Wednesday, July 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1527



সোনার সংসার পর্ব-০২

0

#সোনার সংসার
#লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম
#পর্বঃ২

“দোস্ত কাকে জড়িয়ে ধরেছিস,এটা ত তাবাসসুম নয়।”

যে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে তাকে একটা মেয়ে এসে কথাটা বলল।কথাটা বলার পরপরই সে আমাকে ছেড়ে দাঁড়ায়,,,আমি এবার মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম গায়ের রং ফর্সা,দেখতে খুব কিউট একটা মেয়ে।

“বইন কী বলছিস এটা তাবাসসুম নয়,কিন্তু তুই ত বলেছিলি যে এটাই তাবাসসুম কালো গাউন পড়নে।”(যে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল সে মেয়েটা বলল)

” তোরে আমি উস্টা মাইরা তোর শ্বশুর বাড়িতে পাঠাইয়া দিব বেদ্দপ মহিলা,আমি এখানে।”(পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল)

আমি ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পিছনে তাকিয়ে দেখি উজ্জল শ্যামলা গাঁয়ের রঙের একটা মেয়ে।তারও পরনে আমার মতই কালো গাউন পড়া।বুঝতে পারলাম মেয়েটা তাবাসসুম আর এই মেয়েটা তখন ভুল করে আমাকে জড়িয়ে ধরে।মেয়েটা আবারও বলে উঠল,,,

“দুই বছর তোর সাথে দেখা হয় নি আর এখন আমাকে চিনতেই পারলি না।”

এবার ঐ মেয়েটা বলে উঠল যে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে,,,

“সরি বইন আসলে আমি একদম খেয়াল করি নি।পান্না বলল কালো গাউন পড়াটা তাবাসসুম তাই উত্তেজিত হয়ে ভালো করে না দেখেই ওকে জড়িয়ে ধরি।”

“ঠিক আছে মাফ করে দিলাম এবার ভিক্ষা করে খা।” (বলেই তাবাসসুম মেয়েটা ফিক করে হেসে ফেলল)

আমি ওদের পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলে ওদের মধ্যে তাবাসসুম নামের মেয়েটা আমাকে বলে উঠল,,

“এই যে শোন!”

আমি ওদের সামনে দাড়িয়ে বললাম,,,

“জি বলুন।”

“আসলে সরি তামান্না ভুল করে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছে তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ।”

“না সমস্যা নেই,আমি কিছু মনে করি নি।”

মেয়েটা এবার হেঁসে বলে উঠল,,,

“আমি তাবাসসুম,,,তোমার নাম কী?”

“আমার নাম সাদিয়া।”

“তুমি কী নতুন ভার্সিটিতে?”

“জি আজই প্রথম আসলাম।”

“ওহহ,,,কোন ইয়ারে পড়ছো তুমি।”

“আমি অনার্স ফাস্ট ইয়ারে,,,আপনারা?”

“আরে ব্বাস আমরাও ত ফাস্ট ইয়ারে,,,কী নিয়ে অনার্স করছো তুমি?”

“আমি ইংরেজি নিয়ে অনার্স করছি।”

“আরে তুমি মাথা নিচু করে কেন কথা বলছো?আর আমরা ত ক্লাসমেট আপনি করেই বা কেন বলছো?যাই হোক বাদ দেও,,,ফ্রেন্ড হবে আমাদের!”

মেয়েটা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠল,,,আমিও আর কিছু না ভেবে ওদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে ফেলি।কারন ওদের সাথে কথা বলে খারাপ মনে হয় নি।আর এখানে কাউকে চিনিও না ওদের ছাড়া।অরা একে একে সবাই পরিচয় দিল,,,তখন আমাকে যে মেয়েটা জড়িয়ে ধরেছিল তার নাম তামান্না,আর কালো গাউন পড়া মেয়েটা তাবাসসুম,আরেকজনের নাম পান্না।

“শোন ফ্রেন্ড যখন হয়েছিস তখন তুই করেই বলবি।”(পান্না)

আমি হালকা হেঁসে বলে উঠলাম,,,” ঠিক আছে।”

তারপর সবাই মিলে হাসি খুশি ক্লাসে চলে আসলাম,,,ওদের সাথে হাসি ঠাট্টায় খুব ভালোই কাটল প্রতিটা ক্লাস।মাঝে দিয়ে একটা ক্লাস হবে না তাই সবাই ঠিক করলাম ক্যান্টিনে যাব।খুব গরম পড়েছে কোল্ড ড্রিংক হলে ভালো হবে তাই সবাই সেদিকে চললাম।ক্যান্টিনে গিয়ে কোল্ড ড্রিংক অর্ডার করে তামান্না আমাকে প্রশ্ন করল,,,

“তোর ব্যাপারে ত কিছুই জানা হল না শুধু তোর নামটা ছাড়া,,,আর এত চুপচাপই বা থাকিস কেন বুঝি না আমি।”

“না এমনিতেই চুপচাপ থাকতেই ভালো লাগে।”

“এমন নিরামিষ মার্কা থাকলে তরে উস্টা মাইরা তোর শ্বশুর বাড়িতে পাঠাইয়া দিব।” (তাবাসসুম)

শ্বশুর বাড়ি কথাটা শুনেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল,,,আচমকা চোখে পানি জমা হল।চোখের পানিটা আড়াল করতে চাইলে পান্না আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,,,

“আরে ইয়ার তরা কী শুরু করেছিস বলত,আমাদের সাথে থাকতে থাকতেই ঠিক হয়ে যাবে।এখন এসব বাদ দে আর দেখ ওয়েটার এত ওয়েট কেন করাচ্ছে।”

পান্নার কথা শুনে সবাই হেঁসে ফেলল,,,অতঃপর সবাই কোল্ড ড্রিংক খেয়ে ক্লাসে চলে এলাম।তারপর ক্লাস শেষ করে সবাই সবার ফোন নাম্বার নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য চললাম।আমি আসতে নিলে পান্না আমার পথ আটকায় আমি পান্নার দিকে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলাম,,

“কিছু বলবি তুই।”

“না কিছু বলব না।তোর সাথে যাব একসাথে আমার বাসাও তোর বাসা যাওয়ার রাস্তার দিকেই।”

আমি মুচকি হেসে অর সাথে পা মেলালাম।কিছু দূর আসতেই গেটের সামনে একটা পরিচিত গাড়ি দেখতে পেলাম।আমি দাড়িয়ে গেলাম,সামনে যাওয়ার কোন শক্তি পাচ্ছি না।গাড়িটা দেখার সাথে সাথেই বেহায়া চোখটা চারপাশে খুঁজতে লাগল পরিচিত সেই মুখের মালিককে।আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পান্না বলে উঠল,,,

“কী রে দাঁড়িয়ে গেলি কেন?কোন সমস্যা হয়েছে?”

“নননা ককী হবে?চল যাই।”

এক পা বাড়ানোর পরেই সেই পরিচিত মুখের মানুষটার দেখা পেলাম।গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,,,ক্রিম কালারের টিশার্ট টা গামে শরীরের সাথে লেগে রয়েছে।আগের মত মুখের উজ্জলতা আর নেই,কেমন শুকিয়ে গেছে।বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।পুরনো ক্ষতটা আবারও নতুন হয়ে উঠল,সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে চোখ সরিয়ে চলে যেতে চাইলাম।কিন্তু সে পথ আঁটকে দাড়াল আর পান্নাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

“আমি সাদিয়ার হাসবেন্ড,,,সাদিয়ার সাথে আমার একটু কথা আছে যদি আপনি একটু!”

পান্না আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল,আমি চোখের পানি লুকিয়ে পান্নার দিকে চোখের ইশারায় জানালাম পরে সবটা বলব এখন যা তুই।আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে পান্না চলে গেলো।আমি মাথা নিচু করে হাতের বইটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে দাড়িয়ে আছি।তার দিকে তাকাচ্ছি না,কিছুক্ষণ পর সে নরম গলায় বলে উঠল,,,

“কেমন আছো দিয়া?”

আমি তখনও মাথা নিচু করে চোখের পানিটা লুকাতে চাইছি,কিছু বলতে গেলেই সে বুঝে ফেলবে আমি কাঁদছি।আমি তাকে আমার চোখের পানিটা দেখাতে চাইছি না,,,নিজেকে তার কাছে আর দুর্বল দেখাব না।তাই যতটা সম্ভব নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছি।আমাকে চুপ থাকতে দেখে সে বলে উঠল,,,

“কথা বলবে না তোমার হিটলারের সাথে।”

শরীফের রাগের জন্য ভালবেসে হিটলার ডাকতাম।এই কথাটা শুনে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।নিজেকে যথা সম্ভব শক্ত করে কড়া গলায় বলে উঠলাম,,,

“কেন এসেছেন এখানে আপনি?”

“একটা কাজে এসেছিলাম তোমাকে দেখে কথা বলতে ইচ্ছে করল তাই আসলাম।” (নরম গলায়)

“কথা বলা হয়ে গেছে,এখন আমার পথ ছাড়ুন আমি বাসায় যাব।”

আমার কথা শুনে শরীফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল,,,

“বললে না ত কেমন আছো?”

“যেমন থাকার কথা তেমনই আছি,আর আমার এত ভালো মন্দের খবর আপনার নিতে হবে না।আপনি বরং আপনার নতুন বউয়ের খবর নিন তাতে কাজে হবে।”

আমার কথা শুনে শরীফ মুচকি হেঁসে বলে উঠল,,,

“তুমিই ত আমার বউ,আর এখন ত আমার বউয়ের খবরই নিচ্ছি।”

বউ কথাটা শুনে আরেকদফা বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।

“ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবেন সই করে দিব,বউয়ের দাবী নিয়ে আমার সামনে আর আসবেন না দয়া করে।ভালো থাকবেন,আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা রইল।”

তারপর শরীফকে আর কিছু বলতে না দিয়ে দৌড়ে সেখান থেকে চলে এলাম,এখন আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারছি না।নিজেকে ত সামলেই নিয়েছিলাম তবে কেন আজ সে আমার সামনে আসল।গত এক মাসে ত আমার খবর একবারও নেয় নি তবে কেন আজ আমার সামনে এসে জ্বালাটা বাড়িয়ে দিল।

#চলবে…

সোনার সংসার পর্ব-০১

0

#সোনার সংসার
#লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম
#পর্বঃ১

আমি কখনও মা হতে পারব না বলে আজ আমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করছে।আমাকে দুদিন যাবৎ একটা ঘরে আটকে রেখেছে।আমার শ্বাশুড়ি বলেছে আমার মত অলক্ষী,অপয়ার ছায়া যাতে তার ছেলের উপর না পড়ে।বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেও বলেছিল কিন্তু যাওয়ার কোন জায়গা নেই বলে মুখ বুঝে সবটা শয্য করছি।যাওয়ার জায়গা নেই বলতে আমার আজ সব থেকেও কিছু নেই।সবই আমি হারিয়েছি সাত মাস আগে।আমি আমার স্বামীর বিয়েটা চুপচাপ মেনে নিয়েছি,কারন আমি ত কখনও আমার স্বামীকে সন্তান সুখ দিতে পারব না,আর না পারব তাদের বংশধর দিতে।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে আমার ধ্যান ভাঙ্গে,,,সামনের ব্যাক্তিটিকে দেখে আমার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠে।সামনে থাকা ব্যাক্তিটি আর কেউ নয় আমারই স্বামী শরীফ আহনাফ।সে ধীর পায়ে আমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আলতো হাতে আমার গাল ছুঁয়ে কপালে ভালবাসার পরশ একে দেয়।আমি তার স্পর্শে চোখ বন্ধ করে অনুভব করি,,,পরমুহূর্তেই মনে পড়ে যায় আজ ত তার বিয়ে এখন সে এখানে কীভাবে?তবে কী বিয়েটা হয়ে গেছে!সে কী আজ অন্য কারো হয়ে গেলো?ভাবতেই বুকের ভিতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ নিজেকে যতই বোঝাই না কেন এখন আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারছি না।ইচ্ছে করছে তাঁকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে।যেখানে সে শুধু আমার হবে,শুধু আমার হবে।এসব ভাবতেই চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।আমার চোখের পানি তিনি সযত্নে মুছে দিয়ে বলে উঠে,,,

“ক্ষমা করো আমাকে।”

কথাটা শোনার পরেই একটা ব্যাথা অনুভব করি,আর ডলে পড়ি তার বুকে।সে পরম আবেশে আমাকে বুকে আগলে নেয়।

____________________________

যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করি।আমি ধরফরিয়ে বিছানা থেকে উঠতে গেলেই হাতে টান অনুভব করি।হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি স্যালাইন লাগানো,পরক্ষণেই স্যালাইন এর ক্যানেলটা টান দিয়ে খুলতে গেলে আরেকটা হাত আমার হাত ধরে ফেলে।আমি তাকিয়ে যাকে দেখি তাকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলাম না।কিন্তু তাকে দেখে আর চোখেরজল আটকে রাখতে পারি না।তাই জাপিয়ে পড়ি তার বুকে আর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি,,,

“আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি মা,আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।আমার সোনার সংসার ভেঙ্গে গেছে মা,,,আমার স্বামী আজ অন্য কারো হয়ে গেছে।আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি মা,সব হারিয়ে আজ আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।”

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠে,,,

“কে বলল তুই নিঃস্ব হয়ে গেছিস হে,আমরা আছি তোর পাশে।তোর পুরো পরিবার আছে তোর পাশে,তুই শান্ত হ মা।”

