অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-০৮

0
1171

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (৮ম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

ভাইয়া চোখ লুকিয়ে থামা গলায় বললো..
___ ইথিলার বিয়ে!?

আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম,
___হ্যাঁ ভাইয়া আপুর তো বিয়ের কথা হচ্ছে। খুব ভালো ভালো জায়গা থেকে সব সমন্ধ!

ভাইয়া মলিনমুখেই মাথাটা একটু ঝাকালো! আর আমার দিকে আর না তাকিয়েই সেখান থেকে উঠে ধিরে ধিরে বাইরে চলে গেলো।
আর আমি অবাক হয়ে ভাইয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এমনটা আশা করিনি, ভাইয়া ভাবীর বিয়ের কথা শুনে এমন চুপসে গেলো কেন? তারপর উনাকে আপু ডাকার ব্যপারটাও ভাইয়াকে কেমন চমকে দিয়েছে!
আর বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আমি ইচ্ছে করেই মিথ্যে মিথ্যে বলেছি। যাতে বুঝতে পারি সত্যিই ইথিলা ভাবী দূরে চলে গেলে ভাইয়া খুশি হবে কিনা!
তবে উনার তো খুশি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হলোনা কেন?
ভাইয়ার কি সত্যিই কোনো প্রেমিকা আছে? আর থাকলে এখনো এই ব্যপারে কোনো কথা শুনছিনা কেন?
নিশ্চয়ই কিছু আছে, হয়তো ভাইয়া কিছু গোপন করছে, নয়তো ইথিলা ভাবী। তবে ভাইয়ার মধ্যে অজানা কিছু আছে যা কাউকে জানাতে চাচ্ছেনা। কি হতে পারে সেটা? ইয়াজকে জানাতে হবে পুরো বিষয়টা।

আমি তারাহুরো করে রুমে যেতে চাইলেই বিন্তি আমাকে আঁটকালো। ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,
___কিরে কেমন আছিস?

বিন্তি বললো,
___আমি তো ভালো আছি, তুই কেমন আছিস বল? ইয়াজ ভাইয়া কি খুব খারাপ ব্যবহার করে? তোর সাথে একদম কথা বলতে চায়না?

আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম, ওকে কি বলবো বুঝতে পারলাম না। কারণ এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছি। বিন্তি আমাকে ঝাকিয়ে আবার বললো,
___বিন্দিয়া ইয়াজ তোকে আগে এতটা ভালোবেসেও কি করে বিয়ের রাতে বাড়ি আসলোনা? তুই কি কিচ্ছু বলিস নি?

আমিও এবার বিন্তির কাঁধে হাত রাখলাম আর বললাম,
___ তুই দেখেছিস সে বাড়ি আসছে কি আসে নাই?

বিন্তি থতমত করে বললো,
___সবাই তো তাই বলছে!

আমি ভ্রু কোঁচকে বললাম,
___তো ওরা কি ছিল ইয়াজের সাথে? কি অদ্ভুত তুই! মানুষের কথা শুনে এতো মাথা ঘামাচ্ছিস। যাহ এতো চিন্তা তোর না করলেও চলবে!

বলেই আমি আমার রুমে চলে গেলাম।

রুমে যেতেই দেখি ইয়াজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কিন্তু আমার আগমন টের পেয়ে চোখ খোলে তাকালো। আমি বিছানায় বসেই অস্থির গলায় বললাম,
___শুনেন কি হয়েছে, ভাইয়াকে মিছামিছি বলেছিলাম ইথিলা ভাবীর বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে। এটা শোনার পরে ভাইয়ার চেহেরাটা পুরো পেঁচার মতো হয়ে গিয়েছিলো, ভাইয়ার সামনে ইথিলা ভাবীকে আপু ডাকছিলাম আর সেসময়ও উনি অদ্ভুতভাবে প্রশ্ন করলো ভাবী না ডেকে ইথিলা আপু কেন ডাকছি! তখন ভাইয়ার মুখ দেখে আমার মনে হয়নি ভাইয়ার অন্যত্র সম্পর্ক আছে।

ইয়াজ উঠে বসে মাথা নেড়ে বললো,
___উমম বুঝলাম।তবে তুমি কিন্তু মিথ্যে বলোনি। ইথিলার জন্য অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব আসতেছে। যারা আগে আমার জন্য ইথিলার কাছাকাছি আসতে পারতোনা তাদের মধ্যেও কয়েকজন সাহস করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে । ইথিলাকে অনেকেই পছন্দ করতো, কিন্তু আমি আমার বাড়িতে কোনো পাত্র আসতে বারণ করে দিয়েছি! কারণ জানি ইথিলা এসবে পাত্তা দিবেনা, কারণ সে তোমার বাদল ভাইকে ভালোবাসে।

আমি বিমর্ষ চেহেরায় ইয়াজের ভাঁজ করে বসা পায়ের উপর মাথা রেখে শুলাম। ইয়াজ মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করলো,
___ চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে বিন্দিয়া।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। সত্যিই ওর মধ্যে নিরাশার প্রভাব নেই। যা আছে সবটাই আশা আর ভরসা দিয়ে পূর্ণ!

রাতে খাওয়ার সময় আমাদের সাথে ভাইয়াকে মা বারবার ডাকছিলো কিন্তু ভাইয়া আসছিলোনা। কিন্তু বাবা বসেছে আমাদের সাথেই। বাবা কেন জানি সাহস করে ইয়াজকে কিছুই বলছেনা। মাও আলগা থেকে শুধু খাবার বেড়ে দিচ্ছে। কথা বলতে যেন তাদেরকে রাজ্যের ভয় কাবু করে রেখেছে। ইয়াজও বিষয়টাকে কোনো রকম পরোয়া করছেনা। কিন্তু অর্ধেক খাওয়ার পরেই ভাইয়া আসলো। ইয়াজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়েই খাবার রেখে চুপচাপ উঠে চলে গেলো। আমরা চারজন ওর দিকে ১০ সেকেন্ড তাকিয়ে একে অপরের দিকে তাকালাম। তারপর কিছু না বলে আমিও উঠে চলে গেলাম। এতে স্পষ্ট দেখলাম ভাইয়ার মুখটা সবচেয়ে বেশি ভার হয়ে গেছে। ইয়াজ প্রতি ক্ষেত্রে ভাইয়াকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিচ্ছিলো।

পরেরদিন সকাল সকালই ইয়াজ চলে যাওয়ার জন্য তাড়া করছিলো। সত্যি বলতে আজ ইয়াজের অফিস আছে, শুধু দুইদিনের ছুটি নিয়েছিলো। আর সেটা কালকেই শেষ, তাই আজকে এখান থেকে গিয়েই অফিস ধরবে।
এমনকি খাওয়ার সময় পর্যন্ত ছিল না। এদিকে আমার মা ভাবেনি সে এতো তাড়া করবে, তাই রান্না সম্পূর্ণ হয়নি। ইয়াজ সবকিছু গুছিয়ে বের হতে লাগলো, আমিও তৈরি হয়ে গেলাম। বারবার দেখছিলাম খাবার রেডি কিনা। শেষ পর্যন্ত খাবার তৈরি শেষ কিন্তু ইয়াজ বের হয়ে যাচ্ছে। আর আমি পেছন গিয়ে বললাম,
___প্লিজ অল্প খেয়ে নিন।

ইয়াজ গাড়ীতে উঠতে উঠতে মা’কে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
___এতক্ষণে রান্না করে ডাকলে আর কোনো লাভ নাই, এখন আর আমার সময় নেই! আপনার মেয়ের ইচ্ছে হলে খেতে বলেন, আমি একা চলে যাই।

মা কথাটা শুনে একটু মন খারাপ করলো। আমি হাত ধরে বললাম,
___কিছু মনে করো না। ও আসলে এমনই! সময় নেই যে তাই এভাবে বলছে!

এদিকে ভাইয়া দাঁত ব্রাশ করতে করতে এদিকে আসছিলো, আর এসেই এই বিষয়টা দেখলো আর দেখলো আমরা চলে যাচ্ছি,। অন্যদিকে ভাইয়া তাকিয়ে দেখলো ইয়াজ এভাবে বলায় মা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এবার ভাইয়াও এসে মন খারাপের স্বরে আমাকে বললো,.
___ মা’কে আগে বললে উনি ভোর রাতেই রান্না কম্পলিট করে রাখতেন, তা যাই হোক ভালো থাকিস বিন্দিয়া, আর আমায় পারলে ক্ষমা করিস।

আমি মাথা নেড়ে গাড়ীতে উঠলাম। আর তাদেরকে টাটা দিয়ে তারপর সোজা হয়ে বসলাম। খারাপ লাগছে শেষবারেও মা’কে মন খারাপ দেখে বের হতে হয়েছে। ভাগ্যিস বাবা এখনো ঘুমিয়ে আছে,নইলে উনিও এখন বিষয়টাতে আবার কষ্ট পেতেন। আর আমাকে তিনটা মুখ একসাথে খারাপ দেখে আসতে হতো। ইয়াজ আমাকে চুপ দেখে বললো,
___বাদল ভাইয়া তখনি না আসলে আমি এটা করতাম না। তোমার মা’কে এভাবে বলায় আমারও খারাপ লাগছে। আবারো সরি! তুমি রাগ করো না প্লিজ।

আমি কিছু বললাম না। সারা রাস্তা এমন গোমড়ো মুখে করেই গেলাম, মাঝ রাস্তায় ইয়াজ নেমে গেলো কারণ এদিকেই নাকি তার অফিস। আর ড্রাইভার আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলো।

পৌঁছাতেই ইথিলা ভাবী এসে আমাকে একসাথে প্রশ্ন ছুড়তে লাগলো,
___ইয়াজ কি সেখানে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছে? রাতে কোথায় ছিল?

আমি হেসে বললাম,
___রাতে আর কোথায় থাকবে? আমার সাথেই ছিল!

ভাবী মুখটা অন্য দিক ফিরিয়ে বললো,
___তোমার ভাইয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নাই তো?

আমি ভাবীর কাঁধে হাত রেখে বললাম,
___বেশি করেনি। তবে আমার সাথে যা করেছে ভাইয়া তাতেই কষ্ট পেয়েছে খুব।

ভাবী মুখটা কালো করে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি ভেতরে গিয়ে আমার শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে কুশল বিনিময় করলাম।
তাদেরও একই প্রশ্ন! ইয়াজ খারাপ ব্যবহার করেছে কিনা!
! আমিও ভাবীকে যে উত্তর দিয়েছি তাদেরকেও সেই উত্তর দিয়ে নিজের রুমে গেলাম।
ফ্রেশ হয়ে এসে অল্প খেয়ে নিলাম, ইয়াজের জন্য আমিও খেয়ে আসতে পারিনি। ইয়াজও খায়নি, আর আমাকেও খেতে দেয়নি,তবে সে বলেছে বাইরে থেকে খাবে। কে জানে এতো তারাহুরোতে খেলো কিনা! তাও আবার নতুন চাকরিতে আছে, সময় খুব কম পায়!

এদিকে সারাদিন সবার সাথে টুকটাক কাজ,কথাবার্তায় মনে হলো দিনটা দ্রুতই চলে গেছে। কিন্তু দু-টানায় ছিলাম ইয়াজ ফিরবে কিনা, কিংবা ফিরলেও তারাতাড়ি ফিরবে কিনা৷ কিন্তু আমার ধারণা বদলে দিয়ে ইয়াজ সন্ধ্যার পরেই দুই কেজি রসমালাই নিয়ে বাড়ি আসলো।
বক্স খুলেই ইথিলা ভাবীকে জোর করে একসাথে কয়েকটা খাওয়ালো। ভাবী জোর করে খেয়ে বললো,
___তোর বিয়ের তো দুইদিন হয়েছে, এটা কিসের মিষ্টি ভাই?

ভাবীর কথা শুনে আমিসহ সবাই হেসে ফেললো, তবে আমি দ্রুতই হাসি থামিয়ে দিলাম। কারণ আমি জানি ইয়াজ আমাকে নিয়ে এখন উদ্ভট কিছু বলবে, যেটা বিয়ের পর থেকে সবাইকে বুঝাচ্ছে। কিন্তু সে আমার এই ধারণাকেও বদলে দিয়ে ভাবীকে বললো,
___ইথিলা তোমার জামাই তোমাকে নিতে রাজী হয়েছে! আমার সাথে যে কাজ করে, বিন্দিয়াদের বাড়ির পাশের সবুজ ভাই, উনাকে নাকি বলেছে আমাকে এইটা জানিয়ে দিতে যে তুমি রাজী থাকলে সে তোমাকে আবার তার বাড়িতে নিবে।

বলেই ইয়াজ দুইটা রসমালাইয়েরর গোল্লা নিজের মুখে পুরলো। আমি অবাক হয়ে ভাবছি ভাই এতো তারাতাড়ি কীভাবে রাজী হলো? সত্যিই কি উনি আমার এসব দেখে, আর ইয়াজের অভিনয়ে কষ্ট পেয়ে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছেন? ভুলগুলো সত্যিই বুঝতে পেরেছেন তো? এখন কেন মনে হচ্ছিলো সবকিছু খুব দ্রুত সমাধান হওয়া কি করে সম্ভব? উপরে তাকিয়ে শুকরিয়া জানানোর আগেই ভাবী বললো,
___ইয়াজ এতো লাফাচ্ছো কেন? তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে আছি?

ভাবীর কথার সাথে সাথেই আমার শাশুড়ী বললো,
___ কাল রাতে তৃষান এসেছিলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, তোর মনে আছে ওর কথা? ইথিলাকে একবার চিঠিতে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো বলে তুই ওকে খুব মেরেছিলি? সে এখনো বিয়ে করে নাই,কিন্তু নির্দ্বিধায় ইথিলাকে বিয়ে করতে রাজী!

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে