Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 202



নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: ত্রিশ (অন্তিম পর্ব)

অন্ধকারের একটি কুঠুরিতে নয়নাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার গায়ের কাপড় অনেক অংশ ছেঁড়া। হাতাহাতির সময় হাতে পায়ে খামচি লেগেছে। অন্ধকার ঘরে এক ফালি আলো উপর থেকে তীর্যকভাবে নয়নার উপর পড়ছে। নয়ানর গলা শুঁকিয়ে চৌচির। তৃষ্ণায় হা করে নিশ্বাস ফেলছে। সে জানে না তার এই অবস্থা কে করেছে। অন্ধকারে শুধু কেউ তাকে বাজেভাবে স্পর্শ করতে চায়। বাশারের মতো তার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে ছুঁয়ে দিতে চায়। নয়না খুব করে তার থেকে বাঁচতে চায়ছে কিন্তু পারছে না। কীভাবেই বা পারবে? তাকে তো এই অন্ধকার কুঠুরিতে আঁটকে রাখা হয়েছে। আবারও কুঠুরির দরজা খুলে গেলো, নয়নাও সাথে ঘাবড়ে গেলো। জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো। যথাসম্ভব গা ঢাকার চেষ্টা করলো। মানুষটা নয়নার একদম কাছাকাছি এসে বসলো। নয়না ঢোক গিলে প্রশ্ন করলো, ” কে আপনি?”
অপরপাশ নিশ্চুপ, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে
নয়না পুনরায় প্রশ্ন করলো,” আমার কাছে কি চান?”

মানুষটা এবার নয়নার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” তোকে।”

নয়নার চোখজোড়া সাথে সাথে বড়ো হয়ে গেলো। মানুষটার চেহারা এবার নয়না স্পষ্ট দেখতে পেলো। মানুষটা আর কেউ নয়, বরং তূর্য। তবে আজ তূর্যের চেহারায় নিষ্পাপতা নয় বরঞ্চ পাগলামো দেখতে পেলো নয়না। এলোমেলো ঘামার্ত মুখে সাইকোদের মতো লাগছে। নয়নার দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হেসে বলল, ” তোকে বিয়ে করলে কী হবে। আনন্দ তো পাচ্ছি না!”

এরপর নয়নার সারা শরীরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে পুনরায় বলল,” তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, নয়না।”

নয়না চিৎকার করে উঠে, সাথে সাথে তার ঘুম ভেঙে গেলো। শোয়া থেকে উঠে নয়না জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো। টি টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি পান করে নিজেকে স্থির করে পাশে ফিরে বিছানায় তূর্যকে দেখতে পেলো না নয়না। ঘড়ির কাঁটা ভোর পাঁচটা বাজে বিশ মিনিট। নয়না এমন দুঃস্বপ্ন প্রায়ই দেখে। তবে আজকের স্বপ্নটা বেশ ভয়ংকর ছিলো। নয়নার তূর্যের উপর পূর্ণ আস্থা আছে সে নয়নার কোন ক্ষতি করবেও না ক্ষতি হতে দিবেও না। তূর্যের কথা ভাবতে ভাবতে নয়না বিছানা ছাড়লো। কে জানে তার পাগল ডাক্তার কী পাগলামি করছে!

বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে প্রায়ই পৃথিবীর বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে। বর্ষার মৌসুমের জন্য তূর্য অধৈর্য চিত্তের অপেক্ষাও সমাপ্ত হয়েছে। আজ তাদের বিয়ের অর্ধ বছর পূর্ণ হলো। প্রিয়তমা স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে তূর্যের যা তা আয়োজন। সকাল সকাল নয়নাকে তৈরি হওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলো তূর্য। বেচারি নয়নার আজ ঘুম ভাঙছেই না যেন। তূর্যের বুঝে আসে না, নয়নার চোখে এতো ঘুম আসে কোথায় থেকে। কিছুক্ষণ আগেও না সপ নয়নার শব্দ শুনেছে! এই সময়েই ঘুমিয়ে পড়লো? সকাল ছয়টায় নয়নাকে উঠিয়ে তৈরি হতে বলে নিজেও তৈরি হয়ে নিলো তূর্য। ছয় মাসেও নয়নার কোনো পরিবর্তন হয়নি, তূর্য এখনো নতুন বউয়ের ঘ্রাণ পায় নয়নার শরীর থেকে। প্রতিনিয়ত নতুনরূপে পায় নয়নাকে। সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায় নয়নাকে দেখে। নয়না তূর্যের চোখের, অন্তরের প্রশান্তির কারণ। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর নয়নার কণ্ঠস্বর তূর্যের ক্লান্তির অবসানের কারণ। তূর্যের ইচ্ছে করে সবসময় নয়নাকে চোখের সামনে বসিয়ে মন ভরে দেখতে। তূর্য যদি পারতো তাহলে নয়নাকে নয়নে বেঁধে রাখতো। তার শরীরের একাংশ নয়না।
বৃষ্টির সকাল,শীতল করে রেখেছে চারিপাশ। তূর্য নয়নার স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে একটি পাতলা শাল নিয়ে নিলো তূর্য। নয়না তৈরি হয়ে বের হলে তূর্য প্রথমে তার চোখে একটি কালো কাপড় দ্বারা বেঁধে দেয়। নয়না প্রথমে ভরকে গেলেও পরমুহূর্তে তার ডাক্তারের কথা ভেবে মুচকি হাসলো, ” সকাল সকাল ডাক্তার সাহেবের কী হলো!”

তূর্য নয়নার কানে অধর ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল, ” সারপ্রাইজ!”

নয়না আর কিছু বলতে পারে! সে তো জমে ফ্রিজ হয়ে আছে। তূর্য মুচকি হেসে নয়নাকে কোলে তুলে নিলো। বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে বসিয়ে দিলো নয়নাকে। অজানা গন্তব্যে নয়না পাড়ি জমাচ্ছে তার প্রাণ প্রিয়র সাথে।

কানাইয়া বাজারে পৌঁছে তূর্য গাড়ি থামালো। এখানে সচারাচর আসা যাওয়া হয় বলে কিছু মানুষের সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে, রফিক আজম। পেশায় সে কৃষক। খড়া মৌসুমে বিল শুঁকিয়ে চৌচির হয়ে গেলে ধান চাষ করে সে। কানাইয়া বাজারে তার একটি ছোট্ট চায়ের দোকান আছে। তূর্য গাড়িটা সেই দোকানের পাশেই পার্ক করে। নয়নার চোখ তখনো বাঁধা অবস্থায় ছিলো। তূর্য মুচকি হেসে নয়নার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,” ভয় করছে?”
নয়না প্রশস্ত হেসে উত্তর দিলো,” তুমি পাশে তো কীসের ভয়?”
তূর্যের হাসিমাখা মুখ উবে গেলো, সেখানে এক টুকরো কাঠিন্যতা এনে বলল,” যদি বিশ্বাস ভেঙে ফেলি? যদি অতীতের মতো তোমাকে ব্যবহার করি?”
নয়নার মুখের হাসি আরেকটু প্রশস্ত করে বলল,” অভাগীর কপালে এতোমাস সুখ লেখা ছিলো, এটা ভেবে না হয় মৃত্যুকে গ্রহণ করে নিবো!”

তূর্য কিছু বলল না। গাড়ি থেকে নেমে নয়নাকেও হাত ধরে নামিয়ে নিলো। তবে তূর্যের এবারের ছোঁয়া নয়নার কাছে খুব অপরিচিত মনে হলো। নয়না তবুও কিছু বলল না। সেসকালের দুঃস্বপ্নের রেশ বলে কাটিয়ে নিলো। নয়না সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে। জীবনের যেই সময়টুকু সে তূর্যকে পাশে পেয়েছে তার স্মৃতি নিয়ে আজীবন কাটাতে পারবে। তূর্য নয়নাকে নিয়ে প্রায় পাঁচশত গজ সামনে এগিয়ে এসেছে যা নয়না চোখ বাঁধা অবস্থায় অনুধাবন করতে পারলো। তূর্য একপর্যায়ে থেমে গেলো। নয়নার হাত ছেড়ে দিলো। নয়না ঠায় দাঁড়িয়ে রউলো সে তূর্যের পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায় রইলো। প্রায় পাঁচ মিনিট পর তূর্য নয়না গা ঘেঁষে দাড়িয়ে বললো,” কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
” হৃদয়ে।”
” অনেক নাকি একটু?”
” মাপা যাবে না।”
” ইশ! বড্ড খারাপ তো আমি! এমন মিষ্টি বউকে কষ্ট দিচ্ছি! আরেকটু কলিজা! এরপর আর কষ্ট হবে না। সারাজীবনের জন্য সব কষ্ট শেষ হয়ে যাবে।”

তূর্যের রহস্যময় কথায় নয়নার নড়চড় হলো না। তূর্য তা দেখে হেসে নয়নার হাত শক্ত করে ধরলো। নিচু হয়ে নয়নার পায়ের জুতা খুলে দিলো। এরপর পায়ে পা মিলওয়ে হাঁটা শুরু করলো। কাঁচা রাস্তা শেষে পিচ্ছিল কাঁদায় পা বাড়ালো দুজন। কিছুক্ষণ পর শীতল পানির পা ছুঁয়ে দিচ্ছে অনুভব করলো নয়না। নয়নার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বিড়বিড় করে বলল,” আমার স্বামী কখনোই খারাপ হতে পারে না।”

তূর্য নয়নাকে প্রশ্ন করলো,” কেমন ফিল করছো?”
” মনে হচ্ছে কোনো অজানা গন্তব্যে ভেসে যাচ্ছি।”
” আমি থাকতে অজানা নয় সুন্দরী! আমার মনের রাজ্যে ভেসে বেড়াবে তুমি।”

নয়না লজ্জা পেলো। তূর্যের হাতে চিমটি কাটলো। কিছুদূর এগোতেই কাঙ্খিত স্থানে এসে থেমে গেলো দুজন। তূর্য এবার নয়নার চোখের বাঁধন খুলে দিলো। অনেক সময় চোখ বাঁধা অবস্থায় ছিল বিধায় তাকাতে সমস্যা হচ্ছিল নয়নার।কিছু সময় পর স্বাভাবিক হলে নয়নার চোখের সামনে ভাসমান হলো সাদা, গোলাপী রঙের পদ্মফুলে সাজানো নৌকা। খুশিতে নয়নার চোখজোড়া চিকচিক করে। জনবল লোকসমাগমের কথা ভুলে সে তূর্যের বুকে মাথা ঠেকালো। তূর্য নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” আমাদের এক হওয়ার অর্ধ বছর পূর্তিতে আর কী চাই প্রিয়তমার?”

নয়না চট করে মাথা তুলে নিলো। আজকের দিনটার কথা সে কীভাবে ভুলে গেলো! অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে নয়নার অন্তর তা দেখে তূর্য নয়নার হাত ধরে নৌকার দিকে আগাতে আগাতে বললো,” আজকের দিনে মন খারাপ নয় তোমার মুখের হাসি দেখতে চাই, নয়ন!”

দুজন নৌকায় উঠলো। তূর্য পূর্ব থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিল। নয়নার পুরো নৌকায় নজর ঘুরিয়ে দেখলো। একপাশে খাবার রাখা আছে, সুঘ্রাণে পুরো নৌকা ভরে গেছে। নয়না তা দেখে তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,” সকালে না ঘুমিয়ে এসব করছিলে, তুমি?”

তূর্য মাথা চুলকে বলল,” সারা জীবন কী বউয়ের হাতেই খাবো নাকি? একটু আকটু না খাওয়ালে শেষ বয়সে খোঁটা তো ঠিকই শোনাবে।”

নয়না তূর্যের বুকে কিল বসিয়ে বলল,” আমাকে ভালোই ভয় দেখানো হচ্ছিল, তাই না!”

তূর্য আফসোসের স্বরে উত্তর দিলো, ” ভয় পেলে তো! তোমার শিরা উপশিরায় এই তাবরেজ তূর্যকে এমনভাবে মিশিয়ে রেখেছো যে, তূর্য হাজার অপরাধ করলেও বিশ্বাস করবে না।”

নয়না আনমনে বললো,” আমরা যার কাছে ঠায় পাই, তাকেই আপন ভেবে নেই; কিন্তু তাদের মনের কথা বুঝতে পারি না।”
” আমাকেও বুঝতে পারো না, নয়ন!”
নয়না তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,” আমার জীবনের পূর্ণতা তুমি। তুমি আমাকে এমন কিছু উপহার দিয়েছো, যা পেয়ে আমি তুমি পরিপূর্ণ।”
তূর্যের হাসিমুখ এইটুকু হয়ে গেলো। নয়নার কথার মর্মার্থ বুঝতে প্রশ্ন করলো,” কীসের উপহারের কথা বলছো?”

নয়না তূর্যের হাত নয়নার পেটে রেখে ফিসফিস করে বলল,” কেউ আসছে!”

তূর্যের চোখ চিকচিক করছে খুশিতে। কী করবে, কোথায় যাবে, কাকে বলবে ভেবে পাচ্ছে না সে। সে কী বেলাই বিলে ঝাপ দিবে? দিলে কী হবে, আনন্দ কী বাড়বে নাকি কমবে। নয়নার কপালে গাঢ় অধর ছুঁয়ে তূর্য মুঠোফোন হাতে নিলো।
মাহবুব শিকদার সিঙ্গাপুর গিয়েছে গত মাসেই। ফিরবে দুই তিন মাসের মধ্যেই। তূর্য চাচাকে ফোন করলো। একবার রিং হতেই মাহবুব শিকদার রিসিভ করে হ্যালো বলার পূর্বেই তূর্য বলে উঠলো, ” ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলেছে! ভাবছি তোমাকে পার্মানেন্ট সিঙ্গাপুরে থাকার ব্যবস্থা করে দিবো। দেশে জায়গা কম তো! তা কী সিদ্ধান্ত নিলে?”

মাহবুব শিকদার কী বলবেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে চিৎকার করে বলল, ” আমি নেক্সট ফ্লাইটেই আসছি,বাপ! ডাক্তারী তুইই করিস।”

তূর্য হেসে ফোন কেটে দিলো। সিঙ্গাপুর থেকে আসতে একমাস সময় লাগবে। ততদিন না হয়,মাহবুব শিকদার আনন্দ জমিয়ে রাখুক!

তূর্য নয়নাকে নিয়ে সারাবিল ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুজনেই চুপচাপ, নয়না প্রকৃতি উপভোগ করছে আর তূর্য নয়নাকে দেখছে। কিছুক্ষণ পর তূর্য একটি শুঁকনো শাপলা ফুলের মালা পিছন থেকে বের করে এনে নয়নার গলায় পরিয়ে দিলো।নয়নার চিনতে অসুবিধা হয়নি, এই মালাটা সেই মালা যেটা সে তূর্যের সাথে প্রথমবার বেলাই বিলে এসে বানিয়েছিল। এটা তো নয়না যত্ন করে রেখে দিয়েছিল, তূর্য পেলো কোথায়? নয়না জিজ্ঞেস করলো,” কোথায় পেলে?”

তূর্য হেসে উত্তর দিলো,” তোমার ঘরে।”
নয়না আর কিছু বলল না। তূর্যের কাঁধে মাথা রেখে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো।

তূর্য গলা ছেড়ে নয়নাকে শক্ত করে ধরে বলতে শুরু করলো,” আজ নেই কোনো বাঁধা, নেই কোনো ভয়! আছে শুধু অঘাত ভালোবাসা। প্রিয়তমা! তোমাকে রাখিবো মনে, বাঁধিব নয়নে! চিৎকার করে জানিয়ে দিব সকলকে, নয়নে বাঁধিব তোমায় ও প্রাণ গো নয়নে বাঁধিব তোমায়!”

নয়নাদের জীবনেও সুখ আসে। হাতে হাত রেখে মাইলের পর মাইল পথ চলার সঙ্গী আসে। বুকে ঠায় দিয়ে সকল দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়ার মানুষ আসে। গল্প উপন্যাসের পাতায় নয়নাদের জীবনে সুখ আসে কিন্তু বাস্তবতা বড্ড ভিন্ন! নয়নাদের মতো মেয়েদের সম্মান কখনোই রক্ষা করতে পারে না। রাতের আঁধারে কতো নয়নার শরীর ক্ষরণ হচ্ছে তা অজানা। নয়নাদের দুর্বল নয়, মাসুদার মতো শক্ত হতে হবে।

সমাপ্ত

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-২৯

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: ঊনত্রিশ

রাত তখন বারোটা পয়তাল্লিশ মিনিট, মাসুদা দরজা খুলে বের হলো। সারা বাড়ি নিস্তব্ধতায় ঘেরা, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সদর দরজার কাছে আসলো। পিছনে ফিরে সোফায় শুয়ে থাকা আকলিমাকে শেষবারের মতো দেখে বলল,” ঘুমাও আকলিমা! আজকের পর থেকে তোমার জেগে থাকার দিন শুরু হবে।”
পরদিন সকালবেলা বাশারের বাড়ির সামনে পুনরায় পুলিশ এসে উপস্থিত হলো। এবার বাশারের কোমরে দড়ি বেঁধে সকলের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আকলিমা বাকরূদ্ধ! যখন থেকে এসপির কাছে ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার কারণ শুনতে পেরেছে তখন থেকেই সটান হয়ে বসে আছে। এদিকে বাশার পুলিশদের হাতে পায়ে ধরে আকুতি মিনতি করছে তার দোষটা জানতে চাইছে কিন্তু কেউ তাকে কিছুই বলছে না। অবশেষে বাশারকে গাড়িতে উঠানো হলো। গাড়ি চলছে আপন গতিতে, বাশার ছটফট করছে, সে জানতে চাইছে তার দোষটা কোথায়? শেষে একজন অফিসার মুখ খুলল,” তোর বউ তোর নামে মামলা করছে, নারী নির্যাতন মামলা। একেবারে প্রমাণ সহ থানায় হাজির হইছে।”
বাশার মাথায় হাত রেখে অবাকের সুরে বলল,” মাসুদা!”

গতকাল রাতে মাসুদার করা ভিডিওর কথাও অফিসার বলল। বাশারের ভীষণ আফসোস হলো! এই মুহূর্তে হাতে কানা কড়ি ও নেই। মাসুদার সেই এক লক্ষ টাকার পালঙ্ক পরিশোধ করেছিল কাঁকন নামক মেয়েকে ব্ল্যাকমেইল করে। টাকা পরিশোধ করে বাশার মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলো। কাঁকনের সাথে অনলাইনে বাশারের সম্পর্ক হয়েছিল, বোকা মেয়েটার থেকে বাশার প্রেমের ফাঁদে ফেলে ন্যুড ছবি ভিডিও সংগ্রহ করেছিল।সেই ভিডিওই বশারের কাজে লেগে গেলো, বাশারও বিপদমুক্ত হয়েছিল। কিন্তু আজ সে কী করবে? কার কাছে সাহায্য চাইবে। বাশারকে থানায় নেয়া হলো। পরদিন সকালে গাজীপুর থেকে কাশিমপুর জেলে চালান করে দেয়া হলো।

বিকালে বাশারকে দেখতে মাসুদা এলো। বাশারের মর্মান্তিক অবস্থা দেখে মুখে তার ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো। বাশারের বিরুদ্ধে পাকাপোক্ত প্রমাণ আছে, সে চাইলেও নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। অনুমতি নিয়ে বাশারের সাথে দেখা করতে মাসুদা এলো। তাকে দেখে বাশার ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,” কতোদিন আমাকে আটকে রাখবি। একদিন তো ছাড়া পাবো! সেদিন তোর এমন অবস্থা করব যে, তুই নিজে নিজের মৃত্যু কামনা করবি।”

মাসুদা হাসলো, হাসতে হাসতে মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে কাঠিন্যরূপ প্রকাশ পেলো, দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” কখনো শুনেছিস, ধর্ষণের শাস্তি মুক্তি মিলতে? অবশ্য বর্তমানে আমাদের দেশে হাজার হাজার ধ’র্ষ’ক খোলা পথে ঘুরছে। মনে করিস না, তুইও এভাবে ঘুরবি। আমি বেঁচে থাকতে ধ’র্ষ’কে’র শা’স্তি তোকে দিয়ই ছাড়বো।”

মাসুদার কথায় বাশার ভয় পেয়ে গেলো। ভয় তারাই পায় যারা অন্যায় করে! বাশারও কী তবে ধর্ষক কিন্তু কার? তরতর করে বাশার ঘামছে। শরীর একদম জবুথবু অবস্থা! কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলো বাশার,” তুমি কে?”

মাসুদার কণ্ঠস্বরে কাঠিন্যের আভাস পাওয়া গেলো,” হালিমার কথা মনে আছে? ইন্জিনিয়ারিং পড়ার সময় যাকে সরল পেলে দিনের পর দিন ব্যবহার করেছিস?”

বাশার শুঁকনো ঢোক গিলে নিলো। হালিমাকে সে কীভাবে ভুলবে? তার জীবনের প্রথম মেয়ে ছিলো হালিমা! যার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে বাশারের ছোঁয়া ছিলো। সমাজের ভাষ্যমতে বাশার প্রতিনিয়ত মেয়েটিকে ধ’র্ষ’ণ করতো। একজন মেয়ের কাছে তার সম্মানের থেকে মূল্যবান সম্পদ আর কিছুই নেই। মেয়ে যতোই সরল সোজা হোক না কেনো একদিন ঠিকই ছেলেকে উচিত জবাব দিবে! একজন মেয়ে তো আর এতো সহজে কোনো ছেলের কাছে ধরা দিবে না! হালিমা বাশারকে পাগলের মতো ভালোবাসতো কিন্তু বাশার! হালিমার দেহকে। ফলস্বরূপ হালিমাকে ভালবাসার দোহাই দিয়ে ব্যবহার করতো। একটা সময় হালিমা নাকচ করলো কিন্তু বাশার তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে লাগলো। হালিমার ভিডিও জনসম্মুখে প্রকাশ করে দিবে বলে ভয় দেখাতো। হালিমা তার পায়ে পড়ে কতো কাঁদত! অনুনয় বিনয় করতো কিন্তু বাশার তা কানে নিতো না সে তার পাপকর্মে মনোযোগী থাকতো। একটা সময় হালিমা কেমন চুপচাপ হয়ে গেলো। ঠিকমতো ক্লাসে উপস্থিত হতো না, বাহিরেও বের হতো না। একদিন খবর এলো হালিমার এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে। সেখানে স্পট ডেথ। বাশার খুব আফসোস করেছিল, মরে যাওয়ার জন্য নয় বরঞ্চ তার দেহ পিয়াসা মেটানোর মানুষ চলে গেলো বলে। হালিমার কথা ভাবতে ভাবতে বাশার মাসুদার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,” তুমি?”
” আমি হালিমার ছোট বোন। তোকে আমার ফাঁদে ফেলতে কী-ই না করেছি। নিজের চাচাদের ব্যবহার করে আমার রূপের জালে ফাঁসিয়েছি। তোর থেকে প্রমাণ উদ্ধার করার জন্য তোর বউ হয়েছি, মা’র খেয়েছি।”

” আমি কাউকে চিনি না, কোনো প্রমাণ নেই তোর কাছে তুই আমার কিছু করতে পারবি না।”

বাশারের কথায় মাসুদা বাঁকা হাসলো। ব্যঙ্গ স্বরে বলল,” প্রমাণ তো আমি নিজেই, আর কী চাস? আপার মৃত্যু এক্সিডেন্ট ছিলো না, পরিকল্পনা মোতাবেক মা’র্ডা’র ছিলো। আপা মৃত্যুর আগে ডায়েরিতে তোর সমস্ত পাপকর্মের কথা লেখে গেছে। আর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ তোর কম্পিউটার যেখানে আপার মতো হাজারো নারীদের সাথে করা কাজের প্রমাণ আছে। বর্তমানে সব এখন পুলিশের হাতে। তোর কী হবে রে, বাশার?”

বাশার দূরে সরে দাঁড়ালো। সময়ের ব্যবধানে সে এমন পর্যায়ে এসে দাড়াবে ভাবতে পারেনি। মাসুদা প্রশান্তি অনুভব করলো। ছলছল চোখে বলল,” আপা তো না জেনে পাপ করেছিল, শাস্তি তো পচ্ছেই। কিন্তু তুই অপরাধ করেও ঘুরে বেড়াচ্ছিস।”

সময় নিয়ে চুপ থেকে পুনরায় বলল,” ধ’র্ষ’কে’র শাস্তি একমাত্র মৃত্যু হওয়া উচিত।”

—————————-

হাসপাতালে ক্যান্টিনে তূর্যের সাথে একজন মেয়ে বসে আছে। তারা অপেক্ষা করছে নয়নার জন্য। নয়না ভাবনার বাসায় ছিলো, তূর্যের ইমারজেন্সি কল আসাতে তাড়াহুড়ো করে আসতে হলো তার। দূর থেকে তূর্যের সাথে অপরিচিত মেয়েকে বসে থাকতে দেখে মান হয় নয়নার। ভয় হয় এই ভেবে, যদি মেয়েটা তার কাছ থেকে তূর্যকে কেড়ে নিয়ে নেয়! নানান ভাবনার মাঝে নয়না তাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়। তূর্য হাসিমুখে নয়নার হাত ধরে পাশে বসিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলো,” মিস মাসুদা, মিট মাই লাভলী ওয়াইফ, নয়না তাবরেজ তূর্য।”

মাসুদা প্রসস্থ হাসলো। নয়নাকে দেখে বলল,” সত্যিই তুমি অপরূপ। তোমার বর এতোক্ষণ যা যা বলেছে একটাও মিথ্যা নয়।”

নয়না লজ্জা পেলো। তূর্য এবার নয়নাকে মাসুদার পরিচয় বলল,” নয়ন! ইনি হচ্ছে মাসুদা। তোমার শুভাকাঙ্খী।”

শুভাকাঙ্খী শব্দটা শুনে নয়না প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করলো। তূর্য তা দেখে একে একে নয়নাকে সবটা ঘটনা খুলে বলল। নয়নার চোখে পানি, আকস্মিক অপরিচিতা মাসুদাকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো। মাসুদা নিষ্প্রাণ হেসে বলল,” পৃথিবীতে নয়নার মতো নরম মেয়েদের জন্য মাসুদা আছে। তোমার সাথে করা প্রতিটা অন্যায়ের শাস্তি এবার বাশার পাবে।”

নয়নার মাসুদাকে ছেড়ে তূর্যের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়লো,” তারমানে তুৃমিই উনাকে ঐ বাড়িতে পাঠিয়েছিলে?”

তূর্য বুকে হাত বেঁধে মুচকি হেসে বলল,” তোমার মতো আজই আমার সাথে এই অপরিচিতার প্রথম সাক্ষাৎ, নয়ন! আমি চেয়েছিলাম বাশারকে তিলে তিলে শাস্তি দিতে কিন্তু তারর পূর্বেই বাশারের কাল হয়ে মিস মাসুদা চলে আসে।”

নয়না চোখ মুছলো। গলার স্বর উঁচু করে বলল,” আমি বাশার ভাইয়ের শেষ পরিণতি স্ব চোক্ষে দেখতে চাই।”

তূর্য নয়নার কথায় সায় দিলো। মাসুদাকে বিদায় জানিয়ে নিজ গন্তব্যে ছুটলো।”

——————————-

কাশিমপুর জেলখানায় পরের সপ্তাহে তূর্য নয়নাকে নিয়ে আসলো। প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বাশারের সাথে দেখা করার সুযোগ পেলো নয়নারা। বাশারকে প্রথমে দেখা মাত্রই নয়না চিৎকার করে উঠলো। বাশারকে সে চিনতেই পারছে না। সারা মুখে কালচে দাগ, হাত পায়ের অবস্থাও খারাপ। হাতের নখগুলো উঠিয়ে নেয়া হয়েছে কিন্তু কেন? প্যান্টের অনেকটা অংশ ছেঁড়া বিধায় আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। নয়না মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাশার নয়নাকে দেখতে পেয়ে আকুতি মিনতি করা শুরু করলো,” আমাকে বাঁচিয়ে নে, নয়না! আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।”

নয়না তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,” ঐটা কী ভুল ছিলো, বাশার ভাই?”
” আমি পাপ করেছি বোন! আমাকে ক্ষমা করে দে।”

” আমি ক্ষমা করার কেউ না,বাশার ভাই। শুধু তোমাকে দেখে আফসোস হচ্ছে। না জানি তুমি নিজ হাতে কতো পরিবারকে শেষ করেছো। কাঁকনের সাথে করা কাজটাও তুমি করেছো তাই না! একজন মায়ের বদ দোয়ার প্রতিফল ভোগ না করে কীভাবে তুমি মুক্তির আশা করো।”

বাশার প্রত্ত্যুত্তরে কিছু বলল না। হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো। তূর্য নয়নাকে ধরে দূরে সরিয়ে আনলো। বাশারের দিকে তাকিয়ে বলল,” পাপ বাপকেও ছাড়ে না, শালা সাহেব! মাসুদা তো তোকে জেলে ঢুকিয়েছে, আমি তোকে জেলের ভেতর পঁচে গলে ম’রা’র ব্যবস্থা করব।”

বাশার চিৎকার করতে লাগলো। পাগলের মতো নিজেকে আঘাত করতে লাগলো। এই নরকে থাকলে সে এমনিতেও পঁচে গলে ম’রে যাবে। নিজের পাপকর্মের কথা ভেবে আফসোস করলো।

নয়না যখন আকলিমার বাড়িতে পা রাখলো তখন বিকাল প্রায়। বাড়িতে প্রবেশ করে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। এ বাড়ির প্রতিটা দেয়াল, আসবাবপত্র তার সাথে করা অন্যায়ের স্বাক্ষী। নয়নার আর্তনাদ শুনে হয়তো এরাও কাদতো। আকলিমাকে নয়না পেলো তার ঘরে। অন্ধকার ঘরে শুয়ে কুঁকড়াচ্ছে। নয়না লাইট জ্বালিয়ে দিলো। আকলিমা নয়নাকে ফিরে আসতে দেখে হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো। আকলিমা বিছানায় শায়িত অবস্থায় পড়ে আছে। বাশার চলে যাওয়ার পর তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হতে নিলে পিছলে পড়ে যায়। ডান উরুর জয়েন্টে ব্যথা পায়! আশেপাশের ফার্মাসির ডাক্তার ধারণা করছে হাড় ভেঙ্গে গেছে কিন্তু আকলিমাকে কে নিয়ে যাবে? মাহবুব, রিহানের সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় পেলো না আকলিমা। নয়নকে দেখে সে বলল,” মা রে! তোর সাথে করা অন্যায়ের প্রতিফল ভোগ করছি। আমার এখন জীবনে কিছুই নেই। দাম্ভিকতা আমাকে শেষ করে দিয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দে মা!”

নয়না ফোঁস করে নিশ্বাস ত্যাগ করলো। সে কখনো তার শত্রুদেরও মৃত্যু কামনা করে না। সেখানে আকলিমা তো তার ফুফু ছিলো। নয়না আকলিমার পাশে বসলো। তূর্যের কথা উঠালো সে, ” আমার স্বামী একজন ডাক্তার। তোমার চিকিৎসা করার সামর্থ্য তার আছে। তুমি চিন্তা করো না, আমি তোমার চিকিৎসা করাবো।শুধু একটাই অনুরোধ, এভাবে আর কোনো মেয়ের জীবন শেষ করে দিও না।”

আকলিমা হু হু করে কেঁদে উঠে। সত্যিই সে বড়ো অন্যায় করেছে যার শাস্তি সে পাচ্ছে।

চলবে………………..

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-২৭+২৮

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: সাতাইশ

কখনো কী শুনেছেন, বিয়ের পর বউকে নিয়ে কাজে যেতে? শুনেননি তো! তবে আজ শুনুন। কাজটা কে করেছে ইতিমধ্যে বুঝতেও পেরেছেন হয়তো! তূর্যের কেবিনে মুখ ফুলিয়ে নয়না বসে রয়েছে। তার বরের মতো পাগল ডাক্তার এই জনমে কোথাও দেখেনি সে।
বিয়ের পরেরদিন সে বউ ছাড়া হাসপাতালে আসবেই না। ইমারজেন্সী বিভাগ থেকে বারবার কল আসছিলো। এদিকে নয়নাও জিদ ধরে বসেছিল যে, সে আজ বাহিরে কোনোক্রমে বের হবে না। লাজ শরম কিছু থাকতে হবে তো! এমনিতেও পুরুষদের তুলনায় নারীদের লাজ একটু বেশিই থাকে। এই পরিস্থিতিতে চাইলেও তারা লোকসমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারে না, পুরুষরা কী তা বুঝবে?
অগত্যা নয়না তূর্যের সাথে হাসপাতালে আসতে বাধ্য হয়। বর্তমানে নয়না তূর্যের কেবিনে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সময় এখন দুপুর বারোটা বাজে নয়না এখানে এসেছিল সকাল আটটায়। এই কয়েকঘন্টা সময়ের মধ্যে একবারও তূর্যের দেখা পায়নি সে কিন্তু বউয়ের খোঁজ খবর ঠিকই রেখেছেন তিনি। কখনো কফি কখনো জুস আবার কখনো হালকা নাস্তা দিয়ে পাঠাচ্ছে তূর্য। দরজার কড়াঘাতে নয়না উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো তার মন বলছে এবার তূর্য এসেছে। মন কী আর ভুল বলবে! অর্ধ খোলা দরজার হাতলে ধরে তূর্য কারো সাথে হেসে কথা বলছে। নয়না তার বরের হাসি দেখছে। সে ভাবছে, প্রাণোচ্ছল ছেলেটাই কী তার স্বামী? পরক্ষণে মনে মনে বলল, হ্যাঁ! এই সুদর্শন দুষ্ট মানবটা শুধু তারই। নয়না লজ্জায় দাড়িয়ে গেলো,সে কী বলবে সেটাও মনে মনে সজিয়ো নিলো। এদিকে দরজা আটকে তূর্য ঘরে প্রবেশ করে সরাসরি নয়নার কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। মাঝে মাঝে নয়না তূর্যকে দেখে বুঝতে পারেনা যে তার মনে কী চলছে! প্রায় পাঁচ মিনিট নয়নাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে রাখলো তূর্য। ফিসফিস করে বললো,” মিস ইউ সো মাচ, মাই লেডি!”

নয়নার মান গলে পানি হয়ে গেলো কিন্তু মিছে অভিমান করে রইলো। তূর্যের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,” মিস না ছাই! কতো সময় ধরে একা বসে আছি। এখন আসার সময় হলো!”

তূর্য নয়নাকে নিয়ে চেয়ারে বসলো। নয়নাকে কোলের উপর বসিয়ে বলল,” ইমারজেন্সীতে আজ একজন মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে। বয়স কতো হবে, আঠারো কী ঊনিশ! বিষ খেয়েছিল, ওয়াশ করিয়ে কেবিনে শিফট করতে দেরী হয়ে গেছে। এজন্যই আসতে দেরী হলো, রাগ করে না বউ!”

নয়না নিজের কথা ভাবছে, সেও তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল কিন্তু তার পাশে তূর্য ছিলো বিধায় বেঁচে ফিরতে পেরেছে। মেয়েটাও নিশ্চয়ই তার মতো নরকে পা দিয়েছিল,তাইতো আত্মহত্যার মতো খারাপ পথ বেছে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবলো না। নয়না মনে মনে সিদ্ধান্তঃ নিলো সে মেয়েটাকে দেখতে যাবে, সুখ দুঃখের কথা বলবে। কারণ সে জানে, এই পরিস্থিতিটা কতোটা ভয়াবহ। নয়না তূর্যের কাছে আবদার জুড়ে বসলো,” আমাকে মেয়েটার কাছে নিয়ে যাবে, তূর্য? ”

তূর্য দেখতে পেলো তার প্রিয়তমা স্ত্রী সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছে, তারমানে নয়না মেয়েটাকে সত্যি সত্যিই দেখতে যাবে। তূর্য নয়নার এই ইচ্ছেটাও অপূর্ণ রাখবে না তাই মুচকি হেসে বলল,” লাঞ্চটা সেরেই নিয়ে যাবো। এবার চলো।”

নয়নাকে নিয়ে তূর্য গাজীপুরের রাজবাড়ী মাঠ থেকে একশ গজ দূরে অবস্থিত চিকেন চিলি রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসলো। দুপুরের খাবার খেয়ে বের হতে নিলে নয়না হাঁটার গতি থামিয়ে দিলো। নয়নার শরীর কাঁপছে, ভয়ে হাত পা শীতল হয়ে আসছে। সে নিজেকে তূর্যের পিছনে আড়াল করে রেখেছে। তূর্য নয়নার ভাবভঙ্গি লক্ষ করে সম্মুখে তাকালে বাশারকে দেখতে পেলো। মুহূর্তেই তূর্যের হাসিমুখ পরিবর্তন হয়ে লালা আভা ভেসে উঠলো। বাশার তাদের দিকেই এগিয়ে আসলো। নয়নাকে ভালোভাবে দেখে বলল,” এই শহরেই তোর এতো নাগর থাকলে আমাকে কী আর মনে ধরবে? এজন্যই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস,তাই না? অবশ্য তুই তো তোর মায়ের দিক পেয়েছিস, তোর মা যেমন বাজারী ছিলো তুইও তেমন হয়েছিস।”

তূর্যের সামনে তার স্ত্রীকে অপদস্ত করছে তাও বিশ্রী ইঙ্গিতে! ব্যাপারটা সহ্য করার মতো নয়। তূর্য তেড়ে এসে বাশারের নাক বরাবর ঘুষি মেরে দিলো। একটা নয় দুইটা নয় পরপর কয়েকবার ঘুষি মেরে নাক থেকে র’ক্ত বের করে ফেলল। নয়না তূর্যকে বাঁধা দিচ্ছে বারবার অনুরোধ করছে যেন আর না আঘাত করে। এদিকে বাশার যেন তার পরিকল্পনায় সফল হয়েছে। তূর্যের থেকে ছাড়া পেয়ে নাকে হাত দিলয়ে র’ত মুছে নিলো। আশেপাশে ভালোভাবে লক্ষ করে জোরে চেচামেচি শুরু করলো,” আমার বোনরে ফিরাইয়া দেন, ভাই! আমার মা বোনের জন্য কান্না করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই যে, ভাইয়েরা দেখে যান! ডাক্তার বলে আমার মতো সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করছে। আমার বোনকে পালিয়ে এনে রক্ষিতা করে রেখেছে। এই দেখেন, আমি প্রতিবাদ করায় মেরে কী অবস্থা করে দিয়েছে।”

রেস্টুরেন্টের সামনে বিরাট বড়ো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলল বাশার। লোকজন সমবেত করে মনগড়া কাহিনী বলে দিলো সে। আর আমাদের দেশের মানুষ সবসময়ের মতো একপাক্ষিক বক্তব্য শুনে তাই বিশ্বাস করে নিলো। কয়েকজন তূর্যের দিকে আঙুল তলতে ভুল করলো না।বাশার এসব দেখে বিশ্রী হাসলো। নয়নার দিকে বাজে ইঙ্গিত করলো। তূর্য নীরব দর্শকের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে চাইছে নয়নয় কিছু বলুক, তূর্য তার জীবনের কতোটা অংশ জুড়ে আছে সবাইকে বলুক। তূর্যকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, লোকজনের সামনে নয়না স্পষ্ট গলায় বলতে শুরু করলো,” ইনি আমার স্বামী। আমরা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। দয়াকরে এই লোকের কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না।”

বাশারের হাস্যজ্বল মুখ নিমিষেই চুপসে গেলো। থমথমে পরিবেশে নয়নার কথা কানে বাজতে লাগলো। কিন্তু বাশার তবুও বেঁকে গেলো না, পুনরায় প্রশ্ন তুলল,” কী প্রমাণ আছে? নির্লজ্জ মেয়ে, কোন পাড়ায় তোকে নিয়ে যায় যে নিজেকে এই ছেলের বউ বলতেও লজ্জা পাচ্ছিস না!”

বাশার বলতে বলতে নয়নার কাছে আসছিল। তূর্য তখন বাঁধা দিয়ে বলল,” আর এক পা আগালে তোমার পা ভেঙে দিব, শালা সাহেব!”
এরপর সমবেত লোকজনের উদ্দেশে বলল,” আজকাল কী বিয়ের রেজিস্টার প্যাপার সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হবে? আমাদের মুখের কথা কী বিশ্বাস হচ্ছে না! একজন মেয়ের হাত,নাক,কানের অলংকার কখন পরে? অবশ্যই বিয়ের পর! এখন অনেকেই বলবেন, আজকালকার মেয়েরা বিয়ে ছাড়াই অলংকার পরে ঘুরে বেড়ায়। তাদের উদ্দেশে বলছি, বিয়ে হচ্ছে পবিত্র বন্ধন যারা এই বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাদের বাহ্যিক অভ্যন্তরীণ দিক লক্ষ করলেই বুঝা যায়। আর সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার হচ্ছে, এই লোকের ভাষা! দেখুন তো, আমি তার মতো কোনো মেয়েকে অপমান করেছি কী না!”

তূর্যের কথায় সকলে সহমত পোষণ করলো। কেউ কেউ বলল,” এই লোকের মনেই শয়তানী, সাধারণ পাবলিকদের সহায়তায় আপনাকে হেনস্তা করতে চেয়েছে।”

রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার ততক্ষণে এসে উপস্থিত হলো। তূর্যের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পরে দারোয়ান দিয়ে বাশারকে পথ দেখিয়ে দিলো।

পুরো ঘটনায় নয়না খুব ভয় পেলো। তূর্যের শার্ট খামছে ধরে বলল,” হাসপাতালে চলো, তূর্য!”

তূর্য কথা বাড়ালো না। নয়নাকে শক্তকরে ধরে গাড়িতে উঠলো।
————————————

সন্ধ্যা হয়ে আসলো। তূর্যের ডিউটির সময় শেষের পথে। এবার সে নয়নাকে একা রাখেনি, রাউন্ডের সময়ও নয়নাকে পাশে রেখেছে। তূর্য ও নয়না যখন বিষপান করা মেয়েটির কেবিনে প্রবেশ করছিল তখন তারা শুনতে পেলো, মেয়েটির মা বলছে,” আমি পুলিশের কাছে যাবো, ঐ ছেলেকে জেলে ঢুকাবো। আমরা গরীব বলে, মানুষ না! আমার মেয়েটার আজ এই অবস্থার জন্য ঐ কুলাঙ্গার দায়ী।”

তূর্যের আগমনে মেয়েটির মা থেমে গেলো। তূর্য ফাইল চেক করতে লাগলো।নয়না এক ধ্যানে মেয়েটির নিস্তেজ শরীর দেখছে, মায়াবী চেহারার অধিকারী মেয়েটার জীবনে কী এমন ঘটেছিল যার কারণে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিল! নয়না সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটির মায়ের উদ্দেশে বলল,” আত্মহত্যা কেন করতে গিয়েছিল, আন্টি। সঠিক সময়ে নিয়ে না আসলে কী হতে পারতো, ভাবতে পারছেন?”

কিছু সময় আমরা মনের দুঃখ প্রকাশ করাতে অপারগ হয়ে যাই, দায়িত্বের ভাড়ে নিজেদের পাথর বানিয়ে ফেলি। কিন্তু যখন কেউ আমাদের কাঁধে ভরসার হাত রাখে, তখন মন প্রাণ উজার করে দুঃখ বিলাপ করতে থাকি। মেয়েটির মায়ের অবস্থাও তেমন। একাকী মেয়েকে নিয়ে লড়তে থাকা পাথর হৃদয় গলে গেলো নিমিষের।চোখের কোণে অশ্রু এসে ভীড় করলো। মেয়ের হাত ধরে বিলাপের সুরে বলল,” কোন এক ছেলের সাথে কথা বলতো, কাঁকন। দুইদিন ধরে মেয়েটা আমার কাছে এসে বলল, তার কীসের ভিডিও ছেলের কাছে আছে। দুই লাখ টাকা চাইছে, নইলে ভিডিও ভাইরাল করে দিবে। মেয়ের সম্মান বাঁচাতে জমানো টাকা ঐ ছেলেকে দিয়ে দেই। আমাদের সম্বল ঐটুকুই ছিলো। মেয়েকে বলছি যেন চিন্তা না করে। কিন্তু কী হয়ে গেলো! আমার মেয়েটা আত্মহত্যার পথ বেছে নিলো।”

কাঁকনের মা আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো। নয়নার বর্তমান যুগের মেয়েদের বোকামি শুনে বড়োই আফসোস হলো। এই মাকে স্বান্তনা দেয়ার ভাষা নয়নার জানা নেই। সে লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে প্রশ্ন করলো, ” পুলিশকে জানান, আন্টি! আমার স্বামী এবং আমি আপনার পাশে আছি। আমরা সকল ধরনের সহায়তা করব।”

কাঁকনের মায়ের চোখ মুখ চিকচিক করছে। মেয়ের সাথে করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস সঞ্চয় করে সে। তূর্য নয়নাকে দেখে মুচকি হাসে, কে বলবে এক সময় এই মেয়ে অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করেছে! আজও তো ভয়ে তূর্যকে আঁকড়ে ধরেছে। তূর্য কাঁকনের মায়ের উদ্দেশে বলল, ” টাকা কার হাতে দিয়েছিলেন?”

” একটা ছেলের হাতে।”
” দেখতে কেমন ছিল।”

” খাটো, সুন্দর, গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি। গালে একটা কাটা দাগ আছে।”

কাকনের মায়ের কথা শেষ হতেই মুহূর্তেই নয়নার চোখ জোড়া বড়ো হয়ে গেলো। সে বিড়বিড় করে বলল,” এই কাজ বাশার ভাইয়ের নয়তো!”

চলবে…………….

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: আটাশ

বাশরের ঘর এখন পুরোটাই মাসুদার দখলে। শুধু ঘর বললে ভুল হবে পুরো বাড়িটাই মাসুদার দখলে। ইদানীং মাসুদা ঘরে বসে কী যেন কাজ করে! আকলিমা দরজায় আড় পেতে কখনো ঠুসঠাস শব্দই শুনতে পায় আবার কখনো কাগজপত্র উলট পালট করার শব্দ পায়। মেয়েটার মতিগতি আকলিমার বুঝে আসে না। ঘর থেকে বের হলে রান্না করে, খায়ও কিন্তু আকলিমাকে সাধে না। সে যে এবাড়ির বউ কেউ দেখে বলবে না। আকলিমা এই মেয়ের চালচলন দেখে অতিষ্ঠ তার উপর ছোট ছেলেকে বোরহান নিয়ে চলে গেছে। একদিনও খবর পর্যন্ত নেয়নি আকলিমার। এতদিন হাঁটু ব্যাথার অভিনয় করতে করতে আজকাল হাঁটুতে সত্যি সত্যিই ব্যাথা দেখা দিয়েছে। বেশিক্ষণ হাঁটাচলা করলে ব্যাথা বাড়ে।

সন্ধ্যায় বাশার বাড়ি ফিরে আসলো জীর্ণশীর্ণ হয়ে। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন, ঠোঁট কে’টে র’ক্ত বের হয়ে তা শুঁকিয়ে গেছে, মাথায় বেন্ডেজ করা। আকলিমা ছেলেকে দেখে চিৎকার করে উঠে। মাসুদা তা শুনে দরজা খুলে বাহিরে দেখে, বাশারের এই অবস্থা দেখেও ভাবান্তর হলো না তার। দরজা খোলা রেখে পুনরায় ঘরে চলে গেলো। আকলিমা রাগে গজগজ করে বাশারকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,” কেমন মেয়েকে বউ বানিয়ে আনলি, স্বামীর করুণ অবস্থা দেখেও কাছে আসলো না!”

বাশার নিরুত্তর, সে ভাবছে নয়নাকে কীভাবে ঐ ডাক্তারের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে পারবে। আকলিমার কথা শুনছেই না বুঝতে পেরে আকলিমা নিজেই মাসুদার কাছে গেলো। চুলের মুঠি শক্তকরে ধরে বাহিরে টেনে আনতে লাগলো। মাসুদা ব্যথায় গোঙরাতে লাগলো। নিজেকে বাঁচাতে সে আকলিমার পেটের দিকটায় শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঘাত করলো। আকলিমা কী আর সহ্য করতে পারে! ছিটকে পড়লো দরজার কাছটায় যেখান থেকে বাশারকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ব্যাথা-বেদনার থেকে বেশি আওয়াজে আর্তনাদ করে উঠলো আকলিমা। ছেলেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো,” ও বাশার, ম’রে গেলাম রে! তোর বউ আমাকে আজ মে’রে ফেলবে। আমাকে বাঁচা বাপ, আমাকে বাঁচা!”

বিরক্তিকর দৃষ্টিতে বাশার আকলিমার কাছে এলো। হাতে ধরে উঠাতে নিলে আকলিমা গগনবিদারী চিৎকার করে বলল,” তোর বউকে তো কিচ্ছু বলবি না! বলবি কেনো? বউকে পেয়ে মাকে তো ভুলেই গেছিস। আজ তোর চুপ থাকাতে আমাকে আঘাত করেছে কাল মে’রে ফেলবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে!”

এমনিতেও বাশার চিন্তায় ছিলো তার উপর সারাদিনই মা’র খেয়ে গেলো। বাড়িতে এসেও অশান্তি শুরু হলো। সব মিলিয়ে বাশার নিজেকে সামলাতে পারলো না। আকলিমাকে ডিঙিয়ে গিয়ে মাসুদাকে ইচ্ছেমতো মারতে শুরু করে দিলো। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এবার মাসুদা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। বাশার মারতে মারতে মাসুদাকে শুইয়ে দিয়ে দরজার কাছে আসলো। আকলিমা ছেলের রাগ দেখে ভরকে গেলো সে তো চেয়েছিল বাশার মাসুদাকে এক দুইটা চর থাপ্পড় বসিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিক কিন্তু বাশার যে এতো মারবে বুঝতে পারেনি। বাশার এসেছিল দরজা আটকাতে, আকলিমা ছেলেকে বাঁধা দিলো,” বাবা, মাথা খারাপ করিস না। এই মেয়ের কিছু হলে আমাদের জেল হয়ে যাবে। ছেড়ে দে বাপ!”

” দরজার সামনে থেকে সরে যাও, মা! এই মা’গী’র তেজ আজ শেষ করমু। কতো বড়ো সাহস, আমাকে জেলের ভাত খাওয়াবে? আজ একে না শায়েস্তা করতে পারলে আমি শান্তি পাবো না।”

বাশার যা করতে চাইছে আকলিমা তা কখনো করতে দিবে না। ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে বাহিরে এনে নিজের ঘরে আটকে রাখে। বাশারের ঘরে উঁকি দিয়ে মাসুদার অবস্থান দেখে নিলো। মেয়েটা গুটিশুটি মেরে খাঁটের সাথে মিশে আছে। আকলিমার মনে কষ্ট নয়,আনন্দের জোয়ার ভাসছে। এবার যদি আপদ বিদায় হয়! এদিকে আকলিমার অগোচরে মাসুদা রহস্যময় হাসলো। দুর্বল শরীরে হেঁটে টেবিলের কাছ থেকে আগ থেকে সেট করে রাখা গোপন ক্যামেরা বের করে বিড়বিড় করে বলল,” খেলা এবার জমবে ভালো।”

——————————–

হাসপাতাল থেকে দশদিনের ছুটি মঞ্জুর করা হলো। এই দিনগুলোতে তূর্যের অনেক কাজ। প্রথমত নয়নাকে পুরো দুনিয়ায় সামনে স্বীকৃতি দিতে হবে দ্বিতীয়ত মাহবুব শিকদারের রিটায়ার্ড হওয়ার সময় পরের মাসে। গাজীপুর সিটিতে চাচার জন্য একটি চেম্বার খুলতে হবে। যার কাজ এখন থেকেই শুরু করতে হবে। সকাল থেকেই তূর্য দৌড়ের উপর আছে কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে নয়নার খোঁজ ঠিকই নিচ্ছে সে। প্রায় ছয় ঘণ্টা তূর্য নয়নার থেকে দূরে তাই সে ঠিক করলো দুপুরের খাবার সে নয়নার সাথে বসেই খাবে। এমনিতেও বিবাহিত হয়েও এখনো সিঙ্গেলদের মতো জীবন যাপন করতে হচ্ছে তূর্যকে। অনুষ্ঠান না করা অবদি নয়না তার কাছে ধরা দিবে না বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে।মহারাণীর কথা কী আর তূর্য ফেলতে পারে! অগত্যা এক বাড়িতে থেকেও তূর্য ও নয়না আলাদা রাত্রিযাপন করছে।

গাড়ি মারতার রাস্তায় ঘুরিয়ে নিলো তূর্য। তার পাশের সিটেই একগুচ্ছ গোলাপের তোড়া রাখা আছে। তূর্য নয়নাকে এই পর্যন্ত কিছুই দিতে পারেনি। ফেরার পথে কিছু অলঙ্কার নিয়ে আসলো। বাড়িতে প্রবেশ করে তূর্য সময় অপচয় করলো না, নয়নার নাম ধরে হাঁক ছাড়লো। নয়না রান্না শেষ করে গোসল করতে ঢুকেছে সবে। তূর্যের ডাক তার কানে পৌঁছায়নি। নয়নার সাড়া শব্দ না পেয়ে তূর্য কিছুটা ভয় পেলো, তাড়াহুড়ো করে উপরে চলে আসলো। নয়না গোসল করছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। দরজার কাছটায় এসে বলল,” বউ! একটা কথা শুনবে?”
ভেতর থেকে নয়নার কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো,” কিছু বলবে, তূর্য?”

তূর্য ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” বলতে তো চাইছি অনেক কথা, উজাড় করে দিতে চাই ভালোবাসা।”

আচমকা নয়না দরজা খুলে দিলো। তূর্যের কাব্যিক কথায় ভীষণ হাসি পেলো। তূর্যের মাথার কেশবে হাত চালিয়ে বলল,” পাগল,ডাক্তার।”

তূর্য মাথা চুলকে ফুলের তোড়া নয়নার দিকে ধরলো। আকস্মিক নয়নার দিকে ভালোভাবে তাকাতে মস্তিষ্ক কিছুটা নষ্টালজিক হয়ে গেলো। অর্ধভেজা শরীর,মাথায় তোয়ালে প্যাঁচিয়ে রাখা, ঘাড়, গলায় বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। তূর্যের নজরে আসলে সে শুকনো ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলল,” এই রূপ দেখালে সুস্থ মানুষ এমনিতেও পাগল হয়ে যাবে, যেখানে আমি তো পাগল ডাক্তার।”

নয়নার অস্বস্তি বাড়লো। সে তো স্বাভাবিক মনেই তূর্যের সামনে এসেছিল কিন্তু পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাড় করাবে কে জানতো! গোলাপের তোড়া হাতে তুলে নাকের কাছে ধরে লম্বা নিশ্বাস নিলো। গোলাপ ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ নাকি তূর্যের নয়া বঁধুর শরীরের ঘ্রাণ কোনটা বেশি সুন্দর! তূর্য ভাবছে। মস্তিষ্ক থেকে দুষ্ট মনোভাব সরিয়ে নয়নার হাত ধরে বিছানায় বসালো তূর্য। প্যান্টের পকেট থেকে দুইটা বক্স বের করে নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” আমাদের বিয়ে হঠাৎ করে হওয়ার তোমাকে গহনা দিতে পারিনি। আমার ইচ্ছে ছিল, আমার স্ত্রীকে নিজের উপার্জিত টাকায় গহনা কিনে পরাবো তাই সামান্য উপহার আনলাম।”

তূর্য কথাগুলো বলতে বলতে কানের দুল ও নাকের ফুল বের করলো। নয়নার কানের দুল খুলে তূর্যের নিয়ে আসা দুল খুব যত্নে পরিয়ে দিলো কিন্তু বিপত্তি ঘটলো নাকের ফুল পরানোর সময়। তূর্য নয়নার একদম কাছাকাছি চলে গেলো। তারা একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তূর্য এবার মনের সাথে যুদ্ধ করলো না, মন যা চায় তাই করলো। নাকের ফুল পরিয়ে সেখানে চুমু খেলো। নাক থেকে সরে এসে নয়নার দিকে গভীর নয়নে তাকিয়ে রইলো। নয়নার ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপছে তূর্যকে তা খুব টানছে। নয়নার অনুমতি ছাড়া সে কিছুই করতে চায় না অগত্যা মনোযোগ সরাতে নয়নার মাথা থেকে তোয়ালে খুলে নিলো সে। নয়নার কপালের চুলের দিকটায় গভীরভাবে চুমু একে ধরে রাখলো। ঠোঁট সরিয়ে সেভাবে থেকেই বলক,” তুমি খুব সুন্দর, নয়ন!”

একটি বাক্য, যা প্রতিটা নারীকে লজ্জায় ফেলার জন্য যথেষ্ট। লজ্জায় নয়না মাথা নিচু করে রাখলো। পরপর তূর্যের ভারী কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো,” একটু জড়িয়ে ধরি, নয়ন?”

এতো আকুল আবদার নয়না কর ফেলতে পারে? নিজেই হাত বাড়িয়ে তূর্যকে জড়িয়ে ধরলো। নয়নার সম্মতি পেয়ে তূর্যও মুচকি হেসে নয়নাকে জড়িয়ে ধরলো, খুব শক্ত করে। নয়নাও মুচকি হাসলো, তূর্যের বুকে মাথা রেখে বলল,” বৈবাহিক স্ত্রীর কাছে কী সব বিষয়েই অনুমতি নিতে হয়?”

চলবে……………..

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-২৫+২৬

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: পঁচিশ + ছাব্বিশ

বহুদিন পর ভাবনার বাসায় নয়নার আগমন ঘটে। নাইট ডিউটি করে এসে ভাবনা তখন ঘুমাচ্ছিল। তূর্য যখন নয়নাকে নিয়ে আসে তখন বিকাল প্রায়। শপিং শেষে বাড়ি ফিরবে এখন। জোড়পুকুর পাড় আসতেই নয়না ভাবনাকে দেখার আবদার জুড়ে বসলো। তূর্য মুচকি হেসে নয়নার আবদার পূরণ করতে ভাবনার বাসায় চলে আসলো। ঘুমঘুম চোখে ভাবনা দরজা খুলে নয়নাকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো। তূর্যকে রেখে নয়নার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। তূর্য মিছে অভিমান করে ফোন চালাতে ব্যস্ত হলেও তার কান দ্বয় সচল রাখলো। ফিসফিস করে দুজন কী যেন বলাবলি করছে। কিছুক্ষণ পর নয়নাকে নিয়ে ভাবনা তার ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। তূর্য থতমত খেয়ে ভাবনার কাণ্ড দেখলো কিন্তু কিছুই বুঝলো না।
তূর্য বারবার ফোনে সময় দেখে নিচ্ছে। দুই মেয়ে ভেতরে বসে কী খিচুড়ি পাকাচ্ছে কে জানে! প্রায় আধাঘণ্টা পর ভাবনার ঘরের দরজা খুললে তূর্য বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো। বসা থেকে উঠে বিরক্তিকর চোখে মুখে বিস্ময়ের আভা ভেসে উঠলো। নীল রংয়ের শাড়িতে নয়নাকে নীল পরি লাগছে। যেমনটা সে কল্পনা করেছিল তার থেকেও সুন্দর লাগছে নয়নাকে। নতমুখী নয়না অস্বস্তিতে দুই হাতের তালু ঘষছে। ভাবনা পিছন থেকে বলে উঠলো,” কেমন দিলাম?”

তূর্য মাথা চুলকে বলল,” আ’ম শকড। কখন যেন অজ্ঞান হয়ে যাই, নয়ন!”
শেষোক্ত কথা বিড়বিড় করে বললেও নয়না ঠিকই শুনতে পেলো। মুচকি হেসে আনমনে নয়না বলল,” ভাগ্যিস ভাবনা আপু পাশে আছে! নয়তো আমিও তোমার মতো লজ্জায় ম’রে যেতাম, তূর্য।”

স্বচ্ছ আকাশ হঠাৎই মেঘাচ্ছন্ন রূপ ধারণ করে ফেলল। মুহূর্তেই ঝুমঝুম বৃষ্টি ঝড়তে শুরু করলো। নয়নার আর বাড়ি ফেরা হলো না। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকন করার প্রয়াশ জাগলো স্থিরমনে। নয়নার ইচ্ছে অপূর্ণ রাখার মানুষ নয় তূর্য। গাড়ি থামালো মারতা ব্রিজ থেকে কিছুটা সামনে। এই জায়গাটা জনমানবশূন্য। দুই ধারে ধান ক্ষেতের মাঝে পিচঢালা রাস্তা। মাঝেমধ্যে দুই তিনটে অটো ও সি এন জি আনাগোনা করছে। বৃষ্টি থেকে বাচার জন্য কয়েকজন রিকশাওয়ালা একপাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে অদূরে দোকানে অবস্থান করেছে। তূর্যদের বাড়ির পৌঁছাতে আরো দশ মিনিট সময় লাগবে। গাড়িতে বসে পরিপূর্ণভাবে বৃষ্টি উপভোগ করতে পারছে না নয়না। উশখুশ করছে বাহিরে বের হতে। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করছে সে। এতটুকু কী আর মন ভরে? তূর্য ব্যপারটা বুঝতে পেরে নয়নার পাশের দরজার লক খুলে দিলো। নয়না বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকালে সে বলল,” মহারানীর ইচ্ছে অপূর্ণ রাখার সাধ্য কী আর এই অধমের আছে? অসুখ হলে তো ডাক্তার বাড়িতেই সুযোগে সৎ ব্যবহার করবে, বিষয়টা নিশ্চয়ই মহারানীর পছন্দ হবে না! অবশ্য আমার জন্য কিন্তু মন্দ হবে না।”

নয়না ধ্যাৎ বলে তূর্যের বুকে আঘাত করে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। দুইহাত মেলে বৃষ্টি ছুঁয়ে দিতে চাইলো। পরিধানে তার নীল সুতি শাড়ি। নয়না শাড়ির আঁচল দিয়ে শরীর ভালোভাবে ঢেকে নিলো। জুতা জোড়া হাতে নিয়ে ধীরগতিতে হাঁটতে শুরু করলো। সে অপেক্ষা করছে তূর্যের৷ বৃষ্টির মধ্যে তূর্যের পাশাপাশি হাঁটলে মন্দ হবে না। অবশ্য যে কোনো মৌসুমেই নয়না তার প্রেমিক পুরুষের সঙ্গ আশা করে। কেননা তূর্যই এখন তার মনে প্রাণে সবটা জুড়ে আছে।
তূর্য নয়নার মনোভাব বুঝতে পারলো। গাড়ি লক করে নিজেও বের হয়ে নয়নার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো। তার মুখের হাসি আজ সরছেই না। কিছুক্ষণ পর নয়নার হাত ধরলো, নয়না সেদিকে তাকালে তূর্য বলল,” সিনেমার মতো তো আর নেচে গেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারব না। আমরা না হয় হাতে হাত রেখে বৃষ্টির তালে পথ চলি!”

নয়না কিছু বলল না। সময়টা উপভোগ করলো। তূর্য খালি গলায় গান ধরলো,
“আগে কত বৃষ্টি যে দেখেছি শ্রাবণে
জাগেনি তো এতো আশা,
ভালোবাসা এ মনে
সে বৃষ্টি ভেজা পায়ে
সামনে এলে হায় ফোটে কামিনী,
আজ ভিজতে ভালো লাগে
শূণ্য মনে জাগে প্রেমের কাহিনী”

——————————-

একঝাঁক বৃষ্টি ঝড়ার পর পুরো পৃথিবী শীতল হলো। মানুষের চলাচল আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করলো। সদর হাসপাতালে ইমারজেন্সী বিভাগে আজ রোগীর সংখ্যা কম। মাহিন ও মিনহাজ কাজ না থাকায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল। অবশ্য পাঁচ মিনিট পূর্বেই রাউন্ডে দুইজন রোগীদের অবস্থা দেখে এসেছে। দুই বন্ধু খোশালাপনে ব্যস্ত তখনই বাশার ইমারজেন্সী বিভাগে প্রবেশ করলো। তার শরীরের ক্ষত অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। মাহিন মিনহাজ দ্রুত এগিয়ে এসে বিনাবাক্যে চিকিৎসা প্রদান করতে শুরু করলো। কাজের ফাঁকে বাশারের পরিচয়, কীভাবে আঘাত পেলো ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চাইলো কিন্তু আশানুরূপ কোনো প্রত্ত্যুত্তর পেলো না। কাজ শেষে বাশার এদিক সেদিক তাকিয়ে তূর্যকে খুঁজতে শুরু করলো। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, নয়না তূর্যের সাথেই আছে। আজ যদি এখানে তাকে না পায় তো বুঝে নিবে তূর্যের সাথেই নয়নাকে সে দেখেছে। বাশারের চোরা চোখে তাকানোটা মিনহাজ খেয়াল করলো সে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,” কাউকে খুঁজছেন? ”

বাশার তখন উত্তর দিলো,” আপনাদের সহকর্মী তূর্যকে দেখছি না! উনি কী আসেনি?”

মাহিনের ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। এতোক্ষণ ব্যাটাকে এতো এতো প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পেলো না। যদিও মুখ খুলল সাথে সাথেই তূর্যের কথা জিজ্ঞেস করলো! আকস্মিক মাহিনের চোখজোড়া চাঞ্চল্য রূপ ধারণ করলো। বাশারের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ে বলল,” আপনার নাম কী বাশার?”

অপরিচিত মানুষের মুখে নিজের নাম শুনে ভয় পেলো বাশার। ইতস্তত হয়ে বলল,” আপনি কীভাবে জানলেন?”

মাহিন ও মিনহাজের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। দুইজনেই এগিয়ে আসলো বাশারের একদম কাছে। কপালের ব্যান্ডেজ ছুয়ে দেয়ার বাহানায় মিনহাজ বলল,” তুই হাসপাতালে আসবি চিকিৎসার জন্য, গোয়েন্দাগিরি করগে আসবি কেনো? আজই শেষ, আর কোনোদিন যদি হাসপাতালের আশেপাশে দেখেছি তো পেট কে’টে কলিজা, কিডনি সব বের করে রেখে দিবো।”

প্রকাশ্যে হু’ম’কি ধমকি শুনে বাশারের গলা শুঁকিয়ে এলো। কয়েকবার শুঁকনো ঢোক গিলে মিথ্যা হেসে বলল,” আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করেছিলাম। আজ আসি হ্যাঁ!”

বাশার চলে যেতে নিলে মাহিন ডেকে উঠলো,” ঐ ব্যাটা, টাকা দিবে কে?”

পকেট খালি, টাকা পাবে কোথায় বাশার! সে তো গোয়েন্দাগিরি করতেই এসেছিলো কে জানতো এদের পাল্লায় পড়বে?
” টাকা তো আনিনি।”

মিনহাজ কথাটা শুনে বাঁকা হাসলো। দারোয়ান ভাই ব্রাদার্সদের ডেকে এনে উত্তম মাধ্যম দিলো।
————————

রাত বারোটা বাজে পয়তাল্লিশ মিনিট। লিভিং রুমে তূর্য ও মাহবুব শিকদার ছাড়া কেউ নেই। নয়না ঘুমিয়ে পড়েছে। দুজনের মধ্যে নীরবতা বিরাজমান। মাহবুব শিকদার ঘুমে ঢুলছে কিন্তু তূর্যের জন্য উঠে যেতে পারছে না। সে জানে তার একমাত্র ভাইপো কথা শেষ না করে তাকে উঠতে দিবে না। সেই কখন থেকে তূর্য আমতা আমতা করছে কিন্তু মূল কথাই বলছে না। অগত্যা মাহবুব শিকদার ঝিমাচ্ছে। বাবা সমেত চাচাকে কীভাবে নিজের বিয়ের কথা বলবে অনেক্ষণ যাবত ভাবছে,তূর্য। সে জানে মাহবুব শিকদার নয়নাকে খুব স্নেহ করে। একদিন তিনিই নয়নাকে বিয়ে করার জন্য তূর্যকে বলেছিল কিন্তু তূর্যই মানা করে দিয়েছিল। আজ সে কীভাবে বলবে? কিন্তু তূর্যকে তো বলতেই হবে, নয়তো আজ যা ঘটেছে! মিনহাজ এগারোটার দিকে তূর্যকে ফোন করে বাশারের কথা জানিয়ে দিয়েছে। তূর্য ভেবেছিল পরের মাসে ধীরচিত্তে বিয়েটা সেড়ে নিবে কিন্তু এখন আর তা করবে না। আকস্মিক সে মাহবুব শিকদারের উদ্দেশে বলল,” আমি আজই নয়নাকে বিয়ে করতে চাই, চাচ্চু।”

মাহবুব শিকদারের শরীর ঝাঁকিয়ে সোজা হয়ে বসলো। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে বলল,” এই রাতে তোর বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে?”

” সময়ের কাজ সময়ে করা ভালো। তুমি ব্যবস্থা করবে? নাকি কাজী অফিসের দিকে যাবো।”

বোম ফাটানো খবর শুনে কী আর মাহবুব শিকদার স্থির থাকতে পারবে? সে জানে, তার ভাইপো কেমন প্রজাতির মানুষ! মুখে যা বলবে তাই-ই করে ছাড়বে। অগত্যা মুঠোফোন বের করে কাউকে ফোন করার ফাঁকে উত্তর দিলো, ” তুই-ই বংশের নাম উজ্জ্বল করবি।”

—————————–

রাত আড়াইটা বাজে মিনহাজ ও মাহিন ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে তূর্যের বড়ি আসলো। দুইজনের থেকে ভাবনা খুবই এক্সাইটেড হয়ে আছে। তার চোখ মুখ চিকচিক করছে আনন্দে। বাড়িতে প্রবেশ করেই মাহিন ও মিনহাজ সোফায় লুটিয়ে পড়লো। ভাবনা তা দেখে কোমরে হাত রেখে বলল,” তোরা বন্ধুর বিয়েছে আনন্দ করতে এসেছিস নাকি ঘুমাতে এসেছিস?”

মাহিন কোনোমতে উত্তর দিলো,” ঘুমাতে এসেছি, যা ডিসটার্ব করবি না।”

ভাবনা ভেংচি কেটে ধেই ধেই করে উপরে উঠে আসলো। নয়না নিশ্চিত মনে ঘুমাচ্ছে। এদিকে তূর্য যে তার বিয়ের সানাই বাজিয়ে ধেয়ে আসছে তার খবর নেই। ভাবনা নয়নার ঘরের সামনে এসে দরজায় করাঘাত করলো। কিছুক্ষণ পর ঘুম ঘুম চোখে নয়না দরজা খুলে ভাবনাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভরকে গেলো। মুচকি হেসে ভাবনা ঘরে প্রবেশ করে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। গতকাল শপিং করে নিয়ে আসা জামাগুলোর মধ্য থেকে একটি লং সাদা গোলাপি সংমিশ্রণের থ্রি পিস নিয়ে নয়নার হাতি ধরিয়ে দিলো।নয়নাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঠেলে বাথরুমে প্রবেশ করালো। বাহিরে দাড়িয়ে থেকে বলল,” বেশি দেরি করো না,নয়না! একজনের তর আর সইছে না। শেষে তোমার দেখা না পেয়ে বিরহে ম’রে যাবে।”

সময় নিয়ে নয়না বের হলো। ভাবনা পূর্বের মতো নয়নাকে টেনে বিছানায় বসালো। নিজের ব্যাগ থেকে কাজল, লিপস্টিক বের করে ঝটপট লাগিয়ে দিলো। নয়নাকে এতোটুকুতেই অপূর্ব লাগছে। এরমধ্যে তূর্য নয়নার ঘরে প্রবেশ করলো। সাদা কাপড়ে স্নিগ্ধময়ীকে দেখে বুকের বাম পাশটায় হাত রাখলো। নয়না বোকা বোকা চোখে চেয়েই রইলো।তূর্য নয়নার কাছে এসে যখন বলল, ” চলো,নয়ন!”
নয়নার তখন খেয়াল হলো। সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বলল,” এতো রাতে কোথায় যাবো?”
” বিয়ে করতে।”
কতো বড়ো কথা কিন্তু বলেছে কতো স্বাভাবিকভাবে তূর্য। নয়নার কর্ণধার যেন ভুল শুনেছে সে পুনরায় সঠিক বাক্য শোনার প্রয়াস করে বলল,” কী বললে?”
তূর্য শান্ত স্বরে বলল,” যা শুনলে তাই, চলো!”
” মজা করছো? কথা বার্তা কিছুই হলো না, হঠাৎ বিয়ে!”
তূর্য নয়নার চোখে চোখ রাখলো। হাতে হাত রেখে বলল,” আমায় বিশ্বাস করো তো, নয়ন!”

সম্মোহনী দৃষ্টিতে নয়না উত্তর দিলো,” হুম!”
” বিয়ে জিনিসটা ধীরে সুস্থে আগাতে হয় কিন্তু আমার হাতে তেমন সময় নেই। তোমার পরিজন যেকোনো মুহূর্তে আমার কাছ থেকে তোমাকে নিয়ে যেতে চাইবে। আমার কোনো রাইট নেই তোমাকে নিজের কাছে আটকে রাখার। কিন্তু আজ যদি আমাদের বিয়ে হয়, তবে তোমাকে নিজের কাছে রাখার পুরো রাইট থাকবে।”

নয়না কী করবে বুঝতে পারছে না। সে কোনোভাবেই ঐ নরকে ফেরত যেতে চায় না। বাশার নামক কিটের সামনে পড়তে চায় না। এদিকে তূর্য, যাকে সে জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। প্রতিটি মেয়েই তূর্যের মতো ছেলে চায় নয়নাও তূর্যকে মনে প্রাণে চায় কিন্তু এভাবে! ভাবনায় বিভোর থাকা নয়না আকস্মিক হাওয়ায় ভাসতে শুরু করলো। তূর্য নয়নাকে কোলে তুলে হাঁটতে শুরু করলো। নয়না ছটফট করছে, এভাবে কী কেউ কাউকে বিয়ে করে! তূর্য শান্ত স্বরে বলল, ” বড্ড ছটফট করেন, মিস নয়ন!””
” তাতে তোমার কী?”
” আমার সমস্যা নেই, তবে আপনি ব্যথা পেলে পুনরায় রোগী ফেলে আপনার কাছে বসে থাকতে হবে,এই রিক্স আমি নিচ্ছি না। তবে এরচেয়ে বড়ো রিক্স নেয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। বি রেডি মাই লেডি! সারাজীবনের জন্য তূর্যের হওয়ার জন্য তৈরী তো!”

লাজরাঙা গাল অস্পষ্ট থাকলো, নয়নার চিবুক নত অবস্থায় বলল, ” ডাক্তার মানুষ এতোটা নির্লজ্জ কীভাবে হয়?”

নয়নার বিড়বিড় আওয়াজ তূর্যের কানে প্রবেশ ঠিকই করল কিন্তু কোনো ভাবান্তর হলো না।
সোফায় মাহবুব শিকদার সহ আরো একজন লোককে বসারত অবস্থায় দেখতে পেলো নয়না। তূর্য দোতলায় পৌছাতেই নয়নাকে নামিয়ে দিয়েছে। বড়োদের সামনে অসভ্যতার ট্যাগ লাগাতে চায় না তারা।
তূর্য ও নয়নাকে পাশাপাশি বসানো হলো। ভাবনা এসে সর্বপ্রথম মাহিন ও মিনহাজের পশ্চাৎদেশের লাথি মেরে জাগালো। দুইটার দিকে তাকি বিশ্রী গালি দিলো। মাহবুব শিকদারকে এতোক্ষণ মাহিন ও মিনহাজ খেয়াল করেনি। তাকে দেখা মাত্রই তাড়াহুড়ো করে সোফা ছেড়ে সটান হয়ে দাড়িয়ে রইলো।

চারজন মনুষের উপস্থিতিতে নয়না ও তূর্যের বিয়ে সম্পন্ন হলো। নয়না পুরোটা সময়ে নিশ্চুপ ছিলো। বিয়ের সময়ে প্রতিটা মেয়েরই অভিভাবক পাশে থাকে অথচ নয়নার কী ভাগ্য! বাবা মা কী! চার কুলে কেউ নেই। কথাগুলো মনে হতেই কান্নায় ভেঙে পরে নয়না। তূর্য নয়নাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নয়নার হাতে হাত রেখে বলল,” খারাপ লাগছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”

নয়না নাক টেনে উত্তর দিলো,” বাবার কথা খুব মনে পড়ছে, তূর্য!”

তূর্য মুচকি হাসলো। নয়নার হাত শক্ত করে ধরে বলল,” মনে তো পড়বেই, নয়ন! কেননা তুমি আজ আঙ্কেলের শেষ আশা পূরণ করেছো।”

নয়না বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে মাথা তুলে তাকালো। চোখে মুখে তার প্রশ্নের ছাপ! মাহবুব শিকদার কাজীকে এগিয়ে দিয়ে এসে তূর্যের শেষোক্ত কথা শুনে বলল,” তোমার বাবার আইসিইউ থাকাকালীন সেন্স ফিরে আসে। তিনি আমাকে কিছু বলতে চাইছিল। তোমার বাবার অবস্থাও আশংকাজনক ছিলো।শেষ কোনো আশা আছে কী না তা জানার জন্য অক্সিজেন মাক্স খুলে দেই। তখন উনি আমাকে বলেছিলে, যেন তোমাকে দেখে রাখি। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই মনে মনে তূর্যের জন্য পছন্দ করেছিলাম। তোমার বাবার কথা শুনে আমার আরজিও জানাই। তখন তিনিও সায় প্রদান করেন। এরপরই পাঁচ মিনিটের মাথায় উনি মৃত্যু বরণ করেন।”

বাবার মৃত্যুর ঘটনা শুনে নয়না ভেঙে পড়লো। তূর্য নয়নার মাথা চেপে বুকে ঠেকিয়ে বলল,” থামো নয়ন! তোমার কান্না আমার বক্ষস্থলে ক্ষতের সৃষ্টি করছে।”

নয়না তো কান্না থামালোই না উলটো অজ্ঞান হয়ে গেলো। তূর্য পালস চেক করে পাঁজা কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেলো।”

——————————-
সকালের কিরণ চোখে পড়তেই নয়নার ঘুম ভেঙে গেলো। আড়মোড়ে উঠতে নিলে খেয়াল হলো সে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে আছে। নড়াচড়া করার জো নেই তার। এমনভাবে মানুষটা আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই নয়না পালিয়ে যাবে। নয়না খেয়াল করলো, জড়িয়ে ধরে রাখা মানুষটার শরীর থেকে চেনা পরিচিত ঘ্রাণ পাচ্ছে। পরমুহূর্তে নয়নার শেষ রাতের কথা স্বরণে আসে। তূর্যের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। এখন সে আর একা নয়, তূর্য নামক পুরুষটিও তার জীবনে জড়িয়ে গেছে। নয়নার নড়াচড়ায় তূর্যের ঘুম হালকা হয়ে গেলো। সে নয়নার মাথা বুকের মধ্যে চেপে রেখে ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,” ঘুমাও তো বউ! তোমার চিন্তায় সারারাত বসে ছিলাম, এবার আমার জন্য সারাদিন বসে থাকবে।”

লজ্জায় নয়না তূর্যের বুকে চুপটি করে শুয়ে রইলো। অস্বাভাবিক নিঃশ্বাস আটকে রাখার মিথ্যা প্রয়াস করলো কিন্তু নিঃশ্বাস আটকে রেখে কতক্ষণই বা থাকবে! অস্বস্তিতে যখন নয়না ছটফট করতে শুরু করলো তখন তূর্য বিরক্তির স্বরে বলল,” সমস্যাটা কী, নয়ন?”
” ছাড়ো তো!”
” না ছাড়লে কী ফাঁ’সি’র দড়িতে ঝুলাবে?”
নয়না তূর্যের বুকে কিল বসিয়ে বলল,” এসব কেমন কথা?”
” তাহলে কী বলবো, রোমান্টিক কথাবার্তা? বললে কী তুমি শুনতে পারবে?”

” তুমি একটা!”
নয়নার কথা অসম্পূর্ণ অবস্থায় তূর্য বলল,” পাগল, ডাক্তার।”

নয়না এবার খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো। সেই হাসিতে মুগ্ধ তূর্য। নয়নার দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো।

চলবে………

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-২৪

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: চব্বিশ

বিগত পনেরো দিনের ধকল কাটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো বাশার। এক লক্ষ টাকা পরিশোধ করতে কতো কিছু করতে হয়েছে তাকে। তার উপর মাসুদার আবদার পূরণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু প্রবাদটির মর্মার্থ বাশার প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছে। এখন তার বাড়িতে যেতে ভালো লাগে না। সারাদিন পথে ঘাটে ঘুড়ে বেড়ায়, গভীররাতে বাড়িতে ঢুকে। গাজীপুরের রেলওয়ের পাশেই মন্দির। মন্দিরের সামনের গেইটের পাশে কালিদাস নামক একজন দাদা নিমকি বিক্রি করে। এই ব্যবসা তাদের পূর্বপুরুষ থেকে চলে আসছে। বাশার বিশ টাকার নিমকি কিনে নিলো, তার মনে পড়ে গেলো নয়নার কথা। প্রথম প্রথম নয়না বাশারকে ভাই ভাই বলে বেড়াতো। একদিন বাশার ঘরে বসে ফুল সাউন্ডে গান শুনছিল।নয়না কোথায় থেকে বাশারের ঘরে আসলো। বাশারের কাছে এসে বললো,” আমাকে নিমকি কিনে দিবে,বাশার ভাই?”

বিরক্তির সাথে বাশার সেদিন উত্তর দিয়েছিল,” জ্বালাস না তো, নয়না!”

নয়না হাত জোর করে বাশারের কাছে নিমকি কিনে দেয়ার জন্য বললো। বাশারের শরীরে ঝাকিয়ে অনুরোধ করলো। ততক্ষণে বাশার সাউন্ড বন্ধ করে নয়নার দিকে ফিরলো। গলায় ওড়না পরিহিতা নয়নার শরীরের গঠন সেদিনই চোখে পড়লো। বাশারের কামোত্তেজনার শুরু হয় নয়নাকে দেখে। সেদিন বাশার এখান থেকে নিমকি নিয়ে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু বিনিময়ে নয়নার শরীরের অঙ্গের ভাঁজে হাত ঘুরাতো সে, চক্ষু দিয়ে গিলে খেতো নয়নার শরীরকে। নয়না প্রথম প্রথম না বুঝলেও পরবর্তীতে বুঝে গেলো। আপাদমস্তক ঢেকে চলাফেরা শুরু করলো। বাশারের কুদৃষ্টি থেমে গেলো। বাশার পরবর্তীতে প্রকাশ্যে নয়নাকে শয্যাসঙ্গীর আহ্বান জানালো। সময়ে অসময়ে নয়নার গা ছুঁয়ে দিতে চাইতো। না জানে, মেয়েটা কোথায়,কী অবস্থাতে আছে! নয়নার কথা স্বরণে আসতে বাশারের শরীরের শিরা উপশিরা টগবগ করে উঠে। নয়নাকে শয্যাশায়ী করার ইচ্ছে জেগে উঠে। নিমকি খেতে খেতে দুই হাত দূরে টপস প্যান্ট পরিহিতা যুবতীর দিকে চোখ যায় বাশারের। মাথা থেকে পা পর্যন্ত বারবার ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে সে। একসময় মেয়েটি দুইজন ছেলে সমেত বাশারের সামনে দাঁড়ালো। বাশারের গাল বরাবর দুইটা থাপ্পড় দিয়ে মেয়েটি বললো,” মেয়ে মানুষ দেখলেই চোখ দিয়ে গিলতে মনে চায় তাইনা? আমি কিছুক্ষণ ধরে এই লোকটার কার্যক্রম লক্ষ্য করছি। একবার আমার দিকে তো একবার অন্য নারীর দিকে বাজেভাবে তাকাচ্ছে। ইচ্ছে তো করছে আরো কয়েকটা লাগাতে।”

মেয়েটার কথা শেষ হলো। আশেপাশে মানুষজন জড়ো হলো। বাশার ঘাবড়ে গিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে মুখ খোলার আগে পাশ থেকে একজন ছেলে বলে উঠলো,” তোদের মতো মানুষদের জন্য আজ গোটা পুরুষ জাতি খারাপ।”

বাশার রাগে গজগজ করতে শুরু করলো। একটা সময় আসে, যখন আমাদের প্রচুর রাগ হয় এবং সেটা কাঙ্খিত মানুষের উপর ঝাড়তে না পারি তখন সেই রাগ অন্যের উপর বর্তাতে দ্বিধাবোধ করি না। বাশারের ক্ষেত্রেও তেমন কিছু ঘটেছে। বাড়ির রাগ সে বাহিরে ঝাড়তে শুরু করে দিলো। দুই এক লোকের কথার প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” তাকাইছি তো কী হইছে? তোর মায়ের দিকে তো তাকাই নাই, যা ভাগ!”

লোকসমাগমে ভুল একটা কথা বলা মানেই ভয়ংকর কিছু। বাশারের কথা দশজন লোকের পছন্দ হলো না। কথার প্রেক্ষিতে কথায় হাতাহাতি পর্যায়ে চলে গেলো। বাশার মাঝ রাস্তায় জনগণের মা’র খেলো।
আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা ফ্রীতে বিনোদন নিতে পছন্দ করে, আরেক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা কোলাহলমুক্ত থাকতে পছন্দ করে। বাশারকে কিছু মানুষ ফ্রীতে মা’র দিলো, কিছু মানুষ এসে বিষয়টি মিটমাট করে ছাড়িয়ে দিলো।

ব্যাথায় জর্জরিত বাশার খুঁড়িয়ে চলছে, মুখে তার অকথ্য ভাষা রয়েছেই। রেললাইনের পাশে সুরমা রেস্তোরাঁ অবস্থিত, আকস্মিক বাশার হাস্যজ্বল নয়নাকে দেখতে পেলো। বাশারের চোখের সামনেই কোনো একজন ছেলের সাথে রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলো। বাশারের পরিবারকে চিন্তায় ফেলে নয়না নাকি একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে? বাশার নয়নাকে অন্য ছেলের হতেই দিবে না। সে আজ নয়নাকে পেলে চরম শিক্ষা দিবে, যা নয়না কোনোদিনও ভুলতে পারবে না। রাস্তার অপরপ্রান্ত থেকে আসতে আসতেই নয়নার গাড়িটা ছেড়ে দিলো। বাশার পিছু পিছু কিছুদূর দৌড়ে এসেও গাড়িটা নাগালে পেলো না। বাশার রাস্তার দিকে তাকিয়ে কটমট সুরে বলল,” একবার তোকে পেয়ে নেই, নয়না! তোর জীবনের সব রঙে পানি ঢেলে দিবো।”

পরমুহূর্তে কিছু একটা স্বরণে আসতেই চোখমুখ চিকচিক করে উঠে বাশারের। সে একটি রিকশা ডেকে উঠে পড়লো,রিকশাওয়ালা জায়গা জিজ্ঞেস করায় বলল,” গাজীপুর সদর হাসপাতালের দিকে নিয়ে যান, মামা।”

——————————–

ভালোবাসার অতলে ডুবে গেলে অপ্রিয়রাও প্রিয় হয়ে যায়। ডানা মেলে আকাশে উড়তে ইচ্ছে হয়! ভালোবাসার মানুষটির কথা ভেবে আনমনে হাসতে ইচ্ছে হয়! উত্তরার বড়ো একটি রেস্টুরেন্টে নয়না বসে তূর্যের কথাই ভাবছে। পাগল ছেলেটা নয়নাকে নিয়ে জনসম্মুখে না বসে প্রাইভেট রুমে বসিয়ে রেখেছে। তার চিন্তা চেতন এমন যে, নয়নাকে বাহিরের কেউ দেখতে পারবে না। কতোটা পাগলাটে হলে তূর্য এমন করে! এসব ভেবে মুখে নয়নার মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে। তূর্য নয়নাকে বসিয়ে রেখে কোথায় যেনো গেলো, নয়নাও সময় পেলো তার পছন্দের মানুষটাকে নিয়ে ভাবার। সময় অতিবাহিত হচ্ছে, তূর্যের ফেরার নাম নেই। নয়নার এবার চিন্তা হচ্ছে কিছুটা।
নয়না উঠতে যাবে তখনই তূর্যের আগমন ঘটলো একগুচ্ছ গোলাপের তোড়া হাতে। নয়না বাকরুদ্ধ হয়ে রইলো, তূর্য নয়নার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে বলল,” আমার ফুলের জন্য একগুচ্ছ ফুল। আমাকে বিয়ে করবে, নয়ন!”

টেলিভিশন, সিনেমায় নয়না ফুলের সমাহার দেখতো। বাস্তবে আজ দেখে আবেগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। কান্না করে দিলো। নয়নার ইচ্ছে করছে তূর্যকে একবার জড়িয়ে ধরতে কিন্তু সম্পর্কের জোর নেই বলে ধরলো না। ফুলের তোড়ায় মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। তূর্য প্রেয়সীর কান্না দেখে থতমত খেয়ে গেলো। নয়নাকে স্বান্তনা কীভাবে দিবে বুঝতে পারলো না। এমনিতেও সে নয়নার অনুমতি ছাড়া তাকে স্পর্শ করে না। নয়নার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েও গুটিয়ে নিচ্ছে বারবার তূর্য। নয়না তা দেখে ফুলোর তোড়া তাদের মাঝখানে রেখে মাথা এলিয়ে দিলো তূর্যের বুকে। তূর্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে রইলো। নয়নার কান্না তার বুকে এসে লাগছে। সে কী ভুল কিছু বলেছে? নয়নার মনে কী কষ্ট দিয়েছে? নয়নার কী সম্মতি নেই? যদি এমনই হয়, তবে তূর্য তো জীবিত থেকেও ম’রে যাবে। নয়নাই তার জীবনের প্রথম ভালোলাগা। একজন সাধারণ মেয়ে তূর্যের চোখে অসাধারণ হয়ে উঠা। তূর্যের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নয়নার চোখের অশ্রু তার কাছে বিষক্রিয়া মনে হচ্ছে। তূর্যের এক্ষুনি সেই বিষক্রিয়া পান করে ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে।

নয়নার মাথায় হাত রেখে তূর্য চোখ বন্ধ করে রইলো। সময় নিয়ে নরম স্বরে বলল,” কান্না করে না, লক্ষীটি!”

নয়না তূর্যের বাহুডোর থেকে সরে আসতে চাইলে তূর্য বাঁধা প্রদান করলো। নয়নার মাথা শক্তকরে বুকে চেপে ধরলো সে। ধীর কণ্ঠে বলল,” এ বুকের তোলপাড় কার জন্য জানো, নয়ন? এ বুকের স্থানটা কার জন্য জানো কী? আমি বলছি, এ বুকের প্রতিটা বিট দ্রুত হয় একজনের কাছেই আসলে। আর সে হচ্ছে, নয়ন! আমার নয়ন, যার কাছে আমি অন্য এক তূর্য।”

নয়না নাক টেনে উত্তর দিলো,” এতো ভালোবাসা কেন দিচ্ছো, তূর্য?”
” কারণ তুমি তূর্যের ভালোবাসার প্রাপ্য।”
” আমার তো ভয় হয়!”
” আমি আছি তো!”
” যদি বাশার,,,,

তূর্য নয়নার মুখ তুলে ধরলো। তূর্যের নিশ্বাস নয়নার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। নয়নার চোখের অশ্রু মুছে তূর্য বলল,” তোমার অতীত যতোটা ভয়ংকর, বর্তমান ততোটা সুন্দর; ভবিষ্যৎ আমার জন্য তুলে রাখো। আমি তোমার সকল সময়ে বিচরণ করতে চাই!”

নয়না এক দৃষ্টিতে তূর্যকে দেখছে। এতো কাছাকাছি একই প্রথম তার দেখা। তূর্য ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে। নিজেকে প্রাণপণে নিয়ন্ত্রণে রাখছে কিন্তু পারলে তো! দিনশেষে সেও তো পুরুষ! নয়নার চঞ্চলতা ভরা চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,” একটু পঁচা কাজ করি, একটু! ব্যাথা পাবে না।”

নয়না কিছু বুঝার আগে তূর্য নয়নার কপালে শক্তকরে চুমু খেলো। কতক্ষণ তূর্য ও নয়না এভাবে ছিলো জানা নেই। নয়না সরে যেতে চাইলেও তূর্য শক্তকরে ধরে রাখলো। যেন ছেড়ে দিলেই নয়না পালিয়ে যাবে।

দুইজন সুখী মানব মানবীর সুখের গল্প ধারাবাহিকতায় চলবে নাকি বাশার নামক কুৎসিত প্রকৃতির মানুষের আগমন ঘটবে, তা সময়ই বলে দিবে।

চলবে……………………

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-২২+২৩

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: বাইশ

সন্ধ্যা নামতে বেশি সময় বাকী নেই। এতো সময় কীভাবে পেরিয়ে গেলো নয়না বুঝতেই পারেনি। মেয়েরা যেভাবে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় কান্না করে নয়না ঠিক সেভাবেই কান্না করছে। তূর্য অধৈর্য চিত্তে সোফায় মারুফের সাথে বসে ছটফট করছে। মিছিলদের বাড়িতে নয়না সেইদিনই না এলো! এতো তাড়াতাড়ি দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেছে! এই তো সেদিন ধুমধামে মিছিলদের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হলো। নয়নার সেদিন আনন্দ দেখে কে! মিছিলের সাথে সাথে সেও চঞ্চলা পাখির মতো উড়ছিল। সারাবাড়ির আনাচে কানাচে নয়না মিছিলের হাস্য ধ্বনি বাজছিল। এতো তাড়াতাড়িই সময় ফুরিয়ে গেলো! নয়না ভেবেছিল সে এখানেই থাকবে কিন্তু তার ধারণায় এক বালতি পানি ঢেলে তূর্য সকাল থেকে এসে বসে আছে। নয়না যাবে না বলার উত্তরে শান্ত স্বরে বলেছে, ” এই বাড়ির ঠিকানা তোমার পরিবার জানে। আমি চাই না তারা তোমাকে খুঁজে বের করে আবারও সেই নরকে নিয়ে যাক।”

তূর্যের কথায় মিছিলের পরিবার সবাই সহমত পোষণ করলো। এসব দেখে মিছিল বেজায় ক্ষেপে গেলো। বিদায়ের সময়ে নয়নার সাথে মিছিলেরও সেই কী কান্না! দুই বান্ধবীর কান্নায় কোরবানি হচ্ছে পুরো পরিবার। মারুফের স্ত্রী হেনার মনটাও খারাপ।
এই কান্নার শেষ নেই তূর্য বুঝে গেছে। এক প্রকার অধৈর্য হয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। নয়নার কাছে এসে বলল,” মন হচ্ছে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছো। আমাকে কী এখন বলাতে চাচ্ছো যে, বউ কান্না করো না আগামীকাল তো নিয়েই আসবো। আমার কিন্তু কথাগুলো বলতে কোনো সমস্যা নাই।”

তূর্যের কথা শেষ হতেই সারাঘরে হাসির রোল পড়লো।
নয়না কটমট চোখে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্যের এই মুহূর্তে ফাজলামো করতে ইচ্ছে করছে! নয়নার দুঃখ বুঝতে চাইছে না! তূর্য দাঁত বের করে হেসে বলল,” চলো বউ!”

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। নয়না নাক টেনে টেনে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। তূর্য নয়নার দুঃখে ঘি ঢালার জন্য টিস্যু এগিয়ে দিলো। নয়না তাতে তেতে উঠে তূর্যের পিঠে কিল বসিয়ে বলল,” মজা হচ্ছে! আমার দুঃখে আনন্দ পাচ্ছো? থাকবো না তোমার সাথে। গাড়ি থামাও, আমি থাকবো না তোমার সাথে।”

চলন্ত গাড়ি জোরে ব্রেক কষলো তূর্য। চোখ মুখ তার রক্তিম হয়ে গেলো মুহূর্তেই। নয়নার দিকে ফিরে দুই বাহু শক্তকরে ধরে বলল,” তুমি কী চাও, আমি নিঃশেষ হয়ে যাই! এই মেয়ে, আমাকে বুঝো না কেনো! তোমাকে সময় কাটানোর জন্য সাথে রাখিনি, তোমাকে ভালোবাসি, সারাজীবনের জন্য নিজের করে রাখতে চাই, ড্যাম ইট!”

তূর্যের উঁচু আওয়াজ শুনে চমকে উঠে নয়না। আঁখি জোড়ায় নেমে আসে অবাধ্য অশ্রুকণা! হেঁচকি তুলে কান্না করতে থাকে মেয়েটা। তূর্য স্টিয়ারিংয়ের উপর হাত দ্বারা আঘাত করে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলো। সে নয়নাকে এভাবে কষ্ট দিতে চায়নি। নয়না তাকে ছেড়ে চলে যাবে শুনেই তো রাগ হয়েছিল। নয়নার দুই গালে হাত রেখে কান্না থামাতে চেষ্টা করলো তূর্য,” আ’ম সরি, লক্ষীটি! রাগটা কন্ট্রোল করতে পারিনি। আমি কী করবো, জড়িয়ে ধরবো? না থাক, তুমি কী মনে করবে। কান্না থামাও নাহলে, নাহলে!”

নয়না তূর্যে হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তাতে কপাল ঠেকালো। ক্ষনে ক্ষনে হেঁচকি তুলছে সে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মাথা তুলে বলল,” এতো সুখ আমার কপালে সইবে না,তূর্য! আমাকে কেন এতো ভালোবাসেন, বলবেন? আমি তো সাধারণ একজন মেয়ে, আপনার মতো ডাক্তারের জন্য অন্য কেউ…..!

নয়না কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না তার আগেই তার ঠোঁট জোড়ায় তূর্য আঙুল রেখে বলল,” হুঁশ! আমার অন্য কাউকে নয়, তোমাকে প্রয়োজন নয়ন! প্লিজ আমার হয়ে যাও, নয়ন!”

নয়না অপলক দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। সময়ের হিসাব তার অজানা, আপাতত এভাবেই সময় চলুক। কে জানে! আগামীকাল যদি এই সময় না পাওয়া যায়!

প্রায় বিশ মিনিট পর নয়না দেখতে পেলো গাড়ি ভাবনার বাড়ির রাস্তায় না ঢুকে অন্যদিকে যাচ্ছে। প্রশ্নবোধক চাহনিতে নয়না তূর্যের দিকে তাকালে হেসে ফেললো তূর্য। ডান পাশে মোড় ঘুরিয়ে বলল,” তোমার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি, নয়ন।”

নয়না কী বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। এই লোকটা এতোটা ঠোঁটকাটা স্বভাবের কেনো? ভালোভাবে বললে কী হচ্ছিলো না! বলতেই তো পারতো যে,’ নয়না, আমাদের বাড়ি,গাড়ি, দেয়াল, ড্রায়ার সব দেখাবে নিয়ে যাচ্ছি।’ তা না বলে ডিরেক্ট শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কথা! অসভ্য, নির্লজ্জ ডাক্তার। মনে মনে শত কথা আওড়ালেও জোরে বলতে পারলো না নয়না।
গাজীপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সাত কিলোমিটার দূরে মারতা বাজার অবস্থিত। বাজার থেকে ডানে মোড় টানলো তূর্য। প্রায় দুই মিনিট পর সবুজে ঢাকা একটি বাড়ির গেইটের সামনে এসে গাড়ি থামালো সে। ইশারার নয়নাকে নামতে বলে নিজেও নামলো।

তূর্য এগিয়ে এসে নিজেই গেইট খুলে দিলো। নয়না তূর্যের পিছু পিছু হাঁটছে। বাড়ির আশপাশ দেখে মনে হচ্ছে, বাড়িটি একদম নতুন তৈরি করা হয়েছে। তিন তলা বিশিষ্ট বাড়ির সম্মুখে ছোট ছোট গাছ লাগানো হয়েছে। এখানে নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় কিন্তু কে করে? নয়না আশেপাশে দেখতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে তূর্য তাকে রেখে অনেকটাই সামনে এগিয়ে গেলো। নয়না একপ্রকার দৌড়ে তূর্যকে ধরে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো।
বাহির থেকে যতোটা সাধারণ মনে হয়েছে বাড়ির ভেতরটা ততোই অসাধারণ। আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ির আসবাবপত্র দেখে নয়না মুখ হা করে রইলো। ডুপ্লেক্স বাড়ি নয়নার প্রথম দেখা, মাথার উপর বড়ো ঝাড়বাতি দেখে বিস্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলো। তূর্য সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপর উঠে গিয়েছিল। নয়নাকে থামতে দেখে পিছনে ফিরলো। নয়নার বিস্ময়কর তাকানো দেখে বেশ লাগছিলো তার কাছে তাইতো মুঠোফোন বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।
নয়নার নড়চড় না দেখে বলল,” দেখা হয়েছে? চাচ্চু অপেক্ষা করছে।”

লাজুক হেসে নয়না সিঁড়িতে পা দিলো। তিনলায় পৌঁছে তূর্য সরাসরি দক্ষিণ পাশে চলে গেলো, যেখানে মাহবুব শিকদার বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। নয়না তখনো মাহবুব শিকদারের ব্যপারে অজ্ঞ। ঘরে প্রবেশ করতেই তূর্য ডেকে বলল,” এবার তো কথা বলবে আমার সাথে,চাচ্চু? নাও, তোমার মেয়েকে নিয়ে এসেছি।”

মাহবুব শিকদারকে দেখে নয়নার অবাকের অন্ত নেই। মুখে হাত রেখে বলল,” ডাক্তার আঙ্কেলই তূর্যের চাচা?”

মাহবুব শিকদার এগিয়ে এসে বলল,” হ্যাঁ রে মা! তূর্য তোকে আমার কথা বলেনি?”
নয়না আড়চোখে তূর্যকে দেখে বলল,” বলেছে কিন্তু আপনিই যে চাচ্চু তা বলেনি।”

তূর্যের দিকে মিছে রাগ নিয়ে মাহবুব শিকদার তাকালে সে মাথা চুলকে বলল, ” সেভাবে জিজ্ঞেস করেনি তাই!”

মাহবুব শিকদার বেশি কথা বাড়ালো না। নয়নার উদ্দেশে বলল,” তুমি গিয়ে রেস্ট করো। আমাকে একবার হাসপাতালে যেতে হবে। কিছু লাগলে, তূর্যকে বলো কেমন!”

তূর্য নয়নাকে নিয়ে পশ্চিম পাশটায় এসে দাঁড়ালো। পাশাপাশি দুইঘরের মধ্যে দ্বিতীয় ঘরটার দিকে ইশারা করে বলল,” আজ থেকে এই ঘরে থাকবে, কিন্তু তা কিছুদিনের জন্য।”

নয়না বোকার মতো উত্তর দিলো,” তারপর কী ভাবনা আপুর বাসায় চলে যাবো?”

তূর্য দুষ্ট হেসে নয়নার উদ্দেশে বলল,” না গো, কলিজা! তারপর তো তুমি আমার সাথে থাকবে; বিয়ের পর!”

নয়না চোখ বড়ো করে তূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ডাক্তারটা এতো নির্লজ্জ কেনো?
তূর্য হাসতে হাসতে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে করতে বলল,” হাসপাতালে যেতে হবে, নয়ন! ফ্রেস হয়ে এক কাপ কফি আনবে,প্লিজ? নিচ তলায় বাম পাশে রান্নাঘর!”

তূর্যের হুটহাট আবদারে নয়না আলাদা সুখ অনুভব করে। মানুষটা একটু ঠোঁটকাটা স্বভাবের কিন্তু সে জানে তা নিতান্তই নয়নার কাছেই। তূর্য একান্তই তার পছন্দের পুরুষ, ভালোবাসার পুরুষ। কাউকে ভাগ বসাতে দিবে না, নয়না। নিজের ভাবনায় মুচকি হাসলো নয়না। সেও তূর্যের মতো পাগল হয়ে গেছে।
—————

প্রায় দেড় দিনের মাথায় বাশারকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হয় বোরহান। লজ্জায় তার মাথা কাটা গেছে। নিজের ছেলের বিয়ের ব্যপারেও সে জানতো না। আকলিমা বিশেষ কিছু কখনে জানায় না। এমন একরা বড়ে কাণ্ড ঘটিয়েছে সেটাও জানাতো না যদি টাকার ব্যাপার না হতো! এদিকে নয়না দুই তিন সপ্তাহ থেকে নিখোঁজ। আদৌও বেঁচে আছে কী না কে জানে?
বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাশার সর্বপ্রথম নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। মাসুদা তখন গুনগুন করে গান গাইছিল আর মাথার চুল আঁচড়াচ্ছিল। বাশার কোনো কথা না বলে মাসুদার চুলের মুষ্টি ধরে বাহিরে নিয়ে আসলো। রাগে থরথর করে কাঁপছে সে, এক পর্যায়ে বলতে শুরু করলো,” সেদিন ঐ লোককে টাকা দিলি না কেন, মা’গী। আমাকে পুলিশে নিয়ে গেলো তখনো ফিরালি না কেন? এক্ষুণি টাকা দিবি নয়তো তোকে মেরেই ফেলবো।”

কথা শেষ হতেই বাশার মাসুদাকে মারার জন্য উদ্যোগ নিলে বোরহান বাঁধা দেয়। বাশারের হাত থেকে মাসুদাকে ছাড়িয়ে উলটে বাশারের গালে থাপ্পড় বসায়। আকলিমা তেড়ে আসছিল স্বামীর দিকে বোরহান আকলিমার গালেও থাপ্পড় বসিয়ে চিৎকার করে বলতে শুরু করলো,” তোর জন্য আমার সন্তানরা আজ বিপথে। তোকে করুণা করে বিয়ে করেছিলাম, যেন এই অবৈধ বাচ্চা বৈধতা পায়! নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলাম। কিন্তু আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, আগাছা কেটে দিলে যেমন কিছু গাছ পরিষ্কার হয় না তেমন জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয় না। তুই প্রমাণ করেই দিলি, তোর আর তোর ঐ লম্পট প্রেমিকের রক্ত এই ছেলের শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। ভাবীর কথায় যদি তোকে বিয়ে না করতাম তাহলে পঁচে গলে মরতি। এজন্যই তুই নয়নাকে দেখতে পারিস না,তাই না? মেয়েটাকে মেরে ফেললি তো? দেখেছিস পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না। তোর সামনে তোর পরিবার আজ ছিন্নভিন্ন।”

এতো বছর পর কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়ে আকলিমা দেয়াল ঘেঁষে জমিনে বসে পড়লো। বাশারও স্তব্ধ প্রায়! সে অবৈধ সন্তান, বারবার একথাটাই মস্তিষ্কে ঘুরছে। এতোকিছুর মধ্যে মাসুদা হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। তার আহাজারিতে পড়া প্রতিবেশী এক হয়ে গেলো। কেউ কেউ এসে বাড়ির পরিস্থিতি দেখে প্রশ্ন করলো, ” ব্যাপারটা কী?”
মাসুদা তখন আহাজারি করতে করতে বলল,” আমার স্বামী যৌতুকের টাকা এনে দেইনি বলে, আমাকে বাড়ি থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চাইছে।”

পাড়া প্রতিবেশীরা ছি ছি করতে শুরু করলো।বাশার অবাক হয়ে বলল,” আমি কখন বললাম?”

উত্তরে মাসুদা বাঁকা হাসলো।

চলবে……….

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: তেইশ

তিমিরাচ্ছন্ন পৃথিবী। নিস্তব্ধতায় ঘেরা চারপাশ। বন জঙ্গল থেকে পেঁচা ও শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। আজকাল শেয়াল রাতের সাথে দিনের আলোয়ও লোকালয়ে ঘুরাফেরা করে। চোখের সামনে গল্পের বইয়ে পড়া কাল্পনিক শেয়ালকে দেখে অনেকেই চমকায়, আবার অনেকে ভয়ে উলটে দৌড় লাগায়। নয়নার এই মুহূর্তে কঠিন একটি কাজ করতে ইচ্ছে করছে। ঘন জঙ্গলে এই রাতে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে। একাকী সে কীই বা আর করবে! বারান্দায় বসে গুনগুন করে গান গাইছে। সময়ের হিসাব তার জানা নেই। রাত্রির ঠিক কয়টা বাজে খবর নেই। সন্ধ্যায় তূর্যের কাছে একটা ইমারজেন্সী কল আসায় দ্রুত হাসপাতালে যেতে হয়েছে। কিছুক্ষণ পর মাহবুব শিকদারও চলে যান! সেই থেকেই সে তূর্য ছাড়া একা সময় কাটাচ্ছে। বারান্দার ফ্লোরে মুঠোফোন পড়ে আছে, নয়নার নজর সেদিকেই গেলো। পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর ফোনে আলো জ্বলে উঠছে, নয়না স্মিত হেসে রিসিভ করে কানে ধরলো।অপরপাশ থেকে তাড়াহুড়োর স্বর শোনা গেলো,” এখনে বারান্দায় বসে আছো?”
” হু!”
তূর্য অপরপাশ থেকে ধমকের সুরে বলল,” তুমি কী চাইছো, রোগী রেখে তোমার কাছে চলে আসি! বুঝতে চেষ্টা করো না কেনো লক্ষীটি, আমি শান্তিতে রোগীদের সেবা করতে পারব তখনই যখন তুমি ঠিক থাকবে।”

নয়না মুচকি হাসলো। বারান্দা থেকে ঘরে এসে থাই গ্লাস লাগিয়ে দিলো। বিছানায় আরাম করে শুয়ে বলল,” আমি তো ঠিকই আছি।”
” কোথায় ঠিক থাকলে? একা একা ঠিক থাকা যায়? ডর ভয় নাই নাকি? এই নয়ন, শোনো?”
” হুম, বলো!”
” আমি কী চলে আসবো?”

তূর্যের কথা শুনে নয়না ফিক করে হেসে ফেলল। তূর্য এমনভাবে কথা বলছে যেন নয়না তার বিয়ে করা বউ! নয়না নিজের ভাবনায় থতমত খেয়ে গেলো, লজ্জায় মুখখানা লাল টকটকে হয়ে গেলো। বালিশে মুখ গুঁজে মিনমিন করে বলল,” আমার ঘুম পাচ্ছে, তূর্য!”

তূর্য নিশ্চুপ হয়ে গেলো। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তার মাতাল স্বর ভেসে আসলো,” ঘুমাও,প্রিয়া! তোমার ঘুমের শব্দ শুনে আমি রাত পাড় করি!”
নয়না চোখ খুলে ফেললো। উঁচু আওয়াজ করে বলল,” আশ্চর্য! আমি কী ঘুমের মধ্যে নাক ডাকি নাকি?”

” আশ্চর্যের কিছু নেই, নয়না! স্লিপিং বিউটিকেও খুব সুন্দর লাগছিল তিনি দীর্ঘ শুয়েছিলেন, কখনও বৃদ্ধ হননি এবং তার প্রিন্স চার্মিং পাওয়ার জন্য তাকে নাক ডাকা ছাড়া আর কিছুই করতে হয়নি।”

নয়না উচ্চ স্বরে হাসলো। তূর্যের কথার প্রেক্ষিতে উত্তর দিলো,” তাহলে তো আমারও প্রিন্স চার্মিং এর জন্য নাক ডাকা শুরু করতে হবে!”

” তোমার প্রিন্স তোমাকে এমনিতেই ভালোবাসে। তার জন্য নিজেকে পরিবর্তন নয়, নিজেকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করো। তোমাকে পাওয়ার আকুলতা বিশাল পর্বতের চেয়েও উঁচু।”

রাত যতো গভীর হচ্ছে, প্রেমিকযুগলের খোশ আলাপন ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে প্রেমিক পুরুষ তূর্যের মতে হলে নয়নার মতে মেয়ের দুঃখের অবসান হতো।

——————————

প্রভাতের আলো ফুটতেই আকলিমা নড়েচড়ে বসে। সূর্যের আলো ঠিক তার চোখের উপর পড়ছে। চোখ খুলতেই বোরহান উদ্দিনের অবয়ব ভাসমান হলো আকলিমার চোখের সামনে। বোরহান উদ্দিন ব্যাগ প্যাক করে তৈরি হয়ে নিয়েছে। আকলিমা উঠে স্বামীর পাশে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাচ্ছো?”

” রিহানকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছি।”

আকলিমা বোরহানের হত ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,” রিহানকে নিয়ে যাচ্ছো মানে? আমার সন্তানকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যেতে দিব না।”

বোরহান হাসলো। আকলিমার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে বলল,” খবরদার ঐ খারাপ মুখে রিহানের নাম উচ্চারণ করবে না। এতোই যদি ছেলে ছেলে করো তবে কেনো ছেলেটাকে অসুস্থ অবস্থায় হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলে। কেনো নিজের সন্তানকে দূরে রাখলে?”

আকলিমার কাছে এর উত্তর নেই। সে তো বাশারের বুদ্ধিতে এই কাজ করেছিল। সে মিনমিন করে বলল,” বাশার বলেছিল,,,,

” বাশার, বাশার, বাশার তুই থাক তোর পাপের ফল নিয়ে। রিহান চলো,বাবা।”

ছোট্ট রিহান, বুঝ ক্ষমতা ভালো। ভালো,খারাপ বুঝেও।আকলিমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,” আমি মানুষের মতো মানুষ হয়ে ফিরব, মা! বাবাকে ভুল বুঝো না, বাবার সাথে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা আমার।”

আকলিমা বাকরূদ্ধ। মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। এই শোক সে কীভাবে কাটাবে? বোরহানের হাতে পায়ে ধরলো সে, অনুরোধের স্বরে বলল, ” এমন শাস্তি দিও না। রিহান কে রেখে যাও।”

বোরহান শুনলে তো! আকলিমার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।

দরজার আড়াল থেকে মাসুদা সবটাই দেখলো। তার চোখে মুখে ক্রুর হাসি। ফিসফিস করে বলল, ” বদলা তো মাত্র শুরু! এখনো কতো কিছু বাকী আছে! আস্তে আস্তে বুঝবে, মেয়েদের সম্মানে হাত দেওয়ার নির্মম পরিণতি কেমন হয়, বাশার!”

———————

লোকে বলে, প্রেমিকা পটানোর আগ পর্যন্ত অথবা বিয়ে করার আগ পর্যন্ত নাকি প্রেমিকের বা স্বামীর হাতে ঢের সময় থাকে কিন্তু পটে গেলে বা বিয়ের পর তাদের সময় কোথায় চলে যায় কে জানে! বিগত এক সপ্তাহ ধরে নয়নার তূর্যের প্রতি সেই কী অভিমান! নয়নাকে কাছে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিলো, তূর্যের সময়ও ছিলো অনেক। নয়নাকে একা রাখেনি কখনো, অথচ নয়নাকে কাছে আনার পর থেকে সাহেব একদম পরিবর্তন হয়ে গেছে। সারারাত হাসপাতালে কাটায় আর সারাদিন ঘুমে। নয়নার সাথে সময়ের হিসাব করে সাক্ষাৎ হয় তার, কথাও হয় অল্প স্বল্প। ভাবখানা এমন যেন এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নয়না সাক্ষাৎ করতে এসেছে, সীমিত সময় কথা বলেই ডাক্তার সাহেব চলে যাচ্ছে।
গতকালই তূর্যের রাতের ডিউটি শেষ হলো। আজ তার ছুটি আগামীকাল থেকে দিনের ডিউটি শুরু হবে সাথে তূর্যের ব্যস্ততাও। সাধারণত তূর্য ছুটির দিনটাও হাসপাতালে কাটাতো কিন্তু নয়না তার জীবনে আসার পর থেকে ছুটির দিনটার জন্যই অপেক্ষা করতে থাকে। দুপুর পর্যন্ত একটানা ঘুমিয়ে তূর্য নয়নাকে খুঁজতে শুরু করলো। তিনতলায় নয়নাকে না পেয়ে নিচে আসলো। এক দুইবার নয়নার নাম ধরে হাঁক ছাড়লো কিন্তু আশানুরূপ কোনো সাড়া পেলো না। তূর্যের মনে ভয় ঢুকলো ভেবে, নয়নার কিছু হয়ে যায়নি তো! তাড়াহুড়ায় সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামতে গিয়ে হোটচ খেতে খেতে বেঁচে গেলো। রান্নাঘর থেকে টুংটাং পাতিলের শব্দ ভেসে আসছে, তূর্য সেদিকে আগালো। পোলাওয়ের ঘ্রাণ তূর্যের নাকে বাড়ি খেলে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে হাসলো। নয়না তখন পেঁয়াজ বেরেস্তা পোলাওয়ের উপর ছিটিয়ে দিচ্ছিল। তূর্যের আগমনে তার কোনো ভাবান্তর হলো না। তূর্যকে ইগনোর করে সে তার কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহত দৃষ্টিতে তূর্য প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে। খানিকটা কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে কিন্তু কেউ শুনলে তো! অবশেষে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তূর্য বলতে শুরু করলো,” কী করছো আমার না হওয়া বউ?”

আগুনের উপর ঘি ঢেলে দিয়ে তূর্য দুষ্ট হাসলো, নয়না গোস্ত নাড়াচাড়া করছিল; খুন্তিটা তূর্যের দিকে এগিয়ে এনে বলল,” একদম উলটা পালটা সম্বোধন করবে না, তূর্য।”

তূর্য বুক হাত রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল,” হায়! তোমার সুরে আমার নামটা কী কিউট শোনায়!”

তূর্যে লজ্জায় লাল হওয়া ভাব দেখে নয়নার রাগ নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো কিন্তু সে বাহিরে তা প্রকাশ করলো না৷ মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,” হাসপাতালে যাবে না! যাও যাও, জলদি তৈরী হয়ে নাও। নয়তো তোমার ইয়াং ইয়াং মেয়েরা যারা রোগী সেজে বসে আছে,তারা তোমার দেখা না পেলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে।”

নয়নার কথায় তূর্যের ভীষণ হাসি পেলো। মেয়েটার মনে এসব চলে! দুষ্টু সুরে বলল,” আর ইউ জেলাস,নয়ন!”

নয়না থতমত খেলো। মনকে প্রশ্ন করলো, সত্যিই কী সে জেলাস! তূর্যের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য চেহারা আড়াল করে উত্তর দিলো,” বয়েই গেছে।”

তূর্য বলল,” মেয়ে তুমি হিংসার অজুহাত না খুঁজে,ভালোবাসার অজুহাত খুঁজো!”

নয়না মুখ বাঁকিয়ে বলল, ” নিজের মানুষটাকে অন্য কেউ দেখবে তা পৃথিবীর কোনো নারীই সহ্য করবে না। ”
” আমি সত্যিই কী তোমার পুরুষ, নয়ন!”
” এতেদিনেও বুঝলে না?”
” মুখে না স্বীকার করলে কীভাবে বুঝি!”
” সব কথা মুখে বলতে নেই, অপরপাশের মানুষটার জন্য মনের কোণে আলাদা স্থান আছে, তা বুঝে নিতে হয়।”

তূর্য গভীর নয়নে নয়নাকে দেখছে। নয়নার কাজ শেষ, সে রান্না ঘর থেকে বের হতে নিলে তূর্যের চোখের গভীরতা দেখে লজ্জা পেলো। তূর্যের চোখের উপর এক হাত রেখে বলল, ” এভবে তাকাবে না, আমার অস্বস্তি হয়।”

তূর্য হেসে নয়নার হাতে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। সহসা প্রেমিকের প্রেমময় প্রথম স্পর্শে নয়নার শরীরের শিরা উপশিরা টনটন করে উঠলো। হাত সরিয়ে তূর্যকে ধাক্কা দিয়ে বের হয়ে গেলো।
তূর্য তা দেখে বিড়বিড় করে বলল,” আর অপেক্ষা নয়!তোমাকে বৈধতায় আবদ্ধ করার সময় হয়ে গেছে, নয়ন!”

চলবে…………

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-২০+২১

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: বিশ

গাজীপুর থেকে প্রায় সাইত্রিশ কিলোমিটার দূর মাওনা চৌরাস্তায় অবস্থিত কাকলি ফার্নিচারের প্রধান শো রুম। বাশারকে তার স্ত্রী এক ঘণ্টার পথ জার্নি করে এখানে নিয়ে এসেছে। শো রুমে প্রবেশ করতেই নীচতলায় খাঁট, সেলফ, কেবিনেট ইত্যাদি সামগ্রী দেখতে পাওয়া গেলো। মাসুদার নীচতলায় কোনো কাজ নেই তাই বাশারকে নিয়ে সোজা দোতলায় উঠে গেলো। সোফা, খাট সহ নানারকম কাঠের আসবাবপত্র সাজানো গোছানো রয়েছে। মাসুদা এক লক্ষ টাকার পালঙ্কের কাছে এসে ছুঁয়ে দেখছে। বাশারও খুব খুশি! তাদের মতো মধ্যবিত্তদের ঘরে এক লক্ষ টাকার পালঙ্ক মানে কতো কিছু! আর টাকার বিষয়টাও বাশারকে ভাবাচ্ছে না কেননা টাকার থলিকেই তো বিয়ে করে এনেছে! এখন কী আর তার চিন্তা আছে?
শো রুমের মালিক মোঃ সোহেল রহমান বাশার এবং মাসুদাকে হাসিমুখে স্বাগতম জানিয়ে বলতে শুরু করলো,” আপনারা খুব লাকি বুঝলেন! পৃথিবীতে কতজন আর আছে! যারা পালঙ্কের উপর ঘুমায়! পৃথিবীতে আশি শতাংশ মানুষরা দামী গাড়ি,দামী পোশাক, কিনে টাকা উড়ায়, যা আজ আছে কাল নেই। কিন্তু আপনারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কাকলি ফার্নিচার বিশ্বের একমাত্র ভাইরাল ফার্নিচার। যা দামে কম কিন্তু মানে ভালো।”

ভদ্রলোকের বিশাল ভাষণ শুনে বাশার মনে মনে বলল,” বিক্রয় করার অভিনব কৌশল হলো, কথার আকর্ষণ। তুমি মিয়া বলতে থাকো।”

মাসুদা খুশিতে গদগদ হয়ে বাশারের উদ্দেশে বলল,” আমি আজই এক লক্ষ টাকার পালঙ্ক ঘরে নিয়ে যাবো। প্লিজ প্লিজ তুমি ব্যবস্থা করো!”

বাশার স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়ে মোঃ সোহেল রহমানের উদ্দেশে বলল,” আপনি সব ফর্মালিটি পূরণ করুন। আমরা এটাই নিব।”

” কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। আমরা আজই আপনাদের ঠিকানায় পৌঁছে দিব।”

ফর্মালিটি পূরণ করে বাশার ও মাসুদা শো রুম থেকে বের হয়ে আসে। সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামার সময় মাসুদা সোহেল রহমানের দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসে।

—————————————-

হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ!” গানটা ছাড়া বিয়ে বাড়ির আমেজ জমে উঠে না। ঊনিংশ শতকের সময়ে দাদী চাচীরা গলা ছেড়ে গান গাইতো, একজোট বেঁধে গীত গাইতো। বর্তমান জেনারেশনে গানগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে। বাংলা গানের পরিবর্তে হিন্দি বা ডি জে গান চলে হলুদের অনুষ্ঠানে। ময়মনসিংহ থাকতে নয়নারা ভাই বোনেরা হলুদের গান শুনে নাচতো। হৈ হুল্লোড়ে মাতিয়ে তুলতো সারা এলাকা। এখন সেগুলো স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ। মিছিলের সাথে কোনো একদিন হলুদের আনন্দ নিয়প গল্প করছিল। সেই সুবাদে আজ মিছিল একমাত্র বন্ধুর জন্য হলুদের গান বাজাতে বলে। নয়নার দেখা সেই স্টেজে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো হয়ছে। একপাশে সাউন্ড বক্সে হলুদের গান বাজছে অপরপাশে স্টেজে বাচ্চারা নাচছে।
বিকালের এই সময়টায় মানুষের আনাগোনা কম। অতিথিরা এখনো আসা শুরু করেনি। নয়না এই সুযোগে বাচ্চাদের আনন্দ উপভোগ করছে। বাচ্চাদের ভুলভাল নাচে করতালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে সে। মুখে তার ভুবন ভোলানো হাসি। দূর থেকে কেউ যে তার হাসিতে মাতোয়ারা হচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। নয়নার পাশে তূর্য এসে দাঁড়ালো। নয়নার সেদিকে খেয়াল নেই। তূর্যের ঐ বাচ্চাদের উপর হিংসে হচ্ছে। তাদের স্থানে সে কেন থাকলো না? তূর্যের জন্য তাহলে নয়নার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠতো! নয়নার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বিষয়টা তখন খেয়াল হয় যখন তূর্য নয়নার হাতে একটি শপিং ব্যাগ তুলে দেয়। উৎসুক দৃষ্টিতে নয়না তূর্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” এটা কী?”
তূয নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,” শাড়ি।”
” আমি নিতে পারব না।”
নয়না শপিং ব্যাগ তূর্যের হাতে ধরিয়ে দিলো। সে আর তূর্যের কাছে ঋণী হয়ে থাকতে চায় না। নয়না চলে যেতে নিলে তূর্য নয়নার হাত ধরে ফেললো। নয়নার হাত টেনে একদম নিজের কাছাকাছি এনে বললো,” আমার সব তোমার জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি, তোমার দুঃখকে নিজের করে নিয়েছি। আজ আমার খুশির জন্য এটা নিতে পারবে না, নয়ন!”

নয়না শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে হাত ছাড়িয়ে নিলো। ছলছল চোখে বলল,” আমাকে ছোঁবেন না, তূর্য! অতীতের ঘা তাজা হয়ে উঠে। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি।আমি চাই না, দ্বিতীয়বার আপনাকে অবিশ্বাস করতে।”

তূর্য গাঢ় চোখে নয়নাকে দেখে নিলো। মেয়েটা কী তাকে ভয় পাচ্ছে! তূর্যের উদ্দেশ্য তো খারাপ ছিলো না। অবশ্য সে এখনো নয়নার কাছে পরপুরুষ! নয়নার অনিচ্ছায় ছোঁয়া ঠিক হয়নি। তূর্য দুই হাতে মাথার চুল টেনে বললো,” আচ্ছা সরি, ছুঁবো না। কাছেও আসবো না। তবে আমার কথা শুনো! মানতে চাও না কেন? আমি কী তোমার দিকে বাজে উদ্দেশ্যে তাকিয়েছি! তোমাকে ভালোবাসি, বুঝতে চাইছো না কেন? ”

তূর্যের উচ্চ আওয়াজে নয়নার অন্তর কেঁপে উঠলো। তূর্যের বলা একটা কথাও ভুল নয়। সেই বেশি বেশি বুঝে। নয়নাই বা কী করবে! তার অতীত যে খুবই বিশ্রী। একজনের জন্য
সে তূর্যকে কষ্ট দিলো যে কী না নয়নার দুঃখে সুখে সাক্ষী হিসাবে আজীবন তার পাশে থাকবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। তূর্য তাচ্ছিল্য হাসলো। নয়নার হাতে শপিং ব্যাগ তুলে দিয়ে চলে যেতে নিলো। নয়নার ঠিক সেই মুহূর্তে কী হলো! তূর্যের টি শার্টের পিছনের দিকটা খামচে ধরলো। নয়নার মাথা তূর্যের পিঠে ঠেকিয়ে বলল,” যাবেন না, প্লিজ!”
” থাকলে তো আমায় খারাপ ভাববে।”
” আমি নির্বোধ, এবারের মতো ক্ষমা করুন!”
” আমি কে ক্ষমা করার। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে কোনো সম্পর্ক নেই।”
” জিদ দেখাচ্ছেন কেন? আমার সম্পর্কে তো সবই জানেন।”
” বুকে হাত রেখে বলো তো! আমায় বিশ্বাস করো কী না!”
” মিথ্যা বলি!”
“হুম!”
” আপনার কাছাকাছি থাকলে শান্তি পাই না! দূরে গেলে ছটফট করি না। আপনার অনুপস্থিতিতে বুকে ব্যাথা হয় না। আপনার কথা ভেবে হাত পা নিশপিশ করে না। আপনার কথা শুনলে শুনতে ইচ্ছে করে না।”

তূর্যের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। চোখ বন্ধ করে সময়টাকে অনুভব করতে লাগলো সে। এদিকে নয়নাও নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। তূর্যের থেকে কিছুটা দূরে সরে বলল,” আজ সন্ধ্যায় থাকবেন না?”
তূর্য নয়নার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” যদি আমার জন্য সাজো, তবে আসবো। ”
নয়না নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” আমি অপেক্ষায় থাকবো।”
—————————

সন্ধ্যা লগ্নে আকলিমার বাড়ির সামনে উপচে পড়া ভীড় জমে আছে। লোকের মাথা লোকে খাচ্ছে। বড়ো বড়ো দুই দুইটা পুলিশের গাড়ি থেমেছে বাড়ির সামনে। আজ মাহবুব শিকদারের রেখে যাওয়া বডিগার্ডরাও উধাও। কোথায় গেছে কে জানে! নাকি পুলিশের ভয়ে পালিয়েছে? এতো মানুষের ভীড় সাথে পুলিশের আগমনের ব্যপারটা অদ্ভুত নয় কী? মাহবুব শিকদার মানুষ ডিঙিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেন। অতিরিক্ত মানুষেরা মিলে শব্দ দূষণের সাথে বায়ু দূষণ করছে। মুখে মাক্স চেপে মাহবুব শিকদার খুব কষ্টে ভেতরে ঢুকেন। নয়নার ফুফা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে আছেন। আকলিমা পাশেই জমিনে পড়ে আহাজারি করে কাঁদছে। মাহবুব শিকদার সঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। বাশারকে তার ঘর থেকে কয়েকজন ধস্তাধস্তি করে বাহিরে নিয়ে আসলো। বাশার বারবার বলছে, ছেড়ে দাও।” কে ছাড়বে বাশারকে? আর মাসুদাই বা কোথায়? কয়েকজনের মধ্যে কাকলী ফার্নিচারের মালিক সোহেল রহমানও ছিল। ভদ্রলোকের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। মাহবুব শিকদার বুঝতে পারলেন পরিবেশ খুবই গরম। তখন শুনতে পেলেন একজন ভদ্রলোক বলতে শুরু করলো,” টাকা দিতে পারবেন না, তাহলে লাখ টাকার খাট নিয়েছেন কেনো? নিয়েছেন তো নিয়েছেন, খাটটা ভেঙেও ফেলেছেন! আরে আস্ত থাকলেও তো বিক্রি করে টাকা উসুল করতে পারতাম!”
মাহবুব শিকদারের চোখে মুখে আশার আলো ছড়িয়ে পড়লো। সে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো,” ঘটনা কী ভাই?”

ভদ্রলোক বলল,” কি বলবো ভাই ব্যবসায়ীদের কষ্ট! এই ব্যাটা বলেছিল বাড়িতে যদি পালঙ্ক দিয়ে আসি তাহলে টাকা পেমেন্ট করবে। অগ্রীম ২০ হাজার টাকা দিয়েও এসেছিল কিন্তু বাড়িতে আসার পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মিল না হওয়ায় আমার লোকেদের ইচ্ছামত পিটিয়ে তাড়িয়ে দিল। টাকা চাওয়াতে আরো কয়েকটা মেরে বের করে দিলো। আবার কী বলল, আমার ব্যবসা নাকি একবার লাটে উঠেয়ে দিবে। এতোটুকু কথা কী কম ছিল?উপায়ান্তর না পেয়ে আমি পুলিশ নিয়ে আসলাম। হয় বেটা টাকা দিবে নাহলে পুলিশের মার খাবে।”

খুবই দুঃখের বিষয়। মাহবুব শিকদার তাদের কষ্টে কষ্টিত হলো। চোখ থেকে চশমা খুলে বললো,” বেয়ান সাহেবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।”

চলবে……..

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: একুশ

দরজায় করাঘাতের শব্দ হচ্ছে সাথে নয়নার বুকের ধুকপুক আওয়াজও বাড়ছে। শাড়ি পরিহিতা নয়না চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। সে কোনোক্রমে দরজা খুলবে না বলে পণ করেছে। হলুদের অনুষ্ঠান অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। আজ নয়না সেজেছে, চোখে মোটা করে কাজল লাগিয়েছে, ঠোঁট জোড়ায় লাল রঙের লিপস্টিক দিয়েছে। এতটুকুতেই অপ্সরা লাগছে। হলুদের দিনে হলুদ শাড়ি না পরলেই নয়, তূর্যের পছন্দের প্রশংসা করতে হয়। নয়নার গায়ে হলুদরঙ ফুটে উঠেছে। নয়না অস্বস্তিতে দুই হাতের তালু ঘষছে। সে ঠাহর করতে পারছে দরজার অপরপাশে তূর্য দাড়িয়ে আছে। তাই তো লাজে চোখ বন্ধ করে আছে। কিছুক্ষণ পর মিছিলের কণ্ঠস্বর নয়না শুনলো,” শুনছিস নয়না! তূর্য ভাই এসেছে। তোর হলো নাকি?”

নয়না ফিসফিস করে উত্তর দিলো,” উনার জন্যই তো বের হচ্ছি নারে, মিছিল! তুই বুঝবি না।”

মিছিল আরো কয়েকবার দরজায় করাঘাত করে চলে গেলো। ভাইয়ের বিয়ে, মিছিলের কতো কাজ! তূর্য অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। নয়নাকে ডাকার জন্য কয়েকবার করাঘাত করেছিল কিন্তু আফসোস মেয়েটা দরজা খুলল না। ইতিমধ্যে মিছিল, নয়না ও তূর্যের সম্পর্কে সমস্ত ঘটনা তার পরিবারকে জানিয়েছে। সবাই নয়নার সুখেই খুশি। তূর্যকে পরিবারের একজন মনে করে নিয়েছে। বিগত দুইদিনে এজন্যই তূর্যের মিছিলদের বাড়িতে আনাগোনা নিয়ে কেউ কিছু বলছে না।
তূর্য এবার নিঃশব্দে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। সে জানে, নয়না দরজার কাছেই দাড়িয়ে রয়েছে। তূর্য বুকভরা নিঃশ্বাস ফেলে নয়নাকে ডাকলো,” নয়ন! চলে যাবো?”

তৎক্ষনাৎ দরজা খুলে গেলো। তূর্যের চক্ষুদ্বয়ের সামনে প্রদর্শিত হলো হলদে কন্যার। আচ্ছা, আজ হলুদ কার?প্রশ্নটা করা অযাচিত কেননা তূর্যের মনে, প্রাণে নয়না ছাড়া আর কেউ ধরা দিবে না। নয়না নতমুখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে, ভুলেও একটিবারের জন্য তূর্যের দিকে তাকাচ্ছে না। এদিকে তূর্য পলক ফেলার কথা বেমালুম হয়ে নয়নাকেই দেখছে। শাড়ি পরিহিতা নয়নাকে আজ প্রথমই দেখা। লাজরাঙা মুখশ্রীতে হালকা সাজসজ্জা। তূর্য বুকে হাত রেখে বলল,” ওহে রূপসী! আমি ক্ষণে ক্ষণে হারিয়ে যেতে চাই তোমার আঁখিতে। আমার প্রেয়সী, আমার প্রেমময়ী! তুমি কী জানো, তোমার চেহারার মায়ায় প্রতিনিয়ত ডুবে যাচ্ছি; ফেরাতে পারছি না গো মনকে।”

নয়না দুই হাতের তালু ঘর্ষণ করছে। এমন কাব্যিক কথার প্রত্ত্যুত্তরে কী বলতে হয়! তারও কী কাব্যিকভাবে উত্তর দিতে হবে! নয়না মনে মনে ভাবছে, ডাক্তারটা এতো ভালো কেনো? তার প্রতিটা কথায় গভীরতা আছে। নয়নার জন্য তার আকুলতা সাময়িক সময়ের জন্য নাকি সারাজীবনের জন্য? প্রশ্নটা মনে আসতেই নয়না চোখ তুলে তাকালো। তূর্যের চোখে মুখে আকুলতা।নয়নার একটি কথাশোনার প্রবল আকাঙ্খা। নয়না মুচকি হেসে বলল,” ডাক্তার হঠাৎ কবি হলো কীভাবে? পেশা কী চেঞ্জ করে ফেলেছেন?”

তূর্য গাঢ় চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” এক সর্বনাশীর প্রেমে পড়ে ডাক্তার এখন কবি হয়ে গেছে।”

” মোহ কে’টে গেলে আগের পেশাই ঠিক লাগবে।”

তূর্য নিগূঢ় হেসে বলল,” এই মোহ কখনেই কাটবে না। একবার ভালোবেসেই তো দেখো!”

” যদি মনঃক্ষুণ্ন হয়! সাধারণ মেয়ের কপালে সুখ আসে না। বেদনাই তাদের নিত্যকার সঙ্গী।”

” আমি সাধারণ, পছন্দ করিও সাধারণ। ওই সাধারণ মেয়ের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করতেই চাই কিন্তু সে তো মন বুঝে না!”

তূর্যর মন শক্ত লোহার মতো। কোনো কথায় বাঁকানো যাবে না। কিন্তু নয়না যে সাহস পাচ্ছে না, একবার মনে হচ্ছে তূর্যকে আঁকড়ে ধরলে বাঁচতে পারবে আরেকবার মনে হচ্ছে তার জীবনে তূর্য আসলে সেও দুঃখের অতলে ডুবে যাবে।

নয়না ও তূর্য পাশাপাশি হাঁটছে। সবসময় তূর্য এই সেই কথা বলে নয়নাকে লজ্জায় ফেলে দেয় কিন্তু এখন সে নিশ্চুপ মনে, বিষয়টা নয়নার একদমই ভালো লাগছে না। সে যেচে কথা বলবে তারও সাহস হচ্ছে না। বারবার মাথা ঘুরিয়ে তূর্যকে দেখছে। নয়নার ভাবভঙ্গি তূর্য সবটাই খেয়াল করছে। নিজের মনকে সে আর আটকাতে পারলো না, পরিশেষে বলল,” বাঁকা চোখে না তাকিয়ে সরাসরি দেখলে আমি মাইন্ড করব না। যতোই হোক! আমার মন তো তোমার কাছেই বন্দী। তুমি যখন ইচ্ছে এই মনকে পড়তে পারো।”
নয়না বেশ লজ্জা পেলো। শাড়ির আঁচল কাঁধ বরাবর শক্ত করে ধরে বলল,” তেমন কিছু না। আজ আপনাকে অন্যরকম লাগছে।”
” কেমন?”

তূর্যের তৃষ্ণার্ত স্বর, নয়নার এক একটি কথা,শেনার প্রবল আকুলতা। নয়না দাড়িয়ে গেলো, তূর্যের হাত শক্ত করে ধরে বলল, আপনার হাতে হাত রেখে হাঁটলে কী আপনার সমস্যা হবে, তূর্য?”

কতোদিনের অপেক্ষা! কতো আকুলতা! হাহাকার করা হৃদয় এই বুঝি শীতল হলো। তূর্যের বিশ্বাস হচ্ছে না। তার শরীর হিম হয়ে আসছে। সে তো নয়নার মনে এভাবেই জায়গা করে নিতে চেয়েছিল! অবশেষে সে স্বার্থক হলো। খুব শক্তকরে নয়নার হাত ধরলো সে। এতোটাই শক্ত যে, নয়না চাইলেই এই বন্ধন ছাড়তে পারবে না৷ নয়না তূর্যের প্রতি অভিমান করে বলল,” চলে যাবো না, তবুও ভয়!”

” ভয় নয়, নিজেকে ঠিক রাখতে আপাতত তোমাকে প্রয়োজন।”
” হাসপাতালে যাবেন না?”
তূর্য পাল্টা প্রশ্ন করলে,” তুমি বলা যায় না? আপনি তো পরকে বলে ডাকে। আমি পর বুঝি?”

নয়না উত্তর দিলো,” আপনি আমার হৃদয়ের সুপ্ত স্থান দখল করে নিয়েছেন। যেই স্থানটা আমি বিশেষজনের জন্য রেখেছিলাম। আপনি নিজেও জানেন না, আপনি আমার জন্য কতোটা ইম্পর্ট্যান্ট, তূর্য!”

একসাথে এতে ধাক্কা তূর্য হজম করতে পারছে না। আপাতত তার বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়া প্রয়োজন। নয়নার কথার প্রত্ত্যুত্তরে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” হাসপাতালে যেতে হবে নয়ন! তোমার এরূপ আমার জান নিয়ে ফেলবে, নয়ন!”

নয়না হাসলো। তূর্যের হাতের বন্ধন নরম করলো। নয়নার চোখে চোখ না মিলিয়ে একপ্রকার নয়নার থেকে পালিয়ে চলে গেলো তূর্য। নয়না একাকী প্রিয় পুরুষের চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকলো।

——————–

আকলিমার বাড়িতে কান্নার রোল, বোরহান উদ্দিন টাকা নিয়ে থানায় ছুটেছেন। রিহানকেও হোস্টেল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে, সে আপাতত ভাইয়ের উপর প্রচুর বিরক্ত। রিহান জানে, তার ভাইয়ের মতো মুখোশধারী লোক পৃথিবীতে নেই। তবে সে যে এতোটা নীচু পর্যায়ে চলে যাবে কে জানতো!
আকলিমা ছেলের শোকে পাগল প্রায়। কী থেকে কী করছে নিজেও জানে না। সে খেয়াল করলো, তার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে মাসুদা একবারের জন্যও ঘর ছেড়ে বের হয়নি। কিন্তু কেনো? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে হানা দিতেই আকলিমা ছেলেট ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। মাসুদাকে খুশি মনে আচার খেতে দেখে রাগান্বিত স্বরে বলল,” এই মেয়ে! তোমার স্বামীকে যে বিনা কারণে পুলিশে নিয়ে গেছে, সেই সম্পর্কে কোনো চিন্তা আছে? তুমি কীভাবে এখানে বসে বসে আচার খাচ্ছো?”

মাসুদা আচার চিবোতে চিবোতে উত্তর দিলো,” আপনারা তো আছেনই, তাই চিন্তা করছি না।”

আকলিমা ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু যখন শাশুড়ির চরিত্রে থাকে তখন সে পুরো দজ্জাল শাশুড়ীর মতো ব্যবহার করে। মাসুদার হাত থেকে আচারের বয়াম কেড়ে নিয়ে বলল,” তোমার জন্যই আমার ছেলে থানায়। টাকাটা দিয়ে দিলে কী হতো!”

মাসুদা এবার সোজা হয়ে দাড়ালো। আকলিমার দিকে আঙুল তুলে বলতে শুরু করলো,” আপনার ছেলে আমাকে বাড়ি থেকে পালিয়ে এনে বিয়ে করেছে। আমার ভরনপোষণের খেয়াল তো তারই রাখতে হবে! আমি তো এমন কোনো শর্তে বিয়ে বসিনি যে, বিয়ের পর টাকার গদির উপর তাকে রাখবো!”

” টাকার গরম দেখাচ্ছো? আমার ছেলে একবার আসুক, তোমাকে উচিত শিক্ষা দিব।”
মাসুদা আকলিমার থেকে এক ধাপ এগিয়ে বলল,” কীভাবে শিক্ষা দিবেন! যেভাবে নয়নাকে প্রতিদিন মেরে শিক্ষা দিতেন,সেভাবে?”

আকলিমা বিষ্ময় হয়ে গেলে। অবিশ্বাসের সুরে বলল,” তুমি নয়নাকে কীভাবে চেনো?”

মাসুদা রহস্যময় হেসে আকলিমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” ইট’স সিক্রেট।”

—————————

উত্তরা কমিউনিটি সেন্টার, ৬ নাম্বার সেক্টরে অবস্থিত। মারুফের স্ত্রী হেনাকে এখান থেকেই উঠিয়ে দেয়া হবে। মিছিলরা কমিউনিটি সেন্টারে পৌছে গেছে ইতিমধ্যে। বর পক্ষের সকলে উপস্থিত হলেও উপস্থিত নেই নয়না ও তূর্য। তারা দুইজন আলাদা গাড়িতে আসবে। মিছিল বারবার তূর্যের ফোনে কল করেই যাচ্ছে কিন্তু তূর্য ফোন তোলার খবর নেই। এই নিয়ে মিছিলের ক্ষোভের অন্ত নেই সে ফোন হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,” নয়া নয়া আশিক হইয়া আমার বান্ধবীরে নিয়া নিছে। ভবিষ্যতে তোমাকে বাসর ঘরে ঢুকতে দিব না, ডাক্তার ভাইয়া! হুহ।”

কতোটা দুঃখ, কতোটা কষ্ট নিয়ে মিছিল কথাটা বলল। তূর্য শুনতে পেলে কী অবস্থা করতো!
এদিকে নয়না মুখ ফুলিয়ে গাড়িতে বসে আছে। তার পাশেই তূর্য মনের সুখে গাড়ি চালাচ্ছে। ভাবখানা এমন, যেন সে রাস্তায় নয় আকাশে উড়ে উড়ে গাড়ি চালাচ্ছে। নয়নার মান হওয়ার কারণ তূর্য। এই একরোখা জিদ্দি ডাক্তার নয়নাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চার হাত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নয়নার খুব ইচ্ছে ছিল মিছিলের সাথে কমিউনিটি পর্যন্ত যাবে কিন্তু বদ ডাক্তার মানলে তো! উলটো নয়নাকে ফোর্স করছে তূর্যকে তুমি করে বলতে, যা নয়না কখনোই করতে পারবে না। এদিকে তূর্য নয়নার মুখ থেকে তুমি সম্বোধন না শোনা পর্যন্ত কমিউনিটি সেন্টারে যাবে না বলে পন করেছে। উত্তরার অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নয়নার কোনো কথাই শুনছে না। অগত্যা মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো নয়না। তূর্য তা দেখে মুচকি হেসে খালি গলায় গান ধরলো,
“ভালোবাসি বলে দাও আমায়,
বলে দাও হ্যাঁ সব কবুল।
তুমি শুধু আমারই হবে,
যদি করো মিষ্টি এই ভুল।”

নয়না মুগ্ধ হয়ে গান শুনছে। এক ডাক্তার আর কী কী পারে খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তূর্য হাসছে নয়নার মুগ্ধতা ছেয়ে যাওয়া মুখটা দেখে। নয়নাকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য একটু কেশে বলল,” কবুল বলে দেখো, তোমার এই লাজ ভাঙার দায়িত্ব আমার। শুধু যে কাটাছেঁড়া করতে পারি তা ভেবে ভুল করো না মেয়ে! আমি কিন্তু আদরও করতে জানি।”

তূর্যের কথা শেষ হতেই নয়না ছিহ্ বলে তূর্যের হাতে আস্তে করে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। তূর্য হু হা করে হাসতে লাগলো। নয়নাও মুচকি হাসছে, সে এমন একজনের পাল্লায় পড়েছে যে নয়নাকে সর্বদা লজ্জায় ফেলে। নয়না বুঝতে পারছে তূর্য আজ তার মুখ থেকে তুমি সম্বোধন না শোনা পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে। অগত্যা নিঃশ্বাস আটকে নয়না বলল,” কমিউনিটি সেন্টারে চলো, তূর্য! ”

তূর্য হঠাৎ করে ব্রেক কষলো। নয়নার দিকে তাকাতে নিলে নয়না তার চোখে হাত দিয়ে রাখলো। তূর্য স্মিত হেসে বলল,” আজ তুমি বলেছো, কাল ভালোবাসিও বলবে।”

নয়না ভেঙচি কাটলো। বিড়বিড় করে বলল,” বাঙালিরা বসতে চাইলে খেতেও চায়।”

চলবে………..

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১৮+১৯

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: আঠারো

মানুষের জীবনের মোড় কোনদিকে ঘুরে যাবে কারো জানা নেই। গল্প উপন্যাসের মতো যদি বাস্তবের জীবন হতো কতোই না ভালো হতো; কিন্তু হায়! বাস্তবতা খুবই কঠিন।
নয়নাকে অস্থিরতার মধ্যে রেখে তূর্য দরজা আটকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেই সকালে তূর্য এসেছে, নয়নার বলা কথা শুনে বেচারা বিশাল বড়ো ধাক্কা খেয়েছে তাইতো বলা নেই কওয়া নেই চট করে গেস্ট রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। নয়না অনেকবার ডাকার চেষ্টা করে না ডেকেই ফিরে আসে। দুপুর হতে চলল, তূর্য এখনো ঘুমাচ্ছে। নয়না ভাবছে, তূর্যের পরিবারের কথা। এই যে সকাল থেকে তূর্য বাড়ি ছাড়া তার খবর কী পরিবারের মানুষজন রাখে? চিন্তা করছে না বুঝি! আশ্চর্য মানুষটার আশ্চর্য পরিবার। কোনো চিন্তাভাবনা নেই। ভাবনায় বিভোর থাকা নয়নার সময়ের খবর নেই যখন ধ্যান হলো ততক্ষণে যোহরের আজান দিলো। নয়নারও কিছু খাওয়া হয়নি, মূলত অতিরিক্ত চিন্তায় কিছু খায়নি। কিন্তু না খেয়ে আর কতক্ষণ? তূর্য ঘুম থেকে উঠলেও তো কিছু দিতে হবে? সাতপাঁচ ভেবে দুই হাতে চুল প্যাঁচিয়ে খোঁপা করে নিলো নয়না। সাধারণত তূর্যের সামনে মাথায় ওড়না চেপে রাখে এখন যেহেতু তূর্য নেই তাই ওড়না শরীরে প্যাঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটে।

ফ্রিজের মাছ,মাংস ছাড়া আর কোনো অপশন নেই নয়নার কাছে। অগত্যা দেশী মুরগী ফ্রিজ থেকে নামিয়ে পানিতে ডুবাল। ঝটপট চিকেন বিরিয়ানি রান্না করে নয়না ক্ষান্ত হলো। সময়ের হিসাব করলে নয়না দেখতে পেলো দুপুর দুইটা বাজে। এখনো মানুষটা উঠেনি! ডাক্তার মানুষের সময় নাকি অনেক মূল্যবান হয়, এই তার সময়ের হিসাব! নয়না অন্তরে সাহস সঞ্চয় করে গেস্ট রুমের দরজায় করাঘাত করলো। দুই মিনিটের মধ্যে তূর্য দরজা খুলে নয়নার চিন্তিত মুখখানা দেখে হেসে উঠলো। ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,” এক কাপ কফি করে দিবে, নয়ন? আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।”

তূর্যের ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর নয়নার হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা বাড়িয়ে দিলো। সে বুকের বাম পাশটায় চেপে ধরে কফি বানাতে চলে গেলো। প্রায় পাঁচ মিনিট পর তূর্য ফ্রেস হয়ে বের হয়। তূর্যের ব্যপারে নয়না একটা বিষয় বুঝতে পেরেছে, তূর্য একদম ফিটফাট থাকতে পছন্দ করে। এই যে, ফ্রেস হওয়ার পর তূর্যের পোশাক থেকে শুরু করে মাথার চুল, হাতের ঘড়ি সব ঠিকঠাক করেই বের হয়েছে! তূর্য মুঠোফোন বের করে কাউকে ফোন করলো। নয়না এই সুযোগে কফির কাপ তূর্যের সামনে টেবিলের উপর রেখে সরে আসলো। ফোনে ব্যস্ত থাকলেও তূর্য সবটা খেয়াল করলো। কথা বলা শেষে জোরে নয়নাকে ডেকে বলল,” কোথায় গেলে?”

ইশ! মনে হচ্ছে বিয়ে করা বউকে আহ্লাদ করে ডাকছে। নয়না ঘর থেকে মাথা বের করে বলল,” কিছু লাগবে?”

কফির কাপ চুমুক দিয়ে তূর্য প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” উম! চিনি ছাড়া কফির সাথে তোমাকে লাগবে।”

নয়না ভেংচি কাটলো। একাকী পুরুষের সামনে থাকতে আপত্তি প্রকাশ করে বলল,” নুন ছাড়া যেমন তরকারিতে স্বাদ নেই, সম্পর্ক ছাড়া তেমন পুরুষের আশেপাশেও থাকতে নেই।”

” সকাল থেকে তাহলে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কী দরজার সামনে ঘুরঘুর করেছো?”

নয়না নাক সিটকে উত্তর দিলো,” ছিহ! কীসব কথা?”

তূর্য হাসলো। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল,” উচিত কথা বললেই ছিহ! এদিকে যার মন নিয়ে নিতে চাইছো তাকেই অনাহারে রাখছো? এটা ঠিক নয়,নয়ন!”

নয়না জিহ্বায় দাঁত চেপে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো।
সে ভুলেই বসেছিল, তূর্য সকাল থেকে না খাওয়া। ভাবনার ফ্যাটটা খুবই ছোট। দুইটা বেডরুম, ডাইনিং ও পাকঘর; এতটুকুতে টুকটাক জিনিস নিয়ে মেয়েটা ফ্ল্যাট সাজিয়েছে। সোফার টেবিলে নয়না বিরিয়ানি রাখলো। বিরিয়ানির ঘ্রাণে সারাঘর ম ম করছে। তূর্য লম্বা করে নিঃশ্বাস টেনে নিজেই প্লেটে খাবার পরিবেশন করে নিলে। নয়না তখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তূর্য ততক্ষণে এক লোকমা মুখে পুরে নিয়েছে। নয়নার হাতের রান্নার তুলনা হয় না। তূর্য এই পর্যন্ত যা যা খেয়েছে অমৃত মনে হয়েছে। তূর্য এতোটাই এক্সাইটেড ছিল যে নয়নার কথা ভুলে গেলো। একাকী এক প্লেট বিরিয়ানি শেষ করে আরেকবার নিলো। তূর্যের তৃপ্তি সহকারে খাওয়া দেখে নয়নার ভালো লাগলো। সে হেসে বলল,” আরেকটু দিব?”

তূর্যের এতক্ষণ পর নয়নার কথা স্বরণে আসলো। সে নয়নাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,” দাড়িয়ে আছো কেন? এদিকে আসো, তুমি কী জানো! তুমি কতো মজার রান্না করো! কীভাবে জানবে, আসো এক লোকমা খাইয়ে দেই। আমার থেকে খেয়ে বলবে কেমন হয়েছে!”

বলতে বলতে তূর্য নয়নাকে বসিয়ে এক লোকমা মুখে ঢুকিয়ে দিলো। তূর্যের আকস্মিক কাজে নয়না নিশ্বাস নেয়ার মতো সময় পেলো না। মুখে খাবার নিয়ে হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলো। এক্সাইটেড হয়ে তূর্যের করা কাজে সেও বিস্মিত হলো! নয়না তাকে ভুল বুঝলো না তো! নয়নাকে স্বাভাবিক করার জন্য সে বলল,” আমার চাচ্চু বলে, আমার হাতের রান্না নাকি অনেক মজার। তোমার কী মনে হয়?”

মুখের খাবার কোনোমতে গিলে নয়না উত্তর দিলো,” ভালো।”

” ভালো তো হতেই হবে! আমি যে বিরিয়ানিতে বিশেষ কিছু মিক্সড করি।”

নয়নার জানতে ইচ্ছে করলো না কী মিক্সড করে তূর্য।দেখা গেলো তূর্য নিজেই বলল,” জানতে চাও বিশেষ জিনিসটা কী?”

মাথা সায় দিয়ে নয়না সম্মত জানালো। তূর্যের খাওয়া শেষ, প্লেটে পুনরায় বিরিয়ানি তুলে নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ” ভালোবাসা।”

বিস্মিত চোখে নয়না তূর্যের দিকে তাকালো। প্রত্ত্যুত্তরে কী বলবে সে! লজ্জা গ্রাস করছে নয়নাকে। তূর্য নয়নার হাতে প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,” পুরুষের এটো থালায় খাবার খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে। খেয়ে প্রমাণ করো তো! কথাটা সত্য নাকি মিথ্যা!”

———————–

দুপুরের খাবারের টেবিলে হরেক পদের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে আকলিমার বাসায়। আভিজাত্যপূর্ন আসবাবপত্র চিকচিক করছে টেবিলের উপর। আকলিমা মাথায় হাত রেখে ভাবছে,এই আসবাবপত্র সে কবে কিনেছিল? মনে নেই। এরমধ্যে মাসুদা ও বাশার ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। খাবারের টেবিল দেখে মুচকি হেসে বলল,” আসলে আমার পাতিলে রান্না করা খাবার পছন্দ না। সারাজীবন রান্নাঘরে দামী প্যান দেখে অভ্যস্ত। সকালে নোংরা পাতিল গুলো দেখে গা ঘিনঘিন করছিল। এখন ঠিক আছে। থ্যাঙ্কিউ জানু!”

বাশার খুশিতে গদগদ করছে। দুপুরেই মাসুদা মোটা অঙ্কের টাকা দিলো বাশারের হাতে। সেই টাকা দিয়েই এসব কেনা। থলে ভর্তি টাকা আর সুন্দরী বউ পেলে মা, ভাইকে কে চেনে? আকলিমা বাশারকে রামধমক দিলো,” টাকা পেয়েছিস কোথায়? এতো টাকা দিয়ে ইন্জিনিয়ার বানালাম, আমাদের তো একটা সুতা পর্যন্ত কিনে দিতে পারিসনি। আর বউ বলার সাথে সাথেই লাখ লাখ টাকা বের করছিস? টাকা কোথায় পেলি?”

” উফ মা! এতো কৈফিয়ত চাচ্ছো কেন? খেলে খাও, নয়তো আমাকে খেতে দাও। মাসুদাও সকাল থেকে না খেয়ে আছে।”

আকলিমা রাগে গজগজ করতে করতে না খেয়েই চলে গেলো। বাশার মাকে ফেরালো না। মাসুদার হাত ধরে বিশ্রী ভঙ্গিতে বলল,” এবার তো কাছে আসো, সোনা?”

মাসুদা খাবার খাওয়ার বাহানায় প্রত্ত্যুত্তর দিলে,” জানোই তো! পালঙ্ক ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না। টিভিতে দেখলাম, কাকলী ফার্নিচারে এক লাখ টাকার পালঙ্ক বিক্রি হচ্ছে। আমার সেটা চাই-ই চাই! আর যদি এনে না দাও, তাহলে কাছে আসতে পারবে না।”

বাশার মাসুদার গলার দুই ইঞ্চি নিচে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,” তুমি বললে এক লাখ টাকার খাঁট কেন? পুরো ফার্নিচারের দোকান তুলে আনবো, জানমান! আজই নিয়ে আসবো, আর রাতেই,,,,,!

মাসুদা লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। এদিকে বাশার মনে মনে এই বলে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে, ” টাকার থলে তো আমার ঘরেই, চাইলে এক লাখ কী দশ লাখ খরচ করলেও টাকা কমবে না।”

———————————–
বিকাল চারটায় মিছিল নয়নাকে নিতে আসলো। ভাবনা তখন বাড়িতে ছিল।আশ্চর্যজনকভাবে সেও নয়নাকে মিছিলের সাথে যেতে রাজি হলো। অথচ দুইদিন আগেও ভাবনা নিষেধ করেছিল। নয়না খুশিমনে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তূর্যের কথা মনে পড়ায়। তূর্য যাওয়ার আগে বলে গেছে সে আগামীকাল নয়নাকে নিয়ে তার চাচার কাছে যাবে। যদি আগামীকাল এসে নয়নাকে না পেয়ে মন খারাপ করে! তখন সে কী করবে? বিছানায় বসে নয়না হাজারো কথা ভাবছে। নয়নাকে বসে থাকতে দেখে মিছিল এগিয়ে আসলো। আঁজলা ভরা মুখখানা উঁচু করিয়ে বলল,” কী হয়েছে, আমার জানটার?”

” উনি যদি রাগ করে?”

নয়নর উনিটা যে কে, তা মিছিল খুব ভালো করেই জানে। তবুও নয়নাকে বাজিয়ে দেয়ার জন্য বলল,” তোর উনিটা কী ডাক্তার তাবরেজ তূর্য, নয়ন!”

লজ্জায় নয়নার গালদুটো লাল টমেটো হয়ে গেলো। মিছিল তা দেখে নয়নার কাছে এসে আরো খোঁচানোর উদ্দেশে বলল,” এসব কী নয়ন! কতদূর গড়লো শুনি? ইয়ে টিয়ে কী সব হয়ে গেছে?”

নয়না আশ্চর্য হয়ে যায়। এই মিছিলটা এতো দুষ্ট হল কবে থেকে? নয়নাকে নাস্তানাবুদ করার জন্যই বদটা আজ এসেছে? নয়না অকপটে উত্তর দিলো,” তুই একটু বেশিই ভাবছিস। ঐসব কিছু না।”

নয়না নার্ভাসের কারণে ঘামতে শুরু করে। মিছিল বিষয়টা খেয়াল করলে নয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” আমার নয়নতারা! তুই কী জানিস! আকাশের বুকে তুই জ্বলন্ত একটা চাঁদ! তোকে যে পাবে সে খুব ভাগ্যবান হবে।”

নয়নার চোখের সামনে তূর্যের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। পছন্দের মানুষ বলে কী? লজ্জায় নয়না মিছিলকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,” সে ভাগ্যবান নয় মিছিল বরঞ্চ তাকে যেই মেয়ে পাবে সে ভাগ্যবতী।”

চলবে……….

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: ঊনিশ

মিছিলদের বাড়িতে প্রবেশ করে নয়নার বিষ্ময় শেষ হলো না। আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে গেইট থেকে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত সাজানো হয়োছে। রংধনুর সাত রং যেভাবে দূর আকাশে মেলে থাকে ঠিক তেমনভাবে ফুলগুলোকে সাজানো হয়েছে। অদূরে স্টেজ সাজানো হয়েছে নয়না সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। মিছিলের আনন্দ আজ দেখে কে? প্রিয় বান্ধবীকে নিয়ে বাড়িতে এসেছে, এই আনন্দ ধরে রাখার মতো নয়! বাড়িতে প্রবেশ করে উচ্চ স্বরে হাঁক ছাড়লো মিছিল, ” মা! তোমার মেয়েকে নিয়ে এসেছি। কোথায় গেলে?”

মিছিলের মা পাশের ঘরেই ছিল। মেয়ের ডাকে ঘর ছেড়ে নয়নাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। পরম মমতায় আদরের সাথে বলল,” কেমন আছিস মা!”

নয়না মুচকি হেসে উত্তর দিলো, ” ভালো আছি।”

মিছিলের বাবা নুরুল ইসলাম পেশায় একজন ব্যবসায়ী। সারা বছর তার দেখা মিলে কই? ব্যবসার কাজে এ-শহর থেকে ঐ-শহরই ঘুরে বেড়াতে হয়। ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাসায় থাকা! নয়নাকে দেখা মাত্রই বলতে শুরু করলো,” সেদিন আমি বাড়ি থাকলে তোমাকে ঐ পশুদের সাথে যেতে দিতাম না। ভালো করেছো চলে এসে। এখন থেকে এখানেই থাকবে। ”

নয়না মুচকি হেসে সায় দিলো। মিছিলের মা দুই মেয়েকে এবার তাগাদা দিলো, ” তোরা ফ্রেস হয়ে খেয়ে নে। খবরদার মিছিলের সঙ্গ পেয়ে বসে থাকবি না নয়না? এই মেয়েটা আস্ত অলস, আমার সাথে কোনো কাজই করতে চায় না। দুইজন এসে আমাকে সাহায্য করবি।”

নয়না হেসে বলল,” আচ্ছা, আন্টি।”

ছেলে পক্ষের বিয়ের অনুষ্ঠান কেমন হয়? মেয়ে বিদায়ের সময়ে মেয়ে পক্ষরা যেভাবে কান্না করে, ছেলে পক্ষও কী কান্না করে? নয়না ছেলে পক্ষের জমজমাট বিয়ে দেখেনি। ময়মনসিংহ থাকতে মেয়েদের ধুমধামে বিয়ে হতে দেখেছে, তাও দূর থেকে। ছেলেদের বিয়ে দেখেনি, কেনো দেখেনি সে নিজেও জানে না। ছেলে পক্ষের বিয়ে দেখার জন্য এক্সাইটেড হয়ে আছে নয়না। লজ্জায় সে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না।

আজ সন্ধ্যায় মেহেদীর অনুষ্ঠান, আগামীকাল গায়ে হলুদ। মেহেদী অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। মিছিলও সেখানেই ব্যস্ত! নয়না একাকী ঘরে বসে মুঠোফোন হাতে নিয়ে বসে রইলো। তূর্যের নাম্বারটাতে ডায়াল করে কয়েকবার কেটেও দিলো। সে আসার পর থেকে মানুষটার সাথে কথা হয়নি। সেও তো একবার খবর নেয়নি! নয়নার বুঝি অভিমান হয় না! পরক্ষনেই নয়নার মনে পড়লো, তূর্যের তো এখন নাইট শিফট চলছে।হয়তো মানুষটা ঘুমাচ্ছে! শুধু শুধু ফোন করে ডিস্টার্ব করা কী ঠিক হবে? মুঠোফোন রেখে দিলো নয়না। বিকালে না হয় ফোন করে নিবে সে?

এদিকে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ পর পর মুঠোফোন চেক করছে তূর্য। নয়নার একটি কলের আশার ঘুম হচ্ছে না তার। অথচ মেয়েটার কোনো চিন্তাই নাই সে হয়তো এতক্ষণ বিয়ে বাড়িতে নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে।

সন্ধ্যা লগ্নে নয়না ব্যতীত সবাই তৈরি হয়ে নিলো। নয়নার অস্বস্তি হচ্ছে এতো মানুষের ভীড়ে যেতে। মিছিল কোথায় থেকে দৌড়ে আসলো, হাতে করে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে লাগলো মেয়েটা। নয়না এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো, তার মনোযোগ মিছিলের দিকে শপিং ব্যাগে কী আছে দেখার ইচ্ছে নেই। মিছিলকে পাশে বসিয়ে বলল,” কুকুরের দৌড়ানো খেয়েছিস নাকি? এভাবে হাপাচ্ছিস কেনো?”

নয়না খেয়াল করলো, মিছিল খুব সুন্দর সবুজ রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। সবুজ রংটা বেশ মানিয়েছে মিছিলের গায়ে। আমরা সাধারণত যারা গাঢ় রঙগুলো এভয়েড করি তারা হঠাৎ সেই রঙের পোশাক পরলে ফুটে ওঠে। মিছিলের সবসময় সবুজ রং অপছন্দ। আজ পরার পর সবুজ পরী লাগছে। মিছিল শপিং ব্যাগ নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” বাঘের খপ্পরে পড়েছিলাম। এটা ধর, পরে তৈরি হয়ে নে। আমি মায়ের কাছ থেকে গহনা নিয়ে আসছি। একসাথে সাজবো।”

যেভাবে এসেছিল সেভাবেই নয়নাকে একা ফেলে দৌড়ে চলে গেলো মিছিল। নয়নার প্রত্ত্যুত্তরের অপেক্ষা করলো না মেয়েটা।কী ধুরন্ধর মেয়ে! নয়না একবার হাতের কাছে পেলে উত্তম মাধ্যম দিবে।

শপিং ব্যাগ খুলে সুন্দর সবুজ রঙের আনারকলি দেখতে পেলো নয়না। সবুজ রঙের সাথে লাল ওড়নার কম্বিনেশন দারুণ লাগলো তার কাছে। সময় অপচয় না করে নয়না জামা পরে নিলো। মিছিল কাউকে বকতে বকতে ঘরে প্রবেশ করলো। তার হাতে গহনার বক্স। নয়নাকে দেখামাত্রই গহনার বক্স বিছানায় রেখে এসে জড়িয়ে ধরলো। ময়নার গালে চুমু খেয়ে বলল,” আমার নয়ন চাঁদটাকে দারুণ লাগছে। রঙটা তোর শরীরে খুব মানিয়েছে। আয় তোকে গহনা পরিয়ে দেই।”

নয়না নাকচ করলো। সে তাদের গহনা কেন পরবে? মিছিলের চোখ রাঙানো দেখে নয়না চুপটি করে বসে রইলো। সিম্পল একটা গহনার সেট নয়নাকে পরিয়ে দিলো মিছিল। তাতেই অপরূপা লাগছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে কাজল এনে নয়নার চোখে পরিয়ে দিলো মিছিল। এবার যেন মেয়েটার রূপের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে। নয়নাকে বসিয়ে মিছিলও তৈরি হয়ে নিলো। একসাথে দুই বান্ধবী ঘর থেকে বের হতেই মিছিলের মায়ের সামনে পড়লো। ভদ্রমহিলা নয়নার এরূপ আগে কখন দেখেনি। আঁজলা ভরে এক হাত রেখে বলল,” মাশাআল্লাহ, আমার মেয়েটাকে তো অল্প সাজেই অপরূপা লাগছে।”

নয়না লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে রাখলো। মিছিলের মা হেসে চলে গেলো। স্টেজ রেখে পুরো ছাদ ডেকোরেশন করা হয়েছে লাল নীল রং কাগজ ও শতকের মতো আয়না দিয়ে। নয়না হা করে সবটা দেখছিল। এতোকিছুর মধ্যে বেচারি মনে মনে তূর্যকে খুব মিস করছে। কিছুক্ষণ আগে সে মনে সাহস সঞ্চয় করে তূর্যকে ফোন করেছিল, লজ্জায় লাল নীল হয়ে তূর্যের স্বর শোনার অপেক্ষা করছিল, কিন্তু আফসোস! নয়নার মনের বাসনা পূরণ হলো না। তূর্যের ফোন বন্ধ ছিলো। নয়নার মনটাই খারাপ হয়ে যায়। বর্তমানে নয়না ঘুরে ঘুরে ছাঁদের ডেকোরেশন দেখছে। মিছিল ছাদে আসতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নয়না একাকীই ঘুরছে। ফটোসেশানের জন্য একটা স্থান তৈরি করা হয়েছে। যেখানে দাঁড়ালে দশটি আয়নার মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাওয়া যায়। নয়না সেখানে দাড়িয়ে ছিল। আচমকা সে পিছনে জলপাই রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত তূর্যেকে দেখতে পেলো। এক মিনিট দুই মিনিট কতক্ষণ সময় ধরে সে তাকিয়ে ছিল হিসাব নাই। তূর্যও তার দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনের ভুল ভেবে নয়না দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় তাকালো। এবারও সে তূর্যকে দেখতে পেলো। নয়না বুঝতে পারলো, তূর্য তার কল্পনায় নয় বাস্তবে দাড়িয়ে আছে। মস্তিষ্কে বিষয়টা গেঁথে যেতেই নয়না চট করে তূর্যের দিকে ফিরে তাকালো। এদিকে তূর্য নয়নাকে দেখে অন্য এক পৃথিবীতে চলে গেলো। সাজগোজহীন নয়নাক যতোটা স্নিগ্ধ লাগে সাজগোজ করা নয়নাকে ততোটা অপরূপা লাগছে। লজ্জায় নয়না মাথা নত করে রাখলো। তূর্য মুঠোফোন বের করে এই অবস্থাতেই তার এবং নয়নার কিছু ছবি তুলে নিলো। নয়নার কাছাকাছি এসে মাতাল সুরে বলল,” তুমি সবুজ পাতার বুকে সেই পদ্মফুল, যার রূপের আগুনে ঝলসে যাচ্ছে আমার বুক!”

নয়না চোখ তুলে তূর্যের দিকে তাকালো। কাজলদিঘী চোখে তূর্য মুহূর্তেই ডুবে গেলো, বিড়বিড় করে বলল,” এই কাজলদিঘী মেয়েটাই তাবরেজ তূর্যের অস্তিত্ব জুড়ে আছে।”

নয়না স্পষ্ট শুনতে পেলো। কিছুটা অভিমান হলো তূর্যের প্রতি, সে অকপট সুরে বলল,” আসলেন কেনো?”

তূর্য হাসিমুখে জবাব দিলো,” তবে কী চলে যাবো!”

” বলছি কী?”
” কি বলতে চাও!”
” ফোন বন্ধ ছিলো যে?”
” সারাদিন খোঁজ নিয়েছো?”
” আপনিও তো নিলেন না।”
” আমি আর তুমি কী এক?”
” ছেলেরা কী সব পারে? মেয়েদের কোনো অধিকার নাই?”
” তা বলিনি! বাদ দাও, কাছে এসো কথা আছে।”
” দূর থেকেই বলুন, কাছে আসলে পাপ হবে।”
” বড্ড কথা বলো, কার কাছে শিখেছো? মিছিল কী পড়িয়ে পড়িয়ে নিয়ে এসেছে?”

নয়না মিছে অভিমান করে চলে যাওয়ার ভান ধরে বলল,” বোবা নই, কথা জানি। ঝগড়া ডাবল পারি।”
” বিয়ের পর করো।”

নয়না থেমে গেলো। বিয়ের পর বলবে এর অর্থ কী? তূর্যের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিলে সে বলল,” বিয়ে করবে আমায়, নয়ন?”

নয়না প্রত্ত্যুত্তর করলো না। আবার দাড়ানো থেকেও নড়লো না। তা দেখে তূর্য এগিয়ে এসে বলল,” চলে যেতে হবে, হাসপাতালে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এবার বিদায় দাও,নয়ন!”

নয়নার বলতে ইচ্ছে করছে, “যাবেন না তূর্য!” কিন্তু সে বলতে পারলো না। গলায় কী যেন আটকে আছে। তূর্যকে এগিয়ে দেয়ার বাহানায় সম্মুখে হাঁটা শুরু করলো।
এদিকে মিছিল তূর্যকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এগিয়ে এসে বলল,” সারাদিন আমাকে জ্বালিয়ে প্রেমময়ীর সাথে কথা বলেই চলে যাচ্ছেন? এটা মানবো না।”
” আজ সারাদিন তুমি আমার খুব উপকার করেছো। এখন বলো কী চাও!”
মিছিলের হাতে মেহেদি ছিল সে ভেবে উত্তর দিলো, ” হাত বাড়িয়ে দিন, বলছি।”
তূর্য হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলো। মিছিল সুন্দর করে সেখানে টি এবং এন ইংরেজি অক্ষরে লেখে লাভসেটের মধ্যে আবদ্ধ করে দিয়ে বলল,” আজীবন আমার জানটার মুখে এভাবেই হাসি ফুটিয়ে রাখবেন, ভাইয়া! এটা আপনার এই ছোট বোনের আবদার!”

তূর্য মুচকি হেসে অন্য হাতে মিছিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” যেদিন থেকে তার দুঃখগুলো মুছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছি সেদিন থেকেই তাকে নিজের করে নিয়েছি।”

মিছিল ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। কেউ ডাক দেয়ায় তূর্যকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।

মিছিলদের বাড়ির গেইটের কাছাকাছি আসতেই নয়না থেমে যায়। তার পিছনে তূর্য, ছাদ থেকে নামতে দেরী করেছে। নয়নার কাছাকাছি এসে তূর্য কঠিন এক আবদার জুড়ে বসলো,” একবার তোমার হাতটা ধরতে দিবে, নয়ন?”

নয়না কী করবে বুঝতে পারছে না। নয়না দাড়িয়ে রইলো। নীরবতা সম্মতির লক্ষ্মণ, তূর্য এটা ভেবে মুচকি হেসে নয়নার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে বলল,” এই হাত কখনোই ছাড়বো না। সাবধানে থেকো, নয়ন!”

তূর্য চলে গেলো। রেখে গেলো থরথর করে কাঁপতে থসকা নয়নাকে। তূর্য যেই হাত ধরেছিল সেই হাত চোখের সাৃনে মেলে ধরে নয়না। তূর্যের হাতে আঁকা মেহেদির ছাপ তার হাতে লেগে আছে। নয়না আশ্চর্য হয়ে তা দেখে বলল,” মানুষটা ইচ্ছে করেই এই কাজ করলো!”

চলবে…………..

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১৬+১৭

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: ষোলো + সতেরো

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ নয়নাকে ভাবনার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে তূর্য চলে গেলো। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে তার রাতের ডিউটি। অথচ সারা বিকেল বিশ্রামের নাম পর্যন্ত নেয়নি। রাত নয়টা বাজে, নয়না মাত্র গোসল সেরে বের হয়েছে। পরিধানে তূর্যের পছন্দ করা জামা। নয়না আয়নার সামনে দাড়ালো, ওড়না বিহীন শরীরে এখনো কালসিটে দাগগুলো বুঝা যাচ্ছে। নয়নার মনে পড়ে গেলো বাশারের কর্মকাণ্ডের কথা, মুহূর্তেই ঘামতে শুরু করলো মেয়েটা। বুকে ওড়না গুঁজে বিছানা ঘেঁষে আস্তে আস্তে বসে পড়লো নয়না, বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,” পৃথিবীর সকল পুরুষ অভিশপ্ত, নষ্ট। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না, কাউকে না।”

ভয় মানেই ভয়ংকর। একবার মনে ঢুকে গেলে ভয় কাটিয়ে উঠতে সময়ের প্রয়োজন হয়। এমন মানুষকে একাকী নয় বরঞ্চ সঙ্গী হয়ে একজনকে সারাক্ষণ পাশে থাকতে হয়। সারাদিন নয়নার পাশে কেউ না কেউ ছিল। দিনের অর্ধেক সময় তূর্যের সাথে কাটিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও কালো অতীত স্বরণে আসেনি নয়নার। কিন্তু অতীত! তা কী কখনো পিছু ছাড়ে? সর্বক্ষণ আঠার মতো মস্তিস্কে গেঁথে থাকে। একাকীত্বের সময় হানা দিয়ে বেড়ায়। বাশারের ছোঁয়া মনে হচ্ছে নয়নার সর্বাঙ্গে লেগে আছে। নয়না হাত, ঘাড়ে ইচ্ছেমতো হাত বুলাতে থাকলো। তার কাছে মনে হচ্ছে, এই জায়গাটুকু অপবিত্র হয়ে গেছে। মেয়েটা যেন নিজের মধ্যে নেই, মাথার চুল টেনে টেনে চিৎকার করে কাঁদছে।

রাত বারোটা ত্রিশ মিনিট,
তূর্য রোগীদের দেখে মাত্রই কেবিনে আসলো। আজকে রোগীদের সংখ্যা একটু বেশিই ছিল। ডিনার করারও সময় পায়নি সে। এখন খাবে কিন্তু একাকী খেতে কী আর ভালো লাগে? তূর্যের তিনজন সহকর্মী, সহকর্মী থেকে তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বেশী, মিনহাজ, মাহিন ভাবনা, এরা সারাদিন ডিউটি করে সন্ধ্যায় চলে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু রোগী বেশি থাকায় থেকে যেতে হলো। তূর্য খাবার সামনে রেখে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সে জানে আগামী পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিন বদমাশ এখানে এসে উপস্থিত হবে। শুধু তাই নয়, তূর্যকে লজ্জায় ফেলতে যা মুখে আসে তাই বলবে। গুনে গুনে তিন মিনিট পর তূর্যের কেবিনের দরজায় করাঘাত হলো। একে একে তিন মাথা ঢুকিয়ে একসাথে আওয়াজ করলো,” আসতে পারি, স্যার?”
তূর্য প্লেট সাজানোর মিথ্যা বাহানা করে বলল,” আয়!”

হুড়মুড় করে তিনজন প্রবেশ করে কে কার আগে চেয়ারে বসতে পারবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিলো। আড়চোখে তূর্য দেখে কিছু বলল না। প্লেটে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করলো। তূর্য ছাড়া বাকী তিনজন রেলগেইটের বিখ্যাত হাজির বিরিয়ানি থেকে কাচ্চি নিয়ে এসেছে।বিরিয়ানির ঘ্রাণে সারা কেবিন ম ম করছে। মিনহাজ বিরিয়ানির প্যাকেট থেকে গন্ধ শুঁকে বলল,” মামার হাতের জাদু তো এই কাচ্চিতেই। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, মামার হাতের জাদু বউয়ের উপর কীভাবে ফেলে, চ্যাপ্টা হয়ে যায় না?”

ভাবনা মিনহাজের পিঠে দুরুম করে কিল বসিয়ে বলল,” আজাইরা বকতে একদিনই নিষেধ করিনি! তোর সাথে আমার সম্পর্ক সব শেষ।”

মিনহাজ চুপসে যায়, ভাবনার এপ্রোনের কোণা টেনে ইনোসেন্ট হয়ে বলল,” মুখ আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না, জানেমান। প্লিজ রাগ করো না।”

তূর্য বন্ধুদের মজা দেখে হাসছে। এরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। আগামী দুই বছর ক্যারিয়ার গঠন করে বিয়ে পর্যন্ত এগোবে। তূর্য বিনাবাক্যে খেয়েই যাচ্ছে, কথা বলছে না। এদিকে তিন বন্ধু কীভাবে কথা তুলবে বুঝতে পারছে না। বুকে সাহস সঞ্চয় করে ভাবনা বলে উঠলো,” বাসায় নয়না একা, না জানি কী করছে!”

তূর্য খাওয়া বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে নিয়ে পুনরায় খেতে লাগলো। ভাবনা নড়েচড়ে মাহিন ও মিনহাজকে ইশারায় বলাবলি করে তূর্যের উদ্দেশে বলল,” নয়না কী বলল রে?”

” আমার গলার সুর নাকি শেয়ালের মতো।”

তূর্যের থমথমে কথায় পুরো কেবিনে হাসির বন্যা বয়ে গেলো। মিনহাজ হাসি থামিয়ে বলল,” তোর এ্যাটিটিউড একজনের কাছেই শেষ। শেষে কিনা তোকে শেয়াল বানিয়ে দিলো!”

তূর্যের খাওয়া শেষ। হাত ধুয়ে এসে তিন বন্ধুদের তাগাদা দিয়ে বলল,” বের হো তোরা। আমার কিছু প্রাইভেট কাজ আছে।”

তিন বন্ধু একসাথে সুর তুলল। ভাবনা প্যাকেট গুছিয়ে প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” নয়নার নিয়ে ভানাই তো তোর এখন প্রাইভেট কাজ, তাই না?”

” বেশি বকবি না, তুই আজ চলে যা। নয়নাকে এখন একা রাখা ঠিক হবে না।”

” ওরে! কী চিন্তা নয়নার জন্য! এদিকে বন্ধুরা কতো না খেয়ে শুঁকিয়ে যাচ্ছে তার খবর নাই।”

মাহিনের কথা শেষ হতেই ভাবনা বা হাত ঢোকায়,” প্রেমিকাকে পেয়ে আজ বন্ধুদের ভুলে গেছে, আমাদের হ্যান্ডসাম তূর্য।”

” বাজে বকিস না, ভাবনা। মিনহাজকে নিয়ে বিদায় হো। আমি এদিকটা সামলে নিব।”

ভাবনা, মিনহাজ হেসে বিদায় নিলো। মাহিনের খাওয়াও শেষ পর্যায়ে। সে সিরিয়াস ভঙ্গিতে তূর্যকে বলল,” মেয়েটার মেডিক্যাল কন্ডিশন কেমন মনে হলো তোর কাছে? ”

তূর্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,” বুঝতে পারছি না। তবে তাকে একাকী রাখা যাবে না। একবার বিশ্বাস উঠে গেলে দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। নয়নার সাথে যা ঘটেছে তারজন্য সে গোটা পুরুষজাতিকেই ভয় পাবে, ঘৃণা করবে। নয়নার মনে আদৌও বিশ্বাস জন্মাতে পারব কী না, জানি না।”

” ওর ফুফুর বাড়ির লোকেদের শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।”

ফুফুর কথা উঠায় তূর্যের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। হেলান ছেড়ে রূঢ় সুরে বলল,” তাদের ব্যবস্থাও করে ফেলেছি।”

রাত একটা বাজে পয়তাল্লিশ মিনিট,
মাহিনকে বসিয়ে তূর্য হাসপাতালের দক্ষিণ পাশে চলে আসলো। উদ্দেশ্য নয়নার সাথে কথা বলার। এতো রাতে ফোন দেয়া অবশ্যই ভদ্রতার কাজ নয় কিন্তু তার মন মানছে না। নয়নার গলার স্বর শোনার জন্য মন আকুপাকু করছে। নয়নাকে রেখে আসার সময় জোর করে এন্ড্রয়েড ফোন দিয়ে এসেছে সে। ফোন ধরবে কী না সন্দেহ! সাতপাঁচ ভেবে তূর্য ফোন করল, একবার দুইবার রিং হতেই ঘুম ঘুম কণ্ঠে নয়না ফোন ধরে বলল,” আপনারা ডাক্তাররা কী রাতেও ঘুমান না?”

ঘুম ঘুম স্বরেও কী আলাদা সুর আছে? তূর্য চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আপনমনে বলল,” ঘুমালেও মেয়েটার মস্তিস্ক সচল থাকে, ভবিষ্যতে জামাইকে ভাই ডাকার সম্ভাবনা থাকবে না।”

” শুনছেন?”

তূর্য এবার মুখ খুলল। ঠোঁটের আগায় দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলল,” একজন মেয়ে এভাবে কখন ডাকে, জানো?”

নয়না ঘুমঘুম চোখে উঠে বসলো। ভাবনা পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পিঠে বালিশ চেপে বলল,” কখন?”

” বিয়ের পরে। আমার এখন বিয়ে বিয়ে ফিলিংস হচ্ছে, নয়ন!”
নয়নার চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেলো। কান থেকে ফোন সরিয়ে আচ্ছামতো তূর্যকে বকেও নিলো। অপরপাশে তূর্য বেহায়ার মতো হাসতে লাগলো। নয়না ফোন কানে রেখে শক্তকণ্ঠে বলল,” আপনার রোগীরাও কী আপনার মতো পাগল?”

তূর্য একধাপ এগিয়ে উত্তর দিলো,” আমার থেকেও মহা পাগল, নয়ন! মহা পাগল।”

নয়ন ফট করে কল কেটে দিলো। তূর্যের কথায় তারও ভীষণ হাসি পাচ্ছে। এমনসময় ভাবনা ঘুমঘুম কণ্ঠে বলে উঠলে, ” বাহ! নয়না দেখি হাসতেও জানে।”

ফোন বালিশের নিচে রেখে নয়না দ্রুত শুয়ে পড়লো। শুধু তাই নয়, চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখলো যেন ভাবনা ফের কথা বলার সুযোগ না পায়।

———————

সকাল সকাল আকলিমার ঘুম ভাঙে পাতিলের ঠাস ঠুস আওয়াজ শুনে। বেচারি রাতে কড়া ঘুমের ঔষধ সেবন করে ঘুমিয়েছিল। মাসুদা নামক মেয়েটার পরিচয় জেনে আকলিমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মাসুদা সেই মেয়ে যার পরিবার বাশারকে দেখতে এসেছিল। নয়নাকে এবাড়িতে দেখে বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। এরজন্য নয়না বিনা কারণে আকলিমার হাতে মা’র খেয়েছিল। আকলিমার ভদ্র, সুশিক্ষিত ছেলে সেই মেয়ের সাথে প্রেমালাপ করে বিয়েও করে নিয়ে এসেছে! এসব শুনে আকলিমার প্রেশার বেড়ে গেছে। বাশার রাতে বাড়ি ফিরলে আকলিমা কিছুক্ষণ জুতাপেটা করলো। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে নিজের ঘরে চলে গেলো। সকালের উচ্চ আওয়াজ আকলিমার সহ্য হচ্ছে না। ঘর ছেড়ে তাই আকলিমা বের হয়ে আসলো। রান্নাঘর থেকে শব্দ ভেসে আসছে। আকলিমা সেদিকেই গেলো। মাসুদা আকলিমার এতো বছরে গড়া পাতিলগুলো পুঁতা দিয়ে ভর্তা বানাচ্ছে। আকলিমা দৌড়ে মাসুদার হাত থেকে পুঁতা নিয়ে নিলো। পাতিলগুলোর দিকে মায়াভরা চাহনি দিয়ে রাগান্বিত স্বরে ধমক দিয়ে বলল,” একদিনের মেয়ে হয়ে আমার সংসারের জিনিস নষ্ট করছো কোন সাহসে।”

মাসুদা আকলিমার কথার প্রত্ত্যুত্তরে কিছু না বলে মরা কান্না শুরু করলো,” ও বেবিই! দেখে যাও তোমার মা আমাকে কথা শোনাচ্ছে।”

বাশারের মন আজ ফুরফুরে। এতো বছরের মনোবাসনা পূরণ হয়েছে। সুন্দরী বউয়ের সাথে ভালো সম্পদও ফ্রী হিসাবে পেয়েছে। এখন বউয়ের আহ শব্দও কী সহ্য করা যায়! বাশার ঘর ছেড়ে দৌড়ে আসলো। মাসুদার কান্না দেখে জিজ্ঞেস করলো,” কী হয়েছে আমার ময়না পাখির?”

” তোমার মা আমাকে নিজেই বলল, পাতিল গুলো ভাঙতে। আর এখন নিজেই এসে কথা শোনাচ্ছে।”

আকলিমা আকাশ থেকে টপকে পড়লো যেন। মুখে তা রা নেই। ইশারায় কথা বলবে শরীর সায় দিচ্ছে না। বাশার মুখ ফুলিয়ে বলল, ” ছেলের বউয়ের সাথে এ কেমন ব্যবহার,মা! তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি।”

আকলিমা স্তব্ধ হয়ে গেলো। থমকে গেলো তার পৃথিবী। যেই সন্তানের জন্য নিজের ভাইজিকে বিনা দোষে পিটিয়েছে সেই সন্তানই তার উপর আঙুল তুলছে! এটাই কী শাস্তি? বাশার সেই কখন চলে গেছে! আকলিমা নষ্ট করা পাতিল গুলোর দিকে চেয়ে গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

—————————

রবিবার তূর্যের ছুটির দিন থাকে। প্রয়োজন ছাড়া এই দিনে তূর্য ছুটি কাটায় না। আজ ছুটির দিনটা নয়নার সাথে কাটাবে বলেই দক্ষিণ ছায়াবীথি এলাকায় আসে। এখন বাজে সকাল সাতটা। এই সময়ে সবাই ঘুমে নিমগ্ন। তূর্য একটু বেশি সকালেই আলে আসলো নাতো! সময়ের চিন্তা মাথায় আসতেই তূর্য বিরক্তি প্রকাশ করলো। এই সময়টুকু সে কোথায় কাটাবে? ভাবনার বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো তূর্য। গাড়ি থেকে নেমে এদিকসেদিক পায়চারি করতে লাগলো।

নয়নার ঘুম সকাল সকাল ভেঙে গেলো। সকালের সতেজ হাওয়া গায়ে লাগানোর জন্য বারান্দায় আসে সে। চারপাশের মনোরম দৃষ্টি উপভোগ করে নিচে তাকাতেই তূর্যের দেখা মিলে। তূর্য অস্থির চিত্তে পায়চারী করছে তা দেখে নয়না ডেকে উঠলো তূর্যকে,” সকাল সকাল জগিং করতে বের হয়েছেন নাকি, ডাক্তার সাহেব?”

তূর্য মনে মনে খুব খুশি হলো। সে তো নয়নার জন্যই এখানে এসেছে। কিন্তু এভাবে যে পেয়ে যাবে কল্পনাও করেনি। মুখে হাসির রেখা টেনে তূর্য বলল,” ডাক্তার মানুষ তো! একটু নিয়ম মেইনটেইন করতে হয়! ডাক্তারের সঙ্গ লাগবে বুঝি!”

নয়না ভেংচি কেটে বলল, ” অমন হাতুড়ি ডাক্তারের সঙ্গ পাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই।”

অন্য কেউ শুনলে অপমানবোধ হতো কিন্তু তূর্য নির্লজ্জের মতো হেসে বলল,” এই ডাক্তারের উপরই কিন্তু একসময় ক্রাশ খেয়েছো, মেয়ে!”

মন্দ শোনা গেলেও কথাটা মিথ্যা নয়। নয়নার মনের দুর্বল একটা স্থান রয়েছে তূর্যের জন্য। যা সে কাউকে বলেনি, আর কখনো হয়তো বলতে পারবেও না। তবে তূর্য এভাবেই যদি নয়নার আশেপাশে সবসময় ঘুরঘুর করে তো কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। যা নয়না চায় না।
সে কিছু না বলে ঘরে ফিরে আসে। ভাবনা গোসল শেষ করে তাড়াহুড়োর মধ্যে আছে। বেচারি আজ রান্নাও করতে পারেনি। দশ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারলে মাহবুব শিকদার তার শিরচ্ছেদ করে ফেলবে। ভাবনার জলদি কাজ করা দেখে নয়না বলে উঠলো, ” আমার জন্য আপনার সমস্যা হচ্ছে, আপু। আমি না থাকলে আপনার সমস্যা হতো না। এরচেয়ে ভালো হয়, আমি চলে যাই। তাহলে আপনি চিন্তামুক্ত থাকবেন।”

ভাবনা গায়ে এপ্রোন জড়িয়ে উত্তর দিলে,” আপু ডাকছো কিন্তু মানছো না, নয়না। তুমি আমার ছোট বোনের মতো। তুমি থাকলে আমার বিরক্ত নয় ভালো লাগে। একাকী বাসায় আসার পর দুইখানা কথা বলার মানুষ পাই না এই শহরে। তোমাকে পেয়ে কথা বলার মানুষ পেয়েছি। এছাড়া তোমার এখন সেফটি প্রয়োজন। তোমার ফুফু, ভাই হায়েনার মতো তেমাকে খুঁজছে। তূর্য সবটা সামলে নিচ্ছে। পরিস্থিতি ঠিক হলে সেই তোমাকে বলে দিবে, কী করতে হবে।”

নয়না কী বলবে ভেবে পেলো না। এমন সময় সদর দরজায় করাঘাতের আওয়াজে শোনা গেলো।নয়না জানে, মানুষটা কে? ভাবনা ভেবেছে নয়না দরজা খুলে দিবে কিন্তু তাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেই এগিয়ে গেলো।
তূর্যকে এতো সকালে দেখে ভাবনার কোনে ভাবান্তর হলো না। বরং সে তূর্যকে তাগাদা দিয়ে বলল,” নয়নকে নিয়ে একবার স্যারের সাথে দেখা করিয়ে আনিস তো তূর্য! আমি বেরোলাম, কিছু লাগলে নয়নাকে বলিস।”

তূর্য নয়নার পাশে এসে দাঁড়ালো। এই মুহূর্তে নয়না তূর্যকে তার কাছাকাছি আশা করেনি। সে চলে যেতে নিলে তূর্য হাত ধরে ফেলে নয়নার উদ্দেশে বলল,” যে তোমাকে আগলে রাখবে তার কাছে নিজেকে নিরপদ মনে করবে। মনে রাখো, সব পুরুষ নারী লোভী হয় না।”

” গোটা পুরুষজাতি খারাপ হওয়ার জন্য দলবদ্ধ হতে হয় না। পুরুষজাতিকে চেনার জন্য একজন পুরুষই যথেষ্ট।”

তূর্য নয়নার হাত ছেড়ে দিয়ে শান্তস্বরে বলল,” সব পরুষ যদি খারাপ হতো, তবে পৃথিবীর কোনো মেয়েই-ই বাবার রাজকন্যা হতো না। তোমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে বিশ্বাস করতে না পারো, কষ্ট দিও না।”

তূর্য মুচকি হেসে নয়নাকে এক ঝলক দেখে চলে গেলো। নয়নার কী হলো জানে না। বারবার চোখের সামনে তূর্যের আহত মুখখানা ভেসে উঠলো। নয়নার ছলছল চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি ঝড়ে পড়লো। সে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো, ” তুই তো মানুষটাকে দূরে সরিয়ে রাখতেই চাইছিলি। তাহলে কাঁদছিস কেন?”
উত্তরটা নয়নার অজানা।

————–

ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। বারান্দায় চেয়ার পেতে বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ে নয়না বাহিরে দৃষ্টিনিপাত করে আছে। তূর্য চলে যাওয়ার পর থেকেই অনুশোচনায় ভোগছে মেয়েটা। হৃদপিণ্ডের যন্ত্রণায় পুড়ছে সে। সে তো মানুষটাকে কষ্ট দিতে চায়নি কথায় কথায় কী ভুলভাল বকে ফেলেছে! নয়নার মনে পড়ে যায়, তার বিধ্বস্ত সময়কার কথা। যখন সে মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে ট্রেনের নিচে ঝাপ দিচ্ছিল তখন এই মানুষটাই তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। সেই সময় থেকে এই পর্যন্ত মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে নয়নাকে আগলে রেখেছে। নয়নার মানসিক শান্তির জন্য শত ব্যস্ততার মাঝে সময় দিয়েছে। আজ নয়না তার হৃদয়ে কষ্ট দিলো!

টেবিলের উপর মুঠোফোন পড়ে আছে। নয়নার দৃষ্টিতে অনেক্ক্ষণ যাবত সেদিকেই। তূর্যকে কল দিবে কী না! সাতপাঁচ ভেবে তূর্যের নাম্বারে কল লাগালো নয়না। একটি ফোনকলের আশায় তূর্য হয়তে অপেক্ষায় ছিল। রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ করে বলল,” এখন আসতে বলবে না,প্লিজ! আমি নিজেকে আটকাতে পারব না।”

নয়না মুচকি হেসে তূর্যের নিষেধাজ্ঞা কাজটাই করলো, ক্ষীণ স্বরে বলল,” আসুন না?”

তূর্যের ছটফটে কন্ঠ থেমে গেলো। ভেসে উঠলো একচিলতে গভীর নিঃশ্বাস! থেমে থেমে উত্তর দিলো,” দরজা খুলো।”

অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে নয়না। তূর্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে? তারমানে সে যায়নি, এতক্ষণ দরজার পাশেই ছিলো? তাড়াহুড়োয় নয়না নিজের দিকে খেয়াল করলো না। সোজা দরজার কাছে এসে খুলে দিলো।

এলোমেলো কেশ, চিন্তিত মুখ, ভরাট চোখজোড়া চাঞ্চল্য মন! এতটুকুতেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তূর্য। তার অবাধ্য মন চলে যেতে চায়নি। সে জানতো নয়না তাকে খুঁজবে। হলোও তাই! তূর্য মুচকি হেসে বলল,” কী ব্যাপার ম্যাডাম! তাবরেজ তূর্যকে কী মনে ধরেছে?”

নয়না নতমুখী হয়ে উত্তর দিলো, ” অল্পস্বল্প মনে ধরেছে, কিন্তু পুরোটা না।”

” তা পুরো মন দখল করার জন্য ডাক্তারকে কী মনোবিজ্ঞ বিদ্যা পড়া শুরু করে দিতে হবে?”

নয়নার হাসি পাচ্ছে। গম্ভীর তূর্যের থেকে ঠোঁটকাটা তূর্য বড্ড অশান্ত। নয়নাকে নাস্তানাবুদ করতে এক পা এগিয়ে। দরজা ছেড়ে দাড়িয়ে উত্তর দিলো,” আপনার মনকে শক্ত করে বেঁধে আমাকে দিয়ে দিন, তাহলেই চলবে।”

চলবে………….

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১৫

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: পনেরো

কারো ঘরে সুখ নামে তো কারো ঘরে দুঃখ। ভালো খারাপ মিলিয়েই মানুষের জীবন। এই জীবনে দুঃখ যখন নেমে আসে সুখের ঠিকানা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যায়। আকলিমা ভাত রান্না করছিলো, পাতিলের উপর খুন্তি দিয়ে ঠিকই নাড়াচাড়া করছিল কিন্তু তার ধ্যান ছিলো অন্যদিকে। ভাতের মাড় হাতে ছিটকে আসায় ধ্যান ভাঙলো। কলের পানি ছেড়ে কিছুক্ষণ হাত ধরে রাখলো, আহ! পুড়ে যাওয়ার কী যন্ত্রণা! জ্বলছে খুব কিন্তু ঔষধ লাগিয়ে দেয়ার মতো কেউ নেই। আকলিমার মনে পড়ে নয়নার কথা! একদিন মুরগি কা’ট’তে গিয়ে হাত কে’টে ফেলল আকলিমা। গলগল করে র’ক্ত বের হচ্ছিল। নয়না সোফা পরিষ্কার করছিল, ফুফুর আর্তচিৎকার শোনা মাত্রই কাজ ফেলে চলে আসে। কাটা জায়গায় চেপে ধরে ফোপাঁতে থাকে। সেদিন আকলিমার কাছে নয়নার কান্না নেকামি মনে হয়েছিল কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছে নয়না তাকে কতোটা আপন মনে করতো।

আকলিমার চিন্তার শেষ নেই! একদিকে নয়না নিখোঁজ অন্যদিকে নতুন আপদ এসে জুটেছে আকলিমার সংসারে। দুই ডাক্তারের যন্ত্রণায় আকলিমা বিরক্ত সাথে চিন্তিত। রাত নাই দিন নাই সময়ে অসময়ে যাকে ভদ্রলোক ভেবেছিল সে মিসড কল মারে। নাম্বার কোথায় পেয়েছে কে জানে! আকলিমা প্রথম ভেবেছিল দুধ ওয়ালা কিন্তু ফোনে কথা বলার পর ভদ্রলোক বলে উঠলো, ” বেয়াইন সাহেবা! পুদিনা পাতার ভর্তা করতে পারেন? সেই স্বাদ, জিভে লেগে থাকার মতো। আমি খুব ভালো বানাতে পারি। একদিন আপনার জন্য নিয়ে আসবো। পুদিনা পাতার সাথে কাঁচা মরিচের কম্বিনেশনটা দারুণ। মনে রাখবেন, কাঁচা মরিচ পুদিনা পাতার থেকে পরিমানে বেশি থাকতে হবে, নয়তো স্বাদ পাবেন না। সর্বশেষে যা বলতে ফোন করেছিলাম, আমার বউমাকে খুঁজে পেলেন?”

ভদ্রলোকের কথার আগা মাথা আকলিমা বুঝলো না। সে প্রত্ত্যুত্তরে বলেছিল, ” আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন? আমার ভাইজি কোথায় কীভাবে আছে তা আমাদের ব্যাপার। আপনাকে যেন আর নাক গলাতে না দেখি।”

এই কথাগুলো আকলিমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপর থেকে ভদ্রলোক সরাসরি কল নয় মিসড কল দিতে থাকে। বিরক্ত হয়ে সকাল থেকে আকলিমা ফোন বন্ধ করে রেখেছে। হাতের জ্বালা কমছেই না। বাশার সারাদিন কানে ফোন রেখে ঘরের কোণায় পড়ে থাকে। আজ সকাল থেকে কোথায় গেছে কে জানে? সকাল সকাল বেশ তাড়াহুড়ায় বের হয়েছিল, এখন বিকাল প্রায়! বাশার ফিরে আসেনি। এদিকে একাকী আকলিমা দুপুরের খাবারও খায়নি। রান্না করতে বসলো আর হাত পুড়ে গেলো! বেসিন থেকে হাত সরিয়ে ঘরের দিকে আগাচ্ছিল আকলিমা। উদ্দেশ্য বান ক্রিম পুড়ে যাওয়া স্থানে লাগিয়ে দিবে। কিন্তু তা আর হলো না, কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দুয়ারের সামনে থেকে ঘুরে আসতে হলো আকলিমার। বিরক্তি তার চোখেমুখে, অসময়ে কারো আসার কথা নয়। বিড়বিড় করতে করতে আকলিমা দরজা খুলল। দরজার অপরপাশে মাহবুব শিকদার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। একহাতে শপিং ব্যাগ। আকলিমা কাচুমাচু হয়ে দরজা অবরোধ করে দাড়িয়ে বলল,” ভদ্রলোক বলে চিল্লাপাল্লা করছি না, বাধ্য করবেন না।”

মাহবুব শিকদার আহত হওয়ার নাটক করে বললেন, ” আমরা আপনার জন্য পুদিনা পাতার ভর্তা বানিয়ে এনেছিলাম, বেয়াইন।”

আকলিমা বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলো চারপাঁচ জন ছেলে দাড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে। আকলিমা শুঁকানো ঢোক গিলে পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। মাহবুব শিকদার খুশিতে গদগদ হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।

” এক কাপ চা হবে বেয়াইন সাহেবা?”

আকলিমা দাঁতে দাঁত চেপে চা বানাতে চলে গেলো। মাহবুব শিকদার আরামে সোফায় বসলেন। রিটায়ার্ডের সময় হয়ে এসেছে। শেষ বয়সে নাটক ফাটক করতে বেশ লাগছে তার কাছে। আকলিমা চা আনলো, শব্দ করে মাহবুব শিকদার চুমুক দিয়ে বলল,” এক ফ্যাক্স চা করে দিতে পারবেন, বেয়াইন সাহেবা! রোদে পুড়ে যাওয়া আমার ছেলেদের জন্য! তারা আজ থেকে আপনার বাড়ির বাইরে ঘুরাফেরা করবে, আপনার নতুন অতিথি হিসাবে।”

আকলিমা চমকালো। ঐ ‘গু’ণ্ডা’র মতো ছেলেপেলেরা তার বাড়ির সামবে থাকবে? কিন্তু কেন? মাহবুব শিকদার চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর বিড়বিড় করছেন। আকলিমা বুঝতে পারলো এই লোককে কিছু বলে লাভ হবে না। আসলে এখন তার সময় খারাপ।

এক ফ্যাক্স চা হাতে মাহবুব শিকদার উঠে দাঁড়ালো। অন্য হাতে রাখা শপিং ব্যাগ আকলিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” পুদিনা পাতার ভর্তা অবশ্যই ট্রাই করবেন। চায়ের প্যাকেট দিয়ে গেলাম দিনে সাতবার কিন্তু ছেলেদের খোঁজ নিবেন। কিপ্টামি করবেন না বলে দিলাম, বেয়াইন সাহেবা! আমার ছেলেরা কিন্তু যেমন ভালো তেমন খারাপ। সময়ে চা নাস্তা না পেলে আমার মতো ঘরে চলে আসবে।”

দুষ্ট হাসিতে মাহবুব শিকদার আকলিমার গলা শুঁকানোর কাজ করে গেলো। দরজা পেরোনোর পূর্বে সিরিয়াস হয়ে বলল,” ক্ষমতা আপনিও দেখিয়েছেন, আমরাও দেখাবো। ভুলে যাবেন না, এতিমরাও মানুষ। তাদের উপর অত্যাচার উপরওয়ালাও সহ্য করেন না। প্রতিফল কিন্তু সবারই একদিন পেতে হবে।”

মাহবুব শিকদার হেসে চলে গেলো। আকলিমা দরজা বন্ধ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। ভাবতে লাগলো, তার সুখের দিনগুলো এভাবে শেষ হয়ে গেলো!

কতক্ষন আকলিমা বসেছিল, জানা নেই। পুনরায় কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে নড়েচড়ে উঠে সে। এবার কে এলো? গু’ণ্ডা’দ’লে’র লোক নয়তো! কাঁপা হাতে দরজা খুলে দেয় আকলিমা। দরজার অপরপাশে অচেনা মেয়েকে দেখে প্রশ্ন করলো,” তুমি কে,মা!”

মেয়েটা আকলিমাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঠেলে বলল, ” আমি মাসুদা, আপনার ছেলের বউ!”

এমনিতেও আকলিমা দৈহিক অসুস্থতার মধ্যে ছিল তার উপর এতো বড়ো সংবাদ পেয়ে নিজেকে সামলাতে পারলো না; লুটিয়ে পড়লো জমিনে। মাসুদা শাশুড়িকে পড়ে যেতে দেখে ধরলো না বরং ডিঙিয়ে নিজের ঘর খুঁজতে চলে গেলো।

——————————-

উত্তরার রাজলক্ষ্মীর নিচতলায় অবস্থান করছে নয়না। দুইহাতে তার শপিং ব্যাগ। তূর্য দশমিনিট ধরে তাকে এখানে দাঁড় করিয়প কোথায় যেন চলে গেছে ফেরার নাম নেই। এদিকে ভয়ে,চিন্তায় নয়নার হাত পা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। প্রায় দশ মিনিট পর তূর্য হাসিমুখে এগিয়ে এলো। নয়নার ধারণা ডাক্তররা সুন্দর হয়। কারণ ঘাঁটলে জানা যাবে, ডাক্তাররা সব সময় পরিষ্কার পরিপাটি থাকে বলেই সুন্দর মনে হয়। তূর্যও তাই! সুন্দর সাথে সুদর্শন। এই যে চোখে সানগ্লাস, মুখে হাসিতে ঘায়েল হবে যে কেউ। নয়না চোখ ফিরিয়ে নেয় তার অবাধ্য চোখজোড়া আজ বাধ্য করেই ছাড়বে। ভুলেও তাকাবে না। তূর্য নয়নার কাছে এসে তাগাদা দিয়ে বলল,” আমার সাথে চলো।”

নয়না বিরসমুখে উত্তর দিলো,” চলা ছাড়া কী আর উপায় আছে?”

তূর্য হাসলো, নয়নার বাঁকা কথাও তার ভালো লাগে। অবশ্য সে যেই পরিস্থিতিতে ছিল তূর্যকে মেনে নিতে বেশ কষ্ট হবে। তূর্য সেইদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে যেদিন নয়না নিজ ইচ্ছায় তূর্যের পাশে এসে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে মনের কথা বলবে।
আজীমপুরের পাশে লাল রঙের প্রাইভেট কার দাড় করানো আছে। তূর্য নয়নাকে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়।নয়নার হাত থেকে শপিং ব্যাগ গুলে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে রাখে। নয়না তূর্যকে বাঁধা দিয়ে বলতে শুরু করলো,” কার গাড়িতে ব্যাগ রাখছেন, নিয়ে চলে যাবে তো?”
তূর্য তখন শরীর ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয়,” আস্ত তাবরেজ তূর্যকে দেখো না মেয়ে! তোমাকে রাণীর মতো সাজিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে, তাবরেজ তূর্য। গাড়িটাও আমার, পাশের সুন্দরী আমার।”

” ফালতু কথা না বলে বাড়ি চলুন। আমার এখানে ভালো লাগছে না।”

তূর্য হাতের বন্ধনীতে নজর দিয়ে একটি রিকশা ডাকলো। প্রথমে তূর্য উঠে বসলো। কিন্তু নয়নার কোনো নড়চড় নেই সে দ্বিধায় দাঁড়িয়ে রইলো। তূর্য নয়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,” উঠে এসো, আমার নিয়ত খারাপ থাকলে বেলাই বিলেই অনেককিছু করতে পারতাম।”

মনে মনে নয়না ভীষণ লজ্জা পেলো। তূর্যের হাত না ধরেই রিকশায় চড়ে বসলো। দুজনের মাঝে যথেষ্ট ফাঁকা রয়েছে। এর মধ্যে দুর্যোগ গুনগুন করে গান ধরল,

“এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো!”

মুখে না বললেও নয়না মনে মনে উত্তর দিলো,” খুব খারাপ হতো, ঠিক আপনার গানের গলার মতো।”

চলবে…………..