অবেলার বকুল পর্ব-১৫

0
328

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-পনেরো
মাহবুবা বিথী

আগামীকাল ১০ই ফেব্রুয়ারী। ঢাকা ভার্সিটিতে ক ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে। বকুলের খুব টেনশন হচ্ছে। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার লালিত স্বপ্ন বকুল ছোটোবেলা থেকে লালন করে আসছে। কিন্তু সেই স্বপ্নটা সত্যি হবে কিনা বকুল জানে না। এই মুহুর্তে বকুলের সময়টা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। একদিকে ভর্তির টেনশন অন্যদিকে আয়ানের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন। কোনোজায়গায় ও স্বাচ্ছন্দ ফিল করতে পারছে না। খুবই বৈপরীত্য সময়ের মধ্য দিয়ে বকুলের দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে। এখন আপাতত ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে খুব টেনশনে আছে।
পড়াশোনার ব্যস্ততার কারনে বকুলের সাথে আয়ানের খুব একটা দেখা সাক্ষাত হয়নি। আয়ান অবশ্য বহুবার চেয়েছে বকুলের কাছাকাছি যেতে। যদিও আয়ান প্রতিরাতে বকুল ঘুমিয়ে যাবার পর ওর রুমে গিয়ে নিস্পাপ মুখশ্রীর দিকে প্রাণভরে তাকিয়ে থাকতো। আর মনে মনে আয়ান ভাবতো কেন বকুল ওকে আপন করে নিতে পারে না। বকুলের কিসের এতো বাঁধা। কি সেই অদৃশ্য বাঁধা! যার কারনে বকুলের কাছে আয়ান আসতে পারে না। সেই বাঁধাটা বকুলের দিক থেকেই ছিলো। আসলে বকুল খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। আত্মসম্মানবোধ ও প্রবল। বকুল আশা করেছিলো আয়ান নিজ থেকে ওর কাছে জেসিকার বিষয়টা ফয়সালা করবে। কিন্তু তা না করে আয়ান জেসিকার বিষয়টা বকুলের কাছে গোপন করেছে। এই কারনে আয়ানের উপর বকুলের অভিমান বেড়েই চলেছে।

রাত বারোটা বাজে। বকুল এখনও জেগে আছে। মাঘের শেষ। আর দু,দিন পর পহেলা ফাল্গুন। জানালা দিয়ে ঝিরঝির করে দখিনা বাতাস বইছে। এই সময় আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর। না শীত না গরম। পরীক্ষার টেনশনে বকুলের চোখে ঘুম আসছে না। তবুও শোয়ার প্রস্তুতি চলছে। খুব ভোরে উঠতে হবে। যদিও কাল ছুটির দিন। তবুও ভর্তি পরীক্ষার কারনে রাস্তায় অনেক জ্যাম হবে। পরীক্ষা যদিও সকাল দশটা নাগাধ শুরু হবে কিন্তু বকুল ঠিক আটটার সময় বাসা থেকে বের হওয়ার চিন্তা করছে। এমন সময় দরজা কে যেন নক করছে। বকুল সচকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—কে?
—বকুল আমি,একটু কথা ছিলো।
—আসুন,
আয়ান রুমে এসে খাটের কোনায় বসে জিজ্ঞাসা করলো,
—তোমার সিট পড়েছে কোথায়? আমাকে তো কিছু জানালে না?
—-ঢাকা ভার্সিটিতে আমার সিট পড়েছে। আমি একাই যেতে পারবো। আপনি ব্যস্ত মানুষ। নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই আমার বিষয়গুলো আমি একাই সামলে নেওয়ার চেষ্টা করি।
—-কাল তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমি অফিসে যাবো।
—-মনে হয় না তার দরকার হবে। আমি একাই যেতে পারবো।
—-দেখ বকুল,আমি এক কথা বার বার বলা পছন্দ করি না। তুমি আমার সাথে যাবে এটাই ফাইনাল। এটা নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। সায়ানও আমাদের সাথে যাবে।এখন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো।
এ কথা বলে আয়ান পাশের রুমে চলে গেল। বকুলও আর এই বিষয়টা নিয়ে কথা বাড়ালো না।

পরদিন খুব ভোরে উঠে বকুল ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো। এরপর শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। বারান্দায় কাপড় মেলতে গিয়ে দেখে আয়ান দাঁড়িয়ে আছে। মেদহীন ঝড়ঝড়ে এক বলিষ্ট পুরুষ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান জিম করে ঘর্মাক্ত শরীরে একটু ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ নিতে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো। আয়ানকে এভাবে দেখে বকুলের বেশ ভালো লাগছিলো। মনে মনে ভাবলো, মানুষটা বেশ সুপুরুষ। আই কন্ট্রাক হওয়ামাত্রই বকুল চোখ নামিয়ে ঘরে চলে আসলো। আয়ানরও সদ্যস্নাত বকুলকে দেখে বেশ ভালো লাগলো। তবে ভালো লাগার আর একটা বড় কারন বকুলের চোখে আয়ান মুগ্ধতা দেখেছিলো। আর সেই মুগ্ধতাটুকু যে ওকে কেন্দ্র করে ছিলো সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।

অতঃপর বকুল ওর শ্বশুর শাশুড়ীর কাছে বিদায় নিয়ে সায়ান আর আয়ানের সাথে গাড়িতে করে ঢাকা ভার্সিটির দিকে রওয়ানা হলো। অনেকদিন পর আয়ান বকুলকে সাথে নিয়ে বের হলো। ড্রাইভিং সিটে আয়ান বসে সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। পাশের সিটে বকুলকেও সিটবেল্ট বেঁধে নিতে বললো। পিছনে সায়ান বসেছে।আয়ান গাড়ি চালাচ্ছে আর আড় চোখে অপার মুগ্ধতা নিয়ে বকুলকে দেখছে। অপরদিকে বকুলের মুখটা বিষাদে ঢেকে আছে। হাতদুটো কোলের উপর রেখে বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। চুলগুলো কানের পাশে অবিন্যস্তভাবে উড়ছে। আয়ান ভাবছে বকুল হয়তো পরীক্ষা নিয়ে খুব টেনশনে আছে। তাই বকুলের মনটা খারাপ।ওকে সাহস দিতে আয়ান ওর হাত বকুলের হাতের উপর রাখলো। আয়ানের হাতের উষ্ণ স্পর্শে বকুল চমকে উঠলো। হাতটা আয়ানের হাতের মুঠ থেকে বের করে আনতে চাইলো। কিন্তু শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। বকুল সায়ানের দিকে ইঙ্গিত করলে আয়ান একসময় হাতটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আয়ান পিছন ফিরে সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-একজন তো এমনমুখ করে বসে আছে দেখে মনে হচ্ছে একটু পরেই তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হবে। তোর কি অবস্থা?
—-অন্য কোনোদিকে মন না দিয়ে গাড়িটা ঠিক মতো ড্রাইভিং কর। এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে আবার এক্সিডেন্ট করে বসিস না।
—-তুই সববিষয়ে একটু বেশী বুঝতে চাস।
বকুল উদাসীনভাব নিয়ে বললো,
—-পরীক্ষার টেনশনে আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমার এতো কথা শুনতে ভালো লাগছে না।
আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-এতো চাপ নিও না। আমার বিশ্বাস ইনশাআল্লাহ তোমাদের দু,জনের পরীক্ষা খুব ভালো হবে।
বকুল আয়ানের দিকে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে বললো,
—-রেজাল্টের পর আমি জলঢাকায় চলে যাবো।
—-হুম,আমিও তাই ভাবছি তোমার জলঢাকা যাওয়া উচিত।
আয়ানের মুখে একথা শুনে মনে মনে বকুল বললো,
“তাহলে তো আপনার ভালোই হয়। প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে নিশ্চিন্তে পরকীয়া চালাতে পারবেন।”
গাড়ি কলাভবনের সামনে চলে আসলো। বকুল আর সায়ান গাড়ি থেকে নেমে পরীক্ষার হলের দিকে আগাতে লাগলো। পরীক্ষা শেষ হলে বকুল আর সায়ানকে আয়ান এই জায়গাতেই আসতে বললো। ওরা চলে যাবার পর আয়ানের মোবাইলটা বেজে উঠলো। জেসিকার ফোন দেখে ও খুব বিরক্ত অনুভব করলো। এই মুহুর্তে আয়ানের ফোনটা রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না। ফোনটা বেজে বেজে একসময় থেমে গেল।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বকুল যথারীতি গাড়িতে এসে বসলো। সায়ান এসে আয়ানকে বললো,
—-ভাইয়া আমি ফ্রেন্ডদের সাথে একটু টাইম স্পেন্ড করতে চাচ্ছি। আমার ফিরতে রাত হবে। আমার হয়ে আম্মুকে বুঝিয়ে বলিস।

সায়ান চলে যাবার পর আয়ান বকুলকে নিয়ে ফ্রেস হতে কোনো রেস্ট্রুরেন্টে গিয়ে বসতে চাইলো। বকুল রাজী হলো না। যদিও পরীক্ষা ভালো হয়েছে তারপরও রেজাল্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছিলো না। আয়ানও হয়তো বকুলের মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলো তাই আর জোর করলো না। দু,দিন পর রেজাল্ট বের হলো। বকুল মেধাতালিকায় তিনশত তম স্থান অর্জন করলো। সায়ানও একশত তম স্থান অধিকার করলো। এমন সময় বকুলের এক সহপাঠি ফোন দিয়ে ওকে কোচিং সেন্টারে আসতে বললো। তখন সকাল দশটা বেজে গেছে।বকুলও ওর খুশীটাকে সেলেব্রেট করতে ফার্মগেটএ উদ্ভাসের কোচিং সেন্টারে হাজির হলো। ওখানে সবার সাথে দেখা করে ওর এক বান্ধবীর সাথে রিকশা করে ঢাকা ভার্সিটির দিকে রওয়ানা হলো। তারপর ওরা দু,জন ভার্সিটি, টিএসসির চত্বর সবঘুরে একসময় ওদের ক্ষুধা অনুভব হলো। ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর দুটো ছুঁয়েছে। ওরা দু,জন মধুর ক্যন্টিনে চলে আসলো। কিন্তু ক্যান্টিনে ও যাকে দেখলো তা ও কখনও আশা করেনি। ক্যান্টিনের ভিতরে একটু কর্ণারের দিকে আয়ানকে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলো। মেয়েটা চেহারা ওর কাছে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। পরে মনে হলো এতো জেসিকা। ও আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ওখান থেকে চলে আসলো। ওর বান্ধবী সোমা খুব অবাক হলো। হঠাৎ বকুলের কি হলো ও বুঝতে পারলো না। বকুল ওকে বললো ওর শরীর খুব খারাপ লাগছে। যাই হোক একটা সিএনজি ভাড়া করে বকুল সোমার কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ীর পথে রওয়ানা হলো। বকুলের খুব কান্না পাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজের চোখের জল সংবরণ করলো।পথে অনলাইনে নভোএয়ারের টিকিট কাটার চেষ্টা করলো। কিন্তু এতো দ্রুত টিকিট পাওয়া তো সম্ভব নয়। উপায়ন্তর না দেখে ওকে একটা সৈয়দপুরের এয়ারের টিকিট ম্যানেজ করে দেওয়ার জন্য সায়ানকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে অনুরোধ করলো। সায়ান টিকিট কাটার আগে ওকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তুমি যে সৈয়দপুর যাচ্ছো ভাইয়াকে বলেছো?
—-বলেছি। ভাই আমার আর এখানে মন টিকছে না। আব্বু আর দাদীকে দেখার জন্য আমার মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে।
—আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি বাড়ী গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নাও। আমার এক বন্ধু নভোএয়ারে পার্টটাইম জব করে। ওর কাছ থেকে টিকিট কাটার ব্যবস্থা করছি।
বকুল বাড়ী এসে ওর শাশুড়ীকে আয়ানের ব্যাপারে বিস্তারিত জানালো। পুরোটা শুনে রাহেলা আর বাঁধা দিলো না। ফোন করে হামিদুরকে সৈয়দপুর এয়ার পোর্টে আসতে বলে দিলো। বকুলও ব্যাগ গুছিয়ে শ্বশুর শাশুড়ীর কাছে বিদায় নিয়ে সায়ানের সাথে শাহজালাল বিমান বন্দরে পৌঁছে গেল। তারপর সন্ধা ছ,টায় নভোএয়ারে করে বকুল জলঢাকার উদ্দ্যেশে ঢাকা থেকে উড়াল দিলো। ওদিকে হামিদুর এতোদিন পর মেয়ের বাড়ী ফেরার খুশীতে কার ভাড়া করে সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে লাগলো। বকুল ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে এই খুশীতে হামিদুরের বুক গর্বে ভরে উঠেছ। বকুল সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলে হামিদুর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়। এর পর ভাড়া করা গাড়িতে ওরা জলঢাকার পথে রওয়ানা হলো। তবে পুরো গাড়িতে বকুলের মুখটা বিমর্ষ দেখে হামিদুরের বুকটা হাহাকার করে উঠলো। একসময় থাকতে না পেরে বকুলকে জিজ্ঞাসা করলো,
—হ্যারে বকুল, আয়ান তো তোর সাথে আসতে পারতো?
—-আব্বু ওর অফিসে অনেক ব্যস্ততা। তাই আমি একাই এসেছি। তুমি খুশী হওনি?
—-নারে, মা খুব খুশী হয়েছি। তোকে দেখার জন্য আমার চোখ দুটো ব্যাকুল হয়ে আছে।
বাড়ী পৌঁছাতে বকুলের রাত আটটা বেজে গেল।

জেসিকাকে কথাগুলো শুনানোর পর আয়ানের অপমানের জ্বালাটা আজ নিভে গেল। আয়ান আজ জেসিকাকে বলতে পেরেছে। ওর জীবনে জেসিকা ছিলো ভুল মানুষ। ভুল মানুষকে ভালোবাসার থেকে তাকে চিরজনমের মতো ঝেড়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ। যদিও জেসিকা ওকে বলেছিলো আয়ানই ছিলো ওর ভালোবাসার সঠিক নির্বাচন। দ্বিতীয় স্বামীর কাছে নিগ্রহের স্বীকার হয়েছে বলে আজ ওর মনে হয়েছে আয়ান ওর সঠিক মানুষ। বলারই কথা। রাতভর নাইটক্লাবে পড়ে থাকে। এদিকে জেসিকাকে দিয়ে সংসারের ঘাণি টানায়। আবার মাঝে মাঝে দু,চার ঘা লাগিয়ে দেয়। অথচ আয়ানের কাছে ও রাজরানীর মতো থাকতো। তারপরও পোষালো না। আয়ান চারিদিক থেকে বিপর্যস্ত করে ও ক্ষান্ত হলো। যদিও আয়ান চায় না জেসিকা এভাবে অত্যাচারিত হোক। কিন্তু মানুষ একসময় তার কর্মফল ঠিক ভোগ করে।
আয়ান গাড়ি চালিয়ে ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরছে। আর মনে মনে ভাবছে বকুলকে আজ ও আদরে আদরে ভরিয়ে দিবে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে