দুই পথের পথিক পর্ব-০৫ + বোনাস পর্ব

0
144

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৫
#বর্ষা
নাহিন হসপিটালের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’দিন যাবৎ হসপিটালে সে।পূর্বের নাহিন মুনতাসির গত সাতবছর যাবৎ একবারেই অন্যরকম জীবন-যাপন করছে।কারণ ছিলো সাতবছর আগের সেই বিকেল।তবে কারণকে হারানোর ভয় জেঁকে বসেছিলো তার অন্তরে।

সাতবছর আগে…

কানাডা থেকে বিজনেস পারপাসে দেশে এসেছিলো সে।কম বয়সে এতো চাপ সহ্য করতে না পারায় ড্রাগ নেওয়ার নেশাও ছিলো তার।সেদিন ড্রাগের সন্ধানে অনেকটাই গ্রাম্য অঞ্চলের দিকে যেতে হয়েছিলো।ফেরার পথে গাড়ির ইঞ্জিনে সমস্যা হওয়ায় আর গাড়ি স্টার্ট হয়নি।নেটওয়ার্ক সিগন্যাল এতোই বাজে ছিলো যা বলার বাইরে।তার ওপর জঙ্গল এরিয়া।চোর-ডাকাতের উৎপাতে ভরা‌।

নাহিন তখন মোবাইল হাতে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে‌।কোথাও থেকে ভেসে আসে আর্তনাদ।পুরুষনালী সেই আর্তনাদ ছিলো খুবই করুণ।পূর্বের দিক থেকে ভেসে আসছিলো সেই আর্তনাদ।নাহিন দৌড়ে যায় সেদিকে।দেখতে পায় রক্তাক্ত শরীরে মেয়েটা কুপিয়ে জখম করছে নিচে পড়ে থাকা দুই ছেলেকে।নাহিন আঁতকে ওঠে।দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে পেছন দিয়ে ধরে।ফেলে দেয় মেয়েটার হাতের সুক্ষ্ম সেই লাঠি।বাঁধন থেকে ছুটতে না পেরে মেয়েটা বিরতিহীন বলতে থাকে,

—নরম পেয়ে গরম দেখাতে চেয়েছিলি কুত্তা*** ।কুহেলিকা চৌধুরী নিজের অহমিকায় ফিরে গেলে কেউ বাঁচবি না,কেউ না।কুহেলিকা চৌধুরী কোনো নাম নয় বরং আতংক।আর সেই আতংকের সাথে বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিলি! শাস্তি তো ভোগ করতেই হবে।

নাহিনের সাথে সেই মুহূর্তে প্রথম দেখা কুহেলিকার সাথে।সারা দেহ থেকে রক্তের স্ফুরাঙ্গ এতোই ছিলো যে জ্ঞান হারায় কুহেলিকা।টেনে হিচড়ে আনার দাগ রয়েছে মাটিতে।নাহিনের রাগে শরীর কাঁপতে থাকে।ঠিক সেই মুহূর্তেই ভাগ্যক্রমে নাহিনের নিকট এসে পৌঁছায় ড্রাইভার।ভয়ে কাঁপতে থাকে সে।জানায় গাড়ি ঠিক হয়েছে।দ্রুত বেরিয়ে যেতে এখান থেকে।নাহিন গিয়েছিলো ঠিকই তবে কুহেলিকাকে সঙ্গে নিয়ে।জানতো এদেশে অসৎ কর্ম করতে চাওয়া ব্যক্তির থেকে যার সাথে অন্যায় হচ্ছিলো তার শাস্তি বেশি।তাইতো সেদিন ফেলে এসেছিলো ওই হারামীগুলোকে।

নিকটবর্তী হাসপাতালটা ছিলো শহরের মাঝেই।বলতে গেলে তারা যেই স্থানে আছে তা ঢাকা শহরের বুকে ছোট্ট গ্রাম। জঙ্গলের অন্য পাশে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছিলো তবে ঘটনা ঘটার স্থান থেকে বেশ অনেকটাই দূরে!

হসপিটালে গিয়ে নাহিন থমকে যায় বেডে পরে থাকা কুহেলিকাকে দেখে। গোলগাল মুখশ্রী মায়া জড়িত। প্রথমবারের মতো হৃদয় যেন থমকে দাঁড়ায় তার। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিও বেড়ে যায় কয়েকগুণ।এইতো সেই মেয়ে যাকে খুঁজতে ব্যাকুল ছিলো তার মন।

নাহিন জড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরে না প্রেয়সীকে।ভেবে অবাক হয় এইতো সে মেয়ে যে গতপরশু মাঝ রাস্তায় পথশিশুদের সাথে বৃষ্টিতে যুবুথুবু হয়ে ভিজছিলো।হাতের ব্যাগটা শক্ত করে আগলে রেখেছিলো সে। বাচ্চাদের সাথে সেও বাচ্চা বনে গিয়েছিলো!

নাহিন ভাবনাচ্যুত হয়।ফোন বেজে উঠেছে।আজ তার পি.এ নির্ধারণের জন্য ইন্টারভিউ নেওয়ার কথা।তবে সময় মতো পৌঁছাতে পারছে না সে।নাহিনকে কিছু বলার পূর্বেই নাহিন নিজের মতো করে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,

—আমি আসছি না।আর দ্বিতীয়বার কল দিয়ে যদি ডিস্ট্রাব করেছো তো খবর আছে।মিজানকে বলো আমাকে কল দিতে।

মিজান কল দিতেই নাহিন রিসিভ করে।শীতল কন্ঠে বলে ওঠে,

—তোমাদের ভবিষ্যৎ ম্যামের ছবি দিচ্ছি।কাজ শেষে ছবি ডিলিট করবে আর কোনো খবর যেন বাইরে বের না হয়।আমার ওর সম্পর্কে সব খবর চাই এক ঘন্টার মধ্যে।

করিডোরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো নাহিন।পেছন থেকে ডক্টর বলে ওঠে,

—এক্সকিউজ মি মিষ্টার মুনতাসির আপনার পেশেন্টকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে।আর কোনো সমস্যা হলে আমাদের সাথে যোগাযোগে বিলম্ব করবেন না।

ঘন্টাখানেক নাহিন হসপিটালেই বসে ছিলো।একবার কেবিনে যাচ্ছিলো তো একবার নার্সদের জিজ্ঞেস করছিলো কখন জ্ঞান ফিরবে মেয়েটার।নাহিনের মনে ছিলো কুহেলিকার নাম। তাইতো রোগীর নামের জায়গায় ঠিক নামটাই স্থানান্তর করেছিলো।

ফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করে নাহিন।মিজান কল দিয়েছে।ঘন্টা পেরোতে এখনো দুই মিনিট।নাহিন হাসে।মিজান ছেলেটা যে কতটা পান্চুয়াল তা তার কাজের ধরণেই বুঝেছে সে। তাইতো এত বড় দায়িত্ব তাকেই দিয়েছিলো।

—হ্যা মিজান বলো।

—স্যার ম্যামের নাম কুহেলিকা চৌধুরী।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে স্টাডি করছে। ফার্স্ট ইয়ার। চট্টগ্রামের মেয়ে। অভিভাবক কোহিনুর চৌধুরী।এছাড়াও আমাদেরই অফিসে চাকরির অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছে।

—পিতা-মাতার নাম?

—দুঃখিত স্যার। সার্টিফিকেটের কোথাও পিতা-মাতার নাম উল্লেখিত নেই। শুধু অভিভাবকের নামের জায়গায় কোহিনুর চৌধুরী লেখা।ম্যাম হয়তো অনাথ‌।

নাহিন ফিরে তাকায় ফুলের মতো নিশ্চেষ্ট মেয়েটার দিকে। কেবিনের বাইরে থেকেই কাচ লাগালো অংশ দিয়ে দেখছে সে তাকে।মেয়েটা কি তার মতোই অনাথ! নাহিনের ভেতরটা হুঁ হুঁ করে ওঠে।কল রাখার পূর্বেই বলে ওঠে,

—তোমাদের ম্যামকে আমার পি.এ হিসেবে নিযুক্ত করো।আর শোনো তাকে জানিও না এবিষয়ে।

নাহিন সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিলো হসপিটাল থেকে। হসপিটালের লোকদের মুখ বন্ধ করিয়েছিলো টাকা দিয়ে।হয়তো কুহেলিকা তাকে খুঁজে ছিলো! রিহ্যাবে গিয়েছিলো নিহান।নিজেকে প্রতিবর্তের ঝোঁক জেকে বসেছিলো তার মনে।তবে পরের সপ্তাহ থেকেই প্রতিদিন দেখা মিলেছিলো কুহেলিকার।নাহিন সহ্য করতে পারতো না কুহেলিকার অন্য কোনো পুরুষের সাথে মিষ্টি ব্যবহার।তাইতো কুহেলিকা যার সাথে মিষ্টি ব্যবহার করতো তাদেরই ট্রান্সফার হতে হতো আরেক বিল্ডিং এ।তারপর হঠাৎ একদিন….

—স্যার?

ম্যানেঞ্জার তাইহুং এর ডাকে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে নাহিন।ম্যানেঞ্জারের সাথে রেগে আছে সে। কেননা এই ছেলেটা নাকি কুহেলিকাকে বলে দিয়েছে যে সে আবারো ড্রাগস নিয়েছিলো।সেই রাগে দুঃখে কুহেলিকা ফোন ধরছে না।নাহিন হাতের পাশেই রাখা মোবাইল ফোন ছুঁড়ে মারে।তাইহুং ধরে ফেলে।বলে ওঠে,

—স্যার ম্যাম কল করেছে।আপনি কল ধরছেন না তাই…

নাহিন ছুটে এসে তাইহুং-র থেকে ফোন নিয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে বলে ফোন দেয় প্রেয়সীর নিকটে।ক্ষমা প্রার্থনা করে কিছু বলে ওঠার পূর্বেই ওপাশ থেকে কুহেলিকা বলে ওঠে,

—আমাকে অপরাধী বানাতে চান?আমার কারণে যখন ছেড়েছিলেন তাহলে আবার কেন ড্রাগস নিলেন?আমাকে একা করে হারিয়ে যেতে চান স্বার্থপরের মতো!

কুহেলিকার অগোছালো কথা আর কথা বলার ধরণে নাহিন বুঝে যায় তার প্রেয়সী এখনো কাঁদছে।আলতো হাসে সে।এই মেয়েটার জন্য যে সে পাগল। মানুষের ভয়ই মানুষকে শেষ করে দেয়।তাইতো নাহিন না চেয়েও নিজের প্রেয়সীকে কাঁদিয়েছে।জীবনে একমাত্র বেঁচে থাকার অম্বল বলতে তো কুহেলিকাই তার সব।আর কেউ কি তার বেঁচে থাকার অম্বলকে নিজ ইচ্ছায় আঘাত দেয়!

কুহেলিকাকে ওয়াদা করে নাহিন।আর কখনোই সে ড্রাগস নেবে না।যত যাই হোক না কেন!কুহেলিকা নাহিনকে তবুও তার ভালোবাসার কথা বলে দেয় না অর্থাৎ ইজহার করে না নিজ প্রণয়ের।প্রকৃত প্রণয় কি বারেবারে ইজহার করতে হয়! অনেক ক্ষেত্রে প্রণয়ের দেখা মেলে অভিমানে,অভিযোগে, খুনসুটিতে,কেয়ারনেসে,সম্মানে।

কথা শেষে এশার নামাজ পড়ে নেয় কুহেলিকা।রাতের খাবার খেতে বের হবার সময়ই তার রুমে কায়ফা প্রবেশ করে।কায়ফাকে দেখে কুহেলিকা আঁতকে ওঠে।সেই আগের সুন্দর মুখশ্রী আর নেই। ভেঙে গেছে।কুহু সেদিন পেছন থেকে দেখেই বোনকে চিনে ফেলেছিলো তবে মুখশ্রী আজই দেখলো!কেমন যেন দেখতে লাগে!কায়ফা ঢুকড়ে কেঁদে ওঠে।বলে,

—কুহু আমাকে মাফ করে দে বোন।জীবনে এই ক্ষুদ্র সময়ে তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি।তবে বলে না, আল্লাহ ছাড় দেয় ছেড়ে দেয় না।ঠিক তেমনি তোর সাথে করা প্রত্যেকটা অন্যায়ের শাস্তি পেতে চলেছে আমার ছেলেটা।

—মানে?কি বলতে চাচ্ছো কায়ফা আপু?আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

—কুহু আমার ব্রেন ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ!

কুহেলিকা যেন আঁতকে ওঠে।কায়ফা কি সত্য বলছে!সত্যি বলতেই পারে তার চোখে মুখের অবস্থার পরিবর্তন,কন্ঠস্বরের পরিবর্তন সবই যেন সেগুলোর লক্ষণ।কায়ফা বিছানায় বসে বলে ওঠে,

—তোর দুলাভাই দূরের কথা বাড়ির কেউ জানে না এ সম্পর্কে।কিভাবে বলবো বল আমিই যে জেনেছি মাত্র কয়েকমাস পূর্বে!কিভাবে যে প্রাণঘাতী এই রোগ হলো বুঝতেই পারলাম না।তোর দুলাভাই যে আমায় বড্ড ভালোবাসে।সে যদি জানতে পারে কিভাবে বাঁচবে!

কুহেলিকা আগলে নেয় কায়ফাকে। একজন প্রকৃত মানুষ সামনের ব্যক্তিকে যতই ঘৃণা করুক না কেন তবে সামনের ব্যক্তির মৃত্যু লড়াইয়ের সংবাদ শুনে শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারে না।কুহেলিকাও তেমনি সইতে পারে না কায়ফার ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে হওয়ার কথাটা।যদি কায়ফা বোনের সম্পর্ক নিভাতো তো কুহেলিকার যে কাছের মানুষ কি আর কেউ হতো!

—কুহু আমি মরার পর তুই কি আমার সিনানের খেয়াল রাখবি।সাফিনকে বোঝাবি।সাফিন যে আমায় বড্ড ভালোবাসে!

কুহেলিকা সাফিন নামটা শুনে মুচকি হাসে।গত তিনদিন আগেই মাঝরাত্রে সে জানতে পেরেছে সাফিনই তার দুলাভাই। অবশ্য এ সংবাদ আর কেউ নয় বরং আয়শা দিয়েছে কুহেলিকাকে।দাওয়াত পেয়েছিলো সেও। সম্পর্কে ফ্যামিলি ফ্রেন্ডস তাইতো জানতে পারলো কুহু কে তার দুলাভাই!

মানুষের মনে যদি সামান্যতম মনুষ্যও থাকে তাহলেও সে কষ্ট পাবে কায়ফার পরিণতির জন্য।ক্যান্সারে যে একমাত্র সেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এমন না।তবে খুব অল্প বয়সে মা’কে হারানোর পর্যায়ে আছে সিনান।আর মা-বাবা হীন জীবন যে কত কষ্টের তা অন্ততপক্ষে কুহেলিকার অজানা নয়।

চলবে কি?

#দুই_পথের_পথিক
#বোনাস_পর্ব
#বর্ষা
ভোর হতেই কুহেলিকা বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে।শুনেছে আজ সাফিন স্যার আসবে অর্থাৎ ওর দুলাভাই আসবে।কুহেলিকার মনে কোথাও না কোথাও সাফিন আছে।তবে সাফিনের জন্য ভালোবাসা নয় বরং অগাধ শুকরিয়া আছে‌। কেননা সেদিন যদি সাফিন তাকে ফিরিয়ে না দিতো তবে সে তো আর নাহিনের মতো মানুষকে পেতো না।যে পুরুষ একজন নারীকে নিজের করার পূর্বে নিজে ভালো মানুষে পরিণত হয়,এরুপ পুরুষই কি মেয়েদের চাওয়া নয়!

কুহেলিকার এখনো মনে পড়ে সেদিনটা‌।প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হতেই নাহিন তার সামনে প্রস্তাব রেখেছিলো কানাডায় তার পি.এ হিসেবে যোগদানের এবং পাশাপাশি স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের সাথে উচ্চতর ডিগ্রি।কুহেলিকা প্রথমে অবাক হয়েছিলো।পরে নাহিন বুঝিয়েছিল মানুষের যোগ্যতা সার্টিফিকেটে নয় বরং দক্ষতা,পরিশ্রম এবং ইচ্ছা ও কর্মশক্তিতে।যার পুরোটাই আছে কুহেলিকার।

কুহেলিকার বিদেশ ভ্রমণের প্রথম সঙ্গী হলো নাহিন।নাহিনেরও প্রথম যাত্রা কোনো মেয়ের সাথে ছিলো। তাছাড়া কোনো মেয়ে শব্দ দুটো তো আসবে না কেননা নাহিনের প্রথম মেয়ে যাত্রীসঙ্গিনী ছিল তারই ভালোবাসার মানুষ।

—ম্যাম ফাইলটায় সাইন লাগবে।

কুহেলিকা ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করছে রাশিয়ান বায়ারদের সাথে। গার্মেন্টস সেক্টরের ব্যবসা ওদের। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন দেশে লাভজনক ব্যবসা রয়েছে নাহিনের।আর সেই কোম্পানিরই পঁচিশ পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ডার হওয়ার পাশাপাশি কোম্পানির এমডিও সে। ”গ্রিনলাইফ” কোম্পানির সিইও নাহিন,এমডি কুহেলিকা,মেইন এডভাইজার শেখ দাউদ ……!

—রেখে যান।

—ম্যাম ইম্পর্ট্যান্ট..

ইমপ্লয় নোভাকে এই কয়দিন যাবৎ তার সন্দেহ হচ্ছে।পাওয়া ডিলও হাতছাড়া হওয়ার পাশাপাশি প্রেজেন্টেশন চুরির যে বিষয়টা তাও ভাবাচ্ছে কুহেলিকাকে।

—প্লিজ জাস্ট গিভ ফাইভ মিনিটস…

কুহেলিকা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ছেড়ে যে ফাইল চেক করে দ্যান সাইন করবে ভাবতে পারেনি নোভা।ভয়ে ঘামতে থাকে।ধরা পড়লে জীবন শেষ।বলে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়!ঠিক তেমনি কুহেলিকাও পেয়ে যায় ফাইলের মাঝে লুকায়িত ব্ল্যাংক পেপার।নোভাকে চোখ রাঙানি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে গম্ভীরভাবে মিটিং শেষ করে ছাব্বিশ বছর বয়সী এই রমনী।

—এইটা কি?

—ম্য ম্যাম ব্ল্যাংক পেপার…

—ফাইলের মাঝে কি করছিলো..

—(নিশ্চুপ)

—এন্সার মি ড্যামিড।

—(নিশ্চুপ)

—প্রশ্নের জবাব দেও নয়তো পুলিশকে কল দিতে বাধ্য হবো।

নোভা পা জড়িয়ে ধরে মেঝেতে বসে পড়ে।কুহেলিকা পা ছাড়ানোর চেষ্টা চালায়।আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে নোভা।আজ অব্দি অনেকজন হায়ার ইউপ্লয় এসেছে।তবে কেউই এতোটা গুরুত্ব দিয়ে ফাইল দেখেনি,কে জানতো এখনকার হায়ার ইউপ্লয় গুরুত্ব দিয়ে ফাইল চেক করবে!

—ম্যাম ম্যাম আমাকে মাফ করে দেন।এমন ভুল আর কখনো হবে না।ম্যাম প্লিজ ম্যাম ক্ষমা করে দেন।

কুহেলিকা কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নোভার দিকে।গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,

—শর্ত রয়েছে…যার হয়ে কাজ করছিলে তার ফুল ইনফরমেশন চাই এবং প্রমাণ চাই যে সে চোর জাতির…

—ম্যাম আমাকে মাফ করে দেন আমি পারবো না..

—শর্তে রাজি হয়ে যাও নয়তো পুলিশের হেফাজতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।আর ভেবো না আমি হাওয়ায় গুলি ছুড়ে তোমায় জেলে পাঠাবো। একদম প্রমাণ সমেত যাতে কমপক্ষে ছয়মাস তোমার জেল হয়।বুঝতেই পারছো তারপর তোমার লাইফ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!

কুহেলিকার বাঁকা হেসে বলা কথায় নোভা আঁতকে ওঠে।কুহেলিকাকে যেন আতংকের সমার্থক মনে হচ্ছে তার।নোভা বলে ওঠে,

—ম্যাম আমি আমি রাজি…

***

কুহেলিকা মির্জা ইনড্রাসটিজের সামনে দাঁড়িয়ে। জুনায়েদ মির্জার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।কাসেম মির্জা আর কায়েস মির্জা খুব কমই আসে। জুনায়েদ পি.এ মায়মুনার কোমড় জড়িয়ে অসৎ সম্পর্ক স্থাপন করছে নিজ কেবিনের মাঝেই।সময় আর পারমিশন বিহীন ঢুকে যায় কুহেলিকা।হাতে তালি দিতে দিতে বলে ওঠে,

—বাহ বাহ কি চমৎকার!মির্জা বংশের ছেলে নাকি ঘরে বউ বাচ্চা রেখে বাইরে পরকিয়া করছে।তাও আবার কার সাথে,নিজের পি.এ এর সাথে!বাহ

—কুহেলিকা তোর সাহস কি করে হলো আমার কেবিনে আসার?আর তোকে পারমিশন কে দিয়েছে আমার পার্সোনাল জীবন নিয়ে কথা বলার!

—নূন্যতম লজ্জাবোধ নেই তাই না!তোমার ছোট বোন তোমাকে পরকিয়া প্রেম করা অবস্থায় হাতেনাতে ধরেছে তাও তুমি গলা উঁচিয়ে কথা বলছো ছিঃ

—আমার বা** ছোট বোন আসছে।কোন ছেলের হাত ধরে পালিয়েছিলি সতিত্ব আছে নাকি হারিয়ে ফিরিছিস কে জানে!তাও যে তোকে চৌধুরী ভিলায় থাকতে দেওয়া হয়েছে এই বেশি।সো আমাদের জীবন নিয়ে কথা বলতে আসবি না।

কুহেলিকার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।তারা তাকে থাকতে দিয়েছে মানে কি!সে নিজের বাসায় থাকে। চৌধুরী ভিলা থেকে শুরু করে চৌধুরী ইন্ড্রাসট্রিজ সবকিছুই তো তার। চৌধুরী বংশের একমাত্র উত্তরসূরী হিসেবে কোহিনুর চৌধুরী তাকেই তো রেখে গিয়েছেন।কুহেলিকা রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠে,

—স্যাট আপ মিষ্টার জুনায়েদ মির্জা। থাকছেন আমারটায় আর কোথাও শোনাচ্ছেন আমায়!

—তোরটায় থাকছি মানে?দাদাজানের বাড়িতে থাকছি। তুই মেয়ে তোর কি কোনো অধিকার আছে নাকি সেখানে!আমাদেরই তো সব।

—মগের মুল্লুক পেয়েছেন?দাদাজানের উইল হয়তো পাননি তাই জানেন না।তবে আজ জানবেন। আপনার সো কল্ড ফ্যামিলিও জানবে কত অনেস্ট এবং বিলিভেবল পারসন আপনি!

—কুহেলিকা..

—আমার সাথে চিৎকার করার মতো ভুল ভুলেও করবেন না মিষ্টার জুনায়েদ মির্জা।

কুহেলিকা বেরিয়ে আসে।ফোন দেয় কোহিনুর চৌধুরীর লয়ারকে।কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠে বেরিয়ে যায় চৌধুরী ভিলার উদ্দেশ্যে।আজ আর অফিসে যাবে না। এমনিতেই মন মেজাজের ঠিক নেই কখন কাকে ছেড়ে ঝেড়ে ফেলবে কে জানে!

চৌধুরী ভিলায় প্রবেশের সময় নাহিন কল দেয়। পরিবারের কারো সাথে তার এতোই সুদৃঢ় সম্পর্ক নেই যে ভয়ে প্রেমিক পুরুষের কল কেটে দিবে সে।তাইতো রিসিভ করে। ভিডিও কল।

—বলো তো আমি কোথায়?

—কোথায়?

—বাংলাদেশে।

—সিরিয়াসলি?

—হুম একদম সিরিয়াসলি।

—চট্টগ্রামে আছি।সোজা ফ্লাইটে চলে আসেন।

—চট্টগ্রামে তো আমার কোনো বাড়ি নেই।থাকবো কোথায়?

—আগে আসেন তো।এতো চিন্তা আপনাকে করতে হবে না।

—আচ্ছা,আর একটা সিক্রেট কি জানো আমি চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে চট্টগ্রামে থাকবো।

—হোয়াট!আমি এখনই তবে বের হচ্ছি। অপেক্ষায় থাকবো আপনার।

মিনিট ত্রিশের মতো লাগে কুহেলিকার এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে। এয়ার পোর্টে পৌঁছে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে থাকে। জরুরী ফোন আসায় রিসিভ করে।তবে ওপাশ থেকে কোনো জবাব তো আসেই না তার ওপর আবার কেউ পেছন থেকে চোখ আটকে ধরে।কুহেলিকা মুচকি হেঁসে হাত ছাড়িয়ে বলে ওঠে,

—আপনার পারফিউমের সুগন্ধেই চিনে ফেলতে পারি আপনাকে সেই দূর থেকেই!

*****

চৌধুরী ভিলায় ভোজের আয়োজন করা হয়েছে।জামাই এসেছে আবারো।মেয়ের স্বাস্থ্যের এই দূরবস্থার পরও যে মেয়েকে আগলে রেখেছে এই ছেলে!একে কি আর অনাদর করা যায় নাকি!রুমানা আফরোজ আদূরে কন্ঠে বলেন,

—জামাই বাবা তোমাকে আরেকটু দেই?কিছুই তো খেলে না। আরেকটু পোলাও কোরমা দেই

—আম্মু আর খেতে পারবো না।এখন একটু বিশ্রামের দরকার।আর এখন থেকে তো চট্টগ্রামেই আছি।চিন্তা নেই আর।

ড্রয়িংরুম থেকে খুব ভালোই দেখা যায় অন্দরমহলে প্রবেশের দরজাটা। দুপুর দুইটা।কুহেলিকা ফিরেছে।সাথে আছে আরেকজন সুদর্শন পুরুষ।সবার আগে তার ওপর যেন সাফিনেরই দৃষ্টি পড়ে। দাঁড়িয়েও চলে যাওয়া থেকে থেমে যায়।সবাই সাফিনের দৃষ্টির সরাসরি তাকায়।

কুহেলিকার মুখে মিষ্টি হাসি।সে আজ বিরতিহীন বক্তা যেন।আর পাশের ছেলেটা ধৈর্য্যশীল শ্রোতা।কই কুহেলিকা তো তাদের সাথে কখনোই তো কথা বলেনি।নাকি তারাই তাকে সেই সুযোগ দেয়নি! জুনায়েদ নিভৃতে কুহেলিকাকে কথা শোনাতে পিঞ্চ মেরে বলে ওঠে,

—কি দিনকাল এলো মেয়ে মানুষ বাসায় আনছে পুরুষ মানুষ ছিঃ

—বিয়ে করে পরকিয়া তো আর করছি না।

জুনায়েদ বুঝে যায়।এই মেয়ে যত ভালো,ঠিক ততটাই খারাপ।যখন তখন বেফাঁস কথা বলে ফাঁসিয়ে দিতে পারে।তাই চুপ থাকাই শ্রেয়।কায়েস মির্জা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বলে ওঠে,

—কুহু ইনি কে?

—আমার ভবিষ্যৎ স্বামী। কিছুদিন তিনি এখানেই থাকবে। গেস্ট রুম খুলে দিবেন ওনার জন্য।

নাহিনসহ উপস্থিত সবাই চমকায়।নাহিন নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না তার প্রেয়সী তাকে তার ভবিষ্যৎ স্বামী হিসেবে পরিবারের নিকট পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।তবে নাহিনের কেন জানি খটকা লাগে। কেননা এতবড় এবং বিত্তশালী পরিবার থাকতেও কেন সাতবছর আগে কুহেলিকা চাকরির সন্ধানে এদিকসেদিক ঘুরছিলো!কেন তাকে তার খরচ জোগাতে পরিশ্রম করতে হচ্ছিলো! কেন তার পিতা-মাতার নামের জায়গাটা শূন্য ছিলো!সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এই বিশাল বাড়িতেই।

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে