Monday, July 14, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 359



চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৮

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
অষ্টম_পর্ব
~মিহি

“লেখা, একটু শোন তো।” খুব স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে হঠাৎ যখন বড় ভাই এভাবে ডাকে ঠিক তখনই সমস্ত পাপকর্ম মনে পড়তে থাকে চিত্রলেখার। মাথার এ পাশ ও পাশ খুঁজেও কোনো গ্যাঞ্জামের কথা মনে করতে না পেরে তবুও ভয়ে তটস্থ হয়ে বড় ভাইয়ের সামনে দাঁড়ায় সে।

-ভাইয়া ডেকেছিলে?

-হুম। তোর আর প্রাইভেট পড়াতে যাওয়ার দরকার নেই।

-কেন ভাইয়া?

-তোর সামনে পরীক্ষা, অন্যকে পড়াতে গিয়ে তোর পড়াশোনার ক্ষতি হোক এটা আমি চাই না। আর এর উপর কোনো দ্বিমত আমি শুনতে চাচ্ছি না। বুঝেছিস?

-জ্বী ভাইয়া।

চিত্রলেখার মন খারাপ হলেও কিছু করার নেই। তবে হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে সে খানিকটা বিচলিতই হলো। মন খারাপ করে ঘরে বসে ফোন হাতে নিল। আজকের দিনটা আসলেই খারাপ। রঙ্গনের চলে যাওয়ার এক অজানা মন খারাপ, আশফিনা আহমেদের রাগী দৃষ্টি এখন আবার বাড়িতে এসে ভাইয়ার বকাবকি। চিত্রলেখা ফেসবুকে ঢুকলো। তার নিজস্ব আইডির কথা কেউ জানে না। সে চায়ও না কাউকে জানাতে। আচমকা পিপল ইউ মে নো’তে রঙ্গনের আইডিটা ভেসে উঠলো। কৌতুহলবশত প্রোফাইলে ঢুকলো চিত্রলেখা। প্রোফাইলে সম্ভবত কলেজ লাইফের একটা ছবি দেওয়া। শেষ পোস্টটা নজর কাড়লো চিত্রলেখার।

‘কখনো যদি একাকী শ্রাবণ আমার তরে হাত বাড়ায়,
আমি আলিঙ্গন করে বলবো আমি বৃষ্টি ভালোবাসি
বর্ষণের আড়ালে অশ্রু বিসর্জন করতে ভালোবাসি।’

চিত্রলেখার কৌতুহল দমলো না। প্রোফাইলের প্রায়শই পোস্টেই এরূপ বিষাদমাখানো একটা মায়া মিশে আছে। চিত্রলেখার ইচ্ছে হলো রঙ্গনকে জিজ্ঞাসা করতে কিসের এত দুঃখ তার! নক দিবে কি না এ নিয়ে ভারী দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো সে। ‘যা হবে দেখা যাবে’ ভেবে নক দিলো চিত্রলেখা, “এত স্যাড পোস্ট? কিসের এত দুঃখ আপনার?” টেক্সট করেই অফলাইনে গেল সে। ছোট ভাবী খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে। ফোন রেখে টেবিলের দিকে এগোলো সে।

_______________

আজ সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি রঙ্গন। ক্লাসেও যায়নি। রাহাত অবশ্য গিয়েছিল। বিকেলে অবনীর সাথে ফিরেছে। দুজন সেই থেকে রুমে বসে আছে। রঙ্গনের ইচ্ছে হলো না ওদের প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করতে। একাকী বারান্দায় বসে ফোন হাতে নিয়ে গুনগুন করছিল সে। অবনীকে ইদানিং অন্যরকম লাগে তার। মেয়েটা আগে তাকে ছোট বোনের মতো যত্ন করতো। এখন অবনীর মধ্যে পরিবর্তনটা বেশ চোখে পড়ার মতো। পড়াশোনায় ভালো মেয়েটা অদ্ভুতভাবে ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করেছে। রাহাত রঙ্গনের সাথে এক ফ্ল্যাটে থাকলেও এখন আর কথা বলে না। দুজনের মধ্যে এ দেয়ালটা অবধারিতভাবে পাকাপোক্ত হয়েছে। অবনী সন্ধ্যের খানিকটা পর রাহাতের ঘর থেকে বেরোল। রঙ্গন কী ভেবে যেন ডাকলো তাকে।

-অবনী শোন তো।

-ওকে ডাকছিস কেন?

-রাহাত, আমি অবনীকে ডেকেছি। তুই কেন উত্তর দিচ্ছিস?

-আমি ওর বয়ফ্রেন্ড। আমি জিজ্ঞাসা করতেই পারি তুই ওকে কেন ডেকেছিস।

-না পারিস না কারণ তোর গার্লফ্রেন্ড হওয়ার আগে ও আমার বন্ধু। বন্ধু হিসেবে আমি ওকে ডাকতেই পারি।

-বন্ধু? হাস্যকর! তুই ওকে বন্ধু ডাকার যোগ্য? বন্ধু হওয়ার মতো কী করেছিস তুই? মেয়েটার মনের অবস্থা একটুও বুঝেছিস? ও যখন তোকে ভালোবাসতো তখন তো পাত্তা দেস নাই, এখন আমি ওকে নিজের করে নিয়েছি বলে জ্বলছে তোর?

রঙ্গন অবাক হলো। রাহাত কী বলছে এসব? অবনী এসে রাহাতকে থামানোর চেষ্টা করলেও রাহাত থামলো না।

-তোর সাথে এই ফ্ল্যাটে আমি আর থাকবো না। তোকে দেখলে আমার রাগ উঠে।

-রাহাত, কী বলছিস তুই? অবনী আমার ছোট বোনের মতো!

-কিসের বন্ধু রে তুই যে অবনী তোরে কী ভাবতো সেটাও বুঝিস নাই! উল্টো মেয়েটার ছোটখাটো এফোর্টগুলোরে এড়িয়ে গেছিস।

এ মুহূর্তে দুজনের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত একটা ক্ষোভ উতলে ওঠার উপক্রম। ঠিক সেসময় অবনী মেজাজ হারিয়ে রাহাতের গালে চড় বসিয়ে দিল। রাহাত গালে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে অবনীর দিকে তাকালো। অবনীর মুখে তখনো রাগ।

-তুই এই কাজটা কী করে করলি রাহাত? তোকে বিশ্বাস করেছিলাম আমি। সেজন্যই রঙ্গনকে পছন্দ করার কথা বলেছিলাম। তারপর এটাও বলেছিলাম আমাদের মধ্যে কখনো কিছু হবে না। তাই যেন এ বিষয় আড়ালেই থাকে। আমি কি তোর সাথে কোনরকম খারাপ ব্যবহার বা তোরে অবহেলা করছি? তাও কেন তুই রঙ্গনকে এসবের মধ্যে আনলি?

-এখন সব দোষ আমার?

-একটা মেয়ে যখন বিশ্বাস করে কিছু একটা শেয়ার করে, তখন সেটা গোপন রাখাটা কি দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা? তুই শুধু আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট করিসনি রাহাত, তুই আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বটাও শেষ করে দিলি!

অবনী রেগে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। রাহাত অসহায়ের মতো মেঝেতে বসে কাঁদতে লাগলো। রঙ্গনের তখনো সবকিছু এলোমেলো লাগছে। অবনীকে সে কখনো ছোট বোন ছাড়া কিছু ভাবেনি। তবে এসব নিয়ে ভাবার সময় এখন নয়। রঙ্গন দ্রুত রাহাতের পাশে বসলো। রাহাতকে সামলানোর চেষ্টা করলো। রাহাত কোনভাবেই রঙ্গনের কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। এক পর্যায়ে রাহাত রঙ্গনকে ধাক্কা ছিল। নিজেকে সামলাতে না পেরে রঙ্গন খানিকটা দূরে ছিটকে গেল। ফোনটা আরো দূরে গিয়ে পড়লো।

-রাহাত, তুই অস্বাভাবিকের মতো আচরণ করা থামাবি? তোর এই আচরণের জন্য অবনী চলে গেছে।

-তোর জন্য হয়েছে সব। তুই থার্ড পার্সনের মতো আমাদের সম্পর্কটা শেষ করলি।

-তোর নূন্যতম লজ্জা হয়না? অবনীর বিশ্বাস ভেঙে এখন আমাকে ব্লেইম করছিস? ভাই, মেয়েটা আমাকে পছন্দ করতো কিন্তু তোকে ভালোবেসেছে। আর সেই ভালোবাসার মানুষ যখন বিশ্বাস ভাঙে তখন কী অবস্থা হয় ভাব! আমি মানছি তুই আমাকে সহ্য করতে পারছিস না এখন। এটাই স্বাভাবিক। আমাকে মেরে ফেলিস তবে এখন গিয়ে অবনীকে বোঝা।

রাহাতের কী হলো বুঝলো না রঙ্গন। উঠে চোখ মুছে রঙ্গনকে জড়িয়ে ধরে দ্রুত বাইরে দৌড় দিল। রঙ্গন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘরটা শান্ত নিস্তব্ধ হয়ে আছে। কেউ বলতে পারবে একটু আগে এ ঘরে কী এক প্রকাণ্ড ঝড় বয়ে গেছে! রঙ্গন মুচকি হাসলো। আপাতত সে এই ফ্ল্যাট থেকে শিফট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। রাহাত এবং অবনীর থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকাই উভয়ের জন্য মঙ্গল। রঙ্গন আশেপাশে তাকিয়ে নিজের ফোনটা খোঁজার চেষ্টা করলো। রাহাতের সাথে ধস্তাধস্তিতে ফোনটা পড়ে যাওয়াতে স্ক্রিনে বেশ কয়েকটা ক্র্যাক দেখা যাচ্ছে। রঙ্গন ভালোমতো খেয়াল করে দেখলো প্রটেক্টরে ক্র্যাক এসেছে শুধু। ফোন অন করলো রঙ্গন। ওয়াইফাই কানেক্ট হতেই মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। রঙ্গন খানিকটা অবাক হলো। তার সাথে সবাই মোটামুটি হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে। মেসেঞ্জারে তাকে কে টেক্সট করলো। টেক্সট ওপেন করে মুচকি হাসলো রঙ্গন। স্যাড পোস্ট করা নিয়েও অপরিচিত কেউ খোটা দিতে পারে জানা ছিল না তার। আইডির নামটা বেশ অদ্ভুত, ‘অলকানন্দা’। এটা বাস্তবিক অর্থেই মেয়েটির নাম নাকি ফেক আইডি? রঙ্গন সচরাচর অপরিচিত মেসেজের রিপ্লাই দেয় না তবে এক্ষেত্রে কৌতুহল দমাতে পারলো না। রিপ্লাই করলো,”হ্যাঁ আমার জীবনে অনেক দুঃখ, আপনি কি একটু ধার নিতে পারবেন?” মেসেজ ডেলিভার হলো না অর্থাৎ মেয়েটা অফলাইন। রঙ্গন চুলে হাত চালিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে বিছানায় বসলো। মেয়েটার প্রোফাইল লক করা অথচ নিজে থেকে রঙ্গনকে টেক্সট করেছে বিষয়টা অদ্ভুত লাগলো রঙ্গনের। অবশ্যই এটা পরিচিত কেউ। রঙ্গন অনেকক্ষণ পর টেক্সটের রিপ্লাই পেল। প্রায় সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি সময়ে মেয়েটি রিপ্লাই দিল।

-আপনার দুঃখগুলো ধার নিলে আপনার সাহিত্যচর্চা বন্ধ হয়ে যাবে। আমি একজন উদীয়মান লেখককে সাহিত্যজগত থেকে বিচ্ছিন্ন করার দুঃসাহস দেখাতে চাইনা।

-তবে দুঃখবিলাসী হতে বলছেন?

-মন্দ হয় না। আমারো অনেকখানি দুঃখ আছে। কখনো সুযোগ পেলে দুঃখবিলাস করা যাবে।

-পরিচয় না জানলে দুঃখবিলাস করাটা ঠিক জমবে না। তো জনাবা, আপনার নাম জানালে উপকৃত হতাম।

-অলকানন্দা।

রিপ্লাই করে ফোন অফ করলো চিত্রলেখা। দরজার বাইরে কারো পায়ের শব্দ পেয়েছে সে। চটজলদি ফোন রেখে চোখ বন্ধ করলো চিত্রলেখা। একটু পর তার বড় ভাই এসে লাইট জ্বালালেন। চিত্রলেখার মাথায় আলতো করে হাত বোলাতে লাগলেন।

“তোকে কখনো আমি সৎবোন ভাবিনি। নিজের আপন বোনের চেয়েও বেশি আগলে রাখার চেষ্টা করেছি। সেই তোকে নিয়ে মানুষজন উল্টোপাল্টা মন্তব্য করবে তা আমি মেনে নিব না। আমি জানি তুই মন খারাপ করেছিস কিন্তু আমি সবটাই তোর ভালোর জন্য করেছি।” বোনের কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে লাইট অফ করে বেরিয়ে গেল অর্ণব। চিত্রলেখার চোখজোড়ায় তখন অশ্রুদের দল খেলা করছে। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে রঙ্গনদের বাড়িতে সে আগামীকাল শেষবারের মতো যাবে।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৭

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
সপ্তম_পর্ব
~মিহি

হোয়াটসঅ্যাপে অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ভয়েস নোট দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেল চিত্রলেখা। ভয়েস নোটটা ওপেন করতেই শোনা গেল পরিচিত কণ্ঠ,

“যদি কোন চিত্র আঁকি
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী,
সেই চিত্রতে তুমি
পার্ফেক্টলি বসো…”

ব্যস এটুকুই। সিয়ামের কণ্ঠ চিনতে অসুবিধা হয়নি চিত্রলেখার। রিপ্লাই করবে কি করবে না এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো সে। এরই মধ্যে সিয়াম আবারো টেক্সট করলো।

-ঘুমিয়ে পড়েছিস?

-না। গান তো ভালোই গাও তুমি।

-ঐটা আমার গাওয়া নয়, আমার এক বন্ধুর কণ্ঠ।

-ঢপ দিও না, তোমার কণ্ঠ আমি চিনিনা?

-আরে সত্যিই আমার বন্ধুর কণ্ঠ। তোকে এজন্যই দিলাম যে শুনে দেখ তো ওর কণ্ঠ আর আমার কণ্ঠ সেইম কিনা। সবাই বলে এটা। তুইও বললি, বুঝলাম।

-সত্যি বলছো? এত মিল কণ্ঠে, বাহ!

-তো আবার কী? তোকে কেন গান শোনাতে যাবো? এটা বাদ দে, ভাবী বলেছে কিছু?

-না। কিছুই বলেনি। কী যে হয়েছে ভাবীর।

-তোর অত চিন্তা করতে হবে না। কাল আমার ভোরের বাস। তুই ঘুমা, টাটা।

-টাটা।

ফোন রেখে বালিশে হেলান দিল চিত্রলেখা। সিয়াম ভাইয়ের সকালের বাস তার মানে আর দেখা হবে না। চিত্রলেখা মাথা ঘামালো না বেশি। সারাদিনের ক্লান্তিতে বালিশে মাথা রাখতেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো তার চোখজুড়ে।

_______________

সময় বহমান কথাটা প্রকৃতপক্ষেই সত্য। এইতো রঙ্গন ফিরেছিল বাড়িতে এত তাড়াতাড়ি দুই সপ্তাহের বেশি হয়ে গেছে। আজ তাকে ফিরতে হবে। রাতের বাস আছে। রঙ্গন ঠিক করেছে চিত্রলেখার সাথে একবার কথা বলবে, একটা ধন্যবাদ জানানো উচিত। শেষ এক সপ্তাহ ঠিকমতো কথাই হয়নি তাদের। মূলত আশফিনা আহমেদের কড়া নজরদারিতে রঙ্গন সুযোগই পায়নি চিত্রলেখার সাথে কথা বলার। অপেক্ষায় প্রহর গুণছে রঙ্গন। এই বুঝি লেখা আসবে। অপেক্ষা পূর্ণতা পেল না, চিত্রলেখা আসলো না। রঙ্গনের এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু বিরক্ত লাগলো। আবারো ঢাকা শহরের বিষাক্ততার সম্মুখীন হতে বাধ্য সে। রাত এগারোটায় বাস। মাশরুর আহমেদ তাকে রেখে আসবেন বলেছেন। রঙ্গনের না বলার সাধ্য নেই।

এখন নয়টা বাজে। রঙ্গন জানালার ধার ঘেঁষে বসে আছে। রাতের আঁধারে রোডলাইটের স্মিত আলোয় রাস্তাটা জ্বলজ্বল করছে। অথচ রঙ্গনের মন জুড়ে আঁধার বিরাজ করছে। উদাসী চোখজোড়া একদৃষ্টিতে রাস্তার পানে চেয়ে আছে। নেই প্রতীক্ষা, নেই প্রত্যাশা তবুও কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করছে।

অহম ধীর পায়ে এসে রঙ্গনের কোলের মধ্যে ঢুকে পড়লো। রঙ্গন মাঝে মাঝে ভুলেই যায় তার এই ভাইটা কি আদৌ নাইনে পড়ে নাকি ক্লাস টুতে।

-বাচ্চাদের মতো কোলে বসলি কেন?

-ভাইয়া, তুমি আবার কবে আসবে?

-একেবারে পরীক্ষার পর।

-আমার আজ খুব মন খারাপ। ম্যামও আসলো না, তুমিও চলে যাচ্ছো। আমাকে কে সামলাবে?

-তোর আবার কেন মন খারাপ?

-আমার ব্রেক-আপ হয়েছে। ঐ রসায়ন স্যারের মেয়ের জন্য। বেদ্দপ মেয়ে বলে কিনা আমি ওকে প্রপোজ করছি। আমার জিএফ মেনেও নিলো! একটু বিশ্বাস করলো না!

-দেখ, তুই যেমন ছোট, ঐও ছোট। এখন স্বভাবতই বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে তোদের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে একটা কথা মনে রাখবি, ভালোবাসায় ‘সম্মান’ জিনিসটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোকে সাজেস্ট করবো তোর জিএফকে এখন বেশি বিরক্ত করিস না।

-এখন ওকে না মানালে পরে আবার কথা শোনাবে।

-কথা শোনানোর অপেক্ষা কর। প্রেম করছিস, খুনসুটি কেন মিস করবি?

-তুমিও নাহ ভাইয়া! নিজে তো আমার ম্যামকে পটাতে পারলে না আবার আমাকে লাভ টিপস দিচ্ছো!

-কোল থেকে নাম।

অহম হাসতে লাগলো। রঙ্গন রাগী দৃষ্টিতে তাকালেও অহমের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। রঙ্গনের মন ভালো হয়ে গেল। ভালো থাকার জন্য বড়সড় কারণ লাগে না। ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই মানুষকে ভালো রাখে।

রঙ্গন সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাবার সাথে বের হলো। আশফিনা আহমেদের দৃষ্টিটা পড়তে অসুবিধা হয়নি রঙ্গনের। এ দৃষ্টি শাসনের নয়, সতর্কতার। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। চেনা এক অপরিচিত মহলে আবারো দম বন্ধ করে বসে থাকতে হবে তাকে।

____________________

চিত্রলেখা আজ সময়ের একটু আগেই এসেছে অহমকে পড়াতে। আগেরদিন আশফিনা আহমেদ নিষেধ করায় আসেনি সে। অহমকে আজ বেশ শান্ত মনে হচ্ছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় যথেষ্ট চুপচাপ।

-কী হয়েছে অহম? আজ এত শান্ত যে?

-কাল ভাইয়া চলে গেছে। একা একা ভালো লাগছে না।

-রঙ্গন? মানে রঙ্গন ভাইয়া?

-হ্যাঁ। ঢাকায় চলে গেছে। ভাইয়ার মতো বড় হয়ে গেলে আমিও ভাইয়ার ভার্সিটিতে পড়বো।

-তার জন্য পড়াশোনা করা লাগবে। বই খোলেন।

অহম বই বের করতে লাগলো। রঙ্গনের যাওয়ার খবরটা খানিকটা কষ্ট দিলো চিত্রলেখাকে। রঙ্গন একবার বলেওনি তাকে! পরক্ষণেই মনে হলো সে কে যে রঙ্গন তাকে নিজের সব কথা বলবে। নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অহমকে পড়াতে শুরু করলো সে।

আশফিনা আহমেদের মন গতকাল খানিকটা বিমর্ষ থাকলেও আজ তিনি ফুরফুরে মেজাজে আছেন। তার ভাই নওশাদ আসছে। ভাই তার জন্য সুপরামর্শের ভাণ্ডার তবে কোনক্রমেই এ ভাইটাকে তিনি সংসারমুখী করতে পারেননি। বয়স আটত্রিশ ছুঁলেও দাম্পত্য জীবনের থেকে দুহাত ছাড়িয়ে তিনি। ভাবতে ভাবতেই নওশাদ এসে তার দরজায় টোকা দিল। বুঝতে পেরে আশফিনা আহমেদ হাসলেন। নওশাদ ভেতরে এসে বিছানায় সটান হয়ে বসলো।

-কী বনু? ভুলে গেছো ভাইকে?

-সে আর কোথায়? তুই তো খোঁজ রাখিস না।

-এখন সব দোষ আমার? দোষ না দিয়ে কফি দিলেও পারো।

-দাঁড়া আনাচ্ছি।

আশফিনা আহমেদ চেঁচিয়ে কফি আনার কথা বললেন কিন্তু নিচ থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে বেশ বিরক্ত হলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর নিচ থেকে সম্মতিসূচক বাক্য এলো। বিরক্তির উপর ছাই ফেলে আশফিনা আহমেদ ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলেন।

চিত্রলেখা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাবেয়ার দিকে। তার ডান হাতে বেশ খানিকটা কেটেছে। চিত্রলেখা যাওয়ার সময় আর্তনাদ শুনতে পেয়ে এসে দেখে এ অবস্থা। এরই মধ্যে আশফিনা আহমেদ কফির জন্য চেঁচালে রাবেয়া অনেকক্ষণ পর সম্মতি জানালো। রাবেয়ার অবস্থা দেখে চিত্রলেখার মায়া লাগলো। সে নিজেই কফি বানালো। অতঃপর ট্রে তে করে সাজালো।

-ম্যাডাম, আমাকে দিন আমি দিয়ে আসি।

-খালা, আপনার হাতে লেগেছে। আপনি পারবেন না। আপনি বসুন, আমি দিয়ে আসছি।

-বড় মেমসাহেব রাগ করবেন ম্যাডাম।

-সমস্যা নেই, আমি বুঝে নিব। আপনি ওষুধ লাগিয়েছেন, বিশ্রাম করুন।

রাবেয়াকে বিশ্রাম করতে বলে চিত্রলেখা কফির ট্রেটা নিয়ে আশফিনা আহমেদের ঘরের দিকে এগোলো। দরজাটা একটু চাপানো। এক হাতে ট্রে ধরে অন্য হাত দিয়ে নক করলো চিত্রলেখা। আশফিনা আহমেদ রাগী স্বরে ভেতরে প্রবেশ করতে বললেন। চিত্রলেখা কফির ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আশফিনা আহমেদের রাগ আরো বাড়লো।

-তুমি কেন এসেছো কফি নিয়ে?

-আসলে আন্টি, রাবেয়া খালার শরীরটা…

-কফি রেখে চলে যাও।

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। কফির ট্রে টা রাখার সময় অযাচিতভাবে চোখ পড়লো নওশাদের দিকে। মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের চিত্রলেখার দিকে তাকানোর ভঙ্গিটা অদ্ভুত রকমের। চিত্রলেখার অস্বস্তি হলো। কফি রেখে সে দ্রুত রুম পরিত্যাগ করলো। নওশাদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। কফির মগটা হাতে নিল সে।

-মেয়েটা কে?

-ও অহমের টিচার।

-এত অল্পবয়সী? এ নিজে এস.এস.সি পাশ করেছে?

-ধূর বাদ দে ওর কথা। তোর দুলাভাই এনেছে। সাথীর কথা মনে আছে না? ওর ননদ।

-সাথীর ননদ? ওহ আচ্ছা।

নওশাদ আর কথা বাড়ালো না। সাথীর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে তার বোন পছন্দ করে না সে জানে। এ বিষয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই তবে সাথীর ননদের প্রতি নওশাদের দৃষ্টিটা বেশ প্রখরভাবেই স্থায়ী হলো। নওশাদের চোখে বারবার চিত্রলেখার অল্প ভীত মুখখানি, লাল আভা মাখানো ঠোঁটটা ভাসতে লাগলো। নিজেকে চরম অতৃপ্ত মনে হলো তার। আর এ অতৃপ্তির কারণটাও সে অনুভব করতে পারছে। নওশাদের মন তখন চিত্রলেখাকে নিয়ে খেলছে, উন্মত্ত এক খেলা।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৬

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
ষষ্ঠ_পর্ব
~মিহি

“সিয়াম ভাইয়া…পানি…” চিত্রলেখার আওয়াজে ঘোর কাটলো সিয়ামের। হাতে থাকা পানির বোতলটা বাড়িয়ে দিল তার দিকে। কিছু মুহুর্ত আগের কল্পনাটা মনে করতেই সিয়ামের মুখে খানিকটা লাজুকতা ভর করে। কল্পনায় কত সহজে মনের কথাটা বলে ফেলল সে তবে বাস্তবতাটা বড্ড কঠিন। এখনো চিত্রলেখাকে মনের কথা বলার সময় আসেনি তা ভালোমতোই জানে সে।

চিত্রলেখা খাওয়া শেষ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সুবহা তখনো লাস্ট প্লেট বলে আরেকটা প্লেট হাতে নিয়েছে। এ মুহূর্তে চিত্রলেখা খানিকটা বিরক্ত হচ্ছে। তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাড়িতে গেলে ভাবী নিশ্চিত ঝাড়বে তাকে। বিষয়টা বুঝতে পেরে সিয়াম সুবহাকে তাড়া দিল। সুবহা তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করলো। বিল পরিশোধ করার পর যাওয়া নিয়ে একটা ঝামেলা বাঁধলো। সিয়াম এক বাইকে দুইজনকে নিয়ে যেতে পারবে না, আবার চিত্রলেখাকে একাও ছাড়তে পারবে না। একবার ভাবলো দুজনকে রিকশায় পাঠাবে তারপর চিত্রলেখার বাড়ি থেকে সুবহাকে পিক-আপ করবে। এমন সময় আচমকা পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল সে। পেছনে ফিরে দেখলো তার চাচা অর্থাৎ সুবহার বাবা।

-আসসালামু আলাইকুম চাচ্চু।

-এখানে কেন তুমি?

-কালকে চলে যাবো তাই ওদের খাওয়াতে এনেছিলাম।

-সন্ধ্যে হয়ে এসেছে সিয়াম, তোমার খেয়াল রাখা উচিত। আমি সুবহাকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি লেখাকে রেখে এসো।

-আচ্ছা চাচ্চু। আপনি কোনো কাজে যাচ্ছিলেন?

-না, কলেজে একটা মিটিং ছিল। ওখান থেকে বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। এখন ফিরছিলাম। তুমি যাও, দ্রুত লেখাকে রেখে আসো। লেখা মা, যাও ভাইয়ার সাথে।

চিত্রলেখা মাথা নাড়লো। সুবহাকে বিদায় জানালো সে। এশার আযান দিয়েছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে চিত্রলেখার। বড় ভাবী নিশ্চিত আজ ছাড়বে না তাকে।

-বাইকে উঠবি নাকি রেখে চলে যাবো?

-হ্যাঁ উঠছি।

চিত্রলেখা আনমনেই সিয়ামের পেছনে বসে পড়লো। হঠাৎ তার মনে হলো বিকেলে ভাবীর সামনে সে হিজাব পড়ে ছিল না। এখন হিজাব পড়ে গেলে নিশ্চিত ভাবীর বকা বেশি খাবে। সিয়ামকে থামতে বলে হিজাব খুলে ওড়নার মতো মাথায় মেলে দিল।

সিয়াম বেশ জোরেই বাইক চালাচ্ছে। চিত্রলেখা সিয়ামের কাঁধে কোনোরকম একটা হাত রেখে বসেছে। বাতাসে খোঁপার কাঠি খসে পড়লো, কোমড় অবধি চুলগুলো পুরোপুরি না খুললেও ঘাড় অবধি মেলে পড়লো। সামনের অবাধ্য চুলগুলোর তাড়নায় ছটফট করতে লাগলো চিত্রলেখা।

-নড়ছিস কেন? সমস্যা হচ্ছে বসতে? এত মোটা কবে হলি?

-আরে ধূর! আমি মোটা হইনি। চুলগুলো বিরক্ত করছে।

-খুলেই রাখ। আধখোলা রাখলে তো বিরক্ত করবেই।

-তুমি বেশি জানো?

-মেয়েমানুষের সাথে কথা বলাই বৃথা।

-কী বললে তুমি? বেশ, এরপর ভুলেও কথা বলবো না কোনোদিন।

সিয়াম ব্রেক কষলো। চিত্রলেখা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। সিয়াম তার তোয়াক্কা না করেই বাইক সাইড করে পাশের একটা আইসক্রিমের স্টলের দিকে ছুটলো। দুটো আইসক্রিম এনে একটা চিত্রলেখার সামনে বাড়িয়ে দিল।

-নে আইসক্রিম খেয়ে ঠাণ্ডা হ।

-আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে সিয়াম ভাই।

-আমি কাল চলে যাবো, আমার কত কাজ আছে জানিস? তবুও তোকে সময় দিচ্ছি ভালো লাগছে না তাইনা?

-সময় দিতে বলেছে কে?

চিত্রলেখা মজার সুরে কথাটা বললেও খারাপ লাগলো সিয়ামের। বাক্যটা ছুরির মতো ফালা ফালা করে দিল তার হৃদয়টাকে। তবুও ঠোঁটে হাসিটা বহাল রাখলো সে।

-ভাবী কি এখনো মারে তোকে?

-কাল থেকে হঠাৎ ভালো হয়ে গেছে। বুঝতে পারছি না হঠাৎ কী হয়েছে।

-ভালো হলে তো ভালোই। অত বুঝতে হবে না। আইসক্রিম শেষ কর।

-ওহ হ্যাঁ, তোমাকে ধন্যবাদ নোটসগুলোর জন্য।

-একবারে দেইনি, পড়ে ফেরত দিবি আবার।

-কিপ্টা!

-আমার টাকায় আইসক্রিমের খেয়ে আমারেই কিপ্টা বলো! আচ্ছা ছাড়, মিস করিস না আমাকে একটুও?

-তোমাকে মিস করার কী আছে? দিব্যি তো রাবির বাসে হেলান দিয়ে বেশ আছো।

-এই তুই আমার প্রোফাইল স্টক করিস! তার মানে তুই ফেসবুক চালাস। আগেরবার মিথ্যে বলেছিস।

-ভাবীর আইডিতে দেখেছিলাম তোমার ঐ প্রোফাইল পিকচারটা তাও অনেকদিন আগে।

-মিথ্যা বলার জায়গা পাস না? দুইদিন আগে এটা আপলোড করছি আর তুই অনেকদিন আগে দেখছিস? কেমনে? টাইম ট্রাভেল করে?

চিত্রলেখা ধরা পড়ে বিষম খেল। সমানে কাশতে লাগলো। সিয়াম মুচকি হেসে পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলতে লাগলো, ‘বালাই শাঁট!’ অল্পক্ষণেই কাশি থেমে গেল। ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। সিয়ামও বুঝতে পারলো। আর দেরি না করে দ্রুত চিত্রলেখাকে বাড়ি থেকে একটু সামনে নামিয়ে দিল।

-আমি কি ভেতরে রেখে আসবো? ভাবী বকবে না দেরি হলো যে?

-তুমি গেলে বেশি বকবে। তার চেয়ে একাই যাই।

-আচ্ছা শোন আমি কাল চলে যাচ্ছি।

-কয়বার বলবা?

-একবার ভালো করে বিদায় জানাইছিস? রাজশাহী চলে যাওয়ার পর থেকে দেখতেছি তুই আমারে পাত্তাই দেস না।

-আচ্ছা আচ্ছা। সাবধানে যেও।

-তোর নম্বরটা রেখে দিছি। বাসায় গিয়ে নক দিব। খবরদার যদি ব্লক করছিস।

চিত্রলেখা হ্যাঁ-না কিছু না বলেই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। ভেবেছিল বোধহয় তুলকালাম কাণ্ড হবে। সেরকম কিছুই হলো না। বড় ভাবীকে আশেপাশে দেখাই গেল না। বরং সাথী এসে খানিকটা বকাবকি করলো চিত্রলেখাকে এত দেরি করার জন্য। মাথা নিচু করে সবটা শুনে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল চিত্রলেখা। মনে মনে সুবহাকে গালি দিতে লাগলো। বেয়াদব মেয়েটাই নিশ্চয়ই সিয়াম ভাইকে তার নম্বরটা দিয়েছে। আর কিছু না ভেবে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে।

_______________

ফোন স্ক্রল করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়েছে রঙ্গন। ভার্সিটি মিস দিয়ে বাড়িতে এসে বসে আছে। পরীক্ষার শিডিউল নেই দেখে এমন করতে পারছে তবে শীঘ্রই ঢাকায় ফিরতে হবে তাকে। রঙ্গনের আবারো মন খারাপ হচ্ছে। ঢাকা শহরটা কোনোভাবেই আর তাকে টানছে না। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাটা দিয়ে ঐ দূষিত শহর থেকে মুক্ত হতে পারলে বাঁচে সে। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতেই আশফিনা আহমেদ তার রুমে ঢুকলেন। রঙ্গন খেয়াল করে উঠে দাঁড়ালো।

-আমি কি টিচার যে আমাকে দেখলেই দাঁড়াতে হবে?

-না, মা। আসলে…

-ঢাকায় ফিরবে কবে?

-এক সপ্তাহ পর যাবো ভাবছিলাম।

-ক্যাম্পাসে কিছু হয়েছে? দীর্ঘসময় বাড়িতে থাকার ছেলে তো তুমি নও।

-না মা, কিছু হয়নি। তোমাদের মিস করছিলাম তাই এসেছি।

-রঙ্গন, তুমি যতই বড় হও না কেন আমার কাছ থেকে কিছু আড়াল করতে পারবে না। তুমি আমার খুব আদরের। আমি যখন একটা সন্তানের অভাবে দীর্ঘসময় যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিলাম, তখন তোমাকে পেয়েছি। তোমাকে নিয়ে আমার স্বপ্নগুলো আকাশচুম্বি। মরীচিকার পেছনে আমার ছেলে ছুটবে না। কখনোই না, বুঝেছো?

-জ্বী মা।

-খেতে এসো।

আশফিনা আহমেদ রঙ্গনকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। রঙ্গন আবার আগের মতো বসে পড়লো। বিড়বিড় করতে লাগলো,”মরীচিকা কিনা জানিনা মা তবে চিত্রলেখা আমার জন্য দরকারি কিছু। মরীচিকা হলেও তার সংস্পর্শে থাকতে আমার ভালো লাগে। এটা ভালোবাসা না, এটা বেনামী একটা অনুভূতি। সে আমার বন্ধু, বেনামী বন্ধুত্ব আমাদের।”

খাবার টেবিলে আজ মাশরুর আহমেদকে পাওয়া গেল না। তিনি শহরের বাইরে। অহম নিজের ঘরে বসে খেয়ে নিয়েছে। আবারো মুখোমুখি কেবল আশফিনা আহমেদ এবং রঙ্গন। রঙ্গন আজ বড্ড অস্বস্তিতে ভুগছে নিজের মায়ের সামনে। মায়ের চোখে চোখ রাখতেও ভীত হচ্ছে সে। আশফিনা আহমেদ লক্ষ করেছেন রঙ্গনের এ অস্বস্তি।

-রঙ্গন, তোমার তিরার কথা মনে আছে?

-তিরা? মানে তোমার বেস্টফ্রেন্ডের মেয়ে?

-হ্যাঁ, ওর সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করবো ভাবছি।

-মা, ওকে আমি ঠিকমতো চিনিও না।

-ঠিকমতো না চিনলে সময় কাটানো যায় না?

-না যায় না, মা। যাকে ঠিকমতো চিনিই না, তার সাথে সময় কাটবেই কিভাবে?

-যেভাবে চিত্রলেখার সাথে তোমার সময় কাটে।

বিষম খেল রঙ্গন। পানির গ্লাসটা তার দিকে বাড়িতে দিয়ে আশফিনা আহমেদ বেশ শান্ত গলায় বলে উঠলেন,”রঙ্গন, নিজেকে ভুল পথে এতটা এগিয়ে দিও না যেন পরে অনুতাপে চোখে চোখ না রাখতে পারো।”

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য৷ পর্ব-০৫

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
পঞ্চম_পর্ব
~মিহি

“আপনি একা বসে আছেন যে?” রঙ্গনের প্রশ্নে চমকে গেল চিত্রলেখা। অনেকক্ষণ এক ধ্যানে বসে থাকায় খানিকটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল সে। আচমকা রঙ্গন প্রশ্ন করাতে খানিকটা অপ্রস্তুতই হয়ে পড়লো সে।

-না আসলে আন্টি বললেন অহম কী যেন কাজ করছে, একটু পর আসবে।

-আমি আপনাকে আধঘণ্টা আগে রেখে গেলাম, বাইরে থেকে কাজ সেরে চলেও আসলাম অথচ আপনার ছাত্রের কাজ শেষ হলো না! থামুন আমি দেখে আসি কী করছে।

-আচ্ছা।

রঙ্গন বুঝতে পারছে তার মা ইচ্ছে করেই চিত্রলেখাকে এখানে বসিয়ে রেখেছে। তবে এটা নিয়ে মায়ের সাথে তর্কে জড়াতে চায় না সে। চিত্রলেখার জন্য মায়ের সাথে ঝগড়া করা মানেই অশান্তি সৃষ্টি করা যেখানে মা মেয়েটাকে পছন্দই করে না, তার চেয়ে বরং অহমকে খুঁজে বের করে এখানে পাঠানোটা ভালো।

রঙ্গন চলে যাওয়ার পর চিত্রলেখা ফোনের দিকে তাকালো। ভাবীর আইডিতে লগইন করেছে সে। তার ফেসবুক আইডি এখনো খোলা হয়নি। কলেজ গ্রুপে কী যেন একটা নোটিশ দিয়েছে। নোটিশ সিন করতেই সুবহার আইডি থেকে মেসেজ আসলো।

-লেখা? কাল কলেজে সিনিয়রদের বিদায় অনুষ্ঠান, যাবি?

-মনে হয় না, গেলেই আমাদের দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিবে।

-আরে, তুই এত বোরিং ক্যান! প্লিজ আয়, মজা হবে।

-কাজ করতে আবার কিসের মজা?

-তুই আসবি কি না?

-আচ্ছা দেখি, রাতে কল করে জানাবোনি। ওহ হ্যাঁ, বড় ভাবী নতুন ফোন কিনে দিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপে নক দিচ্ছি তোকে দেখ।

-আচ্ছা রাতে দেখবোনি, এখন কাজ আছে।

চিত্রলেখা একবার দরজার দিকে তাকালো, অতঃপর আবারো নিরাসক্তের মতো ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগলো। ‘পিপল ইউ মে নো’তে একজন পরিচিত মুখ দেখা গেল। ‘সিয়াম শাহরিয়ার’ নামটা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। সাদারঙা শার্টটা মানিয়েছে বেশ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটার সাথে হেলান দিয়ে যেন নিজেকে ভারমুক্ত মনে করছে। চিত্রলেখার হাত কাঁপছে। একবার ইচ্ছে হচ্ছে ব্লক করে ফেলতে, আবার পরক্ষণেই ইচ্ছে করছে আইডিটাতে ঢুঁ মারতে। চিত্রলেখা দুইটার একটাও করলো না। এটা ভাবীর আইডি, অযথা বেশি ঘেঁটে লাভ নেই। হোয়াটসঅ্যাপ খুলে সুবহাকে টেক্সট করলো চিত্রলেখা। আর কিছু করার আগেই পায়ের শব্দ পেল। দরজার দিকে তাকালো সে। অহম মলিন মুখে এগিয়ে এসে তার সামনে বসলো।

-স্যরি ম্যাম, গেম খেলতে খেলতে বুঝতেই পারিনি আপনার আসার টাইম হয়েছে।

-দেখো, শিক্ষককে বসিয়ে রাখা অবশ্য বেয়াদবি তবে তুমি যেহেতু নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো এটাই যথেষ্ট। এখন বলো সমস্যাগুলো খুঁজে বের করেছো কিনা।

-আমার সবকিছুই সমস্যা লাগছে। পড়ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না পড়া ঠিক হচ্ছে কিনা।

-এটার একটা বুদ্ধি আছে। এখন থেকে আমি প্রতিটা চ্যাপ্টার বুঝিয়ে পরেরদিন সেটার পরীক্ষা নিব। পরীক্ষা নিলেই তোমার সমস্যা বের করা যাবে।

অহম মাথা নাড়লো। চিত্রলেখা পড়ানো শুরু করলো। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রঙ্গন চিত্রলেখার কথাগুলো শুনে মুচকি হাসলো। মেয়েটা বয়সের তুলনায় একটু বেশিই ম্যাচিউর। রঙ্গন দরজার কাছ থেকে সরে গেল। মায়ের চোখে পড়লে তার বিপদ বাড়বে। চিত্রলেখার উপস্থিতি তার বেশ ভালোই লাগে। মেয়েটার মধ্যে একটা পজিটিভ এনার্জি আছে। যতক্ষণ আশেপাশে থাকে, পজিটিভিটি ছড়ায়। অবশ্য রঙ্গনের পজিটিভিটির খুব প্রয়োজন। ভার্সিটি লাইফ খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। বন্ধুত্বের বিচ্ছেদটা অন্যান্য বিচ্ছেদ থেকে বেশি যন্ত্রণাদায়ক। রঙ্গন এই দুঃসহ মুহুর্তটাই পার করছে। আচমকা সব বন্ধুদের দূরে সরে যাওয়া তার জন্য ধাক্কার মতো। বন্ধু বলতে তার জীবনে দুইজনই ছিল, অবনী আর রাহাত। অদ্ভুতভাবে দুইজন প্রেমে জড়িয়ে পড়লো আর বন্ধুত্বটা ফিকে হয়ে আসলো। এখন জগতটা তাদের দুইজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। রঙ্গনের নিজেকে আউটসাইডার মনে হয়। তবে চিত্রলেখাকে দেখলে আবার ভালো লাগে, এই ভালো লাগার কোনো কারণ নেই। বন্ধুহীন জীবনে চিত্রলেখার সংস্পর্শ তাকে খানিকটা মানসিক শান্তি দেয়। তাই হয়তো আজ কিছু মুহূর্ত ধার চাইতে ছুটে গিয়েছিল সে।

_____________

পড়ানো শেষ হতেই চিত্রলেখার ফোনে সুবহার নম্বর থেকে কল আসে। চিত্রলেখা প্রথমে অবাক হলেও রিসিভ করলো।

-হ্যাঁ সুবহা বল।

-তুই কোথায় আছিস?

-একটা কাজে, কেন?

-এমনি তোর সাথে দেখা করবো। বল না কোথায় তুই? না দাঁড়া, তুই এড্রেসটা টেক্সট কর তো।

-কিন্তু কেন?

-যা বলছি কর।

চিত্রলেখা কিছু না ভেবে সুবহাকে রোড নম্বরটা জানিয়ে দিল। সুবহা পরক্ষণেই তাকে রিপ্লাই দিল,’ওখানেই থাক, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি।’

চিত্রলেখা ঘড়ির দিকে তাকালো। পাঁচটা পঞ্চান্ন বাজে, সন্ধ্যে হয়েই এসেছে। এখন সুবহা কেন তার সাথে এখানে দেখা করতে আসতে চাইছে? বাড়িতে আসলেই পারতো। চিত্রলেখা বের হতেই ড্রাইভার তাকে ডাকলো।

-মা, চলো। যাবেনা?

-না আঙ্কেল। আজ আমার এক বান্ধবী আসবে, ওর সাথে যাবো। আপনার যেতে হবে না।

-কিন্তু একা কী করে? স্যার রাগ করবেন।

-অসুবিধা হবে না আঙ্কেল। আপনি চিন্তা করবেন না।

-আচ্ছা সাবধানে যেও মা।

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে রাস্তার দিকে এগোতে লাগলো। ড্রাইভার মজিদ চাবি দেওয়ার জন্য ভেতরে প্রবেশ করতেই রঙ্গনের মুখোমুখি হলো।

-আরে আঙ্কেল, আপনি চিত্রলেখাকে রাখতে যাননি?

-উনার বন্ধু আসবে স্যার, বললাম রেখে আসি। আমার কথা তো শুনলেন না। রোডেই দাঁড়িয়ে আছেন হয়তো।

-আচ্ছা।

রঙ্গন একবার ভাবলো চিত্রলেখাকে রেখে আসবে। পরক্ষণেই ভাবলো বন্ধুকে ফেলে সে নিশ্চয়ই যেতে চাইবে না। তার চেয়ে বরং যতক্ষণ বাইরে আছে, ততক্ষণ কথা বলা যাক। রঙ্গন আশেপাশে তার মাকে খুঁজলো। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো এখন তার মা আশফিনা আহমেদ অফিসের ফাইল নিয়ে ব্যস্ত। মাশরুর সাহেবের অনেকাংশ কাজ তিনি রি-চেক করেন। রঙ্গন নিশ্চিন্তে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার দিকে এগোলো। চিত্রলেখা তখন রাস্তার এ পাশে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। রঙ্গন টি-স্টল থেকে দুই কাপ চা নিলো। বিল পরিশোধ করে একটা কাপ চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে দিল। আচমকা পেছনে ফিরতেই তাল সামলাতে কষ্ট হলো রঙ্গনের। গরম চায়ের খানিকটা ছিটে রঙ্গনের হাতে এসেও পড়লো।

-দুঃখিত! আপনি এখানে? লেগেছে কি আপনার? আমি আসলে খেয়াল…

-ওয়েট ওয়েট! আস্তে, এত সিরিয়াস কিছু হয়নি। নিন চা ধরুন।

চিত্রলেখা ভ্যাবাচাকা খাওয়ার মতো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত বুঝতে পারলো না।

-কী হলো, চা কি নিবেন না?

-হুম, নিচ্ছি।

চিত্রলেখা চায়ের কাপটা নিল। মুখে বিরক্তির ভাঁজ তার। সুবহা কেন আসছে না? অযথা তার এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

-আপনার বন্ধু কখন আসবে?

-বললো তো পনেরো মিনিট।

-ততক্ষণ ভেতরে বসলেই পারতেন।

-সমস্যা নেই তো এখানে।

-এই সন্ধ্যাবেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে একা মেয়ে মানুষ, কেউ এসে হামলা করলে?

-আশেপাশে অনেক মানুষ আছে, কেউ না কেউ তো বাঁচাবে।

-আশেপাশের মানুষ কখনো আপনাকে বাঁচাবে না চিত্রলেখা, তারা দূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখবে।

রঙ্গনের গম্ভীর মুখ দেখে চিত্রলেখার হাসি পেল। কিছু মানুষকে গাম্ভীর্য মোটেও মানায় না। ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো সে।

-এত সিরিয়াস কথায় এই প্রতিক্রিয়া?

-আপনাকে আসলে গাম্ভীর্য ঠিক মানায় না।

-ভালো চিনেছেন আমাকে।

চিত্রলেখা আর কিছু বলার আগেই রাস্তার দিকে দৃষ্টি পড়লো তার। সুবহা এসেছে, সিয়াম ভাইয়ের বাইকে। রঙ্গন তখনো চিত্রলেখার পাশে দাঁড়িয়ে। চিত্রলেখা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। এই মেয়েটা সিয়াম ভাইকে কেন এনেছে! সুবহা বাইক থেকে নেমে চিত্রলেখার পাশে এসে দাঁড়ালো। রঙ্গন বুঝলো তার কিছু মুহূর্ত সে ব্যয় করে ফেলেছে। এখন চিত্রলেখার থেকে ক্ষণিকের বিদায় নেওয়াটাই সমীচীন।

-আপনার বান্ধবী এসে গেছে। স্যরি বান্ধবী সাহেবা, আপনি আসার আগে আপনার বান্ধবীকে এক কাপ চা অফার করেছিলাম, আপনার জন্যও এক কাপ বরাদ্দ। আমি এনে দিচ্ছি।

-না ভাইয়া, আমি চা খাইনা।

-ওহ, স্যাড! আচ্ছা গল্প করুন। আমি আসছি।

রঙ্গন অনিচ্ছাসত্ত্বেও সরে গেল। সিয়াম তখনো বাইকে বসে দৃশ্যগুলো অবলোকন করছে। রঙ্গনের উপস্থিতি তার গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। রঙ্গন চলে যেতেই সিয়াম এগিয়ে আসলো।

-আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

-তুমি তো ডুমুরের ফুল হয়ে গেছো চিত্রলেখা।

-না ভাইয়া, সেরকম না।

-আচ্ছা, কাল চলে যাচ্ছি আমি। সুবহা ট্রিট নিবে বলছিল। এদিকে সামনেই ফুচকার একটা স্টল আছে। চলো দুজনকেই ট্রিট দিই।

সিয়াম চিত্রলেখা এবং সুবহাকে রিকশায় তুলে দিয়ে নিজে বাইকে উঠলো। চিত্রলেখার হাসিটা তার চোখে ভাসছে। একইসাথে অপরিচিত ছেলেটাকেও। অদ্ভুত একটা দহনে পুড়ছে সে। এ দহনের নাম কিংবা কারণ এখনো চিত্রলেখাকে জানানো হয়নি।

সুবহা ঝাল ঝাল ফুচকা খাচ্ছে। ওর খাওয়া দেখে চিত্রলেখার নিজেরই ঝাল লাগছে। খাওয়া থামিয়ে সিয়ামের কাছে পানি চাইতে গেল সে।

-ভাইয়া পানি আছে?

-তোর সাথে আমার কথা আছে।

-কী কথা?

-নোট খাতা দিয়েছি, পড়েছিস?

-ব্যাগেই আছে, দেখিনি এখনো। ধন্যবাদ তোমাকে।

-তোর ধন্যবাদটা আমি নিব না।

-কেন?

-আমার ইচ্ছে।

-অদ্ভুত তো!

সিয়াম চিত্রলেখার দিকে খানিকটা এগিয়ে গেল। চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ রেখে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,’ভালোবাসি চিত্র…’।

চলবে..

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৪

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
চতুর্থ_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখা করুণ চোখে তাকিয়ে আছে নিজের ভাবীর দিকে। পাঁচটা দোকান ঘুরে প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকার তিনটা ড্রেস আরো নানান জিনিসপত্র কিনেছে অপর্ণা। চিত্রলেখা ভুলেও ভাবেনি এসব কেনাকাটা করতে অপর্ণা তার কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে ছিল। ভাগ্য ভালো সিয়াম ভাই এবং তাকে একসাথে দেখে ফেলেনি সে। ঘণ্টা দেড়েক ধরে কেনাকাটা করে সব জিনিসপত্র বুঝে মার্কেট থেকে বের হলো অপর্ণা। চিত্রলেখা বোকার মতো তার পিছু পিছু হাঁটছে। পাঁচটা ব্যাগের দুটো তার হাতে। তাও সে নিজে নিয়েছে। অপর্ণা তার প্রতি অকস্মাৎ এত ভালো কেন হলো বুঝে উঠতে পারছে না সে।

-ভাবী, হঠাৎ এতকিছু কেনার কী দরকার ছিল?

-তোর কাপড়গুলো যথেষ্ট পুরনো হয়েছে। তাছাড়া তোর ভাইকে কল করেছিলাম কিন্তু ধরলোই না। ওহ হ্যাঁ ভালো কথা মনে পড়েছে, তোর জন্য একটা ফোনও কিনতে হবে।

-কিন্তু ভাবী আমার তো বিকালে পড়াতে যেতে হবে। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে দেরি হয়ে যাবে।

-আচ্ছা তোকে রিকশায় তুলে দিচ্ছি, তুই এগুলো নিয়ে বাসায় যা। বাসায় পৌঁছে সাথীকে বলবি আমাকে কল করতে।

চিত্রলেখা মাথা নাড়লো। এতগুলো জিনিস নিয়ে রিকশা ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। অপর্ণা রিকশা ডাকলো। চিত্রলেখাকে উঠিয়ে দিয়ে ভাড়াটাও নিজে পরিশোধ করলো। চিত্রলেখা অবাক দৃষ্টিতে কেবল এসব পর্যবেক্ষণ করে গেল। তার সাথে কী হচ্ছে এখনো বুঝতে পারছে না সে। সে কি স্বপ্ন দেখছে? রিকশা থেকে লাফ দিয়ে চেক করবে একবার? অদ্ভুত সব খেয়াল ঘুরঘুর করছে তার মাথায়। একজন মানুষ এরকম তড়িৎ গতিতে কিভাবে পরিবর্তিত হতে পারে? ফোনের জন্য অবশ্য ইচ্ছে করেই মানা করেনি সে। বাড়িতে সবারই ফোন আছে। বড় ভাইয়া ব্যবসার কাজে প্রায়শই বাইরে থাকেন তাই ভাবীর একটা ফোন আছে। ছোট ভাইয়া শহরের বাইরে চাকরী করেন। সপ্তাহে একবার কিংবা মাস অন্তর দুইবার আসেন। ছোট ভাবীর জন্যও ফোন আছে কিন্তু চিত্রলেখার নেই। অবশ্য তার লাগেও না। কোনো দরকার পড়লে ছোট ভাবীকে বললেই ফোন পায় সে কিন্তু বড় ভাবীর মাথায় কী চলছে তা বোঝার জন্য চুপচাপ আছে সে। ভাবনা-চিন্তার মাঝেই দরজার কাছে এসে রিকশা থামলো। ব্যাগগুলো নিয়ে নামার সময় আবারো কিছু মানুষ ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। অন্যের কাজে নাক গলানো ছাড়া এদের কোনো কাজ বোধহয় না আছে!

______________

-ভাবী, কী হচ্ছে কী বলো তো। বড় ভাবী হঠাৎ এত ভালো হলো কী করে?

-আম খাও, আঁটি গুণে কী করবা?

-ধ্যাত! ভাবী কল দিতে বলেছে তোমাকে। গেলাম আমি।

সাথী হাসলো। অপর্ণাকে বলা কথা চিত্রলেখার কাছে কোনোভাবেইই বলতে পারবে না সে। দেখা যাবে মেয়েটা অস্বস্তিতে পড়ছে। সাথী ভাবনার পশরা বন্ধ করে অপর্ণার নম্বর ডায়াল করলো।

-হ্যালো আপা, লেখা পৌঁছেছে। তোমার আসতে কি দেরি হবে? বাচ্চাদের খাইয়ে দিয়েছি আমি।

-না, আর আধঘণ্টার মতো লাগবে। শোন, লেখাকে বলবি একটা নতুন জামা পড়ে যেতে। গোলাপি রঙের একটা জামা আছে দেখিস, ওটা পড়তে বলবি। আর একটু পরিপাটি করে পাঠাস।

-সে আবার বলা লাগে আপা? আমি দেখে নিচ্ছি।

-আচ্ছা আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।

সাথী ফোন রেখে চিত্রলেখার জন্য তরকারি গরম করতে লাগলো। ততক্ষণে মেয়েটা গোসল সেরে নিক। হঠাৎ সাথীর জামার কথা মনে হলো। অপর্ণার কথা না শুনলে অযথা চেঁচামেচি করবে। সাথী রান্নাঘর থেকে চিত্রলেখাকে ডাকলো।

-লেখা! এদিকে আয় তো একটু।

-বলো শুনছি।

-এখানে আসতে পারিস না? আচ্ছা শোন, আপা যে জামাগুলো কিনেছে, তার মধ্যে থেকে গোলাপিটা পড় আজ।

-আজকেই পড়তে হবে?

-পরে এসে চেঁচালে আমার দোষ নাই।

-আচ্ছা বাবা বুঝছি!

চিত্রলেখা আর কী করবে, গোলাপি জামাটা নিয়ে গোসলে ঢুকলো। জামাটা সুন্দর। হালকা গোলাপি রঙের গোল জামা, মাঝ বরাবর সাদা একটা লাইন সুন্দরভাবে ডিজাইন করা আর সাদা বর্ডার। চিত্রলেখা মনে করতে পারলো না এত কেনাকাটা তার জন্য তার ভাবী শেষ কবে করেছিল। বরাবরই পোশাক আশাকের জন্য তার বড় ভাইয়ের কাছেই যেতে হয়। ভাবীর কানে পড়লে বরং ঝামেলা বাঁধে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝর্ণা ছেড়ে দিল সে। ভিজতে ভিজতে হঠাৎ খেয়াল হলো সিয়াম ভাইয়ের কথা। বেচারা মানুষটাকে এড়িয়ে ভাবীর সাথে চলে গেল সে কিন্তু কিছু তো করার ছিল না। সিয়াম ভাই কি বুঝবে ব্যাপারটা? একটা ছোটখাটো দুঃখিত আর ধন্যবাদ পাঠানো অতিশয় প্রয়োজনীয় কাজ হয়ে পড়েছে।

গোসল সেরে বেরিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখল। গোলাপি রঙটা মানিয়েছে তাকে। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, ক্রমেই পিঠ ভিজে উঠলো। চুল ভালোমতো মুছে তোয়ালে মাথায় জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলো।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠতেই অপর্ণা এলো। চিত্রলেখা মাত্র নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য উঠেছে, অপর্ণা এসে তার সামনে দাঁড়ালো। ফোনের বক্সটা চিত্রলেখার হাতে ধরিয়ে দিল। চিত্রলেখা ভেবেছিল বাটন ফোন আনবে হয়তো অথচ তার ভাবী সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে স্মার্টফোন এনেছে! বিগত এক বছরে তার জন্য করা মোট খরচ আজকের একদিনের খরচের চেয়ে কম।

-এই নে তোর ফোন। টিউশনি শেষ হলে বা কোথাও গেলে কল করবি। এত বড় একটা মেয়ে, কখন কোথায় যাস খোঁজ পাইনা! যা রেডি হ।

-আচ্ছা ভাবী কিন্তু এত দামি ফোনের…

-তোর ভাবতে হবে না সেটা। যা রেডি হ।

চিত্রলেখা বাক্য ব্যয় না করে চুপচাপ ফোনটা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বড় ভাবী যেভাবে তার পেছনে পড়ে আছে, একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই। চুল খোঁপা করে মাত্র ক্লিপ আটকাতে নিয়েছে অমনি আবারো দেবদূতের মতো হাজির বড় ভাবী।

-এই এই, চুল বাঁধছিস কেন?

-হিজাব পড়বো তো ভাবী, চুল খোলা রেখে তো পড়া যাবে না।

-একদম হিজাব-টিজাব পড়ার দরকার নেই। কী সুন্দর চুল। চুল খোলা রেখে যা। সুন্দর লাগবে।

-কিন্তু ভাবী ওখানে আমি পড়াতে যাই, সেখানে খোলা চুলে যাওয়াটা…

-আমি যা বলেছি তার উপর একটা কথাও না।

চিত্রলেখা ভারি মুসিবতে পড়লো। এ কেমন জোরজবরদস্তি! পরক্ষণেই তার মাথায় বুদ্ধি আসলো। ভাবীর সাথে তর্ক না করে সে সম্মতি জানালো। অপর্ণা খুশি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চিত্রলেখা চটজলদি হিজাব এবং পিনগুলো নিজের ব্যাগে রেখে দিল। গাড়িতে বসে এসব পড়ে নিবে দ্রুত, আবার আসার সময় খুলে রাখবে। অহমদের বাড়িতে খোলা চুলে গেলে বিষয়টা কতটা অস্বস্তিকর হতে পারে তা সে নিজেও আন্দাজ করতে পারছে। এখনো গাড়ি আসেনি এই ভেবে নতুন ফোনটা অন করলো সে। ভাবী নিজেই সিম কিনেছে এবং নিজ দায়িত্বে পরিবারের সদস্যদের নম্বর সেভও করেছে। চিত্রলেখার সুবহার নম্বর মনে ছিল। সেটাও সেভ করলো সে। সুবহাকে কি একবার কল করবে? না থাক, অযথা আবার সিয়াম ভাইয়ের আলাপ শুরু হতে পারে। সুবহা আসলে এখনো বাচ্চা স্বভাবের। সিয়াম ভাইকে নিয়ে আলোচনা করতে তার অস্বস্তি হয়না কিন্তু চিত্রলেখার হয়। একটা মানুষ নিঃস্বার্থভাবে সবসময় তাকে সাহায্য করে এটা ভেবেই সে লজ্জায় পড়ে যায়। গাড়ির হর্ণের শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। ফোনটাও ব্যাগে রেখে ব্যাগটা নিয়ে বাইরে বেরোলো। বড় ভাবী দরজার কাজে দাঁড়িয়ে ছিল। চিত্রলেখা কিছু বলার আগেই তাদের গাছের জবা ফুল তার কানে গুঁজে দিল। অতঃপর তাকে ঠেলে গাড়িতে তুলে দিল। অদ্ভুত তো! এই মহিলা কি তাকে জোকার বানিয়ে ছাড়বে?

গাড়ি স্টার্ট দিতেই চিত্রলেখা চটজলদি জবাফুলটা খুলে পাশের সীটে রাখলো। চুলগুলো খোঁপা করে হিজাব বাঁধতে শুরু করলো। অভ্যেস থাকাতে আয়নার প্রয়োজন পড়লো না তবে গাড়ি জোরে চালানোর ফলে খানিকটা অসুবিধা হচ্ছিল তার। হিজাব বাঁধতে বাঁধতেই সে বলে উঠলো,’আঙ্কেল, গাড়িটা একটু ধীরে চালান।’

গাড়ি ব্রেক করে সামনে থেকে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে পেছনে ফিরলো রঙ্গন। চিত্রলেখার হাত থেকে পিন নিচে পড়ে গেল।

-কী অদ্ভুত ম্যাম! আপনার চোখের সমস্যা তো মারাত্মক, এখনো ডাক্তার দেখাননি যে?

-আপনি কেন?

-আমার বাবার গাড়ি আমি চালাতে পারি না?

-না সেটা না!

-তবে কথা কিসের? খোলা চুলে খারাপ লাগছিল না আই গেজ!

-সবকিছুর একটা ক্যাজুয়াল রূপ থাকে।

-বাহ বেশ তবে সবকিছুর একটা নিয়মও থাকে। সীটবেল্ট বাঁধুন আগে।

চিত্রলেখা খোঁচাটা ধরতে পারলো। পিনটা নিচে থেকে তুলতে গিয়ে অনুভব করলো আঙুলে খানিকটা আচড় লেগেছে সেটার। রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়েছে অল্প অংশ। সেদিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে সীটবেল্টটা বেঁধে নিল সে। রঙ্গন ফ্রন্ট মিররে দেখলো চিত্রলেখার অস্বস্তি। মেয়েটাকে এখন বাড়িতে না নিয়ে গিয়ে কোনো অজানা জায়গায় নিয়ে গিয়ে যদি সে বলে, আপনাকে কাডন্যাপ করেছি। মেয়েটা কি ভয় পাবে? বোধহয় পাবে। বাচ্চা মেয়ে! নিজের কীর্তিকলাপে নিজেই হেসে উঠলো রঙ্গন।

গাড়ি থামলো রঙ্গনদের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে বের হলো চিত্রলেখা। দরজা লাগানোর সময় বেকায়দায় আঙুলে লাগলো তার। ব্যথায় ক্ষীণ আর্তনাদ করে উঠলেও তা রঙ্গনের কানে গেল। ‘দেখি কোথায় লেগেছে’ বলে আঙুলটা ধরলো সে। চিত্রলেখার অদৃষ্টের পরিহাসে এ দৃশ্য পুনরায় চোখ জ্বালিয়ে দিল আশফিনা আহমেদের।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৩

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
তৃতীয়_পর্ব
~মিহি

“কোথা থেকে এ ভরসন্ধ্যায় আসছে মহারানি তাও আবার এত বড় গাড়িতে? কী করতে গিয়েছিলি তুই? সমস্ত পাড়ার লোক আমাদের বাড়ির দিকে বাকা চোখে তাকাচ্ছে!” বলতে বলতেই চিত্রলেখাকে মারার জন্য হাত উঁচু করলো অপর্ণা। চিত্রলেখা ভয়ে পিছু সরলো।

-ভাবী, আমি তো পড়াতে গিয়েছিলাম। ছোট ভাবীকে বলে গিয়েছিলাম।

-ছোট ভাবীকে বলে গিয়েছিস মানে? খাস আমার স্বামীর টাকায় আর আলগা পিরিত করো ছোট ভাবীর সাথে। থাপ্পড় চেনো? আমার অনুমতি নিছিস তুই? তোর সাহস কী করে হলো আমায় না জানিয়ে এসব করার?

-ভা…ভাবী! আমি আসলে…

চিত্রলেখা নিশ্চুপ হয়ে গেল। অপর্ণা নিজের রাগ ঝাড়ুক সেটাই ভালো। বেশি কথা বলতে গেলে নিশ্চিত মা তুলে গালি দিবে। তার চেয়ে তাকেই অপমান করুক। অপর্ণা কিছু বলার আগেই সাথী এলো সেখানে। চোখের ইশারায় চিত্রলেখাকে সরতে বললো। ভীত চিত্রলেখা নড়ার সাহস পাচ্ছিল না তবুও সাথীর আশ্বস্ত করাতে চুপচাপ সরে গেল। সাথী অপর্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

-আরে আপা! কী করছো কী? এত বোকামি করলে চলে?

-কী বলতে চাচ্ছিস তুই?

-দেখো, ও একটা বড়লোক বাড়িতে পড়াতে যায়। সেখানে সব বড়লোকদের উঠাবসা। তাছাড়া চিত্রলেখার বয়স কম, দেখতে শুনতে খারাপ না। কারো যদি ভুলেও পছন্দ হয়, তাহলে ওর বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের?

-আরে বাহ, তুই তো ভালো বুদ্ধি দিয়েছিস রে। একটা বড়লোক বুড়ো জুটিয়ে ফেললে সে টাকায় আমরাও আয়েশ করতে পারবো। এর বাপ তো দুই বউ রেখে সব টাকা ধ্বংস করে চলে গেছে। এখন ওর থেকে ওসুল করা যাবে।

-হ্যাঁ, সেজন্যই তো ওর সাথে ভালো আচরণ করো এখন। ওকে একটু ভালো পোশাক আশাক পড়াও। পরে লাভ তো আমাদেরই।

-ঠিক বলেছিস। তোর বুদ্ধি আমার পছন্দ হয়েছে। কাল তোকে চটপটি খাওয়াবো।

সাথী মুচকি হাসলো। ভালো মানুষদের ভালো কথায় এবং খারাপ মানুষদের কুমতলব বাতলে দিয়েই আটকাতে হয়। এ কুমতলব যখন অপর্ণার মাথায় ঢুকেছে, তখন নিজের স্বার্থেই সে চিত্রলেখার সাথে ভালো ব্যবহার করবে।

-আচ্ছা ভাবী থাকো, আমি লেখাকে খাবার দিয়ে আসি।

-আরে দাঁড়া, আমি যাচ্ছি। কী তরকারি রেঁধেছিস?

-আলু পটলের ঝোল।

-লেখা তো ঝোল তেমন পছন্দ করে না। ওর জন্য একটা ডিম ভেজে দে।

সাথী মনে মনে হাসলো। মানুষ আসলেই অদ্ভুত! যে এতদিন চিত্রলেখার খাওয়া নিয়েই খোঁজ রাখেনি, আজ সেই মানুষটাই চিত্রলেখার পছন্দ অপছন্দের কদর করছে। সাথী মুচকি হেসেই রান্নাঘরের দিকে এগোলো। অপর্ণা তখন সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে চিত্রলেখার জন্য কয়েকটা জামা কিনতে হবে। চটজলদি অর্ণবকে কল দিল সে। বারকয়েক রিং হওয়ার পরও অর্ণব রিসিভ করলো না। বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকলো সে।

_______________

চিত্রলেখা হাতমুখ ধুয়ে বেরোতেই দেখল রূপসা তার বিছানার উপর বসে আছে। রূপসা হলো চিত্রলেখার ভাতিজি, অপর্ণা এবং অর্ণবের ছোট মেয়ে। রূপসা চিত্রলেখা বলতে পাগল। তাই অপর্ণা চিত্রলেখাকে অনেকটাই অপছন্দ করে। রূপসার বড় ভাই রাদিফ আবার অন্যরকম স্বভাবের। সে শান্ত, কথা খুব কম বলে। পড়ে ক্লাস থ্রিতে তবে হাবভাব দেখলে মনে হবে সে বয়সে যেন সবার বড়। বাচ্চাসুলভ আচরণ তার মাঝে নেই। চিত্রলেখা বিছানায় বসতেই রূপসা চিত্রলেখার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। এতক্ষণ যেন এ মুহূর্তের অপেক্ষাতেই সে ছিল।

-এখন এসেছিস যে? পড়াশোনা নেই? ভাবী দেখলে মাইর দিবে।

-আমার পড়া অনেকক্ষণ শেষ। পড়ি ক্লাস টু তে, পড়া শেষ দুই মিনিটে।

-আরে আরে, রূপ তো কবিতা বলতে শিখে গেছে। রাদিফ এখনো পড়ছে?

-ভাইয়ার পড়া শেষ হয় কখন? সারাক্ষণই তো এ বই, সে বই নিয়েই বসে থাকে। আমার সাথে একটু খেলেও না।

-আহারে সোনাপাখি, চলো আমরা ‘রস-কস’ খেলবো।

-না না, তুমি গল্প শোনাবে আমাকে।

-গল্প? আচ্ছা, কিসের গল্প শুনতে চাও?

রূপসা উত্তর দেওয়ার আগেই অপর্ণা খাবারের প্লেট হাতে উপস্থিত হলো। চিত্রলেখা মনে হয় ভূত দেখার মতো চমকালো। অপর্ণা খাবারের প্লেট হাতে তার ঘরে? রূপসার জন্য বোধহয়।

-ভাবী, তুমি আসতে গেলে কেন? আমি রূপসাকে পাঠিয়ে দিতাম। রূপসা, যাও খেয়ে নাও।

-আরে এটা রূপসার জন্য না। তোমার জন্য ডিম ভাজি-ভাত এনেছি। খেয়ে নাও।

চিত্রলেখা এবার আকাশ থেকে পড়লো। তার ভাবীকে কি জ্বীনভূত আছড় করলো? কেমন কেমন কথা বলছে! তার জন্য কিনা খাবার বেড়ে এনেছে! চিত্রলেখার চোখ গেল দরজার দিকে। সাথী সেখানে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। চিত্রলেখা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সাথীর ইশারাটা ঠিকঠাক ধরতে না পারলেও অপর্ণার কথামতো খাবারের প্লেটটা নিয়ে খেতে শুরু করলো।

_____________

রঙ্গন নিজের ঘরে বসে নিজের বইগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিল। লক্ষ করলো অহম বারবার তার ঘরের দিকে এসে ফিরে যাচ্ছে। রঙ্গন ঘরে ডাকলো তাকে। অহম এসেই রঙ্গনের বিছানার উপর পা তুলে বসে পড়লো।

-অশরীরী আত্মার মতো আমার ঘরের বাইরে ঘুরছিলি কেন?

-আমার ম্যামটা দেখতে কিন্তু সুন্দর, বলো।

-তাতে তোর কী?

-আমার আবার কী? আমি কোলে নিয়েছিলাম নাকি?

-তুই কিন্তু খুব বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস অহম।

-সত্য কথার দাম নেই আসলে। আমি এসেছিলাম তোমাকে একটা খুশির খবর দিতে আর তুমি অযথাই বকলে। যাও বলবো না এখন।

-কী খুশির খবর বল শুনি।

-চকলেট দাও আগে।

-আমি কি দোকানদার যে সারাক্ষণ চকলেট নিয়ে বসে থাকবো?

-তোমার ব্যাগে সবসময় চকলেট থাকে আমি জানি। দাও চুপচাপ।

রঙ্গন অহমের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অতঃপর ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে অহমের হাতে ধরিয়ে দিল।

-হ্যাঁ, এখন খুশির খবর হচ্ছে তুমি অতি শীঘ্রই আমার ম্যামের প্রেমে পড়তে চলেছো।

-চকলেট ফেরত দে!

অহম চকলেট নিয়ে দৌড় দিল সেখান থেকে। রঙ্গন আর কিছু বললো না। টিন-এজ বয়সে সবার প্রেম কাহিনী এভাবেই সাজাতে ভালো লাগে, এসব ততটাই অবাস্তব যতটা রাজপুত্রের পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে আসা।

______________________

-লেখা, সিয়াম ভাই তোর জন্য নোট খাতা দিয়ে গেছে আমাকে।

-ভাইয়া এসেছে?

-জ্বী। চাচাতো ভাই আমার অথচ আমাকে তো দেয় না নোটখাতা! তোকেই কেন দেয় বুঝিনা।

-আমাদের দুঃখ একরকম তাই হয়তো। উনিও এতিম আর আমিও।

-এসব কথা কেন বলিস? তোর ভাই তোকে কত ভালোবাসে অথচ তুই সবসময় নিজেকে একা ভাবিস।

চিত্রলেখা হাসলো। সুবহা তো জানেনা একজনের ভালোবাসার আড়ালে কতজনের ক্ষোভ সে সহ্য করে! অবশ্য এখন তা অকস্মাৎ কমেছে একদিনেই।

-আচ্ছা বাদ দে, এত ভাবতে হবে না। ভাইয়া পরশু চলে যাবে, তুই কি দেখা করবি?

-দেখা করার সুযোগ কোথায়? ভাইয়াকে আমার হয়ে শুভ কামনা দিস আর অনেকগুলো ধন্যবাদ।

-তুই চাইলেই দেখা করতে পারিস। আজ বিকেলে পড়ার নাম করে চলে আয় বাসায়।

-না, বিকেলে কাজ আছে।

-ভালো! দুনিয়ার সব কাজ তোর! থাক কাজ নিয়েই।

চিত্রলেখা আবারো নিরুত্তর বসে রইলো। সিয়াম ভাই তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। তার অসহায়ত্ব বুঝতে চেষ্টা করেন, বোধহয় অনুভবও করতে পারেন অনেকাংশে তবে চিত্রলেখা তাকে এখন এড়িয়েই চলে। ভুলবশত তার ভাবীর কানে পড়লে সিয়াম ভাইয়ের সম্মানটুকুও ভরাবাজারে নিলামে তুলবেন তিনি।

কলেজ যথাসময়ে ছুটি দিল। চিত্রলেখা আগে আগেই বেরিয়ে পড়লো। সুবহার সাথে গেলেই সুবহা বারবার তার বাড়িতে যেতে বলবে। মাথা নিচু করে দ্রুত পায়ে কলেজ গেট অতিক্রম করছিল চিত্রলেখা। আশেপাশের কোনোকিছুতে তার ধ্যান নেই।

‘চিত্রলেখা’ পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেয়ে আঁতকে উঠলো চিত্রলেখা। পিছু ফিরতেই দেখতে পেল দুপুরের রোদে ঘর্মাক্ত ক্লান্ত চেহারাটা। চিত্রলেখা এড়িয়ে যাওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারতো না কিন্তু পেছনে ফিরতেই দেখলো সিয়াম ভাইয়ের থেকে কিছুটা দূরেই তার বড় ভাবী কৌতুহলী আঁখি মেলে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে আঁতকে উঠলো সে। না জানি কোন ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে তার জন্য!

চলবে …

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০২

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
দ্বিতীয়_পর্ব
~মিহি

“পড়াতে এসে প্রথমদিনেই মাথা ঘুরে আমার বড় ছেলের কোলে ঢলে পড়লো আর তার কাছে আমি আমার ছোট ছেলেকে পড়াবো? টাকার অভাব নাকি আমার? কিছু টাকা ছুঁড়লে টিচারের লাইন লেগে যাবে!” কথাটা খানিকটা চেঁচিয়েই বলেছেন রঙ্গনের মা আশফিনা আহমেদ। দরজার বাইরে থাকা রঙ্গনের কানেও গেল বাক্যটা। সে চুপচাপ দরজার কাছ থেকে সরে গেল। আড়ি পেতে নিজের বাবা-মায়ের কথা শোনার ইচ্ছে তার নেই।

-তুমি মেয়েটাকে অযথা ভুল বুঝছো। অহম ওর পায়ের কাছে বাজি ফাটিয়েছে। ওর ভয় পাওয়া কী স্বাভাবিক নয়?

-রঙ্গনের কোলেই পড়তে হলো ওর? এ মেয়েকে আপনি বাদ দিন।

-আশফিনা, বেশি কথা বোলো না। আমি যখন বলেছি লেখাই অহমকে পড়াবে, তার মানে আমার কথাই শেষ কথা। এর উপর কারো কোনো মতামত আমি শুনতে চাইনা। তুমি ওকে সহ্য করতে পারোনা ঠিক আছে, অযথা ওর সাথে খারাপ আচরণ করবে না।

আশফিনা আহমেদ কিছু না বলেই চলে গেলেন। রঙ্গনের বাবা মাশরুর আহমেদ শান্ত স্বভাবের, তাই বোধহয় এমন রগচটা স্ত্রী লাভ করেছেন। অবশ্য আশফিনার রাগটা দিব্যি বুঝতে পারছে সে। আশফিনার ভাতিজি সাথীকে লেখার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিল সে। এমনকি রাগ করে সে বিয়েতেও যায়নি। তার একটাই সমস্যা যে লেখার বাবা দুইটা বিয়ে করেছে, তার বাড়ির পরিবেশ সাথীর উপযুক্ত নয়। কথাটা ফেলে দেওয়ার মতোও নয় তবুও সাথী লেখার ভাই অনিককে ভালোবেসেছিল। তাদের ভালোবাসার কারণেই পরবর্তীতে দুই পরিবার রাজি হয় বিয়েতে। এ বিয়ের সূত্র ধরে আশফিনা এবং সাথীর বাবার সম্পর্ক প্রায় শেষ কিনারায় বললেই চলে। মাশরুর সাহেব এসব ভাবনা-চিন্তা রেখে অহমের ঘরের দিকে এগোলেন। এতক্ষণে নিশ্চিত লেখার জ্ঞান ফিরেছে।

________

চিত্রলেখার জ্ঞান ফিরতেই অনুভব করলো সে বেশ নরম বিছানায় হেলান দিয়ে আছে। চটজলদি উঠে পড়তেই সামনে ভ্রু কুঁচকে বসে থাকা ছেলেটা মুখ বিকৃত করলো।

-আপনি এত ভীতু? একটা বাজি ফাটাতেই এত ভয় পেলেন কেন? আপনার এ ভয় পাওয়ার জন্য কত বকা খেয়েছি জানেন? রঙ্গন ভাইয়া কত বকলো! আব্বুও বকলো। আচ্ছা ছাড়ুন, আপনি তো আমাকে পড়াবেন। নাম কী আপনার?

-চিত্র..লে..লেখা।

-এমা আপনি তোতলা?

-না।

-আচ্ছা, আমি অনেক দুঃখিত। এখন থেকে আমি একদম ভদ্র বাচ্চার মতো পড়বো, কোনো দুষ্টুমি করবো না প্রমিজ।

চিত্রলেখা ঢোক গিলল। কোন বিচ্ছুকে পড়াতে এসেছে সে! একবার মনে হলো মানা করে দেবে কিন্তু তাতে ছোট ভাবী মন খারাপ করবে। তাছাড়া টাকাটাও দরকার। এসব ভাবতে ভাবতেই মাশরুর আহমেদ অহমের ঘরে ঢুকলেন। চিত্রলেখা ততক্ষণে বিছানা থেকে উঠে সামনের চেয়ারে বসেছে। অহম বসেছে তার মুখোমুখি। মাশরুর আহমেদ আসতেই চিত্রলেখা দাঁড়িয়ে পড়লো।

-আরে বসো মা, দাঁড়াচ্ছো কেন? আমি শুধু একটু কথা বলতে এসেছি। আসলে আমার এ ছেলেটা এতটাই বাঁদর যে বলার মতো না! এখন তোমার উপরেই ওর দায়িত্ব। যেভাবে পারো এই গাধাটাকে কিছু শেখাও। অনেক টিচারই রেখেছি ওর জন্য, লাভ তো হয়নি। দেখো তুমি যদি আমার দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে পারো।

-আমি চেষ্টা করবো আঙ্কেল।

-আচ্ছা তুমি ওর সাথে কথা বলে নাও। নিচে গাড়ি আছে, তোমাকে রেখে আসবে।

-ধন্যবাদ আঙ্কেল।

মাশরুর আহমেদ কথা বাড়ালেন না। তিনি চলে যেতেই চিত্রলেখার মুখে আবারো মলিন রেখা দৃশ্যমান হলো। অহম ছেলেটা সত্যিই দুষ্টু। প্রথমত তার বড় ভাইয়ের সাথে একটা ভুল বোঝাবুঝি হলো, তারপর আবার তার ছোট ভাই এমন দুষ্টুমি করলো। চিত্রলেখার মন সায় দিচ্ছে না এখানে থাকতে। এমনিতেই সে একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের। তার উপর আজকের ঘটনার পর রঙ্গনের মুখোমুখি হওয়া তার জন্য কঠিন।

-ম্যাম, আপনি কী ভাবছেন?

-কিছুনা। তোমার সমস্যা কোন সাবজেক্টে?

-রসায়ন ছাড়া আমার কোনো সমস্যাই নেই। আমি সব সাবজেক্টেই ভালো করছি কিন্তু রসায়ন স্যার মোটেও ভালো পড়ায় না। তার উপর ওনার মেয়ের সাথে আমার আদা-কাঁচকলার সম্পর্ক তো, তাই ফেল করিয়ে দিয়েছে ইচ্ছে করে।

-ওনার মেয়ের সাথে তোমার কিসের শত্রুতা?

-আর বলবেন না ম্যাম! আমার গার্লফ্রেন্ড আছে তাও ছ্যাঁচড়ার মতো আমার পিছনে পড়ে থাকে। আমি তো লয়্যাল তাও কেমন কেমন করে। একদিন থাপ্পড় দিয়েছিলাম, সেটাই বাবাকে শুনিয়ে আমাকে ভিলেন বানিয়ে ফেলেছে।

-ইয়া আল্লাহ, খোদা! এটুক ছেলের গার্লফ্রেন্ড? এই তোমাদের জেনারেশন এত ফাস্ট কেন?

-ফাইভ-জি’র যুগে এসে স্লো হলে চলে ম্যাম?

চিত্রলেখা চুপ হয়ে গেল। কোন ধাতুতে গড়া এ ছেলে? একদিনের পরিচয়ে নিজের কীর্তিকলাপ সব কী সগৌরবে বাতলে দিচ্ছে! এমন ঠোঁটকাটা ছেলে সে কস্মিনকালেও দেখেনি।

-আচ্ছা বই বের করো।

-ম্যাম, একটা জিনিস বুঝান তো, নিউক্লিয়াস নিজের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে উচ্চ শক্তিস্তর বা নিম্ন শক্তিস্তরে কিভাবে যায়? এই প্রশ্ন পরীক্ষায় এসেছিল। আমি উত্তর দিয়েছি, ইলেকট্রনের ইচ্ছা! জিরো দিয়েছে আমাকে।

-ঠিকই করেছে। দেখো, মনে করো তুমি ইলেকট্রন। এখন তোমার ক্ষুধা লেগেছে। তুমি খাবার খেয়ে মোটা হবে নাকি শুকিয়ে যাবে?

-যাহ ম্যাম! খাবার খেয়ে আবার কেউ শুকায় নাকি?

-ইলেকট্রনও তেমন শক্তি শোষণ করে উচ্চ শক্তিস্তরে যায়, তুমি যেমন খাবার খেয়ে মোটা হও। তারপর ধরো বেশি খেয়ে ফেললে তো আবার হাঁটাহাটি করে খাবার হজম করো, তাইনা?

-বুঝেছি ম্যাম। ইলেকট্রন শক্তি বিকিরণ করে নিম্ন শক্তিস্তরে আসবে। আরেহ! এটা তো সহজ, আমি অযথাই কনফিউজড ছিলাম এতদিন?

-রসায়ন ততটাও কঠিন না যতটা তুমি ভাবো। আচ্ছা আজ বেশি কিছু পড়াবো না। প্রথমদিন তো, তুমি বরং নিজের সমস্যাগুলো গুছিয়ে রাখো, আমি পরবর্তী দিন থেকে সলভ করাবো।

-আচ্ছা।

-তবে আমি আসি আজ।

-ম্যাম, একটা কথা বলি?

-বলো।

-আপনার কলেজে চান্স না হলে কি আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে?

চিত্রলেখা কী উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। বাচ্চাটার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এ কলেজে না হলে তোমার জীবন শেষ! কী অদ্ভুত মোহময় জগতে বাস করছে মানুষ। চিত্রলেখা অহমের মাথায় হাত রাখলো।

-আমার কলেজে চান্স না পেলে তোমার জীবন এখনকার মতোই চলবে।

-সত্যিই?

-হ্যাঁ তবে তোমার বুঝতে হবে তোমার জীবনে তুমি কী করতে চাও।

চিত্রলেখার জটিল কথাটা বোধহয় অহমের মাথায় ঢুকলো না তবুও সে মুচকি হাসলো। চিত্রলেখা হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে নিচে নামতেই সকালের লোকটার সাথে দেখা হলো। চিত্রলেখার মনে খানিকটা চাপা রাগ আছে লোকটার প্রতি। লোকটা তো বলতে পারতো রঙ্গন এ বাসার বড় ছেলে। তার ইজ্জতের তো ফালুদা হতো না। চিত্রলেখাকে দেখেই লোকটা এগিয়ে এলো।

-ম্যাম, আপনার জন্য বাইরে গাড়ি রাখা আছে। সাদা যে গাড়িটা, ঐটাতে বসবেন।

-জ্বী আচ্ছা।

চিত্রলেখা বের হয়ে আরেক বিপদে পড়লো। সামনে দুইটা সাদা গাড়ি। কোনটাতে উঠতে হবে বুঝতে পারলো না। একটা গাড়ির ড্রাইভিং সীট ফাঁকা। অপর গাড়িতে ড্রাইভিং সীটে সাদা সাদা পোশাক পড়া একজনকে দেখা যাচ্ছে। চিত্রলেখা বুঝতে পারলো এটাই তার যাওয়ার জন্য রাখা হয়েছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। চিত্রলেখা ঝটপট গাড়িতে বসে বলে উঠলো, “ড্রাইভার আঙ্কেল তাড়াতাড়ি চলুন, সন্ধ্যা হয়ে আসছে।” বলেই সে সীটবেল্ট লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সীটবেল্ট লাগানো শেষ করে সামনে তাকাতেই দেখলো রঙ্গন গম্ভীর ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

-সকালে ‘রঙ্গন’, এখন ‘আঙ্কেল’? চশমা বোধহয় ঠিকমতো কাজ করছে না আপনার। দ্রুত ডাক্তার দেখান।

-আপনি! আমি দুঃখিত। আসলে ঐ আঙ্কেল বললো সাদা গাড়ি..এখানে দুইটাই সাদা গাড়ি … আমি বুঝতেই পারিনা…

-আরেহ! শান্ত হোন। আমিই ড্রপ করে আসছি, এড্রেস বলুন।

-না..না, তার দরকার নেই।

-এটা আপনার আঙ্কেল বলার শাস্তি। ইউ কান্ট ডিনাই!

এরই মধ্যে ড্রাইভারকে আসতে দেখে চটজলদি ‘স্যরি’ বলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল চিত্রলেখা। রঙ্গন বিস্মিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। অদ্ভুত তো মেয়েটা! রঙ্গন কি তাকে রেখে আসতে পারতো না?

চিত্রলেখা যে রঙ্গনের গাড়িতে গিয়ে বসেছিল তা নিজের ঘরের বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখলেন আশফিনা আহমেদ। পরবর্তীতে চিত্রলেখার নেমে যাওয়া তাকে ততটা প্রভাবিত করলো না। চিত্রলেখার জন্য ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে তা মনে মনে স্থির করে ফেলেছেন তিনি।

চলবে…

চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০১

0

#চিত্রলেখার_কাব্য
সূচনা_পর্ব
~মিহি

“লেখা, এত রাতে লুকিয়ে রান্নাঘরে কী করছিস তুই? তোর এতবড় সাহস আমার বাচ্চাদের জন্য আনা এত দামী বিস্কিট তুই চুরি করে খাচ্ছিস!” ভাবীর চেঁচামেচিতে চিত্রলেখার হাত থেকে বিস্কুটের বয়ামটা মেঝেতে পড়ে বিকট শব্দে ফেটে যায়। ভাবীর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায় চিত্রলেখা। এখন তার সাথে কী হবে তা কল্পনা করতেও ভীত হচ্ছে সে। এমনিতেই তার বড় ভাই আজ ব্যবসার কাজে বাইরে গেছে। আজ তো ভাবীকে আটকানোরও কেউ নেই!

-তুই জানিস এই বিস্কিটের দাম কত? আমার ভাই বিদেশ থেকে পাঠিয়েছে এটা আমার বাচ্চাদের জন্য আর তুই সব নষ্ট করে ফেললি!

-ভাবী স্যরি, আমি ইচ্ছে করে করিনি সত্যি। আসলে আমি দুপুর থেকে খাওয়ার সময় পাইনি তাই রান্নাঘরে কিছু খেতে এসেছিলাম। টেবিলের উপর বিস্কুটের বয়াম ছিল। ভাবলাম ওখান থেকেই কয়েকটা…

-কী এমন রাজকার্য করছো সারাদিন? এক রান্না ছাড়া তো কিছুই করো না, বই নিয়ে বসে থাকো। তাও তো তোমার ভাই তোমারে পালতেছে। অন্য কেউ হলে এমন সৎ বোনরে মাথায় নিয়ে পালে নাকি!

চিত্রলেখা কোনো উত্তর দিতে পারলো না। ‘সৎ’ শব্দটা কানে বাড়ি খাচ্ছে তখন। সামান্য একটা বিস্কুটের জন্য এত কথা শুনতে হয় তা জানলে চিত্রলেখা কোনভাবেই বয়ামটাতে হাত দিত না। চিত্রলেখার ভাবী অপর্ণার চেঁচামেচিতে তার ছোট ভাবী সাথীও ঘুম ঘুম ভাবে রান্নাঘরে এলো।

-কী হয়েছে আপা? এত চেঁচামেচি করছো কেন রাতে? বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে তো।

-চেঁচামেচি করবো না তো কী করবো? তোর এই ননদ কী করেছে জানিস? আমার ভাই বাচ্চাদের জন্য বিদেশ থেকে বিস্কিট পাঠিয়েছে। এ মেয়ে সব নষ্ট করে ফেলল। আমার ভাইকে আমি কিভাবে মুখ দেখাবো বল?

-আহা আপা! এর জন্য তুমি রাত বিরাতে এভাবে বকছো মেয়েটাকে? বাদ দাও তো। ঘুমাতে যাও। রাত জাগলে তোমার চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে যাবে তো।

অপর্ণা কথা বাড়ালো না। চিত্রলেখার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। সাথী লক্ষ করলো চিত্রলেখা তখনো রান্নাঘরের মেঝেতে বসে কাঁচের টুকরোগুলো পরিষ্কার করতে ব্যস্ত।

-লেখা, রেখে দে ওসব। তোর তো কাল পরীক্ষা, হাত কেটে গেলে সমস্যা হবে।

-এইতো হয়ে গেছে ভাবী। তুমি বাঁচিয়ে নিলে আজ।

-তোকে কতবার বললাম খেয়ে পড়তে বস। তোর জন্য তো খাবার ফ্রিজে রেখেছিলাম আমি। জানিই তো তুই খালি পেটে ঘুমাতে পারিস না।

-ফ্রিজের ভাতে বড় ভাবী পানি দিয়েছে আর তরকারিও ফেলে দিয়েছে।

-আচ্ছা দাঁড়া, আমার ঘরে ড্রাইকেক আছে, ঐটা খেয়ে নে চল।

চিত্রলেখা সাথীর দিকে তাকাতেই তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মাকে হারানোর পর সে কারো কাছ থেকেই ভালোবাসা পায়নি একমাত্র কিছু মানুষ ছাড়া। বাবা তো তাকে কেবল নিজের পাপ ভেবে গেছে সবসময়। মা মারা যাওয়ার পর যখন বাবা তাকে এ বাড়িতে আনে, তখন তার বয়স নয়। এখন বয়সটা বিশ ছুঁই ছুঁই অথচ এখনো ভালোবাসার কাঙাল সে। বড় ভাইয়া আর ছোট ভাবীই তাকে একটু ভালোবাসে। কানন আপুও মাঝে মাঝে ভালোবাসে। চিত্রলেখা আনমনে সব ভাবতে ভাবতে ড্রাইকেক খেতে লাগলো। কাল শেষ পরীক্ষা অথচ আজ মনটা এমন বিক্ষিপ্ত হলো। কালকের পরীক্ষা কেমন যাবে বুঝতে পারছে না সে।

___________

-পরীক্ষা কেমন হয়েছে লেখা?

-মোটামুটি ভাবী। মনে হয় পাশ এসে যাবে তবে নম্বর ভালো আসবে না।

-আচ্ছা চিন্তা করিস না, ফাইনালে কভার করে নিবি। তোর জন্য একটা সংবাদ আছে।

-কী সংবাদ? সুসংবাদ তো আসে না আমার জন্য!

-আমার এক ফুপা আছে, তুই হয়তো চিনিস না। বেশ বড়লোক, তো তার ছেলে এবার নাইনের ফাইনাল এক্সামে ডাব্বা মেরেছে। এখন তারা একজন শিক্ষক খুঁজছে। ছেলের বাবার শখ তোদের কলেজেই যেন ওর চান্স হয়।

-বাঁশবাগানে ছেলেকে পাঠানোর এত শখ কেন!

-আরে ধুর! মজা করিস না তো। তো আমাকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করলো। তুই তো ভালো ছাত্রী। তোর কি সময় হবে একটু পড়ানোর? ওরা যথেষ্ট টাকা দিবে বলছে।

-সংবাদটা আসলেই সুসংবাদ ভাবী। এখন আমার পড়াশোনার টাকা সংক্রান্ত ঝামেলা খানিকটা কমলো। তোমাকে অনেক থ্যাংকস। তোমার জন্য আজ বিকেলে সেমাই রান্না করবোনি।

-আহা শখ কত! তোমার বড় ভাবী আমাকেও সেমাইয়ের সাথে গিলে খাবে। তিনি দুধ রেখেছেন চুলে দেওয়ার কী জানি বানাতে, খাওয়ার জন্য না।

-এই ভাবী যত জিনিস চুলে দেয়, তাতে আমাদের একমাসের খাবার হয়ে যেত।

-এই চুপ! যাও ফ্রেশ হও আর ওরা আজ বিকেলে গাড়ি পাঠাবে। ওরাই নিয়ে যাবে, নামিয়ে দিয়ে যাবে। তুমি শুধু ভালোমতো পড়াও।

চিত্রলেখা মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। সত্যিই সে অনেক খুশি। বড় ভাইয়ার কাছ থেকে সবসময় টাকা নিতে তার খানিকটা লজ্জাই লাগে আর ভাবীর কাছে চাইতে গেলে তো কুরুক্ষেত্র বেঁধে যায়। এসব ভেবে ভেবে কয়েকটা প্রাইভেটও বাদ দিতে হয়েছে তার। এখন বোধহয় সমস্যাটা মিটলো। ভাবতে ভাবতেই সে হাতমুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে নিল। খানিকটা ক্লান্ত লাগছে। একটু চা পেলে ভালো হতো কিন্তু এখন চা বানাতে গেলে বড় ভাবী চেঁচামেচি করবে। বাজখাই গলায় বলে উঠবে,’গ্যাসের বিল তোর মা দেয়?’ সচরাচর এসব গালিতে বাবাকে আনা হয় কিন্তু চিত্রলেখার মাকেই দোষারোপ করে অপর্ণা। এমনকি কতবার যে তাকে নাজায়েজ শব্দের সাথে পরিচিত করিয়েছে তা গোণার বাইরে অথচ চিত্রলেখার মা ছিলেন তার বাবার প্রথম স্ত্রী। এসব অতীতের স্মৃতিগুলো মনে করলেই চিত্রলেখার বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করতে থাকে।

ঘড়ির কাঁটা চারটে ছুঁই ছুঁই। সরু রাস্তায় এক বিশালাকার গাড়ি এসে সমস্ত জায়গা দখল করে ফেলেছে। আশেপাশের লোকজন বিরক্তির সমেত তাকাচ্ছে সেদিকে। বাচ্চারা গাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করছে। চিত্রলেখা দ্রুত গাড়িতে বসতেই গাড়ি হর্ণ বাজিয়ে সরে গেল। আশেপাশের লোকজন তখনো ভ্রু কুঁচকে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতায় পরিক্রমা করে বেড়াচ্ছে কতিপয় অশ্লীলতর কথাবার্তা। চিত্রলেখার চরিত্র সম্বন্ধে তারা এখন নিজেদের সবজান্তা ভাবতে শুরু করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।

____________

-এসে গেছি ম্যাম, নামুন। ভেতরের দরজায় গেলে একজন আপনাকে রুম দেখিয়ে দিবে।

-ধন্যবাদ।

চিত্রলেখা গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে গেল। বাড়ির সামনে বিশাল বাগান। বাগানে শোভা পাচ্ছে প্রচুর ফুল। রঙ্গন ফুলের সংখ্যা বেশি। ধীর পায়ে দরজায় আসতেই একজন যন্ত্রন্যায় গলায় প্রশ্ন করে বসলো তাকে।

-কাকে চান?

-না মানে আমি আসলে পড়াতে এসেছি।

-কাকে পড়াতে?

‘সর্বনাশ!’ মনে মনে উচ্চারণ করলো সে,’আমি তো ভাবীর কাছে ছাত্রের নামও শুনিনি। এখন কী বলবো একে?’ চিত্রলেখা ভারী মুসিবতে পড়লো।

-রঙ্গন স্যার উপরে আছেন। যান।

-আচ্ছা ধন্যবাদ কিন্তু ঘরটা?

-উপরে গিয়ে সিঁড়ির ডানপাশের রুমটা।

চিত্রলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে। প্রথমদিনেই ছাত্রের নাম না জেনে পড়াতে আসা নিশ্চিত লজ্জাজনক ব্যাপার হয়ে যেত। প্রথম ইমপ্রেশনটাই শেষ হতে চলেছিল। চিত্রলেখা ভাবলো ছাত্রের নাম বুঝি রঙ্গন! সে বাড়ির ভেতরটা একদৃষ্টিতে দেখে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। সিঁড়ির ডানপাশের রুমটার দরজা হালকা আটকানো। চিত্রলেখা ‘রঙ্গন’ বলে ডেকে উঠলো।

-রঙ্গন? ভেতরে আসবো আমি?

-আসুন।

দরজা অল্প খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই চমকালো চিত্রলেখা। প্রায় ছয় ফুটের এক দানবীয় পুরুষকে দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। একে পড়াতে হবে? কতবার ফেল করলে এ এখনো নাইনে পড়ে থাকতে পারে? আদুভাই লাইট? না না আদুভাই প্রো ম্যাক্স!

রঙ্গন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। পুঁচকি একটা মেয়ে কিনা তাকে নাম ধরে ডাকে। ভারী সাহস তো!

-কে আপনি? কী দরকার?

-আমি আসলে পড়াতে এসেছি। আপনি এখনো নাইনে পড়ে আছেন কেন?

-অ্যাহ? আমি? এক্সকিউজ মি! আমার ছোট ভাই অহমকে পড়াতে এসেছেন আপনি।

কথাটা শোনামাত্র চিত্রলেখার মাথা ঘুরে উঠলো। মনে মনে বললো,’হে ধরণী, দ্বিধা হও!’ বোকাসোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুঃখিত বলে দরজা অতিক্রম করতেই বিকট একটা শব্দে মাথা ঘুরে পড়ে গেল চিত্রলেখা।

চলবে…

অবেলার বকুল পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

আয়ানের বাড়ী পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে গেল। ডোরবেল বাজাতে রায়হান চৌধুরী এসে দরজাটা খুলে দিয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসে পড়লো। আয়ান ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখলো রায়হান চৌধুরী,রাহেলা বেগম আর সায়ান মুখ কালো করে বসে আছে। ওদের বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছে এ যেন শোকের বাড়ী। অথচ বাড়ীতে তো আজ আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা। আয়ানের কাছে বকুল আর সায়ান দুজনের রোল নাম্বার ছিলো। অনলাইনে ও রেজাল্ট দেখেছে। তাই আসার সময় মিষ্টি কিনে আয়ান বাড়ী ফিরেছে। বকুল মিষ্টি খেতে পছন্দ করে বলে একটু বেশী করে মিষ্টি কিনে এনেছে। সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তোরা সব এখানে। বকুল কোথায়?
সায়ান কিছু বলার আগেই রাহেলা বেগম একটু তেতে বললেন,
—-ও চলে গেছে।
—-মানে কি? কোথায় গেছে?
—কোথায় আবার? যেখানে যাওয়ার সেখানেই চলে গেছে। শোন আয়ান, বিয়ের আগে তোকে বলেছিলাম,মা মরা মেয়েটাকে কষ্ট দিস না। অথচ তুই সেই কাজটাই করলি।
—আমি তো ওর প্রতি কোনো দায়িত্ব অবহেলা করিনি?
—ভালো তো বাসিসনি? ভালোবাসলে তুই কি আবার জেসিকার সাথে যোগাযোগ করতে পারতি?
—আম্মু,আমি জেসিকার সাথে যোগাযোগ করিনি। ও আমার সাথে যোগাযোগ করেছে।
—-তুই সাড়া দিলি কেন?
—সাড়া কোথায় দিলাম,বরং আজ ওকে অপমান করে আমার মনের জ্বালা জুড়িয়েছে। ওকে সামনে বসিয়ে অপমান করার আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিলো। সেই সুযোগটা যখন হাতের কাছে পেয়েছি আমি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছি।
রায়হান চৌধুরী বিরক্ত হয়ে আয়ানকে বললো,
—-ও আবার এতোদিন পর তোর সাথে কেন যোগাযোগ করলো? যতটুকু জানি ওতো বিদেশে ছিলো। এছাড়া সব কিছু তো অনেক আগেই চুকে বুকে গেছে।
—ঐ যে বাবা বেটার অপশন। খুব আগ্রহভরে বিয়ে করেছিলো। ধারণা ছিলো আমার সাথে যা করেছে সব জায়গায় একই আচরণ করে পার পাবে। কথায় আছে,
“বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান
এবার ঘুঘু তোমার বঁধিব পরাণ”
ওর অবস্থা হয়েছে তাই। বর্তমান হাসব্যান্ডের পাল্লায় পড়ে বান্দীর মতো সংসারের সব কাজ করতে হতো। বিদেশে কাজের লোক কোথায় পাবে? তার উপর মাঝে মাঝে কাজে ভুলত্রুটি হলে ঐ লোক দুঘা লাগিয়ে দিতে দেরী করতো না। তখন ওর মনে হয়েছে আমিই ছিলাম ওর বেটার অপশন। তাই ছুটিতে দেশে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। আমি রাজী থাকলে ও ওর হাসব্যান্ডকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবে।
এমন সময় সায়ান একটু গম্ভীর হয়ে বললো,
—তুই ভাবীকে এই কথাগুলো জানালেই পারতি? তাহলে বেচারা এতো মনোকষ্ট নিয়ে বাড়ী যেতো না। আজ কি তুই ভার্সিটিতে কারো সাথে দেখা করেছিস?
—হুম,জেসিকা এসেছিলো।
—ভাবী মনে হয় তোদের দুজনকে একসাথে দেখেছে। তুই ভার্সিটিতে গেলি কেন?
—বকুল যে ভার্সিটিতে ঘুরতে যাবে তা কি আমি জানতাম? আর তা ছাড়া জেসিকার সাথে আমার তো কেনো সম্পর্কও নেই।
—-বকুলকে জেসিকার ব্যাপারে এই কথাগুলো জানালে মেয়েটা হয়তো এভাবে বাড়ী চলে যেতো না।
—-আম্মু আমি তো বলতেই চেয়েছিলাম। ওর পরীক্ষা ছিলো বলে বলিনি। ভাবলাম পরীক্ষাটা শেষ হোক তারপরে পুরো ঘটনাটা ওকে বলবো।
—বড্ড দেরী করে ফেলেছিস।
—আমিও অবাক হচ্ছি এতোটুকু মেয়েটাকে তোমরা একা যেতে দিলে কেন?
—-সমস্যা নেই ভাইয়া। আমি ভাবীকে প্লেনে তুলে দিয়ে এসেছি। আর সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে আঙ্কেল এসেছিলো।

বকুলের চলে যাওয়ার কথা শুনে আয়ানের ভীষণ খারাপ লাগলো। ও ওর নিজের ফ্লাটে চলে আসলো। মনে মনে বকুলকে বললো,”আর একটু অপেক্ষা করতে পারলে না।”
আয়ান এসে বকুলের বিছানাটায় শুয়ে পড়লো। সেখানে বকুলের গায়ের সুবাস লেগে আছে। বালিশটাতে বকুলের চুলের শ্যাম্পুর সুবাসটা লেগে আছে। আয়ান মনে মনে ভাবছে শারীরিকভাবে হয়তো বকুল ওর থেকে অনেকটা দূরে আছে কিন্তু আত্মিকভাবে ও যেন বকুলের সাথেই আছে। কারণ ওর মনপাখিটা বকুলে আসক্ত হয়ে আছে।

ওদিকে বকুলের দু,চোখে ঘুম নেই। অভিমানে বকুলের দু,চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে সিথানের বালিশ ভিজে যাচ্ছে। যদিও ও বাবা আর দাদীর কাছে ভিতরের অভিমানের জল লুকিয়ে রেখেছিলো কিন্তু এখন বন্ধ আর্গলের ভিতর বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো বেড়িয়ে আসতে চাইছে। বকুল চোখের জলটা মুছে ফেলে ভাবছে, “ও কি সত্যি আয়ানকে ভালোবেসে ফেলেছে। সেই কারনে কি জেসিকার সাথে আয়ানকে দেখে ওর প্রচন্ড কষ্ট হলো। এই কষ্টটা কি আয়ানকে হারিয়ে ফেলার ভয়ের কষ্ট। মানুষ নাকি যাকে ভালোবাসে তার প্রতি প্রচন্ড পজেসিভ হয়।”
বকুলের এখন মনে আছে আয়ানও একদিন ওকে ওর সহপাঠি ছেলের সাথে হেসে কথা বলতে দেখার সাথে সাথে নিজের মেজাজকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। সেদিন ওর সাথে আয়ান খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলো। আয়ানের উপর অভিমান করে ওর এভাবে চলে আসা ঠিক হলো কিনা ও জানে না। কিন্তু নিজের কষ্টটুকু আড়াল করতে এ ছাড়া ওর কাছে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিলো না।

রাত ন,টা বাজে। জীবনে ভুল মানুষকে ভালোবেসে ও অনেক কষ্ট সহ্য করেছে আর নয়। আয়ান ওর এক্সিও গাড়িটা নিয়ে বের হয়ে পড়লো। হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলছে। আকাশে আজ গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। বকুলের খুব ইচ্ছে ছিলো এরকম এক চাঁদনি রাতে ওর বাসর হবে। না আর কোনো দ্বিধা নয়, নিজের ভালোবাসাকে জয় করে নেওয়ার এখনই সময়। আর এভাবে প্রণয়ের হোমানলে নিজেকে পুড়ে ছাই হতে দিবে না। গাড়ির গতি আয়ান বাড়িয়ে দিয়েছে।

পূর্ণশশীর অস্তরাগের মুহুর্তে বকুলের চোখটা কেবল লেগে এসেছিলো। দরজায় নক করার শব্দে ঘুম ঘুম চোখে দরজাটা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে আয়ান ঘরে ঢুকেই বকুলকে জড়িয়ে ধরলো। ডিম লাইটের মৃদু আলোতে ঘুম ঘুম চোখে বকুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
—-আপনি, কখন এসেছেন? ছাড়ুন আমাকে?
—-ছাড়ার জন্য তো এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে তোমার কাছে ছুটে আসেনি। আজ তোমাকে আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। তুমি কেমন করে আমাকে ফেলে চলে আসলে? তার শাস্তি তোমাকে এখন পেতে হবে।
—-কেন এসেছেন? আমি আপনার কে? আপনার জীবনে আমি বাঁধা হয়ে থাকতে চাইনি। তাই নিজ থেকেই চলে এসেছি।( অভিমানী স্বরে)
আয়ান রেগে গিয়ে তখন বকুলকে বললো,
—-তুমি কি জানো, তোমার এভাবে চলে আসাতে ও বাড়ির মানুষগুলো কেমন কষ্ট পাচ্ছে? এতোগুলো মানুষের কষ্টের কোনো দাম নেই তোমার কাছে তাই না?
—হুম বুঝলাম, তবে আমার সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে সে কি কষ্ট পেয়েছে? কষ্ট পেলে কি সে তার প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে সময় কাটাতে পারতো?
—-কষ্ট না পেলে নির্লজ্জের মতো মাঝরাতে তোমার কাছে ছুটে আসি। আর বাহ্যিকদিক থেকে যা দেখা যায় তা সব সময় ঠিক নয়। ওকে আমি বলেছি ও ছিলো আমার জীবনের ভুল মানুষ। আমি আজ এক ভালোবাসার রত্নাকরের সন্ধান পেয়েছি। যতদিন বাঁচবো সেই রত্নাকরে ডুবেই বাঁচবো।

বকুলের ভাসা ভাসা নয়ন দুটি আনন্দের আতিশয্যের জলে ভেসে গেল। ও কিছু বুঝে উঠার আগেই আয়ান সমস্ত সংযমের বেড়া ভেঙ্গে বকুলকে আলতো করে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নেয়। তারপর পরম যত্নে বিছানায় শুয়ে দেয়। আষ্টেপৃষ্টে বকুলকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। এতোদিন ওদের দু,জনের বুকের গহীনে যে গাঢ় অভিমান লুকিয়ে ছিলো তা ভালোবাসার ছোঁয়ায় ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। কবে থেকে যে ওদের হৃদয়ের অন্তরালে এতো গভীর ভালোবাসার জন্ম হয়েছিলো তা ওরা কেউ যেন বুঝতেই পারেনি। ভালোবাসার স্বরুপটা মনে হয় এমনিই।

সমাপ্ত।

অবেলার বকুল পর্ব-১৫

0

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-পনেরো
মাহবুবা বিথী

আগামীকাল ১০ই ফেব্রুয়ারী। ঢাকা ভার্সিটিতে ক ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে। বকুলের খুব টেনশন হচ্ছে। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার লালিত স্বপ্ন বকুল ছোটোবেলা থেকে লালন করে আসছে। কিন্তু সেই স্বপ্নটা সত্যি হবে কিনা বকুল জানে না। এই মুহুর্তে বকুলের সময়টা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। একদিকে ভর্তির টেনশন অন্যদিকে আয়ানের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন। কোনোজায়গায় ও স্বাচ্ছন্দ ফিল করতে পারছে না। খুবই বৈপরীত্য সময়ের মধ্য দিয়ে বকুলের দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে। এখন আপাতত ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে খুব টেনশনে আছে।
পড়াশোনার ব্যস্ততার কারনে বকুলের সাথে আয়ানের খুব একটা দেখা সাক্ষাত হয়নি। আয়ান অবশ্য বহুবার চেয়েছে বকুলের কাছাকাছি যেতে। যদিও আয়ান প্রতিরাতে বকুল ঘুমিয়ে যাবার পর ওর রুমে গিয়ে নিস্পাপ মুখশ্রীর দিকে প্রাণভরে তাকিয়ে থাকতো। আর মনে মনে আয়ান ভাবতো কেন বকুল ওকে আপন করে নিতে পারে না। বকুলের কিসের এতো বাঁধা। কি সেই অদৃশ্য বাঁধা! যার কারনে বকুলের কাছে আয়ান আসতে পারে না। সেই বাঁধাটা বকুলের দিক থেকেই ছিলো। আসলে বকুল খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। আত্মসম্মানবোধ ও প্রবল। বকুল আশা করেছিলো আয়ান নিজ থেকে ওর কাছে জেসিকার বিষয়টা ফয়সালা করবে। কিন্তু তা না করে আয়ান জেসিকার বিষয়টা বকুলের কাছে গোপন করেছে। এই কারনে আয়ানের উপর বকুলের অভিমান বেড়েই চলেছে।

রাত বারোটা বাজে। বকুল এখনও জেগে আছে। মাঘের শেষ। আর দু,দিন পর পহেলা ফাল্গুন। জানালা দিয়ে ঝিরঝির করে দখিনা বাতাস বইছে। এই সময় আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর। না শীত না গরম। পরীক্ষার টেনশনে বকুলের চোখে ঘুম আসছে না। তবুও শোয়ার প্রস্তুতি চলছে। খুব ভোরে উঠতে হবে। যদিও কাল ছুটির দিন। তবুও ভর্তি পরীক্ষার কারনে রাস্তায় অনেক জ্যাম হবে। পরীক্ষা যদিও সকাল দশটা নাগাধ শুরু হবে কিন্তু বকুল ঠিক আটটার সময় বাসা থেকে বের হওয়ার চিন্তা করছে। এমন সময় দরজা কে যেন নক করছে। বকুল সচকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—কে?
—বকুল আমি,একটু কথা ছিলো।
—আসুন,
আয়ান রুমে এসে খাটের কোনায় বসে জিজ্ঞাসা করলো,
—তোমার সিট পড়েছে কোথায়? আমাকে তো কিছু জানালে না?
—-ঢাকা ভার্সিটিতে আমার সিট পড়েছে। আমি একাই যেতে পারবো। আপনি ব্যস্ত মানুষ। নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই আমার বিষয়গুলো আমি একাই সামলে নেওয়ার চেষ্টা করি।
—-কাল তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমি অফিসে যাবো।
—-মনে হয় না তার দরকার হবে। আমি একাই যেতে পারবো।
—-দেখ বকুল,আমি এক কথা বার বার বলা পছন্দ করি না। তুমি আমার সাথে যাবে এটাই ফাইনাল। এটা নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। সায়ানও আমাদের সাথে যাবে।এখন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো।
এ কথা বলে আয়ান পাশের রুমে চলে গেল। বকুলও আর এই বিষয়টা নিয়ে কথা বাড়ালো না।

পরদিন খুব ভোরে উঠে বকুল ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো। এরপর শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। বারান্দায় কাপড় মেলতে গিয়ে দেখে আয়ান দাঁড়িয়ে আছে। মেদহীন ঝড়ঝড়ে এক বলিষ্ট পুরুষ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান জিম করে ঘর্মাক্ত শরীরে একটু ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ নিতে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো। আয়ানকে এভাবে দেখে বকুলের বেশ ভালো লাগছিলো। মনে মনে ভাবলো, মানুষটা বেশ সুপুরুষ। আই কন্ট্রাক হওয়ামাত্রই বকুল চোখ নামিয়ে ঘরে চলে আসলো। আয়ানরও সদ্যস্নাত বকুলকে দেখে বেশ ভালো লাগলো। তবে ভালো লাগার আর একটা বড় কারন বকুলের চোখে আয়ান মুগ্ধতা দেখেছিলো। আর সেই মুগ্ধতাটুকু যে ওকে কেন্দ্র করে ছিলো সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।

অতঃপর বকুল ওর শ্বশুর শাশুড়ীর কাছে বিদায় নিয়ে সায়ান আর আয়ানের সাথে গাড়িতে করে ঢাকা ভার্সিটির দিকে রওয়ানা হলো। অনেকদিন পর আয়ান বকুলকে সাথে নিয়ে বের হলো। ড্রাইভিং সিটে আয়ান বসে সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। পাশের সিটে বকুলকেও সিটবেল্ট বেঁধে নিতে বললো। পিছনে সায়ান বসেছে।আয়ান গাড়ি চালাচ্ছে আর আড় চোখে অপার মুগ্ধতা নিয়ে বকুলকে দেখছে। অপরদিকে বকুলের মুখটা বিষাদে ঢেকে আছে। হাতদুটো কোলের উপর রেখে বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। চুলগুলো কানের পাশে অবিন্যস্তভাবে উড়ছে। আয়ান ভাবছে বকুল হয়তো পরীক্ষা নিয়ে খুব টেনশনে আছে। তাই বকুলের মনটা খারাপ।ওকে সাহস দিতে আয়ান ওর হাত বকুলের হাতের উপর রাখলো। আয়ানের হাতের উষ্ণ স্পর্শে বকুল চমকে উঠলো। হাতটা আয়ানের হাতের মুঠ থেকে বের করে আনতে চাইলো। কিন্তু শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। বকুল সায়ানের দিকে ইঙ্গিত করলে আয়ান একসময় হাতটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আয়ান পিছন ফিরে সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-একজন তো এমনমুখ করে বসে আছে দেখে মনে হচ্ছে একটু পরেই তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হবে। তোর কি অবস্থা?
—-অন্য কোনোদিকে মন না দিয়ে গাড়িটা ঠিক মতো ড্রাইভিং কর। এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে আবার এক্সিডেন্ট করে বসিস না।
—-তুই সববিষয়ে একটু বেশী বুঝতে চাস।
বকুল উদাসীনভাব নিয়ে বললো,
—-পরীক্ষার টেনশনে আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমার এতো কথা শুনতে ভালো লাগছে না।
আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-এতো চাপ নিও না। আমার বিশ্বাস ইনশাআল্লাহ তোমাদের দু,জনের পরীক্ষা খুব ভালো হবে।
বকুল আয়ানের দিকে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে বললো,
—-রেজাল্টের পর আমি জলঢাকায় চলে যাবো।
—-হুম,আমিও তাই ভাবছি তোমার জলঢাকা যাওয়া উচিত।
আয়ানের মুখে একথা শুনে মনে মনে বকুল বললো,
“তাহলে তো আপনার ভালোই হয়। প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে নিশ্চিন্তে পরকীয়া চালাতে পারবেন।”
গাড়ি কলাভবনের সামনে চলে আসলো। বকুল আর সায়ান গাড়ি থেকে নেমে পরীক্ষার হলের দিকে আগাতে লাগলো। পরীক্ষা শেষ হলে বকুল আর সায়ানকে আয়ান এই জায়গাতেই আসতে বললো। ওরা চলে যাবার পর আয়ানের মোবাইলটা বেজে উঠলো। জেসিকার ফোন দেখে ও খুব বিরক্ত অনুভব করলো। এই মুহুর্তে আয়ানের ফোনটা রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না। ফোনটা বেজে বেজে একসময় থেমে গেল।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বকুল যথারীতি গাড়িতে এসে বসলো। সায়ান এসে আয়ানকে বললো,
—-ভাইয়া আমি ফ্রেন্ডদের সাথে একটু টাইম স্পেন্ড করতে চাচ্ছি। আমার ফিরতে রাত হবে। আমার হয়ে আম্মুকে বুঝিয়ে বলিস।

সায়ান চলে যাবার পর আয়ান বকুলকে নিয়ে ফ্রেস হতে কোনো রেস্ট্রুরেন্টে গিয়ে বসতে চাইলো। বকুল রাজী হলো না। যদিও পরীক্ষা ভালো হয়েছে তারপরও রেজাল্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছিলো না। আয়ানও হয়তো বকুলের মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলো তাই আর জোর করলো না। দু,দিন পর রেজাল্ট বের হলো। বকুল মেধাতালিকায় তিনশত তম স্থান অর্জন করলো। সায়ানও একশত তম স্থান অধিকার করলো। এমন সময় বকুলের এক সহপাঠি ফোন দিয়ে ওকে কোচিং সেন্টারে আসতে বললো। তখন সকাল দশটা বেজে গেছে।বকুলও ওর খুশীটাকে সেলেব্রেট করতে ফার্মগেটএ উদ্ভাসের কোচিং সেন্টারে হাজির হলো। ওখানে সবার সাথে দেখা করে ওর এক বান্ধবীর সাথে রিকশা করে ঢাকা ভার্সিটির দিকে রওয়ানা হলো। তারপর ওরা দু,জন ভার্সিটি, টিএসসির চত্বর সবঘুরে একসময় ওদের ক্ষুধা অনুভব হলো। ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর দুটো ছুঁয়েছে। ওরা দু,জন মধুর ক্যন্টিনে চলে আসলো। কিন্তু ক্যান্টিনে ও যাকে দেখলো তা ও কখনও আশা করেনি। ক্যান্টিনের ভিতরে একটু কর্ণারের দিকে আয়ানকে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলো। মেয়েটা চেহারা ওর কাছে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। পরে মনে হলো এতো জেসিকা। ও আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ওখান থেকে চলে আসলো। ওর বান্ধবী সোমা খুব অবাক হলো। হঠাৎ বকুলের কি হলো ও বুঝতে পারলো না। বকুল ওকে বললো ওর শরীর খুব খারাপ লাগছে। যাই হোক একটা সিএনজি ভাড়া করে বকুল সোমার কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ীর পথে রওয়ানা হলো। বকুলের খুব কান্না পাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজের চোখের জল সংবরণ করলো।পথে অনলাইনে নভোএয়ারের টিকিট কাটার চেষ্টা করলো। কিন্তু এতো দ্রুত টিকিট পাওয়া তো সম্ভব নয়। উপায়ন্তর না দেখে ওকে একটা সৈয়দপুরের এয়ারের টিকিট ম্যানেজ করে দেওয়ার জন্য সায়ানকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে অনুরোধ করলো। সায়ান টিকিট কাটার আগে ওকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তুমি যে সৈয়দপুর যাচ্ছো ভাইয়াকে বলেছো?
—-বলেছি। ভাই আমার আর এখানে মন টিকছে না। আব্বু আর দাদীকে দেখার জন্য আমার মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে।
—আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি বাড়ী গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নাও। আমার এক বন্ধু নভোএয়ারে পার্টটাইম জব করে। ওর কাছ থেকে টিকিট কাটার ব্যবস্থা করছি।
বকুল বাড়ী এসে ওর শাশুড়ীকে আয়ানের ব্যাপারে বিস্তারিত জানালো। পুরোটা শুনে রাহেলা আর বাঁধা দিলো না। ফোন করে হামিদুরকে সৈয়দপুর এয়ার পোর্টে আসতে বলে দিলো। বকুলও ব্যাগ গুছিয়ে শ্বশুর শাশুড়ীর কাছে বিদায় নিয়ে সায়ানের সাথে শাহজালাল বিমান বন্দরে পৌঁছে গেল। তারপর সন্ধা ছ,টায় নভোএয়ারে করে বকুল জলঢাকার উদ্দ্যেশে ঢাকা থেকে উড়াল দিলো। ওদিকে হামিদুর এতোদিন পর মেয়ের বাড়ী ফেরার খুশীতে কার ভাড়া করে সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে লাগলো। বকুল ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে এই খুশীতে হামিদুরের বুক গর্বে ভরে উঠেছ। বকুল সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলে হামিদুর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়। এর পর ভাড়া করা গাড়িতে ওরা জলঢাকার পথে রওয়ানা হলো। তবে পুরো গাড়িতে বকুলের মুখটা বিমর্ষ দেখে হামিদুরের বুকটা হাহাকার করে উঠলো। একসময় থাকতে না পেরে বকুলকে জিজ্ঞাসা করলো,
—হ্যারে বকুল, আয়ান তো তোর সাথে আসতে পারতো?
—-আব্বু ওর অফিসে অনেক ব্যস্ততা। তাই আমি একাই এসেছি। তুমি খুশী হওনি?
—-নারে, মা খুব খুশী হয়েছি। তোকে দেখার জন্য আমার চোখ দুটো ব্যাকুল হয়ে আছে।
বাড়ী পৌঁছাতে বকুলের রাত আটটা বেজে গেল।

জেসিকাকে কথাগুলো শুনানোর পর আয়ানের অপমানের জ্বালাটা আজ নিভে গেল। আয়ান আজ জেসিকাকে বলতে পেরেছে। ওর জীবনে জেসিকা ছিলো ভুল মানুষ। ভুল মানুষকে ভালোবাসার থেকে তাকে চিরজনমের মতো ঝেড়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ। যদিও জেসিকা ওকে বলেছিলো আয়ানই ছিলো ওর ভালোবাসার সঠিক নির্বাচন। দ্বিতীয় স্বামীর কাছে নিগ্রহের স্বীকার হয়েছে বলে আজ ওর মনে হয়েছে আয়ান ওর সঠিক মানুষ। বলারই কথা। রাতভর নাইটক্লাবে পড়ে থাকে। এদিকে জেসিকাকে দিয়ে সংসারের ঘাণি টানায়। আবার মাঝে মাঝে দু,চার ঘা লাগিয়ে দেয়। অথচ আয়ানের কাছে ও রাজরানীর মতো থাকতো। তারপরও পোষালো না। আয়ান চারিদিক থেকে বিপর্যস্ত করে ও ক্ষান্ত হলো। যদিও আয়ান চায় না জেসিকা এভাবে অত্যাচারিত হোক। কিন্তু মানুষ একসময় তার কর্মফল ঠিক ভোগ করে।
আয়ান গাড়ি চালিয়ে ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরছে। আর মনে মনে ভাবছে বকুলকে আজ ও আদরে আদরে ভরিয়ে দিবে।

চলবে