Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 199



শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে পর্ব-০৪

0

#copywritealert❌🚫
#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
কিছুক্ষণ পর আর্শি তার মাকে গিয়ে বলে,
“মা, শোনো না, তুমি তো আরুর হবু শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে পরিচিত না। তাই চাইছিলাম কি উনাদেরকে বাড়িতে ডাকো কাল। তোমরা তো আমাকে না জানিয়ে বিয়ের সবকিছু ঠিক করে ফেলেছো, জাস্ট ফর সারপ্রাইজ! যেহেতু আরুর বড়ো বোন হিসাবে ওর বিয়ে এটেন্ড করব তাহলে তো হবু শ্বশুরবাড়ির লোকদেরকে জানতে হবে।”

মিসেস আশালতা কিঞ্চিত ভাবলেন। ফের বললেন,
“তা তুই ঠিক বলেছিস। তাহলে এক কাজ করি তোর মামা-চাচাদেরকেও বলি। ওরাও তো তোর সাথে দেখা করবে।”

“বলো। তাহলে কালকে নাহিদের পরিবার আসছে?”

“আমি বলব ওদের।”

আর্শি মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমে চলে আসে। আগামীকাল সে নাহিদের থেকেই জানতে চাইবে এতো কিছুর পর কী আর পরিবার ছিল না বিয়ে করার জন্য!

_________

মিসেস আশালতা কল করেন নাহিদের মা মিসেস নেহাকে। সপরিবারে দাওয়াত পেয়ে মিসেস নেহা দারুণ উৎফুল্লিত। তিনি নাহিদের বাবাকে ও নাহিদকে ডিনারের সময় দাওয়াতের কথাটা বলেন। নাহিদ প্রথমেই না করে দেয় কিন্তু নাহিদের বাবা হাসান সাহেব বলেন,

“দেখো নাহিদ, তোমার কথা শুনে আমরা ঘটক দ্বারা সম্বন্ধ পাঠিয়েছি। পরিবার ভালো দেখে আমাদেরও ভালো লেগেছে। এখন উনারা দাওয়াত দিয়েছেন, সেখানে না গেলে খারাপ দেখা যায়। কাল তোমাকে যেতেই হবে।”

“আমার কাজ আছে, বাবা। তোমরা গেলে যাও। আমি যাব না।”

এই বলে নাহিদ ডিনারের টেবিল ছেড়ে উঠে যায়। নিজের রুমে গিয়ে ভাবতে থাকে, হঠাৎ এই দাওয়াত কেন? এসব ভাবনা চিন্তার মধ্যে একটা আননোওন নাম্বার থেকে হোয়াটসএপে মেসেজ আসে,

“মিস্টার নাহিদ আহমেদ, আগামীকাল আপনার সত্য প্রকাশ করা হবে। আপনার মতো নিচু মানসিকতার লোকের সাথে অন্তত আমার বোনের বিয়ে হতে পারে না।”

মেসেজটা দেখে নাহিদ ঘাবড়ে যায়। সে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে চিৎকার করে বলে,
“তোমরা কেউ কালকে আরিয়ার বাড়িতে যাবে না।”

মিসেস নেহা, মিস্টার হাসান ও নাহিদের খালাতো ভাই আশিক অবাক চোখে চেয়ে আছে। মিসেস নেহা বলেন,
“আমি কথা দিয়ে ফেলেছি, নাহিদ। তাছাড়া আমাদের দুইদিন পর এমনিতেও যেতে হতো। তুমি তো জানো, আমাদের পরিচিত বেনারসির কারিগর থেকে বেনারসি শাড়ি আনাই। সেই কারিগর আমাদের জন্য আটটা বিয়ের শাড়ি দেখানোর জন্য রেখেছেন। আমি চাই, আটটা শাড়িই আরিয়ার গায়ে কোনটা মানায় দেখে বাছাই করতে। আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা।”

নাহিদ অস্থির স্বরে বলে,
“আরে মা, বোঝার চেষ্টা করো। আমি….”

মাঝ থেকে আশিক বলে ওঠে,
“কী হয়েছে, ভাইয়া? বিয়ের কয়েকদিন আগে এভাবে দাওয়াত রিফিউজ করাটা ভালো দেখায় না। শুনলাম আরিয়ার আপু এসেছে।”

“আরিয়া তোর ভাবি হয়! নাম ধরে কেন ডাকছিস?”

কথাটা নাহিদ রেগেই বলে। আশিকের মুখমণ্ডল নিমিষেই চুপসে যায়। সে মৃদু স্বরে বলে,
“অভ্যাস তো। ভাবি হওয়ার আগে আরিয়া আমার ক্লাসমেট। তুমি তো জানোই।”

“এখন সে তোর ভাবি হয়। মাইন্ড ইট।”

আশিক মাথা নাড়ায়। মিস্টার হাসান বিরক্তি নিয়ে বলেন,
“তুমি না যাও সেটা আমরা সামলো নিব। কিন্তু আমরা যাচ্ছি। তোমার মন-মর্জি সব জায়গাতে চালাতে চাইবে না।”

“বাবা…”

“তোমার কোনো কথা আমি শুনছি না। উনাদেরকে বিয়ের জন্য একপ্রকার জোড় করে রাজি করানো হয়েছে। উনারা তো চাননি, বড়ো মেয়ে রেখে ছোটো মেয়ের বিয়ে দিতে। কিন্তু তোমার কারণে আমরা রিকুয়েস্ট করে রাজি করিয়েছি।”

নাহিদ রেগে সেখান থেকে চলে যায়। মিস্টার হাসান এবার নিজ স্ত্রীর উপর রাগ ঝাড়েন। তিনি বলেন,
“ছেলেকে এতো আশকারা দিয়ে একগুঁয়ে বানিয়েছো। নিজের মনমতো কিছু না হলেই সব তছনছ করে ছাড়ে। এবার বাড়িতে বউ আনছো, স্বভাব বদলাতে হবে।”

এই বলে মিস্টার হাসানও খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যান। মিসেস নেহা হতাশ হয়ে বলেন,
“দুইজনের বিপরীতমুখী রাগ। কী করব আমি?”

আশিক খেতে খেতে বলে,
“রিল্যাক্স, খালামনি। কাল সকালেই দেখা যাবে। এখন তুমি খাও তো।”

এদিকে আর্শি আরিয়ার থেকে জানতে পেরেছে নাহিদের খালাতো ভাই আশিক, আরিয়ার ব্যাচমেট। দুজনে একই ভার্সিটিতে, একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। ফোর্থ ইয়ারে। আর্শি কৌশলে জানতে চেয়েছে নাহিদ আরিয়ার সাথে কেমন ব্যবহার করে। আরিয়া বলেছে,

“ভালোই। তার সাথে পরিচয় মাত্র দেড় মাসের। আমার পছন্দ-অপছন্দ জানতে চেয়েছে। ফ্রেন্ডশিপ করেছে। আমারও ভালোই লেগেছে।”

“তুই কি তাকে ভালোবেসে ফেলেছিস?”

আরিয়া লাজুক হেসে বলে,
“কিছুটা। অনেক কেয়ারিং উনি। আমার প্রতিটা কথার খেয়াল রাখেন।”

আর্শি এবার অনেকটা চিন্তায় পড়ে যায়। যদি সে কিছু বলে তাহলে আরিয়ার মন ভেঙে যাবে নাতো? কীভাবে বলবে সেটাই এখন ভাবনার বিষয়। আর্শিকে নিরব দেখে আরু ওর চোখের সামনে হাত নেড়ে বলে,

“কী হলো, আপু? কী ভাবছো?”

আর্শি জোরপূর্বক হেসে বলে,
“না। কিছু না। ঘুমা এখন। আমারও অনেক ঘুম পাচ্ছে।”

“আমারও ঘুম পাচ্ছে। আর শোনো, তুমি কিন্তু আবার ব্যালকনিতে গিয়ে বসে থেকো না। আকাশ ডাকছে মানে বৃষ্টি হতে পারে।”

আর্শি মিষ্টি হেসে আরিয়ার গালে হাত রেখে বলে,
“না যাব না। ঘুমা।”

এরপর দুই বোন ঘুমিয়ে পড়ে।

_______

সকাল থেকে রান্নার তোড়জোড় চলছে। আর্শি ও আরিয়া, তাদের মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করছে। একটু পর ওদের মামা-চাচারাও এসে পড়বে।

এদিকে সকাল ১০টায় ঘুম থেকে উঠে নাহিদ জানায় সেও যাবে। মিসেস নেহা এতে খুব খুশি হোন। তিনি বেনারসি বিক্রেতাকে ফোন করে জলদি শাড়িগুলো নিয়ে আসতে বলেন।

দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে নাহিদ তার বাবা-মা ও খালাতো ভাইকে নিয়ে আরিয়াদের বাড়িতে আসে। টুকটাক শরবত, নাস্তার পর নাহিদের মা আরিয়াকে কোন বেনারসিতে কেমন লাগে তা দেখার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়লে আর্শি নাহিদকে ছাদে আসতে বলে। নাহিদ বাধ্য হয়ে ছাদে যায়। আশিক আগামীকাল থেকে নাহিদকে ভীত দেখে আজকে আবার আরিয়ার বড়ো বোনের এক কথায় ছাদে যেতে দেখে সন্দেহ করতে শুরু করে। তাই চুপিচুপি সেও ছাদে যায়। সেখানে গিয়ে শুনতে পায়,,

আর্শি বলছে,
“তো, মিস্টার নাহিদ আহমেদ। কেমন আছেন?”

নাহিদ ঘাবড়ানো স্বরে বলে,
“তুমি কাউকে কিছু বলবে না। তোমার সাথে আমার রিলেশন ছিলো না। জাস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম।”

আর্শি হাসলো। ফের বলল,
“আপনার উদ্দেশ্যে কী বলুন তো? এমনতো না যে আপনি জানতেন না, আরিয়া আমার বোন। রেলস্টেশনে আমি পরিচয় করিয়েছিলাম। আমাকে রিফিউজ করতেই পারেন, নো ম্যাটার। কিন্তু হিউমিলেট করে আমারই ছোটো বোনকে বিয়ে করতে এসেছেন? চক্ষুলজ্জা বলেও কিছু হয়!”

নাহিদ অপ্রস্তুত হয়ে ইতস্তত করে বলে,
“দেখো, ভুলে যাও ওসব। বিয়ের মাত্র কিছুদিন বাকি। আমার ভুল হয়েছিল সেদিন। কারণ আমি তোমার বোনকে প্রথম থেকে ভালোবাসি। প্রথম দেখাতেই। তারপর তোমার প্রপোজাল! তখন আমার খুব রাগ ধরে গিয়েছিল।”

আর্শি তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“রাগ ধরলে যে কারও ক্যারেক্টারে প্রশ্ন তুলতে হয়, ক্যারেক্টার নিয়ে বাজে কথা বলতে হয়, সেটা আবার কেমন রাগ? আপনার ভাষ্যমতে আমার ক্যারেক্টার খারাপ। তাহলে আমারই ছোটো বোনকে বিয়ে করতে যেয়ে মনে হচ্ছে না যে ও ওর বোনের মতোই হতে পারে?”

“না। কারণ আমি ও-কে ফলো করেছি। আরিয়া কোনো ছেলেদের সাথে চলাফেরা করে না। তোমার মতো ইগোয়েস্টিক না।”

“ওহ আচ্ছা! আমার বোন কী, সেটা আমি জানি। আপনার জন্য ভালো হবে যে মেয়েদের জাজ করা বন্ধ করুন। নয়তো…”

এই বলে আর্শি ছাদ থেকে চলে আসতে পা বাড়ালে নাহিদ বলে,
“তুমি যদি বিয়ে ভাঙতে চাও তবে মান-সম্মান তোমাদেরই যাবে। বড়ো মেয়েকে রেখে ছোটো মেয়ের বিয়ে ঠিক করা! আবার বিয়ে ভাঙা! সমাজে কী বলবে? তখন তো সমাজই বলবে তোমাদের চরিত্রে সমস্যা!”

আর্শির মুখশ্রীতে কাঠিন্য ভর করলো। এক ঝটকায় ঘুরে নাহিদের গালে ক*ষে থা*প্পড় মা*রে আর বলে,
“মুখ সামলে কথা বলবি। তোর মতো লো মেন্টালিটির মানুষ যে নিজের মনেই মিথ্যা ধারণা নিয়ে বসে থাকে, সেটা কেউ বদলাতে পারবে না।”

আর্শি সেখান থেকে রেগে হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে। আশিক দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। আর্শির আগেই নেমে ফোন রেকর্ডটা সেভ করে নেয়। মনে মনে বলে,

“ভাইয়া এটা ঠিক করছে না। সত্যটা এখন আরিয়া জানতে না পারলে পরে জানতে পারলে ও ওর আপুকে ভুল বুঝবে। আর্শি আপু কি বলতে পারবে? আমি কি আরিয়াকে জানিয়ে দিব?”

ভাবনায় পড়ে গেলো আশিক।

চলবে ইন শা আল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে পর্ব-০৩

0

#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে

    #নুরুন্নাহার_তিথী
    #পর্ব_৩
    লঞ্চ থেকে নামার পর নাহিদ আর্শিকে ক্রশ করে সামনে এগুলে আর্শি নাহিদের সাথে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু নাম তো জানে না। তাই ডাকে,

    “এক্সকিউজ মি, মিস্টার।”

    নাহিদ আর্শির থেকে দুই হাত সমান দূরত্বে সামনে ছিল। সে ডাক শুনেও ভাব নিয়ে পেছনে ফিরলো না। আর্শি পুনরায় ডাকলো। এবার নাহিদ পিছু ফিরে না জানার ভান করে বলে,
    “আপনি বারবার কাকে ডাকছেন, মিস? আপনার কর্কশ কণ্ঠে আমার কানে পেইন হচ্ছে। আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ডাকছেন তো!”

    সহসা আর্শির মন পরিবর্তণ হয়ে গেলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
    “একজনকে থ্যাংকিউ বলার ছিল। থ্যাংকিউ।”

    “ওয়েলকাম, মিস!”

    আর্শি এবার নাহিদকে ক্রস করে এগিয়ে যেতে নিলে নাহিদ বলে,
    “আমি নাহিদ। বারবার ‘মিস্টার’ বলতে হবে না।”

    আর্শি নাহিদের উদ্দেশ্যে বিরক্তিমিশ্রিত হাসি দিয়ে বলে,
    “আপনাকে আর ডাকার কোনো প্রয়োজন হবে না। তাই নাম জানার ইচ্ছে নেই। গুড বায়।”

    আর্শি তার বন্ধুদেরকে ডেকে চলে যায়। কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে, ট্যুর শেষ হতে না হতেই সে নাহিদকে ভালোবেসে ফেলবে। আর্শি স্বভাবতো চঞ্চল ও এক্সট্রোভার্ট। একা একা ঘুরতে ভিষণ ভালোবাসে। তিন দিনের ট্যুরে সে পৌঁছানোর পরদিন সকালে একা একা জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে বিপদে পড়ে গিয়েছিল। সেখানে নেটওয়ার্কও পাচ্ছিলো না। সেইসাথে সা*পের ভয়তো আছেই। সুন্দরবনের গাছের সাথে সা*প যেন মিশে থাকে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কাঁদতে বসেছে আর্শি। প্রায় অনেকক্ষণ পেরিয়ে যায়। অতঃপর সেখানে সেভিয়রের মতো উদয় হয় নাহিদ। নাহিদ ছুটে এসে আর্শিকে টেনে তুলে রেগে চিৎকার করে বলে,

    “আর ইউ মে*ড? না বলে এসেছো কেন? তোমাকে সবাই দুই ঘণ্টা যাবত খুঁজছে।”

    আর্শি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
    “আ..আমি বুঝতে পারিনি। আমার ইচ্ছে ছিল একা একা এক্সপ্লোর করা।”

    “সাট আপ! এখানে নেটওয়ার্ক প্রবলেম এটাতো মা*থায় থাকার কথা। নাকি মাথার ভেতরে শুধু রা*গ ভর্তি! বুদ্ধি বলতে কিছু নেই!”

    আর্শি মাথা নিচু করে কাঁদছে। নাহিদ এরপর ধ*মকে বলে,
    “চলো! এখন নাটক করো না। আছে শুধু বড়ো বড়ো কথা।”

    আর্শি বিপরীতে একটা রা ও করে না। যতোই বলুক, দোষটা তো তার নিজেরই। বোঝা উচিত ছিল। তাই নাহিদের দেখানো পথ অনুসারে চলতে থাকে।

    সেই ঘটনার পর থেকে ট্যুর শেষ হওয়া পর্যন্ত এই সময়টুকুতেই আর্শি নিজের অজান্তেই নাহিদকে ভালোবেসে ফেলে। জীবনে প্রথমবার কেউ তার মনে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে এসেছে। ফেরার পথেও ওরা সবাই ফিরেছে একই সাথে। খুলনা থেকে ট্রেনে করে ঢাকা এসেছে। গিয়েছিল দুটো গ্রুপ কিন্তু ফিরেছে একটা গ্রুপ হয়ে। আর্শির দুই বান্ধবী ও নাহিদের দুই বন্ধুর মধ্যেও খানিক প্রেম প্রেম ভাব!

    কমলাপুর রেলস্টেশনে আর্শির ছোটোবোন আরিয়া ও বড়ো ভাই আবিদ এসেছে আর্শিকে রিসিভ করতে। রাত প্রায় নয়টার মতো বাজে। আরিয়া খুব শান্ত স্বভাবের। আর্শির ফ্রেন্ডদেরকে শুধু হ্যালো বলে কথা বাড়ায়নি। সম্পূর্ণ আর্শির বিপরীত নজর আসে নাহিদের কাছে। আরিয়া বারবার আর্শিকে সময়ের তাড়া দিচ্ছিলো, যা নাহিদের কাছে ভালো লাগে।

    এরপর দেখতে দেখতে তিন মাস পেরিয়ে যায়। আজ আর্শির বান্ধবী রুহির বিয়ে নাহিদের ফ্রেন্ড জিসানের সাথে। আর্শি অনেক এক্সসাইটেড কারণ সে আজ নাহিদকে প্রপোজ করবে বলে ভেবেছে। তিনমাসে ফেসবুকে, হোয়াটসএপে নাহিদের সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আর্শির প্রতি নাহিদের কনসার্ন ও কেয়ার দেখে আর্শি সত্যি সত্যি ভেবে বসেছে, নাহিদও তাকে ভালোবাসে। আর্শি আজ খুব সুন্দর করে সেঁজেছে। মায়ের একটা কাঞ্জিভরম শাড়ির সাথে বড়ো গোল্ডেন ঝুমকো, কুন্দনের চুড়ি ও টিকলি ম্যাচিং করে। আর্শি এমনিতেও সুন্দর। সিম্পল মেকআপের সাথে আর্শিকে দারুণ লাগছে। রুহি নিজে আর্শিকে দেখে বলে,

    “দেখ দোস্ত, মানুষ তোকেই না বউ ভাবে। যেভাবে সেঁজেছিস!”

    আর্শি হেসে বলে,
    “তুই পারিসও! বউতো তোকেই লাগবে। বউয়ের বান্ধবী হয়ে সাঁজবো না, তা কি হয়? বরের বন্ধুদের ভিমড়ি খাওয়াতে হবে না?”

    নিতু কথার মাঝে বলে উঠে,
    “কাকে? নাহিদ ভাইয়াকে? সে যেভাবে তোর কেয়ার করে, তাতে তার ভিমড়ি খাওয়া লাগবে না। সোজা অ্যা*টাক!”

    বলেই হেসে ওঠলো। কলির সাথে বাকিরাও তাল মেলায়। আর্শি লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে উঠে চলে যায়।

    ________

    বরপক্ষ সবে এসে পৌঁছালো। গেইট ধরা থেকে শুরু করে বরের জুতো চু*রি সবই করলো রুহির কাজিন ও বান্ধবীরক মিলে। আর্শি নাহিদকে কমিউনিটি সেন্টারের ছাদে নিয়ে আসে। সেখানে আগে থেকে আর্শির বন্ধু-বান্ধবীরা উপস্থিত ছিল। বিকেলের দিকে ছাদে বর-বধূর ছবি তোলার জন্য ডেকোরেশন করা আছে। আর্শি নাহিদকে বলে,

    “আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।”

    “হ্যাঁ বলো। জলদি বলো। জিসানরা গ্রুপ ছবি তুলবে।”

    “একটু অপেক্ষা করো। বলছি তো।”

    আর্শির ফ্রেন্ডরা ছাদের স্টেজের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। ওরা আড়াল থেকে আর্শিকে মোটিভেট করছে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আর্শি নাহিদকে বলেই ফেলে,

    “আই লাভ ইউ। অন দ্যাট ডে, ইউ সেভ মি, আই ওয়াজ স্টার্টেড টু ফিল সামথিং টুয়ার্ডস ইউ। আই নেভার থট, আই উডবি ইন লাভ উইথ এন আননওন পার্সোন। আই থিংক উই হ্যাভ অ্যা কানেকশন…..”

    আর্শির বলা শেষ হওয়ার আগেই নাহিদ তাকে থামিয়ে দেয়। বলে,

    “ওয়েট ওয়েট। হোয়াট! ইউ লাভ মি? রিয়েলি? এন্ড ইউ কল মি হেয়ার টু প্রপোজ? আর ইউ মে*ড?”

    আর্শি নিমিষেই থতমত খেয়ে যায়। নাহিদের এহেনো রিয়াকশন সে আশা করেনি। নাহিদ একটু থেমে আবার বলে,
    “তুমি ভাবলে কী করে, আমি তোমাকে ভালোবাসি? রিয়েলি?”

    আর্শি বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আর্শির থেকে জবাব না পেয়ে নাহিদ খানিক জোড়ে হেসে ওঠে। তারপর আর্শির চোখের দিকে চেয়ে বলে,

    “তুমি সুন্দর, এটাকে ডাউট নেই কিন্তু আমার টাইপের না। আমি তোমার স্বভাবের মেয়ে পছন্দ করি না। তুমি বললে না যে, অপিরিচিত ছেলের প্রতি ফিলিংস আসবে তা ভাবতেও পারোনি! তুমি যদি এক অপিরিচিত ছেলেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভালোবাসতে পারলে পরিচিত ছেলেদেরকে….!”

    নাহিদ কথাটা বলতেই আর্শির হাতের চ*ড় খেয়ে বসলো। রাগে কাঁপছে আর্শি। চোখের কোণ গড়িয়ে ঘৃণার অশ্রু ঝড়ছে। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
    “সাট ইউর মাউথ আপ! ইউর আর সো ডিজগাসটিং! ইউ হ্যাভ নো রাইট টু টক এবাউট মাই ক্যা*রেক্টার।”

    নাহিদ বাঁকা হেসে বলে,
    “দুইদিন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলাতেই ভেবে নিয়েছো, আমি তোমাকে ভালোবাসি! তার আবার ক্যা*রেক্টার!”

    আর্শি প্রচন্ড রেগে গিয়ে নাহিদের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরতেই আর্শির ফ্রেন্ডরা সবাই বের হয়ে আসে। নিতু, কলি, সারা, আফরা সবাই আর্শিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। রাকিব, সাগর, অভি, সোহানরা মিলে নাহিদকে সরিয়ে নিয়ে যায়। সোহান বলে,

    “দেখেন ভাই, আজকে আমাদের বান্ধবীর সাথে আপনার বন্ধুর বিয়ে। আমরা চাইলে এখানেই মে*রে আপনার মুখের নকশা বদল করে দিতে পারি! কিন্তু নিজেদের বান্ধবীর জন্য সেটা করছি না।”

    রাকিব বলে,
    “আরে সোহান, তুই এই ব্যাটাকে এত সম্মান দিয়ে কথা বলছিস কেন? এই ব্যাটা সম্মানের যোগ্য না। তোর যেহেতু আর্শিকে পছন্দ না, তাহলে পোলাইটলি না করে দিতি। ওর ক্যারেক্টারে প্রশ্ন তুললি কেন?”

    রাকিব রেগে গেছে প্রচুর। সে নাহিদের দিকে তেড়েই যাচ্ছিলো, সাগর আটকে রেখেছে। অভি বলে,
    “আপনি কতটুকু জানেন আর্শির ব্যাপারে? আপনার কি মনে হয় ওর ছেলে ফ্রেন্ড আছে বলেই ও খারাপ? আমাদের মধ্যে ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিটের’ সম্পর্ক না। আমাদের এই ফ্রেন্ড গ্রুপটাতে ইতি আর সামির ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কিন্তু বাকিদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়া কোনো খারাপ সম্পর্ক নেই। আপনার নিজের কি ভার্সিটিতে মেয়ে ফ্রেন্ড ছিল না?”

    নাহিদ কড়া কণ্ঠে বলে,
    “ছিল কিন্তু তোমাদের মতো কয়েকজন ছেলে-মেয়েরা মিলে ট্যুরে যাইনি। ট্যুরের নামে বাহিরে আউটিং এসব!”

    সোহান বলে,
    “এবার কিন্তু বেশি বলতেছেন? আপনি যে কয়দিন আমাদের সাথে ট্যুরে ছিলেন, আমাদের দেখেছেন? আর্শি, কলিদের হাতটা পর্যন্ত ধরতে? তাহলে কীভাবে বলেন এসব? আর্শিকে পছন্দ না, সরাসরি পোলাইটলি বলে দিবেন। না বলার অধিকার আপনার আছে কিন্তু ক্যারেক্টারে প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই।”

    “তোমাদের সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নেই আমার। নিজেদের আরেক বান্ধবীর চোখে পানি দেখতে না চাইলে আমার সাথে লাগতে এসো না।”

    এই বলে নাহিদ ছাদ থেকে নেমে যায়। রাকিব নিজেকে সাগরের থেকে ছাড়িয়ে আর্শির কাছে গিয়ে ও-কে ক*ষি*য়ে একটা থাপ্পড় দেয়। অতঃপর বলে,

    “তুই সবসময় বলতি না? ছেলেদের তোর বিশ্বাস হয় না। তাই এসব প্রেম-ভালোবাসার ভিতরে তুই নাই। তাহলে এই লো মেন্টালিটির নাহিদকে কীভাবে ভালোবেসে ফেললি? আদিব ভাই জানলে এই নাহিদকে টু-করো টু*করো করে ফেলবে।”

    কলি ভয় পেয়ে বলে,
    “এটা করিস না ভাই। আদিব জানলে সত্যি ভীষণ ঝামেলা হয়ে যাবে।”

    সাগর এতক্ষণ পর বলে,
    “আমার মনে হয়, এসব বিষয় নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। অবশ্য কথা বলারও কিছু নেই। যার চিন্তা-ধারা যেমন। আমরা চাইলেও বদলাতে পারব না। নাহিদ ভাই যেমনটা বলেছেন, তেমন যে দুনিয়াতে নেই তেমনটাও তো না। অহরহ হচ্ছে। উনার উচিত হয়নি আর্শির ক্যারেক্টারে প্রশ্ন তোলা। কোনো মেয়ের ক্যারেক্টারে না জেনে প্রশ্ন তোলা উচিত না।”

    “তুই চুপ কর। এরে উচিত জবাব দিতে তো হবেই। রুহির বিয়েটা মিটে যাক শুধু…”

    রাকিবকে থামিয়ে আর্শি বলে,
    “না। তোরা কিছু করবি না। এই বিষয়টা এখানেই ক্লোজ। এটা নিয়ে একটা শব্দও না।”

    আফরাও তাতে তাল মেলায়। রাকিব আবারও কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু সোহান, অভি, সাগর ও-কে বলতে দেয় না।
    এরপর ওরা স্বাভাবিক হয়ে নিচে নেমে যায়। রুহির বিয়েটাও আর কোনো ঝামেলা ছাড়াই মিটে যায়।

    ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড**

    পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতেই ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে। আর্শি আরিয়াকে উঠিয়ে নামাজ পড়ে আবার ঘুমায়।

    সকালের নাস্তার পর আর্শি ওর মাকে জিজ্ঞাসা করো,
    “মা, আরুর বিয়ের অনুষ্ঠানতো সাতদিন পর থেকে শুরু হবে?”

    “হ্যাঁ। একদিন মেহেদী ফাংশন, তার পরদিন হলুদ। তারপর বিয়ে।”

    “আরিয়ার জন্য সম্বন্ধ কে এনেছিল?”

    “ঘটক এনেছিল। ছেলের ছবি দেখে আরিয়া বলেছিল, নাহিদকে নাকি আগেও একবার দেখেছে। সুন্দরবন ট্যুরে নাকি এই ছেলেই তোকে বাঁচিয়েছিল। খুব ভালো ছেলে। পরিবারও খুব ভালো।”

    মিসেস আশালতা কথাগুলো বলতে বলতে মেয়ের দিকে তাকায়। আর্শি মুখে কৃতিম হাসি ফুটিয়ে বলে,
    “আমি একটু আসছি।”

    আর্শি উঠে রুমে চলে আসে। বিয়ের মাত্র কিছুদিন বাকি, এখন কী বলবে সবাইকে?

    চলবে ইন শা আল্লাহ,

শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে পর্ব-০২

0

#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
আর্শি ও আরিয়াকে ওদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে নাহিদ আবার গাড়ি স্টার্ট করছিল তখন আরিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে,
“আপনি গাড়ি স্টার্ট করছেন কেন? বাড়ির ভিতরে যাবেন না?”

নাহিদ আর্শিকে একবার দেখে আরিয়ার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,
“তোমাকে বলেছিলাম তো আমার একটা কাজ আছে। আই অ্যাম অলরেডি লেইট।”

আরিয়া মন খারাপ করে বলে,
“ওহ আচ্ছা। তাহলে আর কী! যান।”

নাহিদ মুচকি হেসে বলে,
“দ্যাটস হোয়াই আই লাভ ইউ। এখন রেস্ট করো গিয়ে। বায়।”

আরিয়া মৃদু হাসলো। অতঃপর নাহিদ গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলো। পুরো বিষয়টা আর্শি দাঁড়িয়ে থেকেই দেখলো। যখন নাহিদ বললো, ‘দ্যাটস হোয়াই আই লাভ ইউ।’ তখন আর্শির মনে হলো নাহিদ কথাটা আর্শিকে নিচু দেখাতে বলেছে। কিন্তু আরিয়ার মুখের খুশির লাবণ্য দেখে আর্শি ভাবতে শুরু করেছে, তার ভুলটা ঠিক কোথায় ছিল? এই প্রশ্নের জবাব অন্তত সে ডিজার্ভ করে।
ভাবনার সুতো ছিঁ*ড়ে আরিয়ার ডাকে।

“কী হলো আপু? কি ভাবছো? ভেতরে চলো। মা-বাবা, ভাইয়া, সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

আর্শি কৃতিম হাসে। দুই বোন বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই যেন এক আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আর্শিকে নিয়ে নানান তোড়জোড় শুরু হলো। এরমধ্যে আরিয়া রাগ করে বলল,

“দেখে মনে হচ্ছে সাত দিন পর আপুর বিয়ে, আর আপু ঘর ছেড়ে যাচ্ছে!”

মিসেস আশালতা ও মিস্টার রিয়াজউদ্দীন, ছোটো মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেললেন। মিসেস আশালতা বললেন,

“সাত দিন পর তুই তো ঘর ছেড়ে যাবি, আর আর্শি তো দেশ ছেড়ে যাবে আবার। আমাদের ছাড়া থাকা তো শিখে গেছে। এখন তো…”

বলতে বলতেই মিসেস আশালতার চোখ ভরে এলো, কণ্ঠ ধরে এলো। আরিয়া ও আর্শি উঠে মায়ের কাছে যায়। আর্শি মায়ের কাঁধে মাথা এলিয়ে মলিন কণ্ঠে বলে,

“প্লিজ মা, কেঁদো না। আর এক বছর পর তো আমি চলে আসব।”

আরিয়াও মায়ের আরেক কাঁধে মাথা এলিয়ে বলে,
“আমি তো মজা করে বলেছি। তুমি কষ্ট পেয়ো না তো। তুমি যদি এখনি এতো কান্না করো তাহলে আমার ও আপুর বিয়েতে তোমার চোখের পানি কম পড়ে যাবে না?”

মিসেস আশালতা কান্নারত অবস্থায় হেসে ফেলেন। ছোটো মেয়ের হাতে মৃদু চ**ড় মে**রে বলেন,
“ফা*জিল মেয়ে, সব জায়গায় তার হাসি-ঠাট্টা করতে হয়।”

“ওমা! আমি আবার কই হাসি-ঠাট্টা করি? তোমার বড়ো মেয়ের কাছে তো এসব বিষয়ে আমি চু*নোপুঁটি। আমি হলাম শান্তশিষ্ট, লাজুক স্বভাবের মেয়ে।”

“হয়েছে হয়েছে থাম। খেয়ে নাও এখন।

________

গভীর রাত। অন্ধকার পুরো শহর নিস্তব্ধ। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ হচ্ছে। আর্শির রুমের শখের দেয়াল ঘড়িটা কিছুক্ষণ আগেই জানান দিলো তিনটা বেজেছে। প্রায় আধঘণ্টা যাবত ব্যালকনির ফ্লোরে বসে এক দৃষ্টিতে রাতের আকাশ দেখছে। মাঝেসাঝে আকাশে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। এখন তো বৃষ্টির কোনো নির্দিষ্ট রুটিন নেই। শ্রাবণ মাস যে। হঠাৎই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। তুমুল বৃষ্টি। ব্যালকনির গ্রিল গ*লিয়ে বৃষ্টির তীব্র ছাঁট ব্যালকনির ফ্লোর অবধি ভিজিয়ে দিচ্ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে আর্শিকেও। কিন্তু সবসময়ের মতো বৃষ্টি দেখে ছুটে ঘরে চলে যাওয়া মেয়েটা আজ এক চুলও নড়ছে না। ঠায় বসে আছে নিজের জায়গায়। যেন ফ্লোর ও আর্শির মধ্যে তীব্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করছে। আর্শি এখনও নিষ্পলক অম্বরপানে চেয়ে। তার নিষ্প্রাণ আঁখিযুগল তার রবের কাছে আর্জি জানাচ্ছে ‘আমার প্রাণোচ্ছলতা কেন হারিয়ে গেল?’। বৃষ্টিতে ও নেত্রজলে অক্ষিপল্লব ভিজে ভারী হয়ে আসছে। বৃষ্টিতে পুরোপুরি ভিজে এখন শীতে থরথর করে কাঁপছে আর্শি।

তীব্র বৃষ্টির শব্দ ও ঠান্ডা লাগার কারণে আরিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। জলদি করে ফ্যান বন্ধ করে ব্যালকনির দিকে চেয়ে দেখে হাট করে দরজা খোলা। পাশে তার বোন নেই। আরিয়া প্রথমে বুঝতে পারলো না যে, তার বোন কোথায় গেছে। রুমের দরজা তো লাগানো। ভাবলো হয়তো বাথরুমে গেছে। কিন্তু তার মস্তিষ্কে এটা কোনো ভাবেই আসলো না যে তার বোন ব্যালকনিতে থাকতে পারে। আরিয়া উঠে বাথরুমের দিকে নজর গেলে দেখে বাথরুমের লাইট জ্বালানো থাকলে নিচ দিয়ে সামান্য রশ্নি বুঝা যায়, কিন্তু তা বুঝা যাচ্ছে না। তাহলে গেলো কোথায়? চিন্তায় পড়ে গেলো আরিয়া। সে এবার রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেখলো রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ মানে বাহিরে যায়নি। কৌতুহলের বশে ব্যালকনিতে উুঁকি দিয়ে দেখে একদম ভিজে চুবচুবা হয়ে ব্যকলকনির ফ্লোরে বসে আছে আর্শি! আঁতকে উঠে আরিয়া। দ্রুত করে বোনের কাছে গিয়ে জোড় করে উঠিয়ে টেনে রুমে নিয়ে আসে। ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে গামছা নিয়ে নিজেই বোনের চুল ও হাত, ঘাড় মুছতে মুছতে বলে,

“তুমি কি পা*গল, আপু? এই গভীর রাতে বৃষ্টিতে ভিজছিলে?”

জবাব দেয় না আর্শি। আরিয়া ফের বলে,
“তুমি তো বৃষ্টি পছন্দ করো না। তোমার শরীরে বৃষ্টির এক ফোঁটা পড়লেও তোমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সেই তুমি বৃষ্টিতে ভিজছিলে? কী হয়েছে তোমার?”

“কিছু না।”

এই বলে আর্শি জামা-কাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। প্রায় পনেরো মিনিট পর শাওয়ার নিয়ে বের হয়। বের হতেই আরিয়া তাকে চেপে ধরে,

“তুমি যাকে ভালোবাসতে, সেই লোকটা তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি এক মাসের ব্যাবধানে ইটালি চলে গেলে। তুমি চুপচাপও হয়ে গিয়েছিলে অনেক। কে ছিল লোকটা? তখন কতোবার তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, বলোনি। আজ তো বলো। কে ছিল লোকটা? যার জন্য তুমি এখনও কষ্ট পাও।”

“যেই ছিল সে আর নেই। সে এখন অন্যকাউকে ভালোবাসে।”

“নাম কি তার?”

“তার নাম জানার দরকার নেই। আমি তাকে আমার জীবনে ফিরে পেতেও চাই না। কোনোভাবেই না।”

আরিয়া কিয়ৎ মৌন রইলো। আর্শি ব্যাগ থেকে দুইটা প্যা*রাসি*টেমল বের করে খেয়ে নিলো। আরিয়া ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তাহলে ভিজছিলে কেন?”

আর্শি তাচ্ছিল্য হেসে জবাবে বলল,
“কেন? বৃষ্টিতে ভেজার জন্য কি ওই লোকটাকে ফিরে পেতে চাওয়ার কোনো কানেকশন আছে? আমি তো তা মনে করি না। সে যদি আমার পায়ের তলে ফুলের গালিচাও বিছিয়ে দেয়, আমি তাও তার জীবনে ফিরে যেতে চাইব না। আমার সেল্ফ রেসপেক্ট আছে অন্তত। সে শুধু আমার মনকে হার্ট করেনি, আমার সেল্ফ রেসপেক্টেও আ*ঘা*ত করেছে।”

“আপু…”

“ঘুমা, আরু। কথা বলিস না বেশি। আর সকালে যেন মা এই বিষয়ে না জানে। আব্বু-আম্মু, ভাইয়া কেউ জানেনা আমি কাউকে ভালোবাসতাম। আমি জানাতেও চাই না।”

কথাটা বলেই আর্শি বিছানার সাইডে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আরিয়াও লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লো।

পুরোনো স্মৃতিগুচ্ছ আর্শির মনের দরজায় ভেসে উঠতে শুরু করলো। নাহিদের সাথে আর্শির পরিচয় সুন্দরবন ট্যুরে। আর্শির বন্ধুদের সাথে অনার্সের ফেয়ারওয়েল ট্যুর ছিল সুন্দরবন। সেখানেই নাহিদ তার দুই বন্ধুকে নিয়ে ট্রিপে গিয়েছিল।

ফ্ল্যাশব্যাক,,
সুন্দরবনের জন্য খুলনা লঞ্চঘাট থেকে ছোটো লঞ্চে আর্শিরা উঠেছিল সেটাতে নাহিদরাও উঠেছিল। সেখানেই পরিচয়। লঞ্চ ছাড়ার পর আর্শি খোলা চুলে লঞ্চের সামনে ডেগে হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তখনি নাহিদের সাথে কথা শুরু। নাহিদ নিজ থেকে এসে বলে,

“আপনি পড়ে যেতে পারেন, মিস। মেয়েদের ব্যালেন্স কম হয়।”

আর্শি ভ্রুকুটি করে ঘুরে তাকিয়ে বলে,
“সরি!”

“বললাম, আপনি পড়ে যেতে পারেন। ওখান থেকে চলে আসুন।”

কথাটা আর্শির পছন্দ হয়নি। তার চলে আসতে ইচ্ছে করলেও সে জেদ করে আরও কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর তার এক ফ্রেন্ড এসে ডেকে নিয়ে যায়। লঞ্চের ছাদে উঠার জন্য খাড়া, সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে আর্শি তার লম্বার গোল জামার সাথে পা বেজে পড়ে যেতে নিলে নিচ থেকে নাহিদ আর্শিকে ধরে ফেলে। তারপর বলে,,

“বলেছিলাম না? মেয়েদের ব্যালেন্স কম! পড়ে গেলেন তো। একটু কেয়ারফুল হোন।”

আর্শি তখন ঘাবড়ে ছিল। তাই নাহিদকে প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারেনি। আর্শির এক বান্ধবী এসে নাহিদকে ধন্যবাদ জানিয়ে ও-কে নিয়ে যায়। আর্শিদের গ্রুপে আর্শি সহ আট জন মেয়ে আর ৬ জন ছেলে। তারমধ্যে আবার একটা কাপল। যারা রিসেন্টলি বিয়ে করেছে। আর্শিকে ওর বান্ধবী নিতু বলে,

“দোস্ত, ছেলেটা কিন্তু খারাপ না। তুই যে আমাদেরকে এসে বলেছিলি ছেলেটা রুড। তেমন কিন্তু না। তুই ভাব শুধু, তুই যদি পড়ে যেতিস?”

আরেক বান্ধবী রুহি বলে,
“ঠিক বলেছিস নিতু। যদি পড়ে যেত তবে কুমিড় বুঝি ও-কে ছেড়ে দিতো? তারউপর সাঁতার জানেনা।”

আরেকজন বান্ধবী কলি বলে,
“দিতো দিতো। কুমিড়ের পেটে একটা পরী হজম হতো না!”

আর্শি কপট রেগে কলিকে দুই ঘা বসিয়ে দেয়। বন্ধুদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়। আর্শি ভাবতে থাকে সে ছেলেটাকে সরি বলবে ও ধন্যবাদ জানাবে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে পর্ব-০১

0

#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#সূচনা_পর্ব

এয়ারপোর্টের ডিপার্চার গেইটের কাছে নিজের ছেড়ে যাওয়া অতীতকে দেখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো আর্শি। কিছুক্ষণ আগে,,

“হ্যালো, মা। আমি এয়ারপোর্টে ওয়েট করছি। তুমি তো বলেছিলে আরিয়া ওর উডবির সাথে এসে আমাকে রিসিভ করবে। দ্যান হোয়ার আর দে?”

মিসেস আশালতা উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালেন,
“কী বলছিস! আরিয়া তো প্রায় আধঘণ্টা আগে আমাকে জানালো ওরা পৌঁছে গেছে। দাঁড়া কল করে দেখি। তুই ডিপার্চার এড়িয়াতেই থাক। আমি ওদের ওখানেই যেতে বলছি।”
“আচ্ছা।”

বলে আর্শি ফোন কেটে আশেপাশে আবারও নজর বুলাতে শুরু করলো। প্রায় দশ মিনিট যাবত লাগেজ নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। এখন তো রীতিমতো মাথা চক্কর দিচ্ছে। এক জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা যে! অস্বস্তি হয়। তাই খানিক সাইডে গিয়ে লাগাজটাকে কাত করে তাতেই বসলো। বসে বসে আশেপাশের লোকজনের ভীড়ে নিজের বোনকে খুঁজতে লাগলো।

অপরদিকে আরিয়াকে ওর উডবি নাহিদ এয়ারপোর্টের ভেতরের স্টল গুলো থেকে চকলেট কিনে দিয়েছে। আরিয়া চকলেট খেতে খেতে বলছে,

“আপনার যে কখন কী হয়! জাস্ট বলেছিলাম, আপু নিশ্চয়ই আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবে। তাতেই আপনি আমাকে জোড় করে চকলেট কিনে দিতে নিয়ে আসলেন! আবার প্যাকেট খুলে বলছেন, খাও! স্ট্রেঞ্জ আপনি।”

“তুমি তো চকলেট ভালোবাসো। তাহলে সমস্যা কোথায়? খাও না।”

নাহিদের কথার পিঠে আরিয়া প্রত্যুত্তর করবে তার আগেই আরিয়ার ফোন বেজে উঠলো। আরিয়া চকলেটের প্যাকেটটা নাহিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফোন বের করে দেখে তার মা কল করেছে। নিশ্চয়ই মেয়ের খবর জানতে। সে ফোন রিসিভ করে,
“হ্যাঁ, মা। বলো।”

“কই তোরা?”

“এইতো এয়ারপোর্টেই।”

“তাহলে আর্শিকে রিসিভ করছিস না কেন? মেয়েটা আমার কতক্ষণ ধরে তোদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।”

আরিয়া হকচকাল। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“আপু চলেও এসেছে! আচ্ছা রাখো রাখো। আমরা এখনি যাচ্ছি।”

কল কেটে হড়বড়িয়ে নাহিদের বাম হাত চেপে ধরে ছুটতে শুরু করলো আরিয়া। নাহিদ পেছন পেছন তাল মিলিয়ে ছুটতে ছুটতে বলতে থাকে,
“আরে এভাবে ছুটছো কেন? রিলাক্স! তোমার বোন বাচ্চা না যে হারিয়ে যাবে!”

আরিয়া ঘাড় সামান্য পেছনের দিকে ঘুরিয়ে জবাবে বলে,
“আমি জানি আমার বোন বাচ্চা না। বাচ্চা হলে নিশ্চয়ই একটা বছর ভিনদেশে একা একা কাটিয়ে দিতে পারতো না! আমরা এখানে এসেছি কেন? আপুকে রিসিভ করতেই, তাই না? তাহলে এখানে এসে চকলেট খাওয়ার মানে তো দেখছি না আমি।”

কথা বলতে বলতে আরিয়া কিন্তু দাঁড়ায়নি। যার বদৌলতে সামনের দিকে এক ব্যাক্তির সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে বেঁচে গেছে। লোকটিকে সরি বলে আবার ছুটতে থাকে। নাহিদ আরিয়ার জবাব শুনে খানিক ইতস্তত বোধ করলো। সে আশা করেনি আরিয়া তাকে এভাবে পালটা জবাব দিবে। আরিয়া শান্তশিষ্ট, কম কথা বলে বলেই তো তাকে পছন্দ করেছে। নয়তো…!
নাহিদ কিছুটা সংকোচ করে বলে,

“আরিয়া, আমার মনে হয় তোমার বোন এতক্ষণে হয়তো চলে গেছে। প্লেন ল্যান্ড করেছে প্রায় অনেক্ষণ তো হলো। চলো আমরা ফিরে যাই। তোমাকে ড্রপ করে আমার একটা কাজ আছে।”

আরিয়া এবার থামলো। নাহিদের হাত ছেড়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। অতঃপর সন্দিহান হয়ে বলল,
“প্লেন অনেকক্ষণ আগে ল্যান্ড করেছে তা আপনি জানতেন! তারপরও আপনি আমাকে নিয়ে চকলেট কিনতে এসেছেন? আবার এখন বলছেন, বাড়ি ফিরে যাই! আমাকে ড্রপ করে আপনার একটা কাজ আছে! তাহলে গতকাল রাতে আপনাকে যখন বললাম, আপনি আমার সাথে এয়ারপোর্টে আপুকে রিসিভ করতে যাবেন, তখন সরাসরি কেন না করলেন না? আপনি না করলে আমি ভাইয়াকে রাজি করিয়ে নিয়ে আসতাম নয়তো আমি একাই আসতাম। আমি তো গতকাল আপনাকে শুধু এটা বলেছিলাম যে আমি আপুকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। আপু এখনো আপনার ছবি দেখেনি এমনকি নামও শুনিনি। আমি সরাসরি আপুর সাথে আপনাকে এয়ারপোর্টে মিট করাতে চেয়েছিলাম।”

নাহিদ ভেতরে ভেতরে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। কিন্তু বাহ্যিকভাবে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে নিজের যুক্তি রাখতে বলে,
“আমি চাইনি তুমি হার্ট হও। তাই বলিনি। লেট ইট বি। লেটস গো। সি মাইট বি ওয়েটিং।”

আরিয়া কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। চুপচাপ আগে আগে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। কিন্তু নাহিদ চিন্তায় পড়ে গেছে। গতকাল রাতে আরিয়া তাকে এয়ারপোর্টে যাওয়ার কথা বলার পর সে চেয়েও না করতে পারেনি, এজন্য এই প্ল্যান করেছিল। সে জানে আরিয়ার বড়ো বোন আর্শি ভিষণ অধৈর্য মেয়ে। এতো পথ জার্নি করে এসে এতো সময় অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকবে না। যেভাবেই হোক আর্শির সাথে দেখা হওয়াটা আটকাতে চাচ্ছিলো সে। কিন্তু এখন আরিয়ার মনে সন্দেহ ঢুকে গেছে। তাই বাধ্য হয়েই দেখা করতে হবে। মনে মনে খুব করে চাইছে যেন আর্শি তাকে দেখে নেগেটিভ রিয়াকশন না দেয়।

ডিপার্চার এড়িয়াতে পৌঁছাতেই আরিয়া সামনে তার বোনকে লাগেজ কাত করে বসে থাকতে দেখলো। খুশিতে তার আঁখিদ্বয় যেন ডগমগিয়ে ওঠলো। ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে জড়িয়ে ধরলো আর্শিকে। আচমকা জড়িয়ে ধরাতে আর্শি ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। আঁতকে উঠে সে। অতঃপর বুঝতে পেরে আরিয়ার পিঠে একটা কি*ল বসিয়ে দিয়ে বলে,

“শ*য়-তা*ন! আমি ভয়ে পেয়ে গেছিলাম জাস্ট।”

আরিয়া সরে এসে খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলে,
“ভয় পেতেই তো করেছি। ওয়েলকাম ব্যাক, আপু।”

“হুহ্! চল এবার। অনেক্ষণ ধরে বসে আছি। শরীর খারাপ লাগছে।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাবো তো। আগে কারও সাথে তোমাকে ইন্ট্রোডিউস তো করাই।”

আর্শি উঠে দাঁড়িয়ে লাগেজ সোজা করে সামনে তাকাতেই থমকে যায়। প্রতিক্রিয়া দেখানোর মতো শক্তিও যেন সে পাচ্ছে না। ল্যাগেজে ভর দিয়ে ব্যালেন্স সামলে নির্নিমেষ সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখছে। এদিকে আরিয়া পরিচয় করায়।

“আপু, মিট, মিস্টার নাহিদ আহমেদ। আমার উডবি হাজবেন্ড।”

আরিয়ার প্রথমোক্ত কথাগুলো ঠিকমতো খেয়াল না করলেও শেষোক্ত ‘আমার উডবি হাজবেন্ড’ বাক্যটা যেন তার কর্ণকুহর হয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করতেই সব সমীকরণ ঘেটে দিয়েছে। মস্তিষ্কের নিউরণ গুলোর মধ্যে যেন এক অদৃশ্য প্যাঁচ লেগে গেছে। ক্রমশ শরীরের ভেতরকার তাপমাত্রা বাড়ছে এবং হুট করে শরীরের তাপমাত্রা কমতে শুরু করলো। যার দরুণ হুট করেই মাথা ঘুরে উঠলো। আরিয়া নাহিদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বোনের দিকে চাইতেই ভয় পেয়ে যায়। আর্শি লাগেজ ধরে হাঁটু ভাজ করে বসে পড়েছে। আরিয়া উদগ্রীব হয়ে ওঠলো। বোনের সন্নিকটে বসে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে প্রশ্ন ছুঁ*ড়লো,

“কী হলো তোমার? শরীর বেশি খারাপ করছে? প্রেশার ফল করলো মনে হচ্ছে।”

তারপর নাহিদের দিকে চেয়ে ঘাবড়ানো কণ্ঠে বলল,
“জলদি একটা চকলেট দিন। আপুর প্রেশার ফল করেছে। এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা যে করছিল।”

নাহিদ ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতে চকলেট এগিয়ে দিলো। আরিয়া ছোঁ মে*রে চকলেটটা নিয়ে আর্শিকে জোড় করে খাওয়ালো। এয়ারপোর্টের মধ্যে এমন অবস্থায় চার-পাঁচজন মহিলা-পুরুষ এগিয়ে এসে ‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইছে। উনাদেরকে নাহিদ হ্যান্ডেল করে নেয়। মিনিট দুয়েক পেরোনোর পর আরিয়া সতর্ক স্বরে বলে,

“আপুকে খোলা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। নাহিদ, আপনি আপুর লাগেজ নিয়ে আসুন। আমি আপুকে ধরে নিয়ে বের হচ্ছি।”

নাহিদ প্রত্যুত্তর না করে তাই করলো। আর্শি সেন্স হারায়নি কিন্তু একা একা চলাচল করতে পারছে না। আরিয়ার সাহায্যে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় এসে বেঞ্চে বসলো। এক্ষেত্রে এয়ারপোর্টের নিরাপত্তারক্ষীরা খুব সাহায্য করেছে।

কিছুক্ষণ পর আর্শি সুস্থ বোধ করলে মৃদু স্বরে বলে,
“বাড়ি চল, আরু।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ চলো। সরি আপু। আমি ইচ্ছে করে লেট করিনি। নাহিদ আমাকে বলেছিল প্লেন ল্যান্ড করতে সময় বাকি। তাই আমাকে চকলেট কিনে দিতে নিয়ে গেছিলো। সো সরি, আপু।”

আর্শি এক পলক নাহিদের চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে আরিয়াকে কৃতিম হাসি দেখায়।

চলবে ইন শা আল্লাহ

দুই পথের পথিক পর্ব-২৭ এবং শেষ পর্ব

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২৭ (অন্তিম পর্ব)
#বর্ষা
জীবনের পয়গম্বর আমরা নিজেরাই।যখন তখন জীবনে নতুন মোড় আসে।আসে নতুন মানুষেরা।তবে ভিন্ন পথেক পথিকেরা প্রতিবারই কেমন করে যেন একসাথে জড়িয়ে যায়।নাহিন যে ছিলো সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ী হঠাৎ করে আসলো বাংলাদেশে সঙ্গ ধরলো এক অজানা রমনীর।বেয়ারা,রাগী,ব্যস্ত ছেলেটা বদলে গেলো।না,না থমকে গেল একজনের প্রতি।সারা দুনিয়ার জন্য ব্যস্ত ছেলেটা প্রিয়তমার জন্য সময় বের করলো অফুরন্ত।ভালোবেসে সঙ্গী হলো প্রতিবাদের তার প্রতিশোধের!

কুহেলিকা দেশে ফিরলো বাবার খোঁজ পেয়ে।বুদ্ধি আটলো প্রতিশোধের।তবে বাবার হাতে দায়িত্ব দিয়ে ফিরে তাকালো পেছনে নাহিনের খোঁজে।প্রেমিক পুরুষের কষ্টে হৃদয়ে করলো ব্যথা উপলব্ধি।প্রিয়তমের সঙ্গ দিলো,প্রমাণ করলো জোগাড় জ্যোতির আত্মহত্যার পেছনে দায়ী খুনীদের গুণাহের!তবে প্রমাণ ছিলো অতি নগণ্য।তাইতো পথ বদলিয়ে অন্য পথে হাটলো। একে একে শাস্তি দিলো অপরাধীদের।

সিনানের হত্যাকারী আর কেউ ছিলো না বরং সাফিন নিজেই ছিলো। পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত সে।দুই দুইটা মানসিক সমস্যায় এখন সে পাগলখানায় আটকা। শুধুমাত্র মুখ দিয়ে সিনান সিনান করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না সে।সাফিনের দ্বি-সত্ত্বা খুন করেছে তার‌ নিজ পুত্রকে।কুহেলিকা এই সত্যি জানতে
পেরেছে সাফিনের ডক্টর মায়রা থেকে।ডক্টর মায়রাই পাগল খানায় দেখভাল করছে সাফিনের।সাফিনের নিজের স্বীকারোক্তি এটা।তবে কুহেলিকার মনে সন্দেহের বীজ নিভে যায় না!

ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা জুড়ে দিয়েছে নাহিন-কুহেলিকার নাম।যাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায় তারাই তো প্রকৃত সুখটা পায়।তবে এই পূর্ণতা আদৌ বিদ্যমান থাকবে কিনা তা তো ভবিষ্যৎ বলবে!জুনায়েদ হয়তো স্ত্রীকে ভালোবাসেনি তবে মেয়েকে তো ভালোবেসেছিলো তবে পায়নি তার পান্হা। আদরের ছোট্ট মেয়ের তার প্রতি ঘৃণার কারণে আর বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলাতেই তো নিজের জীবনের বলিদান দিয়ে দিলো শয়তানের নামে।

সুইসাইড করা তো শয়তানের কাজ।আজ জুনায়েদ তো শয়তানি কাজ করতোই।আর তার মাঝে সে সবচেয়ে বড় গুণাহ আল্লাহর দেওয়া জীবনকে ত্যাগ করলো!এইটা তো শয়তানের কাজ আর সে তো তাহলে শয়তানের নামেই কাজ করলো।

রাইসা-তাকদির ভালো আছে।রামায়সা ভালো বাবাই পেয়েছে।জীবনের নতুন মানে পেয়েছে রাইসা,রামায়সা।আর তাকদির?সে তো এক রমনীর ছেড়ে যাওয়া পুরুষ। নিজের ভালোবাসা হারিয়েছে।তবে নতুন করে ভালোবেসে ঠকে যায়নি। সন্তানের ভালোবাসা পাচ্ছে। রাইসার মতো যত্নশীল স্ত্রী পেয়েছে।জীবনে সুখী থাকতে গেলে আর কি লাগে!

নাহিন-কুহেলিকার জীবনের বদ-লোকেরা তাদের শাস্তি পেয়েছে। জয়নুবা বেগম আর কাসেম মির্জা‌ ছোট ছেলে জাহিদের পরিবার বোঝা হয়ে গিয়েছিলো।তারা এখন বৃদ্ধাশ্রমে থাকছে।হায়!যেই সহায় সম্পত্তির খাতিরে কোহিনুর চৌধুরী,তানজিল চৌধুরীকে ধোঁকা দিয়েছে,সেই সহায় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী যাদের বানাতে চেয়েছে তারাই আজ তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে।সত্যিই জীবন বড্ড বৈচিত্র্যময়!

রাব্বি মুনতাসির হার্ট অ্যাটাকের পাঁচদিন পর নাহিনের দেখা চেয়েছে।নাহিনের হাত ধরে ইচ্ছে মতো কেঁদেছে। জীবনের মানে সে বুঝেছে।সে নাকি আজরাইলের দেখা পেয়েছে!রাব্বি মুনতাসির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। বাচ্চাদের মতো বিহেভ করছিলো।স্বামীর এমন অবস্থা দেখে ভেঙে পড়েন ফাতেমা বেগম।নাহিনের হাত জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চান। কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

”নাহিন আমরা জ্যোতির অপরাধী ক্ষমা করে দে আমাদের।আমরা নিজেদের সন্তানদের হারিয়েছি।বুঝেছি সন্তান হারানোর কষ্ট।”

ফাতেমা বেগমের এই কথা শুনে নাহিন স্তব্ধ করে থাকলে জয়া আর রুহি হেসেছে বাইরে বেড়িয়ে। প্রচুর হেসেছে।তবে এক পর্যায়ে হাসি থামিয়ে একে অন্য জড়িয়ে ধরে একে অপরের চোখের জল মুছেছে। বোনদের সম্পর্ক বলে কথা।তার ওপর আবার বেষ্ট ফ্রেন্ড।জয়া হাসতে হাসতে বলেছিলো,

”এরা কত নিখুঁত অভিনয় জানে!”

তাও সেই ঘটনার পেরিয়ে অনেক গুলো দিন।পেরিয়েছে অনেকগুলো বছর।এর মাঝে হারিয়ে গেছে বহু সম্পর্কের সুতো। ছিঁড়েছে মনের বাঁধন।আবার অনেক বাঁধন জুড়েছে হৃদয়ের সাথে হৃদয়কে।

জিনিয়া-মুফতির সম্পর্ক জোড়ালো করে এসেছে নিয়তি।মেয়ের নাম রেখেছে নিয়তি।নিয়তির কারণেই তো তাদের দেখা হওয়া,একে অপরকে অল্প সময়ে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরা। ইফতেখার আহমেদ প্রথমে রাগ দেখালেও পরে মেনে নিয়েছেন ছেলে বউমাকে।কোলে পিঠে করে মানুষ করছেন নিয়তিকে।

সম্পর্কের জোড়াতালি দেওয়া অংশটাও ছিঁড়ে পড়েছে।জিনিয়ার সাথে আর যোগাযোগ নেই বাবা-মায়ের।ওই স্বার্থপর মানুষগুলো একবারও তো ওদের ভালোবেসে আগলে নেয়নি। শুধুমাত্র প্রয়োজনের সময় ভালোবাসা দেখিয়েছে।তা কি আর সত্যি ছিলো!সেদিনও তো হার্টে অনেক বড় এক অপারেশন করাতে হবে।অনেক টাকার ব্যাপার সেপার। মুনতাসিরদের ব্যবসা তখন লাটে উঠেছে।শেয়ার মার্কেটে ভ্যালু তলানিতে। অপারেশন না করলে হার্টের ব্লকেজের কারণে মৃত্যু অনিবার্য।তাইতো নাহিনকে ডেকে এনে আদর, সোহাগ ক্ষমা চাওয়ার অভিনয় করলো।নাহিন ক্ষমা না করলেও টাকা দিয়েছিলো।কারণ সে হয়তো আগেই বুঝেছিলো গিরগিটি রং বদলায় তবে জাত না। অপারেশন শেষে তারাই আবার নাহিনের নামে কুৎসা রটিয়েছে।হয়তো বাড়ি ছিলো না সে তবে খবর কি কানে যায়নি তার!

জয়া,রুহির খাতির হয়েছে ওদের কাকিসাহ এর সাথে। মুনতাসির বংশের বড়দের সাথে হয়তো যোগাযোগ নেই।তবে ভাতিজা,ভাতিজির সাথেও কি সম্পর্ক ছিন্ন করবে নাকি!নাহিন নিয়ে এসেছিলো ওদেরকে ওদের ভাই-বোন দেখাতে।কি মায়া জড়ানো ভাবে কথা বলেছে ওরা।কুহেলিকার মনে হয়েছে আসলেই কি মুনতাসিররা মানুষ!কি করে পারলো এতো মায়াবী বাচ্চাগুলোকে বোর্ডিং এ রাখতে!

জয়ার বিয়ে হয়েছে তার সেই প্রেমিক পুরুষের সাথে।পালিয়ে বিয়ে করেছে। অবশ্য সাহায্য করেছে রুহি।জয়ার প্রেমিক পুরুষকে দেখে রুহি একদফা হেসেছে।তারপর বলেছে,

”দোস্ত তোর ভ্যাবলা প্রেমিক আমার চিৎকারের শব্দে সাইকেল থেকে পড়েছে।এ তোকে ভাগিয়ে এনেছে বিশ্বাস যেন হতে চাচ্ছে না”

হ্যা,জয়ার প্রেমিক পুরুষের দেখা সেদিন ছাদে থেকেই পেয়েছিলো রুহি।জয়ার ভালোবাসা আরিয়ান।ভাগ্য ওদের এক করেছে।তবে রুহির মনে কষ্টেরা বাসা বেঁধেছে ‌।মুখটা তার হাসি হাসি হলেও মনের মাঝে তার বিশাল ক্ষত।হ্যা সেই দিনের ভ্যাবলা যুবকটিকে মন দিয়ে বসেছিলো ষোড়শী সেই রমনী‌।তবে তা এক নজরের ঘটনা বলে এড়িয়ে যায় রুহি।তবে আদৌতে ভালোবাসতে তো এক মুহুর্তই যথেষ্ট।রুহি হয়তো ভুলে বসেছিলো তা‌।এখনো জীবনে এগিয়ে দেখেনি কাউকে।দুই বোনের সম্পর্কটাও নেই আর আগের মতন।রুহি দেশ ত্যাগ করে নাহিন-কুহেলিকার কাছে।আর জয়া দেশেই আছে স্বামীকে নিয়ে।

নাহিন-কুহেলিকা ভালোবাসার আরেক নাম!কিয়ান আর কিনায়া বড় হয়েছে। বাবা-মায়ের মিষ্টি মধুর সংসার থেকে ভালোবাসতে শিখছে। ভালোবাসা এক পবিত্র অনুভূতি এই সম্পর্কে অবগত তারা। তাদের কাছে ভালোবাসা মানে মাম্মাম,পাপাই,জয়া আপ্পি,রুহি আপ্পি,জিনিয়া মামি,মুফতি মামু,তাকদির মামু,রাইসা মামি আর নিয়তি বনু,রামায়সা আপ্পি।জয়া,রুহি বাদে নাহিনের ভাইদের আর কোনো সন্তান যোগাযোগ রাখেনি ওদের সাথে।নাহিনও আর চেষ্টা করেনি। বাচ্চাদের দুই মাস হওয়ার পরপরই পাড়ি জমিয়েছে সিঙ্গাপুরে।তবে দেশ ছাড়ার পূর্বে নাহিন গিয়েছিল মুনতাসির পরিবারে ফিরে।চলে আসার পূর্বে নাসরিন সুলতানাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো,

”আম্মু আমি তোমার জন্য ফিরে এসেছিলাম।আর তুমিই আমায় সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছো‌।তোমার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে।তাই তোমাদের জন্য একটা ফিক্সড ডিপোজিট করে যাচ্ছি।প্রয়োজন মাফিক টাকা তুলে নিয়ো।তবে এই টাকা অব্দি আমার প্রতি তোমাদের অধিকারের সীমাবদ্ধতা আমি নির্ধারণ করলাম।তোমরা আমার সন্তানদের সাথেও নিজেদের স্বার্থের জন্য দেখা করেছিলে। তুমি কি করে পারছো এদের সাথে মিশে আমার ক্ষতি চাইতে!তুমি না মা,তুমি সন্তানের ক্ষতি চাচ্ছো।বাহ,বেশ ক্ষতি চাও।তবে শুনে রেখো আজ থেকে তোমাদের নিকট জ্যোতি (নাহিনের মৃত বোন)আর নাহিন দু’জনেই মৃত।আসছি আমি।ভালো থাকতে বলবো না। বরং নিজেদের কর্ম অনুযায়ী বাকি জীবন অতিবাহিত করো”

”বর্তমান”

কুহেলিকা আজ আবারো বাংলাদেশে এসেছে।তবে আট বছর অতিক্রম করেই।তবে ওইবার সঙ্গে যেমন কেউ ছিলো না তবে আজ সঙ্গে আছে কিয়ান।মেয়েটা বাবা পাগল হয়েছে।বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবে না তাই রেখে আসা।আর কিয়ান সে মা ভক্ত।তাইতো মায়ের সাথে চলে আসা।

”মাম্মাম,এই জায়গার মানুষগুলো এমন কেন?কত হ্যারাস করালো আমাদের”

এয়ার পোর্টে হ্যারাসের শিকার হয়েছে কুহেলিকা। বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে এমনটা প্রায়ই হয়।আর সেই সংবাদ ভাইরাল হতেও সময় নেয় না।কুহেলিকা কিয়ানের গালে হাত রেখে বলে,

”পাপা এটা বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর নয়।আর প্রতিটা দেশেই কিছু না কিছু সমস্যা থাকে। তুমি তো জানো তাই না?”

কিয়ান মাথা নাড়ায়।কুহেলিকার সামনে গাড়ি থামতেই দেখতে পায় মুফতিকে।সাথে আছে ছোট্ট নিয়তি আর জিনিয়া।জিনিয়াকে দেখেই কিয়ান ‘পিমি’ বলে জড়িয়ে ধরে।পিপির পি আর মামির মি দিয়ে পিপি ডাকে সে।গাড়িতে উঠতেই কল আসে নাহিনের।নাহিন কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

”কুহু কিনায়ার হেয়ার কিভাবে বাধবো?মেয়ে তো বলছে তোমার মতো বেঁধে দিতে! মেয়েকে একটু বোঝাও না পাপা তো পাপার মতো বাঁধতে পারে।সে কিভাবে তোমার মতো বাঁধবে!”
”ফোন দেও আমার মেয়েকে”(কুহু)
”মাম্মাম দেখো না পাপাই আমায় কেমন করে চুল বেঁধে দিচ্ছে!মাম্মাম তুমি আমায় চুল বেঁধে দিয়ে যাও।”(কিনায়া)
”বেবি মাম্মাম তো বাংলাদেশে।মাম্মাম কিভাবে বেঁধে দিবে! তুমি পাপার মতোই বেঁধে নেও”(কুহু)
”আমি তোমার কাছে যাবো মাম্মাম।অ্যা অ্যা”(কিনায়া)

নাহিন মেয়ের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে কুহেলিকাকে বলে,
”এখন কিন্তু আমিও মেয়ের মতো কেঁদে দিবো!আমরা বাংলাদেশে আসছি।উই মিস ইউ ”
”আমি তো সঙ্গে আসতেই বললাম। তোমাদের বাপ-মেয়েরই তো সুইজারল্যান্ড যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। সেখানে যাও।রাখছি”(কুহেলিকা)
”ভাবী এভাবে বললে কেন?ভাইয়া যদি রাগ করে?”

রাইসার কথায় কুহেলিকা হেসে দেয়।নিয়তি আর কিয়ানকে দেখিয়ে বলে,
”বাচ্চারা যেমন এই মারামারি,ঝগড়া করে পরমুহূর্তেই বন্ধু হয়ে যায় ঠিক তেমন তোমার ভাইয়া আর আমার সম্পর্ক।তোমার ভাইয়াকে আমি অন্য জায়গায় যেতে বললাম না?দেখো আর কয়েক ঘন্টা পরই সে বাংলাদেশে থাকবে মেয়েকে নিয়ে।আমি নিশ্চিত মেয়েকে ইচ্ছে করে কাঁদিয়েছে।আর মেয়েও আছে বাবার সাথে সঙ্গ দিতে কেঁদেছে ”

কুহেলিকার ফোনে রাইসার ভিডিও কল আসে।কুহেলিকা মুচকি হেসে ভিডিও কল রিসিভ করে মৃদু শব্দে বলে ওঠে,”সারপ্রাইজ ভাবী!”
”শয়তান মেয়ে আমি তোমার ভাই বলছি।আমাকে কি তোমার ভাবী ভাবী লাগে!”(তাকদির)
”একদম না,আমার ভাইকে তো ভাইয়ের মতো লাগে।হি হি হি”(কুহু)
”কতদূর এসেছো?আর মুফতি ছোকড়া কোথায়!ওই ছোকড়ার খবর আছে। এতগুলো ফোন দিয়েছি একটাও ধরেনি।”(তাকদির)
”কুল ডাউন ব্রাদার।ইয়োর ব্রাদার ইজ হেয়ার।কাল রামায়সা মামনির থার্টিন বার্থডে আর আমরা তা সেলিব্রেট করতে আসবো না তা কি করে হয়!”(মুফতি)

কুহেলিকার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে কথা বলতে থাকে মুফতি।আর জিনিয়া হাসতে থাকে।সবার জীবন সুখেই যাচ্ছে।জীবনটা হচ্ছে একটা দাড়ি পাল্লার মতো। মুনতাসিরদের খবর আর রাখেনি নাহিন। নেওয়ার প্রয়োজনবোধ হয়তো করেনি!হয়তো মনের বিতৃষ্ণা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।তবে তাকদির একবার বলেছিলো নাসরিন সুলতানা নাহিনের নাম্বার চেয়েছে।নাহিন দিতে নিষেধ করেছিলো।তারপর কি হয়েছে নাহিন আর জানতে চায়নি। বাচ্চাদের নিয়ে তো বেশ আছে। কয়দিন আগে রুহি কানাডা গিয়েছে।মেডিকেলে আরেকটা কোর্স করতে। যোগাযোগ হয় তবে পড়াশোনা আর নিজের খরচ নিজে চালানোর জেদে সেই যোগাযোগ হয় অতি স্বল্প। তবে যেমনি করেই হোক জীবনের দৌড়ে সবাই এগিয়ে গেছে। পেছন ফিরে তাকানোর এখন আর কারো সময় নেই।তবে হঠাৎ নির্জনে গেলে তাদের সবার ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস!কারো দীর্ঘশ্বাসের নাম আছে,আবার কারো দীর্ঘশ্বাসের নাম তারা খোঁজার প্রয়াসই করেনি।

জীবন বহমান।বইতে থাকবে সময়।সময়কে তো আর আগলানো যায় না।আগলে রাখতে হয় স্মৃতিদের।দেখা যাক ভবিষ্যৎ কি হবে!আবারো কি তাদের জীবনে দুঃখের হাতছানি হবে নাকি দুঃখ শেষে তারা সুখের মুখ দেখেছে অবশেষে!দোয়া রইলো ভালোবাসার প্রতি।ভালোবাসার মানুষদের প্রতি। ভালোবাসা তখনই সুন্দর যখন ভালোবাসার মানুষটি আপনার আপন!

সমাপ্ত

দুই পথের পথিক পর্ব-২৬

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২৬
#বর্ষা
কুহেলিকা বাচ্চাদের গোসল করিয়ে দরজা আটকিয়ে নিজেও গোসলে ঢুকেছে। তখনই বাইরে থেকে চেঁচামেচির হালকা হালকা আওয়াজ পায় সে।তবে ভিজে যাওয়ায় তো আর ওভাবে বের হতে পারে না।তাই দ্রুত গোসল করে পোশাক পাল্টে নেয়।নাহিন অফিসে গেছে।রাইসা ভাবী অবশ্য আছেন।তিনি কয়েকদিন আছেন বলেই তো নাহিন অফিসে যেতে শুরু করেছে।

রুম থেকে বেরিয়ে কুহেলিকা দেখে বাইরে জিনিস পত্র অগোছালো।যেন কেউ এমন করেছে।কুহেলিকা দেখে দরজার লক ভাঙা।রাইসার রুমে গিয়ে দেখে সে কাঁদছে।কারণ! জুনায়েদ এসেছিলো এখানে।রাইসাকে দেখে পাগলামি যেন আরো বেশি শুরু করে।রাইসাকে শত্রু দাবী করে বেরিয়ে যায়।তবে জুনায়েদের এই রুপ দেখে ভয় পেয়েছে রামায়সা।বাবাকে দেখে ছুটে গিয়েছিলো তবে জুনায়েদ তখন নিজের নেশায় বুঁদ ছিলো। ভাঙচুর শুরু করে।রাইসা এগিয়ে যেতে কত কথা বলে।রামায়সা এসব দেখে কান্না করে দেয়। চিৎকার করে বলে,

”পাপাই আই হেইট ইউ। ইউ আর অ্যা বেড হিউম্যান।মাম্মাম ইজ রাইট।আই অনলি লাভ ভালো বাবাই এন্ড মাই মাম্মাম।জাস্ট আউট ”

রামায়সার কথায় স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জুনায়েদ।তারপর বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেছে।রাইসা কাঁদছে।কুহেলিকার হঠাৎ মনে পড়ে দরজার লক তো ভাঙা কেউ যদি বাচ্চাদের ক্ষতি করে!দৌড়ে ঘরে ফিরে আসে।

আল্লাহর রহমতে বাচ্চারা সহি-সালামতেই আছে।কুহেলিকা দরজা আটকে ঘরে বসে পড়ে।ফোন দেয় নাহিনের কাছে।ঘটনার বিশ্লেষণ করে।নাহিন এখনই বেরবে বলে জানায়।

কুহেলিকা আবারো আওয়াজ পায়।তবে এবার শব্দটা অন্যরকম।কুহেলিকা দরজা খুলে দেখে অপরিচিত একজন যুবক এসেছে।রামায়সাকে বুকের সাথে লেপ্টে রেখেছে।কুহেলিকাকে বেরিয়ে আসতে দেখলে রাইসা জানায় এই হলো তাকদির। পরিচিত হয় কুহেলিকাও।তাকদির বোন বানিয়ে নেয় কুহেলিকাকে।তার নিজের আপন কোনো বোন নেই।আর ছোট চাচার দুই মেয়ে ছিলো রাইসা আর রোহানী।রাইসা তো এখন ওর বউ আর রোহানী শালী। সেক্ষেত্রে রোহানী মেয়ের খালা হয়। তাহলে মেয়ে তার পিপি পাবে কোথায়?তাইতো কুহেলিকাকে বোন পাতানো।

তাকদির আজই বউ,বাচ্চা নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরতে চায়।রাইসা বাঁধা দেয়।তবে কুহেলিকাই বলে রিস্ক নিয়ে এখানে থাকার প্রয়োজন নেই।আগে সব ঠিকঠাক হোক তারপর নাহয় পুরো একবছর থাকবে।রাইসা এসেছে দশদিন। সেক্ষেত্রে আজ বাচ্চাদের বয়স সতেরো দিন।

বাচ্চাদের কান্নার শব্দে ছুটে আসে কুহেলিকা।কিনায়া উঠে পড়েছে। মা কোলে নিতেই কান্না বাদ দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। বারোটা দশবাজে।দুপুর প্রায় হয়েই এসেছে।কিনায়াও সজাগ থাকায় গোসল করিয়ে দেয় কুহেলিকা।বাচ্চার মা হওয়ায় সবই শিখে নিতে হচ্ছে তাকে। বাচ্চাদের ড্রেসের পার্সেল এসেছে কাল।খোলা হয়নি।কিনায়াকে গোসল করিয়ে খাইয়ে দোলনায় শুইয়ে দেয় সে।কিয়ানকে আরো আগেই গোসল করানো হয়েছে।এখন সে ঘুমাচ্ছে।আর কিনায়া তাকিয়ে তাকিয়ে আশেপাশের সব দেখছে।

পার্সেল নামিয়ে সবগুলো খুলতে বসে ইলিয়ানা।চারদিন আগে অর্ডার করেছিলো।কাল এসে পৌঁছেছে।ইলিয়ানা সবগুলো ড্রেস খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখে নেয়।বাচ্চাদের জন্য আরামের হবে কিনা তাও দেখে নেয়।হ্যা,যা যা বলা ছিলো ঠিক তেমনই পোশাক এসেছে।ফর্ড ছিলো না।ফর্ডদের ইনকাম হলো একবারের জন্য।গ্রাহক ধরে রাখা ওদের লক্ষ্য না। তবে অধিকাংশ ভালো পণ্যই দেয়।মুখের বুলির সাথে কর্মেও মিল রাখে।

বেবি ওয়ারড্রোবে প্রতিটা কাপড় আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে রাখে সে।রাইসা রান্না করছে।নাহিন আসলে পরে ওরা যাবে।ড্রয়িংরুমেই বসে আছে তাকদির ভাই।

”বনু?”

তাকদির ভাইয়ের আওয়াজ পেতেই পোশাক ঠিক করে মাথায় ওরনা লেপ্টে দরজা খুলে দেয় কুহেলিকা।রাইসাও সঙ্গে আছে দেখে অস্বস্তি মুক্ত হয় কুহু।ভেতরে আসতে বলে।কিনায়াকে কোলে নিয়ে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলে,

”মামার তরফ থেকে মুখ দেখার জন্য বকশিশ।”(তাকদির)

”ভাইয়া এগুলো প্রয়োজন ছিলো না।”(কুহু)

”চুপ করো মেয়ে।আমি আমার ভাগ্নে ভাগ্নিকে দেবো তুমি বলছো কেন?”(তাকদির)

কিনায়া কান্না শুরু করতে কুহেলিকা কিনায়াকে নিয়ে নেয়।আর কিনায়ার কান্নায় জেগে ওঠে কিয়ান।কিয়ানকে কোলে নিয়েও একই কাজ করে তাকদির।কুহেলিকা আবারো নিষেধ করতে নিয়েছিলো তবে তাকদির আগেই চুপ করিয়ে দিয়েছে।রাইসা হাসছে কুহেলিকার মুখের অবস্থা দেখে!

নাহিন রুমে প্রবেশ করে তাকদিরকে দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।কুহেলিকা নাহিনকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নাহিনকে ডাকে।পার্শে ফিরে তাকায় তাকদির।প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে দেখে কিঞ্চিত চমকায়‌‌।কিয়ানকে কুহেলিকার কোলে দিয়ে তাকদির নাহিনকে জড়িয়ে ধরে।

”বন্ধু কেমন আছিস?কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি?”
”এইতো আলহামদুলিল্লাহ।আর ছিলাম আশেপাশেই তোরা খুঁজে পাসনি শুধু ”(নাহিন)
”শালা ঢং বন্ধ কর আর তুই এখানে?”(তাকদির)
”আমার বউ বাচ্চারা এখানে তো আমি কোথায় থাকমু!”(নাহিন)
”তার মানে আমি তোর শালা?”(তাকদির)
”কেমনে!রাইসা ভাবীর যেহেতু তুই জামাই সেহেতু তুই তো আমার ভাই লাগোস”(নাহিন)
”আরে ছাগল কুহেলিকা আমার পাতানো বোন।তাইলে আমি তো তোর শালা লাগি ”(তাকদির)

”ভাইয়া আপনারা অন্য কোথাও গিয়ে কথা বলুন।আমরা মেয়েরাও কিন্তু এখানে আছি!”

কুহেলিকা কথাটা বলেই হেসে দেয়।তাকদির আর নাহিন মাথা চুলকায়। তাকদির রাইসাকে ইশারা করে বাইরে আসতে।তা দেখে আবারো হেসে দেয় কুহেলিকা।নাহিন ফ্রেশ হতে চলে যায়।তবে তার পূর্বে একজনকে দরজা ঠিক করতে আসতে বলে।

★ ★

জুনায়েদ ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।ভয়-ডর কিছুই যেন ওকে ছুঁতে পারছে না। মানুষ যখন সর্বোচ্চ মাত্রায় ভেঙে পড়ে তখন তাকে আর কোনো ভয়-ডর ছুঁতে পারে না।জুনায়েদের ভাবনায় শুধু ভাসছে তার মেয়ের বলা কথাগুলো।এতো ছোট মনেই সে নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগিয়েছে!কেমন বাবা সে। মানুষ হিসেবে জঘন্য,বাবা হিসেবে সে ঘৃণ্য!জুনায়েদের মস্তিষ্কে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে ছোট্ট রামায়সার কথা।

”পাপাই আই হেইট ইউ। ইউ আর অ্যা বেড হিউম্যান।মাম্মাম ইজ রাইট।আই অনলি লাভ ভালো বাবাই এন্ড মাই মাম্মাম।জাস্ট আউট ”

জুনায়েদ কাঁদতে থাকে। হঠাৎ ঝাঁপ দেয় ব্রিজের ওপর থেকে।নিচে ছোটখাটো একটা নদী।তবে গভীরতা অনেক।আরো ওপরে হচ্ছে ব্যস্ত ব্রিজ।কেউ আর দেখবে তাকে!জীবনটা কি ত্যাগ করলো সে?হয়তো।

★ ★

মুনতাসির ভিলায় রাব্বি মুনতাসির হার্ট অ্যাটাক করেছেন।প্রথমে আরো একবার করেছিলেন।এই নিয়ে দুইবার। হসপিটালে টানাটানি হচ্ছে ওনাকে নিয়ে।বাড়িতে নেই কোনো ছেলে।সবাই তো জেলেই।নাহিনের বাবা বাসায় থাকা আর না থাকা একই কথা!সেই গুমোট হয়েই থাকে সে।

বাড়ির মেয়ে জয়া আর রুহি দাদুকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছে।রাব্বি মুনতাসিরের আবার মেয়ে বাচ্চাকাচ্চা অপছন্দের তাইতো বাড়িতে রাখতে দেননি কাউকে।আর আজ সেই মেয়েরাই আজ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে!

”দাদু আরেকটু সহ্য কর এইতো চলে এসেছি”

রুহির কথায় এই অবস্থাতেও রাগ দেখান রাব্বি মুনতাসির।রুহির রাগ লাগে।এই লোকটা মরার সময়ে এসেও রাগ দেখাতে ভুলছে না।জিনিয়া বাবার সাথে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে। ভাইদের অন্যায়ের কথা শুনে বাবাকে সে বলেছিলো ওদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে।চড় পড়েছিলো গালে।সেদিন রাগ করে এই যে বেড়িয়েছে আর এমুখো হয়নি।কোথায় আছে কেউই জানে না।তবুও পুরনো নাম্বারে কল দেওয়ার চেষ্টাও এতোদিন কেউ করেনি।তবে আজ জয়া কল দেয় জিনিয়াকে।

কল রিসিভ হতেই জয়া বলে ওঠে,

”পিপি রাগ করে থাকলে থাকো।তবে শুনো তোমার বাবা পরলোক গমনের পথে হাঁটছে।হার্ট অ্যাটাক করেছে।মুখ দর্শন করতে চাইলে ***** হসপিটালের সেকেন্ড ব্রাঞ্চে চলে আসো।”

জয়ার কথা শোনা মাত্র জিনিয়ার হাত থেকে ফোন পড়ে যায়।মুফতি জিনিয়াকে ধরে ফেলে।জিনিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,

”মুফতি বাবা,বাবা অসুস্থ!আমি বাবার কাছে যাবো।আমায় বাবার কাছে নিয়ে চলো”

কুহেলিকার বেষ্টু মুফতিই হচ্ছে এই মুফতি।জিনিয়ার সাথে ছয়মাসের অনলাইন রিলেশন এখন বিয়ে অব্দি গড়িয়েছে মাত্র তিনদিন।ঢাকাতেই সংসার জুড়েছে দু’জনে।মুফতিও শ্বশুরের অসুস্থতার খবর শুনে চিন্তিত হয় তবে ব্যতিব্যস্ত হয় না। কেননা এই লোকটা একটা জঘন্য মানুষ মুফতির কাছে।মুফতির কাছে অনেক ওল্ড রিপোর্টই আছে রাব্বি মুনতাসিরের। গোয়েন্দা বিভাগের পুরনো সদস্য।ট্রান্সফার নিয়ে চলে এসেছে ঢাকাতে।

”আচ্ছা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেও। শশুরকে দেখে আসি চলো”(মুফতি)
”রেডি হতে হবে না।এভাবেই যাবো চলো প্লিজ”(জিনিয়া)

মুফতি জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরে প্রথমে শান্ত করে। চোখের পানি মুছে দিয়ে রেডি হয়ে আসতে বলো।জিনিয়াও মুফতির কথা মেনে নেয়।তবে হাতে মুখে পানি দিয়ে মুখ মুছে হিজাব পড়ে বেরিয়ে আসে।মুফতি গাড়ি বের করে।

চলবে কি?

দুই পথের পথিক পর্ব-২৫

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২৫
#বর্ষা
সাতদিনের দিন বাচ্চার আকিকা দিয়ে নামকরণ করা হয়।বাবা মায়ের দায়িত্ব এটা।অনেকে দেরি করেও আকিকা দেয়।তবে কুহেলিকা-নাহিন অপেক্ষা করতে চায় না।যেহেতু ফ্লাটে উঠে পড়েছে আর লোক দিয়েই সব গোছগাছ করিয়ে নেওয়া হয়েছে তাই কুহেলিকার আর সমস্যা হয়নি। শুধু নিজের রুমটা সুন্দর করে সাজিয়েছে। বাচ্চাদের জন্য সাজিয়েছে একদম নিজের মতো করে।

কুহেলিকার গরুর গোশতে এলার্জি আছে।আর সন্তানের আকিকার গোশত মা খাবেনা তা কি হয়!তাইতো খাসি এনেছে নাহিন।ছেলের জন দুইটা আর মেয়ের জন্য একটা। নিচতলায় জবাইয়ের তদারকি দেখছে সে।আর কুহেলিকা তার পুচকো-পুচকিকে নিয়ে পিপির সাথে পটরপটর করছে।

কিয়ান আর কিনায়া দু’জন একসাথেই কাঁদতে শুরু করে।কুহেলিকা দ্রুত কল কেটে দুজনকে ছোট ছোট দুইটা দোলনায় শুইয়ে আস্তে আস্তে দোল দেয়। বাচ্চাদের কান্না থেমে যায়।ঘুমের মাঝেই কাদছিলো দুইজনে।হয়তো স্বপ্ন দেখে নয়তো পেটে ব্যথায় ধারণা করে নেয় কুহেলিকা।এইবয়সের বাচ্চাদের পেটে গ্যাস হলে ব্যথার সমস্যা দেখা যায়। ওরা তো আর বলতে পারে না।

”কুহু,কুহু।দেখো কে এসেছে”

নাহিন ডাকতে ডাকতে রুমের দিকেই আসছিলো।কুহেলিকা ওরনা ফেলেই বাচ্চাদের দোল দিচ্ছিলো‌।তার স্বামী যদি বাচ্চা দেখাতে লোক রুমে নিয়ে আসে এ আসঙ্কায় দ্রুত ওরনা লেপ্টে নেয় মাথায়।সত্যিই রুমে নিয়ে এসেছে।

”কুহু কেমন আছো?”

রাইসা ভাবী এসেছে।চোখ মুখে উজ্জ্বলভাব।আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে আরো।রামায়সা ছুটে আসে।কোলে উঠতে চায়।তবে রাইসা আটকে দেয়।রাইসা বলে ওঠে,

”ডন্ট ট্রাই টু ডু দিজ এগেইন আম্মু।দেখছো না তোমার পিপির বেবি হয়েছো।পিপির তো রেস্ট লাগবো।তাইনা?”

”ভাবী আমার পিপিকে কিছু বলো না।এইদিকে আসো প্রিন্সেস।”

কুহেলিকা নিচু হয়ে বসে।রামায়সা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।রাইসা দেখে,হাসে।তখনই ফোন বেজে ওঠে তাকদির ফোন করেছে।রাইসার দ্বিতীয় স্বামী।অবশ্য ওরই চাচাতো ভাই হয়।তাকদিরেরও দ্বিতীয় বিয়ে।ও কখনো বাবা হতে পারবে না তাই ওর বউ ওকে ছেড়ে চলে গেছে।রামায়সাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখতে লাগে।হঠাৎ করে রামায়সাকে হারানোর ভয় জেঁকে বসতেই চাচার কাছে আবদার করে রাইসাকে বিয়ে করতে চায় সে।রাইসার বাবাও ভেবে দেখেন মেয়ের,নাতনির ভবিষ্যৎ আছে।রামায়সার ওপর প্রভাব পড়বে ওর বাবা খুনি জানলে।তার চেয়ে ভালো বাবাই আনলে তো সমস্যা নেই।তবে রাইসা রাজি হয়নি।তবে রামায়সার ভবিষ্যৎ এর কথা উঠতেই রাজি হয়।তাইতো জুনায়েদ জেলে যাওয়ার সাত মাসের মাথায় সে অন্যকারো স্ত্রী বনে যায়।কেননা একটা বাচ্চার জীবনে মায়ের ভালোবাসা যতটা প্রয়োজন,তেমনি বাবার ভালোবাসাও প্রয়োজন।সেখানে রামায়সা জানবে ওর বাবা খুনি!তার চেয়ে তো ভালো বাবাই তাকে ভালো রাখবে।

”হ্যা তাকদির বলুন?”(রাইসা)
”বাসায় ঢুকেছো?”(তাকদির)
”হুম।আপনাকে তো আসতে বললাম।আসলেন না কেন?”(রাইসা)
”ওড লাগছিলো। আচ্ছা আমার মেয়ে কি করছে?”(তাকদির)
”ওর পিপির সাথে খেলছে”(রাইসা)
”একদিন আমাকেও আমার বোনের সাথে দেখা করিও”(তাকদির)
”আজ আসলেই পারতেন”(রাইসা)
”একসাথে এতগুলো ঘটনা না জানানোই ভালো।আমি নাহয় পড়ে সাক্ষাৎ করবো।মেয়েকে দেখে রেখো।আর নিজেরও খেয়াল রেখো।রাখছি। আল্লাহ হাফেজ ”(তাকদির)
”আল্লাহ হাফেজ”(রাইসা)

রাইসা কল কেটে মুচকি হাসে। ছোট্ট ছোট্ট এই কেয়ার গুলোর অভাব ছিলো জুনায়েদের ঘরে। জুনায়েদ সবসময় টাকায় মুড়ে রাখতো রাইসাকে। সেটাকেই সুখ ভেবে, ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছিলো সে।হ্যা জুনায়েদ ভালোবাসা তার রুপকে , তাদের আদরের মেয়েকে।প্রত্যেক পিতার কাছেই যে তার কন্যা রাজকন্যা,কলিজা।

”ভাবী‌ হঠাৎ আসলে যে?”(কুহু)
”খুশি হোসনি?খুশি না হলে চলে যাচ্ছি!রামায়সা..”(রাইসা)
”আরে ভাবী রাগ করছো কেন?তোমার সাথে এতো গভীর সম্পর্ক তো ছিল না যে আসবে।তাই আরকি”(কুহু)
”কুহেলিকা আমি জানি তোমার সাথে আমার ব্যবহারগুলো ছিলো অন্যরকম।তবে একটা বিষয় আমি বুঝেছি,তুমি যেমনই হও তুমি অনেক ভালো মনের অধিকারী।আর এমন কাউকে ভালো না বেসে থাকা যায়!আর তোমাকে একটা খবর জানাতে এসেছি!”(রাইসা)
”কি খবর ভাবী?”(কুহু)
”জুনায়েদ জেল থেকে পালিয়েছে”(রাইসা)
”কি!আর তুমি জানলে কি করে তা?”(কুহু)
”জুনায়েদ আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো।মেয়েকে দেখতে চেয়েছিলো।আমি পুলিশের ভয় দেখাতেই পালিয়ে যায়।আর পরদিনই পুলিশ এসেছিলো বাসায় খবর নিতে।আমি সত্যিটাই বলেছি।”(রাইসা)
”ভাবী জুনায়েদ ভাই কবে এসেছিলো?”

কুহুর কন্ঠে চিন্তা পরিলক্ষিত হয়।রাইসা বলে ওঠে,

”গত দশদিন আগে রাত দশটার সময়”

কুহেলিকা কিছু ভাবতে থাকে।সন্দেহ জাগে সেদিন কি তবে জুনায়েদ এসেছিলো হোটেলে!তবে সে এসেছিলো কেনো? প্রতিশোধ নিতে!তবে কুহেলিকা তো জানায়নি পুলিশকে কিছু।তবে গ্রেফতার তো সে নিজের দোষেই হয়েছে। তাহলে কুহেলিকার পিছনে লাগার কারণ কি!

★ ★

জয়নুবা বেগম এখন অনেকটাই সুস্থ।এখন হুইলচেয়ারে বসে নিজ হাতেই খেতে পারেন।ছোট ছেলের সাথে আছেন এখন।জাহিদ বাড়ি ফিরেছিলো ভাই,বাবা গ্রেফতার হওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায়।আর তার ছয়মাস পর তো কাসেম মির্জাও বাড়ি ফেরেন।তবে বড় বউমাকে আর ফেরাতে পারেন না।জেলেই ছেলেকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে ডিভোর্স নিয়েছে যে সে।তাইতো আর অধিকার দেখাতে পারেনি।তবে নাতনি আনার চেষ্টা করেছিলো।আদালত অব্দি গড়িয়েছিলো।

ছয়মাস পূর্বে….

আদালত চত্বরে মেয়েকে আঁকড়ে বসেছিলো রাইসা।সরকারি উকিল আর সরকারি বেবি কেয়ারের একজন মহিলা নিয়ে যায় রামায়সাকে।কথা বলবে ওর সাথে তাই।বাইরে বসে থাকে রাইসা‌।

উকিল রামায়সাকে চকলেট দেয়। রেকর্ডার আর ক্যামেরা ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞেস করে পার্শ্ববর্তী কক্ষে।ঠিক আছে নিশ্চিত হয়ে রামায়সার দিকে এগিয়ে আসে।আলতো করে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

”মা তোমার নাম কি?”(উকিল)
”রামায়সা মির্জা।সবাই আমাকে ছোট রাইসা বলে ডাকে”(রামায়সা)
”ছোট রাইসা দেখে কেন? তুমি বল না আমি তো বড় তোমরা আমায় ছোট বল কেন!”(উকিল)
”বিকজ আমার নাম তো রামায়সা।আর আমার মাম্মামের নাম রাইসা।আমি তো আমার মাম্মামের ডুপ্লিকেট”(রামায়সা)
”আচ্ছা মা তোমার কি তোমার দাদা দাদুর কথা মনে পড়ে?”(উকিল)
”হুম”(রামায়সা)
”যদি তোমায় নিয়ে যেতে চায় যাবে তাদের সাথে?”(উকিল)
”মাম্মামের সাথে যাবো।”(রামায়সা)
”মাম্মাম কে তো নেওয়া যাবে না।একা একা যেতে হবে।যাবে?”(উকিল)
”না,না আমি মাম্মামকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।মাম্মাম,মাম্মাম….”

রামায়সা কাঁদতে শুরু করে।বেবি কেয়ারের মহিলা যখন রামায়সাকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয় তখন রাইসাকে ডেকে নেওয়া হয়। রাইসা জড়িয়ে নিতেই মেয়ে শান্ত হয়।সন্তান কি আর মা’কে ছেড়ে বেশিক্ষণ শান্তভাবে থাকতে পারে?কখনোই না। মা’কে ছাড়া একটু সময় শান্ত থাকা গেলেও একটু পর যে অস্থিরতা শুরু হয়,কান্না পায় যা ছোট্ট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

উকিল আর বেবি কেয়ারের মহিলাটা বেরিয়ে যান।রাইসাকে তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে এও বলে চলে যান।রাইসাও মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেই এক মহিলা রুমে তালা লাগিয়ে দেন।

পরেরদিনই ডেট পড়ে আদালতে।মেয়েকে নিয়ে আবারো ছুটে আসতে হয় রাইসাকে।জজ প্রথমে রামায়সার সাথে কথা বলেন। এবারও আগের বারের মতোই প্রশ্ন ছিল।আর রামায়সার কান্না ছিলো।আর এবারও রাইসাকেই সামলাতে হয় মেয়েকে।একবার রাইসাকে বাইরে বসতে বলে দাদা-দাদীর কাছে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় রামায়সাকে।

রামায়সা গিয়ে কোলে ওঠে দাদার।চুমু খায়।গল্প করে। অনেক কথা বলে।যার প্রতিটা কথাই মা’কে ঘিরে।এই ছোট্ট প্রাণটার সবটা ঘিরে যে মা থাকবে তাইতো স্বাভাবিক।তবে একসময় বিরক্ত হয়ে পড়েন কাসেম মির্জা‌।কোল থেকে নামিয়ে পাশে বসান। দুপুরের সময় হয়ে আসায় খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করতে বলেন।এক লোকমাও খাইয়ে উঠতে পারে না।জজ সাহেব কিছু লেখেন।তারপর পঞ্চাশ মিনিটের বিরতি দিতে বেরিয়ে যান।

আবারো আদালতে কারবাহি শুরু হয়।এবার রামায়সাকে পাঠানো হয়েছে বেবি কেয়ারের মহিলাটার সাথে।সরকারি উকিল কথা বলছেন।আর রাইসার উকিলও আছেন।তবে দুই উকিলই এখন একপক্ষে।তাহলে আর কি করে দায়িত্ব পাবে মির্জারা?জজ সাহেবের রায় হয় রাইসার পক্ষে। সবশেষে মেয়েকে হারানোর ভয়টা কাটিয়ে ওঠে সে।তবে প্রশ্ন উঠেছিলো,রাইসা তো কোনো কাজ করেনা মেয়ের দেখভাল কিভাবে করবে?তখন তাকদির দাঁড়িয়েছিল বলেছিলো,যতদিন আমরা আছি রামায়সাকে অন্য কারো দেখতে হবে না।বাবা হয়ে আগলে রাখবো!

★ ★

জয়া বাড়ি ফিরেছে।মায়ের ছেলে হয়েছে দেখতে আসবে না?মায়ের ছেলে!মাত্র চার বছর বয়সে বাড়ি ছেড়েছে। মা’কে মা আর বাবা’কে বাবা বলে ডাকার খুব একটা সুযোগ হয়নি। এসএসসির পর সব বন্ধু-বান্ধব বাড়ি ফিরেছে আর তাকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে IELTS কোর্স আর কলেজে ভর্তির প্রিপারেশনে।আর এখন কলেজেও আছে হোস্টেলে।বোন দু’জন থেকেছে একসাথে তাই দুইটার মাঝে মনের টান আছে।এখনও তো একসাথেই আছে।জয়া কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে আর রুহি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে মাত্র।

”রুহি চলতো বাইরে থেকে ঘুরে আসি”

ড্রয়িংরুমে বসে চিপস খাচ্ছিলো রুহি।বোনের কথায় মুখ তুলে তাকায়। চিপসের প্যাকেটটা গোপন করে বলে ওঠে,
”ঘুরতে যাবি নাকি তাকে দেখতে যাবি?
”রুহি”

জয়ার ধমকে যেন ভয় পায় এমন অভিনয় করে রুহি। একবছরের ছোট বড় হলেও দুজন যেন বেষ্ট ফ্রেন্ড।জয়া কারো সাথে সম্পর্কে আছে।রুহি বাদে মা-বাবার এই ভালোবাসাহীন জীবনে কারো ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়েছে।রুহি তো ওর জানে জিগার।

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে দু’জনে।বাড়ির থেকে একটু দূরে পুকুর পাড়।আর তার থেকে একটু দূরেই সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের ছোঁয়া।শহরের মাঝেও গ্রাম। পুকুর পাড়েই দুইবোন বসে।গল্প করে।প্রায় অনেকক্ষণ বসে থাকে।রুহি পাশের দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে আনে।আবারো পাড়ে বসে পড়ে আইসক্রিম খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে,

”কিরে কখন আসবে তোর হিরো?”
”আমিও তো তাই ভাবছি ”(জয়া)
”এতোদিন দেখলাম নায়িকা দেরি করে আর এখন দেখছি নায়ক দেরি করে।সন্ধ্যা হয়ে যাবে একটু পরই।এখন চল।তোর নায়ক হয়তো কোথাও আটকে পড়েছে”(রুহি)
”আচ্ছা চল।”

জয়া মনমরা হয়ে বলে ওঠে। রুহি হাসে।বাসায় ফিরতেই রুহির বড় মা অর্থাৎ জয়ার মা নুরি ওদের ফ্রেশ হয়ে দ্রুত নিচে আসতে বলে।জয়া ঘাড় ত্যাড়ামি করে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরঘুর করে তারপর ওপরে গিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ে নিচে আসে।দোতলা থেকে দেখে রুহি এখনো আসেনি।তাই সে রুহির ঘরের দিকেই যায়।তবে রুম ফাঁকা।জয়া ভাবে হয়তো তারই ভুল রুহি হয়তো নিচে আছে।

”জয়া নোমানকে ধরতো।আমার আর ভালো লাগছে না।এতো কাঁদছে!একটু শান্তিতে কথাও বলতে পারছি না।”

”আমি পারবো না। নিজের ছেলে নিজে দেখো।”

জয়া অবাক হয়ে তার মা’কে দেখে।জয়ার হয়তো বাবার জন্য কষ্ট লাগছে না কেননা সে তো বাবার ভালোবাসা পায়নি কখনো।তার মায়ের তো কষ্ট লাগার কথা।এখানে সে দিব্যি মানুষের সাথে হেএ হেসে কথা বলছে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় জয়া মায়ের মুখে নিজের প্রতি তিক্ত বুলি শুনেও পাত্তা না দিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

”রুহি রাতের বেলা ছাদে কি করছিস?”(জয়া)
”দেখ আকাশটা কত সুন্দর!তবে আজ ও আমাদের মতোই একা।”(রুহি)
”আমরা কি একা? তুই আমাকে কেউ মনে করিস না?তোর জন্য আমি আছি আর আমার জন্য তুই তো আছিস।তাহলে আমরা কি করে একা?”(জয়া)
”হ্যা রে মা আমরা একা না।আমরা আছি একে অপরের জন্য ”(রুহি)

চলবে কি?

দুই পথের পথিক পর্ব-২৪

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২৪
#বর্ষা
বাসা থেকে বড্ড দূরে হোটেলে উঠেছে কুহেলিকা-নাহিন বাচ্চাদের নিয়ে।কুহেলিকার মন বিষিয়ে গেছে শাশুড়ি মায়ের ব্যবহারে!মুনতাসির পরিবারে থাকলে জাস্ট শুধু তার মেয়েই একটু ভালোবাসা পাবে।আর ছেলেটা শিখবে কনসপারিসি আর বৈষম্য। তারচেয়ে ভালো দুইজনকেই একাকী বড় করা। এতে একাকী বড় হলেও নৈতিক গুণাবলী গড়ে উঠবে দুজনের মাঝে।

কিয়ান প্রচন্ড শান্ত যা কুহেলিকার মনে ভয় বাড়িয়েছে।কেন বাচ্চাটা শান্ত থাকবে!কিনায়া একটু পরপরই কেঁদে ওঠে।কুহেলিকার চাই দু’জনেই এভাবে কাঁদবে।মায়ের মন ভয় তো করবেই।

নাহিন যতই সাহায্য করুক না কেন তবুও তো একটা মেয়ে মায়ের কমতি জীবনে উপলব্ধি করে এইদিনে।কুহেলিকারও মনে হচ্ছে আজ মা থাকলে কত ভালো হতো!আজ বাবা বেঁচে থাকলে কেউ তার সাথে এমন করার সাহস পেতো না।

”কুহু তুমি বেবিদের নিয়ে থাকো।আমি আমাদের ফ্লাটটা পরিষ্কার করতে বলেছি।ফ্লাটে উঠবো।কাজ কতদূর দেখে আসি”
”আচ্ছা, সাবধানে যেও। আল্লাহ হাফেজ ”

নাহিন বেরিয়ে যেতেই মুফতি রুমে প্রবেশ করে।কুহেলিকার হাতে ফাইল তুলে দেয়। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

”দোস্ত আরেকবার ভেবে নে। তুই যা করতে যাচ্ছিস তা অনেক রিস্কি। বাচ্চাদের জীবনের বিষয়”

”ওদের ভালোর জন্যই রে।আমি যদি আজ উঠি না দাঁড়াই তাহলে ওরা কিভাবে দাঁড়াতে শিখবে!”

কুহেলিকা ল্যাপটপও আনিয়েছে। বাচ্চা দুইজন ঘুমাচ্ছে। আজকে কুহেলিকার মিটিং ছিল। তবে গত পরশু সে সন্তান জন্ম দিয়েছে।তবে আর যাইহোক বাবার স্বপ্ন পূরণ যে তাকে করতেই হবে।দীর্ঘক্ষণের এই মিটিং।তবে বাচ্চারা অনেক ছোট। তাদের তো একটু পরপরই মায়ের প্রয়োজন।

কুহেলিকা মুফতি বেরিয়ে যেতেই রুম লক করে দেয়। মিটিং শুরু হতে আরো ঘন্টাখানেক।কিয়ান তাকিয়ে আছে মিটিমিটি করে।কুহেলিকা বাচ্চার সাথে একটু কথা বলে।যেহেতু কাঁদছে না তাই আগেভাগেই রেকর্ডের প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে থাকে। প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সময় তো আর প্রশ্ন করা হয় না।তখন নাহয় রেকর্ডেড ভিডিও ছেড়ে দিবে।তাও মিনিট পনেরোর ব্যাপার স্যাপার।

প্রেজেন্টেশন তৈরি শেষে কুহেলিকা লেপটপ সাইডে রেখে দেয়।কিয়ানকে কোলে নিয়ে খেলতে থাকে।গল্প শোনাতে থাকে।তখনই কিনায়া কেঁদে ওঠে।কুহেলিকা কিয়ানকে সুইয়ে কিনায়াকে কোলে নেয়।খাওয়াতেই আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।কাল রাত জেগেছে তাই দিনে ঘুমাচ্ছেন মহারানী।আর যুবরাজ তো রাতে ঘুমিয়েছে তাই এখন মিটিমিটি তাকিয়ে আছে।

”মাম্মামের যুবরাজ কি মাম্মাম কে দেখে?আমার যুবরাজ,উম্মাহ”

দরজায় টোকার শব্দে এগিয়ে যায় কুহেলিকা।রুম সার্ভিস এসেছে।কুহেলিকা দরজা খুলতে গিয়েও খোলে না।তার মনে আছে ঘন্টা দুই আগেই তো রুম সার্ভিস এসে সব ক্লিয়ার করে গেছে।আবার আসবে কেন?কুহেলিকা দরজা খোলে না। বরং লোকটার মতিগতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।কেমন যেন অস্থির অস্থির।এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ দৌড়ে পালায় সে।

কুহেলিকা অবাক হয়।একটু পরেই উপস্থিত হয় নাহিন। দরজায় নক করে।কুহেলিকা নাহিনকে দেখে দরজা খুলে দেয়।দরজার সাথে ওকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে,
”কে কে জানে আমরা এখানে আছি?”
”কে জানবে?আমি, তুমি,মুফতি আর বাড়ির মানুষেরা”(নাহিন)
”বাড়ির সবাইকে যখন বলেই দিয়েছেন কোথায় আছি তাহলে দূরে থেকে লাভ কি! তাদের সাথে গিয়েই থাকি চলুন। ক্রিমিনাল ফ্যামিলি”(কুহু)
”কুহেলিকা”(নাহিন)
”একদম ধমকাবেন না আমায়”(কুহু)
”কুহুপাখি কি হয়েছে?এমন খেপছো কেন?কেউ এসেছিলো?”(নাহিন)
”এসেছিলো কেউ। তবে জানি না কে এসেছিলো।বলেছিলো রুম সার্ভিস ”(কুহু)
”তাহলে আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছো কেন?(নাহিন)
”বেকুব একদিনে কয়বার রুম সার্ভিস আসে?”(কুহু)

নাহিন ভাবনায় পড়ে যায়।দুইবার রুম সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে এখানে।তবে তাও আটঘন্টা পরপর।তাহলে এখন কে এসেছিলো?নাহিন ল্যান্ডলাইনে ফোন দেয় রিসেপশনে।তবে অবাক হয় জেনে যে কোনো রুম সার্ভিসের লোক আসেনি তিনতলাতে।

*****

মাস্ক খুলেছে জুনায়েদ। বাঁকা হাসি হাসছে।বড্ড কষ্টে পালিয়েছে ওই নরক থেকে।আবার যদি সেখানে যেতেই হয় তবে কুহেলিকাকে খুন করেই যাবে।তাইতো চট্টগ্রাম থেকে ট্রাকের পেছনে করে চলে এসেছে এতদূর অব্দি।

জুনায়েদ হোটেল থেকে বেরিয়ে পুকুরের মতো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।পাশেই পড়ে থাকা নুড়ি পাথর তুলে পুকুরে ছুঁড়ে মারছে।জলরাশিতে পানিরা আকৃতি বানিয়ে যে খেলছে।জুনায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।সে দ্বিধায় আছে।জেল থেকে না পালিয়ে যে উপায় ছিলো না চৌদ্দ বছরের জেল ছিলো।পুরো জীবনটাই তো জেলে বসেই কেটে যেতো!মেয়ের বেড়ে ওঠা দেখা হয়ে উঠতো না।

জুনায়েদ জেল থেকে পালিয়ে সবার আগে মেয়েকে দেখতেই গিয়েছিলো।তবে রাইসা জুনায়েদকে দেখেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে।রামায়সার দেখাও দেয় না।জুনায়েদকে ধিক্কার জানিয়ে বলে ওঠে,

”তোমার কারণে এমনিতেও আমাদের জীবনটা জাহান্নামে পরিণত হয়েছে।এখন কি আমাদেরকে জাহান্নামের আগুনেও জ্বালাতে চাও! চলে যাও এখান থেকে ”

জুনায়েদ অনুরোধের সুরে বলেছিলো,”জাস্ট একবার রামায়সার দেখা দিয়ে দেও।আমি সত্যি বলছি আমি চলে যাবো।”

”আমার মেয়ে কোনো খুনির সাথে দেখা করবে না।চলে যাও তুমি।আমি চাইনা আমার বাচ্চার ওপর আবারো তোমার প্রভাব পড়ুক।”(রাইসা)

”প্লিজ রাইসা জাস্ট একবার”(জুনায়েদ)

”তুমি যাবে নাকি আমি পুলিশকে কল করবো”(রাইসা)

জুনায়েদ মেয়ের দেখা না পেলেই চলে আসতে বাধ্য হয়।সে তো জানে তার জেলে যাওয়ার পেছনে হাত রয়েছে কুহেলিকার। তাইতো ওর জন্য শুধু মাত্র ওর জন্য আজ ও ওর মেয়ের দেখা পায়নি। জুনায়েদ পাগলা কুকুরের মতো খোঁজ লাগায় কুহেলিকার।লোক লাগিয়ে খোঁজও পেয়ে যায়।আর ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে চলে আসে স্বপ্নের শহর ঢাকাতে।

****

মুনতাসির পরিবারে আনন্দের বহার।এতো সব দুঃখের মাঝেও আনন্দের বিষয় জিহানের ছেলে আজ বাসায় আছে।জোভানের বউ ইরুসি সব কাজ একাহাতে করছে‌।জোভান জেলে যাওয়ায় তার যে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে তা মনে হচ্ছে না।প্রতিদিন ছেলে মেয়ের সাথে কথা বলছে।আগে যেমন গম্ভীরভাবে বসে থাকতো।এখন আর তেমন নেই।হাসে,প্রাণ খুলে বাঁচে।

”মেঝ বউ তোমার মাঝে তো কোনো দুঃখই নাই।আমার মেঝ পোলাটায় জেলে।আর তুমি আরো হাসিখুশি থাকতে আছো”

ফাতেমা বেগমের কথায় মুচকি হেসে ইরুসি বলে ওঠে,
”আম্মা তিনদিন আগেই না বড় ভাইজান মারা গেলো আর আজই আপনি ধ্যাই ধ্যাই করে বাইরে থেকে ঘুরে আসলেন।”

ফাতেমা বেগম গালাগালি করতে শুরু করেন।সত্য সবসময় তিতা হয়।ইরুসির মাঝে মাঝে মনে হয় এই তিনভাই হয়তো কিনে আনা কোথাও থেকে।নয়তো কেউ কি তার সন্তানদের খারাপ শিক্ষায় দিক্ষিত করতে চায়! ফাতেমা বেগম‌‌‌ চলে যেতে আবারো রান্নার কাজে লেগে পড়ে ইরুসি।আজ বড় ভাবী আসবে।বড় ভাবী স্বামীর মৃত্যুর দিনও আসতে পারেনি। কেননা লাশই তো এখনও ফেরত দেওয়া হয়নি।পুলিশের কাছ থেকে চেয়ে আনাও হয়নি। বরং ওদের বলা হয়েছে নিজেদের মতো কোথাও দাফন করতে!

”মা ও মা ”

রুহি গতকাল বাড়ি ফিরেছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মা’কে ডাকছে।ইরুসি সাড়া দিতেই ছুটে আসে এদিকে।মা’কে রান্না করতে দেখে আরো খেপে ওঠে।রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,

”মা তোমার তো এলার্জির সমস্যা।এতো গরমে রান্না করছো কেন তুমি? মুনতাসিরদের কি টাকার কমতি পড়েছে যে কাজের লোক রাখতে পারছে না?”

”তোর বাপে কাড়িকাড়ি টাকা রেখে যাই নাই যে তোদের পেছনেও ঢালমু আবার বাসায় কাজের লোকও রাখমু!”

ফাতেমা বেতন গ্লাসে পানি ঢালতে নিয়ে বলে ওঠেন। রুহি আরো রেগে যায়।তার বাবা কি কিছুই করেনি!যেমনই মানুষ হোক।টাকা উপার্জন তো কারিকারি করেছে তাদের জন্য। তাহলে এখন কেন তারা কথা শুনবে!রুহি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেই ফেলে,

”আমার বাবা তো টাকা কামায়নি তুমি এতদিন বিজনেস সামলিয়েছো।”

”ইরুসি মেয়েকে তো বেয়াদব বানিয়েছো!”(ফাতেমা)

”রুহি চুপ থাক মা”(ইরুসি)

রুহি চুপ থাকার পরিবর্তে আরো রেগে যায়।তেড়ে এসে জানায় পানির গ্লাসটা কেড়ে নেয় হাত থেকে। ছুঁড়ে মারতে গিয়েও মারে না। কেননা সেই কাচ তার মা’কেই পরিষ্কার করতে হবে।তাইতো পানি খেয়ে উল্টো করে গ্লাস রেখে ফাতেমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,

”আমার মা’কে তো সময়ই দেওনি আমাকে শিক্ষা দেওয়ার।তার পূর্বেই তো আমাকে,ইয়ামানকে বোর্ডিং এ পাঠিয়েছো কনসপারেসি করে।এখন তাহলে আমার মা’কে দোষারোপ করছো কেন! নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ করো।আমি আর বোর্ডিং এ যাচ্ছি না।”

রুহি বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে।শরীরের জ্বালা মিটছে না।বাবাকে নিয়ে বলবে কেন তারা?তারা নিজেরাই তো তার বাবাকে লালন-পালন করেছে। তাহলে বাবার দোষের দোষী তো তারা নিজেরাই।রুহি রাগ নিবারণে ছাদে চলে যায়।চিৎকার করতে থাকে।সামনে দিয়ে সাইকেলে করে যাচ্ছিলো এক যুবক।রুহির চিৎকারে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে।রুহি নিচে তাকিয়ে শ্যাম যুবকে এভাবে পড়তে দেখে হাসতে শুরু করে।আর যুবক লজ্জায় লাল হয়ে দ্রুত কেটে পড়ে সেখান থেকে!

চলবে?

দুই পথের পথিক পর্ব-২৩

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২৩
#বর্ষা
কুহেলিকার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে নাহিন।নাহিনের মনে বিতৃষ্ণা জেগেছে মায়ের প্রতি।কি এমন কারণ যে তার মা তার স্ত্রীর প্রতি এমন আচরণ করবে!যেই মেয়ের কারণে আজ সে সুস্থ তার সাথে তিনি কি করে এমন অকৃতজ্ঞের মতো ব্যবহার করতে পারে!নাহিন কুহেলিকাকে উঠায়।চলে যাবে সে।তবে কুহেলিকা কিছু সময় স্থির থেকে গম্ভীর হয়ে বলে ওঠে,

”আমি সম্পূর্ণ ভাবে অনাথ হয়ে গিয়েছে নাহিন।আমি চাইনা তুমি অনাথ হয়।আর আমাদের বাচ্চা দাদা-দাদির আদরহীন বড় হোক। তুমি চিন্তা করো না আমি ঠিক আছি।আমার কিছু হলে যে আমি আমার বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে পারবো না।”

নাহিন অবাক হয়ে যায়। ক্ষণিকের মাঝেই কি এমন হলো যে কুহেলিকা এতোটা পরিবর্তন হয়ে গেল!কুহেলিকা রুমের দিকে পা বাড়ায়।ভাবতে থাকে দুইমাস আগের ঘটনা।

বিজনেস মিটিং থেকে ফেরার পথে একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে বসে কুহেলিকা আর তানজিল চৌধুরী। তানজিল চৌধুরী মেইন কোর্স আসার পূর্বে কুহেলিকাকে বলে,

”আম্মা জানিস মানুষ দীর্ঘদিন বাঁচে না।তবে একজন মৃত মানুষের জন্য যদি তুই নিজের স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব ফেলিস তাহলে সে কষ্ট পায়।”
”আব্বু হঠাৎ এসব বলার কারণ কি?”(কুহু)

কুহেলিকার প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তানজিল চৌধুরী আবারো বলে ওঠেন,
”মৃতের জন্য কান্না করতে নেই মানুষের সামনে। মানুষ মানুষের শত্রু যা তুই ইতিমধ্যে উপলব্ধি করেছিস। মানুষ তো শুধু কাঁচা ঘাতে ক্ষত করতে পারে।ভরতে পারে না।তাই কখনো যদি আপন কাউকে হারাস তাহলে একদম দূর্বল হবি না।আর যদি দূর্বল হোস তাহলে দেখবি এই দূর্বলতাকে কেন্দ্র করেই তোকে শেষ করে দিতে চাইবে।তাই সবসময় স্ট্রং থাকবি।বুঝলি?”
”হুম আব্বু।তবে..”(কুহু)
”আর কথা নয় খাওয়া শুরু কর।আর শোন আমি বাসায় ফাইল পাঠিয়ে দিবো বিজনেস হ্যান্ডওভার করবো তোকে।এই বয়সে ব্যবসা সামলাতে ভালো লাগে না।তোরটা তুই বুঝে নে”

তানজিল চৌধুরীর এতটুকু স্পষ্ট কথা ছিলো।পরে তিনি বিরবিরিয়ে আরো অনেক কিছুই বলেন তবে তা কুহেলিকার শোনার বাইরে ছিলো।আজ কুহেলিকা বুঝেছে তার বাবার প্রতিটা কথার মানে।সত্যিই দূর্বলতা কারো সামনে প্রকাশ করতে নেই। দূর্বলতা কেন্দ্র করে মানুষ খেলে।কুহেলিকা পেটে হাত বুলায়।আস্তে আস্তে বলে,

”তোরা চিন্তা করিস না মা আছে তো।আমি হয়তো আমার মা-বাবাকে বাঁচাতে পারিনি।তবে তোদের কিছুই হতে দিবো না ইনশাআল্লাহ।মা তোদের সুস্থ জীবন দিবে।”

কুহেলিকা ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয়।অনেক ঝড় গেলো আজ তার ওপর দিয়ে। বিছানার দিকে তাকায় একবার সে।এখনো বিছানায় পড়ে আছে রিভার্সিবলের তৈরি ব্ল্যাংকেট।কুহেলিকা তা দেখে মুচকি হাসে।তবে রক্তের গন্ধে গা গুলিয়ে আসে ওর। তলপেটে হালকা হালকা ব্যথাও অনুভব হচ্ছে।কুহেলিকার ব্যথা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

”নাহিন,নাহিন আমি পারছি না।নাহিন ”

কুহেলিকা চেঁচিয়ে ওঠে।নাহিন ছুটে আসে।কুহেলিকা মেঝেতে রক্তের মাঝেই বসে পড়েছে।নাহিন বুঝতে পারে কুহেলিকার লেবার পেইন উঠেছে।তবে ডেইট তো ছিলো সামনের মাসে!নাহিন কুহেলিকাকে কোনো মতে উঠিয়ে কাঁধে ভর দিয়ে গাড়ি অব্দি নিয়ে আসে। ওর বাবা কিংবা মা একবারের জন্যও বের হয়ে দেখে না কি হয়েছে!

কুহেলিকার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে।ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে সে।নাহিন ড্রাইভ করছে।পারছে না কুহেলিকাকে আগলে ধরতে।কুহেলিকা আজ হারে হারে বুঝতে পারছে মা থাকা সত্যিই একটা মেয়ের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ!মা যতই রাগ করে থাকুক না কেন মেয়ের কষ্টে ঠিকই এগিয়ে আসে।তবে অন্যরা কি আদৌ খোঁজ নিয়ে দেখে!

কুহেলিকার নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। কাসফিয়া চৌধুরী আর নাহিদ খানও ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছে।জমজ হয়েছে কুহেলিকার।একটা মিষ্টি মেয়ে আর একটা মিষ্টি ছেলে। অবশ্য এইটা তো কুহেলিকারা আরো আগে থেকেই জানতো।

নাহিন বাচ্চা দু’টোকে কোলে নিয়েছে।ছেলেটা একদম কুহেলিকার মতো দেখতে হয়েছে।মায়ের চোখ পেয়েছে।এমা একি কান্ড মেয়েটাও তো মায়ের চোখ পেয়েছে। তবে কাসফিয়া চৌধুরী বলেন মেয়েটা দেখতে নাকি নাহিনের মতো হয়েছে।কুহেলিকাকে এই নিয়েই সব বলছে নাহিন।

বাচ্চা কোলে না নিয়ে বউয়ের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিলো সে।কুহেলিকাকে বেডে দিছে তারপর বাচ্চা কোলে নিয়েছে সে।বাচ্চার কানে আজান দিয়েছে।পাগল একটা!কুহেলিকা নার্সের মুখে স্বামীর এমন কথা শুনে এমন অবস্থাতেও হেসে ফেলেছে।নাহিন দু’জনকে নিয়ে এসেছে।

নরমাল ডেলিভারিতে আটঘন্টা অতিক্রম হওয়ার পর কষ্ট অনেকাংশ কমে এসেছে কুহেলিকার।তবে দূর্বলতা জেঁকে বসেছে তাকে।বাচ্চা দুটো ঘুমিয়ে আছে।নাহিন খাবার আনতে গিয়েছে একটু আগেই। কাসফিয়া চৌধুরীর ইমার্জেন্সি চট্টগ্রাম ব্যাক করতে হয়েছে।আর নাহিদ খান রয়ে গেছেন। কেননা তার এমনিতেও এখানে থাকতে হতো। অপারেশন ছিলো তার পাশের একটা হসপিটালে। সেখান থেকেই চট্টগ্রাম ব্যাক করবেন তিনি।

কুহেলিকার অনেক একা লাগছে।ভাবছে আজ যদি আব্বু বেঁচে থাকতো তবে নিশ্চই কুহেলিকাকে বেড থেকে নামতে দিতো না।মা বেঁচে থাকলে হয়তো ওকে খাইয়ে দিতো জোর করে। বাচ্চাদের দেখে রাখতো।কুহেলিকার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।তবে কপোল পেড়নোর পূর্বেই কুহেলিকা অশ্রুরেখা মুছে নেয়।

একটু চোখ বুজেই ছিলো তখনই হুড়মুড়িয়ে কয়েকজন ঢোকে কেবিনে।নাসরিন সুলতানা আর নাহিনের বাবার সাথে রাব্বি মুনতাসির আর ফাতেমা বেগম।এসেই কুহেলিকার বাচ্চাদের দিকে হাত বাড়াতে নেবে তখনই প্রবেশ করে নাহিন।

”দাড়ান।কি করছেন আপনারা এখানে?”

নাহিনের কন্ঠস্বর পেতেই নাসরিন সুলতানা বলে ওঠেন,

”নাহিন এ কেমন ব্যবহার!আমি দাদি হই ওদের।কোলে নিতেই যাচ্ছিলাম”

নাসরিন সুলতানা বাচ্চা মেয়েটাকে কোলে নেয়।নাহিন বাঁধা দিতে চেয়েছিলো।তবে কুহেলিকা বাঁধা দিতে নিষেধ করে।যেমনই হোক মায়ের ভালোবাসা তো পেয়েছে ওনার থেকে তাই টানটা রয়েই গেছে।নাসরিন সুলতানা বাচ্চা মেয়েটাকে দুলাতে থাকেন।

”নানু ভাইয়ের নাম কি হবে ভেবেছিস নাহিন?”

কুহেলিকা অবাক হয়।সবাই শুধু তার মেয়েটার দিকেই এটেনশন দিচ্ছে।ছেলেটার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।কারণ কি?মেয়ে হারিয়ে বলে কি শুধু নবজাতক মেয়েই আদর পাবে আর ছেলেটা ফেলনা হবে!নাহিন ওর বাবার কথার জবাব তার পূর্বেই ফাতেমা বেগম বলে উঠে,
”কি বলো ভাই! ওরা তো বাচ্চা মানুষ।ওরা কি নাম রাখতে পারে।নাম তো রাখে বাড়ির বড়রা।কি বলো নাসরিন?”
ফাতেমা বেগমের কথায় তাল মিলিয়ে ‘হুম,ঠিক বলেছেন আপা’ বলে ওঠেন নাসরিন সুলতানা। তবে কুহেলিকা চুপ থাকে না।বাচ্চা মেয়েটা কাঁদতে থাকে।কুহেলিকা ছিনিয়ে নেয় নিজের কোলে।পরিষ্কার করে দেয়।তারপর আলতো করে বলে ওঠে,

”কিনায়া কি হয়েছে মাম?আর কান্না করে না।তুমি তো আমার কিনায়া,আমার কিনায়া পাখি”

”এ কেমন বেয়াদবি কুহেলিকা?বাচ্চাটা তো ব্যথা পেতো।কিভাবে ছিনিয়ে নিলে তুমি!আর কেমন নাম কিনায়া!আমার নানুর নাম ভাই জ্যোতি। পরিবারের বাকিদের নামের সাথে মিলিয়ে। আমাদের জ্যোতি”

নাসরিন সুলতানার কথায় কুহেলিকার রাগ ওঠে।এতদিন তার মানে মুখোশের আড়ালে ছিলো। মানুষ পারেও বটে।ওহ, মুখোশ আড়ালে থাকার কারণও তো ছিলো।তখন তো কুহেলিকার বাবা ছিলো,একজন ক্ষমতাধর বিজনেস ম্যান!কুহেলিকা রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় না।দেখতে চায় নাহিন কিছু বলে কিনা।তবে নাহিন চুপ থাকে এই জ্যোতি নাম শোনামাত্রিক।কুহেলিকার রাগে যেন তা ঘি ঢালার মতো।

”দুঃখিত আম্মু, আপনাদের দেওয়া নাম রাখতে পারবো না।আমার যেহেতু ছেলে-মেয়ে সেহেতু নাম রাখার অধিকারও আমার”(কুহেলিকা)
”বাহ,কুহেলিকা এতদিন তো আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতি না আর এখন আমার মুখে মুখে তর্ক করছিস!আর বাচ্চা কি তোর একার?বাচ্চা তো আমার ছেলেরও।আর আমাদের ছেলের মানে আমাদেরও অধিকার আছে”(নাসরিন)
”আপনাদের ছেলের বাচ্চা যেহেতু তাহলেই ওই পেটে ধরতো!নয়মাস পেটে ধরলাম আমি।আর অধিকার চলে গেল আপনাদের কাছে।বাহ”(কুহেলিকা)
”নাহিন,তুই কিছু বলবি!তোর বউ কথায় কথায় তোর মা’কে অপমান করছে”(নাহিনের বাবা)
”অপমান করার সুযোগ করে দিছো কেন তোমরা?কি বলবো আমি ওকে?তোমার ভাই-ভাবী,ছেলে মিলে আমার বউকে মারার প্ল্যান করে নিজে মরে যায়।আর দোষ হয় আমার বউয়ের।আমার অন্তঃসত্ত্বা বউয়ের দায়িত্ব দিয়ে আসি মায়ের কাছে,তিনি কোথায় যেন চলে যান!বসায়া এসে ডাইনি উপাধি দেন আমার বউকে। অধিকার, অধিকার যে করছো তোমাদের কোনো অধিকার নেই তো কুহেলিকার বাচ্চাদের ওপর।আমিও যে অধিকার দেখাতে পারছি না ওদের ওপর।আমার রক্ত হয়তো ওদের ওপর বইছে কিন্তু শেষ সময়ে তোমরা কুহুর সাথে যা করেছো তার কারণে আমি যে সেই অধিকার হারিয়েছি।জাস্ট তোমাদের কারণে।তোমরা হয়তো আমার ওপর অধিকার দেখাতে পারো।তবে ওদের ওপর পারবে না”

নাহিন কাঁদতে থাকে।কুহেলিকা স্থির বসে থাকে।তার ছেলেটা এবার কেঁদে ওঠে।সবার দৃষ্টি এবার ওর দিকে যায়।এতোক্ষণ তো ওনারা এক বাচ্চা নিয়েই মাতোয়ারা করেছে।নাহিনের কষ্ট যেন তা দেখেই আরো বেড়েছে।তবে তা নিয়ে আর বলেনি।এদের সাথে কথা বলতেই এখন রুচিতে বাঁধছে ওর।তবে যত যাই হোক মা’কে তো ও ভালোবাসতো। ফেলে দিবে কি করে! বাচ্চারা আরেকটু বড় হলেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে নাহিন।

”দোস্ত,দোস্ত আমি মামা হইছে”
কেবিনে হুড়মুড়িয়ে ঢোকে মুফতি। কিছুক্ষণ আগেই কুহেলিকা তাকে জানিয়েছে।এখনই এসে হাজির।ঢাকাতেই ছিলো। অবশ্য ডেটে যাবে বলে এসেছিলো।তবে ভাগ্য ওকে এখানে আনলো।হাতে কয়েকটা ব্যাগ।তবে এতো লোকজন দেখে শান্ত হয়ে গেছে বেচারা।নয়তো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে খুশিতে বলতো,
”দোস্ত আমাদের ছোট্ট বেলায় খেলা পুতুলঘর তোর মনে আছে?আমরা ওদের নিয়ে আবার পুতুল পুতুল খেলবো।”

”পরপুরুষের যে হারে এই মেয়ের সাথে ওঠাবসা আদৌ এই বাচ্চা আমার ছেলের তো!”
নাসরিন সুলতানা এই বাক্য উচ্চারণ করেই চলে যান।নাহিন মায়ের কথায় ধিক্কার জানায়। মুনতাসির পরিবারের সবাই বেরিয়ে যায়।নাহিন গিয়ে মুফতিকে হাগ করে। জিজ্ঞেস করে,
”কেমন আছো?”(নাহিন)
”সুপারভ ভাই।তবে তুমি নাকি কান্নাকাটি করছো!”(মুফতি)
”কে বলছে!”(নাহিন)
”কে আর তোমার গুণধর বউ আমাকে বলছে! আচ্ছা সরো তো আমি আমার মামাদের সাথে একটু সাক্ষাৎ করি।নয়তো ভবিষ্যতে বলতে পারে যে মামা তুমি আমাদের থেকে আমার মা-বাবাকে বেশি ভালোবাসো”(মুফতি)
”হ্যা ,হ্যা এই নে তোর বড় মামাকে!”

কুহেলিকাকে কিনায়াকে এগিয়ে দেয়।কিনায়া দুই মিনিটের বড় ছেলের থেকে।মুফতি কিনায়ার গালে চুম্বন করতে গিয়েও করে না কেননা বড়দের মুখে অনেক ধরনের জীবাণু আছে যা নবজাতকের জন্য ক্ষতিকর।কিনায়াকে দিয়ে ছেলে বাবুকে কোলে নিয়ে বলে ওঠে,
”আমার মামাদের নাম কিরে ফকিন্নী?”
ফকিন্নী শব্দ শোনা মাত্রই কাঁদতে থাকে ছেলে বাবুটা।মুফতি বলে ওঠে,
”সরি মামা তোমার মা তো রানী।আর তুমি রাজপুত্র। কাঁদে না মামা”
নাহিন-কুহেলিকা হেসে দেয় মুফতির সরি বলা দেখে।তবে কিয়ান কাঁদছিল অন্য কারণে।তাই নাহিন কিয়ানকে নিয়ে পরিষ্কার করে দেয়।আর কুহেলিকা বলে ওঠে,
”মেয়ের নাম কিনায়া মুনতাসির আর ছেলের নাম কিয়ান মুনতাসির ”

চলবে কি?

দুই পথের পথিক পর্ব-২২

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২২
#বর্ষা
বাকশক্তি হারিয়েছে কুহেলিকা।কখনো কথা বলতে পারবে কিনা ডক্টররা নিশ্চিত নয়। কেননা কুহেলিকা কেমন নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে।কথা বলার চেষ্টা করছে না।যেন তার নিজেরই কোনো ইচ্ছে নেই।কুহেলিকাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে কায়েস মির্জার কথাগুলো।উনি আত্মসমর্পণ করেছে।যত যাই করুক না কেন ওর সাথে,ওদের সাথে একসময় তো ওনাকে আব্বু ভেবে কত অভিযোগ লুকিয়ে রেখেছে।খুব কি দোষ হতো উনি নির্দোষ হলে!

সেই ঘটনার দুইদিন পেরিয়ে গেছে।কুহেলিকার তো টানা দুইদিন জ্বরে চোখ খোলার অবস্থাই ছিলো না।আজ জ্বর ছেড়েছে। ইমার্জেন্সি রুম থেকে আবারো কেবিনে দিয়েছে।ডাক্তাররা তো ভেবেই নিয়েছিল কুহেলিকাকে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না। একেতো গলা চিপে ধরায় কন্ঠনালির ক্ষতি,দ্বিতীয়ত কোনো প্রকার মেন্টাল ট্রমা থেকে জ্বর।

কুহেলিকা আজ চোখ মেলে তাকিয়েছে।টুলে বসে কুহুর হাত দুটো আঁকড়ে কাদছিলো নাহিন।কুহু মুচকি হাসার চেষ্টা করে‌।কথা বলার চেষ্টা করে।তবে কন্ঠ বের হয় না।কুহেলিকা আতংকিত হয়ে বারবার চেষ্টা করতে থাকে।যা ওর জন্য আরো মারাত্মক পরিণতি সৃষ্টি করতে পারে। নাহিন ওকে শান্ত করতে জড়িয়ে ধরে।কুহেলিকা নেতিয়ে পড়ে।নার্স তাকে ইনজেকশন দিয়েছে।এই অবস্থায় উত্তেজিত হওয়া মোটেও কাম্য নয়।তবে এভাবে যদি বারবার ওকে ইনজেকশন দিয়ে শান্ত করতে হয় তাহলে এটা ড্রাগের মতো কাজ করবে।

তানজিল চৌধুরী মেয়ের এই কষ্ট দেখতে পারছেন না। তিনি নিজেকে দায়ী করছেন এসবের জন্য। তিনি বারবার ভাবছেন কেন তিনি পরিবারের খুনিদের ধরতে মেয়েকে আনলেন এর মাঝে! কাসফিয়া চৌধুরী নিউরোলজিস্ট হওয়ায় কুহুর কন্ঠ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে না পারলেও মানসিক সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছে।নাহিন গতরাত থেকে না খেয়ে বসে থাকায় বহু বলে কয়ে ওকে খেতে পাঠিয়েছে।আর কুহুর জন্য খাবার আনতেও বলেছে।

সাতদিন পর,,,

দেখতে দেখতেই পার হয়নি সাতদিন। কুহুর কষ্ট,আবেগ সব যেন মিশে আছে।তানজিল চৌধুরীর সাথেও পরিচিত হয়েছে নাহিন।নাহিন জোভানের নামে কেস করেছে।তবে সে কেস গ্রহণ করা হলেও কার্যকর হয়নি। কেননা জোভানের অবস্থা এখনও ভালো হয়নি।

কুহেলিকা এখন অনেকটাই নিজেকে সামলে নিয়েছে।সে যে কথা বলতে পারবে না এটা সে মেনে নিয়েছে।বাড়ি ফিরেছে আজ তারা‌।রাব্বি মুনতাসির কুহুকে চড় মারতে নিলেই হাত ধরে ফেলে নাহিন।হুমকির স্বরে বলে,

”চাচা ভুল করো না।চাইলে তুমি আর তোমার স্ত্রীকেও জেলে ঢুকাতে পারি।আমি কিন্তু জানি তোমরা লামিয়ার সাথে কি করেছে!”

রাব্বি মুনতাসির থেমে যান। রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ান। ফাতেমা বেগমকে টেনে রুমে নিয়ে যান।রাকিব মুনতাসির এগিয়ে আসে।ওর মা আর বোনকে ও নানাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে সপ্তাহ আগে।আজ ও চলে যাবে।এখানে থাকলে ওর বোন আরো মানসিক সমস্যাও সাইকো হয়ে উঠবে তাই এই সিদ্ধান্ত।জারিফ আদালতে নিজের আরো অপকর্মের মাঝে লামিয়াকে মেন্টালি উইক করে পাগলা গারদে পাঠিয়েছে।

রাকিব বেরিয়ে যায়। নাসরিন সুলতানা ছুটে এসে কুহুকে আগলে নেন।দূর থেকেই বউমাকে অবলম্বন করে নাহিনের বাবা।এতোদিন পর মেয়ের অপরাধীদের ছাড় দেওয়ার আফসোস তার হচ্ছে।মেয়ের জন্য মনটা কাঁদছে।নাহিনের বাবা সেখান থেকে সরে যান।

তানজিল চৌধুরী মেয়েকে রেখে ফিরে যেতে পারেন না।তবে বেয়াই বাড়িতেও থাকেন না।কিছু দূরে হোটেলে উঠবেন বলেই সিদ্ধান্ত নেন।মেয়ে কাগজে কলমে লিখে জানায় যে চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রি যেন রিওপেন করা হয়। কাগজ পত্র দেয় কুহেলিকা।আর বাবাকে এও জানায় বাবা যেন দায়িত্ব নেয় এর।

দেখতে দেখতে আরো দুইমাস কেটে যায়।জোভান দশবছরের জন্য জেলে আছে।আর জারিফের তো ফাঁসি হয়েই গেছে।কুহেলিকাও আগের থেকে এখন অনেকটা ইমপ্রুভ করেছে।জিহানের কোনো খোঁজ খবর নেয়।তবে রাব্বি মুনতাসির আর ফাতেমা বেগমের আচরণ সন্দেহজনক।এই দুইমাস ভালো ব্যবহার করে মন জয়ের চেষ্টা করে চলেছেন।

”নাহিন,নাহিন,নাহিন”

কুহেলিকা ডাকতে থাকে নাহিনকে। অল্পস্বল্প কথা সে বলতে পারছে এখন। পুরোপুরি খত না হওয়ায় ধীরে ধীরে কন্ঠস্বর ফিরছে।নাহিন বাইরে থেকে মাত্রই এসেছে।বউয়ের এমন চেঁচামেচিতে ছুটে আসে।

”কি হয়েছে বউ?”(নাহিন)
”নাহিন গেস করো তো কি হয়েছে?”(কুহু)
”উমমম…পারছি না তো তুমিই বলো ”(নাহিন)
”তুমি বাবা হতে চলেছো নাহিন”(কুহু)
”ওহ..কি!”

নাহিন প্রথমে খেয়াল না করলেও পরবর্তীতে অবাক হয়ে যায়।কুহেলিকার কপালে চুমু খায়।চোখ দিয়ে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।এই অশ্রু আনন্দের।

তানজিল চৌধুরী সুখবর জানতে পেরে মেয়ের জন্য হাত ভরে বাজার করে এনেছে।মেয়ের পছন্দের সব চকলেট,মিষ্টি,ফল সব এনে সামনে রেখেছে।বাবার এমন কাজে কুহেলিকা তো হাসতে হাসতে শেষ।আর ওর বাবা তো কতশত কথা বলছে।এই বলছে আমার একটু ছোট বোন আসবে আবার বলছে আমার একটা ছোট ভাই আসবে।

”আম্মা শোন মেয়ে হলে কিন্তু নাম রাখবি কিনায়া আর ছেলে হলে নাম রাখবি কায়ান। সুন্দর না কি বলো নাহিন?”(তানজিল)
”আব্বু নামগুলো তো সুন্দর।তবে আপনিই তো রাখবেন।”(নাহিন)
”হুম নাহিন ঠিক বলেছে আব্বু”(কুহু)

তানজিল চৌধুরী হাসেন।তবে সেই হাসির মানে বুঝতে কুহেলিকার লেগে যায় আট মাস।তানজিল চৌধুরী মারা যান।কারণ খুঁজলে পাওয়া যায় তিনি ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত ছিলেন। অপারেশন করেননি।মারা গেলেন শেষমেশ।কুহেলিকা নয়মাসের প্রেগন্যান্ট।বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে ও।কবর দেওয়ার সময় নাহিন নেয়নি তাকে।

নাসরিন সুলতানা সাধ্যমতো কুহেলিকাকে সামলে রেখেছেন।মেয়েটা আবারো নিশ্চুপ হয়ে গেছে।বাবার মৃত্যুর সপ্তম দিনে কুহেলিকা কবর স্থানে যাওয়ার সুযোগ পায়।নাহিন বউকে নিয়ে যায়।কবর স্থানে গিয়ে বাবার কবরের কাছে বসে পড়ে কুহেলিকা। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে,

”আব্বু কেন আমায় জানালে না যে তোমার ব্রেন টিউমার!আব্বু আমায় একা করে কেন ভিন্ন পথে চলে গেলে আমায় রেখে!আব্বু তোমার আমার পথ কেন আবারো আলাদা হলো!আব্বু আমার ভালোবাসার মানুষেরা কেন হারিয়ে যায়?”

কুহেলিকা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ে। নাহিন কুহেলিকাকে ওখান থেকে নিয়ে আসে।বাসায় ফিরে নাহিন দেখে জিদান ফিরে এসেছে।মুখে তার ক্রুড় হাসি।নাহিন লক্ষ্য করে।কুহেলিকার মাথা থেকে সবই বেড়িয়ে যায়।

আরো চারদিন পেরিয়ে গেছে।নাসরিন সুলতানা কোনো কাজে বাইরে গিয়েছেন।আর একদিন আগেই নাহিন চট্টগ্রাম গিয়েছে কোনো এক কাজে।বাসায় কুহেলিকা একা।হ্যা মানুষ আছে তবে শত্রুপক্ষ জিদান,রাব্বি মুনতাসির আর ফাতেমা।

কুহেলিকা বাবাকে হারিয়ে সাইকোতে রুপান্তরিত হয়েছিলো।কাউকে আর আগের মতো নিজের কাছে ঘেঁসতে দেয়নি।একাই বিরবির করে কি জানি‌ বলে।আজ বাড়ি ফাঁকা দেখে জিদান বন্দুক হাতে কুহেলিকার ঘরে যায়। বিছানায় কাউকে শুয়ে থাকতে দেখে কুহেলিকা মনে করে গুলি চালায়। বন্দুকের গুলি রিভার্স মোডে তার দিকেই ফিরে আসে।মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জিদান।কুহেলিকা বারান্দায় ছিলো। বন্দুকের শব্দে আঁতকে ওঠে সে।দ্রুত বেরিয়ে এসে দেখে জিদান মরে পড়ে আছে। একদম বুক বরাবর লেগেছে।ফাতেমা বেগম আর রাব্বি মুনতাসির তো ক্ষেপে যান।কুহেলিকাকে মারতে এগিয়ে আসতে নিলেই চাকু দেখিয়ে ভয় দেখাতে থাকে সে।রাব্বি মুনতাসির পুলিশে ফোন দেন। ফাতেমা বেগম কাঁদতে থাকেন।

পুলিশ আসার মিনিট দশেক পরেই সিআইডি টিম উপস্থিত হয়।কিছু এনালাইসিস করে বডি নিয়ে যায় ফরেনসিক টিম।তবে যাওয়ার আগে সুইসাইড বলেই ধারণা বলে যায়।জিদানের লাশের হাতে তখনও শক্ত করে বন্দুক ধরা।কুহেলিকাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিলো তবে সে মোটামুটি সবই পজেটিভলি বলেছে।তাই তারা ফিরে গিয়েছেন।তবে সংবাদ মাধ্যম তার কাজ করেছে।আর ইতিমধ্যে নাসরিনও ফিরে এসেছেন। ফাতেমা জাকে জড়িয়ে বউমার নামে কু্ৎসতা রটাতে থাকে।আর কোনো এক অজানা কারণে প্রথমবারের মতো কুহেলিকার গায়ে হাত তোলেন তিনি।বলে ওঠেন,

”তোর মতো মেয়ে অভিশাপ।যেদিন থেকে এ বাড়িতে এসেছিস সব শুধু ধ্বংস করছিস! নিজের মা-বাবাকে খেয়েছিস।এখন এই বাড়ির ছেলেগুলোকেও খাচ্ছিস।ডাইনি”

কুহেলিকা ভেঙে পড়ে। নাহিন কুহেলিকাকে সারপ্রাইজ দিতে দ্রুত এসেছিলো।তবে এয়ারপোর্টে নেমে খবর শুনা মাত্রই আর অফিসে না গিয়ে বাসায় এসেছে।মায়ের কথাগুলো তারও কানে ঢুকেছে।নাহিন যেন অবাকতা কাটিয়ে উঠতে পারে না।একেতো সে তার মায়ের দায়িত্বে বউকে রেখে গিয়েছিলো সে তো তার দায়িত্বে অবহেলা করেছে আবার তার মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়া মেয়েটাকে আরো দূর্বল করে দিচ্ছে!

”কুহেলিকা ওঠো,আমরা….!”

চলবে কি?