#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২১
#বর্ষা
জারিফের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা হয়েছে।এত দ্রুত সব হয়ে গেল যা বলার বাইরে। অবশ্য মৃত্যুদন্ড না হয়ে যাবৎ জীবন কারাদন্ডও হতে পারতো! জারিফের মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০,বাংলাদেশ অনুযায়ী। কেননা ব্রিজের নিচে যাকে রেপ করা হয়েছিলো সে আত্মহত্যা করেছে। খোঁজ মিলেছিলো সেই মেয়ের পরিবারের।তারা সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি রেখেছে।মেয়েটার মোবাইলটাও হস্তান্তর করেছে।
জারিফের মৃত্যুদন্ডের সংবাদ শোনা মাত্রই আদালত থেকে বেরিয়ে জোভান হামলে পড়েছে কুহেলিকার উপরে।একেতো পাবলিক প্লেস , তার ওপর আদালত।ফায়দা লুটে নেয় কুহেলিকা।অন্য জায়গায় যদি আঘাত করে তাহলে সেটা হয়তো তাকে আসামী করবে। কিন্তু এখন তো জোভানই হামলা করেছে তার ওপর তাও আদালতে।কুহেলিকা জোভানের গোপনাঙ্গ বরাবর হিল পায়ে লাত্থি মারে।মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জোভান।
পুলিশ সদস্যরাও এগিয়ে এসেছিলো প্রায় জোভানকে ধরতে।একটা মেয়ের গলা চিপে ধরেছে পুলিশ কি কিছুই করবে না!কুহেলিকা কাঁশতে থাকে।লাত্থি তো মেরেছে সর্বশক্তি দিয়ে।তবে এখন ওর নিজেরই মাথা ঘুরাচ্ছে,দম বন্ধ হয়ে আসছে,শ্বাস নিতে পারছে না।নাহিনের নিষেধ মান্য করা উচিত ছিলো।নাহিন আদালতে আসতে নিষেধ করেছিলো তাকে।
পুলিশ সদস্যরা ধরাধরি করে দু’জনকেই হসপিটালে আনে। যেহেতু পাব্লিক প্লেসে হয়েছে এমনটা তাই খুব দ্রুতই সংবাদ মাধ্যমেও প্রচারিত হতে থাকে এই ঘটনা।
নাহিন মিটিং এ ব্যস্ত।তবে ওর মা বারবার ফোন দিয়েই চলেছে।দুই দেশে সময়ের পার্থক্য আছে। সিঙ্গাপুর তো দুই ঘন্টা এগিয়ে।জরুরি অবস্থায় আজই গিয়েছে সে।দুইদিন থাকতে হবে। নতুন প্রজেক্টের কাজে।কুহেলিকাকেও আসতে বলেছিলো।তবে কুহেলিকা নাসরিন সুলতানার বাহানা দিয়ে আর যায় না।তবে কে জানো পন্ডিতের মাথায় কি ঘুরছে!
নাসরিন সুলতানা একাধারে ছেলেকে বলেন কি হয়েছে।নাহিন তো পাগল হয়ে যায়। মিটিং তো শেষই ।ছুটে বেরিয়ে যায় মিটিং রুম থেকে। উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ।তবে আজকের আর ফ্লাইট নেই বাংলাদেশের। নাহিনের ইচ্ছে হচ্ছে সব ভেঙে লুটিয়ে দেওয়ার।তখনই নাহিনের ফোনে ভেসে ওঠে কুহেলিকার নাম্বার।
”এই মেয়ে আমার একটা কথাও তোমার ভালো লাগে না তাই না!সব সময় বেশি পন্ডিতি করতে কে বলছে তোমায়!আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো কিভাবে বাচতাম আমি”
নাহিন একাধারে কথা বলে।ওপাশ থেকে ভাঙা গলায় কুহেলিকা বলে,
”এতো দ্রুত কিছু হবে না।শুনুন কিসের জন্য ফোন দিয়েছি।”
”কিসের জন্য?”(নাহিন)
”আমি মিষ্টার জোভানের নামে কেস করবো”(কুহু)
”করো”(নাহিন)
”আমার কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তুমি থাকো।আর শোনো প্রজেক্টের কাজ যেন ঠিক ভাবে চলে। প্রজেক্টে ভুল হলে তোমার খবর আছে”(কুহু)
”ইয়েস বস”
নাহিনের শেষ কথায় কান্না যেমন প্রতিয়মান।ঠিক তেমনি হাসিটাও বিদ্যমান। সবচেয়ে ভয়ংকর অনুভূতি একসাথে হাসি-কান্নার মাঝেই যে লুকিয়ে।কুহেলিকা ফোন কেটে দেয়।দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকায়।ওমা,কাকে দেখছে ও!কায়েস মির্জা এসেছেন।কান্না ভেঙে পড়েন।কুহেলিকার পায়ের কাছে বসে কাঁদতে থাকেন।কুহেলিকা ক্যানোলা হাতে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে টুলে বসায়।হাত দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে।তবে সেদিকে পাত্তা দেয় না কুহেলিকা।
”মারে আমাকে ক্ষমা করে দিস।তোর থেকে অনেক সত্য লুকিয়েছি।এই লুকিত সত্যের বোঝ যে আর বইতে পারছি না। আজ যখন তোকে হারানোর খবর শুনলাম মনে হলো রুহটা বেরিয়ে গেলো।আত্মগ্লানিতে ডুবলাম সত্য লুকানোর।আজ তোকে সব বলতে চাই।”
কায়েস মির্জার চোখে জল।কুহেলিকা জানে তিনি কি বলতে চলেছেন।তবে কুহেলিকাকে অবাক করে কায়েস মির্জা আরো গভীরের তথ্য বলতে লাগলেন,
”দিনটা ছিলো বৃহস্পতিবার।এখনো স্পষ্ট স্মরণে আছে। তানজিল চৌধুরী আর ডায়ানা দেশে আসলো।ওহ তোকে তো বলাই হয়নি ওরা কারা।ওরাই তোর আসল মা-বাবা। চৌধুরী বংশের ছেলে তোর বাবা তানজিল চৌধুরী।তাই তোর সব কাগজেও চৌধুরী আর ডাকেও চৌধুরী।
তুই তখনও ভূমিষ্ঠ হোসনি।তোর বাবা হয়তো আমাদের চিনতে পারেনি।তবে কাসেম ভাই তোর বাবাকে চিনে ফেলেছিলো।তোর বাবা কক্সবাজার গিয়েছিলো ঘুরতে।আর আমরাও ফ্যামিলি পিকনিকে গিয়েছিলাম সেখানে।আব্বা যাননি।
তানজিলের সাথে কাসেম ভাইয়ের ধাক্কা লেগেছিলো। তানজিল তখন যুবক।রক্ত টগবগে।ভাইয়ের দোষ থাকা সত্ত্বেও ভাই অগ্রাহ্য করে তানজিলকে মারতে গেলে তানজিল হাত মুচড়ে ধরে।সেদিন থেকেই যেন ঝামেলার সূত্রপাত হয়।
তার একবছর কয়েকমাস পর আমরা গেলাম কোরিয়ায়। তুই ভূমিষ্ট হয়েছিস।আব্বাই নিয়ে গেল আমাদের। তানজিলকে দেখে ভাইয়ের মনে পড়লো সেই অপমানের কথা।আর ভাইয়ের অপমান মানে আমার অপমান এমনই ছিলো তখন আমার ধারণা।
তোর মতো মিষ্টিকে তখন মনে জায়গাও দেইনি।ফিরে আসলাম দেশে।কয়দিন পরেই খবর এলো তোদের ওখানে সবাই মারা গেছে।জাস্ট তুই বেঁচে আছিস।আব্বা তোকে নিয়ে আসলো।তবে জানিস তো এই হামলার পেছনে সম্পূর্ণ ভাবে আমিই দায়ী!”
কুহেলিকা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।কায়েস মির্জা নিজের অপরাধ শিকার করেছে!কায়েস মির্জা একা করেছে এমনটা!কেন করলো।সেই অপমানের কারণে! সেই ক্ষুদ্র অপমানের কারণে এতো বড় স্টেপ!কুহেলিকার ভাবনার মাঝেই কায়েস মির্জা আবারো বলতে শুরু করেন,
”তুই হয়তো ভাবতে পারিস আমি খুন করেছি অপমানের প্রতিশোধ। আসলে এমনটা নয়।দেশে আসার পর আব্বা জানালেন যে আমরা শুধু মির্জা বংশের সম্পত্তি পাবো। চৌধুরী বংশের সম্পত্তি তিনি লিখে দেবেন তানজিলকে।
এমনিতেও সেই অপমান তার ওপর আবার সম্পত্তি না পাওয়ার ক্ষোভে আমার বিবেক লোপ পায়।ভাইয়ের উত্তেজনামূলক কথাবার্তায় আমি পাগলপ্রায় হয়ে উঠি তোদের রক্ত ঝড়াতে। ভাইয়ের খাস লোক টিংকুর সাহায্যে কোরিয়ায় লোক পাঠাই।ততদিনে তোরা ওখান থেকে চলে এসেছিস।তারপর আমি বহু কষ্টে তোদের ঠিকানা জোগাড় করে সেখানে লোক পাঠাই।সিলিন্ডার ব্লাস্টের প্ল্যান ছিলো।তবে তোদের সিলিন্ডারের ব্যবস্থা তো ছিলো না।তাই গুলিবিদ্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করি।আর তাতেই সফল হই।তবে তুই কোনো ভাবে বেঁচে যাস।
আর এদিকে তোদের সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি পাই আমার সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়েটার মৃত্যুতে।ক্ষোভ যেন তোর প্রতি আরো বাড়ে।একেই হারিয়েছি সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তান।তার ওপর আব্বা তোকে এনে জানায় তুই পাবি তার সব সম্পত্তি।তোর আঠারো বছর হওয়ার আগে যদি তোর কিছু হয় তবে সেই সবসম্পত্তি সরকারের হাতে চলে যাবে।তাই তোকে মানুষ করার দায়িত্ব নিলেও উদ্দেশ্য ছিলো তোকে হত্যা করা।”
কুহেলিকা বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে।কায়েস মির্জা চোখের পানি মুছে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেন,
”রুমানা আর জুলফিকারকে ছেড়ে দিস মা। ওদের অনেক দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। খোঁজার চেষ্টা করিস না।ভালো থাকিস।আর অভাগা,শয়তান এই লোকটাকে পারলে ক্ষমা করিস।ক্ষমা করিস মা”
কুহেলিকার মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে।চোখ দিয়ে অজস্র ধারায় গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুরা।কায়েস মির্জা চলে যায়।কুহেলিকা যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।ওর ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদার।পারছে না ও।নিরব অশ্রু বিসর্জন দেওয়াই যেন হয়ে উঠেছে ওর লক্ষ্য।
তানজিল চৌধুরী কেবিনে প্রবেশ করে দেখতে পান মেয়ের হাত দিয়ে রক্ত ঝড়ছে।ক্যানোলা চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে।সে ছুটে যায় মেয়ের কাছে। কাসফিয়া চৌধুরীও এসেছে। ভাইয়ের হায়হুতাশের শব্দে দ্রুত এগিয়ে আসে এদিকে। উদ্দেশ্য ছিলো কুহেলিকাকে দেখা।তবে আরো গুরুতর অবস্থায়!
কাসফিয়া চৌধুরী দ্রুত হাত থেকে ক্যানোলা বের করে হাতে ড্রেসিং করার ব্যবস্থা করেন।ব্যান্ডেজ করে দেন হাত।কুহেলিকা জ্ঞানহীন।বুক ফেটে যাচ্ছে তানজিল চৌধুরীর। বোনের সামনে মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদতেও পারছেন না তিনি। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে।জানা যায় কায়েস মির্জা আত্মগোপন করেছেন। স্বীকারোক্তি দিয়েছেন আজ অব্দি করা তার অপরাধ সমূহের।তবে ঢাকাতেই কেন!
হঠাৎ তানজিল চৌধুরী ছুটে বেরিয়ে যায়। সিসিটিভি রুমে এসে সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে আকুতি মিনতি করে ভিডিও ফুটেজ দেখে।মেয়ের এই অবস্থার পেছনে কে দায়ী বুঝতে পারে। তবে বুঝতে পারে মেয়ে তার এই দূরাবস্তাতেও মায়ের খুনির শাস্তি পাইয়ে দিয়েছে।
তানজিল চৌধুরী ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। কাসফিয়া চৌধুরী অবাক হোন ভাইয়ের এই কাজে। লজ্জায় পান ভাইয়ের কি তবে অল্প বয়সের এই মেয়েকে ভালো লাগলো নাকি! নিজের চিন্তায় নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানান। তানজিল চৌধুরী মেয়েকে রেখে বোনের হাত ধরে বলে ওঠে,
”আপা আমার মেয়েকে তুই বাঁচা।ও আপা ও যে আমার মেয়ে।আমার মেয়ের জীবন ভিক্ষা দে আপা।ওর জানি কিছু না হয় আপা”
কাসফিয়া চৌধুরী হতভম্ব।তার ভাই আর তার ভাস্তি তার থেকেই তাদের পরিচয় কি সূক্ষ্মভাবে গোপন করলো! কাসফিয়া চৌধুরী রাগ করেন না।তবে মনে প্রশ্নটা থেকেই যায় কুহেলিকা যদি তানজিলের মেয়ে হয় তবে কায়েসের মেয়ে কোথায়!
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২০
#বর্ষা
”নাহিন জানো একসময় না আমার খুব বাচ্চা পছন্দ ছিলো।বলতে পারেন মা হওয়ার স্বপ্ন প্রতিবেলাতেই দেখতাম। একজন ভালো মা হওয়ার স্বপ্ন।মায়ের ভালোবাসা কি তা তো তখন জানতাম না,আকুলতা ছিলো অনেক বেশি..”
কুহেলিকা নাহিনের বুকে মাথা রেখে বলতে থাকে।আজ জ্যোস্না রাত।বেলকনির দরজা খোলা হওয়ায় অন্ধকার রুমও যেন আলোকিত হয়ে আছে।কুহেলিকার কথার মাঝেই নাহিন বলে ওঠে,
”আমার কিন্তু বাচ্চা অনেক ভালোই লাগে। তুমি বললে আমরা কিন্তু…”
কুহেলিকা চোখ রাঙানি দেয় নাহিনকে।নাহিন হেসে ফেলে।কুহেলিকা সিরিয়াস হয়ে বলে,
নাহিনের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে কুহু। পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তির স্থান যেন এই স্থানটাই।ক্লান্ত নাহিনও আদূরে বউকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে।আবার কালকে কি হয় তার জন্যও তো তর সইছে না তার।নাহিন চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
নাহিন ঘুমিয়ে পড়তেই রাত দুইটার দিকে জেগে ওঠে কুহেলিকা।নাহিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মোবাইল হাতে নেয়।ভুলে করে আর ভিডিও সেন্ট করাই হয়নি তার। তাইতো তা মনে পড়তেই ঘুম উড়ে গেছে।দ্রুত ভিডিও পাঠায় কুহেলিকা।সত্যিই সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো বড্ড উপকারী।আর একটা দিন দেরি হলেই হয়তো আর প্রমাণগুলো পাওয়া যেতো না।থ্যাংকস টু আল্লাহ।
কুহেলিকাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে নাহিন ভ্রু কুঁচকে মিটিমিটি চোখে তা দেখে।তার ঘুম যে বড্ড পাতলা।তার আদুরিনী বাঁধন ছুটাতেই তার ঘুম উড়ে গেছে।তবে তা জানতে দেয়না সে তার বউকে।বিশ্বাস আছে।আর যেহেতু বলেছে কাল তার জন্য সারপ্রাইজ আছে। তাহলে নিশ্চয়ই আছে।অন্ধ বিশ্বাস করছে তবে নিজের ভালোবাসার ওপর ভরসা করছে।আটবছরে যতোটুকু চেনা যায় তার চেয়েও বেশি যেন কুহেলিকা তার কাছে।তবে মেয়েটার রহস্যগুলো সে নিজেই সামনে আনছে।নাহিন চায়ও না কুহেলিকা তার মতের বিরুদ্ধে নাহিনের প্রভাবে রহস্যের সমাধান করুক।নাহিন জানে কুহেলিকা সঠিক সময়ে ঠিক বলবে তাকে।
মধ্যরাতে রাস্তায় জাগ্রত অধিকাংশ মানুষ হয় নয়তো চোর নয়তো পুলিশ।চোর জাগে চুরির উদ্দেশ্যে আর পুলিশ জাগে সাধারণ জনগণকে এদের হাত থেকে রক্ষা করতে।আর এই দুই শ্রেণীর বাইরে যারা তারা হলো খেটে খাওয়া মানুষ। রিক্সায় করে যাত্রী পৌঁছে দেয় এই মধ্যরাতেও। অবশ্য এই খেটে খাওয়া মানুষের বদনামে কয়েক চোরও রাতের বেলা রিক্সায় যাত্রী নিয়ে লুটে খায় যাত্রীকে।সম্মানহানি হয় এই খেটে খাওয়া মানুষদের।আজও তেমনি ঘটছে।
রাস্তা দিয়ে স্বামী-স্ত্রী তৌফিকুল সাহেব আর লামিয়া বেগম হাঁটছিলেন। নিত্যদিনের অভ্যাস এই দম্পতির মাঝরাতে হাঁটতে বের হওয়া।বয়স বেশি হয়নি বিয়ের। তাইতো এই রোমাঞ্চকতা। তৌফিকুল সাহেব জারিফের এক্স সিক্রেটারি। জারিফের কালা অধ্যায় সম্পর্কে প্রায় সবই জানা ওর।বিয়ের আগে আগেই চাকরি ছেড়েছে।পেয়েছে বড় অংকের টাকা। তবে লোভী মানুষদের সাথে থাকলে লোভও যে বেড়ে যায় কয়েকগুণ।তাইতো জারিফের শত্রুকে তারই গোপন কয়েক বৈঠকখানার ঠিকানা বলে লুফে নিয়েছে বেশ বড় বড় কয়েক অংক।লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু।তাইতো তৌফিকুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু।
লামিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর মাথা বরাবর গুলি করে মাস্ক পরিহিত লোকটা। তৌফিকুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর মাথা বরাবর আঘাত করে কেউ।জারিফ দাঁড়িয়ে। তাদের ব্যবসায় ধোঁকাবাজির জায়গা নেই।আর যে ধোঁকা দেয় তার বেঁচে থাকার জায়গা নেই।তবে এতো সহ্য মৃত্যুও যে কাম্য নয়।
জারিফের ইশারায় লোক তিনটে তৌফিকুল আর ওর বউয়ের দেহ সরিয়ে ফেলে। তৌফিকুলকে নিয়ে যাওয়া হয় গোডাউনে আর লামিয়ার দেহ!লামিয়ার দেহ যায় পদ্মার মাছেদের উদ্দেশ্যে।
জারিফ বাড়ি ফিরে দেখে বউ তার চোখ রাঙিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তবে জারিফের এক চড় খেতেই সেই চোখ রাঙানি চোখ দুটো মাটিতে নিবদ্ধ হয়।জোভান,জারিফ,জিদান প্রত্যেকের বউই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। ভালোবেসে কিংবা সমাজের ভেদভাও দূর করতে তারা বিয়ে করেনি।তারা তো বিয়ে করেছে বউ যাতে থাকে নিশ্চুপ, নির্বিকার। তার কথা বলা থাকবে বারণ।চোখ থাকবে মাটিতে।বাচ্চাগুলোকেও বাড়িতে রাখেনি।হোস্টেলেই থাকে ইয়ামান,রুহি,জয়া,জয়।জোভানের এক ছেলে জয়।জারিফের দুই সন্তান ইয়ামান,রুহি।আর জিদানের বড় মেয়ে জয়া।জয়া কলেজে ভর্তির প্রিপারেশন নিচ্ছে।ইয়ামান ক্লাস এইটে,রুহি টেইনে।আর জয় ক্লাস সিক্সে।
জারিফের চড় খেয়ে চুপচাপ থাকলেও মনে মনে স্বামীর পতন চায় ইরুসি।আজ কতগুলো বছর ধরে সংসার ধর্মে নিজেকে আটকে রেখেছে। শশুর-শাশুড়ির সেবা করছে তাও কারো মন পেয়ে ওঠা হলো না।কান্না লুকিয়ে ইরুসি সিড়ি বেয়ে ওপরে চলে যায়।জারিফ বউয়ের চলে যাওয়ায় আরো রেগে যায়।জুতা ছুড়ে মারে ওপরের দিকে।তবে ওপরে ছুঁড়ে মারা জিনিস সবসময় নিজের মুখেই লাগে।তেমনি জুতাটাও পড়েছে জারিফের মুখে।
****
তানজিল চৌধুরী এখন বোনের বাসাতেই থাকেন। বোনের প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন কষ্টের আভাস পান।প্রশ্ন জাগে সন্তান কই তোর!তবে আর জিজ্ঞেস করে ওঠা হয় না।তানজিল চৌধুরী এই রাতেও ড্রয়িংরুমে বসে আছেন।অন্ধকারের সাথে যেন অন্ধকার অন্ধকার খেলছেন!
”তানজিল?”
বোনের কন্ঠ পেতেই ফ্লাসলাইট চালান তিনি।সামনে বড় বোন দাঁড়িয়ে। সামনের সোফায় জায়গা ফাঁকা থাকতে কি ভেবে যেন তানজিল চৌধুরী জায়গা ছেড়ে দেন। ভাইয়ের পাশেই বসেন কাশফিয়া চৌধুরী।বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন।
”আপা ঠিক আছিস তুই?”
”হুম”
চোখ বন্ধ করে সোফার হাতলে মাথা রাখেন তিনি।মৃদু স্বর।ভাইকে বলার আছে অনেককিছু।তবে দ্বিধাবোধ কিছুই বলতে দিচ্ছে না।
নাহিদ খান বিছানায় কাসফিয়াকে না দেখে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে আসতে নিয়েও ঘরে ফিরে যান।ভাই এর সাথে হয়তো দুঃখের ভাগ করবে।নাহিদ খানও তো চান তার বউটার চাপা দুঃখ একটু কমুক।কম তো সময় একসাথে নেই।প্রায় চল্লিশ বছর একসাথে!নাহিদ খান বেলকনিতে চলে যান।ফোন এসেছে।
কাসফিয়া চৌধুরী কিছুক্ষণ নিরব কান্না কেঁদে বলে ওঠেন,
”মাই আমি তোদের সাথে অন্যায় করেছিলাম পালিয়ে এসে।তাই তোদের সাথে করা অন্যায়ের শাস্তিও পেয়েছি আমরা”
”কি বলতে চাচ্ছিস আপা?”
তানজিল চৌধুরী যেন কিছুই বোঝেন না।তবে আন্দাজ করতে পারেন কি বলতে চলেছেন কাসফিয়া। কাসফিয়া চৌধুরী বলে ওঠেন,
”আব্বুকে সন্তান স্নেহ থেকে দূরে সরিয়ে আমি কখনো সন্তানের মুখ দেখতে পারিনি।আমি মা হতে পারিনি।”
তানজিল চৌধুরী কি বলবেন ভেবে পান না।তবে সান্ত্বনা দিতে বলেন,
”আপা তুই ভুল ভাবছিস।আব্বা তোকে অনেক ভালোবাসতো তুই তো জানিস।আব্বা সবসময় তোর সুখের কথাই চিন্তা করেছে।আর মা হতে পারা না পারা সব তো আল্লাহর হাতে বল!”
কাসফিয়া চৌধুরী যেন শান্ত হওয়ার পরিবর্তে আরো জোরেই কেঁদে ওঠেন।তানজিল চৌধুরী একপাশে বোনকে জড়িয়ে নেয়।নাহিদ খান স্ত্রীর কান্নার শব্দে ছুটে আসেন। অষ্টাদশী প্রেমিকা থেকে আজ এতো বছরের বউ তার। ছোট বাচ্চার মতোই তো সামলে এসেছে বউকে তিনি।তাইতো তানজিল সরিয়ে বউকে ঘরে নিয়ে এসেছে।এই সেই বলে ভুলানোর চেষ্টা করছে।
*****
কায়েস মির্জা জুলফিকারকে ইচ্ছে মতো জুতা পেটা করছে।কারণ একটাই কুহেলিকাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করছে।তবে রুমানা আফরোজ যেন আরো ক্ষেপে ওঠেন তাতে। জুলফিকার আর ওনার মাঝে এসে অনেকটা চেঁচিয়েই বলে ওঠেন,
”নিজের ছেলেরে মারতাছেন এমন একটা মেয়ের জন্য যে আমাদের রক্তই না।নাকি ওই মেয়ের মায়ের সাথে…”
কায়েস মির্জা ঠাসিয়ে চড় লাগান স্ত্রীর গালে। চেঁচিয়ে বলে ওঠেন,
”তোমাকে যদি আরো আগে এই চড়টা মারার বোধ হতো তবে আজ এমন কিছুই হতো না।”
”তুমি আমায় মারলে?থাকবো না আমি তোমার সংসারে আর।আজই ভাইয়ের বাড়ি চলে যাবো!”(রুমানা আফরোজ)
”যাও যাও।দেখো গিয়ে তোমার ভাই তোমায় জায়গা দেয় কিনা!তোমার ভাই জায়গা দিলেও ভাবী যে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে তার নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি।যাও যাও”(কায়েস)
”আব্বু তুমি আমার আম্মুর সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না”(জুলফিকার)
”তোর থেকে শিখতে হবে কিভাবে কথা বলবো।যা বেড়িয়ে যা এই বাড়ি থেকে।যার বাড়িতে থাকছিস তাকে নিয়েই বাজে মন্তব্য করছিস।বেহায়া, অকৃতজ্ঞের দল”(কায়েস)
কায়েস মির্জা যেন কুহেলিকার সেদিনের সাহায্যে ভালো হয়ে গেছেন।কুহেলিকার শরীরে তার রক্ত না থাকলেও কুহেলিকার রক্ত আছে তার শরীরে।জীবন বাঁচাতে সেদিন দিয়েছিলো তো তাকে।বয়স বাড়লে অধিকাংশ পাপের কথা মানুষের মস্তিষ্কে ঘোরে।আর তাইতো মানুষ অস্থিরতায় পাগল প্রায় হয়ে যায়।
রুমানা আফরোজ ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে এসেছেন।সোফায় বসে কায়েস মির্জা দেখছেন।তবে আটকানোর মতো মন মানসিকতা নেই তার।এই বিবেকহীন মানুষটাকে বিবেক বান বানাতে আগে কষ্ট যে দিতেই হবে।বোঝাতে হবে এই যে বিশাল বাড়িতে থাকছে খাচ্ছে তা তার নিজের নয় বরং অন্যের দান।তাই যেন সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।নাকি সেই মানুষটির প্রতি ক্ষিপ্রতা!তবে চিন্তাও হচ্ছে এই শেষরাতে বউ তার নেশায়লুপ্ত ছেলে নিয়ে কোথায় যাবে!
****
ঢাকাবাসী যেন আজ বড্ড অবাক।একসাথে দুইটা চমকপ্রদ সংবাদ। প্রথমত আলোড়ন সৃষ্টিকারী সংবাদ চৌধুরী টেক্সটাইল রিওপনিং আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে লোমহর্ষক। দুইটা ভিডিও তবে দুইটাতেই দোষী জারিফ মুনতাসির।সাংবাদিক আগে পৌঁছেছে।তার কিছুক্ষণ পরপরই পুলিশের আগমন।
সকাল সকাল এতো চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ছুটে গেছে কুহু আর নাহিনেরও।কুহেলিকা হাসে তার মানে কাজ হয়েছে। আর নাহিন ভ্রু কুচকায়।দ্রুত ফ্রেশ হয়ে দু’জনই নিচে যায়।প্রেসের লোকেরা ঘিরে ধরেছে পুরো বাড়ি। দারোয়ান ভয়ে গেট খুলে পালিয়েছে।সদর দরজা লাগানো।তাইতো ধাক্কাধাক্কি তীব্র শোনাচ্ছে।নাহিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই কুহেলিকা ফর্মাল ড্রেসে এসে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়। সুযোগ বুঝে পুলিশের লোকেরা ভেতরে ঢুকে লাঠি দিয়ে বেরিকেট বানিয়ে আটকায় সাংবাদিকদের।
নাহিন এর দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করে,
”স্যার মিষ্টার জারিফের রুমটা কোথায়?”
নাহিন হাতের ইশারায় দেখিয়ে দেয়।বুঝে ফেলে কুহেলিকার প্রতিটি চাল। তবে সামনে কি হয় তাও দেখতে চায়।জারিফকে বাইরে নিয়ে এসেছে অফিসাররা।তবে এখনো নেশা কাটেনি জারিফের।
ফাতেমা বেগম আর রাব্বি মুনতাসিরও ইতিমধ্যে বেরিয়ে এসেছেন রুম থেকে।রাব্বি মুনতাসির কাকে কাকে যেন ফোন দিচ্ছেন।ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তবে কেউই ফোন ধরছে না তার।রাব্বি মুনতাসির নিরুপায় হয়ে পুলিশদের কাছে আগে রিজন জানতে চান।রিজন যদি হয় ঠুনকো তবে টাকা দিয়ে মিটিয়ে নিবে এমনই ভাবছেন তিনি।তবে উনি তো আর জানেন না পুলিশ নয় মিডিয়া তার ছেলের কালো চিট্ঠা ফাঁস করছে।
”আপনার ছেলে জারিফ দুইমাস পূর্বে একটা পাগলিকে রেপ করার চেষ্টা করছে,আবার তার ঠিক দুইদিন আগে সে ওভার ব্রিজের নিচে এক পথচারী মেয়েকে…! সিসিটিভি আমাদের কাছে আছে। তবে মেয়েটার চেহারা দেখা না গেলেও আপনার সুপুত্রের চেহারা সুস্পষ্ট। তাছাড়া কাল রাতে খুনও করেছে আপনার ছেলে এক নারীকে। লাপাত্তা তার স্বামী”(পুলিশ)
”স্যার টাকা লেনদেন করে যদি…”(ফাতেমা)
”মিসেস আপনি আমাকে ঘুষ দিতে চাচ্ছেন!আপনি জানেন পুলিশকে ঘুষের কথা বলার অপরাধে আপনার জেল হতে পারে!”(পুলিশ
”সরি স্যার সরি।মহিলা মানুষ বেশি বুঝে,এতো গভীরভাবে নিবেন না দয়া করে।স্যার আমার মনে হচ্ছে আমার ছেলেকে কেউ ফাসাচ্ছে।বোঝার চেষ্টা করুন ”(রাব্বি)
নাহিন আর ইরুসি ওপর থেকেই সব দেখছে।ইরুসির মুখে প্রশান্তি স্পষ্ট।নাহিন লক্ষ্য করে।তবে নাহিন বোঝে না কেন জারিফের স্ত্রী তাকে বাঁচাতে ছুটছে না। নাকি জারিফ তার বউয়ের সাথেও প্রতিনিয়ত অন্যায় করে যে তার বউয়েরও তার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছে!নাহিন ভাবে না আর। তবে নিজের রুমে চলে যায়।যাওয়ার পূর্বে নিজের বাবা-মায়ের রুমের দরজা বাইরে দিয়ে খুলে দিয়ে যায়।সে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে বাইরে দিয়ে দরজা আটকে দিয়েছিলো।চায়নি তার মা কষ্ট পাক কোনো কারণে।তবে এই কারণটা তো তার মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে!তবে কুহু কোথায় গেল এই চিন্তাতে মগ্ন থেকেই রুমের দিকে অগ্রসরিত হয় নাহিন।
”কুহু?”
অবিশ্বাস্য স্বরে নাহিন জিজ্ঞেস করে।কুহেলিকা রুমে বসে আছে।কুহেলিকা নাহিনের অবিশ্বাস্য মুখশ্রী দেখে বলে,
”আরে সদর দরজা দিয়েই এসেছি। তুমি মায়ের ঘরের দিকে গিয়েছিলে তাই দেখনি।”
”এসব কিভাবে হলো কুহু?”(নাহিন)
”কোন সব?(কুহু)
”বলবে?(নাহিন)
কুহেলিকা নাহিনের কাছে এসে বলে ওঠে,”রেপ কেস গুলোর ভিডিও আমিই দিয়েছিলাম।খুন, লাপাত্তা বিষয়ে আমিও জানি না।হয়তো জারিফেরই শত্রু।”
”তুমি ভিডিও পেয়েছিলে কোথায়?”(নাহিন)
”বাংলাদেশে প্রথম যেদিন আসি। সেদিনটায় আমি ব্লগিং করেছিলাম।রাত এগারোটায় ঢাকায় পৌঁছেছি একটু না ঘোরাঘুরি করলে হয়। বারোটার দিকে আমার বাস ছিলো।তবে শর্টকাট নিতে বাইক ভাড়া করে নির্জন দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ক্যামেরার ভিডিও তে চোখ আটকে যায়। একজন পুরুষ এক নারীর সাথে .….!আমার সহ্য হয় না।চারপাশ নির্জন।তাইতো আমি আর ওই বাইকের ভাইয়া মিলে জারিফকে সেদিন রেকর্ড করার পাশাপাশি ইচ্ছে মতো মারি।সেখান থেকে কিছুই দূরে ফেলে আসি..আর”(কুহেলিকা)
”আর আর কি কুহেলিকা?”(নাহিন)
”দরজায় দেখো”
কুহেলিকার কথায় দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় জোভান দাঁড়িয়ে আছে।ছুটে এসে কুহেলিকার গাঁয়ে হাত দিতে নেবে তার পূর্বেই হাত ধরে ফেলে নাহিন।জোভান যেন পাগলা কুত্তায় পরিণত হয়েছে।নাহিনকে মারতে শুরু করে।নাহিনও কম কিসে।লেগে যায় দুজনার।কুহেলিকা থামাতে গেলে জোভান ধাক্কা মারে। টেবিলের কোণায় লেগে কেটে যায় ওর মাথা।ধস্তাধস্তির শব্দ পুলিশেরা উপরে চলে আসে।থামায় দু’জনকে।জোভানকে থ্রেট দিয়ে যায়।ভাই জেলে যাচ্ছে নিজে জেলে যাওয়ার যেন বন্দোবস্ত না করে!
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৯
#বর্ষা
বিল্ডিং দেখতে এসে কুহেলিকা পড়েছে বিপদে।বহু পুরনো এই চৌধুরী টেক্সটাইল গ্রুপের বিল্ডিংটা। কোহিনুর চৌধুরীর মৃত্যুর পর বিল্ডিং এর ভেতরের প্রায় জিনিস বেঁচে সাফ করে ফেলা হয়েছে।তাও তো কম সময় না,প্রায় দশবছর।বিল্ডিংটা খিলক্ষেত এরিয়ায় পড়েছে।চারপাশে আরো অনেকগুলো বিল্ডিং যেন কলোনি।তবে কুহেলিকাকে ‘চৌধুরী টেক্সটাইল’ বিল্ডিং নিয়ে কথা বলতে দেখে দারোয়ান ফোন করে কাউকে।দ্রুত পাশের বিল্ডিং থেকে এক লোক এগিয়ে আসে।
”এক্সকিউজ মি. আপনি কে?”
ভদ্র করে লোকটা এগিয়ে আসে।কুহেলিকা সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো।কোনো সহজ-সরল কথাবার্তা না বলে সোজাসুজি বলে ওঠে,
”এই বিল্ডিং এর চাবি দিন”
”আপনি?”
”কুহেলিকা চৌধুরী ”
”ম্যাম আমাকে বলতেন আমি আপনাকে নিতে আসতাম। কষ্ট করে খুঁজতে গেলেন কেন?”
কুহেলিকার লোকটার কথায় ভ্রু কুচকায়। আপন মানুষ ছাড়া কারো ফাউ প্যাচাল শুনতে তার ভালো লাগে না।কুহেলিকা বিরক্ত হচ্ছে বুঝতে পেরে লোকটা সময় চেয়ে ছুটে পূর্বের বিল্ডিং এর সিকিউরিটি ফ্লোরে যায়। মিনিট পাঁচেক পর হাঁপাতে হাঁপাতে উপস্থিত হয়।
”ম্যাম সব রেডি করেই রেখেছিলাম।আপনি বলার পরপরই সব এনে রেখেছিলাম।তবে আপনি যদি আগে জানিয়ে আসতেন তাহলে আমি ফাইল নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম”
কুহেলিকা রঞ্জনের কথা শোনে। হিন্দুগোষ্ঠীর লোক হলেও বোঝার উপায় নেই তা।বছর এক আগে কুহেলিকা মুফতির সাহায্যে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলো চৌধুরী ইন্ড্রাস্ট্রিজ সরকারের হাতে চলে গিয়েছে।কুহেলিকা তো তখন পাগল প্রায়। নিজের সঙ্গে থাকা বহু প্রমাণাদি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে বাংলাদেশে পাঠায়।ওর লয়ার ছিলো কুন্তী।রঞ্জনের বড় বোন।তারপরই তো কুহেলিকা জানতে পারলো কুন্তী আর কেউ নয় বরং তারই ছোটবেলার ঝগড়াসঙ্গি।কুন্তী বান্ধুবীর কয়েকটা সমস্যার কথা জেনে রাজি হলো কুহেলিকা হেল্প করতে।ভাইগুলো সব ওর ভাইয়ের কাছে দিলো।আর ভাই যেহেতু ওখানের একটা ফ্লোরে কম্পিউটার সিকিউরিটি সিস্টেমের কোর্স করছে তাই খোঁজ খবরও জোগাড় করতে পারলো।
”কোনো খোঁজ আছে যে দিনের আলোয় কেউ আসে কিনা?”
ফাইলগুলো হাতড়ে দেখার সময়ই প্রশ্ন করে কুহেলিকা। কোহিনুর চৌধুরীর সব সম্পত্তি সে পেলেও এই কম্পানিটা ছিলো তানজিল চৌধুরীর নামে অর্থাৎ ওর বাবার নামে।তাই কুহেলিকাও লজিকের বৃষ্টি ঘটালো নিজেদের প্রপার্টি সরকারের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনলো।
কুহেলিকার প্রশ্নে রঞ্জন না বোধক মাথা নাড়ায়।ঘড়িতে সময় দেখতে থাকে বারবার।কুহেলিকা জিজ্ঞেস,”করে কোনো সমস্যা?”
”আসলে ম্যাম আমার ব্রেক টাইম শেষ হয়ে আসছে।এখন না গেলে লেইট হবে”
রঞ্জনের সংকোচিত উত্তর।কুহেলিকা রঞ্জনকে তার কোচিং সেন্টারে ফিরতে বলে।কুহেলিকা বুঝতে পেরেছে এই ছেলে বড্ড বোঁকা গোছের।কুন্তীও তো তাই বলেছিলো যে দোস্ত আমার ভাইটা বড্ড বোকা। স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটলেও মাঝে মাঝে এতো বোকা বোকা কাজ করে বলার বাইরে।
কুহেলিকা রঞ্জনের যাওয়ার দিকে তাকায় তো একবার ফাইলের দিকে।সে ভাবে আজ যদি কেউ জানতো রঞ্জনই ওর হয়ে কাজ করছে তাহলে কি হতো!ছেলেটা কি যাচাই বাছাই না করেই ফাইলগুলো দিয়ে দিতো।ভাগ্য ক্রমে কুহেলিকার হাতেই পড়েছে নয়তো আবার কত ঝামেলা পোহাতে হতো কে জানে!
কুহেলিকা ইফতেখার আহমেদকে ফোন দেয়।তবে তার পূর্বে ফাইলের থেকে কয়েকটা অংশের ছবি তুলে নেয় সে।কুহেলিকা কল দিতেই কল রিসিভ করেন তিনি।
কুহেলিকা এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। লক্ষ্য করে সকাল থেকেই একটা বাইক তাকে ফলো করছে।এখনও এখানে আছে।কুহেলিকা কিছুই বলে না। সেদিকে দ্বিতীয়বার ফিরেও তাকায় না যেন সে দেখেইনি।
”মামনি সব ঠিক আছে। তবে ফাইলগুলো সামনাসামনি দেখতে পারলো ভালো হতো। যাইহোক ফাইলগুলো পেলে কোথায়?”
”আংকেল এর জন্যই ঢাকায় আসা। চৌধুরী টেক্সটাইল আবারো মাথা তুলে দাঁড়াবে।রাখছি আল্লাহ হাফেজ”
কুহেলিকা কল কেটে দূরে দাঁড়ানো ওভারের দিকে অগ্রসরিত হয়।আসার সময়তেও এটাতেই আসা।কুহেলিকা গাড়িতে উঠতেই সো সো করে গাড়ি চলতে শুরু করে।কুহেলিকা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। কয়েকজনকে একসাথে কনফারেন্সে কল দেয়।ফরেন পিপলস্ দের সাথেই মূলত মিটিং।কথা হচ্ছে চৌধুরী ইন্ড্রাস্ট্রিজের রিওপনিং নিয়েই।
***
জয়নুবা বেগম হসপিটালের বেডে নিস্তেজ পড়ে আছেন।ক্যানোলাতে চলছে তার স্যালাইন।আর খাবারও দেহে যাচ্ছে পাইপ দিয়ে।ছেলে স্বামীকে পুলিশে ধরায় ট্রমা সহ্য করতে পারেননি।ব্রেন স্ট্রোক করেছেন।দেহের একপাশ পুরোপুরি প্যারালাইস হয়ে গেছে।ডান পাশে নড়াচড়া করতে পারলেও তা যেন খুবই সামান্য।
রাইসা রামায়সাকে নিয়ে বাপের বাড়ি গমন করেছে।স্বামী মানুষ হিসেবে খারাপ তা সে জানতো।তাই বলে জঘন্যতম তা সে জানতো না।প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ভালো খারাপ গুন থাকে।তাই ভেবে রাইসা এতো দিন জুনায়েদের প্রত্যেক খারাপ কাজ এড়িয়ে গিয়েছে।অন্ধ থেকেছে স্বামীর ভালোবাসায়।তবে এই মানুষটা যে জঘন্য তা জানা ছিলো না তার!
রামায়সা পাপা যাবো, পাপা যাবো বলায় দু’ঘা চড়ও খেয়েছে মায়ের হাতে।মেয়ের এমন ব্যবহারে আতংকিত রাইসার বাবা-মা।তাইতো রামায়সাকে রাইসার থেকে দূরে রেখেছে। কিন্তু তারা হয়তো ভুলে গেছে সন্তানকে মায়ের থেকে দূরে রাখলে মায়ের পাগলামি কমার পরিবর্তে আরো বাড়ে।রাইসা নামাজে বসে ঢেসকি পেরে কাঁদছে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছে।বলছে,
”আল্লাহ আমি তো ওর ভালো দিকগুলো নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম।তবে কেন ওর জীবনের এই কালো সত্য সামনে আসলো! আল্লাহ এই সত্যটা কি আরো আগে আসতে পারেনি?আমার বাচ্চাটাকে যে সবাই বলবে তোর বাবা খুনি!ও আল্লাহ তুমি কেন আমার রাইসাকে এক খুনির ঘরে জন্ম দিলে? আল্লাহ আমার রাইসা যেন মাসুম।আমি তো চায়নি কখনো ওকে হিংসা কি তা শেখাতে।সেখানে তুমি ওর বাবাকে খুনি বানালে! আল্লাহ আমার রাইসা এতো সহায়-সম্পদ দিয়ে কি করবে?ও যে ওর বাবার ভালোবাসাই পাবে না। আল্লাহ আমার স্বামীকে তুমি ক্ষমা করে দেও। ওকে তুমি ইহলোকেই শাস্তি পাইয়ে দেও। আল্লাহ পরকালে যে আমি ওর হাত ধরে জান্নাত ঘুরতে চাই!”
রাইসা আবারো কান্নায় লুটিয়ে পড়ে। হঠাৎ মনে হয় আমার মেয়েটা কোথায়!বুক কেঁপে ওঠে।দ্রুত দরজা খুলে বাইরে বের হয়।বাবা-মায়ের রুম খোঁজে তবে পায়না।রাইসার পাগল পাগল লাগতে লাগে।রাইসা দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে ড্রয়িংরুমে মেয়েকে দেখতে পায়।রোহানীর কোলে মেয়েটা।
”রামায়সা”
মায়ের ডাক শুনতে সেদিকে তাকায় রামায়সা। ছোট্ট রামায়সা হয়তো বুঝতে পারছে না তাদের জীবনে কি ঝড় উঠেছে তবে এতটুকু বুঝতে পারছে তার মাম্মাম ভালো নেই।তাইতো চারদিন ধরে মা তাকে আদর করছে না।কাছেও আসছে না,খাইয়ে দিচ্ছে না।রামায়সা অভিমান করে বসে থাকে না। বরং ছুটে যায় মায়ের কাছে।রাইসা রামায়সাকে জড়িয়ে কলিজা ঠান্ডা করে।রোহানীর চোখ বেয়ে আপনাআপনি অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে।রোহানী মনে মনে বলে,
”আল্লাহ তুমি আমার আপির সাথে কেন এমন করলা?আমি স্বার্থপর হয়ে আমার আপিকে দিয়ে নাহিনকে পাওয়ার জন্য উল্টাপাল্টা কথা হয়তো বলিয়েছিলাম।তাই বলে আমার আপি তো স্বেচ্ছায় এমন করিনি।আমার জেদের কারণে আর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কারণে করেছিলো। আল্লাহ আমার আপির এই দুঃখ যে আমার সইছে না।'”
****
নাহিন অফিসের কাজ শেষে গাড়ি করে বেরিয়েছে।আজ বাংলাদেশে ঢাকা সেক্টরের অফিসে তার তৃতীয় দিন কেটেছে।জুতা,ব্যাগ শিল্পের সেক্টর এইটা।ব্র্যান্ডেড জুতা আর ব্যাগের ব্যবসায় আকাশ ছোঁয়া সাফল্য পেয়েছে সে।আর কি লাগে! নিজের তৈরি অভাবনীয় সুন্দর ডিজাইনে জুতা তৈরি আর স্বল্প লাভে ছেড়ে দেওয়ায় পণ্যের গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে ব্যবসাটাও ধীরে ধীরে প্রগতিশীল হয়েছে।তাছাড়া অস্ত্র উৎপাদনের যে ব্যবসাটা আছে তা থেকেও তো বিশাল বড় এমাউন্ট আসে তার একাউন্টে।রাশিয়ার হয়ে অস্ত্র তৈরি করার চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ সে। পাশাপাশি নিজস্ব কয়েকটা সরুমও আছে উত্তরা, নিউমার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
নাহিন গাড়ি করে বাড়ি ফেরার পথে বাইরে তাকিয়ে থাকে।চোখ পড়ে প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়া গোলাপের দিকে।তবে কষ্ট যেন সেই ফুলের মালিককে দেখে আরো বেশি লাগে তার।কি মায়াবী একটা ছোট শিশু ফুল বিক্রি করছে।বয়স কত হবে?দশ বা এগারো!নাহিন গাড়ি থামাতে বলে সেদিকে অগ্রসরিত হয়।
”ফুল তোমার ফুলগুলো আমায় দেও তো।আর এই নেও টাকা”
বাচ্চাটার চোখ যেন চকচক করে ওঠে।দ্রুত ফুলগুলো নাহিনের হাতে দেয়।সাতটা ফুল। নাহিন পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দেয়।বাচ্চাটার মুখে অন্ধকার নেমে আসে।কান্না ভেজা কন্ঠে বলে ওঠে,
”সাহেব আমার কাছে তো এতো বড় টাকা ভাংতি নেই।ভাংতি দিন না..”
নাহিনও কিছু একটা ভেবে মাসুম চেহারা করে বলে ওঠে,”ফুল আমার কাছেও যে ভাংতি নেই।কি করা যায় তাহলে!”
বাচ্চাটার মুখটা চুপসে যায়।নাহিনের মায়া হয়।নাহিন মুচকি হেসে বলে,
”ফুল শোনো তুমি এই পাঁচশো টাকাই আজ রেখে দেও।আমি কাল নাহয় তোমার থেকে আবার ফুল নেবো।”
বাচ্চাটার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।হয়তো আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পাড়ার খুশিই তার মুখকে আলোকিত করছে।বাচ্চাটার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে নাহিন।জানতে পারে বাচ্চাটার নাম অদ্রি।বাবা-মা সবাই ছিলো।ডিভোর্সের পর কেউই তাকে রাখতে চায়নি তারপর সরকারের থেকে ওর দূর সম্পর্কের মামা ওর দায়িত্ব নিলো।আর সেখানে খেতে গেলে ওর কাজ করেই কাটাতে হবে এমনটাই বলেছিলো তারা।কাজ করে খেতে হলেও মামীর ভালোবাসা জুটেছে কপালে তার। কেননা মামির পাঁচটাই ছেলে।কোনো মেয়ে নেই।আর মেয়ের শখ অদ্রি পুড়িয়েছে যেন।
নাহিন গাড়ি ফিরে এসে ভাবতে থাকতে কেমন বাবা-মা যে ডিভোর্সের পর সন্তানকে ফেলে দেয়!নাহিন আঁতকে ওঠে তার অযৌক্তিক সব কল্পনায়।ভাবে কোনো কারণবশত যদি তার আর কুহেলিকার আলাদা হতে হয় তখন!তখন কি তাদের সন্তানেরও পরিণতি এমন হবে!নাহিন নিজের এই ভাবনার জন্যই আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ যেন এমন কখনোই না করে তাদের জীবনে!
নাহিন বাসায় ফিরে দেখে নাসরিন সুলতানা খাইয়ে দিচ্ছে কুহেলিকাকে।তা দেখে বেচারারও মায়ের হাতে খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। মাগরিবের আজান পড়ে চারপাশে অন্ধকার ছড়িয়েছে অনেকক্ষণ।নাহিনও মায়ের কাছে গিয়ে খাবার খেতে হা করে।তা দেখে কুহেলিকা বলে ওঠে,
”দেখেছো আম্মু তোমার ছেলে কত হিংসুটে!আমায় তুমি খাইয়ে দিচ্ছো দেখে ওর সহ্য হলো না।এসে পড়েছে খাবার খেতে”
কুহেলিকা বলতে বলতে নাহিনের হাতের দিকে তাকায়।গোলাপ ফুল।কুহেলিকার বড্ড পছন্দের এই গোলাপ।প্রায় মানুষেরই যে পছন্দের।কুহেলিকা আবার বলে ওঠে,
”দেখি দেখি দেও তো ফুলগুলো আমায়”
”তোমায় দেবো কেন?”(নাহিন)
”আম্মু দেখো তোমার ছেলে আমায় ফুল দেয় না”(কুহেলিকা)
”নাহিন তুমি আমার মা’কে না ক্ষেপিয়ে ফুলগুলো দিয়ে দেও।এমনিতেও আমার মা’টা দুপুরে কিছু খায়নি ঠিকভাবে”(নাসরিন সুলতানা)
”এই তুমি খাও নাই কেন?”(নাহিন)
কুহেলিকা নাহিনের জবাব দেয় না। বরং নাহিন ফুলগুলো আলগা হাতে ধরতেই ফুরুৎ করে ফুলগুলো নিজের হাতে নিয়ে নেয়।তবে হাতে কাঁটা বিঁধতেই হালকা আর্তনাদ করে ওঠে।নাসরিন সুলতানা যেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে কুহেলিকাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে কোথায় ব্যথা পেয়েছে সে।সত্যিই কুহেলিকার আজ নিজেকে বড্ড ভাগ্যমান মনে হচ্ছে নিজেকে।মায়ের ভালোবাসা না পাক তবে শাশুড়ি নামক মমতাময়ী মা তো পেয়েছে!
নাসরিন সুলতানাকে শান্ত করে কুহেলিকা নাহিনকে প্রশ্ন করে,
”তা ফুলগুলো নিস্তেজ কেন?”
”ফুলগুলো এক ফুলের থেকে কিনেছি তাই”(নাহিন)
”মানে?কোন ফুলের কথা বলছো তুমি বেয়াদব ছেলে?আমার মেয়েকে ভুলে অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকালে তোমার খবর আছে এই বলে দিলাম আমি।”(নাসরিন সুলতানা)
নাহিন খুশি হয় মায়ের কথা বলার ধরণে।তবে চিন্তিত হয় মা’কে নিয়ে।মা সুস্থ তো ঠিকই হচ্ছে।তবে তার পাগলী বউটার মতো সবকথা না শুনেই একগাদা কথা শুনাচ্ছে।নাহিন অদ্রির কথা খুলে বলে ওদের।কুহেলিকার মুখটা চুপসে যায়।তবে শুনে খুশি হয় বাচ্চাটার জীবনে অত্যন্ত তার মামী আছে তাকে ভালোবাসতে!নাসরিন সুলতানারও কষ্ট হয় বাচ্চাটার জন্য।তবে ওনার ঘৃণা হয় ওই বাচ্চার মা-বাবার প্রতি।যেমন উনি নিজের স্বামীকে ঘৃণা করলেও অসম্মান করেননা বরং এড়িয়ে চলেন তেমন। কতগুলো বছর একঘরে থাকলেও আকাশসম দূরত্ব তাদের!
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৮
#বর্ষা
”আম্মু,আম্মু দেখো তোমার ছেলে আমার সাথে কেমন করে?”
কুহেলিকার মাসুমিয়াতে যেন মাত্র একদিনেই নাসরিন সুলতানা সুস্থ হয়ে গেছেন পুরোপুরি।পরিবেশ ফ্যাক্ট নামক চিকিৎসার ফল।আমরা যদি অসুস্থ, অপরিষ্কার পরিবেশে থাকি তাহলে আমরা অনুভবও করবো তেমনটাই।তবে নিজেকে যদি ভালো পরিস্থিতিতে রাখার চেষ্টা করি তাহলে কিন্তু একটু হলেও সুস্থতা থাকে।ভালো পরিবেশ বলতে সুস্থ পরিবেশ যেখানে মানুষের মনে এক আর বাইরে আরেক নয়।
—নাহিন তুমি আমার আম্মাজানকে কি করেছো?
নাসরিন সুলতানা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন।নাহিন আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
—আম্মু আমার বউ তো আমার ঘরেই আসে না।
—নির্লজ্জ,বেহায়া কোথায় কি বলতে হয় তাও জানেন না!
কুহেলিকা কয়েকটা কথা শুনিয়ে দ্রুত নাসরিন সুলতানার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পথিমধ্যে দেখা হয় লামিয়ার সাথে।এইটা দ্বিতীয় দফায় দেখা।প্রথমদিনের পর আজকে আর দেখা হয়নি তাদের। এখনই হলো।কুহেলিকা এড়িয়ে যেতে চাইলে লামিয়া পথ আটকে বললো,
—বড়লোকের ছেলে দেখে লোভ সামলাতে পারোনি তাইনা?নাহিনকে নিজের রুপের আগুনে আটকেছো নাকি বিয়ের আগে নিজের সতি….
লামিয়া সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারে না।তার পূর্বেই কুহেলিকা কষে চড় লাগায়।লামিয়া উল্টো মারতে নিলে কুহেলিকা হাত ধরে ফেলে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে ওঠে,
—বয়স তো আঠারোও পেরয়নি এখনি কথার যা তেজ কয়দিন পর তো মেয়ে তোমায় কয়লা রুপে দেখতে হবে।সাবধানে থাকো, আগুনে নিজেকে জ্বালিয়ে মেরো না।
—মানে?
কুহেলিকা লামিয়ার হাত ঝাড়া মেরে ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে যায়।জারিফ দূর থেকে দেখছিলো।কাছে এসে লামিয়ার গালে কষে চড় লাগায়।লামিয়া রাগান্বিত হয়ে যায় জারিফকে দেখে। কেঁদে দেয় রাগে।জারিফ লামিয়ার গাল চেপে বলে ওঠে,
—কালকে তোকে কতবার বলছি যে এই মেয়ের সাথে লাগতে যাস না মেরে ফেলবে।তাও কেন তোর ওর সাথে লাগতে হবে!ভালো ভাবে থাকার চেষ্টা কর নয়তো আবারো সেখানে রেখে আসবো তোকে।
শেষের কথাটা জারিফ আস্তে বলে।লামিয়া কেঁপে ওঠে।ভয় যেন তাকে জেঁকে ধরে।মাথা চেপে ধরে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।জারিফের মুখে ভেসে ওঠে ক্রুড় হাসি।তবে তা হাসি মিলিয়ে সে কেটে পড়ে সেখান থেকে।
লামিয়া দরজা আটকে মেঝেতে বসে পড়ে। মাত্র কয়েকমাস সে বাসায় এসেছে।তার আগের দিনগুলো তো ছিলো আরো নির্মম। সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাকে মানসিক হাসপাতালে রোগী করে রাখা হয়েছিলো।প্রতিনিয়ত কি ছাইপাশ খাওয়াতো ওকে।জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো।তারপর জ্ঞান ফিরলে মনে হতো ওর শরীরের একপাশ কেউ কেটে ফেলেছে।সারাদেহে থাকতো দাগ।যেন জঙ্গলী লতাপতার ওপর টানা হয়ে ওকে।
লামিয়ার মনে পড়ে আরো দুঃখময় ঘটনা। বাকিদের সাথে বনিবনা করে থাকতে যে সে পারতো না। সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হয়ে কিভাবে সে পাগলামি করবে তাদের সাথে!লামিয়ার জীবনে তিনটা বছর তো সেই পাগলা গারদেই শেষ হয়ে গিয়েছে।বুকের মাঝে তৈরি করে বিভৎস সব স্মৃতি।
লামিয়া মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে থাকে।এমনটা তাকে পাগলা গারদে থাকতে প্রায়ই করতো হতো।প্রায়ই তাদের শক দেওয়া হতো।তখন মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়া হতো যাতে চিৎকারের আওয়াজ বাইরে না আসে।
রাকিব হবু স্ত্রীর সাথে প্রেমালাপ করতে করতে রুমের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ দৃষ্টি আটকায় কুহেলিকার দিকে।অতি চেনা পরিচিত মুখ লাগে।তবে চিনতে পারে না সে।কুহেলিকা তাকানো মাত্রই চোখ চোখ পড়তেই রাকিব নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দেয়।
কুহেলিকার কাছে এই পরিবারকে বড্ড অদ্ভুত লাগে।আজকে সে নাহিনের থেকে জেনেই ছাড়বে কেন নাহিন তাকে এতদিন বলেনি তার পরিবার আছে,সে অনাথ না।আজ কুহেলিকা জানতে চায় সব না হলেও দুই একটা প্রশ্নের উত্তর।যদিওবা কুহেলিকা জানে সময় সব প্রশ্নের উত্তর দেয়।
নাহিন মায়ের সাথে কথা শেষে ঘরে এসে বউকে ভাবুক দেখে ভ্রু কুচকায়। অবশ্য এই বাজে অভ্যাসটা কুহেলিকার।নাহিন কুহেলিকার সামনে গিয়ে ধপ করে বিছানায় সুয়ে পড়ে।কুহেলিকার মাঝে ভাবান্তর দেখা যায় না।নাহিন এবার প্রশ্নই করে,
—কুহু কি হয়েছে?
—আপনি আমায় আগে কেন জানাননি যে আপনার পরিবার আছে?(কুহু)
—প্রয়োজনীয় ছিলো না তো।(নাহিন)
—পরিবারকে আপনি অপ্রয়োজনীয় বলছেন?(কুহু)
—আমার আম্মু ছাড়া সবাই আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়।(নাহিন)
—বাবাইও?(কুহু)
—হুম।(নাহিন)
—সব বাবা সন্তানের ভালো চায়।আর সে বাবাকে অপ্রয়োজনীয় বলছেন!(কুহু)
—আমার আব্বু কখনো আমাদের ভালো চায়নি।যদি চাইতো তাহলে নায়মা আপির অন্যায়কারীদের খোলা বেঁচে থাকতে দিতো না।(নাহিন)
—নায়মা আপি?(কুহু)
—শুনবে আমার জীবনের সবচেয়ে কালো গাঁথা?(নাহিন)
কুহেলিকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।নাহিনের চোখে অনেক কথাই ঘুরছে। মস্তিষ্ক বলতে দ্বিধায় আছে।আর হৃদয় একাকী এই ভার বহনে বড্ড ক্লান্ত!এবার যে রেহাই চায়।নাহিন বলতে শুরু করে,
—আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন বাসায় ফিরে দেখলাম আমার আপি বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে।আর তার চোখ গিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।এতো করে জিজ্ঞেস করলাম কেউ বললো না আমার আপি কেন কাঁদছে।তখন কিন্তু সে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।ভালো মন্দ বোঝার বোধও তার হয়েছে।কোনো উত্তর না পেয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। সারাদিন আপার রুমের আশপাশ দিয়ে টইটই করলাম।না আম্মু একবার আপিকে কি জেনো বুঝিয়ে গেলো সেও কাঁদল।আর কেউ আসেনি।
ঘটনা আমি জানতে পারলাম তখন যখন রাত প্রায় বারোটা।পানি তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙ্গে যায়।পাশের পানির গ্লাসটাও ফাঁকা।পানি খেতে বের হলাম। হঠাৎ ভেসে এলো কতগুলো কথা।আপির রুমে থেকেই আসছিলো।আমি চুপিচুপি সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম।আমি বিহীন সবাই ছিলো। চাচা আপাকে বলছিলো কিছু একটা গোপন করতে আর আমার গুণধর চাচাতো ভাইয়েরা মেঝের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলো।আমি ভেবেছিলাম হয়তো হাস্যকর কিছু হচ্ছে সেখানে।যখনই ঢুকতে যাবো রুমে তখনই এমন একটা শব্দটা শুনলাম রুহ কেঁপে উঠলো।একটু হলেও বোধ শক্তি হয়েছিলো আমার তখন।আপিই আমায় শেখাতো সব।ভালো মন্দের জ্ঞান দিতো।
আমার আব্বু ছিলেন বড় ভাই ভক্ত।পুরো ভক্ত না অন্ধ ভক্ত।আমি শুধু ছোট চাচুকেই দেখেছিলাম যিনি একটু অন্যরকম।বড় চাচাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন না, নিজের ইচ্ছায় সব করতেন।তো সেই ভাইয়ের অন্ধ ভক্তির ফায়দা লুটেন বড় চাচা।ভাইকে বলেন,ছেলেরে একটা ভুল করেই ফেলেছে এখন এসব বাইরে জানাজানি হলে মেয়ের সম্মানও যাবে।আবার ছেলেদের ভবিষ্যৎও খারাপ হবে।চাচার কথায় ছিলো স্বার্থপরতা।আপি বিরোধিতা করে সেদিন প্রথমবার সবার মুখের ওপর বলেছিলেন,আমার জীবন তো এমনিতেও শেষ হলে গেলো চাচা।তাই আমার মিথ্যে উছিলা দিয়ে নিজের মেয়ে লোভী ছেলেদের বাঁচাতে আসবেন না।সেদিন জোভান ভাই সকলের সামনেই বলেছিলো,ধর্ষিতা চুপ থাক।এখনো মুখেমুখে বড় বড় কথা।সেদিন না চাচী তাদের শাসন করেছিলো আর না চাচা।এমনকি আমার আব্বু উল্টো আমার আপিকে চড় লাগিয়েছিলো মুখেমুখে কথা বলায়।তিনি এতটায় অন্ধ ভক্ত ছিলেন যে নিজের হাতে যে নিজের মেয়ের অপরাধীদের ছেড়ে দিচ্ছেন বুঝতেই পারলেন না।আম্মু সেদিন শুধু কেঁদেছিলো।আমি সবই দেখেছিলাম তবে ভয় পেয়েছিলাম।কাউকে বলিনি আমি যে সব জানি। তিনদিন কাটলো সেই ঘটনার। হঠাৎ পরেরদিন সকালে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো আমার আপি সুইসাইড করেছে।তখনও আমি চুপ ছিলাম এতোটা বোধ শক্তি যে তখনও হয়নি।তবে অষ্টম শ্রেণীতে উঠতেই যেন শান্ত শিষ্ট আমি বদলে গেলাম।প্রতিদিন মারামারি করে বাসায় ফিরতাম।সেদিন বড় চাচি আমায় শাসন করতে আসলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেছিলাম, নিজের ছেলেদের তো জানোয়ার বানিয়ে আমার বোনটাকে হত্যা করেছো।কখনো যদি ফিরি ভেবে নিও তোমাদের শাস্তি এসেছে।তোমাদের সবাইকে সবার কৃতকর্মের শাস্তি দিতে আমি ফিরবো তখন।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে খালামনির বাড়িতে চলে গেলাম। তাদের সব বললাম।আমার খালু আমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদলেন।আমার খালা তো হা হুতাশ করে জ্ঞান হারালেন।তারা ছিলেন নিঃসন্তান তবে ভালোবাসায় ভরপুর ছিলো তাদের সংসার।আমাকে আর আপিকে সন্তান স্নেহ দিতেন।আমার খালা,খালু আমাকে আবারো ফেরত পাঠানোর সাহস পেলেন না।আমায় নিয়েই পাড়ি জমালেন ভীমদেশে।
নাহিন থেমে গেলো।তার চোখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে।এখন হয়তো সে কাউকে খুনও করে ফেলতে পারে।কুহেলিকা জানতো না তার প্রিয়তম নিজের মাঝে এতো কষ্ট নিয়ে আছে।কুহেলিকার নিজেকে অপরাধী মনে হয়।কেন সে তার প্রিয়তমের কষ্ট নিজের সাথে ভাগ করে নিতে ব্যর্থ হলো।নাহিন পানি খেয়ে আবারো বলে ওঠে,
—তারপর সব তুমি জানো।
—ওয়াদা করছি আপুর মৃত্যুর পেছনে যে আছে তাদের আমরা ছাড়বো না। আপনার পাশে আছি।ওই জানো*** খুন করে ফেলবো।আইন যদি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয় তবে রক্তে হাত রাঙাবো।
কুহেলিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জড়িয়ে ধরে নাহিন।আচ্ছা যাদের জীবনে বিপর্যয়ের হাতছানি আছে তারাই কি এক হয়!অবশ্য এতে ভালোই হয়েছে। দু’জন দুইজনের কষ্টের সঙ্গিও হতে পারবে।সামলাতে পারবে একে অপরকে।
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৭
#বর্ষা
কুহেলিকাকে দেখে সবার মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে।তবে কাউকেই যথাযোগ্য জবাব দিচ্ছে না নাহিন। কেননা তার মনেই প্রশ্ন ঘুরছে তার প্রিয়তমা স্ত্রী কি করে জানলো যে এটাই তার শশুরবাড়ি!কুহেলিকা হাসি হাসি মুখে কৌতুহলী দৃষ্টিতে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে।সোফায় বসে আছে।নাহিন রান্নাঘরে গেছে।কুহেলিকা সেদিকেই তাকিয়ে। হঠাৎ গানের শব্দ পেয়ে উপরের দিকে তাকায়।শর্ট টপস আর জিন্স পরিহিতা কমবয়সী একটা মেয়ে নামছে।টপসটা একেবারে আঁটসাঁট।কুহেলিকার রুচিতে লাগে লামিয়াকে দেখে।মুখ ফিরিয়ে নেয়।
”জুসটা খেয়ে নেও ভালো লাগবে”
নাহিনের কথায় কুহেলিকা জুসটা নেয়। নাহিন ফিরতে ঘুরতে নিলেই লামিয়া এগিয়ে আসে সেদিক দিয়ে।কুহেলিকা নাহিনের হাত টান দেয়। সোফায় ধপ করে বসে পড়ে নাহিন।আর লামিয়া সে তো মেঝেতে পড়েছে।কুহেলিকা খিলখিলিয়ে হেসে দেয়।তবে পরমূহুর্তেই হাসি থামিয়ে গরম চোখে তাকায় নাহিনের দিকে।আর এদিকে লামিয়াও খেপে কুহেলিকাকে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই নাহিন কুহেলিকাকে পাঁজাকোলা করে দোতলায় নিজের রুমে নিয়ে আসে।
ড্রয়িংরুমে বসে সবই দেখছিলো বাড়ির লোকেরা।জারিফ তো ভয়ে ভয়ে কোনো মতে ডাইনিং এ এসে বসেছে কেননা এই মেয়ে যা গুন্ডি!জিদান ছ্যাচড়ার মতো এখনোও সেদিকেই তাকিয়ে।রাকিব গিয়ে বোনকে সোফায় তোলে।বড় ভাই বাবা মরার পর বাবার শেয়ারের ব্যবসার দেখাশোনা করে। সামনের সপ্তাহে বিয়ের পীড়িতে বসতে চলেছে সে।
—বনু ঠিক আছিস?(রাকিব)
—ভাই ওই মেয়েটার কারণেই আমি পরে গেছি।আর দেখেছো নাহিন আমাকে কোলে না নিয়ে ওই মেয়েটা কোলে তুলে দোতলায় নিয়ে গেলো।(লামিয়া)
—দোষ তো তোরই কেন গিয়েছিলি নাহিনের কাছ দিয়ে?দূর দিয়ে গেলেই তো পারতি।তোকে তো বারণ করা হয়েছে নাহিন ভাইয়ের থেকে দূরে থাকতে।আর কি নাহিন নাহিন করিস?নাহিন ভাই বলবি ওনাকে।(রাকিব)
—আজ আব্বু থাকলে তোমরা আমায় বকার সাহস পেতে না।আজ আমার আব্বু নেই দেখে কেউ ভালোবাসে না আমায়।
লামিয়া কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।রাকিব দীর্ঘশ্বাস নেয়।বোন এই কথা বলতে পারে দেখে শাসন করেনি কখনো।আর সে বোন আজ বলছে তাকে নাকি কেউ ভালোবাসে না।রাকিব ডাইনিং এ ফিরে খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যায়। রাকিবের মায়ের আশকারাতেই মেয়ের এই অধঃপতন।টেবিল থেকে মেয়ের জন্য খাবার নিয়ে উঠে চলে যান তিনি।
—ঢং
রাব্বি মুনতাসির ব্যাঙ্গ করে বলে ওঠেন।খুব কম কথা বলা লোকটা যখন কথা বলেন তখন মুখ দিয়ে বিষই বের করেন। অবশ্য তা শুধু পরিবারের মানুষগুলোই জানে।বাইরে তো তিনি দয়ালু,পবিত্র মানুষ সেজে বেড়ান।
কুহেলিকাকে রুমে নিয়ে বিছানা রাখে নাহিন।কুহেলিকার তো শ্বাস ওটা নামা করছে।এতো কাছে কখনো আসা হয়নি তাদের এতো বছরেও।নাহিন কুহেলিকা বিছানায় রাখতেই কুহেলিকা তাকে টান দেয়।নাহিনও বিছানায় পরে যায়।তবে কুহেলিকা সরে গিয়ে হেসে দেয়।
খুনসুটিতে মেতে ওঠে দুজনে।বালিশ নিয়ে কিছুক্ষণ ঝগড়াঝাঁটি করে।তারপর কুহেলিকা শান্ত হয়ে বসে পড়ে।নাহিনও পাশে এসে বসে।নাহিন কুহেলিকার কপালে চুম্বন করে।কুহেলিকা কিছুক্ষণ নিরব থেকে জোরে করে বালিশ নাহিনকে আঘাত করে।নাহিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
—কি হয়েছে এভাবে তাকাও কেন?(কুহেলিকা)
—মারলে কেন?(নাহিন)
—তোমার সাথে ওই মেয়ের এতো কিসের মোহাব্বত?(কুহেলিকা)
—কার সাথে কিসের মোহাব্বত?(নাহিন)
—ওই যে মেয়েটা নিচে পড়লো।(কুহেলিকা)
নাহিন ভাবে।ভাবতেই পেয়ে যায় কুহেলিকা হয়তো লামিয়ার কথা বলেছে।নাহিন মজা করে বলে,
—দেখে আমি কত সুদর্শন আসতে না আসতেই মেয়েরা লাইন লাগিয়েছে বাসায়।
নাহিনের কথায় ক্ষেপে যায় কুহেলিকা।একেবারে নাহিনের ওপর হামলে পড়ে বলে ওঠে,
—একেবারে খুন করে ফেলবো।
—কাকে?(নাহিন)
—আপনাকে।(কুহেলিকা)
—আমাকে খুন করবে কেন?(নাহিন)
—আপনার দিকে মেয়েরা তাকাবে কেন?(কুহেলিকা)
—এখানে কি আমার দোষ নাকি?(নাহিন)
—অবশ্যই।তোমার দিকে কেউ তাকাবে কেন!(কুহেলিকা)
—আচ্ছা একটা বিষয় বুঝলাম না তুমি আমাকে একসময় তুমি তো আবার একসময় আপনি বলো কেন?(নাহিন)
কুহেলিকা উত্তর না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকে। অবশ্য সেও কখনো চিন্তা করেনি এ বিষয়ে।তবে নাহিন তাকে থাকতে দেয় কতক্ষণ?নাহিন বলে ওঠে,
—এই এখন তো সকাল দশটা বাজে। তুমি কি খেয়ে এসেছো নাকি খাবে?
কুহেলিকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে রাগি কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
—আমার ব্যাগ এনে দেও। আমি শাওয়ার নিবো।
—তুমি ওয়াশ রুমে যাও আমি ব্যাগ আনছি।
নাহিন রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ডাইনিং রুমে গিয়ে মাকেও সেখানে দেখে।নাহিন ব্যাগ কাঁধে নিয়েই মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে,
আবেগপ্রবণ হয়ে নাসরিন সুলতানা ছুটে আসেন।মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝান তিনি দেখবেন।নাহিন মা’কে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায়।ফাতেমা বেগম ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকেন।তবে তাতে লাভ হয় বলে মনে হয় না।
***
চট্টগ্রামে আজ রাত অন্যরকম।চৌধুরী ভিলায় প্রেসদের আস্তানা হয়েছে। স্বনামধন্য সব সংবাদমাধ্যম উপস্থিত সেখানে।তারা জানতে চায় গতকাল মধ্যরাতে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটির মানে কি।সত্যিই কি জুনায়েদ কোহিনুর চৌধুরীর খুনি!
পেনড্রাইভ এখন পুলিশের হাতে।তবে তা কপি।সত্যিকারেরটা আদালতে দেওয়া হবে বলেই জানানো হয়েছে।জুনায়েদের মা তো কেঁদে কেটে অস্থির।এতো বছরের পুরনো খুনির শাস্তি কি এখন পাবে সে!কাসেম মির্জা একসময় লয়ার ছিলেন।তাই ছেলের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে নিজেও ফেসেছেন।অপরাধ কারী আর অপরাধ করতে সাহায্যকারী যে সমান অপরাধী।
তিনি বলেছিলেন,
”অতীতে যখন জুনায়েদ খুন করেছিলো তখন তো সে আঠারো বছরেরও কমবয়সী ছিলো,তরুণ ছিলো।আর তখন শাস্তি পেলে তো শাস্তিটা কম হতো।তবে এখন যে তা বহু বছরেরও বেশি হবে শাস্তি ”
পুলিশ বুঝে ফেলেছিলো কাসেম মির্জা আগে থেকেই সব জানতো।তবুও এতবছর লুকিয়ে রেখেছিলো খুনের কথা।জাহিদ তো পুরোপুরি গা ঢাকা দিয়েছে।ভয়ে গায়ের লোম তার খাঁড়া হয়ে গিয়েছে।তাইতো মনের ভয়ে লুকিয়েছে।জয়নুবা বেগম একসাথে দুই শোক সইতে পারলেন না।স্বামী আর পুত্র উভয়েই পুলিশি হেফাজতে।স্ট্রোক করে বসেন তিনি।
—জয়নুবা?
কাসেম মির্জা স্ত্রীর কাছে ছুটে আসতে চেয়েছিলো।তবে পারেনি।পুলিশ বাহিনী হাতে হাতকড়া পরিয়ে টেনে টেনে বাপ ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে।আর ব্রেকিংনিউজ করছে সাংবাদিকেরা।
***
তানজিল চৌধুরী পায়ের ওপরে পা তুলে হাসছেন।হাসতে হাসতেই তিনি কেঁদে ফেলেন।বুকটা তার ভার হয়ে উঠেছে।জীবন মানে কি শুধুই কষ্ট?না,হয়তো সে আগে তার ভাগের সুখের অংশটুকু উৎযাপন করে ফেলেছে!মেয়ের ছবিটা বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন তিনি।মেয়েটাই তো এখন সম্বল তার।
তানজিল চৌধুরীর কাছে ফোন আসে স্বনামধন্য এক সংবাদ মাধ্যম থেকে।অপর পাশের ব্যক্তিটি তাকে সম্মান দেখিয়ে বলে ওঠে,
”স্যার আপনার কারণে আজ অনেক বড় সত্য সকলের সামনে আসলো।আপনাকে যে আমাদের সংবাদমাধ্যমে প্রয়োজন তাহলে আমরা সাহসিকতার সাথে সকল অন্যায়কারীদের সত্য ফাঁস করতে পারতাম।”
তানজিল চৌধুরী কিছু বলেন না।কল কেটে দেয়।আবদ্ধ রুমের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে সে।যা চারদেয়ালের মাঝেই ঘুরপাক খেয়ে তাকে আঘাত করে।তানজিল চৌধুরীর মনে হচ্ছে যে,প্রিয়তমা স্ত্রী ডায়ানা তাকে উদ্দেশ্য করে বারবার বলছে তানজিল তুমি বাবার খুনের শাস্তি তো দিলে তবে আমার খুনীকে এখনো ধরলে না।আমি কি তোমার কাছে ফেলনা?তাহলে কেন লাগছে তোমার এতসময়!আমি যে ভালো নেই,আমার বড্ড খারাপ লাগে।
তানজিল চৌধুরী মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে বলে ওঠেন,
—ডায়ানা অপেক্ষা করো,আরেকটু অপেক্ষা করো।আমিও যে ভালো নেই।আমাদের মেয়েটাও তো ভালো নেই।আমি তো প্রমাণ জোগাড় করছি প্রিয়।আমিও যে চাই তোমার খুনি, আমাদের হাসি খুশি পরিবার ধ্বংসকারী যেন শাস্তি পায়।আমার আরেকটু সময় প্রয়োজন।আমি কাউকে ছাড়বো না প্রিয়।করায় গন্ডায় সবাইকে শাস্তি দিবো।
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৫
#বর্ষা
সাইক্রাটিস্টের সাথে কথা বলছে কুহেলিকা।সাফিনের মেন্টাল হেলথ নিয়েই কথা চলছে অবশ্য।চল্লিশ বছর বয়সী সাফিন ওসিডি রোগে আক্রান্ত বলেই টেস্টে জানা গিয়েছে।কুহেলিকা কোনো প্রকার রিস্ক নিতে চায় না বিধায় বোন জামাইকে সাইক্রাটিস্টের সরণাপন্ন করে সাফিনের ফুফি সোহাগী বেগমকে জানিয়েছে। অবশ্য তাদের আসতে ঢের দেরি।তাই কুহেলিকা ডক্টর মালহোত্রার সাথে কথা বলছে।
—ডক্টর এই ওসিডি রোগটা কি যদি খুলে বলতেন.
—ওসিডির পূর্ণরুপ অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার। নিশ্চই এর পূর্ণরুপ শুনেই বুঝে ফেলেছেন এই রোগটা কেমন হতে পারে।ছয় বছর বয়স থেকে যেকোনো বয়সে নর-নারী, শিশু যে কারো হতে পারে।যেহেতু আপনি বললেন মিষ্টার সাফিন অদ্ভুত আচরণ শুরু করেছে তার ছেলে সিনানের মৃত্যুর পর থেকে, সেহেতু ধারণা করা হয় সাফিন সেই আঘাতেই ওসিডিতে আক্রান্ত হয়েছে।
ডক্টরের কথায় কুহেলিকা মাথা ঝাঁকায়।সে বুঝেছে।তবে প্রশ্ন জাগে সাফিন কি আর সুস্থ হতে পারবে?তাই কুহেলিকা সময়ব্যয় না করেই বলে ওঠে,
—আচ্ছা ডক্টর সাফিন স্যার কি সুস্থ হবেন?
—সঠিক চিকিৎসা নিলে অনেকে ছয়মাসে একেবারে ভালো হতেও পারে।আবার অনেকে ভালো হওয়ার পর আবারও আক্রান্ত হয় এই রোগে।যারা সুস্থ হয় না তাদের ঔষধ খেয়ে আর থেরাপি নিয়েই স্বাভাবিক জীবন যাপনের চেষ্টা করতে হয়।
কুহেলিকার ফোন বেজে ওঠে।এক্সকিউজ মি বলে সরে আসে কুহেলিকা।তার ম্যানেজার ফোন দিয়েছে। ম্যানেজারের ফোনে ভ্রু কুঁচকে যায় কুহেলিকার।সময় দেখে নেয়।এসময় তো ফোন দেওয়ার কথা নয়!ফোন রিসিভ করতে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ওপাশ থেকে ইংরেজি ভাষায় গটগট করে ম্যানেজার বলতে থাকে,
—ম্যাম নাহিন স্যার সিঙ্গাপুর নেই।এমনকি কানাডাতেও ব্যাক করেননি। বরং তিনি গতকালই বাংলাদেশে পৌঁছেছেন।
কুহেলিকার কপালে চিন্তান ভাঁজ পড়ে।যদি নাহিন বাংলাদেশে এসেও থাকে তাহলে সে কোথায় গেলো!আর আসবে তা তো একবারও জানালো না তাকে।সে শান্ত মস্তিষ্কে বলে ওঠে,
—নাহিনকে বলো না যে আমি জানি ও সিঙ্গাপুরে নেই।আর তোমার সাথে যে আমার কথা হয়েছে তাও যেন কেউ না জানে।
—আচ্ছা ম্যাম।
কুহেলিকা ফোন কেটে দেয়। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে।তবে হঠাৎ করে মেয়েলী কন্ঠের চিৎকার চেঁচামেচিতে ভরকে যায় সে।শব্দের উৎস খুঁজতে সেদিকে যায়।পঞ্চাশের বেশি হবে এমন বয়সী মহিলা নার্সদের সাথে কথা কাটাকাটি করছেন।কুহেলিকাকে দেখে নার্স কিছু একটা দেখায় মহিলাকে।ছুটে এসে কুহেলিকার দুই হাত ধরে ঝাকুনি দেয়।বলে ওঠে,
—আমার সাফিন পুত্তার কই?তুমি না আমারে ফোন দিছিলা।আমার ভাতিজা কই?
কুহেলিকা পর্যবেক্ষণ করে মহিলাটিকে।মুখে বয়সের ছাপ স্পষ্ট।চোখে অশ্রুকণা চিকচিক করছে।কন্ঠটাও কান্নায় মোড়ানো।পাশেই দাঁড়িয়ে আছে শার্ট প্যান্ট পড়া ষাটোর্ধ্ব একজন পুরুষ আর সাফিন স্যারের কিছুটা কমবয়সী একজন লোক।কুহেলিকা বলে ওঠে,
—সাফিন স্যার ওভজার্ভেশনে আছে।
—সাফিন ভাইয়ের কি হইছে?
কুহেলিকা ছেলেটার দিকে তাকায়।হয়তো ছেলেটা ইতস্ততবোধ করে এতে।কুহেলিকাও বিষয়টা বুঝতে পেরে লজ্জিত হয়,মুখে কিছু বলে না।তবে ছেলেটা পরিচয় দিতে বলে ওঠে,
—আমি সাফিন ভাইয়ের ফুফাতো ভাই নোমান আহসান। মিরপুরে ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট আছে।আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।
—আমি কুহেলিকা চৌধুরী। সম্পর্কে কায়ফা মির্জার বোন।
—আপনার সম্পর্কে আগে শুনিনি তো তাই চিনতে পারিনি।তা একটু পরিষ্কার করে বলুন তো কি হইছে সাফিন ভাইয়ের আর ভাবী,ছটু ওরাই বা কোথায়?
কুহেলিকা শুনে অবাক হয় যে সাফিন স্যারের আত্মীয়রা জানেই না যে কায়ফা,সিনান আর নেই।কুহেলিকা নিজের অবাকত্ব আড়াল করে বলে ওঠে,
—কায়ফা আপু প্রায় তিন সপ্তাহ আগেই পরলোক গমন করেছেন।আর তার একসপ্তাহ পরেই সিনান…!আর একসাথে দুইটা শোক স্যার সহ্য করে উঠতে পারেননি হয়তো তাই ওসিডি রোগ তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে ভেতর থেকে।
—কি কায়ফা,সিনান মারা গেছে মানে?
পঞ্চাশোর্ধ মহিলার মাঝে ফুটে উঠে কৌতুহলের রেখা।তার মাঝে দুঃখের চেয়ে যেন কৌতুহল বেশি।কুহেলিকার মনে হচ্ছে এনারা যতটা মোহাব্বত দেখাচ্ছে ঠিক ততটা এনারা নন।তবুও কুহেলিকা সম্পূর্ণ ঘটনা আবারো শোনায় তাদের যা সবাই জানে ঠিক তেমন করেই।
***
নাহিনের বিছানায় শুয়ে আছে লামিয়া।এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য তবে বয়সে সে অষ্টাদশী রমনী।গায়ের রক্ত দুধে আলতা।তবে পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ।পোশাক-আশাকে বিদেশী ভাব তবে কেরেক্টার যে খুব একটা ভালো নয় নাহিন তা এই একদিনেই বুঝে ফেলেছে।কালকে থেকেই নাহিনের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি কেমন বেহায়াপনা করছে ছিঃ!
—এই মেয়ে তুমি আমার ঘরে কি করছো?
ডিনার শেষে মাত্রই ঘরে ফিরেছে নাহিন। বিছানায় নজর যেতেই রাগে শরীর রি রি করে ওঠে তার। বর্তমান যুগের মেয়েগুলো এতো বেহায়া কেন?নাহিনের মনে একবার এমন প্রশ্নের উদয়ন ঘটে তবে পরমূহূর্তেই মনে পড়ে সব মেয়ে তো বেহায়া না,কিছু কিছু মেয়ে পারিবারিক শিক্ষার অভাবে, সুস্থ পরিবেশের অভাবে বেহায়া হয়ে উঠছে।
নাহিন লামিয়ার মুখের ওপরেই দরজা লাগিয়ে দেয়।নাহিনের ভাবতেও অবাক লাগছে একই স্থানে বড় হয়েও জিনিয়া আর লামিয়ার মাঝে কত ফারাক।জিনিয়া কত ভদ্র, সহজ-সরল আর এই মেয়েটা আস্তো একটা বেহায়া।
বিছানার চাদর উঠিয়ে ময়লা কাপড়ের ওখানে রেখে আরেকটা চাদর বিছিয়ে নেয় সে। নিজের দেহে যাতে অন্য কোনো রমনীর দেহের গন্ধও না ছোঁয়া লাগে তাই এই প্রচেষ্টা।বোন হলেও এই মেয়ে যে তাকে ভাই মানে না তা এই মেয়ের কাজেই প্রকাশিত। ভাই-বোনের সম্পর্ক হয় বন্ধুর মতো আর যা লামিয়ার কর্ম দেখেই মনে হচ্ছে অসম্ভব।
নাহিন মোবাইল হাতে কল লাগায় তার কাঙ্খিত রমনীর কাছে। মুহূর্ত দুই বাদেই কল রিসিভ হয়।যেন তার কলের জন্যই অপেক্ষায় ছিলো সে।কুহেলিকা নিজের রাগ,চিন্তা,অভিমান গোপন করে বলে ওঠে,
—কেমন আছো?
—আলহামদুলিল্লাহ।তুমি কেমন আছো?
—আছি ভালোই।কি করছো?
—বিছানায় সুয়ে পড়লাম। তুমি?
—মাত্র বাসায় আসলাম।
—কুহেলিকা তুমি বড্ড বেখেয়ালে হয়ে উঠছো দিনকে দিন।কত রাত হয়েছে সেদিকে খেয়াল আছে!
—কাজ ছিলো তাই দেরি হয়েছে।আচ্ছা শুনো ফ্রেশ হয়ে ফোন দিবো।
—শুধু ফ্রেশ হয়ে না বরং ডিনার কমপ্লিট করে তারপর।রাখছি।
নাহিন কল কাটতেই কুহেলিকার চোখ পড়ে ড্রয়িংরুমে বসে থাকা জুলফিকারের দিকে।এইটা তো সেই ইন্টার্নটা। এখানে কি ওর?আর রুমানা আফরোজই বা কেন এতো সেবা সুশ্রসা করছে এর!কুহেলিকা এগিয়ে যেতেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে কায়েস মির্জা।কুহেলিকাকে দেখে তিনিই নিজ থেকে বলে ওঠেন,
—কুহু এই হলো জুলফিকার তোমার ….
কায়েস মির্জা কথা সম্পন্ন করার পূর্বেই কারেন্ট চলে যায়।কুহেলিকার নিউরনগুলো দ্রুত কাজ করতে থাকে।এইপাশটায় তো কখনো কারেন্ট যায় না।তাহলে হঠাৎ কি করে আজই কারেন্ট গেলো!কোনো বিপদ আসছে কি!
কুহেলিকার আকাশ কুসুম চিন্তার মাঝেই জেনারেটর সাপ্লাই চালু হয়ে যায়।একদম কুহেলিকার সামনাসামনি জুলফিকার দাঁড়িয়ে।কুহেলিকা ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে।একেই মনের ভেতরকার ভয় তারওপর আরেক মুসিবত যে কেউ ভয় পাবেই।কথায় আছে মানুষকে মারতে হলে তার জীবন কেড়ে নিতে হয় না বরং তাকে ভীত করতে হয়।আর একবার যে ভীত হয়ে পড়ে সে জীবিত থেকেও মরার ভয়ে মৃতদের তালিকায় পৌঁছে যায়।
চলবে কি?
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৬
#বর্ষা
জুলফিকারের পরিচয় জেনে একটু নয় বরং প্রচন্ড অবাক হয়েছে কুহেলিকা। জুলফিকার আর কেউ না বরং ওর ভাই হয় সম্পর্কে।কায়েস চৌধুরী আর রুমানা আফরোজের ছেড়ে যাওয়া বড় ছেলে।কুহেলিকার বিশ্বাস হয় না যে এই ছেলে তাদের ছেড়ে গেছে। বরং ওর মনে হচ্ছে যে হয়তো কায়েস চৌধুরী আর রুমানা আফরোজ পরিকল্পনা করেই ওকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো।
খাবার টেবিলে বসে জুলফিকার জুনায়েদের সাথে বকবক করছে।কুহেলিকা দোতলার করিডোর থেকে দেখে। সিঁড়ি বেয়ে ডাইনিংরুমে চলে আসে। কুহুকে দেখেই থেমে যায় ওদের বকবক করা। জুলফিকার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,
—ম্যাম গতকালকে আপনি অফিসে আসলেন না কেন?
—আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে?
কুহেলিকা প্লেট উল্টিয়ে খাবার নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে। জুলফিকার নিম্ন আওয়াজে সরি বলে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।একটু পরই রামায়সা ছুটে এসে কুহেলিকার কোলে বসতে চায়।এতদিনে ফিরেছে তাহলে পুচকিটা। অবশ্য খালার বিয়েতে যাবেনা তো কি করবে!
রোহানী পাগলামি শুরু করেছিলো।রাইসা বোনকে কান ধরে বাবার বাড়ি নিয়ে গেছে। জোরজবরদস্তিতে রোহানীরই বয়ফ্রেন্ড লুকাসের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। অবশ্য এবাড়ির সবাই আমন্ত্রিত ছিলো।তবে কেউই যায়নি।কুহেলিকা এ বিষয়ে বেশি কিছু জানেও না।রামায়সাকে কোলে তুলে নেয়। জুনায়েদ আড়চোখে দেখে।কুহেলিকার নজর এড়ায়নি বিষয়টা।কুহেলিকা জানে একদিন এই বাচ্চাটাও ওকে ঘৃণা করবে ওর বাবাকে শাস্তি পাইয়ে দেওয়াতে।
—রামায়সা কেমন কাটলো মামনির বিয়ে?
—খুব ভালো। কিন্তু ওরা আমার মামনিকে নিয়ে চলে গেলো।
—এটাই যে নিয়ম মামনি।
—তুমিও আমায় ছেড়ে চলে যাবে?
—হুম।
—পিপি প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না।
—আমি তোমায় ছেড়ে যাবো না।তোমায় নিয়ে যাবো ঠিক আছে?
—পাপাই,মাম্মামও যাবে?
—উমম না। শুধু তুমি আর আমি।
কুহেলিকা খেতে খেতে রামায়সার সাথে দুষ্টুমি করতে থাকে।আর রামায়সাকেও একটু করে খাইয়ে দেয়।কুহেলিকার ছোট থেকেই বাচ্চা পছন্দের।ষোড়শী বয়সে বান্ধবীদের বলতো দেখিস আমি আঠারোতে বিয়ে করে ঊনিশে মা হবো। ছোট্ট দেহটাকে নিজের মতো করে বড় করবো।
রামায়সা চলে যায় রাইসার কাছে।একটা বাচ্চা খুব করে হলে কিছু সময়ই মা’কে না দেখে থাকতে পারে।তারপর সে প্রচন্ড রকম ভীত হতে শুরু করে, কাঁদতে শুরু করে। বুকের ভেতর কেমন যেন করে ওঠে।যেমনটা মায়ের ভেতরেও হয়। বারবার বাচ্চাটার জন্য চিন্তা হয়।
কুহেলিকা ঘরে চলে আসে।সকাল সকালই সে ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হবে।নাহিনের বর্তমান লোকেশন ওর জানা।ফোন ট্রাক করেছে। মুফতি গেটে এসে ফোন দেয়। এয়ারপোর্ট অব্দি যাবে সে।কুহেলিকা ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে আসার সময় কায়েস মির্জাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
—আমি ঢাকা যাচ্ছি।চার-পাঁচদিন ঢাকাতেই থাকবো।আমায় নিয়ে ভাববেন না।
কুহেলিকা কিছু শোনার অপেক্ষা না করে দ্রুত পায় বেরিয়ে আসে।বাইকে উঠে বসে।তবে মুফতি আর নিজের মাঝে কাঁধের ব্যাগটা রাখে।বাইক চলতে শুরু করে। মুফতি বলে ওঠে,
—কিরে পাগল এতো সকাল সকাল ঢাকায় তোর কাজ কি?
—আছে কিছু কাজ।
—ওই বিয়াত্তা মহিলা শোন আমারে একটা গার্লফ্রেন্ডের ব্যবস্থা করে দে।
কুহেলিকা চিমটি দেয় মুফতির ঘাড়ে।কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
কুহেলিকা ডানে বামে মাথা নাড়ায় অর্থাৎ সে জানে না। মুফতি বাঁকা হেসে দুষ্টামি করে বলে ওঠে,
—বিয়াত্তা মানে হচ্ছে যেই মেয়ে অবিবাহিত জীবনের মতো বিবাহিত জীবনেও আগের মতোই থাকে।
—ওহ,আচ্ছা তাহলে অবিয়াত্তা মানে কি উল্টো হবে?
মুফতি বাইক থামায়। গাট্টা মেরে বলে ওঠে,
—এজন্যই বলি বিদেশ গিয়ে ধলাদের মধ্যে বড় না হয়ে দেশে থাক। সব কিছুর মানে শিখবি।আমি মজা করে বলছি আর তুই সিরিয়াস নিয়ে বসে আছিস!স্টুপিড।
কুহেলিকা কিছু বলে না।যেই শব্দ আগে শুনেনি সেই শব্দ বলবেটা কি করে। অবশ্য শুনলেও যে তার মনে নেই।কুহেলিকা খেয়াল করে এয়ারপোর্টের সামনেই বাইক থামিয়েছে মুফতি।কুহেলিকা বিনা শব্দব্যয়ে এয়ারপোর্টে ঢুকে যায়।
ফ্লাইটে ওঠার আগে কুহেলিকা ফোন দেয় তানজিল চৌধুরীকে।একবার ,দুইবার, তিনবার ফোন দেয়।রিসিভ হয়না।চিন্তা লাগতে লাগতে কুহেলিকার।তখন ফোনটা বেজে ওঠে কাসফিয়া চৌধুরীর ফোন।কুহেলিকা রিসিভ করে।
—কুহু ব্যস্ত তুমি?
—না তবে ফ্লাইটে উঠবো একটু পর।কেন?
—না মানে আজকে আমার বাসায় তো পার্টি আর তুমি থাকবে না তা ভেবেই খারাপ লাগছে।
—দুঃখিত আমি তো ঢাকা যাচ্ছি।আপনারা ইঞ্জয় করুন।
—আচ্ছা সাবধানে যেও।
কাসফিয়া চৌধুরী কল রেখে নাহিদ খান আর তানজিল চৌধুরীর দিকে তাকায়।তানজিল চৌধুরী বোনের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে বলে ওঠে,
—কি হইছে আপা?
—কুহেলিকা ঢাকা যাচ্ছে আসতে পারবে না।
তানজিল চৌধুরী অবাক হয়।তার মেয়ে ঢাকায় যাচ্ছে আর সেই জানে না।ফোন হাতে নেয়।মেয়ের তিনটা কল। সর্বশেষে ম্যাসেজ।”আব্বু ঢাকায় যাচ্ছি।চার-পাঁচ ঢাকাতেই থাকবো।এদিকটা তুমি সামলে নিয়ো।আর ঢাকায় চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রি আবারো রিওপেন করবো।সব প্ল্যান ফিক্সড ”
তানজিল চৌধুরী ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।মোবাইল চুরি হলেও ভয় নেই।তিনবার পাসওয়ার্ড ভুল হলে মোবাইল একাই লক হয়ে যাবে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট,ফেস সেন্সর ছাড়া আর খোলা যাবে না।পার্টি ইঞ্জয় করতে থাকে।বহুদিন এমন পার্টিতে আসা হয়না তার। সাংবাদিক পেশাতেই ঢুবে ছিলো এতদিন।
কুহেলিকা ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যায় ঢাকাতে। উদ্দেশ্য নাহিন।ওভার বুক করার দশ মিনিটের মাঝেই চলে আসে।কুহেলিকা আধাঘণ্টার দূরত্বের একটা এড্রেস দেয়।গাড়িতে গা এলিয়ে দেয়।
নাহিন সকালে উঠেই রান্না ঘরে ঢুকেছে।মায়ের জন্য নিজে থেকে কিছু বানাচ্ছে।তার সন্দেহ মায়ের খাবারে কিছু মেশানো হচ্ছে যার কারণে সে নিজেই এখন খাবার বানাতে এসেছে।
জিনিয়ার কথায় কিছুই বলে না নাহিন।ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে ওঠে।কুহেলিকার ফোন।জিনিয়ার চোখ এড়ায়না বিষয়টা।ভাইকে প্রাইভেসি দিতে রান্না ঘর ত্যাগ করে বিদায় জানিয়ে।কল রিসিভ করতেই কুহেলিকা বলে ওঠে,
—বাইরে আসো দ্রুত।
নাহিন কিছু বুঝে উঠতে পারেনা।তার পূর্বেই কল কেটে দেয় কুহেলিকা।নাহিন দ্রুত বেরিয়ে আসে।কুহেলিকাকে দেখে চমকে ওঠে, আঁতকে ওঠে।এই বাড়িতে কিছুতেই রাখা যাবে না ওকে।এই বাড়ির পুরুষ মানুষগুলো নারীদের খুবলে খায়!
—কুহু তুমি এখানে?
—বাহরে শশুর বাড়িতে আসবো না?
—কুহু আমি তোমাকে পরে সব খুলে বলবে। তুমি এখান থেকে চলে যাও প্লিজ।জায়গাটা তোমার জন্য বিপদজনক।
—ওয়াদা করেছিলাম সবসময় তোমার পাশে থাকবো।
—এখন এই ওয়াদা মানতে হবে না।আগে তোমার সেফটি।
কুহেলিকা নাহিনকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় বাড়ির।নাহিনের সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা জানলো কিভাবে যে সে এখানে!নাহিন বুঝে ফেলে এই ঘাড় ত্যাড়া মেয়েকে এখান থেকে সরানো সম্ভব না।তাই ঘাড়ের ব্যাগ খুলে নিজের হাতে নিয়ে নেয়।ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো জারিফ,জিদান।বসে বসে কফি খাচ্ছিলো।জিদান বসেছিলো সদর দরজার মুখোমুখি।
—ভাই মা*টা কিন্তু অস্থির।তবে কে এইটা?
জারিফ পেছন ফিরে তাকায়।হাত-পা কাঁপতে থাকে তার।মাসও হয়নি এখনো।এই মেয়েটা তাকে হাত পা বেঁধে যে বেধড়ক মার মেরেছে সেদিনের পর আর মেয়েদের তাকানোর সাহস হয়নি।
অতীত,,,
জারিফ সেদিন ফুটপাতের এক পাগলের সাথে খারাপ কাজের চিন্তা করছিলো।আর তখনই কুহেলিকা কোথা থেকে এসে যেনো মাথায় বারি মারে।মাটিতে ব্যথায় লুটিয়ে পড়ে জারিফ। মূহূর্তেই হাত পা বেঁধে ফেলে কুহেলিকা।আরো কয়েকজন ছিলো সেখানে।সবাই মিলে বেধড়ক মার মেরে তাকে লেকের ওখানকার ফুটপাতে ফেলে আসে। ভাগ্যক্রমে পুলিশ টহল দিতে এসে তাকে দেখে।নয়তো সেদিন যে কি হতো!এখনো মনে পড়ে কুহেলিকার বলা কথাগুলো,,
”তোদের মতো জানো**দের কারণে ফুটপাতের এই পাগলেরাও মা হচ্ছে। অপবিত্র হচ্ছে তোদের দ্বারা।আর যদি কখনো কারো দিকে তাকাস চোখ উপরে ফেলবো”
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৩
#বর্ষা
অনেকদিন বাদে অফিসে গিয়ে মস্তিষ্কের রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।কোনো কাজই যেন পছন্দসই লাগছে না কুহেলিকার। ছোট্ট ছোট্ট ভুলগুলোর জন্যই ইচ্ছে মতো ঝেড়ে চলেছে সবাইকে।কেউ কিছু বলতেও পারছে না কেননা তারা একেতো নিম্ন পদের কর্মচারী,তার ওপর আবার আশ্চর্য।যেই মেয়েটা হাসিখুশি ভাবেই তাদের কাজ বুঝিয়ে দিতো ভুল হলে সে নাকি এভাবে তাদেরকে অপমান করছে ভাবা যায়!
কেবিনে ফিরে মাথা এলিয়ে দেয় টেবিলে। নিষিদ্ধ দিনের শুরু আজ।এইদিন এলেই পেটের ব্যথা আর কোমরের ব্যথা এতোটা বেড়ে যায় যে বদমেজাজি ব্যবহার অনিচ্ছাতেই করে ফেলে।কুহেলিকা ঔষধ নিয়ে খেয়ে নেয়।খারাপ লাগছে ওর।পিয়নকে দিয়ে হট ওয়াটার ব্যাগ আনিয়ে পেট বরাবর রাখে।একটু রিলিভ পাচ্ছে সে।তবে খারাপ লাগাটা কমেনি এক শতাংশও।
—মে আই কাম ইন ম্যাম?
—ইয়েস কাম ইন।
দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুজেই কুহেলিকা অনুমতি দেয়। নতুন ইন্টার্ন হিসেবে যোগদান করেছে জুলফিকার রাসেল।পালোয়ানের মতো দেখতে।ভয় পাবার মতোই মুখশ্রী তার।প্রথম দেখায় ভয় পেয়ে যায় কুহেলিকা।লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। জুলফিকার ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়।
—ম্যাম ইজ এভরিথিং ওকে?
—হু আর ইউ?
—ম্যাম আমি নিউ ইন্টার্ন।
কুহেলিকা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারো চেয়ারে বসে।শান্ত ভঙ্গিমায় বলে ওঠে,
—হ্যা বলুন কোনো সমস্যা?
—ম্যাম ফাইলটা..
কুহেলিকা ফাইল নেয়। পর্যবেক্ষণ করে।অবাক হয় একজন ইন্টার্নকে বড় একটা প্রজেক্টের কাজ দেওয়া হয়েছে দেখে।আবার তার চেয়েও বেশি অবাক হয় নিখুঁত কাজ দেখে।যেন বহুদিনের অভিজ্ঞতা আছে এনার।তার চেয়েও বড় বিষয় এই লোককে দেখে কোন মতেই ইন্টার্ন মনে হচ্ছে না কুহেলিকার।জহুরি নজরে পরখ করে ফাইল সাইন করে দিয়ে দেয় কুহু। অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে যায় জুলফিকার।কুহেলিকা ফোন দেয় পিয়নকে।বলে ওঠে,
—আই নিড ইনফরমেশন এবাউট হিম।
কুহেলিকা ফোন রেখে উঠে দাঁড়ায়।আজ কান্না করতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো।পেটের ব্যথাটা হয়তো একটু কম লাগতো।কুহেলিকা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে কেবিনের মাঝে।ফোন আসায় দ্রুত এগিয়ে যায়। হসপিটাল থেকে ফোন। অপরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে,
—ইজ ইউ কুহেলিকা?
—ইয়েস আ’ম।
কুহেলিকা পরবর্তী যে কথা শোনে তাতে যেন পৃথিবী ঘুরে ওঠে।চেয়ারে বাজানো ব্লেজার নিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায় অফিস থেকে। হসপিটাল টি প্লাজায় পৌঁছাতেই দেখা মেলে ডক্টর সফিয়ার সাথে অপরিচিত একজন নারীর। রিসেপশন থেকে জেনে এসেছে চারতলার তিন নাম্বার কেবিনে তার আব্বু।ডক্টর নাকি ফোন দিতে বলেছে।নাম্বার পাওয়ার বিষয়টা একবার ভাবলেও তা গভীর ভাবনায় রুপান্তরিত হয়না। লিফটের অপেক্ষায় না থেকে সিড়ি ভেঙেই ওপরে যায় সে।আর সামনেই তো ডক্টর সফিয়ারা ছিলো।
কুহেলিকা কেবিনে উঁকি দিয়ে দেখে কায়েস মির্জা সুয়ে আছে।থমকে যায় সে। অনুভূতিশূন্য ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে।আগে আব্বু ডাকতে এই মানুষটার প্রতি জন্মেছিলো অগাধ ভালোবাসা।তবে মানুষের অতীত সামনে আসলে ঘৃণার যে প্রলেপ পড়ে তা পড়েছে কুহেলিকার হৃদয়ে। ভালোবাসা আর নেই।তবে আছে তারা হৃদয়ে যেখানে শুধুই ঘৃণা তাদের প্রতি।ডক্টর সফিয়া এগিয়ে এসে বলেন,
কুহেলিকা কি বলবে ভেবে পায় না। কেবিনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অনুভূতিশূন্য মাথা ঝাঁকায়। অর্থাৎ সেই মিষ্টার কায়েসের মেয়ে।ডক্টর সফিয়া কিছু পরামর্শ দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।কুহেলিকা কেবিনে প্রবেশ করে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠে,
—রাস্তায় বের হয়ে কিভাবে হাঁটেন?আর গাড়ি থাকতে আপনাকে হাঁটতেই বলেছে কে?আজ মিসেস ফাইজা না বাঁচালে তো পরপারে পৌঁছে….
কুহেলিকার কথায় কায়েস মির্জা শীতল দৃষ্টিতে তাকায়।কথা থেমে যায় কুহেলিকার।ভেতরটা কেমন করে ওঠে।এই অনুভূতির মানে একেবারেই অচেনা কুহেলিকার।থমকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।বাসায় ফোন দিতে চেয়েও দেয় না।বাইরে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। রিসেপশনে কথা বলে।কায়েস মির্জা ডিসচার্জ হলে তারপর নিজের গাড়িতেই বেরিয়ে পড়ে।
—আমার কারণে তোমার কাজের ক্ষতি হলো তাই না কুহু?
বাচ্চাদের মতো অভিমানী কন্ঠ শোনায়।কুহেলিকা তবুও ফিরে তাকায় না।কায়েস মির্জার কাছে কুহেলিকাকে পাথর বই আর কিছুই মনে হয় না।মেয়েটা পাথরে পরিণত হয়েছে।জীবনটা কি অদ্ভুত না!কয়েকবছর আগেও যেই মেয়েটা পিতার সান্মিধ্য পেতে আকুল থাকতো আজ সে মেয়েটাই কতো সুক্ষ্ণভাবে সবাইকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
****
নাহিন অফিসের করিডোরে দাঁড়িয়ে ভাবছে জীবনে সে কি পেলো আর কি খুইয়ে নিঃস্ব হলো।ভিসা রেডি করেছে বহু কষ্টে।আজ থেকে কুহেলিকার মতোই সেও নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করবে।যাদের ঘিরে ওর পরিবার তাদের দোষগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে। অনুতপ্ত করিয়ে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবে।তবে তার পূর্বে উপযুক্ত শাস্তিতেও পাওয়াবে।আর ওর আংকেলের খুনিকেও যে তার উপযুক্ত শাস্তি পাওয়াতে হবে।
মিনিট পঞ্চাশের যাত্রায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে পিয়নের কাছে গাড়ি দিয়ে ঢুকে যায় এয়ারপোর্টে সে। হাঁসফাঁস করতে থাকে সে।ডক্টর জানিয়েছে জন্ডিসের লক্ষণ নাকি দেখা দিচ্ছে তার মাঝে।ঔষধ দিয়েছে।আর দিয়েছে একগাদা পরামর্শ,ডায়েট চার্ট।
নাহিন চোখ বন্ধ করে বসে থাকে চেয়ারে।বুকের ভেতরের ধুকপুকানি বেড়েই চলেছে।কেমন যেন লাগছে।ভেতরটা বারবার কেঁপে উঠছে সেই নির্মমতা সহ্য করার বিষয়টা মনে হতেই। সমাজের ভয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর কথা মনে হতেই রাস্তার কিট মনে হয় তার নিজেকে।কেন সে সেদিন বাধ্য হয়,ঘৃণা করে দেশ ছেড়েছিলো!তার তো উচিত ছিলো আইনের সাহায্য নেওয়া। অবশ্য তাদের সাহায্য নিলেই বা কি হতো! অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তাই যে অসৎ।বদনাম যে শোষিত-রই ছড়াতো।
নাহিন ফোন হাতে নিয়ে কল দেয় কাঙ্খিত নাম্বারে।বহু বছর এই নাম্বারে কল দেওয়া হয় না।দশ বছরের বাচ্চা থাকতে বাড়ি ছেড়েছিলো সে।তখন হয়তো ভয়ে ছেড়েছিলো।তবে তা দীর্ঘত্ব অর্জন করেছিলো আরো কিছু বছর পরে। কেননা সে তখন বুঝদার হয়েছিলো। বিষয়গুলো বুঝতে পেরেছিলো।
ফোন রিসিভ হয়।নাহিন কানে দেয় ফোন।ভাঙা গলা ভেসে আসে।ভেতরটা কেঁপে ওঠে ওর।চোখ দিয়ে একাকী গড়িয়ে পড়ে অশ্রুরা।কেন জানি বড্ড দমবন্ধকর লাগতে লাগে চারপাশটা।শব্দরা যেন অভিমানী হয়ে বেরিয়ে আসতে চায় না।তবুও জোর করে বের হয় তারা।
”আম্মু”
শব্দটা যেন থমকে দেয় অপর পাশের মানুষটিকে।নিরব থাকার কিঞ্চিত সময়ের মাঝেই শোনা যায় অপরপাশের ব্যক্তিটির কান্নারত কন্ঠ।ভাঙা গলায় কানতে কানতে বলে ওঠে,
—আব্বা তুই কই?ও আব্বা আয় না।আমার না তোর জন্য কষ্ট লাগে।মনে হয় বেশিদিন আর বাচমু না..
—আম্মু!
—আব্বা জানিস ওরা না আমায় খেতে দেয় না।তোর বাবাও আমারে আর ভালোবাসে না।খালি বকে।
আবারো কাঁদতে থাকেন অপরপাশের মহিলাটি।নাহিনও কাঁদতে থাকে এপাশ থেকে।ও ইতিমধ্যে জানতে পেরেছে ওর মা মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেছে।কেমন ছন্নছাড়া জীবনটা অতিবাহিত করছে।ওর বৃদ্ধ বাবা আর কতদিক দেখবে।যাদের জন্য জীবনটা শেষ করতে নিয়েছিলো তারা আজ তাদের সাথে থেকেও পাশে নেই। খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধও করেনা!
—আম্মু তুমি চিন্তা করো না আমি আসবো।আমি আগামী কালই তোমার কাছে থাকবো।(নাহিন)
—হ বাপ তুই আয়।আমারে তোর কাছে নিয়ে চল।আমার না আর ভালো লাগে না।সবাই বকে।(অচেনা মহিলা)
—আমি এসে সবাইকে বকে দিবো।কেউ আর তোমায় বকার সাহস পাবে না দেখো!(নাহিন)
—তাড়াতাড়ি আয় বাপ।(অচেনা মহিলা)
”নাসরিন আমার ফোনে তুমি কার সাথে কথা বলছো?”
নাহিন বেশ শুনতে পায় ফোনের অপাশ থেকে আসা পুরুষালী কন্ঠস্বর। ভেতরটায় গম্ভীরতা ছেয়ে যায়।এতোদিন ঘৃণা পুষে রাখতে পারলেও এখন যে আর তা পুষে রাখা সম্ভব না।ওরই জন্মদাতা পিতার কন্ঠ ভেসে এসেছে।একসময় যেই লোকটা নিজের মেয়ের সাথে ঘটা অন্যায়ের কথা চিন্তা না করে ভাইয়ের ছেলেদের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করেছিলো আজ তারা কোথায়!প্রশ্ন জাগে নাহিনের মনে।
—হ্যালো,হ্যালো কে বলছেন?
নাহিন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।গম্ভীর কন্ঠে জবাব দেয়,
—আমি,আমি নাহিন মুনতাসির।
—নাহিন!
ওপাশের মানুষটা যে বেশ অনেকক্ষণ থমকে থাকবে তা জানে নাহিন।কল কেটে দেয়।প্রেয়সীকে এখনই জানাতে চায় না এসব। তার প্রেয়সী তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছে।যদি জানতে পারে নাহিন একসময় আপোষ করেছিলো তাকে যদি ছেড়ে যায়!এই ভয়ে আর বলা হয়নি।তবে নাহিন হয়তো এতসবের মাঝে ভুলে গেছে তার প্রেয়সীর বলা কথা।কুহেলিকা বলেছিলো,
”আমাদের হিতে সবসময় পরিস্থিতি থাকে না।কখনো কখনো প্রতিবাদীদেরও আপোষ করতে হয়। নয়তো অন্যায়কারীদের শাস্তি দেওয়ার পূর্বেই মূর্ছে যেতে হয়।তাই কিঞ্চিত সময়ের জন্য আপোষ করে ভবিষ্যতে অন্যায়কারীদেরকে তাদের উপযুক্ত শাস্তি পাওয়ানোই উত্তম মনে হয় আমার কাছে।”
চলবে কি?
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৪
#বর্ষা
পুরুষ মানুষ নাকি সহজে কাঁদে না।এমনটাই প্রচলিত ধারণা এবং সত্য বলেই গ্রাহ্য।নাহিন কাঁদছে ওর আম্মাকে ধরে কাঁদছে।যেন বহুদিনের একাকীত্ব মনে করে, চারপাশের মানুষদের অগ্রাহ্য করে মনের অনুভূতি সব উগলে দিচ্ছে।মা আর সন্তানের সম্পর্ক তো এমনই হয় তবে শতাংশ হিসেবে খুবই কম।হয়তো কারো মা নেই,নয়তো কেউ মায়ের সাথে সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ করতেই পারেনি। কিছুক্ষেত্রে মা’কে ভয় পাওয়াটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ,ঠিক তেমনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়ের সাথে সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া চাই।
নাহিন মেঝেতে বসে সোফায় বসা মায়ের ক্রোড়ে মাথা নামিয়ে কাঁদছে।দূর থেকে বাড়ির মানুষেরা আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে দেখলেও যে কিঞ্চিত বিরক্ত তাও পরিদর্শিত।নাহিন যে পরিচয় দেয়নি তাদের।এসেই সামনে মা’কে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
—আব্বা আর কাদিস না। তুই কাঁদলে যে আমারও কষ্ট হয়।অনেক কষ্ট হয়।
নাসরিন সুলতানা বুকে আঙুল দেখিয়ে ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠেন। সন্তানের কান্না যে তার সহ্য হচ্ছে না।নাহিনের চোখ জোড়া দেখেই যে বুঝে ফেলেছেন এই তার সেই ছোট পাগল ছেলেটা।নাহিন দ্রুত চোখ মুছে মৃদু হাসার মিথ্যে চেষ্টা করে বলে ওঠে,
—আম্মু দেখো আমি আর কাঁদছি না।তুমি কষ্ট পেয়ো না।
নাহিনের এমন কথায় মুখ বাকায় দূরে দাঁড়ানো ফাতেমা বেগম।একেমন বাচ্চাপনা!মস্তিষ্কের বিকাশ কি ঘটেনি? ফাতেমা বেগম এবাড়ির বড় ছেলে রাব্বি মুনতাসিরের স্ত্রী।যৌথ পরিবারে বড় বউ হওয়ার স্বার্থে সবার ওপরেই রোপ জমান তিনি।ছোট বউ কানিজ আক্তার দেখতে গোলগাল চেহারার মাঝবয়সী বিধবা মহিলা।দুই সন্তান নিয়েই বেঁচে আছেন।আর জীবন অতিবাহিত করছেন স্বামীর শেয়ারে যে টাকা পায় তা দিয়ে। এদের সবার জীবনেরই রয়েছে আলাদা আলাদা গল্প।এখন শুধু বাড়ির বউরাই বাসায়।স্বামী ,ছেলেপুলে আর মেয়েরা বাসায় নেই।
—আআআআআআ
নাহিন উপরে তাকায়। বোকাসোকা ছোটোখাটো একটা মেয়ে।তবে তার দিকে এভাবে কেন চিৎকার করলো মাথায় এলো না। অবশ্য চেহারাটা অস্পষ্ট।মেয়েটা আস্তে আস্তে নাহিনের দিকে এগিয়ে আসতেই নাহিনের মুখ অনুভূতিশূন্য হয়ে দাঁড়ায়।জিনিয়া তো নাহিনকে দেখেই চিনে নিয়েছে।অবশ্য চিনে ফেলারই কথা। কর্পোরেট জগতে উন্নতি করতে চায় আর নাহিনকে চেনে না খুব কমই আছে।
—নাহিন মুনতাসির?নাহিন মুনতাসির স্যার আপনি আপনি আমাদের বাসায়।হাউ লাকি আই আ’ম। দাঁড়িয়ে কেন বসুন।
কথার তালগোল পাকিয়ে ফেলে জিনিয়া।মেয়ের মুখে নাহিন মুনতাসির নাম শুনে ফাতেমা বেগমের হাত কেঁপে ওঠে।হাতে থাকা খুন্তি সঃশব্দে হুমড়ি খায় নিচে।তার চোখে ভেসে ওঠে বছর বারোর ছেলের বলে যাওয়া কথাগুলো।
—আমি পাই টু পাই হিসেব নিবো।আমি যদি ফিরি কাউকে শান্তিতে থাকতে দিবো।সবার পাপের ঘরা পূর্ণ হওয়ার পরই ফিরবো। সবাইকে শাস্তি পাওয়াবো তাদের কর্মের।
তাও একুশ বছর পূর্বে বলা কথাগুলো!কারো দেওয়া হুমকি এতো গভীরভাবে মনে থাকে!না থাকলেও থাকতে বাধ্য করেছে সেই লালাভ চোখ জোড়া।জিনিয়াকে টেনে নিয়ে আসে ফাতেমা বেগম।বড্ড আদরের মেয়ে। কিছুতেই ঘেঁসতে দেওয়া যাবে না ওর সাথে।যদি একই ভাবে প্রতিশোধ নেয়!নাহিন বিষয়টা বোঝে,হাসে।
জিনিয়া রেগে যায় মায়ের ওপর।এতো বছরের স্বপ্ন তার যার সাথে দেখা করার তার সাথে সামনাসামনি পরেও নাকি কথা বলার সময় এতো বাঁধা সহ্য হয়!জিনিয়া রাগ দেখিয়ে বলে,
—মা সরো তো।আমি স্যারের সাথে কথা বলবো।
—থাপ্পরে তোমার গাল লাল করে দিবো।ভুলে ওর আশেপাশে যেন তোমায় না দেখি।নাহিন মুনতাসির তোমার মেজ চাচার ছেলে।পালিয়ে গিয়েছিল যে সে।ওর থেকে দূরে থাকবে।
মায়ের কথায় যেন লাফিয়ে ওঠে জিনিয়া।মাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নাহিনের কাছে ছুটে এসে হাত ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে,
—আপনি সত্যি আমার কাজিন ভাই!আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।আপনি আপনাকে ভাইয়া বলেই ডাকবো কিন্তু।
নাহিন ফাতেমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বাঁকা চোখে বাঁকা হাসে। ফাতেমা বেগম ভয়ে জর্জরিত হয়ে যায়।মেয়েকে টেনে নেওয়ার শক্তি তার মাঝে নেই।বয়স হয়েছে।তাই দ্রুত ড্রয়িংরুম থেকে ছুটে রান্না ঘরে যায়।গ্যাসের চুলা অফ করে সাইডে রাখা মোবাইল হাতে তুলে নেয়। কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে কল দিয়ে বলে ওঠে,
—ওই তোরা কই?এতো কি সারাদিন বাইরে টইটই করছ!বাসায় আয় নাহিন আইছি।আর তোদের বোন চিপকে আছে ওর সাথে।
অপাশ থেকে ভেসে আসে গালাগালিজের শব্দ। ফাতেমা বেগম ক্রুড় হাসি হাসেন।ভেবে নেন জিতে গেছেন।তবে বাইরে এসে যেন আরো বড় ঝটকা খান।যেই মেয়েকে দিয়ে তিনি কুটোটিও করান না সেই মেয়েকে দিয়ে নাহিন জুতা খুলাচ্ছে।চিৎকার করে বলে ওঠেন,
—এই ছেলে তোমার সাহস কি করে হলো আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার মেয়েকে দিয়ে নিজের জুতা খুলানোর!
—ওফ কাকি তুমিও না কত ভুলো মনা।এই বাড়িটা যে তোমার একার না। আমাদেরও সমান শেয়ার আছে।আর আমি দাঁড়িয়ে নই বসে জুতা খুলাচ্ছি।বনুউউ তোর সমস্যা আছে?
—না,ভাইয়া।আমি তো খুলে দিচ্ছি।
নাহিন জ্বালিয়ে মারতে চাইছে যেন।জিনিয়াকে দিয়ে জুতা খুলিয়ে পানি আনাচ্ছে ফ্রিজ থেকে আবার খাবার জিনিস দিতে বলেছে।একেবারে যেন ওর কত কাছের বোন তেমন অধিকার দেখাচ্ছে।আবার কাজের বুয়ার কাজও যে করাচ্ছে তাও বলা যায়। নাহিন এতোটুকু বুঝেছে এই মেয়ে বড্ড সহজ-সরল।নয়তো এতো কিছুর পরও চুপ না থেকে চলে যেতো।যেখানে ওর মা নিজেই ওকে সাপোর্ট করতো।
”মা,মা”
জিদান,জারিফ,জোভান তিন ভাই একসাথেই বাসায় আসে।জিদানের বউ প্রেগন্যান্ট হওয়ায় বাপের বাড়ি আছে। জারিফের স্ত্রী নোভা একাকী থাকতে পারলেই বাঁচে তাই এতশব্দেও বাইরে আসেনি।আর জোভানের স্ত্রী সে তো মজা নিয়ে নাহিনের কাজগুলো দেখছে। শাশুড়িকে শাস্তি পেতে দেখে বেশ মজা পাচ্ছে।গরিব ঘরের মেয়ে বলে কথায় কথায় অপমানের পাশাপাশি একগাদা কাজ তাকে দিকেই করিয়ে নেয়।
—ওহ আমার বড় ভাইয়ারা কেমন আছো?
তিনভাই নিজের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নাহিনের দিকে তাকায়। সৌজন্যমূলক কোনো কথা না বলে সরাসরিই বলে ওঠে,
—এখানে কি চাই তোর?কি জন্যে এসেছিস?(জোভান)
—বাহরে আমার বাড়িতে আমি আসবো না!(নাহিন)
—তোর বাড়ি?তোর বাড়ি আসলো কোত্থেকে?(জারিফ)
—মানলাম তোমাদের সাথে শেয়ারে বাড়িটা।তবে যাই বলো না কেন অধিকার তো আমারও আছে।(নাহিন)
—আগে পা নামিয়ে ভদ্র ভাবে বস।তারপর অধিকার নিয়ে কথা বলতে আসিস।আর কিসের অধিকার তোর?কে তুই?(জিদান)
—কে আমি?সত্যিই তো কে আমি?(নাহিন)
—একদম ফাজলামো করবি না নাহিন।
তিন ভাই একত্রেই শাসিয়ে ওঠে।নাহিন মুখ বাঁকিয়ে তা লক্ষ করে তবে গ্রাহ্য করে না বেশি।এদেরকে গুরুত্ব দেওয়া মানে কুকুরকে গুরুত্ব দেওয়া।এদের চরিত্রগুলোই যে এমন!নাহিন বলে ওঠে,
—তুই যদি মাত্র তেত্রিশ পার্সেন্ট হোস আমরা তিন ভাই মিলে কত পার্সেন্ট হবো বুঝতেই পারছিস?
জিদানের কথায় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে নাহিন। মায়ের হাতে খাবারের প্লেট ধরিয়ে দিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
—ভাই তুমি কি করো?ব্যবসা করো নাকি…
—ব্যবসা করি!(জিদান)
—ওহ আই সি
নাহিন হাসতে থাকে।একজন ব্যবসায়িকের মুখে এরকম তারছিড়া মার্কা কথা শুনলে যে কেউই হাসতে বাঁধতে হবে।যারা সামান্য বুদ্ধিসম্পন্ন আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় দিক্ষিত তারাও অতি সহজেই সহজ হিসেবটা বলতে পারতো। নাহিন অবশ্য আগের থেকেই খবর নিয়েই এসেছে এর ব্যবসার বিনিয়োগের চার ভাগের একভাগও মুনাফা এখনো অব্দি অর্জিত হয়নি।টাকা শুধু ঢেলেই গিয়েছে ফল আর আসেনি।
***
কুহেলিকার সামনে পুরো দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাফিন স্যার।তার মুখে একটাই কথা সে জানতে চায় তার ছেলের খুনি কে।আজ হয়তো কুহেলিকাকে মারবে নয়তো ছেলের খুনির নামটা শুনবে।বউ আর ছেলের শোকে যে পুরোপুরি পাগল বনে গিয়েছে সাফিন তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়।এই যে দাঁড়িগুলো অসমান ভাবে বেড়ে পুরো সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী লাগছে তাকে। চুলগুলো একেবারে অগোছালো, দাঁড়িগুলোও যেন কতদিন পরিষ্কার করা হয় না!আগে তো বেশ ভালোই লাগতো দাঁড়িতে তাহলে এখন এমন লাগে কেন!
কুহেলিকা সাফিনের সাথের ছেলেগুলোর সাথে কিছু কথা বলে ফোন হাতে নেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের ফোনে টাকা পৌঁছে যায়।সাফিন নিরুদ্দেশ ছিলো এতোদিন।আজ হঠাৎ পাওয়ায় কুহেলিকার অনূভুতি কেমন তা অজানা। ছেলেগুলোকে চলে যেতে দেখে সাফিন চিৎকার করতে করতে বলে ওঠে,
—ওই তোমরা চলে যাচ্ছো কেন?আমি বলেছি তো আমি টাকা দেবো।শুধু সাহায্য করো!আমার ছেলেটা যে আমার কাছে ইনসাফ চায়।আমি জানতে চাই আমার ছেলের খুনি কে!
সাফিন কান্নায় ভেঙে পড়ে।কুহেলিকার মায়া হয়।তবে সাফিন এখন যেই অবস্থায় আছে তাকে দেখে পুরো সাইকো মনে হচ্ছে। কথা বার্তার ধরণ যে ওরকমই।আচ্ছা কুহেলিকা কি বেশি ভাবছে নাকি সাফিন অভিনয় করছে? কিন্তু কেউ এতো নিখুঁত অভিনয় করতে পারে! মানুষ ধোঁকা খেতে খেতে সত্যিকেও মাঝে মাঝে ধোকার চোখেই দেখে।
—জানতে চান কে আপনার ছেলের খুনি?
কুহেলিকার কথায় পিচঢালা রাস্তার ওপরে হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থাতেই অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।যেন বড্ড অসহায় সে। আচ্ছা সে যে বললো তার ছেলে ইনসাফ চায়। কিভাবে চায়?নাকি পুরোটাই তার কল্পনায় রটিত কোনো ঘটনা!আচ্ছা এমষ যদি হয় যে কোনো একদিন চোখ খুলে নিজেকে অন্য কোথাও অন্য কারো পরিচয়ে যদি আবিষ্কার করতে হয় তখন কি করবে কুহেলিকা!আত্মা কেঁপে ওঠে। এমনিতেই তো এই জীবনে এতো জটলা,যদি তার ভাবনার মতো কোনো ঘটনা ঘটে সে তো বেঁচে থেকেই পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে!
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১১
#বর্ষা
নৌশিনের প্রতি কুহেলিকার ক্ষিপ্রতার কথা ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বাড়িতে।নটাংকিতে নটাংকি করে বাড়ি মাথায় তুলেছে।অর্ধেক কথাই বলেছে। আদরের দুলালীকে মারায় রোশান শেখ ক্ষেপেছেন।কাউকে না জানিয়েই পুলিশে খবর দিয়েছেন।
পুলিশ আসতে না আসতেই বাড়ি মাথায় তুলেছে পুরো পরিবার। জুনায়েদ ক্ষেপেছে রোশান শেখের ওপর।তবে পুলিশের সামনে কিছু বলতেও পারছে না।একেতো লাশ দ্রুত দাফন নিয়ে ঝামেলা করছে পুলিশ।তার ওপর আবার কুহেলিকা নাকি আগের থেকে জিডি করেই রেখেছে।রোশান শেখ তবুও দমে যাওয়ার মানুষ না।যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলে ওঠেন,
—স্যার স্যার দেখুন এই মেয়ে যদি খুন নাই করতো তাহলে জিডি কেন করলো?সে কিভাবেই বা জানলো আমরা তাকে আরোপী ভাববো!পয়েন্ট আছে না বলুন বলুন।
—আদৌ আপনি বুঝতে পারছেন তো আপনি কি বলছেন?
ইন্সপেক্টর আতিউরের কথায় রোশান শেখ হিসাব মিলাতে শুরু করেন।না, কিছু তো ভুল বলেছেন বলে মনে হচ্ছে না।আবারো ইন্সপেক্টরের দিকে তাকান। এবার ইন্সপেক্টর আতিউর ওনাকে পাত্তা না দিয়ে চলে যায় জুনায়েদের কাছে।বলে ওঠেন,
—মিষ্টার জুনায়েদ শহরে আপনার ভালোই নামডাক আছে।কোনো দূরাত্মীয়ের কবলে পড়ে যেন তা হারাতে না হয় খেয়াল রাখুন।
ইন্সপেক্টর আতিউরকে নিয়ে জুনায়েদ বাইরের দিকে যেতে যেতে কথা বলে।বার দুয়েক ধমকে ওঠেন আতিউর।রাগ দেখিয়ে কনস্টেবলদের নিয়ে চলে যান।তবে যাওয়ার পূর্বে জুনায়েদের ঘোর বিপদের সংকেতও দিয়ে যান।যেন তিনি সবই জানেন তবে তা কাউকে জানাতে পারবেন না।
—কুহু আমার ভিসা হচ্ছে না কোনো এক কারণে।কিভাবে আসবো আমি?
—আরে তুমি চিন্তা করো না।আমি এদিকটা সামলে নিবো।
—তোমার পরিবার যে..
—তাদের নিয়ে চিন্তা করো। বরং আমায় নিয়ে চিন্তা করো তুমি।
—তোমায় নিয়েই তো করছি।
—আচ্ছা শুনো..আমার ছোটবেলার বন্ধু মিফতি।ওর সাথেই এখন কাজ করবো একসাথে।
—আমায় বলছো কেন?
—বললাম যদি আবার কোনো কুটনী মহিলা তোমায় আমাদের একসাথে কার ছবি পাঠিয়ে বলে যে আমি পরকিয়ায় লিপ্ত তাই।
—আমি বুঝি তোমায় বিশ্বাস করি না?
—স্বামী আর স্ত্রী কেউই শয়তানের প্ররোচনায় পড়লে নিজেদের সঙ্গীকে ভুল বুঝতে পারে।তাই তোমায় আগেই জানিয়ে রাখলাম।
—আচ্ছা শোনো মিটিং এ যাবো। জরুরি মিটিং আই.টি কোম্পানির সিইও তুহাউয়ের সাথে। সাবধানে থেকো, নিজের খেয়াল রেখো।
—তুমিও। আল্লাহ হাফেজ।
কুহেলিকা কল কেটে দীর্ঘ শ্বাস নিজের মাঝে নেয়।এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না তার।নাহিনের কাছেও কতশত বিষয় লুকাতে হচ্ছে তাকে।নাহিনকে কবে সব বলতে পারবে সে,আদৌ বলতে পারা অব্দি তাকে বাঁচতে দিবে নাকি আগেই কারো হাতে মারা পড়বে সে কিছুই জানে না সে!
আজকে সূর্য এখনো উঠছে না দেখে কুহেলিকা সময় দেখে।সূর্য উঠে যাওয়ার কথা এতোক্ষণে।হয়তো আজকের আকাশটা এমন মেঘলাই থাকবে।সময়টা অত্যন্ত সুন্দর লাগছে তার।এপাশটায় যেহেতু গাছগাছড়া বেশ ভালোই তাই সকালের সজীব অক্সিজেন তাকে সতেজতা প্রদান করছে।
—কি করছো এখানে?
সাফিনের কন্ঠ পিছনে না ফিরেও বেশ ভালো বুঝতে পারে কুহেলিকার।উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনা।কুহেলিকা বেরিয়ে যেতে নেয় উল্টো দিক দিয়ে।পথ আগলে দাঁড়ায়।
—জবাব না দিয়ে চলে যাচ্ছো?
কুহেলিকা ত্যাড়ামি করে। বিরক্ত নিয়ে বলে ওঠে,
—না দাঁড়িয়ে আছি।
সাফিন রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—ত্যাড়া জবাব দিচ্ছো কেন?
কুহেলিকা ত্যাড়ামি বরকরার রেখে বলে ওঠে,
—ইচ্ছে হইছে।
কুহেলিকা যেন কিছুই জানে না এমন করে জিজ্ঞেস করে,
—সিনানের খুন হয়েছে?
সাফিন কনফিডেন্স নিয়ে বলে ওঠে,
—আমার থেকে ভালো তুমি জানো।
কুহেলিকা সব এড়িয়ে বলে ওঠে,
—আমি কিছুই জানি না।পথ ছাড়ুন আমার।
সাফিন রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠে,
—পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।আমি সব সহ্য করতে পারি,তোমার অবহেলা সহ্য করতে পারি তবে নিজের ছেলের খুনিকে খোলা ঘুরতে দিতে পারবো না।
কুহেলিকা আরো রাগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
—তা আবার আপনিও খুনি নন তো?
সাফিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
—খারাপ মানুষ হতে পারি খারাপ পিতা নই আমি!
****
তানজিল আহমেদ পেনড্রাইভ হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছেন। চট্টগ্রামে প্রবেশ করার দিনকয়েকের মাঝেই অধিকাংশ প্রমাণ জোগাড়ে সক্ষম হয়েছেন।তবে এই প্রমাণগুলো যদি মেয়েটার সামনে যায় তাহলে ভেতর থেকে যে খুকলা হয়ে যাবে সে!সামান্য অনুভূতিগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে।তবে প্রমাণ তো সামনে আনতেই হবে। কিন্তু আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন তাতে।
তানজিল আহমেদ কফি খাচ্ছিলেন রেস্তোরাঁয় বসে।কুহেলিকা মুখ ঢেকে অতি গোপনে প্রবেশ করে। প্রাইভেসি রক্ষার্থে কেবিনের মতো অংশ।কুহেলিকা প্রবেশ করেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে।’আব্বু’বলে কেঁদে দেয়।
—আম্মু তুমি আমার স্ট্রংগেস্ট বাচ্চা হয়েও কাঁদছো?এটা কিন্তু মানায় না কুহেলিকা চৌধুরীর সাথে!
—আব্বু কতগুলো বছর পর আবারো দেখা,তোমাকে ছুঁতে পারার সুযোগ হলো।
—তোমার আশেপাশে না থাকলেও তোমার মাঝেই ছিলাম আমি।আমার বাচ্চাটার কাছে আমার অনেক সরি যে জমানো।রাখতে পারিনি তার খেয়াল আমি।
কুহেলিকা তানজিল চৌধুরীর চোখ মুছে দেয়। চৌধুরী বংশের পরিচয় লুকাতেই আহমেদের ব্যবহার। অবশ্য সাংবাদিকতা পেশায় তাকে সবাই ‘আহমেদ’ নামেই চেনে। পুরো পঁচিশ বছরের তৃষ্ণা বাপ-মেয়ের।সেই আতংক,ঘটনা এমনভাবেই তাদের দূরত্ব বানালো যে চাইলেও কেউ কারো কাছে যাওয়ার উপায় ছিলো না।
বাবার কোলে মাথা এলিয়ে রাখা কুহেলিকা।এই বুকের সন্ধান যে তার বহুদিনের।তবে বিধাতা তাহলে মুখ তুলে চাইলেন।কুহেলিকাকে বটবৃক্ষের ছায়ার মতো শক্ত মস্তিষ্কের,তার প্রতি কোমল হৃদয় নিয়ে চলা ব্যক্তিকে পাঠালেন।
—আব্বু সে রাতে কি হয়েছিলো?
—তোমার দাদাজানের ডাইরিতে পাওনি?
—শুধু তোমার নাম্বার আর কিছু কথা লেখা ছিলো।তাও বড্ড সতর্কতাসহিত।কাগজ যদি আগুনে না ধরতাম তাহলে হয়তো আমি কিছুই জানতে পারতাম না।
—আচ্ছা শোনো তাহলে, ঘটনা শুরু হয় সেখান থেকে…
দিনটা খুবই মিষ্টালো।চেরি ফুল ফুটতে শুরু করেছে। অসম্ভব সুন্দর এক ঋতুতে আমরা কোরিয়া ছিলাম।তখন আমি সাংবাদিক পেশাকে ধ্যান,জ্ঞান সব ধরে বসেছিলাম।তুমি তখন ছয়মাস কি সাত মাসের।তোমার মা ডায়ানা রাশিয়ান কন্যা।বাবা মেনে নেয়নি আমাদের।তবে তুমি হওয়ার সংবাদে কি করে যেন সব বদলে গেলো।বাবা আসলো,কায়েস ভাই, কাসেম ভাই সবাই আসলো। আমাদের মেনে নিলো। কিন্তু সমস্যা যে এখানেই শুরু হবে তা কে জানতো!
বাবা চাইতে লাগলেন আমি যেন দেশে ফিরে ব্যবসায় হাত দেই।বাবার একমাত্র ছেলে বলে কথা। তখনো আমি এবিষয়ে জানতাম না।বাবা মির্জাদের সম্পত্তি ভাইদের বুঝিয়ে দিলেন।বেশ ভালো সম্পত্তিই তাদের কৌঠায় গেল।আমি পেলাম বাবার সব সম্পত্তি।তবে তা এমনভাবে যে পঁচিশে পা দিলেই তুমি মালিক হবে সম্পত্তির।
—আচ্ছা আব্বু কেউ তো জানে না কোহিনুর চৌধুরীর ছোট ছেলের ব্যাপারে।এমনটা কেন?
—সবুর করো বাচ্চা।সবই বলবো আজ তোমাকে।যখন আমি বাচ্চা কিংবা বছর সাত/আটের তখন তোমার দাদিজাকে খুন করে ফেলা হয়।বাড়িতে মেয়ে বলতে ছিলো কাসফিয়া আপু।বিয়ের কথা চলছে তারও কেননা সন্তানের জীবন বাঁচানো জরুরি তখন।তবে হঠাৎ একদিন দেখলাম আপু পালিয়ে গেল।বাবা পুরোপুরি মুর্ছে গেলেন।একেকজন যখন একেক কথা বলতে ব্যস্ত বাবার শান্ত মস্তিষ্কে তখন আমি নামক কেমিক্যাল চলিত।পাঠিয়ে দেওয়া হলো লন্ডনে।বোর্ডিং স্কুলে।দেশে আমার সবকিছু মুছে ফেলা হলো। সুরক্ষিত করতে গিয়ে বাবা আমায় একেবারে খাদে ফেললেন।না পারি কারো সাথে কথা বলতে আর না পারি পড়াশোনায় ভালো করতে।সময়ের সাথে সাথে আমিও বড় হয়ে থাকি তবে পরিবারের বিহীন।আব্বুও খুব একটা ফোন করতো না।তবে বছরে কিংবা ছয়মাসে একবার জাস্ট চোখের দেখা দিয়ে আসতো।ইচ্ছে করতো আটকে রাখি।পারতাম না।আর না পারতাম দেশে আসতে।বারণ ছিলো যে।
—আব্বু আম্মু,দাদুকে কারা মেরেছে? তাদের হত্যা কারী কারা?
—আমি এখনো সব প্রমাণ জোগাড় করতে পারিনি।যা পেরেছি তাও কম না।তবুও উপযুক্ত শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড কিংবা সারাজীবন কারাদণ্ডে রাখতে আমার আরো কিছু প্রমাণের বাকি আছে তাই যখন তা সংগ্রহে নেওয়া হবে তখনই তোমায় তাদের সম্পর্কে জানাবো।
—আব্বু আমি আম্মুকে দেখতে চাই।
কুহেলিকার মিনতিতে যেন থমকে রয় তানজিল চৌধুরী ওরফে সাংবাদিক আহমেদ।মোবাইল বের করে মেয়ের হাতে দেয়। মোবাইলের ওয়াল পেপারেই আছে তানজিল চৌধুরী,ডায়ানা ফ্রিংকেল এবং কুহেলিকা।কি মিষ্টি দেখতে তার মা!কুহেলিকা চমকায় তবে বুঝতে পারে কেন তার চোখ নীলচে।কারণটা তার মা। কেননা ডায়ানা ফ্রিংকেলের চোখ জোড়াও নীলচে।তবে চুলগুলো হালকা গোল্ডেন আর হালকা কালো।তবে অত্যন্ত সুন্দরী এক রমনী ছিলো ডায়ানা ফ্রিংকেল।কুহেলিকা মোবাইল জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। তানজিল চৌধুরী মেয়ের কান্না দেখে।ইশ,মনে হচ্ছে এইতো দিনকয়েক আগের ঘটনা। ছোট্ট কুহু মায়ের কোলে যেতে কাঁদছে! কাঁদতে কাঁদতেই কুহু বলে ওঠে,
—আব্বু আমাদের পরিবারের শেষ হলো কিভাবে?
—তখন তোমার এক বছর হতে দুইদিন বাকি।আমরা দেশে ফিরবো।কায়েস ভাইয়ের স্ত্রী তখন নয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা।তাই তারা আসতে পারবে না।সব গোছগাছ কমপ্লিট।তোমার আন্ট তোমায় নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়েছিলো।আমিও জবে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলাম।ঠিক তখনই কয়েকজন মুখোশধারী আক্রমণ করে। গোলাগুলি করতে থাকে।আমি কোনো মতে বাঁচতে পারলেও সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ওদের কয়েকজন লোকসহ তোমার মাও মারা যায়। তুমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাও যা আমার জানতে বড্ড দেরি হয়ে যায়। সিংহের গুহায় গিয়েই বড় হতে থাকো তুমি।তবে আল্লাহর শুকরিয়ায় তুমি জাহিদের সাথে বিয়ের পূর্বেই পালিয়ে আসো।আমাকে ফোন দেও।নয়তো আমি যে আর তাদের শাস্তি পাওয়াতে পারতাম না…
চলবে কি?
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১২
#বর্ষা
কুহেলিকা দাঁতে দাঁত চেপে কথা গিলছে রুমানা আফরোজের।এই মহিলা এজীবনে বদলাবেন বলে মনে হচ্ছে না কুহেলিকার।রুবেলের কথায় খেপেছেন।রুবেলকে নাকি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে কুহেলিকা।কেন সে বলবে এই নিয়ে যত সব ঢং শুরু হয়েছে।
—কুহেলিকা তোমার সাহস কি করে হয় রুবেলকে বেরিয়ে যেতে বলার?
কুহেলিকা জবাব দেওয়ার পরিবর্তে যেন চারপাশ দেখেই বেশ মজা পায়।রুমানা আফরোজ আরো খেপে ওঠে।কুহেলিকার হাত শক্ত করে ধরে সামনের দিকে ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে,
—বেয়াদব হয়েছো?মায়ের সাথে কেরকম আচরণ করতে হয় শিখনি!
কুহেলিকা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর কিছু না ভেবেই বলে দেয়,
—আপনি তো আমার মা’ই নন।
কুহেলিকা চলে আসে সেখান থেকে।রুমানা আফরোজ শীতল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। হঠাৎ যেন থমকে যেতে চায় হৃদয়। আচ্ছা কাউকে অত্যাধিক বকাবাজি করলেও কি তার মায়ায় পড়া যায়!হয়তো যায়।কুহেলিকা চলে যেতেই রুমানা আফরোজ ধপ করে সোফায় বসে পড়েন।রুবেল ছুটে এসে বলে,
—দেখেছো ফুফু কত বেয়াদব হয়েছে এই মেয়ে।আমি তো ভেবেছিলাম ও আরো ভালো হয়েছে।এখন দেখছি আস্তো এক বেয়াদবে রুপান্তরিত হয়েছে।
—এখন আমাকে একা ছেড়ে দে।তোর সাথে পরে কথা বলবো রুবেল।
রুবেল ড্রয়িংরুম থেকে গেস্ট রুমে চলে যায়।রুমানা আফরোজও সোফা ছেড়ে নিজের রুমে এসে কাঁদতে থাকেন।ভাবতে থাকেন কি দোষ তার যে সে আজ মৃত সন্তানের মাতা।আর যে আছে সেও যে ভুল বুঝে বড্ড দূরে।কোথায় সে তাও যে অজানা।কায়েস মির্জাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠেন,
—ওই শুনছো আমার না আর ভালো লাগছে না।যার কেউ নই তার বাড়িতে বেহায়ার মতো পড়ে থাকার মানে হয়!
কায়েস মির্জা চমকান স্ত্রীর কথায়।তিনি নিজেকে শক্ত রেখে স্ত্রীকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলে ওঠেন,
—সন্তানহারা আমরা।এখন যেই মেয়েটা আমাদের আম্মু,আব্বু চেনে তাকে ফেলে চলে যেতে কি পারবো? কায়ফার মৃত্যুর পর সন্তানের গন্ধ যে ওর থেকেই পাই এখন।
—কিন্তু ও যে আমাদের বায়োলজিক্যাল সন্তান না এটা তুমিও জানো,আমিও জানি আর..
—আর?
—আর কুহেলিকাও জানে।
—তুমি কিভাবে জানলে?
—আজ যখন বকাঝকা করছিলাম তখন আমাকে বলেছে যে আমি ওর মা নই।
—কুহেলিকা জানে না।জানলে ধ্বংস হয়ে যেতো মেয়েটা।তোমার কর্কষ ব্যবহারে কষ্ট থেকে বলেছে।এখন একটু আদর সোহাগ করো।ওকে হারালে কিন্তু আমরা সন্তানের ভালোবাসার জন্য কুঁড়ে কুঁড়ে মরবো।
—কিভাবে ভালোবাসবো বলো ও কারণেই তো তোমরা কোনো সম্পত্তি পেলে না..
—আমি এতোদিন বুঝিনি।সিনানের মৃত্যু্র পর বুঝেছি।আমরা সম্পত্তি রাখি আমাদের সন্তানের জন্য।তবে আমরা মরার কয়েকদিন বাদেই যদি সন্তান মরে যায় তাহলে সে সম্পত্তি অন্যকারো কাছে চলে যাবে। তাহলে লাভ কি এ নিয়ে?
রুমানা আফরোজ আর কিছুই বলেন না।চুপটি মেরে বিছানায় গিয়ে বসেন। প্রেশারের ঔষধ খেয়ে নেন।সাথে মাথা ব্যথারও একটা ঔষধ খান।অসহ্য ব্যথা করছে!তবে তা মাথায় নয় মনে।এ ব্যথা শারীরিক ব্যথার অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং মানসিক ব্যথা।
****
কুহেলিকার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। মুঠোফোনে মায়ের ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তা।নিরব অশ্রু বিসর্জন। অভিযোগ করে বলা,
”মা কেন বাঁচলে না তুমি? তুমি যদি বেঁচে থাকতে তাহলে কি কেউ তোমার কুহুর সাথে এমন করতে পারতো!ও মা,মা কেন বাঁচলে না তুমি?”
বুঝদার কুহেলিকার মুখে অবুঝদারী কথাবার্তা।কুহেলিকা জানে মৃত্যু তো আসে আল্লাহর তরফ থেকে শুধু মানুষের নাক গলানো তা আসে কিছুদিন আগে।তবে তাও নির্ধারিতওই থাকে যে।কুহেলিকা মনকে শান্ত করতে ব্যর্থ।তারও যে চাই বাবা-মায়ের ভালোবাসা।
কুহেলিকার ফোন বেজে ওঠে।নাহিনের ফোন।কুহেলিকা মুচকি হাসে।মনে প্রশ্ন জাগে ছেলেটা কেমন করে প্রতিবার ওর মন খারাপের সময়ই ওকে স্মরণ করায় যে ও একা নয়!কুহেলিকা ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফোন রিসিভ করে।
নাহিন উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করতে থাকে।কুহেলিকা মুচকি হেসে বলে ওঠে,
—জানো নাহিন এই পরিবার আমার কেউই হয় না।দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মতো সম্পর্ক আমাদের।
নাহিন চুপ করে শোনে।তার চোখে যেন লুকিয়ে আছে হাজারো কথা।বলতে চায় তবে কোথাও একটা আটকে যায়।তবুও যেন আজ শত বাঁধা অতিক্রম করে বলে ওঠে,
—কুহু তুমি যাদের কবর আমার বাবা-মায়ের বলে জানো তারা আসলে আমার আংকেল আন্টি।আমি বহুবছর পূর্বে আমার বাড়ি ছেড়ে ছিলাম। অবশ্য ফিরেও গিয়েছিলাম সেখানে।তবে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় কি জানো আমি তাদের কষ্টে একটুও দুঃখ পাইনি। কেননা তারা মানুষ হিসেবে আমার চোখে নিকৃষ্ট।
কুহেলিকা অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো।নাহিনের কথায় একদম চোখ বরাবর চায় সে নাহিনের।ছেলেটার মধ্যেও তাহলে লুকিয়ে আছে হাহাকার।কই নাহিন তো কখনো উদাস থাকে না! নাহিন আবারো বলে ওঠে,
—তুমি ভাবতে পারো যে ছেলের মাঝে উদাসীনতা নেই তার মাঝে এতো বড় সত্য কিভাবে আছে?সত্যিই এ সত্য আছে আমার মাঝে কেননা আমি তাদের ঘৃণা করায় আমাকে কখনো উদাসীনতা গ্রাস করেনি।একটা বিষয় আরো আছে যা আমি লুকিয়েই রাখতে আগ্রহী।তবে যখন দেখবো না আমিই সঠিক জান্তা তখন তোমার হাতে হাত রেখে বলবো সব কথা।
কুহেলিকা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ক্লান্ত সেই চোখের দিকে।কেমন ঘোলাটে দৃষ্টি ছেলেটার!আচ্ছা ও কি আবারো উল্টা পাল্টা কিছু খাচ্ছে?না,এমন কখনোই হবে না।হয়তো কাজের চাপে পড়ে খাওয়া দাওয়া করছে না নিয়মানুসারে।
****
তানজিল চৌধুরী মেয়ের ফোনে কল দিয়ে ব্যস্ত দেখে বুঝলেন মেয়ে তার স্বামীর সাথে হয়তো কথা বলতে ব্যস্ত।অন্যথায় যেকোনো মূল্যে কল রিসিভ হতো। বৃদ্ধকে হসপিটালে পৌঁছে বেরিয়ে আসার সময় পথে আগলে দাঁড়ায় মাঝবয়সী রমনী।মুখ তুলে তাকিয়ে অ হয়ে যায় তানজিল চৌধুরী।পালিয়েই তো থাকতে চেয়েছিলো।তবে এতো আগে কেন সামনে পড়লো!
—ভাই?
ডক্টর সফিয়ার ডাকে না দাঁড়িয়ে এগিয়ে যেতে নেয় তানজিল চৌধুরী।হাত শক্ত করে ধরে ফেলে সফিয়া।নাহিদ খানও সেখানেই দাঁড়িয়ে।অবাক হোন স্ত্রীকে পরপুরুষের হাত ধরতে দেখে।এগিয়ে এসে দাঁড়ান তানজিল চৌধুরীর সামনে।অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন যার মৃত্যু সংবাদ শুনলো পঁচিশ বছর পূর্বে তারই দেখা মিললো এই সময়ে!
—তানজিল?
নাহিদ খানের দিকে তাকায় তানজিল।রাগ ওঠে।এই লোকটাকেই নাকি সে বড় ভাইয়ের স্থান দিয়েছিলো যে তাদের কথা না ভেবেই পালিয়ে নিয়ে গেলো তার বোনকে। অবশ্য এই কারণে কৃতজ্ঞতাবোধও জন্মেছে তার মনে। কেননা তা না হলে হয়তো তারই মতো তার বোনের ওপরেও আক্রমণ হতো।মরে যেতে পারতো তার বোনটা।
—পথ ছেড়ে দাঁড়ান।আমি আপনাদের চিনি না।
ডক্টর সফিয়া কথা শোনেন না ভাইয়ের।টেনে নিয়ে আসেন ক্যাফেটেরিয়ায়।টেবিলে বসে ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
—ভুল বুঝবি আমাকে এখনো?
—আমি বলছি তো আমি আপনাদের চিনি না।
—তা শালা বাবু আমায় কিভাবে ভুললে?
নাহিদ খানের কথায় খেপে যায় তানজিল চৌধুরী।ছোট থেকেই এই শালা শব্দটা বড্ড অপছন্দের তার কাছে।মনে হয় যেন কেউ গালি দিয়েছে তাকে।তেতে উঠে বলে,
—আমি কারো শালা নই।আর আপনি আমায় গালাগাল করতে পারেন না।
একজন সাংবাদিকের এই বিষয়টা খুবই হাস্যকর লাগতে পারে।তবে মানুষের দূর্বলতা থাকে।তবে তার ক্ষেত্রের দূর্বলতাটা খুবই হাস্যকর।ফলে নাহিদ খানও চিনে ফেলেন তার শালাকে।স্ত্রী কাসফিয়া চৌধুরী উরফে সফিয়ার ভাইকে চিনে ফেলেন তিনি।
—তা সফিয়া আর কিছু বলতে হবে তোমায়?বাচ্চা তো নিজেই বলে দিয়েছে কে সে!
—নাহিদ ভাই আমি বাচ্চা নই।বছর ঘুরতেই নানা হবো।আর তুমি আমায় বাচ্চা বলছো!
—তা আমাদের তানজিলের মেয়ে কেমন আছে?আর কোথায় সে?
নাহিদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে তানজিল।তবে খুব সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে যায় মেয়ের বিষয়টা।গোপন রাখতে বলে তার বেঁচে থাকার কথাটা। কাসফিয়া চৌধুরী কিংবা নাহিদ খানের স্ত্রী সফিয়া যাই বলি না কেন তিনি তাকিয়ে আছেন ভাইয়ের দিকে একদৃষ্টিতে।যার মৃত্যু সংবাদে নিজেকে অপরাধী ভেবে কুঁড়ে কুঁড়ে মরছিলেন।আজ যেন সেখানে নতুন করে বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পেলেন।তবে তার খটকা লাগছে,মনটা খচখচ করছে।কারো চেহারার সাথে মিলে যাচ্ছে তার ভাইয়ের চেহারা।তবে স্পষ্ট মনেও পড়ছে না।তবে এটা বুঝেছেন তার ভাই লুকিয়েছে তার ভাগ্নির বিষয়টা। কেন এর পেছনেও কি রয়েছে কোনো রহস্য?কে তার ভাগ্নি?দেখা কি হয়েছে তাদের নাকি….
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১০
#বর্ষা
সিনানের মৃত্যুতে মির্জা বংশ যেমন স্তব্ধ,স্তব্ধ কুহেলিকা নিজেও। ছোট্ট বাচ্চাটা তাদের ছেড়ে চলে গেল!কুহেলিকা ওয়াসরুমে গিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে।যাদের সাথে ওর ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তাদের অধিকাংশই দ্বিতীয় পথের পথিক হয়।সিনানও তেমনি অন্য পথের পথিক হয়ে হারিয়ে গেলো কুহেলিকার থেকে।
হসপিটালের ঝামেলা মিটিয়ে বাড়িতে ফেরে সবাই। দাফন করতে করতে সন্ধ্যা।সিনানের মৃত্যু হয়েছে ওর্গান ফেলিয়ারের কারণে।সাফিন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে সব দেখছে।যেন অনুভূতিশূন্য দাঁড়িয়ে সে।
কুহেলিকা কি করবে বুঝতে পারছে না।নাহিন সিঙ্গাপুর পৌঁছে গেছে।সেই সকালে বেরিয়েছে এখনো না পৌঁছালেই হয়তো আশ্চর্যজনক হতো। নাহিন বুঝতে এবং বোঝাতে পারছে না কিছুই। কেননা সে নিজেই কিছু বুঝতে পারছে না।
কুহেলিকা ফোন বন্ধ করে নিজের রুমে সুয়ে আছে।কায়ফার মৃত্যুতে মির্জা বংশের আত্মীয়স্বজনের কোন এক কারণে দেখা মেলেনি।তবে সিনানের মৃত্যুতে সবাই আসছে,এসেছে।কুহেলিকা নামাজে লুটিয়ে কাঁদছে তবে সিনানের মাগফিরাত কামনা করছে। কেননা সে যে জানে মানুষ জাতি শুধু কয় মুহূর্তের সান্ত্বনা দিয়েই নিরুদ্দেশ। শুধুমাত্র আল্লাহই আছেন যিনি সবকিছু আবারো নতুন করে সাজান,কষ্ট হ্রাস করেন।
ড্রয়িংরুমে কুহেলিকাকে নিয়ে এই মুহূর্তেও সালিশী করছে রুমানা আফরোজ।জাহিদ বাবা-মাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে ক্ষিপ্ততা দেখিয়ে।জুনায়েদ ঘাড়ত্যাড়ার মতোই রয়ে গেছে।আর কায়েস মির্জা? কায়সার নারি ছেঁড়া ধনকে আগলে রাখতে না পারার দুঃখে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে সিনানের সামনে।সাফিন নিরব অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।
—কিরে আপা কুহু বলে ফিরে আসছে কই ও? তোদের এতো বিপদের মাঝেও দেখছি না যে!
বোন রামিজা আফনানের কথায় আফসোসের সুরে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,
—দায়িত্ব-জ্ঞানহীন ওই মেয়ে।ঘরের দরজায় খিল এঁটে বসে আছে দেখগে।
—কুহু তো এমন ছিলো না আন্টি।
রামিজা আফনানের বড় ছেলে রুবেল আহমেদ বলে ওঠে।কুহেলিকার বছর ছয়েকের বড় সে।কায়ফার থেকেও বড়।তবে এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও এখনো অব্দি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি কোনো এক কারণে।রুমানা আফরোজ ভাগ্নেকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন,তবে মন মানসিকতা ভালো না হওয়ায় আর বলেন না।চুপ থাকেন।
—এই কুহু দরজা খোল।দরজা খোল বলছি।
নামাজ পড়ে মাত্রই উঠেছিলো কুহেলিকা। হঠাৎ দরজা ধাক্কা, পাশাপাশি পুরুষনালী কন্ঠস্বর ভেসে আসতে এগিয়ে যায় সে।দরজা খোলে।অপরিচিত পুরুষ মুখশ্রী।তবে কেমন জানি চেনা চেনা ঠেকছে।তবে স্মরণে করতে পারছে না।পুরুষটা কুহেলিকাকে ডেঙিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলে,
—কিরে দাঁড় করিয়ে রাখার প্ল্যান করিছিলি নাকি?
—কে আপনি?(কুহেলিকা)
—তোর নানা।
—মিফতি?(কুহেলিকা)
—তাহলে ম্যাডাম এতক্ষণে চিনেছেন আমাকে।ভুলেই তো গিয়েছিলেন।তা এতগুলো বছর কোথায় ছিলেন আপনি?(মিফতি)
—অনেক জায়গায় ছিলাম।কত জায়গার নাম শুনবি।(কুহেলিকা)
—সব জায়গার।(মিফতি)
—দিল্লি,বাংলাদেশ,সিঙ্গাপুর,কাতার,কানাডা,ইতালি,লন্ডন,লসএঞ্জেলেস,জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড,দুবাই।(কুহেলিকা)
—বাপ রে বাপ।(মিফতি)
কুহেলিকার সাথে মিফতির সম্পর্কে সখ্যতায় ঘেরা। ছোট্ট থেকেই ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছে তাকে এই ছেলেটা। চৌধুরী বংশের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড আবার ফ্যামিলি লয়ারের একমাত্র ছেলে মিফতি। ইসতেগফার আংকেলের ছোটো ছেলে।প্রায়ই আসতো আংকেলের সাথে তাইতো পরিচয়,বন্ধুত্ব।
মিফতি পাঁচ ফুট ছয়।আর কুহেলিকা পাঁচ ফুট চার।একই কলেজে পড়া সূত্রে একসঙ্গে যাতায়াত ছিলো তাদের।মাঝে যে বন্ধুত্বের গ্যাপ তৈরি হয়েছিলো তা ঘুচে গিয়েছিলো বিগত দুই বছরে।মিফতি দেখতে মাশাআল্লাহ।সাদা ত্বকের বিড়াল ছানা। চোখগুলো ছোট ছোট।বাম গালে চোখের নিচে তিল আর চাপ দাঁড়িতে জাস্ট অস্থির লাগছে তাকে। অবশ্য কুহেলিকা তাকে বিড়াল ছানা বলেই ডাকে।
রোহানী দাঁড়িয়ে আছে কুহেলিকার দরজায়।মিফতি যে কুহেলিকার বেডে আধশোয়া হয়ে কথা শুনছে তারই একটা ছবি লুভে নেয় সে।তবে এ যে যথেষ্ট নয়।তবুও পাঠিয়ে দেয় নাহিনের নাম্বারে।তবে কেন জানি লেখা ওঠে ‘কুডেন্ট সেন্ড’।রোহানী রাগের মাথায় ফোন ছুঁড়ে মারে।গিয়ে লাগে মিফতির পায়ে।’আহ’ বলে আর্তনাদ করে দাঁড়িয়ে যায় সে। রোহানী ভয় সেয়ে পালিয়ে যেতে চাইলেও মোবাইলের জন্য ভেতরে আসে।
—এক্সট্রেমলি সরি আমি তোমাদের কথা শুনছিলাম না। আমার মোবাইল হ্যাঙ করছিলো তাই আরকি রাগে…
—তাই নাকি রোহানী?তাহলে মিফতি আর আমার পিক আসলো কোথা থেকে?
রোহানী ঘামতে থাকে।বড় এক বাঁশ খেতে চলেছে সে।তবে ভুল স্বীকার করার পাত্রী সে আদৌতে না। রোহানী যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলে ওঠে,
—হয়তো হ্যাঙ হবার কারণে অজান্তেই উঠেছে।
—আচ্ছা।তাহলে তোমার ফোনটা একটু দেখি ঠিক আছে কিনা।
—এখন তো ঠিক হতেই পারে তাই নয়কি!
—তাও ঠিক।আচ্ছা নেও তোমার ফোন। ইচ্ছে হলে থাকতে পারে।
রোহানী দ্রুত বেরিয়ে আসে।বড় বাঁচা বেঁচেছে।আজকে নয়তো এই বাড়ি থেকে পাঠ চুকিয়ে বেরিয়ে যেতে হতো।রোহানী দ্রুত সরে আসে সেখান থেকে।রাইসার ঘরে ঢুকে যায়।রাইসা রামায়সাকে নিয়ে ঘরেই আছে। কেননা রাইসা প্রেগন্যান্ট আর এঅবস্থায় মৃত্যু দেখতে যাওয়া নাকি অকল্যাণকর। পাশাপাশি মৃত্যু দাফন করে এসে গোসল না করা অব্দি নাকি কাউকে ছুলেও অকল্যাণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
—কিরে কই গেছিলি তুই?সিনানকে দেখেছিস?বাচ্চাটা আমায় মামী মনি মামী মনি বলে ডাকলে কি যে মায়া লাগতো!
রাইসার কন্ঠে দেখতে যাওয়ার ছিলো আকুলতা।তবে নিয়ম গেড়েছে বাড়ির বড়রা।জয়নুবা আর কাসেম এসেছেন পরিবারের বড় বলে কথা।জয়নুবার আদেশেই ঘরবন্দি রাইসা।
—আপু বাদ দেও তো।যার মরার সে মরেছে।তাকে নিয়ে এতো ভাবলে দেখবে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে আর তোমার বেবির ক্ষতি হবে।আর সিনানকে নিয়ে ভাবার পরিবর্তে নিজের মেয়েটাকে নিয়েও একটু ভাবো।আজ খাইয়েছো ওকে?
রোহানীর কথায় রাইসার মনে পড়ে না আজকে সে মেয়েটাকে দুপুরে কিছুই খাওয়ায়নি।তাই হয়তো এতো কাঁদছিলো।মোবাইল দেওয়ার পরও তো কত কাঁদছিলো।তারপর চকলেট পেয়ে কান্না থামালো।
—ইশ আমি তো ভুলেই গেছিলাম।আমার বাচ্চাটা এখনো খায়নি।আমি গিয়ে খাবার নিয়ে আসি।
—আপু তুই পাগল!মরা বাড়িতে কি খাবার রান্না আদৌ হয়?আর তাছাড়া তোর বাইরে বের হওয়া নিষেধ।ঘরে থাক আমি খাবার অর্ডার দিয়েছি। পাঁচ মিনিটে চলে আসবে।আমি নিয়ে আসছি।
রোহানী বেরিয়ে যায় খাবার আনতে।সত্যিই হয়তো একজন মেয়ে যতই খারাপ হোক না কেন সে যদি তার বোনকে ভালোবাসে তবে সে তার বোনের অংশকে নিজের মেয়ে হিসেবেই তার জন্য সব করতে চায়।তবে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতাও থাকে। পরিস্থিতি মানুষের ভেতরকার ভালো মানুষী মেরে ফেলে,বাহির করে প্রতারণা,ছল-চাতুরী।এমনও তো হতে পারে যে তার অতীত বড্ড ভয়ংকর।
…..
রোহানী যেতেই মিফতিও বেরিয়ে গেছে।আবার কখন এসে কি করতে চায়!কুহেলিকার ফোনে ‘আব্বু’ দিয়ে সেভ করা নাম্বার থেকে কল আসে।কুহেলিকা আঁতকে উঠে।চারপাশ ভালো করে দেখে কেউ দেখলো কিনা।না,কেউ দেখেনি।কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা যায় পুরুষনালী শক্ত কন্ঠস্বর।
—কুহু সিনানের মৃত্যুর পেছনে কি তুমি?
—ছিঃ আব্বু তুমি ভাবলে কি করে যে ওতোটুকু বাচ্চার সাথে আমি কিছু করবো!
—আমি সিনানের অল ফাইল রিড করেছি।ওর তো মারা যাওয়ার কথা নয়। তুমি যদি কিছু নাই করো তাহলে করলো কে?
—আব্বু সিনানকে কি খুন করা হয়েছে?
—আমার সন্দেহ আছে।
—আব্বু আমি এই পরিবারকে ঘৃণা করি।একটা বাচ্চাকেও বাঁচতে দিলো না এরা!এরা মানুষ নামক জানোয়ার।
—কুহু উত্তেজিত হয়ো না। নয়তো আমরা ওদেরকে ওদের প্রাপ্য শাস্তি দেওয়াতে পারবো না।
কুহু চুপ হয়ে কাঁদতে থাকে।কোন জানোয়ার কেড়ে নিলো ওই ছোট্ট প্রাণ! এতোক্ষণ তো ভাবছিলো আল্লাহ আল্লাহর মঞ্জুরিতে দান করা প্রাণ নিজ ইচ্ছায় কেড়ে নিয়েছে।মনকে শান্ত করেছিলো। কিন্তু এখন কিভাবে শান্ত করবে সে তার মনকে!শেষমেশ শয়তান গুলো একটা বাচ্চাকে বাঁচতে দিলো না।ধিক্কার মির্জা পরিবারকে।
দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ কানে আসতেই দ্রুত কল কেটে দেয় কুহেলিকা।নৌশিন এসেছে।কায়ফার মামাতো বোন।তাদের জানা মতে কুহেলিকারও মামাতো বড় বোন।নৌশিন এসেই কুহুর মুখোমুখি হয়ে ঠাস ঠাস করে দুই ঘা লাগায় কুহেলিকার গালে।
—আটবছর দূরে থেকে খুনি হয়েছিস?প্রথমে কায়ফা আর এখন ওর ছেলেকে!কি চাস তুই।সাফিন দুলাভাইকে বিয়ে করতে চাস।চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার।
কুহেলিকা পাল্টা চড় মারে।বড় বলে ছেড়ে দেয় না। ধৈর্যের পরীক্ষা অনেক দিয়েছে আর কত দিবে!এখন থেকে যা হবে সব সামনাসামনি।কুহেলিকার চড় খেয়ে ফুঁসতে থাকে নৌশিন।কিছু বলতে উদ্ধত হওয়ার পূর্বেই কুহেলিকা বলে ওঠে,
—জানবে না শুনবে না থাপ্পর মারবে!কুহেলিকাকে দূর্বল ভেবে ভুল করো না।আমি কুহেলিকা চৌধুরী অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমার আছে।আর কিসের এতো মোহাব্বত দেখাচ্ছো তোমরা!কায়ফা আপু যখন মারা গেলো কাউকে তো দেখলাম উঁকি দিতেও।আজ সাফিনের মৃত্যুতে মায়া দেখাতে এসেছো নাকি খুন করে পালিয়ে যেতে না পারায় থাকতে এসেছে এই বাড়িতে?
—কুহেলিকা?
—গলা নামিয়ে।আমার বাড়িতে আমি গলা উঁচিয়ে কথা বলা কাউকে সহ্য করবো না।গেট লস্ট ফর্ম মাই রুম।
#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৯
#বর্ষা
নাহিনের হাত ধরে খোলা মাঠের দিকে ছুটে চলেছে কুহেলিকা। দুজনের পোশাকই সবুজ রঙা যেন কপোত-কপোতী! নাহিনের এক হাতে গুঁজে রাখা কুহেলিকার হাত আরেক হাতে লাটাই।কুহেলিকার হাতে ঘুড়ি।আজ মনে রঙ লেগেছে তাদের।পবিত্র সম্পর্কের জোয়াড়ে গা ভাসিয়েছে।একটু উৎযাপন তো হবারই।তবে তা ভিন্ন ধর্মী যা আজ অব্দি কেউই করেনি।
—নাহিন সুতা ছাড়ুন..দ্রুত ছাড়ুন।বাতাস উল্টো দিকে বইছে তো আবার এদিকে..ঘুড়ি পড়ে যাবে।
—আরে প্রিয়তমা ব্যতিব্যস্ত হয়ও না। তোমার স্বামী তোমার পাশেই আছে।
কুহেলিকা পিছে ফেরে নাহিনকে দেখে।মিষ্টি হাসি তার মুখে লেগে।নাহিনের হাসি মুখটা যেন আরো উজ্জ্বলিত হয়।কুহেলিকা আর নাহিনের আনন্দক্ষণ মুহুর্তের ছবি কেউ আড়াল থেকে তুলে নেয়। লোক সমাগম এদিকে অনেক কম।কুহেলিকার নজর এড়ায় না লোকটা।তবে সেদিকে ফিরে মুচকি হাসে সে।যেন তারই কেউ!
কায়ফা মৃত্যুবরণ করেছে আজ সাতদিন।গতকাল রাত্রের পর এখনো অব্দি বাড়ি ফেরার কথা চিন্তাতেও আনেনি কুহেলিকা।নাহিনকে নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলো। মানুষ কতোটা জঘন্য হলে বোনের স্বামীকে বিয়ে করার কথা বলে!হ্যা,কুহেলিকার সো কল্ড ফ্যামিলি এমনটাই করেছে।কুহেলিকাকে ইমোশনালী ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেছে।
ফ্লাসব্যাক…
রাত নয়টা কি দশটা হবে হয়তো।সিনান কুহেলিকার গা ঘেঁষে ঘুমিয়ে পড়েছে।গত কয়েকদিন যাবৎ খালাগত মায়ের ভূমিকা পালন করেছে সে।ছেলেটা এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।কুহেলিকা লেপটপে কাজ করছিলো তখনই ঘরে ঢোকে রুমানা আফরোজ,কায়েস মির্জা।
—আম্মু তুমি কি ব্যস্ত?
কুহেলিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায় সেদিকে।এনারা নতুন কি ভং ধরেছে তা মস্তিষ্কে নাড়া দেয় না কুহেলিকার।তবে বুঝতে পারে যে এদের কিছু তো চাই নয়তো এতো পেয়ার মোহাব্বত উতরিয়ে পড়তো না।
—জ্বি ব্যস্ত।
—তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে.. শোনো (কায়েস মির্জা)
কুহেলিকার রাগ লাগে।যখন কথা বলবেই তাহলে কেন জিজ্ঞেস করলো সে ব্যস্ত কিনা।রাগ লাগে কুহেলিকার।তবুও দাঁতে দাঁত চেপে লেপটপ বন্ধ করে বলে ওঠে,
—বলুন শুনছি.
—কুহেলিকা তুমি আমাদের ছোট মেয়ে আর কায়ফা ছিলো আমাদের বড় মেয়ে। সেক্ষেত্রে কায়ফার ছেলে তোমার ভাগ্নে অর্থাৎ সন্তানতুল্য।এখন তুমি কি চাইবে তোমার সন্তানতুল্য ছেলে সৎ মায়ের অত্যাচারে জীবনের মানে হারিয়ে ফেলুক।(কায়েস মির্জা)
—কি বলতে চাইছেন খোলা মেলা বলুন।কথা পেচাচ্ছেন কেন?(কুহেলিকা)
—মানে তুমি সাফিনকে বিয়ে করো।এতে সিনান মায়ের ভালোবাসাও পাবে আর সাফিন স্ত্রীও পাবে।(রুমানা আফরোজ)
—ফাজলামো করতাছেন আমার সাথে?কি বলছেন তা আপনারা আদৌ বুঝতে পারছেন তো!(কুহেলিকা)
—হ্যা হ্যা হ্যা বুঝতে পারছি।তবে তুমি এমন মেজাজ দেখাচ্ছো কেন?তোমার মায়ের অধিকার থেকে বলছি তুমি আজকেই সাফিনকে বিয়ে করবে।আজই কাজী আসবে।চলো কায়েস
রুমানা আফরোজ অধিকার দেখিয়ে কথা বলে বেরিয়ে যান।কুহেলিকা তাচ্ছিল্য হাসি হেসে আলমারি থেকে পোশাক বের করে হ্যান্ড ব্যাগে একসেট জামা ভরে অন্যটা পরিধান করে।নাহিনকে ফোন দিয়েও তেমনটাই করতে বলে। ঘুমন্ত সিনানের কপালে আলতো চুম্বন করে বলে ওঠে,
—খালামনি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো বাবা।
কুহেলিকা ব্যাগ কাঁধে নাহিনের হাত ধরে রুমানা আফরোজের সামনে বের হতে নিলেই রাস্তা আটকে দাঁড়ান তিনি। রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠেন,
—কোথায় বের হচ্ছো তুমি?কাজী আসবে আর কিছুক্ষণের মাঝেই আর তুমি এখন পরপুরুষের সাথে বের হচ্ছো!এই ছেলেকে চলে যেতে বলো।
নাহিন কিছুই বুঝতে পারে না।কেন আসবে কাজী?বিয়ে পড়াতে তো আসবে কিন্তু কার!নাহিন বুঝতে পারে না।কুহেলিকার মুখের দিকে তাকায়।কুহেলিকা চোখ দিয়ে ইশারা করে বোঝায় সে বলবে সব। নাহিন চুপ থাকে। এমনিতেই ফিরতে হবে তাকে। বায়ারদের সাথে কোনো কারণে গ্যাঞ্জাম বাধিয়েছে কর্মচারীরা।এ নিয়েই ঝামেলা।কুহেলিকাকে বলাও হয়নি এবিষয়ে।
কুহেলিকা সাফিনের সম্মুখে দাঁড়ায়। সাফিনের মুখশ্রীতে বেদনা ভাব আছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং সে হয়তো আনন্দিত।কুহেলিকা দাঁতে দাঁত চেপে সাফিনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
—স্ত্রী মরেছে একমাসও সহ্য হয়না?বিয়ের জন্য নড়চড় করছেন!ছেলেকে একা হাতে বড় করা যায় না?তাহলে ছেলের জন্য কেন মা চাই! নিজের মায়ের মতো কেউই আদর-সোহাগ দিতে পারে না।তাই নিজের শান্তির জন্য ছেলেকে সামনে দাঁড় করিয়ে কাজ হাসিল করবেন না।
ফ্লাসব্যাক এন্ড..
কুহেলিকা নাহিনের হাত ধরে বেরিয়ে আসার পর শুরু হয় আরেক ঝামেলা।সাফিন রাগান্বিত হয়ে জাহিদের কলার ধরে।এই ছেলের কারণেই এমন হচ্ছে।এই ছেলেই পরামর্শ দিয়েছে সবাইকে যে কুহেলিকার সাথে সাফিনের বিয়ে দিতে। রাগান্বিত হয়ে বলে ওঠে,
—শয়তান তোর জন্য আজ ওই মেয়েটা আমাকে এতো গুলো কথা শুনিয়ে গেলো।জাস্ট তোর জন্য!
—আরে মিয়া এখন দেখি সব দোষ আমার।তুমি মনে হয় চাও নাই ওরে বিয়ে করতে!তলে তলে যে তোমার কি চলে সবই বুঝি।সাধু সাজতে আইসো না।(জাহিদ)
—জাহিদ মুখ সামলে কথা বল।আমি ওরে চাইছি মানে কি?
একপ্রকার হাতাহাতি শুরু হয় বাড়ির ছেলে আর জামাইয়ের মাঝে।জিহাদ এবাড়িতে থাকে না কোনো এক কারণে। তাই এসময়ে উপস্থিত নেই তার স্ত্রী-সন্তান।সিনান কান্না করতে করতে সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সেসময়ই পা পিছলে পড়ে যায়।সাফিন আগলে রাখতে পারেনা ছেলেকে।মাথা ফেটে ফুলকির ন্যায় রক্ত ঝড়তে থাকে।থামার নাম গন্ধই নেয় না। হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছোটে তারা।
নিকটবর্তী হসপিটালে পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গেলেও ডক্টররা রক্ত থামানোর আপ্রাণ চেষ্টায় এখনো ব্যস্ত।রক্ত টেস্টের জন্যও পাঠানো হয়েছে। শেষমেশ পুরো দশমিনিটের প্রয়াসে রক্ত ঝরা থামে।তবে প্রচুর রক্ত অলরেডি ঝড়ে গিয়েছে।বাচ্চার ও+ রক্ত লাগবে।দিতে রাজি হয় জাহিদ।মামা হয়ে ভাগ্নেকে তো আর মরতে দিতে পারেনা।
—আপনাদের মধ্যে পেশেন্টের গার্ডিয়ান কে?
নার্সের কথায় বিধ্বস্ত সাফিন এগিয়ে এসে বলে,”আমি ওর বাবা।”
—ডক্টর আপনাকে ডেকেছেন চলুন।
নার্সের পিছুপিছু যায় সাফিন।ডক্টরের কেবিনে যেতেই দেখতে পায় ডক্টর ফাইলে মুখ গুঁজে আছেন।নার্স ডাক দিতেই ওপরে তাকান তিনি। একজন মাঝবয়সী মহিলা ডক্টর।ওয়াইফ ওফ ডক্টর খান।ডক্টর সফিয়া বলে ওঠেন,
—মিষ্টার সাফিন আহমেদ আপনি কি জানেন আপনার ছেলে কোন রোগে আক্রান্ত?
—জানলে কি হসপিটালে আনতে হতো!
সাফিনের ত্যাড়া জবাবে রাগান্বিত হলেও নিজেকে সংযম রাখেন তিনি। কেননা সন্তানের অসুস্থতায় কোনো পিতা-মাতারই মাথা ঠিক থাকে না।উল্টা পাল্টা বকতে থাকে।ডক্টর সফিয়া নিজেকে শান্ত রেখে বলে ওঠে,
—আপনার ছেলে হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত।মেয়েরা সাধারণত এর বাহক আর ছেলেরা আক্রান্ত হয়।এটা জিনগত রোগ।আপনি কিংবা আপনার মিসেস কেউ এই রোগের বাহকের কাজ করেছেন।তাই আপনাদের সন্তানও হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত।
—হিমোফিলিয়া মানে?(সাফিন)
—হিমোফিলিয়া এমন ধরনের রোগ যা ক্ষত স্থান নিজ থেকে রক্তের সাদা অংশ ক্ষরণের মাধ্যমে বন্ধ করতে পারে না। বরং ক্ষতটা তেমনি থাকে একটা দীর্ঘসময়। এছাড়াও হিমোফিলিয়ায় কোথাও সামান্য কাটলেও প্রচন্ড রক্ত ঝড়ে ফলে মৃত্যুসঙ্কা তৈরি হয়।(সফিয়া)
—ডক্টর আমার ছেলে বাঁচবে তো?(সাফিন)
—আল্লাহ,আল্লাহ করেন। প্রচুর রক্ত গিয়েছে ওর।(সফিয়া)
সাফিন যেন আরো ভীত হয়ে পড়ে ডক্টরের কথায়।কই সে তো কখনো খেয়াল করেনি কায়ফার হিমোফিলিয়ার কথা। আচ্ছা কায়ফা কি মেডিসিন নিতো এই রোগের!সাফিন কিছুই জানে না।আসলে সে জানেটা কি তার স্ত্রীর সম্পর্কে?ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছিলো।বিয়ের পর কি ভালোবাসা উড়ে গেলো!
…..
কুহেলিকা, নাহিন বিকেলে বাড়ি ফিরে জানতে পারে সবাই হসপিটালে।কারণ জেনে নিজেকে অপরাধী লাগতে লাগে তার।কায়ফাকে যে সে কথা দিয়েছে আগলে রাখবে তার অংশকে।সেই কথার অবহেলা সে কিভাবে করলো!
হসপিটালে এসে জানতে পারে ডক্টর সফিয়া ট্রিটমেন্ট দিচ্ছেন।হাত জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করে বলে,
—আন্টি বাচ্চাকে ঠিক করে দিন।আমি একজনকে ওয়াদা দিয়েছে তার অংশকে আগলে রাখবো।আমি পারিনি।
সফিয়া জড়িয়ে ধরেন কুহেলিকাকে। অনেকদিন পর দেখা।পাশে আছে অচেনা পুরুষ।কুহেলিকার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি পড়তেই নাহিন নিজ থেকে পরিচিত হয়ে নেয়।নাহিন বলে ওঠে,
—আসসালামু আলাইকুম আন্টি আমি নাহিন মুনতাসির কুহেলিকার হাসবেন্ড।
—ওয়ালাইকুমুস-সালাম আমি ডক্টর সফিয়া।
সফিয়া যেন বেশ অবাক হয়েছেন কুহেলিকার হাসবেন্ড শব্দটি শুনে।তবে এবিষয়ে তিনি পরে দেখবেন ভেবে কুহেলিকাকে আস্বস্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে যান।সিসিউতে কয়েকটা পাইপের মতো যন্ত্র দ্বারা তার দেহে কি কি যেন দিচ্ছে আবার চেকও করছে।এক হাতের ক্যানোলা দিয়ে রক্ত যাচ্ছে তো আরেক হাতের ক্যানোলা দিয়ে স্যালাইন যাচ্ছে। অবস্থা গুরুতর।
কুহেলিকাকে দেখেই রুমানা আফরোজ,সাফিন ছুটে আসে।সাফিন তো সরাসরি বলেই ওঠে,
—আজ তোমার জন্য আমার ছেলে মরতে বসেছে।ওর কিছু হলে আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না।শেষ করে দিবো।
কুহেলিকা ছোট সিনানকে স্নেহ করলেও মিথ্যে অভিযোগ নিজের ঘাড়ে নেওয়ার মতো মেয়ে সে না।বাসার হ্যাল্পিং হ্যান্ডদের মুখে আসল সত্যি সে শুনেই এসেছে।তাই তো ফটাফট প্রতিবাদ করে বলে ওঠে,
—নিজেদের দোষ ঢাকতে আমাকে দোষী বানাচ্ছেন?আমাকে চলে আসতে দেখে জাহিদ ভাইয়ের সাথে ঝগড়া কে বাধিয়েছিলো?কার কারণে আতঙ্কিত হয়ে পিছলে পড়েছিলো সিনান?কার কারণে!
সাফিন চুপ হয়ে যায়।মাথা কাজ করা তার বন্ধ হয়ে গেছে।কুহেলিকা পাশ ফিরে দেখে নাহিন নেই। অর্থাৎ সে চলে গিয়েছে এয়ারপোর্টের দিকে। বাড়ি ফেরার পথেই নাহিন কুহেলিকাকে জানিয়েছিলো আজ তাকে ইমার্জেন্সিতে সিঙ্গাপুর যেতে হবে। বায়ারদের সাথে বড়সর সমস্যা বাঁধার পূর্বেই!কুহেলিকাও সায় দিয়েছিলো।তবে বাড়ি ফিরে কুহেলিকা এসব জানার পর বলেছিলো,
—আমায় হসপিটালে ছেড়ে আপনি এয়ারপোর্টের দিকে যাইয়েন।
নাহিন যেতে চায়নি।কুহেলিকা জোর করে পাঠিয়েছে কেননা এমনিতেও এদের মন মানসিকতা নিচু পর্যায়ে।তার ওপর একের পর এক আঘাত সহ্য করতে সব রাগ কুহেলিকার ওপর দেখাতে চাইবে ,তবে তার সাথে না পেরে জুনায়েদ মির্জা,কায়েস মির্জা নাহিনের সাথে খারাপ কিছু করতে চাইতে পারে। আর এদের শাস্তি না দেওয়া অব্দি এদের তো আর বাড়ি থেকেও বের করতে পারে না সে!তাই তো নাহিনকেই এখান থেকে নিরাপদ স্থানে পাঠালো।তবে তাকে নিজের করে।