Saturday, July 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 205



এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৪৪+৪৫

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৪

বড্ড অস্থিরতায় ভরপুর নয়ন নিয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিতা ফারিশের দিকে। আশ্চর্য ফারিশের এত ঘাবড়ানোর কি আছে? সে কি সিরিয়াস হয়ে কথাটা বলেছিল নাকি! বলেছে তো মজা করে। হঠাৎই আদ্রিতার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেললো। সে মনে মনে হাসলো। ফারিশের গা ঘেঁষে বসলো একটু। ফারিশ চমকে উঠলো এতে। বললো,“এখনই গা ঘেঁষে বসার কি আছে দূরে সরো?”

আদ্রিতা সরলো না। ফারিশের কানে কানে ফিসফিস করে বলে,“এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন মাফিয়া সাহেব? আমি বউ হয়ে ঘাবড়াচ্ছি না আর আপনি স্বামী হয়ে ঘাবড়াচ্ছেন।”

ফারিশ সরাসরি চাইলো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার চোখে মুখে রহস্যের হাসি। ফারিশ বুঝেছে এ মেয়ে মতলব। ফারিশ এবার সিরিয়াস হলো। নিজেই আদ্রিতার কোমড় জড়িয়ে কাছে আনলো। বললো,“প্রথমবার তো তাই একটু ঘাবড়াচ্ছি। তুমি মানিয়ে নিতে পারলে দেখবে আর ঘাবড়াবো না।”

আদ্রিতা চমকালো এবার। হাসি আসলো তার। তবে হাসলো না। আদ্রিতা বুঝেছে তার আর মজা করা হলো না। এই ছেলে এখন ভয় পেল না কেন! ফারিশ বুঝি আদ্রিতার মনের কথা বুঝলো। আদুরে গলায় বললো,“ফারিশকে ভয় পাওয়ানো এত সোজা বুঝি।”

আদ্রিতা ভ্রু-কুচকে নিজেকে ছাড়ানো চেষ্টা করলো। বললো,“ছাড়ুন তো। আপনি একটা পাঁজি লোক শুধু শুধু এতক্ষণ নাটক করছিলেন।”

ফারিশ চমৎকার ভাবে হাসলো। আদ্রিতার সেই হাসিতে চোখ আটকালো। লোকটা এত সুন্দর হাসে যে আদ্রিতা বার বার প্রেমে যায়। আদ্রিতার চাহনি খেয়াল করলো ফারিশ। সে শীতল গলায় আওড়ালো,
“এভাবে তাকাবেন না ডাক্তার ম্যাডাম, আপনার চাহনি যে আমাকে ভিতর থেকে বড্ড ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়।”

আদ্রিতার মুখভঙ্গি পাল্টালো। এই ছেলে আবার তাকে আপনি করে বলছে। কি সুন্দর এতক্ষণ তুমি বলছিল। ফারিশের তুমিটাতে আদ্রিতা অন্যরকম সস্থি পায়। আদ্রিতা বললো,“ক্ষতের কি আছে ভালোবাসায় কোনো ক্ষত নেই। আছে শুধু পবিত্রতার ছোঁয়া। ”

ফারিশের আচমকা কি যেন হলো সে ছেড়ে দিলো আদ্রিতাকে। আদ্রিতা খানিকটা অবাক হলো এতে। বললো,“কি হয়েছে?”

ফারিশ মাথা নিচু করে বলে,
“আমার জীবনে আপনার আসাটা কি ঠিক হলো?”
“কেন ঠিক হবে না।”
“আমার জীবন যে বড্ড অগোছালো।”
“থাকুক না একটু অগোছালো ক্ষতি কি তাতে?”
“ক্ষতি কি সত্যি নেই?”
“আমি তো দেখি না।”
“তুমি কি পারবে আমার সাথে সারাজীবন অগোছালো হয়ে থাকতে?”
“আপনি সাথে থাকলে আমি ঠিক মানিয়ে নিবো।”

ফারিশ আদ্রিতার দু’হাত আঁকড়ে ধরলো। মলিন মুখে বললো,
“জানো তো আমি এই জীবনে আসতে চাই নি কিন্তু সময়, পরিস্থিতি আমায় এখানে এনে ঢেকিয়েছে।”
“ছেড়ে আসা কি সম্ভব?”
“ছেড়ে দিলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত।”

আদ্রিতা সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেল। বললো,“দরকার নেই। আড়ালের জিনিস আড়ালেই রাখুন। আজ আমি আড়াল করবো ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানেরা আড়াল করবে। তারাও নিশ্চয়ই বাবা প্রেমিক হবে। আপনি আর এসব নিয়ে ভাববেন না। কাল আমাকে হসপিটাল যেতে হবে আসুন ঘুমিয়ে পড়ি।”

ফারিশ কিছু বলে না। চুপ করে রয়। আদ্রিতা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার গায়ে জড়ানো ছিল ভাড়ি লেহেঙ্গা। আদ্রিতার হঠাৎ মনে হলো সে একটা কঠিন ভুল করে ফেলেছে। আসার সময় কোনো জামাকাপড় আনা হয় নি। এগুলো পড়ে তো ঘুমানো সম্ভব নয়। আদ্রিতা ফারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,“আপনার জামা কাপড় কোথায় থাকে মাফিয়া সাহেব?”

ফারিশ শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় আদ্রিতার দিকে। হাত দেখিয়ে আয়নার পাশেই বিশাল আলমারিটাকে দেখিয়ে বলে,“ওইখানে।”

আদ্রিতা দ্বিতীয়হীন এগিয়ে গেল সেখানে। আলমারি খোলাই ছিল। আদ্রিতা আলমারি খুলে দেখলো ফারিশের বেশ কিছু শার্ট প্যান্ট রয়েছে। আদ্রিতা অনেক খুঁজেফুজে মেরুন রঙের একটা ফু’হাতার টিশার্ট বের করলো। সঙ্গে কালো জিন্স। এরপর সেগুলো নিয়ে ছুটে গেল ওয়াশরুমের দিকে। ফারিশ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো আদ্রিতার কর্মকান্ড। কিছু বলতে পারলো না। তবে বুঝেছে খানিকটা। কেন নিলো?’

আধঘন্টা পরই মুখের সাজগাজ মুছে ফারিশের টিশার্ট আর জিন্স পড়ে বেরিয়ে আসলো আদ্রিতা। গায়ে গাতোরের অলংকার খুলে রাখলো আয়নার সামনে। এরপর খুলে ফেলা লেহেঙ্গাটা ফারিশের বেলকনিতে টানাতে গেল। ফিরে এসে ফারিশকে একই ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে বললো,“আপনি কি সারারাত ওভাবেই বসেই থাকবেন?”

ফারিশের উসখুস চাহনী। অস্থিরতায় বুকভাড়। সে মলিন মুখে আবদারের স্বরে শুধালো,“আমায় একটু জড়িয়ে ধরবে বউ?”

আদ্রিতা চকিত চমকে উঠলো। কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই পুরো ঘর জুড়ে অন্ধকার নামলো। কারণ ফারিশের ঘরে তখন লোডশেডিং হয়েছে। আদ্রিতা তখনও বেলকনির দরজার মুখে ঠায় দাঁড়ানো। হঠাৎ ম্যাচের কাটি জ্বলে উঠলো। ড্রয়ার থেকে মোমবাতি বের করে সেটা জ্বালালো ফারিশ। আলতো হাতে রাখলো ড্রেসিং টেবিলের উপর। আদ্রিতা এগিয়ে এলো। মুখোমুখি বসলো। মিষ্টি হেঁসে বললো,“ধরুন।”

ফারিশ দেরি করলো না মোটেও তক্ষৎনাৎ জড়িয়ে ধরলো আদ্রিতাকে। আদ্রিতা চুপচাপ বসে নিজেও ধরেছে তো ফারিশের পিঠ। লোকটার বুকভরা চাপা আর্তনাদ আদ্রিতা টের পাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমরা ভুল কাজ থেকে সরে আসতে চাইলেও সরে আসতে পারি না। কারণ সরে আসার সময়টায় যে আমরা বড্ড দেরি করে ফেলি। আদ্রিতা চায় ফারিশ সব থেকে বেরিয়ে আসুক। কিন্তু ফারিশ যে বললো, বেরিয়ে আসতে চাইলেই মৃত্যু নিশ্চিত। কথাটা ভেবেই বুক কেঁপে উঠলো আদ্রিতার। সে ফারিশের শার্টটা পিছন থেকে শক্ত করে চেপে ধরলো। আদ্রিতা হঠাৎ বললো,“আপনি একবার আমায় আবদার করে ছিলেন আমাদের যতবার দেখা হবে ততবার যেন আমি আপনায় দশ মিনিট করে জড়িয়ে ধরি। সে আবদার এতদিন আমি রাখি নি। তাই আজ থেকে আপনি দশ মিনিটের জায়গায় আমায় ত্রিশ মিনিট জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে পারবেন আমি কিছু মনে করবো না।”

ফারিশ কথাটা শোনে। ঠোঁট মেলে কিঞ্চিৎ হাসে। তবে কিছু বলে না। আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরার মাঝে ফারিশ বরাবরই অন্যরকম প্রশান্তি পায়। ফারিশ চোখ বন্ধ করলো। প্রকৃতি তখন নীরব। অন্ধকারে টুইটুম্বর পুরো শহর। আকাশ জুড়ে থাকা চাঁদটাও বুঝি মেঘে থাকতে ব্যস্ত। তবে এতো ব্যস্ততার ভিড়েও মিট মিট করে জ্বলছিল একখানা আগুনবাতি।”
—-
সূর্যের তীব্র রোদে ঘুম ভাঙলো ফারিশের। পাশ ফিরে আদ্রিতাকে না দেখে খানিকটা চমকে উঠলো। শোয়া থেকে উঠে বসলো দ্রুত। জোরে হাক দিয়ে ডাকলো,“আদিব।”

আদিব দ্রুত ছুটে আসলো তখন। থরথর করে বললো,“বলুন ভা…

পুরো কথা শেষ করার আগেই ড্যাব ড্যাব করে ফারিশের দিকে তাকিয়ে রইলো আদিব। ফারিশ নিচের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করলো,“আদ্রিতা কোথায় আদিব?”

আদিব জবাব দিলো না। ফারিশের দিকেই চেয়ে রইলো শুধু। ফারিশ এবার তাকালো আদিবের দিকে। বললো,“কি হলো আদিব কথা বলছো না কেন?”

পুরো কথা শেষ করে আদিবের মুখশ্রীর দিকে তাকাতেই বিব্রত হলো ফারিশ। আদিব যেন কিভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফারিশ অবাক স্বরে বললো,“কি হলো আদিব তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে এর আগে দেখো নি।”

আদিব আচমকা লাজুক হাসলো। বেশ লাজুকতা নিয়ে বললো,“দেখেছি তো ভাই তবে আজকে।”

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল আদিব। ফারিশ হতভম্ব হয়ে চেয়ে। ব্যাপারটা কি হলো?”
ফারিশ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নিজের শার্টের দিকে তাকালো। সামনের কিছু বোতাম খোলা সঙ্গে বুকের উপরে লিপস্টিকের দাগ। ফারিশ বিস্মিত হয়ে গেল ঘটনাটায়। হতভম্ব স্বরে বললো,“এসব লাগলো কখন? কাল রাতে ছাহ্। আদিব কি ভাবলো তাকে। পরক্ষণেই ভাবলো এত ভাবার কি আছে বউ কিস করেছে পাশের বাড়ির খসেটি খালা তো দেয় নাই। ফারিশ নিজের আচরণে নিজেই অবাক। ফারিশ আবার লজ্জা পাওয়া শুরু করলো কবে!’ ফারিশ একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে টাওয়াল হাতে ওয়াশরুমে চলে গেল।’

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আজকের ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে আদ্রিতা। রান্না প্রায় শেষ। আদ্রিতার গায়ে জড়ানো সবুজরঙা শাড়ি। শাড়িটা আদিব তাকে দিয়েছে। কাল রাতেই চাঁদনীকে নিয়ে কিনেছিল এটা। শাড়িটা ফারিশের রুমের আলমারির পাশেই ব্যাগের মধ্যে ছিল। কিন্তু আদ্রিতা দেখে নি। দেখেছে আজকে সকালে। শাড়ির উপর ব্যাগের মধ্যে ছোট্ট চিরকুটে লেখা ছিল,“ডাক্তার ভাবি এটা আপনার জন্য।”

চিরকুট পড়ে আদ্রিতা মিষ্টি হাসে তখন। তারপরই শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে চলে আসে নিচে। আদ্রিতা খাবার বেড়ে টেবিলের রাখলো। সেই মুহূর্তে সেখানে হাজির হলো আদিব। বললো,“ডাক্তার ভাবি এসব কি করছো? সকালের নাস্তা প্রায় সময় আমি বানাই।”

আদ্রিতা মিষ্টি হেঁসে বলে,“আজ থেকে আমি বানাবো। আর কিছুদিন পর আমি আর চাঁদনী।”

আদিন লাজুক হাসলো এতে। বললো,
“বিয়েটা কি করতেই হবে ডাক্তার ভাবি?”
“অবশ্যই। বিয়ে না করলে আমি আর চাঁদনী একসাথে থাকবো কেমন করে। তুমি বসো ভাইয়া আমি বাকি খাবার নিয়ে আসছি।”

আদিবও বলে,
“আচ্ছা ডাক্তার ভাবি।”

আদিব চেয়ারে বসলো। আদ্রিতা গেল রান্নাঘরের দিকে। এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো ফারিশ। গায়ে জড়ানো নেভিব্লু কালারের শার্ট, কালো প্যান্ট। আদিব ফারিশকে দেখেই হাসলো। ফারিশ এগিয়ে এসে বললো,“এভাবে হাসার কি আছে জীবনে লিপস্টিক দেখো নি।”

আদিব কোনোরকম বললো,“দেখেছি তো ভাই। তবে মেয়েদের ঠোঁটে। আপনার শরীরে পেতথমবার।”

ফারিশ বসতে বসতে বললো,“আমিও তোমার শরীরে পেতথমবার দেখার ব্যবস্থা করছি দাঁড়াও।”

কথা শুনে আদিবের কাশি উঠলো হঠাৎ।’

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৫

হঠাৎই আদিবকে কাশতে দেখে হকচকিয়ে উঠলো আদ্রিতা। খাবারের বাটিটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,“কি হলো ভাইয়া আপনি কাশছেন কেন?”

আদিব কিছু বলতে পারলো না। কাশতেই থাকলো।আদ্রিতা দ্রুত আদিবের হাতে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“পানি খান ভাইয়া?”

আদিব পানির গ্লাসটা নিলো। ঢকঢক করে পানি পান করে বললো,“শুকরিয়া ডাক্তার ভাবি।”

বিনিময়ে আদ্রিতা মৃদু হাসলো। ফারিশের নজর তখন আটকানো ছিল আদ্রিতার গায়ে জড়ানো সেই সবুজরঙা শাড়িটার দিকে। মুখের মৃদু সাজে আর কোমড়ে গুঁজে রাখা আঁচলের ভাজে যেন বউ বউ দেখাচ্ছে আদ্রিতাকে। ফারিশ দৃষ্টি সরালো। বেশি বেহায়া হচ্ছে নাকি তার চোখ। আদিব বুঝি খেয়াল করলো বিষয়টা। সে বললো,“ভাই চোখ সরানোর প্রয়োজন নেই আপনারই তো বউ।”

বিষম খেলো ফারিশ। চোখ গরম করে তাকালো আদিবের দিকে। আদিব হাসলো। দারুণ মিষ্টি দেখাচ্ছিল সেই হাসি। পুরোই তৃপ্তিময়। আদ্রিতা দুই ভাইয়ের ফিসফিস করে কথা বলার দৃশ্য দেখে বললো,“আমায় রেখে কি কথা হচ্ছে শুনি?”

আদিব কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও ফারিশ কথা কেঁড়ে নিয়ে বলে উঠল,“আদিবের বউ লাগবে।”

আদিব অবাক হলো ফারিশের কথা শুনে। সে কখন বললো তার বউ লাগবে। অাদ্রিতা টেবিলে বসতে বসতে বললো,“আজই কাজী অফিস চলুন আমাদের মতো আদিব ভাইয়ার বিয়েটাও দিয়ে দেই। কি বলুন?”

আদিবের আবার কাশি উঠলো। আদ্রিতা হতভম্ব হয়ে চেয়ে। পুনরায় পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,“কি হলো ভাইয়া আপনায় যক্ষা রোগে ধরলো নাকি এত কাশছেন কেন?”

ফারিশ হেঁসে উঠলো। মুখে স্যান্ডউইচ পুড়ে বললো,“ওসব যক্ষা টক্ষা কিছু না। আদিবের এই কাশিকে কি কাশি বলে জানো?”

আদ্রিতা বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,“কি কাশি?”
আদিব অসহায় মুখে ফারিশের পানে চেয়ে। ফারিশ বলে,“বউ কাশি।”

আদ্রিতা চোখ বড় বড় করে বললো,
“বউ কাশি আবার কি কাশি?”
“বউয়ের ভয়ে যে কাশি উঠে তাকে বলে বউ কাশি। আদিব বউ আসার ভয় পাচ্ছে তাই কাশছে। তাই আদিবের এই কাশিকে বলে বউ কাশি।”

ফারিশের কথা শুনে আচমকাই হেঁসে উঠলো আদ্রিতা। টেবিল কাঁপানো এক হাসি। আর আদিব লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে পুরো। আদিব কোনোরকম ব্রেকফাস্ট করেই উঠে গেল। যেতে যেতে বললো,“ভাই আমি গাড়িতে আছি তুমি সময় নিয়ে এসো।”

ফারিশ উত্তরে শুধু বলে,“হুম।”
আদিব যেতেই আদ্রিতা বললো,“আপনি কাজটা ঠিক করেন নি?”

ফারিশ অবাক হয়ে বলে,
“কোন কাজটা?”
“এই যে বউকাশি আদিব ভাইয়া লজ্জায় না খেয়ে চলে গেছে।”
“ওসব কিছু না। ও আমাদের দু’জনকে একত্রে রাখার জন্য দ্রুত বেরিয়েছে।”

আদ্রিতা কিছু বললো না। চায়ের কাপে চুমুক দিলো। ফারিশ শীতল স্বরে শুধালো,
“এত সেজেছে কেন?”
“কেন আমায় ভালো লাগছে না।”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“না।”
মনটা খারাপ হয়ে গেল আদ্রিতার। মাথা নুইয়ে ফেললো মুহূর্তেই। ফারিশ হেঁসে উঠলো। বললো,“কেউ অসুন্দর বললেই মানুষটা কিন্তু অসুন্দর হয়ে যায় না। কিছু অসুন্দর বলার মাঝেও দারুণ সুন্দরতা আছে। তুমি কি তা দেখতে পাও আমার সবুজরঙা বেলীপ্রিয়া।”

আদ্রিতা মুগ্ধ নয়নে তাকালো ফারিশের দিকে। মুখ ভাড় করে বললো,“তখন মিথ্যে বললেন কেন?”

ফারিশের মলিন চোখ। ঠোঁটে জড়ানো করুন হাসি। সে বলে,“মিথ্যে কখন বলেছি আমার না’য়ের মাঝেই হা’য়ের বসবাস। এখন তুমি ধরতে না পারলে আমি কি করতে পারি!”

আদ্রিতার বিস্মিত আঁখি। সে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“আপনি একটা যাচ্ছে তাই লোক।”

ফারিশও উঠে দাঁড়ালো তখন। আদ্রিতা তার পানে চেয়ে। ফারিশ আদ্রিতার কাছাকাছি এসেই কোমড়ে গুঁজিয়ে রাখা শাড়ির আঁচলটা টান মেরে বের করলো। আদ্রিতা হতভম্ব হয়ে গেল ফারিশের এহেম কান্ডে। চোখ বন্ধ করে ফেললো মুহূর্তেই। ফারিশ তা দেখে মৃদু হাসলো। আদ্রিতার কানের কাছে ঠোঁটটা নিয়ে ফিসফিস করে বললো,“জানি তো। আমি সত্যি খুব বাজে লোক।”

আদ্রিতা চোখ খুললো। দৃষ্টি হলো এক। আদ্রিতা বলে,
“আমায় কিন্তু হসপিটাল যেতে হবে।”
“সে যাও, তবে আমি ডাকলেই আসতে হবে কিন্তু।”
“আমি কি আসতে বাধ্য নাকি?”
“ভুলে যেও না আমার বিয়ে করা বউ তুমি। বাধ্য তো বটেই।”

হেঁসে ফেলে আদ্রিতা। বলে,“বিয়ে করতে ভয় পাওয়া মানুষটা বউয়ের উপর অধিকার দেখাচ্ছে ব্যাপারটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং।”

ফারিশের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর,“তুমি হয়তো জানো না আমি মানুষটাও দারুণ ইন্টারেস্টিং।”

আদ্রিতা গলা জড়িয়ে ধরলো ফারিশের। আদুরে গলায় আওড়ালো,“আপনি মানুষটা তো আমারই। ধীরে ধীরে দেখবেন আপনার সবটা জেনে নিবো।”

কথাটা বলেই টুক করে গালে চুমু কাটলো ফারিশের। ফারিশ হতভম্ব হয়ে বললো,“এই তুমি ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে আমায় চুমু খাবে না।”

আদ্রিতা বিস্ময়কর চাহনী নিয়ে বললো,
“কেন?”
“আমার একটা মানসম্মান আছে বুঝো না কেন?”
“স্বামীদের মানসম্মান থাকে না। এখন যান।”

আদ্রিতা ছেড়ে দিলো ফারিশকে। ফারিশ ছাড়লো না। নিজের গালটা আদ্রিতার গালে সাথে ঘষা দিয়ে বললো,“যে গালে বউ চুমু খায় সেই গাল নিয়ে হাসাহাসি মানায় না।”

ফারিশ চলে গেল। আদ্রিতা কিংকর্তব্যবিমুঢ় চাহনি নিয়ে দাঁড়িয়ে। ছেলেটা কি বলে গেল সব যেন মাথার উপর দিয়ে গেল। আদ্রিাতর ঠোঁটে তো লিপস্টিক ছিল না তবে ফারিশ মুছলোটা কি? আদ্রিতা বামহাতটা নিজের গালে লাগালো। তেল তেল লাগলো কিছু। আদ্রিতা চোখ গরম করে বললো,“অসভ্য লোক। খাবার খেয়ে মুখ মুছে নাই।”
—-
সে এক শুক্রবারের বিকেল। প্রকৃতি তার শীতের রেশ কাটিয়ে টগবগা গরম দিচ্ছে। আদ্রিতা আর ফারিশের বিয়ের কেটে গেল দু’দুটো মাস। আজ হসপিটাল বন্ধ আদ্রিতার। তাই ফারিশের রুমে বেলকনিতে চেয়ার পেতে হুমায়ুন আহমেদের লেখা ‘আজ আমি কোথাও যাবো না’ বইটি পড়ছে। আদ্রিতা তার অবসর সময়ে বই পড়তে পছন্দ করে। বাবার বাড়িতে তার ছোটখাটো একটা লাইব্রেরিও ছিল। ফারিশ আর আদ্রিতার বিয়ে উপলক্ষে কোনো বড়সড় অনুষ্ঠান করা গেল না। আদ্রিতার বাবা চেয়েছিলেন করতে কিন্তু আদ্রিতা বারণ করে। খুব অল্প মানুষের ভিড়ে নিজ বাড়িতে ছোটখাটো ভরপুর খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয় শুধু। সেখানে আদ্রিতার বাবার অল্প কিছু কলিগরা, আদ্রিতার বন্ধুবান্ধব আর তাদের আত্মীয়স্বজনরা থাকে। আদ্রিতার ফুপু খালারা খানিকটা রাগ করেছিল বটে। এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে ধাপ করে মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য। আদ্রিতার বাবামায়ের উপর ক্ষিপ্ত ছিল দারুণ। তবে রাগ বেশি রাখা গেল না। খাওয়াদাওয়ার মাঝেই চুকিয়ে গেল সবটা।’

বাড়ির কলিংবেল বাজলো হঠাৎ। আদ্রিতা হকচকিয়ে উঠলো তাতে। এই সময় কে আসলো। ফারিশ আসে তো সেই রাতে। আদ্রিতা বই রেখে উঠে দাঁড়ালো। চলে গেল নিচে। দরজা খুলতেই দেখলো পুলিশ অফিসার কিশোর এসেছে। আদ্রিতা তাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,“আপনি এখানে?”

কিশোর একগাল হেঁসে বললো,“কেমন আছেন ডাক্তার সাহেবা?”

আদ্রিতা বিরক্ত হলেও। মুখে বিনয়ের হাসি রেখে বললো,
“ভালো। আপনি?”
“আমিও ভালো।”

কিশোর ভিতরে ঢুকলো। বললো,“চা খেতে এলাম। ফারিশ সাহেব বাড়ি আছেন?”

আদ্রিতা বললো,
“না।”
“ঠিক আছে। আপনি চা বানিয়ে আনুন আমি বসছি।”

কিশোর সোফায় বসলো। আদ্রিতা বিস্মিত হয়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। এভাবে হুট করে কিশোরের চা খেতে আসাটা কতটা যুক্তিযুক্ত ধরতে পারছে না আদ্রিতা।’

ফারিশ আসলো তার কিছুসময় পরে। কিশোরকে দেখে সে কিছু বললো না। আদ্রিতা তখন রান্নাঘর থেকে কিশোরের জন্য চা বানিয়ে আনছিল। ফারিশকে দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো হঠাৎ। কোনোরকম বললো,“আপনি চলে এসেছেন?”

ফারিশ স্মিথ হেসে বললো,
“হুম।”

আদ্রিতা কিশোরের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে ফারিশকে বললো,
“আচ্ছা আপনি বসুন আমি আপনার জন্য চা নিয়ে আসছি।”

ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করলো তাতে। বললো,“চা খাবো না। কফি খাবো।’

আদ্রিতা বিনাবাক্যে তাই বানাতে গেল। আদ্রিতা যেতেই কিশোরের মুখোমুখি বসলো ফারিশ। বললো,“কেমন আছেন অফিসার সাহেব?”

কিশোর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
“ভালো। আরশাদকে ধরতে পেরেছি।”
“আমার সাহায্য নিলে আরো আগেই ধরতে পারতেন।”
“হয়তো পারতাম। তবুও নিজে খুঁজেছি ভাবলে গর্ববোধ হয়।”

ফারিশ সে কথার জবাব না দিয়ে বললো,
“কোথায় পেলেন?”
“কুমিল্লায়। পরিত্যাক্ত এক জমিদার বাড়িতে লুকিয়ে ছিল।”
“ওহ আচ্ছা।”
“জি।”
“এই খবর জানানোর জন্যই কি বাড়িতে এলেন?”
“যদি বলি আপনার বাড়িটা সার্চ করতে?”

ফারিশ ঘাবড়ায় না মোটেও। বলে,“করতেই পারেন। কিন্তু কারণ ছাড়া সার্চ করাটা আধও কি যুক্তিযুক্ত অফিসার সাহেব।”

কিশোর চর্তুথ বারের মতো চায়ের কাপে চুমুক দিলো তখন। একগাল হেঁসে বললো,“মজা করছিলাম। আপনার বউ কিন্তু চা টা দারুণ বানায়।”

ফারিশ কিছু বলে না। আদ্রিতা এগিয়ে আসে তখন। হাতে কফির কাপ। আদ্রিতা ফারিশের হাতে কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“ধরুন।”

ফারিশ নিলো। এর পরপরই কিশোর উঠে দাঁড়ালো। বললো,“ঠিক আছে আজ তবে আসি। পরে আবার দেখা হবে।”

ফারিশ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে,“এখনই চলে যাবেন আর একটু বসতেন।”

কিশোর আদ্রিতার দিকে একপলক চেয়ে বললো,“আজ থাক। অন্যআরেক দিন বসবো।”

কিশোর চলে গেল। আদ্রিতা বিমুঢ় তার পানে চেয়ে। সে ধরতে পারলো না কিশোর আচমকা এসে চলে গেল কেন! ফারিশ তার কফিটা শেষ করলো। মিষ্টি করে বললো,“আদ্রি শোনো?”

আদ্রিতা গেল। বিয়ের পর থেকে ফারিশ আদ্রিতাকে ছোট করে ‘আদ্রি’ ডাকে। আদ্রিতা ফারিশের সামনের টি-টেবিলটার উপরে বসলো। ফারিশ কিছু বলার আগেই আদ্রিতা বলে উঠল,“আমি কিন্তু ওনায় ডাকি নি।”

ফারিশ হেঁসে বলে,“জানি আমি।”
ফারিশ হাত বারিয়ে আদ্রিতা কাছে ডাকলো। আদ্রিতা গেল। তবে খানিকটা সংকোচ নিয়ে বললো,
“দরজা খোলা তো?”
“কিছু হবে না তুমি আসো।”

আদ্রিতা কোলে বসলো ফারিশের। বুকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। বললো,“কিছু কি হয়েছে?”

ফারিশ উত্তর দিলো সঙ্গে সঙ্গে,
“কি হবে? আমার তুমি থাকলে কিছু হয় নাকি।”
“আপনায় বড্ড বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।”
“ওসব কিছু না।”
“আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আপনি যখন দারুণ বিষণ্ণে তখনই এইভাবে জড়িয়ে ধরেন আমায়।”

ফারিশের উত্তর আসে না আর। আদ্রিতা প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
“আদিব ভাইয়া এলো না। কোথায় সে?”

ফারিশ এবার উত্তর দেয়। বলে,
“চাঁদনীর সাথে লুকোচুরি খেলছে।”

হেঁসে ফেলে আদ্রিতা। আজ থেকে ঠিক পনের দিন আগে বিয়ে হয় আদিব আর চাঁদনীর। ফারিশদের মতোই কোনো ঝাকঝমক ছাড়াই কাজী অফিসে বিয়ে দেয়া হয় তাদের। সে আদিবের কি ঘাবড়ানো। চাঁদনী কবুল বলতে সময় না নিলেও আদিব পাক্কা পনের মিনিট সময় নিয়েছে কবুল বলতে। আরো সময় নিতো তবে ফারিশের চোদ্দ মিনিটের ধমকের পর ফটাফট বলে ওঠে কবুল, কবুল, কবুল। তিন কবুল। আদিবের কান্ডে সেদিন হাসে সবাই। ফারিশও হাসে তবে সবার আড়ালে। উল্টোদিক ঘুরে। এখন এই বাড়িতে তারা চারজন থাকে। আদিব-চাঁদনী, ফারিশ আর আদ্রিতা। আদ্রিতা এবার বুঝলো এই জন্যই বুঝি একঘন্টা আগে চাঁদনী কাজের বাহানা দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। ফিরুক! আচ্ছা করে দেবে এক ঘা। বলে গেলে কি হতো?– আদ্রিতা সে নিয়ে ভাবলো না আর।’

ফারিশ আদ্রিতা অনেকক্ষণ চুপ থাকলো। হঠাৎ আদ্রিতা প্রশ্ন করে,
“কাজে যাবেন না?”

প্রশ্ন শুনে ফারিশের হাতের বাঁধন হয় শক্ত। শরীরের সমস্ত ভাড় লুটিয়ে পড়ে আদ্রিতার ঘাড়ে। সে চোখ বন্ধ করে শীতল স্বরে শুধায়,“আজ আমি কোথাও যাবো না।”

আদ্রিতা আচমকা চমকায়। কথাটা করুন লাগলো তার।’

#চলবে….

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৪২+৪৩

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪২

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ফারিশ আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। তার যেন এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আদ্রিতা এখন আর এই মুহূর্তেই কাজী অফিস গিয়ে বিয়ে করতে চাইছে। ফারিশের এই আচমকা ঘুম ভাঙিয়ে বিয়ের করার ব্যাপারটা টোটালই হজম হচ্ছে না। ফারিশ কিছু সময় চুপ থেকে বললো,“আপনার মাথা কি ঠিক আছে ডাক্তার ম্যাডাম নাকি বন্ধুর বৌভাত খেয়ে এসে মাথাটা পুরোই গেছে।”

আদ্রিতা বিরক্ত হলো দারুণ। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“আমি সিরিয়াস ফারিশ। দ্রুত উঠুন বিয়ে করবো।”

ফারিশ উঠলো না। চুপ করে বসে রইলো। ‘এমন হুট করে বিয়ে করবো বললেই কি তাকে বিয়ে করতে হবে নাকি’। আদ্রিতা তাড়া দিয়ে বললো,“কি হলো ফারিশ উঠছেন না কেন?”

ফারিশ তার চুলগুলো খানিকটা ঠিক করে বললো,“মুড নেই আমার।”

আদ্রিতা অবাক হয়ে বলে,“মুড নেই মানে। আপনি তো বললেন আজ বিকেলে বিয়ে করবেন।”

ফারিশ এতক্ষণ পর যেন সবটা বুঝলো। তার সকালের মজার ছলের কথাটা আদ্রিতা সিরিয়াসভাবে নিয়েছে। ফারিশ মৃদু হাসলো। বললো,“আমি আপনায় বিশ্বাস করি আদ্রিতা তাই এখন বিয়ে করার প্রয়োজন নেই।”

আদ্রিতা আচমকাই ফারিশের শার্টের কলার টেনে নিজের দিকে টানলো। ফারিশ হতভম্ব হয়ে চেয়ে। আজকের আদ্রিতার আচরণ বড়ই উদ্ভট। আদ্রিতা ফারিশের চোখে দিকে চোখ রেখে গম্ভীর এক স্বরে বললো,“আমার দারুণ প্রেম প্রেম পেয়েছে তাই আমরা বিয়ে করবো।”

ফারিশের চক্ষু বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে বলে,“এসব আপনি কি বলছেন?”

বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হচ্ছে আদ্রিতা। জোরে নিশ্বাস ফেলে বিরক্ত নিয়েই বলে,“আপনি কি উঠবেন ফারিশ নাকি আমি চলে যাবো।”

ফারিশ আদ্রিতার হাত দুটো নিজের কলাট থেকে ছাড়ালো। শান্ত গলায় বললো,“এভাবে কি বিয়ে হয় ডাক্তার ম্যাডাম? আমার না হয় আদিব ছাড়া কেউ নেই কিন্তু আপনার তো আছে। আপনার বাবা মা তাদের পারমিশন তো নেয়ার প্রয়োজন।”

আদ্রিতা মৃদু হেসে বলে,“তারাও রাজি। আমি সকালেই তাদের কাছে আপনার কথা বলে দিয়েছি। আপনার ছবি দেখিয়েছি মা পছন্দ করেছে। বাবা প্রথমে একটু নাকচ করেছিল কিন্তু যখন শুনেছে আপনি একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক তখন থেকে আর কিছু বলে নি। আর বাবা আপনায় চেনে কাছ থেকে না হলেও দূর থেকে চেনে। তাই আর সমস্যা নেই। এখন চলুন।”

ফারিশের পুরো ব্যাপারটা যেন মাথা উপর দিয়ে গেল। এমন সময় তাদের কক্ষে এক প্রকার দৌড়ে ঢুকলো মৃদুল। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,“দুলাভাই কই আপনে?”

বলতে বলতে দৌড়ে গিয়ে ফারিশের গলা জড়িয়ে ধরলো মৃদুল। মৃদুলের আকস্মিক এমন কান্ডে ফারিশ চমকে উঠলো। মুনমুন এগিয়ে এসে বললো,“দুলাভাই দুলাভাই চলুন না কাজী অফিস যাই, বান্ধবীর মনে খালি আপনারে চায় আপনারে চায়।”

ফারিশ একে পর এক অদ্ভুত কান্ডে কি করবে বুঝছে না। এই পাগলের দল কোথা থেকে উদয় হলো। রনি ব্যাঙের মতো নাচতে নাচতে বললো,“আরেহ দুলাভাই আপনি এহনো রেডি হোন না কেন? কাজী অফিস যাবেন না।”

ফারিশ করুণ চোখে তাকালো রনির দিকে। এরই মাঝে চাঁদনী আসলো দৌড়ে। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,“ওরে দুলাভাইইইইই…

চাঁদনীর দৌড়ানো ছিল খুব ভয়ানক। যে ছুটে এসে ধাক্কা খেল রনির সাথে রনি ছিটকে পড়লো তার সামনে থাকা মুনমুনের সাথে। মুনমুন ছিঁটকে গেল মৃদুলের গায়ে। মৃদুল পড়বে তার আগে তাকে আটকালো ফারিশ। ঘটনা চক্রে সবাই হতভম্ব। আর ফারিশের মাথায় একটা কথাই ঘুরছিল তখন, “এই পাগলের দল সব আদ্রিতার বন্ধু।”

মৃদুল নিজেকে উঠিয়ে শুঁকনো হেঁসে বললো,“ধন্যবাদ দুলাভাই।”

সেই মুহূর্তে দরজা মুখে হাজির হলো মৃদুলের বউ, নীলিমা তার সাথে আশরাফ আর নয়নতারাও। সেও এসেছে এদের সাথে। সবাই উৎফুল্লের সাথে বলতে লাগলো,“দুলাভাই উঠেন বিয়ে করবেন না?”

এক নিমিষেই ফারিশের ঝিমিয়ে থাকা পুরো বাড়ি নেচে উঠলো। হাসি তামাশায় মক্ত হলো চারপাশ। আদিব দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার চোখে হঠাৎই পানি আসছে। তাদের এত বছরের জীবনে এমন উৎফুল্লকর ঘটনা কখনো ঘটে নি। ফারিশ নিজের কান চেপে ধরলো চারপাশের সবাই একটা কথাই বলে চলছিল তাকেত,“দুলাভাই বিয়ে করবেন না?”

অতঃপর ফারিশ মেনে নিলো। হাল্কা চেঁচিয়েই বললো,“তোমরা সবাই থামো আমি বিয়ে করবো।”

সবাই থেমে গেল হঠাৎ। খুশিতে গদগদ হলো মৃদুল,রনি,চাঁদনী, মুনমুন, আশরাফ,নীলিমা আর নয়নতারা। আদ্রিতা হাসলো এবার। উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,“সত্যিই বিয়ে করবেন ফারিশ?”

ফারিশও নিরুপায় ভঙ্গিতে বললো,“হুম।”
একে একে সবাই বের হলো রুম থেকে। আদ্রিতাও গেল তাদের সাথে। সঙ্গে ফারিশকে বললো, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হতে’। ফারিশও বিনিময়ে জবাব দিলো, ‘ঠিক আছে’। যাওয়ার পথে দরজার মুখে চাঁদনী আদিবের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো শুধু। চোখের ইশারায় বুঝালো,“এরপর তার পালা।”

আদিব বুঝলো বিনিময়ে কিছুই বললো না। শুধু লাজুক হাসলো। সবাই বের হতেই আদিব ভিতরে ঢুকলো। স্বল্প আওয়াজে বললো,“দুলাভাই,,

ফারিশ হতাশ মুখে তাকালো আদিবের দিকে। বললো,“তুমিও শুরু করলে আদিব।”

আদিব উৎফুল্লতা নিয়ে কঠিন সুন্দর এক হাসি দিলো। হাসি হাসি মুখে বললো,
“ভাই আজ আমি খুব খুশি।”

ফারিশ ভাবলো না। উল্টো বললো,
“বিষয়টা তোমার কাছে খুব দ্রুত দ্রুত লাগছে না।”
“আমি জানি ভাই একটা মানুষের থেকে ধোঁকা খাওয়ার পর দ্বিতীয়বার তাকে বিশ্বাস করতে আমাদের সময় লাগে, তার সব কাজেই দ্বিধা কাজ করে। কিন্তু এবার আপনি ঠকবেন না দেইখেন। ডাক্তার ভাবি আপনায় সত্যি ভালোবাসে। আপনি ফ্রেশ হন আমি আপনার জন্য একটা সুন্দর পাঞ্জাবি বের করছি।”

ফারিশ নাকচ করলো সঙ্গে সঙ্গে। বললো,“না পাঞ্জাবি লাগবে না। তুমি কালো রঙের শার্ট বের করো।”

আদিব অবাক হয়ে বললো,“কালো কেন?”
ফারিশ ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,“এমনি।”
—-
বেলা তখন চারটার কাটা ছাড়িয়ে সাড়ে পাঁচটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। ফারিশদের ড্রয়িং রুমে বসে ফারিশের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। ছেলেটা এত দেরি করছে। আদ্রিতা তার ভাড়ি লেহেঙ্গা ধরে উঠে দাঁড়ালো। বললো,“তোরা বস আমি দেখে আসি ওর কতদূর হলো।”

আদ্রিতার কথা শুনে সবাই ‘ও হ’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। আদ্রিতা বিমূঢ় চেয়ে। মুনমুন বললো,“আরেহ বাস এখনো বিয়েই হয় নি তার আগেই ‘ওর’। বিয়ে হলে কি ডাকবি রে আদু জানু, বাবু,সোনা।”

আদ্রিতা হেঁসে বললো,“হুস এর চেয়েও ইউনিক কিছু।”

চাঁদনী অবাক হয়ে বললো,“সেটা কি?”
আদ্রিতা জবাব দিলো না। মিষ্টি হেঁসে ছুটলো ফারিশের কামরার দিকে।”

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে ফারিশ। গায়ে জড়িয়ে কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, শার্টটা ইন করে পড়া,শার্টে হাতাও কনুই পর্যন্ত বোল্ড করা। চুলগুলো খানিকটা অগোছালোই রাখলো আজ। আদিব তার দিকে চেয়ে। ফারিশ তার পায়ে কালো শু জুতো জোড়া পড়তে নিলেই আদিব বসলো নিচে। ফারিশ অবাক হয়ে বললো,“এসব কি করছো আদিব?”

আদিব ফারিশের হাত থেকে জুতো জোড়া নিয়ে আদুরে গলায় বললো,“আমি পড়িয়ে দেই ভাই?”

আদিব এমন ভাবে কথাটা বললো যে ফারিশ চেয়েও আর না করতে পারলো না। ফারিশ পায়ে মুজা জড়ালো আগে। বললো,“কিছু কি বলবে আদিব?”

আদিব যেন চমকে উঠলো। কি করে বুঝলো তার ভাই সে কিছু বলতে চায়। ফারিশ আদিবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,“তুমি আমার ছোট ভাই আদিব আমি তোমায় বুঝবো না।”

আদিব হাসে। নিজ হাতে ফারিশের ডান পায়ে আগে জুতাটা পড়াতে পড়াতে বলে,“আমার জন্যই আপনার জীবনটা এমন এলেমেলো তাই না ভাই।”

ফারিশ অবাক হয়ে বললো,
“তোমার জন্য মানে?”
“আমার জন্যই তো আপনি মাফিয়া ভাই। ওইদিন যদি আমার জন্য খুন না করতেন। তবে তো আজ আমরা এমন থাকতাম না।”
“না মারলে আমরা কি বেঁচে থাকতাম আদিব?”
“তা হয়তো থাকতাম না কিন্তু এমন পাপ কাজ করেও তো বেঁচে থাকা লাগতো না। আমরা মরার পর কি জবাব দিবো ভাই?”
“তোমার জবাব দেয়া লাগবে না তুমি পাপী নাকি। পাপি তো আমি। তুমি ভালোই থাকবে।”

আদিব ছলছল নয়নে ফারিশের দিকে তাকালো। তার চোখ ভেসে উঠেছে। সেই ছোট বেলা থেকেই ফারিশ আদিবের যত্ন করে। ফারিশের কাছাকাছি সবসময় থাকলেও আদিব কখনো তার কাজে নিযুক্ত হতে পারে নি। সে সব জানে কখন ফারিশ কি করে? টুকটাক খবরাখবর দেয় কিন্তু আদিবকে কখনো সেই নেশালো দ্রব্য হাত দিয়ে ছোঁয়ার অধিকার দেয় নি ফারিশ। যা করার ফারিশই করতো আদিব শুধু দেখতো। তার বয়স যখন বিশ তখনও আদিব এই বেআইনি কারবার সম্পর্কে অবগত ছিল না। এরপর হুট করেই সে সবটা জানে। ফারিশও আর লুকিয়ে রাখে নি। লুকিয়ে আর কতকাল রাখবে যে সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে থাকে। আদিব ফারিশের হাত ধরে বললো,“কাজটা কি ছাড়া যায় না ভাই?”

ফারিশ অদ্ভুত নয়নে তাকিয়ে বলে,“কিভাবে ছাড়ি? তুমি তো জানো সবটা।”

আদিব আর কিছুই বললো না। ফারিশ কেমন একটু করে যেন বললো,“আমি কি বিয়ে করে ভুল করছি আদিব?”

আদিব বলে,“না ভাই। ডাক্তার ভাবি তো সব জানে।”
ফারিশ কিছু বলে না। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আদ্রিতার ভিতরের সব কথাই শোনে। বলে না আর কিছুই নীরবে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।’

ঢাকার মানুষ তখন মাগরিবের নামাজ সেরেছে অনেকক্ষণ। সময় তখন প্রায় রাত আটটা। কবুল বলার মাধ্যমে কাজী অফিসেই বিয়ে হয়ে গেল ফারিশ আর আদ্রিতার। আদ্রিতার মা বাবা আর ছোট ভাইও সেখানে উপস্থিত ছিল। বিয়ের শেষে গলায় মালা পড়ালো দুজন দুজনকে। আদ্রিতার মুখ হাসি হাসি। ফারিশ মলিন মুখে তার পানে চেয়ে। করুণ গলায় আওড়ায়,
“আপনি হাসছেন। অথচ আমার হৃদয়টা ভিতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমি মরছি,অন্তরটা ঝলসে যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে পুড়ছে আর যেন কইছে,ফারিশ কি ভুল করেছে?”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৩

আঁধার রাতে কাজী অফিসের বাহিরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে নয়নতারা আর আশরাফ। দুজনের চোখে মুখেই লাজুকতার ছোঁয়া। আশরাফ বললো,“আপনি চাইলে কিন্তু আমরাও বিয়েটা করে নিতে পারি।”

নয়নতারা আশরাফের চোখের দিকে তাকালো। শান্ত স্বরে আওড়ালো,
“আমাদের কি বিয়ে করার কথা ছিল?”
“ছিল না। তবে কথা হতে কতক্ষণ!’

মৃদু হাসলো নয়নতারা। বললো,
“আপনায় আমি করবো কেন?”
“আপনার মন তো এই প্রশ্নের উত্তর জানে। আপনি না জানলে আমি কি করতে পারি।”

চমৎকার হাসি ফুটে উঠলো নয়নতারার ঠোঁটে। হৃদয় জুড়ে প্রেমাসক্তের ঢেউ। সে বললো,“আমি কিন্তু পুলিশ। সন্দেহের রেশ কিন্তু সবসময় থাকিবে।”

আশরাফ হাসলো হঠাৎ। বললো,“আমিও ডাক্তার। আপনায় চুপ করার ঔষধ কিন্তু আমার জানা।”

নিজেদের কথায় নিজেরাই হাসলো দারুণ। প্রশান্তিকর মুহূর্ত সৃষ্টি হলো মুহূর্তেই। আশরাফ হাত ধরলো নয়নতারার। বললো,“আমি কিন্তু আপনার জামাই হিসেবে খারাপ হবো না।”

নয়নতারাও হাতে হাত রাখলো আশরাফের। বলে উঠল,
“আমিও আপনার বউ হিসেবে খারাপ হবো না তবে।”
“তাহলে সবাইকে জানাই।”

লাজুকলতা মুখশ্রী নিয়ে বললো নয়নতারা,“জানান।”

দুজনেই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো দুজনের মুখশ্রীর দিকে। এরই মাঝে মৃদুল হেঁসে বলে উঠল,“দেইখা লাইছি কইয়া দিমু। ও ওহ দেইখা লাইছি কইয়া দিমু।”

মৃদুলের আচমকা কথা শুনে আশরাফ নয়নতারা দুজনেই চমকে উঠলো। হাত ছেড়ে দুজনেই ছিঁটকে চলে গেল দূরে। মৃদুল হেঁসে উঠলো তাতে। আবারও বললো,“দেইখা লাইছি কইয়া দিমু।”

আশরাফ কপট রাগ দেখিয়ে বললো,“কি দেখছোস তুই?”

মৃদুল আশরাফের কাঁধে হাত থেকে রেখে শান্ত স্বরে বললো,“পরপর কতগুলা বিয়া খামু দুস্ত।”

আশরাফ বলে,“এখনও দুটো।”
মৃদুল আফসোসের স্বরে বলে,“এই বিয়ার চক্করে আমি হানিমুন কবে যামু ভাই।”
আশরাফ মৃদুলের বাহুডোর থেকে স্বরে এসে বললো,“একা যাবি কেন আমরাও সঙ্গে যামু বার চা।”

আশরাফ চলে গেল। মৃদুল ফ্যাল ফ্যাল নয়নে শুধু আশরাফের যাওয়ার পানে তাকিয়ে।’

কাজী অফিস খালি হলো। মৃদুল নীলিমা, আশরাফ নয়নতারা, রনি আর মুনমুন চলে গেল মাত্র। এখন আদ্রিতাদের যাওয়ার পালা। ফারিশ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। গলায় তার এখনো মালা জড়ানো। আদিব একটু দূরে চাঁদনীর সাথে কথা বলছে। তাদের মান অভিমানের পাল্লা চলছে। ওই যে গত কয়দিন আদ্রিতার জন্য সে চাঁদনীর সাথে আড়ি করেছিল তারই বোঝা পড়া চলছে। আদিব শুধু বলেছে,“তার মাথায় হঠাৎ গন্ডগোল হয়েছিল যার দরুন এমন অবহেলা।”– চাঁদনী তো তা মানতে নারাজ। পরে অনেক ভুংভাং বুঝিয়ে শেষমেশ মানালো।’

আদ্রিতা দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা মা আর ভাইয়ের সামনে। আদ্রিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন সে ফারিশের সাথে যাবে। তার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ফারিশের তাকে খুব প্রয়োজন। আদ্রিতার বাবা খানিকটা রেগে আছেন বিষয়টায়। এভাবে হুট করে বিয়েটা তিনি মানতে পারছেন না। মূলত মেয়ের হঠাৎ পাগলামির দরুণ তাদের আসতে হয়েছে এখানে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা খুব আবেগী এরা একটু হলেও আত্মহত্যার ভয় দেখায়। আদ্রিতার বাবা ঘুনাক্ষরে টের পান নি তার মেয়েও এমন করবে। ফারিশ সম্পর্কে আদ্রিতার বাবা আগেই অবগত ছিলেন। মেয়ের হঠাৎ চুপচাপ হওয়ার সময়টাতেই তিনি বুঝেছেন। মেয়ের লেখা কিছু ডাইরিও তিনি পড়েছেন। আড়ালে খোঁজ করেছেন ফারিশের। ছেলে ভালো। বাবা মা নেই। বিষয়টায় প্রথমে একটু খারাপ লাগলেও পরে মেনে নিয়েছিলেন। মেয়েকে আটক করা হয়েছিল ফারিশ বাঁচিয়েছে এ খবরও আদ্রিতার বাবা মা জানে। মূলত কাল রাতে আদ্রিতা বাড়ি না ফেরায় তারা পুলিশ স্টেশন যান। সব শোনেন। চিন্তিত হয়ে কিশোরের সাথে যেতে চাইলেও পরে কেন যেন যান নি। কিন্তু সকাল বেলাই মেয়ে হুট করে এসে বললো,“সে বিয়ে করবে ছেলের নাম ফারিশ। যে কিনা ঔষধ কোম্পানির মালিক।”

আদ্রিতার বাবার তাতে দ্বিমত ছিল না। কিন্তু আদ্রিতা বললো সে আজই বিয়ে করবে। এক্ষেত্রে নাকচ করেন আদ্রিতার বাবা। শেষে প্রচুর কথা-কাটাকাটি হয় তার আর মেয়ের মাঝে। এক পর্যায়ে আদ্রিতা হুমকি দেয় আজকের মধ্যে বিয়ে না দিলে সে আত্মহত্যা করবে। মেয়ের আচমকা এমন কান্ডে থতমত খেয়ে যান সবাই। শেষমেশ হার মানেন। আদ্রিতার বাবা বেশ বুঝতে পারছেন মেয়ের এমনটা করার পিছনে কোনো কারণ আছে। কিন্তু কারণটা কি তা ধরতে পারছেন না।’

আদ্রিতা তার মা ভাইয়ের সাথে কথা বললো। তারাও মুখ ভাড় করা ছিল। তবে অসুখী ছিল না। ছেলে তাদের পছন্দ হয়েছে।’

আদ্রিতা সবার পরে গেল তার বাবার কাছে। তিনি গম্ভীর এক আওয়াজে বললেন,“এদিক আসো।”

আদ্রিতা গেল। সে বোধহয় জানে এখন তার বাবা কি বলবে। আদ্রিতার বাবার প্রথম প্রশ্ন ছিল,
“এত তাড়াহুড়োর কি ছিল?”

আদ্রিতা চোখ গেল একটা ছেলে হাতে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে যাচ্ছে তার দিকে। আদ্রিতা উৎফুল্ল নিয়ে বললো,“বাবা চলো হাওয়াই মিঠাই খাই।”

আদ্রিতার বাবা বিমুঢ় মেয়ের পানে চেয়ে। আদ্রিতা তার বাবার হাত ধরে এগিয়ে গেল। দুটো হাওয়াই মিঠাই কিনে একটা বাবার হাতে আরেকটা নিজে নিলো। এরপর সামনের একটা ছোট্ট বেঞ্চিতে বসতে বসতে বললো,“বসো বাবা।”

আদ্রিতার বাবা বসলেন। আদ্রিতা পলিথিন ছিড়ে এক টুকরো হাওয়াই মিঠাই মুখে পুড়ে শান্ত স্বরে বলতে লাগলো,“জানো বাবা আমি না আমার জীবনে একটা ক্ষতমিশ্রিত গভীর শিক্ষা পেয়েছি।”

আদ্রিতার বাবা বিস্মিত হলেন। কণ্ঠখাদে চিন্তিত স্বর এঁটে বললেন,“কি শিক্ষা?”

আদ্রিতার মলিন মুখ। চোখ ছলছল। ঠোঁটে জড়ানোর বিস্ময়ের হাসি। সে বললো,“শিক্ষাটা হলো কারো বিশ্বাস পাওয়ার পর তা ভেঙে দিলে দ্বিতীয়বার সেই মানুষটার বিশ্বাস পাওয়া দারুণ কঠিন।”

আদ্রিতার বাবা গম্ভীর কণ্ঠ বললেন,“বুঝিয়ে বলো।”
আদ্রিতা সরাসরি তার বাবার চোখের দিকে চাইলো। এরপরই মাথা নুইয়ে বললো,“আমি ফারিশের সাথে একটা অন্যায় করেছিলাম তার বিশ্বাস ভেঙেছি। তারপর চেষ্টা করেছি আমার বিশ্বাস আবার ফিরিয়ে আনতে কিন্তু পারি নি। এখনও পেরেছি কি না জানি না।”

আদ্রিতার বাবা নড়েচড়ে উঠলেন। অবাক হয়ে বললেন,“তার মানে তুমি শুধু ছেলেটার বিশ্বাস পাওয়ার জন্য বিয়েটা এত তাড়াহুড়ো করে করেছো?”

আদ্রিতা বাবার পানে তাকিয়ে বললো,
“কিছুটা। তবে আমার আরো একটা কারণ আছে।”
“কারন কি?”
“সেটা টপ সিক্রেট। তোমায় বলা যাবে না।”

আদ্রিতার বাবা আর জোর করলো না। আদ্রিতা তার বাবার হাত ধরে বললো,“আমায় ক্ষমা করো বাবা সকালের ওই পাগলামির জন্য।”

আদ্রিতার বাবা ক্ষমা করলেন কি না বোঝা গেল না। তবে তিনি আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,“যাই করো না কেন ভেবে করো।”

আদ্রিতাও মাথা নাড়িয়ে আশ্বাস দিলো। যার অর্থ ‘ভেবে করবে’!
—-
আচমকাই কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলো ফারিশ। আদ্রিতার মা তার পিছনে দাঁড়িয়ে। ফারিশ দ্রুত ফোন কেটে পকেটে পুড়লো। আদ্রিতা মা বললেন,“এভাবে হুট করে তুমি আমার জামাই হয়ে যাবে এ আমি কস্মিনকালেও ভাবি নি। তা কেমন আছো তুমি?”

ফারিশ দ্বিধাবোধ নিয়ে কোনোরকম বললো,
“ভালো আপনি?”
“আমিও ভালো। আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা। একটু পাগল টাইপ আছে কিন্তু এমনিতে খুব ভালো। তোমার খুব যত্ন নিবে দেখে নিও।”

ফারিশ কি বলবে বুঝচ্ছে না। সম্পর্কে এই মহিলা তার শাশুড়ী হয়। শাশুড়ীদের সাথে কিভাবে কথা বলতে তাও জানে না ফারিশ। ফারিশ কিছু সময় নিয়ে বললো,“চিন্তা করবেন না আমি দেখে রাখবো।”

উত্তরে মিষ্টি হাসে শুধু আদ্রিতার মা। রাফিন এগিয়ে আসে তখন। বলে,“দুলাভাই আমার নাম রাফিন। আমি আপুর ছোট ভাই। সম্পর্কে আপনার শালা।”

ফারিশ মাথায় হাত রাখলো রাফিনের। বললো,“কেমন আছো তুমি?”

রাফিনও ছোট করে উত্তর দিলো,“ভালো আপনি দুলাভাই।”

ফারিশও বললো,“ভালো।”
টুকটাকি কথা হলো মাঝে। রাত আটটা পেরিয়ে দশটা বেজেছে তারা এখনও কাজী অফিসের বাহিরে দাঁড়িয়ে।’

অতঃপর আদ্রিতা সে রাতেই ফারিশের গাড়ি করে ছুটলো শশুর বাড়ি। পুরো সময় তার খারাপ না লাগলেও গাড়িতে ওঠার পর বুক চিঁড়ে আর্তনাদ বের হচ্ছিল। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো খুব। বিয়েটা হঠাৎ এমন ভাবে হয়ে যাবে এ যেন আদ্রিতাও ভাবে নি।’
—–
তখন গভীর রাত। ঘড়িতে বারোটা পেরিয়েছে অনেকক্ষণ। ফারিশের ফুল দেয়া বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে আদ্রিতা আর ফারিশ। মূলত এই রাতটি তাদের বাসর রাত। হঠাৎ বিয়ে,হঠাৎ বাসর রাত। হঠাৎ নিজের রুম ভাগ হওয়ার বিষয়টায় ফারিশ বড্ড নড়বড়ে হচ্ছে। সবকিছু এত বেশি তাড়াতাড়ি হলো যে ফারিশ কিছু টেরই পেল না। তার যেন এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তার বিয়ে হয়েছে গেছে। খাটে ফুল বিছানোর কাজটা আদিবের। কতগুলো গোলাপ ফুলের পাপড়ি বিছিয়ে দেয়া হয়েছে খাটে। আদ্রিতা ফারিশের হাত ধরলো হঠাৎ। সঙ্গে সঙ্গে ফারিশ চমকে উঠলো। আদ্রিতা বললো,“এত ভয় পাচ্ছেন কেন?”

ফারিশ আতঙ্কিত স্বরে বললো,
“আমার কি ভয় পাওয়া উচিত নয়?”
“আশ্চর্য! আপনি একজন মাফিয়া হয়ে আমার সামনে ভয় পাচ্ছেন স্বামী।”

ফারিশের কাশি উঠলো হঠাৎ। এই মেয়ে বলে কি ‘স্বামী’! ফারিশকে কাশতে দেখে আদ্রিতা দ্রুত একগ্লাস পানি দিলো ফারিশের হাতে। ফারিশ ঢকঢক করে পুরো পানিটা গিলে নিলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো। চুপ থাকলো অনেকক্ষণ। আদ্রিতা বললো,“আমার বেবি চাই।”

এবার যেন ফারিশের শ্বাসকষ্ট উঠে যাবে। এই মেয়ের মাথায় নির্ঘাত সমস্যা হয়েছে। নয়তো পাচারকারীদের হাতে পড়ে ভয়ের চোটে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একটু রাগ নিয়ে বললো ফারিশ,“বেবি কি বাজারে কিনতে পাওয়া যায় যে চাবে আর এনে দিবো। অদ্ভুত! তুমি এমন নির্লজ্জ কবে হলে?”

আদ্রিতা ফ্যাল ফ্যাল নয়নে ফারিশের দিকে তাকানো। ফারিশ সে দৃষ্টি দেখে কি করবে বুঝতে পারছে না। রুম থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাবে নাকি ভেবে পায় না।’

#চলবে….

#TanjiL_Mim♥️

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৪০+৪১

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪০

নিকষকালো আঁধারে ভরপুর চারপাশ। গাছের পাতা নড়ছে মৃদু। ফারিশ দাঁড়িয়ে চুপচাপ। দৃষ্টি তার আদ্রিতার নুইয়ে রাখা মুখশ্রীর দিকে। সে কি এগিয়ে যাবে? নাকি আদ্রিতা এগিয়ে আসবে। ফারিশ গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আদ্রিতা মাথা তুলে চাইলো। ফারিশের আঁখিদ্বয় তখনও আদ্রিতাতেই নিবদ্ধ। আদ্রিতাই এগিয়ে আসতে লাগলো। ফারিশ চেয়ে চেয়ে দেখলো শুধু।’

আদিব দাঁড়ানো একটু দূরে। তার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এখানে দাঁড়ানোটা ঠিক হবে না। কিন্তু কোনদিক যাবে বুঝতে পারছে না। সবদিকেই জোনাকরাতের অন্ধকার। আদিবের ভয় লাগছে। আদিব ট্রাকের সামনের ঢাকার পাশ দিয়ে নিচে বসলো। পকেট থেকে মোবাইল আর ইয়ারফুন বের করলো। আদিব সবসময় তার পকেটে ইয়ারফুন রাখে। যদি কখনো সখনো লেগে বসে। আদিব ইয়ারফুন কানে গুঁজলো। আয়াতুল কুরসি অন করে চোখ বন্ধ শুনতে লাগলো তা। আর কোনো প্যারা নাই। এমন ভুতুড়ে পরিবেশ এবার আদিব তুড়ি মেরে পার করে দিতে পারবে।’

আদ্রিতা এগিয়ে এসে ফারিশের মুখোমুখি দাঁড়ালো। মাথা নোয়ানো। তার প্রথম প্রশ্ন,“আপনার কোথাও লাগে নি তো?”

ফারিশ মৃদু হাসে। মলিন মুখে আওড়ায়,“লেগেছে তো?”
আদ্রিতা চোখ তুলে চাইলো তখন। চিন্তিত কণ্ঠে বললো,“কোথায় লেগেছে?”

ফারিশ তার বুকের বা’পাশটা দেখিয়ে বললো,“এইখানে।”

আদ্রিতা ফারিশের কথার অর্থ বুঝতে পেরে বললো,“আমায় কি একটিবার ক্ষমা করা যায় না ফারিশ?”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“না।”
আদ্রিতা ছলছল নয়নে তাকায় ফারিশের দিকে। লোকটা এত বেশি পাষাণ কেন। আদ্রিতা আচমকাই জড়িয়ে ধরে ফারিশকে। ফারিশ ঘাবড়ায় না। আদ্রিতাকেও ধরে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আদ্রিতা তখন ফারিশের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে ওঠে,“আমায় ক্ষমা করে দিন না ফারিশ। বিশ্বাস করুন আমি আপনায় সত্যি ভালোবাসি। আমি মানছি আমি ভুল করেছি। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয় বলুন। ওই পুলিশ অফিসার আমায় ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করে কাজটা করতে বলেছিল। আমি হাজারবার বারণ করা শর্তেও শুনতে চায় নি। আমি আপনাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতাম। সেই যে এক পশলা ঝুম বর্ষায় আহত অবস্থায় আমার হসপিটাল এসেছিলেন তখন থেকেই। আপনার কথার বলার স্টাইল, এটিটিউড সব আমার ভালো লেগেছিল প্রথম দিনই। কিন্তু ওইদিন আমি আতঙ্কিত হয়ে যাই। আপনার ছুরি ধরার বিষয়টা আমায় এলেমেলো করায়। এরপর আমাদের নানা ভাবে দেখা হয়। আপনি আমায় তুলে নিয়ে যান। কক্সবাজারের আপনার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমি মন থেকে অনুভব করি বিশ্বাস করুন। আমি জানতাম আমি আপনার সাথে অভিনয় করছি কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আপনার সাথে বিন্দুমাত্র অভিনয় করি নি। যা করেছি মন থেকে। আমাকে ক্ষমা করে দিন না ফারিশ। আমি আপনায় বিয়ে করতে চাই। একসাথে সারাজীবন বাঁচতে চাই। আমি আর কোনোদিন আপনায় ঠকাবো না। আপনায় ঠকিয়ে আমি ভালো ছিলাম না ফারিশ। আমি ঠুকরে ঠুকরে মরেছি এই কয়দিন। আমি তো ভেবেছিলাম আপনার সাথে বোধহয় আমার আর দেখা হবে না। কিন্তু হলো। আমায় একটি বার ক্ষমা করুন। আমি আর কোনোদিন আপনায় ঠকাবো না। প্লিজ ফারিশ এবারের মতো ক্ষমা করুন।”

আদ্রিতার আর্তনাদ ভরা কণ্ঠ। চোখে মেশানো জলস্রোত। ফারিশ কিছু বলে না। পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। আদ্রিতার কান্না থামে না। সে ফারিশের গলা ছেড়ে শার্ট চেপে ধরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে যায়। এবার বুঝি পাষাণ ফারিশের মন গললো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো আদ্রিতাকে। আদ্রিতা তা অনুভব করে বলোল,“আমায় ক্ষমা করে দিয়েছেন ফারিশ?আর ঘৃণা নেই তো মনে।”

ফারিশ এক সেকেন্ড, দু’সেকেণ্ড, তিন সেকেন্ড চুপ থেকে শীতল স্বরে শুধায়,
“আপনি কি জানেন ডাক্তার ম্যাডাম? যাকে ভালোবাসা যায়। তাকে ঘৃণা করা যায় না। আমি ঘৃণা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরিশেষে দারুণ ব্যর্থ হয়েছি।”

আদ্রিতা খুশি হলো। তার নয়ন জোড়া খুশিতে খিলখিলিয়ে উঠলো। সে আর একটু শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরলো ফারিশকে। ফারিশ অনুভব করলো। আজ আদ্রিতা বুঝি পুরোপুরি তার সাথে মিশে যেতে চাইছে। ফারিশ হেঁসে বলে,“আবারও প্রেমআলাপের গল্প কি শুরু হবে?”

আদ্রিতা বলে,“কেন নয়!’
হঠাৎ ফারিশের মনে হলো তার সব বলে দেয়া উচিত। ফারিশ বলে,“আমায় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন না ডাক্তার ম্যাডাম। আমি আপনায় কিছু বলবো। কথাগুলো শোনার পর যদি আপনি আমায় ছাড়েন তবে আপনার মুক্তি চিরতরে মুক্তি। আর যদি না ছাড়েন তবে…

পরেরটা আর বললো না ফারিশ। থেমে গেল। আদ্রিতা বললো,
“তবে কি?”
“না ছাড়ার তবেটা আজ থাকুক পরে বলবো।”
“যা বলবেন তা খুব কঠিন।”
“কঠিন কি না জানি না। তবে জটিল দারুণ।”
“আপনি বলুন আমি শুনছি।”

আদ্রিতা ফারিশকে শক্ত করে ধরে। একটা মানুষকে জড়িয়ে ধরার অনুভূতিটা আজ যেন গভীরভাবে আঁকড়ে ধরেছে আদ্রিতাকে। ফারিশ নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,“আমি সত্যিই মাফিয়া আদ্রিতা। দেশ বিরোধী মাফিয়া।”

আদ্রিতা কথাটার গুরুত্ব দেয় না। বলে,
“মজা করছেন?”
ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“না সত্যি বলছি। সেদিনও আমি এই কথাই বলতে নিয়েছিলাম। আমি সত্যিই মাফিয়া। সেদিন রাতের এক পশলা ঝুম বর্ষায় হসপিটালে ঢুকে পড়া মাফিয়াটি আমিই ছিলাম। কিশোর আমার সম্পর্কে আপনায় যা বলেছে তা সব সত্য। আমি একজন মাদকব্যবসায়ী। এছাড়াও আমার অনেকগুলো বেআইনি কারবার আছে। আপনায় আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম না সেদিন আপনি পপি গাছের নাম শুনেছেন কিনা। যার ইংরেজি নাম হলো Papaver somniferum যা দিয়ে আফিম তৈরি হয় এছাড়াও এ থেকে মরফিন পাওয়া যায়। আমার দেশের কিছু জায়গায় পপি গাছ আছে। সেই গাছের দু প্রজাতি দিয়ে আমি আফিম আর মরফিন পাই। যার একটা দিয়ে নেশাদ্রব্য তৈরি হয় আর একটা দিয়ে ঔষধ। দেশের মানুষ আমাকে একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক জানলেও। আমি ঔষধের পাশাপাশি মরণব্যাধিও তৈরি করি। যাকে বলে একহাতে মানুষ বাঁচাই আরেক হাতে মারি। আমি ভালো মানুষ নই। এবার আপনি চাইলে এই কথা কিশোরকে বলে দিতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।”

কথাগুলো বলে থেমে গেল ফারিশ। কতকাল আর এ কথা লুকিয়ে রাখবে। মিথ্যে দিয়ে জীবন শুরু করলে কখনোই জীবন সুন্দর হয় না। তার চেয়ে বিষাদ ভালো। ফারিশ কিছুসময় পর বুঝতে পারলো এতকিছু শোনার পরও আদ্রিতা তাকে ছেড়ে দেয় নি। জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিশ বললো,“আদ্রিতা।”

আদ্রিতা সঙ্গে সঙ্গেই বললো,“হুস। চুপ থাকুন। আর কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না। যা এতবছর লুকিয়ে রেখেছেন আজ থেকেও লুকিয়ে রাখুন। আমিও না হয় ভালোবাসার জন্য একটু স্বার্থপর হলাম। আমি কোনো মাফিয়া সাহেবকে চিনি না। আমি চিনি আমার মিস্টার বখাটেকে। যে কিনা একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক।”

সময় চলতে থাকে। দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ফারিশ আদ্রিতার কথার পিঠে আর কিছু বলতেই পারলো না। বেশ কিছু সময় পর আদ্রিতা ফারিশকে ছাড়ে। ফারিশ তাকায় আদ্রিতার দিকে। বলে,
“একটুও ভাবলেন না?”
“আপনার বউ হবো এত ভেবে আমার কি কাজ! চলুন আমায় বাড়ি পৌঁছে দিবেন।”

ফারিশ কথা না বলে আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে থেকেই এগিয়ে চলে। হঠাৎই ফারিশের মনে পড়ে তার সাথে আদিবও ছিল। ফারিশ আদ্রিতার থেকে নিজের হাতটা ছাড়ালো। বললো,“এক সেকেন্ড।”

আদ্রিতা শুনলো। ফারিশ আশেপাশে তাকিয়ে ডাক দিলো,“আদিব।”

আদিবের সাড়াশব্দ নেই। ফারিশ আতঙ্কিত হলো আবার। সে উচ্চ শব্দে ডাকলো,“আদিব কোথায় তুমি?আদিব। আমি তোমায় ডাকছি আদিব।”

আদিবের এবারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। কারণ সে যে কানে ইয়ারফুন গুঁজে আয়াতুল কুরসি শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়েছে রাস্তায়।’

ফারিশ আরো দু’তিনবার ডাকতে ডাকতে ট্রাকের চাকার কাছে এসে ঠেকলো। আদিব বাচ্চাদের মতো ট্রাকের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ফারিশ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। এই ছেলেটা আর বড় হলো না। আদ্রিতা এগিয়ে আসলো তখন। হতভম্ব গলায় বললো,“আদিব ভাইয়াকে পেয়েছেন ফারিশ?”

ফারিশ হেঁসে বলে,“হুম।”
ফারিশ তার মোবাইলের ফ্যাশ লাইট অন করে মুখে ধরলো আদিবের। বললো,“আদিব ওঠো বাড়ি যাবে না, আদিব।”

দু’বার ডাকতেই আদিব উঠে গেল। কান থেকে ইয়ারফুন খসে পড়লো নিচে। আদিব বললো,“আপনাদের হয়ে গেছে ভাই।”

ফারিশ বলে,“হয়েছে পাগল। চলো এখন বাড়ি যাই।”
আদিব উঠে দাঁড়ায়। বলে,“চলুন ভাই এই ট্রাকে করেই যাই। আপনি আর ডাক্তার ভাবি ট্রাকের পিছনে বসুন। আমি ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যাই।”

ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করলো। বাম হাতে আদিবের কাঁধ চেপে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললো,“কিসব বলছো আদিব? তোমার মাথা ঠিক আছে।”

আদিব অবাক হয়ে বলে,“খারাপ কি বললাম ভাই?”
ফারিশের ডানপাশেই হাঁটছিল আদ্রিতা। তার বাম হাতটা মুঠোতে ছিল ফারিশের। ফারিশ বলে,“তুমি বুঝো না কেন আদিব, বিয়ের আগে নো বদ্ধঘর।”

ফারিশের কথা শুনে হেঁসে ফেলে আদ্রিতা। আদিব বলে,“আপনিও না ভাই।”

ফারিশ হাসে। রাতটা তখন প্রায় শেষ প্রহরের দিকে। ছিমছাম রাস্তায় হাঁটছে আদিব,ফারিশ আর আদ্রিতা। আদ্রিতা ফারিশের কথা শুনে মুখে কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে ঠিকই আওড়ায়,“লোকটা আসলেই একটা বজ্জাত। চরম লেভেলের বজ্জাত।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪১

রাতের আঁধার ছাড়িয়ে তখন দিনের আলো ফুটলো কেবল। আদিব গাড়ির পিছন সিটে বসে ঘুমে কাত। আদ্রিতাও ঘুমাচ্ছে জানালার পাশে মাথা ঠেকিয়ে। ফারিশ জেগে। চুপচাপ বসে বসে গাড়ি ড্রাইভ করছে। ফারিশের বর্তমান অনুভূতি কেমন তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে ফারিশের মাথায় ঘুরছে আরশাদ। কিশোর আজকের মধ্যে ধরতে না পারলে এই কাজটা ফারিশই করবে। ফারিশ তার লোক লাগিয়ে দিয়েছে। আরশাদকে খোঁজা হচ্ছে। আশা রাখে খুব শীঘ্রই আরশাদকে ধরতে সে সক্ষম হবে। আরশাদের সাথে ফারিশের পরিচয় খুব অল্প সময়ে। তারা ঔষধের কেনা বেচা নিয়ে পার্টনারশিপে ব্যবসা করত। ফারিশ যে আলাদাভাবে মাদক ব্যবসায়ী এ সম্পর্কে আরশাদ অবগত ছিল না। কিন্তু আরশাদ সম্পর্কে ফারিশের সব জানা ছিল। পার্টনারশিপের দশদিনের মাথাতেই ফারিশ জেনে যায় আরশাদের আলাদাভাবে মেয়ে পাচার করার কাজ করছে। যা ফারিশের পছন্দ হয় নি। মেয়ে মানুষ নিয়ে ব্যবসা করা ফারিশের পছন্দ নয়। তাই ফারিশ পুলিশের নিকট আরশাদকে ধরিয়ে দেয়। তার পনের বছরের জেলবন্দীর সাজা দেয়া হয়। কিন্তু দু’বছরের মধ্যেই আরশাদ জেল থেকে পালায়। আদ্রিতা সম্পর্কে আরশাদ কতটুকু অবগত বা আধও অবগত কি না এ সম্পর্কে ফারিশ তেমন কিছু জানে না। তবুও কোথাও গিয়ে সংশয় যদি জেনে থাকে।’

আদ্রিতার ঘুম ভাঙলো হঠাৎ। সে দ্বিধাহীন ফারিশের বুকে মাথা রাখলো। ফারিশ কিছুটা চমকে উঠলো এতে। নিজের ভাবনা গুলো ভুলে গেল মুহূর্তেই। ফারিশ নিজেকে সামলালো। আদ্রিতা ফারিশের গলা জড়িয়ে ধরে মিষ্টি হেঁসে বললো,“শুভ সকাল মিস্টার বখাটে।”

ফারিশ আদ্রিতার পানে না তাকিয়েই বললো,“আপনায় কতবার বলবো আমি বখাটে নই।”

হাসে আদ্রিতা। বলে,“জানি তো। তাও আপনাকে বখাটে ডাকতে আমার ভালো লাগে।”

ফারিশ এ কথার আর জবাব দিলো না। আদ্রিতা কিছু সময় চুপ থেকে বলে,“আজ আমার বন্ধু মৃদুলের বৌভাত আপনি কি যাবেন ফারিশ?”

ফারিশের দ্বিধাহীন জবাব,“কি পরিচয়ে যাবো?”
আদ্রিতা অবাক হয়ে বললো,“কেন আমার বয়ফ্রেন্ডের পরিচয়ে।”

ফারিশ নাকচ করলো তাতে। বললো,“না আমার কাজ আছে। আপনি ঘুরে আসুন।”

আদ্রিতা খানিকটা বিরক্ত নিয়ে বললো,
“আপনি কি আমায় তুমি করে বলতে পারেন না ফারিশ?”
“আপনিটাতেই কেমন যেন আমি সস্থি পাই।”
“কিন্তু আমার অসস্থি লাগে।”

চোখ মুখ কুঁচকে বললো আদ্রিতা। ফারিশ হাসলো। বললো,“বিয়ে হোক বলবো?”

আদ্রিতা খুশি মুখে বললো,“সত্যি বলবেন।”
ফারিশ এক ঝলক আদ্রিতাকে দেখলো। পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
“হুম।”
“বিয়ে কবে করবেন ফারিশ? চলুন আজই করে ফেলি।”

ফারিশ নিরুত্তর। আদ্রিতা বিচলিত হয়ে বললো,“করবেন বিয়ে চলুন আজই করে ফেলি।”

ফারিশ এবারও উত্তর দিল না। আদ্রিতা এবারও উত্তর না পেয়ে পাল্টা কিছু জিজ্ঞেস করলো না। নীরবতা চললো বেশ কতক্ষণ। ফারিশ গাড়ি থামালো হঠাৎ। আদিব একটু নড়ে চড়ে উঠে। পরক্ষণেই আয়েশ করে শুয়ে পড়লো গাড়ির সিটে। গভীর ঘুম পেয়েছে তার। আদ্রিতা তার মাথাটা ফারিশের নিকট থেকে উঠালো। সোজা হয়ে বসে বললো,“গাড়ি থামালেন যে?”

ফারিশ আদ্রিতার চোখের দিকে তাকিয়ে শীতল স্বরে শুধায়,“আপনার আচরণ আমার কাছে ঠিক লাগছে না ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতা বিষম খেয়ে বল,“মানে?”
ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“আমি একজন মাফিয়া আদ্রিতা।”
আদ্রিতার ভাবনাহীন উত্তর,
“তো।”
“আপনি আমার সাথে সত্যি থাকতে চান? বিয়ে করতে চান?”

আদ্রিতা তক্ষৎণাৎ উত্তর,
“হুম।”

ফারিশ আবার বলে উঠে,“ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন নাকি ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতার মুখটা মলিন হয়ে গেল। ফারিশ তা দেখে হাসলো। বললো,“আরে মজা করছিলাম চলুন।”

এই বলে ফারিশ আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছুটলো দূরে। গাড়ি এসে সোজা থামলো আদ্রিতাদের বাড়ির সম্মুখে। আদ্রিতা গাড়ি থেকে নামলো না। চুপটি করে বসে রইলো। ফারিশ বললো,“কি হলো যান?”

আদ্রিতা গেল না। তাও বসে রইলো। ফারিশ তার কপাল চুলকে বলে,“কি হয়েছে? রাগ করেছেন?”

আদ্রিতা জবাব দেয় না। ফারিশ আদ্রিতার দু’কাধ চেপে ধরে বলে,“আমি মজা করছিলাম।”

আদ্রিতা মলিন মুখে তাকালো ফারিশের দিকে। চোখ ভিজে এসেছে তার। আদ্রিতা বলে,“কি করলে বুঝবেন আমি ধোঁকা দিবো না?”

ফারিশ হাসলো। আদ্রিতার চোখের পানিটুকু নিজ হাতে মুছে দিয়ে মজার ছলে বললো,“বিকেলেই বিয়েটা করলে। এখন নামুন আপনার বাবা মা আপনার অপেক্ষা করছে। দুশ্চিন্তা করছে নিশ্চয়ই। তাড়াতাড়ি যান।”

আদ্রিতা নেমে পড়লো। গাড়ির দরজা আঁটকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললো,“সাবধানে যাবেন।”

ফারিশ মাথা নাড়িয়ে বলে,“নিশ্চয়ই।”
অতঃপর ফারিশ চলে যায়। আদ্রিতাও জোরে দম ফেলে ছুটে চলে গেল বাড়ির ভিতর। ঘরে ঢুকতেই তার মা এসে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। আদ্রিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল শুধু। মনে মনে কি যেন ভাবে?”
—-
মৃদুলের বউভাত শেষের পথে। নয়নতারা আর আশরাফকে বেশ সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে দুপুর থেকে। বেলা তখন প্রায় চারটা। আদ্রিতা ভাড়ি লেহেঙ্গা পড়ে নিজেকে সাজিয়েছে খুব। বড় কমিউনিটি সেন্টারে মৃদুলের বৌভাতের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে ছিল।’

আদ্রিতা সবাইকে একত্রে ডাকলো। এখন তারা বাড়ি ফেরার মেজাজে ছিল। আদ্রিতার ডাকে সবাই একজোট হলো। মৃদুল বললো,“কি হইছে কি কবি তুই?”

আদ্রিতা সবার দিকে একঝলক তাকিয়ে তড়িৎ বলে,“আমি বিয়ে করবো আজ আর এক্ষুণি।”

সঙ্গে সঙ্গে সবাই যেন বিষম খেল। রনি মাত্রই তার কোকের বোতলে এক চুমুক দিয়েছিল। সেটাও হজম করতে না পেরে কলকলিয়ে ফেলে দিল। চাঁদনী বললো,“মজা করছিস আদু?”

আদ্রিতা চোখে মুখে সিরিয়াস দৃষ্টি ভঙ্গি এঁটে বলে,“না আমি সিরিয়াস।”

আশরাফ আদ্রিতার দিকে এগিয়ে গেল। শান্ত গলায় আওড়ালো,
“ছেলেটা কে?”
“ফারিশ মাহমুদ।”

এবার যেন আরো শকড হলো সবাই। মুনমুন বললো,“ফারিশ ওই যে ঔষধ কোম্পানির মালিক।”

আদ্রিতার দ্বিধাহীন উত্তর,“হুম।”
——
শেষ বিকেলের রোদটুকু বিছানায় চুইয়ে ফারিশের গায়ে ঠেকছে। গায়ে তার পাতলা কাঁথা জড়ানো। জানুয়ারির শীতটা খুব একটা গায়ে লাগে না তখন। ফারিশ ঘুমোচ্ছে। বাড়ি এসেই গোসল সেরে ন’টার দিকে সে ঘুম দেয়। যেই ঘুম এখনো ভাঙে নি। গত কয়েকদিনের না হওয়া ঘুমগুলো যেন আজ একদিনেই পূরণ করছে ফারিশ। আদিব রুমে ঢুকে তখন। পরে আবার বেরিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর ভাড়ি লেহেঙ্গা গায়ে জড়িয়ে আদ্রিতা আসে। ফারিশকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে মৃদু হেঁসে গিয়ে পাশে বসে। কপালে হাত ছুঁইয়ে বলে,
“মিস্টার বখাটে উঠুন।”

ফারিশ এক চুলও নড়লো না। আদ্রিতা এবার আর একটু উচ্চ শব্দে বললো,“ফারিশ শুনছেন,

এবার খানিকটা নড়লো ফারিশ। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,“উফ। ডাকছো কেন? দেখছো না আমি ঘুমোচ্ছি।”

আদ্রিতা মিষ্টি হাসে। বলে,“এখন উঠুন পরে ঘুমাবেন।”

ফারিশ স্বপ্ন দেখছে আদ্রিতা নতুন বউয়ের মতো লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে তাকে ডাকছে। ফারিশ ঘুমের ঘোরে আদ্রিতার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো,”এত সেজেছো কেন তোমায় যে পুরো বউ বউ লাগছে।”

বাস্তবিক আদ্রিতা তা শুনে হেঁসে উঠলো। সে বুঝলো ফারিশ স্বপ্ন দেখছে। আদ্রিতা খানিকটা ঝুকলো ফারিশের দিকে। কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিস ফিস করে বললো,“ফারিশ উঠুন বিয়ে না করলে বউ বউ লাগবে কেমন করে?”

তড়িৎ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো ফারিশ। ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ মেলেই আদ্রিতাকে মুখোমুখি আর ভাড়ি লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা পড়নে দেখে অবাক স্বরে বললো,“আপনি এখানে কি করছেন ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতা আয়েশ করে বসে বললো,“কি আর করবো? বিয়ে করবো উঠুন।”

ফারিশের মুখভঙ্গি পাল্টে গেল হঠাৎ। বিস্মিত স্বরে আওড়ালো সে,“কি বলছেন? পাগল হলেন নাকি।”

আদ্রিতার বিরক্ত লাগলো এবার চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“পাগল হওয়ার কি আছে বিয়ে করবো বলেছি।”

ফারিশ শোয়া থেকে উঠে বসলো। চোখ মুখ ঢলতে ঢলতে হাই তুলে বললো,
“মজা করছেন?”
“আশ্চর্য মজা করবো কেন? ফ্রেশ হন আমরা কাজি অফিস যাবো।”

আদ্রিতার কথাগুলো এবার যেন সত্যিই সত্যিই লাগছে ফারিশের। সে প্রশ্ন করলো,
“সত্যিই কাজি অফিস যাবো?”

আদ্রিতা মাথা নাড়িয়ে লাজুক স্বরে বললো,“জি।”
সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর ভাবে বিষম খেল ফারিশ। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো শুধু, তার ডাক্তার ম্যডামের দিকে।’

#চলবে….

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৩৮+৩৯

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৮

নিজের হাইস্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিতা। আজ বহুদিন পর এখানে এসেছে সে। ইচ্ছাকৃত নয়। বিকেলের দিকটায় খুঁটিনাটি বাজার করতে বেরিয়েছিল আদ্রিতা। কাল মৃদুলের বিয়েতে বেশ আনন্দ হইচই করেছে তারা। নয়নতারা আর আশরাফের সাথে বেশ ভাব জমেছে। আসার সময় ফোন নাম্বারও আদান-প্রদান হয়ে গেছে। আদ্রিতা খুশি যাক তাদের ফ্রেন্ড গ্রুপের শেষ সিঙ্গেল ছেলেটাও মিঙ্গেল হওয়ার লাইন ঢুকেছে। চাঁদনীর জন্য খারাপ লাগছে আদ্রিতার। সে শুনেছে আদিব তার সাথে কথা বলছে না। কারণ কি তাও বলছে না। তবে আদ্রিতা জানে এর কারণ কি! কি করবে ভেবে পায় না। আদ্রিতার যে ফারিশের সাথে সম্পর্ক ছিল বা তাদের ভিতরকার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার কিছুই আদ্রিতার বন্ধুমহল জানে না। আদ্রিতা বলে নি। আর বলতেও চাইছে না। কি বলবে তাও একটা প্রশ্ন! নিজের ওপর অত্যাধিক ঘৃণা ধরেছে আদ্রিতার। বিতৃষ্ণায় সবকিছুই শূন্য শূন্য লাগে। আদ্রিতা চেয়েও কিছু করতে পারছে না। ফারিশ তাকে শুনতেই চাইছে না। ফারিশের ওপর আদ্রিতার এসব নিয়ে কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই যা আছে সেটা হলো খারাপ লাগা,ইমোশন। ফারিশের জায়গায় আদ্রিতা থাকলেও সেইম কাজ করতো। কিন্তু আদ্রিতা ফারিশকে কি করে বোঝাবে যে আদ্রিতা এতদিন যা করেছিল তা অভিনয় ভেবে করলেও কোনোটাই অভিনয় ছিল না। সত্যিকারের ভালোবাসা ছিল। সেই গভীর রাতের কনকনে শীতের মাঝে আগুন নিয়ে বসে থাকার সুন্দর মুহূর্তগুলো যেন এখনো আদ্রিতার চোখে ভাসে। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো আদ্রিতার।

আদ্রিতা বন্ধ থাকা স্কুলটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার শৈশবের কতকত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই স্কুল নিয়ে। কত হাসি, তামাশা, হুল্লোড়। ইস! আনমনা হেঁসে উঠলো আদ্রিতা। যাকে বলে দুঃখের মধ্যেও হাসি।’

কাল মৃদুলের বৌ-ভাত। আদ্রিতাদের সকাল সকালই যেতে বলেছে সেখানে। আপাতত হসপিটাল থেকে তিনদিনের ছুটি নেয়া। আদ্রিতা আর দাঁড়ালো না। বিকেল হয়েছে বাড়ি ফেরা দরকার। আদ্রিতা উল্টোদিকে হাঁটা ধরলো। আদ্রিতার বাড়ি এদিকে নয়। অথচ আজ আনমনা হাঁটতে হাঁটতে এদিকে চলে আসলো। এলাকাটা খুব নিরিবিলি। বিশেষ করে চারটার পর। পুরো স্কুল ফাঁকা থাকে আর আশপাশটাও। আদ্রিতার যেতে যেতে মনে পড়লো এই পথ দিয়েই একসময় কাঁধে স্কুল ব্যাগ, গায়ে ইউনিফর্ম জড়িয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতো। তখন আদ্রিতারা এই কাছেই একটা দোতলা বাড়িতে ভাড়া থাকতো। এখন নিজেদের বাড়ি হয়েছে বাবা করেছেন সেখানেই থাকে। স্কুল থেকে বেশ দূরে তার অবস্থান। আদ্রিতা পুরনো স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে আস্তে আস্তে হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে চললো। চারপাশ চুপচাপ। হঠাৎ আদ্রিতার মনে হলো কেউ বুঝি তার পিছন পিছন আসছে। আদ্রিতা পিছন ঘুরে চাইলো কিন্তু না কিছুই নেই সব ফাঁকা। খুব একটা ভাবলো না সে হাঁটা ধরলো। আবারও শোনা গেল কারো পায়ের পদধ্বনি তাও একজন না দুজনের। আদ্রিতা আবারও ঘুরলো কিন্তু কাউকে দেখে হাঁটলো। হয়তো মনের ভুল।’

আদ্রিতা হাঁটতেই একটা গলির ভিতর থেকে দুটো ছেলে বের হলো। কাউকে ফোন করে বললো,“গলির মুখে গাড়ি নিয়ে আয় বলির পাঠা পাইয়া গেছি।”

কথাটা বলেই আদ্রিতার থেকে দূরত্ব নিয়ে ওর পিছু পিছু হাঁটলো।’

আচমকাই গা ঘেঁষে একটা গাড়ি থামতেই আদ্রিতা চমকে উঠলো। ঘাবড়ে গেলো খানিকটা। হাত ফসকে পড়ে গেল হাতের ব্যাগটা। ব্যাগ থেকে পড়ে গেল কিছু আলু পেঁয়াজ। আদ্রিতা বিচলিত হয়ে নিচে বসে সেগুলো ওঠাতে ব্যস্ত হলো। গাড়ি চালিত মানুষটি দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো। হতভম্ব স্বরে নিচে বসে বললো,“আপনি ঠিক আছেন তো আসলে আমি..

পুরো কথা শেষ করার আগেই আদ্রিতাকে দেখে চোখমুখ খিঁচে ফেললো আদিব। কারণ গাড়ি চালক আর কেউ নয় আদিব ছিল। আদ্রিতাও তার দিকে তাকিয়ে বললো,“আদিব,

আদিব উঠে বিনা বাক্যে হাঁটা ধরলো। আদ্রিতা দ্রুত উঠে দাড়িয়ে বললো,“আদিব ভাইয়া যাবেন না প্লিজ।”

আদিব একটু দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা ধরলো। আদ্রিতা অসহায় ন্যায় বললো,“প্লিজ ভাইয়া যাবেন না।”

খুবই করুণ কণ্ঠস্বর আদ্রিতার। আদিবের মায়া হলো সে দাঁড়ালো। আদ্রিতা দৌড়ে গিয়ে আদিবের মুখোমুখি দাঁড়ালো। বললো,“আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। তবুও আমার সাথে কি একটু কথা বলা যায় না।”

আদিব আর ফারিশের মতো করে বলতে পারলো না,“না যায় না। সে করুণ দৃষ্টি ফেললো আদ্রিতার দিকে। মেয়েটার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আদ্রিতা দারুণ অনুতপ্ত। আদিব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,“এত কিছু তো করলেন আর কি করতে চান?”

আদ্রিতা কেঁদে উঠলো হঠাৎ। আদিব ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল তাতে। উত্তেজিত হয়ে বললো,“আরে আরে কাঁদছেন কেন?”

আদ্রিতা কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দিলো,“আমি আপনাদের কি করে বোঝাবো যে আমি ফারিশের সাথে অভিনয় করি নি।”

আদিব অবাক হলো খুব। কথার অর্থ না বুঝে বললো,“মানে।”

আদ্রিতা উত্তর দিতে পারলো না। তার চোখ বেয়ে অজস্র হারে পানি পড়ছে। আদিব কি করবে বুঝতে না পেরে দ্রুত গাড়ির কাছে ছুটে গেল। গাড়ির ভিতর থাকা পানির বোতলটা এনে আবার এগিয়ে আসলো আদ্রিতার দিকে। পানিটা এগিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললো,“খান।”

আদ্রিতা পানির বোতলটা নিলো ঢকঢক করে পানিটা গিলে বললো,“ধন্যবাদ।”

আদিব আর আদ্রিতা গিয়ে বসলো সামনের ফুটপাতের রাস্তার উপর। আদিবের গাড়ি পাশেই। আদিব শান্ত ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,“বলুন কি হয়েছে?”

আদ্রিতা ছলছল নয়নে আদিবের দিকে তাকিয়ে বললো,“আমায় কি একবার ক্ষমা করা যায় না?

আদিব জবাব দেয় না। আদ্রিতা আবার বলতে থাকে,
“আমি মানছি আমি ভুল করেছি। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয় বলুন। ওই পুলিশ অফিসার আমায় ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করে কাজটা করতে বলেছিল। আমি হাজারবার বারণ করেছি কিন্তু শুনতে চায় নি। আমার ফারিশকে প্রথম থেকেই পছন্দ ছিল। সেই যে এক পশলা ঝুম বর্ষায় সে আহত অবস্থায় আমার হসপিটাল এসেছিল সেদিন থেকেই। লোকটার কথা বলার স্টাইল, এটিটিউড সব আমার ভালো লেগেছিল প্রথম দিনই। কিন্তু ওইদিন আমি আতঙ্কিত হয়ে যাই। উনি আমার পিঠে ছুরি বসিয়ে কিছু মানুষকে মিথ্যে বলতে বলে সে এখানে আসেনি। আমিও আতঙ্কিত হয়ে মিথ্যে বলি। পরেরদিন সকালে খবরে দেখানো হয় এক মাফিয়া হসপিটালে ঢুকে। আপনি বলুন আমার কি খটকা লাগবে না। এরজন্য বন্ধুদের ওনার কথা বলতেই তারা আমায় পুলিশ স্টেশন নিয়ে যায়। জানি উনি কোনো মাফিয়া টাফিয়া কিছু না একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক। ওইদিন প্রথম অনুতপ্ত হই। তারপর উনি আমায় ধরে নিয়ে যায়। আমাদের কক্সবাজারে সাক্ষাৎ হয়। ওনার সাথে আমার যতবার দেখা হতো আমি ততবারই মুগ্ধ হতাম। দারুণ ভালো লাগতো ওনাকে, ওনার রাগটাকে। আলাদা অনুভূতিও তৈরি হয় ওনার প্রতি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি। আমি ওনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। যেই মুহূর্তে আমি বিষয়টা বুঝবো সেই মুহূর্তেই কিশোরের আগমন। ওনার কথা শুনে আমি ফারিশের সাথে একটু ঘনিষ্ঠ হই। আমি নিজের দিক থেকে তার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোকে অভিনয় করছি ভাবতাম। কিন্তু ওগুলো আসলে অভিনয় ছিল না। প্রতিটি মুহূর্ত আমার ভিতর থেকে আসা চরিত্র ছিল। আমি অভিনয় করছি ভাবলেও আমি অভিনয় করি নি। ফারিশের সাথে কাটানো সময়টুকুতে আমার কোথাও মনে হয় নি সে খারাপ। বা মাফিয়া। তার সাথে মেশার আগেও আমি জানতাম না সে আধোতেও মাফিয়া কি না। এখনও তো জানি না। তবে আমি বিশ্বাস করি ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়। আমাদের বিচ্ছেদ ঘটার দু’দিন আগে থেকে ফারিশ আমায় কিছু বলবে বলবে বলেও বলছিল না। আমি ভেবেছিলাম সেই কথাগুলো যদি মাফিয়া রিলেটেড কোনো কথা না হয়। কিশোরকে তার রেকর্ড শুনিয়ে মুখের উপর বলবো,“বিশ্বাস হলো আপনার। আমার ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়।” – এরপর আমি আর ফারিশ বিয়ে করে সুখে থাকতাম। কিন্তু তার আগে আমি এগুলো সব বলতাম। কিন্তু দেখেন কি করে সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমি শুরুটা অভিনয় দিয়ে করলেও কোনোটাই অভিনয় ছিল না। আমি কি করে বুঝাই ফারিশকে। আমার খুব কষ্ট হয় আদিব। আমি সত্যিই ফারিশকে ভালোবাসি। তার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই। বাঁচতে চাই নতুন করে।”

বলতে বলতে আবার কেঁদে উঠলো আদ্রিতা। আদিব কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার কি সান্ত্বনা দেয়া উচিত নাকি রাগ দেখানো উচিত বুঝতে পারছে না।’

আদিব স্নেহময় হাতে আদ্রিতার মাথায় হাত বুলালো। বললো,“কি বলবো সত্যি বুঝচ্ছি না।”

আদ্রিতা ছলছল নয়নে তার পানে তাকিয়ে বলে,“আমায় কি একবার ক্ষমা করা যায় না?”

আদিব উত্তর দিতে পারে না। তার ফোন বাজে। একটা ইমারজেন্সি কাজের জন্যই এদিকে এসেছিল আদিব। ফারিশের আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে হঠাৎ মত বদলায়। আদিবও জোর করে নি। আদিব বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বলে,“আমায় যেতে হবে।”

আদ্রিতাও বারণ করে না। চোখ মুছে বলে,
“লাস্ট একটা কথা বলবো ভাইয়া?”

আদিব মাথা নাড়িয়ে বলে,“বলুন?”
আদ্রিতাও উঠে দাঁড়ায়। মায়াভরা কণ্ঠে বলে,“আমার জন্য চাঁদনীকে ছাড়বেন না ভাইয়া ও এসব বিষয়ে কিছু জানে না। কিছু না। শুধু ও না আমার বন্ধুবান্ধব কেউই এসবের কিছু জানে না। আমার জন্য ওকে শাস্তি দিবেন না।”

আদিব এবার এ কথার উত্তর দেয় না। ছোট করে বলে,“ভালো থাকবেন।”

বিনিময়ে মৃদু হাসে আদ্রিতা। আদিব গাড়িতে উঠে বসে। তার ওদিকে যেতে হবে। না হলে আদ্রিতাকে সে বাড়ি পৌঁছে দিত। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল আদিব।

আদ্রিতাও আর বসে রইলো না। সন্ধ্যা নামবে তাকে দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে। আদ্রিতা তার ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা ধরলো।’

এতক্ষণ পর সামনের মেয়েটাকে একা পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো পিছনের ছেলেদুটো। এতক্ষণ তারা গলির মুখে লুকিয়ে ছিল। আদিবের গাড়িটা গলির মুখটা ছাড়াতেই। আচমকা আরেকটা বড়গাড়ি এসে থামলো আদ্রিতার মুখোমুখি। আদ্রিতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির দরজা খুলে তাকে জোর জবরদস্তি উঠিয়ে নিলো গাড়িতে। হাত থেকে বাজারের ব্যাগ পড়ে গেল নিচে। আদ্রিতা চেঁচানোর আগেই মুখে রুমাল চেপে ধরলো আগন্তুকরা। সঙ্গে সঙ্গে সে লুটিয়ে পড়ে গাড়ির ভিড়ে। ধীরে ধীরে চারপাশটা হয়ে গেল অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার।”
—-
বেশ কয়েকদিন পর আজ নিজের ঔষধের কোম্পানিতে পা রেখেছে ফারিশ। এতদিনের সব ঝামেলার জন্য এদিকটায় খুব একটা নজর পড়ে নি তার। ফারিশ জোরে নিশ্বাস ফেললো। এরপর আস্তে আস্তে ঢুকে গেল ভিতরে।”

#চলবে…..

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৯

প্রকৃতি তখন সন্ধ্যার দখলে। অন্ধকার নেমেছে ধরণীতে। আদ্রিতাকে রাখা হলো একটা বন্ধ ঘরে। তার মাথাটা এলানো ছিল কারো কাঁধে। আদ্রিতার হুস ফিরলো। সে আস্তে আস্তে বসা তার এলিয়ে যাওয়া মাথাটা উঠালো। অন্ধকারের মতো ঝাপসা ঝাপসা লাগছে চারপাশ। কিছু সময় এগোতেই আদ্রিতার কাছে চারপাশ পরিষ্কার হলো। তার হাত বাঁধা। আদ্রিতার আশপাশ দেখলো অনেক মেয়েদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। চকিত চমকে উঠলো আদ্রিতা। এখানে সে একা নয় তার মতো আরো অসংখ্য মেয়ে আছে। আদ্রিতার পুরো বিষয়টা বুঝতে কিছু সময় লাগলো। তার মানে সে অপহরণ কারীদের নিকট বন্দী। আদ্রিতা তার পাশের মেয়েটিকে আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,“আমি এখানে এসেছি কতক্ষণ হয়েছে?”

মেয়েটি উত্তর দিলো,“ঘন্টা দুই।”
আশেপাশের মেয়েরা কাঁদছে। তাদের চিতকারে আদ্রিতার বুকের ভেতরটা কামড়ে উঠলো। এ কোথায় এসে পৌঁছালো। একটা মেয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে। আর বলছে,“আমাগো ছাইড়া দে শয়তানগুলা, তোগো কোনোদিন ভালো হইবো না। আমাগো ছাড় শয়তান।”

তার কথা শুনে একজন এসে দরজা খুললো। স্ব-জোরে মেয়েটির গালে থাপ্পড় মেরে বলল,“শালী ছাইড়া দেওনের জন্য বুঝি ধইরা আনছি তোগো। আর কিছু সময় হেরপরই তোগো আরেক দেশে পাঠাইয়া দিমু। সুখে থাকবি তোরা।”

লোকটার কথা শুনে মুখে থুঁ মারলো থাপ্পড় খাওয়া মেয়েটি। চেঁচিয়ে বললো,“তোগো কোনোদিন ভালো হইবো না। কোনোদিন না।”

লোকটা রেগে গেল। তড়িৎ হাতে থাকা একটা ইনজেকশন পুস করে দিলো মেয়েটার ঘাড়ে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি এলিয়ে পড়লো নিচে। বাকি সবাই আঁতকে উঠলো এমন ঘটনা দেখে। আদ্রিতা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। লোকটা চলে গেল। দরজা আঁটকে দিলো ভেতর থেকে।’

আদ্রিতার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তারওপর এই মেয়েগুলোর আর্তনাদ যেন আরো ধারালো বিঁধছে কানে। আদ্রিতা চেঁচিয়ে উঠলো হঠাৎ। কড়া কণ্ঠে বললো,“তোমরা কাঁদছো কেন থামো?”

কেউই থামলো না। আদ্রিতার বিরক্তিতেই মাথা ধরেছে সে আবার চেঁচিয়ে বললো,“কাঁদছো কেন থামো বলছি?”

এবার থেমে গেল সবাই। আদ্রিতা বললো,“আমরা এখানে কতগুলো মেয়ে আছি?”

একটা মেয়ে বললো,“তুমারে লইয়া দেড়শো।”
আদ্রিতা চুপ থাকলো কিছুক্ষণ এরপর প্রশ্ন করলো, তাদের কি আলাদা আলাদা ঘরে রাখা?”

রোগা মতো মেয়েটি বললো,“হা। প্রত্যেক ঘরে মনে হয় বিশজন কইরা।”

আদ্রিতা শুনে আঁতকে উঠলো। কি করবে ভেবে পায় না। কিন্তু কিছু তো একটা করতেই হয়।’
—-
রাত তখন এক’টা। হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে ফারিশ তার পাশেই আদিব। মূলত আদ্রিতাকে খোঁজার জন্যই তারা বেরিয়েছে। সেই সময় আদিব গলির মুখ থেকে বের হওয়ার পূর্বে গাড়ির ডানেপাশের লুকিং গ্লাসে দেখেছে দুটো ছেলে আদ্রিতাকে তুলে নিয়েছে। সে সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি গোড়ায় কিন্তু আদিব যতক্ষণে আসে ততক্ষণে আদ্রিতাকে নিয়ে চলে যায় আগন্তুকরা। আদিব পিছু নেয় গাড়িটির। শেষ মুহূর্তে এসে গুলিয়ে ফেলে। আদিব সেই মুহূর্তেই ফারিশকে কল করে। ফারিশ সব শুনেই ছুটে আসে। আদ্রিতার আদিবকে বলা সব কথাও ফারিশকে বলে। ফারিশের সেই বিষয়ে কোনো ভারাক্রান্ত নেই। এই মুহূর্তে তার একমাত্র কাজ হচ্ছে আদ্রিতাকে খুঁজে বের করা। সেই সন্ধ্যা থেকে খুঁজছে। পুলিশকেও বলা হয়েছে সবটা। কিশোর নিজে এই নিখোঁজ কেসটা নিয়েছে। ফারিশ আদিবকে বললো,
“গাড়ির নাম্বার সঠিক ছিল তো আদিব?”
“জি ভাই।”
“গাড়ির কালার সাদাই ছিল?”
“জি।’

আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে পৌছাতে পৌঁছাতে হঠাৎ আদিব বললো,“ভাই এহিনে থামান।”

ফারিশ থামালো। আদিব গাড়ি থেকে নামলো দ্রুত। এগিয়ে গেল কাছে এক জঙ্গলের ভিড়ে গাছের আড়ালে। সেখানে একটা গাড়ি রাখা। এর আগেও এমন গাড়ি কয়েকটা দেখেছে কিন্তু নাম্বার মেলেনি।আদিব তার মোবাইলের ফ্লাশ লাইট অন করে পুরো গাড়িটা দেখলো। নাম্বার চেক করে বুঝলো। এটাই সেই গাড়িটা। ফারিশ গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত এগিয়ে আসলো। বললো,“কিছু দেখলে আদিব?”

আদিব ফারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভাই এই গাড়িটাই।”
“তুমি শিওর আদিব?”
“জি ভাই। ডাক্তার ভাবিরে এই গাড়িতেই নিছে।”

ফারিশ আদিবকে এক সেকেন্ড দাঁড়াতে বলে গাড়ির কাছে গেল। গাড়ির সিটের নিচে লুকিয়ে রাখা পিস্তলটা নিলো। এরপর আদিবকে নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,“সাবধানে আসো আদিব।”

আদিব শুনলো। ভয় পেলেও চললো ফারিশের পিছু পিছু। কিছুদূর এগোতেই হঠাৎ নজরে আসলো একটা পুরনো বাংলো বাড়ির। চারপাশ আটকানো। ফারিশ কৌতুহলী এগিয়ে গেল। আদিব ভয়ে কাইত। সে ফারিশের শার্টের কোনা ধরে শুঁকনো ঢোক গিললো। বললো,
“ভাই ভিতরে যাওয়া কি ঠিক হবে? কোনো ভূতটূত থাকলে।”
“ভূত বলতে কিছু নেই আদিব। মানুষই ভূত বুঝেছো। আর শার্ট না ধরে হাত ধরো। শার্টটা ছিঁড়ে গেলে।”

লজ্জায় পড়লো আদিব। শার্ট ছেড়ে হাত ধরলো ফারিশের। আদিব যে কেন এত ভীতু তা আদিব নিজেও জানে না। ফারিশের মতো একটা মানুষের সাথে চলাফেরা তার। অথচ আজও একটু ভয় কমলো না।’

ফারিশ সরাসরি বাংলোর দরজার সামনে দাঁড়ালো। তালা বদ্ধ। ভিতরে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আদিব সাইট করে দাঁড়ালো। ফারিশ মোবাইলের আলো দিয়ে আশপাশ দেখলো। একটা বড় ইট নিয়ে মারতে লাগলো তালাতে। তালাটাতে খুব বেশি জোর লাগাতে হলো না। চারপাঁচটা বারি মারতেই খুলে গেল। দরজা খুলতেই ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢুকলো। বিশাল একটা রুম। তার চারদিকে অনেকগুলো দরজা যার প্রত্যেকটাই খোলা। ফারিশ হতাশ হলো। তার কেন যেন মনে হলো সে আসতে দেরি করেছে। আদ্রিতা এখানেই ছিল। কিন্তু এখন নেই।”

আদিব দরজা হাতরে তখনই ভিতরে ঢুকলো। আশেপাশে কাউকে না দেখে বললো,“ভাই বাড়ি দেখি ফাঁকা।”

ফারিশের হঠাৎ চোখ গেল নিচে পড়ে থাকা একটা কানের দুলের দিকে। কানের দুলটা আদ্রিতার। বোধহয় টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় খুলে গিয়েছিল। ফারিশ এটা বেশ কয়েকবার আদ্রিতার কানে দেখেছিল। তার মনে আছে একবার আদ্রিতা বলেছিল এটা তার মায়ের দেয়া।’

ফারিশের নিজের ওপর রাগ উঠলো আর কতক্ষণ আগে কি আসতে পারতো না এখানে।’

দূর থেকে ট্রাক যাওয়ার শব্দ শোনা গেল। ফারিশ উঠে দাঁড়ালো দ্রুত। আদিবকে বললো,“কিশোরকে কল করে এখানে আসতে বলো আদিব। আমরা বোধহয় খুব দেরি করি নি।”

আদিব শুনলো। ফারিশ তক্ষৎনাৎ বের হলো বাংলোর ভিতর থেকে আদিবও গেল তার পিছন পিছন। কল করলো হাঁটতে হাঁটতে।’
—-
গভীর রাতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে একটা ট্রাক বের হলো রাস্তায়। ট্রাকের ভিতর আছে পঞ্চাশটা মেয়ে। যাদের সবারই হাত পা মুখ বাঁধা। আদ্রিতা কিছু করতে পারে নি। তার করার কিছু ইচ্ছে থাকলেও সে ব্যর্থ হয়েছে। সবসময় নিজের কাছে ইনজেকশনসহ নানাবিদ ঔষধী নিয়ে ঘুরলেও আজ সময়ের সময় তার কিছু ছিল না। ব্যর্থ আদ্রিতা। তার নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে এখন। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে আদ্রিতার। আর বুঝি ফারিশের নিকট যাওয়া হলো না। চোখে ঝাপসা দেখছে আদ্রিতা। হঠাৎ গাড়িতে ব্রেককষা হলো। গাড়ি গেল থেমে। সব মেয়েরা একত্র হয়ে একদিকে এলে পড়লো। কর্নারে থাকা মেয়েগুলো ব্যাথাও পেয়েছে দারুণ।’

গাড়ির চালক বিরক্ত। হঠাৎ সামনে কেউ চলে আসায়। ড্রাইভারের পাশে ছিল আরেকটা লোক মুনিব। সেও বসে চুপচাপ। ফারিশ এগিয়ে আসলো তখন। ফেক একটা পুলিশ অফিসারের আইডি কার্ড দেখিয়ে বললো,“পুলিশ। এতরাতে ট্রাকে করে কি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”

ঘাবড়ে গেল মুনিব। বললো,“তেমন কিছু না সাব। গরুর খড়।”

ফারিশ মানতে চাইলো না। মুনিবকে ইশারায় নামতে বললো। মুনিব নামলো। আদিব চুপচাপ ফারিশের পাশে দাঁড়ানো। তার কপাল চুইয়ে ঘাম পড়ছে। ফারিশ মুনিবকে বললো,
“ভিতরে কি আছে আমি দেখতে চাই?”
“সাহেব গরুর খড়ই আছে।”
“তাই দেখবো আমি। রতন গাড়ির কাগজগুলো দেখো।”

আদিব চমকে উঠলো। কোনোরকম বললো,“দেখাতাছি ভা,উম দেখতাছি স্যার।”

ড্রাইভারের কাছে গাড়ি কাগজ চাইলো আদিব। আর ফারিশ গেল মুনিবের সাথে গাড়ির পিছনে। হুকুম দিয়ে বললো,“গেট খোলো।”

মুনিবের মাথা চুইয়ে ঘাম পড়ছে। কি করবে বুঝচ্ছে না। এভাবে হুট করেই পুলিশ চলে আসবে সে বুঝতে পারে নি।’

এদিকে আদ্রিতা যেন স্পষ্ট ফারিশের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে। মুখ ফুটে কিছু বলবে তাও পারছে না। অসহায় লাগছে নিজেকে। ফারিশ তীক্ষ্ণ স্বরে শুধায়,“খোলো তাড়াতাড়ি আমার কাছে সময় নেই।”

মুনিব বললো আবার,“গরুর খড়ই আছে সাব।”

এবার হুংকার দিয়ে উঠলো ফারিশ। মুনিব ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত দরজা খুললো। কিছু গরুর খড় পড়লো নিচে। ফারিশ হতাশ হলো। খড়ের মধ্যে হাত দিলো। এখানেও নেই আদ্রিতা। আদিব ছুটে আসলো তখন। গাড়ির কাগজ দেখিয়ে বললো,“স্যার গাড়ির কাগজ।”

ফারিশ একবার চোখ বুলালো। সে আর্তনাদ ভরা কণ্ঠে বললো,“আপনি কোথায় ডাক্তার ম্যাডাম?”

ঠিক সেই মুহূর্তের ট্রাকের ভিতর দিয়ে বিকট এক শব্দ আসলো। আদিব, ফারিশ, মুনিব তিনজনই চমকে উঠলো। ফারিশ বললো,“কিসের শব্দ হলো?”

মুনিব বললো,“কই কিছুর শব্দ নাই তো সাহেব।”
পরপর আরো দু’বার শব্দ হলো। ট্রাকের ভিতরের মেয়েরা যে যেভাবে পারছে শব্দ করছে। কেউ পা দিয়ে, কেউ হাত দিয়ে, কেউ মাথা দিয়ে। ফারিশ দ্রুত খড় সরানোর চেষ্টা করলো। মুনিব দৌড় দিবে তখনই। তাকে সাহস করে ধরলো আদিব। সেই মুহুর্তেই সেখানে উপস্থিত হলো কিশোর। ড্রাইভারও পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারে নি। কিশোর নাক বরাবর কয়েকটা ঘুষি মারলো মুনিবকে।’

অতঃপর সামনের সাজিয়ে রাখা খড়গুলো সরাতেই স্পষ্ট দেখা গেল বেশ কয়েকটা মেয়েদের মুখ। আর তাদের মাঝে আদ্রিতাকে। ফারিশ চেয়ে রইলো তার দিকে। আদ্রিতাও দেখলো। মলিন চোখ তার।’

একে একে মেয়েগুলো বের হলো। সবাই ফারিশকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কেউ ভাইজান ডেকে কেঁদে ফেলছে। এই মেয়েগুলোর বেশির ভাগ ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েরা। যারা বাবা মাকে ছেড়ে হোস্টেলে থাকে। এদের মধ্যে কিছু মেয়ে বিবাহিত ছিল। একটা মেয়ে ছিল যে উকিল হবে। সে ল এর স্টুডেন্ট। মেয়েটার নাম তিশা। তিশা ফারিশের হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বললো,“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া আজ আপনি না এলে আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যেতাম। আমি একজন ল’য়ের স্টুডেন্ট। খুব শীঘ্রই উকিল হবো। আপনার জীবনে যদি কখনো প্রয়োজন পড়ে আমায় জানাবেন ভাইয়া। আমি আমার সর্বশ দিয়ে আপনায় সাহায্য করার চেষ্টা করবো।”

ফারিশ শুধু দেখলো মেয়েটাকে। গালে পাঁচ আঙুলের দাগ। খুব মেরেছিল বোধহয়। ফারিশ মেয়েটার মাথায় হাত বুলালো। বললো,“ভালো থেকো সবসময়।”

মেয়েটি মিষ্টি হাসে। সব মেয়েদের কিশোরের হাতে তুলে দেয়া হলো। এখানে টোটাল পঞ্চাশজন মেয়ে ছিল বাকিরা আরো দুটো ট্রাকে। মুনিবকে মেরে বাকিগুলারও হদিস পাওয়া যাবে। কিশোর এগিয়ে আসলো। বললো,“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ফারিশ।”

ফারিশ চায় কিশোরের দিকে। বলে,“আপনায় আগেই বলেছিলাম আমার পিছনে না ঘুরে আসল অপরাধীকে ধরুন। এই সব কাজ আরশাদ করেছে। যে দু’মাস আগে জেল থেকে পালিয়েছে। আমার সেদিনের ট্রাকেও মেয়েও ওই রেখেছিল।”

কিশোর হাত মেলায় ফারিশের সাথে। বলে,“ইনফরমেশন দেয়ার জন্য আপনায় ধন্যবাদ। বাকিটা আমরা দেখে নিচ্ছি।”

বলেই চলে যেতে নিলো কিশোর। পরপরই দাড়িয়ে বললো,“ডাক্তার সাহেবাকে পারলে ক্ষমা করে দিয়েন ওনার কোনো দোষ নেই। আমিই বাধ্য করেছিলাম তাকে।”

ফারিশ কিছু বলে না। কিশোর চলে যায়। ফারিশের দৃষ্টি যায় ট্রাকের পাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার ম্যাডামের দিকে। কেমন মলিন মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফারিশ মনে মনে আওড়ায়,
“এভাবে কেন তাকান ডাক্তার ম্যাডাম,আপনার চাহনি যে বরাবরই আমায় নিঃস্ব করে ছাড়ে।”

#চলবে….

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৩৬+৩৭

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৬

বেশ নিরাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সবাই আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার সেদিকে হুস নেই। সে নিজের মতো করে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে। মৃদুল এতক্ষণ মুরগীর রোস্ট নিয়ে এতকিছু বললো তাতেও তার ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন শুনতে পায় নি। হঠাৎই মুনমুন বললো,“আদু,

আদ্রিতা জবাব দিলো না। আদ্রিতার কান্ডে একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো সবাই। আশরাফ সবাইকে চুপ হতে বলে এগিয়ে গেল আদ্রিতার কাছে। সামনে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো। তাও আদ্রিতার কোনো হেলদোল দেখা গেল। বেশ চিন্তিত হলো সবাই। আশরাফ আলতো করে আদ্রিতার কাঁধে হাত রাখলো। নিচু স্বরেই ডাকলো,“আদু,”

আদ্রিতা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো এবার। কোনোরকম বললো,“জি,

পরমুহূর্তেই চোখের সামনে তার বন্ধুমহলের সবাইকে দেখে হতভম্ব স্বরে বললো,“তোরা এখানে? কখন এলি?”

বিষম খেলো সবাই। তারা সেই কখন এখানে এসেছে হইচই করছে অথচ আদ্রিতা তাদের দেখতে পায় নি। সবাই বেশ বিস্মিত।’

বিকেলের ফুড়ফুড়ে আলোতে শীতল বাতাসময় পরিবেশ। হসপিটাল থেকে খানিকদূরেই অবস্থানরত এক নদীর পাড়। তার সামনের এক বেঞ্চিতে বসে আছে আদ্রিতা। আর তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে আশরাফ, মুনমুন, মৃদুল, রনি আর চাঁদনী। মূলত দু’ঘন্টার একটা ছুটি নিয়ে তারা এখানে এসেছে। প্রকৃতির মিষ্টি বাতাস তাদের ছুইলো হঠাৎ। আশরাফই শুরু করলো আগে। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,“কি হয়েছে তোর?”

আদ্রিতার ছলছল দৃষ্টি ভঙ্গি। বুকে তীব্র ব্যাথা। তবুও প্রশ্ন এড়াতে বললো,“কি হবে?”

“আমাদের থেকে কিছু লুকাচ্ছিস তুই”–চিন্তিত স্বর মৃদুলের।

আদ্রিতা আশেপাশে চায়। বিস্মিত কণ্ঠে বলে,“না।কি লুকাবো?”

সন্দিহান দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে রইলো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতা শুঁকনো হাসলো। বললো,“কিছু হয় নি রে আসলে কাল রাতে ঠিক মতো ঘুম হয় নি। তাই আর কি নিজেকে মরা মরা লাগছে। প্রচুর ঘুমও পাচ্ছে।”

কথাটা বলে হাই তুললো আদ্রিতা। শুরুতে কেউই বিশ্বাস করতে চাইলো না আদ্রিতার কথা। কিন্তু আদ্রিতার চোখ বোধহয় সত্যি বলছে। সে ক্লান্ত। তার চোখ খানিক লাল। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সবাই। মৃদুল পরিবেশ ঠিক করতে বললো,“তাইলে কিছু খাওয়া যাক। ঝালমুড়ি ফুচকা খাবি তোরা?”

সবাই চেঁচিয়ে উঠলো। যার মানে ‘তারা খাবে’।
মেয়ে তিনজন ফুচকা আর ছেলে তিনজন ঝালমুড়ি খাবে বলে ঠিক করলো। আশরাফ ওরা গেলো আনতে, এরপর খেতে খেতে মৃদুলের বিয়ের কথাবার্তা চলবে। ঘুম পেয়েছে বললেই তো আর আদ্রিতাকে ঘুমোতে দেয়া যাবে না এখন।’
—-
খুলনার ফ্যাক্টরিতে পা রেখেছে ফারিশ। আজ অনেকদিন পরই পা রেখেছে এখানে। বেলা তখন বিকেল ছাড়িয়ে। ফারিশকে দেখেই সেখানকার ম্যানেজার মহিন উদ্দিন দৌড়ে আসলেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে আওড়ালেন,“কেমন আছেন স্যার?”

ফারিশ সামনে হাটলো। তার পিছনে আদিব। আর তাদের সঙ্গে মহিন উদ্দিন। ফারিশ গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল,
“ভালো। কাজ কেমন চলছে?”
“জে ভালোই স্যার।”
“আজ রাতে কি মাল ডেলিভারি দেয়া হবে?”
“জে স্যার।”
“কোন কোন দেশে যাবে?”
“একটা জাপানে, আরেকটা নেদারল্যান্ড।”

ফারিশ ছোট করে উত্তর দিলো,“ওহ।”
একটু থেমে আবার বলে,
“ঔষধের কি খবর?”
“স্যার দেশেই অনেকগুলো অর্ডার আছে। ঢাকার বেশিরভাগ সরকারি, বেসরকারি হসপিটালগুলো আমাদের ঔষধ ব্যবহার করছেন। বাচ্চাদের জন্য নতুন তৈরিকৃত কাশির ঔষধটাও ব্যাপক ভালো হয়েছে। ঢাকা সরকারি হসপিটালের ড. ওয়াজিহা আদ্রিতা নামের একজন ডক্টর ঔষধটার ভালো রিভিউ দিয়েছে স্যার। এছাড়া খুলনাতেও বেশ সাড়া ফেলেছে।”

ফারিশ কিছু বললো না। ওয়াজিহা আদ্রিতা নামটা শুনতেই বুক কাঁপলো ফারিশের। যন্ত্রণাও হলো বুঝি। আদিব বুঝলো। এগিয়ে এসে বললো,“আপনি ভাই ওখানের একটা চেয়ারে বসুন আমি বাকিটা দেখে নিচ্ছি।’

ফারিশ শুনলো না। জোরে নিশ্বাস ফেলে বললো,“আমি ঠিক আছি আদিব।”

কথাটা বলে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সবটা। মেয়েটার সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়ছে ফারিশের। অস্থির লাগছে আচমকা। মুখ থেকে অস্পষ্টনীয় বার্তা বের হলো একটু,“এভাবে না ঠকালেও বোধহয় হতো ডাক্তার ম্যাডাম।”
—-
নিঝুম রাত! চুপচাপ হাঁটছে আদ্রিতা। সেদিনের পর চারদিন কাটলো আজ। ফারিশের সাথে চারদিন যাবৎ কথা নেই। ফোন নাম্বার থাকতেও কল দেয়া মানা। আদ্রিতা চাইলেও কল করতে পারছে না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ফোন করে কি বলবে তাও জানে না! ক্ষমা চাইবে কি না তাও বুঝচ্ছে না। আর ক্ষমা চাইলেই কি ফারিশ তাকে ক্ষমা করে দিবে! অবশ্যই দিবে না। আদ্রিতা চাইছে ক্ষমা না করলেও ফারিশ কম করে হলেও তার সাথে রাগারাগি করুক। চেঁচামেচি করুক। ছেলেটার এভাবে গুম হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আদ্রিতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তার কষ্ট হচ্ছে। একটা ভুল তার পুরো জীবন ওলোট পালোট করে দিলো। কোথাও গিয়ে তার মনে হচ্ছে তার কক্সবাজার যাওয়াই ভুল হয়েছে। না যেত কক্সবাজার, না দেখা হতো ফারিশের সাথে, আর না ওই পুলিশ অফিসারের সাথে। আনমনা রাস্তার কর্ণার থেকে ফুটপাতের রাস্তা থেকে নামলো আদ্রিতা। এরপর পিচঢালা রাস্তা দিয়ে হাঁটলো। তার কিছু ভালো লাগছে না। মাঝরাতে এভাবে হেঁটে বেড়ানোটাও সেইফ না। কিন্তু তবুও আদ্রিতা হাঁটছে। রজনীর রাতে, আলোকিত ল্যামপোস্টের নিচে বিষণ্ণ মন নিয়ে হাঁটছে আদ্রিতা। হঠাৎই উল্টো পথ দিয়ে একটা গাড়ি ছুটে আসলো আদ্রিতার দিকে। সে বিমূঢ় চেয়ে। গাড়িটা সরাসরি আদ্রিতার মুখোমুখি এসে থামলো। গাড়ির লাইটের আলোতে চোখ ধাদিয়ে উঠলো তার। খানিকটা ঘাবড়ানো, আর ভয়ার্ত মুখ নিয়েই সে চেয়ে রইলো গাড়িটির দিকে। চুপ হয়ে গেল গাড়ির স্থির দৃষ্টিতে বসে মানুষটাকে দেখে। ফারিশ বসে। তার গাড়ি ব্রেকফেল করেছিল। ভাগ্যিস এখানে এসে থেমেছে। সে বুঝতে পারে নি এই মুহূর্তে রাস্তার দিকে তার মুখোমুখি আদ্রিতা দাঁড়িয়ে থাকবে। ফারিশের স্থির দৃষ্টি। ফারিশ তার পকেট থেকে ফোন বের করলো। আদিবকে বললো,“আমার গাড়ি ব্রেকফেল করেছিল আদিব। নতুন গাড়ি পাঠাও আমি হসপিটাল রোডে আছি।”

ফোন কাটলো ফারিশ। সে গাড়ি থেকে বের হলো। আদ্রিতা তখনও তার দিকে তাকিয়ে। ফারিশ পুরো গাড়িটা চেক করে বুঝলো সে আসার সময় ভুল করে নষ্ট গাড়ি নিয়ে এসেছে। এই গাড়ির ব্রেকফেল আরো আগেই হয়েছিল। ফারিশ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো ইদানীং কি তার ভুলের পাল্লা ভাড়ি হচ্ছে নাকি।’

ফারিশ একটু একটু করে এগিয়ে আসলো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার বুক ধড়ফড় করছে। ফারিশ বললো,“আমি খুব দুঃখিত হঠাৎ এমন সামনে চলে আসায়। আসলে আমার গাড়ি ব্রেকফেল করেছিল।”

কথাটা বলেই ফারিশ সরে আসলো। আদ্রিতার গলা বুঝি আটকে গেছে। মুখ দিয়ে কথাই বের হতে চাইলো না। সে কি করবে বুঝচ্ছে না বাড়ি চলে যাবে। নাকি দাঁড়িয়ে থাকবে। দাঁড়িয়ে কেন থাকবে? ফারিশের আচরণটাও ঠিক লাগলো না। মনে হলো তাকে চেনেই না। আদ্রিতার বুক ভাড়ি হয়ে আসছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। সে বহুকষ্টে ডাকলো,“মিস্টার বখাটে।”

ফারিশ দাঁড়ালো না মোটেও। গাড়ির চাবি বের করে গাড়িটা লক করে সে হাঁটা ধরলো উল্টোদিকে। আদ্রিতার চোখ বেয়ে পানি পড়লো আচমকা। সে কান্নামাখা মুখশ্রী নিয়েই বলে উঠল,“ফারিশ।”

না চাইতেও ফারিশের পা থেমে গেল। এই অনাকাঙ্খিত মোলাকাত ফারিশ চায় নি। ফারিশকে দাঁড়াতে দেখে আদ্রিতা চোখের পানি মুছতে মুছতে দৌড়ে গেল ফারিশের কাছে। দাঁড়ালো মুখোমুখি। বললো,“আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে ফারিশ?”

ফারিশের স্বাভাবিক মুখভঙ্গি। শান্ত গলা,
“আমার মনে হয় না আপনার আমার সাথে কোনো কথা থাকতে পারে।”
“অবশ্যই আছে।”
“আমি শুনতে চাইবো কেন?”
“সত্যিই কি শোনা যায় না?”

আদ্রিতার বিষণ্ণ মুখ। মলিন কণ্ঠস্বর। ফারিশ চাইলো এবার আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। এতক্ষণ তাকায়নি কিন্তু এবার না তাকিয়ে পারলোই না। ফারিশ ঝুকে গেল আদ্রিতার দিকে। নিশ্বাস ছাড়লো হঠাৎ। সেই নিশ্বাস গিয়ে লাগলো আদ্রিতার মুখপানে। সে চোখ বন্ধ করে আবার খুললো। তবুও নড়লো না। স্থির দাঁড়িয়ে। ফারিশ শীতল স্বরে আওড়ায়,
“যারা মন ভাঙে, দুঃখ দেয়,হৃদয়ে জ্বালাপোড়া ঘটায় তাদের কথা শোনা কি আধও শোভা পায় ডাক্তার ম্যাডাম!”

আদ্রিতা থমকে যায়। মাথা নুইয়ে ফেলে তক্ষৎনাৎ। এ কথার পিঠে কি উত্তর দেয়া যায় সে ভাবে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। উত্তর নেই এ কথার। ফারিশ মলিন হাসে। করুন দেখায় সেই হাসি। ফারিশ নীরব স্বরে আবার শুধায়,
“তোমায় ভালোবেসেছিলাম বলেই দুঃখ দিতে পারলে, নয়তো এই আমিকে দুঃখ দেয়ার সাহস এই ধরণীর কারো নেই।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৭

নিকষকালো অন্ধকারে ঘেরা চারপাশ। শাঁ শাঁ করে ঢেউদের শব্দ শোনা যাচ্ছে ব্রিজের নিচ বেয়ে। তুমুল বাতাস আর শীতের আভাস বইছে দারুণ। জানুয়ারি মাসের চার তারিখ পেরিয়ে পাঁচ তারিখকে বহু আগেই ছুঁয়ে ফেলেছে সময়। আদ্রিতা আর ফারিশ ঠায় দাঁড়িয়ে রাস্তার কর্নারে। কারো মুখেই কথা নেই। ফারিশের প্রতিটা কথার ধাঁজ এতটাই ধারালো যে আদ্রিতা চেয়েও আর কিছু বলতে পারছে না। ফারিশের কথার পিঠে কথা বলার মতো কোনো শব্দই খুঁজে পাচ্ছে না যেন। আর শেষ কথাটার “তুমি” সম্মোধনটা। আদ্রিতার বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। ফারিশ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কপাল চুলকে বললো,“রাত কিন্তু অনেক হয়েছে দাঁড়িয়ে না থেকে বাড়ি যান।”

আদ্রিতা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ফারিশের দিকে। নরম গলায় প্রশ্ন করলো,“আমার কথা কি একটুও শোনা যায় না ফারিশ?”

তড়িৎ উত্তর এলো ফারিশের,
“আগে হলে যেত এখন যায় না।”
“মানুষ মাত্রই তো ভুল করে।”
“আপনি তো ভুল নয়,
“জানি অন্যায় করেছি।”
“জানেনই যখন তখন বলছেন কেন?”
“আমি একটু সময় নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।”

মিনতির স্বরে শুধায় আদ্রিতা। ফারিশ শোনে না। গম্ভীর এক আওয়াজে বলে,
“আমার মনে হয় না আমাদের আর কোনো বলার মতো কথা থাকতে পারে।”
“আমার তো কিছু বলার আছে।”
“কিন্তু আমার কিছু শোনার নেই।”
“এত ঘৃণা,

মলিন হাসে ফারিশ। বলে,
“ফারিশ মানুষটাই ঘৃণার।”
“না।”

হেঁসে ফেলে ফারিশ। এবারের হাসিটায় খানিকটা শব্দও হয় বটে। ফারিশ বলে,“ফারিশকে ঠকানো যায়,তার সাথে মিথ্যে অভিনয় করা যায়,কিন্তু ভালোবাসা যায় না।”

আদ্রিতা আবারও চুপ হয়ে গেল। ফারিশ চায় তার পানে। মৃদুস্বরে আওয়াড়,,“আপনার কি মনে আছে ডাক্তার ম্যাডাম আপনাকে একদিন হসপিটাল বসে আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম?”

চকিত চাইলো আদ্রিতা। চাইলো ফারিশের চোখের দিকে। কি নিদারুণ বিষণ্ণ মাখা সেই চোখ জোড়ায়। আদ্রিতা প্রশ্ন করে,“কোন কথা?”

ফারিশ সময় নেয় না। শান্তস্বরে বলে,“আপনায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে কি ভালোবাসা যায় ডাক্তার ম্যাডাম?”

থমথমে মুখটা তড়িৎ কেঁপে উঠলো আদ্রিতার। বিস্মিত নজরে চোখের পলক ফেললো বার কয়েক। হাত কচলালো মুহুর্তে। ফারিশ দেখলো। বললো,“সেদিন আপনার উত্তর কি ছিল তা কি আপনার মনে পড়ে।”

আদ্রিতা মাথা নুইয়ে ফেলে আবার। যার অর্থ ‘তার মনে আছে’। ফারিশ বলে ওঠে তক্ষৎনাৎ,“আপনি উত্তরে বলেছিলেন ‘পৃথিবীর সব মানুষকেই ভালোবাসা যায় শুধু সেই মানুষটাকে ভালোবাসার মর্মতা বুঝতে হয়।’ এখন প্রশ্ন হলো আমি কি মর্মতা বুঝে নি?”

আদ্রিতা কিছু বলে না। ফারিশ চুপ থাকে না আবার বলে,“আজ আপনি সত্যি সত্যিই প্রমাণ করে দিলেন ফারিশকে ভালোবাসা যায় না। ফারিশরা কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই নই বোধহয়।”

করুন শোনালো ফারিশের শেষ কণ্ঠস্বর। তার কথা বোধহয় আবার আটকে আসছে। আদ্রিতা এবার মুখ খোলে। লজ্জিত স্বরে বলে,
“আপনি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ফারিশ।”

ফারিশ নিজেকে সামলে বলে,
“তাহলে কি করে ঠকালেন বলুন তো?”
“আমায় কি একবার ক্ষ..

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই ফারিশ হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয় তাকে। বলে,“ক্ষমা শব্দটা ব্যবহার করবেন না ওটা শুনতে ইচ্ছে করছে না। আপনি বাড়ি যান।”

আদ্রিতা গেল না। আদিবের গাড়ি আসলো তখন। ফারিশ তাদের গাড়িটা দেখতে পেয়েই ছুটে গেল সেদিকে। আদ্রিতা তার পানে চেয়ে। অতঃপর আর কোনো কথা না বাড়িয়েই চলে গেল ফারিশ আর আদিব। আদিব আদ্রিতাকে দেখলেও কিছু বললো না। চুপচাপ চলে গেল।’

আদ্রিতা বিস্মিত মন ভাঙা মন নিয়ে দাঁড়িয়ে। চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো নিচে।’

আজ মৃদুলের বিয়ে! তুমুল হইচই আর গানবাজনা হচ্ছে বাড়ির ভিতর। বড় বড় বাস ভাড়া করা হয়েছে বরযাত্রীদের যাওয়ার জন্য। মৃদুলদের জন্য স্পেশাল ফুল সাজানো গাড়ি। সেই গাড়ি করে যাবে আদ্রিতা,মুনমুন, রনি,আশরাফ, মৃদুল আর চাঁদনী। গাড়িটা বড়সড়। আদ্রিতা ভাড়ি একটা লেহেঙ্গা পড়েছে। চুলগুলো খোলা। মুখে মলিন হাসি ঝুলছে। বাকিরাও সেজেছে খুব। মৃদুলের কাজিনকুজিনও আসছে পিছনের গাড়ি করে। মৃদুল ওরা গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। মৃদুল টিস্যু দিয়ে নিজের মুখটা মুছতে মুছতে বললো,“দোস্তরা আমার না খুব নার্ভাস লাগছে! গাড়ি থাইক্যা নাইম্যা যামু নি।”

আশরাফ চোখ কুঁচকে ফেললো। সে গাড়ি চালাচ্ছে। আশরাফ লুকিং গ্লাস দিয়ে এক পলক মৃদুলকে দেখে বললো,“মৃদুলের বাচ্চা সেদিনের মতো যদি আজকেও অজ্ঞান-টজ্ঞান হোস তো দেখিস। বাড়ি এসে তুমুল পিডামু।”

আশরাফের কথা শুনে গাড়ি কাঁপিয়ে হাসলো সবাই। আদ্রিতাও হাসলো খানিকটা। মৃদুল কাচুমাচু হয়ে বললো,“ওইদিন কি আমি ইচ্ছা কইরা অজ্ঞান হইছিলাম নি। ওটা তো জাস্ট এক্সিডেন্ট ছিল।”

“ওই এক্সিডেন্টই আজ যেন না ঘটে চান্দু”–রনির গম্ভীর আওয়াজ।”

“এই তোরা থামবি বেচারা বিয়ে করতে যাচ্ছে এত শাসন না করলেও চলবে।” –চাঁদনী কথাটা বলে মৃদুলের কাঁধে হাত দিলো।’ মৃদুল মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে তার পানে চেয়ে রইলো। যেন এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বন্ধুই হচ্ছে চাঁদনী।”

প্রচুর হুল্লোড় আর হাসি তামাশা নিয়ে গাড়ি ছুটে চললো মৃদুলের শশুর বাড়ি। আদ্রিতাও নিজেকে তাদের মধ্যে জড়িয়ে নিল।’

পাক্কা দু’ঘন্টা পর গাড়ি এসে থামলো আহসান মঞ্জিলের সামনের। আহসান নীলিমার বাবার নাম। মৃদুলদের গাড়ি দেখেই কেউ একজন ছুটে গেল ভিতরে চিল্লাতে চিল্লাতে বললো,“বর আইছে, বর আইছে।”

মৃদুলের বুকটা কেঁপে উঠলো আচমকা। সে বুকে হাত দিয়ে বললো,“আমার কইলজা কাফে ভাই।”
আদ্রিতা মাথায় চাটি মারলো তার। বললো,“এত নাটক করিস না। ভাবি বইসা আছে।”

ভাবির কথা শুনতেই মৃদুলের মাঝে সাহস চলে আসলো। বেশ ভাব নিয়ে বললো মৃদুল,“প্রথমবার বিয়ে করছি না একটু নাটক না করলে চলে।”

আশরাফ হেঁসে বললো,“বুঝচ্ছি। এবার চল হাঁদা।”
গেটের কাছে আসতেই বাঁধায় এসে দাড়ালো নয়নতারাসহ আরো কিছু মেয়েপক্ষরা। তাদের একটাই কথা বিশ হাজার টাকা না দিলে জামাইকে ভিতরে ঢুকতে দিবে না। তা নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি হচ্ছে আশরাফ আর নয়নতারা মধ্যে। আর বাকিরা মজা নিচ্ছে।’

রুম জুড়ে আধার। ঘুটঘুটে অন্ধকার বলে যাকে। অথচ বাহিরে তীব্র রোদ। বদ্ধ একখানা রুম। চেয়ারে বসে আছে কেউ, হাতে খালি মদের গ্লাস। গায়ের জড়ানো ধূসর রঙের পাঞ্জাবি। মুখ ভর্তি দাঁড়ি, কুচকুচে কালো চোখ, গায়ের রঙ ফর্সা, সুঠাম দেহের অধিকারী এক সুদর্শন পুরুষ বলা যায়। তীব্র সেই অন্ধকারে বসে আছে লোকটি। রকিং চেয়ারে দুলছে। হঠাৎ মোবাইল বাজলো তার। চেয়ারের পাশে থাকা ছোট্ট টি-টেবিলটার ওপরে ফোনটার লাইট জ্বলছে। লোকটা বিরক্ত হলো। নীরবতার ভিড়ে হঠাৎ ঝনঝাল তার পছন্দ হয় নি। লোকটা ফোনটা তুললো না। সেকেন্ড টাইম বাজতেই একরাশ বিরক্ত নিয়ে ফোনটা তুললো। কিছু বলার পূর্বেই অপরপাশে থাকা লোকটা আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো,“বস দেড়শো মেয়ের মধ্যে একটা মাইয়া কম পড়ছে।”

মুহুর্তের মধ্যে মেজাজ তুঙ্গে উঠলো তার। তীব্র রাগ নিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে আওড়ালো,“কি করে কমলো?”

অপরপাশের মানুষটি ভয়ে ভয়ে বললো,“বস গলায় চাকু দিয়া পোঁচ দিছে নিজে নিজেই।”

লোকটি কিছু বললো না। চুপ থাকলো অনেকক্ষণ। এরপর শান্ত গলায় বললো,“কালকের মধ্যে নতুন মেয়ে চাই আমার। বুঝেছো লতিফ!”

লতিফ মাথা নাড়িয়ে বললো,“দেখতাছি বস, দেখতাছি।”

ফোন কেটে গেল। পাঁচ মিনিট সব চুপ। এরপরই ড্রয়ার থেকে ম্যাচের কাটি বের করলো লোকটি। একটা জ্বালিয়ে কাছের মোমবাতিটি জ্বালালো। বিশ্রী এক হাসি দিয়ে বললো,“ফারিশ, আমি যে ফিরে এসেছি এবার তোর কি হবে? প্রতিশোধের আগুন যে এবার দাউদাউ করে জ্বলবে।”

কথাটা বলেই হাসতে লাগলো লোকটি। ঘর কাঁপানো এক ভয়ংকর হাসি।’
—-
তখন নিরিবিলি বিকেল। ফারিশ বসে আছে তার সিঙ্গেল সোফায়। চোখে মুখে বিষণ্ণ ভাব। আদিব আসলো তখন। পাশে বসে বললো,“ভাই একটা খবর আছে?”

ফারিশ তাকালো আদিবের দিকে। বললো,
“কি খবর?”
“আরশাদ জেল থেকে পালিয়েছে।”

ফারিশ অবাক হলো না মোটেও। এ খবর সে আরো দু’মাস আগে জেনেছে। অথচ আদিব জানছে আজকে। ফারিশ শান্ত স্বরে বললো,“জানি আমি।”

আদিব ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,“এবার কি করবেন ভাই?”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,
“যেখান থেকে পালিয়েছে সেখানেই পাঠাবো।”
“আপনার ক্ষতি করতে চাইলে,
“ভয় পেও না কিছু হবে না।”

হঠাৎই প্রসঙ্গ পাল্টে ফারিশ বললো,
“তুমি কি চাঁদনীর সাথে যোগাযোগ রাখছো না আদিব?”

আদিব একটু ভড়কায়। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে তড়িৎ জবাব দেয়,“না।”

#চলবে…
#TanjiL_Mim♥️.

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৩৪+৩৫

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৪

নিস্তব্ধ চারপাশ। পিনপিনে নীরবতা বিরাজ করছে পুরো পরিবেশ জুড়ে। এই শীত সমৃদ্ধ পরিবেশেও আদ্রিতা ঘামছে। তার শরীর চুইয়ে বুঝি ঘাম ঝড়ছে। গরমে বিতৃষ্ণা লাগছে। আদ্রিতা নড়ে চড়ে উঠলো। খানিকটা থমকানো কণ্ঠস্বরে বললো,“এসব আপনি কি বলছেন?”

ফারিশের ঠোঁট জুড়ে তখনও মলিন হাসি। ভিতরটা যেন একটু একটু করে খন্ড খন্ড হচ্ছিল। ফারিশ করুণ চোখে প্রশ্ন করলো,“আপনি বুঝতে পারেন নি?”

আদ্রিতা নিশ্চুপ কি বলবে বুঝচ্ছে না। হঠাৎই ফারিশের নজরে আসলো আদ্রিতার ফোনের দিকে। কিছু একটা চলছে। ফারিশ আচমকাই খপ করে আদ্রিতার হাত থেকে ফোনটা নিলো। আদ্রিতা চমকে উঠলো। বিস্ময় নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ফারিশ দেখলো রেকর্ডার অন করা। রেকর্ড হচ্ছিল কতক্ষণ আগের তার আর আদ্রিতার কথা বলার মুহূর্তগুলো। এবার যেন আদ্রিতা পুরোদমে থমকে গেল। ঘাবড়ে গেল পুরো। ফারিশ মোবাইলটা দেখিয়ে বললো,“আমায় আপনি ভালোবাসেন নি আদ্রিতা। আমি বুঝতে পেরেছি। আমার সম্পর্কে জানার জন্য এত নিখুঁত অভিন..।”

ফারিশ চুপ হয়ে গেল। তার নিশ্বাস আঁটকে আসছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। বিশ্বাস করতেও খারাপ লাগছে এতদিন যাবৎ যে মেয়েটাকে নিয়ে এত এত স্বপ্ন দেখলো ফারিশ। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। ছোট্ট সংসার পাতার স্বপ্ন। অথচ যাকে নিয়ে দেখলো সেই মেয়েটা নাকি তাকে ভালোবাসে নি। শুধুমাত্র তার সম্পর্কে জানার জন্য অভিনয় করে গেল।’

ফ্লাসবেক…

চাঁদনীর সাথে সময় কাটিয়ে আদিব যখন বেরিয়ে আসতে চায় হসপিটাল থেকে সেই মুহুর্তেই আদিব দেখতে পায় পুলিশ অফিসার কিশোরকে। যে কি না আদ্রিতার চেম্বারে ঢুকে। আদিব কৌতুহলী এগিয়ে যায় চেম্বারের দিকে।

অন্যদিকে,
আদ্রিতা বাহিরে ফারিশের কাছে যাবে সেই মুহূর্তেই কিশোরকে দেখলো। কিশোর ভিতরে ঢুকেই বললো,“কেমন আছেন ডাক্তার সাহেবা?”

আদ্রিতা বেশ অবাক চোখে তার পানে তাকালো। বললো,“আপনি এখানে?”

কিশোরের মুখ হাসি হাসি। আদ্রিতার সাজগোছ দেখেই মিষ্টি হাসলো সে। বললো,“মাফিয়া সাহেবকে তো ভালোই পটিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তার সম্পর্কে এখনও তো কোনো প্রমাণ পেলাম না।”

আদ্রিতা তখনই বলে,“আমি চেষ্টা করছি তো অফিসার। উনি কাল থেকে কিছু বলবে বলবে বলেও বলছেন না। কাল রাতে ভেবেছিলাম বলবে মোবাইলে রেকর্ড করার জন্য রেকর্ডারও অন করেছিলাম কিন্তু উনি কিছু বলেন নি। অথবা বলতে পারেন নি। দেখুন সেই কক্সবাজার থেকে আমায় আপনারা বিরক্ত করছেন। আমার এখন মনে হচ্ছে আপনার কথা শোনা আমার উচিত হয় নি।”

আদ্রিতার রাগ উঠলো। শুধুমাত্র এই অফিসারের কাজে হেল্প করার জন্য ফারিশের জীবনে ঢুকে আদ্রিতা। কক্সবাজারের সেই ক্যান্সারের কথা বলা লোকটাও মিথ্যে ছিল সে আসলে এই কিশোরের একজন লোক ছিল। সেই আদ্রিতাকে বলে ফারিশ একজন মাফিয়া। দেশ বিরোধী মাফিয়া। কিন্তু তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। ফারিশের পাওয়ার আর বুদ্ধিমত্তার কাছে বার হেরে যায়। যার কারণে তারা তাকে ধরতে পারছে না। এখন আদ্রিতা যেন তাদের সাহায্য করে। কারণ তারা দেখেছে ফারিশ একটু হলেও আদ্রিতার প্রতি উইক। আদ্রিতা শুরুতে এসবে রাজি হতে চায় নি। কিন্তু পরে কিশোরের অনেক অনুরোধের পর রাজি হয়। ভালোবাসাটাকে নোংরাভাবে ব্যবহার করার জন্য আদ্রিতার নিজের দিকে তাকাতেও এখন লজ্জা লাগে।

কিশোর আশপাশ দেখে বললো,“কুল ডাউন ডাক্তার সাহেবা। পারেন নি কিন্তু পারবেন। আমার মনে হয় আজই ফারিশ আপনায় সব বলবে।”

উত্তরে আদ্রিতা কিছু বলে না।’
এদিকে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আদিব সব শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। তার নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ডাক্তার ম্যাডাম ফারিশ ভাইয়ের সাথে অভিনয় করেছে। আদিব টের পেল আদ্রিতা চেম্বার থেকে বের হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে সে আড়াল করে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। এরপর কিশোরও বের হলো। আদিব হন্তদন্ত হয়ে যায় কি করবে না করবে বুঝতে বুঝতে সে কল করে ফারিশকে। কিন্তু ফারিশ তার কথা না শুনে একা একাই সব বলে কেটে দেয়। এরপর থেকেই আদিব লাগাতার কল করে ফারিশকে। কিন্তু ফারিশ তোলে না। অতঃপর একান্নবারের কলটা তোলে। আর সব শেষ।’

ফ্লাসবেক ওভার…

নির্বিকার চাহনি নিয়ে ফারিশ তাকিয়ে আছে আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার চোখে মুখে ভয়। সে বুঝতে পারে নি। আচমকাই ফারিশ সব জেনে। আদ্রিতা মাথা নুইয়ে রইলো। ফারিশ অসহায় কণ্ঠস্বরে বলে,“এমনটা কেন করলে আদ্রিতা? আমাকে জানার জন্য আর কি কোনো পথ ছিল না?”

আদ্রিতা চোখ তুলে তাকালো ফারিশের দিকে। ফারিশ আবার তাকে তুমি করে বলছে। অথচ এই তুমির মাঝে কোনো ভালোবাসা নেই আছে ঘৃণা। আদ্রিতা জবাব দেয় না। ফারিশ আবার বলে,“কেন করলেন এমনটা?”

আদ্রিতা নিরুত্তর। ফারিশের চারপাশ বুঝি ঘুরছে। তার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। বিষয়টা কোনোভাবেই মানতে পারছে না। ফারিশ শক্ত করে আদ্রিতার দু’হাত চেপে ধরলো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,“আমার দিকে তাকান।”

আদ্রিতা তাকায়। ফারিশের চোখদুটো রক্তলাল বর্ণ ধারণ করছে। আদ্রিতা তাকাতে পারছে না। নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে। তাও আদ্রিতা তাকালো। ফারিশ বললো,“কেন করলেন এমন? আমার ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিল না। আমি তো সত্যি সত্যিই আপনায় ভালোবেসেছিলাম। এই হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আপনি এমনটা কেন করলেন?”

আদ্রিতা নিরুপায় কণ্ঠস্বর,
“পুলিশ আমায় বাধ্য করেছিল।”
“একটা মানুষকে ঠকাতে কষ্ট লাগলো না কোনো।”

আদ্রিতা কি বলবে বুঝচ্ছে না। ফারিশ পুনরায় আওড়ায়,“ভালো না বাসার ইচ্ছে যখন ছিল। তখন না বাসতেন এত অভিনয়ের কি দরকার ছিল?”

আদ্রিতা মাথা নিচু করে রয়। ফারিশ আদ্রিতার হাত ছেড়ে দেয়। অনেকক্ষণ চুপ থেকে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে। বুকের বামপাশটা দেখিয়ে বলে,
“আমার ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে আপনি কি টের পাচ্ছেন?”

আদ্রিতার বুক কেঁপে উঠলো সে কথা শুনে। চোখে পানি টলমল করছে। নিজেকে শক্ত রাখা যাচ্ছে না। ফারিশ আর কথা বাড়ালো না। শক্ত কণ্ঠে বললো,“নামুন।”

আদ্রিতা চাইলো ফারিশের দিকে। ফারিশ সরাসরি আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“আমার গাড়ি থেকে নামুন।”

আদ্রিতা কোনোরকম কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,“ফা..রি

পুরোটা শেষ করার আগেই ফারিশ ভয়ংকর রেগে গিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে,“আপনার ওই মুখে আমি আমার নাম শুনতে চাই না। বের হন দ্রুত।”

ফারিশের হুংকার শুনে আদ্রিতা আর বসে থাকতে পারলো না। দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো। ফারিশ বললো,“নিজের ভালো চাইলে আর কোনোদিন আপনার মুখ আমায় দেখাবেন না। ভালো থাকুন সবসময়।”

কথাটা বলেই ফারিশ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। দ্রুত স্পিড বাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল দূরে -সূদুরে। আদ্রিতায় ঠায় দাঁড়িয়ে। তার কষ্ট হচ্ছে। বুক ফেটে যাচ্ছে। জ্বালাপোড়া করছে ভিতরে। আদ্রিতা বুকে হাত দিলো। বিড় বিড় করে বললো,

“এত তো কষ্ট হওয়ার কথা ছিল না আদু। তুই তো শুরুই করেছিলি অভিনয় দিয়ে। তবে কি অভিনয় করতে গিয়ে সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিস ফারিশকে।”

আদ্রিতা আচমকা কেঁদে উঠলো। পরিবেশ তখন প্রবল বেগের বাতাসের ধাক্কায় কাঁপছে। নদীর স্রোতও বইছে অহরহ। সঙ্গে নামছে অন্ধকার। ঘনকালো অন্ধকার।’
—-
রাত তখন আটটা। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ঢুকছে আদিব। তার ফারিশ ভাই কোথায় জানার জন্য মনটা ছটফট করছে। ফারিশ তাকে বলেছিল আদ্রিতাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। একটা সুন্দর বিকেল করবে। কিন্তু কোথায় যাবে তা বলেনি। তবুও আদিব ঢাকার অনেক জায়গায় গিয়েছিল কিন্তু ফারিশকে পায় নি। শেষমেশ হতাশ হয়ে বাড়ি আসলো। আদিব বাড়ির সদর দুয়ার খোলা দেখেই বুঝতে পারলো ফারিশ বাড়িই এসেছে। আদিব দ্রুত পা চালিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ফারিশের রুমের দরজা খোলা। আদিব দৌড়ে ঢুকলো ভিতরে। বুক কেঁপে উঠলো তার। পুরো কক্ষের জিনিসপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলেছে ফারিশ। কোথাও কোথাও রক্তের ফোটাও দেখা যাচ্ছে। আঁতকে উঠলো আদিব। পুরো রুমেও চোখ বুলিয়ে ফারিশকে দেখা গেল না। আদিব একটু একটু করে এগিয়ে গেল বেলকনির দিকে। বেলকনির কাছে গিয়ে চোখ দিতেই আরো চমকে উঠলো। ফারিশ পুরো অগোছালো ভঙ্গিতে নিচে বসে আছে। হাত দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। পাশেই মদ আর সিগারেট। ফারিশ মদ খাচ্ছে আবার। গত একমাস যাবৎ ফারিশ এগুলো সব ছেড়ে দিয়েছিল। আদ্রিতার মিথ্যে ভালোবাসা তাকে একটু একটু করে ভালো বানাচ্ছিল। ফারিশ নামাজ পড়াও শুরু করেছিল।’

আদিবের চোখ ভেসে উঠলো। সে দৌড়ে ফারিশের পাশে বললো। অসহায়ত্ব নিয়ে বললো,“ভাই।”

ফারিশ নির্বিকার ভঙ্গিতে আদিবের দিকে তাকালো। শান্ত স্বরে বললো,“তুমি এসেছো আদিব। এত দেরি করলে যে,

আদিবের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ফারিশ বললো,
“আরে তুমি কাঁদছো কেন আমি ঠিক আছি।”
“তুমি ঠিক নাই ভাই।”

ফারিশ মদের গ্লাসে চুমুক দিলো। বললো,“আমি ঠিক আছি আদিব।”

আদিব আবারও বললো,
“তুমি ঠিক নাই ভাই।”
“আমি খুব বোকা তাই না আদিব। না হলে একটা মেয়ে এতদিন যাবৎ আমার সাথে মিথ্যে ভালোবাসার নাটক করলো আর আমি শালার ধরতেই পারলাম না।”

আদিব ড্রিংকের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললো,
“ভাই আমার রুমে চলো আজ তুমি ওইখানেই ঘুমাবে।”
“আমি খুব বোকা তাই না আদিব।”

আদিবের বুক কেঁদে ওঠে। সে বলে,
“তুমি বোকা নও ভাই।”

ফারিশ আচমকাই জড়িয়ে ধরে আদিবকে। আদিব হতভম্ব হয়ে যায়। ফারিশ বলে,
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আদিব। আমি নিতে পারছি না। আমার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। তুমি আমার বুকে গুলি করো আদিব।”

আদিব যেন পুরোদমে থমকে গেল ফারিশের কথা শুনে। এই কোন ফারিশকে দেখছে। আদিব কান্নাভেজা কণ্ঠেই বললো,“ভাই এভাবে বলবে না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে থাকবো।”

ফারিশ জবাব দেয় না। কতক্ষণ পর আবার আওড়ায়,“ও আমায় ভালোবাসে নি আদিব। ও আমায় ভালোবাসে নি। আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। মনে হচ্ছে আমি যেন পুরোটাই শেষ হয়ে গেলাম।”

ফারিশের নেশা হয়ে গেছে। শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আদিব বহুকষ্টে তাকে ধরে দাঁড় করালো। এগিয়ে যেতে যেতে বললো,“সব ঠিক হয়ে যাবে ভাই। সব ঠিক যাবে।”

ফারিশ মাতাল স্বরে আবারও শুধায়,“ও আমায় ভালোবাসে নি আদিব,ও আমায় ভালোবাসে নি।”

#চলবে…

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৫

পৃথিবী তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। গাঁ কাঁপা এই শীতে বেশিরভাগ মানুষই ল্যাপকম্বল জড়িয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। অথচ ঘুম নামক এই শান্তির ভিড়ে অশান্তি নিয়ে বেলকনিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আদ্রিতা। তার ভিতর পুড়ে ছারখার হচ্ছে। ফারিশের সেই ঘৃণা ভরা চোখ। নিশ্বাস আঁটকে আসার মুহূর্ত। কথা বলার ধরণ, কণ্ঠস্বর সব আদ্রিতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আদ্রিতা বুঝতে পেরেছে, সে কাজটা ঠিক করে নি। পুলিশের কথা শুনে ফারিশের সাথে অন্যায় করেছে। ভুল করেছে, না ভুল নয় ভয়ংকর অপরাধ। যে অপরাধের ক্ষমা নেই। আদ্রিতার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আদ্রিতা ফারিশকে সত্যিই ভালোবাসে। শুরু থেকেই ফারিশকে তার ভালো লাগতো। তার কথা বলার ধরণ, হঠাৎ করে রাগ দেখানো। সব। কক্সবাজারের কিছু মুহূর্তও তার পছন্দের। বিশেষ করে রাতের সেই আলাপন। কিন্তু আদ্রিতা বুঝতে পারে নি তার ভালো লাগা আসলে ভালোবাসা ছিল। আদ্রিতার মনে পড়লো কক্সবাজার থেকে সেই ফেরত আসার দিনটা। সোহেল গাড়ি আনতে লেট করায় তাকে কল করে তখন একটা লোক আদ্রিতাকে প্রশ্ন করে “আপনি ডক্টর আদ্রিতা তো?”

আদ্রিতা তক্ষৎনাৎ পিছন ঘুরে চায়। অনাকাঙ্ক্ষিত লোকটিকে দেখতে পেয়ে বলে,“জি। আমি ডক্টর আদ্রিতা।”

তখনই লোকটি বলে,“আসলে ম্যাডাম আমার বাবার বিষয়ে কিছু কথা ছিল।”

আদ্রিতা তখনও বুঝতে পারে নি লোকটি আসলে একজন পুলিশ ছিল। বাবার ক্যান্সারের কথা বলে আদ্রিতা আর সেই লোকটি গিয়ে বসে আধ ফাঁকা এক রেস্টুরেন্টে। যেহেতু সোহেল আসতে লেট করছিল তাই আর বারণও করতে পারে নি আদ্রিতা। তখনই লোকটি বলে,
“সরি ম্যাম পাবলিক প্লেসে কথাগুলো বলা যেত না তাই মিথ্যে বলে এখানে আনা লাগলো”

আদ্রিতা বেশ অবাক হয়ে বলে,“মানে?”
লোকটি দ্রুতই বলে,“আসলে ম্যাডাম আমি একজন পুলিশ। গত তিনদিন যাবৎ আপনায় যে লোকটার সাথে দেখা যাচ্ছে ফারিশ মাহমুদ। আপনি কি জানেন উনি কে?”

আদ্রিতা বিনাদ্বন্দে বলে,“জি। জানি। উনি একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক।”

লোকটি হাসে। বলে,“না আপনি ভুল জানেন উনি আসলে একজন মাফিয়া। দেশ বিরোধী মাফিয়া। ওনার অনেকগুলো বেআইনি কারখানা আছে। এই ধরনের নানা কিছু বলে আদ্রিতাকে।”

কিন্তু আদ্রিতা মানতে চায় না। আদ্রিতাকে অনেক অনুরোধ করা হয়। শেষমেশ উপায় না পেয়ে রাজি হয়। আদ্রিতা কাজটা করার সময়ও জানতো না ফারিশ সত্যিই একজন মাফিয়া। এমনকি গত দু’দিন আগেও ধরতে পারে নি। সে ভেবে নিয়েছিল পুলিশগুলো তাকে মিথ্যে বলেছে। ফারিশ খারাপ মানুষ নয়। হয়তো সন্দেহের বসে ওসব বলছে। আদ্রিতা ফারিশের সাথে অভিনয় করবে ভেবে মিশলেও। তার করা আচরণ। কোনোটাই অভিনয় ছিল না। যা করেছে সব মন থেকে। মাঝরাতে ফারিশের সাথে ঘুরতে যাওয়া, ফোনে কথা বলা, ফারিশের জন্য কালকের সাজার মুহুর্তটা সব মন থেকে করা। আদ্রিতা বুঝতেই পারে নি সে এতদিন অভিনয় করে নি। সত্যিই ভালোবেসেছিল ফারিশকে। ফারিশের প্রতি তার অনুভূতি কোনোটাই মিথ্যে ছিল না। কিন্তু এগুলো এখন ভেবে কোনো লাভ নেই আদ্রিতা এবার যতই ফারিশকে বোঝাক ফারিশ তাকে বিশ্বাস করবে না। কোথাও গিয়ে আদ্রিতা অন্যায় তো করেছে। ফাস্টলি বাংলো বাড়ির ঠিকানা আদ্রিতাই কিশোরকে দেয়। তারা পুরো বাড়ি খোঁজ করে কিন্তু কিছুই পায় না। আদ্রিতা তা শুনে খুশি হয়। অনেক কিছু বলেও কিশোরকে। ফারিশের বলা কথাগুলো আদ্রিতা সিরিয়াস নেয় নি প্রথমে কিন্তু ফারিশের বলা গাড়িতে বসে কথাগুলোর মধ্যে পপিগাছ– এটা আদ্রিতাকে ভাবাচ্ছে। পরে ভাবছে পপিগাছ থেকে পাওয়া একটা অংশ যা ‘মরফিন’ নামে পরিচিত যা দিয়েই ঔষধ বানানো হয়। এখানে খারাপের কিছু নেই।”

আদ্রিতা চোখ খুলে চাইলো। তার নিশ্বাস আটকে আসছে। দম বন্ধ হওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছে। আদ্রিতা ভেবেছিলাম ফারিশের কথার মধ্যে যদি মাফিয়া-টাইপ কিছু না থাকে তবে কিশোরকে তা দেখিয়ে শাসাবে। কিন্তু তার আগেই সব শেষ। ফারিশের কথাও আর শোনা হলো না।’

আদ্রিতা নীরবে চোখের পানি ফেললো। আদ্রিতার ফোন বাজলো তখন। এতরাতে কল। আদ্রিতা হেঁটে তার রুমের মধ্যে গেল। ঘড়িতে দু’টো ছাড়িয়ে। কলটা কেটে গিয়ে আবার কল বাজলো। কিশোর কল করেছে। আদ্রিতার চরম বিরক্ত লাগলো। কিশোর সবসময় এই টাইমেই কল করে। কারণ সে জানে আদ্রিতা বেশির ভাগ সময়ই এই টাইমে তার চেম্বারের থাকে। আদ্রিতা প্রথমে কলটা তুলবে না ভাবলো। কিন্তু পরে আবার তুললো। বিরক্ত নিয়ে বললো,“হ্যালো।”

ওপাশ থেকে কিশোরের কণ্ঠ শোনা গেল। সে বললো,“কিছু কি পেয়েছেন ডাক্তার সাহেবা?”

আদ্রিতা তেতে উঠলো,“কি পাবো বলুন তো। শুধুমাত্র আপনাদের জন্য একটা মানুষের সাথে আমি বেইমানি করেছি। শুধুমাত্র আপনাদের জন্য তাকে আমি কাঁদিয়েছি। ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়। বুঝতে পেরেছেন সে কোনো মাফিয়া নয়। আর হ্যা ফারিশ সব জেনে গেছে। আমি যে আপনাদের কথা শুনে তার জীবনে ঢুকেছিলাম সব জেনে গেছে। আর ফোন দিবেন না আমায়। আবারও বলছি ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়। তার পিছনে না ছুটে যে আসল দোষী তাকে ধরুণ।”

কল কেটে দিলো আদ্রিতা। মোবাইলটা ছুড়ে মারলো খাটে। তার কিছু ভালো লাগছে না। সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে।’
—-
বছরের শেষ দিন আজ। আজকের দিন পেরিয়ে রাত বারোটা পার হলেই নতুন বছরের আগমন হবে আর পুরনো বছরের ছুটি। ফারিশ ঘুমোচ্ছে। গভীর ঘুমে মগ্ন সে। কাল আদিব তাকে নিয়ে আসে আদিবের ঘরে। বিছানায় শুয়ে দেয়। কম্বল জড়িয়ে দেয় গায়ে। কনকনে শীতের মাঝে কম্বলের ছোঁয়া লাগতেই ক্লান্তিত দেহখানা নিস্তেজ হয়ে পড়ে বিছানায়। ফারিশ ঘুমিয়েছে টের পেতেই আদিব চলে যায় ফারিশের রুমে। তছনছ করা রুমটা সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।’

সূর্যের প্রখর তেজে ফারিশের ঘুমটা ভাঙতে থাকে হঠাৎ। কিছু একটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আদ্রিতার সেই ঠোঁট, না ঠোঁট নয়। ঠোঁটের জড়ানো কথা। আদ্রিতার পলকহীনভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকা, কনকনে শীতে আদ্রিতার কোলে শুয়ে থাকার সুন্দর মুহূর্তটা। কালকের সেই ভয়ংকর মুহূর্ত, কক্সবাজার থেকে ফেরার মুহূর্ত, রেস্টুরেন্টে খাওয়া,আদ্রিতাকে কোলে তোলা। সবই ফারিশের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কিন্তু এসবের মাঝেও কিছু একটা নজরে আসলো ফারিশের তা হলো আদ্রিতার চোখ। কি মায়াবী সেই চোখ জোড়া। ফারিশের আচমকা মনে হলো,“এত সুন্দর মায়াবী চোখজোড়াও কি ফারিশের সাথে মিথ্যে খেলা খেললো।”

আচমকাই চোখ খুলে চাইলো ফারিশ। আশপাশটা দেখতে লাগলো খুব। বুঝলো আদিবের রুমে সে শুয়ে আছে। ফারিশ শোয়া থেকে উঠে বসলো। মাথা তার ভাড় হয়ে আছে। মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে। ফারিশ কতক্ষণ নিজের মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। মুখ থেকে অস্পষ্টনীয় কণ্ঠে বললো,“আমাকে ভেঙে দেয়ার জন্য দারুণ পথ বেছে নিয়েছিলেন ডাক্তার ম্যাডাম। কিছুটা সফলও হয়েছেন বলা যায়।”

ফারিশ হেঁসে ফেলে। ফারিশকে ভেঙে দেয়া সত্যিই কি খুব সোজা। কালকের দিনটা তার বিষাক্ত ছিল। কিন্তু আজকের সকালটা তা নয়। ফারিশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে বুঝায়,“জীবন তো কম আঘাত দেয় নি ফারিশ। তোর তো ফুলহীন একটা বাগান ছিল,অথচ সেই বাগানে সামান্য একটা ছোট্ট ছুরি এসে তছনছ করে দিলো। কিন্তু ছুরি তো জানে না। ফারিশের ফুলহীন বাগান কতটা শক্তপোক্ত আর চওড়া। এক ছুরি দিয়ে তো একদিনের মধ্যে বাগান শেষ করা যাবে না।”

ফারিশ গম্ভীর এক আওয়াজে আদিবকে ডাকলো। বললো,“আদিব…

আদিব তখনই দৌড়ে আসলো। কিচেনে কাজ করছিল। আদিব বললো,“কি হয়েছে ভাই?”

ফারিশ তাকালো আদিবের দিকে। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,“গাড়ি বের করো খুলনার ফ্যাক্টরিতে যাবো?”

আদিব বেশ বিস্মিত হয় বলে,“আজই যাবেন ভাই?”
ফারিশ বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বলে,“হুম।”
—-
নিজের চেম্বারের চুপচাপ বসে আছে আদ্রিতা। মনমরা লাগছে নিজেকে। তখনই ঝড়ের বেগে তার চেম্বারে ঢুকলো আশরাফ, মুনমুন, মৃদুল, রনি আর চাঁদনী। মৃদুল তো চেঁচিয়ে বললো,“উড়ে দোস্ত বিয়া খামু?”

ওর কথা শুনে হেঁসে ফেললো সবাই। আশরাফ মৃদুলের মাথায় চাটি মেরে বললো,“আরে হাঁদা তুই বিয়া করবি বিয়া তো খামু আমরা।”

মৃদুল দাঁত কেলিয়ে বলে,“ওই একই হইলো। তোগো চাইয়া বেশি খামু আমি। ইয়া ইয়া মুরগীর রোস্ট।”

মৃদুলের কথায় আবারও হাসলো সবাই। শুধু হাসলো না আদ্রিতা। কারণ সে তো মগ্ন অন্যকোথাও!’

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️.গল্পের

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৩২+৩৩

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩২

বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা চলছে দুজনের মাঝে। ফোন কানে দিয়েছে রেখেছে ঠিকই কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। আদ্রিতা মুখ খুললো অনেকক্ষণ পর,
“এই যে আপনি ফোন দিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। কথা বলেন না। এটাকে কি প্রেম বলে?”

ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
“তুমি যদি অনুভব করতে পারো এই নীরবতাকে। তবে প্রেম। নয়তো প্রেম নয়। পারো কি অনুভব করতে?”
“পারি তো।”
“তাহলে প্রেম।”
“আমার আপনাকে কিছু বলার আছে ফারিশ?”

ফারিশের দ্বিধাহীন উত্তর,
“জি বলুন,

আদ্রিতার চট করে মনে পড়লো। কতক্ষণ আগে ফারিশ তাকে ‘তুমি’ করে বলেছে। আদ্রিতা বিচলিত কণ্ঠে বললো,“একটু আগে আপনি আমায় তুমি করে বলেছেন?”

ফারিশ পুরোই অমান্য করলো কথাটা। সে বললো,“কই না তো।”

আদ্রিতা দমে গেল। ভুল শুনলো কি তবে। ভাবতে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
“সত্যি বলছেন?”
“মিথ্যে বলে আমার লাভ।”

আদ্রিতা চুপ হয়ে গেল। বিষয়টা ঝেরে ফেলে বললো,
“যাক বাদ দিন। যে কথা বলছিলাম।”
“জি বলুন। কি কথা?”
“ফোনে বলা ঠিক হবে কি না বুঝচ্ছি না।”
“সমস্যা নেই। বলে ফেলুন দ্বিধাহীন।”

আদ্রিতা কিছু সময় নিলো। বার কয়েক নিশ্বাস নিয়ে বললো,“কথাটা আমার বান্ধুবী চাঁদনীকে নিয়ে।”

এবার যেন বেশ আগ্রহ পেল ফারিশ। সে সটান হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। চিন্তিত স্বরে বললো,
“কি হয়েছে চাঁদনীর?”
“না না কিছু হয় নি। আসলে হয়েছে কি,
“পরিষ্কার করে বলুন।”

আদ্রিতা আর বেশি সময় নিলো না। চটপট বলে ফেললো,“আসলে আমার বন্ধু চাঁদনী আপনার ভাই আদিবকে পছন্দ করে। ভালোওবাসে আর আমার এও মনে হয় আদিব ভাইয়াও চাঁদনীকে পছন্দ করে কিন্তু বলতে পারছে না। আমার বন্ধু চাঁদনীর মতোই। তাই আপনি যদি এ বিষয় কিছু করতে পারতেন।আদিব ভাইয়ার সাথে কথা বলে।”

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে থেমে গেল আদ্রিতা। ফারিশ চুপচাপ বসে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। ফারিশের চুপ থাকাটায় বেশ বিপাকে পড়লো আদ্রিতা। সে বললো,“কিছু বলবেন না।”

চট করেই ফারিশ হেঁসে উঠলো। শব্দ হলো সেই হাসিতে। আদিব সোফায় বসে চিপস খাচ্ছিল আর টিভি দেখছিল। ফারিশের হাসিটা এতটাই উচ্চস্বরে ছিল যে আদিবও শুনতে পেল সেই হাসি। আদ্রিতা ভড়কে গেল মুহূর্তেই। কান থেকে একবার ফোন সরিয়ে পুনরায় কান পেতে বললো,“কি হলো আপনি হাসছেন যে?”

ফারিশ জবাব দিলো না। তার হাসির রেশ বাড়লো। মিনিট তিন যেতেই থামলো। আদ্রিতা তখনও চুপচাপ বসে। ফারিশ বললো,“শুনছেন,

আদ্রিতা কপট উত্তর দিলো,
“জি বলুন।”
“আপনার বান্ধবীকেও আমার ভাইও ভালোবাসে। কিন্তু লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। এখন আপনার কাজ হলো চাঁদনীকে ফোন করে কথাটা বলা আর বাকিসব আমি দেখছি।”

কথাটা বলেই তড়িৎ ফোন কেটে দিল ফারিশ। আদ্রিতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বসা। বিষয়টা হুট করেই মাথার উপর দিয়েই গেল মনে হয়। কিছু সময় যেতেই ব্যাপারখানা বুঝতে পেরে আদ্রিতা আপনাআপনি হেঁসে উঠলো। এবার মনে হয় চাঁদ আপু আদিব ভাইয়ার কোলে উঠতে প্রস্তুত হবে।”
—-
ফারিশ হেঁটে এসে সোজা বললো আদিবের পাশ দিয়ে। আদিব তখন বাচ্চাদের মতো চিপস খাচ্ছিল আর টিভি দেখছিল। ফারিশ আয়েশ করে সোফায় বসে আদিবের চিপসের প্যাকেট থেকে দু’টো চিপস নিয়ে মুখে পুড়ে নিলো। বললো,“তোমার জন্য একটা সুখবর আছে আদিব।”

আদিব চট করেই চাইলো ফারিশের মুখশ্রীর দিকে। অবাক নয়নে শুধালো,
“কি সুখবর ভাই?”
“তোমার বিয়ে দিচ্ছি আমি।”

তড়িৎ কাশি উঠে গেল আদিবের। ফারিশ টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে আদিবকে খাওয়ালো। আদিব পানিটুকু ঢকঢক করে গিলে বললো,
“এসব কি বলছো ভাই?”
“ঠিকই বলছি। তুমি আজ হসপিটালে যাবে আদিব। উঠে দাঁড়াও গোসল করে আসো। আজ তোমার একটা হিল্লে না করলেই নয়।”

আদিব সটান হয়ে দাঁড়ালো। মিনমিন কণ্ঠে বললো,“আজ না বললে হয় না।”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“না হয় না। চলো দ্রুত।”
আদিব অসহায়ের ন্যায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চিপসের প্যাকেট ধরিয়ে দিলো ফারিশের কাছে। ফারিশ নিলো। এক টুকরো চিপস মুখে পুড়ে বললো,“ভালো মতো গোসল করবে আদিব। তাড়াতাড়ি যাও। আমি অপেক্ষা করছি।”

আদিব আর দাঁড়ালো না। সে বুঝেছে ফারিশ ভাই আজ তার হিল্লে করিয়েই ছাড়বে।

আর ফারিশ ভাবছে আজ আদিবের হিল্লের সাথে সাথে আদ্রিতাকেও সেই গোপনীয় কথা বলবে। যে গোপনীয় কথা আদিবহীনা কেউ জানে না।’
—-
বেলা তখন দুপুরের কড়া রোদ্দুরে আচ্ছন্ন। ঘড়িতে প্রায় দুপুর দুটোর কাছাকাছি। আদ্রিতা মাত্র গোসল সেরে আসলো পরনে ঢিলেঢালা সেলোয়ার-কামিজ। চুল মুছতে মুছতে নিজ রুমে প্রবেশ করলো আদ্রিতা। বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখানে কড়া রোদ্দুরে ভরপুর। মাত্র গোসল সেরে আসায় শীতে শরীর কাঁপছে আদ্রিতার। ভেবেছিল ছাঁদে যাবে না কিন্তু শীতে ঠেলায় না গিয়ে উপায় নেই। আদ্রিতা ভেজা জামাকাপড় নিয়েই ছুটে গেল বাড়ির ছাঁদে। কিছুক্ষণ রোদ্রে বসে মাথা শুকিয়ে ফিরবে।”

“তোমার কি এখনো রোদ পোয়ানো হয় নি আদিব?”

খানিকটা বিচলিত কণ্ঠে সদ্য গোসল সেরে আসা ফারিশ বললো। ছাদের উপর থেকে উত্তর এলো না কোনো। ফারিশ আলমারি খুলে কিছু রঙচটা পোশাক দেখলো কি পড়া যায়। ফারিশ সচরাচর পাঞ্জাবি পড়ে না। কিন্তু আজ তার পাঞ্জাবি পড়তে ইচ্ছে করছে। একবার ভাবলো পড়বে। আবারও কোথাও গিয়ে বললো,“আজ থাক অন্য আরেকদিন।”

ফারিশ কফি কালার শার্ট বের করলো। সঙ্গে ছাইরঙা প্যান্ট। ফারিশ শার্ট প্যান্ট দুটো বিছানায় রাখতে রাখতে আবারও আওয়াজ বললো,“তুমি কি এখনো আসো নি আদিব?”

শুধু টাওয়াল গায়ে শীতে কাঁপতে থাকা আদিব বললো,“এই তো ভাই হয়েছে আসছি।”

ফারিশের রুমের উপরই ছাঁদ। নিচ থেকে জোরে আওয়াজ করে বললেই শোনা যায় সব। আশেপাশে আলাদা কোনো শোরগোল না থাকায় আরো সুবিধা হয় ব্যাপারটায়।’

ফারিশ শার্ট প্যান্ট পড়ে তৈরি। মাথার চুল চুইয়ে পানি পড়ছে। সে এলেমেলো ভাবে চুলগুলো ঠিক করলো। কপাল লেপ্টে পড়ে রইলো তা। ফারিশের এলোমেলো চুল রাখা বেশি পছন্দ। তাই বেশিভাগ ক্ষেত্রেই চুল এলেমেলো রাখে। দেখতেও দারুণ লাগে। ফারিশ আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে পরখ করলো। চোখের পাশের দাগটা নজরে আসলো প্রথমে। এই দাগটা কিভাবে লেগেছিল ফারিশের ঠিক মনে নেই। তবে আবছা আবছা মনে পড়ে খুব সম্ভবত ছোট বেলায় সে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল তখনই দাগটা হয়। ফারিশ হাত দিয়ে চোখের পাশের দাগটা একটু স্পর্শ করলো। হাতে ঘড়ি জড়ালো আজ। হাল্কা একটু পারফিউমও লাগালো। এরপরই ডাকলো,“আদিব হয়েছে তোমার?”

আদিব এসে দাঁড়ালো দরজার মুখে। হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললো,“জি ভাই।”

ফারিশ পিছন ঘুরলো। কালো প্যান্ট আর কালো টিশার্ট জড়িয়েছে আদিব। ফারিশ হতাশার নিশ্বাস ছাড়লো। বললো,“তুমি এইভাবে যাবে আদিব?”

আদিব অবাক হয়ে বললো,“কেন ভাই? এইভাবে কি সমস্যা?”

ফারিশ জবাব দিলো না। অতঃপর নিজেই আদিবকে সাজালো। কালো স্যুটব্যুট পড়িয়েছে ফারিশ। গলায় সাদা শার্টের ওপর কালো টাই। চুলগুলোও সুন্দর মতো সাজিয়ে দিলো। একদম পাক্কা বিজনেস ম্যানের মতো দেখাচ্ছে আদিবকে। ফারিশের চেয়ে আদিবের গায়ের রঙ ফর্সা। চোখদুটো বাচ্চাদের মতো মায়া ভরা। আদিব গায়ে গাতোরে বড় হলেও ফারিশের কাছে আদিবকে এখনও বাচ্চাদের মতো লাগে। সেই ছোট্ট তুলতুলে আদিব এখনও কেমন ভয় পেলে ফারিশের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদে। ফারিশ মৃদু হাসলো। বললো,“আজ ভাবিকে না মানিয়ে কিন্তু ফিরবো না আদিব।”

উত্তরে আদিব লাজুক হাসলো। ফারিশের ঠোঁটে হাসি দেখা গেল তার পরপরই।’
—-
ঘড়ির কাটা তড়তড় করে বাড়ছে। আদ্রিতা তার জর্জেট শাড়ি সামলাতে সামলাতে ব্যর্থ। আদ্রিতা সচরাচর শাড়ি পড়ে না। কিন্তু আজ স্পেশালি ফারিশের জন্য শাড়ি পড়েছে। শাড়ির গোলাপি রঙটা তার গায়ে মুক্তার মতো ফুটে উঠেছে। বাম হাতে পড়েছে ফারিশের দেয়া একডজন কাঁচের চুড়ি রিনিকঝিনিক শব্দ করছে তা। ডান হাতে ছোট্ট একটা কালো ওয়াচ। চুলগুলো খোলা। আদ্রিতা বরাবরই সিম্পল ছাম্পেল থাকতে পছন্দ করে কিন্তু আজ একটু সেজেছে। চোখে গাড়ো কাজল লাগিয়ে ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিকে দারুণ দেখাচ্ছে। আয়নায় নিজেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। আদ্রিতার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে এখানে সে ফারিশের জন্য সাজছে। আপনাআপনি হেঁসে উঠলো আদ্রিতা। দারুণ লজ্জা লাগছে তার। আজ ফারিশ নিশ্চয়ই তাকে দেখে মুগ্ধ হবে অনেকটা। শেষ বারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে কাঁধে ছোট্ট ব্যাগ ঝুলালো। ফোনটা নিয়ে মাকে উচ্চ আওয়াজে বললো,“আমি আসছি মা।”

আদ্রিতা ঘর থেকে বের হলো। রুমে রাফিন আর মা তাকে দেখেই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার আগেই আদ্রিতা বেরিয়ে পড়েছে। আদ্রিতা রিকশা ডাকলো। এরই মাঝে তার ফোন বাজলো তাকে জানানো হলো ইমারজেন্সি হসপিটালে যেতে হবে।’

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৩

হসপিটালের সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিতার দিকে। এই প্রথম তারা আদ্রিতাকে সাজ সমৃদ্ধ রূপে শাড়ি পরিধিত দেখছে। তাকে দেখেই ডক্টর কবির এগিয়ে এলেন। তিনি আদ্রিতাদের একজন সিনিয়র ডক্টর। আদ্রিতা এগিয়ে গিয়ে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো,
“কি হয়েছে স্যার?”
“রুম নাম্বার চারশো ছয়ে যাও।”

আদ্রিতা দেরি করলো না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল রুম নাম্বার চারশো ছয়ের দিকে। রুমে একজন মহিলা আছে। বুড়ো মহিলা তার মাথায় সার্জারী হয়েছে একসপ্তাহ হয়েছে। তার একটা সমস্যা হলো তিনি আদ্রিতাকে অনেক পছন্দ করে। তাকে ছাড়া আর কারো কাছেই কোনো চিকিৎসাই নিবেন না। একটা ঔষধী ইনফেকশন পুস করা হবে তার হাতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই সেটা কোনো নার্সের কাছ থেকে নিবেন না। নিবেন আদ্রিতা থেকে। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই আদ্রিতাকে ডাকা হয়েছে। আদ্রিতা রুম খুলে ভিতরে ঢুকতেই মহিলাটি হাসলেন। বললেন,“তুমি আইছো পাখি।”

আদ্রিতা মৃদু হাসলো। সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো,“হুম এসেছি। কিন্তু কি শুনছি আমি? তুমি নাকি ইনজেকশন দিতে দিচ্ছেলে না।”

মহিলাটি মিনমিনে কণ্ঠে বললো,“ওনারা ব্যাথা দেয়। তুমি দেও। তুমি দিলে আমি ব্যাথা পাই না।”

আদ্রিতা আর কিছু বললো না। নার্সের হাত থেকে ইনজেকশনটা নিলো। এগিয়ে গেল মহিলাটার দিকে।
—-
চাঁদনীর চেম্বারে স্যুটব্যুট পড়ে বসে আছে আদিব। হাতে একগুচ্ছ গোলাপ যা তাকে ফারিশ কিনে দিয়েছে। ফারিশ নিচে আছে গাড়ি নিয়ে। বলেছে, ‘তুমি গিয়ে শুরু করো না পারলে আমি আসছি।’

আদিব কিছু বলে নি। শুধু নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়েছিল ফারিশের দিকে। চাঁদনীর ডাকে ধ্যান ফিরলো আদিবের। সে বললো,“এই যে মিস্টার, আজ কি সমস্যা নিয়ে আসলেন?”

আদিব কেঁপে উঠলো খানিকটা। হাতের ফুলগুলো চাঁদনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,“এগুলো আপনার জন্য।”

চাঁদনী বেশি ভাবলো না। হাত বাড়িয়ে নিলো। প্রশ্ন করলো,“হঠাৎ ফুল কেন?”

আদিব ঘামছে কিছু বলছে না। তার কানে ব্লুটুথ। ফারিশ বললো,“তুমি কি বলবে আদিব নাকি আমি আসবো।”

আদিব আচমকাই চেঁচিয়ে উঠলো। বললো,“না।”
আদিবের আচমকা চেঁচানি শুনে চাঁদনী ঘাবড়ে গেল। থমথমে কণ্ঠে বললো,“কি হয়েছে?”

আদিব চাইলো চাঁদনীর দিকে। বললো,“কিছু হয় নি। আমার আপনাকে কিছু বলার আছে।”

চাঁদনী শান্ত হলো। বললো,“ঠিক আছে বলুন।”
আদিব কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ববলে উঠলো,“আসলে আমি..

চাঁদনীও পরপর উত্তর দিলো,“আসলে আপনি..
আদিবের আবার ঘাম বের হচ্ছে সে বললো,
“আসলে আমি..
“আসলে আপনি,
“আসলে..

এবার চাঁদনীর বিরক্ত লাগলো। সে কর্কশ কণ্ঠে বললো,“কি কখন থেকে আসলে আসলে করে যাচ্ছেন পরেটা তো বলুন।”

অন্যদিকে ফারিশও বিরক্ত। সে বুঝলো এ ছেলে আজও বলতে পারবে না। ফারিশ বললো,“তোমায় বলতে হবে না আদিব আমিই আসছি।”

কথাটা বলে গাড়ির দরজা খুলতে নিলো ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে আদিব চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো,“আসলে আমি আপনাকে ভাললবাসি। বিয়ে করতে চাই।”

ফারিশ হেঁসে উঠলো। গাড়ির দরজা আস্তে করে বন্ধ করে দিল। ফারিশ এমনিতেও যেত না। আদিবকে ঘাবড়ানোর জন্যই দরজা খুলেছিল শব্দ করে।’

আদিব চোখ বন্ধ করে বসে। তার হাত পা কাঁপছে। চাঁদনী কি রিয়েকশন দিলো। দেখতেও তার ভয় হচ্ছে। হঠাৎই হাতে কারো স্পর্শ পেল আদিব। আদিব চাইলো। চাঁদনী তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে। চাঁদনী লাজুক হাসলো। শান্ত স্বরে শুধালো,“এতটুকু কথা বলতে কেউ এত সময় লাগায় খবিশ।”

আদিব বার কয়েক চোখের পলক ফেলে তাকিয়ে রইলো চাঁদনীর দিকে। চাঁদনী মৃদু হেঁসে আদিবকে জড়িয়ে ধরলো। শীতল স্বরে আওড়ালো,“আমিও আপনায় ভালোবাসি মিস্টার খবিশ।”

আদিব তিন সেকেন্ড স্তব্ধ থেকে হেঁসে উঠলো আপনাআপনি। কানের পাশে ফারিশ বললো,“অল দা বেস্ট আদিব। সুখি হও। ফারিশের কথা শুনে আদিবের হাসি আরো চওড়া হলো মৃদু শব্দ করে বললো,“শুকরিয়া ভাই।”

কান থেকে ব্লুটুথ সরিয়ে কল কাটলো ফারিশ। যাক অবশেষে আদিব তার মনের মানুষটাকে পেয়ে গেল। এবার সুন্দর একটা দিন দেখে আদিব আর চাঁদনীর বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে। ফারিশ হাত ঘড়িটা দেখলো। বেলা প্রায় চারটার কাটায় ছুঁই ছুঁই। ফারিশ আদ্রিতাকে মেসেজ লিখলো,“আর কতক্ষণ অপেক্ষায় থাকবো ডাক্তার ম্যাডাম, এবার তো নিশ্বাস ফেলাও দায় হয়ে পড়ছে।”

আদ্রিতা তখন নিজের ক্যাভিন থেকে বের হবে। সে মেসেজ লিখলো,“আমার হসপিটালের সামনে এসে মেসেজ লিখুন আমি আসছি।”

পরপরই মেসেজ আসলো,“আমি হসপিটালের কাছেই আছি চলে আসুন।”

আদ্রিতা একটু অবাক হলেও বেশি ভাবলো না। মুচকি হেসে লিখলো,
“একটু অপেক্ষা করুন আসছি।”
“ঠিক আছে।”

ফারিশের ‘ঠিক আছে’ মেসেজটা পেতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আদ্রিতা। মোবাইলে একটু দেখে নিলো নিজেকে। সব ঠিক আছে। ভেবেই কাঁধে ব্যাগটা নিলো। বাহিরে যাবে এরই মাঝে তার ক্যাভিন খুলে ভিতরে আসলো কেউ। বললো,“কেমন আছেন ডাক্তার সাহেবা?”

আদ্রিতা বেশ অবাক চোখে তার পানে তাকালো। বললো,“আপনি এখানে?”

পনের মিনিট যাবৎ ফারিশ বসে আছে গাড়িতে অথচ আদ্রিতার খবর নেই। এই মুহূর্তে ফারিশের মনে হচ্ছে ডাক্তারদের সাথে পিরিত করতে নেই। এদের যখন তখন ইমারজেন্সি হয়ে যেতে পারে। ফারিশ হতাশার সুর টানলো। হঠাৎ ফারিশের মনে হলো আদ্রিতা আসছে। ফারিশ গাড়ির দরজা খুললো। আদ্রিতা হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে আসছে ফারিশ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো আদ্রিতার দিকে। এই প্রথম আদ্রিতা তার সামনে শাড়ি পড়ে এসেছে। গোলাপী শাড়ি আর খোলাচুলে মেয়েটাকে এত বেশি সুন্দর লাগছে কেন! আজ যেন নতুন করে আদ্রিতার প্রেমে পড়লো ফারিশ। ফারিশ হাসলো। মিষ্টি সেই হাসি। যে হাসিতে কোনো মিথ্যে নেই। আদ্রিতা ততক্ষণে ফারিশের কাছাকাছি এসে পড়েছে। সে মিষ্টি স্বরে বললো,“আপনি বিকেল চেয়েছিলেন আমি কিন্তু বিকেল নিয়ে এসেছি ফারিশ।”

ফারিশ আদ্রিতার হাত ধরলো। আনমনা ঠোঁটে হাতে চুমু কাটলো,“একটু ছুইলাম কথা দিচ্ছি বিয়ের আগে এভাবে আর ছুবো না।”

আদ্রিতা বরফের ন্যায় কেঁপে উঠলো। ফারিশ মুগ্ধ নয়নে তার পানে তাকিয়ে। নীরব। চুপচাপ। শান্ত চাহনি। আদ্রিতা বললো,“বিকেলটা কি এখানে দাড়িয়েই কাটাবেন?”

ফারিশ আশপাশ দেখলো। আদ্রিতার কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললো,“এমন বিকেল আমার রোজ চাই ডাক্তার ম্যাডাম।”

আদ্রিতা হাসে। বলে,“আগে আজকের বিকাল তো শেষ করি।”

ফারিশ পুরো পাগলাটে হয়ে গেছে। নিজেকে সামলানো কঠিন হচ্ছে। আদ্রিতা গাড়িতে গিয়ে বসলো। ফারিশ নিজের ভাবনায় নিজেই মাথায় একটা চাটি মারলো। নিজেই নিজেকে বললো,“তুই এমন পাগলাটে কবে থেকে হলি ফারিশ।”

উত্তর এলো না। নিজের প্রশ্নের উত্তর কি নিজে নিজে দেয়া যায়। ফারিশের কল আসলো আদিব করেছে। নিশ্চয়ই খুশির চোটে ফোন করেছে। ফারিশ ফোনটা তুলে আদিবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললো,“কি আদিব খুশি তো। তোমার ডাক্তার ম্যাডামকে নিয়ে বের হচ্ছি। এসে কথা বলবো। কেমন!”

ফোন কেটে দিল ফারিশ। এরপর দ্রুত গিয়ে বসলো ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,“আমি হঠাৎ বেসামাল হয়ে উঠলে এর দায় কিন্তু আপনার। এত সেজেছেন কেন?”

আদ্রিতা অবাক হয়ে বললো,“আপনিই তো বললেন একটু ভিন্নভাবে আসতে।”

ফারিশ কিছু বলবে এরই মাঝে আদিব আবার ফোন করলো কিন্তু ফারিশ তুললো না। এই ছেলের এখনই ধন্যবাদ না দিলে কি চলবে না। ফারিশ ফোনটা সাইলেন্ট করে সামনে রাখলো। অতঃপর পারি দিলো দূর সীমানায়।’

ফারিশদের গাড়ি এসে থামলো এক নির্জন ব্রিজের সামনে। ফারিশ নামলো। আদ্রিতাকেও বললো,“নামুন।”

আদ্রিতা নেমে পড়লো। শাড়ির কুঁচি ধরে নামলো। এগিয়ে গেল। দুজন দাঁড়ালো ব্রিজের একদম মাঝ বরাবর। বিকেলের সুন্দর শীতলমাখা বাতাস এসে নাড়িয়ে দিল তাদের। আদ্রিতা আসার সময় হাতে করে গায়ের চাদর এনেছে যেটা বর্তমানে গাড়ির ভিতর বিরাজ করছে। ফারিশ পাশে এসে দাঁড়ালো। শান্ত স্বরে বললো,“আমি আজ আপনায় অনেককিছু বলবো আদ্রিতা। হয়তো কথাগুলো শুনে আপনি আমায় অনেককিছু ভাববেন। ভাবতেই পারেন। তবে আমি মনে করি আমাদের নতুন জীবন শুরু করার আগে আপনার আমার ব্যাপারে সবটা জানা উচিত।”

আদ্রিতা শীতল দৃষ্টি নিয়ে ফারিশের দিকে চাইলো। ফারিশ কিছু বলবে তার আগেই ফারিশের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো,“হুস এখন নয় পরে শুনবো।”

ফারিশ থেমে গেল। চুপ করে রইলো। আর কিচ্ছুটি বললো না। ব্রিজের নিচ বেয়ে নৌকা, স্টিমার যাচ্ছিল। বিশাল বিশাল ঢেউ দিচ্ছিল নদীতে। প্রকৃতিটা আজ যেন একটু বেশিই সুন্দর।’

অন্যদিকে গাড়িতে আদ্রিতার ফোনটাও ফারিশের ফোনের কাছে শুয়ে। আসার সময় ভুলে রেখে গেছে। ফারিশের ফোন বাজছে। আদিব লাগাতার কল করছে। এত তাড়া যে তার কিসের!’

সময় গড়ালো। বিকেল তখন সন্ধ্যার মুখে। আদ্রিতা ফারিশ এসে বসলো গাড়িতে। ফারিশ এবার অস্থির প্রায় আদ্রিতাকে সবটা জানানোর জন্য। ফারিশ গাড়িতে বসেই বলে উঠল,“এবার তো শুনুন আমার কথা।”

আদ্রিতা তার ফোন হাতে নিলো। কেউ কল করেছে কিনা চেক করলো। এরপর বললো,“জি বলুুন।”

ফারিশ জোরে এক নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,“আমি সত্যিই ভালো মানুষ নই আদ্রিতা। আমি একজন খারাপ মানুষ।”

আদ্রিতা সরাসরি চাইলো ফারিশের দিকে। বললো,“আবারও মজা করছেন ফারিশ?”

ফারিশ হতাশ হয়ে আদ্রিতার হাত ধরলো। তাকে ঠিক লাগছে না। আদ্রিতা এবার কিছুটা সিরিয়াস হলো। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ এনে বললো,“কি হয়েছে?”

ফারিশ বেশি সময় নিলো না। প্রশ্ন করলো,“আপনি পপি গাছের নাম শুনেছেন। যার ইংরেজি নাম হলো
Papaver somniferum যা দিয়ে আফিম তৈরি হয় এছাড়াও এ থেকে মরফিন পাওয়া যায়।”

আদ্রিতা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললো,“শুনেছি। কিন্তু এখানে আপনার খারাপ হওয়ার কি আছে?”

ফারিশ বলে উঠল,“আছে অনেক কিছু আছে। আসলে দুনিয়ার মানুষ আমায় যে নামে চেনে বা যে সম্পর্ক নিয়ে জানে তা পুরোপুরি..

আর বলার আগেই বিকট শব্দে ফোন বেজে কেটে গেল ফারিশের। ফারিশ থেমে গেল। নজর গেল ফোনের দিকে। আদিব পঞ্চাশ বার তাকে কল করেছে। এবার যেন বেশ অবাকই হলো ফারিশ। আদিব এতবার কল করছে কেন! আদ্রিতা এবার তাড়া দিলো। বললো,“কি হলো থেমে গেলেন যে।”

ফারিশ বললো না। আদিবকে কল ব্যাক করবে এরই মাঝে আদিব আবার কল করলো। ফারিশ আদ্রিতাকে চুপ হতে বলে। আদিবকে উদ্দেশ্য করে বললো,“কি হয়েছে আদিব এতবার কল করছো কেন?”

তখনই আদিব কিছু বললো। অনেককিছু বললো। ফারিশ নির্বিকার ভঙ্গিতে আদ্রিতার পানে তাকিয়ে। কতক্ষণ পর ফারিশ কান থেকে ফোন সরালো। চুপ থাকলো অনেকক্ষণ। ফারিশের নীরবতায় আদ্রিতা থমকালো। প্রশ্ন করলো,“কিছু কি হয়েছে?”

ফারিশ মলিন হাসলো। চোখ জ্বলছে তার। নিশ্বাস আটকে আসছে। চাকুর আঘাতের চেয়েও ভিতরটা বেশি ছারখার হচ্ছে। ফারিশ নিজেকে সামলালো। করুণ কণ্ঠে আদ্রিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,“আমাকে জানার জন্য এত নিখুঁত অভিনয়ের খুব কি দরকার ছিল ডাক্তার ম্যাডাম?”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️.গল্পের

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৩০+৩১

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩০

সময়ের স্রোতে ভাসমান প্রকৃতি। মাঝে দিন পেরুলো অনেকগুলো। প্রায় মাসের কাছে ছুঁই ছুঁই। নতুন বছর আসতে খুব বেশি দেরি নেই। হাতে গোনা দু-চারদিন বাকি। ফারিশ এখন আদ্রিতাতে আসক্ত। রোজ রাতে প্রেমআলাপ। আর দু’দিন পর পর রাতের ঘুরাঘুরি। এটা একটা রুটিনে পরিনত হয়ে গেছে। আদ্রিতাকে ছাড়া ফারিশের চলে না এখন। ফারিশ চাইছে শীঘ্রই বিয়ে করতে। কিন্তু কোথাও গিয়ে দোটানায় পড়ছে। সে কি করে? সে সম্পর্কে আদ্রিতা এখনও অবগত নয়। ফারিশের ভিতর কিছুটা হলেও ভয় ঢুকেছে। আদ্রিতা তার সম্পর্কে জানলে মেনে নিবে তো। নাকি ছেড়ে চলে যাবে। ফারিশ জেনেছে কক্সবাজারের সেই পপি গাছে ফলন হয়েছে ভালো। খুব শীঘ্রই গাছে ফল ধরবে। ফারিশ বেশ চিন্তিত। কি করা যায়! যে ভয় তার শুরুতে ছিল সেই ভয় ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিষয়টা চেপে যাবে তাতেও শান্তি পাচ্ছে না। আবার বলে দিবে তাও পারছে না। দ্বিধাদ্বন্দে আছে খানিকটা।’

প্রকৃতি তখন দুপুরের দখলে। ক্লান্ত শরীরে গাড়িতে বসে আছে ফারিশ। আকাশ ছুঁয়ে রোদ্দুর উঠেছে তখন। ঢাকার শহরে বেশ জ্যাম আজ। যানযটে আটকা পড়েছে ফারিশ আর আদিব। আদিব ড্রাইভ করছে। তার পাশে ফারিশ। আদিব প্রশ্ন করলো,“ভাই কাশ্মীরের লোকেরা আবার মাল চাচ্ছে দিবো কি? আগেরবার দেরি করেছিলাম বলে ক্ষেপে ছিল। পরে আবার দমেও গেছে। এবার বেশি চাচ্ছে। কি করবো?”

ফারিশ দু’মিনিট ভেবে বললো,
“দিয়ে দেও।”
“আচ্ছা।”
“কারখানায় কাজ কেমন চলছে?”
“রাত একটায় একবার যাবেন ভাই।”
“আজ হবে না। কাল যাবো।”
“ঠিক আছে।”
“এখন কই যাবেন?”
“পুরনো বাড়ি যাবো।”
“আচ্ছা।”

জ্যাম কাটলো আরো দশ মিনিট পর। আদিব গাড়ি স্টার্ট দিলো। ফারিশ চুপচাপ বসে। সে প্রশ্ন করলো,“তুমি এখনও ডাক্তার ম্যাডামের বন্ধুকে প্রপোজ কেন করো নি আদিব?”

আদিব বিষম খায়। হাত অবশ হয়ে আসে। কণ্ঠনালিতে কথায় আঁটকায়। তবুও আদিব নিজেকে সামলে বলে,“আমি বলতে পারি না ভাই। আমার ভয় লাগে।”

ফারিশের গম্ভীর মুখ। চোখে মুখে বিষণ্ণ। সে হাসলো না। বেশ গভীর ভাবনা নিয়ে বললো,“তুমি কি চাচ্ছো তোমার হয়ে আমি ডাক্তার ম্যাডামের বন্ধুকে প্রপোজ করি?”

আদিব কি বলবে বুঝে না। চুপ করে রয়। ফারিশ আবারও বলে,“কালকের মধ্যে এই মামলা সেট করবে আদিব। তুমি না পারলে আমি কিন্তু দেখবো।”

আদিব তাও কিছু বলে না। কি বলবে তাও জানে না। আদিব চেষ্টা করে। বেশ কয়েকবার সে গিয়েও ছিল চাঁদনীর কেভিনে। কিন্তু মেয়েটার সামনে গেলেই আদিব চুপসে যায় এমন ভাব নেয় যেন মেয়েটাকে সে চেনেই না। প্রথম দেখছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কখনো পরে নি আদিব। তাতেও সমস্যা হচ্ছে। চাঁদনী কি না কি বলে তা নিয়েও সে ডিপ্রেশনে আছে। মেয়েটার কথার যে ধাঁজ। কখন না হাত চালিয়ে বসে গালে। এ ভেবেও আদিব সাহস পায় না।’

পুরো রাস্তায় চুপ থাকলো আদিব। ফারিশও কিছু বললো না। তবে সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে কালকেও যদি আদিব কিছু করতে না পারে তাহলে ফারিশই দেখবে বিষয়টা। নির্জন দুপুরে গাড়ি এসে থামলো সেদিনের আদ্রিতাকে নিয়ে আসা পুরনো বাংলো বাড়ির সামনে। ফারিশ বের হলো। আদিবও নামলো। সেদিনের পুড়ে থাকা ডালপালা গুলো সেখানেই লুটিয়ে পড়ে। কালো কুচকুচে রঙেই সজ্জিত তারা। ফারিশ সেদিনের পর আর এদিকে আসে নি। ফারিশ জ্বলে যাওয়া ডালগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে বাড়ির দরজার মুখে দাড়ায়। আশপাশ দেখে। আদিব টবের নিচে লুকিয়ে রাখা চাবিটা উঠিয়ে ঘরের দরজা খুলতে নিলো। হঠাৎই কিছু একটার আচ পেল ফারিশ। সঙ্গে সঙ্গে সে আদিবের হাত ধরে থামিয়ে দিলো দরজা খোলা থেকে। আদিব বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,“কি হলো ভাই?”

ফারিশ নিজ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো,“হুস। চুপ। এখানে কেউ আছে আদিব?”

আদিব বিচলিত হলো। ফিসফিস করে বললো,“এখানে কে থাকবে?”

ফারিশ জবাব দিলো না। আচমকাই পিঠের পিছনে লুকিয়ে রাখা পিস্তলটা হাতে নিলো। আদিব ঠায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ফারিশ আদিবকে মৃদুস্বরে বলে,“একদম নড়বে না এখানেই চুপটি করে বসে থাকবে। কেমন!”

আদিব মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, ‘সে বসে থাকবে’। ফারিশ আস্তে আস্তে বাড়ির কর্ণারটা দেখলো কারো পদধ্বনি পাওয়া গেল। ফারিশ আচমকাই দৌড় দিলো। সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের ভিড়ে লুকিয়ে থাকা কেউ আড়াল থেকে বেরিয়ে দৌড় দিলো। ফারিশ তার পিছু নিলু। লোকটি হতভম্ব হয়ে গেল। ফারিশ কাঙ্ক্ষিত লোকটিকে দেখতে পেয়েই পায়ে গুলি করতে নিলো। কিন্তু সামনে গাছ চলে আসায় লাগলো না। লোকটি গায়ে চাঁদর মুড়ি দিয়ে অনবরত দৌড়াচ্ছে। ফারিশও তার পিছনে ছুটছে। কিন্তু লোকটা একসময় পালাতে সক্ষম হলো। ফারিশ গুলি মারলো সেটা লাগলো সোজা লোকটির হাতে। তবুও পিছন ঘুরলো না। হাত চেপে বেরিয়ে আসলো সেখান থেকে। চাঁদর লুটিয়ে পড়লো নিচে।’

ফারিশ আশপাশ দেখে। বিরক্ত নিয়ে বললো,“শীট।”

ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে আদিব। থরথর করে কাঁপছে। গুলির শব্দ কানে আসলেই আদিব প্রচন্ড ঘাবড়ে যায়। তার শরীর দিয়ে ঘাম বের হয়। নিজেকে সামলাতে প্রায় সময় অক্ষম হয়। ফারিশ এসে বসলো তার পাশে। হাতের পিস্তল সরিয়ে বললো,“খুব ভয় পেয়েছো আদিব?”

আদিব ঘাবড়ে গেল। সে বাচ্চাদের মতো করে বললো,“আমি এখানে থাকবো না ভাই, আমি এখানে থাকবো না।”

ফারিশ আদিবের মাথায় হাত বুলালো। শান্ত স্বরে বললো,“ভয় কেন পাচ্ছো। তোমার ফারিশ ভাই আছে না। তোমার কিছু হবে না আদিব। এই ফারিশ তোমার কিছু হতে দিবে না।”

আদিব চুপ করে রয়। কিছু বলে না। ফারিশের মনে পড়লো ছোট বেলার এক ঘটনা। যেই ঘটনার পর আদিব কখনোই তাকে তুই করে বলে না। বলে তুমি করে।”

সে অনেক বছর আগের পুরনো ঘটনা। তখন মাঝরাত। বাহিরে তুমুল বেগের বর্জপাত আর বৃষ্টি হচ্ছিল। মাথায় টিন চাপিয়ে রাস্তার এক কিনারায় বসে ছিল ফারিশ আর আদিব। তখন তাদের বয়স দশ, নয়। ফারিশের দশ আর আদিবের নয়। আদিব ছোট থেকেই অনেক ভীতু টাইপের। সবকিছুতে তার ভয়। দারুণ ভয়। সে রাতের বর্জপাত আর টিনের ঝাঁকড়ানির শব্দে আদিব ভয়ে স্তব্ধ। পুরো রাস্তা নির্জন। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। ল্যাম্পপোস্টও জ্বলছে নিভছে। তখনই কোথা থেকে যেন একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় ছুঁটে আসে তাদের দিকে। পায়ে আঘাত থাকায় সে লুটিয়ে পড়ে ফারিশদের সামনে। ফারিশ আদিব দুজনেই লোকটার কাছে যায়। লোকটা আর্তনাদ ভরা কণ্ঠে বলে,“আমাকে বাঁচাও তোমরা নয়তো ওরা আমায় মেরে ফেলবে।”

ফারিশ তখন সামনে তাকায়। দুজন লোক এগিয়ে আসে। গুলির শব্দ হয়। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়া লোকটাকে অনবরত গুলি মারা হয় তাদেরই চোখের সমানে। লোকটি তখন বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারে না মারা যায়। ফারিশ আদিব দুজনেই ছোট তারা কিছুই বোঝে না। আদিব ফারিশের হাত ধরে গুলির শব্দে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। রুহু সমেত তার ভয়ে কাঁপে। কিন্তু ফারিশ থাকে স্থির। তার দৃষ্টি থাকে ওই লোকদুটোর চোখ আর তাদের হাতে থাকা পিস্তলের দিকে। তখনই একটা ছেলে বলে,“এরা দুজন দেখে ফেলেছে এদেরকেও মেরে ফেল।”

আদিব ঘাবড়ে যায়। ফারিশের হাত আরো শক্ত করে খামছে ধরে। আমতা আমতা করে বলে,“আমগো মাইরা ফালাইবো ভাই। আমরা আর বাঁচুম না।”

‘আমরা আর বাঁচুম না’। কথাটা ছোট ফারিশের বুকে গিয়ে বিঁধে। কি করবে ভাবে। ছেলেগুলো ততক্ষণে এগিয়ে আসে। প্রথম আঘাতটা তারা আদিবকে করে। মাথা ফেটে যায়। আদিবের মুখে গুলি ধরে যেই না শুট করবে সেই মুহূর্তেই ফারিশ মরে থাকা সেই লোকটির পকেটের পিস্তলটা উঠিয়ে পর পর কয়েকটা গুলি মারে। আদিব থমকে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে নিচে। আরেকটা ছেলে ফারিশের এহেম কান্ড দেখে রাগ নিয়ে ছুটে আসতেই তার দিকেও গুলি তাক করে ফারিশ। সেও মরে যায়। দূর থেকে এই ঘটনা কেউ লক্ষ করে। তার সাথে করেই নিয়ে আসে ফারিশ আর আদিবকে। আদিব সেদিন রাতেও এমন ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেছিল,“আমি এহিনে থাকুম না ভাই, আমি এহিনে থাকুম না।”

সময় গড়ালো। পরিস্থিতি সামলে এলো। বাড়ির ভিতর আর ঢোকা হলো না। ফারিশ দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো। মাথায় তখন একটি প্রশ্নই ঘুরছিল,“কে ছিল ওই চাঁদরের আড়ালে?”
—–
নিজের চেম্বারে বসেছিল আদ্রিতা। তখনই হন্তদন্ত হয়ে কে যেন চেম্বারে ঢুকলো। লোকটি আহত। হাত দিয়ে কলকলিয়ে রক্ত পড়ছে। আদ্রিতা বেশ চিন্তিত স্বরে এগিয়ে এসে বললো,
“কি হয়েছে আপনার?”

লোকটি কোনোমতে বললো,“আমার হাতে গুলি লেগেছে প্লিজ আমার চিকিৎসা করুণ।”

আদ্রিতা শুনলো। দ্রুত লোকটিকে নিয়ে ছুটে গেল ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে। আদ্রিতার ফোনে মেসেজ আসে তখন। ফারিশ লেখে,“আমার আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে ডাক্তার ম্যাডাম। শোনানোর জন্য আমার কিছু সময় চাই।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩১

তখন রাত। গভীর রাত। শীতের আভাস প্রচুর। বাহিরে বাতাস বইছে। শিরশিরিয়ে উঠছে শরীর। আদ্রিতা আর ফারিশ জ্বলন্ত আগুনের নিকট বসে। একটু দূরত্বে। একদম নিরিবিলি পরিবেশ। শহর ছেড়ে দূরে। নদীর স্রোত বইছে কাছে। ফারিশ আদ্রিতার পানে তাকানো। তার দৃষ্টি শান্ত। স্বাভাবিক। নির্জীব। কিছু ভাবছে। আদ্রিতা পখর করলো তা। সে দেখছে বেশ অনেকক্ষণ যাবৎই ফারিশ তাকিয়ে আছে তার দিকে কিন্তু কিছু বলছে না। অথচ ছেলেটা ফোনে মেসেজ দিয়ে বলছিল,‘সে কিছু বলতে চায়।’

আদ্রিতার কণ্ঠে দৃঢ়তার ছোঁয়া মিললো। আঙুল কচলে বললো,“মিস্টার বখাটে।”

ফারিশের ধ্যান ফিরলো। আশপাশ দেখলো। পরমুহূর্তেই আদ্রিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,“জি বলুন।”

আদ্রিতার নিরাশ চাহনি। অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে মুখে। আদ্রিতা একটু এগোলো সামান্য দূরত্ব ঘুচিয়ে বললো,“কি হয়েছে আপনার কিছু বলছেন না কেন?”

ফারিশ নিরুত্তর। আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে। আদ্রিতা হাত ধরলো ফারিশের। আবারও প্রশ্ন ছুড়লো,“কি হয়েছে কিছু বলছেন না কেন?”

ফারিশের চোখে মুখে বিস্ময়। অস্থির লাগছে ভিতরটা। সে শীতল স্বরে এতক্ষণ পর আওড়ালো,“আমায় একটু জড়িয়ে ধরবেন ডাক্তার ম্যাডাম, আমি নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছি।”

আদ্রিতার বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠলো। মানুষটা এমন তো করে না কখনো। হা মাঝে মাঝে আবদার করে হাত ধরার, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার, কোলে মাথা রাখার। কিন্তু আজকের কণ্ঠস্বর কেমন যেন ঠেকলো আদ্রিতার। খুব বেশি অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে ফারিশের চোখে মুখে। আদ্রিতা বেশি সময় নিলো না। সে নিজ থেকেই জড়িয়ে ধরলো ফারিশকে। ফারিশও ধরলো। তার বুকের ভেতর টিপ টিপ করছে। শ্বাসটা বুঝি আঁটকে আসছে। এক ভয়ানক খারাপ লাগা কাজ করছে। আদ্রিতা তাকে ছেড়ে চলে যাবে কি না ভাবলেই তার মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আদ্রিতা ফারিশের পিঠে হাত বুলালো। ফারিশের গায়ে জড়ানো ছিল শুধু ছাইরঙা শার্ট। গায়ে কোনো গরম পোশাক ছিল না। তার নাকি গরম লাগছে সেইজন্য গায়ের জ্যাকেট খুলে রেখেছে মাটিতে। আদ্রিতা ফারিশের পিঠে হাত বুলাতেই অনুভব করলো ফারিশের পিঠের সেই ক্ষত। লম্বা আকৃতি রেখাটা যেন এখনও হাতে বিঁধছে। আদ্রিতা প্রশ্ন করলো,“এবার বলুন না। কি হয়েছে? আপনায় এমন অস্থির লাগছে কেন?”

ফারিশ চোখ বন্ধ করেই বলতে লাগলো,
“আমি আপনায় কিছু বলতে চাই কিন্তু বলতে পারছি না।”
“কেন পারছেন না?”
“আমার ভয় লাগছে।”
“ভয় কিসের আমি তো আপনার আপন মানুষ আমাতেও এত ভয়।”
“কথাগুলোই এত তেঁতো যে আমি নিজেই সইতে পারছি না।”

আদ্রিতা চিন্তিত হলো। তবুও নিজেকে সামলে বললো,“এত ভাবছেন কেন বলেই ফেলুন না।”

ফারিশ প্রসঙ্গ পাল্টালো। অদ্ভুত স্বরে বললো,“আমায় কি আপনি খুব ভালোবাসেন ডাক্তার ম্যাডাম?”

চমকে উঠলো আদ্রিতা। বিস্ময়কর কণ্ঠে বললো,
“হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
“আমরা তো সরাসরি কখনোই একে অপরকে বলি নি আমি তোমায় ভালোবাসি।”
“না বললে কি ভালোবাসা যায় না।”

ফারিশ চোখ খুললো। চমৎকার এক হাসি ফুটে উঠলো মুখে। সে আদ্রিতাকে ছাড়লো। মলিন মুখে বললো,“আমাকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে আপনার?”

রুহু সমেত কেঁপে উঠলো আদ্রিতার। এ বুঝি ভয়ংকর এক প্রশ্ন ছিল আদ্রিতার জীবনে। সে ভড়কালো। আঁখিযুগলে অশ্রুরেখা মিললো। কেমন করে যেন বললো,“এভাবে কেন বলছেন ফারিশ?”

ফারিশ তক্ষৎনাৎ উত্তর দিলো,
“আমি ভালো মানুষ নই। আমার শরীর জুড়ে পাপ।”

আদ্রিতা যেন পুরোদমে স্তব্ধ হয়ে গেল ফারিশের কথায়। শরীর অবশ হয়ে আসছে। আদ্রিতা নিজেকে শক্ত করলো। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে দমালো। শান্ত স্বরে বললো,“আমার সাথে মজা করছেন ফারিশ?”

ফারিশের মলিন মুখ। চোখের চাহনি লজ্জিত। সে মাথা নুইয়ে বললো,“ইস! যদি সত্যিই মজা হতো।”

আদ্রিতা এবার পুরোপুরি স্বাভাবিক হলো। সিরিয়াস কণ্ঠে ফারিশের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,“আমার দিকে তাকিয়ে বলুন ফারিশ। কি হয়েছে? কি পাপ করেছেন আপনি?”

ফারিশ চাইলো না। চুপ করে রইলো। তার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। এত বেশি কষ্ট কেন হচ্ছে। আদ্রিতা সব শুনে ছেড়ে চলে যেতে যাবে বলে। নিশ্চয়ই যাবে না। সে কি ছেড়ে যাওয়ার মতো মানুষ। অবশ্যই আদ্রিতার কাছে তা নয়। মেয়েটি তাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। ফারিশ দম ফেললো। আদ্রিতার অস্থির লাগছে। সে দ্রুত প্রশ্ন করলো,“চুপ করে থাকবেন না ফারিশ। কথা বলুন। আমার দিকে তাকান।”

ফারিশ এবার চাইলো আদ্রিতার দিকে। মেয়েটার চোখ জুড়ে অস্থিরতার ছোঁয়া। সবটা জানার আগ্রহতা। চিন্তিত ভাব। থমথমে শরীর। সবটাই বুঝচ্ছে ফারিশ। ফারিশ আশপাশে আবার তাকালো। বিতৃষ্ণা লাগছে। পানি খেতে ইচ্ছে করছে। তৃষ্ণার্ত ঠেকছে গলায়। কিন্তু আশেপাশে পানি নেই। ফারিশ ঘামছে। এই কনকনে শীতের রাতেও সেও ঘামছে। আদ্রিতা নির্বিকার। ফারিশ বললো,“যদি কখনো শোনেন আমি মানুষটা..

ফারিশ বলতে পারছে না। তার গলা ধরে আসছে। আশ্চর্য! এত বেশি কষ্ট কেন হচ্ছে। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো আচমকা। তড়তড় করে বললো,“আপনি এখানে চুপটি করে বসুন আমি এক্ষুণি আসছি।”

আদ্রিতার পাল্টা জবাবের অপেক্ষা করে না ফারিশ। চলে যায়। আদ্রিতা স্তব্ধ নয়নে তার পানে তাকিয়ে। বড্ড বেশিই কি কষ্ট পাচ্ছে কোনো বিষয় নিয়ে। আদ্রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিচে শুইয়ে রাখা ফোনটা হাতে নিলো। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আবার বন্ধ করে দিলো। এরপর চাইলো আগুনের ফুলকির দিকে। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। শীতের রেশ বেজায় কম।’

ফারিশ ছুঁটে এসে গাড়ির নিকট দাঁড়ালো। গাড়ির ভিতর থাকা পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে পুরো এক বোতল ঠান্ডা পানি গিলে নিয়ে শান্ত হলো। বার কয়েক নিশ্বাসও ফেললো এর মধ্যে। মিনিট পাঁচ যেতেই ফারিশ নিজেকে সামলাতে সফল হলো। গায়ের অস্থির ভাবটা কাটলো। শীত ঠেকলো এবার। ফারিশ চিন্তা করলো। আজ বলবে না। কাল বলবে। ভয় হয় হোক। কালকেই বলবে সব। তারপর আদ্রিতা যা সিদ্ধান্ত নেয়। সবটা আদ্রিতার হাতে। বুকে জড়িয়ে নিলে যত্নে রাখবে। আর ছুড়ে ফেলে দিলে.. ভাবলো না ফারিশ। আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল আদ্রিতার নিকট।’
—-
রাতের তখন শেষ প্রহর চলছে। আদ্রিতা আর ফারিশ বাড়ির পথে যাচ্ছে। ফারিশ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। আদ্রিতা ঘুরে ঘুরে তাকে দেখছে। কিছু বলতে পারছে না। আদ্রিতা অনেকক্ষণ হা-হুতাশ করে শেষমেশ প্রশ্ন করেই বসলো,“আপনি তো কিছু বললেন না ফারিশ?”

ফারিশের চোখ মুখের চাহনি আগের চেয়ে ভিন্ন। ফারিশ বললো,“কিছু বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু এখন বলতে ইচ্ছে করছে না।”

আদ্রিতা ভ্যাবাচ্যাকা খেল। অদ্ভুত স্বরে বললো,
“আপনি কি একটা পাগল?”
“হতে পারি। জানা নেই।”

আদ্রিতার চোখেমুখে রাগ ফুটে উঠলো। এমন মিনিটে মিনিটে রঙ বদলানো পুরুষ মানুষ দুটো দেখেনি। সে নাক ফুলিয়ে বললো,“আপনি একটা অসভ্য মানুষ।”

ফারিশ হাসলো। অদ্ভুত সুন্দর দেখালো সেই হাসি। একটু থেমে নীরব কণ্ঠে শুঁধালো,“আমাকে অসভ্য বলবেন না ডাক্তার ম্যাডাম, আমি সত্যি সত্যি অসভ্য হয়ে গেলে আপনি কিন্তু সইতে পারবেন না।”

আদ্রিতা চোখ রাঙালো। ভেবেছে কি! এমন আধখাওয়া কথাবার্তা বললেই আদ্রিতা গলে যাবে। আদ্রিতার খুব রাগ হচ্ছে। কেউ কিছু বলবে বলেও যখন বলে না তখন তার দারুণ রাগ হয়। যেমন এখন হচ্ছে।”

আদ্রিতাদের গাড়ি এসে থামলো আদ্রিতার বাড়ির সামনে। আদ্রিতা কোনো কথা না বলে রাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারলো না। এক পুরুষালির ভাড়ি কণ্ঠ তাকে থামালো। সে বললো,“আদ্রিতা শোনো।”

এই প্রথম ফারিশের মুখে নিজের নাম শুনতে পেল আদ্রিতা। সে থমকালো,ভড়কালো, অবাক হয়ে চাইলো ফারিশের দিকে। ফারিশ আদ্রিতার হাত ধরলো দ্বিধাহীন। খুব সরল কণ্ঠে বললো,“আমার একটা সুন্দর নিরিবিলি বিকেল চাই ডাক্তার ম্যাডাম।”

আদ্রিতার চোখে মুখে আবারও বিস্ময়। সে বললো,
“আপনি তো আসেনই রাতের বেলা বিকেল পাবো কই?”
“কালকের বিকেলটা কি আমায় দেয়া যায়?”

আদ্রিতা কিছুসময় ভেবে বললো,
“আপনি থাকবেন?”

তড়িৎ উত্তর ফারিশের, “আপনি রাখবেন।”
আদ্রিতা হেঁসে উঠলো আচমকা। মিষ্টি হেঁসে জবাব দিল,“ভেবে দেখবো।”

আদ্রিতা বেরিয়ে গেল। ফারিশ আবার বললো,“বিকেলটায় কিন্তু ভিন্ন কিছু চাই ডাক্তার ম্যাডাম।”

ফারিশ দাঁড়ালো না আর। আদ্রিতার কথাটা বুঝতে দু’সেকেন্ডের মতো সময় লাগলো। পরমুহূর্তেই নিজের দিকে তাকিয়ে। অস্পষ্টনীয় ভাবে বললো,“ঠিক আছে মিস্টার বখাটে।”
—-
পরেরদিন আদ্রিতা হসপিটাল বান দিয়েছে। সকাল সকালই ফোন করে বলেছে,“বিকেলটায় না থাকলেও রাতের বেলা যাবে। অনেক দের অবদি থাকবে।”
মৃদুলের বিয়ের ডেট পড়েছে সামনে। মুনমুন আর রনির সম্পর্কটাও মেনে নিয়েছে তাদের পরিবার। খুব শীঘ্রই তাদের বিয়ে পড়ানো হবে। আশরাফের খাতা এখনো খোলে নি। তবে শীঘ্রই খুলবে বলে ভেবে নিয়েছে সবাই। চাঁদনীর ব্যাপারটা এখনও আঁটকে। এর একটা কিছু করতেই হয়। আদিব প্রায়সই তাদের হসপিটালের আসে। এটা ওটার ছুতা দিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। কিন্তু আধও কি কারণে আসে আদ্রিতা বুঝি একটু হলেও ধরতে পারে।”

বেলা এগারোটা। সূর্যের তবে তেজমাখা রোদে ঘুম ভাঙলো আদ্রিতার। ফোনের কিরিং কিরিং শব্দ বাজলো তখন। আদ্রিতা মৃদু হাসলো। ফারিশ কল করেছে। আদ্রিতা ফোনটা তুললো। ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো,“জি বলুন মিস্টার বখাটে।”

তখনই অপর পাশ থেকে হতাশার সুরে বলে উঠলো ফারিশ,“আপনাকে কতবার বলবো আমি বখাটে নই।”

আদ্রিতার নিদারুণ সুখময় কণ্ঠস্বর,“জানি তো।”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️.গল্পের

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-২৮+২৯

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৮

মাথা নিচু করে আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নয়নতারা। মৃদুলের কান্ডে সে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেছে। নয়নতারা বুঝতে পারে নি সামান্য একটু মজা করার জন্য পাত্র এভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। শুঁকনো ঢোক গিললো নয়নতারা। নীলিমা দৌড়ে রুমে আসলো তখন। তার বাবা মাও এলো। নীলিমা নয়নতারার কাচুমাচু মুখখানা দেখে বললো,“কি করেছিস?”

নয়ন মিনমিনিয়ে নিজের চোখের চশমাটা ঠিক করে বললো,“আমি কিছু করি নি। খালি বলেছি আমি নীলিমা ব্যাস তাতেই অজ্ঞান হয়ে গেছে।”

মৃদুল দেখছে আশরাফকে। বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে। রনির চোখে মুখে বিস্ময়। ছ্যাড়াডা কামডা করলো কি? আশরাফ পানি আনতে বললো। নয়নতারা দৌড়ে পানি আনতে গেল। আদ্রিতারা অবাক চোখে তার যাওয়ার পানে তাকালো। এই বুড়ো মহিলা এভাবে দৌড়ে গেল কিভাবে। একটু আগেও তো কাঁপতে কাঁপতে আসছিল। নয়নতারা দৌড়ে এসে আশরাফের হাতে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“নিন।”

আশরাফ একঝলক তাকালো মহিলাটির দিকে। কণ্ঠটা কেমন ইয়াং মেয়েদের মতো ঠেকলো। আশরাফ বেশি ভাবলো না দ্রুত পানির গ্লাসটা নিয়ে পানি ছিটালো মৃদুলের চোখে মুখে। সঙ্গে সঙ্গে লাফ মেরে উঠে বসলো মৃদুল। থমথমে কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললো,“আব্বা আমি বিয়া করতাম না।”

আশরাফ ওরা নিরাশ হলো মৃদুলের কান্ডে। নিজেদের মুখে চাপড় মারলো সবাই। এমনিতেই লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে তারা। তারওপর মৃদুলের এমন উদঘাট কান্ড। নীলিমার বাবা এতক্ষণ পর খেয়াল করলো তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক সাদা চুলওয়ালা মহিলাকে। তাকে চিনতে না পেরে বললো,“আপনি কে?”

নয়নতারা কাচুমাচু হলো এবার। নীলিমা বললো,“বাবা ও নয়ন।”

সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় করে বললো,“ও নয়নতারা।”

সবাই চাইলো নয়নতারার দিকে। নয়নতারা মাথা নাড়ালো নীলিমার বাবার কথায়। নীলিমার বাবা বললেন,“তার মানে এসবের পিছনে তোর হাত আছে।”

নয়নতারা এগিয়ে আসলো। মাথার ঘোমটা তার অনেক আগেই পড়ে গেছে। নয়নতারা তার মাথায় লাগানো আলগা সাদা চুলের গোচা খুলে ফেললো। চোখের চশমাও খুললো। গালে লাগানো আলগা ফেস মাস্ক আর মেকাপ উঠাতেই তার ঝকঝকে ফর্সা মুখখানা আর ঘনকালো চুলগুলো দেখা গেল। আশরাফের নজর কাড়লো সেই মুখশ্রী। নয়নতারা থমথমে কণ্ঠে বললো,“বিশ্বাস করুন আঙ্কেল আমি একটু মজা করছিলাম কিন্তু উনি যে অজ্ঞান হয়ে যাবেন বুঝতে পারি নি। আমি খুব দুঃখিত আঙ্কেল।”

উপস্থিত সবাই এতক্ষণে পুরো ঘটনা ঠাহর করতে পারলো। নীলিমা এগিয়ে গেল মৃদুলের দিকে। বসলো ওর পাশ দিয়ে। মৃদু কণ্ঠে আওড়ালো,“আপনি ঠিক আছেন তো। ও আমার ফ্রেন্ড নয়নতারা। আপনাদের সাথে একটু মজা করার জন্য ওমন সেজে এসেছিল। ও নীলিমা না আমি নীলিমা।”

মৃদুল এবার চাইলো নীলিমার দিকে। মুগ্ধ হলো। না বাবার চয়েস খারাপ না। নীলিমার বাবা কি বলবেন বুঝতে পারছে না। নীলিমার মাও চুপ। অতঃপর নীলিমার বাবাই লজ্জিত স্বরে বললো,“তোমরা কিছু মনে করো না ও একটু ওমনই ফাজিল টাইপের মেয়ে।”

সবার দারুণ হাসি পাচ্ছে বিষয়টায়। কিন্তু তারা হাসতে পারছে না। আশরাফ অনেকটা নিজেকে সামলে বললো,“আমরা কিছু মনে করি নি।”

নয়নতারা সরাসরি চাইলো আশরাফের দিকে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,“আমি খুবই দুঃখিত বিষয়টায়। কিন্তু আমি সত্যি বুঝতে পারি নি উনি এই সামান্য বিষয়টায় অজ্ঞান হয়ে যাবেন।”

মৃদুলের এবার লজ্জা লাগছে। ইস! এটা কি করে ফেললো। মৃদুল মিটমিট করে তাকালো তার বন্ধুদের দিকে। চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে সবাই। সে বুঝতে পেরেছে আজ চরম লেভেলের লজ্জাজনক একখানা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। যা তার বন্ধুমহলের সদস্যদের দারুণ লজ্জায় ফেলেছে।’
—-
রাত তখন বেশ গভীর। কনকনে শীতের আভাস বইছে চারিপাশে। আজ হসপিটাল থেকে বের হতে রাত প্রায় তিনটে বেজে গেল আদ্রিতার। ক্ষিদে আর ক্লান্তিতে শরীর অবশ প্রায়। আদ্রিতা বরাবরের মতো সোহেলকে ডাকলো। সোহেল এলো। দ্রুত জবাব দিলো,“ম্যাডাম হয়েছে।”

আদ্রিতার ক্লান্তমাখা শরীরে উত্তর,
“হুম। চল দ্রুত।”
“আচ্ছা ম্যাডাম আসেন।”

আদ্রিতা হেঁটে গিয়ে বসলো গাড়িতে। সোহেলও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্ট্যার্ট দিলো। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো গাড়ি স্ট্যার্ট হচ্ছে না। সোহেল বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরও গাড়ি স্ট্যার্ট না হওয়ায় বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হলো আদ্রিতা। থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“কি হয়েছে সোহেল?”

সোহেলের নিরাশ চাহনি। হতাশায় ঘেরা মুখ। সে বললো,
“বুঝচ্ছি না ম্যাডাম।”
“রাত হলে এটার কি হয় সোহেল?”
“আমিও জানি না দিনে তো ঠিকই থাকে রাতে কি হয় বুঝি না।”

সোহেল গাড়ি থেকে নামল। গাড়িটা অনেকক্ষণ চেক করে বললো“ম্যাডাম গাড়িতে তেল নেই।”

আদ্রিতার ইচ্ছে করছিল সোহেলকে অনেক্ক্ষণ পেটাতে কিন্তু পারলো না। সে গাড়ি থেকে বের হলো। বিরক্ত নিয়ে বললো,
“এটা আরো আগে দেখো নি কেন সোহেল?”

সোহেল মাথা নুইয়ে বললো,“বিশ্বাস করুন ম্যাডাম সকালেও ফুল ছিল হঠাৎ কি করে খালি হয়ে গেল বুঝচ্ছি না।”

আদ্রিতা আর কথা বাড়ালো না। সোহেল বললো,“গাড়ি এনে দিবো ম্যাডাম।”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আদ্রিতা। বললো,“আগে এটাকে ঠিক করো সোহেল। কাল থেকে এমন হলে আমি তোমায় দেখে নিবো।”

কথাটা বলে হনহন করে হেঁটে গেল আদ্রিতা। সোহেল মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে। রাগে ফুঁসলো আদ্রিতা। সে বুঝতে পারছে না রোজ রাতে গাড়িটার হয় কি। আদ্রিতা তার মায়ের নাম্বারে কল করলো। সঙ্গে সঙ্গেই ধরলো তার মা। যেন তার কলেরই অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। আদ্রিতার মা চিন্তিত স্বরে বললো,
“কখন ফিরবি আদ্রিতা?”
“আমার একটু লেট হবে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো মা।”

কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিল। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। এত রাতে খাওয়ার মতো কিছু নেই আশেপাশে। পুরো রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি টাড়ি কিছুই দেখা যাচ্ছে না তেমন। আদ্রিতার ইচ্ছে করছে সোহেলের কানটা ছিঁড়ে ফেলতে। ছেলেটা আগের চেয়ে বড্ড বেখেয়ালি হয়ে গেছে। এমন চলতে থাকলে সে সোহেলকে বাদ দিয়ে নতুন ড্রাইভার রাখবে। কথাগুলো একা মনে বলছে আর হাঁটছে আদ্রিতা। হঠাৎই পিছন থেকে গাড়ির হর্ণ বাজার আওয়াজ শোনা গেল। আদ্রিতা আরো বিরক্ত হলো এতে। পিছন ঘুরে বিরক্ত নিয়েই চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“সমস্যা কি এভাবে মাঝরাতে শুধু শুধু হর্ণ বাজাচ্ছেন কেন?”

ফারিশের কণ্ঠ শোনা গেল। সে বললো,“সমস্যাটা হচ্ছেন আপনি।”

আদ্রিতার টনক নড়লো। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ফারিশের মুখের দিকে। বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন বললো,“আপনি এখানে?”

ফারিশ গাড়ির দরজা খুলে দিলো। আদ্রিতা ছুটে গিয়ে বসলো গাড়িতে। সিটব্লেট লাগিয়ে বললো,“এত রাতে এখানে কি করছিলেন?”

ফারিশের এক বাক্যের জবাব,“অপেক্ষা।”
আদ্রিতা চোখ বড় বড় করে চাইলো ফারিশের দিকে। ক্লান্তি ভাবটা আচমকাই উবে গেল কোথাও। সে বললো,“আপনি কখন থেকে আমার অপেক্ষা করছিলেন?”

ফারিশের আবারও এক বাক্যের উত্তর,“অনেকক্ষণ।”

আদ্রিতা জোরে নিশ্বাস ফেলে তার মাথাটা এলিয়ে দিলো গাড়ির সিটে। চোখ বন্ধ করে বললো,
“খুব ভালো করেছেন আমার অপেক্ষায় ছিলেন নয়তো এতরাতে কতদূর আমার হাঁটা লাগতো কে জানে।”
“কেন আপনার গাড়ি কই?”
“আর বলবেন না ওটায় কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। রোজ রাতে সমস্যা করছে। পরশু টায়ার ফেটে গেছিল। কাল ঠিক ছিল। কিন্তু আজ আবার তেল নেই।”

ফারিশ ছোট করে বললো,“ওহ।”
আদ্রিতা চাইলো ফারিশের দিকে মাঝে একদিন তার সাথে ফারিশের দেখা হয় নি। তবে রাতে কথা হয়েছিল। আদ্রিতা বললো,
“কাল এলেন না কেন?”
“রোজ তো গাড়ি নষ্ট করা যায় না। তাই ভেবেছি একদিন পর পর করবো।”

মুহুর্তের মধ্যে চোখ চড়ুই গাছ আদ্রিতার। বিস্ময়কর এক চেহারা নিয়ে বললো,
“তার মানে এই দুইদিন।”
“হা আমি করেছি।”
“কিন্তু কেন?”
“এভাবে একসাথে বাড়ি ফেরার জন্য।”
“আমায় বললে কি আমি আসতাম না।”
“চমকানো তো যেত না।”

আদ্রিতা হেঁসে ফেলে। বলে,
“আপনি আসলেই একজন অদ্ভুত মানুষ।”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,
“জানি তো।”
“কাল থেকে আর গাড়ি নষ্ট করবেন না। এই দূরে অপেক্ষা করবেন আমি আসবো।”

ফারিশ রাস্তার পানে তাকিয়েই বলে,“আচ্ছা।”
আদ্রিতার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। দ্বিধাহীন কণ্ঠে বললো,
“আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”

ফারিশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আমাকে কি বিশ্বাস করা যায় ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতা চমকালো,ভড়কালো, অবাক হলো খুব। বললো,
“কেন যাবে না।”
“তাহলে আমার সাথে যাবেন দূরে।”

আদ্রিতার মিনমিনিয়ে বললো,
“কোথায়?”
“আছে এক জায়গা যাবেন।”
“আমার যে ক্ষিদে পেয়েছে।”
“তার জন্যই তো যাবো। আপনাকে খাওয়াবো। যাবেন?”

আদ্রিতা বেশি ভাবলো না। বললো,“ঠিক আছে।”
ফারিশ দ্রুত গাড়ি ঘোরালো। গাড়ির স্পিড দিল বাড়িয়ে। আদিবকে কল করে বললো,“আদিব আজ রাতে আমি ফিরছি না। তুমি চিড়ামুড়ি কিছু একটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

অপরপাশের কিছু শোনা গেল না তার আগেই ফারিশ ফোন কেটে দিয়েছে। আদ্রিতা তার দিকে তাকিয়ে। ফারিশ বিনা কথায় পুরো এক ঘন্টার রাস্তা আধঘন্টায় এসে থামালো গাড়ি। আতঙ্কিত আদ্রিতার তখন থমকানো মুখ। সে ডান পাশে চাইলো। বনজঙ্গলে ঘেরা একটা জায়গা। আদ্রিতা সরু চোখে তাকালো ফারিশের দিকে। বললো,
“আমরা কি এখানেই নামবো?”

ফারিশ জবাব দিলো না। সরল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। করুন স্বরে বললো,
“আমার যদি হঠাৎ প্রেম প্রেম পায় তবে কি আপনি খুব রাগ করবেন ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতার বিস্মিত চেহারা। চোখ মুখ কুঁচকালো। শরীর অবশ হলো প্রায়। সে বললো,“এসব কি বলছেন?”

ফারিশের দুষ্ট মার্কা হাসি,
“আমি জানি বিয়ের আগে প্রেম প্রেম পাওয়াটা একটা দণ্ডনীয় অপরাধ। তবুও হঠাৎ পেয়ে বসলে আপনি কি রাগ করবেন?”

আদ্রিতার দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টালো। কিছু বুঝলো। হাসলো। সুরেলা সুরে আওড়ালো,“আমি আপনায় খুন করবো ফারিশ।”

ফারিশের মুখ হাসি হাসি। দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। সে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“পারলে মারুন। আপনি মারলে আমি বেঁচে যাই।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৯

কনকনে শীতে থর থর করে কাঁপছে শরীর। আদ্রিতা তার গায়ে জড়ানো কালো চাঁদরটা আর একটু শক্ত করে চেপে ধরলো। আশপাশ পুরো নির্জীব। বনজঙ্গলের ঘেরা পুরো জায়গাটা। নিশি রাতের শিশিরে ভেজা মৃদু ঘাসের ওপর মোড়া পেতে বসে আছে আদ্রিতা। তার সামনেই ডালপালা পুড়িয়ে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত ফারিশ। আদ্রিতার সামনে একটা থমথমে বাড়ি দেখা যায়। বাড়িটা অনেক পুরোনো আর ভুতূরে টাইপ। ফারিশ সেই বাড়ির ভিতর ঢুকেই ডালপালা নিয়ে এসে এই মৃদু ভেজা ঘাসের উঠোনে আগুন জ্বালাচ্ছে। আদ্রিতা প্রশ্ন করলো,“আমরা কি বাড়ির ভিতর যাবো না?”

ফারিশ একঝলক চাইলো আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। পরমুহুর্তেই দ্রুত জবাব দিলো,“আমরা না শুধু আপনি।”

আদ্রিতা হতাশ হলো। মুখভঙ্গি বদলালো। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এমনটা কেন?”
“আমার ইচ্ছে তাই।”
“এমন অদ্ভুত ইচ্ছে কি বেমানান নয়।”
“হয়তো বেমানান তবে আমার কাছে সুন্দর।”

আদ্রিতা চুপ হয়ে গেল। ফারিশ আগুন জ্বালিয়ে ফেললো কিছুক্ষণেই। একটা ডাল আগুনে পেতে তাড়া দিয়ে বললো,
“এবার বলুন কি খাবেন?”
“আপনি যা খাওয়াবেন। আর তাছাড়া আপনার কাছে এই মুহূর্তে খাওয়ানোর মতো কি কি আছে তা আমি কি করে জানবো?”
“ডিম রুটি খাবেন। আমি শুধু অমলেট বানাতে পারি।”

আদ্রিতা মৃদু হাসলো। বললো,
“করুন। তবে জলদি করবেন। আমার কিন্তু দারুণ ক্ষিদে পেয়েছে।”

ফারিশ দেরি করলো না। সে চলে গেল বাড়ির ভিতর। আদ্রিতা চুপচাপ বসে আগুন পোয়ালো। ফারিশ ফিরে এলো মিনিট পনের পরে। হাতে কিছু গরম করা পাউরুটি আর দুটো ডিমের অমলেট।’

আগুনের তাপে ঘাসের জমির কিছু অংশ গেছে বেশ শুকিয়ে। ফারিশ সেই শুঁকনো ঘাসের উপর বসলো। আদ্রিতার দিকে অমলেটের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“ভয় পেয়েছিলেন?”

আদ্রিতা তড়িঘড়ি করে বললো,“অল্পস্বল্প।”
ফারিশ হাসে। আদ্রিতা চেয়ে রয় শ্যামবর্নের সেই পুরুষটির দিকে। মানুষটা হাসলে এত কেন সুন্দর লাগে কে জানে। আদ্রিতা প্লেট ছুঁইলো। মোড়া ছেড়ে ফারিশের মুখোমুখি একটু দূরত্ব নিয়ে বসলো। বললো,
“আপনি খাবেন না?”
“না। আপনি খান।”
“কেন?”
“আমার ক্ষিদে পায় নি।”

আদ্রিতা কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো। খুব জলদি জলদিই করলো। ফারিশ তার পানে তাকিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটার বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। আদ্রিতার বেনুনী করা চুলগুলো বেশ এলেমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে সামনে। গায়ে জড়ানো সবুজ রঙা চুড়িদার। বুকে জড়ানো কালো চাদর। খুবই সাদামাটা। তবুও অসাধারণ দেখাচ্ছে। চোখে পলক ফেলছে বার বার। ক্লান্তি ভাবটা আগের চেয়ে বেশ কমেছে। ফারিশ আদ্রিতার থেকে দৃষ্টিতে সরিয়ে আগুনের দিকে চাইলো। পাশে জমিয়ে রাখা শুঁকনো ডাল দিলো। ডালের ছোঁয়া পেতেই তড়তড় করে বেড়ে উঠলো আগুন। গরম গরম উষ্ণতা আরো বাড়লো। শীত কমিয়ে দিলো আর একটু। আদ্রিতা খেতে খেতেই প্রশ্ন করলো,“এখানে কে থাকে?”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর, “কেউ না।”
আদ্রিতার বিস্মিত নজর। বার পলক ফেলা পাপড়িযুগল। ফারিশ নিজেই বললো,
“এককালে এই বাড়িতে আমি আর আদিব থাকতাম। এখন আর থাকি না। তবে মাঝে মাঝে আসা হয়।”

আদ্রিতাকে শান্ত দেখালো। উত্তেজিত ভাব কমলো। নরম করে বললো,“ওহ আচ্ছা।”

এরপর নীরবতা চললো অনেকক্ষণ। আদ্রিতা তার খাওয়া শেষ করলো। বেশ ভালো লাগছে এখন। ফারিশ তার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। আদ্রিতা নিলো। একটু সময় নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা শেষ করলো। জোরে নিশ্বাস ফেলে বললো,“অবশেষে নিজেকে শান্ত লাগছে।”

ফারিশ পানির গ্লাসটা পুনরায় হাতে নিয়ে পাশে রাখলো। বললো,“অমলেট কেমন লাগলো?”

আদ্রিতা তৃপ্তির ঢেঁকুর দিয়ে বললো,“দারুণ।”
ফারিশ খুশি হলো। আদ্রিতা এবার আয়েশ করে আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। বললো,
“জায়গাটা সুন্দর তবে ভয় ভয় লাগে।”
“ভয় কিসের আমি তো আছি।”
“তাই তো চুপচাপ আছি নয়তো কখন দৌড়ে পালাতাম।”

ফারিশ এবার উচ্চ শব্দে হাসলো। আদ্রিতাও হাসলো। ফারিশ আকাশ পানে চাইলো। খোলা আকাশের মাঝে অনেকগুলো তাঁরা দেখা যাচ্ছে। এত রাতে আকাশ ভর্তি তাঁরা এ যেন প্রথম লক্ষ্য করলো ফারিশ। ফারিশ মৃদু স্বরে বললো,“আকাশটা আজ খুব সুন্দর তাই না।”

আদ্রিতাও তাকালো আকাশের দিকে। বললো,“হুম।”

আবারও নীরবতা ভর করলো দুজনের মাঝে। কথা বলার মতো কোনো কথাই যেন পাচ্ছে না। সময়ের চাকা টিকটিক করে বাড়ছিল শুধু। হঠাৎই ফারিশ নিঃসংকোচে আবদারের স্বরে বললো,“আমি আপনার কোলে মাথা রাখি ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতার অদ্ভুত চোখ। ফারিশের শীতল দৃষ্টি। কণ্ঠস্বর বেশ নরম। আদ্রিতা বেশি সময় নিলো না। মাথা নাড়িয়ে মিষ্টি হেঁসে বললো,“আচ্ছা রাখুন।”

ফারিশ খুশি হলো। বিনা দ্বিধায় সে শুয়ে পড়লো নিচে মাথা রাখলো আদ্রিতার কোলে। আদ্রিতার হাত আপনাআপনি চলে গেল ফারিশের চুলে। হাত বুলাতে লাগলো ধীরে ধীরে। ফারিশ চোখ বন্ধ করলো। বললো,
“জানেন আমি না কখনো এভাবে কারো কোলে মাথা রাখি নি। আপনাকে কেন যেন আমার বড্ড আপন মনে হয়। কি যাদু করলেন বলুন তো?”

আদ্রিতা উত্তর দেয় না। ফারিশ আবারও বলে,
“আমার বয়স যখন পাঁচ তখন প্রথম রংপুরের সেই ইমাম আমায় নিয়ে ঢাকা আসেন। আমাকে বলে এখন থেকে নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। আমি তখন বেশ অবাক হই তার কথায়। আমাকে তিনি রেখে গেলেন এক এতিম খানায়। সেখানেই পরিচয় হয় আমার আদিবের সাথে। কিছু ছেলেরা ওকে ধরে মারছিল আমি আটকায়। তাদের থামাই। সেই থেকেই নাকি ওর জীবন বদলে যায়। এতিম খানায় থেকে ছিলাম দু’বছর। হঠাৎ শুনি যিনি এতিম খানা করেছিলেন তার ছেলে নাকি এতিম খানা বিক্রি করে দেয়। আমাদের এক নিমিষেই সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কে কোথায় গিয়েছিল জানা নেই। তবে আদিব আমার সঙ্গেই ছিল। ক্ষুধার জ্বালা ভয়ংকর জ্বালা আমি বুঝি। এমনও দিন গেছে আমাদের শুধু পানি খেয়ে কেটেছে পুরো চব্বিশ ঘন্টা। আদিব আমার চেয়ে এক বছরের ছোট ছিল। ক্ষুধার জ্বালা সইতে পারতো কম। কাঁদতো আমায় ধরে। আমি শুধু হাত বুলিয়ে দিতাম মাথায়। কি করতাম? কিছু তো করার নেই। জুতা পালিশ করে যা ইনকাম হতো তা দিয়ে মোটামুটি একবেলা চলে যেত কিন্তু রাত হলে সেই আবার জ্বালা। ধীরে ধীরে সয়ে গেল সব। শীতের এই কনকনে রাতে শুধু পলিথিন চাপিয়ে শুয়ে কাটিয়েছি কতরাত ঠিক নেই। পুলিশের হাতের মারও কম খাওয়া হয় নি মোদের। তবুও জীবন সুন্দর। তাই না।”

আদ্রিতা কি বলবে বুঝে না। ফারিশ চুপ হয়ে গেল। আর কিছু বললো না। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। গভীর ঘুম। শান্তির ঘুম। আদ্রিতা ঘুমন্ত ফারিশের দিকে চাইলো। সে বুঝলো ফারিশ আর কিছু বলবে না। আদ্রিতা জোর করলো না। প্রশ্ন করলো না কোনো। চুপচাপ বসে চেয়ে রইলো ফারিশের মুখের দিকে। সামনেই জ্বলজ্বল করে জ্বলছে আগুন। আদ্রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে বুঝলো। সবার ছেলেবেলা সুন্দর হয় না। তারটা সুন্দর ছিল কিন্তু ফারিশের ছিল না। বুকচাপা এক আর্তনাদ বেরিয়ে আসলো আদ্রিতার।’

সময়ের কাটা সুড়সুড় করে বাড়ছে। ফারিশ গভীর ঘুমে মগ্ন তখন। আগুন প্রায় নিভে যাওয়ার মুহূর্তে। শুঁকনো ডাল আর নেই। আদ্রিতা এবার ডাকলো ফারিশকে। বললো,“শুনছেন,উঠুন। বাড়ি যাবেন না?”

ফারিশ হাল্কা নড়লো। আদ্রিতাকে আর একটু শক্ত করে চেপে ধরলো। আদ্রিতা অনুভব করলো তার শরীর মৃদু কাঁপছে। হয়তো ফারিশের সংস্পর্শে। আদ্রিতা আবারও ডাকলো। জোরেশোরে বললো এবার,“ফারিশ উঠুন না প্লিজ।”

ফারিশ এবার উঠলো। আশপাশ দেখলো। আচমকাই শোয়া থেকে উঠে বসলো। অদ্ভুত এক প্রশ্ন করলো,“আপনি যান নি?”

আদ্রিতা চোখ মুখ কুঁচকালো। বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো,“আমার কি একা একা যাওয়ার কথা ছিল।”

ফারিশ চুপ করে রইলো। তার মনে হচ্ছে সে বহুকাল পর একটু আরামে ঘুমিয়ে ছিল। এই আরাম সে বিগত বহুবছর পায় নি। ফারিশের নিজেকে গোছাতে সময় লাগলো দু’মিনিট। সে বললো,“চলুন যাই। ক’টা বাজে?”

আদ্রিতা তার হাত ঘড়িটা দেখলো। বিনয়ের সাথে বললো,
“সাড়ে চারটা।”
“আমি কি অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম?”
“না। খুব জোর পনের মিনিট।”

ফারিশের এবার বেশ অবাক লাগলো। মাত্র পনের মিনিট ঘুমিয়েছে অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে বহুক্ষণ ঘুমিয়েছে অনেক ঘন্টাও ছাড়িয়ে গেছে বোধহয়। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আদ্রিতাও উঠলো। আগুন ততক্ষণে পুরো দমে নিভে গিয়ে লাল লাল ফুলকি দেখাচ্ছিল শুধু। ফারিশ তাড়া দিয়ে বললো,“দ্রুত চলুন আপনায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”

আদ্রিতা শুনলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,“ঠিক আছে।”
—-
নীরবে গাড়ি চালাচ্ছে ফারিশ। মুখে কোনো কথা নেই। আদ্রিতাই বললো আগে,
“আপনি সেই বাড়ির ভিতর না নিয়েই পারলেন আমায়।”
“বাড়ির ভিতর নেয়ার কি কোনো কথা ছিল?”
“বাড়ির ভিতর কি রহস্য লুকিয়ে রেখেছেন তা বলুন।”

ফারিশের নিবিড় উত্তর,“একটা খাট আর একটা আলমারি। ওহ রান্নাঘরের বাহিরে একটা ফ্রিজ আছে। আর রান্নাঘরের ভিতরে রান্নার সরঞ্জাম। হাড়ি পাতিল। এই রহস্য।”

আদ্রিতার সন্দিহান দৃষ্টি,
“তাহলে ভিতরে নিলেন না কেন?”
“আসলে বদ্ধ করে আমার ভীষণ ভয় লাগে।”

আদ্রিতা অবাক হয়ে বললো,“মানে। আপনি তো একাই বাড়ির ভিতর থাকলেন আমায় নিলেন না তখন ভয় করলো না।”

ফারিশের এলেমেলো দৃষ্টি। বিষণ্নভরা চাহনি। সে বললো,“একা নয় আপনায় নিয়ে বদ্ধ করে থাকতে আমার ভয় লাগে।”

আদ্রিতার চোখমুখ ভয়ংকরভাবে কুঁচকে গেল। অদ্ভুত স্বরে আওড়ালো,“কি বলতে চাচ্ছেন একটু পরিষ্কার করে বলুন তো?”

ফারিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল,
“আমি আগে প্রচুর ধৈর্য্যশীল পুরুষ ছিলাম। কিন্তু ইদানীং আপনি আশেপাশে থাকলে আমার নিজেকে বড্ড অধৈর্য্যশীল পুরুষ মনে হয়। এমনিতেই নিশিরাত কনকনে ঠান্ডা। তারওপর যদি হয় বদ্ধ ঘর। আমি তো বেসামাল হয়ে উঠবো। বদ্ধ ঘরে আমার যদি প্রেম প্রেম পায় তখন। দেখুন আমি যথেষ্ট সতর্কবান মানুষ। বিয়ের আগে নো বদ্ধঘর।”

আদ্রিতার আচমকাই প্রচন্ড হাসি পেল। কি অদ্ভুত লজিকে তাকে বাড়ির ভিতরে নিলো না। আদ্রিতা হেঁসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,“আপনি এক বদ্ধ উন্মাদ ফারিশ।”

ফারিশের সহজ সরল উত্তর,“জানি তো।”
আদ্রিতা হাসতে থাকলো। তার ফারিশের কথায় দারুণ মজা লেগেছে। প্রকৃতি তখন একটু একটু করে জানা দিচ্ছিল রাতের আঁধার ছাড়িয়ে দিন আলো আসছে। আশেপাশে মসজিদ নেই। যার দরুন তারা টের পাচ্ছে না দূর আকাশে ফরজের আজান দিচ্ছে। ফারিশ একটুখানি গাড়ির জানালা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে এক শীতল হাওয়া তাকে নাড়িয়ে দিলো। আদ্রিতার তখনও মুখ ভরা হাসি। ফারিশের সেই হাসিতে চোখ আটকালো ক্ষণে ক্ষণে বহুবার। ফারিশ বুকে হাত দিলো। মনে মনে আওড়ালো,
“এভাবে হাসবেন না ডাক্তার ম্যাডাম,আপনি হাসলে আমার যে বড্ড ব্যাথা লাগে।”

#চলবে….

#TanjiL_Mim♥️

এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-২৬+২৭

0

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৬

সময়টা প্রায় বিকাল চারটা পাঁচের কাছাকাছি। আদ্রিতা লজ্জায় মাথা নুইয়ে বসে আছে। আচমকা ফারিশকে জড়িয়ে ধরায় সে বেশ লজ্জিত। এই উদগাট কাজ এর আগে কখনো করে নি আদ্রিতা। ইস! ফারিশ কি ভাবলো। আদ্রিতা আড়চোখে ফারিশকে দেখলো। ছেলেটাকে বেশ স্বাভাবিক আর শান্ত দেখাচ্ছে। কি সুন্দর নীরবে গাড়ি চালাচ্ছে। যেন কিছু হয় নি এমন। আদ্রিতার মুখ দিয়ে আর কথা বের হতে চাইলো না। ফারিশ অনেকক্ষণ পর বললো,
“এভাবে হুটহাট জড়িয়ে ধরলে আমি কিন্তু মারা পড়বো ডাক্তার ম্যাডাম।”

আদ্রিতার লজ্জিত মুখ আরো লজ্জিত হলো। তার ইচ্ছে করছে চলন্ত গাড়ি থেকে ছুট্টে পালিয়ে যেতে। কিন্তু তা আর হলো না। নিজেকে পুরোপুরি ধাতস্থ করে লজ্জিত স্বরে বললো,
“আমি তো ডাক্তার মানুষ পুরোপুরি মারা পরার আগে ঠিক বাঁচিয়ে নিবো।”

ফারিশ হাসলো। বললো,
“আপনি কিন্তু দারুণ কথা জানেন।”
“আপনার চেয়ে কম।”
“আমার তো মনে হয় না।”
“কিন্তু আমার মনে হয়।”
“এর আগে কোনো পুরুষকে জড়িয়ে ধরেছেন ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতা আবার লজ্জায় পড়লো। এই ছেলে জড়িয়ে ধরা ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা কি বলতে পারছে না। আদ্রিতা নীরব রইলো। ফারিশ বললো,
“উত্তর কিন্তু পেলাম না।”
“যদি না দেই।”
“আমি কি জোর করতে পারি!”
“আপনি কি চান আমি আর কখনো আপনায় জড়িয়ে না ধরি?”

ফারিশ জবাব দেয় না। আদ্রিতাও আর কিছু বলে না। গাড়ি চলে আপন মনে। গাড়ি তখন প্রায় হসপিটালের কাছাকাছি চলে এসেছে। হঠাৎ ফারিশ প্রশ্ন করে,
“আপনি কি কাঁচের চুড়ি পছন্দ করেন?”

আদ্রিতা বেশ অবাক হয় প্রশ্নে। বলে,“কেন?”
ফারিশ বিরক্তবোধ করে উত্তরে। চোখ মুখ কুঁচকে বলে,“কেনোর উত্তর দিবো না। পছন্দ করেন কি না বলুন?”

আদ্রিতা শান্ত স্বরে শুধায়,“করি।”
ফারিশ কতদূর গিয়েই হঠাৎ গাড়ি থামায়। হসপিটাল দেখা যায় দূর থেকে। আদ্রিতা বিচলিত কণ্ঠে বললো,“আর একটু সামনে যেতে হতো তো।”

ফারিশ সামনে যায় না। উল্টো পিছনে যায়। আদ্রিতার চোখে মুখে বিস্ময়। ফারিশ তখন আসার পথে একটা ছেলেকে দেখে মাথায় হাজি চেপে কাঁচের চুরি নিয়ে যাচ্ছে। ফারিশ সোজা ছেলেটার সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো। জানালার কাঁচ নামিয়ে ডাকলো,“এই পিচ্চি।”

ছেলেটি দাঁড়ালো। পিছন ফিরেই বললো,“আমারে ডাহেন।”

ফারিশ তার পানে তাকিয়ে বলে,“হুম তোমারেই ডাকি। এদিকে আসো।”

ছেলেটি খুশি হলো মাথার হাজিটা শক্ত করে চেপে ধরে এগিয়ে গেল ফারিশের দিকে। ফারিশ গাড়ির দরজা খুললো। বললো,“চুড়ি কত করে?”

ছেলেটি মাথার হাজি মাটিতে রাখলো। ক্লান্ত শরীরে বললো,
“কয়ডজন নিবেন এক এক ডজন চল্লিশ টাহা কইরা।”
“সব কি কাঁচের চুড়ি?”
“হ।”
“সব মিলিয়ে কত ডজন হবে?”
“পনচাস ডজন।”
“ভালো হবে তো।”
“হা। এককালে খাসা মাল আইজগোই বাজার তোন কিন্না আনছি। সাহেব হয়ালে করেন বাড়ি যাওন লাগবে নইলে আম্মায় রাগ হইবো। আম্মার আবার জ্বর আইছে। ঔষধও কেনা লাগবো।”

ফারিশের বুক ভাড়ি হয়ে উঠলো। ফারিশ আর সময় না দিয়ে মানিব্যাগ থেকে দুটো এক হাজার টাকার নোট বের করে ছেলেটার কাছে দিলো। বললো,“সব চুড়ি দিয়ে দেও।”

ছেলেটির চোখ ছানাবড়া। সে বললো,
“এতগুলান চুড়ি আমনে একলা নিবেন?”
“হুম।”

ছেলেটি খুশি হলো। এক হাজি চুড়ি এগিয়ে দিলো ফারিশের দিকে। ফারিশ নিলো। আদ্রিতার কাছে দিয়ে বললো,“এগুলো আপনার জন্য।”

আদ্রিতার চোখ আরো দিগুণ বড় বড় হয়ে গেল। হতভম্ব স্বরে বললো,
“এতগুলো চুড়ি।”
“হুম।”

ফারিশ ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,“ভালো থেকো। আর তোমার আম্মার যত্ন নিবা কেমন।”

ছেলেটির মুখে জড়ানো হাসিটা আরো বাড়লো। হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললো,“আমনেও ভালো থাকবেন। আমি যাই।”

ছেলেটি দৌড়ে টাকা দুটো দেখতে দেখতে চলে গেল। ফারিশ বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ছেলেটির যাওয়ার পানে। অতঃপর জোরে নিশ্বাস ফেলে গাড়ির দরজা আঁটকে বললো,“তাহলে যাওয়া যাক।”

আদ্রিতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
“এতগুলো চুুড়ি নিয়ে আমি কিভাবে হসপিটাল যাবো?”
“এটা আপনার সমস্যা আমার না।”
“আপনি তো ভাড়ি অদ্ভুত মানুষ।”
“এটা কি আজ নতুন নাকি।”

আদ্রিতার অসহায় মুখ। এখন কি করবে ভাবছে। তার বন্ধুমহল এগুলো দেখলে নির্ঘাত সন্দেহের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে যাবে। ফারিশ এসে হসপিটালের সামনে গাড়িটা থামালো। নীরবে বললো,“নামুন।”

আদ্রিতা নামলো না। ঠায় বসে রইলো। ফারিশ আবার বললো,“কি হলো?”

আদ্রিতার অসহায় মুখ। ছলছল চোখে
বললো,
“এগুলো পরে নিলে হতো না।”
ফারিশ শ্বাস ফেলে বললো,
“কত পরে?”
“ওই রাতে ফেরার পথে।”

ফারিশ বেশি ভাবলো না। আদ্রিতার হাত থেকে চুড়ির হাজিটা নিয়ে বললো,“ঠিক আছে।”

আদ্রিতা নেমে পড়লো। বললো,“আমি কিন্তু ওগুলো নিবো।”

ফারিশ মৃদু হেসে বললো,“আচ্ছা।”
আদ্রিতা চলে গেল। ফারিশও আর না দাঁড়িয়ে গাড়ি স্ট্যার্ট দিলো।’
—-
আদ্রিতা হসপিটালে ঢুকতেই তার আদিবকে নজরে পড়লো। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে বাহিরে বের হয়েছে। আদ্রিতা কৌতুহলী এগিয়ে গেল আদিবের দিকে। বললো,“ভাইয়া আপনি এখানে?”

আদিব খানিকটা চমকে উঠলো। মৃদু হেসে জবাব দিলো,
“তুমি এসে পড়েছো?”
“জি। তা আপনি এখানে কি করছেন?”
“তেমন কিছু না।”
“আপনার কি গালে ব্যাথা?”

সঙ্গে সঙ্গে গাল থেকে হাত সরালো আদিব। বললো,“না। এক বন্ধু এই হসপিটালে ভর্তি তাকেই দেখতে এসেছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা।”

আদিব হন হন করে চলে গেল। ঘাবড়ে ছিল একটু। আদ্রিতাও বেশি না ভেবে ছুটে গেল ভিতরে।”
—-
রাত প্রায় বারোটা ছাড়িয়ে। আদ্রিতা তার কাজ সেরে হসপিটাল থেকে বের হলো। সোহেলকে বললো,“গাড়ি নিয়ে আসতে।”

সোহেল সঙ্গে সঙ্গেই এলো। তবে মাথা নিচু করে। আদ্রিতা বিস্মিত নজরে তাকালো সোহেলের দিকে। তার হাবভাব দেখে বললো,“কি হয়েছে?”

সোহেলের কাঁদো কাঁদো মুখ। বিস্ময়কর চেহারা নিয়ে বললো,“ম্যাডাম কে যেন গাড়ির হাওয়া বের করে দিছে।”

আদ্রিতা হতভম্ব স্বরে বললো,“কি বলো এসব?”
সোহেল মাথা নিচু করেই বললো,“মিথ্যা বলছি না ম্যাডাম আপনি গিয়া দেখেন।”

আদ্রিতা গেল। সত্যি সত্যি তার গাড়িটার সামনের এক চাকার পাম নেই। আদ্রিতা বিরক্ত হলো খুব। ক্লান্ত লাগছে প্রচুর। আদ্রিতা নিরাশ সরে বললো,
“গাড়িটা ঠিক করে নিও।”
“আচ্ছা ম্যাডাম। আমি কি একটা গাড়ি নিয়ে আসবো আপনার জন্য?”
“দরকার নেই আমি পারবো।”

আদ্রিতা বেরিয়ে গেল। আদ্রিতা হসপিটাল থেকে বের হতেই দূর থেকে একটা গাড়িও বের হলো। পিছু নিলো আদ্রিতার কতদূর এগিয়েই সোজা আদ্রিতার সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো। বললো,“আপনার চুড়িগুলো কি নিবেন না ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতা তড়িৎ চমকে উঠলো। এতরাতে ফারিশকে আশা করে নি। ফারিশ গাড়ির দরজা খুললো। বললো,“ভিতরে আসা হোক।”

আদ্রিতা নিরদ্বিধায় গাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো। দরজা আঁটকে সিটব্লেট লাগালো। বললো,“আপনি কখন এলেন?”

ফারিশের দ্রুত জবাব,“গেছিলাম কখন।”
আদ্রিতা অবাক হলো। বিস্মিত নজরে তাকালো। বললো,“আপনি তখন যান নি?”

ফারিশের দ্বিধাহীন উত্তর,“আপনার চুড়িগুলো যেতে দিল কই।”

ফারিশ গাড়ির পিছন থেকে হাজি সমেত চুড়ি আদ্রিতার হাতে দিলো। বললো,“নিন যত্নে রাখবেন। মাঝে মধ্যে পড়বেন। রিনিকঝিনিক শব্দ করে আমাকে মাতাল বানাবেন। ঠিক আছে।”

ফারিশের শেষ কথায় হাসলো আদ্রিতা। বললো,
“আপনি একটা বিশাল আজব মানুষ।”
“সত্যি কি আজব মানুষ আমার কিন্তু মনে হয় না।”
“আপনার সাথে কথায় জেতা মুশকিল।”
“হারতেও তো নারাজ।”

আদ্রিতা এবার চুপ হয়ে গেল। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। ফারিশ প্রশ্ন করলো,
“খেয়েছেন?”
“না বাসায় গিয়ে খাবো।”
“আমার সাথে খাবেন।”
“মা অপেক্ষা করছে।”
“আচ্ছা তাহলে অন্য আরেকদিন।”
“ঠিক আছে।”
“আপনায় একটা কথা বলবো?”
“জি বলুন,

ফারিশ সময় নিলো এক সেকেন্ড, দু’সেকেন্ড, এক মিনিট চলে তাও কিছু বললো না। আদ্রিতা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,“কি হলো বলুন?”

এবার তড়িৎ উত্তর ফারিশের
“আজ থাক। অন্য আরেকদিন।”

আদ্রিতাও আর জোর করলো না। ফারিশ গাড়ি নিয়ে এসে সোজা থামালো আদ্রিতাদের বাড়ির সামনে। আদ্রিতা একঝলক বাড়িটার দিকে তাকিয়ে। ফারিশের দিকে এগোলো। ফারিশ চমকে উঠলো। প্রশ্ন করলো,“কি করছেন?”

আদ্রিতার হাঁসি পেল। ছেলেটা কি ভয় পাচ্ছে। আদ্রিতা ফারিশের কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বললো,“বিকেলের উত্তরটা এখন দিলে আপনি কি খুব রাগ করবেন মিস্টার বখাটে?”

ফারিশ কিছু বলে না। আদ্রিতা শীতল স্বরে আওড়ায়,
“আমি আপনিহীনা কোনো পুরুষকে গভীর ভাবে কখনোই ছুঁই নি।”

আদ্রিতা কথাটা বলেই জড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল। ফারিশ ঠায় বসে। তার কথাটা বুঝতে তিন সেকেন্ডের মতো সময় লাগলো। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে মুচকি হাঁসলো। নিদারুণ সুখময় কণ্ঠ নিয়ে বললো,“এ বুকের হাজারো যন্ত্রণার ভিড়ে আপনি এক শ্রেষ্ঠ অনুভূতি ডাক্তার ম্যাডাম।”

#চলবে…..

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৭

নিকষ কালো অন্ধকারে ঘেরা চারপাশ। শীতের আমেজে ভরপুর রাত্রিটা। ফারিশ আনমনা একা একা ড্রাইভ করছে। হৃদয়ের অনুভূতি দারুণ। ফুড়ফুড়ে মেজাজ। হঠাৎই সেই মেজাজে তার সামনে হাজির হলো কিশোর। হাতের ইশারায় গাড়ি থামাতে বললো ফারিশকে। ফারিশ থামালো। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বললো,“আরে অফিসার সাহেব যে,

কিশোরের গায়ে পুলিশ ইউনিফর্ম নেই। কিশোর বললো,“আমাকে কি একটু লিফট দেয়া যায়। আসলে আমার গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে।”

ফারিশ কিশোরের থেকে একটু দূরে থাকা কিশোরের গাড়িটা দেখলো। বেশি না ভেবেই বললো,“আসুন।”

কিশোর ঢুকে বসলো গাড়িতে। কিশোর বসতেই ফারিশ গাড়ি স্ট্যার্ট দিলো। কিশোর প্রশ্ন করলো,
“এত রাতে কোথা থেকে ফিরছেন?”

ফারিশের সোজা জবাব,“বউকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসলাম।”

ফারিশের কথায় কিশোর হাসলো। বললো,
“মজা করছেন?”
“এত রাতে আমি আপনার সাথে মজা করবো অফিসার সাহেব।”

কিশোর কিছুটা দ্বিধায় পড়লো। খানিকটা দ্বন্দ্ব নিয়ে বললো,
“কিন্তু আমি যতদূর জানি আপনি বিয়ে করেন নি। তাহলে?”
“ঠিকই জানেন। আমি সত্যি মজা করছিলাম।”

কিশোর থতমত খেল। নিজেকে সামলে শুঁকনো হাসলো। বললো,
“আপনি আসলেই একটা কনফিউশানে ঘেরা মানুষ।”
“আপনি যা মনে করেন। আমাকে একেক মানুষ একেক কিছু মনে করে। কেউ ভাই, কেউ মাফিয়া, কেউ বখাটে, কেউ ঔষধ কোম্পানির মালিক আরো কত কিছু কে জানে কিন্তু আসলে যে আমি কি তা কেউই জানে না।”
“তবে কি আপনি শিকার করছেন আপনি এগুলোর একটাও নন।”
“তা কখন বলেছি। ক্লিয়ার করে বলছি শুনুন আমি হলাম ফারিশ মাহমুদ। একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক।”

কিশোর নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
“তবে আমি কিন্তু জানি আপনি একজন মাফিয়া। তাও দেশ বিরোধী মাফিয়া।”

ফারিশের মুখচুখ স্বাভাবিক। সে মটেও ঘাবড়ালো না। উল্টো শান্ত করেই জবাব দিলো,“আপনি যা মনে করেন। আপনার মনে করায় তো আমি মানুষটা বদলাচ্ছি না।”

কিশোর চুপ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর আবার বললো,“আপনি কি জানেন আপনার পাওয়া সেই ট্রেকে মেয়েমানুষ ছিল যাদের কি না বাংলাদেশ থেকে ব্যাংককে পাচার করার কথা ছিল।”

ফারিশ এবারও শান্ত। দ্বিধাহীন উত্তর,“সত্যি কি মেয়েমানুষ ছিল আমি তো জানতাম না।”

ফারিশের গা ছাড়া ভাবটা একদমই সহ্য হচ্ছে না কিশোরের। তবুও নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। সফলও হলো। এবার ফারিশ প্রশ্ন করলো,“আচ্ছা আমার ট্রেকে যে মেয়েমানুষ ছিল তা আপনি কি করে জানলেন?”

কিশোর নড়েচড়ে উঠলো। বললো,
“জেনেছি কোনো একভাবে। আপনাকে জানাতে চাচ্ছি না।”
“যাক ভালো। চেষ্টা চালিয়ে যান। তবে একটা সত্যি কথা বলি। ফারিশ মেয়েমানুষ নিয়ে কিছু করে না। এই তথ্য আপনাকে যারা দিচ্ছে ভূয়া দিচ্ছে। হয়তো অন্যকেউ কাজটা করে আমাকে ফাঁসাচ্ছে। তাই শুধু শুধু আমার পিছনে পড়ে না থেকে সঠিক মানুষ খুঁজুন। আমি জানি গত পনের দিনে ঢাকার দশটা ভার্সিটির পনেরজন ছাত্রী নিখোঁজ। আপনি হয়তো এই বিষয়টায় আমার হাত আছে ভেবে আমার পিছনে পড়ে আছেন। পড়ে থাকুন আমার সমস্যা নেই। কারণ আমি যা করি না তাতে ধরা পড়ার মতো আমার বিন্দুমাত্র ভয় নেই। তাই এখনো সময় আছে আসল মানুষকে খুঁজুন। নয়তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। আপনার ওপর প্রেশার বাড়বে অফিসার সাহেব।”

কিশোর বিনিময়ে আর কিছু বললো না পুরো চুপ হয়ে বসে রইলো। ফারিশের শেষের কথাগুলো তার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। ছেলেটি কি সত্যিই, সত্য কথা বলছে। কিশোর বুঝতে পারছে না।’
—-
সূর্যের কিরণে ঝলমল করছে আদ্রিতার কক্ষ। গায়ে কম্বল জড়িয়ে আদ্রিতা ঘুমে বিভোর। আজ বৃহস্পতিবার। হাসপাতাল থেকে হাপ বেলার ছুটি নেয়া হয়েছে। এই ছুটিটা নেয়ার পিছনে একটা বিশাল কারণ আছে। কারণটা হলো মৃদুলের পাত্রী দেখতে যাওয়া। বেশ ঘটা করেই আজ মৃদুলকে নিয়ে পাত্রী পক্ষ দেখতে যাওয়া হবে। আদ্রিতারাও সঙ্গে যাবে। আদ্রিতার ফোন বাজলো। ঘুমটা ভেঙে গেল আচমকা। আদ্রিতা ফোনটা সাঁতরে নিয়ে ঘুমো ঘুমো কণ্ঠে বললো,“হ্যালো।”

অপরপাশের মানুষটি কিছু বললো না। আদ্রিতার চট করেই ঘুমটা চলে গেল। সে ফোনটা দেখলো আননোন নাম্বার। আদ্রিতা পুনরায় ফোনটা কানে নিয়ে বললো,
“কে বলছেন?”

এবার উত্তর আসলো,
“নাম না বললে কি কথা বলা যাবে না।”

তড়িৎ বুকটা কেঁপে উঠলো আদ্রিতার। বিস্ময়কর কণ্ঠে বললো,“মিস্টার বখাটে।”

ফারিশ চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো এবার। বললো,“আপনায় কতবার বলবো আমি বখাটে নই।”

আদ্রিতা মৃদু হেসে বললো,“জানি তো।”
ফারিশ তার ড্রয়িংরুমের সিঙ্গেল সোফায় বসলো। মৃদু হাসলো। বললো,
“একটা কথা বলবো ডাক্তার ম্যাডাম?”
“জি বলুন।”

সময় গড়ালো এক সেকেন্ড, দু’সেকেন্ড, চার সেকেন্ড ফারিশ কিছু বলছে না। আদ্রিতা দ্বিধায় পড়ে বললো,“আজও কি বলবেন না?”

ফারিশ বেশ আদুরে স্বরে বললো,
“কথাটা বললে কি কথাটা আপনি রাখবেন?”
“কথাটা রাখার মতো হলে আমি নিশ্চয়ই রাখবো।”

ফারিশ তাও দোনামনা করলো। ভিতর থেকে কথাটা বের করতে পারছে না। ফারিশ অনেকটা যুদ্ধ করে আবদার নিয়ে বললো,“আমাদের যতবার দেখা হবে ততবার কি আপনি আমায় রোজ দশ মিনিট করে জড়িয়ে ধরে রাখতে পারবেন ডাক্তার ম্যাডাম।”

ফারিশের কথা শুনে আদ্রিতার কেমন অনুভূতি হওয়া উচিত সে বুঝচ্ছে না। আদ্রিতার কথা আঁটকে গেল। নিশ্বাস হলো ভাড়ি। ফারিশ বললো,“কি হলো?”

আদ্রিতা জোরে নিশ্বাস ফেলে বললো,
“যদি না রাখি।”
“আমি কি আপনায় জোর করতে পারি।”

আদ্রিতা হেঁসে ফেলে কিছু বলে না। ফারিশও আর কিছু বললো না। অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,“চলুন বিয়ে করে ফেলি।”

তড়িৎ চমকে উঠলো আদ্রিতা। হেঁসে হেঁসে বললো,“জোর খাটানোর ধান্দা।”

উচ্চ স্বরে হাসে ফারিশ। হাসির শব্দ মোবাইল থেকে আদ্রিতার কানেও গিয়ে বিঁধে। ফারিশ মাথা চুলকে বলে,“কিছুটা।”

আদ্রিতা মিষ্টি হেঁসে বলে,
“আপনি একটা পাগল।”

ফারিশ সিঙ্গেল সোফায় তার মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,
“জানি তো।”

আবারও হাসলো আদ্রিতা। ফারিশ ফিস ফিস করে বললো,“আমাকে পাগল বানানোর অভিযোগে আমার বুকের মধ্যিখানে এক নিস্তব্ধ জেলখানায় আপনার শাস্তি হোক।”

আদ্রিতা কি বলবে বুঝছে না। সে চুপ করে রইলো।’
—-
পাত্রপক্ষ বেসে পাত্রীর বাড়িতে বসে আছে মৃদুল,আশরাফ,মুনমুন, চাঁদনী,আদ্রিতা আর রনি। মৃদুল খুব নার্ভাস। কিভাবে কি বলবে বুঝছে না। পাত্রী হলো মৃদুলের বাবার বন্ধুর মেয়ে। বেশ আসা যাওয়া মৃদুলের বাবার এখানে। তার মেয়ে পছন্দ। শুধু মৃদুল পছন্দ করলেই হয়ে যাবে বিয়েটা। মেয়ে একজন পুলিশ। মৃদুল বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,“দোস্তরা আমার কি খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে। দুই একখান অশুদ্ধ কইলে সমস্যা আছে।”

মৃদুলের প্রশ্নে সবাই হেঁসে ফেলে। আদ্রিতা বলে,
“তোর যেমন ইচ্ছে তেমনই কথা বলবি।”
“আমার খুব নার্ভাস লাগছে মেয়েটা আমায় পছন্দ করবে তো।”
“এত প্যারা নিচ্ছিস কেন আমি আছি তো(রনি)

মৃদুল চোখ কুঁচকে বললো,“তুই আছিস মানে রনি ভুইলা যাস না মুন এইখানে আছে।”

রনি তাকালো মুনমুনের দিকে। মুনমুন চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চাঁদনী উঠে এগিয়ে গেল বাড়ির দরজার দিকে কারো আসার নাম গন্ধ নেই। অদ্ভুত তো ব্যাপারটা। আশরাফ চাঁদনীর কান্ডে মৃদুস্বরে বললো,“চাঁদ এদিকে আয়।”

চাঁদনী গেল। আশরাফের পাশে চুপটি করে বসলো। বললো, “ওনারা কেউ আসছে না কেন? পাত্রীর মা সেই কখন বলে গেল মেয়ে আসছে। কই এখনো দেখি না ক্যান?”

এমন সময় হাতে ট্রে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো এক বুড়ি মহিলা। গায়ে জড়ানো লাল ঢুকঢুকে শাড়ি, মাথায় সাদা চুল,চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কোমড় নুইয়ে হাতে ট্রে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে আসছে বুড়িটি। মৃদুল তাকে দেখেই শক্ত করে চেপে ধরলো আশরাফের হাত। থমথমে কণ্ঠে বললো,“দোস্ত এ আবার নীলিমা না তো।”

আশরাফ নিজেকে যথেষ্ট ধাতস্থ করে বললো,“না এই মেয়ে নীলিমা হবে কেন এ নিশ্চয়ই পাত্রীর দাদি-টাদি হবে।’

বুড়ি মহিলাটি এক হাত ঘোমটা টেনে লাজুক ভঙ্গিতে সামনের চেয়ারে বসলো। আদুরে স্বরে বললো,“কি কইবেন কন আমিই নীলিমা।”

সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবাই থতমত খেল। মৃদুল বললো,“আমনে নীলিমা।”

বুড়িটির লাজুক কণ্ঠস্বর,“জে আমি নীলিমা। আমনের আব্বার বন্ধুর মাইয়া।”

সঙ্গে সঙ্গে কুপকাত মৃদুল। কারণ সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে বিছানায়। উপস্থিতি সবাই মৃদুলের কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেল।’

#চলবে….

#TanjiL_Mim♥️