Wednesday, June 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 294



এক টুকরো আলো পর্ব-৩৯+৪০

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

ঘুম ঘুম ভাব। চোখ বন্ধ করে আছে ফাবিহা। আচানক পিঠে ছু*রি জাতীয় কিছুর টা*ন পড়লো। সাথে সাথেই প্রাণ বিষিয়ে উঠল। ঝট করে চোখ খুলে দেখলো র*ক্তে মাখোমাখো হাত। ভ*য়*ঙ্ক*র এক হাসি। আত্মা কেঁপে উঠলো ফাবিহার। এদিকে পিঠ থেকে র*ক্ত ঝরছে। দ্বিতীয় কো**প দেওয়ার জন্য সুমন হাত ওঠাতেই চিৎকার করে উঠলো ফাবিহা।

ঘুম ভেঙে গেল এক ভ*য়*ঙ্ক*র স্বপ্নের মাধ্যমে। হাঁপাচ্ছে সে। তার চিৎকারে শাবাবের ঘুম ভেঙে গেল। সদ্য ঘুম ভাঙায় বিচলিত গলায় ফাবিহাকে জিজ্ঞেস করল,“কী হয়েছে? ভয় পেয়েছ কেন?”

ফাবিহা হাঁপাচ্ছে। শাবাব একহাত নিয়ে ওকে আগলে ধরে বলল,“খা*রা*প স্বপ্ন দেখেছ?”

ফাবিহা শাবাবের ভাঙা হাত মুঠো করে ধরলো। শাবাব স্পষ্ট টের পেল ফাবিহার কম্পন। হাত সরিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরে বলল,“পানি খাও।”

ফাবিহা এক ঢোক পানি খেয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিল। তাকে সময় দিল শাবাব। খানিকক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে শুয়ে পড়ল ফাবিহা। শাবাব শরীরে কম্বল টে*নে দিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল,“ভয় পেয়েছিলে কেন?”

ফাবিহা ধীর গলায় নিজের স্বপ্ন বর্ণনা করল। শাবাব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডান হাত ফাবিহার পেটের উপর রাখলো। মাথায় এক হাত রেখে চুলের ভাঁজে হাত চালালো। ফাবিহাকে সান্ত্বনা দেওয়া আর তার পুরুষ মনের আকাঙ্ক্ষা দুটোই সমাধান হলো।
“সুমনের একটা কঠিন ব্যবস্থা নেব। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না।”

ফাবিহা শাবাবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর নিজের পেটে থাকা হাতের দিকে মনোযোগ ঘুরিয়ে নিলো। শাবাবও বোধহয় বুঝতে পারল। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তার হাতের নড়চড় হলো না। ফাবিহা হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল,“সুমনের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তবুও। ”

শাবাব আবারও হাত রাখল। চোখ বন্ধ করে বলল,“ওর পরিবারকে জানানো হয়েছে। ওকে দমানোর আরো চেষ্টা চলছে।”

ফাবিহা ওর হাতটা আবারও সরাতে নিলো। এবার মেজাজ খা*রা*প হয়ে গেল তার। দাঁতে দাৃত চেপে বলল,“সমস্যা কী তোমার? আবার বিয়ে করেছো কেন? এভাবে ঘরের এককোনায় ফে*লে রাখার জন্য?”

ফাবিহা ঠাণ্ডা স্বরে বলল,“আমার এভাবে শুয়ে অভ্যাস নেই। ঘুম হয় না।”

শাবাব এবার পা দিয়েও পেঁচিয়ে ধরে বলল,“অভ্যাস কারোরই থাকে না। এখন তুমি আমার সাথে থাকতে না চাইলেও থাকতে হবে। এখান থেকে জে*লে যেতে হবে। ওখানে আমাকেও যেতে হবে।”

“তোমাকে মে*রে আমি একা একাই জে*লে যাব।”

শাবাব ফাবিহার বলার ভঙ্গিমা পরোখ করে মিটিমিটি হাসল। অতঃপর অধরে অধর মিশিয়ে চুপ করিয়ে দিল তাকে। প্রথমে সরাতে চাইলেও এক সময় ফাবিহা নিজেও সাড়া দেয়। দুটো বিপরীত লিঙ্গের মানুষ একই ঘরে, একই বিছানায় থাকলে আকর্ষণ কাজ করা স্বাভাবিক। হঠাৎ যখন ফাবিহার মস্তিষ্ক সজাগ হলো, সে বুঝতে পারলো কী করছে, তখনই সিটকে সরে গেল। শাবাবের দিকে পিঠ করে পাশ ফিরে শুলো। মাঝপথে এভাবে সরে যাওয়ায় শাবাবের রাগ হলেও হজম করার চেষ্টা করল। খানিকটা ধাতস্থ হতেই ফাবিহাকে আবার পেছন থেকে আলিঙ্গন করে বলল,“আমি তোমায় ভালোবাসি, তাই তোমার প্রতি সব রকম টা*ন অনুভব করি। শারিরীক, মানসিক দুটোই। এভাবে দূরে থাকা আমার জন্য কষ্টের।”

ফাবিহা লজ্জা পেল শাবাবের কথায়। নিজেকে স্বাভাবিক বুঝাতে সে কোনো প্রতিক্রিয়া না করে সোজা হয়ে শুয়ে রইল। শাবাব তাকে ধরে ওভাবেই ঘুমিয়ে গেল।

★★★

“বউয়ের ঘুম হইছেনি?”

ফাবিহা গলা পরিষ্কার করে ছোট্ট করে জবাব দিল,“জি মামি।”

“শাবাবরে ডাক দেও। বেলা হই যাইতেছে। নাস্তা করবো কোন সময়?”

“ডাকছি মামি।”

শাবাবকে ডাকল ফাবিহা। শাবাব ঘুম ঘুম চোখ ঝাপসা দেখল একটা জলপাই রঙের শাড়ি পরে তাকে ডাকছে ফাবিহা। হালকা সাজগোছও আছে বোধহয়! ফাবিহা এবার জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল,“উঠছো না কেন? আমার খিদে পেয়েছে।”

শাবাব উঠে বসে হাই তুলে বলল,“সেজে আছো মিষ্টি বউয়ের মত। কিন্তু কথা এমন তিতা কেন? আদর করেও তো ডাকা যেত।”

“আদর তোমার অন্য হাতে দেব। কালরাতে কী করেছিলে আমি ভুলিনি।”

শাবাব বিস্মিত হতে হতেও হেসে ফেললো। বলল,“তুমি নিজেও চেয়েছিলে আমি তোমার কাছে যাই। সেজন্যই তো বাঁধা দাওনি।”

ফাবিহা কপট রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। শাবাব না বললেও সত্য তো আর মিথ্যা হয়ে যাবে না। গতরাতের সেই চুম্বনে তারও সায় ছিল শারিরীক দিক থেকে। মানসিক দিক থেকে সে এখনো পুরোপুরি ভরসা করতে পারছে না। নিজেই দোটানায় আছে। এই শারিরীক টা*ন তাকে বুঝিয়ে দিল সংসার করতে ভালোবাসার প্রয়োজন হয় না। হাজার হাজার দম্পতি এভাবে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে সংসার করে চলেছে। এখন কেবল সন্তানের টা*ন*ই দুজনকে এক করে রেখেছে। ভালোবাসাটাই মূখ্য বিষয় নয়। তবুও সে চায় তার জীবন ভালোবাসাময় হয়ে উঠুক। দেরিতে হলেও ভালোবাসা আসুক।

শাবাব ঝটপট হাতমুখ ধুয়ে খেতে এলো। ফাবিহা আর সে পাশাপাশি বসে খাচ্ছে। মামি শীতের পিঠা বানিয়েছেন। ফাবিহা বেশ আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। তার আগ্রহ দেখে শাবাব নিজের প্লেট থেকে একটা পিঠা ওর প্লেটে তুলে দিল। ফাবিহা খাওয়া থামিয়ে বলল,“আমার আর লাগবে না।”

আশেপাশে দুজন ঘুরতে বের হলো। এক একটা বাড়ির দূরত্ব পাঁচ মিনিটের। রাস্তায় খুব একটা মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে ফাবিহা বলল,“আমাদের বাসায় ফিরে যাওয়া উচিত।”

শাবাব বলল,“এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে তোমার?”

“না। বাড়িতে তোমার বাবা অসুস্থ। আম্মা, তুলি সবাইকে একা রেখে এসেছি। এভাবে আসা উচিত হয়নি আমাদের।”

“সমস্যা নেই। মা কিছু মনে করবে না।”

“আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাসায় চলে যাব।”

ফাবিহার মতিগতি বুঝলো না শাবাব। দুপুরের পরই দুজন আবার বেরিয়ে পড়ল। মামি মনঃক্ষুণ্ন হয়ে বললেন,“এটা কোনো কথা হইলো? কিছুদিন থাকবা এখানে, আর তোমরা কালকে আইসা এখন যাইতাছো গা। আমি কিছু কইছি?”

“না না মামি। তুমি মোটেও এসব ভেবো না। বাড়িতে বাবা অসুস্থ। তাই মন টিকছে না আমার।”

ফাবিহাকে নিয়ে শাবাব গাড়িতে চড়লো। দুজনকে বাড়ি ফিরতে দেখে সুরাইয়া অবাক হলেন। শাবাব মাকে বুঝ দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
সি*গা*রে*ট ধরাতেই ফাবিহার কথা মনে পড়ল। তাই সোজা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বাইরে থেকে খেয়ে তারপর ঘরে ঢুকলো। তবুও টের পেল ফাবিহা। স্থির চোখে তাকিয়ে বলল,“শেষ?”

“কী?”

“সি*গা*রে*ট খাওয়া শেষ?”

শাবাব অবাকতার সুরে বলল,“আমি কি সি*গা*রে*ট ধরেছি নাকি?”

ফাবিহা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,“আমি দেখিনি ভেবেছ?”

শাবাব চট করে তাকে একটা চুমু খেয়ে বলল,“স্মেল আসছে? আসছে না। এবার বিশ্বাস হলো? আমি সি*গা*রে*ট খাইনি।”

ফাবিহা কটমট করে বলল,“মিথ্যা বলা কবে ছাড়বে?”

শাবাব পুরো ভদ্র ছেলের মত বলল,“সি*গা*রে*টে*র কথা ছাড়া আর কোনো মিথ্যা বলি না তোমার সাথে। এটাও সেদিন থেকে বলবো না, যেদিন তুমি আমার কাছে আসবে।”

ফাবিহা ফোঁস করে বলল,“মিথ্যা বলে আবার গলায় জোর দিচ্ছ?”

“দিচ্ছি।”
বলেই হেসে চলে গেল শাবাব। আবার পিছু ফিরে বলল,“এখন থেকেই ছেড়ে দেব সুন্দরী, যদি তুমি চাও।”

“এখন বউয়ের সাথে ফ্লার্ট করছো? তোমার মত অ*ভ*দ্র আমি দুটো দেখিনি।”

“বউয়ের কাছে সাধু সেজে কয়জন ছেলেমেয়ের বাপ হতে পেরেছে? আমার আবার বাপ হওয়ার খুব শখ। তাই সাধুসন্ন্যাসী হওয়া আমার দ্বারা হবে না।”

নিজের জালে নিজেই ফেঁসেছে ফাবিহা। তাই চাইলেও কিছু বলতে পারে না। কারণ স্বেচ্ছায় যে গলায় দড়ি পরেছে।
হুরাইনকে কল দিয়ে কথা বলল। হুরাইরা জিজ্ঞেস করেছিল বইগুলো পড়েছে কিনা? জবাবে ফাবিহা বলেছিল,“সময় পাইনি। পড়ে তোমায় জানাবো।”

তাই একটা বই নিয়ে বসলো। “কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ”। শাবাব এসে তাকে পড়তে দেখে জিজ্ঞেস করল,“কী পড়ছো?”

বইয়ের নাম উল্টে দেখে কিছু বলল না।

★★★

হুরাইন বাবার বাড়িতে যাওয়ার দুদিন পরই তাকে নিয়ে এসেছে তাসিন। জনাব আজাদ কেবল গম্ভীরভাবে জামাতাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তাসিন যে হুরাইনকে নিয়ে চলে এসেছে, তিনি বাঁধা দেননি। এটা দেখে তাসিন যেন হাতে সুযোগ পেয়ে গেল। হুরাইনকে রাগানোর জন্য বলল,“তুমি বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল আর তোমার বাবা তোমাকে বাড়ি থেকে বের করার জন্য পাগল। দেখলে না তুমি চলে আসাতেও বা্ধা দেয়নি। মনে মনে আ*প*দ বিদায় হয়েছে বলে খুশি হয়েছেন।”

হুরাইন রেগেও গেল।
“আমি আমার বাবার ছোটো মেয়ে। আমার জন্য সবার আদর বেশি। বাবাতো কিছু বলেননি লজ্জায়। যেভাবে দুদিন না যেতেই এসে বউ নিয়ে টা*না*টা*নি শুরু করেছেন।”

তাসিন মিটিমিটি হেসে বলল,“না না, তুমি যতই তোমার বাবাকে উপরে রাখার চেষ্টা করো, তোমার বাবা কিন্তু তোমাকে বাড়ি থেকে বিদায় করতে পেরেই খুশি হয়েছেন। চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।”

“আপনি আর আমার সাথে কথা বলবেন না।”

“কথা না বললে কী হবে? আমার এত ইচ্ছে নেই তোমার সাথে কথা বলার।”

“ঠিক আছে। দেখা যাবে।”

“হ্যাঁ, দেখা যাবে।”

বাড়ি এসে মসিবতে পড়লো তাসিন। হুরাইন সত্যি সত্যি তার সাথে কথা বলছে না। এদিকে জ্বীনের মত তার জিনিসপত্র কোথায় রেখেছে, সেগুলো খুঁজে পাচ্ছে না তাসিন।
তাই বাধ্য হয়ে হুরাইনের সামনে গিয়ে হার মেনে বলল,“সব দোষ আমার। তোমার বাবা জিতে গিয়েছে। এবার দয়া করে আমার জিনিসপত্র বের করে দাও।”

হুরাইন ভাব নিয়ে বলল,“নিজের দোষ স্বীকার করার জন্য ধন্যবাদ আশা করবেন না।”

তাসিন দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়েও হেসে ফেললো। ভবিষ্যতে দুঃখ পেলেই তাকে হাসতে হবে। কোনোভাবেই দুঃখ প্রকাশ করা যাবে না।

#চলবে……

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৪০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

ফাবিহা আফসোস করছে কেন মা-বাবা তাকে মাদ্রাসায় পড়াল না! তাহলে সে অনেক কিছু থেকে বেঁচে যেত। বিপদ-আপদ, পা*প থেকে বাঁচতে পারত। হুরাইনের জীবন এখন কতই না সহজ। তুলিকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো সে। শাবাব ঘরেই আছে। দুজনের হাঁটার মাঝেই এক মিষ্টি কণ্ঠ শুনে তুলি, ফাবিহা দুজনই ঘুরে তাকাল। ফাবিহার তুলনায় ছোটো একটি মেয়ে। মিষ্টি হেসে তুলিকে জিজ্ঞেস করল,“শাবাব ভাইয়ার বউ?”

“হ, ভাইজানের বউ। সুন্দরী আছে না?”

মেয়েটি ফাবিহাকে আগাগোড়া পরোখ করে বলল,“হুম, খুব সুন্দরী। হাই, আমি অরিন।”

ফাবিহাও মিষ্টি হেসে বলল,“আমি ফাবিহা।”

শাবাব বারান্দায় এসে অরিনকে দেখল। অরিনের নজরও পড়ল তার উপর। ডেকে উঠে বলল,“কী অবস্থা?”

শাবাব হেসে জবাব দিল।
“খুব একটা ভালো না। দাঁড়াও আমি আসছি।”

শাবাব বেরিয়ে আসতেই দুজনের কথা জমে গেল। তুলি আর ফাবিহা যেন পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া অপরিচিত লোকজন। অরিন এক সময় চলে গেল। ফাবিহা জিজ্ঞেস করল,“মেয়েটি কে?”

শাবাবের আগে তুলি মুখ খুললো। মুখ চেপে হেসে বলল,“ভাইজানের প্রেমিকা আছিলো এই আফু। পাশের বাড়ি আফুর নানার বাড়ি।”

ফাবিহা রেগে গেলেও প্রকাশ করল না। আগে প্রেম করেছে। অথচ একটু আগেও দেখে মনে হচ্ছিল দুজনের মাঝে জন্মের ভাব। শাবাব তুলির কথা শুধরে দিয়ে বলে উঠলো,“ ওর সাথে আমি প্রেম করিনি। ওর বোনের সাথে প্রেম করেছি। প্রাক্তন শা*লি*কা।”

ফাবিহা দাঁতে দাঁত কামড়ে ছিল। এবার নিচ থেকে একটা ইট তুলে নিতেই শাবাবের চোখ চড়কগাছ। আগুন ধরাতে গিয়েছে। এখন তো দেখছে বো**ম ফাটবে। সে জীবন বাঁচিয়ে দৌড়ে পালালো। কটমট করছে ফাবিহা। ভালো নেই, না? ওই মেয়েকে দেখে তো দিব্যি ভালো হয়ে গেল। খিলখিল করে হেসে উঠল তুলি। রাগ করে তাকে ধমক দিল ফাবিহা।
“হাসবি না। তুই আর তোর ভাইজান দুটোই ফা*ল*তু।”

তুলি হাসি না থামিয়ে ফাবিহার গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে বলল,“ভাইজান আপনেরে ডরায় ভাবি।”

ফাবিহা গলা খাঁকারি দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। চোখমুখে গম্ভীর ভাব ফোটানোর চেষ্টা করছে।

নিজের শুকনো জামাকাপড় ভাঁজ করছে ফাবিহা। পেছনে কোমরের দিকে শাড়ি নেমে গিয়েছে অনেকটা। শাবাব ফোন টিপছে কম ফাবিহাকে দেখছে বেশি। এখন তাকিয়ে আছে ফাবিহার শাড়ি সরে যাওয়া দৃশ্যমান আকর্ষণীয় কোমরে। ফাবিহার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যাপারটা জানান দিতেই সে নিজের কোমরে হাত দিল। তারপর হাতের শাড়ি ভাঁজ করা বাদ দিয়ে শাবাবের সামনে এসে তার দিকে পিঠ করে দাঁড়ালো। শাড়িটা কোমর থেকে আরেকটু নামিয়ে দিতেই গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল শাবাব।
“আরে কী করছ তুমি?”

ফাবিহা শাবাবের দিকে তাকিয়ে বলল,“তুমি যা দেখতে চাইছ, সেটাই দেখাচ্ছি।”

“ওহ্৷, দেখি আরেকটু দূরে দাঁড়াও। এত কাছ থেকে ভালো করে দেখছি না।”
বলেই ফাবিহার কোমরে দৃষ্টি স্থির করল সে। ফাবিহা অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে শাড়ি ঠিক করে বলল,“অ*স*ভ্য। ক*টা*ক্ষও বোঝে না।”

শাবাব ভ্রু কুঁচকে বলল,“তুমি ক*টা*ক্ষ করেছ? ভালোভাবে দেখতেও দিলে না। ধ্যাত!”

ফাবিহা ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস টে*নে নিজের হতাশা কমানোর চেষ্টা করছে। শাবাব সাধু পুরুষ হবে, এটা আশা করা বোকামি। সে মাথায় হাত চেপে বসে আছে। শাবাব গায়ে শার্ট জড়িয়ে বের হওয়ার আগে তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,“আই লাভ ইউ। আমি জানি এটা শুনতে না পেরে তোমার মন খা*রা*প। তাই বলে দিলাম। নয়তো তোমার মত বিস্ফো**রণ ঘটানো বো*ম*কে ভালোবাসতে আমার বয়েই গেছে।”

চলে যেতে গিয়েও আবার কানের কাছে মুখ এনে বলল,“বালিশের পাশে সিগারেট রেখেছি। আমি আসতে আসতে তুমি ফেলে দিও। তারপর আমার সিগারেট ফেলে দেওয়ার অপরাধে আমি তোমাকে চু*মু খাবো। তুলিকে দিয়ে ফেললে শা*স্তি দ্বিগুণ হবে বলে দিলাম।”

ফাবিহা নড়চড় না করে ওভাবেই বসে রইল। মনে হচ্ছে সে পাবনা মে*ন্টা*ল হাসপাতালে আছে।

রাতে দুজন বিছানার দুপাশে শুয়ে আছে। শাবাবের মুখ ফাবিহার দিকে ঘোরানো। সে ফাবিহাকে দেখছে। ফাবিহা সোজা হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। শাবাবের দৃষ্টির অর্থ সে পড়তে পারছে। তার মনের উপর ঝুলে আছে শাবাব। নিরবতাকে ছুটি দিয়ে ফাবিহা মৃদু আওয়াজে বলল,“শাবাব।”

“হুঁ?”

“তুমি আমার কাছে আসতে পারো।”

শাবাব ফিসফিস শব্দে হেসে বলল,“তুমি মন থেকে চাওনি।”

ফাবিহা মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
“আমি না চাইলেও তুমি কাছে আসতে পারো। আমি বাঁধা দেব না।”

“মন থেকে চাইলেই আসব।”

ফাবিহা চুপ করে গেল। শাবাব ওর নাক টে*নে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,“ঘুমাও।”

চোখ বন্ধ করলেও ঘুমালো না শাবাব। ফাবিহা এখনো তাকিয়ে আছে। একটু পর আবারও বলল,“তুমি কাছে আসতে পারো শাবাব।”

“ঘুমাও ফাবিহা। সকালে কথা হবে।”

“আমি মন থেকে চাইছি।”

“না, তুমি মন থেকে চাওনি।”

“চেয়েছি।”

এবার শাবাব চোখ খুলল। চাতকের মত তাকিয়ে থেকে আহ্বান পেয়ে তা গ্রহণ করে নিলো সে। ফাবিহা চোখ বন্ধ করে রইল। শাবাব এগোতে গিয়েও রেগে গিয়ে পাশ ফিরে শুলো। ফাবিহার আচরণ বলছে সে তাকে মন থেকে গ্রহণ করেনি। কেবল স্ত্রীর অধিকার পালন করেই দায় থেকে মুক্ত হতে চাইছে। ফাবিহা অনেকক্ষণ কোনো সাড়া না পেয়ে চোখ খুলে শাবাবকে পাশ ফিরে থাকতে দেখে হতাশ হলো। সে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে শাবাবকে কাছে আসার আহ্বান জানিয়েছে। বিয়ে যেহেতু হয়েছে, তার অধিকার থেকে তো তাকে বঞ্চিত করা যায় না। সে ছোট্ট করে বলল,“সরি শাবাব!”

শাবাব ফিরলো তার দিকে। কাতর স্বরে বলল,“কীভাবে তোমার ভরসা অর্জন করতে পারি, বলো? আমি জানি আমি অ*ন্যা*য় করেছি। সবটা ঠিকঠাক চলছিল। মাঝখান থেকে তুমি আবার আমায় সুযোগ দিলে। আমি লো*ভী। তোমার লো*ভী। তোমাকে পাব বলে আবারও বিয়ে করে নিয়েছি। ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। কিচ্ছু ঠিক হয়নি। এভাবে অশা*ন্তিতে থাকা যায় না ফাবিহা। এতে কোনো স্বস্তি নেই।”

ফাবিহার দৃষ্টি স্থির। সে কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। তার দৃষ্টি ঘুরছে শাবাবের চেহারায়। শাবাব তপ্তশ্বাস ছেড়ে বলল,“তুমি না-হয় দেশের বাইরে চলে যাও পড়ার জন্য। দূরত্ব আসলেই স্বস্তি মিলবে। কাউকে ভালোবেসে এত কাছে থেকেও মন থেকে যোজন যোজন দূরে থাকাটা কঠিন। যেকোনো একটা করো। হয় আমাকে ভালোবাসো অথবা দূরে চলে যাও।”

“আমি না-হয় চলে গেলাম। তখন তুমি এদিকটা কীভাবে সামলাবে?”

“কয়েক বছর গেলে সবাই এমনিতেই বুঝে যাবে। আমাকে কিছু বোঝাতে হবে না।”

“নিজেকে কী বোঝাবে।”

“ভালোবাসলেই পেতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। নিজেকে বোঝাবো এটা আমার ক*র্মে*র শা*স্তি।”

ফাবিহা ক্ষণ সময় পর নিজ থেকেই শাবাবের অধর স্পর্শ করল। শাবাব কিছুক্ষণের জন্য চমাকালেও আঁকড়ে ধরলো ফাবিহাকে। ফাবিহা সরতে চাইলেও ছাড় পেলো না। শাবাব ফিসফিস করে বলল,“নিজ থেকেই এসেছো।”
পরপর ফাবিহার চোখের পাতায় চুমু খেলো।

★★★

চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে সুমনকে। চোখে কালো কাপড় বাঁধা। বুক বরাবর লা*থি পড়তেই চেয়ার সহ উল্টে পড়ল সে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে। চোখের কালো কাপড় সরিয়ে দিতেই মাথায় র*ক্ত উঠে গেল সুমনের। রাগে হুঙ্কার ছাড়ল।
“শাবাব।”

শাবাব দাঁতে দাঁত চেপে উপর থেকে নিচে একবার মাথা দুলিয়ে দ্বিগুণ রেগে হুঙ্কার ছাড়ল, “শাবাব।”

“কু**********, তোর হাত ভে*ঙেও শিক্ষা হয়নি? আমার হাতের বাঁধন খুলে দে।”

“ফরহাদ, তোর ভাবি আর আমার বিয়ে উপলক্ষে এই জা******* মিষ্টি দিয়ে দে।”

“জি ভাই।” বলে ফরহাদ র*ড হাতে তুলে নিলো। সুমন সবরকম গা*লি দিয়ে যাচ্ছে। ফরহাদ আর সাথের দুটো ছেলে সুমনকে পি*টি*য়ে যাচ্ছে। ওর আর্তনাদে কেঁপে উঠছে কক্ষটি। শাবাব ফারহাদের হাত থেকে র*ড নিয়ে বলল,“এদিকে দে। কী মা*র*ছি*স? তাকিয়ে থাক।”

র*ড তুলে সুমনকে এক বা*ড়ি দিতেই ফরহাদ বলল,“ভাই আপনি হাতে ব্যথা পাবেন।”

শাবাব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,“এর চামড়া ছিঁ*ড়ে জায়গামত লবণ -মরিচ দিতে পারলে ভালো লাগত।”

সুমনের দু’পায়ের ফাঁকে দুটো লা*থি বসিয়ে দিল। অবস্থা খুবই শোচনীয়। ফরহাদ বলল,“ভাই এবার মনে হয় ছেড়ে দেওয়া উচিত। আরও কয়েকটা পড়লে ম*রে যাবে। যা লা*থি মে*রে*ছে*ন, মনে হয় না আর ওর বংশধর আসবে।”

“যাক, ওরে গু*ম করে দিবি। ওর ফ্যামিলিকে সুন্দরভাবে বুঝিয়েছি। কোনো স্টেপ না নিয়ে ছেলেকে আরও প্রশ্রয় দিয়েছে।”

ফরহাদ আশঙ্কায় শাবাবকে বুঝিয়ে সুমনের নেতিয়ে পড়া শরীর দড়ি থেকে খুলে ফেললো। শাবাব এখন রাগে জ্ঞানশূন্য হয়ে আছে। তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল।

ঘরে ঢুকে চুপিচুপি কম্বলের নিচে ঢুকতে নিতেই তেজী স্বরে প্রশ্ন ভেসে এলো।
“কোথা থেকে এসেছো?”

“কাজ করে এসেছি।” বলে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লো শাবাব। ফাবিহা শক্ত মুখে বলল,“রাত দেড়টা বাজে। কাজটা কি নতুন প্রেম? তা এসেছ কেন? ভোরের পর আসতে।”

ফাবিহার রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে শাবাব মনে মনে হাসছে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,“প্রেমিকার বাবা দেখে ফেলেছে। তাই চলে এসেছি।”

ফাবিহার চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। সে বলল,“শাবাব তুমি সীমা ছাড়াচ্ছ। তোমাকে বিশ্বাস করাই আমার ভুল ছিল।”

ফাবিহা সবটা সত্য ভেবে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে দেখে শাবাব সত্যটা বলল।
“আরে শান্ত হও।”

ফাবিহাকে সবটা বলতেই তার চোখ চড়কগাছ। বিস্ময়ে বলল,“তুমি এই হাত নিয়ে কীভাবে এতবড়ো সাহস করেছো?”

শাবাব হাসলো। ফাবিহাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“মাথায় চাপ না দিয়ে ঘুমাও।”

ফাবিহা ওর হাত সরিয়ে দিয়ে শুলো। শাবাব বিরক্ত হয়ে বলল,“কালই তো সব ঠিকঠাক ছিল। আবার হাত সরাচ্ছো কেন?”

“চুপচাপ ঘুমাও শাবাব। তুমি কোনো রাজকার্য সামলে আসোনি। মা*র*ধ*র করে এসেছো।”

“আশ্চর্য! আমি কী করলাম?”

ফাবিহা সাড়া দিলো না। শাবাব মৃদু আর্তনাদ করে বলল,“আহ্ আমার হাত ভেঙে দিয়েছ।”

ফাবিহা শাবাবের দিকে ফিরে বলল,“অভিনয় না করে ঘুমাও। তোমার জন্য আমি এখনো ঘুমাতে পারিনি। ঘুমাতে না চাইলে ঘর থেকে বের হও।”

শাবাব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বলল,“জীবনে আর শান্তি পাবো না। জেনেশুনে আ*গু*নে ঝাঁপ দিয়েছি। কখন কোন মুড নিয়ে থাকে, বলা যায় না।”

#চলবে……

এক টুকরো আলো পর্ব-৩৭+৩৮

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

প্রথমবার ফা*টা*লো মাথা। দ্বিতীয়বার ভাঙা হাত নিয়েই বিয়ে করতে হলো।
আজ জেঠার বাসায় দাওয়াত আছে। সুরাইয়া ফিরোজ আলমকে রেখে যাবেন না। ফাবিহা আর শাবাবের সাথে তুলি যাবে। শাড়ির আঁচল ঠিক করছে ফাবিহা। সিগারেটের উৎকট গন্ধ নাকে ঢুকে গেল। শাবাব বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বাঁ হাতে সিগারেট ফুঁকছে। ঠোঁটজোড়া কালচে দেখাচ্ছে। ফাবিহা সিগারেটের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শাবাব হঠাৎ লক্ষ করল বিষয়টি। ফাবিহার চাহনি দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,“তুমিও সিগারেট খাবে? এসব স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।”

ফাবিহা কড়া স্বরে বলল,“আমি তোমার মত খ*বি*শ নই, যে ছাইপাঁশ খাব। এসব ছাড়তে হবে তোমায়?”

“ছেড়ে দেব, কিন্তু বিনিময়ে কী পাব?”
শাবাবের ভেতরকার অভিসন্ধি আঁচ করতে পেরে চোখ সরু হয়ে এলো ফাবিহার।
“আর কী চাইছ? কী পাওয়া বাকি?”

শাবাব ফাবিহার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,“পেয়েও তো স্বাধীনতা পেলাম না।”

“ভালো হয়ে যাও শাবাব।”

শাবাবের ঠোঁটে তীর্যক হাসি। বলল,“তুমি আমায় সুযোগ দিয়েছো।”

ফাবিহার কিছু বলার পূর্বেই তুলি দরজায় এসে দাঁড়ায়।
“ভাইজান, ভাবি আপনেগো হয় নাই?”

শাবাব বলল,“না, মাত্র তো বিয়ে হলো। বাচ্চাকাচ্চা হতে অন্তত এক বছর তো অপেক্ষা করতেই হবে।”

তুলি লজ্জা পেয়ে মিটিমিটি হাসলো। ফাবিহা ফুঁসে উঠলো।
“শাবাব আমি কিন্তু তোমার মুখ ভেঙে দেব। ছোটোদের সামনে কী বলছ তুমি?”

শাবাব ভ্রু কুঁচকে বলল,“তুলি তুই ছোটো? ওহ্ তাহলে তুই যা। এখন থেকে তোর ভাবিকে গোপনে বলব।”

তুলি লজ্জা লজ্জা মুখ করে ছুটে পালিয়ে গেল। শাবাব বলল,“তুলি চলে গিয়েছে। এবার বলব?”

“যে ভালো হাতটা আছে না? ওটাও এখন ভেঙে ফে*ল*ব।”

এক বস্তা রাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল ফাবিহা। শাবাব আলগোছে হাসলো। এখনও জড়তা কাটেনি ফাবিহার। তবে এই রাগটা উপরি উপরি।
গাড়ি নিয়ে খালার বাড়ি দাওয়াত খেতে গেল। যাওয়ার পর থেকে দুজন এক জায়গায় বসে আছে। তুলি আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে। যোহরের আজান পড়ল। ফাবিহা শাবাবের উদ্দেশ্যে বলল,“নামাজ পড়তে যাও।”

শাবাব নড়েচড়ে বসল। ফাবিহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,“কী হলো?”

শাবাব বলল,“আমার হাতে সমস্যা তো। সুস্থ হলে পড়বো।”

“ভাঙা হাত নিয়ে বিয়ে করতে পেরেছ, খেতে পার, সব পার। আর নামাজ পড়তে পারবে না? তাহলে এক কাজ করো খাওয়া, বাথরুম, গোসল এসবও সুস্থ হলেই করে নিও।”

শাবাব বসা থেকে উঠে ইচ্ছে না থাকার পরও পা বাড়ালো। ফাবিহা তার প্রতিটি কদম মনোযোগ দিয়ে গুনছে। এবার সে-ও নামাজ পড়ে নিলো।
শাবাব অনেকদিন পর আজ আবার মসজিদে প্রবেশ করলো খালুর সাথে।

শরীরে মৃদু শিহরণ বয়ে গেল। জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করে বাড়ি ফিরতেই খালা পুরুষদের একসাথে খাবার খেতে বসিয়ে দিলেন। পরের মেয়েদের সাথে ফাবিহা বসবে।
শাবাব বলল,“ ফাবিহা, তুলি বসে যাও আমাদের সাথে।”

খালা বললেন,“ওরা আমাদের সাথে খাবে। তোরা খেয়ে নে।”

শাবাব খেয়ে উঠে গেল। ফাবিহা খালা শাশুড়ির সাথে পরেই খেয়ে নিলো। বাড়ি আসার পর হুরাইনের কল পেয়ে ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো। সালাম বিনিময় করে বলল, “কেমন আছ?”

“আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? সব ঠিকঠাক চলছে?”

“চলছে। তুমি এখনো আমাকে আপনি করেই ডাকবে? আমি তোমায় প্রথম থেকেই তুমি ডেকে এসেছি।”

হুরাইন মৃদু হেসে বলল,“অনুমতি পেয়ে গিয়েছি। এখন থেকে তুমি বলব।”

কথার মাঝেই শাবাব প্রশ্ন করল,“কার সাথে কথা বলছো?”

“হুরাইন।”

শাবাব বলল,“ওনাকে একটা ধন্যবাদ দিও আমার পক্ষ থেকে।”

হুরাইনকে ধন্যবাদ দিতে হলো না। সে শাবাবের কথা শুনতে পেয়ে মৃদু ঠোঁটে হাসলো। ফাবিহাকে বলল,“আল্লাহর কাছে চাইতে থাকো আপু। যা চাইবে, তাতে যদি তোমার কল্যাণ নিহিত থাকে; সেটা তুমি পাবে। আমি তোমাদের জন্য দোয়া করছি। তোমার দোয়াতেও আমাদের সকলকে রেখো।”

“কী করছো তুমি?”

“বই পড়ছিলাম।”

“আমাকেও কয়েকটা বই সাজেস্ট করো।”

“আমি একটু পরই মেসেজ করে জানাচ্ছি কী কী বই পড়বে।”

“আচ্ছা, নিজের খেয়াল রেখো। বাইরে থেকে এসেছি। পরে কথা বলব।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

হুরাইন ইসলামিক বই পড়ে, সেটা সে জানে। বইয়ের নাম সাজেস্ট করার কথা হুট করে আবেগ থেকেই বলেছে। একেবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে ইসলামকে জানার উদ্দেশ্যে বলেনি।

রাত্রি গভীর হলো। বেশ রাত করে ঘুমানো শাবাবের অভ্যাস। সে ঘুমন্ত ফাবিহাকে খুব কাছ থেকে দেখছে। তার নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে শাবাবের গলায়। শাবাব ঘুমন্ত ফাবিহার সুযোগ নিলো। নাকের ডগা আর অধর ছুঁয়ে দিল নিজ ওষ্ঠ দ্বারা। নড়েচড়ে উঠলো ফাবিহা। খানিক্ষন বাদে তার ঘুম ছুটে গেল শরীরের উপর ভারী কিছুর স্পর্শ পেয়ে। নিভু নিভু চোখ খুলে শাবাবকে ঘুমন্ত অবস্থায় তার গায়ে হাত দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখলো। এভাবে ঘুমাতে অসুবিধা হয় তার। শাবাবের হাত সরিয়ে দিয়ে আবারও গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল। শাবাব মিটমিট করে হাসছে। আবারও সে হাত রাখলো। কয়েকবার ফাবিহা হাত সরিয়ে দেওয়ার পরও সে বারবার হাত রাখছে। শেষে শাবাবের ইচ্ছাকৃত কাজ বুঝতে পেরে ফাবিহা ওর হাত ধরে সরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে কামড়ে ধরলো।
এবার দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো শাবাব। ফোনের আলো জ্বালিয়ে হাতে বসে থাকা দাঁতের স্পষ্ট চিহ্ন দেখে আঁতকে উঠলো। কয়েকবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় ফাবিহার ঘুম একেবারে হালকা হয়ে গেল। সে না ঘুমালেও চোখ বুজে আছে। মনে মনে পৈশাচিক হাসি হাসছে। শাবাব আর হাত রাখলো না। সটান হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন ফাবিহার শশুর বাড়ি এলো তাসিন। হাতে কয়েকটা বই। এগুলো হুরাইন পাঠিয়েছে। অবাক হলো ফাবিহা। সে গতকাল বইয়ের নাম চেয়েছিল আর হুরাইন বই সহ পাঠিয়ে দিল? তাসিনের আপ্যায়ন চলছিল বেশ। শাবাবের সাথেও কথা হলো। শাবাব কয়েকবার বাঁকা চোখে তাকালো তাসিন আর ফাবিহার দিকে।

ফাবিহা ঘরে ফিরতেই শাবাব বলল,“তোমার তাসিন ভাই দেখছি একেবারে চোখ তুলেই তাকাচ্ছেন না।”

ফাবিহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,“তুমি এসব খেয়াল করছিলে? সবাইকে নিজের মত ভাবো, তাইনা?“

“আশ্চর্য! আমি খা*রা*প কী বললাম? উনি এসেছেন থেকেই মাথানিচু করেছিলেন। সেজন্যই জিজ্ঞেস করেছি।”

ফাবিহা এবার স্বাভাবিক গলায় বলল,“তিনি স্ত্রীর কথা মেনে চলেন। কোনো পরনারীর দিকে তাকান না। সব ধরনের হা*রা*ম কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন।”

শাবাব বলল,“এমন শাসন পেলে আমিও সব ছেড়ে দিতে রাজি আছি।”

ফাবিহা চুপ করে আছে। শাবাব জবাবের অপেক্ষায় থেকেও জবাব না পেয়ে বলল,“তুমি কি সম্পর্কের উন্নতি চাও না? না চাইলে কেন বিয়ে করেছো?”

ফাবিহা বলল,“তোমার ধৈর্য এত কম কেন?”

“কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি, সেজন্য আমার ধৈর্য কম। এটা স্বাভাবিক নয় কি? নিজের পছন্দের মানুষকে বৈধভাবে পেয়ে কাছাকাছি থেকেও তার মন ছুঁতে না পারা, তাকে ছুঁতে না পারা ব্যক্তির ধৈর্য কম হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। আমাদের দুজনেরই কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে।”

ফাবিহা গমগমে স্বরে বলল,“তোমাকে তো আমি অপেক্ষা করতে বলিনি। তোমার যা চাই, তা তুমি আদায় করে নাও। সব রকম অধিকারই তোমার আছে।”

শাবাব মৃদু আওয়াজে বলল,“আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে, আমাদের সম্পর্ককে একটা সুযোগ দিতে চাও, সেজন্যই বিয়ে করেছো। আমি আগেও বলেছি জোরজবরদস্তি করতে চাই না আর। মন না টা*ন*লে আবারও কেন জড়ালে? এতদিন সব তো খুব ভালোই চলছিল।”

ফাবিহা কথা বলছে না। আগ বাড়িয়ে শাবাবের কাছ ঘনাতে পারছে না সে। কেমন জড়তা কাজ করে।
শাবাব রাগ করে দরজায় লা*থি দিয়ে বেরিয়ে গেল।
সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে শুয়ে পড়লো। রাতের খাবারের সময়ও উঠলো না। ফাবিহা ডাকাডাকি করেও ওকে ওঠাতে পারছে না। পাশে বসে ওর গায়ে হাত রেখে ডাকল।
“শাবাব উঠে খেয়ে নাও।”

শাবাব স্বাভাবিক গলায় বলল, “তোমরা খেয়ে নাও। আমার খিদে নেই।”

ফাবিহা বলল,“খাবার নিয়ে আসবো?”

“বললাম তো তোমরা খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।”
এই বলে শরীর থেকে ফাবিহার হাত সরিয়ে দিল। ফাবিহারও আর ইচ্ছে হলো না খেতে। শরীর কেমন ভার হয়ে আসছে।
শশুর-শাশুড়ি আর তুলিকে খাবার দিয়ে সে এসে শুয়ে পড়লো।

রাতে জ্বর এসে গেল ফাবিহার। ফজরে আর ওঠেনি। ও সহজে অসুস্থ হয় না; একবার অসুস্থ হলে সহজে সেরে ওঠে না।
ফাবিহাকে ডাকতে এলো তুলি। ওর ডাকে শাবাবের ঘুম ভেঙে গেল। সে ফাবিহার দিকে ফিরে ডাকতে গেল।
তুলি আবারও ডাকলো।
“ভাবি ওঠেন। রাইতে না খাইয়া ঘুমাইছেন বইলা খালাম্মা চিল্লাচিল্লি করতাছিল। এখনও ঘুমাইয়া আছেন দেইখা আমারে চিল্লায়ইতাছে।”

শাবাবের টনক নড়লো। ফাবিহা রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছে? একবার নরম স্বরে ওকে ডাকলো।
“ফাবিহা।”

ফাবিহা সাড়া দিল না। কয়েকবার ডেকে দেওয়ার পর উঠলো ফাবিহা। ফ্রেশ হয়ে এসে বাইরে চলে গেল। শাবাব শুয়েই রইল। ফাবিহা আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। অসুস্থ লাগছে চোখমুখ। এটা কি ঘুমের কারণে?

সুরাইয়া প্রথমে বকাবকি করলেও পরে ফাবিহার শরীরের উত্তাপ টের পেলেন। তুলিকে বললেন, “ঘরে ঔষধ আছে, নাস্তা করে ঔষধ খেয়ে নিতে বলিস।”

নাস্তা করার ফাঁকে তুলি বলল,“ভাবি ঘরে ওষুধ আছে। খালাম্মা কইছে নাস্তা কইরা জ্বরের ঔষধ খাইতে।”

ফাবিহা মাথা নাড়লো। তার দিকে চোখ তুলে তাকালো শাবাব। তারমানে তার ধারণা ভুল নয়। শাবাব বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ঘরে এসে ফাবিহাকে বসে থাকতে দেখলো। কোনো কথা ছাড়ায় এগিয়ে এসে ফাবিহার কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা চেক করলো। শরীরে বেশ জ্বর।
শাবাব বলল,“চলো ডাক্তারের কাছে যাব।”

“যেতে হবে না। এমনিতেই সেরে যাবে।”

“আমার কথা না শুনলে আমি কিন্তু জোর করতে বাধ্য হবো।”

ফাবিহা বসেই রইলো। শাবাব অকস্মাৎ ওর অধর চেপে ধরলো। কয়েক সেকেন্ড পরই ছেড়ে দিয়ে ফাবিহার দিকে তাকিয়ে বলল,“চলো।”

ফাবিহা চোখ লুকিয়ে বলল,“আমি যাব না।”

“তাহলে আবার চুমু দেব।”

ফাবিহা জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল,“তোমার ওই সিগারেটে পোড়ানো ঠোঁটে আমায় ছুঁতে এলে তোমার ঠোঁট আমি কু*চি*কু*চি করে ফেলবো।”

শাবাব বলল,“তোমার ছুঁতে পারলে আর সিগারেট ছুঁয়ে দেখবো না। প্রমিস!”

★★★

হুরাইন ফোন করে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেছিল বইগুলো পড়ে জানাতে, কেমন লেগেছে। তাই ইচ্ছে না থাকার পরও একটা বই নিয়ে বসলো ফাবিহা। জ্বরের শরীরে কিছুই ভালোলাগছে না। সুরাইয়া এটা-ওটা বলে বকাবকি করছেন, আবার নিজেই সব কাজ করে ফেলছেন।
শাবাব একটু বের হয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসে। আজ আর বের হলো না। ফাবিহাকে নিয়ে সে বিকেলে ডাক্তারের কাছে যাবে।

ফাবিহা বইয়ের দিকে তাকাতে পারলো না। তিন-চার লাইন পড়ার পরই ওর চোখ জ্বালা বেড়ে গেল। চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। তাই বই রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। শাবাব এসে আবারও কপালে হাত রেখে জ্বর দেখলো। ফাবিহা চোখ খুলে তাকালো।

“চলো ডাক্তারের কাছে।”

এবার শরীর খুব খা*রা*প লাগছে। তাই ফাবিহা আর বাড়াবাড়ি না করে শাবাবের কথায় উঠে পড়লো। বোরকা পরে বের হলো শাবাবের সাথে। সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। শাবাব জিজ্ঞেস করল,“বেশি খা*রা*প লাগছে?”

“হুম।”

“আমি আছি, ডাক্তার ঔষধ দিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
বলে ফাবিহার হাত নিজের মুঠোয় নিলো। ডাক্তারের কাছে যেতেই ফাবিহার জ্বর যেন অর্ধেক কমে গেল। ঔষধপত্র নিয়ে বের হয়ে শাবাব জিজ্ঞেস করলো, “কী খাবে?”

“আমি বাসায় যাব।”

#চলবে……..

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

“ঠান্ডা পানি ধরিস না। তোর শাশুড়ি কিছু বললেও ধরার দরকার নেই।”

ফাবিহা বলল,“কাজ তুলি আর উনিই করেন। আমি টুকটাক এগিয়ে দিয়ে থাকি।”

“শাবাব তোর সাথে খা*রা*প আচরণ করে? শুধু মাকে বলবি।”

“না। কেউই খা*রা*প আচরণ করছে না।”

“তবুও সাবধান থাকিস।”

“আচ্ছা। বাবা কোথায়?”

“বাড়িতে নেই। তোকে দেখতে যাবে বলেছে।”

“কখন?”

“সেটা বলেনি।”

মায়ের সাথে কথা বলার ফাঁকেই তুলি এসে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দিয়ে বলল,“ঠাণ্ডার মাঝে এমন বইসা রইছেন ক্যান? ভাইজান চাদর পাঠাইছে।”

ফাবিহা চাদর ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে মায়ের সাথে কথা শেষ করল। তুলিকে জিজ্ঞেস করল,“তোর ভাইজান আমায় কখন দেখল?”

“বাড়িত ঢুকনের সময় দেখল আপনে ছাদে শীতের কাপড় ছাড়া বইসা আছেন।”

“ওহ্।”

“আপনের জ্বর কমছে?”

“এখন একটু কম আছে।”

“তুলি নিচে যা।”
শাবাবের পুরুষালি স্বর শুনে তুলি, ফাবিহা দুজনই পিছু ঘুরে তাকাল। শাবাব এসেছে ছাদে। তুলি ভাইজানের আদেশ পেয়ে দ্রুত নিচে চলে গেল।
শাবাব গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,“এখন জ্বর কেমন?”

“কম আছে।”

“দেখি।” বলে ফাবিহার কপাল, গলা ছুঁয়ে দিল শাবাব। তারপরই পকেটে হাত গুঁজে বলল,“এভাবে ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে জ্বর আবার আসবে। নিচে চলো।”

ফাবিহা কোনো প্রকার সংকোচ না করে তাকিয়ে রইলো শাবাবের পানে। সে ভাবছে শাবাব কি সত্যি মন থেকেই তার জন্য এসব করছে না কি ছলনা? সে বশ্যতা স্বীকার করার পরই নিজের রূপ দেখিয়ে দেবে?
শাবাব দূরত্ব কমিয়ে এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বলল,“কয়দিন চুলে চিরুনি চালাও না?”

ফাবিহা দৃষ্টির নড়চড় না করেই ক্ষীণ ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,“চুলে চিরুনি না চালালে কি খা*রা*প দেখায়?”

শাবাব চোখ ছোটো করে বলল,“নায়িকা তো লাগে না। ভূতের মত থাকলে ভূতনিই লাগবে। তোমার চোখের নিচও ভূতনির মত কালো হয়ে গিয়েছে।”

“আমাকে ভূতের মত দেখালে সমস্যা তো নেই। তোমার জন্য তো মেয়ের অভাব নেই। আরো তিনটে বিয়ে করলেও কেউ না করবে না।”

“সত্যি?”

ফাবিহা তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করল। শাবাব আলতো হেসে বলল,“একজনের ভালোবাসাই আমার জন্য যথেষ্ট। তার মাঝেই আমি চারজন খুঁজে নেব। কখনো রাগী, কখনো শান্ত, কখনো চঞ্চল আর কখনো আদুরে বিড়াল।”

ফাবিহা হাসলো। তাতে কটাক্ষ ছিল বোধহয়!
“এভাবেই মেয়েদের পটিয়ে নিতে, তাইনা?”

শাবাব শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,“আমি এসব ভুলতে চাই ফাবিহা।”

ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“আমার মনে হচ্ছে আমি অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”

শাবাব ফাবিহার এক কথায় বলে ফেলল,“কোথায় যেতে চাও? তোমার পছন্দের জায়গায় যাব আমরা। সাজেক, কক্সবাজার, যেখানে যেতে চাও বলো।”

“ওসব জায়গায় না। গ্রাম হলে ভালো হয়। আগে ছোটোবেলায় দাদা বাড়ি যেতাম। দাদা-দাদি মা*রা যাওয়ার পর থেকে আর যাওয়া হয় না।”

“আমার দাদার বাড়িতে কেউই নেই। আমরা, জেঠুরা আর ফুফু সবাই শহরে থাকি। নানার বাড়িতে বড়ো মামা আছেন। যাবে ওখানে?”

★★★

রাতের বাসে চড়ার ইচ্ছা থাকলেও শাবাব অপেক্ষা করল ফাবিহার জ্বর আরো কিছুটা কমার। সকালে ঘুম থেকে উঠে সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পাচ্ছে না শাবাব। তন্নতন্ন করে বিছানা, ড্রয়ার সব জায়গায় খুঁজে যাচ্ছে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে ফাবিহাকে ডাকল।

“ফাবিহা ঘরে এসো তো।”

ফাবিহা শশুরের কাছ থেকে উঠে ঘরে এসে জিজ্ঞেস করল,“কী হয়েছে?”

“আমার সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পাচ্ছি না।”

ফাবিহা ভাবলেশহীন বলল, “আমি ফেলে দিয়েছি।”

“কীহ্!” মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো শাবাব।

“আবার বলতে হবে? কটন আছে ঘরে। কান পরিষ্কার করে নিও।”

শাবাব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“তুমি সিগারেট ফেলেছো কেন?”

“সিগারেট এবং সিগা*রেট*খোর মানুষ দুটোই আমার অপছন্দ। আজ সিগারেট ফেলেছি, কাল মানুষটাকেই জানালা দিয়ে ফে*লে দেব।”

ফাবিহা খুবই শান্ত মেজাজে কথা বলছে। শাবাব ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,“তুমি কত ফে*ল*বে? আমি আবার নিয়ে আসবো।”

“তুমি যতবার নিয়ে আসবে, আমি ততবারই ফে*লে দেব।”

“তুমি আমার যতগুলো সি*গা*রে*ট ফেলবে, আমি গুনে গুনে তোমায় ততোগুলো চুমু খাব।”
বলে ধূর্ততার পরিচয় দিয়ে হাসলো শাবাব।

ফাবিহা কটমট করে তাকাতেই শাবাব তার রাগ আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিতে বলল,“আজ পাঁচটা সি*গা*রে*ট ফেলেছো। চলো এখন থেকেই শুরু করি।”

ফাবিহার দিকে এগিয়ে আসতেই ফাবিহা দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,“একদম এগোবে না তুমি।”

কে শোনে সাবধানের বাণী? শাবাব এগিয়ে এসে চট করে দুটো চুমু খেয়ে সরে গেল। বলল,“বাকি তিনটে তোলা রইল। এ দুটো আগে হজম করে নাও।”

ফাবিহা হাতের কাছে পানির গ্লাস পেল। পানি ছুঁড়ে মা*রা*র আগেই শাবাব খপ করে তার হাত ধরে ফেলে বলল,“বুঝতে পেরেছি, বাকি তিনটে চুমু তোমার এখনই লাগবে। নয়তো তোমার মাথা ঠাণ্ডা হবে না। রাগ কোরো না, তুমি বললে আমি একশো একটা চুমু দিতে রাজি আছি।”
মুখের কথা শেষ করতে না করতেই বু*লে*টে*র গতিতে বাকি তিনটে চুমু দিয়ে গ্লাস টে*নে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ফাবিহা হতভম্ব হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার কিছু ফিল হচ্ছে। কিন্তু তাৎক্ষণিক সে অনুভূতিটা কেমন সেটা ঠাওর করে উঠতে পারলো না।
শাবাব বাইরে থেকে আসার সময় তিন প্যাকেট সিগা*রেট কিনে নিয়ে এসেছে। ফাবিহাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বালিশের পাশে রাখছে। ফাবিহা সিগা*রেট ফেললেই তার উদ্দেশ্য সফল। আসার সময় বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে।
ফাবিহা ভুলেও সিগা*রেট ফেলল না।

দুপুরে খাওয়ার পর জায়গামত সিগা*রেট না পেয়ে শাবাব দুর্বোধ্য হাসলো। ফাবিহার দিকে এগোতে এগোতে বলল,“চলো, গুনে গুনে..

কথা শেষ করার আগেই ফাবিহা হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিল।
“তেমার সিগা*রেট আমি ফেলিনি। তুলি ফেলেছে।”
বলেই ধূর্ত হাসলো। অতঃপর বলল,“চুমু দেবে না?”

শাবাবের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেল। সে ক্ষ্যা*পা স্বরে বলল,“এটা তুমি ইচ্ছে করে করিয়েছ।”

“অবশ্যই। আমি অস্বীকার করছি না।”
ফাবিহার সহজ স্বীকারোক্তি শুনে শাবাব বলল,“আমি একবার সুযোগ পাই, তখন তোমার নিস্তার নেই।”

★★★

ফাবিহার জ্বরের প্রকোপ কমে যাওয়ায় নানা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো শাবাব, ফাবিহা। গতরাতের পরিবর্তে আজ রাতে গাড়িতে চড়লো দুজন। বাসে কেউ কেউ ঘুমিয়ে আছে, কেউ বা নিজেদের মত করে ফোনে মগ্ন। ফাবিহা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। শাবাব তার চাদর ঠিক করে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। ফোন দেখতেও ভালোলাগছে না। তাই ফাবিহাকে বিরক্ত করল।

“হ্যালো মিস! আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

ফাবিহা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপরই বলল,“নানা শশুর বাড়ি যাচ্ছি। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

শাবাব বলল,“আমিও। তবে নানা শশুর বাড়ি না, নানার বাড়িতেই যাচ্ছি।”

“রাতের বাসে কেন যাচ্ছেন?”

“আসলে আমার ওয়াইফ চাচ্ছিল, সেজন্যই। কিন্তু আপনি মেয়ে মানুষ একা একা কেন রাতের বাসে যাচ্ছেন?”

“আমার সাথে একজন বডিগার্ড আছে।”

শাবাব বুঝতে পারলো তার কথাই বলছে। হাজবেন্ড বলতে পারত! সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,“আপনার বডিগার্ড বেশ হ্যান্ডসাম।”

ফাবিহা বলল,“জি, তবে হাত ভাঙা।”

শাবাব আবারও মনঃক্ষুণ্ন হলো। বলল,“হাত তো কিছুদিন পরই ভালো হয়ে যাবে।”

তারপর দুজনই চুপ। শাবাব ফোন বের করে নিজের একটা ছবি বের করে ফাবিহাকে দেখিয়ে বলল,“দেখুন, এটা আমার ছবি।”

ফাবিহা ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,“ওহ্, আমি ভেবেছিলাম কোনো ছিন*তাই*কারীর ছবি।”

শাবাব হতাশ চোখে তাকালো। নিজের আরেকটি ছবি দেখাল। পরপর নিজের কয়েকটা ছবি দেখিয়ে ফাবিহার একটি ছবি দেখিয়ে বলল,“এটা আমার ওয়াইফ।”

এবার মুখ খুললো ফাবিহা।
“সুন্দরী।”

শাবাব সূঁচালো চোখে তাকালো। ফাবিহা ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর নিজের ফোন রের করে তার চৌদ্দগোষ্ঠীর সবার ছবি দেখিয়ে বলছে– এ অমুক, এ তমুক।”

শাবাব বিরক্ত হয়ে বলল,“আপনার হাজবেন্ডের ছবি নেই?”

“না।”

“ফেসবুক একাউন্টে ঢুকলেই তো পাবেন।”

“সে ফেসবুক ব্যবহার করে না।”

“আপনি নাম দিয়ে সার্চ দিলেই পাবেন।”

ফাবিহা বলল,“আমার ফোনে এমবি নেই।”

শাবাব ফাবিহার ফোন টেনে নিয়ে নিজের একটা ছবি তুলে দিয়ে বলল,“এইতো আপনার হাজবেন্ডের ছবি। গুড লুকিং।”

ফাবিহা বলল,“আপনার চোখে ছানি পড়েছে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।”

শাবাব বলল,“ আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি একজন ডাক্তার। প্লিজ আমার চোখ ভালো করে দিন!”

ফাবিহার ঘুম পাচ্ছে। তাই সে আর কথা বলল না। সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে নিলো। শাবাব আবার একা হয়ে পড়লো। সে ফাবিহার দিকে তাকিয়ে রইলো।

★★★

নিশি বাবার বাড়ি আসলে যেন বন্দীশালা থেকে মুক্তি পায়। স্বাধীনতা পাওয়া মানুষ ধরাবাঁধা নিয়মে পড়ে গেলে হাঁপিয়ে ওঠে। তার অবস্থাও তেমনি। ফজরের পর জা’য়েদের সাথে মিলে নাস্তা বানাতে হয়। একটু ঘুমানোর সুযোগ নেই। হাজবেন্ড নামাজ, পর্দা এসব ছাড়া আর কোনো চাপ দেয় না। যা প্রয়োজন হয়, যা খেতে চায় নিয়ে আসে। তবুও নিশি এখনো পুরোপুরি মন থেকে সবাইকে গ্রহণ করতে পারেনি।

তাসিনের কাছ থেকে পড়া নিচ্ছে হুরাইন। এখন সে নিজে নিজেই পড়তে পারে। মাঝেমাঝে তাজবিদে ভুল করে। সেগুলোই ঠিক করিয়ে দেয় হুরাইন। পড়ানো শেষ করে তাসিনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো সে। আদুরে গলায় বলল,“একটা কথা বলবো?”

তাসিন বলল,“বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা ছাড়া হাজারটা কথা বলতে পারো।”

হুরাইন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বলল,“আমার আব্বুর সাথে আপনার কী শ*ত্রু*তা?”

“সেটা তো আমিও জানি না। কোন শ*ত্রু*তা*র জের ধরে তিনি আমাকে আমার বউ থেকে দূরে রেখেছেন? আমিও সেই শ*ত্রু*তা*র জের ধরে ওনাকে ওনার মেয়ে থেকে দূরে রাখছি।”

“সবার কথা খুব মনে পড়ছে আমার।”

“ভিডিও কল করে দেখে নাও। বিকল্প তো আছেই।”

হুরাইন কিছু বলল না। ঘুমানোর সময় তাসিন ওকে জড়িয়ে ধরতে নিতেই হুরাইন কোলবালিশ দেখিয়ে বলল,“কোলবালিশ জড়িয়ে ধরুন। বিকল্প পদ্ধতি তো আছেই।”

তাসিন আমতা আমতা করে বলল,“আচ্ছা যেও বাপের বাড়ি।”

হুরাইন খুশি হয়ে গেল। ফজরের পর থেকেই তার প্রস্তুতি চললো বাবার বাড়ি যাওয়ার। তাসিন মসজিদ থেকে ঢুলতে ঢুলতে এসে বলল,“দেখোতো হুরাইন, আমার বোধহয় আজ জ্বর আসবে। তুমি বাপের বাড়ি অন্যদিন যেও।”

হুরাইন তাসিনের কপাল চেক করে বলল,“না তো। জ্বর বোধহয় আমি বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর আসবে।”

#চলবে………

এক টুকরো আলো পর্ব-৩৫+৩৬

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

স্মৃতি রোমন্থনে নামলো ফাবিহা। মনে তখন হাজারো প্রজাপতি ডানা ঝাপটে চলেছে। বিনা বাধায়, বিনা চাওয়ায় আকাঙ্ক্ষিত পুরুষটি তার হতে যাচ্ছে। পছন্দ মনে সদ্য প্রেম জন্ম দিয়েছে। তারপরই জীবনে শাবাব নামক বখা*টের আগমন। সবকিছুই কেমন হুট করে, অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে যাচ্ছে। তারপর একের পর এক সেই বখা*টের প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। শুরু হলো বখা*টের নানাভাবে হেনস্তা। চুপ না থেকে পাল্টা জবাব দিয়েছে। যতবার তাকে হেয় করার চেষ্টা করেছে, ততবারই সে পাল্টা আক্র*মণ করেছে।
এরপরই এলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়। দুজনের জীবন জুড়ে গেল এক সুতায়। বিয়ের দুদিন পরই অস্বাভাবিকভাবে সেই বখা*টে শান্ত হয়ে গেল। এক কথায় মেনে গেল তার কথা। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তার প্রতি নমনীয় হয়ে এসেছে।
আজ মন খানিকটা নয়, পুরোপুরি গলতে চাইছে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল, “যে অনুতপ্ত, সে কি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়?”

নিজের এতখানি পরিবর্তনের পেছনে সম্পূর্ণ হাত হুরাইনের। যদি না হুরাইন তাকে বোঝাতো, তবে শাবাবকে ক্ষমা করার চিন্তাটাও মাথায় আসতো না। আসলেই কি ক্ষমা করা যায়? ক্ষমা পাওয়ার মত কী করেছে সে? আড়াল থেকে তাকে প্রটেক্ট করার চেষ্টা করেছে বলেই কি ক্ষমা করতে হবে?
মাথা ঝিমঝিম করছে।

★★★

সুরাইয়ার করুণ দশা। একদিকে অসুস্থ স্বামী অন্যদিকে অসুস্থ ছেলে। সবদিক সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ছেলে ম*র*তে বসেছে। কার জন্য? নিজের ডি*ভো*র্সি বউয়ের জন্য। ভাবতেই শরীর আর মন জুড়ে তাচ্ছিল্য আসছে। আবারও বোন এসে ওনার সংসার সামলাচ্ছে। তিনি ছেলের কাছে হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছেন।

“মা।”
অস্পষ্ট, রুগ্ন স্বর শুনে পিছু ফিরলেন সুরাইয়া। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠছে। কাঁ*টা*ছে*ড়া যুক্ত মলিন চেহারা। রাজপুত্তেরের মত দ্বীপ্ত, নিটোল চেহারা হারিয়ে গিয়েছে মুখে জায়গা করে নিয়েছে ফ্যাকাশে ভাব। রক্তশূণ্য শুষ্ক ঠোঁট জোড়া। সুরাইয়ার সারাদিন কান্না পায়। একটাই তো সন্তান দিলেন আল্লাহ। তাহলে তার জীবনে কেন এত এত বি*প*দ, খা*রা*প মানুষের দেখা?
কান্না গিলে জিজ্ঞেস করলেন,“ব্যথা করছে আব্বা?”

“তুমি খেয়েছ?”

“হ্যাঁ।”

“আর কেউ এসেছে?”

“সবাই এসে দেখে চলে যাচ্ছে। রাতে তোর জেঠু আসবেন।”

“বাবা কেমন আছে?”

“ভালো থাকে কী করে? তুই ভালো থাকতে দিচ্ছিস কোথায়? কী দরকার ছিল ওই মেয়ের জন্য মা*রা*মা*রি করতে যাওয়ার?”

শাবাব কোনো জবাব দিচ্ছে না। সে মায়ের কথা সিরিয়াসভাবে নিচ্ছে না। সুরাইয়া দাপুটে, তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,“সত্যি করে বল তো, তুই কি এখন আবার ওই মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখছিস? একবার ছেড়ে দিয়ে আবার সম্পর্কে জড়াচ্ছিস। বলছি তোদের এই খেলা কবে শেষ হবে?”

শাবাব বলল,“ডি*ভো*র্স হলে আবার সম্পর্ক রাখে কীভাবে?”

“সবই পারা যায়। কত মানুষকে দেখলাম আগে ডি*ভো*র্স দিয়ে দেয়। পরে হুজুরের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে আবার ফিরিয়ে এনে সংসার করে। খবরদার তুই যদি এমন নাটক শুরু করিস, তাহলে লু*লা বাপ-ছেলে দুটোকে রেখে আমি নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”

শাবাব আলতো হেসে বলল,
“পারবে আমাকে আর বাবাকে রেখে যেতে?”

সুরাইয়া ছেলের হাসিমাখা মুখে তাকিয়েই থেমে গেলেন। তারপর আবারও তেতে উঠে বললেন,“তুই তাহলে ওই মেয়েকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছিস?”

শাবাব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“তুমি চিন্তা কোরো না মা। ও কখনোই আসবে না।”

“আসবে না তোকে কে বলেছে? কালই তো ফরহাদের সাথে এখানে এসেছে। এত বড়ো অভিনেত্রী। চোখে পানি নিয়ে দেখিয়ে গেল আমার ছেলের জন্য তার কলিজা ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে। নাটকবাজ মেয়ে। সাথে তুই আজকাল নাটক করা শিখেছিস আমার সাথে।”

শাবাব বিস্মিত হলো ফাবিহার আগমনের কথা শুনে। প্রবল আগ্রহী স্বরে শুধালো, “ফাবিহা এখানে এসেছে?”

সুরাইয়া ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও সূচালো চোখে তাকালেন।
“তুই এত ব্যাকুল হচ্ছিস কেন?”

শাবাব দমে না গিয়ে ফের বলল,“ও যখন এসেছে, তখন আমাকে জাগাওনি কেন?”

সুরাইয়ার চোখ কথা বলছে। এই মুহূর্তে ছেলেকে যেন গিলে ফেলবেন।

ফাবিহা আজ আবার হাসপাতালে এলো শাবাবকে দেখতে। শাবাব মায়ের সাথেই কথা বলছিল। তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি টের পেয়ে দুজনই দরজার দিকে তাকালো। ফাবিহা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। সুরাইয়া কিছু বলতে যাবেন, শাবাব৷ মায়ের হাত চেপে ধরে চোখের ইশারায় অনুনয় করল “প্লিজ মা!”

মুখে ফাবিহাকে বলল,“দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো।”

ফাবিহা ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে সুরাইয়ার দিকে। পা বাড়াতেই সুরাইয়ার ধমকে আগের জায়গায় চলে গেল।
“এ্যাই মেয়ে, আর এক পাও এগোবে না তুমি। আমার ছেলের মাথা তো তুমি খেয়েই রেখেছো। তুমি যেভাবে নাচাচ্ছো, সেও সেভাবেই নাচছে। আমি তোমাকে আর কোনো সুযোগ দেব না।”

শাবাব মাকে বলল,“মা প্লিজ থামো!”

সুরাইয়া ছেলেকে ঝাড়ি দিলেন।
“কেন? বিবির জন্য পরান জ্বলে যাচ্ছে? মায়ের জন্য জ্বলছে না?”

“ওর কোনো দোষ নেই মা। সব দোষ আমার। এতদিন যা যা ঘটেছে, সব আমার কারণে ঘটেছে। ও কী বলতে এসেছে, সেটা আগে শুনি!”

সুরাইয়া ছেলের পাশ থেকে উঠে বেরিয়ে গেলেন হনহন পায়ে। শাবাব ফাবিহাকে ডাকলো,“মায়ের কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দুঃখিত! তুমি ভেতরে এসো।”

ফাবিহা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে শাবাবের পাশে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছো?”

শাবাব মৃদু হেসে বলল,“ভালো।”

“কেন গিয়েছ সুমনের সাথে ঝা*মে*লা*য় জড়াতে?”
ফাবিহার প্রশ্ন সরাসরি এড়িয়ে গিয়ে শাবাব জিজ্ঞেস করল,“তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে? বাসার সবাই ভালো?”

ফাবিহা শক্ত মুখে বলল,“তুমি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছো। কেন গিয়েছিলে সুমনের কাছে?”

“আমার ওর সাথে ব্যক্তিগত ঝা*মে*লা আছে। সেটা মেটাতেই গিয়েছি। তুমি হঠাৎ আমাকে দেখতে এলে যে?”

ফাবিহা শক্ত হয়ে বলল,“আমি এখানে থাকতে আসিনি। আমার জন্য কেন ঝা*মে*লা*য় জড়ালে সেটাই জানতে এসেছি। আমার জন্য কেউ নিজের ক্ষতি করুক সেটা আমি চাই না।”

“আমি তোমার জন্য ঝামেলায় জড়াইনি। বলেছিতো আমার ব্যক্তিগত ঝা*মে*লা আছে সুমনের সাথে।”

“ফরহাদ আমায় মিথ্যা বলল?”
ফাবিহার তীর্যক চাহনি। শাবাব বলল,
“ফরহাদ কী বলল না বলল এসব তোমায় বিশ্বাস করতে হবে? পৃথিবীতে মানুষের কাজের অভাব পড়েছে যে তোমার জন্য ঝা*মে*লা*য় জড়াতে যাব?”

ফাবিহা শাবাবকে আগাগোড়া একবার স্ক্যান করে নিলো। সেই ভাঙা ডানহাত মৃদু চেপে ধরতেই মৃদু চিৎকারে আর্তনাদ করে উঠলো শাবাব।
“এ্যাই কী করছো? প্রথমবার রাতে আমার ভাঙা হাতে পিঠ দিয়ে শুয়েছো, এখন আবার আমার হাত গুঁড়ো করে ফেলছো।”

ফাবিহা শাবাবের চোখে চোখ রেখে বলল,“ব্যথা লাগে?”

শাবাবের নাক ফুলে উঠেছে রাগে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“না খুব আরাম পাচ্ছি। আরো জোরে চেপে ধরো ইডিয়ট!”

ফাবিহা শক্ত মুখে বলল,“সত্যটা বলো শাবাব।”

“হ্যাঁ আমি তোমার জন্য ঝা*মে*লা*য় জড়িয়েছি। কারণ সুমন তোমার পেছনে পড়ার কারণ হিসেবে আমি দায়ী।”

হাত ছেড়ে দিল ফাবিহা। হালকা ভাবেই হাত ধরেছিল। দ্বিতীয়বার আ*ঘা*ত পাওয়া জায়গা মৃদু চাপ দিলেও ব্যথা পাওয়া স্বাভাবিক। এবার স্বাভাবিক গলায় বলল,“সুমন তোমার কারণে আমার পেছনে পড়ে থাকেনি। তাই নিজেকে দায়ী করে চালাকি করার চেষ্টা করবে না।”

শাবাব হাতের দিকে তাকিয়ে রইল বেদনাদায়ক দৃষ্টিতে। ফাবিহা বলল,“তেমন কিছু হয়নি হাতের। আসছি আমি।”

ফাবিহা পা বাড়াতেই শাবাব বলে ফেললো,“তুমি নাকি কাল আমার জন্য কেঁদেছ? এতো দরদ?”

ফাবিহা ঘাড় বাঁকা করে পিছে ফিরে বলল,“কে বলেছে তোমায় এসব ফাউল কথা?”

শাবাব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,“বিয়ে করছো না কেন?”

ফাবিহা বলল,“তুমি কেন করছো না?”

“জীবনে আর কতবার বিয়ে করবো? একবার তো করলাম। খায়েশ মিটে গিয়েছে।”

“ওটা বিয়ে ছিল না।”

“যদি তোমার কোনো বান্ধবী সিঙ্গেল থাকে তাহলে বোলো।”

ফাবিহা হতাশ হলো।
“তুমি কখনো ভালো হবে না।”

শাবাব এবার সিরিয়াস হয়ে বলল,“আবারো অনুরোধ করছি। যদি কখনো পারো, আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

“আমি বোধহয় তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আবার দ্বিগুণ ঘৃ*ণা করি। আই হেইট ইউ ইনফিনিটি।”

“ক্ষমা করে আবার কেন ঘৃ*ণা করো?”

“তোমার মেয়ে সঙ্গ দূর হয়নি। অনুতপ্ত ভেবে ক্ষমা করেছি। কিন্তু তুমি ভালো হওনি।”

শাবাবের মেজাজ খা*রা*প হলো।
“তুমি কী চাইছো বলো তো? বলছো বিয়ে করে নিতে। আর বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজলেই দোষ?”

“পাত্রী খুঁজলে দোষ না। দোষ তোমার নজরে। এক্স ওয়াইফ এর ফ্রেন্ডের দিকে নজর দাও।”

“আশ্চর্য! তাকে তো আমার বিয়ে করা জায়েজ। আর তুমিই তো বললে ওটা কোন বিয়ে ছিল না। তাহলে সে আমার এক্স ওয়াইফের ফ্রেন্ড কীভাবে হয়?”

ফাবিহা ফোঁস করে বলল,“শাবাব তুমি কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলছো।”

শাবাব মলিন হেসে বলল,“আমি তো তোমার সামনে যাইনি ফাবিহা। তুমি নিজেই এসেছো। আজ আমি বলছি, প্লিজ তুমি আর আমার সামনে এসো না!”

ফাবিহা থমকে গেল। এতদিন সে শাবাবকে নিজের সামনে আসতে বারণ করতো, আর আজ শাবাব তাকে বারণ করছে। সে প্রশ্ন করে ফেললো,“আমি আসলে কি তোমার খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে?”

“হ্যাঁ, আমি আবারও বে*য়া*দ*ব, অ*স*ভ্য হয়ে যা কিছু করে ফেলতে পারি। হয়তো তোমায় আটকেও ফেলতে পারি! তাই নিজের কথা ভেবেই তুমি আর এসো না।”

শাবাবের কথা কীসের ইঙ্গিত দিলো ফাবিহার বুঝতে কষ্ট হয়নি। সে বলল,“আমি আসছি।”

ফাবিহা আবারও পা বাড়ায়। দরজা পর্যন্ত গিয়ে শুনতে পায়।
“তুমি প্লিজ আর কখনোই আমার সামনে এসো না। আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি তোমার প্রতি।”

ফাবিহা না ঘুরেই চলে গেল। রাগ উঠে গেল শাবাবের। এভাবে ফাবিহার কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ না করলেও পারতো।

★★★

শাবাব বাড়ি এসেছে এক সপ্তাহ। সুরাইয়া দুজনকে নিয়ে বড়ো বি*প*দে আছেন। তুলি ছোটো একটা মেয়ে। সে রান্নাবান্নার কাজে সাহায্য করে।
স্ক্রিনে ফাবিহার নম্বর দেখে অবাক হলো শাবাব। রিসিভ করে চুপ করে রইল। ওপাশেও নিরবতা।
শাবাবের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ফাবিহা ডাকলো,
“শাবাব? আছো?”

“হুম, বলো।”

“আমার বিয়ে হচ্ছে শীঘ্রই। তোমার নিমন্ত্রণ রইল।”

থমকে গেল শাবাব৷ রুদ্ধশ্বাসে বলল,“কংগ্রাচুলেশনস।”

“পাত্রকে তুমি চেন। আমার ফ্রেন্ড সানির কাজিন। তোমার ফ্রেন্ডেরও কাজিন সে। তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে!”

শাবাব সাথে সাথে কল কেটে ফোন দূরে ছুঁড়ে মা*র*লো। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ঠোঁটে চেপে লাইটার অন করলো বাম হাতে। পরপর কয়েকটা সিগারেটের ধোঁয়া পুরো রুম প্রায় অন্ধকার করে ফেলেছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।

★★★

বাড়িতে একা মন টিকছে না। ফাবিহা খালার বাড়ি চলে এলো। হুরাইন তাকে পেয়ে খুশিই হয়েছে। নতুন বিয়ের জন্য অগ্রিম অভিনন্দন জানালো। কিন্তু ফাবিহা খুশি দেখাচ্ছে না। তাই হুরাইন জিজ্ঞেস করল,“আপনি কি বিয়েতে খুশি নন আপু?”

ফাবিহা ইতস্তত করে বলল,“আমি দ্বিধায় আছি। বিয়েতে মন সায় দিচ্ছে না।”

“বিয়ে হতে তো এখনো দেরি। ততদিনে মন ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চয়ই?”

“জানি না।”

“আপনি কি আগের বিয়ে নিয়ে কোনো ভয় পাচ্ছেন?”

“না।”

“তবে কীসের পিছুটান? কোনোভাবে কি আপনি আপনার আগের স্বামীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছেন? দেখুন, এখনো সময় আছে।”

ফাবিহা বলল,“না না। কোনো দুর্বলতা নেই। আমি বিয়ে করবো।”

“আপনি না বললে কিন্তু সবসময় সবাই মনের কথা বুঝবে না। তাই কী নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, সেটা বললে ভালো হয়।”

“কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি না।”

হুরাইন আর জোরাজোরি করলো না। বিকেলে ফাবিহা নিজ থেকেই হুরাইনের কাছে গেল। চিন্তিত সুরে বলল,“আমি যতবার বিয়ের কথা ভাবি, ততবার শাবাবের কথা মনে হয়। এমন নয় যে ওকে আমি ভালোবাসি। কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।”

হুরাইন হাতে তসবিহ পড়ছে। কথা বলছে না। রাতে সাজেদার সাথে সে আলাপ করলো ফাবিহাকে নিয়ে।
“আম্মা আমার মনে হয় ফাবিহা আপু আর ওনার স্বামীর ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখা উচিত। কথায় যতটুকু আমি ধারণা করেছি, দু’জনের মনেই কিছু না কিছু আছে। তাই আমার মনে হয় আরেকবার সবার সাথে কথা বলে ওনাদের এক করার ব্যবস্থা করলে ভালো হবে। আপনি খালার সাথে কথা বলে দেখুন।”

“তোমার খালা শাশুড়ি ওই ছেলের কথা শুনতেই পারে না। কোনো লাভ হবে না।”

“ আচ্ছা বুঝিয়ে বলেই দেখুন না। ওনারা স্বামী-স্ত্রী দুজন ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। ফাবিহা আপু ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। তাই সবাই মিলে একটা চেষ্টা দেওয়া উচিত।”

“আচ্ছা আমি কাল কথা বলব ওর মা-বাবার সাথে। তুমি এখন ঘুমাতে যাও।”

#চলবে……

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

“তোকে একটা কথা বলতে চাই। রাগ করিস না।”

“কী কথা?”

সাজেদা বললেন,“কথাটা ফাবিহাকে নিয়ে। তুই আগেই রাগ করিস না। ওর বাবা আছে পাশে?”

“আছে। কী কথা? বলো।”

“স্পিকার অন কর।”

“করেছি।”

“ফাবিহাকে যে বিয়ে দিচ্ছিস, ওর মতামত নিয়েছিস?”

“ও তো আমাদের উপর সব বিয়ের আগেই ছেড়ে দিয়েছে। তাছাড়া এতদিন পর একটা ভালো সমন্ধ পেয়েছি। ও অমত করবে কেন?”

“তুই কি জিজ্ঞেস করেছিস ওকে?”

“আশ্চর্য! জিজ্ঞেস করার কী আছে? অমত থাকলে তো ও নিজেই বলতো।”

“আমার মনে হয় ওর আগের সম্পর্কের কথা একবার ভেবে দেখা উচিত।”

“আগের সম্পর্ক কী ভেবে দেখবো?”

এবার কথা বললেন আতাউর রহমান।
“আপনি কী বলতে চাইছেন আপা? বুঝিয়ে বলুন।”

“ফাবিহার আগের সংসারের কথা বলছি। দুজনে সম্পর্কে ফিরতে চায় কি না জিজ্ঞেস করে নতুন সম্পর্কে এগোনো উচিত বলে আমি মনে করি।”

ফাবিহার মা বললেন,“আপা তোমার মাথা খা*রা*প হয়ে গিয়েছে। কী বলতে কী বলছো বুঝতে পারছ না।”

আতাউর রহমান বললেন,“আপা তারা একসাথে থাকবে না বলেই তো নিজেদের মত করে সিদ্ধান্ত নিলো। ডি*ভো*র্স ও হয়ে গেলো। তাহলে এখন কোন হিসেবে এসব বলছেন আপনি?”

“ডি*ভো*র্স হলেও ফেরার নাকি উপায় আছে, তাসিনের বউ বলল। আর তোমাদের মেয়ের গতিবিধি লক্ষ করেই ও আমাকে তোমাদের সাথে কথা বলতে বলেছে।”

“ফাবিহা কি বউমার কাছে আগের সংসারে ফিরে যেতে চায়, এমন কিছু বলেছে?”

“না। তবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই বিয়েতে তার মত নেই, জামাইয়ের কথাও আকারে-ইঙ্গিতে বুঝাচ্ছে।”

ফাবিহার মা বললেন,“তোমার ছেলের বউয়ের মাথা খা*রা*প। একবার আমার মেয়ের জীবন ন*ষ্ট করেছে। ভাবছে তাসিনকে ফুসলিয়ে যদি আবার আমার মেয়েকে তাসিনের গলায় ঝুলিয়ে দেই। সেজন্যই আমার মেয়ের ক্ষ*তি চাইছে।”

“তুই ভুল ভাবছিস। যেখানে তোর মেয়ের বিয়েই হয়ে যাবে অন্য কোথাও, সেখানে ওর এসব ভাবনা আসবে কেন? আমি চিনি ওকে। আমার বউমা খা*রা*প না।”

ফাবিহার মা বিলাপ করে বলছেন,“তুমি তো জানো না আপা। ওই মেয়ে তোমার ব্রেনওয়াশ করে ফেলেছে। দেখো গিয়ে তা*বি*জ ক*ব*জ করে তোমায় বশ করে ফেলেছে। নইলে আমার বোন কীভাবে পাল্টে যায়?”

সাজেদা বিরক্ত হয়ে বললেন,“এখন মনে হচ্ছে তোরই মাথা খা*রা*প হয়েছে। মেয়ে তোর, যা ইচ্ছা তুই কর।”
বিক্ষিপ্ত মেজাজে কল কেটেে দিয়ে বসে রইলেন তিনি।

আতাউর রহমান কিছু ভাবছেন। ফাবিহার মা বললেন,“কী ভাবছো তুমি?”

আতাউর রহমান চিন্তিত গলায় বললেন,“তুমি ফাবিহাকে বাড়িতে আসতে বলো।”

মায়ের ফোন পেয়ে ফাবিহা খালার বাড়ি থেকে চলে এলো। রাতেই বাবা তাকে ডাকলেন।

“বাবা ডেকেছ?”

আতাউর রহমান মেয়েকে চেয়ার দেখিয়ে বললেন,“হ্যাঁ বোস।”

ফাবিহা বসল।
“তোর যে বিয়ের কথা চলছে। এতে তোর মত আছে?”

ফাবিহা অস্বস্তি নিয়ে বলল,“হঠাৎ এসব কথা কেন বাবা?”

“না, জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন আছে।”

ফাবিহা মাথানিচু করে আছে। আতাউর রহমান বললেন,“তোর মত না থাকলে আমরা না করে দেব। তবে কেন মত নেই, সেটা বলতে হবে।”

ফাবিহা ফ্লোরের দিকেই তাকিয়ে রইল। পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোর খোঁচাচ্ছে। আতাউর রহমনা সবটা সূক্ষ্ম চোখে পরখ করে জিজ্ঞেস করলেন,“শাবাবের সংসারে ফিরে যেতে চাস?”

ফাবিহা এবার চমকে উঠে বাবার দিকে তাকাল। তাকিয়েই রইল। আতাউর রহমান বললেন,“কী চাস, স্পষ্ট করে বল।”

ফাবিহা অস্থির হয়ে বলল,“আমি কিছু জানি না।”

ধমকে উঠলেন আতাউর রহমান।
“জানি না বললে তো হচ্ছে না। কী চাস বল।”

“আমি এখন বিয়ে করতে চাই না বাবা।”

“কেন বিয়ে করতে চাস না? তোর সব সমস্যা সমাধানের এখন একটাই রাস্তা। তাহলে কেন সেই রাস্তা বেছে নিচ্ছিস না?”

ফাবিহা নিরুত্তর। আতাউর রহমান বললেন,“তোর ভাবগতি ভিন্ন কথা বলছে। যদি শাবাবের কাছে ফিরে যেতে চাস, তাহলে আগে এত নাটক করলি কেন? কেন জোরজবরদস্তি করে তা*লা*ক নিলি?”

ফাবিহা একটাও শব্দ উচ্চারণ করল না। আতাউর রহমান তীব্র রাগে চেয়ারে লা*থি দিয়ে উঠে গেলেন।
ফিরোজ আলমকে বাড়ি আনার পর একবার দেখে এসেছেন তাকে। আজ মেয়ের উপর রাগ থেকেই কল দিলেন। সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করলেন,“কেমন আছেন?”

“ভালো আর থাকি কীভাবে? ছেলে হাসপাতাল থেকে ঘুরে এলো, আমিও ঘরে অসুস্থ। আপনার কী অবস্থা?”

“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। শাবাবের আবার কী হলো?”

ফিরোজ আলম অবাক হয়ে বললেন,“আপনি জানেন না? আপনার মেয়ে বলেনি?”

আতাউর রহমান যেন তারচেয়ে বেশি অবাক হলেন।
“কী বলবে?”

“এখন আবার তারা দুজন নতুন নাটক শুরু করেছে। ফাবিহাকে বিরক্ত করায় সুমনের সাথে মা*রা*মা*রি করে আবার হাত ভেঙে এসেছে। আপনার মেয়েও হাসপাতালে আসাযাওয়া করছে।”

“কীহ্?”

“আপনি তো দেখছি কিছুই জানেন না।”

আতাউর রহমান রাগ চেপে বললেন,“আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করবেন সে কী চায়? আমার মেয়ে কী চায়, তা আংশিক ধরতে পেরেছি আমি।”

“কী চায়, সেটা জিজ্ঞেস করতে হবে না। এমনিতেই বুঝা যাচ্ছে। প্রথম থেকেই শাবাবের ভাবগতি এমন ছিল, ও ত*লা*ক দিতে চায়নি।”

“তবুও দুজনকে সামনাসামনি বসিয়ে জিজ্ঞেস করা উচিত। কবে বন্ধ হবে তাদের সার্কাস? আর যদি এভাবেই চলতে থাকে, তো দুজনকে বের করে দেওয়া উচিত হবে। দূরে গিয়ে রংতামাশা করুক।
মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছি। এতদিন সে কিছু বলেনি। আজ বলছে বিয়ে করবে না এখন।”

★★★

শাবাবকে সুরাইয়া আর ফিরোজ আলম বাঘের মত ধরলেন।
“এত নাটকের মানে কী? আর কী শান্তিতে থাকতে দিবি না আমাদের? ফাবিহা আর তোর মাঝে কী চলছে?”

“কী চলবে?”

“কিছু না চললে ওর বাবা আমাকে কল দিয়েছে কেন? সে কেন বিয়ে করতে চাইছে না?”

“আমি জানি না।”

সুরাইয়া বললেন,“সত্যি করে বল। আমাদের ধোঁয়াশার মধ্যে রাখবি না।”

“ও কেন বিয়ে করতে চাইছে না সেটা আমি কীভাবে জানবো?”

“তুই জানিস না?”

শাবাবের শক্ত জবাব “না।”

সুরাইয়া বললেন,“ঠিক আছে। আমি তোরজন্য মেয়ে দেখছি। বিয়ে করে নে।”

“আমি এখন বিয়ে করব না।”

চেঁচিয়ে উঠলেন সুরাইয়া।
“তোদের মধ্যে কিছু চলছে না, তুই বিয়েও করবি না। তাহলে চাইছিসটা কী?”

শাবাব কোনো প্রকার সংকোচ না করে দৃঢ় স্বরে বলল,“ও কেন বিয়ে করতে চাইছে না আমি জানি না। আর আমি যেদিন ওকে ভুলতে পারবো সেদিন অন্য কাউকে বিয়ে করবো। তার আগে নয়।”

কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে শাবাব গটগট পায়ে বেরিয়ে যেতে নিলো। দরজায় আসতেই ফিরোজ আলম হুঙ্কার ছাড়লেন,“তাহলে ছেড়েছিলি কেন?”

“ও চেয়েছে, তাই। আমি আগে যা করেছি, এরপরে আর জোরজবরদস্তিতে কিছু হোক তা চাইনি।”
বলেই চলে গেল সে। সুরাইয়া ধপ করে বসলেন। ফিরোজ আলম ফোন করলেন আতাউর রহমানকে। জানালেন শাবাবের ব্যাপারে। তারপর আতাউর রহমান বললেন,“আমি একটা প্রস্তাব রাখতে চাই।”

“আপনি কী বলবেন, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা করলেই কি সমাধান পাওয়া যাবে? এরপর যদি আবারও তারা উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নেয়? তখন দায়ভার কে নেবে?”

“তখন আর তাদের ব্যাপার আমরা জানি না। এখন তারা যা চাইছে, সেটাই হচ্ছে। পরবর্তীতে আবার একসাথে থাকতে চাইবে না বললে তো হবে না। দুজনকে দিয়ে কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করিয়ে নেওয়া হবে।”

“এখন আপনি-আমি বললে তো হবে না। এভাবে এক হওয়ার বিধান কী? আগে একজন বিজ্ঞ আলেমের সাথে কথা বলতে হবে।”

“আমার ভায়রাভাই এর বেয়াই আছেন। ওনার সাথে আগে কথা বলে দেখি।”

“ঠিক আছে।”

★★★

তাসিনের বাবাকে নিয়ে হুরাইনের বাবার কাছে গেলেন আতাউর রহমান। সবটা শোনার পর তিনি বললেন,“উপায় আছে একটা।”

“কী?”

“নতুন করে বিয়ে কিরে নিলেই তারা সংসার করতে পারবে।
আপনার বর্ণনামতে তা*লা*ক আপনার মেয়ের পক্ষ থেকে। অর্থাৎ স্বামীর মুখ থেকে তিনি তা*লা*কে*র স্বীকারোক্তি আদায় করিয়ে নিয়েছেন। এটাকে বলা হয় খুলা। যখন স্বামী স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতেন, তখন তাকে বলে তা*লা*ক। এখন যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে খুলা। যদি দুজনে চান যে তারা একসাথে আবারও সংসার করবেন, তাহলে দ্বিতীয়বার মোহর দিয়ে বিয়ে করতে হবে।”

তাসিনের বাবা বললেন,“কিন্তু বউমা যে বলল তা*লা*ক।”

জনাব আজাদ বললেন,“আপনারা আসবেন সে আমাকে জানিয়েছে। এবং বিস্তারিত ঘটনাও বলেছে। সে তা*লা*কে*র কথা এবং দ্বিতীয়বার ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিল আপনাদের মেয়ের বর্ণনা থেকেই। আপনাদের মা বারবার তা*লা*ক হয়েছে বলেছিল; কিন্তু সেটা কীভাবে ওটা তো বলেনি। তাছাড়া ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলার কারণেই আপনাদের মেয়ে দ্বিতীয়বার সংসার নিয়ে ভেবেছে। মুখ খুলেছে। আর কখনো ফিরতে পারবে না বললে সে কখনোই মনের কথা মুখে আনতো না। ভাবতো চিরতরে বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে তাদের। আমাদের দেশে অসংখ্য দম্পতি আছেন, রাগের মাথায়, কোনোপ্রকার বুঝাপড়া না করেই খুলা কিংবা তা*লা*ক দিয়ে ফেলেন। পরে আমাদের কাছে ছুটে আসেন দুজনে এক হওয়ার জন্য। যদি সুযোগ থাকে, তবে তাঁরা এক হতে পারেন। কেউ যদি তিন তা*লা*ক দিয়ে ফেলেন, তাহলে আমাদের সাধ্য নেই তাদের এক করার। তখন তারা একে অপরের জন্য হা*রা*ম হয়ে যান।”

“আজ তবে উঠি।” বলে আতাউর রহমান উঠে পড়লেন। তাসিনের বাবাও বেয়াইকে বিদায় দিয়ে বের হলেন। সবটা পরিষ্কার, হুরাইনের কারণেই ফাবিহার মন পরিবর্তন হয়েছে। আতাউর রহমান এতে খুশি না কি বেজার বুঝা যাচ্ছে না।

★★★

ফিরোজ আলম শাবাবকে বললেন,“তৈরি হয়ে নে।”

“কেন বাবা?”

“তোর মায়ের সাথে যাবে বিয়ে করতে।”

বিস্মিত হয়ে বলল,“কীহ্!”

“ফাবিহাকে বিয়ে করবি। ওর বাবা সব ব্যবস্থা করেছেন। আর বিয়ের আগে অবশ্য একটা পেপার সাইন করতে হবে। দ্বিতীয়বার ছাড়াছাড়ি হলে দুজনকেই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, হা*জ*ত*বা*সও হতে পারে।”

“তুমি কীসব বলছ বাবা?”

“তোকে তৈরি হতে বলেছি। যদি শর্তে রাজি থাকিস তাহলে তৈরি হয়ে আয়। নয়তো আমি ফাবিহার বাবাকে না করে দিচ্ছি।”

শাবাব নিজের ঘরে এলো ত্রস্ত পায়ে। ফোন হাতে নিয়ে পরপর ফাবিহাকে কল দিয়ে গেল। ও ফোন তুলছে না। এতে মেজাজ আরো খা*রা*প হচ্ছে। পঞ্চমবারে ফোন তুললো ফাবিহা। শাবাব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“ফোন তুলতে এতক্ষণ লাগে?
কী শুরু করেছ তুমি? কী বলছে বাবা?”

ফাবিহা শান্ত গলায় বলল,“কী বলেছে?”

“তোমাকে”
একটু থেমে আবার বলল“ তোমাকে বিয়ে করতে বলছে। এটা কী সত্যি?”

“হ্যাঁ।”

শাবাব দমে এলো। রুদ্ধশ্বাসে বলল,“তুমি কিছু বলোনি?”

“না।”

“কিন্তু কেন?”

“বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমিও মেনে নিয়েছি।”

“জোরজবরদস্তি সম্পর্ক তোমাকে মেনে নিতে হবে না। তুমি তোমার বাবাকে না করে দাও।”

“না করার দরকার নেই।”

শাবাব সন্দিহান গলায় বলল,“আজ তোমার গলা এত শান্ত লাগছে কেন?”

“আমি বিয়েতে মত দিয়ে দিয়েছি শাবাব। এটাই তোমার জন্য সুযোগ। এরপর আর এমন সুযোগ পাবে না।”
ফাবিহা কল কেটে দিল। শাবাব সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ফাবিহার অভিব্যক্তি সে বুঝতে পারছে না। বাবার উপর জেদ করে না কি মন থেকে বিয়েতে হ্যাঁ বলেছে বুঝা যাচ্ছে না। সে আবার গেল বাবার ঘরে।

“বাবা ফাবিহার মত নিয়েছো তোমরা?”

“ওর মতিগতি লক্ষ করেই ওর বাবা আমাকে এই প্রস্তাব দিয়েছেন। এজন্যই ও নতুন সম্বন্ধে না করে দিয়েছে। বলেছে বিয়ে করবে না।”

শাবাবের দ্বিধা কাটলো। সে খুশি হবে কিনা বুঝতে পারছে না।

ফাবিহা চুপচাপ বসে রইলো। তার হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে তড়িৎ গতিতে। সে নিজের দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার আগেই বাবা সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিয়েছেন। কড়া কয়েকটা হু*ম*কি*ও দিয়েছেন। তাই বিয়েতে সে মত দিয়ে দিয়েছে। তার একটা দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার উপর সবটা ঝুলে আছে। তাই সবাইকে ঝুলিয়ে না রেখে হ্যাঁ বলে দিল।

শাবাব মা, জেঠা-জেঠী, খালা নিয়ে ফাবিহার বাড়ি আসলো। তার অস্বস্তি হচ্ছে। ফাবিহার মা থমথমে হয়ে আছেন। একইরকম শাবাবের মাও। বিয়েটা হচ্ছে কেবল ফিরোজ আলম আর আতাউর রহমানের কারণে।
নাস্তা পর্ব শেষে বিয়ে পড়ানোর পালা এলো।

হুরাইন ফাবিহাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে বলল,“মাশাআল্লাহ।”

ফাবিহা হুট করে হুরাইনকে জড়িয়ে ধরলো।
“আমি জানি না আমার ভবিষ্যৎ কী? অনিশ্চয়তার মাঝে আবারও পা বাড়াচ্ছি। দোয়া করিও আমার জন্য।”

“ইনশাআল্লাহ খুব ভালো সংসার হবে আপনার। আপনার কী মনে হচ্ছে না আপনার স্বামী পরিবর্তন হয়েছে?”

“আমার ভয় হচ্ছে ও যদি পরে আবার আগের মত আচরণ করে?”

“আপনি আছেন কী করতে? তাঁকে পিটিয়ে মানুষ বানিয়ে নেবেন। আবার সত্যি সত্যি পে*টা*বে*ন না কিন্তু। ওটা হলো কৌশলের পে*টা।”
বলেই হেসে ফেললো হুরাইন। ফাবিহাও হেসে ফেললো।

শাবাব ভাঙা হাত নিয়ে কাচুমাচু করে বসে আছে। কাজি নতুন করে দেনমোহর ধরে বিয়ে পড়াচ্ছেন। পাশের ঘরেই ফাবিহা। তাকে কবুল বলতে বলা হলো। সময় চলে যাচ্ছে, ফাবিহার মুখ দিয়ে কবুল বের হচ্ছে না। শাবাব অশান্ত হয়ে পড়লো। তারমানে আবারও জোরজবরদস্তি হচ্ছে। সে বলল “ও বলতে না চাইলে বলার দরকার..

শাবাবের কথা সম্পন্ন না হতেই ফাবিহা তিন কবুল বলে ফেললো। এবার শাবাবের পালা। সেও বলে ফেললো কবুল। আবারও দুজনের জীবন একসাথে জুড়ে গেল।

হুরাইন ফাবিহাকে বলল,“আল্লাহ আপনাদের বিবাহিত জীবনে কল্যাণকর করুন। ছোটো হয়ে একটা কথা বলি। সবসময় দুজনই উত্তেজিত আচরণ করবেন না। একজন রেগে থাকলে অন্যজন চুপ থাকবেন। এরপর মাথা ঠাণ্ডা হলে দুজনে ব্যাপারটা নিয়ে বুঝাপড়া করুন। হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না, যাতে পস্তাতে হতে পারে। এবার আপনারা এক হতে পেরেছেন বলে ভাববেন না বারবার সুযোগ পাবেন।”

খাওয়াদাওয়া শেষ করে সুরাইয়া পুত্রবধূ নিয়ে বাড়ি যাবেন। ফাবিহার মা এখনো আতঙ্কে আছেন। মেয়ের না কিছু হয়ে যায়। শাবাবের ভালো কোনো আচরণ এখন পর্যন্ত ওনার নজরে পড়েনি। তাই তিনি ভরসা করতে পারছেন না। কেবল স্বামীর কথার উপর কথা খাটাতে পারেননি বলেই মেয়েকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। ফাবিহা জড়িয়ে ধরে তিনি হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলেন। ফাবিহাও মাকে ধরে কাঁদছে। আতাউর রহমান কাঁদলেন না। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,“সবসময় মাথা ঠাণ্ডা রাখবে। দ্বিতীয়বার যেন কোনো ধরনের সমস্যা না হয়। তোমাদের ভেতরকার সমস্যা তোমরা মিটিয়ে ফেলবে।”

শাবাবকে বললেন,“তোমার উপর ভরসা রাখার জায়গাটা রেখো। অন্যথায় সাইন তো করেছো। কী লেখা আছে, তা নিশ্চয়ই পড়েছো।”

শাবাব মাথানিচু করে বলল,“আমি আমার বাবার, আপনার সবার ভরসা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।”

গাড়িতে সবাই একত্রে উঠলো। শাবাব আর ফাবিহার মাঝে কথা হলো না। শাবাবের বাড়ি যাওয়ার পর সকলে মিলে দুজনকে আবারও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে খাইয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিল।
দুজনেই চুপ। ফাবিহা তার জায়গায় শুয়ে পড়েছে। শাবাব গলা ঝেড়ে সেও পাশে শুয়ে পড়লো। খানিকক্ষণ পর বলল,“তোমার সমস্যা হলে বলিও।”

ফাবিহা বলল,“সমস্যা হলে কী করবে?”

“কিছু না।”

ভ্রু কুঁচকে গেল ফাবিহার।
“তাহলে জিজ্ঞেস করার কী প্রয়োজন ছিল?”

“যদি সমস্যা হয়, তবে মানিয়ে নেব।”

এরপর দুজনই চুপ। পরক্ষণেই কম্বল নিয়ে টানাটানি। দুজন দুদিক ফিরে খাটের দুই মাথায় শুয়েছে বিধায় কম্বল টা*ন পড়ছে। শাবাব টা*ন*ছে একদিকে, ফাবিহা টা*ন*ছে অন্যদিকে।
শাবাব এবার পুরো কম্বল ছেড়ে দিল। ফাবিহার দখলে সব কম্বল।

সোজা হয়ে চোখ বুজে আছে শাবাব। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে। ফাবিহার কাছে সবটুকু কম্বল, অথচ সে ঘুমায়নি। ধীরে ধীরে পাশ ফিরলো। বুকে দুহাত ভাঁজ করে রেখেছে শাবাব। আস্তে করে তার গায়ে কম্বল তুলে দিয়ে মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে নিলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শাবাবের চোখ, সরু নাক, পুরো মুখের আদল দেখছে। যদি না তাসিনকে সে পছন্দ করতো আর শাবাবের চরিত্র সম্পর্কে না জানতো, তবে কি সে শাবাবের প্রেমে পড়তো না? নিজের মনকে প্রশ্ন করে জবাব পেয়ে গেল। কোনো বাঁধা না থাকলে নিশ্চয়ই সে শাবাবের জালে পা দিয়ে ফেলতো।
হঠাৎ ঝট করে চোখের পাতা খুলে ফেললো শাবাব। ফাবিহা এক ঝটকায় দূরে সরে গেল। আবারও কম্বল সরে গেল শাবাবের শরীর থেকে।
শাবাব বলল,“আমার ঠাণ্ডা লাগছে ফাবিহা।”

ফাবিহা নড়চড় করলো না। তাই শাবাবই আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে গায়ে কম্বল জড়িয়ে নিলো।

সকালে ফাবিহার আগে ঘুম ভাঙলো। সে সময় দেখলো। ফজরের সময় এখনো আছে। তাই দেরি না করে উঠতে গিয়ে আঁচল টা*ন দিলো। শাবাবের পিঠের নিচে পড়ে আছে। সে টা*না*টা*নি করছে। হয়রান হয়ে শাবাবের হাতে মৃদু ধা*ক্কা দিয়ে বলল,“শাবাব, শাবাব আমার আঁচল ছাড়ো।”

“হুম?” শাবাব ঘুমঘুম কণ্ঠে জবাব দিল।
ফাবিহা বলল,“আমার আঁচল ছাড়ো।”

“আমি তোমার আঁচল ধরিনি।”

ফাবিহা শাবাবের নাক চেপে ধরলো। শ্বাস নিতে না পেরে শাবাব ধড়ফড়িয়ে উঠলো। আঁচল ছাড়া পেয়ে চলে গেল ফাবিহা। শাবাব হতভম্ব হয়ে বসে রইল।

নাস্তা করতে বসে শাবাবের কাজিন বলল“ওমা ভাবির চুল দেখি শুকনো।”

শাবাব বিষম খেল। তার দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিল ওর জেঠাতো ভাই। ভাগ্যিস বড়োরা কেউ নেই এখানে। মিফতাহকে ওর ভাই ধমক দিল।
“তোর এতকিছুর কী দরকার?”

ফাবিহা লজ্জায় মাথানিচু করে আছে। শাবাব তাকিয়ে দেখল ফাবিহার চোখেমুখে আজ রাগ নেই। তার লজ্জায় আলুথালু গালের দিকে তাকিয়ে ঘোর নিয়ে তাকিয়ে রইল।

#চলবে…..

এক টুকরো আলো পর্ব-৩৩+৩৪

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সময়ে সাথে সাথে হুরাইনের শরীরের পরিবর্তনগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। শরীর অনেকটাই মুটিয়ে গিয়েছে। সবসময় ওড়না দিয়ে পেট পর্যন্ত ঢেকে রাখে। একটু বসে থাকলেই পা ফোলা দিয়ে ওঠে। পা ঘন্টাখানেক আগেও ঠিক ছিল। কিছু সময়ের ব্যবধানে এতটা ফোলায় বিচলিত হলো তাসিন। উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল,“পা এমন হলো কীভাবে? দেখি।”

হুরাইন বলল,“এমন আরো হয়েছে। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার ফল।”

“এভাবে একটানা দাঁড়িয়ে থাকবে না।”

“আচ্ছা।”
বলে তাসিনের দিকে তাকিয়ে ফের বলল,“আপনি চিকিৎসক হলেন কবে?”

তাসিন ভ্রু কুঁচকে বলল,“চিকিৎসক হলাম মানে?”

“এই যে, এভাবে চলবে, ওভাবে চলবে। একটু পর পর খাবে, পানি পান করবে, ভারী জিনিস ধরবে না।”

তাসিন নিরব রইলো। হুরাইনের কথা কানে না তুলে নিজের শার্ট আয়রন করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। হুরাইন বলল,“আমি করে দিচ্ছি।”

তাসিনের কাজে মনোযোগী গম্ভীর স্বর,“একেবারে সুস্থ হলে তখন করে দিও। এখন আমি করি।”

“আচ্ছা আপনার ফোনটা দিন। আমি মায়ের সাথে কথা বলবো।”

“তোমার ফোন কোথায়?”

“ওটা রান্নাঘরে ফেলে এসেছি।”

তাসিন নিজের ফোন বাড়িয়ে দিলো হুরাইনের দিকে। হুরাইন মায়ের সাথে কথা বলে দেখলো তাসিন ঘরে নেই। তাই সে ইউটিউবে ঢুকলো। ওয়াজ সার্চ দেওয়ার জন্য সার্চ লিস্টে গিয়ে সার্চ লিস্ট দেখে সে আচমকা হেসে উঠলো। ঠোঁট চেপে হাসছে। সার্চ লিস্টে “প্রেগ্ন্যাসি সময়ে করণীয় কী? প্রেগন্যান্সিতে কী কী খাবার খেতে হয়? প্রেগন্যান্সিতে কীভাবে চলাফেরা করা উচিত?” দেখে তার হাসি থামবার নয়।
তাসিন ঘরে ঢুকলো কিছু খাবার নিয়ে। হুরাইনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তাকে হাসতে দেখে কৌতুহলী স্বরে বলল,“কী দেখে হাসছো?”

হুরাইন ফোনের স্ক্রিন তাক করলো তাসিনের দিকে। থতমত খেয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে ফোন নিয়ে নিলো তাসিন।
“তোমাকে কে বলেছে আমার ফোন ঘাটতে? এই নাও তোমার ফোন।”

হুরাইন বলল,“এজন্যই তো বলি নতুন নতুন চিকিৎসক এলো কোথা থেকে?”

তাসিন বলল,“দুনিয়াতে কি তুমি একাই প্রেগন্যান্ট?”

হুরাইন রগঢ় করে বলল,“তো এসব নিজের জন্য সার্চ করেছেন? আপনি তাহলে প্রেগন্যান্ট?”

অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো তাসিন। হতাশার সুরে বলল,
“তোমায় শান্তশিষ্ট মেয়ে ভেবেছিলাম। বিয়ের পরই বুঝেছি কতটা ব*দে*র হাড্ডি তুমি।”

হুরাইন মিছেমিছি রাগ করে বলল,“আমি যখন ভালো না, তখন এখানে থেকে কী করবো? বাপের বাড়ি চলে যাব।”

তাসিন বলল,“জামাকাপড় সব গুছিয়ে দেব?”

এবার চোখ পাকিয়ে তাকালো হুরাইন।
“আমি রাগ করেছি। কোথায় আপনি রাগ ভাঙাবেন। তা না করে আমাকে আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন?”

তাসিন না বুঝার ভান করে বলল,“ওহ তুমি রাগ করেছো? দেখেছো, তোমার চেহারা দেখে আমি বুঝতেই পারনি। ভেবেছি তুমি হাসতে হাসতে বাপের বাড়ি যেতে চাচ্ছো।”

হুরাইন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তাসিন আবারও বলল,“তোমার বাবা খুব ধূর্ত মানুষ। আমাকে তাঁর মেয়ের সাথে ঠিক করে দেখা করতে দেয়নি। আমিও আমার বাচ্চাকে ওনার সাথে দেখা করতে দেব না। তাই বাপের বাড়ি যেতে হলে আমার বাচ্চাকে দিয়ে তারপর যাবে। নিয়ে যাক তোমার বাবা তাঁর মেয়েকে।”

হুরাইন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“একেবারে খুব বড়াই করছেন? আপনি আপনার বাচ্চাকে না দেখতে দিলে আমার কী? আমার বাবা আমার বাচ্চাকে দেখবেন।”

তাসিন বলল,“তোমার আবার কী? এটা আমার বাচ্চা।”

হুরাইন ভেংচি কেটে বলল,“বড়ো গলায় একা নিজের বাচ্চা বলে লাফাচ্ছেন। নিজের পেটে রেখে বড়ো করার তো মুরোদ নেই।”

তাসিন বলল,“এই একটা দুর্বলতাই তো পেয়েছো। নয়তো তোমাকে আর তোমার বাবাকে পাত্তা দিতাম না আমি।”

“মনে হচ্ছে আপনার পাত্তা পাওয়ার জন্য আমরা বাবা-মেয়ে কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলেছি!”

“সেটাই তো বাকি রেখেছো।”

হুরাইন ফুঁসে উঠে বলল,“বেশি কথা বললে একদম আম্মাকে বলব বাড়িতে ঢুকতে না দিতে।”

তাসিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“ক্ষমতা যেখানে নারীর হাতে, সেখানে অযথা তর্ক করে এনার্জি খরচ করার কোনো মানেই হয় না। নারী নিজের কথা উপরে রাখার চেষ্টা করবেই।”

★★★

“আজ শাবাব ভাইকে দেখলাম একটা মেয়ের সাথে। নতুন গার্লফ্রেন্ড মনে হয়। খুব হাসিখুশি দেখলাম।”

“তাতে আমার কী? ওর কথা আমাকে বলছিস কেন? আমি ওর কথা আগেও শুনতে চাইনি, এখনো চাই না।”
রাগী সুরে বলল ফাবিহা।

রিপা বলল,“আমিও তো সেটাই বলি। শাবাব তো এখন আর নেই। এভাবে নিজেকে বন্দী করে রাখার মানে কী? চিল কর, আনন্দ কর নিজের লাইফে। কে কী বলল, না বলল তাতে তুই পাত্তা দিবি কেন? সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিতে পারলেই জীবন উপভোগ করতে পারবি। ওদের কথায় পাত্তা দিলে তুই জীবনেও সুখী হতে পারবি না।”

“সমাজকে পাত্তা দিতে না চাইলেও, তাঁদের কথায় অজান্তেই আ*ঘা*ত পেয়ে যাই। আমি নিজের সম্পর্কে কিছু শুনতে পারি না, এটা তোরা জানিস।”

“শোন, এসব বা*লে*র সমাজের গোষ্ঠী মা*রি। আমাকে দেখ্, ওদের দু’পয়সার পাত্তা দিচ্ছি না। তুই আজকে চলে আয়। সানির বার্থডে পার্টির পর আজ সবাই আমরা ওখানেই থাকবো রাতে। এভাবে একা থেকে নিজেকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলিস না।”

ফাবিহা বলল,“না পার্টিতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার।”

“তুই তোর বাকি দুই বান্ধবীর মত বিহেভ করছিস। ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টিতে আসতে কী সমস্যা? আমিও তো যাচ্ছি। তোরা তিনজন ছাড়া বাকি সবাই আসছে। তুইও আয়।”

“না।”

“থাক তুই এভাবে। ম*র*গা। শাবাব ফূর্তি করুক। আর তুই বিরহে দিন কাটা। দিন দিন ফকিন্নি মার্কা চেহারা বানাচ্ছিস। মনে তো হচ্ছে তোর আর শাবাবের জনম জনমের প্রেম ভেঙে গিয়েছে।”
রিপা কল কেটে দিলো।

ফাবিহার মেজাজ খা*রা*প হয়ে আছে। নিজের উপরই প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে সে। সে এতদিন ভেবেছিল শাবাব হয়তো সত্যিই ভালো হতে চাইছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া দুজনের মধ্যকার ঘটনা রোমন্থন করে খানিকটা দয়া হলো। সংসার না করলেও ভেবেছিল মন থেকে ক্ষমা করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু না সে কীভাবে এত বড়ো ভুল করতে পারলো? কু*কু*রে*র লেজ কখনো সোজা হয় না। শাবাবও ভালো হবে না।
তার কাছে ক্ষমা চেয়ে আগের মতই মেয়ে নিয়ে ঘুরছে। এতে কি তার অপ*মান হচ্ছে না?
অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো পার্টিতে যাবে। সত্যিই তো এভাবে নিজেকে বন্দী করে ক্ষতি ছাড়া কী লাভ হচ্ছে?

সন্ধ্যায় বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। মাকে বলেই বেরিয়েছে সে। তাকে পার্টিতে দেখে রিপা হাসিমুখে এগিয়ে এলো।
“আমি জানতাম তুই আসবি। গুড গার্লের মত কাজ করেছিস। শোন্ , সানির চাচাতো ভাই তোকে খুব পছন্দ করে। মা*ল*টা*ও হেব্বি। চান্স দিয়ে দেখ। চাইলে ডিরেক্ট বিয়ে করে ফেলতে পারিস।”

ফাবিহা বিরক্ত হয়ে বলল,“ভালোলাগছে না রিপা। তোর ইচ্ছে হলে তুই গিয়ে ঝুলে পড়। কারণ তুই আর শাবাব দুটোই সেইম ক্যাটাগরির।”

রিপা বিদ্রুপ করে বলল,“খুব সতীসাবিত্রী বলেই তো তোর লাইফে এত ঝামেলা। শাবাবের সাথে দুই-তিন মাস প্রেম করতি। ব্যাস, সমস্যা শেষ।”

ফাবিহা জেদ করে পার্টিতে তো এলো। কিন্তু তার দুই বান্ধবীকে না পেয়ে ভালোলাগছে না। রিপার সাথে সম্পর্কটা গভীর নয়। একজন থেকে অপরজন পরিচয় যেভাবে, ঠিক সেভাবেই।
সানির সাথে দেখা করে একপাশে বসে রইল সে। সানির কাজিন এসে নম্র, কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,“আপনি কি অসুস্থবোধ করছেন মিস?”

ফাবিহা সৌজন্য হেসে বলল,“না আমি ঠিক আছি।”

“মনে হচ্ছে আপনি পরিবেশটা এনজয় করতে পারছেন না।”

“না সেরকম ব্যাপার নয়।”

“ওকে, আপনি বসুন। প্রবলেম হলে আমাকে ডাক দিতে পারেন।”

ফাবিহা জোরপূর্বক হেসে বলল,“জি।”

ভার্সিটিতে কয়েকবার সানির সাথে দেখা গিয়েছে তার এই কাজিনকে। ছেলেটা যে ফাবিহাকে পছন্দ করে, সে খানিকটা আন্দাজ করেছিল। আজ রিপার কথা শুনে শিওর হলো।
সানিসহ বাকি ফ্রেন্ডরা এসে তাকে ধরে নিয়ে গেল।
“তুই এমন রোহিঙ্গাদের মতো ওখানে বসে আছিস কেন? আমরা সবাই এখানে।”

রিপা হাসতে হাসতে সানিকে বলল,“বলেছিলাম তোর কাজিনকে একটা চান্স দিতে। ছেলে ভালো। বললে বিয়েও করে নেবে।”

ফাবিহা বলল,“আসলে রিপা আমার উপর দিয়ে বলছে। তার নিজেরই চান্স পেতে ইচ্ছে করছে।”

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। সানি বলল,“না ভাই, আমার ভাই যাকে পছন্দ করেছে তাকেই লাগবে। সমস্যা কী ফাবিহা? লাইফটা গুছিয়ে নে না। আমাদের মাঝে তোর লাইফটাই এখন এলোমেলো।”

ফাবিহা বলল,“সানি আমি বাসায় যাবো। মাথাব্যথা করছে।”

“সবাই আজ এখানে থাকবে। তুইও কোথাও যাবি না। এখন একটু রেস্ট কর।”

“না, বাসায় যাবো।”

“আচ্ছা আমি তোকে পৌঁছে দেব একটুপর।”

“তোদের যেতে হবে না। আমি একাই যেতে…
বলতে বলতে শাবাবকে দেখে থেমে গেল। ও এখানে কেন? শাবাবের দিকে আঙ্গুল তাক করে সানিকে জিজ্ঞেস করল,“ও এখানে কেন?”

“আমার মেজো ভাইয়ার ফ্রেন্ড মনে হচ্ছে।”

“আচ্ছা আমি যাচ্ছি।”

সানির কাজিন এসে বলল,“বাসায় চলে যাচ্ছেন? আমি পৌঁছে দেব?”

“ধন্যবাদ। আমি যেতে পারবো।”

শাবাবও দূর থেকে দেখলো ফাবিহাকে। স্থির হয়ে গেল সে। ফাবিহা তার সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছে। একা বের হচ্ছে দেখে সেও পিছু পিছু এলো। ফাবিহা একবার পিছু ঘুরে শাবাবকে আসতে দেখেই মনে মনে তিরস্কার করল তাকে। দ্রুত সে বেরিয়ে যাচ্ছে। শাবাবের লম্বা কদমের সাথে পাল্লা দিয়ে বেশিদূর যেতে পারলো না। সে থেমে গিয়ে শাবাবকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেবে বলে মনস্থির করলো। তাকে আশ্চর্যের চরমে পৌঁছে দিয়ে পাশ কাটিয়ে শাবাব এগিয়ে গেল। রাগ আরো বেড়ে গেল তার। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে গাড়ি ডেকে উঠে পড়লো। যেতে যেতে গাড়ির পেছনে তাকিয়ে দেখলো শাবাবের গাড়ি তাদের পেছনেই আসছে। এভাবে কয়েকবার তাকিয়ে একইভাবে শাবাবকে আসতে দেখে সে ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ করল,“আমাকে ফলো করছো কেন?”

কোনো জবাব এলো না। এবার কল দিলো ফাবিহা। শাবাব ফোন তুললো না প্রথমবারে। দ্বিতীয়বারে কানে তুলে প্রশ্ন করল,“কে?”

ফাবিহার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে এলো। দাঁত চেপে বলল,“আমাকে ফলো করছো কেন?”

“আশ্চর্য! আমি কেন আপনাকে ফলো করতে যাবো? আমি কি আপনাকে চিনি?”

“না চেনার ভান করছো? নম্বর সেইভ থাকার পরও কীভাবে এত নাটক করছো?”

“একমিনিট, ফাবিহা?”

“কাকে আশা করেছিলে? নিউ গার্লফ্রেন্ড? শোনো, তোমার যা ইচ্ছে করো। আমাকে আর বিরক্ত করবে না।”

শাবাব বলল,“তোমার নম্বরতো এখন আর সেইভ নেই। ফলো করে বিরক্ত করার প্রশ্নই আসে না?”

ফাবিহা চোখ বুজে রাগ দমনের চেষ্টা করে বলল,“আমি জানি শাবাব, তুমি আমার পিছু পিছু আসছো। নাটক করবে না। তোমাকে চেনা আছে আমার।”

“তোমাকে তো আমি দেখিইনি। তাহলে ফলো করবো কীভাবে?”

“তুমি একটা অ*স*ভ্য। আর সারাজীবন অ*স*ভ্য*ই থেকে যাবে। ভালো হবে না।”

“আমি রাখছি ফাবিহা। আর কিছু বলবে? ইমপোর্টেন্ট কাজ আছে।”

ফাবিহা নিজেই খট করে কল কেটে দিলো।
শাবাব ফোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে ইচ্ছে করেই ফাবিহার নম্বর ডিলিট করে দিয়েছে। নম্বর দেখে চিনে ফেললেও সত্য প্রকাশ করলো না।
ফাবিহাকে বাসার সামনে নামতে দেখে সে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। তার আগেই দেখে নিলো ফাবিহা।
বিড়বিড় করে বলল,“এবার তোমায় আমি খু*ন করে তবেই শান্ত হবো শাবাব।”

বাড়ির ভেতর ঢুকতেই বাবা-মায়ের চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেল ফাবিহা। বাবা বলছেন,“তুমি রাতের বেলা মেয়েকে একা ছাড়লে কোন সাহসে? কী কী ঘটে গিয়েছে কিছুই মনে নেই, না?”

“মেয়ে কি ঘরে বসে থেকে ম*রে যাক, সেটা চাও তুমি? গেল তো বন্ধুর বাসায়।”

ফাবিহা বলল,“আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করো না। আমি চলে এসেছি।”
কাউকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। শাবাবের প্রতি ক্ষো*ভ নিয়ে ঘুমালো সে। রাতে এক চমকপ্রদ স্বপ্ন দেখলো। ইচ্ছে মত শাবাবকে পে*টা*চ্ছে সে।
স্বপ্ন হলেও শান্তি পেল ফাবিহা। রাগ একেবারে পানি হয়ে গিয়েছে। সকাল সকাল শরীর, মন দুটোই ভালোলাগছে। এলার্ম দিয়ে রেখেছিল ফজরের জন্য। এখন ছাদে হাঁটাহাঁটি করছে। কতদিন ভার্সিটি না গিয়ে থাকবে? সে মাঝারি মানের স্টুডেন্ট থাকলেও এখন আর তা নেই। পড়াশোনায় একেবারে পিছিয়ে পড়েছে। ভাবলো একটা বোরকা কিনবে। হুরাইনের কথামতো নিজেকে সুমনের কাছ থেকে আড়াল করা যাবে। কিন্তু জীবনে বোরকা না পরায় এখন কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। পরক্ষণে ভাবলো বোরকা কিনবে না। সুমনের নামে মা*ম*লা করা হয়েছে। সেও শাবাবের মত সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।
ভেবে দেখলো সানির কাজিন যদি প্রপোজ করে, তবে সে বিয়ের কথা তুলে ফেলবে। রাজি হলে বিয়েটাও করে নেবে।
পরক্ষণেই ভাবলো শাবাবের উপর জেদ করে সে কেন বিয়ে করে নেবে?

★★★

শাবাবের ফেসবুক একাউন্টে গতদিনের একটা ছবি পোস্ট দেখলো। যেখানে তার জেঠাতো বোন মিফতা আর সে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাপশন “সুইট সিস্টার”।
ফাবিহা ছবিটি নিয়ে রিপাকে পাঠালো।
“দেখতো, এই মেয়েটাকেই দেখেছিস?”

রিপ্লাই এলো,“না। অন্যজন ছিল।”

ফাবিহা আবারও নিজেকে ধিক্কার জানালো। সে কেন রিপাকে এই ছবি পাঠাতে গেল? শাবাবকে সাধুসন্ন্যাসী বানানোর এত ইচ্ছে কেন জেগেছে তার। রিপা আবার রিপ্লাই করল,“তোকে পার্টিতে আনার জন্য দুষ্টুমি করেছি। আমি শাবাব ভাইকে কারো সাথে কেন, একাও দেখিনি।”

ফাবিহার রাগ এবার রিপার উপর গিয়ে বর্তাল। বুঝে উঠতে পারলো না তার এখন কী করা উচিত।

#চলবে…..

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

“শাবাব তোর বাবা ডাকছে তোকে।”

শাবাব অফিসের কিছু কাজ গুছিয়ে রাখছিল। বাবা যেভাবে সবটা সামলাতেন, বাড়িতে সময় দিতেন, সে ঠিক সেভাবে সব পেরে ওঠে না। এখনো ততটা দক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি। মাঝেমাঝে হাঁপিয়ে ওঠে, বিরক্তি ধরে যায়। পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় আগে বাবার উপর নির্ভরশীল ছিল। বাবা না দিলেও মাকে বললেই টাকা পেয়ে যেত। ইচ্ছেমত খরচ করেছে। এখন বুঝতে পারছে উপার্জনে কত কষ্ট।
ল্যাপটপ বন্ধ করে ধীর পায়ে বাবার ঘরে গেল সে। ফিরোজ আলম চলাফেরা করতে পারেন না। কেবল মুখটাই এখন শক্ত আছে। বললেন,
“এই ঠাণ্ডার মধ্যে এটা কী পরে আছিস? পাতলা গেঞ্জিতে শীত যায়? বস এখানে।”

শাবাব বসতে বসতে বলল,“ঘরে গিয়ে পরবো গরম কাপড়। এখন শরীর কেমন আছে?”

“ভালো আছে। অফিসের কী খবর? সব সামলাতে পারছিস তো?”

“একটু কষ্ট হচ্ছে; তুমি চিন্তা কোরো না। ইনশাআল্লাহ সব সামলাতে পারবো।”

ফিরোজ আলম গম্ভীর স্বরে বললেন,“হুম। যদি মনে হয় নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে পারবি, তহলে বলিস। বিয়ে করিয়ে দেব। বয়স তো বাড়ছে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছিস।”

শাবাব গলা খাঁকারি দিয়ে ইতস্তত করে বলল,“মাত্র ২৭ শেষ হলো। বুড়ো হলাম কোথায়?”

“২৮ বছরেও কি নিজেকে কচি খোকা মনে করছিস? যেটা বলেছি মাথায় রাখিস। নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারলে মুখ খুলবি। নয়তো জবান বন্ধ রাখবি।”

“এখন এসব নিয়ে ভাবছি না আমি। কাজে মন দিচ্ছি। ওটাই মন দিয়ে করার চেষ্টা করছি।”

“শুধু টাকা কামালেই চলবে না। সবদিকে নজর রাখতে হবে। এখন যা।”

শাবাব উঠে নিজের ঘরে চলে এলো। সুরাইয়া ঘরে ঢুকে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন,“কী বলল?”

“বলল এখন এসব নিয়ে ভাবছে না।”

“ও কী আর মুখে বলবে যে আমাকে বিয়ে করিয়ে দাও? ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারি না আমি। আমার কী ছেলে কী হয়ে গেল।”

ফিরোজ আলম বিদ্রুপ করে বললেন,“তোমার ছেলের লজ্জা-শরম আছে নাকি? বিয়ে করতে চাইলে নিজেই বলবে। আর কী বললে? ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারছো না? তাহলে নির্ঘাত তোমার চোখে ছানি পড়েছে। নয়তো ছেলের পরিবর্তন কেন দেখতে পাচ্ছো না? আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তাছাড়া তোমার ছেলে স্বেচ্ছায় যখন তা*লা*ক দিয়েছে, তখন দুঃখ পেতে যাবে কীসের ভিত্তিতে? গর্দভ মহিলা।”

সুরাইয়া কটমট করে বললেন,“তুমি অসুস্থ বলে কিছু বললাম না। এখন তোমার মুখ চলে বেশি।”

“সারাজীবন কি চুপ করেই থাকবো?”

“না চুপ করবে কেন? আমিই তোমার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে চুপ করিয়ে দেব।”

★★★

মাকে নিয়ে বের হয়ে বোরকা কিনলো ফাবিহা। মেয়েকে তীক্ষ্ণ চোখে পরোখ করে বলেও ফেললেন,“হঠাৎ বোরকা কেনার শখ হল কেন?”

“সুমন যাতে না চিনতে পারে।”

“যারা চেনে, তারা চোখ আর হাঁটার ধরণ দেখেই চিনে ফেলে।”

ফাবিহা ভেবে দেখলো তাইতো? মনঃক্ষুণ্ন হলো। বোরকা কিনবে না বলে ফিরে যেতে নিয়েও কিনে ফেললো। রাতে বোরকা পরে ঘুরেফিরে নিজেকে দেখলো। একেবারে অন্যরকম লাগছে। কেমন লজ্জাও লাগছে। তখনই সাজেদার ফোন।

“কেমন আছো খালা?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। শোন খালা ব্যস্ত আছি। তোকে কল দিয়েছি কাল আমাদের বাড়ি আসার জন্য। নিশির শশুর বাড়ি থেকে মেহমান আসবে। তুই কাল চলে আসিস। তোর মাকে ফোন করেছি। আমার ফোন তুলছে না।”

ফাবিহা বলল,“তুমি একবার আসলেই তো পারো খালা। তখন রাগ না ভেঙে কোথায় যাবে?”

সাজেদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,“কিন্তু কাল আসার সময় কোথায়? মেহমানের আপ্যায়নের কাজ। হুরাইন এসব একা পারবে না। তাছাড়া ও অসুস্থ মানুষ।”

“আচ্ছা আমি কাল চেষ্টা করবো যাওয়ার।”

“আচ্ছা রাখছি।”

ঘন্টাখানেক পর বসার ঘরে শোরগোল শুনে ফাবিহা ঘর থেকে বের হলো। সাজেদা আর তাসিনকে দেখে সে আশ্চর্য হলো। বোনকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন সাজেদা। ফাবিহার মা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এখন আসার বুদ্ধি হুরাইনে। সে-ই ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছে। তাসিনকেও সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারও উচিত খালার সাথে মনমালিন্য দূর করা। দোষটা তো তারই বেশি।
সাজেদা আর তাসিন মিলে চেপে ধরলেন তো ধরলেনই। অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। তাসিন বারবার মাফ চাইলো। সাজেদা বললেন,
“আল্লাহ চাইলে আমার নাতি-নাতনি আসবে দুনিয়াতে। তুই তার কথা ভেবে মাফ করে দে আমার ছেলেকে। আমি নিজেও ওর উপর অসন্তুষ্ট ছিলাম। বউয়ের উপরও আমার রাগ ছিল। কিন্তু এখন মনে হয় আমার সংসারের জন্য হুরাইনকেই দরকার ছিল। আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।”

ফাবিহার মা বললেন,“এখন নিজের ভালো খুঁজলি। তোর নাহয় ভালো হলো; কিন্তু আমার মেয়ের জীবন তো ধ্বং*স হয়ে গিয়েছে।”

“জীবনে কত খা*রা*প সময় আসে। আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করেন। এই সময়টাতে ধৈর্য ধারণ করতে হয়।”

ফাবিহা বলল,“মা এসব মনে পুষে রেখে কী লাভ হচ্ছে তোমার? আমাকে নিয়ে তোমাদের চিন্তা, অথচ আমি এসব মনেও রাখিনি।”

ঘন্টাখানেক বসে থেকে নাছোড়বান্দার মত বোঝানোর পর ফাবিহার মায়ের মন খানিকটা গললো গেল। তাসিন আর সাজেদা উঠবে। ফাবিহার মা বললেন,“রাতের খাবার খেয়ে তারপর যাবি।”

“না না। বউ বাড়িতে একা আছে। এমনিতেই অনেকক্ষণ হলো। আজ উঠি। কাল যাবি কিন্তু।”

আতাউর রহমানও বাড়িতে ঢুকলেন। ওনার সাথেও কথা হয়ে গেল। তাসিন আর সাজেদার মন হালকা হলো। এতদিন মনে যে একটা ভার ছিল। সেটা আর নেই। এর জন্য হুরাইনের একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।
মাঝপথে সাজেদা বললেন,“হুরাইন কী খাবে? কিছু কিনে নে।”

তাসিন মনে মনে হাসলো।
বাড়ি ফিরে হুরাইনকে কুরআন তেলাওয়াত করতে দেখা গেল। তাসিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে। চোখমুখে প্রফুল্লভাব। হুরাইন পড়া শেষ করে উঠে গেল। উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো,“খালা মেনেছেন?”

“না মেনে উপায় আছে? তুমি অনেক বড়ো উপকার করলে। এর জন্য কী চাও বলো।”

হুরাইন হেসে ফেলে বলল,“সব তো আমারই আছে।”

তাসিন হুরাইনের হাসিতে ডুবে গিয়ে তাকে কাছে টেনে নিলো। মন্থর গলায় বলল,“যা তোমার, তা তোমারই থাকবে। এর বাইরে কিছু চাও।”

“আপাতত কিছু মনে পড়ছে না। যখন কিছু লাগবে, তখন চেয়ে নেব?”

“তাহলে কি পাওনা তোলা রাখলে?”

“হুম।”

“তুমি আগে যখন বলেছিলে, তখনই আমাদের যাওয়া উচিত ছিল। তাহলে অনেক আগেই সবটা মিটমাট হয়ে যেত।”

“থাক, আর আফসোস না করে খুশি হোন।”

★★★

ফাবিহা বোরকা পরে বের হতে গিয়ে কেমন জড়তা কাজ করছে। সবাই কেমন চোখে তাকাবে? এই ভেবে শীতের মাঝেই তার গরম লাগছে। আতাউর রহমান মেয়েকে দেখে বললেন,“মাশাআল্লাহ! আজ তো আমার মেয়েকে অনেক ভালো দেখাচ্ছে।”

ফাবিহা আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো,“সত্যিই ভালোলাগছে?”

“তাহলে আর বলছি কী?”

নাস্তা করে বাবার সাথেই বের হলো সে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন ওদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে বলাবলি করছে “দেখ্, দেখ্, এখন পর্দায় ঢুকেছে। পর্দার ভেতরেই সব শ*য়*তা*ন থাকে।”

আতাউর রহমান মেয়ের মাথা চেপে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,“নিজের কাজে মন দাও।”

ফাবিহা আর মাথা ঘুরানোর চেষ্টা করলো না। চলে গেল বাবার সাথে। ক্লাসে অনেকেই জিজ্ঞেস করছে।
“নতুন মেয়েটা কে?”
কেউ এসে বলছে “বাবাহ বোরকাও পরছো রীতিমতো।”

ক্লাসে সবাইকে টপকিয়ে সুমনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ই তার হার্টবিট বেড়ে গেল। এই বুঝি তাকে চিনে ফেললো। দুরুদুরু বুক নিয়ে সমুনকে পেরিয়ে গেল। দ্রুত গাড়িতে উঠে চলেও এলো।
মা আর বাবা তাসিনদের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। সেও ওখানে এসেই নেমেছে। বোরকা পরে ভেতরে ঢুকে হুরাইনকে না দেখে তার ঘরে এগিয়ে গেল। দএজনের কুশল বিনিময়ের পর হুরাইন ভীষণ খুশি হয়ে বলল,“মাশাআল্লাহ!”

“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। সুমনের সামনে দিয়ে চলে এসেছি, সে আমাকে চিনতেই পারেনি। তবে আন্দাজ করতে পেরেছি কয়েকবার অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছিল।”

“আপনার চিন্তা কী? মানে নিজেকে নিয়ে কিছু ভেবেছেন?”

ফাবিহা চুপ করে আছে।

“তুমি খেয়েছো?” বলতে বলতে ঘরে ঢুকে পড়লো তাসিন। হুরাইন, ফাবিহা দুজনই তাকালো। তাসিন ফাবিহাকে সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
হুরাইন বলল,“না, খাব পরে।”

“অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আমি এখানে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।”

বলেই বেরিয়ে গেল সে। ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। কিছুক্ষণের মাঝে দুজনের খাবারই চলে এলো। হুরাইন বলল,“বোরকা খুলে হাত-মুখ ধুয়ে এসো।”

ফাবিহা হাত-মুখ ধুয়ে নিলে দুজনই খেয়ে নিলো। সে জিজ্ঞেস করল,“তাসিন ভাই তোমার খুব যত্ন নেয়, তাইনা?”

হুরাইন হাসছে। যেন নূর ভাসছে তার চোখেমুখে। এতটুকুতেই নিজের প্রশ্নের জবাব স্পষ্ট দেখতে পেল ফাবিহা। হুরাইন বলল,“আপনিও নিজেকে নিয়ে ভাবুন, আপনাকেও যত্ন করার মানুষ এসে যাবে। আল্লাহ চাইলে সেই যত্ন আপনার প্রত্যাশার চেয়ে বেশিও হতে পারে।”

“আমি জানি না কতদিন সুমনের চোখ ফাঁকি দিয়ে থাকতে পারবো। পড়াশোনার জন্য ওর সামনে যেতেই হচ্ছে।”

“আপনার স্বামী কি আপনার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে?”

ফাবিহা উদাসী গলায় বলল,“নাহ্। আমার নম্বরও ওর ফোনে সেইভ নেই। কিন্তু কয়েকদিন আগে ও আমাকে ফলো করছিল।”

“কেন? আর নম্বর সেইভ নেই, সেটা আপনি কীভাবে জানলেন?”

“কেন ফলো করছিল আমি জানি না। আর নম্বরের ব্যাপার জেনেছি আমি ফোন করার পর।”

“আপনি ফোন করেছিলেন? কিন্তু কেন?”

“ওকে রাতেরবেলা আমার পিছু পিছু আসতে দেখেই আমি ফোন করেছিলাম। ও আমাকে মিথ্যা বলল। ও নাকি আমায় ফলো করছে না। অথচ আমি যখন বাড়ির সামনে নামলাম, তখন স্পষ্ট ওকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে দেখলাম।”

হুরাইন ভাবুক হয়ে বলল,“এমনও তো হতে পারে তিনি আপনাকে এখনো মন থেকে সরাতে পারছেন না।”

ফাবিহা হাসলো।
“আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিল না। নাম মাত্র বিয়ে।”

“তা*লা*কে*র জন্য কিন্তু আপনিই জোর করেছিলেন। কখনো কি জিজ্ঞেস করেছিলেন ওনার মনে আপনার জন্য কিছু আছে কিনা?”

ফাবিহা চুপ হয়ে গেল। তা*লা*কে*র জন্য সে-ই চাপ প্রয়োগ করেছে। শাবাব মুখে কিছু না বললেও নিরবে অস্বীকার করেছিল। সে তা*লা*ক দিতে চাইছিল না। প্রথমবারেও সে বলল যেখানে বিয়ে মন থেকে হয়নি, সেখানে তা*লা*কে*র কী দরকার? পরেরবারও সে তা*লা*ক দিতে গড়িমসি করার চেষ্টা করছিল। কিছুকিছু কাজ ভাবায় তাকে। দ্বিধায় আছে শাবাবের কাজকর্ম নিয়ে।
হুরাইন বলল,“কী ভাবছেন আপু?”

“হুঁ? না কিছু না।”

“আপনি তাহলে বসুন। আমি প্লেট রেখে আসছি রান্নাঘরে। মেহমান আছে বলে কাজ শেষ করে ঘরে এসে বসে আছি। মহিলাদের আপ্যায়নে আম্মা আর খালা আছেন। আব্বা আর উনি পুরুষদের খাবার তদারকি করছেন। আমাকে আম্মা ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।”

ফাবিহা বলল,“এগুলো আমি নিতে পারবো। তুমি অসুস্থ।”

হুরাইন মৃদু হেসে বলল,“সবাই আমাকে অসুস্থ বলছে। কোথায়? আমি তো আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ। এগুলো করলে বরং আমার শরীর আরো ভালো থাকবে।”

ফাবিহাকে উঠতে না দিয়ে হুরাইনই উঠে চলে গেল। ফাবিহা ভাবনায় ডুবে গেল। শাবাব কেন সেদিন তার পিছুপিছু এসেছিল? সে বিয়ে করে বর নিয়ে ঘুরছে কিনা সেটা দেখতে? সে সংসার করছে বলে শাবাব কি জেলাস? হুরাইন এসে ডাকলো কয়েকবার। ফাবিহার সাড়া পেল না। সে ভাবনায় মগ্ন। হুরাইন কিছু একটা আন্দাজ করে আর ডাকলো না। খালা শাশুড়িকে বলে ফাবিহাকে দুদিনের জন্য রেখে দিল।
সে ফাবিহার গতিবিধি লক্ষ করছে। পুরোপুরি কোনো ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে পারছে না। সকাল হলেই নিজের সাথে ডেকে তুলে নিচ্ছে। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ ডেকে ডেকে নামাজ পড়ায়। সাজেদার সাথে বিকেলে বসিয়ে তাকেও হাদিস পড়ে শোনায়।

নিশির মতিগতি বুঝলো না হুরাইন। দিন কয়েকের ব্যবধানে তার মাঝে পরিবর্তন চলে আসবে, এমনটা আশা করা বোকামি। তবে চাপে পড়ে সব মেনে চলার চেষ্টা করে। এ বাড়িতে থাকতেই আজান দিলেই নামাজ পড়ে ফেলতো। হুরাইনের সাথে টুকটাক কথাও বলেছে।

দুদিন সুমনের চোখ ফাঁকি দিলেও আজ সে চিনে ফেললো হুরাইনকে। অ*ক*থ্য ভাষা শুরু করলো।
“আমার চোখ ফাঁকি দিতে শিখে গিয়েছো? মা*ম*লা করা, না? আমি কিন্তু শাবাব না, যে মা*ম*লা করার পরও তোকে মাথায় তুলে চুমু খাবো। একেবারে গু*ম করে ফেলবো ****।”

ফাবিহা গর্জে উঠে বলল,“সমস্যা কী তোমার? আমার পেছনে এভাবে কেন লেগেছো?”

“তোর ***** বেশি। তাই তা একেবারে না কমিয়ে তো থামতে ইচ্ছে করছে না।”

“অ*স*ভ্য আমাকে যেতে দাও।”

“যাবি? যা।”

ফাবিহা পথ খোলা পেয়েই বেরিয়ে গেল। সুমনের নজর ফাবিহার পায়ের গতির উপর। ঠোঁটে কুটিল হাসি।

প্রতিদিনের খবরাখবর শাবাব রাখে। সুমন কোনো ঝামেলা করে কিনা তার খোঁজ ফরহাদ তাকে দিয়ে থাকে। সে ফাবিহা আর সুমনের উপর নজর রাখে। ফাবিহাকে গত দুদিন সে দেখেনি। মূলত বোরকা পরার কারণে চিনতে পারেনি। আজ সুমন যখন ধরে ফেললো, তখন সেও অবাক হলো। ফাবিহা বোরকা পরেছে সুমনের চোখ ফাঁকি দিতে?
সে শাবাবকে ফোন করে জানিয়ে দিল।
মাথার চুল টেনে ধরলো শাবাব। ক্রোধান্বিত স্বরে
ফারহাদকে বলল,“পোলাপান রেডি রাখ। আজ ছিঁ*ড়ে ফেলবো *****কে।”

সুমনকে ফোন করে বলল,“তোর সাথে কথা আছে। ব্রিজের উপর চলে আসিস দশটার পর। তখন আমি ফ্রি থাকবো।”

সুমন হাসতে হাসতে বলল,“তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই। তাই আসার প্রশ্নই ওঠে না।”

শাবাব হুঙ্কার ছাড়লো। হিসহিসিয়ে বলল,
“এ্যাই ফাবিহার পেছনে কেন এখনো পড়ে আছিস? তুই যা বলেছিস, আমি করেছি। তোর কাছে মাফ চাইতে বলেছিস, আমি চেয়েছি।”

“তোর এত জ্বলছে কেন? তুই তো ইউজ করেই ফেলেছিস। এবার আমিও একটি ইউজ করি। যদিও তোর ইউজ করা, সেকেন্ড হ্যান্ড, তবুও ব্যাপার না।”

রক্ত উঠে যাচ্ছে মাথায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে না শাবাব। চিৎকার করে বলল,“বে*জ*ন্মা, তুই আর একবার এই কথা মুখে আনলে তোর জিহ্ব টেনে ছিঁ*ড়ে ফেলবো।”

“তুই বে*জ*ন্মা, লু*জা*র। সামান্য একটা মেয়ের গো*লা*ম হয়ে আছিস। কী আছে এই মেয়ের মধ্যে? আমারও তো দেখা লাগবে।”

শাবাব উত্তেজিত স্বরে বলল,“তুই কোথায় আছিস বল?”

“মোকাবেলা করতে চাস? ঠিক আছে। চলে আয় আমার আড্ডাখানায়।”

শাবাব হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে একাই চলে গেল সুমনের ডাকে।

★★★

ফাবিহা চারদিন পর আবার ক্লাস করতে এলো। ফরহাদ যেন অপেক্ষাতেই ছিল তার। সে নিশ্চিত শাবাব ফাবিহাকে ভালোবাসে। ফাবিহাকে দেখেই দৌড়ে গেল। ফাবিহা পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই বলল,“দাঁড়ান।”

ফাবিহা দাঁড়ালো, কিন্তু পিছু ফিরলো না। ফরহাদ পেছন থেকেই বলল,“আপনি কি ভাইকে একটা সুযোগ দিতে পারতেন না?”

ফাবিহা বলল,“আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই ক্লাস আর দ্বিতীয়বার পাবো না।”

ফরহাদ বলল,“শাবাব ভাইও একবার চিরতরে হারিয়ে গেলে আর দ্বিতীয়বার ফিরে পাবেন না। আপনার জন্য সুমন ভাইকে মে*রে একেবারে আধ*ম*রা করে দিয়েছে।”

চমকে উঠলো ফাবিহা। পেছন ঘুরে বিস্ময় নিয়ে বলল,“মানে?”

“সেদিন আপনাকে সুমন বিরক্ত করেছিল শুনে, আমাকে বলল পোলাপান রেডি রাখতে সুমনকে শায়েস্তা করবে। কিন্তু তার আগেই সুমন ভাইকে উল্টাপাল্টা বলে রাগ উঠিয়ে দেওয়ায় ভাই একা একাই চলে গেলেন। আর একা পেয়ে ভাইকে ইচ্ছামতো মে*রে*ছে সুমন আর তার ছেলেরা। এক্সি*ডেন্টে যে হাত ভেঙেছে, সেই হাতই আবার ভেঙে গিয়েছে।”

ফাবিহা উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে বলল,“ওকে কে বলেছিল সুমনের সাথে ঝামেলায় যেতে? আমার সাথে তো আর ওর লেনাদেনা নেই। আমারটা আমি বুঝবো। ও কেন আমার জন্য সুমনের সাথে আবার ঝামেলা করলো?”

“ভাই আপনাকে ভালোবাসে। আপনিই বুঝতে পারলেন না।”

বারবার চমকাচ্ছে ফাবিহা। সে অবিশ্বাস্য চোখে বলল,“মিথ্যা বলবে না।”

ফরহাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,“আপনি না বুঝলে তো আর করার কিছু নেই। নয়তো ভাইয়ের কী দরকার প্রতিদিন আমাকে দিয়ে আপানার খোঁজ নেওয়ার? সুমন আপনাকে বিরক্ত করে কি না তার খোঁজ নেওয়ার কী দরকার? আপনি বললেন আর আপনার মতকে গুরুত্ব দিয়ে ডি*ভো*র্স দেওয়ার কী দরকার? আচ্ছা বাদ দিন। আপনার ক্লাস আছে।”

ফরহাদ চলে গেল। পেছন থেকে ফাবিহা ডাকলো,“দাঁড়াও।”

ফরহাদ পিছু ফিরতেই বলল,“কোন হাসপাতালে?”

“গেলে আমার সাথে আসুন।”

ফাবিহা দ্বিতীয়বার না ভেবে ফরহাদের সাথে চলে গেল। শাবাব ঘুমাচ্ছে। সারা শরীরের দৃশ্যমান অংশ, মুখের আ*ঘা*তে*র চিহ্ন। প্রথমবার শাবাবের কথা ভেবে তার বুক কেঁপে উঠল। চোখের কোনে একটুখানি পানিও জমা হয়েছে। সুরাইয়া বাথরুম থেকে বেরিয়ে ফাবিহাকে দেখেই তেতে উঠলেন।
“এখানে কেন এসেছে এই মেয়ে? যাও এখান থেকে।”

ফাবিহা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। তার মস্তিষ্কে কোন কথাই ঢুকছে না। এক নাগাড়ে সুরাইয়া কথা শুনিয়েই যাচ্ছেন।

বাড়ি ফিরলো অশান্ত মন নিয়ে। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। মাথা ঝিমঝিম করছে। কিছুই ভালোলাগছে না। শাবাবের কথা মাথা থেকে সরছেই না।

#চলবে……

এক টুকরো আলো পর্ব-৩১+৩২

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩১
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

নিশিকে ফোন করলো ফাবিহা। কথার এক পর্যায়ে জানতে পারলো নিশির বিয়ে। কিন্তু কিছুতেই এত তাড়াতাড়ি বিয়ের কারণ জানতে পারলো না ফাবিহা। নিশি বলল ফ্যামিলি জোর করে বিয়ে দিচ্ছে।
ফাবিহা ঠিক করলো অন্যদিন নয়, ক্লাস শেষে আজই খালার বাড়ি যাবে।

হলোও তাই। সাজেদা আসবাবপত্রের ধূলোময়লা পরিষ্কার করছেন। পেছন থেকে শুনতে পেল,“খালা কেমন আছো?”

সাজেদা ফাবিহাকে দেখে একটু অবাক হলেন। নিশির কাছে শুনেছিল তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বিয়ের পর এভাবে আসবে তিনি ভাবতে পারেননি। হেসে বললেন,“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”

নিভে এলো ফাবিহা। মুখ ছোটো করে বলল,“এই তো ভালোই আছি।”

“তোর মা আর বাবা কেমন আছেরে?”

“ভালো। শুনলাম নিশির নাকি বিয়ে ঠিক করেছো?”

সাজেদার মুখের হাসি মলিন হয়ে গেল।
“হ্যাঁ।”

“ও তো ছোটো এখনো।”

“১৮ তো হয়েছে।”

“তবুও খালা।”

“ওর ভালোর জন্যই আমরা বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পড়াশোনাও ভালো না। আর বসিয়ে রেখে কী লাভ?”

ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“ভাবি কোথায়?”

“আছে ঘরে। এতক্ষণ কাজ করছিল।”

“আমি তাহলে দেখা করে আসি।”

“তাসিন আছে ঘরে। আমি বরং ডেকে দিচ্ছি।”

ফাবিহা মাথা নাড়লো।

সাজেদা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হুরাইনকে ডাকলেন। জলদি ঠিক হয়ে বসলো হুরাইন। মাথায় কাপড় দিয়ে বেরিয়ে আসলো।
“জি আম্মা।”

“ফাবিহা এসেছে। ডাকছে তোমায়।”

হুরাইন এসেই হাসিমুখে সালাম দিলো। ফাবিহাও হাসিমুখে সালামের জবাব দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হুরাইনকে জড়িয়ে ধরতেই দেখলো তাসিন ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। তার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছিস?”

ফাবিহা মনে অনেকটা কষ্ট পেল। সে কি এতটাই খা*রা*প হয়ে গিয়েছে? তাসিন তার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। সেও কোনোভাবে বলল,“ভালো। তুমি কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ। আমি বের হচ্ছি হুরাইন। কিছু লাগবে তোমার?”

“না।”

ফাবিহা খেয়াল করলো তাসিনের আগে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল। এখন তারচেয়েও লম্বা দেখাচ্ছে। ফাবিহার দিকে চোখেচোখে না তাকানোর কারণটা ভিন্ন। ফাবিহাও তার জন্য পরনারী। অথচ ফাবিহার বুঝার ভুল। সে ভাবলো তাসিন অন্য কোনো কারণে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
হুরাইন ফাবিহাকে বসিয়ে বলল,“আপনি বসুন আপু। আমি একটু আসছি।”

হুরাইনের মতিগতি বুঝতে পেরে ফাবিহা ওর হাত চেপে বলল,“তুমি চুপচাপ বসো তো। আমি এই বাড়ির মেহমান না যে এখন আমাকে আপ্যায়নের জন্য নাস্তা লাগবে।”

সাজেদা রান্নাঘর থেকে বললেন,“তোরা কথা বল। আমি আসছি।”

ফাবিহা হাসিমুখে বলল,“বাবু কেমন আছে?”

হুরাইনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মৃদু হেসে বলল,“আলহামদুলিল্লাহ।”

“আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম বাবু আসার কথা শুনে।”

হুরাইন মিটিমিটি হেসে বলল,“আমরা খুশি হচ্ছি কবে?”

ফাবিহা ধপ করে নিভে গেল। বুক চিড়ে বেরয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। বলল,“ডি*ভো*র্স হয়ে গিয়েছে।”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল হুরাইন।
“বলেন কী আপু? বিয়ের কত মাস হলো? কীভাবে হলো এসব?”

ফাবিহা বিস্তারিত বলল। কীভাবে তাদের বিয়ে হয়েছে, কতদিন শশুর বাড়ি ছিল। বলতে বলতে ততক্ষণে সাজেদাও এসে পড়েছেন। সব শুনে তিনিও বিস্মিত, ব্যথিত হলেন। নিজেকেও আবার দোষারোপ করা শুরু করলেন। ছেলেকে বিয়ে করাবেন কথা দিয়েও তিনি কথা রাখতে পারেননি। হুরাইন বলল,“বিয়ের আগের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আপনাদের সংসারে অনীহা? দুজনে বসে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলতে পারতেন।”

ফাবিহা বলল,“তোমার কাছে সবকিছু যতটা সহজ মনে হয়, বিষয়টা ততটা সহজ ছিল না।”

“তবুও আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার স্বামী অনুতপ্ত ছিলেন নিজের কাজ নিয়ে।”

“ তবুও আমি ওকে ক্ষমা করতে পারছি না। ওকে দেখলেই আমার আগের সবকিছু মনে পড়ে যায়।”

“আপনি বলেছেন ওনাকে জে*লেও পাঠিয়েছেন। অনেকটা শা*স্তি তো আপনি সেখানেই দিয়েছেন। আমি বলছি না আপনি তাঁকে জে*লে পাঠিয়ে ভুল কাজ করেছেন। এরপর বিয়ে যেহেতু হয়েছে একবার দু’জনে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে পারতেন। পাহাড়সম পাপ নিয়ে তওবা করলে, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করলে তিনিও মাফ করে দেন। আপনিও ক্ষমা করে একটা সুযোগ দিতে পারতেন।”

ফাবিহা অস্থির হয়ে বলল,“কীভাবে আমি ক্ষ*মা করতাম?”

“উনি অন্যায় করেছেন। আপনিও যথেষ্ট শা*স্তি দিয়েছেন। বিয়েরদিন মাথাও ফাটিয়ে দিয়েছেন। উনি যখন আপনার সাথে খা*রা*প আচরণ করতেন, তখন কি আপনি চুপ থাকতেন?”

“কেন আমি চুপ থাকবো?”

হুরাইন শান্ত গলায় বলল,“শান্ত হোন আপু।”

ফাবিহা শান্ত হয়ে বসল। হুরাইন বলল,“এখন জীবন নিয়ে কী ভেবেছেন?”

“আর কোনোদিন বিয়েই করবো না। একাই কাটিয়ে দেব।”

“এটা খুবই কঠিন। যদি সন্তান থাকতো, তাহলে কিছুটা হলেও সহজ হতো। একা একা জীবন পার করতে গেলে মানুষ আপনার কাছ থেকে সুযোগ নিতে চাইবে। বে*হা*য়া পুরুষেরা বা*জে ইঙ্গিত দিতেও পিছপা হবে না।”

ফাবিহা মাথানিচু করে বলল,“জীবন নিয়ে আমার আর কোনো শখ, আহ্লাদ নেই। যত তাড়াতাড়ি ম*র*তে পারবো, তত তাড়াতাড়ি শান্তি।”

হুরাইন আলতো হেসে বলল,“মৃ*ত্যু*র পর যে শান্তি পাওয়ার আশা করছেন, তার কাজ কতটুকু এগিয়ে যাচ্ছেন?”

ফাবিহা থমকে গেল। আসলেই তো। কিছুই তো করেনি। তাহলে ম*রা*র পর শান্তির আশা করছে কীভাবে? হুরাইন আবারও হেসে বলল,“মৃ*ত্যু সহজ নয় আপু। নিজের মৃ*ত্যু কামনা না করে পরকালের জন্য কিছু করার চেষ্টা করুন। আমি যদি বলি এভাবে চুল খোলা রেখে, পর্দাহীন ভাবে চলাফেরা করাও ইভ*টিজিং এর একটা বড়ো কারণ? আমাদের এলাকায় নাম করা কিছু বখাটে আছে। যারা অন্যান্য মেয়েদের উ*ত্য*ক্ত করলেও পর্দা মেনে চলা মেয়েদের দেখলে দৃষ্টি সরিয়ে নিত। আমার রোজ যাতায়াত ছিলো তাঁদের ঘাটির সামনে দিয়ে। অথচ আমাকে বা আমার বান্ধবীদের উত্যক্ত করার সাহস তাঁরা পায়নি। আপনার ভাইয়ের কথাই বলি। তিনি কেন আমাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন? অন্য কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে নিশ্চয়ই প্রেমের প্রস্তাব দিতো। তাহলে আমার বাবার কাছে কেন বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো?”

ফাবিহা বলল,“কারণ সে জানে তুমি প্রেমের সম্পর্কে জড়াবে না।”

হুরাইন মৃদু হেসে বলল,“আমিও সেটাই বোঝাতে চাচ্ছি। আমি যদি পর্দাহীন চলাফেরা করতাম, উনি আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতেন। রাজি না হলে পেছনে পড়ে থাকতেন। বারবার নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতেন। দেখা গেল একদিন তুলে নিয়ে যাওয়ারও সাহস করতেন।”

“তুমি বলতে চাইছো শাবাবের কোনো দোষ নেই? আমার কারণেই আমি উ*ত্য*ক্ত হয়েছি?”

“না। আপনি মেয়ে বলে দো*ষ আপনার, ছেলে মানেই সা*ত*খু*ন মাফ। সেটা আমি বলিনি। চরিত্র এমন একটি দিক, যা মানুষ নিজে কন্ট্রোল করতে পারে। সবকিছু হাতের মুঠো থাকার পরও তিনি বি*প*থে চলেছেন। এখন যেহেতু সুপথে আসতে চাচ্ছেন, আপনার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।”

“তুমি তাসিন ভাইকে শুদ্ধ পুরুষ পেয়ে গিয়েছো হুরাইন। তাই এসব সহজে বলে দিতে পারছো।”

হুরাইনের ঠোঁটের কোনে হাসি। ফাবিহা তো ঠিকই বলেছে। ফাবিহার দৃষ্টিতে তাসিন একেবারে শুদ্ধ পুরুষ। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ইসলামের চোখে শুদ্ধ পুরুষের সংজ্ঞা ভিন্ন।
ফাবিহা আবার বলল,“বাদ দাও এসব কথা। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। নিশিকে তো দেখছি না।”

সাজেদা বললেন,“আছে ঘরে।”

“আমার কথা শুনে তো এতক্ষণে এসে পড়ার কথা।”

“হয়তো তুই এসে দেখা না করায় রাগ করেছে তোর সাথে।”

“আমি যাচ্ছি ওর কাছে।”

ফাবিহা উঠে চলে গেল। সাজেদা এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলেন তার যাওয়ার পানে। হুরাইন তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল,“আপনার কি এখনো আফসোস হয় আম্মা? আমি কি সত্যিই আপনার চোখে আপনার ছেলের যোগ্য নই?”

সাজেদা দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন,“আল্লাহ যা চান, তা কেউ খণ্ডাতে পারে না। তবে মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে আমার কষ্ট হয়।”

★★★

“কীরে শুয়ে আছিস কেন?”

“তুমি এসেছো কেন এখন? মন ভরেনি তোমার ভাবির সাথে কথা বলে? এখন আমার সাথেও কথা বলা লাগবে?”

ফাবিহা ভ্রু কুঁচকে বলল,“রাগ করছিস কেন?”

“তো নাচবো?”

“না, থাক। এখন বল বিয়ে এত দ্রুত কেন দিচ্ছে? খালাও কিছু বলছেন না, তুইও না।”

নিশি থতমত খেয়ে বলল,“এমনি, আমি শিওর ভাবি মা-বাবা আর ভাইয়ার মাথায় এসব ভূত চাপিয়েছে। নিজে কম বয়সে বিয়ে করছে, এখন আমাকেও পার করতে চাইছে।”

ফাবিহা তাদের পারিবারিক কথায় নাক গলানোর চেষ্টা করলো না। দুজনের অনেকদিন পর অনেক কথা হলো।

উঠে এসে হুরাইন আর সাজেদাকে বলল,“আজ আসছি।”

হুরাইন বলল,“আজ এখানে থাকবেন আপনি। কোনো বাঁধা শুনছি না।”

“না না, অন্যদিন আসবো।”

সাজেদা বললেন,“ সে কি? তুই থাকবি বলে হুরাইন রাতের রান্নার জোগাড় করে ফেলেছে।”

“মা জানলে বকবে।”

“বল বান্ধবীদের বাড়ি আছিস।”

“মা পরে জানতে পারলে…

“এক সময় তো জানবেই। আজ থাক।”

হুরাইন বলল,“মিথ্যা না বলে সত্যিটা বলেই দিন। কতদিন আর রাগ করে থাকবেন?”

“না, আমি বরং চলে যাচ্ছি।”

ফাবিহাকে জোর করেও আটকানো গেল না। সে চলে গেল।

★★★

শাবাব হাসপাতালে আর বাড়িতে যাতায়াত করছে। ভাঙা হাত নিয়েও মায়ের কী কী লাগে, সব কিনে এনে দিচ্ছে।

সুরাইয়া ছেলের একটুখানি হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,“তোকে আমি একটা শান্তশিষ্ট মেয়ে বিয়ে করাবো। ওই মেয়ের কথা ভুলে যা।”

শাবাব হেসে বলল,“তুমি এসব কথা কেন বলছো? আমি ওর কথা মনে করছি না। আমাদের দুজনেরই সিদ্ধান্ত ছিল এটা।”

“আমাকে শেখাচ্ছিস? তাহলে এত নাটক করে বিয়েশাদির কী দরকার ছিল?”

শাবাব চুপ করে আছে। ফাবিহাকে মনে করছে না বললেও মনে পড়ে যাচ্ছে।

★★★

ফাবিহা বাড়ি থেকে বের হলো। কয়েকজন তাকে নিয়ে কানাকানি করছে।
ফাবিহা চুপচাপ হেঁটে চলে গেল। অনেকদিন পর সুমন সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখে হাসছে। ফাবিহা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। সুমন বলল,“শুনলাম শাবাব ছেড়ে দিয়েছে! এখন আর তার মধু ভালোলাগে না? তাহলে আমাকে সুযোগ দিয়ে দেখো।”

ফাবিহার রাগ বাড়ছে। তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করে হেঁটে চলে যাওয়ার চেষ্টা করল। সুমন বলল,“যাবে নাকি আজ রা*তে আমার বাসায়? শাবাবের চেয়ে আমার টাকা বেশি আছে।”

এবার পেছনে হেঁটে এলো ফাবিহা। পা থেকে জুতা খুলে ঠা*স করে একটা মা*রা*র পরই অপমানে সুমন ওর হাত চেপে ধরলো।
“*******, আজ তোর এই তেজ আমি কমিয়েই ছাড়বো। শাবাবের জন্য নয়, তোর এই তেজের কারণেই তুই আমার নজরে পড়েছিস। শাবাবের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে ভেবে ভাবলাম ছেড়ে দেই। শাবাব আমার কাছে এসে নত হয়েছে বলেই তোকে ছেড়েছি।
এবার আর ছাড়বো না। কারণ শাবাবের সাথে তোর আর লেনাদেনা নেই।”

ফাবিহা হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলো। পেরে উঠলো না। ফরহাদ কোথা থেকে দৌড়ে এসে বলল,“কী হচ্ছে এসব? ভাইয়ের সাথে আপনার কী কথা হয়েছিল? ভাবির হাত ছাড়েন।”

সুমন বলল,“চুপচাপ এখান থেকে যা। কে তোর ভাবি? শাবাব ওকে ছেড়ে দিয়েছে। ও এখন আর তোর ভাবি নেই।”

ফারহাদ ওর হাত থেকে ফাবিহার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,“ভাবি আপনি যান।”

বুক ধুকপুক করছে ফাবিহার। সুমন গর্জে উঠে আবার ফাবিহাকে খপ করে ধরতে গেল। ফরহার ঝাপটে ধরলো সুমনকে। ফাবিহাকে বলল,“যান ভাবি।”

ফাবিহা কোনো কিছু না ভেবেই ছুটে স্থান ত্যাগ করলো। আর ক্লাসের উদ্দেশ্যে না গিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটলো। তার চোখেমুখে আতঙ্ক।

সুমন আর ফারহাদের হাতাহাতি লাগলো।

বাড়ি ফিরে ঘরে একা একা কান্নায় ভেঙে পড়লো ফাবিহা। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ মনে পড়লো সুমনের কথা। শাবাব তার কাছে নত হয়েছিল বলেই সে এতদিন ফাবিহাকে কিছু করেনি। শাবাব কি সত্যিই নিজের কাজে অনুতপ্ত? এতদিন পর আজ প্রথম শাবাবের ব্যাপার তাকে ভাবাচ্ছে।

#চলবে………

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সাদামাটা আয়োজনে বিয়ে হয়ে গেল নিশির। ফাবিহাও বিয়েতে এসেছে।
বোরকা পরিয়ে কেন নিয়ে যাওয়া হবে? এটা নিয়েও মা আর ভাবির সাথে হম্বিতম্বি করেছে নিশি। বোরকা পরানোর পর আগে আগে ধপধপ করে হেঁটে গেল। মায়ের কাছ থেকেও বিদায় নিলো না। মেয়ের এমন উ*গ্র আচরণে সাজেদা আতঙ্কে আছেন। আবার কী গণ্ডগোল বাঁধিয়ে বসে!

ফাবিহা নিজের বিয়ের কথা মনে করলো। কেমন পরিস্থিতিতে তার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর রা*গ দমন করতে না পেরে কী করেছিল। এটা নিয়ে শাবাব কিছুই বলেনি তাকে। সবকিছুতেই শাবাবকে পাল্টা জবাব দিয়েছে সে। কিছু কিছু সময় চুপ থেকেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো গোপনে।
নিশিকে বিদায় দেওয়ার পরই বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। সাজেদার বুক হাহাকার করে উঠছে মেয়ের জন্য। মনমরা হয়ে আছেন। হুরাইন তাঁর ঘাড়ে হাত রেখে বলল,“আপুকে নিয়ে চিন্তা করবেন না আম্মা। ইনশাআল্লাহ ধীরে ধীরে সবটা মানিয়ে নেবেন।”

ফাবিহা আজ থেকে গেল। মাকে সত্যটা বলেই এসেছে এখানে। তিনি আসতেই দিচ্ছিলেন না। তবুও জোরপূর্বক সে এসেছে। সাজেদা ফোন করে দাওয়াত দিয়েছেন নিজের দিকের সবাইকে। ফাবিহার মা-বাবাকেও। তাঁরা কেউই রাগ থেকে আসেননি। হয়তো-বা তিনি নিজে গিয়ে দাওয়াত দিলে আসার সম্ভাবনা ১ শতাংশ হলেও থাকতো। হুরাইন বলেছিল শাশুড়ি যেন নিজে গিয়ে সবটা মিটমাট করে আসেন। সাজেদা বলেছিলেন “ফাবিহার কথা শোনার পর থেকে নিজেকে এখন আরো অপরাধী মনে হয়। কীভাবে আমি তাদের মুখোমুখি হবো?”

রাতের খাবারের সময় হুরাইন সবাইকে ডাকলো। ফাবিহাকে ডাকতে গিয়ে দেখলো সে উদাস হয়ে বসে আছে। হুরাইন ডাকছে, অথচ সে অন্যমনষ্ক।
মৃদু ধাক্কা দিলো হুরাইন। চমক কাটতেই ফাবিহা জিজ্ঞেস করল,“কী হয়েছে?”

“খেতে ডাকছি আপু।”

“ওহ্, আসছি। তুমি যাও।”

হুরাইন দরজা পর্যন্ত গিয়েও আবার ফিরে তাকালো। জিজ্ঞেস করল,“একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল আপু। জিজ্ঞেস করবো?”

“করো।”

“আপনি কী নিয়ে এতটা মনমরা হয়ে আছেন? সেদিনও আসার পর আপনার চোখমুখ মলিন দেখালো। আজও পুরো দিন একইরকম।”

ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,“সেটা তুমি বুঝবে না। যার জীবনে ঝড় বয়ে যায়, সেই বুঝে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।”

হুরাইন বলল,“খেতে আসুন। খাওয়ার পর আপনার কাছে গল্প শুনবো। আপনার জীবনের গল্প। আবার আমার গল্পও শোনাবো।”

ফাবিহা অবাকতার সুরে বলল,“তোমারও গল্প আছে?”

হুরাইন কেবল মুচকি হাসলো। খাওয়াদাওয়ার পর তাসিনের কাছ থেকে এক ঘন্টার সময় নিয়ে ফাবিহার ঘরে চলে এলো হুরাইন। তাকে দেখে ফাবিহা হেসে ফেলে বলল,“ছুটি পেয়েছো তবে।”

“হ্যাঁ।”

“বসো।”

হুরাইন কম্বলের নিচে পা ঢুকিয়ে বসে পড়লো। ফাবিহা বলল,“আউচ, তোমার পা দুটো কী বরফ।”

হুরাইন হেসে ফেললো। বলল,“এবার সত্যি সত্যি বলবেন আপু। কেন এত আপসেট থাকেন আপনি? কাউকে এমন দেখতে আমার ভালোলাগে না।”

ফাবিহা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো হুরাইনের মুখের দিকে। মলিন হেসে বলল,“জানো আমি ভাবতাম সুন্দরী হলেই জীবনে আর কিছুর প্রয়োজন হয় না। সুখ আপনা-আপনি এসে ধরা দেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। আমি মানসিকভাবে দুর্বল হতে থাকলাম। কিছুতেই আর আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারছি না। প্রথমে বিয়ে ভাঙলো। এরমাঝে শাবাবের যন্ত্রণা, বিরক্ত করা থেমে নেই। আমিও অতিষ্ঠ হয়ে ওকে আ*ঘা*ত করেছি। কথা দিয়ে বা হাত দিয়ে। ওকে দমনের নানা চেষ্টা করে ওকে থা*না*য় পাঠানোর পর মনে হলো বাঁচতে পেরেছি। এরপর আমাকে দেখতে এলো। সব ঠিকঠাক থাকার পরও বিয়ে ভেঙে গেল। তারপর জানতে পারলাম শাবাব রয়েছে এর পেছনে। এরপর ও আমার সবগুলো বিয়ে ভাঙে। কিছুদিনের জন্য আমি ফুফুর কাছে চলে গেলাম। সেখান থেকে আসার পর ও যা করেছে, এরপর তো বিয়েই হয়ে গেল। ও আমার বাবাকেও অসম্মান করেছে। ওর বিয়ে ভাঙার কারণে এলাকায় আমি টিকতে পারছিলাম না। লোকে আমায় দেখলেই নানা কথা বলে। বাবা বের হলেই বাবাকে বলে। বিয়ের দু’দিনের মাথায় শাবাবের কী হলো জানি না। আমাকে সরি বলল। আমি শুধু চেয়েছিলাম সম্পর্কটা থেকে মুক্ত হতে। আমার কথা ও মেনেও নিলো। পরদিনই পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে যেতে দিলো।
ওর আর ওর বাবার এক্সি*ডেন্টের পর আমি যখন যাই, তখন জানতে পারি ওর বাবা সেদিন আমার কারণেই ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। যেহেতু আমাদের শুধু ধর্মীয় ভাবেই বিয়ে হয়েছিল, তাই আর ডিভোর্স পেপার নিয়ে আমরা কেউ মাথা ঘামাইনি। এক্সি*ডেন্টের দিন ওদের আত্মীয়স্বজনরা আমাকে ওখানে থাকার জন্য চাপাচাপি করলেন। তারপর আমিও থেকে গেলাম। ওদের পাশে থাকা হলেও আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল শাবাবের মুখ দিয়ে তা*লা*ক শব্দটা বের করা। দুদিন পর ওকে আমি ওকে চাপ দিয়ে ওর বাবা-মা আর আমার বাবার সামনে তা*লা*ক নিয়েছিলাম। এরপর বাড়ি আসলাম। শাবাব আমাকে ছাড় দিলেও সমাজ দিলো না। তারা আগের চেয়ে আরো হিং*স্র হয়ে উঠলো। আরেকটা কথা তো বলতেই ভুলে গেলাম। ভার্সিটিতে শাবাবের শ*ত্রু পক্ষের আরেকজন আছে। যে শাবাবের চেয়ে খা*রা*প। সে আমাকে বিরক্ত করার পাশাপাশি দুইবার রে*প করার চেষ্টায় নেমেছিল। প্রথমবার শাবাবের বাবা আমাকে বাঁচিয়েন। আর সেদিন শাবাবের সাথের একটা ছেলে। তাহলে বলো, এতকিছুর পর আমি কীভাবে স্বাভাবিক থাকি? কীভাবে হাসিমুখে নিয়ে ঘুরি? যেখানে আমার জীবনের ৯০ শতাংশ সমস্যার কারণ শাবাব, সেখানে তাকে ক্ষমা করে দিয়ে কীভাবে সংসার করি?”

হুরাইন মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল,“আপনার সাথে যা হয়েছে, তা সত্যিই অনেক বেদনাদায়ক আর লোমহর্ষক। এখনো আপনি সব সমস্যা কাটিয়ে উঠেননি। সমাজের, তারপর সুমন নাকি কী যেন বললেন! সেই লোকটা তো একেবারে ডেঞ্জা*রাস। আপনি তো সেদিন এতটা বিস্তারিত কিছু বলেননি। আমার মনে হয় আপনার উচিত হবে এখন ভার্সিটিতে না যাওয়া।”

“যাচ্ছি না ওই ঘটনার পর।”

“এই যে এত এত সমস্যা, সব দূর হয়ে যাবে। আল্লাহকে ডাকুন আপু। নামাজ পড়ুন, কুরআন পড়ুন, পর্দা মেনে চলুন। জীবন থেকে সব সমস্যা এমনভাবে দূর হয়ে যাবে, আপনি টেরও পাবেন না। আল্লাহর কাছে সব আছে। শুধু আমরা মানুষেরা তাঁর কাছে চাই না। আমাদের বিয়ের একমাস পেরোনোর পর আমি নিজের জীবনে, সংসার জীবনে অশান্তি দেখলাম। আমার পক্ষে সংসারে মন দেওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। আমার স্বামীর চলাফেরা কিছুতেই আমার সাথে মিলছিলো না। পরনারীর সাথে কথা বলা যেখানে জায়েজ নেই, সেখানে তিনি মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব রাখতেন। নামাজ নেই, হা*রা*মে লিপ্ত থাকতেন। আমি শুধু আল্লাহর কাছে কেঁদেছি। প্রয়োজনে ওনার সাথে কঠোর হয়েছি। তারপর একদিন আল্লাহর রহমতে তিনি হেদায়াতের পথে হাঁটলেন। যখন দেখলাম তিনি অনুতপ্ত, সঠিক পথে আসতে চায় তখন আমিও তাকে একটা সুযোগ দিলাম। এখন পর্যন্ত সে দ্বীনের পথে হাঁটার চেষ্টা করছে। যদি কোনোদিন আবার সে এই পথ থেকে সরে যায়, আমি তাকে আবার রবের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করবো। আমরা চাইলেই কাউকে হেদায়াত দিতে পারি না। আল্লাহ যাকে হেদায়াত দেন, তাকে সুযোগ দেওয়া উচিত। যদি সে সুযোগ না পেয়ে পূর্বের পথে ফিরে যায়, তখন বড়ো গলা করে সে কারণ দেখাতে পারবে “আমি ফেরার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কেউ আমাকে সুযোগ দেয়নি”।
হয়তো আমার কথাগুলো আপনার খা*রা*প লাগছে! আপনি ভাবছেন আপনি পর্দা মেনে চলছেন না বলে আমি ভাবছি আপনি খা*রা*প মেয়ে। না, আপনি খা*রা*প মেয়ে নন। এটা সাময়িক একটা ভুল আপনার। নিজেকে পরিবর্তনের এখনো সুযোগ আছ। আপনি খুবই দামী। তাই নিজেকে আবৃত রাখুন।”

ফাবিহা চুপ করে আছে। তাসিনের মত পুরুষকে পেয়েও হুরাইন সংসারে সন্তুষ্ট ছিল না শুনে অবাক হলো সে। হুরাইন বলল,“আপনাদের কি তিন তা*লা*ক হয়ে গিয়েছে?”

“মানে?”
বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ফাবিহা। হুরাইন বলল,“শরিয়া মোতাবেক তিন তুহুরে তিন তা*লা*ক দিলেই সম্পূর্ণ বিবাহবিচ্ছেদ হয়। যদি এক তা*লা*ক বা দুই তা*লা*ক হয় তবে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে স্বামী-স্ত্রী দুজন আবার এক হতে পারেন। এটা দুজনের মনোমালিন্য দূর করার একটা সুযোগ। দুইবার এই সুযোগ পাওয়া গেলেও তৃতীয়বার আর কোনো সুযোগ থাকে না। আপনার জন্য সহজ করে বলি। যদি তিনবার তা*লা*ক বলা হয়ে যায়, তাহলে আর সুযোগ থাকবে না।”

ফাবিহা চিন্তিত স্বরে বলল,“শাবাব তো এভাবে কিছুই বলেনি, তাহলে কি তিন তা*লা*ক হয়নি?”

“তাহলে আপনার স্বামী চাইলেই তিনমাসের মধ্যে আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। আর আমি বলি কি, সমাজ আর ওই ছেলেটার আ*ত*ঙ্ক থেকে বাঁচতে হলেও আপনার একবার আপনার স্বামীকে সুযোগ দেওয়া উচিত।”

ফাবিহা চিন্তিত স্বরে বসে রইল। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ায় হুরাইন ঘরে চলে গেল। ফাবিহা ঘুরেফিরে একটা বিষয় নিয়েই পড়ে রইলো। চিন্তা বেড়ে গেল তার। ঘুমাতে হলো গভীর রাত।
ফজরের সময় চোখের পাতা ভারী হয়ে আছে। গভীর নিদ্রায় ডুবে আছে সে। কানের কাছে স্পষ্ট কারো ডাক ভেসে আসছে।
হুরাইন ফাবিহাকে ফজরের জন্য ডাকছে। অনেকক্ষণ থম ধরে শুয়ে থাকার পরও হুরাইন যাচ্ছে না। নাছোড়বান্দার মত ডেকেই যাচ্ছে। ফাবিহা বিরক্ত হয়ে বলল,“এখন যাও, কাল থেকে পড়বো।”

হুরাইন বলল,“এই মুহূর্তে ম*রে গেলে পরের ওয়াক্ত পড়ার সময় পাবেন না। কাল তো বহুদূর। এই অবস্থায় ম*র*তে চান আপনি?”

ফাবিহার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। ভয় ঢুকলো মনে। আর শুয়ে থাকলো না। ঝট করে কম্বল সরিয়ে উঠে পড়লো। হুরাইন চমৎকার হাসলো।
ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওজু করতে কষ্ট হয়েছে। তবুও ভালোলাগছে। আজ অনভিজ্ঞ দু’হাত তুললো আল্লাহর কাছে। তিনিই সঠিক পথ দেখাবেন।

★★★

বিয়ের দুদিন পর বাবার বাড়ি এসেই নিশির কান্নাকাটি। ওখানের কিছুই তার ভালোলাগছে না। সকালে ঘুমাতে পারে না। খেতে গেলেও সমস্যা। তারা চার জা মিলে এক থালায় খাবার খায়। এতে ওর ঘৃ*ণা হয়। সব অসহ্য লাগে। কীভাবে খায়? যদিও এটা বাধ্যতামূলক না। ও চাইলেই আলাদা খেতে পারে। কিন্তু নতুন বউ বলে কিছু বলতেও পারে না।

ফাবিহা এখন নামাজ পড়ার চেষ্টা করে। পাঁচ ওয়াক্ত পড়তে না পারলেও প্রতিদিন পড়ার চেষ্টা করে। অভ্যাস ধরে রাখার চেষ্টা করে। দুনিয়ার সব চিন্তাভাবনা একপাশে রেখে যখন আল্লাহকে ডাকে, তখন মনে হয় কোনো অশান্তি তার জীবনে নেই। মনে শান্তি অনুভব হয়।

★★★

দেখতে দেখতে দেড়মাস হয়ে গেলেও শাবাবের কাছে সময়টা অনেক বেশিই মনে হচ্ছে। হাতের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে। বাসায় বাবা অসুস্থ। সে অফিস সামলাচ্ছে। মাঝখানে সবকিছু তাদের অসুস্থতার কারণে থেমে ছিল। ফরহাদকে কল দিল।
“ফাবিহা কি ভার্সিটিতে আসে?”

“না ভাই। সেদিনের পর থেকে আর আসেনি।”

শাবাব ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো।
“ঠিক আছে। এখন না আসলেই ভালো। যদি কোনো সমস্যা হয় আমাকে জানাবি। আমার কারণেই তো ওর জীবনে এত সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।”

ফরহাদ ভীত গলায় বলল,“ভাই, আপনি মনে হয় ভাবিরে সত্যি ভালোবাইসা ফালাইছেন!”

শাবাব চোয়াল শক্ত করে বলল,“আমি এসব করছি দায় থেকে। যেহেতু আমার জন্যই ও সুমনের নজরে পড়েছে।”

ফরহাদ নিভে গিয়ে বলল,“আপনি ওরে কিছু করছেন না কেন?”

“তখন তো অসুস্থ ছিলাম। আর এখন তো ওকে ধরার সুযোগই পাচ্ছি না। একবার ধরতে পারলে মে*রে*ই ফেলবো।”
বলতে গিয়ে কপালের রগ দপদপ করে উঠলো শাবাবের। অতঃপর নিজেকে শান্ত করে ইতস্তত করে বলল,“একটা কাজ করতে পারবি ফরহাদ?”

“আপনি শুধু বলেন ভাই।”

শাবাব ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,“একবার খোঁজ নিয়ে দেখবি ফাবিহার কি বিয়ে হয়ে গিয়েছে? মানে আমার জন্য তো বারবার ওর বিয়ে ভেঙে গিয়েছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।”

ফরহাদ মিনমিন করে বলল,“ভাই আমার মনে হয় আপনি গিয়ে নিজ চোখে দেখে এলে ভালো হবে। ভাবি যদি নতুন সংসারে সুখী থাকে, তাহলে আপনার অপরাধবোধও কিছুটা কমবে।”

শাবাব অশান্ত গলায় বলল,“না থাক।”

না থাক বলেও শাবাব রাতে গাড়ি নিয়ে বের হলো। মন উশখুশ করছে। ফাবিহা কি সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিয়েছে? ফাবিহার বাড়ির রাস্তায় এসে দাঁড়ানোর সাহস করলো না। আবারও ফিরে গেল। যদি সত্যি ফাবিহা বিয়ে করে থাকে আর সাথে যদি তার হাজবেন্ড থাকে? এটা অন্তত মন সইবে না।

#চলবে….

এক টুকরো আলো পর্ব-২৯+৩০

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সকাল থেকে পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে। সাজেদাকে জানায়নি হুরাইন। ব্যথা তেমন তীব্র নয়। তবুও ক্ষণে ক্ষণে চোখমুখ মলিন হয়ে বিষিয়ে ওঠে। সাজেদা জহুরি নজরে পরোখ করে জিজ্ঞেস করলেন,“কী হয়েছে তোমার?”

“পেট ব্যথা আম্মা।”

সাজেদা ধমকে উঠে বললেন,“আমাকে জানাওনি কেন? পরে দোষারোপ করার জন্য?”

হুরাইন বলল,“ব্যথা সহ্য করার মত। সেজন্যই জানাইনি আম্মা।”

“তুমি এসবের কী বুঝো? র*ক্ত*ক্ষ*র*ণ হয়?”

“না।”

“যাও বোরকা পরো গিয়ে।”

হুরাইন জিজ্ঞেস করলো,“কেন আম্মা?”

“ডাক্তারের কাছে যাবো।”

“কিন্তু আম্মা…

সাজেদা বিরক্ত হয়ে বললেন,“কথা বাড়িয়ো না। সব সময় তুমি নিজের কথা উপরে রাখার চেষ্টা করো।”

হুরাইন মিনমিন করে বলল,“আম্মা রান্না?”

“রান্না বাকিটা নিশি এসে করে নেবে।”

রান্না শেষের পথে। নিশিরও আসার সময় হয়েছে। তাই সাজেদা তাড়া দিলেন হুরাইনকে। ঝটপট বোরকা পরে বেরিয়ে এসে শাশুড়িকেও তৈরি দেখলো হুরাইন।

ঘরে ঢুকলো নিশি। তাকে রান্না নামানোর কথা বলে হুরাইনকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন সাজেদা। দুজন সিএনজিতে উঠে বসলেন। তাসিনকে কল দিলেন তিনি।

“আসসালামু আলাইকুম মা। বলো।”

“আমার বিকাশে কিছু টাকা পাঠা। হুরাইনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।”

বিচলিত স্বর শোনা গেল তাসিনের।
“কী হয়েছে মা? সব ঠিক আছে? কোন ডাক্তারের কাছে নিচ্ছো? আমি আসছি।”

ধমক দিলেন সাজেদা।
“তোকে টাকা পাঠাতে বলেছি, টাকা পাঠা। বেশি বুঝিস না।”

হুরাইন পাশ থেকে মা-ছেলের ফোনালাপ শুনে হাসছে মুখ টিপে।
তাসিন নরম হয়ে এলো।
“পাঠাচ্ছি।”

কিছুদূর গিয়ে সিএনজি থেমে গেল। একজন ছেলে যাত্রী পেছনে হুরাইনের পাশে উঠতে নিলো। সাজেদা বাঁধা দিলেন।
“আরে আপনি কোথায় উঠছেন?”

ড্রাইভারকে বললেন,“আপনি লোক নিচ্ছেন কেন পেছনে? আমরা পুরো ভাড়া দেব।”

ড্রাইভার বললেন,“আপনি তো বলেননি আগে।”

“আমি ওঠার সময়ই বলেছি। আপনি খেয়াল করেননি।”

ড্রাইভার সামনে এগিয়ে গেল। হুরাইন স্বস্তির শ্বাস নিলো।
ডাক্তার দেখিয়ে রিপোর্টের জন্য বউ-শাশুড়ি বসে রইল। তাসিন কয়েকবার কল দিয়ে খবর নিয়েছে।
রিপোর্টে সব ঠিকঠাক আছে শুনে সাজেদা হাঁপ ছাড়লেন।
যাওয়ার পথে হুরাইনকে জিজ্ঞেস করলেন,“কিছু খেতে মন চায়? কী খাবে?”

“কিছু খাবো না আম্মা।”

“আরে বলো। এই সময় অনেককিছুই খেতে মন চায়।”

হুরাইন কাচুমাচু করে বলল,“চিপস খেতে মন চায় আম্মা।”

সাজেদা দ্বিরুক্তি না করে হুরাইনের জন্য অনেকগুলো চিপসের প্যাকেট কিনে নিলেন। সিএনজিতে উঠে বসতেই হুরাইন বলল, “আমার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে আপনি বোধহয় তাকে খুব আদর করতেন, তাই না আম্মা? ফাবিহা আপু থাকলে হয়তো আরো বেশি আদর করতেন।”

সাজেদা চুপ হয়ে গেলেন। হুরাইন আবারও বলল,“আমার কি দোষ আম্মা?”

সাজেদা মুখ খুললেন। থমথমে গলায় বললেন,“দোষ আমার কপালের।”

হুরাইন নিচু স্বরে বলল,“আমি ম*রে গেলে আপনার ছেলে যখন আরেকটা বউ নিয়ে আসবে, তাকে নিশ্চয়ই আদর করবেন। তার তো কোনো দোষ থাকবে না।”

“আল্লাহ মাফ করুন। কী আবোলতাবোল কথা বলছো?”

“মৃ*ত্যু তো যেকোনো সময়ই হতে পারে আম্মা।”

“গাড়িতে বেশি কথা বলা ভালো না। চুপচাপ বসে থাকো।”

হুরাইন চুপ করে গেল। সাজেদা যে নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছেন সেটা টের পেয়েই ভালোলাগছে তার। এই যে তাকে নিয়ে আজ এতটা উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করলেন, মায়া না থাকলে কি এতটুকু কেউ করে?

বাড়ি আসতেই নিশিকে গাল ফুলিয়ে থাকতে দেখা গেল। তার মেজাজ খা*রা*প হয়ে আছে। চুলার উপর রান্না বসানো ছিল। সেগুলো নামানো, রান্নাঘর পরিষ্কার, আরো কিছু কাজও তাকে করতে হয়েছে। সাজেদার সাথে কথা বলছে থমথমে গলায়। সাজেদা জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে?”

“কিছু না।”

“কাজ শিখতে হবে না? বিয়ে দিলে কী করবি? তোর ভাবি কি তোর চেয়ে বড়ো? তারও তো বিয়ে হয়েছে। এটুকু কাজেই এত গাল ফোলানো।”

“আমি এখন বিয়ে করছি না যে আমাকে সবকিছু শিখতে হবে।”
ধপধপ করে পা ফেলে চলে গেল সে। সাজেদা তাকিয়ে রইলেন কেবল।

হুরাইন কয়েক প্যাকেট চিপস নিয়ে গেল নিশির জন্য। নিশি রাখলো না। বলল,“আমি প্রেগন্যান্ট না। আপনি খান।”

হুরাইনকে সে যেহেতু পছন্দ করে না, তার দেওয়া জিনিস নেবে কেন? হুরাইন চিপস নিয়ে শাশুড়ির ঘরে বসলো। এক প্যাকেট খুলে শাশুড়ির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল,“আম্মা খান।”

সাজেদা বললেন,“তুমি খাও। আমি বাচ্চা না।”

হুরাইন বলল,“শুধু বাচ্চাদেরই এসব খেতে ইচ্ছে করে? বড়োদেরও তো খেতে ইচ্ছে করে। খেয়ে দেখুন।”

হুরাইনের জোরাজোরিতে সাজেদা চিপস মুখে দিলেন। ভালোলাগায় বললেন,“বেশ ভালোই তো লাগছে।”

তারপর দুজনে খেতে খেতে কথাবার্তা বলল। বলতে বলতে সাজেদা হেসে উঠছেন। আগে এভাবে সাজেদা হুরাইনের সাথে কথা বলেননি। আজ মনে হচ্ছে দুজনের সম্পর্ক খুব সহজ। হুরাইনকে তাকিয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে হাসি বন্ধ করে ফেললেন সাজেদা।

তাসিন অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ একটু জলদি করে ফিরলো। হুরাইন ইসলামিক বই পড়ছে। তাসিন হাতমুখ ধুয়ে পাশে বসে জিজ্ঞেস করল,“এখন পেট ব্যথা করে?”

বইয়ে চোখ রেখে হুরাইন জবাব দিলো,“না।”

“ঔষধ নিয়েছো দুপুরে?”

“হুম।”

“বই রাখো। আমার দিকে তাকাও।”

হুরাইন বই রেখে তাসিনের দিকে তাকালো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল,“তাকিয়েছি। কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।”

তাসিন রগঢ় করে বলল,“কী দেখতে চাইছো? শার্ট খুলতে হবে?”

হুরাইন চোখমুখ কুঁচকে বলল,“মোটেই না।”

তাসিন পেছনে এসে বসলো। হুরাইনের ঘাড়ে ঠেকলো তার চিবুক। হুরাইনের হাত থেমে গেল। স্থির হয়ে গেল সে। মুহূর্তের মাঝে চুম্বকের স্পর্শের মত ঠোঁটের ছোঁয়া লাগলো। সামান্য কেঁপে উঠলো সে। তাসিন সরে আসলো দ্রুত। নিচে চোখ যেতেই দেখতে পেল চিপসের প্যাকেট পড়ে আছে। প্যাকেট তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলো,“এগুলো কে ফেলেছে?”

হুরাইন জবাব দিল,“আমি।”

“এসব খাওয়া ভালো না। মুখের রুচি নষ্ট হয়। কে এনে দিয়েছে?”

হুরাইন নিষ্পাপ চাহনি দিয়ে বলল,“আম্মা কিনে দিয়েছে?”

তাসিন অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। মাথা কাত করে চোখের ইশারায় জানতে চাইলো,“সত্যি?”

“হুঁ।”

“বাহ্! শাশুড়িকে দেখছি ইমপ্রেস করে ফেলেছেন।”

হুরাইন ভাব নিয়ে বলল,“আমার সাথে থাকলে কেউ আমাকে আদর না করে থাকতেই পারবে না।”

তাসিন হাসলো। দুষ্টু হেসে বলল,“আমিও।”

হুরাইন লজ্জা পেয়ে কথা কাটানোর জন্য শাসনের সুরে বলল,“আপনি পড়া শেষ করেছেন?”

তাসিন চোখমুখ কুঁচকে বলল,“প্লিজ ম্যাম আমি এখন আপনার ছাত্র নই। এই মুহূর্তে আমি আপনার স্বামী।”

হুরাইন নাটকের সুরে বলল,“ম্যামকে বিয়ে করতে লজ্জা হলো না? আমার তো শুনেই লজ্জা পাচ্ছে।”

তাসিন অবাক হয়েও ক্ষণিকের মাঝে হেসে বলল,“আচ্ছা? লজ্জা হচ্ছে আপনার? আসলে ম্যাম এত সুন্দরী যে আমি বিয়ে না করে পারলাম না। এত সুন্দর করে পড়ান, আমার শুধু ম্যামের কণ্ঠ শুনে যেতেই ইচ্ছে করে। আমার ম্যামও আবার একটু দুষ্টু আছেন। তিনি আবার যখন-তখন চুমু-টুমু দিয়ে বসেন, চেয়ে বসেন।”

হুরাইন অন্যদিকে ফিরে মুখ লুকিয়ে হাসছে। তাসিন বলল,“এদিকে ফিরে হাসুন। আমিও একটু দেখি।”

হুরাইন হাসি বন্ধ করে মুখ কঠিন করে বলল,“আজ জোহরের নামাজ পড়েছেন?”

“জি পড়েছি।”

“কয়জন মেয়ের দিকে তাকিয়েছেন?”

তাসিন ভেবে বলল,“তাকিয়েছি একজনের দিকে। আসলে বারবার চোখ চলে যায়।”

হুরাইনের হাসিখুশি চেহারায় আঁধার নামলো। চোখমুখ শক্ত করে উঠে গেল। ট্রলি খুঁজে নিজের জামাকাপড় বের করছে। সে চলে যাবে বাপের বাড়ি।
তাসিন বুকে আড়াআড়ি দুইহাত গুঁজে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হুরাইন দ্রুত হাত চালাচ্ছে। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ভয়ঙ্কর রেগে আছে বোঝাই যাচ্ছে। যতক্ষণ না হুরাইনের জামাকাপড় গোছানো হলো ততক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল তাসিন। বোরকা হাতে নিতেই তাসিন শব্দ করে হেসে ফেললো। হাত থেমে গেল হুরাইনের। তাসিন মুখে হাত চেপে হাসি আড়াল করে বলল,“নিজের বউয়ের দিকে তাকালেও যদি কেউ এভাবে রাগ করে, তাহলে আর কী করার আছে? এভাবেই আমার মত নিরীহ পুরুষেরা অত্যা*চারিত হচ্ছে।”

হুরাইনের রাগ কোথায় যেন পালালো। বোরকা রেখে জামাকাপড় সব আগের জায়গায় রাখতে যাচ্ছিল। তাসিন তাকে রাগানোর জন্য বলল,“বোরকা পরছো না কেন? চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। তুমি না চলে যাবে?”

চোখ পাকিয়ে তাকাল হুরাইন। তাসিন নির্দোষের মত বলল,“আশ্চর্য! আমি কী করলাম?”

হঠাৎ হুরাইন এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তাসিন। বউয়ের মতিগতি সে বুঝে উঠতে পারে না। মেয়েটা কখন কী করে বসে। মাত্রই তো চোখ রাঙালো। এখন আবার জড়িয়ে ধরেছে।

ঘুমাতে গিয়ে বরফ শীতল হাত দুটো তাসিনের টি-শার্টের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো হুরাইন। তাসিন নির্লিপ্ত রইল। ভ্রু কুঁচকে গেল হুরাইনের। সে তড়িৎ উঠে বসলো। গ্লাসের পানি হাতে ঢেলে হাত ভিজিয়ে আবার কম্বলের নিচে ঢুকলো। ঠাণ্ডা হাত দুটো আবারও টিশার্টের নিচে রাখতে গেলে তাসিন হাত ধরে ফেললো। হুরাইন এক হাত ছাড়িয়ে তাসিনের গলায় চেপে ধরলো। শক্ত করে হাত দুটো নিজের গরম মুঠোয় নিয়ে হুরাইনকে বলল,“ঘুমাও।”

হুরাইন মজা করে বলল,“না ঘুমালে কী করবেন? আরেকটা বিয়ে দিয়ে দেবেন?”

তাসিনের ধারালো নজর দেখে হুরাইন কম্বলের নিচে মুখ লুকিয়ে সরল হয়ে গেল। আর বিন্দুমাত্র নড়চড় করলো না। তা দেখে মৃদু হাসলো তাসিন। মনে মনে বলল,“নিজের সাথেই আরেকবার বিয়ে দেবো।”

★★★

সুরাইয়া হাসপাতালে যাচ্ছে। সাথে শাবাবও বাবাকে দেখার জন্য যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো। সে এমনিতেই খুঁড়িয়ে হাঁটে, হাত ভাঙা। সুরাইয়া বললেন,“তোর যাওয়ার দরকার নেই। নিয়াজ নিয়ে যাবে আমাকে।”

শাবাব বারন শুনলো না। জামাকাপড় হাতে নিতেই ফাবিহা বলল,“শাবাব আমিও আঙ্কেলকে দেখতে যাব তোমাদের সাথে।”

শাবাব ছোটো করে বলল,“চলো।”

ফাবিহাকে শাবাবের সাথে বের হতে দেখে শাবাবের খালা প্রশ্নাত্মক চোখে তাকালেন। শাবাব বলল,“ফাবিহা আমাদের সাথে যাবে।”

শাবাবের খালা বললেন,“এবার যদি সুমতি হয় তোর বউয়ের।”

ফাবিহা চুপ করে রইল। সকালে নাস্তা বানাতে গিয়েও মহিলা তাকে কথা শুনিয়েছেন। তখনও চুপ করে ছিল। শাবাব খালাকে বলল,“আমাদের দুজনের সিদ্ধান্ত ছিল এটা। আর এখন এসব কথা বাদ দাও খালা।”

বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফাবিহাকে বলল,“তুমি খালার কথায় কিছু মনে কোরো না। দুজনেই মেহমান। দুদিন থেকেই চলে যাবে।”

ফাবিহা বলল,“সমস্যা নেই। তোমার কি হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে?”

সমস্যা তো হচ্ছেই। শাবাব মুখে বলল,“না ঠিক আছি আমি।”

তারপর দুজনই নিরব রইল। শাবাব হুট করে ডেকে উঠলো,“ফাবিহা।”

“হুঁ?”

ফাবিহা চোখ তুলে তাকালেও শাবাব চোখে চোখ রাখতে পারলো না। সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,“আমাকে ক্ষমা করে দিও। এই অনুরোধটা রেখো!”

ফাবিহা কিছুই বলল না। সবার সাথে গাড়িতে চড়ে বসলো। শাবাব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
সুরাইয়াকে হাসপাতালে রেখে ফিরোজ আলমকে দেখে ফাবিহা আর শাবাব বাড়ি পথে রওনা হলো।

ফাবিহা বলল,“শাবাব একটা প্রশ্ন করি?”

“করো।”

“ধরো আজ থেকে ২০/২৫ বছর পর তোমার মেয়েকে প্রতিনিয়ত কোনো ছেলে উত্যক্ত করছে। মেয়েটা শান্তিতে চলাফেরা করতে পারছে না। যতটা নীচ ব্যবহার করা যায়, ততটাই নীচ ব্যবহার তোমার মেয়ের সাথে করছে। ছেলেটা পরবর্তীতে তোমার মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইলো। তুমি বাবা হিসেবে মেয়েকে কী পরামর্শ দেবে?”

শাবাব থমকে গেল। জবাব দিতে পারলো না। সে কখনোই মেয়েকে বলতো না ক্ষমা করে দিতে। বরং ছেলেটার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে ধরতো। ফাবিহা জবাব চাইলো।
“শাবাব?”

শাবাব অস্থির গলায় বলল,“আমি কখনোই তাকে ক্ষমা করার পরামর্শ দিতাম না।”

ফাবিহা হাসলো। বলল,“তাহলে ভেবে দেখো, আমি তো ভুক্তভোগী। আমি কীভাবে ক্ষমা করে দেই, বলো?
আমি এসব কালো অধ্যায় জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাই। ভুলে যেতে চাই সব। নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে চাই। কিন্তু কেউ আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। সমাজ, তোমার দেওয়া আঘাত, ভার্সিটি গেলে সুমন, আমি শান্তি পাই না শাবাব। নিজেকে মানসিক রোগী মনে হয়। আমি কীভাবে বেঁচে আছি আমি জানি।”

ফাবিহার চোখে পানি টলমল করছে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না শাবাব। তীব্র অপরাধবোধ, লজ্জায় দৃষ্টি বারবার নত হয়ে আসে। ফাবিহার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখলে মনে হয়, সে ক্ষমার অযোগ্য।

দুজনের আর কথা হলো না। খানিকক্ষণ পর ফাবিহা কিছু মনে পড়ার মত করে বলল,“আমার জামা কিনতে হবে। তোমাদের বাড়িতে আমার কোনো জামাকাপড় নেই।”

শাবাব ওকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। ফাবিহা দুটো জামা কিনে নিলো। শাবাব দাম দিতে গেলে ফাবিহা বাঁধা দিলো।
“আমার কাছে টাকা আছে। তোমার দিতে হবে না।”

নিজেই দাম চুকিয়ে আগে আগে বেরিয়ে গেল। শাবাব ধীর পায়ে এগিয়ে এলো পেছন পেছন।

#চলবে……

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

নিশিকে কয়েকবার খেতে ডাকলো হুরাইন। আসছি বলেও বসে রইল সে। সাজেদা বিরক্ত হয়ে নিজেই মেয়ের ঘরের দিকে গেলেন। কম্বলের নিচে মাথা মুড়ে শুয়ে আছে নিশি। নড়াচড়া উপর দিয়েই টের পেলেন সাজেদা। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই কম্বল সরিয়ে ফেললেন। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখে চোখ চড়কগাছ তাঁর। ধড়ফড়িয়ে উঠলো নিশি। কানে হেডফোন থাকায় কারো উপস্থিতি টের পায়নি। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। কষিয়ে মেয়ের গালে চ*ড় বসিয়ে দিলেন সাজেদা। লজ্জায় কিছু বলার মত মুখ রইল না নিশির। সাজেদা অসম্ভব রেগেছেন। আঙ্গুল তুলে চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,“তোর খাওয়া বন্ধ। এই চোখদুটো আমাকে আর দেখাবি না।”

সবাই সন্দেহ করবেন বলে সাজেদা চলে গেলেন দ্রুত। তাসিনের বাবা জিজ্ঞেস করলেন,“কোথায় নিশি?”

সাজেদা বললেন,“ও এখন খাবে না। তোমরা খেয়ে উঠে যাও।”

তাসিন বলল,“সময়ের খাবার সময়ে খাবে না, খাবে কখন? এজন্যই তো এমন শুকিয়ে যাচ্ছে দিনদিন।”

সাজেদা স্বাভাবিকভাবে বললেন,“যখন খিদে পাবে, তখন খাবে। তোরা খা।”

তাসিনের বাবা বললেন,“মেয়েটা এখন কথা শুনতে চায় না। বউমা কতবার ডাকলো।”

দুপুর থেকেই সাজেদাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।
হুরাইন আসর নামাজ পড়ে শাশুড়ির ঘরে গেল। কেমন থম ধরে বসে আছেন তিনি। কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন মনে হচ্ছে। চিন্তায় এতটাই মশগুল যে হুরাইনের উপস্থিতি টের পেলেন না। হুরাইন ডাকলো,“আম্মা।”

সাজেদা সাড়া দিলেন না। ফের ডাকলো হুরাইন।
“আম্মা শুনছেন?”

ঘোর কাটার মত চমকে জবাব দিলেন সাজেদা।
“হুঁ?”

“আসর নামাজ পড়েছেন?”

“না, এই তো পড়ব।”

“সময় চলে যাচ্ছে। নামাজ পড়ে ফেলুন।”

“যাচ্ছি” বলে সাজেদা অজু করতে গেলেন। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে আসর নামাজ পড়ে নিলেন। হুরাইন জিজ্ঞেস করল,“আপনি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত আম্মা?”

“না তো।”

হুরাইন বুঝলো সাজেদা কিছু বলতে চাইছেন না। তাই সে আর ঘাটালো না। সাজেদা এক এক করে সব হিসাব করতে লাগলেন। ছয়মাস যাবত নিশি যতক্ষণ বাড়ি থাকে নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে। দিনদিন তার শরীরের অবনতি হচ্ছে। কিছু বললেই বলে “আমি মুটিয়ে যাচ্ছি। তাই ডায়েট করছি।”
অথচ তার খাবার তালিকায় কোনো পরিবর্তন নেই। এভাবে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। ছেলে-মেয়েদের কিছু প্রাইভেসি থাকে বলে এতটা স্বাধীনতাও তাঁদের দেওয়া উচিত নয়। একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে মাঝেমাঝে সবকিছুতে খোঁজ নেওয়া উচিত। প্রাইভেসির নাম করে সে এমন কিছু করছে কি না, এমন কিছু দেখছে কি না তাতে নজর রাখা উচিত।

নিশি ঘর থেকে বের হয়নি দুপুর থেকে। কান্নাকাটি করে ভয়ে বসে রইল ঘরে।

রাতে তাসিনের বাবা ঘরে এলে সাজেদা বললেন,“মেয়ের জন্য পাত্র দেখ।”

“হঠাৎ? কিছু হয়েছে?”

“হ্যাঁ, মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে।”

“মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে তাতো আমি দেখছি। তুমি আর নিশি তো এত দ্রুত বিয়ে দেওয়ার পক্ষে না। তাহলে হঠাৎ কেন তুমি ওর বিয়ের কথা বলছো? নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।”

“কী হবে? মেয়ে বড়ো হয়েছে, বিয়ে দেবে।”

তাসিনের বাবা শান্ত গলায় বললেন,“দেখ সাজেদা, আমি কিন্তু ওর বাবা। সবকিছুরই একটা কারণ আছে। আর কারণ না জেনে আমি মেয়ে কেন বিয়ে দেব? বলো আমাকে। ছেলে ঘটিত ব্যাপার?”

সাজেদা নরম স্বরে বললেন,“না। তবে এমন কিছু, যা তোমায় আমি বলতে পারবো না। শুধু বলবো মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও। এই মুহূর্তে এটাই সমাধান।”

তাসিনের বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন,“তুমি সমস্যার কথা বললে তো আমরা অন্য সমাধানও খুঁজে বের করতে পারবো।”

“না। তুমি জানলেও আমার সাথে একমত হবে। আমার কথা বুঝার চেষ্টা করো।”

সাজেদার করুণ চাহনি দেখে তাসিনের বাবা কিছুটা স্থির হলেন। অনেকরকম পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেই বললেন,“আচ্ছা ঘুমাও।”

★★★

তিনদিনের মাথায় নিশির জন্য সম্বন্ধ আসলো। নিয়ে এলেন জনাব আজাদ। পাত্র একজন আলেম। তাসিনের বাবা সাজেদার সাথে কথা বলার পরদিনই জনাব আজাদকে বললেন একটা ভালো, ধার্মিক ছেলের সন্ধান দিতে। পাত্র হাতেই ছিলো। সেও বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রী খুঁজছে। তাই দ্রুতই দেখাশোনা।

তাসিন বা সাজেদার আপত্তি নেই। তাসিনও মনে মনে এটাই ভাবছিল। বিয়ে দিলে হয়তো চাপে পড়ে হলেও নিশির চলাফেরায় পরিবর্তন আসবে। আগে তার চোখে এটা স্বাভাবিক চলাফেরা হলেও এখন স্বাভাবিক মনে হয় না। তার চোখেরও পরিবর্তন এসেছে। দুই পক্ষের পরিবার সম্পর্কে তাঁরা খোঁজখবর নিয়েই পাত্রী দেখার কাজে এগিয়েছেন। হুরাইনকে যেভাবে তার দাদির উপস্থিতিতে তাসিন দেখেছিল, ঠিক তেমনই তাসিনের উপস্থিতিতে নিশিকে এক নজর দেখেছে পাত্র। সে জানিয়েছে তার নিশিকে পছন্দ হয়েছে।

পাত্র পক্ষ চলে যাওয়ার পরই নিশি ঘরে এসে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। সে কিছুতেই এই ছেলেকে বিয়ে করবে না। ছেলের লম্বা লম্বা দাড়ি তার পছন্দ নয়। তাছাড়া এই পরিবারে বিয়ে হয়ে গেলে সে বন্দী হয়ে যাবে। সাজেদা শাসিয়ে বললেন,“চুপ। তোকে এমন পরিবারে পাঠালে তারাই ঠিক করতে পারবেন।”

নিশি নিজের ক্ষো*ভ ঢাললো হুরাইনের উপর।
“ভাবির কথা ধরেই এসব করছো, তাই না? আমি বুঝি না কেন করছো এসব? কার পাল্লায় পড়েছো তুমি? আমাকে শেখাতে হবে না। আমি দেখছি তো তোমার পরিবর্তন।”

বন্ধ ঘরে নিচু স্বরে মেয়েকে শাসাচ্ছেন সাজেদা।
“তোর লজ্জা করছে না কথা বলতে? আমি কারো কথা কেন ধরতে যাবো? আমার বিবেক নেই? কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হয় আমি জানি না?”

সাজেদা বেরিয়ে এলেন। হুরাইন বলল,“আম্মা একটা কথা বলি?”

সাজেদা মেয়ের ব্যাপার নিয়ে রেগে আছেন। তাই ঝাড়ি দিয়ে বললেন,“বলো।”

হুরাইন মৃদু স্বরে বলল,“আপু দেখলাম কান্নাকাটি করছেন। ওনার মতামত নেওয়া উচিত।”

সাজেদা বললেন,“তোমার বিয়ের সময় তোমার মত ছিল?”

হুরাইন অকপটে বলল,“কিছুটা শঙ্কিত ছিলাম আমি। তবে আব্বুর সিদ্ধান্ত বলে অমত করিনি। আব্বু কখনো আমাদের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নেননি।”

সাজেদা এবার শান্ত স্বরে বললেন,“ কোনো বাবা-মাই সন্তানের খা*রা*প চায় না। ও কখনো ধার্মিক ছেলে বিয়ের জন্য রাজি হবে না। আর ওর পছন্দ মত বিয়ে হলে ও আরো স্বাধীনতা পেয়ে যাবে। আশা করি তুমি আর এই বিষয়ে কথা বলবে না!”

হুরাইন মাথা নাড়লো। তার বলার সে বলেছে। বাকি তাঁদের মেয়ের জীবনের সিদ্ধান্ত কী নেবে না নেবে তা তাঁদের ব্যাপার।

★★★

হুরাইন কুরআন তেলাওয়াত করছে। পাশেই একটা কায়দা নিয়ে বসে আছে তাসিন। অর্ধেক পর্যন্ত কায়দা তার শেষ। কায়দার সাথে সাথে মদ্দ, গুন্নাহ শিখছে সমানতালে। নিজের পড়া শেষ শেষ করে তাসিনের পড়া ধরলো হুরাইন।
“ইখফার হরফ এবং গুন্নাহ বলুন।”

তাসিন ১৫ টি ইখফার হরফ বলতে পারলেও গুন্নাহ ভুল করলো।

হুরাইন চোখমুখ শক্ত করে একটি চাহনি দিল। তাসিন চোখের পলক ঝাপটালো ঘনঘন। হুরাইন কঠিন স্বরে বলল,“এখন ভালোভাবে শিখে আমাকে পড়া দিবেন। নয়তো রাতে নিচে ঘুমাবেন। কম্বলও পাবেন না।”

তাসিনের অবস্থা ছলছল নয়নে। মনে মনে বলল,“আরে হুজুরের কাছে পড়লেই তো লাভ ছিল। পড়া না পারলে পেছনে দুইটা বেত দিয়ে বসিয়ে দিতেন। এমন শা*স্তি পেতে হতো না।”

হুরাইন আরেকবার হুশিয়ারি দিয়ে বলল,“কী হলো?”

তাসিন আমতা আমতা করে বলল,“এ কেমন শা*স্তি?”

হুরাইন বলল,“শা*স্তি কি কম হয়ে গিয়েছে? আচ্ছা ঠিক আছে। শুধু আজ নয়, একসপ্তাহ আপনি নিচে ঘুমাবেন কম্বল ছাড়া।”

তাসিন কথা না বাড়িয়ে পড়ায় মন দিলো। বিছানা, কম্বল, বউ তিনটাই তার চাই। হুরাইন মাঝেমাঝে জহুরি নজরে দেখছে তাসিন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে কি না।

★★★

আজ চলে যাবে ফাবিহা। তাই যাওয়ার আগে ফিরোজ আলমকে একবার দেখে যেতে হাসপাতালে চলে গেলো। তিনি কেবল তাকিয়ে আছেন। কথা বলার মত অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। সুরাইয়া আবারও মুখ ভার করেছেন। আতাউর রহমান হাসপাতালে এলেন মেয়েকে নিয়ে যেতে। শাবাব এখান থেকে বাড়ি চলে যাবে। সুরাইয়ার কাছে গিয়ে ফাবিহা বলল,“আম্মা আমি যাচ্ছি।”

সুরাইয়া মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

শাবাব আতাউর রহমানকে একা পেয়ে মাথানিচু করে নিলো। হাত জোড় করে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দেবেন আঙ্কেল। আমি জানি, আমি ক্ষমার অযোগ্য। আপনার সাথেও খুব খা*রা*প ব্যবহার করেছি।”

আতাউর রহমান বললেন,“আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করো।”

ফাবিহা শাবাবের পাশে এসে দাঁড়ালো। নিচু স্বরে বলল,“বলো শাবাব।”

“কী?”

“আমাদের কী কথা হয়েছিল? সুস্থ হলে কী করবে মনে নেই?”

শাবাব অসহায় চোখে তাকালো ফাবিহার দিকে। ফাবিহা অপেক্ষায় আছে শাবাবের মুখে সেই কথাটি শোনার জন্য। শ্বাস টে*নে নিজেকে প্রস্তুত করলো শাবাব। যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে। অনেকক্ষণ পর হয়ে যাওয়ার পরও শাবাব সাড়া দিচ্ছে নাদেখে ফাবিহা বলল,“তুমি কি বলবে না?”

শাবাব এগিয়ে গেল সামনে। দুজনের বাবা আর সুরাইয়াকে উপস্থিত রেখে সে রুদ্ধশ্বাসে বলে ফেললো,“আমি ফাবিহাকে মুক্ত করে দিলাম।”

সকলে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। এতদিন তবু একটা সুযোগ ছিল। শাবাব এটা কী করে ফেললো? ফাবিহা ছাড়া সকলেরই চোখমুখের রং পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শাবাব বেরিয়ে গেল। পেছন পেছন ফাবিহাও গেল। চোখের পানি আড়াল করার আগেই দুই ফোঁটা ঝরে পড়লো। ফাবিহার নজর এড়লো না। সে স্তব্ধ হয়ে দেখছে। শাবাবের চোখে পানি সে আশা করেনি। তাদের তো হাসিখুশি সংসার ছিলো না। বলতে গেলে সংসারই হয়নি। তার উপস্থিতি টের পেয়ে শাবাব দ্রুত শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিলো। খুঁড়িয়ে হাঁটায় সহজেই ফাবিহা তাকে ধরে ফেলতে পারলো। তবে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইলো না বলেই কাঁদার কথা জিজ্ঞেস করলো না। বলল,“ধন্যবাদ শাবাব। ভালো থেকো। পারলে একজন ভালো মানুষ হয়ে যেও।”

শাবাব কেবল চেয়েই রইলো। ফাবিহা বিদায় নিলো,“আসছি।”

উল্টোপথে বাবার কাছে ফিরে গেল ফাবিহা। শাবাব পেছন থেকে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করলো এই দুনিয়াটাই মরিচিকা।
বাবার সাথে বাড়ি যাচ্ছে ফাবিহা। সে একটা সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেল। তবুও কোথাও একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। জীবনে এতকিছু ঘটে যাওয়াতেই বোধহয় জীবন নিয়ে এই অতৃপ্তি।

হাসপাতাল থেকে বাড়ি গিয়ে ঘরে ঢুকলো শাবাব। আর দরজা খুললো না। একের পর এক সিগারেট ধরাচ্ছে। ফ্লোরে সিগারেটের উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একবার ফাবিহা যে পাশে ঘুমাতো, বিছানার সে পাশে তাকালো। তারপর তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো। চোখদুটো লাল হয়ে আছে। খালা আর তুলি অনেকবার ডেকে গিয়েছে খাওয়ার জন্য। শাবাব বিরক্ত করতে না করলো।

ফাবিহা শাবাবের বাড়ি থেকে ফিরেছে কাল। আজই ভার্সিটি গেল। সুমনকে এখন আর তার নজরে পড়ছে না। কেবল আজ নয়। গত এক মাস যাবতই সুমন তার পথে আর আসছে না। স্বস্তি পেল সে। আর এসব ভালোলাগছে না। পাড়ায় শান্তি নেই, ভার্সিটিতে নেই। কোথাও শান্তি পাচ্ছে না। এক দিন গিয়ে খালার সাথে দেখা করে আসবে।

#চলবে…..

এক টুকরো আলো পর্ব-২৭+২৮

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

দীর্ঘ দেড় মাস পর শশুর নিজ থেকেই ডাকলেন তাসিনকে। সাথে বাবাও আছেন। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর দুই বেয়াই আলোচনায় বসলেন। জনাব আজাদ বললেন,“আমি আরো একবার আপনার ছেলেকে সুযোগ দিতে চাই। তাসিনের বাবা মৃদু হেসে বললেন,“আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কাছে আমি ঋণী থাকবো। আমার ছেলের পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড়ো অবদান আপনার। তারপর আপনার মেয়ের। আপনি মেয়ে বিয়ে না দিলে তো আর মেয়ে আমার ছেলেকে সঠিক পথে আনার চেষ্টায় নামতে পারতো না। আমি তার ধৈর্য দেখে অবাক হয়েছি। চোখের সামনে স্বামীর চলাফেরা, ভুল পথে হাঁটার চেষ্টা দেখেও বিন্দুমাত্র অভিযোগ করেনি কারো কাছে। আমি বেশি আশ্চর্য হয়েছিলাম যখন আপনার কাছে জানতে পারলাম আপনাদেরও কিছু জানায়নি। কেবল চেষ্টাই করে গিয়েছে। আর যাই হোক আমি এমন রত্ন হারাতে চাই না।”

জনাব আজাদ প্রসন্নচিত্তে বললেন,“আমি খুশি হয়েছি। আমার মনে হয় জামাই খুব জলদি নিজেকে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সফল করুন। আমার অভিজ্ঞতায় অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের পরিবর্তন খুব জলদি হয়েছে আবার কারো বছরের পর বছর লেগে গিয়েছে। আসল হলো নিজের চিন্তাধারা। আপনি জেনে অবাক হবেন যে আমার মা একটি দ্বীনি পরিবার থেকে এলেও আমার বাবা তেমন ছিলেন না। মা ধৈর্য ধরে বাবাকে সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। নামাজ পড়তে বললে বাবা বিরক্ত হয়ে মায়ের গায়েও হাত তুলেছেন। কিন্তু আমার মা ধৈর্য ধরে পড়ে রইলেন। আমার বড়ো দুই ভাইয়ের জন্মের পর ধীরে ধীরে বাবার মাঝে পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন মানেই সবকিছু ছেড়ে দাড়ি-টুপি, আলখেল্লা পরে ঘুরে বেড়ানো নয়। ইসলামের বেইসিক কিছু দিক মেনে চললেই যথেষ্ট। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, হালাল উপার্জন, চরিত্রের হেফাজত।”

তাসিনের বাবা অবাক হয়ে বললেন,“কেবল আপনার মায়ের প্রচেষ্টায় আপনারা সব ভাই-বোন দ্বীনের পথের এগিয়েছেন?”

“আমার মায়ের চেষ্টার কমতি ছিলো না। মাকে দেখে আমাদেরও আগ্রহ জন্মাতো। আমাদের মানুষ করাও এতটা সহজ ছিলো না। হাফিজি পড়ার সময় বেশি জ্বালা দিয়েছি মাকে। কতবার পালিয়েছি মাদ্রাসা ছেড়ে।”
বলেই মুচকি হাসলেন জনাব আজাদ।

তাসিন পায়চারি করছে। দুই বেয়াইয়ের মাঝে কী কথা চলছে তাকে জানাচ্ছে না। বাবা বেরিয়ে তার সামনে আসতেই সে রয়েসয়ে জিজ্ঞেস করল,“কী কথা হলো?”

বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন,“তোমায় আরো একটি সুযোগ দেওয়া হলো। মনে রেখো এটাই শেষ সুযোগ। দুদিন পর বউমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে।”

তাসিন চমক পেল। এটা ছিলো অপ্রত্যাশিত। চোখে খুশির ঝিলিক। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে একটু গম্ভীর থাকার চেষ্টা করে বলল,“বাড়ি যখন যাবেই, তখন দুদিন পরের কী দরকার? আজ কেন নয়?”

বাবা সরু চোখে তাকাতেই তাসিন অপ্রস্তুত হয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল,“দুদিন পর আমার কাজ থাকবে। তাই আজ চলে গেলেই ভালো হয়।”

“আমি কথা বলছি বেয়াই এর সাথে।”
বলেই বাবা চলে গেলেন। তাসিন বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দ্রুত পায়ে হুরাইনের ঘরে ঢুকলো। তাকে কিছু বুঝে উঠতে না দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,“আমি এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম।”

হুরাইন নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা না করেই বলল,“আপনার চেয়ে বেশি এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। তবে এটাই শেষ সুযোগ বলে দিলাম।”

তাসিন বাঁধন শক্ত করে বলল,“আমি আর সুযোগ নিতে চাই না। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চাই।”

তাসিন আর তার বাবা হুরাইনকে নিয়েই বাড়ি ফিরলেন।
সাজেদাকে সালাম দিলো হুরাইন। তিনি জবাব দিয়ে বললেন,“যাও আগে বিশ্রাম নাও।”

হুরাইন জিজ্ঞেস করল,“আপনার শরীর এখন কেমন আছে আম্মা?”

“আমি আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছি। তুমি নিজের চিন্তা করো।”

কঠিন হতে গিয়েও কেন যেন পারেন না। সাজেদা কবুতর রান্না করলেন হুরাইনের জন্য। সে ঘরে যাওয়ার পরই ফল কেটে পাঠালেন।

তাহাজ্জুদ পড়তে উঠলো হুরাইন। সে বিস্মিত। তাসিন জায়নামাজে। তার সাথে চোখাচোখি হতেই সামান্য হেসে বলল,“প্রতিদিন উঠতে পারি না। চেষ্টা করছি।”

হুরাইন আনন্দে ছুটে গেল ওজু করতে। বলে গেল আমি আসি তারপর একসাথে পড়বো।

তাসিন অপেক্ষা করলো। হুরাইন আসতেই দু’জনে একসাথে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করলো। এখনো ফজরের আজান পড়েনি। তাসিনের ঠিক সামনে গিয়ে বসলো হুরাইন। ওর কপালে চুমু দিয়ে চোখে চোখ রেখে কোমল স্বরে বলল,“এটা নিজের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হওয়ার চেষ্টার জন্য।”

তাসিন মুখ নামিয়ে এনে হুরাইনের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,“বেশি বেশি উপহার দিলে আমার উৎসাহ আরো বাড়বে।”

হুরাইন মিটিমিটি হেসে তাসিনের সারা মুখে চুমু খেল। তার এই খুনসুটিময় পাগলামিতে হেসে ফেললো তাসিন। ফজর পড়ে মসজিদ থেকে ফিরে হুরাইনকে কুরআন তেলাওয়াত করতে দেখে তাসিন পাশে বসে বলল,“এখন একটু বিশ্রাম করো। অসুস্থ তুমি। এখন এতো প্রেশার নিও না।”

হুরাইন আয়াত শেষ করে কপাল কুঁচকে বলল,“কে বলল আমি অসুস্থ? আলহামদুলিল্লাহ আমি সুস্থ আছি। এই সময়ে কত মেয়েরা এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়ার শক্তি পায় না। আল্লাহ আমাকে শক্তি দিয়েছেন ইবাদত করার। এটা আমার জন্য কতবড়ো নিয়ামত। একজন সৎ, নেককার সন্তান জন্মদানে গর্ভাবস্থায় ইবাদতের বিকল্প নেই।”

তাসিন পাশে থেকে তেলাওয়াত শুনছে হুরাইনের। কিছুক্ষণ পর হুরাইন বলল,“আপনি নিজেও তো প্রতিদিন সকালে অন্তত এক লাইন হলেও তেলাওয়াত করতে পারেন।”

তাসিন কোনো প্রকার সংকোচ না রেখে বলল,“আমি সব ভুলে গিয়েছি। তুমি আবার নতুন করে শিখিয়ে দাও আমায়।”

হুরাইন উৎফুল্ল হেসে বলল,“আপনি শিখতে চান?”

“হুঁ।”

“তাহলে আজ থেকেই শুরু করি?”

তাসিন মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
হুরাইন বলল,“সর্বপ্রথম আপনাকে হরফ শিখতে হবে শুদ্ধভাবে।”

হুরাইন মনোযোগ দিয়ে আগ্রহ নিয়ে তাসিনকে আরবি হরফ শেখাচ্ছে। মাত্র চারটি হরফ শিখিয়ে বলল,“আজকের জন্য এতটুকুই।”

তাসিন বলল,“সবগুলো পড়িয়ে দাও।”

“না। এক সাথে সবগুলো পড়ালে এখন ঠিকঠাক পারলেও পরদিন দেখা যাবে উচ্চারণে ভুল করছেন। এমন পড়ে লাভ নেই। গোড়া মজবুত করা জরুরি। গোড়া যত নড়বড়ে হবে, গাছ তত দ্রুত ভেঙে পড়বে। আমাদের কোনো তাড়া নেই। ধীরেসুস্থে শিখবেন।”

তাসিন বাধ্য ছাত্রের মত মেনে নিলো হুরাইনের কথা।

রান্নাঘরে গিয়ে সাজেদার হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে দিল হুরাইন। ভারী কাজগুলো ধরতে দিলেন না সাজেদা। বললেন,“যতক্ষণ শরীরে শান্তি লাগে, তুমি হাঁটাচলার কাজগুলো করো।”

★★★

ফাবিহা দিনদিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। জীবন কেন তার সাথে এভাবে খেলছে? তার চিন্তায় বাবা-মা দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মাকে বলল,“আমি আবার ফুফুর কাছে চলে যাই মা।”

মা মুখে আঁচল চেপে কাঁদেন। মেয়ের ভবিষ্যৎ এমন হবে তিনি ধারণা করতে পারেননি। আতাউর রহমানও মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। বিভিন্ন মানুষ আজকাল প্রস্তাব নিয়ে আসেন মেয়ের জন্য। দেখা গেল ছেলের দুই-তিনটা বাচ্চা আছে। তিনি সবাইকে না করে দেন। মেয়ে এত দ্রুত বিয়ে দেবেন না জানিয়ে দিলেও তিনি জানেন এসব মানসিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া জরুরি। নয়তো এই পরিবেশ থেকে রক্ষা পাবে না সে।
মেয়েকে বললেন,“ফুফুর কাছে গিয়ে কী করবি? সেখানে গেলেও এখন ওর শশুর বাড়ির লোকজন ইঙ্গিতে আরো কথা শোনানোর সুযোগ পাবে।”

ফাবিহা কেঁদে ফেলে বলল,“আমি কী করবো? আমার জীবনটাই কেন এমন হতে হলো?”

আতাউর রহমান মলিন স্বরে বললেন,“সবসময় জেদের ভাত নেই মা। সব সময় জেদ দেখাতে নেই। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ের পরিচয় দিতে পারোনি। দুদিন হলো মাত্র। অন্তত একমাস থেকে ভেবেচিন্তে দেখা উচিত ছিলো তোমার। চলে আসলেও তোমাকে কী কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, কীভাবে সেসব মোকাবেলা করবে এসব ভাবা উচিত ছিল তোমার।”

ফাবিহা বলল,“তুমি আমার জায়গায় থাকলে কী করতে বাবা? আমার মাথায় একটাই চিন্তা ছিল। কীভাবে আমি বেরিয়ে আসবো। বিয়ের আগে থেকে শাবাব আমাকে যেভাবে টর্চার করেছে, বিয়ের পর আমি তাকে বিশ্বাস করে একমাস কেন, এক মুহূর্ত থাকার কথাও ভাবতে পারিনি। বিয়ের পরও ও আমার সাথে মিসবিহেভ করেছে। আমিও চুপ করে থাকিনি। আমিও ওর মতই ওর সাথে ব্যবহার করেছি। কিন্তু এভাবে কতদিন? আমি কিছুই ভুলতে পারছি না বাবা। ও আসার পর থেকেই আমার জীবন ওলটপালট হয়ে গেল।”

কান্নায় ভেঙে পড়লো ফাবিহা। আতাউর রহমান চুপ করে রইলেন। সমাজকে পাত্তা দিও না বললেও সবসময় সমাজকে এড়িয়ে চলা যায় না। ফাবিহা নিজেকে ঘরবন্দী করে নিলো। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে ম*রে যেতে।

শাবাব আজ মাকে ফোন করলো। রিসিভ করে সুরাইয়া হাউমাউ করে কাঁদছেন।
“কোথায় আছিস আব্বা। কীভাবে থাকছিস, কী খাচ্ছিস? তুই বাড়ি ফিরে আয় আব্বা। তোর আব্বা আর কিছু বলবে না। আমার আর কে আছে আব্বা। তোরা বাবা-ছেলে ছাড়া আমার আর কে আছে? এভাবে কেন আমাকে একা করে দিচ্ছিস?”

শাবাব কানে ফোন চেপে ধরে আছে। চোখজোড়া ভেজা। কোনো কথা বলতে পারছে না। গলা রোধ হয়ে আছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে বলল,“আমি ভালো আছি মা। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমাকে আর ফিরতে বোলো না! আমি চাই না বাবা আমার জন্য আর কারো কাছে ছোটো হোক।”

সুরাইয়া ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন,“তুই যদি না আসিস, তবে আমি ম*রে গেলেও আর আসিস না। আমার খাটিয়া ধরার অধিকারও তোর নেই।”

বুক ছ্যাৎ করে উঠলো। আর্তনাদ করে কাতর স্বরে ডেকে উঠলো, “মা।”

সুরাইয়া কল কেটে ইচ্ছেমতো কাঁদলেন। শাবাব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কী করবে? মাকে কীভাবে বুঝাবে? সারারাত দুশ্চিন্তায় ঘুম হলো না। এপাশ-ওপাশ করেই ভোর হলো। শাবাব সিদ্ধান্ত নিলো একবার লুকিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। দশটার পর বাবা বাড়ি থাকেন না। সে ওই সময়টাকেই কাজে লাগালো। দশটার পর বাড়িতে গিয়ে বেল দিলো। তুলি দরজা খুলে শাবাবকে দেখে চেঁচাতে চেঁচাতে ভেতরে গেল,“খালাম্মা ভাইজান বাড়ি আইছে।”

শাবাবের পা কাঁপছে। ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর পা বাড়ালো। সুরাইয়া অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটে এলেন। শরীর নেতিয়ে পড়বে যেন। অথচ ছেলের বুকে মাথা দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,“আমার আব্বা আসছে। তুই আর আমাকে ছেড়ে যাবি না আব্বা।”

“তোমার ছেলে এই বাড়িতে কী করছে?”
বাবার বাজখাঁই গলা শুনে চমকে উঠলো শাবাব। বাবা তো এই সময় বাড়িতে থাকেন না। সে স্থির হয়ে গেল। সুরাইয়া গতকাল থেকে অসুস্থ। সেজন্যই আজ দেরি করে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন ফিরোজ আলম। সুরাইয়া ছেলেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বললেন,“তোমার দোহাই লাগে। এবার এসব বন্ধ করো।”

শাবাব মাথানিচু করে বলল,“আমি যাচ্ছি মা।”

ফিরোজ আলম গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। সুরাইয়া ঝাপটে ধরে রাখলেন শাবাবকে।
“আমার কথা শোন। তোর বাবা রেগে আছে। তুই গিয়ে মাফ চা। তোর উপর রেগে থাকতে পারবেন না। তুই ভালো হয়ে যা বাবা। আমাদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও ভালো হয়ে যা। তুই এবার চলে গেলে আমি ম*রে যাবো। আমার জন্য হলেও তোর বাবার কাছে ক্ষমা চা।”

শাবাব কাঁপা গলায় বলল,“কোন মুখে ক্ষমা চাইবো মা?”

“তুই শুধু ক্ষমা চেয়ে দেখ। তোর বাবা ক্ষমা না করে পারবেন না। আমাদের একমাত্র ছেলে তুই। তোর বাবা বেশিদূর যায়নি। যা আব্বা।”

শাবাব দ্বিধান্বিত চোখে তাকালো। তুলি বলল,“ভাইজান আপনের জন্য খালাম্মা সারাদিন কান্দাকাটি করে। খাওনা খায় না। অসুস্থ হইয়া পড়েন। আপনে খালুর কাছে ক্ষমা চান।”

শাবাব দ্বিধা কাটানোর চেষ্টা করে বের হলো। বাবা এখনো যাননি। ড্রাইভারের সাথে কী কথা বলছেন। সে দ্রুত পা চালিয়ে বাবার কাছে গেল। পেছন থেকে ডাকলো,“বাবা।”

ফিরোজ আলম তাকালেন না। শাবাব বলল,“তোমার সাথে আমার কথা আছে বাবা।”

ফিরোজ আলম এবারও কথা না বলে গাড়িতে চড়ে বসলেন। শাবাব সাহস করে নিজেও গাড়িতে চড়ে বসলো বাবার পাশে। ফিরোজ আলম কঠিন স্বরে আদেশ দিলেন, “গাড়ি থেকে নামো।”

শাবাব না নেমে হাত জোড় করে বলল,“আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা। আমি এখন থেকে তোমার সব কথা মেনে চলবো।”

ড্রাইভার বাবা-ছেলের কথায় বিরক্ত না করে গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে গেলেন। ফিরোজ আলম বললেন,“আমার কথা শোনার দরকার নেই। তোমাকে আমি চিনি না।”

শাবাব বারবার আকুতি-মিনতি করছে। কিছুতেই মন গলছে না ফিরোজ আলমের। তিনি এতক্ষণ কথা বললেও এবার শক্ত হয়ে বসে রইলেন। আর কোনো কথা বলছেন না। হঠাৎ এক ঝড় এসে মুহূর্তের মাঝে তাণ্ডব ঘটিয়ে চলে গেল। জড়ো হলো মানুষ। রাস্তার মাঝে তিনটি শরীর। বড়ো বাসের ধাক্কায় ড্রাইভার জায়গায় মৃত্যুবরণ করেন। রাস্তার একপাশে ছিটকে পড়েছে শাবাবের শরীর। মাঝখানে পড়েছে ফিরোজ আলমের দেহ। লোকজন ঘিরে ধরেছে ফিরোজ আলমকে। মাথা দিয়ে গলগল করে র*ক্ত ঝরছে। পা ভেঙে একেবারে উল্টে আছে। ঝাপসা চোখে অস্পষ্ট কিছু মানুষের মুখ ভেসে উঠছে। অনেক কষ্টে আওড়ালেন,“আমার ছেলে। আমার ছেলেকে আগে ধরুন।”

খানিক সময় পর চোখদুটো বন্ধ হয়ে এলো। ছেলের প্রতি বাবার ভালোবাসা সবসময় অপ্রকাশিত থেকে যায়। শাবাব শরীর টে*নে*হিঁ*চ*ড়ে বাবার দিকে আসার চেষ্টা করলো। কয়েকজন মিলে তাকে সিএনজিতে তুলে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পারলো না। বলল,“আমার কিছু হয়নি। আমার বাবাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।”

#চলবে…..

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

স্বামী-সন্তান দুজনই হাসপাতালে। সুরাইয়ার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। বলা হয়েছে ফিরোজ আলমের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। কী হয় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে এক্সি*ডেন্টের খবরটা ফেসবুক ফিডে আতাউর রহমানও পেলেন। সামান্য পরিচয়ে ভালো মানুষ মনে হয়েছে ফিরোজ আলমকে। আতাউর রহমান বের হতে নিলেন। ফাবিহার মা জিজ্ঞেস করলেন,“কোথায় যাচ্ছো?”

“ফাবিহার শশুর আর শাবাব এক্সি**ডেন্ট করেছে। যতটুকু বুঝলাম ওর শশুরের অবস্থা খুবই খা*রা*প।”

ফাবিহার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে সেদিনই তো লোকটি সুমনের হাত থেকে বাঁচিয়ে তাকে স্বসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে, সেদিনই তো তাকে এসে নিজের সাথে বাড়ি নিয়ে গিয়েছে। শাবাব যা করেছে, তাতে তার বাবা-মাকে দোষারোপ করে না ফাবিহা। কণ্ঠে বিস্ময়ের সাথে দুঃখ প্রকাশ পেল।
“কী বলছো বাবা! কখন হলো এসব?”

“এগারোটার পর নাকি এই ঘটনা ঘটে।”

“তুমি এখন কোথায় যাবে? কোন হাসপাতালে আছে সেটা তো জানো না।”

“আমি আগে ওনার বাড়িতে যাবো। সেখান থেকে হাসপাতাল যাবো।”

ফাবিহা গলা নামিয়ে বলল,“একটু অপেক্ষা কর। আমিও যাবো বাবা।”

ফাবিহার মা বললেন,“তোর বাবা যাচ্ছে যাক। তুই এখন গেলে কেমন দেখাবে?”

ফাবিহা অবাক হয়ে বলল,“আশ্চর্য মা! কেমন দেখাবে মানে? আমি তো আনন্দে উৎসব করতে যাচ্ছি না।”

ফাবিহার মা জড়তা নিয়ে বললেন,“দাঁড়া আমিও যাবো।”

তিনজন একসাথে বের হলো। শাবাবের বাড়িতে প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের ভীড়। ফাবিহা আর তার মাকে বাড়িতে নামিয়ে একজনের কাছ থেকে জেনে নিয়ে আতাউর রহমান হাসপাতালে গেলেন।

সুরাইয়া আহাজারি করে কাঁদছেন। “ আমার ছেলে, আমার স্বামীর কী হয়ে গেল? আল্লাহ আমার স্বামী-ছেলেকেই পেলো? আমি কেন ছেলেকে তার বাবার পেছন পেছন পাঠালাম? তাহলে তো দুজনের একজনও এত তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে বের হতো না।”

সুরাইয়ার পাশে ওনার বোন এবং জা রয়েছেন। তুলি একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
সুরাইয়ার আহাজারি থামছে না।

“আমার ছেলে বাড়ি ফিরলো কতদিন পর। আমি জোর করে ওর বাবার কাছে পাঠালাম মাফ চাইতে। কী হয়ে গেল আল্লাহ। আমি কেন পাঠালাম?”

বলতে বলতে স্বর কমে আসে। আবার আহাজারি করেন। ফাবিহা বুঝলো না শাবাব কোথা থেকে বাড়ি ফিরেছে। সুরাইয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত রেখে বলল,“কাঁদবেন না আম্মা। ইনশাআল্লাহ সবাই ঠিক হয়ে যাবে।”

ফাবিহাকে দেখে সুরাইয়া বললেন,“তুমি কেন এসেছো গো মা? আমার এখন আর কাউকে প্রয়োজন নেই। তুমি তো চলে গিয়েছিলে। এখন কি আমার ছেলে আর স্বামীর প্রাণ গিয়েছে কিনা সেটা দেখতে এসেছো?”

ফাবিহা অস্বস্তি নিয়ে বলল,“আম্মা আপনি শান্ত হোন।”

সুরাইয়ার কান্না দেখে ফাবিহার মায়েরও খা*রা*প লাগছে। একসাথে স্বামী-সন্তান দুজনের এত বড়ো বিপদ। তিনি পাশে বসলেন। ফাবিহা উঠে গিয়ে তুলিকে একপাশে ডেকে নিলো।
“বাড়িতে কী হয়েছিল তুলি? শাবাব এতদিন পর ফিরেছে মানে? কোথায় ছিল সে?”

তুলি নাক টানতে টানতে বলল,“আপনে চইলা যাওনের পর খালু ভাইজানরে বাইর কইরা দিছে। ক্যান আপনেরে ছাইড়া দিছে? ভাইজান কাউরে না জানাইয়া বাড়ি থেকে চইলা যান। এর ভিতর কারো লগে যোগাযোগ করেন নাই। হাতে টাকাপয়সাও ছিল না। কী খাইছে, কোথায় থাকছে? কাল খালাম্মারে ফোন দিছে। খালাম্মা কান্নাকাটি কইরা কইছে না আসলে খালাম্মা ম*ই*রা যাইবো, খাটিয়া ধরতে দিবো না। খালাম্মার লগে দেখা করতে আইসা খালুর সামনে পইড়া যায় ভাইজান। খালু রাগারাগি কইরা বাইর হওনের পর আম্মা আবার খালুর কাছে মাফ চাইতে পাঠাইছেন। এরপরই দুইজন গাড়িতে চইড়া চইলা যায়। তারপরেই এক্সি*ডেন্টের খবর আসে।”

শাবাব তো তাকে ছাড়েনি। বরং তার কথায় তাকে যেতে দিতে রাজি হয়েছে। ফাবিহা নরম হয়ে বলল,“চোখ মুছে ফেল। আম্মাকে দেখতে হবে তোর।”

তুলি কান্না না থামিয়ে অনবরত হেঁচকি তুলে বলল,“আপনের তো দয়ামায়া নাই ভাবি। ভাইজান আর খালুর লাইগা আমার কলিজা ফাইটা যায়।”

ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে দয়ামায়া দেখালেই বা কি? মানুষ দুটো কি সুস্থ হয়ে যাবে? সুরাইয়ার কান্না দেখে সে মনেপ্রাণে চাইছে শাবাব আর ফিরোজ আলম যেন সুস্থ হয়ে যায়।

ফাবিহার জেঠী শাশুড়ি ডাকলেন তাকে।
“তোমরা না ভালোবেসে লুকিয়ে বিয়ে করেছো? তাহলে সংসার দুদিনও টিকলো না? কেমন ভালোবাসা তোমাদের? ডিভোর্স কি হয়ে গিয়েছে?”

“না। এমনিতেই আলাদা হয়েছি। আমাদের অফিশিয়াল কোনো কাগজপত্র নেই।”

“যাই হোক, তোমাকে একটা কথা বলি। যা হয়েছে শেষ। আবার ভেবে দেখো। ডিভোর্স যেহেতু হয়নি তোমার উচিত এখন তোমার শাশুড়ির পাশে থাকা। সবাই তো আর সংসার ফেলে থাকতে পারবে না।”

ফাবিহা অস্বস্তি নিয়ে বলল,“আমরা তো আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আলাদা হয়েও গিয়েছি। এখন কীভাবে আমি এখানে থাকবো?”

“তা*লা*ক তো হয়নি। দেখো এমন আহামরি বয়স তোমাদের হয়নি। আরো বয়স্ক, জ্ঞানী মানুষও ভুল করে। মনে করো এটা ভুল শোধরানোর একটা সুযোগ।
তোমরা একসাথে না থাকলে সেটা পরে দেখবে। আগে তোমার শাশুড়ির পাশে থাকো।”

ফাবিহার জেঠী শাশুড়ি চলে গেলেন। ভাবনায় পড়লো ফাবিহা। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। মায়ের কাছে চলে গেল। কানাঘুঁষা চলছে ফিরোজ আলম বেঁচে নেই। কয়েকজন মহিলা সুরাইয়ার গয়নাগাটি খোলার তাড়া দিলেন। একটা ঘোরের মাঝে আছে সুরাইয়া। কী বলছে সবাই। গয়নাগাটি কেন খুলতে হবে? ফাবিহার হাঁসফাঁস লাগছে।
সুরাইয়া কিছুতেই কিছু খুলবেন না। আধাঘন্টা পর খবর এলো শাবাবের জ্ঞান আছে। একটা হাত ভেঙেছে তার। পায়েও ব্যথা পেয়েছে। তবে ভাঙেনি। রাস্তার একপাশে ছিটকে পড়ায় তেমন ক্ষয়-ক্ষতি তার হয়নি। ফিরোজ আলমের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। তিনি গুরুতর আঘাত পেয়েছেন।

বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেল। সবার। যেই ভদ্রমহিলা গয়নাগাটি খোলার কথা বললেন, শাবাবের খালা ওই মহিলাকে কচলে ধরলেন।
“না জেনে আন্দাজে খবর ছড়ানো কোন অভ্যাস? আমরা জানলাম না আর আপনি জেনে গেলেন দুলাভাই নেই।”

মহিলা আমতা আমতা করতে লাগলেন। দোষ তাঁরও নেই। তিনিও অন্যজনের মুখে শুনেছেন।
ফাবিহার মা এবার চলে যাবেন। সুরাইয়ার কাছে ফাবিহাকে নিয়ে বিদায় জানাতে এলেন।
“আমরা আসছি আপা।”

দূরদূরান্তের কেউ জানেন না ফাবিহা আর শাবাবের বিচ্ছেদের কথা। তাঁরা অবাক হয়ে বললেন,“বউ কোথায় যাচ্ছে? স্বামী-শশুর মৃ*ত্যু*র পথে। বাড়িতে শোক। এই মুহূর্ত বউ যাচ্ছে কোথায়?”

সুরাইয়া নিস্তেজ হয়ে অসন্তোষ গলায় বললেন,“যাক। তারা আর একসাথে থাকবে না। দুজনেই আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।”

চরম আশ্চর্যে অনেকের মুখে হাত।
“কী বলছেন? বিয়ে হতে না হতেই এই অবস্থা? তা*লা*ক কি হয়ে গিয়েছে?”

“তা*লা*কের কী দরকার? তারা একসাথে থাকবে না সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটাই তো যথেষ্ট।”

এবার সবাই ফাবিহার দিকে ছুটলেন।
“কীগো মেয়ে নিজেরা নিজেরা বিয়ে করেছো, আবার নিজেরাই আলাদা থাকছো? স্বামী-স্ত্রীর রাগারাগি হয়েই থাকে, তাই বলে কি আলাদা থাকতে হবে? এত রাগ, জেদ ভালো না। কেমন পাষাণ মেয়ে তুমি? স্বামীর প্রতি কি একদিনের জন্যেও তোমার মায়া জন্মায়নি? মানুষের জন্যই তো মানুষ।”

সুরাইয়া ভেবেছিলেন ফাবিহা আগের সব ভুলে গিয়ে এসেছে যখন, তখন থাকবে। চলে যাওয়ার কথা বলতেই মনে কষ্ট পেলেন তিনি। নিজেকে বেহায়া বলে কয়েকবার গা*লি দিলেন। সবার চাপাচাপিতে ফাবিহার মা বললেন,“আপনারা যা জানেন না তা নিয়ে দয়া করে কথা বলবেন না।”

“যা কিছু হোক, আপনার মেয়ে তো এখনো এই বাড়ির বউ। তার তো উচিত এই সময়ে পাশে থাকা।”

ফাবিহার মা আতাউর রহমানকে কল দিয়ে জানালেন সবাই কী কী বলছে। এজন্যই তিনি মেয়ের আসা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন। আতাউর রহমান বললেন,“ও থাকুক এখন। এভাবে চলে যাওয়া বেমানান।”

তেতে গেলেন ফাবিহার মা। ফাবিহা চারদিক বিবেচনা করে বলল,“মা আমি থাকি দুদিন। এদিকটা স্বাভাবিক হলে আমি চলে যাবো।”

এবার মেয়ের উপর চটে গেলেন ফাবিহার মা।
“তুই কি শাবাবের সাথে সংসার করতে চাইছিস?”

ফাবিহা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,“মা আমি শুধু আমার শাশুড়ির পাশে থাকতে চাইছি। শাবাব আর আমার মধ্যে যেহেতু আইনত আর ধর্মীয় ছাড়াছাড়ি হয়নি, সেটারও ব্যবস্থা করতে হবে। ও সুস্থ হলেই যাতে এদিকটা সামলে নেয়, তার জন্যও তো কথা বলতে হবে।”

“আমার ভয় হচ্ছে। একা পেয়ে ও না আবার তোকে মে*রে গুম করে দেয়।”

“মা এতদিন সুযোগ থাকার পর ও আমাকে গু*ম করলো না। আর এখন ভাঙা হাত-পা নিয়ে আমাকে গু*ম করবে? তুমি সবসময় বাচ্চাদের মত কথা বলো।”

“আমি কিছু জানি না তুই আমার সাথে চলে যাবি।”

“মা অবুঝ না হয়ে ভেবে দেখো। এটা খারাপ দেখায়।”

আতাউর রহমান এসে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফাবিহার মাকে নিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে আত্মীয়স্বজনরা ও চলে গেলেন। ফিরোজ আলম মা*রা গিয়েছেন খবর শুনেই এত মানুষের ভীড় জমেছিল। ফাবিহার খালা শাশুড়ি থেকে গেলেন। ফাবিহার সাথে কথা না বলে নিজের কাজ নিজে করছেন। সুরাইয়াও কথা বলছেন না ফাবিহার সাথে। খুব অসহায় লাগছে তার। এমনিতেই সে আগের তুলনায় ভেঙে গিয়েছে। ওরাই তাকে থাকতে বলল, আর ওরাই কথা বলছে না।

শাবাবকে নিয়ে ওর কাজিন চলে এলো। ফিরোজ আলমের কাছে ওনার ভাই, ভায়রাভাই আছেন।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে মায়ের কাছে যেতেই সুরাইয়া ছেলেকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। শাবাবের চোখ দিয়েও নিরবে পানি ঝরছে। এমন অসহায় আর কোনোদিন লাগেনি। তার অন্তর কেঁপে উঠলো যখন লোকমুখে শুনলো “লোকটা নিজের মৃ*ত*প্রা*য় অবস্থাতেও আগে ছেলের খোঁজ নিলেন।”

শাবাব ভাবতো মা তাকে বেশি ভালোবাসে। বাবা বোধহয় কম ভালোবাসে। আজ বুঝলো বাবা মা কেউ তাকে কম ভালোবাসেন না। বাবার ভালোবাসা অপ্রকাশিত। তার এত অপ*রা*ধের পরও বাবা তার খোঁজ নিলেন।
মায়ের কাছ থেকে সরে এসে চমকে উঠলো ফাবিহাকে দেখে। চোখের পলক ঝাপটে নিজের ভ্রম কাটাতে চাইলো। ফাবিহার জন্য যে তার মনে কিছু আছে সেটা সে এর আগেই টের পেয়েছে। পলক ঝাপটে আবারও ফাবিহাকে দেখলো। কিছু না বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে গেল।

ঘরে বসে রইলো। শরীরে যন্ত্রণা। তারচেয়ে বেশি যন্ত্রণা মনে। বাবার এই অবস্থার জন্য বারবার নিজেকেই দায়ী করে।
রাতে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকালো সে। ফাবিহা খাবার হাতে ঘরে ঢুকলো। শাবাব মলিন মুখে বলল,“তুমি এখানে?”

ফাবিহাও একইভাবে জবাব দিলো,“এক্সি*ডেন্টের কথা শুনে এসেছিলাম। সবাই থাকার জন্য চাপাচাপি করলো।”

“সবাই বললেই তোমায় থাকতে হবে? জীবন তোমার, অন্যদের নয়।”

ফাবিহা কথা না বলে টেবিলের উপর খাবার রাখলো। ,“খেয়ে নাও। আমি দুদিন পরই চলে যাবো।”

বলে হাতের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো শাবাবের ডানহাতে ব্যান্ডেজ। আবারও বলল,“আমি খাইয়ে দেব?”

শাবাব জবাব দিলো,“না। একটা চামচ নিয়ে এসো। আমি খেয়ে নেব।”

ফাবিহা বেরিয়ে গেল চামচের জন্য।
শাবাব বাম হাতে চামচ নিয়ে মুখে খাবার তুললো। একটু বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। তবুও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করছে না। ফাবিহা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর হাতের দিকে। শাবাবের খাওয়া শেষ হলে বলল,“থ্যাংকস। এখন তো রাত, তুমি বরং কাল চলে যেও। কেউ কিছু বলবে না। আমি আছি বাসায়।”

ফাবিহা বলল,“তুমি রেস্ট নাও।”

শাবাব বলল,“তুমি বরং ঘরে ঘুমাও। আমি অন্যঘরে যাচ্ছি।”

“এসবের কি সত্যিই দরকার আছে শাবাব? আমরা এর আগেও এক ঘরে এক বিছানায় ছিলাম।”

“তখনের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এখন তুমি আর আমি সম্পর্কে নেই।”

শাবাবের অভিব্যক্তি স্পষ্ট হচ্ছে না। তার সব কথাই স্বাভাবিক। ফাবিহা বুঝতে পারছে না তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সে ফাবিহাকে দায়ী করছে কিনা?
ফাবিহা বলল,“তুমি কি সবকিছুর জন্য আমাকে দায়ী করছো?”

“তুমি দায়ী হবে কেন? আমার কারণেই এসব হয়েছে। রাত হয়েছে। শুয়ে পড়ো।”
বলে শাবাব উঠে যেতে নিতেই ফাবিহা বলল,“তোমার এখন ঘর ছাড়ার প্রয়োজন নেই। এতে আরো বাজে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।”

শাবাব বিরক্ত হয়ে বলল,“তুমি কী প্রমাণ করতে চাইছো, আমি বুঝতে পারছি না। লোকে যাই বলুক, তুমি তো কখনো সেসব কান দাওনি। তাহলে আজ থেকে গেলে কেন? যেখানে আমরা দুজনই জানি আমাদের পথ আলাদা।”

ফাবিহা বলল,“তুমি ভালো কথা বলেছো। সুস্থ হয়ে সবার সামনে বলে দিও আমার সাথে তুমি থাকতে চাও না। মানে ডিভোর্সের যেই ব্যাপারটা। সেটার কারণেই আমার থেকে যাওয়া।”

শাবাবের চোখ স্থির হয়ে গেল। ফাবিহা নিজের ভালোটা ভেবেই এখানে থেকে গিয়েছে। সামান্য আবেগ থেকেও নয়।
“বলে দেব। এখন শুয়ে পড়ো।”

“হুম।”

ফাবিহা প্লেট নিয়ে চলে গেল। শাবাব কল দিল জেঠার কাছে বাবার অবস্থা জানার জন্য। তিনি জানালেন ফিরোজ আলমের জ্ঞান এসেছে। একজন মহিলা হলে ভালো হয়।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে বাবার কথা জানালো। কেউ ঘুমায়নি। সুরাইয়া বললেন,“কাল তাহলে আমি যাবো।”

শাবাব বলল,“তুমি অসুস্থ মানুষ। কীভাবে যাবে?”

সুরাইয়া বললেন,“আমার স্বামী, আমি যতটা বুঝবো ততটা অন্যকেউ বুঝবে না। আমার ঠেকা বেশি। বাড়িতে তোর খালা আছে, তুলি আছে।”

ফাবিহার কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। বললেন,“তুই ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়।”

“তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো।”

শাবাব ঘরে এসে দেখলো ফাবিহা শুয়ে পড়েছে। তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,“কোথায় গিয়েছো?”

“মায়ের ঘরে। বাবার জ্ঞান ফিরেছে।”

“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ঔষধ নিয়েছো?”

“এখন নেব।”

ফাবিহা উঠতে নিতেই দেখলো শাবাব ঔষধ বের করে পানি হাতে নিয়েছে। ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। দু’জন বিছানার দুপাশে। একজনেরও চোখে ঘুম নেই। দুজনই বুঝতে পারছে পাশের ব্যক্তি জেগে আছে।

ফাবিহা বলল,“আমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো!”

শাবাবের পাশ থেকে জবাব এলো,“কেমন?”

“বাকি মেয়েদের মতই। বিয়েটা না ভেঙে গেলে এখন সুন্দর একটা সংসার হতো।”

“তোমার বিয়ে তো আমার জন্যই ভাঙলো।”

“না, তারও আগে। তুমি যখন আমায় প্রেম প্রস্তাব দাও, তখন আমার বিয়ে ঠিক ছিল কাজিনের সাথে। তারপর সে আরেকজনকে বিয়ে করে নিলো।”

“তোমাদের মাঝে কি সম্পর্ক ছিল?”

“নাহ্, আমি তাকে পছন্দ করতাম।”

“এখনো?”

“না। আমি এখন আর কোনো কিছুর জন্য আক্ষেপ করি না। সে আমার ভাগ্যে ছিল না কখনো। তার ঘরে এখন নতুন সদস্য আসছে।”

শাবাব বলল,“ঘুমাও।”

এই বলেও দুজন কথা চালিয়ে গেল আরো কিছুক্ষণ। এটাই তাঁদের ঠাণ্ডা মাথায় দ্বিতীয় আলাপ।

হাতে ব্যথা পেয়ে ঘুম ছুটে গেল শাবাবের। ভোররাতে ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়ায় জড়োসড়ো হয়ে শুয়েছে ফাবিহা। গোটানো হাঁটুর নিচে শাবাবের ডান হাত পড়েছে। চোখমুখ কুঁচকে হাত টে*নে নিলো। টিমটিমে আলোয় ফাবিহাকে অবলোকন করলো। সেও আক্ষেপ করল তাদের জীবন সুন্দর হতে পারতো।
নতুন সদস্য তাদের দুজনের ঘরেও আসতে পারতো। সব অসম্ভব হয়েছে তার নিজেরই কারণে। যদি নিজের অতীতের কর্ম, কথাগুলো ফিরিয়ে নেওয়া যেত, সেটা যতটা কঠিনই হোক সে ফিরিয়ে নিতো।

#চলবে…….

এক টুকরো আলো পর্ব-২৫+২৬

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সকলে একসাথে বসে নাস্তা করছে। ফাবিহা ফিরোজ আলমের উদ্দেশ্যে বলল,“বাবা আমি পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চাই।”

“অবশ্যই তুমি পড়াশোনা করবে।”

শাবাব খেয়ে চলেছে একমনে। ফাবিহা সৌজন্যে হেসে বলল,“ধন্যবাদ। আমি আজ একবার ক্লাসে যেতে চাচ্ছি।”

“শাবাব অফিস যাওয়ার সময় বউমা কে নিয়ে যেও।”

শাবাব ফাবিহার উদ্দেশ্যে বলল,“তৈরি হয়ে নিও তাড়াতাড়ি।”

ফাবিহা বলল,“আমি একা চলে যেতে পারবো।”

ফিরোজ আলম বললেন,“একা কেন যাবে? দুজন একসাথে চলে যাও। শাবাব তোমাকে নামিয়ে দিয়ে অফিস যাবে। তখন আর চিন্তা থাকবে না।”

দুজনের মাঝে কী চলছে ফিরোজ আলম জানেন না। তিনি শুধু চাইছেন তাদের মাঝে একটা বুঝাপড়া হোক। ফাবিহা আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিলো।

শাবাব অপেক্ষা করছে গাড়ি নিয়ে। ফাবিহা বেরিয়ে আসছে। ড্রাইভিং সিট থেকে তাকিয়ে রইলো শাবাব। ফাবিহা কাছাকাছি আসতেই চোখ সরিয়ে নিলো। বিয়ের পর ফাবিহার জন্য কোনো শপিং করা হয়নি।
ফাবিহাকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিল। আসার পথে দুজনের মাঝে একদণ্ড কথা হয়নি। পেছনে না তাকিয়ে ভেতরে চলে গেল ফাবিহা। শাবাব যেতে নিয়েও কিছু একটা নজরে পড়ায় গাড়ি থেকে নেমে গেল। তাদের বিয়ের খবর এখনো গোপন রয়েছে। ফাবিহা হাঁটতে হাঁটতে সুমনের সামনে পড়লো। পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই সুমন পথ আগলে দাঁড়ালো। বিশ্রী ভঙ্গিতে হেসে বলল,“নাগরকে দেখি ভালোই পটিয়েছ। আমাকে এসে মা*র*ধ*র করে গিয়েছে।”

ফাবিহা কিছু না বুঝতে পেরে বলল,“মানে?”

সুমন খপ করে ফাবিহার হাত চেপে ধরে বলল,“তোমার নাগর কয়টা? আমি তো শাবাবের কথাই বলছি। ওর জ্বালা মিটিয়েছিস, এবার আমার জ্বালা মেটাবি।”

ফাবিহা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“হাত ছাড় বলছি।”

“না ছাড়লে কী করবি তুই?”

ফাবিহা থুতু ছুড়ে মা*র*লো সুমনের মুখে। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো সুমন। হাত দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে তাকালো। তার চোখ টকটকে লাল। হাত উঠানোর আগেই তার মুখে ঘু*ষি এসে পড়লো। দু-কদম পিছিয়ে গেল সে। শাবাব তার হাত থেকে ফাবিহার হাত ছাড়িয়ে নিলো। আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলল,“পরেরবার মাটিতে ফুঁতে ফেলবো। মাইন্ড ইট।”

সুমন বলল,“তুই তো এক মা*ল এতদিন ছেঁকে দেখিস না। এখনও খাস নাকি এই মা*ল?”

ফাবিহা রাগে শরীর কাঁপছে। শাবাব তার গতিবিধি লক্ষ করে শান্ত গলায় বলল,“ক্লাসে যাও তুমি। আমি দেখছি ওকে।”

ফাবিহা যাচ্ছে না। সে শাবাব, সুমন দুজনকেই সমান দোষী মনে করে। শাবাবের জন্যই তো সুমন তার পেছনে পড়েছে। শাবাব আবারও বলল,“যাও ফাবিহা।”

সুমন এই ফাঁকে শাবাবকে আক্রমণ করে বসলো। দুজনের মাঝে তুমুল মা*রা*মা*রি চলছে। ফাবিহা বুঝে উঠতে পারলো না কী করবে। কেউ কাউকে ছেড়ে দিচ্ছে না। এমন হলে খুনাখুনি হয়ে যাবে। শেষে ফাবিহা শাবাবকে টে*নে সরানোর চেষ্টা করলো। ক্ষ্যাপা ষাঁড়কে একা থামানোর সাধ্যি তার নেই। তবুও দুহাতে পেছন থেকে টে*নে ধরলো তাকে।
“ছাড়ো শাবাব।”

আপনা-আপনি সুমনের কাছ থেকে আলগা হয়ে এলো শাবাব। সুমন আবার তেড়ে আসলো। শাবাব এগিয়ে যেতে নিতেই ফাবিহা তাকে আবারও টে*নে ধরলো।
নিজের কোমরের কাছে ফাবিহার হাত দুটোর দিকে তাকাচ্ছে বারবার। রাগে ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,“তুমি ক্লাসে যাও। আমি যাচ্ছি।”

ফাবিহা ক্লাসের দিকে এগিয়ে যেতেই শাবাব সুমনের উদ্দেশ্যে বলল,“ওর দিকে চোখ দিবি না। তোর যা ইচ্ছে তুই কর। শুধু ওদিকে চোখ দিলে ভালো হবে না।”

সুমনের হাসি দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সে শাবাবের কথায় কান দিচ্ছে না।

শাবাব ঠাণ্ডা মাথায় বলল,“তোর সাথে আমার এখন আর লেনাদেনা নেই। আমি তোর কোনো কাজে হাত দিচ্ছি না। তাহলে তুই কেন এখনো পুরনো শ*ত্রু*তা ধরে বসে আছিস? কী চাইছিস তুই?”

সুমন গাল চুলকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,“মেয়েটার প্রতি তোর এত ইন্টারেস্ট কেন?”

“তুই ওর পিছু ছেড়ে দে।”

“ছাড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটা বড্ডো তেজী। আমার রাগ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ওর তেজ কমানো ছাড়া আমি থামছি না।”

শাবাব শক্ত গলায় বলল,“ওর পরিচয় জানিস?”

সুমন বিদ্রুপ হেসে বলল,“তোর খেয়ে ছেড়ে দেওয়া মা*ল।”

কষিয়ে আরেকটা থা*প্প*ড় পড়লো সুমনের গালে। শাবাব হিমশীতল কণ্ঠে বলল,“ওর সাথে আমার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এখন ও আমার স্ত্রী। তাই যা করবি, ভেবেচিন্তে।”

শাবাব ঘড়ি দেখে গাড়িতে গিয়ে বসলো।
সুমন চমকে উঠলো। থা*প্প*ড়ে নয়, শাবাবের কথা শুনে।
শাবাব ড্রাইভ করতে করতে ভাবনায় ডুবে গেল। সুমনের ফাবিহাকে এভাবে উত্যক্ত করা তার ভালোলাগেনি। সে কিছুতেই এটা একসেপ্ট করতে পারছে না। সেও তো ফাবিহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বারবার তাকে উত্যক্ত করেছে। নিজের কাছে নিজেই ছোটো হয়ে এলো। সুমন আর নিজের মাঝে তফাত খুঁজে পেল না। অফিসের সামনে গাড়ি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে হেঁটে গেল ভেতরে।

★★

“আমাদের বাসায় নতুন সদস্য আসছে। এই খুশি তোমার উপভোগ করার কথা ছিল। কিন্তু অন্যকেউ তা উপভোগ করছে।”

ফাবিহা বলল,“এসব বাদ দে নিশি। যার ভাগ্যে যে লেখা আছে, সে শত বাঁধার পরও জীবনে আসবেই। আমি এখন আর আফসোস করি না। তবে নতুন সদস্য আসছে শুনে খুশি হলাম। আমি বিকেলে একফাঁকে এসে দেখে যাবো ভাবিকে।”

“সে তো তার বাবার বাসায়।”

“ওহ্। তুই গিয়েছিস দেখতে?”

“না।”

“নাম্বার দিতে পারবি? কথা বলবো।”

“আচ্ছা আমি পাঠাচ্ছি।”

ফাবিহা ভাবলো নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা কাউকে জানাবে না। কিছুদিন পর তো সে শাবাবের কাছ থেকে আলাদা হয়েই যাবে। তবুও অবুঝ মন উশখুশ করছে। জড়তা নিয়ে বলল,“আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে নিশি।”

নিশি বিস্মিত হয়ে মৃদু চিৎকার দিল।
“কীহ্? কী বলছো এসব? কবে, কখন? জানালেও না!”

ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“জানানোর সুযোগ ছিল না। পরিস্থিতির কারণে জানাতে পারিনি। হুট করেই বিয়ে। তুই নাম্বার পাঠিয়ে দে।”

নিশি আফসোস করছে।
“ইশ্! নিজের ভাইয়ের বিয়েতেও আনন্দ করতে পারিনি। ভেবেছিলাম তোমার বিয়েতে চুটিয়ে মজা করবো!”

ফাবিহা তাচ্ছিল্য হাসলো। বিয়ে নিয়ে তো তারও কত স্বপ্ন ছিল। সবকিছু কি আর পূরণ হয়? বলল,“রাখছি। আমায় বাসায় যেতে হবে।”

নিশি মন খারাপ করে বলল,“ঠিক আছে। ভালো থেকো।”

নিশির কল কাটার পাঁচ মিনিটের মাথায় আবার কল এসে পড়লো ফাবিহার। রিসিভ করতেই শাবাব বলল,“কখন ছুটি হবে?”

“সেটা জেনে তুমি কী করবে?”

“তোমায় বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যই জিজ্ঞেস করেছি।”

“আমি একাই যেতে পারি শাবাব। প্লিজ এসব অভিনয় করে ভালো সাজার চেষ্টা কোরো না। আমাদের পথ আলাদা।”

শাবাবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে কিছু না বলেই কল কেটে দিল। সুমন একা পেয়ে আবার কিছু না করে বসে। এই ভেবে পরক্ষণেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। ভার্সিটির কাছাকাছি যেতেই ফাবিহাকে রিকশায় দেখলো সে। শান্ত হয়ে পেছন পেছন গাড়ি নিয়ে আসলো। ফাবিহাকে বাসার সামনে নামতে দেখে দূর থেকে আবার ফিরে গেল। সে যা করেছে, এরপর চায় না তার জন্য ফাবিহার আর কোনো ক্ষ*তি হোক।
তুলি বসে বসে আচার খাচ্ছে। সুরাইয়া তাকে বকাবকি করছেন। রান্নাঘরে সব এলোমেলো পড়ে আছে।
“সব জমিদারের বেটি এসে আমার কাছে পড়ে। একজন গিয়ে উঠেছে ভার্সিটিতে, আরেকজন বসে বসে আচার খাচ্ছে। আমি হলাম দাসী।”

বকতে বকতে সবকাজ গুছিয়ে নিলেন। এসে তুলিকে চেঁচিয়ে বললেন,“জমিদারের বেটি, আচার খাওয়া হলে এবার ভাত গিলতে আসুন।”

তুলি বিরক্ত হয়ে বলল,“খালাম্মা আমি তো কইছি আচার খাইয়া সব কাম করুম। আপনে করতে গেলেন ক্যান?”

“আমার প্রেশার বাড়াবি না।”

ফাবিহা বাড়িতে ঢুকলো। সুরাইয়া তাকে দেখে বললেন,“তুলি সবাইকে তাড়াতাড়ি খেতে আসতে বল।”

ফাবিহা বলল,“আমার দেরি হবে আম্মা। গোসল করে তারপর খাবো। আপনারা খেয়ে নিন।”

সুরাইয়া থমথমে মুখে বসে রইলেন। ফাবিহা গোসল করে খেতে এসে দেখলো সুরাইয়া আর তুলি বসে আছে। সামনে খাবার। সে অবাক হয়ে বলল,“আপনারা খাননি এখনো?”

তুলি মুখ টিপে হাসলো। সে ভাবে তার খালাম্মার মাথায় গন্ডগোল আছে। নয়তো কে এমন করে? তার সাথে সবসময় ক্যাটক্যাট করে। আবার নিজে গিয়ে আগ বাড়িয়ে কাজ করে ফেলে। খাওয়ার সময় ডেকে ডেকে খাওয়ায়। এটা শুধু তার ক্ষেত্রে না। সবার ক্ষেত্রেই তিনি এমন। ফিরোজ আলমের সাথেও কিছু নিয়ে ঝগড়া হলে তাঁর যত্ন নিতে ভুলবেন না। তবে কথায় কথায় খোঁচা দেবেন। ফাবিহার দিকে প্লেট বাড়িয়ে দিল তুলি। ফাবিহা বসে পড়লো। আড়চোখে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। খাওয়া শেষ করে সে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। সুরাইয়া তুলিকে খ্যাঁক করে উঠে বললেন,
“এ্যাই তুলি, কাজ পড়ে আছে চোখে দেখিস না?”

তুলি পা টিপে টিপে ফাবিহার সাথে কাজে হাত লাগালো। ফাবিহা বলল,“এটুকু আমি করতে পারবো। তুমি যাও।”

শাবাব বাড়ি ফিরলেও কথা বললো না ফাবিহার সাথে। ফাবিহাও বললো না। হুরাইনের নম্বরে কল দিল।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কে বলছেন?”

“আমি ফাবিহা। নিশির খালাতো বোন।”

হুরাইন চিনতে পেরে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল,“কেমন আছেন আপু?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন? বাবু কেমন আছে?”

হুরাইনের মৃদু হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
“আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালো আছি। আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হচ্ছে। বিয়ের পরদিন যে দেখা দিয়ে চলে গেলেন আর এলেন না। আমাদের বাড়িতে আসুন।”

ফাবিহা হেসে বলল,“আমি এখন শশুর বাড়িতে ভাবি।”

“আপনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে? আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে আপনার স্বামীকে নিয়ে আসুন।”

শাবাব তীক্ষ্ণ চোখে কখন থেকে তাকিয়ে আছে। ফাবিহা কার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে?

স্বামীর কথা বলায় ফাবিহা চুপ করে গেল। কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে বলল,“নিজের যত্ন নিচ্ছেন তো ভাবি?”

“সবাই যত্ন নিচ্ছে।”

“অন্যদিন কথা হবে।”

“ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ।”
কল কাটতে গিয়েও ফাবিহা জিজ্ঞেস করলো,“আচ্ছা ভাবি, কী করলে সুখী হওয়া যায়?”

হুরাইন কিছু বুঝলো কি না সেটা আন্দাজ করা গেল না। কেবল বলল,“বেশি বেশি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত আর আল্লাহর কাছে সবকিছু চাইবেন আপু।”

ফাবিহা অস্থির গলায় বলল,“যদি কখনো মনে হয় আমি নিজের জীবন নিয়ে সুখী না তাহলে?”

হুরাইন ধরেই নিলো ফাবিহা হয়তো এখনো তাসিনের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবে। সে মুচকি হেসে বলল,“আল্লাহ যাঁকে যাঁর জন্য সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সাথেই তাঁর জীবন জুড়বে। তিনি যা করেন, মানুষের ভালোর জন্যই করেন। তাই ধৈর্য ধারণ করা উচিত।”

ফাবিহা বলল,“পরে আবার বিরক্ত করবো আপনাকে।”

“যখন-তখন স্মরণ করতে পারেন। আমি বরং খুশি হবো।”

কথা শেষ করে ঘরে ঢুকলো ফাবিহা। শাবাব ফোনে মনোযোগ দিয়েছে। যেন সে এতক্ষণ ফাবিহার দিকে তাকায়ওনি। ফাবিহাও নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। নিরবতা ভেঙে শাবাব বলল,“কাল তোমার জন্য শপিং করে নিও। এখানে ওয়ালেট রাখা আছে।”

ফাবিহা শান্ত গলায় বলল,“আমার জামাকাপড় আছে।”

“সেটা থাকতেই পারে। বিয়েটা যেভাবেই হোক, তোমাকে কিছু দেওয়া হয়নি।”

“আমি তোমার কাছ থেকে কিছু আশাও করি না।”

শাবাব তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,“সরি!”

চোখ উলটে তাকালো ফাবিহা। জিজ্ঞেস করলো, “কীসের জন্য?”

“তোমার সাথে যা যা হয়েছে সবকিছুর জন্য সরি!”

ফাবিহা ঠাণ্ডা গলায় বলল,“সরি বললেই কি সব সমাধান হয়ে যাবে? সব আগের মত হয়ে যাবে?”

“আমি জানি কিছুই ঠিক হবে না। তুমি আমার জেদ ছিলে। সেজন্য আমি যেকোনো ভাবে তোমাকে নত করতে চেয়েছিলাম। আমি ক্ষমা চাইছি।”

“ক্ষমা মন থেকে আসে শাবাব। আমি চাইলেই নিজের সাথে করা তোমার নীচ কাজগুলো ভুলতে পারছি না। তুমি কী কী করেছো আমার সাথে। আমি সবকিছু ভুলে গিয়ে নিজের মত করে আবার সবটা শুরু করতে চেয়েছি। ফুফুর বাড়ি থেকে আসার পর তুমি আবারও সবটা তচনচ করে দিলে। তোমার কাছে যেটা বিয়ে মনে হয়, সেটা আমার কাছে বিয়ে নয়। আমার মনে হয় নিজের ইজ্জত বেচে দেওয়া হয়েছে। সেদিন তুমি যা করলে, মানুষ যা যা ব্যবহার করলো তাতে আমার ওটাকে আর বিয়ে মনে হয়নি। তোমার কারণে সুমন আমার পেছনে পড়েছে। আমাকে ‘মা*ল’ সম্বোধন করছে। তোমার খেয়ে ছেড়ে দেওয়া মা*ল। যাকে তুমি এখনো ছেঁকে দেখো। এতকিছুর মূল্য কীভাবে চোকাবে শাবাব? একটা সরি দিয়ে?”

ফাবিহার গলা শান্ত হলেও সুরে তাচ্ছিল্য। শাবাব দৃষ্টি নিচু করে রেখেছে। নিস্তেজ গলায় বলল,“তুমি কী চাও?”

“তুমি ভালো করেই জানো।”

“ঠিক আছে। তুমি কালই চলে যেতে পারো।”

শাবাবের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না ফাবিহার। সন্দিহান গলায় বলল,“তুমি আমার সাথে মজা নিচ্ছো? আমি তোমায় চিনি শাবাব। তুমি এক মুখে দুই কথা বলো।”

শাবাব বলল,“আমি কসম করেছিলাম তোমার জীবন জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বো। আমি সেটা করেছি। এবারও চাই তুমি আগের মত নিজের জীবন নিয়ে খুশি থাকো।”

ফাবিহার বুক থেকে ভারী পাথরটা নেমে গেল। উৎফুল্ল চোখে চেয়ে বলল,“আমাদের তো কাগজে-কলমে বিয়ে হয়নি। তাহলে মুখেই ডিভোর্স দিয়ে দাও।”

শাবাব থমকে গেল। ফাবিহাকে বিয়ে করার কথা সে কখনো কল্পনা করেনি। হঠাৎ করে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দুজনের জীবন জুড়ে গেল। দুজনের কেউই কাউকে চায়নি। তবুও শাবাব যেন বাঁধা পাচ্ছে। সে মলিন হেসে বলল,“যেখানে মন থেকে কেউ কবুলই বলিনি সেখানে ডিভোর্স আবার কী?”

ফাবিহা বলল,“আমি কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে। আশা করছি তুমি আর আমার সামনে আসবে না।”

“আসবো না।”

রাতে ফাবিহার ভালো ঘুম হলো। সকালে সে সব গুছিয়ে নিচে নামলো। সুরাইয়া আর ফিরোজ আলম দুজনে একসাথে জিজ্ঞেস করলেন,“তোমরা কোথাও যাচ্ছো?”

শাবাব বলল,“ফাবিহা চলে যাচ্ছে ওর বাড়ি। আমরা একসাথে সংসার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

ফিরোজ আলম, সুরাইয়া, তুলি তিনজনই বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন।

#চলবে……

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সুরাইয়া আতঙ্কিত স্বরে বললেন,“কী বলছো তোমরা? দুজনে বিয়ে করেছো না? তাহলে এসব কী বলো?”

শাবাব বলল,“শান্ত হও মা। বিয়েটা আমাদের ইচ্ছেতে হয়নি। সংসার করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।”

ফিরোজ আলম গরম হয়ে গেলেন।
“সব তোমাদের মর্জিমাফিক হবে? প্রথম থেকে যেভাবে আমাদের নাচিয়ে এসেছো, আমরাও সেভাবেই নেচে এসেছি।”
অতঃপর শুধু শাবাবের উদ্দেশ্যে বললেন,“তুই বিয়ে যেহেতু করবি না, তাহলে এত কাহিনী কেন করলি? বিয়ের উদ্দেশ্য না থাকলে একটা মেয়ের পেছনে এভাবে পড়ে থাকার কারণ কী?”

শাবাব চুপ করে রইল। এর যথাযোগ্য জবাব তার কাছে নেই।
“চুপ করে থাকবি না। আমার কথার জবাব দে।”

শাবাব শক্ত মুখে বলল,“কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সংসার সম্ভব নয় বাবা। আমরা কেউই আর সংসার করতে চাই না।”

ফাবিহা বলল,“আমি এই বিয়েতে খুশি নই। বাবার জোরাজোরিতে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি।”

সুরাইয়া একবার ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন তো একবার ফাবিহার দিকে। শাবাবের মুখ দেখে তিনি আন্দাজ করে নিলেন শাবাব যা বলছে মিথ্যা বলছে। এভাবে সংসার ভেঙে দেওয়াতে তার মত নেই। সে হয়তো জোরপূর্বক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি এবার পুরোপুরি নরম খোলসে বেরিয়ে এলেন। ফাবিহাকে ধরে বললেন,“এসব বলে না মা। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভাবছো সংসার ভেঙে এখান থেকে চলে গেলে তোমার জীবন আরো সহজ হবে। এসব ভুলেও চিন্তা কোরো না। জীবন আরো কঠিন হয়ে যাবে। এভাবে নিজেদের জীবন নষ্ট কোরো না।”

ফাবিহা সুরাইয়ার হাতে হাত রেখে নরম স্বরে বলল,“দেখুন আম্মা, আপনাদের কারো উপর আমার রাগ নেই। আমার পক্ষে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে সংসার করা সম্ভব নয়।”

সকলেই অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। অতঃপর নিরবতা ভাঙলেন ফিরোজ আলম। ফাবিহার উদ্দেশ্যে বললেন,“আমরা তোমায় আটকাবো না। তবে তোমাকে একা তো ছাড়া যায় না। তোমার বাবা-মাকে খবর দিচ্ছি।”

ফাবিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ফিরোজ আলম ফোন বের করে কল দিলেন আতাউর রহমানের নম্বরে।

আতাউর রহমান স্ত্রী নিয়ে চলে এলেন। দুই পরিবারের উপস্থিতিতে শাবাব আর ফাবিহাকে আরেকবার ভাবতে বলা হলো। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। ফাবিহার মা মেয়ের পক্ষে। তিনি মেয়েকে বল দিয়ে বললেন,“মা তোর পাশে সবসময় আছি।”

সকালের নাস্তা আর কারো হলো না। পরিস্থিতিই এমন ছিলো যে, গলা দিয়ে খাবার নামানোর চিন্তা কারো মাথায় ছিলো না। শেষ পর্যন্ত ফাবিহা আর শাবাবের সিদ্ধান্তেই সবাইকে হার মানতে হলো। ফাবিহার বাবা-মা তাঁদের সাথে মেয়েকে নিয়ে যাবেন। ফাবিহা জেঠী শাশুড়ির দেওয়া গলার হার আর টাকা শাশুড়ির হাতে দিয়ে বলল,“এগুলো যার প্রাপ্য, তাকেই দেবেন। আসি আম্মা।”

সুরাইয়া বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর ফিরোজ আলমের কাছ থেকে বিদায় নিলো ফাবিহা। শাবাবের দিকে আর ফিরে তাকালো না। বাবা-মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে এলো। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো তিনটি মানুষ।
দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যেতেই ফিরোজ আলম শাবাবের দিকে তাকালেন। রাগে, কষ্টে, অপমানে বললেন,“সারাজীবন তুই আমাকে ছোটোই করে এসেছিস। কোনোদিন আমার মুখ উজ্জ্বল করতে পারিসনি। না আদব-কায়দায় আর না পড়াশোনায়। কোনোদিন একবিন্দু শান্তি দিসনি আমায়। ভুল করেছি তোকে বাঁচিয়ে রেখে। ছোটো বেলায় লবণ খাইয়ে মে*রে ফেললেই ভালো হতো। তুই ম*র*তে পারিস না?”

শাবাব অসহায়বোধ করলো। সুরাইয়ার বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো। তিনি বিচলিত কণ্ঠে বললেন,“কী বলছো এসব?”

ফিরোজ আলম রাগের মাথায় আবারো বললেন,“তোমার ছেলেকে যেহেতু সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শিখে গিয়েছে, তাহলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের রুটিরুজি নিজেকে জোগাড় করতে বলে দিও। তার দায়িত্ব নেওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।”

স্থান ত্যাগ করলেন তিনি। শাবাব ভেবে দেখলো তার কৃতকর্মের ফল সে একা নয়, বরং আশেপাশের সব মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে। নিজের জন্য আরো একটি সিদ্ধান্ত নিলো। বাবা-মাকেও এবার একটু শান্তি দেওয়া প্রয়োজন। ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিস্তেজ পায়ে হেঁটে এলো নিজের ঘরে। সুরাইয়া সবসময় ছেলের অন্যায়কে অন্যায় মনে করেননি। আজ আর স্বামীর বিরুদ্ধে ছেলের জন্য প্রতিবাদ করতে পারেননি। তিনিও চুপ ছিলেন। কিন্তু শাবাবের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত হলে বোধহয় আরো একটা চমক পেতেন।

দুপুরে সবাইকে খেতে ডাকলো তুলি। আশ্চর্যজনকভাবে সবাই এসে চুপচাপ খেয়েও নিলো। কাউকে দ্বিতীয়বার খাবারের জন্য ডাকতে হয়নি। কিন্তু কারো মুখে কথা ছিল না।

ফাবিহা নিজেকে মুক্ত পাখি ভেবে প্রাণ খুলে হাসলো। অনেকদিন পর নিজের বাড়ির ছাদে এলো। পাশের বিল্ডিং এর এক আন্টি জিজ্ঞেস করলেন,“আরে ফাবিহা যে! কেমন আছো? কবে এসেছো শশুর বাড়ি থেকে?”

ফাবিহা হাসিমুখে বলল,“আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি আন্টি। এসেছি আজই।”

“এবার এত তাড়াতাড়ি আসতে দিল? দুই-তিন দিনই তো হলো।”

ফাবিহা হেসে হেসেই জবাব দিল,“আসতে কেন দেবে না? আমি আসতে চাইলে আমাকে আটকে রাখার সাধ্যি কার?”

“যাই বলো, ভালো শশুর বাড়ি পেয়েছো তবে। আমার মেয়েটাকে তো বছরেও আসতে দেয় না।”

ফাবিহা কথা বললো না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,“জামাইকে একবারও দেখলাম না। কখন আসে কখন যায়?”

ফাবিহা মনে মনে বলল,“আর কখনো দেখবেন না।”
মুখে বলল,“দেখেছেন হয়তো চিনতে পারেননি।”

“হবে হয়তো।”

ফাবিহা নিচে নেমে এলো। ফোন থেকে নিজের হাতের ছবিটা ডিলিট করে দিল। এটার আর প্রয়োজন নেই। ভেবেছিল শাবাবের বিরুদ্ধে এমন ছোটোখাটো কিছু প্রমাণ রেখে দেবে। যাতে পরবর্তীতে তাকে কেউ সংসার করার জন্য জোরজবরদস্তি করতে না পারে। এখন শাবাব নিজেই যেহেতু তার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে, তাই তার বিরুদ্ধে যাওয়ার আর প্রয়োজন পড়ছে না। আর একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সুমনের। মনে হচ্ছে না সে সোজা হবে। চুপ থাকলে বরং তার সাহস আরো বেড়ে যায়।

★★★

তাসিন এশার নামাজ পড়ে মসজিদে বসে রইলো। মোনাজাতে আজকাল সকলের সাথে তার অনাগত সন্তানও ঠাঁই পাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারছে পরিবর্তন যেকোনো বয়সে হওয়া যায়। চেষ্টা থাকলে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়। দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে অনেকের সাথেই দূরত্ব বেড়েছে। এতে এখন আর আফসোস হয় না। মসজিদ থেকে বেরিয়ে বাড়ি গেল। রাতে খেতে বসেই সাজেদা বললেন,“বউকে আর কতদিন বাপের বাড়ি তুলে রাখবি? এবার বাড়ি নিয়ে আয়।”

তাসিনের বাবা চোখ কপালে তুলে বললেন,“তুমি না শান্তিতে আছো? বউমা বাড়ি থাকলেই তো তোমাকে বিরক্ত করে।”

সাজেদা চোখ পাকিয়ে তাকালেন।
“তাই বলে কি স্বামীর বাড়ি আসা লাগবে না? সারাজীবন বাপের বাড়িতেই থাকবে?”

তাসিন খানিক মুচকি হাসলো বাবা-মায়ের ঝগড়া শুনে। তবে মনে মনে দুঃখ প্রকাশ করলো বেশি। শশুরের দেওয়া শর্ত সম্পর্কে বাবা অবগত হলেও মা কিছুই জানেন না। তাই চাইলেও যে এখন হুরাইনকে নিয়ে আসা যাবে না সেটা মা বুঝবেন না। তাসিন বাবার দিকে তাকাতেই তিনি সাজেদার উদ্দেশ্যে বললেন,“বউমা ওখানে থেকে আরেকটু শক্ত হয়ে আসুক।”

সাজেদা তেতে উঠলেন।
“আমি কি তার দেখাশোনা করতে পারবো না? তোমরা ভাবো আমি সারাদিন ওকে কাজ করাবো? নবদের ছেলেমেয়ের জন্য যদি আমি সব কাজ করতে পারি, তাহলে নিজের নাতি-নাতনির জন্য পারবো না?”

তাসিনের বাবা বললেন,“তুমি বুঝতে পারছো না। আমি ওটা বুঝাতে চাইনি। আমি বলতে চেয়েছি তুমি সংসারের কাজে মন দিলে বউমার খেয়াল রাখবে কীভাবে? ওখানে তো তার মা আছে, ভাবি আছে। বোনেরাও আসা-যাওয়া করে।”

সাজেদা কথা বললেন না আর। মেজাজ এখন খুব খা*রা*প আছে। নিশি চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। তাসিনও খেয়ে ধীরেসুস্থে ঘরে এলো।
স্ত্রীকে এখনো থমথমে দেখে তাসিনের বাবা সাজেদার মুখোমুখি হয়ে বললেন,“আজ আমাকে কিছু সত্যি কথা বলবে সাজেদা?”

সাজেদা বেগম চমকালেন। কী সত্যির কথা জানতে চাইছেন? তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন স্বামীর কাছ থেকে কী লুকিয়েছিলেন!
“কী হলো? বলে।”

“বলো কী সত্যি জানতে চাও?”

“তুমি কি সত্যিই বউমাকে পছন্দ করো না? একেবারে মন থেকে বলবে। ফাবিহার সাথে এমন একটা কাণ্ড না ঘটলে কি তুমি সত্যিই হুরাইনের মত বউ পেয়ে খুশি হতে না?”

সাজেদা হাত ছাড়িয়ে নিলেন।
“এটা তোমার প্রশ্ন? যা হওয়ার হয়েছে, বাদ দাও।”

“তোমাকে আজ বলতেই হবে।”

সাজেদা আজ মনের রাগ ইচ্ছেমতো মিটিয়ে বলতে শুরু করলেন,“আমি কত বড়ো মুখ করে বোনের মেয়েকে চাইলাম। তাদের কাছে আমাকে ছোটো বানিয়ে দিল তোমার ছেলে। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমার উপর থেকে। শুধু কি আমি ছোটো হলাম? মেয়েটার মনের অবস্থা কীরকম হয়েছিল? তোমার পুত্রবধূ এসে একেবারে সিংহাসন গেঁড়ে বসেছেন। সবটার মূলে রয়েছে সে। তাই তাকে আমি মন থেকে মানতে পারছি না।”

তাসিনের বাবা বললেন,“সত্যিই কি মন থেকে মানতে পারছো না? তাহলে তাকে বারবার কেন নিয়ে আসতে বলছো? আর যা কিছু হয়েছে তাতে তো তার কোনো হাত নেই। সব দোষ তোমার ছেলের। অথচ ছেলের সাথে দিব্যি কথা বলে যাচ্ছো। তাহলে পরের মেয়ে কী দোষ করলো?”

সাজেদা মুখ ঘুরিয়ে বললেন,“তাকে এই বাড়িতে আনতে বলছি আমার নাতি-নাতনির কথা ভেবে। আমি তো দাদি।”

তাসিনের বাবা আলগোছে হাসলেন। বললেন,“আমি কিছু বলবো না সাজেদা। তুমি একবার নিজের পরিষ্কার মনকে জিজ্ঞেস করে সব প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে নিও।”

তাসিন শশুর বাড়ি এলো। জনাব আজাদ সরু চোখে তাকিয়ে আছেন। নিজের সন্তানের কথা বলে ঘনঘন আসা-যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে নিয়েছে। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,“আপনি কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করছেন।”

তাসিন ভদ্রতা করে হাসলো। নরম সুরে বলল,“শর্ত ছিল আপনার মেয়ে আমার সাথে যাবে না। কিন্তু আমার আসা বারণ ছিল না। যদি বারণ ছিল ধরেও নিই তাহলেও আরেকটা পথ খোলা আছে আমার।”

“ওটাই তো সব সমস্যা।”

তাসিন বলল,“আল্লাহ চান আমি এখানে আসি, সেজন্যই আমার জন্য পথ খুলে দিয়েছেন।”

জনাব আজাদ আর কথা খুঁজে পেলেন না। তাসিন ভেতরে গেল। হুরাইন হাঁটাহাঁটি করছে। দুই ঠোঁট গোল করে কী কী পড়ছে। রাগ হলো তার। এতটা পাষাণ কীভাবে একটা কোমলমতি মেয়ে হতে পারে? স্বামীর জন্য মনে একটু দয়ামায়া নেই। তাসিন পেছন থেকে গলা ঝাড়লো। হুরাইন পিছু ফিরে তাকালো। তাসিনকে দেখে উপরে বেশ বিরক্ত হওয়ার ভান ধরলো।
“আপনি কেন এসেছেন? মাঝে একদিন না যেতেই আবার উপস্থিত?”

“আমি নিশ্চয়ই তোমাকে দেখতে আসিনি।”

মুখ বাঁকালো হুরাইন। তাসিন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,“আমার বাবু কী খেয়েছে?”

হুরাইন চোখ সরু করে তাকালো। বলল,“আমি কী খেয়েছি সেটা জিজ্ঞেস করলেই পারেন।”

“তুমি কী খেয়েছো সেটা আমার জনয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার বাবা আছেন সেটা জানার জন্য। আমি আমার সন্তানেরটা জানতে চাইছি।”

মনে মনে হাসলো হুরাইন। মুখে বলল,“তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ কী? নিজেই জিজ্ঞেস করে নিন নিজের বাচ্চাকে।”

“সে কথা বলতে জানলে নিশ্চয়ই তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম না!”

তাসিন চোখ ঘুরিয়ে হুরাইনের চুলের দিকে তাকালো। বলল,“তুমি কি চুলে তেল দাও না? আমার বাচ্চার চুল পাতলা হলে তোমার দোষ। আমি তখন তোমাকে ধরবো। তেল কোথায়?”

তেল খুঁজতে লাগলো তাসিন। হুরাইন বলল,“চুল পাতলা হলে নাহয় আমার দোষ। কিন্তু বেদ্বীন তৈরি হলে কার দোষ?”

তাসিন এখন আর রাগ করে না। তেল খুঁজে পেয়ে হুরাইনের পেছনে গিয়ে বসলো। হাতে তেল নিতে নিতে বলল,“তাকে এবং তার বাবাকে দ্বীনি পথে পরিচালনা করার দায়িত্ব তার মায়ের। ছাত্র শিখতে না পারলে অবশ্যই তাকে শাসন করার অধিকার শিক্ষকের রয়েছে।”

আজ ছুটির দিন হওয়ায় তাসিন এখানে রইলো। শশুরের সাথে জামাআত ধরার জন্য বের হলো। জনাব আজাদ লক্ষ করছেন তাসিনকে। জুমার নামাজ শেষে আজ মসজিদ জিলাপি দেওয়া হলো। হুরাইন জিলাপি পছন্দ করে। সে হাতে করে নিয়ে এলো হুরাইনের জন্য। জনাব আজাদ একটা নাতির হাতে দিলেন, আরেকটি হুরাইনের হাতে। হুরাইন হাসলো। স্বামী – বাবা দুজনের মাঝে চলা নিরব যুদ্ধ সম্পর্কে সে অবগত। পেটে হাত রেখে বলল,“তুমি বলো তো, তোমার বাবার শাস্তিটা কি এবার একটু কম করা উচিত?”

দুপুরে খাওয়ার পর হুরাইন আর জনাব আজাদ কথা বলতে বসলেন। দুজনের চেহারাই বেশ ভাবুক বানিয়ে রেখেছে। হুরাইন বলল,“আমার মনে হয় এবার আমার ফিরে যাওয়া উচিত আব্বু। কারণ ওনার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে সেটা আমি দূরে থাকার কারণে দেখতে পাচ্ছি না।”

জনাব আজাদ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললেন,“বাহ্যিক যেটুকু আমি নজর রাখতে পেরেছি, তাতে আলহামদুলিল্লাহ অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে।”

“তাছাড়া আমার শাশুড়ি, ননদ ওনারা কিন্তু আমি দূরে থাকায় দ্বীন থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছেন। আমার যাওয়া উচিত।”

“ঠিক আছে। আপনি যাবেন আম্মু। আগে দেখুন জামাই নিজ থেকে আপনাকে যেতে বলে কি না?”

হুরাইন হাসলো কেবল। বাবা না জানলেও সে তো জানে তাসিনের এখানে বারবার আসার উদ্দেশ্য কী। সে কী চায়।

★★★

শাবাব কিছু জামাকাপড় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে মাকে ফোন করে বলল,“আমাকে ক্ষমা করে দিও মা। আমি আর তোমাদের অসম্মানের কারণ হতে চাই না। আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি।”

সুরাইয়ার হাউমাউ কান্নার আওয়াজ শুনে ফোন কেটে দিল শাবাব। মায়ের জন্য তার মনটা কেমন করছে। চোখে পানি এসে ভীড় জমাতে চাইছে।
সাথে কিছু টাকা ছিলো। সেগুলো দিয়ে অনায়াসে দিন পনেরো কেটে গেল। যখন পকেট শূন্য হলো তখন উপলব্ধি হলো বাবা কী জিনিসের নাম। মানুষ সবসময় মায়ের অবদানের কথাই বলে বেড়ায়। বাবা বাইরে থাকেন। লালনপালন, খাওয়ানো, ময়লা পরিষ্কার করা সব করেন মা। অথচ আরেকটু গভীরে গিয়ে ভাবলে উপলব্ধি করা যায় লালন-পালন, আরাম-আয়েশের জীবনের জন্য গাধারখাটুনি করতেই তো বাবা বাইরে থাকেন। খাঁ খাঁ রোদে ঘামে জবজবে শরীর নিয়ে যখন একজন রিকশাচালক বাবার দিকে তাকানো যায়, তখন বুঝা যায় বাবার গুরুত্ব কতটুকু।

কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে ধারে টাকা নিলো। যে ছেলে বাবার টাকার দাপুটে বন্ধুদের নিয়ে টাকা ছিটিয়েছে, সেই ছেলেই বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে টাকা ধার করে চলছে। যতগুলো দিন পেরুচ্ছে ততই জীবনটা কঠিন ও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে আজকাল সম্মানটাও পাচ্ছে না। পাবে কী করে? যেখানে কোনো মুরব্বি দেখলে সম্মান দিয়ে কথা বলাটা অতি অপ্রয়োজনীয় মনে করতো সে, সেখানে সে কীভাবে সম্মান পাবে? সময়ের তীরটা ঘুরতে ঘুরতে একদিন নিজের দিকেই তাক হয়।
বন্ধুদের ধার করা টাকাও ফুরিয়ে এলো। এখন হাত শক্ত করে খরচ করে। একবেলা খেলে আরেকবেলা না খেয়ে থাকে। তিনবেলা খেলেই যে টাকা ফুরিয়ে যাবে। পড়াশোনায় কোনোদিন ভালো করেনি। চাকরির বাজারে তার কদর নেই। যেসব কাজ হাতের কাছে পাচ্ছে তাতে তার প্রেস্টিজে লাগছে। তারউপর বেতন সামান্য।

মসজিদে আজান হয়েছে। পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো শাবাব। অনেকেই ঢুকছেন মসজিদে। শাবাব তাকিয়ে রইলো। কবে সে মসজিদে গিয়েছে, কবে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়েছে সে মনে করতে পারছে না। খুব ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে সেই যে মসজিদে আসা হলো। এরপর আর আসা হলো না। অনেক ভেবেচিন্তে মসজিদের দিকে পা বাড়ালো সে। অন্যদের দেখাদেখি ওজু করলো। কিন্তু ওজুর পূর্বে, ভেতরে কী পড়তে হয় সে জানে না। বিসমিল্লাহ পড়ে ওজু শেষ করে মসজিদে পা রাখলো। শরীর কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো। নামাজ পড়ে মলিন মুখে বসে রইলো। সকলে বেরিয়ে গেলেন। তখনও দুজন হুজুর ভেতরে বসা ছিলেন। তারাও বেরিয়ে গেলেন। শাবাব বসে রইলো। ঘন্টাখানেক পর সেই হুজুরের মধ্যে একজন ভেতরে এসে শাবাবকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে ডাকলেন।
“বাবা, আপনি বাড়ি যাবেন না?”

“হুঁ?”
শাবাব অন্যমনস্ক ছিলো। তিনি বললেন,“অনেকক্ষণ যাবত বসে আছেন দেখছি। বাড়ি যাবেন না?”

শাবাব নিস্তেজ গলায় বলল,“বাড়ি তো নেই।”

“বাড়ি থেকে রাগ করে এসেছেন? রাগ না করে ফিরে যান বাবা।”

“কীভাবে ফিরবো? আমি আমার আশেপাশের সব মানুষকেই অশান্তিতে রাখি। আজ আমার নিজের জীবনেই শান্তি নেই।”

“কী হয়েছে। খুলে বলুন।”

শাবাব নিজের সমস্ত কৃতকর্মের কথা বললো। কীভাবে সে মানুষকে অসম্মান করে এসেছে, মেয়েদের পেছনে ছুটেছে, বাবা-মায়ের সাথে অন্যায় করেছে। শেষমেশ স্ত্রীর সাথে বিয়ের আগেও ও পরে কী করেছো সব বললো।

সে ভেতর থেকে খুবই ভেঙে পড়লো। বলল,“আমি কীভাবে ক্ষমা পাবো?”

হুজুর বললেন,“ক্ষমা করলেও মন থেকে একবার যে অভিশাপ লেগেছে সেটা তো ফেরানো সম্ভব নয়। বুলেট একবার ছুঁড়লে সেটা যেমন ফেরানো যায় না, তেমনি গুরুজন, বাবা-মায়ের মনে কষ্ট এসে গেলে না চাইতেও যে অভিশাপটা পড়ে তা ফেরানো সম্ভব নয়। আপনি বরং বাড়ি ফিরে যান। বাবা-মা মুখে কিছু বললেও আবার বুকে টেনে নেবেন।”

হুজুর চলে গেলেন। শাবাব বেরিয়ে এলো মসজিদ থেকে। মা-বাবা দুজনের কথাই খুব মনে পড়ছে। ফাবিহার বিষয়টি তাকে যতটা না পোড়ায়, তারচেয়ে বাবা-মায়ের সাথে করা অন্যায়, তাদের কাছ থেকে দূরে থাকাটা তাকে পোড়ায়।

ফাবিহা প্রথম কিছুদিন শান্তিতে চলাফেরা করলেও এখন সকলেই ওর স্বামীর কথা, শশুর বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে। ফাবিহা বলেও দিয়েছে সে একেবারে চলে এসেছে। সেই থেকেই তার জীবনে নেমে এসেছে বাঁকা চোখের চাহনি। প্রথম থেকেই অপয়া, অলক্ষ্মী ট্যাগ ছিল। এখন সকলের চোখে সে খুবই ছোটো একটা প্রাণী। ফাবিহা নিজেকে প্রশ্ন করে “জীবনে সুখ কোথায়? কোথায় গেলে একটা সুস্থ জীবন পাওয়া যাবে?”

#চলবে…….

রি-চেইক করা হয়নি।

এক টুকরো আলো পর্ব-২৩+২৪

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সারাদিন ঘুরাঘুরি করে রাতের খাবার খেয়ে মাত্র হোটেল রুমে ঢুকলো ফাবিহা। দুই বান্ধবী ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফাবিহা খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনলো। গত কয়েকদিন সে নিজেকে নিয়ে প্রচুর ভেবেছে। শাবাবের সাথে যেভাবে জীবনটা জড়িয়েছে তাতে সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পার্টনারের প্রতি মন থেকে শ্রদ্ধা থাকা লাগে। শাবাবের প্রতি তার ঘৃ*ণা ছাড়া কিছুই আসে না।
প্রথমদিকে শাবাবকে স্বাভাবিকভাবে না করলেও সে তার আচরণে মাত্রা ছাড়িয়েছে। বিরক্ত হয়ে যা-তা বলা শুরু করলো শাবাবকে। শাবাব থামলো না। তাকে বারবার হেনস্তা করেছে। সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়ে শেষে যা করেছে তাতে কোনোদিনই ফাবিহা তাকে ক্ষমা করতে পারবে না। তার সম্মান নষ্ট হয়েছে, বাবার মুখ ছোটো হয়েছে। এই শাবাবের কারণেই মানুষ তাকে বা*জে কথা বলার সাহস পেয়েছে।

শাবাবকে রিজেক্ট করার কারণ শক্ত। যখন তাকে প্রপোজ করেছিল শাবাব, তখন তাসিনকে সে মনেপ্রাণে জীবনে পেতে চায়। পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে ঠিক। শাবাব মেয়েদের সাথে চুটিয়ে প্রেম করে বেড়ায়। মাস দু-য়েকের মাঝে তার আগ্রহ হারিয়ে গেলে সে অন্য নারীর পেছনে পড়ে। এতগুলো শক্ত কারণ থাকার পরও কোনো মেয়ে কেনো নিজেকে একটা ছেলের দুই-তিন মাসের ব্যবহৃত পণ্য বানাতে চাইবে?

সুমি ডেকে উঠলো,“ফাবু ঘুমাবি না?”

“তোরা ঘুমিয়ে পড়। আমি একটু পর আসছি।”

শাবাব বন্ধুর বাসায় দুদিন থেকেই বাড়ি চলে এলো। ফাবিহা তিনদিন পর সময় মত বাড়ি ফিরলো। আতাউর রহমান মেয়েকে নিয়ে বসলেন। শান্ত হয়ে বললেন,“কী করতে চাস তুই?”

ফাবিহা ভ্রু কুঁচকে বলল,“কোন ব্যাপারে?”

“তোর শশুর যে তোকে নিতে এলো সেই ব্যাপারে।”

ফাবিহা বিরক্ত হয়ে বলল,“বাবা তুমি কি আমায় বোঝা মনে করছো? তাহলে বলে দাও আমি কোথাও চলে যাই।”

মাঝেমাঝে আদরের সন্তানের কাছে বাবা-মাকে কঠিন হতে হয়। আতাউর রহমান গম্ভীর মুখে বললেন,“কোথায় যাবে তুমি? কোথায় যাওয়ার জায়গা আছে তোমার?”

“জানি না।”

“তখন আর বাবা-মা লাগবে না?”

ফাবিহা চোখ বুজে বলল,“বাবা প্লিজ! আমাকে বলো আমি কী করবো?”
বাবার দিকে তাকাতেই তিনি লক্ষ করলেন ফাবিহার চোখজোড়া অসহায়। তিনি ফাবিহার মাথায় হাত রেখে বললেন,“বিয়ে হয়েছে। এটা কোনো সাধারণ পুতুল খেলা নয় মা। তোমার উচিত একবার সুযোগ দেওয়া। সবকিছু যতটা সহজ ভাবছো, ততটা সহজ নয়।”

ফাবিহা স্তব্ধ হয়ে গেল। বাবা কীভাবে তাকে এমন কথা বলতে পারে? কীসের সুযোগ দেবে শাবাবকে? কোনো অধিকার না থাকার পরও সে যা করেছে এখন তো সুযোগ পেয়ে স্বামীর অধিকার খাটিয়ে দ্বিগুণ অ*ত্যা*চা*র করবে। বাবার উপর অভিমান হলো তার। কঠিন গলায় বলে দিল,“তাঁদের আসতে বলো। আমি যাব তাঁদের সাথে।”

আতাউর রহমান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,“রাগ করে নয়, ঠাণ্ডা মাথায় করো সব। এখন তুমি চাইলেই সংসারটা যেনতেন করে ভাঙতে পারবে না। তাঁরা যদি স্টেপ নেয় তোমাকে ঘরে তোলার, তুমি যদি না যাও, তাহলে বিয়ে ভাঙার জন্য নিশ্চয়ই একটা বৈঠক হবে। আর সেখানে সবাই বলবে আগে দুজনে সময় নিয়ে সবটা ঠিক করার চেষ্টা করো। যেভাবেই হোক, তোমাকে শাবাবের ঘরে যেতেই হবে। এরপর যদি মনে হয় কিছুই ঠিক হচ্ছে না, তুমি যখন-তখন চলে আসতে পারো। তুমি বাবার উপর রাগ কোরো না। আমি না পাঠালেও বৈঠকে সবাই তোমাকে ওখানে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করবে।”

মানুষ যখন অতিরিক্ত রাগে থাকে, তখন কোনো ভালো কথাও তার মাথায় ঢুকে না। ফাবিহারও হলো তাই। আতাউর রহমান মেয়েকে শাবাবের দিকে জোর করে ঠেলে দিচ্ছেন না। যাতে অন্যরা মেয়েকে না বলতে পারে ‘তুমি আগে সংসার করে দেখেছো?’
শাবাবকে তিনি নিজেও পছন্দ করেন না। কেবল মেয়ের ভালোর কথা চিন্তা করে এই ঝুঁকিটা নিচ্ছেন। ফিরোজ আলমকে পরদিন আসতে বললেন আতাউর রহমান। তিনি শাবাব বা সুরাইয়া কাউকে নিয়ে আসেননি। ফাবিহা চুপচাপ ফিরোজ আলমের সাথে বেরিয়ে গেল। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলেও বাবার সাথে কথা বললো না।

ফাবিহার মা রাত থেকে স্বামীকে কচলে ফেলেছেন। মেয়েকে তিনি শাবাবের হাতে কিছুতেই তুলে দেবেন না। এখনও যা পারছেন বলে যাচ্ছেন। যে পুরুষ মুখ বন্ধ রাখতে পারে, সংসার জীবনে সে-ই বোধহয় সবচেয়ে সুখী। কেননা এখন মুখ খোলা মানেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যুদ্ধ সৃষ্টি হওয়া। তারচেয়ে বরং মুখ বন্ধ রেখে চুপচাপ সব সহ্য করে যাওয়া ভালো। ফাবিহা চলে যাওয়ার পর থেকে কিছুই খেলো না তার বাবা-মা। আতাউর রহমান ভেতরে ভেতরে চিন্তায় অস্থির। মুখে কিছুই প্রকাশ করছেন না।

ফাবিহাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই সুরাইয়া বউ ঘরে তোলার আগে হাঁকিয়ে গেলেন।
“তুমি নাকি আমার আব্বার মাথা ফাটিয়েছ?”

ফাবিহা অচেনা নারীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফিরোজ আলম স্ত্রীকে বললেন,“শাবাবের মা, আগে যা হয়েছে বাদ দাও এসব।”

“কেন বাদ দেব? আমার আব্বা, আমার একমাত্র ছেলে। আমার ছেলের কিছু হলে ওর মা কি আমাকে একটা ছেলে দেবে?”

“কী আবোলতাবোল কথা বলছো তুমি? ছেলের শাশুড়ি তোমাকে ছেলে দেবে কেন?”

“তুমি চুপ থাকো।”

ফাবিহা প্রচুর বিরক্ত। তবে উপরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। ফিরোজ আলম ফাবিহাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। তুলিকে ডাকতে হলো না। সে আগেই এসে হাজির। তাকে বললেন,“তুলি এটা হলো তোমার ভাইজানের বউ। তোমার ভাইজানের ঘরে নিয়ে যাও।”

তুলি চুপচাপ নতুন বউ নিয়ে শাবাবের ঘরে ঢুকলো। এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার গদগদ কণ্ঠে বলল,“ভাবি আপনে মেলা সুন্দরী। এইজন্যই ভাইজান আপনার জন্য পাগল হইছে।”

অল্প বয়সি একটি মেয়ে তুলি। ফাবিহার ভালো লাগলো মেয়েটিকে। মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি পড়াশোনা করো?”

তুলি মাথা নেড়ে বলল,“না ভাবি। পড়ালেহা ভাল্লাগে না। আমার মাথায় ঢুকে না।”

ফাবিহা ঘর দেখতে দেখতে নাক সিটকালো। সব এলেমেলো হয়ে আছে। এর মাঝে জানতে চাইলো,“এই বাড়ির বাকি লোকজন কোথায়?”

“ভাইজান বাড়িত নাই।”

“বাকি ভাইবোন?”

“ভাইজান তো একলাই। আম্মার আর পোলাপান নাই। ভাইজান হেগো বিয়ার বারো বছর পর হইছে। আর কোনো পোলাপান নাই।”

ফাবিহা ভেবে বলল,“আচ্ছা তুমি যাও। তোমাকে ডেকে না পেলে হয়তো তোমার আম্মা তোমার উপরও রেগে যাবেন।”

তুলি ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,“ধূর, আম্মার রাগ। আম্মার রাগ এই আসে এই পানি হইয়া যায়। তা আপনে কন, আমার এত সুন্দর ভাইজানের মাথা ফাটাইলেন ক্যান?”

“এখন তোমার মাথাও ফাটিয়ে দেব।”

তুলি ভয় পেয়ে “ও মা গো” বলে দৌড়ে চলে গেল। ফাবিহা তুলিকে ভয় পেতে দেখে হেসে ফেললো। শাবাবের ছড়ানো ছিটানো সব জিনিস এক জায়গায় ঠেলে স্তূপ করে রাখলো। বাকি সব গুছিয়ে নিলো।

তুলি নিচে যেতেই সুরাইয়া থমথমে গলায় বললেন,“নবাবের বেটি, ডা*কা*তে*র সর্দারকে নাস্তা দিয়ে আয়।”

তুলি মুখ চেপে হাসলো। পুত্রবধূ আসার পর হামলে পড়লো আর এখন নাস্তা দিয়ে আসতে বলছে। শাবাব বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকতেই চমকে গেল। তার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে ফাবিহা। ঘরের চেহারা পাল্টে গিয়েছে। তার জিনিসপত্র সব এক জায়গায় জড়ো করে রাখা। যেন ডাস্টবিনের ময়লা। ফাবিহাকে বাবা আনতে যাবেন এটা শাবাব জানলেও ফাবিহা যে এত সহজে আসতে রাজি হয়ে যাবে শাবাবের ভাবনার বাহিরে ছিল। সে নিজের জিনিসপত্রের হাল দেখে রাগ দমিয়ে রাখতে পারলো না। চেঁচিয়ে ডাকলো,“এ্যাই মেয়ে ওঠো।”

ধড়ফড়িয়ে উঠলো ফাবিহা। সামনে শাবাবকে দেখে তেতে উঠে বলল,“কী সমস্যা তোমার? এমন মাইক বাজাচ্ছো কেন?”

শাবাব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“আমার জামাকাপড়, জিনিসপত্রের এই অবস্থা কেন?”

ফাবিহা তাচ্ছিল্য করে বলল,
“এসব তোমার জিনিসপত্র? আমি ভাবলাম ডাস্টবিনে ফেলার জন্য ময়লা জমা রেখেছো।”

ফাবিহার কথা শুনে শাবাবের রাগ আরো বাড়লো। বলল,“তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো ফাবিহা।”

“কী বাড়াবাড়ি করছি? শোনো আমি শান্তি চাইছি। দয়া করে শান্তি দাও। তোমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

শাবাব চোখ ছোটো করে তাকালো। কটমট করে বলল,“তোমার সাথে কথা বলার মনে হচ্ছে আমার খুব ইচ্ছে! আমারও তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই। এখন আমার বিছানা ছাড়ো।”

“বিছানা ছাড়বো কেন?”

“আমি ঘুমাবো।”

“তো আমি কি তোমার চোখের পাতা টেনে খুলে রেখেছি?”

শাবাব অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বলল,“তুমি সামনে থাকলে আমার মাথাব্যথা বেড়ে যাবে। দয়া করে এখান থেকে যাও।”

“অন্যের লাইফে মাথা দিতে আসলে মাথা ব্যথা তো হবেই।”

ফাবিহার কটাক্ষ করে বলা কথার প্রত্যুত্তরে শাবাব বলল,“আমার রাগ ওঠাবে না ফাবিহা।”

“তোমার সাথে কথা বলতেই আমি বিরক্ত হচ্ছি।”

শাবাব একটাও কথা না বলে লম্বা কদম ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দরজায় শব্দ হলো সজোরে। ফাবিহা পাত্তা দিলো না শাবাবের রাগকে। সে আবারও শুয়ে পড়লো।

শাবাব রাতে এসে একপাশে শুয়ে পড়লো। ফাবিহা জেগেই ছিল। শাবাবের দিকে না ফিরেই বলল,“নিজের লিমিটের কথা ভুলে যেও না। ওপাশ ক্রস করে এপাশে আসার চেষ্টা করলে ফল ভালো হবে না।”

শাবাব উঠে বসলো। ফাবিহার হাত চেপে ধরে বলল,“এ্যাই তুমি নিজেকে কী ভাবো? আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করবো। এটা আমার বাড়ি। এখানে আমার আধিপত্য চলবে, তোমার নয়। সবাই মিলে তোমাকে আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে বলে তোমায় এতক্ষণ সহ্য করছি।”

ফাবিহা হাতে ব্যথা পেল। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তেজী গলায় বলল,“সেজন্যই বে*হা*য়া*র মত আমার পেছনে পড়ে রইলে? নিজের বাবাকে পাঠিয়ে আমাকে নিয়ে এলে? তুমি আমাকে কী সহ্য করবে? তুমি তো আমাকে ডিজার্ভই করো না। তুমি যেমন থার্ড ক্লাস? তেমনটাই ডিজার্ভ করো।”

হাতটা আবার মুচড়ে ধরলো শাবাব। রাগে কাঁপছে সে।
“আমি থার্ড ক্লাস? নিজেকে দেখেছো তুমি? বাবাকে আমি পাঠাইনি। বাবা নিজেই গিয়েছে। আর তুমিই নি*র্ল*জ্জ বলে বাবা বলার সাথে সাথেই চলে এসেছো। কী ভেবেছো, আমার উপর রাজত্ব করবে? একদম মে*রে ফ্যানের সাথে ঝু*লি*য়ে দেব।”

ফাবিহা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে শব্দ করলো,“আহ্!”

শাবাব ঝাড়ি দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। ফাবিহা হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তে শাবাবকে বালিশ চাপা দিয়ে মে*রে ফেলার শখ জেগেছে। তারই ভুল ছিল। বাবার উপর রাগ দেখিয়ে এখানে আসা উচিত হয়নি। নিজের ভুলের জন্য এতটুকু কথা হজম করেই নিলো।

পরদিন ফাবিহাকে দেখতে তার শশুর আর শাশুড়ির আত্মীয়স্বজন আসা শুরু করলেন। ফাবিহা নিজের নিয়ে আসা জামাকাপড় থেকে একটা কমলা রঙের জামা পরলো। শাবাব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিল। সে ভ্রু কুঁচকে বলল,“এটা কী পরেছো তুমি?”

ফাবিহা যেন শুনতে পায়নি। সব কিছুতে কেন এই ছেলের কথায় পাত্তা দিতে হবে? সে ওড়না ঠিক করছে। শাবাবের রাগ উঠে গেল। প্রথমত এই রঙ তার অপছন্দ। দ্বিতীয়ত জামার গলা খুব বড়ো। সে কঠিন সুরে আদেশ দিল,“অন্য একটা জামা পরে আসো। নিচে আমার জেঠু, জেঠিমা, কাজিনরা আছে। বি*শ্রী লাগছে তোমায়।”

ফাবিহা কথার জবাব দিচ্ছে না। চুপচাপ ওড়না ঠিক করা হয়ে গেলে বের হতে নিলো। শাবাব ওর হাত ধরে ফেললো খপ করে। ফাবিহা কঠিন গলায় বলল,“হাত ছাড়ো শাবাব৷”

“তুমি জামা খোলো।”

ফাবিহার চোখে আগুন।
“আমি খুলবো না। দেখি তুমি কী করো।”

বলার দেরি শাবাবের হাত চলতে দেরি নেই। থ্রিপিসের পাশ থেকে ধরে টা*ন দিয়ে জামার নিচের দিকটা ছিঁড়ে ফেললো।

বিস্মিত হয়ে চোখ বড়ো করে তাকিয়ে রইলো ফাবিহা। তার চোখের পলক পড়ছে না।

শাবাবের কাজিন প্রিয়া চোখে হাত দিয়ে লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলল,“সরি! সরি! এই ভুল সময়ে এসে তোমাদের রোমান্স দেখে ফেললাম। ভাইয়া এতো রোমান্টিক।”

সে চলে গেল দৌড়ে। শাবাবও বেরিয়ে গেল। ফাবিহা ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। এখনো তার মস্তিষ্ক সচল হয়নি।

★★★

সাজেদা হুরাইনকে দেখতে এলেন স্বামীর সাথে। হুরাইন শাশুড়ির সবকিছু আগ বাড়িয়ে করতে যাচ্ছে। সাজেদা তাকে সাবধান করে দিলেন।
“এত উড়াউড়ির দরকার নেই। তিন-চার মাস রেস্টে থাকো। আবার রেস্ট বলতে সারাদিন শুয়ে থাকা নয়, একটু হাঁটাচলা করবে।”

হুরাইন মুখ লুকিয়ে হাসলো। হুরাইনের ভাবি বললেন,“তোমার শাশুড়ি দেখছি খুব যত্নবান।”

হুরাইন মুচকি হেসে বলল,“আমার শাশুড়ির মন ভালো। শুধু মুখেই মায়ের মত বকাবকি করেন।”

সাজেদা কান খাড়া করে শুনলেন ওনার কথা কী বলছে দুজন মিলে। হুরাইনের কথা শুনে সন্তুষ্ট হলেও মুখ রেখেছেন ভার করে। বিকেলে চলে যাওয়ার সময় হলে হুরাইনের মা আবদার করলেন।
“আপা, মেয়ে আমার কাছে দুটো মাস থাকুক।”

সাজেদা বললেন,“আমি কি আপনার মেয়ের যত্ন নিতে পারবো না?”

“না না আপা। আমি সেটা বলিনি।”

সাজেদা আবারও থমথমে গলায় বললেন,“আচ্ছা এখন আরো কিছুদিন থাকুক। যখন ভালোলাগবে, তখন বললেই তাসিন এসে নিয়ে যাবে।”

হুরাইনের মা খুশি হলেন। হাসিমুখে বেয়ানকে বিদায় দিতে দরজা পর্যন্ত এলেন। সাজেদা আবারও পেছন ঘুরে হুরাইনকে বলল,“ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করবে, পানি খাবে। নয়তো শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে।”

হুরাইন মনোযোগ দিয়ে শাশুড়ির কথা শুনে নিচ্ছে।
ওদিকে তাসিন আর তার শশুরের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে।
“আমার মেয়ে কিছু না বললেও আমি কিন্তু সব খবর রাখি জামাই। যেহেতু আমি জেনে-বুঝে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, তাই এভাবে আড়ালে খোঁজখবরটা নিতেই হচ্ছে। আপনি নিজের কথা রাখতে পারেননি। আমি আপনার শর্তটাই মেনে নিয়েছি। এখন থেকে আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে। আপনার বাইরের দিকটা নাহয় আমি খোঁজ নেওয়ায় জানতে পেরেছি, বাড়ির ভেতর কী কী করছেন সেগুলো তো আমার অজানাই রয়ে গিয়েছে। আমি শুধু মেয়ের ধৈর্য দেখে এতদিন চুপ করে ছিলাম। আপনি এখনো বান্ধবীদের সঙ্গ ছাড়তে পারেননি। এসব কিছুতেই বন্ধুত্ব হতে পারে না। ফিতনা ছাড়া কিছুই নয়।”

তাসিন চমকে উঠলো জনাব আজাদের কথায়। হুরাইনকে সে ছাড়তে পারবে না। বান্ধবীদের সাথে সে ইচ্ছে করে দেখা করেনি। গতকাল পথেই একজনের সাথে দেখা। সে আগ বাড়িয়ে কথা বলল। তাসিন কেবল কোনোভাবে উত্তর দিয়ে দ্রুত পাশ কাটিয়ে এসেছিল। দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একসময় আর কথা বলাও হবে না। দূর থেকে দেখে তো আর সবকিছু শোনা বা বুঝা যায় না। যিনিই দেখেছেন, দূর থেকে দেখেই বিচার করে নিয়েছেন। তাসিন কিছুইতে শশুরের কথা মেনে নিতে পারছে না।

“অসম্ভব! আমি হুরাইনকে ছাড়তে পারবো না।”

“যদি হুরাইন নিজেই আপনার সাথে ফিরতে না চায়?”

স্তব্ধ চোখে ভীতি নামলো তাসিনের। হুরাইন এমনিতেই বলে দিয়েছে সে তার সাথে ফিরবে না। এখন যদি বাবার কথা শুনে সত্যি সত্যি ফিরতে না চায়?

#চলবে…..

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

“তাসিন ভাই বিয়ে করলেন আর দাওয়াত দিলেন না! ভাবি কেমন, সেটা তো দেখলাম না। দেখি ছবি দেখান।”

তাসিনের অজানা কারণে হুট করে রাগ হলো। চোয়াল শক্ত হতে লাগলো। তবুও কঠিন মুখে হাসি টে*নে বলল,“আমার স্ত্রীকে দেখার অধিকার তো শুধু আমারই ভাই।”

লোকটি রসিকতা করে বলল,“কী বলেন ভাই, ভাবি কি বেশি সুন্দরী? সেজন্যই দেখাতে চাচ্ছেন না?”

এবার আর ঠোঁটে হাসি টুকু রইলো না তাসিনের। তার স্ত্রী কেমন, বর্ণনা শুনে লোকটি কল্পনা করার চেষ্টা কেন করবে? শক্ত গলায় বলল,“আমার স্ত্রী পর্দা করে। সে পরপুরুষের সাথে দেখা দেয় না।”

লোকটি যেন বিদ্রুপ করে হাসল। হয়তো ভাবলো এ আবার কোথাকার কোন হুজুর এলো। মুখে বলল,“ভালো ভালো।”

তাসিন কথা শেষ দিয়ে বিদায় নিলো। দুদিন ধরে হুরাইনের সাথে কোনো কথা হচ্ছে না। হুরাইন ইচ্ছে করেই ফোন তুলছে না। এদিকে শশুর বাড়ি যাওয়াও তার নিষেধ। আজ আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সন্ধ্যার পর শশুর বাড়ি চলে গেল তাসিন। মেহমান খানায় না ঢুকে সোজা বাড়ির ভেতরে এসে দরজায় দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে পুরুষ মানুষের উপস্থিতি জানান দিলো। সামনের ঘরে কোনো মহিলা থাকলে সরে যাবেন। দরজায় দাঁড়ানোর দুই মিনিট পর ভেতরে ঢুকলো তাসিন। পড়ে গেল শশুরের সামনে।
জনাব আজাদ হাতের কিতাব বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে চাইলেন। প্রশ্ন করলেন,“আপনি এখানে কেন?”

থতমত খেয়ে গেল তাসিন। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো। গম্ভীর স্বরে বলল,“আমি আপনার সন্তানের কাছে আসিনি। আমার সন্তানের কাছে এসেছি।”

জনাব আজাদ আগাগোড়া পরোখ করলেন তাসিনকে। পরিপাটি হয়েই শশুর বাড়িতে এসেছে। মুখ যথেষ্ট গম্ভীর করে রেখেছে। জামাতা যে একটু ধূর্ত আছে, সেটাও তিনি চট করে বুঝে গেলেন। তিনিও কম যান না। কিতাব খুলে তাতে চোখ রাখলেন। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন,“আপনার সন্তান এখনো দুনিয়াতে আসেনি। যখন আসবে, তখন এসে তাকে নিয়ে যাবেন।”

তাসিনের এবার রাগে দাঁত লেগে আসছে। শশুরের সাথে তো আর চেঁচামেচি, হাঙ্গামা করা যায় না। তাই ধপ করে বসে পড়লো। গমগমে আওয়াজ তুলে বলল,“আমার সন্তান দুনিয়ায় আসা পর্যন্ত তার দেখভাল করার অধিকার আমার আছে। আর সে ভূমিষ্ট হওয়ার পর তো অবশ্যই তাকে নিয়ে যাবো।”

“আমার মেয়ের কাছে যাওয়া ছাড়া আপনি যেভাবে পারেন আপনার সন্তানের যত্ন নিন।”

“কথা ছিল আমি শর্ত ভঙ্গ করলে আপনার মেয়ে আপনার কাছে থাকবে। আমার সাথে ফিরবে না। কিন্তু তাতে এটা উল্লেখ ছিল না যে আমি এখানে এসে তার সাথে দেখা করতে পারবো না। ঠিক আছে, তাকে যেতে হবে না আমার সাথে, আমি আসবো এখানে। যতদিন আমার সন্তান এখানে থাকবে, ততদিন আমিও এখানে আসা-যাওয়া করবো।”

জ্বলন্ত চোখে তাকালেন জনাব আজাদ। তাসিন শশুরকে জালে ফাঁসিয়ে দুর্বোধ্য হাসলো। জনাব আজাদ বললেন,“আপনি যতই ছলচাতুরী করেন না কেন, মেয়ে আমি আপনার সাথে যেতে দেব না।”

“ঠিক আছে। আপনার সন্তানের প্রতি আপনার যেমন অধিকার, আমার সন্তানের প্রতিও আমার ততটাই অধিকার। আরো একটা কথা বলে রাখছি। আজ আমাকে আমার সন্তানের কাছে আসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে, একসময় আমিও আপনাকে নাতি-নাতনির কাছে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবো।”

জনাব আজাদ বললেন,“এমন কিছু শর্তে উল্লেখ ছিল না।”

“আমি আমার সন্তানের কাছে আসতে পারবো না, এমনটাও শর্তে উল্লেখ ছিল না।”

তাসিন ফলমূলসহ কয়েক পদের খাবার জিনিস নিয়ে এসেছে। জনাব আজাদ এবার সেদিকে তাকালেন।
“এগুলো আপনার জিনিস আপনি নিয়ে যাবেন।”

তাসিন হেসে বলল,“এগুলো আমার সন্তান খাবে।”

“আপনার সন্তান এসব কীভাবে খাবে?”

তাসিন আবারও হাসলো।
“তার মা খেলে, তার খাওয়া হয়ে যাবে।”

“আমার মেয়ে যাঁর সাথে যাবে না, তাঁর কেনা খাবারও খাবে না।”

“তাহলে আমার সন্তানও কারো কেনা খাবার খাবে না। আলহামদুলিল্লাহ তার বাবার যথেষ্ট সামর্থ্য আছে।”

কথায় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না জনাব আজাদ। গম্ভীর স্বরে বললেন,“তাঁর নানাকেও আল্লাহ সামর্থ্য দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।”

“সে যদি তার নানার টাকায় কেনা খাবার খেতে পারে, তাহলে তার মাও তার বাবার টাকায় কেনা খাবার খেতে পারবে।”

“আপনি আপনার সন্তানকে দেখতে আসতে পারবেন। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। দেখেই চলে যাবেন।”

তাসিন চওড়া হেসে বলল,“শুকরিয়া।”

হুরাইনের ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। জনাব আজাদ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইলেন তার যাওয়ার পানে। হুরাইন আজকাল বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করছে। দোয়া-দূরদ, বেশি বেশি আমল করার চেষ্টা করছে। এখনো বসে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছে। তাসিন ভেতরে ঢুকে চুপচাপ মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছে তার মধুর স্বর। হুরাইন আয়াত শেষ করে বিছানায় তাকালো। তাসিনকে দেখে ভারি চমকালো। এখানে তাকে আশা করেনি। এসেছে কীভাবে? তারও ভেতরে ভেতরে মন পুড়ছিলো তাসিনের জন্য। তাসিন তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলল,“থামলে কেন?”

হুরাইন গম্ভীর হলো। শুধালো,“আপনি এখানে কেন এসেছেন? আপনার তো এখানে আসার অনুমতি নেই।”

“আমি তোমার কাছে আসিনি। আমার সন্তানের কাছে এসেছি। এখন আমার পাশে এসে তার সাথে আমাকে সময় কাটাতে দাও।”

হুরাইন সেই জায়গাতেই বসে থেকে তাসিনের গতিবিধি লক্ষ করছে। তাসিন নিজ থেকে উঠে এসে হুরাইনের পাশে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে বসলো। হুরাইন আগের তুলনায় অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে। তাসিন কোমল স্বরে শুধালো,“তুমি এমন শুকিয়ে যাচ্ছো কেন? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো না, তাইনা?”

হুরাইন তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,“আপনি বলতে চাইছেন আমার বাবা আমাকে খাওয়াতে পারে না, তাইতো?”

তাসিন মিটিমিটি হেসে বলল,“এতো রাগ কীভাবে করতে পারো? আমি ভাবতাম আমার রাগের কাছে কারো রাগ কোনোদিন পাত্তা পাবে না। অথচ আমিই এখন তোমার রাগের কাছে পাত্তা পাই না।”

হুরাইন কুরআন মাজীদ নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিয়ে বলল,“আমি মানুষের মত অকাজে রাগ দেখাই না।”

তাসিন হুট করে তাকে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে দিল। পিটপিট চোখে তাকালো হুরাইন। মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকতে বলল তাকে।
“হুসস! আমি এখন আমার আম্মাজানের সাথে কথা বলবো।”

“আপনি কীভাবে জানেন যে মেয়ে হবে?”

“আমি জানি না সে ছেলে না কি মেয়ে! তবে মন বলছে তোমার মতো একটা জান্নাত আসবে আমার ঘরে। তাকেও তোমার মতো মাদ্রাসায় পড়াবো।”

হুরাইন খোঁচা দিয়ে বলল,“বাবা পুরোপুরি দ্বীন পালন করে না। আর মেয়েকে মাদ্রাসায় পড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে।”

হুরাইনের পেটে চুমু দিয়ে তাসিন বলল,“ইনশাল্লাহ আমি সবকিছু পেছনে ফেলে দ্বীনের পথে এগিয়ে যাব। আর ভুল করলে তখন আমার আম্মাজান আর তার আম্মাজান মিলে শাসন করে শুধরে দেবেন।”

হুরাইন তাসিনকে সরিয়ে দিয়ে বলল,“আমি তো যাবোই না।”

“কারো যদি মেয়ের প্রতি মায়া পড়ে যায়, তখন আমার কাছে ফিরতে পারবে। আমি কিছুই মনে করবো না।”

হুরাইন তাসিনের সুখ সুখ মুহূর্তে বলে উঠলো,“আপনার বাচ্চাকে আদর করা শেষ। এবার সরুন।”

হঠাৎ পেট গুলিয়ে উঠলো। হুরাইন ছুটে ওয়াশরুমে চলে গেল। বমি করার শব্দ শোনা যাচ্ছে। পিছুপিছু তাসিনও ছুটে গেল। সে অস্থির হলেও বুঝে উঠতে পারলো না কী করবে। ভাবলো হুরাইনের হাত চেপে ধরে রাখলে, তাকে সঙ্গ দিলে হয়তো তার ভালোলাগবে। তাই হুরাইনের একহাত চেপে ধরলো। বমি করতে গিয়ে অস্থির অবস্থা হুরাইনের। গলগল করে বমি করতে গিয়ে কথা বলতে পারছে না। বারবার হাত ঝাঁকিয়ে বোঝানো চেষ্টা করছে আমার হাত ছাড়ুন। তাসিন ভাবলো তার হাত শক্ত করে ধরতে বলছে। সে এবার দুই হাত চেপে ধরলো। তাসিন এমন কিছুর সাথে অভ্যস্ত নয়। গর্ভাবস্থায় মেয়েদের এমন বমি হয়ে থাকে এটা জানে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কী করতে হয় তা জানে না। হুরাইন ঝাড়ি দিয়ে হাত সরিয়ে নিলো। ভালো করে কুলি করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তাসিন বলল,“তুমি তো অসুস্থ। যেতে পারবে না। আমি কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।”

হুরাইন রাগি চোখে তাকিয়ে নিজেই হেঁটে চলে এলো। বমি করার সময় কোন পাগল রোগীর দুইহাত চেপে ধরে রাখে? বলদের মত কাজকর্ম। এ আবার বাবা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তাসিন বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। রাগ দেখানোর কারণ বুঝে উঠতে পারলো না।

★★★

ফাবিহা জামা পরিবর্তন করে নিচে নামলো। সবাই জানে শাবাব লুকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। তাই ফিরোজ আলম গিয়ে বউ নিয়ে এসেছেন বাড়িতে। জেঠা শশুর আর জেঠী শাশুড়িকে সালাম দেওয়ার পর শাবাবের জেঠা হাতে টাকা গুঁজে দিলেন। ওর জেঠী একটা চেইন পরিয়ে দিলেন গলায়। যেহেতু শাবাবের বাবা-মাও ওনাদের পুত্রবধূ, মেয়ে জামাইদের এভাবেই উপহার দিয়েছেন। শাবাবতো ফিরোজ আলমের এক ছেলে। তার বউকে তো দিতেই হয়। পুরো দিন ওনাদের সাথেই কাটলো। তাঁরা বিকেলে বিদায় নিলেন।
সন্ধ্যায় সুরাইয়ার জন্য চা করে নিয়ে গেল ফাবিহা।
“আম্মা আপনার চা।”

সুরাইয়া বললেন,“যে আমার ছেলের মাথা ফাটিয়েছে, আমি তার হাতের চা খাবো না। নিয়ে যাও।”

ফাবিহা সোজাসাপটা বলল,“আপনার ছেলেও তো আমার গ*লা চেপে আমাকে মে*রে ফেলতে যাচ্ছিলো।”

খ্যাঁক করে উঠলেন সুরাইয়া।
“আমার ছেলেকে তো হাজতে দিয়েছো।”

“আমাকেও হাজতে রেখে আসুন আম্মা।”
বিড়বিড় করে বলল,“অন্তত আপনার ছেলের সংসার করা থেকে বেঁচে যাই।”

“সবাই তো আর তোমার মতো না।”

“চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে আম্মা।”

সুরাইয়া রাগ করে কাপ নিয়ে ফেলে দিলেন। ফাবিহা প্রতিক্রিয়াহীন দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কাপের ভাঙা টুকরো তুলে বেরিয়ে গেল। তুলিকে পাঠিয়ে দিল ফ্লোর পরিষ্কার করতে।
মনে মনে চৌদ্দগৌষ্ঠী উদ্ধার করলো শাবাবের।
“মা- ছেলে দুজনই এক।”

ঘরে যেতেই সিগারেটের উৎকট গন্ধ নাকে লাগলো। নাক চেপে ধরলো ফাবিহা। শাবাব রুমে বসে আয়েশ করে সিগারেট টানছে। ধোঁয়া উড়ছে ঘরে। ফাবিহা খেয়াল করেনি শাবাব কখন এসেছে। তাকে এভাবে সিগারেট ফুঁকতে দেখে সকালের রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তিরিক্ষি মেজাজে বলল,“সিগারেট খেতে হলে বাইরে গিয়ে খাও। এই ঘরে এসব চলবে না।”

শাবাব সিগারেটে আরো একটা টান দিয়ে ফাবিহার মুখে ধোঁয়া ছাড়লো। কেশে উঠলো ফাবিহা। শাবাব চোয়াল শক্ত করে বলল,“এটা আমার ঘর। গলা নামিয়ে কথা বলবে। এখানে আমি যা চাই, তাই হবে।”

ফাবিহা ধারালো চোখে তাকালো। শাবাবের আঙ্গুলর ফাঁক থেকে সিগারেটের শেষ অংশ টেনে নিলো। শাবাব হেসে বলল,“কয়টা সিগারেট ফেলবে তু….

