Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 299



লুকোচুরি গল্প পর্ব-৩৬

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩৬
#ইশরাত_জাহান
🦋
দীপান্বিতা ও নীরবের বিয়ে পড়ানো সম্পূর্ণ হলো।এখন এদের বিদায় দেওয়ার সময়।দীপান্বিতা শুধু অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে।অভ্র এতক্ষণ খুশি থাকলেও সবার মুখে নিরবতা দেখে তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে।দীপান্বিতা জড়িয়ে ধরে অভ্রকে।বলে,”আমার বাবাই।”

মা না হলেও মায়ের ভালোবাসা আদর দিয়ে বড় করেছে অভ্রকে।মায়ার বাঁধন কি ছেড়ে দেওয়া যায়?দীপান্বিতা জড়িয়ে কান্না করছে।নীরব এসে দীপান্বিতার কাধে হাত রাখে।মুখ উচিয়ে নীরবের দিকে তাকায় দীপান্বিতা।নীরব বলে,”অভ্র আমাদের ছেলে।ওকে আমরা দুজনে মিলে মানুষ করবো।চিন্তার কিছুই নেই।”

খুশি হয় দীপান্বিতা।মিসেস সাবিনা এসে বলেন,”আজকে নানুভাই আমাদের সাথে থাকবে।তাই না নানুভাই?”

অভ্র সহমত দেখিয়ে বলে,”হ্যাঁ।আজকে আমি নানু ননাভাইয়ের সাথে থাকবো।”

নীরা এসে বলে,”হ্যাঁ।থাকবে তো নানুর সাথে।এখন চলো আম্মুর সাথে আমরা তোমার আব্বুর বাসায় যাই।না না ওটা তো তোমার আব্বুর বাসা না ওটা তোমার মামীর বাসা।”

নীরব নীরাকে খেপিয়ে দিতে বলে,”বললেই হলো?এখন তোর বাসা এটা।অবশ্য এটা এখন আমার শ্বশুর বাসা।আমার বাসা তো ওটা।”

“লিসেন ব্রো!এটা আমারও শশুর বাসা।আমার বাবা মা ভুল বশত তোমাকে আগে পৃথিবীতে এনেছিলো।কিন্তু আসলে তো ওটা আমারই বাসা।”

“বাবা মা তোকে ভুল করে পৃথিবীতে এনেছিলো।”

“মোটেই না।তুমি ভুলে এসেছো।”

“আমি না তুই।”

“হবে না তুমি ভুল করে এসেছো।”

লেগে গেছে দুই ভাই বোনের ঝগড়া। কনে বিদায় মানুষ কান্না করবে নাকি বর আর বরের বোনের ঝগড়া দেখবে।অবশ্য এখানে সবাই নীরা ও নীরব সম্পর্কে অবগত।নীরা যেখানে আছে সেখানে কোনো কিছু সুস্থ ভাবে হওয়া সম্ভব?কখনোই না।দীপান্বিতা পর্যন্ত হাসতে থাকে তার বিদায় সময়।দ্বীপ এসে নীরাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে বলে,”আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা আসতে থাকুন।”

নীরা লাফাতে লাফাতে বলে,”ছাড়ুন ক্যাডার সাহেব।আমার বাবার বাসা নিয়ে কথা শুনায়।ওর বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে?বরের মাথা আমি আজ টাক করে দিবো।”
বলতে বলতে দ্বীপ নিয়ে চলে যায় নীরাকে।বাকিরা ধীরে সুস্থে আসতে থাকে।

দীপান্বিতা এসেছে নিজের শশুরবাড়ি।মিসেস নাজনীন দীপান্বিতাকে মিষ্টি খাইয়ে ঘরে প্রবেশ করে।তারপর নীরার ঘরে নিয়ে যায়।দ্বীপ অভ্র ও রিক নীরবের সাথে বাইরে আড্ডা দিতে থাকে।রাতের বেলা দীপান্বিতার মেকআপ মুছে হালকাভাবে সাজিয়ে দেয় নীরা ও কেয়া।নরমাল ভাবেই লাল রঙের বিয়ের শাড়ি পরিয়ে খোঁপায় রজনীগন্ধার গাজরা দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়।মিসেস নাজনীন তার ছেলের বউয়ের জন্য কিছু হালকা গহনা গড়িয়ে রেখেছিলেন।দীপান্বিতাকে ভারী গহনা খুলে এখন কানে হালকা কানের ফুল চিকন চেইন গলায় পরিয়ে দেওয়া হয়।অভ্রকে দ্বীপ নিজের বাবা মায়ের কাছে রেখে এসেছে।এখন অভ্রর ঘুমের সময়।কোনো বাহানা না করেই ভালো ছেলের মত অভ্র চলে গেছে মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস সাবিনার কাছে।

দীপান্বিতাকে আনা হয়েছে নীরবের ঘরে।হালকা সাজে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা এই বাসর ঘর।দীপান্বিতা ও নীরব দুজনেই ভারী সাজ পছন্দ করে না।খাটের কোনা দিয়ে ফুল দিয়ে সাজানো। আর ঘরের কিছু কিছু জায়গায় ডিজাইন করা মোমবাতি জ্বালানো।দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে।দীপান্বিতাকে বসিয়ে দিয়ে বাইরে দাড়ায় নীরা ও কেয়া।দ্বীপ ও রিক মিলে নীরবকে নিয়ে আসে।নীরা ও কেয়াকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সবাই বুঝে যায় কি হয়েছে।নীরব বলে,”ভিক্ষা নেওয়ার জন্য তোকে আমার বাসরটাই খুঁজতে হলো?”

“ভুলে যেও না বিয়েটা কিন্তু আমার ক্রেডিটে হয়েছে।তোমার মতো কেবলা ভাই থাকলে যা হয় আর কি।বোনদের সব করতে হয়।”

“হয়েছে।নিজের সাফাই করতে হবে না।সর এখন।আমার বউ অপেক্ষা করছে।”

“বাহ!এখন বোনের আগে বউ আপন।বিয়ের পর এত চেঞ্জ?”

“তুই কি চাচ্ছিস বলতো?বাসর না করে এখন আমি তোদের খেদমত করি।”

“খেদমত না,পারিশ্রমিক।এই যে তোমার বিয়েতে আমার চুনু মুনুদের নিয়ে এতকিছু করলাম তার পারিশ্রমিক।”

“টাকা ঘরে।”
“তোমার বউও ঘরে।”
“বউয়ের কাছেই তো যেতে চাই।”
“টাকা দেও বউ নেও।”

“সিনেমার ভিলেন তোর মত আচরণ করে।ওরা ঠিক এভাবেই বলে টাকা না দিলে বউ পাবে না।”

“বেশি কথা বললে কিন্তু তোমার বউকে নিয়ে সোজা শশুরবাড়ি চলে যাবো।”

“ওটা এখন আমারও শশুরবাড়ি।”
“ওই বাড়ির পার্মানেন্ট বউ আমি।”
“ওই বাড়ির পার্মানেন্ট জামাই আমি।”

“আমি ওই বাড়িতেই এখন সংসার করি। তাই ওই বাড়িতে আমার অধিকার বেশি।”

“তো যা না।নিজে তো চুনু মুনু এনেছিস।আমাকে বাধা দিচ্ছিস কেনো?”

দ্বীপ পড়েছে বিপাকে।ভাই বোন আনলিমিটেড তর্ক বিতর্ক করা শুরু করেছে।রিক ও কেয়া হাসতে থাকে এদের ভাই বোনদের কান্ড দেখে।নীরা আবার বলে,”এক রাতেই চুনু মুনু আনতে চাচ্ছো তুমি!”

“ভাগ্য ভালো তোর বিয়েতে আমি ছিলাম না।তাহলে তোর বাসরেও আমি বাঁশ দিতাম।”

“আরে আমার তো বাসরই হয়নি।”

এবার নীরব হা হয়ে যায়।অবাক হয়ে বলে,”বাসর না হলে আমার ভাগ্নে/ভাগ্নি কোথায় থেকে আসছে?”

“ওটা এক্সপায়ার্ড বাসর থেকে।তুমি বুঝবে না।টাকা দেও বউ নেও।”

“টাকা কি আমার হ্যান্ড ঘড়ি যে সাথে নিয়ে ঘুরবো?”

“কেনো তুমি জানো না বিয়েতে বাসররাতে টাকা চাওয়া হয়?”

“জানতাম যে শালা শালীরা টাকা চায়।বোন কবে থেকে চায়?”

“এই বোন এখন তোমার শালার বউ।”

দুই ভাই বোনের চিল্লানির শব্দ শুনে হাজির হন মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন।মিসেস নাজনীন এদের শেষের কথাগুলো শুনতে পায় তাই বুঝতে পেরেছেন কাহিনী কি।এক পলক দ্বীপের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত হয়ে বলেন,”এখন তোমার রেস্ট নেওয়ার সময় নীরা। যাও লক্ষ্মী মেয়ের মত রেস্ট নেও।”

মিস্টার রবিন প্রতিবাদ করে বলেন,”আমার মেয়ে এই দিন কি আর ফিরে পাবে?তুমি ওকে বাঁধা দিচ্ছ কেন?”

মিসেস নাজনীন কটমট চোখে তাকান মিস্টার রবিনের দিকে।বলেন,”লাজ শরমের মাথা খেয়েছো বুঝি?তোমার জামাই আছে এখানে দেখতে পাও না।”

মিস্টার রবিন এবার গলা খাকারি দিয়ে নীরাকে বলেন,”মা নীরা!ভাইকে এবার যেতে দেও।ভাইয়ের কষ্ট হচ্ছে তো।”

নীরা চোখ ছোট ছোট করে বলে,”বউয়ের আচল ধরা স্বভাবটা এবার ছাড়ো আব্বু।কয়দিন পর তোমার নাতি নাতনী আসতে চলেছে। নানাভাইকে যদি দেখে বউকে ভয় পেতে তাহলে ওরা তোমাকে খেপাতে থাকবে।”

মিস্টার রবিন এর বিষম উঠে গেছে।মিসেস নাজনীন বলেন,”হয়েছে তো শান্তি?মেয়েকে উড়ন্ত পাখি বানিয়েছিলে না?এবার বোঝো ঠেলা।”

“আমি কি জানতাম ছেলে জামাই জনের সামনে এভাবে ফেস করতে হবে?”

“বিপদ তো তোমাকে কল করে আসবে?”

দ্বীপ এবার আস্তে করে নীরার ঘরে চলে আসে।প্রথমে ভাই বোন তাও মানা যায়।এখন আবার শশুর শাশুড়ি।কেউ কারো থেকে কম না।অবশেষে তর্ক বিতর্ক শেষে মিসেস রবিন টাকা দেন নীরা ও কেয়াকে।তারপর চলে যান সেখান থেকে।নীরবকে ঘরে ঢুকতে দেয় নীরা ও কেয়া।নীরব যাওয়ার পর নীরা ও কেয়া একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে এক চোখ টিপ দেয়।রিক এটা দেখে বলে,”এখন আবার কি হলো?”

কেয়া দাত বের করে বলে,”বাসরটা দেখবো না?”

“কিন্তু কিভাবে?দরজা তো বন্ধ।ঘরের ভিতর তো এখন ওরা। আর বাইরে আমরা।তাহলে কিভাবে বাসর দেখাবো?”

নীরা একগাল হেসে বলে,”কে বলেছে ঘরে ওরা দুজন?”

অবাক হয়ে রিক বলে,”মানে?বাসর ঘরে বর বউ ছাড়া আর কে আছে?”

“বাসর ঘরে এখন বর বউ সহ আমার দাদীন আছে।”
“দাদীন!কোথায় তিনি?”
“খাটের নিচে।”
“আল্লাহ!তাহলে তো ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে।”
“কিছু হবে না। দাদীনের আইডিয়া এটা।”
“কিন্তু আমরা কিভাবে দেখবো?”

নীরা বলে,”আমার ঘর আর ভাইয়ের ঘর পাশাপাশি।আমাদের ব্যালকনির মাঝে শুধু চিকন একটা বর্ডার।ওটা পের হলেই হবে।ব্যালকনির দরজা খোলা।আমরা ওখান থেকেই এন্ট্রি নিয়ে বাসরে সারপ্রাইজ দিবো।”

বলেই নীরা কেয়ার হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে যায়।রিক আর কি তাদের পিছনে দৌড়ায়।নীরা কেয়াকে নিয়ে ঘিরে আসাতে দ্বীপ ভ্রু কুচকে তাকায়।চশমা ঠিক করে বলে,”ওরা বাসায় যাবে না?”
“না।”
“তাহলে?”
“বাসর দেখবে।”
“এই রাতে আর দুষ্টুমি না।অনেক হয়েছে।ওদের এবার রেহাই দেও।”
“আমরা রেহাই দিলেও একজন তো রেহাই দিবে না ক্যাডার সাহেব।”
“কে?”
“সেই ঘণ্টা খানেক ধরে যে দাদীন খাটের নিচে বসে আছে।তার কি হবে?”
“সর্বনাশ! দাদীন ওখানে কেনো?”
“বুড়ি হলে কি হবে দাদী শাশুড়ি আমার এখনও রসিক।”
হাসতে হাসতে বলে নীরা।

“হওয়াচ্ছি তোমার রসিক।”
বলেই হাটা দেয় দ্বীপ।নীরা পথ আটকে বলে,”কোথায় যাচ্ছেন?”

“নীরবের ঘরে।অঘটন ঘটানোর আগে দাদীকে বের করে আনতে হবে।”

“আরে ধুর।বোনের বাসরে কেউ দরজা ধাক্কায়?”

“নাতির বাসরে দাদী আরি পাতে?”

“ধ্যাত!আমার ক্যাডার সাহেব না কিছু বুঝে না।খালি বুঝে চুনু মুনু গিফট করা।আপনি কি বুঝবেন এসবের আনন্দ?”

কেয়া ও রিক মিটমিট হাসতে থাকে।দ্বীপ এবার নীরাকে বলে,”শাট আপ।”

“ইউ শাট আপ।দিন দিন বুড়ো হচ্ছেন।আপনার থেকে দাদীন ভালো।বুড়ি হলে কি হবে মনটা কি সুন্দর কচি।”

“বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু।”
“ভাই ভাবী অঘটন ঘটানোর আগে কি দাদীকে আনতে চান?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আমাকে নিয়ে ব্যালকনিতে চলুন।”
“কেনো?”
“ওখান থেকে আমরা ভাইয়ের ঘরে যাবো।”
“মাথা খারাপ?”

“আমার মাথা ঠিক আছে।আপনার মাথা খারাপ।আপনি জানেন না বাসরে আরি পাতা এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।”

“কোনো কথা না।আমি দাদীনকে আনছি।তুমি চুপ করে এখানে বসে থাকো।”

“ভে ভে ভে।”
কান্নার অভিনয় করে নীরা।
দ্বীপ বলে,”কি হলো?”

“আপনি আমার একটা ইচ্ছাও পূরণ করেন না ক্যাডার সাহেব।আপনি পঁচা।আমার পেটের বাবু আর আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।তাই এখন আমি সারারাত কান্না করবো।”
বলেই কান্নার অভিনয় করে।দ্বীপ বুঝতে পারলো পাগলী ক্ষেপেছে।সারারাত আর থামবে না।এই মেয়ের যে জেদ।তাই দ্বীপ বাধ্য হয়ে নীরাকে ব্যালকনিতে নিয়ে চিকন বর্ডার পার করে।তারপর নিজেও যায় নীরবের ঘরে।রিক ও কেয়াও সেভাবে আসে।

খাটের নিচে বসে বসে কোমড় ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে দাদীনের।কিন্তু নীরব ও দীপান্বিতার কোনো নড়চড় নেই।এটা বাসর নাকি কোনো শান্তি সমাবেশে এসেছে এটাই বুঝতে পারছেন না তিনি।খাটের এক কোনায় নীরবের পা দেখা যাচ্ছে।এখনও কি দীপান্বিতার মুখ থেকে ঘোমটা ওঠায়নি?এমন চিন্তা ভাবনা করছেন দাদী।এদিকে ঘরের ভিতর চারজন ঢুকে পর্দার আড়াল হয়ে যায়।দ্বীপ বলে,”আমার প্রফেশনের সাথে কি এগুলো যায়?”

“আপনার প্রফেশন ধুয়ে আপনি পানি খান।আমার বর হয়ে এগুলো আপনার সাথে যায়।”

“পাগলী বিয়ে করেছিলাম আমি।ভুগতে তো হবেই।”

“পাগলির জন্য কি কি করেছেন তা কিন্তু আমি জানি!”

“এটাই আমার দূর্ভাগ্য।”

এদিকে রিক ও কেয়া বলাবলি করছে। রিক বলে,”আমরা ভালো অ্যাডভান্স ছিলাম তাই না চশমিশ?”

“হ্যাঁ।”

“এদিকে দেখো!নীরব ভাই এখনও দীপান্বিতা আপুর মুখ থেকে ঘোমটা ওঠায়নি।”

“ছেলে মানুষ এত লজ্জা কিসের?”

“এইটাই তো।”

নীরা বিরক্ত হয়ে বলে,”জানতাম আমার ভাই মেয়েদের দিকে তাকায় না।লজ্জা পায়।কিন্তু প্রেমিকাকে বিয়ে করার পরও এত কিসের লজ্জা?তাড়াতাড়ি ঘোমটা ওঠাবে।আমরা কি সারারাত জেগে দেখবো নাকি?শুধু ওদের একটু বোকা বানিয়েই তো চলে যাবো।”

দ্বীপ টিটকিরি দিয়ে বলে,”আমি আগেই বলেছি এসব করার দরকার নেই।এখন বুঝো।ভাগ্য ভালো শীতকাল।এখানে যে চিপা আর গরম।গরমকাল হলে বাবু আর বাবুর মা সব যেতো।”

“ধুর চুপ করে দেখুন তো।”

নীরব একবার দীপান্বিতার মুখের ঘোমটা ওঠাতে যাচ্ছে তো আবার হাত সরিয়ে নিচ্ছে।এরকম করতে করতে মিনিট দশ লাগিয়ে দিচ্ছে তো ঘোমটা ওঠাতে পারছে না।নীরা আবার বলে,”এরা মনে হয় সারারাত ঘোমটা ওঠানো নিয়ে কাটাবে।বাসর আর হবে না।”

“ভাই হয়ে বোনের বাসর দেখছি।এর থেকে লজ্জার বিষয় আর কিছু আছে বলে মনে হয় না।”

“বোন বাসর করছে কোথায়?”
“চুপ।”

“আচ্ছা দিদুনের কি অবস্থা?আমি তো আগে থেকেই মুভ লাগিয়ে দিয়েছিলাম।কি জানি কোমড়ের কি হাল হলো।”
বলেই কেয়া ঝুঁকে চলে যায় খাটের নিচে।কেয়া খাটের নিচে আসার আগেই সেখানে হাজির হয় মিনি(নীরার বিড়াল)।কেয়া ফিসফিস করে বলে,”দাদীন!”
কেয়ার ডাক আর তার সাথে অন্ধকারে সাদা বিড়াল দেখে মিসেস শিউলি ভয় পেয়ে যান।সাথে সাথে চিল্লিয়ে ওঠেন,”আল্লাহ গো!নাতির বাসরে ভুত।”

নীরবের এতক্ষণ ধরে ঘোমটা ওঠানোর প্রচেষ্টা সাকসেস করলো দীপান্বিতা।নিজের ঘোমটা নিজেই উঠিয়ে নীরবের দিকে তাকিয়ে বলে,”দাদীনের আওয়াজ মনে হলো!”

সাথে সাথে নীরা বেরিয়ে এসে বলে,”আমরা সবাই আছি।”

নীরব দীপান্বিতা দূরেই বসে ছিলো।এদের কথা শুনে আরো দূরে সরে যায়।নীরা বলে,”ভেবেছিলাম তোর ঘোমটা ওঠানোর পর আপুকে তুই ভালোবেসে কি উপহার দিস এটা দেখবো।কিন্তু নাহ!তুই তো দেখছি ক্যাডার সাহেবের থেকেও কেবলা।একজন এই প্রান্তে তো আরেকজন ওপর প্রান্তে।”

দ্বীপ নীরাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বলে,”হয়েছে এদের লজ্জা পাইয়ে দিয়েছ।এবার চলো।”
বলেই নীরাকে টানতে টানতে নিয়ে যায়।কেয়া মিসেস শিউলিকে উঠিয়ে দাত বের করে হাসতে থাকে।মিসেস শিউলি বলেন,”আমার নাতবৌ ঠোঁটকাটা হইলেও হোক কথার মালিক।তোমরা পুরুষেরা বাদাইম্মা।”
বলেই কেয়ার হাত ধরে চলে যান।রিক কেয়ার পিছনে চলে আসে।বাইরে বের হয়ে সবাই অট্টহাসিতে মেতে ওঠে।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-৩৪+৩৫

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩৪
#ইশরাত_জাহান
🦋
দুপুরের খাবার খেয়ে মাত্র বসেছে রিক ও কেয়া।এখন আর কেয়া রিকের সাথে কথা বলতে লজ্জা পায় না।রিক ও কেয়া মিলে একসাথে গল্প করতে থাকে।তখনই কল আসে নীরার।কেয়া রিসিভ করতেই নীরা বলে,”শোন শাকচুন্নি! বরের কোল ছেড়ে এবার আমার শ্বশুর বাড়িতে আয়।আমার ননদের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

কেয়া চশমায় হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে বলে,”নীরব ভাইয়ের কি হবে তাহলে?ভাইয়া না আপুকে অনেক ভালোবাসে?”

নীরা কপাল চাপড়ে বলে,”ওরে আমার ননদ আর আমার ভাইয়ের বিয়ের কথাটাই বলছি।তুই আর কমলালেবু(রিক) তাড়াতাড়ি চলে আয় তো।”

“আচ্ছা দোস্ত আমি ওর সাথে কথা বলে আসছি।”

“আমি হলে ক্যাডার সাহেবের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসতাম।বরকে টাইট দিতে শেখ।”

টিটকিরি মেরে কেয়া বলে,”হ্যাঁ আর তোমার জামাই কি করতো?তোমাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে আসতো।”

“ওটাকে ভালোবাসা বলে। মাই ক্যাডার সাহেব ইজ দা বেস্ট হাসব্যান্ড।তাড়াতাড়ি আয়।”

বলেই কল কাটে নীরা।কেয়া রিকের সাথে কথা বলে চলে যায় দ্বীপের বাসায় সাথে করে রিকের মাকেও নিয়ে যায়।মিসেস নাজনীন রিকের মায়ের সাথে সোফায় বসে সবকিছু বলতে থাকেন।রিক দ্বীপ আর নীরব অভ্রকে নিয়ে গল্প করছে।কেয়া নীরা ও দীপান্বিতা তাদের ঘরে বসে আছে।এখন বড়রা মিলে বিয়ের তারিখ ঠিক করবে।তাই সবাইকে ডাকা।

সোফায় বসে আছে বড়রা সবাই।দীপান্বিতা ঘরে ছিলো নীরা টেনে নিয়ে এসেছে।ড্রয়িং রুমের সাথে খাবার টেবিল।সেখানে বসে মেয়েরা আলাপ শুনছে।পুরুষ মানুষ সাথে দ্বীপ ও রিক বসেছে সোফায়।মিস্টার সমুদ্র বলেন,”সামনে তো রোজা।আপনাদের কি ইচ্ছা রোজার ঈদ শেষ করে বিয়ে দেওয়ার?”

দ্বীপ বলে ওঠে,”এত দেরি করার কি দরকার?অলরেডি এদের রিলেশনশিপ গেপ ছিলো অনেক।তাই আমার মনে হয় এদের বিয়ে তাড়াতাড়ি দেওয়াই ভালো।”

মিস্টার সমুদ্র বলেন,”শুভ কাজে দেরি করতে নেই।আমরা তাহলে কবে থেকে বিয়ের আয়োজন শুরু করবো?”

বাবার কথার উত্তরে দ্বীপ বলে,”আমরা কাল থেকেই আয়োজন শুরু করি।এই মাসের মধ্যেই বিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করলেই ভালো হয়।আমার আপাতত কলেজের প্রেসার নেই।”

নীরা আপত্তি জানিয়ে বলে,”কিন্তু এই মাসে তো হাতে গোনা দশ বারোদিন আছে।কিভাবে কি করবো?”

“আমরা সবাই আছি তো।ম্যানেজ হয়ে যাবে।এই মাসের মধ্যে বোনের বিয়ে হলে আমিও একটু শান্তিতে বোনের বিয়ে ইনজয় করতে পারব।”

সবাই খুশি হয়ে দ্বীপের কথাতে রাজি হলো। কালকে থেকেই কেনাকাটা শুরু করবে।লোকজন ডাকবে।তারপর ধুমধাম করে বিয়ে হবে দীপান্বিতা ও নীরবের।নীরা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো দ্বীপের দিকে।কিন্তু এত লোকজনের ভিতর কিছু বললো না।

রাতের খাবার শেষ করে নীরা ঘরে এসে দ্বীপকে বলে,”সত্যি করে বলুন!”

দ্বীপ নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”কি?”

“এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার কারণ কি?”

“কি আবার?বোনের সংসার তাড়াতাড়ি হবে।”

“আমাকে কি খুকি মনে হয়?”

“কিছুতেই না।তুমি তো আমার খোকন খুকির মা।”

“ইয়ার্কি ছাড়েন।বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি কেন?আপনি জানেন আমি একটু পার্লারে যেতে চেয়েছিলাম।আপনার জন্য পারতেছি না।এত তাড়াতাড়ি বিয়েতে কি করবো?”

“আমার বউকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুন্দর লাগে।”

“টাকা বাঁচানোর ধান্দা। কিপ্টা জামাই আমার।”

“মাসে মাসে যে হাজার টাকার জিনিস এনে দেই তা চোখে পড়ে না?চুপচাপ কোনো কথা না বলে বিয়ে ইনজয় করো।”

নীরা এসে দ্বীপের কলে বসে।বলে,”নিজের বউ বাচ্চাকে সুরক্ষিত রাখতে কত চেষ্টা আমার ক্যাডার সাহেবের।”

“বুঝতে পেরেছো তাহলে?”

“কেনো বুঝবো না?আমার ক্যাডার সাহেব আমাকে ভালোবাসে।এটা জানার পর থেকে আমার ক্যাডার সাহেবের মন পড়তে শুরু করেছি।”

বলেই নীরা দ্বীপের চোখ থেকে চশমা খুলে নেয়।চশমা পাশের টেবিলে রেখে বলে,”কয়েকমাস পর থেকে আমাকে আরো সচেতন হতে হবে।লাফালাফি করা যাবে না।ভারী কিছু নেওয়া যাবে না তাই আপনি তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলতে চান।”

দ্বীপ ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে।বলে,”আমার চুনু মুনুদের মায়ের দেখছি চুনু মুনু আসার আগমনে বুদ্ধির আগমন করেছে।”

“হে হে হে।”ভেংচি হাসি দেয় নীরা।

_____
আজ নীরব ও দীপান্বিতার বিয়ের জন্য কেনাকাটা করতে যাবে একসাথে পুরো পরিবার।শনিবার হলেও কলেজে যেতে হবে দ্বীপের।যাওয়ার আগে বারবার নীরাকে বলেছে,”তুমি যেনো মার্কেটে যাবে না।আমি এসে নিয়ে যাবো।রিস্ক নেওয়ার কোনো দরকার নেই।”

নীরা মুখ গোমড়া করে বলে,”বাহ!আমার ভাই আর ননদের বিয়ে আমি কিছু করবো না।আনন্দ করবো না আমি?”

“আনন্দ করবে তবে এখন বুঝেশুনে।বাবুদের আগমনটাও তো বুঝতে হবে।”
বলেই নীরার গালে হাত দিয়ে নীরার দিকে তাকায় দ্বীপ।নীরা আলতো হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে বলে,”ঠিক আছে আমি ওদের সাথে যাবো না।কিন্তু আপনি কলেজ থেকে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন।”

“আচ্ছা,ঠিক আছে। দাদীন আছে বাসায়।কিছু লাগলে ডাক দিও।পারলে তুমি দাদীনের সাথে বসেই গল্প করবে।”

“হুম।”
দ্বীপ নীরার কপালে ভালোবাসা দিয়ে বিদায় নেয়।সবাই মিলে কিছুক্ষণ পর বের হবে।দুপুরে সবাই বাইরে খাবে।নীরার জন্য মিসেস সাবিনা রান্না করে রেখেছেন।

______
দ্বীপ কলেজে থেকে এসেছে।নীরা সাথে সাথে দ্বীপকে জড়িয়ে বলে,”মিস ইউ,ক্যাডার সাহেব।”

দ্বীপ নীরাকে আগলে বলে,”মিস মাই চন্দ্রপাখি অ্যান্ড মাই চুনু মুনু।”
বলেই নীরাকে নিয়ে ঘরে যায়।দ্বীপ গোসল করে বাইরের যাওয়ার ড্রেস পরেই নীরার সাথে দুপুরের খাবার খায়।মিসেস সাবিনা এখন ঝাল মশলা অল্প দিয়ে রান্না করেন।নীরার যেনো গ্যাসের সমস্যা না হয় আর শরীরে পুষ্টি বেশি বেশি থাকে তাই।দ্বীপ নীরার সাথে সেই খাবারটি খাচ্ছে।নীরা বলে,”মামণি তো ফ্রিজে মাংস রেখেছে।আমি গরম করে দেই?”

দ্বীপ নীরার হাত ধরে আটকে বলে,”কোনো দরকার নেই।আমার বউ যদি মা হওয়ায় এত কষ্ট করে আমি কেনো বাবা হওয়ায় কষ্ট করবো না?”

নীরা মিষ্টি এক হাসি দেয়।দ্বীপ নিজেও খাচ্ছে নীরাকেও খাইয়ে দিচ্ছে।খাওয়া দাওয়ার পর দ্বীপ নীরাকে নিয়ে চলে যায় শপিং মলে।শপিং করার ভিতরে দ্বীপ নীরাকে নিয়ে এক কর্নারে আসে।ওখানে বাচ্চাদের জিনিসপত্র বিক্রি হয়।সেখান থেকে ঘোরাঘুরি করে অনেক কিছু দেখতে থাকে দ্বীপ ও নীরা।অভ্রর জন্য কিছু খেলনা আর দুইটি বাবুর ছবি কিনে নেয়।একটি ছবি মেয়ে বাবুর আরেকটি ছবি ছেলে বাবুর।মিসেস শিউলি বলেছেন,”ঘরে বাচ্চাদের ছবি টাঙাইয়া ওই ছবি সারাদিন দেখবা।তোমার বাচ্চাটাও ওরকম সুন্দর হইবো।”

দ্বীপ কথাটি না মানলেও নীরার খুব ভালো লাগে কথাটি।নীরা বলে,”আমার ওমন বাবুর দরকার নেই।আল্লাহ যেমন দিবে তাতেই খুশি।কিন্তু আমি এমনিতেই ঘরে বাবুর ছবি চাই।ওদের দেখলে আমি অনুভব করবো যে আমাদের চুনু মুনু আমার গর্ভে আছে।এমনিতেও ওরা আমাকে উষ্টা দিয়ে উগান্ডায় পাঠাবে।কিন্তু তারপরও আমি চাই বাবুদের ছবি।”

নীরার আবদার দ্বীপ না করতে পারে না।তাই নীরাকে নিয়ে বেবী শপ থেকে কিনে দেয় বাবুদের ছবি।

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩৫
#ইশরাত_জাহান
🦋
রাতের বেলা নীরা ব্যাগ প্যাক করতে থাকে। দ্বীপ ঘরে এসে নীরাকে ব্যাগ প্যাক করতে দেখে অবাক হয়।বলে,”এখন ব্যাগ প্যাক করছো কেনো? কোথাও তো যাওয়ার কথা না আমাদের?”

“আমরা নয় ক্যাডার সাহেব আমি একা যাবো।আমার বাসায়।”

“কেনো?কি হয়েছে?”
নীরা কোনো উত্তর না দিয়ে ব্যাগ প্যাক করছে।দ্বীপ নীরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,”কি হয়েছে বলবে তো?”

“আপনি কি কিছুই বুঝেন না ক্যাডার সাহেব?”

আতঙ্কে দ্বীপ বলে,”কি বুঝবো আমি?”
দ্বীপের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ।যেনো সে কি করেছে কিছুই বুঝতে পারছে না।বুঝবে কিভাবে?সে তো কিছুই করেনি।নীরা হাসতে থাকে।বলে,”আমার ভাইয়ের কাল গায়ে হলুদ ।আমাকে কি এখানে থাকলে হবে?তাই বাপের বাড়ি যাচ্ছি।”

দ্বীপ নীরার ব্যাগ থেকে জামা কাপড় নিয়ে আলমারিতে রাখতে রাখতে বলে,”কোথাও যাবে না তুমি।এখানেই থাকবে।”

ভ্রু কুচকে নীরা বলে,”মানে কি?”

“মানে এই যে ভাইয়ের বিয়েতে জয়েন তুমি বরের বাড়ি থেকেও হতে পারবে।”

“ধুর!দুদিন পর ভাই আমার বউ নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে।আজ একটু আড্ডা দিবো ভাই বোন মিলে।আপনি বাধা দিবেন না।”

“ভাই বোনের সময় সারাদিন পড়ে থাকবে।এখন রাতের সময় স্বামীর দিকে দেখো।”

“আমি এখন স্বামীকে দেখার মুডে নেই ক্যাডার সাহেব।”

“স্বামীকে দেখার মুড এনে দিবো?”

“কিভাবে?”

“চুনু মুনুদের উপর আরো চুনু মুনু এনে।”

“এই না।”

“তোমার কোথাও যাওয়া হচ্ছে না।বিয়েতে ইনজয় করবে ভালো কথা।কিন্তু আমার থেকে দূরে যেয়ে নয়।”

“আমার বউ পাগলা ক্যাডার সাহেব।”

“পাগলির বর হয়েছি পাগল তো হবই।”
নীরা খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে দ্বীপকে।
ব্যালকনিতে বসে ফোনে কথা বলছে নীরব।ফোনের ওপর প্রান্তে দীপান্বিতা আছে।নীরব দীপান্বিতাকে বলে,”অভ্র কি ঘুমিয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে তুমি ব্যালকনিতে আসো।দেখবো তোমাকে।”

“গায়ে হলুদের আগেরদিন কি দেখা করা ঠিক হবে?”

“একদম ঠিক হবে।আসো তুমি।এই চাঁদের আলোয় আমি আমার মায়াবন বিহারিনীর মুখ দেখতে চাই।”

“আচ্ছা,আসছি।”
বলেই দরজা খুলে ব্যালকনির দিকে আসলো দীপান্বিতা।মুখে তার লাজুক হাসি।নীরব আর দীপান্বিতা আগেও এভাবে অনেকবার দেখা করতো।দীপান্বিতা হাসলে গালে টোল পড়ে।সরাসরি নীরবের সামনে দীপান্বিতা হাসলে নীরব এক দৃষ্টিতে দেখতো তাকে।

দূরে দাঁড়িয়ে দীপান্বিতাকে ফোনে জিজ্ঞাসা করে,”তোমার গালে আগের মতো কি সেই টোল পড়ে?”

দীপান্বিতা হেসে দেয়।সোডিয়ামের আলো জ্বলতে থাকে চারপাশে।সেই আলোতে দীপান্বিতাকে স্পষ্ট দেখতে পায় নীরব।দীপান্বিতার মুখে টোল দেখা যাচ্ছে।নীরব বলে,”আয় হায় মায়াবন বিহারিনী!”

আরো কিছু বলতে যাবে তার আগে নীরা তার রুমের দরজা খুলে ব্যালকনিতে এসে বলে,”কি ভাই? কাল গায়ে হলুদ আজ হবু ভাবীকে দেখার এত তারা?”

তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দেয় দীপান্বিতা।নীরব বলে,”তুই ঘুমাস নি? কাল তো অনুষ্ঠান।সকাল সকাল কাজ করতে হবে।”

“তোমার গায়ে হলুদের জন্য যখন এতটাই তাড়াহুড়া তাহলে তুমি ঘুমাও না কেন?শুধু শুধু আমার ননদিনীর সাথে প্রেম করো তাই না?”

“তোর ননদিনী আমার হবু বউ।”

“লজ্জা করে না বিয়ের আগের দিন এভাবে দেখা করে ফিসফিস করে কথা বলতে?”

“নিজের হবু বউকে নিয়ে নিজে ফিসফিস করছি। তোর বাপের কি?”

“আমার বাপের টাকায় গড়া বাড়িতে বসে প্রেম করো।এতেই আমার অনেক।”

“ওটা আমারও বাপ।আমিও আমার বাপের টাকায় বানানো বাড়িতে বসে প্রেম করছি। যা তো শান্তিমতো প্রেম করতে দে।”

এবার নীরা চিল্লিয়ে বলে,”দেখেছেন ক্যাডার সাহেব!বিয়ের আগে আপনার বোনের সাথে আমার ভাই প্রেম করছে।আবার আমার বাপের বাড়ি নিয়ে খোটা দিচ্ছে।”

নীরব এবার নীরাকে আস্তে করে বলে,”বোন আমার।তোর বাপ মানে আমারও বাপ এখন যদি ঘুম ভেংগে যায় তার।রক্ষা নেই আমার আর।”

দাত বের করে হেসে নীরা বলে,”বাপ নিয়ে খোটা দিয়ে তুমি করেছো পাপ।এবার সামলাও তোমার হাবভাব।”
বলেই দীপান্বিতার দিকে উকি দিয়ে তাকায় নীরা।দীপান্বিতা হা হয়ে এদের ভাই বোনের কাহিনী দেখতে থাকে।নীরা দীপান্বিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”সেই তো বিয়ে করবো না বিয়ে করবো না করেছিলে।এখন আবার প্রেম করছো!আমি ভেবেছিলাম আমার ভাইকে বাসর ঘরেও নাকানি চুবানি দিবে তা না।উল্টো বিয়ে ঠিক হতেই দেখছি ননদ আমার বরভক্ত।”

দ্বীপ নীরার পিছনে দাঁড়িয়ে নীরাকে বলে,”সবাই কি তোমার মতো নাকি?”

নীরা দ্বীপের দিকে ফিরে তাকায়।সেই সুযোগে নীরব ও দীপান্বিতা নিজেদের ঘরে দৌড় দেয়।নীরা ক্ষেপেছে মানে সারারাত তর্ক বিতর্ক হবে।নীরা দ্বীপকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমার মতো মানে?”

“এই যে তোমার নজরে বর ছাড়া সারা দুনিয়া আছে।বর কি চায় তা তো দেখো না।দেখবে কিভাবে?তোমার চোখে তো আছে সারা দুনিয়ার কে কে প্রেম করে এগুলো দেখায়।”

“আমি আমার বরকে দেখি না?”

“মোটেও না।”

“বুড়ো বরকে কি দেখবো হ্যাঁ?”

“এখন আমি বুড়ো?”

“অবশ্যই। যার হবু চুনু মুনু আমার পেটে সে তো আস্তে আস্তে বুড়ো হতেই যাচ্ছে।কয়েক বছর গেলেই তো বাচ্চাদের বিয়ে দিয়ে শশুর হবেন।”

“ওহ!আমি বাচ্চাদের বিয়ে দিয়ে শশুর হবো বুড়ো হবো। আর তুমি বাচ্চাদের বিয়ে দিয়েও কচি খুকি থাকবে?”

“আপনি কি জেলাস?গায়ে ঠেলে ঝগড়া করছেন কেনো?”

“বউ আমার বাচ্চা দেওয়ার আগেই বুড়ো উপাধি দিলো।এই দুঃখ আমি কই রাখি!”

হো হো করে হেসে দেয় নীরা।দ্বীপ নিজেই হাসতে থাকে নীরার সাথে।তারপর চলে যায় ঘরে।

_______
সারাবাড়ি আজ হইহুল্লোড়।সবার মুখে আনন্দ খুশি লেপ্টে আছে।নীরব ও দীপান্বিতার গায়ে হলুদের আয়োজন চলছে।ছেলেরা আজ লুংগি আর পাঞ্জাবি পড়বে।মেয়েরা হলুদ রঙের শাড়ি পড়বে।এটা নীরার ইচ্ছা।ও টিভিতে গ্রাম্য বিয়ে দেখেছিলো।তখন থেকেই ওর ইচ্ছা এমনভাবে ভাইয়ের বিয়ে দেওয়ার।

নীরা ঘরে বসে শাড়ির কুচি ঠিক করার চেষ্টা করে।কিন্তু পারছে না ঠিক করতে।কিভাবে শাড়ি ঠিক করবে?শাড়ির কুচি ঠিক করতে গেলে যে তাকে ঝুঁকতে হবে।এদিকে ডাক্তার তাকে ঝুঁকতে না করেছে।নীরার কুচি ঠিক করার চেষ্টার মধ্যেই এক জোড়া হাত নীরার কুচিগুলো ধরে নেয়।নীরা হাতের মালিকের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে।বলে,”আপনাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে ক্যাডার সাহেব।”

দ্বীপ আলতো হেসে নীরার কুচিগুলো ঠিক করে দেয়।দ্বীপের পরনে সাদা ও সবুজের মিশ্রণে লুংগি ও হলুদ পাঞ্জাবী,মাথায় গামছা বাধা আর চোখে তো সবসময় চশমা থাকবেই।নীরার শাড়ি ঠিক করে দ্বীপ বলে,”আমার চন্দ্রপাখিকে সব থেকে বেশি সুন্দর লাগছে।”

বলেই নীরাকে আয়নার সামনে নিয়ে আসে দ্বীপ।নীরার চুলের বিনুনির খুলে আস্তে আস্তে নীরার চুল আঁচড়ে দেয় দ্বীপ।তারপর একটি হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে চুল খোঁপা করে নেয়।ইউটিউব দেখে দেখে নীরাকে সুন্দরভাবে হিজাব বেধে দেয়।নীরা ম্লান হেসে দেখতে থাকে এই যত্নগুলো।

নীরাকে গোছানোর পর নিজেকে দেখে খুশি হয় নীরা।দ্বীপের দিকে ফিরে বলে,”আমাদের জীবনের এই সুখ চিরস্থায়ী হবে তো ক্যাডার সাহেব?”

“সুখ সারাজীবনের জন্য বরাদ্ধ নয় চন্দ্রপাখি।সুখ দুঃখ মিলেই জীবন।এই জীবনে যেমন কেউ আগে আসে কেউ পড়ে আসে ঠিক তেমন কেউ আগে যাবে তো কেউ পড়ে।সুখগুলো সারাজীবন স্থায়ী হবে না।”

নীরা সাথে সাথে দ্বীপকে জড়িয়ে বলে,”আপনার আগে যেনো আমার বিদায় হয় ক্যাডার সাহেব।”

দ্বীপ নীরার ঠোঁটে হাত দিয়ে বলে,”হুশ।আমি কি নিয়ে থাকবো তাহলে?তার থেকে বরং এটাই চাওয়া।গেলে দুজনের জীবন একসাথেই যাবে।”

“হ্যাঁ।তাই ভাল।এই দুনিয়া ছেড়ে যেতে হলে একসাথেই যাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিক খোদা আমাদের।আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”

“আমিও আমার এই দুষ্টু মিষ্টি চন্দ্রপাখি ছাড়া থাকতে পারবো না।”

দীপান্বিতাকে নিয়ে হলুদের আসরে বসানো হয়েছে।নীরব অভ্রকে কোলে নিয়ে সেখানে হাজির হয়।দীপান্বিতার পাশে অভ্রকে কোলে নিয়ে বসে নীরব।ছোট অভ্রকে আজ লুংগি ও পাঞ্জাবি পরানো হয়েছে।দেখতে একদম নীরব দীপান্বিতার ছেলে মনে হচ্ছে।আশেপাশের সবাই এসে তাদেরকে হলুদ দিতে থাকে।কেয়া ও রিক এসেছে দীপান্বিতা ও নীরবকে হলুদ লাগাতে।অতঃপর সবাই মিলে হাতে মেহেদী দিতে থাকে।নীরা আজকে নিজে থেকেই দ্বীপের সামনে হাত পাতে।বলে,”নিন আপনার এলোমেলো জিলাপির প্যাচ দিয়ে আমার হাত রাঙিয়ে দিন।”

সবাই হেসে দেয় নীরার কথায়।দ্বীপ আজকেও নীরার হাতে মেহেদী দিয়ে দেয়।রিক এসে কেয়ার হাত নিয়ে বসে।বলে,”তোমাকেও মেহেদী দিয়ে হাত রাঙিয়ে দিবো চশমিশ।”

কেয়া স্মিত হেসে বলে,”ঠিক জিজুর মতো করে জিলাপির প্যাচ দিবেন তাই না সাদা বিলাই?”

“যেটাই দেই না কেনো!তোমার বর দিচ্ছে ভালোবেসে।”
বলেই সবাই হাতে মেহেদী দিতে থাকে।দ্বীপ নীরা একপাশে রিক কেয়া একপাশে আর মাঝখানে দীপান্বিতার দুই হাত ধরে আছে পার্লারের মেয়েরা।দ্বীপ নীরার হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে আর রিক কেয়ার হাতে।পার্লারের মেয়েরা দীপান্বিতার হাতে মেহেদী দিতে থাকে।নীরব অভ্র মিলে দীপান্বিতার পাশে বসে আছে।দীপান্বিতার হাতের মেহেদী দেখতে থাকে।মেহেদী দেওয়া শেষ হলে সবাই মিলে নাচগান শুরু করে।সবার নাচ দেখে বেচারি নীরা নাচতে যেতে চায়।কিন্তু দ্বীপ নীরার বাহু ধরে আটকিয়ে বলে,”একদম নাচানাচি করবে না।”

চোখ মুখ কুঁচকে নীরা বলে,”বাহ ভাইয়ের বিয়েতে আনন্দ করতে পারবো না?”

“ভাইয়ের বিয়েটা তাহলে চেঞ্জ করে এক বছর পর করে দেই?তখন আনন্দ করো শান্তি মতো।”

“এই না না।এমনিতেই ভাই আমার দেবদাস হয়ে ছিলো।এখন আবার ডেট পিছাইলে দুঃখে সন্ন্যাসী হয়ে যাবে।”

নাচগান শেষ করে সবাই সবার বাড়িতে চলে আসে।নীরা রুমে এসে হলুদের সাজ খুলতে থাকে।দ্বীপ নীরাকে সাহায্য করে দেয়।নীরা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার বউ পাগলা ক্যাডার সাহেব।”
বলেই হেসে দেয় দুজনে।
________
নীরব ও দীপান্বিতার বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে।দীপান্বিতাকে সাজিয়ে গেছে পার্লারের লোকজন।দ্বীপের কথা রাখতে নীরা সাজেনি।অভ্র বসে বসে দীপান্বিতার সাজ দেখতে থাকে।নীরা ব্যাগ প্যাক করছে এখন।দ্বীপ এসে দেখে নীরার ব্যাগ প্যাক করা।দ্বীপের তাকানো দেখে নীরা দাত বের করে হেসে বলে,”টেনশন নট ক্যাডার সাহেব।আপনার বউ কোথাও যাচ্ছে না যাচ্ছে আপনার বোন।”

আশেপাশের লোকজন হো হো করে হেসে দেয়।মিসেস সাবিনা এসে খাইয়ে দেয় দীপান্বিতাকে।নীরা পেটের দিকে তাকিয়ে বলে,”জানিস চুনু মুনু?তোদের দাদী আমাকে একটুও ভালোবাসে না।তোকেও না।”

মিসেস সাবিনা অবাক চোখে তাকিয়ে বলেন,”ও মা আমার কোন কাজে এমন মনে হলো?”

“এই যে মেয়ের বিদায় বলে এখন খাইয়ে দিচ্ছো।আমাকে তো দেও না।”

মিসেস সাবিনা এবার নীরাকে নিজের কাছে এনে দীপান্বিতা ও নীরাকে খাইয়ে দিতে থাকে।অভ্র চোখ পিটপিট করে তাকায়।মিসেস সাবিনা দুজনকে খাইয়ে দিয়ে অভ্রকে খাইয়ে দেন।

দ্বীপকে দেখে মিসেস সাবিনা বলেন,”কনে বিদায়ের সময় কনের সাথে ভাই যায়।তাই আজ তোরা দুজনে ওই বাড়িতে থাকবি।”

মায়ের কথা শুনে দ্বীপ রাজি হয়।নীরা খুশিতে লাফায়।দ্বীপ সাথে সাথে চোখ গরম দিয়ে তাকায় নীরার দিকে।নীরা জিহ্বা কামড় দিয়ে বলে,”সরি।”

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-৩২+৩৩

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩২
#ইশরাত_জাহান
🦋
পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে।মিস্টার সমুদ্র ও মিস্টার রবিন মিলে মিষ্টি খাইয়ে সবাইকে খুশির আনন্দে বলছে,”আমাদের মেয়ে আজ GPA 5 পেয়েছে। নেও তোমরা মিষ্টি খাও।”

হ্যাঁ,আজকে ইন্টারের রেজাল্ট প্রকাশ পেয়েছে।দেখতে দেখতে কতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে। রেজাল্টে নীরা GPA 5 আর কেয়া একটুর জন্য মিস হয়েছে।তবে কেয়ার রেজাল্টও খুব ভালো। আইসিটিতে প্লাস মার্ক না আসাতে কেয়া গোল্ডেন মার্ক উঠাতে পারেনি।রিক ও তার পরিবার এর জন্য কেয়ার উপর খুব খুশি।কেয়া যে পরীক্ষায় পাশ করছে তাও এত ভালো এটা কেউ আশা করেনি।দ্বীপ তো শেষের দিকে কেয়ার জন্য টিউটর দেখেছিলো।পরীক্ষার ভিতর আবার বিয়ের সপ্ন জেগেছিলো কেয়ার।সে মেয়ে যে এ প্লাস পেয়েছে এটা শুনে কেয়ার মা নিজেই মেয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন।দুই বান্ধবীর এত ভালো রেজাল্টের জন্য আজ বাসায় পিকনিক করা হবে। নীরাদের বাসার সামনে ফাঁকা মাঠ আছে।ওখানে সবাই জয়েন্ট হয়ে পিকনিক করবে।

আজ সবার মুখে খুশির ঝলক।কিন্তু নীরা চোখ ছোট ছোট করে তাকাচ্ছে সবার দিকে।খুশি না হয়ে মুখ গোমড়া করে রেখেছে।অভ্র এসে নীরাকে বলে,”কি হয়েছে,মামী?”

নীরা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,”আজ রেজাল্ট বেড় হয়েছে কার?”

অভ্র উত্তর দেয়,”তোমার।”

“ভালো রেজাল্ট করেছে কে?”

“তুমি আর কেয়া আণ্টি।”

“তাহলে মিষ্টি খাওয়ার কথা কার?”

“তোমাদের।”

“মিষ্টি খাচ্ছে কে?”

“মামু।”

“এটা কেমন বিচার?”

“খুব বাজে।”

“এত কষ্ট করে রাত জেগে পড়াশুনা করলাম আমি,ভোরবেলা উঠে বই খাতা নিয়ে কাপাকাপা হাত পা নিয়ে পড়াশুনা করলাম আমি,শীতের মধ্যে থরথর করে কেঁপে কেঁপে পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর দিলাম আমি,অত অত কঠিন কঠিন অংক ইংরেজি মাথায় রেখে পরীক্ষার সঠিক উত্তর দিলাম আমি।রেজাল্টের উপর গোটা গোটা নাম ভেসে আসছে আমার।কিন্তু এলাকাবাসী এসে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে কাকে?”

“আমার মামুকে।”

“কেনো খাওয়াবে তাকে।রেজাল্ট তো আমার ভালো হয়েছে।লোকজন আমাকে মিষ্টি খাওয়াবে তা না,হুহ।”

“আমি শুনেছি তুমি পড়াচোর।মামু না পড়ালে তুমি ভালো রেজাল্ট করতে না।তাই মামুকে সবাই মিষ্টি খাওয়াচ্ছে।”

নীরা এবার কটমট চোখে তাকালো অভ্রর দিকে।বলে,”আমি পড়াচোর?তোমার মামু আমাকে পড়াতে পারতো না যদি আমি আগ্রহ দিয়ে না পড়তাম।”

অভ্র এবার নীরার মত করে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,”আমি দেখেছি তুমি পড়াচোর।একদিন জানালা দিয়ে দেখেছিলাম মামু তোমার গালে একটা মার দিয়েছিলো।পড়াশোনা করলে তো মার খেতে না।”

এত ভালো রেজাল্ট করলো তারপরও যেনো আজ পুঁচকে অভ্রর কাছে অপমান হলো নীরা।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,”তোমার মামুর হাত একটু বেশি চলে।আমি পড়া ঠিকভাবে করতাম।তোমার মামু একটু লিমিটের বাইরে পড়াতো।”

দীপান্বিতা এসে নীরাকে মিষ্টি খাইয়ে বলে,”আমার লিটিল ভাবী।এই নেও মিষ্টি খাও।”

“বাসি মিষ্টি আমি খাই না।”

“ও মা বাসি হবে কেনো?বাবা আর ভাই মিলে সেরা দোকানের মিষ্টি এনেছে।আজকেই বানানো।”

“মিষ্টি সেরা দোকানের হলেও মিষ্টির স্বাদ অন্যজন পেয়েছে।আমি এত ভালো রেজাল্ট করলাম কিন্তু দাম পেলাম না।”

বলেই মুখ ফুলিয়ে ওঠে নীরা।দীপান্বিতা হেসে দেয়।বলে,”ওলে আমার লিটিল ভাবীর অভিমান হয়েছে।চিন্তা করো না।ভাই তোমাকে এর থেকেও সেরা মিষ্টি খাওয়াবে।”

নীরা দীপান্বিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমিও দেখছি আমাদের মতো হয়ে গেছো।”

“তোমাদের ছোয়া পেয়ে তো আমরা সবাই পরিবর্তন।”

সন্ধায় পিকনিক এর ব্যাবস্থা করা হচ্ছে।দ্বীপ কলেজে থেকে এসে সবার থেকে মিষ্টি খেয়ে খেয়ে পেট ভরিয়েছিলো তারপর মিস্টার সমুদ্রর রেস্টুরেন্টে গেছে।সন্ধায় ফিরেছে দ্বীপ ও মিস্টার সমুদ্র।সাথে করে পিকনিকের বাজার সামগ্রী নিয়ে।সবাই আস্তে আস্তে মাঠে উপস্থিত হয়।সবাই এক জায়গায় দাড়ানোর পর দ্বীপ খেয়াল করলো নীরা নেই।দ্বীপ দীপান্বিতাকে জিজ্ঞাসা করে,”নীরা কোথায়?”

“লিটিল ভাবী তো ঘরে।”

“কই না তো।আমি ঘর থেকেই এসেছি।”

“আমি তো লাইভ করতেছিলাম।লিটিল ভাবী বলেছিলো তার এখন ভালো লাগছে না কিছু।তাই ঘুমিয়ে ছিলো। কোথায় যাবে তাহলে?”

“ছাদে গেলো না তো?”
বলেই দ্বীপ চলে যায় ছাদে।কিন্তু নাহ কোথাও নেই নীরা।বাইরে মাঠে এসে দ্বীপ হাফাতে হাফাতে বলে,”কোথায় গেলো ও?মা বাবা সবাই তো এখানে।”

সবাই আলাদাভাবে খুঁজতে থাকে নীরাকে।কেউ খুঁজে পায় না।দ্বীপ অস্থির হয়ে গেছে।চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ।গা হাত পা কাপছে তার।ধপ করে বসে পড়ে মাঠের মধ্যে রাখা কাঠের উপর।মিসেস নাজনীন কান্না করছেন মুখে আচল গুঁজে।মিসেস সাবিনা পাশে এসে শান্তনা দিতে থাকেন।রিকের মাও সেখানে দাড়িয়ে।কেয়া ও রিক একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে কিছু কথা বলে বাইক নিয়ে বের হয় রিক।দ্বীপের করুন অবস্থা মিসেস নাজনীন এর কান্নাকাটি।অভ্র নিজেও এবার ভয় পেয়ে কান্না করছে।বাচ্চা মানুষ সবার চিন্তা দেখে ভয় তো পেয়েছে মামীকে পাচ্ছে না দুই ঘন্টা ধরে।কি হতে পারে।না বলে কোথায় যাবে নীরা।কাউকে সাথে নেয়নি।ফোন করেও পাচ্ছে না নীরাকে।কেউ কিছু বলছে না।দীপান্বিতা অভ্রকে সামলাতে ব্যাস্ত।মামু আর নানুকে কান্না করতে দেখে সেও কান্না করছে।নীরব বাইক নিয়ে বেরিয়েছে।বাকিরা এদিক ওদিক ফোন দিয়ে খোজ খবর নিতে থাকে।

থমথমে পরিবেশ। কারো মুখে নেই কোনো কথা।ঠিক সেই সময় সবার কানে ভেসে আসে,”কি হয়েছে?তোমরা এভাবে কান্নাকাটি করছো কেনো?”

দ্বীপ হাতের মুঠোয় মুখ বুঝে ছিলো।নীরার কণ্ঠ পেয়ে তাকায় নীরার দিকে।হাতের চাপ লেগে চোখের কোনায় চশমার চাপ পড়ে গেছে।শ্যামলা মুখে রক্তের জমাট,চোখমুখ লাল হয়ে আছে।চশমার ভিতর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দ্বীপের চিন্তিত লাল চোখ।তারাতারি উঠে এসে লোকসম্মুখে জড়িয়ে ধরে নীরাকে।বলে,”দুই ঘণ্টা ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাকে।না বলে কোথায় গিয়েছিলে?”

দ্বীপের কণ্ঠে ফোফানির আভাস।নীরা বুঝতে পারলো দ্বীপ খুব চিন্তা করেছে।শুধু দ্বীপ না পুরো পরিবার।নীরা তাকিয়ে দেখলো তার মা কান্না করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা বের করেছে।ছোট অভ্রর চোখ মুখ লাল।মিসেস শিউলি এখনও বুঝতে পারেনি নীরা এসেছে।তিনি ওখানে বসেই তসবি পড়ছেন।বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার দোয়া পরে যাচ্ছেন তিনি।নীরা আস্তে আস্তে হেঁটে এসে মিসেস শিউলির কাছে দাড়িয়ে একটু ঝুঁকে নেয়।তারপর মিসেস শিউলিকে বলে,”নাতবৌ হারিয়ে যায়নি গো দাদীন।নাতির ঘরে পুতিকে আনতে পেরেছে কি না এটা দেখতে গিয়েছিলো।”

নীরার ফিসফিস করে বলা এমন বাক্য শুনে অবাক হয়ে তাকান মিসেস শিউলি।নীরার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কি হলো।নীরার হারিয়ে যাওয়ার জন্য মাথায় চিন্তার মেলা বসেছিলো।তাই নীরার এমন কথার মানে বুঝতে পারছিলো না।মিনিট পাঁচ তাকিয়ে থেকে মিসেস শিউলি জোরে চিল্লিয়ে বলেন,”সত্যি কও নাতবৌ?”

নীরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দৌড় দিলো বাড়ির দিকে।সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে।মিসেস শিউলি জোরে জোরে বলেন,”এমন সময় দৌড়াইতে নাই নাতবৌ।শরীরের ক্ষতি হইবো।”

কেউ কিছু বুঝলো না।দ্বীপ নিজেও দৌড়ে চলে গেলো নীরার পিছনে।ঘরে এসে দ্বীপ দেখে নীরা জানালার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসছে।নীরার কাছে এসে বলে,”কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

“ডাক্তারের কাছে।”

চিন্তার ভাঁজ কপালে ফুটিয়ে উঠলো দ্বীপের।নীরার অতি নিকটে এসে কপালে হাত দিয়ে হাসফাস করে বলে,”আমাকে তো বলবে।আমি যেতাম তোমার সাথে।কি হয়েছে তোমার?”

নীরা উত্তর না দিয়ে মিটমিট হাসে।দ্বীপ এখনও কাপছে।দুই ঘণ্টা একজন জলজ্যান্ত মানুষ হাওয়া।না বলে কোথাও যাওয়ার দরকার তো এখন তার নেই।তারপরও গেছে নীরা।এখন আবার কি হয়েছে তা বলছে না।অবশ্য যে ক্লু নীরা দিয়েছে তাতে বুঝে যাওয়ার কথা।কিন্তু দ্বীপের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।নীরা বুঝতে পারলো।অতঃপর নীরা দ্বীপের হাত নিজের পেটের উপর রেখে বলে,”নিজের অস্তিত্ত অনুভব করার চেষ্টা করুন ক্যাডার সাহেব।”

দ্বীপ সাথে সাথে ধরে ফেলে নীরার কথা।বুঝতে পারে তাদের ভালোবাসার ফল আসতে চলেছে।দ্বীপ নীরার পেটের দিকে তাকিয়ে আছে।ওখানেই দ্বীপের ডান হাত।কোনো কথা না বলে শুধু অনুভব করছে।নীরা আবার বলে,”আমি কয়েকদিন আগে থেকেই নিজের ভিতর পরিবর্তন অনুভব করি।প্রথমে একটু চিন্তা হয়।কিন্তু আমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখতে পাই আমাদের জুনিয়র আসার লক্ষণ।কনফার্ম হওয়ার জন্য হসপিটালে যাই কেয়ার সাথে লুকিয়ে ফুসকা খাওয়ার নাম করে।আপনি কলেজে তখন।বাসায় ইচ্ছা করেই বলিনি।ভেবেছিলাম সবাইকে সারপ্রাইজ দিবো।আজকে প্রেগনেন্সি টেস্টের রেজাল্ট দিয়েছে।আনতে বেশি সময় লাগতো না।কিন্তু ডাক্তার আসায় দেরি হয়।অপেক্ষা করতে হয় অনেকক্ষণ।এদিকে ফোনেও চার্জ ছিলো না।ব্যাগ থেকে ফোন নিয়ে কেয়াকে এসএমএস করবো দেখি ফোন বন্ধ।অপেক্ষা করতে করতে একটু দেরি হয় আর রাস্তার অতিরিক্ত জ্যাম ছিলো।আমি দুঃখিত ক্যাডার সাহেব।সারপ্রাইজ দিতে যেয়ে আমি আপনাদের টেনশনে ফেলে দিয়েছি।কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনাকে আপনার বাবা হওয়ার স্বাদ একটু ভিন্নভাবে দিতে।সবসময় আপনি আমাকে সারপ্রাইজ করে দেন।আমিও চেয়েছি আজ মা বাচ্চা মিলে সারপ্রাইজ দিবো।প্লিজ রাগ করে থাকবেন না।”
কানে হাত দিয়ে রিকোয়েস্ট করে বলতে থাকে নীরা।নীরার চোখেও পানি।সে দ্বীপকে সারপ্রাইজ দিতে পারেনি বরং চিন্তায় ফেলেছে।দ্বীপ নীরার চোখের পানি দেখে হালকা হেসে জড়িয়ে ধরে তার চন্দ্রপাখিকে।বলে,”আজ আমার চন্দ্রপাখি মা হওয়ার অনুভূতি পাচ্ছে।আমি বাবা হওয়ার অনুভূতি।আমার লুকোচুরি ভালোবাসার ব্যাক্তি আমার হয়ে পরিপূর্ণ সংসারী হয়েছে।আমি পূর্ণ হয়েছি আজ।”

দরজায় দাড়িয়ে হাততালি দিতে থাকে সবাই।কেয়া বলে,”আমরা সব শুনেছি।আমি যে কতবার তোকে কল করেছি।তোর কথামত চুপ ছিলাম আমি।আমি তো পারলে এখনই বলে দিবো যে নীরা হসপিটালে।শুধু তোর ইচ্ছা পূরণের জন্য চুপ ছিলাম কিন্তু রিককে পাঠিয়েছি হসপিটালের দিকে।এখনও রাস্তায় সে।বললো জ্যাম পড়েছে খুব রাস্তায়।”

মিসেস নাজনীন এসে নীরার কপালে চুমু দেয়।নীরার হাত দুটো নিজের মুঠে নিয়ে বলেন,”এবার তো একটু বড় হ মা।চিন্তা হয় তো তোকে নিয়ে।তোদের কিছু হলে আমরা বাবা মা যে মরেই যাবো।”

সাথে মায়ের মুখ চেপে ধরলো নীরা।বলে,”আমার মা হওয়ার অনুভূতিতে তুমি এমন কথা বলছো কেনো মা?”

মিসেস নাজনীন জড়িয়ে ধরেন নীরাকে।নীরা বলে,”জানো মা!আমিও এখন মা হবো।”

সবাই হেসে দেয় নীরার কথায়।মিস্টার সমুদ্র নিজের রেস্টুরেন্ট থেকে কেক নিয়ে এসেছে।বাইরে মাঠে সুন্দর করে চেয়ার ও পাটি দিয়ে সাজানো হয়েছে।নীরা ও দ্বীপ মিলে কেক কাটে।একে অপরকে কেক খাইয়ে দিয়ে বাড়ির সবাইকে কেক দেয় নীরা।অভ্র যখন থেকে শুনেছে বাড়িতে নতুন অতিথি আসবে সে ত খুশিতে হাত তালি দিয়ে নাচানাচি করতে থাকে।

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#ইশরাত_জাহান
#পর্ব_৩৩
🦋
শীতের রাতে চারপাশে ঘন কুয়াশায় ঘেরা।সবাই সেই শীতে আগুন জ্বালিয়ে গরম উষ্ণতার উপভোগ করছে।পিকনিকে বার্বিকিউ করা হবে।নীরব রিক ও দ্বীপ মিলে মাংস পোড়ানোর ব্যাবস্থা করছে।এক পাশে গান বাজছে মিউজিক বক্সে।কেয়া এসে নীরার পাশে বসে।বলে,”দেখতে দেখতে আমার বিয়ের আজ প্রায় তিন মাস।তোর জীবনে এসেছে এক গুড নিউজ।আমরা কত তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছি তাই না?”

নীরা কেয়ার কাধে মাথা দিয়ে বলে,”আমরা মাঠে আগে কত লাফালাফি করতাম তাই না দোস্ত?”

“কয়েকদিন পর আমাদের বাচ্চারা খেলাধুলা করবে।”

“মিষ্টি মধুর দিনগুলো এত তাড়াতাড়ি যায় কেন বলতো?”

“নেক্সট জেনারেশন যে আসতে হবে তাই।”
বলেই দুই বান্ধবী ভাবতে থাকে তাদের পুরনো স্মৃতি।কেয়া ও নীরা কখনও একে অপরকে ছেড়ে থাকেনি।কেয়াকে কেউ বাজে কথা বললে নীরা তার মাথা ফাটিয়ে দেয় আর নীরাকে কেউ বাজে কথা বললে কেয়া তার মাথা ফাটিয়ে দেয়।শুধু কি তাই?নীরা ও কেয়া যাই কিনে একসাথে মিলেমিশে কেনাকাটা করেছে।ভিন্ন ঈদে ভিন্ন নামে জামা আসলে নীরা ও কেয়া মিলে কিনতো।কোনো সিনেমা বের হলে একসাথে লুকিয়ে সিনেমা দেখতো।কেউ অসুস্থ হলে আরেকজন তার বাসায় বসে থাকতো।এদের এই বন্ধুত্ব নিয়ে অনেকে চিন্তা করত এরা আলাদা হবে কিভাবে?কিন্তু ভাগ্য তাদের এক করে দিয়েছে।এই যে ফাঁকা মাঠ এই মাঠ কিনে নিয়েছে রিকের পরিবার।এখন এখানেই রিক ও কেয়ার পরিবার গড়ে উঠবে।ভাগ্য নীরার থেকে নীরার প্রিয় মানুষদের আলাদা করেনি।কিন্তু নীরার প্রিয় সময়গুলোকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এত সময় ধরে এগুলো ভেবে নীরা বলে,”মনে আছে দোস্ত?ক্লাসে স্যার পড়াতে শুরু করলে আমাদের সময় যেনো ফুরাতো না।এখন দেখ সুখের সময় কিভাবে ফুরিয়ে যাচ্ছে।”

“হ্যাঁ।স্কুল জীবনে বৃহস্পতিবার করে আমরা কত খুশি হতাম।আজ টিফিন টাইমে ছুটি হবে। কাল শুক্রবার আহ কি আনন্দ করবো।এসব থাকতো আমাদের মাথায়।”

“ক্লাসের ভিতরে টাকলু স্যার যখন পড়াতো আমরা খাতায় তার ছবি আকাতাম।”
বলেই হেসে দেয় নীরা ও কেয়া।মিসেস নাজনীন এসে বসেন নীরার পাশে।বলেন,”পুরাতন স্মৃতিগুলো এমনই হয় মা।জীবনে যত উন্নতি করবে মনে হবে আগের সময়টা কত ভালো ছিলো।মনে হয় ইশ সুযোগ থাকলে এখনই আমি সময়টা ধরবো।কিন্তু না আমরা এটা পারি না।”

“তোমার জীবনে কি এমন আনন্দের সময় আছে আম্মু?”

মিস্টার রবিন এসে স্ত্রী পাশে বসেন।বলেন,”আমাদের সময়ের মুহূর্তগুলো তো আরো মিষ্টি মধুর ছিলো মা।আজকাল প্রেম ভালোবাসা মানে বাজারের ভেজাল শাক সবজির মতো।আমাদের ভালোবাসায় এত ভেজাল ছিলো না।এই ভালোবাসা হোক বন্ধুত্ব হোক বাবা মা আর স্বামী স্ত্রী।আমরা সম্পর্কগুলো সুন্দরভাবে ধরে রাখতাম। হ্যাঁ তোমরাও তেমনটাই আছো।কিন্তু আমাদের আশেপাশে সম্পর্কগুলো এমন হয় না।ভালোবাসায় প্রচুর ভেজাল পড়ে গেছে।”

নীরা বাবার মুখে এমন কথা শুনে খুশি হয়।তার মা বাবার প্রণয়ের বিয়ে এটা নীরা জানে।বাবা তো এক কথায় তার মায়ের জন্য পাগল।নীরা তাই মাঝে মাঝে বাবাকে মনেমনে বউ পাগলা বলে ওঠে।কিন্তু এখন তার ক্যাডার সাহেব ও তো এমন।

মিস্টার রবিনের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে দীপান্বিতা।তাকিয়ে পড়ে নীরবের দিকে। নীরব নিজেও তাকিয়ে আছে দীপান্বিতার দিকে।দীপান্বিতার চাহনি দেখে নীরব দীপান্বিতাকে একটি স্মিত হাসি উপহার দেয়।

মাংসগুলো পোড়ানো হচ্ছে।এদিকে সবার একটাই আবদার।নীরবকে গান গাইতে হবে।গিটার আনা হয়েছে।নীরব গান গাইতে থাকে।দীপান্বিতা মন দিয়ে শুনছে নীরবের গান।

“যদি অভিযোগ কেড়ে নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয় সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলোতে ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার বলো কি থাকে আমার?

যদি ভালবাসা সরে গেলে মরে যেতে হয়,
কেনো সেই প্রেম ফিরে পেলে হেরে যেতে ভয়।”

নীরব এর কণ্ঠে আকুতির সুর।নীরা ও তার পরিবার বুঝতে পারছে নীরবের এই আকুতি।
____
গভীর রাতে শীত বাড়তে শুরু করে।আশেপাশে কুয়াশায় ঘেরা থাকে।আকাশের চাঁদ আস্তে আস্তে তার জায়গা পরিবর্তন করছে।নীরা জানালা দিয়ে দ্বীপের কোলে বসে দেখছে সেই চাঁদ।পিকনিক শেষ করে ঘরে বসে আছে দ্বীপ ও নীরা।দুজনে একসাথে একটি চাদর মুড়িয়ে তাকিয়ে আছে কালো আকাশের দিকে।নিরবতা পালন করে চন্দ্র বিলাস করছে দ্বীপ ও নীরা।ঘণ্টা খানেক এমন হওয়ার পর দ্বীপ বলে,”চন্দ্রপাখি।”

নীরা,”হুম।”
“ঘুমাবে না?”
“আজ আর ঘুম আসবে না ক্যাডার সাহেব।”
“কেনো?”
“আমাদের অস্তিত্ত বেড়ে উঠছে আস্তে আস্তে।আমি আজকে এটা জানতে পেরেছি।সত্যি বলতে কখনও এমন ভালো লাগার অনুভূতি আসেনি।বুঝিয়ে ওঠাতে পারবো না আমি যে মা হবো এমন একটা ফিলিং আমার কেমন যেনো লাগছে।”

“পাগলী বউ আমার।”

“জানেন ক্যাডার সাহেব!ডক্টর যখন আমাকে বলেছিলো যে, কংগ্রাচুলেশন আপনি মা হতে চলেছেন।আমার মনে হচ্ছিলো কোনো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত খুঁজে পেয়েছি।উনি বলেছেন,আমাদের সন্তান নাকি এখন ইদুদের বাচ্চার মত ছোট। আস্তে আস্তে বড় হবে।মাঝে মাঝে আমাকে পেটের ভিতরে লাথি দিবে।আমাকে বাবুর ভালোর জন্য বিভিন্ন উপদেশ দিতে থাকে ডক্টর।তখন মনে হয় আমি বাবুকে কখন কাছে পাবো।একবার ওকে ছুঁয়ে আদর করি।ওকে আমার এখনই পেতে ইচ্ছে করছে।”

দ্বীপ হাসতে থাকে নীরার কথায়।বলে,”চন্দ্রপাখি শান্ত হও।আমাদের চুনু মুনু খুব শীঘ্রই আসবে।এর জন্য তোমাকে ঘুমাতে হবে।প্রপার রেস্ট না পেলে তুমি অসুস্থ হবে আর বাবুর ক্ষতি হবে।”

“হ্যাঁ,ডক্টর বলেছিলো এমন।কিন্তু আমি কি করবো?খুশিতে আমার ঘুম আসছে না।আমি যে মা হবো এটাই আমার খুশিতে ঘুম কেড়ে নিয়েছে।”
কিছুটা মুখ ফুলিয়ে বলে নীরা।
দ্বীপ নীরার ফোলানো মুখে চুমু দিয়ে বলে,”ওলে লে আমার ছোট পাগলী বউ এখন মা হবে।আমার এই বাচ্চা বউ বাচ্চা দিতে যেয়ে ঘুম কামাই করতে চায়।”

নীরা দ্বীপের দিকে ফিরে বলে,”আপনার বউ বাচ্চা না,ক্যাডার সাহেব।বাচ্চা হলে কি আর বাবু এনে দিতে পারতাম?”

“হ্যাঁ,তাইতো।শুধু আমাদের এই এজ ডিফারেন্ট টাই বেশি।”

“অতটাও বেশি না।আমার ক্যাডার সাহেব তো হ্যান্ডসাম পুরুষ।আমার বর আমার কাছে শ্রেষ্ঠ সুন্দর।”

দ্বীপ নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”চাঁদ মামাদের বিলায় বেলা এসেছে,সূর্যি মামাদের আগমন ঘটবে।এবার তো ঘুমোতে হবে।”
বলেই নীরার কথার অপেক্ষা না করে দ্বীপ নীরাকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দেয়।নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”চোখ বন্ধ করো, চন্দ্রপাখি।বাবুর সাথে বাবুর মাকেও এখন রেস্ট নিতে হবে।”

নীরা চোখ বন্ধ করে।দ্বীপ নীরার দিকে তাকিয়ে থাকে।ঘরে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে রাখা আছে।দ্বীপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে তার চন্দ্রপাখিকে।ভাবতে থাকে দুষ্টু মিষ্টি পাগলী বউ কিভাবে আজ মা হওয়ার অনুভূতি পেলো সাথে তাকেও বাবা হওয়ার সুখ দিচ্ছে।দ্বীপের নিজের চোখেও ঘুম নেই।বাবা হওয়ার জন্য তার নিজের ভিতরও আলাদা খুশি কাজ করছে।কিন্তু নীরাকে বোঝানো যাবে না।রাত জেগে গল্প করতে থাকবে তাহলে।
_____
শুক্রবার দিন আজ।নীরার বাসার সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে মিস্টার সমুদ্র।দুপুরে সবাই একসাথে খাবেন।দীপান্বিতা মিসেস সাবিনা ও মিসেস শিউলি মিলে রান্না করছেন।নীরা মুখ ফুলিয়ে সোফায় বসে আছে।তাকে কেউ রান্না করতে দিচ্ছে না তাই।অভ্র খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলছে।নীরা কিছুক্ষণ পর সেদিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর পেটে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,”এখানে যে আছে সেও এক সময় এভাবে খেলা করবে।তাড়াতাড়ি আয় চুনু মুনু।আমি যে তোর দুষ্টুমি দেখবো।একসাথে মিলে ক্যাডার সাহেবকে জ্বালাবো।আচ্ছা তোরা কি একজন নাকি দুইজন?দুইজন আসলে ভালো হবে।এক ডজন চুনু মুনু তাহলে আমি ছয় ছক্কায় আনতে পারবো।কিন্তু এক এক করে আসলে তো আবার বারো বছর ধরেই খালি ডেলিভারি করতে হবে।”

ছোট অভ্র খেলতে থাকে আর পিটপিট করে নীরার দিকে তাকাতে থাকে।নীরার কথার মানে বুঝছে না অভ্র। গাড়ি নিয়ে ঘোড়াতে থাকে আর নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”কি বলো মামী?”

“তোমার ভাই/বোনের সাথে কথা বলি।”
“কোথায় ওরা?”
“ওরা এখন আল্লাহর কাছে আছে।আসবে খুব শীঘ্রই।আমি হাওয়ায় হাওয়ায় কথা বলছি যেনো তোমার ভাই বোন শুনতে পায়।”
“ও”
বলে অভ্র।নীরা অভ্রকে বুঝাতে চায় না এসব বিষয়ে।ছোট মানুষ এসব না জানাই ভালো।
_____
মিসেস নাজনীন চলে এসেছেন আগেই।মিস্টার রবিন ও নীরব জুম্মার নামাজ পড়েই চলে আসবে দ্বীপ ও মিস্টার সমুদ্রর সাথে।বাড়ির মেয়েদের রান্না শেষ করে নামাজ পড়া শেষ।নীরা এখন দীপান্বিতাকে শাড়ি পড়াতে চায়।দীপান্বিতা নাকোজ করে।কিন্তু বাসার সবার কথায় রাজি হয়ে শাড়ি পরতে রাজি হয়।

নীরব দ্বীপ ও বাকি পুরুষ মানুষেরা চলে এসেছে।সবাই সোফায় বসতেই মিসেস নাজনীন ও মিসেস সাবিনা এসে বসলেন সেখানে।নীরা ও মিসেস শিউলি মিলে সাজাচ্ছে দীপান্বিতাকে।নীরবের প্রিয় রঙ বাদামি।অনেক আগেই নীরব দীপান্বিতার জন্য বাদামি রঙের একটি শাড়ি কিনেছিলো।সেই শাড়ি দিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছে দীপান্বিতাকে।

বাড়ির পুরুষ মানুষরা বসে আছে প্রায় বিশ ত্রিশ মিনিট মতো।নীরব বুঝতে পারছে না জুম্মার পর অপেক্ষা কেনো।সবার তো খুদা লেগেছে।ভাবনার ভিতরেই অভ্রর চিল্লানো শুনতে পেলো নীরব।অভ্র হাত তালি দিয়ে বলে,”আম্মু এসেছে।”

নীরব ঘুরে তাকায় সেদিকে।দীপান্বিতার জন্য কিনে রাখা শাড়ি কিভাবে এখানে আসলো বুঝতে পারলো না নীরব।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে।নীরা হেসে বলে,”মা তোমার আলমারিতে দেখেছিলো শাড়িটি।আমরা তো জানি তোমার মনে আমার এই ননদের বসবাস।তাই শাড়ি যে কার হবে এটা বুঝতে পেরেছি।”

নীরব স্মিত হাসি দেয়।অভ্র নীরবের কোলে এসে বসে।দীপান্বিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নীরব ও তাকে নিয়ে বাসার সবাই জানে তাহলে।এবার কি হবে?বাবা কি বলবে? দ্বীপ কি রিয়েক্ট দিবে?ভেবে ভয় পাচ্ছে দীপান্বিতা।

দীপান্বিতাকে অবাক করে সবাই হেসে দেয়।মিস্টার সমুদ্র বলেন,”আমরা সবকিছুই শুনেছি মা।তোদের ভুল বুঝাবুঝি অনেকদূর এগিয়েছে।কিন্তু এত গ্যাপ রেখেও এই সম্পর্কে তোরা অন্য কোথাও মন দিতে পারিসনি।এটাই বড় প্রমাণ তোরা একে অপরকে কতটা ভালোবাসিস।নীরব ছেলে হিসেবে অনেক ভালো।দেখ মা মানুষ মাত্রই ভুল। আর দূর থেকে কাউকে বিচার করাও যায় না।তাই বলি যা হবার হয়ে গেছে ভুলে যা।তাছাড়া তুই নিজেই নীরব ছাড়া অন্য কারো কথা কল্পনায় আনতে পারবি না।এটা নীরা আমাদের খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে।সব মিলিয়ে তোদের সুখের কথা ভেবেই আমি তোদের বিয়ে দিতে চাই।”

মিস্টার সমুদ্রের কথা শেষ হতেই মিসেস নাজনীন এসে দীপান্বিতাকে নিজের সাথে সোফায় বসান।বলেন,”আমার পুত্রবধূ হিসেবে তোমাকে খুব ভালোলাগে।তুমিও তো মনে হয় আমাকে শাশুড়ি হিসেবে পেলে অখুশি হবে না?”

দীপান্বিতা জড়িয়ে ধরেন মিসেস নাজনীনকে।মিসেস নাজনীন আবার বলেন,”আমার ছেলেটার সাথে সাথে তো তুমি নিজেকেও পোড়াতে শুরু করেছো।আমরা বাবা মা কি শুধু দর্শক হয়ে তোমাদের এই কষ্ট দেখবো?বাবা মা তো হয়েছি সন্তানদের সুখী জীবন গড়ে দেওয়ার জন্য।আমি তোমাদের সুখে দেখতে চাই মা।মাফ করে দে আমার ছেলেটাকে।দেখবি এরপর ভুল বুঝলে আমি ওর কান মোলা দিবো।শীতকালে খালি গায়ে বাড়ির বাইরে রেখে দিবো আর গরমকালে সোয়েটার পরিয়ে বাইরে গরমে দাড় করিয়ে রাখবো।”

দীপান্বিতা হেসে দেয়।নীরব নিজেকে এমন কল্পনা করে ভয় পেয়ে যায়।নীরা দীপান্বিতার কাছে এসে বলে,”তো আমার ননদজী।ননদ থেকে ভাবীতে ট্রান্সফার হতে রাজি তো?”

“হ্যাঁ আমার লিটিল ভাবী।এখন তুমিও আমার লিটিল ভাবী থেকে লিটিল ননদ হবে।”

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-৩০+৩১

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩০
#ইশরাত_জাহান
🦋
কেয়াকে সাজানো শুরু করা হয়েছে।পার্লারের মেয়েরা এসে সাজিয়ে দিচ্ছে।সবাই নামাজ পড়ে সাজতে বসেছে।দ্বীপ নীরব অভ্রকে নিয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করতে গেছে।পুরুষ মানুষ সবাই সেখানে।রিক নিজেও জুম্মার সালাত আদায় করে কমিউনিটি সেন্টারে আসবে। রিককে ওয়েলকাম করার জন্য কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ফিতা বেধে রাখা হয়েছে।কেয়ার কোনো কাজিন নেই।কেয়ার বাবা একা ও কেয়ার মামা বিদেশে থাকেন পুরো পরিবার সহ।রিকের খালামণিরা এসেছে।কিন্তু তাদের সন্তানেরা ব্যাস্ত থাকেন তাই আসতে পারেনি।এই জন্য সবকিছু দ্বীপ ও নীরাদের করতে হয়।রিকের মায়ের সাথে নীরার মায়ের ভালো বন্ধুত্ব ছিলো এখন দ্বীপের মায়ের সাথেও হয়েছে।দ্বীপের পরিবার এক কথায় সরল সহজ এক পরিবার।সবাই বলেন মিস্টার সমুদ্র ইচ্ছা করে নিজে ঠকে যাবেন কিন্তু কোনো ঝামেলাতে জড়াবেন না।ঠিক তেমন হয়েছে দ্বীপ। কারো সাথে কোনো ঝগড়া ঝামেলা করে না বরং কারো বিপদে দুই হাত ভরে দিবে।বিশেষ করে তামান্নার বেলায় লোকজন দ্বীপদের বিষয়ে বেশি বেশি অবগত হয়েছেন।একদিকে যেমন সমাজ অভ্রর দিকে আঙুল তুলে ঠিক তেমন মা না হয়েও দীপান্বিতার মাতৃত্বের ভালোবাসার জন্য সেই সমাজ বাহবা দেয়।প্রথম প্রথম অনেকেই বলতেন,”দীপান্বিতা ঠিক করছে না।পরের সন্তানকে নিজের করে মানুষ করা ঠিক না। যার সন্তান তাকে দিয়ে দিলেই হয়।”

বাইরের লোক তো বলতো সাথে করে বলতো পিংকির মা।পিংকি নিজেও অভ্রকে ভালোবেসেছে।কিন্তু মিসেস সাদিয়া সবসময় অভ্রকে কথা শুনিয়ে দিতেন।এমনি সম্পত্তি ভাগাভাগি হবে তার উপর পরের ছেলে।তার ক্ষোভ ছিলো এখানে।কিন্তু এত হেয় কথার বিপরীতেও অভ্রকে ভালোবেসেছে দীপান্বিতা।মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস সাবিনা মিলে সাপোর্ট করেছেন দীপান্বিতাকে।মুখে দুই একবার বলেছিলো অভ্রকে আশ্রমে রাখতে।কিন্তু কোল থেকে ওই ছোট তুলতুলে নরম বাচ্চাকে সরাতেই পারছিলো না দীপান্বিতা।বারবার মনে হতে থাকে তামান্না দেখছে তার সন্তানের বেড়ে ওঠা।একজন মৃত মা তার সন্তানের সুখ হয়তো দুর থেকে দেখছে।দুর থেকে নাহয় এই সুখ দেখুক।দীপান্বিতা সবাইকে বলে,”অভ্র বড় হলে ওকে সোজা আমি বোর্ডিংয়ে ভর্তি করবো।তারপর গ্র্যাজুয়েশন করাতে বিদেশ পাঠাবো। যাতে ওর মনে এটা না আসে যে আমি ওকে আপন সন্তান ভাবি না। হ্যাঁ জীবনে চলতে গেলে নিজের সুখ দেখতে হবে তাই আমিও ওর চার বছর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।আমার ততদিনে গ্র্যাজুয়েশন হয়ে যাবে।আমার গ্র্যাজুয়েশন শেষে নাহয় তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করলে।”

বাসা থেকে সবাই মেনে নেয় দীপান্বিতার কথা।সবার প্রথমে সাপোর্ট করে দ্বীপ।তারপর দীপান্বিতার বাবা মা।প্রতিবেশী হয়ে নীরার বাবা মাও দীপান্বিতাকে অনেক সাপোর্ট করে।আশেপাশে থেকে মানুষ যখন অভ্রকে দেখে ক্ষিপ্ত হতে থাকে মিসেস নাজনীন তখন অভ্রকে কোলে নিয়ে পুরো এলাকা ঘোরাঘুরি করে। প্রায় প্রায় দীপান্বিতার কাছ থেকে অভ্রকে নিয়ে সকালের রোদ পোহাতে যায়।এদের সবার এই ভালোবাসা দেখে আস্তে আস্তে মুখ বন্ধ হয় সমাজের।নীরা ছোট হলেও চঞ্চল ছিলো খুব।নীরাকে সবাই একটু বেশি ভয় পেতো।মুখের উপর উচিত জবাব দেওয়া নীরার অভ্যাস।সবার এত এত সাপোর্ট ভালোবাসায় আজ অভ্র চোখের মণি। আর সমাজের কাছে দ্বীপের পরিবার সরল সহজ নামে পরিচিত।

___
জুম্মার নামাজ পড়ে সবাই চলে এসেছে। পাঞ্জাবী পরেই নামাজ পড়তে বের হয়েছিলো সবাই।তাই তাদের আর সাজগোজ করা লাগেনি।ছেলেরা সবাই বরকে নিয়ে এসে দেখে মেইন গেটের সামনে ফিতা দেওয়া।সবাই বুঝে যায় এটা বরের জন্য করা।কেয়াকে এখনও সাজানো হচ্ছে।কেয়ার পাশে দীপান্বিতা বসে সাজ দেখছে।নীরা ও কিছু প্রতিবেশী মেয়ে মিলে গেছে বরকে ওয়েলকাম করতে।

হাতে মিষ্টি ও শরবতের ট্রে নিয়ে নীরা বলে,”জামাইবাবু আগে আপনাকে ফিতা কাটতে হবে।”

রিকের বাবা বলেন,”তোমাদের কোনো ডিমান্ড নেই?”

“ওটা এখন না আংকেল।সময় হোক উশুল করবো।”

সবাই হেসে দেয়।রিক ফিতা কেটে দেয়।তারপর নীরা শরবতের গ্লাস নিয়ে রিকের সামনে ধরে।রিক শরবতে চুমুক দিতে যাবে তার আগে দ্বীপ গ্লাস কেরে নিয়ে রিকের সামনে ধরে।নীরা চোখ ছোট ছোট করে মনে মনে বলে,”জেলাস,ক্যাডার সাহেব।”

রিক দ্বীপের হাতেই গ্লাসে চুমুক দেয়।মিস্টার রবিন বলেন,”মেয়ে আমার সেরা জামাই পেয়েছে।কি সুন্দর করে গ্লাস নিয়ে বুঝিয়ে দিলো।”

মিস্টার সমুদ্র বলেন,”আপনি তো ট্রেইলার দেখেছেন আর আমি দেখি ফুল মুভি।”

সবাই অট্টহাসিতে মেতে ওঠে।নীরা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে পাশে থাকা মেয়েকে বলে,”জামাইবাবুকে মিষ্টি খাইয়ে দে।আমার উনি আবার জেলাস আছেন।বলা তো যায় না মিষ্টি খাওয়াতে গেলে আবার কোনো এক জায়গা থেকে পোড়া গন্ধ ভেসে আসে।”

বলেই মিষ্টির প্লেট দিয়ে দেয় পাশে থাকা মেয়েটির হাতে। রিককে মিষ্টি খাওয়ানোর পর ছেলেরা মিলে রিককে উচু করে নিয়ে যায় বরের আসনে।বাকিরা হাত তালি দিতে থাকে।নীরা চলে আসে কেয়ার কাছে।কেয়ার সাজানো কমপ্লিট।এখন শুধু গহনাগুলো পরিয়ে দেওয়া বাকি।একে একে সবাই মিলে কেয়ার গহনা দ্রুত পরিয়ে দেয়।সবার খুদা লেগেছে।বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলেই খাওয়া দাওয়ার পালা।কাজী এসেছেন বিয়ে পড়াতে সাথে একজন রেজিষ্টার।বিয়ে পড়ানো সম্পূর্ণ হলো।বর বউ দুজন দুই রুমে বসেই একে অপরকে কবুল বলে গ্রহণ করে নিলো।বড়রা সবাই খেতে বসেছে।নীরা দীপান্বিতা ও বাকি মেয়েরা বড় রক থালা নিয়ে এসেছে রিকের কাছে।রিকের পাশে বর সেজে বসে আছে ছোট অভ্র বাবু।দীপান্বিতাকে দেখে অভ্র হাত উচু করে বলে,”আম্মু আমি এখানে।”

দীপান্বিতা মিষ্টি হাসি দেয় অভ্রকে দেখে।নীরা বলে,”হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের ছোট বর বাবুকে তো আমরা দেখেছি।”

নীরব তাকিয়ে আছে দীপান্বিতার দিকে। রানি গোলাপী ও সবুজের মিশ্রণে খুব সুন্দর শাড়ি পরেছে দীপান্বিতা।মাথায় গোলাপী হিজাব।মুখে কোনো প্রকার মেকআপ না দিয়ে শুধু একটু ক্রিম লাগানো আর চোখে চিকন কাজল ঠোঁটে গোলাপী লিপস্টিক।এই সাজেই দীপান্বিতার প্রতি নেশা ধরে গেছে নীরবের।নীরা নীরবের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে,”উহু উহু।”

নীরব তাকায় বোনের দিকে।নীরা বলে,”বেটার লাক নেক্সট টাইম ভাই।আপাতত বরকে খাওয়াও সবাই মিলে।আফসোস কেয়ার বিয়েটা আমার আগে হতো।আমিও মজা করতে পারতাম।”

দ্বীপের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে।দ্বীপ বলে,”খুব শখ হয়েছে না!পরের বরকে খাইয়ে দেওয়ার?”

নীরা নাক মুখ উচু করে অভিনয় করে বলে,”কোথা থেকে জানি পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে!”

অভ্র বলে,”কিছু পুড়েছে মামী?”

“হ্যাঁ বাবাই,তোমার মামুর মন।”

অভ্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্বীপকে দেখতে থাকে।কোথাও আগুন বা ধোয়া না দেখে বলে,”কোথায়?দেখতে পাচ্ছি না তো?”

“এটা দেখা যায় না বাবাই।আমি স্পেশাল মেজিক দিয়ে বুঝতেছি।”

সবাই আবার হেসে দেয়।অভ্র বেচারা হা করে তাকিয়ে আছে।তার মাথায় ঢুকছে না কোনো কিছুই।নীরব অভ্রর পাশে বসে বলে,”ওসব তোমাকে বুঝতে হবে না বাবাই।আসো আমরা একসাথে তোমার রিক আংকেলকে খাইয়ে দেই।”

“আচ্ছা।”

বলেই সবাই মিকে রিককে খাইয়ে দেয়।দ্বীপ নীরার হাত ধরে নিয়ে আসে এক কোনায়।নীরাকে দেওয়ালের সাথে আটকিয়ে বলে,”খুব শখ না বর বাদেঅন্য ছেলেকে খাইয়ে দেওয়ার?”

মিটমিট হেসে নীরা বলে,”হ্যাঁ,খুব শখ আমার।”

দ্বীপ নীরার হাত জোরে চেপে ধরে বলে,”নিজের বরকে তো খাইয়ে দেওয়ার ইচ্ছা জাগে না।”

“আউচ।লাগছে তো!”

“লিসেন দুষ্টুমি করো কিন্তু ওভার হলে…”

“কি?ওভার হলে কি করবেন?”

“এক সাথে যমজ না একসাথে এক ডজন বাবু এনে দিবো তোমার এই ছোট পেটে।”

নীরা যেনো এবার ভ্রমে চলে গেলো।কল্পনা করছে তার পেট ফুলে উঠেছে বারোটা বাবু তার এই পেটে।ডেলিভারির সময় যখন নার্স আসবে তার পেট কাটতে তখন ঘন্টাখানিক ধরে খালি বাবু বেড় হতেই থাকবে আর নীরা বেচারি বাবু গুলোকে বেড় হতে দেখবে।একসাথে বারোটা বাবু পুষবে কিভাবে?তাড়াতাড়ি নীরা কল্পনা থেকে বেড়িয়ে বলে,”বলছি কি একসাথে এতগুলো না দিয়ে বরং আস্তে আস্তে দুই একটা করে বাবু দিলে হয়না?”

দ্বীপ ঠোঁট কামড়ে হেসে দেয়।বউ তো না যেন কুবুদ্ধির ড্রাম।নীরার নাকের সাথে নিজের নাকের ঘষা দিয়ে বলে,”দুষ্টু চন্দ্রপাখি আমার।”
_____
রিকের খাওয়া দাওয়া শেষ।অন্যদিকে কেয়াকে ওর মা খাইয়ে দিয়েছে।এখন রিকের হাত ধোয়ানো হয়েছে। নীরব দ্বীপ ও বাকি ছেলেরা মিলে রিকের হাত ধুয়ে দিচ্ছে।তারপর রিক ও কেয়াকে একসাথে করে বড় স্টেজে বসিয়ে দেওয়া হলো।কেয়া মুখের উপর পাতলা ঘোমটা দেওয়া।নীরা একটি আয়না এনে কেয়া ও রিক বরাবর ধরে।তারপর বলে,”আয়নায় কি দেখছেন জামাইবাবু?”

রিক কেয়ার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার কিউট গুলুমুলু চশমিশ।”

“আরে বাহ।”

সবাই হেসে দেয়।নীরা বলে,”নেন আপনার চশমিশ বউয়ের ঘোমটা আপনি নিজেই সরিয়ে মুখোদর্ষণ করেন।”

রিক কেয়ার মুখ থেকে ঘোমটা সরায়।সাথে সাথে নীরব দীপান্বিতা অভ্র ও আরো ছেলে মেয়েরা মিলে লাল গোলাপের পাপড়ি ছিটাতে থাকে।রিক ও কেয়া দুজন দুজনকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে।নীরা দ্বীপ ও বড়রা মিলে হাত তালি দেয়।মিসেস শিউলি এসে মজা করে বলেন,”হুনো নাতিন,বউয়ের দিকে সারাজীবন চাইয়া থাইকো।এখন একটু আমাগো দেখতে দেও। আর আজ রাইতে তো বউ তোমার হইয়াই যাইবো।আমার নাতিনের মতো আবার দেরি করে বউরে ভালোবাইসো না।”

দ্বীপ ও নীরা লজ্জায় এদিক ওদিক করে।মিস্টার সমুদ্র বলেন,”আহ মা সবাই আছে তো।”

রিকের বাবা বলেন,”নানী দাদিদের কাজই তো এমন মজা করা।”

সবাই মিলে এখন নাচ গান শুরু করবে।সন্ধার দিকে বিদায় ব্যাবস্থা হবে।দীপান্বিতা ও অভ্র মিলে পাশাপাশি দাড়িয়ে আনন্দ করছে।অভ্রর শরবত খেতে ইচ্ছা করে।দীপান্বিতা অভ্রকে শরবত খাইয়ে দেয়।শরবতের গ্লাস অভ্রর হাত থেকে পড়ে দীপান্বিতার শাড়ির কিছু অংশ ভিজে যায়।দীপান্বিতা অভ্রকে দ্বীপের কাছে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়।শাড়ি ওয়াশ করার সময় দীপান্বিতা পাশে তাকিয়ে ভয় পেয়ে জোরে এক চিৎকার দেয়….

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩১
#ইশরাত_জাহান
🦋
চিৎকার দেওয়ার সাথে সাথে সেখানে হাজির হয় নীরব।নীরবকে দেখে দীপান্বিতা তাড়াতাড়ি নীরবের এক বাহু জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে।নীরব বলে,”কি হয়েছে?”
দীপান্বিতা উত্তর না দিয়ে আঙুল দিয়ে পাশে ইশারা করে দেখায়।নীরব তাকায় দীপান্বিতার আঙুল বরাবর স্থানে।ফ্লোরে জিনিসটি দেখে মুস্কি হাসি দেয় নীরব।বলে,”তেলাপোকা দেখে ভয় পাওয়ার কি আছে?”

“আপনি বুঝবেন এসবের?আমার খুব ভয় করে।প্লিজ সরান ওটা।”

“না সরাব না।”

“প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

“সরাতে পারি।আমার এক শর্ত আছে।”

“কি শর্ত?”

“বলো আমাকে বিয়ে করতে রাজি?”

“না।”

“তাহলে আমিও তেলাপোকা সরাব না।”

“প্লিজ!”

“রাজি হও আগে।তানাহলে কিন্তু আমি তোমার চুলে এই তেলাপোকা গুঁজে দিবো।”

“এই না না না।”

“তাহলে বলো আমাকে বিয়ে করবে।”

কান্না করতে করতে দীপান্বিতা বলে,”হ্যাঁ হ্যাঁ করবো।তোমাকেই বিয়ে করবো।”

নীরব শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,”অভ্র বাবাই চলে এসো।তোমার আম্মু রাজি,তাড়াতাড়ি ডাকো কাজী।”

খুশিতে খুশিতে অভ্র চলে আসে।নীরবের কথা শুনে দীপান্বিতা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়।অভ্র হাত তালি দিয়ে বলে,”আমার হ্যাপি ফ্যামিলি হবে।কি মজা কি মজা।”

নীরব হাসতে হাসতে বলে,”আগে তোমার আম্মুর ভয় তো কমাও।”

বলেই ইশারা করে তেলাপোকার দিকে।অভ্র দেওয়ালের কাছে গিয়ে তেলাপোকাকে হাতে নেয়।দীপান্বিতা নাক মুখ কুঁচকে বলে,”ছিঃ।এগুলো হাতে নেও কেনো,বাবাই?ফেলে দেও।”

নীরব ও অভ্র হেসে বলে,”এটা হলো তোমার বিয়েতে রাজি করানোর ঔষধ।এটা আসল নয় নকল তেলাপোকা।”

দীপান্বিতা অবাক হয়ে তাকায় অভ্রের হাতের দিকে।অভ্র বলে,”আমার আব্বু(নীরবের দিকে তাকিয়ে বলে) বলেছে তুমি রাগ করলে তেলাপোকার ভয় দেখালে রাগ ভাঙবে। আর তোমাকে একা একা এখানে পাঠাতে।তাই আমি তোমার গায়ে শরবত ঢেলে দিয়েছি।”

দীপান্বিতা অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে নীরব ও অভ্রর দিকে।অভ্র ভয় পেয়ে বলে,”আমি না আব্বু বলেছে এগুলো।তুমি নাকি আব্বুর উপর রেগে ছিলে তাই।”

“কিসের আব্বু?”

নীরব বলে,”আমি অভ্রকে প্রস্তাব দিয়েছি।আমাকে ওর আব্বু বানাবে কি না।অভ্র রাজি।”

“অভ্রর আম্মু রাজি না।”

“এই,এই মাত্রই তো রাজি হলে।দেখেছো অভ্র!তোমার আম্মু কি মিথ্যুক?”

“মিথ্যা বলতে নেই আম্মু। দাতে পোকা হয়।”

“তার জন্য বড় বড় দাতের ডাক্তার আছে।তোমাকে পাকনামি করতে হবে না,চলো।”

বলেই দীপান্বিতা অভ্রর হাত ধরে নিয়ে যায়।পিছন থেকে নীরব গলা উচিয়ে বলে,”মানতে তো তোমাকে হবেই মায়াবন বিহারিনী।”

বলেই নিজের হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো ব্রাশ করতে থাকে নীরব।দীপান্বিতা অভ্রকে নিয়ে হাঁটতে থাকে আর আনমনে হাসতে থাকে।

___
কেয়ার বিদায়ের সময় এখন।মা বাবাকে জড়িয়ে কান্না করতে থাকে কেয়া।নীরা এসে কেয়াকে বলে,”এমন ভাবে মেকআপ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।আরে ভাই বিয়ে হয়েছে মানে তো এই না যে তুই দূরে চলে গেছিস।এই তো কয়েক বাড়ি পিছনে তোদের বাসা।”

সবাই হেসে দেয়।কেয়া নিজেও হেসে ফেলে নীরার কথায়।অতঃপর ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে বসে কেয়া ও রিক। আস্তে আস্তে কমিউনিটি সেন্টার ফাঁকা হতে থাকে।কেয়া গাড়ির জানালা থেকে উকি দিয়ে দেখছে তার বাবা মাকে।এই কমিউনিটি সেন্টারের প্রত্যেক কোনায় কোনায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে কেয়া।রিক কেয়ার মাথায় আলতো হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,”এভাবে তাকিয়ে থেকো না চশমিশ।অসুস্থ হয়ে যাবে তুমি।”

“আমাদের মিলনটা এই সেন্টার থেকেই হলো তাই না,সাদা বিলাই?”

“হ্যাঁ। আর এখানেই প্রতি নিয়ত আরো লোকজন এসে আমাদের স্মৃতিগুলোকে সরিয়ে দিবে।”

“স্মৃতিরা চোখের পাতায় থেকে যায়।কিন্তু মুহূর্তগুলো হারিয়ে যায়।”

“এক মুহুর্ত পেরিয়েই তো আমরা আরেক মুহূর্তে যেতে পারবো।”

বলেই কেয়ার মাথা নিজের কাধে রাখে রিক।বলে,”যতগুলো মুহূর্ত আমাদের গড়ে উঠবে সবকিছু মধুর মুহূর্ত হবে,চশমিশ।”

স্মিত হাসে কেয়া।রিক নিজেও ম্লান হাসি দিতে থাকে।

____
দ্বীপ নীরা ও তাদের পরিবার এক গাড়িতে করে আসে।মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন রিকের বাবা মায়ের সাথে আগেই বেড়িয়েছেন।নীরব ও দীপান্বিতা অভ্রকে নিয়ে ঘুরতে থাকে।অভ্রর কাছে ভালো লাগে বাইকে নীরবের সাথে ঘুরতে।সবার অনুমতি পেয়ে দীপান্বিতা নিজেও রাজি হয় বাইকে ওঠার।অবশ্য দীপান্বিতার মন তো এটাই চেয়েছিলো।

বরের গাড়ি এসে পৌঁছেছে বাসার সামনে।রিকের মা মিষ্টি ও পানি নিয়ে বৌমাকে খাইয়ে দিলেন।সব নিয়ম কানুন পালন করে কেয়াকে বাড়ির ভিতরে এনে নরমাল শাড়ি পরানো হলো।রাত অনেক হয়েছে।দীপান্বিতা ও নীরব অনেক আগেই এসেছে।রিকের ঘর সাজানো হয়েছিলো সকালেই।এখন শুধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে নীরা ও দীপান্বিতা।কেয়াকে নিয়ে ঘরে সজ্জিত খাটের উপর বসিয়ে দিলো নীরা।সাথে ছিলেন মিসেস শিউলি। দাদী হলেও রসিক মানুষ তিনি।নীরার জন্য বেশি সুবিধা। দাদী সবকিছু কেয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।কেয়া মাথা নিচু করে চুপ করে আছে।নীরা এবার বলেই ফেলে,”তুই এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন?”

কেয়া চশমা পরনে চোখ উচু করে তাকায় নীরার দিকে।কিন্তু কেয়াকে কিছু বলতে না দিয়েই নীরা বলে,”এমন ভাব করছিস যেনো তুই কিছু বুঝিস না।এদিকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অহরহ সিনেমা দেখেছিলাম যার বেশিরভাগ ছিলো ব্লু ফিল্ম।এখন ঢং করছিস যেনো কিছুই বুঝিস না।একদম লজ্জাবতী লাজুকতা।সেই রিকের প্রেম প্রস্তাব দেওয়া থেকে দেখছি এমন নেকু নেকু ভাব করছিস।আমি বিরক্ত এবার তোর হাবভাবে।”

দীপান্বিতা কেয়ার কাছে এসে বলে,”মেয়েটাকে লজ্জায় আর ফেলো না লিটিল ভাবী।”

“তোমার কি মনে হয় আপু?আমার বান্ধবী হয়ে ও কাচা।যেখানে আমি হলাম ক্যাডার সাহেবের ইচড়ে পাকা সেখানে এই চশমিশ হলো তার সাদা বিলাই এর ইচড়ে পাকা।

চোখের চশমা ঠিক করে বলে,”আমি ইচড়ে পাকা?তোর মতো চুমুখোর না।বিয়ের পর বরের ভালোবাসা পেতে ব্লাকমেইল করিস।”

“দেখেছো দাদীন।এই হলো আমার শাকচুন্নি বান্ধবী।আসল রূপ নিয়ে আসতে পেরেছি আমি।কিন্তু আফসোস তুই আমার বিপরীতে হতে পারলি না।আমি যেমন কথা পেটে চাপায় রাখতে পারিনা তোকে বলে দেই।তুইও তেমন নিজের বাসর ঘরে আমার বাসরের গল্প আমার দাদী শাশুড়ির সামনে বলছিস।”

কিসের লজ্জা কিসের বাসর?কেয়া এবার তেতে উঠলো নীরার কথায়। সাথে সাথে খাট থেকে নেমে সুন্দর করে সাজিয়ে পরানো শাড়ি গুজে নিলো নিজের কোমরে।বলে,”তোর বাসর আমার বাসর হবে পরে আগে তোর ব্যাবস্থা করছি দ্বারা তুই।”

বলেই আশেপাশে তাকাতে থাকে কেয়া।খুঁজে খুঁজে রিকের একটি ব্যাট পায় ঘরের এক কোনায়।কেয়াকে ব্যাট নিতে দেখেই নীরা লাফিয়ে উঠে বলে,”হয়ে গেলো রে!শাকচুন্নি আজ বাসর না করে আমাকে ধাওয়া করবে।”

“তুই শাকচুন্নি,তুই পেত্নী তুই দ্বারা।আজ তুই শেষ।”

বলেই কেয়া তাড়া করতে থাকে নীরার পিছনে।কোমরে শাড়ি গুঁজে হাতে ব্যাট উচু করে নীরার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,”দ্বারা পেত্নী তুই।তোর হেস্তনেস্ত করেই আমি তারপর বাসর করব।”

“বাসরে বান্ধবী মারতে নেই রে,বাসরে বিড়াল মারবি।অবশ্য আমার ক্যাডার সাহেব বাসরের বিড়াল না মেরে আসল বিড়াল মেরেছিলো।তুই তোর সাদা বিলাইকে মারবি।”

“আমার সাদা বিলাই আমার জামাই।আমি তাকে ব্যাট দিয়ে মারবো না মারবো ভালোবাসা দিয়ে।তোকে মারবো তার আগে।”

এদিকে ওরা চিল্লাতে চিল্লাতে ড্রয়িং রুমে চলে এসেছে।দীপান্বিতা ও মিসেস শিউলি আহাম্বক হয়ে ছিলেন।রিকের বাবা মা নীরার বাবা মা দ্বীপ ও নীরব রিককে নিয়ে বসে ছিলো ড্রয়িং রুমে। রিককে দ্বীপ ও নীরব মিলে ঘরে নিয়ে যাবে তার আগেই নীরার পিছনে কেয়াকে এভাবে দৌড়াতে দেখে সবাই অবাক।বাসর ঘরে বউ লজ্জা না পেয়ে বান্ধবীকে তাড়া করে।এবার বাসরের রেকর্ড ভেঙেই ফেললো এই দুই বান্ধবী।সবাই তাকিয়ে মিনিট দুই তিন দেখতে থাকে।কে কাকে সামলাবে বুঝতে পারছে না।কেয়াকে লোকজনের মাঝে রিক ধরে আটকাতে লজ্জা পাচ্ছে। দ্বীপ এমনিতেও বউ লাগল উপাধি পেয়ে বসে আছে।বাকি রইলো নীরব,সে জার্মানে থাকতে কোনো মেয়ে ধরলো না তার অন্য কাউকে!অতঃপর রিকের না নীরাকে ও নীরার মা কেয়াকে ধরে আটকায়।

মিসেস নাজনীন কেয়াকে ধরে বলেন,”এভাবে বাচ্চাদের মতো করছো কেন?কি হয়েছে?”

কেয়া ব্যাট নিয়ে এখনও ছোটাছুটি করছে আর বলে,”তোমার মেয়ে বলছে আমি নাকি ওর মতো নির্লজ্জ।আমি কি ওর মতো চু…”

বাকি কথা না বলে চুপ যায় কেয়া।শশুর শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে হুশ ফিরে কেয়ার।চশমা হালকা নাকের দিকে ঝুঁকে গেছে।মিসেস নাজনীন স্বাভাবিক দেখে কেয়াকে এবার ছেড়ে দিলেন।কেয়া চশমা ঠিক করে বলে,”তেমন কিছুই হয়নি।”

মিসেস শিউলি বলেন,”নাতবৌ আমার ভুল কিছু কয় নাই।তুমি আসলেই লজ্জাবতী নও।আমি তো ভাবছিলাম রিক নাতিন তোমার হাত ধরতে গেলেই তুমি নেতিয়ে যাবে।কিন্তু এখন দেখি বাসরের রেকর্ড ভাঙো।”

কেয়া বারবার রিকের বাবা মায়ের দিকে তাকাচ্ছে আর লজ্জায় ফ্লোরে তাকিয়ে আছে।কেয়ার কোমরে এখনও শাড়ি গোজা আছে।নীরা হাফাতে থাকে।দীপান্বিতা এক গ্লাস পানি দেয়।পানি পান করে নীরা বলে,”নিজের রক্তকেও এত গভীর ভাবে চিনি না যতটা নিজের বেস্টুকে চিনি।গ্যারান্টি দিয়ে বলে দিচ্ছি ওর ভিতর লজ্জার ছিটে ফোঁটা নেই।”

মিসেস নাজনীন ও বাকিরা সবাই বুঝে গেলো কি বিষয়ে এত লাফালাফি।নীরা খেপিয়েছে কেয়াকে। আর কেয়া লজ্জার উপর লজ্জা পেয়ে তেতে উঠেছে।মিসেস নাজনীন নীরাকে চোখ গরম দিয়ে বলেন,”এগুলো কি নীরা?আজ ওদের বিয়ে হয়েছে।লজ্জা পাওয়া তো স্বাভাবিক।”

“হ্যাঁ তাইতো।এত লজ্জা পেয়েছিলো যে আমার সামান্য কথায় লজ্জা নিবারণ হয়ে গেলো। দেখছো না আমাকে কিভাবে ধাওয়া করছে?”

এবার রিকের মা বাবা হেসে দেন।মিসেস শিউলি বলেন,”হইছে।এবার আসো দিদিভাই।রিক নাতিন আমার কষ্ট পায়।কোমরের আচল এখন মাথায় দেও।যদিও তোমার লজ্জা মিশ্রিত মুখ না দেখে নাতিন আমার দেখলো বউয়ের অগ্নিধারণ রূপ।ভয়টয় পাইলো কি না কে জানে?”

নীরা এবার অট্টহাসি দিতে থাকে।তারপর কেয়ার কাছে এসে কেয়াকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বলে,”বাসরে বর লজ্জা নিবারণ না করে বান্ধবী লজ্জা নিবারণ করে দিলো। হ্যাপি মেরেড লাইফ দোস্ত।”

কেয়া নীরার পিঠে আলতো নরম বারি দেয়।তারপর দুজনে একসাথে হেসে ওঠে।সবাই মিলে খুশি হয়।কেয়া ও রিককে এবার একসাথে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়।তারপর নীরা দ্বীপ দীপান্বিতা ও মিসেস শিউলি সবাইকে বিদায় দিয়ে নিজের বাসায় চলে আসে।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-২৮+২৯

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২৮
#ইশরাত_জাহান
🦋
কেয়াকে সাজিয়ে স্টেজে বসানো হয়েছে।কেয়াকে কলাপাতা রঙের সাথে হলুদের মিশ্রণে একটি শাড়ি পরানো হয়েছে।মাথায় গলায় ও হাতে ফ্রেশ ফুলের গহনা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।সেখান থেকে নীরা ও দীপান্বিতাকে ফুলের চুরি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।এখন কেয়ার একপাশে নীরা আর একপাশে দীপান্বিতা বসে আছে।একটু পর কেয়ার হাতে মেহেদী দেওয়া হবে।আপাতত সবাই এসে এসে কেয়াকে মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছে।

মেহেদী দেওয়ার জন্য দুজন মেয়ে এসেছে পার্লার থেকে।কেয়ার হাতে তারা মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে।মেহেদী দেওয়ার পর পার্লারের মেয়েটি বলে,”বরের নাম কি দিবো?”

নীরা বলে ওঠে,”সাদা বিলাই।”

সবাই হেসে দেয় একসাথে।কেয়া চশমার ভিতর থেকে নীরাকে চোখ গরম দিতে থাকে। রিককে আনা হয়েছে হলুদের নতুন পাঞ্জাবী পরিধান করিয়ে।নীরব ও দ্বীপ মিলে রিককে কেয়ার পাশে এসে বসিয়ে দেয়।একে একে এবার সব মেয়েদের হাতে মেহেদী দেওয়া হবে।নীরা ও দীপান্বিতা হাতে মেহেদী দিতে বসে।নীরা হাত পেতে বসার পর পরই দ্বীপ এসে নীরার সামনে বসে বলে,”আজকে আমি দিয়ে দিবো তোমার হাতে মেহেদী।”

সবাই তাকিয়ে আছে দ্বীপের দিকে।কেয়া নিজের বিয়ের জন্য এক্সসাইটেড থাকলেও লজ্জায় মুখ নিচু রাখতো।কিন্তু দ্বীপের মতো মুডি স্যার যাকে কি না সবাই ভয় পায় সে তার বউয়ের কাছে এতটা রোমান্টিক এগুলো যেনো কেয়াকে অবাক করে দেয়।মনে মনে বলে,”স্যার হলে কি হয়েছে?আমার বান্ধবী রোমান্টিক এক বর পেয়েছে।”

মিসেস নাজনীন মেয়েকে তার মতো সুখী দেখে খুব খুশি হন।তিনি তো জানতেন দ্বীপ তার মেয়েকে এভাবেই সুখে রাখবে।মিস্টার রবিন এসে মিসেস নাজনীনের পাশে দাড়িয়ে বলেন,”কি দেখছো এভাবে?তোমার সন্তানেরা সুখেই আছে।”

“আমার মেয়ের এই সুখ নিজ চোখে দেখবো বলেই তো মেয়েকে সফলতা হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলাম।আমার আর আফসোস নেই।আমার মেয়েকে তার মতো করে আগলে রাখার মানুষ যে পেয়ে গেছি।এভাবে সুখে থাকলে আমাদের মেয়ের আর কিছুই লাগবে না।”

“তারমানে নীরার পড়াশোনা বন্ধ করে সংসার করতে দেওয়া যাবে।কি বলো?”

মিসেস নাজনীন বিরক্তিকর চোখে তাকালেন মিস্টার রবিনের দিকে।বলেন,”এই তোমার মাথায় ছাই পাশ কথা বার্তা আসে বলেই আমার মেয়ে পড়াশোনায় মন দেয় না।”

“হা হা হা।”

হাসতে থাকেন মিস্টার রবিন।তারপর বলেন,”আমার মেয়েকে আমি যেমন মাথায় উঠিয়েছি তার দ্বিগুণ তাকে মাথায় উঠিয়ে রেখেছে তার স্বামী। দেখোনা বউ থুয়ে এক রাত থাকতে পারলো না।কেমন হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছিলো।আজ আবার হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে।”

“তোমারই তো জামাই।তোমার মতোই হয়েছে।”

“যাক জামাই আমার শ্বশুরের ছোঁয়া পেয়েছে।বউকে ভালোবাসে খুব।”

মিস্টার রবিন ও মিসেস নাজনীনের কথা শুনতে পান মিসেস সাবিনা ও মিস্টার সমুদ্র।মিসেস সাবিনা বলেন,”দেখেছো বেয়াই বেয়াইদের।কত প্রেম তাদের ভিতর।কিন্তু তুমি এক পানসে লোক।কখনও ভালোবেসে কোথাও ঘুরতেও নিয়ে যাওনি আজ অব্দি।”

“শুরু হয়ে গেছে তোমার?”

“হ্যাঁ,শুরু তো খালি আমিই করি।কোনোদিন শেষ করতে পারোনি।”

বলেই মুখ ভেংচি দিয়ে চলে যান মিসেস সাবিনা।মিস্টার সমুদ্র বিড়বিড় করে বলেন,”বুড়ি হয়েও ভিম্রতি।”

“বউকে ভালোবাসা সুন্নত,বেয়াই সাপ।”কাছে এসে বলেন মিস্টার রবিন।

হালকা হেসে গল্প করতে থাকবেন মিস্টার রবিন ও মিস্টার সমুদ্র।মিসেস নাজনীন গেছেন মিসেস সাবিনার সাথে গল্প করতে।

দ্বীপ নীরার হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে।নীরা চুপচাপ দেখতে থাকে।মেহেদী দেওয়া শেষে দ্বীপ বলে,”কেমন হয়েছে?”

নীরা বলে,”এর থেকে তো জিলাপির প্যাচ করা সহজ।কথায় ফুল কোথায় ডাল কিছুই বুঝতে পারছি না তারপরও সুন্দর হয়েছে।”

অভ্র নীরার কাছে এসে নীরার হাত দেখে।দ্বীপকে বলে,”এটা কি মামু?এর থেকে ভালো আমি ভুতের বাড়ি আকাতে পারি।”

সবাই হেসে দেয় অভ্রর কথায়।নীরব এসে দাঁড়ায় অভ্রর কাছে।বলে,”সবাই ছবি তুলছে বাবাই। চলো আমরাও ছবি তুলি।”

অভ্র রাজি হয়।চলে যায় নীরবের সাথে।অভ্র নিজেও ছোট কলাপাতা রঙের পাঞ্জাবী পড়েছে।নীরবের কোলে অভ্রকে ছবি তুলতে দেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দীপান্বিতা।খুব সুন্দর লাগছে দুজনকে।যেনো মনে হচ্ছে বাবা ছেলে।তামান্না দেখতে ফর্সা ও সুন্দরী ছিলো ওর স্বামী কেমন ছিলো এটা জানে না দীপান্বিতা।কিভাবে জানবে? সময়ই তো পায়নি ওদের ব্যাপারে জানার।ভেবেছিলো অভ্র হওয়ার পর কেস করবে কিন্তু তার আগেই মারা গেলো তামান্না।অভ্রর জন্মের সময় ওর মুখটি লাল টমেটোর মতো হয়েছিলো।অতিরিক্ত ফর্সা মুখে রক্ত জমাট বাঁধা ছিলো।সেই অভ্র আজ দীপান্বিতার ভালোবাসার মানুষের কোলে আদর নিচ্ছে।দীপান্বিতার চোখ দিয়ে নিজ থেকেই সুখের পানি চলে আসে।

মিসেস নাজনীন তাকান দীপান্বিতার দিকে।দেখতে পান দীপান্বিতা মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে অভ্র ও নীরবের দিকে।সাথে সাথে মিসেস নাজনীন কথা বলেন মিসেস সাবিনার সাথে।বলেন,”আচ্ছা আপা,আমার ছেলেকে আপনার কাছে কেমন লাগে?”

মিসেস সাবিনা বলেন”ছেলে তো আপনার মাশাআল্লাহ।শিক্ষিত ভদ্র আবার এখন তো একজন নিউট্রিশন।কেনো বলুন তো?”

“আমি ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছি।কিন্তু আমার মনে হয়েছে আমাদের কাছেই তো আছে যোগ্য পাত্রী।এছাড়া আমাদের মধ্যে এখন আত্মীয়তার সম্পর্ক এসেই গেছে।এটাকে আরো মজবুত করতে চেয়েছিলাম আর কি।”

মিসেস সাবিনা বুঝতে পারলেন মিসেস নাজনীনের কথা।তাই বলেন,”আপনার মেয়েকে আমি নিয়ে নিয়েছি বলে আমার মেয়েটিকেও কি আপনি নিতে চান,আপা?”

“যদি বলি হ্যাঁ তাই?”

“আমার আপত্তি নেই।বাসায় সবাই একসাথে কথা বলে দেখি এই ব্যাপারে।সবাই মিলে না হয় একসাথে মিটিং করবো।”

“আচ্ছা।”

ছবি তোলার মাঝে নীরব অভ্রর কানে কানে বলে,”তোমার আম্মুকে বলো আমাদের সাথে ছবি তুলতে।আমরা তিনজনে মিলে একটা ফ্যামিলি হয়ে যাবো।তুমি খুশি হবে না তাতে?”

কিছুক্ষণ নীরবের দিকে তাকিয়ে অভ্র বলে,”হ্যাপি ফ্যামিলি?”

নীরব স্মিত হেসে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ হ্যাঁ।অভ্র নীরবের গালে চুমু খেয়ে দৌড়ে যায় দীপান্বিতার কাছে।দীপান্বিতাকে বলে,”আম্মু আসো ছবি তুলবো।”

“তুমি তুলো বাবাই।আমি পড়ে তুলবো।”

“না আম্মু আমি হ্যাপি ফ্যামিলি হয়ে ছবি তুলবো।তুমি আসো।”

বলেই দীপান্বিতাকে টেনে নিয়ে যায় নীরবের পাশে।তারপর অভ্র কোল উচু করে নীরবকে দেখায়। বোঝাতে চায় সে নীরবের কোলে উঠবে।নীরব মৃদু হেসে অভ্রকে কোলে নিয়ে দীপান্বিতার সাথে ছবি তোলে।মিসেস নাজনীন খুশি হয়ে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে।মিস্টার রবিন বলেন,”ছেলের সুখটাও ছেলে খুঁজে নিয়েছে।”

“হুম,আমি আপার সাথে কথা বলেছি।উনি বললেন মিটিং করবেন।দেখা যাক কি হয়।”

মিসেস সাবিনা এসে মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস শিউলির কাছে বলেন,”দীপান্বিতার সাথে নীরবকে বেশ মানিয়েছে।কি বলো তোমরা?”

মিস্টার সমুদ্র বলেন”হ্যাঁ,কিন্তু নীরবের বাসা থেকে কি মানবে?”

“আপা নিজেই প্রস্তাব দিয়েছেন আমার কাছে।”

মিসেস শিউলি বলেন,”তাইলে আর অপেক্ষা কিসের বউমা? হ্যাঁ বইলা দেও।নাতি আমাদের কাছেই থাকবে।এছাড়া অভ্রকে তো আমরা বোর্ডিংয়ে দিয়ে দিবো।সমস্যার তো কিছু নেই।”

“দীপান্বিতার সাথে তো কথা বলতে হবে।”

“আচ্ছা,বাড়ি যেয়ে কথা বলে দেখি।”

দ্বীপ ও নীরা চলে যায় কাপল পিক তুলতে।তারপর কেয়া ও রিক ছবি তুলতে থাকে।সবাই একসাথে অনেকগুলো ছবি তুলে নেয়।কেয়া ও রিকের পরিবার সাথে দূরের কিছু আত্মীয় আজ সেন্টারেই থাকবে।এই বড় সেন্টার তারা দুই দিনের জন্য ভাড়া নিয়েছে।রাতে অনুষ্ঠান করে বউকে বাসায় নিয়ে যাওয়া ঝামেলা। আর গুরুজনদের তো একেকটি কথা আছেই। কারো কারো মতে,”রাতের বেলা বিয়ের আগেরদিন মেয়েদের বাইরে থাকতে নেই।নজর লাগে এতে।”
তাই আর কেউ রিস্ক নেয়নি।যদিও কেউ বিশ্বাস করেনা এসব কথা।কিন্তু মুরুব্বিদের সম্মানের খাতিরে এই ব্যাবস্থা।

রাত গভীর হয়েছে অনুষ্ঠান শেষ তাই দ্বীপ নীরাকে বলে,”চলো বাসায় যেতে হবে। কাল আবার বিয়ের কাজ আছে।জুম্মা শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিয়ের ব্যাবস্থা করতে হবে।”

কেয়া এখানে থাকবে তাই নীরা বলে,”আজকে আমিও কেয়ার সাথে থাকবো।বান্ধবীর বিয়েতে বান্ধবীর সাথে থাকি?”

“না, কাল এসে সারাদিন আনন্দ করবে।এখন চলো।”

নীরা লাফাতে লাফাতে বলে,”না আমি আজ এখানে থাকবো।”

“এর পাগলামি শুরু হয়েছে,বাবা।তোমরা আসো আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।”

মিস্টার সমুদ্রকে বলেই দ্বীপ নীরাকে কোলে করে উঠিয়ে নিয়ে যায়।নীরা চিল্লাতে চিল্লাতে বলে,”মেরে দোস্তি কা দুশমান।ছড়িয়ে মুঝে।”

কে আর কি বলবে!সবাই জানে নীরা হাফ মেন্টাল আর দ্বীপ বউয়ের জন্য মেন্টাল।কেয়া মিটমিট হেসে রিকের দিকে তাকায়।রিক সাথে সাথে দ্বীপ ও নীরাকে ইশারা করে কেয়াকে চোখ টিপ দেয়।

দ্বীপ নীরাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়।নীরা চোখ ছোট ছোট করে বলে,”আপনি বউ পাগল হয়েছেন ক্যাডার সাহেব।এটা কি আপনি জানেন?”

“আমার বউয়ের জন্য আমি পাগল হবো না তো কি ওই বখাটে নান্টু হবে?”

“জেলাস?”

“ভীষন আকারে জেলাস।”

“একটু থাকলে কি হতো? কাল বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাবে।”

“আমার চুনু মুনু আনা মিস হয়ে যাবে।”

“লুচু,ক্যাডার সাহেব।”

“বউকে ভালোবাসাকে লুচু বলে না চন্দ্রপাখি।বউকে ভালোবাসাকে আসল পুরুষত্ব বলে।”

“হয়েছে এবার চলেন।আমার ঘুম আসছে।”

দ্বীপ গাড়ি চালানো শুরু করে।নীরা দ্বীপের কাধে মাথা রেখে বসে আছে।

নীরব বাইক আনিয়েছে কল করে। বাইকে করে যাবে তাই।অভ্র আবদার করে নীরবের সাথে বাইকে যাবে।তাই জেদ ধরে।মিসেস শিউলি ইচ্ছা করে বলেন,”পোলাডা আবদার করছে মা হয়ে পূরণ কর।”

দীপান্বিতা তর্ক না করে রাজি হলো।চোখে মুখে ঘুম চলে এসেছে তার।নীরবের সামনে অভ্র বসেছে আর পিছনে দীপান্বিতা।কিছুদূর যেয়ে নীরব অভ্রকে বলে,”বাবাই বাইকে চড়তে কেমন লাগছে?”

“খুব ভালো।”

“কোনো একজনের এমন ভালো লাগতো।কি জানি এখন তার মন পাল্টেছে কি না।বলছি বাবাই আরেকটু বেশি ঘুরবে কি?তাহলে বাইকে এক রাউন্ড দিবো তোমাকে নিয়ে।”

অভ্র খুশি হয়ে বলে,”হ্যাঁ হ্যাঁ দেও।আমি খুব মজা পাচ্ছি।”

নীরব অভ্রকে কোলে নিয়ে বাইক চালাতে থাকে।অভ্রর ছোট ছোট হাত ধরে নিরব বাইক ধরে আছে।অভ্র ভাবছে সে নিজে বাইক চালাচ্ছে।এতেই যেনো তার ভালো লাগা।দীপান্বিতা অভ্রকে এত খুশি হতে দেখে বাধা দেয় না।চুপচাপ দেখতে থাকে ছেলের খুশি।

চলবে…?
#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২৯
#ইশরাত_জাহান
🦋
শীতের রাতের ঘন কুয়াশায় বাইকে করে প্রণয় পুরুষের সাথে অনেকদিন পর সময় কাটাচ্ছে দীপান্বিতা।মুখে তার কোনো কথা নেই।শুধু প্রণয় পুরুষের প্রতি জমা আছে কিছু অভিমান।কেনো সে এতগুলো বছর কথা বলেনি।কেনো সে তার বিপদের কথাগুলো শুনতে চায়নি।এবার একটু সেও বুঝুক অভিমানের পাল্লা ভারী হলে কতটা যন্ত্রণা বসবাস করে মনের গহীনে।

অভ্র ঘুমিয়ে গেছে নীরবের কোলে।দীপান্বিতা নীরবের কাধে এক হাত দিয়ে রেখেছে।নীরবের দৃষ্টি রাস্তার দিকে কিন্তু মন তার মায়াবন বিহারিনীর দিকে।অভ্র ঘুমিয়ে আছে বুঝতে পেরে নীরব বাইক নিয়ে সোজা বাড়িতে চলে আসে।বাইক থামতেই দীপান্বিতার মন খারাপ হয়ে যায়।মনে মনে বলে,”এই পথ যদি শেষ না হতো!”

“তাহলে আমাদের পথ যাত্রা আবার শুরু করা যাক?”(নীরব বলে)

থতমত খেয়ে যায় দীপান্বিতা।স্মিত হেসে নীরব বলে,”প্রিয়তমার মনে আমার জন্য এখনও বাসা বেঁধে আছে।খুব সহজেই বুঝতে পারি সে কি চায়।”

“হ্যাঁ,খুব ভালো বুঝতে পারেন।তাই তো আমার বিপদটা বুঝতে পারেননি।”

“সবকিছু তো নতুন করে শুরু করা যায়?”

“আপনি করেন নতুন করে শুরু।আমি চললাম।”

বলেই অভ্রকে কোলে নিয়ে চলে যায় দীপান্বিতা।নীরব বিড়বিড় করে বলে,”এ মেয়ে সোজা কথা শুনবে না।বাকা পথ দেখতে হবে আমাকে।”

বলেই বাসায় চলে যায় নীরব।
নীরবদের আসার আগেই চলে আসে দ্বীপ ও নীরা।দ্বীপ গাড়ি থেকে নামার পর নীরা দুই হাত উচু করে বলে,”কোলে করে যেমন গাড়িতে উঠিয়েছেন ঠিক কোলে করে এখন আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে যাবেন।আমি এখন অলস বোধ করছি।”

দ্বীপ নীরাকে কোলে নেয়।তারপর বলে,”এভাবে বউ আবদার করলে কি আর না বলা যায়?”

দুজনে হেসে উপরে যেতে থাকে।দ্বীপ নীরাকে কোলে নিয়ে নীরার দিকে তাকিয়ে হাঁটছে আর নীরা দ্বীপের চশমা দেওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিতে থাকে।ফ্ল্যাটের সামনে আসার পর দ্বীপ বলে,”আমার পকেটে দেখো চাবি আছে।দরজা খুলো তুমি।”

নীরা চাবি নিয়ে দ্বীপের কোলে থেকেই দরজা খুলে।ঘরে এসে তাড়াতাড়ি করে হিজাব খুলতে যাবে দ্বীপ হাত ধরে বাধা দিয়ে বলে,”আমি খুলে দিচ্ছি হিজাব।”

নীরা খুশি হয়ে বলে,”ওকে,ক্যাডার সাহেব।”

দ্বীপ ধীরে ধীরে নীরার মাথায় থাকা গাজরা খুলে দেয় তারপর হিজাব খুলতে থাকে।নীরা আয়নায় তাকিয়ে নিজের স্বামীর এই ভালোবাসাগুলো উপভোগ করতে থাকে।আয়নায় দ্বীপের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,”এভাবেই আমাকে সব সময় ভালোবাসবেন তো,ক্যাডার সাহেব?”

দ্বীপ আয়নাতে নীরার দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর নীরাকে জড়িয়ে ধরে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,”সারাজীবন ভালোবেসে কাছে আগলে রাখবো বলেই তো আমার এই ইচড়ে পাকা চন্দ্রপাখিকে বিয়ে করা।উল্টো চিন্তা তো আমার হচ্ছে।”

নীরা আয়নায় দ্বীপের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।বোঝাতে চাইছে দ্বীপ কিসের জন্য চিন্তা করছে।দ্বীপ বলে,”এই যে আমাদের এজ ডিফারেন্ট।তুমি কি আমার বয়স বাড়লেও এতটা ভালোবাসবে?আস্তে আস্তে যখন আমার চুল পাকতে শুরু করবে এই ভালোবাসা কি স্থায়ী থাকবে?”

নীরা দ্বীপের দিকে ঘুরে দ্বীপকে পুরোপুরিভাবে আলিঙ্গন করে বলে,”আমার হবু চুনু মুনুদের বাবাকে আমি কখনও ছেড়ে যাবো না।মৃত্যু ছাড়া আমি কখনও আপনার থেকে আলাদা হবো না,ক্যাডার সাহেব।তাতে আপনি বুড়ো হন না কেনো।”

“ভালোবাসি আমার চন্দ্রপাখি।”(বলেই দ্বীপ নীরাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে)

____
কেয়া ও রিক সবার পরিবার আজ কমিউনিটি সেন্টারে আছে।কেয়ারা এক পাশের রুমে আছে তার ওপর পাশের রুমে রিকেরা আছে।হঠাৎ গভীররাতে কেয়ার ফোনে এসএমএস আসে।কেয়া জেগে ছিলো।ভাবছিলো কাল তার পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে রিকের সাথে থাকবে।ফোনের এসএমএস এর জন্য আলো জ্বলতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকায় কেয়া।ফোন হাতে নিয়ে দেখে রিকের এসএমএস।

“জানি তুমি ঘুমিয়ে নেই।তাড়াতাড়ি ছাদে আসো।আমি আছি তোমার অপেক্ষায়,মাই ডিয়ার চশমিশ।”

রিকের এসএমএস দেখে অবাক হয়ে বালিশের পাশে থাকা চশমা নিয়ে চোখে সেট করে কেয়া।তারপর আবার এসএমএস পড়ে। নাহ রিক তাকে এই রাতে ছাদে যেতে বলেছে।পাশে তাকিয়ে সবাইকে পরখ করে নেয়।সবাই ঘুমে বিভোর হয়ে আছে।কেয়া তাড়াতাড়ি করে একটি চাদর গায়ে মুড়িয়ে কাপতে কাপতে চলে যায় তার সাদা বিলায়ের দিকে।এত রাতে রিক তার জন্যে অপেক্ষা করছে সে কি না যেয়ে পারে?ছাদে এসে দেখে রিক নিজেও একটি চাদর মুড়িয়ে কাপতে থাকে।ভ্রু কুচকে তাকায় কেয়া।রিক কেয়ার কাছে আসে।

বলে,”তোমার এই চশমার ভিতরে ভ্রু কুচকে তাকানো দেখতে আমার অনেক ভালো লাগে,চশমিশ।”

“আর কয়েকঘন্টা পর তো আমাদের বিয়ে।এখন এই হাড় কাঁপানো শীতে ডেকেছেন কেনো?”

“বিয়ের আগের দিন রাতে হবু বউয়ের সাথে প্রেম করবো তাই।”

“শীতে মরে যাচ্ছি।কি কুয়াশা দেখেছেন? গাছগুলো কুয়াশায় ভিজে আছে।”

“আর এই শীতল হাওয়াতে একটু চন্দ্র বিলাস করছি আমি আর আমার চশমিশ।”

কেয়া রিকের ভালো লাগার মুহূর্তকে বাধা দিতে চায় না।তাই রিককে আর কিছু না বলে চুপ থাকে।রিক বলে,”হাড় কাঁপানো শীত হোক আর চৈত্র মাসের সূর্যের করা উত্তাপ ভালোবাসার মুহূর্ত থাকবে সব সময়।এগুলো নিজেদেরকেই তো অর্জন করে নিতে হবে।”

লজ্জাতক দৃষ্টিতে চশমার ফাকে কেয়া তাকায় রিকের দিকে।বলে,”এত ভালোবাসেন আমাকে?”

“অনেক,কেনো তুমি বাসোনা?”

“বলেছি একবারও?”

“ভালোবাসি বলোনি তো একবারও।”

“সব কথা কি মুখে বলতেই হবে?”

“প্রিয় মানুষের মুখে ভালোবাসি শুনতে পাওয়ার অনুভূতিটাই যে ভিন্ন,চশমিশ।একটিবার বলবে আমার এই চোখের দিকে তাকিয়ে?ভালোবাসি।”

কেয়া লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।এই কনকনে শীতে এখন তার হাতের উপর লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। কখনও কাউকে ভালোবাসা প্রকাশ করেনি।আজ কিভাবে বলবে?

রিক বলে,”হায় মেরে চশমিশ!ভালোবাসি বলতে এত লজ্জা?”

“ধেত।”

“বলো একটিবার।”

কেয়া এবার তাকায় রিকের দিকে।দূরত্ব কমিয়ে কিছুটা কাছে এসে চাঁদ বরাবর দাড়িয়ে থাকা রিকের কানের কাছে আসে।ফিসফিস করে রিকের কানে বলে,”আমি ভালোবাসি আমার এই সাদা বিয়ালাইকে।অনেক বেশি ভালোবাসি তাকে।”

বলেই দৌড়ে চলে যায় কেয়া।এখন তার খুব লজ্জা লাগছে এখানে থাকতে।রিক হালকা হাসে।চাঁদের দিকে তাকিয়ে আনমনে এক চোখ টিপ দেয় রিক।যেনো চাঁদকে সাক্ষী রেখেছিলো আজ তার চশমিশ তাকে প্রোপজ করেছে।

ঘরে এসে বসতেই কেয়ার ফোনে আবার একটি এসএমএস আসে।না এবার আর রিক দেয়নি এসএমএস।এবার এসএমএস দিয়েছে নীরা।লেখা,”আরে দোস্ত বিয়ের আগে হাড় কাঁপানো শীতে ছাদে দাড়িয়ে প্রেম করলে জ্বর আসে না।”

কেয়া লেখে,”তুই কি করে জানলি?”

“আইডিয়া যে আমার ছিলো।রিক ভাই তোর মুখে ভালোবাসি শুনতে চেয়েছিলো তাই আমি বলেছিলাম আপনি ওকে রাতের বেলায় একটু ইমোশনাল করে দিবেন।”

কেয়া স্মিত হেসে নীরাকে গুড নাইট জানিয়ে দেয়।দ্বীপের বুকে মাথা দিয়ে নীরা কেয়াকে গুড নাইট লিখে দেয়।নীরা কেয়ার এই রোমান্টিক মোমেন্ট এর জন্যই থাকতে চেয়েছিলো আজ কেয়ার কাছে।কিন্তু ক্যাডার সাহেব তা হতে দিলো কোথায়!নীরা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার লুচু ক্যাডার সাহেব।”

দ্বীপ বলে,”অনেক প্রেম হয়েছে এখন ঘুমাও চন্দ্রপাখি।”

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-২৬+২৭

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২৬
#ইশরাত_জাহান
🦋
{১৮+ এলার্ট…}

নীরব দীপান্বিতাকে কল দিচ্ছে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে।নীরার থেকে দীপান্বিতার নতুন নাম্বার নিয়েছে নীরব।প্রথম কল আসাতে রিসিভ করে দীপান্বিতা।সেই যে নীরবের কণ্ঠ পেয়েছে আর রিসিভ করে না এই কল।অতঃপর নীরব ব্যালকনিতে আসে।গিটার নিয়ে গাইতে থাকে,
“মায়াবন বিহারিনী হরিণী….”

দীপান্বিতার ঘরের জানালা খুলে যায়।নীরব খুশি হয়।পুরনো ভালোবাসা পুরনো স্মৃতি ধরে এখনও দীপান্বিতা চাঁদকে সাক্ষী রেখে প্রেম নিবেদন করবে।কিন্তু নীরবের খুশিকে পানিতে ফেলে জানালার কাছে দেখা যায় অভ্রকে।অভ্র নীরবকে বলে,”তুমি অনেক সুন্দর গান গাও,মামু।”

নীরব ক্ষিপ্ত হয়ে মনে মনে বলে,”মামু!”

ছোট্ট অভ্র কোমরে হাত দিয়ে বলে,”কিন্তু এত রাতে এত জোরে গান গাচ্ছো কেন?আশেপাশে কেউ তো ঘুমাতে পারবে না।এখন আমার ঘুমের সময়।সকালে গান শুনাবে।”

বলেই খট করে জানালা লাগিয়ে দেয় অভ্র।”তোর মামু আমি হওয়াচ্ছি পুঁচকে।”(বিড়বিড় করে বলে নীরব)

নীরা হসপিটাল থেকে এসে ফ্রেশ হয়।ঠিক তখনই দ্বীপ নীরার হাতে একটি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটা পরে আসো।”

নীরা প্যাকেটটি হাতে নিয়ে ভিতরে কি আছে দেখতে থাকে।প্যাকেটের ভিতরে একটি গাঢ় খয়েরী রঙের জর্জেট শাড়ি।শাড়িটি দেখে নীরা বলে,”কি ব্যাপার ক্যাডার সাহেব?আজ হঠাৎ রাতের বেলায় শাড়ি পরতে বলছেন?”

“চন্দ্র বিলাস করবো।”

নীরা খুশি হয়ে ওয়াশরুমে গেলো শাড়ি পরতে।আদা ঘণ্টা পর ওয়াশরুম থেকে বেড় হয় নীরা।নীরা বের হওয়ার সাথে সাথে দ্বীপ তাকায় নীরার দিকে।টুকটুকে খয়েরী রঙের শাড়ির সাথে স্লিভলেস ব্লাউজ চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া।নীরাকে দেখতে একদম দ্বীপের মনের মত লাগছে।নীরা আয়নার সামনে যেয়ে মেকআপ বক্সে হাত দিতে যায় ওমনি দ্বীপ বলে,”খবরদার কোনো প্রকার আর্টিফিশিয়াল প্রোডাক্ট ব্যাবহার করবে না।”

থেমে যায় নীরা।পিছনে ঘুরে নীরা বলে,”এত কষ্ট করে শাড়ি পড়েছি একটু সাজবো না!অন্তত লিপস্টিক দেই ঠোঁটে।”

“উহুম,কোনো প্রকার লিপস্টিকের স্বাদ আমি নিবো না।পরে ক্যান্সার দেখা দিতে পারে।তার থেকে বরং আমি নেচারাল ঠোঁটের স্বাদ গ্রহণ করতে চাই,চন্দ্রপাখি।”

লজ্জায় এদিক ওদিক চাওয়া চাওয়ি করে নীরা।বলে,”চলুন চন্দ্র বিলাস করি আমরা?”

দ্বীপ নীরাকে নিয়ে নিজেদের ছাদে যায়।ছাদ অনেক সুন্দর করে সাজানো।চারিদিকে হলুদ গোলাপের গাছ।নীরার পছন্দের ফুল গাছ দিয়ে ছাদ বাগান করেছে দ্বীপ।পরীক্ষার এই কয়েকদিন নীরা ছাদে আসতে পারেনি।আজ প্রথম আসলো।এসেই মুগ্ধ হয়ে তাকালো সেদিকে।দ্বীপ নীরার হাত ধরে নিজের কাছে টান দিয়ে কপালে কপাল মিলিয়ে বলে,”আমার জীবনের একাংশ আমার চন্দ্রপাখি।খুব খুব খুব ভালোবাসি।”

নীরা চুপচাপ দ্বীপের কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ নিচের দিকে করে আছে।চশমা চোখের ভিতর থেকে দ্বীপ তাকায় নীরার দিকে।ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে নীরার গালে ঠুস করে এক চুমু দেয়।কেপে ওঠে নীরা।দ্বীপ এর আগেও তাকে চুমু দিয়েছিলো।কিন্তু আজকের চুমু যেনো ভালোবাসার গভীরতা প্রকাশ করেছে।

দ্বীপ বলে ওঠে,”আজ এই চাঁদকে সাক্ষী রেখে আমার চন্দ্রপাখিকে দিলাম প্রেমের আবেদন। চন্দ্রপাখি কি করেছে আমার প্রেমকে গ্রহণ?”

নীরা আস্তে আস্তে তাকায় দ্বীপের দিকে।বলে,”আপনার প্রেমে সাড়া দিয়েছি তো আমি সেই অনেক আগে,ক্যাডার সাহেব।আপনার ডায়েরির পাতায় লেখা আমার জন্য আপনার মনে লুকোচুরি প্রেম কাহিনী আমি অনেক আগেই পড়ে নিয়েছি।সেদিন থেকে আমার মনেও তৈরি হয় আপনার জন্য লুকোচুরি প্রেম অনুভূতি।”

“দুজনের এই লুকোচুরি প্রেমের সমীকরণে আজ পূর্ণ হবে আমাদের লুকোচুরি গল্প।”

মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দিলো নীরা।তারপর কিছুক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে নিরবতা পালন করে দুজনে।দ্বীপের কাধে মাথা দিয়ে নীরা তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে।কিছুক্ষণ চন্দ্র বিলাস করে দ্বীপ ও নীরা ঘরে আসে।ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দ্বীপ নীরাকে কোলে নেয়।নীরা তাকিয়ে আছে দ্বীপের দিকে।

দ্বীপ বলে,”বড্ড প্রেম করতে ইচ্ছা করছে, চন্দ্রপাখি।আজ আমি আমার চন্দ্রপাখিকে একদম নিজের করে পেতে চাই।”

নিচের ঠোঁটের সাথে উপরের মিলিয়ে লজ্জা প্রকাশ করে নীরা।দ্বীপ তাকায় সেদিকে।বলে,”আজ এত লজ্জা কেনো চন্দ্রপাখি!এক ডজন চুমু মুনু চাই না তোমার?”

দ্বীপের বুকে মাথা গুঁজে বলে,”হুম।”

হালকা হেসে দ্বীপ নীরাকে বসিয়ে দেয় খাটের উপরে।তারপর যখনই দ্বীপ নীরার কাছে আসতে যাবে নীরা দূরে সরে যায়।দ্বীপ বলে,”এভাবে নড়াচড়া করলে তো ক্রিকেট টিম আসতে পারবে না,বউ।”

নীরা চোখ বন্ধ করে থাকে।তারপর দ্বীপ নীরাকে নিজের কাছে টেনে আলিঙ্গন করে নেয়।

সকালে,
নীরার ঘুম ভেংগে যায় দ্বীপের আগে।সাথে সাথে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা বানাতে যায় নীরা।দ্বীপ এতক্ষণ ঘুমের অভিনয় করতে থেকে।কিন্তু ইচ্ছা করেই নীরাকে কিছু বুঝতে দেয়নি।নীরা নাস্তা বানাতে থাকে ঠিক তখন রান্নাঘরে সবাই হাজির হন।একে একে মিসেস শিউলি মিসেস সাবিনা ও দীপান্বিতা এসে নীরাকে সাহায্য করতে থাকে।

নীরা মিসেস সাবিনাকে বলে,”রুটি ঠিকমত হচ্ছে তো,মামনি?”

বলেই যখন নীরা তাকায় মিসেস সাবিনার দিকে,মিসেস সাবিনা হা হয়ে তাকায় নীরার দিকে।নীরার ঠোঁট ফুলে লাল।মিসেস সাবিনা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলেন,”হ্যাঁ।সব ঠিকঠাক হয়েছে।”

মিসেস শিউলি নীরার ঠোঁট দেখে ইচ্ছা করে নীরার কাছে আসেন।এসে নীরার গলা থেকে চুল সরিয়ে বলেন,”দেখিতো নাতবৌ তোমার এদিক ওদিক কিছু আছে কি না।”

নীরার খেয়াল নেই রাতের কথা।তাই সে বলে,”কি থাকবে দাদীন?”

“আমার নাতির ভালোবাসা।”

বলেই দেখতে পান গলার কোনায় জমাট বাঁধা রক্তের দলা।হালকা হেসে মিসেস শিউলি বলেন,”বুঝছো গো বউমা।খুব তাড়াতাড়ি নাতির ঘরে পুতি আইবো।”

সাথে সাথে নীরা দৌড় দিয়ে ঘরে যায়।মিসেস শিউলি হেসে দেন।সকালে শুধু গোসল করে চুল শুকিয়ে মাথায় ওড়না দিয়ে গিয়েছিলো রান্নাঘরে।এখন আয়নার সামনে এসে নিজেকে দেখে নিজেই অবাক।চিল্লিয়ে বলে ওঠে,”আমার ঠোট!”

দ্বীপ ওয়াশরুম থেকে বেড় হয়ে বলে,”চিল্লাও কেন? লোকে জেনে যাবে তো?”

“ওহ আমি চিল্লালে লোকে জেনে যাবে! আর আপনি যে এত বড় একটা চিহ্ন দিয়ে রেখেছেন তাতে কি হবে?”

“লোকে বলবে প্রফেসর আদনান কবির দ্বীপ তার বউকে খুব ভালোবাসে।তাই চিহ্ন দিয়েছে।”

“শুনুন বাজে কথা বলবেন না।আজ কেয়ার গায়ে হলুদ।এই ঠোঁটে কি লিপস্টিক দেওয়া যায়?আমি কিভাবে থাকবো?”

“মাস্ক পরে থেকো।একচুয়ালী ভালোই হবে।আমার চন্দ্রপাখির ঠোঁট আমি ছাড়া কেউ দেখবে না।”

“ইহহহহ আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।”

হো হো করে হেসে দ্বীপ একটি মলম দিয়ে বলে,”এটা মাখো ঠোঁটে।বিকেলের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।”

নীরা মলম মেখে বলে,”বিকেলের আগে আমি ঘর থেকে বের হচ্ছি না।ইশ মানুষ কি ভাবছে।ছিঃ ছিঃ ছিঃ।”

“মানুষ যখন এক ডজন বাবু দেখবে তখনই আমাদের উপর অস্কার ছুড়ে মারবে।এটা তো সামান্য এক লাভ বাইট।”

“লাগামহীন প্রফেসর।”

“যাহ বাবা বউয়ের কাছে কি না শুনতে হয় লাগামহীন!বলি আমি কি পাশের বাড়ির টুনিকে বলবো এসব কথা?”

“আপনি বলেই দেখেন না।ওই টুনির মাথার চুল একটাও আস্ত থাকবে না।”

“হিংসুটে চন্দ্রপাখি।”

“আমার জামাইয়ের জন্য আমি হিংসুটে হব।আপনার সমস্যা?”

“একদমই না।বলছি সারাদিনে যখন বাইরে বেড় হবেই না।তাহলে এখন আবার প্রেম করা যাক।”

“মাথা খারাপ আপনার!খুদা লেগেছে আমার খুব।তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে খাবার আনেন।”

বলতে না বলতেই দীপান্বিতা দরজায় টোকা দিয়ে বলে,”আসবো লিটিল ভাবী।”

“হ্যাঁ আসো।”

“মা বলেছে তোমাদের খাবার দিতে। আর কোনো সমস্যা হলে মাকে বলবে ঠিক আছে?”

“আচ্ছা।”

“আমি এখন লাইভে যাচ্ছি। দাদীন তোমাদের বাসায় গেছে।বিকালের আগেই কেয়াকে গোসল করানো হবে।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো।”

“আচ্ছা।”

কথা বলেই চলে গেলো দীপান্বিতা।দ্বীপ আর নীরা একসাথে সকালের খাবার খাচ্ছে।দ্বীপ এখন কলেজে যাবে।নীরা দ্বীপকে বলে,”শুনুন ক্যাডার সাহেব,আমার জন্য একটি গাজরা নিয়ে আসবেন।সেই গাজরা আমার এলোমেলো খোঁপায় পরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে।”

“ঠিক আছে।”

বলেই চলে যায় দ্বীপ।নীরা দ্বীপের বুকশেলফ এর দিকে যায়।ঠিক সেই সময় দ্বীপ আবারও এসে নীরাকে ঘুরিয়ে নীরার কপালে একটি চুমু দিয়ে আবার চলে যায়।

নীরা হাসতে থাকে।তারপর আবারও মনোযোগ দেয় দ্বীপের বুকশেলফ এর দিকে।একটি বই নিয়ে বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিতে থাকে নীরা।

দীপান্বিতা লাইভ করছে।অনেকে অনেক ধরনের কমেন্ট করছে।এগুলো দীপান্বিতা পড়ে পড়ে উত্তর দেয়।হঠাৎ একটি কমেন্ট পড়তে যেয়ে দীপান্বিতা থেমে যায়।

সেখানে লেখা,”ওহে মায়াবন বিহারিনি,রাগ করে থেকো না তুমি।”

দীপান্বিতা কমেন্ট ইগনোর করে আরেকটি কমেন্ট পড়ে উত্তর দেয়।তারপর আবারও নীরবের কমেন্ট আসে,”একবার বিয়ে কর আমাকে।এই শাড়ি সবগুলো আমিই কিনবো।কোনো লাইভ করতে দিব না তোমাকে।আমার বউ বিয়ের পর লাইভে যাবে না।”

এরকম আরো কিছু কমেন্ট আসে।কিছু কিছু পাবলিক নীরবের কমেন্টে হাহা দেয় তো কিছু কিছু কেয়ার দেয়।দীপান্বিতা কমেন্টগুলা মনে মনে পড়ে উত্তর না দিয়ে অন্যান্য কমেন্টের উত্তর দেয়

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২৭
#ইশরাত_জাহান
🦋
দুপুর হয়ে এসেছে।এখন কেয়াকে গোসল করানো হবে।কেয়া ও রিকের গায়ে হলুদ থেকে বৌভাত সকল অনুষ্ঠান কমিউনিটি সেন্টারে হবে।রিকের বাবা এসেছেন আজ দুইদিন হয়েছে।ছেলের বিয়ে দিয়ে কয়েকদিন থেকে আবার চলে যাবেন। রিককে বাংলাদেশের ব্যাবসা সম্পর্কে বুঝিয়ে দিবেন তিনি।

নীরা বসে আছে দ্বীপের জন্য।দীপান্বিতা মাত্র লাইভ শেষ করলো।নিজের শাড়িগুলো থেকে নীরাকে একটি শাড়ি দিয়ে নিজের জন্য একটি শাড়ি রাখলো।কলাপাতা পারের হলুদ শাড়ি দীপান্বিতার কাছে এভেইলেবল।তাই আর আলাদা করে কেনা লাগেনি।

দ্বীপ চলে এসেছে।আজকে হাফ টাইম ক্লাস করিয়েছে।দ্বীপের হাতে একটি ছোট প্যাকেট।নীরা প্যাকেটটি দেখে হেসে বলে,”আমার জন্য গাজরা এনেছেন,ক্যাডার সাহেব?”

“হ্যা।চোখ বন্ধ কর।”

“আচ্ছা।”

বলেই চোখ বন্ধ করে নীরা।তারপর অনুভব করে দ্বীপ তার মাথায় হাত রেখেছে।সমস্ত চুলগুলো একসাথে করে বেধে দিচ্ছে দ্বীপ।অতঃপর নীরা অনুভব করে তার মাথার উপর পাতলা কোনো কিছু দেওয়া। গাজরার জায়গায় অন্য কিছু অনুভব করে চোখ মেলে তাকালো নীরা।দেখতে পেলো হলুদ ও সোনালী রঙের মিশ্রণে একটি সুন্দর হিজাব।হিজাব দেখে কপাল কুঁচকে নীরা বলে,”আমার গাজরা কোথায়?”

“গাজরার থেকেও দামী উপহার দিয়েছি।আমার বউয়ের সৌন্দর্য্য আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখবে না।তাই এই হিজাব পরেই অনুষ্ঠানে যাবে।”

“আমি খেলবো না।”

“এখন খেলার মুড আছে বুঝি?”

“আরে!খালি বাজে কথা।দুষ্টু প্রফেসর আমার।আমি চেয়েছি গাজরা আপনি এনে দিলেন হিজাব।আজকে কি সুন্দর সবাই নিজেকে ফুল দিয়ে সাজাবে। আর আমি কি না,ধুর।”

বলেই শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় নীরা।এদিকে নীরব এত চেষ্টা করেও পারছে না দীপান্বিতার অভিমান ভাঙাতে।তাই অসহায় হয়ে বসে আছে ব্যালকনিতে।অভ্র তাদের ব্যালকনি দিয়ে তাকিয়ে আছে নীরবের দিকে।নীরবকে বলে,”কি করছো মামু?”

“তোমার মায়ের অভিমান ভাঙাতে চাইছি পুচকু।”

অভ্র বড়দের মত ভাব করে বলে,”আমার আম্মু অভিমান করেছে কেন?”

“আমি ভালোবাসিনি তাই।”

“তাহলে তো তুমি পঁচা।”

“আমি তো এখন ভালোবাসতে চাই তোমার আম্মুকে।”

“ওহ,তাহলে তুমি ভালো।”

“কি করা যায় বলোতো?”

কিছুক্ষণ ভাবুক ছেলেদের মত ভঙ্গি করে অভ্র বলে,”কাল রাতের মত গান শোনাও আমাকে।আপাতত মাথায় বুদ্ধি আসছে না।”

নীরব কিছু বলতে যাবে তার আগে দীপান্বিতা এসে দাঁড়ায় অভ্রর পাশে।অভ্রকে উদ্দেশ্য করে দীপান্বিতা বলে,”এখানে কি কর বাবাই?ভিতরে আসো।”

বলেই ঘরে ঢোকে দীপান্বিতা।নীরব গলা উছিয়ে গান গায়,
“বাড়ির পাশে আমার উনি,
কথা কয় না আমার সাথে।
বন্ধু আমার রাগ করিছে,
ভাব লয় হারা দিন ভরে।

অভ্র পিছনে ফিরে বলে,”ওয়াও মামু অনেক সুন্দর গান গাও তুমি।”

বলেই হাত তালি দেয় অভ্র।নীরব বারবার মামু ডাক শুনে আর আহত হয়।তারপরও চুপ করে আছে।বিড়বিড় করে বলে,”আগে তোর মাকে বসে আনি তারপর এই মামা ডাক বাদ দিয়ে ডাকবি বাবা।”

নীরা শাড়ি পরে বের হতেই নীরবের এই গান শুনতে পেলো।দ্বীপ খাটে বসে ছিলো।এমন উল্টা পাল্টা কথা দিয়ে গান শুনে নীরার দিকে ফিরে বলে,”তোমরা ভাই বোন দুটো কি মেন্টাল এসাইলাম থেকে ডেলিভারি হয়েছিলে?”

“আলতু ফালতু কথা বলবেন না আমাদের নিয়ে।আমরা এরকম বলেই তো আজ আপনাদের ভাই বোনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।”

“হ্যা।সে তো দেখতেই পাচ্ছি।এক বোন নিজের গায়ে হলুদের দিন মঞ্চ কাপিয়ে দেয়। আর ভাই প্রতিবেশীর গায়ে হলুদের দিন এলাকা কপিয়ে দেয়।”

“আমার ভাই আপনার বোনের প্রেমে পরে দেবদাস হয়েছে।আপনি কি করছেন ভাই হয়ে?একবারও বোনকে বুঝিয়েছেন!”

হামি তুলতে তুলতে দ্বীপ বলে,”ওসব কুটনি বুদ্ধি তোমার মাথায় চলে।আমি এতে নেই।”

ভেংচি কেটে নীরা নিজেকে সাজাতে থাকে।কেয়াকে কমিউনিটি সেন্টারে নেওয়ার আগে তাদেরকে যেতে হবে।কমিউনিটি সেন্টারে যেয়েই গোসলের পর্ব চলবে।নীরা হিজাব বাঁধছে আর দ্বীপ কলাপাতা রঙের পাঞ্জাবী পরে এসে আয়নায় নিজের চুল সেট করছে।নীরা আড় চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকে।হিজাব বেধে বলে,”এটা কি হলো?”

“কোনটা কি হলো?”

“আপনি কেনো চুল সেট করছেন?”

“তাহলে কি করবো?”

“না,আপনি হ্যান্ডসাম দেখতে হলে তো আমার জীবন তেজপাতা।”

বলেই দ্বীপের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয় নীরা।স্মিত হেসে দ্বীপ নীরাকে বলে,”চোখ বন্ধ কর।”
“কেনো?”
“কর।”
“আচ্ছা।”

বলেই চোখ বন্ধ করে নীরা।দ্বীপ নীরার হিজাব দেওয়া মাথায় সুন্দর করে ক্লিপ দিয়ে বেলি ফুলের গাজরা সেট করে দেয়।কপালের উপর থেকে রাউন্ড করে মাথার পিছনে গাজরার দুই প্রান্ত একসাথে করে বেলি ফুলের চিকন গাজরা। গাজরা সেট করে দ্বীপ বলে,”চোখ খোলো।”

নীরা চোখ খুলে নিজেকে আয়নায় দেখে।হিজাবের উপর দিয়ে দ্বীপের দেওয়া এই গাজরা খুব সুন্দর মানিয়েছে।নীরা খুশি হয়ে দ্বীপকে জড়িয়ে ধরে।বলে,”আমার ক্যাডার সাহেব আমাকে এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিবে ভাবতেই পারিনি।”

“খুশি হয়েছো তুমি?”

“খুব খুব খুব।”

“আচ্ছা এবার চলো।”

“মুখে কিছু লাগাবো না?”

“একদম না।তুমি এমনিতেই সুন্দর আছো।ওসব কিছু লাগাতে হবে না।বিশেষ করে লিপস্টিক তো নাই। কার না কার নজর লাগবে আমার বউয়ের উপর।তখন হবে আরেক ঝামেলা।”

মেকি হেসে নীরা বলে,”জেলাস ক্যাডার সাহেব।”

নীরার হাত ধরে নিজের কাছে এনে বলে,”বউ তো আমার শখের নারী।তার জন্যই তো জেলাস হব আমি।”

বলেই দুজনে একসাথে হেসে দেয়।তারপর ড্রয়িং রুমে এসে দেখে দীপান্বিতা ও অভ্র রেডি হয়ে এসেছে।মিসেস সাবিনা মিসেস শিউলি ও মিসেস নাজনীন কমিউনিটি সেন্টারে আছেন রিকের মা বাবার সাথে। বড়রা মিলে কিছু নিয়ম কানুনের কাজ করছে।এছাড়া সমস্ত কাজ কেটারিংয়ের লোক করছে।নীরা ও দ্বীপকে একসাথে দেখে নতুন সাজের সাথে দীপান্বিতা ওদের কিছু ছবি তুলে নিলো।এর ভিতর কলাপাতা রঙের পাঞ্জাবী পরে এসেছে নীরব।আজকের গায়ে হলুদে ছেলেদের পাঞ্জাবী কলাপাতা রঙের হবে।মেয়েরা কলাপাতা পারের হলুদ শাড়ি।সবাই মিলে একসাথে রওনা দেয় কমিউনিটি সেন্টারে।

কেয়াকে নিয়ে এসেছে কেয়ার বাবা মা।চশমা চোখে সুতির হলুদ শাড়ি পরে আছে কেয়া। গোসলের জন্য তাকে আপাতত নরমাল শাড়ি পরানো হয়েছে।সাথে করে গায়ে একটি গামছা জড়িয়ে দেওয়া আর কানের গোড়ায় দুইটি লাল গোলাপ দেওয়া আছে।বিয়ের কনের ভাব চলে এসেছে কেয়ার মুখশ্রীতে।

রিককে নিয়ে এসেছে নীরব ও দ্বীপ।রিক ও কেয়াকে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ফাঁকা জায়গায় রোদে পাশাপাশি দাড় করিয়ে মাঝখান থেকে বড় এক মোটা কাপড়ের পর্দা দেওয়া হয়েছে।কেয়ার গোসলের দিকে ছেলেরা আসবে না। আর রিকের গোসলে মেয়েরা যাবে না।

গোসলের আগে সবাই মিলে হালকা হলুদ ছোঁয়ালো একে অপরকে।ছেলেরা ছেলেদের মতো করে আর মেয়েরা মেয়েদের মতো করে আনন্দ করছে।অবশেষে রিক ও কেয়ার হলুদের গোসল সম্পূর্ণ করা হলো।শীতে কাপতে থাকে রিক ও কেয়া।

নীরা কেয়াকে বলে,”আরে দোস্ত এত কাপছিস কেনো?বিয়েতে গোসল করলে তো আর জ্বর আসে না।”

সবাই মিলে হাসতে থাকে।নীরার বিয়ের সময় কেয়া কথায় কথায় বলতো দোস্ত এটা করলে বিয়ে হয় না ওটা করলে বিয়ে হয় না।এগুলো মনে পরে গেলো নীরা ও কেয়ার।

কেয়া বলে,”রিভেঞ্জ নিচ্ছিস?সেই তো বরের সাথে খুশি খুশি সংসার করছিস। আর আমার বিয়েতে শীতে কাপাকাপি করাচ্ছিস।”

পর্দার ওপাশ থেকে রিক বলে,”ডোন্ট ওয়ারী চশমিশ।তোমার সাদা বিলাইও এই শীতে তোমার মতো ভিজে একাকার।আমরা একসাথে একই দুঃখ ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।”

কেয়া রিকের কথা শুনে খুশি হয়।নীরা ও দীপান্বিতা মিলে কেয়াকে নিয়ে যায় কাপড় পাল্টাতে।এখন কেয়াকে হলুদের সাজে সাজানো হবে।কেয়াকে একটি রুমে বসিয়ে রাখার পর পরই অভ্র এসে নীরাকে ডাক দেয়।বলে,মামু ডাকছে তোমাকে।”

নীরা চলে যায় সেখানে।দ্বীপ উল্টো দিকে ফিরে আছে।নীরা এসে বলে,”আমাকে ডেকেছিলেন ক্যাডার সাহেব?”

দ্বীপ নীরার দিকে ঘুরে তাকিয়ে নীরার কাছে আসে।তারপর নীরার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নির্জন পরিবেশে।কোনো কিছু না বলেই নীরার গালে আলতো করে হলুদ মেখে দেয়।তারপর নীরার গাল থেকে নিজের গালেও মেখে নেয় হলুদ।নীরা তাকিয়ে থাকে দ্বীপের চশমা দেওয়া চোখের দিকে।নীরার নাকের সাথে দ্বীপ আলতোভাবে নিজের নাক ছুঁয়ে বলে,”আমাদের বিয়ের সময় ইচ্ছা ছিলো তোমাকে এভাবে হলুদ ছোয়ানোর।কিন্তু তখন তুমি ছিলে আমার জন্য নিষিদ্ধ।কবুল বলার আগে তো ভালোবাসার মুহূর্ত গড়ে তুলতে চাইনি।আমার পুরুষ মনকে আমি কবর দিয়ে রেখেছিলাম অনেক কষ্টে।আজ তার পুনর্জন্ম নিচ্ছে,চন্দ্রপাখি।”

নীরা দ্বীপকে জড়িয়ে ধরে বলে,”ভালোবাসি আপনার সমস্ত চিন্তাভাবনাকে।ভালোবাসি আপনার এই ছোট ছোট মুহূর্তকে।ভালোবাসি আপনার সুপ্ত অনুভূতিকে।আমি ভালোবাসি আমার এই আস্ত ক্যাডার সাহেবকে।”

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-২৪+২৫

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২৪
#ইশরাত_জাহান
🦋
ভিতর থেকে ভাঙচুরের শব্দ আসছে।মিসেস নাজনীন বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছেন মিস্টার রবিনের দিকে।তারা দুজনে এটা বুঝতে পেরেছে দীপান্বিতা ও নীরবের ভিতর কিছু একটা চলছে।

নীরা বালিশ থেকে শুরু করে ঘরে থাকা যত কাচের জিনিস আছে সব ছুঁড়ছে।নীরব কিছু কিছু জিনিস কেস ধরে আবার কিছু জিনিস তার পাশ দিয়ে পড়ে ভেঙ্গে যায়।না পেরে নীরব বলে,”কি হয়েছে তা বলবি তো?”

“তুমি দীপান্বিতা আপুকে ধোঁকা দিয়েছো কেনো?”

কপাল কুঁচকে নীরব বলে,”আমি কোথায় ধোঁকা দিয়েছি?সে নিজেই তো তার জীবন সঙ্গী নিয়ে ভালো আছে।”

“জীবন সঙ্গী আসলো কোথা থেকে?”

“মানে?”

“মানে কে সে যার দ্বারা দীপান্বিতা আপুকে সঙ্গ দেয়?”

“আমি কি জানি?অভ্র তো আর আকাশ থেকে উড়ে আসবে না।”

কপাল চাপড়ে নীরা বলে,”আরে আমার ভাই।ওটা দীপান্বিতা আপুর বায়োলজিক্যাল সন্তান নয়।”

“তাহলে?”

“দীপান্বিতা আপুর বেস্ট ফ্রেন্ড তামান্না আপুকে তুমি চিনো কি না জানি না।অভ্র তার সন্তান।তামান্না আপু বেচে নেই।”

“তাহলে অভ্র দীপান্বিতার কাছে কেন?”

“খুব বেশি আমার স্পষ্ট মনে নেই।যতটুকু জানি ততুটুকু বলতে পারি।দীপান্বিতা আপু যখন অনার্স ভর্তি হয় তখন তাদের বাসায় এসে তামান্না আপু।তামান্না আপুর অবস্থা খুবই মর্মান্তিক ছিলো।মুখ হাত পা সব জায়গায় মারের দাগ।হাতের উপর পুড়ে যাওয়া কালচে চামড়া।দেখে বোঝা যায় কোনো নরপশুর অত্যাচার সহ্য করেছে।তামান্না ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করে।পালিয়ে বিয়ে করার সময় কিছু গহনা ও টাকা নিয়ে পালায়।বিয়ের প্রথম দিকে ওই গহনা টাকা নিয়ে সুখেই সংসার চলে।চাকরি করবে বলে গহনা বিক্রি করে টাকা উড়ায় তামান্না আপুর বর।সব শেষ হয়ে গেলে আবার আড্ডা যুয়াতে নেমে পড়ে তামান্না আপুর বর।সেই সময় তামান্না আপু প্রেগনেন্ট হয়।সাথে বেড়ে যায় তামান্না আপুর উপর অত্যাচার।এক সময় তামান্না আপুর বর তাকে বিক্রি করতে চায় এক নষ্ট এলাকায়।অনেক ঝগড়া ঝাটির পর তামান্না আপুর চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে বেশ কয়েকবার বাড়ি মারে।কপাল ফুলে ফেটে রক্ত বের হয়।না পেরে তামান্না আপু পালিয়ে আসে।পলাতক মেয়ে গর্ভবতী হয়ে ফিরেছে বলে মেনে নেয় মা তামান্না আপুর বাবা মা।বাধ্য হয়ে এদিক ওদিক আশ্রয় খুঁজতে থাকে।অতঃপর আসে দীপান্বিতা আপুর কাছে।মামনি বাবাইয়ের(দ্বীপের বাবা মা) হাত পা ধরে।তামান্না আপুর করুন অবস্থা দেখে সবাই রাজি হয় আপুকে কাছে রাখতে।এক কথায় লুকিয়ে ছিলো এখানে।

গর্ভবতী অবস্থায় মারধর সহ্য করে ছিলো।খাওয়া দাওয়ার ঘাটতি ছিলো প্রচুর। যার ফলে তামান্না আপুর শরীর দূর্বল থাকতো।রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।ডাক্তার বলেছিলো,’ রোগীর অবস্থা খুব খারাপ।এমন চললে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবে।’

ক্যাডার সাহেব নিজের বিসিএস নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো।এদিকে পিংকির মায়ের ঝামেলা তো ছিলোই।তাই দীপান্বিতা আপু ব্যাস্ত থাকতো তামান্না আপুকে নিয়ে।হঠাৎ একদিন তামান্না আপু অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।তাড়াতাড়ি করে হসপিটালে নেওয়া হলে ডাক্তার জানায়,’ যেকোনো একজনকে বাঁচানো যাবে।’

তামান্না আপুর এক কথা,’ বেঁচে থাকতে বাবা মায়ের মুখে চুন কালি মিশিয়েছি এখন নিজের সন্তানকে খুন করে নিজের জীবন কিছুতেই বাঁচাবো না।আমার সন্তান না তাহলে আমি নিজেও থাকবো না।’

অগত্যা আমাদের তামান্না আপুর কথা শুনতে হয়।ডেলিভারির আগে তামান্না আপু রিকোয়েস্ট করে দীপান্বিতা আপুর সাথে কথা বলে।কি কি বলে আমি জানি না।আমি আব্বু আম্মু বাইরে ছিলাম।ক্যাডার সাহেব আর বাবাই ব্যাস্ত ছিলো তাই আমরা আসি।

নার্স যখন অভ্রকে কান্নারত অবস্থায় বের হয় দীপান্বিতা আপু সাথে সাথে কোলে নেয় অভ্রকে।অভ্রর কান্না নিজে থেকে থেমে যায়।অভ্রের জন্মের সাথে সাথে মৃত্যু হয় তামান্না আপুর। পিংকির আম্মু অনেক কথা শুনায় কিন্তু দীপান্বিতা আপুর এক কথা।আজ থেকে অভ্র তার ছেলে। অতটুকু অভ্রকে কোলে নিয়ে আমিও যেনো মায়ায় জড়িয়েছিলাম।প্রায় যেয়ে যেয়ে খেলা করতাম অভ্রর সাথে। আস্তে আস্তে আমরা সবাই অভ্রকে ভালোবাসতে শুরু করি।অভ্র আমাদের কাছের একজন হয়ে উঠেছে। পারা পড়শীরা কিছু বলতে আসলে প্রতিবাদ করে দীপান্বিতা আপু।এই জন্য কয়েকদিন পরই অভ্রকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করবে।”

এইটুকু বলে থেমে যায় নীরা।নীরার চোখ দিয়ে পড়ছে পানি।পানিগুলো মুছে আবার বলে,”কিন্তু আমি এটা বুঝলাম না যে তুমি এগুলো জানো না কেন?”

“আমার সাথে দীপান্বিতার সম্পর্ক জার্মান যাওয়ার পরও থাকে।কিন্তু ছয়মাস পর হঠাৎ একদিন আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়।অনেক খুঁজি আমি ওকে।কিন্তু পাই না কোথাও।প্রায় বছর পর আম্মুর সাথে ভিডিও কলে কথা বলার সময় দেখি আণ্টি (মিসেস সাবিনা)অভ্রকে কোলে নিয়ে আছে।আমি জিজ্ঞাসা করি বাচ্চাটা কে।আম্মু বলে দীপান্বিতার ছেলে।আমি ভেবে নিয়েছিলাম ওর মনে হয় বিয়ে হয়েছে,সংসার করছে।একদিন ও আমাকে কল দেয় রাগে দুঃখে আমি আমার কন্টাক্ট নাম্বার অফ রাখি।সবকিছু পাল্টে ফেলি।”

মাথায় হাত দিয়ে নীরা বলে,”এতকিছু হয়ে গেছে।অথচ কিছুই জানতাম না।কিন্তু দীপান্বিতা আপু তোমার সাথে কন্টাক্ট অফ রেখেছিলো কেনো এটা আমিও জানি না।”

“হয়তো ব্যাস্ত ছিলো।কিন্তু আমি কত বড় ভুল করলাম।যদি ও একটিবার আমাকে ওর অবস্থাগুলো বলতো আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতাম।”

“মানুষ মাত্রই ভুল।আমরা কাউকে দুই মিনিটে বিশ্বাস করে ঠকি আবার চোখের পলকে অবিশ্বাস করেও ঠকি।এটা অবস্থা বুঝে।”

“হুম।এখন কি করবো?”

“কি করবে মানে?দীপান্বিতা আপুকে বিয়ে করবে।মেয়েটা সারা জীবন তোমার অপেক্ষায় ছিলো।”(জোরেই বলে)

“ও কি মেনে নিবে?যেভাবে রেগে আছে।”

“ওহ কাম অন ভাই।তুমি এই মুনজেরিন নীরার ভাই।ক্যাডার সাহেব হলো তোমার দুলাভাই।তুমি অবশ্যই পারবে।”

“লিমার কি হবে?ওকে তো আজকে আংটি পড়িয়ে এসেছি।”

“ওই লিমা যদি হয় আমার ভাবী।আমার মাথা কিন্তু হয়ে যাবে আতা মাঝি ছাতাকলি।”

“বিয়েটা ভাঙবো কিভাবে?”

কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে নীরা দুষ্টু বুদ্ধি বেড় করে।নীরব ও নীরা সেগুলো নিজেই আলোচনা করে।তারপর বেড় হয় ঘর থেকে।ড্রয়িং রুমে এসে দেখে দ্বীপ এসেছে।মিসেস নাজনীন মিস্টার রবিন ও দ্বীপ সোফায় বসে গল্প করে।নীরা বলে,”বলে দিয়েছেন সব।”

দ্বীপ সোফায় বসা অবস্থায় বলে,”সব জানলে তো বলবো!”

মিস্টার রবিন বলেন,”না মা তেমন কিছুই বলেনি দ্বীপ।আমরা শুধু এটুকুই বুঝেছি নীরব ও দীপান্বিতার ভিতর জিলাপির প্যাচ আছে।”

মিসেস নাজনীন চোখ রাঙিয়ে বলেন,”এতদিন তো ছেলে মেয়ে হিসাব করে কথা বলনি।আজ অন্তত জামাইকে দেখে কথা বলো।”

নীরা মিস্টার রবিনের পাশে বসে বলে,”আরে ধুর।আমার আব্বু হলো সাদা মনের মানুষ।কত প্যাচ বুঝে না।তাই মনে যা আছে মুখ ফুটে বলে।”

তারপর নীরা সবাইকে সবকিছু প্রকাশ করে।নীরব ফ্লোরে তাকিয়ে আছে।সবকিছু বলার পর নীরা বলে,”আমি এটা বুঝলাম না!ভাইয়া জার্মানে যাওয়ার ছয় মাস পর দীপান্বিতা আপু কন্টাক্ট কেনো রাখে না?”

দ্বীপ বলে,”যদি ঘটনা ওই সময়ের হয়ে থাকে তাহলে তো তখন দীপান্বিতা ইন্টার এক্সাম দিবে।তখন ওর ফোন নষ্ট হয়ে যায় পানিতে পড়ে।বাবা বলেছিলো ওকে নতুন ফোন কিনে দিবে কিন্তু পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর।পরীক্ষার পর তো আমরা একটু ব্যাস্ত হয়ে পড়ি তারপর তামান্নার সমস্যা শুরু হয়।”

নীরা বলে,”হুম বুঝলাম।কিন্তু আমার ফোন কখন দিবেন?আমার ফোন তো সেই পরীক্ষার তিন দিন আগে থেকে নিয়েছেন।এদিকে আমার পরীক্ষা কাল শেষ হয়ে গেছে।ফোন তো দিলেন না!”

চলছে সিরিয়াস কথা।নীরা বলে উল্টা পাল্টা কথা।সবাই তাকিয়ে আছে নীরার দিকে।মেকি হাসি দিয়ে নীরা বলে,”না মানে মনে পড়লো হঠাৎ তাই আর কি।”

দ্বীপ কথা পাল্টে বলে,”তারমানে এই যে তোমাদের দূরত্ব বাড়লেও তোমাদের মনের গহীনে লুকিয়ে আছে জমানো অনুভূতিগুলো।”

“হ্যাঁ। আর তাদেরকে এক করার দায়িত্ত্ব আমাদের।”

মিসেস নাজনীন বলেন,”লিমার কি হবে তাহলে?”

নীরা লাফিয়ে উঠে বলে,”এই বাড়ির বউ যদি হয় লিমা!সত্যি বলছি তোমার ছেলের মাংস হয়ে যাবে কিমা।সারাদিন এই বাড়িয়ে আমি বাজাবো অক্ষয় কুমারের ডিজে গান বালমা।”

দ্বীপ বলে,”বাবা মা(নীরার বাবা মাকে দ্বীপ বাবা মা বলে) তো তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন।এখন কি করবে?”

“বিয়ে ভাঙবো।”

“কিভাবে?”

কনফিডেন্সের সাথে নীরা বলে,”যাহা পার নীরা হোতি হে টেনশন লেনেকা কোয়ী জারুরাত নেহি।মে হু না।”

মিসেস নাজনীন বলেন,”ওটায় তো বড় সমস্যা।নিজের বিয়ে ভাঙতে যেয়ে কি করেছিলে মনে আছে?বখাটে নান্টুকে টাকা দিয়ে রেখেছিলে নিজেকে কিডন্যাপ করার জন্য।ভাগ্য ভালো দ্বীপ দেখে ফেলে আর প্ল্যান ঘুড়িয়ে দেয়।”

বলেই জিহ্বায় কামড় দেন মিসেস নাজনীন।নীরা চোখ ছোট ছোট করে বলে,”তারমানে ওই ভুয়া গুন্ডাগুলো ক্যাডার সাহেবের লোক ছিলো?বিয়েতে যা দৌড়ানি গেছে সব ক্যাডার সাহেবের জন্য!আমি কি না ভয় পেয়ে ক্যাডার সাহেবের হাত ধরে দৌড়ে কমিউনিটি সেন্টারে আসি।নিজের বিয়েতে মিথ্যা গুন্ডা ভাড়া করে তাড়া খেতে লজ্জা করে না?”

“নিজের বিয়েতে গুন্ডাদের টাকা দিয়ে কিডন্যাপ করানোর প্লান করতে তোমার লজ্জা করে না?”বলেন মিসেস নাজনীন।

“আমি খুবই স্ট্রেট।আমাকে কেউ তার মনের সত্যিটা বললে নিজের বিয়েতে আমি বিরিয়ানি আর রোস্ট মজা করে ইনজয় করতাম।কত টেস্টি ছিলো খাবারগুলো।”

বলেই জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট নাড়ায় নীরা।দ্বীপ বুঝতে পারে এর পাগলামি শেষ হবে না।তাই বলে,”আচ্ছা পরশু তো রিক আর কেয়ার বিয়ে।দায়িত্ব আমাদের উপরেই বেশি।তাই আমরা ওদিকটায় ফোকাস দেই।চলো বাসায় চলো।”

“না আজ আমি এখানে থাকবো।বলেছিলাম তো আপনাকে।”

দ্বীপ কথা না বাড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে নীরার হাত ধরে নিয়ে যায়।

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২৫
#ইশরাত_জাহান
🦋
হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে মিসেস নাজনীন এর কাছে।নীরবকে কিছু লোকজন মিলে খুব মারধর করেছে।এখন সে সেন্সলেস হয়ে হসপিটালে ভর্তি।মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন এসে পৌঁছায় সেখানে।ভিতরে নীরবের চিকিৎসা চলছে। আর বাইরে বসে কান্না করছেন মিসেস নাজনীন।নীরাকে খবর দেওয়া হয়েছে।নীরবের অবস্থা খারাপ শুনে আতকে উঠে দীপান্বিতাও।নীরা ও দ্বীপের সাথে সেও যায় হসপিটালে।

হবু জামাই হসপিটালে ভর্তি হয়েছে এই খবর কানে আসতেই হসপিটালে হাজির হন লিমার বাবা মা ও লিমা।মিসেস নাজনীনকে শান্তনা দিচ্ছেন লিমার মা।নীরা ও দীপান্বিতা তাকিয়ে আছে লিমার দিকে।মেয়েটা বেশ সুন্দর।কিছুক্ষণ পর অপারেশন রুম থেকে বের হলো ডাক্তার।

ডাক্তারকে দেখে মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন দৌড়ে যান ডাক্তারের কাছে।মিসেস নাজনীন বলেন,”আমার ছেলের কি হয়েছে?ওর অপারেশন চলছে কেনো?সামান্য মারে কি কাউকে অপারেশন করতে হয়?”

ডাক্তার বলেন,”আসলে ওনাকে গভীরভাবে আহত করা হয়েছে।প্রচুর রক্তপাত হয়েছে।ইনফ্যাক্ট মেইন পয়েন্টে আঘাত করা হয়েছে ওনাকে।স্যরি টু সে উনি বাবা হওয়ার দিক থেকে অক্ষম।”

ডাক্তারের কথা শুনে ভেঙ্গে পড়েন মিসেস নাজনীন।ছেলের তার কি হাল হলো।কান্না করতে থাকেন সাথে সাথে।বলেন,”আমরা ওর সাথে দেখা করতে চাই।”

“এখন উনি ঘুমিয়ে আছেন।জ্ঞান ফিরলে দেখা করতে পারবেন।”

সবাই রাজি হয়।লিমার বাবা মা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে বলেন,”আলহামদুলিল্লাহ নীরব বাবা সুস্থ আছেন।”

মিসেস নাজনীন খুশি হন।কিন্তু লিমার বাবা মায়ের পরবর্তী কথাতে তার খারাপ লাগে।লিমার বাবা বলেন,”যেহেতু নীরব বাবার এত বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে আমরা তো আর আমাদের মেয়েকে…”

কিছু বলার আগেই মিসেস নাজনীন বলেন,”হ্যাঁ।খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি।আমাদের কোনো আপত্তি নেই।এমনিতেও আমরাই না করে দিতাম।বিবেকবোধ কিছুটা হলেও আমাদের আছে।”

“ধন্যবাদ।”বলেই চলে যায় তারা।

লিমারা চলে যাওয়ার পর নার্স এসে বলে,”আপনারা ভিতরে যেতে পারেন।”

কেউ কিছু করার আগে দৌড় দিয়ে ভিতরে ঢোকে দীপান্বিতা।এসেই শুয়ে থাকা নীরবের একপাশের কাধ জড়িয়ে ধরে বলে,”আপনার এ কি অবস্থা হলো।”

বলেই কান্না করতে থাকে।নীরব ফিসফিস করে বলে,”আরে এগুলো নাটক ছিলো।তুমি কান্না করোনা।কিছুই হয়নি আমার।”

নীরবের এমন কথা শুনে কান্না থামিয়ে হা হয়ে যায় দীপান্বিতা।সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে বসে নীরব।জোরে জোরে বলে,”মা বাবাকে নিয়ে ভিতরে আয় বোন।”

সাথে সাথে হা হা করে হেসে ক্যাবিন এর ভিতরে ঢোকে নীরা।সবাই আহাম্মকের মত তাকিয়ে আছে।নীরব শোয়া থেকে উঠে বসে।মিসেস নাজনীন বলেন,”নীরব তো একদম সুস্থ!”

নীরা বলে,”হ্যাঁ।বিয়ে ভাঙার জন্য আমি আর ভাই মিলে এই প্লান করি।”

মিসেস নাজনীন কিছু বলতে যাবেন তাকে আটকিয়ে মিস্টার রবিন বলেন,”আহা বাদ দেও।বাচ্চারা তাদের সুখের জন্য করেছে এসব।”

“তাই বলে এভাবে মিথ্যা সাজিয়ে।লোকজন এখন বলবে আমাদের ছেলের খুত আছে।”

“তুমি চিন্তা কর না।দুদিন পর যখন আমাদের নাতি নাতনির মুখ দেখবে তখন দুর হবে ওদের খুত।”

শ্বশুরের মুখে এমন কথা শুনে দ্বীপ ফোন বেড় করে টিপতে থাকে।দীপান্বিতা মাথা নিচু করে বসে আছে লজ্জাতে।নীরা ও নীরব মিটমিট হাসতে থাকে।মিসেস নাজনীন বলেন,”ঠোঁটকাটা বাবার ঠোঁটকাটা সন্তান।জামাইকে তো দেখো।”

নীরা দ্বীপকে খেপাতে বলে,”আরে আম্মু চিন্তা করার কিছু নেই।আমার ক্যাডার সাহেব দেখতে যেমন,আসলে সে মোটেই তেমন নয়।সে হলো আড়ালে আবডালের গভীরতর ঠোঁটকাটা।”

মিসেস নাজনীন সাথে সাথে মিস্টার রবিনকে নিয়ে চলে যায়।এরা বাবা মেয়ে মিলে মানুষের সামনে মান সম্মান ধরে রাখবে না।

নীরার বাবা মা চলে যাওয়ার পর সবাই চুপচাপ থাকে।নীরা তাকায় দ্বীপ দীপান্বিতা ও নীরবের দিকে।বিরক্ত হয়ে নীরা বলে,”কি ব্যাপার ভাইয়া?আমার বর্তমান ননদ হবু ভাবীকে তো এনে দিলাম।এখন প্রোপজ কর।”

দীপান্বিতা বলে,”এগুলো কি নীরা?ভয় দেখানোর কোনো মানে ছিলো?”

“অবশ্যই ছিলো।মানুষকে বেশি তেল মাখলে সে পিছলে সরে যায়।আমি অত অপেক্ষা করতে পারবো না।এমন কাজ করি ডিরেক্ট কাজে লেগে যাবে।”

দ্বীপ বলে,”কিন্তু এগুলো হলো কিভাবে?”

“কিভাবে আবার নান্টুকে টাকা দিয়ে ভাইকে মার খাইয়েছি।”

চশমা ঠিক করে দ্বীপ বলে,”আবার নান্টু!এই বখাটে কে তো আমি এলাকা ছাড়া করাবো।”

“আরে আরে এবার আমি নান্টুর সাথে কথা বলিনি।ভাই বলেছিলো ওর সাথে কথা।”

“সে না হয় বুঝলাম।কিন্তু এতবড় একজন ডাক্তার হয়ে কিভাবে তোমাদের সাথে যুক্ত হতে পারে?ডাক্তার হয়ে এটা একটা ক্রাইম ছিলো।”

“ঘোড়ার ডিমের ক্রাইম।ক্রাইম এর ক বুঝেন?আমার ভাই একজন নিউট্রিশন।তার হাতে এসব ডাক্তার তো থাকেই।ফ্যামিলি ডাক্তার আবার ভাইয়ের সাথেও ফ্রেন্ডলি তাই আংকেল রাজি হয়েছে অভিনয় করতে।”

দীপান্বিতা বলে,”এসব করার কোনো দরকার ছিলো না নীরা।তোমার ভাই অন্য কাউকে বিয়ে করলে সুখে থাকবে।আমি তো সম্পর্ক ধরে রাখতে পারি না।আমার সম্পর্কগুলো নড়বড়ে।”

“আমি স্ক্রু গুলো টাইট করে নিবো।”(নীরব বলে)

নীরা হেসে দেয়।দ্বীপ বিড়বিড় করে বলে,”যেমন বাবা তার তেমন ছেলে আবার মেয়েও।”

রেগে যেয়ে দীপান্বিতা বলে,”ইয়ার্কি করছেন আপনি?কথা বলব না আমি আপনার সাথে।গেলাম আমি।”

বলেই বেড় হয়ে যায় দীপান্বিতা।নীরব বলে,”এবার কি হবে? মায়াবন বিহারিনী তো রাগ করেছে।”

নীরা তাড়াহুড়ো দিয়ে বলে,”আরে ভাই আমার।ভাবীর পিছনে দৌড়াও।এখানে বসে থেকে লাভ নেই।”

সাথে সাথে নীরব যায় দীপান্বিতার পিছনে।দ্বীপ নীরার কাছে এসে বলে,”চলো,ওদের ব্যাপার ওরা বুঝুক।কিছু সম্পর্কের গভীরতা বুঝতে খুনসুটির দরকার হয়।”

“কি ব্যাপার ক্যাডার সাহেব!আপনিও দেখছি আমার মত হয়ে যাচ্ছেন।”

“চন্দ্রপাখির ছোঁয়া লেগেছে তাই।”

বলেই দ্বীপ ও নীরা একসাথে বের হয়।শীতের দিনেও বৃষ্টি হচ্ছে।দ্বীপ ও নীরা হসপিটাল থেকে বের হয়ে দেখে নীরব ও দীপান্বিতা একটি ছাউনির নিচে দাড়িয়ে আছে।দীপান্বিতা মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে আছে।নীরব বলে,”ওহে মায়াবন বনবিহারিনী,করে না আমার সাথে আড়ি।তোমার প্রেমেই তো জ্বলছে আমার হৃদয়খানি।”

দীপান্বিতা তাও চুপ।এতদিনের অভিমান এত তাড়াতাড়ি কি শেষ হয়?কখনই না।গার্লস ইগো বলেও তো কিছু আছে।নীরব আবার বলে,”করেছিলাম আমি এক মিথ্যা অভিমান। যার কারণে বেড়েছে আমাদের দূরত্বের পরিমাণ।যদি থাকো তুমি এখন নিজ থেকে দূরে।সত্যি বলছি জাপ দিবো আমি এখন এই শীতের বৃষ্টিতে।”

জোরে জোরে হেসে দেয় দীপান্বিতা।নীরব এই সন্ধায় সোডিয়ামের আলোতে দেখতে থাকে তার মায়াবন বিহারিনীর হাসি।কতগুলো বছর পর প্রিয়তমার হাসি দেখছে।মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে নীরব।

নীরা দ্বীপকে বলে,”সন্ধ্যা তো হয়েই গেছে।চলুন আমরা শীতের এই বৃষ্টিসন্ধাতে চা উপভোগ করি।”

দ্বীপ বলে,”প্রস্তাব মন্দ না।এক কাপ চায়ে আমি আর আমার চন্দ্রপাখি।সাথে সাক্ষী থাকবে সন্ধার আকাশে হাসি দেওয়া মিষ্টি চাঁদ।”

নীরা খুশি হয়ে নীরব ও দীপান্বিতাকে বলে,”শোনো,তোমাদের মান অভিমান রাখো এক সাইডে।এখন চলো আমরা যাই শীতল হওয়ার বিলাসে।”

দীপান্বিতা বলে,”শীতের বৃষ্টিতে ভিজলে তো ঠান্ডা লাগবে।”

“আরে ক্যাডার সাহেব এত বড় গাড়ি নিয়ে এসেছে কেনো?গাড়িতে করে আমরা চায়ের দোকানে যাবো।এই শীতের রাতে ঝুম বৃষ্টির সাথে মালাই চা। উফ আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।”

“আচ্ছা চলো।”

বলেই সবাই চলে যায় চায়ের ছোট দোকানে।ঝিরঝির বৃষ্টি থেমে এখন ঘন কুয়াশার মেলা বসতে শুরু করেছে।আকাশে শুধু একটি চাঁদের দেখা মিলছে।বৃষ্টির কারণে আজ দেখা দিচ্ছে না তারাদের মেলা।দ্বীপ নীরা ও নীরব দীপান্বিতা আলাদা বেঞ্চে বসেছে।দোকানদার চারটি মটকায় করে মালাই চা নিয়ে আসে। নীরব ও দীপান্বিতা অন্যদিকে ফেরা। দ্বীপ ও নীরা তাদের পিছনের বেঞ্চে বসেছে।দ্বীপ প্রথমে নিজের চায়ের মটকা নিয়ে নীরার সাথে শেয়ার করে চায়ের উপভোগ করে।এক চুমুক চা দ্বীপ নেওয়ার পর সেই মটকা থেকে নীরা আরেক চুমুক নেয়।এভাবে এক মটকা শেষ করার পর নীরার মটকা চা ঠিক একইভাবে উপভোগ করে দুজনে মিলে।দুজনের মুখে মিষ্টি চায়ের সাথে এক মিষ্টি হাসি বিরাজ করছে।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-২২+২৩

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব২২
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকালে গোসল করে শাড়ি পরে দীপান্বিতা।একটু পর লাইভ করবে শাড়ি সেলের জন্য।ভেজা চুলে হিজাব বাধা সম্ভব না।তাই আপাতত চুল মেলে রেখে ভেজা জামা কাপড় নিয়ে ছাদে আসে।কাপড় চোপড় রোদে শুকাতে দিবে।ছাদে এসে কাপড়গুলো তারে মেলতে থাকে দীপান্বিতা।নীরব ছাদেই ছিলো। সিগারেটে নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছিলো।একজন নিউট্রিশন হয়েও আজ নিজের সঙ্গী হিসেবে সিগারেট বেচে নিয়েছে।দীপান্বিতা ছাদে আসাতে আনমনে তার চোখ যায় সেদিকে।কতদিন পর আজ শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলো নিজের মায়াবন বিহারিনীকে।দেখে নিজের চোখের পিপাসা মেটাতে থাকে নীরব।ঠিক তখনই অভ্র এসে দীপান্বিতার শাড়ির আঁচল ধরে টান দেয়।সাথে সাথে দীপান্বিতা হাত দিয়ে শরীরের কাপড় ঠিক রাখতে সক্ষম হয়।শাড়ি দিক বেদিক না হলেও কোমর থেকে হালকা শাড়ির পার সরে যায়।অভ্রকে দেখে নীরবের বিবেকে নাড়া দেয়।সে তার নিষিদ্ধ নারীকে দেখছে।

এদিকে শাড়ির এমন অবস্থা হওয়াতে নীরব দীপান্বিতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,”লাইভে এসে তো আজকাল মানুষ নিজেদের রূপ যৌবন দেখিয়ে ইনকাম করছে।এখন কি তাদের ছাদে এসেও বাকিটুকু খোয়াতে হবে?না জানি কত কি দেখতে হয়।”

পিছন থেকে নীরবের এমন দৃষ্টিকটু কথা সহ্য করতে পারে না দীপান্বিতা।ছাদ থেকে সোজা ঘরে চলে আসে।ঘরে এসে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে।অভ্র দীপান্বিতার পিছনে এসে দীপান্বিতাকে বলে,”কি হয়েছে আম্মু?”

আজ প্রথম দীপান্বিতা রাগে দুঃখে অভ্রকে চড় মেরে বলে,”কে তোর আম্মু?আমি তোর আম্মু না।চলে যা চোখের সামনে থেকে।”

বলেই বালিশে মুখ গুজে কান্না করতে থাকে।বেশ কিছুক্ষণ কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যায় দীপান্বিতা।আজ আর লাইভ করা হলো না তার।ঘণ্টা খানিক পর মিসেস সাবিনা এসে ডাক দেন দীপান্বিতাকে।দীপান্বিতাকে ডেকে বলেন,”লাইভ করিস নি?অভ্রকে তো গোসল করাতে হবে।”

“অভ্রকে আজ তুমি গোসল করিয়ে দেও মা।”

“নানাভাই কোথায়?”

“কোথায় মানে?ও তোমার কাছে নেই?”

“না।আমি তো রান্না করতে ব্যাস্ত।কিছু হয়েছে?”

“আমি আজকে ওকে রাগের মাথায় মেরেছি মা।কটু কথা শুনিয়েছি।মাথা গরম ছিলো তাই।গেলো কোথায় ছেলেটা আমার?”

বলেই খাট থেকে লাফ দিয়ে ওঠে দীপান্বিতা।নীরার পরীক্ষার আজ শেষ দিন।দ্বীপ নিজেও আজ পরীক্ষার সেন্টারে ব্যাস্ত।পিংকি ওইদিনের পরেই চলে যায় হোস্টেলে।মিস্টার সমুদ্র নিজের কাজে গেছেন।মিসেস শিউলি তালিমের দাওয়াত পেয়েছেন তাই সেখানে গেছেন।বাসায় শুধু মিসেস সাবিনা ও দীপান্বিতা ছিলো।মিসেস সাবিনা রান্না করছেন।এমনিতেই দীপান্বিতার ঘর রান্নাঘর থেকে দূরে তারউপর প্রেসার কুকারে সিটি বাজার শব্দে দীপান্বিতার কথা শুনতে পান না।যদি শুনতে পেতো তাহলে তখনই অভ্রকে নিজের কাছে নিয়ে নিতেন।

সাড়া ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে যাচ্ছে দীপান্বিতা।অভ্রকে খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও।এবার যেনো নিজেই জ্ঞান হারাবে দীপান্বিতা।এই বাড়ি ওই বাড়ি খুঁজতে থাকে।মিসেস সাবিনা তাড়াতাড়ি খোঁজ নেন মিসেস নাজনীনের কাছ থেকে।কিন্তু না অভ্র সেখানেও নেই। নীরব বাসায় আছে আজ।বিকালে যাবে নিজের সেন্টারে।সোফায় বসে মায়ের কাছে শুনতে পেলো অভ্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।বাচ্চা অভ্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে বুকে মোচড় দিলো নীরবের নিজেরও।ভাবতে লাগলো ঘণ্টা দুই আগের ঘটনার জন্যই কি এমন হলো?তাড়াতাড়ি করে অভ্রকে খুঁজতে বাইক নিয়ে বের হয় নীরব।নীরার সাথে অভ্রর বেশ কয়েটা ছবি আছে।সেগুলো দেখিয়ে দেখিয়ে খুঁজবে অভ্রকে।

মিসেস সাবিনা ফোন করে দিলেন মিস্টার সমুদ্রকে।অভ্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে তিনিও দৌড়ে চলে এসেছেন।গোল্লিতে এ বাড়ি ও বাড়ি করেও অভ্রর কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না।দীপান্বিতার কানে এখন শুধু চার বছর আগের সেই পুরোনো প্রতিশ্রুতি ভেসে আসছে।কেউ একজন তাকে মারা যাওয়ার আগে বারবার বলেছিলো,”আমার অভ্রকে তুমি দেখে রেখো।আমার কলিজার টুকরোর এই দুনিয়ায় কেউ নেই।জন্ম দিয়ে আমি চলে যাচ্ছি।কিন্তু তার আসল গার্জিয়ান তুমি।”

পারলো না আজ দীপান্বিতা।এতগুলো বছর নিজের হাতে গড়ে তোলা অভ্রকে দুই মিনিটে হারিয়ে ফেললো।মাত্র চার বছরের এক শিশু তার মনে কি এতই ক্ষোভ?যে সামান্য একটু কথাতে সে আঘাত পেয়ে চোখের বাইরে চলে গেলো।বাচ্চা হলে কি হবে?সে তো মানুষ।হয়তো এই জন্যই অভ্রর মনেও দাগ কেটে নিয়েছে এই কথাটি।এমনিতেও কত মানুষ ওকে কত রকম কথা শুনিয়ে দেয়।শেষমেশ তার মাও কি না তাকে আজ কথা শুনিয়েছে।সহ্য করতে পারেনি অভ্র।

দ্বীপ নীরাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে।এমন সময় দ্বীপের ফোনে কল আসে।মিস্টার সমুদ্র করেছে এই ফোন।দ্বীপ ফোন রিসিভ করতেই মিস্টার সমুদ্র বলেন,”অভ্রকে পাওয়া যাচ্ছে না তিন ঘণ্টা হতে চললো।দীপান্বিতার অবস্থা খুবই খারাপ।দুইবার অজ্ঞান হয়েছে।আমি আমাদের এলাকার ভিন্ন গোল্লিতে খুঁজছি।তুমি ওদিক দিয়ে আসার সময় একটু ভালোভাবে পরখ করে নিও।নীরব গেছে গোল্লির মাথায় অভ্রকে খুঁজতে।”

ফোন লাউডে ছিলো।নীরা ও দ্বীপ অভ্রর কথা শুনে দুজনেই নার্ভাস হয়ে গেছে।তারপরও দ্বীপ বলে,”আমরা ভালোভাবে খোঁজ নিচ্ছি বাবা।”

দ্বীপ আস্তে আস্তে ড্রাইভ করছে আর রাস্তায় কোনায় কোনায় ভালোভাবে তাকাচ্ছে।নীরা নিজের জানালার পাশ দিয়ে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখতে থাকে। গোল্লির মাথায় এসে গাড়ি থামিয়ে দ্বীপ ও নীরা একসাথে ভিন্ন জায়গায় খুঁজতে থাকে অভ্রকে।বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর এক জায়গায় দাড়ায় দ্বীপ ও নীরা।হঠাৎ নীরার কানে ভেসে আসে ফোফানির শব্দ।কেউ রাস্তার পাশে একটি ডাস্টবিনের পিছনে কান্না করছে।নীরা তাড়াতাড়ি সেখানে যেয়ে দেখে অভ্র হাঁটু চেপে ধরে কান্না করতে থাকে।নীরা দ্বীপকে ডাক দিয়ে বলে,”অভ্র এখানে ক্যাডার সাহেব।”

দ্বীপ দৌড়ে আসে ওদের কাছে।নীরা অভ্রর হাঁটুতে হাত দিয়ে বলে,”এখানে কিভাবে লেগেছে বাবা?”

“একটা কুকুর আমাকে তাড়া করে।আমি দৌড়াতে দৌড়াতে পড়ে যাই।তারপর এখানে লুকিয়ে থাকি।”

দ্বীপ অভ্রকে কোলে নিয়ে বলে,”তুমি কাউকে কিছু না বলে এভাবে বাসা থেকে বেড়িয়েছো কেনো?তোমাকে সবাই খুঁজছে তো।”

অভ্রকে চোখের পানি মুছে বলে,”আম্মু বলেছে আমাকে চলে যেতে।আম্মু আমার মা না।আমার মা বাবা কে?”

দ্বীপ এবং নীরা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে অভ্রকে নীরা বলে,”তোমার মায়ের নাম দীপান্বিতা।তোমার মাও যে বাবাও সে।”

বলেই কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করে নীরা।তারপর বাড়ির দিকে রওনা দেয়।নীরা ফোন করে মিস্টার সমুদ্রকে বলে,”আমরা অভ্রকে পেয়েছি।বাসায় আসছি এখনই।”

মিস্টার সমুদ্র সাথে সাথে সবাইকে বলে।দীপান্বিতা তাড়াহুড়া করে মেইন গেটের কাছে এসে অপেক্ষা করে অভ্রর জন্য।নীরবকে কল করে জানিয়ে দেন মিসেস নাজনীন।দ্বীপের গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামতেই দীপান্বিতা অভ্রকে কোলে নিয়ে আদর করে।কান্না করতে করতে বলে,”আম্মুর কথায় কেউ রাগ করে,বাবা?একটু রেগে গেছিলো আম্মু। আর কখনও রাগ করবে না।”

ঠিক তখনই নীরব আসে সেখানে।অভ্রকে দেখে নিজেও এবার শান্তি পেলো।মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস সাবিনা চলে গেলেন বাসার ভিতরে।বাচ্চারা সবাই না খেয়ে আছে।মিসেস নাজনীন অভ্রকে আদর করে নিজের ফ্ল্যাটে চলে যান।নীরব এসে দীপান্বিতাকে বলে,”বাচ্চাকে আগলে রাখতে পারেন না?এমন বেপরোয়া থাকেন কেনো আপনার সম্পর্কগুলো?”

দীপান্বিতা চোখের পানি মুছে বলে,”আমি আমার ছেলেকে কিভাবে আগলে রাখবো সেটা আমি বুঝে নিবো।আপনাকে দেখতে হবে না।”

বলেই অভ্রর হাত ধরে হাটা দেয় দীপান্বিতা।নীরব ক্ষিপ্ত হয়ে হাটা দেয় নিজের বাড়ির দিকে।দ্বীপ এদের কান্ড দেখলো।নীরা একবার তাকায় দীপান্বিতার যাওয়ার দিকে আরেকবার তাকায় নীরবের যাওয়ার দিকে।দ্বীপ নীরাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,”কি হয়েছে?”

“কেমিস্ট্রি।”

ভ্রু কুঁচকে দ্বীপ বলে,”মানে?”

“যখন কোনো নারী ও পুরুষ একে ওপরের বিপরীত দিকে হাঁটতে থাকে তখন তার মানে কি বোঝায় জানেন?”

দ্বীপ মাথা নাড়ায় মানে না।নীরা আবার বলে,”এরা একে ওপরের বিপরীত মুখী।কিন্তু এদের মিলন আবারও হবে।”

“কোন কবির থেকে শুনেছো এই কথা?”

“লোকে চাইলে এই নীরাও হতে পারে এক কবি।”

“তোমার কি মনে হয়?দীপান্বিতা ও নীরবের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে?”

“বর্তমানে আমার সচক্ষে নেই।তবে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি এদের মধ্যে কিছু একটা আছে।যেটা এখন প্রকাশ পাচ্ছে না।”

“অভ্রর কি হবে?দীপান্বিতা ওকে এখন নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসে।জীবনে প্রথম মা ডাক শোনার অনুভূতি।তার উপর কারো সাপোর্ট ছাড়াই মানুষ করে অভ্রকে।”

“অভ্রর জন্য এখন আমরা আছি।তখন নাহয় দায়িত্ব নিতে পারিনি।এখন তো পারবো। আর এমনিতেও অভ্রকে দীপান্বিতা আপু বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করাতে চেয়েছে।”

“ভাই হিসেবে বোনের জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।নীরব ছেলে হিসেবে অনেক ভাল।আমার সাথে বসে যখন চায়ের আড্ডা দিতো আমার খুব ভাল লাগতো।তাই নীরবকে আমি না করবো না।কিন্তু অভ্রকে ছাড়া দীপান্বিতা এখন শূন্য।”

“চেষ্টা তো করতে থাকি।দেখা যাক ভাগ্যে কি হয়!”

“হুম।”

বলেই দ্বীপ ও নীরা বাড়ির ভিতরে ঢুকলো।আজ সন্ধায় রিক ও কেয়ার বিয়ের কেনাকাটা হবে।এই জন্য নীরা ও দ্বীপকে ডাকা হয়েছে।দ্বীপ ও নীরা রেডি হয়ে অভ্রকে নিয়ে চলে যায় শপিং মলে।কেয়ার পছন্দের ড্রেস কিনে দেওয়া হয় কেয়াকে। রিককেও কেয়ার পছন্দ করে দেওয়া পাঞ্জাবি কিনে দেওয়া হয়।সবকিছু কেনাকাটা করার পর সবাই বাড়ি ফিরবে কিন্তু নীরা দ্বীপকে খুঁজে পায় না।কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর নীরা দেখলো দ্বীপ বাইরে থেকে আসছে।

নীরা বলে,”কোথায় গিয়েছিলেন?”

“বাইরে একটু কাজ ছিলো তাই।”

“আচ্ছা,চলুন বাসায় যাই।”

বলেই সবাই বাসায় চলে যায়।

{শুনো গিটার সাহেব।তুমি যখন ব্যালকনি দিয়ে গিটারের তালে তালে গাইবে মায়াবন বিহারিনী আমি তখনই আমার জানালা দিয়ে তোমাকে দেখবো।রাতের আধারে প্রেমিক পুরুষের গানের সাথে চন্দ্র বিলাস করার মজা আলাদা।দুজন দুর দূরান্তে থেকেও আমরা গানের তালে করবো প্রেমের আবেদন।}

দীপান্বিতার এই পুরনো কথাগুলো মগজে বারবার বারি খাচ্ছে নীরবের।নীরব খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।গিটার বাজানো এক নেশা নীরবের কাছে।সেই নেশায় যোগ দেয় দীপান্বিতা।তখন নীরবকে গিটার সাহেব বলে ডাকতো।আবার যখন নিরব বলতো সে নিউট্রিশন হতে চায় তখন দীপান্বিতা তাকে খাদ্য বিশেষজ্ঞ সাহেব বলে ডাকতো।

পুরনো স্মৃতি মাথা থেকে মুছে ফেলতে চায় নীরব।তাই সে মিসেস নাজনীনকে বলে,”আমার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করো মা।আমি আর আপত্তি করবো না।”

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব২৩
#ইশরাত_জাহান
🦋
ছেলের কথা শুনে খুশি হন মিসেস নাজনীন।মেয়ে দেখার জন্য তার কিছু বান্ধবীকে কল করেন।শীঘ্রই ছেলের বিয়ে দিতে চান তিনি।

আজ বাসায় সিঙ্গারা বানিয়েছে নীরা।সিঙ্গারার শেপ একদম পারফেক্ট আর আলু রান্নাটা হুবহু হয়েছে।শুধু সিঙ্গারা খেতে যেয়ে মনে হচ্ছে পড়াটার ভিতর আলুর দম মেশানো।সবাই টমেটো সস দিয়ে নীরার এই সিঙ্গারা উপভোগ করছে।মিসেস সাবিনা বলেন,”মা নীরা,তোমার মাকে একটা কল দিয়ে বলো আমাদের বাসায় আসতে।মেয়ের হাতের প্রথম সিঙারা খাবে।”

নীরা খুশিতে খুশিতে কল দেয় মিসেস নাজনীনকে।মিসেস নাজনীন ফোন রিসিভ করে বলেন,”হ্যাঁ মা বল?”

“তাড়াতাড়ি আমার শশুড় বাড়িতে চলে আসো।আমি সিঙ্গারা বানিয়েছি।”

“এখন তো আর সম্ভব না মা।আমি তো বাইরে।”

“বাইরে কোথায়?”

“তোর জন্য ভাবী দেখতে যাচ্ছি।লাইসেন্স পেয়ে গেছি।এখন কি না করা যায়?”

“আমার জন্য ভাবী আনতে যাচ্ছো মানে কী?”

নীরার কথা শুনতে পেলো দীপান্বিতা। আর খেতে পারলো না সিঙ্গারা।বুঝতে পেরেছে নীরবের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছে।মনে মনে বলে,”আমি এই পাঁচটি বছর তার জন্য অপেক্ষা করলাম।এদিকে সে মুভ অন করে নিলো।আমার দোষটা কি তাও বললো না।”

মিসেস নাজনীন বলে ওঠে,”আরে নীরবের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি।নীরব অনুমতি দিয়েছে।”

“আমাকে জানাও নাই কেন?”

“আরে আমরা তো দেখতে যাচ্ছি।যদি পছন্দ হয় তারপর তোকে দেখাবো। আর আজই তো বিয়ে হচ্ছে না।”

নীরা বলে ওঠে,”বাড়ির কাছে মেয়ে থাকতে তুমি কোন জায়গায় যাচ্ছো মেয়ে দেখতে?”

“বাড়ির কাছে কোন মেয়ে আছে?সবাই তো ….?”

বাকি কথা বলার আগেই ফোন কেটে গেলো।নীরা আবার কল দেয় মিসেস নাজনীনকে।ফোন বন্ধ বলছে।বাবাকে কল দিতে যেয়েও দিলো না।ভাবলো যেহেতু দেখতে যাচ্ছে যাক।ওরা বাসায় আসলে কথা হবে।

মিসেস নাজনীন ফোন চেক করে দেখেন ফোন বন্ধ হয়ে গেছে।রাতে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিয়েছেন।সকালে মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার আগে তার ডিটেইলস নিতে নিতে ব্যাস্ত।ফোন আর কখন চার্জ দিবেন?

মিসেস সাবিনা বলেন,”কি হয়েছে?”

“মা ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখতে গেছে। আর ভাইয়া মেয়ে দেখার জন্য হ্যাঁ বলেছে।”

সবাই খুশি হলো।কিন্তু নীরা তাকিয়ে আছে দীপান্বিতার দিকে।দীপান্বিতার মন মরা হয়ে আছে।দ্বীপ নেই বাসায়।সে তার কাজে ব্যাস্ত।

নীরব মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন বসে আছেন সোফায়।সাথে করে যে সম্মন্ধ নিয়ে এসেছে সেও আছেন তাদের সাথে।মেয়ে পক্ষ থেকে অনেক ভালো ব্যাবস্থা করা হয়েছে।একে একে সবাই এসে টি টেবিলে সব খাবারগুলো সাজিয়ে রাখছে।মিসেস নাজনীন তার বান্ধবীর সাথে গল্প করছেন।মেয়ের বাড়ি খুব সুন্দর ফিটফাট।মেয়ে সবে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে।বাবা ব্যাবসায়ী মা গৃহিণী।

সবকিছু সাজানোর পর সবার অনুমতি পেয়ে মেয়েকে আনা হচ্ছে।মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন মেয়ের হেঁটে আসা দেখছেন।মেয়ে দেখতে মাশাআল্লাহ।যদিও নাম জানে কিন্তু তারপরও ফর্মালিটি এর জন্য মিসেস নাজনীন বলেন,”তোমার নাম কি মা?”

“আমার নাম লামিয়া লিমা।”

তারপর সবাই ভিন্ন ভিন্ন কথা বলে। নীরব এক পলক তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেয়।সহ্য হচ্ছে তার এসব।কিন্তু সহ্য করতে হবে তাকে।

সবাই ছেলে মেয়েদের আলাদা কথা বলতে বলছে।তাই নীরব ও লিমা আলাদা কিছু কথা বললো।কথা বলা শেষে নীরব সবাইকে বলে,”আমার পছন্দ হয়েছে।তোমরা চাইলে আংটি পড়িয়ে রাখতে পারো।”

লিমাও কোনো আপত্তি জানায়নি।সবাই খুশি হয়।লিমাকে আজই আংটি পরিয়ে দেয় মিসেস নাজনীন।

নীরবের চোখ কাপছে।তার চোখে ভাসছে দীপান্বিতা।কিছুতেই ভুলতে পারছে না মায়াবন বিহারিনীকে।

সবাই গল্প করে সন্ধার একটু পরে বের হলো।মিসেস নাজনীনের খুব ভালো লেগেছে এই পরিবার।

সন্ধায় দ্বীপ বাসায় আসলে নীরা দ্বীপকে সেই পরাটার স্বাদের সিঙ্গারা খেতে দেয়।সিঙ্গারা খাওয়ার পর দ্বীপ ও নীরা ঘরে চলে আসে।দীপান্বিতা মন খারাপ করে ঘরে বসে আছে।নীরা সবকিছু দ্বীপকে খুলে বলে।দ্বীপ সব শুনে বলে,”যেহেতু নীরব মতামত দিয়েছে আর সবাই মেয়ে দেখতে গেছে আমার মনে হয় না দীপান্বিতাকে এর ভিতর আনা উচিত।”

“কিন্তু আমি তো দীপান্বিতা আপুকে কান্না করতে দেখেছি।ভালোবাসা হারানোর কষ্ট অনেক ক্যাডার সাহেব।একবার কেউ প্রেমে পড়লে সে তাকে হারাতে চায় না।”

“তুমি কারও প্রেমে পড়েছ?”

“হুম।আমার ক্যাডার সাহেবের প্রেমে পড়েছি।তাই তো আমি বুঝি দীপান্বিতা আপুর কষ্ট।”

“দীপান্বিতার ব্যাপারটা দেখার আগে দেখতে হবে নীরব কি চায়। আর এদের ভিতরে কি আদৌ দুজনের মনের মিলন আছে নাকি এক তরফা প্রেম তাও তো দেখতে হবে। এমনও হতে পারে নীরব অন্য কাউকে ভালোবাসে।”

“আমার এমন মনে হয় না।ভাইকে আমি দেখেছি,দীপান্বিতা আপুর কথা শুনলে কেমন অন্য মনষ্ক হয়ে যায়।আবার ভাইয়ের ফোনে আমি মায়াবন বিহারিনী নামে দীপান্বিতা আপুর আগের নাম্বার সেভ করা দেখেছি।আমি শিওর ওরা আগে একে অপরকে ভালোবাসতো আর তাও গভীরভাবে।”

“সবার ভালোবাসা দেখে শুধু আমারটাই দেখে না।”বিড়বিড় করে বলেই চেয়ারে বসে পরে দ্বীপ।

নীরা মেকি হাসি দিয়ে দ্বীপের কোলে বসে পড়ে।বলে,”কে বলেছে আমি আপনার ভালোবাসা দেখতে পাই না।আপনার ভালোবাসা দেখতে পাই বলেই তো আপনাকে আরো বেশি ভালোবাসি।”

দ্বীপ নীরাকে ধরে রেখে বলে,”তাহলে বলো না কেন?”

“আপনিও তো বলেননি ক্যাডার সাহেব?”

“কি?”

“আমাকে দেওয়া আপনার মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা নাম।কতদিন লুকিয়ে রাখবেন আপনার এই লুকোচুরি গল্প?”

“তুমি সব জানো?”(অবাক হয়ে)

“নীরা দুই হাত দিয়ে দ্বীপের গলা জড়িয়ে বলে,”অনেক আগে থেকে।সেদিন আমি যখন রাগ করে ছিলাম তখন একবার আপনি বলেছিলেন।আমি শুনেছি কিন্তু প্রতিক্রিয়া করিনি।ভাবলাম পরীক্ষা শেষ হলে বলবেন।কিন্তু আপনি তো বলছেন না।একবার বলুন আমাকে দেওয়া নাম।আপনার মুখে শুনতে চাই এই নামটি।”

“চন্দ্রপাখি।”

বলেই দ্বীপ নীরার কপালের সাথে নিজের কপাল এক করে নেয়।দ্বীপ নীরাকে আরও একটু এগিয়ে আসতে যাবে তখনই কল আসে মিস্টার রবিনের।নীরা বাবার কল দেখে রিসিভ করে।

মিস্টার রবিন খুশিতে খুশিতে বলেন,”মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে।মেয়ের নাম লামিয়া লিমা।আজই আংটি পরিয়ে এসেছি।তাড়াতাড়ি বিয়ে হবে তোর ভাইয়ের।”

“মা যে বললো মেয়ে দেখে চলে আসবে।আংটি কেনো পরালে?”

“আরে তোর ভাইয়ের তাড়াহুড়া বেশি।তাই আংটি পরানো হয়েছে।মেয়ে দেখতে সুন্দরী।”

“রাখো তোমার সুন্দরী।আমি এখনই আসছি।”

বলেই কল কেটে নীরা যেতে নিলে দ্বীপ বলে,”কোথায় যাচ্ছো?”

“দুই ভাঙ্গা মনের জোড়া লাগাতে।আজকের রাত আমি ওখানে থাকবো।আপনি গেলে আসেন আমি দৌড়ালাম।”

বলেই নীরা দৌড়।দ্বীপ আহত কণ্ঠে বলে,”হায়রে আমার কপাল!এতদিন বউ কাছে আসতো আমি পরীক্ষার অজুহাত দিতাম।এখন আমি বউয়ের কাছে যাই বউ পরিবারের অজুহাত দেয়।আমার মনে হয় আর চুনু মুনু আনা হবে না।”

আজ দ্বীপ নীরাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো।কিন্তু নীরবের কথা শুনে নীরা দৌড়ে চলে গেলো নীরাদের বাসায়।নীরা ভেবেছিলো আজকে মেয়ে দেখতে গেছে যাক।আসার পর নাহয় নীরবের সাথে কথা বলবে।কিন্তু এখন তো নীরব নিজেই ঝামেলা করে দিয়েছে।

নীরা বাসায় এসে সোজা ড্রয়িং রুমে দাড়িয়ে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে,”আরে এই খাদ্য বিশেষজ্ঞ ভাই আমার।খুব শখ না বিয়ে করার!মেটাচ্ছি তোর শখ।আমার ননদ কান্না করে বন্যা বয়ে দিবে আর তুই করবি অন্য মেয়ে বিয়ে?”

কথাগুলো বলেই হাফাতে থাকে নীরা।নীরার চিল্লানো শুনে বেডরুম থেকে মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন এসে হাজির হয়।নীরব তখনও আসেনি।

মিসেস নাজনীন বলেন,”এটা কেমন ব্যাবহার নীরা?পাশে তোমার শশুড় বাড়ি। আর কয়দিন পর তোমার ভাইয়ের বিয়ে।লোকজন এই সময় খোঁজ খবর নিতে আসে।এসব দেখলে কি বিয়ে হবে?”

“নিকুচি করেছে বিয়ের।কে বলেছে একজনের মন ভেঙ্গে বিয়ে করতে।”

এবার ঘর থেকে নীরব বের হয়ে আসে।নীরাকে বলে,”কি হয়েছে বোন?এভাবে চেচাচ্ছিস কেনো?মেয়ে দেখতে তোকে নিয়ে যাইনি তো কি হয়েছে?বিয়ের আগে ঠিকই যাবি।”

“তোর ওই বিয়েতে যদি আমি তোকে জবাই করে কিমা বানিয়ে ওই লিমাকে না খাইয়েছি তো আমার নাম মুনজেরিন নীরা না।”

মিসেস নাজনীন চোখ রাঙিয়ে বলেন,”বড় ভাই হয় তোমার।মুখ সামলে কথা বল।”

“আরে কিসের বড় ভাই?যে বড় ভাই আমার ননদের মন নিয়ে খেলা করে সে কি করে বড় ভাই হয়?একজনকে মায়াবন বিহারিনী বলে করে দেয় তার হৃদয় হরিণী।করাচ্ছি তোকে বিয়ে।”

বলেই নীরবের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঘরে।মিসেস নাজনীন এগোতে আসলে নীরা বলে,”ভাই বোনের পার্সোনাল কথা চলবে।মা বাবা নট এলাউ।”

বলেই ধুম করে দরজা লাগিয়ে দেয়।মিসেস নাজনীন ক্ষিপ্ত হয়ে মিস্টার রবিনকে বলেন”এই শিক্ষা দিয়েছো মেয়েকে।এবার বুঝো।”

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-২০+২১

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২০
#ইশরাত_জাহান
🦋
রাতের খাবার খেয়ে পিংকি ঘরে এসে বসেছে।ঠিক তখনই মিস্টার সমুদ্র আসেন পিংকির ঘরে।পিংকি মিস্টার সমুদ্রকে দেখে বলেন,”কিছু বলবে মামা?”

“হ্যা,তোমার সাথে কিছু কথা বলার দরকার আমার।”

“আচ্ছা,বলো।”

মিস্টার সমুদ্র পিংকির পড়ার টেবিলের সামনে যান।তারপর চেয়ার টেনে বসেন সেখানে।পিংকির দিকে তাকিয়ে বলেন,”জীবনের আসল সফলতা কোথায় জানোতো?”

পিংকি কিছু না বলে মিস্টার সমুদ্রর দিকে তাকায়।এমন কথার মানে কি?মিস্টার সমুদ্র পিংকিকে আবার বলেন,”জীবনের আসল সফলতা কারো জীবনে ভালোবাসার স্থান গড়ে নেওয়া।এত বিদ্যা শিখে কি লাভ যদি তুমি কোনো সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে যাও?”

পিংকি মাথা নিচু করে ফ্লোরে তাকায়।মিস্টার সমুদ্র হালকা হাসেন।পিংকি মিসেস সাদিয়ার মত হলেও পিংকির মনে এই পরিবারের প্রতি ভালোবাসা আছে।এটা মিস্টার সমুদ্র জানেন।তিনি আবার বলেন,”তোমাকে আমি আমার দ্বীপ ও দীপান্বিতার থেকে কম দেখি না। জানো তুমি যখন হয়েছিলে তোমার নাম আমি রেখেছিলাম দীপা।আমার ছোট মেয়ে হবে দীপা।কিন্তু তোমার মা আমাকে রাখতে দেয় না এই নাম।তোমাকে কখনও সৎ বোনের মেয়ের চোখে দেখিনি।যদি তাই হতো তাহলে তুমি আজ এই বাড়িতে থাকতে পারতে না।আশেপাশের লোক যখন জিজ্ঞাসা করতো এই মেয়েটি কে?আমি বলতাম ও আমার জীবনের তৃতীয় এক অংশ,আমার সন্তান।ঢাকা শহরে এত এত হোস্টেল থাকতেও তোমাকে এখানে রাখা কারণ তুমি আমাদের আরেক নয়নের মণি।তুমি দ্বীপকে ভালোবাসতেই পারো।ভালোবাসা কারোর হাতের তালা চাবি না যে কাউকে ভালোবাসতে পারবে না।কিন্তু ভালোবাসলেই তাকে পেতে অন্যায় করবে এটা কিন্তু সবথেকে খারাপ একটা দিক।দ্বীপ তোমাকে কখনও ভালোবাসার চোখে দেখেনি।আমার ছেলেটার যোগ্যতা দিয়ে সরকারি স্কুল কলেজ পড়াশোনা করে আজ ক্যাডার হয়েছে।আমার কাছে কখনও কিছু আবদার করেনি।সেদিন তোমাদের মা মেয়ের কথাগুলো শুনে আমি দেখেছিলাম দ্বীপের চোখের ভীত ভাব।কাউকে হারানোর আতঙ্ক ছিলো।সত্যি বলতে সাদিয়া আমাকে তোমার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলে হয়তো রাজি হতাম বোনের খাতিরে।কিন্তু আমার ছেলেটার ভালোবাসা ব্যতীত কি শুধু ওই সম্পত্তিতে তুমি সুখী থাকবে?”

পিংকির চোখে পানি।মিস্টার সমুদ্র সব জানেন।শুধু মিস্টার সমুদ্র না দ্বীপ এই বাড়ির সবাই সবকিছু জানেন।কিন্তু তারপরও পিংকিকে এই বাড়িতেই রেখেছে।কতটা ভালোবাসে সবাই তাকে।মিস্টার সমুদ্র পিংকির চোখের পানি মুছে বলেন,”তোমাকে আমি শাসন করিনা একটাই কারণে তোমার উপর মেয়ের অধিকারে শাসন করলে তোমার মা এটা বুঝবেন না।আমি ছোটবেলা থেকে দ্বীপকে অনেক কাজেই বকা দিয়েছি।দীপান্বিতাকে থাপ্পড় দিয়েছি।কিন্তু কেউ এসে একটা প্রতিবাদ করেনি।কিন্তু তোমাকে তোমার ভালোর জন্য কিছু বললে কথা উঠবে আমি এই কাজ করার কে?আমি ঘরের কাজে আজ পর্যন্ত কথা বলিনি।এই জন্য তোমার মা যত পেরেছে সাবিনাকে খাটিয়েছে।আমি ইনকাম করে টাকা পাঠাতাম কিন্তু সাবিনা দ্বীপ দীপান্বিতা আমার মা এরা যতটা তার ভাগ পেয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ ভাগ পেয়েছে তোমার মা।সাবিনা মানুষটি ছিলো নরম মনের।আমাকে খুব ভয় পেতো।কিন্তু আমি কখনও ওকে বকা দিতাম না বা মারতাম না।বিয়ের পর প্রথম আমি সাবিনাকে বলেছিলাম আমার বাবার দেওয়া আমানত সাদিয়া।সাদিয়াকে দেখাশোনা করা আমাদের দায়িত্ব।বাবা মারা যাওয়ার আগে হাফাতে হাফাতে বারবার বলেছেন,’ আমি তোমার মায়ের সাথে পাপ করেছি।যেদিন আমি সাদিয়ার মাকে বিয়ে করে আসি তারপর থেকে তোমার মা আমার সাথে আর একটিও কথা বলেনি।আমি এখন বুজেছি আমি অন্যায় করেছি।মাফ করে দিও আমাকে তোমরা।হয়ত আর বাঁচবো না।শরীরের ভিতর জ্বালাতন করছে খুব।আমার সাদিয়াকে কখনও সৎ বোনের চোখে দেখবে ন।ওর মা নেই আমিও হয়তো থাকবো না।আমার শরীরের অবস্থা ভালো না।তুমি ওকে ভালোবেসে আগলে রেখো।’
বলেই বাবা ওখানে আমার হাত ধরেই শেষ নিশ্বাস নেন।মৃত বাবাকে আমি বলতে পারিনি আমি ওকে ভালোবাসতে পারবো না।তবে আমি ওকে আপন বোনের মতোই দেখবো।সাদিয়াকে পড়াশোনা করাতে চেয়েছি কিন্তু ও পালিয়ে বিয়ে করে তোমার বাবাকে।তোমার বাবা এখন যতটা ভালো তখন এমন ছিলেন না।তখন ছিলেন বখাটে।তারপরও আমরা মেনে নিয়েছি।সাদিয়াকে আমি যা যা দিয়েছি তার এক কানাকড়ি আমি সাবিনাকে দেইনি।শুধু এই যে বাড়িটি দেখছো এটা আমি আমার সাবিনার নামে অর্ধেক লিখেছি আর অর্ধেক অংশ দ্বীপ ও দীপান্বিতার নামে। আর গ্রামের বাড়িটি সম্পূর্ণ তোমার আর সাদিয়ার নামে।”

বলেই গ্রামের বাড়ির কাগজ জেকেটের ভিতরের পকেট থেকে বের করে পিংকির হাতে দিলো।পিংকির বিবেকে নাড়া দিলো।হাত বাড়িয়ে নিতে পারলো না কাগজটি।এই জমিতে তার মায়ের থেকে তার মামার হক বেশি।কিন্তু তারপরও পুরো বাড়িটি মামা তার আর মায়ের নামে করে দিয়েছে।এতদিন তার মা কি না সম্পত্তির জন্যই তাকে এখানে রেখেছিলো।কিন্তু পিংকি জানে সে তো শুধু দ্বীপের জন্য ছিলো এখানে।

মিস্টার সমুদ্র বের হতে যেয়েও দরজায় দাড়িয়ে বলেন,”সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি আসলে তারা কখনও সুখে থাকে না। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।এটা শুধু একটি প্রবাদ বাক্য নয় এটি একটি বাস্তব জীবনী। আশা করি আজ থেকে তুমি আমাদের নীরাকে দ্বীপের সাথে সুখে থাকতে দিবে।”

বলেই চলে যান মিস্টার সমুদ্র।পিংকি হাউমাউ করে কান্না করে দেয়।আজ তার খুব কষ্ট লাগছে।তার মা এতদিন কত খারাপ কথা বলতো এদেরকে নিয়ে।অথচ তারা কখনও এমন কিছুই করেনি।

অপরদিকে,
ডিনার করে দ্বীপ ও নীরা ঘরে চলে আসে।নীরা একটু মাথা আচড়াবে তাই আয়নার সামনে যায়।দ্বীপ তাকিয়ে আছে নীরার দিকে।নীরা মাথা আচড়াতে আচড়াতে আয়নায় দেখতে পেলো দ্বীপ তার দিকে তাকিয়ে আছে।নীরা দ্বীপের দিকে ঘুরে বাম ভ্রু উচু করে বলে,”কি হয়েছে?”

দ্বীপ নীরার কাছে এসে বলে,”আমি টিউব লাইট?”

নীরা হালকা হাসে।সন্ধায় হওয়া কথাটি এখনও মাথায় রেখেছে দ্বীপ।নীরা বলে,”ওটাতো রাগ করে বলছিলাম।”

“দুই দুইবার শুনেছি আমি তোমার মুখে যে আমি টিউব লাইট।তাহলে চলো আজ দেখিয়ে দেই আমি টিউব লাইট কি না,বউ।”

যেই নীরা এতদিন দ্বীপকে খেপাতো আজ সেই নীরা ঘাবড়ে যাচ্ছে।তোতলাতে তোতলাতে বলে,”আ আসলে ক কাল পরীক্ষা।এখন ত তো আমাদেরকে …”

কিছু বলার আগে চশমার ভীতর দিয়ে নীরার দিকে তাকিয়ে দ্বীপ বলে,”এক ডজন বাবু আনার প্রসেসটা আজ পরিপূর্ন করে ফেলি,কি বলো?আচ্ছা তোমার এতটুকু একটা জায়গায় বারোটি বাবু ঢুকলে কেমন লাগবে?”

সাথে সাথে নীরার হাত যায় তার পেটে।কল্পনা করতে থাকে এই পেটে বারোটি বাবু ঢুকলে তো পেট ফুলে ফেটে যাবে।দ্বীপ স্মিত হেসে বলে,”আমার কাছে ভালো উপায় আছে।প্রত্যেক বছরে আমরা যমজ বাবু নিবো। এতে করে ছয় বছরে বারোটি বাবু হয়ে যাবে।”

খুক খুক করে কেশে ওঠে নীরা।ছয় বছরে যদি পেট বড় হয় আর পেট কাটতে হয় তাহলে বাঁচবে আদৌ!তার উপর আবার একেক বছরে দুইটা করে বাচ্চা।ভাবতেই নীরার মাথা ঘুরছে।দ্বীপ ঘরে ঘরম পানির জন্য ফ্লাক্স রেখে দেয়।সেখান থেকে কুসুম গরম পানি গ্লাসে ঢেলে নীরাকে দেয়।নীরা পানি নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটাই গিলে ফেলে।

দ্বীপ গায়ে থাকা নরম চাদরটি দুই হাতে নিয়ে চিকন আকারে করে।তারপর নীরার পিছনে নিয়ে নীরার কোমড়ে চাদরটি দিয়ে হালকা টান দেয় নীরাকে।নীরা হালকা নড়াচড়া করে।দ্বীপ নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”কি হলো বউ?এক ডজন বাবু চাই না তোমার!এত নড়াচড়া করলে হবে?”

নীরা এবার জোরে এক নিঃশ্বাস নিয়ে গড়গড় করে বলে,”ভালো রেজাল্ট করতে হবে তো।এখন পড়তে বসবো।”

দ্বীপ ছেড়ে দেয় নীরার কোমড় থেকে চাদরটি।বলে,”রাত অনেক হয়ে গেছে।এখন ঘুমাও আমি ভোরের দিকে এলার্ম দিয়ে দিচ্ছি।তখন আবার রিভিশন দেওয়া যাবে।”

দ্বীপের বলতে দেরি নীরার খাটে যেয়ে শুয়ে পড়তে দেরি হয়নি।দ্বীপ লাইট অফ করে এসে নীরার থেকে দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়ে।শুতে শুতে দ্বীপ নীরাকে বলে,”চিন্তা করো না বউ।তোমাকে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে দেওয়ার দায়িত্ব যেমন আমার,তোমাকে এক ডজন বাবু এনে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”

নীরা চোখ বন্ধ করে মিটমিট হাসতে থাকে।

সকালে,
নীরা তার রেজিস্ট্রেশন কাগজ ও প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে নিজেকে রেডি করছে।দ্বীপ নীরাকে একটি বোরকা কিনে দিয়েছে।নীরা এখন সেই বোরকা পরেছে।আজ প্রথম বোরকা পরলো।কেমন জানি লাগছে নীরার কাছে।তারপরও তার ক্যাডার সাহেব দিয়েছে তাই এক আলাদা ভালো লাগা কাজ করছে।কেয়া এসেছে নীরার কাছে।নীরা বলেছে আসতে।সবাই একসাথে যাবে।মিস্টার রবিন,মিসেস নাজনীন ও নীরব এসেছে নীরার সাথে দেখা করতে।মিস্টার সমুদ্রও আজ অফিসে যায়নি।দ্বীপ বারবার নীরাকে এক কথাই বলে,”এটা কিন্তু তোমার টেস্ট পরীক্ষা না।তাই এবার সম্পূর্ণ সময় বসে থেকে পরীক্ষা দিবে।মাথা ঠাণ্ডা রাখবে।তোমার জন্য আমি পানি দিয়েছি।গলা শুকিয়ে আসলে পানি খাবে।”

নীরা এবার বলে ওঠে,”আপনি আমাকে সেই সকাল থেকে এই এক কথা কেনো বলছেন?”

“আগেরবার টেস্টে তো হাফ এক্সাম দিয়ে বেড় হয়েছিলে।তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।”

“আপনি কিন্তু আমাকে এক্সামে যাওয়ার আগে অপমান করছেন।”

সবাই হেসে দেয় এদের কথায়।মিস্টার রবিন ও মিসেস নাজনীন মিলে নীরাকে কিছুক্ষণ আদর করেন।তারপর গাড়ির কাছে চলে আসেন সবাই।দ্বীপ ও নীরা ফ্রন্ট সিটে বসেছে।রিক ও কেয়া ব্যাক সিটে বসেছে।দ্বীপ নীরাকে নিয়ে চিন্তায় আছে।যদিও বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজ দায়িত্বে দ্বীপ নীরাকে পড়িয়েছে।কিন্তু এই মেয়ের তো ঠিক ঠিকানা নেই।পড়ার ভিতর গানের কথা ভাবে।পরীক্ষার হলে কি করবে কে জানে?

সবাই যে যার মত ঘরে এসেছে।দীপান্বিতা অভ্রকে নিয়ে হাঁটছে।নীরব বাসায় যেতে নিবে দেখে দীপান্বিতা ও অভ্র একসাথে দাড়িয়ে আছে।দীপান্বিতা তাকিয়ে আছে নীরবের দিকে।নিরব কিছু একটা ভেবে দীপান্বিতার কাছে এসে বলে,

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২১
#ইশরাত_জাহান
🦋
“এগুলো আপনার ছেলের জন্য।”

বলেই কিছু চকলেট অভ্রর হাতে দিয়ে চলে যায়।যাওয়ার সময় নীরব এক পলক তাকায় দীপান্বিতার দিকে।কিন্তু কোনো কথা বলে না। দীপান্বিতাও আজ চুপচাপ।

দ্বীপ নীরাকে পরীক্ষার হলে নিয়ে আসে।নীরা ও কেয়া নিজেদের মতো করে সিট খুঁজতে চলে যায়।দ্বীপের নিজস্ব কলেজেও আজ গার্ড দিতে হবে।তাই দ্বীপ চলে যায়।যাওয়ার আগে নীরাকে বলে,”আমি না আসা অব্দি দাড়িয়ে থাকবে।একটু দেরি হবে কিন্তু তুমি কোথাও যাবে না।”

নীরা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝায়।রিক কেয়াকে ‘বেস্ট অফ লাক’ বলে দ্বীপের সাথে চলে যায়।

পরীক্ষা শুরু হয়েছে।একদিকে নীরা পরীক্ষা দিচ্ছে তো অন্যদিকে দ্বীপ অন্য পরীক্ষার্থীদের গার্ড দিচ্ছে।পরীক্ষায় গার্ড দিলেও দ্বীপ শুধু নীরাকে নিয়ে ভাবছে।নীরা ঠিকভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে কি না!কোনো সমস্যা হলো কি না এগুলো ভাবতে থাকে দ্বীপ।

দুপুরে,
নীরার পরীক্ষার সময় শেষ।খাতা জমা দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেয়ার সাথে। কেয়াও দাড়িয়ে আছে রিকের জন্য।দ্বীপ ছাত্রছাত্রীদের খাতা জমা নিয়ে ওগুলো ভালোভাবে মিলিয়ে তারপর গেলো নীরার কাছে।রিক চলে এসেছে বাইক নিয়ে।এখন কেয়া ও রিক বাইকে করে যাবে আর নীরা ও দ্বীপ তাদের গাড়িতে করে যাবে।

গাড়িতে ওঠার পর দ্বীপ বলে,”পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”

“খুব খুব খুব সহজ প্রশ্ন এসেছে।কিন্তু জানি না সঠিক লিখেছি নাকি ভুল।”

“কেনো?তুমি কি লিখেছো তুমি নিজেও জানো না!”

“অতগুলো চেপটার মাথায় রাখাটাও তো লাগবে।তিন ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়েছি।লেখার তালেই ছিলাম।যেমন করছে হাত ব্যাথা তেমন করছে মাথা ভনভন।”

“খুদা লেগেছে খুব?”

নীরা মাথা উচু নিচু করে হ্যা বুঝিয়ে দিলো।দ্বীপ এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে দেয়।তারপর নীরাকে বলে,”চলো তোমার প্রিয় ফুসকা খাওয়া যাক।”

নীরা খুশি হয়ে নেমে যায়।গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় দেয় ফুসকার দোকানে।দ্বীপ কিছু বলে ওঠার আগেই নীরা বলে,”বেশি বেশি ঝাল দিয়ে ফুসকা বানিয়ে দিন।”

দ্বীপ চোখ রাঙিয়ে বলে,”তোমার এখন পরীক্ষা।এই সময় এতো বেশি ঝাল খেলে অসুস্থ হয়ে যাবে।”

“আরে কিছু হবে না।কতদিন পর আজ ফুসকা খাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আর আপনি কি না আমাকে বাধা দিচ্ছেন।”(বলেই কাদো কাদো ফেস করে)

দ্বীপ আর বাধা দেয় না।ফুসকা রেডি হলে দোকানদার নীরাকে ফুসকা দেয়।নীরা ফুসকা খেতে খেতে দ্বীপকে বলে,”আপনি খাবেন না?”

“না,তুমি খাও।আমি এসব খাই না।”

“আরে,আজকে একটু খেয়েই দেখেন।অনেক মজা হয় ফুসকা।”

বলেই দ্বীপের দিকে একটি ফুসকা এগিয়ে দেয়।যেই দ্বীপ হা করে নীরার হাতের ফুসকা খেতে যাবে ওমনি নীরা ওটা দ্বীপের সামনে থেকে নিয়ে নিজের গালে দেয়।দ্বীপ অবাক হয়ে আশপাশ দেখতে থাকে।নীরা হা হা করে হেসে বলে,”আপনি তো ফুসকা খান না।তাই আর জোর করলাম না।”

দ্বীপ কোনো রিয়েকশন না দেখিয়ে নীরার খাওয়া হয়ে গেলে দোকানদারকে টাকা দিয়ে গাড়ির দিকে এগোতে নেয়।ঠিক তখন নীরা একটি আইস ক্রিম স্টল দেখতে পায়।সাথে সাথে নীরা বলে,”আমি আইস ক্রিম খাবো।”

“এই শীতে একদম কোনো আইস ক্রিম হবে না।পরশু তোমার পরীক্ষা।আমি যেনো ঠান্ডা জ্বর আসতে না দেখি।”

“প্লিজ প্লিজ প্লিজ”(বলেই দ্বীপের হাত ধরে লাফাতে থাকে)

অগত্যা দ্বীপকে আইস ক্রিম কিনতে হয়।পুরো পরিবারের সবার জন্যই দ্বীপ আইস ক্রিম কিনে নেয়।বাসায় এসে সবাই মিলে আইস ক্রিম উপভোগ করে।

মিসেস সাদিয়া এসেছেন আজ।এতদিন গ্রামে নিজের শশুর বাড়িতে ছিলেন।মিসেস সাদিয়া এসে সবাইকে বলেন,”আমার মেয়েটা কি এতই বোঝা হয়ে গেছে?যে এখন তাকে মামার বাড়িতে না থেকে হোস্টেলে থাকতে হবে।”

কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারে না।ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে পিংকি এসে তার মাকে দেখে।মিসেস সাদিয়াকে দেখে পিংকি অবাক হয়ে বলে,”তুমি এখানে কেনো,মা?”

শাড়ির আচল মুখে গুজে কান্নার ভান করে মিসেস সাদিয়া বলেন,”আমার মেয়ে একা একা হোস্টেলে থাকবে।আমি মা হয়ে কিভাবে সহ্য করবো।তাই ছুটে এসেছি।”

মিস্টার সমুদ্র দুপুরে খেতে এসেছেন।খাওয়া দাওয়ার পরই আইস ক্রিম খাচ্ছিলেন।তার পরই এই কাহিনী।মিস্টার সমুদ্র অবাক হয়ে পিংকির কাছে এসে বলেন,”তুমি হোস্টেলে যাচ্ছো!কই আমাদের তো বলোনি?”

“আসলে আমি ভেবে দেখেছি আমার এখানে থাকা উচিত হবে না। আর এমনিতেও আমি বড় হয়েছি।কতশত মেয়ে হোস্টেলে থাকে।আমি কেনো থাকতে পারবো না?”

“মেয়ের কি মাথাটা গেছে।এসব বলছে কেনো?এগুলো বললে তো সম্পত্তি পাবে না।”(মনে মনে বলেন মিসেস সাদিয়া)

পিংকিকে বলে ওঠে,”তুই এসব কি বলছিস?হোস্টেলে কেনোই বা যেতে হবে?কে কি বলেছে তোকে?”

“আমি একদম ঠিক বলেছি আর ঠিক কাজ করেছি মা। আর চিন্তা করো না তোমার সম্পূর্ণ ইচ্ছা পূরণ না হলেও অর্ধেক ইচ্ছা পূরণ হয়েছে।”

কেউ কিছু বুঝলো না শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে।পিংকি ঘর থেকে সম্পত্তির কাগজ এনে মিসেস সাদিয়ার হাতে দিয়ে বলে,”গ্রামের সম্পূর্ণ অধিকার এখন তোমার আর আমার।মামা আমার নামেও কিছু অংশ লিখেছে।শুধু তোমার চাহিদার ভিতর ঢাকার সম্পত্তি পেলে না। আর পেতে বলেও মনে হয় না মা।কারণ দ্বীপ বে (আর না বলে) ভাই এত বড় শিক্ষিত একজন মানুষ আর মামা নিশ্চয়ই ছেলেমেয়েদের না দেখে খালি আমার একার দিকে দেখতো না।”

মিস্টার সমুদ্র খুশি হন।তার কথাগুলো পিংকির বিবেকে লেগেছে।এটাই তো অনেক। কত মানুষ আছে ভালো কথার মূল্য দেয় না।সেখানে পিংকি নিজে থেকে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।সব কাজে বাধা দিতে নেই।তাই আজ কেউ পিংকির কাজে বাধা দিচ্ছে না।

মিসেস সাদিয়া মেয়েকে দেখে অবাক হচ্ছেন।মেয়ের তার এত পরিবর্তন।কিভাবে সম্ভব?এইতো কালকেও তারা কত কুবুদ্ধি দেওয়া নেওয়া করছিলো।আজ এক রাতে কি হয়ে গেলো?

পিংকি সবাইকে দেখে আবার বলে,”আমি হোস্টেল ঠিক করেছি। কাল উঠে যাবো সেখানে।এখানে যত থাকবো হয়তো আমি খারাপ কিছুই করবো।”(দ্বীপের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে)

নীরার কাছে এসে নীরার হাত দুটি ধরে পিংকি বলে,”সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে আসাটা যেমন লোকের চোখে দৃষ্টিকটু,ঠিক তেমনই তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থাকাটা অনেক কষ্টকর।আমি এতদিনে এটা বুঝেছি।কিন্তু আমার ইচ্ছাশক্তির কাছে সবকিছু লোপ পেয়েছিলো।ভাগ্যিস তুমি স্ট্রং একজন মানুষ। আর বাসার সবাই তোমাকে অঢেল ভালোবাসে।তাই তো আজ আমার মতো তৃতীয় ব্যাক্তির সমাপ্তি হতে যাচ্ছে।পারলে ক্ষমা করে দিও ভাবী।”

নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজে থাকে দূরে সরে যাচ্ছে।তাই নীরা নিজেই আজ পিংকিকে জড়িয়ে ধরে।সবাই আজ খুশি হয়।মিসেস সাদিয়া কিছু বলেন না।মেয়ে তার ভালো এখন বুঝতে শিখেছে। আর এখন নীরাকে যা বললো তারপর তার কোনো কথা বলা মানায় না।মিসেস সাদিয়া এসে ক্ষমা চাইলো মিস্টার সমুদ্রর কাছে।মিস্টার সমুদ্র বোনকে ক্ষমা করে দেন।

পিংকি এসে দাঁড়ায় মিসেস সাবিনার কাছে।বলে,”আমার মায়ের জন্য তুমি সুখে থাকতে পারনি মামী।শুরু থেকে সুখ না পাও শেষ বয়সে এসে আশা করি তুমি হবে শ্রেষ্ঠ সুখী। এত ভালো বউমা হয়েছে তোমার।রূপবতী গুনবতী আবার চঞ্চল।হয়তো ওর জন্যই আজ আমার বিবেকবোধ ফিরে এলো।”

মিসেস সাবিনা জড়িয়ে ধরে পিংকিকে বলেন,”তোকে কখনও পর ভাবিনি মা।তুই আমার পরিবারের এক অংশ ছিলি থাকবি।”

আজ পিংকিও কান্না করে দেয় মিসেস সাবিনার কোলে মাথা গুঁজে। লোভে পড়ে এখানে থাকলেও মায়া তো মানুষের মনের মধ্যে বিরাজ করে।তাই তো পিংকির মনে এখন এই পরিবারের সবার জন্য ভালোবাসার টান কাজ করছে।পিংকির সপ্ন মিসেস সাদিয়ার থেকে ভিন্ন ছিলো।পিংকি ভেবেছিলো সে দ্বীপের বউ হয়ে শশুর শাশুড়ির সেবা করবে।মায়ের হক বুঝিয়ে সেও তার মতো সংসারী হবে।কিন্তু ভালো চিন্তার সাথে অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে তা কখনও সম্পূর্ণ হয় না।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-১৮+১৯

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৮
#ইশরাত_জাহান
🦋
আজ সবাই একসাথে নীরাদের বাসায় আছে।নীরব আসবে সেই আনন্দে মিসেস নাজনীন সারাদিন নীরবের পছন্দের খাবার রান্না করছেন।মিসেস সাবিনা এখন তাকে সাহায্য করতে গেলো।মিস্টার রবিন ও মিস্টার সমুদ্র এক ঘরে বসে গল্প করতে থাকে।নীরার খুদা লাগে হঠাৎ।কিছু খাওয়ার জন্য খাবার টেবিলের দিকে যায়।সব ফলমূল সুন্দর করে কেটে সাজিয়ে রাখা।মিষ্টিগুলো সাজিয়েছে মিসেস নাজনীন।নীরব এভাবে খেতে ভালোবাসে তাই।এগুলোতে এখন হাত দেওয়া যাবে না।

টেবিলের মাঝে একটি ছোট ঝুড়িতে কলা ছিলো।তার ভিতর এক জোড়া কলা নীরা ছিঁড়ে খেতে যায় ওমনি মিসেস শিউলি খেয়াল করেন।রসিকতা করে বলেন,”নাতবৌ জোড়া খাবার খাইতে নাই।এতে যমজ বাচ্চা হয়।”

নীরা দাদী শাশুড়ির কথা শুনে হিসাব করলো,যদি এক জোড়া খাবার খেলে যমজ বাচ্চা হয় তাহলে আমি ছয় জোড়া কোনো খাবার খেলে এক ডজন হয়ে যাবে।সাথে সাথে নীরা দ্বীপকে বলে ওঠে,”শুনুন ক্যাডার সাহেব,আমার জন্য কালকে ছয় জোড়া কলা আনবেন।একটা ক্রিকেট টিম হবে আর একজন ওই টিমকে কন্ট্রোলে রাখবে।”

নীরার কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠেন মিসেস শিউলি।তিনি বলেন,”নাতবৌ আমার দেখি বারোটা বাচ্চার শখ করছে!”

কেউ আর কিছু বলার আগে কলিং বেল বেজে ওঠে।নীরা যেয়ে দরজা খুলে দেয়।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীরব। নীরবকে দেখার সাথে সাথেই নীরা “ভাইয়া” বলেই এক চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরে।মিসেস নাজনীন রান্নাঘর থেকে এসে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন।দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর পর আজ ছেলেকে দেখছেন তিনি।মাতৃত্বের প্রথম স্বাদ তিনি নীরবকে গর্ভে ধারণ করে পেয়েছিলেন।এই ছেলে এতগুলো বছর দূরে ছিলো।কত মনে পড়তো ছেলের কথা।ছেলেকে কোলে নিয়ে কত আদর করতো সবকিছুই যেনো আজ চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।সাথে সাথে নীরবের কোলে মুখ গুজলেন মিসেস নাজনীন।হাউমাউ করে কান্না করছেন ছেলের কোলে মুখ রেখে।সবাই দেখছে মা ছেলের মুহূর্ত।নীরব মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি যেদিন জার্মানে গিয়েছিলাম ঐ দিনও তো এত কান্না করনি তোমরা!আজ এসেছি আর কান্নার বন্যা বয়ে গেলো?”

নীরা মিসেস নাজনীনকে জড়িয়ে বলে,”তুমি কি করে জানবে আমরা কান্না করেছিলাম কি না।মাকে তো জোর করে খাইয়ে দিতে হতো।শুধু তোমার সপ্নের জন্য তোমাকে সুযোগ করে দেওয়া।এই জন্য মা তোমার সামনে স্ট্রং ছিল।”

নীরব বোনের মাথায় হাত দিয়ে বলে,”এবার ভাইকে ভিতরে আসতে দিবি নাকি বাইরে দাড় করিয়ে রাখবি?লম্বা একটা জার্নি করে এসেছি আমি।বাকি সবার সাথে তো সাক্ষাৎ করতে দে।”

নীরা হেসে দিলো।মিসেস নাজনীনকে নিয়ে সাইড হয়ে মিস্টার রবিনের দিকে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় নীরবকে।বাবা হলেও মিস্টার রবিন হলেন নীরবের বেস্ট ফ্রেন্ড।সব সময় বেস্ট ফ্রেন্ডের মত করেই চলাফেরা করেন তারা।নীরব ঘরে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।মিস্টার রবিন নীরবকে বুকে টেনে বলেন,”আমার কলিজার টুকরোর এক অংশ।”

মিস্টার রবিন সব সময় নীরা ও নীরবকে বলে এসেছেন,”তোমরা দুইজন আমার কলিজার টুকরো।কিন্তু আমার কলিজার একাংশ জুড়ে আছে তোমাদের মা।বয়স বাড়বে দিন শেষ হবে কিন্তু তোমাদের মাকে আমি কখনও ভুলতে পারবো না।তোমাদের মা আর তোমরা দুই ভাই বোন আমার একটি আস্ত কলিজা।তোমাদের কোনো কিছু হলে আমি ঠিক থাকতে পারবো না।”

বাবা,মা ও বোনের সাথে সুখ দুঃখের মুহূর্ত ভাগাভাগির পর নীরব মিস্টার সমুদ্র,মিসেস সাবিনা ও মিসেস শিউলিকে দেখে সালাম দিলো।তারপর দ্বীপের সাথে কোলাকোলি করে নিলো।অতঃপর দীপান্বিতার দিকে তাকালো নীরব।দীপান্বিতা এতক্ষণ নীরবের দিকেই তাকিয়ে ছিলো।কতগুলো বছর পর তার প্রণয়ের পুরুষকে দেখছে।আগের থেকে আরো সুন্দর হয়েছে।বয়স বেড়েছে কিন্তু মুখের ছোপ ছোপ চাপদারী আর বডি ফিটনেস দেখলে তো একদম মিস্টার পার্ফেক্ট লাগছে।দীপান্বিতা মনে মনে বলে ওঠে,”আমারও তো বয়স বেড়েছে।বয়সের সাথে সাথে মুখের উজ্জ্বলতা কমে এসেছে। আর এনাকে দেখো উজ্জ্বলতা যেনো আমার থেকে ঢেলে ঢেলে নিয়েছে।আমাকে হয়তো এখন আর মানাবে না তার সাথে।তাই তো এতদিন কন্টাক্ট অফ রেখেছে।”

নীরব দীপান্বিতার কাছে আসতে যাবে ওমনি অভ্র এসে দীপান্বিতার হাত ধরে বলে,”খুদা লাগছে,আম্মু।”

থমকে গেলো নীরব।চেয়ে আছে দীপান্বিতার চোখের দিকে।এখন দীপান্বিতা তার নিষিদ্ধ নারী।দীপান্বিতাকে ইগনোর করে চলে গেলো ঘরের ভিতর।বুকের ভিতর জ্বলতে থাকে নীরবের।আয়নার সামনে দাড়িয়ে দীপান্বিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”এক সময়ের ময়াবন বিহারিনী।এখন আমার হৃদয়হরণী।”

দীপান্বিতা অভ্রকে কিছু খাইয়ে দিতে চায় তাই মিসেস নাজনীনকে বলে খাবারের ব্যাবস্থা করে।দীপান্বিতা অভ্রকে খাইয়ে দিচ্ছে।এমন সময় নীরব পোশাক পাল্টে ড্রয়িং রুমে এসে দীপান্বিতাকে দেখতে থাকে।নীরা সবকিছুই খেয়াল করে দেখছে।অভ্র দীপান্বিতাকে বলে,”ওনাকে আমি কি বলে ডাকবো আম্মু?”

দীপান্বিতা চুপ থাকলেও নীরা বলে ওঠে,”মামা।মামা বলে ডাকবে আমার ভাইকে।আমার ভাই মানে তো দীপান্বিতা আপুরও ভাই।সেদিক থেকে মামা বলা যায়।”

নীরবের মাথা ঘুরতে শুরু করলো।এক সময়ের ছাইয়া এখন হয়ে গেলো ভাইয়া!নীরার মত বোন থাকলে সব সম্ভব।অভ্র নীরবের কাছে এসে বলে,”আমার নাম অভ্র।তুমি আমার নতুন মামা।আমার জন্য চকলেট এনেছো?আমি সেই বিকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।”

নীরব কি করবে বুঝতে পারছে না।মন তো চাচ্ছে ঠাটিয়ে দিবে এক চড়।মামা মামা করছে সে।এগুলো সহ্য হয় নাকি তাই?মনের দুঃখ মনে রেখে নীরব “হুম” বলে মাথা নাড়ায়।

সবাই মিলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করতে বসেছে।মিসেস নাজনীন ও নীরা আজ পরিবেশন করছে।নীরব ও দীপান্বিতা টেবিলের সামনা সামনি বসে আছে।দুজন দুজনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজেদের খাওয়া দাওয়াতে মন দেয়।খাওয়ার মাঝে হঠাৎ দীপান্বিতার পায়ের সাথে ছোয়া লাগে নীরবের পা। পায়ে পায়ে ছোয়া লাগাতে দীপান্বিতা ও নীরব একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে।ভুল বশত লেগেছে পা।সারাদিন প্লেনে বসে ছিলো নীরব।পা একটু অবাস হয়ে আছে।তাই পা নাড়াতে যেয়ে দীপান্বিতার সাথে লেগে যায়।

সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে সবাই বাড়িতে চলে আসে।ঘরে এসে লাইট জ্বালানোর সাথে সাথে দ্বীপ নীরাকে বলে,”তুমি আমার থেকে কয়টা চুনু মুনু চাও?”

“এক ডজন,কেনো?আপনি দিবেন না আমাকে এতগুলো চুনু মুনু?”

দ্বীপ নীরার অতি নিকটে এসে নীরার কানে ফিসফিস করে বলে,”আমি দিতে পারবো কিন্তু তুমি নিতে পারবে তো?”

নীরা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে দ্বীপের দিকে।দ্বীপ হাসতে হাসতে আলমারি থেকে বাড়ি পড়ার পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।পাঞ্জাবি পাল্টে টি শার্ট পরে আসে।নীরা কিছু না বলে জামা নিয়ে ওয়াশরুম থেকে শাড়ি পাল্টে ঘরে আসে।এসেই খাটে শুয়ে পড়ে।মিনিকে এখন সোফায় ঘুমোতে দেয়।

কিছুক্ষণ নিরবতা ভেঙ্গে নীরা আস্তে আস্তে দ্বীপের দিকে এগোতে থাকে।দুই কদম আগায় তো কিছুক্ষন থেমে থাকে।এরকম করতে করতে যেই নীরা দ্বীপের কাছে আসবে ওমনি দ্বীপ বলে ওঠে,”স্টপ,এখানেই থেমে থাকবে। আর এগোবে না।পরীক্ষা শেষ হয়ে যাক তারপর তোমার এক ডজন বাবু লাগে নাকি দুই ডজন লাগবে সবকিছুর ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।”

যে নীরা এতক্ষণ দ্বীপের কাছে আসছিলো সেই নীরা যখন দ্বীপের মুখে দুই ডজন বাচ্চার কথা শুনে সাথে সাথে দূরে সরে আসে।দ্বীপ মিটমিট করে হাসতে থাকে।নীরাকে শায়েস্তা করার জন্য তাকেও কি না নীরার মত হতে হয়।

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৯
#ইশরাত_জাহান
🦋
কাল নীরার পরীক্ষা।তাই আজ সকাল থেকে পড়াশোনায় ব্যাস্ত নীরা।দ্বীপ কলেজে গেছে পরীক্ষার জন্য তাদের আলাদা মিটিং করতে হয়।নীরা মনোযোগ দিয়ে বই পড়তে থাকে।কলেজে যাওয়ার আগে দ্বীপ বলেছে,”আমি এসে কিন্তু প্রত্যেকটি চেপটার থেকে প্রশ্ন করবো।সঠিক উত্তর যেনো পাই তানাহলে তো জানোই শাস্তি হিসেবে কি থাকবে।”

নীরা জানে এই আদনান কবির দ্বীপ এখন বিদ্যাসাগরের রূপ ধারণ করেছে। কাল পরীক্ষা এদিকে যে স্বামী সেই আবার তার শিক্ষক।পড়াশোনা না করলে স্বামী হয়ে যাবে তার জীবনের আসামি।তাই নীরা বলে,”হ্যা হ্যা জানি।পড়াশোনা মনোযোগ দিয়েই করবো।এমনিতেও তো এই মাস দুই ধরে তো খালি বই আর বই করেছেন।সকালে উঠে পড়তে বসেছি আর রাতে ঘুমানোর আগে বই বন্ধ করেছি।”

“হুম,কেউ কিছু বললে কান দিবে না।যদিও কেউ কিছু বলবে না যে বলার সেও আজ কলেজে যাবে।”

“আপনি কিন্তু খবরদার কোন ডাইনির দিকে তাকাবেন না। আর বুঝিনা আমি!চুলগুলো এভাবে স্পাইক করার কি দরকার?কলেজে তো পড়াতে যাচ্ছেন ফ্যাশন দিচ্ছেন কেনো?”

“তাহলে কি করবো? টেলি সামাদ হয়ে যাবো?”

“দরকার পড়লে তাই যাবেন।আজ থেকে আপনি টেলি সামাদ সেজেই যাবেন।”

বলেই নীরা দ্বীপের মাথা নারকেল তেল দিয়ে দিলো।তারপর মাঝখান থেকে সিতি করে বলে,”একদম পারফেক্ট লাগছে আপনাকে।আমাদের স্কুলে যে হেড টিচার ছিলো তার মত লাগছে।এখন কেউ নজর দিবে না।যেতে পারেন আপনি।”

দ্বীপ কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।কি বউ জুটলো কপালে। দ্বীপ ড্রয়িং রুমে আসার সাথে সাথেই দ্বীপকে দেখে সবাই হাহা করে হাসতে থাকে।পিংকি ভেবাচেকা খেয়ে থাকে।বলদ বউ পেয়ে কি জামাইও বলদ হয়ে গেলো!এ কোন লুক নিয়ে যাচ্ছে কলেজে?

পিংকির হা করে তাকানো দেখে নীরা বলে,”এভাবে দেখার কিছু নেই।এবার থেকে কলেজে যাওয়ার সময় মাথায় তেল দিয়ে যাবে আর এসে শ্যাম্পু করবে।ছেলেদের আসল সৌন্দর্য তাদের হেয়ার স্টাইল দিয়েই হয়।তাই আমার ক্যাডার সাহেবের সৌন্দর্য আমি দেখবো।”

পিংকি নীরার কথার উত্তরে বলে,”আর সিক্স প্যাক!তারপর চাপদারী এগুলো?”

“আমার জামাইয়ের সিক্স প্যাক এর দিকে তোমার এত নজর কেনো হ্যা?ওটার ব্যাবস্থা নেই বলেই তো চুলে তেল দিয়ে দিলাম।যদিও আজ থেকে ঘি দিয়ে গরম ভাত আর বেশি বেশি আলুর তরকারি খাওয়াবো।সিক্স প্যাক বেশিদিন থাকবে না।”

মিসেস শিউলি বলেন,”একদম ঠিক কথা কইছো নাতবৌ।বর মানুষ যত্ত সুন্দর লাগবো তত্ত বেশি মাইনষের নজর লাগবো।”

বলেই হাসতে থাকেন সবাই। দ্বীপ কোনো কথা না বলে বের হয়।বাড়ির বাইরে এসে তেল আলা চুলগুলো হাত দিয়ে উচু করে সেই স্পাইক আকারেই করে।নীরার সামনে আর করে না এই কাজ।যে লেভেলের ঝাজ!দ্বীপকে আজ মিটিংয়ে যেতেই দিতো না।

~~~~
বিকালে দ্বীপ আসে কলেজ থেকে।নীরা না খেয়েই আছে তার জন্য।এটা নীরার এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।দ্বীপের লাঞ্চ টাইমে নীরাকে কল দিয়ে যদি বলে দ্বীপ খেয়েছে তখন নীরা ভিডিও কলে থেকে পিংকিকে দেখিয়ে দেখিয়ে খায়।আজ দ্বীপ ক্লাস করানোর পর মিটিংয়ে ব্যাস্ত ছিলো তাই কল দিতে পারেনি। নীরাও না খেয়ে আছে।দ্বীপ গোছল করে এসে নীরার সাথে একসাথে খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়।তারপর নীরার কাছ থেকে পড়াগুলো আদায় করে।

এর কিছুক্ষণ পর কেয়া ও কেয়ার আম্মু আসে নীরার সাথে দেখা করতে।মিসেস সাবিনা ও মিসেস শিউলি মিলে গল্প করে কেয়ার আম্মুর সাথে।দ্বীপ নীরা অভ্রকে নিয়ে কেয়ার সাথে গল্প করে।কেয়া বলে,”দোস্ত বাসা থেকে আমাকে ও রিককে মেনে নিয়েছে।পরীক্ষার পর আমাদের বিয়ে।বলতে গেলে আজ পরীক্ষা শেষ তো পরশু বিয়ে।তাই আম্মু এসেছে সবার সাথে কথা বলতে।”

নীরা খুশি হয়ে হাত তালি দেয়।নীরার দেখা দেখে অভ্রও হাত তালি দেয়।দ্বীপ বলে,”বিয়ের কথা পরীক্ষার পর বললে মনে হয় ভালো হতো।তোমরা যে লেভেলের পড়া চোর।এতে করে বিয়ের আনন্দে পড়াশোনা গোল্লায়।”

নীরা চোখ ছোট ছোট করে তাকায় দ্বীপের দিকে।বলে,”আমার জীবনটা তো নিরামিষ বানিয়েছেন এখন আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর পিছনে লেগেছেন!আপনি কি আমাদের জীবনে একটু রোমান্টিক লাইফ স্পেন্ড করতে দিবেন না?”

“সব কিছুর একটা সময় থাকে।এখন পরীক্ষা চলছে তোমাদের।তোমার রেজাল্ট করার দায়িত্ব তো আমি নিয়েছি। আর কেয়া তোমাকে বলছি।তোমার মাকে বলে আমাদের কলেজের এক প্রফেসরকে ঠিক করে দিচ্ছি।পরীক্ষার এক মাস তার কাছে পড়াশোনা করবে।”

কেয়া কাদো কাদো মুখ করে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝায়।মনে মনে বলে,”আমি তো ভুলেই গেছিলাম!আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী এখন আমার কলেজের শিক্ষক।কোন দুঃখে যে এখন বিয়ের অ্যাডভান্স কার্ড দিতে আসলাম।বিয়ের কার্ড দিতে এসে পরীক্ষার জন্য টিউটর জুটলো।হায়রে আমার বিয়ের অ্যাডভান্স গিফট।”

কেয়ার আম্মুর সাথে কথা বলেই দ্বীপ চলে যায় নিজেদের রেস্টুরেন্টে।মিস্টার সমুদ্রর সাথে একবারে মাগরিবের নামাজ পড়ে ফিরবে।নীরা কেয়ার কাছে এসে বলে,”বুঝলি দোস্ত!তুই ক্যাডার সাহেবকে হেল্প না করলে আমিও কোনো এক রোমান্টিক জামাই পেতাম আর তুইও তোর বিয়ের জন্য আনন্দ করতে পারতি।”

কেয়া কাদো কাদো ফেস করে বলে,”কোথায় ভাবলাম টেনে টুনে পাশ করে বের হবো।তারপর সাদা বিলাইকে বিয়ে করে পড়াশোনা থেকে দশ হাত দূরে থাকবো,তা না বান্ধবীর প্রফেসর বর কি না আমাকেও বিদ্যাসাগরে ভাসিয়ে দিলো।একটা সত্যি কথা বলবি দোস্ত?”

নীরা তাকায় কেয়ার দিকে।ইশারা করে বোঝায়,”কি?”

“তোদের কি কোনো রোমান্টিক মুহূর্ত আছে?এই যে বিয়ের এতগুলো দিন হয়ে গেলো। স্যার কি তোকে ভালোবাসার কোনো প্রবাদ বাক্য শুনিয়েছে? না কি খালি বই নিয়ে বসে থেকেছে?যেভাবে আমাকে বিয়ের আগে কংগ্রাচুলেশন না জানিয়ে বিদ্যাসাগরে ঢুকিয়ে দিলো।মনে তো হয় না তোর জীবনে এত তাড়াতাড়ি কিছু হবে।”

নীরা দুঃখ প্রকাশ করতে যাবে তার আগে দেখলো পিংকি তার ঘরের পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে কথা শুনছে।নীরা জোরে জোরে বলে ওঠে,”কি যে বলিস না দোস্ত!আমার ক্যাডার সাহেব আমাকে বলেছে পরীক্ষার পর চুনু মুনু গিফট করবে।ইনফ্যাক্ট জোড়ায় জোড়ায়।শুধু কি তাই আমি যখন ঘুমাতে যাই আমাকে ভালোবাসার পরশ দিয়ে ঘুম পাড়ায়।”

কেয়া হা করে আছে।কেউ বলবে এমন মুডি শিক্ষক বউ পেলে রোমান্টিক হবে।অবশ্য স্বামী স্ত্রীর ভিতর তো রোমান্স হবেই।সে শিক্ষক হোক বা কোনো হুজুর।বউ তো বউ তাকে কি আর অন্য মেয়েদের মত ট্রিট করা যায়?

পিংকি আহত হয়ে ভিতরে ঢুকলো।রাগ উঠছে তার।এদের সম্পর্ক ভাঙার জন্য প্ল্যান করতে থাকে পিংকি।কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসি দেয়।

সন্ধায় কেয়া বাসায় চলে আসে।কেয়ার শিক্ষক সন্ধার পর আসবে।এতে কেয়ার আম্মু খুশি হয়েছে।নীরা ও কেয়ার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।সন্তানদের সফলতা বাবা মায়ের তৃপ্তির স্থান।ভালো পাত্র পেয়েছে দুই বান্ধবী।শুধু কি তাই?এরা যেমন ভালো চরিত্রের পাত্র পেয়েছে ঠিক তেমন ভালোবাসার মতোও পেয়েছে।দ্বীপকে দেখলে বোঝা যায় সে নীরার প্রতি কতটা সেনসেটিভ।আবার রিক সে যদি এতটাই খারাপ হতো তাহলে মাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতো না।রিক কয়েকদিন কেয়ার সাথে ঘোরাফেরা করলেও কেয়ার মন বুঝতে চেয়েছিলো।যথেষ্ট সম্মান করে রিক কেয়াকে।রিকের মায়েরও মনে ধরেছে কেয়াকে।বউমা হিসেবে তার কেয়াকে পছন্দ।

সন্ধ্যায় নীরাকে পড়াতে বসেছে দ্বীপ।দীপান্বিতা লাইভ করে এখন রাতের খাবার রেডি করতে এসেছে মিসেস সাবিনার সাথে। পিংকিও এসেছে হেল্প করতে।মিসেস সাবিনা বলেন,”থাক মা তোকে কষ্ট করতে হবে না।তুই গিয়ে পড়তে বস।”

পিংকি ইচ্ছা করে নীরার মাইন্ড ডাইভার্ট করতে চায়।তাই জোরে জোরে রান্নাঘর থেকে বলে,”তা বললে কি আর হয় নাকি মামী?তোমাদের ছেলেকে বিয়ে দিয়েছো এমন একজনের সাথে যে কি না পড়াশোনা তো করেই না আবার কাজও পারে না।আমি একটু হেল্প করি তোমাদের।”

দ্বীপদের বাসা তিনতলা বিল্ডিংয়ের।দ্বিতীয় ফ্লোরে দ্বীপরা থাকে।একটি ফ্লোর হওয়ায় সবার ঘরের সামনেই ড্রয়িং রুম আর ড্রয়িং রুমের কাছেই আছে রান্নাঘর।রান্নাঘর থেকে একটু জোরে কথা বলায় নীরার কানে ভেসে আসে পিংকির কথা।একটু রাগ উঠলেও পাত্তা দেয় না নীরা। কাল তার পরীক্ষা।আজকে এসব কথায় পাত্তা দিবে না।

মিসেস সাবিনা দীপান্বিতাকে রান্নার কথা বলে ঘরে যান।মিস্টার সমুদ্রের সাথে কথা বলতে।পিংকি আবারও জোরে জোরে বলে,”আহারে আমার মামীর কপাল!ছেলের বিয়ে দিলো অথচ বউমার সেবা পেলো না।উল্টো কি না ছেলের বউকে সেবা করতে হয়।পিচ্ছি ভাবী কপালে জুটেছে বলে আজ এক অসহায় ননদকেও ঘরের কাজ করতে হচ্ছে। ফেলটুশ তো ফেলটুশ তার সাথে পারে না কোনো কাজ।”

নীরার এবার আর রাগ কন্ট্রোল হলো না।দ্বীপ নীরাকে কিছু প্রশ্নের উত্তর লিখতে দিয়েছিলো।বানান দেখার জন্য।নীরা উত্তর লিখে দ্বীপের কাছে খাতা দেয়।দ্বীপ সেদিকে মনোযোগ দিয়েছিলো।হঠাৎ দেখলো নীরা ধুম করে চেয়ার থেকে উঠে কোমরে ওড়না বেধে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। দ্বীপও সাথে সাথে উঠে যায় নীরার পিছনে।নীরাকে বাধা দিয়ে বলে,”তুমি রান্নাঘরে এসেছো কেনো?”

কিসের পড়াশোনা নীরার এখন মাথায় আগুন ধরে গেছে।হুংকার দিয়ে দ্বীপকে বলে,”দেখতে পারছেন না আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।রান্নাঘরে মানুষ কেনো যায়?রান্না করতে।আমিও রান্না করবো।ঘরের বউ হয়েছি আমি এখন।আগে রান্নাবান্না তারপর পড়াশোনা।”

দ্বীপ বুঝতে পারলো এই মেয়েকে এখন চড় থাপ্পড় থ্যারাপি দিলেও কাজ হবে না।তাই শান্ত হয়ে বলে,”কাল তোমার পরীক্ষা।মাথা ঠাণ্ডা রাখো।পরীক্ষার পর রান্না বান্না করো।মাত্র তো এক মাস।দরকার পড়লে বৃহস্পতিবার রাত করে রান্না করবে।আমি বাধা দিবো না।প্লিজ চলো।”

কিসের কি নীরার চোখ তো পিংকির দিকে।শয়তানি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে পিংকি।পিংকি চায় দ্বীপ আজ নীরার বাড়াবাড়ি দেখে কিছু একটা করুক।যে ঝামেলা বাদিয়ে দিয়েছে এখন এরা বর বউই যা করার করবে।নীরা পিংকির দিকে তাকিয়ে বলে,”ও কেনো রান্না করবে?ও রান্না করবে ওর শশুর বাড়িতে।আমি এখন আমার শ্বশুর শাশুড়ির জন্য রান্না করবো।ননদকে ভুগতে দিবো না আমি।আমি ভালো বউ হবই হবো।”

বলেই নীরা দৌড় দিতে যায় রান্নাঘরে।ওমনি দ্বীপ নীরার কোমর জাপটে ধরে।নীরা লাফালাফি করে বলে,”ছাড়ুন আমাকে ক্যাডার সাহেব।আমার মাথা এখন আতা মাঝি ছাতাকলি হয়ে গেছে।হয় আজকে ওর মাথা ফাটবে নাহয় বাড়িতে আগুন লাগবে।”

বলতে বলতে নীরার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে।যোগ্য বউ না যোগ্য বউ না ফেলটুশ করে করে পিংকি যতটা খোটা নীরাকে দেয় এতটা নীরাকে কেউ বলেনি।তাই একটু কষ্ট হয় নীরার।দ্বীপ বুঝতে পারে নীরা আজ কষ্ট পেয়েছে।পিংকিকে কেউ একটু প্রতিবাদ করেও কিছু বলেনা।যদিও পিংকির কথার পাত্তা দেয় না কেউ।কিন্তু নীরার মন তো এতেই কষ্ট বাড়িয়ে দেয়।তাই দ্বীপ বলে,”মাথা ঠাণ্ডা করো চন্দ্রপাখি।শান্ত হও তুমি।সবাইকে বলে রাখছি আমার বউকে কেউ রাগাবে না।পরীক্ষার পর আমার বউয়ের হাতের রান্না তোমাদের পেট ভরে খাওয়াবো।এখন সে তার মত পড়তে বসবে।আমার বউ দেখিয়ে দিবে সে ফেলটুশ না। সেও একজন ব্রিলিয়ান্ট।কি বউ পারবে না দেখাতে?”

কথা বলার মাঝে দ্বীপ দীপান্বিতাকে চোখ টিপ দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে সে নীরাকে শান্ত করতে এমন বলে।দীপান্বিতা মিটমিট হাসে।নীরা এবার একটু শান্ত হলো।তাকালো দ্বীপের দিকে।দ্বীপ আবার বলে,”লোকজন কিন্তু এটা বলেও তোমাকে খোঁচা দিবে যে তুমি এসএসসি ফেলের মত ইন্টার ফেল করেছো।একটা মাস অপেক্ষা করো তারপর সংসারের কাজ করলে লোকে বলবে নীরা ইজ দ্যা বেস্ট।যে নারী রাধে সে চুলও বাঁধে।ভালো রেজাল্ট এখন ইম্পর্ট্যান্ট।তারপর ভালো বউ হও।”

বলেই নীরাকে নিয়ে ঘরে যায়।নীরা হাফাতে থাকে।দ্বীপের বুকেই মাথা রেখে কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে।কিছু একটা ভেবে নীরা দ্বীপকে বলে,”আমার মুখে এখন ভালোবাসার স্পর্শ দিবেন ক্যাডার সাহেব।”

দ্বীপ অবাক হয়ে বলে,”হোয়াট?”

“হুম এই ডাইনি ননদিনীর সামনে আপনি আমার শুষ্ক গালে ভালোবাসার পরশ একে দিন।”

“পাগল হয়েছো তুমি?এখানে সবাই আছে।”

“তেমন কেউ নেই।দীপান্বিতা আপু আর পিংকি ছাড়া।আমি চাই কেউ একজন তার চাওয়ার বিপরীতে অন্য কিছু দেখে জ্বলুক।আপনি যদি এখন আমাকে ভালোবাসার পরশ না দেন আমি এই রাতেই বাড়ি চলে যাবো। আর এলাকা জুড়ে বলবো ক্যাডার সাহেব একজন টিউব লাইট।তাই বাধ্য হয়ে দুই মাস সংসার করে চলে এসেছি।আমি এই কথা রটালে আর কোনো বউ জুটবে না আপনার কপালে। আর যদি আমি যাওয়ার পর পিংকি নামক ডাইনিকে আপনি বিয়ে করেন।এই সমাজ কিন্তু ধরে নিবে আমাদের বিয়ে ভাঙার পিছনে আপনাদের দুই জনের হাত আছে।”

“যত্তসব উল্টা পাল্টা ভাবনা চিন্তা।”

“তিন সেকেন্ড সময় দিলাম।আমি যদি আমার শুষ্ক ত্বকে মিষ্টি ছোয়া না পাই তাহলে আমি চলে যাবো।”

“ঠিক আছে” বলেই দ্বীপ নীরার মুখে ভালোবাসার ছোয়া দিয়েই দেয়।

পিংকি আহত হয়ে তাকায়। কোথায় ভাবে এই গালে এখন থাপ্পড় থ্যারাপি হবে তা না হলো কি না চুম্বন থ্যারাপি।নীরা খুশি হয়ে দ্বীপের সাথে ঘরে চলে যায়।দীপান্বিতা রান্নায় ব্যাস্ত ছিলো।অবশ্য দ্বীপ ইশারা করে অন্য দিকে ফিরতে বলে দীপান্বিতাকে।

চলবে…?