এক টুকরো আলো পর্ব-০৪

0
222

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_০৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

ফাবিহা ধীরে পা চালালো। দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে অদ্ভুত অনুভূতি। তাসিনের কথা বলার প্রসঙ্গ কী হতে পারে সেটা ভেবেই অস্থির সে৷ তাসিন সামনে চেয়ারে ইশারা করলো।
“বোস্।”

ফাবিহা বলল,“তুমি বলো। আমি শুনছি।”

“পড়াশোনা কেমন চলছে?”

মাথা দোলালো ফাবিহা।
“ভালো।”

“কোন সমস্যা হয় না তো?”

ফাবিহা চেপে গেল শাবাবের কথা। বলল,“না সব ঠিক আছে।”

এবার মূল কথায় আসতে চাইছে তাসিন। মনে মনে কথাগুলো ঠিক গুছিয়ে নিলেও ফাবিহার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারলো না। সব গোছানো কথা এলোমেলো হয়ে গেল। মেয়েটার চোখমুখে স্বপ্নের উজ্জ্বল বাতি। তাই সিদ্ধান্ত নিলো মাকে দিয়েই বলাবে। ছোটো স্বরে ফাবিহাকে বলল,“যা।”

“হুঁ?” প্রশ্নাত্মক চোখে তাকালো ফাবিহা। তাসিন রাশভারী স্বর পুনরাবৃত্তি করলো,“যা।”

ফাবিহা মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে এলো। দরজার বাইরে এসেই কয়েকটা বকা দিল তাসিনকে। সে ভেবেছিল সিরিয়াস কিছু কিংবা প্রেমালাপ করতে ডেকেছে। অথচ সে কিনা পড়াশোনার খোঁজ করে চলে যেতে বলছে?

নিশি দুষ্টু হেসে বলল,“কী করলে দুজনে এতক্ষণ?”

ফাবিহার চোখমুখ শক্ত। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“প্রেমালাপ করেছি। এমন প্রেম বাক্য আমার ইহজীবনে শুনিনি। এই নিরামিষের সাথে সংসার কী করে হবে?”

নিশি অবাক হওয়ার ভান করে বলল,“সে কি গো ভাবি। তবে কি আমার আর জীবনে ফুফি হওয়া হবে না? এখন দেখছি স্বপ্নে ভাতিজা-ভাতিজিকে কোলে নিতে হবে। বাস্তবে সম্ভব না।”

তেড়ে এলো ফাবিহা। “এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।”

হাসতে লাগলো নিশি। বিকেলে ফাবিহা মায়ের সাথে চলে গেল। যদিও তার থাকার ইচ্ছে ছিল প্রকট। কিন্তু মায়ের সামনে মুখ খুলে বলতেও লজ্জা। খালা আর নিশি অনেকবার চেষ্টা করেছেন। মা কিছুতেই রেখে যাবেন না ফাবিহাকে। বিয়ের আগে এই বাড়িতে রাত কাটানো যাবে না বলে তার উপর ১৪৪ ধারা জারি করলেন।

ফাবিহা চলে যেতেই মা তাসিনের ঘরে এলেন। সে ল্যাপটপে আঙ্গুল চালাচ্ছে। ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেলেও মাথা তুললো না। মা কিছুটা রাগ নিয়ে বললেন,“এভাবে ঘরে ঢুকে থাকার মানে কী তাসিন? তোর খালা এসেছেন, তার সাথে কথা বলবি বের হবি। তা না করে ঘরে পড়ে আছিস। আগে তো খালার সাথে জমিয়ে কথা বলতিস৷ এখন এমন অসামাজিক কেন হয়ে যাচ্ছিস?”

তাসিনের মনে হলো এখনই উপযুক্ত সময়। মাকে হুরাইনের কথাটা বলে দেবে। নিজেকে ধাতস্থ করে গম্ভীর স্বরে বলল,“বাবা কোথায়?”

“আমি তোকে কী জিজ্ঞেস করেছি?”

“আমার কথাটা বাবারও শোনা জরুরি।”

“কী এমন বলবি যে তোর বাবাকেও প্রয়োজন? আমি কি যথেষ্ট নই?”

তাসিন ল্যাপটপ বন্ধ করে মাকে পাশে বসিয়ে দিল। বলল,“দুজনই আমার অবিভাবক। আমি একটা ভুল করে ফেলেছি মা। তাই দুজনকেই খুঁজছি।”

মা চোখ কুঁচকে নিলেন। বয়সের সাথে সাথে চামড়ার ভাঁজটাও গাঢ় হলো। দৃষ্টি প্রখর হলো। তীক্ষ্ণ স্বরে শুধালেন,“কী ভুল করেছিস?”

তপ্ত শ্বাস ছাড়লো তাসিন। নত হয়ে বলল,“খালাকে না করে দাও। আমি ফাবিহাকে বিয়ে করতে পারবো না।”

বিস্ফোরিত নেত্রে তাকালেন তাসিনের মা৷ মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,“কী?”
ধীরে ধীরে উত্তেজিত হতে দেখা গেল তাঁকে।
“কেন বিয়ে করতে পারবি না ফাবিহাকে? ওর কমতি কী আছে? লম্বা, ফর্সা, সুন্দরী, পড়ালেখা জানা, সংসারী, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার দক্ষতা। কোনটার অভাব আছে?”

তাসিন মায়ের দিকে তাকালো। চোখে চোখ রাখার সাহস পাচ্ছে না। বলল,“যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা নয়। আমি এমন একজনকে জীবনে চাই যার নিজেকে হেফাজতে রাখার ক্ষমতা আছে। যে সূক্ষ্ম নজর থেকেও নিজেকে হেফাজতে রাখতে জানে।”

মা শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“কে সেই জাদুকরী? যে আমার ছেলের মাথা আগেই খেয়ে নিয়েছে?”

“মা কেউ আমায় জাদু করেনি। সে নিজেও জানে না আমি তাকে পছন্দ করি।”

“এখন মায়ের কাছে ওই মেয়ের সাফাই গাইতে শুরু করেছিস? সত্যি করে বল তো, এসব ওই মেয়ে শেখাচ্ছে না তো তোকে? তুই তো এমন ছেলে নয়।”

এবার তাসিন কিছুটা রাগী স্বরে বলল,“কতবার বললাম হুরাইন কিছুই জানে না। মা না জেনে কারো ব্যাপারে মন্তব্য করা উচিত নয়।”

“ আচ্ছা হুরাইন?”
কিছুটা টে*নে বললে মা। অতঃপর বললেন।
“করলাম না ওই মেয়েকে নিয়ে মন্তব্য। তুই যখন ওই জাদুকরীতেই আটকে আছিস, তখন আমার মেয়েটাকে কেন এভাবে অপমান করলি? ফাবিহাকে বিয়েতে হ্যাঁ কেন বললি?”

“মা আমি তখন দ্বিধায় ছিলাম। সেজন্য আমি অনুতপ্ত। এখনো বিরাট কিছু হয়ে যায়নি। বিয়ের দিনও বিয়ে ভেঙে যায়।”

“তুই শুনে রাখ। ফাবিহাকে বিয়ে না করে ওই মেয়ে ঘরে তোলার স্বপ্ন এখানেই মাটি দিবি। নয়তো যা করার বাড়ির বাইরে গিয়ে করবি। আমি তোকে আর চিনি না।”

ধুপধাপ পা ফেলে চলে যাচ্ছেন মা। ফ্লোরে সজোরে শব্দ হচ্ছে। যা কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে। একটা ফুলদানি নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারলো গাসিন। তবুও রাগ কমছে না। ফোঁসফোঁস করে বেড়েই যাচ্ছে। সে তো মানুষ। মানুষের দ্বারা কি ভুল হয় না?

তাসিনের মা ঘরে আটকে রাখলেন নিজেকে। মেজাজ খুব খা*রা*প হয়ে আছে। বোনকে কথা দিয়ে ফেলেছেন তিনি। এখন চোখ মেলাবেন কী করে? তাসিন যদি আগেই বলে দিত তার পছন্দ আছে তবে বোনকে কথা দিতেন না। ওই মেয়েকে বউ করতেও সমস্যা ছিল না। এখন বোন হয়তো স্বামীর চাপে পড়ে সম্পর্কটাও নষ্ট করে দিতে পারে। শুধু বোন নয়, বাবা-মা, ভাই বাকি বোনেরা সবার চোখে নিচু হবেন তিনি। সবচেয়ে বড়ো কথা একটা মানুষকে সুখের সপ্ন দেখিয়ে তার স্বপ্নগুলো কীভাবে চুরমার করে দেবেন তিনি? ফাবিহা যে তাসিনকে পছন্দ করে সেটা মেয়েটার চোখেমুখে স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনিও নিরুপায়। সবদিক বিবেচনা করলে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। যেকোন একদিক ছাড়তে হবে। ছেলের ভুলটাকে ধরে রাখলেন তিনি। মনে মনে জেদ চেপে গেল, এই বাড়ির বউ ফাবিহাই হবে।

বাড়িতে থাকা সকলেই তাসিনের ব্যাপারটি নিয়ে অবগত হয়ে গেল। না চাইতেও তাসিন আর তাঁদের তিনজনেের মাঝখানে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেল। তাসিনও মায়ের মতোই জেদি। সেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলো। মা-ছেলে কেউই স্যাক্রিফাইস করতে রাজি নয়।

সকলকে অগ্রাহ্য করে আবারো হুরাইনের পেছনে ছুটলো তাসিন। মাদ্রাসা থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য সিএনজি খোঁজ করছে তিন বান্ধবী। তিন সিট ফাঁকা কোন সিএনজি পাচ্ছে না। তাসিন দূরে দাঁড়িয়ে সবটা লক্ষ করেছে। একটা সিএনজিতে পেছনের সিটে একজন মেয়ে। তাসিন এগিয়ে গিয়ে সিএনজি থামিয়ে দিল। মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,“আপু আপনাকে আরেকটা সিএনজি ঠিক করে দিচ্ছি। আমার পেছনের তিনটা সিট লাগবে। অনেকক্ষণ ধরেই খোঁজ করছি। পাচ্ছি না।”

মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলল,“আমি কী করবো? আপনি অন্য সিএনজি দেখুন।”

“প্লিজ আপু!”

কী যেন ভেবে মেয়েটি নেমে পড়লো। আরেকটা সিএনজি নিয়ে চলে গেল। তাসিন তিনজন বোরকা পরা রমনীর দিকে আঙ্গুল তাক করে ড্রাইভারকে বলল,“উনাদের তিনজনকে পৌঁছে দেবেন।”

গরমে বোরকার ভেতরটা ভিজে একাকার। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। নিকাবের আড়ালে গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। একজন তাদের দিকে আঙ্গুলের ইশারায় কিছু দেখিয়ে দিচ্ছে। হুরাইনের চোখ আটকে গেল। তার যষ্ঠ ইন্দ্রীয় জানান দিচ্ছে পুরুষটিকে সে দেখেছে। সেদিন কুকুর তাড়িয়ে তাকে বাড়ি যেতে সাহায্য করেছে। এক পলকের দেখায় ঝট করে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো হুরাইন। সেই সিএনজিটা তাদের সামনে এসেই দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলেন ড্রাইভার, “কই যাইবেন?”

“বটতলা।”

“উঠেন।”

তিনজনে উঠে গেল। হুরাইনের মনের ভেতর অন্য চিন্তাভাবনা ঢুকে গেল। তার মাথায় ঘুরছে সেই পুরুষটির কথা। নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে নিজেই ভীষণ অবাক। পর পুরুষকে নিয়ে সে কেন ভাবছে?

দুদিন পরের কথা। মাদ্রাসা থেকে ফিরে চমকে গেল হুরাইন। তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। এই খবরটা তাকে জানালো ভাবি। সাথে এটাও জানালো পাত্র পূর্বে এই বাড়িতে এসেছে। হুরাইন ভেবে পেল না কে হতে পারে? ফুফু একবার ছেলের জন্য হুরাইনের হাত চাইলেন৷ বড়ো চাচাও নিজের ছেলের জন্য হুরাইনকে চাইলেন। ভাইকে দিলে বোন অসন্তুষ্ট আর বোনকে দিলে ভাই অসন্তুষ্ট হবে। সেজন্য জনাব আজাদ দুজনকেই এক জায়গায় নিয়ে বসলেন। সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন ব্যাপারটা। বললেন,“আমি চাই না আমাদের সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হোক। তোমরা দুজনই হুরাইনকে নিজের মেয়ের মতো ভালবাসো। কারো মনে কষ্ট দিতে চাই না আমি। ঘরে ঘরে আত্মীয় না পাতানোই ভালো।”

এ নিয়ে অবশ্য চাচা আর ফুফু কিছুদিন মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন। এখন সবটা আগের মতোই স্বাভাবিক। তাহলে এবার কে এসেছে? ভাবি বারবার এসে জ্বালিয়ে মারছে হুরাইনকে। লজ্জায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো সে। তাই ঘরের দোর দিয়ে বসে আছে।

মেহমান খানায় জনাব আজাদের সামনে বসে আছে তাসিন। না, তার পাশে পরিবারের কেউ নেই। একাই এসেছে সে। জনাব আজাদকে গম্ভীর দেখাচ্ছে। প্রস্তাবটা সেই পাঠিয়েছিল। জনাব আজাদ প্রস্তাব পেয়ে সরাসরি তাসিনকেই ডাকলেন।

★★

ভার্সিটি থেকে বেরুতেই ফাবিহার পথ রোধ করে দাঁড়ালো শাবাব। আগাগোড়া একবার পরোখ করে হাসলো। ফাবিহা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো। এই তাকানো স্বাভাবিক নয়। চোখমুখ শক্ত করে বলল,“পথ ছাড়ুন।”

“তোমাকে এগিয়ে দিতে এসেছি সুন্দরী।” বলেই ঠোঁট কামড়ে হাসলো শাবাব। ঘৃ*ণা*য় অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো ফাবিহা। পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই আজ আবার ফাবিহার হাত চেপে ধরলো। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে ফাবিহা। পেরে না উঠে সেও গতদিনের মতো শাবাবের গালে আরেকটা চ*ড় বসালো। আজ শাবাবকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। চেহারায় রাগ নেই। বোঝা যাচ্ছে শান্ত মাথায় খেলতে এসেছে। ঝট করে ফাবিহার হাতের পিঠে পরপর দুটো চু*মু বসিয়ে দিল। অতঃপর ক্রুর হেসে বলল,

“দুটো চ*ড়ে*র বিনিময়ে দুটো চুমু। যদি আবারও আমার ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে চাও, তবে তোমার জন্য আমার দুয়ার উন্মুক্ত।”

ফাবিহা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। রাগে, লজ্জায় চোখে পানি এসে পড়েছে। কেবল গড়িয়ে পড়া বাকি। দ্রুত চোখ মুছে ছুটে চলে গেল৷ শাবাব চুমু দেওয়ার পরই হাত ছেড়ে দিয়েছে। ফাবিহা আর জবাব দিল না। সে জানে এখন জবাব দেওয়া মানে নিজের সম্মানে হাত দেওয়া। তবে এই চুপ থাকাটা চুপ থাকা নয়। এর দাম শাবাবকে দিতেই হবে। বিড়বিড় করে বলল,“ তোমাকে আমি দেখে নেব প্লেবয় শাবাব।”
শাবাব পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,“হেই, কিছুদিনের জন্য আমার হয়ে যাও লিটল গার্ল।”

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে