Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 298



এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০৮

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৮
[মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

রক্তিম সূর্যটা পশ্চিমে ডুবেছে অনেক্ষণ হলো। অন্তরীক্ষে লালাভ বর্ণের ছড়াছড়ি। দূরের ঘন বৃক্ষরাজি কৃষ্ণরূপ নিয়েছে। একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে যাচ্ছে কাছেই কোনো গাছে বসে। পুরোপুরি আলো হারায় নি, আবছা আঁধারি নিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীর বুকে। ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে বাগানে এলো চারুলতা। গতকাল রাতেই অর্ধেক বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে। অভ্যাগত অতিথিরা অনেকেই চলে গেছেন কাল বৌভাত থেকে ফিরবার পর। বাকি যারা ছিলেন, তারাও আজ সকালেই গেছেন যার যার নিজস্ব ঠিকানায়। কয়েকদিনের হৈ-চৈয়ের পর তাই বাড়িটা আজ বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কেমন অদ্ভুত শূন্যতা চারপাশে!
অন্ধকারে পথ হেঁটে ‘দখিন হাওয়া’র দিকটায় আসছিল চারু। হঠাৎ মনে হলো কে যেন ওখানে বসে। আওয়াজ আসছে। চমকে উঠে ‘কে?’ — প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না চারু। ঠোঁটের ডগায় আসা প্রশ্নটা বন্ধ করে, চুপ করে দাড়িয়ে রইলো অন্ধকারে। নিশ্চুপে শুনলো কোনো আগন্তুক গুনগুন করে সুর ভাজছেন। রবিঠাকুরের ভীষণ জনপ্রিয়, প্রেম-বিরহের করুণ সুরের গানটি এই গায়ক তার সম্মোহনী কণ্ঠে গাইছেন,
— “যদি আরও কাহে, তুমি ভালোবাসো
যদি আরও ফিরে, নাহি আসো
তবে তুমি যা চাও, তাই যেন হয়!
আমি যতোই দুঃখ পাই গো~”
বিকেল থেকে উদাস ছিল চারু। পুরনো স্মৃতিরা বারেবারে দোলা লাগাচ্ছিল মনে। বেরিয়ে আসতে চাইছিল বুকের ভেতর আবদ্ধ সিন্দুকটা ছেড়ে। যে সিন্দুকের অবস্থান তার গহীনে, তার তিক্ত অতীতের গল্প মুড়িয়ে!
অচেনা মানুষটির এই মর্মস্পর্শী করুণ সুর ওর দুঃখের ব্যথায় আগুন ধরিয়ে দিলো। হৃদয়ের দুয়ারে আঘাত হেনে স্মৃতিরা বেরোলো ঝুলি থেকে। একে-একে করে। সেই আড়াই বছর আগের কথা। সেই বিয়ের রাত। বাসর রাতে প্রথম দেখা, অচেনা পুরুষ মাহতাবের সঙ্গে। অন্তর্মুখী চারুর বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়। বিয়ের আগে তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি। একবার শুধু মাহতাবের সঙ্গে কফি খেতে গিয়েছিল রেস্তোরাঁয়। তাও বিয়ের দিন চারেক আগে। আধ ঘণ্টার সেই সময়টুকুতে কতটুকুই বা চেনা-জানা হয়?
বিয়ের রাতে তাই স্বল্প পরিচিত পুরুষটির সামনে আড়ষ্টতার মর্মে মlরে যাচ্ছিল চারু। লজ্জিত আনত মুখ তুলে তাকানো হয় নি। আগে থেকে ভেবে রাখা একটা পরিকল্পনাও পূরণ হয় নি। কল্পনায় এঁকে রাখা কতো শত গল্প, কতো কি ভাবনা! সারা রাত গল্প হবে, লোকটাও যেন কেমন। মনের দেয়া নেয়ার আগেই শরীরের দেয়া-নেয়া হয়ে গেল। লজ্জায় চারু দ্বিমতটুকু করবার সুযোগ পায় নি। আট-দশটা দম্পতির মতো অতি সাধারণ নিয়মেই সংসার জীবনে প্রবেশ করলো চারু। স্বামী-শ্বশুরবাড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো দ্রুতই!
মাহতাবদের পরিবারে সে বড় ছেলে। দাদার বংশে প্রথম নাতি। দাদা বেঁচে নেই, দাদিরও যাই-যাই করছেন। বড় সাধ নাতির সন্তান দেখে মlরবেন। অতএব, মাহতাবের বিয়েটা তড়িঘড়ি করেই দিয়েছে তার পরিবার। মাস খানেকের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির সবার ‘বাচ্চা নাও, বাচ্চা নাও’– শুনতে শুনতে বিষয়টা বুঝতে পারে চারু। একে স্বামী নামক লোকটার সঙ্গে তার তেমন বোঝাপড়া হয় নি। এখনো সেভাবে ভালোবাসাটাই হয়ে উঠে নি, তাতেই বাচ্চার দায়িত্ব? চারু সময় চাচ্ছিল। মাহতাব মানতে নারাজ। সেও দ্রুতই বাবা হওয়ার বাসনা করে। অপারগ চারুকে শেষ অবধি রাজি হতে হয়। কিন্তু মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া, এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎ আছে। চারু মেনে নিয়েছিল, মনে নিতে তার সময় দরকার ছিল।
ক্রমাগত চেষ্টার পরও বারবার ব্যর্থ হয় ওরা। পরিবার চাপ দিতে থাকে। ভাইবোন সবাই বড় হয়ে যাওয়ায় বাড়িটা ওদের ফাঁকা ফাঁকা। বাচ্চা-কাচ্চা এলে তা পূর্ণ হবে যেন। তাই সবার মুখেই এক কথা — “একটা সন্তান চাই। একটা সন্তান চাই।” পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, সবারই ওই এক কথা। শুনতে শুনতে বিরক্ত হয় চারু। মাঝে মাঝে বিতৃষ্ণা আসে। সবাই এমন করে কেন? সময় হলে কি বাচ্চা হবে না? এতো জোর দেয়ার কি আছে? তারা তো চেষ্টা করছেই।
কিন্তু চেষ্টাটা সফলতার মুখ দেখে না। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তিনি একসময় সত্যতা জানান। “চারু ইজ অ্যান ইনফার্টেইল উম্যান। শি ক্যান নেভার বি অ্যা মাদার।” সাজানো সংসার ভাঙতে দেরি হয় নি আর। খুব দ্রুতই ডিভোর্সের মাধ্যমেই সম্পর্কের ইতি টানে মাহতাব!
নিজের বিয়েতেও চারুর ভূমিকা ছিল না, বিয়ে ভাঙাতেও তার ভূমিকা রইলো না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, পুরুষের কথাই গ্রহণ করলো। মাহতাব সব চুকাতে চাইলেই চুকে গেল সবকিছু! চারু ফিরলো তার নীড়ে। কপালে তালাকের তকমা লাগিয়ে!
একা দাড়িয়ে স্মৃতিচারণ করছিল চারু। গান থেমে গেছে কখন সে জানে না। চটকা ভাঙলো গায়কের দরাজ গলায়,
— “কে ওখানে?”
চকিতে ফিরে তাকালো মেয়েটা। অন্ধকারে অস্পষ্ট সব। ভেতরে কে বসে বোঝা যাচ্ছে না। আগন্তুক উঠে বাতি জ্বাললো। হলদে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতেই লোকটাকে দেখতে পেল চারু। নিখিল নওশাদ!
— “ও আপনি?”
উৎকণ্ঠিত অবস্থা স্তিমিত হয়ে এলো। নিখিল এগিয়ে এসে দরজায় দাড়িয়ে বললো,
— “আসুন না। বাইরে দাড়িয়ে কেন?”
স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দেখালো। চারু এগোলো না। নড়লোও না একটু। উপচে পড়া কান্নাটাকে এক ঢোক গিলে রুদ্ধ করলো। কাষ্ঠ হেসে জানালো,
— “না থাক। আপনি গান গাইছেন, বিরক্ত না করি।”
— “শুনে ফেলেছেন বুঝি? ইসস, এই বাজে কণ্ঠটা নিয়ে যে কি করি। হুটহাট মুখ ফসকে সুর বেরিয়ে যায়! তাও যদি ভালো হতো—”
— “না। না। আপনার গানকে মোটেও খারাপ বলি নি। আমি বললাম–”
চারু প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করে। প্রশ্রয় পেয়ে নিখিল হাসে,
— “খারাপ যদি না বলেন, তবে ভেতরে এসে বসুন না। ভয় নেই, জোর করে গান শোনাবো না। এমনই গল্প করবো। আসুন না, প্লিজ?”
গল্প করবার মানসিকতা তার নেই। ভঙ্গুর মন তার। কবেই ঝুরঝুর করে ভেঙে গেছে! হারিয়ে গেছে কতো সুর, কতো ছন্দ!
এতদিন ধরে একটু একটু করে সামলে নেয়া, শক্ত আবরণে নিজেকে মুড়িয়ে নেয়া — সবটাই বিফলে গেছে ক্ষনিকের তরে। ফিরে এসেছে পুরোনো, ব্যথিত চারুলতা। ফুলের মত কোমল, একটুতেই নুয়ে পড়া লতা।
কিন্তু লোকটা এতো করে অনুরোধ করছে, তাকে না বলাটাও কেমন ঠেকলো ওর কাছে। অগত্যা রাজী হলো,
— “আচ্ছা, আসছি।”
নিখিল সরে গিয়ে ভেতরে ঢুকবার স্থান করে দিলো। চারুকে বসবার ইঙ্গিত দিয়ে নিজে বসলো ওর বিপরীতে। চারু হাসলো একটু। নিতান্তই কথা খুঁজে না পেয়ে শুধালো,
— “আপনি কি নিয়মিত গান নাকি? প্রফেশনাল?”
নিখিল যেন লজ্জিত হয়ে তড়িঘড়ি করে বললো,
— “না-না। প্রফেশনাল নই। এই একটু-আধটু সাধ হলে মাঝে মাঝে। আসলে কথা পাগল মানুষ তো। বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারি না। সৌভিক নেই অনেক্ষণ হলো। এখানে এসে একা বসে আছি। ভাবলাম একটু গাই। এরমধ্যে আপনার কানে গিয়ে পৌঁছল ফাটা বাঁশের চ্যানচ্যানানি — হা হা হা।”
— “আপনি যেভাবে বলছেন অতটাও খারাপ নয়।”
বাধ সাধতেই নিখিলের চটপট জবাব,
— “বারবার ও-কথা বলবেন না। আমাকে আবার পেয়ে বসলে, আপনাকে ধরে জোর করে গান শুনাতে বসবো। তখন ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা হবে!”
ওর বলার ধরন দেখে আর চুপ করে থাকতে পারলো না চারু। নিমিষেই মন খারাপ ভুলে, হেসে ফেললো খিলখিল করে। সেই হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো নিখিলও!

সৌভিক সারাদিন বাড়ি ছিল না। বাড়ির একটা দরকারে গিয়েছিল শহরে। সারাটা দিন সেই কাজে কর্তন করে ও যখন ফিরলো তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। গেট দিয়ে ঢুকে লন পেরোবার সময় ওর হঠাৎ কানে বাজলো হাসির আওয়াজ। শব্দ আসছে বাগানের দিক থেকে। এই ঝিঁঝিঁ ডাকা নিঝুম রাতে ওখানে বসবে কে? কৌতুহলী হয়েই পা বাড়ালো সে। একটু দূরে যেতেই চোখে পড়লো দৃশ্যটা। না কোনো অশালীন কিছু নয়, তবে অপ্রত্যাশিত তো বটেই!
‘দখিন হাওয়া’য় নিখিল আর চারু মুখোমুখি বসে। দু’জনেই কি নিয়ে যেন হাসছে খুব। প্রফুল্ল সে হাসি, কানায় কানায় আনন্দ পূর্ণ। বহুদিন পর চারুকে এমন প্রাঞ্জল দেখে অবাক হলো সৌভিক। চারুর খুশিতে সে অবশ্যই খুশি হয়, কিন্তু নিখিল? নিখিল কেন হাসছে ওর সঙ্গে? হঠাৎ কী একটা গোপন ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে ওর বুক। অব্যক্ত আক্রোশে ফুঁসে ওঠে মন। ক্রোধান্বিত হয়ে নীরবে প্রস্থান করে সে!
__

ঘর গোছাতে ব্যস্ত ছিল অনুলেখা। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন উদর ছুঁলো ওর। হিমশীতল ঠাণ্ডা দু’ হাতে ঘনিষ্ট ভাবে জড়িয়ে ধরতেই পিলে চমকে উঠলো। চেঁচানোর জন্য মুখ খুলতে নিলেই একটা আহ্লাদী সুর ভেসে এলো কানে,
— “কি করছে আমার বৌটা?”
বলা বাহুল্য, এ কার কণ্ঠ! অনু মিষ্টি করে হাসলো,
— “দেখছ না ঘর গোছাচ্ছি?”
— “ঘর তো গোছানোই আছে। তুমি বরং আমাকে গুছিয়ে দাও।”
একঝটকায় ওকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরালো। একহাতে পিঠ জড়িয়ে, অন্য হাতে কোমড় চেপে মিশিয়ে নিলো নিজের সঙ্গে। চোখে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষা। ওর নেশালু সে চোখের দৃষ্টি দেখে, অনু ভুবন ভুলানো হাসি দিলো। ওর থুতনিতে একটা চিমটি দিয়ে বললো,
— “এটা কি সেই সময়? অসময়ে উল্টো-পাল্টা না বললেই নয়?”
— “না নয়। কারণ, বৌ আমার, সময়ও আমার। এখন আমি যা খুশি বলবো। যা কিছু করবো।”
বলেই নিজের কথার প্রমাণ দেখাতে মত্ত হলো। ঠেসে ধরে চুমু খেল ওর গালে-মুখে। অবাধ্য হলো হাতের বিচরণ। অনু দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে ছটফটিয়ে উঠলো,
— “আহা, কি করছ মাহাদ? দরজা খোলা, এক্ষুনি কেউ এসে পড়বে। দেখে ফেললে কি ভাববে বলো তো?”
— “কেউ আসবে না। আর এসে দেখলেও বা কি। আমি আমার বৌয়ের সাথে কি করছি, না করছি তাতে কার কি? বরং নিজেই লজ্জা পেয়ে পালাবে!”
— “ইসস! তুমি কি নির্লজ্জ গো!”
বলেই ওকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো অনু। মাহাদ কিন্তু ছাড়লো না। বরং আষ্টেপিষ্টে আঁকড়ে ধরলো। কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে বললো,
— “হুম। একটু তো বটেই!”

কিছুটা সময় পার হলো এভাবেই। ছটফট করতে করতে একসময় হাল ছেড়ে দিলো অনু। মৃদু স্বরে জানতে চাইলো,
— “আচ্ছা, একটা কথা বলি?”
— “শুধু একটা? একশোটা বলো? আমি কিছু মনে করবো না। শতহোক, একটাই বৌ আমার!”
ওর দুষ্টুমিতে বিরক্ত হয়ে বললো,
— “আহ্ হা। শোনোই না!”
মাহাদ ওর নাক টিপে দিয়ে বললো,
— “আচ্ছা। বলোই না।”
অনু চুপ করে রয়। কিয়ৎক্ষণ পর হঠাৎ শুধায়,
— “তখন তুমি আপাকে কি বললে? আমি চলে আসবার পর?”
এ-প্রশ্নে অবাক হয় ছেলেটা,
— “কেন?”
— “আহ্ হা। বলো তো!”
জোর দেখায় খুব। মাহাদ একটু ভেবে জানায়,
— “তেমন কিছু না। তার বোনকে নিয়ে যাচ্ছি। তার কাছে একটু মত নিতে হবে না? তাই আর-কি!”
— “সেজন্যে আমাকে চলে যেতে বলবার কি ছিল? আর ওর কাছেই বা বলবার কি? ও কে?”
হুট করেই যেন রেগে ওঠে অনু। আগের চেয়ে কণ্ঠ বেশ উঁচু শোনায়। হাত ছেড়ে দিয়ে দূরত্বে দাড়ায় মাহাদের। আকস্মিক ওর এহেন আচরণে বেশ অবাক হয় মাহাদ,
— “তুমি তাতে রেগে যাচ্ছ কেন? আমি কি ভুল কিছু করেছি? সে তো তোমার বোন!”
— “হ্যাঁ। বোন। কিন্তু তাতে কি? বোন হয়েছে বলে আমার মাথা কিনে নিয়েছে? যে ওর কাছে পারমিশন নিতে হবে?”
দপ করে আগুন জ্বলে ওর মাথায়। বারুদের মত ফুঁসে ওঠে মেয়েটা। সহসা এই ক্রোধান্বিত অনুকে চিনতে পারে না মাহাদ। প্রবল বিস্ময়ে হতবিহ্বল চোখে চেয়ে রয়,
— “এভাবে বলছো কেন? কি হয়েছে তোমার?”
সে প্রশ্নের জবাব দেয় না অনু। প্রচন্ড রাগে জ্বলতে থাকে ওর শরীর। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে নিজের মতো চেঁচিয়ে যায়,
— “সবাই ওর মধ্যে পেয়েছেটা কি? খেতে চারু, বসতে চারু, সবকিছুতে চারু, চারু আর চারু! সমস্যা কি সবার? কি এমন কলোজাদু করেছে ও? যে ওকে ছাড়া কেউ কিচ্ছু বোঝে না?”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০৭

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৭

বাংলায় ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ বলে একটা শব্দ আছে। যার অর্থ — কিং সাহেব যখন তার কর্তব্য পালন করতে না পেরে বিমূঢ় হয়ে যান! নিখিলের একটু আগে বলা কথাটা শুনে সৌভিকও নতুন একটি শব্দের আবিষ্কার করলো– সৌভিককর্তব্যবিমূঢ়!
হতবুদ্ধি চোখে বন্ধুর দিকে চেয়ে আছে সৌভিক। কোনমতে মুখ খুলে বললো,
— “কি বললি তুই? কে?”
ওর এমন আশ্চর্যজনক চাহনি, নিখিলকে ভাবান্বিত করে তুললো। সে কি কোনো ভুল কিছু বলে ফেলেছে? চারুলতাকে কি ভালোবাসা যায় না? নাকি সে অধিকার তার পাওয়ার যোগ্যতা নেই? মৃদু কণ্ঠে ফের স্বগোক্তি করলো,
— “চারুলতা জাফরিন!”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো সৌভিক,
— “আর ইয়্যু কিডিং? ফাজলামি করছিস তুই?”
— “না। মজা করবো কে—”
হঠাৎ করেই ছেলেটাকে কেমন ক্ষেপাটে মনে হতে লাগলো। গৌড় বর্ণের উজ্জ্বল দেহকান্তের রং পাল্টাতে লাগলো। রক্তিমাভা ধারণ করলো মুখশ্রী, চোয়াল হলো শক্ত। আকস্মিক ওর এই পরিবর্তনে অবাক হলো নিখিল। কিছু বলবে তার আগেই ধমকে উঠলো ও,
— “চারুকে তুই কতটুকু চিনিস? তুই কি জানিস ওর সম্বন্ধে? তাতেই ওকে নিয়ে এসব ভাবতে পারিস কি করে?”
— “তুই এতো রেগে যাচ্ছিস কেন?”
ফ্যাকাশে মুখে জিজ্ঞেস করে। সৌভিক আরও তেঁতে গেল। বারুদের মত দপ করে জ্বলে উঠলো,
— “রেগে যাচ্ছি কেন, মানে? তুই রাগার মত কথা বলে বলিস, রাগছি কেন? হু?”
বলেই ওর বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো। তাল সামলাতে দু’ কদম ছিটকে বিছানার অন্যপ্রান্তে পড়ে গেল নিখিল। সেভাবেই ওর গাল বরাবর ছুঁড়ে দিলো একটি শক্তপোক্ত, মুখ তুবড়ে দেয়া ঘুষি। উঠতে গিয়েও, উঠতে পারলো না ছেলেটা। পড়ে যেতে গিয়েও বাঁদুরঝোলা হয়ে ঝুলে রইলো মশারির সঙ্গে! ভাগ্যিস, ওটা টাঙানো ছিল! তাই রক্ষে!
অকস্মাৎ আক্রমণে অপ্রস্তুত হলেও, দিশেহারা হলো না নিখিল। দ্বিতীয়বার ওর দিকে আঘাতের মুষ্ঠি ধেয়ে এলেই, আটকে দিলো সবেগে। ঝপ করে উঠে বসে সৌভিকের বাড়িয়ে দেয়া মুঠবদ্ধ হাত করায়ত্ত করে ফেললো নিমিষেই। তারপর একেবারে ফিল্মি স্টাইলে ওরই বাড়িয়ে দেয়া মুঠি, ওরই মুখের সামনে ধরে হিসহিস করে উঠলো,
— “হোয়াট আর ইয়্যু ডুইং? হ্যাভ ইয়্যু গন ম্যাড? শুধু তো ভালোবাসার কথা বলেছি। তাতেই এতো ক্ষেপছিস কেন? বোন হয় তোর। কোনো সম্পত্তি না যে, এরকম পাগলের মতো আচরণ করবি! আর আমি তো খারাপ কিছুও বলি নি। তাহলে?”
সৌভিক সহসা কোনো কথা বলতে পারলো না। ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে রইলো কেবল। একটু ধাতস্থ হতেই ওকে ছেড়ে দিলো নিখিল। কাছ থেকে সরে গিয়ে, নিরাপদ দূরত্বে বসলো। শান্ত কিন্তু দৃঢ়তার সহিত বললো,
— “এতো ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে মারামারি করতে পারে আমার ধারণাই ছিল না! তুই এরকম ইমম্যাচিউর তাও জানতাম না। চারুলতাকে আমার প্রথম দেখায় ভালোলেগেছে। আমি ভাবছিলাম, কীভাবে তোকে কথাটা জানাবো। একটু লজ্জা লাগছিল, ভেবে পাচ্ছিলাম না কিছু। এরমধ্যে তুই জিজ্ঞেস করলি — আমি বলে দিলাম আমার মনে কি আছে। কিন্তু তোর এরকম রিয়েকশন—”
একটু থেমে আবার বললো,
— “তোর সমস্যা কি আমি জানি না। কেন এরকম ষাঁড়ের মতো তেড়ে এলি, জানি না। কিন্তু আমি আশা করবো, তুই আমাকে কারণটা বলবি। এখন হয় তো বলতে চাচ্ছিস না। যখন ইচ্ছে হবে তবে তখন বলিস। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস, চারুকে আমি ভালোবেসেছি। সবসময়ই বাসবো!”
কথা শেষ করে ওর দিকে চোখ তুলে চাইলো। সৌভিকের কোনো হেলদোল নেই। এখনো ঠায় বসে আছে। মুখটা নিচু, ঘনঘন শ্বাস ফেলার আওয়াজ আসছে। ওকে চেনে নিখিল। সহজে এমন রাগ করবার পাত্র নয়। তবে আজ হঠাৎ কেন এতো রেগে গেল কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না। ওকে ওর মতো সময় নিতে দিয়ে ঘুমিয়ে গেল নিখিল। থাকুক, ও ওর মতন। শান্ত হয়ে ভাবুক!
___

দোতলায় চারুর ঘরটার সামনে দাড়িয়ে আছে অনুলেখা – মাহাদ। দু’ জনের পরনেই বাইরে যাবার পোশাক। মাহাদের হাতে একটা লাগেজ। বোঝাই যাচ্ছে, চলে যাবার প্রস্তুতি! বৌভাতের দ্বিতীয়দিন আজ। বাঙালিয়ানা নিয়মে বিয়ের পর নাইওর এসেছিল অনু। আজ তার সময় ফুরালো, ফেরৎ যেতে হবে নতুন ঠিকানায়। তার স্বামীর ঠিকানায়!
যাওয়ার আগে চারুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে ওরা। অনুর আসবার মন ছিল না, হয় তো আসতোও না। কিন্তু মাহাদের অনুরোধ ফেলতে পারলো না। ছেলেটা এতো মিষ্টি করে বললো, “যাওয়ার আগে চারু ভাবীকে বলবে না?” — ওর সরল চাহনির বিপরীতে কোনো ত্যাড়া উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না আর। শতহোক, প্রিয় মানুষের আবদার!
দরজা খুলে অনুকে দেখে বেশ অবাকই হলো চারু। গত দুদিন এই মেয়ের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় নি বললেই চলে। হলেও দু’ জনেই এড়িয়ে গেছে। আজ হঠাৎ? জিজ্ঞেস করবার জন্য মুখ খুলতে গেলেই অনু সোজাসাপ্টা বললো,
— “আমি শশুরবাড়ি যাচ্ছি। যাওয়ার আগে দেখা করতে এসেছি।”
ওর দায়সারা গোছের কথাটা শুনে একটু হাসলো চারু। শ্লেষ মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
— “না এলেই পারতি। শুধু শুধু এতটা রাস্তা হেঁটে কষ্ট করা!”
এরচেয়েও ত্যাড়া জবাব তৈরি ছিল অনুর। ও সেটা প্রয়োগ করেই ফেলতো, কিন্তু মাহাদের উপস্থিতির জন্য সতর্ক হতে হলো। বিচিত্র কারণে চারুকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে মাহাদ। সেই বড় আপার সঙ্গে খারাপ আচরণ ও সহ্য করবে না। নব পরিণীতার জীবনে ঝঞ্ঝাট চায় না অনু। তাই চুপ রইলো।
ওর পক্ষ থেকে উত্তরটা দিলো মাহাদ। বিনয়ী হেসে বললো,
— “ওভাবে বলছ কেন, ভাবী? তোমার সঙ্গে দেখা না করে আমি চলে যেতে পারি?”
মাহাদের এমন সহজ স্বীকারক্তি পুরোনো কিছু স্মৃতি জাগিয়ে দিলো মনে। খুব যত্ন করে আবদ্ধ রাখা, বুকের গভীরে লুকোনো কিছু মধুর সম্পর্ক, কিছু অমলিন সময়! পরক্ষণেই পুরোনো ঘায়ে টান পড়লো যেন। রlক্ত ছলকে বেরোলো, ভিজিয়ে তাজা করে দিলো ক্ষতটা। ঠোঁটটা কেমন বাঁকা করে বললো চারু,
— “পরশু বিয়ের সময় তো আমাকে মনেও করো নি। এখন হঠাৎ?”
— “কে বলেছে মনে করিনি? আম্মা তো বললো, তুমি অসুস্থ ছিলে। তাই আর— তুমি ভুল বুঝ না, ভাবী! আমি তোমার খোঁজ নিয়েছিলাম।”
কাঠিন্য স্বরে চারুর প্রত্যুত্তর,
— “আমাকে ভাবী ডাকা বন্ধ করো, মাহাদ। তোমার সঙ্গে সে সম্পর্ক আর আমার নেই।”
— “কিন্তু ভাবী ডেকেই তো আমি অভ্যস্ত। ভাইয়া, ও-বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হতে পারে, তাই বলে কি আমার সঙ্গেও?”
আকুল চোখে তাকায়। চারু নির্বিকার,
— “যেখানে আসল মানুষটার সঙ্গেই সব চুকে-বুকে গেছে, সেখানে তুমি তো— যাক গে, বাদ দাও। আমি যেহেতু তোমার স্ত্রীর বড় বোন, সে হিসেবে আপু ডাকলেই খুশি হব। পুরোন সম্পর্ক, যার কিনা কোনো অস্তিত্ব নেই তার প্রয়োজন কি?”
হাসার চেষ্টা করলো। ভাবী ডাকায় ঘোর আপত্তি বুঝতে পেরে দমে গেল মাহাদ। কিছুই আর আগের মত নেই। সেই সুন্দর ভাবী- দেবরের সম্পর্ক, খুনসুটি — হারিয়ে গেছে সব! মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,
— “ঠিক আছে। আপা ডাকবো তবে।”
— “আচ্ছা।” চারু হাসে।
মাহাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনুকে বললো,
— “তুমি যাও। আম্মা – আব্বার কাছে বিদায় নাও। আমি আসছি।”
ওকে চারুর কাছে ফেলে চলে যেতে যদিও ইচ্ছে ছিল না অনুর তবুও দিরুক্তি না করে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো।
চারু প্রশ্নাত্মক চোখে চাইলো,
— “কিছু বলবে, মাহাদ?”
কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর মাহাদ শুধায়,
— “তুমি কি আমাদের উপর রাগ করে আছ? বিয়েটাকে মেনে নিয়েছ তো?”
— “তোমার কেন মনে হচ্ছে, আমি রাগ করবো? কেন মানব না তোমাদের বিয়ে? যেটা আমার পুরো পরিবার মেনে নিয়েছে সেটা আমি না মানার কে? আর আমার না মানা দিয়ে তোমাদের কি যায় আসে?”
ইতঃস্তত হয়ে বলে,
— “তোমাকে অনুর বড় আপা বলবার আগে, ভাবী বলে ডেকেছি। তুমি যদিও সব ভুলে যেতে চাও। ভুলে যাওয়াই উচিৎ। কিন্তু আমার কাছে সেই সম্পর্কটার গুরুত্ব আছে। জীবনে প্রথম যে নারীকে বড় ভাবীর জায়গা দিয়েছি; মায়ের পর যাকে শ্রদ্ধা করেছি; তার দোয়া না নিয়ে আমি সংসার করতে পারি? তাকে ব্যথা দিয়ে আমি—”
ঠোঁটের কোণে হাসিটা লেগেই রয়েছে ওর,
— “হয়েছে হয়েছে। আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি মাহাদ। তুমি এখনও সেরকমই আছো। পাল্টাও নি। তেমন সহজ – সরল। আমি দুঃখ পাই নি মোটেও। খুশি হয়েছি এই ভেবে যে আমার উড়নচন্ডী, বেখেয়ালি বোনটাকে তোমার কাছে তুলে দিতে পেরেছি। দোয়া করি, সুখী হও। অনেক বেশি সুখী হও।”
কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া পেয়ে ভীষণ খুশি হয় ছেলেটা। উজ্জ্বল অনুপ্রভা ছড়িয়ে পড়ে ওর সুদর্শন চেহারাখানা জুড়ে। মাথা হেলিয়ে বিদায় নেয় সে,
— “আসছি, ভাবী। তুমি ভালো থেকো!”
শেষবারের মতো ভাবী ডাকটা শুনে চোখে জল ভীড় করলো চারুর। ঝাপসা দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে ধীরে ধীরে গমনদ্যোত মাহাদের পানে। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়,
— “আহা রে, জীবন!”
___

অন্ধকার ‘দখিন হাওয়া’য় একা বসে নিখিল। আশেপাশে কেউ নেই। নির্জন, জনশূণ্য। আজ সারাদিনে সৌভিকের সঙ্গে দেখা হয় নি ওর। ঘুম থেকে উঠে ঘরে পায় নি। সৌভিক ছিল না। অথচ, গতোকাল দুই বন্ধু একসঙ্গে বাইরে বেরিয়ে নাশতা করেছে, ঘুরেছে আশেপাশের এলাকা। আজকের জন্যও প্ল্যানিং করা ছিল। কোথায় কোথায় যাবে, এ এলাকার আর কি কি জায়গা দেখবার মতো। কিন্তু তারমধ্যেই কি-না-কি হয়ে গেল!
সৌভিকের ব্যাপারটা নিয়ে ও খুব অবাক হয়েছে। সেই আমলের বাংলা সিনেমার ভিলেনের মত আচরণ! নায়িকাকে পছন্দ করে শুনলে, নায়কের উপর নায়িকার ভাই যেমন চড়াও হয়! খলনায়কের ভূমিকায় অবতরণ করে, ঠিক তেমন! অথচ সৌভিকের চরিত্রের সাথে এ যায় না। একদমই না! তাহলে?
উদাস হয়ে ভাবে। আচ্ছা, কোনোভাবে কি সে ভুল করে ফেললো? সৌভিক নিজেই চারুকে পছন্দ করে না তো? কিংবা ওদের মধ্যে সম্পর্ক নেই তো? ওদের সম্পর্কে ও নিজেই অনধিকার প্রবেশ করে ফেললো কি?
কিন্তু তাও বা কি করে হয়? সৌভিকের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়, বন্ধুত্ত্ব। প্রাণের সম্পর্ক ওদের। কই, কোনদিন তো দেখে নি এমন কিছু! এমনকি ওর কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে — এমন কিছুও শোনে নি। চারুকে দেখেও তো মনে হয় নি। তবে? কি করে?
ছটফট করে ওঠে সমস্ত মন। আনচান করে প্রাণ। অদ্ভুত গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছে সে! যার কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০৬

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৬

বাড়িতে খুশির আমেজ। কতো কতো মানুষ! সবই অপরিচিত, কাউকেই চেনে না নিখিল। তারপরও এই হাস্যোজ্বল মুখগুলো দেখতে ভালোলাগছে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ রিংকু-টিংকুর সঙ্গে দেখা হলো ওর। ওরা দু’ জনে দাড়িয়ে আছে একগাদা মেয়ের মাঝখানে। ঠাট্টা-তামাশা করছে। নিখিলকে দেখতে পেয়েই রিংকু ডাকলো,
— “নিখিল ভাইয়া, এদিকে এসো তো। জলদি জলদিই!”
এগিয়ে এসে ওর হাত ধরলো টিংকু। একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেল ওকে। নিখিল বিপন্ন হলো,
— “আরে, আরে! হয়েছে কি? টানছ কেন?”
হুড়মুড়িয়ে মেয়েদের মাঝখানে ঢুকানো হলো ওকে। ও আসতেই কলকলিয়ে উঠলো মেয়েরা। বিদ্রুপের সুরে বললো নেত্রী গোছের কেউ একজন,
— “ভাইয়া? ভয় পাচ্ছেন নাকি? আমরা কি খেয়ে ফেলবো?”
নিখিল একটু অপ্রস্তুত হাসি দিলো,
— “খেতেও পারো। বলা তো যায় না, মানুষরূপী রাক্ষস যদি হও!”
সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠলো রিংকু-টিংকু। সাবাশি দিলো,
— “ফাটিয়ে দিয়েছ, ভাইয়া। চালিয়ে যাও!”
মেয়েগুলোও সাড়া দিলো,
— “বাপ রে, ছেলে মানুষের এতো ভয়! আমরা তো ভেবেছিলাম—”
হৈ-হৈ করে উঠলো বাকিরা। নিখিলের বুঝতে বাকি রইলো না কেন তাকে এভাবে বগলদাবা করে হাজির হলো টিংকু। ওকে নিয়ে হুল্লোড় থেকে একটু সরে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— “আমাকে এখানে এনেছ কেন, টিংকু? এসব কি?”
টিংকু হড়বড় করে বললো,
— “আরে ভাইয়া দেখছেন না মেয়েগুলো কেমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে আমাদের? কেমন ভাবটা নিচ্ছে? যেন আমরা কিছুই না! এখন ওদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে না, কাদের সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছে? তাই—”
ওদের সমস্যাটা বুঝলো নিখিল। দু’ জন ছোট ছেলে সাত-আটটা মেয়ের সঙ্গে চাপার জোরে পারবে নাকি? তাই দলভারী করতে ওকে ডাকা। কিন্তু নিখিল যে এসব পারে না। মেয়েদের সাথে বচসা করা ওর স্বভাববিরুদ্ধ। মেয়েরা হয় নরম – কোমল। ওদের সঙ্গে গল্প করে আরাম। তা না করে ঝগড়া?
বিব্রত হয়ে বললো,
— “ইয়ে, টিংকু কিছু মনে করো না। একটা কথা বলি। মেয়েদের সঙ্গে আর যাই করো, ঝগড়ায় যেও না। তুমি মরে গেলেও ওদের যুক্তির সাথে পারবে না। ওরা চাইলেই আকাশকে মাটি, মাটিকে আকাশ বানিয়ে দিতে পারে শুধু চাপার জোরে! তাই বলছি ভাই–”
— “তুমি মেয়েদের ভয় পাও?”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নিখিল চটপট বললো,
— “না, ভাই। মেয়েরা ভয় পাওয়ার জিনিস না। কিন্তু ওদের সাথে ঝগড়াটা ভয় পাওয়ার। ওরা কখন কি করে বসে, পরে কি-না-কি হয়! তোমরা এসব সামলাও। আমি নেই।”
সটকে পড়ার মতলব। টিংকু অসহায় গলায় বললো,
— “নিজেদের এতো ছোট ভাবলে হয়, ভাইয়া? ছেলে হয়ে ছেলেমানুষের ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করতে পারো না? আমি বলছি, একবার এসো তুমি। দেখো আগে ওদের কি করে তুলোধুনা করি!”
হাত ধরে এগোতে চাইলো। নিখিল ওকে ফিরালো,
— “কিছু কিছু জায়গায় ছোট ভাবার দরকার আছে। ছোট তাই বুঝবা না। এককাজ কর, তোমাদের দলে তোমাদের বড় আপুদের এনে ঢুকাও। মেয়েতে-মেয়েতে ঝগড়া হলে জিতলেও জিততে পার!”
নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করলো। টিংকু কিন্তু হাত ছাড়লো না। বিরস মুখে বললো,
— “তুমি এমন করছ কেন? আপুরা কেউ আসলে কি আর তোমায় ধরে টানাটানি করি? বলো?”
— “কেন? আসবে না কেন?”
— “ঋতু আপু, প্রমি আপু ছবি তোলায় মগ্ন। ডেকে মরে গেলেও নড়বে না। ইমা আপু তো আরেক। সারাক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ত! আমাদের কথায় আসবে, ভেবেছ?”
নিখিলের হুট করেই চারুর কথা মনে পড়লো। সাত-পাঁচ না ভেবেই জিজ্ঞেস করে ফেললো,
— “আর চারুলতা? সেও আসবে না?”
— “দূর! বড় আপা কি করে আসবে। ও তো এ-বাড়িতেই আসে নি।”
এতক্ষণে আসল কথাটা শুনলো। চারু তবে আসে নি? কিন্তু কেন? শুধালো,
— “কেন? অনু তার ছোট বোন না?”
সঠিক কারণটা যদিও জানা, কিন্তু তবুও সেটা ওকে জানালো না টিংকু। সে ছোট হলেও জানে, সবকথা সবাইকে বলতে নেই। এড়িয়ে গেল কথাটা,
— “আসলে বড়পা একটু অসুস্থ। এতো চিৎকার-চেঁচামেচিও পছন্দ করে না। তাই বাড়িতেই থেকে গেছে!”
— “ওহ্ আচ্ছা।”
নিরাসক্ত গলায় প্রত্যুত্তর করলো ছেলেটা। টিংকু চেয়েই ছিল ওর পানে। চারু আসে নি শুনে, কীভাবে ওর চেহারার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে গেল সেটা ঠিকই নজরে এলো ওর। সন্দেহী মনে খটকা লাগলো বেশ!
___

নব পরিণীত বর-বধূকে নিয়ে যখন অরুণা ম্যানশনে প্রবেশ করলেন আহাদ রাজা তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। গোধূলির হলদে আলোয় রাঙিয়ে, তুমূল ঢাকঢোল পিটিয়ে সকলে ফিরলো বাড়ি। দুদিন আগেই যে মেয়েটা ছিল এবাড়ির পরম কাছের মানুষ, হেসে-খেলে বেড়াতো যে সারা বাড়িময়, সেই মেয়েটাই আজ এথায় হয়েছে আত্মীয়। সদ্য পরিণয় প্রাপ্ত অনুলেখা আজ এ-বাড়ির অতিথি!

সদ্য বিবাহিত দম্পতিটিকে প্রথমেই তাদের ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হলো না, বরং বসবার ঘরে পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখা হলো। আত্মীয়-স্বজনের ভীড় অনেক। ইতোমধ্যেই অনেকে চলে যাবার তোড়জোড় শুরু করেছেন। বিদায় নিতে আসছেন অনুলেখার কাছে। নব্য জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে; প্রাণভরে দোয়া করে, তারা একেকজন বিদায় নিচ্ছেন। অনেক্ষণ হল এই চলছে।
কিছুক্ষণ পর ওদের রেখে নাশতা আনতে ছুটলেন বড়রা। সোফায় অনু হাসিমুখে বসে। কিন্তু কেমন উসখুস করছে মাহাদ। যেন বসে থেকে স্বস্তি পাচ্ছে না। ক্রমাগত এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। অনু চাপা গলায় শুধালো,
— “হয়েছে কি তোমার? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন? কাউকে খুঁজছ?”
মাহাদ অন্য দিকে তাকিয়েই বললো,
— “আচ্ছা, চারুভাবীকে দেখছি না যে? কাল বিয়ের আসরেও তো ওনাকে দেখলাম না? আমাদের বাড়িও তো যায় নি বোধ হয়—”
চারুর নাম শুনতেই ভ্রু কুঁচকে এলো অনুর। ত্যক্ত গলায় বললো,
— “যাবে কি করে? যাওয়ার মুখ থাকলে তো!”
মাহাদ কেমন যেন চোখে তাকালো। অবাকের সুরেই বললো,
— “এভাবে বলছ কেন? ইট ওয়াজ অ্যান এম্ব্যারেসিং সিচুয়েশন ফর বোথ ওফ্ দেম। ভাইয়ার জন্যও, আর ভাবীর জন্যও। কিন্তু আমার কথা হলো, এ-বাড়িতে তার দেখা নেই কেন? উনি কি এই বিয়েটাতে খুশি হন নি?”
— “যাও যাও। ওর খুশি-অখুশির দাম কে দিচ্ছে!”
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলো অনু। বোনের সম্পর্কে ওর এহেন উদাসীন মন্তব্য মাহাদ কে ভাবিয়ে তুললো। বরাবরই দেখছে, অনু এ ব্যাপারে একটু কেমন যেন! সন্দিহান হয়ে জানতে চাইলো,
— “তারমানে চারু ভাবী এই বিয়েটায় নাখোশ? তাই উনি নেই?”
অনু বিপাকে পড়লো। কি মুসিবত হলো! মাহাদ কেন বারবার চারুর প্রসঙ্গ টানছে? ওদের মধ্যে তাকে আনার কি প্রয়োজন? অগত্যা বললো,
— “ও বাড়িতেই আছে, আর খুশিও হয়েছে। বিয়েতেও ছিল তুমি হয় তো দেখো নি।”
— “আর এখন?”
খুব বিরক্ত হলো এবারে,
— “তুমিও তো মাত্র এলে, আমিও মাত্র এলাম। তো কি করে বলবো কে কোথায়?”
অন্য দিকে তাকালো। মাহাদের এই জাতীয় কথাবার্তা তার পছন্দ হচ্ছে না। একদম না! মাহাদ কিন্তু দমে গেল না। স্ত্রীর কোমল হাত দুটো শক্ত করে ধরলো। অনুকে ফেরালো নিজের দিকে। নমনীয় স্বরে বললো,
— “শোনো, অনু। কখনো কাউকে কষ্ট দেবে না। যদি ভুল করেও দিয়ে ফেলো তবে মাফ চেয়ে নিবে। কাউকে কষ্ট দিয়ে কিন্তু কখনোই পার পাওয়া যায় না! সেই কষ্ট কোনো না কোনো ভাবে ঠিকই ফিরে আসে নিজের দিকে।”
অনু বুঝেও না বোঝার ভান করলো,
— “এসব বলছো কেন? আমি কাকে কষ্ট দিলাম?”
— “কষ্ট দাও নি হয় তো। কিন্তু তবুও বললাম। আমাদের এই বিয়েটা অনেকেই পছন্দ করে নি, অনু। ভাইয়া-ভাবীর গল্পে বিচ্ছেদটা না থাকলে হয় তো এমন হতো না। কিন্তু কি আর করা— আমি চাই না, এ নিয়ে তোমার কারো সঙ্গে মনোমালিন্য থাকুক। যদি থেকে থাকে তবে তুমি সেটা ঠিক করে নেবে। ঠিক আছে?”
ওর দু’ গালে হাত রেখে কথাগুলো বললো মাহাদ। কথাগুলো ভালো না লাগলেও স্বামীর মন রক্ষার্থেই ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলো অনু। খুশি হয়ে ওর কপালে উষ্ণ চুম্বনের পরশ বুলিয়ে দিলো মাহাদ! সে চায় না, তাদের নতুন জীবনে কোনো দুঃখ আসুক। কারো হতাশার হাহাকার লাগুক! সে চায়, সুখী হতে! ভীষণ রকমের সুখী হতে!
___

রাতের খাবার শেষে সবে ঘরে ঢুকেছে নিখিল। এসেই দেখলো, সৌভিক ইতোমধ্যেই মশারি টাঙিয়ে প্রস্তুত করে ফেলেছে শয্যা। কাঁথা-টাথা খুলে গায়েও পেঁচানো শেষ! নিখিল হাসলো,
— “কি রে? ন’টা নাই বাজতে ঘুম?”
— “বাজে নি কে বলেছে? দেখ তো, ঘড়ির দিকে! ন’টা তেতাল্লিশ বাজে! একটু পর দশটা বাজবে।”
দেয়াল ঘড়ির দিকে ইশারা করলো। ওর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে নিখিলও চাইলো ওই দিকে। অতঃপর হাসলো খানিক,
— “তা না হয়, বাজলো। কিন্তু তারপরও। দশটায় ঘুমিয়ে যাবি, এটা কোনো কথা? লোকে শুনলে কি বলবে?”
— “লোকের কথায় আমার কি? ওরা কি জানে, দু’দিন ধরে ঘুম হয় না আমার? ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছি – ঝক্কি কতো জানে? কতো খাটনি!”
ঠোঁট বেঁকালো সৌভিক। নিখিল হাসলো আবারও,
— “ও বাবা! খুব পরিশ্রম গেছে, না? কাজ করে তো একেবারে উল্টে দিয়েছ তুমি! দেখলাম না?”
— “হ্যাঁ, দেখলিই তো।”
তারপর মাথা চুলকে বললো,
— “কথা বাদ দিয়ে ঘুমোতে আয় তো। চটপট শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দেব।”
নিখিল এলো ঠিকই কিন্তু শুয়ে পড়লো না। আধশোয়া হয়ে বসলো। বন্ধুকে প্রস্তাব দিলো,
— “এত তাড়াতাড়ি ঘুমোতে ভাল্লাগছে না। চ’ গল্প করি?”
সৌভিক বিরক্ত হয়,
— “কি গল্প করবি? তোর বৌ-বাচ্চার? বিয়ে করেছিস তুই?”
নিখিল কপট লাজুকতায় মুড়িয়ে নেয় নিজেকে,
— “করিনি। কিন্তু করতে কতক্ষণ?”
— “আচ্ছা?”
নড়েচড়ে বসলো সৌভিক। এবার কথার বিষয় খুঁজে পেয়েছে সে। বিছানা থেকে বালিশটা তুলে, কোলের উপর রাখলো। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ ভ্রু নাচালো,
— “তারমানে মেয়ে তোর পছন্দ করা আছে? হু?”
বলেই ঠেলা মারে। কোনোমতে মাথা নেড়ে নিখিল সায় দিতেই, উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে সৌভিক,
— “আমি জানতাম! জানতাম তোর মধ্যে একটা খিচুড়ি পাকছে। তোর ফেইস দেখেই আমি টের পেয়েছিলাম। তা বলতো, কে এই ছাম্মাক ছাল্লো? কি দেখে পাগল হইলি, মাম্মা?”
শেষের কথায় দুষ্টুমি মিশে। ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে সৌভিক। যেন, বন্ধুর মনের গোপন দুয়ার খুলে গুপ্তকথা বের করাটা কোনো মহান কীর্তি! ওর মনোভাব বুঝতে নিখিল বিব্রত হয় তাতে। কথাটা কীভাবে বলবে ভেবে পায় না! অবশেষে বলে,
— “এভাবে বলিস না। মেয়েটা খুব ভালো। তুই চিনবি।”
— “চিনবো? ও বাপ রে? কোনখানে দাও মারলি, ভাই? কে এই মেয়ে!”
নিখিল দু’ সেকেণ্ড সময় নেয় উত্তর দিতে। তারপর ঢিমে যাওয়া গলায় বলে,
— “চারু।”
আশেপাশেই কোথাও বিস্ফোরণ ঘটলো। হতবিহ্বল সৌভিক সর্বোচ্চ স্বরে চেঁচায়,
— “কীহ্?”
বিস্ময়ে হা হয়ে গেল ওর মুখ। চোখ দুটো এতো বড় করে তাকালো যে মনে হতে লাগলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই কোটর থেকে ঠিকরে বেরোবে তারা!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০৫

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৫

পরদিন বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙলো চারুর। সাধারণত সে খুব ভোরেই ওঠে। ফজরের আজান কানে পড়া মাত্রই তার সজাগ মস্তিষ্ক শরীরকে জানিয়ে দেয়, ‘উঠতে হবে। নামাজ পড়তে হবে।’ কিন্তু আজ হঠাৎ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বেশ দেরি করেই নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। এর কারণ কি কাল রাতের সেই কান্নাকাটি না অন্য কিছু — চারু জানে না!

বাড়ি ভর্তি মেহমানে। গতকাল বিয়ের মূল আয়োজন ছিল। আজ বৌভাত। এ-বাড়ির সবাই ও-বাড়িতে যাবে দাওয়াতে। তারপর খেয়ে-দেয়ে বাড়ির মেয়ে আর মেয়ে জামাই নিয়ে ফিরে আসবে হাসিমুখে — যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই তো বাঙালিয়ানা প্রথা। নিচে আসতেই চারু দেখতে পেল, ইতোমধ্যেই বৌভাতে যাওয়ার তোড়-জোড় শুরু হয়ে গেছে। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কি কি নিয়ে যাবেন সে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আজমীর রাজা। ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলছেন তিনি। চারু সন্তর্পণে বাবাকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলো।

তিন জা, দুই ননদ আর দু’জন কাজের মহিলা — বাড়ির কর্ত্রীস্থানীয় সবাই যেন রান্নাঘরে উপস্থিত। কেউ মাছ কুটছে, থালা-বাসন ধুচ্ছে, সবজি কাটছে, একেক জনের একেক কাজ। ঘরময় তাদের পদচারণা, কথাবার্তার উচ্চস্বর, হাসা-হাসিতে কলকলিয়ে উঠছে পরিবেশ। তার উপর চুলোয় কি একটা চড়িয়েছে, তেলের ছ্যাঁত ছ্যাঁত আওয়াজ। চারুকে দেখেই আমেনা বলে উঠলেন,
— “চারু? এই তোমার উঠার সময়? ঘড়িতে দেখো তো, কতো বেলায় উঠলে?”
ভর্ৎসনা নয়, ফুপুর মুখে অভিমানী সুর। চারু লজ্জায় নত শীর করে বললো,
— “দুঃখিত, ছোট ফুপু। উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে!”
ভাইঝির কথা শুনে হাসলেন আমেনা। প্রশ্রয় দিয়ে বললেন,
— “আচ্ছা, মা। সমস্যা নেই। হাতমুখ ধুয়েছ? নাশতা করবে না এখন?”
চারু ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলো। মেজ চাচী রুটি বেলছিলেন, ওর দিক প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
— “কি খাবি, চারু? রুটি না পোলাও? পোলাও কিন্তু বাসি— আর রুটি খেলে গরম গরম ভেজে দিচ্ছি।”
— “আচ্ছা, দাও।”
মাথা নাড়ে মেয়েটা। মেজো চাচী তিনটে কাঁচা পরোটা বানিয়ে ওর মায়ের হাতে দেন। চমক সেগুলো ভাজবেন তখনই আহসান রাজাকে আসতে দেখা গেল এদিকটায়। তিনি সংবাদ দিলেন, খাবার ঘরে এখন দ্বিতীয় ব্যাচ চলছে; তৃতীয় ব্যাচের খাবার প্রস্তুত করত। কিছু ঘাটতিও হতে পারে! অতএব, রান্না-বান্না দ্রুত সারতে। অতিথিদের সামনে যেন খেলো হয়ে যেতে না হয়!
চমক ব্যতিব্যস্ত হাতে কোনোমতে পরোটাগুলো ভেজে, ডিম আর আলুভাজি সহযোগে মেয়ের হাতে দিলেন। চারু আর বাড়তি করে খাবার ঘরে যাওয়ার ঝক্কিতে গেল না। ফুপুদের একপাশে বসলো টুল টেনে নিয়ে বসলো। বড় ফুপুকে জিজ্ঞেস করলো,
— “তোমরা খেয়েছ, ফুপু?”
— “না রে, খাই নি। কখন খাবো? সকাল থেকে যে দৌড়াদৌড়ি—”
উত্তরটা শুনে বেশ অবাক হয়ে চারু বললো,
— “সে কি! এখনো খাওয়া হয় নি তোমাদের? একজনও খাও নি।”
ছোট চাচী কড়াইয়ে গতদিনের বেঁচে যাওয়া মাংস গরম করতে দিয়েছেন। খুন্তি দিয়ে সেটা নাড়তে নাড়তে ওর দিকে তাকালেন। শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বললেন,
— “আর খাওয়া! কাজ করেই কূল পাচ্ছি না— তোর অতো হিসেব নিতে হবে না। তুই ঝটপট খেয়ে নে। একজন লোক অন্তত কমুক।”
এতোগুলো মানুষ না খাওয়া, অথচ চারু এখানে একা বসে গিলবে? কিছুতেই যেন মন মানলো না মেয়েটার। নরম হৃদয়ে খুব অশোভন লাগলো আচরণটা। একটু টুকরো রুটি ছিঁড়ে ভাজি লাগিয়ে দিলো বড় ফুপুর মুখে,
— “নাও নাও, হা করো।”
ফুপু প্রথমে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেও চারুর জেদের কাছে পারলেন না। টুপ করে গিলে নিলেন খাবারটা। এরপর একে-একে সবাইকেই একটু একটু করে খাইয়ে দিলো চারু। চমকের কাছে নিতেই উনি কপট রাগ করলেন,
— “নিজের মুখেও একটু দাও। এতো মানুষ কেউই একেবারে না খেয়ে নেই। নাশতায় চা-বিস্কুট সবারই জুটেছে। তুমিই শুধু বাকি।”
— “সে হোক। তুমি খাও তো!”
হাসতে হাসতে আরেকটা রুটির অংশ ঠুসে দিলো মায়ের মুখে।

সকাল হতেই ডেকোরেটরের লোক চলে এসেছে। সাজানো প্যান্ডেল খুলছে তারা। আসাদ রাজা লনে দাড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন। তদারকি করছেন সবকিছুর। কখনো শান্ত সুরে, নরম গলায় কথা বলছেন, আবার কখনো বা বেজায় চটে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন। “এই এই, এটা করছ কেন? আহ্ হা। তোমরা কি কিছু বুঝতে পারো না? আরে — ওটা করতে নিষেধ করলাম না!” — ক্ষণে ক্ষণেই তার মুখ থেকে এ-জাতীয় বাক্য শোনা যাচ্ছে। তার হম্বি-তম্বিতে ওরা সবাই অস্থির! ফলে আরও বেশি ভুল হচ্ছে কাজে, আর আসাদকেও সমানতালে চিৎকার করতে হচ্ছে!

এককাপ চা হাতে বাইরে বেরিয়েছে চারু। চাচাকে রাগ করতে দেখে এগিয়ে এলো এদিকে। কাপে চুমুক দিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো,
— “কি হয়েছে, ছোট চাচা? এতো রাগ করছ কেন? তোমার হৈচৈ শুনে তো মনে হচ্ছে ডাকাত পড়েছে বাড়িতে! এতো রাগ করলে চলে?”
ভাতিজির স্নিগ্ধ হাসিটা চোখে পড়তেই একটু থামলেন আসাদ রাজা। তার বরাবরই শর্ট টেম্পার। অল্পতেই রেগে একাকার। তবে আশার কথা হলো, বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তিনি চেঁচামেচি করেন না। রাগটাও তেমন দেখান না। তাই আজও তার তথাকথিত ‘হট’ মেজাজটাকে ক্ষণিকের জন্য দমিয়ে রাখতে হলো। খানিক হতাশামথিত কণ্ঠে বললেন,
— “রাগ না করে করবো কি, বল? এরা একেকটা যে গাধার গাধা! একটা কাজও পারে না। উপরন্তু চোর! ওদের চেয়ারের সাথে সাথে আমাদের চেয়ারও নিয়ে যাচ্ছে! আবার বলে না-কি ডেকোরেটরের দোকান খুলে বসেছে। কতোবড় জোচ্চোর বুঝতে পারছিস?—”
আবহাওয়া বেশ গরম। বিlস্ফোlরণ হতে দেরি নেই। চারু বুঝতে পেরে সাবধান হয়ে গেল। আসাদ রাজার উদ্দেশ্যে নরম গলায় বললো,
— “সেজন্যে এতো চেঁচাতে হবে নাকি? তোমার যে বিপি হাই, সে কথা মাথায় নেই? তুমি এক কাজ কর, এদিকে অন্য কাউকে দাও। কাব্য, কবির ভাই বা কাউকে। তুমি ওদিকে গিয়ে বিশ্রাম করো গে!”
ওনাকে ঠেলতে শুরু করলো। ওর কথা যেন গায়েই ফেলতে দিলেন না আসাদ রাজা। ক্ষেপাটে ভঙ্গিতে বললেন,
— “আরে, আমি না দেখলে তো সব সাফ হয়ে যাবে। কবির – কাব্যের কথা বলছিস? তোর ওই বলদ মার্কা ভাইগুলো কিছু পারে নাকি? দেখবি ওদের চোখের সামন দিয়ে পুরো বাকি ফাঁকা করে দিয়ে গেলেও এরা কিচ্ছু টের পাবে না। ওদের উপর ভরসা করে মlরবো? বড়ভাই কতো ভালোবেসে দায়িত্ব দিয়েছে—”
— “কিন্তু তাই বলে..”
ওকে কথা শেষ করতে দিলেন না। আবারো চিৎকার করতে করতে ছুটলেন প্যান্ডেলের দিকে। ওরা স্টেজ খোলার নাম করে বাড়ির টেবিলের উপরে চড়ে কেমন অসভ্যের মতো দাপাচ্ছে। গলা উঁচিয়ে তারস্বরে চেঁচালেন ফের,
— “আরে! তোমাদের টেবিল নেই? ওটা আমাদের বাড়ির— ভাঙবে তো!”
চারু কিছুক্ষণ হতাশ চোখে তাকিয়ে পা বাড়ালো।

সৌভিকদের এই বাড়িটা আকারে বেশ বড়। দোতলা ছিমছাম ধরনের সুন্দর বাড়ি। সামনে বিরাট লন। গার্ডেন সাইডে গাছের সংখ্যাও কম নয়। একান্নবর্তী পরিবারের জন্য আদর্শ। সৌভিকের দাদা আহাদ রাজার সঙ্গে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখার পর উপলদ্ধিটা আসলো নিখিলের। বৃদ্ধ আহাদ রাজার চমৎকার বাসস্থান “অরুণা ম্যানশন”– সত্যিই মনোমুগ্ধকর!
বাগানের ভেতরে একটা কটেজের মতো করা। ছোট্ট ষড়ভুজ আকৃতির ঘর, উপরে টিনের চালার মতো করে মাটির টালি বিছানো। ভেতরে বসবার জায়গা আছে। বেতের চেয়ার সাজানো, মাঝখানে কাঠের টেবিল। দেয়াল নেই বিধায় অফুরন্ত বাতাসের কারখানা। পুরো বাড়ি ঘুরে এই জায়গাটাই সবচে’ পছন্দ হলো নিখিলের। আহাদ রাজার সঙ্গে এখানেই বসলো। একটু পরেই কাজের ছেলেটা চা দিয়ে গেল ওদের। আহাদ রাজা শুধালেন,
— “তারপর, দাদুভাই? বলো দেখি, আমার বাড়ি তোমার কেমন লাগলো?”
টেবিল থেকে নিজের কাপ তুলেছিল সবে। কাপে চুমুক দিয়ে হেসে জানালো,
— “সত্যি বলতে কি, ভীষণ সুন্দর! কি পরিপাটি, গোছালো বাড়ি আপনার! সবচে’ ভালো লেগেছে এই জায়গাটা। এতো বাতাস চারপাশে! আমি মুগ্ধ!”
নিজের দারুণ কৃতিত্বের কথা শুনে কে না ভালোবাসে? সবাই তো প্রশংসাই খোঁজে! তবে নিখিল ছেলেটার কথা নিছক সৌজন্যতা রক্ষায় নয়। ওর মুখের প্রশান্ত চেহারাই সেটা বলে দিলো অভিজ্ঞ আহাদ রাজাকে। তৃপ্তির হাসি হাসলেন বৃদ্ধ,
— “এই জায়গাটা আসলেই খুব সুন্দর। আমার নাতি-নাতনিরা সবাই এই জায়গা পছন্দ করে। প্রতিদিন বিকেলে আড্ডা দেয়। হৈ-চৈ করে এখানে বসে। ওরাই ভালোবেসে এর নাম দিয়েছে “দখিন হাওয়া”! আমার বড় নাতনি চারু, ওরই বেশি শখ ছিল এই নাম নিয়ে!”
চারুর প্রসঙ্গ উঠতেই উত্তাল হলো বুকের ভেতরটা। চনমনিয়ে উঠলো সারা দেহমন। এখন বসন্ত নয়, শীতের আমেজ। তবুও ওই একটি নাম কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই যেন শরীরে বসন্ত বাতাস ছুঁয়ে দিলো। হৃদয়ে দোলা লাগিয়ে মানসপটে ভাসলো, সেই পবিত্র-স্নিগ্ধ মুখখানি। কি সুকোমল চাহনি, সরলা বালিকার ন্যায়! অজান্তেই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল,
— “অপূর্ব!”
আহাদ রাজা দাম্ভিক হাসলেন। নিজের সন্তান, নাতি-নাতনিদের গল্প বলতে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। ভালোবাসেন তার সুখী পরিবারটির গল্প বলতে!
কল্পনায় এঁকে চলা রূপসী নারীকে দেখতে বিভোর ছিল নিখিল। হঠাৎ চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেল সেই মুখশ্রী! স্মৃতিপটের অতীন্দ্রিয় দেবীর আগমন ঘটলো কল্প থেকে মর্ত্যলোকে। আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে চারু আসছে এদিকেই কোথাও। হাতে চায়ের কাপ, চুমুক দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। চারুকে দেখেই হাঁক ছাড়লেন আহাদ রাজা,
— “ও চারু? এদিকে আয় তো, ভাই!”
চট করে ফিরে তাকালো মেয়েটা। কটেজের ভেতরে বসা দাদুকে দেখতে পেয়ে প্রত্যুত্তর করলো,
— “আসছি, দাদু!”
নিখিল এক দৃষ্টিতে চেয়েই ছিল মেয়েটার দিকে। পরনের জামাটায় লালচে রঙের শেড। ওড়নাটা ধবধবে সাদার! ঘন কালো চুলে লম্বা বেণী থেকে আলুথালু কেশ বেরিয়ে। সেই গুচ্ছ গুচ্ছ এলোকেশ এসে কপালের দুপাশে দুলছে। চোখের চশমাটা নাকের ডগায় নামানো। কাচ ভেদ করে দৃশ্যমান হয়েছে ফোলা ফোলা নেত্র। চোখে চোখ পড়তেই নিখিলের হঠাৎ গতরাতের কথা মনে পড়লো। এতক্ষণ ও যেই স্মৃতিচারণ করছিল, বারে বারে মুগ্ধ হচ্ছিল, সেই উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়লো। গতরাতের ক্রন্দনরত সেই ব্যাকুল নারীর সঙ্গে আজকের দিনের আলোয় দেখা এই নারীর কতো ফারাক! রাতের রহস্যময়ী আর দিনে স্নিগ্ধতার মায়ায় জড়ানো — আসলে সে কেমন? কেন সে রাতে কাঁদলো? তাও মাঝরাতে, একা ছাদে? কোন গভীর ব্যথায়? আচ্ছা, মেয়েটা যে একা একা কাঁদে; তা কি এরা কেউ জানে? জানে কি, ওই হাস্যোজ্বল মুখের পেছনের কষ্ট কি? চারুর মুখের দিকে অনিমেষ চেয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হলো নিখিল।
___

অনুর বৌভাত। অনুষ্ঠানে অরুণা ম্যানশনে সবাই এসেছে। বাড়ির মেয়ের বৌভাত, না আসলে হয়? সবাই সেজে-গুজে, হাসি হাসি মুখ করে চলে এসেছে। দুপুরের খাবারের দাওয়াত। তারপর নববর-বধূকে নিয়ে নিজেদের বাড়ি যাবে তারা।
বেশ কিছুক্ষণ হলো একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে নিখিল। এতোক্ষণ সৌভিকের সঙ্গেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ কে যেন এসে ডাকায় ওকে রেখে চলে গেছে ছেলেটা। অগত্যা অপরিচিত বাড়িটায় একা একা ঘুরতে হচ্ছে নিখিলকে। এতে অবশ্য ও বিরক্ত হচ্ছে না। বরং, অতি আগ্রহের সাথেই সে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আর আনমনে খুঁজে বেড়াচ্ছে চারুকে। কি জানি কেন, গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে এই নামটি তার মাথা থেকে বেরোচ্ছেই না! কেমন আঠার মতো লেগে গেছে মাথার ভেতর। চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে সে। তাকে নিয়েই ওর যতো কল্পনা-জল্পনার আয়োজন চলছে! এর কারণ ঠিক প্রেম না অন্যকিছু, অনুভূতি বিশ্লেষণে অনভিজ্ঞ নিখিল নওশাদ তা জানে না!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০৪

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৪

অরুণা ম্যানশনের সবারই মোটামুটি আশঙ্কা ছিল মাহতাবকে নিয়ে। শত হোক, তারই ছোট ভাইয়ের বিয়ে। সে না এসে পারে না। কিন্তু এসে গেলেও এখানে আছে চারুলতা। তার প্রাক্তন স্ত্রী। দু’ বছর আগে ওদের সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেলেও, এমন নয় যে ওরা দু’জন দু’জনকে পুরোপুরি ভুলে গেছে! সেটা তো সম্ভবও নয়। অথচ এই উজ্জ্বল আলোকসজ্জায় সজ্জিত, রঙিন সাজের বাড়িটির চমৎকার পরিবেশে ওদের দেখা হয়ে গেলে কেমন বিব্রতকর ঘটনার সৃষ্টি হবে তা কি ভাবা যায়?
সবাই তাই দুশ্চিন্তায় ভুগছিল। কেউই চাচ্ছিল না, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে। যাতে এই সুন্দর সময়টা নষ্ট হতে পারে। থমকে যেতে পারে, ওদের আনন্দ-উল্লাস! কিন্তু ওদের ভাগ্যটা ভালো। কোনো অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলো না এ-যাত্রায়। বরের বড় ভাই, মাহতাব এলো না বরযাত্রীর সঙ্গে। কারণ হিসেবে জানানো হলো, ছোট ভাইয়ের বিয়ের এতো আয়োজন সামলে হিমশিম খাচ্ছে মাহতাব। তাদের গোছগাছ এখনো শেষ হয় নি, বিধায় সে বাড়িতেই রয়ে গেছে তার আরও কিছু আত্মীয়সহ। মাহতাবের বাবা মুনিম শেখ স্মিত হেসে এই কথা জানালেন আজমীর রাজাকে। বেয়াইয়ের মুখের কথা শুনে বাইরে একটু অসন্তোষ প্রকাশ করলেন বটে; “না, না, ভাই সাহেব কাজটা ঠিক হয় নাই। ছোট ভাইয়ের বিয়েতে আসলো না, এটা কেমন কথা?” — বলে রাগও দেখালেন খানিক। কিন্তু মনে মনে তিনি হাঁফও ছাড়লেন! মাহতাব ছেলেটা কাজটা ঠিকই করেছে না এসে। এতে, তারও মঙ্গল আর তার বড়মেয়ে চারুরও! আর এর ফলে নির্ঘাত অস্বস্তির হাত থেকে বেঁচে গেলেন তিনি এবং তার পরিবারও!

বাড়ির বড়কর্তী হিসেবে বাড়ির প্রতিটি ঘরের চাবি, প্রতিটি জিনিসের সঠিক তত্ত্বাবধান করেন চমক। তাই বাড়ির অন্য সদস্যের চেয়ে সবকিছুতেই তার কর্তব্য যেন একটু বেশিই। ছোট বৌয়েরা যতোই কাজ করুক, সাহায্য করুক, যিনি মূল তিনিই তো মূলই। এই বাড়ির প্রতিটি কাজের পরিকল্পনা, রক্ষণাবেক্ষণ সবই তার কাঁধের উপর। আর আজ তার মেয়ের বিয়ে সেখানে তার দায়-দায়িত্ব কি কম?
বিয়ের খাবারের আয়োজন, বাবুর্চির সঙ্গে বোঝাপড়া, বেচে যাওয়া খাবারের বিলি-বণ্টন, সব ঠিকঠাক করে গুছিয়ে চমক যখন শোবার ঘরে ঢুকেছেন রাত বারোটা পেরিয়েছে। আজমীর রাজা অনেক আগেই শুয়ে পড়েছেন, এতোক্ষণে বোধ হয় ঘুমিয়েও গেছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলাতে এলাতে তিনি মৃদু স্বরে ডাকলেন স্বামীকে,
— “ঘুমিয়েছ?”
আশা করেন নি কোনো জবাবের। তিনি তো জানেনই লোকটা ঘুমিয়েছে। তবুও শুধু অভ্যাসবশত ডেকেছেন। পাশ ফিরে শুতেই আজমীর সাহেবের গলা শোনা গেল,
— “নাহ্। মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। আজ কি আর ঘুম আসবে, বলো?”
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চমক বললেন,
— “এক মেয়েকে বিয়ে দিলাম, আরেক মেয়েকে কষ্ট দিয়ে। যে বাড়িতে বড় মেয়ের জায়গা হলো না, সে বাড়িতেই ঢাকঢোল পিটিয়ে ছোট মেয়েকে পাঠাচ্ছি। আমরা কেমন বাবা-মা?”
— “কাজটা ঠিক হয় নি, জানি চারুর মা। কিন্তু কি করতাম? তোমার ছোট মেয়ের যে জেদ!”
চুপ করলেন আজমীর রাজা। সন্তান স্নেহের কাছে তারা সবাই বাঁধা। এক সন্তানের জন্য তারা আরেকজনকে কষ্ট দিতে পারেন না। চারুর দুর্ঘটনাটা হওয়ার পর, তারা চেয়েছিলেন অনুর অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে। কিন্তু মেয়ে রাজী হয় নি। জানিয়েছে, মাহাদকে সে ভালোবাসে। বড় বোনের জীবনের দুর্গতির জন্য, নিজের ভালোবাসাকে ত্যাগ করতে পারে না। তারপরও যদি তারা ওকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালান, তবে মেয়ে ভালো-মন্দ কিছু একটা করে ফেলতে দ্বিধা করবে না!
এই নিয়ে বাড়িতে বহুৎ ঝগড়া-অশান্তি হয়ে গেলেও জেদী মেয়েটা নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়ে নি। মার খেয়ে পর্যন্ত অটল থেকেছে নিজের কথায়। মেয়ের সঙ্গে রাগ করে দীর্ঘদিন কথা বলা বন্ধ করেছিলেন আজমীর রাজা। কিন্তু শত হোক, নিজের মেয়ে। সে যতোই খারাপ হোক, অবুঝ হোক, তারা তো তার খারাপ চান না। কোনোভাবে ক্ষতি করতেও পারেন না। তাই বড় মেয়েকে কষ্ট দিয়ে হলেও ছোট মেয়ের ইচ্ছে তারা রেখেছেন। বিয়ে দিয়েছেন পছন্দের মানুষের সঙ্গে!
ভাবনার সুতো ছিঁড়লো স্ত্রী চমকের কথায়,
— “থাক, যা হবার হয়েছে। মেয়েটা যদি খুশি থাকে তো সব ঠিক। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখী হোক, দোয়া করি। বাবা-মা হয়ে সন্তানদের দুঃখ তো দেখতে পারি না। একে চারুর অবস্থা দেখলে আমার ভালোলাগে না। ওর কোমল মুখটা দেখলে বুকভার হয়ে আসে। শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। তাতে অনুর যদি কিছু হয়— থাক, ও নিজের মতো। যেভাবেই থাক, সুখী যেন হয়!”
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলে উঠলেন আজমীর রাজা,
— “চারুর বিয়েটা তো আমরা দেখে-শুনেই দিয়েছিলাম। ছেলে দেখতে ভালো, মাইনেও ভালো, পরিবার-বংশ — সব দেখেই তো—”
অনুশোচনায় দlগ্ধ মন। আত্মজার দুর্দশায় আদ্র হলো মাতৃ হৃদয়,
— “এতো ভালো মেয়ে আমাদের। এতো নম্র-ভদ্র! কখনো কারো মুখের উপর কথা বলে না। রাগ করে না। কি শান্ত-শিষ্ট থাকে সবসময়, সেই মেয়েটার কপালে এমন হবে কেন? ওর কপালে কি আল্লাহ্ আর ভালো কিছু দিতে পারলো না? এতো কষ্ট রাখতে হলো ওর ভাগ্যে? কোন দোষের শাস্তি পাচ্ছে মেয়েটা?”
বলতে বলতেই গলা ভারী হলো। আঁচলে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন তিনি। শুনশান নীরবতার নিঃস্তব্ধ গভীর রাতে স্ত্রীর এই মৃদু ফোঁপানির আওয়াজ যেন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো না আজমীর রাজার কানে। একহাতে পৌঢ়া স্ত্রীকে আগলে সান্ত্বনাবাণী উচ্চারণ করলেন,
— “এটা আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি হয় তো এই ছোট কষ্টটার বিনিময়ে আমাদের চারুকে অনেক বেশি সুখী করবেন। হয় তো ওর জন্য এমন কোনো উপহার তিনি তৈরি করে রেখেছেন, যাতে ওর ভবিষ্যৎ অনেক সুন্দর হবে!”
— “তাই যেন হয়, গো। তাই যেন হয়!”
কাঁদতে কাঁদতেই মেয়ের জন্য প্রার্থনা করলেন তিনি। সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে স্ত্রীর প্রার্থনায় সহযোগী হলেন আজমীর রাজা। গভীর রাতে তাদের এই হাহাকার মিশ্রিত মোনাজাত সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো কি কর্ণগোচর হলো? কেউ কি জানলো, সন্তানের ভবিষ্যৎ আশঙ্কায় কি নিদারুণ যন্ত্রণা বুকে পুষে বেঁচে আছেন দু’টি মানুষ?
___

সন্ধ্যায় ঘুমোনোর কারণে রাতের খাবারটা আর খাওয়া হয় নি চারুলতার। ফলশ্রুতিতেগভীর রাতে ক্ষুদা পেয়ে গেল ওর। দেড়টার সময় ঘুম ভেঙে বেচারী উঠলো পেটের জ্বালায়!
এমন নয় যে কেউ তার খোঁজ-খবর রাখে না বিধায় তাকে অভুক্ত থাকতে হয়েছে। বরং সে নিজেই ঘুমোতে যাবার আগে বড় ফুপুকে বলেছে রাতে খাবে না। বড় ফুপু প্রথমে একটু বুঝানোর চেষ্টা করেছেন; ও যখন কিছুতেই বুঝলো না তখন খুব রাগ করেছেন, ধমকি-ধামকি করে বলেছেন তার মাকে বলে দেবে। চারু সেসবকে কাঁচকলা দেখিয়ে ঘরে গিয়ে বিছানাকে আঁকড়ে ধরেছিল। প্রচণ্ড মাথা ব্যথাকে ছুটি দিতে, একটা ব্যথানাশক ওষুধ গিলে পরে ছিল বালিশ নিয়ে। কিন্তু সেই সাধের ঘুমটা ভেঙে গেল তার এই ক্ষিদের যন্ত্রণায়!
নাহ্, আর পারা যাচ্ছে না। পেটে বালিশ চাপা দিয়ে বিছানায় মোচড়া-মুচড়ি করে দাবানলের মতো ক্ষুধাকে আটকানো যাচ্ছে না। অগত্যা রাত দেড়টায় চারুকে উঠতেই হলো, বেরোতেই হলো খাবারের সন্ধানে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে এসে ড্রয়িং স্পেসে আসতেই চারুর চোখে পড়লো একগাদা ঘুমন্ত মানুষকে। সোফা আর টি-টেবিল সরিয়ে মাঝখানে বেশ বড়সড় ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেছে। সেখানে বড় একটা তোষক বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে ক’জন। সৌভিকসহ সবগুলো ব্যাচেলর কাজিনকে দেখা যাচ্ছে। কারোরই অবস্থা বিশেষ ভালো না। একেকজন একেক ভাবে শুয়েছে, বেঘোরে ঘুমের মাঝে কেউ কেউ তোষক ছাড়িয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে, কেউ বালিশবিহীন হয়ে হা করে ঘুমোচ্ছে, কেউ নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার বংশধর হয়ে চার-হাত-পা ছড়িয়েছে, কেউ আবার পাশের জনের গায়ে উঠে পড়েছে, অন্যের পেট জড়িয়ে ধরেছে — একঝলক ওদের অবস্থা দেখে চোখ সরিয়ে নিলো চারু। ইসস, কি একটা অবস্থা! এভাবে কেউ ঘুমায়?
সাবধানে ওদের পাশ কাটিয়ে এগোলো রান্নাঘরের দিকে। মিটসেফ বা ফ্রিজে খুঁজতে হবে, যদি কিছু পাওয়া যায়। তার ক্ষুধা নিবারণের জন্য! কয়েক পা এগোতেই কথাগুলো কানে এলো ওর, চমক আর আজমীর রাজার কথোপকথন। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা, তার মন্দভাগ্য নিয়ে আহাজারি!
কারো দরজায় আড়ি পাতার অভ্যাস চারুলতার নেই। সে জানে কাজটা অত্যন্ত গর্হিত, অনুচিত। কিন্তু তবুও সে দাড়াতে বাধ্য হলো। সত্যি বলতে, তার পা দুটো আসলে অসাড় হয়ে আসছিল। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল অবর্ণনীয় কষ্টে! নিজের হতভাগ্য নিয়ে চারু দারুণ লজ্জিত। তার কি উচিৎ ছিল না, বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর? তাদের একদণ্ড শান্তির ব্যবস্থা করবার? অথচ সে অপারগ হয়ে বসে! তালাকের তকমা নিয়ে ঘরে ফেরা নারী!
কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে চোখের কোণে জল জমেছে টের পায় নি মেয়েটা। হুশ হলো যখন নোনা অশ্রুকণা কার্নিশ উপচে গড়িয়ে পড়লো, তখন! বিবশ হাতটা গালে ছুঁইয়ে খুব সংগোপনে জল মুছলো চারু। তারপর ত্রস্ত পায়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। মুহূর্তেই ভুলে গেল, তার ব্যক্তিগত প্রয়োজন, ক্ষুন্নিবৃত্তির কথা!

এক দৌড়ে ছাদে এসে হাজির হলো চারুলতা। মাঝরাতে ছাদে আসা যে ওর মতো একটা মেয়ের উচিৎ নয়, এটা ও ভুলে গেছে এখন। সব ভুলে গিয়ে ছাদে এসেছে শুধু একটু স্বস্তির জন্য। একটু নিরিবিলি খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ার জন্য।
আকাশে চাঁদ আছে, কিন্তু তা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে। নিঝুম রাতের হিমশীতল সমীরণ বয়ে চলেছে ক্ষণে ক্ষণে। গাছের ডালে ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে একটানা। এই সুন্দর, মোহনীয় রাতের ফিনিক ফোটা জোৎস্নায় একটি মেয়ে একা দাড়িয়ে ছাদে! হু হু করে কেঁদে যাচ্ছে অপরূপ রূপবতী সেই মেয়ে! নীরব প্রকৃতির কাছে যেন নিজের দুঃখটা উজাড় করে দিচ্ছে। ব্যাকুল হয়ে নিজের সমস্ত আক্ষেপ, আফসোস, যন্ত্রণা ব্যক্ত করছে। চোখের জলে ধুয়ে ফেলছে সব বেদনা আর না বলা আহাজারি!
আপনমনে কাঁদতে ব্যস্ত চারুলতা। হঠাৎ শুনলো কার যেন কণ্ঠস্বর,
— “কে? কে ওখানে?”
ঝিঁঝিঁ ডাকা নিশ্চল রাতে গমগমে মনুষ্যধ্বনি কর্ণগোচর হতেই চকিতে ফিরে তাকালো চারু। জলভরা ঝাপসা চোখে সিঁড়িঘরের উল্টোদিকে কে যেন দাড়িয়ে আছে। পুরুষ দেহাবয়ব। ওকে ঘুরে তাকাতে দেখেই সে এগিয়ে ফের প্রশ্ন করলো,
— “কে? চারুলতা?”
আকস্মিক চাপে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। বিস্ময়ের রেশ কাটতেই লোকটার দিকে ভালো করে তাকালো। উচ্চতায় গড়পড়তা বাঙালির মতো, তবে বাঙালিদের ননীযুক্ত শরীর নয়। মেদহীন; সুঠাম। হঠাৎ করে চাইলে যেন পুরুষালি সৌষ্ঠব আলাদা করে নজরে পড়ে। এই অপরিচিত লোকটি ঠিক কে চারু চিনে উঠতে পারে না! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই লোকটি একেবারে ওর সম্মুখে এসে দাড়ায়। বিহ্বল নয়নে বলে,
— “আপনি কাঁদছেন?”
প্রশ্নটা যেন চারুকে নয়, সে নিজের মনেই করলো। চারু জবাব না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। লোকটাকে সে চিনতে পেরেছে। সৌভিক ভাইয়ার বন্ধু; নিখিল নওশাদ। তার জন্য পুরোপুরিই অপরিচিত একজন মানুষ। এরকম কারো সামনে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা, বেদনা প্রকাশ করে দেয়ার মত মেয়ে সে নয়। নিজের হতভাগ্যের বর্ণনা কাউকে বলে, সহানুভূতি কুড়ানোর মানসিকতাও ওর নেই। চোখ মুছে ওর দিকে না চেয়েই পাল্টা প্রশ্ন করলো,
— “আপনি? এতরাতে এখানে কি করছেন? ঘুমাতে যান নি কেন?”
সহসা কথা বলতে পারলো না নিখিল। নির্বাক দৃষ্টিতে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো জোৎস্না স্নাত চারুকে। চারিদিকের নিঃস্তব্ধ নিরালোকের মাঝে অতীন্দ্রিয় দেবীর মতো রূপবতী নারীর ক্রন্দনরত মুখশ্রী, অদ্ভুত রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছে। সেই রহস্যময়ীর ভেজা চোখের দিকে অনিমেষ চেয়ে ঢিমে যাওয়া গলায় নিখিল শুধায়,
— “একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি। এতরাতে না ঘুমিয়ে আপনি কি করছেন? এই একা ছাদে, খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে— কীসের ব্যথায়, কার জন্য কাঁদছেন? কেন ব্যাকুল হয়ে বিসর্জন দিচ্ছেন নিজের মূল্যবান অশ্রুজল? বলুন, এই প্রশ্ন কি আমি আপনাকে করতে পারি না?”
কণ্ঠে আশ্চর্য মাদকতা মিশে। নিচু স্বর অথচ প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট করে উচ্চারণ করা। বলার ভঙ্গিতেও একটা দুঃখবোধ আছে। না, সে ওর জন্য নয়, নিজেরই জন্য বোধ হয়!
অতলস্পর্শী সেই কণ্ঠের ঝংকারে বিমুগ্ধ হয় চারু। মনে হয়, এতো সুন্দর মায়াময় সুরে যে তার দুঃখ জানতে চাইতে পারে, নির্দ্বিধায় যেন তাকে সবটা বলে দেয়া যায়! কিন্তু সে কি করে বলবে, তার অন্তরের গভীরতম স্থানে, একান্ত নিভৃতে যে ব্যথা আছে — সে কথা?
তুষের আগুনের মতো যে জ্বালা তার অন্তরে অচিন কোণে! সতেজে প্রত্যুত্তর করলো,
— “না, পারেন না। আপনি এ-বাড়ির মেহমান। সে হিসেবে মেহমান কেন না ঘুমিয়ে ছাদে পায়চারি করছে তা জানতে চাওয়া আমার কর্তব্য। কিন্তু আমার বিষয়ে আপনার প্রশ্নটা ঠিক যায় না। অধিকার থাকে না।”
নিখিল একটুও দমে না গিয়ে বলে,
— “অধিকার না থাক। নিতান্ত সৌজন্য রক্ষার্থে হলেও আমি কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারি?”
অন্য দিকে ফিরে চারু। ওকে কিছু বলতে না দেখে নিখিল স্মিত হাসে,
— “প্রশ্নটা ব্যক্তিগত পর্যায়ের হয়ে গেছে, বুঝতে পারছি। আসলে মাঝরাতে একটা মেয়েকে নির্জনে একাকি কাঁদতে দেখে কৌতুহল জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। তাই বলে ফেলেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না।”
বলে একপল তাকায় নীরব চারুর পানে। ওর মৃদু ঘাড় নাড়াতেই ফের বলে,
— “অনধিকার চর্চা হচ্ছে জানি, তবুও না বলে পারছি না। কান্না কোনো কষ্টের শেষ করতে পারে না। যদি পারতো তবে পৃথিবীতে দুঃখ বলতে কিছু থাকতো না। ধৈর্য ধরে বিপদকে হাসিমুখে জয় করুন। সৃষ্টিকর্তা আপনার পাশে থাকবে। দেখবেন, দিনশেষে বিজয় সুনিশ্চিত। আমি কথাপাগল মানুষ, কথা বলতে ভালোবাসি। তাই বলে ফেললাম এসব। নিজগুণে ক্ষমা করবেন। আর একটা কথা মনে রাখবেন, চাঁদের মুখে কান্না মানায় না। তাকে উজ্জ্বল হাসিতেই শোভা পায়।”
চাঁদের সঙ্গে তুলনা দেয়ায় চমকে উঠে চারু। নিখিলের অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে আড়ষ্ট বোধ করে। নিখিল চমৎকার হেসে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে শেষ কথাটা বলে যায়,
— “কষ্ট থাকুক আর যাই থাকুক, এখন হাসিমুখে গিয়ে চোখ বুঁজুন। বোনের বিয়েতে কাজ অনেক। না ঘুমালে চলবে? আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বলে ছাদে এসেছিলাম, হাওয়া খেতে। এখন ঘুম পাচ্ছে। আসছি!”
নিখিল চলে যাবার পরও সেখানে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকে চারু। একটা অপরিচিত লোক তাকে নিয়ে কতো কি বলে গেল, অথচ সে নির্বাক-নিশ্চল!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০৩

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৩

নাচ শেষ করে সৌভিকদের কাছেই আসতে দেখা গেল কবির – জাবিনকে। ওদের দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো সৌভিক। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
— “আরে, ভাইয়া! তোমরা তো ফাটিয়ে দিয়েছ একেবারে!”
— “তাই, না?”
হাসলো ওরা দু’জনেই। নিখিলের সঙ্গে তখন পরিচয় করিয়ে দিলো সৌভিক,
— “দোস্ত, এই যে আমার বড় ভাই-ভাবী। এদের কথাই তো বলছিলাম তোকে। আর ভাইয়া, এ হলো নিখিল। আমরা সহকর্মী হলেও সম্পর্কটা একদম বন্ধুত্বের।”
কবির হাত বাড়িয়ে দিলো নিখিলের দিকে। করমর্দন করতে করতে বললো,
— “পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো।”
— “আমারও।”
এরপর একে একে প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত হয়ে নিলো নিখিল। সৌভিকের সব ভাইবোনের সঙ্গেই দেখা হলো, কথা হলো। শুধু কথা হলো না একজনের সঙ্গে। সন্ধ্যার সেই হৃদয় হরিণী নারী, ডাগর ডাগর আঁখিতে যে দৃষ্টি মেলে ধরে, পানপাতার ন্যায় ছোট্ট মুখখানিতে যার সর্বদা মিষ্টতা লেপ্টে, সেই চারুলতারই সাক্ষাৎ পেল না নিখিল। সারা বিয়েবাড়ি জুড়ে এতো এতো মানুষের মাঝেও নিখিলের দুটি চোখ শুধু তাকেই খুঁজে বেরালো। এতো এতো সুন্দরীর ভীড়কে উপেক্ষা করে তার মানসপটে ভেসে এলো সেই সরলার সুশ্রী চেহারা। তার বলা প্রতিটি শব্দের ঝংকার বাজতে লাগলো কানে। হৃদয় মাঝে জাগলো এক গোপন সুখের ব্যথা। নিজের অজান্তেই গুনগুন করে উঠলো সদ্য প্রেমে পিছলে পড়া দামাল সাতাশের যুবক,
“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না~”
__

‘বিয়ে’ — শব্দটা দু’ অক্ষরের হলেও এটা আদৌ কোনো ছোট ব্যাপার নয়। এতে দুটি মানুষকে সারাজীবনের জন্য তো এক করে দেয়া হয়ই, সঙ্গে দুটি ভিন্ন পরিবারের মধ্যেও সৃষ্টি করে দেয় নতুন সম্পর্কের। যার সূচনা বিয়ের অনুষ্ঠান থেকেই। মুসলিম মত অনুসারে বিয়ের কালেমা পড়তে আর রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করতে কখনো মিনিট বিশেকের বেশি লাগে না। অথচ এই ছোট্ট কাজ সারবার জন্য কতো যে আয়োজন মানুষ করে, তার ইয়াত্তা নেই। গায়ে হলুদ, মেহেদী কতকিছু করে, বিয়ে! আবার সেই বিয়েতেও কি কম ঝক্কি?
অন্যান্য বিয়ের ক্ষেত্রে যা হয়, গাড়ি থেকে বর নামতেই সারা বাড়িতে সাড়া পড়ে যায়, “বর এসেছে, বর এসেছে!” তার সঙ্গে সঙ্গেই উঠতি বয়সী সব ছেলেপুলেরা ভীড় জমায় গেটের কাছে। বরের পথ আটকে তারস্বরে চেঁচায়,
— “টাকা দাও, নইলে ভেতরে যাওয়া হবে না!”
বরপক্ষ প্রথমে রাজী হলেও কনেপক্ষের আকাশছোঁয়া চাহিদা দেখে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দু’ পক্ষের চলে কাচা বাজারে সবজি কেনার মত দরকষাকষি। পরিবেশ সরগরম হয়ে উঠে মুহূর্তেই। চিৎকার – চেঁচামেচিতে মুখরিত হয় সবকিছু। কয়েক প্রস্থ কথা কাটাকাটি শেষে, মুরব্বী স্থানীয় কারো হস্তক্ষেপে বর ভেতরে ঢুকবার অনুমতি পায়। মিষ্টি মুখ করে, ফুলের তোড়া উপহার নিয়ে বর হেলেদুলে গিয়ে স্টেজে বসে। আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে সেখানে চলে হাসি – ঠাট্টার আসর। কোনো একফাঁকে বরের জুতো চুরি যায়। ওই পক্ষের সব বাঘা বাঘা লোকেরা এসে ছেঁকে ধরে কনে পক্ষকে। জুতো চুরি নিয়েই ঘণ্টা দেড়েকের বিরাট ঝগড়া হতে দেখা যায় অধিকাংশ বিয়েতে। তারপর বর-কনের খাওয়ার সময়ও চলে সমবয়সীদের নতুন মশকরা। নতুন জামাইকে কতো রকম উপায়েই যে ওরা উত্যক্ত করে! টক-ঝাল-মিষ্টির মিশেলে সময়টা দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্ণিত এই লোকরীতির দু’ একটার ব্যতিক্রম দেখা যায় বটে কিন্তু খুশির কমতি থাকে না কোথাও এক ছটাক অবধি! সবাই আনন্দ করে, উল্লাসে মেতে ওঠে। চারুর বিয়েতেও এসবই হতে দেখেছে এ-বাড়ির সবাই। বংশের প্রথম মেয়ের বিয়েতে সবাই ভীষণ আনন্দ করেছিল। গেট ধরা, জুতো চুরি থেকে শুরু করে সবটাই করেছিল ওরা সব ভাইবোনেরা মিলে। কিন্তু এবার অনুর বিয়েতে এসবের কিছুই যেন হলো না। বড়রা আয়োজনের কোনো ত্রুটি রাখেন নি। অ্যাপায়নেও কিছু কমতি নেই। তবুও সেরকম ভাবে জমলো না অনুষ্ঠান!

মূল স্টেজের থেকে বেশ দূরত্বে এসে আড্ডা সাজিয়েছে ওরা। ছোট ফুপু দেশে আসতে পারেন নি বলে, তার ছেলে অমিত ছাড়া এখানে প্রায় সব ভাইবোনই উপস্থিত। বরযাত্রী আসবার আগ পর্যন্ত ওরা নিজেদের মতো হুল্লোড় করেছে। কিন্তু আপাদত সবাই। যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ফোন স্ক্রোল করতে করতে কখনো বা দুটো কথা বলছে। ঋতু একবার ছোট দুই বিচ্ছুকে খোঁচা দিলো,
— “কি রে, রিংকু-টিংকু দুলাভাইয়ের জুতো চুরি করবি না?”
রিংকু বিরস বদনে বোনের দিকে তাকালো। কিছু বললো না। বড় ফুপুর ছোট মেয়ে প্রমি, ঋতুর ব্যাচমেট। জিগরি দোস্ত ওরা একে-অপরের। বান্ধবীর কথায় সায় দিয়ে বললো,
— “তাই তো রে, বিয়ের এতো ইম্পর্ট্যান্ট একটা সেগমেন্ট তোরা বাদ দিয়ে দিবি? এক্কেবারে বাতিলুন?”
বলেই চাপড় দিলো টিংকুর কাঁধের উপর। টিংকু মহাবিরক্ত হয়ে ওর হাতটা সরিয়ে দিলো,
— “তোমার এতো শখ থাকলে তুমি যাও, না। চুরি করো গে! আমাদের সাধছ কেন?”
— “না, বাবা। দরকার নাই।”
— “তাহলে আমাদের গুঁতোগুঁতি করছো কেন?”
মুখভার করে বসে রইলো ঋতু। এ ঘটনায় আশেপাশের কারো ভাবান্তর হলো না। শুধু একপ্রান্তে বসে থাক নিখিলের এই বিষয়টা কেমন খটকা লাগলো। এটা বিয়েবাড়ি, এখানে বর-কনে দু’ পক্ষেই আছে, তাদের মধ্যে বেয়াই-বেয়াইন সম্পর্কের মিষ্টি ঝগড়া হবে, হৈচৈ করবে, আমোদে-আহ্লাদে আনন্দ করবে — অথচ সেরকম কোনো ব্যাপার যেন চোখে পড়ছে না। শুরুতে তাও যা গান-টান গাইছিল, নাচানাচি করছিল, এখন আর কারো তেমন আগ্রহ নেই। কেমন বিমর্ষ হয়ে বসে আছে সবগুলো!

নির্বিঘ্নে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। সে সময়ও এরা কেউ জায়গা ছেড়ে উঠলো না। বর – কনের ফটোশ্যুটের সময় ছোট চাচী এসে ডাকলেন ওদের। কারোর বিশেষ কোনো ভাবাবেগ হলো না। রিতা বিরক্ত হয়ে বললেন,
— “তোরা এরকম শুরু করেছিস কেন? ওখানে সবাই ছবি তুলছে, অনুটা ডাকছে তোদের। যেতে পারছিস না?”
কাব্য ভাই ফোন স্ক্রোল করছিলো। সেভাবে থেকেই বললো,
— “আমাকে এখন ডেকো না, চাচী। আমি একটা কাজ করছি।”
হতাশ হয়ে পাশে থাকা কাব্যের বৌ রাত্রির দিকে তাকালেন রিতা,
— “তুমিও কি কাজ করছ?”
— “না, চাচী। যাচ্ছি।”
দোনোমনা করতে করতেই উঠে দাড়ালো রাত্রি। একে-একে টিংকু, প্রমি আর বুশরাকেও সাথে নিলেন চাচী। সৌভিক গেল না, ভীড় পছন্দ করে না বলে। জাবিন ভাবী আর ঋতু খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন করছিল, চাচীকে পাত্তাও দিলো না। ইমা মাথা ব্যথার অজুহাতে পার পেল। আর রিংকু তো সোজাসাপ্টা বলেই ফেললো,
— “শোনো মা, অনু আপার ওই আলগা ঢং দেখার জন্য তুমি আমাকে ডাকবে না। ওই ঢংগীর সাথে ছবি তোলার কোনো শখ আমার নাই।”
ছেলের এই ধৃষ্টতা দেখে তেড়ে এসে কানমলে দিলেন রিতা,
— “বিরাট শখওয়ালা হয়েছ তুমি, না? বের করছি তোমার শখ, দাড়াও!”
— “উহ্, মা! ছাড়ো তো।”
জবরদস্তি করে নিজের কানটাকে রিতার কাছ থেকে উদ্ধার করে রিংকু। তারপর আসন ছেড়ে উঠে চলে আসে নিখিলের কাছে। ওর পিছে আশ্রয় নিয়ে বলে,
— “আমি নিখিল ভাইয়ার সাথে থাকবো। তুমি যাও তো!”
বিপন্ন হয়ে নিখিল ওকে বলে,
— “তোমার মা যখন ডাকছেন তখন গেলেই ভালো হতো না, রিংকু?”
— “না। আমি যাচ্ছি না।”
একগুঁয়ে উত্তর দেয় ছেলেটা। অগত্যা রিতাকে চলে যেতে হয়। বরযাত্রীদের খাইয়ে – দাইয়ে বিদায় দিতে দিতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজলো। বিদায়বেলায় সাধারণত খুব কান্নাকাটি হয়। এখানেও ব্যতিক্রম হলো না। খুব কাঁদলো অনুলেখা। মা – চাচী – ফুপুদের গলা ধরে কাঁদলো। এতক্ষণ হাসি-খুশি হয়ে রঙিন ফানুসের মতো উড়তে থাকা মেয়েটাকে এমন হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে একটু খারাপই লাগলো নিখিলের। মেয়েদেরকে চিরায়িত এই নিয়মটা মেনে নিয়ে চলতে হয়। নিজের বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়ি গিয়ে থাকতে হয়, নিজের সারাজীবনের পরিচয়, বাবা নামক বটগাছের আশ্রয় ছেড়ে নিত্যান্ত অল্পপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত একটি পুরুষ যাকে বলা হয় তার স্বামী; তার পরিচয়ে বাঁচতে হয় — এইতো নিয়ম। সব জেনেশুনেও মেয়েটার এই অঝোরে বৃষ্টির মতো কান্না, ওর শুষ্ক মনটাকে বাষ্পীভূত করে দিলো। অনু একটু ধাতস্থ হলে ওকে গাড়িতে তুলে দিতে এগোলো সবাই। তখনই কথাটা শুনলো নিখিল, কে যেন বলছে,
— “অনু তো যাইবো গা, চারু মাইয়াটা কই? বইনের বিদায়ে থাকবো না সে?”
ভীড়ের একপাশে দাড়িয়ে পান চিবোতে চিবোতে দু’টো মহিলা কথা বলছিলেন। চারুর প্রসঙ্গ উঠতেই প্রবল আগ্রহ নিয়ে কান খাড়া করলো নিখিল। ওদের সামন দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন মহিলা। খুব সম্ভব মহিলাটি সৌভিকের বড় চাচী। পূর্বোক্ত মহিলাটি তার যেন হাত টেনে ধরে শুধালেন,
— “আপা, আপনার বড় মাইয়া কই? ছোট বইনের বিয়াত সে আইসে নাই?”
— “চারু? এসেছে তো। আসবে না কেন? আসলে, মেয়েটা একটু অসুস্থ। তাই—”
— “ওহ্ আইচ্ছা।”
বলেই পিচ করে শব্দ করে ওখানেই পানের পিক ফেললেন মহিলাটি। সৌভিকের বড় চাচী ব্যস্ততায় ছিলেন, মহিলা হাত ছাড়া মাত্রই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। তার মেয়ের বিদায় হচ্ছে, উনি যাবেন না?
তার প্রস্থানের পরপরই নিখিলের কানে ফের বাজলো দুটো কথা। মহিলা দুটি একে-অপরের সঙ্গে বলাবলি করছেন,
— “বুঝলা, রাজুর মা। চমক আপার এইসব হইলো ঢং। চারুয় অসুস্থ, না? এক্কেরে মিছা কথা। আসলে ছেরিটারে অনুষ্ঠানে এরাই আইতে দেয় নাই।”
তথাকথিত রাজুর মায়ের কণ্ঠ শোনা গেল। হাঁসের মতো ফ্যাঁস ফ্যাঁসে গলায় তিনি পরচর্চা করলেন,
— “ঠিকই কইছ তুমি। ওই ছেরি যে অলক্ষুণে— ভয় পায়, ছোটটার কপালও যদি পুড়ায়!”
বলেই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসলেন দু’জন। নিখিলের বিরক্ত লাগছিল কথা শুনতে। সে আশা করেছিল এরা চারুলতার সম্বন্ধে ভালো কিছু বলবে। ক্ষণিক দেখায় সেই হৃদহরিণীকে নিয়ে এমন কিছু বলবে যা শুনে সে তার কর্ণকুহর ধন্য করবে, প্রাণ জুড়াবে। বাকিটা রাত ওই মনমোহিনীকে নিয়ে মিষ্টি মিষ্টি স্বপ্ন দেখে পার করবে। কিন্তু কথাবার্তার ধরনে বুঝলো, এদের চরিত্র বাংলা সিরিয়ালের অতি পরিচিত সেই কুটিল মহিলাদের মতোই। যাদের কাজই হলো, অন্যের পিঠ-পিছে বদনাম রটানো। ত্যক্ত হয়ে বেরোতে চাইলো এখান থেকে কিন্তু ভীড় কাটিয়ে বেরোনো গেল না। রাজুর মায়ের বিশ্রী হাসির সাথে শুনতে পেল; তাদের এতক্ষণের বোগাস আলাপকে পাত্তা না দিলেও এই কথাটা তার ভেতরে একটা খচখচানির সৃষ্টি করলো,
— “কথায় আছে না, অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর,
অতি বড় সুন্দরী না পায় বর? ওদের চারুর সেই দশা! হা হা।”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০২

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০২

চোখ মেলার পর নিজেকে একটা অপরিচিত পরিবেশে আবিষ্কার করলো নিখিল। চারপাশে হৈ-চৈ; উচ্চস্বরে বাজতে থাকা গানের ছাড়াছাড়া অংশ কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো হুড়মুড়িয়ে। একমুহূর্তের জন্য সে চমকে উঠে ভাবলো, ‘এটা তো তার ব্যক্তিগত কক্ষ নয়। তার কক্ষের শান্ত – স্নিগ্ধ ভাবের বদলে এতো চেঁচামেচি, কলরব কোথা থেকে আসছে?’ বিস্ময় নিয়ে চোখ পিটপিট করতে করতে আশে-পাশে তাকাতেই নজরে এলো, পাশের বালিশে সৌভিকের ঘুমন্ত মুখখানি। সাথে সাথেই মনে পড়লো নিজের অবস্থান। ক্ষনিকের উত্তেজনা খামোশ হয়ে স্মৃতিপটে ভাসলো, ছুটি কাটাতে সৌভিকের সঙ্গে ওর বাড়িতে এসেছে; ওরই জোরাজুরিতে। এখানে একটা আয়োজন চলছে, সৌভিকের কোন বোনের বিয়ে সে উপলক্ষ্যে। তাই হয়তো এতো আওয়াজ। গানবাজনার হিড়িক!
ট্রেনের দীর্ঘ ভ্রমণের পর অবসন্ন শরীর নিয়ে তিনটের দিকে ওরা এসে পৌঁছে এ-বাড়িতে। তারপর কোনোমতে মধ্যাহ্নের আহারটুকু সেরে, সৌভিকের ঘরে এসে বিছানায় গা’এলিয়ে দিতেই ঘুম নেমে এলো চোখে। আর এইমাত্র জেগে উঠলো!
নিখিলের চটকা ভাঙলো একটা রিনরিনে কণ্ঠের ধ্বনি শুনে। বাইরের এতো কোলাহল ভেদ করেও কানে বাজলো একটা কিন্নরী সুর,
— “ভাইয়া, দরজা খোল!”
সঙ্গে করাঘাতের আওয়াজ। নিখিল পাশ ফিরে সৌভিককে ডাকে,
— “দোস্ত? কে যেন এসেছে! নক করছে বাইরে। ওঠ!”
চোখ না মেলেই আলসেটা শুধায়,
— “কে?”
— “আমি চারু। দরজা খোলো। জলদিই!”
— “হুঁ।”
বলেই মাথার নিচের বালিশ টেনে, কানে চাপা দেয় সৌভিক। নিখিল বিরক্তিতে হাল্কা ঝাঁকি দেয় ওকে,
— “আরে হুঁ কি? ওঠ, কে যেন এসেছে। দরজাটা খুলে দে।”
সৌভিকের হেলদোল নেই। মটকা মেরে পড়ে রয়েছে বিছানায়। ওদিকে দরজার ওপাশে ক্রমাগত নক করেই চলেছে চারু নামের মেয়েটা। নিখিল আবার ঠেলা মারলে বাধ্য হয়েই চোখ মেলে সৌভিক। মুখ ঘুরিয়ে উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করে,
— “কি হয়েছে?”
তারপর ওর দিকে এলপল চেয়ে অনুরোধের সুরে বলে,
— “বোধ হয়, ঘরের কিছু লাগবে। তুই একটু কষ্ট করে দরজা খুলে দিয়ে আয় তো। কি লাগে, এসে নিয়ে যাক ঘর থেকে। আর যদি, বাইরে যেতে ডাকে তো বলিস, আমরা পড়ে যাবো। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে!”
বলেই কাঁথা দিয়ে কান-মাথা পেঁচিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়!
অগত্যা উঠতে হয় নিখিলকেই। ঘুমঘুম চোখ দু’টো নিয়ে কোনোমতে দরজা খুলতে গিয়েই ঝটকাটা খেল!
সম্মুখে দাড়ানো চশমা পরা একটি রূপবতী তরুণীকে দেখে যেন বুকের ভেতর দামামা বেজে উঠলো ওর। শিরায় শিরায় ছলকে উঠলো র|ক্ত, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া সম্ভবত নিয়ম ভেঙে থেমে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য!
মেয়েটি আনমনে কথা বলছিল। বলতে বলতেই হঠাৎ তার দিকে ফিরলো, আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘোর বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— “আপনি কে?”
চটকা ভাঙতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো নিখিল। মেয়েটাকে ও আগে দেখে নি। তাই ওর পরিচয় জানে না। সম্ভবত নিখিলের কোনো বোন-টোন হবে। রমণী দ্বিতীয়বার মুখ খুললো, তবে আগের মত অস্বাভাবিক ভাবটা এবার তার চেহারায় নেই। বেশ নম্র কিন্তু সতেজের সাথেই বললো,
— “কিছু মনে করবেন না। আপনার পরিচয়টা কি আমি ঠিক জানি না। তাই চিনতে পারছি না। আপনি কে, কার কি হন, সেটা বললে আত্মীয়তার সম্পর্কটা বুঝতে সুবিধা হতো।”
ফর্মাল ভঙ্গিতে কথাগুলো বলেই দরজা থেকে একটু পিছিয়ে দাড়ালো মেয়েটা। নিখিল ওর কায়দা করে দাড়ানো, মুখভঙ্গি দেখে হাঁফ ছাড়লো। একটু আগে মেয়েটার প্রতিক্রিয়া দেখে ও বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিল। না জানি, কার পাল্লায় পড়েছে–কেমন আচরণ করে! কিন্তু শির দাড়া সোজা করে মেয়েটার এই দাড়ানোর ভঙ্গি, ছোট পানপাতার মতো সুশ্রী মুখখানি আর তার শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ লোচনের কড়া নজর দেখে বোঝা গেল, সে অবুঝ-নাদান বালিকার মতো অপরিচিত একটি লোককে দেখেই চিল্লিয়ে হুলস্থুল করবার মতো নয়। কিছু জ্ঞান বোধ নিশ্চয়ই রাখে!
কপাট থেকে হাত সরিয়ে প্রতিপক্ষের মতো সটান দাড়িয়ে নিখিল নওশাদ তার পরিচয় জ্ঞাপন করলো,
— “নিখিল নওশাদ। আমি ঠিক এ-বাড়ির আত্মীয় নই। আমার বন্ধুবর সৌভিক রেজার সৌজন্যে বিয়ের দাওয়াতে মেহমান হয়ে আসা। আপনি?”
চোরাচোখে লোকটার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ সেরে ছোট্ট করে বললো,
— “চারুলতা। সৌভিক ভাইয়ার ছোট বোন। দুঃখিত, আপনাকে চিনতে পারি নি।”
একটু লজ্জিত হয়ে নত হলো। নিখিল হাসলো ওর বিনয় দেখে,
— “আরে না, না। দুঃখিত হবার কিছু নেই। আপনি তো আমাকে দেখেন নি। চেনবার প্রসঙ্গ আসবে কোত্থেকে! হা হা।”
কথা সত্য। বাস্তবিকই পূর্বে তাদের সাক্ষাৎ হয় নি। অতএব, নিখিলকে চেনার কথা নয়। স্মিত হেসে প্রশ্ন করলো,
— “ভাইয়া কোথায়? ঘরে নেই?”
— “কে সৌভিক? হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঘরে আছে তো। যান!”
দরজা থেকে সরে দাড়ালো নিখিল। পথ করে দিলো চারুর ভেতরে যাবার। ও কিন্তু গেল না। সামান্য উঁকি দিয়ে বিছানায় শোয়া মানুষটাকে দেখেই ফিরে তাকালো। ঠোঁট উল্টে বললো,
— “ভাইয়া তো ঘুমোচ্ছে। আমি বোধ হয় অসময়ে বিরক্ত করে ফেললাম। আচ্ছা, আসি।”
প্রস্থানের উদ্যোগ করছিল; নিখিল শুধালো,
— “ওকে ডাকছিলেন কেন? কোনো জরুরি দরকার? থাকলে বলতে পারেন। আমি ওকে টেনে তুলছি!”
চারু স্মিত হেসে মাথা নাড়ালো,
— “তেমন কিছু নয়। আমি আসলে একটা পেইন-কিলার ট্যাবলেটের জন্য এসেছিলাম। ভাইয়া গোছালো মানুষ, ওর কাছে সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়া যায় তো।”
— “পেইন-কিলার? কেউ অসুস্থ হয়েছে না-কি?”
— “ওই সামান্য মাথা ব্যথা হয়েছে–”
— “সামান্য ব্যথায় কেউ তো ওষুধ গেলে না। অন্তত বাঙালিদের এ ব্যাপারে বিশ্বাস করা যায় না। অবস্থা নিশ্চয়ই গুরুতর! আপনি দাড়ান, আমি এনে দিচ্ছি। আমার কাছে রয়েছে।”
চারুকে রেখে ঘরে ঢুকে গেল নিখিল। ফিরলো সেকেন্ড ত্রিশেক বাদে, হাতে একপাতা প্যারাসিটামল নিয়ে। সেটা চারুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— “নিন। একপাতা প্যারাসিটামল আমার কাছে সবসময়ই থাকে। এই দিয়ে আপনি আপনার সমস্যার সমাধান করুন।”
— “ধন্যবাদ!”
চারু মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে এলো তৎক্ষণাৎ।
___

অনুর এই বিয়েতে বাড়ির কেউই প্রথমটায় রাজি ছিল না। বড়রা তো নয়ই, ছোটরা অবধি ঘোর বিরোধী ছিল এমন বিব্রতকর সম্বন্ধ মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে। সবার মুখেই ছিল একই কথা, এ কী করে হয়! যে বাড়িতে বড়বোনের সংসার টেকে নি, তালাক নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে বিয়ের মাস ছয়েকের মধ্যে; সে বাড়িতে তারই ছোট বোনের বিয়ে — এ কি মেনে নেয়া যায়?
কিন্তু মেনে নিতে হয়েছে। অনুর অসম্ভব রকমের জেদ, একগুঁয়েমির কারণে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে সবাই।
পারিবারিক ভাবেই চারুর বিয়েটা হয়েছিল মাহতাবের সঙ্গে। ওই বিয়েকে কেন্দ্র করেই বরের ছোট ভাই মাহাদের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরি হয় কনের ছোট বোন অনুলেখার। বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতায়, চিরায়িত বেয়াই-বেয়াইন সম্পর্কের টক-ঝাল ঝগড়া আর ঠাট্টা-মশকরার আসরে সেটা বুঝতে বাকি ছিল না কারো। তাই মোটামুটি দু’ পরিবারই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এদেরও একই সুতোয় বাঁধবার!
সব ঠিক চলছিল। কিন্তু একদিন সব পাল্টে গেল। দমকা হাওয়ার মতো প্রবল ঝাপটায় চারুর সংসার নামক তাসের ঘর ভেঙে পড়লো নিমিষে! বিয়ের ছয় মাসের মাথাতেই একদিন চারুকে ফিরতে দেখা গেল, লাগেজ-ব্যাগ গুছিয়ে। বাড়ির সবার একটু খটকা লাগলো, জামাই কেন এলো না তা নিয়ে। কিন্তু কিছু বললো না। আসল ঘটনা জানা গেল রাত্রেই। বাপ – চাচার সামনে দাড়িয়ে নতমুখে চারু খবরটা দিলো। মাহতাবের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না কিছুতেই। দুটি মানুষ একসঙ্গে থেকেও যোজন যোজন দূরের মানুষ যেন। মিথ্যে মায়া নিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার খেলা খেলতে খেলতে অতিষ্ট হয়ে ফিরে এসেছে চারুলতা। সব শুনে ওরা হতবাক, বিস্মিত, হতবিহ্বল!
তারপর শুরু হলো আরেক অশান্তি। সবাই অনেক চেষ্টা করলো ওই দুটি মানুষকে এক করে দেবার। তাদের নৌকার ভাঙা পাল জুড়বার। কিন্তু ভাঙা কাচ কি জোড়া লাগে? কাচের মতো চূর্ণ – বিচূর্ণ হয়ে একে-অপরের থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়া ওদের তাই আর জোড়া লাগানো যায় নি। তালাকের তকমা নিয়ে ফেরে চারুলতা! চাঁদবদন মুখটিতে লাগে কলঙ্কের ছাপ!
চারুর সবকিছু শেষ হয়ে গেলেও অনুর তখন সবে শুরু। চারুর বিয়েতেই প্রথমবারের মতো দেখা হয় মাহাদের সঙ্গে। এরপর, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলে বোনকে দেখার অছিলায় প্রায়ই বোনের শ্বশুরবাড়িতে হাজির হতো অনু। নিয়মিত সাক্ষাৎ হতো মাহাদের সঙ্গে।ওদের রসায়নটা যখন জমে উঠতে শুরু করেছে, তখনই ভাঙ্গনের করাল গ্রাস লেগেছিল চারুর সংসারে। তারপর তো একসময় ওই পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফিরেই এলো চারু। সবকিছু জেনে-শুনেও ওরা এগিয়েছিল প্রণয় থেকে পরিণয়ে। স্বভাবতই এই বিষয় নিয়ে দ্বিমত ওঠে। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে প্রথম দফাতেই প্রস্তাব নাকচ করা হয়। কিন্তু কথায় আছে, ’পিরিতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়ে না!’ অনু – মাহাদের প্রেমও তাই ছাড়লো না। নানান জটিলতার পরও কাঁঠালের আঠার মতো লেগে থাকতে থাকতে শেষ অবধি দুই পরিবার রাজি হলো বিয়েতে!
___

ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা। বর্ণিল অরুণা ম্যানসনে চলছে আনন্দ উৎসব। ঝকঝকে – তকতকে সুন্দর পাঞ্জাবি পরে, গায়ে সুগন্ধি মেখে, এক্কেবারে ফুলবাবুটি সেজে, বন্ধু নিখিলকে নিয়ে ঘর থেকে বেরোলো সৌভিক। প্যান্ডেলের দিকে ছুটলো অন্যদের কাছে। বিয়ের আয়োজন চলছে জমিয়ে!
বধূবেশে সজ্জিত অনুকে ইতোমধ্যেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে স্টেজে। তাকে ঘিরেই এখন ভীড়। আত্মীয় – স্বজনের তো মেলা লেগে আছেই, সঙ্গে আছে ক্যামেরাম্যানের ভীড়। বিয়েতে বড় শখ করে একদল লোক ভাড়া করে এনেছে অনুলেখা। ফটোশ্যুট করবার জন্য। তার মতে, বিয়ে তো একবারই করবো, তাতে একটু ছবি-টবি তুলবো না?
ছবি তুলতে দোষ ছিল না। কিন্তু সেটা নিয়ে বাড়াবাড়িও ভালো লাগে নি কারোরই। এমনিতেই বিয়েটা নিয়ে একটু খুঁত-খুঁতে ভাব দুটো পরিবারের মধ্যেই আছে! তবুও কি আর করা—

নিখিলকে সঙ্গে নিয়ে প্যান্ডেলের ভেতরে ঢুকলো সৌভিক। কনের সঙ্গে দেখা করানো হয় নি বন্ধুকে। তাই দেখা করাতে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্টেজের যা অবস্থা, তাতে ওর কপালে সে সুযোগ মিলবে কিনা কে জানে! আশেপাশে একগাদা আত্মীয়ের ভীড় নিয়েও রংঢং করে ছবি তুলতে ব্যস্ত অনুলেখা। ওই ভীড় – ভাট্টা ঠেলে বন্ধুকে নিয়ে ভেতরে যাবার ইচ্ছে হলো না আর। অগত্যা ওরা এগোলো ভাই-বোনদের কাছে।

প্যান্ডেলের অন্য পাশে সবাই একত্র হয়েছে। মিউজিক বক্সে বাজছে জনপ্রিয় কিছু রোমান্টিক হিন্দি গান। তাতে কাপল ড্যান্স করছে বিবাহিত দম্পতিরা। নিখিলরা যখন এসে পৌঁছলো তখন বাজছে,
Tumko paya hai toh jaise khoya hoon
Kehna chahoon bhi toh tumse, kya kahoon?
Tumko paya hai toh jaise khoya hoon
Kehna chahoon bhi toh tumse, kya kahoon?
দর্শকদের মধ্যমণি হয়ে শাহরুখ – দীপিকার পাট করছে একটি সুদর্শন দম্পতি। টুকটুকে লাল শাড়ি জড়ানো এক রূপবতী বধূ আর কালো স্যুট-টাই পরিহিত সুপুরুষ নাচছে সুরের ছন্দে ছন্দে। চোখের দৃষ্টি যাদের স্বপ্নালু, ভঙ্গি যাদের অমায়িক। সৌভিক ওদের দেখিয়ে নিখিলের কানে ফিসফিস করে বললো,
— “ওই যে দেখছিস, নাচছে? আমার বড় ভাই – ভাবী। বিয়ে করেছে প্রায় তিনবছর গড়ালো। কিন্তু এখনও কি প্রেম! দেখে কি মনে হচ্ছে বল তো? এক্কেবারে সদ্য সদ্য প্রেম হওয়া কপোত-কপোতী, না?”
চাপা হাসলো সৌভিক। বন্ধুর সঙ্গে তাল দিয়ে নিখিলও হাসলো। তারপর বললো,
— “কিন্তু যাই বল, তারা যে একজন আরেকজনকে ভীষণ রকমের ভালোবাসে সেটা তাদের চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কি স্বচ্ছ চোখের চাহনি! মনেই হচ্ছে না আমাদের উপস্থিতি ওরা টের পাচ্ছে। কি সুন্দর!”
একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো সৌভিক। ওকেও পাশের চেয়ারে বসবার ইঙ্গিত দিয়ে বললো,
— “হুঁ। এদের এই প্রেম দেখলে মাঝে মধ্যে মনটা চায়, বিয়েটা করে ফেলি। কিন্তু—”
— “কিন্তু কি? করে ফ্যাল বিয়ে! আপত্তি কীসের?”
— “আপত্তি তো অনেক। পাত্রী যে নাই!”
হতাশার ঠোঁট উল্টালো। ওর ভঙ্গি দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো নিখিল। পিঠে একটা চাপড় মেরে বললো,
— “আরে মাম্মা, এইটা কোনো কথা! দেশে এতো মেয়ে থাকতে তোমার পাত্রীর অভাব? আমাদের বললেই তো, হয়ে যায়। দেখবি, এক চুটকিতে কতো মেয়ের লাইন লাগিয়ে দেই! হা হা হা।”
স্বর্ণালী সন্ধ্যাটা মুখরিত হয়ে ওঠে দু’ বন্ধুর কলহাস্যে!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-০১

0

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০১
#মৌরিন_আহমেদ

— “বেশি রূপবতী হইলে এইরকমই হয় কপালে স্বামীর ঘর জোটে না!”

ছোট বোনের মুখে এরকম বাঁকা কথা শুনে মুখের হাসি বিলীন হয় চারুলতার। চোখ ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকাতেই দেখে, অনুলেখা মুখ কুঁচকে তারই পানে চেয়ে। ওর বধূবেশে সেজে থাকা অঙ্গে ঝলমল করতে থাকা দামী বেনারসি আর চকচক করতে থাকা গয়নাগুলো যেন একসঙ্গে কটাক্ষ করছে চারুকে!
বিয়ে বাড়ির কল-হাস্যে মুখর এই ঘরের আর সবার নজর এখন চারুর উপর ন্যস্ত। অনুর বাঁকা কথার খোঁচা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কক্ষে উপস্থিত কাজিনরা একজন – আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। একটু আগের হৈচৈ হল্লা হারিয়ে গেছে নিমিষে, সকলের চাউনি থমথমে। চারু অপ্রস্তুত হলো খুব। ফেলে আসা তিক্ত অতীত নিয়ে খোঁচাটা সামলে কিছু বলবে তার আগেই মধ্যস্থতা করলো ইমা; ওদের বড় ফুপুর মেয়ে। অনুকে উদ্দেশ্য করে ধমকে ওঠে,
— “এমন করে কথা বলছিস কেন, অনু? বড়দের নিয়ে এভাবে কথা বলতে হয়?”
— “তো কীভাবে কথা বলতে হয়?”
অনু সরাসরি ইমার চোখে চোখ রাখলো। ইমা কঠিন স্বরে বললো,
— “অসভ্যের মতো করবি না। চারু আপা আমাদের সবার বড় বোন। তার সঙ্গে এরকম ঠেস দিয়ে কথা বলা তোর সাজে না।”
— “সাজে না? হাহ্! কেউ দোষ করলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না?”
কটাক্ষ করলো অনু। ইমা পুনরায় ধমকে উঠলো,
— “না দেয়া যাবে না। কারণ চারু আপা কোনো দোষ করে নি। স্বামীর সাথে বনিবনা না হলে কেউ ছাড়াছাড়ি করতেই পারে। এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেখানে তোর কথা বলার কিছু নেই।”
— “অবশ্যই আছে। কারণ মাহতাব ভাই এ-বাড়ির প্রাক্তন জামাই হলেও নতুন আরেকটা সম্পর্ক শুরু হতে যাচ্ছে তার সঙ্গে। উনি মাহাদের বড় ভাই! সেই হিসেবে..”
— “তোর ভাসুর। জানি আমরা সেটা। নতুন করে বলবার কিছু নেই।”
ভাগ্যিস এখানে বড়রা কেউ নেই। সব কচি-কাঁচার আসর বসেছিল বৌয়ের সাজের ঘরে, তাই রক্ষে! ওদের বোনদের এই কথা কাটাকাটি কেউ শুনলো না।
ইমা থামলো না, কঠিন হুঁশিয়ারি দিলো অনুর প্রতি,
— “শোন, আজ তোর বিয়ে বলে কিছু বলছি না। শুধু বলবো তোর এই উড়নচণ্ডী চালচলন আর অকারণে অন্যকে হেয় করার অভ্যাসটা ছাড়।পরের বাড়ি যাচ্ছিসই, স্বভাব না বদলালে পস্তাতে হতে পারে!”
কথা শেষ করে দাড়ালো না ইমা। ‘চলো তো আপা। মা ডাকছে!’ — বলে চারুর হাত ধরে নিয়ে গেল ঘর থেকে। পেছনে পড়ে থাকলো অপমানে মুখ লাল হওয়া অনুলেখা। ঘর ভর্তি মানুষ, যারা সবাই কি-না ওর চেয়ে বয়সে অনেক অনেক ছোট — তাদের সামনে ইমা ওকে এভাবে কথা শুনিয়ে দিয়ে গেল?

অরুণা ম্যানসন।
আহাদ রাজা তার প্রাণাধিক প্রিয় জীবনসাথী অরুণার জন্য তৈরি করেছেন এই বাড়ি। আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে। সেই থেকে চলছে এই পরিবারের গল্প।
পরিবারটির গোড়াপত্তন করেছিলেন আহাদ রাজা। হাল আমলের বেশ বড় গ্রামের হাভাতে চাষার ছেলে থেকে আহাদ রাজা শুধুমাত্র নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমের জোরেই হয়ে উঠেছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। শুরু করেছিলেন খুব ছোট্ট কিছু দিয়ে। উপশহরে একটা ছাট কাপড়ের দোকান ছিল। সেই দোকানের বেচা-বিক্রি করতেন নিয়মিত। তারপর আস্তে আস্তে প্রসার হলো। ছাট কাপড় থেকে শাড়ি, থ্রি-পিস সবকিছু চলে এলো। হাতে কাচা পয়সাও আসতে লাগলো প্রচুর। সেসব নিজের জন্য খরচা না করে জমাতে লাগলেন। কিছু টাকা জমে গেলে, লোন নিলেন ব্যাংক থেকে। সবমিলিয়ে মূল শহরে একটা দোকান ঘর ভাড়া নিলেন। নতুন দোকানের সঙ্গেই রইলো টেইলার্স। নিত্যনতুন কাপড়ের চালান আনা শুরু হলো। কর্মচারী বাড়লো। ধীরে ধীরে রমরমা হয়ে উঠলো দোকান। এখন গোটা শহরে তার ”আহাদ এম্পোরিয়াম”–এর বেশ নামডাক!

ব্যক্তিগত জীবনে তিন কন্যা এবং তিন পুত্রের জনক আহাদ রাজা। স্ত্রী অরুণা গত হয়েছেন বছর সাতেক হলো। সন্তানদের সকলেই বিবাহিত, (এমনকি তাদের কারো কারো ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে, কিংবা বিবাহ ভারগ্রস্থ!) নিজেদের পরিবার নিয়ে পিতার সঙ্গেই থাকেন। এবং তিন পুত্রই পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পিতার অবসর নেয়ার পর সবকিছু শক্ত হাতে সামলাচ্ছেন তারা। ইতোমধ্যে বেশ উন্নতি সাধন করেছেন। নতুন দোকান হয়েছে বেশ কয়েকটা। একথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, আহাদ রাজার তিন পুত্রই বাপের চেয়েও বেশি বিজ্ঞ এবং দক্ষ হয়ে উঠেছেন!
ছেলেদের মধ্যে আজমীর রাজা বড়। দুই কন্যার জনক। চারুলতা এবং অনুলেখা। চারুর বিয়ে হয়েছিল দু’ বছর আগে। কিন্তু কোনো কারণে সংসারটি টেকে নি। ছোটোজন অনুলেখা, তার বিয়ে উপলক্ষেই বাড়িতে আজ এতো আয়োজন!
আহসান রাজা দ্বিতীয়। তিন পুত্র তার। কবির, কাব্য এবং সৌভিক — সকলেই পড়ালেখার পাট চুকিয়ে নিজ নিজ কর্মসংস্থান করে নিয়েছে। তবে কেউই পরিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় নি। বৈবাহিক অবস্থার হিসেবে বড় দু’জনই বিবাহিত। এখনো বাকি রয়েছে সৌভিক।
আসাদ রাজা। একটি নম্র-ভদ্র মেয়ে এবং দুটি হাড়ে বজ্জাত জমজ ছেলের বাপ। মেয়েটি ঋতু। সাস্টের পলিটিক্যাল স্টাডিজের ছাত্রী। আর দুই রিংকু – টিংকু; অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। পড়ালেখা ছাড়া তাবৎ দুনিয়ার সমস্ত কাজ যাদের ভীষণ প্রিয়! তাদের অন্যতম দায়িত্ব হলো বড় ভাইবোন গুলির পিছনে জাসুসি করে বেড়ানো, তাদের প্রতিটি দোষ বড়দের কাছে বলে দেয়ার হুমকি দিয়ে ফায়দা লোটা!

তিন কন্যার বড়জন আলেয়া। প্রাইমারি স্কুলের টিচার, সিলেটে নিজের স্বামী এবং দু’ কন্যার সঙ্গে শ্বশুর বাড়িতেই থাকেন। মেজোজন আয়েশা। অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরিরত, পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকেন। দুই পুত্র-কন্যার জননী। এবং সবশেষে ছোটটি আমেনা। গৃহিণী; স্বামী এবং একমাত্র পুত্র সন্তান নিয়ে কানাডা প্রবাসী হয়েছেন আজ বছর পাঁচেক হলো।

নিচতলার সবচে’ যে বড় ঘরটি তাতেই আহাদ রাজার বাস। যেহেতু তিনিই বাড়ির কর্তা, স্বভাবতই তার কক্ষের আলাদা আভিজাত্য আছে। আকারে বেশ বড়-সড় হলেও এখানে আসবাবের আতিশয্য নেই। ছিমছাম পরিবেশ। কিন্তু গাম্ভীর্যে পূর্ণ!
সাধারণত এখানেই যতো গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক আলাপ – আলোচনা, পুত্রদের সঙ্গে বসে ব্যবসা সংক্রান্ত গোপন বৈঠক সেরে থাকেন আহাদ রাজা। তাই অন্যরা এই ঘরের ব্যাপারে সমঝেই চলে, যেমন চলে ঘরের মালিককেও। কিন্তু অনুর বিয়ে উপলক্ষ্যে পুরো বাড়িই যখন নতুন আমেজে সেজেছে, তখন কি ভেবে যেন বৃদ্ধ আহাদ রাজা তার এই ঘরটি ছেড়ে দিয়েছেন নাতি – নাতনীদের জন্য। করুক ওরা হৈ-হুল্লোড়, আমোদ – উল্লাস! কিন্তু বর্তমানে ঘরটার দখল আছে আলেয়ার হাতে। পরশু কানাডা থেকে এসেই বাপের ঘরটা কব্জায় নিয়েছেন তিনি। তার বদৌলতেই মহিলামহলের যত প্রকার আড্ডা, ঠাট্টা – মশকরা এমনকি পরচর্চা – পরনিন্দারও আসর হয়ে উঠেছে এই জায়গা!
ইমার সঙ্গে চারু এসে দাড়ালো ঘরের দোরগোড়ায়। আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরের কিছু অংশ। আলেয়া ফুপু, আয়েশা ফুপু দুজনেই বিছানায় বসে, হাসছেন। ওরা যেহেতু আছে তারমানে অন্যদেরও থাকবার সম্ভবনা প্রবল, ভাবলো চারু। গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে আলোচনা হতে পারে। একটু কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে বললো,
— “বড়ফুপু ডেকেছ?”
হাসির কলকলানি থামলো মুহূর্তের জন্য। সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো দরজায় দাড়ানো চারুলতার পানে। গলা উঁচিয়ে ডাক দিলেন আলেয়া,
— “হ্যাঁ, আয় তো চারু।”
অনুমতি পেয়ে নম্র পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো চারুলতা। ইমা ঠিক ঢুকলো না, দরজার ফাঁকটুকু দিয়ে মাথা গলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “আমাকেও কি থাকতে হবে, আম্মা? না, চলে যেতে পারি?”
— “তুমি যাও।”
আদেশের সুর ভেসে এলো। মাথা দুলিয়ে সায় দিলো ইমা,
— “আচ্ছা।”
ইমা চলে গেল। হাত বাড়িয়ে সস্নেহে ভাতিজিকে কাছে ডাকলেন আয়েশা,
— “এদিকে বোস তো, মা।”
চিরকালের ধীর – স্থিরমতি চারু এগিয়ে গিয়ে বসলো তার মেজোফুপুর কাছে। বসবার আগে একপল্ চেয়ে নিলো কক্ষে উপস্থিত সকলের দিকে। মা – চাচী – ফুপু এরাই আছেন। তারা কথা বলতে শুরু করেছেন আবার। যার অধিকাংশই অনুর বিয়ে সংক্রান্ত আলাপ। বড় ফুপুও এতে শামিল আছেন। ওদের এই সাংসারিক আলাপ ওকে কেন ডাকা হলো? আলেয়া কি খামোখাই ওকে টেনে আনলেন দোতলার আসর থেকে? চারু বুদ্ধিমতী মেয়ে, তাই বুঝতে অসুবিধে হলো না বড় ফুপুর উদ্দেশ্য। উনি অবশ্যই ওকে জরুরি কিছু বলতে ডেকেছেন। শুধু শুধু কিছু করবার পাত্রী তো তিনি নন। আর সেই জরুরি কিছু যে এতো মানুষের মাঝে উনি বলবেন না তাও বুঝলো বেশ। তাই অধৈর্য না হয়ে চুপটি করে বসে ওদের কথা শুনতে লাগলো চারুলতা।
একটু পরেই সাঙ্গ হলো ওদের কথা। আসাদ রাজা এসে ডেকে গেলেন তার বড় ভাবীকে। কি এক রান্না নিয়ে যেন বাবুর্চির সঙ্গে তার তর্ক লেগেছে। এখন মীমাংসা করতে বড় ভাবীকেই লাগবে। উনি রান্নায় সিদ্ধহস্ত কি-না!
চারুর মায়ের প্রস্থানের পরই আসর ভাঙলো। একে একে চলে গেলেন সবাই। ঘরে একা রয়ে গেল চারু আর আলেয়া বেগম। ফাঁকা পেয়ে চারু বিনীত হয়ে শুধালো,
— “আমায় কি জন্য ডেকেছিলে, বড় ফুপু?”
ওর কথায় ফিরে তাকালেন আলেয়া। হাত ধরে কাছে টেনে নিলেন ওকে। চিবুক ছুঁয়ে আদর করে বললেন,
— “কেমন আছিস, মা? মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন?”
পাংশুটে ভাবটা লুকোবার প্রচেষ্টায় হাসলো খানিক চারু,
— “কই, না তো!”
— “দুঃখ লুকাস না, চারু। তোর কষ্টটা আমি বুঝি। আমি জানি, এটা তুই মানতে পারছিস না। মন ছোট করছিস। যে বাড়ি থেকে তোর সংসার নষ্ট হলো সেখানে — কিন্তু কি করবি বল, অনু যে একেবারে জেদ — ”
বলতে বলতেই ওর চোখের দিকে তাকালেন আলেয়া। সেই দৃষ্টির সু-গভীর ভাষা আর চেহারার নিদারুণ অসহায়ত্ব দেখে না চাইতেও মনটা খারাপ হয়ে এলো ওর। মুখ নামিয়ে স্তিমিত সুরে বললো,
— “তুমি খামোখাই ভাবছ। আমি মোটেও মন ছোট করি নি। আজকে অনুর বিয়ে, আমার ছোট বোনের বিয়ে! এই নিয়ে কি আমার মন খারাপ করা সাজে? হতে পারে, অনুর যে পরিবারে বিয়ে হচ্ছে সে পরিবারের সঙ্গে একসময় আমার নিজস্ব একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেটা তো অতীত। এর আগে মাহাদ আমার দেবর থাকলেও এখন তো আমার হবু ভগ্নিপতি। আর ওই.. ওই লোকটা, সে তো শুধুই একজন পরপুরুষ। তাকে কিংবা তার সঙ্গে থাকা আমার অতীত নিয়ে কোনো ভাবনা আমার নেই। তুমি চিন্তা করো না, প্লিজ।”
আলেয়ার হাতের উপর নিজের ডান হাতটা রাখলো। আশ্বস্ত করে চাপ দিলো সামান্য। আলেয়া বুঝেও যেন বুঝতে চাইলেন না। অবিশ্বাসী কণ্ঠে বললেন,
— “তুই সত্যিই ওসব নিয়ে ভাবছিস না তো? মাহতাব কে নিয়ে –”
ফুপুর কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে চারু বললো,
— “না। বিশ্বাস করো। তাকে নিয়ে আমার আর কোনো ভাবনাই নেই। আমি সব ভুলে গেছি। যদিও এটা ভোলার মতো নয় কিন্তু তবুও — অনুর বিয়ে নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। ও ওর পছন্দের মানুষকে বিয়ে করবে এতে আমি বাঁধা দেওয়ার কে? আমি চাই ও সুখী হোক।”
— “আমিও চাই তুই সুখী হ। অনেক অনেক সুখী হ। পুরোন সবকিছু ভুলে যা!”
ভাতিজিকে কাছে টেনে গালে চুমো দিলেন আলেয়া। পরম মমতায় আগলে নিলেন বুকের মাঝে। এই মেয়েটা যে তার কতো আদরের, কতো ভালোবাসার তা কি কেউ জানে?
তখনও তিনি সংসার জীবনে প্রবেশ করেন নি। অনার্সে ভর্তি হয়েছেন সদ্য। বড় ভাই আজমীর রাজার বিয়ের দীর্ঘদিন পরেও কোনো বাচ্চা – কাচ্চা হচ্ছিল না। আত্মীয় – স্বজনেরা তো অনেকে নানান বাজে কথা বলা শুরু করেছিল আড়ালে। চমক ভাবীকে বাঁজা, আজমীর ভাইকে আঁটকুড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি উপাধিতেও ভূষিত করেছিল। তারপর মেজ ভাইয়ের যেদিন তৃতীয় ছেলে সৌভিকের জন্ম হলো সেদিনই শোনা গেল, বাড়িতে নতুন সদস্যের আগমনের সংবাদ! হাসপাতালে মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিলেন চমক ভাবী, তখনই টেস্ট করে জানা গেল চমকে যাওয়ার খবর! চারুলতার খবর!
কতগুলো দিনের অপেক্ষার পর সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে, চমক ভাবীর কোল আলো করে এলো এই মেয়ে। প্রিয় ভাতিজির সুন্দর পানপাতার মতো ছোট্ট মুখ, আর নমনীয় কোমল শরীর দেখে বড় শখ করে আলেয়াই নাম রেখেছিলেন “চারুলতা জাফরিন”!
প্রথম কন্যা সন্তান হিসেবে সকলেরই বড় আদরের, বড় যত্নের হলেও তার কাছে ওর বিশেষ কদর। তার জীবনে প্রথম মাতৃত্বের স্নেহ জাগিয়ে দিয়েছিল চারু। প্রথম কোনো ছোট প্রাণ তার উষ্ণ কোলে বসে ছোট ছোট হাত দিয়ে জড়িয়েছিল তার গলা, আধো – আধো বুলিতে তাকে ডেকেছিল বুবু! ফুপু যে তখনো ডাকতে শেখে নি বাচ্চাটা। ওই পুচকু মেয়েটার মুখে সারাক্ষণ ‘বু-বু’ ডাক শুনেই তো ওর প্রতি মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে গেলেন আলেয়া। যে বন্ধন এ জন্মে আর কাটবার নয়!
চারুর বয়স যখন দুই তখন চমক ভাবীর পেটে অনুলেখা। ভাবী তখন অসুস্থ। ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারেন না ওর। তখন ছোট্ট চারুর সর্বক্ষণের খেলার সঙ্গী, আবদারের ঝুলি হয়ে উঠেছিল আলেয়া। মা অসুস্থ তাই তার কাছেও ভিড়ে না। কিন্তু একমুহূর্ত বড়ফুপুকে না দেখে ওর চলে? কতো যত্নের এই পুতুলটা!
সেই চারু আজ কতো বড় হয়েছে! জীবনের কতো চড়াই-উৎরাই এসে হাজির হয়েছে ওর সামনে। ও কি সেসব পাড়ি দিতে পারবে? ভাবতে ভাবতেই চোখ ভিজে আসে আলেয়ার। চারুকে আরেকটু নিবিড়ভাবে টেনে নেন নিজের সঙ্গে। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আশীর্বাদ করেন ওকে। সুখী হ!

অনেকটা সময় ফুপুর সঙ্গে কাটিয়ে ঘর থেকে বেরোলো চারু। লন এরিয়ায় প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে বিয়ের। ইমার কাছে শোনা, ওদিকটাতেই নাকি সব পুচকুগুলো জড়ো হয়েছে। গান বাজাচ্ছে, নাচানাচি করছে। আনন্দ করছে নিজেদের মতো করে! অনুর কাছে গিয়ে নতুন করে ঝামেলা বাঁধানোর চেয়ে এই ছোটদের মেলায় যাওয়া যেতে পারে। ভেবেই এগুলো চারু।
বাইরে পা দিতে না দিতেই কানে এসে বাজলো সাউন্ড বক্সের কান ফাটানো শব্দ। হাইবিটে বেজে চলেছে সেখানে হিন্দি গান,
“Kabhi Lage Monalisa
Kabhi Kabhi Lage Lolita
Aur Kabhi Jaise Kadambri
Haaye Meri Param Param Param Param
Param Sundari”
সেই সঙ্গে ওর কাজিনমহলের ছোট-ছোট ভাইবোনের সোল্লাসে চিৎকার! সবচে বেশি শোনা যাচ্ছে রিংকু – টিংকুর ফাটা বাঁশের মতো গলা। দু’ মিনিটের মধ্যেই মাথা ধরে গেল চারুর। এই অবিরাম হৈ-হৈ গান-বাজনা যে ওর জন্য মোটেও উপযোগী নয় সেটা বুঝেই সটকে পড়লো। ঝিম ধরানো মাথায় একহাত চেপে ফিরে এলো বাড়ির ভেতর। গন্তব্য দোতলার শেষ প্রান্তের নিরালা ঘরখানি, তার শান্তিনিবাস!

ওদের বাবা-চাচা-জ্যাঠা সবার ঘর নিচে। পুরোটাই মুরব্বীরা দখল করে আছেন। আর ওরা ভাই-বোনগুলি সব ঠাঁই পেয়েছে বাপেদের একদম মাথার উপরে, অর্থাৎ দোতলায়। চারু একহাতে মাথা চেপে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছিল। উপরে উঠেই হাতের বাঁ পাশে কবির ভাইয়ের ঘর। পাশ দিয়ে যাবার সময় ভেতর থেকে চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ শুনতে পেয়ে নক করলো চারু,
— “ভাবী, আসবো?”
— “কে? চারু? হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসো! দরজা খোলা।”
দোর ঠেলে ভেতরে ঢোকে চারু। ওকে দেখেই আহ্লাদী হেসে বলে জাবিন,
— “ভালো হয়েছে তুমি এসেছ। আমি যে কী বিপদে পড়েছিলাম!”
— “কেন? হয়েছে কি?”
মুচকি হাসলো চারু। জাবিন মুখটা পেঁচার মতো করে বললো,
— “হেসো না, মেয়ে। কি জ্বালায় পড়েছি আমি, সেটা আমিই বুঝছি। তুমি এসে একটু কুচি ধরে দাও তো!”
— “আচ্ছা। দেখছি!”
চারু এগিয়ে এসে ভাবীর আদেশ মানলো। সুন্দর করে শাড়ির কুচি ধরে দিতে লাগলো জাবিনকে। আঁচল টেনে ঠিক করে দিলো। শাড়িতে অনভ্যস্ত জাবিনের যেন সমস্যা যেন না হয় তাই ভালো করে পিন গুঁজে দিতে দিতে বললো,
— “তুমি তো শাড়ি পরো না, আজ হঠাৎ? পরলেই যখন তখন কাউকে ডাকলে না কেন?”
জাবিনের ভোঁতা মুখ সোজা হলো না। মুখ লটকে জানালো,
— “তুমি তো জানোই, আমি শাড়ি পরতে পারি না। অনুর বিয়ে উপলক্ষ্যে সবাই পরছে দেখে শাড়ি কিনেছি। কিন্তু দেখো তো, একঘণ্টা ধরে পরছি কিন্তু এখনও কুচিটাই গোছাতে পারলাম না! কাউকে যে ডাকবো তারও উপায় নেই। দোতলায় কেউ নেই! ওদিকে তোমার ভাই গেছে নিচে। গান-বাজনা করছে সবকয়টা মিলে। বারবার কল করে আমাকে তাড়া দিচ্ছে, রাগ হচ্ছে, আমি যাচ্ছি না কেন! ও কি জানে আমার অবস্থা?”
শেষের কথাটা একটু রাগ করেই বললো। বেচারীর করুণ কাহিনী শুনে ফিক করে হেসে ফেললো চারু। হাসতে হাসতে ভাবীর দিকে চেয়ে দেখলো তার মুখখানা। কেমন ছোট বাচ্চাদের মত গাল ফুলিয়ে চেয়ে আছে, দেখো? চারু হাসতে হাসতে জাবিনের গালে একটু চিমটি কাটলো,
— “ইসস! এখানে খুব রাগ দেখানো হচ্ছে, না? নিচে ভাইয়ার সামনে গেলে, ঠিকই তো ভুলে যাবে সব! গদগদ হয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুলবে!”
গোপন কথা ফাঁস হওয়ায় বেশ লজ্জায় পড়তে হলো ওকে। রক্তিমাভা গাল দুটো লুকিয়ে কপট রাগ দেখালো ননদিনীকে,
— “বলেছে তোমাকে!”
— “বলেছেই তো!”
দ্বিগুণ লজ্জায় মিইয়ে যায় জাবিন। চারু আরেকটু জোরেই হেসে উঠে এবার। প্রসঙ্গ পাল্টাতে জাবিন হঠাৎ বলে,
— “এই তুমি তখন কি কারণে এসেছিলে বলো তো? এসময়ে এখানে তো কেউ নেই! তুমি একা একা দোতলায় কি করছো?”
হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় চারু জানায়,
— “ওহ্। আমি এসেছিলাম একটা ঔষধ নিতে। বাইরের এতো শব্দে মাথাব্যথা শুরু হয়েছে রীতিমত। তাই ভাবছিলাম, ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে নেব।”
— “সেকি ঘুমোবে কেন? বিয়ে দেখবে না? অনু তো তোমারই বোন!”
আঁতকে উঠলো যেন। ওর বিভ্রান্তি কাটিয়ে দিলো চারু,
— “বিয়ের এখনও অনেক দেরি, ভাবী। ন’টায় বিয়ে, এখন সবে সন্ধ্যে ছ’টা! দু’ আড়াই ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেয়া যাবে। তুমি পেইন-কিলার দাও তো। খেয়ে একটু আরাম পাই। ভারী যন্ত্রণা করছে মাথাটা!”
বলতে বলতেই কপালের কোণায় হাত ঠেকালো। জাবিন কয়েকটা ড্রয়ারে খুঁজে নিরস হয়ে বললো,
— “আমার ঘরে তো ট্যাবলেট নেই, চারু।”
— “তবে? মাথা তো যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে আমার!”
অসহায় শোনালো কণ্ঠ। জাবিন একটু ভেবে নিয়ে বললো,
— “তুমি ঋতু বা অন্য কারো কাছে চাও। কিন্তু পাবে কি-না, ঋতুটা যা ভুলোমনা! কোথায় কি রাখে! তুমি বরং সৌভিকের কাছে যাও। ওর কাছে সবকিছুই পাওয়া যায়। দারুণ গোছালো ছেলে!”
সৌভিক ভাইয়ার কথা উঠতেই চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো চারুর। তাই তো, সৌভিক ভাইয়ার কথাটা তো মাথায় আসে নি। ওর কাছে চাইলেই তো হয়! ভাবীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তৎক্ষণাৎ পা বাড়িয়ে ছুটলো সৌভিকের কক্ষের দিকে।
ইংরেজিতে যাকে জেন্টলম্যান বলে তারই যোগ্য উদাহরণ হলো এই সৌভিক। যার সবকাজ গোছালো, নিখাদ-নির্মল-নিখুঁত। প্রতিটি কাজ যে করে পরিচ্ছন্ন হয়ে, সাজিয়ে-গুছিয়ে! তার কাছে এখন একটা পেইন-কিলার পাওয়া কি এতই অসম্ভব?

সৌভিকের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। মানে ভাইয়া ঘরেই আছে। দরজায় করাঘাত করলো চারুলতা,
— “এ্যাই, ভাইয়া? দরজা খোলো তো! এ্যাই!”
— “কে?”
আওয়াজ এলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ঘুম মেশানো কেমন জড়ানো গলা। সৌভিক ভাইয়া এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি? স্বর উঁচিয়ে জবাব দিলো চারু,
— “আমি চারু। দরজা খোলো। জলদিই!”
— “হুঁ।”
আজ দুপুরেই বরিশাল থেকে বাড়ি ফিরেছে সৌভিক। লম্বা সফরের ধকল সইতে পারে নি হয় তো। তাই ঘুমিয়েছে। বুঝতে পেরে আর জোরাজোরি করলো না চারু। কিছুক্ষণ চুপ করে অপেক্ষা করলো সৌভিকের দোর খোলার। একটু পর ভেতর থেকে সৌভিকের কণ্ঠ ভেসে এলো,
— “কি হয়েছে?”
সঙ্গে কপাট খুলবার আওয়াজ। চারু বলতে শুরু করলো,
— “আর বলো না, মাথা ব্যথায় তো মlরে যাচ্ছি একেবারে। বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। কেউ নেই আমাকে সাহায্য করতে। একমাত্র বড় ভাবীর কাছে গেলাম কিন্তু তার কাছে ঔষধ নেই। এখন তোমার কাছে কি পেইন-কিলার—”
বলতে বলতেই সামনে চেয়ে হঠাৎ থেমে গেল চারুলতা। দরজা হাঁট হয়ে খুলে গেছে ততক্ষণে। সেখানে সৌভিক নয়, বরং উপস্থিত হয়েছে অন্য কেউ! সেই অন্য কেউটা একজন অপরিচিত ব্যক্তি বুঝেই চোখ বড় বড় করে তাকালো চারু। প্রবল বিস্ময়ে দুটি শব্দ ছিটকে বেরোলো মুখ থেকে,
— “আপনি কে?”

চলবে___

আমার তুমি পর্ব-১৮

0

#আমার_তুমি
#পর্ব_১৮
#জান্নাত_সুলতানা

-“কিভাবে?
মাথা ঠিক আছে তোর?
কি সব বলছিস?”

-“একদম ঠিক আছে।
ভাব যদি বর্তমান এমপি মহোদয় নমিনেশন না পায়?”

-“মানে?”

সাদনান উত্তর দেয় না। শুধু বাঁকা হাসে।
রাহান বোঝলো এই হাসি মানেই ভয়ংকর কিছু চলছে তার বন্ধুর মাথায়।
তবে তা আর সে জানতে চাইলো না।

———–

-“বোম টা টাইম বোম ছিল।”

রাহান ফোন টা কানে নিয়ে ওয়াসিফ দেওয়ান কে বলে।
ওয়াসিফ দেওয়ান বড্ড চিন্তিত হলেন।
সাথে আঁতকে ওঠেন।
কিন্তু নিজে কে যথাসম্ভব শান্ত রেখে জিজ্ঞেস করে

-“সবাই সেফ আছে? ”

-“হ্যাঁ।
সাদনান আগেই সবাই কে কথা টা জানিয়ে দিয়েছে। তাই ওনারা প্রথমে মিটিং করার জন্য আগে যে জায়গায় করেছে ঠিক তবে সেটায় আমরা যাই নি।
নতুন আরেক জায়গায় বসিয়েছে লোক জন।”

রাহান নিজের কথা শেষ সাদনানের হাতে ফোন টা ধরিয়ে দেয়।
সাদনান ফোন টা নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ওয়াসিফ দেওয়ান কে বলে উঠে

-“কিছু করার প্রয়োজন নেই আপনার।
এখন যা করার জণগণ করবে।”

-“বোকা নই আমি।
আগে থেকে জানতে ব্যাপার টা তুমি। চাইলে আইনের সাহায্য নিয়ে কিছু করতে পারতে।
কিন্তু না তুমি তা করো নি।
কারণ টা আমি খুব ভালো করেই বোঝে গিয়েছি।
তখন শুধু কিছু সংখ্যক মানুষ জানতো আর এখন গোটা জেলা জেনে নিলো।
তবে আমি নির্বাচন কমিশন অফিসে কথা বলবো ব্যাপার টা নিয়ে।”

ওয়াসিফ দেওয়ান এর কথার কোনো উত্তর করে না সাদনান।
নিঃশব্দে ফোন কাটে।
রাত এখন প্রায় দশ টার বেশি সময় বাজে।
এখন শহরে যাওয়া সম্ভব নয়।
তাই এখানের এক চেয়ারম্যান এর বাড়িতে আজ তারা রাত টা থাকবে কাল সকালেই নিজের গন্তব্য রওনা দেবে।
এই চেয়ারম্যান এর সাথে ওয়াসিফ দেওয়ান এর কোনো এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় আছে।
আর ওয়াসিফ দেওয়ান কথা বলে আজ রাত টা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
যদিও হবু এমপি হিসেবে তারা সাদনান কে আজ যেতে দিতো না।
আর নিজ থেকে মন্ত্রী হতে প্রস্তাব পেয়ে চেয়ারম্যান আহ্লাদে আটকান হয়ে গেছে।
তাই তো ভীষণ বন্দবস্ত করে এমপি কে আজ চেয়ারম্যান বাড়ি নিমন্ত্রণ জানিয়ে চেয়ারম্যান।

———-

-“মেয়ে টা কে ছিল?

কবির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সামনে রাতের অন্ধকারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
কিন্তু হঠাৎ বাবার কণ্ঠে এমন প্রশ্নে অবাক হয়ে পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে

-“কোন মেয়ে?”

-“নাটক করো না।
দুপুরে যে মেয়ে টাকে তোমার গাড়ি করে হোস্টেল পৌঁছে দিয়ে ছিলে।”

কবির নিজের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া এবার ঠিক করে নেয়।কিন্তু ওর মুখ টা এবার চরম বিরক্তিতে পরিণত হলো।
তার বাবা তকে অনুসরণ করছে?
সিরিয়াসলি ছেলে মেয়ে পটাতে ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করছে। আর তার বাপ সেটা নিয়ে তাকে আবার গোয়েন্দাদের মতো জেরাও করছে? এসব ভাবা যায়?
কিন্তু কিছু করার নেই তার বাপ তার সাথে সব সময়ই এভাবে কথা বলে।
কবির বিরক্ত হলেও তা আবার নিমেষেই উধাও হয়ে যায়।
বাবা তার জন্য নিজের সব ত্যাগ করেছে।
সব সময় তার পাশে ছায়ার মতো থেকেছে।
মা নেই সেটা উপলব্ধি করতে দেয় নি।বাবা মা দুই টাই হওয়া আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
কিন্তু চাইলেই কি সব সম্ভব?
কবির এসব হাবিজাবি চিন্তা করে শান্ত কণ্ঠে বাবা কে বলে

-“কাল ঠিক তিন টায় তোমার অফিসের পাশে রেস্টুরেন্টে থাকবা।
তোমার সব কনফিউশান দূর করে দেবো।
এখন চলো ঘুমাতে যাও।”

কালাম খাঁন আর কিছু বলে না ছেলে যখন একবার বলেছে তার মানে ঠিক কাল তার সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেবো।
কিন্তু কথা হলো আজ আর তিনি ঘুমুতে পারবে না।

———

প্রিয়তা রাত দশ টার দিকে সারা সহ ও পরীক্ষার প্রয়োজনীয় জিনিস সব গুছিয়ে নিলো।
সারা প্রিয়তা এক সাথেই আজ পড়েছে সাদনানের ছোট লাইব্রেরীতে।
এই বাড়িতে ছোট একটা লাইব্রেরী আছে।
যেটায় অনেক বই আছে।
সেখানেই সারা আর প্রিয়তা পড়তে বসেছে।
আজ সারা থাকবে প্রিয়তার সাথে। মূলত এটা আম্বিয়া মির্জার নির্দেশ।
কারণ টা প্রিয়তা বুঝতে পেরেছে।
কারণ সারা কে সাথে থাকার কথা বলাতে সালেহা বেগম অমত পোষণ করলে তিনি সোজা বলে দিয়েছেন বউ মানুষ একা কিছুতেই থাকতে দেওয়া যাবে সাথে বয়স কম আবার চালায় ফোন। তার ধারণা মতে প্রিয়তা যদি রাত জেগে কোনো পরপুরুষ বা কোনো খারাপ কাজ করে?
সাথে এটাও বলেছে তিনি প্রিয়তা এসএসসি পরীক্ষা পর আর পড়া লেখা করাবে না।
বউ মানুষ আবার এতো পড়া লেখা কিসের?
বউ তো বউই সে সংসার করবে সে কেন বাহিরে স্বামীর সাথে ঘুরেবেড়াবে?
প্রিয়তা কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ডান চোখ দিয়ে টপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে বইয়ের উপর পরে।
সারার নজর তখন প্রিয়তার দিকে যায়।
সারা প্রিয়তা কে কাঁদতে দেখে একটু অবাক হয় না। কারণ আম্বিয়া মির্জা সত্যি আজ বড্ড কটু কথা বলেছে।
আর একটা মেয়ের কাছে এই কথা গুলো খারাপ লাগবে এটাই স্বভাবিক।
সারা নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে এসে এক হাতে প্রিয়তা কে জড়িয়ে নিয়ে স্বান্তনার স্বরে বলল

-“দাদি আগের দিনের মানুষ।
তুই তো জানিস তাই একটু বেশি বাচবিচার করে চলাফেরা করি আমরা সবাই।
আর তাছাড়া লেখা পড়া বন্ধ করে দিবে বলেছে?
দেয় নি তো।
আমার ভাই থাকতে এটা সম্ভব হবেও না।
এটা তুই আমি সবাই জানি।
দাদিও জানে।কিন্তু রাগের মাথায় বলে ফেলেছে।
তুই মন খারাপ করিস না।
এখন চল ঘুমিয়ে পড়ি।”

প্রিয়তা শুনে সারার কথা কোনো উত্তর দেয় না।
শুধু উঠে গিয়ে বিছানার এক পাশে চুপ চাপ শুয়ে পড়ে।
সারাও গিয়ে প্রিয়তার পাশে শুয়ে পড়ে।

—————

প্রিয়তা সারা দুই জন পরীক্ষা শেষ হল থেকে বেড়িয়ে আসে।
দুই জনে একই হলে পড়েছে।
তবে দুই জনে দুই সারিতে।
প্রিয়তা সামনে সারাও সামনে।
দুই জনের পরীক্ষায় ভালো হয়েছে। সহজ পরীক্ষা ছিল বাংলা।
সারা প্রিয়তা কথা বলতে বলতে কলেজ হতে বেরিয়ে আসে।
কাল পরীক্ষা নেই।
তবে প্রিয়তার মন টা বড্ড ছটফট করছে।
তার একমাত্র কারণ হলো সাদনান আসার কথা এসছে কি?
ওর মন সাদনান কে দেখার জন্য ছটফট করছে।
গেইট দিয়ে বাহিরে এসেই দেখলো অনেক ভীড় মানুষ জন গিজগিজ করছে।
প্রিয়তা সারা সেই ভীড় ঠেলে একটু রাস্তার সাইডে এসে একটু ফাঁকা জায়গা দাঁড়ালো।
এখানেও মানুষ আছে।
তবে বেশি না।
প্রিয়তা চোখ এদিক সেদিক কিছু খুঁজে চলছে।
সারা পাশে দাঁড়িয়ে পানি খাচ্ছে।
তার ঠিক মিনিট দুই এর মাথায় সাদনান এর কালো গাড়ি টা দেখা গেলো।
কিন্তু তার বিপরীত দিক হতে রাহাতের গাড়ি টাও এসে দুই দিক হতে দুই টা গাড়ি ওদের সামনে থামে।
রাহাত জানতো না সাদনান আসবে নয়তো ও আসতো না।

-“আমি সারা কে নিয়ে বাড়ি যাই?”

রাহাত গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করে
সাদনান শান্ত কণ্ঠে বলে উঠে

-“সাথে ড্রাইভার নিয়ে যাও।”

-“আচ্ছা।”

রাহাত বাধ্য ছেলের মতো রাজি হয়ে যায়।
সারা গিয়ে ততক্ষণে পেছনে বসে পড়েছে।
রাহাতও গিয়ে বসে।
অতঃপর তারা এই স্থান ত্যাগ করে।
প্রিয়তা তখনো সাদনান এর দিকে একটু পর পর আঁড়চোখে তাকাচ্ছে।
সাদনান সেটা লক্ষ করে ঠোঁট এলিয়ে হাসে। কিন্তু সেটা প্রিয়তার নজরে আসে না।
তার কারণ সাদনান মাক্স পড়ে আছে।

-“বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই?”

সাদনান পাঞ্জাবির হাত গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত নিতে নিতে জিজ্ঞেস করে।
প্রিয়তা সে দিকে একবার তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে উঠে

-“ইচ্ছে না থাকলে বুঝি রেখে যাবেন?

-“না, একদম না।
দরকার পড়লে কোলে করে নিয়ে যাব।”

#চলবে……

লুকোচুরি গল্প পর্ব-৩৭ এবং শেষ পর্ব

0

#লুকোচুরি_গল্প
#শেষ_পর্ব
#ইশরাত_জাহান
🦋
“বাচ্চারা বলো,A for Apple”
গুটিকয়েক বাচ্চারা মিলে চিল্লিয়ে বলে,A for Apple.”
“তারপর বলো,B for Ball.”
সবাই চিল্লিয়ে বলে ওঠে,”B for Ball.”
এভাবে করে ছোট ছোট বাচ্চাদের ফ্রীতে পড়াতে থাকে নীরা।রিক নীরব ও দ্বীপের সহায়তায় কেয়া দীপান্বিতা ও নীরা আজ একটি এনজিও চালায়।সরকারি প্রশিক্ষণ এটি।নীরা ইংলিশ কেয়া বিজ্ঞান ও দীপান্বিতা অংক।তিন রমণী মিলে বাচ্চাদের প্রতিদিন পড়াশোনা করায়।আশেপাশে গরীব বাচ্চা যারা আছে সবাইকে এই সংস্থায় বিনামূল্যে পড়াশোনা করাচ্ছে।সাথে করে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে গত তিন বছর যাবত।সকাল নয়টা থেকে দুপুর বারোটা ক্লাস করায় তারা।এখন সবার ছুটির সময়।বারোটা বাজতেই ঘড়িতে শব্দ হয়।সাথে সাথে পড়া বন্ধ করে নীরা বলে,”তাহলে বাচ্চারা!আজ তোমাদের এই পর্যন্ত ক্লাস।আজ আমি আসি।বাই বাই ভালো থেকো।”

সকল ছাত্রছাত্রী মিলে বলে,”আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।”
মিষ্টি হাসি দিয়ে নীরা উত্তর করে,”ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
বলেই নীরা ক্লাস থেকে বের হয়ে দেখা করে কেয়া ও দীপান্বিতার সাথে।কেয়া ও দীপান্বিতা অন্যদের ক্লাস করিয়ে এসেছে।সবাই একসাথে এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়।তারপর সবাই মিলে বাড়িতে যায়।

নীরা বাসায় এসে দরজা খুলতেই নীরাকে এটাক করে তার দের বছরের যমজ দুই মেয়ে(দিশা ও নেহা)। তুতলিয়ে বলে,”আমাদেল নিয়ে দাওনি কেন?”

নীরা ভাবুক ভঙ্গি করে বলে,”আসলে মনে পড়ছে না।ও হ্যাঁ মনে পড়েছে।আমি কত করে চেয়েছি তোমাদের নিয়ে যেতে।কিন্তু তোমাদের বাবা কি পঁচা কি পঁচা।আমাকে বলে তোমার দুই বিচ্ছুকে নিব না।বলেই আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যায়।”

নীরার কথা চোখ মুখ উচু করে শুনতে থাকে দিশা ও নেহা।বলে,”পাপা পতা,পাপা বুলো।”
নীরা সারাদিন দ্বীপকে বুড়ো বুড়ো বলে।তাই এখন বাচ্চারাও দ্বীপকে বুলো বলে।

“হ্যাঁ,আমার সোনামনিরা।আচ্ছা দাদীকে বেশি জ্বালাওনি তো?”
বলতে না বলতেই মিসেস সাবিনা এসে বলেন,”তোমার মেয়ে হয়ে তারা জ্বালাবে না।এটা আদৌ মানতে হবে আমাদের!”

মিসেস শিউলি টিপ্পনী কেটে বলেন,”তা নাতবৌ!এই আট বছরে তো মোট চারটা বাচ্চা নিয়েছো এখন পেটেও এক জোড়া রাখছো (নীরার পেটের দিকে তাকিয়ে)। আর কত নিবা?”
হ্যাঁ,নীরা ও দ্বীপের এই লুকোচুরি গল্পের আট বছর হয়ে গেছে।এই আট বছরে নীরার জোড়ায় জোড়ায় মোট চারটি চুনু মুনু এসেছে।কেয়া ও রিকের দুইটি বাবু তবে যমজ না।দুই বছর গ্যাপ দিয়ে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে(হৃদ ও কোয়েল)।দীপান্বিতার একটি মেয়ে বাবু হয়েছে(নিধি)।নীরা নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলে,”এবার আমি নিজেও হাঁফিয়ে গেছি দাদীন।পোলাপান যা হয়েছে এই তাই মানুষ করতে কষ্টও হচ্ছে।বাকিগুলো নিয়ে কি করবো?শখ মিটে গেছে।”

মিসেস শিউলি ও মিসেস সাবিনা হেসে দেন।নীরা বলে,”দায়ান আর দিহান(নীরার বড় যমজ ছেলে এখন সাত বছর চলে)এরা কোথায়?স্কুল থেকে আসেনি?”

মিসেস সাবিনা বলেন,”তোমাদের বাবা ওকে আনতে গেছে। আর অভ্র নানাভাই আসবে কাল।তোমার baby shower হবে তাই।”
অভ্র এখন বোর্ডিংয়ে পড়াশোনা করে।অভ্রকে ছয় বছর বয়সে বোর্ডিংয়ে দেওয়া হয়।অভ্র ওখানে যেতে না করেনি। বরং সবার সাথে সেও রাজি হয়েছে।শিক্ষকদের ব্যাবহার ও অন্যান্য ছাত্রদের দেখে অভ্র এখন ওখানে থাকতে আনন্দ পায়।দীপান্বিতা মাসে একবার করে সাত দিনের জন্য অভ্রকে নিজের কাছে এনে রাখে।বোর্ডিংয়ের লোকদের সাথে কথা বলা আছে তার।

বিকালে,
দ্বীপ বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকে মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে।পুরো ঘর এলোমেলো।সোফায় স্কুল ড্রেস খাট অগোছালো কাথা কম্বল এলোমেলো।মিউজিক বক্সে গান চলছে,
‘লুংগি ড্যান্স লুংগি ড্যান্স লুংগি ড্যান্স’ গানের তালে দ্বীপের লুংগি পরে নাচতে থাকে পাঁচ বিচ্ছু।বাচ্চা ও মা সাথে করে পেটের ভিতর বেড়ে ওঠা সন্তান মনে হয় পেটেই ডিজে ড্যান্স করছে।তানাহলে এভাবে কেউ সাত মাস অবস্থায় লাফালাফি করতে পারে।মনের খুশিতে নাচানাচি করছে।দেখলে মনে হবে সে প্রেগনেন্ট না তার এমনি এমনি পেট বেড়েছে।তাও আবার ইয়া বড় এক পেট।নীরা মনের খুশিতে নাচতে থাকে কিন্তু হঠাৎ করে গান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নীরার নাচ বন্ধ হয়ে যায়।কিন্তু দিশা ও নেহা এখনও লাফিয়ে লাফিয়ে বলে,”লুংগি দান্ট লুংগি দান্ট।”

বলার পর যখন হুশ ফিরলো গান বন্ধ তখন ওরা বলে,”কি হলো!গান বন্ধ কেনোওও?”

নীরা ও দায়ান দীহান দ্বীপের দিকে তাকিয়ে আছে।বাচ্চারা বাবাকে দেখা মাত্রই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বাবাকে।দ্বীপ একসাথে তার চার সন্তানকে বুকে আগলে নেয়।তারপর বলে,”I miss you all.”

বাচ্চারা বলে,”আমিও।”
দ্বীপ সবাইকে চকলেট দিয়ে বলে,”পাপার গিফট।এখন তোমরা পাপকে গিফট দেও।”

চার বাচ্চা এসে দ্বীপকে চুনু দিয়ে দেয়।অতঃপর দ্বীপ নীরার কাছে আসে।বাচ্চারা চলে গেছে ছাদে।দ্বীপ বলে,”বাচ্চাগুলো তো এমনিতেই বিচ্ছু হয়েছে।পেটের গুলোকে কি আসার আগেই বিচ্ছু বানাবে?”

নীরা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে,”আমি আর পারছি না ক্যাডার সাহেব।এই বারবার বাবু নিতে নিতে পেট ফুলে কুমড়ো হয় তার ভিতর আবার আপনার একশত এক রুলস।”

“তো আমি কি করবো?”

“আমাকে চুনু মুনু গিফট করা বন্ধ করুন ক্যাডার সাহেব।”

“এক ডজন এর জন্য দাবি ছিলো তোমার, চন্দ্রপাখি।”

“আমার এখন শখ মিটে গেছে।এতগুলো বাচ্চা নিলে সরকার আমাদের উপর আইনি পদক্ষেপ নিবে।বলবে,এরা হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির আসল কারণ।এদের জন্যই দেশের জনসংখ্যা বেড়ে আজ বাংলাদেশ দরিদ্র।”

“হুম বুঝলাম।এখন তাহলে আমি চুনু মুনু গিফট করা থেকে রিটায়ার্ড পেলাম।”

“জি,ক্যাডার সাহেব।আসুন আপনাকে খাবার দেই।”

বলেই নীরা চলে যায় ভাত বাড়তে।দ্বীপ ফ্রেশ হয়ে চলে আসে।দুজনে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে।বাচ্চারা বিকালে ঘুম থেকে উঠছিলো না বলেই নীরা গান চালিয়ে নাচতে শুরু করে।অতঃপর দ্বীপ আসাতে এখন সব কাজিন মহল একসাথে হয়ে খেলাধুলা করছে।

_______
দীপান্বিতা ও কেয়া মিলে প্লেট সাজাচ্ছে।baby shower এর থালা সাজানো হচ্ছে।এদিকে নীরাকে সবাই কিছু না কিছু খাওয়াবে।তাই বড় একটি প্লেটে খাবার সাজানো হয়।নীরাকে একটি শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে।মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢাকা।কেয়া ও দীপান্বিতা মিলে নীরাকে এনে বসিয়েছে নীরার আসনে।একে একে সবাই মিলে নীরাকে দোয়া করে দেয়।মিসেস শিউলি গুরুজন তাই তিনি নীরার হাতে baby shower এর থালা তুলে দেন।কিছু দোয়া পড়ে নীরার গায়ে ফু দিয়ে দেন।অতঃপর বলেন,”আর পুতি চাই না গো নাতবৌ।আমার নাতির সম্পত্তি তো শেষ হয়ে যাবে।”

আরেক প্রতিবেশী রসিকতা করে বলেন,”তা বলি তোমার দাদুভাইও তো কম না।বিয়ের পরপর যে মেয়েটাকে বাচ্চা দিচ্ছে এখন বছরের পর বছর বাচ্চা দিতেই আছে।”

আরেক প্রতিবেশী বলেন,”আমাদের অবশ্য ভালো।বছর বছর দাওয়াত পাচ্ছি।”

মিসেস শিউলি বলেন,”দেখছো তো নাতবৌ!তোমাগো জন্য এখন প্রতিবেশীরা বছরের পর বছর আমাগো বাড়িতে আইতে পারে দাওয়াতের জন্য। আর যে কত টাকা যাইবো।”
বলেই সবাই হেসে দেন।

“এই যা!আমরা আসার আগেই baby shower হয়ে গেলো।”
কথাটি শ্রবণ হতেই সবাই মিলে পিছনে তাকিয়ে দেখে পিংকি ও তার স্বামী।সাথে করে মিষ্টি হাসি দেওয়া একটি মেয়ে।মেয়েটির বয়স দুই বছর।মিসেস সাবিনা এসে পিংকিকে জড়িয়ে ধরে বলে,”মামীকে তো ভুলেই গেছো।”

“সংসার শুরু করলে কি আর বাবার বাড়ির দিকে চোখ আসে মামী?তুমি নিজেই তো তোমার বাবার বাড়ির দিকে কম যাও।”

মিসেস সাবিনা হেসে দেন।বলেন,”এটাই যে নিয়ম মা।”

নীরা বলে,”ভাগ্যিস আমাকে আম্মু জোর করে বিয়ে দেয়।নাহলে আমাকেও আজ এটা ভুগতে হতো।”

দীপান্বিতা নীরার কাছে এসে বলে,”শুধু কি তুমি লিটিল ভাবী?আমিও তো তোমার মতো লাকি।”
নীরা এক হাতে জড়িয়ে ধরে দীপান্বিতাকে।ঠিক তখনই দরজায় দাড়িয়ে অভ্র বলে,”আম্মু।”

সাথে সাথে দীপান্বিতার চোখ যায় সেদিকে।দীপান্বিতা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমার বাবাই।আমার কলিজা।কত মনে পরে তোমার কথা।এই এসেছো আর যেতে দিবো না।”

অভ্রর বয়স বারো বছর।কয়েকদিন পরেই তেরো হবে।পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে অভ্র।বলে,”আমাকে তো টপার হতে হবে।তবে আমি মামুর মত না আব্বুর মত বাইরে থেকে পড়াশোনা করতে চাই।আমার তামু(তামান্না) মায়ের সপ্ন পূরণ করতে চাই।”

অভ্রকে দীপান্বিতা সব সত্যি বলে দিয়েছে যখন অভ্রর সাত বছর বয়স।প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে অভ্রকে সব সত্যি বলে দেয় দীপান্বিতা।অন্যদের থেকে জানার থেকে ভালো সে সত্যি জানিয়ে নিজের কোলে আগলে রাখবে অভ্রকে।অভ্র তার জন্মের সময়ের ঘটনা জানার পর কিছুটা কষ্ট পেলেও সবার ভালোবাসায় তা ঢাকা পরে যায়।অভ্র চায় সে তার মৃত মায়ের সপ্ন পূরণ করবে।স্কুল জীবনে থাকতে তামান্না দীপান্বিতাকে বলতো,”আমার প্রথম যদি ছেলে সন্তান হয় ওকে উচ্চ শিক্ষিত করিয়ে বিদেশ পাঠাবো।তারপর তোর মেয়ে হলে তার সাথে বিয়ে দিবো।”

দীপান্বিতা বলতো,”আমার যদি মেয়ে না হয়?”

তামান্না মুখ শুকিয়ে বলতো,”তাহলে তোর কোনো ভাগ্নি দেখে বিয়ে দিবো।”
বলেই দুই বান্ধবী হেসে দিতো।

পুরনো কথা মাথা থেকে বিচ্ছেদ ঘটে নীরার চিৎকারে।নীরা জোরে চিৎকার করে বলে,”ও মা গো।”

মিসেস নাজনীন এতক্ষণ হাসাহাসি করলেও নীরার চিৎকারে আতঙ্কে তাকান নীরার দিকে।দ্বীপ ও বাকি ছেলেরা ঘরে ছিলো।মেয়েলি কাজে ওরা থাকতে চায়নি।নীরার ছটফটানিতে বাইরে চলে আসে ওরা।দেখতে পায় নীরা পেটে হাত দিয়ে বলছে,”খুব পেটে ব্যাথা করছে।ঘর ঘুরছে আমার।এমন তো এর আগে হয়নি।”

মিসেস নাজনীন ও মিসেস সাবিনা মিলে নীরার মাথায় তেল পানি দিতে থাকে।কেয়া ও দীপান্বিতা মিলে নীরার হাত পা মালিশ করছে।দ্বীপ সাথে সাথে নীরার কাছে এসে বলে,”কি হয়েছে?”

নীরা কান্না করতে করতে বলে,”আমি মনে হয় আজ মারা যাবো ক্যাডার সাহেব।খুব ব্যাথা করছে।ওরা পেটের ভিতর খুব লাথি দিচ্ছে।”

ছেলে মেয়েরা মায়ের এমন অবস্থা দেখে আতকে ওঠে।কান্না করে দেয় নীরার কাছে এসে।নীরা তাকায় ওদের দিকে।কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।রিক বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে।কিছুক্ষণ নীরাকে ঘরোয়া উপায়ে ডাক্তারের পরামর্শে চলার পরও যখন কাজ হয় না তখন ডাক্তারকে ফোন দিয়ে শুনতে পায়,”অনেক সময় প্রেগনেন্সির সাত মাসেও ডেলিভারি হয়।এটাকে প্রী মেচিয়োর বেবী বলে।ওনাকে হসপিটালে আনতে হবে।”

নীরাকে কোলে করে নিয়ে দ্বীপ গাড়িতে ওঠে।নীরাকে ধরে বসে আছে কেয়া ও দীপান্বিতা।নীরব তার পার্সোনাল ডক্টর ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে হসপিটালে নীরার ভর্তির ব্যাবস্থা করে।বাচ্চাদের কান্নাকাটি বেড়ে যায় তাই বাধ্য হয়ে তাদেরকে নিয়ে হসপিটালে আসেন মিসেস নাজনীন।অন্যান্যরা আরো জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে আসছেন।

হসপিটালে আসার পর নীরাকে দেখে ডাক্তার বলেন,”ওনার ডেলিভারি করতে হবে।”

নীরাকে নিয়ে অপারেশন রুমে যাওয়ার আগে নীরা তাদেরকে বাধা দিয়ে বলে,”আমি আমার পরিবারকে কিছু বলতে চাই।”

দ্বীপ তড়িৎ গতিতে নীরার কাছে এসে নীরার হাত ধরে বলে,”হ্যাঁ বলো চন্দ্রপাখি।”

নীরা বলতে শুরু করে,”আমি জানি না আমি বাঁচবো কি না।যদি আমি মারা যাই আপনি যেনো দ্বিতীয় বিয়ে করবেন না।”

সবাই হা হয়ে যায় নীরার কথা শুনে। দায়ান ও দিহান এগিয়ে এসে শুনতে থাকে মায়ের কথা।নীরা বলে,”আপনি আরেকটি বিয়ে করলে সেই ঘরেও আরো সন্তান হবে।তখন আমার চার সন্তান সৎ মায়ের কাছ থেকে অনেক মার খাবে। মরার পর ভুত হয়ে আমি এসব দেখতে পারবো না।”

দ্বীপ বলে,”মাথা কি গেছে নাকি? মরার পর ভুত!এসব কি কথা?”

নীরা চিল্লিয়ে পেইন সহ বলে,”হ্যা হ্যা ভুত।আপনি কি মনে করেছেন?আমি মরে গেলে আরেক বিয়ে করবেন।আসলে এটা হবে না।আমি ভুত হয়ে আপনাদের দেখবো।
যাতে আমার মৃত্যুর পর আপনি বিয়ে না করতে পারেন।”

“মাথা গেছে তোমার?

নীরা বলে,”হ্যাঁ,আমার মাথা গেছে।লোকে যেমন দারোয়ান হয়ে চোর পাহারা দেয় আমি তেমন ভুত হয়ে সতিন পাহারা দিবো।”

মিসেস নাজনীন বিরক্ত চোখে তাকান।মেয়ের এতগুলো বাচ্চা হলো।হায়ার এডুকেশন কমপ্লিট করলো আবার এখন একজন উদ্যোক্তা সাথে ছোটখাটো শিক্ষক সে কি না এমন কথা বলে।

দ্বীপ নীরাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নার্সকে বলে,”ওকে নিয়ে যান তো ভিতরে। বউ সহ বাচ্চাকে নিয়ে আসবেন।”

নীরা তার চার সন্তানকে জোরে জোরে বলে,”শোনো চুনু মুনুরা।তোমাদের মা মারা গেলেও ভুত হয়ে আসবে।তাই তোমরা পাপাকে আরেকটি বিয়ে করতে দিবে না।”

দায়ান ও দিহান বলে ওঠে,”হ্যাঁ হ্যাঁ পাপাকে বিয়ে করতে দিবনা।”

ভাইদের এমন বলতে দেখে দিশা ও নেহা বলে,”হ্যাঁ হ্যাঁ বিয়ে কলতে দিবনা।”

সব ভাই বোন মিলে বলে,”সৎ মা আসবে না আনবো না।আসবে না আনবো না।তুমি আম্মু চিন্তা করোনা।”

নার্স নীরাকে নিয়ে ভিতরে যাচ্ছে।নীরা জোরে জোরে বলে,”আমি মারা গেলে ভুত হয়ে আপনার সব সম্পত্তি ভ্যানিশ করে আমার সন্তানদের নামে করে দিবো।আপনি কিন্তু অন্য বিয়ে করার কথা মাথায় আনবেন না ক্যাডার সাহেব।কারণ ভুতের অনেক পাওয়ার থাকে।তারা ম্যাজিক জানে।আমি ম্যাজিক করে আপনার দ্বিতীয় সংসার ভেঙ্গে দিবো।”

দিশা ও নেহা তুতলিয়ে বলে,”আনবে না ক্যাডাল তাহেব।”
দ্বীপের মাথায় হাত। চার বিচ্ছু মায়ের মত পাগল।বাকিরা হাসবে নাকি চিন্তা করবে বুঝতে পারছে না।
________
নীরাকে অপারেশন রুমে নেওয়ার পর সবকিছু শান্ত হয়ে আছে।দ্বীপ একটি বেঞ্চে বসে চিন্তা করতে থাকে।বাবাকে চিন্তা করতে দেখে বাচ্চাগুলো চুপ করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।ছোট দুই দিশা ও নেহা কান্না করতে শুরু করে।তাদেরকে কোলে নিয়ে শান্তনা দিচ্ছে কেয়া ও রিক।কিছুক্ষণ পর রুম থেকে দুটো বাচ্চার কান্নার আওয়াজ বের হয়। নার্সের কোলে করে আসে ছোট ছোট পুষ্টিহীনতার দুইটি বাবু।একটি ছেলে ও একটি মেয়ে।নার্স এসে দাঁড়াতে দ্বীপ তাদেরকে কোলে নেয়।কিছুক্ষণ দেখার পর বাচ্চাদের কানে আজান দিতে থাকে।দ্বীপ ও মিসেস নাজনীন একসাথে বলে,”বাচ্চাদের মা কেমন আছে?”

দিশা ও নেহা বলে,”বাত্তাদেল মা কেমুন আতে।”

নার্স হেসে দেয়।বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।আপনারা ঠিক সময়ে আনতে পেরেছেন তাই সঠিক সময়ে চিকিৎসা করে ডেঞ্জার থেকে মুক্ত।”
নার্সের কথায় সবাই শান্তির নিঃশ্বাস নিতে থাকে।

________
নীরাকে বাসায় আনা হয়েছে আজ দুই মাস।সোফায় বসে মাথায় হাত দিয়ে মেয়ে বাবুকে ফিডিং করায় নীরা।মিসেস শিউলি ছেলে বাবু কোলে নিয়ে আছেন।দিশা ও নেহা কান্নাকাটি করছে।বাচ্চা নব্য দুজনকে ফিডিং করাতে করাতে হাপিয়ে গেছে নীরা।এখন আবার এরা আবদার করছে।ওদিকে দায়ান ও দিহান গোসল না করে মারামারি করছে চিল্লাচিল্লি করছে।মেয়েকে খাওয়ানোর পর ছেলে কেদে ওঠে আবার ছেলেকে শান্ত করার পর মেয়ে কান্না করে।এক কথায় নীরা শেষ।

মিসেস শিউলি বলেন,”কি গো নাতবৌ। আর যমজ কবে নিবা?”

“একবার মরণের হাত থেকে ফিরে আসছি। আর যাইতাম না।”
মিসেস শিউলি হেসে দেন।মিসেস সাবিনা রান্না শেষ করে নীরার কাছে এসে বাবুকে কোলে নিয়ে বলেন,”এবার যমজ মেয়ে দুটোকে আদর করো মা।”

বিরক্ত হয়ে নীরা বলে,”আমাকে এবার একটু আদর করতো।”

মিসেস শিউলি বলেন,”তোমার আর আদর করতে দিমু না।আমি ভাই এবার পুতি হইলে নিজেই বিয়ে কইরা নতুন হউর বাড়ি যামু।”

_______
বাবুদের ফিডিং করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দোলনায় রেখেছে। দায়ান ও দিহান মিলে দিশা ও নেহাকে নিয়ে বাচ্চাদের ঘরে ঘুমাতে গেছে।দ্বীপ নীরার কাছে এসে বলে,”তাহলে শুরু করা যাক?”
“কি!”
“মিশন নেক্সট চুনু মুনু।”
“মাফ চাই, আমার ভুল হয়ে গেছে।তখন আমার আবেগ কাজ করেছিলো এখন বিবেকে নাড়া দেয়।গুড নাইট ক্যাডার সাহেব।”

বলেই নীরা কাথা মুড়ি দেয়।দ্বীপ আলতো হেসে নীরার গা ঘেসে শুয়ে নীরার মাথায় হাত দিয়ে বলে,”পাগলী চন্দ্রপাখি।”
নীরা দ্বীপের দিকে তাকায়।দেখতে পায় চশমা পরিহিত সেই সুদর্শন পুরুষ। যার ছয়টি বাচ্চার মা এখন সে।দ্বীপের দিকে ফিরে নীরা বলে,”বউ পাগলা ক্যাডার সাহেব।”
বলেই দুজনে হেসে দেয়।

সমাপ্ত