“একটা বেঈমানের জন্য না করো কাঁদতে তোমার মেয়েকে,ভালবাসা ফুরিয়ে গেছে ছেড়ে দিয়েছে।দুইদিনের ভালবাসার জন্য তোমার মেয়ে তার পরিবার পরিজন সব ছেড়ে চলে গিয়েছিল।এখন সব ভালবাসা শেষ হয়ে গেছে তাই ফেলে চলে গিয়েছে।”

দরজা দিয়ে ডুকতে ডুকতে কথাটা বলল শাহজাহান সাহেব।আমি বাবার কন্ঠ শুনে মাকে ছেড়ে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছে আর তার পাশেই আমার ছোট দুই ভাই ফরহাদ আর আরাফাত।মা বাবাকে ধমকে বলে উঠল,,,

“তুমি থামো,মেয়েটার এমনিতেই মন মানসিকতা ভালো না তার উপর তুমি এভাবে বলে মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না।”

বাবা মায়ের কথা শুনে চুপচাপ কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।আর তখনই আমার পাশে আমার ছোট ভাই আরাফাত এসে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,,,

“আপু তুই কাঁদিস না প্লিজ,তকে যে বা যারা কষ্ট দিয়েছে তাকে আমরা দুই ভাই কঠিন শাস্তি দিব।”

ছোট ভাইটার কথা শুনে তাকে বুকে আগলে ধরে আবারও কেঁদে উঠি আমি তখনই পাশে থেকে ফরহাদ ধমকে বলে উঠে,,,

“এত কাঁদিস কেন বল ত?তরা মেয়েরাও না এই একটা কাজই করতে পারিস।কান্না বন্ধ কর নয়ত এই হসপিটালের ছাদঁ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব।”

“এই তোরা থামবি,এখান থেকে যা ত তরা তোদের আপুর সাথে আমার কথা আছে,যা এখন এখান থেকে।”

মায়ের কথা শুনে চুপচাপ ফরহাদ,আরাফাত বের হয়ে যায় কেবিন থেকে।তখন মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠে,,,

“তোর বাবার কথায় কিছু মনে করিস না মা,জানিসই ত মানুষটা কত রাগি আর তুই সেদিন শরীফের সাথে পালিয়ে গেলি সেটা তোর বাবা এতদিনেও মেনে নিতে পারে নি।তাই ওভাবে বলে ফেলেছে তুই কষ্ট পাস না মা।”

“না মা কী মনে করব?বাবা তার জায়গায় ঠিকই আছে।কিন্তু মা আমি এখানে কীভাবে আর তোমরাই বা এখানে কীভাবে?”

আমার কথা শুনে মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,,,

“হসপিটাল থেকে ফোন দিয়ে তোর কথা বলল তখন সেটা শুনেই আমরা আসলাম।”

“কিন্তু আমি ত ঐ বাড়িতে ছিলাম,এখানে কীভাবে এলাম আমি।”

মা আমার কথা শুনে আবারও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,,,

“সেটা তুই ই ভালো জানবি,এখন এসব বাদ দিয়ে একটু খেয়ে নে তারপর বাড়িতে ফিরব আমরা।”

মার কথাশুনে ভাবতে লাগলাম আমি কীভাবে এখানে এলাম।তখনই মনে পড়ল গাড়ে কিছু একটা ব্যাথা অনুভব হওয়ার পর জ্ঞান হারাই তারপর আর কিছু মনে নেই।তখন মা আমার মুখের সামনে খাবার তুলে বলে উঠে,,

“হা কর,স্যুপটা খেয়ে নে।”

“আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না মা,আমি এখন কিছু খাব না।আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলো।আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে মা।”

“বাড়িতে নিয়ে যাব ত,কিন্তু তার আগে খেয়ে নে নয়ত বাড়িতে নিয়ে যাব না।”

অতঃপর মায়ের জোরাজুরিতে খেয়ে নিলাম।

__________________________

“আমি সাদিয়া,গতবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।তারপর আর পড়ার সৌভাগ্য হয় নি,শরীফের সাথে তিন বছরের রিলেশন ছিল।বাড়িতে জানানোর পর দুই পরিবারের কেউ মেনে নেয় নি তাই ভালবাসার পূর্নতা দেয়ার জন্য পালিয়ে বিয়ে করি।বিয়ের পর আর পড়াশোনার কথা মাথায় আনি নি।বাবা,মা ছোট দুই ভাই নিয়ে আমার পরিবার,,,আমার ছোট দুই ভাই টুইন।আমার বাবা ছোটখাটো একটা ব্যাবসা করে আর মা গৃহিনী।ছোট দুই ভাই ক্লাস এইটে পড়ছে।”

“শরীফের পরিবারে তার বাবা,মা,বড় এক ভাই, ভাবি আর তাদের মেয়ে স্বর্না এক বছর বয়স আর ছোট এক ভাই অমিত,সে ক্লাস সেভেনে পড়ছে।তাদের সাথে তাদের চাচা,চাচী,চাচাত বোন নিলুফাও থাকে।নিলুফা আপু শরীফের এক বছরের ছোট।অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে এবার।শরীফ এবার ডিগ্রি থার্ড ইয়ারে পড়ছে আর তার পাশাপাশি বাবা আর বড় ভাইয়ের সাথে বিজনেস সামলাচ্ছে।”

🍁🍁কেটে গেছে এক মাস,এই এক মাসে অনেক কিছু পাল্টে গেছে।নিজেকে যতটা সম্ভব শক্ত করার চেষ্টা করছি।সারাদিন নিজেকে যতই শক্ত রাখি কিন্তু রাতের বেলা আর পারি না।তখন মন খুলে কাদি।কেউ সে কান্না দেখে না,শরীফের সাথে বারবার কথা বলতে ইচ্ছে করে।সে কী আমাকে ভুলে গিয়ে তার নতুন বউকে নিয়ে সুখে আছে আমার কথা কী তার একবারও মনে পড়ে না,,,এসব ভেবে খুব কষ্ট হয়।আমার বাবাও এ কয়দিনে আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।কিন্তু বাবা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি ঐ পরিবারের কারো সাথে কোন যোগাযোগ করা যাবে না।তাই আমিও আর কারো সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি নি।ঐ বাড়িতে কারো সাথে কথা বললেই পুরনো ক্ষতটা আবার নতুন হয়ে উঠবে।আর মা সবসময় চোখে চোখে রাখে আমাকে।ছোট দুইটা ভাইও সারাদিন পাশে পাশে থাকে,,,স্কুল থেকে ফিরেই তাদের গল্পের ভান্ডার খুলে বসবে কী কী করেছে সারাদিন স্কুলে।মা চাইছে আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে জীবনটা নতুন করে সাজাতে।আমিও রাজি হয়ে যাই পড়াশোনার মধ্যে থাকলে ত নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে পারব।ব্যাস্তাতার মধ্যে থাকলে হয়ত শরীফ আহনাফ নামের লোকটার কথা ভুলে থাকতে পারব।

রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার পরপরই ফোনটা বেজে উঠে।আমি রিসিভ করে বলে উঠি,,,

“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।”

“———”

“হ্যালো,কে বলছেন আপনি?”

“———-”

“আজব ত কথা না বললে ফোন কেন দিয়েছেন?”

কথাটা বলে রেগে ফোনটা রেখে দেই আর শুতে চলে যাই।

অন্যদিকে ফোনের ওপর পাশের মানুষটা একটা তৃপ্তির হাসি হাসে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলাম।কালো একটা গাউন পরেছি তার সাথে ম্যাচিং হিজাব।চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি কালার লিপস্টিক।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিচে নেমে এলাম তারপর বাবার সাথে চললাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।বাবার পরিচিত একজনের ভার্সিটিতেই ভর্তি করাবে।দীর্ঘ এক ঘন্টা পর ভার্সিটিতে পৌঁছালাম আমরা তারপর বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে চলে যায় গাড়ি নিয়ে তার কাজে।ভার্সিটির ছুটির সময় আবার এসে নিয়ে যাবে।ভার্সিটির একজন দারোয়ান আমাকে নিয়ে যাচ্ছে আমার ক্লাসে।আমি নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে রেখেছি,,,নতুন ভার্সিটি নতুন সবকিছু।কাউকে চিনি না কীভাবে কী করব এসব ভেবে খুব নার্ভাস আমি।

এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম তখন কেউ একজন আমাকে জড়িয়ে ধরে।এমন ভাবে ধরেছে যে তাকে দেখতেও পারছি না।

#চলবে,,,

পুতুল বিয়ে পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৯ম_এবং_শেষ_পর্ব
#অনন্য_শফিক


টানা পানি ভাঙতে শুরু করে আমার।আর শরীর হয়ে আসে অসাড়। বিছানা থেকে কিছুতেই উঠতে পারি না। আমার ভয় করছে। খুব ভয় করছে।
আমার শাশুড়ি পাড়ার ধাত্রীকে ডেকে আনেন।ধাত্রী এসে আমায় দেখে বলে,’এইডা কোনো সমস্যাই না। আউয়াল কবিরাজের কাছ থিকা উতার পড়া (পানি পড়া)নিয়া আসো গিয়া।খাওয়াইয়া দিলেই দেখবা আবু (বাচ্চা)নিজেই খালাস হইয়া গেছে!’
আমার শাশুড়ি মিতুলকে খুঁজতে থাকেন। তাকে বাড়িতে খুঁজে পান না।ফোন করেন। রিং হলেও সে রিসিভ করে না। অবশেষে আমার শাশুড়ি নিজেই পানি পড়া আনতে যান। পানি পড়া নিয়ে আসেন আরো ঘন্টাখানেক পর। তখনও পেটের ব্যথাটা চিনচিনে। কষ্ট হচ্ছে খুব আমার।
সুলেমা ধাত্রী তাড়াহুড়ো করে আমায় পানি পড়া খাইয়ে দেয়।একটু পানি ছিটিয়েও দেয় শরীরের উপর।
পানি পড়ায় কোন কাজ হয় না।ব্যথা বাড়ে না। আমার সাড়া শরীর তখন কাঁপতে শুরু করে।সুলেমা ধাত্রী তার ইচ্ছেমতো চেষ্টা কসরত করে যাচ্ছে।আমি জানি এইসব কিছু আমার জন্য কতটা ক্ষতিকর। কিন্তু আমি না বলতে পারছি না।না বললে ওরা কেউ শুনবে না!
মিতুল তো জানে দু’দিন ধরে আমার শরীর খারাপ।সে নিজেই তো এর জন্য দায়ী।ওর কী উচিৎ ছিল না আমার পাশে থাকা! আমার জন্য কিছু একটা করা!
এতো দিন পর আমি বুঝতে পারি মিতুল আসলে আমার কেউ না।এই জীবন মরনের সন্ধিক্ষণেও যেহেতু সে আমার পাশে রইলো না তবে সে আমার হতে পারে কী করে?
আমার কান্না আসছে। বুকের ভেতর থেকে তীব্র বেগে ঝড়ের মতো তান্ডব চালিয়েছে সেই কান্না। আমি দু হাতে মুখ চেপে ধরে কান্না শুরু করেছি। আমার শাশুড়ি তখন বলে,’কাঁদবা না।আল্লা খোদার নাম নেও।আল্লা খোদার নাম নেও।আল্লাই আসান করবো!’
আমি চুপিচুপি আল্লাহকে ডাকি।আর মার কথা ভাবি।বড় বোনের কথা ভাবি। কেন আমি অতগুলো ভুল করলাম?কেন অন্ধ আবেগের পেছনে দৌড়ালাম দিনের পর দিন? কার জন্য আমি কাঁদলাম রাতভর। চোখের জল ফেলে কার জন্য বালিশের পেট ভেজালাম!
মা যদি আজ পাশে থাকতো তবে কোন ভয় ছিল না।হাতে একটা পয়সা না থাকলেও তিনি পয়সা জোগাড় করতেন।প্রয়োজনে নিজের শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিতেন। তবুও আমার একটু কষ্ট হতে দিতেন না!
আমার সবকিছু এখন চোখের সামনে ভাসছে। একবার ছোট্ট বেলায় ঈদের বাজারে একটা লাল টুকটুকে জামা দেখে পছন্দ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মার কাছে বললাম। কিন্তু মার হাতে জামা কেনার মতো টাকা নাই। তিনি রেগে গিয়ে বাজারেই আমায় বললেন,’খালি জামা জামা করস!টাকা কই থেকে আসে?টাকা নাই। জামা কেনা যাবে না!’
সেদিন বাজার থেকে ফেরার সময় কী যে কান্না করেছিলাম আমি!মার প্রতি খুব রাগ হয়েছিল।মনে হয়েছিল আমার মা খুব খারাপ। খুব খুব খারাপ!যার সন্তানের প্রতি কোন মায়া নাই। ভালোবাসা নাই।সে আবার মা হয় কী করে!
কিন্তু ঈদের দিন সকাল বেলা অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটলো।ঘুম থেকে মা আমায় ডেকে তুললেন।আমি ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে তাকাতেই দেখি মার হাতে সেই লাল টুকটুকে জামা।মা বললেন,’এই নে তোর কলিজা!’
সেদিন জামাটা হাতে নিয়ে কী যে খুশি হয়েছিলাম আমি! আমার জীবনে কোনদিন এমন খুশি হতে পারিনি আমি!
সবকিছু মনে পড়ছে আমার। সবকিছু। এতো দিন আমি অন্ধ ছিলাম।একটা ভ্রান্ত ঘোরের ভেতর ছিলাম আমি!সব ভুলগুলোকেও তখন সঠিক মনে হতো।কারোর কথাই আমার মাথায় ঢুকতো না।মনে হতো ওরা ভুল বলছে।আর আমি যা করছি তাই ঠিক!
কিন্তু আজ আমি বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি জীবনের ভয়ংকর একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছে গিয়েছি আমি!যেখান থেকে বেরুবার আর কোন পথ নাই!

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা এলো।পেটের ব্যথা তখনও বাড়ছে না। আমার শাশুড়ির তেমন তাড়াহুড়ো নেই। তখন রক্ত ভাঙতেও শুরু করেছে।আমি ভয়ে শিউরে উঠছি।মনে হচ্ছে মৃত্যু খুব কাছে।
এই সময় বড় চাচী এসে তাড়া দিলেন। আমার শাশুড়িকে তিনি বললেন,’মেয়েটার যদি কিছু হয় তখন বুঝবা কত ধানে কতো চাল!ওর মা আর মামারা তোমায় জন্মের শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে!’
আমার শাশুড়ি তখন ভয় পেয়ে গেলেন।আর তাড়াহুড়ো করে একটা সিএনজি ডেকে সরকারি সদর হসপিটালে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ওখানে গিয়ে পড়লাম আরো বিপাকে।নার্সেরা কাছে তেমন ঘেঁষে না।ডাক্তার আসে না।
এদিকে আমার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি আমি।তখন আর ওদের কারোর উপর আমি ভরসা করতে পারি না। মিতুল হসপিটালে এলেও আমায় একটা ভালো কথা বলে সান্তনা দেয়নি।মনে একটু সাহস জোগায়নি। হসপিটালে আমায় রেখে আবার কোথায় যেন ও নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
আমি তখন আমার শাশুড়ির কাছ থেকে ফোন নিয়ে বড় আপুর ফোনে কল করি।বড় আপু প্রথম বারেই ফোন রিসিভ করে।বলে,’কি রে রাফি তোর কোন সমস্যা?’
আমি সঙ্গে সঙ্গে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি।কথা বলতে পারি না। তবুও কষ্ট করে বলি,’আপারে,আমি জেলা সদর হসপিটালে ভর্তি।তোরা তাড়াতাড়ি আয়।দেরি করলে আমারে আর পাবি না!’
কথাটা বলে শেষ করতে করতে হাত থেকে ফোন পরে যায় নীচে। আমিও কেমন গোঙাতে থাকি কষ্টে। তীব্র যন্ত্রণায়। তখনও রক্ত ভাঙছে। কিন্তু নার্স ডাক্তারেরা আসছে না!

আপুদের আসতে এক ঘন্টা সময় লাগে।আপু আর মা আসে।মামারা কেউ আসেনি।কারণ তারা আমার নামও শুনতে পারে না।আমি তাদের মান সম্মান জলে ভাসিয়ে দিয়েছি! আমি মরে গেলেই বরং তাদের জন্য ভালো ‌।

আপু আর মা এসে আমার এই অবস্থা দেখে পাগলের মতো হয়ে যায়।আপু তখন একটা সি এনজি ভাড়া করে সঙ্গে সঙ্গে এই হসপিটাল থেকে একটা প্রাইভেট হসপিটালে নিয়ে আমায় ভর্তি করায়। ওখানে ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তার আমায় দেখে আঁতকে উঠে।বলে,’অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাচ্চাটা মে বি পানি শূন্যতাই এক্সিডেন্ট হতে পারে!’
কথাটা শুনে ফেলি আমি।আর তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলি,’আমায় মেরে ফেলুন। তবুও আমার বাবুর যেন কোন ক্ষতি না হয়!’

আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর অসীম দয়া। হসপিটালে ভর্তি হওয়ার আধঘন্টা পরই আমার সিজার হয়। এবং সুস্থ সুন্দর ছেলে বাচ্চার জন্ম হয়। বাচ্চা জন্মের পরেও তার বাবার দেখা নাই। শুধুমাত্র আমার শাশুড়ি একদিন ওখানে ছিলেন। তারপর তিনি চলে যান। আমার পেছনে যতো খরচ পত্তর প্রয়োজন সব দেন আমার মা আর বড় আপু।ওরা এক পয়সাও দেয়নি।
অবশেষে আমার ছেলেকে আমি কোলে তুলে নিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। হয়তোবা আমার একটু দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমি বুঝতে তো পারি!তাই মনে মনে কঠিন শপথ করি।বলি যে, আমার ছেলেকে আমি একা মানুষ করবো। তাকে এমনভাবে গড়ে তুলবো যে কি না নারীদের সম্মান দিতে জানবে। যেখানেই সে দেখবে কোন নারীকে অসম্মান করা হচ্ছে,ঠকানো হচ্ছে সেখানেই সে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার ছেলে পৃথিবীর অবহেলিত, নির্যাতিত সকল নারীর অধিকার আদায়ে লড়বে! নারীর অধিকার আদায়ে তার জীবন উৎসর্গ করবে!

(আপুদের কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনারা রাফির মতো অন্ধ ভালোবাসার মোহে নিজের সুন্দর জীবন নষ্ট করবেন না।আর ভাইয়ারাও ভালোবাসার নাম নিয়ে মিতুলের মতো কোন মেয়ের সুন্দর একটা জীবন নষ্ট করে দিবেন না এভাবে, অবলীলায়! ভালো হোক সবার!)

___সমাপ্ত___

পুতুল বিয়ে পর্ব-০৮

0

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৮ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



আমি যে কনসিভ করেছি এই বিষয়টা আমি আমার শাশুড়িকে জানিয়েছিলাম। জানানোর প্রয়োজন ছিল বলেই জানিয়েছিলাম।না জানালে পরে সমস্যা করতেন তিনি। অস্বীকার করতেন হয়তোবা।আমি তাকে এটাও বলেছিলাম যে,মা, আপনার ছেলেকে আপাতত এই সবের কিছু বইলেন না।ও শুনলে ঝামেলা করবে। এমনিতেই ও সন্তান নিতে রাজি ছিল না!’
শাশুড়ি বললেন,’ঠিক আছে বলবো না। তুমি টেনশন কইরো না!’
আমার কাছে বলবো না বললেও তিনি কিন্তু মিতুলকে বলেই দিলেন। মিতুল শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো।সে আমার কাছে এসেই আমায় প্রচন্ড রকম মারতে শুরু করলো। অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করে নোংরা নোংরা গাল বকতে শুরু করলো।
আমি ওর কাছে মিনতি করে বললাম,’দোহাই আল্লার এমন করো না তুমি! আমার সমবয়সী যাদের বিয়ে হয়েছে সবার সন্তান আছে।তারা সন্তানদের নিয়ে খেলা করে।সময় কাটায়। আমারও খুব ইচ্ছে হয়েছিল।তাই এটা করেছি আমি।’
মিতুল তখন বললো,’সন্তান নিয়েছো ভালো কথা। এবার এবরোশন করে ফেলো। দিন তো আর বেশি হয়নি। কেবল দু’মাস।’
আমি ওর কথা শুনে ভয়ে আঁতকে উঠলাম।সারা শরীর আমার কেমন কেঁপে উঠলো।ও অত সহজে এমন ভয়ংকর একটা কথা বলতে পারলো?
আমি তখন ওকে বললাম,’এমন কথা বলো না তুমি আমায়! নিজের সন্তানের খুনি আমি হতে পারবো না! এরচেয়ে তুমি আমায় মেরে ফেলো।এটাই ভালো হবে!’
মিতুল তখন রেগে গিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসলো।আর আমার গলায় শক্ত করে চেপে ধরলো।আরেকটুর জন্য দম আটকে গিয়েছিল প্রায়! মিতুল তখন ছেড়ে দিল।আর একটা ধাক্কা দিয়ে আমায় বিছানার উপর ফেলে দিয়ে বললো,’জাহান্নামে যা তুই !’
আমি আর কোন কথা বললাম না তখন। শুধু বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থেকে চুপিচুপি কাঁদলাম।আর ভাবতে লাগলাম,কষ্ট আমি করবোই। আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগ পর্যন্ত আমি কষ্ট করে যাবো।সে পৃথিবীতে এলেই সবকিছু বদলে যাবে।বদলে যাবে তার পিতার চরিত্রও।

আমার প্রেগন্যান্সির ছ’মাস চলছে। ইদানিং মিতুল আরো উচ্ছেন্নে গিয়েছে। আগে তো একটু আধটু বাড়িতে আসতো। কিন্তু এখন আর আসে না। রাতের বেলা বাইরে থাকে।দিনে এসে কোনদিন বিছানায় পড়ে মাতালের মতো ঘুমায়। আমার এসব দেখে আর সহ্য হয় না। জীবনে প্রথমবারের মতো প্রেগন্যান্সির সময়টাতে প্রত্যেকটি মেয়েই ভীত হয়। ভীষণ রকম আতংকে থাকে তারা। এই সময়টাতে তার একটা আপন মানুষের প্রয়োজন হয়।যে মানুষটার হাত ধরা যায় অনায়াসে।যে মানুষটা কি না তাকে সাহস জোগাবে।হাত ধরে বলবে, তোমার কিচ্ছু হবে না।এই যে আমি তোমার হাত ধরে আছি।এই হাত আর কক্ষনো ছাড়বো না!’
আমার কান্না আসে খুব!
একদিন সন্ধ্যা বেলায় মা দেখেন আমি বিছানায় পড়ে থেকে কাঁদছি। খুব খুব করে কাঁদছি।
মা তখন জিজ্ঞেস করেন,’কী হয়েছে?কাঁদতেছো কেন?’
আমি তখন কান্নাভেজা গলায় বলি,’মা, মিতুল এখন একদম আসে না ঘরে। আসলে আমার সাথে কোন কথাবার্তা বলে না।আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর দেয় না!’
মা চুপ হয়ে থাকেন।আর কোন কথা বলেন না।
আমি তখন অনুরোধের গলায় মাকে বলি।বলি,’মা, আমার পেটে তো আপনার নাতী। আপনার ছেলের সন্তান।ওর দিকে তাকিয়ে হলেও আপনি মিতুলকে একটু বুঝিয়ে বলুন।ও না এখনও খারাপ পাড়ায় যায়!’
কথাটা বলতে বলতে আবার কেঁদে উঠি আমি।
মা তখন আমার শিউরের পাশে বসেন। তারপর বলেন,’শোন বউ, এইসব নিয়ে টেনশন কইরো না! তুমি এখন গর্ভবতী। তোমার পেটে সন্তান। এখন তুমি মিতুলরে নিয়ে ভাইবো না। তুমি ভাবো তোমার সন্তান নিয়া। সন্তানের সুস্থতা নিয়া।’
আমি মার একটা হাত ধরে ফেলি খপ করে। তারপর বলি,’মা,ও খারাপ মেয়েদের সাথে গিয়ে থাকে! আমার সহ্য হয় না এসব!’
কথাটা বলতে গিয়ে আমার কী যে কান্না আসে।
মা তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,’ভয় পাইওনা। এইরকম হয়। পুরুষ মানুষ তো বুঝোই! তুমি তো গর্ভবতী।সে তোমার কাছে আসতে পারে না।এই জন্য ওইখানে যায়। বাচ্চা হোক। এরপর দেইখো ঘর থাইকাই রাতের বেলা বের হইবো না!’
মার কথা শুনে আমার প্রচন্ড রাগ পায়! একজন মা কী করে এমন বিশ্রী কথা বলতে পারে!তাও এই নোংরা কথাগুলো কতো সুন্দর করে গুছিয়ে বলছে,যেন এই কথাগুলো তেমন কিছুই না।যেন এইগুলো সভ্য সমাজেরই উদাহরণ!

দিন যায় রাত যায়। আমার চিন্তা বেড়েই চলে।কষ্ট হয় খুব। বুকের কাছে যন্ত্রণা হয়। ইচ্ছে করে কোথাও গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। কিন্তু পারি না। ওকে ছেড়ে যেতে পারি না!
আগে তো মিতুল আমার ধারে কাছেও ঘেঁষতো না। এখন আসে। এসে খারাপ ব্যবহার করে।এটা ওটা কাজ দেয়।ভারী ভারী কাজ!
অথচ আমার শরীরে পানি এসে গেছে। শরীর কেমন দূর্বল হয়ে আসছে। হাঁটতে পারি না।কষ্ট হয় খুব!এসব দেখার পরেও সে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে! জোর করে কাজ করায়।মা দেখেও কিছু বলে না। নিজেও এগিয়ে এসে কাজটা করে দেয় না!

তখন আমার প্রেগন্যান্সির আট মাস চলছে। মিতুল তখন একটা ব্যবসা শুরু করেছে। বিভিন্ন প্রোগ্রামে ডেকোরেশনের কাজ করতো। এমনিতে সে কখনো সামিয়ানা ধোয়ার জন্য বাড়িতে আনেনি।কারণ কাজের লোকেরাই সেসব ধুতো! কিন্তু একদিন হঠাৎ করে সে অনেক গুলো ময়লা হয়ে থাকা সামিয়ানা বাড়িতে নিয়ে এলো।আর আমার কাছে এসে আমায় বললো,’এইগুলো আজ দুপুরের ভেতর ধুয়ে রোদে দেও।আজ দিনে দিনে যেন শুকায়।রাতে প্রোগ্রাম আছে।এই সামিয়ানা গুলো নিয়ে ওখানে ডেকোরেইট করবো!’
আমি দেখে অবাক হয়ে যাই।এতো এতো ভারী কাপড় নিয়ে এসেছে সে আমার কাছে।এই ভার শরীর নিয়ে কী করে আমি এসব করবো?
মিতুলকে আমি একবার অনুনয়ের গলায় বলি,’মিতুল,আমি তো হাঁটতেই পারি না!কী করে এতো গুলো কাপড় ধুবো?’
মিতুল তখন শান্ত গলায় বলে,’তোমায় হাঁটতে বলিনি তো আমি!বলেছি কাপড়গুলো ধুতে।’
আমি অবাক হই ওর নির্মমতা দেখে!কী ভয়ংকর মানুষ ও!
মিতুল ঘর থেকে চলে যায়।আর যাওয়ার সময় বলে,’আমি যেন ফিরে এসে দেখি কাপড় রোদে শুকাতে দিয়েছো।আর না দিলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ!’
ও চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে কাঁদি। তারপর ভাবি কাঁদলে আর কী হবে?দোষ তো সব আমার।নিজেই তো নিজের পায়ে আমি কুড়াল মেরেছি!
তারপর অতগুলো সামিয়ানা নিয়ে বাথরুমে ঢুকি। তারপর এই ভারী এবং দূর্বল শরীর নিয়েই কাপড় কাচতে শুরু করি।
একটা সামিয়ানা কাচার পরই মিতুলের বড় চাচী আমাদের ঘরে আসেন। এসে আমায় দেখে অবাক হয়ে বলেন,’এই বউ,তুমি কী করতাছো এইসব?’
আমি ধরা গলায় তখন বলি,’কী করবো বলুন!ও তো বললো করতে!’
বড় চাচী তখন আমায় জোর করে ওখান থেকে উঠিয়ে দেন।বলেন,’মরার শখ লাগছে না খুব !এই ভার শরীর নিয়া এইসব কাজ করলে তুমি আর তোমার সন্তান কেউ বাঁইচা থাকবা না দুনিয়ায়!’
তারপর বড় চাচী নিজেই কাচতে শুরু করেন এগুলো।
মিতুল বাইরে কোথায় যেন গিয়েছিল।আজ এসেও পরে বাইরে থেকে দ্রুত। এসে দেখে আমি শুয়ে আছি। তারপর আমার কাছে এসে অবাক হয়ে বলে,’শুয়ে আছো কেন? কাপড় ধুইবা না তাইলে নাকি?’
আমি তখন কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,’ধুতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু বড় চাচী ধুতে দেননি। বললেন,এই শরীর নিয়ে কাপড় ধোয়া যাবে না।তাই তিনি নিজেই ধুয়ে দিচ্ছেন।’
মিতুল আমার মুখ থেকে কথাটা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো।আর সঙ্গে সঙ্গে আমায় বিছানা থেকে উপরে টেনে তুলে আবার জোরেই বিছানার উপর ছেড়ে দিলো। ওর এমন করায় মনে হলো আমার পেট বুঝি এই ফেটে যাচ্ছে। এবং সেদিন থেকেই আমার আরেকটা সমস্যা শুরু হলো। চিনচিন করে পেট ব্যথা। এই ব্যথা আমার জন্য খুব কষ্টদায়ক হয়! কিন্তু ওরা আমায় ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায় না।বলে,’এটা স্বাভাবিক।ডাক্তার লাগবে না। এলাকার ধাই আছে।ধাইয়েই বুঝবে সবকিছু!’

#চলবে

পুতুল বিয়ে পর্ব-০৭

0

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৭ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মিতুলের দ্বিতীয় বিয়ে টিকলো না। মানুষ বলে না যে প্রতারক নিজেও অন্যের কাছে একদিন প্রতারিত হয়।মিতুলও হলো। পিয়ার সাথে ওর বিয়ের তিনমাস পেরুতেই মিতুল জানতে পারলো পিয়া অন্য একটি ছেলের সাথে কথা বলে।ওর একটা আলাদা প্রেমের সম্পর্ক আছে। মিতুল ভেবেছিল ওর কাছ থেকে দ্রুত সড়ে আসবে। কিন্তু ওর আর নিজ থেকে সড়ে আসতে হলো না। পিয়া নিজেই একদিন বাড়ি ছেড়ে ওই ছেলের সাথে পালালো। পিয়া আর কোনদিন ওর জীবনে ফিরে এলো না!

মিতুল এবার ভেঙে পড়লো। খুব খুব ভেঙে পড়লো।সে এখন চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকে। ঠিকমতো খায় না দায় না।মন খারাপ করে বসে থাকে। সেদিন সন্ধ্যার পর আমার কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করলো।বেশ অনুতাপের গলায় বললো,’তোমায় আমি কষ্ট দিয়েছি অনেক। আল্লাহ তাই আমায় এর শাস্তি দিয়েছেন! তুমি আমায় আর বদ দোয়া দিও না। এখন থেকে আমি তোমার।তোমায় ছেড়ে আর কোথাও যাবো না!’
ওর কথাগুলো শুনে আমার ভেতরটা জুড়িয়ে গেল। মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম।মিতুলকে জড়িয়ে ধরে বললাম,’তোমার জন্য কখনোই আমি বদ দোয়া করি না। তোমার অমঙ্গল কামনা করার আগে যেন আমার নিজের অমঙ্গল হয়!’
মিতুল শুনে ভীষণ খুশি হলো।আমায় জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেতে খেতে সে বললো,’আমার লক্ষ্মী বউ। তুমি ভীষণ ভীষণ ভালো!’
তারপর থেকে আমার ভালো সময় কাটতে লাগল। মিতুল রোজ নিয়ম করে আমার কাছে আসতো।আদর করতো। ভালোবেসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতো।আমি তখন ভেবেছিলাম এই আমার সুখের দিন এসে গেছে। এখন আর কোন চিন্তা নেই!
কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। মিতুল যেন কেমন হয়ে গেছে। এখন আর বাড়িতে তেমন থাকে না। আমার কাছে ঘেঁষে না খুব একটা।টেনেও তাকে কাছে আনা যায় না!বলে ভালো লাগছে না।ক্লান্ত!
আমার তখন সন্দেহ হয়। তাই খোঁজ খবর নিতে শুরু করি। এবং খোঁজ খবর নিয়ে দেখি আমার সন্দেহ মিথ্যে নয়।যা ভেবেছি তার চেয়ে বেশিই সত্য।
মিতুল এখন খারাপ মেয়েদের কাছে যায়। ওখানেই রাত কাটায়।
আমার মাথায় হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।কী করবো আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না! ওদিকে মার কথার খেলাপ করেছি দুই দুইবার। এখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না তার কাছে।মা সহজে মেনে নিবে না। তাছাড়া মামারা মাকে খুব বকেছে।বলেছে,তোর নষ্ট মেয়ে যদি এই বাড়িতে আবার ফিরে তবে তোদের সবগুলোরে বাড়ি থেকে বের করে দিবো!
আমি আর এখন আমার পায়ের নিচে কোন মাটি দেখি না। উপায়হীন হয়ে শুধু ভাবি। ভেবে আর কোন কূল পাই না!
হ্যা আপনি এখন বলতেই পারেন, এই জমানায় এসে এমন কথা বললে চলে? চাকরি বাকরির অভাব আছে নাকি দেশে?
কিন্তু মঞ্জুরও তো অভাব নাই এই দেশে!এই অতি আধুনিক জমানায় এসেও কিন্তু এই দেশ মেয়েদের জন্য উপযুক্ত নয়। এখনও এ দেশের হাজার হাজার মেয়ে পুরুষের অত্যাচারের শিকার।নারীরাও নারীদের ধাবিয়ে রাখছে।রোজ শত শত ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে লজ্জা এবং ভয়ের ছায়ায়।কেউ মুখ খুলছে না। শুধু লেখক তার গল্পে,নাট্যকার তার নাটকে কিম্বা রাজনৈতিক বড় নেতারা তাদের বক্তৃতায় বড় বড় গলায় বলছে,নারী স্বাধীনতার কথা।নারীরা নাকি পুরোপুরি স্বাধীন। কিন্তু সত্য হলো এটাই যে নারীরা এখনও স্বাধীন নয়। নারীদের অধিকাংশই এখনও পুরুষের কতৃত্ব দীন। নিজের ইচ্ছায় যে তারা কিছু করবে তা গোটা কতক পরিবার ছাড়া অন্য কোথাও পারছে না!
আমি কাঁদি। অসহায়ের মতো।আর চারদিকে দেখি ঘন কালো অন্ধকার। এইসব অন্ধকার এসে আমায় চারিধার থেকে ঘিরে ফেলেছে। জড়িয়ে ধরেছে স্বর্ণলতার মতো।দিনদিন আমি ভেঙে পড়তে থাকি।মনে হয় মৃত্যু আমার খুব কাছে এসে গেছে।
শাশুড়ি মার কাছে এসব কথা নিয়ে ঘেঁষা যায় না। তিনি বলেন,’তুমি কী মাইয়া মানুষ না? আমার তো সন্দেহ হয়। মাইয়া মানুষ হলে স্বামীরে সন্তুষ্ট করতে পারো না কিসের জন্য?যদি সন্তুষ্ট করতেই পারতা তাইলে তো আর সে বাইরে বাইরে ঘুরতো না!অন্য নারীর কাছে যাইতো না!’
কী জঘন্য মহিলা একটা!কী বিশ্রী তার কথাগুলো! আচ্ছা আপনিই বলুন, আমাদের নারীরাই কী নারীদের পায়ের তলায় পিষে রাখছে না? তবে শুধু পুরুষকে দোষ দিবো কেন? আমার তো মনে হয় মিতুলের চেয়েও তার মা বড় অপরাধী!যদি দেশের প্রতিটা মা এমন হতো!যদি তার ছেলে কোন নারীকে অসম্মান করলে নিজের মা তার সেই অপরাধী ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ না দিয়ে নিজ হাতে খুন করতো, অপরাধের কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দিতো তবে পৃথিবী আরো অনেক আগেই শুদ্ধ হয়ে যেতো। বাতাসে বাতাসে পুরুষ আর নারীর মিষ্টি কথার সুঘ্রাণ ছড়াতো! পৃথিবীর প্রতিটি ঘর হতো ছোট ছোট স্বর্গ!

কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে মিতুলের বড় চাচীর কাছে সব খুলে বলি।তার বড় চাচী তখন বলেন,’সন্তান নেও। সন্তান নিলে দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে। আগে তোমার জায়গা পাকা করো মা।ঘরে শিখড় গাঁথুনি দেও। তারপর যা ইচ্ছা তাই করতে পারবা!’
বড় চাচীর কথাটা আমার মনে ধরে।আমি চিন্তা করি, বিয়ের যেহেতু দু- তিন বছর হয়েছে এবার তবে সন্তান নেয়া যায়। সন্তান হলে সন্তানের মায়ায় হলেও মিতুল ঘরমুখো হবে।
কিন্তু সন্তান নেয়াটা খুব কঠিন। মিতুল চাইতোই না আমরা এখন সন্তান নেই। ওর কাছে বলতেই ও রেগে যায়।বলে,’আরো চার পাঁচ বছর পর সন্তান নেয়া নেয়ি। এখন সময় হয়নি।’
আমি বলি,’সময় হয়নি কেন?আমি তো আর চাকরি বাকরি করছি না কোন!’
মিতুল বলে,’সন্তান নিলে তুমি বুড়ি হয়ে যাবে।বুড়ি বউ নিয়ে আমি সংসার করবো না!’
আমি তখন বলি,’এখনও কী তুমি আমার সাথে সংসার করো? তুমি তো থাকো পাড়ায় পাড়ায়!’
মিতুল তখন আমায় হুমকি দেয়।বলে,’এইসব নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু ঘরে আমি ফিরবোই না!’
আমি তখন চুপ হয়ে যায় একেবারে।আর কথা বলি না ভয়ে। কীভাবে কথা বলবো?ওর সাথে যাই বলতে যাবো তাই তো ওর কাছে ভুল হিসেবে গণ্য হবে!সে ভয় দেখাবে আমায়। ছেড়ে যাওয়ার ভয়!
বড় চাচীর সাথে আবার দেখা করি।বলি,’চাচী,সে তো শুনতেই পারে সন্তান নেয়ার কথা।সে বলে আরো চার পাঁচ বছর পর সন্তান নিতে। এখনও নাকি আমার সময় হয়নি!’
বড় চাচী তখন বলে,’তুমি হইলা বড় বেকুব মাইয়া।জগতে তোমার মতন যতো বেকুব মাইয়া আছে এদের কপালে শান্তি জিনিসটা নাই!ডান বাম কিছুই বুঝো না। একটা কথা শুনো, তোমার মঙ্গলের জন্য তোমায় একাই লড়তে হইবো।সে সন্তান নিতে না চাইলে না নিক। সন্তান তো আর তার পেটে থাকবে না। সন্তান থাকবে তোমার পেটে। শুরুতে গোপন রাখবা সবকিছু।পরে প্রকাশ হওয়ার সময় হলে তো এমনিতেই সব প্রকাশ হবে।’
আমি ভয়ে ভয়ে বলি,’তখন ও সবকিছু জেনে যদি সমস্যা করে?’
বড় চাচী হাসেন।বলেন,’কিছুই হইবো না। একটু রাগা গোস্বা হইবো। তারপর সব ঠিক হইয়া যাইবো। ঔরসের সন্তানের মহব্বত বড় মুহব্বত বুঝলা!’
আমি বলি,’ঠিক আছে।আমি ওকে না জানিয়েই সন্তান নিবো।’

মিতুল পৃথিবীর বিখ্যাত চতুরদের একজন! সেদিন রাতে যখন ওর কাছে বলেছিলাম আমরা সন্তান নিবো এরপর থেকেই সে স্বতর্ক হয়ে যায়। আমার কাছে কম আসে।আসলেও স্বতর্ক থাকে। নিজের হাতে পিল খাইয়ে দেয়। এতো কিছুর পরেও একদিন ওর চোখ ফাঁকি দিয়ে কনসিভ করে ফেলি আমি।আর ধরে নেয় আমার পেটের সন্তানই আমার ভাগ্য। আমার সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল ভবিষ্যত।সে জন্ম নিয়ে আমায় নতুন করে গড়বে।তার পিতাকে ঘরমুখো করবে।আর আমাদের সমস্যাপূর্ণ, ভালোবাসাহীন ঘরটা তখন ভরিয়ে তুলবে ভালোবাসাময়। আমার দুর্দিন তখন আর থাকবে না।আমি আমার সন্তান আর স্বামী নিয়ে হবো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখিদের একজন!

#চলবে

পুতুল বিয়ে পর্ব-০৬

0

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মিতুলদের বাড়িতে যাওয়ার পর কেউ আমায় মেনে নিতে চায় না।সবাই আমায় দেখে নাক সিঁটকাতে শুরু করে।যেন আমি বড় পাপিষ্ঠা মেয়ে।যেন আমার মতো নোংরা মেয়ে আর একটাও এ ধরায় নেই আর!
ওর মা আমার মুখের উপর বলে,’ঠিক ঠিকানা নাই,চাল চুলো নাই যে মেয়ের তাকে আমরা পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করতে পারবো না! তাছাড়া পালিয়ে যাওয়া একটা মেয়ে আর যায় হোক ভালো কেউ হতে পারে না!’
আমি তখন কান্নাভেজা গলায় বললাম,’মা, আপনি তাড়িয়ে দিলে কোথায় যাবো আমি? আমার তো আর যাওয়ার কোন জায়গা নাই!’
মিতুলের মা তখন বললো,’আমি তোমারে মাইনা নিতে পারবো না। কই যাবা তুমি তা আমি বলে দিতে পারবো না।যেইদিকে দুই চোউখ যায় ওইদিকে চলে যাও। এখন ভালোয় ভালোয় আমার বাড়ি ছাড়ো। আমার ছেলের পেছন ছাড়ো!’
মিতুল তখন আমায় ইশারায় বলে ওর মায়ের হাত পা ধরতে।সেও তার মার হাত পা ধরে। অনুরোধ করে। আমিও উপায় না দেখে তার মায়ের হাতে ধরি। অনুরোধ করি।বলি,’আমরা যেহেতু একটা ভুল করেই ফেলেছি আপনি আমাদের দূরে সরিয়ে দিবেন না। আপনি শুধু আমায় একবার মেনে নিন।আমি সারা জীবন আপনার অনুগত থাকবো। জীবন ভর আমি আপনার সব কথা শুনবো!’
আমার কান্না দেখে আর কথাগুলো শুনে
মিতুলের মা- বাবার মনে খানিক দয়া হয়।তারা সেবারের মতো তাদের পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেন আমায়।
এবার ভেবেছিলাম সংসারটা এখন থেকে সুন্দর হবে। এবার থেকে মিতুলকে নিয়ে সুখে বসবাস করবো আমি। আবার আমরা আগের মতো হবো। মিতুল আমার জন্য সব সময় উদগ্রীব থাকবে।আমায় পাগলের মতো ভালোবাসবে।
কিন্তু না। আমার ভাগ্য মনে হয় মন্দ।অথবা আমি সৌভাগ্য মেনে নিতে জানি না।
মিতুল আবার প্রতারণা করতে শুরু করলো আমার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে। আবার কথা বলা শুরু করে ওই মেয়েটির সাথে।আমি মাঝে মধ্যে ওকে হাতেনাতে ধরে ফেলি। কিন্তু তখন ও নানান বাহানা করে। মিথ্যে বলে আমায় সাত পাঁচ বোঝায়!
আমার এসব মেনে নিতে কষ্ট হয়।আমি কাঁদি। কাঁদতে থাকি।আর শাশুড়ি মাকে বলি।অভিযোগ করি তার কাছে।
শাশুড়ি মা বলেন,’সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য্য ধরো। ধৈর্যের ফল হয় মিষ্টি। সুস্বাদু।’
আমি ধৈর্য্য ধরি। দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকি। কিন্তু দিন দিন তার কাছে আমি একটা অবহেলার বস্তুতেই পরিণত হতে থাকি।যেন আমি মূল্যহীন কোন বস্তু।যেন আমি পঁচে যাওয়া কোন দ্রব্য।

মিতুলের পরিবার আমায় মেনে নেয়ার ছ’মাস পরের কথা-
তখন আমি একেবারেই ভেঙে পড়েছি।কারণ মিতুল তখন আমার সাথে একটা কথাও বলতো না।আমায় সহ্য করতে পারতো না। কেমন যেন হয়ে উঠছিল ও। একদিন আমার শশুর আমায় আদর মাখা গলায় বলে,’মা, তোমার উপর দিয়ে তো অনেক ঝড় ঝাপটা বয়ে যাচ্ছে। তুমিও এখন ক্লান্ত। এখানে এভাবে পড়ে থাকলে তো তুমি শেষ হয়ে যাবে। এরচেয়ে চলো তোমায় তোমার মার কাছে দিয়ে আসি আমি। ওখানে গিয়ে কদিন থাকো।আর ততোদিনে মিতুলকে আমি বুঝাবো।ওই মেয়ের বাবার সাথে কথা বলে মিতুলের জীবন থেকে ওকে দূরে সরিয়ে দিবো!’
আমি বাবার কথায় আশ্বস্ত হই।তার সাথে মার কাছে আসি।
কিন্তু মার কাছে আসার পর থেকেই নতুন এক সমস্যার সম্মুখীন হই আমি।মিতুলের ফোন বন্ধ। দিনের পর দিন কল দেই।ওপাশ থেকে রিং হয় না।সুইচ অফ।একটা অল্প বয়সী মেয়ে বারবার করে একই কথা বলে যায়। দুঃখিত, আপনার কাঙ্খিত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।কি বিরক্তিকর কথা! ইচ্ছে করে ঢিল মেরে মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলি। আবার নিজের উপরই নিজের রাগ হয়।মনে মনে বলি,কেন বাড়িতে এলাম। ওখানেই থাকতাম। চোখে চোখে রাখতাম ওকে!
তারপর হঠাৎ করে ভাবি ওদের তো ঘরের নম্বর আছে।ওর মাকে ফোন দেই। বাবাকে দেই। ফোন দিলাম ও। কিন্তু ওরা বললো তাদের ছেলে কোথায় আছে তারা জানে না।আমি আসার পর থেকেই নাকি মিতুল বাড়ি ফিরে না। নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে!
এটা কেমন ধরনের উদ্ভট কথা! চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে উঠি।ভাবি কোন বিপদ হলো কি না! তারপর বড়দের কাছে কথাটা বলি। তাদের অনেকেই ধৈর্য্য ধরার কথা বলে। আমার এক দূর সম্পর্কের মামী আছে। আল্লাহ ভক্ত মহিলা। তিনি একটা দোয়া লিখে দেন আমায়।আমি সেই দোয়া জপতে থাকি। আল্লাহর কী অসীম খুদরত।এই দোয়া যে রাতে জপেছি ঠিক এর পরদিন সকাল বেলা মিতুল ফোন করে আমায়। মোবাইলের স্ক্রিনে ওর নম্বর দেখে আমার শরীর কাঁপতে থাকে। খুশিতে ঠিক কেঁদে ফেলি আমি। তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিভ করে ভেজা গলায় বলি,’কীভাবে আমার সাথে যোগাযোগ না করে থাকছো তুমি? কোথায় ছিলে এতো দিন তুমি?কার কাছে ছিলে?’
মিতুল তখন যে কথাটা বলে তা শুনে মাথা চক্কর দিয়ে উঠে আমার।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কাঁপা হাত থেকে টুপ করে মোবাইল ফোন পড়ে যায় জমিনের উপর।
আমি আবার সেই ফোন হাতে তুলে নেয়। তারপর আবার কানে চেপে ধরে বলি,’মিতুল কী বললে তুমি এটা?’
মিতুল বলে,’কানে কী শুনতে পাও না নাকি?বলেছি আমি ওই মেয়েটা মানে পিয়াকে বিয়ে করেছি।বাবা নিজে আমাদের দুজনের বিয়ে দিয়েছেন।আমি এখন ওদের বাড়িতেই আছি। আচ্ছা এখন রাখি।পরে কথা বলবো।’
আমি এ পাশ থেকে বলি,’মিতুল তুমি বলো যা বলেছো তা মিথ্যা।একটা কথাও সত্য না।বলো তুমি আমার সাথে এতোক্ষণ ফান করেছিলে।বলো মিতুল। আমার প্রিয় মিতুল!’
মিতুল এবার রাগ পেয়ে যায় খুব।রাগত স্বরে সে বলে,’ঢং আমার ভাল্লাগে না। এখন রাখতে বলছি রাখো।আমি ঘরে যাবো। পিয়ার কাছে যাবো।ও যদি জানে তোমার সাথে কথা বলেছি তবে সে খুব রাগ করবে।আমি তাকে রাগাতে চাই না রাফি!’
আমি আর কিছু বলতে পারি না।হেলে পড়ি জমিনের উপর।মা দেখে দৌড়ে আসেন।বড় বোন আসে।মামা মামীরা এগিয়ে আসে।নাকে মুখে জল ছিটিয়ে দেয়। মাথায় জল ঢালতে থাকে।
এক সময় হুঁশ ফিরে আসে আমার। হুঁশ ফেরার পর আমি কাঁদতে থাকি।
ওরা জানতে চায় কী হয়েছে। কেন এমন করছি আমি।
আমি তখন কান্নাভেজা গলায় বলি,’আমার সব শেষ হয়ে গেছে।মিতুল আরেকটা বিয়ে করেছে।’
সবাই তখন আফশোস করতে থাকে।বলে,’এটা অন্যায়।ঘোর অন্যায়।মিতুল এমন করলেও ওর পরিবার কীভাবে এমন করতে পারে?মেনে নেয়ার পর এমন করাটা অন্যায়!’
মা এবার শক্ত হন।আমায় বলেন তিনি,’অনেক হয়েছে। এবার আমি যা বলবো তাই হবে।ওই হারামজাদাকে ডিভোর্স দিবি।এটাই ফাইনাল কথা!’
কিন্তু আমি এমন বোকা কেন?
মিতুলকে ছাড়া থাকতেই পারি না।মিতুলকে ছাড়া এই পৃথিবীতে একা বাঁচবো এটা ভাবতে গেলেই মনে হয় এরচেয়ে আমার জাহান্নাম ভোগ শত গুণে ভালো। মিতুল আমার প্রশান্তি।ও আমার ভালোবাসা। কিন্তু মিতুল তো আমায় ঠকাচ্ছে। খুব করে ঠকাচ্ছে। তবুও ওকে চাই কেন আমি?

মিতুলের সাথে আবার কথা বলি আমি।বলি,’তোমায় ছাড়া আমি কিছুতেই থাকতে পারবো না।মরে যাবো।’
মিতুল বলে,’আমি এখন তোমায় নিয়ে একা থাকতে পারবো না। বিয়ে যেহেতু পিয়াকে করেছি এখন থেকে তাই দুজনকে নিয়েই থাকতে হবে। তুমি যদি সতীন নিয়ে আমার ঘর করতে পারো তবেই আমি তোমায় আমার বাড়ি আনতে পারি।’
আমার এটা মানতে কষ্ট হয়। আমার ভালোবাসার মানুষটা তবে দু ভাগ হয়ে যাচ্ছে!
তবুও ওর বাড়িতে ফিরতেই হয় আমার। বাঁচার জন্য ফিরতে হয়।আমি জানি ওর বাড়িটা আমার জন্য যন্ত্রণাময়। আমি জানি ও আমায় ভালোবাসে না। কিন্তু সত্যি হলো এটাই যে ভালোবাসার মানুষের কাছে কাছে থাকতে পারাও যে প্রশান্তির।তার কাছ থেকে প্রাপ্ত আঘাতও যে মিষ্টি! ওকে ছাড়া যদি আমি থাকতে পারতাম তবে কোনদিন আমি ওর বাড়ি ফিরতাম না। ওকে ঠিক ডিভোর্স দিতাম। কোনদিন ওর ছায়াও মাড়াতাম না। কিন্তু ওকে ছাড়া বাঁচবো না বলেই ওর কাছে আবার ফিরতে হয় আমার।মেনে নিতে হয় ওর দ্বিতীয় বিয়ে।

#চলবে

পুতুল বিয়ে পর্ব-০৫

0

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



উপায়হীন হয়ে কী করবো না করবো বুঝতে পারছিলাম না।তাই বাসার সামনে বারান্দায় বসে কাঁদছিলাম।আর একটা অজানা ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম।
হঠাৎ একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেলো। বাসার সামনের উঠোন পেরিয়ে যে সরু রাস্তা ওখান দিয়ে আমার বড় বোনের মতো কাউকে হেঁটে যেতে দেখলাম। ওকে দেখেই কেমন চমকে উঠলাম আমি। যেখানে আগে ভয়ে ভয়ে ছিলাম ওরা যদি আমায় খুঁজে বের করে ফেলে তখন আমার কী হবে? সর্বনাশ তো হবেই। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমি হাতের নাগালে স্বর্গ পেয়েছি। বেঁচে থাকার একটা সম্বল হাতের নাগালে পেয়েছি।আমি দৌড় দিলাম।বসা থেকে উঠে এক দৌড়ে মেয়েটির কাছে গেলাম।হ্যা আপুই। আমার বড় আপু। আপুকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে ওর বুকে হামলে পড়লাম।
আপু আমার দিকে তাকিয়ে রাগে চোখ লাল লাল করে আমার গালে দুটো চড় বসিয়ে দিলো। তারপর সে নিজে থেকেই আমায় বুকে টেনে নিয়ে কাঁদতে লাগলো।আর বলতে লাগলো,’এটা কীভাবে করতে পারলি তুই? জানিস তোর কথা ভেবে মা কতবড়ো অসুখ বাঁধিয়েছে!’
আমি কথা বলতে পারি না। শুধু কাঁদি। তারপর ওকে টেনে নিয়ে বাসায় আসি।
ও বলে,’আল্লার কী খোদরত দেখ! ভেবেছিলাম অত বড় শহরে তোকে কোথায় পাবো? কিন্তু আল্লাহ খুব সহজেই তোকে পাইয়ে দিলেন। আচ্ছা মিতুল কোথায়?’
হাঁটতে হাঁটতে বাসার দিকে যাচ্ছি।আপুর কথা শুনে বুকটা আমার ধ্বক করে উঠলো।আমি ভেজা গলায় বললাম,’ও আমায় রেখে চলে গেছে!’
আপু আশ্চর্য হওয়া গলায় বললো,’কী বললি!’
আমি কেঁদে ফেললাম। কেঁদে কেঁদে বললাম,’আপু,ও একটা প্রতারক।আমি ছাড়াও ওর আরেকটা গার্লফ্রেন্ড আছে।ওর সাথে রেগ্যুলার কথা বলে।’
আপু আমায় জড়িয়ে ধরলো। সান্তনা দিলো।বললো,’ব্যাপার না।যা হবার হয়ে গেছে। আল্লাহ ভালোর জন্যই সব করেন।ও চলে গেছে তাই তুই বেঁচে গিয়েছিস। ওদের পরিবার সম্পর্কে আমরা খোঁজ নিয়েছি।ওরা ধনী হলে কী হবে ওদের চরিত্র ভালো না।ওর বাবাও খারাপ মেয়েদের কাছে যায়!’
আমি কথা বলি না।চুপ করে শুধু শুনি।
আপু বলে,’আগামীকাল সকালের ট্রেনে আমরা চলে যাবো।ঠিক আছে? তারপর বাড়িতে গিয়ে আবার তুই পড়াশোনা করবি। এখানে যা ঘটেছে তা এখানেই রেখে যাবি। সাথে নিয়ে যাওয়া যাবে না এসব চিন্তা ভাবনা!’
আমি বললাম,’আপু,কাল তো যাওয়া যাবে না।আরো দু’দিন থাকতে হবে।অফিস থেকে স্যালারি দিবে আগামী পড়শুদিন।স্যালারি নিয়ে বাসা ভাড়া চুকাতে হবে। দোকানের পাওনা আছে।’
আপু বলে,’ঠিক আছে। দু’দিন থাকবো এখানে। কোন সমস্যা নাই। আচ্ছা তোর সাথে কী কী ঘটেছে বলতো?অত প্রেমের মাঝে সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে গেল কেন?’
আমি সবকিছু খুলে বললাম আপুর কাছে। এমনকি মঞ্জুর বিষয়টাও।আপু শুনে ভয়ে আঁতকে উঠলেন।আর বললেন,’এখানে রাতে কিছুতেই থাকা যাবে না।চল।আমরা সোনাপুর যাবো। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। ওদের বাসায় দু’দিন থাকবো। তারপর ওখান থেকে এসে ভাড়া চুকিয়ে বাড়ি ফিরবো।’
আমি বললাম,’আচ্ছা।’

বাড়ি ফিরেছি আজ তিনদিন হলো।মা সত্যিই অনেক রোগা হয়ে গিয়েছেন। আমার জন্য অনেক কেঁদেছেন।কষ্ট পেয়েছেন খুব।মার জীবনটা সত্যিই কষ্টের।বাবা আমাদের ছোট্ট রেখে মারা গিয়েছিলেন।দাদু আমাদের সম্পদের ভাগ দিয়ে যাননি।দাদুর মৃত্যুর পর চাচারা মিলে আমাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমাদের পাওনা সম্পদটুকুও ওরা গ্রাস করে।মা তখন আমাদের নিয়ে মামার বাড়ি উঠে।এখানেও কত কষ্ট।মামীদের কত কথা যে শুনতে হতো তাকে।মামারাও অনেক সময় অনেক কিছু বলে বসতো।মা কাঁদতেন।সারা জীবন গেল তার কান্নায় কান্নায়। এখন আমরা বড় হয়েছি। এখন মার সুখ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার জন্য হলো না।আমি মাকে কাঁদালাম। খুব করে কাঁদালাম।কষ্ট দিলাম আবারও।
মা তবুও আমায় বুঝালেন। বললেন,’যা হয়েছে হয়েছেই। এখন অতীত ভুলে ফেল। পড়াশোনা কর। পড়াশোনা শেষ হলে একটা চাকরি নিবি। তারপর দশটা ছেলে দেখে ভালো একটা ছেলের কাছে তোকে বিয়ে দিবো!’
মার এই কথাও রাখতে পারিনি আমি।বাড়ি ফেরার এক মাস পর মিতুল আমার সাথে যোগাযোগ করে।ও সরি বলে আমার কাছে। তারপর বলে,ও আমায় ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চায়। তাছাড়া বলে, আগে তার রাগ হয়েছিল। কিন্তু এখন সে বুঝতে পেরেছে আমার সাথে এমন করা উচিৎ হয়নি। বাড়িতে এসে আমার জন্য সে অনেক কষ্ট পেয়েছে।আমায় ভুলে থাকতে পারে না সে।তাই আমায় নিতে এসেছে।
আমি বলি,’আমায় নিতে হলে ওই মেয়ের সাথে কোন যোগাযোগ রাখা যাবে না।’
মিতুল তখন বলে,’ওর সাথে কোন সম্পর্ক নাই আমার।কসম!’
তারপর মায়ের অবাধ্য হয়ে আবার ওর সাথে যাই
ওর বাড়িতে যাই।

#চলবে

পুতুল বিয়ে পর্ব-০৪

0

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক


মঞ্জুকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।আর তাকে খারাপ ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল আমার ধারণা ভুল।সে এরপর আর ক’দিন আসেনি। একদিন পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ আনতে দোকানে গেলাম। তখন মঞ্জু বললো,’বইন।আইতাম পারি না আগের মতন। সারাদিন এই কাম ওই কাম, দোকানে কাম কাজ ঝামেলা এইসব লাইগাই থাকে। তুমি আবার রাগ কইরো না।ভাইবো না তোমার ভাই তোমারে ভুইল্যা গেছে!আমি কিন্তুক তোমারে ভুলি নাই।আসবাম।আমি সময় পাগলেই আসবাম!’
মাস শেষ হতে আর তিনদিন বাকী। এরপর বোধহয় স্যালারি পাবো।স্যালারি পেলেই ওর টাকা বুঝিয়ে দিয়ে একটা হোস্টেলে উঠে যাবো। এখানে থেকে থেকে শুধু শুধু অত টাকা নষ্ট করে লাভ কি কী?

কিন্তু রাতের বেলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবি,এই বাসাটা বদলাতে পারবো না আমি কিছুতেই।বাসাটা বদলিয়ে ফেললে মিতুল আমায় কী করে খুঁজে পাবে? আমার দীর্ঘ বিশ্বাস মিতুল আসবে।আজ না হোক কাল।মিতুল আমার কাছে আসবেই! আমাকে ছাড়া ও থাকতে পারবে না!

দু’দিন পর রাত আটটার দিকে চুলোয় রান্না চড়িয়েছি আর তখনই মঞ্জু এসে হাজির। মঞ্জু এসে বলছে,’বইন, আইজকা একটু টাইম পাইছি।ভাবছি বইন কী রান্ধাবারা করে দেইখা আইগা।পেডেও খিদা আছে।ভাই বইন একলগে বইয়া গাপ্পুস গুপ্পুস খাইবাম!’
বলেই হে হে হে করে হেসে উঠেছে মঞ্জু।
আমার আবার বিরক্তি লাগছে। কিন্তু করার তো আর কিছু নাই!সে আমার কাছে পাওনাদার।আমি তার কাছে ঋণী।ঋণের দায়ে হলেও তার সাথে আমার ভালো ব্যবহার করতে হবে!
আমি বললাম,’বসেন। বেগুন দিয়ে শুঁটকি মাছ রাঁধতেছি। খাবেন!’
মঞ্জু বললো,’বইন, তোমার কাছে গ্যাস্টিকের বড়ি আছে এক আড্ডা?’
আমি বললাম,’না ভাইয়া নাই!’
মঞ্জু মুখ কুঁচকে বললো,’পেটডাত বিরাট বেদনা করতাছে।’
বলেই সে পেটে ধরে শুয়ে পড়লো।
আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। একটা লোক আমায় বোন বলে ডাকে,সে এসে আমার ঘরে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে আছে তার জন্য আমি কিছু করতে পারছি না!
মঞ্জু ব্যাথায় কঁকাচ্ছে।কঁকাতে কঁকাতে বলছে,’বইন পেটডা ছিঁইড়া যাইতাছে।ও বইন বাঁচতাম না মনে হয়! আমার পেটডা ছিঁইড়া যাইতাছে!একটু ধরবা বইন চাপ দিয়া পেটডাত!’
একটা অসুস্থ মানুষ আমার সামনে এমন ভাবে অসুখে কাতরাচ্ছে! আমায় অনুরোধ করছে তার ব্যথার পেটে একটু চাপ দিয়ে ধরার জন্য। কিন্তু আমি অস্বস্তিতে ভোগছি। ওর পেট চেপে ধরবো,এটা কী করে সম্ভব!
কিন্তু ওর আহাজারি শুনেও খারাপ লাগছিলো।আমি যখন ওর পেটে চেপে ধরবো কী ধরবো না এমন দুটানায় ভোগছি ঠিক তখন আমার একটা হাত খপ করে ধরে ফেললো মঞ্জু।সেই হাত সে টেনে নিলো তার দিকে। একেবারে তার নাভীর কাছে। তারপর। তারপর হাতটা জোর করেই টেনে নিয়ে গেল নাভির নিচের দিকে!
সঙ্গে সঙ্গে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বুঝিয়ে দিলো আসন্ন বিপদের কথা।আমি ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর হাতে একটা কামড় দিয়ে ওর কাছ থেকে কোনমতে বাঁচলাম। কিন্তু এরপর কীভাবে বাঁচবো?
মঞ্জু লাফিয়ে উঠেছে বিছানা থেকে। তারপর আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলছে,’দৌড়ঝাঁপ দিও না।ভালাই ভালাই রাজি হইয়া যাও।এতে তোমার লাভ। জীবন ভরা দোকান থাইকা বাকী খাইবা টেকা শোধ করন লাগবো না!মাছ গোশতোও কিইন্যা দিবাম আমি!’
আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছি।মানুষটা মধ্য বয়স্ক। কিন্তু গায়ে বল অনেক! কেমন হিংস্রের মতো দেখাচ্ছে।আমি দৌড়াতে চাইলাম। কিন্তু এর আগেই সে আমায় খপ করে এক হাত ধরে ফেলেছে। তারপর বলছে,’ছুডাছুডি কইরো না।তোমরার চাহিদা আমি জানি। তোমার চেহারা সুরত ভালা। চাহিদা বেশি থাকবো এইডা স্বাভাবিক বিষয়। টেকার নেশা আমার নাই। আমার নেশা মাইয়া মাইনষের।’
বলেই সে তার পকেট থেকে তিন হাজার টাকার তিনটে নোট বের করে আমার উপর ছুড়ে মারলো।
আমি ওর ফেলে দেয়া টাকার উপর থুতু ছিটিয়ে ফেললাম।
মঞ্জু এবার বললো,’তুমি কী ভাবছো আমি সাধারণ ব্যবসায়ী? এইখানে দুই টেকার দোকান দেই বইলা এইরম ভাবতাই পারো! কিন্তু আমার আরো কাজ কারবার আছে। ওইসব শুইনা তোমার লাভ নাই। এখন ভালাই ভালাই রাজি হইয়া যাও। নাইলে কিন্তুক ভেজাল হইবো কইলাম!’
মঞ্জুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া খুব কঠিন।আমি তখন মনে প্রাণে আল্লাহকে ডাকছি। আল্লাহ ছাড়া আমায় রক্ষা করার মতো তখন আর কেউ নাই!
মঞ্জু আমায় পেছন থেকে জাপটে ধরে ফেলে।আর তখনই বারান্দার কলিং বেল বেজে উঠে।কে এসেছে জানি না।যেই আসুক আমার মনে একটা সাহস সঞ্চার হয়।আমি আশার আলো দেখতে পাই। মুহূর্তে ওর হাতে কুটুস করে একটা কামড় বসিয়ে দেই। মঞ্জু তখন আমায় ছেড়ে দিয়ে তার হাতের দিকে মনোযোগ দেয়।আর আমি সুযোগ পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেই।
দরজা খুলতেই দেখি আমার সামনে মিতুল দাঁড়ানো। সঙ্গে সঙ্গে আমি মিতুলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি।আর কাঁদতে থাকি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলি,’ওর হাত থেকে বাঁচাও আমায়!ওই শয়তানটার হাত থেকে বাঁচাও!’
মঞ্জু একটুও ঘাবড়ে যায় না তখন।ভয়ও পায় না।সে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায় আর মিতুলকে সে বলে,’আপনের বউ আমার টেকা খাইছে।টেকার বিনিময়ে তার সাথে আমার শারিলীক সম্পরক্ষ করার ওয়াদা আছিলো। ওয়াদা রক্ষা করার লাইগা আইছিলাম।আপনে আইয়া দিলেন গিড়িঙ্গি বাজাইয়া!’
বলে মঞ্জু চলেই যাচ্ছিলো। ঠিক তখন মিতুল আমায় পেছনে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে মঞ্জুর জামায় পেছন থেকে খামচে ধরলো। তারপর এক লাথি দিয়ে ওকে জমিনের উপর ফেলে দিয়ে ওর ঘাড় চেপে ধরে বললো,’তুই একটা নোংরা লোক। আমি আমার স্ত্রীকে চিনি।তোর কথা মিথ্যে। তোকে আমি পুলিশে দিবো!’
মঞ্জু খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলো তখন।আর বললো,’তোর ইজ্জত থাকবো না ছেড়া!জনে জনে জানবো তোর বউ একটা নডি!’
মিতুল দাঁতে দাঁত কামড়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ছেড়ে দিল।
মঞ্জু ছাড়া পেয়েই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল।ও চলে যাওয়ার পর মিতুল আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ঘরের ভেতর। তারপর বললো,’ওর সাথে তোর কী চুক্তি ছিল?’
আমি অবাক হওয়া গলায় বললাম,’কিসের চুক্তি?’
‘ওর কাছ থেকে বাকীতে বাজার এনে খেয়েছিস।আর বিনিময়ে—-
মিতুলকে কথাটা শেষ করতে দেইনি আমি।ও যেন শেষের নোংরা কথাগুলো না বলতে পারে তাই তার মুখে হাত চেপে ধরি।
মিতুল আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,’আমার আইডি কার্ড দে!’
আমি তখন জিজ্ঞেস করি,’তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে?’
ও বলে,’তুই কী আমার রাজা মহারাজা নাকি যে তোর প্রশ্নের জবাব দিতে হবে আমার! তোকে যা বলেছি তা কর।আইডি কার্ড দে।’
আমি তখন সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি।ওর বুকের কাছে ঘেঁষতে চাই। কিন্তু ও আমায় তার কাছে ঘেঁষতে দেয় না।বলে,’নষ্টা তুই।দূরে যা। আমার আইডি দে।দেরি করিস না।দেরি করলে তোকে এখন মারতে মারতে অবস্থা খারাপ করে ফেলবো!’
আমি বলি,’মারো। তবুও আইডি কার্ড দিবো না।আইডি কার্ড দিলে তুমি চলে যাবে আমায় ছেড়ে!’
মিতুল আমায় এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে ফেলে দেয়ালের সাথে ঠেস দেয়া লাগেজটা খুলে ফেলে।আর ওখান থেকে আইডি কার্ড বের করে নিয়ে চলে যেতে বের হয়। আমি ওর পথ আগলে দাঁড়ালে আমায় এমন ধাক্কা দেয় যে আমি ফ্লোরে পড়ে গিয়ে অনেকটা জখম হই।আর ওখান থেকে যতোক্ষণে উঠতে পেরেছি ততোক্ষণে দেখি মিতুল উধাও!ও চলে গিয়েছে।
এবার আমি আরো ভয়ংকর বিপদে পড়ে গেছি। একদিক মঞ্জু। মঞ্জু ওর প্রতিশোধ নিতে চাইবে। অন্যদিকে আমি একা।শুধুই একা।মিতুল শুধুমাত্র ওর আইডি কার্ড নিতে এসেছিল নাকি অন্য কাজ ছিল জানি না! কিন্তু ও যে আমায় ছেড়ে চলে গেছে শুধু তা জানি। এখন আমার গন্তব্য কোথায়? কোথায় যাবো আমি?নাকি মঞ্জুর শিকার হবো আবার?

#চলবে

পুতুল বিয়ে পর্ব-০৩

1

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা টা ঘটলো পরদিন।আমি অফিসে গিয়েছি। দুপুর পর্যন্ত অফিস করে লাঞ্চ করার জন্য বাসায় ফিরে এসে দেখি মিতুল বাসায় নেই! ওকে বাসায় না পেয়ে আমার ভেতরটা কেমন হো হো করে কেঁপে উঠলো। ওকে যে একটা ফোন দিবো সেই অবস্থাও নাই। ফোন তো আগেই বিক্রি করে দিয়েছি!
ওর জন্য আধ ঘন্টার মতো অপেক্ষা করেছি।মিতুল ফিরেনি। আমার হঠাৎ কেন জানি একটা সন্দেহ হলো! সন্দেহ বশত ব্যাগের চেইনটা খুলে দেখি যা ভেবেছি তাই সত্য।একটা টাকাও নাই আর! ওকে যে দু হাজার দিয়েছিলাম তা তো নিয়েছেই,বাকী যা আমার ছিল তাও নিয়ে গেছে। তবে কী ও বাড়িতেই চলে গেছে!
আমার মন মানছে না।মনে হচ্ছে ওর কোন বিপদ টিপদ হলো কি না! হয়তো ওখানেই টাকার প্রয়োজন হয়েছে।আর ওর বিপদ হলে তো আমায় জানাতেও পারবে না।জানাবে কী করে? আমার তো আর মোবাইল ফোন নাই!

বাসার সামনে যে দোকান আছে ওখানে গেলাম দৌড়ে। গিয়ে দোকানীকে অনুরোধ করলাম ওর ফোনটা একটু দেয়ার জন্য। ফোন দিলে আমি মিতুলকে ফোন করলাম।ওর ফোনের সুইচ অফ!
কী সর্বনাশের কথা! আমার শরীর কাঁপছে থরথর করে। বুঝতে পারছি না ও কোথায়? একবার মনে হচ্ছে আমায় পেলে রেখে বাড়ি চলে গিয়েছে। আবার অন্যবার মনে হচ্ছে কিছুতেই এমন করতে পারে না আমার মিতুল!আমায় তো সে ভালোবাসে।ভালোবাসে বলেই তো আমায় নিয়ে পালিয়ে এসেছিল!

আমার কেমন ভয় ভয় করছে।ভয় করছে বলেই যতদূর আমি হাঁটতে পেরেছি ততদূর হেঁটে হেঁটে খুঁজেছি।মিতুলকে পাইনি! কোথাও সে নেই!
যেদিকেই তাকিয়েছি মানুষ আর মানুষ।ঢাকা শহরে কী আর মানুষের অভাব আছে?নাই। কিন্তু অত অত মানুষের ভেতর তো আর আমার মানুষ নাই!
তারপর ভেবেছি ও বোধহয় রাতে ফিরবে। কিন্তু ফিরেনি।সারা রাত ওর জন্য আমি জেগে জেগে অপেক্ষা করেছি।প্রহর গুণেছি ওর জন্য। কিন্তু মিতুল আসেনি।আমি রাতের খাবার খাইনি। পরদিন সকালেও খাইনি।অফিসেও যাইনি।কী করবো আমি বুঝতে পারছিলাম না। এখানে তো আমি একা। আমার তো আর কেউ নাই!

কেঁদেছি। ইচ্ছে মতো কেঁদেছি।গলা ছেড়ে।নিঃশ্বব্দে।বালিশে মুখ ডুবিয়ে।মুখে ওড়না গুঁজে ধরে!কেউ আমার কান্না শুনেনি!
পরদিন আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় থাকতে পারি না। শরীর কাঁপে থরথর করে। এই ক্ষুধার্ত শরীর আর ব্যথিত মন নিয়ে অফিসে যাওয়া যায় না। কিংবা আমি অফিসে যাবো কার জন্য?যার জন্য অফিসে যেতাত সে তো এখন আমার পাশে নাই!

পেটে ক্ষুধা লাগলে জল দিয়ে আর আপনি কতোক্ষণ চালাবেন?জল পিপাসা মেটায়,পেটের ক্ষুধা না!
সামনের দোকানীটা খুব ভালো। এই মাঝ বয়সী দোকানী আমায় খুব মুহব্বত করে।আপা আপা ডাকে।বলে, আপনে আমার ছোড বোনের মতন ‌। আমার দেশের বাড়ি ময়মনসিঙ্গের ফুলপুরে। আপনার মতন আমার একখান বইন আছিলো। ফুটফুইট্টা চান্দের মতন চেহারা। সেই বইন যহন কেলাস টেনে পড়ে তহন এক বড় লোকের ছেড়ার লগে বাগা মারলো (পালিয়ে গেলো)। বুঝতে পারে নাই ছোড মানুষ। কিন্তুক যে ছেড়ার সাথে বাগা দিলো সেই ছেড়ার চরিত্র খারাপ।সে তার বন্ধু বান্ধব লইয়া আমার বইনের সব্বোনাশ করলো।বইন আমার কোনদিন বাড়িত ফিইরা আহেনাই।আয়ছে তার লাশ।ছেড়ার কাছ থিইকা প্রতারিত ওইয়া বইন আমার গাড়ির নীচে ঝাঁপ দিয়া মারা গেছে!’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,’আপনার বোনের নাম কী ছিল?’
দোকানী বললো,’নাম আছিলো খোশনাহার। কিন্তুক এই নাম তার পছন্দ না।নাম বদলাইয়া হে নিজেই তার নাম রাখছিলো রাফি।তারে রাফি বইলা না ডাকলে সে গোস্যা করতো!’
দোকানী কাঁদছে।তার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।
আমি তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।আর বললাম আমার বিপদের কথা।দোকানী আমায় আস্বস্ত করলো।বললো,’আমি আপনের ধর্মের ভাই। আমার নাম মঞ্জু। এই মঞ্জু যতদিন বাইচ্যা আছে ততোদিন আপনের কোনো টেনশন নাই আপা।আপনেরে আমি ফালাইতাম না। বাজার যতো লাগে নিবাইন।মাস শ্যাষে টাকা অইলে দিবাইন।টাকা না অইলে দিবাইন না।ভাই বইনের সম্পরক্ষ টেকার না।মনের।বুঝছইন আপা?’
আমি মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললাম,’আপনি আমায় চেয়ে অনেক বড়। তাছাড়া আমি আপনার ছোট বোনের মতো। আমার নামও রাফি। আপনি আমায় রাফি বলেই ডাকবেন।’
মঞ্জু মিয়া ভীষণ খুশি হলো।সে গদগদ করে হাসতে হাসতে বললো,’আইজ থিইকা তোমারে আমি রাফিই ডাকবাম।আর আইজকা সময় নাই।বাসায় একটা কাম আছে। আগামীকাল রাইতে বইনের হাতের রান্ধন খাইবাম!’
আমি মৃদু হেসে বললাম,’অবশ্যই ভাই। অবশ্যই।’

তিনদিন পর অফিসে গেলাম। কিন্তু অফিসে গিয়েও মন ঠিকছে না। ভালো লাগছে না কিছুই।রাফিদের বাসার কোন নম্বর নেই আমার কাছে।ওর নম্বর তো খুলছেই না।বাড়িতেও ফোন করতে পারছি না। কোন মুখে আমি বাড়িতে ফোন করবো!আমি তো ওদের ঠকিয়ে রেখে এসেছি।আমি তো ওদের মান সম্মান সবকিছু ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়ে এসেছি!

সন্ধ্যা বেলায় বাসায় ফিরে বোকার মতো বসে থাকি। কাঁদি। কিছুই ভালো লাগে না।একটু পর হঠাৎ করে বারান্দার কলিং বেল বাজে। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরটা আমার কেঁপে উঠে। আনন্দে আমি আত্মহারা হয়ে উঠি। আমার বাসায় তো আর কেউ আসে না। শুধুমাত্র মিতুল ছাড়া। তবে কী আমার মিতুল ফিরে এসেছে!
কাঁপা কাঁপা হাতে দরজায় ছিটকিনি খুলতেই হতাশ হই।মন ভেঙ্গে যায়।মিতুল না। বাসার সামনের দোকানী মঞ্জু এসেছে।তার হাতে একটা ব্যাগ।ব্যাগ ভর্তি বাজার।
মঞ্জু হাসি হাসি মুখে বললো,’বাজারে গেছিলাম।চিতল মাছ দেইখা পছন্দ হইয়া গেলো খুব।বইনের লাইগা অধ্ধেকটা কিইন্যা নিয়া আইলাম।আর সাথে নয়া আলু।ফইল্যা ফইল্যা দিবা আলু।বিরাট টেস্ অইবো!’
মঞ্জু মিয়ার অত আহ্লাদ আমার ভালো লাগছে না। এইসব পাতানো সম্পর্ক টম্পর্ক আমার বিরক্তি লাগে। তবুও যেহেতু বিপদে একটা ছায়া পাওয়া গেল তাকে তো আঁকড়ে ধরতেই হবে।
আমি তাকে বললাম,’ভাইয়া,ফ্যানের নিচে বসেন।ঠান্ডা হন।আমি রান্না চড়াচ্ছি।’
মঞ্জু হেসে বললো,’এক গেলাইস পানি দেও বইন। আমার তিয়াস পাইছে।পানি খাইয়া এক টিপ ঘুমাই।এই সুযোগে তুমি রাইন্ধালাও!’
আমি কিচেনে গিয়ে তার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এলাম।সে পানি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো!

মঞ্জু মিয়া আমার বাসায় প্রায় সময় আসা যাওয়া করে। নিজের বোনের মতোই দেখে আমায়।আচার আচরণ মন্দ না। তবে তাকে যেন কেন আমার সহ্য হয় না।তার মুখে অতি ভক্তি।এই অতি ভক্তি জিনিসটাই আমার পছন্দ না। কিন্তু পছন্দ না করেও উপায় নাই। আমার হাতে পয়সা কড়ি নাই।এই দুঃসময়ে তার অবদান ভুলবো কী করে আমি? কিংবা তার সাহায্য ছাড়া চলবোই বা কী করে?

এক সপ্তাহ পরের কথা-
আমি বাথরুমে গোসল করছি।
মঞ্জু মিয়া এসে কলিং বেল বাজাচ্ছে।আমি ভেজা কাপড়েই দরজা খুলে দিলাম।ওর হাতে এক বয়াম দুধ। সেই দুধ আমার হাতে তুলে দেয়ার সময় সে আমার ভেজা শরীরের দিকে কেমন করে যেন তাকালো! এই তাকানোটা আমার কাছে মোটেও ভালো লাগলো না। এবং এটা সত্য যে মেয়েরা পুরুষের চোখকে খুব ভালো করেই চিনে। কোন চাহুনি তার প্রতি ভালোবাসার আর কোন চাহুনি লোভাতুর,কামার্ত তা চেনা খুব একটা কঠিন বিষয় না মেয়েদের জন্য। সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের এই গুণ দিয়েই সৃষ্টি করেছেন!

#চলবে


(গল্পটা পড়ুন। এগিয়ে যান। বাস্তবতা কী বুঝতে পারবেন!)

পুতুল বিয়ে পর্ব-০২

1

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



আরেকটি সকাল হলো।পূবের জানালায় আলোর খেলা। জানলার বাইরে একটা বুড়ো কাঁঠাল গাছ। সেই গাছে এক জোড়া দোয়েল বসে আছে।সাদা আর কালো পালকের দোয়েল।একটি অপরটির ঠোঁটে ঠোঁট ঘষছে।
সারাটা রাত আমার ঘুম হয়নি। সকাল হতেই আমি ছুটে এসেছি জানলার কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির খেলা দেখছি। কিন্তু এই একটা দৃশ্য আমায় খুব কাঁদালো। একজোড়া পাখি। তাদের প্রণয় দৃশ্য। এইসব দেখে অত কাঁদবার কী আছে? কিন্তু আমার কান্না পেয়ে গেল।মনে পড়ে গেল অতীতের কিছু কথা।মিতুলের সাথে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে উড়নচন্ডি হয়ে ঘুরা। প্রচন্ড তেষ্টা পেলে জলের বদল একে অপরকে চুমু খাওয়া।
মিতুল বলতো,’তোমাকে যদি না পায় তবে এই সবুজ পৃথিবীকে আমি দোযখ বানিয়ে ফেলবো।আর নিজের জীবনকেও!’
আজ সে আমায় পেয়েছে। কিন্তু সবুজ পৃথিবী অথবা তাকে নয়।আমাকেই দোযখ বানিয়ে দিচ্ছে।

কিচেনে রান্না চড়াতে যেতে হবে।একটু পর অফিস। রান্না হলে গোসল করতে হবে। এছাড়াও ঘরে অনেক কাজ কর্ম আছে। চটজলদি জানলা থেকে সরে এলাম আমি।বা হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে কিচেনে ঢুকলাম। কিচেনে ঢুকে মনে হলো ঘরে চাল নাই।কী সর্বনাশ! আমার জন্য আমি ভাবছি না। আমি না হয় পানি খেয়ে পেট ভরে নিবো। সমস্যা নাই এতে। ছোট বেলায় এমন করে দু তিনদিন থেকেও অভ্যেস আছে। কিন্তু মিতুলের কী হবে?ওর জন্য তো খাবার প্রস্তুত করতে হবে।বড় লোকের ছেলে ও। ছোট বেলা থেকে খাবারের কষ্ট কী সে টের পায়নি। এখানে এসে যে আমার জন্য ধৈর্য ধরে এসব কমদামি খাবার দাবার খাচ্ছে এটাই তো আমার রাজ কপাল!

হাতে একটা টাকাও নাই। পালিয়ে আসার সময় মার সারা জীবনের সঞ্চয় আমি চুরি করে নিয়ে এসেছিলাম। টাকাটা সামান্য।বিশ হাজার টাকা। কিন্তু আমার মার কাছে এই টাকা অনেক বড় কিছু ছিল। টাকাটা হাওয়ার মতো ফুরিয়ে গেছে প্রথম মাসেই।তার পরের মাস থেকে চাকরি জুটিয়েছি। কিন্তু এতে যা স্যালারি তা দিয়ে দুজন মানুষের এক মাস চলা খুব কষ্টকর।এ মাসেও এমন হলো।পনেরো তারিখের আগেই সব শেষ। তাছাড়া মিতুলের ফোনের খরচাটাও আমায় দিতে হয়।ওর তো আর আলাদা ইনকাম সোর্স নাই।আমি ছাড়া ওকে আর কে বা টাকা দিবে!

বাসা থেকে বের হয়ে সামনের দোকান থেকে কিছু চাল বাকীতে নিলাম। চিন্তা করলাম আমার ফোনটা বিক্রি করে দিবো।এতে মাসের বাকী পনেরো দিন খুব ভালো ভাবেই কেটে যাবে। কিছু হাতেও থাকবে।পরে টাকা হলে ফোন কেনা যাবে।
বাসায় ফিরে কিচেনে গিয়ে রান্না চড়ালাম। রান্নার এক ফাঁকে গোসল সেরে নিলাম। তারপর অফিসের জন্য রেডি হয়ে মিতুলকে আস্তে করে ডাকলাম।
মিতুল ঘুম জড়ানো গলায় বললো,’কী হয়েছে?ডাকছো কেন?’
‘রান্না হয়েছে।আমি অফিস চলে যাবো।উঠো, একসাথে খাই!’
মিতুল ত্যাক্ত গলায় বললো,’এখন খাবো না।ডিস্টার্ব করো না।একটু ঘুমাতে দাও!’
আমি মনে মনে নিজেকেই বকলাম। অনেক রাত অবধি জেগেছে ও। এখন একটু ঘুমোচ্ছে। আমার একটুও উচিৎ হয়নি ওকে ডাকা।
তারপর একা একাই সকালের খাবার খেয়ে ওর জন্য আলাদা করে খাবারটা ঢেকে রেখে দিলাম। তারপর যখন বের হতে যাবো তখন মিতুলের গলা শোনা গেল। মিতুল পেছন থেকে বললো,’কথাটা তো জানালে না!আমি কী চলে যাবো নাকি?’
মিতুলের এই একটা কথা শুনে আমার বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তবে আমি কার জন্য এসব করছি! চাকরি বাকরি, সকাল হতেই নিজের কথা না ভেবে শুধুমাত্র ওর কথা ভেবে বাকীতে চাল আনা, রান্না চড়ানো। কেন করছি এসব। ওকে ভালোবাসি বলে? ভালোবাসা কী এমন। ভীষণ রকম অসহায়?
আমার কান্না আসে খুব। ঠোঁট কেঁপে উঠে বন পাতাদের মতো তিরতির করে। বুকের কাছে যেন সমুদ্রের গর্জন হয়।ঢেউ ভাঙ্গে পাঁজরের খুব কাছে!
কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে দেই একপাশে। তারপর ধপাস করে বসে পড়ি ফ্লোরের উপর দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে। এবার ওড়নায় মুখ চেপে ধরে কাঁদতে থাকি খুব!
মিতুল অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার কান্না দেখে। তারপর বিছানা থেকে নেমে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়।চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,’রাফি,আই অ্যাম সরি! একচ্যুয়েলি আমি তোমার সাথে ফান করছিলাম। কেন অত সিরিয়াস হয়ে যাও তুমি বল তো!’
আমি তখন পাগলের মতো হয়ে যাই।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো মিতুলকে জাপটে ধরি।ওর জামার আস্তিনে খাবলে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলি,’তুমি আমায় নিয়ে এমন পুতুল পুতুল খেলা খেলো কেন বল তো?জানো, তোমায় ছাড়া আমি কিছুতেই থাকতে পারবো না তবুও কেন দূরে সড়ে যাওয়ার কথা বলো?’
মিতুল আমায় শক্ত করে ওর বুকের সাথে লেপ্টে ধরে রাখে। ঘাড়ে ওর দাঁতের নরম কামড় বসিয়ে দিতে থাকে। পিঠে হাত বুলাতে থাকে দ্রুত। তারপর আমার কানের কাছে ওর মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,’মানুষের জীবনটাই তো পুতুলের মতো!এসো আমরা পুতুলের বিয়ে খেলি।’
বলে সে আমায় পাঁজাকোলা করে বিছানার কাছে নিয়ে যায়।বহু বহুদিন পর আমরা আবার মিলিত হই। এমন একটা সকালকে আমার স্বর্গের সকাল মনে হয়। এমন একটা সকাল পবিত্র জলের মতো।মনের সবটুকু ঘ্লানি,ভেতরে জমা সবটুকু অভিমান,ক্লেদ,রাগ, সন্দেহ সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়।

সেদিন অফিসে যাইনি আমি। ভেবেছিলাম সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে।মিতুল আবার আমার হয়ে গেছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম আমি।এক পরিচিত বন্ধুকে দিয়ে ফোনটা ভালো দামে বিক্রি করিয়ে মিতুলের জন্য একটা ভালো পাঞ্জাবি কিনে আনি।ওর হাতে পড়ার জন্য একটা ঘড়ি কিনি।রাতে ফিরে ওর হাতে গিফট ধরিয়ে দিতেই ও চকচকে চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি ভেবেছিলাম ও বুঝি ধন্যবাদ দিবে। কিন্তু ধন্যবাদ না দিয়েই জিজ্ঞেস করে,’অত টাকা পেয়েছো কোথায়?’
আমি তখন বলি,’ফোনটা বিক্রি করে দিয়েছি।’
মিতুল হাসি হাসি মুখে বলে,’কত বিক্রি করেছো?’
‘আট হাজার টাকা।’
‘আমায় কিছু দিতে পারবে?বেশি না।দু হাজার হলেই চলবে।পরে তোমায় ফিরিয়ে দিবো!’
ওর ফিরিয়ে দেয়ার কথাটা শুনে আমার যা কষ্ট হলো!ওর তো এমনিতেই খরচা করে অভ্যেস।বড় লোকের ছেলে। আমার সাথে কতো কষ্ট করেই না সময় কাটাচ্ছে ও!কত শখ আহ্লাদ আমার জন্য মাটি করেছে ও।আর আমি কি না ওকে মাত্র দু হাজার টাকা দিলে তা ফিরিয়ে নিবো!
আমি বললাম,’টাকাটা দিবো যদি তুমি ফিরিয়ে দিবে না কখনো এই শর্তে রাজি হও?’
মিতুল গাঢ় হেসে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে কোনদিন ফিরিয়ে দিবো না। এখন হলো?’
কথাটা বলে মিতুল আমার কপালে চুমু খেলো।
তারপর ফিসফিস করে আমার কানের কাছে ওর মুখ নিয়ে বললো,’ভালোবাসি।’
আমি লজ্জায় ওর বুকের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে লাগলাম।আর মনে মনে বলতে লাগলাম,আমার মিতুল যেন সারা জীবন ঠিক এরকমটাই থাকে।
কিন্তু এরকমটা আর রইলো না। সেদিন রাতেও ঘুম ভেঙ্গে আমি দেখি মিতুল বিছানায় নাই। গতকালের চেয়ে আজ আরও বেশি করে বুকটা কেঁপে উঠে আমার।মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে ভনভন করে। ফুল স্পীড। তবুও আমার শরীর কেমন ঘামছে। আমি তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে আবার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।মিতুলের কানে ফোন ধরা। হেসে হেসে ও মিষ্টি করে কথা বলছে।গাঢ় করে চুমু খাচ্ছে কাউকে ফোনেই।
মাথাটা আমার ঘুরছে।মনে হচ্ছে পড়ে যাবো টুপ করে। তবুও আমি চুপচাপ এসে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।একটু পর মিতুল এলো। এসে সে সোজাসাপ্টা বললো,’রাফি, আমার আর কিছুই করার নাই।একটু সময় দাও। মেয়েটা আমায় পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু আমি বাসি না।ও আমায় হুমকি দেয়।বলে সোইসাইড করবে।আর আমাকে নাকি এর জন্য দায়ী করবে। তুমি কী চাও আমি জেলে পঁচি?’
ওর কথা শুনে আতংকে আমার বুকটা কেঁপে উঠে।আমি তখন বলি,’জেলে পঁচবে কেন? তোমার কী এতে?মরে গেলে ও মরে যাবে!’
মিতুল বলে,’এইসবকিছু তুমি বুঝবে না।ও মরার আগে চিরকুটে লিখে যাবে ওর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী।’
আমার এবার খুব ভয় হয়। খুব খুব ভয়!আমি বলি,’এখন কী করবে তবে?’
মিতুল রাগী রাগী গলায় বলে,’কী আর করবো? তুমি কী ভেবেছো ও যা বলে তাই মানবো? কিছুতেই না।ওর নাকে বড়শি দিয়ে ঘুরাবো। আপাতত একটু সহ্য করো।একটু একটু শুধু ওর সাথে কথা বলবো। তারপর ওর মাথা থেকে সোইসাইডের ভূত নেমে গেলে ওর পাছায় লাথি দিয়ে ওকে বিদেয় করবো!’
আমি ওর কথায় আস্বস্ত হই
যদিও কোন স্ত্রী কিংবা প্রেমিকাই পারবে না তার স্বামী কিংবা প্রেমিককে আলাদা কোন নারীর সাথে প্রেম করার জন্য অনুমতি দিতে। কিন্তু আমার দিতে হলো।কারণ আমি ভীতু।মিতুলকে হারানোর ভয় সব সময় আমায় তাড়িয়ে বেরায়। নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারি আমি কিন্তু মিতুলকে না।
আমি তখন মিতুলের গলা জড়িয়ে ধরে বলি,’মিতুল, তুমি কিন্তু আমায় ঠকাবে না?’
মিতুল তখন বলে,’তোমায় ঠকাবার আগে যেন আমার মরণ হয়!’

#চলবে