Saturday, July 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 204



নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০৪

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: চার

শেষরাতে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে নয়নার ঘুম ভাঙে। তরতর করে তার শরীর ঘামতে শুরু করে। তৃষ্ণার্ত গলা, ভীত চোখ জোড়া এক ফোঁটা পানির খোঁজ করছে। হৃদপিণ্ডের দ্রুত উঠানামা জানান দিচ্ছে সে এই মুহূর্ত প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। মানুষ যখন কোনো বিষয় নিয়ে আশঙ্কায় থাকে অথবা একজন মানুষকে যখন কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত চাপ দেয়া হয় যা দিনে রাতে তাকে সেই বিষয় সম্পর্কে ভাবায়, তখন স্বপ্নঘোরে সে তাই দেখে। নয়নার কাছে স্বপ্নটা জীবন্ত মনে হচ্ছে। সন্দেহ দূর করার জন্য সে দরজার দিকে তাকায়, নাহ! দরজা সে যেভাবে আটকে রেখেছিল সেভাবেই আছে। পানির জগ খালি, এই রাতে নিশ্চয়ই সবাই ঘুমে মগ্ন। ঘর থেকে বের হয়ে পানি আনতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায় নয়না। রান্নাঘরের পশ্চিম পাশটার ঘরটা বাশারের ঘর সেখান থেকে এখনো আলো জ্বলছে। নয়না তা দেখে শুঁকনো ঢোক গিলে। যথাসম্ভব শব্দহীন পায়ে পানি পান আনতে যায়। বলে না! ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়’ অর্ধ পোশাকে বাশার দরজা খুলে বের হয়ে আসে। দরজার আড়ালে নয়না তখন লুকিয়ে, নিশ্বাসের গতি নামা নিয়ন্ত্রণ করে রাখে কিছু সময়ের জন্য। বাশার চারদিকে না তাকিয়ে সরাসরি ফ্রিজের দিকে এগোয়। ঠান্ডা পায়েসের বাটিতে আঙুল ভিজিয়ে চেটেপুটে খেয়ে নেয়। নয়না আড়াল থেকে সবকিছুই দেখছে, ঘৃণায় পেটের ভেতর থেকে সব গুলিয়ে আসছে। বাশার নামক মানুষটার প্রতিটা কাজে সে ঘৃণিত ইশারাই বুঝতে পায়। অথচ সে গোটা বিশ্বের কাছে পবিত্র ছেলে।
বাশার যেভাবে আসছিল সেভাবেই ঘরে চলে যায় তবে এবার সে দরজা আটকায় না। নয়না পড়ে মহা বিপাকে, যদি ভুলক্রমে বাশার তাকে একবার দেখতে পারে তো রক্ষা নাই। ধীরপায়ে নয়না নিজের ঘরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। খাবারের টেবিলের কাছাকাছি আসতেই বাশার পুনরায় ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। এবার কোনোদিকে না তাকিয়ে নয়নার কাছে এসে বিশ্রীভাবে হাসলো। ঝট করে নয়নার হাত ধরে বলল,” আমি জানতাম, তুই আমার কথায় রাজি হবি। আর একমুহূর্তও দেরী করিস না, নয়না। আমার ঘরে চল। মা কিছুই টের পাবে না।”

” হাত ছাড়ো, বাশার ভাই। নয়তো আমি তোমাকে আঘাত করে বসবো।”

” আমাকে রাগাস না, নয়না। আপোষে রাজি হয়ে যা, নয়তো আমি কী কী করতে পারি আজ দেখলিই তো। ”

নয়না হাত মোচড়াচ্ছে, ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। একজন পুরুষের শক্তির কাছে নারীর শক্তি কিছুই না। নয়নার ক্ষেত্রেও তাই। তার আর পানি পান করা হলো না, বাশারের হাতেই তৃষ্ণার্ত অবস্থায় হরন হবে তার শরীর! রিহানের ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে নয়না নড়েচড়ে দাঁড়ায়, উৎসুক দৃষ্টিতে রিহানের আগমনের প্রার্থনা করে নয়না। রিহান ঘুম ঘুম চোখে ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসে। হাতে পায়ের বিভিন্ন স্থানে তার ব্যান্ডেজ। নয়নাকে এই বাড়িতে যদি কেউ আপন ভাবে তবে সে রিহান। পূর্বে বাশারের নজর নয়নার উপর ছিল আজকাল যা শরীরে হাত দেয়া পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। রিহান বুঝে, না বুঝে নয়নার সামনে ঢালস্বরূপ দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাশার এবং নয়নাকে একসাথে দেখতে পেয়ে যা বুঝার বুঝে যায় সে। বাশারের উদ্দেশে বলল,”” আপার হাত ছাড়ো, ভাইয়া।”

উপরওয়ালা কখন কাকে কার দ্বারা, কীভাবে কাকে সাহায্য করেন তিনিই জানেন। নয়না রিহানের কাছে চির কৃতজ্ঞ। সবসময়ের মতো আজও তার ছোট ভাই তাকে রক্ষা করতে ঢাল হয়ে আসছে। বাশার রিহানের কথা কানে নেয় না, রিহানকে বুঝানোর চেষ্টা করতে থাকে সে, ” রিহান, কী হয়েছে ভাইয়া? কিছু খাবে? ভাইয়াকে বলো, এনে দেই?”

” তুমি নয়না আপার হাত ছেড়ে দাও, ভাইয়া। নয়তো আমি মাকে ডাকবো।”

” তোর আপাকে একটা পড়া বুঝিয়ে দিব, তুমি ঘরে যাও, ঘুমিয়ে পড়।”

রিহান দমিয়ে যাওয়ার পাত্র না। সে বাশারের কাছে এসে এক ঝটকায় নয়নার হাত ছাড়িয়ে নেয়। দশ বছর বয়সী ভাই, বাশারের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছে বিষয়টা যেমন বাশারের কাছে লজ্জার তেমন রাগের। বাশার কিছু বলার উদ্যোগ নেওয়ার পূর্বে রিহান বলল,” তুমি রাতে লুকিয়ে সিগারেট আর কোকাকোলার মতো বিশ্রী গন্ধের পানি পান করো, মাকে কিন্তু বলে দিব। আপার থেকে দূরে থাকো, ভাইয়া। ”

বাশারের এমন রূপ নয়না ছাড়াও কেউ জানে! বাশার ঘামছে আর ভাবছে কীভাবে রিহান এসব জানলো? পরমুহূর্তে মনে পড়লো কিছুদিন আগের কথা, রিহান ভাইয়ের সাথে ঘুমাবে বলে বায়না ধরেছিল। আকলিমা নিষেধ করেনি, ভাই ভাই একসাথে থাকবে; এটা আনন্দের। কিন্তু নাকচ করেছিল বাশার, সে ঐদিন মা’দ’ক’দ্র’ব্য বাড়ি এনেছিল। রিহানকে সেদিন অনিচ্ছায় সাথে এনেছিল। সে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মা’দ’ক’দ্র’ব্য সেবন করেছিল কিন্তু সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি যে রিহান সজাগ ছিল। রাগে গজগজ করতে বাশার ঘরের দরজা আটকে দেয়।

নয়না ছলছল চোখে রিহানের হাতে ও শরীরে হাতড়াচ্ছে। রিহানকে সে সেদিন অনিচ্ছায় আঘাত করেছিল। আকলিমা ও বাশার নয়নাকে তো রিহানের কাছেও ঘেষতে দেয়নি। রিহানের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে বলল, ” আমি তোকে ইচ্ছে করে আঘাত করিনি, রিহান।”

” আমি সুস্থ আছি, আপা। পানি খাব।”

নয়না রিহানকে চেয়ারে বসিয়ে পানি আনতে চলে যায়। দুই ভাই বোন গলা ভিজিয়ে আরো কিছুক্ষণ দুঃখ সুখের গল্প করে নেয়। নয়না আজ রিহানের জন্য বেঁচে গেছে কিন্তু পরেরবার! পরেরবার তাকে কে বাঁচাবে?

————————–

দুই সপ্তাহ পর। সময় তখন সকাল দশটা বাজে। ব্যস্ত নগরীর মানুষদের ব্যস্তকর্ম তখন শুরু হচ্ছে। ব্যস্তময় শহরে ট্রাফিকের লাল বাতি, সবুজ বাতি জ্বলা শুরু করেছে। নয়নার অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা আর কিছুদিন পর। ক্ষুধার্ত পেটে বই কেনার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছে সে। আরো একটা কারণ আছে, নুরুজ্জামান তাকে ডেকেছেন। সকালের নাশতা সেই তৈরি করেই এসেছে। আকলিমার ইদানীং হাঁটুতে ব্যথা এসেছে। সারাদিন বিশ্রামেই থাকে। আগে নয়নাকে দিয়ে টুকটাক কাজ করাতো, এখন সংসারের পুরো কাজ করায় তাকে দিয়ে। প্রায়ই কাজকর্ম শেষে অভুক্তই থাকতে হয় নয়নাকে। আজও তাই, তবে গত দুই সপ্তাহে তার নির্ভয়ে দিন কেটেছে। বাশার চট্রগ্রাম বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেছে। একেবারে বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ঘুরে বাসায় আসবে। ততদিন নয়না মন ভরে নিশ্বাস নিবে।

নয়নার বাবার কাছে চিঠি পৌঁছেছে। হয়ত তাই তিনি নয়নাকে ডেকেছেন। নয়না বাবার কাছে এসেছে। নুরুজ্জামান মেয়েকে ডেকে উধাও। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করাতে বলল, তিনি নাকি বাজারে গেছেন, নয়নার জন্য চাবি রেখে গেছেন। ঘরবাড়িহীনদের জন্য সরকারের করে দেয়া বাড়িতে নুরুজ্জামান থাকেন। নিজের ঘর বাড়ি, অর্থ সম্পদ, প্রিয়জনদের সর্বনাশা আগুন খেয়ে নিল তখন সব ছেড়ে শহরে আশ্রয় নেয় নুরুজ্জামান। মেয়েকে নিজের কাছে না রেখে বোনের কাছে রাখেন যেন দশজন মানুষের সামনে মেয়ের সম্মান হরন না হয়। কিন্তু তিনি কী জানেন! মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে কতোটা খারাপ করে ফেলেছেন! এখন তো দৈনিক সম্মান হরনের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হয় নয়নাকে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পরও নুরুজ্জামানের আসার কোনো লক্ষণ দেখতে না পেয়ে নয়না ঘর থেকে বের হয়ে আসে। পরিধানে তার কালো বোরকা। যথারীতি ঘরে তালা ঝুলিয়ে চাবী প্রতিবেশীর কাছে রেখে রওনা করে। পথিমধ্যে সে দেখতে পায় কিছু মানুষ জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু পথচারীরা জটলা ছেড়ে নয়নার দিকেই এগিয়ে আসছে। নয়না তখন তাদের কথোপকথন শুনতে পায়,” আহারে! লোকটা কতো ভালো মানুষ ছিল। নিজের মেয়েকে বোনের কাছে রেখে নিজে কষ্টে দিন পাড় করতো। এভাবে হঠাৎ করে ম’রে যাবে, কে জানতো!”

নয়নার অন্তর কেন যেন কেঁপে উঠে। দ্রুত সামনে আগায় সে৷ মানুষদের ঠেলে দেখতে পায় নুরুজ্জামানকে যিনি জমিনে পড়ে আছেন। এক পায়ে জুতা আছে অন্য পায়ের জুতা কোথায় যেন পড়ে আছে। সময় নষ্ট না করে নয়না বাবাকে কাছে এসে বসে। নুরুজ্জামানের মাথা কোলে রেখে ডাকলো, ” বাবা, বাবাগো! ও বাবা, কথা বলো!”

কিন্তু আফসোস! নয়নার বাবা কথা বলা তো দূরের কথা চোখ জোড়া খুলে দেখছে না। নয়না আশেপাশের মানুষদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়ায়, ” আমাকে কেউ সাহায্য করুন, বাবাকে হাসপাতালে নিতে হবে। একজন ধরলেই হবে!”

কেউ এগিয়ে আসেনি। কিছু মানুষ জটলা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে তো কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। একদল মুঠোফোন বের করে পুরো দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যস্ত।
নয়না কাঁদছে, এই নশ্বর পৃথিবীতে কেউ যে কারো আপন নয়, আবারও প্রমাণিত হলো।

মেডিক্যালের একটি বাস ঐ পথ ধরেই কোথাও যাচ্ছিল। মানুষদের ভীড় দেখে গাড়ি থামায়। ঘটনাস্থল তখন খুবই করুণ, নয়না জোরে জোরে কাঁদছে। একজন ডাক্তার সবার আগে এগিয়ে আসে। গায়ে ফর্মাল পোশাকের উপর এপ্রোন। নুরুজ্জামানের কাছে এসে হাতের পালস পরীক্ষা করতে শুরু করে। ঘড়ি ধরে এক মিনিট সময়! কাঙ্খিত হৃৎস্পন্দন না পেয়ে সহকর্মীদের ডাকতে শুরু করে সে, ” মিনহাজ, ভাবনা, মাহিন দ্রুত আয়, রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।”

কোনো মেয়ে বাবার আশঙ্কাজনক খবর শুনে স্থির থাকতে পারবে না, নয়নাও পারছে না। নুরুজ্জামানের গালে হাত রেখে চিৎকার করে উঠলো, ” বাবা, কী হয়েছে তোমার? এই যে আমি এসেছি। এমন করো না বাবা, তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।”

উত্তর পায় না নয়না। পাগলের মতো বিলাপ করতে থাকে সে। এমনসময় ভাবনা এসে নয়নাকে তার বাবার থেকে দূরে সরিয়ে আনে। তিনজন যুবক নুরুজ্জামানকে ধরে বাসে উঠায়। অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছানোর সময়ও নেই। নুরুজ্জামানের মাথার পাশটায় যেই যুবক ধরেছে, সে উচ্চ স্বরে ভাবনার উদ্দেশে বলল, ” ওর খেয়াল রাখবি তো!”

ভাবনা আশ্বাসের স্বরে উত্তর দেয়, ” হ্যাঁ।”

নয়নাকে জাপ্টে ধরে রেখেছে ভাবনা। কিছু একটা মনে করে সে যুবকটিকে ডাকলো, ” তূর্য!”

তূর্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ভাবনা তখন বলল, ” একসাথে গেলে মন্দ হয় না। মেয়েটার অবস্থা বুঝার চেষ্টা কর!”

তূর্য নুরুজ্জামানকে এক নজর দেখে বলল, ” নিয়ে আয়, তবে কাঁদতে নিষেধ কর তাকে। তার কান্না দেখে আমি চিকিৎসা করতে পারব না।”

ভাবনা খুশি হয়। সে নয়নাকে জোর করে বাসে তুলে। দুই তিনটে সিট পাশাপাশি ততক্ষণে বিছানো হয়ে গেছে। নুরুজ্জামানকে সেখানে শুইয়ে দেয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে। স্টেথোস্কোপের সাহায্যে হৃৎস্পন্দন খোঁজার চেষ্টা করছে তূর্য। নয়নার বাবার হাত ধরে গুনগুন শব্দ করে কাঁদছে। যার কারণে তূর্যের চিকিৎসার ব্যাঘাত ঘটে। সে বিরক্ত হয়ে ধমক দেয় নয়নাকে, ” চুপ করা যায় না! দেখছেন না চিকিৎসা চলছে? কান্না ছাড়া আর কিছুই কী বুঝেন না? চুপ করে বসে থাকুন, নয়তো বাস থেকে নামিয়ে দিব।”

নয়নার কান্না বন্ধ হওয়ার বদলে আরে বেড়ে যায়। তবে সে এবার জোরে কাঁদছে না। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। তূর্যের এবার মাথা গরম হয়ে যায়। সে বিনাবাক্যে পুনরায় চিকিৎসা শুরু করে।
কান্নারত অবস্থায় নয়না তূর্য নামক ডাক্তারকে ভালোভাবে দেখে নেয়। এই ডাক্তার সেই ডাক্তার যে নয়নাকে বিবাহিত ভেবেছিল। নয়না এপ্রোনের বুকপকেটে গোটা অক্ষরে লেখা নামটা কয়েকবার মুখে আওড়াল, ” তাবরেজ তূর্য।”

চলবে………….

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০৩

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব:তিন

” তোমাকে আকলিমার বাড়িতেই থাকতে হবে,নয়না। আমাদের দুঃসময়ে তোমাকে যে আশ্রয় দিয়েছে তার ক্ষতি করে পালিয়ে আসলে কীভাবে? আরে! পশুদের এক দুইদিন আদর যত্ন করলে তারাও পোষ মেনে যায়। আর তোমাকে তো আমার বোন খাইয়ে দাইয়ে বড়ো করছে। একটুও মায়া জন্মায়নি? সবকিছুর প্রতিদান তুমি এভাবেই দিয়ে আসলে?”

নির্বিকার নয়না,পিতার মুখে এহেম কথা সে আশা করেনি। অবশ্য একপাক্ষিক কথা শুনে অপরপক্ষকেই সবসময় দোষারোপ করা হয়। নিশ্চয়ই এখন নয়নার বাবা তার কথা শুনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন! সেই প্রত্যাশায় নয়না মুখ খুলে, ” বাবা, আমি কিছু বলতে চাই!”

” আমি জানি, তুমি কী বলতে চাইবে। আকলিমা তোমাকে মেরেছে এই বিষয়েই তো?”

নয়না ‘হ্যাঁ’ বলার সুযোগ হয় না তাঁর পূর্বেই নুরুজ্জামান অর্থাৎ নয়নার বাবা ক্রোধভরা কণ্ঠে বলে উঠেন, ” গুরুজন শাসন করতেই পারে, তাই বলে তার ক্ষতি তো করতে পারো না। রিহানের কথা বাদই দিলাম, বাশারের সাথে তুমি এমন আচরণ কীভাবে করতে পারলে। ছেলেটার আজ ইম্পর্ট্যান্ট ইন্টারভিউ ছিলো সেখানে না গিয়ে বিছানায় কাকুতি করছে।”

” বাবা,বাশার ভাই আমার শরীরে,,,,!

” আমি সব জানি, আকলিমা আমাকে সব বলেছে। তুমি এক্ষুণি আমার সাথে ফিরে যাবে এবং তোর ফুফু ও বাশারের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে।”

নুরুজ্জামান নয়নার কোনো কথা শুনতে রাজি না। তিনি মেয়েকে নিজের সাথে বোনের বাড়িতে নিয়ে উঠবেন। মিছিলের পরিবার অসহায়, নয়নার বাবা জীবিত সেখানে তারা অধিকার খাটাতে পারে না। নয়নার হয়ে কথা বলতে গেলেও শেষে নয়নার সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক নষ্ট হবে তাদের। প্রিয় বান্ধবীর ক্ষতি মিছিল চাইছে না, তাই নুরুজ্জামানের কথার প্রেক্ষিতে বলে,” আঙ্কেল, আপনি নিশ্চয়ই স্বইচ্ছায় আপনার মেয়েকে নরকে ফেলতে চাইবেন না। ঐটা বাড়ি নয়, আমার কাছে জাহান্নামের আগুন মনে হয়। যেখানে একজন অসহায় মেয়ের উপর মানসিক, শারীরিক অত্যাচার করা হয়।”

আকলিমা এতক্ষণ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। ঘরে বসে ভাইকে যেভাবে পড়িয়ে নিয়ে এসেছিল সেভাবেই নুরুজ্জামান কথা বলছে, এ নিয়ে তিনি মনে মনে ভীষণ খুশি ছিল কিন্তু মিছিলের কথায় নড়েচড়ে বসেন তিনি। খুব সূক্ষ্মভাবে মিছিলের কথার প্রত্ত্যুত্তরে বলেন, ” কীসব বলছো মা, নয়না আমার ভাইজি। তাকে শাসন করার অধিকার আমার আছে। তোমার মা বাবা কী আদর শাসন ছাড়াই বড়ো করছে? শুনো মেয়ে! নয়না তোমার বন্ধু, সে যা বলবে তাই তুমি বিশ্বাস করবে৷ আমাদের কথা বিশ্বাস হবে না। আমরা এখন নিরপরাধ হলেও অপরাধী হয়ে আছি তোমাদের চোখে।”

মিছিল প্রত্ত্যুত্তরে বলতে পারল না। সে কীই বা বলবে, আকলিমার কথার প্রেক্ষিতে কিছু বললেও যুক্তিতে সে পারবে না।

নয়না নুরুজ্জামানের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত জোর করে অনুনয় করে বলল,” বাবা, আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। ঐ বাড়িতে আমি ফিরে যাবো না, ঐ বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”

” আমি রাস্তায় পড়ে থাকি, তুমি মেয়ে মানুষ সেখানে থাকতে পারবে? মাথার উপর ছাদ আছে এমন বাড়িতে তোমাকে রাখছি, তবুও তোমার মন ভরছে না?”

বাবার কথায় কষ্ট পায় নয়না। আহত হয় বাবার অন্যায় বিচারে। প্রত্ত্যুত্তরে ভাঙা গলায় সে বলল,” বাবার ছায়া পেলে ছাদ প্রয়োজন পড়ে না, মাথায় হাত রাখলেই শান্তি পাওয়া যায়। আমি ফুফুর বাড়িতেই থাকব,বাবা। তুমি আর রাগ করো না, শরীর খারাপ করবে।”

নয়না দেরী করে না। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে মিছিলের ঘরে চলে যায়। আকলিমা বেজায় খুশি। মনে তার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। এই মেয়ের জন্য তার দুই ছেলে বিছানায় শোয়া অবস্থায়। তিনি এতো সহজেই নয়নাকে ছেড়ে দিবেন না।

মিলিছ কাঁদছে। সে জানে, নয়না আকলিমার কাছে গেলে সুখে থাকবে না। প্রিয় বান্ধবীর কষ্ট কবে লাঘব হবে কে জানে! তার জীবনে সুখের ছন্দ আদৌও কী বাজবে?

———————–

সুখ দুঃখে ভরা আমাদের জীবন। ছোট্ট এই জীবনে চাহিদাও অনেক। রঙে প্রাচুর্যে গড়া পৃথিবীতে বাঁচার তাগিদে কতকিছুই ত্যাগ করতে হয়। নয়না না হয়, জীবনটাই বিসর্জন দিয়ে দিল! রাতের আঁধারে নয়না নিজের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বিছানায় দুই হাঁটু একত্রিত করে জড়োসড়োভাবে মাথা নেতিয়ে কাঁদছে। এই নশ্বর পৃথিবীতে কেউ তার আপন না। নয়নার কানে বাড়ির সকলের হাসি ঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। নয়না ভাবছে কিছুক্ষণ পূর্বের কথা।

বাড়িতে প্রবেশকরা মাত্রই নয়না বাশারের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাশারের মাথায় ব্যান্ডেজ করা, নাক মুখ ফুলে ফেঁপে একাকার। নয়নাকে ফিরে আসতে দেখে বিশ্রীভাবে হাসে। নয়নার অন্তর তা দেখে কেঁপে উঠে। নুরুজ্জামান মেয়ের উদ্দেশে তখন বললেন,” আকলিমা আর বাশার কাছে ক্ষমা চাও, নয়না।”

ছলছল চোখে ব্যথাযুক্ত হৃদয়ে নয়না বাবার দিকে তাকায়। তার গভীর চাহনির কথাগুলো নুরুজ্জামান আদৌও বুঝতে পারছে? নাহ! নয়নার বাবার বুঝ ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। ইট পাথরের ভীড়ে থাকতে থাকতে মনটাও শক্ত হয়ে গেছে। গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নয়না ক্ষমা চেয়ে নেয়, ” আমাকে ক্ষমা করে দাও, ফুফু। তোমার ছেলেদের উপর হাত তোলা আমার উচিত হয়নি।”

এরপর বাশারের উদ্দেশে বলল,” আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করো, বাশার ভাই। আজ থেকে তোমার আশেপাশে ঘেঁষবো না তুমিও আমার কাছে এসো না।”

ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করে দেয়া মহৎ গুন। কথার প্রেক্ষিতে সে বাশারকে তার আশেপাশে ঘেঁষতে নিষেধ করে দিল, তা কী কেউ বুঝতে পেরেছে? অবশ্য বাশারের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই। সে নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল, ” আমার মনে কোনো দুঃখ নেই,বোন। যেভাবে তোর ভালো হবে, সেভাবেই এবাড়িতে থাকবি। এমন কাজ করবি যেন আমরা খুশি হই।”

নয়না বাঁকা চোখে বাশারকে পর্যবেক্ষণ করে। তার লোলুপ দৃষ্টি নয়নার শরীর পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। কেউ দেখলে বুঝবে না, বাশার নামক ভদ্রলোকের আড়ালে বিকৃত রূপ।
আকলিমা ভাইয়ের সামনে ভালোমানুষির নাটক শুরু করে দেয়। নয়নার মাথায় হাত রেখে বললেন,” ফুফুর সাথে রাগ করে এভাবে চলে যেতে হয় নাকি? আমি না হয় একটু শাসনই করেছিলাম। ঐসব আর মনে নিস না, মা!”

বাশারও মায়ের কথার তালে তাল মিলিয়ে বলল, ” হ্যাঁ, মা ঠিকই বলেছে নয়না। আর রাগ করে থাকিস না। সব ভুলে নতুন করে শুরু কর।”

আপনজন নামক জালেমদের অভিনয় দেখে নয়না তাচ্ছিল্যে হাসে। ধীরপায়ে নিজ ঘরে এসে দরজা আটকে বসে থাকে। অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, বাহিরে হাসির আড্ডা চলছে আর নয়নার মনে চলছে কাল বৈশাখী ঝড়। দরজার কষাঘাতে নয়না নড়েচড়ে বসে। নুরুজ্জামান মেয়েকে ডাকতে এসেছেন। একবার দুইবার তিনবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে চলে যান তিনি। অশ্রুসিক্ত আঁখি মুছে নয়না পড়ার টেবিলের দিকে আগায়। খাতা কলম বের করে বাবার জন্য চিঠি লেখে।

প্রিয় বাবা,

তুমি একবারও আমারদিক জানতে চাওনি। ভালো আছি কী নেই একবারও বুঝতে চেয়েছো? প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ একই ছাদের নিচে থাকলে কুমন্ত্রণার শিকার হবেই। বাশার ভাই আমাকে বোনের নজরে নয়, খারাপ নজরে দেখে। নিজেকে রক্ষা করার জন্য তাকে আঘাত করেছিলাম। একবার ভেবে দেখো তো, একজন মেয়ে কখন একজন ছেলেকে আঘাত করে? আমি উত্তর দেই! একজন মেয়ে তখনই একজন ছেলেকে আঘাত করে যখন ঐ মেয়ের সম্মানে কেউ হাত দেয়! আমিও তো তাই করেছিলাম।
তুমি আজও আমাকে চিনলে না! আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে করে না জানো বাবা! মিনা, মিন্টুর মতো আমিও যদি সেদিন মায়ের সাথো আগুনে পুড়ে ম’রে যেতাম, তাহলেই ভালো হতো। অন্তত তোমার বোঝা হতাম না। মা বেঁচে থাকলে হয়তো আমার চাহনি দেখেই বুঝে যেত। আমার বিপদের আভাস পেত। তুমি কী জানো বাবা, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ভাগ্য নিয়ে আমি জন্মেছি! নয়তো আমার মা কেন আমায় একা করে চলে গেলো? আর আমার বাবা, যিনি বেঁচে থেকেও আমার কাছে মৃত। আমার প্রতি এতো অনিহা কেন,বাবা? আমি তো তোমারই সন্তান। নতুন করে তুমি সংসার গড়েছো, তাই কী আমাকে নিজের কাছে রাখছো না? আহ! আমার ভাগ্য! ও বাবা আমাকে একটা বিষের বোতল এনে দিবে! গলাটা ভিজাই! এরপর এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেই। তাহলে পুরুষ নামক পশুদের লালসার শিকার হবো না! ফুফুর কথা শোনার সময় পেলে অথচ আমার কথা শুনলে না! সত্যি বলতে, তুমি আমার বাবা না। আমার ছোটবেলার বাবার সাথে এই বাবার মিল নেই। আমার বাবা আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনতো, কিন্তু এখন বাবা পরের কথার তালে চলে। আমি তোমাকে চাই না, বাবা। আর আমি এই নরক ছেড়েও যাব না। এখানেই পঁচে গলে প্রাণ হারাবো।

ইতি,
নয়না

ডুকরে কেঁদে উঠে নয়না। খাতা কলম বন্ধ করে বিছানার দিকে টলমল পায়ে এগোয়। সে আজ ঘুমাবে, অনেক ঘুমাবে। হতে পারে, আজ রাত্রিই তার জীবনের শেষ রাত্রি!

——————–

ঘুমের ঘোরে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে নয়নার। মনে হচ্ছে কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। চোখ খুলে তাকায় সে, এলোমেলো চুলে আকলিমা তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। পায়ের কাছে বাশার যে নয়নার পা দুটো শক্তকরে ধরে রেখেছে। আকলিমার চক্ষুর আড়ালে তার বেয়াড়া হাতজোড়া পায়জামা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করতে ব্যস্ত। দুটো অসহনীয় যন্ত্রণায় নয়নার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। চোখ দুটো লাল হয়ে আসছে। বাঁচার আকুতি মিনতি করছে সে। হাত পা যথাসম্ভব নাড়িয়ে ছাড়া পেতে চাচ্ছে কিন্তু এতো সহজেই ছাড়া পাওয়া সম্ভব! আকলিমার ক্রোধভরা কণ্ঠস্বর নয়নার কানে পৌঁছে, সে বলছে, ” আজ তোকে মে’রেই ফেলব, অলক্ষ্যি মেয়ে।”

চলবে………..

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০২

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব:দুই

” আমার এতো বড়ো সর্বনাশ করো না,বাশার ভাই।”

নয়নার কোনো কথাই বাশারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। মেয়েটার আকুতিভরা টলমলে চোখদ্বয়ও বাশারের লোলুপ মনে বাঁধা সৃষ্টি করছে না। নয়না ঘামছে, ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। বাশারকে হিংস্র পশুর ন্যায় মনে হচ্ছে নয়নার কাছে। ভাই সমেত গুরুজন যখন ভক্ষক হয়ে দাঁড়ায় তখন প্রশ্ন উঠে, পৃথিবীর কোন পুরুষটির কাছে মেয়েরা নিরাপদ! বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে নারীরা বেশিরভাগই আপনজনের কাছেই যৌনতার শিকার হয়। কলঙ্কের ভয়ে কতো নারীরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে, তারা ভাগ্যের কাছে অসহায়।
নয়নার আকুতি, আহাজারি বাসারের মনমন্দিরে কামেচ্ছা বাড়িয়ে দিচ্ছে। নয়নার দিকেই সে ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে। আজ কী কালরাত্রি? নয়নার তাই মনে হচ্ছে। আজ তার সম্মান হরণ হলে কেউই টের পাবে না, আকলিমা যে ঘুমের ঔষধ সেবন করে ঘুমাচ্ছে; তাকে রিহানের দেখবালের দায়িত্ব দিয়ে! যার মন অসৎ থাকে সে সুযোগের জন্য উৎ পেতেই থাকে। বাশারের ক্ষেত্রেও তাই। সে সুযোগের অসৎ ব্যবহার করতেই নয়নাকে নিজের ঘরে জোর করে নিয়ে এসেছে। নয়নার অনুনয়-বিনয় কিছুই শোনার ইচ্ছে মাত্র নেই তার।

” আমাকে ছেড়ে দাও, বাশার ভাই। কথা দিচ্ছি, ফুফুর কাছে আজকের ঘটনার কিছুই বলব না।”

বাশার অট্ট হাসে। উত্তর দেয়, ” কখনো শুনেছিস, ক্ষুধার্তের সামনে খাবার আছে কিন্তু সে না খেয়ে আছে? তোকে পাওয়ার ইচ্ছে কী এজনমের?”

নয়না চোখের পানি মুছে নেয়। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে বিপদমুক্তির পথ খুঁজতে থাকে সে। বাশার গায়ের বস্ত্রে হাত বাড়াতেই নয়না ইস্পাতের তৈরী পানির পাত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করে। আকস্মিক আঘাতে বাশার টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে। অল্প সল্প র’ক্ত ঝড়ছে সেখান থেকে। চোখ, নাক, মুখ কুঁচকে ব্যাথা সংবরণের চেষ্টা করতে থাকে। নয়না মুখ চেপে কাঁদে, একবার এগিয়ে বাশারকে ধরতে যায় কিন্তু পরমুহূর্তেই আপন জান বাঁচাতে ঘরের এদিকসেদিক পায়চারি করতে থাকে। বাশার নয়নাকে বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছে, নয়নার কানে কিছুই প্রবেশ করছে না। সে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্কুল ব্যাগে ভরে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। প্রধান ফটকের কাছে আসতেই পুনরায় বিপদের মুখোমুখি হয় নয়না। তালাবদ্ধ দরজার চাবি তো আকলিমার কাছে! সে বের হবে কী করে? ঘরে গেলে তো রাবণের হাতে পড়বে। উপায়ন্তর খুঁজে পাচ্ছে না নয়না। আকস্মিক খেয়াল হলো, রান্না ঘরের জানালা দিয়ে বের হওয়া সম্ভব হবে। সময় নষ্ট না করে সেদিকেই দৌড় লাগায় নয়না। বাশার মাথায় হাত চেপে তার দিকেই আসছে। নয়না রান্না ঘরের দরজা আটকে দিয়ে বুকে স্কুল ব্যাগ চেপে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। তার আর এই জগত সংসারে বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। বাশার দরজায় কষাঘাত করছে, রাগে গর্জে উঠে বারবার। নয়না দুর্বল চিত্তে রান্নাঘরের জানালার দিকে এগোয়। অন্ধকারে সে কিছুই দেখছে না, জান বাঁচাতে লাফ দেয় অন্ধকার স্থানে।
—————————–

” তোমার শরীরের প্রতি কী মায়া মহব্বত নেই, মা? এতো অত্যাচার কীভাবে সহ্য করো। বোবা নাকি? প্রতিবাদ করতে জানো না? পুরোনো ঘা শুকায়নি তারমধ্যে নতুনভাবে আঘাত পেয়ে বসেছো। এতো ধৈর্যশক্তি কোথায় পাও, শুনি?”

নয়নার আঁখি পল্লব বন্ধ করে রাখা। ডাক্তারের কথায় সে শাসনের আভাস পাচ্ছে। দীর্ঘ বছর পর বাবা ব্যতীত তাকে কেউ শাসন করছে। বিষয়টা তার নিকট উপভোগময়। বুজে রাখা চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নয়নার। দুর্বল চিত্তে উত্তর দেয়,” যাদের জীবন দুঃখের ছায়ার তলে গড়ে, তারা আবার নতুন করে আঘাত পাবে কী করে?”

মধ্যবয়স্ক ডাক্তার নয়নার পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিল। নয়নার কথা শুনে সে থমকে যায়, হাতজোড়া আপনাআপনি কাজ বন্ধ করে দেয়। কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় নয়নার অগোচরে। স্নেহের আদরে মেয়েটাকে আগলে রাখতে ইচ্ছে করে ডাক্তারের। কী এক আলাদা টান!
নয়নার প্রিয় বান্ধবী মিছিল, নামটা অদ্ভুত হলেও এটাই তার সার্টিফিকেট নাম। মিছিলের বাবা নুরুল ইসলাম শখ করে মেয়ের আনকমন নামটা রাখেন। মিছিলই নয়নাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ক্ষত শরীরে কুল-কিনারা না পেয়ে বান্ধবীর দুয়ারে কড়া নাড়ে সে।

” পায়ে ভালোই আঘাত পেয়েছে, হাসপাতালে দুইদিন থাকলে ভালো হবে।”

হাসপাতালে থাকা মানে খরচ বেড়ে যাওয়া। যা নয়না কখনোই চায় না। এমনিতেও ফুফুর বাড়ি ছেড়ে চলে আসার ব্যপারে নয়নার বাবা কিছুই জানে না। আজ সে নিজেই বাবার কাজের জায়গায় যাবে। অনেক কাজ বাকী
আছে তার! ডাক্তারের কথার প্রত্ত্যুত্তরে চট করে বলে ওঠে,” একদমই না, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। চল মিছিল!”

কথা দীর্ঘ করতে পারলো না নয়না। তার পূর্বই তীব্র পায়ের ব্যথায় হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ে নয়না। মিছিল ধরার আগেই ডাক্তার নয়নার হাত ধরে দাড় করায়।

” বড়োরা কখনো খারাপ চায় না, মা! দুইদিন থেকে যাও, সুস্থ হলেই তো বাড়ি ফিরে যাবে।”

অশ্রুসিক্ত আঁখিতে নয়না ডাক্তারের দিকে তাকায় বুকপকেটে মাহবুব শিকদার নাম ভেসে উঠে। নয়নার অশ্রুমাখা মুখশ্রী দেখে মায়া হয় মাহবুব শিকদারের। সে আস্বস্ত স্বরে বলে,” টাকার ব্যাপারটা মাথায় এনো না। সুস্থভাবে বাঁচতে শিখো, তোমার জীবন মাত্র শুরু এতো সহজেই ঝরে যেতে দিও না,মা।”
————–

হাসপাতালের চার দেয়ালের মাঝে অর্ধদিন অতিবাহিত হয় নয়নার। পুরোটা সময় মিছিল নয়নার সাথেই ছিল। দুর্বলতার জন্য সেলাইন দেয়া হচ্ছে। মাহবুব শিকদার রাউন্ডে দুইবার দেখে গিয়েছেন নয়নাকে। ফিনাইল ও স্যাভলনের গন্ধে মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে মৃত্যু পুরিতে চলে এসেছে নয়না। জীবনের প্রথম হাসপাতালে থাকা। ইতিপূর্বে নয়নার মা ও ভাইবোনদের মরনকালে হাসপাতালে পা মাড়ানোর সুযোগ হয়নি তার পূর্বেই উপর ওয়ালার প্রিয় হয়ে যায়। নয়নার বয়স তখন কতোই বা ছিল! সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া নয়নার সম্মুখেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল আগুন। চোখের সামনেই মা, ভাই-বোনদের আর্তচিৎকার আজও কানে বাজে নয়নার। এখন সব অতীত, নয়নার অতীতও দুঃখ জর্জরিত ছিল বর্তমানও।

হাসপাতালে দুইদিন থাকার পর ডিসচার্জ মিলে নয়নার। হাসপাতালের সমস্ত খরচ মিছিলই বহন করে। আশ্চর্যজনকভাবে নয়নার খরচ কেউ অর্ধ পরিশোধ করে ফেলে। নয়নার বুঝে আসে না, সে বিড়বিড় করে বলে, “কে সেই মহামানব!”

মিছিলের বাড়িতেই নয়না উঠে। এবাড়িতে অনেক আদর পায় সে। এবাড়ির প্রতিটা সদস্যই নয়নার আপন। কিছু কিছু সম্পর্ক রক্তের না হলেও আপন হয়ে উঠে। মিছিলের মা নয়নাকে দেখে এগিয়ে আসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,” এখন কেমন আছো,মা?”
” ভালো, আন্টি।”
” ঐ বাড়ি ছেড়ে এসেছো, এই সিদ্ধান্তটা আমি খুব পছন্দ করেছি। এবাড়িতে থাকলে সংকোচবোধ করবে না। মিছিল, মারুফের সাথে আজ থেকে তুমিও আমার মেয়ে।”

অমন মা নামক শান্তি কেন নয়নার নেই। আকলিমা তো তার বাবার বংশের তার কাছে কী নয়না আদর প্রাপ্য ছিল না! ফুফুরা ভাইজিদের মা বলে ডাকেন অথচ নয়নার ফুফু তাকে সহ্যই করতে পারে না। নয়না মিছে হেসে উত্তর দেয়,

” তা হয় না, আন্টি। এই পৃথিবীতে আমার বাবা এখনো প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছেন, উনাকে ছেড়ে আমি অন্য কোথাও বসতি গড়তে পারব না। আগামীকাল সকালেই আমি বাবার কাছে চলে যাব।”

অভিভাবক থাকা অবস্থায় চাপ প্রয়োগ করা অযাচিত। মিছিলের মা সায় দিয়ে বলেন,” আচ্ছা যেও, এখন ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নাও।”

মিছিল ঘরজুড়ে পায়চারী করছে। নয়নাকে নিয়ে নিজের ঘরে এসেই তার মুখে পুরো ঘটনা শুনেছে সে। মিছিল বুঝতে পারছে না, বাশার নয়নার আপন ফুফাতো ভাই হয়েও কীভাবে মনে এরুপ আশা পোষণ করে! সে উত্তেজিত কণ্ঠে নয়নাকে বলে, ” তুই আর ফিরে যাস না, নয়ন! বাশার নামক জানোয়ার তোকে বাঁচতে দিবে না। সুযোগ পেলেই খুবলে খেতে চাইবে।”

সিলিং ফ্যানের দিকে নয়না এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মন মস্তিষ্কে একটা বাক্যই বাজছে, ” বাশার ভাই আমাকে এত সহজেই কী ছেড়ে দিবে?”

উত্তরটা অপ্রকাশিত। নয়না নিজেও জানে, বাশার তার পিছু এতো সহজেই ছাড়বে না। আজ নয়তো কাল, নয়নার জীবনের কালো অধ্যায় হয়ে বাশার হাজির হবেই।

সন্ধ্যা লগনে নয়নার জ্বর আসলো, একশো তিন ডিগ্রি জ্বর। শরীরের উত্তাপে কাঁপছে নয়না। মা, মাগো বলে আর্তনাদ করছে অসহ্য শরীরের ব্যথায়। মিছিল ও তার মা সাময়িক চিকিৎসা করেছে শরীর মুছে, কপালে জ্বরের পট্টি দিয়ে দিয়েছে কিন্তু মেয়েটার জ্বর কমছেই না। ঔষধ পত্র আনতে হবে তো! উত্তেজিত মনে সে মুঠোফোন হাতে বের হয়ে যায় ঘর থেকে।

কিছুক্ষণ পর মিছিল দৌড়ে নয়নার কাছে আসে। মেয়েটা এখনে কাঁপছে। মিছিলের বড্ড মায়া হচ্ছে প্রিয় বান্ধবীর জন্য। গায়ে হাত রেখে আস্তে আস্তে ডাকে নয়নাকে। দুর্বল শরীরে আঁখি মেলে নয়না। কর্ণধারে মিছিলের বাণী তখন প্রবেশ করে,” তোর বাবা, আর ফুফু তোকে নিতে এসেছে নয়না।”

নয়না হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছাড়ে। ভয়ার্ত চেহারায় বিড়বিড় করে,” আমি ঐ নরকে যাবো না, মিছিল। বাশার ভাই, আমাকে মে’রে ফেলবে।”

চলবে………………..

নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০১

0

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব:এক

” গতকাল বাসার ভাই আমার বুকে হাত দেয়ার চেষ্টা করেছিল, ফুফু!”

কথাটা শেষ করা মাত্রই নয়নার ফর্সা গালে থাপ্পড় পড়ে। মেয়েটি টাল সামলাতে না পেয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়ে। হাতের কাছে কাঁচের গ্লাস ছিল সেটাও জমিনে ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে যায়। ফিনকি দিয়ে নয়নার ঠোঁট কে’টে র’ক্ত ঝড়ছে। মস্তিস্তের নিউরনে জানান দিচ্ছে ব্যাথা অনুভব করার তীব্র যন্ত্রণা।

নয়নার ফুফু আকলিমা রুটি তৈরী করার জন্য আটা মাখছিলেন, সেই হাতেই ভাইজির গালে থাপ্পড় বসান; রাগে তার শরীর কাঁপছে। লাখে একজন বাসার, ইন্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরি খুঁজছে। অমন সোনার টুকরো ছেলের সম্পর্কে অযাচিত কথা আকলিমা কেন কোনো মা-ই বিশ্বাস করবে না। নিচে পড়ে নয়না কাঁদছে, কপালের বাম পাশটায়ও কে’টে র’ক্ত ঝড়ছে; সেদিকে তার চেতনা নেই। ভাগ্যের আকস্মিক উত্থান তাদের পরিবারকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সবার জায়গা তিন হাত মাটির নিচে থাকলেও নয়না ও তার বাবার জীবন এখনো নশ্বর এই পৃথিবীতেই আছে।
রিহান দৌড়ে আসে প্রিয় বোনকে বাঁচাতে। সম্পর্কে সে নয়নার ফুফাতো ভাই, বয়স দশ বছর। নয়নাকে ধরতে গেলে সে হাত ঝাড়া দিয়ে ওঠে, ছোট্ট রিহান টাল সামলাতে না পেরে কাঁচের উপর পড়ে যায়, মুহূর্তেই আর্তনাদ করে উঠে। তার কষ্টে নয়না অন্তর মুচড়ে ওঠে। নিজের ব্যথার কথা বেমালুম হয়ে রিহানকে বুকে জড়িয়ে নেয়। হাতে ভাঙা গ্লাসের টুকরো বাজেভাবে গেঁথে গেছে। নয়না এক টানে বড়ো টুকরো বের করে ফেলে। নিজের ওড়না দিয়ে চেপে ধরে খুব শক্তকরে।
কিছু সময়ের ব্যবধানে বড়ো ঘটনা ঘটে গেল। আকলিমা পুরোটা সময়ে ঘোরের মধ্যে থেকে যায়। যখন চেতনা ফিরে আসে ততক্ষণে ব্যপারটা অনেক অতলে ডুবে গেছে। আকলিমা দর্জির কাজ করে। কাপড় পরিমাপের লম্বা স্কেল হাতের কাছে ছিল। রাগে সেটার দ্বারা নয়নার পিঠে আঘাত করতে থাকে সাথে বিশ্রী গালি।

” নিজের ভাই-বোনদের খেয়ে এখন আমার ছেলেকে খেতে চাইছিস? দূর হো আমার ছেলের কাছ থেকে। তোর মতো অপয়া মেয়ের আমার ঘরে কোনো জায়গা নেই, বের হো আমার বাড়ি থেকে বের হো।”

উন্মাদের মতো আকলিমা নয়নাকে মারছে। রিহানকে বাঁচাতে নয়না সহ্য করে নিচ্ছে। রিহান এতক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। নয়না উপায়ন্তর না পেয়ে চিৎকার করে বলে,” আর মেরো না, ফুফু। রিহানকে হাসপাতালে নিতে হবে।”

আকলিমা থেমে যায়। বাসার বাহিরে ছিল, এসে রিহানের অবস্থা দেখে নয়নার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। আকলিমা তখনই নিজের ঝাল মেটায়, ছেলের কানে বিষ ঢুকিয়ে দেয়, ” ভাইজি বলে এই অপয়া মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। এখন আশ্রয়দাতাকেই ভক্ষন বলছে। আবার রিহানকে মে’রে ফেলতে চাইছে। এর আজকে একটা ব্যবস্থা কর,বাসার! নয়তো এই মেয়ে আমাদের সবাইকে মেরে জমি জমায় হাত বসাবে।”

বাসার ছোঁ মেরে রিহানকে নয়নার থেকে কেড়ে নেয়। নয়নার পেট বরাবর লাথি মেরে জমিনে ফেলে দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। আকলিমাও ছেলের পিছু দৌড়াতে থাকে।

নয়নার শরীরে অসংখ্য ক্ষত। চুইয়ে চুইয়ে সেখান থেকে রক্ত ঝড়ছে। তার সেদিকে ধ্যান মন কিছুই নেই। সে অনুতপ্ত রিহানকে আঘাত করে। তখন ব্যথার তাড়নায় ভেবেছিল তার ফুফু পুনরায় আঘাত করতে আসছে। ফেরাতে গিয়ে রিহানকে আঘাত করে বসে, বুঝতে পারে তার ভাইটা তার যন্ত্রণা ভাগাভাগি করতে এসেছিল। র’ক্তা’ক্ত ওড়না দেখে হকচকিয়ে উঠে নয়না। এই র’ক্ত তার রক্ষাকারীর, আদরের ভাইয়ের, যাকে সে নিজেই আঘাত করেছে। চিন্তন ফিরে আসতেই নয়না দৌড়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।

পকেটে কড়ি নেই, গাজীপুর শহরের পথঘাটও অচেনা। বিশ মিনিটের পথ এক ঘণ্টায় পায় হেঁটে গাজীপুর সদর হাসপাতালে পৌঁছায় নয়না। তার ফুফুদের চিকিৎসা এই হাসপাতালেই হয়ে থাকে। কাল বিলম্ব না করে মেডিসিন বিভাগে পৌঁছে কাঙ্খিত মানুষদের খোঁজা শুরু করে নয়না। চোখে তার অশ্রু, হাসপাতের সবাই অবাক নয়নে তাকে দেখছে। কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করার পর ইমারজেন্সি ঘরের সামনে আকলিমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নয়না। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,” রিহান কেমন আছে, ফুফু?”

আকলিমার আক্রোশ তৎক্ষনাৎ বেড়ে যায়। নয়নার হাত চেপে ধরে সে। মা বলে মেয়েটা মেয়েটা আর্তনাদ করে উঠে। কাঁচ ফুটা জায়গায় আরো জোরে চেপে ধরে।
” আমার জান বের হয়ে যাচ্ছে, ও ফুফু ছেড়ে দাও!”

” তুই হয়েছিস তোর মায়ের মতো। অপয়া, অলক্ষ্যি; তোর মায়ের কারণে আমি বাপের বাড়ি থাকতে পারিনি। তার মেয়েদের নাকি আমি সহ্য করতে পারি না। ওরে হা’রা’ম’জা’দি, তুই-ই দেখছি আমাদের সুখ সহ্য করতে পারিস না। খেয়ে ফেললি না আমার ছেলেটাকে? আবার জিজ্ঞেস করছিস, রিহান কেমন আছে?”

আকলিমার চিল্লাচিল্লিতে ইমারজেন্সি ঘরের দরজা খুলে যায়। মাক্স পরিহিত একজন যুবক বলে উঠে,” আপনাদের পারিবারিক প্রব্লেম বাহিরে গিয়ে মিটমাট করুন। আপনাদের জন্য আমাদের কাজের সমস্যা হচ্ছে।”

নয়না ব্যথাতুর দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকায়, অনুনয়ের স্বরে বলে,” আমাকে একটু রিহানের সাথে দেখা করতে দিবেন, প্লিজ! আমি একটু কথা বলেই চলে আসব, ডাক্তার সাহেব!”

ছেলেটি কিছুক্ষণ নয়নাকে দেখে দরজা আটকে দেয়। নয়না ব্যথাতুর মনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তার শরীর ভেঙে আসছে। কিয়ৎ সময় পর বাসার ঔষধ হাতে উপস্থিত হয়, নয়নাকে দেখে রেগে তেড়ে আসে। ভালোমানুষির আড়ালে লুকায়িত অমানুষটাকে মায়ের সামনে প্রকাশ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সে। আকলিমাকে আড়াল করে নয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিশ্রী হাসে। কোমরে হাত ছুঁয়ে দেয়ার বাহানায় হাত এগিয়ে এনে বলে,” কোমড়ে হাত দেয়ার কথা বলার পর তোর এই হাল হয়েছে তাহলে বুঝে নে, তোর শরীরের বিশেষ জায়গায় হাত দিলে তোর কী অবস্থা হবে? আরো বলবি, মায়ের কাছে?”

নয়না কাঁদতে কাঁদতে পিছনে সরে যাচ্ছে। হাত জোর করে অনুনয়ের সুরে বলছে,” আল্লাহ সইবে না, বাসার ভাই। আমি তোমার বোন হই।”

” আজকালকার বোনেরা রক্ষিতাও হয়, আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যা, নয়না! তাহলে সবার জন্য ভালো হবে।”

ঘৃণায় নয়না মুখ ফিরিয়ে নেয়। দুর্বল শরীরে পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে। আল্লাহ আল্লাহ বলে দোয়া করছে যেন কেউ এসে তাকে বাঁচিয়ে নেয়। বাসার নয়নার ওড়নার নিচে হাত নিবে তার আগেই ইমারজেন্সির দরজা খুলে যায়।

” আপনার হাত থেকেও রক্ত ঝড়ছে, আসুন ড্রেসিং করিয়ে দেই।”

মেয়েলি কণ্ঠস্বর শোনা মাত্রই নয়না বাসারকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। ক্রন্দনমাখা চোখে মেয়েটির দিকে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলে,” আপনাকে আমি সারাজীবন মনে রাখব।”

পর্দার আড়ালে রিহানের চিকিৎসা চলছে। নয়না উঁকি দিয়ে দেখার বৃথা চেষ্টা করছে। রিহানের চিকিৎসা করছে সেই মাক্স পরা যুবক। হাতের ইশারায় নার্সকে এটা সেটা এগিয়ে দিতে বলছে। নয়নার চিন্তিত মুখখানা একবার দেখে সে বলে,” এখানে চিকিৎসা চলছে, সার্কাস নয়! ডাক্তারদের চেহারায় মধু লেগে নেই। অন্যকিছু দেখার চেষ্টা না করে, তাদের কাজ দেখুন।”

নয়না কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। লজ্জায় আড়ষ্টভাব চলে আসে নাকে মুখে। ফর্সা গাল দুটো নিমিষেই গোলাপী বর্ণ ধারণ করে। সে তো রিহানকে দেখার জন্য উঁকি দিয়েছিল কিন্তু ডাক্তার তাকে কী ভাবলো? এদিকে নয়নাকে নিয়ে আসা মেয়েটি মুচকি মুচকি হাসে। নয়নার লাজরাঙা মুখশ্রীতে আরেকটু লাজ ঢেলে দেওয়ার জন্য বলে,” আমাদের স্যার কিন্তু ভীষণ হ্যান্ডসাম সাথে সিঙ্গেলও।”

নয়না বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। এতটুকু সময়ের মধ্যে নার্স নয়নার হাতের কাচগুলো বের করে পরিষ্কার করে ফেলে। বেন্ডেজ করার সময় তার নজর নয়নার হাতের কনুইয়ের উপর। জায়গাটুকু ফুলে লাল হয়ে আছে দেখে বুঝাই যাচ্ছে, আঘাতটা নতুন। নার্স নয়নাকে জিজ্ঞেস করে,” আপনার শরীরে এতো আঘাতের চিহ্ন কীভাবে? কে মেরেছে আপনাকে?”

” ঐ কিছুনা।”
নয়না ইতস্ততভাবে উত্তর দেয়। নার্স কিছু না বললেও পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে আসা ডাক্তার বলে উঠে,” আজকাল বিবাহিতা নারীরা স্বামী দ্বারা অত্যাচারীত হয়েও ‘কিছু না’ বলে পাশ কাটিয়ে দেয়। এসব তুই বুঝবি না, ভাবনা।”

নয়না স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে আছে। সে বিড়বিড় করে বলে,” ডাক্তার কী আমায় বিবাহিতা মনে করেছে?”

চলবে……………..

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৫৫ এবং শেষ পর্ব

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫৫ #অন্তিম_পর্ব

সময়ের স্রোত বড্ড অদ্ভুত জিনিস। একে কখনোই ধরে রাখা যায় না। আদ্রিতারাও ধরে রাখতে পারে নি। দেখতে দেখতে তাদের জীবন থেকে চলে গেল পাঁচটি বছর। ফারিশ নেই। এটা যেন পুরো বাংলাদেশে কঠিন এক ঝড় উঠিয়ে ছিল। আদালতে রায় পাওয়ার পর কোনো আসামির এমন পরিণতি এটা কেউ মানতে পারলো না। কিন্তু ধীরে ধীরে সবটা ঘুচে গেল। মানুষ ভুলতে বসলো বাংলাদেশের ঔষধ কোম্পানির মালিক ফারিশ মাহমুদকে। ভুলতে বসলো সেই দেশ বিরোধী মাফিয়াকে। সাধারণত আমাদের জীবন থেকে কোনো জীবিত মানুষ হারিয়ে গেলে আমরা তার অপেক্ষা করি তাকে ভুলতে পারি না। কিন্তু কেউ মরে গেলে দু’রাতের মাঝেই মোটামুটি আমরা তাকে ভোলার চেষ্টা করি। এ যেন প্রকৃতিরই নিয়ম। মৃত মানুষকে আমরা কেউই বেশিদিন মনে রাখি না বা রাখতে পারি না। সময়ের তালে তালে আমরা তাদের ঠিকই ভুলে যাই। ফারিশকেও কেউ মনে রাখে নি। তার কুকর্ম, তার সাথে হওয়া পুরো ঘটনা কোনোটাই কেউ মনে রাখে নি তেমন। সময়ের তালে তালে হারিয়ে গেল সবটা।’

জাপানের রাজধানী টোকিও শহর। বর্ষাকাল চলছে। বর্ষাকাল চললেও আজ চারদিন যাবৎ বৃষ্টি নেই এই শহরে। রাস্তাঘাট সবই শুঁকনো। বিশাল এক মাঠে সুন্দর এক ফুলগাছের নিচে বসে আছে আদিব। চোখ জোড়া তার আকাশপানে। জীবন তাদের সাথে কি খেলটাই না দেখালো। আদিবের অভিযোগ নেই। তবুও কোথাও গিয়ে শূন্যতা। আদ্রিতার একটা ছেলে হয়েছে বয়স চার। কি ফর্সা দেখতে। চেহারার গঠন পুরো ফারিশ মতো। আর গায়ের রঙটা আদ্রিতার মতো। তবে আদ্রিতার চেয়েও উজ্জ্বল সেই রঙখানা। ছেলের নাম রাখা হয়েছে ফায়াজ। ফারিশের ছেলে ফায়াজ। আদিবের তিন’বছরের একটা ছোট্ট মেয়ে আছে এত দুষ্ট। ফায়াজকে সারাদিনই বিরক্ত করে। নাম স্রোত। আদিব শুনেছে চারবছর আগে আশরাফ আর নয়নতারার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে সেই বিয়েতে আদ্রিতারা কেউই যায় নি। নয়নতারা প্রেগন্যান্ট খুব শীঘ্রই নতুন সদস্য আসবে। বিয়ের চার বছর পর আশরাফ বাবা হতে চলেছে খুশিতে পরিবেশ খুবই সুন্দর। রনি আর মুনমুনের একটা মেয়ে আছে। মৃদুল আর নীলিমার ছেলে। মোটামুটি সবাই তাদের নিজস্ব জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আদিব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। হঠাৎ গম্ভীর এক আওয়াজ আসলো। আদিবের পাশেই শুয়ে থাকা যুবকটি বলল,“তুমি এত সেন্টিখোর কেন আদিব?”

আদিব চমকে উঠল ফারিশের কথা শুনে। অবাক কান্ড ফারিশ ভাই বুঝলো কেমন করে সে সেন্টি খাচ্ছিল। এই ফারিশ ভাইয়ের কাছে কিছুই লুকাতে পারে না আদিব। আদিব ফারিশ পানে তাকিয়ে বলল,“তেমন কিছু না ভাই জীবন নিয়ে ভাবছিলাম।”

ফারিশ শোয়া থেকে উঠে বসলো। গত পাঁচ বছরে ফারিশের জীবন আর চেহারায় এসেছে বিরাট পরিবর্তন। ফারিশের মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোফ,চোখে কালো ফ্রেমের মোটা চশমা। গায়ে জড়ানো মেরুন রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট। ফারিশ আদিবের পানে তাকালো। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল,
“জীবন নিয়ে ভাবার মতো কিছু নেই আদিব। জীবনকে জীবনের মতো থাকতে দেও আর তুমি তোমার মতো থাকো।”

আদিব নিরাশ ভঙ্গিতে বলল,
“ভাই তুমি কি আজও সেদিনকার ঘটনার জন্য রাগ করে আছো?”

ফারিশ মিষ্টি হেঁসে বলে,
“না তো। তবে আমি বুঝি নি তোমার এমন ভয়ানক কোনো বুদ্ধি থাকবে।”
“সত্যি বলতে ভাই ওই বুদ্ধি আমার ছিল না। ছিল তিশার। আমি শুধু তার কথা মতো কাজ করেছি।’
“গুলিটা কি করে মারলে আদিব?”

উত্তর দেয় না আদিব। চুপ করে রয়। ফারিশ মৃদু হাসে। বলে,“বাদ দেও এমনি জিজ্ঞেস করেছি। আসলে কি বলো তো মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষদের ভালোর জন্যও আমাদেরকে তাদের আঘাত করতে হয়।”

আদিব মাথা নুইয়ে বলে,
“দুঃখিত ভাই।”

ফ্ল্যাসবেক–
পাঁচবছর আগের সেদিনকার ঘটনায় ফারিশের বুকে গুলি করা আগন্তুকটি আদিব ছিল। যে কি না তার জীবনের প্রথম অস্ত্র হাতেই গুলি করে বসলো ফারিশকে। কারণ এ ছাড়া আদিবের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। ফারিশ ভাইকে বাঁচাতে হলে তাকে মারতে হবে। আদিবকে এই বুদ্ধি দিয়েছিল তিশা। তিশা দিনরাত ভেবেছে যে করেই হোক ফারিশ ভাইয়াকে বাঁচাতে হবে। তিশা আদিবকে চিনতো। বহু কষ্টে আদিবের ঠিকানা যোগাড় করল। এরপর.. ফারিশকে বাঁচানোর মিশনে কাজ করেছে আদিব তিশা ছাড়াও আরো ছয়জন মানুষ। মৃদুল, আশরাফ,রনি, মুনমুন, চাঁদনী আর পুলিশ রূপে নয়নতারা। আদ্রিতাকে এগুলো জানানো হয় নি। ফারিশের বুকে গুলি এটাতে হয়তো আদ্রিতা রাজি হতো না। ফারিশ যখন অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করে মৃদুল। আদালত মহলে তখন চাপা উত্তেজনা। মৃদুল যেহেতু ফরেনসিক ডক্টর। তাই ফারিশের বডি পোস্টমর্টেম করার দায়িত্ব তাকেই দেয়া হয়। সেই সুযোগটাই লুফে নেয় সবাই। বডি তদন্তের বদলে ফারিশের চিকিৎসা চলে। তবে এখানেও একটা ঝামেলা ছিল সেটা হলো ফারিশের মৃত দেহ পুলিশকে দেখানো লাগতো যেহেতু ফারিশ একজন আসামি। এই প্ল্যান বহুদিন আগেই করানো হয়। যার দরুন ফারিশের দৈহিক বৈশিষ্ট্যের মতো আরেকজন মৃত ব্যক্তিতে খোঁজা হয় এবং তার মুখটাকে করা হয় প্ল্যাস্টিক সার্জারী। তাকে দেয়া হয় ফারিশের মুখ। সঙ্গে ফারিশের নামটাও। আর আসল ফারিশকে ইমারজেন্সি চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় জাপানে। শুরু হয় নতুন ফারিশের গল্প। যেখানে ফারিশের নাম নির্ধারণ করা হয় ফারহান হোসেন নামে। প্রায় দু’মাস ফারিশ বেডরেস্টে থাকে। আদিবের সে কি অনুশোচনা? তবুও সে নিজেকে সামলায়। শুরু হয় তাদের নতুন জীবন কাহিনী। আদ্রিতাকে এই ঘটনা জানানো হয় ঘটনার দু’দিন পরই। প্রথমে সবার ওপর রাগ করলেও ধীরে ধীরে সবটা স্বাভাবিক হয়। শুরু হয় নতুন রূপের এক পশলার গল্প। কিশোর ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল কি না আদিব জানে না। তবে আদিবের মনে হচ্ছে কিশোর জানে। না হলে হঠাৎ হঠাৎ ফোন দিয়ে বলবে কেন ফারহান সাহেব কেমন আছেন?”

পরপর সব ঘটনাগুলো মনে পড়তেই আদিব চুপ হয়ে গেল। এসব ভাবলেই তার সারা শরীর ভয়ে শিরশিরিয়ে ওঠে। যদি কোনোভাবে তারা দেশ থেকে আসার সময় ধরা পড়তো। যদি ফারিশ ভাই সত্যিই সত্যিই মারা যেত। ভাবলো না আদিব। আতঙ্কে সর্বাঙ্গ ঝলসে যাচ্ছে তার। ফারিশের পুরো বিষয়টা মানতে একটু সময় লাগে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেও মেনে নেয়। যতই হোক ফারিশ শাস্তি তো পেয়েছে। সে আর ফিরতে পারবে না বাংলাদেশে। আদ্রিতার সাথে কাটানো সেই সব জায়গাগুলোতে আর যাওয়া হবে না। ফারিশ তার আসল নাম খুইয়েছে। তাকে এখন আর কেউ ফারিশ নামে চেনে না। চেনে ফারহান হোসেন নামে।’

তপ্ত নিশ্বাস ফেললো ফারিশ। পুরনো কথা ভুলে বলল,“আদিব কাজ বাজ কি করবে বলে ভেবেছো?”

আদিব কিছু বলে না। কারণ গত পাঁচবছর যাবৎ তারা কিছুই করছে না। ফারিশ বলল,
“চলো আদিব তুমি আমি মিলে ঝালমুড়ির দোকান দেই।”
“বিদেশের বাড়িতে ঝালমুড়ি।”
“তাইলে সবজির দোকান দিবা। দুজন মিলে দেশি ড্রেস লুঙ্গি আর ফতুয়া পড়ে সবজি বেচবো।”
“ভাই বিদেশীরা আমাদের ভিখারি ভাব্বে।”
“তুমি না আদিব। চলো বাড়ি যাই বউ ছাড়া ভালো লাগে না।”
“ভাই তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো ভাবি এখনও হসপিটাল থেকে আসে নি।”
“ধুর এইসব হসপিটালের কেতায় আগুন। যে হসপিটাল বউকে আঁটকে রাখে সে হসপিটাল বয়কট করা উচিত।”
“কি যে বলো ভাই?”

আদিব আর ফারিশ উঠে দাঁড়ালো। তখন বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা হওয়ার মুখোমুখি। আদিব ফারিশ পাশাপাশি হাঁটছে। ফারিশ বলল,
“দেখো আদিব আমরা আর কতদিন বউদের টাকায় বসে বসে খাবো চলো তুমি আমি মিলে সবজির ব্যবসা করি।”
“কি ভাই আপনি পড়ে আছেন সবজিতে। আমাদের বউরা ডাক্তার আর আমরা কি না সবজি বেচবো।”
“তাতে কি? শোনো আদিব, আমরা হালাল ব্যবসা করবো। আর হালালে পান্তা ভাতেও তৃপ্তি। কিন্তু হারামে বিরিয়ানিতেও মজা নেই।”
“ভাই তাইলে পাঁচ বছর আগে যে বিরিয়ানিগুলা খাইছিলাম ওগুলো মজা লাগছিল ক্যান।”

চোখ গরম দিল ফারিশ। এই আদিবটা না সব কথার উল্টো মিনিং বের করবে। আদিব চুপ হয়ে গেল। ফারিশ আদিবের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“যত যাই বল আদিব সবজির ব্যবসা করবোই। তুমি আমি লুঙ্গি পড়ে গান গাইতে গাইতে সবজি বেচবো।”

ফারিশের এবারের কথায় আদিব আর কিছু বললো না। কারণ সে জানে তার ফারিশ ভাই তার কথা শুনবে না। ফারিশ সত্যি সত্যিই সবজির ব্যবসা দিয়েই ছাড়বে। এতদিন হাওয়া গরম ছিল যার দরুন এসব নিয়ে ভাবাভাবি হয় নি। কিন্তু এখন হাওয়া ঠান্ডা এবার ফারিশ সবজির ব্যবসা দিয়েই ছাড়বে।’


বাড়ি আসতেই দেখা হয়ে গেল চাঁদনীর সাথে। সে ফায়াজ আর স্রোতকে নিয়ে বসা। দুজন খেলছে। চাঁদনী বসে বসে দেখছে। ফারিশকে দেখতেই ফায়াজ দৌড়ে গেল। বলল,“পাপা।”

ফারিশ খুশি মনে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। কপালে চুমু এঁটে বলল,“তোমার আম্মা এসেছে ফায়াজ?”

ফায়াজ মাথা নাড়িয়ে বলল,“হু।”
জাপান আসার পর শুরুতে একটু সমস্যা হয়েছিল তাদের। আশরাফের এক বন্ধু ছিল যে কি না টোকিও এক হসপিটালে চাকরি করে। তার সুবাদেই হসপিটালে চাকরি হলো আদ্রিতা আর চাঁদনীর। তারপর ধীরে ধীরে জীবন সুন্দর।’

ফারিশ ফায়াজকে কোল থেকে নামিয়ে বলল,“তুমি স্রোতের সাথে খেল আমি এক্ষুণি আসছি।”

ফায়াজও বলল,“আচ্ছা পাপা।”
ফারিশ তাদের রুমের দিকে গেল। ফারিশ যেতেই চাঁদনীর পাশে গিয়ে বসলো আদিব। বলল,
“তোমায় আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।”

খানিকটা লজ্জা পেল চাঁদনী। বলল,“তোমাকেও।”
হাসে আদিব। চাঁদনী তার কাঁধে মাথা রাখে। আদিব আবেশে তাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। চেয়ে থাকে ফায়াজ আর স্রোতের দিকে।’


রুমে ঢুকেই আদ্রিতাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ফারিশ। আদ্রিতা প্রথমে একটু চমকে উঠলেও পরক্ষণেই মানুষটার স্পর্শটা উপলব্ধি করে হাসল। মিষ্টি স্বরে বলে,“হঠাৎ এত প্রেম?”

ফারিশ বলে,
“তোমাকে দেখলেই আমার খালি প্রেম প্রেম পায়।”
“আর তোমায় দেখলে আমার রাগ হয়।”

ফারিশ অবাক হয়। আদ্রিতাকে ঘুরিয়ে বলে,“কেন?”
মলিন চোখে ফারিশের দিকে তাকালো আদ্রিতা। হাত রাখলো ফারিশের বাম দিকের বুকে। সেখানে এখনও গুলির দাগ বিদ্যমান। ফারিশ বলে,
“আজও ভুলতে পারলে না?”
“এটা কি ভুলে যাওয়ার মতো বিষয় বলো।”

আদ্রিতার কপালে চুমু কাটে ফারিশ। বলে,
“তোমায় ভীষণ ভালোবাসি বেলীপ্রিয়া।”

আদ্রিতা মিষ্টি হাসে। বলে,
“আমিও।”
“তাহলে রাগ করলে কেন?”

উত্তর দেয় না আদ্রিতা। অনেক সময় পর বলে,
“জানো বখাটে, আমি যখন তোমায় বিয়ের করেছিলাম তখন আমার দুটো উদ্দেশ্য ছিল যার একটা ছিল তোমায় বিশ্বাস করানো আমি তোমায় সত্যি ভালোবাসি। আর দুই নাম্বার উদ্দেশ্য ছিল আমি শুরুতে সত্যি চেয়েছিলাম তুমি আত্মসমর্পণ করো। কিন্তু তোমার সাথে দু’মাস কাটানোর পরই আমি আমার উদ্দেশ্য বদলে ফেলি কারণ এর পরিণতি ভেবে আমি ঘাবড়ে যাই। এরপরই আমি স্বার্থপর হয়ে উঠি। কিন্তু তুমি কি করলে? যদি আদিব ভাইয়া ওই কাজটা না করতো তখন কি হতো?”
“কিছুই হতো না। তবে এখন ভালো হয়েছে আরশাদসহ আমার যত শত্রু আছে তারা আমি মরে গেছি ভেবে আনন্দ পাচ্ছে আর আমি সস্তি পাচ্ছি। আচ্ছা শোনো আমি কি ভেবেছি জানো আমি আর আদিব মিলে সবজির ব্যবসা দেবো।”

আদ্রিতা খানিকটা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“আর কিছু নেই।”
“আছে কিন্তু আমি এগুলোই করবো।”
“আচ্ছা করো।”
“আমায় জড়িয়ে ধরো?”

আদ্রিতা ধরলো। হঠাৎ আকাশ পথে মেঘ ডাকলো। শুরু হলো বৃষ্টি। এক পশলা বৃষ্টি। ফারিশ বলল,
“তোমার কি মনে আছে সেই “এক পশলা ঝুম বর্ষায়” আমার আগমনের কথা?”

আদ্রিতা ধ্যানমগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
“ভুলে যাওয়ার মতো বিষয় এটা। তুমি জানো আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম সেদিন?”

ফারিশ মৃদু হেসে বলে,
“হু মনে থাকবে না কেন ডাক্তার ম্যাডাম আমায় কাঁপা কণ্ঠে বলেছি, আমার কি আপনাকে ভয় পাওয়া উচিত?”

পুরনো কথা ভেবে হেঁসে ফেলে আদ্রিতা। বলে,
“আর তুমি উত্তর কি দিয়েছিলে, আপনার ভয় পাওয়া উচিত কি না বলতে পারছি না কিন্তু আপনি যে ভয়ে কাঁপছেন তা কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি।”

ফারিশ হাসে। কি নিদারুণ সুন্দর দেখায় সেই হাসি। আদ্রিতা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখে সেই হাসি।’

#সমাপ্ত!’

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। শেষটা পরিপূর্ণ রূপে ইতি টানতে পারলাম কি না ধরতে পারছি না। ইদানীং শেষ পর্বে আমি আঁটকে যাই। অজানা এক খারাপ লাগা কাজ করে যার দরুণ এই অবস্থা। আশা করি পুরো উপন্যাসটা তোমাদের ভালো লেগেছে। এই উপন্যাসে অনেক গ্যাপ দিয়েছি। অনেকেই দারুণ বিরক্ত হয়েছো। তবুও এতটা পথ সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ। আশা রাখি পরবর্তী গল্প বা উপন্যাসে এমন গ্যাপ যাবে না। অতঃপর পুরো উপন্যাসটা তোমাদের কেমন লাগলো জানাতে ভুলো না। আর ছোট্ট একটা কথা,“ঈদ মোবারক।”🥰]

#TanjiL_Mim♥️.

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৫৪

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫৪

নিকষকালো অন্ধকারে ভরপুর রুমখানা। চাঁদের আলো জানালার কার্নিশ ছুঁইয়ে ঢুকছে ঘরে। নিজ কক্ষের বেলকনিতে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে আদিব। হাতে জলন্ত সিগারেট। আদিব তার এত বছরের জীবনে আজই প্রথম বোধহয় সিগারেট ফুঁকছে। ফারিশ ভাই সবসময় তাকে সিগারেট, মদসহ নানাবিধ মাদকদ্রব্য থেকে দূরে রেখেছে। তাকে নিষেধ করেছে এসব খেতে। অথচ নিজেই ছিল আফিম ব্যবসায়ী। ফোশ করে শ্বাস ফেললো আদিব। বেলকনির দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছে আদিব। এক হাঁটুর ভাজ করা। অন্য হাঁটুর ওপর হাত। হাতে জ্বলন্ত সিগারেটের ধুঁয়া উড়ছে।
আদিব কিছুটা ফারিশ বেসে বসেছে। সঙ্গে চিন্তা করছে তার জায়গায় যদি ফারিশ ভাই থাকতো আর ফারিশ ভাইর জায়গায় সে। তবে কি ফারিশ ভাইও তার মতো এভাবেই বসে থাকতো। নাকি তার জন্য কিছু করতো। আদিবের মনে হচ্ছে ফারিশ ভাই থাকলে ঠিক তার জন্য কিছু একটা করে তাকে রক্ষা করতো। শাস্তি থেকে তাকে দূরে রাখতো। দেখা যেত জেল ভেঙেই তাকে নিয়ে পালাচ্ছে। আদিন হয়তো পালানোর জন্য রাজি হতো কিন্তু ফারিশ ভাই কি পালাতে রাজি হবে। অবশ্যই হবে না। ফারিশ ভাই কখনোই আদিবের মতো হতো না। আদিব শুনেছে ফারিশ ভাই আজ আদালতে কি কি বলেছে? কিভাবে আফিম ব্যবসায়ে ঢুকেছে। তার জীবন তাকে কোথায় কিভাবে নিয়ে গিয়েছে সবটাই বলেছে। অথচ ফারিশ ভাই তাকে কোনো জায়গায় উল্লেখ করে নি। ফারিশ ভাই সেই বর্ষার রাতে তাকে বাঁচাতেই অস্ত্র নিয়ে খুন করেছিল তা উল্লেখ করে নি। আদিবকে কতটা ভালোবাসে ফারিশ তা উল্লেখ করে নি। সম্পূর্ণ ঘটনাটাকেই নিজের মধ্যে দিয়ে ঘুরিয়ে বলেছে। অথচ সেই সকল ঘটনায় আদিব ফারিশের সঙ্গে ছিল। আদিব সিগারেটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। শুরুতে কাশি আসলেও এখন আর আসছে না। সেই সন্ধ্যা থেকে আদিব একস্থানে বসা। পরপর পনেরটা সিগারেট শেষ তার। আদিবের মনে হচ্ছে ফারিশ ভাই একটা স্বার্থপর মানুষ। না হলে আদালতে তার কথা উল্লেখ করবে না কেন? আদিব এবার বুঝেছে ফারিশ কেন তাকে আদালতে যেতে বারণ করেছিল। যাতে তার মিথ্যে কথাগুলোর মাঝে আদিব প্রতিবাদ জানাতে না পারে। আদিবের নিজের ওপর রাগ হচ্ছে, রাগ হচ্ছে ফারিশ ভাইয়ের ওপর। আদিবের পাশেই কুঁচি কুঁচি করে পড়ে আছে কতগুলো কাগজের টুকরা। আদিব ছিঁড়েছে। জেদের বসে কাগজ ছিঁড়েছে। আদিব আকাশ পানে চাইলো। তার কিছু ভালো লাগছে না।’

হঠাৎ আদিবের ফোনে একটা মেসেজ আসলো। আদিব দেখলো। কিছুক্ষণ নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে থেকে বলল,“তুমি খুব খারাপ ভাই। খুব খারাপ।”


কারাগারে বন্দী আরশাদ তাচ্ছিল্যে হাসছে ফারিশের অবস্থা দেখে। মানুষ ঠিক কতটা আহাম্মক হলে এমন একটা কাজ করে। আরশাদের মজা লাগছে। একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে সে একা কেন জেল খাটবে! ফারিশও খাটবে। কম করে হলেও ফারিশের শাস্তি পনের বিশ বছরের জেল নিশ্চিত। আর যদি মৃত্যুদন্ড হয় তবে তো, ভেবেই খিলখিলিয়ে হাসে আরশাদ। তার পরিকল্পনা ছিল জেল থেকে বের হলেই সবার আগে ফারিশকে খুন করবে। অবশ্য এখনও সে পরিকল্পনা পুরোপুরি ঘুচে যায় নি। হিসাব করলে ফারিশের আগেই আরশাদের মুক্তি হবে। আরশাদ খুন একটা করবে। তার ইচ্ছে করছে এখনও গিয়ে ফারিশকে খুন করতে। আরশাদ শুনেছে আদালতে নাকি ফারিশ অনুরোধ করেছে তাকে বাঁচিয়ে রাখার। আরশাদ ভেবেছে আদালত ফারিশকে বাঁচিয়ে দিলেও আরশাদ দিবে না। সাজা তো হবেই সাজার পর মৃত্যু। কথা ভেবে আবারও বিচ্ছিরি ভাবে হাসলো আরশাদ। আরশাদ এও জানে সে যদি ফারিশকে মারায় ব্যর্থ হয় তবুও ফারিশের আরো শত্রু আছে তারাও মেরে দিতে পারে। ফারিশের অবস্থা এখন চোরাবালিতে আটকে পড়ার মতো। ডাল ধরে আছে ঠিকই তবে সে ডাল বেয়ে না উঠতে পারছে আর না ডাল ছেড়ে দিয়ে ডুবতে। আরশাদের মজা লাগছে ফারিশের করুণ অবস্থার কথা ভেবেই। ‘ভালোবাসা’–ছাহ্! হেতির ভালোবাসারে স্যালুট।’

হাত উঠিয়ে স্যালুট ভঙ্গিটা করলো আরশাদ। ঠোঁট জড়ানো হাসি তো আছেই। আরশাদের সামনের জেলে থাকা এক আসামি তার কার্যকলাপের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে, ‘সামনের হারামজাদার মাথা খারাপ হইছে। নইলে এল্লা এল্লা হাসবে ক্যান?’


জেল বন্দী ফারিশ নিরালায় বসে আছে একা। জেলখানা থেকে দিয়ে যাওয়া শুঁকনো রুটি পড়ে আছে প্লেটে। ফারিশ আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে খানিকটা। খাওয়া দাওয়া করছে না। সারাদিনে শুধু পানি ছাড়া তেমন কিছুই খাচ্ছে না। পরশু তার পাপের রায় দেবে। আচ্ছা যদি জজ সাহেবের রায় হয় তাকে পনের বছর জেল খাটতে হবে তাহলে কেমন হবে। আজ থেকে পনের বছর পর ফারিশকে কেমন দেখাবে? বয়স তার প্রায় পয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ পেরোবে। আচ্ছা পনের বছর পর ফারিশের ছেলে বা মেয়ের বয়স কত হবে। কম হলেও চোদ্দ। চোদ্দ বছর পর যদি কোনো সন্তান তার বাবাকে দেখে তাহলে তার রিয়েকশন কেমন হবে? তাকে দরজার মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তার সন্তানের প্রথম প্রশ্ন কি হতে পারে?”
“তুমি কেমন আছো বাবা? নাকি আপনি কে?’

দেখা গেল ফারিশ যখন বাড়ি গেল তখন আদ্রিতা বাসায় নেই। তার ছেলে বা মেয়ে তাকে দেখে ভিখারী ভেবে বলল,“মা বাসায় নেই আপনি পড়ে আসুন।”

ফারিশ চমকাল। কি আশ্চর্য! এসব কি ভাবছে ফারিশ। জেলে থেকে থেকে তার মাথা নষ্ট হলো নাকি। তবে যত যাইহোক ব্যাপারটা কিন্তু খুব অদ্ভুত আর ইন্টারেস্টিং লাগছে। পনের বছর পর বাবার সাথে সন্তানের দেখা। আচ্ছা আদ্রিতার কি রিয়েকশন হবে? তার জীবনের পনেরটি বছর যাবে বৃথা। একটা আসামীর ফিরে আসার অপেক্ষা করতে করতে। আদিব কি তাকে ভুলে যাবে? অবশ্যই ভুলবে না। ফারিশ কি ভুলে যাওয়ার মতো মানুষ নাকি। আদিবও ততদিনে দু’তিন বাচ্চার বাবা হয়ে যাবে। না আদিবের দু’তিন বাচ্চার বাবা হলে চলবে না তাকে হতে হবে চার পাঁচ বাচ্চার বাবা। ইস, ভুল হয়ে গেছে আদিবকে আসার সময় বলে আসা উচিত ছিল, ‘আদিব আমি যেন ফিরে এসে দেখি তুমি চার পাঁচ বাচ্চার বাবা হয়ে গেছো।”

আচ্ছা ঢাকার শহর কি পনের বছরে অনেকটা বদলে যাবে। যাবে নিশ্চয়ই। ফারিশ আর ভাবলো না। জীবনটা ঠিক কোথায় যাবে ফারিশ ধরতে পারছে না। নয়নতারার পদধ্বনি শোনা গেল। আজ তার নাইট ডিউটি পড়েছে। কিশোর কিছু কাজে খুলনা গেছে। সন্ধ্যায় গিয়েছে। ফিরবে পরশু সকালে। তাই এই দুইদিন নয়নতারাই নাইট ডিউটি করবে বলেছে। আশরাফের সাথে নয়নতারার মনমালিন্য চলছে। আশরাফ তার সাথে কথা বলে না। ঝগড়াও করে না। নয়নতারা এতবার বোঝালো ফারিশ ভাই বারণ করেছিল তাও আশরাফ মানতে চাইলো না। নয়নতারা ফারিশের জেলের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল,“ফারিশ ভাইয়া।”

ফারিশ চকিত তাকালো। অবাক হলো দারুণ। নয়নতারাকে দেখে এগিয়েও আসলো। বলল,
“এত রাতে তুমি এখানে?”

নয়নতারা বলল,
“আজ আমার নাইট ডিউটি ছিল ভাইয়া। আচ্ছা শুনুন আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।”

ফারিশ বোধহয় আচ করলো কে এসেছে। তবুও প্রশ্ন করলো না। শুধু বলল,
“রাত কয়টা বাজে নয়নতারা?”

নয়নতারা তার হাত ঘড়িটা দেখে বলল,
“দুটো।”
“তাকে ফিরে যেতে বলো।”
“আপনি দেখা করতে চান না ভাইয়া।”
“সে কি জানে না এতরাতে কারো সাথে দেখা করতে নেই।”
“আমি বারণ করেছিলাম কিন্তু শুনতে চায় নি। খুব পাগলামী করছে।”
“মায়া ছাড়তে এখনও শিখলো না।”
“পাঠিয়ে দেই?”
“দেও।”

নয়নতারা চলে গেল। জেলখানায় মানুষ নেই তেমন। নয়নতারা জানে সে যে কাজটা করছে তা অন্যায়। তবুও আদ্রিতার মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারলো না। নয়নতারা আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বলল,“আসো।”

আদ্রিতা মলিন মুখে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে ভিতরে ঢুকলো। ফারিশ জেলের ভিতর যথাসম্ভব চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখা। আজ কেমন যেন নিজেকে ভাঙা ভাঙা লাগছে। আদ্রিতা ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। হাত রাখলো জেলের শিকে। ফারিশ উল্টোদিক ঘুরে দাড়ানো। বুকের ভিতর টিপটিপ করে শব্দ হচ্ছে। আদ্রিতা মলিন কণ্ঠে ডাকলো,“মিস্টার বখাটে।”

ছ্যাঁত করে উঠলো বুকখানা। এই নামটা আজ কতদিন পর শুনলো ফারিশ। ফারিশ সঙ্গে সঙ্গেই পিছন ঘুরলো। আদ্রিতার মলিন মুখ দারুণ পীড়া দিল। তবুও প্রকাশ করলো না। আদ্রিতা প্রশ্ন করলো,“কেমন আছো?”

ফারিশ মৃদু হাসে। বলে,
“ভালো। তুমি?”
“আমিও ভালো।”
“এখানে আসলে কেন?”
“ইচ্ছে হলো তাই।”
“সব ইচ্ছে যে পূরণ করতে নেই জানো না।”
“স্বার্থপর মানুষদের জন্য তাই।”

ফারিশ কথা বলে না। চুপ করে যায়। তার গলা ধরে আসছে। ফারিশ ফোশ করে শ্বাস ফেলে বলল,
“চলে যাও আদ্রি।”

আদ্রিতা গেল না। জেলের শিকে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ল। ফারিশও বসলো। পিঠে পিঠ লাগলো একটু। ফারিশের স্পর্শে ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো আদ্রিতার। ফারিশ বলল,
“আমি কি ভুলে করেছি?”

আদ্রিতা অনেকক্ষণ পর জবাব দেয়,
“না।”
“আমার উপর রেগে আছো?”
“রাগ থাকলে আসতাম বুঝি।”
“আদিব বলেছিল কেউ আসছে।”
“তাহলে জেনেছো?”
“তুমি তো জানালে না।”
“অভিমানের দেয়াল এত ভাড়ি ছিল আমি বলতেই পারলাম না।”
“সে কেমন আছে?”
“ভালো।”
“আমিহীনা তাকে বড় করতে পারবে না আদ্রি?”
“বাবার ভালোবাসা কি মা দিতে পারে?”
“তুমি চেষ্টা করলে ঠিক পারবে।”
“ফিরে আসবে তো ফারিশ?”
“তুমি অপেক্ষায় রাখতে পারলে ঠিক আসবো।”
“আমার কষ্ট হয়।”
“আমারও হচ্ছে।”
“জীবনটা সহজ’সরল কেন হলো না?”
“মাফিয়াদের প্রেমে পড়লে জীবন সহজ’সরল হয় বুঝি।”

আদ্রিতা প্রসঙ্গ পাল্টালো। বলল,
“খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না তাই না?”

জবাব দেয় না ফারিশ। উল্টো বলে,
“তুমি এত রাতে এখানে এসে ভুল করেছো?”
“তোমার কাছে আসায় কোনো ভুল নেই মাফিয়া স্বামী।”

নীরবতা চলে আসলো। এত কথা বললো যে আর কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। আদ্রিতা ফারিশের দিকে ঘুরে তাকালো। অনুরোধের স্বরে বলল,
“একটু তাকাও না আমার দিকে?”

ফারিশের হৃদয়টা কেঁপে উঠলো। কি যন্ত্রণা হলো বা’দিকের বুকখানায়। ফারিশ তাও ঘুরলো। চোখাচোখি হলো দুজনের। আদ্রিতা হাত জড়িয়ে ধরলো ফারিশের। চোখে পানি চলে এসেছে তার। ফারিশ চোখের পানি মুছলো আদ্রিতার। বলল,
“কাঁদবে না বেলীপ্রিয়া, তুমি কাঁদলে আমি ভালো থাকবো না।”
“কষ্ট দিয়ে ভালো থাকতে বলছো।”
“রায়ের দিন তুমি আসবে বেলীপ্রিয়া?”
“তুমি চাও আমি আসি?”
“এসো। কালো শাড়ি পড়ে এসো।”
“কালো শাড়ি কেন?”
“শোকে শোকে কাটাকাটি হবে তুমি ভালো থাকবে।”

আদ্রিতা মৃদু হেসে বলে,
“তুমি একটা অদ্ভুত মানুষ।”
“জানি তো।”
“কচু জানো।”

অভিমানী স্বরে বলে আদ্রিতা। কথা শুনে হাসে ফারিশ। নিরাশ কণ্ঠে শুধায়,“আমার তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।”

আদ্রিতাও চোখ বন্ধ করে শীতল স্বরে জানায়,
“আমারও।”

কিন্তু জড়িয়ে ধরা গেল না। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বসে রইলো দুজন। নয়নতারা দূর থেকে সে দৃশ্য দেখে মোহনীয় চোখে চেয়ে রইলো। ‘ভালোবাসা এত সুন্দর’– তার আঁখিপল্লব ভেসে উঠলো।’


মাঝে কাটলো একদিন। আজ বুধবার। আজ দুপুর বারোটায় ফারিশের মামলার রায় দিবে। আদ্রিতা কালো রঙের শাড়ি পড়েছে। চুলগুলো বাঁধা। মুখে হাল্কা একটু পাউডার। ব্যস আদ্রিতা তৈরি।’

সেদিনের মতোই সবাই হাজির হলো কোর্টে। কালো শাড়ি পরিধিত আদ্রিতা চুপটি করে বসা। ফারিশের দৃষ্টি তার দিকেই। জজ সাহেব আসলেন। কিছু সময় চুপ থাকলেন। এরপর বললেন,
“আসামী ফারিশ। তিনি নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। ওনার এই কাজটাকে আমি হৃদয় থেকে সম্মান জানাই। পৃথিবীতে কোনো মানুষই জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে পাপী হয় না। পরিস্থিতি তাদের পাপী বানায়। কিন্তু পাপ তো পাপই হয়। তাই সব দিক বিবেচনা করে এই আদালত ফারিশ মাহমুদকে পনের বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করল। আশা রাখি আমার এই সিদ্ধান্তে আমার আশপাশের মানুষেরা সম্মান জানাবে। দা কোর্ট ইজ ডিস মিস।”

বলেই হাতুড়ির মতো একটা বস্তু দিয়ে টেবিলের উপর বারি মেরে জজ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তার দেখাদেখি সবাই উঠে দাঁড়ালো। ফারিশের রায় শুনে বিন্দুমাত্র ভয় বা সংকোচতা নেই। কারণ এটা সে জানতো। কিশোর এগিয়ে আসলো ফারিশের কাছে। ফারিশ চুপচাপ তার মুখোমুখি দাড়িয়ে মলিন হাসলো। বলল,
“ভালো থাকবেন অফিসার।”

কিশোরও বলল,“আপনিও।”
আদালতের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে ফারিশ। তার থেকে একটু দূরেই কিছু পুলিশ। আদ্রিতা ফারিশ মুখোমুখি দাঁড়ানো। ফারিশ কিশোরের থেকে পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছে। একটু আদ্রিতার সাথে কথা বলার জন্য। কিশোর দিয়েছে। আদ্রিতা, চাঁদনী, মুনমুন,আশরাফ, মৃদুল, রনি, মৃদুলের বউ, নয়নতারা, আদ্রিতার বাবা-মা, ভাই সবাই দাঁড়ানো। ফারিশ আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তবে গেলাম বেলীপ্রিয়া। ফিরে আসার অপেক্ষায় থেকো। কথা দিচ্ছি এবার ফিরে আসলে ফারিশ আর ভুল করবে না।”

উত্তরে শুধু মৃদু হাসে আদ্রিতা। ফারিশ বলে,
“যে আসছে তার যত্ন নিও বেলীপ্রিয়া, আর নিজেরও যত্ন রেখো। আমার ভাইটাকেও দেখো।কেমন।”

আদ্রিতা উপর নিচ মাথা নাড়ায়। ফারিশ সবাইকে বিদায় জানায়। আদ্রিতার বাবা মার কাছে ক্ষমা চায়। শেষে গিয়ে আশরাফকে বলে,“নয়নতারাকে ক্ষমা করো আশরাফ ওর কোনো দোষ নেই।”

আশরাফ কিছু বলে না শুধু তাকায় নয়নতারার দিকে। অতঃপর সবাইকে বিদায় জানিয়ে ফারিশ আবার তাকায় আদ্রিতার দিকে। বলে,
“আমিহীন ভালো থেকো বেলীপ্রিয়া।”

.
ফারিশদের থেকে খানিক দূরে উঁচু একটা বিল্ডিং। সেই বিল্ডিংয়ের ছাঁদে কালো জ্যাকেট, মুখে মাস্ক, মাথায় কালো ক্যাপ আর হাতে গান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। তার উদ্দেশ্য ফারিশের বুক বরাবর গুলি করা। যুবকটি ফারিশের বুক সমান নিশানা ঠিক করলো।’

ফারিশ আশেপাশে তাকালো এত মানুষের ভিড়েও ফারিশ আদিবকে দেখলো না। তবে ফারিশ জানেন আদিব আশেপাশেই আছে শুধু তার সামনে আসছে না। ফারিশ স্বল্প আওয়াজে বলল,“ভালো থেকো আ..

পুরোটা বলার আগেই ঘটে গেল এক বিস্মিত ঘটনা। বিকট শব্দ হলো একটা। হঠাৎ ফারিশ উপলব্ধি করল তার বুক বেয়ে রক্ত পড়ছে। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল আচমকা এই ঘটনায়। কারণ কেউ একজন ফারিশের বুক বরাবর গুলি করেছে। আদ্রিতা ফারিশ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। ফারিশ লুটিয়ে পড়ল নিচে। আদ্রিতা তাকে ধরলো। গালে হাত চেপে ডাকল,
“মিস্টার বখাটে কথা বলুন?”

ফারিশ টিপটিপ চোখে থাকায়। বলে,
“আমার অপেক্ষা তোমায় নিঃস্ব করেই দম নিল বেলীপ্রিয়া। ভালো থেকো বউ।”

কথাটা বলেই চোখ বুজিয়ে নিল ফারিশ। আদ্রিতা ফারিশকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। তার চিৎকারে আশপাশের দেয়ালও বুঝি ভাড়ি হলো। মৃদুল ফারিশের হাতের পার্লস চেক করল। আদ্রিতার আশাপূর্ণ চাহণী। মৃদুল মাথা নুইয়ে ফেললো। মলিন মুখে জানালো,
“He is no more.”

#চলবে…

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৫২+৫৩

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫২

হন্তদন্ত হয়ে পুলিশ স্টেশন ঢুকলো আদিব। আর একটু আগাতেই তার পথ আটকালো নয়নতারা। শান্ত স্বরে বলল,“কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?”

আদিব তাকায় নয়নতারার দিকে। বলে,
“আমি ফারিশ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চাই।”
“এভাবে তো আমরা আপনার সাথে দেখা করাতে পারি না।”
“দয়া করে আমায় ভিতরে যেতে দেও। আমি অল্পক্ষণ থাকবো। ভাইকে দুটো কথা বলেই চলে আসবো।”

নয়নতারা মাথা নত করলো। অফিসে কিশোর নেই। কিশোর যাওয়ার আগে নয়নতারাকে পই পই করে বলে গেছে,“আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না আসবো ততক্ষণ পর্যন্ত ফারিশের সাথে কাউকে দেখা করতে দিবেন না মিস নয়নতারা।”

নয়নতারাও মাথা নাড়িয়ে হা জানায়। কিন্তু এখন আদিবকে কি করে আটকাবে। নয়নতারার ভাবনার মাঝেই আদিব আবার বলে,“প্লিজ নয়নতারা আমায় একটিবার যেতে দেও।”

নয়নতারা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ভাইয়া অফিসে কিশোর স্যার নেই। উনি বলে গেছেন আমি যেন কাউকে ফারিশ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে না দেই।”
“প্লিজ নয়নতারা মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য আমায় দেখা করতে দেও।”

নয়নতারা মানলো। বলল,
“ঠিক আছে কিন্তু বেশি সময় নিয়েন না ভাইয়া।”

আদিব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। দ্রুত ঢুকে গেল ভিতরে। নয়নতারা দরজার কাছে দাঁড়ালো। মনে মনে প্রার্থনা করল,“কিশোর স্যার আসার আগে যেন আদিব ভাই বেরিয়ে যান।”


চুপচাপ বসে আছে ফারিশ। সময় কেমন হবে বিকেলের প্রথম প্রহর। পুরো একটা দিন কেটে গেল ফারিশ চার দেয়ালে বন্দী। ফারিশের আচমকা আদ্রিতাকে দেখতে মন চাইলো। কিন্তু কি করে দেখবে? ফারিশের অসহায় লাগলো। মেয়েটা একবার আসতো। আদিব কি করছে? তাকে ছাড়া চলতে পারছে তো। ফারিশের এত খারাপ লাগছে বোঝানো যাচ্ছে না। হঠাৎ আদিবের কণ্ঠ শোনা যায়। সে নিদারুণ বিষণ্ণ সুরে ডাকে,“ভাই।”

ফারিশের বুকটা বুঝি আচমকা কেঁপে উঠলো। পুরো একটা দিন পর আদিবের কণ্ঠ শুনছে ফারিশ। ফারিশ চাইলো। আদিব অসহায়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে। চোখ ছলছল। ছেলেটা কাঁদবে। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একটু একটু করে এগিয়ে গেল আদিবের দিকে। আদিব শক্ত করে জেলের শিক চেপে ধরলো। ইচ্ছে করছে জেলের শিক ভেঙে ফারিশকে বের করতে। ফারিশ হাসার চেষ্টা করলো। আশ্চর্য! তার হাসি আসছে না। ফারিশ তাও চেষ্টা করলো। না হচ্ছে না। ফারিশ জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল,“কেমন আছো আদিব?”

আদিব শোকাহত স্বরে বলে,
“ভালো।”
“আমায় মিথ্যে বলছো?”
“সত্যিটা জেনেও জানতে চাইলে কেন?”

ফারিশ উত্তর দেয় না প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
“তোমার ডাক্তার ভাবি কেমন আছে আদিব?”
“তুমি যেমনটা রাখতে চেয়েছিলে তেমনটাই আছে।”
“আমার উপর রাগ করেছো তুমি?”

আদিব জবাব দেয় না। মাথা নুইয়ে ফেলে। ফারিশ বলে,
“তোমাকে এখানে আসতে বারণ করেছিলাম না আদিব। তাও এলে কেন?”
“তোমার কি কষ্ট লাগছে না ভাই?”
“ফারিশদের কষ্ট লাগে না।”

তড়িৎ জবাব ফারিশের। আদিব মৃদু স্বরে বলে,
“তুমি খুব স্বার্থপর ভাই।”
“চলে যাও আদিব।”

কথা বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ফারিশ। শক্ত কণ্ঠে বলে,
“তোমায় দেশ ছাড়তে বলেছিলাম আমি।”
“আমিও তো বলেছি ছাড়বো না।”
“চলে যাও। এখানে আর এসো না।”
“তুমি একটা নিষ্ঠুর মানুষ।”

ফারিশ জবাব দেয় না। আদিবের নিজেকে ধৈর্য্যহীন লাগে। বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে ওঠে,“তুমি বাবা হতে চলেছো ভাই।”

কথাটা যেন ভূমিকম্পের ন্যায় কানে বাজলো ফারিশের। ফারিশে রুহু সমেত কেঁপে উঠল। এ কি শুনলো সে? ফারিশ ঘুরে চাইলো। আদিবের আর একটু কাছে এগিয়ে বলল,
“এসব তুমি কি বলছো আদিব?”
“সত্যি বলছি ভাই ডাক্তার ভাবি মা হতে চলেছেন।”

ফারিশের হঠাৎ সবটা এলেমেলো লাগলো। আদিব বলল,“এবার তো মনে করো ভাই তুমি কাজটা ঠিক করো নি।”

ফারিশ জবাব দেয় না। কি বলবে! সবটা এমন অগোছালো লাগলো কেন! আদিব বলল,
“এবার কি করবে ভাই?”

ফারিশ শক্ত মুখে চোখ বন্ধ করে বলল,
“তুমি বাড়ি যাও আদিব।”
“এখান থেকে বার হওয়ার কোনো কি পথ খোলা নেই?”

ফারিশ কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“না নেই। তুমি যাও।”
“আদ্রিতা ভাবির কাছে ফেরার ইচ্ছে নেই।”

ফারিশ মলিন মুখে বলে,
“আমি কি করবো আদিব? কিছু করার নেই তুমি চলে যাও?”

আদিব কিছু বলবে এরই মাঝে নয়নতারা ছুটে আসলো। থরথর করে বলল,“আদিব ভাইয়া চলুন কিশোর স্যার এসে পড়েছেন।”

ফারিশ আতঙ্কিত স্বরে বলল,
“তুমি যাও আদিব।”
“ভাই,
“তোমাকে যেতে বলেছি আমি,

প্রচুর বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল ফারিশ। আদিব কিছু সময় চুপ থাকলো। ফারিশের অস্থিরতা দেখে আর দাঁড়ালো না। আদিব অশ্রু ভেজা চোখে বলল,
“আপনি খুব খারাপ ভাই। আপনি খুব খারাপ।”

কথাটা বলেই চলে গেল আদিব। ফারিশ ঠায় দাঁড়িয়ে। জেলের শিক শক্ত করে চেপে ধরলো। তার হঠাৎ রাগ লাগছে। এত রাগ হচ্ছে, ইচ্ছে করছে নিজের প্রানটাই নিয়ে নিতে। আদ্রিতার মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠলো ফারিশের। ফারিশ জেলের দেয়ালে ঘুষি মারলো। তার জীবনটা এমন কেন হলো? ফারিশ ভুল করেছে। আদ্রিতাকে তার জীবনে আনা ঠিক হয় নি। আদ্রিতার জীবন নষ্ট করেছে ফারিশ। কথাটাগুলো ভেবেই রাগ হলো ফারিশের। সে পরপর কতগুলো ঘুষি মারলো দেয়ালে। সেই মুহূর্তে হাজির হলো কিশোর। ফারিশকে পাগলের মতো করতে থতমত খেল কিশোর। দৌড়ে ছুটে গেল জেলের ভিতর। ধরলো ফারিশকে। বলল,
“এসব কি করছেন আপনি?”

ফারিশ কিশোরের কথার উত্তর দেয় না। অনবরত ঘুষি মারতে থাকে। কিশোর উপায় না পেয়ে দুজন কনস্টেবলকে ডাকে। তারা দৌড়ে আসে। কিশোর একটা চেয়ার আর দড়ি আনতে বলে। তারা আনে। অতঃপর তিনজন পুলিশ মিলে ফারিশকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে দেয়। কিশোর বলে,“শান্ত হন ফারিশ এসব কি করছেন?”

ফারিশ বলে,
“আপনার কাছে রিভলবার নেই আমার বুকে গুলি করুন অফিসার। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”

কিশোর কি বলবে বুঝছে না। আচমকা ফারিশের হলো টা কি!’

সময় গেল দশ মিনিট। পরিবেশ হলো শান্ত। কিশোর বাকি দুজন কনস্টেবলকে চোখের ইশারায় বললো চলে যেতে। তারাও আদেশ মেনে চলে গেল। কিশোর জেল থেকে বেরিয়ে ফারিশের জন্য পানি আর একটা চেয়ার নিয়ে আসলো। ফারিশের একহাত খুলে হাতে দিল পানি। ফারিশ নিলো। কিশোর বলল,
“পানিটা খান।”

ফারিশ খেল। অতঃপর কিশোর সামনে চেয়ারটায় বসলো। শান্ত স্বরে বলতে লাগলো,
“আপনি কি জানেন ফারিশ সাহেব আমার আপনার ওপর একটা চাপা রাগ ছিল। অবশ্য ছিল বললে ভুল হবে এখনও বোধহয় আছে।”

ফারিশ অবাক স্বরে বলে,
“কিসের রাগ?”
“বলছি,

ফারিশ চেয়ে রয় কিশোরের মুখের দিকে। কিশোর তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,
“আপনার মনে আছে কি না জানি না বছর তিনেক আগে আপনাকে খোঁজার জন্য আপনার গাড়ির সামনে একটি মেয়ে আসে। মেয়েটার নাম মাইশা। একজন জার্নালিস্ট ছিল।”

ফারিশ অবাক হলো কিশোরের কথা শুনে। বছর তিনেক আগে। হ্যাঁ ফারিশের মনে পড়েছে, একদিন মধ্যরাতে একটা মেয়ে হঠাৎ তার গাড়ির সামনে এসে সাহায্য চায়। বলে তাকে কিছু বাজে লোক তাড়া করেছে ফারিশ যেন তাকে সাহায্য করে। ফারিশ সেদিন সাহায্য করে। এরপর,

কিশোর বলে ওঠে তখন,
“মেয়েটা আপনায় ভালোবেসে ছিল ফারিশ। আর আপনি তাকে রিজেক্ট করেন। ও মূলত আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ খোজারের জন্য গিয়েছিল। কিছুমিছু পেয়েও ছিল। কিন্তু ও বেইমানি করে আপনি মাফিয়া জেনেও বলে মাফিয়া নন। আপনি যেদিন ওকে রিজেক্ট করে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেইদিন ও গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। ও আমার বোন ছিল। আমার কথাতেই ও আপনার কাছে এসেছিল আদ্রিতার মতো। কিন্তু ওই যে আপনি আদ্রিতার প্রেমে পড়লেও আমার বোনের প্রেমে পড়লেন না। এই ব্যাপারটায় আমার প্রথমে রাগ থাকলেও এখন আর নেই। কারণ এতে আপনার কোনো দোষ ছিল না। তবুও ভাই তো তাই রাগ নিয়েই আপনার বিরুদ্ধে শুধু প্রমাণ খুঁজেছি। কিন্তু আপনার বুদ্ধিমত্তার কাছে আমি প্রতিবার ব্যর্থ হয়েছি। সেদিন যখন আপনি আমায় ফোন করে বললেন আপনি আত্নসমর্পণ করবেন। বিশ্বাস করুন আমি দারুণ অবাক হয়েছি। ভালোবাসা মানুষকে জেনেশুনে এমন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে এ যেন আপনায় না দেখলে জানতামই না। আপনি চিন্তা করবেন না আমি আপনার তরফ থেকে আদালতে একটা দরখাস্ত পাঠাবো, সেখানে বিশেষ করে ওই মেয়ে পাচারকারীর দলটা ধরিয়ে দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকবে। আশা করি তারা আপনার শাস্তি কমিয়ে দিবেন।”

এই বলে ফারিশের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল কিশোর। ফারিশ বলল,
“আপনার বোনকে আমি বুঝিয়ে ছিলাম আমার জীবন ঠিক নয়। কিন্তু ও যে এমন কিছু করবে আমি ভাবতে পারি নি।”

কিশোর মৃদু হেঁসে বলে,
“বুঝতে পেরেছি। আবেগী ছিল আমার বোনটা যার দরুন এমনটা করেছে। যাক আপনার ভালো হোক।”

কিশোর চোখ মুছে বেরিয়ে গেল জেলের ভিতর থেকে ফারিশ চুপচাপ বসে। এসব সে কি শুনলো? মাইশা মেয়েটা আর ফারিশের কাছে আসছে না বলে ফারিশ ভেবেছিল বোধহয় বিষয়টা বুঝতে পেরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করেছিল মাইশা। এরপর কাজে কাজে আর মেয়েটার কথা মনে ছিল না ফারিশের। অথচ আজ কি শুনলো?’ ফারিশের ভীষণ মন খারাপ হলো।


টানা কয়েকদিন ফারিশকে জেলবন্দী করে রাখা হলো। এই কয়েকদিনে ফারিশ শুধু চুপচাপ বসেই থাকলো। সারাক্ষণ ভাবলো। আদ্রিতার কথা, আদিবের কথা, তার অনাগত সন্তানের কথা।’ ফারিশ বুঝতে পারছিল না কি করবে? তিশার কথাটা কি তার শোনা উচিত ছিল?”

আজ সোমবার। ফারিশের কেসটা কোর্টে ওঠার দিন। আজই হয়তো ফারিশের কাজের শাস্তি কিরূপ হবে তা জানা যাবে। আদ্রিতা তৈরি হচ্ছে। তার চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। গত কয়েকদিন যে নির্ঘুম কাটিয়েছে। এই কয়েকদিনে ফারিশের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ করে নি আদ্রিতা। মাঝে পাঁচ’দিন আগে আদ্রিতার বাবা, মা আর ভাই এসেছিল তার সাথে দেখা করতে। আদ্রিতার মায়ের সে কি কান্না! আদ্রিতা শুধু বুঝিয়েছে কিছু হয় নি মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আদিবের মন খারাপ থাকে সারাক্ষণ। কি করবে? ভেবে পায় না। বসে বসে কি শুধুই দেখবে ফারিশ ভাইয়ের শাস্তির কাহিনি।’

#চলবে…

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫৩

বিষণ্ণ মনে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিতা। পরনে আকাশীরঙা সেলোয়ার-কামিজ। চুলগুলো কালো রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। আদ্রিতা ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করছে তার সঙ্গে বেড়ে ওঠা অংশটাকে। আদ্রিতার চোখ বেয়ে পানি পড়লো। এত বেশি কষ্ট হচ্ছে। আদ্রিতা মনে মনে পরিকল্পনা করছে ফারিশকে কোর্টে ওঠানোর আগে একবার দেখা করবে। আবার ভাবছে না থাক। আদ্রিতার আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। সে বুঝতে পারছে তার আগামী জীবন কাটবে একটা জেলে বসে থাকা আসামীর অপেক্ষা করতে করতে। অপেক্ষা বড় অদ্ভুত জিনিস। ধৈর্য্যশীল মানুষদের জন্য অপেক্ষা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু অধৈর্য্যশীল মানুষদের জন্য এই অপেক্ষা বড্ড ভয়ংকর জিনিস। দুনিয়াতে সব অপেক্ষার চেয়ে কঠিন অপেক্ষা হলো একটা জীবিত মানুষের ফিরে আসার অপেক্ষা। বড়ই ভয়ানক। আদ্রিতা তা দিনে দিনে উপলব্ধি করছে। চাঁদনীর গলা শোনা গেল। দরজার মুখে দাড়িয়ে বিষণ্ণ স্বরে বলল,
“আদু।”

আদ্রিতা শুনেও বোধহয় শুনলো না। চাঁদনী দ্বিতীয়বার ডাকতেই তার হুস আসল। ছলছল নয়নে পিছন চাইলো। চাঁদনীর বুকটা কেঁপে উঠল। প্রিয় বান্ধবীর এমন নিরাশময় চেহারা, এমন দুঃখকাতর জীবন মেনে নিতে পারছে না। মনে মনে খুব করে চাইছে আজ কোনোভাবে যদি ফারিশ ভাইয়ের মুক্তি হতো তবে বেশ হত। চাঁদনী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কারণ সে জানে এমনটা হওয়ার নয়। চাঁদনী আদ্রিতার দিকে একটু এগিয়ে গেল। শান্ত স্বরে বলল,“যাবি না?”

আদ্রিতা বিষণ্ণ মনে এগিয়ে আসে তখন। মলিন কণ্ঠে শুধায়,“যাবো।”

আদ্রিতাকে নিয়েই নামলো চাঁদনী। আদিব বাড়ির রাস্তার ধারে গাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর। তবে আদিব জানে এ চেষ্টায় প্রতিবারের মতোই ব্যর্থ হবে৷ আদিবের মনে আছে একবার ছোট বেলায় দৌড়াতে গিয়ে আদিব পড়ে গিয়ে হাঁটুতে ব্যাথা পায়। ব্যাথা পেয়ে আদিবের সে কি কান্না। ফারিশ ছুটে এসে তাকে ধরার বদলে পাশে বসে। হাসতে হাসতে বলে,
“তুমি এত কাঁদতে পারো আদিব, তোমার কান্না দেখলে আমার হাসি পায়।”

আদিব আচমকা হেঁসে ফেলে। ফারিশ ভাইয়ের হাসিটা কতই না মোহনীয় ছিল। আদিব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুকটা ধরে আসছে। শুধু মাথায় ঘুরছে,
কোথায় গেল সেই সোনালী সময়গুলো। আদিবের চোখের কোনে পানি জমে। চোখের পানিটুকু হাত দিয়ে দ্রুত মুছে নিল আদিব। চাঁদনী কাঁধে হাত রাখে তখন। আদিব চমকে তাকায়। বলে,
“ডাক্তার ভাবিকে এনেছো চাঁদ?”

চাঁদনী মলিন মুখে বলে,
“এনেছি।”

আদিব মুখ লুকিয়ে গাড়ির ভিতর ঢুকতে নেয়। চাঁদনী ধরে। শীতল স্বরে বলে,
“কান্না পেলে কান্না লুকাতে নেই। তুমি কাঁদো। বেশি কষ্ট হলে আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদো। তবুও কাঁদো।”

আদিব করুন চোখে তাকায়। হঠাৎ কেমন হয়ে যায়। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চাঁদনীকে। বলে,“আমার বুক ফেটে যাচ্ছে চাঁদ, আজ ফারিশ ভাইয়ের কিছু হয়ে গেলে কি করবো আমি?”

আদিবের পিঠে হাত বুলায় চাঁদনী। ধাতস্ত কণ্ঠে বুঝায়,“ভয় পেও না কিছু হবে না।”

আদিব কথা শোনে। বুঝে। ভয় না পাওয়ার চেষ্টা চালায়। তবুও তার ভয়টা কমে না।’


আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ফারিশ। মলিন মুখ। পরনে সেই ধূসররঙা শার্ট। কালো প্যান্ট। চুলগুলো এলোমেলো। মুখের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি খানিক বেড়েছে। চোখে মুখে মলিনতার ছড়াছড়ি। তাকে ঘিরে সামনের বেঞ্চগুলোতে বসে আছে কতশত মুখ। এদের মধ্যে সবচেয়ে করুন মুখে বসে আছে আদ্রিতা। কতদিন পর আদ্রিতাকে দেখলো ফারিশ। আদ্রিতার চেহারার দিকে তাকালেই ফারিশের হৃৎপিণ্ড থমকে যাচ্ছে। বার বার মন কইছে,’মেয়েটা এলো কেন? না আসলেই হতো না।’ অাদ্রিতার বন্ধুমহলের সবাই এসেছে। আদ্রিতার বাবা, মা আর ভাইও আছে। পুলিশ বেসে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর, নয়নতারা সহ আরো কিছু পুলিশ। এদের মধ্যে এক পশলা ঝুম বর্ষার রাতে ফারিশকে ধাওয়া করা সেই পাঁচ জন পুরুষ আর একজন মহিলাও আছে। তারা বুঝতে পেরেছে সেইদিন ড. আদ্রিতা তাদের মিথ্যে বলেছিল। কোর্টে তিশাও এসেছে আজ। তার বড্ড খারাপ লাগছে। ফারিশ পুরো জায়গায় চোখ বুলিয়ে বুঝলো,এত মানুষের মাঝেও একটা মানুষ মিসিং আর সেই মিসিং মানুষটা হলো আদিব। ফারিশ জানে আদিব এসেছে শুধু তার সামনে আসতে পারছে না। ফারিশ চায়ও না আদিব আসুক।’


সময় গেল। পরিবেশ হলো থমথমে। জজ সাহেব ভিতরে ঢুকেছেন মিনিট পাঁচেক হবে। আদালতে উপস্থিত এক উকিল ফারিশ রিলেটেড সমস্ত ঘটনা উল্লেখ করলেন। তার সঙ্গে বললেন ফারিশের যেন কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি হয়। ফারিশের পক্ষে কেউ ছিল না। যার দরুন এক পাক্ষিক সব হলো। জজ সাহেব পুরো ঘটনা শুনে কিছু সময় চুপ থাকলেন। ফারিশকে জিজ্ঞেস করলেন,“আপনার কিছু বলার আছে ফারিশ মাহমুদ?”

ফারিশ এতক্ষণ মাথা নুইয়ে চুপটি করে উকিলের কথা শুনছিল মন দিয়ে। এতক্ষণ পর তাকে কিছু বলতে বলায় সে সরাসরি চাইলো জজ সাহেবের দিকে। শান্ত গলায় বলল,“জজ সাহেব আমি যদি শুরু থেকেই সবটা শুরু করি। তবে কি সেটা অন্যায় হবে?’উকিল সাহেব অনেক কিছু বললেন, আমি খারাপ, আমি মাফিয়া, আমি মানুষের ক্ষতি করেছি, দেশের ক্ষতি করেছি। কিন্তু উনি তো একবারও আমায় এটা প্রশ্ন করলেন না আমি এমন কেন করেছি। কিভাবে ঢুকে গেলাম এমন বেআইনি কার্যক্রমে। মানুষ কি জন্মের পরই পাপী হয় জজ সাহেব? আমাকে একটু সময় দিলে আমি কিছু বলতে চাই।”

জজ সাহেব সুযোগ দিলেন। দিলেন সময়। শুকনো কণ্ঠে জানালেন,“ঠিক আছে বলুন?”

ফারিশ এক ঝলক আদ্রিতার দিকে তাকালো। আদ্রিতার দৃষ্টিও তার দিকে। ফারিশ অপরাধীর ন্যায় চোখ নামিয়ে নিল। জজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল,
“আমি ফারিশ। আমার নামটা রেখেছিলেন রংপুরের একজন ইমাম সাহেব। বেশির ভাগ সন্তানদেরই নাম রাখে তাদের বাবা মা। কিন্তু আমার বেলায়। এখানে উপস্থিত অনেকেই হয়তো জানে তাদের বাবা মা কে? কিন্তু আমার কে মা, আমার কে বাবা এটাই আমি জানি না। রংপুরের ইমাম সাহেব বলেছিলেন কেউ একজন আমাকে রংপুরের এক মসজিদ রেখে যান। তারপর থেকেই তিনি পালেন। নাম দেন। জীবন যখন আমার পাঁচ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে। তখন এই ঘটনা আমি জানি। বলুন না জজ সাহেব আমার কি দোষ ছিল আমার জন্মদাতাদের আমি কি বলেছিলাম আমায় জন্ম দিয়ে মসজিদে ফেলে যেতে। তারা জীবনে ভুল করেছে আর আমায় দিয়েছে সাজা। এমন শতশত ছেলেমেয়ে আছে যারা রাস্তার এ কোনায় ও কোনায় পড়ে থাকে। আমিও তেমনই রাস্তার ছেলে ছিলাম। আমাকে পাঁচ বছর বয়সে ইমাম সাহেব ঢাকা নিয়ে আসেন। এখনকার এক এতিমখানায় রেখে যান। সেখানে আমি দু’বছর ছিলাম। তারপর আমাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। জীবন যে কি কঠিন জজ সাহেব তা আমি উপলব্ধি করেছি সেই সব দিনগুলোতে যে দিনগুলোতে আমার পাশে কেউ ছিল না, রোদ্দুরে পুড়েছি, পথে পথে ঘুরেছি, কেউ দু’পয়সার খাবার কিনে দেয় নি। ক্ষুধার জ্বালা কি যে ভয়ংকর জ্বালা তা যদি আপনায় বোঝানো যেত। তারওপর এরওর অহেতুক মার। তবুও জীবন চলছিল। হঠাৎ জীবনে মোড় আসে,

দিনটি ছিল বর্ষাকালের। মাঝরাত। বাহিরে তুমুল বেগের বর্জপাত আর বৃষ্টি হচ্ছিল। মাথায় টিন চাপিয়ে রাস্তার এক কিনারায় বসেছিলাম আমি। তখন আমার বয়স হয়তো দশ। সে রাতের বর্জপাত আর টিনের ঝাঁকড়ানির শব্দে আমি ভয়ে স্তব্ধ। পুরো রাস্তা নির্জন। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। ল্যাম্পপোস্টও জ্বলছে নিভছে। আমি ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে বসে। তখনই কোথা থেকে যেন একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় ছুঁটে আসে আমার কাছে। পায়ে আঘাত থাকায় সে লুটিয়ে পড়ে আমারই সামনে। আমি ভয়ার্ত হয়ে লোকটার কাছে যাই। লোকটা আর্তনাদ ভরা কণ্ঠে বলে,“আমাকে বাঁচাও তুমি, নয়তো ওরা আমায় মেরে ফেলবে।”

কথা শুনে আমি সামনে তাকাতেই দেখি দুজন লোক এগিয়ে আসে। গুলির শব্দ হয়। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়া লোকটাকে অনবরত গুলি মারে আমারই চোখের সামনে। লোকটি তখন বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারে না মারা যায়। আমি গুলির শব্দের ভয়ে কুঁকড়ে যায়ই রুহু সমেত কাঁপে। তখনই একটা ছেলে আমায় দেখে বলে,“আমি দেখে ফেলেছি আমাকেও মেরে ফেলবে।”

সেইসময় আমি ছোট থাকলেও আমার বাঁচার ইচ্ছে ছিল প্রবল। ভয়ার্ত আমি আতঙ্কিত হয়ে ঘটিয়ে ফেলি আরেক ঘটনা। নিচে পড়ে থাকা একটা পিস্তল উঠিয়ে তাদের মেরে দেই। এটাই ছিল আমার প্রথম খুন।

আদালতের উপস্থিত সবাই থমকে গেল ফারিশের কথা শুনে। জজ সাহেব বলে উঠল,“তুমি মেরে দিলে? কিন্তু এমন ঘটনা তো আমার নজরে আসে নি।”

ফারিশ মৃদু হেসে বলে,“এই দুনিয়া ছলনাময়ীদের দখলে জজ সাহেব, আপনি ঠিক ততটুকুই দেখবেন যতটুকু তারা আপনায় দেখাবে। সে রাতে আমার এই ঘটনা একজন দেখেছিল। ওনার নাম মোসাদ্দেক হোসেন। উনিই ঘটনা লুকায়। কেউ জানলোই না হঠাৎ এক রাতে এক শিশুর সাথে কি ঘটে ছিল! আমার যে ব্যবসা, যে বেআইনি কারবার সব ওনার। আমাকে এই লাইনেও উনিই এনেছিলেন। আমি ছোট ছিলাম ভালো মন্দ কিছু বুঝতাম না। উনি আমায় পড়াশোনা শেখায়, ঋণী করেন। বড় করেন। বানায় মাফিয়া। আফিম ব্যবসায়ী। অস্ত্র পাচারকারী। ব্যাস সেই থেকেই আমি মাফিয়া। দেশ বিরোধী মাফিয়া।”

জীবনে আমি কখনো উপলব্ধি করি নি আমি ভুল করছি। অন্যায় করছি। কারণ আমার নেশা ছিল একটাই টাকা,টাকা, শুধুই টাকা। মোসাদ্দেক হোসেন মারা গিয়েছিলেন প্রায় চারবছর আগে তারপর থেকেই এই ব্যবসা আমি নিজেই চালাই। ছাড়ার কথা মাথাতেই আসে নি। সব ঠিকই ছিল। কিন্তু হঠাৎ এক পশলা ঝুম বর্ষায় আমার জীবনে আগমন ঘটে এক রমণীর। তার ভালোবাসায় স্নিগ্ধ হয়েই নিজের পাপ ধৌত করতে এসেছি জজ সাহেব। আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। পাপ করেছি। কিন্তু আমি ইচ্ছে করে এসব করি নি। আমার জীবনই আমায় এখানে নিয়ে এসেছে। আমায় যা শাস্তি দিবেন আমি মাথা পেতে নেব। শুধু আমার অনুরোধ আমাকে বেঁচে থাকার অনুমতিটুকু দেয়া হোক। আমি বাঁচতে চাই জজ সাহেব। পাপ ধুঁইয়ে নতুন করে বাঁচতে চাই। প্রথমবার বাঁচার জন্য আমি অস্ত্র হাতে খুন করেছিলাম আর শেষবারের বাঁচার জন্য আমি কাঠগড়ায় এসেছি। আমি শুধু বাঁচতে চাই জজ সাহেব। এবার বাকিটুকু আপনি যা করেন। আমি তাই মাথা পেতে নেব।’

দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করে ফারিশ দম ফেললো। পুরো বিচারসভা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই চুপচাপ। এবার আর কেউ ফারিশের ফাঁসি চায় না। শাস্তি দেয়া হোক কিন্তু ছেলেটাকে বাঁচিয়ে রেখে শাস্তি।’

সবাই জজ সাহেবের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি কিছু সময় চুপ থেকে বললেন,“এই মামলার রায় বুধবার বারো ঘটিকায় জানাবো হবে।”

বিচারকের কথা শুনে ফারিশ পুনরায় তাকায় আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার মলিন মুখ। চোখ ছুঁইয়ে পানি। ফারিশের বুকটা কেঁপে ওঠে। সে শীতল কণ্ঠে ধীরস্বরে আওড়ায়,
“তুমি এভাবে কেঁদো না গো বেলীপ্রিয়া, তোমার কান্নায় যে আমার নিশ্বাস আঁটকে আসে।”

#চলবে…

#TanjiL_Mim♥️.

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৫০+৫১

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫০

হাত খসে নিচে পড়লো চিঠি। আদ্রিতা স্তব্ধ বনে খাটে বসে পড়লো। আদিব মাথা নুইয়ে দরজার কর্নারে দাঁড়িয়ে। চাঁদনীও নেই যে আদ্রিতাকে বোঝাবে। সামলাবে। আদ্রিতার হঠাৎ বুকে ব্যাথা উঠলো। চোখের পাপড়ি ভিজে আসলো আপনাআপনি। পেটে হাত রাখলো নীরবে। আদ্রিতার এত কষ্ট হচ্ছে, পাষাণ লোকটা এভাবে ব্যাথা দিয়ে চলে গেল। আদ্রিতা বিড়বিড় করে বলল,“চলেই যখন যাবে তখন এসেছিলে কেন? সেই এক পশলা ঝুম বর্ষায় এলাহী কান্ড ঘটিয়ে আমার হৃদয় নাড়িয়ে ছিল কেন? আমাদের গন্তব্য কি এতটুকুই ছিল বখাটে সাহেব? আমি তো তোমায় নিয়ে শেষ পর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছিলাম। একটু পারলে না আমার মতো স্বার্থপর হতে। এখন এই ভাঙামন নিয়ে আমি কিভাবে চলবো ফারিশ। আমাদের সন্তান তাকেই বা কি জবাব দিবো? তুমি এমনটা কেন করলে? একেবারেই কি না করলে হতো না?”

আদ্রিতা ভেঙে পড়েছে। তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চারপাশ বুঝি ফারিশের শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। আদ্রিতা নিজের মাথা চেপে ধরলো। আদিব এগিয়ে আসলো তখন। তারও তো কষ্ট হচ্ছে। ফারিশ ভাই খুব বাজে কাজ করেছে। এটা না করলে কি সত্যিই হতো না। আদিব আদ্রিতার পাশে এসে বসলো। আদুরে গলায় বলল,“ডাক্তার ভাবি।”

আদ্রিতা অশ্রুমাখা চোখ নিয়ে তাকালো আদিবের দিকে। শান্ত গলায় বলল,“কাজটা কি ঠিক করলো আদিব ভাইয়া?”

আদিব সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিতে পারে না। চুপ থাকে। কিছু সময় যায়। আদিব কথা সাজায়। এরপর নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,“প্রথম প্রথম আমারও মনে হয়েছিল ভাই কাজটা ঠিক করে নি ডাক্তার ভাবি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বোধহয় দরকার ছিল। ফারিশ ভাই নিতে পারছিল না ব্যাপারটা। তার কষ্ট হচ্ছিল। আঘাত লাগছিল। আমি আঁচ করতে পারছি ভাই কতটা যন্ত্রণা নিয়ে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। তুমি চিন্তা করো না ভাবি। ভাই আমায় বলেছে, চার-পাঁচ বছর পর ভাই ফিরে আসবে। তারপর আমরা নতুন করে বাঁচবো। জানো তো ভাই আমায় কখনো মিথ্যে বলে না। ভাই তোমায় চিঠিতে বলেছে না এসব?”

আদ্রিতা মাথা নাড়ায়। যার অর্থ,’বলেছে।’
আদিব খুশি হলো। বলল,“পাঁচবছর খুব বেশি সময় না ভাবি। দেখবে দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ভাই আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে। বলেছে, ভাই যতদিন না ফিরে আসে ততদিন আমি তোমার খেয়াল রাখি। তুমি কোনো চিন্তা করো না ভাবি আমি আছি তো। আর চাঁদনীও তো আছে। ভাই ফিরে আসবে ভাবি, দেখে নিও ভাই তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।”

বলতে বলতে গলা ধরে আসছে আদিবের। নিজেকে শক্ত রাখা যাচ্ছে না। পাঁচবছর সত্যি কি খুব কম সময়? আদিব নিজের চোখ মুছতে মুছতে আবার বলল,“তুমি কষ্ট পেও না ভাবি। দেখো না আমিও কষ্ট পাচ্ছি না।”

আদ্রিতা বিস্মিত নজরে তাকিয়ে থাকে আদিবের দিকে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে আদিব কাঁদছে, কষ্ট পাচ্ছে তবুও মুখে বলছে কষ্ট পাচ্ছে না। কি অদ্ভুত!’

দুজনের মাঝে নীরবতা চলল অনেকক্ষণ। সন্ধ্যা নেমে আসছে ধরণীতে। দূর থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ ভেসে আসছে। আজান দিচ্ছেন তিনি। আদ্রিতা নিজেকে শক্ত করল। চোখ মুছে বলল,“আমায় জেলখানায় নিয়ে চলো আদিব ভাইয়া আমি ওনার সাথে দেখা করতে চাই।”

আদিব কিছু সময় চুপ থেকে বলে,“ওনারা কি দেখা করতে দিবে?”

আদ্রিতা দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে,“তুমি নামাজ পড়ে আসো ভাইয়া। তারপর আমরা পুলিশ স্টেশন যাবো।”

কথাটা বলেই ওয়াশরুমে ঢুকলো আদ্রিতা। ওজু করতে হবে। আদিব উঠে দাঁড়ালো। নিচে উল্টে পড়ে থাকা ফারিশের চিঠিটা উঠালো। তবে পড়লো না। কারণ ফারিশকে যখন কিশোর হাতে হ্যানকাপ পড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন আদিব ছিল ঠায় দাঁড়িয়ে। বুক জুড়ে চলছিল কি বিষাদ! ঠিক সেই সময় ফারিশ আদিবের হাতে এই চিঠিটা ধরিয়ে দেয়। আদেশস্বরূপ বলে,“এটা আদ্রিকে দিও। আর শোনো, তুমি এই চিঠি খুলবে না আদিব। এটা একান্তই আমার বউয়ের জন্য লেখা। তুমি ভুলেও খুলবে না। পড়বে না।”

আদিব সেই কথা রেখেছে সে চিঠি খোলেও নি,পড়েও নি। কারণ আদিব কখনো ভাইয়ের হুকুমের অবাধ্য হয় না। আজও হয় নি। আদিব টেবিলের উপর চিঠিটা রেখেই রুম থেকে বের হলো। নিজ রুমে গিয়ে নামাজের টুপিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।’


তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। আদ্রিতা আর আদিব দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ স্টেশনের বাহিরে। আদিব ভিতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে পায় না। কারণ ফারিশ ভাই তাকে বারন করেছে পুলিশ স্টেশন আসতে। আদ্রিতা বোধহয় ব্যাপারটা বুঝলো। সে বলল,“তুমি দাঁড়াও ভাইয়া আমি একাই যাচ্ছি।”

কথাটা বলে আদ্রিতা একাই চলে গেল। আদিব দাড়িয়ে রইলো। ভিতরে ঢোকার সাহস এলো না।’

আদ্রিতা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। তার ভিতরটা কেমন কেমন করছে। আদ্রিতা আশপাশ দেখলো। তাকে প্রথমেই নজরে পড়লো কিশোরের। সে মিষ্টি হেঁসে বলল,“আসুন ডাক্তার সাহেবা। আমি জানতাম আপনি আসবেন।”

আদ্রিতা নীরবে এগিয়ে গেল। শান্ত স্বরে বলল,“আমি একটু ফারিশের সাথে দেখা করতে চাই অফিসার।”

কিশোর নাকচ করলো প্রথমে। বলল,“আমরা তো এভাবে দেখা করতে দিতে পারি না ডাক্তার সাহেবা।”

আদ্রিতা মিনতির স্বরে বলল,“একটু দেখি।”
কিশোর বুঝলো। বলল,“ঠিক আছে। তবে একটুই যেন দেখেন।”

আদ্রিতা আর কথা বাড়ালো না। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল লকাপের দিকে।’

গায়ে ধূসর রঙের শার্ট। কালো প্যান্ট। অগোছালো চুল। আর শ্যামবর্ণের মুখখানা নিয়ে মাথা নুইয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে ফারিশ। আদ্রিতার বুক কেঁপে উঠলো এমন দৃশ্য দেখে। বুকখানায় এত কষ্ট হচ্ছে তখন। আদ্রিতা নিজের চোখ মুছে ডাকলো,“মিস্টার বখাটে।”

তড়িৎ চমকে উঠলো ফারিশ। চোখ তুলে চাইলো তক্ষৎণাৎ। আদ্রিতার মুখটা দেখলো। কেমন থমথমে হয়ে আছে। ফারিশের হৃদয়খানায় বুঝি হাহাকার করে উঠলো। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একটু একটু করে এগিয়ে আসলো। প্রশ্ন করলো,“তুমি কেন এসেছো বেলীপ্রিয়া?”

আদ্রিতা মলিন মুখে চায়। বলে,
“এমনটা করা কি খুব দরকার ছিল ফারিশ?”

ফারিশ তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলে,
“বোধহয় ছিল।”
“আমি যে ভালো নেই তুমি কি দেখতে পাচ্ছো?”
“পাচ্ছি।”
“আমি যে তুমিহীনা ভালো থাকবো না এটা জানতে না?”
“জানতাম।”
“তবুও কেন করলে?”
“আমি যে বাধ্য ছিলাম। তুমি তো জানো।”
“একটু কি স্বার্থপর হওয়া যেত না?”
“বোধহয় যেত কিন্তু সস্থি পাচ্ছিলাম না।”
“আমার ভালোবাসা তোমায় সস্থি দিত না ফারিশ?”

ফারিশ কথা বলে না। চুপ করে রয়। মাথা নুইয়ে ফেলে। আদ্রিতা আবার বলে,“আমায় ছেড়ে যাওয়ার এত তাড়া তোমার।”

ফারিশ চোখ তুলে তাকায়। বিষণ্ণ কণ্ঠে জানায়,
“আমার কষ্ট হয় বেলীপ্রিয়া।”

মলিন মুখে হাসলো আদ্রিতা। কি বলবে ভেবে পায় না আর। ফারিশ মাথা নুইয়ে বলে,“চলে যাও।”

আদ্রিতা লকাপের শিকে হাত রাখে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধায়,“এতটা পাষাণ কিভাবে হলে?”

ফারিশ ছলছল নয়নে তাকায়। আদ্রিতার হাতটা ধরে। আদ্রিতার শরীর ফারিশের স্পর্শে আরো কাতরে উঠল তখন। ফারিশ বলল,“আমায় ভুল বুঝছো বেলীপ্রিয়া?”

আদ্রিতা জবাব দিতে চায় না। ফারিশ মৃদু হেসে বলে,“সত্যি করে বলো তুমি কি এমনটা চাওনি আদ্রি?”

আদ্রিতা চোখ তুলে সরাসরি তাকায়। এবারও কিছু বলে না। ফারিশ হেঁসে বলে,“বাড়ি যাও বেলীপ্রিয়া। এখানে আর এসো না।”

আদ্রিতা গেল না। ঠায় দাড়িয়ে রইলো। তবে কোনো কথাও বললো না। চুপচাপ পাথর মনে দাঁড়িয়ে থাকলো। ফারিশ বলে,“আমার ভাইটার যত্ন নিও আদ্রি, ও খুব ভীতু। জানোই তো। আমার শাস্তির কথা ওকে এখনই জানিও না। আমার কেসটা যেদিন কোটে উঠবে ওইদিন তুমি বা আদিব কেউই এখানে থেকো না। দূরে কোথাও চলে যেও কেমন।”

এই বলে আদ্রিতার দু’গাল চেপে চোখের পানি মুছে দিল। এরপর খুশি মনে বলল,“এবার বাড়ি যাও। নিজের যত্ন নিও বেলীপ্রিয়া। আমি থাকি বা না থাকি নিজের যত্ন নিতে ভুলো না কিন্তু।”

আদ্রিতা আর সেখানে দাঁড়াতে পারছে না। বুকের ভেতর যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তা এত সহজে ঘুচবে না। আদ্রিতা বলল,
“আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।”

আঁতকে উঠল ফারিশ। ঠোঁটে হাত দিয়ে বলল,“হুস! এভাবে বলে না। আমি ফিরবো দেখো।”

আদ্রিতা আর কিছু বলতে পারলো না। একরাশ অভিমান। জড়তা, ভয় আর যন্ত্রণা নিয়ে ছুটে আসলো। ফারিশ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো।’


পরেরদিনটা যেন বিষণ্ণের সকাল। বাংলাদেশের সমস্ত টিভি চ্যানেলে ফারিশের কেচ্ছার কথা জানালো হলো। ঔষধ কোম্পানির আড়ালে ফারিশের এই বেআইনি কারবার। আফিমসহ সকল নেশালো দ্রব্য এবং দেশীয় অস্ত্রের সবটা টিভিতে দেখানো হল। একদল জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ফারিশের ঔষধ কোম্পানিতে ভাংচুর চালালো, কেউ কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিল। ফারিশের তৈরিকৃত সকল ঔষধ ব্যান করা হলো। যদিও তাতে কোনো ভেজাল ছিল না। তবুও!’

আদ্রিতার কলিগ,বাবা,মা, ভাই, আত্মীয়স্বজন সবাই হতভম্ব হয়ে গেল এমন নিউজে। একের পর এক কল আসছে আদ্রিতার বাবা,মা, ভাইর ফোনে। তারা ফোন তুলছে না। ফারিশের বাড়িতে ভাংচুর করা হলো। ভাগ্যিস তখন বাড়ির ভিতর আদিব আর আদ্রিতা ছিল না। খবর পেয়ে সূদুর চট্টগ্রাম থেকে ছুটে আসছে চাঁদনী। এই একদিনের ব্যবধানে কি ঘটে গেল সে বুঝতে পারছে না। ফারিশ ভাই মাফিয়া এই যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

বাকরুদ্ধ হয়ে গেল আদ্রিতার বন্ধুমহলের সকল সদস্য। মৃদুল,রনি,মুনমুন,আশরাফ ইতিমধ্যে বেরিয়ে পড়েছে আদ্রিতার খোঁজে। প্রাণ প্রিয় বান্ধবীটার কি অবস্থা হচ্ছে এটা তারা ধরতে পারছে না। আদিবকে কল করা হয়েছে। সে একটা এড্রেস দিয়েছে। সেই এড্রেসের উদ্দেশ্যেই রওয়ানা দিয়েছে সবাই। এই বিষয়টা সম্পর্কে আদিব ফারিশ ছাড়াও নয়নতারা জানতো। কিন্তু ফারিশ বারণ করায় কাউকে কিছু বলতে পারে নি সে। এজন্য খানিকটা ক্ষিপ্ত আশরাফ। চাপা উত্তেজনায় ভরপুর ঢাকার শহর। আজকের নিউজ চ্যানেলগুলোতে যেন ফারিশেরই উদ্ভাবন।’


বেলা এগারোটা। পুলিশ স্টেশনের বাহিরে এসে থামলো একটা রিকশা। সেখান থেকে নামলো একটি মেয়ে। পরনে সাদা রঙের থ্রি-পিস। সে ভিতরে এগিয়ে আসলো। কিশোরের মুখোমুখি দাড়িয়ে হাতে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি ফারিশ মাহমুদের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

#চলবে…

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫১

“আমাকে চিনতে পারছেন ফারিশ ভাইয়া?”
আচমকা এক মেইলি কণ্ঠ কানে আসতেই খানিক চমকে চাইলো ফারিশ। সাদা থ্রি-পিস পড়া এক মেয়ে দাঁড়িয়ে। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল মেয়েটির পানে। মেয়েটি ফারিশকে দেখেই মৃদু হাসলো। আবার জিজ্ঞেস করল,“আমাকে চিনতে পেরেছেন ভাইয়া?”

ফারিশ কতক্ষণ চেয়ে দেখলো মেয়েটিকে। অদ্ভুত ব্যাপার তার মেয়েটির কথা মনে পড়ছে না। ফারিশের স্মৃতি শক্তি খুব একটা দূর্বল নয় তবুও মেয়েটিকে তার মনে পড়ছে না। মেয়েটি ফারিশের দৃষ্টি ভঙ্গি বোধহয় বুঝতে পারলো। সে বলল,“আমি তিশা ভাইয়া। আপনার মনে আছে ওই এক বছর আগে মেয়ে পাচার কারির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।”

ফারিশের তড়িৎ মনে পড়ে গেল সবটা। এই মেয়েটা ল’য়ের স্টুডেন্ট ছিল। ফারিশ দারুণ অবাক হলো। সে ভাবতেও পারে নি। ওই মেয়েটা আসবে। ফারিশ বিস্মিত নজরে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“কেমন আছো তুমি?”

তিশা মিষ্টি স্বরে বলল,
“ভালো ভাইয়া। আপনি?”
“আমি তো এই আছি।”
“আপনি সত্যি মাফিয়া ভাইয়া?”

ফারিশ মাথা নাড়িয়ে বলে,
“দেখে মনে হয় না তাই না।”
“তেমনটাই।”
“আসলে কি বলো তো দুনিয়ার সব খারাপ মানুষই ভালো মানুষের মুখোশ নিয়ে ঘোরে।”
“আপনি খারাপ মানুষ নন।”

চমৎকার হাসলো ফারিশ। বলল,
“টিভিতে আমার অস্ত্র সস্ত্র, মাদকদ্রব্য দেখো নি?”

তিশা কথা বলে না। ফারিশ বলে,
“তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে এসেছো?”
“বিষয়টা মিথ্যে হলে আমি প্রাণপণ চেষ্টা করবো।”

ফারিশ বলে,
“আমি যে আত্মসমর্পণ করেছি শোনো নি?”
“শুনেছি। তবুও মিথ্যে বলে মনে হয়েছে। কারো কি ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়েছেন ভাইয়া।”

ফারিশ মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, ‘হয়েছে।’
তিশার ঠোঁটে হাসি রেখা দেখা যায়। সে আওয়াজ করে বলে,“সত্যি। নাম বলুন আমি সাক্ষর প্রমাণ সংগ্রহ করে আপনায় ছাড়াবো।”

ফারিশ আবার হাসে। মেয়েটার কথায় তার এত হাসি পাচ্ছে। ফারিশ বলে,“সে তো কোনো মানুষ নয় তিশা।”

তিশা অবাক হয়ে বলল,
“মানে?”
“আমি যে ভালোবাসায় ব্ল্যাকমেল বদ্ধ তিশা।”

তিশা ফারিশের কথার আগামাথা বুঝে না। তিশা বলে,“আমায় একটু বুঝিয়ে বলুন না।”

ফারিশ দ্বিধাহীন কিছু কিছু বললো। তিশা অবাক না হয়ে পারলো না। ভালোবাসার জন্য জেল খাটছে এসেছে ফারিশ। তিশা বলল,
“আমি আপনায় বের করবো ফারিশ ভাইয়া। আপনি কোনো টেনশন করবেন না পুরো কেস আমি ঘুরিয়ে দিব। আমি জানি এতে আমাকে অনেকগুলো মিথ্যে সাজাতে হবে তবুও আমি আপনায় বাঁচাবো।”

ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করলো তাতে। বলল,
“লোকে বলে খারাপ মানুষের সাথে মিশলে মানুষ খারাপ হয়ে যায়। তুমি তো আমার সাথে মেশো নি তবুও খারাপ কেন হচ্ছো?”
“আমি আপনায় বাঁচাতে চাই ভাইয়া। মাঝে মাঝে কিছু ভালোর জন্য আমাদের একটু আকটু খারাপ হতে হয়।”
“এতে আমার আত্নসমর্পণ করে লাভটা কি হলো?”
“বেআইনী কাজ থেকে তো মুক্তি পেলেন।”
“তোমার কি মনে হয় জেল থেকে বের হলেই আমি মুক্ত। শুনেছি আমার সাথে যারা কাজ করতো তাদের মধ্যে দুজন পালিয়েছে। তোমার কি মনে হয় তারা আজীবন পালিয়ে থাকবে আমায় খুন করতে আসবে না।”

তিশা কি বলবে বুঝতে পারছে না। ফারিশ বলে,
“একটা কথা বলি শোনো,আইনের পোশাক যেহেতু পড়েছো। সবসময় সত্যের হয়ে লড়বে। আর আমার সত্য হলো আমি পাপী। আমার মুক্তি নেই। কঠিন শাস্তিই আমার প্রাপ্য।”
“আমি আপনায় সাহায্য করতে চাই ভাইয়া?”
“করবে তো তবে এবার নয় পরের বার। পরেরবার ফারিশ ভুল করবে না।”

তিশা ছলছল নয়নে তাকিয়ে রয় ফারিশের দিকে। ফারিশ শান্ত গলায় বলে,“চলে যাও তিশা। আমার এই মুহূর্তে সাহায্যের প্রয়োজন নেই। পরেরবার লাগলে আমি নিজে তোমায় ডাকবো।”

তিশা মাথা নুইয়ে বলে,
“আপনার ওপর যে অভিযোগগুলো আছে তার শাস্তি অনেক কঠিন ভাইয়া। মৃত্যুদন্ড হওয়ার চান্স আশি পারসেন্ট। বাকি বিশ পারসেন্টের শাস্তিও সহজ নয়। কম করে হলেও পনের থেকে বিশ বছরে জেল।”

শাস্তির কথা শুনে ফারিশ হাসিমুখে বলে,
“যে শাস্তিই হোক আমি নিতে প্রস্তুত।”
“একটু কি মিথ্যের আশ্রয় নেয়া যায় না?”
“এতদিন যাবৎ তো ছিলাম মিথ্যের আড়ালে প্রথমবার সত্যের কাছে এলাম। কঠিন হলেও শান্তি পাচ্ছি। মিথ্যেতে শান্তি নেই আছে গুমোট অশান্তির নিঃশ্বাস।”

তিশা আর কিছু বলতে পারলো না। অতঃপর তাকে নিরাশ হয়েই ফিরতে হলো। ফারিশ কিছুতেই রাজি হলো না। তিশা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে পুলিশ স্টেশন থেকে বের হলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। মানুষটা বাজে কাজ করলেও মনটা ভালো ছিল। তিশার মন খারাপ হলো। মনে মনে ভাবলো,
“আমার কথাটা মানলে খুব বেশি কি ক্ষতি হতো ফারিশ ভাইয়া?”

প্রশ্ন আসলো। তবে উত্তর আসলো না। তিশা প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে চলে গেল।’


পুরনো বাংলো। এটা হলো সেই বাংলো যেখানে ফারিশ আর আদ্রিতা প্রায় আসতো। বাংলোর ওই সামনের উঠোনটায় গতবারের শীতের সেই সময়ে আগুন জ্বালিয়ে ফারিশ আদ্রিতার কত প্রেমআলাপ চলতো। আদ্রিতা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে সেই উঠোনটার দিকে। মন জুড়ে বিষাদ ঘুরছে। আদিবের আওয়াজ শোনা গেল তখন। সে বলছে,
“ডাক্তার ভাবি আসবো?”

আদ্রিতা পিছন ঘুরে চাইলো। আদিব খাবার নিয়ে এসেছে। আদ্রিতা কাল থেকে কিছু খায় নি। আদিব খাবার নিয়ে যেতে যেতে বলল,“খাবারটা খেয়ে নেও ভাবি।”

আদ্রিতা শান্ত ভঙ্গিতে বলে,“আমার খেতে ইচ্ছে করে না ভাইয়া।”

আদ্রিতার অসহায় কণ্ঠস্বর শুনে আদিবের কষ্ট লাগলো। খাবারটা বিছানায় রেখে বলল,
“এভাবে বলে না ভাবি শক্ত হও ভাই ফিরে আসবে দেখো। ভেঙে পড়লে কি চলবে বলো?”

আদ্রিতা হেঁটে আসতে নেয়। দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না। হঠাৎ আদ্রিতার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। সে পড়ে যেতে নিলো সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে বসলো আদিব। বলল,“সাবধানে ভাবি।”

আদ্রিতা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে চাইলো। পেট কামড়ে বমি আসলো তখন। আদ্রিতা দ্রুত ছুট লাগালো ওয়াশরুমে। আদিব চিন্তিত নজরে তার পানে তাকানো। কাল রাত থেকেই দেখছে আদ্রিতা ভাবি ঠিক নেই। ঘন ঘন বমি করছে। আদিব ওয়াশরুমের দিকে যেতে গিয়েও গেল না। খানিক সংকোচ লাগে। বাড়ির কলিংবেল বাজলো তখন। আদিব আদ্রিতাকে বলে চলে যায় নিচে। নিশ্চয়ই আদ্রিতার বন্ধুমহলেরা এসেছে।”

সোফায় গোল হয়ে বসে আছে আশরাফ, রনি,মুনমুন, মৃদুল আর আদিব। চাঁদনী এখনও চট্টগ্রাম থেকে পৌছায় নি। আদ্রিতা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সোফায় বসেছে মাত্র। মুনমুনই তাকে ধরে বসালো। সবাই ফ্যাল ফ্যাল নজরে তাকিয়ে আছে আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতা বেশ বিরক্ত নিয়ে বলল,
“তোরা এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আগে কখনো দেখিস নি আমায়।”

জবাব দিতে চায় না কেউই। কিছু সময় পর মৃদুল বলে,“তুই ঠিক আছিস তো আদু?”

আদ্রিতা স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে,
“হুম।”

মুনমুন বলছে,“এমন বমি কি তোর ঘনঘন হচ্ছে? চোখ মুখেরও তো বেহাল অবস্থা।”

আদ্রিতা কিছু বলার আগেই আদিব বলে উঠল,
“হুম। কাল থেকেই দেখছি।”

মৃদুল হেঁসে বললো,“দোস্ত আমরা কি মামা হমু?”
মৃদুলের আকস্মিক প্রশ্নে হতমত খেয়ে গেল সবাই। এমন একটা সময়ে এই কথাটা কি বলার মতো সময়। রনি বলল,“তুই আর মানুষ হলি না।”

মুনমুন চেয়ে চেয়ে দেখলো আদ্রিতাকে। মৃদুলের কথাটা একেবারেও ফেলে দেয়ার মতো নয়। আদ্রিতার চোখমুখ যেন সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আদিব বিস্মিত নজরে তাকিয়ে আছে আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতা কিছু বলছে না। মুনমুন বলল,“মৃদুলের ধারণা কি ঠিক আদু?”

আশরাফ বলল,“তুইও মৃদুলের মতো শুরু করলি।”
মুনমুন বলল,“আদ্রিতার মুখ থেকেই শুনি।”

সবাই আদ্রিতার দিকে তাকাল। মুনমুন ফের প্রশ্ন করে,“আদু মৃদুলের ধারণা কি সত্যি?”

আদ্রিতা এবার মাথা নাড়ালো। মলিন মুখে জানালো,“সত্যি।”

আদিব হতভম্ব হয়ে গেল আদ্রিতার উত্তর শুনে। বুকের ভেতর আচমকা মোচর দিয়ে উঠলো। এমন একটা সময়ে তার ভাই বাড়ি নেই। আদিবের ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। আদিব উঠে দাঁড়ালো। তার মনে হলো এই খবরটা ভাইকে দেয়া দরকার।

বিষয়টা খুশির হলেও আদ্রিতার বন্ধুমহলের কেউ খুশি হতে পারলো না। সবার চোখে মুখে বিষণ্ণ ভাব। এখন কি হবে? ফারিশের কথা চিন্তাও করতে পারছে না কেউ। তারা বুঝতেই পারে নি যাকে নিয়ে তারা পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ করতে গিয়েছিল সে আসলেই মাফিয়া ছিল। অথচ তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি কত ভিন্ন। আগামীতে কি হবে কেউ ধরতে পারছে না যেন। সবার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। কেমন হবে তাদের বান্ধুবীর ভবিষ্যতে?”

আদিব বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। নিজে ড্রাইভ করে ছুটছে। তার উদ্দেশ্য আদ্রিতার মা হওয়ার ব্যাপারটা ফারিশকে জানানো। তাকে বোঝানো সে যেটা করেছে সেটা ভুল করেছে। ঠিক করে নি। আদিবের মাথা কাজ করা হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে সে ভুলতে বসেছে ফারিশের বলে যাওয়া একটি কথা,“তুমি পুলিশ স্টেশন আসবে না আদিব।”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আপাতত কিছু বলার নেই শুধু বলবো একটু ধৈর্য্য ধরতে।]

#TanjiL_Mim♥️.গল্পের

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৪৮+৪৯

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৮

ফারিশ চুপ থাকে। পুরো কক্ষজুড়ে নীরবতা বয় বেশক্ষণ। দূর আকাশের থালা বেশের চাঁদটা তা দেখে বুঝি লাজুক হাসে। বেশক্ষণের নীরবতার দড়ি ছিন্ন করে অভিমানী স্বরে বলে আদ্রিতা,“আপনি আমায় এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারেন নি তাই না ফারিশ?”

ফারিশ খানিক বিস্মিত হয়। আদ্রিতাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরায়। চোখে চোখ রেখে শীতল স্বরে আওড়ায়,“এমন মিথ্যে কে বলল তোমায়?”

আদ্রিতা স্মিথ হাসে। চোখভরা অশ্রুগুলোর একফোঁটা গড়িয়ে পড়ে নিচে। ফারিশ অবাক হয়। আদ্রিতার দু’গাল চেপে অস্থির কণ্ঠে বলে,
“আশ্চর্য! তুমি কাঁদছো কেন?”
“আমার আচরণে আপনি দুঃখ পান এককথা আমায় বললেন না কেন?”

ফারিশের আর বুঝতে বাকি রইলো না আদ্রিতার দুঃখ পাওয়ার কারণ। এই আদিবটা না আর বড় হলো না। সেই বলেই দিল। ফারিশেরই ভুল হয়েছে কথাগুলো বলার পর কড়া করে বলা উচিত ছিল,“শোনো আদিব, এইকথাগুলো ভুল করেও তোমার ডাক্তার ভাবিকে বলবে না।”

ফারিশ নিরাশ শ্বাস ফেললো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো আদ্রিতাকে। শক্ত করে। আদ্রিতা অনুভব করলো না তা। নীরবে চোখ বুঝিয়ে নিল। এই লোকটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলে আদ্রিতার এত ভালো লাগে। সস্থি লাগে। প্রশান্তিকর অনুভূতি হয় তা বুঝানোর মতো নয়। ফারিশ বলতে শুরু করে,“আমি তোমায় অবিশ্বাস করি না,তোমায় অবিশ্বাস করা কি আমার সাজে বলে। আমার খালি ভয় লাগে। এই না তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাও। আমার মাফিয়া পেশাটা তুমি কিভাবে নিচ্ছো আমি বুঝতে পারছি না।”

এবার আদ্রিতা বলে,“আমার আপনার মাফিয়া পেশা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই ফারিশ। আমি আপনায় ভালোবাসি। গোটা আপনিটাকেই ভালোবাসি। আমি জানি আপনার মানুষরূপের দুটি সত্তা আছে যার একটিতে আছে নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড। আপনি চাইলেও এই কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে আসতে পারবেন না। আমি এটাও জানি। তাই আমি চাই না আপনি ফিরে আসুন। পিছে কোনো বিপদ ঘটলে তখন। আমি শুধু চাই আপনি আমার হয়ে থাকুন। এতবছর যেভাবে সবার থেকে বিষয়টা লুকিয়ে রেখেছেন বিশেষ করে কিশোরের থেকে সেভাবেই লুকিয়ে থাকুন। আমি জানি এই কথাগুলোয় স্বার্থপরতা লুকিয়ে আছে। তবুও আপনার জন্য আমি স্বার্থপর হতে রাজি ফারিশ। দয়া করে এই বিষয়টা নিয়ে আপনি আর কষ্ট পাবেন না।”

ফারিশ চুপ করে থাকে। অতঃপর প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করে,“এগুলো তুমি সাজিয়েছো?”

আদ্রিতা ফারিশের বাম দিকের বুকের অংশে নাক ঘষে ‘না’ বুঝায়। জানায়,
“আদিব ভাইয়া করেছে?”
“আর বিলীন হওয়ার কথাটাও বুঝি আদিব শিখিয়ে দিয়েছে?”

দুষ্টু হেসে বলে ফারিশ। আদ্রিতা লজ্জা পায়। ফারিশের থেকে নিজেকে দূরে সরায় তক্ষৎণাৎ। লাজুক স্বরে বলে,“আপনি একটা অসভ্য লোক। এই কথা আদিব ভাই ক্যামনে বলে দিবে। সে কি আপনার মতো বেহায়া। অবশ্য তার বউয়ের সাথে হতে পারে আমার সাথে ক্যামনে হবে।”

শেষ কথাটায় আদ্রিতা মুখ ভাড় করে ফেলে। ফারিশ দেখতে পেয়ে হাসে। নিদারুণ দেখায় হাসি। কপাল কুঁচকে চোখ দুটো ডেবে যায় সেই হাসিতে। ফর্সা দাঁত বের হয় খানিকটা। আদ্রিতা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখে সেই হাসি। ফারিশ তাকায় আদ্রিতার দিকে। জর্জেট শাড়িটাতে যেন বেশ মানিয়েছে আদ্রিতাকে। শাড়ির ভাঁজে আদ্রিতার ফর্সা পেটটা খানিকটা দৃশ্যমান। এতক্ষণ লক্ষ্য করে নি ফারিশ। আচমকা কেমন নেশাগ্রস্ত লাগলো নিজেকে। ফারিশ এগোলো একটু। আদ্রিতার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে আনলো। আদ্রিতা থমকালো। ফারিশকে লক্ষ্য করলো। ফারিশের চাহনি নেশালো। ফারিশ আদ্রিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে নেশাভরা কণ্ঠে বলে,“এমন বেসামাল শাড়ি পড়েছো কেন,আমি কিন্তু বদ্ধ উম্মাদনায় ভুগছি।”

আদ্রিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। সরে আসবে। হঠাৎ ফারিশ এক আকস্মিক কান্ড ঘটালো। সে চুমু কাটলো আদ্রিতার ঘাড়ে। আদ্রিতা কেঁপে উঠল এতে। সর্বাঙ্গ বুঝি শিহরিত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। ফারিশ কোলে তুলে নিলো আদ্রিতাকে। দুষ্টুস্বরে বলল,“আজ এই মাফিয়া সাহেবের থেকে আপনায় কেউ বাঁচাতে পারবে না ডাক্তার ম্যাডাম।”

আদ্রিতা সে কথার জবাব দিল না। লজ্জায় মুখ লুকালো ফারিশের বুকে। ফারিশ আদ্রিতাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে মৃদু হাসলো। খাটের পাশের টেবিলটায় সাজিয়ে রাখা শুভ্ররঙের মোমটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। এরপরই নিজের হাত দু’খানা ডুবিয়ে দিল আদ্রিতার দু’হাতে। ধীরে ধীরে বিলীন হলো একে অপরের।’

হঠাৎ আকাশ কেঁপে উঠলো। ঝিরিঝিরি শব্দে শুরু হলো বৃষ্টিপাত। তীব্রতার বেশ নিল মুহুর্তেই। আকাশের সুন্দর চাঁদটাকে তখনও দেখা যায়। জ্বলজ্বল করছিল খুব। বোধহয় বলছিল একেই বলে সঠিক সময়ের ‘মধুময় প্রেমবর্ষণ।’


সময়! সময় বড়ই অদ্ভুত একটা জিনিস। এই সময় মানুষের জীবনটা হঠাৎ হঠাৎ বদলে দেয়। হঠাৎ দুঃখ বয়ে আনে,আবার দুঃখ হাটিয়ে সুখ দেয়। কারো জীবনে নতুন মানুষের আগমন ঘটায়। কাউকে দেয় বিষাক্ত বিচ্ছেদের বিষাদ। সময়ে সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ বদলায়,প্রকৃতি বদলায়,বদলে যায় দিন,ক্ষণ, তারিখ! তেমনই বদলে গেছে আদ্রিতা ফারিশের জীবন। বদলেছে আদিব চাঁদনীর জীবন। বদলেছে মৃদুল মিথিলার জীবন। বিয়ে করেছে মুনমুন আর রনি। সবশেষে বিয়ের কথাবার্তা চলছে নয়নতারা আর আশরাফের। দেখতে দেখতে ফারিশ আদ্রিতার সংসার জীবনের কেটে গেল একটি বছর। যাকে দিনে হিসেব করলে হয় তিনশো পঁয়ষট্টি দিন। কেমনে যে চলে কেউ ধরতেই পারলো না।’

আজ রবিবার। মাস জানুয়ারির মাঝপথ। খানিক শীত খানিকটা গরমের হাবভাব। এবছরটায় খুব একটা শীত পড়ে নি। আদ্রিতা খুব সকাল সকাল বের হচ্ছে হসপিটাল। পরপর কয়েকটা সার্জারীর অপারেশন আছে তার। পুরো দিনটাই ব্যস্ত আজ। ফারিশ বিছানায় শুয়ে। বেঘোর ঘুমে মগ্ন। গায়ে জড়ানো মোটা কম্বল। আদ্রিতা পরিপাটি পোশাক পড়ে বিছানার দিকে তাকালো। ঘড়িতে সকাল ন’টার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। আদ্রিতা ফারিশ দিকে তাকিয়ে বলল,“বখাটে সাহেব শুনতে পাচ্ছেন, আমি কিন্তু যাচ্ছি।”

ফারিশ নড়লো না একচুলও। আদ্রিতা দ্রুত সামনের জানালাটার সাদা পর্দা সরালো। সঙ্গে সঙ্গে এক ফালি রোদ্দুর চোখের উপর পড়লো ফারিশের। ফারিশ খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো এতে। মিহি কণ্ঠে বলল,“উফ! বেলীপ্রিয়া কি হচ্ছে? আমি ঘুমাই না।”

আদ্রিতা মিষ্টি হেঁসে ফারিশ মুখের সামনে দাঁড়ালো। এতে ছায়া পড়লো ফারিশের চোখে। আদ্রিতা বলল,“ওঠো না কেন? আমি যাবো এখন।”

ফারিশ চোখ খুলে তাকায় সঙ্গে সঙ্গে। বিস্ময়কর চাহনী নিয়ে বলে,“যাবো মানে? কোথায় যাবে তুমি?”

আদ্রিতা বিছানায় বসলো। ফারিশও উঠে বসলো তখন। শরীর জুড়ে ক্লান্তি তার। আদ্রিতা বলে,“তোমায় কাল বললাম না আজ আমার পরপর কয়েকটা অপারেশন করাতে হবে। তাই যাচ্ছি। বেলা গড়িয়ে ফিরবো। তুমি চিন্তা করো না কেমন।”

কথাটা বলে ফারিশের গালে চুমু কাটে আদ্রিতা। এরপর নিজের গালটাও এগিয়ে দেয় ফারিশের দিকে। ফারিশও ঘুম জড়ানো চোখে নিজের অধর ছোঁয়ায়। এটা নিয়ম। কেউ বাড়ি থেকে বের হওয়ার পূর্বে এক অপরের গালে চুমু কাটে। আদ্রিতা নিজের ব্যাগটা নিল। উঠে দাড়িয়ে বলল,“যাই তবে।”

ফারিশ উত্তর দিল না। হাত টেনে ধরলো আদ্রিতার। আদ্রিতা অবাক হয়ে বসলো খাটে। চোখের ইশারায় বুঝাল,’কি হলো?’

ফারিশ সে ইশারা বুঝেও জবাব দিল না। আদ্রিতা ঠায় চেয়ে। নিরাশ স্বরে বলে,“কিছু বলবে না?”

ফারিশ সে’কথার জবাব না দিলেও কাছে টেনে নেয় আদ্রিতাকে। বুকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ। আদ্রিতা মিষ্টি হেঁসে বলে,“সকাল সকাল এত প্রেম! বাহ্ বাহ্!

ফারিশের হাতের বাঁধন শক্ত হলো। আদ্রিতা উপলব্ধি করলো তা। কিছু বলল না। ফারিশ মলিন মুখে প্রশ্ন করল,“তোমার অপারেশন শুরু কয়টায়?”

আদ্রিতা কিছুটা অবাক হলেও ভাবলো না তেমন। বলল,
“দশটা পনের।”
“এখন বাজছে কয়টা?”
“ন’টা পাঁচ।”
“তার মানে আমার কাছে এখনও সময় আছে সত্তর মিনিট।”
“কিসের সময় বলো তো?”
“কেন তোমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকার।”
“আমি তো এখন বের হবো?”
“এখনও তো এক ঘন্টার বেশি বাকি একটু বসে গেলে হয় না।”
“তুমি তো জানো আমি অপারেশনের একঘন্টা আগে হসপিটাল যাই। একটু নিজেকে গোছাই।”
“আজ একটু অনিয়ম করলে হয় না।”

ফারিশ শেষ কথাটা এমন মলিন স্বরে বলল যে আদ্রিতা চেয়েও বারণ করতে পারলো না। মিষ্টি হেঁসে বলল,“ঠিক আছে।”

ফারিশ খুশি হলো। সময়টা তখন টিপটিপ করে বাড়ছে। ফারিশ চুপচাপ বসে আদ্রিতা জড়িয়ে ধরে। কোনো কথা বলছে না। সময় চলতে চলতে দশটা পনের বাজতে ত্রিশ মিনিট বাকিতে ঠেকে। তখন আদ্রিতা বলে,“এবার যাই। আমার পৌঁছাতেও তো সময় লাগবে।”

ফারিশ মেনে নিল। ছেড়ে দিল আদ্রিতাকে। কপালে চুমু কেটে বিষণ্ণ স্বরে শুধাল,“কেমন যেন আমার মনে হচ্ছে তুমি গেলেই আমি হারিয়ে যাবো।”

আদ্রিতা কপট রাগ দেখালো। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,“যাওয়ার সময় এ কেমন কথা।”

ফারিশ চমৎকার শব্দ করে হাসলো। বলল,“তোমাকে রাগাতে আমার এত ভালো লাগে কেন?”

আদ্রিতা জবাব দিল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। ফারিশ হেঁসে বলল,“যাও,তোমার লেট হচ্ছে।”

আদ্রিতাকে অসয়হায় দেখালো। একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিজের ব্যাগটা নিল। নিরাশ ভঙ্গিতে বলল,“কোথাও যাবে না। বাসায় বসে থাকবে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় আসবো।”

ফারিশ বলল,“আচ্ছা। এখন যাও।”
আদ্রিতা যেতে নিল। আবার দাঁড়ালো। পিছন ঘুরে মলিন মুখে বলল,“কোথাও যাবে না কিন্তু।”
ফারিশ মাথা নাড়িয়ে জানান দিল,“যথা আজ্ঞা মাই বেলীপ্রিয়া।”

ফারিশের কান্ডে ফিক করে হেসে দিল আদ্রিতা। বলল,“আসছি।”

অতঃপর আদ্রিতা চলে গেল। ফারিশের উজ্জ্বল মুখখানা হঠাৎ মলিন হলো। নিরাশাতায় ভরে উঠলো চারপাশ। সে গলা ছেড়ে ডাকলো,
“আদিব..।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৯

পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে পুরো কক্ষ জুড়ে। জানালার কার্ণিশ ছুঁইয়ে ছুটে আসছে বাতাস। রোদের আলোতে ভরপুর পরিবেশ। আদিব চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ আগে ফারিশের ডাকে ছুটে এসে দাঁড়াল। ফারিশ কিছু বলছে না চুপচাপ বিছানা বসে। ফারিশ গায়ের কম্বলটা পা থেকে সরালো। একঝলক আদিবের দিকে তাকিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলো। মাথা নুইয়ে বলল,“আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আদিব।”

আদিব তড়িৎ চমকে তাকালো ফারিশের দিকে। খানিক ভীতু স্বরে শুধাল,“কি সিদ্ধান্ত ভাই?”

ফারিশ চুপ হয়ে গেল। কথা আঁটকে আসছে নাকি। কি সাংঘাতিক! ফারিশের এত বছরের জীবনে এমন আকস্মিক ঘটনা কখনও হয় নি। ফারিশ দম ছাড়লো। আদিব হতভম্ব হয়ে চেয়ে। খানিক এগিয়ে প্রশ্ন করল,“কি হলো ভাই? কথা বলছো না কেন?”

ফারিশ চাইলো আদিবের দিকে। চোখ জোড়ায় বিষণ্ণের হইচই। আদিবের বুক হঠাৎ অজানা ভয়ে কামড়ে উঠলো। সে নিচে বসে পড়লো আচমকা। তড়তড় করে ফারিশের হাত জড়িয়ে ধরে বলল,“আমাদের ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করছো না তো ভাই?”

ফারিশের চোখেমুখে অসহায়ত্বতা ফোটে। ছোট্ট প্রশ্ন করে,“চাঁদনী কি ঘরে?”

আদিব মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,“না। ও তো খুব ভোরে চট্টগ্রাম গেছে।”

এবার ফারিশ হাত ধরলো আদিবের। আদিব থমকে গেল হঠাৎ। ফারিশ ভাইয়ের আচরণ ঠিক লাগছে না। ফারিশ বলল,“তোমায় একটা কাজ করতে হবে আদিব?”

আদিব বিমুঢ় চেয়ে। বলে,
“কি কাজ ভাই?”
“তুমি এই শহর ছেড়ে চলে যাবে। তোমার যে ফারিশ নামের একটা পাতানো ভাই আছে এটা তোমায় ভুলতে হবে।”

আদিব বিস্মিত হয়ে গেল ফারিশের কথা শুনে। এসব কি বলছে ফারিশ ভাই। চলে যাবে, ভুলে যাবে। এগুলোর মানে কি? আদিব হতাশার ঘোরে বলল,
“এসবের মানে কি ভাই? ভুলে যাবো কেন?’
“মানে একটাই তুমি এই শহর ছাড়ছো।”
“কেন ছাড়বো? আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না। আর আচমকা এসব কি?”
“বাচ্চাদের মতো জেদ করো না আদিব।”
“তুমি অবুঝের মতো কথা বলছো। আচমকা শহর ছাড়বো কেন?”
“তুমি আমার সাথে থাকলে বিপদে পড়বে।”
“কিসের বিপদ?”
“আমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবো আদিব।”

তড়িৎ উত্তর ফারিশের। মুহূর্তের মধ্যে থমকে গেল আদিব। স্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশে। এখনও যেন ফারিশের ঠান্ডা স্বরে বলা কথাটা কানে বাজছে আদিবের। ‘আমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবো আদিব।’– আদিব বিমুঢ় চেয়ে রইলো। তার চোখ জ্বলছে। পানি জমা হতে শুধু করছে বোধহয়। ফারিশ নিরাশ হলো। আদিবের হাত মুঠোবন্দি করে আঁকড়ে ধরলো। নিরুপায় ভঙ্গিতে বলল,“এভাবে বাঁচা যায় না আদিব।”

আদিব কিছু বলে না। শুধু চেয়ে রয়। কিছুসময় পর টের পায় তার চোখ বেয়ে লাগামহীন অশ্রু পড়ছে। বুকের ভেতর ভয়ার্ত এক অনুভূতি হচ্ছে। ফারিশ বোধহয় ধরতে পারলো আদিবের অবস্থা। সে ধমকের স্বরে বলল,“ভয় পাবে না আদিব।”

আদিব তখনও কিছু বলে না। অনেক সময় পর ফারিশ বুঝায়,“একটা জিনিস কি জানো? আমরা যতক্ষণে না নিজেদের পাপটা উপলব্ধি করতে পারি ততক্ষণ পর্যন্ত পাপী কাজটাকে আঁকড়ে থাকবে পারি। আমাদের মনেই হয় না আমরা প্রতিনিয়ত অন্যায় করছি। কিন্তু যেই উপলব্ধি করি ভুল হচ্ছে, প্রিয় মানুষদের সাথে অন্যায় করছি তখনই কষ্ট হয়। শুরুতে তো সব ঠিকই ছিল। কিন্তু এখন আর নিতে পারি না। কাজটা করতে চাচ্ছি না আবার ছেড়ে দিতেও পারছি না। তাই ভেবে দেখলাম আমার পুলিশের কাছে আত্নসমর্পণ করাটাই ঠিক হবে। আমি শুনেছি নিজ থেকে আত্মসমর্পণ করলে শাস্তি কম পাওয়া যায়। ওনারা নিশ্চয়ই পাঁচ ছয় বছর পর আমায় ছেড়ে দিবেন। তখন তো আমি ফিরেই আসবো। সব ছেড়েছুড়ে সাধারণ জীবন গড়বো।”

আদিব তড়িৎ বলে ওঠে,“যদি না ছাড়ে।”
ফারিশ বিছানায় থেকে নামলো। আদিবকে বসা থেকে উঠালো। হেঁটে হেঁটে বুঝাল,“কেন ছাড়বে না? আমি নয়নতারার সাথে কথা বলেছি। ও বলেছে নিজ থেকে আত্নসমর্পণ করলে শাস্তি কম হয়। কিন্তু কিশোর যদি আমায় ধরতে পারে তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু।”

আদিবের রুহু বুঝি কেঁপে উঠল ফারিশের শেষ কথা শুনে। ফারিশ বলে,“এবার বুঝচ্ছো তো আদিব আমি কেন নিজ থেকে ধরা দিতে চাইছি।”

আদিব কান্নামিশ্রীত স্বরে বলে,“আমার খুব ভয় হচ্ছে ভাই। আমিও যাই তোমার সাথে। আমারও তো দোষ আছে। শাস্তি তুমি একা কেন পাবে? আমিও পেতে চাই।”

ফারিশ তড়িৎ রেগে যায়। ধমকের স্বরে বলে,“কিসের শাস্তি পাবে তুমি। তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি নিষ্পাপ। যা পাপ করার আমি একা করেছি।”

আদিব মানতে চায় না। সে বলে,“আমি ওসব জানি না। আমিও তোমার সাথে যাবো ভাই।”

ফারিশ চাইলো আদিবের দিকে। ছেলেটা যে এত কেন ভালোবাসে তাকে কে জানে? ফারিশ মিষ্টি হাসলো। বলল,“সবাই চলে গেলে আমার বউ, তোমার বউ এদের দেখবে কে?’ তাছাড়া তুমি পাপী নও আদিব। পাপী আমি। আমাদের আবার দেখা হবে তো।”

আদিব বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে,
“সব বুঝলাম কিন্তু আমায় শহর ছাড়তে হবে কেন?”
“কারণ আমি যতদিন জেলে থাকবো ততদিন তুমি আমার সাথে দেখা করতে যাবে না। আমি যে অবস্থাতেই থাকি না কেন তুমি যাবে না। এই শহরে থাকলে, না তুমি এই শহর নয় এই দেশ ছাড়বে আদিব। সঙ্গে করে আদ্রিতা আর চাঁদনীকেও নিয়ে যাবে।’

ফারিশের হঠাৎ মনে হলো। সে একটা ভুল করেছে দেশ ছাড়ার বিষয়টা তার আরো আগে ভাবা উচিত ছিল। খুব বড় ভুল হলো একটা।’

আদিব রাগ দেখালো এবার। কপট তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানাল,“সে কোথাও যাবে না। যা হবে সবটা সে নিজ চোখে দেখবে।”

ফারিশ মানতে চাইলো না। এই নিয়ে আদিব আর ফারিশের মাঝে মোটামুটি একটা দ্বন্ধ চললো। শেষমেশ ফারিশ রেগে বলে,“তুই আমার রক্তের ভাই যে তোকে সবটা দেখতে হবে। কিছু দেখবি না। তুই আজকের মধ্যে দেশ ছাড়বি।”

আদিবও একপর্যায়ে রাগ নিয়ে বলে,“আপনিও আমার রক্তের ভাই নন যে আপনি যা বলবেন আমাকে শুনতে হবে।”

ফারিশ আহত হলো। এ ছেলে সহজে কিছু মানতে চায় না কেন? ফারিশ অসহায় ভঙ্গিতে খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। আদিবও বসে। নীরবতা চলে বেশক্ষণ। হঠাৎ আদিব হাত ধরে ফারিশের। মিনতির স্বরে বলে,“এসব না করলে হয় না ভাই। চলুন না সব ছেড়েছুড়ে আমরা চারজন দূরে কোথাও চলে যাই।”

ফারিশ শুঁকনো হেঁসে বলে,“তোমার কি মনে হয় এতে আমরা ভালো থাকবো। আমার সাথে যাদের লেনদেন, ব্যবসায়ের আদান প্রদান চলছে তারা এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিবে আমাকে।”

আদিব কিছু বলে না। ফারিশ তপ্ত নিশ্বাস ফেলে ক্লান্ত স্বরে বলে,“আমায় যেতে দেও আদিব। দেখে নিও আমি ফিরবো। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেখা হবে। আমি প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিয়ে বাঁচবো। কতদিন হয়ে গেল আমি প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেই না। আমি প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাই আদিব। কাল আমার ছেলেমেয়ে হলে তারা যেন কোনোদিন বলতে না পারে তাদের বাবা খুব খারাপ মানুষ। একজন দেশ বিরোধী মাফিয়া। আমি শুধু চাই আমি যতদিন না ফিরবো, ততদিন তুমি আমার ভাই, আর আমার বউয়ের যত্ন নিবে। তাদের ভালো রাখবে। তারপর আমি ফিরে এসে একটা সৎকাজ ধরবো এই ধরো ঝালমুড়ির ব্যবসা।”

শেষ কথা শুনে আদিব অতি দুঃখেও হেঁসে দেয়। আবার সব চুপচাপ হয়। অতঃপর আদিব হেরে গেল। ভাঙাচোরা মন নিয়ে বলল,“কখন পুলিশ ডাকবেন ভাই?”

ফারিশ নিরুপায় ভঙ্গিতে বলে,“ডাকা হয়ে গেছে। যখন তখন এল বলে।”

আদিব কিছু বলে না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে তার ফারিশ ভাইকে। লোকটা কি দারুণ দাঁত বের করে হাসছে। যেন পুলিশের জেলখানায় দাওয়াত খেতে যাচ্ছে।’


গোধূলি বিকেল। চারপাশ লালচে হয়ে আছে পুরো। জানালার কার্ণিশ ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পর্দা নড়ছে। ফারিশের রুম ফাঁকা। ফারিশ নেই। আদ্রিতা খুশি মনে ছুটে আসল ঘরে। আজ একটা খুশির দিন আদ্রিতা মা হতে চলেছে। আদ্রিতা বাড়ি বয়ে আসতে আসতে ভেবেছে সে ছুটে এসেই ফারিশকে জড়িয়ে ধরে বলবে,“আপনি বাবা হতে চলেছেন মিস্টার বখাটে।”

ঘরে ঢুকেই আদ্রিতার মুখ ফ্যাকাসে হলো। ফারিশ ঘরে নেই। গেল কই?– এই লোকটা আর ঠিক হলো না আদ্রিতা এতবার বললো বাহিরে না যেতে তাও গেল। আদ্রিতা উচ্চ আওয়াজে ডাকলো,“আদিব ভাইয়া…

আদিব দ্রুত পায়ে ছুটে আসলো। তার চোখ ফুলোফুলো। আদ্রিতা আদিবের উপস্থিতি টের পেতেই জিজ্ঞেস করল,“তোমার ভাই কই?”

আদিব জবাব দেয় না। আদ্রিতা ঘুরে তাকায় আদিবের দিকে। চোখমুখের বেহাল অবস্থা দেখে প্রশ্ন করে,“তোমার কি হয়েছে ভাইয়া?”

আদিব শক্ত মনে পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে আদ্রিতার হাতে দিল। বলল,“পড়ো।”

আদ্রিতা বিস্মিত হয়ে চিঠি খোলে। কোনো প্রশ্ন না করেই পড়তে শুরু করল। যেখানে শুরুতেই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল,

‘প্রিয় বেলীপ্রিয়া’
আমি জানি তুমি বাড়ি এসে আমায় না দেখে খুব উত্তেজিত হবে। আমায় খোঁজার জন্য ছটফট করবে। কিন্তু বিশ্বাস করো এগুলো করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি পুলিশের কাছে আত্নসমর্পণ করে দিয়েছি। আমার যত বেআইনি কারবার সব বলে দিয়েছি। আমার যাদের সাথে বেআইনী কারবার ছিল তাদের কথাও বলে দিয়েছি। তুমি কি রাগ করেছো। রাগ করো না গো সখি। আমি জানি তুমি আমায় বুঝবে। আমি যে পাপী এটা তো সত্য বলো। তোমায় সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোতে না আমি খুব ভেবেছি। তুমি পবিত্র মানুষ, কত মানুষদের চিকিৎসা করে সুস্থ করো। আর আমি কিনা অপবিত্র মানুষ হয়ে তোমার সাথে থাকছি। আমার খুব কষ্ট হয় বেলীপ্রিয়া। আমি মানতে পারি না। গত একটা বছর আমি কতটা অসহায় হয়ে তোমার সাথে মিশেছি। আমার কিছু ভালো লাগে না। তোমার নিষ্পাপ মুখটা দেখলেই আমি ভেঙে পড়ি। আমার ভিতরটা মচকে যায়। ইচ্ছে করে কোনো এক ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করি। আমার এত পাপী শরীর তুমি সাদরে গ্রহণ করছো এও যেন আমার কাছে বিষাক্ত লাগে। নিজেকে এত অপরাধী মনে হয়। আমি শুধু দিনরাত ভেবেছি, এই পাপী মানুষটার সাথে এত নিষ্পাপ মুখের মিলন ঘটলো কি করে?
কোথাও গিয়ে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা বুঝি আমায় একটা সুযোগ দিয়েছেন পাপ ছেড়ে পুন্যে আসার। আমি সেটাই করেছি। আমি জানি না আমি ফিরবো কি না। আদিবের সাথে আমি একটা মিথ্যে বলেছি আমার সাজা পাঁচ বছর জেলখাটা হবে না। হবে আরও অধিক। হয়তো বছর পনের– কুড়ি পরে। তুমি কি ততদিন আমার অপেক্ষায় থাকবে। একটা কথা কি জানো এই কুড়ি পনের বছর পড়েও আমি বেঁচে থাকতে পারবো কি না জানা নেই। আমার সাথে যারা কাজ করতো তাদের ধরিয়ে দিচ্ছি। কেউ যদি বেঁচে যায়। তবে সে নিশ্চয়ই আমায় মারবে। দেখা গেল জেল থেকে বেরিয়েই বুক বরাবর গুলি। আমি ওখানেই শেষ। আর যদি কারাগার থেকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তবে তো… যাক বাদ দেও। আচ্ছা আমি মরে গেলে তুমি কি ভালো থাকবে বেলীপ্রিয়া? আমি বলবো, ভালো থেকো।’ অন্তত পাপী পুরুষ থেকে তো মুক্তি পেলে। আজ তবে গেলাম। যদি ফিরি তবে আমাদের আবার সংসার হবে। আর যদি না ফিরি তবে।.. শুনেছি মানুষ অপূর্ণতা নিয়ে মরে গেলে তাদের নাকি আবার জন্ম হয়। কথাটা কতটুকু সত্য জানা নেই। যদি সত্য হয় তবে,

“তুমি আবার জন্ম নিও বেলীপ্রিয়া। দেখে নিও, আমি সেবারেও তোমারই প্রেমে পড়বো।”

ইতি-
তোমার বখাটে সাহেব,
ফারিশ মাহমুদ!’

#চলবে…

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৪৬+৪৭

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৬

নিস্তব্ধ নীরবতায় ভরপুর চারপাশ। আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরে এখনো বসে আছে ফারিশ। আদ্রিতা নিশ্চুপ। সে ধরতে পারছে না আচমকা ফারিশের হলো টা কি! আদ্রিতা ফারিশের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। নির্জীব কণ্ঠে বললো,“আমাকে ছাড়বেন না?”

ফারিশের উত্তর এলো না। সে চুপ রইলো। আদ্রিতা আবার বললো,“কি হলো কথা বলছেন না কেন?”

ফারিশ নিরাশ স্বরে বললো,
“কিছু বলতে ভালো লাগছে না।”
“এমন কেন করছেন? কি হয়েছে? বলুন আমায়।”
“কি হবে, কিছু হয় নি তো।”
“আমরা কিন্তু একভাবে অনেকক্ষণ বসে আছি।”
“তো।”

আদ্রিতা নিরাশ হলো। নিজের মাথাটা ফারিশের কাঁধ থেকে সরিয়ে বললো,“আপনার কি মন খারাপ?”

ফারিশের তক্ষৎনাৎ উত্তর,“না তো।”
ফোস করে শ্বাস ফেললো আদ্রিতা। উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,
“আমায় ছাড়ুন।”
“যদি না ছাড়ি।”
“দরজা খোলা। একটু বুঝুন যখন তখন চাঁদনী ওরা চলে আসবে।”
“আসুক। সমস্যা কি? তুমি আমার বউ ভুলে যাচ্ছো কেন?”
“আপনি একটা যাচ্ছে তাই লোক।”
“জানি তো।”

চোখ বাকিয়ে চাইলো আদ্রিতা। আর কি বলবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ফারিশ ছেড়ে দিলো আদ্রিতাকে। ফারিশ ছাড়তেই আদ্রিতা হুড়মুড় করে নেমে পড়লো ফারিশের কোল থেকে। ফারিশ শুঁকনো হেঁসে মলিন মুখে বলে,“আমার থেকে পালানোর এত তাড়া।”

আদ্রিতা দাঁড়ানো ছিল। খানিকটা ঝুকলো ফারিশের দিকে। শীতল স্বরে বললো,“আপনার থেকে পালানোর থাকলে দু’মাস আগে ঘটা করে বিয়ে করতাম না আপনায়।”

ফারিশ কিছু বলে না। আদ্রিতা চলে যায় রান্নাঘরের দিকে।”
—-
অন্ধকার ভরা রাত। ছাঁদের উপর ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করার তোড়জোড় চলছে খুব। আদিব আর চাঁদনী ফিরেছে সন্ধ্যার পরেই। ফারিশকে বাসায় দেখে খানিকটা অবাক হয়েছিল আদিব। তবে কিছু জিজ্ঞেস করে নি। ছাঁদের পাতানো সেই চেয়ার টেবিলটা সাজাতে ব্যস্ত হচ্ছে আদিব আর ফারিশ। ফারিশকে খানিকটা চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিছু একটা নিয়ে সে চিন্তিত। আদিব বললো,“ভাই,

ফারিশ টেবিলের উপর কাঁচের প্লেট রাখছিল। আদিবের কথা শুনে ফারিশ তাকালো। বললো,“হুম বলো,
আদিব কিছু সময় চুপ থেকে প্রশ্ন করলো,“ভাই তুমি ঠিক আছো তো?”

ফারিশ প্রশ্ন শুনে অবাক হলো। ভড়কানো গলায় বললো,
“আমার আবার কি হবে?”
“রাতের ঘুমাও না ঠিক মতো চোখ লাল কেন?”
“ওসব কোনো ব্যাপার নেই। তুমি ভুল ভাবছো।”
“কিছু কি হয়েছে?”

ফারিশ আদিবের কাঁধে হাত দিলো। মৃদু হেসে মিহি কণ্ঠে বললো,“আমার কিছু হয় নি আদিব।”

আদিব বিনিময়ে কিছু বললো না। তবে কথাটা বিশ্বাসও করলো না। হাতে মুরগীর রোস্টের বাটি নিয়ে ছাঁদে হাজির হলো চাঁদনী আর আদ্রিতা। একগাল হেঁসে বললো,“গরম গরম মুরগীর রোস্ট হাজির।”

ওদের কথা শুনে ফারিশ,আদিব দুজনেই তাকালো। বিপুল হাসি তামাশা। আর জমজমাট পরিবেশে ডিনার শেষ হলো। চারজনের ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। আদিব বললো,“ভাই আমরা কোথাও একসাথে ঘুরতে যাই নি একদিন ঘুরতে গেলে কেমন হয়।”

ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে বলে,“খুব বাজে।”
চোখ কুঁচকালো আদিব। বললো,“বাজে কেন?”
সে কথার জবাব দেয় না ফারিশ। আদ্রিতা বলে,“ওনার কথা বাদ দিন তো দুলাভাই। কবে যাবেন? কোথায় যাবেন? ঠিক করুন আমরা যাবো।”

ফারিশ ফোস করে নিশ্বাস ফেললো। শান্ত স্বরে বললো,“ঢাকার শহরে সবচেয়ে ভালো মুরগীর খামার কোথায় আছে আদিব?”

আদিব হতভম্ব হয়ে বললো,“মুরগীর খামার দিয়ে কি হবে ভাই?”

ফারিশ কোকের বোতলে চুমুক দিলো। দ্বিধাহীন কণ্ঠে বললো,“ঘুরতে যাবো।”

চাঁদনী বিষম খেল ফারিশের কথা শুনে। থতমত খেয়ে বললো,“কি বলেন দুলাভাই মুরগীর খামারে ঘুরতে যাবো।”

ফারিশের ভাবনাহীন উত্তর,“সমস্যা কি?”
আদ্রিতা বিস্মিত কণ্ঠে বলে,“মুরগীর খামারে দেখবো কি?”

ফারিশ চমৎকার হেঁসে বললো,“কেন সারি সারি মুরগী।”

ফারিশের কথা শুনে আচমকা অট্টহাসিতে লুটে পড়লো সবাই। ফারিশ হাসলো না। সিরিয়াস কণ্ঠে বললো,“আশ্চর্য তোমরা হাসছো কেন?”

আদিব বলে,“ভাই আমার মুরগীর চেয়ে খাসি বেশি পছন্দ। খাসিরটায় গেলে কেমন হয়?”

ফারিশ চমৎকার হেঁসে বলে,“দারুন।”
আদিবের মুখ মলিন হলো। সে হতভাগ হলো ফারিশের উত্তর শুনে।
—–
রাত বেজে তিনটে। প্রকৃতি ছুয়ে সুন্দর বাতাস হচ্ছে। চাঁদটা দেখা যাচ্ছে দূরে। ফারিশ আদ্রিতা পাশাপাশি বসে ছাঁদে। চাঁদনী আর আদিব কতক্ষণ আগেই গেল রুমে। আদ্রিতা হাই তুলে বললো,“ঘুমোতে যাবেন না মিস্টার বখাটে?”

ফারিশ উদাসীন ভঙ্গিতে শুয়ে পড়লো নিচে। মাথা রাখলো আদ্রিতার কোলে। আহ্লাদী স্বরে বললো,
“এক রাত না ঘুমালে কি শরীর খারাপ করে ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতা ফারিশের চুলে বিলি কাটে। বলে,
“একটু আকটু করে।”
“তাইলে আমরা না হয় আজ একটু আকটু শরীর খারাপ করি।”
“সারারাত কি ছাঁদেই থাকবো?”
“তোমার কি ভয় হচ্ছে?”
“আপনি থাকলে কিসের ভয়!”

ফারিশ আচমকাই শোয়া থেকে উঠে বসলো। আদ্রিতার চোখে দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। শীতল স্বরে শুধালো,“তোমার কি একটুও খারাপ লাগছে না বেলীপ্রিয়া?”

আদ্রিতা আচমকা অবাক। এ কেমন প্রশ্ন! আদ্রিতা ফারিশের দিকে চেয়ে। বিলম্বিত চোখে তাকালো। জিজ্ঞাসাসূচক কণ্ঠে বলে,
“খারাপ লাগবে কেন?”
“আমি মাফিয়া তাই।”

আদ্রিতা নিরাশ হলো। ভয়ংকর নিরাশ হলো। এই সুন্দর মুহূর্তে এটা শুনতে চায় নি। আদ্রিতা করুন গলায় বলে,“এই সুন্দর মুহুর্তে মাফিয়া আসলো কোথা থেকে?”

ফারিশ বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো,“তোমার কি সত্যি খারাপ লাগে না? তোমার স্বামী একজন মাফিয়া। দেশ বিরোধী মাফিয়া। সে মাদকব্যবসায়ী, বেআইনি অস্ত্র পাচারের কারবারে জড়িত। তোমার খারাপ লাগে না দুঃখ হয় না। তুমি তো ডাক্তার কিভাবে এত সহজে সবটা মেনে নিলে। তোমার কি ঘৃণা আসে না আমার ওপর?”

ফারিশের গলা জড়িয়ে ধরে আদ্রিতা। বার কয়েক চুমু খায় ফারিশের গালে,কপালে, অধরে। ফারিশ হতভম্ব। আদ্রিতা শান্ত স্বরে বলে,
“আপনি কি জানেন মিস্টার বখাটে? যাকে ভালোবাসা যায় তাকে ঘৃণা করা যায় না। আমি আপনায় ঘৃনা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরিশেষে দারুণ ব্যর্থ হয়েছি।”

ফারিশ ভড়কালো,চমকলো,অবাক হলো দারুণ। এই মেয়ে তার কথাই তাকে ফিরিয়ে দিলো। কি সাংঘাতিক কান্ড! ফারিশ পলকহীন আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে। আর আদ্রিতা সেই চাহনী দেখে মিষ্টি হাসে।’
—-
পরেরদিন খুব ভোরেই মুরগীর খামারে ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো আদিব,ফারিশ, আদ্রিতা আর চাঁদনী। আদিবের সে কি মন খারাপ! সে বুঝে না মুরগীর খামারে ঘুরতে যাওয়ার মতো কি আছে? তাও আবার বউকে নিয়ে। আদিবের বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলানো কান্ডে ফারিশ হাসে। আদিব আর চাঁদনী পিছনে বসেছে। ফারিশ আর আদ্রিতা সামনে। ফারিশ গাড়ি ড্রাইভ করছে।’

আদ্রিতা আর চাঁদনী হসপিটাল বান দিয়েছে আজ। প্রায় দু’মাস পর আজ একদিনের ছুটি নিয়েছে তারা। আদ্রিতা চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“আমরা কি সত্যিই মুরগী খামারে ঘুরতে যাবো?”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“হা।”
ফারিশের কথা শুনে নিরাশ আদ্রিতা,চাঁদনী আর আদিব।’

প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে ফারিশ গাড়ি থামালো। কেউ গাড়ি থেকে নামলো না। সবাই মুখ ফুলিয়ে বসে। ফারিশ হেঁসে বলে,“তোমরা এমন বাচ্চাদের মতো রাগ করছো কেন? দেখো মুরগীর খামার খুবই সুন্দর একটা জায়গা। এখানে নানাবিদ মুরগীরা বাস করে। একেক মুরগীর একেক ওজন, কোনোটা এক কেজি, কোনোটা চার কেজি। কোনোটার রঙ লাল, কোনোটার রঙ হয় সাদা। বোঝো এগুলা!’

ফারিশের কথায় ভ্রু-কুচকে তাকালো সবাই। ফারিশ হেঁসে বললো,“নামবে তোমরা।”

কেউ নামলো না। ফারিশ তীক্ষ্ণ স্বরে আদিবকে উদ্দেশ্য করে বললো,“আদিব…”

আদিব হুড়মুড় করে নেমে পড়লো সঙ্গে সঙ্গে। সামনে তাকাতেই সে অবাক। কারণ জায়গাটা কোনো মুরগীর খামার নয়। এক বিপুল সৌন্দর্যে ঘেরা নয়ন জুড়ানো প্রকৃতি। আদিব সবাইকে তাড়া দিয়ে বললো,“এই তোমরা নামো,

আদ্রিতা, চাঁদনী দুজনেই বিরক্ত নিয়ে নামলো। সামনে তাকাতেই দুজনেই অবাক। বিশাল সবুজে ঘেরা এক উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের পাশে ছোট্ট টিনের কুঁড়েঘর। চারপাশে শাঁ শাঁ শব্দ করে বাতাস বইছে। মাথার উপর ধবধবে সাদা আকাশ। কি নিদারুণ সুন্দর প্রকৃতি। আদিব বিস্ময় নজরে চেয়ে। সে বলে,“এটাই কি মুরগীর খামার ভাই?”

ফারিশের বিস্ময়কর হাসি। মলিন মুখের কণ্ঠস্ব। সে বলে,“আমার ছোট ভাই মুরগীর খামারের কথা শুনে মুখ ফুলায়। রাগ করে। সেখানে আমি কি করে যাই আদিব?”

আদিবের চোখে পানি চলে আসলো মুহূর্তেই। সে ফারিশের দিকে তাকিয়ে। ফারিশের মুখ হাসি হাসি। চোখের চাহনি ভিন্ন। আদিব ফারিশকে দেখে মনে মনে ভাবে,“তার ফারিশ ভাই তাকে এত ভালোবাসে কেন? এই ভালোবাসায় কারো নজর না লাগুক। থু থু!’

#চলবে…

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৭

নিঝুম বিকেল। সারাদিন তোড়জোড় আর হৈ-হুল্লোড় করে নিচে মাদুর পেতে বসে ফারিশ আর আদিব। তাদের সামনেই আদ্রিতা আর চাঁদনী ঘুরে ঘুরে সেলফি তুলছে। এই মেয়েদুটোর আর কোনো কাজ নেই বোধহয়। সেই আসার পর থেকেই শুধু সেলফি আর সেলফি। ফারিশরা খাবার বানালো এখানে এসে। ওই যে ছোট্ট কুটির ঘর ছিল সেখানে বসে। ফারিশ আগে থেকেই সব বন্দোবস্তো করে রেখেছিল। দুপুরের লান্স হিসেবে ছিল গরম গরম ভাত, সিদ্ধ আলুর ভর্তা আর ফারিশের হাতের ডিম ভাজা। এই প্রথম ফারিশ নিজ হাতে রান্না করেছে। আদিব তো তা দেখে দারুণ অবাক। খাবার দাবার খুব সাদামাটা থাকলেও আনন্দের রেশ ছিল বেশ। সে কি উৎসবমুখর পরিবেশ! তবে এত উৎসবের মাঝেও আদিব লক্ষ্য করেছে ফারিশ ভাই হঠাৎ হঠাৎ চুপ হয়ে যান। গভীর ভাবনায় মগ্ন হন। যেমন এখন হচ্ছে। ফারিশ ভাই তাকিয়ে তো আছে ডাক্তার ভাবির দিকে তবুও চোখে মুখে কোথাও গিয়ে বিষণ্ণতা। আদিব নড়েচড়ে বসলো। মাদুরের মধ্যখানে রাখা জুসের বোতলটা নিলো। জুস ঢাললো গ্লাসে। এরপর ফারিশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ভাই তুমি হঠাৎ হঠাৎ নেতিয়ে যাচ্ছো কেন? ডাক্তার ভাবি কি খুব পীড়া দিচ্ছে?”

ফারিশের হুস হাসে। সে তাকায় আদিবের দিকে। জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে মলিন মুখে বলে,“তেমনটাই।”

আদিব অবাক হয়। বিস্মিত কণ্ঠে আওড়ায়,“মানে?”
ফারিশের ঠোঁটে জড়নো তখনও মলিন হাসি। আদিব সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কিছু একটা বুঝে। অতঃপর আচমকা ফারিশের হাত চেপে বলে,“কিছু কি হয়েছে ভাই?”

ফারিশ জুসের গ্লাসের চুমুক দেয়। বিষণ্ণ চোখে তাকায়। আগের সেই এক উত্তর তার,“কি হবে?”
আদিবের হঠাৎ বিতৃষ্ণা লাগলো। বারে বারে ফারিশ ভাইয়ের ভণিতা করা এক উত্তরে বিরক্ত বোধ করলো। আদিব কপট রাগ নিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে শুধাল,“আমার সাথে বার বার মিথ্যে বলছো কেন?”

আদিবের রাগ দেখে ফারিশের হাসি আরো চওড়া হয়। চোখ ছলছল করে। দৃষ্টি নত করে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
“তুমি আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছো আদিব?”

ফারিশ মলিনের কণ্ঠস্বরে আদিব রাগের পানি হয়ে গেল। মন ছটফট করলো। খানিকটা আঘাত রাখলো বুকে। সে বলল,
“আমি রাগ দেখাতে চাই নি ভাই।”

ফারিশ সরাসরি তাকালো আদিবের দিকে। মলিন মুখে বিতৃষ্ণার ছোয়া এঁটে বলে,“আমার কিছু ভালো লাগে না আদিব। সব কিছু থেকেও কোথাও যেন সুখ নেই।”

আদিব বিস্মিত কণ্ঠে বলে,“এমনটা কেন হচ্ছে ভাই?”
ফারিশ মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,“জানি না।”
আদিব মাথা নুইয়ে খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলে “বিয়েটা করে কি সুখ হও নি ভাই?”

ফারিশ একঝলক তাকালো আদ্রিতার দিকে। মেয়েটা সেই সূদুরে ছুটে ছুটে ছবি তুলছে। সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে বসছে। নানানভাবে ভণিতা করে মুঠোফোনে আবদ্ধ করছে নিজের ছবি। গায়ে জড়ানো শুভ্র কামিজে কি নিদারুণ সুন্দরী না দেখাচ্ছে তাকে। ফারিশ পলকবিহীন তার দিকে তাকিয়ে থেকেই উত্তর দিল,“তেমন কোনো ব্যাপার নেই।”

সস্থি পেল আদিব। নিশ্চিতের শ্বাস টেনে বলল,
“তাহলে সমস্যা কি?”
এবার ফারিশ সহজ হলো। নিজের কঠিন হৃদয়টাকে আঁটকে রেখে লাগামহীন বলতে লাগল,
“আমার কেন যেন কিছু ঠিক লাগছে না আদিব। এই ডাক্তার ম্যাডামের আচরণও আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। মেয়েটা জানে আমি একজন মাফিয়া। মাদকের ব্যবসা করি। তাও কিছু বলছে না। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করছে না। এমন আচরণ করছে যেন কিছুই জানে না। ওর তো উচিত আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া। ও তো ডাক্তার, কি করে মেনে নিচ্ছে মানুষের ক্ষতি করা এই মানুষটাকে। আমি যে ওর এই অস্বাভাবিক আচরণে আঘাত পাচ্ছি। ও কেন বুঝচ্ছে না। আমি ভিতর থেকে সস্থি পাচ্ছি না। প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে পারছি না। মাথার উপর পাপের ভাড়ি বোঝাটা আমাকে ভিতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমি ছিন্ন ভিন্ন হচ্ছি। আমার হৃদয় পুড়ে ছারখার হচ্ছে। হাতুড়ি পেটার মতো বুকটা হঠাৎ হঠাৎ যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমি কাতরাচ্ছি। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি কি করবো? বুঝচ্ছি না। পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে দিবো আদিব। আচ্ছা একজন দেশবিরোধী মাফিয়ার শাস্তি কি খুব ভয়ংকর হয়?”আমার শাস্তি কি হবে মৃতুদন্ড। নাকি সারাজীবনের জেল! আমার জেল হলে আমার প্রেয়সী কি ভালো থাকবে? তুমি ভালো থাকবে আদিব? আমিহীনা নিজেকে মেলাতে পারবে তো সমাজের সাথে?”

আদিব থমকে গেল। স্তব্ধ লাগলো চারপাশ। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো ফারিশের মুখপানে। এসব কি বলছে ফারিশ ভাই? আদিবের আচমকা চোখ ভেসে আসলো। বাচ্চাদের মতো করে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,“তুমি কোথাও যাবে না ভাই?”

ফারিশ হাসলো। সে জানতো তার ছোট ভাইর উত্তর এমনটাই হবে। আদিবের মাথায় হাত বুলালো ফারিশ। আশ্বাস দিয়ে বললো,“ভয় পেও না যাবো না।”

আদিব তাও শান্ত হতে পারলো না। ফারিশ ভাই ছাড়া তার জীবন যে শূন্য। সেই ছোট বেলা থেকে ফারিশ আদিবকে আগলে রেখেছে। নিজে না খেয়ে আদিবকে খাইয়েছে। অস্ত্র হাতে আদিবকে বাঁচাতে খুন করেছে। এই যে এখনকার পরিস্থিতি, ফারিশের নামের পাশে ট্যাগ আসে মাফিয়ার এটার দায়ও অধিকাংশ আদিবের। আদিবের সব এলেমেলো লাগলো হঠাৎ। মাথায় তীব্র জ্বালা পোড়া শুরু হলো। ফারিশ বুঝি আদিবের পরিস্থিতি বুঝলো। সে আলতো হাতে আদিবকে বুঝালো,“আমি এসব কিছু করবো না আদিব।”

আদিব মলিন মুখে আওড়ায়,“সত্যি করবা না তো ভাই?”
ফারিশ চোখের ইশারায় বুঝায়। যার অর্থ,“ভয় নেই করবো না।”

আদিব অত্যাধিক ভীতু একটা ছেলে। বিশেষ করে যখন তার ফারিশ ভাই তার আশেপাশে থাকে না। চারপাশ কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বিষণ্ণ জাগে মনে,ভয় হতে থাকা এই সুন্দর ধরণীকে। সেই বর্ষণের রাতে ভয়ানক ঘটনা চোখে ভাসে। আদিব আগে নিজের রুমের লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতো। কিন্তু জীবনে চাঁদনী আসার পর সেই ভয় খানিকটা হলেও কমেছে আদিবের। তবুও ফারিশ ভাইহীনা আদিব অচল। আদিব জানে না ভবিষ্যতে কি হবে? যদি সত্যিই সত্যিই ফারিশ ভাই পুলিশের কাছে আত্নসমর্পণ করে দেয় তখন কি হবে? আদিব কিভাবে বাঁচাবে ফারিশকে? আদিবের হঠাৎ ভয় লাগলো। তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করলো। ফারিশের গম্ভীর আওয়াজ ফের আসলো তখন। তীক্ষ্ণ স্বরে শুধালো ফারিশ,“আমি ভয় পেতে বারণ করেছি। এত সহজে তোমার জীবন থেকে ফারিশের ছায়া সরবে না আদিব। তুমি নিশ্চিত থাকো!”

আদিবের চোখ জ্বলে উঠলো। প্রাণপণ দিয়ে চেষ্টা চালালো। বোঝাতে চাইলো,“ফারিশ ভাই বিশ্বাস করুন আমি ভয় পাচ্ছি না।”

ফারিশ চেয়ে চেয়ে দেখে সেই অসহায় ছেলেটির কান্ড। ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করে ছেলেটির ব্যর্থতার মুহুর্ত। মনে মনে হাসে আর বলে,“হচ্ছে না আদিব। হচ্ছে না।”
—–
নিকষকালো অন্ধকারে ভরপুর চারপাশ। ফারিশ নিজ কক্ষে আসে তখন। তারা বাড়ি ফিরে এসেছিল সেই সন্ধ্যায়। এরপর ফারিশ যায় কাজে। ফিরে মাত্র। আদিব নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফারিশ রুমে ঢুকতেই অবাক। কারণ তার পুরো রুম মোম আর ফুল দিয়ে সাজানো। ফারিশ পুরো রুমে চোখ বুলায়। দেখে জানালার ধারে জর্জেটের লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিতা। ঘনকালো লম্বা কেশ কোমড় পর্যন্ত ছড়ানো। চোখেমুখে হাল্কা সাজ। বাহিরের চাঁদের আলো এসে লাগছে অাদ্রিতার মুখে। ফারিশ বিস্ময়ের ন্যায় এগিয়ে যায় সেদিকে। পিছন থেকে আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরে। ছোট্ট প্রশ্ন করে,“এসব কি করেছো বেলীপ্রিয়া?”

ফারিশের বেলীপ্রিয়া চমকে ওঠে তখন। বুকের ধুকপুকানি ক্ষণে ক্ষণে বাড়ে প্রায়। লজ্জায় সর্বাঙ্গ বুঝি ছুঁয়ে যায়। ফারিশ শীতল স্বরে আওড়ায়,
“এত সেজেছো কেন, আমার ধ্বংস চাই?”

আদ্রিতা কোনোরকম ‘না’বোধক মাথা নাড়ায়। লজ্জামিশ্রীত কণ্ঠে শুধায়,“আপনাতে বিলীন হতে চাই।”

#চলবে…

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️.