Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 203



নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১৪

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: চৌদ্দ

সত্যিকারের বন্ধু কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবে না। শত ঝড় তুফান বয়ে যাক, বন্ধু কখনো আপনাকে ভুলবে না। আবার কিছু নামমাত্র বন্ধু আছে যারা প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে দূরে সরে যাবে। নয়না ও মিছিলের বন্ধুত্বটা অন্যরকম। নয়নাকে মিছিল ও তার পরিবার এতোটা আপন ভাবে যতোটা নয়নার ফুফুও ভাবে না। মিছিলের কোলে নয়না শুয়ে চোখের জল ফেলছে। মিছিলও সমানতালে নাক টানছে। সে ভাবতেও পারছে না কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রিয়,বন্ধুর সাথে এতো বড়ো ঘটনা ঘটে গেছে। এই তো, মিছিলের বড়ো ভাইয়ের বিয়ে পরের সপ্তাহে। সেই সুবাদে ব্যস্ত ছিল সে। এখন নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। মিছিল নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” আমাকে একটা কল করতি,মিছিল। পুলিশ নিয়ে তোর ফুফু এবং ঐ বদমাশ ভাইকে ধরিয়ে দিতাম।”

” সেই পরিস্থিতিতে ছিলাম না। আমার ফোনটাও নষ্ট হয়ে গেছে, ফুফুর কাছে পড়ে আছে। ”

সকাল সকাল মিছিলের আগমন ঘটেছে। ঠিকানা তূর্যই দিয়েছে তাকে। ভাবনা সকাল সকাল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলো। নয়নার জন্য নাশতা রেডি করে এসে বলল,” আমি চললাম, নয়না। দরজা আটকে বসে থাকবে। অবশ্য তূর্য ছাড়া এখানে কেউ আসবেও না। তবুও সাবধানে থাকবে।”

নয়না চট করে শোয়া থেকে উঠে প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” সে আসবে কেন? আর এমনিতেও আজ আমি চলে যাচ্ছি তাই না?”

ভাবনা অবাক হয়ে বলল,” কোথায় যাবে? তূর্য শুনতে পেলে তোমার ঠ্যাং ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবে। কোথাও যেতে হবে না, বোরিং লাগলে বই পড়ো, টিভি দেখো।”

এরপর মিছিলের উদ্দেশে বলল,” এই অবস্থায় নয়নাকে অন্য কোথাও পাঠানো ঠিক হবে না। তূর্য একদম বাড়ির বাইরে বের হতে নিষেধ করেছে। জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছো, কিন্তু নয়নার ভালোর জন্যই তূর্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

নয়না নাকচ করছে। সে অন্যের দোহাই দিয়ে চলতে চলতে ক্লান্ত। আকলিমা ছিল তার আপন ফুফু, খাইয়ে পড়িয়েছে সে। সেই ঋণ পরিশোধ করার দোহাই দিয়েই এত বছর সেখানে পড়ে ছিল। নিজের সম্মানও বিসর্জন হয়ে যাচ্ছিল। তবুও সেখানেই পড়ে থাকতো। ভেবেছিল বাবাহারা মেয়ের আপজন তো একজনই আছে। বাবা সমেত ফুফা ও তো কতো আদর করে! কিন্তু সেই যখন নয়নার দিক বিবেচনা না করে সবার মতো স্বার্থপরদের কাতারে দাঁড়ালো তখনই নয়নার জীবন এলোমেলো হয়ে গেলো। সে বুঝে গিয়েছিল এই পৃথিবীতে কেউ তার আপন নয়। সবাই স্বার্থপর, নিজের কার্যসিদ্ধি হাসিল করার জন্য নয়নাকে ব্যবহার করে শুধু। নয়না কাউকে জীবনে আর বিশ্বাস করতে পারবে না। বিশেষ করে পুরুষদের।
নয়না করুণ স্বরে ভাবনাকে বলল,” দুনিয়াটা স্বার্থপর, স্বার্থপর দুনিয়ার মানুষও। চাহিদা শেষ হলে সবাই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যাবে। আমি আর কারো বোঝা হয়ে থাকতে চাই না।”
” তার কাছে তুমি বোঝা নও, ভালোবাসার মানুষ।”

ভাবনা মুচকি হেসে চলে গেলো ঠিকই কিন্তু পিছনে রেখে গেলো অবাক হওয়া দুই রমণীকে। যারা আশ্বর্যিত হয়ে বসে আছে।
———————-

দুপুরে ঘুমানো আমাদের সমাজের মানুষের প্রধান কাজ। দুপুরের আলস্য সময়ে যাদের ঘুমানোর অভ্যাস নেই তারা নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে মগ্ন থাকে। নয়নাকে রেখেই মিছিলের চলে যেতে হলো। ভাবনা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই মিছিলের মুঠোফোনে কল আসলো, কয়েকমিনিটের কথায় মিছিলের মুখে হু হা ছাড়া কিছুই শুনতে পায়নি নয়না। শুধু দেখতে পেয়েছিল তার হাসিমাখা মুখটা হঠাৎ চুপসে গেলো। মিনমিন করে বলল, ” আচ্ছা, ভাইয়া।”

নয়নার যা বুঝার সে বুঝে গিয়েছিল। মিছিল আরো কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলো। দুপুরে নয়নার ঘুমানোর অভ্যাস নেই। অচেনা পরিবেশে কী করবে বুঝতেও পারছে না। অগত্যা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো নয়না। তিনতলা বিশিষ্ট বাড়ির থেকে কিছুদূরে একটি পুকুর রয়েছে। পুকুরটির নাম জোড়পুকুর। দুই পুকুর মিলে বিশাল আয়তকার পুকুরটি এরপর বিস্তৃত মাঠ। কয়েকজন ছেলেপুলে ক্রিকেট খেলছে। নয়না এক দৃষ্টিতে তাদের খেলা দেখছে। ব্যাট হাতে হ্যাঙলা ছেলের থেকে ব্যাটের উজন বেশি মনে হচ্ছে তার কাছে। বোলিং করা ছেলেটা গুলুমুলু, দারুণ এনার্জিতে দৌড়ে আসছে বল হাতে। টানটান উত্তেজনা, নয়না ভেবেই নিয়েছে হ্যাঙলা ছেলেটা আজ ব্যাটের ভাড়ে ম’র’বে অথবা বল লেগে। প্রায় পাঁচ মিনিট যাবত তূর্য নয়নার উৎকণ্ঠা দেখছে। মেয়েটা অদূরে কাকে দেখছে? তূর্যকে একটু আকটু দেখলেও তো পারে! এই যে, রোগীদের ফেলে নয়নাকে এক নজর দেখার জন্য সে দৌড়ে এসেছে। এই খবর কী মেয়েটা রাখে? তূর্যের ঐ দৃষ্টির উপর হিংসে হচ্ছে যেই দৃষ্টি তূর্যকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখছে। তূর্য নিজের ভাবনায় ভয়ংকরভাবে আশ্চর্য হয়! তাবরেজ তূর্য কারো দৃষ্টিকেও হিংসে করছে? ভাবা যায়! আশাপাশে নজর ফেলে তূর্য উচ্চ স্বরে বলল,” বউ, ও বউ!”

লোকসমাজে বউ বলে কেউ সম্বোধন করলে নয়না নয় যেকোনো মেয়েই ফিরে তাকাবে। নয়নার আর হ্যাঙলা ছেলের কতল দেখা হলো না তার পূর্বেই দৃষ্টি সরিয়ে আনলো। তূর্য নিচে বাইকে হেলাল দিয়ে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। তার মুখে অমায়িক হাসি। নয়নাকে দেখে হাত নাড়িয়ে হাই জানাচ্ছে। নয়না ভাবলো তার শুনতে ভুল হয়েছে তাই আড়চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি পুনরায় মাঠের দিকে নিবদ্ধ করবে তখনই তূর্য পুনরায় বলল,” ও বউ! তাকাও না!”

আশ্চর্য! নয়নাকে ডাক্তার বউ ডাকছে? কিন্তু কেন? এই ডাক্তার এমবিবিএস ডাক্তার নাকি পাগলদের ডাক্তার। পাগলদের ই হবে, নয়তো পাগলের মতো বিলাপ করছে কেন? নয়না কিছু না বলে নিচু মাথায় ঘরে চলে এলো।
তূর্য নয়নার চিন্তিত মুখখানা দেখে ভালোই মজা পাচ্ছিল কিন্তু নয়নার এরূপ চলে যাওয়ায় নিজেই বেকুব বনে গেলো। ভ্রু যুগল কুঁচকে হাতের বন্ধনীতে তাকিয়ে বিল্ডিংয়ের ভেতরে প্রবেশ করলো।

প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শুনে যাচ্ছে নয়না কিন্তু সে দরজা খুলছে না। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছে, দরজা খোলা উচিত হবে কী না। বাশারের কৃতকর্মের পর নয়না আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বাশার ছিল তার আপন ফুফাতো ভাই, তার কাছেই নয়না রেহায় পেলো না কিন্তু তূর্য! সেও বাশারের মতো হবে না তো! চার পাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজার অপর পাশ থেকে তূর্যের কণ্ঠস্বর শোনা গেলো, সে ভরাট কন্ঠে বলছে,” দরজা খুলো বলছি নয়না। আমি জানি তুমি দরজার কাছেই আছো! একজন খারাপ তাই বলে পুরো পৃথিবীর ছেলেরা খারাপ নয়। আর একজন ডাক্তারের সময় নষ্ট করে কী তুমি ঠিক করছো?”

সবাই বলে, ডাক্তারদের সময়ের মূল্য আছে। তাদের সময় নষ্ট করা মানে একজন রোগীর সাথে অন্যায় করা। নয়না কাল বিলম্ব না করে দরজা খুলে দাঁড়ায়। তূর্য নয়নার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর ফেলে বলল,” গোসল করোনি?”

পরিধানের মতো পোষাক নয়না নিয়ে আসেনি। ভাবনাও তার থেকে খাটো। টাইট ফিটিং জামা পড়ে ভাবনা। নয়না সেই পোষাক পরতে পারবে না। সে সবসময় ঢোলা ঢালা জামা পরিধান করে। দরজা ছেড়ে নয়না ভেতরে চলে আসলো। তূর্য ভেতরে প্রবেশ করে কিন্তু দরজা আটকালো না। সোফায় বসে নয়নার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,” চার্জে বসাও, আর এক কাপ কফি দাও।”

এমনভাবে তূর্য কথা বলছে যেন নয়না তার বিয়ে করা বউ! সে ভাবছে, বাশারের মতো তূর্যও যদি সুযোগে গা ছুঁয়ে দিতে চেষ্টা করে? তখন সে কী করবে? নয়না ইতস্ততঃ হয়ে ফোন হাতে নিলো সাথে তার ধারণাও পালটে গেলো। তূর্যের প্রতি অল্প বিশ্বাসও স্থাপন হলো মনে। তূর্য টি টেবিলের উপর রাখা হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা বইটি হাতে নিয়ে নড়াচড়া করে থাকলো। নয়না এই সুযোগে ফোন চার্জে বসিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। মেহমান ঘরে আসলে চা পানি খাইয়ে বিদায় দেয়ার মতো মেয়ে নয়না নয়। রান্নাঘরে থাকা ফ্রীজ খুলে ডিম দেখতে পেলো নয়না। সেল্ফের উপর নুডলস দেখেছে সে। ঝটপট নুডলস রান্না করে এক কাপ কফিও তৈরী করে নিলো নয়না। ট্রের উপর সুন্দরভাবে সাজিয়ে তূর্যের সামনে পরিবেশন করলো। তূর্যের উপন্যাসের প্রতি কখনো আগ্রহ জন্মায়নি। শুধুমাত্র নয়না যেন তার উপস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকতে পারে এজন্যই বই ধরা। গল্পের ইমনের ছোটবেলার কচ্ছপ ধরার কাহিনীটুকু পর্যন্ত পড়তে পেরেছে। নয়নাকে আসতে দেখে বই বন্ধ করে তাকালো তূর্য। চোখের সামনে নাস্তা কফি দেখে খানিকটা অবাক হলো। টু শব্দ না করে নুডলস হাতে নিলো। এক চামচ নুডলস মুখে পুড়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো। তূর্যের মা মা’রা যাওয়ার পর থেকে নিজে অথবা চাচা রান্না করে খাওয়া হয়। মাহবুব শিকদারের কোনো সন্তান নেই। স্ত্রী অল্প বয়সেই প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায় তারপর আর ভদ্রলোক বিয়ে করেনি। তূর্যকে লালন-পালন করে বড়ো করেছেন। বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদই আলাদা আর বাড়ির খাবারের স্বাদই আলাদা। আরেক চামচ মুখে দিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলল,” বাহ! এখন থেকেই ডাক্তারের কঠোর মনকে নরম করার কৌশল শিখে ফেলছো? আ’ম ইম্প্রেসড।”

নয়না মুখ বাঁকা করে উত্তর দিলো,” মেহমান এসেছে আপ্যায়ন করছি, সে ডাক্তার নাকি পাগল তা দেখছি না। আপনাকে খুশি অখুশি করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। অন্য কেউ আসলে তাকেও আপ্যায়ন করতাম!”

” কিন্তু আমাকে স্পেশালভাবে আপ্যায়ন তো করছো, মুখে স্বীকার না করলেও আমি জানি।”

নয়না আঙল তুলছিল কিছু কটু কথা শুনিয়ে দিবে। তূর্য বলতে না দিয়ে কফির দিকে ইশারা করে বলল,” কফির বদলে শরবত মেহমানকে খাওয়াতে চাচ্ছো? গরম করে নিয়ে আসো।”

তূর্যকে নয়নার ইচ্ছে করছে গলা টিপে মে’রে ফেলতে। প্রথমদিন নয়না ভেবেছিল তূর্য বেশ গম্ভীর ও বদমেজাজী ডাক্তার মানুষ কিন্তু আজ দেখলো, তূর্যের মতো দুষ্ট, ইতর, ঠোঁটকাটা ডাক্তার এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।

নয়নাকে রাগিয়ে তূর্য বেশ মজা পাচ্ছে। কফির কাপ হাতে নিয়ে হনহন করে নয়না চলে গেলো। তূর্য নুডলস পুরো শেষ করে বিড়বিড় করে বলল,” তিনবেলা খাবার রান্না করার জন্য হলেও এই রাঁধুনিকে আমার চাই!”

পরমুহূর্তে নয়নার কথা চিন্তা করে হেসে ফেলল। কফির মতো তেঁতো মুখো মুখ করে নয়না আসলো। তূর্য এবার দৃষ্টি সরায়নি, নয়নার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে নয়না বলল,” এখন আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে না?”

তূর্য কফির কাপ হাতে নিতে নিতে উত্তর দিল,” ডাক্তার যখন রোগী হয়ে যায়,তখন সময়ের চিন্তা করে কী লাভ! আমার একটু চিকিৎসা করে দাও তো, রাঁধুনি!”

নয়না প্রচুর বিরক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে তূর্যের ঠোঁট কাটা কথা শুনে ইচ্ছে করছে জোড়পুকুরে চুবাতে। নয়নার কাছ থেকে প্রত্ত্যুত্তর না পেয়ে তূর্য সিরিয়াস কণ্ঠস্বরে বলল,” ফোনটা নিয়ে আসো তো,নয়ন!”

নয়ন-ই তো ডাকলো! কিন্তু এই ডাকায় আপন আপন সুর বেজে উঠলো কেন? সাথে নয়নার হৃদ কম্পনও দ্রুত হলো। পা টিপে টিপে নয়না ফোন নিয়ে আসলো। তূর্যের হাতে ফোন দিলে এবার তূর্য ভদ্রতা দেখালো না। নয়নার হাত শক্ত করে ধরে দরজার দিকে এগিয়ে তাগাদা দিয়ে বলল,” দ্রুত চলো, নয়ন! ডাক্তারদের মতো আজকাল মার্কেটের লোকেদের হাতেও সময় কম থাকে। যখন তখন দোকান খুলে বসে থাকে না।”

নয়না হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। চিৎকার করছে সমানতালে,” হাত ছাড়ুন। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

তূর্য সিঁড়ি ডিঙিয়ে নামতে নামতে উত্তর দিলো,” তোমাকে বেঁচে দিতে।”

চলবে…………..

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১৩

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: তেরো

মাহবুব শিকদার সোফায় বসে আছে। ভদ্রলোক আরামে বসে চা পান করছে। অবশ্য চা তিনি নিজেই চেয়ে নিয়েছে। আকলিমা সম্মোহনী হয়ে চা করে নিয়ে এসেছে। বুট স্যুট পরিহিত ভদ্রলোককে পরিচিত মনে হচ্ছে তার কিন্তু স্বরণে আসছে না। কথাবার্তায় ভদ্রতার ছোঁয়া, বড়োলোকও হবে! আকলিমার বুঝে আসছে না, ভদ্রলোক কেন এসেছে।
আকলিমার প্রতিবেশী ফজল মিয়া, রোজ স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে। কারণ ঘাঁটলে দেখা যায়, স্ত্রী পরকিয়ায় আসক্ত। আজও তাদের মাঝে ঝগড়া হচ্ছে। ভদ্রলোক বাড়িতে আসছে, শব্দদূষণেরও একটা ব্যাপার আছে! আকলিমা প্রধান ফটক আটকে দেয়ার জন্য উদ্যোগ নিলো। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে তখন মাহবুব শিকদার বলল,” দরজা আটকাবেন না, আমার ভাইপো আসবে। বুঝেনই তো! জোয়ান ছেলে, শরীরের রক্ত গরম। হাতের কাছে সবকিছু তৈরী করা না পেলে গুণ্ডামি শুরু করে।”

আকলিমা আরো ভয় পেলো সাথে অবাকও হলো, ভদ্রলোকের সাথে কথা আগানো শুরুই করেনি তারমধ্যে বলছে ভাইপোও আসবে? আবার ছেলেটা নাকি ডেঞ্জারাস! আকলিমা ভদ্রলোকের কাছে এসে বলল,”আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে, কোথায় যেন দেখেছি।”

” আমি ডাক্তার মাহবুব শিকদার। শুরুতেই তো বললাম!”

হেঁয়ালিপূর্ণ কথায় আকলিমা চুপসে গেলো। এতো বড়ো মাপের মানুষ তার বাড়িতে এসেছে। উদ্দেশ্যই বা কী? মাহবুব শিকদার মিটিমিটি হাসছে তার দৃষ্টি ঘুরেফিরে আকলিমার চুপসে যাওয়া মুখের দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে। আসার পূর্বে ভাইপোর কাছে সমস্ত ঘটনা শুনেছে। নয়নার সাথে তাদের কু-আচরণের কথাও জেনেছে। মাহবুব শিকদার কেশে মনোযোগ নিজের দিকে এনে আকলিমাকে প্রশ্ন করলো,” আমার বউমা কোথায়?”

আকলিমার তো দুই সন্তান, দুইজনই ছেলে। তাহলে ভদ্রলোক কার কথা জিজ্ঞেস করছেন? নয়নার কথা ভুলে বসেছে সে। আকলিমার হয়তো শুনতে ভুল হয়েছে তাই সংশোধন করে নেয়ার জন্য বলল,” আপনার ভুল হচ্ছে, আমার দুই ছেলে। আপনি কোন মেয়ের কথা জানতে চাইছেন?”

” নয়নার কথা জিজ্ঞাসা করছি। তা সে কোথায়! ডাকুন তাকে। আজ একেবারে পাকা কথা ফাইনাল করেই উঠবো।”

আকলিমা আঁতকে উঠলো, নয়না তো আজ দুইদিন ধরে নিখোঁজ। পাড়া প্রতিবেশী কেউ টেরই পায়নি নয়না যে বাড়ি নেই। তাহলে এই ভদ্রলোক কীভাবে জানলো? আকলিমা ঘামতে শুরু করেছে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। কাঁপা স্বরে উত্তর দিলো,” নয়না তো বাড়িতে নেই!”

” কি বলছেন? নুরুজ্জামান মৃত্যুর পূর্বে আমাকে তো বলেছিল, মেয়েকে এই বাড়িতেই রেখেছেন। তাহলে নেই বলছেন কেন? কোনোভাবে কী মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছেন?”

আকলিমার ভয়ে কেঁদে দেয়ার মতো অবস্থা। এবার সে ভদ্রলোককে চিনতে পেরেছে। নুরুজ্জামানের মৃত্যুর পর হাসপাতালে এক নজর দেখেছিল। এই বাড়িতে সে ছাড়া বাশারও আছে কিন্তু সে তো ঘর আঁটকে বসে আছে। বাহিরে যে আকলিমার উপর সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে তার খবর রাখে? থরথর করে কাঁপছে আকলিমা। এরমধ্যেই বাড়ির বাহিরে মোটরযান এসে থামলো। মাহবুব সোফায় হেলান দিয়ে বাঁকা হেসে বলল, ” মেয়ের হবু জামাই প্রথমবারের মতো এসেছে, যান বরন করে এগিয়ে নিয়ে আসুন।”

না চাওয়া সত্ত্বেও আকলিমা দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। চোখে সানগ্লাস পরে, ফর্মাল পোশাকে তূর্য বাইক থেকে নেমে আসলো। মোটরযান একপাশে সাইড করে রেখে এদিকেই এগিয়ে আসলো। আজ তূর্যের সাথে নয়নারও আসার কথা ছিল কিন্তু নয়না ঘর আটকে বসে আছে। তূর্য অনেকবার চেষ্টা করেছিল নিয়ে আসতে, ধমক অনুরোধ কেনোটাই নয়না শুনেনি। অগত্যা নাটক সাজিয়ে মাহবুব শিকদারকে পাঠায় তূর্য।

আকলিমার সামনে তূর্য এসে দাঁড়ালো। সানগ্লাস খুলে বুকপকেটে রেখে বলল,” ফুফু শাশুড়ি আম্মা, এতো কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন? ঘরে বুঝি মন টিকছে না?”

আকলিমা সেই কখন থেকে হা করেই আছে মুখ বন্ধ করছে না। মাহবুব শিকদারকে দেখে যতোই না অবাক হশেছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ অবাক হয়েছে তূর্যকে দেখে। তূর্য এতক্ষণে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ফলেছে। নজর ঘুরিয়ে বাড়ির অভ্যন্তরীণ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। আকলিমা এবার দরজা আটকাতে ভুলল না। এগিয়ে এসে তূর্যের উদ্দেশে বলল,” তুমি!!!!”

আকলিমার কথা শেষ করার পূর্বে তূর্য সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে বলল,” আমি তাবরেজ তূর্য শিকদার। মাহবুব শিকদারের একমাত্র ভাইপো এবং নয়নার একমাত্র হবু স্বামী।”

আকলিমা বাকরূদ্ধ, কী বলবে সে? কোথাকার কেউ এসে তারই বাড়িতে উঁচু আওয়াজে কথা বলছে অথচ সে কথাই বলতে পারছে না। বাশারের ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ হলো। আকলিমার সাইডটাও যেন ভারী হলো। সে উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,” দেখ বাবা, এরা কী বলছে? ”

বাশার অচেনা মানুষের দেখে এগিয়ে আসলো। ভ্রু যুগল তার কুঁচকে আছে। অসময়ে যার তার প্রবেশ তার ভীষণ অপছন্দ। এগিয়ে আসতে আসতে বাশার মাকে প্রশ্ন করলো, ” কারা এসেছে?”

তূর্য মুষ্টি বদ্ধ হাতে বসে আছে। সে বর্তমানে এমন একজন কীটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে যে নারীদের ভোগের সামগ্রী মনে করে। তূর্য নিজের রাগকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেষ্টা করছে। সে নয়নার পরিবারকে সহজে নয় কৌশলে শাস্তি দিবে। বাশার কাছাকাছি চলে আসতেই তূর্য উঠে দাঁড়ালো। তূর্যের পিঠ তখন বাশারের মুখ বরাবর। বাশারের হাইট পাঁচ ফিট তিন কিন্তু তূর্যের সামনে নিজেকে দেড় ইঞ্চি বাট্টু মনে হচ্ছে। তূর্য বাশারের দিকে ফিরে তাকিয়ে পিঠে দুইটা চাপড় দিয়ে বলল,” কী ব্যাপার, শা’লা।”

অচেনা মানুষ বাশারকে শালা বলছে? ব্যপারটা হজম হলো না বাশারের। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” এক্সকিউজ মি!”

” কয়েকদিন পর সম্পর্কে শা’লা হবে। তো শা’লা’কে শা’লা বলবো না তো ফিটার খাওয়া বাবু বলবো?”

তূর্যের জবান মুখে চললেও হাত চালাচ্ছে বাশারের পিঠে। প্রতিটা কথায় বাশারের পিঠে চাপড় দিয়ে যাচ্ছে। বাশার ভালোই আঘাত পাচ্ছে দাঁতে দাঁত চেপে তা হজম করে নিচ্ছে। বাশার বুঝতে পারছে, তূর্য ইচ্ছে করেই তাকে আঘাত করছে।

তিনজন মিলে সোফায় বসলো। আকলিমা ছেলের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার ছেলের মতো সেও এতক্ষণ ভালোই হেনস্থা হয়েছে। মাহবুব শিকদার গলা খাকাড়ি দিয়ে বলতে শুরু করলো,” মেয়ে বাড়ি না বুঝলাম। কোথায় গিয়েছে জানেন না তাও বুঝলাম। কিন্তু মেয়েকে তো খুঁজে বের করতে হবে! একটা কাজ করি, আমার বন্ধু জসিম। গাজীপুরের এসপি। তাকে বরং ফোন দিয়ে নয়নার কথা জানাই, কি বলেন?”

মাহবুব শিকদার মুঠোফোন বের করে বন্ধুকে কল লাগালো। বাশার কিংবা আকলিমার প্রত্ত্যুত্তরের অপেক্ষা করলো না। বাশার আকলিমা দুজনই ঘামছে তাদের পাপকর্মের ফল এভাবে ভোগ করতে হবে জানলে নয়নার সাথে খারাপ করতো না। শুধু বাশার নয় পাপকর্মের ফলাফল কতোটা ভয়াবহ তা যদি পৃথিবীর সকল অপরাধী জানতে তাহলে কখনোই পাপ করতো না।

তূর্য তীর্যক দৃষ্টিতে বাশারকে দেখছে। তার ইচ্ছে করছে এখনই বাশারের মাথা মাটিতে পুঁতে ফেলতে। কিন্তু সে এতো তাড়াতাড়ি এমন কিছু করবে না। বসা থেকে তূর্য দাঁড়িয়ে গেলো। আকলিমার উদ্দেশে বলল,” নয়নার ঘরটা কোন দিকে?”

হাতের ইশারায় আকলিমা নয়নার ঘর দেখিয়ে দিলো। তূর্য সেদিকেই এগিয়ে গেলো।

একটা খাট, একটা পড়ার টেবিল, একটা আলমারি ছোট ঘরটাতে এই কয়েকটা আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। তূর্য প্রথমে বিছানায় বসলো এক দুইবার বিছানা ঝাঁকিয়ে পড়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। বই খাতা পরিপাটি করে গোছানো দেখে মুচকি হাসলো তূর্য। ধুলোর স্তূপের ফু দিয়ে উড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল,” এভাবেই ফু দিয়ে তোমার সব কষ্ট উড়িয়ে দেব, নয়ন!”

আলমারি খুলে শুঁকনো শাপলাফুলের মালা দেখে স্তব্ধ বনে গেল তূর্য। কাপড়ের উপরে সযত্নে নয়না মালা রেখে দিয়েছে। তূর্য চোখ বন্ধ করে এতোদিনের বোকামির জন্য আফসোস করে। তার মনে পড়ে যায় সিঙ্গাপুর যাওয়ার দুইদিন আগের কথা,

তূর্য সেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছিল। মাহবুব শিকদার ভাইপোর সিঙ্গাপুরে যাওয়ার ব্যপারে নাখুশ ছিলো। বড়ো ভাই মারা যাওয়ার পর একমাত্র ভাইপোকে একাহাতে মানুষ করেছে মাহবুব শিকদার। কখনো চোখের আড়াল করেনি। সেদিন সরাসরি তূর্যের কাছে গিয়ে বলেছিল,” সিঙ্গাপুর যেয়ো না তূর্য। আমি তোমার জন্য মেয়ে পছন্দ করেছি।”

তূর্য সেদিন অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিল, ” আমাকে জিজ্ঞাসা না করে কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিলে চাচ্চু?”
” মৃত বাবার কাছে কথা দিয়েছি, তার মেয়েকে পুত্রবধু করে ঘরে তুলবো। আমার কথার খেলাফ কখনো হয়নি। এবারও যেন না হয়। নয়নাই তোমার স্ত্রী হবে।”

তূর্য সেদিন অনেক রাগ করেছিল। নয়নার সাথে একবেলা কাটানো মুহূর্ত ভেবে রাগ হচ্ছিল কিন্তু আজ! আজ সে আফসোস করছে। এতোদিন নয়নার খোঁজ নিলে হয়তো মেয়েটার সাথে এমন কিছু ঘটতো না।

শাপলা ফুলের মালা হাতে প্যাঁচিয়ে তূর্য ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। বাশারের কাছে বসে পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, ” কী ব্যপার শা’লা, মুখটা অমন শুঁকনো লাগছে কেন? মনে হচ্ছে বড়ো কোনো অপরাধ করেছো? এমন তো নয়! তোমার কারণে আমার হবু বউ নিখোঁজ হয়ে গেছে? ”

বাশারের প্যান্ট ভিজে যাওয়াই বাকী ছিল। সেটাও অল্প স্বল্প ভিজিয়ে ফেলেছে। পুলিশকে কে না ভয় পায়! বড়ো বড়ো অপরাধীরাও পুলিশের সামনে আসলে খেজুর হয়ে যায়। আর বাশার তো সামায নারীলোভী! এতোক্ষণে তূর্য ও মাহবুব শিকদারের ক্ষমতা সম্পর্কে তার ধারণা হয়ে গেছে। একবার যদি নয়নার নিখোঁজ হওয়ার কারণ তারা জানতে পারে তো চৌদ্দ শিকলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে। বাশার তুলতে উত্তর দেয়,” নয়নাকে তো আমি আপন বোনের মতোই আদর করতাম। মনে হয় বান্ধবীর বাসায় গেছে, চলে আসবে।”

” আসলেই ভালো। আমাকে মিসড কল দিতে বলো, আসল কারণ জেনে নিব।”
এরপর মাহবুব শিকদারের উদ্দেশে বলল, ” আসল অভিভাবক তো অনুমতি দিয়েই দিয়েছে। তাহলে আর কার অনুমতির অপেক্ষা করছো চাচ্চু! মেয়ে বাড়ি ফিরলে না হয় আবার আসবো!”
মাহবুব শিকদার তূর্যের কথায় সায় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ব্লেজারের মধ্য বোতাম আটকে আকলিমার উদ্দেশে বলল,” আজ চললাম। মেয়ে দেখতে এসে মেয়েকেই পেলাম না। কী ভাগ্য কী ভাগ্য। আমরা না হয় কাল পুলিশ নিয়ে আবার আসবো। কি বলেন বেয়াইন?”

আকলিমা মিছে হেসে বলল, ” তার আর দরকার পড়বে না। আমাদের মেয়ে এর আগেই চলে আসবে।”

তূর্য বাশারের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বলল, ” শা’লা, নিজের জান বাঁচা! প্যান্টটা পাল্টে নে, নয়তো চেটেপুটে খেয়ে নে। পরবর্তীতে যদি খাওয়ার মতো মুখই না থাকে?”

তূর্য বাঁকা হেসে মাহবুব শিকদারকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আকলিমা এবার আটকে রাখা নিঃশ্বাস ফোঁস করে ছেড়ে বলল, ” এরা ডাক্তার! নাকি ডা’কা’ত!”

বাশার প্যান্টের দিকে তাকিয়ে নাক মুখ কুঁচকে উত্তর দিলো, ” তোমার, আমার জম!”

চলবে………..

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১২

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: বারো

হাসপাতালের অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি কেবিনে অশান্ত তূর্যের দেখা মিললো। ছেলেটা সারা কেবিনে অস্থির চিত্তে পায়চারী করছে। বারবার নয়নার শরীরের আঘাত গুলো চোখে ভাসছে তূর্যের। যতবারই মনে পড়ছে বক্ষস্থলের বাম পাশে ব্যথা অনুভব করছে। তূর্যের ইচ্ছে করছে, বুকের বাম পাশটা চিঁড়ে দেখতে। কী এমন রোগ হয়েছে! যার কারণে এতো ব্যথা হচ্ছে! অনেক ভেবে তূর্য সিদ্ধান্ত নিলো, সে নয়নার কষ্ট ভাগাভাগি করে নিবে। মেয়েটার সরল, স্বচ্ছ মন আগেই তূর্যের অন্তরে দুর্বলতা তৈরি করেছিল। তূর্যের চাচার কথাও মাথায় আছে। কিন্তু তূর্যের ভয় হচ্ছে, নয়না যদি তার বিমুখী হয়! যখনের কথা তখন হবে। তূর্য কিছু একটা ভেবে কেবিন থেকে বের হলো, সরাসরি রিসিপশনের কম্পিউটারে কিছু খুঁজতে শুরু করলো। প্রায় পাঁচ মিনিট খোঁজার পর কাঙ্খিত জিনিস পেয়ে সময় অপচয় করলো না মুঠোফোন বের করে কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে নাম্বার নিয়ে নিয়ে নিলো, নাম্বারটি মিছিলের, তূর্য ফোন করলো। দেয়াল ঘড়িতে এগারোটা বাজে, এসময়ে মিছিল সজাগ কী না কে জানে?
দুই তিনবার রিং হতেহতে কেটে গেলো। মুঠোফোন টেবিলের উপর সজোরে রেখে মাথায় হাত রেখে বলতে শুরু করলো,” এই মেয়ে আমাকে পাগল করে দিবে।”

রিসিপশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত রবিন। নতুন জয়েন হয়েছে, প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিতে গিয়েছিল। তূর্যের অস্থিরতা দেখে প্রশ্ন করলো, ” ঠিক আছেন, স্যার?”

তূর্যের কী যে হলো! সে ছেলেটার দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেলে প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” আমাকে দেখতে কী আপনার এ্যাবনরমাল মনে হচ্ছে?”

ছেলেটা ভয় পেয়ে গেলো। মাথা না বোধক ইশারা করে বলল,” তা বলিনি।”

তূর্য ছেলেটার কথা শুনলে তো! হনহন পায়ে চলে গেলো।

প্রায় এক ঘণ্টা পর তূর্যের ফোনে কল আসলো, মিছিল কল করেছে। সময় অপচয় না করেই তূর্য রিসিভ করে বলল,” আমি ডাক্তার তূর্য। কিছুদিন আগে নয়নার সম্পর্কে যার কাছে বলেছিলেন। চিনতে পারছেন?”

” ইয়েস ডক্টর। অ্যানি প্রবলেম?”

তূর্য লম্বা একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,” নয়না আমাদের কাছে, আপনার বান্ধবী আজ সুইসাইড করতে যাচ্ছিল। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে।”

বিগত সপ্তাহগুলোতে মিছিল ভাইয়ের বিয়ের জন্য ব্যস্ত ছিলো। নয়নার খোঁজ নিতে পারেনি। প্রিয় বন্ধুর নির্মম অবস্থা দেখে চোখে জল চলে আসে। কাঁপা স্বরে উত্তর দেয়,” এখন নয়না কেমন আছে?”

” ভালো আছে, কিন্তু কতক্ষণ ভালো থাকবে জানা নেই।”
” মানে?”
” আপনার বন্ধুর পরিবার এতো জঘন্য, পুলিশকে জানানি কেন?”

মিছিল নিশ্চুপ হয়ে গেলো। সে কী-ই বা বলবে! কার কাছে অভিযোগ করবে? সে তো বন্ধুকে নিজের বাড়িতেই ঠায় দিয়েছিল কিন্তু তার বাবাই তো! মিছিল সেদিনের পুরো ঘটনা তূর্যকে বলল সাথে বাশারের অপকর্মের কথাও। পূর্বে বাশারের কথা গোপন রেখেছিল কিন্তু এবার কেন যেন তূর্যকে বিশ্বাস করলো কিন্তু কেন? উত্তর মিছিলের জানা নেই।

মিছিলের সাথে কথা বলে তূর্য কেবিন থেকে বের হয়ে এলো। সে খুব তৃষ্ণার্ত, নয়নাকে এক নজর দেখা আবশ্যক, নয়তো বক্ষস্থলের ব্যথায় মরে যাবে সে।

—————————–

স্বচ্ছ আকাশ হঠাৎই বাদলে ঢেকে গেলো। প্রকৃতির এরূপ পরিবর্তন নয়নার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো। গুড়ুম গুড়ুম মেঘ ডেকে যাচ্ছে, নয়না পিটপিট চোখে চারদিকে দেখছে। সে মনে করতে চেষ্টা করছে, তার সাথে কী ঘটেছিল। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর তার মনে পড়লো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তের ঘটনা। সে তো ট্রেনের নিচে ঝাপ দিতে যাচ্ছিলো, তখন কেউ তাকে বাঁচিয়ে নেয়। ট্রেনের আবছায়া আলোয় দেখতে পেয়েছিল, উদ্ধার দাতা ছিল তূর্য। আসলেই কী তাই? নয়না কী তূর্যের বাসায় আছে? মস্তিষ্কে কথাগুলো ঘুরপাক খেতেই নয়না লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়লো। ধীরপায়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ালো। কেউ নেই! নয়না কী করবে? রাতও বেড়েছে তার উপর আবহাওয়াও খারাপ। যেই ঘর থেকে হাঁটা শুরু করেছিল সেই ঘরে এসেই নয়না থামলো। বাথরুমে পানির শব্দ হচ্ছে, তারমানে কেউ গোসল করছে। বাথরুমে কী নয়না নক করে দেখবে? যদি তূর্য বের হয়ে আসে! নয়না তখন কী করবে? দৌড় দিবে নাকি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। সাতপাঁচ ভেবে দরজায় করাঘাত করবে তখনই লোডশেডিং হয়ে গেলো। অচেনা বাড়ি, অচেনা স্থান,সবকিছুই নয়নার কাছে অচেনা। ইতিমধ্যে ফ্ল্যাটের প্রধান ফটকে করাঘাত করছে কেউ। নয়না কী করবে ভেবে পেলো না। অন্ধকারে হাতড়ে দরজা খুলে দেয়াই উচিত মনে করলো। দারজার অপর পাশের মানুষটা একেবারেই ধৈর্যহারা, একেরপর এক করাঘাত করেই যাচ্ছে। নয়না ভেবেই নিলো, অপরিচিতকে কিছু কথা শুনিয়ে দিবে সেই আশায় গেইট খুলে বলার আগেই কেউ একজন তার চোখে লাইট ধরলো। আলো থেকে বাঁচার জন্য নয়না দুই হাত চোখের সামনে এনে ধরলো।
তূর্য এ মুহূর্তে নয়নাকে আশা করেনি সে চোখ বড় বড় করে নয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো। আবহাওয়া বদলে নয়নাকে আজ অন্যরকম লাগছে। কয়েক সপ্তাহ পূর্বের মলিন নয়না আর আকজের নয়না আলাদা। নয়না দুই হাত দ্বারা চোখ ঢাকলো ঠিকই কিন্তু ঠোঁটজোড়া উন্মুক্ত রাখলো। ফলস্বরূপ বিড়বিড় করা ঠোঁটজোড়া দেখে তূর্য শুকনো ঢোক গিলে বলল,” তুমি সর্বনাশিনী, ভয়ংকর রমণী।”

ভাবনা গোসল সেরে নয়নাকে বিছানায় দেখতে পেলো না। দরজার কাছে বোকা তূর্যকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলো,” কখন এলি,তূর্য? নয়নার চোখে লাইট ধরে রেখেছিস কেন?”

বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে তূর্য ফোন নামিয়ে নিলো। নয়নাও লজ্জায় চোখ থেকে হাত নামালো। সে ভুলেও তূর্যকে দেখছে না। ভাবনা টেবিল লাইট জ্বালিয়ে দেয়ার ফাঁকে দুষ্ট হেসে বলল,” নায়ক নায়িকার সিন শেষ হলে দরজা বন্ধ করে ভেতরে গিয়ে বোস। আমি লাইট জ্বালিয়ে আনছি।”

তূর্য গম্ভীর মুখে দরজা আটকে দিলো। নয়নার কাছে অচেনা পরিবেশ ও অচেনা স্থানে আপাতত তূর্যকে অনুসরণ করা ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই।

লাইটের পরিবর্তে ভাবনা দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে আনলো। একটি টেবিলের উপর অপরটি রান্নাঘরে। তূর্য সোফায় বসে ফোন ঘাটাঘাটি করছে। ভাবনা ভ্রু যুগল কুঁচকে রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল, ” নয়নার জন্য স্যুপ বানিয়েছি, তোর জন্য কফি আনবো?”

তূর্যের গাম্ভীর্যভাবে উত্তর, ” উইথ আউট সুগার।”

” হ্যাঁ জানি! কফির বদলে করল্লার রস তোর প্রিয় খাদ্য।”

নয়না নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ভাবনা মেয়েটা চঞ্চল, তবে মনের দিক দিয়ে ভালো। নয়না কিছুক্ষণ যাবত তূর্যকে জিজ্ঞাস করার জন্য উশখুশ করছে। শেষবার সে যেই তূর্যকে সে দেখেছিল, আজকের তূর্য সে নয়। আজ নয়না গম্ভীর তেঁতো মুখো তূর্যকে দেখছে। মনে হচ্ছে, এই তূর্যকে কিছু জিজ্ঞেস করা মানে আগুন নিয়ে খেলা। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে নয়না জিজ্ঞেস করলো,” আমাকে কেন বাঁচালেন?”
” বউ বানানোর জন্য।”

তূর্যের সোজাসাপ্টা উত্তর কিন্তু কঠিন! নয়না বিষম খেলে। ভাবনা দৌড়ে পানি নিয়ে আসলো, নয়নার পিঠ চাপড়ে পানি দিয়ে বলল,” আস্ত মুরগী কী গলায় ঢুকিয়ে ফেলেছো? বিষম খেলে যে?”

কাশতে কাশতে নয়নার চোখ বেয়ে পানি বের হয়ে গেলো। তূর্য তা দেখে বাঁকা হেসে বিড়বিড় করে বলল,” আস্ত মানুষের মন চুরি করে ফেলেছে। কবে যেন খেয়েও ফেলে।”

নয়নাকে শান্ত করে ভাবনা স্যুপ নিয়ে আসলো। তূর্যের দিকে এক কাপ কফি এগিয়ে দিয়ে বলল, ” এই সময়ে আসলি যে? হাসপাতালে সব ঠিক আছে?”

কফিতে চুমুক বসিয়ে তূর্য উত্তর দিলো,” তোকে দেখতে আসলাম।”

” আমাকে নাকি নয়নাকে?”
ভাবনার সুর টানা কথায় তূর্যের কোনো নড়চড় হলো না। সে মনের সুখে কফি পান করতে করতে বলল,” তাকে জিজ্ঞেস কর, কেন আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে যাচ্ছিল। দুঃখ কী তারই আছে? পৃথিবীতে কতে মানুষই তো দুঃখী কই তারা তো আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে না!”

নয়নার মনে পড়ে বাশার তার সাথে যা করেছিল সেই কথা। তারসাথে ফুফার ডিসিশন, ফুফুর বানেয়াট কথা! সবকিছু মনে করে নয়না দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,” দুঃখীদের দুঃখ গায়ে লাগে না ডাক্তার সাহেব। তাদের মন ইস্পাতের তৈরী, সহজেই নরম হয় না। কিছু কারণ অজানা থাকলে যদি আমি ভালো থাকি তাহলে কী দোষ হবে?”

নয়নার কথনগুলো তূর্যের মনের কোটায় আস্তানা গড়ে তুললো। কফির কাপ সজোড়ে টেবিলের উপর রেখে বলল,” আগামীকাল তৈরী থাকবে, নয়ন! আমরা তোমার ফুফু ও ফুফার বাড়িতে যাব।”

নয়না ভয় পেয়ে গেলো। বিচলিত হয়ে বলল,” আমি ঐ নরকে আর ফিরে যেতে চাই না। দয়াকরে আমাকে কিছুদিন সময় দিন! কিছু একটা করে আমি এখান থেকে চলে যাবো।”
” কাল মানে কালই! আমার কথার কোনো নড়চড় হবে না। আমিও দেখতে চাই, তোমার আত্মীয় স্বজন কীরূপ আচরণ করে।”

————————–

দিনের শুরুটা যার ভালো কাটে সারাদিনই নাকি তার সাথে ভালো কিছুই ঘটে। আকলিমার আজ সকাল থেকেই ব্যস্ত সময় কাটছে। নয়না থাকাকালীন তিনবেলা তাকে দিয়ে রান্না করিয়েছে আকলিমা। হাঁটুর ব্যথার নাম করে আরাম করেছে এতোদিন। আজ দুইদিন হলো নয়নার কোনে খোঁজ নেই। ম’রে আছে নাকি বেঁচে আছে কে জানে? বাশারকের এই দুইদিন হাতের কাছে বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। সারাদিন এক ফোন কানে দিয়ে রাখে। জিজ্ঞাসা করলেই বলে, ইম্পর্ট্যান্ট কল, চাকরি ব্যবস্থা নাকি করে দিবে। আকলিমা আর কথা বাড়া না নিজ কাজে মনোযোগ দেন।

কলিং বেল বাজছে অনবরত। আকলিমার আটা মাখছিল, সেই হাতেই দরজা খুলতে চলে আসলো। অপরিচিত মানুষকে দেখে প্রশ্ন করল,” আপনি কে?”
উত্তর এলো,
” আমি ডাক্তার মাহবুব শিকদার। ভেতরে আসতে পারি?”

চলবে………………….

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১১

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: এগারো

কালরাত্রি বলে কী কোনো রাত আছে? যদি হয়েও থাকে তবে সেটা কী সবার জীবনে একবারই আসে? নাকি নয়নার জীবনের মতে বারবার আসে! বাস্তবে নয়নারা কী কখনোই সুখী হয় না! তাদেরও তো বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়, আকাশে ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছে হয়, কিন্তু! বাশারদের নতো নরপশুরা নয়নাদের বাঁচতে দিতে চায় না। ভোগের সামগ্রী মনে করে। নয়নার মতো অসংখ্য নয়না রয়েছে, রাতের আঁধারে যারা আপনজনের দ্বারা নির্যাতিত হয় কিন্তু দিনের আলোয় তাদের হাসিমুখে চলতে হয়। নয়না এই যাত্রায় তাদের বিপরীত ছিল।

নয়নার ঘরে বোরহান উদ্দিন বসে আছে। পাশেই আশ্চর্যান্বিত হয়ে আকলিমা দাঁড়িয়ে আছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, বাশার এতোটা নীচু প্রকৃতির। আজও হয়তো বিশ্বাস করতে না যদি বোরহান স্বচক্ষে ছেলের পাপকর্মের সাক্ষী না হতো। বাশার মাথা নিচু করে অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে। নয়না ডাইনিং টেবিলে মাথা নিচু করে কাঁদছে। বোরহান ছেলের দিকে রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে বলতে শুরু করল,” যা করেছিস, ভালো করিসনি। যাকে বোনের নজরে দেখার কথা তার সাথেই, ছিহ! এতো খারাপ কি করে হতে পারলি? একজন এতিম মেয়েকে অপদস্ত করতে তোর কলিজা কাঁপলো না?”

বাশার বাঁচার জন্য মনে মনে নতুন ফন্দি আঁটলো। বোরহানকে মিথ্যা কথা বলল,” আমরা একে অপরের ভালেবাসি, বাবা। একটু মন মালিন্য হয়েছিল সেটাই ঠিক করতে এসেছিলাম।”

বোরহান এগিয়ে এসে বাশারের গাল বরাবর থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” জোর করা আর প্রেম করা আমাকে তোর শেখাতে হবে না, জানোয়ার। আমার তোকে সন্তান বলতেই ঘৃণা হচ্ছে।”

বেরহান সারাঘর পায়চারি করতে করতে আকলিমার উদ্দেশে বলল,” তোমার জন্যই দুই ছেলেকে ফেলে দূরে থাকছি, এই তোমার শিক্ষা!”

আকলিমা নিস্তেজ শরীরে উত্তরে বলল,” আমাদের সম্মান আর রইলো না। লোকসমাজে আমরা মুখ দেখাবো কীভাবে?”

বোরহান নিশ্চুপ হয়ে কিছু একটা ভাবলো। এরপর চট করে বলল, ” আমি কালই বাশার আর নয়নার বিয়ে দিতে চাই।”

নয়না কান্না থামিয়ে বোরহানের কাছে এসে হাত জোর করে বলল, ” দয়া করো ফুফা, এমন শাস্তি দিও না। আমি এই রাতের আঁধারে বাড়ি ছাড়বো, তোমাদের সম্মানে কোনো দাগ ফেলতে দিব না। তবুও আমাকে এই খারাপ লোকটার সাথে বিয়ে দিও না।”

আকলিমা তেড়ে আসে নয়নার কাছে। হাত মুচড়ে ধরে বলল,” আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে ভালো সাজা হচ্ছে! আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম,তুই আমার ছেলেকে তোর রূপের জালে ফাঁসাচ্ছিস। হয়েছেও তাই!”

বোরহান উদ্দিন আকলিমার কথার প্রত্ত্যুত্তরে গর্জে উঠলো, ” আকলিমা! ঐ মেয়েকে কেন দোষারোপ করছো? নিজের ছেলেকে এতো ভালো মনে করো না। আমি তোমার ছেলের দুষ্ট রূপ দেখেছি।”

আকলিমা চুপ হয়ে যায়। যাকে সে সহ্য করতে পারে না তাকে কীভাবে পুত্রবধূ হিসাবে গ্রহণ করবে! বাশার বোরহানের পায়ে পড়লো। কান্নার সুরে বলল,” আমি ভুল করেছি, প্রায়শ্চিত্ত আমিই করব। নয়নাকে বিয়ে করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আগামীকাল না, দুই সপ্তাহ পরে নয়নাকে বিয়ে করব।”

আকলিমাও ছেলের কথায় সায় দিয়ে বলল,” বাশার ঠিক বলেছে। নয়তো লোকেরা বলাবলি করবে, একরাতের মধ্যে বিয়ে! নিশ্চয়ই ছেলে মেয়ে অকাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে, তাই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।”

” মানুষ ভুল তো আর বলছে না! তোমার ছেলেই তো মেয়েটার সর্বনাশ করতে চেয়েছিল।”

তাদের কথোপকথনের মাঝে নয়না বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তিনজন মানুষ নয়নাী বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অজ্ঞ। ঠিকানা বিহীন পথ ধরে চলতে শুরু করেছে নয়না। শা শা করে গাড়ি তার শরীর ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। নয়নার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। গাজীপুরের রেললাইনের কাছাকাছি চলে আসে নয়না। সময় তখন তিনটা বাজে পঞ্চান্ন মিনিট। ভোর চারটার ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। গাজীপুর রেল গেইট থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে। নয়না চোখ বন্ধ করে মা ছোট ছোট ভাইবোনদের চেহারা মনে করতে চেষ্টা করে। বাবার চেহারা চোখের সামনে ভাসতেই নয়নার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে থাকে। জীবনের কাছে নয়না হেরে গেছে। একাকী লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠেছে সে। ট্রেনের হুইসিল কর্ণধারে পৌঁছালো নয়নার, আপনাআপনি মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ধীরপায়ে রেলগাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। আর কিছু সময়! এরপরই নয়না নামক কারো অস্তিত্ব এই নশ্বর পৃথিবীতে থাকবে না। কেউ আর নয়নাকে বোঝা মনে করবে না। ভয়ে রাতের পর রাত জেগে থাকতে হবে না। চোখ বন্ধ করে মৃত্যুকে স্বাগত জানায় নয়না। দুইহাত মেলে ধরে ঝাপ দিবে এই মুহূর্তে কেউ একজন নয়নার হাত টেনে ধরে। ঝকঝক করে ট্রেন নয়নার পাশ দিয়ে চলে গেল। অশ্রুসিক্ত চোখে নয়না শুভাকাঙ্ক্ষীর দিকে তাকানোর পূর্বেই মানুষটা নয়নার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল,” কী করতে যাচ্ছিলে, পাগল মেয়ে!”

এমনিতেও ঘুমের ঔষধ সেবন করার কারণে নয়নার শরীর দুর্বল ছিল। তার উপর এতো ধকল! থাপ্পড় খেয়ে মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে সামনের মানুষটার বুকে ঢলে পড়ে।

বলিষ্ঠ দেহে শক্ত করে নয়নাকে জড়িয়ে ধরে তূর্য। নয়না জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে তা প্রত্যাশা করেনি সে। ভাবনা ব্যাগ কাঁধে তূর্যের দিকে দৌড়ে এসে বলল,” মেয়েটা কে? কী হয়েছে?”

” নয়না, সেই নয়না! যার জন্য তাবরেজ তূর্যের সিঙ্গাপুর যাওয়া মিস হয়েছে। তার স্বপ্ন পূরণ হওয়া অপূর্ণ রয়ে গেছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! যাকে দূর থেকে ঘৃণা করতে চাচ্ছি সেই এখন আমার বুকে।”

তূর্যের কাঠকাঠ জবাবে ভাবনা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এতোদিন সে জানতো তূর্য তার চচার জন্য সিঙ্গাপুর যায়নি কিন্তু আজ সত্যি জেনে সে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

তূর্য নয়নাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে গালে হাত রেখে জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করলো। গালে কয়েকবার চাপড় দিয়ে তূর্য ডাকলো,” এই মেয়ে! এই নয়না! শুনতে পাচ্ছো? ড্যাম! কীসের এতো কষ্ট তোমার? শুনতে পাচ্ছো?”

কিন্তু নাহ! নয়নার জ্ঞান ফেরাতে পারলো না তূর্য। অবশেষে ভাবনা তূর্যের কাঁধে হাত রেখে বলল,” ওকে হাসপাতালে নিতে হবে, তূর্য! দেরী করিস না।”

সময় অপচয় না করে তূর্য নয়নাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো। বন্ধুদের ডেকে নিজের ব্যাগ সামগ্রী উঠাতে বলতে ভুললো না।

রেলগেইট থেকে গাজীপুর সদর হাসপাতালের দূরত্ব দেড় কিলোমিটার প্রায়। পাঁচ ছয় মিনিটের রাস্তা তূর্যের কাছে বিশাল মনে হচ্ছে। ভোর রাতে রিকশা ছাড়া অন্য কোন যানবাহন পাওয়া যায়নি। তূর্য কাল বিলম্ব না করে নয়নাকে নিয়ে রিকশায় চড়ে বসে। নয়নাকে বসিয়ে নিজে পাশে বসে। নয়নার মাথা তূর্যের কাঁধে রাখা, একহাতে তূর্য তাকে ধরে রেখেছে। দৃষ্টি তার নয়নার শুকনো মুখশ্রীতে। তূর্য অমন মায়াবী শুকনো মুখখানা দেখে আনমনে বলল,” তোমার অন্তরে আমার নিশ্বাসের আশ্রয় মিলে যাক, তোমার ভালোবাসায় আমার জীবন পাগল হয়ে যাক। তোমার দুঃখগুলো সব আমার হয়ে যাক।”

তূর্য কথাগুলো বলে খিঁচে চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়। মেয়েটাকে সে যতো দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে মেয়েটা ততো কাছে আসছে। মেয়েটার মায়াভরা চাহনি উপেক্ষা করা মুশকিল! মাদকতা কাজ করে, মায়া জন্মে যাচ্ছে।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর হাসপাতালে পৌঁছে তূর্য। নয়নাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে ইমারজেন্সি বিভাগের দিকে এগিয়ে যায় সে।
ভাবনা ইতিমধ্যে পৌঁছে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করলো। তূর্য ততক্ষণে কাপড় ছেড়ে নয়নার কাছে আসলো। ভাবনা প্রেশার মেপে সূর্যয়ের উদ্দেশে বলল,” গতবারের মতো শরীর দুর্বল।”

তূর্যের কী যে হয়! সে মিছে রাগ করে নয়নার উপর। ভাবনার কথার প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” এতো বড়ো ধিঙ্গি মেয়ে! অথচ নিজের যত্ন নেয় না। এতো বড়ো একটা কাজ করতে যাচ্ছিল! হাসপাতালে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। ওকে না হয়,তোর ফ্ল্যাটে নিয়ে যা। আমি সেলাইন, খাবার নিয়ে আসছি।”

কথাগুলো বলেও তূর্য দাঁড়িয়ে রইলো। নয়নার গালে, হাতে আজও আঁচড়ের দাগ, হয়তো মেয়েটার উপর অত্যাচার করা হয়েছে! তূর্যের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মুষ্টিবদ্ধ হত টেবিলের উপর আঘাত করে হনহনিয়ে বের হয়ে আসে।

দুইজন নার্সের সাহায্যে ভাবনা নয়নাকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসলো। দক্ষিণ ছায়াবীথির চার নাম্বার বাড়ির তৃতীয় তলায় ভাবনা একাকী থাকে। আপনজন সবাই ময়মনসিংহে গ্রামে থাকে। ছুটিতে তূর্য সহ আরো কয়েকজন বন্ধুরা মিলে ভাবনার বাড়িতেই গিয়েছিল। আজ সকালেই ফিরেছে সবাই। বন্ধুরা মিলে হেঁটে ফিরতে যাচ্ছিল তখনই রেললাইনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবাই। তারা তখনও জানতো না মানব অথবা মানবীটা নয়না। তূর্য জীবন বাজি রেখে নয়নাকে বাঁচিয়ে নেয়।

নয়নার সেলাইন চলছে। তূর্য নিজে আসবে বললেও আসেনি। মিনহাজকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় সে। ভাবনা বন্ধুর অদ্ভুত আচরণ ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছে না। সবার বেলায় তূর্য স্বাভাবিক থাকলেও নয়নার কাছে আসতেই অস্বাভাবিক আচরণ করে। নয়নাকে একবার কাছে টানে তো একবার দূরে সরিয়ে দেয়। ভাবনা ভাবছে, কী চলছে ছেলেটার মনে?
————————–

হাসপাতাল, পথঘাট, রেলস্টেশন কেনোটাই খোঁজা বাদ রাখেনি বাশার। নয়নাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে সে। বোরহান উদ্দিন নির্দেশ দিয়েছেন, নয়নাকে নিয়ে বাসায় না ফিরতে পারলে বাড়িতে জায়গা দিবে না। প্রায় দুইঘণ্টা যাবত নয়নার কোনো খোঁজ না পেয়ে বাশার একটি কফিশপে গিয়ে বসে। কিছুক্ষণ যাবত তার মুঠোফোন বাজছে, দৌড়াদৌড়ি করার জন্য ফোন ধরতে পারেনি। ক্লান্ত শরীরে টেবিলের উপর এক বোতল পানি দেখে ঢকঢক করে পান করে নেয় বাশার। প্যান্টের পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে বাঁকা হাসলো। রিসিভ করে ফোন কানে দিয়ে বলল,” কেমন আছো সুইটহার্ট?”

চলবে………………

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১০

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: দশ

আজকের দিনটার কথা নয়না কখনোই ভুলবে না। কেনোই সে ভুলবে! বাশার আজ তার কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। নয়না কী করবে, কোথায় যাবে,কাকে বলবে বুঝতে পারছে না। অবশেষে উপরওয়ালা তার দরখাস্ত কবুল করেছেন। নয়নার ধৈর্য্যের ফল সে আজ পেয়েছে।

নয়না ভাবছে বিকালের সময়ের কথা। যখন সে নিঃশব্দে বসে কাঁদছিল। বাশার বাসায়ই ছিল নয়না তা জানতো না নাহলে সে দরজা আটকে ঘরে বসে থাকতো। কান্নার মাঝেই নয়না অনুভব করে তার মাথায় কেউ হাত রেখেছে। নয়না ভেবেছিল বোরহান হবে কিন্তু তার ধারণা ভুল করে বাশার নিজেই নয়নার ঘরে প্রবেশ করে এবং সেই নয়নার মাথায় হাত রাখে। নয়না তাৎক্ষণিক সরে বসলো। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বলল, ” নিজের জীবন দিয়ে দিব, কিন্তু নিজেকে কলঙ্কিত হতে দিব না। আমাকে ছুঁবে না,বাশার ভাই।”

নয়নার কথা অগ্রাহ্য করে বাশার হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসলো। দুই হাত তুলে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ” আমাকে ক্ষমা করে দে, নয়না! তোর সাথে এতোদিন খুব খারাপ আচরণ করেছি। আমি অনুতপ্ত, আমাকে যেই শাস্তি দিবি তাই মাথা পেতে নিব।”

অশ্রুসিক্ত নয়ন, অনুনয়ের স্বর, বাচনভঙ্গি পরিবর্তন। নয়না কী সত্যি দেখছে? অবিশ্বাসের তীর এখনো বাশারের দিকেই এগোচ্ছে। নয়না কী! কোনো মেয়েই বাশারকে বিশ্বাস করবে না এবং ক্ষমাও করবে না। সে ভীত স্বরে বলল,” আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারব না, বাশার ভাই। আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও, নয়তো ফুফাকে ডাক দিব।”

বাশার দুঃখী হয়ে উঠে দাঁড়ালো। নয়নার পা ছুঁয়ে দেয়ার বাহানায় এগিয়ে এসে বলল,” তোর দুটো পা ধরি, নয়না! আমাকে ক্ষমা করে দে। আজ তোর কষ্ট দেখে আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি।”

বিছানার এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে নয়না বসে রইলো। তার শরীর কাঁপছে। বাশারকে একদম সহ্য হচ্ছে না। পাগলের মতো প্রলেপ করতে শুরু করলো, ” চলে যাও, বাশার ভাই! তোমার ভালো রূপও আমার সহ্য হয় না। তোমার মুখ দেখাও আমার জন্য পাপা। ঘৃণা হয় তোমাকে দেখলে। আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও। আমাকে বাঁচতে দাও।”

বাশার চোখের পানি মুছে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়ে বলল, ” ভয় পাস নে, নয়না। এখন কথা বলছিস না ঠিক আছে, আমি পরে আবার আসবো।”

বাশার প্রস্থান নেওয়ার পর থেকে নয়না ভাবনার জগতেই কাটালো। এ কেমন জীবন যাপন করছে নয়না! সুখ আসলেও সে হাসতে পারে না, দুঃখভরা জীবনে আজীবন চলতে হচ্ছে তার!

রাতের খাবার টেবিলে এলাহী কাণ্ড ঘটে গেলো। বাশার আজ রাতের খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়েছে। রিহানকেও সন্ধ্যায় হোস্টেল থেকে নিয়ে এসেছে সে। বোরহান উদ্দিন ছোট ছেলেকে কাছে পেয়ে আপ্লুত হোন। সারা মুখে আদরে ভরিয়ে দেন। নয়নার খুব আফসোস হয় তা দেখে! সেও কল্পনার জগতে ডুবে যায়।
বাশার নিজে হাতে সবাইকে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। বিশেষ করে নয়নার পাতে, ভাত, তরকারি, ডাল তুলে দিচ্ছে। আকলিমা ছেলের হাবভাবে দেখে বিরক্ত হোন। নয়নার প্রতি এক্সট্রা কেয়ারে ধমক দেন বাশারকে, ” এতো আদিখ্যেতা দেখানোর কী আছে? নয়নার কী হাত নাই? তোর এতো পিরিত কীসের? চুপচাপ খা, নয়তো ঘরে যা। এই মেয়ের জন্য নিজের ছেলেকেও সন্দেহ করতে হচ্ছে, এই মেয়ে, তুই কেন আমার সংসারে পড়ে আছিস? রাস্তায় পড়ে ম’রে যেতে পারিস না?”

বোরহান উদ্দিন নিশ্চুপে খাবার খাচ্ছিল। আকলিমার কটু কথা তার পছন্দ হলো না, অর্ধ খাওয়া রেখে সে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। আকলিমার উদ্দেশে বলল, ” তোমাকে নয়নার আপন ফুফু বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। ফুফু ভাইজির বন্ধুর মতো থাকে কিন্তু তুমি হলে নয়নার জীবনের চরম শত্রু। আমি ভেবে নিয়েছি, এবার নয়নাকে নিয়ে ফিরবো। এখানে থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরে যাওয়ার থেকে দূরে না খেয়ে মরুক, তাও ভালো।”

আকলিমা রাগে ফুসফুস করছে। তার ভেতরের সত্তা আজ অনেক কথাই বলতে চাইছে কিন্তু সে ছেলের সামনে বলতে চাইছে না। টেবিলের উপর থেকে বাসনপত্র ফেলে দিয়ে নয়নার উদ্দেশে বলল,” আমার ছেলেকে নষ্ট করতে পারছিস না বলে এখন আমার স্বামীকে হাত করছিস? এতোটা নীচে নামতে পারলি কীভাবে? তোর বাবার অনুরোধ সেদিন না শুনলেই ভালো হতো, তবে আজ আমার সংসার বাঁচতো।”

ভীত নয়না আকলিমার কথার প্রত্ত্যুত্তরের জন্য কথা সাজিয়ে নিলো। সে যা চায় না, তাই ঘটে যায় তার সাথে। বিনা অপরাধে অপরাধী হতে হয় তাকে। আকলিমার দিকে ফিরে ছলছল চোখে বলল,” এতোদিন লাথি, মার খেয়েও মনে মনে ভাবতাম যে, আমার একজন অভিভাবক আছে! আজ তুমি আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করলে, আমাকে বে’শ্যা’দে’র সাথে তুলনা করতেও ভুল করলে না। জানো ফুফু! পৃথিবীর কোনো পুরষের প্রতি আকর্ষণ কাজ করে না। পুরুষদের বিশ্বাস করি না৷ তারা নারীদেরকে ভোগের বস্তু মনে করে মাত্র। আর রইলো ফুফার কথা! তিনি আমার গুরুজন। তোমার ছেলেকে আমি জাস্ট ঘৃণা করি, ঘৃণা। তার চেহারাও আমার দেখতে ইচ্ছে করে না।”

এতোকিছুর মধ্যে বাশার একদম নীরব। পেটভরে ভাত খেয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে। খাওয়ার শেষে সেমাই হাতে নিয়ে বলল,” সবাই ঘুমাতে যাও। আমি বের হচ্ছি, ফিরব আগামীকাল। একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য স্টাডি করতে হবে।”

বাশারের নীরবতা নয়নার চোখে বাঁধে। বাশারকে সে যতটুকু চিনেছে, সে এত সহজে ভালো হবে না। যতোই সে ক্ষমা চেয়ে নিক তার অন্তর কালো কুচকুচেই থাকবে।

আকলিমার মুখের উপর কথা! নয়নার দিকে তেড়ে আসতে নেয় আকলিমা। নয়না তা দেখে পিছনে সরে আসলো। হাত জোর করে বলল,” আজকের রাতটা সহ্য করে নাও, ফুুফু। কাল সকালেই আমি মিছিলের কাছে চলে যাবো।”

ঘরে ফিরে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করে নয়না। কাঁদতে কাঁদতে একসময় সেভাবেই ঘুমিয়ে যায় সে! আজ এতো জলদি ঘুম চলে আসলো নয়নার! যেখানে রাতের পর রাত নির্ঘুমে কাটাতে হয় তাকে!
———————

মধ্যরাত, পুরো পৃথিবীর মানুষ নিদ্রায়মাণ। আঁধার আকাশের বুকে একখণ্ড চাঁদ কিরণ ছড়াচ্ছে। হেলানো বাতাসে গাছপালারাও হেলছে দুলছে। নয়নার ঘরের দরজা তখনই কেউ খুলে ফেলে। মিনি রেজারের সাহায্যে কেউ দটজার লক ভেঙে ফেলে একটি মূর্তিছায়া নয়নার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষটা কী চোর? কী চুরি করতে এসেছে? নয়নার ঘরে তো তেমন কোনো সম্পদও নেই! ছায়ামূর্তিটার লক্ষ হলো নয়না, সে ধীরপায়ে নয়নার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নয়নার পরিধানে সুতি থ্রি পিস। ঘুমে নিমগ্ন নয়না। তার ঘরে কেউ প্রবেশ করেছে টেরই পায়নি। ছায়ামূর্তিটি নয়নার ওড়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। একটানে নয়নার শরীর থেকে ওড়না আলাদা করে নিজের শার্টের বোতামে হাত লাগালো। নয়না তখনও বিভোর ঘুমে নিমগ্ন। যেই সম্মানের ভয়ে দিবা রজনী শংকায় কাটাতো আজ তা কেউ হরন করছে তারই অগোচরে। শার্ট বিহীন ছায়ামূর্তি এবার দাঁত বের করে হেসে নয়নার সারা শরীরে চোখ বুলালো। নয়নার মুখের কাছে ঝুঁকে ঠোঁটের পাশটায় হাত বুলিয়ে বলল,” বলেছিলাম না, আমি আবার আসবো। তোকে আজ কে বাঁচাবে, নয়না!”

ঘুমের ঘোরে নয়না কপালে, হাতে, ও শরীরের স্পর্শ কাতর জায়গায় কারো ছোঁয়া অনুভব করছে কিন্তু চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। শরীরের শক্তি যেন কেউ শুষে নিয়ে গেছে। নয়না হাত তুলে শরীরের উপর ভর করে থাকা মানুষটাকে সরাতে চাইছে। কিন্তু মানুষটা সেই সুযোগ দিচ্ছে না। দুর্বল শরীরে বাঁচার জন্য নয়না হাতড়ে কিছু খুঁজছে। অবশেষে পেয়েও যায় নয়না, হিজাবের সাথে পরার সেফটিপিন মানুষটার ঘাড় বরাবর ঢুকিয়ে দেয় নয়না। মানুষটি আহ বলে সরে আসে। ঘাড়ে হাত দিতেই তরল পদার্থ অনুভব করে সে। নয়না দুর্বল পায়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো। গায়ে ওড়না জড়িয়ে বলল,” বাশার ভাই!”

বাশার উন্মাদের মতো আচরণ করতে শুরু করলো। সে নয়নার চুলের মুঠোয় ধরে বলল, ” আজ তোর শরীর খুলবে খাবো, মা’গি। অনেকদিনের ইচ্ছা আজ পূরণ করব।”

” এমনটা করো না, দোহাই লাগে বাসার ভাই।”

” সবাই ঘুমাচ্ছে। এই সুযোগ আমি কীভাবে হাতছাড়া করি। তোকে কীভাবে ছেড়ে দেই বল! কত বছরের ইচ্ছে তুই! আজ সারাদিন তোর সাথে ভালো ব্যবহার করছিলাম যেন এমন একটা সুযোগ পাই। কাছে আয়, নয়না।”

কাছে আসার বিপরীতে নয়না দূরে সরে যায়। বাসারকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। নয়নার উদ্দেশ্য, সে এখনই পালাবে যেভাবে হোক এই নরক থেকে সে আজীবনের জন্য মুখ ফিরিয়ে নেবে। ভাবনা অনুযায়ী কাজ করা কি এতই সহজ! নয়না কী কখনো পারবে এই নরক থেকে মুক্তি পেতে!

ডাইনিং টেবিলের কাছাকাছি আসতে নায়না ওড়নার মধ্যে টান অনুভব করে। ভয়ে সে পিছনে ফিরে তাকালো। বাশারের ঘামার্ত মুখে বিশ্রী হাসি দেখতে পেলো। নয়না চিৎকার করে বলল, ” ফুফু, ফুফা, রিহান!”

” কেউ আসবে না। সবাই ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে।”

নয়নার এক হাত ধরে টেনে বাশার ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের জীবন বাঁচাতে অন্য হাতের কাছে যা পাচ্ছে তা দিয়েই নয়না আটকাতে চাচ্ছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। হাতের আঘাতে ডাইনিংয়ের চেয়ার মাটিতে পড়ে বিকট শব্দ হলো। বাশারের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে জানে, আজ ঘূর্ণিঝড় হলেও বাড়ির কেউ জানতে পারবে না। নয়নাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারে। প্যান্টের চেইনে হাত তার! শরীর গরম হয়ে আসছে। নয়নাকে দেখে কামোত্তেজনা বেড়ে গেছে।কামুকতার শীর্ষ পর্যায়ে নয়না পুনরায় উঠে যেতে নেয়। এবার বাশারের সহ্য হলো না, সে সজোড়ে নয়নার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। এতে নয়নার ঠোঁট কে’টে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত ঝড়তে শুরু করে। দ্বিতীয়বার নয়নার দিকে হাত বাড়াতে নিতেই কেউ একজন হুঙ্কার ছাড়লো। বাশারের শরীরে দুই তিনটে কিল, ঘুষি মেরে বলল, ” জা’নো’য়া’র! বোনের সাথে কী করেছিস?”

নয়না আবছায়া দৃষ্টি মেলে মানুষটার দিকে তাকালো। কান্নামাখা স্বরে বলল, ” আমাকে বাঁচাও, ফুফা।”

চলবে…………….

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০৯

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: নয়

কলুষিত মনের অধিকারী মানুষের মন পরিষ্কার হয় না তবে কখনো তাদের মনের রং পরিবর্তন হয়ে যায়। বিগত দুই সপ্তাহ নয়নার সারাদিন কেটেছে বদ্ধঘরে। একজন পাগলকে যেমন আটকে রাখা হয়, নয়নাকেও তেমন আটকে রাখা হয়েছিল; পার্থক্য ছিল শুধু একটি শিকলের। আকলিমা তিনবেলার খাবার শুধু দিয়ে যেতো। নয়না ইচ্ছে হলে খেতো, আবার ইচ্ছে হলে রেখে দিতো। জানালার ধারে বসে আকাশের বুকে পাখিদের ডানামেলে উড়ে যাওয়া দেখতো। কতোবার আত্মহত্যার চিন্তা সে করেছে হিসাব নেই। চলন্ত পাখার দিকে তাকিয়ে মনে হাজারো কল্পনা ঝল্পনা আঁকতো সে। এতো সহজেই কী আত্মহত্যা করা যায়! আত্মহত্যার পথ মন্দ কথাটা স্মরণে আসতেই ডুকরে কেঁদে উঠতো নয়না। সে ভেবেছিল এভাবেই তাকে বন্দিনী অবস্থায় জনম পাড় করতে হবে। কিন্তু তার ধারণা ভুল, গতকাল রাতেই আকলিমা তাকে মুক্ত করে দিলো। নয়নার দিকে নতুন এক সেট কাপড় ছুড়ে দিয়ে বলল,” আগামীকাল সকালে তৈরী হয়ে থাকবি। তোকে দেখতে আসবে।”

বাশারের কাছে সম্মান হারানোর থেকে পরের ঘরে পড়ে থাকাই উত্তম মনে হলো নয়নার। তবে মনের এক কোণে পড়ে থাকা তূর্যের প্রতিচ্ছবির কথা ভেবে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে নয়না। ভাগ্য তার এমনিতেও খেলা করছে। মেয়েদের জীবনে চাহিদার কমতি নেই অথচ নয়নার একটাই চাহিদা আর সেটা হলো সুখ! সুখ আদৌও কী নয়নার ভাগ্যে আছে?

নয়নার ফুফা চা-খোর। ভদ্রলোকের নাম বোরহান উদ্দিন। আকলিমা অজানা কোনো এক কারণে স্বামীকে দেখতে পারেন না। দুরুত্ব বজায় রাখেন সর্বদা। তাতে ভদ্রলকের মাথা ব্যাথা নেই। তিনি নিজের জীবন নিয়ে দিব্যি সুখে আছেন। তবে নয়নার কেন যেন মনে হয়, তার মায়ের কারণে আকলিমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারিয়েছে; যার কারণে আকলিমা নয়নাকে সহ্য করতে পরে না।

ফুফার জন্য নয়না কড়া লিকারের চা করে আনলো। চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো বোরহান উদ্দিন। অনিমেষ চেয়ে রইলো নয়নার দিকে। তখনই নয়নার ঠোঁটের কোণে কালো দাগ দেখে বুঝতে বাকী রইলো না তার অবর্তমানে নয়নার সাথে কী কী ঘটে। বোরহান উদ্দিন তপ্ত নিশ্বাস ত্যাগ করে বলল,” তোর ফুফু এখনো তোকে মা’রে?”

নয়না মিথ্যা বলল,” না, ফুফা।”

” তাহলে তোর হাতে, মুখে কালসিটে দাগগুলোর কীসের?”

নয়না হাতের দাগগুলো ওড়নার আড়ালে লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,” বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম, চা কেমন হয়েছে ফুফা?”

বোরহান উদ্দিন বুঝতে পারলেন নয়না কথা ঘোরাতে চেষ্টা করছে। তিনি উদাস হয়ে চায়ের কাপে চুমুক বসান।

সকালবেলায় বোরহানকে দেখতে পেয়ে বাশার অবাক হয়ে গেলো, মুখে প্রকাশিত হল বিরক্তির ছাপ! বাবার কাছে এসে পায়ে ধরে সালাম করলো সে। ভদ্রতার খাতিরে বলল,” আমাকে খবর দিতেন,আব্বা। বাস স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে আসতাম!”

বোরহান উদ্দিন ছেলের কদমবুসিতে প্রফুল্লচিত্তে বললেন,” সারারাত পড়াশোনা করেছিস, তাই বলিনি। কেমন আছিস,বাবা?”

” ভালো আছি। আপনার শরীর ভালো তো আব্বা?

বোরহান উদ্দিনের উত্তরের অপেক্ষা করলো না বাশার, উচ্চ স্বরে নয়নাকে ডেকে বলল,” বাবাকে চা দিয়েছিস,নয়না?”

‘মুখে মধু, অন্তরে বিষ’ কথাটার সাথে বাশারের চরিত্র যায়। বোরহান উদ্দিনের সামনে বোনের মতো আচরণ করছে অথচ নয়নার সামনে রক্ষিতার মতো আচরণ করে। নয়নার ক্ষমতা থাকলে বাশারের জিভ কে’টে নিতো। পশ্চাৎদেশে একশো বেত্রাঘাত করে উলঙ্গ অবস্থায় ছেড়েও দিতো। তখন বাশার বুঝতো একজন নারীর কাছে তার সম্মান ঠিক কেমন।

নয়নার উত্তর না পেয়ে বাশার অপমানিতনোধ করলো। বাবার সামনে দাঁতে দাঁত চেপে আগের চেয়ে নরম স্বরে ডাকলো,” নয়না, বোন আমার! খুব ক্ষুধা পেয়েছে। সকালের নাশতায় কী বানালি?”

এতো মধু! নয়নার শরীর জ্বলছে, রাগে ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। রান্নাঘর থেকেই উত্তর দিল, ” পরোটা, ডাল, ভাজি।”

” আহ! নয়না যা নাশতা বানায় বাবা! বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্টও হার মানাবে, আমার তো সবসময় ওর রান্না পছন্দ। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, ঐ হাতজোড়া খুঁটিয়ে দেখতে। কিন্তু ছোট বোন লজ্জা পাবে তাই দেখি না।”

বাশার কথার সারমর্ম বোরহান উদ্দিন না বুঝলেও নয়না ঠিকই বুঝে। ঘৃণায় এক দলা থুতু ফেলে ডাস্টবিনে।

————————

দুপুরে নয়নাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। বাশার বাড়ির বাহিরে ছিল, সে নয়নাকে দেখতে আসার ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল। পাত্রপক্ষ হচ্ছে সেইদিনের হ্যাংলা পাতলা নুমান। বাশারের বন্ধু। বাবা-মাকে নিয়ে আঁটসাঁট বেঁধে আকলিমার দুয়ারে এসেছে। বোরহান উদ্দিন বাড়ি এসেই এমন পরিস্থিতির শিকার হবেন ভাবতেই পারেননি। সম্মানার্থে অতিথিদের সাথে খোশগল্প করছেন হাসিমুখেই। আকলিমা পারছে না, আজই নয়নাকে নুমানের ঘাড়ে তুলে দিতে। পাত্র কে সেই ব্যপারে নয়নাও জানে না। ঘরে এসে জানালার দিকে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দীর্ঘশ্বাসে একরাশ অভিমান! তার জীবনে কেউ টিকে থাকলো না। বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু আর তূর্য! তূর্যের কথা ভাবনায় আসতেই নয়না পড়ার টেবিলের পাশে যত্নে রাখা শাপলার মালার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। তার আত্মা, তার মন কোনোটাই ঠিক নেই। কেউ যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।

আকলিমা নয়নার ঘরে এসে দেখেন সকালের কাপড় এখনো নয়নার গায়ে। একপ্রকার বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন,” ঢং বাদ দিয়ে তৈরী হয়ে বাহিরে আয়। মেহমান চলে এসেছে।”

কথাটা বলে আকলিমা চলে যেতে নিয়ে পুনরায় ফিরে আসলো। নয়নার দিকে গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলল, ” হাতে, মুখে পাওডার মেখে নিস। দাগগুলো বুঝা যাচ্ছে।”

আকলিমা চলে যেতেই নয়না তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। গায়ের জামা পরিবর্তন করে হাতে ও মুখে পাওডার মেখে নেয় সে। সাজগোজ তার কোনোকালেই পছন্দ না। মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে।

নয়নাকে আকলিমা ধরে পাত্রপক্ষের সামনে বসিয়ে দিলো। নয়না চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। আকলিমাই কথাবার্তা শুরু করলো,” নয়না, আমার ভাইজি। যেমন সুন্দরী তেমন কাজেও পটু। বিয়ের পর আপনাদের কোনো কাজই করতে হবে না। লাখে এক আমার ভাইজি।”

নুমান লজ্জা পাচ্ছে। অমন সুন্দরী বউ তার হবে ভেবেই শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। নুমানের মা মুখ খুলল,” আমার নুমানও লাখে এক। সারাদিন বাবার সাথে দোকানে বসে, কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেই না। বাজে কোনো নেশা নেই।”

আকলিমা মনে মনে ভেংচি কাটেন। এই ছেলেকে দুইদিন আগেও বাজারে সিগারেট খেতে দেখেছে সে। এদিকে তার মা বলছে কী? যাই বলুক না কেন? আকলিমার এতে কিছু যায় আসে না। সে এই মেয়েকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচে।
” নয়নার সাথে আমি আলাদাভাবে কথা বলতে চাই,আন্টি।”

পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে মেয়ে নয়না চোখ তুলে তাকালো। বাশারও ঠিক সেই সময়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো।নুমানকে দেখে বলল,” এখানে কী করছিস?”
নুমান আমতাআমতা করে উত্তরে বলল,” মেয়ে দেখতে এসেছি।”

বাশারের অগ্নিসংযোগে এক ফোঁটা ঘি ঢালার জন্য নুমানের কথাই যথেষ্ট ছিল। সে সকলের সামনে নুমানের কলার চেপে ধরে বলল,” সারারাত গাঞ্জা টাইনা দিনে মুসল্লি সাজতে আসছিস? বের হো আমার বাড়ি থেকে।”

আকলিমা হতভম্ব। বাশার নুমানকে পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিলো। নুমানের বাবা-মা ছেলেকে অপমানিত হতে দেখে নাকমুখ কোঁচকান। যাওয়ার আগে আকলিমার উদ্দেশে বলেন, ” ঘরে অবিবাহিত ছেলে মেয়ে রেখে ফষ্টিনষ্টি করান, আর লোকসমাজের সামনে ভাল সাজান? আপনার মুখোশ যদি টেনে না খুলছি তো আমি নুমানের মা না।

” তোরে যদি দ্বিতীয়বার এদিকে দেখি,তো জানে মেরে ফেলবো।”

আকলিমা রাগান্বিত হয়ে ছেলের গালে পরপর থাপ্পড় বসান। বোরহান উদ্দিন আকলিমাকে ধমক দেন সাথে সাথে, ” ওকে মারছো কেন?”

আকলিমা নিরুত্তর। সে যা বুঝার বুঝে গেলো। নয়নার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” আমার ছেলের মাথা খেয়েই ছাড়লি, মা’গী।”

বাশার রাগে কাঁপছে। নয়নাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা আজ আরো গাঢ় হলো। বাশার জানে, আকলিমা নয়নাকে আজকের পর থেকে যেভাবেই হোক বাড়ি ছাড়া করবে। কিন্তু নয়নাকে তার চাই-ই চাই। এর জন্য যদি তার বাবা মায়ের কাছে খারাপ হতে হয় তাই করবে। এখন শুধু রাতের অপেক্ষা!

চলবে………………

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০৮

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: আট

সন্ধ্যা নামছে, সাথে শহরের ব্যস্ততাও। দুপুরের আলসে সময়ের পর পর শহরও নীরব হয়ে যায়, জমজমাট হয়ে উঠে সন্ধ্যার পরে। নয়নাকে বিদায় জানিয়ে তূর্য নিজের পথে চলে যায়। বহুদিন পর নয়না মনভরে নিঃশ্বাস নিয়েছে। প্রাণবন্ত হাসিতে ঝনঝন করে উঠেছে মন ও শরীর। বাড়ি ফিরতে নয়নার বেশ দেরী হয়ে গেলো। পৃথিবীর বুকে তখন আঁধার নেমে এসেছে। নয়না কলিং বেল চাপ দিলো। সময় নিয়ে দরজা খুলে দেয় রিহান। তার চোখ মুখ শুঁকনো হয়ে আছে। নয়নাকে দেখামাত্রই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করে সে। নয়না হতবাক বনে গেলো। রিহানের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ” কী হয়েছে আমার ভাইটার?”

” ভাইয়া বলেছে, আগামীকাল আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিবে, নয়ন আপু। মাকে বুঝাও আপু,আমি হোস্টেলে থাকবো না।”

নয়নার অন্তর কেঁপে উঠে। প্রশ্ন জাগে, হঠাৎ রিহানকে কেন বাশার ভাই হোস্টেলে পাঠাবে? নয়না একবার ভাবে, বাশারকে জিজ্ঞেস করবে পরক্ষনেই বাশারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা মনে পড়লে চুপসে যায় সে। নয়নাকে তার কাছে যেতে দেখলে নিশ্চয়ই ভেবে নিবে সে বাশারের ডাকে সাড়া দিয়েছে কিন্তু বাস্তবে নয়না এমনটা কিছুই চাইছে না।

রিহানক নিয়ে নয়না ঘরে চলে আসে। ওড়নার আড়াল থেকে নেতিয়ে যাওয়া শাপলার মালা বের করে সে। রিহানকে আজকের দিনের সব ঘটনা খুলে বলে। আকলিমা বাসায় নেই, বাজার করতে গেছে। বাশার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেছে। নয়না তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারছে। রিহান মালাখানা উলট পালট করে দেখে বলল,” আপু, ডাক্তারটা কিন্তু খুব সুন্দর। ”

” হ্যাঁ, কিন্তু জানিস রিহান! মানুষটা অদ্ভুতও।”

নয়নার আনমনে উত্তরে হাহাকারের আভাস পাওয়া গেলো। তবে কী অল্প সময়ের মধ্যে নয়নার মনে তূর্যের জন্য আলাদা জায়গা করে নিয়েছে? মনে ডাক্তারকে স্থান দিলেই বা কী! ডাক্তার তো সপ্তাহ খানিক পর বিদেশে পাড়ি জমাবে। নয়নাকে কী তার তখন মনে পড়বে? নয়না আর ভাবতে চায় না। সে কাল্পনিক জগতে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। বাস্তবে তূর্যের সাথে দেখা না হোক! স্মৃতির পাতায় তূর্যকে নিয়ে ভাববে সে।

————-

রাত দশটায় আকলিমা, বাশার ও অপরিচিত একজন ছেলে বাড়িতে আসে। নয়না রান্নাঘরে তখন ব্যস্ত। আকলিমার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে আসে সে। অপরিচিত মানুষ দেখে মাথার কাপড় ঠিক করে। অপরিচিত ছেলেটা নয়নার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখে বাঁকা হাসলো। নয়নার কাছে ছেলেটির তাকানো ভালো লাগেনি। এমনভাবে বাশার তাকে দেখে। কাচুমাচু হয়ে নয়না আকলিমার উদ্দেশে বলল,” ডাকছিলে ফুফু?”

আকলিমা রেগেমেগে তেড়ে নয়নার কাছে আসলো। দুই গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলল, ” সারাদিন কোন না’গ’রে’র সাথে ঘুরে বেড়িয়েছিস? সত্যি করে বল ছেলেটা কে?”

নয়না হতভম্ব হয়ে যায়। ভয়ে শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। এতোদূরের পথ সম্পর্কে ফুফু কীভাবে জানে? মনে প্রশ্ন জাগে। মিথ্যা বলল নয়না,” কেউ ছিল না।”

বাশার কথার ফোড়ন কেটে তখন বলল,” মিথ্যা কেন বলছিস। নুমান নিজ চোখে তোকে দেখেছে। আর আমিও নিজের চোখে তোকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেছি।”

ছেলেটির নাম নুমান। নয়না এতক্ষণে বুঝতে পারে, এসব বাশারের কারসাজি। নুমান এবার মুখ খুলল, ” এটাই তো সেই মেয়ে, যাকে আজ আমি বেলাই বিলে দেখেছি। বাশার তো বলেছিল, ছেলেপেলে দিয়ে ব্যাটাকে আচ্ছা রামধোলাই দিতে কিন্তু দেখতেই বোঝা গেছে বড়োলোক বাড়ির বিগড়ে যাওয়া সন্তান, তাই চেপে গেছি।”

আকলিমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। সে নয়নাকে চড় থাপ্পড় দিয়ে যাচ্ছে আর সাথে অকথ্য গালিগালাজ। নয়না কাঁদতে কাঁদতে বারবার ক্ষমা চাইছে কিন্তু আকলিমা তা শুনলো না। একসময় নয়নার নাক দিয়ে র’ক্ত বের হওয়া শুরু করল। বাশার তা দেখে মায়ের উদ্দেশে বলল, ” থামো এবার। জেলে যাওয়ার শখ হয়েছে নাকি?”

রিহান পর্দার আড়াল থেকে নয়নার মার খাওয়া দেখছে। ছেলেটা একবার আঘাত পেয়ে ভয় পেয়েছে। নয়নার কষ্ট দেখে কাঁদছে সে। আকলিমা ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে ফিরে যায়। রিহানকে দেখে বাশার নিজের ঘরে আটকে রাখে। নুমান বাশারকে ইশারায় বাহিরে ডেকে এনে বলল,” যাই বলিস বাশার, তোর বোনটা কিন্তু ভীষণ সুন্দরী। দুধে আলতা গায়ের রং! একটু যত্ন পেলে ঝলমল করবে শরীর। একটা কাজ করলে হয় না! মেয়েটাকে এতো মারধর না করে আমাকে দিয়ে দে।”

নুমান কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই বাশার নুমানের নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে বলল, ” নয়না আমার জিনিস। একদম নজর দিবি না, শা’লা। চোখের সামনে খাবার পেয়েও আমি খেতে পারছি না সেখানে তুই উড়ে এসে নিয়ে চলে যাবি? জান বাঁচাতে চাইলে আমার সামনে আর আসবি না।”

নুমান বন্ধুকে গালি দিতে দিতে বাড়ি ছাড়লো।

নয়নার শরীরে শক্তি নেই। নাকের র’ক্ত ঝড়া বন্ধ হচ্ছে না। ওড়না চেপে ধরে রেখেছে সে। এতো অত্যাচার সহ্য করতে পারছে না নয়না। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় আবারও বাড়ি ছাড়বে। সেবার বাবা ছিল, পিছুটান ছিলো নয়নার। এখন তার ইহজগতে কেউ নেই। নয়না বাচলো কর মরলো তা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথাও নেই। দুর্বল শরীরে নয়না বাড়ি থেকে বের হতে চাইলে বাশার পথ আটকায়। নয়নাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড় বরাবর নাক রাখে। লম্বা করে নয়নার শরীরের ঘ্রান শুঁকে বলে, ” এখনও সময় আছে, নয়না। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যা। নয়তো মায়ের হাতে এভাবেই মার খেতে থাকবি।”

” আমি মরে যাবো, তবুও তোমার হবো না।”

কাঁপা স্বরের উত্তরে বাশারের রাগের মাত্রা বেড়ে গেলো। সে নয়নাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলল,” আপোষে না পেলে জোর করতে আমি জানি। আজ তোকে আমার হতেই হবে।”

নয়নার ওড়না দিয়ে খুব শক্ত করে মুখ বেঁধে ফেলে বাশার। নয়নাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় বাড়ির বাইরে। নয়না যথাসম্ভব নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে। আকলিমা কি যেন ভেবে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। বাশারের এহেন আচরণে চিৎকার করে বলল,” কি করছিস, বাশার?”

নয়নার হাত ছেড়ে দিলো বাশার। আমতাআমতা স্বরে বলল, ” ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলাম আরকি।”

” এতো রাতে কোন ডাক্তারের কাছে নিবি? ঐ মেয়েকে এতো আহ্লাদ কেন করছিস,শুনি? ছেড়ে দে! ওর মুখ বেঁধেছিস কেন?”

” আমাকে বাপ মা তুলে বকছিল, মা। তাই!”

বাশারের একের পর এক মিথ্যা কথাতে নয়না মাথা ঝাঁকিয়ে না বোধক ইশারা করছে। হাত ছাড়া পেয়ে চট করে মুখ খুলে বলল,” আমাকে বাঁচাও, ফুফু নয়তো একদম মেরে ফেলো। বাশার ভাই আমার সর্বনাশ করতে চাইছে।”

যতটুকু সহানুভূতি আকলিমার মনে তৈরি হচ্ছিল তা নিমিষেই ফুরিয়ে গেলো। ছেলেকে সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। তার মতে, নয়না তার মায়ের মতো। নয়নার মা যেভাবে তার ভাইকে ফুসলিয়ে বিয়ে করেছিল, নয়নাও সেভাবে তার ছেলেকে ফুসলিয়ে নিজের করতে চায়। আকলিমা নয়নার হাত ধরে টেনে বাড়িতে নিয়ে আসে। নয়নাকে ঘরে আটকে রেখে বাহির থেকে তালাবদ্ধ করে দিলো সে। বাশারের উদ্দেশে রেখে বলল,” এই মেয়ের আশেপাশে তোকে যেন না দেখি।”

বাধ্য ছেলের মতো বাশার মায়ের কথা মান্য করে ঘরে চলে যায়। আকলিমা নয়নাকে শুনিয়ে বলল, ” বে’শ্যা’বাড়ি যেতে পারিস না? আমার ছেলেকে কেন নষ্ট করতে চাচ্ছিস?”

নয়না উন্মাদের মতো ভেতর থেকে হেসে উত্তর দিল,” আমাকে মে’রে ফেলো,ফুফু! আমি আর বাঁচতে চাই না।”

পরদিনই রিহানকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বাশার নিজেই সবকিছু ঠিকঠাক করে এসেছে। তার মনে কী চলছে সেই জানে! বাড়ি ফিরে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে। তাকে বাঁধা দেয়ার মতো আর কেউ নেই। সমাজের লোকেদের ভয়ে নয়নাকে নিয়ে বাহিরে সে যেতে পারবে না। যাই করবে এবাড়িতে থেকেই করবে। নয়নার এমন অবস্থা সে করবে যেন কাউকে বলতে না পারে। নয়নার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা ভাবতেই শরীর গরম হয়ে আসে বাশারের।

—————

সপ্তাহ দুয়েক পর এক সকালে নয়না রান্না করছিল। কলিংবেলের আওয়াজ তখন তার কানে আসে। এতো সকালে কেউ আসে না। ভীত পায়ে নয়না প্রধান ফটক খুলে দেয়। নয়নার ফুফা অর্থাৎ আকলিমার স্বামী হাস্যজ্বল মুখে দাঁড়িয়ে নয়নাকে দেখে বলল, ” কেমন আছিস,মা!”

দীর্ঘদিন পর কারো মুখে আদুরে ডাক শুনতে পেয়ে নয়না কাঁদতে কাঁদতে বলল, ” বাবার জানাজায় আসলে না কেন,ফুফা?”

“নুরুজ্জামান মারা গেছে? কবে? কীভাবে? আকলিমা তো আমাকে কিছুই জানায়নি!”

বাশারের বাবার কথায় তাচ্ছিল্য হাসে নয়না। আপন ফুফু এতোটা নিকৃষ্ট হতে পারে আকলিমাকে না দেখলে কেউ বুঝতো না। মিছে হেসে নয়না বলল,” তুমি কষ্ট পাবে,তাই হয়তো বলেনি!”

চলবে……………..

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০৭

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: সাত

কল্পনার জগতে সবার স্বপ্নই পূরণ হয় কিন্তু বাস্তবে কখনো পূরণ হয় না; স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে যায়। পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ আছে যাদের স্বপ্ন বিশাল কিন্তু পূর্ণ হতে হতে আয়ু শেষ হয়ে যায়। আবার কখনো ম্যাজিকের মতো কেউ এসে স্বপ্ন সত্যি করে দেয়! লাখে একজন সেই ভাগ্যবান হয়। নয়নার জীবনে এমন একজনের খুব প্রয়োজন। বাস্তবে নয়নার মতো মেয়েদের জীবনে এমন কেউ আসে না৷ সমাজের কটুবাক্য আজীবন তাদের শুনতে হয়।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। অর্ধ পরিচিত একজন ছেলের সাথে নয়না যাচ্ছে, গন্তব্য তার এখনও অজানা। অর্ধ পরিচিত বলার কারণ, নয়না তূর্যের সম্পর্কে শুধু জানে সে একজন ডাক্তার। কার ছেলে, কার ভাই, কার বন্ধু কিছুই জানে না সে। মোটকথা ব্যক্তিগত জীবনে তূর্য কেমন সেই সম্পর্কেও অজ্ঞ সে। নয়নার বাবার মৃত্যুর সময়কার সাহায্যের কারণে সে তূর্যকে ভাল মনের মানুষ বলেই চিনে। সেই সূত্রপাতে আজকে তূর্যকে বিশ্বাস করেই অজানা গন্তব্যে যেতে রাজি হয়েছে। এছাড়াও সন্ধ্যার আগে সে বাড়ি ফিরতে পারবে না। পথঘাটে কতক্ষণই বা ঘুরে বেড়াবে। ব্যস্ত শহরে সবাই যে ব্যস্ত থাকবে তা কিন্তু নয়! আবার সবার মনই যে তূর্যদের মতো থাকবে তাও নয়। বাশারের মতো হাজার হাজার পুরুষ রয়েছে যাদের নজর একবারের জন্য হলেও নয়নার উপর পড়বে। তখন সে কোথায় যাবে? একাকী নয়নাকে পেয়ে নিশ্চয়ই তারা খুবলে খেতে চাইবে!

গাড়ি চলছে গাজীপুরের পূবাইলের পথে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়নাকে মুগ্ধ করছে। কানাইয়া পৌঁছে নয়না গাড়ি থেকে নামার জন্য ছটফট করতে শুরু করে। তূর্য আয়নায় দেখে মুচকি হাসে। বাবাহারা মেয়ের মন শান্ত করার জন্য তূর্য শান্তির জায়গায় তাকে নিয়ে এসেছে। কানাইয়া ব্রিজের পাশে গাড়ি পার্ক করে বের হয়ে আসে তূর্য। তার হাতে মাঝারি সাইজের হাত ব্যাগ। নয়না জিজ্ঞাসু চোখে তূর্যের দিকে তাকালে তূর্য হেসে বলল, ” সময় হলে এই ব্যাগের ভেতর কী আছে তা জানতে পারবে।”

নয়না কথা বাড়ায় না। তূর্যকে অনুসরণ করে পথ এগোয়। কানাইয়া ব্রিজ থেকে ইটের রাস্তাধরে আগাচ্ছে তূর্য তাকে অনুসরণ করছে নয়না। মনে হচ্ছে, একটি জীবন্ত পুতুল তার মালিকের অনুগত্য করে যাচ্ছে। ইটের রাস্তার পাশেই বেলাই বিল। আট কিলোমিটার বিস্তৃত বিলের বুকের উপর শাপলা ও কচুরিপানা শোভা পাচ্ছে। নয়না মুগ্ধ নয়নে তা দেখছে। খুশিতে তার চোখ চিকচিক করছে। আল্লাহর সৃষ্টি কতো সুন্দর, তা এখানে না আসলে সে বুঝতেই পারতো না। নয়নার থেকে কিছুদূরে তূর্য মাঝির সাথে দামদর করে নিল। তারা বিলের বুকে দুই ঘণ্টা সময় থাকবে এই চুক্তিতে নৌকা ভাড়া করলো। নয়না তূর্যের দিকে ফিরে তাকালে তূর্য বলল,” চলে এসো, আমরা নৌকায় চড়বো।”

নয়না কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,” নৌকা কী আপনি চালাবেন?”

” আমি ডাক্তার, মাঝি নই।”

নয়না জিভ কাটে। সত্যিই তো! ডাক্তার মানুষের কাজ হচ্ছে কা’টা’কা’টি করা, প্রেসক্রিপশনে ভুজুংভাজুং লেখা লেখে সাধারণ মানুষদের কনফিউশানে ফেলা সেখানে নয়না ডাক্তাকে কীসব বলছে। মাথা নত অবস্থায় নয়না এগিয়ে যাচ্ছে। মাথায় এখনো তূর্যের বলা কথা বাজছে। নৌকায় পা বাড়ানোর সময় অমনোযোগী হয়ে যায় নয়না, ফলস্বরূপ পা পিছলে পড়ে যেতে নেয় সে। তূর্য নয়নার ভাবগতি লক্ষ্য করছিল, নয়নাকে পড়ে যেতে দেখতে পেরে হাত শক্তকরে ধরে ফেলল সে। ভয়ে নয়না চোখ বন্ধ করে নেয়, তূর্য তার বুজে থাকা চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকল, কতো সময় তার জানা নেই। চিন্তন ফিরে আসতেই নয়নার হাত তাৎক্ষণিক ছেড়ে দিয়য়ে বলল,” সবসময় কেন তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকো? এটা কী লঞ্চ পেয়েছো! যে নির্দিষ্ট সময় না উঠলে ছেড়ে দিবে? আসো আমি তোমাকে হাত ধরে উঠতে সাহায্য করি।”

কথা বলতে বলতে এক লাফে তূর্য নৌকায় চড়ে দাঁড়ায়। নৌকার তখন ঝুলছে, নয়না তা দেখে মিনমিন করে বলল, ” নৌকা ঝুলছে, আপনি আমাকে ফেলে দিবেন না তো?”

তূর্য হতাশ হলো কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল,” অবিশ্বাস করা কী তোমার বংশগত বৈশিষ্ট্য?”

” জি!”

নয়নার কথার গ্রাহ্য না করেই তূর্য হাত মেলে ধরে বলল,” আমার হাত ধরে উঠে এসো। ভয় নেই, ফেলে দিব না। আমরা ডাক্তাররা জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। আমি সজ্ঞানে তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিব না।”

মুগ্ধ হয়ে নয়না তূর্যের কথা শুনে গেলো। শিক্ষিত মানুষদের কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো, তারা মানুষের সাথে খুব সুন্দরভাবে কথা বলতে পারে। তাদের কথায় আলাদা মুগ্ধতা থাকে। ছাঁদ বিহীন নৌকা হেলেদুলে চলছে সাথে নয়না আর তূর্যও।

বেলাই বিলের বুকে নৌকার ছড়াছড়ি। দূর দূরান্ত থেকে অনেকেই সময় কাটানোর জন্য এসেছে। নয়নার সেদিকে ধ্যান নেই, সে প্রকৃতির সাথে মিশে সময়টা উপভোগ করছে। মাঝে মাঝে পানিতে হাত ডুবিয়ে শাপলা তুলে নিচ্ছে, পানির ছিটিয়ে খিলখিল করে একাকীই হাসছে। তূর্য নয়নার আড়ালে একটি ছবি তুলে নেয়। সে কেন এমন কাজ করলো নিজেও জানে না। অবহেলিত সমাজে আমরা যখন কারে কাছে গুরুত্ব পাই, তখন সবকিছু ভুলে তাকেই আপন ভেবে নেই। মন খুলে তখন নিঃশ্বাস নেই। নয়নাও মন খুলে আজ নিঃশ্বাস নিলো। দুই হাত মেলে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,” আজকের দিনটার কথা আজীবন মনে রাখবো। দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে ঋণী করে দিলেন, ডাক্তার সাহেব! এই ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব?”

” আমাকে সঙ্গ দিলে কিছুটা ঋণ শোধ হতে পারে, মিস নয়ন।”

নয়না চোখ খুলে দেখতে পায় তূর্য খাবার নিয়ে বসে হাসে। নৌকার উপর রোমাল বিছিয়ে খুব সুন্দর করে খাবার ডেকোরেশন করেছে তূর্য। নয়না অবাক হয়ে যায়, খাবারের আইটেম বিরিয়ানি, পাস্তা, জুস আর কোঁকাকোলা। তূর্য খাবার পরিবেশন করতে করতে বলল,” এখানে খাবার পাওয়া যায় না। আমি সবসময় রান্না করেই নিয়ে আসি। প্রত্যেকবার নৌকার মাঝি আমার মেহমান হয়। আর আজ!”

” আর আজ আমি আপনার মেহমান, তাই তো?”

তূর্য চমৎকার হাসলো। নয়নার দিকে পাস্তা এগিয়ে দিতে দিতে বলল,” তোমার ব্রেন তো খুবই পরিষ্কার! পড়াশোনা কতদূর করেছো?”

” অনার্সে দ্বিতীয় বর্ষ।”

এক চামচ বিরিয়ানি মুখে নিতেই নয়না চোখ বন্ধ করে ফেলে। একজন ছেলের হাতের রান্নার স্বাদ এতোটাই মজা যে তার আরো খেতে ইচ্ছে করছে। পরপর কয়েক চামচ খেয়ে নয়না বলল,” আমও এতোদিন ভাবতাম, ডাক্তাররা শুধু কাটা ছেঁড়াই করতে জানে অথচ ডাক্তাররা যে এতো ভালো রান্নাও জানে তা আজ জানলাম।

তূর্য হাসলো। একজন মেয়ের কাছ থেকে রান্নার প্রশংসা শুনে লজ্জা পেল। সবকিছু একপাশে রেখে সিরিয়াস হলো তূর্য। নয়নাকে এখানে নিয়ে আসার আরে একটি কারণ আছে। আজ সেই বিষয়ে নয়নার সাথে কথা বলবে। তূর্য নিজেকে তৈরী করে বলল,” ফুফুর কাছ থেকে চেলে আসছো না কেন?”

অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকায় নয়না। তার সম্পর্কে তূর্য একটু বেশিই আগ্রহ প্রকাশ করছে না তো! নয়নার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও সে জ্ঞাত! নয়না উত্তর দিলো,” দুইজন মানুষের মুখের দিকে চেয়ে এখনো ওই বাড়িতে পড়ে আছি।”

” কে? কাদের কথা বলছো?”

” রিহান, যাকে আপনি বাঁচিয়েছিলেন। আরেকজনের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক বা থাকলেও সে আমার খুবই আপন। আমার ফুফা মো: হাফিজুল ইসলাম। ওনি কাজের সুত্রে সীতাকুণ্ডে থাকেন। আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। বাবার পর তিনিই আমার পরম আপনজন ছিলেন। ফুফুর সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক থাকলেও ফুফা আমাকে এবাড়িতে নিয়ে এসেছেন। উনি যতদিন বাড়ি থাকেন আদরে যত্নে আমাকে কমতি দেন না। রিহান তার বাবার মতো, আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।”

” আর তোমার ফুফু ও তার ছেলে?”

আকলিমা ও বাশারের কথা উঠাতেই নয়না চুপ বনে যায়। তাদের সম্পর্কে সে কীই বা বলবে! নয়নাকে চুপ থাকতে দেখে তূর্য বলল,” যাই বলো নয়ন! তুমি কিন্তু খুবই সুইট মেয়ে। আমি চলে গেলে তোমাকে মনে রাখবো।”

” আপনি কোথায় চলে যাবেন?”

নয়নার হতভম্ব উত্তর তূর্যের ভীষন মনে ধরে। সে মুচকি হেসে বলল, ” এক বছরের জন্য আগামী সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে যাচ্ছি।”

” অহ!”

নয়নার হতাশার সুর তূর্যের কানে আসলো। সে আক্ষেপের স্বরে বলল,” তোমার জীবনটাকে গুছিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তাতে রাজি না। একটা কথা শুনে রাখো, নয়ন! পৃথিবীতে ভালো মানুষের পরিসংখ্যান করলে দুই থেকে তিনজনকে পাবে। সবাইকে বিশ্বাস করো না।”

নয়না ডাগরডোগর চোখে শুধু শুনেই গেলো। আজকের দিনটা শেষ না হোক! কিছুক্ষণ পরই তো সন্ধ্যা নামবে সাথে নয়নার জীবনেও আঁধার নামবে।

একটি ছোট্ট মেয়ে নৌকায় করে শাপলা ফুলের মালা বিক্রি করছে। তূর্য মেয়েটাকে ডেকে মালা কিনে নিলো। নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” সাধারণের মধ্যে অসাধারণ মেয়েটাকে আমার তরফ থেকে সামান্য উপহার।”

নয়না গ্রহন করে নিল। শাপলা ফুলের মালা গলায় পরে বলল,” আমাকে কেমন লাগছে?”

তূর্য আনমনে উত্তর দেয়,” পদ্মফুলের মতো!”

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। জনে জন্য মানুষও কমে এসেছে। দুই ঘণ্টার কথা বললেও চার ঘণ্টা বেলাই বিলের কাটিয়েছে দুইজন। কানইয়া ব্রিজে পৌঁছানোর পথে ইটের রাস্তা পড়ে। তূর্য সেদিকে তাকিয়ে বলল,” বর্ষাকালে এই রাস্তায় পানি জমে থাকে। খালি পায়ে হাঁটার অনুভূতি দারুণ হয়। তুমি সময় করে বর্ষাকালে এসো। তখন আমার কথা মনে করবে।”

” আমি আজীবন আপনাকে মনে রাখবো, ডাক্তার!”

তূর্য হেসে বলল,” আমাদের মাঝে আজ যেই বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছে তা আজীবন থাকবে। আমিও তোমাকে ভুলবো না।”

অপরিচিত থেকে পরিচিত, পরিচিত থেকে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রণয়! আদৌও কী সম্ভব? নয়নার মন আজ আকাশ বাতাসে উড়ছে। তার জীবনের সকল কষ্ট ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আদৌও কী তাই! নয়না কী জানে, দূর হতে একজোড়া চোখ নয়নাকে পর্যবেক্ষণ করছে! মুঠোফোন বের চোখ জোড়ার মালিক কাউকে ফোন করে বলে,” পেয়েছি, কিন্তু সাথে একজন ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি। বয়ফ্রেন্ড হতে পারে। কী করব?”

অপর পাশ থেকে উত্তর আসে, ” মে’রে ফেল।”

চলবে……………..

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০৬

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: ছয়

এই পৃথিবীতে বাবা নামক ছায়া মাথার উপর থেকে উঠে গেলে চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায়। জীবনযুদ্ধ সেদিন থেকেই থেকেই শুরু হয়। ধীরে ধীরে মানুষ চিনতে শিখে। বিশাল পৃথিবীতে টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে। নয়নার জীবনের মোড় কোনদিকে ঘুরে গেছে সে নিজেও জানে না। বাবা চলে গেছে বেশি সময় হয়নি। অথচ পুরো পৃথিবী এখন তার কাছে অচেনা মনে হচ্ছে। সহানুভূতি দেখানোর মতো কেউ নেই তার জীবনে। পিতৃহারা নয়নার পৃথিবীতে নতুনকরে জন্ম হয়। অভিভাবকহীন নয়নার আপন ঠিকানা একমাত্র ফুফুর বাড়ি। সেখানেই এসেছে সে। অটোরিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে প্রধান ফটকে পা মাড়ায় নয়না। কান্না তার দলা পাকিয়ে আসছে। বাবা জীবিত থাকাকালীনই তার উপর অন্যায় করে আসছিল, আজ তার বাবা পৃথিবীতে নেই; কী হবে তার সাথে? কেমন ব্যবহার পাবে ফুফুর কাছ থেকে! নানান ভাবনার মাঝে নয়না বাড়িতে প্রবেশ করে। সারাবাড়ি নীরবতায় ঘেরা, নয়নার ফুফুকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। খাবারের টেবিলের উপর পানির পাত্র থেকে একগ্লাস পানি করে পান করে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে নয়না তন্মধ্যে বাশারের বাড়িতে আগমন ঘটে। ব্যাগপত্র নিয়ে ফিরে এসেছে সে, একলা বাড়িতে কাউকে দেখতে না পেয়ে নয়নার তলপেটে হাত ছুঁয়ে দেয় বাসার। নয়না ‘আল্লাহ’ বলে দূরে সরে দাঁড়িয়ে বাশারের উদ্দেশে বলল,” চুপচাপ থাকি, তোমাকে ভয় পাই বলে ভেবো না আমি দুর্বল। তোমার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করব, বাশার ভাই। নয়তো নিজের হাতে তোমাকে খুন করে জেলে পঁচে মরব।”

” তোর এতো সাহস আছে? আর স্বাক্ষী পাবি কোথায়? আমার এইরূপ তুই ছাড়া কেউ জানে না, নয়না!”

” কেউ না জানলেও আল্লাহ জানেন, তুমি কতোটা নিকৃষ্ট। দুনিয়াতে তোমার শাস্তি না হলেও পরকালে তো হবে? ”

” অযথা কথা না বলে একবার আমার হয়ে যা, নয়না! ভালো খেতে পারবি, পরতে পারবি! তাছাড়া মায়ের হাত থেকেও তোকে সারাজীবন রক্ষা করব।”

” মরে যাবে কিন্তু সম্মান খোয়াবে না, এই নয়না।”

বাশার বিশ্রী হাসে। তার হাসিটা গা জ্বালানো হাসি। মাথার চুল এলোমেলো করে সে বলল,” কি যেন বলছিলি! আমাকে পুলিশে দিবি?”

নয়না মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ দিব, তোমাকে চৌদ্দ শিকলের ভেতরে আজীবনের জন্য থাকার ব্যবস্থা করব।”

নয়নাকে রাগাতে মূলত বাশার শেষোক্ত প্রশ্ন করে। মানুষ রাগের সময় হিতাহিতজ্ঞান লোপ পায়। বড়ো ছোট কাউকে মান্য করে না। মুখে যা আসে তাই বলে বেড়ায়। নয়নার শেষ কথা আকলিমা শুনতে পায়। সে এতোক্ষণ নিজের ঘরেই ছিল। হাঁটুর ব্যথার ঔষধ সেবন করে ঘুমিয়েছিল। বিনা কারণে ছেলের এতো বড়ো সাজার কথা শুনে রেগে যায় সে। নয়নার কাছে এসে চুলের মুষ্টি ধরে দুইগালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় আকলিমা। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে ভুলে না সে। রাগান্বিত স্বরে আকলিমা বলল, ” যার ঘরে খাচ্ছিস তাকেই চৌদ্দ শিকলে ঢুকাতে চাইছিস? এই তোর এতো কীসের দেমাক? সামান্য রূপেরই তো? এই রূপ দিয়েই আমার ছেলেকে ফাঁসাতে চাচ্ছিস, তাই না! শুনে রাখ, নয়ন! আমি আমার ছেলের জন্য রাজকন্যা নিয়ে আসবো যার কোটি কোটি টাকা থাকবে। তোর মতো এতিমকে এই আকলিমা কখনো বউ করবে না।”

” ছাড়ো ফুফু, আমি বাশার ভাইয়ের থেকে মুক্তি চাইছি। দরকার পড়লে তোমার বাড়ির ঝিঁয়ের কাজ করব কিন্তু তোমার ছেলেকে বিয়ে করব না।”

নয়নাকে বিয়ে করবে এমন মনস্থির বাশার কখনও করেনি। ভবিষ্যতে করবেও না। নয়না বাশারের নিকট ভোগের বস্তু মাত্র। নয়নার দুঃখেও তার কিছুই না সুখেও না। সে মনে মনে হিসাব কষে বলল,” আরে মা, ছাড়ো তো! ওর ক্ষমতা কথা পর্যন্তই, বেশি বললে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিব তখন ওর বাপও কবর থেকে উঠে বাঁচাতে আসবে না।”

মানুষের মৃত নির্ধারিত। কেউ চিরকাল এই পৃথিবীতে বসবাস করতে পারে না। কেউ মারা গেলে তার প্রশংসা করায় রয়েছে বিশেষ উপকার। আবার কেউ যদি মৃত ব্যক্তির খারাপ গুণ বর্ণনা করে তবে এর পরিণামও খুবই খারাপ। এজন্য কেউ মারা গেলে তার খারাপ গুণ বলে বেড়ানো থেকে বিরত থাকা জরুরি। ব্যক্তির ভালো গুণ প্রকাশ করায় রয়েছে কল্যাণ। এই জ্ঞানটুকু যদি শিক্ষিত নামক মূর্খদের থাকতো তবে মৃত ব্যক্তির দোষ গুন নিয়ে আলোচনা করতো না। নয়নার মনে বাশারের প্রতি ঘৃণার মাত্রা বেড়েই চলেছে। সে মুখ ফিরিয়ে নেয় আকলিমা ও বাশারের থেকে।

নয়নাকে ধাক্কা দিয়ে আকলিমা ছেলেকে বলল, ” সমাজের লোকদের কথা শুনতে হবে নয়তো এই মেয়েকে আজই বাড়ি ছাড়া করতাম।”

মা ছেলের কথা নয়নার আর শুনতে ইচ্ছে করছে না। সে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। নয়নার আড়ালে বাশারের মুখে ক্রুর হাসি ভেসে উঠল। নয়নাকে আজ সে আকলিমার হাতে ইচ্ছে করেই মার খাইয়েছে। বাশারের ভাষ্যমতে, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতেই হবে। নয়নাকে এতদিন সে মানসিক চাপ প্রয়োগ করেছে আজ থেকে তাক শারীরিকভাবে আঘাত করবে। এতে করে একসময় না একসময় নয়না তার কাছে আসবেই আসবে।

——————————————

সপ্তাহের শুক্রবার নয়নার জন্য কখনও সুখকর হয় না। এইদিনে কাজের চাপ বেশি থাকে। সপ্তাহে চারদিন পড়াশোনা করার অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হতে পারলেও শুক্রবারে আকলিমা তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না। দিনের সময়টায় আকলিমার সব কাজ তাকে দিয়ে করায়। আজ নুরুজ্জামানের মৃত্যুর চল্লিশদিন পূরণ হয়েছে। আকলিমার থেকে লুকিয়ে একমাসে তিনটা টিউশনি করিয়েছে সে। হাজার পাঁচেক টাকার মিষ্টি কিনে গরীব অসহায়দের বিলিয়ে দিবে ভেবেছিল কিন্তু আকলিমা আজ তাকে বাড়ি থেকেই বের হতে দিচ্ছে না।
বাশারের জন্য আকলিমা মেয়ে দেখেছেন। নয়নার মতো রূপসী না হলেও অর্থ প্রাচুর্যের দিক থেকে কম নয় মেয়েটি। ঢাকায় বড়ো বড়ো দুইটা বাড়ি আছে মেয়ের নামে, আর কী চাই আকলিমার! ছেলের বদৌলতে নিজেরও উপকার হবে।
সকাল থেকে নয়না রান্নাঘরে রান্না করছে। হাতে, মুখে কালি মেখে একাকার নয়না। এবার সে কোনোভাবেই মেহমানদের সামনে যাবে না। নয়নার মনে পড়ে যায় গতবারের মেহমানদের নিয়ে কিছু ঘটনা, সেবার বাশারের বিয়ের কথাবার্তা প্রায় পাকাপাকি হয়েছিল। খাবারের সময় নয়না মেহমানদের খুশিমনে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত তখনই একজন বলেছিল, ” আপনাদের ঘরেই তো সুন্দরী মেয়ে আছে, তবে আমাদের মেয়েকে কেন পছন্দ করলেন? পাত্রী হিসাবে আপনার ভাইজি কিন্তু দারুণ, আমার ছেলে থাকলে বউ বানিয়ে নিয়ে যেতাম।”

আকলিমা সেদিন ইতস্ততভাবে বলেছিল,” আপনারা যেমনটা ভাবছেন তেমন কিছু না। ও আসলে আমার দূর সম্পর্কের ভাইয়ের মেয়ে। আমার এখানে কাজ করে, বাশারকে তো ভাই ভাই ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আমাদের ছেলে মেয়ের মাঝে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।”

লোকটি সেদিন উত্তরে বলেছিল, ” সম্পর্ক নেই তা বুঝলাম কিন্তু ছেলেমেয়েদের মন! কখন কি হয়ে যায় বলা মুশকিল। আমরা এই বাড়িতে মেয়ে দিব না।”

মেহমানরা চলে গেল। বাশারের বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় আকলিমা সেদিন নয়নাকে বেত দিয়ে পিটিয়েছিল। নয়নার এরপর সাতদিন বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। নয়না অতীতের লোমহর্ষক দিনগুলোর কথা ভেবে লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে। আকলিমা কাজ দেখার জন্য তখন রান্নাঘরে আসলো। নয়নার ক্লান্তমাখা মুখখানা দেখে বলল, ” এবার কোনো অঘটন ঘটাবি না, নয়না। আজ যদি একবারের জন্য ঘর থেকে বের হয়েছিস তো সাতদিন খাবার বন্ধ থাকবে।”

আকলিমার কথার প্রত্ত্যুত্তরে নয়না কিছুক্ষণ ভেবে বলল,” বাড়িতে থাকলে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতেই হবে তারচেয়ে আমি বাহিরে চলে যাই। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরে আসব, ফুফু।”

নয়না মরে গেলেই কী আর বেঁচে থাকলেই কী। আকলিমার যায় আসে না। সে তো চায়, নয়না ইচ্ছে করেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাক। পরমুহূর্তে কাজের কথা ভেবে আকলিমা নিজেই চুপসে থাকে। নয়নার কথায় আকলিমা সায় দিয়ে বলল, ” যা, তবে এখন খাবার পাবি না। মেহমানদের খাওয়া শেষ হলে তবেই খাবার পাবি।”

” খাওয়া নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না,ফুফু। না খেয়ে থাকা আজ প্রথম নয়। তোমার বাড়িতে এসে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।”

আকলিমা মুখ বাঁকিয়ে বলল,” বেশি মুখ চালাবি না, নয়ন! যা এখান থেকে, মেহমানরা আসলো বলে!”

এক কাপড়ে হাসিমুখে নয়না টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। মিষ্টির দোকান থেকে জিলাপি কিনে গাজীপুরের রেলগেটের দিকে চলে আসে। পথশিশুদের মাঝে মিষ্টি বিলিয়ে নিজেও বসে খেয়ে নেয়।

শুক্রবার তূর্যের ছুটির দিন। সাধারণত শুক্রবারে ডাক্তাররা নিজস্ব চেম্বারে বসে কিন্তু তূর্যের বিষয় আলাদা। হাসপাতালের কাজকর্ম ছাড়া বাকী সময় নিজের।

গাজীপুরের বেলাই বিল একটি মনোরম জায়গা। চেলাই নদীর সাথে বেলাই বিল। এখানে ইঞ্জিন চালিত আর ডিঙ্গি নৌকা দুটোই পাওয়া যায়। বিকালে এই বিলের চারপাশে অপূর্ব দৃশ্য তৈরি হয় সাথে শাপলার ছড়াছড়ি। কিছুক্ষণ পরপর বাতাসে গায়ে ঝাপটা লাগে। তূর্য এখানে প্রায়ই একাকী আসে। নদীর সাথে তার আত্মার সম্পর্ক, সময় নিয়ে বসে উপভোগ করে। পছন্দের স্থানে পছন্দের গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে সে। রেললাইন পাড় হতেই নয়নাকে পথশিশুদের সাথে বসে থাকতে দেখতে পায় তূর্য। যথারীতি ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয় সে। গাড়ি থামিয়ে এগিয়ে যায় সেদিকে। নয়না তখন মনখুলে গল্প করতে ব্যস্ত। পুরুষের পা জোড়া তার সামনেই থামতে দেখে মাথা তুলে তাকায় সে। তূর্যকে দেখে নয়নারও ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে। বিড়বিড় করে বলে,” এই বিপদ আসলো কেন?”

চারপাশে পর্যবেক্ষণ করে তূর্য নয়নাকে বলল,” আমার সাথে এসো।”

নয়না হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। সে কী ভুল শুনছে? পরমুহূর্তে তার মনে প্রশ্ন জাগে, তূর্য তাকে কেন যেতে বলছে? নয়নার কোনো ক্ষতি করবে না তো! এমনও তো হতে পারে, নয়নাকে একা পেয়ে সুযোগ খুঁজবে? আজ আবার আপনি থেকে তুমি তে নেমে এসেছে। সাতপাঁচ ভেবে নয়না বলল,” আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। ”

তূর্য দাঁতে দাঁত চেপে এবার বলল,” আমার সাথে রঙ্গ লীলা করতে আসতে বলিনি। সারামুখে কালি নিয়ে বত্রিশ দাঁত বের করে হাসছো, মানুষ পাগল বলছে, দেখো চারপাশে তাকিয়ে, সবাই হাসছে।”

তূর্যের কথা সঠিক। অনেক স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রী তাকে দেখে হাসছে। অগত্যা কাচুমাচু হয়ে নয়না তূর্যকে অনুসরণ করে।

গাড়িতে বসে তূর্য নয়নাকে ইশারা দিয়ে বসতে বলে। নয়না শুঁকনো ঢোক গিলে পিছনের সিটে গিয়ে বসে। তূর্য কথা বাড়ায় না গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেয়। রেলপথের পাশদিয়ে গাড়ি চলছে, নয়না মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারপাশ দেখছে। গাজীপুরের পথে ঘাটে চলাচল করলেও দূরে কোথাও যায়নি সে। গাজীপুরের যে সবুজের সমারোহের ছোঁয়া আছে জানতোও না। তূর্য ফ্রন্ট মিররে সবকিছুই দেখছে। কিছুপথ এগোতেই একটি পানির বোতল ও টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল,” মুখ মুছে নাও।”

নয়না বোকার মতো গাড়ির মধ্যেই মুখে পানি দিতে শুরু করে। তূর্য তা দেখে চিৎকার করে বলে, ” পাগল হলে নাকি? সরাসরি মুখে পানি না ঢেলে পরিষ্কার করার কোনো উপায় নেই নাকি?”

তূর্য গাড়ি থামিয়ে দিলো। পিছনে ফিরে টিস্যু বের করে অল্প পানি দিয়ে ভিজিয়ে বলল,” কাছে আসো!”

নয়না কাছে আসার পরিবর্তে দূরে সরে বসে। তূর্যকে সে কখনোই শরীর স্পর্শ করতে দিবে না। নয়নার ভীতিকর অবস্থা দেখে তূর্য দুই হাত উপরে উঠিয়ে বলে, ” আ’ম সরি।ভুল বুঝো না, আমি মূলত হেল্প করার জন্য বলছিলাম। আমার মাঝে খারাপ কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না।”
নয়নার দিকে টিস্যু এগিয়ে দেয় তূর্য সাথে নিজের ফোনটাও। সেলফি ক্যামেরা বের করে দিয়ে বলল, ” ক্লিন ইট।”

নাকে মুখে বেশ কয়েক জায়গায় কালি লেগে আছে।৷ নয়না লজ্জায় মাথা নত করে পরিষ্কার করে নেয়। ফোন এগিয়ে দেয়ার সময় ভুলবশত হাতের ছোঁয়ার ছবি তুলে ফেলে নয়না। আকস্মিক শব্দে ভয়ে নয়নার হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো। নয়না ফোন তুলে তূর্যের হাতে দিয়ে বলল, ” আমি ইচ্ছে করে ফেলিনি।”

তূর্যয় হেসে বলল,” এতে হাইপার হচ্ছো কেন? কিছু হয়নি তো!”
এরপর কিছু একটা ভেবে বলল,” তোমাকে কোথায় নামিয়ে দিব?”
” যে কোনো রাস্তার পাশে নামিয়ে দিলেই চলবে।”

নয়নার প্রত্ত্যুত্তরে তূর্য অবাক হয়ে বলল,” মানে? তুমি কী সারাদিন রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে?”
” হ্যাঁ, সন্ধ্যায় বাসায় যাব।”

তূর্য কিছুক্ষণ ভেবে নয়নার উদ্দেশে বলল,” আমার সাথে এক জায়গায় যাবে?”

নয়না হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো তূর্যের দিকে।

চলবে…………….

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০৫

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: পাঁচ

গাজীপুরের সরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নুরুজ্জামানকে রাখা হয়েছে। হার্ট বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান মাহবুব শিকদার নুরুজ্জামানের কেস দেখছেন। তূর্য সহকারী ডাক্তার, মাহবুব শিকদারের আশেপাশে থেকে রোগীর প্রতি মিনিটের আপডেট জানাচ্ছেন। জন্ম মৃত্যু সব উপরওয়ালার হাতে। নুরুজ্জামান কী জানতো! পরদিনের সূর্য অস্ত সে দেখতে পাবে না! কার কখন মৃত্যু নির্ধারণ করা হয়েছে কেউ জানে না। আইসিইউর রুম থেকে কিছু দূরে নয়না বসে আছে। আত্মীয় স্বজন কেউ নেই তার আশেপাশে। আকলিমাকে সে ফোন করেছিল, ‘নুরুজ্জামান হাসপাতালে ভর্তি’ এই খবর শুনে নানান অজুহাত দিয়ে ফোন কে’টে দেন তিনি। হাসপাতালের এতো খরচ নয়না কীভাবে পূরণ করবে তাই ভাবছে বসে।

ভাবনা এই পথেই আসছিল, নয়নার সাথে তার কাজ আছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টসে নয়নার স্বাক্ষর লাগবে। নয়নাকে নির্বিঘ্নে বসে থাকতে দেখে ভবনা বলল,” কাঁদছো?”
” না, ভাবছি ফুফু ফোন কেটে দিল কেন? উনার কী ভাইয়ের অসুখের কথা শুনে খারাপ লাগেনি?”

ভাবনা নিরুত্তর। সে কাছ থেকে নয়নার মতো অনেক দেখেছে, যাদের আসল রূপ দুঃসময়ে দেখতে পাওয়া যায়। নয়নার দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়,” দুঃখ পেয়ো না,নয়না। এই দুঃসময়ে তোমার পাশে উপরওয়ালা আছেন। তিনি সব ঠিক করে দিবেন।”

নয়না লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বাহিরে দৃষ্টিনিপাত করে। বাবার চিকিৎসার খরচের জন্য মিছিলের কাছে হাত পেতেছে সে। মেয়েটা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে রাজিও হয়ে গেল। মিছিলের ভাইকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ভাবনার ডাকে নয়না চিন্তা থেকে বের হয়ে আসলো।

” তোমাকে স্যার ডেকেছে, কিছু ফর্মালিটি বাকী আছে সেগুলোর মধ্যে স্বাক্ষর লাগবে।”

নয়না কথা না বাড়িয়ে ভাবনার সাথে ডাক্তারের চেম্বারের দিকে অগ্রসর হয়।
মাহবুব শিকদার তখন নুরুজ্জামানের রিপোর্ট দেখছিল। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে তাকালে নয়নার ফোলা চোখের দিকে নজর যায়। নয়নাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে সে। রিপোর্টগুলো কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে কিছু কাগজপত্র নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ” সাইন ইট।”

” আমি কী জানতে পারি বাবার কী হয়েছে?”

নয়নার কথায় দুঃখের আভাস। মাহবুব বলল,” তোমার বাবা স্ট্রোক করেছেন। এছাড়াও উনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এখন পর্যন্ত ভালো কোনো রেসপন্স পাচ্ছি না। কতক্ষণ সময় উনি যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করতে পারবেন, জানি না।”

ডুকরে কাঁদতে থাকে নয়না। বাবার অসুস্থতা তাকে খুব পুড়াচ্ছে। সে ভাবছে, তার ভাগ্যটাই কী এমন! কী পাপ করেছিল সে? সব যন্ত্রণা কেন তারই হয়! নয়না এবার বলল, ” হাসপাতালের খরচ বাবদ কতক্ষণের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে?”

এমন পরিস্থিতিতে খরচের খাতার কথা ভুলেনি, নয়না। মাহবুব মনে মনে মেয়েটার প্রশংসা করলো। প্রথমে মাহবুব নয়নাকে চিনতে পারেনি কিন্ত পরক্ষণে নয়নার ডাগরডোগর চোখ জোড়া দেখে চিনে ফেলে সে। মেয়েটার মায়াভরা মুখখানা দেখে বড্ড মায়া হয় তার! মাহবুব সময় নিয়ে উত্তর দেয়, ” হাসপাতালের কমিটির পক্ষ থেকে তোমার বাবার চিকিৎসার খরচ বহন করা হয়েছে।”

নয়না অবাক হয়ে যায়। তার জন্য এতো সুবিধা কেন জিজ্ঞেস করে, ” কারণ কী, স্যার? ”

মাহবুব শিকদার মুচকি হেসে বলল,” কারণ তুমি আমার মেয়ের মতো। আরো একটা কারণ আছে, তোমার বাবা সুস্থ হলে তাকে বলবো। আপাতত তোমার বাবার চিকিৎসা করতে দাও।”

নয়না নির্বিকার। কী বলবে সে? কতো বছর পর তার ভাগ্য উলটো দিকে ঘুরলো, জানে না সে। এত বছর ধরে তার সাথে খারাপই হয়ে আসছে কিন্তু আজ! ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে নয়না মিছিল ও তার ভাই মারুফকে এসেছে। নয়না দৌড়ে মিছিলকে জড়িয়ে ধরে, কান্নার স্বরে বলতে থাকলো, ” বাবা, বাবা আইসিইউতে মিছিল! ফুফু আসলো না। ডাক্তার বলল, বাবার অবস্থা ভালো না। কি করবো আমি, আমি তো এতিম হয়ে যাবো রে, মিছিল।”

মিছিল নয়নাকে স্বান্তনার দেয়ার জন্য বলল, ” শান্ত হো। আঙ্কেল ঠিক হয়ে যাবে।”

ঠিক হয়ে যাবে বললেও নুরুজ্জামান ঠিক হলো না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন। ভাবনা আইসিইউতে মাহবুব শিকদারের সাথে ছিল। সে দ্রুত বের হয়ে এসে নয়নাকে ডেকে বলল, ” মনকে শক্ত করো,নয়না। তোমার বাবা আর নেই।”

বাবা বলে আর্তচিৎকার দিয়ে নয়না জমিনে লুটিয়ে পড়লো। শরীরের দুর্বলতা, অতিরিক্ত চিন্তা, চাপ নেওয়াতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নয়না। তূর্য এতক্ষণ আইসিইউতে ছিল, তার মেজার প্রচন্ড রকমের খারাপ। আইসিইউর ভেতর এমন কিছু ঘটেছে যা ঘটার উচিত ছিল না। নয়নাকে কটু কথা শোনাতেই সে এগিয়ে আসছিল কিন্তু মেয়েটার জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া দেখে দৌড়ে আসে। সাথে সাথেই বাহ্যিক জীবনের কথা ভুলে ডাক্তারের কর্তব্য পালন করতে থাকে। নয়নার হাতের পালস পরীক্ষা করে দ্রুত পাঁজা কোলে তুলে নেয় তূর্য। মেয়েটার ওজন এতো কম, ভেবে অবাক হয় সে। ইমার্জেন্সি রুমে প্রবেশ করে সাময়িক চিকিৎসা দিতে থাকে নয়নাকে। শরীরের দুর্বলতা, না খেয়ে থাকার কারণে সেলাইন দিতে হয় নয়নাকে। মিছিল বান্ধবীর করুণ অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। তূর্যের উদ্দেশে বলল, ” এমন পোড়া কপাল যেন আর কারো না হয়, ডাক্তার। নয়নাকে এমন ঔষধ দিয়ে রাখুন, যেন সে আজীবন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। কেননা মেয়েটা চোখ খোলা অবস্থায় ভালো কিছুর সম্মুখীন হয় না, কষ্টে থাকে।”

তূর্য অবাক হয়ে মিছিলের কথা শুনে। তার কৌতূহল জাগে নয়নার সম্পর্কে জানার জন্য। কালবিলম্ব না করে মিছিলকে প্রশ্ন করলো, ” নয়নার সম্পর্কে জানতে চাই।”

মিছিল হতভম্ব হয়, পরবর্তীতে তূর্যের দ্বিতীয় বাক্য শুনে নয়নার সম্পর্কে এক এক করে জানাতে থাকে তূর্যকে।

—————————–

নুরুজ্জামানের জানাজা সম্পন্ন হয় তার মেয়ের অনুপস্থিতিতে। নয়নার জ্ঞান ফিরেনি, শারীরিক দিক বিবেচনা করে তূর্য তাকে কড়া ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। নয়নার শারীরিক অবস্থা ভাল না। স্ট্রোকের পর্যায়ে চলে গেছে, এতো অল্প বয়সে স্ট্রোক করলে জীবন শংকাজনক।

প্রায় বারো ঘণ্টা পর নয়নার জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ বন্ধ অবস্থায় সে মনে করতে চেষ্টা করে তার সাথে ঠিক কী ঘটেছিল। যখন বাবার কথা মনে পড়ে তখন চোখ খুলে সে। তূর্য কেবিনের কোণার চেয়ারে বসে ফোন টিপছে। নয়নার দিকে তার ধ্যান নেই। নয়না ধীরে উঠে বসে। দুর্বল শরীরে বিছানা থেকে উঠতে নিলে হাতে টান অনুভব করে সে। সাথে সাথেই আহ করে শব্দ করে। তূর্য ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে নয়নাকে বসিয়ে হাত উঁচু করে বলল, ” বাচ্চা নাকি? আমাকে ডাকলে হতো না! দেখি, হাত উঁচু করে ধরুন। র’ক্ত উঠে গেছে দেখেছেন?”

সত্যি সেলাইনের পাইপ বেয়ে অনেকটুকু র’ক্ত উঠে গেছে, নয়না ভয় পেয়ে যায়। পাইপে র’ক্ত উঠে যাওয়া স্বাভাবিক এই বিষয় তার অজানা। তবে এই মুহূর্তে এসব মাথায় না এনে সে তূর্যের উদ্দেশে বলল,” আমার বাবা!”

” জানাজা সম্পন্ন হয়ে গেছে। আপনি অসুস্থ ছিলেন, ঘুমের মেডিসিন দেয়া আবশ্যক ছিল। এখন মোটামুটি সুস্থ আপনি।”

তূর্যের স্বাভাবিক উত্তরে নয়না অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকলো। সে চিৎকার করে বলল, ” আমার বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে দিলেন না! আমার যা ইচ্ছে হোক, বাবাকে একবার দেখতে দিতেন!”

” আমি একজন ডাক্তার। ইচ্ছে করে কারো জীবন সংকটে ফেলতে পারি না। ঘুমের ইনজেকশন না দিলে আপনার ক্ষতি হতো।”

নয়না কাঁদছে, বাবার শেষযাত্রায়ও সে থাকতে পারেনি। কতোটা খারাপ ভাগ্য তার! দুঃখে মাথার চুল টানতে থাকলো, বিড়বিড় করে বলল, ” আমি এতিম, আজ থেকে আমি এতিম!”

তূর্য দুইটা কাগজ নয়নার দিকে এগিয়ে দেয়। তূর্য জানে, এখন কাগজগুলো দেয়ার সঠিক সময় নয়, কিন্তু নয়নাকে শান্ত করার জন্য এই পদক্ষেপ নিতে হলো তূর্যকে।

” আপনার বাবার জানাজা শেষে রিহান নামক একজন ছেলে আপনার বান্ধবীকে দিয়েছিল। সে কিছুক্ষণ আগে বের হয়ে গেছে, যাওয়ার আগে কাগজ দুটো আমার হাতে তুলে দিয়েছে। বলেছে, এগুলো নাকি আপনার বাবা মৃত্যুর আগে রিহানকে দিয়েছিল।”

নয়না চোখের পানি মুছে কাগজ দুটো হাতে তুলে নেয়। একটা তার লেখা চিঠি অপরটি নুরুজ্জামানের। সে চোখের সামনে নুরুজ্জামানের চিঠি মেলে ধরে পড়তে শুরু করলো,

মা রে!
আমাকে ক্ষমা করিস। তোর ভালো চাইতে গিয়ে পৃথিবীর নিকৃষ্টতর পিতা হয়ে গেছি। আজ বুঝলাম রে মা! মানুষের বাহিরের রূপ দেখে ভেতরের সত্তা বিচার করতে নেই। তোকে আর কষ্ট পেতে দিব না। কাল সকালেই চলে আসবি। আমরা ময়মনসিংহ চলে যাব। কুঁড়েঘর বানিয়ে সেখানেই থাকব।

নয়না কাগজের উপর চুমু খেয়ে কাঁদতে থাকে। তার বাবাকে সে এতোদিন ভুল বুঝে আসছিল। সত্যি কথা হলো, আকলিমা এতোদিন নয়নার বাবাকে উলটা পালটা যা বুঝিয়েছে নুরুজ্জামান তাই বুঝেছে।ছোট্ট মেয়েটার কথা কানে নেয়নি। আকলিমা নয়নার বিরুদ্ধে প্রতিটি কথা এমনভাবে নুরুজ্জামানের কানে ঢুকিয়েছে যা সত্য মনে হয়েছে।

তূর্য নয়নার কান্না সহ্য করতে পারছে না। সে মিনতির স্বরে বলল, ” কান্না থামান, প্লিজ!”

নয়না শুনছে না। তার এই মুহূর্তে একটা শান্তির নীড় প্রয়োজন, একটি কাঁধ প্রয়োজন যেখানে সে মাথা রেখে মনের দুঃখ ভুলতে পারবে। তূর্য নয়নার পাশে বসে ইতঃস্তত বোধ করে তার হাত ধরলো নয়নার তখন কি যেন হলো! সে তূর্যের কাঁধে মাথা রেখে পুনরায় কান্না করতে থাকলো। তার আর্তনাদ শুনে তূর্যের চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে যায়, মুষ্টিবদ্ধ হাতে সে শক্ত হয়ে বসে থাকলো। তখনই নয়না বিড়বিড় আওয়াজ তার কানে আসলো, ” মনভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। এতো কষ্ট আর সইতে পারছি না। আমাকে বাঁচান, ডাক্তার!”

চলবে……….