Thursday, June 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 297



এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-২৫+২৬

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৫

ছেলের প্লেটে খাবার সাজাতে সাজাতে অধৈর্য মাতা ফের শুধালেন,
— “হ্যাঁ রে, বাবু? বললি না তো মেয়েটা কে?”
মার কথায় লজ্জা পেল নিখিল। এভাবে মায়ের সামনে প্রেমিকার কথা বলা যায় নাকি? কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— “আগে খাবারটা দাও, আম্মি। ছেলেকে ভুখা পেটে এসব কথা জিজ্ঞেস করো না! বিরক্ত লাগে।”
নাজিয়া শব্দ করে প্লেটটা ঠেলে দিলেন। সাপের মতো ফোঁস করে উঠে বললেন,
— “বিরক্ত লাগে, না? আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেই খুব বিরক্ত লাগে? আর ফোনে যখন প্রেমিকার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্যাঁচাল পারো তখন কিছু হয় না? হুঁ?”
হতাশ শ্বাস ফেলে নিখিল,
— “চারু আমার সেরকম প্রেমিকা নয়!”
— “তো কি রকম শুনি?”
— “বলছি।…”
বলেই প্লেট টেনে নিয়ে খেতে শুরু করলো। নাজিয়া রাগি মুখে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। অকারণে তরকারির বাটি টানাটানি করলেন, চামচ দিয়ে ঘুঁটঘাঁট করলেন। গ্লাসে পানি ঢেলে রেখে দিলেন। কিন্তু সহিষ্ণু হতে পারলেন না। তার এই নটাংকি ছেলে যে কি করছে! কেন যে বলছে না!
খেতে খেতে একবার মুখ তুলে তাকালো নিখিল। মার অস্থিরপানা মুখখানি দেখে শীতল সুরে বললো,
— “কথাগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আম্মি। খেতে খেতে বলবার মত হাল্কা নয়। আমি খাচ্ছি, সঙ্গে তুমিও খেয়ে নাও। তারপর আমরা ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলবো।”
নাজিয়া দিরুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ছেলের গম্ভীর চেহারা দেখে কেন যেন কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। সুস্থির হয়ে খেতে বসলেন।

খাওয়ার পর্ব সেরে বসার ঘরে গিয়ে টেলিভিশন ছেড়ে বসলো নিখিল। রান্নাঘর গুছিয়ে দ্রুতই সেখানে উপস্থিত হলেন নিলুফার নাজিয়া। এসেই চঞ্চল চিত্তে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
— “তুই কি এখন বলবি? শোন, নিখিল। অনেকক্ষণ ধরে ধানাই-পানাই দেখছি তোর। আর কিন্তু সহ্য হচ্ছে না…”
— “বলছি, আম্মি। শান্ত হয়ে বসো।”
রিমোট চেপে টেলিভিশন বন্ধ করলো। মায়ের একহাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে দিলো। নাজিয়া বসেই ফের বললেন,
— “ঝটপট বল। কোনো কাহিনী করবি না!”
লম্বা দম নিয়ে বলা শুরু করলো নিখিল,
— “চারুলতা জাফরিন। আজমীর রাজার বড় কন্যা। আহাদ রাজা’র বড় নাতনি। তার দাদার নামটা তুমি শুনেছ, তাই উল্লেখ করলাম। আহাদ এ্যাম্পোরিয়ামকে তো চেনোই। তোমার শাড়ি কেনার দোকান। সেই বাড়ির মেয়ে চারু। ওর আরেকটা পরিচয় হলো, সৌভিকের ছোট বোন সে। গত ছুটিতে সৌভিকদের বাড়িতে গিয়ে প্রথম পরিচয় হয়।”
— “সৌভিকের বোন? সত্যিই? দেখতে কেমন? তোর ফোনে আবছা ছবি দেখলাম। বুঝি নি। তুই বল, কেমন দেখতে? ভাইয়ের মতই সুন্দর? অবশ্য তা-না হওয়ারই সম্ভবনা বেশি। যে পরিবারের ছেলেরা সুন্দর, নায়ক নায়ক হয়, সেই পরিবারের মেয়েগুলো হয় একেকটা বান্দর। পরীক্ষিত সত্য… যাইহোক, মেয়ের বয়স কেমন?”
একসঙ্গে এত কথা বলে তবেই থামলেন নাজিয়া। মায়ের উত্তেজনা টের পেল নিখিল। হেসে জানালো,
— “সব ক্ষেত্রে ‘পরীক্ষিত সত্য’ খাটে না, আম্মি। কিছুক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। সৌভিকের সব ভাই-বোনরাই তামিল সিনেমার নায়ক – নায়িকার মত সুন্দর। তারমধ্যে চারু হলো বেস্ট। ওর লাবণ্য মাখা মুখ দেখলেই তোমার মন ভালো হয়ে যাবে! ট্রাস্ট মি, এত্তো মিষ্টি ও!”
— “হয়েছে, হয়েছে। এ বয়সে ডায়েবেটিস বাঁধাতে চাই না। মেয়ের বয়স বল। তোর চেয়ে ছোট তো? মিনিমাম পাঁচ বছরের ছোট না হলে কিন্তু সংসারে ভালো হবে না—”
— “আমি ওর সঠিক বয়স জানি না। তবে চব্বিশ অথবা পঁচিশ হবে।”
— “সে কি, তোরই তো আঠাশ! বয়সের ডিসটেন্স এতো কম হলে—”
— “আম্মি! আজকাল বয়সে কি হয়?”
মাঝপথে বাঁধা দিলো নিখিল। নাজিয়া দম ফেলে পুনরায় বললেন,
— “মেয়ে রান্নাবান্না, কাজকর্ম সব জানে তো? তাকে তোর ফ্যামিলী নিয়ে বলেছিস? দেখিস, বিয়ের পর যেন এসে না বলে, আমার সঙ্গে থাকবে না। সংসার আলাদা করবে! আমার একটা মাত্র ছেলে! তাকে কিন্তু আমি বৌ নিয়ে আলাদা হতে দেব না—”
তাকে আর কিছু বলতে দিলো না নিখিল। হাত ধরে কোমল গলায় আশ্বস্ত করলো,
— “তোমার ছেলে সবসময়ই তোমার থাকবে। ভয় পেয় না তুমি। চারু অমন মেয়ে নয়! তুমি ওর সঙ্গে একবার পরিচয় হলেই বুঝবে!”
— “কবে করাবি পরিচয়?”
আবদারি সুর তার। নিখিল হাসলো,
— “সরাসরি সাক্ষাৎ তো এখন হবে না; আমি বরং তোমাদের ভার্চুয়াল মিটিং সেট করে দেই, কেমন? পরশু কথা বলিয়ে দেব।”
— “পরশুই তো? মনে থাকে যেন!”
— “আচ্ছা।”
সায় দিলো বাধ্য ছেলের ন্যায়। অতঃপর আরও টুকটাক কিছু আলাপ সেরে মাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে দিলো।

নাজিয়া চলে যেতেই হাঁফ ছাড়লো নিখিল। এতক্ষণ অদ্ভুত এক আতঙ্কে সময় কাটাচ্ছিল সে। বারেবারে মনে হচ্ছিল এই বুঝি মা ক্ষেপে যায়! এই বুঝি রেগে বলেন, ‘না, আমি চারুকে মানি না!’ তখন কি হতো? মা আর চারু কাকে বেছে নিত সে?
এ জগতে মা ছাড়া ওর কেউ কি আছে? আর চারু ছাড়া ভালোবাসা? সেও তো হয় না। কিন্তু মার প্রতিক্রিয়া দেখে সে তৃপ্ত হয়েছে। চারুকে মা ঠিক মেনেছেন। শুধু তার মুখে শুনেই। এখন পরিচয় হলেই আর দ্বিধা থাকবে না!
কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়। নিখিলের মনে ভয় আছে অন্য কিছু নিয়ে। আর সেটা হলো, চারুর অতীত। মা যদি চারুর অতীত প্রসঙ্গে কিছু বলেন? বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। লুকোছাপা এখানে চলে না। কথা এগোলে চারুর অতীত নাজিয়া ঠিকই জানবেন। তবে তার আগে চারুর সঙ্গে তার সখ্যতা হওয়া দরকার। চারুকে একবার দেখলে নাজিয়া মা কখনোই তাকে দোষী বলবেন না, এ নিখিলের দৃঢ় বিশ্বাস। তার মাকে তো সে চেনে!
___

লিফটের দরজা খুলতেই একটু চমকে গেল সৌভিক। আনিকা দাড়িয়ে। সর্বাঙ্গ কালো রঙের পোশাকে মোড়ানো, মুখখানি রুগ্ন, ফ্যাকাশে। বেশ কিছুদিন পর এই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হলো ওর। অসুস্থতায় লিভ নিয়েছিল সে। আজ থেকেই যে কাজে ফিরবে সৌভিক জানত না। ওকে দেখে অবাকই হলো। বললো,
— “আপনি? এতদিন পর?”
— “ছুটি নিয়েছিলাম, স্যার।”
নম্র মুখে বললো। সৌভিক মাথা নাড়ালো,
— “শুনেছি। অসুস্থ ছিলেন। তো এখন সব ঠিক হয়েছে?”
— “জ-জ্বি।”
— “আচ্ছা, ভালো। কাজে যান।”
আনিকা মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে গেল। সৌভিক সূক্ষ্ম চোখে ওর যাওয়া দেখলো। লিফটে ওঠা ছেড়ে, পেছন ফিরে মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল অনিমেষ। অদ্ভুত কারণে তার মনটা অশান্ত হয়েছে। কেমন একটা উচাটন লাগছে ভেতরে ভেতরে। এতক্ষণ কিন্তু ব্যাপারটা হয় নি। এখনই হঠাৎ হচ্ছে কেন বুঝলো না। কারণটা ধরতেই আনিকার দিকে চেয়ে থাকা। কোনোভাবে কি ওর সঙ্গে তার ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক আছে?

এরপর সারাদিন আনিকার সঙ্গেই থাকতে হলো ওকে। আনিকা অফিসে নতুন বিধায় এক মাস তার আন্ডারেই থাকবে। আজ সৌভিক অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, মেয়েটা বদলেছে। সবসময়ের ‘বেখেয়ালি আনিকা’ যেন এ নয়। যে যা বলছে, করছে। মন দিয়ে সবার কথা শুনছে। কোনো অদ্ভুতুড়ে আচরণ নেই। উড়নচণ্ডী ভাব নেই। সব কেমন শান্ত, নির্মল। দুপুরে একটা মিটিং ছিল। সেই মিটিংয়ে প্রেজেন্টেশন দেয়ার ছিল ওর। সেখানেই আরও বিস্ময়কর ব্যাপার লক্ষ্য করলো সৌভিক। আধ ঘণ্টার লম্বা সময়টা সে সহ রুমে উপস্থিত বাকি সবাই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে। কারণ তুখোড় মেধাবী মেয়েটা তখন জাদুকরী বাচন ভঙ্গিতে মোহগ্রস্ত করে রেখে সবাইকে!

বিকেলে চারুর সঙ্গে নিখিল তার মাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। ছেলে তার কেমন মেয়েকে পছন্দ করে, তাকে দেখতে বেশ উতলা হয়ে ছিলেন নিলুফার নাজিয়া। সাক্ষাৎ তো আর সম্ভব নয়, ভিডিও কলেই আলাপ সারা হলো। ছেলেকে তুলে দিয়ে, ঠেলেঠুলে বের করে দিয়ে, ল্যাপটপ নিয়ে নাজিয়া বসে পড়লেন গল্প করতে।
— “তুই যা তো, নিখিল। আমি চারুর সঙ্গে কথা বলি।”
— “হ্যাঁ, এখন তো যেতে বলবেই। আমি তো ফেলনা হয়ে গেলাম—”
কপট রাগ দেখালো সে। নাজিয়া হাসলেন ছেলের গাল ফুলানো দেখে,
— “হিংসে করছিস কেন? তুই যা বাইরে। আমি একটু কথা বলি?”
— “বলো। বলো। আমাকে বের করে দিয়ে একা কথা বলো!”
তেজ দেখিয়েই বেরিয়ে গেল। এবার জোরেই হেসে উঠলেন নাজিয়া। কলের ওপ্রান্তে, সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে অরুণা ম্যানশনে নিজের ছোট্ট কক্ষের বিছানায় বসে বসে মা – ছেলের অবস্থা দেখে চারুও হেসে উঠলো তাল মিলিয়ে। হাসি থামিয়ে নাজিয়ার মন্তব্য,
— “দেখেছ, তোমার বরটা কেমন হিংসুটে? শুধু কথা বলছি বলেই কি জ্বলছে!”
নিখিল ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল। সেভাবেই জবাব দিলো,
— “কি জ্বলছে? কার জ্বলছে? আমার কোনো জ্বলন-টলন নেই! কথা বানাবে না কিন্তু—”
সেই প্রতিবাদী স্বর কানে আসতেই আরেকদফায় হাসাহাসি শুরু হলো দুই প্রান্তের দুই নারীর। তাদের মধুময় অট্টহাসি শুনে অজান্তেই মন ভালো হয়ে গেল নিখিলের। শার্ট গায়ে জড়িয়ে, কব্জির উপরে ঘড়িটা পরতে পরতে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল বুক জুড়ে! আহা, এই সুখ কবে চিরস্থায়ী হয়ে আসবে তার জীবনে?
__

ব্রেক টাইমে বহুদিন পর বন্ধুর সঙ্গে লাঞ্চ শেয়ার করলো সৌভিক। নিখিল তখন একা একা নিজের মত খাচ্ছিল। হুট করে চোখ তুলে তাকাতেই সম্মুখে সৌভিককে দেখতে পেল। খাবারের প্লেট হাতে সে হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে। নিখিল কিছু বললো না। মুখ নামিয়ে খাওয়ায় মন দিলো। সৌভিকও ব্যস্ত হলো খাওয়ায়। সে নিজে থেকে এগিয়েছে একধাপ। নিখিলের কি উচিৎ নয় সহযোগিতা করা?
খানিক বাদে নিজের লাঞ্চ বক্সটা ঠেলে সামনে এগিয়ে দিলো নিখিল। শব্দে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই হাসলো,
— “ধর, টেস্ট কর। মা বানিয়েছে।”
সৌভিক কয়েক পল্ ভাবলো। বক্স থেকে বিরিয়ানির সুঘ্রাণ আসছে। নাজু আন্টির রান্না!
বরাবরই তার রান্নার ফ্যান সৌভিক। প্রতি উৎসব-পর্বেই আন্টি দারুণসব রেসিপি করে পাঠান নিখিলের দ্বারা। সেসব এতোই সুস্বাদু আঙুল পর্যন্ত কামড়ে খেয়ে নিতে ইচ্ছে করে ওর। আজ তাই মিস করা যায়? জলদিই চামচ ভরে মুখে পুরলো সৌভিক। তৃপ্তি সূচক ‘উমম্ উমম্’ করতে করতে নিখিলের দিকে চোখ পড়তেই একটু থামলো। নিখিল সব মেনে নিয়েছে?
প্রশ্নটা মাথায় আসতেই বললো,
— “তুই রেগে আছিস এখনও?”
— “রাগলে বিরিয়ানির অফার দিতাম?”
হাসলো নিখিল। থমথমে মুখে চেয়ে থাকা বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে বললো,
— “আমি তোর উপরে কখনো রাগ করি নি, দোস্ত। তোর পরিস্থিতিতে নিজেকে দাড় করিয়ে আমি বুঝেছি, সব মেনে নেয়া তোর জন্য সহজ নয়। গড়মেলে জটিল। তবে তুই সবকিছু মেনে নিয়েছিস, তাতে আমি খুশি।”
— “মেনে না নিয়ে উপায় আছে? কিছুই যে আমার অনুকূলে নয়!”
অন্যমনস্ক চোখে চেয়ে বিড়বিড় করলো সৌভিক। নিখিল সেই মৃদু গুঞ্জন শুনতে পেল না। সে নিজের খুশি জাহির করে বললো,
— “আজকে আমি অনেক খুশি, দোস্ত। ভীষণ খুশি!”

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৬

চারুর অতীত নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ নিখিল আর তুললো না। কেন যেন ওর ভয় হচ্ছিল, সব জেনে-শুনে নাজিয়া কিছুতেই চারুকে মেনে নেবেন না। কিন্তু তাকে ছাড়তেও তো চায় না নিখিল। ভালোবাসাকে কি ছাড়া যায়?
মাকে সে ভালোবাসে না তাও নয়। কিন্তু জীবনের জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে মা আর প্রেমিকার মধ্যে যে কোনো একজনকে গ্রহণ করে, অন্যকে ত্যাগ করবার মানসিকতা ওর নেই। সব জায়গায় প্রতিবাদী নিখিলও, এই একটি জায়গায় বড্ডো দূর্বল। তাই একটু নিজেকে স্বস্তি দিতেই মার কাছে সব লুকিয়েছে! এখন রোজ চারুর সঙ্গে মার কথা হয়। সকালে – বিকালে যখনই খোঁজ নাও, দেখতে পাবে দু’ প্রান্তের দুই বঙ্গ নারী বসে পড়েছেন আলাপে। কখনো ভিডিও, কখনো বা ভয়েস কলে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের আলাপ চলছে। সংসারিক থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক — কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না! নিখিল সব শুনছে। নাজিয়া মাঝে মাঝে চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছেন, ইশারায় রাগ দেখিয়ে ছেলেকে বিদায় করছেন নিজেদের গোপন আলাপ থেকে। ঠেলা খেয়ে অসহায়ের মত নিখিলও সরে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের নির্মল-শীতালু হাওয়া তার বুকেও প্রশান্তি এনে দিচ্ছে। একটি নতুন সুখের আশায়, একটি বহুল কাঙ্খিত বাসনায়!
___

ঘন তমসায় ডুবে থাকা নিসর্গ। কাছে-পিঠেই কোনো ঝোপঝাড়ে একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকার শব্দ ছাড়া আশেপাশের সবকিছুই স্তব্ধ, নিশ্চুপ। ছাদের অবস্থাও ব্যতিক্রম নয়। হঠাৎ মৃদু ‘ক্যাচ ক্যাচ’ আওয়াজ তুলে দরজা খুলে গেল হাট হয়ে। অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ হওয়ায় দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো মাহাদ। অদ্ভুৎ ভঙ্গিতে দাড়িয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। যেন প্রকৃতির নিশ্চল নীরবতায় ছেদ ঘটিয়ে মহাপাপ করে ফেলেছে সে! তাই মার্জনা চাইছে কারো কাছে!
কিয়ৎক্ষণ পর স্বাভাবিক হলো সে। আস্তে করে দরজা চাপিয়ে এগোলো অন্যদিকে। বাড়ির মূল ফটকে নিরাপত্তার জন্য জ্বালিয়ে রাখা দশ ওয়াটের বাল্ব থেকে ছিটকে আসা ক’ফালি আলোকচ্ছটায় দেখা যাচ্ছে, রেলিংহীন ছাদের একপ্রান্তে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মানবমূর্তি। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট থেকে উড়ছে ধুম্র কুণ্ডলীরা!
নিভৃতে একা বসে শলাকায় সুখটান দিতে ব্যস্ত মানুষটিকে দেখে নিঃশব্দে এগিয়ে এলো মাহাদ। চুপচাপ তার পাশে বসে পা ঝুলিয়ে দিলো নিচে, তারই অনুকরণে। কারো উপস্থিতি টের পেয়েও খামোশই বজায় রইলো মাহতাবের ভেতর। ঠোঁটের ফাঁকে জ্বলন্ত শলাকা রেখে, পকেট থেকে আস্ত প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলো ভাইয়ের দিকে। মাহাদ হাসলো। একটা সিগারেট তুলে নিয়ে জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,
— “অনেকদিন ধরে খাই না, বুঝছ? আজকে হঠাৎ ইচ্ছে হলো…”
— “ছেড়ে দিতে চাইছিস? দে তাহলে। ভালো জিনিস তো না—”
শান্ত সুরে বললো। মাথা নাড়লো মাহাদ,
— “বিয়ে করেছি নতুন, সিগারেট খেলে বৌ গা ঘেঁসতে দেয় না; সারাক্ষণ মা খিটখিট করে— ভাল্লাগে না সব। তাই ছাড়তেই চাইছি—”
— “মা তো আগেও খিটখিট করতো। তখন তো ছাড়িস নি!”
বলেই কেমন ব্যঙ্গাত্মক চোখে তাকালো। বড় ভাইয়ের ইশারা দেখে কিঞ্চিৎ লজ্জিত হলো মাহাদ। গা বাঁচিয়ে বললো,
— “মেয়ে মানুষ! বুঝোই তো, কেমন জিদ্দি। যা বলবে তাই করবে। কাউকে মানবে না। আগে মার কথা না শুনলেও এখন বৌয়ের কিথা না শুনেও উপায় নেই। সারাক্ষণ ঘ্যানর ঘ্যানর করে—”
— “মহিলা মানুষের কাজই ওইটা। ঘ্যানর ঘ্যানর করা। বস্তাপঁচা ইমোশনাল টপিক নিয়া ন্যাকামি করা। এদের এতো পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। নিজে যা বুঝবি, তাই করবি। বুঝছিস?”
গম্ভীর গলায় বললো। মাহাদের খুব করে বলতে ইচ্ছে করলো, সেইজন্যই কি তুমি চারু ভাবীকে পাত্তা দিতে না? তার ভালোবাসাকে ন্যাকামি ভেবে যা ইচ্ছে করতে? আর তাই চাও আমিও তোমার মতো করে দিনশেষে আমার বৌকে ডিভোর্স দেই? কিন্তু বললো না। বড় ভাইয়ের এই পুরুষবাদী মন্তব্য শুনেও নিশ্চুপ থাকলো। কেননা সে বরাবরই শান্তিপ্রিয়। কারো কোনোকিছু পছন্দ না হলেও সেটা বলে অকারণে ঝামেলা করা তার আচরণ বিরুদ্ধ।
চুপচাপ দুজন সিগারেটে টান দিতে থাকলো। অন্ধকারে গোল গোল করে ছেড়ে দিতে লাগলো ধোঁয়ার কুণ্ডলী!
হঠাৎ নিচ থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেল। দুটো মেয়েলি স্বরের তীক্ষ্ণতা ভেসে আসছে। হৈ-চৈ চিৎকার থেকে ছিটকে আসছে কিছু গালাগাল। মাহতাব একটা শ্বাস ফেললো। ছোট ভাইয়ের দিকে অত্যন্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
— “তোর বৌটার সমস্যা কি বলতে পারবি? রোজ রোজ এরকম চিল্লায় কেন?”
— “সমস্যা শুধু কি ওর? ভাবী কি নির্দোষ? সে কিছু করে না?”
অভিযোগ নয়, অনুযোগ। মাহতাব বড্ডো বিরক্ত হলো। এই মুহূর্তে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তর্ক করতে সে অনিচ্ছুক। চোখ সরিয়ে হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো, আগের সিগারেটটা ফুরিয়ে এসেছে। তাতে শেষ টান দিয়ে দূরে ছুঁড়তে ছুঁড়তে জানালো,
— “কার কী দোষ আমি জানি না। ওসব মেয়েলি কারবারে আমি নেই। রোজ বৌটা কানের কাছে বকবক করে তোর বৌকে নিয়ে। তার ঝামেলার ধাঁত আছে। তাই বললাম আর কি—”
— “অনুও তো রোজ বলে, ভাবীই নাকি—”
ইচ্ছে করেই কথা শেষ করলো না। সবসময় অপ্রিয় সত্য বলতে নেই। মাহতাবের ত্যক্ত কণ্ঠ,
— “আসলে মহিলা মানুষের স্বভাবই এইটা। সারাক্ষণ ঝগড়া-ঝাটি, কুট-কাচালি। আগে তাও বাড়িতে একজন ছিল, এখন দুইজন হয়েই হয়েছে ঝামেলাটা।”
— “এক বনে দুই রাজা থাকে না।”
ফিচেল কণ্ঠে বললো মাহাদ। মাহতাব ততোধিক গম্ভীর হলো,
— “ওরা কোনো রাজা-টাজা না। মহিলা মানুষের নেতা হওয়ার যোগ্যতা নেই। অন্দর মহলের জিনিস ওরা, ওখানেই ওদের মানায়।”
মনঃক্ষুন্ন হলো মাহাদের। অন্য সময় হলে সে দুটো কথা বলত। কিন্তু আজ বললো না। বড় ভাইয়ের এই পুরুষবাদী মন্তব্য শুনেও নিশ্চুপ থেকে পরমত সহিষ্ণুতার পরিচয় দিলো।
ফের কিছুক্ষণ কাটতেই চেঁচামেচি কমে গেল। নিশ্চয় ওদের মা এসে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। মধ্যস্থতা করেছেন। রোজ এমনই হয়। কোনো একটা ছুঁতো পেলেই এ বাড়ির দুই বৌ নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দেয়। অবস্থা বেশি বিগড়ে গেলে শাশুড়ি এসে থামান ওদের। এ-ই তো হচ্ছে আজকাল!
হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাহাদ,
— “কি যে শুরু হয়েছে বাড়িতে। বুঝালেও কেউ কিছু বোঝে না!”
ইতোমধ্যেই মাহতাব নতুন একটা সিগারেট ধরিয়েছে। বললো,
— “বুঝানোর দরকার নেই। কটা দিন যেতে দে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আগে মাহি একা থাকতে তো কোনো ঝামেলা হয় নি। আবার একা করে দিলে—”
— “করবে কীভাবে? অনুও তো এ-বাড়িতেই থাকে।”
— “সামনের মাসে নতুন একটা ফ্ল্যাট কিনবার কথা। দেখা যাক যদি কিনতে পারি তো—”
— “নতুন ফ্ল্যাট? তুমি না ক’ মাস আগেই ঢাকায় একটা প্লটে শেয়ার কিনলে? এতো জলদিই?”
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো সে। মাহতাব ভ্রু কুঁচকালো,
— “এমন রিয়্যাক্ট করার কি আছে? আমি কি তোর মত বেসরকারি চাকরী করি? সরকারি কর্মকর্তা। বেতন তোর চেয়ে বেশি। টাকার জোগাড় কি হতে পারে না?”
কথার পৃষ্ঠে সহসাই কোনো জবাব দিলো না মাহাদ। কিছুক্ষণ তীব্র চোখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে থেকে শীতল গলায় বললো,
— “আমি, এমনকি আমাদের পুরো পরিবারই খুব ভালো করে জানে, তুমি সরকারি কর্মকর্তা। বেতন লাখের কাছাকাছি। তবুও এই বেতন দিয়ে ক’ মাস পরপর বাড়ি কেনা, ফ্ল্যাট কেনা, বড় বড় অনুষ্ঠান করার অর্থ যোগান দেয়া এতো সহজ নয়। গতমাসেই তো ‘ভাবীর সাধ’ আয়োজনে কতো লাখ খরচ করলে। তার আগে তোমার গ্রামের দিকে জমি কিনলে— তুমি কি ভাবো, বাড়ির লোক জানে না কিছুই? বোঝে না কীসের টাকা?”
মাহতাব একটুও অবাক হলো না। কোনো উচ্চবাচ্যও করলো না। কেবল সাপের মত ঠাণ্ডা চাউনি নিক্ষেপ করলো ভাইয়ের দিকে,
— “আমি ঘুষ খাই, এ তো অস্বীকার করি নি। করবোও না। এটা তো এ বাড়ির ওপেন সিক্রেট। ইভেন, শুধু আমি না, এদের যতগুলো সরকারি চাকরিজীবী আছে তারা প্রত্যেকের ঘুষ খায়। যতই মুখে মুখে ঈমানের বুলি আওড়াক না কেন, খেতেই হবে। তুই খাতা আন; আমি লিখে দিচ্ছি! তাতে কি?
আরে বাবা, আমি ঘুষ না খেলে তোদের এতো চাকচিক্য কোথা থেকে আসবে? এই যে মা মাসে মাসে গহনা বানাচ্ছে, মাহিয়া শাড়ি কিনছে, কাজের লোক রাখছে বাড়িতে এতটাকা দিয়ে, ঘরে ঘরে এসি, টিভি — এতোসব কোত্থেকে আসবে?”
ক্রোধের ধিকধিকি আগুন জ্বলছে ওর দু’ চোখে। মাহাদ তা উপলদ্ধি করলো বলেই ঝামেলা করলো না। শান্ত হয়ে বললো,
— “দুর্নীতি যারা করে তাদের কাছে তার জন্য অজুহাত সর্বদা তৈরি থাকে, ভাইয়া। আমি তর্ক করবো না। তবে বলবো, তুমি যে চাকচিক্যের কথা বললে সেসব না পেলেও আমাদের জীবন থমকে যাবে না। আমরা আমাদের মতোই বাঁচবো। তোমার দুর্নীতি না করলেও চলবে। যা বেতন পাও, তাতে যথেষ্ট সচ্ছলতার সাথেই বাঁচবে তোমার পরিবার, অনাগত ভবিষ্যৎ। অন্যকে বুঝ দেয়া অজুহাত না দেখিয়ে নিজের কর্ম সম্বন্ধে ভাবো বরং। আমি যাই!”
প্রায় নিভে যাওয়া ধুম্রশলাকাটা দূরে ছুঁড়ে উঠে গেল মাহাদ। ত্বরিৎ পায়ে হেঁটে নেমে গেল ছাদ থেকে! পেছনে ফেলে গেল রাগান্বিত এক শ্বাপদকে!
__

বিশাল বিল্ডিংটার সামনে এসে কালো গাড়িটা থামলো। ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে ভেতর থেকে নামতে দেখা গেল সৌভিককে। স্যুট-বুট পরনে একদম ফর্মাল চেহারায়। হাত ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে সে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো। দোতলায় তাদের মিটিং প্লেস। এতটুকুর জন্য লিফটে চড়া অপ্রয়োজনীয়।
কাচের দরজাটা খুলতেই আনিকার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওর। নীল সালোয়ার স্যুটে মেয়েটাকে মানিয়েছে ভালোই। চেহারায় আত্মবিশ্বাসী ভাব। সৌভিককে দেখে এগিয়ে এলো। চঞ্চল ভঙ্গিতে বললো,
— “স্যার, পার্ফেক্ট সময়ে এসে গিয়েছেন। মিটিং আধঘণ্টা এগিয়ে এনেছে এমডি স্যার। আপনাকে জানাবো একদমই মনে নেই—”
— “আপনি সবসময় ভুল করেন, মিস. আনিকা। স্বভাবটা বদলান প্লিজ!”
গম্ভীর মুখে বললো সৌভিক। ইতোমধ্যেই বেশ ক’ মাস পেরিয়ে গেছে। ‘আনিকা’ নামক সেই আনকোরা মেয়েটা বেশ ভালোই উন্নতি ঘটিয়ে নিয়েছে নিজের। যদিও পুরোপুরি রূপে নিজেকে এই কর্পোরেট দুনিয়ার পার্ফেক্ট ‘ওয়ার্কিং উম্যান’ গড়তে পারে নি। তবে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।ভুলোমনা, উদাস, খামখেয়ালী এই নারীর প্রতি তাই আগের মত বিদ্বেষী ভাবটা পোষণ করে না সৌভিক। যথাসম্ভব মানিয়েই চলে। হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান হয় না; তেমন অফিসের প্রত্যেক সহকর্মী সমান নয়। কেউ বেশি কো-অপারেটিভ, অ্যাটেন্টিভ; কেউ একটু খামখেয়ালি ঠিক ‘আনিকা’র মতো!
মিটিংটা হচ্ছে সৌভিকদের অফিসের অন্য একটা ব্রাঞ্চে। খুবই গুরত্বপূর্ণ মিটিং। ওদের ব্রাঞ্চ থেকে নিখিল, আনিকা আর দুজন সহকর্মী সহ সে এসেছে। শুরু হওয়ার কথা সাড়ে এগারোটায়। হঠাৎ করে আধঘণ্টা এগিয়ে কেন নেয়া হলো সে জানে না। এমনটা সচারচর হয় না। মিটিং পিছিয়ে দেয়া হয়, আগানোর নজির খুব কম। সৌভিক হেলেদুলেই তৈরি হচ্ছিল। মাঝপথে এসে নিখিল কল করে জানালো, মিটিং এগোবার কথা। সঠিক সময়ে যেন সে পৌঁছায়! বাকিরা এসে গেছে। অথচ এই মিটিংয়ের সমস্ত কিছু আনিকার উপরে দায়িত্ব দেয়া ছিল। খবরটা তাকে আনিকারই জানানোর কথা ছিল। কিন্তু সে জানায় নি! এখন বলছে, ভুলে গিয়েছে। কি অদ্ভুত!
সৌভিক আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেল।
দু’ ঘণ্টার মিটিং শেষ করে বন্ধুবর নিখিলকে নিয়ে সে যখন বেরোলো তখন নিখিলের পকেটে ফোন বাজছে। বের করতেই চারুর কল! স্ক্রিনে ভাসমান নামটার দিকে একনজর চাইতেই লক্ষ্য করলো, সৌভিকেরও দৃষ্টি এদিকেই। অপ্রস্তুত হাসলো।
— “এক মিনিট, হু? কথা সেরে নেই!”
— “আচ্ছা।”
একটু কি উদাস শোনালো ওর কণ্ঠটা? কে জানে!
সৌভিক স্পেস দিলো ওকে। এগিয়ে গেল ক্যান্টিনের দিকে। মিটিংয়ের পর লাঞ্চ খাওয়ানো হচ্ছে এখান থেকেই। ক্যান্টিনে আগেই এসে বসেছিল আনিকা। বেখেয়ালেই ওর টেবিলে গিয়ে বসলো সৌভিক। মনের উদাস ভাবটা কাটাতেই টুকটাক কথা বলতে শুরু করলো ওর সঙ্গে।

চলবে___

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-২৩+২৪

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৩

রাত্রি নয়টা। খাবার ঘরে পরিবেশনের সময় আজ স্ত্রীকে দেখে নি মাহাদ। সারাদিন অফিসে পার করে বাড়ি ফিরবার পর যেটুকু সময় সে পায়, সেটুকুর পুরোটাই প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেবার জন্য মুখিয়ে থাকে সে। অফিস থেকে ফিরে প্রথম শরবতের গ্লাস হাতে একঝলক দেখা দেয়া থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোবার পূর্ব পর্যন্ত ওর সঙ্গ পেতে চায় ব্যাকুল মন। রোজকার নিয়মে তাইই হয়। প্রতিটা মুহূর্তে অনু পাশে থাকে বটে, তবে আজ কেন যেন ব্যতিক্রম হয়েছে! আর অনুর দেখা পায় নি সে। এক লহমার জন্যও নয়! তবে মা – ভাবির কাছ থেকে শুনেছে অনেক অনেক কিছু! সকালের ঘটনা থেকে বিগত দিনগুলোর অনেক কিছুই সেসবের মধ্যে ছিল!
অন্ধকার ঘরে জানালার কাছে দাড়িয়ে আছে অনু। জানুয়ারির রাতের শীতালু বাতাস বয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বাইরে কুয়াশা। অনু উদাস চোখে চেয়ে আছে সেদিকে। হঠাৎ অনুভব করলো দু’টি বরফ ঠাণ্ডা হাত পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে নিয়েছে, নির্মেদ কোমড়ে বিচরণ চলছে এলোমেলো। উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে কাঁধে। ক্ষণিকের জন্য শিউরে উঠলেও স্বামীকে চিনতে অসুবিধে হলো না ওর। নিজের দুহাত দিয়ে হাত আটকে দিলো মাহাদের। চট করে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। চোখ রাখলো চোখে। মাহাদ কোমল সুরে বললো,
— “কি হয়েছে অনু? এতক্ষণ ছিলে না কেন ঘরে?”
কি ছিল ওর কণ্ঠে? জাদুর ছোঁয়া? অনু আহ্লাদে গলে গেল যেন। অন্যদিকে ফিরে অভিমানী সুর তুললো,
— “আমার খেয়াল এ-বাড়ির কয়জন রাখে? যে যাবো?”
মাহাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ওকে দু’হাতে আগলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “এভাবে বলছ কেন? কিছু হয়েছে?”
— “ন্যাকামো করো না। এ-বাড়ির লোকজনের যা স্বভাব! ওরা এতক্ষণে তোমায় কিছু না বলে আছে?”
কপট রাগ দেখালো অনু। বাহুডোর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস চালালো। মাহাদ ছাড়লো না। শক্ত-পোক্ত বাঁধনে জড়িয়ে নিলো ওকে। সারাদিন এতো ঝক্কি পোহানোর পর বাড়ি ফিরে এসব ঝামেলা তার ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে। এখন রেগে কিছু বললে কথা কাটাকাটি হবে। অশান্তি বাড়বে। তাই শান্ত হয়ে বললো,
— “শুনেছি আমি। কিন্তু সেটা এক পাক্ষিক। বিচার তো এভাবে হবে না। তোমার পক্ষের কথাও তো শোনা উচিৎ। ঠাণ্ডা মাথায় বলো?”
অনু সরে যেতে যেতে বললো,
— “থাক। শুনতে হবে না। যা জেনেছ, তাই নিয়েই থাকো। আমি নতুন করে কিছু বলবো না।”
— “কেন?”
বড্ডো করুণ শোনাল। অনুর একরোখা উত্তর,
— “এমনিই। তোমার বিচার করার প্রয়োজন, তুমি একপক্ষ শুনেই করো। আমি কিছু বলতে চাই না।”
মেয়েটা রেগে আছে। বোঝা যাচ্ছে। মাহাদ উদাস হয়ে কি যেন ভাবলো। সংসার মানেই কি এতো ঝুট-ঝামেলা? সে তো ভেবেছিল, সংসার মানে অনেক ভালো কিছু। স্বামী-স্ত্রীতে মিলেমিশে থাকা। যাদের মধ্যে প্রেম থাকে, একে – অপরকে বুঝবার ক্ষমতা থাকে, বিশ্বাস থাকে— সবচেয়ে বড় কথা ভালবাসা থাকে!
কিছু সময় পর মুখ খুললো সে। আশ্চর্য শীতল সুরে বললো,
— “যা যা শুনেছি, তাই যদি আসল ঘটনা হয়; তবে তোমাকে আমি সাপোর্ট করতে পারি না অনু। সংসার কখনো একার চেষ্টায় সুন্দর হয় না। সবাই মিলেমিশে থাকলে, একত্রে চেষ্টা করলে, তবেই একটা সুন্দর জীবন হয়। আনন্দপূর্ণ জীবন হয়। এখানে কেউ তোমার পর নয়। সবাই আপন। তুমি যেমন আমার কাছে প্রিয়, এরাও আমার তেমনই প্রিয়। আর আমাকে বিয়ে করে তুমি এই মানুষগুলোকে নিজের আপন হিসেবে পেয়েছ। তাদের হাসিমুখে গ্রহণ করো। কোনো মানুষ ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নেই। সবাই ছোটখাটো দোষ আছে। সেগুলো নিয়ে দুঃখ পেয় না। একে-অন্যকে খুঁচিও না। আমি জানি তুমি একটু রাগী। কিন্তু সেটাকে সংবরণ করো। অশান্তি বাড়িও না। কাউকে অযথা হিংসে…”
বিদ্যুৎ বেগে ফিরে আসে অনুলেখা। চোখে একপলের জন্য ঝিলিক দিয়ে গেল রাগের ফুল্কি। মাহাদের মুখোমুখি এসে দাড়াল সে। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
— “আমি হিংসা করি? আমি অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করি? এতবড় কথা তুমি বলতে পারলে? পারলে?”
মাহাদ সংগোপনে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বললো,
— “আমি সেভাবে বলি নি, অনু। ভুল বুঝ না। আমি শুধু তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি—”
ওকে শেষ করতে দিলো না অনু। চেঁচিয়ে উঠলো তারস্বরে,
— “কি বুঝাতে চেয়েছ তুমি? আমি বুঝি না? তোমরা সবাই একই রকম। নিজেদের ভুল ধরবে না! অন্যেরটা ধরে টানাটানি করবে। তোমাকে বিশ্বাস করে, তোমার উপর ভরসা করে, এই বাড়িতে এসেছি আমি। কোথায় তুমি আমার সাথ দেবে, না— বিয়ের আগে খুব দরদ দেখানো গিয়েছিল। এখন সেসব হাওয়া, না? বুঝি তো— বোকা না আমি। এখন বিয়ে হয়ে গেছে। সস্তা পেয়েছ—”
ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কথা বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। পেছনে হতবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলো মাহাদ। সে কি বলতে চেয়েছিল, আর কি হলো? আশ্চর্য!
____

সবে কেবিন থেকে বেরিয়েছে সৌভিক, পেছন থেকে নিখিলের গলা ভেসে এলো,
— “দোস্ত, দাড়া!”
ওর দাড়াবার ইচ্ছে ছিল না। উপেক্ষা করে চলে যাওয়াতেই মন ছিল।তবুও কি যেন ভেবে দাড়িয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি সমস্যা?”
ত্বরিৎ পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসলো নিখিল। চট জলদি বললো,
— “তোর সঙ্গে কথা আছে আমার, চল!”
— “কোথায়? আর কেন?”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ওর কাঁধ চাপড়ে নিখিলের প্রত্যুত্তর,
— “ক্যান্টিনে। বললাম না, কথা আছে? চল!”
নিজের মতো বলেই পা বাড়ালো। সৌভিক ঘাড় কাত করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো ওর দিকে। একটু এগিয়ে নিখিল যখন ফিরে তাকালো, তখন বললো,
— “আমার কাজ আছে। সময় নেই। আমি যাব না।”
কণ্ঠে তিক্ততা মিশে। নিখিল ততোধিক শান্ত সুরে বললো,
— “পাক্কা আধ ঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক, সৌভিক! আই থিঙ্ক ইট’স এনাফ। আর তোর কোনো কাজ নেই। এমনিও আজ হাফ ডে নিয়েছিস। জানি আমি!”
সৌভিক এবার একটু রাগই হলো। ওর সব ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে কেন? কীসের এতো খবরদারি নিখিলের? বাঁকা চোখে তাকালো,
— “নজরদারি করছিস?”
নিখিল হাসলো,
— “সেটা করতে যাবো কেন? কারো উপর নজরদারি করার অভ্যাস আমার নেই। হাফ ডে নেয়ার বদৌলতে তোর বাদবাকি কাজ আমার ঘাড়ে এসে চেপেছে। তাই জানি সব।”
সৌভিক কিছু বললো না আর। চুপ করে রইলো। নিখিল কিছুক্ষণ সময় দিলো ওকে। এগোতে এগোতে বললো,
— “ক্যাফে নির্ঝরে চল্। কফিতে সিপ দিতে দিতে আলাপটা সারছি!”

কফি এসে গেছে। ধোঁয়া ওঠা গনগনে গরম কাপে একের পর এক চুমুক বসিয়ে যাচ্ছে সৌভিক। নিশ্চল-নির্বিকারে। এক ফাঁকে আড়চোখে নিখিলকে দেখে নিলো। সেও নিশ্চুপ। কুচকুচে কালো আলকাতরা রঙের কফির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ। সিপ তুলছে না, কিন্তু চেহারা গম্ভীর। সম্ভবত কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। আচ্ছা, নিক। সৌভিক বাঁধা দেবে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিখিল মুখ না খুললে কিছু বলবে না। একটা বাক্য এমনকি শব্দও নয়!
কিয়ৎক্ষণ পর নিখিল কথা শুরু করলো। ফার্স্ট বলে উইকেট নেয়ার জন্য বলকে ঠিক যেভাবে হিট্ করা উচিৎ, সেভাবেই মোক্ষম কথার বাণ ছুঁড়ে দিলো বন্ধুবরের উদ্দেশ্যে,
— “আই নৌ, চারু ইজ ইয়্যুর লাভ। বাট আনফরচুনেটলি, সে তোর হয় নি। তুই ওকে ভালোবাসিস, ব্যাপারটা সম্ভবত সে জানেও না। তাই না?”
চট করে মুখ তুলে তাকালো সৌভিক। কাপে পরবর্তী চুমুক বসাতে উদ্যত হওয়া ঠোঁট দু’টো ঝুলে গেল তৎক্ষণাৎ। বিস্ময়াহত চাউনিতে অনিমেষ চেয়ে রইলো ইয়ারি দোস্তের পানে।
নিখিল পুনর্বার হাসলো,
— “আমি জানি, তুই অবাক হচ্ছিস। এটা ভেবে যে যেকথা কেউ জানলো না আমি কি করে জানলাম? শোন, তোর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ত্ব। তাই তোর আচরণ কোন ক্ষেত্রে কেমন হতে পারে সেটা আমি জানি। চারুকে ভালোবাসিস বলেই ওকে নিয়ে তুই ওভার পজেসিভ। যেটা তোর অন্য বোনদের ক্ষেত্রে নেই। স্বভাবতই তুই মিশুক ছেলে, কেয়ারিং ম্যান। কিন্তু চারুর প্রতি তোর কেয়ারিং অনেক বেশি। ওর জন্য অনেক বেশি কনসার্ন তোর! সবই খেয়ালই করি—”
— “সবই যদি জেনে থাকিস তবে, ওর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালি কেন? কেন বন্ধুর ভালোবাসাকে নিজের দিকে টানতে গেলি?”
হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো সৌভিক। রাগে ওর শরীর জ্বলছে, দাউ দাউ অনলের ধারালো শিখা মন – মস্তিষ্কের ভেতর!
নিখিল রাগলো না। বরং ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বললো,
— “কারণটা খুব সহজ, সৌভিক। তুই ওকে ভালোবাসিস এ-কথা আমি জানতাম না। সেক্ষেত্রে আমার ফল করা কি দোষের? দেখ, চারু ইজ অ্যা ভেরি প্রীটি গার্ল। অভিয়াসলি অ্যাট্রাক্টিভ অ্যান্ড সুইট। আরেকটা ওয়ার্ড বলতে মন চাইছে, কিন্তু তুই ওর ভাই বলেই বলছি না। কটু শোনাবে। বাট বন্ধু হিসেবে…”
নিখিল দুষ্টু হাসলো। রাগ করলো সৌভিক,
— “আমাকে চেঁতাস না, প্লিজ! আমি জানি না কি করে ফেলবো!”
— “ওকে, ওকে। ক্ষেপে যাস না। দেখ, চারুর এতো এতো গুণ থাকার পর ওকে দেখে প্রেমে পড়ে যাওয়া কি অসম্ভব কিছু! এমনকি ভালোবেসে ফেলা? আমি ঠিক ভালোবেসেই ফেললাম। সঙ্গে বিয়ের পরিকল্পনাও চলে এলো মাথায়। তখন তোর ভাবনা মাথায় এলো। তুই ছেলে ভালো, তোদের ফ্যামিলি ভালো। বন্ধুর ছোট বোনকে প্রেমের প্রস্তাব না দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়াই যুক্তিযুক্ত। ভেবেই তোকে বলতে গেলাম, আর তুই? তখনই আমি বুঝতে পারি, ব্যাপারে ঘাপলা আছে। তোর অনুভূতি আছে ওর প্রতি!”
— “কিন্তু—”
— “আমাকে কথাটা শেষ করতে দে?”
— “কর।”
নিখিল শ্বাস ফেলে পুনরায় শুরু করলো,
— “চারুর অক্ষমতা, বিশ্রী অতীত — এগুলো কোনটা নিয়েই আমার মাথা ব্যথা ছিল না, সৌভিক। আমি সবটা মেনে নিতে পারি, নিয়েছিও। এতে তোর সমস্যা হওয়ার কথা না। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক চলছে। তুই সবই জানিস। কিন্তু সব জেনেও তুই এরকম কেন করছিস? শুধু ওকে ভালোবাসিস বলে? কিন্তু তুই তো এতদিন কিছু বলিস নি? তাহলে? নাকি তুই চাস, চারু সারাজীবন দুঃখী দুঃখী মুখ করে তোদের বাড়ির চার দেয়ালের ভেতর আটকে থাকুক? ভুলে যাক সমস্ত সুখ, স্বপ্ন-আহ্লাদ?”
— “বাজে বকবি না একদম। আমি এমনটা চাই না মোটেও!”
— “তবে তুই কি চাস?”
নিখিলের প্রচন্ড চিৎকারে কেঁপে উঠলো পুরো কফিশপটা। উঁচু গলার স্বর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে বারবার কানে বাজতে লাগলো সৌভিকের। আশেপাশে চেয়ে দেখল, সকলেই হতভম্ব চোখে দেখছে ওদের!
নিখিল নিঃশ্বাস ফেললো। মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে হঠাৎ। সত্যিই সে ওকে বুঝতে পারছে না। কি চায়, সৌভিক? কি চায়?
একটুপর সৌভিক বললো,
— “আমি তখন সদ্য ভার্সিটিতে যাই। সারাজীবনের বেড়ে ওঠা প্রিয় বাড়ি, প্রিয় আঙিনা ছেড়ে হলে উঠেছি। অবাধ স্বাধীনতা আমার দুয়ারে এসে হানা দিয়েছে। আশেপাশের রঙিন পৃথিবী দেখছি। মনটা উড়ু উড়ু করছে। নতুন জগৎটাকে আমার ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করলো। মনে হলো, ইসস, এত্ত সুন্দর সবকিছু! কিন্তু প্রায় মাসখানেক থাকবার পর এই রঙিন দুনিয়াটা হঠাৎ করেই আমার ভীষণ অসহ্য ঠেকলো। আমি ধীরে ধীরে অনুধাবন করলাম, এখানে আমার মন টিকছে না। যান্ত্রিক শহরের চাকচিক্য, পশ লাইফ স্টাইল — আমায় ক্ষণিকের জন্য আকর্ষণ করেছিল। আমার মন এখানে ভালো নেই। শূণ্য বুক জুড়ে আমার হাহাকার। কেননা এখানে ভালোবাসা নেই!
আমি ফিরতে চাইলাম, কিন্তু ফেরা হলো না! যে পাখি পিঞ্জর ছাড়ে একবার, তার যে আর ফেরা হয় না!
সেবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে সেখানককার সবকিছুকেই আমার খুব ভালো লাগলো। মা-বাবা, চাচা-চাচী, ভাইবোন — সবাইকেই। আর বিশেষ করে ভালো লাগলো কাকে, জানিস? চারু! ভার্সিটিতে আমার অনেক অনেক মেয়ে বন্ধু ছিল; তুই জানিস সেটা। কিন্তু তাদের কাউকেই আমার ভালো লাগতো না। কারণ চারু। ওর মতো স্নিগ্ধ, শান্ত, নম্র-ভদ্র মেয়েকে ছেড়ে অন্যদের কেন ভালো লাগবে? ওর প্রতি অনুভুতির শুরু আমার ঠিক কখন থেকে, আমি জানি না। তবে সেবার ঈদের ছুটিতে গিয়েই আমি টের পাই আমার ভালোবাসা চারু।
আমি গোপনে গোপনে ভালোবাসতে থাকি। চারুকে প্রাণভরে দেখি, মনে মনে কতশত কল্পনা করি! এসব কিছুই ওকে বলি নি। পাছে অবজ্ঞা করে দূরে থেকে দেয়? আমি অপেক্ষা করি সময়ের। যেদিন চাকরী পাবো, সেদিন বড় আব্বাকে বলবো। তার মেয়ের হাত চাইবো…”
এ পর্যায়ে নিখিল মৃদু কণ্ঠে শুধালো,
— “তবে করলি না কেন?”
— “সুযোগ হয় নি।
— “মাস্টার্সের ছাত্র আমি তখন। ছুটিতে বাড়ি যাবার কথা। কিন্তু কি যেন এক ঝামেলায় যাওয়া হলো না। কিছুদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। ফোনটা নষ্ট হয়েছিল। তার মাস খানেক পরেই সম্ভবত পুজোর ছুটি ছিল। সেই ছুটিতে বাড়ি যাবো, মা ফোন করে বললো ওরা আসছে। তখনই জানতে পারি, চারুর বিয়ের কথা। কেনাকাটা করতে ঢাকা আসছে সবাই। ওই মুহূর্তে কি রিয়েকশন দেখানো উচিত ছিল আমি জানি না। বালির বাঁধের মত ঝুরঝুর করে পড়ে গিয়েছিল আমার সমস্ত স্বপ্ন, সাধ-আহ্লাদ!
ওরা সবাই ঢাকায় এলো। হৈচৈ হুল্লোড়! কি আনন্দ সবার চোখেমুখে। চারুকে একবার জিজ্ঞেস করলাম,
‘তুমি খুশি?’
মেয়েটা লজ্জায় মাথা নোয়ালো। কষ্টে বুক ফেটে গেল আমার। আমি দাদুর কাছে ধর্না দিলাম। আকুল হয়ে নিজের মনের কথা বললাম। দাদু গম্ভীর হয়ে জানালো, আমি যা ভাবছি তা সম্ভব নয়। চারুর আংটি বদল হয়েছে আগের মাসে, বিয়ের তারিখ ঠিকঠাক। এতদিন ধরে তারা পাত্র দেখেছে, কথাবার্তা হয়েছে, এখন কি করে—
তাছাড়া আত্মীয়ে-আত্মীয়ে সম্পর্কটা বাড়ির লোকজন ভালো চোখে দেখবে না। এসব কথা উঠলে ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝামেলা হতে পারে। দাদুর এতবছরের আগলে রাখা এই সংসার! ঠুনকো কারণে তিনি ভাঙতে দেবেন না।
চারুর তো মাহতাবকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই। সে নাকি খুশিই ছিল। তাহলে?
দাদুর কাছে ব্যর্থ হয়ে আমি মা’র কাছে ছুটলাম। তার ছোট ছেলে আমি, অতি আদরের। কিন্তু সেই আদরের ছেলের একটিমাত্র আবদার তিনিও রাখলেন না। বড় চাচীর সঙ্গে তাঁর কি রেষারেষি আছে, বড় চাচীর মেয়েকে ছেলের বৌ করতে তিনি নারাজ। ঘরের মেয়ে, মেয়ে হিসেবেই নাকি মানায়। বৌ হিসেবে মানা যায় না!
সবদিক দিয়ে আমায় নিরাশ হতে হলো। সেই ছুটিতেই চারু বিয়ে করে মাহতাবদের সঙ্গে চলে গেল শ্বশুরবাড়িতে!”
— “তারপর? তারপর দু’ বছর পর আবার তোর কাছে সুযোগ আসে। তুই তখনো চারুকে নিজের করে নিতে পারতি!”
সৌভিক একটা ক্লান্ত নিশ্বাস ফেললো। কফির কাপে শেষ চুমুকটা বসিয়ে বললো,
— “চারুর সংসার হলো না। মাহতাব ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিলো। বাড়ি ফিরে চারু খুব ভেঙে পড়েছিল। আমি সময় দিচ্ছিলাম ওকে। নতুন করে সবটা সাজাতে চেয়েছিলাম। আমি জানি এবারও পরিবার আমার বিপক্ষে যাবে। ছ’ মাস আগে মা আমার বিয়ের কথা তুলেছিল। আমি চারুর কথা বলতেই উনি আবারও নারাজ হলেন। রাগারাগি করলেন। নাতি – নাতনির মুখ তিনি দেখতে চান। আগে তাও যেটুকু মেনে নেয়ার সম্ভবনা ছিল, সব কর্পূরের মতো উবে গেল। আমার বিয়ের প্রসঙ্গ ধামাচাপা দিলেন। আমিও রাগ করে ঢাকায় ফিরলাম। তারপর বাড়ি যাওয়া হয় নি।
এবার তোকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম, অনুর বিয়ে খেতে। এরমধ্যে…”
নিখিল কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে আসলেই বুঝতে পারছে না এখানে কার দোষ বেশি! কিংবা কার দোষ কম!
কোনোমতে বললো,
— “আমি সত্যিই জানতাম না, সৌভিক। জানলে নিজের প্রিয় বন্ধুর ভালোবাসাকে আমি কেড়ে নিতাম না। কিন্তু এখন আমি কি করবো, বল তো? আমি চারুকে ভালোবাসি। যতটুকু বুঝি, সেও আমাকে। তুই কেন আগে কিছু বললি না? কেন সময়কে বিশ্বাস করলি? এই সময় যে তোকে আগেও ধোঁকা দিয়েছিল!”

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৪

দেখতে দেখতে মাস গড়ালো। ফেব্রুয়ারিতে পদার্পণ করলো মাস। শুষ্ক-শীতল আবহাওয়ায় দিনগুলো ভালোই কাটছিল। সৌভিক-নিখিলের মতো কর্মকরা মানুষের কর্মব্যস্ত দিন। চারুর সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কটা বেশ জমেই গিয়েছে নিখিলের। রোজ রোজ ফোনকলে কথা, সকালে অফিস যেতে-যেতে, দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের ফাঁকে আর রাতে বাড়ি ফিরে বিছানায় শরীর এলিয়ে টুকটুক করে দু’ প্রান্তের দু’জন মানুষ গল্পে মেতে ওঠে। সারাদিন কি কি করলো তারা, লাইনের ওপাশের অপরপক্ষকে জানায়। মাঝে মাঝে ভিডিও কলেও সাক্ষাৎ হয় ওদের। কিন্তু তা মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। ভিডিও কলে নিখিলের সামনে বসে কথা বলতে ভীষণ লজ্জা পায় কি-না! নিখিল অবশ্য হাসে খুব। এই নিয়ে ওকে পঁচানি দিতেও ছাড়ে না,
— “এখনই এতো লজ্জা পাচ্ছেন? বিয়ের পর কি করবেন, বলুন তো?”
ওর চোখের দুষ্টু ইশারা বুঝতে অসুবিধে হয় না চারুর। লাজে রাঙা গাল নিয়ে মন্তব্য ছুঁড়ে ওর দিকে,
— “সে তখন দেখা যাবে!”
— “তখন কিন্তু এসব লজ্জা-ফজ্জা চলবে না, ম্যাডাম! শুধুই আদর চলবে!”
চারু লজ্জায় অবনত আরক্তিম মুখখানি লুকোনোর জায়গা খুঁজে পায় না। চট করে কল কেটে অফলাইনে চলে যায়। ওপাশ থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নিখিল!
রিংকু-টিংকুর মতো ভীষণ দুষ্টু ছেলেদের জন্য মহানন্দের সময়। তারা কোনোমতে উতরে গেছে তাদের ক্লাস এইট। বছর শুরুর দিনগুলি। তাই দু’ ভাইয়ের এখন পড়ালেখা নেই। তাদের জোর দাবি তারা বড় হয়ে গেছে। ক্লাস নাইনে উঠেছে কি-না!
অনুলেখার সাংসারিক জীবন চলছে তার মতন। রোজকার একঘেঁয়ে রুটিন। আজকাল বাপের বাড়িকে খুব মনে পড়ে মেয়েটার। মাঝে মাঝে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে এ বাড়িতে, তার আজন্ম বেড়ে ওঠা প্রিয় ‘অরুণা ম্যানশনে’! কিন্তু ফেরা হয় না। যে নারী একবার ‘কবুল’ বলে স্বামী নামক মানুষটির হাত ধরে বাড়ি ছাড়ে, তার যে বাপের বাড়ি বলে আর কিছু থাকে না!
মাঝে মাঝে দু’ একদিনের জন্য আসে বটে কিন্তু আগেকার সেই দখলদারিত্ব, দাপুটে ভাবটা আর নেই। মনে মনে অনুও জানে সেরকম অহং দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে ফিরে যায় শ্বশুরবাড়িতে; তার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের একমাত্র ঠিকানায়।
এরমধ্যে একটা খবর এসে জীবনটাকে সুখের করে তোলে তার। অনু জানতে পারে, সে মা হতে চলেছে। দু’ বাড়িতেই মোটামুটি খুশির জোয়ার বয়ে যায়। সেই প্রথমবার, হ্যাঁ, সেই প্রথমবারের মত বড় বোনকে টেক্কা দিতে পেরে ভীষণ আনন্দিত হয় অনুলেখা। তার সারাজীবনের আফসোস, চারুর চেয়ে এগিয়ে না থাকার, প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ হতে না পারার আক্ষেপ, মুছে যায় নিমিষেই!
মাতৃত্বের আনন্দের চেয়ে এই আনন্দটাই ওর কাছে বেশি হয়ে ওঠে তখন। চারুকে সে হারিয়ে দিয়েছে!
____

ক’দিন ধরে অফিসে আসে না আনিকা। কি যে হয়েছে আল্লাহ্ মালুম। এমডি স্যার সেদিন খোঁজ করলেন। সৌভিকের উপর দায়িত্ব পড়েছে মেয়েটার। খবর রাখা আবশ্যিক। ও কল করলো। একবার না, কয়েকবার। ধরবে তো দূর, কল তো গেলই না! সুইচ অফ্ বলছে। বিরক্ত সৌভিক আর কল করল না। এরকম ইরেস্পন্সিবল এমপ্ল্যোই নিয়ে চলা মুশকিল।
ক’ দিন কাটলো। আনিকা তখনো অনুপস্থিত অফিসে। সৌভিক এরমধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা করে নি। লাঞ্চ ব্রেকে ওর এক কলিগ রাসেলের কাছেই শুনলো আধো আধো,
— “বুঝলেন, ভাই। অফিসের যে নতুন এমপ্ল্যোই গুলো এসেছে অধিকাংশই কেমন যেন। সব ইরেগুলার, ইরেস্পন্সিবল। এদের নিয়ে যে কি করবো—”
— “কেন? কে আবার কি করলো?”
খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো সৌভিক। রাসেল শ্রাগ জানালো,
— “আর বলবেন না, ভাই। আমার ঘাড়ে পড়েছে এক উজবুক। এমন বেকুবের বেকুব মাস খানেক ধরে বুঝিয়েও কিছু বুঝাতে পারছি না। ইসস, জীবনডা জ্বালায় ভেজে ভেজে খাচ্ছে—”
রাসেলের আহাজারি শুনে সৌজন্য হাসলো সৌভিক। কিছু বললো না। উনি নিজেই ফের বললেন,
— “আপনার কি অবস্থা? ওই মেয়ে, কি যেন নামটা, আনিতা—আনিশা—”
— “আনিকা।”
সৌভিক শুধরে দিতেই সায় দিলেন,
— “হ্যাঁ, হ্যাঁ। আনিকা। তার কি অবস্থা? দেখতে – শুনতে তো ভালোই মেয়ে। কিন্তু বোধ হয় একটু ঢিলে। খামখেয়ালী টাইপের— না?”
সৌভিক মাথা নাড়ালো,
— “কি জানি, ভাই। অতশত বুঝি না। কিন্তু একটু উইয়ার্ড মেয়ে। কোনো কথা বললে কেমন যেন রিয়েকশন দেয়। চট করে কিছু বোঝে না। কাজে মন নেই। উদাস কিন্তু কাজ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে খুব উৎফুল্ল। অদ্ভুৎ!”
— “অদ্ভুৎ তো বটেই। কিন্তু মেয়েটা কিন্তু খুব ব্রিলিয়ান্ট। এটা খেয়াল করেছেন? সেদিন আমার একটা প্রবলেম ফট করে সলভ করে দিলো! আ’ম ইমপ্রেসড্!”
রাসেল ভাইয়ের চোখে তৃপ্তি। সৌভিক অনিমেষ চেয়ে লক্ষ্য করলো। আনিকার গুণ শুনে একটু অবাকও হলো। সে বরাবরেই এই মেয়েকে বাতিলের খাতায় ফেলেছে। ওর ধারণা আনিকার মতো উদাস, বেখেয়ালি মেয়েকে দিয়ে আর যাই হোক, কর্পোরেট দুনিয়ায় চাকরী হবে না! এখন শখ করে হয় তো এসেছে, টিকতে পারবে না। কিন্তু সহকর্মীর কথায় অবাক হলো,
— “মেয়েটা ক্রিয়েটিভ আছে, বুঝলেন? কিন্তু কেয়ার করে না। আল্লাহ্ সবসময় অপাত্রেই ভালো জিনিস দান করেন কেন কে জানে!”
সৌভিকের বড় ইচ্ছে করলো জিজ্ঞেস করতে ‘কি এমন গুণ দেখলেন ওই উড়নচণ্ডী মেয়ের মধ্যে? এতো মুগ্ধ গিয়ে গেলেন?’ — কিন্তু জিজ্ঞেস করলো না। অজানা সংকোচ ঘিরে ধরলো। কথা পাল্টে বললো,
— “ও কদিন ধরে অফিসে আসে না কেন, জানেন?”
— “জ্বর এসেছে তো। জানেন না? কাল বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছে।”
— “ওহ্। জানতাম না।”
ক্লান্ত শ্বাস বিমোচন করলো সৌভিক। সে সত্যিই জানতো না কিছু। মেয়েটা তবে অসুস্থ! সেজন্যই আসে না! সে আরো না জেনে মেয়েটাকে ‘ইরেগুলার, ইরেস্পন্সিবল’ কতকিছু বললো! কাজটা ঠিক হলো না। মেয়েটা অন্যমনস্ক কিন্তু অতটাও খারাপ নয়! ফাঁকিবাজি নেই ওর ভেতর। তারপরেই হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, সবাই যেটা জানে ও সেটা জানলো না কেন? নিতান্ত আনিকা সম্বন্ধে কিছু জানতে চায় নি, আগ্রহ দেখায় নি বলেই?
___

ছেলের ঘরে যাচ্ছেন নিলুফার নাজিয়া। রাতের খাবার খেতে ডাকছেন সেই কখন থেকে। নিখিলের কোনো পাত্তা নেই। রাগ করে এলেন, ওর কান ধরে টেনে নিয়ে যেতে। ‘রাত কত হয়েছে, সে হুশ আছে? সারারাত কি ভাত নিয়ে আমি বসে থাকবো? আমার আর কাজ নেই?’ — রাগে গজগজ করতে করতে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। ঘর ফাঁকা। লাগোয়া বাথরুম থেকে পানির তিরতির শব্দ আসছে। নিখিল ওয়াশরুমে। বিছানায় রাখা ওর ফোন বাজছে। উনি গলা উঁচিয়ে ডাকলেন,
— “এ্যাই ছেলে? বেরোবি না? তাড়াতাড়ি বেরো!”
ভেতর থেকে সাড়া নেই। হয় তো আওয়াজে শুনতে পায় নি। নাজিয়া দু’ সেকেন্ড পর ফের হাঁক দিলেন,
— “এ্যাই নিখিল! শুনছিস?”
ট্যাপ বন্ধ হলো। পানির ঝিরঝিরে শব্দটা কমে এলো। নিখিল জবাব দিলো,
— “হুম। থামো।”
— “থামো মানে? তোর ফোন বাজছে তো। কানে শুনিস না? কল রিসিভ করবে কে?”
একটু বাদেই বিখিলের জবাব,
— “রিসিভ করে দেখো তো কে! আমি গোসল সারছি…”
— “রাত-বিরেতে তোকে গোসল করতে হবে কেন? শুনি! এই শীতে— নিউমোনিয়া হলে দেখিস।”
রাগে গজগজ করতে করতে ফোনের কাছে এগোলেন। অনবরত বেজে চলেছে সেটা। কি এক রিংটোন ব্যবহার করে তার ছেলে। একটানা চ্যানচ্যানে আওয়াজ! উফ্! মাথা ধরে যায়! মুখ কুঁচকে ফোনটা হাতে তুলে নিলেন নাজিয়া। স্ক্রিনে গোল করে ভাসছে একটা মেয়ের ছবি। চমৎকার রূপবতী এক মেয়ে। নিচে ইংরেজিতে লেখা,
“Charulota Jafrin”
কে এই মেয়ে? নিখিলের সঙ্গে চাকরী করে না-কি? কলিগ? ভাবতেই ভেতর থেকে ছেলের গলা শোনা গেলো,
— “আম্মি, রিসিভ করলে? কে এলে?”
— “হুঁ, করছি।”
— “তাড়াতাড়ি করো।”
তাড়া দেয়ায় আর কিছু ভাবলেন না তিনি। স্ক্রিনের জ্বলজ্বলে সবুজ অংশে সোয়াইপ করে সেলফোনটা কানে চাপলেন। ওপাশ থেকে মেয়েলি মিষ্টি স্বর ভেসে এলো,
— “আসসালামু আলাইকুম, নিখিল সাহেব। কেমন আছেন?”
এই কোকিলা কণ্ঠি নারীর পরিচয় কি? জানতে উদগ্রীব হলেন নাজিয়া। সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম। নিখিল নেই, মামণি। আমি ওর মা বলছি।”
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। চারু থমকালো। নিখিলের মা বলছে? কেন? নিখিল কোথায়?
— “নিখিল নেই?”
— “ও তো শাওয়ার নিতে গেছে। তুমি কে বললে না তো? ওর কলিগ?”
চারু আবারও সময় নিলো। কি পরিচয় দেবে এখন? নিখিলের বন্ধুর ছোটবোন? ধুর, সে পরিচয়ে আবার কিছু হয়। তবে? সে কি করে বলবে ‘আপনার পুত্রের প্রণয়িনী আমি’? এ কি বলা যায়? একে তো লজ্জার কথা, তার উপরে—
একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে স্বপ্রতিভ গলায় বললো,
— “জ্বি না, আন্টি। আমি চারুলতা জাফরিন। আপনার সঙ্গে কখনো কথা হয় নি আমার। আশা করি ভালো আছেন। একটা প্রয়োজনে কল দিয়েছিলাম। ফিরলে তাকে বলবেন। পরিচয়টা নাহয় উনিই দেবেন!”
বাহ্, মেয়েটার বলবার ভঙ্গি তো দারুণ! নাজিয়ার ভীষণ পছন্দ হলো এই অচেনা মেয়েকে। কলিগ নয় তবে এ কে? নিখিল প্রেম করছে? ও-মা! ‘তুমি কি ওর প্রেমিকা?’ — প্রশ্নটা করতে গিয়েও করা হলো না, ওপাশ থেকে মেয়েটার নির্মল ঝরঝরে কণ্ঠ,
— “রাখছি, কেমন? ভালো থাকবেন আন্টি!”

কল কেটে গেল। বিস্ময়াহত নাজিয়া স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো নিখিল। হাতের টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে মার উদ্দেশ্যে বললো,
— “কে কল দিয়েছিল, মা? বললে না?”
সেলফোনটা পূর্বের স্থানে রেখে ছেলের দিকে সরু চোখে তাকালেন,
— “চারুলতা জাফরিন কে রে? কল দিয়েছিল!”
হুট করে মায়ের কথা শুনে চমকে উঠলো নিখিল। ত্বরিত কর্মরত হাত দু’ খানি থেমে গেল। বিমূঢ় বনে নিস্পলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। নাজিয়া এগিয়ে এলেন কয়েক পা। কোমড়ে হাত রেখে বললেন,
— “তুই প্রেম করছিস, বলিস নি কেন হুঁ?”
মার বলার ধরণ দেখেই হেসে ফেললো নিখিল। যদিও হাসা উচিৎ না। কঠিন পরিস্থিতি। তবুও হাসি আটকানো গেল না।
নাজিয়া থমথমে মুখে বললেন,
— “হাসছিস কেন, বজ্জাত ছেলে!”
— “তুমি এমন অ্যাটম বোlমের মতো ফুলে আছো কেন মা? কি হাস্যকর দেখাচ্ছে জানো?”
হাসতে হাসতে বললো নিখিল। নাজিয়া রাগে ফেটে চৌচির,
— “বদমাশ! ঢং করবি না কিন্তু। আসল কথা বল আগে! কতোদিন ধরে চলছে এসব? শুধু প্রেম না বিয়েও করে রেখেছিস? হুঁ?”
হুংকার দিয়ে উঠলেন। নিখিল এসে মাকে আগলে নিল। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— “বলছি তো। হাইপার হচ্ছো কেন?”
— “না, আগে বল। বিয়ে করেছিস? না শুধু প্রেম— বল।”
তেঁতে উঠলেন। নিখিল হাসলো,
— “তুমি যে কি-না, আম্মু! বিয়ে করবো কেন? তাও তোমায় না জানিয়ে, একটু আধটু কথা হয়—”
— “কবে থেকে? বলিস নি কেন আমাকে?”
ক্রোধানল কমলো জননীর। বদৌলতে অভিমানি কণ্ঠে অনুযোগ করলেন। নিখিল শান্ত করবার চেষ্টা করলো তাকে,
— “বেশিদিন হয় নি। আমি জানাতাম তোমাকে। কিন্তু—”
— “জানাতি, না? মিথ্যুক!”
— “ওওও মা! শোনো তো—”
মাকে বুঝিয়ে খাবার ঘরের দিকে এগোলো নিখিল। খেতে খেতে ধীরে-সুস্থে বলবে সব।

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

(পরবর্তী পর্ব পেতে পেইজে লাইক-ফলো দিয়ে সঙ্গে থাকুন। গল্প আপলোড দেয়া মাত্র নিউজফিডে পৌঁছে যাবে ❤️)

[যে মানুষটির সঙ্গে ফোটনের বিয়ে ঠিক হয়েছে তাকে দেখে ওর একটুও পছন্দ হলো না। গোমড়ামুখো বিদ্যেধরী সেই পুরুষটিকে দেখেই ফোটন নাক কুঁচকে মনে মনে ভাবলো,
–এ আমায় বিয়ে করে করবে কি? সোহাগ করবে, না মাস্টারি?
হ্যাঁ, ফোটনের বরটি পেশায় একজন মাস্টার। প্রাইমারি স্কুলের নয়, কলেজের মাস্টার। ভদ্র ভাষায় বললে ‘প্রভাষক’। নাম হলো, খন্দকার জাফর। নামের মধ্যেই কেমন একটা অহংকার মিশে আছে না? অন্তত ফোটনের তাই মনে হচ্ছে। ইসস, খন্দকার! কেমন ঢং ওয়ালা নাম। শুনেই গা জ্বলে ওঠে!
চেহারাটাও তেমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়। ফর্সা ছিল বোধ হয় কোনো কালে! এখন তামাটে বর্ণ হয়েছে। আয়ত চোখ, উঁচু নাক আর গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সোফায় বসে থাকায় উচ্চতাটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে আন্দাজ করা যায়, গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে একটুখানি লম্বা। কিন্তু তাতে কি?
নায়কোচিত কোনো হাবভাব তো নেই। রাশভারী গাম্ভীর্য, মার্জিত, মেপে মেপে কথা বলার ভঙ্গি দেখেই নিজের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষটির প্রতি অদ্ভুত এক বিরক্তিতে মনটা ভরে এলো। বসার ঘরের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পাত্রের মুখখানায় দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হলো না আর। সবেগে পর্দা উড়িয়ে নিজের উপস্থিতির কথা সক্কলকে জানিয়ে, দর্প নিয়ে হেঁটে ফিরে গেল ঘরে!
পাত্র তার পছন্দ হয় নি, একটুও নয়!
ঘরে গিয়ে পৌঁছানো মাত্রই পিছু পিছু চলে এলো মায়মুনা বেগম। একমাত্র কন্যারত্নের এই বেত্ত্মিজ আচরণ দেখে শাসাতে এসেছেন তিনি। কিসব ব্যবহার এগুলো?
রাগ করে বললেন,
–এসব কি ফোটন? তুই ওখানে দাড়িয়ে ছিলি কেন? আর এলি যখন চুপ করে আসতে পারিস নি? হস্তিনীর মতোন আসবার কি দরকার?
মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরলো ফোটন। আদুরে গলায় বললো,
–গোমড়ামুখো প্যাঁচাটাকে আমার পছন্দ হয় নি, আম্মা। আমি বিয়ে করবো না।
–বিয়ে না করলে কি করবি, মা?
মায়মুনা বেগম স্নেহাতুর হয়ে তাকান। ফোটনের বয়স উনিশ চলছে। তাদের মফস্বল শহরে মেয়ে বিয়ে দেয়ার এই তো উপযুক্ত সময়! জেদী বাচ্চার মত মাথা নাড়ে ফোটন,
–জানি না!
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন মায়মুনা। মেয়ের চিবুক ধরে উঁচু করলেন মুখটা। বললেন,
–মেয়েদের বিয়ের বয়স হলে, বিয়ে করে নেয়াই ভালো। তোর আব্বারে তো চিনিস। নিজে যা বুঝে তাই করে। তার উপরে কারো বলার সাধ্য নাই। সে যে পাত্র দেখছে, তার সাথে বিয়ে হলে তুই সুখী হবি রে মা!
নীরবে সম্মতি দিলো ফোটন। ওই গম্ভীর ভালুকটাকে তার পছন্দ না হলেও করবার কিছু নেই; আব্বা বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন!

ফোটনের আব্বা ফারুক আহমেদ। স্থানীয় একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। একুশ বছরের চাকরী জীবনের শুরুতে ছিলেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। পদোন্নতি হয়ে অধ্যক্ষ হয়েছেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন বলেই হয় তো, তার চরিত্রে ‘মাস্টার মাস্টার’ ভাবটা স্থায়ী হয়ে গেছে। ঘরে – বাইরে সবজায়গায় তার কর্তৃত্ব। স্বৈরাচারী এই লোকটির ভয়ে তটস্থ ছাত্রসহ বাড়ির মানুষগুলো পর্যন্ত!
তার একমাত্র কন্যার আজ আংটি বদল। পাত্র তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীর সুযোগ্য ছেলে ‘খন্দকার জাফর’। যে নিজেও একজন সরকারি বেতনভুক্ত কর্মী, কলেজের শিক্ষক!

মিনিট ত্রিশেক পরেই নিচ থেকে ডাক পড়লো ফোটনের। ফারুক আহমেদ উঁচু গলায় ডাকলেন মেয়ের মায়ের উদ্দেশ্যে,
–মায়মুনা? মেয়েকে নিয়ে আসো।
লাল টুকটুকে শাড়ি পরা পুতুলের মতো জবুথবু হয়ে মেহমানের সামনে গেল ফোটন। মায়ের শিখিয়ে দেয়া পন্থায় কুশল বিনিময় করলো। তারপর চুপটি করে বসলো পাত্রের ঠিক মুখোমুখি। কথাবার্তা হলো। আংটি পরানোর পর মিষ্টিমুখ করানো হলো। এরপর পাত্রের পিতা খন্দকার জুলফিকার প্রস্তাবখানা পেশ করলেন,
–ফারুক ভাই, ছেলে-মেয়েদের আলাদা করে কথা বলা উচিৎ ছিল না?
এতক্ষণে ফোটনের স্বৈরাচার বাপের মনে হলো, কথাটা আসলেই যুক্তিযুক্ত। ছেলেমেয়েদের একান্তে কথা বলতে দেয়া উচিৎ। উত্থাপিত প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে তিনি মেঘমন্দ্র গলায় বললেন,
–ফোটন? যাও তো আম্মা, জাফররে ছাদটা ঘুরায় আনো। বাগান দেখাও।
বাপের কথায় দিরুক্তি করবার সাহস ফোটনের নেই, কোনোকালেই ছিল না। অতএব, পিতার আদেশ শিরোধার্য মেনে সে খন্দকার জাফরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ছাদ দেখাতে নিয়ে গেল।
আগে ছেলেটাকে দেখা হয় নি। তাই ফোটন চাইলেই নিরিবিলিতে তাকে ভালোমত দেখে নিতে পারত। পাঁচ মিনিটের ক্ষুদ্র সময়ে ভালোমন্দ বলার সুযোগ না হোক, ভালো করে একটা মানুষকে দেখে তো নেয়া যায়?
কিন্তু অতিরিক্ত লাজুকতায় ফোটন তা পারলো না। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের সামনে পাত্রী হিসেবে দাড়াতে তার লজ্জায় – সংকোচে হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। মুখ তুলে চেয়ে দেখা হলো না মানুষটিকে। নিশ্চল নীরবতায় ছেদ ঘটিয়ে একটি চমৎকার পুরুষালি স্বর বলে উঠলো,
–তোমার নাম ফোটন? অদ্ভুত নাম তো!
কণ্ঠের গভীরতায় ফোটনের বুক কেঁপে উঠলো। আশ্চর্য তো! একটা মানুষ এত সুন্দর করে কীভাবে কথা বলতে পারে? রাশভারী আওয়াজ অথচ কি ঝরঝরে সুন্দর প্রতিটি উচ্চারণ! ফোটন একটু একটু করে গলতে লাগলো।
জাফর আবারও বললো,
–তুমি সাইন্সের ছাত্রী? ফোটন মানে জানো?
লজ্জায় মুখে কিছু বলতে পারলো না মেয়েটা। আরক্তিম চেহারায় কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে জানালো,
–হুঁ।
–বলো তো কি?
–আলোর কণা।
এই প্রথম মুখ খুললো ফোটন। জাফর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে স্বগতোক্তি করলো,
–তোমার কণ্ঠটা তো বেশ সুন্দর! অবশ্য তুমিও খুব সুন্দর…
শরমে মরে গেল ফোটন। ইচ্ছে করলো, একবার লোকটার মুখের দিকে তাকাতে। আড়চোখে একপল চেয়েও দেখলো। বিশেষ কোনো ব্যাপার চোখে পড়লো না বটে; তবে প্রথমবারের মত খারাপও লাগলো না।
ভালো লাগলো লোকটাকে। জাফর ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো তার দিকে,
– সবে উচ্চ মাধ্যমিক দিলে, এখনই বিয়ে করতে চাইছ কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাও না?
ব্যস্! ফোটনের মেজাজটা বিগড়ে যাওয়ার জন্য একটা প্রশ্নই যথেষ্ট ছিল। হলো তো? ষোলোকলা পূর্ণ? মাস্টার সাহেব, মাস্টারি শুরু করলেন তো? সারাজীবন এক মাস্টারের খপ্পরে পড়েই কূল পায় নি, সঙ্গে আরও একজন যোগ হলে চলবে কি করে? বেশ তো কথা কইছিলে বাপু, ফের পড়ার প্রসঙ্গ আনা। কেন?
ফোটনকে চুপ করে থাকতে দেখে জাফরের রাশভারী সুর প্রতিধ্বনিত হলো পুনর্বার,
–তুমি বোধ হয় কথা কম বলো, না?
কথাটা একেবারেই মিথ্যে। কারো সঙ্গে একবার মিশে গেলে ফোটন যে কতো কথা বলতে পারে, তা তো ধারণায়ই নেই মাস্টার মশায়ের! তথাপি ফোটন সরলপানা মুখ করে বললো,
–জ্বি।
–তবে তো হলো না, আমিও যে কম কথা বলি? স্বামী – স্ত্রীতে বোবা হয়ে থাকবো নাকি?
বলেই হাসলো জাফর। গম্ভীর ভালুকটাকে হাসতে দেখে অবাক হয়ে তাকালো ফোটন। এই লোক হাসতেও জানে?
মুক্তোর মতো সাদা দাঁতের ঝলক আর বাতাসে ঝংকার তোলা সুন্দর হাসিটা দেখে ওর একমুহূর্তের জন্য মনে হলো, এই লোকটাকে সে পছন্দ করে ফেলেছে।
সম্ভবত একটু না, অনেক বেশিই!

____
চলবে।

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-২১+২২

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২১

দুপুরে খেয়ে একটু শুয়েছিল অনুলেখা। সাধারণত সে এসময় ঘুমোয় না। শুয়ে শুয়ে একটু ফেসবুক স্ক্রোল করে, ইউটিউব ঘাঁটে। আজ কেন যেন চোখ লেগে এসেছিল। নিদ্রা দেবীর কৃপায় অক্ষিপাতা জুড়ে নেমে এসেছিল শান্তিময় ঘুম!
অনুর সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। গাঢ় সুপ্তির পুরু আস্তর খুব শীঘ্রই ক্ষয় হতে লাগলো কানের কাছে ক্যাচ-ম্যাচ শব্দ শুনে। হালকা হতে হতে একসময় পুরোপুরি ঘোর কেটে গেল ওর। বিরক্ত চোখ কচলে হাই তুলতে তুলতে শয্যা ছাড়লো অনু। আলগা করে চাপিয়ে দেয়া দরজার ওপাশে পোর্চ থেকে আলোর রেখা আসছে। মেহমান এসেছে বোধ হয়, ভাবলো অনু। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিছানা থেকে নামল।

ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বেরোতেই অনু দেখতে পেল বসবার ঘরে কিছু মানুষজনের সমাগম। কলহাস্যে মুখরিত সভা। ভালো করে চেয়ে দেখলো, সবাই অপরিচিত ওর। একমাত্র সমাগমের মধ্যমণি মাহিয়া ছাড়া। অনু দাড়িয়ে থাকতে থাকতেই কোত্থেকে ওর শাশুড়ি চলে এলেন। ছোট বৌকে ডাকলেন সাদরে,
— “বৌমা, এসো এসো। বেয়াই – বেয়াইনের সাথে পরিচিত হও। আরে, মাহিয়ার বাবা – মা এসেছে তো!”
অনু এতক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে দেখছিল সব। এবারে বুঝলো মাহিয়ার এতো হাসিখুশি ভাবের কারণ। বাপের বাড়ি থেকে লোক এসেছে! হুহ, মনে মনে ভেংচি কাটলো। পরক্ষণেই ধ্যান ভাঙলো শাশুড়ির ডাকে,
— “কই? এলে না যে?”
মনে মনে বিরক্ত হলেও শান্ত হয়ে এগিয়ে এলো অনু। বসলো গিয়ে ওদের সামনে।
___

বিকেলবেলা। ফোনের ওপাশে নিখিলের সঙ্গে মৃদু স্বরে আলাপ করছে চারুলতা। টুকটাক গল্প শেষে কল কাটবার আগমুহূর্তে বললো,
— “রাখছি তবে…”
তৎক্ষণাৎ নিখিলের মন খারাপের গলা,
— “এতো জলদিই? তাড়া আছে কোনো? কোনো জরুরি কাজ?”
চারু ইতস্তত করে,
— “না, তেমন কোনো কাজ নেই। তবে…”
— “আমার সঙ্গে আর কথা বলতে ভালোলাগছে না? আমি প্রচুর কথা বলি, তাই?”
দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরলো। ইসস, লোকটা বুঝে ফেললো? ভীষণ লজ্জিত হলো চারু। সত্যিই সে একটু-আধটু বিরক্ত বোধ করছিল। নিখিল আসলেই প্রচুর কথা বলে!
কিন্তু ওর এই ছোট্ট কথাতে লোকটা জেনে ফেললো কি করে?
বললো,
— “না, আসলে…”
নিখিল সহাস্যে জানালো,
— “আমি বোকা নই, চারুলতা। কিংবা সহজে রাগ করবার মানুষও নই। আপনি আমাকে যতটুকু সময় দিবেন আমি ততটুকুতেই খুশি। আর তাছাড়া সম্পর্কের এখনো শুরুই হয় নি। যেদিন পূর্ণ অধিকার পাবো, সেদিন আপনি যতই বিরক্ত হোন না কেন ঠেসে ধরে বসিয়ে রাখবো। কোলের উপর বসিয়ে কানের কাছে ইচ্ছেমত বকবক করবো। কিচ্ছু বলতে পারবেন না!”
ওর বলবার ঢং দেখে হেসে ফেললো চারু। নিজেও ততোধিক রসিয়ে বললো,
— “মুখের ভেতর আলু ঠুসে দেব না!”
বলেই আবার হাসি। নিখিলও এবার হো হো করে হেসে উঠলো।

নিখিল কল কাটবার পর ফোনটা পাশে রেখে দিলো চারু। বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে সে, বাঁ পাশে খোলা জানালা। চোখ ঘুরিয়ে তাকালে দূরের নীল অন্তরীক্ষ খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায়। চারু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। ধূসর মেঘগুলো পেঁজা তুলোর একটু একটু করে ছড়িয়ে, সুদূরে তপন মশাইকে ঢেকে লুকোচুরি খেলছে যেন। মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ পুরনো কথা মনে হলো ওর। আড়াই বছর আগের, তার সেই বিবাহিত জীবনের দিনগুলো…
মাহতাবের ঘরেও এরকম একটা জানালা ছিল দক্ষিণ দিকে। জানালা সংলগ্ন হয়ে বিছানা। চারু রোজ ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ ওই জানালা দিয়ে চেয়ে থাকতো। দৃষ্টি ন্যস্ত করতো গগনমানে। মন তখনো থাকতো অদ্ভুৎ বিষাদময়!
বিয়ের পর ও-বাড়িতে গিয়ে একটুও ভালো লাগে নি ওর। একদম অপরিচিত একটা জায়গা। অপরিচিত মানুষজন। সবাইকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল মাহতাবকে মানতে। লোকটা যেন কেমন!
একটুও সময় দেয় নি তাকে। কবুল বলে যেই না বিয়েটা হলো, অমনই সমস্ত অধিকার চেয়ে বসলো? ভালো করে মিশবার আগেই তার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল চারু। লোকটা তাকে কি যে ভাবত!
‘আমার নীল শাড়ি পছন্দ, তুমি নীল পরবে। কমলা আমার একটুও পছন্দ নয়। কক্ষণো পরবে না!’ —অথচ চারুর নীল রঙ ভালো লাগতো না, কমলা ছিল প্রিয়!
চিংড়িতে মাহতাবের এলার্জি, বিবাহিত জীবনের ক’ মাস চারু বোধ চিংড়ি ছুঁয়েও দেখে নি। খুঁজতে গেলে এরকম আরো কতো গল্প বের হবে!
মাহতাব খুব ব্যস্ত মানুষ। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। স্বভাবতই সে ব্যস্ত। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতেও কীভাবে কীভাবে যেন তার স্ক্যাজিউল পড়ে যেত। বৌকে নিয়ে ঘুরবে কথা দিয়েও, শেষ মুহূর্তে সব ছেড়ে সে ফিল্ডে ছুটতো। হুট করে পাওয়া ছুটিগুলোতেও সে নিজের মতো প্ল্যানিং করত বেরোবার। চারুকে হয় তো সারপ্রাইজ দিতেই এমন করতো। কিন্তু কখনো চারু কোথায় যেতে ইচ্ছুক বা অনাগ্রহী — সে মতটুকু নিতে প্রয়োজন বোধ করে নি।
শরীরের টানে একে – অপরের কাছাকাছি ওরা বহুবার গিয়েছে; কিন্তু মনের টানে কোনদিন গিয়ে এসেছিল সংস্পর্শে?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোলো বুক চিড়ে।

একই ছাদের নিচে থেকেও বহুদিন যেন লোকটা ওর অচেনাই ছিল। হয় তো সেও অচেনা ছিল মাহতাবের কাছে।
ধীরে-ধীরে যখন সব চেনা হয়ে গেল, তখন চারু তার পরিবারের করা ভুলটা বুঝতে পারলো। বড় বড় পাশ দিয়ে ডিগ্রি নিলেই কেউ শিক্ষিত হয়ে যায় না। শিক্ষা অন্তরের ব্যাপার। যা সবাই পাশ করেও অর্জন করতে সক্ষম হয় না!

হঠাৎ দরজায় টুকটুক শব্দে ধ্যান ভাঙলো চারুর। কপোলে অনুভব করলো নোনা জলের। হাতের উল্টো পিঠে অশ্রু মোচন করতে করতে পেছনে ঘুরলো সে, ভেজা গলায় শুধালো,
— “কে?”
— “বড়’পা, আসবো?”
একসঙ্গে দুটি কণ্ঠস্বর। চারু শুনলো, ছোট ভাইদের গলা। রিংকু – টিংকু এসেছে। গত দুদিন ধরেই ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে এরা। চারু ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে। একটু সাজা দেয়া দরকার! যা বিচ্ছু হচ্ছে!
চোখ দুটো পুনরায় ভালো করে মুছে নিলো চারু। হালকা কেশে গলা ঝেড়ে ডাকলো,
— “আয়।”
সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। অনুমতি পেয়ে সুরসুর করে ভেতরে প্রবেশ করলো জমজ দ্বয়। মুখ নিচু করে, অপরাধী ন্যায় দুজনে এগিয়ে এলো বড় বোনের কাছে। ওদের এই চুপসানো চেহারা দেখে ভেতরে ভেতরে হাসি ঠিকরে বেরোতে চাইলেও, নিজেকে যথাসম্ভব গাম্ভীর্যের খোলসে মুড়িয়ে চারু বললো,
— “কি চাই?”
— “তোমার কাছে একটু বসবো, আপা?”
কি করুণ শোনালো টিংকুর গলাটা। চারু রাগ করে কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু ভাইয়ের মুখ দেখে আর বলা হলো না। আবদার রাখলো,
— “বস্।”
দু’ জনে উঠে বসলো ওর পাশে। মিনমিন করে জড়িয়ে ধরতে চাইলো ওকে। মুখ ঘুরিয়ে কপট রাগ দেখালো চারু,
— “অতো ঢং কীসের? অকারণে জড়াজড়ি ভালো লাগে না আমার!”
— “তুমি এখনো রেগে আছো?”
কণ্ঠের স্বর খাদে নামিয়ে শুধায় টিংকু।
— “আমি কে, যে রাগ করবো? আমাকে কেউ ভালোবাসে? না আলাদা করে গুরুত্ব দেয়?”
অভিমানি ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিল চারু। মুখ থেকে ধ্বনি নিঃসৃত হতে না হতেই হঠাৎ দু’ ভাই জাপটে ধরলো ওকে। দু’জনে দু’হাত আঁকড়ে ছোট্ট আদুরে বাচ্চা ছেলের মত মাফ চাইলো তাদের বড় বোনের কাছে,
— “স্যরি, আপা। খুব খুব খুব স্যরি। তুমি প্লিজ রাগ করে থেকো না! প্লিজ, আপা!”
চারু গলে মোম তখন! আর রাগ করে থাকা যায় যায়? সেও দু’ বাহু প্রসারিত করে দুজনকে আগলে নিলো। আদুরে স্বরে বললো,
— “দুষ্টুমি ভালো, ভাইয়া। কিন্তু সেটা অতিরিক্ত করতে গিয়ে বেয়াদবির পর্যায়ে যাওয়া ভালো নয়। আশা করি পরের বার এমন হবে না!”
— “আর হবে না, আপা। আর হবে না!”
অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়। চারু শান্তির শ্বাস ছাড়ে। এদেরকে সে ভীষণ ভালোবাসে, শাসন করতে তারও বুকে লাগে! কিন্তু বাচ্চাদের শাসন না করলে কি হয়?
__

ক্যান্টিনে আজ কেন যেন ভীড় খুব। সচারচর এমন হয় না। ছোট্ট ক্যান্টিনটা ফাঁকাই থাকে। আজ হঠাৎ এতো মানুষ কোত্থেকে উদয় হলো ভেবে পেল না সৌভিক। এদিক – সেদিক তাকিয়ে ফাঁকা টেবিলের সন্ধান করলো। একটা যদি থাকতো!
সবগুলোতে লোকে ভর্তি। মাত্র দু’টো টেবিলে জায়গা আছে বসবার। তাও একটাতে এক দম্পতি বসেছেন, অন্যটাতে একটা মেয়ে। সৌভিক কোথায় বসবে? দম্পতির কাছে বসায় মন সায় দিচ্ছিল না। অগত্যা নাশতার প্লেট হাতে মেয়েটির টেবিলের কাছেই এগোলো।
মেয়েটি পেছনে ফিরে বসেছে। খোলা রেশম চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়ানো। ‘এভাবে এরা কাজ করে কি করে? বিরক্ত হয় না? চুল বাঁধলে কি ক্ষতি?’– ভাবনাটা সৌভিকের মনে আসার কথা নয়। তবুও এসে গেল। সে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে সামনে এসে দাড়ালো মেয়েটির, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বললো,
— “মিস, এখানে বসা যাবে? কেউ আছে এখানে? আমি আসলে জায়গা পাচ্ছিলাম না…”
বলতে বলতেই মেয়েটা চকিতে মুখ তুলে তাকালো। ওকে দেখে এমন ভাব করলো যেন, লহমার কোনো জাদুকর চিল্লিয়ে ‘স্ট্যাচু’ বলে মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে তাকে। অপলক চেয়ে রইলো মুহূর্তগুলো। হাতে সসের বোতল ছিল, পেটিসে ঢালছিল; প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়ায় উপচেও পড়লো — সেটা মেয়েটা খেয়াল না করলেও সৌভিকের অগোচর রইলো না!
সে বিরক্ত মুখে সামনে বসা মূর্তি আনিকা’র উদ্দেশ্যে বললো,
— “কি হলো? অমন করে চেয়ে আছেন কেন? বসবো আমি?”
চটকা ভাঙলো আনিকার। তড়িঘড়ি করে সসের বোতল রাখতে রাখতে বললো,
— “জ্বি, স্যার। জ্বি, স্যার আপনি বসুন। আমি যাই।”
— “আপনাকে যেতে হবে না, খাচ্ছেন খান। আমি বরং একটু বসি।”
মেয়েটার বিনয় দেখে বলতে বাধ্য হলো সৌভিক।
কিন্তু আনিকা নামক এলোমেলো টlর্নেlডো থামলো না।
— “না, না, স্যার। আমি উঠছি।”
বলতে বলতে সে হন্তদন্ত হয়ে উঠতে গিয়ে চেয়ারের সঙ্গে হোঁচট খেল, প্যাঁচ প্যাঁচ করে ওড়না ফাঁড়লো। শব্দে ভ্রু কুঁচকে সৌভিকসহ অনেকেই ফিরে তাকাতেই জিভ কামড়ে টেবিল থেকে ব্যাগ তুলতে গিয়ে প্লেটের উপর থেকে একটা সিঙারা, পাশের পানির বোতল উল্টে ফেলে দিলো!
এই মেয়ের কাণ্ড দেখে এবার বেশ রাগ হলো ওর। চেঁচিয়ে উঠলো প্রায়,
— “এ্যাই, আপনি বসুন তো। এতো কিসের তাড়া আপনার? ট্রেন ছুটে যাচ্ছে?”
ধমকে চুপসে গেল মেয়েটা। তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করে ফেললো। অস্ফুট স্বরে বলবার চেষ্টা করলো,
— “না, মানে…”
— “কীসের ‘না, মানে’? বসেন বলছি, এক্ষুণি বসেন!”
চিৎকার করে উঠলো সৌভিক। আশেপাশে দৃষ্টি ফেলে ত্বরিতে বসে পড়লো আনিকা। ইসস, কতগুলো মানুষের সামনে লজ্জা!

একটু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো সৌভিক। নিচু গলায় বললো,
— “আপনি আমাকে এত ভয় পান কেন? আমি কি বাlঘ – ভাlল্লুlক যে আপনাকে খেয়ে ফেলবো?”
আনিকা ভীতু হরিণীর ন্যায় করুণ চোখে তাকালো। লজ্জায় নুইয়ে গিয়ে কোনোমতে বললো,
— “আপনি অনেক রাগী!”
বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল সৌভিক। সে এই মেয়েকে রাগ করলো কখন? আশ্চর্য!

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২২

রান্নাঘর থেকে খুঁট-খাঁট শব্দ আসছে। অত্যন্ত বিরক্ত মুখে এক ধারছে কাজ করছে অনু। তার মেজাজের পারদ চড়চড় করে বাড়ছে। সেই মেজাজ কাঙ্খিত জায়গায় দেখাতে না পেরে রান্নাঘরের থালা – বাটির উপর তুফানি ঝড় তুলছে সে।
গতকাল বিকেলে মাহতাবের শ্বশুর-শাশুড়ি, তার একমাত্র শ্যালক- শ্যালক স্ত্রী এসেছে। সঙ্গে এসেছে মাহিয়ার এক হাড়ে বজ্জাত ভাইঝি। ছোট ভাইয়ের তিন বছরের বাচ্চা, অথচ কাজ কারবার কি ডা-কা-ত মার্কা! কাল রাতের খাবার খাওয়ার সময় সবাই যখন খাবার ঘরে, ওই বদমাইশ পিচ্চি তখন হানা দিয়েছিল ওর ঘরে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা অর সমস্ত সাজগোজের জিনিসপত্র এলোমেলো করেছে। বডি লোশন ফেলেছে বিছানার চাদরে। তেলের বোতলের মুখ খুলে সবটা উল্টে দিয়েছে মেঝেতে। ওর দামী দামী লিপস্টিকের স্টিক ভেঙে গায়ে – হাতে ল্যাপ্টেছে, ফাউন্ডেশন, শ্যাডোর বক্স নাগাল পায় নি বোধ হয়, উপর থেকে ফেলে গুড়ো গুড়ো করেছে!
সব গুছিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে অনু যখন ঘরে ফিরলো তখন সেই দlস্যু মার্কা বাচ্চা মনের সুখের পাউডার মাখছে মেঝেতে বসে!
রাগে সারা গা জ্বলে উঠেছিল ওর। এতো সাধের, ভালোবাসার ওই জিনিসগুলো। কতো আহ্লাদ করে, যত্ন করে মাহাদ একেকটা জিনিস ওকে গিফট করেছিল!
কিন্তু কিছু বলবার নেই। অনুর এতবড় ক্ষতি করেও বাচ্চাটা পার পেয়ে গেল আরামসে!
বাপের বাড়ির লোকজন দেখে মাহিয়া কাল থেকেই বেশ ফুরফুরে। এমনিতেই প্রেগন্যান্সি পিরিয়ড চলছে, বাড়িতে তার খাতিরের অভাব নেই। এখন বাড়তি হিসেবে বাপের বাড়ির গোষ্ঠী পেয়ে তার ভাব এখন চাঙে!

আগে তাও সকালে রান্নাঘরে একটু ঢুঁ মারতো। দু’ একটা কাজে সাহায্য করতো। কিন্তু আজ যেই দেখেছে, বাড়ি-ভর্তি লোকজন, অমনি তার ঢং শুরু হয়েছে। ‘এখানে ব্যথা – সেখানে ব্যথা! ইসস, ন্যাকা! তোর কাহিনী যেন বুঝি না আমি?’– ভেঙচি কাটলো অনু। ঘসঘস করে গত রাতের এঁটো বাসনগুলো ধুচ্ছে আর বিড়বিড় করছে,

— “নিজের চোদ্দো গুষ্ঠি এসেছে, কোথায় রান্নাঘরে এসে দেখবে কি কি করা লাগবে, তা না! নিজে ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে অর্ডার করছে, ‘আমার বাবা – মা এসেছে, ছোট বৌ ভালো করে রেঁধ। মা কিন্তু ইলিশের পাতুরি খুব পছন্দ করে। কালকের ইলিশটার পাতুরি করো! স্বাদ লাগবে!’ — কেন রে? এতোই যখন তোর দরদ, তখন নিজে রাঁধতে পারিস না? নিজে রেঁধে ইচ্ছে মত খাওয়া। কে মানা করেছে? অন্যের উপর কাজ চাপাস কেন রে, শlয়তান বেটি? আমি কি তোর কাজের লোক? আমার কীসের অত ঠ্যাকা?”

‘কাজের লোক’ প্রসঙ্গ উঠতেই আরও বেশি বিরক্ত হলো অনু। বেলা এগারোটা বাজছে প্রায়, এখনো সেই কাজের মেয়ের আসবার নাম নেই। আজকালকার কাজের মেয়েগুলোও না!
একেকটার জমিদারি চালচলন! ইসস!
ওর ভাবনার মাঝেই হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলো ফুলি। এ বাড়ির কাজের মেয়েটা।
অনু ফিরে তাকালো ওর দিকে। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— “এতদেরি হলো কেন তোর?”

আঁচল দিয়ে মুখ – কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ফুলির সেই রোজকার একঘেঁয়ে জবাব,
— “মেলাক্ষণ দাড়ায় থাইক্যা রিসকা পাই নাই। যখন রিসকায় চরছি, সেইসম রাস্তায় জ্যাম আছিল। বাইরে যেই চিক্কুর দিয়া রোইদটা উডছে—”
— “রোজই তোর রাস্তায় জ্যাম থাকে, তাই না?”
রাগ দেখিয়ে বললো অনু। হাতের প্লেটটা শব্দ করে রাখলো সিঙ্কের পাশে। ফুলি হয় তো সহজ করেই উত্তর দিত, কিন্তু অনুর রাগটা টের পেয়েই আরও বেশি ত্যাড়ামি করলো,
— “আপনের কি মনে হয়, আমি ফুলি মিথ্যা কইছি? আমি মিথ্যা কওনের মানুষ? আমার দাদা কেডা আছিল আপনি জানেন? শেখ ফরিদউদ্দিন বখশ, মাইনষে তারে কইত জিন্দা পীর। জিন্দা পীরের নাতনি হইয়া আমি মিথ্যা কমু? এতবড় কথা কইলেন? এই বাড়িত আমি কাজ করুম না। ছাইড়া দিমু। দিমু ক্যান, দিছি। যহন আপনি কইছেন আমি মিথ্যা—”
ফুলির লম্বা লেকচার আর বংশ গৌরবের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। অন্য সময় হলে সে ঠাস করে ওর গালে চর বিষয়ে দিতে দু বার ভাবত না। কিন্তু এখন বাড়ি ভর্তি মেহমানের সামনে কোনো তামাশা করতে মন চাইলো না। ত্যক্ত গলায় বললো,
— “তুই দয়া করে চুপ কর, ফুলি। অসহ্য লাগছে!”
— “অসহ্য? কীসের অসহ্য? আমি কইছি না কাজ ছাড়ছি? এখন আপনের অসহ্য লাগলেও আমি শুনুম ক্যান? আমি কমুই…”
ফুলি বলে চলেছে। ধীরে ধীরে তার গলার স্বরের তীক্ষ্ণতা বাড়ছে। আস্তে আস্তে চেঁচিয়ে উঠছে সে। অনুর অস্থির লাগতে শুরু হলো। সে সারাজীবন নিজের বাড়ির রাণী হয়ে ছিল। বড় আপা ও বাড়ির রাজ কুমারী, সবার ‘চোখের মণি’ ছিল বটে, তার সব কথা সবাই শুনত। কিন্তু সেও কোনো অংশে কম ছিল না। তার কথা কেউ শুনত না বলেই নিজেকে স্বেচ্ছাচারী করে গড়ে নিয়েছিল। রাজ্যের স্বেচ্ছাচারী রাণীর মতো অধীনস্তের উপরে হুকুমদারি চালাত। সেই অনুকে কোথাকার কোন ‘ফুলি’, কোন জিন্দা পীরের নাতনি; এতো কথা শুনাবে?
আর অনু চুপচাপ দেখবে? তাই হয়?
তবুও সে ধৈর্য রেখেছিল। নিজের বাড়িতে গত বাইশ বছর ধরে যা করে নি, তাই করেছে। ঠাণ্ডা মাথায় নিষেধ করেছে ফুলিকে। চুপ করতে বলেছে। এখনো শোনে নি সে। ও রাগবে না?
গতকাল সন্ধ্যা থেকে জমা একটু একটু বিরক্তি-রাগ, আজকের সকালে ফুলির এই বয়ান শুনবার পর সব একসঙ্গে ক্রোধের আগুনের মত মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
আর সইতে না পেরে ঠাস ঠাস করে ফুলির দু’ গালে দুটো চড় মেরে দিল অনু।
ফুলি হতবাক, হতবিহ্বল!
অবিশ্বাস্য চোখে অনুর রাগান্বিত লালচে মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে রোদন শুরু করলো। যে গগনবিদারি চিৎকারে বাড়ির সবাই ছুটে এলো এক লহমায়। এমনকি অসুস্থ মাহিয়াও!
___

সকালে নিখিলের কল করবার কথা ছিল। কিন্তু কোনো ব্যস্ততায় শেষ পর্যন্ত কলটা আর আসে নি চারুর ফোনে। তাই মনটা একটু উদাসই ছিল ওর। নিখিলের সময়ের অনেক দাম সে জানে। কর্পোরেট দুনিয়ার মানুষ, এদের তো দম ফেলারও জো নেই!
বাইরে থেকে লোকে দেখে তাচ্ছিল্য হেসে উক্তি করে, ‘কি যে ওদের ব্যস্ততা! অফিসের এসির নিচে সারাদিন বসে বসে ওইতো কয়টা কাগজে সই করে, ঘটঘট করে কম্পিউটারের কি-বোর্ড চেপে কতগুলো টাইপ করে, এ আর এমন কি—” কিন্তু যে মানুষগুলো ওখানে বসে তথাকথিত এসির হাওয়া খেতে খেতে ক’টা কাগজে কলম চালায় ওরাই জানে, মাথা খাটিয়ে এই সেক্টরে টিকে থাকার যুlদ্ধটা কেমন!
আমরা তো বাইরেরটাই দেখি। কারো চাকচিক্য দেখেই চোখ ঘুরিয়ে বাঁকা মন্তব্য করি। অথচ ভেতরে যে কী চলে কখনোই জানতে চাই না। রিকশা ওয়ালার কাছে বড় অফিসের কর্মকর্তাদের দেখে মনে হয় কোনো কাজই করে না। অফিস ওয়ালাদের আবার এর বিপরীত ধ্যান-ধারণা। অথচ কোনো কাজই যে এত সহজ নয়, হাড় ভাঙা পরিশ্রম যে সবটাতেই আছে এটা আমরা বুঝেও যেন বুঝি না। সবসময়ই নিজেরটা বুঝি। ভাবি, ‘আমারটাই বড় কষ্ট, এমন কষ্ট কেউ কোনদিন করে নাই, ভবিষ্যতেও করবে না।’ কিন্তু এরচেয়েও বড় কষ্টে মানুষ থাকে আমরা ভাবি না!
কারণ ওসব ভেবে আমাদের লাভ নেই।

দুপুরে অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে নিখিল কল করলো চারুকে। এখন চারুও ব্যস্ত ছিল, কিন্তু সব ফেলে রেখে সে ফোনের কাছে ছুটলো। নিখিল নওশাদ কল করেছে যে!
রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো নিখিলের ক্লান্ত কণ্ঠস্বর,
— “কি করছেন চারু?”
— “তেমন কিছু না। চাচিদের সঙ্গে একটু রান্নায় সাহায্য করছিলাম।”
— “শুধু সাহায্যই করেন? রাঁধেন না কখনো? রান্না পারেন তো?”
একটু দুষ্টুমি করে বললো নিখিল। চারুও হয় তো মজার ছলেই বলতে উদ্যত হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ অপ্রিয় প্রসঙ্গটা চলে এলো,
— “এতো ঠুনকো ভাববেন না, মশাই। ভর্তা থেকে ভাজি, পুডিং থেকে কাচ্চি — সমস্তই আমার নখদর্পণে আছে! আপনি হয় তো ভুলে গেছেন আমি বিবাহিত জীবন পার করে এসেছি বহুদিনের। শ্বশুরবাড়ির সবাই এই রান্না খেয়ে আঙুল অবধি চেটে তুলতো—”
বলেই মুখের হাসিটা বিলীন হলো ওর। কথায় পুরোনো প্রসঙ্গ কোনদিন নিখিল টানে না। এমনকি অতীত নিয়ে একটা প্রশ্নও আজ পর্যন্ত করে নি সে। চারুও এড়িয়ে গেছে, যায় সব। কিন্তু তবুও!
চারুকে আপসেট হতে দিলো না নিখিল। হেসে বললো,
— “আচ্ছা, দেখা যাবে! আপনার হবু শাশুড়ি মিসেস. নাজিয়া নিলুফার কিন্তু সেরা রাঁধুনি। টেলিভিশনের প্রোগ্রামে গিয়ে মাস্টার শেফ হয়ে এসেছে। তাকে যদি রেঁধে খাইয়ে সন্তুষ্টি করতে পারেন— তো ভাবা যাবে। পাশ দিলেও দিতে পারি।”
ওর বলবার ভঙ্গিমায় চেয়েও আর মন খারাপ করা হলো না ওর। ততোধিক রসিয়ে শুধালো,
— “পাশ করলে কি দিবেন? সে বলুন আগে, নয় পরীক্ষা দিয়ে লাভ কি!”
— “দিবো না হয় কিছু। কেন সমস্যা?”
— “সমস্যা নয়? বলছেন কি? আমি এতো কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করবো, আর আপনি যদি রেজাল্টের সময় শুকনো মুখে ‘অভিনন্দন’ বলেন, তা তো হবে না! এতবড় লস হবে আমার—”
চারুর আহাজারি শুনে ফিক করে হেসে উঠলো। ভাগ্যিস বন্ধ কেবিন। নয় তো ওর বেসামাল হাসির তোরে আশেপাশের সবাই কাজ ফেলে অবাক চোখে দেখত ওকে!
হাসি থামিয়ে বললো,
— “আপনার লস হবে না, ম্যাডাম। বরং আমি লোকসান করিয়ে হলেও আপনাকে সবচেয়ে দামী গিফট্ দেব। প্রমিজ!”
চারু মাথা নাড়লো। আনমনে বিড়বিড় করে বললো,

“আপনি শুধু আমায় ভালোবাসুন, নিখিল। পৃথিবীতে এরচেয়ে বড় গিফট্ আর হতে পারে না!”
___

দরজায় কড়া নাড়তেই অনুমতি দিলো সৌভিক। গুটিগুটি পায়ে ভেতরে এসে প্রবেশ করলো আনিকা। হাতে কয়েকটা ফাইল। সেগুলো সৌভিকের টেবিলে দিয়ে, সন্তর্পণে সরে দাড়িয়ে বললো,
— “ফাইল গুলো একটু চেক করে দিন, স্যার। এমডি স্যার এই ফাইলগুলো আজকের মধ্যে কমপ্লিট করতে বলেছেন।”
মুখ তুলে তাকালো সৌভিক। টেবিলের অপর প্রান্তে দাড়ানো আনিকা। অনেকটা জবুথবু হয়ে। ওর কপাল কুঁচকে এলো। মেয়েটা ওকে বেশ ভয় পায় ও জানে। এই নিয়ে গতকাল প্রশ্ন করায় সে নির্দ্বিধায় জানিয়েছে, ‘সৌভিক অনেক রাগী!’
শুনে তাজ্জব বনে গিয়েছিল সে। রাগী তাও সৌভিক? কদিনের পরিচয়ে এই মেয়ে তাকে উগ্র মেজাজী বলে দিলো? অথচ নিজের সমগ্র জীবনে এই কথা কোনদিনও শোনে নি সে। পরিবারের বাধ্য ছেলে, কখনো কারো সঙ্গে উচ্চবাচ্য করে না। দশবার গুঁতোলেও যে একবার ছোট্ট করে নিষেধ করে, সে কি-না রাগীর তকমা পেল! তাকে দেখে নাকি এই মেয়ে কাঁপাকাঁপি করে! কি আশ্চর্য!
অবশ্য ক’টা দিন ওর মন-মেজাজ ভালো ছিল না। তখন সবকিছুতে একটু বিরক্তি এসে গিয়েছিল ওর। একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে সে তো আনিকাকে অকারণে ধমকায় নি। মেয়েটা বোকামি না করলে—
সৌভিক শ্বাস ফেলে ফাইলগুলো হাতে নিল। ভালো করে চেক করলো। নাহ্, উন্নতি হয়েছে মেয়েটার। ভুল তেমন চোখে পড়লো না। সাইন করে দিলো চটপট।

কাজ হয়ে যাওয়ায় হাসি মুখে বেরিয়ে যাচ্ছিল আনিকা। হঠাৎ কি মনে করে পিছু ডাকলো সৌভিক,
— “আনিকা শুনুন?”
চকিতে ফিরে তাকালো মেয়েটা। নিমিষেই হাসি মুখে নেমে এলো ভয়ের ছায়া,
— “কিছু বলবেন, স্যার?”
কি বলবে সৌভিক? মেয়েটা তার ডাক শুনেই কেমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায়। কিছু বললে, জ্ঞান হারাবে না কে গ্যারান্টি দিবে?
তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— “আপনি আমাকে অকারণে ভয় পাওয়া বন্ধ করুন, প্লিজ। আমি বাঘ – ভালুক নই। নেহাৎ ছা-পোষা কর্মজীবী মানুষ। জুনিয়র হিসেবে আপনাকে কিছু কাজ শিখানোর দায়িত্ব পড়েছে কাঁধে। তাই করতে গিয়ে, বিরক্ত হয়ে ধমকেছি। সেজন্যে এমন ভয় পাওয়ার কারণ নেই।”
বলেই থেমে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ওর উপর। নিশ্চিন্ত হতে জিজ্ঞেস করলো,
— “বুঝেছেন?”
— “হু।”
— “এবার যান।”
— “হু।”
ছাড়া পেয়েই ডানা ঝাপটানো পাখির মতো ছটফটিয়ে উঠলো আনিকা। এতক্ষণ যেন বাঘের খাঁচায় ছিল। মুক্তি মিলতেই হুড়মুড় করে বেড়িয়ে যেতে গিয়ে দরজার সাথে বাড়ি খেয়ে উল্টে পড়লো মেঝেতে। বিকট এক‘ধপাস’ শব্দ করে পড়ে গেল নিচে!
কপালে হাত ঘষে ক্রোধ দমনের দোয়া করলো সৌভিক,
–“আল্লাহ্, এই মেয়েকে সহ্য করবার ক্ষমতা দাও আমায়!”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-১৯+২০

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৯

দৌড়ে এসে দু’ ভাই ঘরে ঢুকে পড়লো। দরজা আটকে, বিছানায় আসাম করে বসে টিংকু খামটা হাতে নিলো। আসবার সময় একটা ফল কাটা চাকু নিয়ে এসেছে ডাইন ইন থেকে। খামের আঠা খুলে লুকিয়ে-চুরিয়ে চিঠি বের করতে হবে না? নয় তো, বড়’পা টের পেয়ে যাবে তো!
অত্যন্ত সতর্কতার সহিত টিংকু খামের আঠা খুলছে। রিংকু মুখ লটকে চেয়ে আছে ওর দিকে। এ কাজটা এক্কেবারে ঠিক হচ্ছে না! বড়’পা বুঝতে পারলে রাগ করবে খুব। চিঠিটা সিরিয়াস কোনো ইস্যুতে লিখলে, মন খারাপ করাও স্বাভাবিক। বললো,
— “কাজটা কি ঠিক হচ্ছে, টিংকু? বড়’পা বুঝতে পারলে রাগ করবে—”
অর্ধেক আঠা খুলে এসেছে। খুব ধীরে ধীরে কাজটা করছে। এরমধ্যে সহোদরের জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনে বিরক্ত হলো। ধমকে উঠলো,
— “চুপ থাক, তো! জ্ঞান দিস না!”
— “শোন। টিংকু—”
— “ছোট’পার চিঠি আমরা পড়ি নি? কতো ছেলেরা ওকে চিঠি দিয়েছে, আমরা সবই পড়েছি। ছোট’পা কোনদিন রাগ করেছে? ও তো নিজেই পড়তে দিতো—”
— “কিন্তু সেগুলো চিঠি ছোট’পা কখনো খুলেই দেখত না। আমাদের দিয়ে বলতো ফেলে দিতে। কারণ ওদের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না আপার। কিন্তু এটা নিখিল ভাইয়ের চিঠি। বড়’পাকে উনি পছন্দ করে—”
— “ওরাও তো আপাকে পছন্দ করত।”
যুক্তি দেখায় টিংকু। রিংকু বুঝানোর চেষ্টা করে,
— “নিখিল ভাইকে বড়’পাও পছন্দ করে, টিংকু। ওদের পার্সোনাল বলেও কিছু থাকতে পারে…”
টিংকু এবার বিরক্তির চরমে পৌঁছে গেল। রাম ধমক দিলো জমজকে,
— “চোপ! বেশ বকবক করিস!”
তারপর পরই খামের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করলো,
— “কি আঠা লাগাইছে রে, খুলেই না। পৃষ্ঠা ছিঁড়ে যাচ্ছে —”
রিংকু শেষবারের মতো অনুরোধ করে,
— “টিংকু প্লিজ! চিঠির ক্ষয়ক্ষতি হলে—”
কথা শেষ না করতেই একটা মেয়েলি স্বর ভেসে আসে কানে,
— “কী নিয়ে তোরা এতো বকবক করছিস, রিংকু – টিংকু? কীসের চিঠি?”
চমকে উঠতেই, হাত থেকে চাকুটা ছলকে পড়ে গেল বিছানায়। একটানে খামটা নিয়ে হাতটা পিছে লুকিয়ে ঘুরে তাকালো।
ওদের ঘরের লাগোয়া ওয়াশরুমের দরজায় দাড়িয়ে ঋতু। মাথায় টাওয়াল প্যাঁচানো আর হাতে একগাদা ভেজা কাপড় — দেখেই বুঝলো সে মাত্রই গোসল সেরে বেরিয়েছে। কিন্তু ও এখানে কেন? রিংকু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “তুই এখানে কি করছিস, ছোট’পা?”
— “গোসল করছিলাম। আমাদের ওয়াশরুমে লাইনের সমস্যা। ট্যাপে পানি আসছে না। সে কথা ছাড়। তোরা কি করছিলি?”
বলেই দু’ ভাইয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ওরা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো নিজেদের। টিংকু বললো,
–“কই! কিছু না তো। আমরা তো এমনই…”
ঋতু কয়েক পা এগিয়ে এলো। টিংকুর আচরণ অদ্ভুত। ডান হাতটা পেছনে। সেটা কেন?
সন্দিহান গলায় বললো,
— “তোর হাতে কি, টিংকু?”
— “কই কিছু না তো —”
চট করে হাতটা সামনে নিয়ে এলো। দেখালো বোনকে। ঋতুও কম কীসে? সে ত্বরিৎ পায়ে এগোলো ওর কাছে, বাড়িয়ে দেয়া হাত রেখে অন্যহাতের দিকে দৃষ্টি তাক,
— “ও হাতে দেখি? আন, এদিকে।”
ভারি বিপাকে পড়লো টিংকু। খামটা কোনোমতে পিছনে টি – শার্টের পেছনে লুকোনোর চেষ্টা করলো। কিন্তু রক্ষে হলো না। ঋতুর বাজের ন্যায় শাণিত নজর ফাঁকি দেয়া সহজ নয়। সে হুড়মুড় করে খামটা কেড়ে নিলো হাত থেকে। ধরা পড়ে গিয়ে টিংকুও ঝাঁপিয়ে পড়লো ছোট’পার দিকে,
— “ছোট’পা দাও! দাও ওটা!”

ঋতু দিলো না। খাম ধরা হাত উঁচু করে ধরলো। উচ্চতায় বোনের চেয়ে বেঁটে হওয়ায় টিংকু চেষ্টা করেও নাগাল পেল না। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করলেও, ঋতুর এক ধমকে চুপসে যেতে বাধ্য হলো,
— “সর, বেয়াদব! দেখতে দে আমাকে!”
ঋতু ভেবেছিল ওর দুই বিচ্ছু ভাই নিজেরা কাউকে চিঠি লিখেছে। নয় তো, ওদের কেউ দিয়েছে। তাই আগ্রহ দেখিয়ে ছিনিয়ে নিলো চিঠিটা। এই বয়সে পাকামো করে কাকে চিঠি দিচ্ছে বদমাশ দুটো, জানতে হবে না?

কিন্তু খাম হাতে নিয়েই চক্ষু ছানাবড়া হলো ওর। প্রাপকের জায়গায় বড়’পার নাম! প্রেরকের নাম দেখবার প্রয়োজন হল না। ও শুধু এটুকুই বুঝলো, বিচ্ছু দুটো মহা বেয়াদবি করতে যাচ্ছিল। তীব্র রাগে দু’ ভাইয়ের কান চেপে ধরলো সে। সাপের মতো হিসহিস করে বললো,
— “অসভ্য, বর্বর! আপার চিঠি তোদের কাছে কি করছে!”
রিংকু নিজেকে বাঁচাবার জন্যে সাফাই গাইবার চেষ্টা করলো,
— “আমি কিছু করি নি, আপা। সব দোষ, টিংকুর। ও-ওই এসব—”
— “সব দোষ এখন ওর, না? আমি জানি না বোধ হয়? দুজন যে দুজনকে ছাড়া কিচ্ছু করিস না? বেয়াদব, মিথ্যুক!”
আরও জোড়ে কান মুচড়ে দিলো। তারপর সেভাবেই দুটোকে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করলো। টেনে নিয়ে যেতে লাগলো চারুর কাছে। পথে অপরাধী দু’ ভাই কাকুতি মিনতির পাহাড় জমাবার প্রয়াস করলেও পাত্তা দিলো না ঋতু। দোতলার সিঁড়ি ভেঙে হিড়হিড় করে টানতে টানতে চিৎকার করে ডাকলো চারুকে,
— “বড়’পা? ও বড়’পা? এসো তাড়াতাড়ি!”

চারু রান্নাঘরে মা – চাচিদের সঙ্গে ছিল। একটু আগেই চাচারা সব খেয়ে-দেয়ে দোকান মুখে ছুটলেন। তাই খাবারগুলো গোছাচ্ছিল সবাই মিলে। এরমধ্যেই ঋতুর ডাক কানে আসতেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো চারু। সিঁড়ির মাঝে দাড়িয়ে ঋতু, দু’ হাতে কান মুচড়ে দাড়িয়ে আছে দুই জমজ দ্বয়ের। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
— “কি হয়েছে, ঋতু? ডাকলি কেন? আর ওদের কান—”
পেছন পেছন মেজো চাচীও এসেছে। ঋতু তাই দেখে কিছুটা ধাতস্থ করলো নিজেকে। শান্ত হয়ে বড় বোনকে ডাকলো,
— “তুমি একটু উপরে আসো, আপা। হাতের কাজ রাখো।”
পেছনে থাকা মেজো চাচীর দিকে একবার তাকালো চারু। তার প্রশ্নাত্মক চোখের দিকে চেয়ে, ইশারায় কিছু বলে ঋতুর দিকে এগোলো। ও তখন দুই অপরাধীকে ধরে উপরে যেতে ব্যস্ত।

— “কি হলো ঋতু?”
ঋতু কান ছেড়ে দিলো ওদের। হাতের খামটা বড় আপার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— “তোমার চিঠি।”
— “আমার? কে পাঠিয়েছে—”
বলতে বলতেই প্রেরকের নাম চোখে পড়তেই থেমে গেল চারু। কি আশ্চর্য! নিখিলের চিঠি? এতদিন পর? উচ্ছ্বসিত হয়ে মনটা নেচে উঠতে চাইলেও, পরক্ষণেই সামলালো নিজেকে। ছোট বোনের দিকে তাকাতেই দেখলো, ঋতু চোখ পাকিয়ে চেয়ে আছে স্বীয় জমজ সহোদর দ্বয়ের দিকে। চোখ দিয়ে অগ্নি বর্ষণ করতে করতে বললো,
— “এই বেয়াদব দুটো তোমার চিঠি নিয়েছিল। ঘরে গিয়ে সেই চিঠি পড়বার জন্য খাম ছিঁড়ছিল! কি পরিমাণ অভদ্র এরা, ভাবতে পারছ? অ-স-ভ্য, ব-র্ব-র!”
বলেই চাটা মারলো দুজনের মাথায়। রিংকু ব্যথাসূচক ‘আহ্’ করে বললো,
— “আমি ওকে নিষেধ করছি—”
— “চুপপ!”
ধমকে উঠলো ঋতু। টিংকু এতক্ষণে মুখ খুললো। মাথা নিচু করে অপরাধী স্বরে বললো,
— “স্যরি, বড়’পা। রিয়েলী স্যরি!”
চারু কিছুই বললো না ওদের। নির্বাক শ্রোতা হয়ে সব শুনলো। একসময় চোখের কার্নিশ উপচে পড়া টলটলে জল নিয়ে প্রস্থান করলো। ওর যাওয়া দেখে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে রইলো দু ভাই। এতক্ষণে তাদের মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক হয় নি! আপা রাগ করে নি, কষ্ট পেয়েছে!
লজ্জিত হয়ে মাথা নোয়ালো দুজন।
কাঙ্খিত কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে ঋতুও আর কিছু না বলে স্থান ত্যাগ করলো!

ঘরে এসে দরজা আটকে, খাম নিয়ে বসলো চারু। তার মনের অবস্থা অবর্ণনীয়। একদিকে সে প্রচন্ড খুশি, অন্যদিকে তার মন বিমর্ষ। অদ্ভুৎ দ্বৈত অনুভূতিতে ছেয়ে যাওয়া মন নিয়ে সে বিছানায় বসলো। খামের মুখ ছিঁড়ে বের করলো, আকাশি নীল রঙের ভাঁজ করা কাগজ। যার ভেতরে চমৎকার টানা টানা অক্ষরের লেখা একটি বার্তা,

“প্রিয় চারুলতা,
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা বিখ্যাত উপন্যাসের উক্তি আছে,
‘তোমাকে যখন দেখি, তারচেয়ে বেশি দেখি; যখন দেখি না।’ — পড়েছেন?
আমার বোধ হয় তেমন অবস্থাই হয়েছে। আমি ‘চারুলতা জাফরিন’ নামক মিষ্টি কন্যাকে দেখে প্রেমে পড়েছি। তাকে বাস্তবে ঠিক কতটুকু সময় ধরে দেখেছি জানি না, কিন্তু তারচেয়ে বেশি দেখছি, তার অনুপস্থিতিতে। যখন সে আমার চেয়ে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে! এতবেশি দেখছি, যে আমার দুনিয়া চারুময় সৌন্দর্যে পূর্ণ। অবশ্য চারু মানেই যখন সৌন্দর্য, তখন দুনিয়া তো রঙিন হবেই। তাই না?
আচ্ছা, কথাগুলো কি কাব্যিক শুনাচ্ছে? আপনি নির্ঘাৎ আমায় পাগল সাব্যস্ত করে প্রাণখোলা হাসছেন? হাসুন, আমি দূর থেকে অনুভব করবো সেই আনন্দ। সেই মুক্তোঝরা হাসি কল্পনা করে আরও পাগলামি করবো। কারণ প্রেমিক হয়ে একটু-আধটু পাগলামি না করলে প্রেম শুদ্ধ হয় না। আমি শুদ্ধ প্রেমিক হতে চাই, আমার শুদ্ধ প্রেমের ছোঁয়ায় আপনার জীবনের কলুষ মেশানো অতীত ভুলিয়ে আপনাকে রাঙিয়ে দিতে চাই! ভালোবাসি, চারুলতা!
পুনশ্চ: বকবক করতে করতে আসল কথাই বলতে ভুলে গেছি, আপনার মুঠোফোন নম্বরটা আমার হারিয়ে গেছে। তাই খোঁজ নিতে পারি নি। চিঠির পেছনে আমার নম্বরটা দিচ্ছি। মন চাইলে ছোট্ট একটা মিসডকল দেবেন, আমি সর্বদা আপনার অপেক্ষাতেই—
ইতি
নিখিল নওশাদ”

কাগজটা পুনরায় ভাঁজ করে বুকের কাছে ঠেকালো চারু। ওর চোখে নোনা জল। টপটপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে কপোল বেয়ে। তবে এই জল দুঃখের নয়। প্রচন্ড খুশিতে লোকে যেমন কাঁদে; এই জলও ঠিক তেমনই। চারুর ইচ্ছে করলো চিৎকার করে কাঁদতে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলতে,
‘সে ভোলে নি, ভোলে নি আমায়!’
___

অফিসে নতুন কয়েকজন নতুন স্টাফ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বিভিন্ন সিনিয়র এমপ্লোয়ীর আন্ডারে কাজ শিখতে বলা হয়েছে। এরকমই একজনের দায়িত্ত্ব পেয়েছে সৌভিক। স্টাফটি মেয়ে, নাম নওরোজ আনিকা।
প্রথম দর্শনে মেয়েটিকে দেখে সৌভিকের পছন্দ হলো না। সুন্দরমতো চেহারা বটে, কিন্তু কেমন যেন বোকা-বোকা চাহনি। হাবভাব অদ্ভুৎ।সৌভিক পরিচয় হবার জন্য নাম – ধাম বললো, মেয়েটা মাথা নাড়ানো ছাড়া কিছু করলো না। ভদ্রতা সূচক হাসি, কিংবা পরিবর্তে নিজের নাম বলার সৌজন্যও বোধ হয় জানে না। অথবা নার্ভাসনেসে ভুলে খেয়েছে। ভাবলো সৌভিক।
মেয়েটাকে ওর পাশের কেবিনে ডেস্ক দেয়া হয়েছে। ওর ডেস্ক দেখিয়ে, মেয়েটাকে নিয়ে সৌভিক বেরোলো অফিস দেখাতে। কোথায় কি আছে না আছে, সব বুঝানোর জন্য। সৌভিক এটা-ওটা দেখাচ্ছে আর মেয়েটা সব হা করে গিলে যাচ্ছে। এমন ভাব করছে, যেন সে ফর্মাল কর্পোরেট অফিসে নয়, ফ্যান্টাসি কিংডমে প্রথমবারের মতো এসেছে বেড়াতে! আশেপাশে চেয়ে দেখতে দেখতে রাস্তা দেখে হাঁটতেও ভুলে গেল সে।সৌভিক ত্যক্ত হয়ে আড়চোখে ওকে দেখছে আর মনে মনে কপাল চাপড়াচ্ছে,
‘কার পাল্লায় পরলাম, মাবুদ! এই মেয়ে কিভাবে চলে! এখনই না কারো ঘাড়ে উল্টে পড়ে!’
বলতে বলতেই মেয়েটা একটা ডাস্টবিনের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে উদ্যত হলো। মুখ থুবড়েই পড়তো সৌভিক হাত ধরে টেনে আনায় রক্ষে!
অতঃপর মেয়েটা একটু লজ্জিত হাসলো,
— “স্যরি!”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো সৌভিক। কিছু বললো না। এগিয়ে চললো তার কাজে। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রাগ বাড়ছে চড়চড় করে!

প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে নির্দেশনা দেবার পর সে থামলো। লক্ষ্য করলো, মেয়েটা এখনো অমনোযোগী। আশেপাশে দেখে বেড়াচ্ছে। এবার রাগ হলো বেশ। একটু ধমকের সুরেই বললো,
— “মিস. আনিকা!”
চমকে ফিরে তাকালো ওর দিকে। ডাগর চোখ দু’টোতে এতক্ষণ যে বিস্ময় খেলা করছিল, নিমিষেই তার স্থানে চলে এলো ভয়। মেয়েটা শঙ্কিত চোখে বললো,
— “জ্ব-জ্বি—”
— “আপনি কি আমার কথা শুনছেন?”
— “জ্বি।”
ঘাড় নাড়িয়ে জবাব দিলো মেয়েটা। সৌভিক আশ্বস্ত হলো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে শুধালো,
— “ম্যানেজিং ডিরেক্টর স্যারের কেবিন কোথায়? বলুন তো।”
‘আনিকা’ নামের মেয়েটা শুকনো ঢোক গিললো। আমতা আমতা করে বলবার চেষ্টা করলো,
— “সেকেন্ড ফ্লোরে…”
ক্রুর হাসি দেখা গেল সৌভিকের মনে। তার আন্দাজই সঠিক। মেয়েটা মোটেও সিরিয়াস নয়। সিরিয়াস হলে মাত্র দেখিয়ে আনা বসের কেবিন সে ঠিকমত চিনে নিতে পারতো।
শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললো,
— “শুনুন, আনিকা। আপনাকে কয়েকটা রুঢ় বলি। শুনতে খারাপ লাগলেও, কথাগুলো আপনার জানা উচিৎ। কর্পোরেট অফিসে পারফরম্যান্সের উপর চাকরির স্থায়ীত্ব, পদোন্নতি নির্ভর করে। এটা সরকারি চাকরি নয় যে যেমন-তেমন করে কাজ করে যাবেন, মাস শেষে বেতন উঠাবেন। এখানে সব রূলস-রেগুলেশন স্ট্রিক্টলি মেইনটেইন করা হয়। কাজেই অ্যাটেন্টিভ থাকবেন, বসের মন যুগিয়ে চলবেন। আমাদের এই ব্রাঞ্চটা হেড অফিস। চাপ বেশি। সবকিছু খেয়াল রেখে না চললে টিকতে পারবেন না!”

বলেই ওকে ফেলে গটগট করে এগিয়ে গেল। ক’দিন ধরে মেজাজটা তার এমনিই খিঁচড়ে আছে। অসম্ভব রাগ-বিরক্তির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। মানসিকতা ভালো না। তার উপর এই হাবা মেয়ে পড়েছে কপালে, সামনে না জানি কি হয়!

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২০

সকালে চিঠি পাবার পর চারুর তক্ষুণি কল করতে মন চাইছিল নিখিলকে। কিন্তু কি যেন ভেবে করে নি। চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝি কল করতে হয়? একটু ধৈর্য তো রাখা উচিৎ। তাছাড়া, এখন অফিসের সময়। কে জানে, লোকটা ব্যস্ত কি-না?
রাতেই কল করবে চারু। যখন অফিস সময় পেরিয়ে যাবে, দিনের ব্যস্ততা ফুরিয়ে যাবে, অবসন্ন-ক্লান্ত দেহমন নিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে দু’টো মিষ্টি কথা কইবে সে। ব্যক্ত করবে প্রাণের আকুলতা!
__

হাত ঘড়িতে সময় দেখলো সৌভিক। ন’টা পঁয়তাল্লিশ বাজে। হাতের কাজ আপাদত গুছানো শেষ। কয়েকটা ফাইল আছে সহকর্মী রাতুলের কাছে, সেগুলোর প্রয়োজন। সেগুলো সহ সাড়ে দশটায় একটা মিটিং অ্যাটেন্ড করতে হবে ওকে। জায়গাটা অফিসের বাইরে। এখান থেকে যেতে আধ ঘণ্টার মতো লাগবে। এখনই বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ। বলা তো যায় না, যদি জ্যামে আটকা পড়ে?
কন্ট্যাক্টসে গিয়ে চটজলদি রাতুলকে ফোন করলো। কুশল বিনিময়ের পর ফাইলগুলোর প্রসঙ্গ তুলতেই সে দুঃখিত সুরে জানালো,
— “আজ হাফ ডে ছুটি নিয়েছি, ভাই। বাইরে আছি—”
সৌভিক তিক্ত গলায় বললো,
— “সে কি কথা, রাতুল ভাই? আপনি জানেন তো মিটিংয়ে ফাইলগুলো দরকার! আপনি সেগুলো না দিয়ে…”
ওপাশ থেকে রাতুলের অপরাধী সুর,
— “নিখিল ভাইয়ের কাছে ফাইল রেখেছি। আপনি ওঁকে বলুন একবার।”
‘কি যন্ত্রণা!’ — মনে মনে বিরক্ত হলো সৌভিক। রুঢ় স্বরে বললো,
— “ফাইলগুলো তো আপনার কাছেই রাখবার কথা। তাকে কেন এরমধ্যে—”
তড়িঘড়ি জবাব সহকর্মীর,
— “ভাই, জরুরি কাজে বাইরে এসেছি। বসের কাছে ছুটি চেয়েছি এক দিনের। উনি কিছুতেই দিবেন না। শেষে দয়া করে হাফ ডে দিল, ফাইল তাকে না দিয়ে কার কাছে দেই বলুন তো? প্লিজ ভাই! আমি নিখিল ভাইকে কল করে বলছি। উনি দিয়ে দেবেন।”
— “আচ্ছা।”
সৌভিক বিরস মুখে সায় দিয়ে কল কাটলো।

মনে মনে সে যথেষ্ট বিরক্ত। বাড়ি থেকে ফেরার পর পারত পক্ষে ওকে এড়িয়েই চলছে। একই অফিসে পাশাপাশি কেবিনে ওদের ডেস্ক। যেতে-আসতে দেখা হচ্ছে কতো! নিখিল তো শুধু সহকর্মী নয়, ভালো বন্ধুও।এখানে ওকে উপেক্ষা করে যাওয়া বেশ কঠিন! তবুও তা করেছে। কারণ তার মন ভালো নেই।
নিখিল অবশ্য কথা বলছে। সৌভিকের ভেতরটা কোন অন্তর্দহনে পুড়ে ছারখার হচ্ছে সে সম্বন্ধে তো ওর জ্ঞান নেই!
স্বভাব বশেই দেখা হলে হাত নাড়িয়ে সম্ভাষণ জানাচ্ছে। কিংবা হাসি হাসি মুখ করে জিজ্ঞেস করেছে,
‘কেমন আছিস?’
সৌভিক খুব সূক্ষ্ম ভাবে পাশ কাটিয়ে গেছে। শুনেও যেন না শোনার ভান করেছে। নিখিল হয় তো সেটা বুঝেছে। আহত হয়েছে হয় তো। কিন্তু ওর হেলদোল হয় নি। চারু ওর নেহাৎ পছন্দের মানুষ নয়, ভীষণ ভালোবাসার এক নারী!
তাকে ও বিনা যুlদ্ধে জয় করে নিয়েছে, সৌভিকের জ্বলবে না? মনটা পুড়ে অঙ্গার বনবে না?

ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে সৌভিক এসে নিখিলের দরজায় নক করলো। নিখিল ব্যস্ত ছিল, মুখ না তুলেই ডাকলো,
— “কাম ইন!”
সৌভিক ভেতরে ঢুকে যান্ত্রিক ভঙ্গিতে বললো,
— “রাতুল তোর কাছে যে ফাইলগুলো রেখে গেছে সেগুলো দে।”
মুখ তুলে তাকালো নিখিল। ক’দিন পর বন্ধুকে সরাসরি কথা বলতে দেখে হাসলো মিষ্টি করে,
— “বস্। দিচ্ছি আমি।”
কঠিন সুর সৌভিকের,
— “বসতে আসি নি আমি। কাজ আছে। ফাইল দে।”
নিখিলের দুঃখ হলো। ঠোঁটটা কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে কেমন যেন হাসি দিলো। অতঃপর ফাইল হস্তগত হতেই হনহন করে বেরিয়ে গেল সৌভিক। কোনো কথা না বলেই!

ওর প্রস্থানে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোলো নিখিলের বুক চিড়ে। বন্ধুর অভিমান যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু একেবারে অন্যায্য তাও সে বলতে পারে না। চারুকে তো সেও ভালোবাসে, সৌভিকও। এবং ওর জীবনে আগে থেকেই ছিল সে। তবে কেন সময় থাকতে চারুকে নিজের করে নেয় নি? কেন মেয়েটাকে নির্মম-দুর্দশা সইতে হয়েছে?

ফাইল নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল সৌভিক। লিফটে চড়ে কাঙ্খিত গ্রাউন্ড ফ্লোরের উদ্দেশ্যে বোতাম টিপলো। ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় গন্তব্যে পৌঁছে দরজা খুলে গেল লিফটের। সামনে না তাকিয়েই বেরোচ্ছিল সৌভিক, হুট করে কারো সঙ্গে প্রবল একটা ধাক্কা খেয়ে দু’ পা পিছিয়ে গেল!
এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে আছে, এরমধ্যে—
আগন্তুককে লক্ষ্য করে ঝাড়ি দিতে দিতে ফিরে তাকালো,
— “চোখে দেখেন না? কীভাবে পথ হাঁটেন?”
বলতে বলতেই খেয়াল হলো মেয়েটাকে!
কয়েক হাত দূরে মাটিতে ছিটকে পড়ে আছে আনিকা। ওকে দেখেই দ্রুত উঠে দাড়ালো। এগিয়ে এসে হড়বড় করে বললো,
— “সো স্যরি স্যার। আ’ম সো স্যরি! আমি দেখি নি!”
থমথমে দৃষ্টিতে চাইলো সৌভিক। এখানে কেন এই মেয়ে? শীতল সুরে বললো,
— “মাত্র এলেন?”
ঘনঘন মাথা নাড়লো মেয়েটা। ঠিক অপরাধীর ন্যায়! একপল হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলো সৌভিক। কিছুটা রাগত কণ্ঠে বললো,
— “ন’টা চুয়ান্ন বাজছে। অফিস টাইম সাড়ে ন’টা থেকে। আপনি আধ ঘণ্টা পর কেন?”
ধমক খেয়ে মাথা নিচু করলো আনিকা। অস্ফুট আওয়াজে কি যেন বলতে চাইলো, হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল সৌভিক। তীব্র শোনাল ওর পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
— “থাক। সাফাই দিতে হবে না। ওতে আমার কাজ নেই। লেইট করে অফিসে এলে ইমেজ আপনার খারাপ হবে, আমার নয়! গতকাল ভালো করে বুঝিয়েছি। না বুঝলে কি করার!”
শেষের কথাগুলো আক্ষেপ করেই বললো। আনিকা নামের মেয়েটা লজ্জায় এতটুকু হয়ে কোনোমতে বললো,
— “স্যরি স্যার!”
— “আর দেরি করবার দরকার নেই। কাজে যান।”
মেয়েটা ফের ঘাড় নাড়ালো। তারপর হন্তদন্ত হয়ে ঘুরে হাঁটা ধরলো সিঁড়ির দিকে। সৌভিক মহাবিরক্ত হয়ে ডাকলো,
— “ওদিকে আবার যাচ্ছেন কোন দুঃখে?”
মেয়েটা তৎক্ষণাৎ পিছু ফিরে তাকালো। লজ্জিত হয়ে বললো,
— “না, মানে স্যার…”
— “লিফটে প্রবলেম নাকি? ফোবিয়া – তোবিয়া আছে?”
— “না, না!”
চটপট মাথা নাড়লো। সৌভিকের ত্যক্ত গলা ভেসে এলো,
— “এমনিই লেট করে এসেছেন। লিফট ছেড়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কি এখন সারাদিন পার করতে চান?”
— “স্যরি স্যার।”
মেয়েটা আড়ষ্ট হয়ে দাড়ালো। সৌভিক এবার রাগে ফেটে পড়লো,
— “আবার স্যরি! যান তো আপনি!”
মেয়েটা প্রায় দৌড়েই প্রস্থান করলো!
ওর যাবার দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো সৌভিক। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করলো,
— “অদ্ভুৎ পাগল!”
__

নিখিল অফিস থেকে ফিরছে মিনিট দশেক হলো। চট করে গোসলটা সেরে বেরিয়েছে অমনই ওর সেলফোনের রিংটোন বাজলো। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বিছানায় ফেলে রাখা ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখলো। আননোন নাম্বার। নিখিলের ধরতে মন চাইলো না।
ফোনটাকে সাইলেন্ট করে রেখে সে ব্যালকনিতে চলে গেল টাওয়াল নাড়তে। আবছা-অন্ধকার মেশানো জায়গাকে বরাবরই চমৎকার লাগে ওর। তাছাড়া হিম ছড়ানো শীতল হাওয়ায় বইছিল প্রচুর।। নিখিল গ্রিলে হাত ঠেকিয়ে দাড়িয়ে রইলো।
একটু পরে নাজিয়ার গলার স্বরে চটকা ভাঙলো,
— “নিখিল? খেতে আয়!”
— “আসছি!”
জবাব দিয়ে ত্বরিৎ পায়ে খাবার ঘরের দিকে এগোলো। ততোক্ষণে অজ্ঞাত ফোনকলের কথা মাথা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে গেছে ওর!

দু’ বার রিং করবার পরও যখন ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না তখন একটু খারাপ লাগলো চারুর। তবে হতাশ হলো না। হতেই পারে, নিখিল এখনও ব্যস্ত!
সে বরং একটু পরে কল করবে।
কিন্তু একটু পরেও কল করে নিখিলের কোনো পাত্তা পেল না চারু। কারণ সে যখন কল করে চাতকের ন্যায় ব্যাকুল হয়ে চেয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে, তখন তার থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে নিজের কক্ষের নরম বিছানায় শুয়ে পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজেছে নিখিল। হাতের কাছেই মুঠোফোন রাখা, কিন্তু তা এখন মূকের ভূমিকায় অবতীর্ণ!
অগত্যা নিরাশ হয়ে ফোন রাখলো চারু। খানিকটা দুশ্চিন্তায়, খানিকটা বেদনায় জর্জরিত হলো বিরোহিনী মন!
___

ফোনকলের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে নিখিল। সকালে উঠেও ফোন চেক করা হয় নি। ব্যস্ত হাতে তৈরী হয়ে অফিসে ছুটেছে। কাজের ফাঁকে ফোন চেক করতে গিয়ে, আননোন নম্বরটা চোখে পড়েছে। বেশ কবার কল এসেছে। জরুরি ছিল বোধ হয়। কিন্তু ব্যস্ততায় ‘পড়ে কল ব্যাক করবো’ ভেবে ফোন রাখলো। এরপর মনে রইলো না। এবং চারুর কাঙ্খিত কল ব্যাক করাও হয়ে উঠলো না!

দুটো দিন সেভাবেই পার হলো। চারু এরমাঝে আর কল করলো না। সম্ভবত সে কষ্ট পেয়েছে নিখিলের অনিচ্ছাকৃত এই উদাসীনতায়!

রাতে খাওয়া – দাওয়া সেরে সবে বিছানায় গা এলিয়েছে নিখিল, তখন পুনর্বার কল এলো। আজ নম্বর দেখে ভুল হলো না। রিসিভ করলো নিখিল,
— “আসসালামু আলাইকুম। কে বলছিলেন?”
ওপাশ থেকে নম্র মেয়েলি সুর ভেসে এলো,
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
এক মুহূর্তের জন্য হৃদযন্ত্রের স্পন্দন থমকে গেল। বিস্ময়াহত নিখিলের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল দুটো শব্দ,
— “চারুলতা জাফরিন!”
উত্তর এলো না। রমণীর শান্ত নিঃশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া গেল কেবল। আটকে রাখা দমটা ছাড়লো নিখিল। নিজেকে সামলে শুধালো,
— “কেমন আছেন, চারুলতা?”
— “আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?”
— “এইতো — এতদিনে মনে পড়লো তবে?”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অভিমানিনীর উষ্মা,
— “কদিন ধরে কল করলাম। আপনিই তো গুরুত্ব দিলেন না!”
অপরাধ বোধ জাগলো বটে কিন্তু সেটাকে ছাপিয়ে দিয়ে গেল একটা রঙিন অনুভূতি! চারুর অনুযোগ ওর বুকে ঝড় তুললো। প্রবল ঝড়ে ভেসে গেল নিখিল নওশাদ নামে তুচ্ছ প্রাণী!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-১৭+১৮

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৭

কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দিলেন নিলুফার নাজিয়া। আর ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই তাকে জাপটে ধরলো কেউ। উচ্ছাসে চেঁচিয়ে উঠলো প্রায়,
— “আসসালামু আলাইকুম, আম্মি।”
ছেলেকে দেখে ভীষণ রকমের খুশি হলেন নাজিয়া। একটু অবাকও। কারণ ছেলে যে ফিরবে সে কথা আগে জানায় নি তাকে। ওর তো আসবার কথা ছিল আগামীকাল। আজ হঠাৎ?
মাকে ছেড়ে চমৎকার হাসলো নিখিল,
— “আম্মি তুমি কিন্তু এ-কয়দিনে আরও বেশি সুন্দর হয়ে গেছ! সুইট লাগছে খুব!”
— “আর তুমি? তুমি কিন্তু শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছ, নিখিল। তোমার বন্ধুর বাড়িতে বোধ হয় তোমায় খেতেই দেয় নি!”
নাজিয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর। নিখিল হেসে বললো,
— “চোখে ভুলভাল দেখছ। আমার শরীর ঠিকই আছে। বরং বলো, আমি মোটা হয়েছি। সৌভিকের বোনের বিয়ে ছিল না? কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছি। ওজন বেড়ে গেছে আমার!”
জুতো খুলে ব্যাগ-পত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকলো নিখিল। তারপর টুকটাক কথা হলো। নাজিয়া ছেলের খাবার দিতে চাইলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
— “যা হাতমুখ ধুয়ে নে। তারপর ডাইন ইনে আয়। কি খাবি বলে যা। ভাত রাঁধি নি। রুটি করেছিলাম আমার জন্য। তুই আসবি জানতাম না তো…”
— “কোনো সমস্যা নেই, আম্মি। আমি এখন কিছু খাবো না। বাস থেকে নেমেই হোটেলে খেয়েছিলাম। এখন ঘুমাবো।”
বলেই নিজের ঘরের দিকে এগোয়। নাজিয়া ছেলের পিছু পিছু ছোটেন,
— “সে কি রে? হোটেলে খেলেই হলো নাকি? কিসব বাসি তেল-তুল দিয়ে রাঁধে ওরা…”
— “একদিন না খেলে কিচ্ছু হয় না। আমার ঘুম পাচ্ছে। গেলাম!”
ব্যস! আর কোনো কিছু না বলেই ঘরে চলে গেল। নাজিয়া বেশি জোর করলেন না। ছেলেকে কখনো কোনকিছুতে তিনি জোর করেন না। তাতে একটু স্বাধীনচেতা ধাঁচের হয়েছে বটে, কিন্তু সেচ্ছাচারি নয়। বোধশক্তি যথেষ্ট আছে!
ফ্রেশ হয়ে এসেই নিখিলের সর্বপ্রথম যে নামটি মনে এলো তা হলো, ‘চারুলতা’। চট করে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো কল করবার জন্য। কিন্তু কন্ট্যাক্টসে গিয়ে নাম খুঁজতে গিয়েই মনে হলো, সে তো চারুর নাম্বারটা নিতেই ভুলে গিয়েছে! চারু তার হাতে লিখে দিয়েছিল নাম্বার। সে চেয়েছিলে, ঘরে ফিরে ফোনে সেভ করতে। কিন্তু করে নি! কোনো কারণে ভুলে গিয়েছে!
সেই মুহূর্তেই ছটফটানি শুরু হয়ে গেল বেচারার। মন উচাটন করতে লাগলো। এটা কেমন হলো? কি করবে ও এখন? চারুর সঙ্গে যোগাযোগ করবে কি করে? কইবে কি করে মনের কথা? ওর নাম্বারটাই যে নেই!
___

বিয়ের আগে সে নিজের বাড়ি নিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত ছিল অনুলেখা। বাড়ির মানুষগুলো তাকে ঠিক পছন্দ করত না সে জানতো। আর করবেই বা কেন? তাদের ভালোবাসার ‘চারুলতা জাফরিন’ আছে না? তাকে ছেড়ে ওকে নিয়ে ভাবার সময় কারো আছে? তাই ওকে যখন কেউ ভালোবাসে নি, ওও কাউকে ভালোবাসে নি। ভাবতেই মনটা খারাপ হলো। অসহ্য হিংসেই বুক জ্বলতে থাকলো!
চারু! চারু তার সব কেড়ে নিয়েছে। সবার অ্যাটেনশন, অ্যাপ্রিশিয়েশন — সব! লেখাপড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ে ওর চেয়ে এগিয়ে ছিল। কোনোকিছুতে চারুর চেয়ে ভালো করে কারো নজর কাড়তে পারে নি অনু। কোত্থাও না। না পড়ালেখায়, না নাচে – গানে! এমনকি জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের প্রতি ভালোলাগাতেও চারুকে টেক্কা দিতে পারে নি সে!
ক্লাস নাইনে পাড়ার এক বড় ভাইকে দারুণ মনে ধরেছিল অনুলেখার। পড়ালেখায় ভালো, পাড়ার অনুষ্ঠানে দারুণ গান গাইয়ে, লোকজনের অ্যাটেনশন পাওয়া স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, সুপুরুষ ছেলে। কিশোরী বয়সের প্রথম আবেগ ওর! মনে মনে তাকে নিয়ে ভাবতে গেলেও শরীর শিহরিত হয়। ইসস, কি লজ্জাময় সুখের অনুভুতি! কিন্তু মুখে কি করে বলবে তাকে? তবুও বলতে চেয়েছিল। ম্যাট্রিক পাশ করে প্রেমের প্রস্তাব দিবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখনই তাকেও কেড়ে নিলো চারু!
ফট করে একদিন রাস্তায় দাড়িয়ে দেখলো, কলেজপড়ুয়া চারুকে প্রপোজ করছে সেই ছেলে! রাগে – দুঃখে – অপমানে গা জ্বলে যাচ্ছিল ওর। মন ভাঙার অনুভূতির সঙ্গে বড় বোনের প্রতি অদম্য হিংসেয় জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হচ্ছিল হৃদয়!
এভাবেই ছোট থেকে সবকিছুতে চারু হয়েছিল তার থেকে শ্রেষ্ঠ। পেয়েছিল যা যা ওর পাবার কথা! ওর আকাঙ্ক্ষিত!
বংশের বড় মেয়ে; তার উপর আচার – আচরণে মার্জিত, বিনম্র এবং দারুণ মেধাবী — তাকে তো সবাই ভালোবাসবেই! কিন্তু এসব ভাবার সময় কিংবা ইচ্ছে ছিল না অনুর। সে শুধু তাই জানত, বুঝত যা চোখের সম্মুখে দেখতে পেত। দেখতে পেত, বাড়িতে তার দাম নেই। তার কথার মূল্য নেই, প্রশংসা নেই। অতএব, ক্রমশই বাড়ির প্রতি অনাগ্রহ বাড়ছিল। বাড়ির মানুষগুলোর প্রতি বিতৃষ্ণা বাড়ছিল। বিশেষ করে ওর রোষানলে পুড়ছিল চারু। এতটাই রোষ ওর প্রতি যে কখনো কখনো অতিরিক্ত ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে প্রকাশ করেই ফেলতো। বিনিময়ে বাড়ির লোকেদের বকা জুটত কপালে, আরও ক্ষেপে গিয়ে বেশি করে হিংসা করত চারুকে!
স্বভাবে উগ্র, রগচটা মেয়েটা ধীরে ধীরে হয়ে গেল ভীষণ রকমের স্বেচ্ছাচারী, উড়নচন্ডী। কারো কথা শুনবে না, পরোয়া করবে না কোনো বাঁধা!

শ্বশুরবাড়িতে এসেও এই অভ্যাস অব্যাহত রইলো ওর। এতদিনের বহুল প্রতীক্ষিত মুক্তি পেয়ে আরও বেশি বিগড়ে গেল অনু। ভাবলো, এখানে চারু নেই। ওর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। সে এখানে যা খুশি তাই করতে পারে, যা খুশি তাই বলতে পারে! আনন্দে আত্মহারা হলো। নিজের এই নতুন সংসারকে নিয়ে তার গর্ব, অহংকারের সীমা রইল না!
কিন্তু অচিরেই ওর ভুল ভাঙলো ওর। বালুর প্রাসাদের মতো চুরচুর করে ওর চোখের সামনেই একে একে ভেঙে পড়তে লাগলো ওর সকল চিন্তা – চেতনা। সাতদিনেই অতিষ্ট হয়ে উঠলো অনু। সংসার জীবনে তিক্ততা ঢুকে গেল শুধুমাত্র, একটি মানুষের কারণে!
সে মাহিয়া!
বাড়ির বড় বধূ সে। ওর চেয়ে আগে এসেছে এই সংসারে। তাই বয়স, সম্পর্ক আর অভিজ্ঞতা — তিন ক্ষেত্রেই ওর চেয়ে বড়। সুতরাং, অনুর উপরে খবরদারী তো চলবেই!
কিন্তু এটাই ঠিক অসহ্য হয়ে উঠলো ওর কাছে। এক গ্যাড়াকল থেকে বেরোতে না বেরোতেই অন্য জায়গায় এসে ফাঁসলো? বাড়িতে চারুর সবকিছুতে দখলদারি, এখানে আবার এই মেয়ের? এতসব মানবে কেন অনু?
আর অত্যাচারেরও যেন শেষ নেই। সে রান্না-বান্না অতটা পারে না। সেসব জেনেও রোজ রোজ রান্না নিয়ে খোঁটা। অন্য কাজে দখলদারি দেখানো, অনু-মাহাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পর্যন্ত মাঝে মাঝে কথা বলে! সাহস কত!
কিন্তু মাহিয়াকে চেয়েও কিছু বলতে পারে না ও। চারুর মতো অতটা শান্ত তো নয় এই মেয়ে, আর নাই ওর মায়ের পেটের বোন। যে ছাড় দিবে। অনু কিছু বলতে এলে পাল্টা যুক্তি নিয়ে তেড়ে আসতে দেরি হবে না!

ঘরে বসে এমন কথা ভাবছিল অনু। তখনই কাজের মেয়েটা দরজা নক করলো। ভেতরে আসবার অনুমতি দিলেই এসে বলে গেল,
— “বড় ভাবী, আপনারে বিকেলের নাশতা বানাইতে বলছে। তার শরীলডা ভালা না। শুইয়া থাকবো। কইছে, আপনি য্যান চা – নাশতা কইরা আম্মা আর তার ঘরে পাঠায় দ্যান।”
বলেই দাড়ালো না ফুলির মা। চটপট পায়ে চলে গেল। অনু নিশ্চিত জানে, ও এখন গিয়ে কি করবে। টিভি ছেড়ে সিরিয়াল দেখতে বসবে। অন্যান্য দিন ওর পরাণের বড় ভাবীর সাথে মিলেমিশে সিরিয়াল দেখে, আজ তিনি নেই। অতএব, রাজত্ব তার একার দখলে!
সুখ তো এ-বাড়িতে এই দুজনের। একজন গর্ভ ধারণ করেছেন এই সুখে বাঁচছেন না। দুদিন পর পর ঢং করছেন, রান্না কিংবা কাজের সময় হলেই ‘শরীর ভালো না’র বাহানা! অন্যজন তার খেদমতদারিতে ব্যস্ত বলে কেটে পড়ার ধান্দা। কিছু বলেও লাভ নেই। ফট করে ‘কাজ ছাইড়া দিমু!’ বলে উড়াল দিতে উনি উতলা। আর এদিকে অনু? জ্বালার শেষ নেই তার!
অগত্যা বিছানা থেকে নামতে নামতে মনে মনে ভেংচি কাটলো অনু,
— “দেখাচ্ছি, তোমায়। খুব ঢং না? ঢং যদি বের না করেছি— ক’টা দিন যেতে দাও। সংসারটা গুছিয়ে নেই একটু! তোমারও হচ্ছে! ডাlইlনী কোথাকার!”

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৮

লম্বা ছুটির পর কর্ম জীবনে প্রবেশ করতেই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিখিল। অফিসে এখন চাপ আছে। ছুটিতে তার ডেস্কে ফাইল জমা পড়েছে বেশ কিছু। সেগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতেই কখন যে অফিস আওয়ার পার হলো টের পেল না।

ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ফিরবার পথে ওর মনে হলো চারুর কথা। সৌভিকের কথা। সৌভিকের কাছে চারুর নাম্বারটা চেয়ে নেয়া যায় অনায়াসেই। কিন্তু সেটা করতে ওর বিবেকে বাঁধছে খুব। হয় তো, চারুর প্রতি ওর দুর্বলতা জেনেই!

সেই প্রথমদিন থেকেই লক্ষ্য করে এসেছে নিখিল, চারুর প্রতি অদ্ভুত একটা দুর্বলতা আছে সৌভিকের। ছেলে হিসেবে সে যথেষ্ট অমায়িক এবং আন্তরিক। ভাইবোনদের প্রতি দারুণ স্নেহশীল। তাদের মন রক্ষার্থে, তাদের খুশির জন্য অনেক কিছুই করে। কিন্তু এই স্নেহময়তা, ভালোবাসা যেন চারুর প্রতি একটু বেশিই! নিখিল প্রথম যেদিন বন্ধুর নিকট মনের কথা কইলো, সেদিনও বেশ অদ্ভুত আচরণ করেছিল সৌভিক। শান্ত ছেলেটা হুট করে তেঁতে উঠেছিল। ধুমধাম কিল-ঘুষি মেরে রীতিমত উন্মাদ হয়ে উঠেছিল যেন! নিখিল অবাক হয়েছিল, বুঝতে পারে নি ওর এমন মারমুখো ব্যবহারের কারণ!

কিন্তু দিন যতোই গিয়েছে, ও বেশ বুঝতে পেরেছে। চারুর সঙ্গে নিখিলের দেখা – সাক্ষাৎ, কথাবার্তা ঠিক ভালো চোখে দেখত না সৌভিক। অথচ ও নিশ্চিত জানে, নিখিলের মনের কথা। নিখিলকে দীর্ঘদিন ধরে সে চেনে, তার পরিবারিক অবস্থা জানে। সে যে পাত্র হিসেবে চারুর অযোগ্য নয় তাও জানে!

তবুও প্রিয় বন্ধুর ওর প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব খেয়াল করেছে নিখিল। শুরুতে তেমন পাত্তা না দিলেও, ঢাকায় ফিরবার দিন সন্ধ্যায়, সৌভিকের ওই বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আর কিছু বুঝতে বাকি নেই ওর! ওরই প্রিয় বন্ধু যে ওর ভালোবাসার মানুষটিকে বহু আগে থেকে ভালোবাসে এই চরম সত্য জানবার পর ওর অনুভূতিটা কেমন হয়েছিল সেটা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করবার মতো নয়। নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মেছিল খুব। খারাপ লেগেছে বন্ধুর জন্য। কিন্তু তখন তার আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। চারুকে যে সে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে! তাকে কি ভোলা সম্ভব?

সৌভিকের ব্যাপারটাও সে ভেবে দেখেছে। সে চারুর বিষয়ে সব জানে, তাকে ভালোবাসে। অথচ সে ওর বিয়ের সময়ে কিছু বলে নি, কেন? এখন চারুর অক্ষমতার কথা সবাই জানে, এবং এটা সত্যি যে সবটা জেনে-শুনে এরকম ত্যাগ করতে রাজি হওয়াটা কঠিনই! একজনকে যতই ভালবাসি জীবন সঙ্গী হিসেবে, কিন্তু দিন শেষে নিজের সন্তান তো একজন চাইতেই পারে! পিতৃত্বের স্বাদ নিতে চাওয়া অন্যায় নয়। বাচ্চারা যখন ছুটে এসে কোলে চড়ে ছোট ছোট হাতে গলা আঁকড়ে ধরবে, আধো আধো গলায় ডাকবে ‘বাবা’— সেই অনুভূতি কেমন সেটা জানবার আকাঙ্ক্ষা থাকে তো সবারই!

তবে কি এমন যে, সৌভিক ভালোবেসেও তার পরিবারের কাছে বাঁধা পড়ে আছে? সমাজ – সংস্কারকে ভেঙে এগোতে পারছে না বলেই চারুকে কখনোই জানায় নি তার অব্যক্ত ভালোবাসার কথা? নিখিল ভাবতে থাকে। খোলা জানালায় চোখ রেখে রাতের ব্যস্ত নগরী দেখতে দেখতে আনমনে ভাবতে থাকে সে!
___

কয়েকদিন পেরোলো। চারুলতার জীবন আগের মত নিস্পন্দ, ছন্দহীন। সময়ের স্বাভাবিক গতিতে ওর জীবন স্রোতের মত বয়ে গেল। একেবারে নির্বিকারে। কোনো উত্তালতা নেই, উচাটন নেই। শুধু হঠাৎ হঠাৎ নিরিবিলি শ্রান্ত মধ্যাহ্নে একলা ঘরে বসলে নিখিলের কথা ওর মনে আসত। মনে আসত, অনুর বিয়ের দিন ওকে প্রথম দেখার কথা। সেইরাতে কান্নারত অবস্থায় নিখিলের সান্ত্বনা বাণী, তিস্তা পাড়ে বেড়াতে গিয়ে লোকটার সঙ্গে গল্প আর সবশেষে সেদিনের সেই মনোমুগ্ধকর হৃদয়হরিণী প্রেমত্তাপী কথামালা!
লোকটা চারুকে তাকে ভালোবাসতে বলে নি। কোনো জোর করে নি। আকুল আবেদনে শুধু তার হাত ধরতে অনুরুদ্ধ করেছে। চারু শুধু তার অনুরোধে সাড়া দিয়ে হাত ধরেছিল। লোকটা তাতেই খুশি হয়েছে। শুধু সেই হাত ধরা থেকেই সে ওকে ভালোবাসবে বলে অঙ্গীকার করেছে। ওর দুঃখের সময়ে পাশে থাকবে বলেছে। ওর সুখ-দুঃখের সাথী হতে চেয়েছে। কিন্তু কই?
এখান থেকে ফিরবার পর তো একটিবারও লোকটা ওর খোঁজ নিলো না! না ওকে দিলো কোনো খবর!
একটা ফোনকলের আশায় আশায় চারু কতো গুমড়ে মরলো। চিরকাল নিজের ফোন সম্পর্কে উদাসীন মানুষটা, এক মুহূর্তের জন্য মুঠোফোনকে কাছছাড়া করলো না। পাছে নিখিল কল দিয়ে তার ধরা না পায়?
অথচ নিষ্ঠুর লোকটা? মনেই করলো না ওকে!
সব প্রেম, সান্ত্বনা বাণী, পাশে থাকবার অঙ্গীকার অবলীলায় ভুলে গেল!
লোকটাকে সে ভালোবাসে নি। কিন্তু বিশ্বাস তো করেছিল। তার কথায় বিবর্ণ-মলিন মনের দুয়ারে স্বপ্নের প্রজাপতিরা তো ডানা মেলেছিল? ক্ষণিকের জন্য হলেও তার মনে হয়েছিল, শীতের নিশ্চুপ শুষ্কতা শেষে তার জীবন রাঙিয়ে দিতে বসন্তের আগমন হয়েছে!
কিন্তু কোথায়! সবই যে মিথ্যে! আগের মত বিবর্ণ!
___

পৃথিবীতে দু’ ধরণের মানুষ আছে। একধরণের, যারা ব্রাশে পেস্ট নিয়ে বেসিনের সামনে দাড়িয়েই ব্রাশ করে। অন্যটা যারা ব্রাশে পেস্ট লাগানোর পর পুরো বাড়ি (পারলে এলাকার) চারধারে একপাক চক্কর লাগিয়ে আসে। আমাদের রিংকু – টিংকু ঠিক সেই ধরণের মানুষ। সকাল সকাল ব্রাশ হাতে নিয়ে বাড়ির এ-কোণা থেকে ও-কোণা চক্কর দিয়ে বেড়ানো যাদের কাজ।

স্কুল যেতে হবে আটটায়। মায়ের ঠেলাঠেলিতে আগে আগেই ঘুম থেকে উঠেছে বটে, কিন্তু দু’ ভাইয়ের তাতে মন নেই। ঘুম ভাঙবার পরই তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আজ স্কুলমুখো হবে না। তাই রোজকার চেয়ে আজকে যেন ব্রাশ করতে সময় লাগাচ্ছে দ্বিগুণ বেশি! লন এরিয়ায় হেঁটে বেড়াচ্ছে দুই ভাই। হেমন্তের সকালের মিঠে রোদ গায়ে মাখছে। আর গুটুর-গুটুর করে গল্প সারছে। হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ির মূল ফটকের কাছে গিয়ে পৌঁছলো টিংকু। ব্রাশ মুখে দিয়ে এদিক – ওদিক তাকাতে তাকাতেই একটা লোককে দেখলো এদিকেই আসতে। সাইকেলে চড়ে আসছে লোকটা। সোজা বাড়ির ভেতরেই হয় তো ঢুকতো, কিন্তু ওর প্রশ্নে দাড়িয়ে গেল,
— “কি চাই?”
— “অরুণা ম্যানশন? বাড়ি নং ৩৪, রোড নং ৩/৪, ওয়ার্ড আঠারো?”

টিংকু কিছু না বলে গেটের পাশের নামফলকে হাত রাখলো। মুখটা অসম্ভব গম্ভীর করে ফলকে লেখা ঠিকানাটার প্রতিটি শব্দের নিচে আঙুল ঠেকিয়ে বুঝালো, ঠিকানা ঠিক না ভুল। লোকটা ওর ইশারা বুঝলো। মাথা নাড়তে নাড়তে বললো,
— “এই বাড়ির একটা চিঠি আছে।”

বলতে বলতেই লোকটা তার ব্যাগে হাত ঢুকালো। এতক্ষণে তার দিকে জহুরি চোখে চেয়ে ছিল টিংকু। পোশাক-আশাক, হাবভাব দেখে চিনতে পারলো। ছোটবেলায় বইয়ের ছবিতে দেখেছে ডাকপিয়ন। কিন্তু বাস্তবে কখনো দেখে নি বলে চিনতে একটু কষ্টই হচ্ছিল।

মুখটাকে যথাসম্ভব গম্ভীর শুধালো,
— “কার চিঠি?”

রিংকু ছুটে এসে উপস্থিত হলো সেখানে। কোনো কারণে সে একটু বাগানের দিকটায় ঢুকেছিল। ভাইকে অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে ছুটে এসেছে। লোকটা ওর দিকে একপল তাকালো। মাথা নেড়ে বললো,

— “চারুলতা জাফরিন। প্রযত্নে আজমীর রাজা।”
— “চিঠিটা দিন। চারুলতা আমার আপার নাম।”

কিশোরের চিকন গলায় রাশভারী আওয়াজটা ঠিকঠাক এলো না, বরং হাস্যকর শোনালো ওর এই ঢং করে কথা বলা। লোকটা একটু হেসে বললো,
— “তোমাকে তো দেয়া যাবে না, বাবু। প্রাপক যে, তাকে ডাকো। তাকেই লাগবে।”

বাবু? তাদের দেখে এই লোকের ছোট বাবু মনে হয়? দু’ ভাই মহাবিরক্ত হলো। মুখ থেকে ব্রাশ বের করে। থু করে একদলা পেস্টের ফেনা ভর্তি থুথু মাটিতে ছুঁড়ে রিংকু বললো,
— “আপা বাড়িতে নেই। চিঠি নিতে পারবেন না।”

স্বভাব সুলভ পেশাদার ভঙ্গিতে জানালো,
— “রেজিষ্টার করা চিঠি। সাক্ষর লাগবে। প্রাপক না থাকলে আজমীর রাজাকে ডাকুন। ওনাকে দিচ্ছি।”

দু’ ভাই চোখাচোখি করলো। রাগে দু’ জনেরই গা জ্বলছে। আরে ভাই, আমরা থাকতে বড় আব্বাকে লাগবে ক্যান? আমরা কি যথেষ্ট না?
টিংকুর ত্যক্ত কণ্ঠ,

— “বড় আব্বা বাড়িতে নেই। শুধু সে কেন কোনো বড় মানুষই বাড়িতে নেই। দাওয়াতে গেছে সবাই। চিঠি দিলে আমাদের দ্যান, নাহলে চলে যান।”

কথাগুলো ডাহা মিথ্যা। তবুও কি নির্দ্বিধায় বলে দিলো দু’জন!

চিঠি ওয়ালা তবুও ইতস্তত করতে লাগলো। যমজ দ্বয় পাত্তা দিলো না আর। লোকটার মুখের উপর দরজা আটকে দিতে উদ্যত হলো। ভাবখানা এই —‘আমাদের চিঠি দিবি না তো? আপাকেও দিতে হবে? দরজা আটকালে তখন দিতে পারবি? ব্যাটা উজবুক!’

অগত্যা চিঠিওয়ালা হার মানলো। টিংকুর সাক্ষর সম্বলিত কাগজখানা রেজিস্ট্রি খাতায় রেখে, খামভরা চিঠি দিয়ে বিদায় হলো!

আপাকে কে চিঠি দিতে পারে সে নিয়ে আগ্রহের সীমা ছিল না ওদের। বহুত ঝুট – ঝামেলার পর কাঙ্ক্ষিত চিঠিখানা হাতে পেয়ে উল্লসিত হলো। লাফিয়ে উঠে খামটা নেড়েচেড়ে দেখতেই আবিষ্কার করলো, প্রেরক নিখিল নওশাদ!

বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো রিংকু,
— “নিখিল ভাই চিঠি লিখেছে? ওরেম্মা! কি রোমান্টিক ভাই!”

বলেই চাপড় লাগাল সহোদরের পিঠে। খাম হাতে নিয়ে গম্ভীর হলো টিংকু। কিয়ৎক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে বললো,

— “ফেসবুক – হোয়াটস অ্যাপের যুগে চিঠি? আশ্চর্য!”

রিংকু মুখ কুঁচকে তাকালো,

— “আশ্চর্যের কি আছে? নিখিল ভাই বাকি সবার মত না। আলাদা অনেক। তাই হয় তো, চিঠি দিয়েছে। নব্বই দশকের চিঠি যুগের প্রেম দেখিস নি? কি সুইট আর প্রীটি শুনতে লাগে ওদের লাভ স্টোরিগুলো!”
সহসা জবাব দেয় না টিংকু। খানিক চুপ থেকে কি যেন ভেবে নেয়।

তারপর গম্ভীর মুখটাতে কুটিল হাসি ফুটিয়ে বলে,

— “তাহলে তো চিঠি পড়ে দেখতে হচ্ছে! দেখি, নিখিল ভাই কি লিখেছে!”
— “কীহ্?”

রিংকু ভীষণ অবাক হয়। দু’ জনেই দুষ্টের শিরোমণি বটে, কিন্তু এই প্রথমবার বড়’পার চিঠি নিয়ে দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করে না রিংকুর। এরমধ্যে বাড়ির কাজের মহিলাটাকে দেখা গেল। হলরুমের দরজায় দাড়িয়ে উনি ডেকে গেলেন,

— “ভাইজানেরা তাড়াতাড়ি আয়েন। ইস্কুল যাওয়ার সময় পার হইয়া যাইতেছে!”

সেদিকে একঝলক চেয়ে হাত নাড়িয়ে রিংকুর জবাব,
— “যাচ্ছি। যাও!”

তারপর ভাইয়ের দিকে ফিরে বলে,
— “মানে এই চিঠি আমরা আগে পড়বো। দেখবো, নিখিল ভাই কি কি লিখেছ। তারপর আপাকে দেব! ঘরে চল এখন—”

খামটা পকেটে লুকিয়ে সহোদরকে টানতে টানতে ভেতরে চলে গেল। অনেক হয়েছে দাঁত ঘষাঘষি। কোনোমতে মুখটা ধুয়েই ঘরে গিয়ে দোর দিয়ে চিঠি পড়তে বসবে! আহা, নিখিল ভাইয়ের প্রেমময় চিঠি পড়বার জন্য তর সইছে না পরাণে—

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় পর্ব-১৫+১৬

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৫

ভাতিজির বিয়ে উপলক্ষ্যে বাপের বাড়ি এসে এবার অনেকদিন থাকা হয়ে গেল আলেয়ার। গৃহিণী হলে বাপের বাড়ি থাকবার জন্য স্বামীকে মানালেই হয়। তাতে আবার তিনি করেন চাকরী! এখন স্বামীকে মানানোর সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের বসকেও মানিয়ে ছুটি নিতে হয়। ঘরে স্বামী, অফিসে বস্ — সব সামলিয়ে পাওয়া ছুটিতে বাপের বাড়ি আসা খুব কমই হয়ে ওঠে!
যাই হোক, অনেকদিন পর এবার এরকম লম্বা ছুটি পেয়েছিলেন। বাড়িতে এসে সবার কাছাকাছি থাকতে ভালোই লাগছে। ইচ্ছে করছে, চিরদিন থেকে যেতে। বাবা, ভাই-বোন আর ভাস্তে-ভাস্তিদের নিয়ে কি হৈচৈ করে থাকা হয়। মিলেমিশে, একসঙ্গে! কিন্তু তা তো হবার নয়। নির্ধারিত সময় ফুরোলেই চলে যাবার ঘণ্টা বাজে! দেখতে দেখতে নয়দিনের সময়টা কি করে যে পেরিয়ে গেল—
বিকেলের বাস। দুই কন্যা সহ আলেয়া ফিরবেন শ্বশুরবাড়ি। কন্যাদের বাপ সঙ্গে নেই। তিনি বৌভাতের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে রাতেই সিলেটে গিয়েছেন।
এখন বসে বসে নিজের আর কন্যাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে তুলছেন। একগাদা কাপড় – চোপড়, কয়েক পদের ক্রিম, বডি লোশন, চিরুনি, ফোনের চার্জার, পাওয়ার ব্যাংক, ইয়ারফোন — কতো কিছু! সবই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। বারবার খুঁজে খুঁজে এনে ব্যাগে নিতে হচ্ছে। তাও একা। নিজেদের জিনিসপত্র গুছানোর সময় তো কন্যাদের হাতে নেই! তারা তাদের ভাইবোনদের সঙ্গে হৈহৈ করেই কূল পাচ্ছে না, কাজ করবে কখন?
এই নিয়ে রাগ হলেও সেটা প্রকাশ করতে পারছেন না। বাড়িতে তো মেয়েরা সবকিছুই করে। রান্না-বান্না থেকে শুরু করে সবটাই। অবশ্য মা চাকরীজীবি হলে ছেলে-মেয়েদের সবকিছু শিখতেই হয়। করতেই হয়। কিন্তু তার দুই তনয়া বাড়িতে লক্ষ্মীই থাকে! বহুদিন পর নানাবাড়ি এসে খেই হারিয়েছে। হয় তো একটু মজেছে হুল্লোড়ে! তাই রাগ করতে গিয়েও করছেন না। করুক একটু হৈ-চৈ। বছরে ক’টা দিনই বা এ সুযোগ পায় ওরা?
অগত্যা নিজেকেই সব করতে হচ্ছে। হঠাৎ দরজায় করাঘাত শুনে চটকা ভাঙলো আলেয়ার। হাতের কাপড় ভাঁজ করে অনুমতি দিলেন,
— “আসো!”
আগন্তুক খুব সংগোপনে অনুপ্রবেশ করতে চেয়েছিলেন বলেই হয় তো দরজাখানা ‘ক্যাচ ক্যাচ’ রব তুলে খুলে গেল। অনাহুত শব্দটায় বিরক্ত হয়ে মুখ কুঁচকালেন চমক। আলেয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
— “গোছগাছ হয়ে গেল বুঝি, আলেয়া?”
বড় ভাবীকে দেখে হাসলেন তিনি। ব্যাগটা বিছানার একপাশে সরিয়ে বসবার জায়গা করে দিয়ে বললেন,
— “এই হয়ে এলো প্রায়। তুমি এসো, ভাবী। বসো এখানটায়।”
চমক বসলেন। হাতে হাতে ননদীনির একটু সাহায্যও করলেন। একটা জামা ভাঁজ করবার জন্য নিয়ে আহ্লাদ করে বললেন,
— “আর ক’টা দিন থাকলে হতো না? এই তো সেদিন এলে!”
— “সেদিন কই, ভাবী? নয়দিন হয়ে গেছে এরমধ্যেই!”
হাসলেন আলেয়া। চমক তবুও বলেন,
— “তাতে কি? আরও কটা দিন থেকে গেলে কি আমরা তোমাদের বের করে দিবো? বাপের বাড়ি তোমার। থাকতে পারো না?”
বলেই ভাঁজকৃত জামাটা ননদের হাতে তুলে দেন। আলেয়া সেটা যথা স্থানে রেখে প্রত্যুত্তর করলেন,
— “বিয়ের পর বাপের বাড়ি বলে তো আর নিজের কিছু থাকে না, ভাবী। আমার যেমন নেই, তোমারও তেমন নেই। এই যে অনু গেল, ওরও নেই। এখন সবার ওই শ্বশুরবাড়িই আসল!”
মেয়ের কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন চমক। বললেন,
— “এক মেয়েকে তো তার ঠিকানায় পৌঁছে দিলাম। অন্যটাকে কি করবো, আলেয়া?”
অদ্ভুত করুণ সেই কণ্ঠস্বর। কেমন অসহায়ত্ব মিশে! আলেয়ার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। নরম সুরে বললেন,
— “অতো ভাবছ কেন? চারুর জন্য তোমরা তো আছই!”
— “বাবা – মা কি চিরদিন থাকে? চিরদিন কি ওকে আমরা আগলে রাখতে পারব? মlরবো না আমরা? তখন কি হবে ওর?”
কেঁদেই ফেললেন চমক। কাঁদতে কাঁদতেই প্রশ্নগুলো ছুঁড়লেন ননদের পানে। ক্রন্দনরত ভাতৃজায়ার মলিন মুখশ্রী দেখে সহসা কি বলবেন ভেবে পেলেন না তিনি। সান্ত্বনার বাণী শুনাবেন? কিন্তু শুনিয়ে কি লাভ?
একসময়ে বললেন,
— “চারু ছোট নয়, ভাবী। একজন আত্মনির্ভরশীল নারী কখনো স্বামীর উপর নির্ভর করে থাকে না। আর না-ই বিয়ের জন্য উতলা হয়ে থাকে। নিজেকে গুছানোর সময় ওকে দাও। ও ঠিক গুছিয়ে নিবে!”
— “আর বিয়ে? বিয়ে দিতে হবে না?”
এ কথায় ফিরে তাকায় আলেয়া। রোষ আর বিদ্বেষের মিশ্রণে অদ্ভুত এক দৃষ্টি তার,
— “একবার তো দিয়েছিলে, লাভ কিছু হয়েছে?”
নিরুত্তর থাকেন চমক। কিচ্ছুটি বলেন না আর। ভাতিজির পক্ষে শেষ সিদ্ধান্তটা আলেয়াই জানিয়ে দেন,
— “চারু না চাইলে ওর আর বিয়ে দেবার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। চাকরি – বাকরি কিছু করতে চাইলে ওকে করতে দিও। না করলেও আপত্তি নেই। বাপের তো কম নেই। পাড়া প্রতিবেশী কি বলবে সেটা ভাবতে যেও না। পাড়ার লোক তোমায় ভাত – কাপড় দেবে না। যদি কখনো চারু সম্বন্ধ আসে তো, সর্বপ্রথম ওর মতামত নেবে। আগের মত কোনো ভুল করে, দ্বিতীয়বার ওর জীবনটাকে নরক বানাবে না, প্লিজ!”

*****

বসার ঘরে বসে সবাই টিভি দেখছিল রাতে। কাব্য, ঋতু, রিংকু – টিংকু আর নিখিল। আজ ওদের দলটা বেশ হালকা হালকা মনে হচ্ছে। কবির গেছে বৌকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি। ইমা – ইরাও তাদের মায়ের সঙ্গে বিকেলে চলে গেছে। সৌভিক আপাদত বাড়ি নেই। কোথায় গেছে বলে যায় নি।
সালমান খানের মুভি হচ্ছে একটা। কিসি কা ভাই কিসি কা জান। ফাইটিং সিন চলছে, সবগুলো তাই হা করে গিলছে। এমন সময় সৌভিককে ফিরতে দেখা গেল। স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিখিল ডাকলো,
— “কোথা থেকে ফিরলি?”
— “শহরে গিয়েছিলাম। টিকেট কাউন্টারে।”
চট করে ফিরে তাকিয়ে দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারে তাকালো নিখিল। অনেকদিন তো হয়ে এলো! ছুটির তো আর বেশি বাকি নেই! ফিরতে হবে। সপ্রতিভ গলায় বললো,
— “কনফার্ম করলি?”
— “হুঁ। গুছিয়ে নিস। কাল রাতের বাস। দশটায় টার্মিনাল থেকে উঠবো।”
বলেই পকেট থেকে দু’টো টিকিট বের করে হাতে দিলো ওর। তারপর সোজা উপরে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
টিকিট দু’খানা নিয়ে নিশ্চুপ বসে রইল নিখিল। অনিমেষ চেয়ে কি যেন ভাবতে থাকলো। ছন্দপতন হলো আড্ডার। এতক্ষণের গল্প-গুজবের মৃদু আওয়াজ নিঃশেষ হয়ে কর্ণকুহরে শুধুই বাজতে লাগলো টিভির সালমান যান্ত্রিক স্বর!

****
যে আসে, তারে যেতে হয়!
কেউ থাকে না চিরকাল!
আজ রাতেই নিখিল – সৌভিকের ফেরার পালা। মাথার উপর বিদায় ঘণ্টি বাজছে। ইতোমধ্যেই নিজের সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে নিখিল। তবুও তার মনে হচ্ছে, এখনো অনেক কিছুই গোছানো বাকি!
সেসব কি করে গোছাবে সে? আদৌ কি গুছিয়ে নিতে পারবে?
সারাটা দিন অদ্ভুত এক অস্থিরতায় কাটলো বেচারার। চারুর সঙ্গে একটু কথা বলবার জন্য প্রাণ ছটফট করতে লাগলো। অথচ কথা বলবার উপায় নেই!
এই তো কয়েক ঘর পরেই ওর ঘর; চাইলেই দরজায় নক করে ডেকে নেয়া যায়। বলে ফেলা যায়, মনের কথা। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়?
উচাটন করতে করতে বেলা গড়ালো। বিকেলে রিংকু – টিংকু এলো ওর কাছে। ক’দিনে বেশ ভাব হয়েছে কি-না। নিখিল ভাবলো, ওদেরকেই বলে দেখা যাক। চারুকে ডেকে এনে দেবে। কিন্তু কিছু বুঝে ফেলবে না তো? যদি কিছু মনে করে?
পরক্ষণেই মনে হলো, আরে কি ভাববে? ছোট মানুষ। ক্লাস এইটে পড়ে। এসব ভাবার সময় আছে না-কি? তারপরও, একটা কিন্তু থেকেই যায়!
কিছুক্ষণ ভাবলো। অবশেষে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে বললো,
— “রিংকু – টিংকু? একটা কথা শুনবে?”
দু’জনে বিছানায় আসাম করে বসে ফোনে গেম খেলছিল। স্ক্রিন থেকে চোখ না তুলে বললো,
— “কি?”
— “একটা কাজ ছিল। করবে?”
ইতস্তত করলো।
— “কি কাজ? বলো।”
— “তোমাদের বড় আপা, মানে চারুলতা। তাকে একটু ডেকে দেবে?”
ওর বাচন ভঙ্গিতেই কি যেন ছিল। ত্বরিতে মাথা তুলে দু’ ভাই বাজের দৃষ্টি তাক করলো ওর উপর। রহস্যের গন্ধ পেয়েছে তারা!
রিংকুর ঘোর সন্দিহান গলা,
— “কেন? আপাকে দিয়ে কি কাজ?”
— “আছে। একটু কাজ। ডাকো না?”
অনুরুদ্ধ স্বর। টিংকু একটু ভাব নিয়ে বললো,
— “বড়’পা সবার সাথে কথা বলে না। আর এখন তো বলবেই না। দুপুরে ওর ঘুমোনোর সময়। এখনও ঘুমোচ্ছে।”
— “হোক। তুমি তবুও যাও না? কথা আছে আমার।”
করুণ শোনাল কণ্ঠটা। রিংকু আবারও শুধাল,
— “কি কথা?”
নিখিল বিপাকে পড়লো। তথাপি একটু রাগত স্বরেই বললো,
— “সে আছে। তোমাকে ডাকতে বলেছি। ডাকো।”
দু’ ভাই পরস্পরের দিকে তাকালো একপল। কি একটা ইশারা চোখে চোখেই বিনিময় হলো, নিখিল বুঝলো না। তারপর দু’জন একসঙ্গে বলে উঠলো,
— “বেশ। তবে মাকে ডাকছি। আপাকে ঘুম থেকে তুলতে মায়ের আপত্তি নেই।”
তারপর স্বর উঁচিয়ে ডাকলো,
— “মা-আ-আ!”
সঙ্গে সঙ্গেই নিখিল লাফ দিয়ে উঠে এসে দু’ ভাইয়ের মুখ চেপে ধরলো। করুণ থেকে করুণতর সুরে মিনতি করলো,
— “এমন করে না, সোনা ভাই। প্লিজ! আপাকে একটু ডেকে দাও। প্লিজ?”
চোখে – চোখেই হাসে দু’ ভাই। আচ্ছা জব্দ করা যাচ্ছে তবে!

বেশ কিছুক্ষণ তোষামোদ, চকলেট, ফুসকার লোভ, ওর শহরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার বাহানা, ইত্যাদি ইত্যাদি বলবার মানানো গেল দুই জমজকে। তারা রাজি হয়ে বললো,
— “তুমি ছাদে যাও। আমরা আপাকে আনছি।”
— “তোমাদের ছাদে আসতে হবে না। তোমার আপা এলেই হবে।”
আঁতকে ওঠে নিখিল। দুজন বিটকেলে হাসে,
— “আচ্ছা। আপা যাবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।”
নিখিল নিশ্চিন্ত হয় না। তার হাঁসফাঁস লাগে। দম আটকে আসে। সে ত্বরিত পায়ে ছাদের দিকে এগোয়।

*****
গোধূলী বেলা। নীল অন্তরীক্ষে অদ্ভূত সুন্দর মেঘের ছড়াছড়ি। কিরণময় সূর্যের হলদে রোদের সঙ্গে সাদা পাহাড়ের মতো চমৎকার মেঘের লুকোচুরি। অক্টোবরের মৃদু – মন্দা সমীরণ ছোঁয়ায় মন ভালো হয় নিমিষেই। জুড়িয়ে যায় পরাণ। এমন দারুণ আবহাওয়ায় একা ছাদে দাড়িয়ে চারুর অপেক্ষার প্রহর গুনছিল নিখিল। কখন আসবে, কইবে সে মনের কথা!

চারু অবশ্য বেশি দেরি করলো না। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই চলে এলো। এসেই শুধালো,
— “কি ব্যাপার, নিখিল সাহেব? হঠাৎ তলব করলেন যে!”
নিখিল অন্যদিকে চেয়ে ছিল। ওর কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
— “কেমন আছেন?”
মুচকি হাসলো মেয়েটা,
— “ভালো। আপনি?”
— “আলহামদুলিল্লাহ্!”
বলেই চুপ করলো নিখিল। তার ভাণ্ডারে হঠাৎ শব্দেরা নিখোঁজ। এতক্ষণের সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা প্রস্তুতির সমস্তই বৃথা গেল। অস্বস্তিতে পড়ে মনের গহীনে হাতড়ে বেড়াতে লাগলো দু’ একটি শব্দ, যদি পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়!

নিখিলের অবস্থা বুঝতে পেরে হঠাৎ খুব হাসি পেয়ে ফিক করে হেসে ফেললো। বিব্রত নিখিল হঠাৎ সেই সুন্দর হাসির দিকে চেয়ে সব ভুলে গেল। চারুর হাসিটা যে মারাত্মক সুন্দর, সেটা আবিষ্কার করে অভিভূত হলো। কি সুন্দর শরীর দুলিয়ে হাসে মেয়েটা! নিটোল কোমল গাল দু’টিতে চমৎকার ভাবে ভাঁজ পড়ে, মিষ্টি রঙের পাতলা ওষ্ঠদ্বয়ের প্রাচীর ভেদ করে বেরিয়ে আসে ঝকঝকে মুক্তোর ন্যায় দাঁত! ঝংকার তোলা হাসির আওয়াজে ধ্যান ভঙ্গ হতে বাধ্য হয় যেকোনো ঋষির!
আনমনে ওই হাস্যোজ্বল কন্যার দিকে চেয়ে একটি নিষিদ্ধ ইচ্ছে জাগ্রত হয় নিখিলের মাঝে। ইচ্ছে করে, ওই মিষ্টি অধরের ভাঁজে অধর ডুবিয়ে দীর্ঘ এক চুম্বনের। চারিদিক শীতল বাতাস বইবে, চারুর অগোছালো রেশমি চুলগুলো উড়বে বেখেয়ালি হয়ে, তারই মাঝে দু’টি মানুষ মিলে যাবে দুটিতে!
পরক্ষণেই নিজের ভাবনায় লাগাম টেনে দিলো। যতোই সে চারুকে পছন্দ করে থাকুক, বিয়ের আগে, পরিপূর্ণ অধিকার পাবার আগে সে ওর কাছে পরনারী! আর পরনারীকে নিয়ে এমন চিন্তা পাপ, মহা অন্যায়!

চারু হাসি থামিয়ে ওর দিকে তাকালো। ওর অনিমেষ চাহনিতে লজ্জিত হলো খুব। লাজে গাল গরম হলো, আরক্তিম হলো চেহারা। বুঝতে পারলো, হুট করে হাসা ঠিক হয় নি। বললো,
— “কিছু কি বলবেন আপনি? বললে তাড়াতাড়ি বলাই ভালো। শুনে চলে যাই।”
নিখিল হঠাৎ মোহাবিষ্টের ন্যায় স্বগতোক্তি করলো,
—“আপনাকে যদি আমার বুকের বাঁ পাশের খালি জায়গাটায় বসাতে চাই, আপনি রাজি হবেন, চারুলতা?”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৬

চারু হতচকিত হয়ে তাকায়। ফ্যাল ফ্যাল নয়নে চেয়ে রয় অনিমেষ। নিখিল সময় নেয় না। মনের কথা সব ব্যক্ত করতে হড়বড় করে বলে,

— “আমি জানি, আপনি কি অজুহাত দেখাবেন। আপনার আগে বিয়ে হয়েছিল; ডিভোর্স হয়েছে। আপনার কখনো বাচ্চা হবে না। এজন্যে আমি আপনা কে মানবো কি-না; আমার পরিবার—ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বিশ্বাস করুন। এগুলোতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার কাছে আপনার অতীত গুরুত্বপূর্ণ নয়, আর নয়ই বাচ্চা হওয়া না হওয়ার ব্যাপার। আমার নিজের ক্ষেত্রেও বাচ্চা না হওয়ার বিষয়টা ঘটতে পারতো। নিজের ক্ষেত্রে হলে যেটা আমাকে মানতে বাধ্য, সেখানে ভালোবাসার মানুষের ক্ষেত্রে হলে কেন মানব না? আপনি ইচ্ছে করে নিশ্চয়, নিজের অক্ষমতা সৃষ্টি করেন নি?”

বলেই নিশ্বাস ছেড়ে চারুর দিকে তাকালো। মেয়েটার জল টলমলে আঁখি ওর বুকে চিনচিনে ব্যথার অনুভূতি দিলো। একটু দম নিয়ে বললো,

— “আর রইলো পরিবার। আমার বাবা নেই। মাকে নিয়েই ছোট্ট সংসার। সেখানে আমরা দু’জনেই দু’জনের ভালো বন্ধু। দুজন দুজনকে প্রাধান্য দেই। তাই আমার মনে হয় না, আমার ভালোবাসাকে অযোগ্য ভাবার কোনো কারণই মা’র আছে! তিনি তা করবেনও না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

চারু মলিন গলায় শুধায়,

— “আর সমাজ? আত্মীয়-স্বজন? তারা বাঁধা দিবে না?”
নিখিল যেন আশার আলো পেল ওকে মুখ খুলতে দেখে। খানিক হেসে বললো,

— “আমাদের সমাজের খারাপ দিক কি জানেন? এখানে নিন্দুকের সংখ্যা বেশি। আর এই নিন্দুকেরা কখনো কারো ভালো দেখতে পারে না। ভালোকে নিরুৎসাহিত করাই এদের অভ্যাস। ওদের আমি পাত্তা দেই না। আর আত্মীয়-স্বজনের কথা বলছেন? ওরা হয় তো, সুযোগ পেলে একটু – আধটু বলবার চেষ্টা করবে। কিন্তু ভাববেন না, ও আপনার শাশুড়িই সামলে নেবে। তার বৌমাকে কিছু বলে পার পাবে নাকি?”

হাসলো নিখিল। সেই সঙ্গে ঠোঁটের কোণটা একটু প্রসারিত হলো চারুরও। নিঃশব্দ হাসির তালে দু’ ফোঁটা জল কখন যে গড়ালো কপোল বেয়ে সে টের পেল না। কিন্তু নজর এড়ালো না নিখিলের। এই প্রথম সাহস করে ওর অশ্রু মুছে দিতে হাত বাড়ালো নিখিল। ডান হাত দিয়ে ওর চোখের কোলের সবটুকু জল কণা শুষে নিয়ে বললো,

— “আপনাকে আগে একটা কথা মনে রাখতে বলছিলাম, রেখেছেন? চাঁদের মুখে কান্না মানায় না। তাকে উজ্জ্বল হাসিতেই শোভা পায়। আপনি চাঁদ চারুলতা; আমি আপনাকে আমি পাই বা না পাই, কিন্তু আপনার চোখে অশ্রু দেখার দুর্ভাগ্য আমি চাই না। কখনো কাঁদবেন না!”

চারু না চাইতেও ফুঁপিয়ে উঠলো,

— “কেউ কি শখ করে কাঁদতে চায়?”

— “চায় না, জানি। জীবনে হাসি – কান্না সবই থাকে। কিন্তু আমি চেষ্টা করবো, আপনার জীবনে সেই দুঃসময় গুলো না আসুক। অনেক তো সয়েছেন! আর না—”

বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে; ছোট্ট করে বললো,

— “বাকিজীবনটা আমার হাত ধরে থাকবেন, চারুলতা? প্লিজ?”

ওর সেই নরম গলার ছোট্ট আবদারটা এতো বেশি আদুরে ঠেকলো চারুর কাছে! একটু-একটু করে কোমল হাতটা এগিয়ে এলো নিখিলের পোক্ত হাতের তালুতে। মুঠো করে সেই কোমল হাতের পিঠে চুমু এঁকে দিলো সে! অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালো,

— “ভালোবাসি, চারু। অনেক বেশিই ভালোবাসি!”

পুরুষালি সৌষ্ঠবপূর্ণ অধরের উষ্ণ ছোঁয়ায় আবেশে চোখ বুঁজলো চারু। অনুভূতির জোয়ারে ভেসে গেল সিক্তমন। হৃদ পিঞ্জিরায় ডানা ঝাপটালো বিহঙ্গের দল। কানে কানে ফিসফিসিয়ে গেল প্রজাপতিরা,

— “অবশেষে তোমার জীবনেও ভালোবাসা এলো, চারুলতা!”

*****

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামতেই হাসিতে ফেটে পড়লো দুই ভাই। মুখ হাত চাপা দিয়ে ‘হা হা’ করে পেট থেকে উৎলে আসা হাসিটা আটকানোর ভঙ্গি করলেও হলো না। প্রাণ খুলে হাসতে লাগলো ওরা। এতদিন দুষ্টুমি করে, অন্যকে জব্দ করে তো প্রচুর হেসেছে; কিন্তু আজ— তাদের প্রিয় বোন বড়’পার জন্যে খুশিতে তৃপ্তি নিয়ে হাসলো। উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো টিংকু,

— “আমি বলেছিলাম! বলেছিলাম তোকে! দেখলিই?”

— “হুঁ।”

মাথা নাড়ে রিংকু। ও আবার চেঁচায়,

— “আমি জানতাম। আগেই টের পেয়েছিলাম। নিখিল ভাইয়ের পেটে খিচুড়ি পাকছে! ও যেভাবে বড়’পার দিকে তাকাতো না—”

— “একটু-একটু সন্দেহ তো আমারও জাগত। কখনো সেভাবে খতিয়ে দেখি নি।”

সঙ্গে সঙ্গেই হৈহৈ করে উঠলো টিংকু,

— “ওও? এখন সন্দেহ তোমারও হতো, না? মিথ্যেবাদী! আমি শুরু থেকেই তোকে বলতাম, তুইই বিরুদ্ধে যেতি। বলতি, ‘না-আ-আ! নিখিল ভাইয়া সরল মানুষ। এসবের ধান্দা নেই।’ ইসস, যেন কতো সাধু?”

শেষের অংশে ভেংচিয়ে বললো। রিংকু জবাব না দিয়ে হাসলো। নীরবে মাথা পেতে নিলো দোষ। তাই দেখে প্রসন্ন হলো সহোদর,

— “শোন, বড় বড় সাধুদেরও ধ্যান ভাঙে সুন্দরী নারীর সাহচর্যে এসে। ঋষিত্ব ছেড়ে সংসারী হয় কেবল নারীর প্রেমের টানে। আর সেখানে বড়’পার মতো এতো প্রীটি একটা মেয়েকে দেখে নিখিল ভাই পিছলাবে না? এও হয়! আমাদের আপা কত্তো সুইট!”

বোনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো দুষ্টু দুই জমজও। হবু দুলাভাইকে নিয়েও মন্তব্য করলো,

— “নিখিল ভাইও কিন্তু হ্যান্ডসাম। বলিউড হিরোর মতো ড্যাশিং লুক ওনার, না?”

টিংকু দাম্ভিক হাসলো। কলার ঝাঁকিয়ে বললো,

— “দেখতে হবে না, দুলাভাইটা কার?”

ভাইয়ের অহেতুক দর্পে রাগ করলো না রিংকু। একটু ভেবে বললো,

— “তবে যাই বলিস, মাহতাব ভাইয়ের থেকে নিখিল ভাই অনেক ম্যাচিউর। অনেক ভালো। আপাকে ভালো রাখবে উনি, তাই না?”

মাহতাবের নাম শুনতেই মুখ কুঁচকে ফেললো ও। ঠোঁট উল্টে তীব্র অবজ্ঞাভরে উচ্চারণ করলো,

— “ওই ক্ষ্যাতের নাম নিস না তো। অশিক্ষিত একটা! নাম শুনলেও আপার সুখে নজর লাগবে। ফালতু লোক!”

— “ঠিকই বলছিস। ওর নাম নিলেও কু-নজর লাগবে আপার। কতো খুশির দিন ওর!”

— “তারচে’ চল, পার্টি করি। হোল নাইট মাস্তি!”

বলেই কাঁধ চাপড়ে দিল ভাইয়ের। রিংকু একঝলক হাবার মতো চেয়ে,
‘কিন্তু পড়া —’ প্রসঙ্গ তুলতে চাইলেও, জমজের যুক্তির উপর যুক্তিতে ধোপে টিকলো না কিছু। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দু’ ভাই জড়িয়ে ধরলো দুজনকে! তারপর হাঁটা দিলো নিজেদের ঘরের দিকে।

****
অন্ধকার কক্ষে একলা বসে সৌভিক। সন্ধ্যা নেমেছে সেই কখন! এখনো আলো জ্বালে নি। জানালাও খুলে রাখা আলগোছে। অক্টোবরের হিম ধরানো মাতাল হাওয়ায় পর্দা উড়ছে সবেগে, হাতছানি দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওকে। তবুও তার কোনো হেলদোল নেই!

বাগানের আলোয় দেখা আবছা ঘরে চেয়ে দেখলে বোঝা যায়, ছেলেটা স্তব্ধ মূর্তির ন্যায় নিশ্চুপ বসে। যার চোখের কার্নিশে চিকচিক করছে নোনা জলবিন্দু!

কিয়ৎক্ষণ পর দরজা খুলবার আওয়াজ হলো। বাতি জ্বালিয়ে নিখিল বললো,

— “কি রে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে কি করছিস? জানালাও বন্ধ করিস নি? মশা এসে তো ভরে গেল—–”

বলেই ওর দিকে তাকালো। বিমূঢ় সৌভিক হঠাৎ যান্ত্রিক ভঙ্গিতে মুখ ফিরালো। ওর প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেমন অদ্ভুত গলায় বললো,

— “চারু এতো সহজেই রাজি হয়ে গেল, তাই না? কি জাদু করলি ওকে?”

তাচ্ছিল্য নয়, উপহাসও নয়। বরং নিদারুণ অসহায়ত্ব মিশে। বন্ধুর এমন বিধ্বস্ত দশা দেখে নিখিল হতবাক!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-১৩+১৪

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৩

কাছের মানুষগুলো কাছে থাকলে, কোনো ব্যথাই যেন আর ব্যথা দিতে পারে না। এ পৃথিবীতে দুঃখ নেই কার? কমবেশি সবাই তো আমরা দুঃখী। দুঃখে, কষ্টে জর্জরিত একেকজন। কিন্তু এই ব্যথা-বেদনাগুলো আমরা ভুলে যেতে পারি। জখম আমাদের তা ভুলিয়ে দেয়া হয়!
এ দুনিয়ায় সব মানুষই কষ্ট পায়, কিন্তু সেই মানুষটিই কষ্টের প্রখরতা টের পায় না যার কাছে কষ্ট ভুলিয়ে দেয়ার জন্য কেউ থাকে। থাকে কাছের মানুষ, আপন মানুষ।
চারুর বুক ভর্তি দুঃখ আর হতাশা মেটাতে তার পুরো পরিবার সচেষ্ট হলো। অন্তর্মুখী মেয়েটা কখনো কারো কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। সারাক্ষণ অন্তরালে থাকে একা একা। তাই ওর কাছের মানুষগুলো নিজেরাই কাছে টেনে নিলেন। ফুপু গতরাতে ওর সঙ্গে ঘুমিয়েছেন। অনেকরাত পর্যন্ত চুলে বিলি কাটতে কাটতে পুরোনো দিনের গল্প করেছেন। সকালে রান্নাঘরে কাজ করতে থাকা মা – চাচীদের আড্ডায় ধরে শামিল করলো। বিকেলে ভাই-বোনেরা একসঙ্গে বসে মুভি দেখলো। ড্রইং রুমটার সোফা সরিয়ে মেঝেতে তোষক ফেলে, সামনে পপকর্নের বাটি নিয়ে বসে সবগুলো একত্রিত হলো। মুভি দেখার জন্য! হিন্দি ঘরানার একটা কমেডি মুভি দেখতে দেখতে হেসে গড়াগড়ি খেল ওরা। সে রাতটাও ওরা ক’ বোন একসঙ্গে থাকলো। বহুদিন পর ওরা একসঙ্গে এতো মিষ্টি সময় কাটালো। এতো এতো মানুষের সমাগমে থেকে নিজের ব্যথাটা ভুলতে বাধ্য হলো চারু। মন খারাপেরা দল বেঁধে পালালো। চুটিয়ে আড্ডা, হৈ-হুল্লোড় করতে করতে কেটে গেল প্রহর!

পরদিন আয়োজন করা হলো পিকনিকের। পিকনিক বলতে, সব ভাইবোনেরা মিলে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করলো। যাতে বড়রা রইলো আমন্ত্রিত অতিথিদের ভূমিকায়!

রোদ থেকে বাঁচতে বাগানের একজায়গায় সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে।তার নিচে বড় বড় দু’টো গর্ত করে, ইট বসিয়ে চুলো বানিয়েছে রান্না করবে বলে। রান্নার দায়িত্ব সৌভিক আর চারুর। আগেই বলেছি, সৌভিক ভীষণ গোছালো আর কর্তব্যপরায়ণ ছেলে। তার প্রতি অগাধ আস্থা তার ছোট – ভাইবোনদের। বাজারের দায়িত্ব পড়েছে কাব্য আর কবিরের উপর। তাদের স্ত্রীরা রান্নার সহযোগী। ইমা, ইরা এবং ঋতু অন্যান্য কাজে। সবাইকেই মোটামুটি কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। একমাত্র বাদ গেছে রিংকু – টিংকু। অতি আদরের ছোট দু’টি ভাই, তাদের জন্য কাজ মওকুফ। কিন্তু ভাইয়েরা ভালোবেসে কাজ থেকে রেহাই দিলে হবে কি? তারা নিজেরা তো মহা দেওয়ানী। অন্যরা খেটে মরবে আর ওরা আনন্দে ’তাইরে নাইরে না’ করতে করতে ঘুরবে? ভাই-বোনদের প্রতি এ অবিচার ওরা করবে কি করে? ওদের মানবিকতা বোধ আছে না?
তাই স্বেচ্ছায় তারা কাজে লেগে পড়লো। ইরা শরবৎ বানাচ্ছিল। দু’ জগ ভর্তি করে শরবৎ বানিয়ে ফ্রিজে রাখবে। বেলা একটু পরে গেলেই তো সকলে তৃষ্ণায় ছটফট করবে। মোক্ষম সময়ে যেন তড়িঘড়ি করে কিছু করতে কিংবা হা হুতাশ না করতে হয়, তার প্রস্তুতি আগে-ভাগেই নিচ্ছে। রিংকু – টিংকু এসে দাড়ালো ওরই কাছে। বললো,
— “আপা। দে সাহায্য করি।”
ইরা ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
— “কি করবি?”
— “এভাবে তাকাস কেন? সাহায্য করতে চাইছি।”
ইরা তবুও একইভাবে চেয়ে, তাই বললো,
— “সাহায্য মানে বুঝিস না? ইংরেজিতে বলে হেল্প। এইচ-ই-এল-পি। হেল্প!”
— “হেল্প মানে জানি আমি। মূর্খ নই। কিন্তু তোরা এখানে কেন? কি কুকীর্তি করবার মতলব?”
সন্দিহান গলায় বললো। টিংকু ভারী বিরক্ত হলো তাতে,
— “এই জন্যই মহিলা মানুষরে ভাল্লাগে না। সব জায়গায় খালি প্যাঁচ খোঁজে। আরে ভাই, হেল্প করতে আসছি। কি করতে হবে বল!”
ওদের কথায় আশ্বস্ত হলো কি-না বোঝা গেল না। ক্ষণিক নিশ্চুপ থেকে কুঞ্চিত ভ্রূ সোজা করলো ইরা। বললো,
— “হেল্প করতে চাইছিস ভালো। কিন্তু আমার কোনো হেল্প লাগবে না। আমি নিজেই করতে পারবো। তোরা বরং চুপচাপ দাড়া।”
নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। লেবুর রস ঢাললো জগে। বয়াম থেকে চিনি ঢালতে উদ্যত হয়েছে তখনই হঠাৎ ডাক পড়লো তার। বাড়ির ভেতর থেকে ঋতুর ডাক শোনা যাচ্ছে,
— “ইরা? তোকে ছোট চাচী ডাকছেন! জলদি আয়।”
কাজ থামিয়ে উত্তর করলো ইরা,
— “আসছি।”
বলেই ছুটে গেল ভেতরে। যাবার পূর্বে ভাইদের সতর্ক করতে ভুলে নি। কিন্তু ওর সতর্ক বার্তায় কি যায় আসে দু’ভাইয়ের? তারা তো অকাজ করতে সদা পারদর্শী। তাই চিনির বদলে শরবতে লবণ দিতে কার্পণ্য করল না। একদম বয়াম উপুড় করে পুরোটাই ফেলে দিলো জগের পানিতে। অকাজটা করেই টিংকু শয়তানি হাসি দিলো। ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
— “লবণের সংকেত কি বল তো, রিংকু?”
— “সোডিয়াম ক্লোরাইড!”
–“আর এটা কি তৈরি হলো?”
— “লবণ আর পানির সম্পৃক্ত দ্রবণ!”
— “আর এরই মাধ্যমে সম্পন্ন হলো আমাদের বৈজ্ঞানিক অভিযান। বুঝলি রিংকু, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের কিন্তু কোনো বিকল্প নেই। হরহামেশাই দরকার!
দু’ ভাই কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। তারপর চুপ করে সটকে পড়লো ইরা আসবার আগেই!

নিখিলকে কেউ কোনো কাজ দেয় নি। সে মেহমান মানুষ, তাকে দিয়ে কাজ করানো যায়? তাছাড়া তারা এতোগুলো ভাইবোন যেভাবে কাজ ভাগ করে নিয়েছে তাতে ওর কষ্ট করবার কোনো প্রয়োজন নেই। তথাপি হাত গুটিয়ে থাকাটা নিখিলের পছন্দ হলো না। সে রান্নার জায়গায় বসে চারুর সহযোগিতা করবার জন্য বেশ কয়েকবার অনুরোধ করলো। কিন্তু সৌভিক কিংবা চারু কেউই তাতে রাজি হলো না। ওরা দু’জনে একসঙ্গে চুলোর সামনে বসে। গুটুর-গুটুর করে গল্প করছে, মাঝে মাঝে হাসছে। অদূরে বসে এই দৃশ্য দেখে অন্তর জ্বলে যাচ্ছে নিখিলের! অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো সে।
কিয়ৎক্ষণ পর ইমাকে ডাক দিলো চারু,
— “এ্যাই, ইমা? বাংলা ঘর থেকে কিছু খড়ি নিয়ে আয় তো!”
ইমা সম্ভবত আশেপাশে ছিল না। কিংবা বড়’পার ডাক শুনতে পায় নি। একটু পর সৌভিক ফের ডাকলো। কিন্তু এবারও ফলাফল শূণ্য। অগত্যা চারু বললো,
— “ভাইয়া? তুমি থাকো। আমি এনে দিচ্ছি।”
বলে নিজেই উঠে দাড়ালো লাকড়ি আনবার উদ্দেশ্যে। সৌভিক বাঁধা দিতে চাইলো। চারুর প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা আছে। বললো,
— “না, না। আমি যাই। তুই বস।”
— “তুমি থাকো তো। আমি যাবো আর আসবো।”
চারু এগোলো। নিখিলের চাতকী মন যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল এতক্ষণ। সে চট করে উঠে চারুর কাছে এলো,
— “কি লাগবে আমাকে বলুন না? আমি এনে দিচ্ছি।”
চুলোর জ্বাল ঠিক করছিল সৌভিক। কথা শুনে বন্ধুর দিকে ফিরে তাকালো। অদ্ভুত দৃষ্টিতে। সে দৃষ্টিতে খানিক ক্রোধ আর বিরক্তি মিশে। নিখিল বুঝেও পাত্তা দিলো না। সৌভিককে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চারুর পানে চেয়ে রইলো,
— “এতক্ষণ ধরে রিকোয়েস্ট করছি। আপনারা কিন্তু একটা কথাও রাখেন নি। এবার না বললে হবে না। বলুন, কি দরকার?”
— “সাহায্য তো আমিও করতে চেয়েছি। আমাকে সুযোগ দিলি কই?”
মাঝখান থেকে বলে ওঠে সৌভিক। তার দৃষ্টি এখন ঘুরে চারুর উপরে নিবদ্ধ। মেয়েটা পড়লো বিপাকে। সে কি করবে?
হাসলো অপ্রস্তুত ভাবে
— “তোমরা এমন করছ কেন? বললাম তো আমি করে নিবো।”
— “কিন্তু আমি…”
সৌভিক কিছু বলবার জন্য মুখ খুলতেই চারু অপ্রসন্ন গলায় ডাকে,
— “ভাইয়া, প্লিজ? সকাল থেকে খাটছ। তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাইছি না।”
এবারে নিখিল নিজের আর্জি জানায়,
— “সৌভিক না হয় খুব খেটেছে, আমি তো খাটি নি। আমাকে করতে দিন। অন্তত এই একটি কাজ করে বলতে পারবো, পিকনিকে আমার অবদানও তুচ্ছ নয়।”
বলেই হাসবার চেষ্টা করলো। ওর এতো আন্তরিক আচরণ দেখে আর না করতে পারলো না চারু। কে জানে, এ যাত্রায় ‘না’ বললে হয় তোমন খারাপ করবে। এই সুন্দর সোনালী দিনটায় কেউ মনে কষ্ট নিয়ে থাকুক সে চায় না। মুচকি হেসে সায় দিলো।

বেলা দেড়টা নাগাদ রান্না-বান্নার পর্ব শেষ হলো। ততক্ষনে সব ক’টা ক্ষিদের জ্বালায় কুপোকাত! ঐতিহ্য রক্ষার্থে থালার উপর কলাপাতা নিয়ে অধৈর্য হয়ে বসে। সৌভিক চুলো থেকে হাড়ি নামাতেই ওরা ছুটে গেল। পরিবেশনের ধার ধারে নি কেউ। চটপট যে যা পারছে তাই নিচ্ছে তুলে। হৈহৈ করতে করতে প্লেট পূর্ণ করে ফিরে আসছে নিজ আসনে।ওদের ভীড় কমলে ধীরে – সুস্থে বোল নিয়ে এগোলো চারু। বড়দের পরিবেশন করতে হবে। সৌভিকও বসে গেছিল ভাইদের সঙ্গে। চারুকে কাজ করতে দেখে প্লেট রেখে উঠে এলো। কাজ তো চারুও কম করে নি। তবে তাকে রেখে কেন নিজে খেতে বসা?
কিন্তু এগিয়ে যেতেই দেখলো ইতোমধ্যে নিখিল চলে এসেছে চারুর কাছে। সবাই কাজ করে ক্ষুধার্ত হয়েছে। তাই খাবার প্রস্তুত হতে না হতেই যে যারটা নিয়ে হামলে পড়েছে। কিন্তু নিখিল তেমন কাজ করবার সুযোগ পায় নি। তাই তার অত খাওয়ার তাড়া নেই। এই ফাঁকে সে হাজির তার অব্যক্ত প্রিয়তমার কাছে, তার সহযোগিতার জন্য!
— “গোশতের বোলটা আমায় দিন, চারুলতা। আমি নিচ্ছি।”
— “আরে আপনি কেন এলেন! মেহমান মানুষ, খেতে বসুন।”
চারু বাঁধা দিতে চায়। নাছোড়বান্দা নিখিলের জবাব,
— “আপনারা আমাকে কি পেয়েছেন বলুন তো? মেহমান বলে কি কিচ্ছুটি করতে পারি না? আপনি তখন থেকে কাজ করছেন। সাহায্য করতেও দিচ্ছেন না। এ-তো ভারী অন্যায়। অন্যদের সুযোগই দিচ্ছেন না।”
সেই মুহূর্তে সৌভিক এসে দাড়ায়। ওকে দেখেই চারু বলে উঠলো,
— “আরে ভাইয়া, তুমি এলে যে? কিছু লাগবে?”
— “না। না। তোর কাছে এলাম। দে দেখি, কি করতে হবে।”
নিখিল ফট করে বললো,
— “তোকে আর কিছু করতে হবে না, দোস্ত। অনেক করেছিস। এবার যা, আরাম করে খা।”
নিখিলের উপস্থিতি কেন যেন মানতে পারছিল না সৌভিক। হয় তো, চারুর প্রতি ওর ভালোলাগার কথা জানে বলেই। আবার একই ব্যাপার ঘটছিল নিখিলের সঙ্গেও। বন্ধুবর সৌভিক এবং চারুর প্রতি তার আধিপত্য তার অসহ্য লাগছিল। সৌভিক বললো,
— “করেছি তো কি হয়েছে? বাড়ির ছেলেরা কাজ করবে তাই স্বাভাবিক। তুই অতিথি মানুষ। গিয়ে বসে পর। আমরা সামলে নিবো।”
এদের আচরণে চারু হতবাক। সকাল থেকে খেয়াল করছে এই দু’টো মানুষ তার পেছনে লেগেছে! সে যা করছে, করতে চাইছে সবকিছুতে তাদের আগ্রহ। তাকে সাহায্য করতে যেন এরা দু’জনই মুখিয়ে। সৌভিকের আচরণ ওর কাছে পরিচিত। সে বরাবরই এমন করে। ওর প্রতি অতি স্নেহশীল। কিন্তু তার বন্ধু নিখিল? সে এমন আচরণ করছে কেন!
সে অস্বস্তি নিয়ে বলে,
— “তোমরা যাও, প্লিজ। ভাইয়া? তোমাকে কিছু করতে হবে না। খেতে বসো। আমার একটু বাকি আছে কাজ, একাই করে নিবো। সমস্যা হবে যা। আর নিখিল সাহেব আপনিও যান। এমনই অনেক দেরি হয়েছে। আর দেরি করবেন না। প্লিজ।”
— “কিন্তু…”
— “কোনো কিন্তু নয়। যান।”
নিখিল দিরুক্ত করতে চাইলেও আর শোনে না। দুজনকেই পাঠিয়ে দেয়। তারপর নিজের কাজ গুছিয়ে নেয়। মহিলা মহলের দিকটায় পরিবেশন করতে গিয়ে তাদের সঙ্গেই খেতে বসে। পরমযত্নে বড় ফুপু ধরে খাইয়ে দেন ওকে। হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠে সব!

কিন্তু এতসবের মাঝেও ওর মনের ভেতর কাঁটার মত খচখচ করে কি যেন। সে ছোট বাচ্চা নয়। অবুঝ – নাদান নয়। তার সঙ্গে কে কেমন আচরণ করছে সেটা বুঝবার ক্ষমতা তার আছে। এবং সেই আচরণের পেছনে কার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তাও সে অবগত। পরিপূর্ণ অভিজ্ঞ একজন নারী সে। তার প্রতি একজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের ব্যবহার, কথাবার্তা, চাহনি যদি নাই বুঝে — তবে সে নারী হলো কি করে?
আর বুঝেই সে অবাক হচ্ছে। নিখিল সম্পর্কে কৌতুহল হচ্ছে। ছেলেটা কিছু জানে কি? সব জানবার পর তার প্রতি আগ্রহী হবার তো কোনো কারণ নেই!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৪

পড়ন্ত বিকেল। একটু পরেই টুপ করে ডুবে যাবে সূয্যিমামা। লালিমার রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে আকাশ, আর কালোরা ঝাঁপিয়ে পড়বে দুনিয়ায়। আঁধারিতে ভরে উঠবে পরিবেশ। কিন্তু সে অনেক দেরি!
তার আগেই সবাই মিলে বসে পড়লো একসঙ্গে। সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে বাগানের মাঝখানটায় গোল হয়ে বসলো। এখন আড্ডা হবে, গান হবে। দৌড়ে বাড়ি থেকে কাব্যের গিটার আনলো রিংকু-টিংকু। কাব্য দারুণ গাইতে জানে। একসঙ্গে আড্ডায় বসলে প্রায় এক-আধটা গান গাইতেই হয় ওকে। সবাই অনুরোধ করে। আর আজ এরকম একটা আয়োজন। গান না হলে জমে? কাব্য গান গাইলো, ঋতু কৌতুক বললো। কবির ভালো আবৃত্তি করে। ওর মুখে নজরুলের কোনো কবিতা শুনে এতো প্রাণবন্ত লাগে যে সেটাকে তখন আর স্রেফ একটা কবিতা বলে মনে হয় না। মনে হয় কোনো দৈববাণী, যার প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে গায়ের শিরা-উপশিরায় রlক্ত ছলকে ওঠে। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে প্রাণ দীপ্তিমান হয়! ইরা আবার মূকাভিনয় জানে। ও সেটাই করে দেখালো। চার্লি চ্যাপলিনের একটা পার্ট। ওর অভিনয় দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল বাকি সবাই। যে যার মতো আনন্দের সঞ্চার করে যাচ্ছে আসরে। মেতে উঠেছে সোল্লাসে। কে যেন হঠাৎ প্রশ্ন তুললো,
— “নিখিল ভাই, আপনি কি করবেন? আপনার কোনো হিডেন ট্যালেন্ট নেই?”
সঙ্গে সঙ্গে নয় জোড়া চোখ একসঙ্গে ঘুরে তাক করলো নিখিলকে। আচম্বিতে এ প্রশ্নে চমকিত হলো নিখিল। অপ্রস্তুত চোখে চেয়ে হাসলো। ওর বিব্রতবোধ টের পেয়েই চট করে টিংকু বলে উঠলো,
— “গান হলো, কৌতুক হলো, অভিনয় হলো। আপনি কি করবেন? নাচবেন না-কি? একটু নাচুন না!”
ঝোপ বুঝে কোপটা মেরেই হাসলো ঠোঁট টিপে। তাল দিলো সহোদর রিংকুও,
— “হ্যাঁ , হ্যাঁ। নিখিল ভাই, একটু ড্যান্স হলে মন্দ হয় না!”
বলেই নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করলো দুই বিচ্ছু। বলা বাহুল্য, প্রথমোক্ত প্রশ্নবাণ রিংকুরই ছোঁড়া! চারু ওদের পাশেই বসেছিল। বাঁদর দু’টোর মতলব ধরতে অসুবিধা হলো না। সবার অলক্ষ্যে বাঁ হাতে সাঁই করে একটা চাটা মারলো দুটোর মাথায়। ফিসফিস করে বললো,
— “ভদ্রতা শিখিস নি? এগুলো কি কথা?”
বড় বোনের দিকে ফিরে দাঁতালো হাসি দিলো দু’জন,
— “কুল, বড়’পা! দেখই না কি হয়!”
— “বদমাইশ!”
কড়া সুরে শাসালো সে। ওদের কি আর তাতে কান দেবার সময় আছে! তখনও কুটিল হাসিতে মত্ত দু’জন!

রিংকু – টিংকু দুষ্টুমি করে নিখিলের নাচের প্রসঙ্গ উঠালেও এতক্ষণে সবার খেয়াল হলো ওর দিকে। সত্যিই তো, এই আসরে উপস্থিত সবচে’ অল্প পরিচিত মানুষটি সে। যার ভেতরে কোনো ‘হিডেন ট্যালেন্ট’ তথা ‘লুক্কায়িত গুণ’ আছে কি-না ওরা অবগত নয়। তাছাড়া বাদ-বাকি সবার গুণ – বেগুণ সব ব্যাপারেই তথ্য আছে ভুঁড়ি ভুঁড়ি!
ইমা বলে,
— “ও দুটোর কথায় কিছু মনে করবেন না, ভাইয়া। আপনি বরং বলুন আপনি কি জানেন? আবৃত্তি জানেন? করবেন?”
— “কি বলেন! আমি আর আবৃত্তি— তবেই হয়েছ!”
মুখ লটকে তাকায় ইমা। রিংকু – টিংকু ফের চেঁচায়,
— “নাচ, নাচ। একটু কোমড় দুলাতে হবে!”
এবার ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে ধমক দেয় কবির, উপস্থিত সকলের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই,
— “চুপ, ফাজিলের দল!”
ব্যস। ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় দু’টোর হাসি হাসি মুখ। তথাপি বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশের উদ্দেশ্যে বড় ভাবীর দিকে করুণ চাহনিতে চায়। জাবিন অবশ্যি পাত্তা দেয় না!
গিটারে টুং করে একটা আওয়াজ তুলে কাব্য শুধালো,
— “গান জানো না-কি, নিখিল? গাইবে?”
তাচ্ছিল্য নয়, আন্তরিক আহ্বান। অস্বস্তির পুরু আস্তরণে পড়ে নিখিল হাসলো কোনোমতে,
— “আরে না, না। আমি…”
— “মিথ্যে কথা। উনি ভালো গান জানেন!”
ওর কথা শেষ না করতে দিয়েই হঠাৎ প্রতিবাদ করলো চারু। এক লহমায় সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল ওর পানে। ভারী অবাক করা বিষয় তো! চারু আবার নিখিল সম্বন্ধে জানে কি করে? ওই অন্তর্মুখী মেয়েটা তো সারাদিন একা একাই থাকে। নিজের ঘরের চার দেয়ালের সঙ্গে তার যে সখ্যতা! বেরোতেই চায় না! ভাইবোনদের আসরে বসলেও মুখ খোলে কদাচিৎই। সেই কি-না আজ নিখিলকে নিয়ে বলছে? আশ্চর্য তো বটেই!
সবার মতো সৌভিকও আশ্চর্য হলো, নিখিল তার ভালো বন্ধু। অনেক পুরনো ইয়ারি তাদের। সেই সুবাদেই নিখিলের ভালো গায়কী সম্পর্কে সে অবগত। চাইলে আসরে সেই এই প্রসঙ্গ তুলতে পারতো!
কিন্তু আসরে তারচেয়ে তার বন্ধুর মূল্য বেড়ে যাক — তা ও চায় নি। বিশেষত চারুর সম্মুখে গান গেয়ে নিখিল বাহবা নিক, ওর পছন্দ হয় নি বিষয়টা। তাই চুপ ছিল। চারুর স্বীকারোক্তিতে সে আশায় গুড়ে বালি পড়লো। মনে মনে গাল দিলো বন্ধুকে,
‘শালা, এরমধ্যে গান শুনিয়েও ফেলেছিস!’

চারুর মুখে নিখিলের প্রসংশা শুনে সবাই চেপে ধরলো নিখিলকে। এবার গাইতেই হবে ওকে। অগত্যা বলি বা বাকরা হলো নিখিল। গান গাইতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু এতোগুলো অপরিচিত কিংবা অর্ধপরিচিত মুখের সামনে গিটারে সুর তুলতে ওর ভারী লজ্জা লাগছিল। কিন্তু পুরুষের অল্পে-সল্পে লজ্জা পেলে চলে না। অতএব, গিটারে সুর উঠলো কাব্যের; গলা সাধলো নিখিল,
— “যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!

লাললালা

যদি প্রতিদিন সেই রঙিন
হাসি ব্যথা দেয়,
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে
শুধু কথা দেয়,
তবে শুনে দেখো প্রেমিকের
গানও অসহায়।

লাললালালা

যদি অভিযোগ কেড়ে
নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয়
সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলো কে
ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার
বলো কি থাকে আমার?
যদি ভালোবাসা সরে গেলে
মরে যেতে হয়,
ক্যানো সেই প্রেম ফিরে এলে
হেরে যেতে ভয়?
শেষে কবিতারা দায়সারা
গান হয়ে যায়।

লাললালালা

যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!

লাললালা

ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে নিখিলের মোহনীয় কণ্ঠস্বর। হ্রাস পায় সুরের গতি। মধুর আবেশ তৈরি করে, সকলকে মূর্ছনায় হারিয়ে ফেলে একসময় থেমে যায় গিটার। সর্বশেষ বেসুরো টুং করে একটা আওয়াজ তুলে ওদের চটকা ভাঙলো কাব্য,
— “নাইস, ইয়ার! দারুণ গাইলে তো তুমি!”
কল্পনায় ছেদ ঘটলো। একমুহূর্তের জন্য সবাই নিশ্চুপ থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে অভিবাদন জানাতে উদগ্রীব হলো,
— “ফাটিয়ে দিয়েছ ভাই! সুপার! সুপার!”
— “ওয়ান্স মোর! প্লিজ!”
করতালিতে মুখরিত হলো স্বর্ণালী সন্ধ্যা। সকলে এতো এতো প্রসংশায় ভরিয়ে তুললো ওকে। মন ভালো করে দেয়া একেকটি শব্দ, বাক্য! একরাশ শুভকামনা আর শুভেচ্ছাবাণী যোগ হলো ঝুলিতে। বিনিময়ে লজ্জিত হয়ে শুধুই হাসলো নিখিল। হৈ-হৈ কলরবের মাঝে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো একটি হাসিমুখের দিকে। কোমল পানপাতা মুখটিতে কোনো স্বর নেই, একেবারে নির্বাক শ্রোতা সে। অথচ তার দুটি চোখের দিকে চেয়েই যেন নিজের জন্যে হাজারও অনুপ্রেরণা খুঁজে পেল নিখিল!
সেই মুহূর্তে অনিমেষ চেয়ে রইলো দু’জনেই; নিখিল এবং চারু!

******
রাতের খাবার খেয়ে ব্যালকনিতে দাড়িয়েছে সৌভিক। মনটা বড্ডো উদাস উদাস লাগছে। কিছুতেই কিছু ভালো লাগছে না। চড়ুইভাতি করতে গিয়ে সারাদিন অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে। প্রথমে রান্না – বান্না, গোছ-গাছ তারপর বিকেলের আড্ডা! সবকিছু গুছাতে গুছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল।

সন্ধ্যায় গান গাওয়ার পর এ-বাড়িতে নিখিলের কদর বেড়ে গেছে। না, আগেও ওকে সম্মান করা হতো। কিন্তু সেটা সৌভিকের বন্ধু হিসেবে, একজন অভ্যাগত অতিথি হিসেবে। এখন সবাই কদর করছে ভালো গাইয়ে হিসেবে। তাই তো রাতের খাবার টেবিলেও ওকে নিয়েই ছিল ভাইবোনদের সমস্ত আলাপন। কথা-বার্তা। খাবার শেষ হলেও কথা শেষ হয় নি। ফলস্বরূপ নিখিলকে টেনে নিয়ে ড্রইংরুমে বসে গেছে সবাই। টিভি দেখতে দেখতে এবার গল্প জমবে!

সৌভিকের তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। তার বন্ধুকে সবাই ভালো বলুক, সে চায় না এমন নয়। সেও চায় হয় তো। নাহলে নিখিলকে কেন সে নিজেদের বাড়িতে বেড়াতে এনেছে? সে হিংসুটে হলে তো আনতো না!
কিন্তু ঘাপলা সেখানে নেই। রয়েছে অন্য জায়গায়। বাড়ির সকলে মিলে নিখিলের প্রসংশা করে, মুখে ফেনা তুলতে তুলতে মlরে যাক — ওর কিছু যায় আসে না। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন চারুকে ঘিরে, তখন সৌভিক তো হিংসুটে হবেই! ওর বুকেও তো জ্বলন হবেই! সন্ধ্যায় কেউ না দেখুক, হাততালির কান ফাটানো শব্দ, সবার হুল্লোড় করা জমজমাট আসরের মাঝেও নিখিল কেমন বেহায়ার মতো চারুর দিকে চেয়ে ছিল সে ও দেখেছে। সঙ্গে চারুর মুগ্ধ দৃষ্টিও ওর চোখ এড়ায় নি। তাই তো ওর ভয় হয়! বুক জুড়ে হতাশা তড়পাতে থাকে। আহা রে, চারু কেন তার হলো না? কেন কেউ মানলো না তাকে? দিলো না চারুকে তার করে! একান্ত তার করে?

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-১১+১২

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১১

আকস্মিক হওয়া কাণ্ডে হতভম্ব চারু। ফ্যালফ্যাল নয়নে, চোয়াল ঝুলিয়ে ছোট ভাইদের মুখের দিকে চেয়ে! রিংকু – টিংকু আনন্দে চেঁচাচ্ছে,
— “বড়’পা ভীতু! ভীতুর ডিম!”
উল্লাসে ফেটে পড়ছে যেন। সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো চারু। দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ভাইদের দিকে তাকালো। একটু রাগবার চেষ্টা করে বললো,
— “কেমন আচরণ এটা রিংকু-টিংকু? তোরা আমাকে ভয় দেখালি কেন?”
— “কোথায় ভয় দেখিয়েছি?”
অবাক হবার ভান ধরলো টিংকু। রিংকুর সায় তাতে,
— “আমরা তো তোমার কানটা একটু দেখছিলাম। তুমি যে ভীতু, তাতেই ভয় পেয়েছ। এতে আমাদের দোষ কোথায়?”
অতি সরল জবাব। নিষ্পাপ চেহারা। চারু রাগ করলো,
— “আমার কান তোদের দেখতে হবে কেন? নিজেদের কান দেখতে পারিস না?”
বড়’পা সহজে রাগে না — এটা ওদের অজানা নয়। তাই চারুর এই রাগবার আপ্রাণ চেষ্টাটা যেন পাত্তাই দিলো না ওরা। নির্বিকার গলায় বললো,
— “কি যে বলো না, বড়’পা। তোমার প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে না? এই যে তুমি কান পরিষ্কার না করতে করতে, দিন-কে-দিন ঠসা হয়ে যাচ্ছো; কতক্ষণ ধরে আমরা তোমাকে ডেকে যাচ্ছি তুমি শুনছোও না, উঠছোও না— এটা আমাদের দেখতে হবে না? তাই তোমার কানটা একটু—”
চারু হাত দেখিয়ে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
— “এই থাম, ফাজিলের দল! কান পরিষ্কার করছিলি না সুড়সুড়ি দিচ্ছিলি?”
দু’ ভাই হেসে উঠলো কিছু না বলে। সেই সুন্দর হাসির দিকে তাকিয়ে চারু রাগতে গিয়েও আর পারলো না। তবুও সেটা ওদের বুঝতে না দিয়ে চেহারায় কপট একটা গাম্ভীর্য ধরবার প্রয়াস চালালো। নয় তো এরা যা বিচ্ছু, ওর দুর্বলতা ধরে ফেললে আরও বেশি বlদমাlয়েশি করবে! বললো,
— “কি জন্য এসেছিলি তোরা? ডাকছিলি কেন?”
হাসি থামিয়ে রিংকুর জবাব,
— “সৌভিক ভাইয়া সবাইকে নিয়ে তিস্তার পাড়ে বেড়াতে যাবে বলেছে। তাই তোমাকে ডাকতে এলাম।”
— “সবাই বলতে?”
চারু জিজ্ঞেস করে। টিংকুর চটপট প্রত্যুত্তর,
— “সবাই বলতে সবাই। আমাদের সবক’টা ভাই-বোন। তবে বড়রা কেউ যাচ্ছে না। ওরা কেউ গেলে আমরা যেতে রাজি হতাম না-কি? গিয়েই বলবে, এটা করিস না, সেটা করিস না। দুনিয়ার রেlস্ট্রিকlশন!”
শেষের কথা বলবার সময় ওর চেহারার বিরক্তি ভাব লক্ষ্য করলো চারু। একহাতে ওর কান মুচড়ে বললো,
— “তারা মনে হয় ওসব এমনি এমনি বলে? তোমরা যেন খুব সাধু?”
— “আহা, বড়’পা। ব্যথা লাগছে তো!”
হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়। চারু হেসে ছেড়ে দিতে দিতে শুধায়,
— “তাহলে বল, আজ কোনো দুষ্টুমি করবি না? কোনো রকমের দুর্নাম শুনলে কিন্তু বাড়ি এসে চাচাকে বলে দেব!”
— “আচ্ছা, আচ্ছা। সে দেখা যাবে!”
বলেই কান ডলতে থাকে। যদিও চারু অতো জোড়ে ধরে নি। কিন্তু টিংকু ঢং করেই বলে,
— “আগে তুমি ভালো ছিলে। এখন তুমিও বদ হয়ে যাচ্ছো, সুযোগ পেলেই মাসুম বাচ্চাগুলোকে ধরো! হুহ!”
চারু হেসে বিছানা ছাড়লো। বাইরে যাবার জন্য ড্রয়ার থেকে জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেল তৈরি হতে। রিংকু – টিংকু ততোক্ষণে বসে বসে বড়’পার ফোন ঘাঁটায় ব্যস্ত!

**********

বিকেলের দিকে অরুণা ম্যানশন থেকে তেরোজনের একটা গ্রুপ বেরোল তিস্তা পাড়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য। কবির আর কাব্য ছাড়া গ্রুপের সবগুলোই ব্যাচেলর। এতোগুলো মানুষ কীভাবে যাবে? দফায় দফায় রিকশা ঠিক করা হলো। কবির আর কাব্য দু’জনেই তাদের যার যার বৌ বিয়ে বাইক ছুটিয়ে চললো। বাকিগুলো ধীরে-সুস্থে আসতে থাকলো সুবিধা মত।

নিখিল তৈরি হয়ে বেরিয়ে বাগানে পায়চারি করছে। বাইরে সৌভিক তার বোনদের নিয়ে ব্যস্ত। কি যেন নাম ওদের, ঋতু ইরা, আর ইমা বোধ হয়। ওদের জন্য রিকশা ঠিক করছে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় দাড়িয়ে আছে রাস্তায়। অদূরেই দুই জমজ ভাই গুজগুজ করছে বসে বসে। এতো মানুষের মাঝে নিখিলের দু’ চোখ যে নারীর প্রিয় বদন দেখবার অপেক্ষায় চাতকের মতো চেয়ে, তারই দেখা নেই!
চারু এখনো আসে নি। আচ্ছা, কেন আসে নি? সে কি যাবে না? তাকে কি জানানো হয় নি? তবে?

রিংকু – টিংকু দুই ছটফটে ধরনের ছেলে, তাদেরও প্রস্তুত হতে মিনিট পাঁচেকের বেশি লাগে নি। তৈরি হয়েই ওরা নেমে পরেছে অভিযানে। দখিন হাওয়ায় বসে দুজন লক্ষ্য রাখছে নিখিলের উপর। বাজের শাণিত নজরে নজরবন্দি করে রেখেছে ওকে!
রিংকু বললো,
— “আমার মনে হচ্ছে তুই বেশি বেশি ভাবছিস, ব্যাপারটা মোটেও এমন না। তোর ভুল হচ্ছে।”
টিংকু তার যুক্তিতে অটল,
— “কাউকে দেখেই কিছু ধারণা করা ঠিক না রে, পাগলা! চোখের দেখায় ভুল আছে। সেজন্য গভীর ভাবে ভাবতে হয়। নিখিল ভাইকে আমি সেভাবেই দেখছি। দেখেই বুঝেছি, ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!”
— “তেরা মাথা ভি ডাল হ্যায়!”
রাগ করে ছেলেটা। টিংকু অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো হাসে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আদেশি সুরে বলে,
— “শোন, আজকেই আমি তোর কাছে প্রমাণ করে দেব সবকিছু। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নিখিল ভাই বড়’পাকে লাইন মারছে। আগে ভেবেছিলাম, ঋতু’পার পেছনে, পড়ে ভালো করে বুঝলাম তা নয়। চারু’পার পিছে পড়েছে এই ব্যাটা!”
— “কি করে প্রমাণ করবি?”
অনেকটা রাগত স্বরেই বললো। টিংকুর এই জ্যাঠামি ওর ঠিক ভালো লাগছে না। জানা নেই, শোনা নেই — এমনি একটা কথা!
প্রত্যুত্তরে বাঁকা হাসে টিংকু। শার্টের গলায় ঝুলতে থাকা কালো রোদ চশমাটা তুলে ফুঁ দেয় তাতে। দারুণ একটা ভাব নিয়ে সেটা চোখে পড়তে পড়তে বলে,
— “আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় কেয়া!”
পরপরই বেরিয়ে আসে দখিন হাওয়ার থেকে। অগত্যা রিংকুও ভাইকে অনুসরণ করে।

ইমাদের রিকশায় তুলে দিয়ে ভেতরে ফিরে আসে সৌভিক। নিখিল তখনো একা দাড়িয়ে। এসেই হাঁক ছাড়ে ছেলেটা,
— “কি রে, চারু এখনো এলো না? এ্যাই চারু? তাড়াতাড়ি আয়! আর ওই বিচ্ছু দুটো কই? এ্যাই রিংকু? টিংকু?”
— “আসছি, ব্রাদার। টেনশন নট!”
বলেই হেলেদুলে আসতে থাকে দুই ভাই। তার ঠিক মিনিট দুয়েক পরেই দেখা মিলে চারুলতার। সাদা আর পার্পলের মিশেলে সাদামাটা একটা শাড়ি পরনে মেয়েটার। মাথায় শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরা হিজাবে মেয়েটার চেহারায় অন্যরকম স্নিগ্ধতা খেলা করছে। বড় বড় পা ফেলে ত্বরিতে কাছে এসে দাড়ায় চারু। ভাইদের উদ্দেশ্যে বলে,
— “স্যরি, সৌভিক ভাইয়া। বড় ফুপু ডেকেছিল বলে দেরি হয়ে গেল। তুমি রাগ করো না।”
রাগ? তাও করবে সৌভিক, চারুর উপর? ওর এই শুভ্র-নির্মল দেবীর মতো সুন্দর মুখটির দিকে চেয়ে সে কখনো রাগ করতে পারে? সে তো কিছুক্ষণের জন্য কথা বলতেই ভুলে গেল। পাশে দাড়ানো নিখিলের অবস্থাও ব্যতিক্রম নয়। সেও চারুর লাবণ্যময়ী রূপের ঝলকানিতে মুগ্ধ, বিমোহিত!
রিংকু – টিংকুর চিৎকারে চটকা ভাঙলো ওদের,
— “আরে বড়’পা! কি দারুণ লাগছে তোমায়! উফ্, তোমাকে তো কোত্থাও নিয়ে যাওয়া যাবে না। লোকে দেখলেই নিতে যেতে চাইবে!”
বলেই ছুটে গিয়ে দু’ জন হাত ধরলো ওর। চারু হেসে কথা বলতে লাগলো ওদের সঙ্গে। নিজেকে ধাতস্থ করে সৌভিকও তারা দিলো ওদেরকে,
— “এ্যাই, চল। চল। রিকশা ঠিক করা হয়েছে। চারু আর তোরা দু’জন এক রিকশায়। একজন উপরে উঠবি। আর নিখিল, আমি পেছনের রিকশায় আসছি!”

*******

হেমন্তের বেলা। নদীতে পানির প্রবাহ কম। চর জেগেছে স্থানে স্থানে। সেই চরের উপর খুব লোকে সবজি চাষ করেছে। মিষ্টি কুমড়া, বাদাম, আর কিছু সবুজ শাক-পাতা। নদীর বেশি গভীর অংশটুকুতেই শুধু পানি বিদ্যমান। দু’একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা তাতেই ঘাট বেঁধে দাড়িয়ে। যাত্রী পারাপার করবে, নয় তো নদীতে ঘুরিয়ে আনবে!
চারুরা নামতেই ইমাদের সঙ্গে দেখা হলো। সময়টা হেমন্ত হলেও এখনো কাশফুল ফোটে। নদীর পাড়ের একদিকে বেশ বড় এক ফাঁকা জায়গায় সেরকমই এক কাশবাগান। ইমারা ছুটে এলো বড় বোনকে দেখে। তাকে বগলদাবা করে ফের ছুটলো, কাশবাগানের দিকে। ছবি তুলতে হবে তো!
ছবি তোলার পর্ব শেষ হতেই ভাইদের ডাক পড়ে। অদূরেই একটা ফুচকার স্টল আছে। আজ সবাইকে ফুচকা খাওয়াবে সৌভিক। প্রস্তাব শুনেই হৈহৈ করে ওঠে রিংকু – টিংকু, ইরা, ঋতুরা। ভাবীরাও বেশ সায় দেয়। একমাত্র নির্বিকার থাকে চারু। ফুচকা তার পছন্দের নয় বলে!

একে-একে অর্ডার দেয়া সবগুলো প্লেট এসে হাজির হয়। যে যারটা নেবার পর দেখা যায়, দুটি হাত খালি। চারু নেয় নি। নিখিলও নয়। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে ওদের কাছে মাফ চায় সৌভিক। তার একটুও মনে ছিল না এ-কথা। ওদের জন্য আলাদা করে চটপটির অর্ডার করে অপেক্ষা করতে বলে। চারু হেসে সায় দেয়। কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটতে বেরিয়ে আসে দোকান থেকে।

এখন প্রায় সন্ধ্যা। ডুবুডুবু সূর্যটা পশ্চিমে, রlক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। নদীর ওই পাড়ে, দূরের গাছগুলোকে দেখাচ্ছে কালচে কালচে। ইতোমধ্যেই জ্বলে উঠেছে সড়কের বাতিগুলো। ব্রিজের নিচে, সড়ক সেতু থেকে রেল সেতুতে যাওয়ার কংক্রিটের পথটায় দাড়ানো চারু। নিরিবিলি সন্ধ্যের বাতাস গায়ে মাখছে। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো,
— “কি করছেন, চারুলতা?”
ফিরে তাকালে আবছা আলোয় নিখিলকে চোখে পড়ে ওর। লোকটা না ভেতরে ছিল? এলো কখন? অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে বলে,
— “কি করবো বলুন, দাড়িয়ে দাড়িয়ে বাতাস খাওয়া ছাড়া?—”
— “ফুচকা তো জুটলো না কপালে!”
ওর অর্ধসমাপ্ত কথাটা শেষ করে দিলো নিখিল। তারপরেই হেসে উঠলো হো হো করে। চারুও হাসলো, তবে মার্জিত হয়ে। ঠোঁট নাড়িয়ে। একটুপর নিখিল বললো,
— “তা কি করা হয় আপনার? পড়ালেখা? না চাকরি?”
নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল চারু। সেভাবেই উত্তর দিলো,
— “আপাদত অনার্স শেষ করেছি। মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া বাকি। আপনি? সৌভিক ভাইয়ার কলিগ তো, না?”
— “হুম। বেশ জানেন দেখছি!”
মাথা ঝাঁকায় নিখিল। চারু একঝলক চেয়ে মুচকি হাসে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে নিতে শুধায়,
— “একা এসেছেন কেন? ভাবীকে আনলেই পারতেন। অনুর বিয়ে ছিল, আনন্দ হতো।”
ঠোঁটের হাসি চওড়া হয় নিখিলের,
— “আনা যেত অবশ্য। কিন্তু কি করব বলুন? তার সঙ্গে যে এখনো পরিচয়ই হলো না।”
— “মা-নে?”
অবাক চোখে তাকাতেই হঠাৎ বুঝে ফেলে লজ্জিত গলায় বললো,
— “দুঃখিত, আপনি অবিবাহিত ভাবি না।”
— “ভাববেন না কেন? সৌভিকও তো ব্যাচেলর!”
— “না, মানে। ভাইদের সবার বন্ধু-বান্ধবরাই বিবাহিত তো। তাই—”
মাথা নোয়ায় চারু। নিখিল আর কিছু বলবে তার আগেই সেখানে এসে হাজির হয় দুই বিচ্ছু। রিংকু – টিংকু এসেই চেঁচায়,
— “ট্যান ট্যানান। আপা! তোমাদের চটপটি রেডি। চল, চল।”
বলেই ওর দু’হাত ধরে দুজন দুপাশে টানতে থাকে। চারু ওদের বুঝিয়ে নিরস্ত্র করে,
— “একটু পর যাচ্ছি। তোরা যা।”
দুজনেই মাথা নাড়িয়ে দিরুক্তি জানায়,
— “না, না, না। তোমাদের তো ফেলে যাওয়াই যাবে না!”
চারু ভ্রু কুঁচকায়,
— “কেন?”
কেউ কোনো উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। চারুর হাত ছেড়ে দু ভাই এগোয় নিখিলের দিকে। নদীর পানি নিয়ে গম্ভীর মুখভঙ্গি করে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করে দেয় ওর সঙ্গে। সারাবছর বইখাতার আশেপাশে না গিয়েও দুজন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে হাজারটা কথা কি অবলীলায় বলে যাচ্ছে। বলছে, ফারাক্কা বাঁধ থেকে শুরু করে নানা রকমের নদী বন্দর নিয়ে আলাপ। নিখিলকেও দেখা গেল সেই সকল আলোচনাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে। আকস্মিক, হাওয়া পাল্টাতে দেখে চারু অবাক হয়। ওদের হাবভাব বুঝতে পারে না। হঠাৎ কি হলো? তার সঙ্গে দুষ্টুমি করতে করতে আবার, দেশের আলোচনায় ঢুকে গেল কেন দুই বিচ্ছু?
ওর বিস্ময়ের রেশ ছাড়ায় তখন যখন দেখে, রিংকু – টিংকু খুব দ্রুতই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। নদীর পানির গুরুত্ব থেকে ওরা এগোয় সাঁতারের দিকে। ছেলেবেলায় নদীতে গোসলের গল্প বলে নিখিলকে। সেও মনোযোগ দিয়ে শোনে। একটুপর দেখা যায়, দু’ বlদমাশ কি কি ভুজুং-ভাজুং বুঝাচ্ছে নিখিলকে এই ভর সন্ধ্যায় পানিতে নামবার জন্য,

— “বুঝলে ভাইয়া, আমার খুব শখ। চল না, নামি? সৌভিক ভাইয়াকে এর আগেও বলেছিলাম, ভাইয়া রাজী হয় না। ও একটা আস্ত ভীতু। আরে বাবা সন্ধ্যা হয়েছে তো কি? নদীতে নামা যাবে না? আরে — ”
— “হ্যাঁ, চাইলেই অবশ্য নামা যেত। কিন্তু প্রিপারেশন নেই নি যে?”
— “ওটা কোনো ব্যাপার না। তুমি চাইলেই হবে। আসলে আমাদের দুই জনের খুব ইচ্ছে ছিল একদিন বিকেলে এসে নদীতে গোসল করে যাবো। কিন্তু সময়ের যে টানাটানি। স্কুল গিয়েই কুল পাচ্ছি না —”
মুখটা দুঃখী দুঃখী করে ওরা। ভাইদের মতলব বুঝে পেরে আঁতকে ওঠে চারু। চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকায়। রিংকুর হাত চেপে ফিসফিস করে বলে,
— “তোদের মাথা ঠিক আছে? কি করতে চাইছিস কি তোরা?”

টিংকু তখনও নিখিলের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। ওকে ভুলিয়ে কিভাবে নদীর পানিতে চুবানো যায়, সেই চিন্তায় মস্তিষ্কে চলছে। ভাইয়ের দিকে একপল চেয়ে চোখ টিপে দেয় রিংকু,
— “আহ্ হা। আপা! মজা দেখই না! নিখিল ভাই তো আস্ত হাঁদারাম! এক্ষুনি লাফিয়ে পড়বে—”
— “খবরদার, রিংকু! তোদের কিন্তু দুষ্টুমি করতে মানা করেছি। আমি কিন্তু ছোট চাচাকে সব বলবো!”
— “তুমি দেখই না, বড়’পা! মজা হবে তো!”
চারু হতভম্ব হয়ে যায়। তার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল, এই দুই বিচ্ছু ঠিক কী পরিমাণ বাঁদর! সে তৎক্ষণাৎ কান মুচড়ে ধরে রিংকুর, ওকে সহ এগিয়ে যায় নিখিলের দিকে। হড়বড় করে বলে,
— “নিখিল সাহেব, শুনুন? আপনি এই বদমায়েশ দুটোর কথা শুনবেন না প্লিজ! ওরা কিন্তু আপনাকে পানিতে চুবিয়ে ছাড়বে। প্লিজ, নিখিল সাহেব। শুনুন আমার কথা!”

হঠাৎ চারুর এমন ব্যাকুলতা টিংকু ভড়কায়। বড়’পাটা কি? একটু মজাও করত দেবে না? আর কিছু ভাববার আগেই চারু এসে অন্য হাতে কান মুচড়ে ধরে ওরও। বলে,
— “তোরা এত ফাজিল? আজ বাড়ি যাই শুধু, তোদের হবে! দিন-কে-দিন বেয়াদব হচ্ছিস! নিখিল সাহেব, আপনি চলুন। এদের বিচার হবে।”
দু হাতে দুজনের কান ধরে চারু এগোতে থাকে। নিখিলেরও তখন হুশ হয়। কি বোকামিটাই না করতে যাচ্ছিল সে? আসলে সৌভিক ঠিকই বলে, এই দুই ভাই আস্ত ফাজিল! তাকে কীভাবে ভুলিয়ে – ভালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আর সেও কি বোকা!
চারুর সামনে নিজের বোকামি প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় ভীষণ লজ্জিত হয় নিখিল। কিছু না বলে সরে আসে।
একটু দূর যাবার পরেই বোনের কাছ থেকে নিজেদের কান উদ্ধার করে রিংকু – টিংকু। বড়’পা বেশ ক্ষেপে আছে। তারমানে বাসায় গিয়ে সত্যি সত্যিই বাবার কাছে নালিশ দিয়ে বসবে! সেই ভয়েই হোক, বা অন্য কারণে দু’ভাই ওর হাত জড়িয়ে ধরে। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য মাফ চাইতে থাকে। অন্যসময় হলে চারু ছেড়ে দিতো। কিন্তু এখন ছাড়তে চাইলো না। অপরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে ওদের এই মজা ও ঠিক মানতে পারছিল না। এসব কি? নিখিলের সঙ্গে কেন ওদের এমন আচরণ? সবার সঙ্গে কি সবকিছু মানায়? সে তো এ-বাড়ির আত্মীয়!
যাহোক, নিখিলের হস্তক্ষেপেই শেষমেষ পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেল। নিখিল নিজেই অনুরোধ করলো ওকে, কাউকে কিছু না বলবার জন্য। আর ওদেরও ছেড়ে দেবার জন্য। ছোট মানুষ দুষ্টুমি করতে গিয়ে করেছে, ছেড়ে দেয়াই ভালো। শুধু শুধু সিনক্রিয়েট করা!
চারু ছেড়ে দিলো বটে। কিন্তু খুব রাগ করলো ওদের উপর। এতটা সে আশা করে নি। রিংকু – টিংকুকে দাড় করিয়ে সে বকাঝকা করতে লাগল। এমন কেউ করে? ফাজলামির একটা সীমা থাকা উচিৎ!

হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আসা এক দম্পতিকে চোখে পড়তেই মুখের কথা বিলীন হলো চারুর। থমকে যাওয়া চাহনিতে তাকালো সে অনিমেষ। নিখিল ওদের গিহয়ে কি যেন বলছিল, সেসব আর কানে এলো না। নিরুত্তর চারুর হতবিহ্বল দৃষ্টি তখনো সম্মুখে। মুখ তুলে বড়’পার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই নিজেরাও দেখতে পেল রিংকু – টিংকু; সেই দম্পতিকে। কালো পাঞ্জাবি পরনে লোকটা, সঙ্গে কালো শাড়ির আব্রুতে ঢাকা রূপসী নারী। গোল-গাল মুখচ্ছবিতে হাসি লেপ্টে; সঙ্গের পুরুষের বাহুতে মাথা ঠেকানো। দু’জনের মুগ্ধ দৃষ্টি, শুধু দু’জনাতে নিবদ্ধ!

দেখতে দেখতেই ওরা এগিয়ে এলো। ওদের প্রায় কাছাকাছি। এতক্ষণে চারুকে খেয়াল করলো ওরা। নিমিষেই হাসিমাখা মুখ দু’টোতে কালো ছায়া নামলো। তথাপি সৌজন্যতার খাতিরে পুরুষটি শুধায়,
— “কেমন আছ, চারু?”
ধ্যান ভাঙে চারুর। হতবাক চোখে সে খুব কাছ থেকে দম্পতিটিকে দেখে, অবলোকন করে তাদের শক্ত হাতের বাঁধন আর হাসি হাসি চেহারা। পুরোনো স্মৃতির দুয়ারে আঘাত হানে যেন কিছু, পলকেই ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। নেহাৎ সৌজন্যের ধারও ধারে না সে, প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই হঠাৎ উল্টো ঘুরে হাঁটতে শুরু করে!

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১২

সন্ধ্যা থেকে চারুর ঘরের দরজা বন্ধ। কেউ তাই চেয়েও আসতে পারছে না ভেতরে। একা একা মেয়েটা কি করছে কে জানে? মা-চাচীরা দফায় দফায় ডেকে যাচ্ছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারুর এই নিশ্চুপ-নির্বিকার অবস্থা যেন ওদের ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। দুশ্চিন্তার পাহাড় জমছে বুকে। না জানি, কি করছে মেয়েটা!
বড়’পার ঘরের দরজায় দাড়িয়ে রিংকু – টিংকু। না, আপাকে বিরক্ত করবার কোনো মতলব নেই ওদের। বরং পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তারাও প্রচেষ্টা। অন্যদের মতো এসেই নরম সুরে আপাকে ডাকা, দরজায় টুকটুক শব্দ করা — কোনোটাই ওরা করে নি। নিঃশব্দে দাড়িয়ে আছে দু’জনে। দেয়ালে কান পেতে রিংকু শুনবার চেষ্টা করছে সূক্ষ্ম কোনো আওয়াজ। দীর্ঘক্ষণ হলো এরও কোনো হেলদোল নেই। অধৈর্য হলো টিংকু। ভাইকে ঠেলা মেরে বললো,
— “কি রে? কিছু পেলি? ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে? বড়’পা কাঁদছে নাকি?”
অসহায় শোনায় কণ্ঠ। ওর দ্বিধান্বিত উত্তর,
— “বুঝতে পারছি না। থাম!”
বিরক্ত চোখে রয় টিংকু। একথা খুব সত্য যে, তারা দু’টি ভাই এ বাড়ির সক্কলকেই জ্বালিয়ে ওস্তাদ, চারুও ব্যতিক্রম নয়। বরং বলা চলে, একটু বেশি মোলায়েম আর শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের জন্য চারুকেই ওরা জব্দ করে মজা পায়। চারু’পা ওদের বকে না, মারে না, বড়দের কাছে নালিশও দেয় না। শত দুষ্টুমির বদলে হঠাৎ কানটা মুচড়ে একটু রাগ করে। এরকম মানুষের উপর উপদ্রব না করে ওরা করবে কাকে? তাই তাদের অধিকাংশ বদমায়েশি, দুষ্টুমি, পাকামো করে করা এক্সপেরিমেন্ট তথা অকাজের জন্য চারুই উপযুক্ত। কিন্তু এরসঙ্গে এ-কথাও সত্য যে, দুষ্টুমি করুক আর যাই করুক চারুকে ওরা ভালোবাসে। প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। ওদের করা সকল অপরাধ, সকল দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে গিয়ে এই সত্য, সবচে’ বড় সত্য!
বিরক্তিটা রাগে রূপান্তরিত হতে সময় লাগে না বেশি। জমজকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ত্যক্ত গলায় বলে,
— “সর তো। ঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে থাকলেও তুই কিছু বুঝবি না।”
আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে দু’ পা পিছিয়ে যায় রিংকু। রাগ করে ভাইয়ের দিকে তাকায়। কিন্তু ওকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে টিংকু কান পাতলো দেয়ালে। মিনিট দুয়েকের নীরবতার পর একটা মিহি সুর কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো তার। খুব চিকন সেই সুরের সাথে কান্নার সূক্ষ্ম ধ্বনি! ব্যাপারটা আবিষ্কার করে গভীর বেদনায় বুক ভরে এলো ওর। বড়’পা কাঁদছে! কাঁদতে কাঁদতেই তার প্রিয় গানের সুর তুলছে ঠোঁটে। আহা রে, কি অসীম কষ্ট তাদের প্রিয় আপার!
ছলছল চোখে অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকা রিংকুর দিকে ফিরলো। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো,
— “আপা, খুব কষ্ট পেয়েছে রে। কাঁদছে একা একা!”
কথাটা শুনে আপনাপনিই ঝাপসা হয়ে এলো চোখ। মুখ কুঁচকে অবরুদ্ধ কান্নাটা আটকে অন্য দিকে ফিরলো রিংকু। বড়’পার জন্য তার বুকটাও পুড়ছে ভীষণ! আপা’টা এত্তো ভালো, তবুও তার এতো দুঃখ কেন?

দু’ ভাই বাষ্পচোখে একে অপরের দিকে চেয়ে, হঠাৎ চটকা ভাঙলো বড় ফুপু আলেয়ার কণ্ঠে,
— “এখানে কি করছিস তোরা? সন্ধ্যাবেলায় পড়া নেই?”
বড় ফুপু প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারনী। পড়ালেখা নিয়ে সবসময়ই জোর দেন ওদের। রাগারাগিও কম করেন না। তাই ওরা একটু ভয়ই পায় তাকে! সমীহও করে।
ফুপুর রাশভারী প্রশ্নের জবাবে ওরা মাথা নুইয়ে দাড়িয়ে রইলো। উত্তর দিলো না। ফুপু অবশ্য সে অপেক্ষাতেও ছিলেন না; ওদের পড়তে বসবার হুকুম দিয়ে চারুর দরজায় করাঘাত করলেন সরাসরি,
— “চারু মা? দরজা খোল তো।”
কিছুক্ষণের জন্য একটি নারী কণ্ঠের গুনগুন, তারপর সব চুপ! একদম নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। পরপরই চারুর কান্না ভেজা আওয়াজ পাওয়া গেল,
— “তুমি যাও ফুপু। আমি দরজা খুলবো না!”
বড় ফুপু আদর করে ডাকলেন,
— “তা কেন, মা? রাতের খাবার খাবে না? সময় গড়াচ্ছে তো!”
— “আমি আজ খাবো না। তুমি জোর করো না, ফুপু।”
— “আচ্ছা, আচ্ছা। খেতে হবে না। তুমি দরজাটা খোল। বেশিক্ষণ না আমি একটু কথা বলবো মাত্র। একটু?”
আহ্লাদ পেয়েও গললো না মেয়েটা। কান্না ভেজা কণ্ঠ, কিন্তু একটু জেদি,
— “প্লিজ ফুপু! তুমি যাও, না? আমার কিছু ভালো লাগছে না।”
— “তোমার কষ্টটাও আমার ভালো লাগছে না, চারু। বড় ফুপু ডাকছি, দরজাটা খোল? এবার না খুললে কিন্তু আমি কষ্ট পাবো!”
ভেতর থেকে আর কোনো কথা শোনা যায় না। বড় ফুপু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফিরে তাকাতেই রিংকু – টিংকুকে পুনরায় চোখে পড়ে। ইশারায় ওদের চলে যেতে বলেন তিনি। অগত্যা দু’ ভাই মুখ লটকে পা বাড়ায় ঘরের উদ্দেশ্যে। তারপরেই দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়। দোর খুলেই বড় ফুপুকে দেখে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চারু। দু হাতে তাকে জড়িয়ে, তার মাতৃ সমতুল্য পরম নির্ভরযোগ্য বুকে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে থাকে ছোট্ট শিশুটির মতো, যেমন শৈশবে কাঁদতো!

*******

বাড়ির পরিবেশ গুমোট। বিকেলে এক সঙ্গে সবগুলো ছেলেমেয়ে হুল্লোড় করতে করতে বেরিয়ে গেল, এলো কেমন মন খারাপ করে। বড়দের কারোরও মন বিশেষ ভালো নেই। সব নিশ্চুপ – নীরব। অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতায় ঘেরা!
নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে সৌভিক। মুখোমুখি বন্ধুবর নিখিল বসে, কিন্তু কোনো আলাপ হচ্ছে না। দুজনেই গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত। একটুপর সৌভিকই প্রথম কথা বললো। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠলো ওর চিত্ত,
— “নিখিল, সত্যি করে বল তো! ওই শা* বাlটপাlর চারুকে কি কি বলেছে? হার্ট করেছে? আর ওর বৌটা? ঢং করছিস চারুর সামনে?”
‘শা* বাটপার’ বলে গালিটা কাকে দিলো তা বুঝতে অসুবিধে হয় নি ওর। ঠোঁট বাঁকা করে হাসবার চেষ্টা করলো; বললো,
— “এতো চটছিস কেন? ওরা কিছু বলে নি।”
— “চটব না, মানে? আলবৎ চটবো। শা* শয়**! চারুর মতো এতো ভালো একটা মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে ওর জীবনটা ধ্বংস করে দিলো, আর আমি চুপ করে থাকবো? পারলে, তক্ষুনি একটা ঘুষি মেরে ব্যাটার নাক ফাটিয়ে দিতাম আমি!”
সৌভিক রাগে গজগজ করতে থাকে। নিখিল হাসে। যুক্তি দিয়ে বলে,
— “এখন খুব রাগ দেখাচ্ছিস, ওকে পেলে মারতি। পাস নি, তাই আফসোস! কিন্তু কই, অনুলেখার বিয়েতে যে ও-বাড়ি গেলি তখন তো কিছু বললি না? তোর এত রাগ থাকলে তখন সবার সামনে ওকে পিটাতি?”
কথা সত্য। সৌভিক এখন যতটা ক্ষেপে আছে, রাগ দেখাচ্ছে, হম্বি-তম্বি করছে মাহতাবকে পিটানোর; কিন্তু সেসব আসলে আকাশে ছোঁড়া ফাঁকা গুলির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু নয়। মাহতাবকে সে আগেও সামনে পেয়েছে। কারণে-অকারণে বহুবার দেখা হয়েছে কিন্তু কিছু বলে নি। আজও সেখানে উপস্থিত থাকলে কিছু বলতে পারতো না। হয় তো, ভবিষ্যতেও পারবে না!
সৌভিক নিরুত্তর রয়। চাপা ক্ষোভে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে। কিন্তু বাহিরে সেটা প্রকাশ করবার সুযোগ পায় না!
বন্ধুর ছেলেমানুষী রাগ দেখে নিখিল মনে মনে হাসে। তারপর হঠাৎ সে নিজেও খুব গম্ভীর হয়ে ওঠে। একটা গভীর ভাবনায় তলিয়ে যায় পুনর্বার!

সন্ধ্যায় তিস্তা পাড়ে বেড়াতে গিয়ে চারুর সহিত মাহতাব আর তার স্ত্রী মাহিয়ার দেখা হবার ঘটনাটা চারু নিজমুখে কাউকে জানায় নি। নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করে ভাইবোনদের আড্ডায় ফেরে। মাথা ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে ওদের সবার কাছে অনুরোধ করে বাড়ি ফেরার। পুরো ঘটনা না জানায় কেউ দ্বিমত করে নি। কাব্য তার বাইকে করে ছোট বোনকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। চারু ফেরবার পরপরই মাহতাবের কথাটা ভাইবোনদের সবার মাঝে চাউর করে দেয় রিংকু – টিংকু। সে কথা শুনে সবাই মোটামুটি অবাক হয়। খানিক দুঃখবোধ, খানিক ক্রোধ আর খানিক হতাশার আস্তরণ পরে মনে। এই যে অনুর বিয়েটা হলো, কতো আয়োজন, কতো কিছু, সেখানে চারুর সঙ্গে মাহতাবের দেখা হবার সুযোগ ছিল কতগুলো! দেখা হলে, চারু দুঃখ পাবে পরিস্থিতি সামলানো কষ্টকর হবে — সেরকম মানসিক প্রস্তুতি সবার নেয়া ছিল। বলতে গেলে, সেসব ভেবেই ওরা কেউ অনুর বিয়েতে কোনো প্রকার হৈ-চৈ করে নি। এমন কিছু করে নি যাতে মাহতাবের কথা চারুর স্মরণে আসে। অথচ আজ! সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবেই মাহতাবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চারুর। দেখা হলো সেই অতীতের সঙ্গে, যাকে সে ফেলে এসেছে বহু আগেই! যাকে ফেলে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করেছিল এতোগুলো দিন, কিন্তু দেখুন, নিয়তির পরিহাস কেমন? আমরা যাদের এড়াতে চাই জীবনে, তারাই আরও বেশি করে জুড়ে বসে!

বৃদ্ধ আহাদ রাজা নিয়মিতই তার পুত্র – পূত্রবধূদের নিয়ে সান্ধ্যকালীন চায়ের আসর জমান। আগে সেখানে নাতি – নাতনীগুলো যোগ দিলেও, লেখাপড়া আর চাকরির সুবাদে এখন আর কারো এই আসরে থাকা হয় না তেমন। চারুরা যখন বাড়ি ফিরলো তখন হামেশার মতোই বড়রা সবাই একসঙ্গে বসেছেন। মুড়িমাখা চিবনোর কচর-কচর শব্দ আর চায়ের কাপের টুং-টাংয়ে আড্ডা সরগরম। কথাবার্তা চলছে, মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হেসেও উঠছেন কেউ কেউ। সম্পূর্ণই নিজেদের মতো ছিলেন। কাব্যদের ওরা খেয়াল করে নি। তাই হয় তো অনাহুত প্রসঙ্গটা কখন উঠে ছিল কেউ ঠাহর করতে পারেন না।
বিকেলবেলা অনুর শ্বশুরবাড়ি থেকে কল এসেছিল। বেয়াই-বেয়াইন আজমীর রাজার পরিবারের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। তারই একফাঁকে খবরটা জানান। তাদের বাড়িতে খুশির জোয়ার এসেছে। ছোট ছেলের বিয়ের পরপরই আরও একটা সুসংবাদ তাদের পরিবারকে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে। তাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত একটি স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে, বাড়িতে আসছে নতুন সদস্য। কেননা, মাহতাবের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আজ দুপুরেই ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত হয় তারা!
বাড়িতে সন্তান আসছে, এ অবশ্যই খুব ভালো খবর। আনন্দ করা উচিৎ, হৈচৈও শোভা পায়। খুশির ঠেলায় বেয়াইকে কল দিয়ে জানানোও হয় তো যায়; কিন্তু বেয়াই যদি হয় পুত্রের প্রাক্তন শ্বশুর তখন? এই অতি আনন্দের আতিশয্যে ত্বরিতে বেয়াই মশাইকে ফোনকলে মিষ্টি খাবার দাওয়াত দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আসাদ রাজা। অনুর বিয়ে ওই বাড়িতে দেয়া নিয়ে শুরু থেকেই তার ভেটো ছিল, তার প্রধান কারণ মাহতাব ছিল না বরং ও-বাড়ির মানুষগুলোকেও তার ব্যক্তিগত ভাবে অপছন্দ। তাদের রুচি, চালচলনের সঙ্গে যেন বেশ ফারাক আছে; সহজ ভাষায় ‘ওদের আচরণ যেন কেমন তর!’— এই ছিল তার অভিমত। অতএব, অনুর শ্বশুরের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যবহারে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে কিছু বলছিলেন সভায়। পরিস্থিতি গরম ছিল, প্রসঙ্গক্রমেই অতীত ইতিহাস টেনে আনা হয়েছিল। ফাঁক তালে কখন যে আলোচনার মধ্যমণি ‘চারু’ এসে হাজির হয়েছে এবং না চেয়েও সবটা ওর কানে গেছে তারা টেরও পায় নি!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-১০

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১০

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বেরিয়েছে নিখিল। হেমন্তের মিঠে রোদে একা একা বাগানে বেড়াতে ভালোই লাগছে। বাগানের ভেতরের দিকে গাছপালা বেশ ঘন। কিছুআম, কাঁঠালের গাছ আছে ওদিকটায়। সম্ভবত বড় গাছগুলোর জন্যই এদিকে অতো যত্ন নেয় না মালি। অযত্নে বড় হওয়া ঘাসের ডগায় স্বচ্ছ শিশির বিন্দু। পাতলা চটিকে তোয়াক্কা না করে সেই শিশিরেরা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর পায়ের পাতাকে। প্যাঁচ-প্যাঁচে চটি পরেও বিরক্ত হচ্ছে না সে। বরং অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। চারিদিকে শীতল আবহাওয়া, হিম হিম বাতাসে শ্বাস নিতে অন্যরকম একটা অনুভূতি জাগছে। সতেজ লাগছে শরীরটা, নির্মল – স্বচ্ছ – সুন্দর।

হাঁটা শেষ করে ফেরার পথেই দেখা হয়ে গেল সৌভিকের মেজো ফুপুর সঙ্গে। মেজো ফুপুর পরিবার তৈরি হয়ে বেরিয়েছে। যেন কোথাও যাচ্ছেন। সঙ্গে লাগেজ দেখেই বুঝলো চলে যাবার আয়োজন। ফুপুকে এগিয়ে দিতে বাড়ির প্রায় সব মানুষই এসেছেন যেন। তিন জা’কেই দেখা যাচ্ছে সামনে। ননদের সঙ্গে বিদায়ী আলাপ করতে ব্যস্ত তারা। মেজো ফুপুর চোখে জল। তিনি জল মাখা চোখেই সকলের সঙ্গে মত বিনিময় করছেন। দূরে দাড়িয়ে থেকেই সবটা দেখলো নিখিল। পরিবারের আবেগঘন মুহূর্তে তার মত বহিরাগতের থাকা উচিৎ হবে কি-না ভেবে দ্বিধায় পড়লো। শুনেছে, সৌভিকের এই ফুপু নাকি প্রবাসী। বছরে, দু’ বছরে দেশে আসেন। ভাতিজির বিয়ে উপলক্ষ্যে দু’ বছর পর এবার এসেছিলেন। তার চলে যাওয়ার সময়টা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাই দূর থেকেই সবার চেহারার অভিব্যক্তি দেখতে লাগলো সে।
ভীড় এগিয়ে এলো বাড়ির মূল ফটকের দিকে। দলের অর্ধেক বিদায় পর্ব সেরে ওখানেই দাড়িয়ে রইলেন। আর একদল এগিয়ে এলো বাড়ির চৌহদ্দি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে। আনমনে দেখতে দেখতেই, ভীড়ের মাঝখানে চারুকে আবিষ্কার করলো নিখিল। মেজো ফুপুকে একহাতে জড়িয়ে আছে মেয়েটা। তার চোখভরা জল। কোমল মুখখানিতে ঈষৎ লালচে আভাস, সম্ভবত কান্নার দরুণই। লোকে বলে সুন্দরীদের কাঁদলে নাকি কুশ্রী লাগে। অথচ চারুর এই কান্নাভেজা পেলব-কমনীয় চেহারা দেখে পুনর্বার প্রেমে পড়লো নিখিল। প্রথম দেখার অনুভূতি অন্তরে তরঙ্গ তুললো তার। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়লো শিহরণ। ঠোঁট নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে আবৃত্তি করলো রবিঠাকুরের সেই চিরচেনা কবিতার চরণ,

— “কমলফুল বিমল শেজখানি,
নিলীন তাহে কোমল তনুলতা।
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,
বাজিল বুকে সুখের মত ব্যথা।”

হ্যাঁ। ওই মায়াভরা মুখের দিকে চেয়ে নিখিলের বুকে সুখের ব্যথাই বাজলো। কানে বাজলো গতরাতে চারু সম্বন্ধে সৌভিকের বলা সেই কথাগুলো। চারু ডিভোর্সী মেয়ে। তার বিয়ে হয়েছিল, সংসার হয় নি তার অক্ষম নারীস্বত্ত্বার কারণে। কথাগুলো মনে পড়তেই বুকের ভেতর বাজা সুখের আবেশটুকু অসহ্য যন্ত্রণায় পরিণত হলো ওর। মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো, একটি প্রশ্নের সমাধানে!
‘কি করবো আমি? কি করা উচিৎ?’

*****

বিয়ে – বৌভাতের আয়োজনের পসরা শেষ। আমন্ত্রিত অতিথিদের অধিকাংশই বিদায় নিয়েছেন। আপাদত বাড়িতে নিজের মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। যদিও নতুন সংসারে এসে একমাত্র স্বামীটিকে ছাড়া আর কাউকেই ওর আপন মনে হচ্ছে না; তথাপি অনু মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলো।
নিজের বাড়িতে থাকাকালীন সে রাজকুমারীর হালেই থাকতো। চাল-চলন ছিল নবাবী ঢংয়ের। জীবনে কখনো ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠতে পারে নি; রান্নাঘরে মায়েদের সাহায্য করা তো দূর কি বাত্! সেই অভ্যাসগুলোর জন্যই আজও সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। নতুন বৌ, নতুন সংসার — তেমন করে কেউ কিছু বলে নি। কিন্তু রান্নাঘরে কাজ করতে গিয়ে বড় জা ঠিকই ঠেস দিলো,
— “কপাল তোমারই, ভাই। প্রেম করে বিয়ে করেছ। জামাইবাড়ির সবাই চেনা-পরিচিত। দেরি করে উঠলেও কিছু বলার নেই। সুখ, সুখ!”
অনু অপ্রস্তুত হাসলো,
— “না, আসলে— হয়েছে কি—”
ওকে কিছু বলতে না দিয়েই মাহিয়া বললো,
— “থাক, থাক। আর বলতে হবে না। ব্যাপার বুঝি তো। দিন এখন তোমাদের। আর আমাদের সময়! আহ্, কাউকেই চিনি না। কিছুই জানি না। দেরি করে উঠলে মানুষ কি বলবে, শরমেই রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছিল। তুমি তো সেই হিসেবে বহুৎ আরামেই আছো!”
অনু কোনো প্রত্যুত্তর না করে চুপ করে রইলো। এই কথাগুলো যদি তার বাড়িতে দাড়িয়ে কেউ তার উদ্দেশ্যে বলতো এতক্ষণে কি কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত আল্লাহ্ মালুম! ত্যাড়া করে উত্তর তো দিতোই সঙ্গে, খোঁচা দেয়া মানুষটির সাথে চুলোচুলি করতেও পিছপা হতো না সে। কিন্তু এখন কিছু বললো না। কারণ এটা তার নিজের বাড়ি নয়। শ্বশুরবাড়ি। আর এই হেসে হেসে খোঁচা দেয়া মানুষটি সম্পর্কে তার বড় জা, মাহিয়া। মাহতাব ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী। অনুকে ডিভোর্স দেবার পর যাকে বিয়ে করে বউ করে সে।

নাশতা বানানোর ঝক্কিটা তেমন পোহাতে হলো না। ভাজি-ভুজি যা করবার কাজের মেয়ের সহায়তায় মাহিয়াই করলো। গতকালের বেঁচে যাওয়া গোশত গরম করলো। কিন্তু ঝামেলা শুরু হলো অনুর রুটি বেলতে গিয়ে!
অনুর ধারণা ছিল রুটি বেলা কোনো কঠিন কাজ না। ছোট থেকে দেখে এসেছে, মা – চাচীরা কতো সহজে ময়দার ডো’র উপর বেলনা ঘুরাতো, আর ফটাফট গোল গোল রুটি তৈরি হয়ে যেত। এতো সহজ কাজ-কারবার আবার হাতে-কলমে করবার কি আছে? চারু’পা, ঋতু শুধু শুধু রান্নাঘরে সময় নষ্ট করে এগুলো শেখে। এখানে শিখবার মত আছে কি?
কিন্তু আজ এই এতদিন পর নিজের শ্বশুরবাড়ি এসে রুটি বানাতে গিয়ে অনুর মনে হলো, না, সে যতটা ভেবেছিল কাজটা মোটেও ততটা সহজ নয়। রুটির ডোর উপর বেলন চালালেই আপনাআপনি গোল হয়ে যায় না! বরং বিচিত্র পৃথিবীর বিচিত্র সব দেশের মানচিত্র বেরিয়ে আসে!
আধঘন্টা ধরে একটাই রুটি বেলে যাচ্ছে, তবুও সেটা গোল হবার নামই নিচ্ছে না। কখনো ত্যাড়া-ব্যাকা হচ্ছে, তো কখনো বেশি বলে গিয়ে মাঝখান থেকে ছিঁড়ে যাচ্ছে। অথচ একটু আগেই সে দর্প ভরে উচ্চারণ করেছে,
— “রুটি বেলা কোনো কাজ হলো? দাও, করে দিচ্ছি।”
কিন্তু এখন? মাহিয়া ভাবী আর কাজের মেয়েটা পাশে দাড়িয়ে মিটমিট করে হেসে যাচ্ছে। একেকবার ফোড়ন কাটতেও ভুলছে না!
— “ভাবী দেখি, বিরাট কারিগর! ও আল্লাহ্, আপনে তো রুটি না, আস্ত বাংলাদেশখানই বানায় ফেলছেন! চমৎকার!”
কাজের মেয়েটার কথা শুনে রাগে গা জ্বলে গেল অনুর। চাপা ক্ষোভে ফুঁসে উঠলো,
— “তুই তোর কাজ করতে পারছিস না? এখানে নাক গলাতে বলছে কে?”
— “আমারে বকেন ক্যা? আপনি কাম পারেন না, সেইটা স্বীকার করলেই তো হয়!”
ভেংচি কাটলো মেয়েটা। তারপর মাহিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
— “এতদিন ধইরা এই বাড়িত আছি, কেউ কিছু কইলো না। বড় ভাবী তো কতো ভালা। ধমক টুকুও দেয় না। আর আপনে? আইসাই হম্বি-তম্বি? শুনেন, আমি ফুলি। কাউরে ডরাই না। আপনার মেজাজ আপনে রাখেন!”
অনু তেড়ে এসে কিছু বলবে তার আগেই বড় জা মধ্যস্থতা করলো,
— “আহ্ হা, ফুলি। থাম তো। তুই তোর কাজ কর। গিয়ে সবাইকে ডাইন ইনে বসতে বল। নাশতা খাবে।”
সঙ্গে সঙ্গেই ফুলির প্রতিবাদ,
— “এখনো রুটিই গোল করতে পারে নাই, সে আবার খাবার দিবো কি? দেখবেন, আইজ বেলা গড়াইলেও খাবার জুটব না কপালে। শুধু শুধু মানুষগুলান রে ডাইকা কষ্ট দেয়া!”
— “ফুলি?”
মাহিয়া চোখ পাকিয়ে ধমক দিলো বটে, কিন্তু প্রশ্রয় দিয়ে মিটমিট করে হাসলোও। অনুকেও আরেকটু খোঁচালো,
— “কি? রুটি গোল হচ্ছে না? একটা বাটি এনে দেব? সেই সাইজে গোল করে কেlটে ফেলো? তাহলে আর কষ্ট করতে হবে না!”
— “দরকার নেই। অনু একাই একশো, সব পারে!”
মাহিয়া যেন ভারী মজা পেল তাতে। মাথা নাড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরোল। তারপরই ওর কানে এলো, ওদের বিশ্রী খ্যাঁক খ্যাঁক করা হাসি! বারুদ জ্বlলে উঠলো অনুর মাথায়।
নিজের নাজেহাল দশা দেখে নিজেকে একশোটা একটা গালি দিলো। রাগে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে ওর। অদূরে দাড়ানো দুই নারীকে, মনে হচ্ছে ডাlকিনী! অসহ্য, এরা এভাবে হাসছে কেন? লোককে দেখাতে হবে তাদের দাঁত কেমন সুন্দর? ‘ইসস, সুন্দর না, বান্দর! কানের নিচে দুইটা লাগালেই দাঁত ক্যালানি বেরোবে!’ — মনে মনে ভেংচি কাটলো। আর ঘুষি মেরে ওদের দাঁত ভাঙবার প্রবল ক্রোধ দমিয়ে চালিয়ে গেল রুটি গোল করবার ব্যর্থ প্রয়াস!

*****

স্কুল থেকে ফিরেই হৈ-চৈ শুরু করে দিলো রিংকু – টিংকু। ‘স্কুল তাদের ভাল্লাগে না, তাও রোজ মা তাদের ধরে-বেঁধে স্কুলে পাঠায়। পাঠিয়ে লাভটা কি হয়? মিসেরা বকা দেন, স্যারেরা মারেন।’ — এই নিয়ে ওদের অভিযোগ। এসে কাঁধ থেকে ব্যাগটাও নামায় নি, সারা বাড়ীতে চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। নিখিলকে নিয়ে সৌভিক একটু বাইরে গিয়েছিল। ফিরে ফ্রেশ হবার জন্য উপরে গেছে নিখিল। সৌভিক সোফায় বসে ভাইদের কাহিনী দেখছে নির্লিপ্ত চোখে!
কিয়ৎক্ষণ পর নিখিল যখন হাতমুখ ধুয়ে, কাপড় বদলে নিচে নেমেছে তখনও হট্টগোল চলমান। টিংকু সমানে বকবক করে যাচ্ছে,
— “আমি মিসকে বললাম, আমার আপার বিয়ে ছিল। স্কুলে আসি নি। এইচ. ডব্লিউ. কি ছিল জানি না। তাও আমাকে মারলো, জানো? বেত দিয়ে হাতের তালুতে ঠাস-ঠাস করে লাগিয়ে দিলো!”
এই পরিস্থিতিতে কার কি বলা উচিৎ? নিখিল ঠিক জানে না। তার এমন বিচ্ছু মার্কা ছোট ভাই নেই। সৌভিকও কিছু না বলে উপরে চলে গেল ফ্রেশ হতে। তাই অগত্যা চুপ করে সোফায় বসে সব দেখতে লাগলো। বাড়ির কেউ কিছু বলছে না। যে যার মতো কাজে ব্যস্ত, ছোট দুই বিচ্ছুর কথা শুনেও যেন শুনছে না। কানের কাছে ভাঙা রেকর্ডে বেজে চলেছে একটানা। স্কুলের টিচারদের দুlর্নাম-বদনাম করছে , ওরা এই করেছে, সেই করেছে — ইত্যাদি।
সৌভিককে আসতে দেখা গেল। ওকে দেখেই রিংকু বললো,
— “ভাইয়া, শুনেছ তুমি! কি করেছেন সুস্মিতা মিস? শুধু শুধু মেরে আমাদের হাতের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে!”
সৌভিক একটু ব্যঙ্গ করেই বললো,
— “কই দেখি? মেlরে ফাটিয়ে দিয়েছে নাকি তালু? না হাড্ডি-গুড্ডি গুঁড়ো করে ফেলেছে?”
টিংকু মুখ লটকে বললো,
— “ভাইয়া! মজা করবে না। মিস সত্যিই খুব জোড়ে মেরেছে! দেখনা, হাত লাল? কীভাবে অত্যাচার করেছে?”
— “ওহ্ হো লে। বাবুটা লে। তা তোমরা কি করেছিলে যে তোমাদের মারলো?”
বিদ্রুপের হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। রিংকু-টিংকুর সরল জবাব,
— “কিছুই না। ক্লাসে একটা শব্দও করি নি। মিস হুট করে চিৎকার করলো, আমরা নাকি ক্লাসে ডিস্টার্ব করছি। আমরা অস্বীকার করতেই বললো হোম ওয়ার্ক কই? বললাম, আপার বিয়ে..”

— “এই হয়েছে! হয়েছে! লম্বা কাহিনী বলা বন্ধ কর। আমরা ভালো করেই জানি তোরা কি! মিস নিশ্চয়ই এমনি এমনি মারে নি? তোরা তো এতটাও ভালো নস!”

ওরা আর কিছু বলবে তার আগেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলো ছোট চাচী। হাতের ট্রে তে শরবত আর হালকা কিছু খাবার। নিখিল – সৌভিকের জন্য। বাইরে থেকে এলো, কিছু নাশতা করতে হবে না? ছোট চাচী নাশতাগুলো ট্রে থেকে নামাচ্ছেন, টিংকু লাফ দিয়ে এসে একটা আপেলের পিস তুলে নিলো। হেলে-দুলে নিখিলের সোফার হাতলে চড়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্যে বললো,
— “কি যে বলো না, মা? আমরা কি কখনো খারাপ কিছু করেছি? নিখিল ভাই, তুমিই বলো তো? আমরা খারাপ কিছু করি কখনো?”
— “ও বলবে কি? ও কি তোদের ভালো করে চেনে? না তোদের বিচ্ছুগিরি সম্পর্কে জানে? হুঁ?”
শরবতের গ্লাস নিতে নিতে ভ্রু নাচায় সৌভিক। চানাচুরের পিরিচে খাবলা দিয়ে রিংকুর চটপট জবাব,
— “বিচক্ষণদের মানুষ চিনতে সময় লাগে না বেশি। এরা লোক দেখা মাত্রই বলে দেয় কে কেমন। আমাদের নিখিল ভাইও তো বিচক্ষণ, সে কি তোমার মত গোবর গণেশ? যে লাউ-কুমড়োর ফারাক করতে পারে না, সে মানুষ চিনবে কি করে?”
খোঁচা খেয়ে চুপসে গেল সৌভিক। এ কথা বড়োই সত্য যে, সে দুনিয়ার তাবৎ কাজ করতে পারলেও, একটা কাজ পারে না। সেটা হলো বাজার করা। শস্য-শ্যামলা বাংলার বুকে চাষকৃত হরেক রকমের সবজির মধ্যে সে বুঝি ঠিকঠাক লাউ-কুমড়োর পার্থক্যটাই পারে না। আর সেটা নিয়েই তাকে খোঁচা দিয়ে যায় তাদের বাড়ির দুষ্টুমির চুড়ামণি দু’ ভাই!

টিংকু ছটফটে ছেলে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে ত্বরিতে প্রশ্ন করে বসে,
— “নিখিল ভাই, তোমরা গিয়েছিলে কোথায়? বেড়াতে? ভাই কি দেখালো তোমাকে?”
একটা শ্বাস ফেলে নিখিলের প্রত্যুত্তর,
— “আর কোথায়? এই আশপাশেই ঘুরে এলাম। তোমাদের এখানে নাকি বেরোনোর মতো জায়গা নেই!”
সঙ্গে সঙ্গেই হৈহৈ করে উঠলো দুই দেওয়ানী,
— “কে বলেছে জায়গা নেই? ভাইয়া কি কিছু চেনে নাকি? আরে কি সুন্দর নদীর ঘাট আছে। ভাইয়া দেখাতে নিয়ে যেতে পারলো না?”
ওদের উটকো আলাপচারিতায় বিরক্ত হলো সৌভিক,
— “নদীর ঘাটে দেখবার মত আছে কি রে? যে অতো লাফাচ্ছিস? সেই তো কটা বোল্ডার এনে লাগিয়েছে, কূল বাঁধাই করা তিস্তার ওখানে দেখবিটা কি?”
— “দেখবো নাই বা কি? ব্রিজ আছে। আমাদের নির্মিত সড়ক সেতু আছে, ব্রিটিশদের তৈরী রেল সেতু আছে। নদীর ওপারে পার্ক আছে। সেসব দেখবার মতো নয়?”
— “পার্ক কি আমাদের জন্য? আমরা তোদের মত ছোট বাচ্চা?”
— “কে বলেছে পার্ক বাচ্চাদের জন্য? ওখানে কতো কি আছে জানো?…”
শুরু হয়ে যায় তিন ভাইয়ের বাক-বিতন্ডা। ছোট দুই দেওয়ানী কিছুতেই হার মানতে রাজি নয়। তাদের ভাষ্যমতে, নিখিল এদিকটায় প্রথম বারের মত এসেছে। তো ওকে এখানকার সবকিছু ঘুরে দেখাতে হবে না? হতে পারে, এখানে তেমন ঐতিহ্যপূর্ণ কিছু নেই। প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা ঐতিহাসিক কোনো তেমন সুন্দর অবকাঠামো নেই। কিন্তু যাই বা আছে, তাই কম কীসে? নিজের এলাকার যেটুকু আছে সেটুকু এই বহিরাগতকে অতিথিকে দেখাতে ক্ষতি কি? নিজের এলাকা নিয়ে গর্ব তো থাকা উচিত! হতে পারে, এই আপাত দৃষ্টিতে দেখা ছোটখাটো বিষয়গুলোই কোনোভাবে তার কাছে হয়ে উঠলো গুরুত্বপূর্ণ। হয়ে উঠলো শিক্ষণীয়, দর্শনীয় কিছু!

অবশেষে তাদের বিবাদ থামলো নিখিলের মধ্যস্থতায়,
— “আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমরা থামো। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের ইচ্ছে অনুযায়ীই আমি ঘুরতে যাবো। তোমরা নিয়ে যাবে আমাকে। বলো, কখন যাবে?”
— “বিকেলে ফ্রি আছো? চলো বিকেলে যাই?”
টিংকু যেন এখনো তৈরী ঘুরতে যাওয়ার জন্য। রান্নাঘর থেকে বড় ফুপুর গলা,
— “কীসের রে ঘুরতে যাওয়া? রিংকু – টিংকু? তোদের না সামনে সপ্তাহে পরীক্ষা?”
রিংকুর নির্বিকার উত্তর,
— “দিল্লি বহুদূর, ফুপু! সামনে সপ্তাহ আসতে আরও চারদিন বাকি!”

****

বহুদিন হলো ভাইবোনদের একসঙ্গে হওয়া হয় না। অনুর বিয়ে উপলক্ষে অনেকদিন পর ওরা সবাই একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। মেজো ফুপু সকালে চলে গেছেন, ছোট ফুপু তো আসেনই নি। তাই এ দু’ জনের সন্তান ছাড়া বাকি সবকটা ভাইবোন এখন একসঙ্গে অরুণা ম্যানশনে উপস্থিত। তো, বিকেলে তিস্তা পাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠতেই, বাকিরা বলে উঠলো, সবাই একসঙ্গে গেলেই তো হয়! নিখিলের ঘোরাও হবে আর ওদের বাকি ভাইবোনদের সঙ্গে সময়ও কাটবে ভালো। প্রস্তাব মনে ধরলো সৌভিকের, সুতরাং নাকোচ করবার প্রশ্নই ওঠে না। মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রিংকু – টিংকু ছুটলো তাদের আপাদের কাছে।

নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিল চারু। গতকাল আর আজ সারাদিনে অনেক ব্যস্ততা গেছে, কাজের মাঝে ঘুমোবার ফুরসৎ পায় নি। রাতেও ঘুম হয় নি ইনসমনিয়ার দরুণ। একটু বেলা পড়তেই মাথা ব্যথা উঠেছিল। প্রবল কষ্টটাকে চাপতে পেইন কিলার খেয়ে ডুবে গিয়েছিল গভীর নিদ্রায়।
হঠাৎ কারো ফিসফিসানো আওয়াজ শুনে ওর ঘুম পাতলা হয়ে আসলো। তারপর পরই কেউ কানের ফুটোয় কিছু একটা দিয়ে সুড়সুড়ি দিলো যেন!
আকস্মিক এহেন কাণ্ডে নিদ্রামগ্ন চারু চটকা ভেঙে হুড়মুড় করে উঠে বসলো বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গেই কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো কারো অট্টহাসির আওয়াজ। চোখ কচলে তাকাতেই দেখতে পেল দুই বিচ্ছুর বত্রিশ পাটি দাঁত!
— “বড়’পা ভীতুর ডিম। ভয় পেয়েছে!”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০৯

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৯

সন্ধ্যায় পড়তে বসতে হয় — সম্ভবত এটা বাঙালিদের সর্বজনীন বিধির আওতায় পড়ে। প্রাইমারি থেকে কলেজ সব জাতের শিক্ষার্থীদের বাড়িতেই বাপ-মায়েরা এই নিয়ম চালু করে রেখেছে। সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির সবাই যখন সান্ধ্যকালীন চায়ের আড্ডায় মেতে ওঠেন, বাচ্চারা তখন বইয়ের ভাঁজে মুখ গুঁজে থাকে। অরুণা ম্যানশনও এর ব্যতিক্রম নয়। কটা দিন বিয়ের আমেজে সেজে-গুজে বেড়িয়ে রিংকু – টিংকুর পড়ালেখা চাঙ্গে চড়েছে। আজ বাড়ি ফাঁকা হতেই ছোট চাচী কান ধরে দুটোকে পড়তে বসিয়েছেন। কিন্তু বসালে কি হবে? পড়তে তো হবে?
বদমায়েশির চুড়ামণি, শিরোমণি এই রিংকু – টিংকুর কি সহজে পড়া হয়?
কাজের মেয়েটা জলখাবার দিয়ে গেল। সেই রোজকার এক খাবার। গ্লাস ভর্তি দুধ বিস্কিট। দেখেই মুখ কুঁচকে ফেললো দু’ ভাই। এ বাড়ির সবাই জানে, দুধ নামক তরল পদার্থের প্রতি তাদের কি পরিমাণ অনাসক্তি! তবুও রোজ এটাই আসে নাশতা হিসেবে। বিস্কিটটা তবুও বদলায়, কখনো বা অন্য কিছু আসে। কিন্তু দুধের হাত থেকে নিস্তার নেই!
ট্রে থেকে গ্লাস নামিয়ে মেয়েটা বললো,
— “ভাইজানেরা দুধটুকু খাইয়া লইয়েন কইলাম। ফালায় দিয়েন না। ছোট আম্মা জানলে রাগ করবো!”
— “আরে যাও, যাও। খেয়ে নেব আমরা!”
মেয়েটাকে বিদায় করে টিংকু। তারপর উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে দু’ গ্লাস দুধ ঢেলে দেয় বাইরে। ফিরে এসে বসে বিছানায়। রিংকু বিস্কিটের পিরিচটা দখলে নিয়ে বসেছে। সেখান থেকে একটা বিস্কিট তুলে নিয়ে বসলো সামনের চেয়ারটায়। টেবিলে খোলা বইখাতার দিকে চেয়ে বললো,
— “এটা কোনো কথা, বল? বাড়িতে একটা বিয়ে — আর আমাদের ঘাড় ধরে পড়তে বসিয়ে দিয়েছে?”
— “বিয়ের অজুহাতে কদিন পড়া হয় নি, সে হুশ আছে? সামনের সপ্তাহে মান্থলি টেস্ট শুরু হবে। সিলেবাস কিছু হয়েছে?”
কপট রাগ দেখায় রিংকু। দু ’ ভাইয়ের মধ্যে তুলনামূলক সে একটু লেখাপড়ায় আগ্রহী। টিংকু তো পুরোপুরি বি|দ্বে|ষী এ ব্যাপারে। ভাইয়ের জ্ঞানী আলাপে সে বিরক্ত হয়,
— “আরে রাখ তোর সিলেবাস। আমি বাঁচছি না আমার জ্বালায়!”
— “তোর আবার কীসের জ্বালা?”
— “দু’ বছর ধরে ঝুলতে-ঝুলতে ফেলটুস অনুপার বিয়ে হয়ে গেল। আর আমি এখনো আমার রাইমাকে পটাতেই পারলাম না।”
— “পড়ালেখা ছেড়ে তুই এখন রাইমার কথা ভাবছিস?”
রিংকু অবাক হয় খানিক। রাইমা ওদের ক্লাসমেট। দারুণ সুন্দরী এই মেয়েটির প্রতি টিংকুর প্রবল আকর্ষণ। বছর তিন ধরে ওই মেয়ের পিছে সে ঘুরছে। যদিও পাত্তা পাচ্ছে না একরত্তি! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টিংকু বলে,
— “অনুপার মতো বজ্জাত মেয়ের যদি প্রেম হয়, তবে আমার মত ভদ্র ছেলের সঙ্গে রাইমার মতো ভদ্র মেয়ের প্রেম কেন হবে না?”
— “নিজেকে ভদ্র দাবী করে আর পাপ বাড়াস নে ভাই! ধর্মে সইবে না!”
বিড়বিড় করে ছেলেটা। ওর কথার দাম দেয় কে? উদাসী টিংকু তখন দার্শনিক চিন্তা-ভাবনায় ব্যস্ত,
— “আমি একটা কথা চিন্তা করলাম, জানিস? পৃথিবীতে ভালো মানুষের কোনো সুখ নেই। তারা তাদের ভালবাসা পায় না। এই দেখ না, আমি কতো ভালো মানুষ। ক্লাস ফাইভ থেকে রাইমাটার পেছনে পড়ে আছি। কোনো লাভ হচ্ছে? ভালোবাসা পাচ্ছি? পাচ্ছে কে বল তো? অনুপার মতো বদগুলো। এই দুনিয়ায় আসলে ভালো মানুষের কোনো দাম নেই। বুঝলি?”
ওর জ্যাঠামী দেখে কপাল কুঁচকে রিংকুর প্রতিবাদ,
— “না বুঝি না। তোর এই পাকামো দেখে আব্বা যখন পেঁদিয়ে পেছন লাল করে দেবে? তখন বুঝবো।”
ভালো কথার মধ্যে এই উত্তম-মধ্যমের প্রসঙ্গ আনলে বেজায় খাপ্পা হয় টিংকু। কিঞ্চিৎ রাগ করে বলে,
— “আমার কথা তোর পছন্দ হচ্ছে না, না? আব্বার ক্যালানি খেতে খুব মন চাইছে বোধ হয়? তো আব্বাকে ডাকবো আমি? ডেকে বলবো, তোর কুকীর্তির কথা? গতমাসে স্কুলের ফিসের নাম করে আব্বার কাছ থেকে যে হাজার টাকা মে|রে দিয়েছিস?”
দোষ ধরতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো,
— “আমি একাই সে টাকা মেরেছি? তুই বুঝি খুব তুলসী পাতা?”
— “সে তো আমি। এমনই একটু, হে হে হে।”
দমে গিয়ে হে হে করে হেসে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে। রিংকুও ভাইকে দেখিয়ে দাঁত বের করে হাসে।
হঠাৎ কি একটা মনে পড়ে যাওয়ায় তার ভাবগতির পরিবর্তন হলো। ভাইয়ের দিকে ঝুঁকে এসে টিংকু বলে,
— “একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস, রিংকু?”
— “কি ব্যাপার?”
বিস্কিটে ছোট্ট কামড় দিয়ে জিজ্ঞেস করে সহোদর।
— “নিখিল ভাইয়ের হাবভাব! আমার ঠিক ভালো ঠেকছে না। কেমন যেন লাগছে!”
— “কেমন?”
ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ওর প্রশ্নে একটু চুপ করে টিংকু। চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে বিছানায় চড়ে। ভাইয়ের ঠিক সামনে বসে, মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— “নিখিল ভাই কিছু একটা পাকাচ্ছে। আমার ধারণা, ও ব্যাটা আপার উপর ফল করেছে।”
— “কে? ঋতুপা?”
সন্দিহান সুরে বললো রিংকু। ওর দ্বিধান্বিত উত্তর,
— “ঠিক বুঝতে পারছি না। ঋতুপাও হতে পারে। আবার চারুপাও। নিখিল ভাইকে দেখছি, ওদের পিছ পিছ ঘুরতে। ওরা যেখানে যাচ্ছে, বা যায়-— সেখানেই এই লোক থাকছে, জানিস? ঋতুপা ছাদে ঘুরাফেরা করে। নিখিল ভাই ছাদে। চারুপা দখিন হাওয়ায় বসে। সন্ধ্যায় দেখি, উনি দখিন হাওয়ায় বসে গলা ছেড়েছেন! বুঝছিস কিছু? এই লোকের মতলব? আমি নিশ্চিৎ এ ব্যাটার চরিত্রে দোষ আছে!”
ত্যক্ত হয়ে রিংকুর কথা,
— “এমনই একটা কথা বলবি না তো। সৌভিক ভাইয়ের বন্ধু উনি। এতো খারাপ নিশ্চয়ই নন! ভাইয়াকে তো চিনিস। কত্তো চুজি। থার্ড ক্লাস কারো সঙ্গে সে ফ্রেন্ডশিপ করবে?”
— “আরে ধুর। সে কথা নয়। আমার খটকা অন্য জায়গায়। নিখিল ভাই খারাপ কিনা আমি জানি না। কিন্তু উনি আমাদের কোনো এক আপার উপর ফল করেছে, এ আমি সুনিশ্চিত!”
— “কচুর সুনিশ্চিত! কি দেখেছিস, কি বুঝেছিস আল্লাহ্ মালুম। এখন ঘরে বসে খিচুড়ি পাকাচ্ছিস। যা সর। পড়তে বসবো।”
উঠে দাড়ালো রিংকু। ওকে পাশ কাটিয়ে পাশের চেয়ার টেনে বসলো। বইখাতা খুলে মনোযোগ দিলো। ওর কাজে মহাবিরক্ত হয়ে মাথায় গাট্টা বসালো টিংকু,
— “আমার কথার তো দাম দিচ্ছিস না। পড়ে বুঝবি। গরীবের কথা বাসি হলেও ফলে! হুহ্!”
___

রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরতেই সৌভিকের দেখা মিললো। বিছানার পাশের সিঙ্গেল সোফাটায় বসে আছে। থমথমে চাউনি মেলে চেয়ে আছে ওরই দিকে। নিখিল অবাক হলো একটু, বললো,
— “সারাদিন কোথায় ছিলি? দেখাই পেলাম না তোর! আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে, একা ফেলে উধাও হলি?”
সৌভিকের কোনো ভাবাবেগ হলো না। সে গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করলো,
— “তোর সঙ্গে কথা আছে।”
— “কথা তো আমারও আছে। কিন্তু তুইও তো না শুনে পালিয়ে গেলি। দাড়া, একটু কাজ আছে। সেরে আসছি।”
বলেই ঘরের অন্যদিকে যেতে উদ্যত হলো নিখিল। রাশভারী গলায় আদেশ দিলো,
— “কাজ পড়ে। আগে কথা শেষ করে নেই। বারান্দায় চল।”
বলেই আসন ছেড়ে উঠে দাড়ালো। যন্ত্রমানবের মতো কাঠকাঠ ভঙ্গিমায় হেঁটে ব্যালকনিতে চলে গেল। নিখিল কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। সুযোগ হলো না। অগত্যা বন্ধুবরের ইচ্ছে অনুযায়ী ওর পিছু পিছু হাঁটলো।
আলোহীন জায়গাটাতে কুচকুচে কালোর পসরা। সামনেই অন্ধকার বাগান, এরচেয়েও অন্ধকার এই ব্যালকনি। পাশাপাশি পেতে রাখা দু’টো বেতের চেয়ার। তারই একটাতে সৌভিক এসে বসেছে। নিখিলকে চেয়ার টেনে সামনে বসবার ইঙ্গিত দিতেই ও বসলো।
মুখোমুখি দু’টি মানুষ বসে।
পিনপতন নীরবতা ভেঙে কথা শুরু করলো সৌভিক,
— “তুই চারুকে নিয়ে সিরিয়াস?”
— “তোর কি মনে হয়? আমি ফাজলামি করেছি? নেহাৎ মজা করে একটা কথা বলে তোর ঘুষি হজম করেছি?”
প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন। সৌভিক শ্বাস ছাড়লো একটা। নিখিলের হাবভাব বলে দিচ্ছে ও যথেষ্ট সিরিয়াস। এমতাবস্থায় কি করে ও বলবে সবটা? অথচ না বলেও উপায় নেই। অদ্ভুত জটিল এক পরিস্থিতির কবলে ওরা পড়েছে। যেখানে সবকিছু খোলাসা না করলে আর চলছেই না!
বললো,
— “তুই কিছুই জানিস না। চারুকে তোর চোখের দেখায় ভালোলেগেছে। তাই বলছিস, ভালোবাসিস। স্বপ্ন দেখছিস। কিন্তু যাকে নিয়ে তোর এত কল্পনা-জল্পনার আসর। তার সম্পর্কে তোর জানা উচিৎ না?”
সরাসরি তাকায় ওর দিকে। অন্ধকারে নিখিলের মুখটা স্পষ্ট বোঝা যায় না। তাই ওর চেহারায় কি ভাবের খেলা চলছে তা দেখতে পেল না। শুধু শুনতে পেল নিখিলের আত্মবিশ্বাসী জবাব,
— “যতটুকু জানবার, সম্ভবত আমি জেনে নিয়েছি। চারু তোর বড় চাচার মেয়ে। ছোট বোন অনুর বিয়ে হয়েছে দু’দিন আগে। বিয়েটা প্রেমের। চারু মেয়েটাকে দেখে মনে হয়, শান্ত-শিষ্ট; কিছুটা অন্তর্মুখী চরিত্রের। পড়ালেখা কতদূর আমি জানি না। তবে বোধ হয়, অনার্স পড়ছে। পাশও করতে পারে। আর মেয়ের বাবা সম্বন্ধে? তোদের দাদা আহাদ রাজার গড়া পরিবারিক ব্যবসা, এখন বংশানুক্রমে তোর বাবা – চাচা দেখছেন — সে কি আমার অজানা? তাহলে বল এতকিছু জানবার পর বিয়ে করতে আর কি লাগবে?”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো নিখিল। তার ভাষ্যমতে বিয়ে করতে এসব জানলেই চলবে। কিন্তু ছেলেটা সব খবর নিলেও আসল খবরটাই যে নেয় নি, এটা বেশ বুঝলো সৌভিক। ওর কথার রেশ ধরেই বললো,
— “ব্যস? এটুকুই?”
— “তুইই বল। আর কিছু লাগবে?”
— “তোর কি মনে হয় না, একটা মেয়েকে বিয়ে করবার আগে তার ম্যারিটাল স্ট্যাটাস সম্পর্কে জেনে নেয়া উচিৎ?”
দাঁতে দাঁত পিষে প্রশ্নটা ছুঁড়ে। হঠাৎ করে এমন কথায় একটু ভড়কায় নিখিল। তথাপি বলে,
— “চারুকে দেখে মনে হয় না, সে বিবাহিত। আর বিবাহিত হলে অনুষ্ঠানে ওর বরকে দেখতাম না?”
সৌভিকেরও পাল্টা যুক্তি,
— “হতে পারে তার বর আসে নি। বিদেশে বা দূরে থাকে। আর তোর মাথায় এই প্রশ্নটা কেন আসলো না, যে বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারে বড় বোনের পড়ে ছোট বোনের বিয়ে হয়। সেখানে চারুকে রেখে ছোট বোনকে কেন বিয়ে দেবে?”
এই খটকা তো নিখিলেরও লেগেছিল। কিন্তু চারুর প্রতি অত্যধিক মুগ্ধতায় ও বেচারা ভুলে গিয়েছিল সারা দুনিয়া। প্রশ্নটা মাথায় এসেও যেন আসে নি। সৌভিক ফের শুধায়,
— “বল, প্রশ্নটা তোর মাথায় আসে নি? এই ব্যাপারটা নিয়ে খটকা লাগে নি তোর?”
প্রত্যুত্তরে বিভ্রান্ত সুর,
— “আমি কিছু বুঝতে পারছি না, সৌভিক। তুই এরকম পেঁচিয়ে কথা বলছিস কেন?”
— “কথাটা পেঁচানো বলেই পেচাতে বাধ্য হচ্ছি।”
সরল জবাব। যদিও তারমধ্যে সরলতার লেশ অবধি পেল না নিখিল! অধৈর্য হয়ে উঠলো ক্রমশ,
— “প্লিজ, সৌভিক। ক্লিয়ার করে বল সবকিছু। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে অতঃপর সৌভিকের স্বগতোক্তি,
— “চারু অবিবাহিত নয়, নিখিল। ওর বিয়ে হয়েছিল। মাস ছয়েকের সে সংসার টেকে নি বিধায় অনুর বিয়েতে ওর বরকে তুই দেখতে পাস নি। চারু কুমারী নয়। ডিভোর্সীর ট্যাগ ওর নামের সাথে যুক্ত!”
বেশ বিষণ্ন শোনালো ওর কণ্ঠস্বর। সহসা কি বলবে কোনো ভাষা খুঁজে পেল না নিখিল। মনে হলো যেন, ওর বিশাল শব্দভাণ্ডার মুহূর্তেই শুন্যতায় ডুবে গেছে। অনেক হাতড়েও কোনো সুরাহা হলো না তার!
নিখিলের নীরবতা দেখে হয় তো কিছু আন্দাজ করতে পারলো সৌভিক। রাখঢাক না করেই তাই সবটা জানালো,
— “চারুর বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে। অনুর ভাসুর, মাহতাবকে দেখেছিলি গতকাল অনুষ্ঠানে? ওই মাহতাবই হলো চারুর প্রাক্তন বর। মাহতাবের সূত্র ধরেই মাহাদের সঙ্গে অনুর পরিচয়। বিয়ে।”
— “ওদের ডিভোর্স কেন হলো?”
নিস্পলক চোখে তাকালো। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে মোচন করলো সৌভিক,
— “চারুর শারীরিক সমস্যা আছে। শি ক্যান নেভার বি অ্যা মাদার। মাতৃত্বের স্বাদ নেয়ার ক্ষমতা ওর নেই। মাহতাব বিয়ে করেছিল, বাচ্চারই উদ্দেশ্যে। ওদের পরিবারে বাচ্চার অভাব। তাই—”
— “সেজন্য ডিভোর্স দিয়ে দেবে? বাচ্চা না হলে একটা মেয়ের আর দাম নেই? সংসার ভেঙে দিতে হবে? এটা কেমন কথা?”
হঠাৎ তেঁতে উঠলো ছেলেটা। কণ্ঠে রাগের স্ফুলিঙ্গ ঝরছে। জবাবে কিঞ্চিৎ হাসলো সৌভিক। তাচ্ছিল্য ভরা সে হাসি,

— “আমি জানি, কথাটা খুব তুচ্ছ। সামান্য একটা কারণে কারো সংসার ভেঙে যাবে — এটা তোর মানতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সত্যিটা নির্মমই হয়। মাহতাবের মতো অতি শিক্ষিত, আধুনিক বসবাসকারী একজন মানুষ যে এমন করবে আমি নিজেও ভাবতে পারি নি। ব্যাপারটা আমার জন্যও শকিং ছিল। কিন্তু কিছু করবার নেই। কেউ যদি বলেই দেয়, আমি সংসার করবো না; তখন কি তাকে জোর করা শোভা পায়? আর ওর বিরুদ্ধে মামলা করেই বা কি? তামাশা করে লোক হাসানো ছাড়া?”

কথা সত্য। স্বাভাবিক ভাবে এ ঘটনা যে কেউ শুনলেই অবাক হবেন। স্বাধীন এবং আধুনিক মানসিকতার লোকেরা হয় তো রাগও হবেন। কিন্তু তাতে কি হবে? চারুর সঙ্গে যা হয়েছে তা কি ফেরানো যাবে? আমরা মুখে মুখে যতই বলি, আমরা শিক্ষিত, আধুনিক, উন্নত যুগে বাস করি। কিন্তু আমাদের মনের যে অন্ধকার সংস্কার, ধ্যান-ধারণা আছে সেটুকু কি শিক্ষার আলো দিয়ে সবাই দূর করতে পারি? যদি পারতামই তাহলে, মাহতাব আর তার পরিবারের মত মানুষেরা নারীকে এতো ছোট করে দেখতে পারতো না। নারীকে শুধুমাত্র সন্তান জন্ম দেয়ার মেশিন জ্ঞান করতো না। ভাবত না, সন্তান জন্ম দিতে না পারলে মেশিনটা নষ্ট, অযোগ্য; তাকে ভাগাড়ে ছুঁড়ে ফেলা উচিৎ!
হায় রে, সভ্যতা!

সৌভিক নিজের কথা শেষ করে উঠে চলে গেল ভেতরে। নিখিল বসে রইলো অন্ধকারে, একা!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