের হোক, আত্মার বন্ধন থাকুক, একসময় দূরত্ব সৃষ্টি হয়ই। এই নিয়ম কেউ খন্ডাতে পারে না। অন্য সব বন্ধুর মত নিখিলও এখন বিয়ে করবে, নিজের সংসার গড়বে। একসময়ে তাই নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এই তো নিয়ম!
কিন্তু সৌভিক? সে কি করবে? প্রেম? তার কি প্রেম করার সুযোগ আছে? না আছে সেই মানসিকতা? আর বিয়ে? হুট করে একটা অচেনা-অজানা মেয়েকে বিয়ে করে নিজের সহধর্মিণীর অধিকার দিতে পারবে তো সে?
— “কি রে, কি এতো ভাবছিস?”
চটকা ভাঙলো নিখিলের কথায়। সৌভিক একটু অপ্রস্তুত হলো,
— “কিছু না। তোর কাজ হলো?”
— “হুঁ। এইতো।”
হাতের ফাইলগুলো গুছিয়ে রাখতে শুরু করলো নিখিল। গত আধা ঘণ্টা যাবৎ নিখিলের ডেস্কের সামনেই বসে ছিল সৌভিক। আজ তার কাজ আগেই হয়ে গেছে। এসেছিল বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু নিখিলের তখনও কাজ বাকি। তাই সেখানেই বসে অপেক্ষা করছিল। অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই কখন যে নিজের ভাবনায় মশগুল হয়েছিল টের পায় নি!
নিখিল আড়চোখে বন্ধুর দিকে তাকালো। ওর দৃষ্টি বাইরে, কেবিনের দরজায়। আধ খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে এই কেবিনের মুখোমুখি যে রুমটা সেটার দরজা দেখা যায়। ওই রুমটায় আগে আনিকা বসত। দু’ জন সহকর্মীর সঙ্গে। কেবিনের দরজা খুললে সর্বপ্রথম ওর ডেস্কটাই নজরে পড়ে। যদিও আনিকার ট্রান্সফারের পর থেকেই ওই ডেস্ক ফাঁকা; তবুও! সৌভিকের দৃষ্টি ঠিক সেখানটায় বুঝতে পেরে নিখিল হাসলো। দুষ্টুমির স্বরে বলল,
— “কি অতো দেখছিস ওই ফাঁকা ডেস্কে? কি আছে ওখানে?”
বলেই মুখ টিপে হাসতে লাগলো। সৌভিক ফিরে তাকালো না। ওর মজা করার দূরভিসন্ধি টের পেয়েও নির্বিকার রইলো। ফাঁকা ডেস্কটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে খুব শান্ত গলায় উচ্চারণ করলো,
— “ইদানিং কেন যেন আনিকাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে আমার। জানতে ইচ্ছে করে, কি করে মেয়েটা। কেমন আছে? মেয়েটাকে খুব মিস করি রে!”
— “লক্ষণ তো ভালো নয়। প্রেমে-ট্রেমে পড়লি নাকি?”
ভ্রু নাচিয়ে বললো। সৌভিকের আনমনা উত্তর,
— “কি জানি! হতেও পারে!”
সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো নিখিল,
— “আরে! তুই তো তাহলে পাক্কা প্রেমে পড়েছিস!”
সৌভিক হেসে মাথা নামিয়ে নিলো। কিঞ্চিৎ লজ্জা লাগছে তার। নিখিল উচ্ছ্বসিত হলো,
— “তো, তারপর? প্রেমে যখন পড়লি, উঠবার ব্যবস্থা করবি না? প্রপোজ?”
— “না।”
দু’ পাশে মাথা নেরে অসম্মতি জানাতেই ও অবাক হয়ে তাকালো,
— “সে কি? কেন?”
— “একবারে বিয়ে করে ফেলবো!”
নিখিল কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে। সৌভিক মুখ তুললে চোখে চোখ পড়তেই একসঙ্গে হেসে ফেললো দু’জনে!
_____
অনুর মেজাজটা আজ অত্যধিক খারাপ। নানা কারণে খিঁচড়ে আছে। গত দুদিন ধরে ওর শ্বশুর বাড়িতে নেই। জরুরি কাজে গ্রামে গিয়েছেন। বুড়ো মানুষ, একা যাবেন? সঙ্গে শাশুড়িও গিয়েছেন। এখন ওরা দুই জা আছে শুধু। বাড়ির পুরুষেরা তো হামেশার মতো ব্যস্ত তাদের অফিস নিয়ে!
দু’জনেই অসুস্থ। গর্ভবতী। দুজনেরই যত্ন দরকার। এসময় কি একা ফেলে রাখা যায়? সেজন্য মাহতাব একজন সার্বক্ষণিক কাজের লোক রেখেছে বাড়িতে। বলা বাহুল্য, সেই কাজের মহিলাটিকে আগেই দখল করে নিয়েছে মাহিয়া। অবশ্য দখল করবেই বা না কেন? তার স্বামী বেতন দিচ্ছে; তারই তো সেবা পাওয়া উচিৎ, তাই না?
অনুর এই নিয়েও ক্ষোভ আছে। জায়ের বাচ্চা হবে জন্য তার স্বামী একটা স্পেশাল কাজের মেয়ে রেখে দিলো, আর এদিকে মাহাদ? কি করলো সে? কাজের মেয়ে না রাখতে পারুক, দুটো দিন অফিস থেকে ছুটি নিলে কি হতো?
রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো অনু। একই বাড়ি, একই অবস্থান দুজনের। অথচ একজন আট মাসের উঁচু পেট নিয়ে নিজের ঘরে শুয়ে আরাম করছে, আর অন্যজন ছ’ মাসের গর্ভবতী হয়েও রান্নাঘরে। এক কাপ চা বানিয়ে দেয়ার মত মানুষ নেই!
এরমধ্যেই ফুলির মাকে আসতে দেখা গেল। ওদের দেখাশুনার জন্য ফুলির মাকে রেখে যাওয়া হয়েছে। অথচ সকালবেলা নাশতার সময়ে অনু গিয়ে দেখল, ফুলির মা ঘরে নেই। এমনকি বাড়িতেই নেই!
রাগ করে তাকালো সে,
— “সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলে ফুলির মা?”
— “পান খাইতে গেছিলাম, ভাবী। পান খাইতে! আপনেরা তো পান খান না। কিন্তুক আমার আবার এইটা ছাড়া চলে না। সকাল বেলা এক খিলি পান না খাইলে শরীলডা ভালা ঠেহে না।…”
— “হয়েছে। হয়েছে। এখন চা বানাও তো। মাথা ধরেছে খুব। কড়া লিকারের চা করো।”
বলেই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আবার আগের ভাবনা নিয়ে বিড়বিড় করতে শুরু করলো। সেই বিড়বিড় কথা শুরু হলো মাহিয়াকে গাল দিয়ে আর শেষ হলো ফুলির মাকে নিয়ে। ফুলির মা সবই শুনলো, কিন্তু তার কোনো বিকার হলো না। সে আপনমনে কাজ করতে লাগলো। অনুকে সে ভালো চোখে দেখে না। তার হিসেবে এই মাইয়া পাগল, আর পাগলের কোনো হুশ জ্ঞান নাই। তাদের কথায় জিন্দা পীরের আওলাদ ফুলির মা কিছু মনে করে না!
কিন্তু অনুর রাগটা কমলো না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। ওর রাগটা কমার বদলে আরও বেড়ে গেল। হুরহুর করে! যখন দেখলো দুপুরের খাওয়াও মাহিয়া দোতলায় নিজের ঘরে বসে খেল!
প্রায় অনেকদিন হয়ে গেছে রান্নাঘরে আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে মাহিয়া। রোজ রান্নার সময় এলেই যতো বাহানা! মাথায় ব্যথা, পেটে ব্যথা, পায়ে ব্যথা — নড়তে পারে না। এই যে এখন বাড়িতে কেউ নেই, এখনো সে এলো না রান্নাঘরে। কাজ না করুক, উঁকি তো দিবে?
কিন্তু সে কিছুই করবে না। মাহতাবের ঠিক করে দেয়া কাজের মেয়ে, হাফসাকে সাথে নিয়ে সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে। হয় গা টিপে নিচ্ছে নয় তো পা! একটা মানুষ এতো খারাপ কেন? অনুর রাগ তুঙ্গে চড়লো। সে ডাইন ইনে বসে একা খাচ্ছে, ফুলির মা নিচে বসে; হাফসা এসে মাহিয়ার খাবার নিয়ে গেল। খাবার সেরে গুছাচ্ছে সবকিছু, হাফসা এসে প্লেট জমা দিয়ে গেল সিংকে! সেই এঁটো প্লেটটা দেখে এত রাগ হলো অনুর!
এতটাই ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লো যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সে। প্রচণ্ড রাগে অন্ধ হয়ে একটি ভয়াবহ অপরাধ করতেও তার হাত কাঁপলো না। সব কিছু গুছিয়ে হাফসা আর ফুলির মা যে যার ঘরে চলে গেল। মাহিয়া তখন খেয়েদেয়ে ঘুমোচ্ছে। সেও এলো নিজের ঘরের দিকে। ভাতঘুম দিবে বলে। কিন্তু তার আগে সবার অলক্ষ্যে একগাদা তেল এনে ঢেলে দিলো মাহিয়ার ঘরের দরজার সামনে। ওর দরজার কাছেই সিঁড়ি। পোর্চের সেই অংশটায় তেল ঢালতে ঢালতে এনে দিলো সিঁড়ি অবধি! যেন পা পড়বা মাত্রই পিছলিয়ে পড়ে যায় নিচে, আর ঘটে কোনো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা!
নিজের কুটিল পরিকল্পনার কথা ভেবে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল অনুর ঠোঁটে। খালি বোতল নিয়ে নিজের ঘরে ফিরতে ফিরতে সে বিড়বিড় করলো,
— “এবার দেখাবো মজা! ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে মহারানীর আরাম, তাই না? এবার বেরোবে সব!”
ঘরে এসে দোর দিলো অনু। তারপর বিছানায় শুয়েই এক লম্বা ঘুম!
অনুর সেই ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যায়। মাহিয়ার আর্তচিৎকার শুনে। হুট করে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সবকিছু ভুলে গিয়েছিল সে। হঠাৎ চিৎকারে ভয় পেয়ে গেল। দরজা খুলে হুড়মুড় করে করিডোরে আসতেই দেখতে পেল ঘটনা ঘটে গিয়েছে! তেলের বারান্দায় ফেলে রাখা তেলে পা পিছলে পড়ে গিয়েছে মাহিয়া, সিঁড়িতে চক্কর খাচ্ছে। চোখের পলকেই সিঁড়ির একেবারে নিচে পরে গেল সে। একটা প্রচণ্ড চিৎকার দিয়ে হঠাৎই থেমে গেল ঘূর্ণন, নিথর হয়ে রইলো তার অসুস্থ শরীরটা। লাল রক্তে ভেসে যেতে লাগলো সবকিছু!
এই কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে ওর খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু অনু খুশি হতে পারলো না। চোখের সামনে এমন বিভৎস দৃশ্য দেখে কেই বা খুশি হিরে পারে? একমুহূর্তের জন্য সব ভুলে গেল অনু। এগোতে চাইলো মাহিয়ার সাহায্যের জন্য। কিন্তু পা বাড়াতে গিয়েই, সামনের তেল নজরে পড়লো ওর। এগোতে পারলো না। ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
— “ফুলির মা! হাফসা! কে কোথায় আছো! ভাবী!”
ততক্ষণে ফুলির মা, হাফসা সবাই ছুটে এসেছে। নিথর হয়ে পরে থাকা মাহিয়াকে নিয়ে এরমধ্যেই হৈ-চৈ শুরু হয়ে গেছে। ঘটনাক্রমে সেই সময়ই বাড়িতে প্রবেশ করেছিল মাহাদ। চেঁচামেচি শুনে ছুটে এলো সিঁড়ির গোড়ায়,
— “কি হয়েছে?”
— “সিঁড়ি থেইকা পইড়া গেছে!”
কয়েক পল হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকল সে। তারপর সম্বিৎ ফিরতেই মাহিয়াকে ডাকতে শুরু করলো। জাগানোর চেষ্টা করলো। অনু উপর থেকে শুনতে পেল ওর কণ্ঠ। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তেলের পাশে দাড়িয়ে, কোনোমতে উঁকি দিলো,
— “মাহাদ? ভাবী—ভাবী—”
মুখ তুলে তাকালো মাহাদ। ওর ঘামে ভেজা মুখটায় অজস্র এলোমেলো দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পেল অনু। বলবার চেষ্টা করলো,
— “ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমি—আমি—”
— “হ্যাঁ। নিচ্ছি। নিচ্ছি। তুমি নেমো না, অনু। কিছু একটা হয়ে গেলে—”
অনু নামলো না। তবে উল্টো ঘুরে দ্রুত নিজের ঘরে ছুটে যেতে যেতে জানালো,
— “অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি আমি—”
…
…
রাতের বেলা। নিজের ঘরে থ হয়ে বসে আছে অনু। মনে মনে ভাবছে সন্ধ্যার কথাটা। বাড়িতে এখন কেউ নেই। সবাই হসপিটালে ছুটছে। তখন মাহাদই মাহিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। ওকে নিচে নামতে নিষেধ করে। ওরা তিনজন আড়াল হতেই; সেও দ্রুত ন্যাকড়া এনে তেলগুলো মুছে ফেলে। একটা ভয়াবহ পাপ সে করে ফেলেছে ভেবেই চুপসে গেছে সে। তখন থেকে একলা ঘরে বসে আছে আর ভাবছে। কি হয়ে গেল?
ফোনে খোঁজ নিয়েছিল। অসংখ্যবার কল করা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। মাহাদ একবার রিসিভ করেছে। বলেছে, মাহিয়ার অপারেশন করানো হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চাটাকে নাকি বাঁচানো যায় নি। মারা গেছে মাহতাব-মাহিয়ার ছেলেটা!
খবরটা শুনেই বুকে কামড় পড়েছে অনুর। তার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেই তখন থেকেই। এ কি করল সে? রাগের মাথায়, কি ভয়ংকর অপরাধ করে ফেললো? কি করে কেড়ে নিলো একটা নিষ্পাপ প্রাণকে?
অনুশোচনায় অন্তর পুড়তে লাগলো অনুর। হঠাৎ নিজেকে খুব পাগল পাগল লাগলো। আচ্ছা, সে যেমন করলো এরকম যদি মাহিয়াও ওর সঙ্গে করে? প্রতিশোধ নেয়? তবে? ওর বাচ্চাটা? মেঝেতে বসে নিজের চুল ছিঁড়তে লাগলো অনু। উন্মাদিনীর মতো শুরু করলো চিৎকার! এ কি করলো সে? এখন কি হবে?
একটা দশ। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরলো মাহাদ। সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে আজ! সারাদিন অফিস, তারপর সন্ধ্যায় হসপিটাল, শেষমেষ থানা — উফ্! কি অবস্থা!
স্ত্রীর খবর পেয়েই হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিল মাহতাব। মাহিয়া যখন অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, তখনই সেখানে হঠাৎ পুলিশ গিয়ে পৌঁছলো। কোনোকিছু বুঝে ওঠবার আগেই হ্যান্ড কাপ পরিয়ে থানায় নিয়ে গেল মাহতাবকে! তার বিরুদ্ধে গ্রেফতার ওয়ারেন্ট আছে, সরকারি কাজে দুর্নীতির দায়ে। কথাটা শুনেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছিল মাহাদের। এমনটা হওয়ার আশঙ্কা সে অনেক আগে থেকেই করতো। কিন্তু আজকের দিনেই তা হবে কে জানত?
হাসপাতালের অবস্থা কিছুটা সামলে নিয়েই সে ছুটেছিল থানায়। সেখানেই বাকি খবর শুনলো। দুদক কর্তৃক প্রায় একমাস আগেই নোটিশ দেয়া হয়েছিল মাহ্তাবকে। নিজের আয়, ব্যয় এবং সমস্ত সম্পত্তির হিসেব চাওয়া হয়েছিল। সময় পেরিয়ে গেলেও মাহতাব কোনোকিছুর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে নি। মামলা হয়েছে তাই ওর বিরুদ্ধে!
ভাইয়ের এই পরিণতির কথা ভালোই জানতো মাহাদ। একটুও অবাক হয় নি। কেবল কষ্ট পেয়েছে এই ভেবে, স্ত্রীর কঠিন দুঃসময়ে মাহতাব তার পাশে থাকতে পারছে না। যখন স্ত্রী মৃত বাচ্চা প্রসব করে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে তখন তার পাশে থেকে সাহস জোগাতে পারছে না! হাহ্, দীর্ঘশ্বাস!
সিঁড়ি পেরিয়ে বারান্দায় আসতেই হঠাৎ পায়ে কি যেন ঠেকল ওর। একেবারই পাত্তা না দিয়ে এগোতে চাইলো কিন্তু কি যেন ভেবে থেমে গেল হঠাৎ। পিছু ফিরে আবার হাঁটলো সেই জায়গায়। পায়ের তলায় চ্যাটচ্যাটে লাগছে কি যেন! কি আশ্চর্য! মাহাদ ভ্রু কুঁচকে আশেপাশে পা দিয়ে দেখল, পুরো জায়গাটাতেই কেমন চ্যাটচ্যাটে ভাব। কিছু ফেলেছিল নাকি? সন্দেহে কপালে ভাঁজ পড়ল ওর। কয়েক পা এগিয়ে নিজের ঘরে ঢুকতেই আরও অবাক হলো। মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে অনু। মাথার চুল এলোমেলো, মুখখানি একেবারে বিধ্বস্ত। অবসন্ন দেহ নিয়েও মাহাদ ছুটে এলো প্রিয়তমার কাছে,
— “তুমি ঠিক আছো, অনু?”
— “তুমি যাই বলো মা, আপার এসব কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না। কোথাকার কার সঙ্গে কি করছে — শেষকালে আমাদের পরিবারের মান সম্মান না ডুবায়!”
ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো অনু। সহসা কি বলবেন ভেবে পেলেন না চমক। মিনমিন করেই বললেন,
— “চারুর উপর আমার আস্থা আছে। ওকে চিনিস না? এরকম কিছু ও কেন করবে!”
— “কেন করবে? মানুষ বদলায়, মা। আপা বদলেছে। তুমি খেয়াল করো নি? আগে সারাদিন মনমরা থাকতো। এখন কিন্তু তেমন থাকে না। বরং সারাক্ষণ কানে ফোন থাকে। গুজুর-গুজুর করে কার সাথে— ”
— “সে তো বন্ধুও হতে পারে। ও বদলেছে আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এতে খুশিই তো হওয়া উচিৎ, না? এতোদিন ধরে মেয়েটা মনের মধ্যে দুঃখ পুষে আছে— কারো সঙ্গে মিশে হাল্কা হতে পারা তো ভালো কথা।”
মায়ের সহজ-সরল যুক্তির বিপরীতে তেঁতে উঠলো অনু,
— “তোমরা কেন বিষয়টা এতো হেলা করে দেখছ, বলবে? ওর কথাবার্তা দেখেই তো আমি বুঝেছি ওটা বন্ধুত্ব নয়। একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে তোমার মেয়ে। শুধু ছেলে নয়, ছেলের চোদ্দো গুষ্ঠির সঙ্গে উনি ভাব জমিয়েছেন; আমি নিজ কানে শুনেছি। একবার না, বহুবার!”
চমক চুপ করে থাকলেন। চারু প্রেম করছে? ও কি তেমন মেয়ে? অবিশ্বাস্য!
তবুও তিনি আত্মজাকে বুঝালেন,
— “আচ্ছা, আমি দেখবো সেটা। তুই চিন্তা করিস না। এ-সময় এমন প্রেশার নেয়া ঠিক না। বাচ্চার ক্ষতি হবে। তুই যা, মাহাদ বোধ হয় তৈরি হয়ে এসেছে।”
সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অনু তার কথার ধারে কাছেও গেল না। সে তার কথায় অটল,
— “না, মা। এখানে কিন্তু আমাদের সম্মান মিশে আছে। আপার হাবভাব ভালো না। আর ও যার সাথে প্রেম করছে, সে কে? কোনো পরিচয় জানো? আজেবাজে কেউ হলে? ফাঁদে ফেলে বাড়ির সম্মান— আচ্ছা বাদ দাও সে কথা। ও প্রেম করছে, শাশুড়ি পাতাচ্ছে; ওরা সবাই ওর অতীত জানে? ওর আগে বিয়ে হয়েছিল, বাচ্চা হবে না কোনোদিন — এসব শুনে কে ঘরে তুলবে ওকে?”
— “অনু!”
মেয়ের আজেবাজে কথা আর সহ্য হলনা তার। চিৎকার করে উঠলেন হঠাৎ। অনু কিন্তু দমলো না মোটেও, তার রোখ চেপেছে,
— “হ্যাঁ, এখন তো ধমকাবেই! আমি যখন মাহাদের সঙ্গে প্রেম করতাম, তখন কি করেছিলে মনে আছে? রাগারাগি, মারামারি — কতো কি! মাহাদ তো বিয়ে করেছে আমাকে, ওকে করবে কে? কিন্তু সেসব তোমাদের মাথায় নেই। থাকবে কি করে! বড় মেয়ে, আদরের দুলালী যে প্রেমের নামে নষ্টামি—”
— “চুপ করো, মেয়ে। এই বয়সে এসে তোমার গায়ে হাত তুলতে বাধ্য কর না আমাকে! চলে যাও!”
প্রচন্ড ধমক লাগালেন চমক। অনুও তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
— “যাচ্ছি। যাবই তো। আমি কি থাকতে এসেছি নাকি! একবারে চলে যাচ্ছি!”
হনহন করে বেরিয়ে গেল সে। বাইরে লন সাইডে লাগেজ হাতে দাড়িয়ে ছিল মাহাদ। ফোন স্ক্রোল করছিল একা একা। রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো অনু, প্রায় ধমকেই উঠলো,
— “চলো এই বাড়ি থেকে!”
মাহাদকে কিছু বলতে না দিয়েই টেনে নিয়ে গেল একদম!
দেয়ালের অপর প্রান্তে দাড়িয়ে ছিল রিংকু-টিংকু। এতক্ষণে মা-মেয়ের মধ্যে সমস্ত আলোচনাই ওদের কানে এসেছে। যদিও সেটা ইচ্ছাকৃত ছিল না। দু’ ভাই ঝগড়া করছিল কিছু নিয়ে। একপর্যায়ে টিংকুর চুল ছিঁড়ে দিয়ে দৌড়ে এসে বড়মার ঘরের কাছে এসে লুকিয়ে ছিল রিংকু। টিংকুও ছুটে এসেছে মারতে কিন্তু বদ্ধ কক্ষের ভেতর থেকে ছিটকে আসা কয়েকটা শব্দ শুনেই দাড়িয়ে গেল দুই ভাই। কৌতুহল বশতই নিশ্চুপে দাড়িয়ে শুনলো বাকিসব!
অনুর প্রস্থান দেখে তীব্র বিরক্তি নিয়ে মন্তব্য করলো রিংকু,
— “দেখলি, ভাই? কুটনিটার কাণ্ড?”
— “কোনদিন ভালো হবে না ওর,দেখিস! বড়’পার সঙ্গে যে কীসের এতো হিংসে ওর; আল্লাহ্ মালুম!”
প্রবল ক্রোধ নিয়ে বললো টিংকু। পরক্ষণেই সহোদরের কথায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো কপালে,
— “কিন্তু কি হবে এখন? বড়ম্মুর কান ভাঙানি দিলো যে— নিখিল ভাই, চারু আপার বিয়ে ঠিকঠাক হবে তো!”
একটুপর চমকও বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। মেয়েদের তিনি সমানভাবে ভালোবাসেন, ভালো বেসে এসেছেন। তবুও ছোট কন্যাটি সর্বদা নিজেকে কেন আলাদা চোখে দেখে তিনি বুঝতে পারেন না। মেয়েটার ধারণা ওর পরিবার ওকে ভালোবাসে না, সব ভালোবাসা বড় বোনের জন্য! অথচ বাস্তবতা একদমই এমন নয়!
অদ্ভুত কারণে ছোটবেলা থেকেই চারুর প্রতি ওর বিদ্বেষ-রেষারেষি। চারু অবশ্য বরাবরই ছাড় দিয়ে এসেছে। চমক বুঝালে সবসময়ই বুঝদারের মতো মায়ের মত সুর করে বলতো, ‘আমি বুঝি, মা। আমি বড়। ও ছোট জন্যই এমন করে! বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।’
অনু এখন আর ছোট নেই। বড় হয়ে গেছে। তবুও ঠিক হয়ে যায় নি কিছুই। বোনের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ যেন বৃদ্ধি পেয়েছে আর বেশি করে!
___
আনিকার হাতে রিজাইন লেটার। সেটা ব্রাঞ্চের হেড তথা ম্যানেজিং ডিরক্টরের কাছে জমা দেয়ার কথা। তিনি অফিসে নেই। পিএস জানিয়েছে তাঁর ফিরতে দেরি হবে। আনিকা যেন অপেক্ষা না করে কাজে মন দেয়। স্যার এলে জানিয়ে দেবে ওকে। আনিকা মনে মনে তাচ্ছিল্য করেছে নিজেকে। কীসের কাজে মন দেবে সে? চাকরীই যখন করছে না — মেয়েটা অবশ্য জানে না সে কথা। আনিকা ঘড়ি দেখলো। এগারোটা চুয়ান্ন বাজছে। ডিরেক্টর স্যার আসছেন না কেন?
আনিকা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। এমডি সাহেব এলেন না। অগত্যা বিমর্ষ মন নিয়ে নিজের কেবিনে ফিরলো। দু’টো ফাইল দেখতে না দেখতেই লাঞ্চ আওয়ার হয়ে এলো। আনিকা ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবার আগে একবার উঁকি দিলো সৌভিকের কেবিনে। সৌভিকও নেই।
ক্যান্টিনে এসে কর্ণারের সিটটা দখল করলো আনিকা। অর্ডার দিলো চা-সিঙ্গারার। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রিজাইন লেটারটা বের করে ভাঁজ খুললো। ভুল-ত্রুটি আছে কিনা দেখতে হবে। তাই পুনরায় চোখ বুলিয়ে নেয়া!
অর্ডার চলে এসেছে। ট্রে থেকে কাপ-পিরিচ নামিয়ে দিয়ে ছেলেটা চলে গেল। আনিকা ধীরে-সুস্থে কাপটা ঠোঁটের কাছে নিয়েছে যবে তখনই চেয়ার টানার শব্দ হলো। হুড়মুড় করে সামনে এসে বসে পড়লো সৌভিক। চমকিত আনিকার কাপ ছলকে চা ছিটকে পড়লো, ঠোঁটও পুড়ল বোধ হয়!
— “উফ্! কী অবস্থা দেখুন! আপনার সঙ্গে থাকতে থাকতে আপনার মতোই দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে—”
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। কাপটা টেবিলে রেখে টিস্যু চেপে ধরলো মুখে। তার বুক ধড়ফড় করছে। নার্ভাস লাগছে খুব। এমনটা সবসময়ই হয়। এক খেয়ালে মগ্ন থাকতে থাকতে হুট করে কেউ চলে এলেই! সৌভিকের সামনে যেন একটু বেশিই হয়। ফলশ্রুতিতে ভুলভাল, উদ্ভট কিছু করে বসে সে। আর লোকটা বিরক্ত হয়!
সৌভিক এবারো বিরক্ত হলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— “চা ফেললেন কি করে? মুখ পুড়ালেন নাকি?”
— “খুব গরম ছিল চা’টা।”
সৌভিকের কুঞ্চিত ভ্রূ সোজা হলো না। বরং আরো সূক্ষ্ম কয়েকটা ভাঁজ পড়লো। টেবিলে রাখা কাগজটার দিকে ইশারা করে বললো,
— “ওটা কি?”
— “এমনই কাগজ। তেমন কিছুই না।”
— “ওহ্।”
মুখ ঘুরিয়ে, স্বাভাবিকের চেয়ে খানিক গলা উঁচিয়ে ক্যান্টিনের মামার উদ্দেশ্যে চায়ের অর্ডার করলো। তারপর ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “তারপর কি ঠিক করলেন? কবে যাবেন মৌলভীবাজার?”
— “চাকরিটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি, স্যার। আপনি বলেছিলেন এই সেক্টরে টেকা খুব কঠিন। সত্যিই অনেক বেশি কঠিন। আমি টিকতে পারলাম না!”
লহু স্বরে বললো মেয়েটা। সৌভিক চুপ থাকলো। তার শাণিত নজর একাধারে চেয়ে থেকে পড়ে নিলো ওর চোখের ভাষা। নীরব অভিব্যক্তি। সেকেন্ড ত্রিশেক পর হঠাৎ বলে বসলো,
— “উত্তরা ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার করা হচ্ছে আপনাকে। এবার খুশি, আপনি?”
আচানক কথার মানে বুঝতে পারলো না আনিকা। হ্যাং হওয়া মস্তিষ্কে নির্বাক হয়ে বসে রইলো কেবল!
___
রাতের বেলা। সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ। অরুণা ম্যানশনের রমণীগণ এখন ব্যস্ত সব গোছগাছে। চারু টেবিল মুছছিল, চমক ঠিক তখনই এলেন ওর কাছে,
— “কাজ হলো?”
মাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো,
— “হুঁ। এইতো। তুমি রান্নাঘর গুছিয়েছ?”
— “তোর ছোটচাচী করছে এখন।”
— “ওহ্।”
হাতের কাজ সেরে ফেললো চারু। এখন ঘরে গিয়ে শো’বে। লক্ষ্য করলো, চমক এখনো যান নি। দাঁড়িয়েই আছেন। মুখ তুলতেই চারুর চোখে চোখ পড়লো। একটু অপ্রস্তুত হলেন তিনি। চারু বললো,
— “কিছু বলবে, মা?”
— “হুঁ। তোর ঘরে চল।”
মাকে সঙ্গে নিয়ে চারু দোতলায় নিজের ঘরে এলো। চমক খুব উসখুস করছিলেন শুরুতে। দোনোমনায় ভুগতে ভুগতেই একসময়ে জিজ্ঞেস করে ফেললেন। চারু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তাতে। কিন্তু অস্বীকার করলো না। মৃদু স্বরে জানালো,
— “ওঁর নাম নিখিল। সৌভিক ভাইয়ার বন্ধু। অনুর বিয়েতেই পরিচয় হয়েছে।”
— “ওই কি প্রথমে এগিয়েছিল? বিয়ের পর আর দেখা হয়েছে তোদের?”
— “উহু।”
মাথা নাড়ালো কেবল। চমক সন্দিগ্ন চোখে তাকালেন,
— “তোর সবকিছু ছেলে জানে? ওর পরিবার জানে?”
চারু নীরবে সম্মতি দিলো। হতচকিত চমক,
— “সব জেনেও? ছেলেটা সব জেনে-বুঝেও রাজী হয়েছে? ওর পরিবারের কেউ কিচ্ছু বললো না! অবিশ্বাস্য!”
অবিশ্বাস্য তো বটেই! এ সমাজে যেমন বাচ্চা হবে না নক মাহতাবের মতো উচ্চ শিক্ষিত পুরুষও আছে; তেমনই বাচ্চা হোক বা না হোক, ডিভোর্সী হোক বা অন্য কিছু, ভালোবেসে ঘর করতে, সারাজীবন পাশে থাকতে চাওয়ার মত শুদ্ধ পুরুষও আছে! নিখিল বোধ হয় তেমনই কেউ!
চারুর মুখ থেকে সব শুনে কিয়ৎকাল নিঃস্তব্ধ থাকলেন চমক। অতঃপর মেয়ের হাত ধরে কোমল গলায় বললেন,
— “ছেলেটাকে বল প্রস্তাব পাঠাতে। দুই পরিবার কথা বলি, খোঁজ-খবর নেই। সবকিছু মিলে গেলে বিয়েটা জলদিই দিয়ে দেব। তোর পরিবার কি তোর খারাপ চায়? দেরি করিস না।”
চারু খুশি হয়ে সায় দিলো,
— “আচ্ছা, মা। আমি বলবো।”
মেয়ের কপালে চুমো খেয়ে বিদায় নিলেন চমক। সকাল থেকে তার মনের ভেতর সন্দেহের পোকারা কিলবিল করছিল। অনুলেখার কথাগুলো বারবার ভাবিয়ে তুলছিল তাকে। শত হোক, মা তো! সন্তানের অমঙ্গলের কথা কি ভাবতে পারেন!
কিন্তু চারুর সঙ্গে খোলাসা করে কথা বলে ভালো লাগছে। ছেলেটা নাকি নিখিল। ওই যে, অনুর বিয়েতে সৌভিকের সঙ্গে যে এলো? তখন অবশ্য তাকে তেমনভাবে খেয়াল করা হয় নি; তবে সৌভিকের কাছের বন্ধু যেহেতু; খারাপ নয়। একটু খোঁজ নিলেই হবে। তারপরেই মনে হলো, আরে! সৌভিকের কাছে কল দিলেই তো সব জানো যাবে!
চলবে___
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_৩০
নাজিয়ার সঙ্গে কথা বলছিল চারু। এমন সময়ে ঘরের দরজায় টুকটুক শব্দ হলো। দৃষ্টি ফেরাতেই দেখলো চমক দাড়িয়ে। হাত নেড়ে ভেতরে আসতে বললো। ফোনের ওপাশে নাজিয়ার কাছে বিদায় নিতে উদ্যত হবে অমনই চমক বললেন,
— “নিখিলের সঙ্গে কথা বলছিস?”
— “ওঁর মা।”
— “তাহলে কাটছিস কেন? কথা বলা শেষ?”
— “হু.. তুমি বলবে নাকি?”
— “দিতে চাইছিস? দে!”
মুঠোফোনটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল চারু। একটু আগেই নাজিয়াও খোঁজ করছিলেন ওর মায়ের। নিখিলের কাছে শুনেছেন, চারুর পরিবার প্রস্তাব পাঠাতে বলেছে। তাই নিয়েই ওর সঙ্গে আলাপ করছিলেন আজ। কবে আসবেন এই জানতে। এরমধ্যে চমক এসে যাওয়ায় ভালোই হলো বেশ। বড়দের কথা, বড়রাই সারুক।
ফোনখানা মায়ের হস্তে সঁপে দিয়ে সে নীরবে প্রস্থান করলো। এখানে থাকা তার সমীচীন নয়, উপরন্তু থাকলে লজ্জাই পাবে। অতএব, সরে পরাই ভালো!
অল্প সময়ের মধ্যেই দু’জনের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠলো। চারুর প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত নাজিয়া বললেন,
— “চারু তো আপনার চাঁদের টুকরা মেয়ে। এতো মিষ্টি, লক্ষ্মী একটা মেয়ে। ওকে আমার ভীষণ ভালো লাগে, আপা। কবে যে মেয়েটা আমার বাড়ি আসবে!”
পুরনো স্মৃতি মনে পড়ায় হঠাৎ বিষণ্ণ হলেন চমক। মাহতাবের সঙ্গে যখন চারুর বিয়ের কথা এগোচ্ছিল, তখনো তো কতো সুন্দর করে কথা বলেছিল ওর মা। ঠিক নিখিলের মায়ের মতোই তো মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ছিলেন। কল দিলেই স্তুতি বাক্যে সন্তুষ্ট করতেন রোজ। কতো মধুর ছিল সেই আলাপ!
মনে হতেই মলিন হাসলেন তিনি,
— “এত মিষ্টি হয়ে কি লাভ! চাঁদেরও যে কলঙ্ক থাকে আপা! মেয়েটার কপালে বোধ হয় সুখ নেই—”
মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে সব মায়েরাই একটু আবেগী হয়ে ওঠেন। তাই চমকের এই আক্ষেপকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না নাজিয়া। বললেন,
— “কে বলেছে? একবার মেয়েকে আমার কাছে দিয়েই দেখুন। কথা দিচ্ছি, ও আপনার বাড়িতেও যেমন রাজকুমারী হয়ে ছিল; আমার বাড়িতেও তেমন থাকবে। বরং এখানে ওর রাজ্যে ভাগ নেই, পুরো সাম্রাজ্যই হবে ওর। মনে সন্দেহ রাখবেন না। আমার কথায় বিশ্বাস রাখুন, বোন।”
— “বিশ্বাস তো রাখতেই চাই। কিন্তু মন মানে না। জানেন তো, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়! আমাদের হয়েছে সেই দশা। মেয়েটার যদি অতীত না থাকতো তাহলে— আমরা সবই ভুলে যেতে চাই। প্রথমে তো ভেবেছিলাম মেয়েটা আর বিয়েই করবে না। কিন্তু নিখিল বাবার সঙ্গে কি করে— আপনারা একদিন বাসায় আসুন, আপা। সাক্ষাতেই কথা হবে!”
কথাগুলো এতক্ষণ খুব হালকা ভাবে নিলেও এখন আর হালকা ভাবে নেয়া গেল না। বরং বেশ কঠিন এবং জটিলই মনে হল নাজিয়ার কাছে। কি এক দুর্বোধ্য ইশারা চমকের কথায়। অতীত? কিসের অতীত? চারু কিংবা নিখিল, কিছু কি লুকিয়েছে তার কাছ থেকে?
ভাবনার সুতো ছিঁড়লেন চমক,
— “আপনি কবে আসবেন সেটা বলুন, আপা। সে অনুযায়ী আয়োজন করবো। চারুর বাপ-চাচারা তো সবসময় বাড়ি থাকে না। আগে থেকে দিনক্ষণ জানিয়ে দিলে ভালো হয়।”
— “আমি আপনাকে জানিয়ে দেব। নিখিলের সঙ্গে কথা বলে নেই একটু। কবে ছুটি পায়!”
হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে কোনোমতে বললেন তিনি। চমক সৌজন্য করে হাসলেন,
— “আচ্ছা। রাখছি তাহলে। আল্লাহ্ হাফেজ!”
— “আল্লাহ্ হাফেজ!”
কল কেটে গেল। বিস্ময়ে হতবাক, হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন নাজিয়া। তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। কি হচ্ছে কি এসব?
___
মাহতাবের নতুন ফ্ল্যাটটা কেনা হয়ে গেছে। দলিল-দস্তাবেজ করা হয়ে যাওয়ার পর আজই সবাইকে নিয়ে এসেছে মাহতাব। উদ্দেশ্য ফ্ল্যাটটা দেখানো। সব কাজ যদিও এখনো শেষ হয় নি, আরও বাকি আছে। তবে মাহিয়ার তর সইছিল না। তার আবদারেই আজ সকলকে আনা হলো।
— “ভালোই আছে ফ্ল্যাটটা, কি বলো?”
আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে হাসিমুখে মন্তব্য করলো মাহাদ। স্ত্রীর অভিমত জানতে অনুর মুখের দিকে তাকালো।
— “আছে মোটামুটিই। আহামরি কিছু না।”
— “কেন? ভালোই তো আছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত, চব্বিশ তলা ভবনের আটতলায়। পুরো ফ্ল্যাট মোজাইক করা, টাইলসের চেয়ে বেশ ভালো। এবং রুচিপূর্ণও—তবে?”
সহসা উত্তর দিতে পারলো না অনু। সে আসলে কথাটা অতশত ভেবে বলে নি। মাহতাবের কেনা ফ্ল্যাট, তাও মাহিয়ার নামে—একবাক্যে সেটাকে খারাপ বলাই তার উদ্দেশ্য। সেটা যতোই ভালো হোক!
তবুও মাহাদের প্রশ্নের জবাবে কিছু বলা উচিৎ। সে ব্যাপারটাকে সিরিয়াস করেই নিয়েছে। হঠাৎ চুপ করে গেলে বুঝে ফেলবে অনুর মনের কথা। তাই বললো,
— “আরে দেখো না, রুমগুলো কেমন এলোমেলো করা! প্ল্যান ঠিকঠাক নেই। মেইন ডোর খুলেই কার বাড়িতে কিচেন দেখা যায়? আর ঘরগুলোর সাইজ— ছোট ছোট। একটা কিং খাট ঢুকালেই রুম ব্লক…”
— “বলেছে তোমাকে! দশ বাই বারো’র রুম — তোমাকে বলেছে ছোট! বুঝি না আমি, কেন যে তোমরা ভালো জিনিসকে ভালো বলো না!”
কটাক্ষ করলো স্ত্রীকে। ধরা পড়ে গিয়ে চুপসে গেল অনু। মাহাদটা এতো বুদ্ধিমান কেন? উফ্!
দু’জনেই একা একা ঘুরছে ফ্ল্যাটে। অন্যদের মাহতাব নিজেই সবকিছু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে, এটা-ওটা বলছে। কিন্তু ওরা সে দলে নেই। শুরুতে যদিও ছিল তবে একটু পর অনু বেরিয়ে এসেছে মাহাদকে নিয়ে। একেকটা রুম, ব্যালকনি দেখবার পর মাহিয়ার রিয়েকশন, মুখে হাত দিয়ে ‘ও মাগো, কি সুন্দর!’ বলার ভঙ্গিমা দেখেই মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল ওর। কে দেখে অতো ঢং, কে সয় অতো ন্যাকামো?
গেস্ট রুমে দাড়িয়ে আছে ওরা। এ ঘরের দক্ষিণদিকে একটা জানালা আছে। অনু এগিয়ে এসে জানালার থাই সরালো। বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ স্বপ্নালু চোখে বললো,
— “আমাদের যখন নিজস্ব ফ্ল্যাট হবে; আমরা তখন খুব সুন্দর করে সেটাকে সাজাবো। মাস্টার বেডরুম করবো যে রুমে এমন দখিনা জানালা থাকবে। তাহলে দেখবে, বসন্তে কি সুন্দর বাতাস আসে ঘরের ভেতর! ঠিক আছে?”
স্ত্রীর কথায় মাহাদ হাসলো। ঘাড় নাড়িয়ে বললো,
— “সে না হয় ঠিক আছে। কিন্তু ম্যাডাম, আপনি যে স্বপ্ন দেখছেন তা কি পূরণ হবে? যে ছোট চাকরী আমার! এরকম ফ্ল্যাট কিনতে সারাজীবন লেগে যাবে—”
— “এহহ্! তোমারও যা কথা! ফ্ল্যাট কিনতে সারাজীবন লাগবে নাকি? এখন থেকে একটু একটু সেভিংস করলেই দেখবে ক’বছরের মধ্যেই এমন, না, এরচেয়েও ভালো একটা ফ্ল্যাট আমরা কিনে ফেলেছি। নিজেকে এতটাও ছোট ভেব না, বুঝলে?”
মাহাদ পুনরায় হাসলো। অনুর কথা সত্য, এখন থেকেই টাকা জমানোর চেষ্টা করলেই দেখা যাবে সত্যি সত্যিই ওরা একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে! কিন্তু তার কি কোনো দরকার আছে?
বললো,
— “আমাদের ফ্ল্যাট কেনার কি প্রয়োজন, অনু? আমাদের তো বাড়ি আছেই। বাবা-মা নিয়ে আমরা তো সেখানেই সুখে থাকতে পারি।”
অনু চট করে ফিরে তাকালো,
— “কেন? মাহতাব ভাইয়া যে কিনলো? তার বেলা?”
— “সেটা তার ইচ্ছে। ওর অনেক টাকা! কি করবে — তাই ফ্ল্যাট কেনে, জমি কেনে! আমাদের অতো টাকা নেই। ফ্ল্যাট কেনার দরকারও নেই। তাছাড়া, ভাইয়ারা তো সামনের মাসেই শিফট্ হয়ে যাচ্ছে। তখন ও-বাড়ি তো শুধু আমরা থাকবো। বাবা-মা সহ।
আমরা বেরিয়ে আসলে ওরা বয়স্ক দুজন মানুষ তখন কি করবে একা একা? তাদের দেখতে হবে না?”
বুঝানোর অভিপ্রয়াসেই এতকিছু বললো। কিন্তু ওর সেই চেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উল্টো কথা ধরে টানলো অনু। হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো,
— “ওও, তাদের দেখবার দায়িত্ব একমাত্র তোমার! তাদের জন্য আমার নিজস্ব কোনো শখ-আহ্লাদ থাকবে না? আমার নিজের সংসার হবে না? বড় ভাই তো ঠিকই মুলো দেখিয়ে বিদেয় হবেন। নিজের আখের তো গুছিয়েই নিয়েছে উনি। আর এখন হাদা পেয়েছে তোমাকে, তাই না?”
নয়ন জোড়া বিস্ফোরিত হলো ওর। প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলবে সে সুযোগটুকু অনু আর দিলো না ওকে। হনহন করে বেরিয়ে যাবার পূর্বে বলে গেল,
— “থাকো তুমি!”
ফ্ল্যাট দেখানোর পর মাহতাব সবাইকে নিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলো। দুপুরের খাওয়াটা এখানেই সারবে। পরিবারের সবাই এসেছে। সব মিলিয়ে বড়সড় বাহিনী। তিনটে টেবিল জোড়া লাগানো হলো তাদের খাতিরে। মধ্যমণি হয়ে বসলো মাহতাব-মাহিয়া। অনু আর মাহাদ বসলো পাশাপাশি। অর্ডার দেয়া হলো। কর্তৃপক্ষ জানালো খাবার আসতে সময় লাগবে কিছুক্ষণ। সেই সময়টায় ওরা গল্প মেতে উঠলো।
সবাই এটা-ওটা বলছে, হাসাহাসি করছে; কিন্তু এতসবের মধ্যে অনু কিংবা মাহাদ কেউই যোগ দিচ্ছে না। কেবল দু’ একবার হু হা করছে।
একটু আগে মাহাদের সঙ্গে চোটপাট করবার পর থেকে অনুর মেজাজ খারাপ। মুখটা তেঁতো হয়ে আছে। তারমধ্যে সামনে বসে আছে ন্যাকারানী মাহিয়া! কী ঢং করছে স্বামীকে নিয়ে! দেখেই আরও বেশি গা চিড়বিড় করছে ওর। মুখটা লালচে হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, কোনোকিছু নিয়ে তীব্র ক্ষোভ পুষে রেখেছে ভেতরে। পাশ থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করে মন উদাস হলো মাহাদের। সে আসলেই জানে না, তার কি করা উচিৎ! বিয়ের আগে কতোদিন তো ওরা প্রেম করলো, তখন ঘুণাক্ষরেও তো টের পায় নি এসব। তখনকার অনু আর এখনকার অনুর যে কী বিস্তর ফারাক! ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোলো বুক চিরে।
খাবার এসে গেল আধা ঘণ্টার ভেতরেই। সবে খাবার মুখে তুলেছে, সেই মুহূর্তেই ফোনটা এলো মাহতাবের। কলটা রিসিভ করে সেখানেই কথা সারবার প্রয়াস করলো সে। কিন্তু হলো না। লাইনের ওপাশে থাকা ব্যক্তির কিছু কঠিন কথায় মাহতাবের মুখের রং পাল্টালো। সেও কঠিন স্বরে কিছু বললো। হাসি-ঠাট্টার আসরটা যেন হঠাৎ করেই থমথমে হয়ে উঠলো। কল কেটে গম্ভীর হয়ে বসে রইলো মাহতাব। ওর মা বললেন,
— “কি হয়েছে, বাবা? কে কল দিয়েছে?”
একপলক মাকে দেখলো, অতঃপর সবাইকে। বললো,
— “আমার একটু জরুরী কাজ আছে, আম্মু। আসছি।”
— “সে কি রে, হঠাৎ?”
প্রশ্নটা ঠোঁটের আগায় এসে গেলেও করা হলো না। কাউকে কিছু বলতে না দিয়েই ওয়ালেট নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো মাহতাব!
মে মাস। কাঠফাটা রোদ্দুরে সবকিছু পুড়ে যায়। ফ্যান ছাড়া এক মুহূর্তও টেকা দায়! অথচ বাসায় এখন বিদ্যুৎ নেই। বিনা নোটিশে সে লাপাত্তা। সেই কোন কাক ডাকা ভোরে চারুর ঘুম ভেঙেছিল, চোখ মেলে দেখে সিলিংয়ে চুপটি মেরে আছে ফ্যানটা। সারা শরীর ঘামে ভিজে চিপচিপে! কি অবস্থা!
আজকাল বিদ্যুত না থাকলে কি চলা যায়? একঘণ্টার জন্য হলেও একটা কথা ছিল, কোনোমতে ম্যানেজ করে নেয়া যেত। কিন্তু এ তো সারাদিনের ব্যাপার! বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষেরই মেজাজ এখন চড়া। একেকজন একেকটা কাজ করছেন আর বারেবারে গাল দিচ্ছেন বিদ্যুত অফিসের লোকদের। চারু বিরস মুখে সোফায় বসে। ওড়নার প্রান্ত নাচিয়ে বাতাস করতে ব্যস্ত নিজেকে। এমন সময় দরজায় ‘ঠকঠক’ শব্দ হলো।
একঝলক আশেপাশে চেয়ে নিলো চারু। এই গনগনে গরমওয়ালা ভর দুপুরে বাড়ির সক্কলে এখন ভাতঘুমে মগ্ন। দরজার ঠকঠকানি কি কারো কানে যাবে? ওকেই উঠতে হবে ভেবে এগোলো দরজা খুলতে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার অথচ আগন্তুকের যেন ধৈর্যের বড্ডো অভাব! নয় তো কাজের ভীষণ তাড়া! যেভাবে আওয়াজ করছে!
— “তুই?”
দরজা খুলতেই ছোট বোনের মুখখানি দেখে বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো চারু। অনুর কি হলো কে জানে! কিছু না ভেবেই হঠাৎ জাপটে ধরলো ওকে। বহুদিন পর কোনো প্রিয় মানুষকে দেখে আমরা যেমন আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠি, উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরি একে-অপরকে; ঠিক তেমনি করে! চারু খুব অবাক হলো। অনু নিজেও! আচমকা এমনটা করবে সে হয় তো নিজেও ভাবে নি।
সম্বিৎ ফিরতেই ওকে চট করে ছেড়ে দিলো। খানিক তফাতে দাড়িয়ে অপ্রস্তুত কণ্ঠে শুধালো,
— “কেমন আছিস?”
— “আমি ভালো। তুই?”
চারু মিষ্টি হেসে জানতে চাইলো।
— “এইতো—”
লাগেজ নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল অনু। দরজা আটকাতে গিয়ে চারুর প্রশ্ন,
— “একা যে? মাহাদ কই?”
— “আসে নি।”
— “সে-কি! কেন রে?”
বোনের সরল কথায় হুট করেই বিরক্ত লাগতে শুরু করলো অনুর। ত্যক্ত গলায় বললো,
— “কেন? আমি একা আসতে পারি না? তোর কোনো আপত্তি আছে? থাকলে বল?”
আকস্মিক এমন হওয়ায় চারু ভড়কালো। মাত্রই তো ভালো ছিল মেয়েটা, আবার রাগ করছে কেন? আশ্চর্য! ওর কি কোনদিন পরিবর্তন হবে না?
একদম হুট করেই বাপের বাড়িতে আসা হলো অনুর। ও যে আসবে আগে থেকে কেউ জানতো না। একটা কলও করে নি। মন চেয়েছে, চলে এসেছে। বোধ হয় মাহাদকেও জানায় নি। মেয়ের কাণ্ড দেখে বাড়ির সবাই যেমন খুশি তেমন দুশ্চিন্তাতেও পড়লেন। এমন করে কেউ? পথে কিছু একটা হয়ে গেলে?
আজমীর রাজা কড়া সুরেই ধমকালেন ওকে। আহাদ রাজাও নাতনির আচরণেও সন্তুষ্ট নন বোঝা গেল। অনু অবশ্য সেসব রাগের ধারে-কাছেও গেল না। সে তার মতো রইলো। মা-চাচিদের আদর আপ্যায়ন সাদরে গ্রহণ করলো। রিংকু – টিংকুর সঙ্গে ঝগড়া করলো। এবং খুব সুন্দর করে চারুকে এড়িয়ে গেল। সবসময়ই অবশ্য সে চারুকে এড়িয়ে চলে, তবে ক্ষেত্র বিশেষে সামনে পড়ে গেলে খোঁচা মারতে ভোলে না। এবার তা হলো না। বড় বোনের প্রতি মনে তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করলেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো না!
অনুর পাঁচ মাসে পড়েছে। গর্ভধারণের লক্ষণ শরীরে স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। ওর দিকে তাকালে প্রথমেই নজরে আসে স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু উদর। সেই ফোলা পেটটা স্বগর্বে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্বের কথা। বলছে,
‘দেখো আমার ভেতরে কি আছে! একটি ছোট্ট ভ্রূণ, একটি ছোট্ট প্রাণকে আমি সযত্নে আগলে রাখছি আমার ভেতরে!’
নিজে কখনো মা হতে পারবে না চারু। এই নির্মম সত্যতা মানতে কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছে সে। এমতাবস্থায় ছোট বোনের মাতৃত্বের সংবাদ শুনে তার ভেতরে কোনো খারাপ লাগা কাজ করে নি। বরং খুশি হয়েছে। সে নিজে যা পারবে না, অপারগ-অক্ষম, অন্য কেউ সেটা পারলে হিংসে করাটা ওর ধাঁতে নেই। এ যে ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। তবে হ্যাঁ, অনু যখন তার ফোলা পেটটা নিয়ে হেঁটে বেড়ায় সারা বাড়িময়, ঘুরে-ফিরে ওর চোখের সামনে আসে তখন কেমন অদ্ভুৎ বিষাদের অনুভূতি জাগে ওর। কোনো দ্বেষ নেই, কোনো ঈর্ষা নেই। দুঃখী চারুর প্রবল দুঃখে ব্যথিত মনে শুধু একটা অব্যক্ত হাহাকার ভেসে বেড়ায়। না চাইতেও মাঝেমাঝে মনে হয়,
কেন এমন হলো? সৃষ্টিকর্তা কেন তাকে পূর্ণতা দিলেন না?
___
আনিকার জব পার্মানেন্ট হয়ে গেছে। ট্রেনিংয়ের জন্য এতদিন ধরে হেড অফিসেই ছিল তার ডেস্ক। আজ সকালে এমডি স্যার তাকে কেবিনে ডেকে পাঠালেন। ট্রান্সফার নোটিশটা হাতে দিয়ে জানালেন, তার বদলি হয়ে যাচ্ছে। সিলেটের মৌলবীবাজার জেলায়। লেটার হাতে নিয়ে আনিকা হতভম্ব!
অতো দূরে সে যাবে কি করে?
আনিকার বাড়ি ঢাকার কাছেই এক ছোট্ট মফস্বল শহরে। জন্ম-বেড়ে ওঠা — সবই সেখানে। কলেজ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢাকায় আসে। তারপর এই চাকরি। যদিও ওর পরিবার সায় দিচ্ছিল না তাতে। মেয়ে মানুষের চাকরী করবার দরকার কি? বিয়ে দিলেই তো সব শেষ। সংসার সামলাতে হবে না?
তবুও একপ্রকার জেদ করেই আনিকা এই চাকরিটা নিয়েছে। এতো কষ্ট করে করা লেখাপড়া, ডিগ্রি অর্জন — তার কি কোনো দাম থাকবে না? তাছাড়া স্বাবলম্বী হওয়া তো খারাপ না। ছেলে হোক বা মেয়ে স্বাবলম্বী সকলেরই হওয়া উচিৎ। ইত্যাদি ইত্যাদি বুঝিয়ে সে পরিবারকে রাজি করিয়েছে। কিন্তু এখন চাকরির জন্য যদি সুদূর পূর্ববঙ্গের মৌলভীবাজারে যেতে হয় তবে কি করে মানাবে তাদের? ওর আব্বা তো সাফ মানা করে দেবেন। বেশি কিছু বললে হয় তো ঘাড় ধরে বিয়ের পিরিতেও বসাতে দেরি করবেন না!
চিন্তিত মুখে ক্যান্টিনে বসে এসবই ভাবছিল মেয়েটা। হাতে ধরা কাপটায় কোন আমলে চা ঠাণ্ডায় পানি হয়ে গেছে ওর হুশ নেই। চটকা ভাঙলো সৌভিকের কথায়,
— “আপনি রোজ এই টেবিলটা দখল করেন কেন? আমার পছন্দের বসবার জায়গা — এটা ছাড়া অন্য কোথাও বসতে কি হয়?”
অভিযোগ নয়, নেহাৎ ঠাট্টা। আনিকা সেসব বুঝলো না। কাপ হাতে তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলো,
— “স্যরি, স্যার। আপনি এই জায়গা পছন্দ আমি জানতাম না। আসলে—”
হড়বড় করে আরও কিছু বলবে, ওকে থামিয়ে দিলো সৌভিক। অপর পাশের চেয়ার টেনে বসলো দ্রুত। ওকেও ইশারা করলো বসতে,
— “বসুন। সবসময় এমন অদ্ভুৎ আচরণ করেন কেন আপনি?”
ধপ করে বসে পড়লো আনিকা। সিনিয়রের দিকে চেয়ে মিনমিন করে বললো,
— “কি করেছি আমি, স্যার?”
সেই সুর এতটাই নিম্নগামী যে সৌভিকের কান পর্যন্ত পৌঁছলো না। সে নিজের মতো বললো,
— “আমার দেখা সবচেয়ে অদ্ভুৎ মেয়ে আপনি। প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি খুব খামখেয়ালী, উদাস, উড়নচণ্ডী। ব্যাপারটা একদমই তেমন নয় বটে, কিন্তু খুব ব্যতিক্রমও নেই। আপনার কাণ্ড কীর্তি দেখে আমি অবাক হতে বাধ্য! এমন কেন আপনি?”
আনিকার মন ভার হলো। সে আসলে এমন কেন সে তো নিজেও জানে না। চরিত্রে একটু উদাসীন, খামখেয়ালী বলে কতো মানুষই তাকে রোজ এ প্রশ্ন করে। সে উত্তর দেয় না, কিংবা দিতে পারে না।
আজও মুখ নামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।
সৌভিক কিন্তু চুপ করলো না। প্রসঙ্গ পাল্টালো। আজ তার মনটা বেশ ফুরফুরে। তাই কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব। বন্ধুবর নিখিল নেই। অফিসিয়াল কাজে বরিশাল গিয়েছে দু’দিন হলো। কথা বলতে তাই আনিকার কাছেই এলো সে!
— “শুনলাম, পার্মানেন্ট হয়েছেন? ট্রিট দেবেন না?”
হাসি মুখে জানতে চাইলো। আনিকার মুখটা মলিন হয়ে গেল আরো,
— “চাকরীটা বোধ হয় ছাড়তেই হবে, স্যার। সেটার ট্রিট নেবেন?”
— “মানে? বুঝলাম না ঠিক—”
— “ট্রান্সফার হয়েছে আমার। সকালে লেটার পেলাম।”
— “ভালো তো। কোথায় সেটা?”
— “মৌলভীবাজার।”
বিরস শোনালো কণ্ঠটা। সৌভিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
— “ট্রান্সফার হওয়া তো ভালো। হেড অফিসে চাপ বেশি। অন্য ব্রাঞ্চে কাজ কম। কিন্তু এর সঙ্গে চাকরি ছাড়বার কথা আসছে কেন?”
— “আপনি বুঝবেন না, স্যার। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অনেক জ্বালা। স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চাওয়া এখানে অপরাধ। আমাকে তো চাকরিই করতে দিতে চায় নি, ঢাকায় বলে তাও মেনেছিল। মৌলভীবাজার, অতোদূর যেতে দিবে কেন?”
রোদন রুদ্ধ কণ্ঠে কোনোমতে বললো মেয়েটা। সৌভিক অবাক চোখে তাকালো ওর দিকে। নির্নিমেষ চেয়ে রইলো মুহূর্তখানেক। একটু কি মনটা খারাপ হলো? কি জানি!
____
সন্ধ্যার চায়ের আড্ডায় শামিল সবাই। অনেকদিন পর শ্বশুরবাড়ি থেকে এলো অনু, সে খাতিরেই আসর জমজমাট। মুড়ি মাখায় চানাচুর কম পড়েছে চারু ভেতরে চলে গেল তাই আনতে।
সেকেন্ড ত্রিশের মাথায় চারুর ফোনে বিপ্ শব্দে স্ক্রিনের আলো জ্বলে উঠলো। অনু পাশেই বসে ছিল। না চাইতেও আড়চোখে তাকালো সেদিকে। কল আসছে একটা। স্ক্রিনে ভাসা ‘আম্মি’ নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল আপনাআপনিই। আম্মি আবার কে? ভালো করে আশেপাশে চেয়ে দেখল ওর মা আছে কি-না। ওই তো ছোট চাচীর পাশেই ওদের মা বসে। উনি কীভাবে কল করবেন চারুকে? আশ্চর্য!
এরমধ্যেই চারু ফিরে এলো, মুড়ির বাটিটা সবার সম্মুখে রেখে নিজের স্থানে ফিরলো। ফোনের দিকে চোখ পড়তেই খানিক অপ্রস্তুত হলো। নিখিলের মা কল করেছেন। এই অবেলায়! আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। ঋতু কি একটা বিষয়ে আলাপ তুলেছে, তাই নিয়ে তর্কাতর্কি চলছে!
সবার অগোচরে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে, আসর ছেড়ে উঠে গেল চারু। দোতলায় সিঁড়ির কাছে নিরিবিলিতে এসে আলাপে মত্ত হলো। লক্ষ্য করলো না পেছন পেছন এসে কেউ লুকিয়ে কথা শুনছে তার!
চলবে___
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৮
ব্যালকনিতে একা দাড়িয়ে চারু। মুঠোফোনটা কানে ধরে রাখা। লাইনের ওপাশে কথাপাগল নিখিল একাধারে কথা বলে যাচ্ছে। চারু মাঝে মাঝে ‘হু হা’ করছে শুধু। মনটা বড্ডো উদাস। আনমনা দৃষ্টি গগনপানে ন্যস্ত। সেই গাঢ় নীলরঙা সুন্দর নভোস্থলে সফেত মেঘপুঞ্জের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে নিখিলের বকবক শুনে যাচ্ছে। লোকটা এতো কথা বলতে পারে!
ক্ষণিকক্ষণ পরে নিখিল নরম সুরে বললো,
— “মন খারাপ?”
— “উহু।”
— “তবে? এতো অন্যমনস্ক লাগছে কেন? কিছু হয়েছে?”
আবারো জানতে চাইলো সে। চারু ইতস্তত করলো। তার মন খারাপ নয়, তবে সত্য সত্যই সে বেশ অন্যমনস্ক আজ। সেটা বুঝতে নিখিলের অসুবিধে হয় নি। কিন্তু কারণটা বলতে চায় না চারু।
— “আমি অন্তর্যামী নই, চারুলতা। কিন্তু সমস্যার কথা বললে সমাধান করে দেয়ার চেষ্টা করতে পারি। বলুন না, কি হয়েছে?”
চারু সময় নেয়। কিয়ৎক্ষণ পর মৃদুস্বরে জানায়,
— “আগামীকাল অনুর ‘সাধ’ আয়োজন করেছে। সেই উপলক্ষ্যে বাড়িতে অনেক মেহমান— ওরা— ”
— “ওরা কি, চারু?”
কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে মেয়েটার। অজান্তেই ফুঁপিয়ে উঠেছে। আকস্মিক এমন কাণ্ডে নিখিল থমকালো, চমকালো। বহুদূর থেকে বেতার মাধ্যমে যোগাযোগ করায় ইচ্ছে থাকলেও প্রেয়সীর ব্যাকুল রোদনে কিছুই করতে অপারগ সে। না জানে সে দুঃখের হেতু; না আছে তা ভোলানোর শক্তি। কি করবে নিখিল? কি দিয়ে সান্ত্বনা দিবে?
— “ওরা কি তোমায় নিয়ে বাজে কথা বলেছে? কোনো কটূক্তি—”
কথা শেষ করবার শক্তি নেই। কান্নার বেগ বাড়লো চারুর। হু হু করে কেঁদে উঠলো। সে আসলেই জানে না তার দোষ কোথায়। কেন মানুষ তাকে নিয়ে বাজে কথা বলে, কেন তাকেই ‘মুখপুড়ি, বাঁজা মেয়ে মানুষ, আটকুঁড়ী, অপয়া, অলক্ষ্মী’ — ইত্যাদি বিশ্রী বিশ্রী উপাধি দেয়া হয়? আচ্ছা, কোনো মানুষ কি নিজেই নিজের অক্ষমতা তৈরি করে?
নিখিল ওকে থামালো না। কাঁদতে দিলো ইচ্ছেমত। একটুপর নিজেকে সামলে নিলো মেয়েটা। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “আচ্ছা, একটা কথা বলবেন? আমি তো ডিভোর্সী, উপরন্তু বাচ্চা জন্ম দেয়ার ক্ষমতাও নেই। আমাকে বিয়ে করলে আপনি কষ্ট ছাড়া কি পাবেন? লোকের কটু কথা, আজেবাজে মন্তব্য — জেনেশুনে কেন আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছেন? কেন পথ তৈরি করে দিচ্ছেন লোকেদের কথা শুনানোর?”
নিখিল হাসে। শান্ত হয়ে বুঝায়,
— “আমি যদি বিয়ে না করে সারাজীবন একা কাটাই, লোকে কি বলবে বলুন তো? আইবুড়ো, চিরকুমার — বলে ক্ষেপাবে না? আবার চাকরী করা মেয়ে বিয়ে করি, বলবে এ আমি কি করলাম? বৌ চাকরী করবে না সংসার? চাকরী ছাড়া সুন্দর রূপবতী নারীকে ঘরে আনি, তখনো তার একটা খুঁত ধরবেই? আপনাকে বিয়ে করলেও ছাড় দেবে না। তাহলে পুরো ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে?
আমি যাই করি না কেন, সমাজ আমাকে কথা শোনাবে!
নিন্দুকের মুখ তুমি কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারবে না। তাহলে কি লাভ সে চেষ্টা করে? জীবনটাকে নিজের মতো গুছিয়ে নেয়াটাই কি ভালো না?
তোমাকে ভালোবাসি, তাই বিয়ে করবো। এতে লোকে কি বলবে তাতে আমার কি দরকার?”
অনেকটা সময় দু’ জনে চুপ করে থাকে। আসলে তখনো তাদের কথোপকথন চলতেই থাকে, কিন্তু নীরবে-নিঃশব্দে। একসময়ে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে নিখিল। খুব আদরে-আহ্লাদে জানতে চায়,
— “আপনি কবে আমাকে ভালোবাসবেন, চারুলতা? কবে স্ত্রী হয়ে আমার ঘরের শোভা হয়ে আসবেন? আমি যে অপেক্ষায় আছি—”
আচানক কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না চারু। চট করে মাথা নুইয়ে ফেলে সে। লাজে কাবু হয়ে অসাড় শরীর নিয়ে দাঁড়ায়। কোত্থেকে একদল লজ্জার লাল-নীল প্রজাপতি এসে ছুটতে শুরু করে মন বাগানে। কান দিয়ে ধোঁয়া ছুটছে, গাল দু’টো যেন লাল টুকটুকে আপেল। জবান নেই মুখে!
ওপাশ থেকে অধৈর্য হয় নিখিল। তাড়া দেয়,
— “বলুন না, কবে আসছেন? কবে আমার করে পাচ্ছি, আমার চারুকে!”
— “আপনি যেদিন চান!”
লজ্জার মাথা খেয়ে শেষমেষ বলেই দিলো চারু। সঙ্গে সঙ্গেই কল কেটে ফোন বন্ধ করে ফেললো। কারণ সে জানে, এরপর ওই পাগল লোকটা কি করবে! কতভাবে, কতো পদ্ধতিতে যে ওকে লজ্জায় ফেলবে! ভাবতেই দ্বিগুণ বিব্রত হয়।
________
বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল। অনুর সাধ।
এ-বাড়ির প্রথম কোনো মেয়ের বাচ্চা হচ্ছে। তার জন্য আয়োজনের ত্রুটি রাখেন নি আহাদ রাজা। ছোট করে প্যান্ডেল-স্টেজ সবই বানানো হয়েছে। আঠারো পদের খাবার, যার সবগুলোই অনুর প্রিয়; প্রস্তুত হয়েছে। নিকটাত্মীয়, বন্ধুবান্ধব সবাই আমন্ত্রিত। সারাদিন চললো বাচ্চাদের হৈ-চৈ, বড়দের সমাগম, আলাপ-আলোচনা। অনাগত সন্তানের জন্য উপহার নিতে নিতে ক্লান্তই হলো অনু।
ব্যস্ততম দিন কাটিয়ে অবশেষে ছাড়া পেল সন্ধ্যায়। এককাপ চা নিয়ে ছাদে বসলো। শান্তি লাগছে খুব। ক’দিন ধরে মনের ভেতর খচখচানি ছিল, আজ তা কেটে গেছে। কয়েক মাস আগেই মাহিয়ার বাচ্চা হওয়া উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান করেছিল ওর বাপের বাড়ির লোকজন। মাহতাব যেহেতু বেশ টাকা পয়সার মালিক, বড়লোক মানুষ — স্ত্রীর জন্য কম খরচা করে নি। সেই নিয়ে মাহিয়ার কি অহং!
দাম্ভিক চিত্তে সে অনুকে দেখিয়েছিল সব। অনুষ্ঠানে কে কি দিয়েছে, কতো কতো উপহার পেয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি গল্পের চোটে ক’দিনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল ওর। সারাক্ষণ দেখো অহংকারী গল্প, দেমাগী চাল-চলন, কথাবার্তা। সব অসহ্য ঠেকছিল ওর। তাই তো হুট করে বাপের বাড়ি চলে এলো সে। দাদুর কাছে আহ্লাদ করে বলতেই তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। বড়সড় আয়োজন করলেন নাতনির জন্য। আর করবেন নাই বা কেন!
সে কোন অংশে কম ওই মাহিয়ার চেয়ে? রূপে-গুনে-বংশ মর্যাদায় কোন দিক দিয়ে হার মানাতে পারবে সে ওকে?
নিজের মনেই কথাগুলো ভাবছিল অনু। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুৎ আনন্দে তার মনটা ভরে আসছিল। তৃপ্তির হাসি ঠোঁটের কোণে!
হঠাৎ দু’টো উষ্ণ হাতের স্পর্শ তার উদরে পড়লো, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে মাহাদ। অনু হেসে ঘুরে তাকালো,
— “তুমি? কখন এলে?”
— “এইতো একটু আগে। কেমন গেল তোমার দিন?”
হেসেই প্রত্যুত্তর করলো মাহাদ। তীব্র আনন্দের ঝলকানি দেখা গেল ওর সারা মুখ জুড়ে,
— “দারুণ! জানো, আজ কতো মানুষ এসেছিল? বেবির জন্য কত্তো গিফট্ দিয়েছে? তুমি কেন ছিলে না বলো তো? থাকলে কতো কি হতো —”
— “ছুটি পাই নি যে! মন খারাপ করো না। তুমি বরং আমায় তোমার গল্প শোনাও, কি কি হলো আজ সারাদিন?”
একহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে, এলেমেলো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো মাহাদ। অনু উচ্ছ্বসিত হলো। তার প্রবল আনন্দের সময়টায় তার প্রিয় মানুষটি ছিল না। এই দুঃখে কিঞ্চিৎ ব্যথিত ছিলো হৃদয়। কিন্তু এখন তাকে পেয়ে এক মুহূর্তেই সব ভুলে গেল যেন! হর্ষে-উল্লাসে ফেটে পড়লো মেয়েটা,
— “আর বলো না! এতো মানুষ, এতকিছু। বাপরে! দাদু যে এতবড় আয়োজন করবেন আমি কল্পনাও করি নি। মাহিয়া ভাবির অনুষ্ঠানে কয়জন এসেছিল, এখানে জানো পুরো তল্লাট চলে এসেছিল…”
একসঙ্গে অনেক কথা বলে যেতে লাগলো। আজ সে খুশিতে আত্মহারা। বাঁধনহারা সুখে একের পর এক গল্প সে বলতে চাইলো মাহাদকে, তার প্রিয় স্বামী, প্রিয় মানুষকে। মাহাদ শুনলো, মন দিয়ে শুনলো। একসময় হঠাৎ তার মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠলো। হাসি-খুশি চেহারাটা ধীরে-ধীরে বিলীন হয়ে যেতে লাগলো। প্রিয়তমার মুখের দিকে একধ্যানে চেয়েও সে ডুবে গেল অন্য ভাবনায়!
পৃথিবীতে অনেক ধরণের মানুষ আছে। এরমধ্যে একধরণের মানুষ আছে যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে। অন্যদের গুরুত্ব দিতে চায় না। সবক্ষেত্রে নিজেকে সবচেয়ে ভালো, নিখুঁত মনে করে। তারচেয়ে কেউ ভালো হলেও তাদের মূল্য দিতে চায় না। অন্যকে তুচ্ছ – তাচ্ছিল্য করে। কিংবা অন্য কারো শ্রেষ্ঠত্ব দেখে নিজের ভেতরে ঈর্ষা অনুভব করে। হিংসায়- ক্রোধে জ্বলে পুড়ে মlরে। মাহাদ খেয়াল করে দেখেছে এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কিছু অনুর মধ্যে বিদ্যমান। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যিই সে শুরুতে ব্যাপারটা খেয়াল করে নি। এমনকি বিয়ের আগে সে এর বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারে নি। অনু আসলে সুপ্রেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগছে!
এ নিয়ে মানসিক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছে মাহাদ। কিন্তু তা করলেই অনুকে কাউন্সেলিংয়ের জন্য ডাকবে তারা; তখন কীভাবে ওকে নিয়ে যাবে বুঝতে পারে নি। অনু যা বদরাগী! কথা এগোতে পারে নি তাই
তাই নিজে থেকেই ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে মাহাদ। খেয়াল করে দেখেছে, অনুর এই সমস্যাটা সবক্ষেত্রে নেই। বিশেষ কিছু মানুষের ক্ষেত্রেই শুধু দেখা যায়। যেমন এ-বাড়ির চারুলতা, ও-বাড়ির মাহিয়া। বয়স, অভিজ্ঞতা কিংবা অন্য যেকোনো ক্ষেত্র — অনু এদের চেয়ে বেশ ছোট। সঙ্গত কারণেই বাড়িতে এরা দু’জনেই ভীষণ রকমের প্রাধান্য পায়। চারুর সঙ্গে নিয়মিত উঠাবসা নেই বলেই ওর সঙ্গে রেষারেষির ঠিক কারণটা মাহাদ জানে না। তবে মাহিয়ার সঙ্গে ঝগড়ার ব্যাপারটা সে খুঁজে বের করেছে। ও-বাড়িতে মাহিয়ার প্রভাব বিস্তর! বড় বৌ হওয়ার সুবাদে সকলেই ওকে মান্য করে, ভালোবাসে। অনুকে যে বাসে না, তা নয়। তারপরও অনু কেন যে নিজেকে মাহিয়ার সঙ্গে তুলনা করে কে জানে!
মাহিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়েই আজকাল সবকিছু করে অনু, মাহাদ বুঝতে পারে। এই যে এতোবড় করে একটা অনুষ্ঠান করলো, কারণ কি? মাহিয়ার সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্বে জেতা। শুধুমাত্র নিজের আত্মিক প্রশান্তির জন্যই এসব। এরকম আরো কতো কাণ্ড যে অনু করে!
চটকা ভাঙলো অনুর কথায়,
— “কি হলো? কিছু বলছ না যে?”
বাহু ধরে ঝাঁকালো। ভাবনা ছেড়ে সম্বিৎ ফিরতেই একটু হাসলো মাহাদ। স্ত্রীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সচকিত কণ্ঠে বললো,
— “একটা কথা শুনবে, অনু?”
— “কি?”
আহ্লাদী সুরে বলেই ওর গলায় ঝুলে পড়লো অনু। চোখ পিটপিট করে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে তাকালো। মাহাদ উসখুস করলো কিছুক্ষণ।একসময় খুব করুণ চোখে চেয়ে বললো,
— “কারো সঙ্গে দ্বন্দ্বে যেও না কখনো। কাউকে পরাস্ত করতে গিয়ে একটু দেখো, যেন তোমার-আমার মাঝে দেয়াল তুলে দিও না। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, অনু। অনেক সাধনা করে তোমাকে পেয়েছি। কোনো দেয়াল এসে গেলে, তা ভাঙবার শক্তি যে আমার নেই!”
শেষের কথাগুলো একেবারেই অস্পষ্ট শোনালো। অনু সেসবের কিছুই শুনলো না, বুঝলো না। কেবল ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে রইলো ওর পানে!