অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-১৫+১৬

0
1239

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১৫ এবং ১৬ তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

___যে এমনি অপূর্ণ তার এসব অভিলাষ করার কি মানে বলো?

ইথিলা ভাবীর এই কথা শুনে ইয়াজ থমকে গেলো। ধিরে ধিরে দু পা এগিয়ে বললো,
___ ইথিলা এভাবে বলো না! আমি নিশ্চয়ই পারবো! আমার কলিজার বোনের জন্য আমার এক সন্তান দিতে পারবো, আমার বোন খুশি থাকলেই আমার জগৎ আলোকিত মনে হয়! আর বিন্দিয়াও পারবে। দূরে কোথাও তো যাবেনা, ওর নিজের ভাই আর আমার বোনের কাছেই তো। মানুষ সবসময় যা চায় তাই কি কর‍তে পারে বলো? জীবনের কতো স্বপ্নই তো আমাদের অপূর্ণতায় ঘিরে থাকে। তবে সেটাতে যদি কারো পূর্ণতা আসে সেটা তো কষ্ট পেলেও আনন্দের!

ভাবী কিছু বলতে যাবে তখনি বাদল ভাইয়া আসলো। এসে সবাইকে আবার কাঁদতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
___কি হয়েছে?

ইয়াজ সবটা খুলে বললো। আমাদের কথা শুনে ভাইয়া আগেপিছে তাকিয়ে বললো,
___আমরা সবাই এক জায়গায় থাকলে কেমন হয়?
আমার বাবা-মা, তোমার বাবা-মা, ইথিলা, বিন্দিয়া বাবুরা সবাই একসাথে!

ইয়াজ বললো,
___ আরে এইটা কেন ভাবছিলাম না এতদিন! কিন্তু আমাদের মা-বাবা থাকবে তো? আপনার অফিসের কাছাকাছি বাসা নিয়েন, আমি বাইকে করে যেতে পারবো, অসুবিধা হবেনা। বিন্দিয়া আর বাদল ভাই তোমাদের বাবা-মাকে রাজী করাও, আর আমি আর ইথিলা আমাদের মা-বাবাকে রাজী করাচ্ছি। তাহলে আর কাউকে কষ্ট পেতে হবে না।

আমি এবার হাসলাম,আর ইথিলা ভাবীও হাসলো। চোখমুখ মুছে বিরাজের গালে গাল ঘঁষলেন। ওকে নিয়ে একটু এগিয়ে ইরাজের মাথায় হাত বুলালেন!
আর বললেন,
___আমার দুই বাবার জন্য আমরা সবাই একসাথে হতে যাচ্ছি! বড়মা তোমাদের সাথেই থাকবে! আমরা সবাই একসাথে!


তারপর সবার বাবা মাকে রাজী করাতে অসুবিধা হয়নি। কারণ তারাও কাছ থেকে দেখেছে দুইদিকের কষ্টগুলো। তাই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলো আমরা একসাথে থাকবো। আর একসাথেই এক বাসায় উঠে গেলাম। সব কষ্টগুলো ভুলে এখন আমরা ভীষণ খুশি!


দেখতে দেখতে ১ বছর চলে গেলো। দিন ভালোভাবেই এগুচ্ছে, তবে বিরাজ আমার কাছে ঘুমায় না। এমনকি আমি ওকে খাওয়াতেও পারিনা। ওর বড়মা ওর সব করতে হবে। এমনকি ভাবী গোসল করছে এসময় ওর ঘুম ভেঙেছে সে কান্না করে উঠে ওর বড়মাকে যতক্ষণ না পাবে কাঁদতেই থাকবে।
কিন্তু ইরাজ দুজনের কাছেই থাকে, তবে ওর বড়মার কাছে তেমন যেতে পারেনা। কারণ বিরাজ একাই ওর বড়মার কোল জুড়ে বসে থাকে,ইরাজকে নিলে বিরাজ চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়।
বিরাজের খেলনাতেও ইরাজ ছুঁতে পারেনা, কিন্তু ইরাজের খেলনা বিরাজ নিয়ে খেলে।

আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি বিরাজের রাগ ইরাজের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি। সে ভীষণ একগুঁয়ে আর জেদি। ইরাজকে এখনি সে মারে, একসাথে খেলতে বসলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সে ওর বড়মা ছাড়া কারো কথা শুনেনা! উনি যদি বলে কান্না করো না, সে কান্না করে না। উনি যদি বলে খাও, সে খায়! উনি যদি বলে বসো, সে চুপ করে বসে থাকে।
উনার কোল থেকে ভুলেও আমার কোলে আসেনা।
কোলে নেওয়ার হলে কিছু একটার লোভ দেখিয়ে তারপর নিতে হয়।

ওদের দুজনকে আলাদা করে চেনা যায় শুধু চুল দেখে, ভাবী বিরাজের চূল তেমন ছোট করে না, কিন্তু আমি ইরাজের চুল কেটে ছোট করে ফেলি।
ওদের স্বাস্থ্য, বেড়ে উঠা একরকমই ছিল। কিন্তু ইরাজ শান্ত চেহেরায় থাকে আর বিরাজ রাগী চেহেরায়! বিরাজ ওর বাবার সাথে ঘুরাঘুরি করলেও আমার কাছে বেশিক্ষণ থাকতে চায়না। ওর বড়মা ওর সব!

চলে গেলো আরো কয়েকমাস।
আস্তে আস্তে ওদের মুখে কথা ফুটতে শুরু করেছে, বিরাজ ভাবীকে শুধু মা বলে ডাকে, আমাকে আম্মু বলে। আর ইরাজ আমাকে মা বলে, আর ভাবীকে বড়মা বলে। তবে দুজনেই বাদল ভাইয়া আর ইয়াজকে বাবা বলে ডাকে। এটা নিয়ে মাঝে মাঝে জটিলতা তৈরি হয়, কখন কাকে বাবা ডাকলো, ওদের কণ্ঠস্বরও একরকম!

এদিকে আমার স্বামী আমাদের বাবা মাকে দাভাই আর দিমণি ডাক শেখাচ্ছে। নানা কিংবা দাদাতে কোনো পার্থক্য করে ডাক শেখাতে চাচ্ছেনা কেউই! তবে কাকে কখন ডাকছে সেটা বুঝতে ছোট দা’ভাই বড় দা’ভাই, ছোট দি’মণি,বড় দি’মণি বলে বলে শেখাচ্ছে। আমার শ্বশুর শাশুড়ীকে বড় বলে সম্বোধন করে, আমার মা-বাবাকে ছোট বলে সম্বোধন করে। এমনিতেও আমার শ্বশুর শাশুড়ী আমার বাবা মা থেকে বয়সে বড়। ইয়াজ আর ভাবীর জন্ম উনাদের বিয়ের অনেক বছর পরে হয়েছিলো।

দিনগুলো ভীষণ সুন্দর চলে যাচ্ছিলো।
বিরাজ আর ইরাজ এক বছরেই হাঁটতে শিখেছে। এখন চারদিকে ছুটাছুটি করতে পারে। বল দিয়ে খেলতে পারে! মাঝে মাঝে দুজন একসাথে খেলে আবার কোনো কিছুতে না মিললেই বিরাজ ইরাজকে মারতে শুরু করে। ইরাজ প্রথম কাঁদে না, এরপর আবার মারলেও ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে চায় তাও কাঁদেনা, এরপর আবার মারলে কেঁদে ফেলে। তাই ভাবী বিরাজকে সাথে সাথে রাখেন, আমিও ইরাজকে দেখে রাখি।
.
.
তাদের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে চারমাস হলো। প্রায় সব কথা দুজনে বলা শিখে গেছে। তবে অস্পষ্ট! তাদের মধ্যে কে বড় সেটা আজও জানা হয়নি। আমরাও জানতে চাইনি। তবে এক-দুই মিনিটের ব্যবধান আছে যেটা পরবর্তীতে ডক্টর নিজেই বলতে পারেনি কে দুনিয়ায় আগে আসছিলো! উনিও তাদেরকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন।
কিন্তু আমার মন বলে ইরাজ বড়, ওর মধ্যে এমন গুণ দেখতে পাই, এখন থেকেই অদ্ভুত দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন।
বিরাজকে নিজে থেকে মারেও না, উল্টো নিজে মার খেয়েও সেটা প্রথম হজম করার চেষ্টা করে। আবার নিজে নিজেই ওর সাথে মিলে যায়।


একদিন বিভিন্ন তরকারির বাজার পাঠালো ভাইয়া, সেগুলো একজন এসে দিয়ে গেলো, আসার পরে সেগুলো গুছাতে আমি দরজা বন্ধ না করেই রান্নাঘরে চলে গেলাম। এদিকে মা এসে দরজা খোলা দেখে বন্ধ করে দিলো। কিছুক্ষণ পরে কলিংবেল বাজলো। দরজা খোলে দেখি পাশের বাসার মালিক ইরাজকে সাথে নিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। ইরাজ কাঁদতেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
___ইরাজ বাইরে কখন গেলো? সে কাঁদছে কেন?

উনি রেগেমেগে বললেন,
___ও কি করেছে জানেন? জানালার গ্রিলে দাঁড়িয়ে বল দিয়ে ঢিল মেরেছে,সেটা আমার জানালা দিয়ে ভেতরে গিয়ে আমার বাচ্চার মাথায় পড়েছে। দুটো বাসা তো পাশাপাশি, মাত্র দুইহাতের ব্যবধান। বুঝতে পারছেন বিষয়টা? আঘাতটা কতো গুরুতর হবে!

আমি ইরাজকে কোলে নিয়ে বললাম,
___ইরাজ মোটেও এটা করবেনা। ইরাজ বল ছুড়তে পারেনা।

উনি আবার বললেন,
___আরে ভাবী আমি নিজে দেখেছি।

আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি ভাবী আসছে বিরাজকে কোলে নিয়ে। লোকটা একটু অবাক হয়ে বললো,
___ও না, ওই ছেলেটা মনে হয়। নীল গেঞ্জি, আর বেগুনি গেঞ্জিতে বুঝতে পারিনি। ওই ছেলেটা ঢিল দিয়েছে। এইটুকু বাচ্চা হলে কি হবে এসব ঠিকি পারে!

তারপর ইরাজের গালে হাত রেখে উনি বললেন,
___তোমাকে বকা দিয়েছি সরি বাবু। আর শুনেন ভাবী বাচ্চা দেখে রাখবেন। এখনি যে পরিমাণে দুষ্টামি করে, পরে দিনে একটা মামলা আসবে।

বলেই উনি চলে গেলো। ভাবী বিরাজকে জিজ্ঞাসা করলো,
___বাবা তুমি কি ঢিল ছুড়েছো?

বিরাজ কিছু না বুঝার মতো করে উল্টো প্রশ্ন করলো,
___কী মা?

ইরাজ আমার কোল থেকে বললো,
___বম্মা ও ছুলেতে, তাপর বলেতে টুমি বলতা কুদে নিয়ে আতো। আমি দাওয়াল পলে ওই আঙ্কেল আমায় বকেতে। ( বড়মা ও ছুড়েছে, তারপর বলেছে তুমি বলটা খুঁজে নিয়ে আসো। আমি যাওয়ার পরে ওই আঙ্কেল আমায় বকেছে)

আমি বিরাজের দিকে তাকিয়ে রাগ করে বললাম,
__বিরাজ বেশি দুষ্টামী করো কিন্তু। বল ছুড়েছো আমাদেরকে না বলে ইরাজকে কেন বললে?

বিরাজ রেগে গিয়ে জোরে বললো,
___ ও তাহলে আমাল সাথে বল ছুলাছুলি খেলে কেন? তাই আমি ওই বাসায় দিল মেলেছি।
(ও তাহলে আমার সাথে বল ছুড়াছুড়ি খেলেনি কেন? তাই আমি ওই বাসায় ঢিল মেরেছি)

ইরাজ আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
___ মা আমাল ভয় নাগে, বল ছুললে এটা দিয়ে যদি কিতু ভেঙে দায়! (মা আমার ভয় লাগে, বল ছুড়লে এটা গিয়ে যদি কিছু ভেঙে যায়)

আমি ইরাজের মাথায় হাত রেখে বিরাজের দিকে তাকালাম। সে ভাবীর কোলে অভিমানে মুখ গুঁজে রেখেছে। ভাবী আমাকে ইশারা করলো আর কিছু না বলতে, এরপর আবার রাগে খাবার খাবেনা।
আমি মুচকি হেসে এখান থেকে ইরাজকে নিয়ে চলে গেলাম।

শুধু এটা না, বিরাজ সবকিছুর দোষ ইরাজকে দিয়ে দেয় এমনও হয়। এরপর ওরে অনেক মারে। ইরাজ ঝগড়া পছন্দ করে না কিন্তু বিরাজ ইচ্ছে করে ঝগড়া বাঁধায়।

ওদের তিন বছর পেরিয়ে তখন চার বছরের কাছাকাছি। এখন স্পষ্ট করে কথা বলে দুজন।
আমরা দুজনকেই কাছাকাছি একটা মাদ্রাসায় আরবী শিখতে দিয়েছি। দুজনকে আমি আর ভাবী বোরকা পরে দিয়ে আসি, আবার নিয়ে আসি। মাদ্রাসার পেছন থেকেই আমরা তাদের আনানেওয়া করতাম। কারণ জোহরের পরে ওরা পড়তো, আর তখন ওদের বাবা অফিসে থাকে।

সেদিন বিরাজ পেট ব্যথার বাহানা করে মাদ্রাসায় গেলোনা। ইরাজ একা গিয়েছে। আমি ওকে একা আনতে গেলাম। যাওয়ার পরে ওকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি আস্তে আস্তে একটু ভেতরে যেতেই আমাকে একটা বাচ্চা বললো,
___বিরাজকে একটা ছেলে মেরেছে। সে ভেতরে।

ছেলেটার কথা বুঝলাম না, মনে হয় সেও বুঝেনি এটা বিরাজ নয়, ইরাজ।

আমি তারাহুরো করে গেলাম। আমাকে দেখে সেখানকার হুজুর পাশের রুমে চলে গেলেন। আমি ইরাজকে কোলে তুলে জিজ্ঞাসা করলাম,
___কে মারলো তোমায়, আর কেন?

পাশের রুম থেকে সেই হুজুর বললো,
___বিরাজ কাল আশ্রাফকে মেরেছিলো নাকি, তাই আজকে সে ওর সঙ্গী নিয়ে ওকে মেরেছে। আমি ওদেরকে পড়া দিয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম, এর মধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেছে।

আমি হুজুরকে বললাম,
___ ও তো ইরাজ। বিরাজ আজ আসেনি।

সেখান থেকে হুজুর চমকের সাথে জবাব দিলেন,
___ইরাজের টুপি তো সাদা ছিল, আজকে বিরাজের মতো বাদামী রঙের কেন?

আমি বললাম,
___ইরাজের টুপি বিরাজ নিয়ে গেছে। তাই ইরাজ ওরটা এনেছে। আশ্রাফকে আপনি কিছু বলেননি? সে বিরাজকে নিয়ে বিচার না দিয়ে নিজে মারলো কেন?

হুজুর থমথমে গলায় বললো,
___ইরাজ বিচার দেয়নি এতক্ষণ। মেরেছে এই কথাও বলেনি। পড়া বলতে পারেনি আজ, ভেবেছি এইজন্য মন খারাপ। কিন্তু সবাই চলে যাওয়ার পরে দেখি সে বসে কাঁদতেছে,জিজ্ঞাসা করার পরে এই কথা জানালো। এখন আশ্রাফকে তো আর পাবোনা, আগামীকাল আসলে আশ্রাফ এবং বিরাজ, দুজনকে বুঝিয়ে বলবো। ওদের মা’কেও বলবো। ওরা ছোট তো, কি যে করে বসে!

আমি বললাম,
___আচ্ছা ঠিকাছে।

বলেই আমি ইরাজকে নিয়ে বের হয়ে আসলাম।

চলবে….

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১৬তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

বাসায় এসেই আমি বিরাজকে হাঁক ছেড়ে ডাকতে লাগলাম। ভাবী ওর আঙুল ধরে রুম থেকে বের হয়ে বললো,
___কি হয়েছে বিন্দিয়া?

আমি ইরাজকে দেখিয়ে বললাম,
___দেখো বিরাজ কাল এক ছেলেকে মেরে আজকে পেট ব্যথার বাহানায় বাসায় বসে আছে, এদিকে ওরা ইরাজকে বিরাজ ভেবে মেরেছে।

ভাবী তারাতাড়ি করে আমার কাছে এসে ইরাজকে কোলে নিলো। দেখলো সত্যিই ওর গালে, গলায় খামচির দাগ, স্কেল দিয়েও মেরেছে, পিঠেও লাল দাগ পড়েছে। ভাবী বিরাজকে ধমক দিয়ে বললো,
___বিরাজ এটা ইচ্ছে করে করেছো? আজ এই জন্যই যাওনি? তারপর আবার টুপি বদলে দিয়েছো, কেন করেছো বিরাজ? ও তোমার ভাই না? ও ব্যথা পেলে তোমার খারাপ লাগেনা?

বিরাজ আস্তে আস্তে বললো,
___মা আর হবে না।

ভাবী আবার ধমক দিয়ে বললো,
___আশ্রাফকে কেন মেরেছিলে?

বিরাজ রাগী চোখে এবার তাকিয়ে বললো,
___ আশ্রাফ বলছিল ওর মা ওকে বলেছে, তুমি নাকি আমার আসল মা না। তাই ওকে মেরেছি, আবার বললে আবার মারবো।

বিরাজের কথা শুনে এবার আমার মাথা ঘুরে গেলো। ওর মা না বলাতে এতো রেগে গেছে, অথচ আশ্রাফ মিথ্যেও বলেনি। এদিকে ভাবী এই কথা শুনে ইরাজকে কোল থেকে নামিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে বিরাজকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেললো, ওর গালে কপালে চুমু খেয়ে বললো,
___কে বলে তুমি আমার সন্তান না। আর আমি তোমার আসল মা না? ওরা কিচ্ছু জানেনা।
ওরা এসব বললে তুমি মা’কে এসে জানাবে, মা ওদেরকে বকা দিবো, কিন্তু মেরোনা কাউকে বাবা। পঁচারা মারধর করে, তুমি তো আমার লক্ষী সোনা। কাউকে আর মেরোনা প্লিজ।

বিরাজ ফিক করে হেসে ভাবীর গালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো, আর বললো,
___আচ্ছা আর মারবোনা। তুমিও আমার লক্ষী মা!

আমি ইরাজকে নিয়ে রুমে গেলাম। দাগগুলোতে মলম লাগিয়ে দিলাম
তারপর খাইয়ে দিয়ে ওকে ঘুম পাড়ানোর জন্য শুলাম। শুতেই ইরাজ আমার গলা জড়িয়ে বলতে লাগলো,
___ মা বিরাজ আমার মতো দেখতে কেন? জানো আমি মাদ্রাসায় এমন আর কাউকে দেখিনি। শুধু আমরা দুজন এক রকম। অনেকে আমাদেরকে এইজন্য দেখতে আসে। আর আমিও আয়নার সামনে গেলে মাঝে মাঝে মনে করি এটা বিরাজ। সে আমার মতো হয়েও আমার সাথে মিলে না কেন? সবসময় ঝগড়া করে, আমি ওর সাথে মিশতে চাই খুব। কিন্তু সে একদম মিশেনা।

আমি ইরাজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
___বিরাজ তোমার ভাই যে তাই তোমরা একরকম। দেখোনা তোমার বাবা আর বড়মা একরকম, তাই তোমরাও একরকম। আর সে বুঝেনা, বোকা তো। বড় হলে আর ঝগড়া করবেনা, তোমার সাথে খেলবে, সুন্দর করে কথা বলবে, গলা গলা জড়িয়ে স্কুলে যাবে। তোমরা খুব ভালো বন্ধুও হয়ে যাবে।

ইরাজ খুশি হলো। আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে গেলো।
আমার কেন জানি বিরাজের এসবদিক ভাবাতো। সে তার ভাইয়ের সাথে মিশতে চায়না কেন?
ইথিলা ভাবী আর ইয়াজও তো জমজ ছিল, তারা দুজন ছোট বেলা থেকেই দুজনকে কতো ভালোবাসতো, আর এরা দুজন ঠিক উল্টো। অবশ্য ইরাজ মিশতে চায়, কিন্তু বিরাজ বদরাগী। জানিনা কবে ওরা মিলেমিশে থাকবে!

কিছুদিন যেতেই আমার বাবার শরীরটা আবার খারাপ হলো। ডক্টর দেখানোর পরে জানালো হার্টে সমস্যা আছে, যেকোনো সময় স্ট্রোক করার প্রবণতা বেশি। বাবাকে কেউ কোনো প্রেসার দিতোনা, উনার চাকরির জীবনে যা ছিলো! এখন উনার চিন্তা টেনশন বলতে কিছুই নেই।
তবে এখন সবাই বাবাকে সময় দেয়, হেসে গল্পগুজব করে, উনাকে ফুরফুরে মেজাজে রাখে। ইরাজ বিরাজও তাদের ছোট দা’ভাইয়ের সাথে খেলাধুলা করে, কোলে বসে গল্প শুনে। তবে ইরাজ থাকলে বিরাজ যায়না, আবার বিরাজ থাকলেও ইরাজ যায়, কিন্তু বিরাজ ইরাজকে দেখলে চলে আসে। কেন জানি বিরাজ ইরাজের সাথে কথাই বলতে চায়না।

তবে সময়গুলো ভালোই যাচ্ছিলো। ইয়াজ আর আমি ইরাজকে নিয়ে ভীষণ খুশি ছিলাম। আর ভাবী আর ভাইয়াও বিরাজকে নিয়ে পরিপূর্ণ মা বাবা।

সে-বছর আরো একটা খুশির সংবাদ আসলো, আমি আবারও মা হতে যাচ্ছি। খবরটা শুনে সবার খুশির প্রবণতা আরো বাড়লো।
এদিকে ইয়াজ মজা করে বলে, এবারও দুটো হোক।
আমি ওর কথায় হাসি! কিন্তু সবকিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি, উনি খুশি হয়ে যা দেন।


দেখতে দেখতে আবারও কেটে গেলো ৬ মাস। রিপোর্টে জানলাম এবার মেয়ে বাবু আসবে! এই সংবাদটা ছিল অতিরক্তি খুশিতে আরো খুশির মিশ্রণ। ঘরের সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে নতুন সদস্যের জন্য। বিশেষ করে বাবা বেশি, উনি ইমোশনাল হয়ে যান, বলেন জানিনা আমার ভাগ্যে নাতনির মুখ দেখা লেখা আছে কিনা।
বাবা এসব বললে বাবার প্রতি অভিমান করে বলি,
___এসব বলো না তো বাবা! ইনশাআল্লাহ দেখবে আর দোয়া করি যেন নাতজামাই দেখার মতো আয়ু আল্লাহ তোমায় দিক।

বাবা শুকনো হাসিতে আমার কথা থেকে যেন শান্তনা নেন। বাবা হয়তো বুঝেছিলেন উনি এই সময়টুকু আর পাবেন না।
একমাসের মাথায় বাবা হুট করেই স্ট্রোক করে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। জানিনা প্রতিবার খুশিগুলো দুঃখের সাথে কেন আসে!
বাবার ইচ্ছেগুলোও অপূর্ণ থেকে গেলো। সাথে অপূর্ণতা দিয়ে গেলো আমাদের, ভাইয়া আর আমি এতিম হয়ে গেলাম। মা হয়ে গেলো বিধবা!
বাবা চলে যাওয়ার পরে মা কেমন যেন হয়ে গেছে।
মায়ের শরীরেও এখন বিভিন্ন অসুখের বাসা।

এর মধ্যে আমাদের সবার হৃদয় আলো করে আসলো আমার মেয়ে! সবাই মিলে
ওর নাম দিলো ইব্রিয়া।

আমার মেয়ে আমার নতুন মা হয়ে আসলো, অথচ আমার মা হাসতে ভুলে গেলো। সারাক্ষণ বাবার জন্য মন খারাপ করেন। বলেন, নাতনির আগমনে তোর বাবা কতটা খুশি হতো, এখন উনিই নেই তাহলে আমি কি করে খুশি হবো বল?

আমার শ্বশুর শাশুড়ী, ভাবী ভাইয়া সবাই-ই এখন নতুন বাবুকে নিয়ে মেতে উঠেছে। ইয়াজ তো ভীষণ খুশি, তার এখন ছেলে মেয়ে দুটোই আছে।
এদিকে ইরাজ বিরাজ দুজনেই ওদের বোনকে ভালোবাসে, কোলে নিতে পারেনা তবুও বসে একটু একটু কোলে নেওয়ার চেষ্টা করে। ওর পাশে খেলা করে। ওরা এতদিন একসাথে না থাকলেও এবার বোনের জন্য এক জায়গায় বসে থাকে, ইব্রিয়ার দুই হাতে দুইদিকে ধরে ওরা নানারকম গল্প শুনায়। তবে সেটা শুধু ইব্রিয়ার পাশাপাশি থাকলেই, এমনিতে একটুও কথা বলেনা। ভাবী কতো করে বলে দুজন মিলেমিশে থাকতে কিন্তু সেটা ভাবী বললেই একটু মিলে, নইলে আবার আগের মতো।

ওদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। এদিকে ভাইয়ার অফিসের বস বলছে উনার সিঙ্গাপুরে একটা বিজনেস আছে ভাইয়া যেন পরিবার নিয়ে সেখানে চলে যায়। ভাইয়া উনার বিশ্বস্ত একজন লোক। তাই এইটা দেখাশোনার দায়িত্ব ভাইকেই দিতে চান। এতদিন ধরে ভাইয়া কোনো কথা বলছিলেন না। কিন্তু এবার আমার মায়ের অবস্থা খারাপ, ব্রেনে সমস্যা হয়ে গেছে। দ্রুত উন্নত চিকিৎসা দরকার।
ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিলেন মা’কে নিয়ে হলেও উনি যাবেন,আর উনাকে যেতেই হবে। কিন্তু ভাবীও যাবে,উনাকে এই অবস্থায় কি করে যেতে দিবে।
সবকিছুর মাঝেও নিজের প্রিয়জনদের একসাথে নিয়ে বেশ ভালো ছিলাম। এবার অপূর্ণতার ছায়া আবার দেখা দিলো। বিরাজকে কখনোই রাখতে পারবোনা, সে ভাবীকে ছাড়া কিছুই বুঝেনা।
তাও যেন মন মানছিলোনা। সে রাগী, বদরাগী, ঝগড়াটে তবুও তো আমার সন্তান!
তবুও মুখ ফুটে হাসতে হাসতে বলেছিলাম,,
___ভাবী বিরাজকে রেখে যাও।

ভাবী এখন আর মন খারাপ করলো না। উনিও হাসতে হাসতে বললেন,
___পারলে রেখে দাও।

ভাবী জানে বিরাজের মা হবার অধিকার ভাবীকে কবেই দিয়ে দিয়েছি। এখন শুধু সবসময় নিজের সন্তানকে চোখের সামনে দেখতে চাই।

ওরা চারজনের পাসপোর্ট করলো, বিরাজ চলে যাবে শুনে কয়েকদিন থেকেই ইরাজের মন খারাপ। কিন্তু বিরাজ খুশি ছিলো, তবে ইব্রিয়ার কাছে এসে বলে,
___তোমাকে খুব মিস করবো ইব্রু।

আমাকে ইয়াজ এবার আর কাঁদতে দিলোনা। সে আমাকে বোঝালো আমাদের সন্তান আমাদের চেয়ে তাদের কাছে ভালো থাকবে। এটাও বুঝালো ওরা তো আবার আসবে, আর আমাদের রোজ কথা হবে। মায়েরা পড়ালেখার জন্যও তো সন্তানদের অন্যত্র রাখেন, তারপর আমাদের এখন নতুন একজনও আছে। আমিও সবকিছু বুঝলাম। ভাবীর ভালো থাকার সাথে আমার সন্তানের ভালো থাকাও এখন যুক্ত হয়ে গেছে। আমি জানি বিরাজ ভীষণ ভালো থাকবে।

ওরা চলে গেলো। ইরাজ কয়দিন মন করে থাকলেও ইব্রিয়ার সাথে হেসেখেলে স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
এদিকে প্রতিদিনই ভাবীর সাথে আমাদের কথা হতো, বিরাজ নতুন জায়গায় গিয়ে ভীষণ খুশি। সেখানে স্কুলেও ভর্তি হয়ে গেছে। মা’র চিকিৎসাও ঠিকঠাক চলছে। এসব দেখে আমি আর ইয়াজ আর মন খারাপ করিনা। কিন্তু বিরাজ এতো বেশি খেলায় মগ্ন থাকে যে ফোনে কথা বলতে চায়না, মাঝে মাঝে ইব্রিয়াকে ভিডিও কলে দেখে এইটুকুই।

দেখতে দেখতে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলো। ইরাজ এখন ফাইভে পড়ে। ইরাজ পড়ালেখায় ভালো, তবে ততটাও মেধাবী না। কিন্তু বিরাজ নাকি প্রচন্ড মেধাবী, খেলার পাশাপাশি অল্প যাই পড়ে সব তার মনে থাকে, রেজাল্টও অনেক বেশি ভালো করে।
আর আমার মেয়ে ইব্রিয়া এবার ভর্তি হয়েছে। সে দেখতে প্রায় আমার মতো, সে তাদের ভাই আর বাবার মতো হয়নি।

বিরাজের পরিক্ষার পরে তারা কয়েকমাসের জন্য দেশে আসবে বলেছিলো। কারণ মা এখন পুরোপুরি সুস্থ। আমিও অপেক্ষমাণ ছিলাম কবে আসবে,আর আমার সন্তানকে এতো বছর পরে বুকে জড়িয়ে আদর করবো।
আমার সেই অপেক্ষার অবসান শীগ্রই হলো।

আমি, ইয়াজ, আমার শ্বশুর শাশুড়ী, আমার মেয়ে ইব্রিয়া এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছি তাদের জন্য।
ইরাজের এখনো মনে আছে বিরাজ কীভাবে তার সাথে ঝগড়া করতো। সে আসার পথেও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে,
___আম্মু বিরাজ আর আমার সাথে ঝগড়া করবেনা তাইনা?
আমি হেসে বলেছি,
___ হ্যাঁ এখন তো সে বড় হয়ে গেছে।

তারা কাছাকাছি আসতেই আমরা দৌঁড়ে গিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। ইরাজ বিরাজকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই সে সরে গিয়ে ইব্রিয়াকে বললো,
___কেমন আছো ইব্রু?

ইরাজের মন খারাপ হলো এতে। কারণ বিরাজ তার সাথে সাথে বলেনি। আমি এটা বুঝতে পেরে বিরাজের মাথায় হাত রেখে বললাম,
___বিরাজ। তোমার ভাই ইরাজের সাথে যে কথা বললেনা, আর আম্মুর সাথেও কথা বলোনি এখনো, জিজ্ঞাসা করো কেমন আছি?

বিরাজ চোখ ভ্রু কোঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___তুমি আম্মু কি করে হও? আমার মা, আম্মু,মাম্মি সব তো উনি। আর মা তো একজনই হয়,তাইনা?
তুমি আমার বাবার বোন হলে তো সম্পর্কে আমার ফুফি হও!

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে