এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় পর্ব-২৫+২৬

0
223

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৫

ছেলের প্লেটে খাবার সাজাতে সাজাতে অধৈর্য মাতা ফের শুধালেন,
— “হ্যাঁ রে, বাবু? বললি না তো মেয়েটা কে?”
মার কথায় লজ্জা পেল নিখিল। এভাবে মায়ের সামনে প্রেমিকার কথা বলা যায় নাকি? কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— “আগে খাবারটা দাও, আম্মি। ছেলেকে ভুখা পেটে এসব কথা জিজ্ঞেস করো না! বিরক্ত লাগে।”
নাজিয়া শব্দ করে প্লেটটা ঠেলে দিলেন। সাপের মতো ফোঁস করে উঠে বললেন,
— “বিরক্ত লাগে, না? আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেই খুব বিরক্ত লাগে? আর ফোনে যখন প্রেমিকার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্যাঁচাল পারো তখন কিছু হয় না? হুঁ?”
হতাশ শ্বাস ফেলে নিখিল,
— “চারু আমার সেরকম প্রেমিকা নয়!”
— “তো কি রকম শুনি?”
— “বলছি।…”
বলেই প্লেট টেনে নিয়ে খেতে শুরু করলো। নাজিয়া রাগি মুখে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। অকারণে তরকারির বাটি টানাটানি করলেন, চামচ দিয়ে ঘুঁটঘাঁট করলেন। গ্লাসে পানি ঢেলে রেখে দিলেন। কিন্তু সহিষ্ণু হতে পারলেন না। তার এই নটাংকি ছেলে যে কি করছে! কেন যে বলছে না!
খেতে খেতে একবার মুখ তুলে তাকালো নিখিল। মার অস্থিরপানা মুখখানি দেখে শীতল সুরে বললো,
— “কথাগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আম্মি। খেতে খেতে বলবার মত হাল্কা নয়। আমি খাচ্ছি, সঙ্গে তুমিও খেয়ে নাও। তারপর আমরা ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলবো।”
নাজিয়া দিরুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ছেলের গম্ভীর চেহারা দেখে কেন যেন কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। সুস্থির হয়ে খেতে বসলেন।

খাওয়ার পর্ব সেরে বসার ঘরে গিয়ে টেলিভিশন ছেড়ে বসলো নিখিল। রান্নাঘর গুছিয়ে দ্রুতই সেখানে উপস্থিত হলেন নিলুফার নাজিয়া। এসেই চঞ্চল চিত্তে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
— “তুই কি এখন বলবি? শোন, নিখিল। অনেকক্ষণ ধরে ধানাই-পানাই দেখছি তোর। আর কিন্তু সহ্য হচ্ছে না…”
— “বলছি, আম্মি। শান্ত হয়ে বসো।”
রিমোট চেপে টেলিভিশন বন্ধ করলো। মায়ের একহাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে দিলো। নাজিয়া বসেই ফের বললেন,
— “ঝটপট বল। কোনো কাহিনী করবি না!”
লম্বা দম নিয়ে বলা শুরু করলো নিখিল,
— “চারুলতা জাফরিন। আজমীর রাজার বড় কন্যা। আহাদ রাজা’র বড় নাতনি। তার দাদার নামটা তুমি শুনেছ, তাই উল্লেখ করলাম। আহাদ এ্যাম্পোরিয়ামকে তো চেনোই। তোমার শাড়ি কেনার দোকান। সেই বাড়ির মেয়ে চারু। ওর আরেকটা পরিচয় হলো, সৌভিকের ছোট বোন সে। গত ছুটিতে সৌভিকদের বাড়িতে গিয়ে প্রথম পরিচয় হয়।”
— “সৌভিকের বোন? সত্যিই? দেখতে কেমন? তোর ফোনে আবছা ছবি দেখলাম। বুঝি নি। তুই বল, কেমন দেখতে? ভাইয়ের মতই সুন্দর? অবশ্য তা-না হওয়ারই সম্ভবনা বেশি। যে পরিবারের ছেলেরা সুন্দর, নায়ক নায়ক হয়, সেই পরিবারের মেয়েগুলো হয় একেকটা বান্দর। পরীক্ষিত সত্য… যাইহোক, মেয়ের বয়স কেমন?”
একসঙ্গে এত কথা বলে তবেই থামলেন নাজিয়া। মায়ের উত্তেজনা টের পেল নিখিল। হেসে জানালো,
— “সব ক্ষেত্রে ‘পরীক্ষিত সত্য’ খাটে না, আম্মি। কিছুক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। সৌভিকের সব ভাই-বোনরাই তামিল সিনেমার নায়ক – নায়িকার মত সুন্দর। তারমধ্যে চারু হলো বেস্ট। ওর লাবণ্য মাখা মুখ দেখলেই তোমার মন ভালো হয়ে যাবে! ট্রাস্ট মি, এত্তো মিষ্টি ও!”
— “হয়েছে, হয়েছে। এ বয়সে ডায়েবেটিস বাঁধাতে চাই না। মেয়ের বয়স বল। তোর চেয়ে ছোট তো? মিনিমাম পাঁচ বছরের ছোট না হলে কিন্তু সংসারে ভালো হবে না—”
— “আমি ওর সঠিক বয়স জানি না। তবে চব্বিশ অথবা পঁচিশ হবে।”
— “সে কি, তোরই তো আঠাশ! বয়সের ডিসটেন্স এতো কম হলে—”
— “আম্মি! আজকাল বয়সে কি হয়?”
মাঝপথে বাঁধা দিলো নিখিল। নাজিয়া দম ফেলে পুনরায় বললেন,
— “মেয়ে রান্নাবান্না, কাজকর্ম সব জানে তো? তাকে তোর ফ্যামিলী নিয়ে বলেছিস? দেখিস, বিয়ের পর যেন এসে না বলে, আমার সঙ্গে থাকবে না। সংসার আলাদা করবে! আমার একটা মাত্র ছেলে! তাকে কিন্তু আমি বৌ নিয়ে আলাদা হতে দেব না—”
তাকে আর কিছু বলতে দিলো না নিখিল। হাত ধরে কোমল গলায় আশ্বস্ত করলো,
— “তোমার ছেলে সবসময়ই তোমার থাকবে। ভয় পেয় না তুমি। চারু অমন মেয়ে নয়! তুমি ওর সঙ্গে একবার পরিচয় হলেই বুঝবে!”
— “কবে করাবি পরিচয়?”
আবদারি সুর তার। নিখিল হাসলো,
— “সরাসরি সাক্ষাৎ তো এখন হবে না; আমি বরং তোমাদের ভার্চুয়াল মিটিং সেট করে দেই, কেমন? পরশু কথা বলিয়ে দেব।”
— “পরশুই তো? মনে থাকে যেন!”
— “আচ্ছা।”
সায় দিলো বাধ্য ছেলের ন্যায়। অতঃপর আরও টুকটাক কিছু আলাপ সেরে মাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে দিলো।

নাজিয়া চলে যেতেই হাঁফ ছাড়লো নিখিল। এতক্ষণ অদ্ভুত এক আতঙ্কে সময় কাটাচ্ছিল সে। বারেবারে মনে হচ্ছিল এই বুঝি মা ক্ষেপে যায়! এই বুঝি রেগে বলেন, ‘না, আমি চারুকে মানি না!’ তখন কি হতো? মা আর চারু কাকে বেছে নিত সে?
এ জগতে মা ছাড়া ওর কেউ কি আছে? আর চারু ছাড়া ভালোবাসা? সেও তো হয় না। কিন্তু মার প্রতিক্রিয়া দেখে সে তৃপ্ত হয়েছে। চারুকে মা ঠিক মেনেছেন। শুধু তার মুখে শুনেই। এখন পরিচয় হলেই আর দ্বিধা থাকবে না!
কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়। নিখিলের মনে ভয় আছে অন্য কিছু নিয়ে। আর সেটা হলো, চারুর অতীত। মা যদি চারুর অতীত প্রসঙ্গে কিছু বলেন? বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। লুকোছাপা এখানে চলে না। কথা এগোলে চারুর অতীত নাজিয়া ঠিকই জানবেন। তবে তার আগে চারুর সঙ্গে তার সখ্যতা হওয়া দরকার। চারুকে একবার দেখলে নাজিয়া মা কখনোই তাকে দোষী বলবেন না, এ নিখিলের দৃঢ় বিশ্বাস। তার মাকে তো সে চেনে!
___

লিফটের দরজা খুলতেই একটু চমকে গেল সৌভিক। আনিকা দাড়িয়ে। সর্বাঙ্গ কালো রঙের পোশাকে মোড়ানো, মুখখানি রুগ্ন, ফ্যাকাশে। বেশ কিছুদিন পর এই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হলো ওর। অসুস্থতায় লিভ নিয়েছিল সে। আজ থেকেই যে কাজে ফিরবে সৌভিক জানত না। ওকে দেখে অবাকই হলো। বললো,
— “আপনি? এতদিন পর?”
— “ছুটি নিয়েছিলাম, স্যার।”
নম্র মুখে বললো। সৌভিক মাথা নাড়ালো,
— “শুনেছি। অসুস্থ ছিলেন। তো এখন সব ঠিক হয়েছে?”
— “জ-জ্বি।”
— “আচ্ছা, ভালো। কাজে যান।”
আনিকা মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে গেল। সৌভিক সূক্ষ্ম চোখে ওর যাওয়া দেখলো। লিফটে ওঠা ছেড়ে, পেছন ফিরে মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল অনিমেষ। অদ্ভুত কারণে তার মনটা অশান্ত হয়েছে। কেমন একটা উচাটন লাগছে ভেতরে ভেতরে। এতক্ষণ কিন্তু ব্যাপারটা হয় নি। এখনই হঠাৎ হচ্ছে কেন বুঝলো না। কারণটা ধরতেই আনিকার দিকে চেয়ে থাকা। কোনোভাবে কি ওর সঙ্গে তার ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক আছে?

এরপর সারাদিন আনিকার সঙ্গেই থাকতে হলো ওকে। আনিকা অফিসে নতুন বিধায় এক মাস তার আন্ডারেই থাকবে। আজ সৌভিক অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, মেয়েটা বদলেছে। সবসময়ের ‘বেখেয়ালি আনিকা’ যেন এ নয়। যে যা বলছে, করছে। মন দিয়ে সবার কথা শুনছে। কোনো অদ্ভুতুড়ে আচরণ নেই। উড়নচণ্ডী ভাব নেই। সব কেমন শান্ত, নির্মল। দুপুরে একটা মিটিং ছিল। সেই মিটিংয়ে প্রেজেন্টেশন দেয়ার ছিল ওর। সেখানেই আরও বিস্ময়কর ব্যাপার লক্ষ্য করলো সৌভিক। আধ ঘণ্টার লম্বা সময়টা সে সহ রুমে উপস্থিত বাকি সবাই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে। কারণ তুখোড় মেধাবী মেয়েটা তখন জাদুকরী বাচন ভঙ্গিতে মোহগ্রস্ত করে রেখে সবাইকে!

বিকেলে চারুর সঙ্গে নিখিল তার মাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। ছেলে তার কেমন মেয়েকে পছন্দ করে, তাকে দেখতে বেশ উতলা হয়ে ছিলেন নিলুফার নাজিয়া। সাক্ষাৎ তো আর সম্ভব নয়, ভিডিও কলেই আলাপ সারা হলো। ছেলেকে তুলে দিয়ে, ঠেলেঠুলে বের করে দিয়ে, ল্যাপটপ নিয়ে নাজিয়া বসে পড়লেন গল্প করতে।
— “তুই যা তো, নিখিল। আমি চারুর সঙ্গে কথা বলি।”
— “হ্যাঁ, এখন তো যেতে বলবেই। আমি তো ফেলনা হয়ে গেলাম—”
কপট রাগ দেখালো সে। নাজিয়া হাসলেন ছেলের গাল ফুলানো দেখে,
— “হিংসে করছিস কেন? তুই যা বাইরে। আমি একটু কথা বলি?”
— “বলো। বলো। আমাকে বের করে দিয়ে একা কথা বলো!”
তেজ দেখিয়েই বেরিয়ে গেল। এবার জোরেই হেসে উঠলেন নাজিয়া। কলের ওপ্রান্তে, সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে অরুণা ম্যানশনে নিজের ছোট্ট কক্ষের বিছানায় বসে বসে মা – ছেলের অবস্থা দেখে চারুও হেসে উঠলো তাল মিলিয়ে। হাসি থামিয়ে নাজিয়ার মন্তব্য,
— “দেখেছ, তোমার বরটা কেমন হিংসুটে? শুধু কথা বলছি বলেই কি জ্বলছে!”
নিখিল ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল। সেভাবেই জবাব দিলো,
— “কি জ্বলছে? কার জ্বলছে? আমার কোনো জ্বলন-টলন নেই! কথা বানাবে না কিন্তু—”
সেই প্রতিবাদী স্বর কানে আসতেই আরেকদফায় হাসাহাসি শুরু হলো দুই প্রান্তের দুই নারীর। তাদের মধুময় অট্টহাসি শুনে অজান্তেই মন ভালো হয়ে গেল নিখিলের। শার্ট গায়ে জড়িয়ে, কব্জির উপরে ঘড়িটা পরতে পরতে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল বুক জুড়ে! আহা, এই সুখ কবে চিরস্থায়ী হয়ে আসবে তার জীবনে?
__

ব্রেক টাইমে বহুদিন পর বন্ধুর সঙ্গে লাঞ্চ শেয়ার করলো সৌভিক। নিখিল তখন একা একা নিজের মত খাচ্ছিল। হুট করে চোখ তুলে তাকাতেই সম্মুখে সৌভিককে দেখতে পেল। খাবারের প্লেট হাতে সে হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে। নিখিল কিছু বললো না। মুখ নামিয়ে খাওয়ায় মন দিলো। সৌভিকও ব্যস্ত হলো খাওয়ায়। সে নিজে থেকে এগিয়েছে একধাপ। নিখিলের কি উচিৎ নয় সহযোগিতা করা?
খানিক বাদে নিজের লাঞ্চ বক্সটা ঠেলে সামনে এগিয়ে দিলো নিখিল। শব্দে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই হাসলো,
— “ধর, টেস্ট কর। মা বানিয়েছে।”
সৌভিক কয়েক পল্ ভাবলো। বক্স থেকে বিরিয়ানির সুঘ্রাণ আসছে। নাজু আন্টির রান্না!
বরাবরই তার রান্নার ফ্যান সৌভিক। প্রতি উৎসব-পর্বেই আন্টি দারুণসব রেসিপি করে পাঠান নিখিলের দ্বারা। সেসব এতোই সুস্বাদু আঙুল পর্যন্ত কামড়ে খেয়ে নিতে ইচ্ছে করে ওর। আজ তাই মিস করা যায়? জলদিই চামচ ভরে মুখে পুরলো সৌভিক। তৃপ্তি সূচক ‘উমম্ উমম্’ করতে করতে নিখিলের দিকে চোখ পড়তেই একটু থামলো। নিখিল সব মেনে নিয়েছে?
প্রশ্নটা মাথায় আসতেই বললো,
— “তুই রেগে আছিস এখনও?”
— “রাগলে বিরিয়ানির অফার দিতাম?”
হাসলো নিখিল। থমথমে মুখে চেয়ে থাকা বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে বললো,
— “আমি তোর উপরে কখনো রাগ করি নি, দোস্ত। তোর পরিস্থিতিতে নিজেকে দাড় করিয়ে আমি বুঝেছি, সব মেনে নেয়া তোর জন্য সহজ নয়। গড়মেলে জটিল। তবে তুই সবকিছু মেনে নিয়েছিস, তাতে আমি খুশি।”
— “মেনে না নিয়ে উপায় আছে? কিছুই যে আমার অনুকূলে নয়!”
অন্যমনস্ক চোখে চেয়ে বিড়বিড় করলো সৌভিক। নিখিল সেই মৃদু গুঞ্জন শুনতে পেল না। সে নিজের খুশি জাহির করে বললো,
— “আজকে আমি অনেক খুশি, দোস্ত। ভীষণ খুশি!”

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৬

চারুর অতীত নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ নিখিল আর তুললো না। কেন যেন ওর ভয় হচ্ছিল, সব জেনে-শুনে নাজিয়া কিছুতেই চারুকে মেনে নেবেন না। কিন্তু তাকে ছাড়তেও তো চায় না নিখিল। ভালোবাসাকে কি ছাড়া যায়?
মাকে সে ভালোবাসে না তাও নয়। কিন্তু জীবনের জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে মা আর প্রেমিকার মধ্যে যে কোনো একজনকে গ্রহণ করে, অন্যকে ত্যাগ করবার মানসিকতা ওর নেই। সব জায়গায় প্রতিবাদী নিখিলও, এই একটি জায়গায় বড্ডো দূর্বল। তাই একটু নিজেকে স্বস্তি দিতেই মার কাছে সব লুকিয়েছে! এখন রোজ চারুর সঙ্গে মার কথা হয়। সকালে – বিকালে যখনই খোঁজ নাও, দেখতে পাবে দু’ প্রান্তের দুই বঙ্গ নারী বসে পড়েছেন আলাপে। কখনো ভিডিও, কখনো বা ভয়েস কলে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের আলাপ চলছে। সংসারিক থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক — কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না! নিখিল সব শুনছে। নাজিয়া মাঝে মাঝে চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছেন, ইশারায় রাগ দেখিয়ে ছেলেকে বিদায় করছেন নিজেদের গোপন আলাপ থেকে। ঠেলা খেয়ে অসহায়ের মত নিখিলও সরে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের নির্মল-শীতালু হাওয়া তার বুকেও প্রশান্তি এনে দিচ্ছে। একটি নতুন সুখের আশায়, একটি বহুল কাঙ্খিত বাসনায়!
___

ঘন তমসায় ডুবে থাকা নিসর্গ। কাছে-পিঠেই কোনো ঝোপঝাড়ে একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকার শব্দ ছাড়া আশেপাশের সবকিছুই স্তব্ধ, নিশ্চুপ। ছাদের অবস্থাও ব্যতিক্রম নয়। হঠাৎ মৃদু ‘ক্যাচ ক্যাচ’ আওয়াজ তুলে দরজা খুলে গেল হাট হয়ে। অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ হওয়ায় দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো মাহাদ। অদ্ভুৎ ভঙ্গিতে দাড়িয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। যেন প্রকৃতির নিশ্চল নীরবতায় ছেদ ঘটিয়ে মহাপাপ করে ফেলেছে সে! তাই মার্জনা চাইছে কারো কাছে!
কিয়ৎক্ষণ পর স্বাভাবিক হলো সে। আস্তে করে দরজা চাপিয়ে এগোলো অন্যদিকে। বাড়ির মূল ফটকে নিরাপত্তার জন্য জ্বালিয়ে রাখা দশ ওয়াটের বাল্ব থেকে ছিটকে আসা ক’ফালি আলোকচ্ছটায় দেখা যাচ্ছে, রেলিংহীন ছাদের একপ্রান্তে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মানবমূর্তি। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট থেকে উড়ছে ধুম্র কুণ্ডলীরা!
নিভৃতে একা বসে শলাকায় সুখটান দিতে ব্যস্ত মানুষটিকে দেখে নিঃশব্দে এগিয়ে এলো মাহাদ। চুপচাপ তার পাশে বসে পা ঝুলিয়ে দিলো নিচে, তারই অনুকরণে। কারো উপস্থিতি টের পেয়েও খামোশই বজায় রইলো মাহতাবের ভেতর। ঠোঁটের ফাঁকে জ্বলন্ত শলাকা রেখে, পকেট থেকে আস্ত প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলো ভাইয়ের দিকে। মাহাদ হাসলো। একটা সিগারেট তুলে নিয়ে জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,
— “অনেকদিন ধরে খাই না, বুঝছ? আজকে হঠাৎ ইচ্ছে হলো…”
— “ছেড়ে দিতে চাইছিস? দে তাহলে। ভালো জিনিস তো না—”
শান্ত সুরে বললো। মাথা নাড়লো মাহাদ,
— “বিয়ে করেছি নতুন, সিগারেট খেলে বৌ গা ঘেঁসতে দেয় না; সারাক্ষণ মা খিটখিট করে— ভাল্লাগে না সব। তাই ছাড়তেই চাইছি—”
— “মা তো আগেও খিটখিট করতো। তখন তো ছাড়িস নি!”
বলেই কেমন ব্যঙ্গাত্মক চোখে তাকালো। বড় ভাইয়ের ইশারা দেখে কিঞ্চিৎ লজ্জিত হলো মাহাদ। গা বাঁচিয়ে বললো,
— “মেয়ে মানুষ! বুঝোই তো, কেমন জিদ্দি। যা বলবে তাই করবে। কাউকে মানবে না। আগে মার কথা না শুনলেও এখন বৌয়ের কিথা না শুনেও উপায় নেই। সারাক্ষণ ঘ্যানর ঘ্যানর করে—”
— “মহিলা মানুষের কাজই ওইটা। ঘ্যানর ঘ্যানর করা। বস্তাপঁচা ইমোশনাল টপিক নিয়া ন্যাকামি করা। এদের এতো পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। নিজে যা বুঝবি, তাই করবি। বুঝছিস?”
গম্ভীর গলায় বললো। মাহাদের খুব করে বলতে ইচ্ছে করলো, সেইজন্যই কি তুমি চারু ভাবীকে পাত্তা দিতে না? তার ভালোবাসাকে ন্যাকামি ভেবে যা ইচ্ছে করতে? আর তাই চাও আমিও তোমার মতো করে দিনশেষে আমার বৌকে ডিভোর্স দেই? কিন্তু বললো না। বড় ভাইয়ের এই পুরুষবাদী মন্তব্য শুনেও নিশ্চুপ থাকলো। কেননা সে বরাবরই শান্তিপ্রিয়। কারো কোনোকিছু পছন্দ না হলেও সেটা বলে অকারণে ঝামেলা করা তার আচরণ বিরুদ্ধ।
চুপচাপ দুজন সিগারেটে টান দিতে থাকলো। অন্ধকারে গোল গোল করে ছেড়ে দিতে লাগলো ধোঁয়ার কুণ্ডলী!
হঠাৎ নিচ থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেল। দুটো মেয়েলি স্বরের তীক্ষ্ণতা ভেসে আসছে। হৈ-চৈ চিৎকার থেকে ছিটকে আসছে কিছু গালাগাল। মাহতাব একটা শ্বাস ফেললো। ছোট ভাইয়ের দিকে অত্যন্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
— “তোর বৌটার সমস্যা কি বলতে পারবি? রোজ রোজ এরকম চিল্লায় কেন?”
— “সমস্যা শুধু কি ওর? ভাবী কি নির্দোষ? সে কিছু করে না?”
অভিযোগ নয়, অনুযোগ। মাহতাব বড্ডো বিরক্ত হলো। এই মুহূর্তে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তর্ক করতে সে অনিচ্ছুক। চোখ সরিয়ে হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো, আগের সিগারেটটা ফুরিয়ে এসেছে। তাতে শেষ টান দিয়ে দূরে ছুঁড়তে ছুঁড়তে জানালো,
— “কার কী দোষ আমি জানি না। ওসব মেয়েলি কারবারে আমি নেই। রোজ বৌটা কানের কাছে বকবক করে তোর বৌকে নিয়ে। তার ঝামেলার ধাঁত আছে। তাই বললাম আর কি—”
— “অনুও তো রোজ বলে, ভাবীই নাকি—”
ইচ্ছে করেই কথা শেষ করলো না। সবসময় অপ্রিয় সত্য বলতে নেই। মাহতাবের ত্যক্ত কণ্ঠ,
— “আসলে মহিলা মানুষের স্বভাবই এইটা। সারাক্ষণ ঝগড়া-ঝাটি, কুট-কাচালি। আগে তাও বাড়িতে একজন ছিল, এখন দুইজন হয়েই হয়েছে ঝামেলাটা।”
— “এক বনে দুই রাজা থাকে না।”
ফিচেল কণ্ঠে বললো মাহাদ। মাহতাব ততোধিক গম্ভীর হলো,
— “ওরা কোনো রাজা-টাজা না। মহিলা মানুষের নেতা হওয়ার যোগ্যতা নেই। অন্দর মহলের জিনিস ওরা, ওখানেই ওদের মানায়।”
মনঃক্ষুন্ন হলো মাহাদের। অন্য সময় হলে সে দুটো কথা বলত। কিন্তু আজ বললো না। বড় ভাইয়ের এই পুরুষবাদী মন্তব্য শুনেও নিশ্চুপ থেকে পরমত সহিষ্ণুতার পরিচয় দিলো।
ফের কিছুক্ষণ কাটতেই চেঁচামেচি কমে গেল। নিশ্চয় ওদের মা এসে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। মধ্যস্থতা করেছেন। রোজ এমনই হয়। কোনো একটা ছুঁতো পেলেই এ বাড়ির দুই বৌ নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দেয়। অবস্থা বেশি বিগড়ে গেলে শাশুড়ি এসে থামান ওদের। এ-ই তো হচ্ছে আজকাল!
হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাহাদ,
— “কি যে শুরু হয়েছে বাড়িতে। বুঝালেও কেউ কিছু বোঝে না!”
ইতোমধ্যেই মাহতাব নতুন একটা সিগারেট ধরিয়েছে। বললো,
— “বুঝানোর দরকার নেই। কটা দিন যেতে দে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আগে মাহি একা থাকতে তো কোনো ঝামেলা হয় নি। আবার একা করে দিলে—”
— “করবে কীভাবে? অনুও তো এ-বাড়িতেই থাকে।”
— “সামনের মাসে নতুন একটা ফ্ল্যাট কিনবার কথা। দেখা যাক যদি কিনতে পারি তো—”
— “নতুন ফ্ল্যাট? তুমি না ক’ মাস আগেই ঢাকায় একটা প্লটে শেয়ার কিনলে? এতো জলদিই?”
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো সে। মাহতাব ভ্রু কুঁচকালো,
— “এমন রিয়্যাক্ট করার কি আছে? আমি কি তোর মত বেসরকারি চাকরী করি? সরকারি কর্মকর্তা। বেতন তোর চেয়ে বেশি। টাকার জোগাড় কি হতে পারে না?”
কথার পৃষ্ঠে সহসাই কোনো জবাব দিলো না মাহাদ। কিছুক্ষণ তীব্র চোখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে থেকে শীতল গলায় বললো,
— “আমি, এমনকি আমাদের পুরো পরিবারই খুব ভালো করে জানে, তুমি সরকারি কর্মকর্তা। বেতন লাখের কাছাকাছি। তবুও এই বেতন দিয়ে ক’ মাস পরপর বাড়ি কেনা, ফ্ল্যাট কেনা, বড় বড় অনুষ্ঠান করার অর্থ যোগান দেয়া এতো সহজ নয়। গতমাসেই তো ‘ভাবীর সাধ’ আয়োজনে কতো লাখ খরচ করলে। তার আগে তোমার গ্রামের দিকে জমি কিনলে— তুমি কি ভাবো, বাড়ির লোক জানে না কিছুই? বোঝে না কীসের টাকা?”
মাহতাব একটুও অবাক হলো না। কোনো উচ্চবাচ্যও করলো না। কেবল সাপের মত ঠাণ্ডা চাউনি নিক্ষেপ করলো ভাইয়ের দিকে,
— “আমি ঘুষ খাই, এ তো অস্বীকার করি নি। করবোও না। এটা তো এ বাড়ির ওপেন সিক্রেট। ইভেন, শুধু আমি না, এদের যতগুলো সরকারি চাকরিজীবী আছে তারা প্রত্যেকের ঘুষ খায়। যতই মুখে মুখে ঈমানের বুলি আওড়াক না কেন, খেতেই হবে। তুই খাতা আন; আমি লিখে দিচ্ছি! তাতে কি?
আরে বাবা, আমি ঘুষ না খেলে তোদের এতো চাকচিক্য কোথা থেকে আসবে? এই যে মা মাসে মাসে গহনা বানাচ্ছে, মাহিয়া শাড়ি কিনছে, কাজের লোক রাখছে বাড়িতে এতটাকা দিয়ে, ঘরে ঘরে এসি, টিভি — এতোসব কোত্থেকে আসবে?”
ক্রোধের ধিকধিকি আগুন জ্বলছে ওর দু’ চোখে। মাহাদ তা উপলদ্ধি করলো বলেই ঝামেলা করলো না। শান্ত হয়ে বললো,
— “দুর্নীতি যারা করে তাদের কাছে তার জন্য অজুহাত সর্বদা তৈরি থাকে, ভাইয়া। আমি তর্ক করবো না। তবে বলবো, তুমি যে চাকচিক্যের কথা বললে সেসব না পেলেও আমাদের জীবন থমকে যাবে না। আমরা আমাদের মতোই বাঁচবো। তোমার দুর্নীতি না করলেও চলবে। যা বেতন পাও, তাতে যথেষ্ট সচ্ছলতার সাথেই বাঁচবে তোমার পরিবার, অনাগত ভবিষ্যৎ। অন্যকে বুঝ দেয়া অজুহাত না দেখিয়ে নিজের কর্ম সম্বন্ধে ভাবো বরং। আমি যাই!”
প্রায় নিভে যাওয়া ধুম্রশলাকাটা দূরে ছুঁড়ে উঠে গেল মাহাদ। ত্বরিৎ পায়ে হেঁটে নেমে গেল ছাদ থেকে! পেছনে ফেলে গেল রাগান্বিত এক শ্বাপদকে!
__

বিশাল বিল্ডিংটার সামনে এসে কালো গাড়িটা থামলো। ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে ভেতর থেকে নামতে দেখা গেল সৌভিককে। স্যুট-বুট পরনে একদম ফর্মাল চেহারায়। হাত ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে সে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো। দোতলায় তাদের মিটিং প্লেস। এতটুকুর জন্য লিফটে চড়া অপ্রয়োজনীয়।
কাচের দরজাটা খুলতেই আনিকার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওর। নীল সালোয়ার স্যুটে মেয়েটাকে মানিয়েছে ভালোই। চেহারায় আত্মবিশ্বাসী ভাব। সৌভিককে দেখে এগিয়ে এলো। চঞ্চল ভঙ্গিতে বললো,
— “স্যার, পার্ফেক্ট সময়ে এসে গিয়েছেন। মিটিং আধঘণ্টা এগিয়ে এনেছে এমডি স্যার। আপনাকে জানাবো একদমই মনে নেই—”
— “আপনি সবসময় ভুল করেন, মিস. আনিকা। স্বভাবটা বদলান প্লিজ!”
গম্ভীর মুখে বললো সৌভিক। ইতোমধ্যেই বেশ ক’ মাস পেরিয়ে গেছে। ‘আনিকা’ নামক সেই আনকোরা মেয়েটা বেশ ভালোই উন্নতি ঘটিয়ে নিয়েছে নিজের। যদিও পুরোপুরি রূপে নিজেকে এই কর্পোরেট দুনিয়ার পার্ফেক্ট ‘ওয়ার্কিং উম্যান’ গড়তে পারে নি। তবে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।ভুলোমনা, উদাস, খামখেয়ালী এই নারীর প্রতি তাই আগের মত বিদ্বেষী ভাবটা পোষণ করে না সৌভিক। যথাসম্ভব মানিয়েই চলে। হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান হয় না; তেমন অফিসের প্রত্যেক সহকর্মী সমান নয়। কেউ বেশি কো-অপারেটিভ, অ্যাটেন্টিভ; কেউ একটু খামখেয়ালি ঠিক ‘আনিকা’র মতো!
মিটিংটা হচ্ছে সৌভিকদের অফিসের অন্য একটা ব্রাঞ্চে। খুবই গুরত্বপূর্ণ মিটিং। ওদের ব্রাঞ্চ থেকে নিখিল, আনিকা আর দুজন সহকর্মী সহ সে এসেছে। শুরু হওয়ার কথা সাড়ে এগারোটায়। হঠাৎ করে আধঘণ্টা এগিয়ে কেন নেয়া হলো সে জানে না। এমনটা সচারচর হয় না। মিটিং পিছিয়ে দেয়া হয়, আগানোর নজির খুব কম। সৌভিক হেলেদুলেই তৈরি হচ্ছিল। মাঝপথে এসে নিখিল কল করে জানালো, মিটিং এগোবার কথা। সঠিক সময়ে যেন সে পৌঁছায়! বাকিরা এসে গেছে। অথচ এই মিটিংয়ের সমস্ত কিছু আনিকার উপরে দায়িত্ব দেয়া ছিল। খবরটা তাকে আনিকারই জানানোর কথা ছিল। কিন্তু সে জানায় নি! এখন বলছে, ভুলে গিয়েছে। কি অদ্ভুত!
সৌভিক আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেল।
দু’ ঘণ্টার মিটিং শেষ করে বন্ধুবর নিখিলকে নিয়ে সে যখন বেরোলো তখন নিখিলের পকেটে ফোন বাজছে। বের করতেই চারুর কল! স্ক্রিনে ভাসমান নামটার দিকে একনজর চাইতেই লক্ষ্য করলো, সৌভিকেরও দৃষ্টি এদিকেই। অপ্রস্তুত হাসলো।
— “এক মিনিট, হু? কথা সেরে নেই!”
— “আচ্ছা।”
একটু কি উদাস শোনালো ওর কণ্ঠটা? কে জানে!
সৌভিক স্পেস দিলো ওকে। এগিয়ে গেল ক্যান্টিনের দিকে। মিটিংয়ের পর লাঞ্চ খাওয়ানো হচ্ছে এখান থেকেই। ক্যান্টিনে আগেই এসে বসেছিল আনিকা। বেখেয়ালেই ওর টেবিলে গিয়ে বসলো সৌভিক। মনের উদাস ভাবটা কাটাতেই টুকটাক কথা বলতে শুরু করলো ওর সঙ্গে।

চলবে___

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে