অবেলার বকুল পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0
408

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

আয়ানের বাড়ী পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে গেল। ডোরবেল বাজাতে রায়হান চৌধুরী এসে দরজাটা খুলে দিয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসে পড়লো। আয়ান ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখলো রায়হান চৌধুরী,রাহেলা বেগম আর সায়ান মুখ কালো করে বসে আছে। ওদের বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছে এ যেন শোকের বাড়ী। অথচ বাড়ীতে তো আজ আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা। আয়ানের কাছে বকুল আর সায়ান দুজনের রোল নাম্বার ছিলো। অনলাইনে ও রেজাল্ট দেখেছে। তাই আসার সময় মিষ্টি কিনে আয়ান বাড়ী ফিরেছে। বকুল মিষ্টি খেতে পছন্দ করে বলে একটু বেশী করে মিষ্টি কিনে এনেছে। সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তোরা সব এখানে। বকুল কোথায়?
সায়ান কিছু বলার আগেই রাহেলা বেগম একটু তেতে বললেন,
—-ও চলে গেছে।
—-মানে কি? কোথায় গেছে?
—কোথায় আবার? যেখানে যাওয়ার সেখানেই চলে গেছে। শোন আয়ান, বিয়ের আগে তোকে বলেছিলাম,মা মরা মেয়েটাকে কষ্ট দিস না। অথচ তুই সেই কাজটাই করলি।
—আমি তো ওর প্রতি কোনো দায়িত্ব অবহেলা করিনি?
—ভালো তো বাসিসনি? ভালোবাসলে তুই কি আবার জেসিকার সাথে যোগাযোগ করতে পারতি?
—আম্মু,আমি জেসিকার সাথে যোগাযোগ করিনি। ও আমার সাথে যোগাযোগ করেছে।
—-তুই সাড়া দিলি কেন?
—সাড়া কোথায় দিলাম,বরং আজ ওকে অপমান করে আমার মনের জ্বালা জুড়িয়েছে। ওকে সামনে বসিয়ে অপমান করার আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিলো। সেই সুযোগটা যখন হাতের কাছে পেয়েছি আমি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছি।
রায়হান চৌধুরী বিরক্ত হয়ে আয়ানকে বললো,
—-ও আবার এতোদিন পর তোর সাথে কেন যোগাযোগ করলো? যতটুকু জানি ওতো বিদেশে ছিলো। এছাড়া সব কিছু তো অনেক আগেই চুকে বুকে গেছে।
—ঐ যে বাবা বেটার অপশন। খুব আগ্রহভরে বিয়ে করেছিলো। ধারণা ছিলো আমার সাথে যা করেছে সব জায়গায় একই আচরণ করে পার পাবে। কথায় আছে,
“বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান
এবার ঘুঘু তোমার বঁধিব পরাণ”
ওর অবস্থা হয়েছে তাই। বর্তমান হাসব্যান্ডের পাল্লায় পড়ে বান্দীর মতো সংসারের সব কাজ করতে হতো। বিদেশে কাজের লোক কোথায় পাবে? তার উপর মাঝে মাঝে কাজে ভুলত্রুটি হলে ঐ লোক দুঘা লাগিয়ে দিতে দেরী করতো না। তখন ওর মনে হয়েছে আমিই ছিলাম ওর বেটার অপশন। তাই ছুটিতে দেশে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। আমি রাজী থাকলে ও ওর হাসব্যান্ডকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবে।
এমন সময় সায়ান একটু গম্ভীর হয়ে বললো,
—তুই ভাবীকে এই কথাগুলো জানালেই পারতি? তাহলে বেচারা এতো মনোকষ্ট নিয়ে বাড়ী যেতো না। আজ কি তুই ভার্সিটিতে কারো সাথে দেখা করেছিস?
—হুম,জেসিকা এসেছিলো।
—ভাবী মনে হয় তোদের দুজনকে একসাথে দেখেছে। তুই ভার্সিটিতে গেলি কেন?
—বকুল যে ভার্সিটিতে ঘুরতে যাবে তা কি আমি জানতাম? আর তা ছাড়া জেসিকার সাথে আমার তো কেনো সম্পর্কও নেই।
—-বকুলকে জেসিকার ব্যাপারে এই কথাগুলো জানালে মেয়েটা হয়তো এভাবে বাড়ী চলে যেতো না।
—-আম্মু আমি তো বলতেই চেয়েছিলাম। ওর পরীক্ষা ছিলো বলে বলিনি। ভাবলাম পরীক্ষাটা শেষ হোক তারপরে পুরো ঘটনাটা ওকে বলবো।
—বড্ড দেরী করে ফেলেছিস।
—আমিও অবাক হচ্ছি এতোটুকু মেয়েটাকে তোমরা একা যেতে দিলে কেন?
—-সমস্যা নেই ভাইয়া। আমি ভাবীকে প্লেনে তুলে দিয়ে এসেছি। আর সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে আঙ্কেল এসেছিলো।

বকুলের চলে যাওয়ার কথা শুনে আয়ানের ভীষণ খারাপ লাগলো। ও ওর নিজের ফ্লাটে চলে আসলো। মনে মনে বকুলকে বললো,”আর একটু অপেক্ষা করতে পারলে না।”
আয়ান এসে বকুলের বিছানাটায় শুয়ে পড়লো। সেখানে বকুলের গায়ের সুবাস লেগে আছে। বালিশটাতে বকুলের চুলের শ্যাম্পুর সুবাসটা লেগে আছে। আয়ান মনে মনে ভাবছে শারীরিকভাবে হয়তো বকুল ওর থেকে অনেকটা দূরে আছে কিন্তু আত্মিকভাবে ও যেন বকুলের সাথেই আছে। কারণ ওর মনপাখিটা বকুলে আসক্ত হয়ে আছে।

ওদিকে বকুলের দু,চোখে ঘুম নেই। অভিমানে বকুলের দু,চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে সিথানের বালিশ ভিজে যাচ্ছে। যদিও ও বাবা আর দাদীর কাছে ভিতরের অভিমানের জল লুকিয়ে রেখেছিলো কিন্তু এখন বন্ধ আর্গলের ভিতর বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো বেড়িয়ে আসতে চাইছে। বকুল চোখের জলটা মুছে ফেলে ভাবছে, “ও কি সত্যি আয়ানকে ভালোবেসে ফেলেছে। সেই কারনে কি জেসিকার সাথে আয়ানকে দেখে ওর প্রচন্ড কষ্ট হলো। এই কষ্টটা কি আয়ানকে হারিয়ে ফেলার ভয়ের কষ্ট। মানুষ নাকি যাকে ভালোবাসে তার প্রতি প্রচন্ড পজেসিভ হয়।”
বকুলের এখন মনে আছে আয়ানও একদিন ওকে ওর সহপাঠি ছেলের সাথে হেসে কথা বলতে দেখার সাথে সাথে নিজের মেজাজকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। সেদিন ওর সাথে আয়ান খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলো। আয়ানের উপর অভিমান করে ওর এভাবে চলে আসা ঠিক হলো কিনা ও জানে না। কিন্তু নিজের কষ্টটুকু আড়াল করতে এ ছাড়া ওর কাছে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিলো না।

রাত ন,টা বাজে। জীবনে ভুল মানুষকে ভালোবেসে ও অনেক কষ্ট সহ্য করেছে আর নয়। আয়ান ওর এক্সিও গাড়িটা নিয়ে বের হয়ে পড়লো। হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলছে। আকাশে আজ গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। বকুলের খুব ইচ্ছে ছিলো এরকম এক চাঁদনি রাতে ওর বাসর হবে। না আর কোনো দ্বিধা নয়, নিজের ভালোবাসাকে জয় করে নেওয়ার এখনই সময়। আর এভাবে প্রণয়ের হোমানলে নিজেকে পুড়ে ছাই হতে দিবে না। গাড়ির গতি আয়ান বাড়িয়ে দিয়েছে।

পূর্ণশশীর অস্তরাগের মুহুর্তে বকুলের চোখটা কেবল লেগে এসেছিলো। দরজায় নক করার শব্দে ঘুম ঘুম চোখে দরজাটা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে আয়ান ঘরে ঢুকেই বকুলকে জড়িয়ে ধরলো। ডিম লাইটের মৃদু আলোতে ঘুম ঘুম চোখে বকুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
—-আপনি, কখন এসেছেন? ছাড়ুন আমাকে?
—-ছাড়ার জন্য তো এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে তোমার কাছে ছুটে আসেনি। আজ তোমাকে আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। তুমি কেমন করে আমাকে ফেলে চলে আসলে? তার শাস্তি তোমাকে এখন পেতে হবে।
—-কেন এসেছেন? আমি আপনার কে? আপনার জীবনে আমি বাঁধা হয়ে থাকতে চাইনি। তাই নিজ থেকেই চলে এসেছি।( অভিমানী স্বরে)
আয়ান রেগে গিয়ে তখন বকুলকে বললো,
—-তুমি কি জানো, তোমার এভাবে চলে আসাতে ও বাড়ির মানুষগুলো কেমন কষ্ট পাচ্ছে? এতোগুলো মানুষের কষ্টের কোনো দাম নেই তোমার কাছে তাই না?
—হুম বুঝলাম, তবে আমার সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে সে কি কষ্ট পেয়েছে? কষ্ট পেলে কি সে তার প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে সময় কাটাতে পারতো?
—-কষ্ট না পেলে নির্লজ্জের মতো মাঝরাতে তোমার কাছে ছুটে আসি। আর বাহ্যিকদিক থেকে যা দেখা যায় তা সব সময় ঠিক নয়। ওকে আমি বলেছি ও ছিলো আমার জীবনের ভুল মানুষ। আমি আজ এক ভালোবাসার রত্নাকরের সন্ধান পেয়েছি। যতদিন বাঁচবো সেই রত্নাকরে ডুবেই বাঁচবো।

বকুলের ভাসা ভাসা নয়ন দুটি আনন্দের আতিশয্যের জলে ভেসে গেল। ও কিছু বুঝে উঠার আগেই আয়ান সমস্ত সংযমের বেড়া ভেঙ্গে বকুলকে আলতো করে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নেয়। তারপর পরম যত্নে বিছানায় শুয়ে দেয়। আষ্টেপৃষ্টে বকুলকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। এতোদিন ওদের দু,জনের বুকের গহীনে যে গাঢ় অভিমান লুকিয়ে ছিলো তা ভালোবাসার ছোঁয়ায় ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। কবে থেকে যে ওদের হৃদয়ের অন্তরালে এতো গভীর ভালোবাসার জন্ম হয়েছিলো তা ওরা কেউ যেন বুঝতেই পারেনি। ভালোবাসার স্বরুপটা মনে হয় এমনিই।

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে