Wednesday, July 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1528



পুতুল বিয়ে পর্ব-০১

1

#এক_আপুর_জীবন_কাহিনী_নিয়ে_লিখা_গল্প-
‘#পুতুল_বিয়ে
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে যখন দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে যাবো ঠিক তখন দেখি আমার স্বামী মিতুল কারোর সাথে ফোনে রোমান্টিক ভাবে কথা বলছে, এবং কথা বলার এক পর্যায়ে চুমুও খেয়েছে।
বিষয়টা দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল।সারাটা দিন খাটুনি খেটে এলাম আমি।ওর গায়ে কাজ কর্ম সয়না।এক বাপের এক ছেলে।জীবনেও পরিশ্রম করে অভ্যেস নাই।তাই তার কষ্টের কথা ভেবে আমিই সারাদিন খাটি।অফিস করেও দুটো টিউশনি করাই।আর সে কি না বাসায় বসে বসে এসব করে!
আমি যে অত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবো মিতুল বুঝতে পারেনি হয়তোবা। হঠাৎ আমি গলা খাঁকারি দিতেই ফোন কেটে দিয়ে ব্যাস্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সে বললো,’রাফি,অত সকালে ফিরলে যে?’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে খানিক নুইয়ে পড়ে পা থেকে জুতোর বেল্ট খুলতে খুলতে বললাম,’কেন? বিরক্ত করেছি বোধহয়!’
মিতুল এবার রাগ দেখায়।চোখ লাল লাল করে বলে,’তোমার সাথে থাকাটাই উচিৎ হচ্ছে না।সব ছেড়ে ছুড়ে তোমায় নিয়ে পালিয়ে এলাম। তোমার জন্য শুধু এই ঘরে বন্দী জীবন কাটাচ্ছি।অথচ বাড়িতে আমি ছিলাম রাজপুত্র।যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাম। ভুল করেছি।তোমায় ভালোবেসে পালিয়ে এসে ভুল করেছি।’
মিতুলের রাগ এবং অভিমানী গলার কথা শুনে আমার কেমন কষ্ট হয়। খানিক আগেও যে নিজের চোখে দেখেছি ও ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে তা হঠাৎ কেন জানি আমার কাছে ভুল দেখা মনে হয়!ওর চুমু খাওয়াকেও ভুল মনে হয়!আমি তখন মনকে বোঝ দেই।বলি, আমার মতো গরীব ঘরের একটা মেয়ের সাথে যে সে থাকছে,আমায় যে সে ভালোবাসে এটাই তো আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।আমি কেন শুধু শুধু ওকে সন্দেহ করছি!
জুতো খুলে ব্যাগ গুছিয়ে রেখে আমি এসে বসি মিতুলের পাশে। মিতুল দূরে সড়ে যেতে চায়।আমি তার হাত খপ করে ধরে ফেলি।ও আমার দিকে রাগী রাগী চোখে তাকায়। কিন্তু ওর রাগ মুহূর্তে আমি ভাঙিয়ে ফেলি।হুট করে ওর জামার কলার খামচে ধরে ওর গালে চুমু বসিয়ে দেই। মিতুল তখন আর রাগ ধরে রাখতে পারে না।সেও আমায় জড়িয়ে ধরে। পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,’তুমি আমায় রাগিয়ে দাও কেন বলতো?’
আমি ওর বুকের ভেতর আমার মাথা গুঁজে দিতে দিতে বলি,’তোমায় রাগতে দেখলে সুন্দর লাগে যে এইজন্য!’
কথাটা বলে ফিক করে হেসে উঠি আমি।
মিতুল তখন হাসে না।সে চুপচাপ বসে থাকে। বসে বসে কী যেন ভাবতে থাকে শুধু!
চিন্তিত ওকে দেখে আমার বুকের ভেতর যন্ত্রণা শুরু হয়। আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না ওর জন্য আমার অত মায়া হয় কেন? ভালোবাসার মানুষের প্রতি কী এমন দরদ সব সময় থাকে?

সে রাতে আমি মিতুলের কাছাকাছি যেতে চাই। কিন্তু মিতুল কাছে আসে না।বলে, শরীর ভালো না। খারাপ লাগছে। সকাল সকাল ঘুমোতে হবে।
আমি অস্থির হয়ে বলি,’কী হয়েছে তোমার? আগে বলোনি কেন?ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম!’
মিতুল তখন বলে,’আরে তেমন কিছু না।ঘুম পাচ্ছে।লাইট নিভিয়ে দাও।চোখ কেমন জ্বলছে।’
আমি ব্যাস্ত হয়ে দ্রুত লাইট নিভিয়ে দেই। তারপর মিতুলের পাশে এসে শুয়ে পড়ি।
একটু পরই মিতুলের নাক ডাকার আওয়াজ পাই।ওর এই এক বদ অভ্যাস। ঘুমিয়ে গেলে নাক ডাকে।ঘরঘর শব্দ হয়। কিন্তু আমার ওর এই নাক ডাকাটাই ভীষণ ভালো লাগে। ইচ্ছে করে ওর বুকে মাথা রেখে ওর এই নাক ডাকা শুনি সারারাত ভর। কিন্তু রাতভর আমার আর নাক ডাকা শুনা হয় না। সারাদিন খাটা খাটুনির পর শরীর ক্লান্ত হয়ে আসে।ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠে।আজও এমন হলো। কখন ঘুমিয়ে গেলাম টেরও পেলাম না।

ঘুম ভাঙলো যখন তখন রাত তিনটা। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে।গরম পড়ছে খুব। শরীর ঘামছে। এই জন্যই ঘুম ভেঙ্গে গেছে।ঘুম ভাঙার পর ডান পাশে হাত রাখলাম মিতুল ঘামছে কি না দেখার জন্য। কিন্তু মিতুলের জায়গাটা শূন্য দেখে চমকে উঠলাম আমি। বুকটা কেমন কেঁপেও উঠলো একবার। ভাবলাম, হয়তোবা গরমের জন্য বাইরে গেলো কি না!আমি বিছানা হাতড়ে মোবাইল বের করে লাইট জ্বালাতেই দেখি দরজা খোলা।মিতুলকে দেখা যাচ্ছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।তার কানে ফোন ধরা।কারোর সাথে কথা বলছে।কী মনে করে যেন লাইটটা নিভিয়ে ফেললাম আমি। তারপর ছোট ছোট পা ফেলে দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম।এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে মিতুলের গলা। মিতুল বলছে,’বিশ্বাস করো,আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।’
ও পাশ থেকে কে কী বলছে তা তো আর আমি জানি না।
মিতুলের কথাগুলো শুধু আমি শুনতে পাচ্ছি।মিতুল এবার বলছে,’কথা দিলাম আমি তোমায় বিয়ে করবো। ওকে নিয়ে তুমি ভয় করো না। এইসব পালানো বিয়ে টিয়ে অত শক্ত হয় না।ধরে নাও এটা একটা পুতুল বিয়ে।সময় হলে ঠিক দেখবে আমি তোমার কাছে চলে এসেছি।’
মিতুল এসব কী বলছে?ওর কথাগুলো শুনে আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে এসব ভুল শুনছি আমি।
কিন্তু না সব সত্যি। মিতুল এবার চুমু খাচ্ছে। তারপর বলছে,’শুনো, তুমি আমায় নিয়ে ভয় পেও না।ওর সাথে এখন আমার কোন ফিজিক্যাল রিলেশনও নাই!আমরা দুজন দু বিছানায় থাকি। ওকে ছেড়ে আসতে একটু সময় লাগবে শুধু। তুমি কিছুদিন ওয়েট করো লক্ষ্মীটি।প্লিজ প্লিজ প্লিজ!’
আর সহ্য হচ্ছে না আমার। কিন্তু আমাকে এখনও চুপ থাকতে হবে। গরীবের ঘরে জন্ম আমার। ছোট বেলা থেকেই অনেক কিছুতেই চুপ করে থাকতে হয়েছে। শুধু গলা দেখাতাম মায়ের সাথে।গরীব অসহায় মা আমার বলতো, ওইসব বড় লোকেদের সাথে গরীবদের কোন সম্পর্ক হয় নারে মা।এরা শুধু শরীর চায়।আর কিছু না!
মার কথা আমি শুনিনি। কাউকে না জানিয়েই পালিয়েছি। সেদিন ভেবেছিলাম পালিয়ে আমি জিতে গেছি! কিন্তু এখন? এখন মনে হচ্ছে আমি আটকে গিয়েছি! ভয়ংকর একটা খাদে আমি আটকে গিয়েছি।এখান থেকে আর কিছুতেই বেরুতে পারবো না!

মিতুলের কথা প্রায় শেষ।বোঝায় যাচ্ছে এখন ফোন রেখে দিবে। তারপর এসে শুয়ে পড়বে বিছানায়।আমি তাড়াহুড়ো করে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম ও পাশ ফিরে। এখন আমার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতে তো আর পারবো না।কান্নাকে লুকিয়ে রেখে আমার ঘুমের বাহানা করতে হবে।যেন ও এসে দেখেই বোঝে আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।এতে ওর তৃপ্তি হবে। শান্তির একটা ঘুম হবে।আমি তো ওর শান্তিই চাই।শান্তি না চাইলে কী অতকিছু হজম করতে পারতাম!

মিতুল অতটা চালাক আমি জানতাম না।ও ঘরে এসে অন্ধকারেই আমায় ডাকলো,’রাফি?’
আমি চুপ করে রইলাম। ঘুমের বাহানা করেছি। এখন তো কিছুতেই কথা বলা যাবে না।নড়াচড়াও করা যাবে না।
মিতুল আবার ডাকলো।বললো,’ঘুমের ভাব করতে হবে না।আমি জানি তুমি জেগে আছো। এতোক্ষণ তুমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলে।আমি সব দেখেছি।’
মিতুলের মুখ থেকে এইসব কিছু শুনে আমি বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলাম!এই মিতুল কী সেই মিতুল তবে!আমি তো ভাবতাম এই ছেলে জগতের সবচেয়ে বড় বোকাদের একজন!নাকি প্রেমের বেলায় সব ছেলেরাই এমন বোকা সাজার চেষ্টা করে তার প্রেমিকার কাছে!
মিতুলের কথায় আমি বিছানা থেকে উঠলাম না।মিতুল এবার বললো,’থাক উঠতে হবে না। কিন্তু শুনো,সত্যিটা শোনা তোমার প্রয়োজন।আমি আরেকটা মেয়ের সাথে কথা বলি।ওর সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক। সবকিছু জানার পর যদি তুমি আমার সাথে থাকতে রাজি হও তবে হ্যা বলতে পারো।রাজি না হলে কাল সকালে আমি বাড়ি চলে যাবো। তোমার কাছে জোর করে আমি থাকবো না!’
মিতুল কত সহজ করে এই কথাগুলো বলে দিয়েছে। কিন্তু ওর এই সহজ কথাগুলোই তো আমার বুকে তীরের ফলার মতো গিয়ে বিঁধছে।ব্যথায় নরম বুকটা কাতরাতে শুরু করেছে। খুব বেশিদিন হয়নি তো আমরা পালিয়ে এসেছি।বড়জোর তিন মাস।এই তিন মাসেই আমি ওর থেকে অতটা দূরে সড়ে গিয়েছি!
মিতুল এসে শুয়ে পড়েছে তার জায়গায়। গরমে কেমন হাঁসফাঁস করছে ও।আমি দ্রুত টেবিলের উপর থেকে হাতপাখা টা নামিয়ে এনে ওর গায়ে বাতাস করতে লাগলাম। মিতুল ঘুম জড়ানো গলায় শেষবারের মতো বললো,’এই তুমি চিন্তা ভাবনা করে সকাল বেলা আমায় কথাটা জানিয়ো কিন্তু!’
ওর অত অবহেলা আমার প্রতি! তবুও আমি তাকেই চাই।তার গরম লাগলে আমার কষ্ট হয়।বাতাস করি ওর গায়ে।অথচ নিজে ঘামছি। ভেতরে ভেতরে পুড়ছি। এইসব কিছুর নাম কী ভালোবাসা নাকি দহন?
আমি জানি না!
চোখের পাতায় জল নামে।কান্নায় গলা ধরে আসে।ও পাশে মিতুল নাক ডাকতে শুরু করে আবার!
ঘড় ঘড় ঘড়।কী কুৎসিত ব্যপার!
তবুও ওর নাকের ডাকটাই আমার অত ভালো লাগে!

#চলবে

অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

0

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১৭তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

বিরাজের কথা শুনে আমি আমার মুখ চেপে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। ইয়াজ আমার পাশেই ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলো, এটা শুনে সে সেও হাঁ হয়ে গেলো। ভাইয়া এগিয়ে এসে বিরাজকে বললো,
___বিরাজ এসব কি বলছো? উনি তোমার আম্মু, তুমি তো আম্মুই ডাকবে।

আমার মা আর ইথিলা ভাবী ইব্রিয়ার সাথে কথা বলছিলো, এবার উনারা এদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন, ভাবী সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
___কি হয়েছে?

ভাইয়া ভাবীকে বললো,
___বিরাজ বলছে ওর মা একজনই। সে বিন্দিয়াকে আম্মু ডাকবেনা।

এটা শুনে ভাবী এগিয়ে এসে বিরাজকে ধমক দিলো, আর বললো,
___বিরাজ তুমি ভুলে গেছো উনি তোমার আম্মু। ছোটবেলায়ও আম্মু ডাকতে। এখনো ডাকতে হবে। যদি উনাকে ফুফি ডাকো তাহলে আমাকেও ফুফি ডাকবে। মনে রেখো!

অভিমান নিয়ে ভাবী মুখ ফিরিয়ে নিলেন। বিরাজ কিছু ভেবে ভাবীর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
___ আচ্ছা আম্মু ডাকবো, কিন্তু মা ইরাজকে আমার ভালো লাগে না।

এটা শুনে আমরা অবাক হয়ে ওর তাকিয়ে আছি। ভাবী আবার বললো,
___কেন ভালো লাগে না ইরাজকে? সে তো তোমার ভাই! তোমাকে অনেক ভালোবাসে।

বিরাজ মুখ বাঁকা করে বললো,
___সে আমার মতো দেখতে হয়েছে কেন? ওর মা-বাবা আলাদা, আমার মা-বাবা আলাদা, সেখানে সে আমার মতোই হতে হবে কেন? আমি আমার মতো কাউকে দেখতে চাইনা। ওকে দূরে দূরে থাকতে বলো।

ভাবী কি বলবে বুঝতে পারছেনা। ওর গালে হাত রেখে বললো ,
___আল্লাহ বানিয়েছেন দুজনকে একরকম। এক রকম থাকলে তো ভালো। তুমি দেখতে কেমন সেটা আয়নাতে দেখতে হবে না, ইরাজকে দেখলেই বুঝে যাবে। আর ইরাজের বাবা আর আমি ভাইবোন ছিলাম না? আমরাও তো একরকম হয়েছি, কই আমরা তো ঝগড়া করিনি, মিলেমিশে থেকেছি এতো বছর!

বিরাজ ঠোঁট বাঁকাচ্ছে। তারপরই কিছু ভেবে বলে উঠে,
___তোমরা তো ছিলে আপন ভাইবোন। কিন্তু সে তো..

ভাবী বিরাজকে থামিয়ে দিলেন। বললেন,
___এসব বলোনা বাবা। চলো আমরা বাসায় যাই।

বলেই ওরা হাঁটছে, বিরাজ ইব্রিয়ার আঙুল ধরে এগুচ্ছে। আর ইরাজ পেছনে পেছনে। আর আমি এবং ইয়াজ দাঁড়িয়ে আছি। ইয়াজ আমাকে টানতেছে, কিন্তু আমি সামনে যেতে পারছিনা। ইয়াজ আমার দিকে তাকিয়ে ধির কণ্ঠে বললো ,
___বিরাজ এখনো কিছু বুঝেনা বিন্দিয়া। জানিনা সে এইরকম কেন হলো? সব ঠিক হয়ে যাবে, প্লিজ মন খারাপ করো না। আমি বুঝতে পারছি তোমার কতটা কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কি করবো বলো? সে তো ছোট বেলা থেকেই এমন! প্লিজ চলো এখন..

আমি ইয়াজের সাথে সামনে হাঁটছি, কিন্তু ভেতরটা কেন জানি ফেটে যাচ্ছে। ইয়াজ আমার কাঁধে হাত রেখে বারবার শান্ত করার চেষ্টা করছে।

বাড়িতে পৌঁছেই আমি শুয়ে পড়লাম।
অনেক্ষণ পরে ইব্রিয়া রুমে আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে বললো,
___মা জার্নি করে খারাপ লাগছে? মাথায় হাত বুলিয়ে দেই?

আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে বললাম,
___দাও মা।

ইব্রিয়া আমার পাশে শুয়ে হাত বুলাচ্ছে। তখনি বিরাজ হাতে একটা ফোন নিয়ে দরজা সামনে থেকে ডাকলো,
___ইব্রু আসো, তোমাকে একটা মজার গেইম দেখাই।

ইব্রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___ মা যাই? বিরাজ ভাইয়া ডাকে।

আমি কিছু বলতে যাবো তখন ইরাজ আসলো, দরজায় বিরাজকে দেখে বললো,
___বিরাজ আমাকেও দেখাও না?

বিরাজ মুখ ত্যাড়া করে বললো,
___তোমাকে না, ইব্রুকে দেখাবো।

ইব্রিয়াকে আমি যেতে বললাম। ইরাজ মন খারাপ করে এসে আমার পাশে বসলো। ওকে মন খারাপ দেখে আমিও উঠে বসলাম। ওর মাথায় হাত রেখে বললাম,
___মন খারাপ করো না বাবা। সে একদিন ঠিকি তোমায় ভীষণ ভালোবাসবে!

ইরাজ অভিমান নিয়ে বললো,
___তুমি মিথ্যে বলো মা, সে এখনো তো অনেক বড় হয়েছে তবুও আমাকে একটু ভালোবাসেনা।

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখি ইব্রিয়া আর বিরাজ আমার রুমের দিকে আবার আসছে। কাছে এসেই বিরাজ আমার কাছে বসে বললো,
___ইব্রু এখনি বললো তুমি অসুস্থ। কি হয়েছে তোমার?

বলেই আমার কপালে হাত রাখলো। আমি ওর হাতটা আমার ডান হাত দিয়ে ধরে আমার গালে স্পর্শ করালাম। ওর কপাল ছুঁয়ে আসা চুলগুলো পেছনে নিয়ে বললাম,
___কিছু হয়নি বাবা। আমি একদম ঠিক আছি!

বিরাজ তখন একটু তাড়ার সাথে বললো,
___তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। তুমি হাসিখুশি থেকো সবসময়, হ্যাঁ? এখন যাই।

আমি কৃত্রিম একটা হাসি দিলাম । বিরাজ ইব্রিয়ার হাত ধরে বের হয়ে গেলো। এদিকে সে যাওয়ার পরেই আমি ইরাজকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম । কিছুক্ষণের মধ্যে একটু শান্ত হওয়ার পরেই ইরাজ বললো,
___মা তুমি কাঁদো কেন? বিরাজ আমার সাথে ভালো করে কথা বলেনা বলে? বিশ্বাস করো আমার একদম মন খারাপ হয়না। তুমি সত্যি বলো, সে এখনো বুঝেনা, বড় হলে আমায় খুব ভালোবাসবে, তাইনা মা?

আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম,
___হ্যাঁ সোনা, তোমায় খুব ভালোবাসবে। তোমরা মিলেমিশে একসাথে থাকবে।

বিরাজ ইব্রিয়ার সাথে খুব মিশে। ইব্রিয়াও ভীষন খুশি। শুধু ইরাজ মন খারাপ করে থাকে। ভাবী আশেপাশে থাকলে বিরাজ আমাকে আম্মু বলে ডাকে। কিন্তু যতটা সম্ভব না ডেকে কথা বলার চেষ্টা করে। এগুলো কেন জানি সহ্য করতে পারতাম না।
তবে বুঝতাম সে এখন বুঝে সবার একটা মা হয়, তাই দুইজনকে মা ডাকতে তার অন্য রকম লাগে।

কিন্তু আমার নিজের চেয়েও আমি ইরাজের কষ্টটা বেশি অনূভব করি। এখন শুধু একটাই ইচ্ছে, ওরা মিলেমিশে থাকতো যদি! কিন্তু সেটা বোধহয় পূরণ হবে না। দেখতে দেখতে ওদের চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এর মধ্যে ইরাজ তার বাবা ইয়াজের জন্য ভীষণ পাগল পাগল হয়ে গেছে। সে বলে বাবাকে আর ইব্রিয়াকে নিয়ে চলে যাবে। আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে তোমাকেও নিবো। কিন্তু ওর মুখে ইরাজের কথা একদম আসেনা।

ওরা যেদিন চলে যাবে তার আগেরদিন ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছিলো। ইরাজ আর আমি একসাথে, আর বিরাজ ইব্রিয়া আর ভাবী একসাথে। ভাবী কিছুক্ষণ পরেই আমার মা’য়ের কিছু লাগবে তাই চলে গেছে।
এদিকে ইরাজের ঘুড়ির উচ্চতা বিরাজের চেয়েও বেশি ছিলো। এটা দেখে বিরাজ রেগে যাচ্ছিলো। সে বেশি উড়াতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলো, এর মধ্যে ঘুড়ির সুতো কেটে গেলো। এটা গিয়ে পড়লো অন্য বাসার ছাদে।
এখন বিরাজ কাঁদো কাঁদো চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে। ইরাজ এটা দেখে বললো,
___আসো আমরা নিয়ে আসি। মা তুমি আমারটা ধরো একটু, বিরাজের ঘুড়ি খুঁজে নিয়ে আসছি এখনি।

ওরা দুইজন একসাথে গেলো। এটা দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছিলো। যাক শেষ পর্যন্ত দুজন তো একটু মিলেছে।
ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু আসছিলোনা।কিছুক্ষণ পরে নিচ থেকে ডাক আসলো ইরাজ ব্যথা পেয়েছে। আমি সুতো ছেড়ে এক দৌঁড়ে নিচে গেলাম।
গিয়ে দেখি ইরাজের পায়ে কিছুর আঘাত পড়েছে, চামড়া কষে গেছে, রক্ত বেড়ুচ্ছে। আমি তারাতাড়ি করে প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা করলাম। ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে আমি বিরাজের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___ তোমরা দুজন একসাথে গিয়েছিলে না? ও কি করে ব্যথা পেলো?

বিরাজ ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেছে। ভাবীও বিরাজকে জিজ্ঞাসা করছে কিন্তু সে কিছু বলছেনা। কিন্তু ইরাজ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___মা আসলে ঘুড়িটা ওই নতুন বাসার ছাদে পড়েছে, ওদের বাসার ছাদে অনেকগুলো ইট রাখা। এর একদম ভেতরে চিকন ফাঁকা অংশে গিয়ে পড়েছে। বিরাজ নিচু হয়ে সেটা আনতে গিয়েছিলো৷ আমি দেখলাম ও সেটাতে টান দেওয়ার পরে উপরের ইটগুলো পড়ে যাচ্ছে, সেটা বিরাজের মাথায় পড়তো, আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে পারলেও নিজের একটা পা সরাতে পারিনি, তারপর আমার পায়ে দুটো ইট পড়েছে। বাকিগুলো একপাশে পড়েছে। বলো বিরাজের মাথায় পড়লে ওর কতো বড় ক্ষতি হতো!

ইরাজের কথা শুনে আমি কেঁদে ফেললাম। ওর এই কথা শুনে ওকে নিয়ে যেন আমার গর্ব হচ্ছে। খুশিতে আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। মনে মনে এটা ভাবলাম আমার এক ছেলেই আমার সব অপূর্ণতাকে সারিয়ে দিবে।

আমার কাছ থেকে ভাবী ইয়াজকে টেনে বুকে নিলেন। কেঁদে কেঁদে বললেন,
___ তুমি ঠিক ইয়াজের মতো হয়েছো, ইয়াজও আমার উপর একটা টুকা আসতে দিতোনা। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা ছিল ভালোবাসার, ভালোবাসা থেকে এসবকিছুই সম্ভব। অথচ তুমি আর বিরাজের সম্পর্কটা অন্তত খারাপ, তুমি একা ওকে ভালোবাসো, সে তোমাকে কতো ঘৃণা করে, তাও তুমি তার কথা ভাবো, নিজের ক্ষতি করে ওকে রক্ষা করো। এতো ভালো কেন তুমি? বিরাজও কেন তোমার মতো হলোনা?

বিরাজ চুপ করে সব শুনছে। ভাবী ইরাজকে ছেড়ে বিরাজকে টেনে বললেন,
___বিরাজ এতদিন শুধু এটাই ভাবতাম তুমি হয়তো কখনো বদলাবে, একদিন তোমার ভাইয়ের জন্য ঠিকি তোমার মনে ভালোবাসা আসবে, তোমরা একসাথে খেলবে, অনেক গল্প করবে। কিন্তু এসব কি? তোমার ভাই এতো বড় ব্যথা পেয়েছে, সেটাও তোমাকে অক্ষত রাখতে, আর তুমি কিনা একবারও ওর মাথায় হাত রেখে একটু অনুশোচনা করো নি!
কেন ভালোবাসো না তোমার ভাইকে?

এটা শুনে বিরাজ ওখান থেকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসলো। ইরাজের কাঁধে কাঁধ রেখে বললো,
___তোমার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করবোনা ইরাজ। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।

ইরাজ খুশিতে বিরাজকে জড়িয়ে ধরলো।
সেদিন প্রথমবার আমি ইরাজকে এতটা খুশি দেখেছি। ইরাজ খুশিতে কেঁদেই দিয়েছে। সেদিন থেকে পরেরদিন ওরা খুব ভালোভাবে মিলেমিশে থেকেছে। রাতে দুজন একসাথে থেকেছে। কিন্তু সন্ধ্যায় ছিল ইরাজদের চলে যাওয়ার ফ্লাইট।
তার জন্য বিরাজ ইরাজ দুজনেরই মন খারাপ।
বিরাজ বারবার বলছে,
___আগে কেন বুঝিনি আমি! ইরাজ তুমি আমায় ক্ষমা করেছো তো?

ইরাজের যেন কিছু মনেই নেই। সে তার একটু ভালোবাসায় সব ভুলে গেছে।
আমরা সবাই-ই খুশি মনে তাদের বিদায় দিলাম। আমার মাও আবার তাদের সাথে চলে গেছে।


এবার যাওয়ার পরে বিরাজ ইরাজের সাথে প্রতিদিন কথা বলে। পড়ালেখার ব্যপারেও বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করে। আর প্রতিদিন আমাদেরকে, ইব্রিয়াকে না দেখে বিরাজ ঘুমাতেই যায়না।
খুব সুন্দর করে আমাকে আম্মু আম্মু বলে ডাকে।
বছর পর বছর বিরাজের ভালো রেজাল্ট শুনে অন্য রকম তৃপ্তি অনূভব করতাম। ইরাজও ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু ইব্রিয়া পড়ালেখায় একদম মন দেয়না। ইয়াজ বলে ইব্রিয়া ভাবীর মতো হয়েছে, ভাবীও এমন অমনোযোগী ছিল।


এদিকে ভাবী বলে বিরাজ আমাদের সবার সাথে এখন ভালো করে কথা বললেও সবার সাথে সহজে মিশেনা। সে ভালো ছাত্র, সবাই-ই ইচ্ছে করে ওর সাথে মিশতে আসে কিন্তু সে কথা বলে না। এটা আসলে ওর মধ্যে একটা দূর্বলতা। আবার অল্প কিছুতে রেগেও যায়, মারামারিও করে। এরকম অসংখ্যবার করে এবং করছে। অনেকবার পুলিশে ঝামেলায়ও পড়েছে। তাই ভাবী বিরাজকে নিয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকেন।

এটা নিয়ে ইয়াজকে কিছু বললেই ওর মুখ লাল হয়ে যায়, সে বলে… মনে ইরাজের রাগটাও ভুল করে সে একাই পেয়ে বসেছে। তাই বিরাজ অতিরিক্ত রাগী একগুঁয়ে হয়ে উঠছে।

এদিকে ওদের আবার ৫ বছর পরে ওদের আসার কথা ছিল। কিন্তু সেসময় বিরাজের ছুটি থাকলেও ভাইয়ার কাজের চাপ ছিল। তারপর তাদের কলেজে ভর্তি, ভালো ইউনিভার্সিটির প্রিপারেশন আসাকে থামিয়ে দিলো। দুই বছর পরে আবারও আসার কথা ছিল কিন্তু সেটা হলোনা আমার মায়ের শরীর খারাপের জন্য।
দেখতে দেখতে ওরা অনেক বড় হয়ে গেলো। ইব্রিয়াও এখন কলেজে পড়ে, ইরাজের পড়ালেখা শেষ পর্যায়ে।
আমার ভাইয়া ইতোমধ্যে অনেকগুলো ব্যবসা বাণিজ্যে নিজের বিস্তার করে নিয়েছেন। দেশেও কয়েকটা বিজনেস চালু করেছেন, আর এসবের দেখভাল করার দায়িত্ব ইয়াজকে দিয়েছেন।
একটা বিরাট ফ্ল্যাটও কিনেছেন, যেটাতে আমরা বর্তমানে অবস্থান করছি।
ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার একেবারে দেশে চলে আসবেন। আর বিরাজ চাইলে বিদেশে থাকবে নয়তো ওর ইচ্ছেতে দেশেই থাকবে, এবং বাবার সাথে ব্যবসার দেখাশোনা করবে। ইরাজ এটাতেই রাজী ছিল। সে বললো, সে আর ইরাজ একসাথে কাজ করবে। দেশেই থাকবে এখন থেকে।

এটা আমাদের সবার জন্য ছিল অনেক ভালো আর খুশির সংবাদ। ইরাজ তো আসার কথা শুনেই বললো,
___এবার আসলে বিরাজকে একদম বদলে ফেলবো, সবার সাথে কি করে মিশতে হয় শেখাবো।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে পূর্ণতার হাসি ছুড়তাম। আমার বিশ্বাস হতো ইরাজ এটা পারবে।

কিছুদিনের মধ্যেই ওরা সবাই আসলো। বিরাজ পড়ালেখার পাশাপাশি টুকটাক কাজ করে নিজের রোজগারে আমার জন্য হাতের বালা আনলো, ওর বাবার জন্য দামী পোশাক আনলো, ইব্রিয়া আর ইরাজের জন্য ফোন আনলো। আর দি’মণির জন্য কানের ঝুমকা আনলো। আর ওর দা’ভাইয়ের জন্য কিছু খুঁজে না পেয়ে পাঞ্জাবীর জন্য কাপড় নিয়ে চলে আসলো।
মিলেমিশে আমার একটা সুন্দর পরিবার এখন।

কিছুদিন পর থেকে ওরা দুজন একসাথেই এক গাড়ীতে অফিসে যায়।
আর ইয়াজ আর ভাইয়া এক গাড়ী নিয়ে যায়।
ভাইয়া ওদের জন্য আলাদা করে একটা গাড়ী নিয়েছেন।
ওরা একসাথে অফিসে গেলে সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে থাকে। কারণ দুজনেই একরকম। আবার পোশাকও একরকম পরে যায়। তবে চুলের দিকে তাকিয়ে মানুষ তফাৎ বুঝে, বিরাজের চুল লম্বা আর ইরাজের চুল ছোট।

কিছুদিন যাওয়ার পরে ইরাজ এসে আমাকে বললো,

____মা বিরাজকে না বললে সে কারো সাথে কথা বলেনা। এমনিতে জরুরী কিছু বলার হলেও বলে না। কিন্তু কেউ কাজে ভুল করলে আবার ভীষণ ধমকায়। কেউ কেউ ইরাজ মনে করে কিছু বলতে আসলেও বিরাজ রেগে যায়।

আমি বললাম,
___তুমি জানো সে কতটা বদমেজাজি, এতো সহজে ঠিক হবে না। ধৈর্য্য ধরো একদিন বিরাজ সব বুঝবে।

ইরাজ আমার কথা শুনে আশাবাদী হয়। সেও বিশ্বাস করে বিরাজ বদলে যাবে।

চলে গেলো আরো কিছুদিন।

শীতের রাত,
অন্যসময় বিরাজ আর ইরাজ সন্ধ্যায় ফিরে আসে। কিন্তু সেদিন রাত বারোটা বেজে গেছে তারা ফিরেনি।
ভাইয়া আর ইয়াজ বললো, তারা সন্ধ্যায়ই বাসার উদ্দেশ্যে চলে আসছে।
ফোন করেও পাচ্ছিলাম না। ভাবী আর আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছি। দুজন সারারাত বসে রইলাম। ঘরের কেউ-ই ঘুমায়নি।
অপেক্ষা করতে করতে ফজরের দিকে কলিং বেল বাজলো।
সবাই একসাথে দরজার দিকে দৌঁড় দিলো। দরজা খোলেই দেখি বিরাজের মাথায় ব্যান্ডেজ। ইরাজের হাতে পায়েও ব্যথার দাগ দেখা যাচ্ছে। আজকে প্রথমবার ইরাজ ছাড়া বিরাজকে ব্যথা পেতে দেখেছি। ইরাজের চোখেমুখে ভীষণ ক্লান্তি। কিন্তু বিরাজ এই অবস্থাতেও ভীষণ উত্তেজিত চেহেরায় আছে। ঘরে ঢুকে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললো,
___কেন আমাদের থেকে এতদিন সত্যটা লুকানো হলো?

সবার চেহেরা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেলো। কারোই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা বিরাজের প্রশ্নটা কি!

এবার ইরাজ বললো,
___মা তুমি কেন বলোনি আমরা দুই ভাই এক বাবা-মার সন্তান। আমরা জমজ!

ভাবী মাথায় হাত রেখে বসে পড়েছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। বিরাজ বললো,
___ বলো কে আমাদের আসল মা-বাবা? আমরা কি করে বুঝবো এটা? আমার মা আর বাবার মতো দেখতে আমি, ইরাজও ওর বাবা আর মা’র মতো দেখতে। কিন্তু ডক্টরের পরিক্ষায় আমরা একই মায়ের জমজ সন্তান! কেন আসলো এটা? কেন লুকালে এই সত্য তোমরা?

আমি কথার প্রসঙ্গ বদলাতে বিরাজের মাথায় হাত রেখে বললাম,
___কি করে আঘাত পেলে বাবা?

বিরাজ রাগ কমলোনা। সে রাগের সাথেই বলতে লাগলো,
___ চাঁদার জন্য বাড়াবাড়ি করে গতকাল ঝগড়া বাঁধিয়েছিলাম। তাই ওরা রাতে ফেরার পথে আমাকে আক্রমণ করতে এসেছিলো। ইরাজ আমাকে গাড়ী থেকে বের হতে মানা করেছিলো, বলেছিল সে বিরাজ হয়ে ওদের সামনে যাবে। কিন্তু আমি দেইনি, আর কতকাল সে আমার জন্য নিজে কষ্ট নিবে, সে আঘাত পাবে? কিন্তু সে আমার কথা শুনেনি। পুলিশের গাড়ী তৎক্ষনাৎ আসায় আমাদের তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু তোমরা এখন বলো আমাদের মধ্যে কেন এই মায়া? আর আমিই কেন ছোট থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ওর সাথে খারাপ আচরণ করেছি? কেন তখন বুঝতে পারিনি সব?

সবাই চুপ করে আছে। কেউ কথা বলছেনা। কিন্তু ইরাজ বিরাজ সত্যটা জানতে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবী বসা থেকে ধির কণ্ঠে বললো,
___আমার জন্য বিরাজ।

বিরাজ চুপ হয়ে গেলো। ভাবী থেমে বলতে লাগলো,
___আজীবনের জন্য নিজের দাবী করার মতো একটা সন্তানের জন্য। হ্যাঁ তুমি আর ইরাজ জমজ ভাই। তোমরা ইয়াজ বিন্দিয়ার সন্তান। আমি হলাম তার মধ্যে এক অভাগী, সন্তানলোভী। সন্তানের কাতরতায় মা হওয়ার ইচ্ছে পোষেছিলাম। কোথাও থেকে একটা বাচ্চা নিয়ে আসলে আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম না সে আমার সন্তান! মিল অমিলের পার্থক্যে ঠিকি একদিন বুঝে যেতো। কিন্তু তোমাদেরকে দেখে আমি একজনের মা হওয়ার আকুলতায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আর একটা বাচ্চাকে ছোট থেকে যে সবচেয়ে কাছাকাছি রাখে সে তাকেই বেশি ভালোবাসে, এমনটা বিরাজ তোমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। তুমি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে শুরু করেছিলে, এতটাই ভালোবাসতে যে নিজের মা’কেও এতটা ভালোবাসতে না। আমি তোমাকে কখনো বলিনি তোমার ভাইয়ের সাথে খারাপ আচরণ করো, সেগুলো তুমি নিজে থেকে করতে, কিন্তু আমি তোমায় কোনো শাসন করতাম না। মায়ের সব সন্তান এক রকম হয়না। তুমি ছোট বেলা থেকেই ভীষণ বদরাগী, ইরাজকে পছন্দ করোনা। কিন্তু আমি চাইলেই সেটা পরিবর্তন করতে পারতাম, তোমাকে বুঝাতে পারতাম। কিন্তু বুঝাইনি কেন জানো? আমার মনে হতো তোমরা দুজনকে দুজন ভালোবাসলে আমি কখনোই তোমাকে আমার করে পাবোনা। তোমরা আলাদা হবেনা। আমার মনে হতো আল্লাহ মনে হয় তোমাকে আমার করে দেওয়ার জন্যই তোমার মধ্যে এমন রাগ দিয়েছেন। কিন্তু সেবার দেশে আসার পরে ইরাজের কষ্টগুলো আমাকে দাগ দিয়েছিল, আমি তোমাকে বলেছিলাম ওর সাথে মিশতে, ওকে ভালোবাসতে। তুমি আমার কথা শুনেছিলে। আমার মনে হয়েছিলো এবার আর সমস্যা নাই, আমার যে ভুল ছিল আমি শোধরে নিয়েছি। আমার সন্তান এখন আর কোথাও যাবেনা, সে আজীবন দুই পরিবারকে ভালোবেসেই আমাকে মায়ের অধিকার দিবে। কিন্তু ভাবতে পারিনি এখনো এমন দিন আসতে পারে, যখন তুমি বুঝবে তুমি আলাদা কোনো মায়ের সন্তান নও। আর এটাও ভুলে গিয়েছিলাম আমি আজীবন পূর্ণতার জন্য অপূর্ণ হয়েও এমন অভিলাষ করে আসছি। এসব বেশিদিন টিকবে না।

বলেই ভাবী কাঁদতে শুরু করে দিলো।
আমি আর ইয়াজ ভাবীর পাশে বসলাম। ইয়াজ কিছু বলার আগেই আমি বললাম,
___কেন এসব বলছো? তুমি কোনো ভুল করো নি। তুমি তো আর ওকে এসব করতে শিখিয়ে দাওনি, শুধু এইটুকুই চেয়েছিলে সে তোমাকে মায়ের সম্পূর্ণ অধিকার দিক, সে দিবেও। বিরাজ মা’কে বলো তুমি সারাজীবন উনার সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিবে!

বিরাজও নিচে বসে গেলো। প্রথম আমার মাথায় একটা হাত রাখলো এরপর ভাবীর মাথায় আরেকটা হাত রাখলো। কান্নাভেজা চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো,
___মা আমি তোমাকে অপূর্ণ করতে এসব বলিনি, শুধু জানতে চেয়েছি আমরা কার সন্তান? এই যে আমার দুটো হাত, দুই মায়ের মাথায় একসাথে রাখতে পারছি। বিশ্বাস করো আজীবন আমি এভাবেই রাখবো। তোমাদের দুজনের পদতলেই আমি আমার সুখ খুঁজে নিবো। আর আমি তো ভীষণ সুখী, আমার দুইটা মা! দুইটা বাবা! যারা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে। আমার কিছু হলে আমার দুই মা-বাবা আমার জন্য কাঁদবে।
মা শুনো, আজ থেকে তোমার তিন সন্তান। ইরাজ ইব্রিয়াও তোমার সন্তান। কে বলে তুমি অপূর্ণ? তুমি তো পৃথিবীর সবচেয়ে পরিপূর্ণ মা । তাইনা বাবা?

ইয়াজ আর ভাইয়া মুচকি হাসলো। ইরাজ ইব্রিয়াও এসে আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মা, শ্বশুর শাশুড়ীও হাসছে। ভাবীও বিরাজ আর ইরাজ আর ইব্রিয়ার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে আদর করছে।
বলছে আর যেন এমন পাগলামো না করে। সবার সাথে যেন মিশে। বিরাজও কথা দেয় সে সব শুনবে।

হ্যাঁ উনি আজ পরিপূর্ণ। তবুও তো কখনো কখনো উনার মনে হবে উনার বিরাজ জানে সে তার পেটে ধরা সন্তান নয়, কিন্তু হৃদয় উজাড় করে এক পৃথিবী ভালোবেসেছে ঠিকি। তখন সব পরিপূর্ণতার মধ্যেও হয়তো উনি নিজেকে কিছুক্ষণের জন্যও অপূর্ণ ভাব্বেন। তবে নিজেকে শান্ত করবেন এই ভেবে যে সেগুলো অপূর্ণ হলেও আজ অভিলাষেরা ঠিকি সার্থকতার দুয়ারে দাঁড়িয়ে হাসছে! আর উনিও হাসছেন একজন মা হতে পেরে!

(সমাপ্ত)

অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-১৫+১৬

0

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১৫ এবং ১৬ তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

___যে এমনি অপূর্ণ তার এসব অভিলাষ করার কি মানে বলো?

ইথিলা ভাবীর এই কথা শুনে ইয়াজ থমকে গেলো। ধিরে ধিরে দু পা এগিয়ে বললো,
___ ইথিলা এভাবে বলো না! আমি নিশ্চয়ই পারবো! আমার কলিজার বোনের জন্য আমার এক সন্তান দিতে পারবো, আমার বোন খুশি থাকলেই আমার জগৎ আলোকিত মনে হয়! আর বিন্দিয়াও পারবে। দূরে কোথাও তো যাবেনা, ওর নিজের ভাই আর আমার বোনের কাছেই তো। মানুষ সবসময় যা চায় তাই কি কর‍তে পারে বলো? জীবনের কতো স্বপ্নই তো আমাদের অপূর্ণতায় ঘিরে থাকে। তবে সেটাতে যদি কারো পূর্ণতা আসে সেটা তো কষ্ট পেলেও আনন্দের!

ভাবী কিছু বলতে যাবে তখনি বাদল ভাইয়া আসলো। এসে সবাইকে আবার কাঁদতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
___কি হয়েছে?

ইয়াজ সবটা খুলে বললো। আমাদের কথা শুনে ভাইয়া আগেপিছে তাকিয়ে বললো,
___আমরা সবাই এক জায়গায় থাকলে কেমন হয়?
আমার বাবা-মা, তোমার বাবা-মা, ইথিলা, বিন্দিয়া বাবুরা সবাই একসাথে!

ইয়াজ বললো,
___ আরে এইটা কেন ভাবছিলাম না এতদিন! কিন্তু আমাদের মা-বাবা থাকবে তো? আপনার অফিসের কাছাকাছি বাসা নিয়েন, আমি বাইকে করে যেতে পারবো, অসুবিধা হবেনা। বিন্দিয়া আর বাদল ভাই তোমাদের বাবা-মাকে রাজী করাও, আর আমি আর ইথিলা আমাদের মা-বাবাকে রাজী করাচ্ছি। তাহলে আর কাউকে কষ্ট পেতে হবে না।

আমি এবার হাসলাম,আর ইথিলা ভাবীও হাসলো। চোখমুখ মুছে বিরাজের গালে গাল ঘঁষলেন। ওকে নিয়ে একটু এগিয়ে ইরাজের মাথায় হাত বুলালেন!
আর বললেন,
___আমার দুই বাবার জন্য আমরা সবাই একসাথে হতে যাচ্ছি! বড়মা তোমাদের সাথেই থাকবে! আমরা সবাই একসাথে!


তারপর সবার বাবা মাকে রাজী করাতে অসুবিধা হয়নি। কারণ তারাও কাছ থেকে দেখেছে দুইদিকের কষ্টগুলো। তাই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলো আমরা একসাথে থাকবো। আর একসাথেই এক বাসায় উঠে গেলাম। সব কষ্টগুলো ভুলে এখন আমরা ভীষণ খুশি!


দেখতে দেখতে ১ বছর চলে গেলো। দিন ভালোভাবেই এগুচ্ছে, তবে বিরাজ আমার কাছে ঘুমায় না। এমনকি আমি ওকে খাওয়াতেও পারিনা। ওর বড়মা ওর সব করতে হবে। এমনকি ভাবী গোসল করছে এসময় ওর ঘুম ভেঙেছে সে কান্না করে উঠে ওর বড়মাকে যতক্ষণ না পাবে কাঁদতেই থাকবে।
কিন্তু ইরাজ দুজনের কাছেই থাকে, তবে ওর বড়মার কাছে তেমন যেতে পারেনা। কারণ বিরাজ একাই ওর বড়মার কোল জুড়ে বসে থাকে,ইরাজকে নিলে বিরাজ চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়।
বিরাজের খেলনাতেও ইরাজ ছুঁতে পারেনা, কিন্তু ইরাজের খেলনা বিরাজ নিয়ে খেলে।

আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি বিরাজের রাগ ইরাজের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি। সে ভীষণ একগুঁয়ে আর জেদি। ইরাজকে এখনি সে মারে, একসাথে খেলতে বসলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সে ওর বড়মা ছাড়া কারো কথা শুনেনা! উনি যদি বলে কান্না করো না, সে কান্না করে না। উনি যদি বলে খাও, সে খায়! উনি যদি বলে বসো, সে চুপ করে বসে থাকে।
উনার কোল থেকে ভুলেও আমার কোলে আসেনা।
কোলে নেওয়ার হলে কিছু একটার লোভ দেখিয়ে তারপর নিতে হয়।

ওদের দুজনকে আলাদা করে চেনা যায় শুধু চুল দেখে, ভাবী বিরাজের চূল তেমন ছোট করে না, কিন্তু আমি ইরাজের চুল কেটে ছোট করে ফেলি।
ওদের স্বাস্থ্য, বেড়ে উঠা একরকমই ছিল। কিন্তু ইরাজ শান্ত চেহেরায় থাকে আর বিরাজ রাগী চেহেরায়! বিরাজ ওর বাবার সাথে ঘুরাঘুরি করলেও আমার কাছে বেশিক্ষণ থাকতে চায়না। ওর বড়মা ওর সব!

চলে গেলো আরো কয়েকমাস।
আস্তে আস্তে ওদের মুখে কথা ফুটতে শুরু করেছে, বিরাজ ভাবীকে শুধু মা বলে ডাকে, আমাকে আম্মু বলে। আর ইরাজ আমাকে মা বলে, আর ভাবীকে বড়মা বলে। তবে দুজনেই বাদল ভাইয়া আর ইয়াজকে বাবা বলে ডাকে। এটা নিয়ে মাঝে মাঝে জটিলতা তৈরি হয়, কখন কাকে বাবা ডাকলো, ওদের কণ্ঠস্বরও একরকম!

এদিকে আমার স্বামী আমাদের বাবা মাকে দাভাই আর দিমণি ডাক শেখাচ্ছে। নানা কিংবা দাদাতে কোনো পার্থক্য করে ডাক শেখাতে চাচ্ছেনা কেউই! তবে কাকে কখন ডাকছে সেটা বুঝতে ছোট দা’ভাই বড় দা’ভাই, ছোট দি’মণি,বড় দি’মণি বলে বলে শেখাচ্ছে। আমার শ্বশুর শাশুড়ীকে বড় বলে সম্বোধন করে, আমার মা-বাবাকে ছোট বলে সম্বোধন করে। এমনিতেও আমার শ্বশুর শাশুড়ী আমার বাবা মা থেকে বয়সে বড়। ইয়াজ আর ভাবীর জন্ম উনাদের বিয়ের অনেক বছর পরে হয়েছিলো।

দিনগুলো ভীষণ সুন্দর চলে যাচ্ছিলো।
বিরাজ আর ইরাজ এক বছরেই হাঁটতে শিখেছে। এখন চারদিকে ছুটাছুটি করতে পারে। বল দিয়ে খেলতে পারে! মাঝে মাঝে দুজন একসাথে খেলে আবার কোনো কিছুতে না মিললেই বিরাজ ইরাজকে মারতে শুরু করে। ইরাজ প্রথম কাঁদে না, এরপর আবার মারলেও ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে চায় তাও কাঁদেনা, এরপর আবার মারলে কেঁদে ফেলে। তাই ভাবী বিরাজকে সাথে সাথে রাখেন, আমিও ইরাজকে দেখে রাখি।
.
.
তাদের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে চারমাস হলো। প্রায় সব কথা দুজনে বলা শিখে গেছে। তবে অস্পষ্ট! তাদের মধ্যে কে বড় সেটা আজও জানা হয়নি। আমরাও জানতে চাইনি। তবে এক-দুই মিনিটের ব্যবধান আছে যেটা পরবর্তীতে ডক্টর নিজেই বলতে পারেনি কে দুনিয়ায় আগে আসছিলো! উনিও তাদেরকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন।
কিন্তু আমার মন বলে ইরাজ বড়, ওর মধ্যে এমন গুণ দেখতে পাই, এখন থেকেই অদ্ভুত দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন।
বিরাজকে নিজে থেকে মারেও না, উল্টো নিজে মার খেয়েও সেটা প্রথম হজম করার চেষ্টা করে। আবার নিজে নিজেই ওর সাথে মিলে যায়।


একদিন বিভিন্ন তরকারির বাজার পাঠালো ভাইয়া, সেগুলো একজন এসে দিয়ে গেলো, আসার পরে সেগুলো গুছাতে আমি দরজা বন্ধ না করেই রান্নাঘরে চলে গেলাম। এদিকে মা এসে দরজা খোলা দেখে বন্ধ করে দিলো। কিছুক্ষণ পরে কলিংবেল বাজলো। দরজা খোলে দেখি পাশের বাসার মালিক ইরাজকে সাথে নিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। ইরাজ কাঁদতেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
___ইরাজ বাইরে কখন গেলো? সে কাঁদছে কেন?

উনি রেগেমেগে বললেন,
___ও কি করেছে জানেন? জানালার গ্রিলে দাঁড়িয়ে বল দিয়ে ঢিল মেরেছে,সেটা আমার জানালা দিয়ে ভেতরে গিয়ে আমার বাচ্চার মাথায় পড়েছে। দুটো বাসা তো পাশাপাশি, মাত্র দুইহাতের ব্যবধান। বুঝতে পারছেন বিষয়টা? আঘাতটা কতো গুরুতর হবে!

আমি ইরাজকে কোলে নিয়ে বললাম,
___ইরাজ মোটেও এটা করবেনা। ইরাজ বল ছুড়তে পারেনা।

উনি আবার বললেন,
___আরে ভাবী আমি নিজে দেখেছি।

আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি ভাবী আসছে বিরাজকে কোলে নিয়ে। লোকটা একটু অবাক হয়ে বললো,
___ও না, ওই ছেলেটা মনে হয়। নীল গেঞ্জি, আর বেগুনি গেঞ্জিতে বুঝতে পারিনি। ওই ছেলেটা ঢিল দিয়েছে। এইটুকু বাচ্চা হলে কি হবে এসব ঠিকি পারে!

তারপর ইরাজের গালে হাত রেখে উনি বললেন,
___তোমাকে বকা দিয়েছি সরি বাবু। আর শুনেন ভাবী বাচ্চা দেখে রাখবেন। এখনি যে পরিমাণে দুষ্টামি করে, পরে দিনে একটা মামলা আসবে।

বলেই উনি চলে গেলো। ভাবী বিরাজকে জিজ্ঞাসা করলো,
___বাবা তুমি কি ঢিল ছুড়েছো?

বিরাজ কিছু না বুঝার মতো করে উল্টো প্রশ্ন করলো,
___কী মা?

ইরাজ আমার কোল থেকে বললো,
___বম্মা ও ছুলেতে, তাপর বলেতে টুমি বলতা কুদে নিয়ে আতো। আমি দাওয়াল পলে ওই আঙ্কেল আমায় বকেতে। ( বড়মা ও ছুড়েছে, তারপর বলেছে তুমি বলটা খুঁজে নিয়ে আসো। আমি যাওয়ার পরে ওই আঙ্কেল আমায় বকেছে)

আমি বিরাজের দিকে তাকিয়ে রাগ করে বললাম,
__বিরাজ বেশি দুষ্টামী করো কিন্তু। বল ছুড়েছো আমাদেরকে না বলে ইরাজকে কেন বললে?

বিরাজ রেগে গিয়ে জোরে বললো,
___ ও তাহলে আমাল সাথে বল ছুলাছুলি খেলে কেন? তাই আমি ওই বাসায় দিল মেলেছি।
(ও তাহলে আমার সাথে বল ছুড়াছুড়ি খেলেনি কেন? তাই আমি ওই বাসায় ঢিল মেরেছি)

ইরাজ আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
___ মা আমাল ভয় নাগে, বল ছুললে এটা দিয়ে যদি কিতু ভেঙে দায়! (মা আমার ভয় লাগে, বল ছুড়লে এটা গিয়ে যদি কিছু ভেঙে যায়)

আমি ইরাজের মাথায় হাত রেখে বিরাজের দিকে তাকালাম। সে ভাবীর কোলে অভিমানে মুখ গুঁজে রেখেছে। ভাবী আমাকে ইশারা করলো আর কিছু না বলতে, এরপর আবার রাগে খাবার খাবেনা।
আমি মুচকি হেসে এখান থেকে ইরাজকে নিয়ে চলে গেলাম।

শুধু এটা না, বিরাজ সবকিছুর দোষ ইরাজকে দিয়ে দেয় এমনও হয়। এরপর ওরে অনেক মারে। ইরাজ ঝগড়া পছন্দ করে না কিন্তু বিরাজ ইচ্ছে করে ঝগড়া বাঁধায়।

ওদের তিন বছর পেরিয়ে তখন চার বছরের কাছাকাছি। এখন স্পষ্ট করে কথা বলে দুজন।
আমরা দুজনকেই কাছাকাছি একটা মাদ্রাসায় আরবী শিখতে দিয়েছি। দুজনকে আমি আর ভাবী বোরকা পরে দিয়ে আসি, আবার নিয়ে আসি। মাদ্রাসার পেছন থেকেই আমরা তাদের আনানেওয়া করতাম। কারণ জোহরের পরে ওরা পড়তো, আর তখন ওদের বাবা অফিসে থাকে।

সেদিন বিরাজ পেট ব্যথার বাহানা করে মাদ্রাসায় গেলোনা। ইরাজ একা গিয়েছে। আমি ওকে একা আনতে গেলাম। যাওয়ার পরে ওকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি আস্তে আস্তে একটু ভেতরে যেতেই আমাকে একটা বাচ্চা বললো,
___বিরাজকে একটা ছেলে মেরেছে। সে ভেতরে।

ছেলেটার কথা বুঝলাম না, মনে হয় সেও বুঝেনি এটা বিরাজ নয়, ইরাজ।

আমি তারাহুরো করে গেলাম। আমাকে দেখে সেখানকার হুজুর পাশের রুমে চলে গেলেন। আমি ইরাজকে কোলে তুলে জিজ্ঞাসা করলাম,
___কে মারলো তোমায়, আর কেন?

পাশের রুম থেকে সেই হুজুর বললো,
___বিরাজ কাল আশ্রাফকে মেরেছিলো নাকি, তাই আজকে সে ওর সঙ্গী নিয়ে ওকে মেরেছে। আমি ওদেরকে পড়া দিয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম, এর মধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেছে।

আমি হুজুরকে বললাম,
___ ও তো ইরাজ। বিরাজ আজ আসেনি।

সেখান থেকে হুজুর চমকের সাথে জবাব দিলেন,
___ইরাজের টুপি তো সাদা ছিল, আজকে বিরাজের মতো বাদামী রঙের কেন?

আমি বললাম,
___ইরাজের টুপি বিরাজ নিয়ে গেছে। তাই ইরাজ ওরটা এনেছে। আশ্রাফকে আপনি কিছু বলেননি? সে বিরাজকে নিয়ে বিচার না দিয়ে নিজে মারলো কেন?

হুজুর থমথমে গলায় বললো,
___ইরাজ বিচার দেয়নি এতক্ষণ। মেরেছে এই কথাও বলেনি। পড়া বলতে পারেনি আজ, ভেবেছি এইজন্য মন খারাপ। কিন্তু সবাই চলে যাওয়ার পরে দেখি সে বসে কাঁদতেছে,জিজ্ঞাসা করার পরে এই কথা জানালো। এখন আশ্রাফকে তো আর পাবোনা, আগামীকাল আসলে আশ্রাফ এবং বিরাজ, দুজনকে বুঝিয়ে বলবো। ওদের মা’কেও বলবো। ওরা ছোট তো, কি যে করে বসে!

আমি বললাম,
___আচ্ছা ঠিকাছে।

বলেই আমি ইরাজকে নিয়ে বের হয়ে আসলাম।

চলবে….

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১৬তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

বাসায় এসেই আমি বিরাজকে হাঁক ছেড়ে ডাকতে লাগলাম। ভাবী ওর আঙুল ধরে রুম থেকে বের হয়ে বললো,
___কি হয়েছে বিন্দিয়া?

আমি ইরাজকে দেখিয়ে বললাম,
___দেখো বিরাজ কাল এক ছেলেকে মেরে আজকে পেট ব্যথার বাহানায় বাসায় বসে আছে, এদিকে ওরা ইরাজকে বিরাজ ভেবে মেরেছে।

ভাবী তারাতাড়ি করে আমার কাছে এসে ইরাজকে কোলে নিলো। দেখলো সত্যিই ওর গালে, গলায় খামচির দাগ, স্কেল দিয়েও মেরেছে, পিঠেও লাল দাগ পড়েছে। ভাবী বিরাজকে ধমক দিয়ে বললো,
___বিরাজ এটা ইচ্ছে করে করেছো? আজ এই জন্যই যাওনি? তারপর আবার টুপি বদলে দিয়েছো, কেন করেছো বিরাজ? ও তোমার ভাই না? ও ব্যথা পেলে তোমার খারাপ লাগেনা?

বিরাজ আস্তে আস্তে বললো,
___মা আর হবে না।

ভাবী আবার ধমক দিয়ে বললো,
___আশ্রাফকে কেন মেরেছিলে?

বিরাজ রাগী চোখে এবার তাকিয়ে বললো,
___ আশ্রাফ বলছিল ওর মা ওকে বলেছে, তুমি নাকি আমার আসল মা না। তাই ওকে মেরেছি, আবার বললে আবার মারবো।

বিরাজের কথা শুনে এবার আমার মাথা ঘুরে গেলো। ওর মা না বলাতে এতো রেগে গেছে, অথচ আশ্রাফ মিথ্যেও বলেনি। এদিকে ভাবী এই কথা শুনে ইরাজকে কোল থেকে নামিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে বিরাজকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেললো, ওর গালে কপালে চুমু খেয়ে বললো,
___কে বলে তুমি আমার সন্তান না। আর আমি তোমার আসল মা না? ওরা কিচ্ছু জানেনা।
ওরা এসব বললে তুমি মা’কে এসে জানাবে, মা ওদেরকে বকা দিবো, কিন্তু মেরোনা কাউকে বাবা। পঁচারা মারধর করে, তুমি তো আমার লক্ষী সোনা। কাউকে আর মেরোনা প্লিজ।

বিরাজ ফিক করে হেসে ভাবীর গালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো, আর বললো,
___আচ্ছা আর মারবোনা। তুমিও আমার লক্ষী মা!

আমি ইরাজকে নিয়ে রুমে গেলাম। দাগগুলোতে মলম লাগিয়ে দিলাম
তারপর খাইয়ে দিয়ে ওকে ঘুম পাড়ানোর জন্য শুলাম। শুতেই ইরাজ আমার গলা জড়িয়ে বলতে লাগলো,
___ মা বিরাজ আমার মতো দেখতে কেন? জানো আমি মাদ্রাসায় এমন আর কাউকে দেখিনি। শুধু আমরা দুজন এক রকম। অনেকে আমাদেরকে এইজন্য দেখতে আসে। আর আমিও আয়নার সামনে গেলে মাঝে মাঝে মনে করি এটা বিরাজ। সে আমার মতো হয়েও আমার সাথে মিলে না কেন? সবসময় ঝগড়া করে, আমি ওর সাথে মিশতে চাই খুব। কিন্তু সে একদম মিশেনা।

আমি ইরাজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
___বিরাজ তোমার ভাই যে তাই তোমরা একরকম। দেখোনা তোমার বাবা আর বড়মা একরকম, তাই তোমরাও একরকম। আর সে বুঝেনা, বোকা তো। বড় হলে আর ঝগড়া করবেনা, তোমার সাথে খেলবে, সুন্দর করে কথা বলবে, গলা গলা জড়িয়ে স্কুলে যাবে। তোমরা খুব ভালো বন্ধুও হয়ে যাবে।

ইরাজ খুশি হলো। আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে গেলো।
আমার কেন জানি বিরাজের এসবদিক ভাবাতো। সে তার ভাইয়ের সাথে মিশতে চায়না কেন?
ইথিলা ভাবী আর ইয়াজও তো জমজ ছিল, তারা দুজন ছোট বেলা থেকেই দুজনকে কতো ভালোবাসতো, আর এরা দুজন ঠিক উল্টো। অবশ্য ইরাজ মিশতে চায়, কিন্তু বিরাজ বদরাগী। জানিনা কবে ওরা মিলেমিশে থাকবে!

কিছুদিন যেতেই আমার বাবার শরীরটা আবার খারাপ হলো। ডক্টর দেখানোর পরে জানালো হার্টে সমস্যা আছে, যেকোনো সময় স্ট্রোক করার প্রবণতা বেশি। বাবাকে কেউ কোনো প্রেসার দিতোনা, উনার চাকরির জীবনে যা ছিলো! এখন উনার চিন্তা টেনশন বলতে কিছুই নেই।
তবে এখন সবাই বাবাকে সময় দেয়, হেসে গল্পগুজব করে, উনাকে ফুরফুরে মেজাজে রাখে। ইরাজ বিরাজও তাদের ছোট দা’ভাইয়ের সাথে খেলাধুলা করে, কোলে বসে গল্প শুনে। তবে ইরাজ থাকলে বিরাজ যায়না, আবার বিরাজ থাকলেও ইরাজ যায়, কিন্তু বিরাজ ইরাজকে দেখলে চলে আসে। কেন জানি বিরাজ ইরাজের সাথে কথাই বলতে চায়না।

তবে সময়গুলো ভালোই যাচ্ছিলো। ইয়াজ আর আমি ইরাজকে নিয়ে ভীষণ খুশি ছিলাম। আর ভাবী আর ভাইয়াও বিরাজকে নিয়ে পরিপূর্ণ মা বাবা।

সে-বছর আরো একটা খুশির সংবাদ আসলো, আমি আবারও মা হতে যাচ্ছি। খবরটা শুনে সবার খুশির প্রবণতা আরো বাড়লো।
এদিকে ইয়াজ মজা করে বলে, এবারও দুটো হোক।
আমি ওর কথায় হাসি! কিন্তু সবকিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি, উনি খুশি হয়ে যা দেন।


দেখতে দেখতে আবারও কেটে গেলো ৬ মাস। রিপোর্টে জানলাম এবার মেয়ে বাবু আসবে! এই সংবাদটা ছিল অতিরক্তি খুশিতে আরো খুশির মিশ্রণ। ঘরের সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে নতুন সদস্যের জন্য। বিশেষ করে বাবা বেশি, উনি ইমোশনাল হয়ে যান, বলেন জানিনা আমার ভাগ্যে নাতনির মুখ দেখা লেখা আছে কিনা।
বাবা এসব বললে বাবার প্রতি অভিমান করে বলি,
___এসব বলো না তো বাবা! ইনশাআল্লাহ দেখবে আর দোয়া করি যেন নাতজামাই দেখার মতো আয়ু আল্লাহ তোমায় দিক।

বাবা শুকনো হাসিতে আমার কথা থেকে যেন শান্তনা নেন। বাবা হয়তো বুঝেছিলেন উনি এই সময়টুকু আর পাবেন না।
একমাসের মাথায় বাবা হুট করেই স্ট্রোক করে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। জানিনা প্রতিবার খুশিগুলো দুঃখের সাথে কেন আসে!
বাবার ইচ্ছেগুলোও অপূর্ণ থেকে গেলো। সাথে অপূর্ণতা দিয়ে গেলো আমাদের, ভাইয়া আর আমি এতিম হয়ে গেলাম। মা হয়ে গেলো বিধবা!
বাবা চলে যাওয়ার পরে মা কেমন যেন হয়ে গেছে।
মায়ের শরীরেও এখন বিভিন্ন অসুখের বাসা।

এর মধ্যে আমাদের সবার হৃদয় আলো করে আসলো আমার মেয়ে! সবাই মিলে
ওর নাম দিলো ইব্রিয়া।

আমার মেয়ে আমার নতুন মা হয়ে আসলো, অথচ আমার মা হাসতে ভুলে গেলো। সারাক্ষণ বাবার জন্য মন খারাপ করেন। বলেন, নাতনির আগমনে তোর বাবা কতটা খুশি হতো, এখন উনিই নেই তাহলে আমি কি করে খুশি হবো বল?

আমার শ্বশুর শাশুড়ী, ভাবী ভাইয়া সবাই-ই এখন নতুন বাবুকে নিয়ে মেতে উঠেছে। ইয়াজ তো ভীষণ খুশি, তার এখন ছেলে মেয়ে দুটোই আছে।
এদিকে ইরাজ বিরাজ দুজনেই ওদের বোনকে ভালোবাসে, কোলে নিতে পারেনা তবুও বসে একটু একটু কোলে নেওয়ার চেষ্টা করে। ওর পাশে খেলা করে। ওরা এতদিন একসাথে না থাকলেও এবার বোনের জন্য এক জায়গায় বসে থাকে, ইব্রিয়ার দুই হাতে দুইদিকে ধরে ওরা নানারকম গল্প শুনায়। তবে সেটা শুধু ইব্রিয়ার পাশাপাশি থাকলেই, এমনিতে একটুও কথা বলেনা। ভাবী কতো করে বলে দুজন মিলেমিশে থাকতে কিন্তু সেটা ভাবী বললেই একটু মিলে, নইলে আবার আগের মতো।

ওদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। এদিকে ভাইয়ার অফিসের বস বলছে উনার সিঙ্গাপুরে একটা বিজনেস আছে ভাইয়া যেন পরিবার নিয়ে সেখানে চলে যায়। ভাইয়া উনার বিশ্বস্ত একজন লোক। তাই এইটা দেখাশোনার দায়িত্ব ভাইকেই দিতে চান। এতদিন ধরে ভাইয়া কোনো কথা বলছিলেন না। কিন্তু এবার আমার মায়ের অবস্থা খারাপ, ব্রেনে সমস্যা হয়ে গেছে। দ্রুত উন্নত চিকিৎসা দরকার।
ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিলেন মা’কে নিয়ে হলেও উনি যাবেন,আর উনাকে যেতেই হবে। কিন্তু ভাবীও যাবে,উনাকে এই অবস্থায় কি করে যেতে দিবে।
সবকিছুর মাঝেও নিজের প্রিয়জনদের একসাথে নিয়ে বেশ ভালো ছিলাম। এবার অপূর্ণতার ছায়া আবার দেখা দিলো। বিরাজকে কখনোই রাখতে পারবোনা, সে ভাবীকে ছাড়া কিছুই বুঝেনা।
তাও যেন মন মানছিলোনা। সে রাগী, বদরাগী, ঝগড়াটে তবুও তো আমার সন্তান!
তবুও মুখ ফুটে হাসতে হাসতে বলেছিলাম,,
___ভাবী বিরাজকে রেখে যাও।

ভাবী এখন আর মন খারাপ করলো না। উনিও হাসতে হাসতে বললেন,
___পারলে রেখে দাও।

ভাবী জানে বিরাজের মা হবার অধিকার ভাবীকে কবেই দিয়ে দিয়েছি। এখন শুধু সবসময় নিজের সন্তানকে চোখের সামনে দেখতে চাই।

ওরা চারজনের পাসপোর্ট করলো, বিরাজ চলে যাবে শুনে কয়েকদিন থেকেই ইরাজের মন খারাপ। কিন্তু বিরাজ খুশি ছিলো, তবে ইব্রিয়ার কাছে এসে বলে,
___তোমাকে খুব মিস করবো ইব্রু।

আমাকে ইয়াজ এবার আর কাঁদতে দিলোনা। সে আমাকে বোঝালো আমাদের সন্তান আমাদের চেয়ে তাদের কাছে ভালো থাকবে। এটাও বুঝালো ওরা তো আবার আসবে, আর আমাদের রোজ কথা হবে। মায়েরা পড়ালেখার জন্যও তো সন্তানদের অন্যত্র রাখেন, তারপর আমাদের এখন নতুন একজনও আছে। আমিও সবকিছু বুঝলাম। ভাবীর ভালো থাকার সাথে আমার সন্তানের ভালো থাকাও এখন যুক্ত হয়ে গেছে। আমি জানি বিরাজ ভীষণ ভালো থাকবে।

ওরা চলে গেলো। ইরাজ কয়দিন মন করে থাকলেও ইব্রিয়ার সাথে হেসেখেলে স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
এদিকে প্রতিদিনই ভাবীর সাথে আমাদের কথা হতো, বিরাজ নতুন জায়গায় গিয়ে ভীষণ খুশি। সেখানে স্কুলেও ভর্তি হয়ে গেছে। মা’র চিকিৎসাও ঠিকঠাক চলছে। এসব দেখে আমি আর ইয়াজ আর মন খারাপ করিনা। কিন্তু বিরাজ এতো বেশি খেলায় মগ্ন থাকে যে ফোনে কথা বলতে চায়না, মাঝে মাঝে ইব্রিয়াকে ভিডিও কলে দেখে এইটুকুই।

দেখতে দেখতে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলো। ইরাজ এখন ফাইভে পড়ে। ইরাজ পড়ালেখায় ভালো, তবে ততটাও মেধাবী না। কিন্তু বিরাজ নাকি প্রচন্ড মেধাবী, খেলার পাশাপাশি অল্প যাই পড়ে সব তার মনে থাকে, রেজাল্টও অনেক বেশি ভালো করে।
আর আমার মেয়ে ইব্রিয়া এবার ভর্তি হয়েছে। সে দেখতে প্রায় আমার মতো, সে তাদের ভাই আর বাবার মতো হয়নি।

বিরাজের পরিক্ষার পরে তারা কয়েকমাসের জন্য দেশে আসবে বলেছিলো। কারণ মা এখন পুরোপুরি সুস্থ। আমিও অপেক্ষমাণ ছিলাম কবে আসবে,আর আমার সন্তানকে এতো বছর পরে বুকে জড়িয়ে আদর করবো।
আমার সেই অপেক্ষার অবসান শীগ্রই হলো।

আমি, ইয়াজ, আমার শ্বশুর শাশুড়ী, আমার মেয়ে ইব্রিয়া এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছি তাদের জন্য।
ইরাজের এখনো মনে আছে বিরাজ কীভাবে তার সাথে ঝগড়া করতো। সে আসার পথেও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে,
___আম্মু বিরাজ আর আমার সাথে ঝগড়া করবেনা তাইনা?
আমি হেসে বলেছি,
___ হ্যাঁ এখন তো সে বড় হয়ে গেছে।

তারা কাছাকাছি আসতেই আমরা দৌঁড়ে গিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। ইরাজ বিরাজকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই সে সরে গিয়ে ইব্রিয়াকে বললো,
___কেমন আছো ইব্রু?

ইরাজের মন খারাপ হলো এতে। কারণ বিরাজ তার সাথে সাথে বলেনি। আমি এটা বুঝতে পেরে বিরাজের মাথায় হাত রেখে বললাম,
___বিরাজ। তোমার ভাই ইরাজের সাথে যে কথা বললেনা, আর আম্মুর সাথেও কথা বলোনি এখনো, জিজ্ঞাসা করো কেমন আছি?

বিরাজ চোখ ভ্রু কোঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___তুমি আম্মু কি করে হও? আমার মা, আম্মু,মাম্মি সব তো উনি। আর মা তো একজনই হয়,তাইনা?
তুমি আমার বাবার বোন হলে তো সম্পর্কে আমার ফুফি হও!

চলবে…..

অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-১৪

0

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১৪ তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

আর এটাও জানে সে জিতলেই আমি আমি খুশি! তবে এতে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছে আমি কি করে দুটো বাবুকে আলাদা করে চিনলাম!

ইয়াজ আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকাতে ভাবী আমার দিকে অন্য রকম একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সেটা বুঝে ইয়াজ ধরা না খাওয়ার জন্য তারাতাড়ি চোখ অন্যদিকে সরালো।
কিছু একটা ভেবে ইয়াজ তাড়ার স্বরে বললো,
___ওদের কানে আজান পৌঁছানো হয়েছে?

বাবা পাশ থেকে বললো,
___হ্যাঁ তুমি বাইরে চলে যাওয়ার পরে এটা মনে হতেই আমরা দুই বিয়াই এই কাজটা করেছি আলহামদুলিল্লাহ!

ইয়াজ হেসে বললো,
___আলহামদুলিল্লাহ!

সারাদিনের চিন্তা, ক্লান্তি, দৌড়াদৌড়িতে সবার অবস্থা খারাপ। ইয়াজ ভাবীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
___দুলাভাইয়ের কাছে একজনকে দাও, আর আমি একজনকে নিচ্ছি। তারপর সবাইকে খাওয়ানোর দায়িত্বটা ইথিলা নাও।

ভাবী ঠোঁটে হাসি জড়িয়ে উনার কোলে থাকা বাবুটার দিকে তাকিয়ে বললো,
___বড়মা সবাইকে খেতে দেই? তুমি একটু বাবার কাছে যাও!

ইয়াজ ভাবীর দিকে তাকিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলো আর অদ্ভুতভাবে হাসলো। হাসিটা অদ্ভুত কারণ ওর চোখে জমা আছে কাতরতা আবার ঠোঁটে খুশির প্রবণতা। এদিকে ওদের দুজনের দিকে এখন একসাথে তাকালেই আমার বুকের ভেতর কম্পন উঠে, মনে হয় এখানে কেমন যেন শূন্যতা, আর অপূর্ণতার বিরাজ হতে যাচ্ছে! আবার আমার সন্তানের জন্য ভাবীর হাসিগুলো দেখলে বিশাল মুগ্ধতা আমাকে সব ভুলিয়ে দেয়।
আমার ভাইও ভাবীর খুশিতে ভীষণ খুশি!
তারপর মনে হয় আজীবন আমরা আমরাই তো থাকবো!

রাতে ইয়াজ বাদে পুরুষ যারা ছিল সবাই চলে গেলো। পরেরদিন ভাইয়া অফিস শেষ করে আসবে আর দুই বাবা সকালেই আসবে৷
এদিকে আমি সেদিন সারাদিন শুয়েই কাটালাম। ওদের দুইজনের পুরো যত্ন ভাবী আর ইয়াজ করছে। আর আমার শাশুড়ি মা আর আমার মা পান খেয়ে গল্পগুজব করে সন্ধ্যা রাতেই ঘুমে অতল।
ইয়াজ আর ভাবী সারারাত আমার কি লাগে, বাবুদের কি লাগে সেদিকেই নজরদারি করছিলেন। ইয়াজ একটু হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ বসলেও ভাবী সেটাও করেননি, ওদেরকে একটু কান্না করার সুযোগও দেন না। ডক্টরের পরামর্শে তাদের খাবারউপযোগী গুড়ো দুধ নেওয়া হয়েছে। এমনিতে ডক্টররা এটা খুব সহজে বলেন না, কিন্তু এইখানে এটা বাধ্য হয়েই নিতে হবে, প্রথমত আল্লাহর দেওয়া প্রকৃতিপ্রদত্ত খাবার ব্যবস্থা গ্রহিত হতে আরো সময় নিবে, তারউপর দুইজন। চাহিদা বেশি!
পরবর্তীতে দরকার হবে বলে, তাই প্রথম থেকে খিদেয় কষ্ট না করিয়ে ডক্টর তাদের কৃত্রিমখাবার অল্প অল্প করে খাওয়ানো শুরু করে দিতে বলেছে।

এগুলো সব ভাবী একা সামলাচ্ছে । আমার সারারাতে যতবার ঘুম ভেঙেছে বারবার শুধু দেখছিলাম ভাবী তাদেরকে কতো পরম মমতা দিয়ে যত্ন করছেন!
ইয়াজও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে!

তিনদিন পরেই ডক্টর বললো আমরা এখন বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত! সিজারের পরেরদিন থেকে আমি ওদেরকে অল্প অল্প করে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করলেও বেশিক্ষণ রাখতে পারিনি। একটু একটু হাঁটাচলাও পারি এখন। ইয়াজও দেখলো আমার কন্ডিশন অনেকটাই ভালো তাই সে ডক্টরের কথা অনুযায়ী বাসায় নিয়ে আসলো।

বাসায় যাওয়ার পরে সবার তাড়া নাম ঠিক করা নিয়ে। এদিকে আমার শ্বশুরবাবা-মা আর আমার বাবা-মা বলে দিয়েছে বাচ্চাদের বাবা- মা আর তাদের বড়মা মিলে তাদের নাম ঠিক করুক।
কিন্তু আমি এই দায়িত্ব ইয়াজ আর ভাবীর উপর ছেড়ে দিয়েছি।

পরেরদিন ইয়াজ আর ইথিলা ভাবী বসেছে নাম ঠিক করার জন্য। দুজন অনেক্ষণ বসে শেষ পর্যন্ত দুইজন দুইজনের নাম নিয়ে আসলো। ভাবী এসেই একজনকে কোলে নিয়ে বললো,
___ওদের এমন দুইটা নাম রাখা হবে, যার একজনের সাথে বিন্দিয়ার প্রথম শব্দের মিল থাকবে, আরেকজনের সাথে ইয়াজের। তবে এদুটোতে আমি এবং আমার হাসবেন্ডও আছে! কারণ ইয়াজ আর ইথিলা এক অক্ষরে, বাদল আর বিন্দিয়া এক অক্ষরে! এছাড়াও দুটো নামের শেষভাগেও থাকবে ওদের বাবার নামের সাথে মিল।

আমি উৎসুক হয়ে বললাম,
___কি কি হতে পারে সেটা!?

ইয়াজ আগে আগেই বললো,
___ সে দুটো নাম হলো, বিরাজ আর ইরাজ। সুন্দর না?

আমি কিছু ভেবে বললাম,
___বিরাজ বিন্দিয়ার সাথে ঠিক আছে, কিন্তু ইরাজ তো ইয়াজের সাথে বেশি মিল, এমন না হয়ে যায় বাবাকে ডাকলে ছেলে জবাব দেয়!

ভাবী আর ইয়াজ দুজনেই হেসে উঠলো। ইয়াজ বললো,
___আমার নাম তো আর ইয়াজ না, ইমতিয়াজ। সেটা থেকে ইয়াজ আসছে। পুরো নাম ডাকতে মানুষের নাকি কষ্ট হয়। তবে তুমি বললে ইমতিয়াজ থেকে আনা ইয়াজ বাদ দিয়ে দিবো এরপর যে দুটো অক্ষর আছে সেটা ডাকতে বলবো।

আমি নামটা খেয়াল করে বললাম,
___ তার মানে মতি? ইমতিয়াজ থেকে ইয়াজ বাদ দিল তো মতি থাকে। অঅঅ আপনি ইয়াজ বাদ দিয়ে সবাইকে মতি ডাকতে বলবেন?

বলেই আমি চোখ বন্ধ হাসতে শুরু করে দিলাম। ভাবী আমার চেয়েও বেশি হাসছে। মধ্যখানে ইয়াজ চুপ করে ভেবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে হাসানোর জন্য ইচ্ছে করে বলেছে সেটা আমরা দুজনেই জানি। তবুও হাসতে ভালো লাগছে!

আমাদের হাসি শেষ হওয়ার পরে ইয়াজ বললো,
___ হাসি শেষ হলে আমার কথা শুনো। নাম এটাই চূড়ান্ত। ওদের আকিকার সাথে নাম রেখে ফেলা হবে। কি বলো তুমি?

আমি মাথা নেড়ে বললাম,
___সবাই যা ভালো মনে করে। তবে কার নাম ইরাজ হবে আর কার নাম বিরাজ হবে সেটা নির্ধারণ করো। তারপর না চিনলে দেখা যাবে নাম অদলবদল হয়ে গেছে।

ভাবী ঘুমিয়ে থাকা দুজন থেকে একজনকে প্রথম চুমু খেয়ে বললেন,
___সে বিরাজ, আর ও ইরাজ! তুমি তো মা, মনে রেখো কাকে বিরাজ বলেছি এখন।

তারপর ভাবী ইয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
___তুমিও মনে রেখো কিন্তু।

ইয়াজ থতমত করতে লাগলো। তারপর হ্যাঁ সম্মতি দিলো। কিন্তু ইয়াজের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝেছি সে ওদের দুজনকে উলটপালট করলেই কার নাম কি বলেছিলো ভুলে যাবে।
তবে ভাবীর মনে থাকবে। কারণ এই যাবৎ উনি ওদের মধ্যে কার গালে কয়টা শিরা আছে সেটাও গননা করে ফেলেছেন। এতটাই কাছেকাছে থাকেন। রাতেও ভাবী এখন আমার সাথে থাকে, ইয়াজ ওদের খাওয়ানোর ব্যপারে কিছু বুঝেনা! শুধু একপাশের বিছানায় শুয়ে থাকে, কিছু করতে বললে সাথে সাথে করে। এইইই যা!

দুইদিন পরে ইরাজ বিরাজের আকিকা হলো। অনেক মানুষকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। আমি কারো সামনে ছিলাম না। ইয়াজও ভীষণ ব্যস্ত। এদিকে বাদল ভাই আর ইথিলা ভাবীর কোলে যারাই বাচ্চা দেখতে আসছে সবাই বলে উঠে, আরে আপনাদের বাচ্চা!ওরা তো পুরো আপনাদের দুজনের চেহেরায় হবে। আবার যারা আমাকে দেখেছে তারা বলে, আরেনা ওরা ওদের বাবা ইয়াজের মতো হয়েছে, আর তাদের মা তো ইথিলার স্বামীর বোন। তাই দুই পরিবারের সাথেই ভীষণ মিল আছে বাচ্চা দুটোর। সেদিনের পরে এসব বিষয় রটনা হয়ে গিয়েছিলো, সবাই এটা শুনে অবাক হতো আর দেখতে আসতো।
অনেকে বলে ফেলতো, জমজ হয়েছে সমস্যা নাই, একটা বাচ্চা ইথিলা নিলে সে তার মা এটা বিশ্বাস করাতে কঠিন হবেনা।
কেন জানি এসব শুনে আমার বুকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করতাম। আর আমার ভয়টা আরো বেশি তীব্রতর হতো। যদিও ইয়াজ এখনো বাচ্চা দেওয়ার কথা তুলেনি, তাও আমার ভাবতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে আসতো।


বাচ্চাদের একমাস যখন পূর্ণ হলো, তারা একটু একটু হাসতে শুরু করেছে।
এখন আমিও ওদের যত্ন করতে পারি। খাওয়াই,গোসল করাই। তবে একজনকে ভাবী করাবে। দুজনকে একসাথে দেয়না। ভাইয়া বাড়ি যাওয়ার কথা উচ্চারণই করতে পারে না, ভাবী কান্না জুড়ে বসে। বলে ইরাজ বিরাজকে ছাড়া উনি এক মূহুর্ত থাকতে পারবেন না। এদিকে ইয়াজ এক বাচ্চা নেওয়ার কথাও বলতে পারেনা, কারণ সে জানে তাহলে সে নিজেও অপূর্ণতায় রূপান্তর হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওদের গালে চুমু না দিয়ে ইয়াজ ফ্রেশ হতেও যায়না। ওদের হাসি না দেখে অফিসে যেতে পারে না। দুজনের একজন ঘুমিয়ে থাকলে বসে অপেক্ষা করে কখন উঠবে অন্যজন উঠবে আর ওর কথার সাথে দাঁত ছাড়া কোমল হাসি হাসবে! আর সেটা দেখে সে তৃপ্ত হয়ে নিজের কাজে যাবে! এমন করতে গিয়ে ওর প্রায়ই দেরি হয়, তার জন্য সমস্যার সম্মুখীনও হয়, তাও সে অপেক্ষা করে।

দেখতে দেখতে দুইমাস হয়ে গেলো। আমার বাবার শরীরটা অল্প খারাপ। ভাইয়া ভাবীকে চলে যেতে তাড়া করছে। কিন্তু ভাবী কোনো কথা শুনেনা। উনি একদিনও ওদের ছাড়া কল্পনা করতে পারেননা। ওরা এখন কথা বললে আ আ ও ও বলে, অস্পষ্ট বুলি বলে। ভাবী সারাক্ষণ এগুলো শুনতে কাতর হয়ে থাকেন। ওরা ঘুমিয়ে গেলে চুপ করে পাশে শুয়ে থাকেন আর ওদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। একদিকে আমি থাকি অন্যদিকে ভাবী আর মধ্যে ওরা দুজন। রাতের বেলা একজনকে উনার সাথে নিয়ে যান, আরেকজনকে আমার কাছে দিয়ে যান।
ভাবীর সতেজ নিঃশ্বাস নিতেও ওদের প্রয়োজন! নইলে যেন সেটাও পারেন না।

দিন যাওয়ার সাথে সাথে ওদের চেহেরা স্পষ্ট হচ্ছে, বাবা আর বড়মার মতো চেহেরা আবার ফর্সা গায়ের রঙ, আর কান্না করলে একদম লাল! কিছু একটা করতে না পারলে এখনি ওরা রাগ দেখায়, আর রাগলে মনে হয় তাদের বাবার হুবহু কপি। ভাবী বলে ওরা দুজনেই ওদের বাবার রাগ পেয়ে বসেছে, বড়মার মতো একজনও শান্ত হয়নি।

কিন্তু ইয়াজ এটা নিয়ে বেশি খুশি, সে বলে রাগ হলেই ভালো! এমনকি গলা ছেড়ে সবাইকে বলে বেড়ায় আমার ছেলে আমার মতো হবে, রাগী,তেজী,প্রতিবাদী আর ভালো মানুষ।
মাঝে মাঝে কেউ ওর এসব কথায় হেসে বলে তোর মাইরের দাগ এই এলাকার অর্ধেক ছেলেদের পিঠে আছে, তোর দুই ছেলে একসাথে বড় হলে আর অর্ধেক না সবার পিঠে দাগ বসাবে। ইয়াজ এতে রাগ করেনা উল্টো হাসতে হাসতে কাত হয়ে যায়।

ওদের তিনমাস হওয়ার পর পরেই আমার বাবার শরীরের অবস্থা আবার খারাপ হলো। ভাবী ওদেরকে রেখে যাবেনা বায়না ধরেছে। তারপর আমরা সবাই-ই একসাথে গেলাম। যাওয়ার পরে ভাইয়া ভাবীকে অনুরোধ করতে লাগলো থাকতে! কিন্তু ভাবী মানেনা। আমার আম্মাও বলে থাক সে যখন বাবুদের ছাড়া থাকতে পারছেনা তাহলে থাকুক ওদের সাথে, আমি সব ম্যনেজ করে নিবো। কিন্তু ইয়াজ বুঝতে পারলো আসলে ভাবী আমার মা-বাবার সাথে থাকাটা এখন দরকার।
তবে এটাও বুঝতে পারছে উনি ইরাজ বিরাজকে ছাড়া পাগল হয়ে যাবেন।

সেদিনই ইয়াজ ভীষণ ভীত চেহেরায় ইরাজকে কোলে নিয়ে আমার কাছে আসলো। পাশেই ভাবী বিরাজকে নিয়ে খেলা করছে।
এসে আমাকে বললো,
___বিন্দিয়া মনে আছে ওরা পৃথিবীতে আসার একদিন আগে আমি তোমার কাছে একটা জিনিস চেয়েছিলাম? আমার জন্য তুমি চোখ বন্ধ রাজী হয়েছিলে। কিন্তু এরপর আমি ওদের বাবা সেটা মনে করার সাহসই পাইনি। আমার মনে হয় আমিই এক মূহুর্ত ওদের দুজনকে একসাথে না দেখে থাকতে পারবোনা। আর তুমি তো ওদের মা!
কিন্তু দেখো, আমার বোন ওদের ছাড়া নিজের কথা এখন ভাবতেই পারেনা। আমি দুদিকের এই কঠিন সিদ্ধান্তে ভীষণ ভয়নক অবস্থায় আছি। কিছু বলার সাহস ধারণ করতে পারছিনা।

আমি ইরাজের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললাম। ওর কোল থেকে ইরাজকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
___ না না এ কথা বলবেন না। আমি ওদের একজনকে ছাড়াও পাগল হয়ে যাবো!

ভাবী পাশ থেকে এবার আমাদের দিকে খেয়াল করে বললেন,
___বিন্দিয়া পাগল হয়ে যাবে বলছে কেন? কি হয়েছে? (এতক্ষণ বাবুর সাথে খেলায় মনোযোগ দিয়ে এদিকে খেয়াল করেন নি)

ইয়াজ এবার উনার একটু কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বললো,
___ইথিলা আমি জানি তুমি চাইলেই কোনো অনাথ সন্তানকে এনে লালনপালন করতে পারো। কিন্তু ইরাজ বিরাজের মায়া কমাতে পারবেনা। তুমি তাদেরকে আমাদের মতোই ভালোবাসো। ওদের ছাড়া তুমি ভালো থাকবেনা। আমি বিন্দিয়াকে বলেছিলাম সে যেন তোমাকে আমাদের দুই সন্তান থেকে এক সন্তানকে দিয়ে দেয়!

ইথিলা ভাবী বিরাজকে কোলে তুলে কান্না করে দিলেন। বিরাজের চোখেমুখে চুমু খেলেন আর ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
___ না ইয়াজ, তুমি এটা বলোনা। এতে বিন্দিয়া মরে যাবে! আর আমিও এতটা নির্দয় হতে পারবোনা। আমি এই কয়মাস মাতৃত্বের টান কি জিনিস জেনেছি, মা কখনোই তার সন্তান দিতে পারবেনা! মা কেন তুমি বাবাও সেটা পারবেনা। বলো তুমি একজনকে ছেড়ে ভালো থাকতে পারবে?

আমি ওদের মধ্যে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
___ভাবী তুমি তাহলে কি করে ওদের ছাড়া থাকতে পারবে?

ভাবী কান্নার মধ্যেও মুচকি হাসির চেষ্টা করে বললো,
___যে এমনি অপূর্ণ তার এসব অভিলাষ করার কি মানে বলো?

চলবে…..

অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-১৩

0

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১৩ তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

আমি শুকনো ঠোঁটে পূর্ণতার হাসি হাসলাম।
তবে পরক্ষণেই হাসিটা থেমে গেলো,অনূভব করলাম চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

দুইজন সেবিকা দুটো বাচ্চার ওজন মাপলো,তারপর চলে গেলো বাইরে। তারপর ডক্টর তার বাকি কাজগুলো করে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো।

আমাকে আমার কেবিনে আনা হলো। আমি চোখ ঘুরিয়ে প্রথমেই খেয়াল করলাম ইথিলা ভাবীকে। তাকিয়েই দেখলাম ভাবীর ঠোঁটে কি এক অমায়িক হাসির রেশ! দুইজনকে নিজ হাতে নরম কাপড় দিয়ে আরো পরিষ্কার করে বারবার দুই মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছেন। কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবীর দিকে তাকিয়েই রইলাম। ভাবী ওদের দুইজনের দুইহাতের আঙুল ধরে বললো,
___তোমাদের তো কোনো চিহ্নও নেই, বড়মা তোমাদের দুজনকে আলাদা করে কি করে চিনবে?

এটা শুনে আমি চোখ বন্ধ একটু হাসলাম। তখনি ইয়াজ আমার হাত ধরে বসলো। আমি ইয়াজের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___কার মতো হয়েছে দুজন? আপনার মতো তো?

ইয়াজ মাথায় হাত রেখে বললো,
___ আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে হোক না যার মতো হওয়ার। তুমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো, তোমার প্রচুর বিশ্রাম প্রয়োজন। এখানে ইথিলা আছে, তোমার আমার মা আছে, ওদের ভীষণ খেয়াল রাখবে।

কথাগুলো বলার মাঝেই একজন সেবিকা প্রবেশ করলো, আগে থেকে আনিয়ে রাখা বক্স থেকে একটা স্যালাইন বের করে হাতে আবার সেটা ঝুলিয়ে দিলো, আর বললো,
___একদম কথা বলবেন না। চুপ করে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।

কিন্তু আমি চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না। ভাবীকে ডেকে বললাম,
___দুজনকে আমার কাছে আনবে প্লিজ, আমি ওদেরকে আরো করে দেখতে চাই।

ভাবী মুচকি হেসে ইয়াজকে ডেকে একজনকে তার কোলে দিলো,আরেকজনকে উনি কোলে নিয়ে আমার কাছে এনে দেখালেন। আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে একবার ভাবী আর ইয়াজের দিকে তাকাচ্ছি। আবারও দেখে ওদের দিকে তাকাচ্ছি। একজন চোখ বন্ধ করে রেখেছে, মনে হয় ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আরেকজন চোখ খুলে রেখেছে। নাকের দিকে তাকিয়ে এখনি বুঝা যাচ্ছে সেটা আমার মতো হবে। ওদের বাবার নাক কিছুটা চাপা হলেও আমার নাক খাড়া। চোখের ধরণও আমার মতো লাগছে, ভ্রুগুলোর ধরণ আবার তাদের বাবার মতো দেখা যাচ্ছে। কান,হাত,কপাল এসবই ইয়াজের মতো। সবকিছু তেমন একটা বুঝা না গেলেও তাই তাই হবে বলে মনে হচ্ছে , ছোট বাচ্চারা তো দিনে দিনে অনেক পরিবর্তন হয়। কেন জানি আমার এগুলো দেখে স্পষ্ট মনে হচ্ছে তাদের চোখ আর নাক ছাড়া তারা সম্পূর্ণ তাদের বাবার মতো দেখতে হবে। ইয়াজ তার কোলে যেজন আছে তাকে ইশারা করে বললো,
___ দেখো তোমাদের মা নিজেও চমক খেয়ে গেছে, হয়তো ভাবছে সেও তোমাদের দুজনকে আলাদা করে চিনতে পারবেনা। হাহাহাহা!

ভাবীও হাসি জুড়ে দিলো। আমার মা বাবা আর শ্বশুর,শাশুড়ী দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। ওদের হাসিতে আমিও হাসছি। ডান হাতে স্যালাইন, তাই খুব কষ্টে বা হাত দিয়ে ওদের গাল ছুঁয়ে দিচ্ছি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে ইয়াজকে বললাম,
___আমি চিনতে পারবো। আপনি দুজনকে একটু পরে অদলবদল করে সামনে এনে জিজ্ঞাসা করিয়েন, আমি বলে দিবো এখন যে আপনার কোলে আছে সে কোনজন, আর যে ভাবীর কোলে আছে সে কোনজন!

ইয়াজ চোখটা একটু অন্য রকম করে বললো,
___ সত্যি পারবে?

আমি হেসে বললাম,
___হ্যাঁ!

ইয়াজ তারপর দুজনের দিকে তাকালো। আর আমার সাথে দেখাদেখিতে চ্যালেঞ্জ করে বলে বসলো,
___আমিও পারবো। তুমি মা পারবে, আর তাদের বাবা পারবেনা, কি করে হয়!?

ভাবী তাচ্ছিল্য করে বললো,
___ইয়াজ চাপা কম করো। তুমি পারবেনা।

ইয়াজ জোর গলায় বললো,
___ইথিলা আমি পারবো।

___বেশ তাহলে বাইরে থেকে খাবার আনো, আনার পরে সেটা পরিক্ষা হয়ে যাবে। কে পারে!

সেসময় আমার ভাইয়া রুমে প্রবেশ করলো। এতক্ষণ উনি আসতে পারেনি কারণ ছুটি নিতে পারেননি। ভাইয়া রুমে এসে প্রথমেই আমার কাছে বসে জিজ্ঞাসা করলেন,
___এখন কেমন লাগছে বিন্দিয়া?

আমি আস্তে আস্তে বললাম,
___বুঝতে পারছিনা, কোমরের নিচে তো এখনো অবশ। কিন্তু ভালো লাগছে ওদেরকে দেখে। দেখোনা তুমিও অবাক হয়ে যাবে!

ভাইয়া তারপর ইথিলা ভাবী আর ইয়াজের কোলের দিকে তাকালো। অনেক্ষণ তাকালো, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___কিরে তোর আর আমার মধ্যে যেই দুইটা মিল সেটা ওদের দুজনের মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি, আর কেউ কি খেয়াল করেছে? আর বাকিসব তো ইথিলা আর ইয়াজের মতো লাগছে।

আমার মা পাশ থেকে হেসে বললো,
___ হ্যাঁ ওরা দুজন যদি যেকোনো এক জায়গায় থাকে কিংবা দুই জায়গায় থাকে তারা বিশ্বাস করে নিবে তাদের মা-বাবা ঠিক। ইথিলা আর ইয়াজ তো এক রকমই, আর বাদল বিন্দিয়ার মিলটুকুও ওদের মধ্যে আছে! কি ভীষণ আশ্চর্য নিয়ে আসলো ওরা!
আচ্ছা ওদের নাম কি রাখা হবে কেউ ঠিক করে রেখেছো তো?

আমি ইয়াজের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___এখনো কিন্তু নাম বের করেননি। এই দায়িত্ব আপনার ছিল!

ইয়াজ ইথিলার ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললো,
___এই দায়িত্ব আমি ইথিলাকে দিয়ে দিয়েছি।

ইথিলা ভাবী ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
___এই দায়িত্ব আপনার!

ভাইয়া আমার মা বাবা আর শ্বশুর, শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে বললো,
___না না এই দায়িত্ব উনাদের। নাতিদের নাম ওরা ঠিক করবে।

এই অবস্থায় সবাই আবারও হেসে উঠলো। একজন শুধু আরেকজনকে ঠেলছে।

তখনি ইয়াজ আমাকে ইশারা করলো কম কথা বলতে। আর ভাবী ইয়াজকে বললো শুকনো খাবারসহ সবার জন্য অন্যান্য আরো খাবার নিয়ে আসতে। আমার বাবা, শ্বশুর আর ভাইয়া মনে হয় চলে যাবে। আবার কাল আসবে। এখানে আমার সাথে ইয়াজ ভাবী, আর দুই মা থাকবে।
ইয়াজ বের হয়ে চলে গেলো খাবার আনতে। ভাবী আমাকে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে বললো। আর বললো একটু পরে আমাদের দুজনকেই সেই পরিক্ষাটা করবে যেটা আমরা ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জ করেছি। আমরা বেবিকে আলাদা করে চিনি কিনা! আমি কেন জানি নিশ্চিন্ত ছিলাম চিনবো। তাই চুপ করে চোখ বন্ধ শুয়ে রইলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ লেগে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙতেই দেখি ইয়াজ বসে আছে, আমাকে চোখ খুলতে দেখে বললো,
___এখনো কি পা অবশ লাগছে?

আমি পা একটু নাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
___না এখন তেমন লাগছেনা। ওরা দুজন কোথায়? কি খেয়েছে? ওদের খিদে পায়নি? কান্না করেছিলো?

ভাবী এগিয়ে এসে বললো,
___এতো চিন্তা করো না। আমরা আছি তো! আর ইয়াজ এদিকে এসে বলোতো তখন তোমার কোলে কে ছিল? আর আমার কোলে কে ছিল? খুব তো বলেছিলে চিনবে!

আমি ইয়াজের দিকে তাকিয়ে ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
___ভাবী আমার কাছে আনো, আমার সামনে বলবে!

ভাবী আমার শাশুড়ীর কোলে একজনকে দিলো, আর দুজন দুজনকে নিয়ে আমার বেডে আসলো।
আসার পরে ভাবী আমাকে বললো,
___বিন্দিয়া তুমি আগে বললে হবে না। আগে ইয়াজ বলবে। ইয়াজ বলো তুমি!

ইয়াজ খুব ভালো দেখছিলো। তারপর কিছু বুঝতে না পেরে বললো,
___দুজনের ফতোয়া বদলে ফেলার কি দরকার ছিল ইথিলা? এখন তো কেমন, না না আমি বলতে পারবো।

বলেই ইয়াজ চোখ ঘুরাচ্ছিলো। ভালো করে পরখ করেও সে ভুল বলতে আঙুল নিচ্ছিলো, তখনি আমার দিকে ইয়াজের চোখ পড়লো। আমি চোখ দিয়ে ইশারা করে মানা করলাম। ইয়াজ সেদিক থেকে আঙুল সরিয়ে বললো,
___ও না, এই যে সে আমার কাছে যে ছিল। আর সে তোমার কাছে ছিল ইথিলা!

ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___বিন্দিয়া বলো!

আমি ইয়াজের দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসিতে ভুলজনের দিকে আঙুল দেখালাম।
ভাবী সাথে সাথে ইয়াজের কান টেনে বললো,
___কি করে বুঝলে তুমি? নিশ্চয়ই কোনো চালাকি করেছো! কোনো চিহ্ন রেখে যাওয়ারও কথা না, আমি নিজ হাতে দুজনকে এক রকম থেকে আরো এক রকম করার চেষ্টা করলাম। আর তুমি কিনা বুঝেই গেলে! আর ইথিলা বুঝলো না?

ইয়াজ একহাতে কলার টেনে ভাবসাব নেওয়ার চেষ্টা করলেও আমার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। কারণ সে জানে আমি ইচ্ছে করে তাকে জিতিয়েছি! আর এটাও জানে সে জিতলেই আমি আমি খুশি! তবে এতে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছে আমি কি করে চিনলাম!

চলবে…..

অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-১২

0

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১২ তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

বলেই হাসিটা আর ধরে রাখতে পারলেন না। মুখ চেপে কান্না শুরু করে দিলেন।

উপস্থিত সবাই কাঁদছে, একটা খুশির সাথে আরেকটা কষ্টের মিশ্রণ যেন কষ্টগুলোকে আরো তীব্রতর করে দিচ্ছিলো। একদিকে পূর্ণতার আহাজারিতে মেতে উঠার কথা ছিল কিন্তু অপরদিকের অপূর্ণতা সেটাকে কলুষিত করে রেখেছে। থমথমে নিরবতার মাঝে একজন সেবিকা কিছু ঔষধপত্র হাতে প্রবেশ করলেন। আর সবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
___আপনারা উনার সাথে কষ্ট না পেয়ে প্লিজ বুঝানোর চেষ্টা করুন। এই পৃথিবীতে সবাই পূর্ণতা নিয়ে আসেনা। উনাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করুন। তবে এখন উনাকে ঘুমের একটা ঔষধ খাওয়াবো, উনার বিশ্রাম প্রয়োজন। আপনারা কেউ কোনো শব্দ করবেন না। আর এই বেডের পেসেন্টকে উনার কেবিনে নিয়ে যান।

ইয়াজ আর ভাইয়া উঠে আমাকে আমার কেবিনে নিলো। আমার তেমন জটিল সমস্যা না থাকলেও রাতে আরেকজন ডক্টরের শরণাপন্ন হয়ে কিছু প্রয়োজনীয় পরিক্ষা সাথে এখন থেকে চালিয়ে যাওয়া ঔষধের প্রেসক্রিপশন নিতে হবে। রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও পূর্ব সচেতনতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পরেরদিন আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। মা অনুরোধ করছিলো এইসময় কয়দিন আমাদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে। ইয়াজও রাজী হলো, আর মা-বাবার সাথে আমি বাড়িতে চলে গেলাম। ভাবীকে এর দুইদিন পরে ছাড়া হলো। ভাইয়াও ভাবীর সাথেই ছিল এইকয়দিন, এমনকি তিনি এখন ভাবীর সাথে ইয়াজদের বাড়িতেই আছেন।
সবাই ভাবীর খুব খেয়াল রাখছিলো। আর আমার প্রতিও আমার বাবা-মা ছিল ভীষণ যত্নশীল । কিছু অপূর্ণতার পরেও দুই পরিবার এক হতে পেরে সেখানে আনন্দের সীমা ছিলো না।

এর তিনদিন পরে ইয়াজ আমাকে নিতে আসলো। আমিও সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলাম,তাই ওর সাথে যেতে কোনো আপত্তি ছিল না। যাওয়ার পর পরেই ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিলো ভাবী যেহেতু এখন অনেকটাই সুস্থ ভাবীকেও বাড়িতে নিয়ে আসবেন।
তার আগে সবার পরামর্শে একজন ধর্মীয় অবিজ্ঞকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া হলো উনাদের বিবাহ বন্ধন অক্ষুণ্ণ আছে কিনা। আর এই ডিভোর্স কতটা গ্রহণযোগ্য? উনারা বললেন, শরীয়ত মতে এটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এরপরও এমন ভুল না করার জন্য তওবা করতে করে নিতে হবে।


আমি যাওয়ার একদিন পরেই ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে আমাদের বাড়ি চলে গেলো। এই একদিনে আমি স্পষ্ট দেখেছি ভাবীর শুকনো চোখে লুকানো কষ্ট, কাঁদতে কাঁদতে হয়তো চোখগুলোও এখন বিরক্ত হয়ে গেছে। তবে উনার চোখে তাকিয়ে বুঝেছি সেখানে অপূর্ণতার মোহ উনার সত্তাকে কতটা গ্রাস করে নিয়েছে। উনার এখন হাসতে ইচ্ছে করে না, কথা বলতে ইচ্ছে করে না, তাও নিজের সাথে যুদ্ধ করে হাসেন,বুঝান তিনি ঠিক আছেন!
কেন জানি এখন আমি নিজের জন্য খুশি হওয়ার আগেই ভাবীর মুখটা চোখে ভেসে উঠে, আর ভেসে উঠতেই আমার কলিজায় খুন অনূভব করি।

ইয়াজ আমার ভীষণ খেয়াল রাখে, নিজের কাজের পরে যখনি বাসায় থাকে আমাকে সবকাজে সাহায্য করে। আমার শাশুড়ী তো আমাকে রান্না করতেই দিতে চায়না। মাঝে মাঝে ধমক দিয়ে বলে, সারাজীবন রান্না করার সুযোগ পাবা, এখন নিজের দিকে খেয়াল রাখো।

আমার ভাইও নিজের কর্মস্থল থেকে ফিরে যতটা সম্ভব ভাবীকে সময় দেন। উনার পাশে পাশে থাকেন।
তবে ভাবী নাকি রাস্তাঘাটে কোনো বাচ্চা দেখলে তাকিয়ে থাকেন, ইউটিউবে বাচ্চাদের ভিডিও ছাড়া আর কিছুই দেখেন না। এমনকি আমিও মাঝে মাঝে ফেইসবুকে উনার এক্টিভিটি দেখতে পাই বিভিন্ন বাচ্চার ছবিতে, ভিডিওতে। ইয়াজ এগুলো যখনি দেখে মন খারাপ করে বসে থাকে, মাঝে মাঝে আমার কাঁধে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করে।

দুঃখ কষ্ট, হাসি আনন্দ মিলিয়েই সময় চলে যাচ্ছিলো। তবে দিন যাওয়ার সাথে সাথে আমার শরীরের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। অতিরিক্ত অস্বস্তি লাগা, পিঠে কোমরে ব্যথা, ওজন বৃদ্ধি এসব নিয়ে ইয়াজও ভীষণ চিন্তিত ছিল।

তখন গর্ভধারনের দুইমাস প্রায়। ইয়াজ আর আমি সকালে একটু হাঁটতে বের হয়েছি। সারাদিন কাজকর্ম তেমন করা হয়না,এভাবে শুয়ে-বসে থেকেও ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তাই ইয়াজ ফজরের নামাজের পরে ইদানীং আমাকে নিয়ে একটু হাঁটতে বের হয়। তখন আশেপাশে তেমন লোকজনকেও দেখা যায় না।
এর মধ্যে আমাদের সন্তান ছেলে হবে কিনা মেয়ে হবে এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু সেদিন আমি আনমনেই বললাম,
___আমার কেন জানি মনে হয় অন্যদের থেকে আমার অবস্থাটা অন্য রকম। দুইমাসের পেট দেখে মানুষ নিঃসন্দেহে চারমাস বলবে, মনে হয় দুটো বাচ্চা এখানে।

ইয়াজ আমার হাত ধরে একটু এগিয়ে ছিলো। কিন্তু এটা শুনে উৎফুল্লের হাসিতে পেছনে এসে পেটে হাত দিয়ে বলে উঠলো,
___ সত্যি? চলো আজকেই সেটা পরিক্ষা করবো। আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিচ্ছি, জমজ সন্তান কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দুইমাস যথেষ্ট কিন্তু। তবে ছেলেমেয়ে কিনা সেটা বুঝতে আরো দেরি।

আমি ওর হাসিমুখে তাকিয়ে হাসলাম। তারপর ধিরে ধিরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,
___ সত্যিই যদি হয় ভীষণ ভালো হবে তাইনা?
আর যদি একই রকম দেখতে দুইটা মেয়ে হয় তাহলে তো কথাই নেই। আমি দুইজনকে সবসময় এক রকম করে পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখবো। আমি চাই ওরা একদম ওদের ফুফির মতো হোক।

ইয়াজ মুচকি হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
___ তোমার মতো হোক চাও না কেন?

আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম,
___ তা তো জানিনা। তবে এটা এইজন্য চাই, রাস্তায় বের হলেই যাতে লোকে বলে ইয়াজের সন্তান এরা, যেন নিজ থেকে পরিচয় দিতে না হয়।

ইয়াজ বললো,
___আচ্ছা আজকে হাসপাতালে গিয়ে আগে নিশ্চিত হই। তারপর বাচ্চার জন্য এখন থেকেই জোড়ায় জোড়ায় সব কিনে রাখবো। আচ্ছা ওরা দুইজন আসলে, দুইজন থেকে একজন তোমাকে বেশি ভালোবাসবে আরেকজন আমাকে? না না দুইজনই আমাকে বেশি ভালোবাসবে৷ তুমি শুধু লালন পালন করবে! হেহেহে!

বলেই ইয়াজ হাসতে লাগলো। আমিও হাসলাম। সত্যিই ইয়াজ ভীষণ খুশি, আর দুটো সন্তান হলে সে আরো অনেকবেশি খুশি হবে। মনে মনে এটাই চাচ্ছিলাম যেন আমার এই ধারণাটা সঠিক হয়!

ডক্টরের চেম্বারে বসে ইয়াজ আর আমি দুজনেই হাসছি। ইতোমধ্যেই রিপোর্ট এসে গেছে সেখানে এটা স্পষ্ট হয়ে আমার গর্ভে দুটো সন্তান। আমার নিজের প্রতি আরো যত্নশীল হতে বললেন ডক্টর। ইয়াজকেও বলে দিলো সবসময় খেয়াল রাখতে। ইয়াজ সেখান থেকে বের হয়েই সংবাদটা ভাবীকে জানালো।
ভাবী এটা শুনেই বললো,
___আমি আজকে থেকে গুনে গুনে ৭-৮ মাস তোদের সাথে থাকবো। ইথিলার যাতে কোনো রকম অযত্ন না হয়।

সত্যি সত্যি সেদিনই ভাবী চলে আসলো। আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেন, মাথায় তেল দিয়ে দেন। গ্লাসে পানিটা পর্যন্ত ঢেলে দেন। ভাবী ভীষণ খুশি ছিল। তখন থেকে প্রতিটা সময় আমার কাছে ছিল অসহ্যকর সুন্দর। ভাবীর হাসি,ইয়াজের খুশি,মা-বাবার কৌতুহল আমাকে সাহস দিতো। আর আমি দুজন অতিথিকে নিয়ে নানারকম পূর্ণতার আঁকিবুঁকি আঁকতাম।
ভাইয়া প্রতি শুক্রবার চলে আসেন, এছাড়াও সময়ে অসময়ে ভাবীকে দেখার জন্য হুটহাট উপস্থিত হয়ে যান। সারাক্ষণ ফোনে কথা বলেন। ভাবী খেয়েছে কিনা, দিনে একবার ঘুমিয়েছে কিনা, এসবদিকে ভাইয়া ভীষণ খেয়াল রাখেন। ভাবীর চোখেমুখে আজকাল পূর্ণতার ছোঁয়া দেখতে পাই। তখন আমিও নিজেকে পরিপূর্ণ আর সার্থক মনে করি।

প্রায় সাড়ে তিনমাস পরে আমাদের সব ধারণাকে উল্টে দিয়ে রিপোর্ট আসলো আমার গর্ভে দুটো পুত্রসন্তান। মেয়ে সন্তানের প্রতি আমার বিশেষ ঝোঁক ছিল, কিন্তু এটা শুনেও খুশি না এমন নয়। ভীষণ খুশি,কারণ ছেলে থাকলে মেয়ে এমনি আসবে। আর মেয়ে হলে তো পরেরঘরে চলে যাবে! এটা বলেই নিজেকে বুঝ দিতাম।
আমার দিকে সকলের এখন কড়া দৃষ্টি। ভাবী তো ইয়াজ যতক্ষণ না থাকে আমার থেকে একটুও দূরে যান না। সবার ভালোবাসায় সব কষ্ট, অস্বস্তি, অতিরিক্ত ওজনের আধিক্যতা টের পেতাম না। নিজেকে মা রূপে কেমন করে গড়বো সেটাই ভাবতাম।

ধিরে ধিরে সময় ঘনিয়ে এলো। সিজারে যাওয়ার আগেরদিন রাতে ইয়াজ আমার পাশে বসে ভীষণ মন খারাপের সাথে বললো,
___একটা জিনিস চাইবো দিবে?

আমি মৃদু হেসে বললাম,
___আমার সবই তো আপনার, এখানে চাইবেন কেন?

ইয়াজ চোখ দুটো অন্যদিকে সরিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর স্বাভাবিক হয়ে আমার দিকে ফিরে বললো,
___ আল্লাহ রহমত করলে, দুটো সন্তান যদি সুস্থ অবস্থায় দুনিয়ায় আসে তাহলে আমরা একটা সন্তান ইথিলাকে দিয়ে দিবো। দিবে তো? এটা তোমার কাছে আমার প্রথম চাওয়া, প্লিজ না করো না।

আমি কেঁদে ফেললাম। পেটের উপর ডান হাত রেখে অনুভব করলাম দুজন সুন্দর করে একসাথে তাদের উপস্থিতি বিরাজ করছে। আসবেও একসাথে, আমি মা তাদের দুজনকে একসাথে একটু একটু করে বড় করে তোলার কতো স্বপ্ন ইতোমধ্যে দেখে ফেলেছি। কিন্তু এখন ইয়াজ আমার কাছে এটা কি চাইছে? না না আমি কোনোভাবেই আমার এক সন্তান কাউকে দিবোনা। ওরা দুজনই আমার! কিন্তু কথাগুলো মুখ ভেদ করে বাইরে আসছিলোনা। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিলো, কিন্তু চোখ থেকে শুধু অঝোর ধারাই বয়ে যাচ্ছে। ইয়াজ আমার ডান হাতটা উঠিয়ে সে হাত রেখে বললো,
___ বাবারা শুনতে পাচ্ছো? তোমাদের একজনকে যদি অন্য মা এনে দেই তোমরা বাবার উপর রাগ করবে? বিশ্বাস করো তোমাদের ওই মা আমাদের থেকেও বেশি ভালোবাসবে, অনেক যত্ন করে তোমাদেরকে মানুষ করবে। এই দেখো তোমাদের মা এটা শুনে কতো কান্না করছে, মাকে বুঝাও।

আমি ইয়াজের কপালে কপাল ঠেকিয়ে আরো বেশি কান্না শুরু করে দিলাম। ইয়াজ নিজেও কাঁদছে কিন্তু অনেকটাই সামলে রেখেছে। আমার মাথায় হাত রেখে বলছে,
___তুমি চাওনা দুটো পরিবার পূর্ণ হোক? আমাদের একটা সন্তান হলে কি আমরা মেনে নিতাম না? আর এটা তো আমাদেরই পরিবার, আমরা সবসময় তাকে দেখবো, তোমার যখন ইচ্ছে তাকে গিয়ে কোলে নিবে আদর করবে। শুধু ইথিলার অপূর্ণ জীবনটা পূর্ণ করে দাও। আমি আজীবন আর কিছু চাইবোনা তোমার কাছে। প্লিজ বিন্দিয়া!

আমি ইয়াজের হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম,
___ বেশ!

ইয়াজ কান্নার মাঝেও হেসে দিয়ে আমার কপালে একটা চুমু খেলো, ওর চোখের জলগুলো একাকার হয়ে আমার কপাল ভিজে গেলো।

পরেরদিন সকালে সবার থেকে দোয়া নিয়ে আমরা পরিবার নিয়ে হাসপাতাল গেলাম। প্রথম একটু ভয় ভয় লাগছিলো। কিন্তু সিজারে নেওয়ার পর ১০ মিনিটের মধ্যেই কানে দুটো বাচ্চার একত্রে কান্না স্পষ্ট শুনলাম। ডক্টর আমার চোখের সামনে বাচ্চাদুটো এক করে বললো, দুজন পুরো এক রকম! দুই ভাইয়ের স্বাস্থ্যও এক, নাক,চুল,ঠোঁট সব এক রকম। আমি শুকনো ঠোঁটে পূর্ণতার হাসি হাসলাম।
তবে পরক্ষণেই হাসিটা থেমে গেলো,অনূভব করলাম চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।…

চলবে…

অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-১০+১১

0

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১০ এবং ১১তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

ইয়াজ আমাকে টানতে টানতে পেছনে গিয়ে দেয়াল পর্যন্ত আঁটকে গেলো। সে আর পেছনে যেতে পারছেনা। কিন্তু আমার পেছনে লুকাতেও পারছিলোনা! ইথিলা ভাবী এসে একপাশ থেকে ইয়াজের কান ধরে একটানে বের করে বললো,
___দুইদিন ধরে বাড়ি না এসে চোরের মতো চলাফেরা করা হচ্ছে? তুই কি ভেবেছিলি আমি বুঝবোনা? ভুলে গেছিস আমি তোর ৫ মিনিটের বড়? মানে তোর থেকে ৫ অক্ষর হলেও বেশি জ্ঞান আমার!

ইয়াজ চোখ বন্ধ করে কান ছাড়ানোর চেষ্টায় বললো,
___ইথিলা কান ছাড়ো প্লিজ, খুব লাগছে! আচ্ছা আমি মেনে নিলাম তুমি আমার বড়, এবার ছাড়ো।

ভাবী কানের উপর একটা মুচড় দিয়ে ছেড়ে দিলো, আমার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হাসলো আর ইয়াজকে বললো..
___ভীষণ চালাক তুমি। সবাইকে বুঝাও এক, আর করো আরেক! তাইতো বলি দুইদিন ধরে বিন্দিয়া আগে আগে রুমে এসে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যায় কেন?ওর স্বামী বাইরে আর ঘুম আসে বিষয়টা জটিল, তাই আজকে না ঘুমিয়ে দেখলাম, দেখি দরজা বাইরে থেকে লক আর কেউ নাই আশেপাশে। এক ঘন্টা ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। এবার গোপন সত্য ফাঁস করে দিবো সবার কাছে!

ইয়াজ ভাবীর হাত ধরে বললো,
___ মা’কে বলোনা ইথিলা। তাহলে তোমাকে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটা আবার শুরু করে দিবে। আমি সবকিছু ঠিক করার জন্যই এমন করেছি! সরি,ক্ষমা করে দাও।

ভাবী কিছুটা অবাক বিষ্মিত চেহেরায় বললো,
___আমাকে মিলিয়ে দিতে?

ইয়াজ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
___হ্যাঁ। তুমি বাদল ভাইকে খুব ভালোবাসো না?

ইথিলা ভাবী মুখটা একটু গম্ভীর করে বলল,
___ হ্যাঁ বাসি!

এইটুকু বলেই ভাবী তলপেটে হাত দিয়ে একটা ব্যথাজনক শব্দ করলো। ইয়াজ ভাবীর কাঁধে ধরে বললো,
___কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো ইথিলা?

ভাবী ইয়াজের হাতটা আস্তে আস্তে সরিয়ে বললো,
___তলপেটে মাঝে মাঝে অদ্ভুত ব্যথা করে, সেরে যায় আবার। তুমি চিন্তা করো না, মেয়েদের এমন ব্যথার সম্মুখীন হওয়া গুরুতর কিছু না।

ইয়াজ অস্থির গলায় বললো,
___না ডক্টরের কাছে যেতে হবে। এখন তো সব বন্ধ,গাড়ীও পাবোনা, আচ্ছা কাল সকাল পর্যন্ত থাকতে পারবে তো? আর তোমার খারাপ লাগলে বিন্দিয়া তোমার সাথে থাকবে।

ভাবী হাত দিয়ে মানা করে বললো,
___এইতো এখনি কমে গেছে। আমি ঠিক আছি ভাই,একদম চিন্তা করো না। অল্প ব্যথা, অল্পসময় করে আবার সেরে যায়।

ইয়াজ বললো,
___ সত্যি বলছো তো?

ভাবী মাথা নাড়িয়ে বললো,
___হ্যাঁ সত্যি। আমি তাহলে গিয়ে ঘুমাই।

বলেই এক পা বাড়ালেন। ইয়াজ ভাবীকে ছেড়ে এবার আমার হাতটা ধরলো। ভাবী পেছনে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
___ এই দুষ্ট! খুব পাকনা হয়ে গেছো আজকাল। এখন বড় বোনকে কিছু বলার আর দরকার পড়েনা ?

ইয়াজ লজ্জায় হাসলো আর বললো,
___আসলে বিয়ের পরে গোপনীয়তা বজায় রাখলে ভালো। আর গোপন প্রেমও গভীর হয়। তবে সেটা আর পারলাম কই? তুমি ৫ মিনিটের বড় তাই সেই গুণে ধরে ফেলেছো!

ইয়াজের কথা শুনে ভাবী হাহা করে সেই হাসিটা হাসলো, যেটা ভাবীর মুখেসবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায় । হাসতে হাসতে ভাবী চলে গেলো।

এই বিষয়টাতে আমিও হাসি কারণ ইয়াজ আর ভাবীর মধ্যে এই ৫ মিনিটের ছোট বড় এর মূল্য অনেক বেশি, তবে ইয়াজ নাকি মাঝে মাঝে ত্যাড়ামি করে বলে, আমি তোমার চেয়ে দেখতে বড়,জ্ঞানী আর বুদ্ধিমান, এসব ৫ মিনিট কোনো ব্যবধান হলো?
তবে ইয়াজের কথা ঠিক,সে ছোট বেলা থেকেই মেধাবী, যার কাছেদ্বারেও ইথিলা ভাবী যেতে পারেনি। পড়ালেখাও ভাবী ফাঁকি দিতো।
আর যখন ভাবীর কাছে ইয়াজ হার মানে এবং সেটা স্বীকার করে ভাবী বড়, তখন ভাবী প্রচন্ড খুশি হয়।

ইয়াজ ওর বোনের শেষ হাসি দেখে মুচকি হাসিতে আমাকে নিয়ে রুমে গেলেও পরবর্তীতে ওর মুখটা আবার শুকনো হয়ে গেলো। মনে হয় ভাবীর জন্য চিন্তা করছে। আমি এরপর আস্তে আস্তে বললাম,
___আমি কি ভাবীর রুমে গিয়ে দেখবো? আর কাল তো ডক্টর দেখাবেনই,ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে।

ইয়াজ মাথা নেড়ে বললো,
___বিন্দিয়া আমার বোনের কিছু হলে আমি বেঁচে থাকতে পারবোনা।

আমি মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
___কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা যদি কখনো আমার কিছু হয়?

ইয়াজ আমার দিকে তাকালো। ভীষণ ভীত সেই দৃষ্টি। কাঁপা গলায় বললো,
___কখনো আর এটা বলোনা। তোমাকে, মা’কে,বাবাকে ছাড়া আমি পুরো ছন্নছাড়া হয়ে যাবো। তোমরা সবাইকে আজীবন আমার দরকার!

আমি হেসে বললাম,
___আমার আর আমার ভাইয়ার মধ্যে শুধু দুইটা মিল, আমাদের দুজনের নাক আর চোখ প্রায় এক। কিন্তু সব মিলিয়ে বিস্তর তফাৎ। আর আপনারা দুজন অবিকল এক,শুধু লম্বা খাটো, ছেলে মেয়ের বৈশিষ্ট্যে তফাৎ। তবে আপনি মনে হয় ভাবীকে উনার চেয়েও বেশি ভালোবাসেন।

ইয়াজ হেসে বললো,

____ ভুল বললে। ইথিলা ওর নিজের চেয়েও আমাকে বেশি ভালোবাসে। শুনো বলি,
আমি ছোট বেলায় খুব পেটুক ছিলাম, যখন কিছুই বুঝিনা। ইথিলা আর আমাকে দুইটাতে খাবার দিলে আমি আমারটা খেয়ে ইথিলারটাও খেয়ে ফেলতাম! এমন করতে করতে আমরা বড় হতে লাগলাম,তখন দেখেছি ইথিলা ইচ্ছে হলেও একটা জিনিস পুরোটা খায়না। আমার জন্য রেখে দিয়ে বলে আমার আর ইচ্ছে করছে না, তুমি খেয়ে ফেলো। এখনো বাবা বাজার থেকে কিছু আনলে আমার ভাগ আমি খেয়ে এদিক ওদিক খুঁজে দেখি ইথিলার ভাগ থেকে আমার জন্য রাখা খাবারটা কোথায় রেখেছে। একটা গ্লাস ভাঙলেও সেটার দোষ ইথিলা নেয়। তুমি হয়তো দেখেছো ইথিলা কোনো কষ্ট পেলে আমি নিতে পারিনা,তবে সত্যি এটাই এই শিক্ষা ইথিলার থেকে নেওয়া।
আমরা দুজন স্কুলে প্রথম ভর্তি হওয়ার পরে আমি খুব ভয় পেতাম, এক বছর ভয়ে ভয়েই কেটেছে। ওখানে একটা ছেলে ছিল আমার দিকে ক্ষেপা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। তার একটাই কারণ আমি ক্লাসে প্রথম হয়েছিলাম। ইথিলাকে দেখেছিলাম ওই ছেলের কাছে হাতজোড় করে বলতে, আমার ভাইকে কিছু বলোনা,তোমাকে চিপস কিনে দিবো। মা যে টাকা টিপিনের জন্য দিতো, তার থেকে প্রায়ই ওই ছেলেটাকে এটা ওটা খাওয়াতো, যাতে আমাকে কিছু না বলে। একদিন ইথিলা নিজের জন্য কিছু কিনেছিল, সেদিন সকালে দেরি হয়ে যাওয়ায় সে ভালো করে খেতে পারেনি। কিন্তু প্যাকেট খোলার সময় ওই ছেলেটা সেটা নেওয়ার জন্য চলে আসে, কিন্তু ইথিলা বারবার বলছিলো আজকে না আরেকদিন দিবে,ওর ভীষণ খিদে। ছেলেটা শুনেনি,জোর করে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো। এটা আমি সামনে দেখে সহ্য করতে পারলাম না, জানিনা কোথা থেকে তখন এতো রাগ আসলো, আর আমি একসাথে দুই তিনটা ঘুষি মেরে ওই ছেলেকে সেখানে ফেলে দিয়েছিলাম। এরপর স্যার বাড়িতে বিচার দিলেও সেই ছেলেটা আর আমাদের দিকে ভুলেও তাকায়নি, আর তখন থেকেই কেউ ইথিলাকে কিছু বললে তীব্র প্রতিবাদ করতাম, এমনকি মারধর পর্যন্ত করতাম। তাই কেউ এই সাহস করতে দুবার ভাবতে হতো। আর প্রতিবার আমার ক্ষতি হবে ভেবে ইথিলা পাগলের মতো কান্না করতো।

কথাগুলো বলতে ইয়াজের চোখ ছলছল করছিলো।
আমি ওড়নার একটা অংশ টেনে ওর চোখ মুছে দিলাম।

ওকে কিছু আর বললাম না। কারণ আমিও জানি ভাবী তার ভাইকে ভীষণ রকম ভালোবাসে! তবে এতকিছু জানা ছিলনা। আমিও আমার ভাইকে ভালোবাসি, তবে এখন মনে হচ্ছে ইথিলা ভাবী যতটা তার ভাইকে বাসে ততটা হয়তো পারিনি। কিন্তু সেটাকে কম বললেও হবে না, সবার মতোই স্বাভাবিক। কিন্তু ওদের দুই ভাইবোন একে অপরকে যতটা ভালোবাসে সেটা আজকাল দেখা দুষ্কর! কিন্তু মাঝখানে আমার ভাই আর ইয়াজের বোনের জীবন অসম্পূর্ণ। যার জন্য আমরা এখনো কিছু করতে পারছিনা।

পরেরদিন ছিল শুক্রবার। ইয়াজ সকাল সকাল উঠে ইথিলা ভাবীকে তৈরি হতে বললো। উদ্দেশ্য হাসপাতাল।
কিন্তু ভাবী স্বাভাবিকভাবে বললো,
___ইয়াজ দেখো আমি সুস্থ এখন। আমার কিছুই হয়নি। এটা কালকে হঠাৎ হলে নাহয় চিন্তা হতো, কিন্তু মাঝে মাঝেই হয় আবার সেরে যায়।

কিন্তু ইয়াজ মানছিলোনা। সে আজকেই যাবে।
আমার শাশুড়ী মা এসে ইয়াজকে বুঝিয়ে বললেন,
___ ইথিলা বলছে তো ওর কিছু হয়নি। কেন জোর করছিস? যদি আর এমন ব্যথা হয় তাহলে সাথে সাথে নিয়ে যাস।

মায়ের কথা শুনে ইয়াজ একটু থামলো। আর ভাবীকে বললো,
___আবার যদি ব্যথা হয়, আমাকে সাথে সাথে বলবে, নইলে কিন্তু খবর আছে।

ভাবী হেসে তারপর হ্যাঁ সম্মতিতে বললো আবার হলে জানাবে।
অন্যদিকে মা বারবার ইয়াজ আর আমার দিকে তাকাচ্ছে। কারণ আমরা দুজন একসাথেই বের হয়েছিলাম। মা হয়তো এটা নিয়ে কিছু বলতেন কিন্তু বললেন না। হয়তো ভাবছেন কিছু বললে যদি ইয়াজ আবার এমন করে!

মা চলে যাওয়ার পরে ভাবী একটু তাড়ার সাথে বললো,
___বিন্দিয়া চলো রান্না বসাই। নাস্তা তো হয়েছে, এখন রান্না শুরু করতে হবে তো।

আমি ভাবীর সাথে অগ্রসর হওয়ার আগেই থামলাম। কারণ ইয়াজ ভাবীর হাতে ধরে বলছে,
___তুমি রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। আজকে ছুটি যেহেতু আমি আর বিন্দিয়া রান্না সামলাবো। আর মা’র দিকে নজর রেখো।

ভাবী হেসে বললো,
___তোমরা দুজন পারবে তো? আচ্ছা পারলে ঠিকাছে, আমি মাকে দেখবো। তাছাড়া মা এখন ঔষধ খেয়ে ঘুমাবে।

আমি ইয়াজের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___আপনি রান্না জানেন?

ভাবী হাসতে হাসতে বললো,
___মা-বাবা যখন হজ্জ্বে ছিল, আমি তো তখন শ্বশুর বাড়িতেই ছিলাম তখন সে নিজের রান্না নিজেই করে খেয়েছে। এর আগেও আমরা ভাইবোন মিলে রান্না করে মাঝে মাঝে মা-বাবাকে চমকে দিতাম। বিষ্ময়কর হলেও সত্যি, ইয়াজের রান্না আমার চেয়েও ভালো।

ইয়াজ দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে বললো,
___ইথিলা এসব বলতে নেই। এরপর আমার বউ আমাকে দিয়ে সবসময় রান্না করাবে। তুমি আমাকে আজীবনের জন্য ফাঁসিয়ে দিচ্ছো কিন্তু।

ভাবী মুখ বাঁকিয়ে বললো,
___ আরো বলবো, একশোবার বলবো। তুমিই রান্না করবে, বিন্দিয়া আর আমি শুধু বসে বসে গল্প করবো। হাহাহাহা!

আবারো সেই দুর্দান্ত হাসির সাথে ভাবী চলে গেলো।
ইয়াজ আর আমি গেলাম রান্নাঘরে।

সবকিছু কাটাকুটি ইয়াজ করলো। আমি আস্তে আস্তে বসালাম। কিন্তু মশলাপাতি আমি ঠিক আন্দাজে আগেই দিতে পারতাম না, কেউ না কেউ বলে দিতে হয়। তবে চেষ্টা করলে পারবোনা এমন নয়। তাও আমি ইয়াজকে বলে বলে সব দিলাম।
এরপর চুলার পাশে পাতিল রাখার জায়গাটা একটু খালি করে ইয়াজ সেখানে উঠে বসে পা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
___ বাকিটা তুমি করো, আমি বসে বসে তোমাকে দেখি।

আমি লাজুকলতার হাসি হেসে ঠিকঠাক নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। এর মধ্যে ইয়াজ দুইদিনবার হাত বাড়িয়ে ঘাম মুছে দিতে দিতে বলছে,
___বউ আমার লাল হয়ে যাচ্ছে। সরো নাহলে আমি করছি।

কিন্তু আমি বললাম,
___এই সংসারের একমাত্র ছেলের বউই তো সব দায়িত্ব নিতে হবে, আর কাজকর্মও করতে হবে। আপনি কি আর সবসময় বাড়ি থাকবেন?

ইয়াজ অদ্ভুতভাবে বললো,
___আহা সংসারী বউ আমার।

এরপর একটা আমেজ নিয়ে বললো,
___আরে তরকারির ঘ্রাণটা দারুণ লাগছে। দাও একটু টেস্ট করি?

তখনি শুনি শাশুড়ী মায়ের গলার আওয়াজ। ইয়াজ হুড়মুড় করে উঠে দরজার আড়ালে লুকালো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। মা রান্নাঘরে ঢুকেই বলে,
___ঔষধ না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো আর এটা মনে হলো, পানি নিতে এসে দেখি কি সুস্বাদু ঘ্রাণ নাকে ঠেকছে, তারাতাড়ি করে এলাম। তা কি রান্না করছে আমার বউমা?

বলতেই বলতেই উনি ঢাকনা খুলে দেখলেন। চোখ বন্ধ একটু শুঁকলেন। কিন্তু আমার ভয় লাগছিলো, কারণ উনি ফিরলেই ইয়াজকে দেখে ফেলবেন। ঢুকার সময় দরজার পেছনে খেয়াল না করলেও ভেতর থেকে যাওয়ার সময় চোখ এড়াবেনা। মা উৎফুল্লের সাথে বললো,
___উমম দারুণ দারুণ। আমার তো এখনি খিদে পেয়ে গেছে।

বলেই আস্তে আস্তে মা ফিরলেন। ভয়ে আমি আর পেছনে তাকাচ্ছিলাম না। মা ফিরতেই চমকের স্বরে বললো,
___তুই এখানে কি? এদিকে ঘুরঘুর করছিস কেন?

আমি তাকিয়ে দেখি ইয়াজ একদম মায়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে মায়ের কথার জবাবে বললো,
___ মা তুমি রান্না করেছো? তাইতো এতো সুন্দর ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। রুম থেকে ছুটে এসেছি। আহহ আমার খিদে পেয়ে গেছে।

মা রাগী চেহেরায় বললো,
___ এটা কি একটা সত্যি কথা ছিল? তুই তোর বদ্ধ রুমে,ফ্যানের তীব্র বাতাসে ঘ্রাণ পাচ্ছিলি?

ইয়াজ থতমত করে বললো,
___ হ্যাঁ, তুমিও রুমে গিয়ে দেখো না, পাওয়া যায়! তোমার হাতের রান্ন বলে কথা!

চলবে…

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১১তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

মা তাচ্ছিল্যের সাথে ইয়াজকে বললো,
___আমি তোর মা, আমাকে ডান বাম শিখাতে আসিস না। আর তুই কি আমার রান্না চিনিস না? এসব যে তোর এক্সট্রা ভাব মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে, রান্না আমি করিনি,বিন্দিয়া করেছে।

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন। ইয়াজ ডান হাতের আঙুলগুলো বেঁকে ইশারা করে বললো,
___কি হলো বিন্দিয়া?

আমি হেসে বললাম,
___কি আর, আপনি ধরা খেলেন।

ইয়াজ মনটা খারাপ আবার বসলো। আর আমি ওকে এই অবস্থায় দেখে মুখ টিপে হাসলাম।
কারণ কিছু করার নেই, এক বাড়িতে লুকানো প্রেম বেশিদিন লুকায়িত থাকবেনা এটাই স্বাভাবিক।

এভাবে চলে গেলো আরো ৫ দিন।
এর মধ্যে ইয়াজ আমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেলো। সেখানে সেবার দুইদিন থেকেছিলাম। কেন জানি তখন সে সবার সাথে ভীষণভাবে ভালোভাবে কথা বললো। ভাইয়া ভাবীকে নিতে রাজী ছিল বলে হয়তো। কিন্তু সমস্যাটা এখন ওদের জায়গা থেকে, ভাবী আসার আগ্রহ দিচ্ছিলোনা। আর ইয়াজ সময় দিয়েছিলো দুজনের মনোভাব বুঝতে।
আমার মা-বাবা ইয়াজের ব্যবহারে ভীষণ খুশি ছিলো। বাবা তো আমাকে খুশিতে জড়িয়ে ধরে বললেন..বিন্দিয়া আমি বলেছিলাম না সব ঠিক হয়ে যাবে? আমিও হেসে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ বাবা আমি ভীষণ ভালো আছি।

এরপর এভাবেই চলে গেলো আরো দুইমাস। এর মধ্যে ভাবীর অসুস্থতাটা আর দেখা দেয়নি। তবে দিলেও উনি কাউকে এই ব্যপারে বলেন নি। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় অসময়ে পিরিয়ড থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো।
ইয়াজকে বিষয়টা বলতে মা দ্বিধা করলেও আমি এক মূহুর্তও অপেক্ষা করলাম না। তারাতাড়ি করে তাকে ফোন করে গাড়ী নিয়ে আসতে বললাম। আধ ঘন্টার মধ্যে ইয়াজ এসে ইথিলা ভাবীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ইমারজেন্সি অবস্থায় পরিক্ষার জন্য পাঠানো হলো। এই সংবাদ ভাইয়াকে বলেছিলাম, ভেবেছিলাম ভাইয়া মন খারাপ করবে শুধু। কিন্তু এক ঘন্টার মধ্যে ভাইয়াও এসে উপস্থিত হয়েছে।

হাসপাতালের বারান্দায় আমরা পাঁচজন। ভাইয়া,ইয়াজ,শ্বশুরবাবা আর শাশুড়ী মা, আর আমি। ভাবী বলছিলো তেমন কিছু হবে না, এতজনকে আসতে হবে না। কিন্তু কেউ শুনেনি।
ইয়াজ ভীষণ অস্থির হয়ে উঠছিলো, আর ভাইয়া সেটা হলেও চুপচাপ ছিল । কাকে কি বলবে এইটা ভেবেই উনি চুপ করে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইলেন।
বিভিন্ন রকম মেডিকেল পরিক্ষা শেষ হলেও ভাবী বের হচ্ছিলোনা। ডক্টর এর মধ্যে জানিয়েছেন ব্যপারটা জটিল, তারাতাড়ি রিপোর্ট পাওয়ার সাথে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইয়াজ ডক্টরকে যতটা প্রশ্ন করেছে সবগুলো কাঁদতে কাঁদছে করেছে। ভাইয়া চুপ থাকলেও উনার চোখে থেমে থাকা অশ্রু আমার চোখ ফাঁকি দিচ্ছিলোনা।
রিপোর্ট কি আসে সেটা পেতে যেমন তাড়া ছিল, তেমন ভেতরটাও দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো।
হঠাৎ একজন বললো, গার্জিয়ান কে আছে? উনার স্বামী কিংবা মা থাকলে ভেতরে আসেন। কেন জানি ইয়াজ তখন আমার ভাইয়াকে ইশারা করলো যেতে। ভাইয়া ধির পায়ে ডক্টরের কেবিনে গেলো। ৫ মিনিটের মধ্যে বিধ্বস্ত চেহারায় বের হলো। ভাইয়া বেরুতেই ইয়াজ গিয়ে কাঁধ ঝাকিয়ে বললো,
___কি বলেছে ডক্টর?

ভাইয়া পানি চাইলেন, উনার গলা শুকিয়ে গেছে। ইয়াজ অস্থিরতার সাথেই এক দৌঁড়ে বাইরে গেলো পানি কিনতে, দৌঁড়ে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বোতলটা হাতে দিয়ে বললো,
___ তারাতাড়ি খেয়ে বলুন ডক্টর কি বললো?

ভাইয়া পানি খেয়ে বোতলটার ক্যাপ লাগাতে লাগাতেই একদৃষ্টে কোনো একদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো। ইয়াজ এবার কাঁদতে কাঁদতে রাগ এনে বললো
,___আপনি বলবেন কিনা? নইলে আমি এখনি ভেতরে যাবো।

ভাইয়া ইয়াজের হাত ধরে বললো,
___তোমার বোনের জরায়ুতে টিউমার, সেটাও সাব মিউকাস নামক এক জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ টিউমার। এতো তারাতাড়ি মেয়েদের এই সমস্যা খুব একটা হয়না, এর মধ্যে ডক্টর বললো টিউমার অপসারণ করলেও ভ্রুণ প্রতিস্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। মানে সে আর কখনো মা হতে পারবেনা। আর খুব শীগ্রই এটা অপসারণ না হলে সেটা ক্যান্সার পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে আর তখন থাকবে মৃত্যুঝুঁকি।

ইয়াজ ফ্লোরে ধপাস করে বসে পড়লো। এটা শোনার সাথে সাথে আমার শাশুড়ী মুখ চেপে আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো, বাবাও কাঁদতেছে। আর আমার মাথা ভীষণ যন্ত্রণা করছে, চারপাশ অন্ধকার দেখছিলাম। আমি চোখ বন্ধ করে একটা পিলারে ঠেস দিয়ে বসলাম, আর অস্পষ্টভাবে শুনলাম ইয়াজ বলছে,
___আপনি বলেছেন তো অপসারণের ব্যবস্থা করতে?

ভাইয়া বললো,
___ হ্যাঁ আমি বলেছি ইথিলার জীবন আগে তারপর সব। ১০ মিনিটের মধ্যেই তারা ব্যবস্থা করবে।

আমি চোখ ঢিপঢিপ করে খুলে শেষ দেখলাম ইয়াজ কাঁদতে কাঁদতে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরেছে।

তারপর আর কিছু মনে নেই, তারপর যখন চোখ খুললাম তখন তাকিয়ে দেখি আমার হাতে একটা স্যালাইন চলছে, এখন আমার মাকেও দেখতে পাচ্ছি। ইয়াজ আমাকে চোখ খুলতে দেখেই ঠোঁট ভেঙে মর্মান্তিকভাবে কেঁদে ফেললো। আমি আস্তে আস্তে বললাম,
___ভাবী কেমন আছে? অপারেশন হয়েছে?

ইয়াজ ফ্লোরে বসে আমার হাত ধরে বললো,
___এমন কেন হলো বিন্দিয়া? দুইটা সংবাদ কেন একসাথে? আমার বোনের সাথে এটা কি হয়ে গেলো?

আমি মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে ইয়াজের দিকে তাকালাম। ধীর কণ্ঠে বললাম,
___ আর কি সংবাদ?কি হয়েছে ভাবীর?

আমার মা আমার পাশে এসে বসলেন। কান্নার মধ্যে একটা হাসি টেনে আমার হাত ধরে বললেন,
__ ইথিলার অপারেশন হয়েছে, সাথে তোর জন্য খুশির সংবাদ! তোর বাবা আর আমি নানা নানু হতে যাচ্ছি! আর ইয়াজ তোর সন্তানের বাবা হবে।

আমি আমার পেটে হাত রেখে ইয়াজের কান্নামাখা মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
এটা খুশির কান্না নাকি কষ্টের জানিনা। তবে ভাবী যখন জানবে উনি মা হতে পারবেন না, আর সেইসাথে তার ভাইয়ের সুসংবাদ, না জানি উনার কলিজাটা ফেটে আসবে! ইয়াজ হয়তো এটা ভেবেই এতো বেশি কান্না করছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে বিয়ের আগের একটা ঘটনার কথা,
ভাবী, ইয়াজ আর আমি ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ভাবী মজা করে বললেও কথাগুলো ভেতর থেকে ছিল। সেদিন বলেছিল,
___ আমার যদি আগে ছেলে হয়, আর ইয়াজের মেয়ে হয় তাহলে সেই মেয়েকে ঢুঁ মেরে আমার ছেলেকে দিয়ে নিয়ে আসবো।

আমি হেসে বলেছিলাম,
___ ইয়াজ ভাইয়ার যদি ছেলে হয়, আর তোমার মেয়ে হয়? (তখন ভালোবাসলেও সবার সামনে ভাই ডাকতাম)

ভাবী ভেবে বলেছিল,
___মেয়ে সিনিয়র হলে সমস্যা এটা বলছো? সমস্যা নাই তবুও নিয়ে আসবো। তবে আমার মেয়ে হলে, ইয়াজের ছেলে হলে সমস্যা, সে আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে। তবে আমি দোয়া করবো আমার যাতে প্রথম ছেলে হয়, এরপর মেয়ে। আর ইয়াজের প্রথম ছেলে হলেও যাতে পরে একটা হলেও মেয়ে হয় আমার ছেলের জন্য।

ভাবীর কথাগুলোকে হাসিরসিকতায় আর মাতিয়ে ইয়াজ বলেছিল,
___ইথিলা তুমি কি চাচ্ছো আমরা এই আত্মীয়তায় বোর হয়ে যাই? আমাদের আত্মীয়ের সংখ্যা আর না বাড়ুক?

তখন ভাবীও বুঝেছিলো ইয়াজ কথাটা আমার জন্য বলেছে, কারণ একে তো আমাকে বিয়ে করলে এক আত্মীয়তায় দুইটা হবে, আবার নতুন স্বপ্ন বুনে রাখলে সেটাতে তিনটা যুক্ত হবে। পুরো সম্পর্ক এক জায়গায়ই উলটপালট হবে। নতুন কোনো আত্মীয়তা আর হবে না।
ভাবী বিষয়টা চিন্তা করে চুপ করে গেছিলো।

এসব কথা মনে হতেই আমার খারাপ লাগা তীব্রতর হতে লাগলো।
একটা মেয়ে কিশোরীতে পা রেখেই মা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, বিভিন্ন বাচ্চাদের দেখলে তার মধ্যে মাতৃত্ববোধ জেগে ওঠে। সে ভাবে তার সন্তান হলে কি নাম রাখবে, কেমন করে মানুষ করবে, কেমন করে তার তুলতুলে নরম হাত ধরে ধিরে ধিরে বাড়িয়ে তুলবে।
ভাবীও তো বোধহয় এমন হাজার স্বপ্ন দেখতেন, এমন কতো অভিলাষই না ছিল উনার। সবকিছুই আজ অপূর্ণতায় ছেঁয়ে গেছে। আর কোনোদিন এমন স্বপ্ন দেখার অধিকার পাবেন না। নিয়তি এমন কেন হয়?

ইয়াজ মা’কে বললো, আমার পাশে বসতে সে ইথিলা ভাবীর কাছে যাবে। আমি ডেকে বললাম আমিও যাবো। ইয়াজ বললো,
___ স্যালাইনটা দূর্বলতা কাটানোর জন্য। তুমি এখন অসুস্থ, আর স্যালাইন শেষ হয়নি। পরে যেও।

তখনি নার্স আসলো স্যালাইন কতটুকু হয়েছে পরিক্ষা করতে। আমি উনাকে দেখেই বললাম,
___ ১০ মিনিটের জন্য এটা খুলে রাখবেন প্লিজ। আমার ভীষণ দরকার।

উনি ইয়াজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন খুলবেন কিনা! ইয়াজ বললো এই ফ্লোরেই একদম উত্তর কর্ণারে তার বোনের অপারেশন হয়েছে তাকে দেখতে চায়।
তিনি প্রথম কিছু ভাবলেন তারা বললেন,
___বেডসহ নিয়ে যেতে পারবেন। আপনি ধরেন আমিও হেল্প করছি।

তারপর দুজন মিলে দুই বারান্দা পেরিয়ে শেষ কর্ণারে গিয়ে ভাবীর কেবিনে গেলো। ভাইয়া, আমার শ্বশুর শাশুড়ী, আর আমার বাবা এখানে আছেন। এখন আমরা সবাই এক জায়গায়। ভাবীকে বেশি কথা বলতে বারণ করেছে। তাও তিনি আমাকে দেখে কাঁদার মধ্যে হাসলেন, পরক্ষণে ঠোঁট কামড়েও কান্না রোধ করতে পারছিলেন না। ইয়াজ মাথায় হাত রেখে বারবার শান্ত হওয়ার জন্য ধমক দিতে লাগলো।
আমি উনার বরাবর শুয়ে একপাশে তাকিয়ে বললাম,
___ কেন এমন হলো ভাবী?

ভাবী আমার ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে এবার অদ্ভুতভাবে হাসলেন। আস্তে আস্তে হাতটা বাড়িয়ে দিলো, ভাইয়া হাতটা আঁকড়ে ধরে কোনোরকম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। কারণ তিনি জানেন এখন কাঁদলে ভাবীও কাঁদবে আর এতে উনার ক্ষতি হবে।
ভাবী ভাইয়ার হাত ধরে ইয়াজকে বললো,
___ ভাই তুমি কষ্ট পেওনা। আমরা দুজন আবার এক হওয়ার জন্যই বোধহয় এটা হয়েছে।

ইয়াজ কিছু না বুঝে বললো,
___কি বলছো ইথিলা?

ভাবী ভাইয়ার দিকে একটু তাকালেন। ভাইয়া মাথা নেড়ে কিছু ইশারা করলেন। ভাবী তখন ধিরে ধিরে বললো,
___আমাকে ছাড়তে বলায় তোমার দুলাভাইয়ের উপর ভীষণ রাগ ছিল না? কিন্তু তুমি জানো উনি নিরুপায় হয়ে এটা চেয়েছেন! আমিও না পারতে চেয়েছিলাম। কে মা হতে চাইবেনা বলো? মেয়ের জীবন তো মাতৃত্ব ছাড়া অপূর্ণ। কিন্তু আমি আমার অপূর্ণ অভিলাষকে পূর্ণ করতে উনার কথামতো ছাড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু নিয়তি সেটা চায়নি।
উনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন, এবং বাসতেনও। কেয়ার করতেন,লুকিয়ে লুকিয়ে আমার জন্য কাঁদতেন। উনার হয়তো হাজারবার ইচ্ছে হয়েছে আমার কপালে ভালোবাসার পরশ ছোঁয়াতে কিন্তু পারেননি। কারণ তিনি আগে থেকেই জানতেন তিনি বাবা হতে পারবেন না। তাই চাইতেন উনার জন্য আমার কোনো ক্ষতি না হোক, আমি যাতে অন্য জায়গায় বিয়ে করি। উনাকে জোর করে বিয়ে করানো হয়েছিল, আর আমিও জানি বিয়েটা ভীষণ তাড়ার মধ্যে হয়েছিলো,উনি নিজের সাথে বুঝে উঠতে পারেননি কি সিদ্ধান্ত নিবেন। তাই উনি লজ্জায় সেটা চেপে রেখেছিলেন। বিয়ের পরেও খুব চেয়েছেন বলবেন কিন্তু পারেননি লোকলজ্জার ভয়ে। উনার সহকর্মীরা উনাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলবে সেটা ভেবে। আমাকে অবহেলা করার নাটক কর‍তেন, কিন্তু একটা সময় আমার কষ্ট নিজ চোখে দেখে সহ্য করতে পারেননি। সেইবার বাড়িতে যাওয়ার পরে উনি সাহস করে আমাকে পুরো বিষয়টা জানিয়ে বললেন যাতে আমি অন্যত্র বিয়ের জন্য প্রস্তুত হই। বিশ্বাস করো ইয়াজ, আমি অনেক চেষ্টা করেছি, মা আমাকে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু আমি মন স্থির করতে পারিনি। যদিও মা এখন এটা প্রথম জেনেছে,কিন্তু মা উনার অবহেলা দেওয়ার কথা শুনেই আমাকে নতুন করে সব শুরু করতে বলতো। কিন্তু আমি উনাকে ছাড়া কিচ্ছু কল্পনা করতে পারতাম না। কেন যেন মনে হতো উনার কাছে ছাড়া আমি আর কোথাও ভালো থাকবোনা। তাই একজীবন উনার জন্যই বুঝি লেখা হয়ে গেছে! আজকে উনি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন সবাইকে সত্যটা বলতে, আমরা দুজন দুজনের পাশে ছায়ার মতো থাকলে উনি আর কারো মন্তব্যকে গ্রাহ্য করবেন না। আমরা দুজনেই অপূর্ণ, আর সেই অপূর্ণতায় পূর্ণতা খুঁজে নিবো।

তারপর ভাবী চোখ মুছতে মুছতে হাতটা বাড়িয়ে আমার গালে হাত রেখে বললেন,
___ আমি ফুফি হতে যাচ্ছি, আমি ভীষণ খুশি বিন্দিয়া। তোমার সন্তানকে বলবে আমাকে যেন বড়মা ডাকে,কেমন? আমি ইয়াজের ৫ মিনিটের বড় না?

বলেই হাসিটা আর ধরে রাখতে পারলেন না। মুখ চেপে কান্না শুরু করে দিলেন।

চলবে…..

অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-০৯

0

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (৯ম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

আমার শাশুড়ীর মুখে ইথিলা ভাবীর জন্য তৃষানের বিয়ের প্রস্তাবের কথা শুনে মূহুর্তেই ইয়াজের মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করলো।
সেটা বুঝতে পেরে ভাবী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
___এই ইয়াজ তোমার কিন্তু বিচার আছে, তুমি সেদিন রাতে বাসায় না ফিরে পরেরদিন রাস্তার ওখান থেকে গাড়ীতে উঠেছিলে কেন?

ইয়াজ এই মূহুর্তে ভাবীর কথাটাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে রাগী গলায় বললো,
___ ইথিলা প্রসঙ্গ ঘুরাবেনা। একদিন আমি ছিলাম না বলে তোমরা এতদূর চলে গেছো? কি করে ভাবছো ওই তৃষান মাস্তানকে আমি মেনে নিবো? আর ইথিলা তুমি না বাদল ভাইকে ভালোবাসো? ওর জন্য তোমার এতো কান্না কি ফুরিয়ে গেছে? আমাকে না জানিয়ে তৃষানকে বাড়িতে ঢুকতে দিলে কি করে? আবার স্ব বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ারও সাহস করলো! এদিকে আমি তোমার জন্য, এতোকিছু করলাম! হাহহহ আমি এতকিছু কার জন্য করলাম?
কি করলাম আমি? সবাই তো সবার মতো করেই চলছে! আমি কেন এসব করলাম?

বলতেই বলতেই ইয়াজ কয়েক পা পিছিয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।
ইথিলা ভাবী মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
___মা তুমি কেন বললে এটা? ইয়াজ এখন কতটা ক্ষেপে গেছে ভেবেছো? তুমিও জানো তৃষানকে ইয়াজ খুব মেরেছিল, এখন এমনও তো হতে পারে তৃষান সেটার প্রতিশোধ নিতে বিয়ে করতে চাইছে ! এটা কি জানানোর খুব দরকার ছিল?
এই দেখো অন্যদিকে ইয়াজ আমার জন্য বিন্দিয়া এবং তার পরিবারের সাথে খুব খারাপ আচরণ করছে, এখন ওর ইচ্ছের বাইরে আবারও কিছু হলে সে বিন্দিয়ার সাথে আরো খারাপ ব্যবহার করবে, কারণ সে জানে বিন্দিয়া এবং তার পরিবারের খারাপ অন্তত আমি চাইনা!

আমার শাশুড়ী চুপ করে আছে। আমিও ভয় পেয়ে গেছি। সত্যিই তো ইয়াজ ওদের দুজনকে মিলাতে কতোকিছু করলো, আর এখন কিনা ওর মা ওর সামনেই অন্য জায়গায় বিয়ের ইঙ্গিত দিয়েছে! নিঃসন্দেহে এটা রেগে যাওয়ার মতোই কথা। আমারও খারাপ লাগছে এটা ভেবে, ইয়াজ ভাইয়াকে কষ্ট দিয়ে কতোকিছু করলো, সেটা করতে আমার মা বাবা পর্যন্ত কষ্ট পেয়েছে এবং পাচ্ছে! কিন্তু আমি সবকিছু মেনে নিয়েছিলাম সে দুই পরিবারকে আবার মিলিয়ে দিবে কথা দিয়েছিল বলে! কারণ আমার জীবনটা যেখানে জড়িয়ে গেছে সেখানে কোনো রকম ঘৃণার প্রভাব থাকলে দুটো পরিবারেই অশান্তি বিরাজ করবে। ভাইয়া অন্য জায়গায় বিয়ে করলেও অশান্তি হবে, আবার ইথিলা ভাবীও! এর একটাই সমাধান মিলিয়ে দেওয়া! যেটার জন্য ইয়াজ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। কেন জানি এখন আর কোনো আশা দেখছিলাম না। এতদিন ধারণা ছিল আমার ভাই চাইলেই বুঝি সবকিছু সমাধান হয়ে যাবে কিন্তু না ভাইয়ের এসব কর্মকান্ডে ইতোমধ্যে ভাবীর এবং তার মায়ের মধ্যে জেদ এসে গেছে। যেটা অস্বাভাবিক কিছুও না। এখন এই জেদে জেদে ইয়াজও জেদ করবে,তাহলে এর শেষ কি হবে ভেবে মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। একটু আগে সহজে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আসা ভাবনাটা এতো কঠিনভাবে বিপরীত হবে কল্পনা করিনি।

মা এবার নরম স্বরে বলছে,
___হ্যাঁরে ইথিলা আমার এটা বলা উচিত হয়নি। এমনি এই ছেলের পাগলাটে রাগ, এখন আরো রেগে গেছে। সারাদিন ধরে বাইরে আছে, শ্বশুরবাড়ি থেকেও নাকি খেয়ে আসেনি। এখনো এসেও না খেয়ে চলে গেলো, কে জানে আজ আর ফিরবে কিনা! না আসলে না আসুক, এতো দ্বার দ্বেরেই এই ছেলে মাথায় চড়েছে। আর পারবোনা!

প্রথম বিনয় নিয়ে বলে তারপর হঠাৎ রেগে কথাগুলো বলেই মা এখান থেকে নিজের রুমে চলে গেলেন।
ভাবী ভীষণ চিন্তার রেশ নিয়ে বসে পড়লো। ভাবী সবচেয়ে বেশি চিন্তা করছেন আমাকে নিয়ে। এবার আমি বুঝেছি ইয়াজ আমার পরিবার বাদেও নিজের পরিবারেও কেন এটা জানায়নি যে আমার উপরে তার কোনো ক্ষোভ নেই। সে হয়তো বুঝেছিলো সেটা বুঝালে ইথিলা ভাবী এবং তার মা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকবে। সে কখনোই দুই পরিবার ঠিক কর‍তে পারবেনা। ইথিলা ভাবী মানলেও তার মা মানবেনা।
আমি ভাবীর মুখেও আগে শুনতাম উনার মা অনেক রাগী, গম্ভীরতার সাথে যা স্থির করেন তাই করে বসেন। এইজন্য আগেই উনার সাথে বেশি কথা বলতে ভয় পেতাম। কিন্তু বিয়ের রাতে উনার গভীর মায়াময়ী মুখের বুলিতে সেই ধারণা বদলে ফেলেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে উনি আসলেই ইয়াজের মতো রাগী। তবে ভেতর থেকে ততটাই নরম। ইথিলা ভাবী আর ইয়াজ দেখতে এক রকম হলেও মা-বাবা দুজনের স্বভাব দুজন পেয়ে বসেছেন। বাবা ভীষণ শান্ত, যেমনটা উনার মেয়ে ইথিলা হয়েছে।
এখানে আসার পর থেকে বাবাকে খাওয়ার সময় ছাড়া দেখতেই পাইনা। হয় টিভিতে সংবাদ দেখেন,খেলা দেখেন নয়তো নিউজপেপার পড়েন। চাকরি থেকে রিটায়ার্ড হওয়ার পরে উনার জীবন এভাবেই যাচ্ছে।

রাতে খাওয়াদাওয়া করে মা ঘুমাতে চলে গেলো। ইথিলা ভাবী আর আমি কিছুক্ষণ বসে রইলাম। ইয়াজ আসছেনা, ওর ফোনও বন্ধ। আমাকে এখনো ফোন কিনে দেয়নি, আর আমিও আমার আগে চালানো ফোনটা এখানে নিয়ে আসিনি। বারবার ইথিলা ভাবীর ফোন নিয়ে ইয়াজকে ট্রাই করছিলাম।
কিন্তু কাজ হলোনা। আমি ইয়াজের এসব কান্ডে রেগে যাচ্ছিলাম।
একটা সময় ভাবী আমাকে বললো ঘুমিয়ে যেতে। ভাবীও চলে গেলেন।

রুমে গিয়েই আমার মনে হলো আরে এতক্ষণ ধরে তো জানালার কাছে গিয়ে দেখা উচিত ছিল সে আছে কিনা৷ আমি তো ভুলেই গেছিলাম। এক ফালি হাসি মাখিয়ে তারাতাড়ি করে গিয়ে জানালা খুললাম। খুলে ভীষণ হতাশার সাথে পিছিয়ে গেলাম। কেউ নাই এদিকে। জানালা বন্ধ করে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার খুললাম,কিন্তু সে নেই। কান পেতে রইলাম কখন এসে ঠকঠক আওয়াজ করবে! কিন্তু ঘন্টাখানেক চলে গেলো, কোনো আওয়াজ নেই। এবার লাস্ট খুললাম, না দেখলে ঘুমিয়ে যাবো। জানালা খুলে এবারও হতাশ হয়ে বন্ধ করতে যাবো তখনি দেখি জানালার কপাট থেকে ছোট একটা কাগজ উড়ে ভেতরে পড়েছে, তুলে দেখি লেখা আছে.
” সবাই ঘুমালে পেছনে দিকে দরজা খোলে পুকুর পাড়ে আসো ”

এটা দেখে কেমন ভয় ভয় লাগলো। দরজা খোলে বের হয়ে যাবো? যদিও চাবি আজকেও আমার কাছেই দিয়ে গেছে। কিন্তু নতুন বউ নিয়ে এমন সাহস করাটা অস্বাভাবিক লাগছে, কেউ দেখলে কি জবাব দিবো! পরক্ষণে ভাবলাম আমি ভয় পাচ্ছি কেন? ইয়াজ তো আমার স্বামী! কে কি বলবে? আর বললে সেটা ম্যনেজ করার দায়িত্ব ইয়াজের। আমি তো আর ইচ্ছে করে যেতে চাইনি। আর কিছু না ভেবে চুপচাপ বের হয়ে গেলাম। বেড়িয়েই দেখি ইয়াজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে দেখেই হাতটা বাড়িয়ে দিলো। আমি ওর হাত ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই গরমেও এখানকার বাতাসটা ভীষণ শীতল লাগছে। এখান থেকে অনেকদূর পর্যন্ত গাছ আর জমি ছাড়া কিছু দেখা যায়না, তাই সবসময় এখানে প্রচন্ড বাতাস থাকে। বিয়ের আগে ভাবী ভাইয়ার সাথে এদিকে এসে ছবি তুলেছি,কিন্তু ইয়াজের সাথে এই প্রথম।
ইয়াজ আমার কাঁধ জড়িয়ে উৎফুল্লতার সাথে বললো,
___বিয়ের পরে বউয়ের সাথে লুকিয়ে প্রেম করতে তো আমার দারুণ লাগছে। কেউ দেখে ফেলে কিনা এই আতঙ্ক থাকলে প্রেমটা জমে বেশি তাইনা?

আমি অভিমান জড়িয়ে বললাম,
___কে বলে লুকিয়ে প্রেম করতে? কেন সবাইকে টেনশন দিচ্ছেন? সব বলে দেন, জানিয়ে দেন।

ইয়াজ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___ আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু এতে তোমার ভাইও মিল চাইবেনা, আর আমার মা তো একদমই না। দেখলে তো আজ কীভাবে বললো! ইথিলাকেও এসব বুঝাবে। কিন্তু আমার কেন জানি ইথিলাকে সন্দেহ হচ্ছে, সে নিশ্চয়ই কিছু লুকাচ্ছে। নইলে মা যতোই বলুক সে কোনোদিন তৃষানকে আমাদের বাড়িতে আসতে দিতোনা। আবার সে কোনোদিন এটাও বলতোনা বাদল ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য সে পাগল হয়ে নেই। মানে সে যেতে চাচ্ছেনা।
জানো ইথিলা ভীষণ সহজ সরল, কেউ পেছন থেকে ছুড়ি মারলেও সে মুখ ফিরিয়ে জড়িয়ে ধরে বন্ধুত্ব করে ফেলে। সেখানে তো ওর ভালোবাসার প্রসঙ্গ, সে কখনোই এতটা জেদ করবেনা। তাইতো আমি এতকিছু করলাম! কিন্তু ইথিলা এটা কেন বললো, আমি কিচ্ছ বুঝতে পারছি না বিন্দিয়া!

আমি শান্ত গলায় বললাম,
___ আচ্ছা ভাবী কাউকে ভালোবাসে এমন নয়তো? আমার ভাইও কিন্তু ভীষণ সহজ মানুষ। আমার মনে হয়না ভাইয়ার এমন কিছু আছে!

ইয়াজ হেসে বললো,
___ আমি জানি তোমার ভাই সরল। আর ইথিলাও। ইথিলা মিথ্যে অভিনয় করার মতো কোনো মেয়ে না। সে আর কাউকেই ভালোবাসেনা তোমার ভাই ছাড়া।
আমার মনে হয় এখনো আরো সময় বাকি আছে, ওদের দুজনকে সময় দেওয়া উচিত। তুমিও তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই, দেখি এর মধ্যে কি হয়!

আমি ইয়াজের চোখের দিকে তাকিয়ে ধিরে ধিরে বললাম,
___বেশিনা প্রতিবার ১০ দিন একনাগাড়ে এখানে থেকে বাড়িতে একদুইদিন থাকবো কেমন? আপনি ইচ্ছে না হলে যাবেন না।

ইয়াজ আমার দিকে ভালোবাসা মিশ্রিত রাগী চোখে তাকিয়ে কাছে টেনে বললো,
___ তোমাকে না দেখে আমি কি করে থাকবো?

আমি লজ্জামাখা হাসিতে বললাম,
___তাহলে যাবেন আর কি!

বলেই আরো লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ইয়াজ হাসলো আর আমার চোখের উপর আলতো একটা চুমু খেলো।
আমি ধিরে ধিরে ওর চোখে তাকালাম,ইয়াজ ভীষন কাছে আমার। যতটা কাছে হলে আমার আঙুলে আবদ্ধতায় মুষ্টিবদ্ধ থাকে তার মাথার অর্ধেক চুল!
আর নিঃশ্বাস হয়ে আসে ভারী পুলকসঞ্চার! অনূভব করা যায় তার হৃদকম্পন! সেখান থেকে বারবার প্রতিধ্বনি আসে ভালোবাসি !

ইয়াজের সাথে থাকলে আমি সব ভুলে যাই। কেন জানি মনে হয় তাকে ছাড়া আমি যেন আর কখনোই আমিতে থাকবোনা। তারপর ভাবি ইথিলা ভাবীও তো তাহলে আমার ভাইকে খুব ভালোবেসেছিলো, উনারও তো ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাহলে। ইয়াজ যা করছে সব ঠিক তো? কবে এর পরিত্রাণ হবে?

ইয়াজ আমার হাতের আঙুলে নিজের আঙুলের জায়গা করে নিলো, আর টেনে বললো,
___চলো আমরা ঘুরি। এখন কেউ আমাদের দেখবেনা! তারপর বাসায় যাবো।

আমি ভীত গলায় বললাম,
___চোর ডাকাত ধরলে?

___আরে ভীতু, আমি থাকতে কেউ আসবেনা। এই এলাকার ৯০ ভাগ ছেলেরা আমার ভাই বন্ধু। আমাকে সবাই সম্মান করে। তাদের মধ্য থেকে কেউ যদি চোর হয়ে থাকে তাহলে সেকি আমাকে ধরবে বলো?

আমি অবাক হয়ে বললাম,
___আপনি খারাপ মানুষদের সাথেও মিশেন?

ইয়াজ হেসে বললো,
___সবার সাথেই তো কথা বলি, বেশি আন্তরিকতা না থাকলেও সবাই আমাকে ভালোবাসে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এখানে আমরা দুজন চোর ছাড়া আর কেউ নেই, কেউ আমাদের দেখলে বলবে চোর তো আজকাল বউ নিয়েও চুরি করতে বের হয়! হাহাহাহা!

বলেই কতক্ষণ ইয়াজ হাসলো। আমিও ওর অদ্ভুত সব কথায় হাসতে লাগলাম। তারপর আমাকে টেনে টেনে এখানে ওখানে নিয়ে এটা সেটা চিনালো। একদম শেষ রাতে বাসায় আসলো।

এভাবে ২ দিন চলে গেলো। সারাদিন সে বাড়ি আসেনা। সে তার মা আর ইথিলা ভাবীকে বুঝাতে চাচ্ছে তাদের উপর ভীষণ রেগে আছে। আর এতে করে যাতে মা উনার মাথায় ঘুরপাক খাওয়া সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। ইয়াজ অফিসে সকাল ১০ থেকে বিকাল ০৪ টা পর্যন্ত থাকে। বাইরেই খাওয়াদাওয়া করে, নইলে আমি লুকিয়ে এনে রাখি, সে আসলে খায়।
আর আমি ঘুমানোর বাহানায় তারাতাড়ি রুমে চলে আসি আর পেছন দিকে বের হয়ে ওর সাথে ঘুরাঘুরি করি। আবার ফিরে ওকে নিয়ে ফিরে আসি। সবাই উঠার আগেই সে আবার চলে যায়। সেদিন ইয়াজ আমাকে একটা ফোন কিনে দিলো,আর দুইটা শাড়ী।
বেশি রাত না করে দুজন তারাতাড়িই বাড়িতে ফিরলাম।
পেছনের দরজা খোলে ইয়াজকে ফিসফিস করে বললাম,
___লাইটটা জ্বালান।

ইয়াজ ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালালো। আমি তালা লাগিয়ে ভেতরের দিকে তাকিয়েই চমকে ইয়াজকে জড়িয়ে ধরলাম। ইয়াজ অবাক হয়ে বললো,
___কি হয়েছে?

আমি ছেড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ওকে ঘুরিয়ে দেখালাম ইথিলা ভাবী সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবীকে দেখেই ইয়াজ আমাকে সামনে টেনে আমার পেছনে গিয়ে লুকালো। ইথিলা ভাবী ধিরে ধিরে এগিয়ে আসলো, ইয়াজ আমাকে টানতে টানতে পেছনে গিয়ে দেয়াল পর্যন্ত আঁটকে গেলো।

চলবে….

অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-০৮

0

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (৮ম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

ভাইয়া চোখ লুকিয়ে থামা গলায় বললো..
___ ইথিলার বিয়ে!?

আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম,
___হ্যাঁ ভাইয়া আপুর তো বিয়ের কথা হচ্ছে। খুব ভালো ভালো জায়গা থেকে সব সমন্ধ!

ভাইয়া মলিনমুখেই মাথাটা একটু ঝাকালো! আর আমার দিকে আর না তাকিয়েই সেখান থেকে উঠে ধিরে ধিরে বাইরে চলে গেলো।
আর আমি অবাক হয়ে ভাইয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এমনটা আশা করিনি, ভাইয়া ভাবীর বিয়ের কথা শুনে এমন চুপসে গেলো কেন? তারপর উনাকে আপু ডাকার ব্যপারটাও ভাইয়াকে কেমন চমকে দিয়েছে!
আর বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আমি ইচ্ছে করেই মিথ্যে মিথ্যে বলেছি। যাতে বুঝতে পারি সত্যিই ইথিলা ভাবী দূরে চলে গেলে ভাইয়া খুশি হবে কিনা!
তবে উনার তো খুশি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হলোনা কেন?
ভাইয়ার কি সত্যিই কোনো প্রেমিকা আছে? আর থাকলে এখনো এই ব্যপারে কোনো কথা শুনছিনা কেন?
নিশ্চয়ই কিছু আছে, হয়তো ভাইয়া কিছু গোপন করছে, নয়তো ইথিলা ভাবী। তবে ভাইয়ার মধ্যে অজানা কিছু আছে যা কাউকে জানাতে চাচ্ছেনা। কি হতে পারে সেটা? ইয়াজকে জানাতে হবে পুরো বিষয়টা।

আমি তারাহুরো করে রুমে যেতে চাইলেই বিন্তি আমাকে আঁটকালো। ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,
___কিরে কেমন আছিস?

বিন্তি বললো,
___আমি তো ভালো আছি, তুই কেমন আছিস বল? ইয়াজ ভাইয়া কি খুব খারাপ ব্যবহার করে? তোর সাথে একদম কথা বলতে চায়না?

আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম, ওকে কি বলবো বুঝতে পারলাম না। কারণ এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছি। বিন্তি আমাকে ঝাকিয়ে আবার বললো,
___বিন্দিয়া ইয়াজ তোকে আগে এতটা ভালোবেসেও কি করে বিয়ের রাতে বাড়ি আসলোনা? তুই কি কিচ্ছু বলিস নি?

আমিও এবার বিন্তির কাঁধে হাত রাখলাম আর বললাম,
___ তুই দেখেছিস সে বাড়ি আসছে কি আসে নাই?

বিন্তি থতমত করে বললো,
___সবাই তো তাই বলছে!

আমি ভ্রু কোঁচকে বললাম,
___তো ওরা কি ছিল ইয়াজের সাথে? কি অদ্ভুত তুই! মানুষের কথা শুনে এতো মাথা ঘামাচ্ছিস। যাহ এতো চিন্তা তোর না করলেও চলবে!

বলেই আমি আমার রুমে চলে গেলাম।

রুমে যেতেই দেখি ইয়াজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কিন্তু আমার আগমন টের পেয়ে চোখ খোলে তাকালো। আমি বিছানায় বসেই অস্থির গলায় বললাম,
___শুনেন কি হয়েছে, ভাইয়াকে মিছামিছি বলেছিলাম ইথিলা ভাবীর বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে। এটা শোনার পরে ভাইয়ার চেহেরাটা পুরো পেঁচার মতো হয়ে গিয়েছিলো, ভাইয়ার সামনে ইথিলা ভাবীকে আপু ডাকছিলাম আর সেসময়ও উনি অদ্ভুতভাবে প্রশ্ন করলো ভাবী না ডেকে ইথিলা আপু কেন ডাকছি! তখন ভাইয়ার মুখ দেখে আমার মনে হয়নি ভাইয়ার অন্যত্র সম্পর্ক আছে।

ইয়াজ উঠে বসে মাথা নেড়ে বললো,
___উমম বুঝলাম।তবে তুমি কিন্তু মিথ্যে বলোনি। ইথিলার জন্য অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব আসতেছে। যারা আগে আমার জন্য ইথিলার কাছাকাছি আসতে পারতোনা তাদের মধ্যেও কয়েকজন সাহস করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে । ইথিলাকে অনেকেই পছন্দ করতো, কিন্তু আমি আমার বাড়িতে কোনো পাত্র আসতে বারণ করে দিয়েছি! কারণ জানি ইথিলা এসবে পাত্তা দিবেনা, কারণ সে তোমার বাদল ভাইকে ভালোবাসে।

আমি বিমর্ষ চেহেরায় ইয়াজের ভাঁজ করে বসা পায়ের উপর মাথা রেখে শুলাম। ইয়াজ মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করলো,
___ চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে বিন্দিয়া।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। সত্যিই ওর মধ্যে নিরাশার প্রভাব নেই। যা আছে সবটাই আশা আর ভরসা দিয়ে পূর্ণ!

রাতে খাওয়ার সময় আমাদের সাথে ভাইয়াকে মা বারবার ডাকছিলো কিন্তু ভাইয়া আসছিলোনা। কিন্তু বাবা বসেছে আমাদের সাথেই। বাবা কেন জানি সাহস করে ইয়াজকে কিছুই বলছেনা। মাও আলগা থেকে শুধু খাবার বেড়ে দিচ্ছে। কথা বলতে যেন তাদেরকে রাজ্যের ভয় কাবু করে রেখেছে। ইয়াজও বিষয়টাকে কোনো রকম পরোয়া করছেনা। কিন্তু অর্ধেক খাওয়ার পরেই ভাইয়া আসলো। ইয়াজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়েই খাবার রেখে চুপচাপ উঠে চলে গেলো। আমরা চারজন ওর দিকে ১০ সেকেন্ড তাকিয়ে একে অপরের দিকে তাকালাম। তারপর কিছু না বলে আমিও উঠে চলে গেলাম। এতে স্পষ্ট দেখলাম ভাইয়ার মুখটা সবচেয়ে বেশি ভার হয়ে গেছে। ইয়াজ প্রতি ক্ষেত্রে ভাইয়াকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিচ্ছিলো।

পরেরদিন সকাল সকালই ইয়াজ চলে যাওয়ার জন্য তাড়া করছিলো। সত্যি বলতে আজ ইয়াজের অফিস আছে, শুধু দুইদিনের ছুটি নিয়েছিলো। আর সেটা কালকেই শেষ, তাই আজকে এখান থেকে গিয়েই অফিস ধরবে।
এমনকি খাওয়ার সময় পর্যন্ত ছিল না। এদিকে আমার মা ভাবেনি সে এতো তাড়া করবে, তাই রান্না সম্পূর্ণ হয়নি। ইয়াজ সবকিছু গুছিয়ে বের হতে লাগলো, আমিও তৈরি হয়ে গেলাম। বারবার দেখছিলাম খাবার রেডি কিনা। শেষ পর্যন্ত খাবার তৈরি শেষ কিন্তু ইয়াজ বের হয়ে যাচ্ছে। আর আমি পেছন গিয়ে বললাম,
___প্লিজ অল্প খেয়ে নিন।

ইয়াজ গাড়ীতে উঠতে উঠতে মা’কে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
___এতক্ষণে রান্না করে ডাকলে আর কোনো লাভ নাই, এখন আর আমার সময় নেই! আপনার মেয়ের ইচ্ছে হলে খেতে বলেন, আমি একা চলে যাই।

মা কথাটা শুনে একটু মন খারাপ করলো। আমি হাত ধরে বললাম,
___কিছু মনে করো না। ও আসলে এমনই! সময় নেই যে তাই এভাবে বলছে!

এদিকে ভাইয়া দাঁত ব্রাশ করতে করতে এদিকে আসছিলো, আর এসেই এই বিষয়টা দেখলো আর দেখলো আমরা চলে যাচ্ছি,। অন্যদিকে ভাইয়া তাকিয়ে দেখলো ইয়াজ এভাবে বলায় মা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এবার ভাইয়াও এসে মন খারাপের স্বরে আমাকে বললো,.
___ মা’কে আগে বললে উনি ভোর রাতেই রান্না কম্পলিট করে রাখতেন, তা যাই হোক ভালো থাকিস বিন্দিয়া, আর আমায় পারলে ক্ষমা করিস।

আমি মাথা নেড়ে গাড়ীতে উঠলাম। আর তাদেরকে টাটা দিয়ে তারপর সোজা হয়ে বসলাম। খারাপ লাগছে শেষবারেও মা’কে মন খারাপ দেখে বের হতে হয়েছে। ভাগ্যিস বাবা এখনো ঘুমিয়ে আছে,নইলে উনিও এখন বিষয়টাতে আবার কষ্ট পেতেন। আর আমাকে তিনটা মুখ একসাথে খারাপ দেখে আসতে হতো। ইয়াজ আমাকে চুপ দেখে বললো,
___বাদল ভাইয়া তখনি না আসলে আমি এটা করতাম না। তোমার মা’কে এভাবে বলায় আমারও খারাপ লাগছে। আবারো সরি! তুমি রাগ করো না প্লিজ।

আমি কিছু বললাম না। সারা রাস্তা এমন গোমড়ো মুখে করেই গেলাম, মাঝ রাস্তায় ইয়াজ নেমে গেলো কারণ এদিকেই নাকি তার অফিস। আর ড্রাইভার আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলো।

পৌঁছাতেই ইথিলা ভাবী এসে আমাকে একসাথে প্রশ্ন ছুড়তে লাগলো,
___ইয়াজ কি সেখানে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছে? রাতে কোথায় ছিল?

আমি হেসে বললাম,
___রাতে আর কোথায় থাকবে? আমার সাথেই ছিল!

ভাবী মুখটা অন্য দিক ফিরিয়ে বললো,
___তোমার ভাইয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নাই তো?

আমি ভাবীর কাঁধে হাত রেখে বললাম,
___বেশি করেনি। তবে আমার সাথে যা করেছে ভাইয়া তাতেই কষ্ট পেয়েছে খুব।

ভাবী মুখটা কালো করে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি ভেতরে গিয়ে আমার শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে কুশল বিনিময় করলাম।
তাদেরও একই প্রশ্ন! ইয়াজ খারাপ ব্যবহার করেছে কিনা!
! আমিও ভাবীকে যে উত্তর দিয়েছি তাদেরকেও সেই উত্তর দিয়ে নিজের রুমে গেলাম।
ফ্রেশ হয়ে এসে অল্প খেয়ে নিলাম, ইয়াজের জন্য আমিও খেয়ে আসতে পারিনি। ইয়াজও খায়নি, আর আমাকেও খেতে দেয়নি,তবে সে বলেছে বাইরে থেকে খাবে। কে জানে এতো তারাহুরোতে খেলো কিনা! তাও আবার নতুন চাকরিতে আছে, সময় খুব কম পায়!

এদিকে সারাদিন সবার সাথে টুকটাক কাজ,কথাবার্তায় মনে হলো দিনটা দ্রুতই চলে গেছে। কিন্তু দু-টানায় ছিলাম ইয়াজ ফিরবে কিনা, কিংবা ফিরলেও তারাতাড়ি ফিরবে কিনা৷ কিন্তু আমার ধারণা বদলে দিয়ে ইয়াজ সন্ধ্যার পরেই দুই কেজি রসমালাই নিয়ে বাড়ি আসলো।
বক্স খুলেই ইথিলা ভাবীকে জোর করে একসাথে কয়েকটা খাওয়ালো। ভাবী জোর করে খেয়ে বললো,
___তোর বিয়ের তো দুইদিন হয়েছে, এটা কিসের মিষ্টি ভাই?

ভাবীর কথা শুনে আমিসহ সবাই হেসে ফেললো, তবে আমি দ্রুতই হাসি থামিয়ে দিলাম। কারণ আমি জানি ইয়াজ আমাকে নিয়ে এখন উদ্ভট কিছু বলবে, যেটা বিয়ের পর থেকে সবাইকে বুঝাচ্ছে। কিন্তু সে আমার এই ধারণাকেও বদলে দিয়ে ভাবীকে বললো,
___ইথিলা তোমার জামাই তোমাকে নিতে রাজী হয়েছে! আমার সাথে যে কাজ করে, বিন্দিয়াদের বাড়ির পাশের সবুজ ভাই, উনাকে নাকি বলেছে আমাকে এইটা জানিয়ে দিতে যে তুমি রাজী থাকলে সে তোমাকে আবার তার বাড়িতে নিবে।

বলেই ইয়াজ দুইটা রসমালাইয়েরর গোল্লা নিজের মুখে পুরলো। আমি অবাক হয়ে ভাবছি ভাই এতো তারাতাড়ি কীভাবে রাজী হলো? সত্যিই কি উনি আমার এসব দেখে, আর ইয়াজের অভিনয়ে কষ্ট পেয়ে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছেন? ভুলগুলো সত্যিই বুঝতে পেরেছেন তো? এখন কেন মনে হচ্ছিলো সবকিছু খুব দ্রুত সমাধান হওয়া কি করে সম্ভব? উপরে তাকিয়ে শুকরিয়া জানানোর আগেই ভাবী বললো,
___ইয়াজ এতো লাফাচ্ছো কেন? তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে আছি?

ভাবীর কথার সাথে সাথেই আমার শাশুড়ী বললো,
___ কাল রাতে তৃষান এসেছিলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, তোর মনে আছে ওর কথা? ইথিলাকে একবার চিঠিতে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো বলে তুই ওকে খুব মেরেছিলি? সে এখনো বিয়ে করে নাই,কিন্তু নির্দ্বিধায় ইথিলাকে বিয়ে করতে রাজী!

চলবে….

অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-০৭

0

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (৭ম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

কাঁধে কেউ চেপে বসলে মানুষ যেমনভাবে চোখের গোলা বের করে হাঁ হয়ে যায়, তেমন করে ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে!

ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো কিন্তু সেটা না বুঝিয়ে মুখ স্বাভাবিক করেই বললাম,
___আরে ভাইয়া, তুমি আজকে কোথাও যাবে না। তোমার বোন আজ শ্বশুর বাড়ি থেকে আসছে আর তুমি কিনা চলে যাবে তোমার বাবার শ্বশুরবাড়িতে, এটা হয়না!

ইয়াজ এবার ভাইয়ার দিকে ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে কাঁধটা ছিটকে ছেড়ে দিলো, আর উনার উদ্দেশ্যেই রুক্ষভাষায় বললো,
___ আজ এখান থেকে কোথাও গেলে কাল পা দুটো আর জায়গামতো নিয়ে ফিরতে পারবেন না প্রিয় সমন্ধীমশাই । যাই হোক এখন পা বাড়িয়ে দিন, সালাম করবো।

ভাইয়া ভয়ে ভয়ে দু পা পেছনে গিয়ে বললো,
___ না না এসবের দরকার নাই। আচ্ছা আমি কোথাও যাবোনা, এমনি দোয়া করবো, সালামের কোনো দরকার নেই জামাই।

বলতেই বলতেই ভাইয়া পিছাতে পিছাতে ভাইয়ার রুমের দিকে যেতে লাগলো।
আর ইয়াজ তখনি আমার দিকে রাগী চেহেরায় তাকিয়ে বললো,
___আপনার সমস্যা কি? আমাকে যে অপমান করছে চোখে পড়েনি? পুরো ভাইটার মতোই হয়ছে! ব্যাগগুলো নিয়ে রুমে রাখেন, ভ্যা ভ্যা করে তাকিয়ে আছে। যত্তসব বিশ্রীর বংশ! মুখ দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়!

এবার ভাইয়ার মতো আমিও হাঁ হয়ে গেলাম । ইয়াজ হনহন করে রুমে চলে গেলো। ভাইয়ার আর রুমে যাওয়া হলোনা, উনি দরজার সামনে থেকে ফিরে কথাগুলো শুনে স্থির হয়ে রইলেন। আর সবাই এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে একসাথে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো,
___জামাই এটা কেমন ব্যবহার করলো বিন্দিয়া? বংশ নিয়ে কথা বলছে! বিশ্রী বলছে, আবার বলছে দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়! কি এসব?

আমি সবাইকে কি জবাব দিবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার মা তো কেঁদেই দিলো। আর বাবা আমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে শুনেছে এসেছে ইয়াজ সারারাত বাড়িতেই আসেনি। সেটাও এসে সবাইকে বলেছে, কারণ সবার গুনগুনানিতে আমার কান ব্যথা হয়ে যাচ্ছে ইতোমধ্যে , এর মধ্যে একেকজন এমনও বলতেছে,
___মেয়েটার জীবন শেষ, তার আর সংসার করা হবে না। জামাই যদি বিয়ের পরেরদিনই এমন ব্যবহার করে বাকিদিন কীভাবে সংসার ঠেকাবে?

এই কথার জবাবে তাচ্ছিল্য করে আরেকজন বলছে,
___সংসার করতে এই ছেলে বিয়ে করছে নাকি? দুইদিন ইচ্ছেমতো পুতুলের মতো খেলে ছেড়ে দিবে দেখো।

আমি কিছুটা রেগে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললাম,
___ মা সবাইকে বলো, এইটা আমার স্বামী আর আমার সংসার, সে কেমন ব্যবহার করবে আর কতোদিন সংসার করবে সেটা আশেপাশের মানুষ না ভাবলেও চলবে। তারা আমাকে কোনোদিন দু আনার সাহায্য করতে আসবেনা। অন্যের দিকে না তাকিয়ে নিজের চরকায় তেল দিলে ভালো হবে।

বলেই আমি হাঁটলাম, আর তখন সবাই আস্তে আস্তে ভীড় কমাতে শুরু করলো। মা আমার পাশ ধরে একটু আগাতে আগাতে বললো,
___তোর খারাপ লাগছেনা বিন্দিয়া? কালও খারাপ আচরণ করছে?এমনকি রাতে বাড়িতেও নাকি আসেনি!

আমি মা’র দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
___ মা এমনিতে খারাপ আচরণ করলে কি হয়েছে? ইয়াজ তো আর আমাকে মারধর করছেনা। এসব খারাপ লাগার কিছুনা। ভাইয়া তো ভালোভাবে ব্যবহারের পরেও ভাবীকে ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিলো। আর শুনো, ছেড়ে যাওয়ার হলে সে হাজার ভালো ব্যবহার করলেও তুমি আমি কেউ আঁটকাতে পারবোনা, সে যাবেই। তবে কথা এটাই, আমার কপাল তো আমার ভাই নিজের কুকর্মে গড়ে দিয়েছে। আমার ভাই যা করেছে তার পরে আমার ভাগ্য গিয়ে কোথায় ঠেকবে সেটা কেউ বলতে পারবেনা।

বলতেই আমি চলে গেলাম। আর মা দাঁড়িয়ে গেলো।
আমার কথা শুনে মায়ের কষ্টটা হয়তো আরো বেড়ে গেছে।
কিন্তু আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিলো মাকে বলি, আমি খুব সুখে আছি! ইয়াজের এই রূপটাই আসল রূপ নয়। সে আমাকে ভীষণ ভালোবাসে!
কিন্তু আমার স্বামীর কথা রাখতে আমি সেটা পারলাম না। আমার ভাইকে বুঝানোর মূখ্য হাতিয়ার আমার মা’য়ের কষ্ট। মা কষ্ট পেলেই ভাই সহ্য করতে পারবেনা।

ধির পায়ে আমি রুমে গিয়ে দেখি ইয়াজ সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি মুখ বেঁকিয়ে ওকে পাশ কেটে ব্যাগটা রাখতে গেলাম।
ইয়াজ পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেই আমি সরিয়ে দিয়ে বললাম,
___ বিশ্রীর বংশের সাথে মিশবেন না, এরপর দেখবেন এখানে আপনার বংশধরের মিশ্রণ হয়ে যাচ্ছে।

ইয়াজ জোর করে কোমরে দুইহাত আঁকড়ে ধরে বললো,
___বিশ্রী আর সুশ্রী মিলে তখন অন্য রকম প্রদীপ জ্বলবে। আচ্ছা তুমি কি চাও আমাদের প্রথম সন্তান হলে সে দেখতে কার মতো হোক?

এটা শুনে আমি ফিক করে হেসে দিলাম। রাগের মধ্যে হাসি আসলেই বিষয়টা লজ্জাজনক লাগে। আমারও ঠিক সেই অবস্থা। ভীষণ লজ্জা নিয়ে বললাম,
___ তার ফুফির মতো।

ইয়াজ আমার নাক টেনে বললো,
___কিন্তু তার ফুফি আর বাবা তো একরকমই দেখতে। সরাসরি বললেই হতো বাবার মতো হবে।

তখনি আমি হাত টেনে বললাম,
___ছাড়ুন ছাড়ুন বারান্দায় ভাইয়া।

ইয়াজ একবার তাকিয়ে আরো শক্ত করে ধরে বললো,
___গ্লাসের ভেতরে আমাদের দেখবেনা। তুমি চুপ করে থেকো হ্যাঁ, আর শুনো আমি কি বলি! রাগ করো না কিন্তু!

আমি মুখটা ঘুরিয়ে ইয়াজের দুষ্ট মুখের দিকে একবার তাকালাম। আমি তাকানোর সাথে সাথে ইয়াজ গালে গাল ঘেঁষে জোরে বললো,
___ছি! এমন একটা ঘরে আমি কি করে থাকবো? তোমরা মানুষ যেমন নোংরা, তেমন রুমের অবস্থাও। তোমার যে একটা ভাই আছেনা, ওইটা তো একটা হাতি, টাকা ইনকাম করে আর খেয়ে ভুড়ি বাড়ায়। ভালো একটা পরিবেশ বানাতে পারলোনা। তোমাদের ঘরের লোকজনকে দেখেলেই কেমন অরুচি অরুচি লাগে।

এটা শুনে আমি রেগে গেলাম। আমি ইয়াজের হাতটা টেনে সরানোর চেষ্টা করতে করতে রাগে ফুঁসতে লাগলাম। আর ভাইয়াকে দেখলাম অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কানটা এদিকে দিয়ে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতেছে।

ইয়াজ আমাকে সরতে দিচ্ছেনা। যতো ছাড়াতে চাচ্ছি সে ততটা আঁকড়ে ধরছে। এখন গালে একবার ঠোঁট ছুঁয়াচ্ছে আর বলছে,
___তুমি আমার সামনে থেকে যাও তো।

এইটুকু বলে আবার ছুঁয়ে বলে,
___তোমাকে দেখলেই আমার বিরক্ত লাগে।

তারপর গাল ছেড়ে আবার গলায় ঠোঁট ঘঁষে বলে,
___আমার কথা শুনতে পাচ্ছোনা তুমি? যাও আমার সামনে থেকে।

বলেই সে হুট করে আমার কোমরে ধরে একটু উপরে তুলে এক চক্র ঘুরিয়ে আবার জায়গামতো দাঁড় করালো। সেটার সাথে সাথে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় আমার পা লেগে পাশে রাখা ছোট টি-টেবিলে রাখা জগ গ্লাস ফ্লোরে পড়ে বিকট আওয়াজের সাথে ভেঙে গেলো। আমি বুঝলাম সে ইচ্ছে করে এটা ভাইয়াকে শুনাতে করেছে। বুঝাতে চাইছে রাগে সে ভাঙচুর পর্যন্ত শুরু করেছে।

ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, উনি মুখে পেরাশানের সাথে হাত বুলাতে বুলাতে এখান থেকে সরে যাচ্ছেন। আমি এবার ইয়াজের দিকে তাকিয়ে কান টেনে ধরে বললাম,
___বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। এইগুলো যে ভেঙেছেন কিনে দিয়ে যাইয়েন!

ইয়াজ ভ্রু কোঁচকায়ে বললো,
___ বয়েই গেছে আমার!

___ তো ভাঙলেন কেন?

ইয়াজ ঠোঁটে আঙুল রেখে বললো,
___আমাদের সবার ভালো থাকার জন্য! তোমার ভাইয়ার যদি অন্য কোথাও এবার সম্পর্ক থাকে তাহলেও সেটার দিকে আগানোর কোনো রকম সাহস করবেনা। জানোতো কেন?

আমি আস্তে আস্তে বললাম,
___আমার জন্য!

ইয়াজ চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আমি ওর চোখে বারবার বোনের সুখের জন্য পূর্ণ প্রচেষ্টার প্রতিফলন দেখছিলাম। সে জানে ভাইয়া ইথিলা ভাবীকে পছন্দ করে না, তাও ইয়াজ তার জায়গায় স্থির। কারণ সে চাচ্ছে আমার ভাই তার বোনকে বিয়ে করেছিলো যেহেতু আর তার বোন আমার ভাইকে ভালোবাসে যেহেতু, তাহলে তার বোনকে নিয়েই সংসার করতে বাধ্য হতে হবে।

প্রথম আমার মনে এমন একটা ভাবনা এসেছিল যে ভাইয়া চাচ্ছেনা যেহেতু ভাইয়ার পছন্দ অনুসারেই জীবন গড়ুক, কিন্তু ইয়াজ বলে… আমার বোনও তো তার স্বামীকে ভালোবাসে, তাকে না পেলে সে এলোমেলো হয়ে যাবে। অন্য দিকে তার স্বামীও তাকে না চেয়ে অন্য কাউকে চায়। শুধু মেয়েটাই কেন ছেড়ে দিয়ে এখানে মহৎ হবে? বিয়ে যেহেতু হয়েছে, পবিত্র বন্ধনে যেহেতু আবন্ধ হয়েছে সেহেতু না চাইলেও তাকে নিয়েই সংসার করতে হবে। আর এমনটা না যে আমার বোন ছেড়ে দিয়ে ভালো থাকবে! এখন খারাপ থাকারই যদি হয় দুজন একসাথেই খারাপ থাকবে। তবুও দুজনকে একসাথে থাকতে হবে। একজনকে সুখী করে আরেকজন অসুখী হওয়ার মতো এতো ভালো মানুষির দরকার নেই।

ইয়াজ ভীষণ একগুঁয়ে, আমি জানি সে এটা করেই ছাড়বে। জোর করে হলেও আমার ভাইকে বাধ্য করবে ইথিলা ভাবীকে ফিরিয়ে আনতে।
আর আমিও এটাই চাই, তবে কেন ভাইয়ার ইচ্ছের চেয়েও আমার কাছে আমার স্বামীর ইচ্ছেটা এখন বড় মনে হচ্ছে জানা নেই।
আমি ইয়াজকে ছেড়ে বললাম,
___এসব ভেঙে ফেলার অভিনয় করে আমাকে চলে যেতে বলার অভিনয়টা যখন করলেনই তখন আমি একটু এলোমেলো চেহেরায় বাইরে গিয়ে বিষয়টা জানাই?

ইয়াজ হেসে বললো,
___অওও লক্ষী বউ আমার! যাও যাও জানাও গিয়ে। আমি একটু ঘুমাই।

আমি বের হয়ে আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুমে ঢুকলাম। গিয়ে দেখি ভাইয়া এখানেই এসে অস্থির চেহেরায় বসেছে।
আমাকে দেখেই ভাইয়া অপরাধী চেহেরায় দাঁড়িয়ে গেলো, আর বললো..
___বিন্দিয়া তুই আমাকে ক্ষমা করে দিসরে।

মা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিতে দিতে এসে বললো,
___কি হয়েছে?

ভাইয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
___মা আমার বোন আমার পাপের শাস্তি পাচ্ছে। বিশ্বাস করো, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

মা কাঁদো স্বরে রাগের মিশ্রণ করে বললো,
___ নে দেখ এবার কেমন লাগে? আরেকজনের বোনের বেলায় তো সহজেই পেরেছিলি, নিজের হলে কেমন লাগে বুঝ।

বলেই মা তাড়া করে রান্নাঘর ফিরে গেলো। হয়তো রান্না বসিয়েছে।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
___ ভাইয়া তুমি বসো।

ভাইয়া বসলো আর আমিও বসলাম। আমি বসতেই ভাইয়া বললো,
___তুই আর যাস না প্লিজ। আমি তোকে এই ছেলের সাথে যেতে দিবোনা।

আমি মাথা নেড়ে বললাম,
___না ভাইয়া ইথিলা আপু কালকেই যেতে বলেছে।

ভাইয়া আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললো,
___ইথিলা..আপু?

আমি একটু হেসে বললাম,
___হ্যাঁ ইথিলা আপু, আমার স্বামীর বোন। উনার বিয়ের ব্যপারে কথা হচ্ছে, তাই আমাদের তারাতাড়িই ফিরতে হবে।

ভাইয়া আমার কথা শুনেই কেমন আৎকে উঠলো। চোখগুলো কেমন যেন চিকচিক করে উঠেছে মূহুর্তেই। ভাইয়া চোখ লুকিয়ে থামা গলায় বললো..
___ ইথিলার বিয়ে!?

চলবে…..