Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 201



দুই পথের পথিক পর্ব-০৮

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৮
#বর্ষা
নাহিন রেগে আগুন হয়ে আছে।এই বাড়ির মানুষগুলো কতটা নির্লজ্জ হলে এমন কাজ করতে পারে নাহিন ভেবে পায় না।কুহেলিকা এখনো পৌঁছায়নি। কোথায় গেলো মেয়েটা?ফোনও অফ।নাহিনের চিন্তার মাঝেই তার রুমে আসে মিসেস রাইসা জুনায়েদ মির্জা।সঙ্গে তার রোহানী।রাইসা এগিয়ে এসে খোঁজ খবর নেয়,নাহিন ভদ্র ভাষায় জবাব দেয়।তবে রেগে যায় রাইসার পরবর্তী কথাগুলো শুনে।

—নাহিন ভাই তুমি এতো সুদর্শন তোমার পাশে কি কুহেলিকাকে মানায়?

রাইসার কথায় চোখ তুলে তাকায় নাহিন।রাগ যে উঠেছে তা দাঁত চেপে সহ্য করছে।সে দেখতে চায় এই পরিবার কতটা নামতে পারে তা।রাইসা আবারো বলে ওঠে,

—আমাদের রোহানী এখানে থেকে মাস্টার্স করছে। একদম লাখে একটা মেয়ে।তো..

—তো?

—তুমি তো অবিবাহিত। আমাদের রোহানীও অবিবাহিত, সুন্দরী,স্মার্ট।তোমার সাথে কিন্তু রোহানীকেই মানায়!

—তাই?

—হুম।

—আমি কোনো মডেল নই যে আমার ম্যাচিং কাউকে লাগবে।আর আমি কোনো মডেলকে বিয়েও করতে চাই না।আমার কাছে আমার কুহেলিকাই সেরা।সেই থাকবে এবং সেই আছে।ভুলেও দ্বিতীয়বার আমার সামনে আসবেন না আপনারা।

নাহিনের ধমকে ভয় পেয়ে বেরিয়ে যায় রাইসা আর রোহানী।তবে রোহানীর ভেতরটা জ্বলছে। কেননা আজ অব্দি সেই শুধু রিজেক্ট করেছে কিন্তু এই প্রথম সে রিজেক্টেড হয়েছে।রোহানী ক্রোধে,লজ্জায়,অপমানে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সশব্দে দরজা লাগায়।নাহিন বিরবির করে বলে ওঠে,

—বেয়াদব।

—কাকে বেয়াদব বলছেন মহাশয়?

কুহেলিকা ক্লান্ত ভাবে এগিয়ে এসে নাহিনের সামনের চেয়ারে বসে।নাহিন মোবাইলে সময় দেখে।রাত দশটা পনেরো মিনিট।নাহিনের মেজাজ খারাপ হয়।এই মেয়েটা এখানে এসে কি অনিয়ম করছে।নাহিন রাগ দেখানোর পূর্বেই কুহেলিকা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,

—আমার আপনাকে প্রয়োজন নাহিন,আমার আপনাকে চাই,আমি আপনাকে অনুভব করতে পারি নাহিন‌। আপনি কি আমার হয়েই থাকবেন সারাজীবন?

নাহিনের রাগ গলে পানি হয়ে যায়।কুহেলিকার ক্লান্ত বাক্যগুলোও কত মায়াবী লাগছে। ভালোবাসার মানুষের সবই কি মায়াবী লাগে এমন!নাহিন কুহেলিকার মায়া আচ্ছন্ন থাকা অবস্থাতেই বলে ওঠে,

তোমার দীর্ঘপল্লবে আপনার দৃষ্টিতে শুভদৃষ্টি,
হরিণী চোখে হারিয়েছি হৃদয় বারিবারি।
তোমার নাম খুদিত আপনার চিত্তে,
আটকেছি তোমার আপনাতে অসময়ে।

তোমার কথিত প্রতিটি বাক্যে,
পেয়েছি আপন ঠিকানা খুঁজে!
তোমার নিখুঁত স্বীকারোক্তিতে,
হারিয়েছে আপনার আপনিকে!

কুহেলিকা ক্লান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

—ডিনার করেছেন?

—তুমিই তো মাত্র ফিরলে।

—তাহলে আরেকটু ওয়েট করুন।ফ্রেশ হয়ে এসে একেবারে নিচে যাবো।

—হুম

নাহিনের জবাব শোনা মাত্রই বেরিয়ে যায় কুহেলিকা।আজ প্রচন্ড ধকল গিয়েছে ওপর দিয়ে। বিকেলের দিকে বের হওয়ার সময় কুহেলিকার গাড়ির ব্রেকফেল হয়েছিলো তবে কুহেলিকার সন্দেহ কেউ ব্রেকফেল করিয়েছিলো।মাথায় হিজাব বাঁধা বিধায় বোঝা যাচ্ছে না তার ব্যান্ডেজটা। অবশ্য সে ব্যান্ডেজ খুলে আসতে চাইছিলো তবে যারা তাকে উদ্ধার করেছে তারা দেয়নি।

গাড়ি গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে একদম মুমুর্ষ অবস্থা।যেন আগে থেকেই কেউ গাড়ির অন্তর্পাঠগুলোর মুমুর্ষ অবস্থা করে রেখেছে।গাড়ির তেল ফাটা স্থান দিয়ে বেরতে থাকে।সিটবেল লক হয়ে গেছে বিধায় একদমই বের হতে পারছিলো না সে।দরজা কোনো মতে খুলেও ভেতরে আটকে সে।নিভু নিভু চোখ যেন গাড়ির অক্সিজেনে স্লিপিং গ্যাস দেওয়া।

তখনই কিঞ্চিত দূরে কালো রঙের গাড়ি থামে।বেরিয়ে আসে দুই নর-নারী। পুরুষটি দ্রুত সিলবেট টানতে থাকে। একপর্যায়ে ভেঙে খুলে যায়।গাড়ির তেলও যেন বাঁধ হীনভাবে গড়িয়ে চলেছে।তারা দুজনে সম্মুখে কুহেলিকাকে গাড়ি থেকে বের করে ছুটে দূরে চলে আসে।গাড়িতে হঠাৎ আগুন লেগে যায়।

হসপিটালে জ্ঞান ফিরলে কুহেলিকা দেখতে পায় নাহিদ খানকে। অচেনা মানুষদের থেকে ঘাবড়ে যায় সে।তারপর গাড়ির ঘটনা স্মরণে আসতেই নিজের চারপাশ দেখে।অজ্ঞান হওয়ার পূর্বে যে তাদের দেখেছিলো তা কিঞ্চিত হলেও স্মরণে আসে।

—এখন ঠিক আছো তুমি?

কুহেলিকা তাকিয়ে থাকে নিরুত্তর নাহিন খানের দিকে।নাহিদ খান আবারো বলে ওঠেন,

—বয়সে তুমি আমার সন্তানতুল্য তাই তুমি করেই বললাম।

—আমি এখানে?(কুহু)

—তোমার মাথা থেকে অনেক ব্লিডিং হচ্ছিলো।ইমেডিয়েটলি ট্রিটমেন্ট লাগতো তাই নিয়ে এসেছিলাম.(নাহিদ খান)

কুহেলিকা কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকে।তারপর অনুরোধে সুরে বলে,

—আমাকে কি আপনার ফোনটা কিছু সময়ের জন্য দিতে পারবেন?

—অবশ্যই এই নেও।

—ধন্যবাদ।

কুহেলিকা ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা হাতে নেয়।ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসতে বলে।কুহেলিকা নিজের পোশাকেই আছে অর্থাৎ বেশিক্ষণ হয়নি এখানে সে তাই দ্রুত আরেক জায়গায় কল দিয়ে বলে ওঠে,

—ক্লিন এভরিথিং এট ফাস্ট।

নাহিদ খান শেষের কথাটা বুঝতে পারেননা।তবে প্রশ্ন করে বিব্রতও করেন না।কুহেলিকা মোবাইল ফিরিয়ে দেওয়ার পরপরই সফিয়া প্রবেশ করেন হাতে খাবারে প্যাকেট।তিনি যেন কুহেলিকার বহুদিনের পরিচিত এমন করেই কুহেলিকাকে বলে ওঠেন,

—মা,জ্ঞান যখন ফিরেছে যাও দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।একা না পারলে চলো আমি তোমায় সাহায্য করছি।তারপর কিছু খেয়ে নিবে।

কুহেলিকার চোখে পানি চিকচিক করতে থাকে।আজ প্রথম কোনো নারীকে দেখে তার মা,মা ফিলিংস আসছে। ইচ্ছে হচ্ছে জাপটে ধরে বললে আমি আপনাকে আম্মু ডাকতে চাই।তবে তা যে সে চাইলেও করতে পারে না। একেই তারা কৃতজ্ঞতা করেছে তার ওপর।তারপর আবার অচেনা।হয়তো আজ দেখা হলো কাল হারিয়ে যাবে দূরে।

ফ্রেশ হয়ে আসতেই কুহেলিকা দেখে নাহিদ খান বাইরে গিয়েছেন।সফিয়া পাশে বসে ওর। কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,

—আমি মিসেস সফিয়া,ওয়াইফ ওফ নাহিদ খান।তোমার নাম কি আম্মু?

কুহেলিকা অবাক হয় নাহিদ খান নামটা শুনে।নাহিনের নামের সাথে প্রায় পুরো নামটারই মিল রয়েছে।তবে মুহুর্ত কয়েক বাদেই স্বাভাবিকভাবে নেয় সে নামটা। কেননা একরকম নাম থাকতেই পারে।কুহেলিকা স্বাভাবিক স্বরে মিষ্টি হেসে বলে,

—কুহেলিকা চৌধুরী,গ্রান্ডডটার অফ কোহিনুর চৌধুরী।

কোহিনুর চৌধুরী নামটা শোনামাত্রই সফিয়ার মুখটা কেরকম একটা হয়ে ওঠে।কুহেলিকা মানে খুঁজে পায়না।তবে তারা নাম্বার আদান-প্রদান করে যদিওবা কুহেলিকার ফোন তার কাছে নেই বরং আগুনে ঝলসে গেছে।তবে সিম তো তোলাই যাবে।সফিয়া কুহেলিকাকে গাড়ি আসার পরও অনেকক্ষণ ধরে বেঁধে বসিয়ে রাখে,আদর করে,গল্প করে,মায়া বাড়ায় যেন বহুদিনের তৃষ্ণা মেটায়।

কুহেলিকার ধ্যান ভাঙে কান্নার শব্দে।বাড়িভর্তি মানুষ কান্না করছে কেন?তাহলে কি প্রাণ উড়ে গেলো!কুহেলিকা দ্রুত নিচে আসে।সিনান‌ মায়ের বুকে লেপ্টে কাঁদছে। মৃত্যুদশায় মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছে কায়ফা।কি সেই নির্মম যন্ত্রণা!কুহেলিকারই রুহ কেঁপে ওঠে কায়ফার যন্ত্রণা দেখে। প্রাণ পাখি উড়ে যাওয়ার শেষ সময়ে কায়ফা কুহেলিকাকে ডেকে বলে ওঠে,

—বোন আমায় মাফ করে দিস।আমার সিনানকে মায়ের ভালোবাসা দিস আর..

আর বলতে পারে না কায়ফা।চারপাশে কান্নার আওয়াজ যেন আরো তীব্র হয়।সিনানকে ছাড়িয়ে আনে কুহেলিকা। বুকে শক্ত করে আগলে রাখে।চারবছরের বাচ্চা হয়তো মারা যাওয়া বোঝে না তবে চোখের সামনে মায়ের যন্ত্রণা দেখেই পীড়িত সে। বাচ্চাটা তো বুঝলোও না তার মা হারিয়ে গেছে তার থেকে চিরদিনের মতো।

সাফিন‌ কাঁদছে।দীর্ঘ অপরাধ বোধে কাঁদছে সে। বুকের ভেতর দুরুম দুরুম করে কেউ যেন হাতুড়ি পেটা করছে।হারিয়ে ফেললে মানুষ মূল্য বোঝে।সাফিনেরও হয়েছে সে দশা।সাফিনের মরে যেতে মন চাচ্ছে।বিরবির করে বলছে,

—কায়ফা তুমি না মরে আমি মরলেও তো পারতাম। আমাদের ছেড়ে কেন স্বার্থপরের মতো চলে গেলে।

সবাই ভাবছে কি এমন রোগ ছিলো মেয়েটার যে সুস্থ সবল মেয়েটা রোগা হতে লাগলো,চেহারা নষ্ট হয়ে গেলো,অরুচির দেখা দিলো, কন্ঠস্বর অন্যরকম হয়ে গেলো।রুমানা আফরোজ যেন এসবের মাঝেও চিৎকার করে বলে উঠলেন,

—কুহেলিকাই আমার মেয়ের খুন করছে আমি জানি।আমি ওকে ছাড়বো না।আমি নিজের হাতে খুন করবো ওকে।

কুহেলিকা সরে দাঁড়ায়।যদিও এখন কিছু বলা ঠিক হবে না।তবুও সে বলে কেননা এদেরকে যে অপরাধবোধে ভোগাতেই হবে।আদরের মানুষটাও একসময় বড্ড ফেলনা হয়ে যায় যার প্রমাণ কায়ফার করুণ এদশা।কুহেলিকাকে কাঁপতে দেখে নাহিন‌ শক্ত করে হাত ধরতেই।কুহেলিকা বাকিদের দিকে তাকিয়ে ধমকে বলে ওঠে,

—মেয়েটা গত ছয়মাস যাবৎ অসুস্থ দেখেও হসপিটালে নিতে আপনার কষ্ট লাগে।আর এখন মারা গেছে আমি খুন করেছি তাইতো! আপনাদের সবার অবহেলায় মরেছে কায়ফা আপু।কায়ফা আপু ব্রেন ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে। আফসোস ডক্টর যদি শেষ সময় দিয়ে দেওয়ার আগে আমি জানতাম।যদি জানতাম তবে যত ক্যামো লাগে করাতাম তবুও বাচ্চাটাকে অনাথ হতে দিতাম না।কায়ফা আপু তো আপনাদের সবার আদরের তাহলে তার ক্ষেত্রে কেন করলেন অবহেলা?!

চলবে কি?

দুই পথের পথিক পর্ব-০৭

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৭
#বর্ষা
কোহিনুর চৌধুরীর লয়ারের সাথে তুমুল ঝগড়া চলছে জুনায়েদ মির্জা আর জাহিদ মির্জার।কারণ একটাই যে চৌধুরী বংশের একটা কানাকড়িও তাদের নামে নেই!জুনায়েদ তো অলরেডি পুলিশে ফোন দেওয়ার হুমকিও দিচ্ছে কেননা লয়ার ইসতেগফার হোসেন কড়াকড়ি বলে দিয়েছেন এই বাড়ির বর্তমান উত্তরসূরী কুহেলিকা চৌধুরী।চাইলে কুহেলিকা তাদের রাখতেও পারে আবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বেরও করে দিতে পারে!

রুমানা আফরোজ কুহেলিকার কাছে গিয়ে নরম স্বরে অনুরোধের বাচনভঙ্গিমায় বলে ওঠেন,

—মা তুই বল এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায় যাবো!আর তুই তো আমাদেরই মেয়ে তোর কাছে থাকার অধিকার তো আমাদের আছেই তাই না বল।

—বাহ,বাহ আন্টি কিছুক্ষণ পূর্বেও না এই মেয়ের সাথে নিকৃষ্ট আচরণ করলেন।আর এখনই আপনাদের মেয়ে হয়ে গেল!

নাহিনের কথায় রুমানা আফরোজ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা সম্পূর্ণ রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বলে ওঠেন,

—এই ছেলে বেশি কথা বলো তুমি! আমাদের পারিবারিক বিষয়ে একদম নাক গলাবে না।

—নাহিন‌ আমার ভবিষ্যৎ স্বামী অর্থাৎ আমার ফ্যামিলির অংশ।সো তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে ভুলবেন না।

সাফিন কুহেলিকার কথার মাঝে বা’হাত ঢুকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠে,

—এতো যে স্বামী স্বামী করছো এখনো বিয়ে হয়নি।দেখবে তোমাকে সহ্য করতে না পেরে কয়দিনের মাথাতেই এই ছেলে পালাবে।

নাহিন কুহেলিকার দিকে তাকায়।কুহেলিকাকে হাসতে দেখে থমকে যায় সে।সে তো ভেবেছিলো তার প্রেয়সী এই কথাটার প্রতিবাদ করবে।নাহিনের আঘাত পাওয়া হৃদয়ের অনুভূতি বোঝার পূর্বেই কুহেলিকা হাসতে হাসতে বলে ওঠে,

—দীর্ঘ সাতবছর যেই ছেলেটা আমায় আগলে রাখলো,আমায় সুন্দর জীবন,সম্মান দিলো সে কি আদৌ আমায় ছেড়ে যাবে!যে ছেলে আমায় এতো বছরেও একা রেখে পালায়নি সেই ছেলে আগামীতেও যে পালাবে না তার নিশ্চয়তা অবশ্যই আছে ইনশাআল্লাহ।

সাফিন চুপ হয়ে যায়।তবে নতুন করে আবারো কিছূ বলে ওঠার পূর্বেই লয়ার বলে ওঠে,

—কুহেলিকা মা সব কাগজপত্র তো দিলামই এখন তুমি দেখো কি করবে!আমি চলি তাহলে।

—আচ্ছা আংকেল। আল্লাহ হাফেজ

কুহেলিকা বিদায় জানায় ইসতেগফার হোসেনকে।প্রধান ফটক অব্দি এগিয়ে দিতে দিতে গুরুত্বপূর্ণ কয়েক কথাও সম্পূর্ণ হয় তাদের।তবে তা যে খুব গোপনীয় তা কন্ঠের নমনীয়তা এবং হ্রসতায় পরিবেষ্টিত।

***

কুহেলিকা বাড়িতে নেই।নিহান রয়ে গিয়েছে বিশ্রামের জন্য। পাশাপাশি আজ সকালেই পায়ে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে।সাফিন স্যার দেখে ওদেখা করে নাহিনের পায়ের ওপর চেয়ার তুলে দিয়েছিলো।

—ওফস সরি নাহিন আমি তোমায় খেয়ালই করিনি।খুব কি লেগেছে!

—সমস্যা নেই।আমি ঠিক আছি।

—আমি সত্যি তোমায় খেয়াল করিনি গো।

নাহিন নিজেকে শান্ত রাখলেও তার মনের মানুষ সহ্য করেনি। বরং ঠাস করে বলেই দিয়েছিলো।

—স্যার আপনি বয়স্ক হচ্ছেন তারই লক্ষণ হিসেবে এতো বিশালদেহী নাহিনকেও আপনি লক্ষ্য করলেন না!

কুহেলিকার বাচনভঙ্গিমায় ব্যথার মাঝে মুখে হাসি ফুটে তার।মেয়েটা যে ব্যঙ্গ করতেই বলছে তা এখানে উপস্থিত সবাই বুঝতে পারবে।তাইতো কায়ফা বলে উঠলো,

—কুহু তোর দুলাভাই খেয়াল করেনি বললো তো।তাও কেন পচাচ্ছিস তাকে!

কুহেলিকা তার অভাবনীয় মুদ্ধতা ছড়িয়ে সুপ্রশস্ত হাসি হেসে নাহিন ধরে উপরে নিয়ে যেতে যেতে বলে ওঠে,

—আমিও তো তাই বলেছি।বৃদ্ধ হয়ে পড়ায় দুলাভাই খেয়াল করেনি।

সাফিন হাত মুঠো করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে।ওর এখন অসহ্য লাগে এই নাহিন নামক পুরুষটিকে।কি আছে এই পুরুষের মাঝে?হ্যা আছে সৌন্দর্য আর টাকা। সাফিনের ভাবনা মতে,নারী আটকায় পুরুষের টাকায় আর পুরুষ আটকায় নারীতে!আসলেই সে নিজেদের প্রাধান্য দিলেও অধিকাংশ নারীকে হেয় করেছে।নারী আটকায় পুরুষের যত্নে,সম্মানে, ভালোবাসায়,শ্রদ্ধায়।যার পুরোটাই কুহেলিকা পাচ্ছে নাহিনের থেকে!

কুহেলিকা নাহিনকে ঘরে রেখে পা ম্যাসেজ করে দিয়ে সেই যে গেল আর ফেরেনি এখনো।কুহেলিকা কোনো এক কারণে মির্জা পরিবারকে যে থাকতে দিয়েছে তার ধারণাও করে ফেলেছে সে। কেননা যেই মেয়ে চাইলেই খুব সহজে তাকে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া মানুষদের বের করে দিতে পারে,সেই মেয়ে তাদের খাতির যত্নে রাখছে।বেশ ভাবার বিষয়!

নাহিন ঘরে বসে বিরক্ত হচ্ছিলো বিধায় একটু হাঁটাহাঁটি করতে করিডোরের দিকে যায়।রোহানীও নাচতে নাচতে সামনে না তাকিয়েই এগিয়ে আসছিলো।তা দেখে নাহিন সরে যেতে গিয়ে পায়ে আবারো ব্যথা পায়।রোহানী নিজের বামদিকে তাকিয়ে অবাক হয়।কত সুন্দর একটা ছেলে!

রোহানীকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাবান্তর দেখা যায় না নাহিনের মাঝে।তবে ভেতরে ভেতরে সে প্রচন্ড রেগে যাচ্ছে।মনে মনে ভাবচ্ছে এই বাড়ির কোনো মানুষেরই বুদ্ধিমত্তা ভালো না।সে পড়ে আছে দেখেও এই মেয়ে একটু সাহায্য করছে না বরং হা করে তাকিয়ে আছে।দরজার হাতল ধরে দাড়াতেই রোহানী হাত বাড়িয়ে বললো,

—হায় আমি রোহানী.

—হুম..

—আরে কোথায় যাচ্ছেন পরিচয় তো দিয়ে যাবেন নাকি!

—আমি পরিচয় দিতে ইন্টারেস্টেড নই।সামনে থেকে সরুন।

—আরে আরে যাহ চলেই গেলো।তবে কে ছিলো এই হ্যান্ডসামটা?!

রোহানী ঢুলতে ঢুলতে বোনের ঘরের দিকে যায়। পথিমধ্যে রামায়সার সাথে দেখা।রামায়সা ছুটে এসে তার আন্টকে জড়িয়ে ধরে বলে,

—আন্ট আমার জন্য কি এনেছো?

রোহানীও ভাগ্নিকে কোলে তুলে চকলেট দিয়ে বলে ওঠে,

—আন্ট তো জাস্ট চকলেট এনেছি বেবি সরি।

—নো‌‌ প্রবলেম আন্ট

—তোমার মাম্মাম কোথায় রামায়সা?

—ঘরে।

রামায়সাকে কোল করেই রোহানী ঘরের দিকে যায়।একটা যতই খারাপ হোক না কেন বাইরের মানুষের কাছে। সেক্ষেত্রে নিজের প্রাণপ্রিয় আপির অংশের কাছে সবসময় সেরা থাকারই চেষ্টা থাকে তার। এক্ষেত্রে রোহানীও কিন্তু পিছিয়ে নেই।নিজে জন্ম না দিয়েও খালাগত অধিকারে মা হওয়ার অনুভূতি সর্বাপেক্ষা সুন্দর একটা সম্পর্ক।

****

জুনায়েদ কাউকে ফোন দিয়েছে।কিছু কথা বলছে হয়তো।তবে তা গোপনীয়।রুমটা একদম সাইলেন্ট।আর জুনায়েদ হচ্ছে সাইলেন্ট কিলার। খুব ছোটবেলায় খুব ঠান্ডা মাথায় খুনের খেলা খেলেছিলো।তবে জেল তো দূরের কথা কেউ বুঝতেই পারেনি যে সেটা স্বাভাবিক মৃত্যু‌ নয় বরং খুন।

—শেষ করে দেও।

জুনায়েদ শেষ কথাটা বলে ফোন কান থেকে নামায়। বাঁকা হাসে।রাগে গা জ্বলছে।একে তো নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে তার ওপর আবার বাড়ি নাকি ছাড়তে হবে।মগের মুল্লুক নাকি সব।দরকার পড়লে কুহেলিকাই শেষ করে দিবে।তবুও সম্পত্তি থেকে নজর ঘোর বোকামি হবে!

জুনায়েদ বেচারা আপন মনে সবই চিৎকার করে বলছে।তার তো ধারণা কেউই শুনছে না তার কথা।তবে তার রুমেও যে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে তা হয়তো সে ভুলেই গেছে।কেউ একজন হ্যাক করেছে সেই সিসিটিভি ক্যামেরা। সম্পূর্ণ লাইভ শুনছে কি করতে চলেছে সে।

অন্ধকারে আবৃত কক্ষে বসা লোকটা জুনায়েদের হিংস্র কথাবার্তা শুনে রাগান্বিত হয়ে ওঠে। হাতের কাছের গ্লাসটা জোরে দূরে ছুঁড়ে মারে।চিৎকার করে বলে ওঠে,

—মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার খুব শখ জেগেছে মনে তাই না! মৃত্যুর কাছ থেকে ঘুরিয়ে আনার দায়িত্ব আমার আর মৃত্যুর কাছে পাঠানোর দায়িত্ব তোর কৃতকর্মের।

লেপটপটা ঠাস করে বন্ধ করে বেরিয়ে যায় লোকটা।তিনি বেরিয়ে যেতেই লাইটটা জ্বলে ওঠে। কোনো এক হোটেল রুম।একটু বাদেই প্রবেশ করে কয়েকজন গুন্ডা টাইপ লোক।তবে কাউকে না পেয়ে চিরুনি তল্লাশি করে বেরিয়ে যায় তারা।

করিডোরের ওপর প্রান্ত থেকে বেরিয়ে আসে লোকটা।খুব সূক্ষ্মভাবে কিঞ্চিত জায়গাতে নিজেকে আটকে রেখেছিলো।যেন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কোনো স্পাই।গুন্ডা টাইপের লোকগুলো বেরিয়ে যেতেই কাউকে ফোন দিয়ে বলে উঠলো,

—চট্টগ্রাম আসছি।

—(কন্ঠধ্বনি শোনা যায় না)

—হ্যা তারা আমাকে খুঁজছে। তবে পায়নি এখনো।চট্টগ্রাম সেভ হতে পারে।আর আমি এই সিম ফেলে দিবো নতুন সিমের ব্যবস্থা করে রেখো।রাখছি।

লোকটা কালো হুডির জ্যাকেটটা সামনে আরো টেনে নেয়।এই গরমের মাঝে হুডি!বসন্তকালেই যে গরম পরে বাংলাদেশে তা যেন অন্য দেশের গ্রীষ্মকাল।হায়রে গরম তুই গ্রীষ্মে তো ঝালাপালা করে দিবি। মানুষ তো তখন কারেন্ট না থাকায়,তোর অতিরিক্ততায় আগুনের ফুলকির রুপ ধারণ করবে।সামলাবে কে এদের?

—এক্সকিউজ মি. দিজ ইজ মাই রুম।ক্যান ইউ গিভ মি স্পেস।

মেয়েলী কন্ঠস্বরে পেছনে তাকায়।তবে গুরুত্ব না দিয়ে কিংবা সরি না বলেই বেরিয়ে যায়।মাঝবয়সী নারীটি অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে।কেন জানি লোকটাকে তার খুব কাছের কেউ মনে হতে লাগে।খুব কাছের কেউ! পেছন থেকে বার কয়েক ডাকলেও লোকটা পেছনে ফিরে তাকায় না।

—সফিয়া কিছু হয়েছে? এভাবে কাকে ডাকছো?

—কাউকে না..

চিন্তিত মুখশ্রীতে ঘুরে তাকায় স্বামী নাদিম খানের দিকে। বিশিষ্ট হার্ট সার্জন নাদিম খান। নাদিম খান স্ত্রীর ওরুপ মুখশ্রীতেও অপলক তাকিয়ে থাকেন।এতো বছরেও স্ত্রীর প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা কমেনি তার।

—এমন করে কি দেখছো?

—আমার বউটাকে যে রাগলে কিংবা হাসলে কিংবা কান্না কিংবা চিন্তা করলে সবসময়ই অপরুপা লাগে তাই দেখছি।

চলবে কি?

দুই পথের পথিক পর্ব-০৬

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৬
#বর্ষা
”দূর আকাশের নীলচে তাঁরা
নীলচে আমার বিকেলবেলা!
একলা আমার সকাল-সন্ধ্যা
কেটেছে রঙহীনতায়!”

কুহেলিকা নাহিনের দিকে তাকিয়ে ছড়া আকারে বলার চেষ্টা করে।নাহিন বসে আছে কুহুর ঘরে।নাহিন প্রশ্ন করেছে কুহেলিকাকে কেন তার পদবী চৌধুরী আর তার পরিবারের পদবী মির্জা!কেন তার পিতা-মাতা জীবিত থাকলেও তার সার্টিফিকেটে পিতা-মাতার নাম নেই!

”আমি মির্জা বংশের কেউ না,কেউ না।আমি চৌধুরী বংশের পরবর্তী প্রজন্ম।আমি কোহিনুর চৌধুরীর রক্তের রক্ত ”

”মানে?”

”সঠিক সময় আসুক সব বলবো আপনাকে”

নাহিন আর প্রশ্ন করেনা।কুহেলিকা যখন বলেছে সময় আসুক তারপর বলবে তখন সে সঠিক সময় আসলেই বলবে।এই কথার নড়চড় যে হবে না তা খুব ভালো করেই জানে সে।

”চলুন যাওয়া যাক”

”কোথায়?”

”বাহ রে লাঞ্চ করবেন না?চলুন”

”আমি যে বেশি ওয়েলি খাবার খেতে পারিনা তা তো জানোই ”

”জানি,এখন চলুন”

খাবার টেবিলে খাবার দেখে চমকে ওঠে নাহিন।হেল্পিং হ্যান্ড নাঈমা বিবি খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন।পিনাট,স্যামন মাছের কাবাব,মাটনের সহিত ব্রকলি সুপ।সবই নাহিনের পছন্দের।তবে দেশে সব জায়গায় খুব একটা স্যামন মাছের দেখা যে পাওয়া যায় না তাও জানে নাহিন।আবার ভাবে কে রান্না করলো এগুলো!নাহিন তাকায় কুহুর দিকে।কুহু মুচকি হাসে।নাহিন বুঝে ফেলে কে রেঁধেছে খাবারগুলো।

”কখন রাঁধলে এগুলো?”

”বাসায় এসে”

”একটু আগেই না আসলাম!স্যামন মাছ তো সাধারণ বাজারে পাওয়া যায় না। বাসাতেই ছিলো কি?”

”যাওয়ার সময় ড্রাইভার কাকাকে বলেছিলাম আনিয়ে নিতে। তিনিই এনেছেন”

”এতো অল্প সময়ে রাঁধলে কি করে?”

”আমার খিদে পেয়েছে কিন্তু। খাওয়ার পথ কথা বলবো।এখন আপনিও খান আর আমাকেও খেতে দিন”

নাহিন মাথা ঝাঁকিয়ে হাসতে হাসতে খেয়ে নেয়।তবে খাবার তালুতে ওঠে যখন তারই সামনে বসে অপরিচিত বাচ্চা ছেলেটা বলে ওঠে,

—তুমি কি আমার আন্টের আংকেল?

সিনানের কথায় কুহেলিকা উচ্চশব্দেই হেঁসে দেয়।নাহিন যেন বিপাকে পড়ে।বাচ্চাটা কি বলছে সে আদৌ জানে তো!সিনানকে ডেকে নিজের দিকে আনে সে।কুহেলিকা হাসতে হাসতেই খেতে থাকে।নাহিন বাচ্চাটাকে কোলে বসিয়ে বলে,

—বাবু আমি তোমাল আংকেল হই তোমার আন্টের না।আমি তোমার আন্টের জামাই হই।

‘জামাই হই’কথাটায় যেন খাবার তালুতে ওঠে কুহেলিকার ।কুহেলিকা তো বলেছিলো হবু স্বামী আর এ ছেলে তো আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে।বিয়ের আগেই বলছে স্বামী।পরে দেখা যাবে বিয়ে হওয়ার পর বলবে ‘বাবুর মা’ শোনো। কথাগুলো চিন্তা করেই কুহুর কান দিয়ে ধোঁয়া বেরতে থাকে।

—সিনান চলো আমরা ওদিকটায় খেলি।

ছোট্ট রামাইসা বলে ওঠে।সিনান রামাইসা পুরো নাম উচ্চারণ করতে পারে না বলে ছোট করে রাইসা বলে। সেক্ষেত্রে রাইসা কিন্তু ওর বড় মামীর নামও হয়!জাহিদের তিনবছর বয়সী মেয়ে রামাইসা মির্জা হুর।

সিনান চলে যেতেই কুহেলিকা চোখ রাঙানি দেয় নাহিনকে।নাহিন ভয় পাওয়ার মিথ্যে অভিনয় করে।কুহেলিকা নাহিনকে গেস্টরুমে রেখে নিজের রুমে চলে আসে। দুপুর তিনটা পঞ্চাশ।আছরের আজান দিতে আরো একঘন্টা।কুহেলিকা ঘুমিয়ে পড়ে।

বিকেল বেলা চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে কুহেলিকার।চোখমুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে এমনই হয়।কুহেলিকা ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে।সাফিন ঝামেলা করছে।বলছে,

—আব্বু দেখেন বাড়িতে মেয়ে,বউ,বাচ্চা আছে।এমন অপরিচিত কাউকে বাড়িতে থাকতে দেওয়া খুবই ভীতিকর।ওনাকে আজই চলে যেতে বলুন।

—দুলাভাই আপনাদের নিকট নাহিন অপরিচিত হলেও আমার নিকট অপরিচিত নয়। তাই চিন্তা করবেন না।

—তোর মতো মেয়ে বাড়িতে থাকলেই চিন্তা আর সেখানে অপরিচিত পুরুষের চিন্তা যেন যোগ হলো।

জাহিদের কথায় কুহেলিকা চুপ থাকে না।আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে ঠাঁটিয়ে চড় লাগিয়ে দেয় নিজের থেকে পাঁচ বছরের বড় ভাইকে। জাহিদ তেতে উঠে পাল্টা চড় লাগাতে নিলেই হাত খামচে ধরে কুহেলিকা। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,

—ভাই ভাইয়ের মতো থাকলে মাথার তাজ করে রাখতাম।রাস্তার নেড়ি কুকুরের মতো আচরণ করছেন বিধায় কুকুরের মতো লাত্থিই পাবেন!

—কুহেলিকা তোমার ব্যবহারের অবনতি হচ্ছে!বংশের নাক উঁচু করছো দেখছি!

রাগান্বিত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলে ওঠে কায়েস মির্জা।কুহু বাক্য শুনেও আনশুনা করে দেয়।নাহিনের হাত ধরে বলে ওঠে,

—আমার আঁকড়ে ধরা হাত ভুল মানুষের না। আমাকে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া মানুষটাও নিশ্চিত আল্লাহর লেখা তকদির।তবে সকলের অপমান তকদির মেনে তোমাদের আমি ছেড়ে দিচ্ছি না।সো মাইন্ড ইট দ্যাট হি উইল বিকাম ইউর সান-ইন-লো।

*****

রাত্রি নয়টা কিংবা দশটা। অপরিচিত একজন মধ্যবয়স লোক দাঁড়িয়ে আছে গভীর অরণ্যে।সামনেই দেখা মেলছে ভিন্ন জাতির,ভিন্ন দেশের মানুষদের।কিছু একটা পাচারের চেষ্টাই চলছে সরকারের আড়ালে।ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে ভিডিও করে নেন তিনি।

ভোরের খবরের কাগজে ছেয়ে গিয়েছে ভারত উপমহাদেশের প্রদেশে চলছে ড্রাগ ডিলিং এর অবৈধ আদান-প্রদান। পরিচিত মুখ সাংবাদিক তানজিল আহমেদের তত্বাবধানেই ফাঁস হয়েছে ড্রাগ ডিলিং চক্রের তথ্য। তবে এই মাঝবয়সী লোক এখন ভারত ত্যাগী হয়ে গিয়েছেন কিঞ্চিত মুহূর্ত পূর্বেই।দেশের ধন দেশে ফিরছে।

—হ্যালো,আমি দেশে আসছি।তুমি সব গুছিয়ে রেখেছো তো?

—চিন্তা করো না সব আমাদের হাতের মুঠোয় আছে। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।

—হুম, তবে তার পূর্বে আরেকজনকেও যে খুঁজে বের করতে হবে।

তানজিল আহমেদ কারো সাথে কথোপকথন জারি রাখেন তবে এয়ারপোর্টে সন্দেহজনক কয়েকজনকে দেখে কলটা কেটে দেন।কোমড়ের পেছনের দিক দিয়ে কিছুটা উঁচু।তানজিল আহমেদ জহুরি নজরে বুঝে ফেলেন ওইটা কি।শব্দহীন ভাবে উঠে গিয়ে ওয়াশরুমে দাঁড়ান।যা ভেবেছিলো তাই লোকটাও এসেছে।তানজিল আহমেদের মাথায় গান ঠেকিয়ে বলে ওঠে,

—পেনড্রাইভ দে..

—কি বলছেন আপনি কিসের পেনড্রাইভ?

—সাধু সাজো না? তাড়াতাড়ি পেনড্রাইভ বের কর নয়তো এখনই গুলি করে খাল্লাস করে দিমু।

তানজিল আহমেদ ওয়াশরুমের মিরর গ্লাসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে হঠাৎ করে সিংহের মতো হামলে পড়ে প্রতিপক্ষের ঘাড়ের মাঝে শক্ত হাতে আঘাত করে।লুটিয়ে পড়ে লোকটা।তার এই হামলা দেখে কেউই বলতে পারবে না যে তিনি পঞ্চাশ বছরের মাঝবয়সী।

তানজিল আহমেদ কাউকে ফোন করে কথা বলতে বলতে ওয়াসরুম ত্যাগ করেন।ইশারায় কাউকে কিছু বুঝিয়ে ফোন রেখে প্লেনের দিকে চলে যান হ্যান্ডব্যাগ হাতে।তবে যাওয়ার পূর্বে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে বাঁকা হেসে কিছু তো একটা ভাবেন!

****

সাফিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার বিছানার দিকে তাকাচ্ছে।ঘুমন্ত কায়ফার মাঝে আগের সেই কায়ফার কোনো মিলই পাচ্ছে না।আগে মেয়েটা অনেক খ্যাচখ্যাচ করতো এখন তার সিংহভাগই করে না।আবার দৈহিক সৌন্দর্য্যের পুরোটাই যেন হারিয়েছে।আর মন…?সেটা তো আগে থেকেই জানতো না সে।হ্যা সেই আটবছর আগে থেকেই কায়ফা তার পছন্দের রমনী।তবে ভালোবাসা কি হয়ে উঠতে পেরেছিলো? বিয়ের এই ছয়বছরের সংসারেও কি তাদের মাঝে ভালোবাসা হয়নি!

সাফিন চেয়ারে বসে খুঁজে বের করে মায়াবতী নিকনেমের আইডিটা।আজও স্মৃতি হিসেবে ম্যাসেজগুলো রেখে দেওয়া। মানুষ ভালো না বাসলেও আসক্ত হয়। একজন মানুষের সাথে প্রতিনিয়ত কথা বললে ভালো না বাসলেও তাকে কষ্ট দিতে চাওয়া যায় না।তার কষ্টে কেন জানি নিজেরও কষ্ট লাগে।আবার বহুদিনের চ্যাটিং এ গড়ে ওঠে মায়া।আর মায়ার সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি পোড়ায়।যেমন এখন পুড়ছে সে!” দূরে ছিলো ভালো ছিলো কেন আসলো এখানে ” এমনই মনোভাব এখন হয়েছে তার।সত্যিই তো এতবছর পর কেন আসলো কুহেলিকা!

চলবে কি?

দুই পথের পথিক পর্ব-০৫ + বোনাস পর্ব

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৫
#বর্ষা
নাহিন হসপিটালের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’দিন যাবৎ হসপিটালে সে।পূর্বের নাহিন মুনতাসির গত সাতবছর যাবৎ একবারেই অন্যরকম জীবন-যাপন করছে।কারণ ছিলো সাতবছর আগের সেই বিকেল।তবে কারণকে হারানোর ভয় জেঁকে বসেছিলো তার অন্তরে।

সাতবছর আগে…

কানাডা থেকে বিজনেস পারপাসে দেশে এসেছিলো সে।কম বয়সে এতো চাপ সহ্য করতে না পারায় ড্রাগ নেওয়ার নেশাও ছিলো তার।সেদিন ড্রাগের সন্ধানে অনেকটাই গ্রাম্য অঞ্চলের দিকে যেতে হয়েছিলো।ফেরার পথে গাড়ির ইঞ্জিনে সমস্যা হওয়ায় আর গাড়ি স্টার্ট হয়নি।নেটওয়ার্ক সিগন্যাল এতোই বাজে ছিলো যা বলার বাইরে।তার ওপর জঙ্গল এরিয়া।চোর-ডাকাতের উৎপাতে ভরা‌।

নাহিন তখন মোবাইল হাতে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে‌।কোথাও থেকে ভেসে আসে আর্তনাদ।পুরুষনালী সেই আর্তনাদ ছিলো খুবই করুণ।পূর্বের দিক থেকে ভেসে আসছিলো সেই আর্তনাদ।নাহিন দৌড়ে যায় সেদিকে।দেখতে পায় রক্তাক্ত শরীরে মেয়েটা কুপিয়ে জখম করছে নিচে পড়ে থাকা দুই ছেলেকে।নাহিন আঁতকে ওঠে।দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে পেছন দিয়ে ধরে।ফেলে দেয় মেয়েটার হাতের সুক্ষ্ম সেই লাঠি।বাঁধন থেকে ছুটতে না পেরে মেয়েটা বিরতিহীন বলতে থাকে,

—নরম পেয়ে গরম দেখাতে চেয়েছিলি কুত্তা*** ।কুহেলিকা চৌধুরী নিজের অহমিকায় ফিরে গেলে কেউ বাঁচবি না,কেউ না।কুহেলিকা চৌধুরী কোনো নাম নয় বরং আতংক।আর সেই আতংকের সাথে বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিলি! শাস্তি তো ভোগ করতেই হবে।

নাহিনের সাথে সেই মুহূর্তে প্রথম দেখা কুহেলিকার সাথে।সারা দেহ থেকে রক্তের স্ফুরাঙ্গ এতোই ছিলো যে জ্ঞান হারায় কুহেলিকা।টেনে হিচড়ে আনার দাগ রয়েছে মাটিতে।নাহিনের রাগে শরীর কাঁপতে থাকে।ঠিক সেই মুহূর্তেই ভাগ্যক্রমে নাহিনের নিকট এসে পৌঁছায় ড্রাইভার।ভয়ে কাঁপতে থাকে সে।জানায় গাড়ি ঠিক হয়েছে।দ্রুত বেরিয়ে যেতে এখান থেকে।নাহিন গিয়েছিলো ঠিকই তবে কুহেলিকাকে সঙ্গে নিয়ে।জানতো এদেশে অসৎ কর্ম করতে চাওয়া ব্যক্তির থেকে যার সাথে অন্যায় হচ্ছিলো তার শাস্তি বেশি।তাইতো সেদিন ফেলে এসেছিলো ওই হারামীগুলোকে।

নিকটবর্তী হাসপাতালটা ছিলো শহরের মাঝেই।বলতে গেলে তারা যেই স্থানে আছে তা ঢাকা শহরের বুকে ছোট্ট গ্রাম। জঙ্গলের অন্য পাশে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছিলো তবে ঘটনা ঘটার স্থান থেকে বেশ অনেকটাই দূরে!

হসপিটালে গিয়ে নাহিন থমকে যায় বেডে পরে থাকা কুহেলিকাকে দেখে। গোলগাল মুখশ্রী মায়া জড়িত। প্রথমবারের মতো হৃদয় যেন থমকে দাঁড়ায় তার। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিও বেড়ে যায় কয়েকগুণ।এইতো সেই মেয়ে যাকে খুঁজতে ব্যাকুল ছিলো তার মন।

নাহিন জড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরে না প্রেয়সীকে।ভেবে অবাক হয় এইতো সে মেয়ে যে গতপরশু মাঝ রাস্তায় পথশিশুদের সাথে বৃষ্টিতে যুবুথুবু হয়ে ভিজছিলো।হাতের ব্যাগটা শক্ত করে আগলে রেখেছিলো সে। বাচ্চাদের সাথে সেও বাচ্চা বনে গিয়েছিলো!

নাহিন ভাবনাচ্যুত হয়।ফোন বেজে উঠেছে।আজ তার পি.এ নির্ধারণের জন্য ইন্টারভিউ নেওয়ার কথা।তবে সময় মতো পৌঁছাতে পারছে না সে।নাহিনকে কিছু বলার পূর্বেই নাহিন নিজের মতো করে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,

—আমি আসছি না।আর দ্বিতীয়বার কল দিয়ে যদি ডিস্ট্রাব করেছো তো খবর আছে।মিজানকে বলো আমাকে কল দিতে।

মিজান কল দিতেই নাহিন রিসিভ করে।শীতল কন্ঠে বলে ওঠে,

—তোমাদের ভবিষ্যৎ ম্যামের ছবি দিচ্ছি।কাজ শেষে ছবি ডিলিট করবে আর কোনো খবর যেন বাইরে বের না হয়।আমার ওর সম্পর্কে সব খবর চাই এক ঘন্টার মধ্যে।

করিডোরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো নাহিন।পেছন থেকে ডক্টর বলে ওঠে,

—এক্সকিউজ মি মিষ্টার মুনতাসির আপনার পেশেন্টকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে।আর কোনো সমস্যা হলে আমাদের সাথে যোগাযোগে বিলম্ব করবেন না।

ঘন্টাখানেক নাহিন হসপিটালেই বসে ছিলো।একবার কেবিনে যাচ্ছিলো তো একবার নার্সদের জিজ্ঞেস করছিলো কখন জ্ঞান ফিরবে মেয়েটার।নাহিনের মনে ছিলো কুহেলিকার নাম। তাইতো রোগীর নামের জায়গায় ঠিক নামটাই স্থানান্তর করেছিলো।

ফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করে নাহিন।মিজান কল দিয়েছে।ঘন্টা পেরোতে এখনো দুই মিনিট।নাহিন হাসে।মিজান ছেলেটা যে কতটা পান্চুয়াল তা তার কাজের ধরণেই বুঝেছে সে। তাইতো এত বড় দায়িত্ব তাকেই দিয়েছিলো।

—হ্যা মিজান বলো।

—স্যার ম্যামের নাম কুহেলিকা চৌধুরী।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে স্টাডি করছে। ফার্স্ট ইয়ার। চট্টগ্রামের মেয়ে। অভিভাবক কোহিনুর চৌধুরী।এছাড়াও আমাদেরই অফিসে চাকরির অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছে।

—পিতা-মাতার নাম?

—দুঃখিত স্যার। সার্টিফিকেটের কোথাও পিতা-মাতার নাম উল্লেখিত নেই। শুধু অভিভাবকের নামের জায়গায় কোহিনুর চৌধুরী লেখা।ম্যাম হয়তো অনাথ‌।

নাহিন ফিরে তাকায় ফুলের মতো নিশ্চেষ্ট মেয়েটার দিকে। কেবিনের বাইরে থেকেই কাচ লাগালো অংশ দিয়ে দেখছে সে তাকে।মেয়েটা কি তার মতোই অনাথ! নাহিনের ভেতরটা হুঁ হুঁ করে ওঠে।কল রাখার পূর্বেই বলে ওঠে,

—তোমাদের ম্যামকে আমার পি.এ হিসেবে নিযুক্ত করো।আর শোনো তাকে জানিও না এবিষয়ে।

নাহিন সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিলো হসপিটাল থেকে। হসপিটালের লোকদের মুখ বন্ধ করিয়েছিলো টাকা দিয়ে।হয়তো কুহেলিকা তাকে খুঁজে ছিলো! রিহ্যাবে গিয়েছিলো নিহান।নিজেকে প্রতিবর্তের ঝোঁক জেকে বসেছিলো তার মনে।তবে পরের সপ্তাহ থেকেই প্রতিদিন দেখা মিলেছিলো কুহেলিকার।নাহিন সহ্য করতে পারতো না কুহেলিকার অন্য কোনো পুরুষের সাথে মিষ্টি ব্যবহার।তাইতো কুহেলিকা যার সাথে মিষ্টি ব্যবহার করতো তাদেরই ট্রান্সফার হতে হতো আরেক বিল্ডিং এ।তারপর হঠাৎ একদিন….

—স্যার?

ম্যানেঞ্জার তাইহুং এর ডাকে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে নাহিন।ম্যানেঞ্জারের সাথে রেগে আছে সে। কেননা এই ছেলেটা নাকি কুহেলিকাকে বলে দিয়েছে যে সে আবারো ড্রাগস নিয়েছিলো।সেই রাগে দুঃখে কুহেলিকা ফোন ধরছে না।নাহিন হাতের পাশেই রাখা মোবাইল ফোন ছুঁড়ে মারে।তাইহুং ধরে ফেলে।বলে ওঠে,

—স্যার ম্যাম কল করেছে।আপনি কল ধরছেন না তাই…

নাহিন ছুটে এসে তাইহুং-র থেকে ফোন নিয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে বলে ফোন দেয় প্রেয়সীর নিকটে।ক্ষমা প্রার্থনা করে কিছু বলে ওঠার পূর্বেই ওপাশ থেকে কুহেলিকা বলে ওঠে,

—আমাকে অপরাধী বানাতে চান?আমার কারণে যখন ছেড়েছিলেন তাহলে আবার কেন ড্রাগস নিলেন?আমাকে একা করে হারিয়ে যেতে চান স্বার্থপরের মতো!

কুহেলিকার অগোছালো কথা আর কথা বলার ধরণে নাহিন বুঝে যায় তার প্রেয়সী এখনো কাঁদছে।আলতো হাসে সে।এই মেয়েটার জন্য যে সে পাগল। মানুষের ভয়ই মানুষকে শেষ করে দেয়।তাইতো নাহিন না চেয়েও নিজের প্রেয়সীকে কাঁদিয়েছে।জীবনে একমাত্র বেঁচে থাকার অম্বল বলতে তো কুহেলিকাই তার সব।আর কেউ কি তার বেঁচে থাকার অম্বলকে নিজ ইচ্ছায় আঘাত দেয়!

কুহেলিকাকে ওয়াদা করে নাহিন।আর কখনোই সে ড্রাগস নেবে না।যত যাই হোক না কেন!কুহেলিকা নাহিনকে তবুও তার ভালোবাসার কথা বলে দেয় না অর্থাৎ ইজহার করে না নিজ প্রণয়ের।প্রকৃত প্রণয় কি বারেবারে ইজহার করতে হয়! অনেক ক্ষেত্রে প্রণয়ের দেখা মেলে অভিমানে,অভিযোগে, খুনসুটিতে,কেয়ারনেসে,সম্মানে।

কথা শেষে এশার নামাজ পড়ে নেয় কুহেলিকা।রাতের খাবার খেতে বের হবার সময়ই তার রুমে কায়ফা প্রবেশ করে।কায়ফাকে দেখে কুহেলিকা আঁতকে ওঠে।সেই আগের সুন্দর মুখশ্রী আর নেই। ভেঙে গেছে।কুহু সেদিন পেছন থেকে দেখেই বোনকে চিনে ফেলেছিলো তবে মুখশ্রী আজই দেখলো!কেমন যেন দেখতে লাগে!কায়ফা ঢুকড়ে কেঁদে ওঠে।বলে,

—কুহু আমাকে মাফ করে দে বোন।জীবনে এই ক্ষুদ্র সময়ে তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি।তবে বলে না, আল্লাহ ছাড় দেয় ছেড়ে দেয় না।ঠিক তেমনি তোর সাথে করা প্রত্যেকটা অন্যায়ের শাস্তি পেতে চলেছে আমার ছেলেটা।

—মানে?কি বলতে চাচ্ছো কায়ফা আপু?আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

—কুহু আমার ব্রেন ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ!

কুহেলিকা যেন আঁতকে ওঠে।কায়ফা কি সত্য বলছে!সত্যি বলতেই পারে তার চোখে মুখের অবস্থার পরিবর্তন,কন্ঠস্বরের পরিবর্তন সবই যেন সেগুলোর লক্ষণ।কায়ফা বিছানায় বসে বলে ওঠে,

—তোর দুলাভাই দূরের কথা বাড়ির কেউ জানে না এ সম্পর্কে।কিভাবে বলবো বল আমিই যে জেনেছি মাত্র কয়েকমাস পূর্বে!কিভাবে যে প্রাণঘাতী এই রোগ হলো বুঝতেই পারলাম না।তোর দুলাভাই যে আমায় বড্ড ভালোবাসে।সে যদি জানতে পারে কিভাবে বাঁচবে!

কুহেলিকা আগলে নেয় কায়ফাকে। একজন প্রকৃত মানুষ সামনের ব্যক্তিকে যতই ঘৃণা করুক না কেন তবে সামনের ব্যক্তির মৃত্যু লড়াইয়ের সংবাদ শুনে শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারে না।কুহেলিকাও তেমনি সইতে পারে না কায়ফার ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে হওয়ার কথাটা।যদি কায়ফা বোনের সম্পর্ক নিভাতো তো কুহেলিকার যে কাছের মানুষ কি আর কেউ হতো!

—কুহু আমি মরার পর তুই কি আমার সিনানের খেয়াল রাখবি।সাফিনকে বোঝাবি।সাফিন যে আমায় বড্ড ভালোবাসে!

কুহেলিকা সাফিন নামটা শুনে মুচকি হাসে।গত তিনদিন আগেই মাঝরাত্রে সে জানতে পেরেছে সাফিনই তার দুলাভাই। অবশ্য এ সংবাদ আর কেউ নয় বরং আয়শা দিয়েছে কুহেলিকাকে।দাওয়াত পেয়েছিলো সেও। সম্পর্কে ফ্যামিলি ফ্রেন্ডস তাইতো জানতে পারলো কুহু কে তার দুলাভাই!

মানুষের মনে যদি সামান্যতম মনুষ্যও থাকে তাহলেও সে কষ্ট পাবে কায়ফার পরিণতির জন্য।ক্যান্সারে যে একমাত্র সেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এমন না।তবে খুব অল্প বয়সে মা’কে হারানোর পর্যায়ে আছে সিনান।আর মা-বাবা হীন জীবন যে কত কষ্টের তা অন্ততপক্ষে কুহেলিকার অজানা নয়।

চলবে কি?

#দুই_পথের_পথিক
#বোনাস_পর্ব
#বর্ষা
ভোর হতেই কুহেলিকা বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে।শুনেছে আজ সাফিন স্যার আসবে অর্থাৎ ওর দুলাভাই আসবে।কুহেলিকার মনে কোথাও না কোথাও সাফিন আছে।তবে সাফিনের জন্য ভালোবাসা নয় বরং অগাধ শুকরিয়া আছে‌। কেননা সেদিন যদি সাফিন তাকে ফিরিয়ে না দিতো তবে সে তো আর নাহিনের মতো মানুষকে পেতো না।যে পুরুষ একজন নারীকে নিজের করার পূর্বে নিজে ভালো মানুষে পরিণত হয়,এরুপ পুরুষই কি মেয়েদের চাওয়া নয়!

কুহেলিকার এখনো মনে পড়ে সেদিনটা‌।প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হতেই নাহিন তার সামনে প্রস্তাব রেখেছিলো কানাডায় তার পি.এ হিসেবে যোগদানের এবং পাশাপাশি স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের সাথে উচ্চতর ডিগ্রি।কুহেলিকা প্রথমে অবাক হয়েছিলো।পরে নাহিন বুঝিয়েছিল মানুষের যোগ্যতা সার্টিফিকেটে নয় বরং দক্ষতা,পরিশ্রম এবং ইচ্ছা ও কর্মশক্তিতে।যার পুরোটাই আছে কুহেলিকার।

কুহেলিকার বিদেশ ভ্রমণের প্রথম সঙ্গী হলো নাহিন।নাহিনেরও প্রথম যাত্রা কোনো মেয়ের সাথে ছিলো। তাছাড়া কোনো মেয়ে শব্দ দুটো তো আসবে না কেননা নাহিনের প্রথম মেয়ে যাত্রীসঙ্গিনী ছিল তারই ভালোবাসার মানুষ।

—ম্যাম ফাইলটায় সাইন লাগবে।

কুহেলিকা ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করছে রাশিয়ান বায়ারদের সাথে। গার্মেন্টস সেক্টরের ব্যবসা ওদের। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন দেশে লাভজনক ব্যবসা রয়েছে নাহিনের।আর সেই কোম্পানিরই পঁচিশ পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ডার হওয়ার পাশাপাশি কোম্পানির এমডিও সে। ”গ্রিনলাইফ” কোম্পানির সিইও নাহিন,এমডি কুহেলিকা,মেইন এডভাইজার শেখ দাউদ ……!

—রেখে যান।

—ম্যাম ইম্পর্ট্যান্ট..

ইমপ্লয় নোভাকে এই কয়দিন যাবৎ তার সন্দেহ হচ্ছে।পাওয়া ডিলও হাতছাড়া হওয়ার পাশাপাশি প্রেজেন্টেশন চুরির যে বিষয়টা তাও ভাবাচ্ছে কুহেলিকাকে।

—প্লিজ জাস্ট গিভ ফাইভ মিনিটস…

কুহেলিকা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ছেড়ে যে ফাইল চেক করে দ্যান সাইন করবে ভাবতে পারেনি নোভা।ভয়ে ঘামতে থাকে।ধরা পড়লে জীবন শেষ।বলে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়!ঠিক তেমনি কুহেলিকাও পেয়ে যায় ফাইলের মাঝে লুকায়িত ব্ল্যাংক পেপার।নোভাকে চোখ রাঙানি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে গম্ভীরভাবে মিটিং শেষ করে ছাব্বিশ বছর বয়সী এই রমনী।

—এইটা কি?

—ম্য ম্যাম ব্ল্যাংক পেপার…

—ফাইলের মাঝে কি করছিলো..

—(নিশ্চুপ)

—এন্সার মি ড্যামিড।

—(নিশ্চুপ)

—প্রশ্নের জবাব দেও নয়তো পুলিশকে কল দিতে বাধ্য হবো।

নোভা পা জড়িয়ে ধরে মেঝেতে বসে পড়ে।কুহেলিকা পা ছাড়ানোর চেষ্টা চালায়।আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে নোভা।আজ অব্দি অনেকজন হায়ার ইউপ্লয় এসেছে।তবে কেউই এতোটা গুরুত্ব দিয়ে ফাইল দেখেনি,কে জানতো এখনকার হায়ার ইউপ্লয় গুরুত্ব দিয়ে ফাইল চেক করবে!

—ম্যাম ম্যাম আমাকে মাফ করে দেন।এমন ভুল আর কখনো হবে না।ম্যাম প্লিজ ম্যাম ক্ষমা করে দেন।

কুহেলিকা কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নোভার দিকে।গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,

—শর্ত রয়েছে…যার হয়ে কাজ করছিলে তার ফুল ইনফরমেশন চাই এবং প্রমাণ চাই যে সে চোর জাতির…

—ম্যাম আমাকে মাফ করে দেন আমি পারবো না..

—শর্তে রাজি হয়ে যাও নয়তো পুলিশের হেফাজতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।আর ভেবো না আমি হাওয়ায় গুলি ছুড়ে তোমায় জেলে পাঠাবো। একদম প্রমাণ সমেত যাতে কমপক্ষে ছয়মাস তোমার জেল হয়।বুঝতেই পারছো তারপর তোমার লাইফ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!

কুহেলিকার বাঁকা হেসে বলা কথায় নোভা আঁতকে ওঠে।কুহেলিকাকে যেন আতংকের সমার্থক মনে হচ্ছে তার।নোভা বলে ওঠে,

—ম্যাম আমি আমি রাজি…

***

কুহেলিকা মির্জা ইনড্রাসটিজের সামনে দাঁড়িয়ে। জুনায়েদ মির্জার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।কাসেম মির্জা আর কায়েস মির্জা খুব কমই আসে। জুনায়েদ পি.এ মায়মুনার কোমড় জড়িয়ে অসৎ সম্পর্ক স্থাপন করছে নিজ কেবিনের মাঝেই।সময় আর পারমিশন বিহীন ঢুকে যায় কুহেলিকা।হাতে তালি দিতে দিতে বলে ওঠে,

—বাহ বাহ কি চমৎকার!মির্জা বংশের ছেলে নাকি ঘরে বউ বাচ্চা রেখে বাইরে পরকিয়া করছে।তাও আবার কার সাথে,নিজের পি.এ এর সাথে!বাহ

—কুহেলিকা তোর সাহস কি করে হলো আমার কেবিনে আসার?আর তোকে পারমিশন কে দিয়েছে আমার পার্সোনাল জীবন নিয়ে কথা বলার!

—নূন্যতম লজ্জাবোধ নেই তাই না!তোমার ছোট বোন তোমাকে পরকিয়া প্রেম করা অবস্থায় হাতেনাতে ধরেছে তাও তুমি গলা উঁচিয়ে কথা বলছো ছিঃ

—আমার বা** ছোট বোন আসছে।কোন ছেলের হাত ধরে পালিয়েছিলি সতিত্ব আছে নাকি হারিয়ে ফিরিছিস কে জানে!তাও যে তোকে চৌধুরী ভিলায় থাকতে দেওয়া হয়েছে এই বেশি।সো আমাদের জীবন নিয়ে কথা বলতে আসবি না।

কুহেলিকার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।তারা তাকে থাকতে দিয়েছে মানে কি!সে নিজের বাসায় থাকে। চৌধুরী ভিলা থেকে শুরু করে চৌধুরী ইন্ড্রাসট্রিজ সবকিছুই তো তার। চৌধুরী বংশের একমাত্র উত্তরসূরী হিসেবে কোহিনুর চৌধুরী তাকেই তো রেখে গিয়েছেন।কুহেলিকা রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠে,

—স্যাট আপ মিষ্টার জুনায়েদ মির্জা। থাকছেন আমারটায় আর কোথাও শোনাচ্ছেন আমায়!

—তোরটায় থাকছি মানে?দাদাজানের বাড়িতে থাকছি। তুই মেয়ে তোর কি কোনো অধিকার আছে নাকি সেখানে!আমাদেরই তো সব।

—মগের মুল্লুক পেয়েছেন?দাদাজানের উইল হয়তো পাননি তাই জানেন না।তবে আজ জানবেন। আপনার সো কল্ড ফ্যামিলিও জানবে কত অনেস্ট এবং বিলিভেবল পারসন আপনি!

—কুহেলিকা..

—আমার সাথে চিৎকার করার মতো ভুল ভুলেও করবেন না মিষ্টার জুনায়েদ মির্জা।

কুহেলিকা বেরিয়ে আসে।ফোন দেয় কোহিনুর চৌধুরীর লয়ারকে।কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠে বেরিয়ে যায় চৌধুরী ভিলার উদ্দেশ্যে।আজ আর অফিসে যাবে না। এমনিতেই মন মেজাজের ঠিক নেই কখন কাকে ছেড়ে ঝেড়ে ফেলবে কে জানে!

চৌধুরী ভিলায় প্রবেশের সময় নাহিন কল দেয়। পরিবারের কারো সাথে তার এতোই সুদৃঢ় সম্পর্ক নেই যে ভয়ে প্রেমিক পুরুষের কল কেটে দিবে সে।তাইতো রিসিভ করে। ভিডিও কল।

—বলো তো আমি কোথায়?

—কোথায়?

—বাংলাদেশে।

—সিরিয়াসলি?

—হুম একদম সিরিয়াসলি।

—চট্টগ্রামে আছি।সোজা ফ্লাইটে চলে আসেন।

—চট্টগ্রামে তো আমার কোনো বাড়ি নেই।থাকবো কোথায়?

—আগে আসেন তো।এতো চিন্তা আপনাকে করতে হবে না।

—আচ্ছা,আর একটা সিক্রেট কি জানো আমি চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে চট্টগ্রামে থাকবো।

—হোয়াট!আমি এখনই তবে বের হচ্ছি। অপেক্ষায় থাকবো আপনার।

মিনিট ত্রিশের মতো লাগে কুহেলিকার এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে। এয়ার পোর্টে পৌঁছে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে থাকে। জরুরী ফোন আসায় রিসিভ করে।তবে ওপাশ থেকে কোনো জবাব তো আসেই না তার ওপর আবার কেউ পেছন থেকে চোখ আটকে ধরে।কুহেলিকা মুচকি হেঁসে হাত ছাড়িয়ে বলে ওঠে,

—আপনার পারফিউমের সুগন্ধেই চিনে ফেলতে পারি আপনাকে সেই দূর থেকেই!

*****

চৌধুরী ভিলায় ভোজের আয়োজন করা হয়েছে।জামাই এসেছে আবারো।মেয়ের স্বাস্থ্যের এই দূরবস্থার পরও যে মেয়েকে আগলে রেখেছে এই ছেলে!একে কি আর অনাদর করা যায় নাকি!রুমানা আফরোজ আদূরে কন্ঠে বলেন,

—জামাই বাবা তোমাকে আরেকটু দেই?কিছুই তো খেলে না। আরেকটু পোলাও কোরমা দেই

—আম্মু আর খেতে পারবো না।এখন একটু বিশ্রামের দরকার।আর এখন থেকে তো চট্টগ্রামেই আছি।চিন্তা নেই আর।

ড্রয়িংরুম থেকে খুব ভালোই দেখা যায় অন্দরমহলে প্রবেশের দরজাটা। দুপুর দুইটা।কুহেলিকা ফিরেছে।সাথে আছে আরেকজন সুদর্শন পুরুষ।সবার আগে তার ওপর যেন সাফিনেরই দৃষ্টি পড়ে। দাঁড়িয়েও চলে যাওয়া থেকে থেমে যায়।সবাই সাফিনের দৃষ্টির সরাসরি তাকায়।

কুহেলিকার মুখে মিষ্টি হাসি।সে আজ বিরতিহীন বক্তা যেন।আর পাশের ছেলেটা ধৈর্য্যশীল শ্রোতা।কই কুহেলিকা তো তাদের সাথে কখনোই তো কথা বলেনি।নাকি তারাই তাকে সেই সুযোগ দেয়নি! জুনায়েদ নিভৃতে কুহেলিকাকে কথা শোনাতে পিঞ্চ মেরে বলে ওঠে,

—কি দিনকাল এলো মেয়ে মানুষ বাসায় আনছে পুরুষ মানুষ ছিঃ

—বিয়ে করে পরকিয়া তো আর করছি না।

জুনায়েদ বুঝে যায়।এই মেয়ে যত ভালো,ঠিক ততটাই খারাপ।যখন তখন বেফাঁস কথা বলে ফাঁসিয়ে দিতে পারে।তাই চুপ থাকাই শ্রেয়।কায়েস মির্জা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বলে ওঠে,

—কুহু ইনি কে?

—আমার ভবিষ্যৎ স্বামী। কিছুদিন তিনি এখানেই থাকবে। গেস্ট রুম খুলে দিবেন ওনার জন্য।

নাহিনসহ উপস্থিত সবাই চমকায়।নাহিন নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না তার প্রেয়সী তাকে তার ভবিষ্যৎ স্বামী হিসেবে পরিবারের নিকট পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।তবে নাহিনের কেন জানি খটকা লাগে। কেননা এতবড় এবং বিত্তশালী পরিবার থাকতেও কেন সাতবছর আগে কুহেলিকা চাকরির সন্ধানে এদিকসেদিক ঘুরছিলো!কেন তাকে তার খরচ জোগাতে পরিশ্রম করতে হচ্ছিলো! কেন তার পিতা-মাতার নামের জায়গাটা শূন্য ছিলো!সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এই বিশাল বাড়িতেই।

চলবে কি?

দুই পথের পথিক পর্ব-০৪

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৪
#বর্ষা
সন্ধ্যালগ্নে বাড়ি ফিরেছে কুহেলিকা।হাতে,মাথায় চোটের দাগ স্পষ্ট।হালকা আঁচড় তবে ফর্সা ত্বকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।কুহেলিকা পৌঁছাতেই ড্রয়িংরুমে দেখতে পায় কায়ফাকে।ছেলেকে কোলে নিয়ে টিভি দেখছে।বাড়ির বড়রা সবাই আছে।আছে অচেনা দুইজন রমনীও।তবে আন্দাজ করেই কুহেলিকা বুঝে নিয়েছে কে তারা,নিশ্চয় এ বাড়ির বউ!

কুহেলিকা সোজা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে নিলেই বাঁধ সাধে অপরিচিত আরেক রমনী।ওয়েস্টান ড্রেসে নিজেকে মডেল হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করছে যেন সে।পথ আঁটকে বলে ওঠে,

—এই মেয়ে কে তুমি?আর দারোয়ানই বা কিভাবে ঢুকতে দিলো তোমায়!এখনই বের হও বলছি ক্ষেত কোথাকার।

কুহেলিকা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। প্রথম দেখায় অচেনা কারো সাথে এ কেমন ব্যবহার!আবার কোথাকার কোন মেয়ে তাকে ক্ষেত বলছে।প্রকৃত অর্থে ক্ষেত তো তাকেই লাগছে।কোথায় কোন রকম পোশাকে মানিয়ে নিতে হয় সেই সামান্য বোধও তো নেই এই মেয়ের!

—রোহানী কি হয়েছে মা চিৎকার করছো কেন?

—দেখুন না আংকেল কোথাকার কোন ক্ষেত ঢুকে পড়েছে ভিলায়।এখন দোতলার দিকে যেতে চাচ্ছে।এইসবকে কোন সাহসে দারোয়ান ঢুকতে দেয় বুঝি না!

কাসেম মির্জা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কুহেলিকার দিকে।যেন বহুদিনের তৃষ্ণা মেটান‌।কুহেলিকা সালাম দিয়ে বলে ওঠে,

—বড় আব্বু কেমন আছেন?

—আলহামদুলিল্লাহ আম্মা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো আম্মা?এতদিন কোথায় ছিলে?

—আলহামদুলিল্লাহ বড় আব্বু ভালো আছি। পরিবারের কাছে ছিলাম।

কাসেম মির্জার বুকের ভেতর ছ্যালৎ করে ওঠে।রোহানী বিরক্ত মুখে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে থাকে‌।একে তো এমনিতেই বেড়াতে আসলে যেই রুমে সে থাকতো সেই রুমটায় কেউ তালা লাগিয়েছে।তারপর আবার এই মেয়ে!কাসেম মির্জা রোহানীকে দেখিয়ে বলে ওঠেন,

—কুহেলিকা এই হচ্ছে জুনায়েদের শালী রোহানী।আর রোহানী এই হচ্ছে কুহেলিকা মির্জা।

—বড় আব্বু আপনারা কাগজে কলমে মির্জা হলেও লোকমুখে কিন্তু চৌধুরী বংশের মানুষ।আর আমার কথায় আসলে আমি কাগজে কলমে চৌধুরী হওয়ার পাশাপাশি লোকমুখেও কুহেলিকা চৌধুরী নামেই পরিচিত।

কুহেলিকা আর দাঁড়ায় না সোজা নিজের কক্ষে চলে যায়।রোহানী কুহেলিকাকে যেতে দেখে সিড়ি বেয়ে নিচে চলে আসে।কাসেম মির্জা তাকিয়ে থাকেন ভাস্তির যাওয়ার দিকে।ঠিকই তো বলেছে মেয়েটা।কাসেম মির্জা আর কায়েস মির্জার বাবা-মা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর ওনাদের খালুজান কোহিনুর চৌধুরী নিয়ে আসেন ওনাদের। নিজের বড় মেয়ে কাসফিয়ার মতো লালন-পালন করেন। লোকমুখে ছড়িয়ে যায় কায়েস ও কাসেম কোহিনুর চৌধুরীর ছোটো দুই ছেলে।তারপর থেকে চৌধুরী বাড়িতে চৌধুরী নামেই বেড়ে ওঠা।কুহেলিকা চৌধুরী নামটাই যেন সেক্ষেত্রে বেশি খাটে ওর সাথে!

কায়ফা সিঁড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো।সিনান মনমরা হয়ে মায়ের বুকে লেপ্টে আছে। কেননা সাফিন কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গিয়েছে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।কায়ফা সিঁড়ি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে টিভিতে দৃষ্টিপাত করে।রোহানী কান্না কান্না কন্ঠে এগিয়ে এসে জুনায়েদের বউ রাইসার নিকট গিয়ে বলে ওঠে,

—আপাই তোমার ঠিক করে দেওয়া রুমে তালা দেওয়া।আমি কোথায় থাকবো?আপা আমার কিন্তু ওই রুমটাই চাই।

—তোর রুমে তালা দেবে কে?চল তো আমি দেখছি।

রোহানী বোনের কথায় প্রাপ্তির হাসি হাসে।আজ অব্দি যা তার চাই সবই সে হাতিয়ে নিয়েছে কোনো না কোনো মাধ্যমে।রাইসা বোনকে নিয়ে রুমানা আফরোজ এর কাছে গিয়ে বলে,

—ছোট মা আপনি যেই রুম দেখিয়েছিলেন রোহানীর জন্য,সেই রুমে নাকি তালা দেওয়া।

রুমানা আফরোজের বুঝতে কষ্ট হয়না কে লাগিয়েছে তালা‌।তবে এর পাশাপাশি কুহেলিকার আজকের ব্যবহারে তিনি এও বুঝেছেন কুহেলিকাকে ওই রুম ছাড়া করা অসম্ভব।

—মা রোহানী একটু এডজাস্ট করতে হবে যে বাবু।ওই রুম পুরাতন কেউ নতুন করে হাতিয়ে নিয়েছে।

—ভুল বললেন মিসেস রুমানা আফরোজ। নিজের রুম নিজের করে নিয়েছি।অন্যের জিনিস না বলে নেওয়াকে হাতিয়ে নেওয়া বলে আর যা আমি করিনি‌।

—ছোট মা এই মেয়ে কে?

রাইসার প্রশ্নে রুমানা আফরোজ জবাব দেওয়ার পূর্বেই রোহানী ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে,
—কোথাকার যেন কোন কুহেলিকা মির্জা অফস সরি চৌধুরী!

—নাম ভালো মতো উচ্চারণ করো নয়তো কোনো শব্দ উচ্চারণ করার মতো মুখ রাখবো না।

—থ্রেট দিচ্ছো আমায়!

—না,বোঝাচ্ছি।বাই দ্যা ওয়ে তোমার জন্য আমার সময় নষ্ট হলো।আর সবাই আপনি ডাকের মর্যাদাসম্পন্ন নয়,তাই তোমাকে তুমি করে বলেছি ডন্ট মাইন্ড।

কুহেলিকা রোহানীকে এড়িয়ে রান্না ঘরে ঢুকে যায়।কফির তৈজসপত্র খুঁজে কফি বানিয়ে নিজ রুমে গমন করে। রোহানী রাগে ফুঁসতে থাকে। নিজের কক্ষে এসে দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসে দীর্ঘশ্বাস নেয় কুহেলিকা। আজকের ধকল আর সহ্য হচ্ছে না তার।এতক্ষণ তো ভেবেছিলো কেউ তার স্মৃতি আগলে রাখতেই তার রুমটাকে আগলে রেখেছিলো‌।তবে ভুলটা ভেঙে গেল খুব শীঘ্রই।কেউ তাকে আগলে রাখতে রুমটা আগলে রাখেনি বরং নয়া আত্মীয়ের স্বার্থে ব্যবহার করেছে তার রুমটা!

অসহনীয় দূর্বলতা কাটাতে ফোন হাতে নেয় কুহেলিকা।কল দেয় কললিস্টের সবচেয়ে ওপরের নাম্বারটায় ‘নাহিন’।ওয়েটিং বলায় কুহেলিকা ফোন কেটে বিছানায় রেখে দেয়।আয়নার সামনে দাঁড়ায়। গভীরভাবে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে আঁতকে ওঠে।গলার বা পাশের গাঢ় তিলটা একদম কোহিনুর চৌধুরীর মতো!কিভাবে সম্ভব!

বহুবছর পর সাফিনকে রেস্ট্রিকশন থেকে হটিয়ে দেয় কুহেলিকা। অবশ্য এখনো সে জানে না যে সাফিনই তার দুলাভাই।জানলেই বা কি হতো! অনুভূতিগুলো তো আর পুরোপুরি মরে যেতো না। জীবনটা তো এমনই।যাকে একবার মানুষ মন থেকে ভালোবেসে ফেলে,তাকে হৃদয় থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারে না।কোথাও না কোথাও একটা জায়গায় তার জন্য লুকিয়ে থাকে দীর্ঘশ্বাস!হোক সেটা সুখের কিংবা দুঃখের।

—কুহেলিকা বাসায় আসোনি?

সাফিনের ম্যাসেজে চমকায় কুহেলিকা।লোকটা কি তার আইডি মুখের সামনেই ধরে রেখেছিলো!কুহেলিকা ছোট্ট জবাব দেয়,

—জ্বী এসেছে।

—আমাকে ক্ষমা করে দিও কুহেলিকা।আমার কারণে তুমি হারিয়ে গেলে!আমার উচিত হয়নি তোমাকে সেদিন ফিরিয়ে দেওয়া।নয়তো আজ তুমি ….

সাফিন আর লেখে না‌।পরেরটুকু কুহেলিকা বুঝে নেয়।নিজ থেকেই ম্যাসেজ দেয়,

—জানেন মানুষ হচ্ছে ফিরিয়ে দিয়ে আফসোসকারী। আপনার জীবনে এখন আপনার স্ত্রী,সন্তান আছে তাদের কথা ভাবুন।আমাকে ভুলে যান।আমি নামক কেউ আপনার পরিচিত তা ভুলে যান।ভুলে যান কুহেলিকা চৌধুরী আপনাকে কখনো ইজহার করেছিলো‌।ভুলে যান সব। ভালো থাকুন।

কুহেলিকা ব্লক করে দেয় সাফিনকে।নিজেকে নিজে ওয়াদা করে,এই ব্লক আর কখনোই খুলবে না সে;পুরনো ক্ষতকে আর তাজা করে সুস্থ স্থানে আর আঘাত করবে না।কুহেলিকা থাকতে চায় সাফিনের না পাওয়া স্মৃতিতে। মানুষ পাওয়া জিনিসের তুলনায় না পাওয়া জিনিসের প্রতি বেশি কদর করে।কুহেলিকা না পাওয়া স্মৃতি হিসেবেই থাকতে চায়।

নাহিনের কল রিসিভ করতেই সে শুনতে পায় মোহ মিশ্রিত পুরুষনালী কন্ঠ।ভিডিও কল।ভেসে ওঠে হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রীও।শ্যাম পুরুষের সিল্কি চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে।ঘামশ্রী মুখ কি মায়াবীই না লাগছে।বারবার বুকের দিকটায় হাত বুলাচ্ছে হয়তো গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম।কুহেলিকা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

—সরি মিটিং এ ছিলাম।কি করছো প্রিয়তমা?

—সাফিন স্যারের সাথে চ্যাটিং করলাম।বাই দ্যা ওয়ে আপনি কি অসুস্থ?

সংকোচহীন উত্তর।নাহিনের মাঝে ভাবান্তর দেখা গেল।শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—তেমন অসুস্থতা নেই,তবে খানিক বুকে ব্যথা।তবে কি কথা হলো তোমাদের?

—তেমন‌ কিছু না। শুধু কেমন আছি তা জানলেন আর কোথায় আছি তা জিজ্ঞেস করলেন!তারপর এখন ব্লক লিস্টে আছে।

কুহেলিকা মিথ্যে না বললেও সম্পূর্ণ কথাটাও জানায় না নাহিনকে।ছেলেটা সেই আটবছর যাবৎ আগলে রেখেছে তাকে।কঠিন ছেলেটার তার প্রতি এরুপ টান দেখে আগেই সবাই বলেছিলো,”কঠোর নাহিন মুনতাসির প্রণয়ে আসক্ত হয়েছে”।সত্যিই ছেলেটা দুইবছর আগে নিজের মনের কথা জানিয়েছে তাকে।কুহেলিকা হ্যা না বললেও একেবারে নিষেধ করে দেয়নি।বলেছিলো,
—যদি কখনো সম্পর্ক নামক শব্দটার প্রতি বিশ্বাস আসে,তবে আপনিই হবেন আমার জীবনের কাঙ্ক্ষিত সেই পুরুষ!

নাহিন চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে দেয়।ঢগঢগ করে গ্লাসভর্তি পানি খায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,

—সাফিন স্যার যদি তোমার জীবনে ফিরে আসতে চায় তবে কি তাকে ফিরিয়ে নিবে?

—আপনার কি আমাকে তেমন মেয়ে মনে হয় যে আমি অন্যের স্বামী কেড়ে নিবো!

—সাফিন‌ স্যার বিবাহিত!তবে সে যদি বিবাহিত না হতো তবে তো তাকে নিশ্চিত ফিরিয়ে নিতে তাই না?

—কুহেলিকার মন থেকে যারা উঠে যায় তারা আর সেখানে জায়গা পায় না কখনোই।আর যারা আমৃত্যু কুহেলিকাকে আগলে রাখতে চায় কুহেলিকা তাদের মোহ-মায়ায় আবদ্ধ থাকতে চায়!

—তুমি আমার ম…

নাহিন কথা সম্পন্ন করতে পারে না।গলা কাঁপতে থাকে।নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রঞ্জক পদার্থ।মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে।কুহেলিকা চিৎকার করে ডাকতে থাকে নাহিনকে।কান্না করতে থাকে।তবে নাহিনের হুঁশ থাকে না বেশিক্ষণ।জ্ঞান হারায় সে।কুহেলিকা ব্যতিব্যস্ত হয়ে কল দেয় ম্যানেঞ্জারকে।নাহিনকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হসপিটালে।কুহেলিকার অন্তরটা যেন পুড়ে যাচ্ছে।এশার নামাজ শেষে কয়েক রাকাত নফল নামাজ পড়ে মোনাজাতে বসে সে।ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে,

—হে আল্লাহ মানুষ দুঃখ শুধু শুনতে পারে তবে তুমি তো সেই দুঃখের সমাধান দিতে পারো।আল্লাহ আমাকে ভালোবাসার মতো সবাইকেই তুমি কেড়ে নিয়েছো।নাহিনকে কেড়ে নিও না।আমি তো ভালোবাসা হারানোর ভয়েই নাহিনের কাছে কখনো ইজহার করিনি। আল্লাহ ওকে কেড়ে নিয়ো না আমার থেকে।আমি যে জীবিত লাশ থেকে জীবন পেয়েছি ওর কারণে।আমাকে আবারো জীবিত লাশ বানিয়ে দিও না আল্লাহ।

চলবে কি?

দুই পথের পথিক পর্ব-০৩

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৩
#বর্ষা
যাত্রা শেষে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যে ঘুম ভাঙে কুহেলিকার‌।জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য।সমুদ্রের জলরাশিরও দেখা মেলছে দূর থেকেই।বহুদিন পর আবারো মাতৃভূখন্ডের জলরাশিকে স্বচোখে দেখা।কুহেলিকার মুখে ফুটে ওঠে মিষ্টি হাসির রেখা। আড়মোড়া ভেঙে ফোন নেয় হাতে।ম্যাসেজ এসেছে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির।

—তোমার জন্য কাঁদছে মন, কাঁদছে নয়ন।আসছি খুব শীঘ্রই তোমার শহর।গুড মর্নিং প্রেয়সী।

কুহেলিকার মুখে হাসির রেখা দৃঢ় হয়।তবে পরমুহূর্তেই সেই রেখা মিলিয়ে যায়।আনমনেই বলে ওঠে,

—যাকে চেয়েছিলাম আমি,তাকে পেয়েছে অন্য কেউ।তবে যে চায় আমাকে সে পাবে কি আমায়?!

কুহেলিকার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।বাস থেমে গিয়েছে।পাশের সিটটা ফাঁকা।হয়তো চলে গিয়েছে।কুহেলিকা বেশি ভাবে না।বাস থেকে নেমে লাগেজ কালেক্ট করে নেয়।কিছুটা এগিয়ে যেতেই রিকশার দেখা মেলে।রিকশায় চড়ে বসে সে।শহরের মাঝেই বিশালাকার বাড়ি তাদের। গন্তব্য সেখানেই।

আপন শহরের বাতাস মন ভরে গ্রহণ করছে সে।আলাদা একটা গন্ধ আছে এ বাতাসে।প্রশান্তির পরশ একে দিচ্ছে চিত্তে।কুহেলিকা চারপাশে চোখ বুলিয়েই যাচ্ছিলো হঠাৎ চোখ আটকে যায় পাশেরই এক রেস্টুরেন্টের দোতলাতে।দ্রুত রিকশা থামাতে বলে সে।ভাড়া মিটিয়ে লাগেজ হাতে নেমে পড়ে সে।

—আয়শা?

পরিচিত কন্ঠ কানে আসতেই আয়শা ফিরে তাকায়।প্রিয় বান্ধবীকে দেখে জড়িয়ে ধরে সে।কুহেলিকাও আগলে নেয় বান্ধুবীকে।স্কুল,কলেজ লাইফের বন্ধুত্ব বলে কথা।আয়শার পাশে বসে থাকা মেয়েটা যে কৌতুহলী তা তার চোখে মুখেই স্পষ্ট।আয়শা একবার জড়িয়ে ধরছে তো একবার বান্ধুবীকে দেখছে।

—কুহু বিশ্বাস হচ্ছে না তুই আমার সামনে দাঁড়িয়ে।কুহু জানিস তোকে কত মিস করেছি। আমাকেও জানালি না বিষয়টা!

—ধূর বাদ দে না এসব।এখন তো ফিরে এসেছি।কেমন আছিস বল?

—আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস?

—আলহামদুলিল্লাহ। পরিচয় করিয়ে দিবি না ওনার সাথে?

—ওফস সরি,ও হচ্ছে নায়মা হাওলাদার।আর নায়মা এই হচ্ছে আমার বেস্টু কুহেলিকা চৌধুরী।

নায়মা,কুহেলিকা পরিচিত হয়।সকালের নাস্তাটাও এখানেই করে নেয় কুহেলিকা।নায়মা,আয়শা সম্পর্কে চাচাতো বোন।একই সাথে চাকরি সূত্রে একই স্থানে থাকে।জবে যেতে হবে বিধায় খুব শীঘ্রই বিদায় নিতে হয় তাদের।তবে ক্ষুদ্র এই সময়টাও স্মৃতিতে আগলে রাখে কুহেলিকা। বিদায়বেলায় নাম্বার আদান-প্রদানও করে দু’জনে।

কুহেলিকা দাঁড়িয়ে আছে চৌধুরী ভিলার সামনে। বিশালকার ডুপ্লিক্স বাড়ি। কোহিনুর চৌধুরীর শখের ভিলা।দুই পুত্রের নামেই লিখিত সে বাড়ি।কন্যাকে তো আগেই নিজের নিকট মৃত ঘোষিত করেছেন।তাইতো জীবিত থেকেও পরিবারের কাছে মৃত উপাধিতে ভূষিত সে।

দারোয়ানকে বহুবার বলার পরও যখন গেট খুলতে নারাজ সে তখন কুহেলিকা ধৈর্য হারিয়ে ফোন দিতে বলে কায়েস চৌধুরীকে।ফোন পেয়েই কায়েস চৌধুরী ছুটে আসেন গেট সম্মুখে।বলার অপেক্ষা রাখে না তিনি রাগান্বিত না ব্যথিত‌‌। দারোয়ানকে গেট খুলতে বলেন। ঠাঁটিয়ে কয়েকটা চড় লাগান।বেড়িয়ে যেতে বলেন চৌধুরী ভিলা থেকে।তবে কুহেলিকা বেরিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে মারকে উপেক্ষা করে চৌধুরী ভিলায় প্রবেশ করে।

রুমানা আফরোজ কিচেনে ছিলেন।সদর দরজা দিয়ে কুহেলিকাকে প্রবেশ করতে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে এসে হিজাবের ওপর দিয়েই চুলের মুঠি ধরার চেষ্টা করেন।তবে তার পূর্বেই কুহেলিকা হাত ধরে ফেলে।বলে ওঠে,

—আপনাদের নরম,নাজুক কুহেলিকা আট বছর আগেই মরে গেছে।বর্তমান কুহেলিকা নিজেকে কারো দাঁড়া আঘাত পেতে দেয় না। বরং আঘাতকে সুদে আসলে ফিরিয়ে দিতে জানে।

কুহেলিকা নিজের রুমের দিকে চলে যায়।দোতলার বা’দিকের একদম কিনারার কক্ষটাই তার।ভেতরে গিয়ে লাগেজ ঠেলে মোবাইল বিছানায় ফেলে আয়নায় তাকায় সে‌।গালটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে।তবে পরমুহূর্তেই আশ্চর্যিত হয়ে নিজের কক্ষটাকে দেখে।একদম সাফ সুতরা কক্ষ এটা।বোঝাই যাচ্ছে না যে এই রুমের মানুষ আটবছর যেন প্রতিদিনই কেউ পরিস্কার করে রেখেছে।কে আছে যে তাকে ভালোবেসে তার স্মৃতি আগলে রাখতে তার কক্ষটাকে আগলে রেখেছে!

কুহেলিকা গোসল সেরে ফজরের কাযা নামাজ আদায় করে নেয়।ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে কিছু ফাইল চেক করে‌।ফোনে কাউকে ইন্সট্রাকসন দেয় পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে।এও জানায় আগামীকাল অফিসে আসবে সে।সব ফাইল যেন রেডি থাকে। কোনো ভুলের অবকাশ নেই তার কাছে।

যোহরের নামাজ পড়ে নিচে নামতেই দেখতে পায় জয়নুবা বেগম গুসুর ফুসুর করে কিছু বলছেন রুমানা আফরোজকে‌।থেমে যান কুহেলিকাকে দেখে।মেয়েটা যে আগের তুলনায় আরো সুন্দরী হয়েছে ।

—দুপুরের খাবার প্রস্তুত হয়েছে?

—তোমার জন্য এ বাসায় কেউ রান্না করেনি।

রুমানা আফরোজের কাঠখোট্টা জবাব।কুহেলিকা কিছুক্ষণ দীর্ঘ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজ থেকেই ফ্রিজ থেকে ব্রেড আর জ্যাম নিয়ে খেতে বসে।জয়নুবা বেগম কিছু একটা ভেবে ছুটে এসে বলে ওঠেন,

—আমি তোর জন্য খাবার আনছি।এসময়ে ব্রেড,জ্যাম খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বি‌।

—আপনি আমার অসুস্থতা নিয়ে ভাবছেন?স্ট্রেঞ্জ!

কুহেলিকা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।তবে দেখা মেলেনি কায়ফাসহ চাচাতো দুই ভাইয়ের।কুহেলিকা আন্দাজ করতে পেরেছে কায়ফা নিশ্চই শশুর বাড়ি আছে।আর জাহিদ ভাই তো ব্যবসার কাজে আগে থেকেই জড়িত। জুনায়েদ ভাই তো চিকিৎসক মানুষ,ব্যস্ত মানুষ!

কুহেলিকা খাওয়া শেষ করে উঠতে নিলেই বাচ্চা একটা ছেলে ছুটে আসে।কুহেলিকার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেও কুহেলিকা ধরে ফেলে। রুমানা আফরোজ কেড়ে নেন নাতিকে।কুহেলিকাকে চোখ রাঙানি দিয়ে বাচ্চাটিকে আদূরে কন্ঠে বলে ওঠেন,

—সিনান নানুভাই এভাবে ছুটছিলে কেন?যদি লেগে যেতো তখন কি হতো!

—নান জানো বাবাই এসেছে সকালে।আমার জন্য এত্তো এত্তো চকলেট এনেছে।কি মজা!

—আমাদের জন্য চকলেট আনলে না?

জয়নুবা বেগমের কথায় ছোট্ট সিনান এগিয়ে এসে বলে,

—তোমাকে দিবো না‌। তবে জাবির ভাইয়া আর রাইসা আপিকে দিবো।

সিনানকে ইগনোর করে চলে যেতে নিলেই জয়নুবা বেগম বলে ওঠেন,

—কুহেলিকা এই হলো তোর ভাগ্নে।কায়ফার ছেলে সিনান।

কুহেলিকা তাকায়।বছর চারেকের হবে বাচ্চাটা। অর্থাৎ সে নিরুদ্দেশ হওয়ার বছর দুয়েকের মাঝেই হয়তো বিয়ে হয়েছে কায়ফার।চিন্তা করে না কুহেলিকা।আবারো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটে।সে আজ প্রচন্ড অবাকতর অবস্থায় আছে।প্রথমত এতো বছর নিরুদ্দেশ থেকে হঠাৎ আসার পর তাকে তেমন কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি,দ্বিতীয়ত ও যেন সবার আদরের দুলারি ছিলো এমন ভালো মানসিকতা দেখাচ্ছে ওকে।

—কুহেলিকা তুমি কোথাও যাচ্ছো?

কায়েস চৌধুরী সিড়ি বেয়ে নামার সময়ই প্রশ্ন করেন। সিঁড়ির দিকে তাকায় কুহেলিকা।কিছুটা সময় নিয়ে কুহেলিকা বলে ওঠে,

—হুম,কাজে বের হচ্ছি।

—কাজ না ছাই কোন পিরিতের মানুষের কাছে যাচ্ছে দেখো!এতদিন যার কাছে ছিলো তার কাছেই যাচ্ছো নিশ্চিত!চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার

রুমানা আফরোজ বেশ জোরে সরেই বলে ওঠেন‌।কায়েস চৌধুরী বিরক্তিকর মুখশ্রী বানিয়ে চুপ করতে বলেন তাকে।কুহেলিকার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলেন,

—সিনানের আব্বু এসেছে আজ। ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে দশ মিনিটের রাস্তা।আজ বিকেলে বাসায় আসবে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো দুলাভাই এর সাথে পরিচিত তো হতে হবে তাই নয়কি!

—চেষ্টা করবো।

কুহেলিকা ক্লান্ত পরিবার হীন জীবন কাটিয়ে। তাই আর বাত্তামিজি করলো না। অবশ্য পরিবার ছাড়াও সে বেশ ভালোই ছিলো।যাদের কাছে ছিলো তারা তো তার পরিবারেরই অংশ।তবে নিজের বাবা-মার স্থান যে কাউকেই দেওয়া যায় না।হোক বাবা-মা যতই খারাপ!

কুহেলিকা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো।সূর্যের প্রকোপ অনেকটাই কমে এসেছে।বিকেলের আভা ছড়িয়ে পড়েছে।বাচ্চারা ঘুড়ি হাতে খোলা মাঠের দিকে ছুটছে।আবার কিছু ঘুড়ির দেখা আকাশেও মিলেছে। বসন্ত কালে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবারই পছন্দের খেলা ঘুড়ি ওড়ানো।

সাফিন বসে আছে চৌধুরী ভিলায়। শশুর বাড়িতে কি আর হই হুল্লোড় করা যায় নাকি।যায় তবে থাকতে হয় ছোটো ছোটো শালাশালী।যার অভাব বেশ অনুভব করছে সাফিন।ছেলেটা মায়ের নেওটা হয়েছে। এখানে এসেছেও মায়ের পিছুপিছু চলে গিয়েছে।তবে সাফিনের দৃষ্টি খুঁজছে আরেকজনকে।কুহেলিকাকে খুঁজছে তার দৃষ্টি।বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটা যদি এখন ওকে এখন দেখে তাহলে কেমন অনুভব করবে!

—পাপা চলো না ঘুড়ি উড়াই।

সিনানের মাসুম আবদার না রাখার মানে হয় না।তাছাড়া আজ রাতেই জরুরি তলবে ফিরতে হবে তাকে। একসপ্তাহের ভেতর আর আসার সম্ভাবনা নেই তার।তবে এরপরের বার একেবারে ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসারই চিন্তাচেতনা আছে।ছেলের বেড়ে ওঠা না দেখতে পারলে হয় নাকি!আর স্ত্রীকেও তো সময় দিতে হবে। মনের ভালোবাসা পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তো তা আগলে ধরতে হবে !

চলবে কি?

দুই পথের পথিক পর্ব-০২

0

#দুই_পথের_পথিক
#পর্ব২
#বর্ষা
বাসের হঠাৎ ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙে কুহেলিকার।অতীত ভাবতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তার খেয়ালই নেই।হাত ঘড়িতে একবার সময় দেখে চারপাশটা দেখে নেয় সে।জানতে পারে এখন কুমিল্লাতে আছে বাস। ছোট্ট ব্রেকের ব্যবস্থা আরকি!পাশের সিটটা ফাঁকা।বুকটা ধুক করে ওঠে তার।তবে কি কিঞ্চিত সময়ের নিকটত্বও সহ্য হলো না নিয়তির!

কুহেলিকা শীতল চাহনিতে বাইরের পরিবেশটা দেখতে থাকে।মাঝের দিকে সিট পড়েছে তাদের।সেফ জার্নির জন্য নাকি মাঝের সিটগুলোই নিরাপদ এমন কথা প্রচলিত আছে লোকমুখে।তবে এমন কোনো ধারণায় যেন বিশ্বাস নেই কুহেলিকার।

—আম্মু আস্তে ছোটো নয়তো পরে যাবে।

শব্দগুলো বাক্যে প্রতিধ্বনিত হতেই কুহেলিকা কেঁপে ওঠে।বাসের বাইরে উঁকি দেয়।বছর ত্রিশের লোকটা বাচ্চা মেয়ের পেছনে ছুটছে।আর তাদের থেকে কিঞ্চিত দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন বোরখা পরিহিতা রমনী‌।সুখী পরিবার!কুহেলিকারও তো স্বপ্ন।

—কি দেখছেন বাইরে?

—মিষ্টালো সম্পর্ক।

কুহেলিকা জবাব দিয়েই ফিরে তাকায়।সাফিন কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে।কুহেলিকা দ্রুত দৃষ্টি সরায়।সাফিন সিটে বসে বলে ওঠে,

—মিস যাত্রা তো অনেক লম্বা হতে চলেছে।যদি একে অপরের সাথে গল্প করে কাটাই তাহলে হয়তো সময়টা দ্রুত কাটবে।কি বলেন?

কুহেলিকা ঘেমে একাকার।দীর্ঘ যাত্রায় মাস্ক এখনো খোলা হয়নি‌।তার ওপর সাফিনের গল্প করে কাটানোর বিষয়টা হজম হয়না তার‌।সাফিনকে বলে সাইট কেটে বাস থেকে নেমে আসে সে।ওয়াসরুমে গিয়ে মুখে পানি দেয় সে।উত্তেজনাকে কাবুতে করতে চায় সে।

বাসে বসে এক অভাবনীয় ভাবনায় ব্যস্ত সাফিন।কেন জানি পার্শবর্তী অজানা রমনীকে তার বড্ড চেনা লাগছে।মনে হচ্ছে এই সে মেয়ে যাকে সে মনে প্রাণে কোনো একসময় অনুভব করেছে।সাফিনের ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে ওঠে তার।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলী কন্ঠে কেউ বলে ওঠে,

—কতদূর আপনি?খাওয়া দাওয়া করেছেন?আর আপনার পাশের সিটে কে বসেছে?

একসাথে এতগুলো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সাফিন শুধু বলে,—আরো ঘন্টাখানেক লাগবে।ভোর নাগাদ পৌঁছে যাবো‌।

কল কেটে দিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে দেয় সাফিন।মাথাটা অনেক ধরেছে।বসে ঘুমানোতে মেরুদন্ডের ওখানেও ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। শক্তপোক্ত দেহটা যেন আর কথা শোনে না‌। সাফিন ললাটে হাত ঠেকিয়ে ফিরে যায় অতীতে।

পিকনিক বাসে প্রথমবারের মতো মেয়েদের বাসে সে।তাও পছন্দের রমনীর অনুরোধে।মেয়েটা অনেক রিকোয়েস্ট করায় শেষমেশ যাওয়া।আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসনও ছিলো হৃদয় ছোঁয়া।সিটের কমতিতে বাসের দরজায় ঝুলেই যাচ্ছিলো সে।মেয়েটা হয়তো আমলে নিয়েছিলো তা।ম্যাসেজ দিয়ে অধিকার দেখিয়ে আর্জি জানালো দেখবে তাকে।আসতে হবে মেয়েদের বাসে।আসলো তবে একবারেই শেষ মুহূর্তে।মেয়েটার বাচ্চাপনা তখনো যায়নি।

বান্ধুবীদের সাথে নাচ-গানে আছে সে ধুমধাড়াক্কা। অবশ্য অবাক হয়েছে বেশ সাফিন সেদিন‌।মেয়েটাকে সে সর্বদা এসব থেকে দূরেই দেখেছে তবে হঠাৎ নাচ -গানে তার আবির্ভাবে অবাক হবারই কথা।হিজাবী মেয়েটা সেদিন বান্ধুবীদের তাড়নায় হিজাব ছেড়ে খোলা চুলে আসলো তার সামনে।কি মায়াবতীই না লাগছিলো তাকে। কাছাকাছি ফ্লিড ট্যুরে যাচ্ছিলো তারা।তাইতো হয়নি বেশি সময়ের দেখাদেখির খেলা।

সাফিন ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে হাইডেন কন্টাক্টে গিয়ে আইডি বের করে মেয়েটার।নিকনেম ‘মায়াবতী’ দেওয়া।তবে হয়তো মায়াবতীর রেস্ট্রিকশনের লিস্টে আছে সে আদৌ।শেষ ম্যাসেজটা আওড়ায় সে।

—ভালোবাসা নাকি কষ্ট দেয়!তবে আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা আমায় মুক্তির পথ দেখালো।আপনার থেকে,পরিবার থেকে, এককথায় সবার থেকে আড়ালে মিলিয়ে যাবো আত্মগোপনে।তবে ফিরবো নিশ্চিত নিজেকে সুখী করে!আমি স্বার্থপরতা করবো ঠিকই তবে তা নিজেকে বাঁচাতে।

কুহেলিকার কথাগুলো ছিলো তার প্রেমিক পুরুষের জন্য।হ্যা সেই প্রেমিক পুরুষ আর কেউ নয় বরং সাফিন।হায়রে ভাগ্য দু’জনকে দেখা তো করালো তবে একজন চিনলেও অপরজন আর চিনতে পারলো না!

—কুহু…

সাফিন চোখ খুলে কুহেলিকাকে দেখেই নিরব কন্ঠে বলে ওঠে।কুহেলিকা শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়।ডাকনামে বহুদিন কেউ ডাকে না তাকে। খোলা মুখশ্রী।গোলাপী ঠোঁট একপাশে কামড়ে দাঁড়িয়ে সে।সাফিন বেরিয়ে জায়গা দিতেই কুহেলিকা ঢুকে যায় সিটে।গা এলিয়ে দেয়।সাফিন যেন এখনো স্তব্ধ দাঁড়িয়ে।

—স্যার বসুন…

কুহেলিকার কন্ঠে অনুভূতিশূন্যভাবে বসে পড়ে সে।কি বলবে,কোথা থেকে বলবে কিছুই যেন মস্তিষ্কের শিরদাঁড়ায় পৌঁছাচ্ছে না। অবাঞ্ছিত প্রশ্ন করে সাফিন।

—কেমন আছো?

—জ্বি আলহামদুলিল্লাহ স্যার।আপনি কেমন আছেন?

—আলহামদুলিল্লাহ।এতবছর কোথায় নিরুদ্দেশ ছিলে?

কুহেলিকা চোখ তুলে তাকায়।কারো তো তার নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে মতায়ন করার কথা নয়।আর সেখানে নাকি কেউ মনে রেখেছে তার নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা।কুহেলিকা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে তাকায় তার দিকে।চোখ যেন তার নিরব কথাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলে যাচ্ছে অনায়াসে।

সাফিন বাক্যহীন ঘুরে বসে থাকে।কুহেলিকার সাথে তার বর্তমান সম্পর্কের ভিত যে অন্যরকম।পছন্দ সে কুহেলিকাকে করলেও ভালো তো বাসতো নিজের পছন্দের রমনীকে।

—সবচেয়ে কষ্টদায়ক আনন্দক্ষণ মুহূর্ত তো সেইটা যখন ভালোবাসার ব্যক্তির অন্য আরেক ভালোবাসার মানুষ থাকে।

সাফিনের বারবার মনে পড়ছে কুহেলিকার পূর্বে বলা কথাগুলো।বড্ড আবেগী ছিলো যে সেই মেয়েটা।তবে বর্তমান কুহেলিকার মাঝে আগের আবেগ আর দেখতে পাচ্ছে না সাফিন।কেন জানি তার বড্ড কষ্ট লাগছে!

বাস আবারো চলতে শুরু করেছে। এতক্ষণ অস্বস্তি নামক কোনো কিছু না থাকলেও পরিচয় মেলার পর থেকে যেন দুজনের মাঝেই সমান অস্বস্তি।কুহেলিকার মাঝে প্রশান্তি ছিলো সাফিন ওকে চিনতে পারেনি তবে পাশাপাশি বসতে পেরেছি দু’জনে।তবে এখন সেই ভাবনা বদলে অস্বস্তিরা বিব্রত করছে তাকে।সাফিনের মাঝে আনন্দ থাকলেও জট পেকেছে হাজারো বর্তমানের চিন্তা!

অন্ধকারে আবৃত রাত।বাসের লাইটগুলোও নিভানো। যাত্রীদের মাঝে শুধু দুই জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারীর মাঝেকার আবেগ যেন ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে।তবে বাঁধ মানতে বাধ্য তারা উভয়েই।চোখ জোড়া বন্ধ করতেই সাফিনের ফোনে টুং করে আওয়াজ হয়।মোবাইল বের করে ধরতেই দেখে ‘বিবি সাহেবা’ থেকে ম্যাসেজ এসেছে।

—আপনার জন্য আপনার বিবি,পুত্র অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।দ্রুত আসুন। আপনার অনুপস্থিতিতে যে বড্ড পোড়াচ্ছে আমাদেরকে।জলদি আসুন না…

ম্যাসেজটা চোখ এড়ায়নি কুহেলিকারও।চোখের অশ্রুরা বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়েছে নিঃশব্দে।জানালার দিকে ঝুঁকে প্রিয় মানুষটির বউয়ের ম্যাসেজের কথা ভেবেই অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে।যদিওবা সে ধারণা করেই রেখেছিলো তার প্রিয় মানুষটা হয়তো এতদিনে বিবাহিত।তবুও তকদিরে এই ঘটনা লেখার খুব কি দরকার ছিলো!খুব কি দরকার ছিলো সাফিনের সাথে কুহেলিকার আবার দেখা হওয়ার!খুব কি দরকার ছিলো তারা দু’জন পাশাপাশি বসে যাত্রা করবে এমনটা হওয়ার!কুহেলিকা বিড়বিড় করে বলে ওঠে,

—যার দ্বিধায় বাঁচতে চেয়ে আমি হয়েছিলাম ছারখার,সে আজ বাঁচে তাঁর প্রেয়সীর দ্বিধায়!

চলবে কি?

দু্ই পথের পথিক পর্ব-০১

0

#দু্ই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১
#বর্ষা

আটবছর পর কুহেলিকা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। উদ্দেশ্য ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে অধিকারের সন্ধান,পরিচয়ের সন্ধান।অনেক তো শুনেছে সে অকর্মার ঢেকি,বংশের কলঙ্ক আরো কতকিছু! অনেকগুলো দিনও তো হলো কেউ কি স্মৃতিতে রেখেছে তাকে?

চট্টগ্রামের পথে দীর্ঘ বাস জার্নি।চাইলে হয়তো যেতে পারতো এয়ারক্রাফটে।হয়তো ইচ্ছে নেই,নয়তো তাড়া অনেক। মানুষের তাড়া হয় কয়েক ধরনের।কারো তাড়া জলদি পৌঁছানোর,আবার কারো তাড়া সময় আগলানোর!তেমনি কুহেলিকার তাড়া স্মৃতি আগলানোর।

কালো রঙা কুর্তি সমেত হিজাবে বেশ মায়াবতী লাগছে তাকে। বিদেশীদের মতো নীলচে চোখের অধিকারী সে।দেহের সাদা চামড়া যেন আরো বিদেশী রূপ দিয়েছে তাকে।বিদেশিনী দ্বিভাষীনি কন্যে যে রাত্রী গমন করছে মাতৃভূখন্ডগামী।বাসটা এখনো প্রায় ফাঁকা।হয়তো ঢাকা পেরোনোর পূর্বেই ভর্তি হবে বাস।

—এক্সকিউজ মি মিস এই সিটটা আমার।প্লিজ যদি একটু সরে বসতেন।

কুহেলিকা ওপরে তাকায়।শুভ্র শার্ট পরিহিত এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।তার যে তাড়া অনেক চেহারায় প্রকাশিত।কুহেলিকা সরে বসে জানালার দিকে।সে চেনে,চেনে এই পুরুষটিকে। প্রকৃতি কি চাচ্ছে তার ছেড়ে যাওয়া সবাইকে আবারো তার জীবনে আনতে!

জানালায় মাথা এলিয়ে শুতে গিয়ে বাঁধে আরেক বিপত্তি। কন্ট্রাক্টরের ধমকি শুনতে হয় তাকে। অবশ্য সে তো ভুলেই গিয়েছিলো এখানে গাড়ি,গাড়ি নয় বরং প্ল্যান।কখন কোথা দিয়ে ধাক্কা দেয়!কুহেলিকার নিশ্চুপতা আড়ালে অবলম্বন করে নেয় সাফিন মেহতাব।

সাফিন আড়চোখে মাস্ক পরিহিতা মেয়েটাকে সম্পূর্ণ অবসার্ভ করে নেয়।কারো সাথে বড্ড মিল মিল লাগছে তার।তবে সে যে নিরুদ্দেশ রমনী।আদৌ এ জন্মে মিলবে কি তার খোঁজ!আর ভাবে না সে।দীর্ঘ যাত্রা ঘুমই পারে শুধু দ্রুত পৌঁছে দিতে।

কুহেলিকা একবার ফিরে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।মোবাইল হাতে কাঙ্ক্ষিত আইডিতে ম্যাসেজ দেয়।’বাংলাদেশে এসেছি’।মিনিট দুয়েকের অপেক্ষাও করতো হয়না রিপ্লাইয়ের।উদ্দিগ্নতা মিশ্রিত বার্তা প্রেরিত হয় ওপাশ থেকে।’আমাকে জানালে আমিই তো নিয়ে যেতাম। সাবধানে থেকো।খুব শীঘ্রই এখানের কাজ গুছিয়ে আমিও আসছি।’কুহেলিকা চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে আটবছর পূর্বের ঘটনাদী।

আট বছর পূর্বে..

বাড়িভর্তি বাইরের লোকের সামনে কায়েস মির্জা চড় লাগান কুহেলিকার কপোলে।ছিটকে পড়ে কুহেলিকা।বয়সে তখন সে অষ্টাদশী।সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থী।দোষটা তার একটাই বিয়ে অমুঞ্জরী‌।মির্জা বংশের মতে,মেয়েদের পড়াশোনা করতে হয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়।তবে কুহেলিকার ক্ষেত্রে সবই বিপরীত।না কখনো তাকে দেওয়া হয়েছে পড়াশোনায় সাপোর্ট,না স্নেহ আদর।উল্টো কলেজ টপকানোর পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর গল্প বুনানোর কাজ করেছে।

—তোমার সাহস কি করে হয় মির্জা বংশের মেয়ে হয়ে বড়দের মুখে মুখে তর্ক করো?

—আমি তর্ক করছি না আব্বু।আমি শুধু আমার মতামত প্রকাশ করেছি।আমি বিয়ে করবো না।

—মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছো তখন বিয়ে তো তোমায় করতেই হবে।

—কায়ফা আপুকে বিয়ে দেও।সে তো আমার থেকে আরো পাঁচ বছরের বড়। অবিবাহিত।

—থাপ্পড়ে তোমার গাল লাল করে ফেলবো।কায়ফা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।সামনে ওর বিশাল ভবিষ্যৎ।তুমি ওর বিয়ের কথা বলছো কি করে?

স্যাত করে উঠে বলেন রুমানা আফরোজ।কায়েস মির্জা স্ত্রী,দুই কন্যা সন্তানের মাতা। অবশ্য তাদের এক কন্যাই বলা যায়।তারা তো কখনো কুহেলিকার বেড়ে ওঠাকে খেয়াল করে দেখেনি।আদৌতে তারা কি জানে কুহেলিকার জন্মদিবস কবে?!

—আম্মু আব্বুকে তাহলে বলো যে আমিও তো পড়ছি। আমারও তো ভবিষ্যৎ সামনে।আমায় কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছে।

—চুপ করো বেয়াদব মেয়ে।বাড়িভর্তি লোকের সামনে তুমি তোমার বাবার মাথা নিচু করছো।

—আম্মু তুমি আর আব্বু শুধু আপুকেই ভালোবাসো আমাকে কেন একটু ভালোবাসো না?আমি কি তোমাদের মেয়ে না!

—কুহেলিকা ঘরে যাও অনেক সহ্য করেছি তোমার বেয়াদবি।

বাবার ধমকে ওপরের সিঁড়িতে পা রাখে সে।কায়েস মির্জা ক্ষমা চান অতিথিদের নিকট।বিদায় জানান।তারাও বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যায় কেননা এতক্ষণের ঘটনায় তারা এ বেশ ভালোই বুঝেছে মেয়ের মতামত নেই।কুহেলিকা তখনো দোতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে।নিচ থেকে ভেসে আসা কন্ঠ তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়।তার বড় চাচা কাসেম মির্জা আর বড় চাচি জয়নুবা বেগমের কন্ঠ।

—ভাই শোনো আগেই বলছিলাম তোমার এই মেয়ের কারো সাথে চক্কর চলে।নয়তো বিয়েতে রাজী হবে না কেন?সময় থাকতে বিয়ে দেও নয়তো দেখবা নাক কাটছে আমাদের ‌।

—বড় ভাবী একদম ঠিক বলছে তুমি এই নোংরাটা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে বিদায় করো!

মিসেস জয়নুবার কথায় তালে তাল মিলিয়ে রুমানা আফরোজ বলেন।কলিজায় দাগ টানে ‘নোংরা’ শব্দটা।সে কি এতোটাই নোংরা!কই সে যদি নোংরাই হয় তবে পুরুষের আকর্ষণের কারণ কিভাবে সে!কেন পুরুষেরা তাকে ইমপ্রেস করতে চায়,বিয়ে করতে চায়?

রাতে খাবার টেবিলে কায়ফা,জাহিদ, জুনায়েদ খেতে বসেছে।কুহেলিকার অধিকার নেই ওদের সাথে খাওয়ার। রান্না ঘরে সে খাচ্ছে।থালা ধুয়ে যেই বেরিয়েছে তখনই দেখা কায়ফার সাথে।কায়ফা এমন ভঙ্গিমায় এড়িয়ে গেল যেন সে তার ছোট বোনকে নয় বরং দূর্গন্ধযুক্ত আবর্জনার পাশ দিয়ে যাচ্ছে!

পরিবারের এত এত অবহেলার পরও সুন্দর পৃথিবীটা সে উপলব্ধি করতে চায়। রহস্যময় পৃথিবীর রহস্য উন্মোচন করতে চায়।জীবনের মায়া নেই দেখেই হয়তো এই টান।তবে সবার মতো তারও যে এক দূর্বল স্থান আছে।তবে তা সম্পূর্ণ পাপ।শিক্ষক তো পিতা সমতুল্য।আর সেখানে সে নিজের শিক্ষককেই স্বামী বানাতে চায়।এ যে শুধু পাপ নয় বরং মহাপাপ।

পরদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে কুহেলিকার দেখা হয় কাঙ্ক্ষিত পুরুষের সাথে। শিক্ষকতা পেশাতেই নিবদ্ধ সে।না আছে পিছুটান আর না আছে বিরাট পরিবার।একাকী থাকে এই চট্টগ্রামে। অবশ্য চট্টগ্রামে থাকলেও কুহেলিকার ভাষা চয়ন গুলো কি করে যেন বইয়ের ভাষা।

—আসসালামু আলাইকুম স্যার,কেমন আছেন?

—ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

—স্যার কোথায় যাচ্ছেন?

—টিউশনিতে।তা তুমি এই ভর সন্ধ্যায় বাইরে যে?

—বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে ছিলাম।

—এইচএসসি তো শেষ।তারপর কি করার ইচ্ছা আছে?

—যদি আজ কালকের মাঝে জোরজবরদস্তির বিয়ের পিঁড়িতে না বসি তাহলে খুব শীঘ্রই পালিয়ে যাবো এখান থেকে।

—ছিঃ পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা ভুলেও মাথায় এনো না।পরিবার যা করে ভালোর জন্যই করে।পরিবারকে মানিয়ে পড়াশোনা কন্টিনিউ করে।আসি এখন।

—স্যার..

—কিছু বলবে?

—স্যার আমি আপনাকে ভালোবাসি।আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন?

চোখ বন্ধ করে মনের ব্যাকুল আর্জি জানিয়ে দেয় কুহেলিকা।তবে সামনে থেকে কোনো জবাবই সে পায়নি। সেকেন্ড কয়েক বাদে চোখ খুলে দেখে সামনের দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে তার মনের মানুষটা।হয়তো মুখের ওপর না বলতে পারেনি তাই এড়িয়ে যাওয়া।

সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরতেই রুমানা আফরোজ চুল ধরে ইচ্ছে মতো মারতে থাকে কুহেলিকাকে।জয়নুবা বেগম চেঁচিয়ে বলেন,

—বেলাজ মেয়েকে আরো মারো।কোথাকার মাস্ক পড়া ছেলের সাথে সাঁঝের সময় দেখা করতে যাওয়া না!জাহিদ ঠিক করেছে ছবি তুলে এনে।বেলাজ, বেয়াদব মেয়ে কোথাকার!রুমানা তোমার উচিত ছিলো এই মেয়েকে বড় না করে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা।

কথাগুলো মারের থেকেও বেশি ক্ষতবিক্ষত করছিলো কুহেলিকাকে।দুইদিনে দুইবারের মতো মার।আজ তার দাদী বেঁচে থাকলে এমনটা কিছুতেই করার সাহস হতো না এদের।আগে সব শুনতো তারপর কি পদক্ষেপ নেবে তা ভাবতো।আজ দাদা-দাদি মৃত বলে!

কুহেলিকা মার খেয়ে ঘরে এসে গোসলে ঢোকে।মনের জ্বালা গায়ের জ্বালার চেয়েও বেশি।প্রথমত প্রিয়তমের নিকট নিরব প্রত্যাখান,দ্বিতীয়ত পরিবারের সদস্যদের আচরণ রাস্তার কিটগুলোর মতো হয়ে উঠেছে তার প্রতি।কুহেলিকা বাঁচতে চায়।তবে এখানে থাকলে তাকে মরতে হবে।যদিওবা এতদিন আশ্রয়ের স্থান ছিলো না বলে যায়নি কোথাও সে।তবে আজ তার আত্মসম্মান পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত,হৃদয় ভংগুর,দেহ রক্তাক্ত আর যে সহ্যের সীমানায় নেই কিছু!

—ভালোবাসা নাকি কষ্ট দেয়!তবে আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা আমায় মুক্তির পথ দেখালো।আপনার থেকে,পরিবার থেকে, এককথায় সবার থেকে আড়ালে মিলিয়ে যাবো আত্মগোপনে।তবে ফিরবো নিশ্চিত নিজেকে সুখী করে!আমি স্বার্থপরতা করবো ঠিকই তবে তা নিজেকে বাঁচাতে।

চলবে কি?

বাঁধনহারা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#ছোটগল্প
বাঁধনহারা (অন্তিম পর্ব)
~আরিফুর রহমান মিনহাজ

– ভাত বরফ হয়ে গেছে। একটু বসেন। ইশটোভে বসাইলে দেরি লাগবো না।
আমি মৃদু আপত্তি করলাম। টিকল না। চটপট ভাত বসিয়ে দিল সে। বিদ্যুৎ চলে গেল। চার্জলাইট জ্বলল। আমার হাতে একটা হাতপাখা ধরিয়ে দিল। নিজে একটি নিয়ে ঘুমন্ত ছোটভাইকে বাতাস করতে করতে কপালের চুল সরিয়ে পা ভাঁজ করে বসল। চিন্তামগ্ন হয়ে বলল,
– ও ছাড়া পাবে তো?
আমি এবার কিছুটা বিরক্ত হলাম,
– তোমার নিজের শরীরে ওর আঘাতের অসংখ্য দাগ আছে না মরিয়ম? তুমি যদি চাও,ও শোধরাক তাহলে তার ছাড়া পাওয়া নিয়ে এতো পাগলামি করিও না। একটা শিক্ষা ওর হওয়া দরকার।
মরিয়ম বিষণ্ণ হয়ে চুপ মেরে গেল। কিছুক্ষণ পর গরম গরম ভাত পরিবেশন করল ও। সঙ্গে শুটকির তরকারি আর তেলাপিয়া মাছ। বললাম,
– তোমরা খেয়েছ?
– খাইয়া শুইছিলাম৷ এমনসময় পুলিশ…।
আমি আরকিছু না বলে খাওয়া শুরু করলাম। খেতে খেতে ভাবলাম নিয়তির কথা। মানুষের নিয়তি বড় অদ্ভুত বটে! কস্মিনকালেও কি ভেবেছিলাম ফ্লাইওভারের নিচে খাবার বিক্রি করা গম্ভীর মেয়েটির ঘরে এসে গরম গরম ভাত গিলব? আবার মনে হলো,আমি এখানে কেন? মরিয়ম আমার কে হয়? সে কেনই বা আমাকে এতো রাতে নির্মল মমতা মিশিয়ে ভাত রেঁধে খাওয়াচ্ছে? শুধু ভাইয়ের স্বার্থের জন্য? নাকি এই জনাকীর্ণ শহরে ওর ভরসার কেউ নেই বলে? এই একবছর ঘুরতেই আমি ওর কী এমন আপন হয়ে গেলাম? আমি আড়চোখে তাকালাম ওর দিকে; যেন আমার মস্তিষ্কজুড়ে উৎপাতরত এসব অযাচিত প্রশ্নের সন্ধানে…। মরিয়ম একহাতে নিরলসভাবে হাতপাখা ঘুরিয়ে যাচ্ছে। অন্যহাত মাথায় ঠেকিয়ে সর্বহারা ভঙ্গিতে বসে আছে। ওর তন্বী দেহ উন্নত ধনুকের মতো বেঁকে আছে। যদি চিত্রকর হতাম রংতুলির আঁচড়ে সাদা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে পারতাম ওর এই নয়নরঞ্জন ভঙ্গিটি।
– ভাত দেব?
আমি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে কাঠ হয়ে রইলাম। মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
– দাও।
ভাত বেড়ে দিতে দিতে ও বলল,
– আপনে তো দুপুরে ভাত খান্না। বাইরে এটাসেটা খান প্রইত্তেকদিন। অসুখ একটা বাঁধলে?
আমি বিতৃষ্ণা নিয়ে বললাম,
– বাঁধলে বেঁচে যাই৷ এই একলা জীবনের ঘানি আর টানা লাগল না৷
অসন্তুষ্ট হয়ে ঠোঁটজোড়া সংকুচিত করে ফেলল মরিয়ম। পদ্মের মতো আয়ত চোখজোড়ায় ভেসে উঠল প্রচ্ছন্ন রাগ। মরিয়ম আহামরি সুন্দরী না। কিন্তু এই অভিব্যক্তিতে ওকে সুন্দর দেখাল। আচমকা ওর বৈশিষ্ট্যহীন চেহারার মায়াবী একটি দিক উন্মোচিত হলো যেন। আমি হেসে বললাম,
– আমার জন্য তোমার চিন্তার প্রয়োজন নাই মরিয়ম। আমার মতো মানুষদের জীবনে চিন্তার মানুষ থাকলেই বিপদ।– দাও, আরেকটু শুটকির তরকারি দাও। তোমার রান্নায় ঘরোয়া ঘরোয়া একটা ব্যাপার আছে। অনেকদিন পর—

৩.
নানা চেষ্টা তদবিরের পর মাসকয়েক পরেই মরিয়মের ভাই মাজেদ ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। অবশ্য, এযাত্রায় আমার জমানো টাকা থেকে বেশ বড় একটি অংক খরচ করতে হয়েছিল। মরিয়ম যখন পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে ঋণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অশ্রুপ্লাবিত মুখে আমার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছিল তখন ওকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিল? নির্দ্বিধায় এবং বিনাবাক্যব্যয়ে ওকে সাহায্য করবার কথা জানিয়েছিলাম। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে সে বলেছিল,
– যেভাবে হোক,আপনের টেকা আমি দিয়া দিব, ইসহাক ভাই।
আমি জানি মরিয়মের খরচ অনেক। এই টাকা শোধ করা ওর পক্ষে অসম্ভব প্রায়। আশ্বাস দিয়ে বললাম,
– তাড়া নেই মরিয়ম। তোমার যখন বড় রেস্তোরাঁ হবে? তখন না-হয় দিও। যদি না-ও হয় তবুও আমি দাবি রাখব না। চাপ নিও না।

জেল থেকে ছাড়া পাবার পর মরিয়মের অনুরোধে আর মাজেদকে চোখাচোখে রাখার জন্য আমার কনস্ট্রাকশন সাইটের কন্ট্রাক্টরকে বলে জোগালির কাজ ধরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এতে হলো আরেক বিপত্তি। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রদর্শনীসরূপ হোক কিংবা পরিবার-পরিজনহীন বলে প্রচ্ছন্ন মায়ায় হোক— মরিয়ম প্রায়শই ভাইয়ের মাধ্যমে হটবক্সে করে দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দিতে শুরু করল আমার জন্য। শুরুতে শুরুতে ব্যাপারটায় ভীষণ বিব্রত বোধ করলেও দিনে দিনে আমি যেন লোভী হয়ে উঠলাম। তক্কেতক্কে থাকতে শুরু করলাম কখন মরিয়মের ভালোবাসাময় খাবার আসবে। সপ্তাহে একটি দিন অন্তত মরিয়ম খাবার পাঠাবেই। মনে মনে খুশি হলেও প্রতিবারই আমার একটি কথা,
– মাজেদ, তোমার আপাকে বলবা এসব না করতে। এগুলা আমার পছন্দ না।
মাজেদ হাসে। ওর হাসি দুর্বোধ্য। মাদকের নেশা যেন ভয়ংকরভাবে ওর আত্মার সব নির্যাস সিঞ্চন করে ফেলেছে।
তবে দিন যত গেল,আমার লাজলজ্জা উবে গেল। বিপরীতে আমাদের মধ্যকার নামহীন সম্পর্কটা আরো সহজ-সাবলীল হতে শুরু করল। এতে অবশ্য কিছুটা সংকটও দেখা দিল। কারণ, খাবারের মানের কারণে হোক বা অন্যকারণে; মরিয়মের কাস্টমার হুহু করে বাড়তে শুরু করেছিল। যারফলে আশেপাশের ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা বিষয়টা হজম করতে পারছিল না। তারা মরিয়মকে নানাভাবে ধরাশায়ী করার তালে ছিল। এবং এরই ধারাবাহিকতায় আমার অবারিত উপস্থিতি এবং আমার সঙ্গে মরিয়মের সদাহাস্য ভাবের কারণে তারা মরিয়মের নামে প্রকাশ্যে অপবাদ রটাতে শুরু করল। যা কানেও শোনা যায় না,কলমেও লেখা যায় না। খবর পেয়েছি,এই নিয়ে মরিয়ম ইতোমধ্যেই ওদের সঙ্গে কয়েকদফা বচসায় লিপ্ত হয়েছে। শুনে মরিয়মকে বললাম,
– ওদের সঙ্গে ঝগড়া করা মানে পাগলামো,মরিয়ম। ওরা অশিক্ষিত। তুমি কিছুটা হলেও পড়াশোনা জানো। এখন তোমার আর ওদের মধ্যে তফাত কি থাকলো?
– তাইলে চুপ করে থাকমু?
মরিয়মের স্বর ছাইচাপা আগুনের মতো। দেখতে শীতল মনে হলেও আদতে গনগনে।
– কিছু সময় চুপ করে থাকাটাও সমাধান হতে পারে। এখন ওরা যে অপবাদ দিচ্ছিল সেটা ওরা বিশ্বাস করতে শুরু করবে। আরো জোরেশোরে প্রচার করবে।
মরিয়ম তেমনি চাপা গনগনে গলায় বলল,
– আমি চুপ থাকতে পারমু না। এগুলা আপনার শুনতে ভাল্লাগতে পারে। আমার লাগে না।
আমি আর কিছু না বলে তৎক্ষনাৎ বিদায় নিলাম৷ বুঝলাম, আজ মরিয়মের মাথা ঠিক নেই। থাকার কথাও না।
এরপর দিনসাতেক আমি ওমুখো হইনি। অষ্টমদিন সকাল সাতটায় মরিয়মের স্কুলপড়ুয়া ছোট ভাইটি একটা স্টিলের টিফিন-ক্যারিয়ার নিয়ে হাজির আমার মেসে। আমি চোখ কচলাতে কচলাতে সেটি গ্রহণ করলাম। ঘরে এসে সোৎসাহে খুলে দেখলাম, আমার পছন্দের ডিমওয়ালা পুঁটিমাছের ঝোল আর ভাত। একটি পাত্র খালি। সেখানে একটা পলিমোড়ানো ছোট্ট চিরকুট। চিরকুট খুলে দেখলাম গোটাগোটা অক্ষরে লেখা,

“ইসহাক ভাই, আপনারে কল করতে সাহস হইতেছে না। আপনি রাগ করছেন। আমি সেইদিন ওমনে বলতে চাইনাই। আমাকে মাপ করবেন। আপনি একবার একহাজার টাকা দিয়ে বলছিলেন ডিমঅলা পুঁটিমাছ খাবেন। ওইটা দিলাম। অনেক কষ্ট করে জোগাড় করছি। ”

৪.
এভাবেই আমার নিস্তরঙ্গ, একঘেয়ে জীবনতরী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঊর্মি ভেঙে এগোচ্ছিল। কিন্তু কে বলেছে সমুদ্র সবসময় শান্ত থাকে? কে বলেছে কালান্তক জলোচ্ছ্বাস হানা দেয় না জীবনতটে? এরমধ্যেই একদিন খবর পেলাম চট্টগ্রামের বেশ নামকরা একটি কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়েছে। বেতন যথেষ্ট ভালো। আগামী মাসেই জয়েনিং। সবকিছু হারিয়ে ফেলার হতাশায় নিজেকে আমি লক্ষহীন মানুষ বলে ভাবতে ভালোবাসলেও এই খবরে আমার অন্তর-পরিতোষের কারণে বুঝতে পারলাম মানুষ লক্ষহীন বাঁচতে পারে না৷ নিজের অবচেতনই প্রত্যেক মানুষ একটি লক্ষে এগিয়ে চলেছে। আমিও তেমনই৷ খুশির খবরে মিষ্টি খাওয়ানো দরকার। মেসের রুমমেইট, মরিয়ম আর তর্কসাপেক্ষে মাইশা ছাড়া আর কে আছে আমার কাছের মানুষ? রুমমেইটদের খাওয়ালাম। আমার মতো অমিশুক, অহংকারী বিদায় হবে বলে ওরা বোধহয় খুশিই হয়েছে৷ মরিয়মের কাছে গেলাম মিষ্টি নিয়ে। দারুণ ব্যস্ত সে। গরম তেলে বেগুনি ভাজছে, উলটে দিচ্ছে। কখনো আবার কাস্টমারের হাত থেকে টাকা নিয়ে ক্যাশে পুরছে। পাক্কা আধাঘন্টা পর অবসর মিললে অবাক হয়ে বলল,
– মিষ্টি ক্যান, ইসহাক ভাই?
– নতুন চাকরি হইছে। খাও।
মরিয়ম একটা মিষ্টির অর্ধেকটা মুখে পুরল হাসিমুখে। আমি ধীরে ধীরে বললাম,
– আগামী সপ্তাহেই চট্টগ্রাম চলে যেতে হবে।
ভুরু কুচকে ফেলল মরিয়ম,
– ক্যান?
– চাকরি তো ওখানেই।
– অহঃ
হঠাৎ যেন দপ করে নিভে গেল সে। ওর হাস্যময় চোখে আচমকা যেন মেদুর ছায়া নেমে এলো। প্রথমবারের মতো আমিও একটা অদৃশ্য টান অনুভব করতে লাগলাম এই শহরের প্রতি,এই জায়গাটির প্রতি,মরিয়মের প্রতি। সর্বোপরি আমার নিরানন্দ নিয়মতান্ত্রিক জীবনে মরিয়ম শরত-শিউলির শিশিরভেজা স্নিগ্ধতা নিয়ে এসেছিল। নিস্তরঙ্গ জীবনসমুদ্রকে তরঙ্গায়িত করেছিল। একবার ভাবলাম, থাক বড় চাকরি প্রয়োজন নেই,জীবনে সুখশান্তিই তো আসল। এই শহরে না চাইতেও নির্মল শান্তির যে উপলক্ষ পেয়েছি এমন আর কোথায় পাব? কিন্তু,মানুষ তো! উর্ধ্বে উঠার সোপান ছেড়ে কেইবা নিম্নগামী হতে চায়? আমিও চাইনি৷ মরিয়মকে বললাম,
– আমি মাঝেমধ্যেই আসব। তোমাদের দেখে যাব।
মরিয়ম নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়। কয়েকজন কাস্টমার এসেছিল,ওদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। আমি কাঠগড়ার আসমানীর মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে লাগলাম ওর কার্যকলাপ৷ চিরাচরিত ভঙ্গিমায় কাজ করছে বটে ; কিন্তু ওর ঘাম চিটচিটে শ্যামল মুখে যেন কীসের ছায়া নাচছে! আমার ভেতরটা দুলে উঠল। নাহ,এই অসম মায়াডোর ত্যাগ করাই আমার জন্য উত্তম। কোনোরকম বন্ধন আমার জন্য নয়। আমি আর দাঁড়ালাম না। ফেরার পথ ধরলাম। এখান থেকে মেস অনেক দূর। হাঁটতে লাগলাম। আজ হাঁটব,যতক্ষণ না ক্লান্ত হই।

আমি আমার সিদ্ধান্তে চিরকালই অটল থেকেছি,এবারও তাই। অবশ্যম্ভাবী সবকিছু চিন্তা করেই চট্টগ্রামের কোম্পানি ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম,সুতরাং আর পিছু হটা অসম্ভব। যেদিন বাক্সপেটরা গুছিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম সেদিন বারবার বারণ করা সত্বেও মরিয়ম বাসকাউন্টার পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিতে এসেছিল। ঘনায়মান দুঃখের পরিবেশটা হালকা করার জন্য বলেছিলাম,
– মন খারাপ করছ নাকি মরিয়ম? আমার জন্য রাঁধতে পারবে না বলে?
মরিয়ম বলল,
– না। আপনের ভালা চাকরি হইছে। এখন বিয়েশাদি করবেন। আমার আর চিন্তা নাই।
আমি ভেতরের ভাঙনটা লুকায়িত করার জন্য স্বভাববিরুদ্ধভাবে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠেছিলাম,
– যা বললে মরিয়ম। আমাকে কে বিয়ে করবে? আমার মতো বাঁধনহারাকে?
এই প্রশ্নের জবাবের নিরুত্তর মরিয়ম। বাসে চড়লাম। কিছুক্ষণ পরেই বাস ছেড়ে দিল। বুকের ভেতরে যেন কালবোশেখী মেঘ গর্জাতে লাগল। পেছনে আনাগোনারত অসংখ্য মানুষের ভিড়ে মরিয়ম বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আমি জানালার ফাঁক গলে হাত বের করে বিদায় জানালাম। চোখে পড়ল ওর পরনের বহুলব্যবহৃত জীর্ণ সেলোয়ার-কামিজের দিকে। মনটা বেজার হলো। যাওয়ার আগে একটা কাপড় তো ওকে উপহার দেওয়া যেত! ভাবলাম,পরেরবার এলে দেওয়া যাবে। কিন্তু হায়,কে জানতো এই দেখাই ছিল শেষ দেখা! কে জানতো, ওর এই শেষ বিচ্ছেদ-বিধুর চাউনি বাকিটা জীবন আমার বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হয়ে থাকবে?

চট্টগ্রামে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর নিয়মিত বিরতিতে মরিয়মের সঙ্গে বেশ কয়েকবার ফোনালাপ হয়েছিল। এরপর হঠাৎ করে আমি টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাসখানেক শয্যাশায়ী ছিলাম। দুর্ভাগ্য কাকে বলে— ফোনটাও এই-ফাঁকে চুরি গেল। সুস্থ হয়ে উঠার পরও মাসখানেক বিভিন্ন ব্যস্ততায় ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়ে উঠেনি। কিন্তু এরপর যোগাযোগ করতে গেলে ওকে পাওয়া গেল না। দিনকয়েক অনেক চেষ্টা করেও যখন কোনো মাধ্যমেই মরিয়মকে পাওয়া গেল না তখন আমার চটক ভাঙল। কুচিন্তাপ্রবণ মনকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য আমি সরাসরি দেখা করতে চলে এলাম ঢাকায়,সেই ফ্লাইওভারের নিচে। কিন্তু কোথায় মরিয়ম? কোথাও নেই সে। মাজেদও নেই। কেউ জানে না তাদের খবর। যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে তারা। মরিয়ম যে বাসায় থাকতো সেখানে গিয়ে জানা গেল অপ্রত্যাশিত মর্মন্তুদ সংবাদ। গতমাসে মরিয়মের স্কুলপড়ুয়া ছোটভাইটি কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে ভয়ানকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল। আকস্মিক সেই মৃত্যুর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না পেরে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল মরিয়ম। এরিমধ্যে বোনকে অকূলপাথারে ভাসিয়ে মাজেদ তার পুরনো পথে ফিরে গেছে। সবমিলিয়ে মরিয়মের মানসিক অবস্থা খুব একটা স্থিতিশীল ছিল না৷ গুম হয়ে বসে থাকতো সারাদিন। মাঝেমধ্যেই ভাইয়ের শোকে কেঁদে উঠত। গভীর রাতে কবরস্থানে গিয়ে বসে থাকতো। একদিন প্রতিবেশীরা সকালে জেগে উঠে দেখে, ঘরের দরজা হাট করে খোলা, ঘরে কেউ নেই। সবকিছু পড়ে আছে তেমনি। মরিয়ম নেই। এরপর আরো একমাস পেরিয়ে গেলেও সে আর ঘরে ফেরেনি।

পরিশিষ্ট-

অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। এতবছরে আমার জীবনেও কম অদলবদল হয়নি। যে সাফল্যের সোপান বেয়ে উপরে উঠার আকাঙ্খায় আমি চোখবুঁজে ছুটেছিলাম অনিবার্য বিপর্যয়ের দিকে সেই সাফল্য আমাকে ধরা দিয়েছিল। সরকারি চাকরির মতো সোনার হরিণ আমি পেয়েছিলাম। সংসারীও হয়েছিলাম। মাইশা আমার জন্য অপেক্ষা করেনি। বিয়ে করেছিলাম অন্য কাউকে,যার কোনো ব্যাখ্যা এখানে নিষ্প্রয়োজন। তাকে হয়তো ভালোওবেসেছিলাম নিজের সবটুকু উজার করে দিয়ে। কিন্তু বন্য পাখিকে কি আদর-সোহাগ দিয়ে পোষ মানানো যায়? যায় না। সে ঠিকই তার বুনো চেহারা দেখিয়ে দিয়ে আপন নীড়ে ফিরে যাবে। আমার বউও তাই গেছে। আমার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে,আইনের মারপ্যাঁচে আমাকে বিদ্ধ করে দুই বছরের ফুটফুটে পুত্রসন্তানসহ নিজের কাছে নিয়ে গেছে। আমাকে করে দিয়ে গেছে আগের মতো, একা,নিঃসঙ্গ। আমার প্রতি পর্বতপ্রমাণ অভিযোগ দাঁড় করালেও আমি বিলক্ষণ জানতাম, ওর হৃদয় অন্য কারোর জন্য ব্যথিত ছিল। ডিভোর্স হতে-না-হতেই চাচাতো ভাইকে বিয়ে করেছিল সে। কষ্ট পেয়েছি, অবাক হয়নি। কারণ, আমার যা কিছু সুখকর, প্রশান্তিয় সবকিছু একদিন-না-একদিন খোদাতায়ালা কেড়ে নিবেন এটাকেই আমি নিয়তি বলে বিশ্বাস করে নিয়েছি। সংসার-জীবন থেকে পৃথক হতেই একান্ত নির্জনে পুরনো ক্ষতগুলো তাজা হয়ে উঠতে শুরু করল। মরিয়মের মর্মন্তুদ প্রস্থান আমার জন্য এক মহাজাগতিক বিপর্যয়ের চেয়েও কম ছিল না। সংসারী জীবনে মরিয়মকে বেমালুম ভুলে থাকলেও নিঃসঙ্গ জীবনে ওর প্রস্থান-ব্যাথা পুনরায় ফিরে ফিরে আসে। নিজেকেই বারবার দোষী মনে হয়। চাকরির লোভে চট্টগ্রাম চলে না গেলে গল্পটা হয়তো ভিন্নও হতে পারত! ওর ভাইকে হয়তো বাঁচাতে পারতাম না,কিন্তু ওকে যে হারাতাম না এটাই আমার বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসই আমার নিঃসঙ্গ দিবসরজনীতে অহর্নিশ পীড়া দিয়ে যায়। সর্বোপরি বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে আমার ধূ-ধূ বিরানভূমিতে সে-ই নির্মোহ মমতার বারিধারা বর্ষণ করেছিল। হোক না সেটা অল্প সময়ের জন্য।

কিন্তু এখন কোথায় সে? আমি তো জানি সে বেঁচে আছে,সুস্থ আছে। কিন্তু কি এক বোবা অভিমানে আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে বছরের পর বছর–। যেসব শহর,জনপদ আমি মাড়িয়েছি সেসব শহরে আমার চোখজোড়া অগোচরেই খুঁজে ফিরেছে একটি তন্বী, শ্যামল অবয়বকে। তেমন কাউকে দেখলেই জ্বালানি-পাওয়া সলতের মতো দপ করে জ্বলে উঠে চোখজোড়া,পরক্ষণেই আবার নিরাশ হয়ে নিভে যায়। আমার দৃঢ়তর বিশ্বাস, জীবনের কোনো এক ক্রান্তিলগ্নে আবার সে ত্রাণকর্তা রূপে আবির্ভূত হবে;খরা-দীর্ণ এই বিরানভূমিতে আবারো বর্ষণ করবে শীতল বারিধারা। সেইদিন খুব দূরে নয়। আমি জানি।

—– সমাপ্ত—–

বাঁধনহারা পর্ব-০১

0

ছোটগল্প
বাঁধনহারা (পর্ব ০১)
~আরিফুর রহমান মিনহাজ
১.
মেয়েটির সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটি আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। ভরদুপুরে সস্তায় পেটের খিদে নিবৃত্ত করবার জন্য ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আশেপাশে অগুনতি ভাতের হোটেল থাকা সত্বেও তাতে ঢুকার সাহস হচ্ছিল না সঙ্গত কারণেই। স্বল্প বেতনের একজন সাইট ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষে রোজ-রোজ রেঁস্তোরায় খাওয়ার চিন্তা বিলাসিতা বই আর কিছু নয়। কাজেই মধ্য-এপ্রিলের চাঁদিফাটা তুমুল দাবদাহ উপেক্ষা করে সস্তা খাবারের সন্ধানে বের হওয়া। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকদূর এসে পড়েছিলাম। ফ্লাইওভারের কাছাকাছি। ফ্লাইওভারের নিচে অনেকগুলো ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান চোখে পড়তেই সেদিকে এগিয়ে গেলাম। অবস্থাদৃষ্টে বুঝলাম, এদের খরিদ্দারের বড় অংশই কলেজপড়ুয়া আর চাকরিজীবী। বসার বেঞ্চগুলো দখল হয়ে যাবার পরেও বেশিরভাগ মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মচমচিয়ে ভাজাপোড়া খাচ্ছে,ভাবলেশহীনভাবে। দোকানগুলোতে হরেকরকম আইটেম দেখা গেল। বিরিয়ানি,সিঙারা সমুচা, বেগুনি আলুর চপ, ছোলাবুুট,নুডলস ইত্যাদি। আমি বসার জায়গা হয় এমন একটি দোকানের খোঁজে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করে ব্যর্থ হয়ে তুলনামূলক কম ক্রেতা আছে এমন একটি দোকানের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। অন্যান্য দোকানের মতো এই দোকানেও একই আইটেম উপস্থিত। রসালো ছোলাবুট,বেগুনি,আলুর চপ,জিলাপি এগুলোই।
– কী খাবেন?
আমার চোখ ছিল থরে-থরে সাজিয়ে রাখা খাবারগুলো দিকে।একটি তীক্ষ্ণ মেয়েলি কণ্ঠে আমি চমকে উঠলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি একটি ঘর্মাপ্লুত শ্যামল নারীমুখ কিছুটা নিরুৎসাহিতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখজোড়া জ্বলজ্বলে, নাকটা ঈষৎ বোঁচা, ঠোঁটজোড়া পাতলা এবং তীক্ষ্ণ। চুল চুড়োখোঁপা করা। ছিপছিপে গড়ন। শ্যামল গাত্রবর্ণ। বয়স আঠারো-উনিশের বেশি হবে না। কৈশোরের মৃদু ছাপ যেন এখনো লেপ্টে আছে চোখে-মুখে। পরনে পেঁয়াজ রঙা মলিন সেলোয়ার-কামিজ। বুকের ওপর সুবিন্যস্তভাবে দোপাট্টা টানা। শহরের এমন একটা জনাকীর্ণ জায়গায় একটি উঠতি মেয়ে ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান চালাচ্ছে এই বিস্ময়টি আমি চাপা দিয়ে বললাম,
– ছোলাবুট দেন। সাথে বেগুনি দিয়েন না,শুধু চপ দিয়েন।
আমার মুখে আপনি সম্মোধন শুনেই বোধহয় মেয়েটি একটু অবাক হলো। সেটা গোপন করার চেষ্টা করে সে দ্রুতই ছোলাবুট প্রস্তুত করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি বেশ তৃপ্তি নিয়েই খাওয়া শেষ করলাম। বিল মিটিয়ে বাকি টাকাগুলো ফেরত নিতে নিতে ছোট করে বললাম,
– ছোলাটা ভালো ছিল।
মেয়েটি হা-না কিছু না বলে দ্ব্যর্থকভাবে মাথা ঝাঁকাল শুধু। এরপর অন্য ক্রেতার দিকে ঝুঁকে গেল।
এভাবেই মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা। এরপর থেকে সাইটের কাছাকাছি হওয়ায় কীভাবে যেন আমি সেই ভ্রাম্যমাণ দোকানের নিয়মিত কাস্টমার হয়ে উঠলাম। রোজ একই ধাঁচের খাবারে মন সায় দিত না বটে,কিন্তু সাইটের আশেপাশে এরচেয়ে সুলভ-মূল্যে এমন উপাদেয় খাবার জুটবে কোথা থেকে? উপরন্তু মেয়েটির রন্ধনপ্রণালী যে-কারোরই ভালো লাগতে বাধ্য। প্রথম একমাস তার সঙ্গে আমার কোনো বাড়তি আলাপচারিতার সুযোগ হয়ে উঠেনি,অথবা প্রয়োজনও হয়নি। মেয়েটির নীরবতা আর অম্লান রহস্যের খোলসে নিজেকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল যে আমি সেই চিরশান্ত মূর্তিটাকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখতে শুরু করেছিলাম। যাইহোক, আমাদের আলাপের সুত্রপাত হয় এক কালবৈশাখী-ক্লান্ত অপরাহ্নে। ঝড়ের তাণ্ডবে পুরো শহর যখন পর্যুদস্ত সেই থমথমে পরিবেশে আমি সাইটের কাজ কিছুটা গুছিয়ে খিদের তাড়নায় হাজির হলাম ফ্লাইওভারের নিচে। তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। আকশটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে। গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে মানুষের ভিড় নেই খুব একটা। আমি গিয়ে সরাসরি বেঞ্চে বসেছি। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখে একধরণের জিজ্ঞাসা ঝুলে আছে যার মানে’আজ এতক্ষণে যে’। আমি যেন অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বলে উঠলাম,
– যা ঝড় হলো!… বেচাকেনা তো তেমন হয়নি মনে হচ্ছে।
মেয়েটি ভ্যানের পাশে বড় কড়াইয়ে কিছু একটা ভাজছিল। আমার কথায় সায় দিয়ে বলল,
– হু, ঝড়-বাতাসের মইদ্দে কি আর কাস্টমার হয়! আপনেরে কী দিব?
আমি বললাম,সব তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। কী খাই?
– কাজ না থাকলে একটু বসেন। নুডুলস পাকাচ্ছি।
বলে পাশেই তাকে সাহায্য করতে থাকা বছর দশেকের ছোকরাটিকে বলল, মাজেদ, যা পানি নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি আসিস।
ছেলেটি দুটি বড় পাঁচ লিটারি বোতল নিয়ে তৎক্ষনাৎ চলে গেল। এই ছেলেটিকে কদাচিত দেখা যায় এখানে। কাস্টমারদের খাবার পরিবেশন করে, মেয়েটির ফুট-ফরমায়েশ খাটে। মেয়েটির চেহারার সঙ্গে আংশিক মিল থাকায় বুঝতে কষ্ট হয় না যে ওরা ভাই-বোন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– ও স্কুলে পড়ে না?
– পড়ে। কেলাস থিরিতে। স্কুল থেকে আইসা আমার লগে থাকে আরকি।
এমনসময় একটা ষোল সতের বছরের একটা ছেলে এসে ভ্যানের সামনে দাঁড়ায়। তার চোখ-মুখ উদ্ভ্রান্ত। চুল উশকোখুশকো। রুক্ষ মলিন গায়ের ত্বক। ভাবভঙ্গিতে বেপরোয়া ভাব স্পষ্ট। কোনো ভূমিকা ছাড়াই সে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,
– আপা, কিছু টেকা দে।
মেয়েটি সেদিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ না করে আপনমনে কাজ করতে করতে বলল,
– টেকা নাই,কী করবি টেকা দিয়া?
– লাগবে আমার। তুই দে।
মেয়েটি চোখ পাকিয়ে ক্ষেপে উঠল,
– আমি জানি না তুই টেকা দিয়ে কী করবি? ডেন্ডিখোর কোনাইকার। যা ভাগ এহান থিকা।
– তরে টেকা দিতে কইছি আপা। একজনে টেকা পায়। না দিতে পারলে খবর কইরা ফেলবে।
– করুক। ধার কি আমি করছি? ধার কইরা জুয়া খেলার সময় মনে থাকে না কোত্থিকা দিবি? কাজ নাই কাম নাই সারাদিন খালি ঢ্যাংঢ্যাং। দূর হ এখান থিকা।
ছেলেটি নিস্ফল আক্রোশে দাঁত খিঁচিয়ে গালিগালাজ করতে করতে রাস্তা থেকে একটা পাথর কুড়িয়ে ত্বরিত-বেগে ছুঁড়ে মারল মেয়েটির দিকে। পাথর এসে লাগল হাতের কব্জিতে। বেদনার্ত স্বর ছিটকে এলো তার গলা থেকে। ততক্ষণে ছেলেটি উর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে গেছে।উপস্থিত কয়েকজন লোক ছেলেটিকে হইহই করে ধাওয়া করতে গেলে মেয়েটি আঘাতপ্রাপ্ত হাত চেপে ধরে কাতরাতে কাতরাতে বলল,
– বাদ দেন,ও আমার ভাই হয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বিমূঢ় হয়ে গেলেও দ্রুত তা কাটিয়ে মেয়েটির নিকটে এসে দাঁড়িয়েছি। দেখলাম, চেপে-রাখা হাত থেকে ক্ষীণ ধারায় রক্ত ঝরছে। হাড় ফেটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। আমি বললাম,
– রক্ত পড়ছে। চলুন, একটা ফার্মেসীতে গিয়ে ওয়াশ করে নেওয়া যাক।
মেয়েটি চেপে রাখা হাতটা একবার তুলে দেখে বলল,
– লাগবে না। নুডলস পুড়ে যাইবো আবার।
বলেই একটি ন্যাকড়া বের করল। একটানে ছিঁড়ে হাতে পেঁচিয়ে নিতে নিতে ভাইকে শাপশাপান্ত করতে লাগল বিড়বিড় করে। চোখে টলটল করতে থাকা পানি মুছে নিল একফাঁকে। আমার ভীষণ মায়া লাগল। আশেপাশের লোকগুলো তখন নিষ্ক্রান্ত হয়েছে দেখে আমি অযাচিতভাবে বললাম,,
– ছেলেটা তো বেশ বখে গেছে। শাসন করেন না?
মেয়েটি কড়াইয়ে নুডলস উলটপালট করতে করতে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
– শাসন! আমি দুইটা দিলে আমারে চারটা দিয়ে হাওয়া হয় যায়। কোথায় কোথায় থাকে আল্লায় যানে। বাড়িঘরেও থাকে না। টেকার দরকার পড়লে এমনে আয়া হাঙ্গামা করে। আস্তা হারামযাদা। নইলে এতোবড় ভাই থাকতে আমার দোকানদারি করন লাগে?
আমি বুঝলাম,মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনার ক্ষোভে মেয়েটির ভেতরে থাকা কথাগুলো অনবরত অগ্নুৎপাতের মতো উৎক্ষিপ্ত হয়ে চলেছে। আমার কী যেন হলো আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করে বসলাম,
– আপনার বাবা-মা কিছু বলে না?
মেয়েটি একটু বিরক্ত হলো যেন। কড়াই থেকে নুডলসগুলো একটা বড় থালায় উপুড় করে ঢেলে চামচ দিয়ে তা সুবিন্যস্ত করল। তার ওপর নিপুণহস্তে ধনিয়াপাতা ছিটিয়ে দিল। এরপর একটা পলিথিন দিয়ে থালাটা ঢেকে সামনে সাজিয়ে রেখে শ্লেষের সুরে বলল,
– বাপ-মা নাই।
আমি স্তিমিত হাসলাম। এবার বুঝতে পারলাম ঘটনাটা। অনেকটা আমার মতো অবস্থা। পিতা-মাতা নেই। আত্মীয়স্বজন পরিত্যাগ করেছে। চাচারা জোতজমি দখল করেছে। এখন আমি উদ্বাস্তু হয়ে আছি এই শহরে। নিজের প্রচেষ্টায় কোনোমতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন নামেমাত্র চাকরি করছি। অবশ্য এতেই আমার হয়ে যায়। কোনো পিছুটান নেই বলে বাড়তি আয় নিয়ে আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমাকে যারা উপেক্ষা করেছে তাদের শোধ তোলার জন্য হলেও জীবনে কিছু একটা করে দেখানোর তাড়নায় এখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটির জীবন বৃত্তান্ত আরো সবিস্তারে জানার জন্য কৌতুহল বোধ করলেও আজকের মতো ক্ষান্ত দিলাম৷ প্রথমদিন জানার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। এমনিতেই মেয়েটি স্বল্পভাষী। আমার কৌতুহল যাতে উলঙ্গ হয়ে না পড়ে তা সম্পর্কে আমি সচেতন।
২.
পরবর্তী কয়েকটি মাস নিয়মিত না হলেও প্রায়শই যাওয়া হতো সেই জায়গায়। কখনো দুপুরে আর কখনো-বা বিকেলে। এরমধ্যে বেশিরভাগ দিন মরিয়মের সঙ্গে আমার বাক্যবিনিময়ও হয়নি। আমি কেবল দূর থেকে একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে ওর সংগ্রামী জীবনটাকে দেখে অভিভূত হতাম। আমার নিজের পরিবারের জন্য কিছু করার সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি বলেই বোধহয় ওকে দেখে তৃপ্তি পেতাম। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম। আকস্মিক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মায়ের যুগপৎ মৃত্যুর পর সম্পত্তির লোভ আমার স্বজনদের কাছে আমাকে ব্রাত্য করে তোলে। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। আমি কেবল সেই ইতিহাসের আঁচটুকু ভবিষ্যতের পাথেয় হিসেবে নিজের মধ্যে পুষে রেখেছি সযত্নে। এর বেশি কিছু নয়।
মেয়েটির নাম মরিয়ম। ধীরে ধীরে মরিয়ম সম্পর্কে অনেককিছু জানতে পারলাম।আমার মতো তার জীবনেও রয়েছে বিয়োগান্তক যাতনা আর ;উপেক্ষা! এই শহরের কোনো এক নিম্নবর্গীয় উদ্বাস্তু সমাজে তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। ফ্লাইওভারের ঠিক এই জায়গাটাতেই তার বাবা মতিউরের পান-সিগারেটের দোকান ছিল। ফ্লাস্কে ভরে রং চাও বিক্রি করতেন। দারিদ্র্যের সঙ্গে অহর্নিশ লড়াই করলেও আধুনিক দুনিয়ায় পড়াশোনার মর্মটা তিনি বুঝতেন। বুঝতেন বলেই কষ্টেসৃষ্টে পড়াতেন তিন ছেলেমেয়েকে। মরিয়ম যখন ক্লাস টেনে সে-বছরই আচমকা এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। অন্নসংস্থান বন্ধ হয়ে যায় পরিবারের৷ মরিয়ম মা’কে নিয়ে খোলাখুলি কিছু না বললেও তার চোখের ভাষা পড়ে বুঝা গেল মরিয়মের মায়ের চরিত্র বিশেষ সুবিধার ছিল না। আগে থেকেই তাঁর পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল৷ স্বামী মারা যেতেই তিনি তিন ছেলেমেয়েকে ত্যাগ করে প্রেমিককে বিয়ে করেন। মরিয়মের বাবা মতিউরও বোধকরি স্ত্রীর এই অন্ধকার দিকটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। মৃত্যুর আগে অত্যন্ত সংগোপনে তিনি অল্পকিছু জমানো অর্থ মরিয়মের হাতে তুলে দেন। সেই থেকেই শুরু। শুরুর পথটা অবশ্যই তার জন্য কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। কিন্তু শত প্রতিকূলতার মধ্যেও মরিয়ম আজ অর্থনৈতিকভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে বটে,কিন্তু সে জানে, এখানে স্থিতিশীলতা নেই। মরিয়মের স্বপ্ন, এই ভ্রাম্যমাণত্বের একদিন অবসান ঘটবে আর কোথাও তার একটা স্থায়ী রেস্তোরাঁ হবে। উপরন্তু, তার মা খুব একটা ভালো নেই নতুন স্বামীর কাছে। ভালো থাকার কথাও নয়। মরিয়ম বিলক্ষণ জানতো,প্রতারণার পরিণতি কখনো সুখকর হয় না। তিনিও প্রায়শই মরিয়মের কাছে এসে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন। নতুন স্বামী তাঁর খোঁজখবর নেয় না,মাতাল হলে মারধর করে প্রভৃতি অভিযোগ। মরিয়ম জন্মদাত্রীকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দিতে পারে না ঠিক, কিন্তু কোমলতাও দেখায় না৷ পাহাড়ের মতো নিশ্চল-নিস্পন্দ থেকে নীরবে জানান দেয়,তার রাজ্যে প্রতারকের স্থান নেই।
মরিয়মের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তার মেঝো ভাইটির অবাধ দৌরাত্ম্য। বাবার মৃত্যু, মায়ের অন্তর্ধান এবং সঙ্গদোষ তাকে বিপথগামী করে তুলেছে। শহরের কিশোরগ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে নানাবিধ অপরাধ সংঘটিত হয় তার দ্বারা। এছাড়া, নেশার টাকার জন্য বোনের সঙ্গে দিনরাত হাঁকপাঁক তো আছেই। মরিয়ম কষ্টার্জিত টাকা না দিলেও ঘরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তল্লাশি চালিয়ে সে টাকা চুরি করে নিয়ে যায়,ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে দেয়। এ নিয়ে দুই ভাইবোনেতে ব্যাপক হুজ্জত চলে। কদাচিত মরিয়ম শরীরের বিভিন্ন আঘাত নিয়ে ফিরে আসে। খুবই স্বাভাবিক; নিজ চোখে ছেলেটির যে রুদ্রমূর্তি আমি দেখেছি, কীভাবে যে মরিয়ম একে নিয়ে একছাদের নিচে বাস করে বুঝে আসে না। আমি দেখেই বুঝতে পারি, বিগত রাতে আরো একদফা সংঘর্ষ হয়ে গেছে। নিয়মিত সাক্ষাতের কারণে ততদিনে মরিয়ম আর আমাতে নিজেদের অগোচরেই অলিখিত একটা বোঝাপড়া হয়েছে। ও আমাকে ইসহাক ভাই বলে ডাকে। দেখলেই কুশল বিনিময় করে। আমি নাম ধরেই ডাকি। আমার উদ্বাস্তু হওয়ার ইতিহাসও সে মোটামুটি জানে,অন্তত যতটুকু আমি জানিয়েছি। একদিন আমি ইঞ্জিনিয়ার শুনে সে হাঁ হয়ে গিয়ে বলল, আপনে মজা লইতেছেন? এন্জিনিয়াররা কি এরকম বাইরের খাবার খায়? তারা তো বড় লোক।
আমি হেসে বলি, আমার মতো ছোট ইঞ্জিনিয়াররা খায়। যখন বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো তখন নাহয় তোমার বড় রেস্তোরাঁয় খাব!
ওর চোখেমুখে স্বপ্নিল হাসি ফুটে ওঠে। আমি এই সুযোগে বলি,
– কিন্তু মরিয়ম। তোমার ভাইটার তো একটা গতি করতে হয়। নয়তো দেখবে ও তোমার স্বপ্নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
– কী করমু, ভাই তো! ফালায় তো দিতে পারি না।
– ফেলে দিতে তো বলছি না। রিহ্যাবে দিয়ে দাও। কত ছেলেমেয়ে ভালো হয়ে আসতেছে না রিহ্যাব থেকে?
মরিময় কপাল কুঁচকে চুপ করে থাকে৷ কী ভাবে কে বলবে!
মাসকয়েক পরের কথা। মেসের একচিলতে ব্যালকনিতে উদোম গায়ে বসে একের পর এক সিগ্রেট ছাই করছি। বিদ্যুৎ নেই, ভ্যাপসা গরম পড়েছে। একটু আগের বাইরের আলো ঝলমলে শহরটা হঠাৎ করে নিঝুম অন্ধকারের নিপতিত হয়েছে। পাশের ঘরে রুমমেইটরা মিলে হৈহল্লা করে তাস খেলছে। সাউন্ডবক্সে পুরনো দিনের হিন্দি গান বাজছে। ওদের সঙ্গে কখনোই আমার বনিবনা হয়নি। একেকটা শিক্ষিত হলেও তাদের চিন্তাচেতনার মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন বন্যতা আমি দেখি তার সঙ্গে আমি ঠিক নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি না। এরজন্য ওরা আমাকে অহংকারী ভাবলেও করার কিছু নেই। রাত্রির নির্জনতাকে দীর্ণ কর তাদের হৈহল্লাকে ছাপিয়ে আমার মস্তিষ্কের জালজুড়ে ভাসছিল সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। প্রথমটি ঘটে অফিসে। আমাদের কনসাল্টেন্ট অফিসে আমাকে কদাচিত যেতে হয় সাইটের কাজ সম্পর্কে সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে আলাপ করতে। অফিসটা ছিমছাম। কর্মচারীর সংখ্যা অল্প। কাজের খাতিরে অফিসের একজন নারী অপারেটরের সঙ্গে আমার প্রায়শই আলাপ হতো। নাম মাইশা। একই কলেজের জুনিয়র হওয়াতে আমাদের আলাপের পথটা আরো মসৃণ হয়েছিল। যাইহোক,সম্প্রতি হুয়াটঅ্যাপের একটি দীর্ঘ বার্তায় আমাকে সরাসরি বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে বসে। সেই প্রস্তাবের বিপরীতে আমি বিভ্রান্ত এবং বিব্রত হয়ে চোরের মতো ঘাপটি মেরে বসে আছি। মেয়েটি সুন্দরী,নমনীয় এবং বোধকরি কিছুটা রক্ষণশীল। নিঃসন্দেহে, বর্তমান পাত্রীর বাজারে তাঁর দাম বেশ চড়া হবে। কিন্তু আমার মতো চালচুলোহীন একজন পুরুষ যে কি-না উদ্‌বর্তনের জন্য দিবানিশি ঘাঁড় গুঁজে কাজ করে চলেছে তার জন্য মাইশার মতো পাত্রী ফাঁ-সির কাষ্ঠের মতোই বিপজ্জনক। কিন্তু মাইশার প্রস্তাব যে আমার মতো জিরজিরে প্রাণীর জন্য লোভনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু! মনের গহীনে কোথাও যেন একটা অমীমাংসিত রহস্য রয়ে গেছে যার কারণে আমার বিলোল মন মাইশার প্রস্তাবে একবাক্যে রাজি হবার দুঃসাহস দেখাচ্ছে না।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি হলো,মরিয়ম। অবশ্যসম্ভাবী একটি বিপদ অবশেষে মরিয়মের ঘাড়ে চেপেছে। একদিন মাঝরাতে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে ভেসে এলো নারীকণ্ঠ। চিনতে পেরে আমি বললাম,
– মরিয়ম তুমি এতো রাতে? আমার নাম্বার কোথায় পেলে?
মরিয়ম সে জবাব না দিয়ে হড়বড়িয়ে যা বলল তার সারাংশ হলো, তার ভাই মাজেদ মাদক চোরাকারবারি কাণ্ডে ধরা পড়েছে, একটু আগে পুলিশ তাকে ধরে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আমার সঙ্গে তার দেখা করা দরকার। সভ্য সমাজে তাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই।
আমি মহাফাঁপড়ে পড়ে তার সঙ্গে থানায় গেলাম। মরিয়ম ইতোমধ্যেই থানার দারোগার বিরক্তির কারণ হয়েছে বোধহয়। আমি গিয়ে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করতেই দারোগা আপত্তিকর ইঙ্গিতে মরিয়মকে বলল,
– এতক্ষণ জ্বালায়া খায়েশ মিটেনাই,এখন আবার নাগর নিয়া আসছস!
এতক্ষণ মরিয়মের শরীরী ও মুখের ভাষায় ঋজুতা এবং আনুগত্য বিদ্যমান থাকলেও এইকথায় সে ভয়ংকরভাবে রেগে গিয়ে চোটপাট শুরু করল।
আমি কোনোমতে তার মুখ চেপে ধরে দারোগা সাহেবকে স্যরি বলে সেখান থেকে প্রস্থান করলাম।
থানার বাইরের টং দোকানে বসে ধোঁয়া-ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম,
– এমন চিল্লাফাল্লা করে ফায়দা হবে না মরিয়ম। তোমার ভাই জটিল মামলায় ফেঁসেছে মনে হচ্ছে। ও এখনো কিশোর, ওকে বিশেষ কষ্ট দিবে না যতটুকু জানি। তবে ভালোই হলো, বছর কয়েক ভেতরে থাকলে ওর রিহ্যাবটা হয়ে যাবে।
আমার থেকে দুইহাত দুরত্বে বসে ছিল মরিয়ম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে,
– আপনে পাষাণের মতোন কথা কইতেছেন।
– আমি পাষাণই।
– আপনি কিছু একটা করেন।
আমি একটা নিঃশাস ফেলে বললাম,
– আচ্ছা দেখি কী করতে পারি। আমার একটা ক্লাসমেট আছে। ওর চাচা শহরের নামকরা নেতা। চিন্তা করিও না।
মরিয়ম তবুও কাঁদছে। রাস্তার ধারের ফ্লুরোসেন্ট বাতির মায়াবি আলো ওর কপোল-প্লাবিত অশ্রু কালো মুখাবয়বের ওপর পড়ে চিকচিক করছে। আমি নিমেষহারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ভালোবাসার মানুষের জন্য কান্নাও বুঝি এমন অলৌকিক সুন্দর হয়! আমি শেষ কবে কারো জন্য কেঁদেছি এমন আকুল হয়ে? আমার অপলক দৃষ্টির সামনে মরিয়ম বিব্রত হয়ে পড়ল। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। বললাম,
– ভাবছি মরিয়ম, কারো জন্য কাঁদতে পারাও সৌভাগ্যের।
মরিয়ম আমার কথার গভীরতা হয়তো ধরতে পারল না কিন্তু কণ্ঠের আদ্রতা ঠিকই তাকে স্পর্শ করল। নরম স্বরে সে বলল,
– রাতে খাইছিলেন ইসহাক ভাই?
আমার মনে পড়ল, আমি না খেয়েই শুয়ে পড়েছিলাম। বুয়া আসেনি। বললাম সেটা। শুনে বলল,
– চলেন আমার ঘরে খাবেন। এইতো রাস্তার মোড় পার হইলেই আমার বাসা।
এরপর আমার কোনো আপত্তিই ধোপে টিকল না। এমন সপ্রতিভ মরিয়মকে আগে কখনো দেখা যায়নি। আমার প্রতিশ্রুতির জন্যই বোধহয়! বড় রাস্তা থেকে ছোট ছোট গলিঘুঁজি পেরিয়ে পৌঁছালাম ওর বাসায়। দুই কক্ষবিশিষ্ট ছিমছাম, গুছানো ঘর মরিয়মের। কেমন আঁশটে একটা গন্ধ আশেপাশে। তবুও মনে হলো,এখানে মায়া আছে,মমতা আছে। ডেস্কির পাতিলে হাত দিয়ে মরিয়ম বলল,
– ভাত বরফ হয়ে গেছে। একটু বসেন। ইশটোভে বসাইলে দেরি লাগবো না।
চলবে…