Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 300



লুকোচুরি গল্প পর্ব-১৬+১৭

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৬
#ইশরাত_জাহান
🦋
দুপুরে দ্বীপ বাসায় আসে একটু দেরি করে।বাসায় আসার সাথে সাথে মিসেস সাবিনা বলেন,”ক্যাডার সাহেব এসেছেন!আপনার বউ তো না খেয়ে অপেক্ষা করছে।বলেছে আমার উনি আসলে একসাথে খাবো।”

হাত ঘড়ির দিকে তাকালো দ্বীপ।দেখলো বিকাল হয়ে এসেছে।প্রায় চারটা ছুঁই ছুঁই।নীরা এখনও না খেয়ে আছে।কি এমন হলো যে মেয়েটা এমন করছে এটা বুঝতে পারছে না দ্বীপ।লোক দেখানো কাজ এত কেনো করবে?

দ্বীপ ঘরে আসার সাথে সাথে নীরা দ্বীপের বাড়ি পড়ার পোশাক বের করে দেয়।দ্বীপ বলে,”তুমি নাকি না খেয়ে আছো?”

“হ্যা,আপনি আর আমি একসাথে খাবো তাই।”

“কি হয়েছে তোমার বলোতো?এক থাপ্পড়ে ঘাড় ত্যারা থেকে ঘার সোজা হয়ে গেলো নাকি!”

“ধুর,আপনিও না পড়ে আছেন এক বিষয় নিয়ে।মানুষ বুঝি বদলায় না।”লজ্জা পাওয়ার ভান করে।আবার বলে ওঠে,”তাড়াতাড়ি যান গোছল করে আসেন।দুপুরে না খেয়ে আছি।পেটের ভিতরে ছুঁচোগুলো দৌড়াচ্ছে।”

“আচ্ছা।”বলেই দ্বীপ চলে গেলো গোছল করতে।ফ্রেশ হয়ে একসাথে দুপুরের খাবার খেলো।

বিকাল হওয়ার সাথে সাথে কেয়া এসেছে নীরার সাথে দেখা করতে।অনেকদিন হয়ে গেছে দেখা করে না।কেয়া ও নীরা একসাথে ছাদে গল্প করছে।কেয়া বলে ওঠে,”জানিস সাদা বিলাই আমাকে প্রপোজ করেছে।”

“কবে!কখন!কথায়!আমাকে বলিস নি কেনো?”

“আরে কালকে করেছে প্রোপজ।আমি এখনও ঝুলিয়ে রেখেছি।একসেপ্ট করিনি।”

“কেনো করিসনি একসেপ্ট?”

“কেনো আবার!জানিস না মেয়েদের একটু লজ্জা পেয়ে পেয়ে দেরি করতে হয়।আমি ও সাদা বিলাইকে একটু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তারপর একসেপ্ট করবো।”

“মেয়েদেরকে লজ্জা পেতে হয়?লজ্জা পাওয়ার বেনিফিট কি?”

“একটা মেয়ে যতো বেশি লজ্জা পাবে তার পার্টনার তাকে ততো বেশি আদর যত্ন করে।”

কেয়ার কথা শুনে নীরা মনে মনে বলে,”তাহলে আমাকেও লজ্জা পেতে হবে!আজ থেকে আমিও লজ্জা পাবো।কিন্তু আমার তো অত বেশি লজ্জা লাগে না!”

কেয়া আর নীরার আড্ডার ভিতরেই রিক কল করে কেয়াকে।কল রিসিভ করলে রিক বলে,”কোথায় তুমি,চশমিশ?”

“এই তো আপনার বাসার উল্টো বাসায়।আগে যেই বাসাটা আমার বান্ধবীর ছিলো ওটাতে এখন আমাকেও পাবেন না।আমি এখন বান্ধবীর আরেক বাসায়।”

“পিছনে ঘুরে দেখো।”

কেয়া পিছনে ঘুরে দেখে রিক দাড়িয়ে আছে তাদের ছাদে। রিককে দেখে কেয়া কল কেটে দেয়।সাথে সাথে কেয়া তার ওড়নার শেষ কিনারা আঙুলের সাথে পেচিয়ে পেচিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকায়।কেয়ার লজ্জা লজ্জা ভাব দেখে নীরা বিরক্ত।এভাবে কেউ লজ্জা পায়?তারপর নীরা তাকালো রিকের দিকে।রিক কেয়ার লজ্জা পাওয়া দেখে হাসতে থাকে।কেয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে এক নাগাড়ে।

কেয়াকে লজ্জা পেতে দেখে রিক বলে,”আয় হায় চশমিশ!তোমাকে তো লজ্জা পেলে আরো বেশি সুন্দর লাগে।চশমার ভিতরে তোমার ওই চোখে আমার জন্য লজ্জার আবির্ভাব ফুটে উঠেছে। ইশ এটাকেই তো বলে লুকোচুরি গল্প।”

এই রিকও লুকোচুরি গল্প বললো।ক্যাডার সাহেবও ডায়েরির পাতায় লুকোচুরি গল্প লিখেছে।লজ্জা পেলে বুঝি ক্যাডার সাহেব বুঝে যাবে যে তার চন্দ্র পাখি তাকে নিয়ে লুকোচুরি গল্পে মশগুল হয়ে গেছে।আজকে নীরাও লজ্জা পাওয়ার চেষ্টা করবে।

সন্ধায় দ্বীপ নীরাকে বলে,”বই খাতা বের করো পড়তে হবে।”

নীরা তার ওড়নার কোনায় আঙ্গুল দিয়ে ঘোরাতে থাকে আর ফ্লোরে তাকিয়ে মিটমিট হাসতে থাকে।দ্বীপ দেখলো নীরার কান্ড।কিন্তু কিছু বুঝলো না।দ্বীপ আবার বলে,”কি হলো?পড়তে বসবে না?”

নীরা ফ্লোরে তাকিয়ে ওড়নার কোনায় আঙ্গুল পেচাতে পেচাতে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝায়।দ্বীপ এবার ফোশ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”পড়তে বসার আহ্বান দিয়েছি বাসর করতে আহ্বান দেইনি যে এভাবে লজ্জা পাবে।পরীক্ষার পর লজ্জা পাওয়ার মতো সুযোগ ও কাজ দুটোই করে দিবো।এখন পড়াশোনায় ফোকাস হও।”

শেষ,নীরার লজ্জা পাওয়া শেষ।এমন রসকষহীন বর থাকলে কিভাবে লজ্জা পাবে সে?এমনিতেও নীরার দ্বারা ওসব লজ্জা তারপর ন্যাকা ন্যাকা ভাব আসে না।নীরা সবসময় স্ট্রেট থাকে।সেখানে আজ একটু লজ্জার অভিনয় করলো।কিন্তু এই ক্যাডার সাহেব তা হতে দিলো না।

শীত পড়েছে খুব।তাই আজ মিসেস সাবিনা ও দীপান্বিতা মিলে পিঠা বানাতে থাকে।মিসেস শিউলি ভাত চাপিয়ে দেন। পিংকিও সাহায্য করতে থাকে।মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন এসেছেন।দ্বীপের বাবা মা দাওয়াত দিয়েছেন।নীরা ও দ্বীপ পড়তে বসেছে।দ্বীপ নীরাকে পড়াচ্ছে। আর কয়েকদিন পর নীরার পরীক্ষা।আবার এর ভিতরে নীরব আসবে।শীতকালে এমনিতেই পিঠার আমেজ থাকে।একের পর এক আনন্দ অনুষ্ঠান শীতকালেই বেশি হয়। আর এর ভিতরে নীরার পরীক্ষা।দ্বীপ ও তার পরিবারের কোনো আপত্তি নেই নীরা কোনো কাজ করলো কি না এগুলো নিয়ে।দ্বীপ ভালো করেই জানে নীরাকে কাজ করতে বললে নীরা বই ফেলে কাজের দিকে দৌড় দিবে।

রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছে।নীরা মিস্টার রবিনের এক বাহু ধরে তার কাঁধে মাথা দিয়ে আছে।বিয়ের আগে বাসায় থাকলে মিস্টার রবিন যখনই কাজ করে বাসায় আসতো নীরা সাথে সাথে তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরতো।বিয়ের পর সবকিছু পাল্টে গেছে।নিজের স্থায়ী বাড়ি নিজের জীবন নিজের কাছের মানুষের জায়গা সবকিছু।কিন্তু তারপরও নীরা আজ সুখী।তাকে তার শ্বশুর বাড়ির সবাই ভালোবাসে।তার আসল মানুষ তাকে এতগুলো বছর ধরে ভালোবাসে।এগুলো কি কম নাকি?

মিস্টার রবিন নীরাকে বলেন,”শুনলাম তুমি নাকি পারফেক্ট বউ হওয়ার চেষ্টা করছো।সকাল সকাল উঠে রান্না বান্না করেছো পড়াশোনা করেছো।সবাই তো তোমার খুব প্রশংসা করছে।বরের প্রতি এত যত্ন এসেছে দেখে সবাই খুশী।”

নীরা তাকালো বাবার দিকে।পাশেই মা শশুর শাশুড়ি ও অন্যান্য সবাই আছে।নীরা বলে,”আমি তো তোমারই মেয়ে আব্বু।তুমি যেমন তোমার বউয়ের জন্য পাগল,আমিও তো তেমনই হবো আমার বরের পাগল।এগুলো তো বংশগত রোগ।বাবা যেমন রোমান্টিক হবে তার সন্তানও তেমন রোমান্টিক হবে।”

খুক খুক করে কাশতে থাকেন মিস্টার রবিন।মিস্টার সমুদ্রর বিষম ওঠে।মিসেস নাজনীন মেয়ের আর তার বাবার দিকে চোখ গরম করে তাকায়।মিসেস সাবিনা ও দীপান্বিতা মিটমিট হাসতে থাকে।দ্বীপ কি করবে নিজেও জানে না তাই সে ঘরে চলে আসে।পিংকি আর মিসেস শিউলি নিজেদের মত ঘরে আছে তাই এগুলো দেখছে না।অভ্র সবার এই ভাবভঙ্গি বুঝে উঠতে পারছে না।সে তার মত কার্টুন দেখতে ব্যাস্ত।

মিসেস সাবিনা মিস্টার রবিনকে বিষম খেতে দেখে ফিসফিস করে বলেন,”উম ঢং দেখলে বাচি না।মেয়েটা তো ঠিকই বলেছে।বাবা মা যেমন সন্তান তেমন হয়।তবে তোমার ক্ষেত্রে উল্টো।তোমার বাবা তো রোমান্সের ঠেলায় দুটো বিয়ে করেছিলো তুমি তো তার এক অংশও দেখাও নি।উল্টো ছেলেকে তোমার মত বই পাগল বানিয়েছো।এখন ছেলে আমার বই ছেড়ে বউ লাগল হলেই বাচি।”

ছেলের বউ আসার পর থেকে যেনো বুড়ো বয়সে বউও যুবতী মনের হয়ে উঠেছে।মিস্টার সমুদ্রের যেনো দিন দিন বিষম খাওয়ার গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মিস্টার সমুদ্র মিসেস সাবিনার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলেন,”ছেলের বউয়ের ছোঁয়া লেগেছে মনে! চলো আবার বিয়ে করে নব দম্পত্তি হয়ে যাই।তোমার মনের যত রং লেগেছে মিটিয়ে দেই।”

“সেই সৌভাগ্য কি আর আমার কপালে আছে।”বলেই হামি দিয়ে সোফা থেকে উঠে পড়েন মিসেস সাবিনা।

মিসেস নাজনীন নীরার কাছে এসে নীরার কানে কানে বলেন,”বিয়ে হয়েছে সবকিছু বুঝতে শিখেছো,এটা শিখো নি যে কোথায় কি বলতে হয়?”

“আমি তো সত্যি কথাই বলেছি।বাবা তো তুমি বলতে অন্ধ।তুমি বললে বাবা যাবে ডানে তুমি বললে বাবা যাবে বামে।আমার কপালে বর জুটেছে তার উল্টো।আমাকে কি করতে হয়! বর যদি বলে চলো ডানে আমিও চলি ডানে বর যদি বলে চলো বামে আমিও চলি বামে।”

মিস্টার রবিন মেয়েকে বলেন,”এগুলো বলতে নেই মা।তোমার আম্মু লজ্জা পায়।”

বলেই নীরা ও মিস্টার রবিন হাসতে থাকে।
মিসেস নাজনীন বুঝতে পেরেছে এরা বাবা মেয়ে মিলে তাকে পচাইতে থাকবে।তাই তিনি কথা বাড়ায় না।তাড়াতাড়ি করে বিদায় জানিয়ে চলে যান বাসায়।

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৭
#ইশরাত_জাহান
🦋
আজ নিরাদের বিদায় অনুষ্ঠান।বিদায় অনুষ্ঠানটি খুব বড় ভাবে আয়োজন করা হবে।সাথে পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড দিবে।বিদায় অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেয়েদের নীল শাড়ি ও ছেলেদের পাঞ্জাবী পড়তে বলা হয়েছে।নীরা এই কয়েকদিনের ভিতরে তার ও দ্বীপের জন্য একসাথে ম্যাচিং করে ড্রেস কিনেছে।আজকে সন্ধায় নীরব আসবে।কয়েকটা দিন শুধু নীরার বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকতে হয়েছে।আজকে সারাদিন তার ছুটি।দ্বীপ তাকে এই করা শাসনে রাখে আবার দ্বীপই তাকে ছুটি দেয়।

দ্বীপ ফ্রেশ হয়ে রেডি হবে নীরা তখন দ্বীপকে বলে,”আজকে আপনি এই পাঞ্জাবি পড়বেন।”

দ্বীপ তাকায় পাঞ্জাবির দিকে।পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে নীরাকে বলে,”এটা কখন কিনেছো?”

“ছুটির ভিতরেই কিনেছি।আপনাকে সারপ্রাইজ দিবো তাই দেখাইনি।এখন তাড়াতাড়ি পড়ে আসুন।”

দ্বীপ নীরার থেকে প্রথম কোনো পুরষ্কার পেয়েছে।এতে দ্বীপের ভালো লাগছে।তাই সে পাঞ্জাবি নিয়ে চলে গেলো অথচ দ্বীপ নিজেও জানে না নীরা তার সাথে ম্যাচিং করে শাড়ি পড়বে।

নীরা শাড়ি পরে ড্রয়িং রুমে এসেছে।কয়েকদিন পড়াশোনার চাপে ঘরের কাজ করতে পারে না।এর জন্য কেউ তাকে জোর করেনি।তবে পিংকি নীরাকে কথা শুনিয়ে শুনিয়ে ঘরের অনেক কাজ করেছে।এতে নীরার মনে একটু জেদ চেপেছে।পরীক্ষা শেষ হলে ঘরের কাজে মন দিবে এমন এক জেদ নীরা মনে মনে করে রেখেছে।ড্রয়িং রুমে এসে নীরা দেখে পিংকি অনেক সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে। নৃত্যে নাম দিয়েছে হয়তো।পিংকি অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করে,নীরার কলেজেই।আজ সিনিয়র জুনিয়র সবাই নৃত্য করবে। যার যার ইচ্ছা। পিংকিও নাম দিয়েছে।

নীরার ইচ্ছা ছিলো নৃত্য করার।কিন্তু সে এখন নৃত্য করতে পারবে না।তার ক্যাডার সাহেব চায় না।পিংকি তো তার ডেমো দেখেছিলো।তাই নীরাকে খোঁচা দিয়ে বলে,”মানুষ বুঝে কাকে কোথায় মানায়।তাই তো আজ আমি নৃত্য করতে পারছি। আর অনেকের মনের ইচ্ছা থাকলেও পূরণ তো করতে পারেই না বরং ডেমো দেখিয়ে দেয়।”

নীরা কি কম নাকি!তাকে কেউ কথা শোনাবে আর সে চুপ থাকবে এমন তো হতেই পারে না।পিংকির কাছে এসে নীরা বলে,”কি বলোতো আমি তো জানতাম না আমার ক্যাডার সাহেব নাচনেওয়ালি দেখলে ঘৃণা করে তাই আবদার করেছিলাম।আমার ক্যাডার সাহেব আমাকে তার ব্যাক্তিগত নারী হিসেবে চায়।কোনো পর পুরুষের সামনে নৃত্য পরিবেশন করা নারী হিসেবে না।আমি এতেই খুশি।”

বলেই হামি দিতে দিতে রান্নাঘরের দিকে যায়।পিংকি রাগে চোখ মুখ লাল করে আছে।এই মেয়ের সাথে কথায় পারবে না।তাকে কিছু একটা করতে হবে।

সকালের খাবার খেয়ে দ্বীপ ও নীরা নিজেদের মতো কলেজে আসে।কলেজ গেট থেকে নীরা নেমে যায়।ওখানেই আসে কেয়া।কেয়া দ্বীপ ও নীরাকে দেখে বলে,”বাব্বা,তোরা তো দেখি সেম কালার সহ সেম প্রিন্টের ড্রেস পড়েছিস! স্যারকে তো পুরো হ্যান্ডসাম প্লাস জেন্টেলম্যান লাগছে।”

“নজর দিবি না।”

“আমার বয়েই গেছে নজর দিতে।আমার সাদা বিলাই আছে।তোর ক্যাডার সাহেবের দিকে তো অন্যান্য মেয়েরা নজর দিচ্ছে।ওই দেখ সিনিয়র আপুরা কিভাবে তাকাচ্ছে।”

নীরা দেখলো প্রায় কিছু সংখ্যক মেয়েরা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে আছে।আবার কিছু মেয়েরা কলেজের ভিপিকে দেখতেছে।নীরার হিংসা হতে লাগলো।আরে ভাই ভিপি তারপর আরো হ্যান্ডসাম স্যারের দিকে তাকাচ্ছিস তাকা আমার বরের দিকে কেনো তাকাচ্ছিস?নীরা কেয়াকে বলে,”বুঝলি সাদা বিলাই এর চশমিশ!আমার ক্যাডার সাহেবের নজর দোষ শুধু বাড়িতেই না বাইরেও আছে।কোনো এক ওঝা দেখাতে হবে।যদি নজর থেকে বেঁচে যায়।”

“ধুর তোর মতো রনচন্ডি চ না মানে মেয়ে থাকতে কি আর ওঝা লাগে। এমনিতেও কোনো মেয়ে পাত্তা পাবে না।”

“চন্দ্র পাখি বলেও বললি না কেনো?আমি সবকিছু জেনে গেছি।”

“কিভাবে?”

“তোকে কেনো বলবো!তুই আমাকে বলেছিলি যে ক্যাডার সাহেব আমাকে ভালোবাসে?”

“আরে তুই যে থাপ্পড় থ্যারাপি পেয়েছিস ওগুলো তো একটাও আমি পাই নি।প্রথম দিন তো স্যারের থাপ্পড় খেয়ে অজ্ঞান ছিলি।এখন না হয় তোর অভ্যাস হয়েছে।আমার তো তা না।এই ভয়তে বলিনি।”

কেয়া আসার সাথে সাথে দ্বীপ চলে যায় নিজের স্থানে।কেয়া ও নীরা ঘোরাঘুরি করতে থাকে কলেজে।ঠিক সেই সময় নীরার সামনে একটি ছেলে আসে। ছেলেটি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করে নাম ইশতিয়াক।নীরার কাছে এসে নীরাকে বলে,”তোমাকে অনেক কিউট লাগছে।”

নীরা কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যেতে নেয়। ইশতিয়াক আবার আসে নীরার সামনে।নীরার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে নীরার দিকে গোলাপ ফুল দিয়ে বলে,”দীর্ঘ ছয় মাস হয়েছে আমি তোমাকে ভালোবাসি।তোমাকে বলতে চেয়েও বলতে পারিনি।কিন্তু আজ আর তোমাকে দেখে থমকে থাকতে পারলাম না।তোমাকে এই দুই মাস দেখতে না পেয়ে খুব কষ্ট হয় আমার।আমি তোমার বাড়ির দিকে গেছি কিন্তু তোমাকে পাইনি।আগে যেমন ছাদে বা বাড়ির সামনের মাঠে খেলতে যেতে এখন আর দেখতে পাই না তোমাকে।এই জন্য পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।ভালোবাসি খুব খুব খুব ভালোবাসি আমি তোমাকে নীরা।আমার নীরুবতী।”

নীরা ও কেয়া একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে।নীরা কিছু বলার আগে কেয়া বলে,”আফসোস,আপনি আমার জিজু হতে পারলেন না।আপনি যাকে প্রণয় বাক্য দিয়ে নীরুবতী উপাধি দিলেন সে এখন অন্যের চন্দ্র পাখি।”

ইশতিয়াক বুঝতে পারলো না কেয়ার কথা।তাই কেয়ার দিকে ফিরে বলে,”মানে?”

“মানে এই যে আমার বান্ধবী বিবাহিত।”

ইশতিয়াক মন খারাপ করে দুঃখিত বলে স্থান ত্যাগ করে।কেয়া হাসতে থাকে।বলে,”দোস্ত এই ছেলেটা আগে আসলে তোর আর সুগার ড্যাডি বিয়ে করতে হতো না।মনে আছে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলি তোর সাথে সুগার ড্যাডির বিয়ে ঠিক হয়েছে?”

নীরার কোনো উত্তর না পেয়ে কেয়া খোঁচাতে থাকে নীরাকে।বলে,”কি হলো?এই তুই তোর জামাই থুয়ে ইশতিয়াক ভাইয়ের প্রেমে পড়লি নাকি?”

নীরা সামনে তাকিয়ে কাদো কাদো ফেস করে বলে,”সামনে দেখ।”

কেয়া সামনে তাকিয়ে দেখে দ্বীপ রাগে ফেটে যাওয়া ফেস করে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে।কেয়া বলে,”কাম সারছে রে!”

অনুষ্ঠানের নাচ গান ও বক্তৃতা শুরু হবে বলে সবাই নিজ নিজ জায়গায় বসে।স্যাররা কিছু বক্তৃতা দেয়।তারপর গান গাওয়া শুরু হয়।গান শেষে নৃত্য পরিবেশন করা হয়।একেক করে কয়েকজন নৃত্য করার পর পিংকিকে ডাকা হয় নৃত্যের জন্য।পিংকি গানের তালে প্রতিটি স্টেপ খুব সুন্দর ভাবে নাচে।পিংকির নাচ দেখছিলো দ্বীপ।মূলত দ্বীপ একা না সবাই দেখছে পিংকির নাচ।কিন্তু নীরার চোখে যেনো একা দ্বীপকেই বাদছে।

অনুষ্ঠান শেষে সবাই রেজিস্ট্রেশন কার্ড নিয়ে বাইরে এসে ছবি তুলতে থাকে।ইন্টারের পরীক্ষার্থীরা একসাথে ছবি তুলে কেউ কেউ কান্নাকাটি করে আবার কেউ কেউ বাড়ি চলে আসে।নীরা ও কেয়া গেটের কাছে এসে দাঁড়ায়।দ্বীপ ও রিক আসবে।রিক এসে কেয়ার সাথে ঘুরতে যাবে আর দ্বীপ ও নীরা বাড়িতে যাবে।দ্বীপ এসে নীরার কাছে দাড়াতেই রিক চলে আসে।রিকের হাতে বেলি ফুলের মালা।কেয়ার হাতে দিয়ে বলে,”তোমার এই নীল শাড়ির সাথে বেলি ফুলের মালা অনেক সুন্দর লাগবে,চশমিশ।”

কেয়া লজ্জা পেলো একটু।তারপর রিকের কাছ থেকে বেলি ফুলের মালা নিয়ে নীরাকে বলে,”আমার খোঁপায় একটু ফুল দিয়ে দে দোস্ত।”

নীরা কেয়ার খোঁপায় ফুল গুঁজে দিয়ে দেয়।তারপর তারা বিদায় নেয়।নীরা গাড়িতে উঠতেই দ্বীপ বলে,”আজকাল ছেলেদের থেকে খুব প্রোপজ পাওয়া হচ্ছে।”

নীরা হামি দিতে দিতে বলে,”ঘরে টিউব লাইট বর থাকলে যা হয়। বর তো আর ফুল দেয় না পর দেয়।কিন্তু আফসোস ফুল আর নেওয়া হয় না।এদিকে বান্ধবীদের দেখি বিএফ থেকে ফুলের মালাও গিফট পায়।আমারও ভাগ্য আর লোকেরও ভাগ্য।”

দ্বীপ রাগে জেদে জোরে স্প্রিডে গাড়ি চালায়।নীরা ভয় পেয়ে যায় এবার।বলতে থাকে,”মরে যাবো আমি মরে যাবো।ওরে ক্যাডার সাহেব লাগবে না আমার ফুল।আমার লাইফে আপনার মত ব্লাডিফুল থাকতে অন্য ফুল কেনো নিবো বলুন।গাড়ি আস্তে চালান।”

কে শোনে কার কথা দ্বীপ জোরে গাড়ি চালিয়ে আসে বাড়ির সামনে।নীরা হাফ ছেড়ে বলে,”এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। আর জীবনেও আপনার সাথে আমি এক গাড়িতে উঠবো না।যদিও উঠি তার আগে আপনার নামে আমি জিডি করে রাখবো।আমার মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী থাকবেন।”

বলেই নীরা বাসায় চলে আসে।বাসায় এসে হিজাব খুলে শাড়ি পরেই থাকে।কারণ আর কিছুক্ষণ পর নীরব আসবে।নীরা ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে এসে মাথায় খোঁপা করে।ঠিক তখনই পিছন থেকে দ্বীপ নীরার খোঁপায় বেলি ফুলের মালা গুঁজে দেয়।নীরা আয়নায় এই দৃশ্য দেখতে থাকে।

মাথায় বেলি ফুলের মালা গুঁজে দিয়ে দ্বীপ বলে,”আমার ব্যাক্তিগত নারী শুধু আমার।তাকে না দিবে অন্যকেউ ফুল না দিবে অন্য কেউ ভালোবাসা।”

বলেই দ্বীপ নীরার দিকে ঝুঁকে আসে।নীরা বুঝতে পারে দ্বীপ তাকে এবার ভালোবাসার পরশ ছুঁয়ে দিবে।তাই নীরা চোখ বন্ধ করে নেয়।এবার যেনো নীরার সত্যি লজ্জা করছে।দ্বীপের গরম নিঃশ্বাস নীরার মুখে আলাদা অনুভূতি নিয়ে আসে।ঠিক সাথে সাথেই নীরা ফিল করে তার গালে শুকনো খরখরা কিছুর ছোঁয়া।ঠোঁটের ছোঁয়া কি এমন অদ্ভুত লাগে!নীরার কেনো এমন লাগছে?সাথে সাথে চোখ খুলে নীরা।দেখতে পায় দ্বীপ একটি গোলাপ দিয়ে তার গাল স্লাইড করছে।বিরক্ত হলো নীরা।কি ভাবলো আর কি হলো,ধুর।

দ্বীপ নীরার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,”যত্তসব দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় বিচরণ করে তাইনা?”

বলেই নীরার হাতে গোলাপ দিয়ে চলে যায় ঘর থেকে।নীরা গোলাপ হাতে নিয়ে বলে,”রসকষহীন ক্যাডার সাহেব।বউকে একটা চুমু দিতে পারে না।আমিও বা ভুলি কি করে!ইনি তো আট বছর ধরে ভালোবাসার প্রকাশই করতে পারেনি।আবার দিবে চুমু!একবার পরীক্ষা শেষ হোক আমি যদি আপনার থেকে এক ডজন বাচ্চা না নিয়েছি তো আমার নাম মুনজেরিন নীরা না।”

বলেই নীরা গোলাপ ফুল নিয়ে খোঁপার এক কোনায় গুঁজে।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-১৪+১৫

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৪
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকাল সকাল ঘুম উঠে নীরা ফ্রেশ হয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে।তখন ঠিক সাতটা বাজে।শীতের সকাল।নীরার মতো মেয়ের এই সময় কম্বল জড়িয়ে ঘুমানোর সময়।কিন্তু সে আজ রান্নাঘরে তাও কাপতে কাপতে এসেছে।মিসেস সাবিনা,মিসেস শিউলি ও দীপান্বিতা যখন নীরাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে যায়।নীরা তাদের তাকানো দেখে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞাসা করে,”কি হয়েছে?”

মিসেস শিউলি শাড়ির উপর চাদরটা ঠিক করতে করতে বলে,”নাতবৌ তুমি তো এত সকালে উঠবার পাত্রী না।আজ কি দেইখা উঠলা?”

দাদী রসিকতা করে বললেও পিংকি হাসতে হাসতে বলে ওঠে,”তোমার নাতবৌয়ের দেখো রাতের ঘুম ঠিক মত হয়নি।যে ডোজ দেওয়া হয়েছিল তাকে।রাতে তো না খেয়েই ভাং ধরে ঘুমিয়েছিলো।তাই হয়তো এখন এসেছে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করতে।”

নীরা কাজের রমণীদের মত করে ওড়না কোমরে বেধে বলে,”আমার বর একটু পড়ে নিজের কাজে যাবে।বউ হয়ে তো আর ঘরে বসে থাকতে পারি না।ডাইনিদের নজর পরে যাবে যে।তাই আমার জামাইয়ের উপর দিয়ে নজরদোষ সরানোর পাঁয়তারা করতে শুরু করেছি।”

কেউ বুঝলো না কথার মানে।কিন্তু এইটুকু বুঝেছে যে পিংকিকে ইঙ্গিত করে বলেছে।দীপান্বিতা বলে ওঠে,”মানে?”

“একটু পর আমার উনি ঘুম থেকে উঠবেন।এমনিতেই আমি না খেয়ে ছিলাম বলে তিনিও না খেয়ে আছেন।বউ হয়ে কি জামাইকে এত কষ্ট দিতে পারি!তাই এখন আমি নিজে আমার বরের জন্য রান্না করবো।তারপর আমি আর আমার জামাই একসাথে সকালের খাবার এক ঘরে খাবো। আশা করি কারো বদ নজর পড়বে না আমাদের নব দম্পত্তির উপর?”

মিসেস শিউলি নীরার রান্নার কথা শুনে অবাক হলেও পিংকিকে খোঁচা মারাতে খুশি হয়েছেন।তিনি বলেন,”কিসের সমস্যা হইবো নাতবৌ!কোনো সমস্যা নাই।আরে বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকে তবেই না ভালোবাসা বাড়বে।তুমি রান্না করতে পারবা নাকি আমরা সাহায্য করবো?”

“আজ প্রথম দিন রুটি বানাবো।আমাকে একটু দেখিয়ে দেও।এরপর থেকে আর দেখাতে হবে না।আমাকে শিখিয়ে দিলে আমি শিখে যাই।”

সবাই মিলে নীরাকে সাহায্য করলো।সাহায্য বলতে মুখে মুখে বলে দেয় আর নীরা সেভাবে আটা মাখিয়ে রুটি বেলতে থাকে।সবজি সিদ্ধ করতে দেয় তারপর তেলে দিয়ে ভাজি করে।পরিমাণগুলো সব মিসেস সাবিনা বলে দেন।

সবকিছু পারফেক্ট হইলেও পারফেক্ট হয়না নীরার রুটির সেপগুলো।একটি এশিয়া মহাদেশের মানচিত্র তো আরেকটি আফ্রিকা মহাদেশের।একেক রুটি একেক রকম হয়েছে।

সবাই মিটমিট হাসতে থাকে রুটিগুলো দেখে।অভ্র ঘুম ঘুম চোখে মাত্র এসেছে।রুটিগুলো দেখে বলে ওঠে,”মামী তুমি ডিজাইন করে রুটি বানিয়েছো?কি মজা আজকে অন্য রুটি খাবো।”

বলেই হাত তালি দেয়।ছোট অভ্র কি আর বুঝে যে এগুলো না পারার কারণে হয়েছে।সে তো ভিন্ন সাজের কিছু দেখলে তাতেই খুশি হবে।

পিংকি নীরাকে পিঞ্চ মেরে অভ্রকে বলে,”নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা।তোমার মামী পারেনা তো করবে কি।এগুলো করতে যোগ্যতা থাকা লগে।”

ড্রয়িং রুমে মিস্টার সমুদ্র চা উপভোগ করছেন আর খবরের কাগজ দেখছেন।পিংকির শেষের কথাটি তার পছন্দ হয়নি।তিনি সচরাচর মেয়েদের কথায় বাম হাত ঢুকায় না।তবে আজ নীরার হয়ে প্রতিবাদ করে বলেন,”আজকালকার মেয়েরা ঘরের কাজ করতে চায় না।সেই তুলনায় আমার বউমা কিছু না পারলেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পারফেক্ট বউ হওয়ার।এটাই কি কম নয়?কাউকে সাহায্য করতে না পারো কিন্তু তাকে দুর্বল করতে উঠেপড়ে লাগাটা একটা অন্যায়।পাবলিকের সামনে তুমি আজ যাকে অপমান করবে ওই পুবলিক গুলো কিন্তু একসময় তোমার দিকেও আঙুল ঘুরিয়ে দিবে।এটা মাথায় রেখো।”

পিংকি আর কোনো প্রতিউত্তর করে না।খারাপ হলেও সে মিস্টার সমুদ্রকে মামার মত করেই ভালোবাসে।মায়ের মত সম্পত্তির আশায় লোভ দেখানো সম্পর্ক পিংকি করেনি।শুধু দ্বীপের প্রতি পিংকির এক আলাদা দুর্বলতা।

নীরার বানানো রুটিগুলো প্রথমদিকে খারাপ হলেও শেষের গুলো অনেক সুন্দর হয়েছে রাউন্ড আকারে হয়েছে।ভালো ভালো রুটিগুলো নীরা মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস শিউলিকে দিয়েছে।বাকিগুলো বাড়ির অন্যান্য সবাই খাবে।সবার খাবারের ব্যাবস্থা করে নীরা নিজের ও দ্বীপের জন্য খাবার সাজিয়ে নেয়।তারপর ঘরের দিকে যেতে থাকে।কিছু একটা ভেবে ঘরে যাওয়ার আগে পিংকির কাছে এসে পিংকির কানে কানে বলে,”পাঁচ মিনিটের একটি ডোজ দেখেই তুমি এত খুশি!আফসোস,বাকি ২৩ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের ডোজ গুলো দেখতে পাও না।যে আমাকে থাপ্পড় দিয়েছে সে কিন্তু তা উশুল করেও নিয়েছে।ঘরের বাইরের লোক তুমি তাই বাইরের দিকটি দেখতে পাবে।ভিতরের কাহিনী তো ভিতরের লোকগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ।”

কথাগুলো বলেই নীরা চোখ টিপ দিলো।তারপর প্রস্থান করলো ঘরের দিকে।

ঘরে এসে নীরা দেখতে দ্বীপ ঘুমিয়ে আছে।ঘুমের ঘোরেও কি না তার চোখে চশমা।দ্বীপের পাশের যে জায়গাটিতে নীরা ঘুমায় ওখানে মিনি ঘুমিয়ে আছে।নীরা দ্বীপকে ডাকতে লজ্জা পাচ্ছে।কিভাবে ডাকবে বুঝতে পারছে না।যতই এদিক ওদিক লড়াই করুক তার কি লজ্জা কম নাকি।ডান হাত দিয়ে দ্বীপের বাহুতে আলতোভাবে নাড়া দিলো নীরা। আস্তে আস্তে কাপা কাপা হাতে দ্বীপকে ঝাকানি দিচ্ছে আর বলছে,”ক্যাডার সাহেব উঠুন।সকাল হয়েছে তো।একটু পর আপনাকে কলেজে যেতে হবে।”

বার কয়েক ডাকার পর দ্বীপ চোখ খুলে।চোখ খুলেই নীরাকে দেখে অবাক হয়ে বলে,”কি হয়েছে?”

“তারাতারি ফ্রেশ হয়ে আসুন।আপনাকে কলেজে যেতে হবে না?”

অবাক হলেও দ্বীপ চলে গেলো ফ্রেশ হতে।তারপর ঘরে আসতেই নীরা বলে,”এই নিন আপনার আর আমার জন্য নাস্তা এনেছি।একসাথে খাবো আমরা।”

কি হচ্ছে না হচ্ছে সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে দ্বীপের।এক থাপ্পড়ে কি নীরা বর পাগল হয়ে গেলো নাকি!কিছু না বলে খাটে বসলো দ্বীপ।নীরা এক প্লেটে সবজি নিয়ে তাদের মাঝখানে রাখলো।তারপর বলে,”এই নিন আমরা এক প্লেটে করে দুজনে খাবো।”

এমনি শীতের ঠান্ডা তার উপর নীরার এই রোমান্টিক কথাবার্তা শুনে শুকনো কাশি উঠলো দ্বীপের।বেচারা দ্বীপ একসাথে এতকিছু মেনে নিতে পারছে না।নীরা সাথে সাথে কুসুম গরম করা পানি ফ্লাক্স থেকে বের করে দ্বীপকে দিয়ে বলে,”এই নিন পানি।আপনার ঠান্ডার সমস্যা আছে।তাই আমি গরম পানি এনেছি।”

দ্বীপ চুপ করে পানি পান করলো।পানি পান করার পর দ্বীপ নীরার বানানো রুটিগুলো দেখলো।রুটির সেপগুলো দেখে দ্বীপ মনে মনে হাসতে থাকে।তার বউ পারে না তাও চেষ্টা করে এনেছে।এখন সরাসরি কিছু বললে কষ্ট পাবে।তাই চুপ করে নীরার সাথে এক প্লেটে রুটি ও সবজি খেলো।রুটি খেতে খেতেই দ্বীপ বলে,”একদম পারফেক্ট হয়েছে।সবজির ঝাল মশলা ঠিক ঠিক এবং রুটিও খেতে মজা হয়েছে।কিভাবে করলে?”

“আমি তো শুধু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সব করেছি।পরিমাণগুলো সব মামনি বলে দিয়েছিলো।”

বিয়ের পর থেকে নীরা দ্বীপের মা মিসেস সাবিনাকে মামনি বলে ডাকে। দ্বীপ খুশি হলো নীরা তার পরিবারকে আপন করে নিয়েছে।অবশ্য দ্বীপ জানতো নীরা এমনটি করবে।

খাওয়া দাওয়ার পর দ্বীপ আলমারি থেকে শার্ট ও ব্লেজার বের করতে যাবে ঠিক তখনই নীরা এসে তাকে একটি ব্লেজার পছন্দ করে বের করে দিয়ে বলে,”আজ থেকে আমার পছন্দ করে দেওয়া ড্রেস পড়েই যাবেন।”

দ্বীপ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝিয়ে দেয়। দ্বীপ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে নীরা বলে ওঠে,”আমাকে কোন কোন চেপটার মুখস্ত করতে হবে দেখিয়ে দিবেন না?”

এবার আর দ্বীপ থমকে থাকতে পারলো না।নীরার কাছে এসে নীরার কপালে হাত দিয়ে বলে,”থাপ্পড় খেয়ে কি জ্বর টর বাদিয়েছো?কি সব উল্টা উল্টা কথা বলছো!”

“ইশ থাপ্পড়ের পর হয়ে ঔষধ দিয়েছিলেন ওটাতে ঠিক হয়েছি।”মনে মনে কথাটি বলে সরাসরি বলে,”থাপ্পড়ের সাথে মনে হয় মধু মিক্সড করা ছিলো।তাই তো এখন থেকে বরের সেবা করা শুরু করছি। আর আমার স্বামী যে কি না বিসিএস ক্যাডার আবার প্রফেসর তার বউকে কি অমনোযোগী হলে মানায়?তাই আমিও আজ থেকে পড়াশোনাতে মনোযোগ হবো।”

খুশি হলো দ্বীপ।নীরার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,”পাগলী।”

তারপর নীরাকে সবকিছু দেখিয়ে বের হয় ঘর থেকে।ঘর থেকে বের হতেই নীরা আবার পিছন থেকে ডাক দেয় দ্বীপকে।বলে,”দাড়ান ক্যাডার সাহেব।”

ড্রয়িং রুমে মিস্টার সমুদ্র বাদে সবাই ছিলেন।মিস্টার সমুদ্র কাজে চলে গেছেন।নীরার ডাক শুনে সবাই তাকালো নীরা ও দ্বীপের দিকে।নীরা দ্বীপের কাছে এসে বলে,”টাই না বেধেই চলে যাচ্ছেন!আপনাকে এই লুকে টাই ছাড়া মানায় না।”

বলেই দ্বীপের কাছে এসে টাই বেঁধে দেয়।পিংকির দিকে তাকিয়ে নীরা শয়তানি হাসি দেয়।মূলত পিংকিকে দেখাতেই নীরা এই কাজ করেছে।

মিসেস শিউলি দুষ্টুমি করে বলেন,”কি আর করবে বলো নাতবৌ!আমার নাতি তো রসকষহীন মানুষ।বিদ্যা ছাড়া কিছু বুঝেই না।একদিনে বউয়ের এত সোহাগ ঠিক মাথায় সামলাতে পারছে না।তাই দু একটা ভুল করতেছে।”

তারপর দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মিসেস শিউলি বলেন,”দেইখো,ক্লাসে পড়ানোর সময় বউয়ের সেবাযত্ন গুলো মাথায় আইনো না।তাহলে আবার সব গুলায় ফেলবা।বউ তো আর কলেজে থাকবে না তোমাকে সব সংশোধন করে দেওয়ার জন্য।”

সবাই একসাথে হেসে ওঠে। দ্বীপ গলা খাকারি দিয়ে চলে যায়।

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৫
#ইশরাত_জাহান
🦋
দ্বীপ যাওয়ার পর নীরা মিসেস সাবিনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমার উনি এখন আমাকে পড়তে বলে গেছে।দুপুরের রান্না যখন করবে আমাকে একটু ডাক দিও আমিও রান্না করবো তোমাদের সাথে।”

মিসেস সাবিনা খুশি হয়ে বলেন,”থাক মা তোমাকে আপাতত এত কষ্ট করতে হবে না।তোমার উনি যা যা বলেছে তুমি তাই কর।তোমার আর কয়েকমাস পড়েই পরীক্ষা।ভালোভাবে পড়াশোনা করে তোমার ওনার মনের মত করে রেজাল্ট কর।”

নীরা লজ্জা পেয়ে রুমে যেতে নিলে পিংকি আবারও খোঁচা মেরে বলে,”ছোট ইচড়ে পাকা মেয়েকে বিয়ে করে আনলে এমনই হবে।মামী আজকে আমি তোমাকে সাহায্য করবো,চলো।”

নীরা কিছু বলতে যাবে দীপান্বিতা ইশারা করে না বুঝিয়ে দেয়।নীরার কানের কাছে এসে বলে,”ঘরের বউদের এত তর্ক করতে নেই।কিছু সময় চুপ থেকেও প্রতিবাদ করা যায়।তুমি যেয়ে পড়তে বসো আমরা দেখছি।”

দীপান্বিতার কথার প্রেক্ষিতে নীরা ঘরে এসে পড়তে বসে।প্রায় ঘণ্টাখানেক পর দ্বীপের কল আসে নীরার ফোনে।নীরা কল রিসিভ করলে দ্বীপ বলে,”ঠিকভাবে পড়াশোনা করছো তো!নাকি এখন পারফেক্ট বউ হওয়ার জন্য দুপুরের রান্না করতে গেছো?

“বাবাহ,ক্যাডার সাহেব তো তার বউয়ের প্রতি অনেক যত্নশীল।বউকে রান্না বান্না করতেই দেয় না।এত ভালোবাসা বউয়ের প্রতি?”

“ভালোবাসার পরিমাপ কি আমি বাসায় এসে দেখিয়ে দিবো?”

লজ্জা পেয়ে নীরা বলে,”আমি সব পড়েছি। আর কিছু কিছু চেপটার বুঝিনি।ওগুলো আপনি এসে বুঝিয়ে দিবেন।”

“আচ্ছা,তাহলে রাখছি আমার নেক্সট ক্লাস নেওয়ার সময় হয়ে এসেছে।”

“আচ্ছা,বাই।”

কথা বলা শেষ করে দ্বীপ ক্লাসে চলে যায় আর নীরা দ্বীপের কথা ভাবতে থাকে।হঠাৎ নীরার মনে পড়ে দ্বীপের ডায়েরির কথা।সাথে সাথে বুকশেলফ এর বইগুলোর পিছনে লুকানো ডায়েরি বের করে পড়তে থাকে।

ডায়েরির সূচনা পৃষ্ঠাতে দ্বীপ নীরাকে নিয়ে অনুভূতির কথা কবিতা আকারে লিখেছিলো। আর বাকি পৃষ্ঠাতে লিখেছে নীরাকে কিভাবে দেখলো নীরার প্রতি কিভাবে ভালোবাসার জন্ম নিলো এগুলো।

প্রথম পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নীরা পড়লো,
আজ থেকে আট বছর আগে

‘আমরা এসেছিলাম সপরিবারে।আমি আর বাবা ঢাকাতেই থাকতাম।মা আর দীপান্বিতা ছিলেন গ্রামের বাড়িতে।ঢাকার বাড়ি কমপ্লিট হওয়ার পর আমরা জিনিস পত্র নিয়ে যেদিন প্রথম এই বাড়িতে আসি দেখতে পাই~এক দশ বছর বয়সী মেয়ে হাতে ব্যাট নিয়ে তারা করতে থাকে এক টাকলা লোককে।মেয়েটির মুখে একটাই কথা,”বুইড়া ব্যাটা কত বড় সাহস আমার গাছের ফুল চুরি করে।তাও আবার গাছ থেকে ফুল নিয়ে আরেক বাসার মহিলাকে দেয়। তোরে তো আমি আজ শেষ করছি।ঘরে মেয়ে বউ থুয়ে অন্যের বউকে ফুল দেওয়া তাও আবার আমার লাগানো গাছ থেকে।লুচ্চা,টাকলা,বুইড়া দ্বারা বলছি।”

লোকটিও ভয়তে ভয়তে দৌড়াতে থাকে।অবশেষে না পেরে লোকটি ওখানে বসে হাফাতে থাকে।সেই সময় মেয়েটি এসে হঠাৎই চোখের পলকে তার কপালে ব্যাট দিয়ে দেয় এক বারি।লোকটির টাক মাথায় বসেছিলো আলুর চাক। যার ফলে এলাকার লোকজন সবাই এক হয়।মেয়েটির মা এসে মেয়েটির কান ধরে দেয় এক টান।জিজ্ঞাসা করেন,”কেনো করেছো তুমি এমন কাজ?”

মেয়েটি লোকটির বউ ও মেয়ে সহ পুরো এলাকার সামনে বলে,”দুই দুইটা অন্যায় করেছে।এক ঘরের মেয়ে বউ বাদ দিয়ে অন্যের বউকে ফুল দেয়,দুই সেই ফুল আবার আমার গাছ থেকে ছিঁড়ে নেয়।”

দুই নম্বর অন্যায়ের কথা মানুষ পাত্তা না দিলেও এক নম্বর অন্যায়ের জন্য টাক মাথায় চাক বসানো লোকটির কাছে ব্যাট নিয়ে হাজির হলো তার বউ।কোমরে শাড়ি গুঁজে হাতে ব্যাট নিয়ে এবার সেই বৃহৎ করে দিলো ক্ষুদ্র আলুর চাক।’

নীরা এইটুকু পড়ে হাহা করে হাসতে থাকে।নীরা বুঝতে পেরেছে এটা তাকে নিয়ে বলছে।ছোটবেলায় এমন দুষ্টুমি ও অন্যায়ের প্রতিবাদ নীরা সবসময় করে।নীরাকে মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন বড় করেছেন সমাজের সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে।আশেপাশে কোন কোন মানুষ ভালো কোন কোন মানুষ খারাপ এগুলো সবকিছু কিভাবে বুঝতে হয় এটা নীরাকে ছোট বেলাতেই শেখানো ছিলো।একজন লোক মেয়েদের সাথে কিভাবে কথা বলে কোনটা কোন ইঙ্গিতে বলে এই সবকিছু মিসেস নাজনীন নীরাকে শিখিয়ে দিতেন।সমাজে যে ভালো মানুষের রূপের আড়ালেও নরপশু থাকে এটা উপলব্ধি না করলে মেয়েরা সচেতন হতে পারবে না।তাই প্রত্যেক পরিবারের উচিত মেয়েদের বয়স হওয়ার আগেই তাদের নিজেদের সচেতনতার দিকগুলো বুঝিয়ে দেওয়া।

ওপর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নীরা পড়ে,
আজ প্রাইভেট পড়াতে যাব ওই সময় দেখলাম মেয়েটি রাস্তার এক ছেলেকে ধরে মারছে।বুঝতে পারলাম না কেনো এমন করছে।আহত অবস্থায় ছেলেটিকে দেখলে মায়া লাগে।মেয়েটি একা না সাথে তার বান্ধবীও মারতে থাকে ছেলেটিকে।আশেপাশে থেকে লোক জড়ো হয়।রাস্তার পাশের বাড়ি থেকে একজন লোক এসে জিজ্ঞাসা করে,”তুমি এভাবে নিষ্ঠুরভাবে ওকে মারছো কেনো?গরীব ঘরের ছেলে দিন আনে দিন খায়।তাকে কেউ এভাবে মারে?”

মেয়েটি রেগে বলে ওঠে,”গরীব ঘরের ছেলে চুরি করলে দিন এনে দিন খাবে না তো কি করবে?”

লোকটি বুঝতে পারে না কথাগুলো।তাই বলে,”মানে?”

“মানে এই যে এই নিরীহ গরীব দিন এনে দিন খাওয়া ছেলেটি আপনার বাড়ির জানালা থেকে আইফোন চুরি করেছে।আপনি যদি বলেন তাহলে আমি এই চোরকে না মেরে আপনার ঘর থেকে আনা দিন তাকে খাওয়ার সুযোগ করে দেই!”

মেয়েটির কথা শেষ হতে না হতেই এবার লোকটি ছুটতে লাগলো ওই চোরের পিছনে।এসব দৃশ্য দেখে যেমন মুগ্ধ হতাম ঠিক তেমন হাসতেও থাকতাম।একটি মেয়ে যেমন প্রতিবাদ করে তেমন হাসাতেও পারে।তবে তখনও আমি মেয়েটির প্রতি ভালোবাসা ফিল করতে পারিনি।শুধু একটু ভালোলাগা কাজ করেছিলো।

মাঝখানের কিছু পৃষ্ঠা নীরাকে নিয়ে এমন আরও কিছু লেখা ছিলো।এগুলো পড়ে নীরা নিজেই হাসতে থাকে।কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নীরা পড়ে,
আজ মেয়েটির ভাই জার্মানে চলে যাচ্ছে।দেখতে দেখতে যে কিভাবে তিনটি বছর হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না।মেয়েটির বাঁদরামি একটু কমেছে কিন্তু প্রতিবাদ সে সবসময়ই করে।

রাতের আধারে আমি ব্যালকনিতে বসে পড়ছিলাম।ঠিক সেই সময় দেখি মেয়েটি চাঁদের সামনে দাড়িয়ে কান্না করতে থাকে।সারাদিনে একবারও মেয়েটি কান্না করেনি।কিন্তু রাতের বেলা চাঁদকে সাক্ষী রেখে সে ভাইয়ের জন্য কান্না করতে থাকে।মনের ভিতর তখন একটি কথাই ভেসে আসে,

“রাতের আধারে চন্দ্রকে করো তুমি সাক্ষী,
তোমাকে হইতে দেখেছি আমি উড়ন্ত পাখি।

চন্দ্রকে দেখাও তোমার চোখের পানি,
গোপনে খেলতে থাকি আমি তোমার সাথে লুকোচুরি।

চন্দ্রের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে এক পাখি,
তখনই আমার হৃদয়ে তোমার নাম লিখেছি আমি আমার চন্দ্রপাখি।

তুমি গোপনে রাখিয়াছো তোমার অশ্রুকণা,
আমি তো তাহাতেই হইয়াছি মন ভোলা।

ছুতে না পেরেও গোপনে দেখি তোমারে অল্প সল্প,
তাই তো দিয়েছি আমি আমার প্রেমের নাম লুকোচুরি গল্প।”

‘লুকোচুরি গল্প’ কথাটি নীরা পড়ছে না বরং কথাটি নীরার কানে বারবার বাজতে থাকে।দ্বীপ তাকে গোপনে এত ভালোবাসে যে যেদিন প্রথম কান্না করতে দেখে সেদিনই তার জন্য মনে মনে কবিতা লিখে।কবিতার নিচে লেখা,’ চন্দ্র পাখির চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারছি না।মন চায় এখনই ছুটে যাই তার কাছে।কিন্তু না সাহস করে উঠতে পারিনি।এখনও আমি বেকার আর চন্দ্র পাখির সাথে আমি টাইম পাস করতে চাই না।আমি চাই চন্দ্র পাখি আমার কাছে হালালভাবে আসুক।’

এরপর আরো কিছু পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নীরা পড়ে,
আজ আমি চাকরি পেয়েছি। চন্দ্র পাখি আসার আগে আমার জীবনের উদ্দেশ্য ছিলো একজন ভালো শিক্ষক হওয়া।এই শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা আমারই কলেজের শিক্ষক থেকে এসেছে।মানুষ তো মানুষকে দেখেই নতুন কিছু হওয়ার ইচ্ছা জাগ্রত করে।ঠিক তেমন আমিও করলাম।ভাগ্য আমাকে আর কোনো জায়গায় না আমার চন্দ্র পাখির কলেজেই সুযোগ করে দিলো।চন্দ্র পাখিদের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক অবসর প্রাপ্ত হওয়ায় আমাকে এখন ওই ডিপার্টমেন্টে যেতে হয়।ক্লাসে পড়ানোর সময় আমি সিরিয়াস থাকতাম।কিন্তু চন্দ্র পাখি থাকতো অমনোযোগী।আমি চন্দ্র পাখির সবকিছু সহ্য করতে পারলেও এই একটি বিষয় সহ্য করতে পারতাম না।পড়াশোনাতে এমন অবহেলা আমার আগা গোড়ায় অপছন্দের দিক।ক্লাসের ভিতর একজন এমন হলে তাকে আশকারা দিলে বাকিরা পেয়ে বসবে।তাই চন্দ্র পাখিকে পানিশমেন্ট দিতে বাধ্য হতাম।

চন্দ্র পাখি পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়াতে আন্টির যেনো চিন্তা বেড়ে গেলো।এমনি একবার এসএসসি ফেইল করে।তখন আমারও রাগ হয় খুব।কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলি না।আন্টির রিকোয়েস্টে আমি পড়াতে থাকি চন্দ্র পাখিকে।আমার ইচ্ছা ছিলো না পড়ানোর।কারণ এমনিতেই আমি তার কলেজের শিক্ষক এখন আবার হয়ে গেলাম প্রাইভেট শিক্ষক।কিন্তু আমার মা এবং আণ্টি(মিসেস নাজনীন)এর অনুরোধে না করতে পারি না।

টেনশন যেনো মাথায় উঠে ঘুরপাক খাচ্ছে।যাকে নিয়ে টানা সাত বছর করেছি লুকোচুরি প্রেমের অনুভূতি,আজ সেই হতে গেলো আমার দুই দিকের ছাত্রী।

এইটুকু পড়ে নীরার যেনো হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা শুরু হলো।তারপর শেষের দিকে এসেছে।সেখানে লেখা,
আজকে পিংকি গ্রামে যাবে।এতদিন পড়াশোনার নাম করে খুব জ্বালিয়েছে।যেহেতু ও পড়াশোনার জন্য আমার কাছে আসতো তাই না করতে পারতাম না।বাধ্য হয়ে পড়াতাম পিংকিকেও।পিংকি গ্রামের যাওয়ার আগে ফুফি ও পিংকির কিছু কথা আমি আড়ালে শুনতে পাই।

পিংকি ফুফিকে বলে,”দ্বীপ বেইবের জব তো হয়ে গেছে। এখন মামাকে বলে বিয়ের ব্যাপারটা ফাইনাল করে দেও।আমি যে দ্বীপ বেবীর জন্য অপেক্ষা করতে পারছি না।”

“হ্যা হ্যা খুব তাড়াতাড়ি বলবো। তোর চাচাতো ভাইয়ের মেয়ের আকীকা শেষ করে এসে তোর আর দ্বীপের বিয়ের ব্যাবস্থা করবো।তুই দ্বীপকে পাবি আর আমি পাবো সম্পত্তি।”

এগুলো শুনেও আমি তখন কোনো প্রতিবাদ করিনি।শুধু পিংকি ও ফুফির যাওয়ার অপেক্ষা করেছি।ওরা চলে যাওয়ার পর পরই আমি মাকে আমার মনের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করি।সাথে পিংকি ও ফুফির প্ল্যানগুলো।এসবকিছু শুনে মা বাবা ও দীপান্বিতা আমার আর চন্দ্রপাখির বিয়ে ঠিক করে।আমি বুঝতে পারিনি আণ্টি এত সহজেই রাজি হবেন।বিয়ের সময় চন্দ্র পাখি আমাকে অনেকভাবে বুঝিয়ে দিতো যে সে বিয়েটা করতে চায় না।কিন্তু আমার জীবনে চন্দ্র পাখিকে নিয়ে অনেক আগেই বাসা বেধে রেখেছি।তাই যত পারতাম চন্দ্র পাখিকে এড়িয়ে যেতাম।এমন যদি হতো আমার চন্দ্র পাখি অন্য কারোর প্রতি মত্ত আমি নিজে সরে আসতাম।কিন্তু চন্দ্র পাখি তো পাগলামির জন্য বিয়েটা ভাঙতে চায়।সেখানে আমি কি করে হতে দেই আমার চন্দ্র পাখিকে আমার থেকে দূরে?দিন শেষে ভালোবাসার জালেই হার মানতে হয়েছে আমাকে।আমি ভালোবাসি খুব ভালোবাসি আমার চন্দ্র পাখিকে।শিক্ষক হয়েছি আমি এই দুই বছর ধরে কিন্তু ভালো তো বেসেছি আমি টানা আট বছর ধরে।

বিয়ের সময় গায়ে হলুদের দিন আমার ঘরে কেয়া আসে।হলুদের কিছু জিনিস নিতে।ভুল বশত আমি ডায়েরিটি টেবিলে রেখে যাই।কেয়া পড়ে নেয় আমার এই ডায়েরি।তখন থেকে সেও আমাকে সাহায্য করতে থাকে আমার আর চন্দ্র পাখির বিয়ের জন্য।এই বিয়েতে যত বাধা বিপত্তি পেরিয়েছি সব আমার বুদ্ধিতেই হয়েছে।কিন্তু আমার চন্দ্র পাখি জানতেই পারবে না তার অগোচরে তাকে কেউ ভালোবাসে।আমার এই লুকোচুরি প্রেমে থেকে যাবে আমার লুকোচুরি গল্প।’

এরপর আর কিছু লেখা নেই।হয়তো ব্যাস্ততার জন্য বিয়ের পর লিখতে পারেনি দ্বীপ।ডায়েরি বন্ধ করে নীরা বলে,”আপনার এই লুকোচুরি গল্প সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছে আপনার চন্দ্র পাখি। মাই ডিয়ার ক্যাডার সাহেব।”

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-১২+১৩

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১২
#ইশরাত_জাহান
🦋
সবাইকে জামা কাপড় দিয়ে দ্বীপ ও নীরা ঘরে চলে আসে।নীরা মাথার হিজাব খুলতে থাকে।দ্বীপ হাত ঘড়ি খুলে গলার টাই হালকা লুজ করতে করতে বলে,”আর ইউ জেলাস?”

হাত আটকে যায় নীরার।দ্বীপের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,”কেনো?জেলাস হবো কেনো?”

“পিংকি আমার আশেপাশে আসলেই তুমি যেভাবে প্রতিবাদ করো মনে তো তাই হচ্ছে।”

“আপনার বুঝি ভালো লাগে ওই পিংকি আপনার গায়ে গায়ে চললে?”

“কথা সেটা না,কথা হলো তুমি কেমন ফিল করো?”

“আমি আবার কেমন ফিল করবো!কোনো ফিলই করি না।”

বলেই হিজাব খুলে আলমারি থেকে বাসায় পরার জামা নিতে থাকে।দ্বীপ আবারও জিজ্ঞাসা করে,”তাহলে প্রতিবাদ করো কেনো?”

নীরা জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের ভিতরে যায়।ওয়াশরুমের দরজা দিতে যেয়েও দরজা হালকা ফাঁকা রেখে বলে,”আমার কোনো জিনিস যখন আমার হয়েই পার্মানেন্ট থাকে আমি তা অন্য কাউকে ভাগ করি না।আপনি এখন আমার হয়ে গেছেন ক্যাডার সাহেব।আপনার প্রতি অন্য কোনো নারী আসক্ত হলে তাকে তো একটু ভুক্তে হবে।”

বলেই দরজা লাগিয়ে দেয় নীরা।দ্বীপ স্মিত হাসে।বিড়বিড় করে বলে,”চন্দ্রপাখি তার ক্যাডার সাহেবের প্রতি আসক্ত হচ্ছে।এটা সে বলবে না কিন্তু অন্য নারীকেও আসক্ত হতে দিবে না।নারীপ্রেম বুঝি একেই বলে!”

আজ বিকালে নীরা দীপান্বিতা ও মিসেস সাবিনা মিলে নাস্তা তৈরি করতে থাকে।নীরাকে আজকে ছুটি দিয়েছে দ্বীপ।বিয়ের পরেরদিন থেকেই তো বই পড়া শুরু করেছে সে।আজকের দিন রেস্ট করার সুযোগ পেলো নীরা।সন্ধায় নাস্তা বানিয়ে সবাই মিলে খাবে।সবাই কাজ করছে আর নীরা উকি দিয়ে দিয়ে দেখছে।নীরা রান্না বান্না পারে না।তাই তাকে কেউ রান্না করতেও দিচ্ছে না।

পিংকি নীরার এই দুর্বলতার সুযোগটি নিয়ে নিলো।সাথে সাথে বলে,”বাড়ির বউ হয়ে কি না রান্না পারে না!কেমন মেয়ে বিয়ে দিয়ে এনেছো তোমরা?”

দীপান্বিতা বলে ওঠে,”আমাদের তো সমস্যা নেই।তোর এত কেনো সমস্যা?”

“আমার কোনো সমস্যা নেই।দেখি আমি একটু রান্না করি।দ্বীপ বেইবী তো পাস্তা খেতে খুব ভালোবাসে।আমি রান্না করবো ওর জন্য।বউ তো রান্না পারে না আমি নাহয় করে দেই রান্না।”
পিংকি দ্বীপকে সবসময় এই বেইবী বলে ডাকতো।এখনও তাই বলে।

রাগে দুঃখে অপমানে জেলাসিতে সবকিছুতেই ফেটে পরলো নীরা।সাথে সাথে বলে,”আজকের পাস্তা আমি রান্না করবো।”

পিংকি হো হো করে হেসে দিয়ে বলে,”যে মেয়ে মুখে লিপস্টিক মেকআপ দেওয়া ছাড়া কোনো কাজ পারেনা সে মেয়ে আবার করবে রান্না।ওটা তোমার কাজ নয়।তুমি ঘর সংসার সামলাতে পারবে না।”

“আমি বলছি আমি রান্না করবো মানে করবো।এখন যদি আমাকে রান্না করতে না দেও তো..”

বলেই আশেপাশে তাকিয়ে করাই থেকে গরম খুন্তি হাতে নিয়ে বলে,”এই গরম খুন্তি দিয়ে তোমার মাথা ফাটাবো বলে দিলাম।ভালোয় ভালোয় বলছি আমার ক্যাডার সাহেবের জন্য রান্না করবি না তুই ডাইনি।ওনার জন্য এই নীরা আছে।”

কে আর কি বলবে!নীরার রণচন্ডি রূপ দেখে সবাই হা হয়ে আছে।দ্বীপ এখন একটু বাইরে গেছে।তাদের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট দেখতে। অভ্র হাত তালি দিয়ে বলে,”ঠিক হয়েছে,ঠিক হয়েছে।”

পিংকি ভয়তে দেয় দৌড়।এই মেয়ের পুরনো কিছু রেকর্ড আছে যা পিংকি খুব ভালো করেই জানে।শুধু শুধু বাঘিনীকে খেপিয়ে লাভ নেই।

পিংকি চলে যেতেই নীরা ইউটিউব দেখে পাস্তা রান্না শুরু করে। পাস্তা রান্না শেষে সবকিছু পরিষ্কার করে নিজের ঘরে যায়।দীপান্বিতা ও মিসেস সাবিনাও ঘরে যায় ফ্রেশ হবে বলে।এই সুযোগে পিংকি আসে রান্না ঘরে।এসেই পাস্তায় প্রচুর লবণ ও ঝাল মিশিয়ে দেয়।তারপর চলে যায় ঘরে।

নীরার ফোন ড্রয়িং রুমে ছিলো।অভ্র তখন ড্রয়িং রুমে আসে টিভি দেখবে তাই।ঠিক তখনই নীরার কল আসে।নীরব দেয় কল।অভ্র প্রথম কল আসাতে রিসিভ করে না।কিন্তু দুই তিনবার কল আসাতে রিসিভ করে বলে,”হেলো।”

নীরব বুঝতে পারে এটা অভ্র।পিচ্ছি কণ্ঠ আর এখন তো নীরা দ্বীপের বউ।দ্বীপের বাসায় অভ্র থাকবে এটা স্বাভাবিক।কিন্তু এতদিন কেনো আছে তাই বুঝতে পারছে না।দীপান্বিতা কি শশুর বাড়িতে যায় না?এটা এখন তাদের ব্যাপার।ভেবেই নীরব বলে,”আমি নীরব। নীরার ভাই হই।নীরাকে দেওয়া যাবে এখন?”

“মামী তো ঘরে গেছে ফ্রেশ হতে আর মামু একটু পরে আসবে।”

ঠিক সেই সময় দীপান্বিতা এসে বলে,”কার সাথে বলছো বাবাই?”

“মামীর ভাইয়া ফোন দিয়েছে আম্মু।এই নেও কথা বলো।বলেই ফোনটি দীপান্বিতার কানে দিলো অভ্র।”

আম্মু বলে সন্মোধন শুনে নীরবের মনের গহীনে কাপন ধরলো।খারাপ লাগছে তার।কিভাবে পারলো তার জন্য অপেক্ষা না করে এভাবে বিয়ে করে নিতে?দীপান্বিতা ফোন কানে নিয়ে নরম সুরে বলে,”হেলো।”

কি সুন্দর মধুর কণ্ঠ বাজতে থাকে নীরবের কানে।দীর্ঘ সময় পর আজ তারা একসাথে কথা বলতে পারছে।কিন্তু এখন তো আর আগের সম্পর্ক নেই।নীরব কাটকাট গলায় বলে ওঠে,”বোনকে বলবেন ফ্রী হলে যেনো কল দেয়।”

বলেই কল কেটে দিলো।এতগুলো বছর পর প্রিয় ব্যাক্তির কণ্ঠ শুনে শান্তি পেলেও কথার সুরে তিক্ততা অনুভব করলো দীপান্বিতা।পাল্টে গেছে তার খাদ্য বিশেষজ্ঞ পুরুষটি।নীরবের ছোট থেকে একজন নিউট্রিশন স্পেশালিস্ট হওয়ার ইচ্ছা।তাই দীপান্বিতা নীরবকে খাদ্য বিশেষজ্ঞ সাহেব বলে ডাকতো।

দ্বীপ ও মিস্টার সমুদ্র একসাথে চলে এসেছেন।সবাই মিলে নাস্তা সাজাতে থাকে।নীরা বাটিতে বাটিতে সবার জন্য পাস্তা দেয়।পিংকি মনে মনে অনেক খুশি। দ্বীপ ঝাল সহ্য করতে পারে না।নীরার বানানো খাবার খেয়ে দ্বীপ শিওর নীরাকে বকাঝকা করবে।

সবাই একসাথে পাস্তার খেতে থাকে।প্রথম এক চামচ খেয়ে সবাই নীরার দিকে তাকায়।পিংকি খুব খুশি এবার বোম ব্লাস্ট হবে।পিংকির আসায় পানি ঢেলে অভ্র বলে,”মামী খুব মজা।”

মিসেস সাবিনা বলেন,”হ্যা সবকিছুই ঠিকঠাক আছে শুধু সস একটু কম দিলে হতো।তাও প্রথম রান্না হিসেবে তুমি অনেক ভালো করেছো।”

সবাই নীরার প্রশংসা করতে থাকে।পিংকি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে এদের দিকে।নীরা পিংকির দিকে তাকিয়ে বলে,”কি হয়েছে!কিছু বুঝতে পারছো না তাইতো?”

সবাই তাকায় নীরা ও পিংকির দিকে।পিংকি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে।নীরা আবার বলে,”তুমি আমার ব্যাপারে শুধু মেকআপ করার অভিজ্ঞতা টাই জানলে!এটা জানলে না যে আমি সিনেমা প্রেমী।জীবনে কত নাটক সিনেমা দেখেছিলাম যেখানে এক ডাইনি এসে নায়িকার সমস্ত খাবার নষ্ট করে দেয়।তুমি হলে আমার জীবনের সেই ডাইনি।আমি কি আর জেনে শুনে বকা খাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারি?তাই আগেভাগে খাবার সরিয়ে রাখি। আর তোমার বাটিতে যেই পাস্তা ওটা তোমার হাতের ঝাল মশলা যুক্ত।অভ্র দেখে নিয়েছে তুমি কি কি করেছিলে।এবার ভদ্র মেয়ের মতো নিজের হাতের টেস্টি পাস্তা খেয়ে নেও।”

“আমি পাস্তা খাবো না।অন্য খাবার খাবো।তোমার মন চাইলে তুমি খাও।কি প্রমাণ আছে যে আমি এটাতে ঝাল লবণ দিয়েছি?”

“প্রমাণ অভ্র নিজে।ছোট বাচ্চা তো আর মিথ্যে বলবে না।খেয়ে নেও আমার ডাইনি ননদিনী।এটা এখন তোমাকেই খেতে হবে।”

বলেই নীরা পাস্তার বাটি নিয়ে পিংকির কাছে আসতে থাকে।পিংকি এবার চেয়ার থেকে উঠে দেয় ভো দৌড়।নীরা কি কম নাকি?সেও পিংকির পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,”একবার যখন আমার খাবার নষ্ট করতে চেয়েছিলি তার টেস্ট তো তোকে নিতেই হবে ডাইনি ননদিনী।পালাবে কোথায় আমি নীরা যখন একবার লেগেছি তোমার পিছনে তখন তোমার রেহাই নেই।আমার বরের সাথে সুপার গ্লুর মতো লেগে থাকা তাই না?এবার দেখ সুপার গ্লুর উপরে কি কি আছে।”

বলেই সারা রুম জুড়ে তারা করতে থাকে পিংকিকে।অবশেষে পিংকির দৌড়ানোর সাথে উড়ন্ত ওড়না ধরে ফেলে নীরা।তারপর সোফায় পিংকিকে শুইয়ে দিয়ে গাল টিপে হা করিয়ে পিংকির গালে ঢুকিয়ে দেয় পাস্তা।পিংকি বেচারি কষ্ট করে হলেও গিলতে থাকে।টেবিলে বসা দ্বীপ মাথায় হাত দিয়ে এদের কর্মকাণ্ড দেখে।

দীপান্বিতা দ্বীপকে আস্তে আস্তে বলে,”কে বলবে এই মেয়ে বিয়ের দিন পালিয়েছিলো?বিয়ে করবে না বলা মেয়েটি কি না এখন সেই স্বামীর ভক্ত।”

মনে মনে খুশি হয় দ্বীপ।নীরা একদম ঠিক কাজ করেছে।পিংকি যেমন তাদের সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে ঢুকে পড়ছে এতে ওর এই শাস্তির দরকার।দ্বীপ নিজেও সহ্য করতে পারে না পিংকিকে।খুব তাড়াতাড়ি পিংকির জন্য ছেলে দেখা শুরু করবে।

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৩
#ইশরাত_জাহান
🦋
নাস্তা শেষ করে নীরা ঘরে আসে।দ্বীপ ও মিস্টার সমুদ্র মিটিং করছেন নিজেদের ব্যাবসা নিয়ে।দ্বীপ বাবার ব্যাবসায় যোগ না দিলেও বিভিন্ন পরামর্শে বাবার সাথে থাকে।

নীরা ঘরে এসে ঘরটিকে ভালোভাবে পরখ করে।দ্বীপের ঘরের পাশে একটি বড় শেলফ আছে যেখানে ভিন্ন ভিন্ন গল্পের বইতে ভরা।বিসিএস এর বইগুলো এখনও সাজানো আছে।নীরা শেলফের কাছে এসে বইগুলো দেখতে থাকে।নীরা নিজেও টুকটাক গল্প পড়ে।শেলফের ভিতর ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে একটি কালো মোটা ডায়েরি দেখতে পেলো দ্বীপ।ডায়েরিটি দেখে নীরার মনে আতঙ্ক বিরাজ করলো।সাথে সাথে ডায়েরিটি হাতে নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠা বের করলো।অনেক পুরনো লেখা এখানে।খুব সুন্দর করে প্রথম পৃষ্টায় লেখা,
চন্দ্রের সাথে করিতে দেখিলাম তোমাকে আলিঙ্গন।
উড়ন্ত পাখি যখন চন্দ্রকে সাক্ষী রেখে প্রকাশ করে মনের অনুভূতি।
সেই চিত্র দেখিয়া তোমাকে ডাকিলাম ‘আমার চন্দ্রপাখি’।
অশ্রু ভরা নয়নে চন্দ্রের দিকে ফিরে আছে আমার সেই কিশোরী কন্যার অনুভূতি।
আজই উপলব্ধি করেছি আমি,
ভালোবাসি ভালোবাসি তোমায় আমার চন্দ্রপাখি।”

লেখাটুকু পড়ে নীরা বুঝলো দ্বীপ কাউকে ভালোবাসে এবং তাকেই সে চন্দ্রপাখি বলে ডাকে।কিউরিসিটি নিয়ে বাকি পৃষ্ঠা পড়তে যাবে ঠিক তখনই দীপান্বিতা এসে বলে,”আমার লিটিল ভাবী আসবো কি?”

নীরা ডায়েরির পাতা বন্ধ করে শেলফে রেখে দেয়।তারপর দীপান্বিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার সুইট কিউট ননদিনী আসো।”

দীপান্বিতা ঘরে ঢুকে নীরার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,”তোমার কল এসেছিলো। আর ফোন সবসময় এদিক ওদিক রেখো না।জানোই তো না চাইতেও এক কালসাপ পুষতে হয়।আমার দাদীন আম্মু এরা তো সুখে ছিলোই না এবার উঠে পড়ে লেগেছে তোমার পিছনে।নিজের সেফটি নিজেকে বুঝতে হবে।দাদাইয়ের কথা রাখতে বাবা এগুলো সহ্য করে।যতই হোক দাদাই তো বাবার বাবা ছিলেন।রক্ত ধোঁকা দিলেও রক্তের টান ফিকে হয় না।আমার বাবা তার প্রমাণ।তাই বলছি যতটুকু পারো নিজের জিনিসগুলোর প্রতি যত্নশীল হও।”

“পিংকি এখন কেমন আছে?”

“আমি ওকে লেবুর রস খাইয়ে দিয়েছি।ঝাল কমেছে অনেকটাই।এখন ঘুমিয়ে আছে।তোমার খাদ্য বিশেষজ্ঞ ভাই কল দিয়েছিলো অনেক আগে।বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।টেবিল পরিষ্কার করার সময় তোমার ফোন দেখে মনে পড়লো।এই নেও।”

বলেই দীপান্বিতা ঘর থেকে বের হতে নিবে কিন্তু নীরার কথায় থমকে গেলো।নীরা বলে ওঠে,”আমার ভাইয়ের কথা উঠলে তোমার গলা কাপে কেনো?অন্য সময় কথা বলতে গেলে তো এমন হয় না!”

দীপান্বিতা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে হয়তো।তেমন কিছুই নেই আমার গলার ভিতর।অন্যদের বেলায় যেভাবে কথা বলি তোমার ভাইয়ের বেলায়ও সেভাবেই কথা বলি।”

বলেই প্রস্থান করে দীপান্বিতা।দীপান্বিতা পিছন ফিরে কথা বললেও আয়নায় দীপান্বিতার চোখের পানি দেখতে পায় নীরা। বুকশেলফ এর পাশেই যে আড়াআড়িভাবে আয়না রাখা আছে।সেখানে দীপান্বিতার এক পাশ খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে।দীপান্বিতার চোখ থেকে বের হওয়া অশ্রুর রহস্য বুঝতে পরলো না।কিন্তু কিছু একটি কাহিনী তো আছে এবং তা ভালোবাসার পর্যায়ে এটা উপলব্ধি করতে পারছে নীরা।

বেশি কিছু না ভেবে নীরবকে কল দেয়।সাথে সাথে কল রিসিভ করে নীরব।বোনকে দেখে বলে,”তোর জন্য একটি সারপ্রাইজ আছে শুধু তুই না বাসার সবার জন্য।বলতো কি সেই সারপ্রাইজ?”

“ক্যাডার সাহেবকে বিয়ে করে যে সারপ্রাইজ হতে হয় তাতে তোমার দেওয়া নতুন সারপ্রাইজ মাথায় আসছে না।তুমিই বলে ফেলো।”

হো হো করে হেসে দেয় নীরব।দ্বীপকে নীরব ভালো করেই জানে।একসাথে প্রায় চায়ের দোকানে আড্ডা জমাতো।নীরব যেতো দীপান্বিতার হয়ে দ্বীপকে পটাতে। বড় ভাই পটে গেলে আর তো কিছুই লাগে না।কিন্তু দ্বীপ তার বিদ্যাসাগর নিয়ে কথা বলতো বেশি।এখন সে বুঝতে পারছে নীরাকেও ঠিক কিভাবে ট্রিট করে।রসকষহীন বই পড়ুয়া দ্বীপ আর তার উড়নচণ্ডী ফাঁকিবাজি বোন যেনো বইয়ের এপিঠ ওপিঠ।নীরব হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,”আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে অনেক আগে।আজ রেজাল্ট পাবলিক হয়েছে।আমি সাকসেস হয়েছি বোন।আমার এত বছরের কষ্টের ফল পেয়েছি। আর তোদের থেকে দূরে থাকছি না।এক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাক করছি।”

ভাইয়ের কথা শুনে নীরা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।সাথে সাথে বলে,”হুররে আমার ভাই খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে।”

কিছুক্ষণ মজা করে দীপান্বিতার কথা মনে পড়লো নীরার।তাই সে নীরবকে ইন্ডিরেক্টলি বলে,”তুমি বিডিতে আসার পর আমরা তোমার জন্য মেয়ে দেখবো।রূপবতী গুনবতী কর্মঠ ভদ্র দেখে মেয়ে নিয়ে আসবো।যেমনটা তুমি চাও।জাস্ট এক্সাম্পল আমার কিউট ননদ দীপান্বিতা আপু।তার মতো দেখে বউ পেলে খুশি হবে তো?”

নিজের বিয়ের কথা শুনে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে নীরবের।আবার তারউপর দীপান্বিতার নাম নিয়ে উদাহরণ।পুরো দীপান্বিতাকেই তো তার চাই।তার মতো আবার কি!কিন্তু কোনো প্রতিউত্তর করলো না নীরব।লোক দেখানো এক স্মিত হাসি দিয়ে নীরব বলে,”সবে তো পড়াশোনা শেষ এখন সেটেল হয়ে নেই।তারপর দেখা যাবে।রাখছি বোন,ভালো থাকিস।”

ভাইয়ের শুকনো মুখ দেখে নীরা শিওর হলো ডাল মে কুছ কালা হে।কল কাটার পর বলে,”ভাই আর ননদের কেমিস্ট্রি খুব গভীর।আমাকে এখন ডিটেকটিভ নীরা হতে হবে।কি থেকে কি হয়েছে এগুলো আমাকে বের করতে হবে।সাথে আবার আছে ক্যাডার সাহেবের ওই চন্দ্রপাখি।কতকিছু সম্পর্কের গোয়েন্দা গিরি করবো আমি!উফ এত প্রেসার নেওয়া যায় না।”

“কিসের প্রেসার নেওয়ার কথা বলছো তুমি?”

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে দ্বীপ।নীরা তাকায় দ্বীপের দিকে।আপাতত এনাকে কিছু বলা যাবে না।ইনি থাকুক ইনার বিদ্যা নিয়ে।

“কিছুই না।এই যে আর আড়াই মাস পর আমার এক্সাম।এখন তো স্যার আমার স্বামী তাই তার শুনাম রাখতে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।এটাই ভাবছি।”

“বাব্বা এত চিন্তা আমার জন্য?”

উত্তর দেয় না নীরা।সাথে সাথেই কেয়ার কল আসে।নীরা রিসিভ করে বলে,”হ্যা বল!”

“দোস্ত আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান হবে।সবাই শাড়ি পড়বো। আর বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আছে।আমি নৃত্যে নাম দিবো।তুই কি করবি?”

“আমি কি করবো মানে?আমিও নৃত্য করবো।”

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসার আগে নীরার কান থেকে ফোনটি নিয়ে দ্বীপ বলে,”ও কোনো নৃত্য করবে না।যাবে বক্তৃতা শুনে চলে আসবে।”

বলেই কল কেটে দেয়।কেয়া ভয় পায় দ্বীপের কর্কশ কণ্ঠ শুনে।দ্বীপ ফোন কাটার পর বলে,”সাইকো স্যার।”

নীরা কোমরে হাত দিয়ে দ্বীপের দিকে ডান ভ্রু উচু করে তাকিয়ে বলে,”আমি নৃত্য করলে আপনার সমস্যা কোথায়?”

“আমি বলেছি তো তুমি নৃত্য করবে না মানে করবে না।”

“আমি নৃত্ততে নাম দিবো এবং নৃত্য করবো।”

“আমি বলেছি তো না।”

“হ্যা দিবো নাম।আমি নাকি কোনো কিছু পারি না।অযোগ্য তাহলে নৃত্য করে দেখিয়ে দেই আমার কি কি যোগ্যতা আছে।”

“তোমাকে যতটুকু যোগ্য হওয়া লাগবে তা আমি দেখে নিবো।ভালোভাবে বলছি কোনো নৃত্য করতে পারবে না তুমি।”

“আমি নাম দিবো দিবো দিবো।”

কিছুটা চিল্লিয়ে বলে নীরা।ব্যালান্স হারা হয়ে দ্বীপ ঠাস করে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় নীরার গালে।নীরা অবাক হয়ে যায়।এতদিন থাপ্পড় দিলেও অন্তত বুঝতো পড়াশোনার জন্য কিন্তু আজকের থাপ্পড় কি না সামান্য এক অংশগ্রহণের জন্য।এটাও নীরার সমস্যা না।সমস্যা হলো দ্বীপ ও নীরার কথাগুলো দরজার পাশে থেকে পিংকি আরি পেতে শুনতে থাকে।এখন দ্বীপ তাকে থাপ্পড় দিয়েছে এটাও পিংকি দেখে খুশি হয়।সবকিছু নীরা ভালোভাবেই লক্ষ্য করে কিন্তু দ্বীপ উল্টোদিকে ফিরে ছিলো বলে পিংকিকে দেখে না।

নীরা বাম গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ছিলো। দ্বীপ নীরাকে আদেশের সুরে বলে,”আমার কথার হেরফের হওয়া আমি পছন্দ করি না।নেক্সট টাইম যেনো কোনো অন্যায় আবদার নিয়ে তর্ক করতে না দেখি।”

বলেই ব্যালকনিতে যেয়ে দাড়ায় দ্বীপ।নীরা আজ প্রচুর কষ্ট পায়।কোনো কথা না বলে মিনিকে জড়িয়ে কম্বল মুড়ি দেয়।কম্বলের নিচে ফুফাতে থাকে।

ঘন্টাখানেক নিরবতা পালন করে দ্বীপ।রাতের খাবার কেউই খায় না।দীপান্বিতা এসে দেখে নীরা ঘুমিয়ে আছে। দ্বীপও ব্যালকনিতে চুপচাপ।ভাই রেগে থাকলে দীপান্বিতাও কোনো কথা বলে না।রাগের সময় দ্বীপের মাথা কাজ করে না।তাই তখন সবাই নিরবতা পালন করে।

এগারোটার দিকে ঘরে এসে দ্বীপ দেখে নীরা ঘুমিয়ে গেছে।কোলে মিনিকে নিয়েছে।হালকা হাসে দ্বীপ।ঘুমন্ত নীরার অতি নিকটে এসে নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”আমার চন্দ্রপাখিকে কারো সামনে যোগ্য প্রমাণ হতে হবে না।সে যেমন আছে তেমনই বেস্ট।আমিতো আমার এই দুষ্টু মিষ্টি বউকে বেশি ভালোবাসি।কেনো হতে হবে তোমাকে সবার সামনে পারফেক্ট?তুমি আমার কাছে এমনিতেও পারফেক্ট।সবার সামনে কোমর দুলিয়ে ধেই ধেই করে নৃত্য করবে আর ছেলেরা তাকিয়ে থাকবে এটা আমি কিছুতেই সহ্য করবো না।এটা তো এক অন্যায় আবদার।তুমি কেনো অন্য ছেলেদের সামনে নাচতে যাবে।তুমি আমার জীবনে আমার ব্যাক্তিগত নারী আমার চন্দ্রপাখি।”

বলেই ঘুমন্ত নীরার বাম গালে গুনে গুনে দশটি চুম্বন এঁকে দেয়।তারপর লাইট অফ করে অন্যপাশ হয়ে ঘুমিয়ে পরে।

দ্বীপ লাইট অফ করার সাথে সাথে চোখ মেলে তাকায় নীরা।সে এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে হালকা নিদ্রায় ছিলো।গভীর নিদ্রা তখনও বিরাজ করেনি নীরার চোখে।অন্ধকার রুমে বাইরে থেকে আসা চাঁদের আবছা আলোয় দেখলে থাকে দ্বীপকে।তারপর তার বাম গালে হাত দিয়ে অনুভব করলো।এই মাত্র তার ক্যাডার সাহেব তাকে চুম্বন এঁকে দিলো।তাও আবার গুনে গুনে দশটি।যখন দ্বীপ এই কাজটি করেছিলো নীরার হৃদপিণ্ড কেপে উঠেছিলো।দ্বীপের মুখে চন্দ্রপাখি নাম শুনে নীরা বুঝতে পারলো ডায়েরির ওই কন্যাটি কেউ না বরং সে নিজে।সময় করে দ্বীপের অগোচরে পড়তে হবে ডায়েরিটি।জানতে হবে দ্বীপের মনে তাকে নিয়ে বিচরণ করা অনুভূতি।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-১১

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১১
#ইশরাত_জাহান
🦋
দেখতে দেখতে নীরার টেস্ট পরীক্ষার আজ শেষ দিন।এই কয়দিনে দ্বীপ নিজ দায়িত্বে নীরাকে কলেজে নিয়ে গেছে আবার নিয়ে এসেছে।নীরা যেনো পরীক্ষা দিয়ে তাড়াতাড়ি না পালায় সেই জন্য ওয়ারনিং দিয়েছে।পুরো পরীক্ষা নীরা হামি দিতে দিতে দিয়েছে।টেস্ট পরীক্ষা কি আর এতো লিখতে ইচ্ছা করে?এমনি নীরা অলস পড়া চোর সেখানে এতটুকু লেখা জমা দিলেই এনাফ।কিন্তু ক্যাডার সাহেবের জন্য তাকে সম্পূর্ণ পরীক্ষার সময় বসে থাকতে হয়েছে।

আজকেও দ্বীপ নীরাকে নিয়ে যাওয়ার সময় বলতে থাকে,”পরীক্ষা শেষ করে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।একদম বাইরে যাবে না।যদি দেখেছি পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে খাতা জমা দিয়ে বের হয়েছো এই স্যার থেরাপি আবার ফিরে আসবে।”

স্যার থেরাপি কথাটি শুনেই নীরার গালে অটোমেটিক হাত চলে আসে।মিনমিন করে বলে,”বেটা খচ্চর,বিয়ের পরেও কি না স্যার থেরাপি দিবে!এই জন্য স্যারদের বিয়ে করতে নেই।হয়তো এই জন্যই সবাই বলে স্যার ম্যাম পিতা মাতার সমতুল্য।”

বিড়বিড় করতে করতে নীরা গাড়িতে ওঠে।নিজের ঘরের জানালা দিয়ে মেয়ে জামাইকে একসাথে কলেজে যেতে দেখছেন মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন।তাদের চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি।কতজন বাবা মা পারে এমনভাবে মেয়ের সুখ নিজের চোখে দেখতে? হাতে গোনা গুটি কয়েক জনের মধ্যে তারা এমন লাকি বাবা মা।এই যে যখন ইচ্ছা মেয়ের সুখ একটু উকি দিয়ে দেখছে আবার প্রায় বিকেল বেলা যেয়ে যেয়ে গল্প করছে। দ্বীপ ও নীরাদের গাড়ি দৃষ্টির বাহিরে গেলে মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন দুজন দুজনকে দেখে স্মিত হাসেন।

মিস্টার রবিন বলে ওঠে,”আমাদের মেয়ে সত্যি অনেক ভাগ্যবতী।দ্বীপের মতো কেয়ারিং স্বামী পেয়েছে।আমাদের দ্বীপ নীরাকে যেমন প্রতিষ্ঠিত করবে তেমন নিজের আপন করে নিবে।বাবা মা হয়ে সেই সুখ আমরা নিজের চোখের সামনে দেখতে পারবো।আবার আমাদের মেয়ে আমাদের কাছেও থাকছে।তোমার মনের আশা পূর্ণ হচ্ছে এবার।”

চোখের পানি মুছে মিসেস নাজনীন বলে,”প্রত্যেক বাবা মা চায় সন্তানের সুখ দেখতে।মৃত্যুর আগে চায় সন্তান যেনো তার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজ দায়িত্ব নিতে পারে।আমাদের নীরা অনেক বুদ্ধিমতি ও সবাইকে আপন করে নেয়।কিন্তু পড়াশোনা ও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওর তেমন মাথা ব্যাথা নেই।যেভাবে তিড়িং বিড়িং করে এভাবে তো ওর জীবন আগাবে না।দ্বীপ ওকে শাসন করবে আবার ভালো বাসবে শুধু তাই না দ্বীপ ওর সকল বিষয়ের প্রতি যত্নশীল হতে পারে।আমার পর দ্বীপ সে যে নীরাকে শাসন করে আবার গভীরভাবে ভালোবাসে।আমি দেখেছি দ্বীপের চোখে সেই ভালোবাসা।মেয়েটা বয়সের সাথে সাথে উড়তে শুরু করেছে।সমাজের নিয়ম কানুন থেকে দূরে থেকে ও নিজেকে উড়ন্ত পাখি ভেবে নিয়েছে।ব্যাক্তি স্বাধীনতা ভালো কিন্তু বেশি উড়ন্ত পাখিকে শিকার করতে সময় লাগে না।আমি দ্বীপের হাতে নীরাকে দিয়েছি যাতে আমার নীরা সুখে থাকতে পারে।নীরব আর নীরার সুখ দেখাটাই যে আমাদের শেষ চাওয়া।এরপর তো…”

আর কিছু বলতে দিলেন না মিস্টার রবিন।মিসেস নাজনীনের মুখ চেপে ধরে বলে,”ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।হুটহাট মৃত্যুর নাম উঠিয়ে সুখের মুহূর্ত কেনো দুঃখে পরিণত করবো?”

মিসেস নাজনীন সাথে সাথে মিস্টার রবিনের বক্ষে মুখ গুজে আলিঙ্গন করে নিলেন।মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেন।তাদের প্রেম ভালোবাসা যেনো এখনও অফুরন্ত।

পরীক্ষা শেষ করে নীরা ও দ্বীপ গেটের বাইরে থেকে গাড়িতে ওঠে।উদ্দেশ্য বাড়িতে আসবে।দ্বীপ ড্রাইভ করতে থাকে আর নীরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ নীরা খেয়াল করলো গাড়িটি তাদের বাড়ির রাস্তায় না উল্টো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।নীরা সাথে সাথে বলে,”আমরা আজ কোথায় যাচ্ছি?”

“গেলেই দেখতে পাবে।”

নীরা আর কোনো উত্তর দেয় না।এর কিছুক্ষণ পর দ্বীপ গাড়ি থামিয়ে দেয়।নীরা বাইরে তাকিয়ে দেখে তারা শপিং মলের সামনে এসেছে।নীরা দ্বীপের দিকে ঘুরে বলে,”শপিং মলে কেনো?”

“হানিমুন করতে এসেছি।ইন্টারেস্টেড থাকলে চলো নাহলে এখানে বসে থাকো।আজিব প্রশ্ন শপিং মলে কেনো!”

বলেই দ্বীপ বের হয়ে যায়।নীরা বিড়বিড় করে বলে,”ঘাড় তেরা স্যার।”

শুনে ফেলে দ্বীপ।নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার স্যার প্লাস বর তোমার মতই তো হবে।”

নীরা আর কিছু না বলে মুখ ভেংচি দিয়ে দ্বীপের সাথে হাটতে শুরু করে।শপিং মলে এসে আগে তারা কসমেটিকসের দোকানে ঢোকে।তারপর দ্বীপ নীরাকে বলে,”তোমার মাসে কি কি লাগে আমি জানি না।এখানে মহিলা কর্মী আছে তাই এখানে নিয়ে এসেছি। যাতে করে তোমার প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিতে পারো।বিয়ের শর্ত তো দেওয়া ছিলো মাসে মাসে কসমেটিকস কিনে দেওয়া।আজ এক তারিখ নেও শুরু করো।”

এক দৃষ্টিতে নীরা তাকিয়ে আছে দ্বীপের দিকে।মনে মনে বলে,”লটারি পেয়ে গেলাম মনে হয়।না চাইতেই কেনা কাটা করতে পারছি।এরকম বর কপালে জুটলে আমি তো বলবো আমার শত্রুর কপালেও বর হিসেবে স্যার যুটুক।”

বলেই দাত বের করে হাসে নীরা।তারপর পছন্দ মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করে।কসমেটিকস কেনার পর দ্বীপ নীরাকে কাপড় চোপড়ের দোকানে নিয়ে যায়।কিছু জামা কাপড় কিনতে।প্রত্যেক মাসে মাসে দ্বীপ পরিবারের জন্য জামা কাপড় কিনে।এটা দ্বীপের ভালো লাগা।আজও তাই করছে।

নীরাকে ড্রেসগুলো পছন্দ করে দিতে বলে।নীরা সবার জন্য ড্রেস দেখে নেয়।দ্বীপ চুপচাপ এদিক ওদিক দেখতে থাকে।হঠাৎ দ্বীপের নজরে আসে একটি শাড়ি নিয়ে দুইজন মহিলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন আর দাম কষাকষি করছেন।দ্বীপের কাছে শাড়িটি ভালো লাগে।নীরাকে এই শাড়িতে খুব সুন্দর লাগবে এমনটাই দ্বীপের কাল্পনিক চিন্তা।কোনো কিছু না ভেবে শাড়িটি কেনার জন্য চলে যায় সেখানে।ওই রকম দেখে আরেকটি শাড়ি নিয়ে নেয় দ্বীপ।তারপর তারা বাসায় চলে আসে।

বাসায় এসে দ্বীপ ও নীরা সবাইকে একসাথে করে ড্রেস দেয় ও কার জন্য কি কি এনেছে এগুলো দেখাতে থাকে।পিংকি ও তার মা মিসেস সাদিয়া আছে।তাদের জন্যেও আনা হয়েছে।সবার ড্রেস দেখানো হয়ে গেলে নীরার জন্য কেনা শাড়িটি সবাইকে দেখায় দ্বীপ।নীরা প্রথমে বুঝতে না পারলেও যখন দ্বীপের মুখে শুনে,”এটা আমি তোমাদের বউমার জন্য কিনেছি।”
তখন অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে ক্যাডার সাহেবের দিকে।

পিংকির হিংসা হয়।সে সাথে সাথে বলে,”কই দেখি।ওয়াও অনেক সুন্দর শাড়িটি।আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে।”

মিসেস সাদিয়া পিংকিকে সাপোর্ট দিয়ে বলে,”তোর ভালো লেগেছে।একটা কাজ করি এই শাড়ি তাহলে পিংকিকে দে আর নীরাকে পিংকির জন্য আনা ড্রেসটি দে।”
দ্বীপকে উদ্দেশ্য করে শেষের কথাটি বলে।

পিংকি খুশি মনে শাড়িটি নিতে গেলে নীরা খোপ করে নিয়ে নেয় আর বলে,”তোমার বর যদি তোমাকে কিছু কিনে দেয় তুমি নাহয় সেগুলো এক্সচেঞ্জ করে নিও।আমি তোমার মতো এতো উদার নই।যেটা আমার ওটা আমার করেই নেই।তুমি তোমার জন্য কেনা ড্রেস নিয়ে যেটা তোমার ভাইয়া দিয়েছে ওটা নিয়ে খুশি থাকো।আমি আমার স্বামীর দেওয়া উপহার নিয়ে খুশি হতে চাই।”

মিসেস সাদিয়া ভেংচি কেটে বলে,”আমার মেয়েটা শাড়ি তেমন পরে না। এই প্রথম একটি শখ করে নিতে চাইলো তাও সহ্য হলো না।”

নীরা কিছু বলার আগেই দ্বীপ বলে,”কি বলোতো ফুফি!আমি আবার বউ আর বোনকে আলাদা চোখে দেখি।যেটা বোনের জন্য এনেছি ওটা বোনের আর যেটা বউয়ের জন্য এনেছি ওটা বউয়ের।শুধু শুধু বউ আর বোনের মধ্যে বোনকে সাপোর্ট করে বউয়ের চোখে কাপুরুষ ট্যাগ নিতে চাই না।বোনের চোখে কাপুরুষ হলেও লোক সম্মুখে মুখ দেখানো যায় বউয়ের কাছে কাপুরুষ হলে পুরো জীবন ব্যর্থ।বউ আমার হুট করে বাপের বাড়ি গেলে এই বয়সে শিক্ষক থেকে আমাকে বউয়ের জন্য সন্ন্যাসী হয়ে বসে থাকতে হবে।”

দ্বীপের এমন কথায় হা হয়ে যায় নীরা,পিংকি ও মিসেস সাদিয়া।দ্বীপ তো এসব কথা বলতো না।কি হয়ে গেছে ছেলেটার।ফুফুর সাথে লাগামহীন কথাবার্তা বলছে। আর আগে কি না মুখ থেকে একটা শব্দও বের হতো না।

মিস্টার সমুদ্র ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বিষম খান।মিসেস সাবিনা মিস্টার সমুদ্রকে খোচা দিয়ে বলে,”দেখেছো আমার ছেলেই হলো প্রকৃত পুরুষ।বউকে তো সবসময় টাইট দিয়েই রাখে আবার বউয়ের জন্য লড়াইও করে।ভুল মানুষের বেলায় বউ কে আর বোন কে দেখে না।আমার ছেলেটা হিরের টুকরো।একদম বাপের থেকে ভিন্ন হয়েছে।”

মিস্টার সমুদ্র নিজের বউয়ের মুখে এতগুলো বছর পর আজ প্রথম এমন কথা শুনে যেনো ডাবল বিষম খেলেন।ইচড়ে পাকা বউমা নিয়ে এসে কি সবাইকে ছোঁয়াচে রোগ লাগিয়ে দিলো!ছেলে লাগামহীন কথা বলছে বউ আজ জীবনের কাজকর্ম নিয়ে প্রতিবাদ করছে।

দ্বীপের মুখে এমন কথা শুনে দীপান্বিতা মিসেস শিউলি ও মিসেস সাবিনা একসাথে হাততালি দিতে থাকে।এদের কেউই পিংকি ও মিসেস সাদিয়াকে পছন্দ করে না।মিস্টার সমুদ্র নিজেও পছন্দ করেন না কিন্তু মৃত বাবাকে দেওয়া ওয়াদা রক্ষার জন্য সহ্য করতে হয়।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-১০

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১০
#ইশরাত_জাহান
🦋
নীরা বই পড়ছে আর আড় চোখে দ্বীপকে দেখছে।দ্বীপ তার মতো বইয়ের পাতা দাগিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ করে নীরার চোখ আটকে যায় দ্বীপের চোখের দিকে।চারকোনা আকারে চশমার ভিতর দ্বীপের চোখ যেনো আকর্ষণীয় লাগছে তার কাছে।দ্বীপের খোঁচা খোঁচা দাড়ির মাঝে ছোট্ট একটি তিল দেখা যাচ্ছে যেটা নীরা আজ খুব ভালো ভাবে পরখ করছে।নীরার অজান্তেই নীরা তাকিয়ে ছিলো দ্বীপের দিকে।হঠাৎ নীরার পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দ্বীপও তাকায় নীরার দিকে।দ্বীপ বুঝতে পারে নীরার চাহনির মানে।মোহিত হয়ে যাচ্ছে নীরা।হবে নাই বা কেনো!তারা তো স্বামী স্ত্রী তাদের হক আছে এই ভাবে একে ওপরের প্রতি মোহিত হওয়ার।কিন্তু কাল নীরার পরীক্ষা।ওকে এখন একটু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।দ্বীপ চায় না নীরা তার উপর নির্ভর করে চলুক।দ্বীপ চায় নীরা একজন সফল নারী হোক।সে তার বউকে তার চন্দ্রপাখিকে একজন ভালো আদর্শ সফল নারী বানাতে চায়।ভালোবাসার মানুষ একজন সফল মানুষ হবে এই অনুভূতিটি ভিন্ন।নীরার ভিতর এই সবকিছুর প্রতিভা আছে কিন্তু নীরা নিজেকে হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে।এসব ভেবে দ্বীপ নীরার মাথায় দিলো এক টোকা।নীরার ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটলো।দ্বীপ নীরাকে বলে,”বরকে দেখার জন্য সারা জীবন পরে আছে কিন্তু ইন্টারের রেজাল্ট একবারই আসবে।আমি যেনো দ্বিতীয়বার ইন্টার এক্সাম দিতে না দেখি।”

“বুঝতে পেরেছি।”
বলেই পড়তে শুরু করে নীরা।মনে মনে একটু লজ্জা পায় সে।কিন্তু প্রকাশ করলো না।

সকাল বেলা দ্বীপের আগে ঘুম থেকে ওঠে নীরা।মিনিকে সোফায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।হামি তুলে নীরা তাকালো দ্বীপের দিকে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”ঘুমানোর সময় কেউ চশমা চোখে রাখে!কি আজব ক্যাডার সাহেব আমার।চশমা খুলে ঘুমালে কি হয়?”

বলেই ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

কেয়া আজ নিজের মতো কলেজে যাবে।নীরা দ্বীপের সাথে যাবে।কেয়ার ভালো লাগছে না নীরা তার সাথে নেই বলে।আনমনে হাঁটতে থাকে কেয়া।ঠিক তখনই পিছন থেকে শুনতে পায়,”এই চশমিশ।”

কেয়া তাকালো পিছনে। রিককে দেখতে পেলো। রিককে দেখে ভালো লাগলো কেয়ার কিন্তু চশমিশ নামটি বলার কি খুব দরকার ছিলো!চশমা কি আর সে ইচ্ছা করে পড়ে।তার অসুবিধা আছে বলেই তো চশমা নেওয়া লাগে। প্রতিবাদ করে কেয়া বলে,”আমাকে চশমিশ বললেন কেনো?”

“কারণ তোমাকে চশমা পড়া দেখতে আমার ভালো লাগে তাই।লম্বা চওড়া মুখে চিকন চিকন চোখে চশমা যেনো আলাদাভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।তুমি সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা করলে বলতাম ডাক্তার হও।একদম পারফেক্ট লাগবে।”

“আপনি ডাক্তার হতে বললে আমি ডাক্তার হতাম?”

“জানি না,তবে আমি আমার মনের বাসনা না হয় বলেই দিতাম।সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব তোমার।”

“হুম।”

“আমার বাইকে করে চলো।কলেজে পৌঁছে দেই।”

“আপনি কি আমার ড্রাইভার হওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন?নীরা আমার সাথে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে আপনি আমাকে কলেজে নিয়ে যাওয়া আসা করেন।এগুলো কেনো করেন?”

“এখনও বুঝতে পারোনি?নাকি বুঝেও না বোঝার অভিনয়!”

বিষম ওঠে কেয়ার।সে তো খুব ভালোভাবেই জানে এই সাদা বিলাই তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে। সেও তো সাদা বিলাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।কথা এড়াতে কেয়া বলে,”আমি কি জানবো? আর আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।পরীক্ষা আজ আমার।চলুন কলেজে যাই।”

বলেই রিকের বাইকে উঠলো কেয়া।রিক স্মিত হাসলো। কেয়াও হাসলো এটা রিক দেখতে পেলো।বাইকের আয়নাতে কেয়ার হাসি দেখে রিকের ভালো লাগলো।রিক মজা করে বলে,”আমার চশমিশের হাসি অনেক সুন্দর।”

প্রতিউত্তর করে না কেয়া।মনে মনে খুশি হয়েছে।রিক তাকে নিজের করে বলছে।

নীরা রেডি হয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে। ব্যাগগুলো দীপান্বিতা নিয়ে যাবে।তিনদিন হয়ে গেছে আজ শশুর বাড়িতে যাবে নীরা।পরীক্ষা দিয়ে সোজা শশুর বাড়ি।কিন্তু নীরার মনে খারাপ লাগার আভাস নেই।সে খুব ফুরফুরে আছে।খারাপ আর লাগবে কিভাবে?শশুর বাড়ি আর বাবার বাড়ি তো পাশাপাশি। ব্যালকনিতে দাড়ালেই তার ঘর দেখা যায় আবার দীপান্বিতার ঘরের দিকে গেলে নীরবের ব্যালকনি।মা বাবাকে সারাদিন দেখতে পাবে।

দ্বীপ বারবার নীরাকে বলছে,”পরীক্ষা মনোযোগ দিয়ে দিবে।যেটা পারবে না ওটা বাদ দিয়ে অন্যগুলো লিখবে।যেহেতু টেস্ট পরীক্ষা আপাতত পাশ মার্কস হলেই হবে।যেগুলো পড়িয়েছি মাথায় ভালোভাবে রাখবে।”

নীরা এবার বিরক্ত।দ্বীপের দিকে তাকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলে,”এখন আমরা বের হবো।আপনি কি আমাকে এখনও এসব ভাষণ দিবেন?দেশে মনে হয় আমি সেই মেয়ে যে কিনা স্যারকে বিয়ে করে বইয়ের বিদ্যা নিয়ে ঘুরছে। কোথায় বিয়ে করলাম নতুন নতুন এখন আরো বরের সাথে ঘুরবো ফিরবো তা না।পরীক্ষা এই করো ওই করো।”

দ্বীপ নীরার কাছে আসলো।তারপর বলে,”এই স্যারকে স্বামী রূপে তুমি নিজেই গ্রহণ করতে পারবে না।যেখানে কাজটি তোমার দ্বারা সম্ভব না সেখানে কেনো বারবার এসব কথা বলো।আমি তোমার উপর কোনো প্রেসার ক্রিয়েট করতে চাই না।তুমি যেদিন মন চাইবে সেদিন এই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক পূর্ণ হবে।কিন্তু এখন আপাতত পড়াশোনা মন দিয়ে করো।তোমাকে একজন আদর্শ সন্তান আদর্শ বউ আদর্শ বউমা আর ভবিষ্যতে আদর্শ মা হতে হবে।”

‘আদর্শ মা’ কথাটি শুনেই যেনো নীরার মন অন্যরকম হয়ে গেলো।লজ্জায় আর কিছু বলল না।দ্বীপ তাড়াহুড়া দিতে থাকলো।অবশেষে সবাইকে বিদায় দিয়ে কলেজে চলে গেলো নীরা ও দ্বীপ।

দ্বীপ আজ তাদের নিজস্ব গাড়ি নিয়েছে।আপাতত নীরা ও দ্বীপের ব্যাপারে কলেজে কেউ জানে না।দ্বীপ জানায়নি কারণ নীরার পরীক্ষার ভিতর ওর ফ্রেন্ডরা ওকে নিয়ে প্রশ্নের পাহাড় তুলবে।অনেকে বলবে বর এই কলেজের স্যার আর বউ ছাত্রী নীরার রেজাল্ট তো এমনি ভালো হবে।এতে করে নীরার ওপর প্রভাব পরবে।দ্বীপ চায় না নীরা আপাতত এসব ফেস করুক।অন্তত ইন্টার পরীক্ষা শেষ করে তারপর সবাই জানুক।এজন্য গাড়ি করে যেয়ে গেটের পাশে দিয়ে নীরাকে নামিয়ে সে ভিতরে চলে যাবে।এতে করে কেউ তাদের একসাথে দেখবে না।

পরীক্ষা শুরু হয়েছে।ছাত্র ছাত্রী সবাই সবার সিটে বসেছে।পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে নীরা এসেছে।এসেই কেয়াকে জড়িয়ে ধরে।নীরা ও কেয়ার সিট সামনে পিছনে। স্যার এসেছে সাথে সাথে সবাই চুপচাপ পরীক্ষায় মনোযোগী হতে থাকে।

দেড় ঘণ্টা পরীক্ষা দেওয়ার পর নীরা দেখে সে অনেক কিছুই লিখেছে।গুনতে থাকে কত মার্কস হতে পারে।প্রায় চল্লিশ মার্ক মানে পাশ মার্কের উপরে আছে।টেস্ট পরীক্ষা পাশ মার্কস হলেই হবে।ক্যাডার সাহেব তো এটাই বলেছিলো।তাহলে আর কি খাতা জমা দিয়ে দিলেই হয়।নীরার পিছনে কেয়া বসেছে।নীরা কেয়ার বেঞ্চে হেলান দিয়ে বলে,”দোস্ত কত মার্কের উত্তর দিয়েছিস?”

“পাশ মার্কস উঠে গেছে দোস্ত।তুই কত মার্কসের উত্তর দিয়েছিস?”

“আনুমানিক পঞ্চাশ হবে কিন্তু মনে কর দুই এক মার্ক কাটলে চল্লিশ।বলছি এটা তো টেস্ট এক্সাম।আমার ক্যাডার সাহেব বলেছে পাশ মার্কস উঠলেই হবে।চল খাতা দিয়ে ফুসকা খেতে যাই।”

“আচ্ছা দোস্ত চল।এমনিতেও ভালো লাগছে না লিখতে।”

বলেই দুজনে খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে যায়।বাইরে এসে নীরা ও কেয়া আরামছে ফুসকা ইনজয় করে।তারপর দুজনে মিলে লেকের পাড়ে এসে বসে।দুজনে মন খুলে গল্প করতে শুরু করে।গল্প করতে করতে অনেক সময় হয়ে যায়।দ্বীপের ডিউটি অন্য ডিপার্টমেন্টে ছিলো।ডিউটি শেষ করে সে নীরাকে খুঁজতে লাগলো। কোথাও পেলো না।অবশেষে নীরাকে কল দিলো।নীরা কল রিসিভ করে বলে,”জি বলুন।”

“কোথায় তুমি?”

“আমি আর কেয়া লেকের পাড়ে এসেছি।”

“কখন গেছো তোমরা?”

“এই তো ঘণ্টা দুই হবে।”

“পরীক্ষা কখন দিয়েছো?”

“পরীক্ষা দিয়ে পাশ মার্কস উঠিয়ে তারপর এসেছি।আপনি না বললেন পাশ মার্কস উঠলেই হবে।”

দ্বীপের মাথায় হাত।এই মেয়েকে সারাদিন রাত পড়িয়েছে সকালে একটু টেনশন মুক্ত করার জন্য ওই কথাগুলো বলেছিলো। আর এদিকে সে কি না পাশ মার্কস এসেছে বলে নাচতে নাচতে ঘুরতে গেছে।সাথে সাথে দ্বীপ বলে ওঠে,”আমি কি বলেছিলাম পাশ মার্কস উঠিয়ে বাইরে চলে যাবা?আচ্ছা থাকো ওখানে আমি আসছি।”

“আচ্ছা।”

কল কেটে দিলে কেয়া নীরাকে জিজ্ঞাসা করে,”কি হয়েছে?”

“উনি আসছে আমাকে নিতে।”

“এই উনি টা কে?”

“ঢং!তুই মনে হয় জানিস না?আমার ক্যাডার সাহেব তোদের আদনান কবির দ্বীপ স্যার।”

“তাহলে আর কি আমিও চলে যাই বাসায়।”

“তোর সাদা বিলাইকে কল দে।আসুক তোরা গল্প কর।”

“আইডিয়া মন্দ নয়।কিন্তু আমার লজ্জা করছে।”

“আর লজ্জা পেতে হবে না।ভালো যখন দুজন দুজনকে বেসেছিস দেরি না করে বলে ফেলা ভালো হবে।”

বলতে বলতে দ্বীপ গাড়ি নিয়ে হাজির।নীরা দ্বীপের গাড়ির দিকে তাকালো তারপর কেয়ার হাত থেকে কেয়ার ফোন নিয়ে রিককে এসএমএস দিলো,”আমি লেকের পাড়ে আছি।আপনি যদি চান একসাথে আজকে আমরা কফি ডেট করতে পারি। আমি দশ মিনিট অপেক্ষা করলাম আপনি না আসলে চলে যাবো।”

লিখেই ফোনটি কেয়ার হাতে দিয়ে দিলো।কেয়া এসএমএস দেখে অবাক হলো।বলে,”এটা কি লিখেছিস!এখন উনি কি ভাববে বলতো?আমি কি করবো এখন?”

নীরা ভেংচি কেটে বলে,”তোর সাদা বিলাই কিছুই ভাববে না।উল্টো খুশি হয়ে চলে আসবে। দশ মিনিট সময় দিয়েছি।দেখ কি করে।”

এর ভিতরে দ্বীপ এসে বলে,”কাকে দশ মিনিটের ভিতরে আসতে বলেছো।”

“আসলেই দেখতে পাবেন এক সাদা বিলাই।”বলেই হেসে দেয় নীরা।”

কেয়া সাথে সাথে দ্বীপকে বলে,”আসসালামু আলাইকুম,স্যার।

নীরা ভ্রু কুচকে বলে,”উনি এখন তোর স্যার না।উনি তো এখন তোর জিজু। স্যার তো কলেজে।শুনুন আমাদের কেয়া প্রেমে পড়েছে এক সাদা বিলাইয়ের।তার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছি।আমরা তো চলে যাচ্ছি ও এবার ঘুরুক ওর মতো।”

বলতে না বলতেই রিক হাজির।দৌড়ে এসেছে সে।দ্বীপকে দেখতে পায়নি।হাফাতে হাফাতে বলে,”আগে বলবে না তুমি এখানে এসেছো। ক্লাসেই ঢুকতাম না তাহলে।পিছনের গেট দিয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে।”

বলেই দেখতে পেলো দ্বীপকে।ভয়তে ঢোক গিলতে থাকে রিক।নীরা আবারও রিককে বলে ওঠে,”ভয় পাবেন না ভাইয়া।উনি তো এখন আপনাদের স্যার না উনি এখন আপনাদের জিজু।”

দ্বীপ চোখের চশমা ঠিক করে গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলে,”তাড়াতাড়ি আসো বাড়িতে যেতে হবে।”

বলেই চলে যায়।কেয়া সাথে সাথে ব্যাগ থেকে পানি বের করে খেতে থাকে।এতক্ষণ ভয়তে ছিলো।নীরা ওদেরকে বিদায় জানিয়ে দৌড়ে উঠলো গাড়িতে।

বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয় নীরা ও দ্বীপ।একসাথে ঘরে এসে দ্বীপ গল্পের বই হাতে নেয়।বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বলে,”আমি যদি সবার জিজু হই তাহলে তোমার কি হবো?”

নীরা মিনিকে নিয়ে খেলা করতে থাকে।দ্বীপের এমন কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।দ্বীপ চশমা ভালোভাবে সেট করে বলে,”কি হলো বউ!বলো কি হই আমি তোমার?”

মিথ্যে হামি তুলতে তুলতে নীরা বলে,”আমি এখন ঘুমাবো। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি আমার।”

বলেই মিনিকে নিয়ে কম্বল মুড়ি দেয় নীরা।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-০৯

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৯
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দ্বীপ কলেজে চলে যায় আর নীরা নিজের বাসায় আসে।দীপান্বিতা ও অভ্রকে সাথে করে নিয়ে আসে।দ্বীপ কলেজ শেষ করে নীরাদের বাসায় আসবে।বাসায় এসে নীরা মা বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলো কিছুক্ষণ।তারপর ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে যায়। ব্যালকনিতে দাড়ানোর সাথে সাথে মিসেস শিউলি দ্বীপের দাদী ছাদ থেকে বলে,”কি গো নতবৌ!শশুর বাড়ি দেখবার জন্য এখানে আসছো নাকি?”

“আমি বাসায় থাকলে তো এই ব্যালকনিতে দাড়িয়ে থাকতাম।তোমাদের দেখার ইচ্ছা হলে তোমাদের বাসায় চলে যাবো।”

“তোমার ভাগ্যটা বহুত ভালো।কি সুন্দর বাপের বাড়ি আর শশুর বাড়ি পাশাপাশি পাইছো।আমার নাতনির সোহাগ পাইবা আবার বাপের বাড়ির কথা মনে উঠলে দেখতে পাইবা।”

“তোমার ভাগ্যটাও ভালো দাদী।কি সুন্দর নাটবৌ ফিরুনিতে বাপের বাড়ি আসছে আর তারপরও তার মুখ দেখতে পারছো।কয়জন দাদী শাশুড়ির ভাগ্য এমন হয় বলোতো?”

কথা বলতে বলতে অভ্র আসে সেখানে।তিনজনে মিলে গল্প করে কিছুক্ষণ।

নীরবের ঘরটিতে আজ দীপান্বিতা ও অভ্র থাকবে।কয়েকদিন ধরে বিয়ের কাজকর্মের জন্য অনলাইনে ড্রেস সেল করতে পারেনি দীপান্বিতা।আজ অনলাইনে লাইভে শাড়ি পরে এসেছে।লাইভে এক একটি শাড়ি খুলে দেখাচ্ছে আর দাম বলছে।

জার্মান থেকে দীপান্বিতার লাইভ ভিডিও দেখতে থাকে নীরব।স্ক্রীনে দীপান্বিতার মুখে হাত ছুঁয়ে বলে,
“আমার ময়াবন বিহারিনী।
আমার এক সময়ের প্রণয়ের নারী,
সে এখন আমার জন্য এক নিষিদ্ধ নারী।
তোমায় হারিয়েছি আমি চিরতরে,
তবুও থাকিবে তুমি আমার এই বক্ষস্তরে।”
বলেই চোখের পানি মুছতে থাকে।

নীরব জার্মানে গেছে আজ পাঁচ বছরের একটু বেশি।ফুড নিউট্রিশন নিয়ে পড়াশোনা করতে অনেক জায়গায় এপ্লাই করে সে।কিন্তু ভাগ্য তাকে জার্মানে সিলেক্ট করে।জার্মানে আসার আগে দীপান্বিতার সাথে ছিলো তার প্রেমের সম্পর্ক।দীপান্বিতাকে ছোট থেকেই পছন্দ করতো। আস্তে আস্তে ভালোবাসা শুরু হয়।একই স্কুলে পড়াশোনা করতো তারা।নীরব কলেজে উঠেছিলো আর দীপান্বিতা ক্লাস নাইনে উঠছিলো।এমন সময় নীরব প্রোপজ করে দীপান্বিতাকে।দীর্ঘ আড়াই বছর প্রেম করে তারা।এরপর নীরব চলে যায় জার্মানে।জার্মানে যাওয়ার পরও তাদের কথাবার্তা চলতো।হঠাৎ ছয়মাস পর থেকে দীপান্বিতাকে পাওয়া যায় না।নীরা তখন ছোট তাই ওর কাছেও খোঁজ খবর নিতে পারতো না।এরপর হঠাৎ একদিন মিসেস নাজনীনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে বলতে অভ্র সামনে আসে।
নীরব জিজ্ঞাসা করে,”বাচ্চাটি কে?”

মিসেস নাজনীন বলে ওঠে,”আমাদের দীপান্বিতার ছেলে অভ্র।”

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে আর কথা বলার রুচি থাকে না নীরবের।সাথে সাথে কল কেটে দেয়।এর কয়েকদিন পর দীপান্বিতা কল করেছিলো কিন্তু নীরব কল কেটে দিতো।তারপর নিজে থেকে ফোন নম্বর ও বিভিন্ন ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করে।খোঁজ খবর রাখে না দীপান্বিতার।

কলেজে শেষ করে কেয়া এসেছে নীরার সাথে আড্ডা দিতে।কলেজের ভিন্ন ইনফরমেশন সবগুলো মনোযোগ দিয়ে কালেক্ট করেছে কেয়া।দ্বীপ যে তাকে ওয়ারনিং দিয়েছে তাতে এগুলো করতেই হতো। ইনফরমেশন গুলো নীরাকে দিয়ে বলে,”ভালোভাবে পড়শোনা করবি। আর ফাঁকিবাজি হওয়া যাবে না।একজন প্রফেসরের বউ তুই।এটা মাথায় রাখবি।”

নীরা কেয়ার কপালে হাত রেখে বলে,”তুই সুস্থ আছিস তো,দোস্ত?নাকি সাদা বিলাই তোকে প্রেমের মন্ত্র না দিয়ে বিদ্যার মন্ত্র দিয়েছে!যেটা আমাকে ক্যাডার সাহেব দিতে থাকে।”

কেয়া মনে মনে বলে,”তোর ক্যাডার সাহেবের চক্করে পড়াশোনা থেকে কোনো কিছু করার উপায় আছে!আজ যে ওয়ারনিং দিয়েছে আমাকে জীবনেও ভুলবো না।”

কলেজে~~~~
নীরা কলেজে যায় নি তাই কেয়া ও রিক একসাথে বাইকে করে কলেজে যায়।রাস্তায় রোড ক্রসিংয়ের সময় দ্বীপ ও রিকের বাইক পাশাপাশি থাকে।দ্বীপ দেখে ফেলে রিক ও কেয়াকে।তারপর দ্বীপের কক্ষে কেয়াকে ডাক দেয়।

কেয়াকে দ্বীপের কক্ষে আসলে দ্বীপ বলে,”পরীক্ষা আর তিনদিন পর।তুমি নিজে পড়াশোনায় মনোযোগী না সাথে ওই গাধিটাও।কোনো প্রকার পড়াশোনায় অমনোযোগী আমি সহ্য করবো না।আজ থেকে ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে পড়াগুলো আদায় করবে। আর এই তিনদিনে যা যা শিখবে ইনফরমেশন নীরাকে দিবে।তোমাদের ক্লাসের যে টপ স্টুডেন্ট ওর থেকে এই এক সপ্তাহের ইনফরমেশন কালেক্ট করবে।দুজনে পড়াশোনা ঠিক মতো করবে আজ থেকে।নীরাকে আমি পড়াবো আর তোমার খোজ তোমার বাবা মায়ের থেকে নিবো।পড়াশোনায় তুমিও কম ফাঁকিবাজ না।আজ থেকে মনোযোগী না হলে তোমার জন্য ইশতিয়াক স্যারকে ঠিক করবো।খুব ভালো ভাবেই জানো স্যার কেমন?”

শুকনো ঢোক গিলে কেয়া বলে,”দরকার নেই স্যার আমি মনোযোগ দিয়েই পড়বো আর নীরাকেও ইনফরমেশনগুলো দিবো।”

“গুড গার্ল, আর শোনো আমি যে ইনফরমেশন দেওয়াই এটা চ মানে নীরাকে বলার দরকার নেই।”

“ঠিক আছে,কিন্তু চন্দ্রপাখি বলতে যেয়ে থামলেন কেনো স্যার?”একটু দুষ্টুমি করেই বলে কেয়া।

দ্বীপ চোখ রাঙিয়ে বলে,”ক্লাসে যাও,মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করো।”

কেয়া ভয়তে চলে যায়।দ্বীপ বিড়বিড় করে বলে,”ছাত্রী যখন বউ আর শালী হয় কত কিছুই না সহ্য করতে হয়।”

সন্ধায় দ্বীপ নীরাকে বলে,”বই বের করো পড়তে বসবে।”

“না,আমি এখন ফিরুনিতে এসেছি।নববধূ আমি এখন। কতদিন পর বাবার বাসায় এসেছি।এখন পড়তে বসবো না।”

“ভালোভাবে বলছি পড়তে বসো।”

“কেমন জামাই আপনি?শশুর বাড়িতে এসেছেন জামাই আদর খাবেন গল্প করবেন আড্ডা দিবেন তা না।খালি বলছে পড়তে বসো পড়তে বসো।এমন জামাই আমার ভালো লাগে না।”

দ্বীপ নীরার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,”দুইটা অপশন দিলাম তোমাকে। চয়েস করবে তুমি।
এক স্যার মুড,এই স্যার যদি একবার শিক্ষক মুডে চলে আসে তাহলে তার শিক্ষক থেরাপি তো জানোই।
দুই স্বামী মুড,এই স্যার যখন স্বামী মুড হয়ে যাবে তখন কিন্তু সে জামাই থেরাপি শুরু করে দিবে।
কারণ তুমি তো চাও আমি স্যার থেকে পারফেক্ট স্বামীতে রুপান্তন হই।”

কান গরম হয়ে আসে নীরার।সাথে সাথে বলে,”এগুলো কিসব কথাবার্তা স্যার?”

“ওমা এখন স্যার হয়ে গেছি!এতক্ষণ না শশুর বাড়ির জামাই আদর নিয়ে বলেছিলে!যেহেতু আমি এই বাড়ির জামাই সেদিক থেকে তুমি তো আমার বউ।তাইনা বউ!”

দূরে সরে আসে নীরা।দ্বীপের কথার ধরন মাইন্ড অন্যদিকে নিয়ে যায় তাকে।দ্বীপ আবারও আলতো হেসে চোখের চশমা ঠিক করে নীরার চোখের দিকে তাকায়। নীরাও তাকায় চশমা ওয়ালা এই চোখের দিকে।

দ্বীপ নীরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই স্যারকে যদি স্বামী হিসেবে এখনই চাও সত্যি বলছি এই বছরে তোমার হাতে ইন্টারের রেজাল্ট নয় আমাদের চুনু মুনু আনার রিপোর্ট এনে দিবো।”

নীরা প্রতিত্তর না করে শুকনো ঢোক গিলে।দ্বীপ আবারও বলে,”কিসের মিষ্টি খাওয়াতে চাও সবাইকে?আমাকে ভালো স্যার হওয়ার রেজাল্টের নাকি ভালো স্বামী হওয়ার রেজাল্টের?”

“পড়তে বসবো আমি। আর কোনো ফাঁকিবাজি করবো না।কি কি পড়তে হবে বলেন আমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো পড়তে বসতেছি।”

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-০৮

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৮
#ইশরাত_জাহান
🦋
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই বৌভাতের জন্য প্রস্তুতি নেয়।নীরাকে সাজাতে বসানো হয়।নীরার সাজের জন্য দীপান্বিতা এসে নীরাকে খাইয়ে দেয়।ঠিক তখনই পিংকি এসে খোঁচা দিয়ে বলে,”এত বড় মেয়েকে আবার খাইয়ে দেওয়া লাগে।”

নীরা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।ঠিক তখনই পিছন থেকে দ্বীপ বলে ওঠে,”তোর বিয়ের সময় যখন সাজানো হবে তুই নিজের হাতে খাবি।কেউ তোকে খাওয়ায় দিবে না।আমার বউকে কে কি করলো না করলো এটা আমরা দেখে নিবো।”

প্রিয় ব্যাক্তির মুখে অন্যকে বউ বলে সম্মোধন করা শুনে কষ্ট পেলো পিংকি।বিয়ে করেছে বউ তো হবেই।কিন্তু তাই বলে এভাবে বউ বউ বলে গান গাইতে থাকার তো কিছুই নেই।ওখান থেকে চলে গেলো পিংকি।দীপান্বিতা ও নীরা মিটমিট হাসতে থাকে।দ্বীপ এসেছিলো বৌভাতের জন্য পাঞ্জাবি পড়তে।লোকজন চলে এসেছে।একটু পর দুপুরের খাওয়া দাওয়া শুরু হবে।নীরাকে লোকজন দেখতে আসবে।

বৌভাতের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে।দ্বীপ ও নীরাকে একসাথে বসানো হয় তাদের স্টেজে।মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন এসে মেয়ের সাথে দেখা করে আত্মীয়দের কাছে গেছেন।কেয়া এসেছে নীরার কাছে।নীরা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।কেয়া এসে নীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”দোস্ত আমার সাথে কথা বলবি না?”

“তুই যা করেছিস,এতে কথা বলা যায়!”

“আমি কিছু না করলেও তোর বিয়ে হতো।কি সুন্দর বিয়ে করে বর নিয়ে পাশে আছিস।এখন বান্ধবী ভুলে গেলি!এবারের মতো মাফ কর।”আহ্লাদী কণ্ঠে।

“ঠিক আছে,করলাম মাফ।আশেপাশে দেখ তোর সাদা বিলাই এসেছে কি না।”

“আচ্ছা দোস্ত।”
বলেই মনে মনে বলে,”আমি কিছুই করিনি।করেছে তো তোর ক্যাডার সাহেব।তোকে যে হারে হারে চিনে তাই তো এদিক ওদিক লোক লাগিয়ে রেখেছে।তুই নিজেও জানিস না তোর অগোচরে কি কি হয়েছে।”বলেই কেয়া অন্যদিকে যায়।

সবাই খাওয়া দাওয়া করে এখন ছবি তুলতে শুরু করে।এমন সময় পিংকি এসে দ্বীপের হাত ধরে বলে,”চলো আমরাও ছবি তুলি।”

দ্বীপ হাত সরিয়ে নেয়।সাথে সাথে নীরা বলে,”হ্যা হ্যা ছবি তো আমরা সবাই তুলবো।সাথে ফেইসবুকে পোস্ট করবো।ক্যাপশন থাকবে মাই হাব্বি উইথ মাই বিবেকহীন ননদ(সিস্টার ইন ল)।আংকেল আপনি আমাদের ছবি তুলে দেন।”

পিংকি রেগে যায়।সাথে সাথে স্থান ত্যাগ করে।কেয়া এসে জিজ্ঞাসা করে,”এটা কে দোস্ত?”

“আমার না হওয়া সতীন।একদম সুপার গ্লু আঠার মতো।এসেছে মাত্র চার ঘণ্টা হয়েছে।ক্যাডার সাহেবের লেজ ধরার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে।”

“এর নামই কি পিংকি?”

“হ্যা কিন্তু তুই কিভাবে জানলি?”

“কিছুনা,এমনি।”বলেই মনে মনে বলে,”আমি যা জানি তুই তাও জানিস না।”

রিক এসে দ্বীপ ও নীরাকে কংগ্রাচুলেট করে।তারপর তাকায় কেয়ার দিকে।নীরা বুঝতে পারে রিক কেয়ার সাথে আলাদা কথা বলতে চায়।তাই নীরা কেয়াকে হাত দিয়ে হালকা খোচা মেরে বলে,”যাও যাও তোমার দিন আসতেছে তাড়াতাড়ি।”

লজ্জা পেয়ে কেয়া চলে যায়। ছাদের এক কোনায় এসে দাড়ায় কেয়া।রিক তার পাশে এসে বলে,”কাল কল দিয়েছিলাম।রিসিভ করনি কেনো?”

“ওতো রাতে কল দিয়েছিলেন কেনো?”
“যদি বলি তোমাকে মিস করতেছিলাম!”
“কেনো?আমাকে হঠাৎ এত মিস করতেছেন কেনো?”
“সব কথা একদিনে বলবো! আস্তে আস্তে জানতে পারবে।”
“আচ্ছা,এমনিতেও কাল রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম।টায়ার্ড লাগছিলো খুব।”
“চলো আমরাও কিছু ছবি তুলি।”
“আচ্ছা।”

বলেই রিক ও কেয়া ছবি তুলতে থাকে।কেয়ার প্রতি রিকের এই এট্রেকশন রিকের মা খুব ভালো করেই খেয়াল করেছেন।ছেলের তার বিয়ের বয়স হতে যাচ্ছে।পঁচিশে পা দিয়েছে।এখন এমনিতেও বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছেন।রিক মাস্টার্সের পাশাপাশি একজন ফ্রিল্যান্সার।মাস্টার্স শেষ হলে বাবার ব্যাবসা সেই দেখবে।তাই ছেলের বিয়ে নিয়ে খুব বেশি টেনশন নেই।কেয়াকে যদি রিক পছন্দ করে থাকে তাহলে কেয়ার বাসায় কথা বলে বিয়ের ব্যাবস্থা করবেন তিনি।

বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে নীরা ঘরে বসে নীরবের সাথে কথা বলতে থাকে।নীরব বোনকে দেখতে থাকে মন দিয়ে।সরাসরি তো দেখতে পারলো না বোনের বিয়ে।
নীরা বলে ওঠে,”ভাইয়া তোমার পরীক্ষা কবে শেষ হবে?”

“এই তো আর দুইটা পরীক্ষা আছে।এরপর সার্টিফিকেট পেলেই চলে আসবো।পরীক্ষা তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো দিয়েছি।দেখা যাক কি হয়!”

“তাড়াতাড়ি চলে এসো আর আমার জন্য অনেক অনেক কসমেটিকস আনবে।”

“ঠিক আছে পাগলী বোন আমার।”

এদের কথার মাঝেই ঘরে দীপান্বিতা আসে।নীরাকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে আসে।দীপান্বিতা এসে বলে,”কি করছে আমার ভাবী?”

নীরব দীপান্বিতার কন্ঠ শুনতে পেলো।সাথে সাথে নীরাকে বলে,”আমি রাখছি বোন।পড়তে বসতে হবে। হাতে সময় কম,বাই।”
বলেই কল কেটে দেয়।

কল কেটে দিয়ে নীরব যায় ফোনের গ্যালারিতে।কিছু ছবি দেখতে দেখতে বলে,”আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি ভীষন সুখেই আছো।আমার ‘মায়াবন বিহারিনী’।”বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নীরব।

দীপান্বিতা একটু কষ্ট পেলো।আজ পাঁচটি বছর হলো লোকটি জার্মানে গেছে।কোনো খোঁজ খবর নেই তাদের।অথচ এক সময় তাদের কতই প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো।মনের কষ্ট মনেই রেখে দীপান্বিতা বলে,”মা খেতে ডাকছে। আংকেল আন্টি এখনও আছে।আণ্টি থাকতে থাকতে সবাই একসাথে খেতে বসতে চাই।তাই তাড়াতাড়ি এসো।”
বলেই চলে গেলো দীপান্বিতা।দরজার কোনায় এসে চোখ থেকে গড়ে পরা ছোট পানির বিন্দু টুকু মুছতে থাকে।

নীরা খুব বেশি কিছু না বুঝলেও দীপান্বিতার কণ্ঠে মন খারাপের ছাপ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে।নীরা কিছু বলার আগেই দীপান্বিতা চলে যায়।তাই আর জানতে পারলো না কেনো দীপান্বিতা মন খারাপ করেছে।

রাতের বেলা দ্বীপ ও নীরা ঘুমানোর জন্য ঘরে আসে।দ্বীপ চারপাশ ভালোভাবে পরখ করে।তারপর বলে,”কোথায়?”

চোখ ছোট ছোট করে নীরা বলে,”কে কোথায়?”

“আমাদের বিয়ের আগে পয়দা করা বাচ্চা (মিনি)।”

“ওকে আম্মু আব্বু নিয়ে গেছে। কাল তো ফিরুনিতে যাবো।তাই আজ রাতে ওকে দিয়ে দিয়েছি।”

“আর চারদিন পর তোমার টেস্ট পরীক্ষা।মাথায় আছে তো?”

“বিয়ে করেছি আমি।এখন আমি কারো বউ হয়েছি।সংসারের দায়িত্ব আছে আমার।পড়াশোনা নিয়ে ভাবলে হবে!”

“তোমার বর তোমাকে সংসার করার জন্য পেরা দিচ্ছে না।পড়াশোনা করবে মনোযোগ দিয়ে।আজ ক্লান্ত তাই পড়তে হবে না। কাল থেকে পড়াশোনা শুরু তোমার।আগে তো রাতে দেড় ঘণ্টা পড়াতাম।এখন ছয়ঘণ্টা পড়াবো।”

“এই জন্য বিয়ে করেছি আমি!”
“তা কিসের জন্য বিয়ে করেছো তুমি?”
“মন দিয়ে সংসার করবো বলে।এখন আমি আপনার ছাত্রী না আপনার বউ।”
“তাহলে আসো।”
“কোথায়, আর কেনো?”
“কাছে আসো,সংসার করি।আজ তো বিয়ের দ্বিতীয় রাত।শুরু করি আমাদের সংসার ‘বউ’।”

দ্বীপের ভাব গতি দেখে নীরা আর কিছু বলে না।চুপ করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে যায়।দ্বীপ ঠোঁট কামড়ে হাসে।লাইট অফ করে সেও ঘুমিয়ে পড়ে।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-০৭

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৭
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকাল সকাল বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেংগে যায় দ্বীপ ও নীরার।ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে নীরা বসে।তারপর বলে ওঠে,”সকাল সকাল শশুর বাড়িতে ডাকাত পরলো নাকি।শশুর বাড়িতে আসতে পারলাম না প্রথম দিনই ঝগড়া ঝাটির শব্দে ঘুম ভাঙলো।”

পাশে বসা দ্বীপ চোখের চশমা পরে নিলো।তারপর দ্বীপ ও নীরা একসাথে বের হলো ঘর থেকে।নীরার পোশাক ঠিক ছিলো।কিন্তু শাড়িটা একটু বেকে আছে,কপালের টিপ উল্টে গেছে,চোখে দেওয়া চিকন কাজল লেপ্টে গেছে,লিপস্টিক হালকা উঠে গেছে।এগুলো ভালোভাবে পরখ করলো দ্বীপের দাদী মিসেস শিউলি।

মিসেস শিউলি এসে নীরাকে বলে ওঠে,”কি গো নাতবৌ!আমার নাতি বিড়াল টিরাল মারতে পেরেছিলো ঠিকমতো?”

সদ্য ঘুম থেকে ওঠা নীরা সরল সহজ মনে অন্য কিছু ভেবে বলে ওঠে,”অনেক জোরে মেরেছে দাদী।ব্যাথা পেয়েছে খুব।”

অবাক হলেন মিসেস শিউলি।বলে ওঠে,”কি কও তুমি?এ কেমন বিড়াল মারা যেখানে সে নিজেই ব্যাথা পায়!”

টনক নড়লো নীরার।ওর যে কাল বাসর ছিলো আর এই বুড়ি তারই সূত্র ধরে বিড়াল মারার কথা বলছে এখন বুঝতে পারলো।জিহ্বায় কাপড় দিলো সাথে সাথে।পাশে তাকিয়ে দেখে দ্বীপ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।নীরা দাত বের করে দেয় এক হাসি।দ্বীপ মুড নিয়ে বলে ওঠে,”ইডিয়েট।”

নীরা কথা এড়াতে বলে ওঠে,”আচ্ছা দাদী বাড়িতে ডাকাত পড়েছে ইয়ে না মানে এত চিল্লাচিল্লি কেনো?”

মিসেস শিউলি হামি তুলে বলে,”ডাকাতই পরেছে নাতবৌ,নাটক তো সবে শুরু হলো। সাদে কি আর তোমাদের বিয়ে এত তাড়াতাড়ি করে দেওয়া।ওই যে সুপার গ্লু আঠা তোমার বরের পিছনে লাগছে।এখন তুমি গরম পানি হইয়া তোমার বরের থেকে ওরে ছাড়াও।”

মিসেস শিউলির কথার আগা মাথা বুঝলো না নীরা।দ্বীপ বুঝতে পেরেছে কি হয়েছে।তাই আর সে বাবা মায়ের ঘরে গেলো না।চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ দ্বীপের বাবা মায়ের ঘর থেকেই আসছে।দ্বীপ ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেছে।নীরা দ্বীপের বাবা মায়ের ঘরে গেলো।

নীরাকে দেখে সবাই চুপ হয়ে যায়।ভালোভাবে দেখে নেয় সবাই নীরাকে।এর ভিতরে একটি মেয়ে নাম পিংকি বলে ওঠে,”এই দেখো মা এই মেয়েটি সেই কাল নাগিন।যে আমার থেকে আমার দ্বীপ বেবীকে নিয়ে নিয়েছে।”

পিংকির কথা শুনে পিংকির মা মিসেস সাদিয়া মিস্টার সমুদ্রকে বলে ওঠে,”এটা তো তোমাদের প্রতিবেশী ভাই।এই মেয়ে তো এসএসসি তে ডাব্বা খাওয়া।বয়সেও কম আমাদের দ্বীপের থেকে।এর থেকে আমার পিংকি কত ভালো।একটা ক্লাসেও ফেইল করেনি।তারউপর বয়সে দ্বীপের সাথে মানাতো। আমার মেয়েটা সেই ছোটবেলা থেকেই দ্বীপকে ভালোবাসে। আর তুমি কি না আমার মেয়ের সাথে বিয়ে না দিয়ে এক ফেলটুশের সাথে বিয়ে দিলে!”

মিসেস সাদিয়া আর মিস্টার সমুদ্র ভাই বোন।না,আপন ভাই বোন না।মিস্টার সমুদ্রের বাবার দ্বিতীয় বউয়ের সন্তান মিসেস সাবিনা।যেহেতু বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে মা কিছু বলেনি তাই মিস্টার সমুদ্র চুপ থাকতেন।মিসেস সাদিয়ার মাকে ছোট মা বলেই ডাকতেন।একই বাড়িতে বেড়ে ওঠা মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস সাদিয়া ভাই বোন হয়েই বড় হয়।মিস্টার সমুদ্রের মনে বাবার জন্য অভিমান থাকলেও কখনও প্রকাশ করেনি।বাবার মৃত্যুর আগে তাকে ওয়াদা করতে হয় যে সে কখনও মিসেস সাদিয়াকে অবহেলা করবে না।তাই এখনও ভাই বোনের সম্পর্ক অটুট আছে।মিসেস সাদিয়ার মা ছোটবেলায় মারা গেছেন।এজন্য মিসেস শিউলি তাকে বড় করেছেন।কিন্তু মিসেস সাদিয়া হয়েছে একদম তার মায়ের মত কুচুটি ও লোভী।এজন্য মিসেস শিউলি এদের মন থেকে পছন্দ করে না।মৃত স্বামীর দেওয়া ওয়াদা পালন করেন শুধু।তানাহলে মিসেস সাদিয়ার সম্পত্তি আলাদা করে সে কবেই নিজের মত থাকতে পারতো।

মিসেস সাদিয়ার ন্যাকা কান্না সহ্য হয় না মিস্টার সমুদ্রের।তারপরও তিনি নম্র কণ্ঠে বলে ওঠে,”আমাদের নীরা একবার এসএসসি তে ফেইল করলেও পরেরবার কিন্তু ও A+ পেয়েছে।শুধু একবার ফেইল করেছে বলে ওই দুই সাবজেক্টটিতে হায়ার মার্কস উঠাতে পারেনি।বাকিগুলো কিন্তু ওর সব আশির উপরে মার্কস। আর বয়স আমাদের কাছে বড় ফ্যাক্ট না।আমাদের সবার মনে নীরার জন্য আলাদা জায়গা তৈরি হয়েছে।আমরা শত চেয়েও পারিনি দ্বীপের জীবনে অন্য মেয়েকে আনতে।আমার সাবিনা আমার কাছে কখনও কিছু চায়নি।এই প্রথম বলেছে সে তার পুত্রবধূ হিসেবে নীরাকে চায়।আমিও না করতে পারিনি।বউয়ের একটাই চাওয়া এটি তো পূরণ করতেই হবে।”

অবাক হলেন মিসেস সাবিনা।শুধু তার একার চাওয়া! আর কারোর চাওয়া ছিলো না!কি সুন্দর নিজেকে বাঁচাতে বউয়ের নামে দোষ।কিছু বললেন না তিনি এখন।রাতে একা পেলে বেটাকে বোঝাবে মিথ্যা দোষ দেওয়ার মজা কি?

নীরা ইমোশন হয়ে মিসেস সাবিনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আণ্টি তুমি আমাকে এত ভালোবাসো?আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”

মিসেস সাবিনা জড়িয়ে ধরে নীরাকে।মনে মনে বলে,”ওরে মা তোকে আমরা যত ভালোবাসি তার থেকে বেশি ভালো তোকে তোর ক্যাডার সাহেব বাসে।এজন্যই তো পিংকি দশ দিনের জন্য বাইরে ঘুরতে যাওয়ার সাথে সাথে তোর ক্যাডার সাহেব আমাদের হাতে পায়ে ধরে তোদের বিয়ে দেওয়ায়।”

মনের কথা মনে রাখলেন মিসেস সাবিনা।নীরাকে আপাতত জানানো যাবে না দ্বীপ যে তাকে ভালোবাসে।এই মেয়ে যে পড়া চোর।যদি জানতে পারে তাহলে দ্বীপকে ভালোবাসার ব্লাকমেইল করে পড়াশোনা বাদ দিয়ে নাচতে শুরু করবে।

পিংকি এসে বউ শাশুড়ির ভালোবাসা দেখে ভেংচি কাটে।বলে ওঠে,”ঢং দেখলে বাঁচি না।”

অভ্র ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলো।পিংকির কথা শুনে বলে ওঠে,”আসো তোমার নাক টিপে ধরে রাখি।শ্বাস আটকে মারা যাবে সাথে সাথে।তাহলে আর ঢং দেখতে হবে না।”

দীপান্বিতা সাথে সাথে অভ্রর মুখ চেপে ধরে বলে,”ছিঃ বাবা,এসব বলতে নেই।”

মিসেস সাদিয়া অভ্রকে সহ্য করতে পারে না।উটকো ঝামেলা মনে করে এই অভ্রকে।তাই তিনি বলে,”এই আসছে আরেক হ”ত”ভা”গা। যার জন্মের ঠিক ঠিকানা নেই সে আবার আমার মেয়েকে মারতে চায়।”

তেতে ওঠে দীপান্বিতা।সাথে সাথে বলে,”মুখ সামলে কথা বলো ফুফু।আমি মানছি ছোট মানুষ এর ভিতর কথা বলে ভুল করেছে।কিন্তু আমার ছেলেকে নিয়ে একটা বাজে কথাও বলবে না।আমি এসব সহ্য করবো না।ও কোথায় কিভাবে হয়েছে তোমাকে না দেখলেও চলবে।এর জন্য ওর নানু নানী মা মামা এরা আছে।”

“আমিও আছি,অভ্রর মামী।”হাত উচু করে বলে নীরা।

বেশি তর্ক করতে গেলে পরিবার বিচ্ছেদ হয়ে যাবে।এর ফলে নিজের স্বার্থ হাসিল হবে না।তাই মিসেস সাদিয়া চুপ হয়ে যায়।এমনিতেও পিংকিকে এই বাড়িতে থাকতে হবে।পড়াশোনার জন্য ঢাকায় মামার বাড়িতে থাকে পিংকি।

মিস্টার সমুদ্র বলে ওঠে,”আচ্ছা এসব কথা এখন বাদ সন্ধায় বৌভাত অনুষ্ঠান হবে।অনুষ্ঠানটি আমাদের ছাদে করা হবে।সেসবের আয়োজন শুরু করা হোক।দ্বীপের ছুটি খুব কম।তাড়াতাড়ি শেষ করে ওকে আবার কলেজ যাওয়া লাগবে।”

সবাই সম্মতি জানিয়ে যে যার মতো কাজে চলে যায়।নীরা বের হবে কিন্তু কিছু একটা ভেবে পা থামিয়ে পিংকির দিকে তাকিয়ে ভালোভাবে পিংকিকে দেখে নেয়।মনে মনে অনেক কিছুই একে ফেলে নীরা।তারপর প্রস্থান করে নিজের ঘরে।

ঘরে এসে নীরা ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে যায়।তখনই দ্বীপ বের হয় ওয়াশরুম থেকে।দ্বীপের গায়ে একটি টাওয়াল থাকে শুধু।নীরা দ্বীপকে দেখেই অন্য দিকে ফিরে চোখ বন্ধ করে নেয়।তারপর বলে,”বেলজ্জা পুরুষ মানুষ।ঘরে যে আপনার বউ এসেছে এটা কি ভুলে গেছেন?”

দ্বীপ আলমারি থেকে কাপড় নিতে নিতে বলে,”ঘরে বউ এসেছে এটা ভুলিনি।তবে ঘরে যে বউ রূপে বেগানা রমণী ঢুকেছে এটা ভুলে গেছি।কি দিন আসলো!বউয়ের থেকেও না কি নিজেকে প্রোটেক্ট রাখতে হবে?”

‘বউ’ শব্দটি নীরার কানে বাজতে থাকে।মূলত কবুল বলার পরপরই এই ক্যাডার সাহেবকে কেমন অন্যরকম লাগছে তার কাছে।ক্যাডার সাহেব বদলায়নি।বদলেছে তো নীরার মন।এতদিন এই ক্যাডার সাহেব ছিলো তার শিক্ষক এখন এই ক্যাডার সাহেব তার তিন কবুল বলা বৈধ স্বামী।ভাবতেই মনের ভিতর দিয়ে শীতল হওয়া বয়ে নিয়ে যায়।

নীরার চোখ বন্ধ অবস্থায় ফিল করতে পারে দ্বীপ তার নিকটে এসেছে।অতি নিকটে এসে দ্বীপ বলে,”চোখ খোল।”

নীরা না বোধক মাথা নাড়ায়।তারপর বলে ওঠে,”আপনি উলংগ।পোশাক দ্বারা নিজেকে আবৃত করে নিন।তারপর চোখ খুলবো।”

দ্বীপ নীরার মাথায় আলতো চাটি মারে।ব্যাথা পেয়ে চোখ খুলে নীরা।দেখে দ্বীপ পোশাক পরেছে।দ্বীপ বাইরে যেতে যেতে বলে,”যত্তসব আলতু ফালতু চিন্তা মাথায় ঘুরপাক করে তাই না!ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসো সকালের খাবার দুপুরে খাওয়া আমি পছন্দ করি না।”

দ্বীপ যেতেই নীরা নিজের মাথায় নিজেই বারি দিয়ে বলে,”আই হেট মাই মাইন্ড।”

ফ্রেশ হয়ে দীপান্বিতার কথাতে একটি গোলাপী শাড়ি পরলো নীরা।তারপর দীপান্বিতা নীরাকে নিয়ে এলো ড্রয়িং রুমে।সবাই একসাথে সকালের খাবার খাবে বলে অপেক্ষা করছে।দ্বীপ এসে খাবার টেবিলে বসেছে।প্রায় সবাই বসে আছে।নীরাকে দ্বীপের পাশে বসাতে যাবে তার আগে পিংকি এসে দ্বীপের পাশে বসেছে।সবাই পিংকির এই কাজ দেখে ক্ষিপ্ত হলো।শুধু মিসেস সাদিয়া বাদে।

বসতে বসতে পিংকি বলে ওঠে,”খুব খুদা লাগছে মামী।তোমাদের বউমার জন্য কত অপেক্ষা করতে হয়!এখন খাবার দেও।

দ্বীপ হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যায় তার আগে নীরা বলে ওঠে,”কি কপাল আমার!নতুন বিয়ে করা জামাই বউ আমরা। কোথায় এখন বর বউ একসাথে বসে খাবো তা না মাঝখানে দেওয়াল হয়ে বসে আছে আমার ফুফাতো ননদ।বলি বরের যদি তার বোনের পাশে বসেই খেতে হয় তাহলে বিয়ে করেছিলো কেনো?আমাকে শোপিস হিসেবে সাজিয়ে রাখবে বলে!”

এটুকু বলেই নীরা পিংকির হাত ধরে উঠিয়ে আবার বলে,”আমার দুষ্টু ননদ,ভাবী কিন্তু তোমার এসব কাজে অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিয়ে দিবে।তাই সময় থাকতে বিবেগবোধ গুলোকে জাগ্রত করো।যেখানে যেই সম্পর্ক বিদ্যমান সেখানে সেভাবেই থেকো।”

দ্বীপ খুশি হয় নীরার কথা শুনে।দ্বীপ ভেবেছিলো নীরা কিছু বলবে না তাই নিজে উঠতে চেয়েছিলো।কিন্তু তার বউ যে সম্পর্কের মূল্য ধরে রাখবে এটা বুঝে উঠতে পারেনি।পিংকি ভেবেছিলো নতুন বউ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না।তাই সে দ্বীপের পাশে বসে।কিন্তু এই মেয়েতো লাগামহীন কথাবার্তা শুনিয়ে দিলো।এদিকে সবাই আবার এ জন্য খুশি হয়েছে।এটা সবার মুখ দেখলে বোঝা যায়।তাই না পেরে পিংকি তার মায়ের পাশে বসে।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-০৬

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৬
#ইশরাত_জাহান
🦋
কে ধাক্কা দিলো দেখার জন্য পিছনে তাকালো দ্বীপ।তাকিয়ে দেখতে পেলো গাঢ় খয়েরী রঙের শাড়ি পরিহিতা এক মেয়ে।মেয়েটি আর কেউ না নীরা। নীরা দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খায়। কার সাথে ধাক্কা খেলো তাই দেখতে যেয়ে দেখতে পেলো দ্বীপকে।

দ্বীপ নীরাকে দেখে বলে,”তুমি না পালিয়েছো?পালিয়ে ঠিক তার কাছেই এলে যাকে বিয়ে করবে না।”

নীরা পিছনের দিকে তাকিয়ে আশেপাশে ভালো করে দেখে নিলো।তারপর বলে,আসলে আমি নিজেকে বাঁচাতে দৌড়াচ্ছি।”

“মানে?”

“একটু আগে আমি একা একা স্টেশনে বসেছিলাম।মনের সুখে আপনাকে এসএমএস করতে থাকি।একেতো শীতের সন্ধ্যা তার উপর মশা কামড়ায়।আমি বারবার কেয়াকে কল দিতে থাকি ও কল রিসিভ করে না।হঠাৎ এক চিকনা শুটকি মাছের মত গুন্ডা আমার কাছে আসে।

আমাকে বলে,”সুন্দরী বাড়ি থেকে পালিয়েছো বুঝি!অনেকক্ষণ ধরে বসে আছো। বয়ফ্রেন্ড আসছে না।ওই বয়ফ্রেন্ড আর আসবে না।তাতে কি আমি তো আছি। চল আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”
বলেই আমার হাত ধরে টানতে থাকে।আমি কোনো মতে তার হাত কামড়ে চলে এসেছি।”
হাপাতে হাপাতে বলে নীরা।তারপর আবার বলে ওঠে,”আপনি এখানে কেনো?”

“আমিও পালিয়েছিলাম।”
“মানে কি?”
“মানে বিয়ে যেহেতু তুমি করবে না তাই আমিও এখানে আসি।”
“ওহ আচ্ছা,তার মানে আমরা দুজনে বাসা থেকে পালিয়েছি।আগে যদি জানতাম আপনি পালাবেন তাহলে আমি আর পালাতাম না।”
“এখন কি করবে?”
“কি আর করব!কেয়া ফোন ধরলে ওর বাসায় থাকব।”

ওদের কথার ভিতর সেখানে হাজির হয় চারজন লোক।তারা এসে জিজ্ঞাসা করে,”তোমরা এখানে এই অসময়ে কি কর?”

নীরা ও দ্বীপ একে অপরকে চাওয়া চাওয়ি করে।লোকগুলো উত্তর না পেয়ে আবার বলে ওঠে,”দুজনেই তো বিয়ের সাজ।কি কি আছে তোমাদের কাছে?”

ভয় পেয়ে যায় নীরা।দ্বীপ কিছু বলতে যাবে তার আগে নীরা বলে,”আমরা তো চন্দ্রবিলাশ করতে এসেছি।”

“পাগল মনে হয় আমাদের!তোমাদের সাজসজ্জা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় তোমরা বর বউ!সাথে আরো কিছু থাকতে পারে।”

“ওই তো বিয়ে করেই বর বউ হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসেছি।আবার হাঁটতে হাঁটতে বাসায় যাবো।”

“তোমাদের কাছে কি কি আছে?”

ভয়তে এবার নীরা দ্বীপের পিছনে যায়।দ্বীপ ফিসফিস করে বলে,”আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম।তার আগে কেনো পাকনামি করতে গেলে?”

“আপনি তো এসব বিষয় অকর্মা।তাই ভেবেছিলাম আজকেও মুখে তালা মেরে বসে থাকবেন।”

লোকগুলোর ভিতর একজন বলে ওঠে,”ওই দেখো ফিসফিস করে প্ল্যান করছে।এই এদের এখনই ধরে নিয়ে চল।”

নীরা দ্বীপকে খোঁচাতে থাকে।বলে,”স্যার চলেন বাড়ি যাই। পালান এখান থেকে।বিয়ে হলে হবে কিন্তু এরা ধরে নিয়ে কোথায় গুম করে দিবে কে জানে!তাড়াতাড়ি চলেন পালাই।”বলে নীরা নিজেই দ্বীপের হাত ধরে দেয় দৌড়।ওদের পিছনে লোকগুলোও দৌড়াতে থাকে।

ওরা ওখান থেকে চলে যাওয়ার পর পিছনের গাছ থেকে বেরিয়ে আসে দুইজন মানব।তারা আর কেউ না কেয়া ও রিক।সাথে সাথে কেয়া মিসেস নাজনীনকে কল দিয়ে বলে,”আণ্টি,প্ল্যান সাকসেসফুল।ওরা এখন নকল গুন্ডাদের দৌড়ানি খেয়ে চলে যাচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে ।”

মিসেস নাজনীন হালকা হেসে ফোন কেটে দেয়।সাথে সাথে মিস্টার রবিনকে বলে,”কাজী ডাকো নীরার বাবা।ওরা বর বউ একসাথে গুন্ডাদের তারা খেয়ে এদিকে আসছে।”

বলতে না বলতে হাজির হয় নীরা ও দ্বীপ।ওদেরকে দেখে মিস্টার সমুদ্র বলে ওঠে,”কাজী বসে আছে বেয়াইন।আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।আমার বউমা নিজ দায়িত্বে নিয়ে এসেছে আমার ছেলেকে।এবার বিয়ে সম্পূর্ণ হবে।”

অগত্যা বর বউয়ের স্থানে বসতে হলো নীরা ও দ্বীপকে।কাজী এসে বিয়ে পড়ালেন তাদের।নীরা ও দ্বীপ একে অপরকে তিন কবুল বলে বিয়ের বন্ধনে জড়ালো।তারপর তারা রেজিস্ট্রি পেপারে সই করে।

বিয়ের কাজ শেষ হলে কেয়া ও রিক আসে সেখানে।কেয়া নীরার কাছে বসে বলে,”দোস্ত,মন খারাপ করিস না।জাস্ট চি…”

আর বলতে দিলো না নীরা।এবার নীরা নিজেই বলে,”এবার নিশ্চয়ই বলবি,দোস্ত কবুল বললেই তো আর বিয়ে হয় না!ভুলেও এখন এই পাপের কথা বলিস না।তিন কবুল বলে আমি ফেঁসে গেছি ক্যাডার সাহেবের বিদ্যা সাগরে।”

নীরার এই কথা শুনে হেসে দেয় বিয়ে বাড়ির সবাই।ঠিক সেই সময় উপস্থিত হয় ওই পাঁচ জন গুন্ডা।একজন যে নীরাকে একা পেয়ে হাত ধরে টান দিয়েছিলো। আর বাকিরা যারা নীরা ও দ্বীপকে একসাথে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো।

কেয়া ওদেরকে দেখিয়ে বলে,”পাগল নাকি!আজ আর বলতাম না যে কবুল বললেই বিয়ে হয় না।আসলে এতদিন আমি যা কিছু করেছি আন্টির ইন্সট্রাকশন মেনে।কয়দিন আগে বাড়ির সামনে বখাটে নান্টুকে তুই টাকা দিয়ে রেখেছিলি আর বলেছিলি যে আজ তুই পালাবি ওটা আণ্টি দেখে নেয়।তাই তো আণ্টি আমাকে সব সময় বলে দিতো তোকে কোথায় কখন কিভাবে রাখবো। আর ওই যে লোকটি তোকে স্টেশনে টিচ করে উনি হলো এই কমিউনিটি সেন্টারের দারোয়ান।আর এই যে চারজন তোদের তাড়া করেছে এনারা হলো বাবুর্চি।আণ্টি টাকা দিয়ে তোদের সাথে এই কাজ করেছে।”

নীরা একবার তাকায় কেয়ার দিকে আরেকবার তাকায় মিসেস নাজনীনের দিকে।মিসেস নাজনীন নীরার কাছে এসে বলে,”তুমি চল ডালে ডালে,আমি চলি পাতায় পাতায়।তোমারই তো মা আমি।কি করবে না করবে সব কিছুরই খোঁজ খবর রাখতে হয়।এজন্য তো আজ সারাদিন নজরে নজরে রেখেছি তোমাকে।”

মুখ ভোতা করে বসে আছে নীরা।এরা সব তার শত্রু।তাকে বানিয়ে দিলো বিদ্যা সাগরের বউ।তবে নীরা নিজেও কম না।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,”এই ক্যাডার সাহেবকে যদি আমি বিদ্যাসাগর থেকে না সরিয়েছি আমার নামও ‘মুনজেরিন নীরা’ না।”

কেয়া এবার খাবারের দিকে যায়।রাত অনেক হয়েছে।এখন খুদা লেগেছে তার।খাওয়ার জন্য টেবিলে বসতে যাবে রিক এসে বলে,”তো বেয়াইন সাপ প্ল্যান সাকসেসফুল হল।এবার কি আমরা বন্ধুত্ব করতে পারি?

“বন্ধুত্ব করাই যায়।খারাপ হবে না।”
“তাহলে বেয়াইন সাপের নাম্বার দেন মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নিব।”
কেয়া দিলো নাম্বার রিককে।তারপর একসাথে খেতে বসে তারা।

বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করে সবাই বাড়ি ফিরে।নীরাকে দীপান্বিতার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।ভালো করে সাজিয়ে দিয়ে তারপর দ্বীপের ঘরে আনা হয়।দ্বীপ এখনও আসেনি।নীরা ঘরটি ভালো করে দেখতে থাকে।তার প্রিয় হলুদ গোলাপ ও সাদা কাঠগোলাপ দিয়ে সাজানো খাট।নীরার কাছে সুন্দর লাগে।বিয়ের সবকিছুই নীরার কাছে সুন্দর লাগে।শুধু ওই বর ছাড়া।এমন থাপ্পড় থেরাপি দিতে থাকলে তাকে কি বর বানানো যায়?এমনিতে তার ক্যাডার সাহেব দেখতে মাশাল্লাহ।কোনো হিরোর থেকে কম না।ওই যে একটা গোমড়া মুখ আর কথায় কথায় থাপ্পড় থেরাপি এই জন্য অপছন্দ নীরার কাছে।দ্বীপ এসেছে রুমে।দ্বীপকে দেখার সাথে সাথে সবাই রুম ত্যাগ করে।

সবাই চলে যাওয়ার পর দ্বীপ দরজা লাগিয়ে দেয়।নীরা শুকনো ঢোক গিলতে থাকে।কিন্তু দ্বীপ নীরাকে পাত্তা না দিয়ে আয়নার সামনে যেয়ে হাত থেকে ঘড়ি খুলতে থাকে।চোখের চশমা হালকা ঝুঁকে নাকের দিকে আসে।নীরা তাকিয়ে থাকে দ্বীপের চেহারার দিকে।এই লোকটি এখন তার বর।ভাবতেই গায়ে হালকা শিহরণ দিয়ে গেলো নীরার।

দ্বীপ এসে বিছানায় শুতে যাবে ওমনি নীরা বলে ওঠে,”আপনি এই খাটে ঘুমাবেন?”

“এছাড়া কোথায় ঘুমাবো?”
“আপনি খাটে ঘুমালে আমি কোথায় ঘুমাবো?”

“আমি কি জানি? বনে জঙ্গলে সমুদ্রে যেখানে মন চায় ঘুমাও।আমি এখন ক্লান্ত ঘুমের দরকার আমার।”

বলে দ্বীপ শুতে যাবে নীরা আবার বলে ওঠে,”না আপনি বিছানায় ঘুমাবেন না।আগে আমার তিনটি শর্ত আছে।এগুলো শুনবেন তারপর আপনি ঘুমাতে পারবেন।”

“এই রাতে আবার কিসের শর্ত।প্রচুর ক্লান্ত আমি ঘুমাতে হবে।”

“ইহ আসছে আমার ঘুম পাগলা।কি মনে করেন আপনি?আপনার একার ঘুম আছে আমার ঘুম নাই।আমারও ঘুম আছে।কিন্তু এখন যদি এই কথাগুলো না বলি তাহলে আর বলতে পারব না বললেও শুনবেন না আপনি এটা আমি ভালো করেই জানি।তাই ভালোয় ভালোয় কথাগুলো শুনুন।না শুনলে এখন আমি দিবো এক চিৎকার।আমার চিৎকার শুনে কেউ না আসলেও তাদের মাইন্ড কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছেন!সবাই বলবে ওই দেখো বই পাগলা ক্যাডার সাহেব এক রাত হতে পারলো না বউ পাগলা হয়ে গেছে।”

“কি শর্ত বল?”

“আমার শর্ত তিনটি হলো,
১.আপনি বিছানার ওই কোনায় থাকবেন আর আমি এই কোনায়।আমার ধারেকাছেও আসবেন না।
২.আমাকে মাসে মাসে প্রচুর কসমেটিকস ও ড্রেস কিনে দিতে হবে।আফটার অল আমি আপনার একমাত্র বউ(ভাব নিয়ে)।
৩.ক্লাসে আমি পড়া না পারলে,বই না নিলে,বেশি বেশি গল্প করলে আমাকে বকাঝকা করতে পারবেন না।
বলুন রাজি?”

“মামার বাড়ির আবদার পেয়েছো!প্রথম শর্ত মানা যায় যদি দ্বিতীয় শর্তের কথা না বলতে।বউয়ের কাছে যেতে পারবো না আবার বউকে কি না মাসে মাসে আমার কসমেটিকস আর ড্রেস কিনে দিতে হবে।আবার ক্লাসে পড়া না পারলে কি না কিছু বলা যাবে না।”

“আমি স্কুলের ছাত্রী না যে আপনি আমাকে বকাঝকা করবেন,পানিশমেন্ট দিবেন? শর্তে রাজি না হলে বলুন আমি দিচ্ছি এক চিৎকার।”

বলেই যেই নীরা হা করে ওমনি দ্বীপ বলে ওঠে,”আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে রাজি আমি।সবগুলো শর্তে রাজি।”

“গুড ভেরি গুড।কিন্তু এই মুনজেরিন নীরা তো কারো মুখের কথা বিশ্বাস করে না।এক কাজ করুন নিজের হাতে এখানে তিনটি শর্ত লিখে নিচে লিখুন আমি এগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।”

মান সম্মানের কথা ভেবে দ্বীপকে খাতা কলম বের করে লিখে নিজের সই সহ দিতে হলো।
নীরাকে কাগজটি দিয়ে বলে,”এই জীবনে প্রথম বাসর হচ্ছে যেখানে বউ তার স্বামীকে দিয়ে সই করিয়ে নিলো।তাও আবার কি শর্ত?মাসে মাসে তাকে কসমেটিকস আর ড্রেস কিনিয়ে দেওয়া ও ক্লাসে পড়া না পারলে বকা যাবে না।”

“এটা আমাদের ডিজিট্যাল স্যার ও ছাত্রীর ডিজিট্যাল ওয়েতে বাসর।”বলেই মুখের বত্রিশ পাটি বের করে নীরা।

দ্বীপ কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পরে। নীরাও তার মত করে খাটের ওপর প্রান্তে ঘুমায়।রাতের বেলা হঠাৎ করে দ্বীপ অনুভব করে তার মুখে কি যেনো সুড়সুড়ি দিতে থাকে।দ্বীপ ঘুমের ঘোরে মুখে হাত দিয়ে ছোট নরম তুলতুলে মুখ পেয়ে ভয়তে লাফ দিয়ে ওঠে।উঠে দেখে নরম তুলতুলে জিনিসটি আর কেউ না মিনি।রেগে মেগে দ্বীপ মিনিকে হাতে নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারে।মিনি কান্না করতে থাকে।মিনির কান্নার শব্দ পেয়ে নীরার ঘুম ভেংগে যায়।উঠে দেখে দ্বীপ মিনিকে ছুড়ে ফেলেছে।রেগে গিয়ে নীরা বলে ওঠে,”আপনি আমার মিনিকে মারলেন কেনো?”

দ্বীপ নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”আসলে বাসর রাতে বিড়াল মারতে হয় তো।তাই আমি বাসরের বিড়াল মারতে না পারলেও আসল বিড়াল মারলাম।এবার হয়েছে শান্তি!”

নীরা কিছু না বলে মিনিকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে ঘুমিয়ে পরে। দ্বীপও নিজের মত করে ঘুমিয়ে যায়।

চলবে…?

লুকোচুরি গল্প পর্ব-০৫

0

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৫
#ইশরাত_জাহান
🦋
আজ নীরা ও দ্বীপের মেহেদী অনুষ্ঠান।সবাই আজ নীরাদের বাসায় এসেছে।নীরার দুই হাতে পার্লারের মেয়েরা মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে।নীরা দুইপাশে হাত পেতে বসে আসে।সামনে সবাই নাচগান করতে থাকে।

নীরার খুব ভালো লাগে এই পরিবেশটা।নীরা কেয়াকে বলে ওঠে,”নিজেকে আজ সম্রাট শাহজাহানের বেগম মমতাজ মনে হচ্ছে। আহ দুই পাশ থেকে দুজন আমার হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে,সামনে কিছু মানুষ নাচগান করে ইনজয় করছে আর কিছুক্ষণ পর পর তুই এসে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছিস।”

“তোর শাহজাহান কিন্তু আমাদের এই আদনান কবির দ্বীপ স্যার।”

নীরা কিছু বলতে যাবে তার আগে রিক আসে।রিক সবাইকে বলে ওঠে,”এখানে অনেক মানুষ আছে।আমরা সব একই এলাকার।সেই কারণে আমরা একটু কনফিউজড আছি যে কে বরপক্ষ আর কে কন্যাপক্ষ।তাই আমরা নিজেরা সিলেক্ট করলে ভালো হয় কে কোন পক্ষ।”

সাথে সাথে কেয়া বলে,”যেহেতু আমি নীরার বেস্ট ফ্রেন্ড তাই আমি কন্যাপক্ষ”

কেয়ার উত্তরে রিক হালকা হেসে বলে,”তাহলে আমি বরপক্ষ।”

“ওকে,তাহলে আপনি আমাদের অপজিটে। কন্যাপক্ষরা সব একদিকে হও আর বরপক্ষরা আরেকদিকে।”

“যো হুকুম বেয়াইন সাপ।”বলেই পক্ষ ভাগাভাগি করা হয়।

সবাই মিলে একসাথে এবার নাচগান করতে থাকে।নীরার মেহেদী দেওয়া শেষ।পার্লারের মেয়েটা জিজ্ঞাসা করে,”বরের নাম কি দিবো?”

নীরা কিছু বলে না।কেয়া বলে ওঠে,”বরের পুরো নাম আদনান কবির দ্বীপ।আপনি দ্বীপ লিখে দেন।”

নীরা চোখ বড় বড় করে তাকায় কেয়ার দিকে।কেয়া শুকনো ঢোক গিলে বলে,”দোস্ত মেহেদী তো উঠে যাবে কয়েকদিন পর।এক সপ্তাহের ব্যাপার তো।একবার একটু আন্টির দিকে তাকা।এখন যদি তুই নাম লিখতে বাধা দিস আমি শিওর আন্টির হাতে মিষ্টির পাত্র আর থাকবে না।ওই মিষ্টির পাত্রের জায়গায় আসবে বিছানা ঝারার ঝাড়ু। আর তুই শাহজাহানের ওই তাজমহল না পেয়ে জায়গা পাবি ফুটপাত।তাছাড়া মেহেদী দিলেই তো আর বিয়ে হয় না।”

নীরা তাকালো মিসেস নাজনীনের দিকে।মিসেস নাজনীন এদিক ওদিক সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করছেন আর নীরার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন।ভয়তে নীরা আর কিছু বলে না।নীরা না পেরে তার বাবার দিকে তাকায়।মিস্টার রবিন চোখের চশমা ঠিক করে অন্য দিকে ফিরে।এই দেখে নীরা বলে ওঠে,”বউ পাগলা বাপ আমার।”

কথাটা কেউ না শুনলেও কেয়া শুনে ফেলে।কারণ কেয়া নীরার ডান পাশে গা ঘেসে বসে ছিলো।বাবার নামে এমন বাক্য শুনে হেসে দেয় কেয়া।কেয়া জানে মিস্টার রবিন বউ বলতে কতটা পাগল আবার ভয়ও পায় বউকে।

কেয়ার হাসির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রিক।কেয়াকে হাত ইশারা করে দেখিয়ে বলে,”কিলার হাসি।”

কেয়া লজ্জা পায় একটু।রিকের থেকে মুখ সরিয়ে নীরার দিকে তাকায়।

রাতে নীরা তার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।এই হাতে এখন ইংরেজিতে লেখা আছে ‘Deep’

সকালে~~~~~~
সবার চিল্লাচিল্লির শব্দে ঘুম ভেংগে যায় নীরার।বিয়ে বাড়িতে কি আর ঘুম হয়?ঘুম থেকে উঠে একটা হামি তোলে নীরা।পাশে থাকা মিনিকে কোলে নিয়ে বলে,”জার বিয়ে তার খোঁজ নেই পারা পড়শীর ঘুম নেই।”

ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে গেলো নীরা।নীরা দেখলো নীরার মা সোফায় বসে শাড়ির অচল দিয়ে চোখ মুছছেন।পাশে বসা রিকের মা শান্তনা দিচ্ছেন,”আহা এভাবে করলে কি আর মেয়ে বিদায় দেওয়া যায়?মেয়েকে তো এক সময় বিয়ে দিতেই হবে।তুমি নিজেকে শক্ত রাখো।নীরব নেই তো কি হয়েছে?আমার রিক তো আছে।ও পালন করবে নীরার ভাইয়ের জায়গা।”

নীরা বুঝলো তার বিয়ে দেওয়ার জন্য যেমন লেগে আছে ঠিক তেমন কষ্টও পাচ্ছে মিসেস নাজনীন।

গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো হয়েছে।দুপুরে সবাই বিভিন্ন শ্রী সাজাতে ব্যাস্ত।রিক ও কেয়া মিলে ফুল দিয়ে স্টেজের কাজ করছে।দীপান্বিতা শ্রী সাজাতে থাকে।দ্বীপের মা মিসেস সাবিনা আলপনা আঁকাতে পারেন অনেক সুন্দর।তাই যেখানে দ্বীপ ও নীরাকে হলুদের জন্য বসানো হবে তার সামনে নিজ দায়িত্বে তিনি আলপনা আঁকেন।

সন্ধায় হলুদের আয়োজন শুরু করা হয়।দ্বীপ ও নীরাকে বসানোর একটি স্টেজ করা হয়। আর তাদের সামনে নাচ গান করার একটি স্টেজ করা হয়।নীরাকে হলুদের শাড়ি ও ফুলের গহনা পড়ানো হয়।নীরার প্রিয় হলুদ গোলাপের সাথে রজনীগন্ধার মিশ্রণ করে মালা,টিকলি,কানের দুল ও ভিন্ন গহনা যেগুলো কেয়া ও রিক মিলে বানায় সেগুলো পড়ানো হয় নীরাকে।বিয়েতে রাজি না হলেও নীরার এই সাজ যেনো ভালো লাগে।নীরা নাচতে নাচতে বিয়ে করত।যদি এই বিয়ের পাত্র আদনান কবির দ্বীপ না থেকে অন্য কেউ থাকত।কিন্তু এই ক্যাডার সাহেব যে বিয়ের পর রোমান্স না করে পড়াশোনা নিয়ে জ্ঞান দিতে থাকবে।এগুলো ভাবলেই বিয়ে করার স্বাদ মিটে যায় নীরার।

স্টেজে বসানো হয়েছে নীরাকে।পাশে দ্বীপকে নিয়ে আসে দীপান্বিতা।দ্বীপের পরনে হলুদ পাঞ্জাবী ও কালো জিন্স। হাতা ফোল্ড করা চোখে চশমা চুলগুলোতে জেল দিয়ে স্পাইক করা।নীরা আড় চোখে তাকিয়ে যেনো ক্রাস খায়।ভালোভাবে যখন দ্বীপের দিকে তাকালো দেখতে পেলো দ্বীপ মুড নিয়ে বসে আছে। আর তাকালো না নীরা এই গোমড়ামুখর দিকে।বিয়ে করতে এসে কি না মুড দেখাচ্ছে।

হলুদে সবাই এসে নীরা ও দ্বীপের মুখে মিষ্টি দিয়ে যাচ্ছে।যেই আসছে সেই খালি মিষ্টি,পায়েস আর কেক খাইয়ে দিতে থাকে।টানা এক ঘন্টা এমন চলার পর না পেরে নীরা বলে ওঠে,”আরে আণ্টি,আমাকে কি আপনার খাদক মনে হয়!সেই ধরে খালি মিষ্টি আইটেমগুলো খেয়েই যাচ্ছি।আমি এমনিতেই মিষ্টি মেয়ে।আমার আশেপাশে একজন তেতো লোক আছে তাকে ভরে ভরে মিষ্টি খাওয়ান।যদি একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করে।”

সবাই হেসে দেয় নীরার কথায়।দ্বীপ গলা খাকারি দিয়ে ওঠে।দীপান্বিতার কানে কানে মিসেস সাবিনা বলে,”তোর ভাইয়ের জন্য এই মেয়েই উপযুক্ত।সারাজীবন আমাদেরকে মুড দেখিয়ে চলতে দেখেছি।এখন থেকে দেখবো কিভাবে মুড থাকে ওর।”

পাশে দাঁড়ানো মিসেস নাজনীন শুনে ফেলেন কথাগুলো।সেও খুশি হয়।তার মেয়েকে উপযুক্ত একটি পরিবারে বিয়ে দিতে পারছে বলে।

কেয়া এসে নীরা ও দ্বীপকে হালকা হলুদ ছোঁয়ালো।তারপর হাটা দেয় স্টেজের দিকে নাচ করবে তাই।ঠিক তখনই চারপাশ থেকে লাইট বন্ধ হয়ে যায়।কেয়ার পিছন থেকে হঠাৎ বেজে ওঠে,
“এই যে বিয়ান সাপ।”

শুনতে পেয়ে কেয়া তাকায় পিছনে।দেখতে পায় রিক এসেছে ডিজের লোকজন নিয়ে।লাল আর হলুদের মিশ্রণে পাঞ্জাবি পরা রিক।কেয়া পরেছে হলুদ ও লালের মিশ্রণে একটি শাড়ি।

রিক এসে কেয়ার হাত ধরে স্টেজে নিয়ে যায়।তারপর তারা নাচতে শুরু করে।’বেয়ান সাপ আপনার জন্য ঢাকা থেকে ডিজে আনছি’ গানে।

নীরা এদের নাচ দেখে খুশিতে হাত তালি দিতে থাকে।কিসের ক্যাডার সাহেব!সে তো ভুলেই গেছে কার সাথে তার বিয়ে হচ্ছে।হলুদের সাজ গা থেকে কাচা ফুলের গন্ধ আবার সামনে প্রিয় মানুষগুলোর নাচ এগুলো দেখে সেও যেনো নাচতে শুরু করে।কেয়া ও রিক এসে নীরাকে স্টেজে নিয়ে যায়।বিয়ের বউ নিজে নাচতে থাকে।সবাই যেনো এতে আরও খুশি হয়।অভ্র এসে নীরার সাথে তাল মেলাতে থাকে।

নাচ শেষ করে কিছু মানুষ গান গাইতে থাকে।সবার গান শেষে নীরা বলে,”আমিও গান গাইতে চাই।”

নীরার যে ভাঙা গলার স্বর!এটা ভেবেই মিসেস নাজনীনের মাথায় হাত।দীপান্বিতা নীরার হাতে মাইক দেয়।নীরা গাইতে থাকে,
আমার মায়ের কথা শুইনা,
অল্প বয়সে করমু বিয়া।(২)
ক্যাডার সাহেব হবে আমার ছাইয়া,
থাপ্পড় খাইতে থাকমু আমি গাল ভইরা।(২)
কেউতো বুঝে না আমার জ্বালা,
আ আ আ..

আর গাইতে পারলো না নীরা।মিসেস নাজনীন মাইক নিয়ে নিলেন।সবাই মিটমিট হাসতে থাকে।নীরা যে ঘাড় তেরা এটা প্রতিবেশী সবাই জানে।মিস্টার রবিন খুকখুক কাশতে থাকেন।মিস্টার সমুদ্র গান হজম করতে না পেরে জায়গা ছেড়ে পালিয়ে যায়।মিসেস সাবিনা ও দীপান্বিতা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসতে থাকে।তার ছেলেকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে এই মেয়ে।

অভ্র সে তো এতক্ষণ নীরার ভাঙ্গা রেডিওর সাথে তাল মিলিয়ে নাচতে থাকে।গান বন্ধ হওয়ায় বিরক্ত হয় অভ্র।তাই বলে,”কি হলো মামী?”

“তোমার নানু মাইক নিয়ে নিয়েছে।”মুখ গোমড়া করে বলে নীরা।

রাত দশটা বাজতেই অনুষ্ঠান শেষ করে সবাই বাসায় যায়।ক্লান্ত হয়ে নীরা ঘুমিয়ে পরে।

বিয়ের দিন~~~~~~
বিকাল বেলা নীরাকে বউ সাজাচ্ছে পার্লারের লোকজন।কেয়া পাশে বসে আছে।নীরা এবার রেগে আছে কেয়ার উপর।কোনো আইডিয়া তো দিলো না উল্টো নিজে সাজতে থাকে।

পার্লারের মেয়েটা চলে গেলে নীরা বলে ওঠে,”একটু পর আমার বিয়ে।এই বিয়ে ভাঙার কি কোনো ব্যাবস্থা আছে? কাল এতো পাগলামি করলাম কিন্তু কেউ বিয়ে ভাঙলো না।আমি আর কত চেষ্টা করব?”

নেইল পলিশ পরতে পরতে কেয়া বলে,”আরে ইয়ার চিল কর।দরকার হয় পালিয়ে যাবি।বউ সাজলেই তো আর বিয়ে হয় না।”

“পালিয়ে কোথায় যাবো আমি?”

“আপাতত স্টেশনের কোথাও যেয়ে লুকিয়ে থাক।সন্ধার দিকে কল দিবি আমি যেয়ে চুপটি করে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবো।”

“কাজ করবে আইডিয়া?”
“খুব ভালোভাবে।”

বিয়ের সময় হয়ে গেছে।কাজী এসে বসে আছে।কিন্তু বউ নেই সেই জায়গায়।সবাই বলাবলি করতে থাকে,”বউ পালিয়েছে বউ পালিয়েছে।

প্রিয় ক্যাডার সাহেব/অপ্রিয় আদনান কবির দ্বীপ স্যার,
আপনাকে বিয়ে করবো না বলে অনেক প্ল্যান করেছি।আমি জানি আপনিও আমাকে বিয়ে করতে রাজি না।আপনার গোমড়া মুখ দেখলেই বোঝা যায়।আপনি তো কোনো কাজের না।খালি পারেন বিদ্যা সাগর হতে।ক্ষমতা থাকলে আপনার বইগুলোর সাথে আপনার বিয়ে দিতাম।ভেবে দেখেন তো একসাথে কতগুলো বউ পেতেন!বইগুলো একেকটি হতো একে অপরের সতীন।আপনার বেনিফিট আছে এতে। মানুষ সতীন হলে চুল ছেরাছেরি করে কিন্তু বই সতীন হলে আপনাকে সবাই একসাথে বিদ্যা দিবে।আইডিয়াটা কিন্তু ভালো আছে।পারলে এখনই বিয়ে করুন আপনার বইগুলোকে,আমি পালাই।
ইতি
আপনার অপ্রিয় ছাত্রী প্লাস না হওয়া বউ,
ডাব্বা খাওয়া নীরা

এতবড় চিঠি আকারে এসএমএস পড়ে স্মিত হাসলো দ্বীপ।মনে মনে নীরাকে বলে ওঠে,” পাগলী।”

ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ তাকে ধাক্কা দেয়।

চলবে…?