কথা বন্ধ হয়ে গেল শাবাবের। হাতের মধ্যে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরেছে ফাবিহা। শাবাব দাঁতে দাঁত চেপে ফাবিহার হাত মুচড়ে ধরলো। ফাবিহা ব্যথা পেলেও টুঁশব্দ করলো না।
“দ্বিতীয়বার এমন সাহস করলে হাত ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো।”

ফাবিহার হাত ঝাড়ি দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো শাবাব। আদেশ করলো,“আমার জন্য চিনি ছাড়া এক কাপ চা বানাও।”

ফাবিহা নিজের ফোন হাতে করে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। এবার আর সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে। রান্নাঘরে এসে দাগ হয়ে যাওয়া হাতের কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। তারপর মন দিলো চা বানানোতে।

শাবাব চা খেয়ে বেরিয়ে গেল। রাতে খাওয়ার সময় হলেও শাবাব এলো না। ফাবিহা শশুরের সাথে একসাথে খেয়ে উঠে গেল। শাবাব খাক বা না খাক, কারো জন্য সে অপেক্ষা করতে পারবে না। খেয়ে ঘুমিয়েও পড়লো। সুরাইয়া বকাবকি করলেও কান দেয়নি সে। ওনার ছেলের জন্য কি সে এখন না খেয়ে বসে থাকবে?

শাবাব ফিরলো এগারোটার পর। দরজা খুললেন সুরাইয়া। ছেলেকে বেড়ে খাওয়ালেন। সাথে ফাবিহার কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করলেন। ফাবিহা তার জন্য অপেক্ষা করেনি এতে শাবাবের ভাবান্তর হলো না। সেও চুপচাপ খেয়ে ঘরে গেল। ফাবিহার পাশে বিছানায় বসেই একটা সিগারেট ধরালো। সুখটান দিতে দিতে সরু চোখে ফাবিহাকে পর্যবেক্ষণ করলো। কম্বলের বাইরে হাত দুটো বেরিয়ে আছে। ডান হাত লাল হয়ে আছে। হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেও ঢুকে পড়লো কম্বলের নিচে। চোখে ঘুম ভীড় করেছে। একই বিছানায় এত কাছাকাছি থাকার পরও দুজনের মনে যোজন যোজন দূরত্ব।

ঘুমের ঘোরে ফাবিহার সেই ডানহাত শাবাবের পিঠের নিচে পড়লো। প্রথমে টের না পেলেও হাত যখন ঝিমঝিম করে উঠলো তখন হাত টান দিলো ফাবিহা। হাত বের করতে না পেরে ঘুম ভেঙে গেল তার। শাবাবের পিঠের নিচে হাত দেখে ওকে ধাক্কা দিল।
“আমার হাত ছাড়ো।”

শাবাব নড়েচড়ে উঠলো। হাত বের করে নিলো ফাবিহা। আবারও গভীর ঘুমে হারিয়ে গেল শাবাব। ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু এখন আর ঘুম আসছে না। তার চিন্তা সে কীভাবে এখান থেকে বের হতে পারবে! শাবাবের সাথে সংসার করা কিছুতেই সম্ভব নয়।

#চলবে…..

এক টুকরো আলো পর্ব-২১+২২

0

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২১
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

ফুফুর কাছে ফাবিহার দিন বেশ ভালো কেটেছে। আপাতত তার ফোনে সিম নেই। মা-বাবার সাথে ফুফুর ফোন দিয়েই কথা বলছে। দিন যতই ভালো কাটুক, বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। বাবাকে ফোন করলো তাকে এসে নিয়ে যেতে। আতাউর রহমান এসে গেলেন মেয়েকে নিতে। ফাবিহা বাবার সাথে বাড়ি চলে এলো। লোকজন জিজ্ঞেস করলো সে এতদিন কোথায় ছিল?
আতাউর রহমানের জবাব “বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।”

মানুষের ফুসুরফাসুর চললেও ফাবিহাকে আর কেউ সামনে এসে কটু কথা বললো না। ফোনে আবার সিম চালু করলো। বাড়ি বসে থেকে ভালোলাগছে না। একবার ভার্সিটি থেকে ঘুরে আসা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ। ফাবিহা বেরিয়ে গেল। অনেকদিন পর ভার্সিটি এসে যেমন খালিখালি লাগছে আবার ভালোও লাগছে।
শাবাবের গুপ্তচর ফরহাদ খবরটা জানিয়ে দিতেই শাবাব এসে উপস্থিত। ফাবিহাকে অনেকদিন পর দেখে শান্ত চোখে খানিক সময় তাকিয়ে রইলো। স্বাভাবিক গলায় ফাবিহা বলল,“পথ ছাড়ুন।”

শাবাবের রাগ হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“আমি তোমাকে আটকে রাখতে এখানে আসিনি। আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেই চলে যাব।”

“বলুন কী প্রশ্ন?”

“এতদিন কোথায় ছিলে?”

ফাবিহা শাবাবের চোখে চোখ রেখে বলল,“শশুর বাড়ি।”

শাবাবের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সে বিশ্বাস করে না ফাবিহার প্রতি তার সামান্য অনুভূতি আছে। তার ধারণা তার শরীর থেকে অ*প*মা*নে*র ঘা এখনো শুকায়নি। ফাবিহা কেন এত সহজে বিয়ে করে সুখে থাকবে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,“তোমার হাজবেন্ড আমার চেয়ে অ্যাট্রাক্টিভ?”

“হ্যাঁ, তবে সেটা চরিত্রের দিক থেকে। সে ভালো মানুষ।”

উত্তেজিত হয়ে পড়লো শাবাব। ফোঁস করে উঠে বলল,“তুমি আবার আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলছ? তুমি জানো আর প্রেম করিনি?”

ফাবিহা তার অযৌক্তিক কথায় হাসলো। বলল,“তুমি একটা কেন, একশোটা প্রেম করলেও আমার কিছু যায় আসে না।”

শাবাব এদিকওদিক তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,“তুমি কেন বিয়ে করেছ?”

ভ্রু কুঁচকে গেল ফাবিহার।
“আমি বিয়ে করবো কি না সেটা তোমায় জিজ্ঞেস করবো?”

শাবাব আজ কথা খুঁজে পাচ্ছে না। বলল,“তুমি এখন আর রিয়েক্ট কর না কেন?”

“দেখছি তুমি কতদূর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারো।”

“তোমাকে আমি সুখে সংসার করতে দেব না। তোমার হাজবেন্ডের ঠ্যাং ভেঙে দেব। তখন ল্যাংড়া বর নিয়ে দুঃখী দুঃখী সংসার করবে।”

ফাবিহা পাত্তা দিল না শাবাবের কথায়। বলল,“পারলে ঠ্যাং ভেঙে দিও। এখন সরো।”

শাবাবকে ঠে*লে দিয়ে চলে গেল ফাবিহা। কটমট করে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো শাবাব। এবার তার কাজ ফাবিহার হাজবেন্ডকে খুঁজে বের করা। ঠ্যাং ভেঙেই ছাড়বে সে।
সে চোখ রাখলো ফাবিহার বাড়ির উপর। বউ যতদিন এখানে থাকবে, বর নিশ্চয়ই একদিন হলেও আসবে। এমন কাজ তাকে দিয়ে হচ্ছে অথচ সে এটাকে স্বাভাবিক জেদ ধরে বসে রইলো। দুদিন সে রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। এভাবে না ঘুমিয়ে পাহারা দেয়া যায়? দিনে আবার অফিস যেতে হয়। এভাবে হবে না। তবে হাল ছাড়লো না। পরদিন ফাবিহা বাড়ি থেকে বেরিয়ে লোকসমাগম কম এমন স্থানে আসতেই শাবাব সামনে এসে দাঁড়ালো। ফাবিহা বিরক্ত হয়ে বলল,“সমস্যা কী তোমার? আর কী চাও? আমাকে বারবার হেনস্তা করেও কি তোমার শখ মেটেনি?”

শাবাব শক্ত মুখে জবাব দিলো,“তুমি আমাকে প্রথমবারের মতো থা*না পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছো। এই অপ*মানের শোধ কি অল্পতে তোলা হয়ে যায়? আর আমার চ*রি*ত্র নিয়েও তুমি বা*জে কথা বলেছ।”

“তুমি আমাকে গলা চে*পে মে*রে ফেলতে চেয়েছিলে। চাও নি? তাই থা*না*য় যাওয়া স্বাভাবিক। আর তোমার চরিত্র কি ফুলের মত পবিত্র? তোমায় কোলে নিয়ে মাইক ভাড়া করে “শাবাব ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র। প্রেম করে সর্বত্র।” বলে শ্লোগান দেব?”

শাবাব সরু চোখে তাকিয়ে বলল,“তোমার এখনো সেই ক্ষমতা হয়নি যে আমাকে কোলে তুলবে। এখন তোমার বরকে সামনে নিয়ে আসো।”
শেষ কথাখানা আদেশের সুরে বলল।

ফাবিহা নির্লিপ্ত থেকে বলল,“তোমার যেহেতু প্রয়োজন, তাই তুমি বের করো।”

“ভয় পাচ্ছো আমাকে?”

“না পাওয়ার তো কিছু নেই। তোমার বিশ্বাস নেই, যা কিছু করতে পারো তুমি।”

শাবাবের চোখ জ্বলে উঠলো। ভেবেছিল ইমেজ বাঁচাতে ফাবিহা বলবে -ভয় পাই না তোমাকে। বরকে সামনে নিয়ে এসে বলবে এই দেখো আমার বর। কিন্তু মেয়ে তার বিপরীত। শাবাব বলল,“এক কাজ করি। তোমাকে আটকে রাখি। তখন বউ খুঁজতে বর আপনা-আপনি বেরিয়ে আসবে। কান টানলে যেমন মাথা আসে? ঠিক তেমনই।”

ফাবিহা কিছু বলার আগেই তার নাকে কিছু স্প্রে করে দিল শাবাব। নাকে ওড়না চাপতে বেশ দেরি হয়ে গেল। কিন্তু ফাবিহা নিজের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করতে পারলো না। চোখজোড়া ভীতসন্ত্রস্ত। এরা ওকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে যেকোনো কিছু করতে পারে। সম্পর্কটাই শ*ত্রু*তা*র।
ফাবিহার ভয়কাতুরে চেহারা দেখে শাবাব হো হো করে হেসে ফেললো। পানির বোতল সামনে এনে বলল,“পানি স্প্রে করেছি।”

ফাবিহা রেগে গিয়ে বলল,“কখনোই তুমি ভালো হবে না।”

শাবাব ধীর স্বরে বলল,“হবো। তবে তোমার বরের পা যে পর্যন্ত না ভাঙতে পারবো, ততক্ষণ বোধহয় ভালো হবো না।”
শাবাব দুঃখী দুঃখী একটা চাহনি দিল। ফাবিহা বিড়বিড় করল,“ফা*ল*তু।”

ফাবিহা পা বাড়াতে পারলো না। এবার সত্যি সত্যি তার নাকে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করলো। ফাবিহা ভাবলো এবারো বুঝি পানি স্প্রে করেছে। তার ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে শাবাব তাকে গাড়িতে তুলে নিলো। বাবার গাড়ি এটা। মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিলো বাবার কাছে।
“দুঃখিত বাবা! তোমার গাড়ি নিয়ে একটা অপ*ক*র্ম করতে যাচ্ছি।”

শাবাবের দু’জন বান্ধবী আরও দুটো মেয়ের সাথে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। সবাই বেশ অবস্থা সম্পন্ন ঘরের মেয়ে। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে এখানে থেকে। ফাবিহাকে তাদের কাছে রেখে শাবাব কল করতে নিলো আতাউর রহমানকে। ফোন হাতে নিয়ে টের পেলো তার কাছে তো নম্বরই নেই। এখন করবেটা কী? ফাবিহার ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ফোন লক করা। শাবাব ফাবিহার ফোন হাতে নিয়ে বাসায় চলে এলো। মেয়ের খোঁজ না পেয়ে আতাউর রহমান নিশ্চয়ই মেয়েকে ফোন করবেন। তখন সে কথা বলে নেবে। সে এখনো বুঝতে পারছে না সে কী করেছে। ফাবিহার হাজবেন্ডের পা ভাঙা নয়, বরং লোকটাকে দেখার ইচ্ছা প্রবল। তাকে রিজেক্ট করে কেমন ছেলেকে বিয়ে করেছে, কেবল এটাই দেখতে চায়। ফাবিহা সোজা কথার মেয়ে নয়। সে তো তার বরের ছবি দেখাচ্ছে না। গত দুদিন রাত জেগে ফাবিহার বাড়ির সামনে পাহারা দেওয়ায় ঘুম হয়নি। আজ বাড়ি এসে গোসল করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সন্ধ্যা হয়ে গেল। শাবাবের কক্ষে দুটো ফোন বেজে যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে ফোন দুটো বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রেখে ঘুমালো সে। একটা ফোন ফাবিহার। আরেকটা ফোন শাবাবের নিজের।

★★

ফাবিহা চেঁচামেচি করছে মেয়েগুলোর সাথে। যা পারছে বলে যাচ্ছে। তার জ্ঞান ফেরার পর থেকেই মেয়েগুলো শাবাবকে কল দিচ্ছে। সে ফোন তুলছে না। ফাবিহার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে খুব। পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন এক্ষুনি এসে পড়বে।

“আপনারা কেমন অ*স*ভ্য মেয়ে? একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে এলো আর আপনারাও জায়গা দিয়ে দিলেন? আমার জায়গা যদি আপনারা চারজনের মধ্যে কেউ থাকতেন? তখন কেমন লাগতো?”

একজন সিনিয়র মেয়ে মিলি। মেয়েটা একটু ভীতু ধরনের। ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো,“দেখো, তুমি এমন চেঁচামেচি কোরো না। শাবাবের সাথে যেহেতু প্রেম করেছো, তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধা কোথায়?”

ফাবিহার আশ্চর্য হয়ে বলল,“মাথা খা*রা*প আপনাদের? কে প্রেম করেছে ওই ল*ম্প*টে*র সাথে?”
বলতে বলতে উগ্রভাবে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটি পিছিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ফাবিহা মেয়েটা এক্ষুনি তার মাথা ফাটিয়ে দেবে। বলল,“শাবাব বলেছে। সেজন্যই তো এখানে জায়গা দিয়েছি।”

“না জেনেই জায়গা দিয়ে দেবেন?”

আরেকটি মেয়ে ফাবিহার মতো তেজ নিয়ে বলল,“চুপচাপ বসে থাকো। প্রেম করে আবার মিথ্যা বলছো?”

ফাবিহা চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,“আমার ফোনটা দিন। আমি বাসায় কল করে বলছি আমাকে নিয়ে যেতে।”

ফাবিহা জায়গাটা চিনে না। সেজন্য যেতে অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে। মিলি বলল,“তোমার ফোন তো শাবাব নিয়ে গিয়েছে।”

ফাবিহা মেয়েটিকে ঠাণ্ডা মাথায় আদেশ দিল যেন।
“ওকে ফোন করুন।”

“ফোন করছি সেই কখন থেকে। ধরছে না।”

এভাবে আরো তর্কাতর্কি চললো।

শাবাবের ঘুম ভাঙলো মাগরিবের পর মায়ের ডাকে। ফোন চেক করে তার চোখ কপালে উঠে গেল। ফাবিহার ফোনে ‘বাবা’ নামে সেইভ করা নম্বর থেকে ৫০ টির মতো কল এসেছে। তার ফোনেও অনেকগুলো কল। সে মিলিকে কল ব্যাক করতেই রিসিভ হয়ে গেল। শাবাবের কিছু বলার প্রয়োজন পড়লো না। মেয়েটা হড়বড়িয়ে বলল,“দোহাই লাগে তাড়াতাড়ি আয়। মেয়েটা এক্ষুনি আমাদের মে*রে-টেরে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলবে। এর চোখে ভয় দেখছি না। মনে হচ্ছে খু*ন চেপেছে মাথায়!”

শাবাব ফোন কানে নিয়ে একটা শার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে গেল। কাউকে কিছু জানালো না।

মিলিদের ফ্ল্যাটে পাশের ফ্ল্যাট থেকে লোকজন চলে এসেছে। তাঁরা আবার অন্যান্য ফ্ল্যাট থেকে লোক ডেকে এনেছেন। মিলি সবাইকে বলে দিল তাদের বন্ধু প্রেমিকা নিয়ে এখানে উঠেছে। মেয়েটি এখন ছেলেটিকে বিয়ে করতে চাইছে না।

শাবাব তাদের কাছে ফাবিহার ব্যাপারে যা বলেছে সেটাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরলো মিলি। শাবাবও পৌঁছে গেল। ঝামেলাটা বেড়ে গেল। শাবাব তো স্তব্ধ হয়ে গেল। এতকিছু হয়ে যাবে সে ভাবেনি। সব জায়গাতেই কিছু টাকা খাওয়া পাব্লিক থাকে। এখানেও আছে। তাঁরা শাবাব আর ফাবিহাকে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাথে শাবাবের জরিমানা করা হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে শাবাব সত্যিটাই বলল। মেয়েটা বিবাহিত।

এবার সবাই আরো খারাপভাবে নিলো ব্যাপারটাকে। ঘরে স্বামী রেখে এই ছেলের সাথে বেরিয়ে এসেছে। ফাবিহা চিৎকার করে বলছে“ আমি আসিনি। আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে।”

তার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। শাবাব নিজেও বলল ফাবিহাকে সে তুলে এনেছে। পাব্লিক যা বুঝলো সেটাই সত্য। এদের কথা আর বিশ্বাস করছেন না তাঁরা। কারণ এরা একবার এক কথা বলছে। প্রথমে বলল প্রেমিক-প্রেমিকা। মেয়েটা বিয়ে করতে চায় না বলে তুলে এনেছে। তারপর বলল মেয়েটা বিবাহিত। এখন আবার বলছে প্রেম-টেম কিছু না। তুলে নিয়ে এসেছে। বাঁচার জন্য যে এরা বারবার মিথ্যা বলছে না তার প্রমাণ কী? তাই এবার আর কেউ শুনতে চাইলো না শাবাব ফাবিহার কথা। তাদের সাথে বিপদে পড়লো ফ্ল্যাটের চারজন মেয়ে। শাবাবের চোখজোড়া ফাবিহার কান্নারত মুখের দিকে। তার খা*রা*প লাগছে মেয়েটার জন্য। সে বারবার বলছে সব দোষ আমার।
ফাবিহা বলল,“আপনারা কিছু করার আগে আমার বাবা-মাকে কল দিন। তাঁরা জানে আমি কী করতে পারি আর না পারি।”

একজন বলল,“মেয়েটার বাবাকে কল দিন। ছেলের বাবাকেও কল দেয়া হোক। ছেলে-মেয়ের কীর্তিকলাপ তাঁরা এসে দেখে যাক।”

বাবাকে কল দিতে বলেই ফাবিহার মনে পড়লো বাবা তো হার্টের রোগী। যদি এসব শুনে টেনশনে কিছু হয়ে যায়? ভয় ঢুকলো মনে। আবার ভাবলো বাবা ছাড়া তো কেউ তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। সব রকম চিন্তা, না খাওয়া মিলিয়ে শরীর কেঁপে অসাড় হয়ে এলো। চোখে সব ঝাপসা দেখছে। খাবার না খাওয়ার চেয়ে বেশি ভয়টাই কাবু করে নিলো ফাবিহাকে। সে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। শাবাব দৌড়ে তার কাছে যেতে গিয়েও পারলো না। কয়েকজন মিলে ফাবিহাকে ঘিরে ধরে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। কেউ বা বলছে ঢং করছে মেয়েটি।

এতদিনের অপরাধের কোনো অনুশোচনা না হলেও আজ অপরাধবোধ হলো শাবাবের। তার একটা অন্যায় মেয়েটার জীবন শেষ করে দিচ্ছে। ফাবিহার শশুর বাড়ির লোকজন শুনলে কী হবে? স্বামী রাখতে চাইবে তো তাকে? সংসার টিকবে? ফাবিহার ভালো-মন্দের চিন্তায় ডুবে গেল শাবাব। তার কাছ থেকে ফোন নিয়ে তার আর ফাবিহার বাবাকে কল দেওয়া শেষ।
দু’জনই বোধহয় জান হাতে নিয়ে ছুটে আসছেন। ফাবিহার বাবার চিন্তাটাই যে বেশি।

পরিবেশ আপাতত ঠাণ্ডা। আতাউর রহমান আর ফিরোজ আলম এসে পৌঁছেছেন। ফিরোজ আলমের শাবাবকে মা*র*ধ*র করা শেষ। বৈঠক বসেছে। আতাউর রহমান যেভাবে বললেন তাতে ওনার মেয়ে নির্দোষ। ফাবিহার জ্ঞান ফিরেছে। সে বাবার সাথে লেপ্টে আছে। এখন একটু একটু সাহস এসেছে। ফিরোজ আলমও যা বললেন তাতে ওনার ছেলে দোষী। শাবাব মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

আক্ষেপ করলেন আতাউর রহমান।
“আমার মেয়ের এখন কী হবে? ভালো ঘরে মেয়ে বিয়ে দিতে পারবো আমি? আমার মেয়ের দোষ না থাকলেও লোকে তাকে নিচু চোখে দেখবে।”

শাবাবের ভ্রু কুঁচকে গেল। ভালো ঘরে বিয়ে হবে মানে কী? ফাবিহার না বিয়ে হয়ে গেল?

শাবাবের প্রশ্নটি একজন বৃদ্ধ করে ফেললেন।
“আপনার মেয়ে না বিবাহিত?”

“ওটা এই ছেলের হাত থেকে বাঁচতে বলেছিলাম।”

শাবাব বড়ো সড়ো এক ধাক্কা খেল। কী ভুলটাই না সে করে ফেললো। সেই বৃদ্ধ লোকটি প্রস্তাব করলেন।
“এই ছেলের কারণে যেহেতু এতকিছু। তাহলে সব দায়ভার তাকেই নিতে দিন। দুজনের বিয়ে পড়িয়ে দিন।”

“অসম্ভব!”
আতাউর রহমান তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলেন।

ফিরোজ আলম নিজেও বললেন,“আমি নিজেই নিজের ছেলের উপর ভরসা করতে পারছি না। আর উনি কীভাবে করবেন? অন্য ফয়সালা করুন।”

“অন্য কি ফয়সালা করবো? আপনার ছেলেকে তো পু*লি*শে দেব। কিন্তু মেয়েটার কী হবে?”

ফাবিহা শক্ত মুখে বলল,“জীবনে বিয়ে না হলেও আমি ওকে বিয়ে করবো না।”

তাকে ধমকে উঠলেন বৃদ্ধ লোকটি।
“জীবনের বুঝো কী মেয়ে? তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তোমার বাবা আছেন। কথা বলছো কেন তুমি?”

আতাউর রহমান একরোখা ভাবে বললেন,“আমি তো এই ছেলের হাতে আমার মেয়ে তুলে দেব না।”

রাত বাড়ছে, অথচ কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। বৃদ্ধ লোকটি শাবাবের দিকে তাকালেন। খ্যাঁক করে উঠে বললেন,
“কী শাস্তি নেবে তুমি?”

শাবাব দৃষ্টি নিচের দিকে রেখেছে তো আর তুলছে না। সে নিজেও বুঝতে পারছে না তার জন্য কেমন শাস্তি উপযুক্ত। ফিরোজ আলম আর আতাউর রহমানের উপর সবটা ছেড়ে দেয়া হলো। ফিরোজ আলম নিজের ছেলের উপর ভরসা করতে পারছেন না। আতাউর রহমান মেয়েই বিয়ে দেবেন না। এদিকে কিছু একটা সিদ্ধান্ত না নিয়ে লোকজন তাঁদের উঠতে দিচ্ছে না। বৃদ্ধ লোকটি আতাউর রহমান আর ফিরোজ আলমকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন।
“দেখুন বাবারা। এখন বিয়ে না দিলে পরে ঝামেলা আরো বাড়বে। অনেকেই ভিডিও ধারণ করে রেখেছে। এসব ইন্টারনেটে ছাড়লে ছেলে তো বুক ফুলিয়ে হাঁটবে। মেয়েকেই মুখ লুকিয়ে বাঁচতে হবে। তারচেয়ে বরং ছেলে যেহেতু মেয়েটিকে বিয়ের জন্য এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে তাই উচিত হবে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া। যদি ছেলের সুমতি হয়।”

আতাউর রহমান বললেন,“ওনার ছেলের সুমতির জন্য কেন আমার মেয়েকে বলির পাঠা হতে হবে?”

বৃদ্ধ উঠতে উঠতে বললেন,“আমি যাচ্ছি বাপু। তোমরা দেখো এদের থেকে ছাড় পাও কি না। এমন জায়গায় এসে পড়েছো, সব দা*লা*ল। একটাও এখন কিছু একটা না ঘটিয়ে তোমাদের উঠতে দেবে না। সাথে পয়সা উসুল। এক জায়গা দুটো ছেলেমেয়েকে ধরতে পারলেই এদের কাজ ধরে বেঁধে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া, সাথে মোটা অঙ্ক দাবি করা।”

বৃদ্ধ লোকটি উঠে গেলেন। এতক্ষণ একজনের উপর সব ছেড়ে দিলেও সবাই এবার মাতব্বর হতে এসেছে। যাঁর ঘরে অবিচার, সেও রাজা সেজে বিচার করতে এসেছে।

একজন এগিয়ে এসে বলল,“এতক্ষণ অনেক দেখেছি। ছেলে-মেয়ে যেমন? বাবারাও তেমন। ছেলেমেয়ের পা*প ঢাকতে তাঁরাও মিথ্যা জুড়ে দিয়েছে। আজ বিয়ে দিয়ে পবিত্র হয়ে এখান থেকে বের হবে। নয়তো ছেলে-মেয়ে দুটোকেই পু*লি*শে দেব। সাথে তাদের বাপদেরও মুখে কালি মাখাবো।”

শাবাব এবার ক্ষে*পে গেল।
“বারবার এক কথা কেন বলছেন? বললাম তো সব দোষ আমার। সবাইকে যেতে দিয়ে যা শাস্তি দেয়ার আমাকে দিন।”

লোকজন এসে শাবাবকে চ*ড়, থা*প্প*ড় বসালো। অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেই বৃদ্ধ লোকটি এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আবারও এগিয়ে এসে আতাউর রহমান আর ফিরোজ আলমকে বললেন,“বাবারা আরো বা*জে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আপনাদের আজ বাড়ি যেতে দেবে না এরা। পরে কী হবে সেটা না ভেবে এখান থেকে বের হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।”
ফাবিহাকে বললেন,“তোমার বুঝার বয়স হয়েছে। ভেবে দেখো এখান থেকে মানসম্মান নিয়ে বের হবে না-কি এখানেই পড়ে থাকবে।”

কোনো হাল হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আতাউর রহমান আর ফিরোজ আলম রাজি হলেন। ফাবিহার সব দায়িত্ব ফিরোজ আলম নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন। শাবাব আর ফাবিহা বাঁধ সাধলো। বিনিময়ে ফাবিহাকে বাবা বুঝিয়ে গেলেও শাবাবের কপালে চ*ড় ছাড়া কিছুই জুটলো না। মানুষ এতটাই এগিয়ে গিয়েছে যে, তাঁরা হুজুর নিয়ে হাজির। ফাবিহা আর বাড়াবাড়ি করলো না। এতকিছু যখন তার সাথে ঘটে গিয়েছে, তাহলে সামান্য একটা বিয়ে আর কী করবে তাকে? কোনো অনুভূতি ছাড়াই কবুল বলে দিল। শাবাব স্থির হয়ে গেল। সে কবুল বলতে দেরি করছে। অথচ দেরি করার কথা ছিল ফাবিহার। ধাক্কা খেয়ে শাবাবও কবুল বলে দিল। কয়েকজন ফিরোজ আলম আর আতাউর রহমানকে চেপে ধরলেন তাঁদের চা-নাস্তার টাকা দিতে। এতক্ষণ এখানে সময় দিয়েছেন তারা। আর চা-নাস্তার টাকা খুবই সামান্য। দুজন মিলে চল্লিশ হাজার দিলেই হবে। ফ্ল্যাটের মেয়ে চারজনকে ওয়ার্নিং দিয়ে সকলে বেরিয়ে যাচ্ছিলো এক এক করে।

এর মাঝে এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেল। ফাবিহা কাঁচের জগ তুলে শাবাবের মাথা ফাটিয়ে দিল। তার চোখে তীব্র রাগ। শাবাব ব্যথা স্থানে হাত দিয়ে র*ক্ত দেখে র*ক্তের দিকেই তাকিয়ে রইলো। সকলেই স্তব্ধ। ফাবিহার ভাবগতি খুব খা*রা*প। সে আরো কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। আতাউর রহমান ছুটে গিয়ে মেয়েকে আটকালেন। ফিরোজ আলম শাবাবকে নিয়ে হাসপাতাল যাবেন। শাবাব জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। হাসপাতাল গেল না।

#চলবে….

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সাজেদা কাশিতে ভুগছেন। নিজে উঠে সব কাজ করছেন। নিশিকে ডেকে বললেন,“একটু গরম পানি করে দে তো।”

“যাচ্ছি।” বলে ফোনে ব্যস্ত রইল নিশি। সময় গড়ালো। কাশতে কাশতে বুক ব্যথা হয়ে গিয়েছে। নিশিকে কয়েকবার বলার পরও “যাচ্ছি” বলে বসে থাকা দেখে সাজেদা মেয়েকে বকতে বকতে মনের কষ্টে নিজেই উঠে গেলেন পানি গরম করতে। এবার নিশির টনক নড়লো। ফোন রেখে সে পানি গরম করতে গেল। সাজেদা মেয়ের হাত থেকে পাতিল টে*নে নিয়ে বললেন,“যা এখান থেকে। আমার কাজ আমিই করতে পারবো। একজন খাটের উপর গিয়ে বসে থাক আরেকজন তো আগেই বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেছে।”

সাজেদার মুখ থমথমে। অবসর সময়ে একা একা বসে থাকতে এখন আর ভালোলাগে না। হুরাইন থাকলে ইচ্ছে করেই এসে বসে থাকতো ওনার পাশে। এটা-ওটা বলে গল্প করার চেষ্টা করতো। মেয়ে তো সারাদিন ফোন নিয়েই পড়ে থাকে। মায়ের সাথে কথা বলার সময় কোথায়? নিশি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাজেদা নিজের জন্য পানি গরম করে ঘরে যেতেই শুনতে পেলেন ফোন বেজে চলেছে।
গলা পরিষ্কার করে ফোন ধরলেন। ওপাশ থেকে সালাম দিল হুরাইন।
“আসসালামু আলাইকুম আম্মা। কেমন আছেন?”

সাজেদা থমথমে গলায় জবাব দিলেন,“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আমার ভালোর খবর কে নেয়? তুমি কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ। আপনার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন আম্মা? আপনি কি অসুস্থ?”

“আমার অসুখ হলেই বা কী?”
বলতে বলতে আবারও কেশে উঠলেন সাজেদা।

হুরাইন বলল,“ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন? আমি কি চলে আসবো আম্মা?”

“গিয়েছি। আসতে হবে না তোমার। আরো কিছুদিন থাকো। আরো বড়ো অসুখ নিয়েও সংসার সামলিয়েছি।”

হুরাইন বলল,“বাড়ির সবাই কেমন আছে?”

“আছে ভালোই। তোমার বাবা-মা কেমন আছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন দু’জনেই। আপনার পানি ধরা উচিত হবে না। আরো অসুস্থ হয়ে যাবেন। আমি আব্বুকে বলবো আমাকে ও বাড়ি পৌঁছে দিতে।”

সাজেদা সন্তুষ্ট হলেও মুখে বললেন,“তুমি অনেকদিন পর বেড়াতে গিয়েছো। নিশি আছে, ও পানির কাজকর্ম করে দিলে বাকিটা আমি করতে পারবো।”

হুরাইন শাশুড়ির কথা শুনে হাসলো। নিশি তো কোনো কাজকর্মই পারে না। সাজেদা একবার যেতে বললেই সে চলে যাবে। যদি তাসিনের সাথে সম্পর্ক আগের মত সহজ হত, তবে হুরাইন এখনই চলে যেত। সাজেদা বারবার বলছেন যাওয়ার দরকার নেই। এমন কাশি ঠান্ডা পড়লেই হয়ে থাকে ওনার। ঔষধ নিলেই সেরে যায়। হুরাইন কথা শেষ করলো।

সে বাবার বাড়ি এসেছে চার দিন হলো। এখনো তাসিন সম্পর্কে কাউকে কিছু জানায়নি। তাসিন প্রতিদিন ফোন দিয়ে খোঁজখবর জেনে কল কেটে দেয়। তাদের মধ্যে বাড়তি কোনো আলাপ হয় না।

তাসিন সারাদিনের কাজকর্ম শেষে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিতেই হাজারো চিন্তাভাবনা তার মাথায় এসে ভীড় জমালো। এখন মন থেকেই একটু একটু করে নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে। ধর্ম সম্পর্কে তার অল্পস্বল্প যা ধারণা আছে, তাতে স্পষ্ট হুরাইন তার খারাপ চায় না। বরং তাকে আলোর পথে টে*নে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এতদিন মনকে স্থির করতে না পারলেও এখন মনকে স্থির করে ফেলেছে। সে নিজেকে পরিবর্তন করবেই। তবে এবার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাইরের মানুষ। যাদের সাথে মেলামেশা করে এসেছে এতদিন। তারা যেন নানারকম কথা দিয়ে পেছন থেকে টে*নে ধরে তাকে। বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এ নিয়ে সবার মধ্যে চলছে মনোমালিন্য।
হুরাইনের সাথে বাড়তি কোনো কথাও সে বলছে না। বলতে পারছে না। হুরাইন কীভাবে রিয়েক্ট করে বসবে সেই ভয় থেকেই কথা বাড়াচ্ছে না সে। তার মনে আরো একটি ভয় ঢুকেছে। সেটি হলো হুরাইন যদি আর না ফেরে তার কাছে? ঠিকঠাক ঘুম হয় না তার। সব সময় মনের ভেতর একটা অশান্তি কাজ করে। হুরাইনকে সে ভালোবাসে এটা যেমন সত্য, দুই যুগের বেশি সময় ধরে অভ্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসাটাই কষ্টসাধ্য এটাও তেমনই সত্য। আমি জীবনে সফল হতে চাই। এই চাওয়া তো সবারই থাকে, সফলতা ক’জনে পায়? আর সফল হওয়াটাও কি দুই-একদিনের ব্যাপার? কারো চার বছর, পাঁচ বছর কারো আবার সারাজীবন লেগে যায়।

শশুর তাকে স্মরণ করলো। জনাব আজাদের কল পেয়ে বুক ধ্বক করে উঠলো। এই বুঝি তিনি নিজের শর্তের কথা মনে করিয়ে মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দেবেন! শীতের মাঝেও ঘামছে তাসিন। নিজেকে ধাতস্থ করে কল রিসিভ করে সালাম দেয়ার পূর্বেই জনাব আজাদ সালাম দিলেন। তিনি কখনো কারো সালামের অপেক্ষায় থাকেন না। বরং আগে আগে নিজেই সালাম দেন।
সমাজে অহরহ মুরব্বি দেখা যায়, যাঁরা বয়সে ছোটোদের সালামের অপেক্ষায় থাকেন। আগে সালাম না দিলে বে*য়া*দ*ব বলে আখ্যায়িত করেন। অথচ আগে সালাম দেয়া ব্যক্তি আল্লাহর কাছে উত্তম।

তাসিন সালামের জবাব দিল। দু’জনের মধ্যে ভালো-মন্দ কথা হলো। এবার জনাব আজাদ বললেন,“আপনার সাথে কথা আছে। আগামীকাল আমাদের বাসায় আসবেন জামাই।”

জনাব আজাদের গলা সব সময়ের মতোই শান্ত। তাসিনের ভেতরে ভয় ঢুকলো। সে বুঝতে পারছে না জনাব আজাদের তাকে ডাকার কারণ। কোনোভাবে হুরাইন আর তাকে আলাদা করার প্রস্তুতি না নেয়া হচ্ছে। রাতে ছটফট করতে করতে ভোরের আগে ঘুম হলো তাসিনের। তবে মস্তিষ্ক সজাগ। ফজরের আজান পড়ার পরপরই উঠে পড়লো। আজ আর তাকে কারো ডেকে তুলতে হয়নি। গত দুদিন এভাবেই চলছে। ফজরের নামাজ পড়ে হুরাইনের কুরআন মাজীদ হাতে তুলে নিলো। ভেতরের কিছুই সে পড়তে পারছে না। ছোটবেলায় পড়েছিল। কিন্তু চর্চা না থাকায় কিছুই মনে নেই। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো প্রতিটি হরফ। মনে মনে আওড়ালো হরকতের নাম। অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে সে। তারপর কুরআন মাজীদ আবার রেখে দিল। নাস্তার টেবিলে বাবা-মা দুজনকেই হাসিখুশি দেখালো। কিন্তু খুশির কারণ তার অজানা। নিশি নির্লিপ্ত। তামিম আবার ফিরে গিয়েছে। তাসিন নাস্তা করে চলে গেল অফিসে। মা-বাবাকে বলে গেল সে আজ শশুর বাড়ি যাবে।

শশুর বাড়ি এসে সে আগের মত সবার সাথে আচরণ করতে পারছে না জড়তার কারণে। হুরাইন নিশ্চয়ই সব বলেছে সবাইকে। জনাব আজাদের আচরণ স্বাভাবিক। হুসাইন আর তার শাশুড়িও আগের মতোই তাকে আপ্যায়ন করছে। হুরাইনকে একবারও দেখলো না। সে সামনে এলো না। রাতের খাবরের পর সে ছাড় পেল। অথচ জনাব আজাদ কোনো কথাই তুললেন না। তাসিন দুরুদুরু মন নিয়ে হুরাইনের ঘরে প্রবেশ করলো।

মাথার কাপড় সরিয়ে রেশমি কালো চুলে মাত্র হাত দিয়েছে হুরাইন। তার একহাতে চিরুনি। তাসিন দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লো। হালকা শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকালো হুরাইন। তাসিন চোখ নামিয়ে নিলো। হুরাইন সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে তাসিন ভেতরে ঢুকে বিছানায় বসে পড়লো। হুরাইন চুল বেঁধে এগিয়ে এলো। তার দিকে তাকালো তাসিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হুরাইনের হাত দুটো চেপে ধরলো হাতের মুঠোয়। চোখজোড়া অশান্ত তার। অস্থির গলায় বলল,“আমার সময় লাগবে হুরাইন। আমি চেষ্টা করছি নিজের পরিবর্তনের। তুমি প্লিজ ফিরে চলো!”

তাসিনের চোখে ভয়। হুরাইন মনোযোগ দিয়ে পরোখ করলো। তারপর বলল,“আপনি আগে বলুন কাকে ভয় পাচ্ছেন?”

তাসিন থমকে গেল হুরাইনের প্রশ্নে। অতঃপর সময় নিয়ে বলল,“আমি দুটোতেই ভয় পাচ্ছি। আল্লাহকে ভয় পাচ্ছি সাথে তোমাকে হারানোর ভয়টাও পাচ্ছি।”

হুরাইন বলল,“যদি আপনার কথা সত্য না হয়?”

“কী করলে বিশ্বাস করবে?”

“আমি আপনার পুরো পরিবর্তন চাই। একজন দ্বীনদার মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। তাহলে আমি আর আপনার সন্তান দুজনই আপনার কাছে ফিরবো।”

ভোঁ ভোঁ করে মাথা ঘুরতে থাকলো তাসিনের। হুরাইনের কথা মাথার উপর দিয়ে গেল। তাদের সন্তান আসলো কোথা থেকে? মাথায় আরেকটু চাপ দিতেই সবটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। তার চোখ জোড়া ঝলমল করে উঠলো সাথে ভিজে উঠলো পানিতে। হুরাইনের হাত ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে হুরাইনকে আগলে নিলো। শক্ত করলো বাঁধন। যেন ছেড়ে দিলেই সে পালিয়ে যাবে। হুরাইন নিজেও বাঁধন ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না। অনুভূতি প্রকাশ করতে দিল তাসিনকে। মিনিট পাঁচেক যেতেই তাসিনের হাত ছাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলল,“ছাড়ুন আমাকে।”

তাসিন বাঁধন আরো শক্ত করলো।
“এবার আর ছাড়বো না তোমায়।”

হুরাইন বলল,“আমি আপনার সাথে ফিরবো না। যেদিন আমার মনে হবে আপনি পরিপূর্ণ সঠিক পথে চলছেন, কোনো গাফিলতি হচ্ছে না সেদিনই আমি আপনার সাথে ফিরবো।”

“এবার কিন্তু আমার প্রতি জুলুম হয়ে যাচ্ছে হুরাইন।”

“আমি জুলুম করছি না। আপনি নিজেই নিজের উপর জুলুম করছেন। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।”

তাসিন আহত চোখে তাকালো। লাভ হলো না। হুরাইনের মন নরম হলো না। এখন তার কথাই শুনতে হবে তাসিনকে। শুয়ে পড়লো। আজ তাড়াতাড়ি ঘুম এসে পড়লো। হুরাইন এপাশ-ওপাশ করছে। তাসিনের ঘুম এসেছে বুঝতে পেরে তার দিকে ফিরলো। চুলের ভাঁজে হাত চালিয়ে বলল,“আমি চাই আপনার সাথে থাকতে। তারজন্য আপনাকে পরিপূর্ণ দ্বীন পালনে অভ্যস্ত হতে হবে। আমার ভয় হয়, যদি আবারও নিজের দেয়া কথা আপনি ভুলে যান? তাই যে পর্যন্ত না আপনি নিজের ভালো বুঝতে পারবেন, নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবেন ততদিন আমি ফিরবো না।”

হাত নিয়ে তাসিনের গলা জড়িয়ে ধরলো। আস্তে করে একটা পা তুলে দিল তার শরীরে। তারপর ঠোঁট টিপে হাসলো। নড়েচড়ে উঠলো তাসিন। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরলো হুরাইন। যেন সে ঘুমের ঘোরে তাসিনের গায়ে হাত-পা তুলে দিয়েছে। তাসিনও ঘুমের ঘোরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে।

ফজরে আজ তাসিনকে ডাকতে হলো না। সে নিজ থেকে জেগে ওজু করতে গিয়েছে দেখে হুরাইন অবাক হলো সাথে খুশি হলো বেশ। সাজেদা বেগম খবরটা শোনার পর খুশি হয়েছেন বুঝা গেল। কিন্তু তিনি নিজের খুশিটা পুরোপুরি প্রকাশ করতে নারাজ। হুরাইনকে বলে সাবধান করে দিলেন। এভাবে চলবে, ওভাবে চলবে, ঠিকমতো খাবে। তারপর হুরাইনের মায়ের সাথে কথা বলেও সবটা বুঝিয়ে দিলেন বেয়ানকে। হুরাইন আশার আলো দেখছে। সে পারেনি, তাদের সন্তানের আগমন যদি ওই পরিবারের মানুষগুলোর একটু একটু করে হিদায়াত আনতে পারে! সুসংবাদ পেয়ে সকলের মাঝেই সে অল্পস্বল্প পরিবর্তন লক্ষ করেছে। কেবল নিশি ছাড়া।

★★★

শাবাবকে জোর করে হাসপাতাল নিয়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিলেন ফিরোজ আলম। ফাবিহাকে আতাউর রহমান বাড়ি নিয়ে গিয়েছেন। শাবাবকে নিয়ে ফিরোজ আলম বাড়ি ফিরতেই সুরাইয়া তুলকালাম বাঁধালেন। তিনি তো কিছুই জানেন না। কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। ভেবেছেন শাবাব মা*রা*মা*রি করে এসেছে।
“আব্বা, কেনো গেলে মা*রা*মা*রি করতে?”

ফিরোজ আলম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,“মা*রা*মা*রি*র চেয়ে বেশিকিছু করেছে তোমার ছেলে। বউ ধরে মাথা ফা*টি*য়ে দিয়েছে।”

সুরাইয়া কান্নার মাঝেই খেঁকিয়ে উঠলেন,“এই তুমি আবোলতাবোল কথা বলবে না। আমার ছেলের বউ আসবে কোথা থেকে?”

“তোমার ছেলে আজ বিয়ে করেছে।”

সুরাইয়া বিশ্বাস করলেন না। শাবাবকে জিজ্ঞেস করলেন,“তোর বাবা কী বলছে আব্বা? এই লোকেরে কি জ্বীন-ভূত আছর করেছে না কি?”

শাবাব দৃষ্টিনিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুরাইয়া রেগে গিয়ে বললেন,“বাপ-বেটা দুটোকেই আজ ঘরে জায়গা দেব না। বের হ। আমার প্রশ্নের উত্তর দে।”

শাবাব আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশ্য বলল,“বাবা সত্যি বলছে।”

সুরাইয়া আবারো হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। একমাত্র ছেলে বিয়ে করলো তাদের না জানিয়ে? আবার বলে কি-না বউ তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। কী ডা*কা*ত মেয়ে বিয়ে করলোরে। সুরাইয়ার প্রেশার বেড়ে গেল। তুলি এসে বলল,“ভাইজান আপনে ঘরে যান। আমি আর খালু আম্মারে দেখতাছি।”

সুরাইয়া বিলাপ করছেন। শাবাবের মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। সে ঘরে চলে গেল। আজকের ঘটনা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। ব্যান্ডেজে হাত ছুঁইয়ে ফাবিহার রাগান্বিত চেহারা মনে করলো। ব্যথায় টনটন করে উঠলো মাথা। মনে হচ্ছে এখনই মাথাটা ফাটিয়েছে। দিনে ঘুমিয়েছে বলে এখন আর ঘুমও আসছে না। তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় ডুবে গেল।

ফিরোজ আলম সুরাইয়াকে শান্ত করে সব খুলে বললেন। ছেলের দ্বারা এসব ঘটেছে শুনে তিনি বিস্মিত। আবার ছেলের মাথা ফাটানোর কথা শুনে একবার ফাবিহাকে দেখতে চাইলেন। কতবড়ো কলিজা হলে তাঁর ছেলেকে মে*রে মাথা ফাটিয়ে ফেলতে পারে। তিনি ফাবিহার উপর ক্ষেপে আছেন।

ফাবিহা, শাবাব দুজনই কিছুদিন বাড়ি থেকে বের হলো না। দুজনের অবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখে ফিরোজ আলম ফাবিহাকে নিয়ে যাওয়ার কথা তুললেন। বিয়ে যেহেতু হয়ে গিয়েছে তখন একটা সমাধানে আসা উচিত। ফাবিহা বেঁকে বসলো। সে যাবে না। একরোখা সিদ্ধান্তের সাথে তার মাও একমত। মেয়েকে তিনি কিছুতেই দেবেন না। বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? কেউ তো আর জানে না। আতাউর রহমান আর ফিরোজ আলম কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলেন আরো কিছুদিন ওদের সময় দেয়া যাক। তারপর নাহয় আবার নেয়ার কথা তোলা যাবে। এই সময়ে ফাবিহা ফ্রেন্ড’দের সাথে ঘুরতে চলে গেল তিনদিনের জন্য। তার মাইন্ড ফ্রেশ করা জরুরি। আতাউর রহমান তাই বাঁধা দিলেন না। শাবাবও ব্যাগপত্র নিয়ে কোথাও চলে গেল ফাটা মাথা নিয়ে। এখন অবশ্য অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

#চলবে….