দুই পথের পথিক পর্ব-০৬

0
123

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৬
#বর্ষা
”দূর আকাশের নীলচে তাঁরা
নীলচে আমার বিকেলবেলা!
একলা আমার সকাল-সন্ধ্যা
কেটেছে রঙহীনতায়!”

কুহেলিকা নাহিনের দিকে তাকিয়ে ছড়া আকারে বলার চেষ্টা করে।নাহিন বসে আছে কুহুর ঘরে।নাহিন প্রশ্ন করেছে কুহেলিকাকে কেন তার পদবী চৌধুরী আর তার পরিবারের পদবী মির্জা!কেন তার পিতা-মাতা জীবিত থাকলেও তার সার্টিফিকেটে পিতা-মাতার নাম নেই!

”আমি মির্জা বংশের কেউ না,কেউ না।আমি চৌধুরী বংশের পরবর্তী প্রজন্ম।আমি কোহিনুর চৌধুরীর রক্তের রক্ত ”

”মানে?”

”সঠিক সময় আসুক সব বলবো আপনাকে”

নাহিন আর প্রশ্ন করেনা।কুহেলিকা যখন বলেছে সময় আসুক তারপর বলবে তখন সে সঠিক সময় আসলেই বলবে।এই কথার নড়চড় যে হবে না তা খুব ভালো করেই জানে সে।

”চলুন যাওয়া যাক”

”কোথায়?”

”বাহ রে লাঞ্চ করবেন না?চলুন”

”আমি যে বেশি ওয়েলি খাবার খেতে পারিনা তা তো জানোই ”

”জানি,এখন চলুন”

খাবার টেবিলে খাবার দেখে চমকে ওঠে নাহিন।হেল্পিং হ্যান্ড নাঈমা বিবি খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন।পিনাট,স্যামন মাছের কাবাব,মাটনের সহিত ব্রকলি সুপ।সবই নাহিনের পছন্দের।তবে দেশে সব জায়গায় খুব একটা স্যামন মাছের দেখা যে পাওয়া যায় না তাও জানে নাহিন।আবার ভাবে কে রান্না করলো এগুলো!নাহিন তাকায় কুহুর দিকে।কুহু মুচকি হাসে।নাহিন বুঝে ফেলে কে রেঁধেছে খাবারগুলো।

”কখন রাঁধলে এগুলো?”

”বাসায় এসে”

”একটু আগেই না আসলাম!স্যামন মাছ তো সাধারণ বাজারে পাওয়া যায় না। বাসাতেই ছিলো কি?”

”যাওয়ার সময় ড্রাইভার কাকাকে বলেছিলাম আনিয়ে নিতে। তিনিই এনেছেন”

”এতো অল্প সময়ে রাঁধলে কি করে?”

”আমার খিদে পেয়েছে কিন্তু। খাওয়ার পথ কথা বলবো।এখন আপনিও খান আর আমাকেও খেতে দিন”

নাহিন মাথা ঝাঁকিয়ে হাসতে হাসতে খেয়ে নেয়।তবে খাবার তালুতে ওঠে যখন তারই সামনে বসে অপরিচিত বাচ্চা ছেলেটা বলে ওঠে,

—তুমি কি আমার আন্টের আংকেল?

সিনানের কথায় কুহেলিকা উচ্চশব্দেই হেঁসে দেয়।নাহিন যেন বিপাকে পড়ে।বাচ্চাটা কি বলছে সে আদৌ জানে তো!সিনানকে ডেকে নিজের দিকে আনে সে।কুহেলিকা হাসতে হাসতেই খেতে থাকে।নাহিন বাচ্চাটাকে কোলে বসিয়ে বলে,

—বাবু আমি তোমাল আংকেল হই তোমার আন্টের না।আমি তোমার আন্টের জামাই হই।

‘জামাই হই’কথাটায় যেন খাবার তালুতে ওঠে কুহেলিকার ।কুহেলিকা তো বলেছিলো হবু স্বামী আর এ ছেলে তো আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে।বিয়ের আগেই বলছে স্বামী।পরে দেখা যাবে বিয়ে হওয়ার পর বলবে ‘বাবুর মা’ শোনো। কথাগুলো চিন্তা করেই কুহুর কান দিয়ে ধোঁয়া বেরতে থাকে।

—সিনান চলো আমরা ওদিকটায় খেলি।

ছোট্ট রামাইসা বলে ওঠে।সিনান রামাইসা পুরো নাম উচ্চারণ করতে পারে না বলে ছোট করে রাইসা বলে। সেক্ষেত্রে রাইসা কিন্তু ওর বড় মামীর নামও হয়!জাহিদের তিনবছর বয়সী মেয়ে রামাইসা মির্জা হুর।

সিনান চলে যেতেই কুহেলিকা চোখ রাঙানি দেয় নাহিনকে।নাহিন ভয় পাওয়ার মিথ্যে অভিনয় করে।কুহেলিকা নাহিনকে গেস্টরুমে রেখে নিজের রুমে চলে আসে। দুপুর তিনটা পঞ্চাশ।আছরের আজান দিতে আরো একঘন্টা।কুহেলিকা ঘুমিয়ে পড়ে।

বিকেল বেলা চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে কুহেলিকার।চোখমুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে এমনই হয়।কুহেলিকা ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে।সাফিন ঝামেলা করছে।বলছে,

—আব্বু দেখেন বাড়িতে মেয়ে,বউ,বাচ্চা আছে।এমন অপরিচিত কাউকে বাড়িতে থাকতে দেওয়া খুবই ভীতিকর।ওনাকে আজই চলে যেতে বলুন।

—দুলাভাই আপনাদের নিকট নাহিন অপরিচিত হলেও আমার নিকট অপরিচিত নয়। তাই চিন্তা করবেন না।

—তোর মতো মেয়ে বাড়িতে থাকলেই চিন্তা আর সেখানে অপরিচিত পুরুষের চিন্তা যেন যোগ হলো।

জাহিদের কথায় কুহেলিকা চুপ থাকে না।আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে ঠাঁটিয়ে চড় লাগিয়ে দেয় নিজের থেকে পাঁচ বছরের বড় ভাইকে। জাহিদ তেতে উঠে পাল্টা চড় লাগাতে নিলেই হাত খামচে ধরে কুহেলিকা। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,

—ভাই ভাইয়ের মতো থাকলে মাথার তাজ করে রাখতাম।রাস্তার নেড়ি কুকুরের মতো আচরণ করছেন বিধায় কুকুরের মতো লাত্থিই পাবেন!

—কুহেলিকা তোমার ব্যবহারের অবনতি হচ্ছে!বংশের নাক উঁচু করছো দেখছি!

রাগান্বিত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলে ওঠে কায়েস মির্জা।কুহু বাক্য শুনেও আনশুনা করে দেয়।নাহিনের হাত ধরে বলে ওঠে,

—আমার আঁকড়ে ধরা হাত ভুল মানুষের না। আমাকে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া মানুষটাও নিশ্চিত আল্লাহর লেখা তকদির।তবে সকলের অপমান তকদির মেনে তোমাদের আমি ছেড়ে দিচ্ছি না।সো মাইন্ড ইট দ্যাট হি উইল বিকাম ইউর সান-ইন-লো।

*****

রাত্রি নয়টা কিংবা দশটা। অপরিচিত একজন মধ্যবয়স লোক দাঁড়িয়ে আছে গভীর অরণ্যে।সামনেই দেখা মেলছে ভিন্ন জাতির,ভিন্ন দেশের মানুষদের।কিছু একটা পাচারের চেষ্টাই চলছে সরকারের আড়ালে।ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে ভিডিও করে নেন তিনি।

ভোরের খবরের কাগজে ছেয়ে গিয়েছে ভারত উপমহাদেশের প্রদেশে চলছে ড্রাগ ডিলিং এর অবৈধ আদান-প্রদান। পরিচিত মুখ সাংবাদিক তানজিল আহমেদের তত্বাবধানেই ফাঁস হয়েছে ড্রাগ ডিলিং চক্রের তথ্য। তবে এই মাঝবয়সী লোক এখন ভারত ত্যাগী হয়ে গিয়েছেন কিঞ্চিত মুহূর্ত পূর্বেই।দেশের ধন দেশে ফিরছে।

—হ্যালো,আমি দেশে আসছি।তুমি সব গুছিয়ে রেখেছো তো?

—চিন্তা করো না সব আমাদের হাতের মুঠোয় আছে। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।

—হুম, তবে তার পূর্বে আরেকজনকেও যে খুঁজে বের করতে হবে।

তানজিল আহমেদ কারো সাথে কথোপকথন জারি রাখেন তবে এয়ারপোর্টে সন্দেহজনক কয়েকজনকে দেখে কলটা কেটে দেন।কোমড়ের পেছনের দিক দিয়ে কিছুটা উঁচু।তানজিল আহমেদ জহুরি নজরে বুঝে ফেলেন ওইটা কি।শব্দহীন ভাবে উঠে গিয়ে ওয়াশরুমে দাঁড়ান।যা ভেবেছিলো তাই লোকটাও এসেছে।তানজিল আহমেদের মাথায় গান ঠেকিয়ে বলে ওঠে,

—পেনড্রাইভ দে..

—কি বলছেন আপনি কিসের পেনড্রাইভ?

—সাধু সাজো না? তাড়াতাড়ি পেনড্রাইভ বের কর নয়তো এখনই গুলি করে খাল্লাস করে দিমু।

তানজিল আহমেদ ওয়াশরুমের মিরর গ্লাসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে হঠাৎ করে সিংহের মতো হামলে পড়ে প্রতিপক্ষের ঘাড়ের মাঝে শক্ত হাতে আঘাত করে।লুটিয়ে পড়ে লোকটা।তার এই হামলা দেখে কেউই বলতে পারবে না যে তিনি পঞ্চাশ বছরের মাঝবয়সী।

তানজিল আহমেদ কাউকে ফোন করে কথা বলতে বলতে ওয়াসরুম ত্যাগ করেন।ইশারায় কাউকে কিছু বুঝিয়ে ফোন রেখে প্লেনের দিকে চলে যান হ্যান্ডব্যাগ হাতে।তবে যাওয়ার পূর্বে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে বাঁকা হেসে কিছু তো একটা ভাবেন!

****

সাফিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার বিছানার দিকে তাকাচ্ছে।ঘুমন্ত কায়ফার মাঝে আগের সেই কায়ফার কোনো মিলই পাচ্ছে না।আগে মেয়েটা অনেক খ্যাচখ্যাচ করতো এখন তার সিংহভাগই করে না।আবার দৈহিক সৌন্দর্য্যের পুরোটাই যেন হারিয়েছে।আর মন…?সেটা তো আগে থেকেই জানতো না সে।হ্যা সেই আটবছর আগে থেকেই কায়ফা তার পছন্দের রমনী।তবে ভালোবাসা কি হয়ে উঠতে পেরেছিলো? বিয়ের এই ছয়বছরের সংসারেও কি তাদের মাঝে ভালোবাসা হয়নি!

সাফিন চেয়ারে বসে খুঁজে বের করে মায়াবতী নিকনেমের আইডিটা।আজও স্মৃতি হিসেবে ম্যাসেজগুলো রেখে দেওয়া। মানুষ ভালো না বাসলেও আসক্ত হয়। একজন মানুষের সাথে প্রতিনিয়ত কথা বললে ভালো না বাসলেও তাকে কষ্ট দিতে চাওয়া যায় না।তার কষ্টে কেন জানি নিজেরও কষ্ট লাগে।আবার বহুদিনের চ্যাটিং এ গড়ে ওঠে মায়া।আর মায়ার সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি পোড়ায়।যেমন এখন পুড়ছে সে!” দূরে ছিলো ভালো ছিলো কেন আসলো এখানে ” এমনই মনোভাব এখন হয়েছে তার।সত্যিই তো এতবছর পর কেন আসলো কুহেলিকা!

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে